জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের নন, আন্তর্জাতিক বিশ্বের মহান নেতা ছিলেন। তিনি প্রথমে নিজেকে, পরে আওয়ামী লীগকে, তারপর বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে তৈরি করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি উপলব্ধি করেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে স্বার্থান্বেষী মহল কুতর্ক জারি রেখেছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যদি বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ না করতেন বা যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেতেন, তাহলে স্বাধীনতা ঘোষণা করার সুযোগ পেতেন না, অথবা হয়তো পেতেন তবে অনেক পরে। বঙ্গবন্ধুকে অনেকেই বলেছিলেন, ‘এলএফওর (লিগাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার) অধীনে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গিয়ে কোনো লাভ হবে না।’ তাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এলএফও! এই নির্বাচনকে গণভোট হিসেবে আখ্যায়িত করে আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো এবং প্রমাণ করবো কে এই দেশের নেতা। আর নির্বাচনের পর আমি এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবো।’ জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘The Legal Framework Order irked Mujib sorely. He was particularly irritated at Sections 25 and 27 which vested powers of authentication of the future constitution in the President. It implied that Mujib would not be free to implement his six points, even if he obtained majority seats in the National Assembly (Parliament) unless his Constitution Bill received the President’s approval. It is on the issue that Mujib said, I shall tear the LFO in the pieces after the election.’ (পৃষ্ঠা-১৬-১৭) এলএফওতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব মেনে নেয়া হয়।
জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি (সংরক্ষিত নারী আসনসহ) আসনের মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে আমরা পেলাম ১৬৯টি আসন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যাতে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে না পারেন সে জন্য এলএফওতে বিতর্কিত ২৫ ও ২৭ নম্বর দুটি অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করেন। এলএফওতে সন্নিবেশিত দুটি ধারাই ছিল আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী দলকে ঠেকানোর অপপ্রয়াস। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সত্যিকার অর্থেই নির্বাচনকে গণভোটে রূপান্তরিত করে বিজয়ী হন। নির্বাচনের পরপরই ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএকে নিয়ে শপথ অনুষ্ঠান করে বলেছিলেন, ‘এই গণভোটের মাধ্যমে ৬ দফা আজ আমার না, আমার দলেরও না, ৬ দফা আজ জনগণের সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যদি কেউ ৬ দফার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে তাকে জ্যান্ত কবর দেয়া হবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ এভাবে তিনি ৬ দফাকে আপসহীন অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু জানতেন ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করবে। সেজন্য বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগিয়েছেন। এই নির্বাচনে সারা দেশ সফর করে তিনি বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ১ মার্চ যখন ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন, মানুষ রাজপথে নেমে আসে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার এক মোহনায় দাঁড় করিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তরিত করেন। নির্বাচনের পরপরই ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ডেকে চার জাতীয় নেতার সামনে আমাদের চারজনকে- মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই ও আমাকে- একটি ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ভারতে গেলে আমরা কোথায় আশ্রয় পাব, থাকব, সে জন্য আমাদের চার টুকরা কাগজ দিয়ে বলেছিলেন মুখস্থ করো। কাগজে ঠিকানা লেখা ছিল, ‘সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এই ঠিকানায় আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি। অর্থাৎ বহু আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা করেন। সেই ১৯৬২ সালে তিনি দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা নিয়ে আগরতলা গিয়েছিলেন। আগরতলা মামলা তো মিথ্যা ছিল না। কিন্তু পরিকল্পনামতো কাজ হয়নি। আগরতলা মামলায় যারা অভিযুক্ত তারা তো আসলেই স্বাধীনতার জন্য একটি সশস্ত্র পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এটা সত্য। যার জন্য ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বললে যারা অভিযুক্ত তারা অসন্তুষ্ট হন। তারা বলেন, ‘আমরা তো ষড়যন্ত্র করিনি। আমরা তো দেশের স্বাধীনতার জন্যই একটি পরিকল্পনা করেছিলাম।’
বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তার বড় প্রমাণ ৬ দফা। তিনি বিচক্ষণ নেতা ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে নির্বাচন পেছালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকার সুযোগ পাই। নির্বাচনের দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। সেদিন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আপনি কয়টি আসন পাবেন?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি অবাক হবো যদি আমি দুটি আসন হারাই।’ বিস্ময়ের ব্যাপার দুটি আসনই আমরা হারিয়েছিলাম। একটিতে নুরুল আমিন, অন্যটিতে রাজা ত্রিদিব রায় জয়ী হন। নির্বাচনের পরই তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনার ছক এঁকেছিলেন যখন তিনি ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে লন্ডন সফরে যান। সেখানে ভারতীয় প্রতিনিধি ফনীন্দ্র নাথ মুখার্জি, তথা পিএন মুখার্জি- যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘মিস্টার নাথ’ বলে সম্বোধন করতাম- বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লন্ডনে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ভূমিকা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। যেগুলো পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়িত হয়। বঙ্গবন্ধু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তবেই স্বাধীনতা ঘোষণা করার রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করেন।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে বক্তব্য পেশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু সব সময় চেয়েছেন তিনি আক্রান্ত হবেন, কিন্তু আক্রমণকারী হবেন না। সে জন্যই ২৫ মার্চ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পূর্ব প্রস্তুতি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যেটা সিদ্দিক সালিক তার বইতে লিখেছেন, ‘When the first shot had been fired, ‘the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wavelength close to that of the official Pakistan Radio. In what must have been, and sounded like, a pre-recorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the ‘People’s Republic of Bangladesh.’ It said, ‘This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh, wherever you are and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৭৫)
প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এ রকম একটি চূড়ান্ত ঘোষণায় পৌঁছতে বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ ২৪টি বছর বাঙালি জাতিকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য স্থির করে, ধাপে ধাপে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে, শাসকগোষ্ঠীর সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, জেল-জুলুম-হুলিয়া-ফাঁসির মঞ্চকে উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছে। এক দিনে হয়নি। বহু বছর ধরে, অগণিত মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাকে শিরোধার্য জ্ঞান করেছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত এই ঘোষণাটিই ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৬ নম্বর প্যারায় অনুমোদিত হয়ে সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করেছে। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণাই ২৬ মার্চ দুপুর দেড়টায় চট্টগ্রাম বেতার থেকে এম এ হান্নানের কণ্ঠে বারবার প্রচারিত হয়েছে। ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের ঘোষণার কোনো রেকর্ড নেই। এমনকি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ‘প্রামাণ্যকরণ কমিটি’র চেয়ারম্যান মফিজউল্লাহ কবীর ও হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র’ সংকলনের ৩ নম্বর খণ্ডে আছে, ‘জিয়াউর রহমান মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মার্চ ঘোষণা দেন।’ কিন্তু ২৬ তারিখ তো যুদ্ধ শুরু হয়েছে। জেনারেল শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, মেজর রফিক ইতিমধ্যে ডিফেক্ট করে যুদ্ধ শুরু করেছেন। সুতরাং ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের ঘোষণার কথা মোটেও সত্য না। যারা ২৬ মার্চ জিয়ার ঘোষণার কথা বলেন, তারা অসত্য কথা বলেন। বাস্তবের সঙ্গে যার কোনো মিল নেই।
ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চের ভাষণে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করে একজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘সপ্তাহ খানেক আগেই আমার উচিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা...। ...কেননা কয়েকটি শর্ত দিয়ে সে আমাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সে আক্রমণ করেছে- এই অপরাধ বিনা শাস্তিতে যেতে দেয়া হবে না।’ এবং এই একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে সামরিক আদালতে বিচার হয়। সামরিক শাসক কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল যে, আমার মতো একজন ক্ষুদ্র কর্মীকেও আমার অনুপস্থিতিতে সামরিক আদালতে বিচার করল। ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, আবিদুর রহমান ও আমাকে মার্শাল ল কোর্টে হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়। পরে ২৭ এপ্রিল আমাদের অনুপস্থিতিতে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। আজকাল বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম দাবি করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছাড়া আমরা ছাত্রলীগের কেউ কিছু করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় নেতা হিসেবে যা করতে পারতেন না, আওয়ামী লীগের অগ্রগামী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তা পালন করতো। কোনোটাই বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন ছাড়া হয়নি।
১৯৭১ সালের শহীদ দিবস ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ দিন মধ্যরাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই বাংলার স্বাধিকার-বাংলার ন্যায্য দাবীকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে। এখনও চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। কিন্তু বাংলার সাত কোটি মানুষ আর বঞ্চিত হতে রাজী নয়। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন হলে আরো রক্ত দেবো। আর শহীদ নয়, এবার গাজী হয়ে ঘরে ফিরবো। বাংলার ঘরে ঘরে আজ দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে হবে আমাদের সংগ্রাম। মানুষ জন্ম নেয় মৃত্যুর জন্য; আমি আপনাদের কাছে বলছি এই বাংলার মানুষ রক্ত দিয়ে আমাকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছে, আমিও আপনাদের জন্য নিজের রক্ত দিতে দ্বিধা করবো না। বাংলার সম্পদ আর লুট হতে দিবো না।’ ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার মন্ত্রিসভা বাতিল করেন এবং পিন্ডিতে গভর্নর ও সামরিক প্রশাসকদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে, লারকানা ও রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকে গৃহীত গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘...গত সপ্তাহে জাতি যে ধরনের নাট্যাভিনয় প্রত্যক্ষ করেছে, তা বন্ধ হওয়া দরকার। জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালের উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। ...পাকিস্তানে যখনই জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণে উদ্যত হয়েছে তখনই এই তামস শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই গণবিরোধী শক্তি ১৯৫৪ সনে পূর্ব বাংলার নির্বাচিত শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ১৯৫৬ সনের আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়, ১৯৫৮ সনে দেশে সামরিক আইন জারী করে এবং তারপর প্রতিটি গণআন্দোলন ব্যর্থ করার জন্য হস্তক্ষেপ করে। এই ষড়যন্ত্রকারী শক্তি যে আবার আঘাত হানার জন্য তৈরী হচ্ছে, জাতীয় পরিষদের তারিখ ঘোষণার পর যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলো থেকেই এটা প্রতীয়মান হয়। জনাব জেড এ ভুট্টো ও পিপল্স পার্টি আকস্মিকভাবে এমন সব ভঙ্গিমা ও উক্তি করতে শুরু করেছে যা জাতীয় পরিষদের স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি করে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি বানচালের প্রবণতাই উদঘাটন করে। এভাবে জনসাধারণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। ...বাংলাদেশের জাগ্রত জনতাকে, কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র ও জনগণকে বিজয় বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ...আমরা যে ক্ষমতাকে স্বীকার করি, তা হচ্ছে জনগণের ক্ষমতা। জনগণ সকল স্বৈরাচারীকেই নতি স্বীকারে বাধ্য করেছে। কারণ স্বৈরাচারীর ক্ষমতার দম্ভ জাগ্রত জনগণের সংকল্পবদ্ধ আঘাতের কাছে টিকে থাকতে পারেনি। ...আমরা আজ প্রয়োজন হলে আমাদের জীবন বিসর্জন করারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি-যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের একটি কলোনীতে বাস করতে না হয়। যাতে তারা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সম্মানের সাথে মুক্ত জীবন যাপন করতে পারে, সে প্রচেষ্টাই আমরা চালাবো।’
এই দীর্ঘ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যৎ বংশধরদের যাতে একটি কলোনিতে তথা উপনিবেশে বসবাস করতে না হয়, তার অংশ হিসেবে ‘একটি স্বাধীন দেশের’ কথা বলছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত করতে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে সার্বিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক সাব-ডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল’ এবং বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ বেলা ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত করেন। পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা বক্তব্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরীসহ সমগ্র বাংলাদেশ। এ দিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয় এবং ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারা দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রাম করেই মুক্তি আনবো। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।’
এরপর আসে বাঙালির ইতিহাসের পরমাকাঙ্ক্ষিত দিন ৭ মার্চ। সেদিন ছিল রোববার। সংগ্রামী বাংলা সেদিন অগ্নিগর্ভ, দুর্বিনীত। বঙ্গবন্ধু যখন ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে বক্তৃতা শুরু করেন জনসমুদ্র পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে যায়। সে দিন নেতার বক্তৃতার শেষাংশ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বস্তুত এটাই ছিল বীর বাঙালির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা।
লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে শুধু জ্ঞান অর্জনই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন নৈতিকতা ও মানবিকতার গভীর চর্চা। শিক্ষা যদি মানুষকে কেবল প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করে, তবে সমাজে স্বার্থপরতা, সহিংসতা ও মূল্যবোধহীনতার বিস্তার ঘটবে। তাই শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মানবিক গুণাবলি সহানুভূতি, সততা, দায়িত্ববোধ, পরোপকার ও ন্যায়বিচারের বোধ জাগ্রত করা। নৈতিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের সঠিক-ভুলের পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে, আর মানবিকতা তাদের অন্যের অনুভূতি উপলব্ধি করতে শেখায়। পরিবার, স্কুল এবং সমাজ যদি একসাথে এই মূল্যবোধগুলো গঠনে ভূমিকা রাখে, তবে শিক্ষার্থী শুধু দক্ষ পেশাজীবীই নয়, বরং দায়িত্বশীল নাগরিক ও শুভচিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। এমন শিক্ষা ব্যবস্থা একটি সুস্থ, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।
ছাত্র জীবনে সাফল্য অর্জনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা। লক্ষ্যহীন পড়াশোনা কখনোই দীর্ঘমেয়াদি সফলতা এনে দিতে পারে না; বরং স্পষ্ট উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের অধ্যবসায়, সময় ব্যবস্থাপনা ও ইতিবাচক মনোভাব গঠনে সহায়তা করে। আত্মবিশ্বাস সেই লক্ষ্য পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগায়, চ্যালেঞ্জ এলেও হাল না ছাড়া, নিজের সক্ষমতার উপর বিশ্বাস রাখা এবং ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা তৈরি করে। তাই ছাত্রজীবনে ছোট-বড় বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ, নিয়মিত অগ্রগতি মূল্যায়ন এবং নিজের প্রতি স্থায়ী বিশ্বাসই সাফল্যের আসল সূত্র। এভাবেই একজন শিক্ষার্থী শুধু ফলাফলে নয়, ব্যক্তিত্ব ও মানসিক উন্নয়নেও পারদর্শী হয়ে ওঠে।
শিক্ষার্থীদের সফলতার পথে অগ্রসর হতে সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার এবং পড়াশোনাকে সুসংগঠিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টাইম ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের কাজকে গুরুত্ব অনুযায়ী ভাগ করে নিতে শেখায়, ফলে অযথা সময় নষ্ট হয় না এবং চাপ কমে। অন্যদিকে মাইন্ড ম্যাপিং জটিল বিষয়গুলোকে সহজভাবে বুঝতে সহায়তা করে, এটি চিন্তাকে চিত্রের মাধ্যমে সাজিয়ে ধারণার মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে, যা স্মরণশক্তি বাড়ায় এবং অধ্যয়নকে আরও কার্যকর করে তোলে। সময় ব্যবস্থাপনা ও মাইন্ড ম্যাপিং একসাথে শিক্ষার্থীর শৃঙ্খলা, মনোযোগ ও সৃজনশীলতা বাড়িয়ে তাদের লক্ষ্য অর্জনের পথকে আরও সুস্পষ্ট করে।
একটি সমৃদ্ধ, সুন্দর ও শান্তিময় বাংলাদেশ গড়তে প্রয়োজন সুস্থ দেহ ও প্রশান্ত চিত্তের নতুন প্রজন্ম। শারীরিক সুস্থতা শিক্ষার্থীদের সক্রিয়, কর্মক্ষম ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, আর মানসিক প্রশান্তি তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সৃজনশীল চিন্তা ও ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখতে সহায়তা করে। যখন তরুণ প্রজন্ম স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নকে গুরুত্ব দেয়, তখন তারা ব্যক্তিগত ও জাতীয় উন্নয়নে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। সুস্থ ও শান্ত চিন্তার মানুষই সমাজে নৈতিকতা, সহমর্মিতা ও দায়িত্বশীলতার চর্চা বাড়ায়। তাই নতুন প্রজন্মকে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তুললেই তারা ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে সত্যিকারের স্বর্গভূমিতে রূপান্তরিত করতে পারবে।
উপরের আলোচিত নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস, সময় ব্যবস্থাপনা, সুসম্পর্ক এবং সুস্থ-প্রশান্ত জীবন, এসব গুণের ভিত্তিকে আরও দৃঢ় করতে শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত মেডিটেশন অত্যন্ত কার্যকর একটি অনুশীলন। মেডিটেশন মনকে শান্ত করে, একাগ্রতা বৃদ্ধি করে এবং চিন্তার স্বচ্ছতা আনে। ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের লক্ষ্য নির্ধারণ, পরিকল্পনা করা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে আরও সহজভাবে। নিয়মিত ধ্যান মানসিক চাপ কমায়, আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং ইতিবাচক আচরণ গড়ে তোলে, যা নৈতিকতা ও মানবিকতার বিকাশে সরাসরি ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি এটি সহপাঠী ও পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ধৈর্য ও সহমর্মিতা বাড়ায়। সুস্থ দেহ ও প্রশান্ত চিত্ত গড়ার ক্ষেত্রেও মেডিটেশন একটি শক্তিশালী মাধ্যম। তাই সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন ও সফলতার যাত্রায় একজন শিক্ষার্থীর জন্য মেডিটেশন চর্চা অনিবার্য।
২১ ডিসেম্বর ২০২৫ বিশ্ব মেডিটেশন দিবস মানসিক প্রশান্তি, আত্মচেতন ও দৈহিক সুস্থতার গুরুত্ব সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার এক অনন্য সুযোগ। আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, চাপ, প্রতিযোগিতা ও অনিশ্চয়তার ভিড়ে মানুষ ক্রমেই মানসিক স্থিতি হারাচ্ছে; আর ঠিক এই সময়ে মেডিটেশন হয়ে উঠছে মনকে শান্ত রাখার, একাগ্রতা বৃদ্ধি এবং জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলার বৈজ্ঞানিক ও কার্যকর পদ্ধতি। এ দিবসের মূল বার্তা হলো নিজের ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে প্রতিদিন নির্ধারিত সময় নিয়ে নীরবে বসা, শ্বাস-প্রশ্বাসে মনোযোগ দেওয়া এবং সচেতনভাবে নিজেকে সামলে নেওয়া। কর্মজীবী, গৃহিণী, প্রবীণ সবার জন্য বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের জন্য মেডিটেশন মানসিক সুস্থতার একটি সার্বজনীন উপায়। বিশ্ব মেডিটেশন দিবস তাই মানবিকতা, শান্তি ও সুস্থতার বিশ্ব গড়ার চেতনাকে আরও বেগবান করে।
অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত রোবেল: পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন ১২ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে ওসমান হাদিকে মাথায় গুলি করে দুর্বৃত্তরা। প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৫ ডিসেম্বর ওসমান হাদিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার তিনি মারা যান। তার মরদেহ গতকাল সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আনা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ কমপ্লেক্সে থাকা জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও জুলাই বিপ্লবী শহীদ শরীফ ওসমান হাদিকে। শরিফ ওসমান বিন হাদির ওপর হামলা পতিত স্বৈরাচার ও আগ্রাসী আধিপত্যবাদী বিদেশি ষড়যন্ত্রের যৌথ পরিকল্পনার অংশ, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা যেকোনোভাবেই আগামি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভণ্ডুল করে দিতে মরিয়া এবং বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ওসমান হাদির মতো একজন প্রতিবাদী লড়াকু সৈনিক, আধিপত্যবাদ বিরোধী সোচ্চার কন্ঠকে চিরতরে থামিয়ে দিতে এই হামলা চালানো হয়েছে। এখন এ ঘটনার জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করতে গিয়ে তদন্তকারীরা এসব নানা বিষয় জানতে সক্ষম হয়েছেন। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে এর পেছনে মাস্টারমাইন্ড কারা ছিল। তাদের আরও অনেক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা রয়েছে,যা আগামিতে ঘটানোর জন্য তাদের প্রস্তুতি রয়েছে।ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মূল চ্যালেঞ্জ যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, তফসিল ঘোষণার এক দিনের মাথায় ঢাকা–৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় তা আরও স্পষ্ট হলো। মোটরসাইকেলে আসা সন্ত্রাসীরা খুব কাছ থেকে গুলি চালায়। হাদিকে যে পরিকল্পিতভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, সেটা স্পষ্ট। খোদ রাজধানীতেই প্রকাশ্যে দিনের বেলা একজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে গুলি করার ঘটনায় অন্যান্য প্রার্থী ও নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা ও ভয় ছড়িয়ে পড়াটা স্বাভাবিক। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়ে কেউ যেন নির্বাচনী পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত না করতে পারে, সেটা নিশ্চিতের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা বাংলাদেশে সবসময় ঘটে থাকলেও এবারের পরিস্থিতি যেকোনো বারের চেয়ে নাজুক। কেননা ভেঙে পড়া পুলিশি ব্যবস্থা এখনো আগের অবস্থানে ফেরেনি, গোয়েন্দা–ব্যবস্থাও এখনো পুরোদমে সক্রিয় নয়। অভ্যুত্থানের আগে–পরে দেশের বিভিন্ন কারাগার ভেঙে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী ও জঙ্গি পালিয়ে যায়, কারও কারও জামিনও হয়েছে । বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও কারাগার থেকে খোয়া যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের অনেকটাই উদ্ধার করা যায়নি। এ ধরনের পরিস্থিতি যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যই বড় হুমকির কারণ। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়ের মতো অপরাধে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জড়িত থাকার বিষয়টি উদ্বেগ তৈরি করেছে। নভেম্বর মাসে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় একের পর এক টার্গেটেড হত্যাকাণ্ড ঘটে। চট্টগ্রামে একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর প্রচার চলাকালে সন্ত্রাসীরা খুব কাছ থেকে প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর এক তরুণকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীও আহত হন। তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি না হলে নির্বাচনী পরিবেশের ওপর তার ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতির জন্য সরকার যে ১৬ মাস সময় পেয়েছে, সেটা যথেষ্ট। দুঃখজনক হলেও সত্যি, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতিতে সরকারের দিক থেকে কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ দেখা যায়নি। তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা নিয়ে শিথিলতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিতে সশস্ত্র বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর ৯ লাখ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন, এটি দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ফলে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনো অজুহাতই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সম্ভাব্য প্রার্থীর ওপর হামলাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল—সবার জন্যই সতর্কবার্তা। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা যাতে ভয়হীন পরিবেশে প্রচার চালাতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চোরাগোপ্তা হামলা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও নাশকতার আশঙ্কা আরও প্রবল হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। পাশাপাশি যানবাহন এবং নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত হওয়া স্থাপনায়ও অগ্নিসংযোগ করে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টাও হতে পারে—এমন আভাসও পেয়েছে পুলিশ। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনাকে সতর্কবার্তা হিসেবে দেখতে হবে। নির্বাচন বানচাল করতে চায়, এমন গোষ্ঠীটি চোরাগোপ্তা হামলা ও নাশকতার মাধ্যমে ভীতি তৈরির চেষ্টা করবে; যার একটা অন্যতম লক্ষ্য নির্বাচনী কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটানো ও ভোটার উপস্থিতি কমানো। ওই গোষ্ঠীর দেশে-বিদেশে পলাতক থাকা একটা অংশের অনলাইনে এ–সংক্রান্ত কিছু আলাপ-আলোচনার উপাদান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে এসেছে। ইন্টারনেটে একটি যোগাযোগ অ্যাপে এ রকম একটি আলোচনায় লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারও এই বিষয়গুলোকে নির্বাচন বানচালের বড় ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। মূলত নির্বাচন ঘিরে মানুষের মধ্যে কীভাবে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা যায়, সেটি গুরুত্ব পেয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ফ্যাসিস্ট টেররিস্টদের দমনের’ উদ্দেশে অবিলম্বে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত বা বানচাল করার যেকোনো অপচেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। এর পেছনে বিরাট শক্তি কাজ করছে। ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনটি হতে না দেওয়া। এই আক্রমণ খুবই ‘সিম্বলিক’। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে নির্বাচনকেন্দ্রিক সামগ্রিক নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। এই নিরাপত্তাব্যবস্থায় জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার কারণে যাঁরা সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকতে পারেন, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখা দরকার । সীমান্ত হয়ে যেন অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ করতে না পারে এবং কোনো আসামি পালাতে না পারে, অবৈধ পথে সীমান্ত পারাপার বন্ধে নজরদারি বাড়াতে হবে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্রের মজুত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করেছে এমন চিহ্নিত ব্যক্তিদের ধরতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া পেশাদার সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। এসবের পাশাপাশি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধারে জোর দিতে হবে। নতুন করে দেশে অস্ত্র প্রবেশের আশঙ্কার পাশাপাশি লুট হওয়া অস্ত্রগুলো কোনো অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সেটিকেও বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করার দাবি এসেছে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও। গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিও এসেছে। সব মিলিয়ে নির্বাচনের সময়কালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারকে এ বিষয় নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পুলিশের পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার, করতে হবে। কোনোভাবেই নির্বাচন বানচালের চেষ্টা সফল হতে দেয়া যাবে না। মাঠপর্যায়ে ভোটার এবং প্রার্থীরা যেন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে পুলিশ সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকতে হবে। শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলাকে ‘একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটা একটা বার্তা। আর বার্তাটা খুব সোজা, রাজনীতির মাঠে যে কণ্ঠটা একটু আলাদা, আবার বড় দলগুলোর সরাসরি ছায়ায় নেই, তাকে আঘাত করো। কম ঝুঁকি, বেশি লাভ। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দিকটা হলো টাইমিং।
দেশ এখন ফেব্রুয়ারি ২০২৬ নির্বাচনকে সামনে রেখে দাঁড়িয়ে। এই মুহূর্তে একজন পরিচিত মুখকে গুলি করা মানে এক ঢিলে অনেক পাখি মারা। জনমনে আতঙ্ক বাড়বে, রাজনৈতিক পক্ষগুলো সন্দেহ করবে, পাল্টা ভাষা আরও কড়া হবে, মাঠ আরও উত্তপ্ত হবে। নির্বাচনের আগের বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করার চেয়ে কার্যকর অস্ত্র খুব কম আছে। হাদিকে টার্গেট করার যুক্তিটা এখানেই। তিনি বিএনপি-জামায়াতের মতো বড় দলগুলোর প্রকাশ্য কর্মী নন। ইনকিলাব মঞ্চ নিজেকে আলাদা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তুলে ধরেছেন, হাদি নিজেও সেই পরিচয়ই সামনে রাখেন। ফলে তাকে আঘাত করলে কোনো দল ‘দলীয় আক্রমণ’ বলে সঙ্গে সঙ্গে পুরো মেশিন নামাবে না, কিন্তু জনমনে তার প্রতিক্রিয়া হবে বড়। কারণ, হাদি এক বছরের বেশি সময় ধরে জনপরিসরে দৃশ্যমান ছিলেন, শক্ত ভাষায় কথা বলতেন, যার অনেক কথা নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়, সেই কথার সঙ্গে যেমন কিছু মানুষ একমত হয়েছেন, তেমনি অনেকে বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু মানুষ তাকে শুনতেন। এই শোনা, এই দৃশ্যমানতা, এই আবেগই তাকে হাই ভ্যালু টার্গেট করে তোলে।
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনাকে এর জন্য দায়ী করার এক ধরনের যৌক্তিক কারণ আছে। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তেও যদি এই ধরনের কোনো প্রেক্ষাপট দেখা যায় সে ক্ষেত্রেও সব পক্ষকে দেখাতে হবে গভীর সংযম। আমাদের মনে রাখতে হবে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো হয় একটা অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলাকে উসকে দেওয়ার জন্য। যাঁরা এমনটা চান, তারা চান মারাত্মক এবং ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া।একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ফিরে যাক, এটা এই রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য জরুরি হলেও দেশের অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের কিছু মহল চায় না বাংলাদেশ একটা স্থিতিশীল অবস্থায় যাক। কে না জানে, কিছু মাছ শিকারের জন্য কেউ কেউ ঘোলা পানিই পছন্দ করে। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার ঠেকানোর উপায় হচ্ছে পানি ঘোলা হতে না দেওয়া। ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে বিভেদ না বাড়িয়ে ঐক্যের চেতনা জাগ্রত করুক। আর সবচেয়ে জরুরি কথা রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকা সরকারেরই প্রধান কাজ অপরাধীদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করে, ঝুঁকির মুখে থাকা ব্যক্তিদের নিরাপত্তা বিধান করে জল যেন ঘোলা না হয় সেটা নিশ্চিত করা। এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন, এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট।
বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি উদীয়মান মানবিক শক্তির নাম। সামরিক সক্ষমতার পাশাপাশি শান্তি, সহনশীলতা ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশ যে পরিচিতি অর্জন করেছে, তার পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ করে সেনাবাহিনীর নিরবচ্ছিন্ন আত্মত্যাগ। সুদানের আবেই অঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ড্রোন হামলায় ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর শাহাদাত সেই আত্মত্যাগেরই সর্বশেষ ও বেদনাবিধূর অধ্যায়।
শনিবার বেলা সোয়া ১১টার কিছু আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন শহীদ শান্তিরক্ষীদের নিথর দেহ বহনকারী বিমান অবতরণ করে, তখন গোটা জাতি শোক ও গর্বে নীরব হয়ে পড়ে। উগান্ডার এন্টেবে বিমানবন্দর থেকে দীর্ঘ আকাশপথ পাড়ি দিয়ে দেশে ফেরা এই ছয়টি কফিন যেন বহন করছিল বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মানবিক অবদানের ইতিহাস। রোববার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাদের জানাজা ও দাফনের মধ্য দিয়ে জাতি শ্রদ্ধা জানাবে সেই বীর সন্তানদের, যারা দেশের সীমানা পেরিয়ে মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন।
গত শনিবার সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিকস বেইসে স্থানীয় সময় বিকাল ৩টা ৪০ থেকে ৩টা ৫০ মিনিটের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর আকস্মিক ড্রোন হামলায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী। আহত হন আরও আটজন। যাদের দ্রুত কেনিয়ার নাইরোবিতে আগা খান ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেনাবাহিনীর তথ্যমতে, আহতদের অধিকাংশই শঙ্কামুক্ত, যদিও একজনের অস্ত্রোপচার শেষে নিবিড় পর্যবেক্ষণ চলছে। আজ দেশে ফেরা ছয় শহীদ হলেন;করপোরাল মো. মাসুদ রানা (নাটোর), সৈনিক মো. মমিনুল ইসলাম (কুড়িগ্রাম), সৈনিক শান্ত মণ্ডল (কুড়িগ্রাম), সৈনিক শামীম রেজা (রাজবাড়ী), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) এবং লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা)। তারা সবাই নিজ নিজ পরিবারের কাছে ছিলেন প্রিয় সন্তান, ভাই কিংবা বাবা। কিন্তু জাতির কাছে তারা এখন বিশ্বশান্তির শহীদ, আন্তর্জাতিক মানবতার প্রতীক।
বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা অভিযানের ইতিহাস নতুন নয়। ১৯৮৮ সালে মাত্র ১৫ জন সদস্য নিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। সেই ছোট পরিসরের অভিযাত্রা আজ বিশ্ব পরিমণ্ডলে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১১৯টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা কেবল অস্ত্রধারী সৈনিক নন।তারা শান্তির দূত, মানবিক সহায়তাকারী এবং ভরসার প্রতীক।
তবে এই পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। সংঘাতপ্রবণ অঞ্চল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সশস্ত্র গোষ্ঠীর হুমকি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সবকিছুর মাঝেই শান্তিরক্ষীদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ পর্যন্ত জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের ১৬৮ জন বীর সদস্য বিশ্বশান্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। সুদানের মরুভূমিতে ঝরে পড়া ছয়টি প্রাণ সেই দীর্ঘ ত্যাগের মিছিলে নতুন সংযোজন, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবদানকে আরও উজ্জ্বল করেছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা শুধু যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই দায়িত্ব শেষ করেন না। তারা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশে স্কুল পুনর্গঠন, চিকিৎসা সহায়তা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং মানবিক ত্রাণ বিতরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ফলে সংঘাতকবলিত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা আস্থা ও মানবিকতার প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন। এই বিশ্বাসই অনেক সময় তাদের লক্ষ্যবস্তু বানায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর।
সুদানের আবেই অঞ্চলের হামলা সেই বাস্তবতারই নির্মম প্রমাণ। ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার দেখিয়ে দিয়েছে, আধুনিক সংঘাতে শান্তিরক্ষীদের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। তবুও বাংলাদেশ তার অঙ্গীকার থেকে সরে আসেনি। কারণ, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা কেবল কূটনৈতিক ঘোষণা নয়—
এটি একটি নৈতিক দায়িত্ব, যা বাংলাদেশ তার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মানবিক মূল্যবোধ থেকে ধারণ করেছে।
এই আত্মত্যাগ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকেও শক্তিশালী করেছে। জাতিসংঘসহ বৈশ্বিক শক্তিগুলো বাংলাদেশকে একটি দায়িত্বশীল, শান্তিপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে দেখে। শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব কেবল সংখ্যায় নয়, পেশাদারিত্ব ও শৃঙ্খলায়ও অনন্য। নারী শান্তিরক্ষী প্রেরণ, প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণ এবং মানবাধিকার সংবেদনশীলতার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে।
তবে এই গৌরবের পেছনে রয়েছে অগণিত পরিবারের নিঃশব্দ কান্না। শহীদদের পরিবার শুধু একজন স্বজনকে হারায়নি; তারা হারিয়েছে জীবনের ভরসা। আমি মনে করি, রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব এখন এই পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো। তাদের ত্যাগকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে হবে। এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই ইতিহাস জানাতে হবে।
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগ কোনো একক ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি একটি ধারাবাহিক সংগ্রাম। যেখানে প্রতিটি শহীদ এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। সুদানের আকাশে ঝরে পড়া সেই ছয়টি প্রাণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে,শান্তি কখনো বিনামূল্যে আসে না। এর মূল্য দিতে হয় সাহস, নিষ্ঠা এবং কখনো কখনো জীবন দিয়ে।
আজ যখন শহীদদের কফিনে মোড়া জাতীয় পতাকা বাতাসে উড়ে। তখন তা শুধু শোকের নয় গর্বেরও প্রতীক বলে আমি মনে করি। কারণ, বিশ্বশান্তির মানচিত্রে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী তথা সেনাবাহিনীর নাম লেখা রয়েছে রক্ত, ত্যাগ আর মানবতার গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে। শহীদ শান্তিরক্ষীদের জন্য অতল শ্রদ্ধা।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ঢাকা।
বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাস, নেতৃত্ব ও বাস্তবতার পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র পরিচালনার পথে যেমন অর্জন এসেছে, তেমনি এসেছে নানা চ্যালেঞ্জ ও পরিবর্তন। এই রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা ও বিরোধী রাজনীতির অভিজ্ঞতা অর্জন করে। দলটির প্রতিষ্ঠা, নেতৃত্বের পরিবর্তন, রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতার বাইরে থাকা সব পর্যায়ই দেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও গণতান্ত্রিক চর্চায় প্রভাব ফেলেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান, সংগঠনিক সক্ষমতা এবং ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়ে আলোচনা ক্রমেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। এই প্রবন্ধে ইতিহাস ও সমসাময়িক বাস্তবতার আলোকে বিএনপির ভূমিকা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার ফল। স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার পথচলা কখনো স্থিতিশীল, কখনো অস্থির এই দুই মেরুর মধ্যেই আবর্তিত হয়েছে। এই রাজনৈতিক প্রবাহে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। দলটির উত্থান, ক্ষমতায়ন, বিরোধী রাজনীতি এবং বর্তমান অবস্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ বোঝার জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনীতি ও বিএনপির আবির্ভাব:
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো নির্মাণের এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন মতাদর্শ ও নেতৃত্বের উত্থান ঘটে।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৮ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেন। বিএনপি আত্মপ্রকাশ করে একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক কাঠামো, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপকারী রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে। এই দল অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়।
জিয়াউর রহমান: মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা: জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন সেক্টর কমান্ডার ও সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার নেতৃত্ব ও সংগঠনের ভূমিকা ইতিহাসে স্বীকৃত। স্বাধীনতার পর তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত হন এবং পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার শাসনামলে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু হয়, সংবাদপত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের বিকাশে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসব কারণে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যু ও রাজনৈতিক রূপান্তর: ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে এক সামরিক ঘটনার সময় জিয়াউর রহমান নিহত হন। এই ঘটনায় দেশের রাজনীতিতে হঠাৎ একটি পরিবর্তন আসে। রাষ্ট্র পরিচালনা ও দলীয় রাজনীতিতে নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়।এই সময়ে বিএনপি সাংগঠনিক ও নেতৃত্বগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, যা পরবর্তী সময়ে দলটির রাজনীতির দিকনির্দেশনায় প্রভাব ফেলে।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভূমিকা: জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়া ধীরে ধীরে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হন। ১৯৮০-এর দশকে তিনি বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং দলকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার শাসনামলে সংসদীয় ব্যবস্থার কার্যকারিতা, অবাধ গণমাধ্যম এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসে। ২০০১-২০০৬ সময়কালেও তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তারেক রহমান ও বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো: তারেক রহমান বিএনপির রাজনীতিতে সংগঠক হিসেবে যুক্ত হন এবং পরবর্তী সময়ে দলীয় কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বর্তমানে তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। দলের নীতিনির্ধারণ, সাংগঠনিক পুনর্গঠন এবং ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে তার ভূমিকা দলীয় রাজনীতিতে একটি বাস্তবতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিএনপি ও রাজনৈতিক জোটের বাস্তবতা: বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোটভিত্তিক রাজনীতি একটি স্বীকৃত বাস্তবতা। বিএনপি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট গঠন করেছে। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে রাজনৈতিক সমন্বয়ও ছিল। এই জোট রাজনীতিকে বিএনপি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকে, যা দেশের বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ। জোট রাজনীতির সুফল ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি: বর্তমানে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে রয়েছে। সাম্প্রতিক নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় দলের অংশগ্রহণ নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা রয়েছে। দলটি রাজনৈতিক সংস্কার, নির্বাচনকালীন পরিবেশ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে অবস্থান প্রকাশ করে আসছে। একই সঙ্গে বিএনপি তাদের সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। মাঠ পর্যায়ে দলীয় কার্যক্রম ও রাজনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে।
ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও সম্ভাবনা: বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ভূমিকা নির্ভর করবে-নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ, সাংগঠনিক শক্তি ও নেতৃত্বের সমন্বয়, রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতা সংস্কৃতি, জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি কার্যকর বিরোধী দলের উপস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই বাস্তবতায় বিএনপির ভবিষ্যৎ ভূমিকা দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যে তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতি ইতিহাস, নেতৃত্ব ও বাস্তবতার সমন্বয়ে গঠিত একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে বিএনপি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রেখে চলেছে। দলটির অতীত অভিজ্ঞতা, সাংগঠনিক সক্ষমতা এবং ভবিষ্যৎ কৌশল দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং রাজনৈতিক সংলাপের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতি স্থিতিশীল ও কার্যকর পথে এগিয়ে যেতে পারে।বাংলাদেশের রাজনীতি একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিএনপি এই প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দলটির ইতিহাস, নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক অবস্থান দেশের রাজনৈতিক গতিপথ বোঝার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।
আগামী দিনে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি, নির্বাচন ও সংলাপের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক বিকাশ এগিয়ে যেতে পারে। এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। আমরাও সেই আশায় পথ চেয়ে আছি।
লেখক: রাজনীতিবিদ ও সাবেক অধ্যাপক।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বিস্তৃত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে মাদকের বিস্তার এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো অপরাধমূলক ঘটনা নয়। এটি ধীরে ধীরে একটি গভীর সামাজিক, মানবিক ও নিরাপত্তাজনিত সংকটে রূপ নিয়েছে। ইয়াবা ও অন্যান্য সিনথেটিক মাদকের প্রবাহ ক্যাম্পের অভ্যন্তরীণ জীবনকে যেমন বিপর্যস্ত করছে, তেমনি এর অভিঘাত পড়ছে স্থানীয় জনপদ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং জাতীয় নিরাপত্তার ওপরও। বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে সংবাদমাধ্যমে উঠে এলেও সাম্প্রতিক সময়ে এর ব্যাপ্তি ও তীব্রতা নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা নতুন নয়। ইতিহাস বলছে, ১৯৭৮ সালে এবং ১৯৯১–৯২ সালেও মিয়ানমার থেকে কয়েক দফায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। তবে বর্তমান সংকটের সূত্রপাত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর, যখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের মুখে কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় সাত থেকে আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ থেকে ১৩ লাখে পৌঁছায়। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে অল্প জায়গায়, সীমিত সম্পদ ও কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে রাখার ফলে ক্যাম্পগুলোতে যে সামাজিক চাপ তৈরি হয়েছে, মাদক সমস্যা তারই একটি ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশ।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সবচেয়ে বেশি যে মাদকটির বিস্তার ঘটেছে, সেটি হলো ইয়াবা। কক্সবাজার-টেকনাফ অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই ইয়াবা পাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে পরিচিত। মিয়ানমারের শান ও রাখাইন অঞ্চলে উৎপাদিত ইয়াবা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসে, এরপর ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ক্যাম্পগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং প্রশাসনিক জটিলতা এই পাচারকে তুলনামূলক সহজ করে তুলেছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলা জরুরি। ক্যাম্পে বসবাসকারী সবাই মাদক কারবারে জড়িত—এই ধারণা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং সংবাদমাধ্যম ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যে দেখা যায়, একটি সীমিত অংশ, বিশেষ করে তরুণ ও যুবকদের একটি অংশ, এই চক্রে যুক্ত হচ্ছে। তাদের অনেকেই মূল পরিকল্পনাকারী নয়; তারা বাহক, পরিবহনকারী বা খুচরা পর্যায়ের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। দীর্ঘদিন কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকা, বাইরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা, শিক্ষার সীমিত সুযোগ এবং মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল জীবন অনেককে ঝুঁকিপূর্ণ পথে ঠেলে দিচ্ছে।
মাদক কারবারের মূল নিয়ন্ত্রণ থাকে ক্যাম্পের বাইরে থাকা স্থানীয় ও আঞ্চলিক চক্রগুলোর হাতে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সীমান্তের দুই পাশে সক্রিয় অপরাধী নেটওয়ার্ক, দালাল ও সিন্ডিকেট এই ব্যবসা পরিচালনা করে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে তুলনামূলক কম ঝুঁকির বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, কারণ তাদের সামাজিক অবস্থান দুর্বল এবং আইনি সুরক্ষা সীমিত। এতে একদিকে তারা অপরাধচক্রের সহজ শিকার হয়, অন্যদিকে পুরো জনগোষ্ঠীটি সামাজিকভাবে কলঙ্কিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।
এই মাদক প্রবাহের প্রভাব বহুমাত্রিক। ক্যাম্পের ভেতরে মাদকাসক্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চুরি, সহিংসতা, দলাদলি এবং অস্ত্রের ব্যবহারও বেড়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত খবর প্রকাশিত হচ্ছে। নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে ক্যাম্পবাসীর সম্পর্কেও সৃষ্টি হচ্ছে অবিশ্বাস ও ক্ষোভ। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়রা মনে করছেন, মাদক ও অপরাধের চাপ তাদের জীবনযাত্রাকেও অনিরাপদ করে তুলছে। এই সামাজিক টানাপোড়েন দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করতে পারে।
মাদক সমস্যার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত আরেকটি বিষয় হলো আন্তর্জাতিক সহায়তার সংকোচন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন কারণে রোহিঙ্গা সংকটে আন্তর্জাতিক তহবিল কমেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে, খাদ্য রেশন কমানো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় কাটছাঁট করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এই বাস্তবতায় ক্যাম্পবাসীর মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা বেড়েছে। যখন ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোই কঠিন হয়ে পড়ে, তখন অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকের কাছে টিকে থাকার একটি উপায় হিসেবে দেখা দেয়। ফলে মাদকচক্র নতুন লোক সংগ্রহে আরও সুবিধা পায়।
এই সংকটের একটি আন্তর্জাতিক মাত্রাও রয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা এবং আঞ্চলিক মাদক অর্থনীতির সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিস্থিতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিনথেটিক ড্রাগ উৎপাদন ও পাচার নেটওয়ার্কের প্রভাব বাংলাদেশেও এসে পড়ছে। এই বাস্তবতা দেখায়, সমস্যাটি শুধু বাংলাদেশের একক প্রচেষ্টায় পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব নয়; এখানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিকার কী? প্রথমত, মাদক সমস্যাকে কেবল আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন হিসেবে দেখলে চলবে না। কঠোর অভিযান প্রয়োজন, এতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে সেই অভিযান যেন মূল অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়, ভুক্তভোগী পর্যায়ের মানুষদের নির্বিচারে লক্ষ্য করে নয়। একই সঙ্গে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি, নইলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
মানবিক সহায়তা টেকসইভাবে বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবা কমে গেলে মাদক ও অপরাধের ঝুঁকি বাড়ে—এটি বাস্তবতা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই বিষয়টি অনুধাবন করে সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে আশ্রয় দেওয়া একটি দেশের পক্ষে এককভাবে এই বোঝা বহন করা কঠিন।
তৃতীয়ত, তরুণদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ, পরিবেশবান্ধব ক্ষুদ্র উৎপাদন বা সামাজিক উদ্যোগের সুযোগ তৈরি করা গেলে মাদক অর্থনীতির বিকল্প তৈরি হতে পারে। সংবাদমাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে, উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা একা টেকসই ফল দিতে পারে না।
শিক্ষা ও শিশু সুরক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। স্কুল, শেখার কেন্দ্র এবং খেলাধুলা ও মনোসামাজিক সহায়তা কার্যক্রম কিশোরদের অপরাধচক্র থেকে দূরে রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। একটি প্রজন্ম যদি মাদক ও সহিংসতার মধ্যে বড় হয়ে ওঠে, তার প্রভাব শুধু ক্যাম্পেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদকের ছোবল একটি মানবিক সংকটের ভেতরে জন্ম নেওয়া নিরাপত্তাজনিত বিপর্যয়। এটি সমাধানে একদিকে যেমন কঠোর ও লক্ষ্যভিত্তিক আইন প্রয়োগ দরকার, অন্যদিকে তেমনি দরকার মানবিক সহায়তা, শিক্ষা ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা তৈরির উদ্যোগ। এই সমন্বয় ছাড়া মাদক সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এই সংকট ধীরে ধীরে ক্যাম্পের সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য আরও বড় ঝুঁকিতে পরিণত হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে নীতিনির্ধারকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভারসাম্য রক্ষা করা। একদিকে দেশের সার্বভৌম নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অন্যদিকে শরণার্থী জনগোষ্ঠীর মানবিক অধিকার ও ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিত করা—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদকের ছোবল মূলত একটি দীর্ঘস্থায়ী সংকটের উপসর্গ। এর প্রতিকার তাই তাৎক্ষণিক অভিযানেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। সমন্বিত, তথ্যভিত্তিক ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগই পারে এই সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং একই সঙ্গে দেশ ও অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে।
এই সংকট মোকাবিলায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিবির ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত সংস্কার। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে, ক্যাম্পগুলোর ভেতরে প্রশাসনিক সমন্বয়ের ঘাটতি, অতিরিক্ত জনঘনত্ব এবং নজরদারির সীমাবদ্ধতা অপরাধচক্রকে সুবিধা করে দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শিবির প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে তথ্য বিনিময় ও সমন্বয় আরও কার্যকর না হলে মাদক চক্র বারবার ফাঁকফোকর খুঁজে বের করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কমিউনিটি পর্যায়ে বিশ্বাসভিত্তিক নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে মাদক কারবারের প্রাথমিক পর্যায়েই তথ্য পাওয়া সম্ভব।
এখানে কমিউনিটি নেতাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা সমাজের ভেতরে যারা ধর্মীয় বা সামাজিকভাবে প্রভাবশালী, তাদের সঙ্গে কাজ করে মাদকবিরোধী সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, যেসব ক্যাম্পে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক ও কমিউনিটি প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা বেশি, সেখানে সহিংসতা ও অপরাধ তুলনামূলক কম। এই অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, কেবল বাহ্যিক চাপ নয়, ভেতর থেকে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাও জরুরি।
একই সঙ্গে সীমান্ত ব্যবস্থাপনার প্রশ্নটি উপেক্ষা করা যাবে না। ইয়াবা পাচারের মূল উৎস সীমান্তের ওপারে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা এবং আঞ্চলিক মাদক অর্থনীতি এই প্রবাহকে অব্যাহত রাখছে। বাংলাদেশ বারবার আন্তর্জাতিক ফোরামে এই বিষয়টি তুলে ধরেছে যে, রোহিঙ্গা সংকটের মূল সমাধান মিয়ানমারে নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা। প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত থাকলে ক্যাম্পে দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতা তৈরি হবে, আর সেই স্থবিরতাই মাদক ও অপরাধের জন্য উর্বর জমি হয়ে উঠবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত মতামত কলামগুলোতে প্রায়ই বলা হয়, রোহিঙ্গা সংকটকে শুধু মানবিক সহায়তার প্রশ্ন হিসেবে দেখলে চলবে না; এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অপরাধ দমনের সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত। এই দৃষ্টিভঙ্গি নীতিনির্ধারণে প্রতিফলিত না হলে সমস্যা এক জায়গায় চাপা পড়ে অন্য জায়গায় বিস্ফোরিত হবে। মাদক দমন অভিযান একদিন জোরালো, পরদিন শিথিল এই ধারাবাহিকতা ভাঙতে হবে। প্রয়োজন ধারাবাহিক নীতি ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
সব মিলিয়ে বলা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদকের ছোবল কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এটি বছরের পর বছর জমে ওঠা অনিশ্চয়তা, বঞ্চনা ও নিরাপত্তা ঘাটতির ফল। এই বাস্তবতা অস্বীকার করলে বা সমস্যাটিকে কেবল আইনশৃঙ্খলার খাতায় আটকে রাখলে সমাধান আসবে না। মানবিক সহায়তা, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা, এই সবগুলো স্তরে একযোগে কাজ করতে হবে।
আজ যে মাদক সংকট রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দৃশ্যমান, তা যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে তার ঢেউ দেশের মূল ভূখণ্ডে আরও গভীরভাবে আঘাত হানবে—এই সতর্কবার্তা সংবাদমাধ্যমে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। তাই প্রশ্নটি এখন আর শুধু ক্যাম্পের ভেতরের সমস্যা নয়; এটি বাংলাদেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার প্রশ্ন। সময়োপযোগী, সমন্বিত ও মানবিক প্রতিক্রিয়াই পারে এই ছোবলকে প্রতিহত করতে এবং ভবিষ্যতের জন্য বড় বিপর্যয় ঠেকাতে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো। ফলে উখিয়া ও টেকনাফের বিশাল রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে কমে আসছে আর্থিক সহায়তা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অনুদান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য মৌলিক সেবা প্রদানে মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে রোহিঙ্গাদের দৈনন্দিন জীবনে। ফলে মাদক চোরাচালান ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে। আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। তাদের ক্যাম্পের বাইরে কাজ খুঁজতে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিদেশি এনজিওগুলো প্রথম প্রথম যেভাবে সাপোর্ট দিয়েছে বর্তমানে সে সাপোর্ট নেই। ফান্ড ক্রাইসিসের কারণে অনেক প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এক সময় ক্যাম্পে ১৫০ থেকে ২০০ এনজিও কাজ করত। সেখানে বর্তমানে কাজ করে মাত্র ৫-১০টি বিদেশি এনজিও। ফান্ড ক্রাইসিসের কারণে এনজিওগুলো কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকটের কোনো টেকসই সমাধান নেই। দাতা দেশগুলোর সহায়তা কমে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে। আর্থিক অনটনে থাকা রোহিঙ্গারা মাদক পাচার, অস্ত্র বেচাবিক্রি, অপহরণ, হত্যাকাণ্ড ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। পুলিশের ডেটাবেজ অনুযায়ী, ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে বিভিন্ন অভিযোগে ২০৮টি মামলা হয়। ২০২৫ সালের ৯ মাসেই এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে পাঁচ গুণের বেশি। বড় ধরনের আর্থিক তহবিল সংকটে পড়েছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে থাকা রোহিঙ্গা ক্যাম্প। আগের তুলনায় প্রায় ৭০ ভাগ ফান্ড কমেছে। যে ফান্ড আছে তা দিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত চালানো যেতে পারে। ২০২৬ সালে কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় প্রতিদিন চাকরি হারাচ্ছেন বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তাদের মধ্যে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। চাকরি হারিয়ে নানা ধরনের অপরাধ চক্রে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। এতে ক্যাম্প ঘিরে দেখা দিয়েছে নিরাপত্তাসংকট। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও প্রায় প্রতিদিন হারাচ্ছেন চাকরি। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে তারাও জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধ চক্রে। এতে পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বর্তমানে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। প্রতিনিয়ত খুন, গ্রুপিং ও মারামারির মতো ঘটনা ঘটছে। এতে নিরাপত্তা সংকটে পড়ছেন ক্যাম্পে প্রকল্প নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। বর্তমানে কক্সবাজার ও টেকনাফ ক্যাম্পে ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এখন তহবিল সংকট, স্থানীয় নারীদের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ এবং বাজার উপযোগী চাকরির অভাবের মতো বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শুধু আন্তর্জাতিক সংস্থা বা এনজিওর ওপর নির্ভর করলে হবে না। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহায়তায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিতে হবে, নারীদের জন্য বিশেষ পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে। পাশাপাশি, নিরাপত্তা জোরদার ও মাদক দমন অভিযান আরও কার্যকর করতে হবে। রোহিঙ্গাসংকট একটি মানবিক সমস্যা হলেও, এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব স্থানীয় মানুষের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করছে। এখনই যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এ সংকট ভবিষ্যতে আরও গভীর হবে এবং এর ভুক্তভোগী হবে গোটা সমাজ। তাদের অর্থনৈতিকসংকট কেবল চাকরি হারানোতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে স্থানীয় অর্থনীতির প্রতিটি স্তরে। বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় আয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক পরিবার এখন দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। এই আর্থ-সামাজিক অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধচক্র। স্থানীয় ও রোহিঙ্গা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত যুবসমাজ বেকারত্ব ও হতাশা থেকে মাদক ব্যবসা ও সেবনে জড়িয়ে পড়ছে। ইয়াবা ও অন্যান্য মাদকদ্রব্যের বিস্তার বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা, চুরি-ছিনতাই এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধি। তহবিল সংকট শুধু অর্থনীতি ও সমাজেই নয়, পরিবেশেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ক্যাম্পের আশপাশে বন উজাড়, ভূমি ক্ষয়, পানিদূষণ এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি অব্যাহত রয়েছে। আগে এনজিওগুলোর মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ প্রকল্প চালু থাকলেও এখন সেই উদ্যোগগুলো কমে আসায় পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। জীবিকার তাগিদে শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গারা সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে।
মিয়ানমারের রাখাইনে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশে ইয়াবা ও আইসের নতুন প্রবাহ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির মাদকের অন্যতম গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। ২০২৪ এর ০৫ আগস্টের পর নতুন করে অন্তত ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকায় নির্মিত ক্যাম্পে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের অধিকাংশই ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক অভিযানের সময় পালিয়ে বাংলাদেশ আশ্রয় নেয়।কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে মাদকের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। ৩০টি শিবিরে ইয়াবাসহ মাদক বিক্রির চিহ্নিত আখড়া আছে ৫০০-র বেশি। শরণার্থী শিবিরের বাইরেও রোহিঙ্গারা ইয়াবা বহন করছে। দুই দেশের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এদের নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একাংশ মাদক ব্যবসা, পরিবহন ও শিবিরের ঘরগুলোতে এসব মজুত রাখছে। ইয়াবা পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই দেশেরই কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত। আর সে কারণে এটা বন্ধ হচ্ছে না। রোহিঙ্গারা ধীরে ধীরে সবার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাদের হাতে হাতে এখন ইয়াবা ছাড়াও অবৈধ অস্ত্রও পাওয়া যাচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ইয়াবার ব্যবসায় নেমেছে স্থানীয় ইয়াবা কারবারিদের সহায়তায়। শিবিরগুলোর মধ্যেকার পানের দোকান, ফার্মেসি, শাকসবজির দোকান এবং ঝুপড়িঘরে লুকিয়ে ইয়াবা বিক্রি হয়। ইয়াবা বিক্রির টাকা ও কমিশন ভাগাভাগি নিয়ে শিবিরগুলোতে প্রতিদিনই কোনো না-কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করায় টেকনাফের শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী রোহিঙ্গা শিবির ও তার আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। তারা এখন নিজেরা আড়ালে থেকে রোহিঙ্গাদের দিয়ে ইয়াবার ব্যবসা চালাচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের শীর্ষস্থানীয় কতিপয় ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা ইয়াবা উৎপাদন ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছে বাংলাদেশের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, যাদের দৃশ্যমান পরিচয় রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী হিসেবে। কারও আবার বিশেষ কোনো পেশা-পরিচয় নেই। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের এলাকায় ইয়াবার কারখানা আছে ৪০টি। এর মধ্যে ‘ইউনাইটেড ওয়া স্টে-ইট আর্মি’ নামে আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারী সংগঠনেরও চারটি কারখানা রয়েছে। অন্যগুলোর মালিক মিয়ানমারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। ওই কারখানাগুলোতে তৈরি ইয়াবা মিয়ানমারভিত্তিক ডিলাররা বাংলাদেশের এজেন্টদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। এটা বন্ধ করতে হলে দরকার মিয়ানমারের আন্তরিকতা। তা না হলে ইয়াবা চোরাচালান বন্ধ করা খুব কঠিন হবে। মাদক বহনকারী’ থেকে ইয়াবা ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে বসবাসকারী শরণার্থী রোহিঙ্গারা। কক্সবাজার জেলায় রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় ইয়াবাসহ শরণার্থীদের আটকের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে রোহিঙ্গা নারী, কিশোর ও পুরুষরা। গোয়েন্দা পুলিশের তৈরি করা ইয়াবা কারবারিদের তালিকায়ও রয়েছে নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা শরণার্থীর নাম। তবে এই তালিকায় স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যাই বেশি। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদক বিক্রি ও সেবনের আখড়া। ইয়াবা মজুতের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে জনবহুল ওই ক্যাম্পগুলো। এমনকি অনেক ইয়াবা কারবারিও সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে। এভাবেই টেকনাফ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ইয়াবা ব্যবসা ও পাচার বেড়ে চলছে। একসময় অভাবের তাড়নায় রোহিঙ্গারা ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে পড়ে এই কথা সত্য। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, স্থানীয় প্রভাবশালীরা রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এ কাজে তাদের ব্যবহার করেছে। তবে অনেক রোহিঙ্গা এখন খুচরা ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পর থেকে ইয়াবা পাচার বেড়েছে। কিছু স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী রোহিঙ্গাদের এ কাজে জড়াতে সহায়তা করছে। তবে এখন অনেক রোহিঙ্গা নিজেরাই এই ইয়াবা ব্যবসা জড়িয়ে পড়েছেন। তবে তাদের ধরতে পুলিশের অভিযান সবসময় অব্যাহত রয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় যে ক্যাম্পগুলো আছে সেগুলো একটা সংরক্ষিত জায়গায় থাকে। চারদিকে বেড়া থাকে। বিভিন্নভাবে তাদের আটকানোর একটা ব্যবস্থা আছে। মিয়ানমার থেকে আসা কক্সবাজার টেকনাফ উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে সেটা নাই। মাদক কারবারের বহুমাত্রিক হুমকি ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে মাদকের অনুপ্রবেশ যখন দেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করছে, তখন শুধু অভিযান চালিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও বহুস্তরীয় জাতীয় পরিকল্পনা, যা সাপ্লাই চেইন বন্ধ করা, চাহিদা হ্রাস করা এবং আসক্তদের পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্ব দেবে। প্রথমত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো—মাদকের প্রধান সরবরাহ পথ সম্পূর্ণ ছিন্ন করা। এর জন্য মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তে নজরদারি ও প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করতে হবে। তবে শুধু বাহক বা খুচরা বিক্রেতা ধরে সমস্যার সমাধান হবে না। মূল ফোকাস দিতে হবে ‘ইয়াবা-আইস গডফাদার’ এবং তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের ওপর। রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে যারা মাদকের ট্রানজিট রুট নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর, দ্রুত ও দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে। সাবেক জনপ্রতিনিধি, তার পরিবারের সদস্যরা এবং তাদের রাজনৈতিক আঁতাতের মাধ্যমে যে বিশাল সম্পত্তি অর্জন করেছে, সেগুলোর অর্থনৈতিক উৎস অনুসন্ধান করে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। এ কালো টাকা জব্দ করা গেলে মাদক সাম্রাজ্যের মূল মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে। এ পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীনতা দেওয়া অপরিহার্য।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলামিস্ট।
অনুবাদ
(৯) আল্লাহ হলেন সে সত্ত্বা, যিনি বাতাস পাঠান। অতঃপর তা দ্বারা মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন। তারপর আামি তাকে এক শুষ্ক মৃত ভূমির দিকে পরিচালিত করি। এরপর তা দিয়ে আমি ভূমিকে জীবন্ত করি, তার মৃত্যুর পর। এরূপই হবে পুনরুত্থান। (১০) যে ব্যক্তি সম্মান-প্রতিপত্ত চায়, (তার জানা উচিত যে,) সব সম্মান-প্রতিপত্তিই আল্লাহর। তারই দিকে উত্থিত হয় উত্তম কথা, আর নেক আমল তাকে আরো উপরে উঠায়। যারা মন্দ কাজের চক্রান্ত করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। আর তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ হবেই।
মর্ম ও শিক্ষা
ইতোপূর্বে ঘোষণা করা হয়েছে যে, কাফির মুশরিক ও বাতিলপন্থিদের জন্য আখিরাতে কঠিন শাস্তি রয়েছে। আর সত্যপন্থি মুমিনদের জন্য আখিরাতে মাগফিরাত ও মহা পুরস্কার রয়েছে। এরপর এখানে আলোচ্য আয়াতগুলোতে কিয়ামত ও আখিরাতের পক্ষে প্রকৃতি সঙ্গত দলীল দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ যেভাবে মৃত ভুমিকে আবার পানি দিয়ে সবুজ ও জীবন্ত করে তুলেন। তেমনিভাবে তিনি কিয়ামতের দিন সকল মৃত মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবেন। আরো প্রমাণ পেশ করা হয়েছে যে, আল্লাহ মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন। এরপর মাটি থেকে উৎপন্ন ফলমুল ও ফসরের নির্যাস হিসাবে মানব দেহের এক কণা শুক কীট থেকে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে মানুষের সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছেন। সে আল্লাহর পক্ষে আবার মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করা মোটেই কঠিন নয়। বরং অতি সহজ।
পরকালের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ
পরকালে অবিশ্বাসীরা মনে করে মৃত্যুর পর মানুষের দেহ যখন মাটিতে মিশে যায় তার হাড্ডিও পচে গলে শেষ হয়ে যায়। তারপর কিয়ামতের দিন জগতের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল মানুষের পুনরুজ্জীবন দেয়া অত্যন্ত কঠিন। তাদের ধারণায় এমন পুনরুজ্জীবন অসম্ভব। কাজেই তারা মনে করে, কিয়ামত ও আখিরাত নেই। কিয়ামতে অবিশ্বাসীদের এই বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল প্রমাণের জবাব দেয়া হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে। তাদের প্রমাণের ভিত্তি হলো, প্রকৃতিগতভাবে মৃত্যুর পর মানব দেহের যা ঘটে, তার থেকে কিভাবে আল্লাহ পুনরুজ্জীবন দিতে পারেন। এখানে আল্লাহ তায়ালা তার একটি ব্যবহারিক পদ্ধতির কথা বলেন। যখন কোনো ভূমি পানির অভাবে শুষ্ক হয়ে যায়, যাতে কোনো প্রকার ঘাস, তরুণলতা তা বৃক্ষ জন্মায় না। তারপর আল্লাহ সেখানে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। বৃষ্টি হয় সেই বৃষ্টির পানিতে আবার সেই মৃত ভূমি জীবন্ত হয়ে উঠে। সেখানে ফল হয়, ফসল হয়। শস্য শ্যামল হয়ে উঠে সেই মৃত ভূমি। যে আল্লাহ সেই মৃত ভুমিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন, তার পক্ষে এই মৃত দেহকে পুনরুজ্জীবিত করা কঠিন নয়।
অনাবাদী শুষ্ক জমিকে আবাদী জমিতে পরিণত করা
আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ শুষ্ক-মৃত ভুমিকে বৃষ্টির পানি দ্বারা পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন। অর্থাৎ বৃষ্টির পানি দিয়ে অনাবাদী শুষ্ক ভূমিকে আবার জীবন্ত আবাদী ভুমিতে পরিণত করেন। এখানে মানুষের জন্য শিক্ষা রয়েছে। আর তা হলো এই যে, পৃথিবীতে যতো অনাবাদী জমি, আছে সেখানে সেচের ব্যবস্থা করে তাকে আবাদী ভূমিতে পরিণত করা উচিত। আর পানি ছাড়া সেখানে যদি অন্য কিছুর প্রয়োজন হয়, প্রযুক্তির মাধ্যমে অনাবাদী জমিকে আবাদী জমিতে পরিণত করা উচিত।
ইজ্জত, সম্মানের মিথ্যা অহমিকায় সত্য-প্রত্যাখ্যান নিতান্তই অযৌক্তিক
তৎকালীন মক্কা ও আরবের অনেকেই শেষনবী মুহাম্মদ (স.)-এর সততা উপলব্ধি করতে পেরেছিল এবং কোরআন যে আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব তাও বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তবু তারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে। এই সত্য-প্রত্যাখ্যানের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এই যে, তারা যদি মুহাম্মদ (স)-কে নবী মানে এবং কুরআনকে গ্রহণ করে তাহলে তাদের নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব চলে যাবে। তাদের যে ইজ্জত ও সম্মান আছে তা চলে যাবে। কারণ ঈমান আনলে তাদেরকে রাসূলের আনুগত্য করতে হবে এবং অনুসরণ করতে হবে। তখন তারা অনুসারী আর এখন তারা অনুসৃত। অনুসৃত অবস্থা থেকে অনুসারী পর্যায়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ইজ্জত ও সম্মানে লাগে। এ প্রেক্ষাপটে এখানে বলা হয়েছে তাদের এই মিথ্যা ইজ্জত ও সম্মানের অহমিকায় সত্য-প্রত্যাখ্যান সম্পূর্ণরুপে অযৌক্তিক কারণ আসল ইজ্জত ও সম্মানের মালিক হলো আল্লাহ। আল্লাহ যাকে সম্মান দেয সেই সম্মান পায়। যার থেকে ছিনিয়ে নেয় তার সম্মান থাকে না। সুতরাং দেখা গেছে আরবের যেসব নেতৃবৃন্দ সম্মানের অহমিকায় সত্য-প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের গোটাকয় মুসলমানের হাতে পরাজিত হয়েছে। অনেকে নিহত হয়েছে। অনেককে লাঞ্চিত অবস্থায় দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। সুতরাং ইজ্জত ও সম্মানের মিথ্যা অহমিকায় সত্য থেকে দূরে থাকা নিতান্ত বোকামী ছাড়া কিছুই নয়।
প্রকৃত সম্মান আল্লাহর হাতে: তাই ইসলামী নীতি ও আদর্শ অনুসরণই কাম্য
আল্লাহর হাতে রয়েছে প্রকৃত মান, সম্মান ও ইজ্জত। যারা আল্লাহর পথে চলে, তাদেরকে মানুষ সম্মান করে। ভালো মানুষ হিসাবে সমাজের সবার মনে তাদের প্রতি সম্মান থাকে। অপরপক্ষে যারা দুর্নীতিবাজ, লম্পট ও ঠকবাজ তারা যতই ধনী হোক মানষ তাদের ঘৃণা করে। এছাড়া সত্যপন্থিরা বিজয়ের সব শর্ত পূরণ করে তখন তারা বিজয়ী হয়, তারা সমস্ত ক্ষমতার আধার হয়। তারা সুতরাং ইজ্জত ও সম্মান পেতে ইসলামী জীবনাদর্শের অনুসরণ করা উচিত।
লোক দেখানো যিক্র আল্লাহর ও আমলে কোনো ফায়দা নেই
ইজ্জত ও সম্মান রয়েছে আল্লাহর আনুগত্য ও নেক আমলে। যারা লোক দেখানোর উদ্দেশে উপরে উপরে যিক্র, আনুগত্য ও ভালো কাজ করে, আর তাদের ভেতরে থাকে গণ্ডগোল, তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে না। কারণ আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট নন। বিশেষ করে যারা উপরে উপরে আনুগত্য দেখায়, অথচ তাদের অন্তরে রয়েছে মন্দ কাজের চক্রান্ত, তাদের ভাগ্যে আল্লাহর সন্তষ্টি তো জুটবেই না। বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। লোক দেখানো আনুগত্যে তারা কোনো ইজ্জত বা সম্মান পাবে না। তৎকালীন সময়ে অনেক মুনাফিক নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দিতো। মুসলিমদের দলে থাকতো। বাহ্যত আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য দেখাতো। অথচ তাদের ভেতরে ঈমান ছিল না। কাজেই তাদের সব কাজই ছিল লোক দেখানো। এমন লোক দেখানো আমল দ্বারা আল্লাহর নিকট থেকে সেই ইজ্জত ও সম্মান পাওয়া যাবে না।
প্রকাশ্য শত্রুদের জন্য রয়েছে অপমান ও আখিরাতের শাস্তি
তৎকালীণ আরবের আদর্শিক শত্রুরা প্রকাশ্যে ইসলাম ও মুমিনদের বিরোধিতা করেছেন। তাদের উপর আক্রমণ করেছেন, নির্যাতন চালিয়েছে। গোপনে গোপনে রাসূল (স)-কে গ্রেপ্তার ও হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছে। তারা মনে করতো, রাসূল (স)-কে শেষ করতে পারলেই তারা তাদের নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু এখানে ঘোষণা করা হয়েছে যে, যারা এমন চক্রান্ত করে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। তাদের জন্য এই শাস্তি ছিল দুনিয়াতেও। বদরের যুদ্ধে অনেক নেতৃস্থানীয় কাফির ও মুশরিক নিহত হয়। অনেকে বন্দি হয়। মদীনায় যাওয়ার পর সে সব ইহুদীরা রাসূল (স) ও ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। তাদের কেউ কেউ নিহত হয়েছে। কেউ কেউ দেশ থেকে বহিস্কৃত হয়েছে। যারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তারা দুনিয়াতেও অপমানিত হয়েছে আর আখিরাতে তো তাদের শাস্তি রয়েছেই।
ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে কোনো চক্রান্ত সফল হবে না
আল্লাহ এখানে ঘোষণা করেছেন, বাতিলপন্থিদের চক্রান্ত নসাৎ হবে। অন্য স্থানে ঘোষনা করা হয়েছে, সত্য সমাগত আর বাতিল পরাভূত। অর্থাৎ সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব থাকবেই আর শেষ পর্যন্ত সত্যের বিজয় হবে। অসত্য ও বাতিল পরাজিত ও অপমানিত হবে। কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, অনেক সময় দেখা যায় ইসলাম ও মুসলিমরাই মার খাচ্ছে। দুনিয়ার বাতিলপন্থিরা তাদের উপর বিজয়ী হচ্ছে। তাহলে সত্যের বিজয় কোথায়। এর একাধিক জবাব আছে। প্রথম, আল্লাহর কথা ও পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদি। এই দীর্ঘ মেয়াদে কখনো কোনো দ্বন্দ্বে বাতিলপন্থিদের প্রভাব বেশি থাকবে পারে। ইসলাম ও মুসলিম চাপে থাকতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইসলাম ও মুসলমানের জয় অবধারিত। দুনিয়ার মানুষের এক বা দুই প্রজন্মের জীবন আল্লাহর নিকট অতি অল্প সময়। কোনো মানুষ তার জীবনে ইসলাম ও মুসলমানের বিজয় না দেখলেও তার জীবন অতি অল্প সময। তার জীবনের পরে যথা সময়ে ইসলাম ও মুসলমানের বিজয় আসবে। দ্বিতীয়, ইসলাম ও মুসলমানের বিজয়ের জন্য কতগুলো শর্ত আছে। বিজয়ের জন্য সেসব শর্ত পূরণ করতে হবে। যতক্ষণ তা না হয় ততক্ষণ বিজয় বিলম্বিত হবে। সেসব শর্তের অন্তর্ভুক্ত হলো মযবুত ঈমান, মুসলিম মিল্লাতের ঐক্য, সীসাঢালা প্রাচীরের মতো জিহাদ, সকল প্রকার সামরিক প্রস্তুতি ইত্যাদি। যতক্ষণ পর্যন্ত এ শর্তগুরো পূরণ না হয় ততক্ষণ বিজয়ের আশা করা যায় না। গভীরভাবে চিন্তা করলে আজকের বিশ্বে দেখা যায় মুসলিম মিল্লাত শত শত দেশ ও ভুখণ্ডে বিভক্ত। তাদের মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধভবে সামরিক অস্ত্র তৈরি করতে পারছে না। তারা রাসূলের আনুগত্যের বদলে পশ্চিমাদের আনুগত্য করছে। তাদের মধ্যে সীসাঢালা প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে যুদ্ধ করতে পারে, এমন লোকের অভাব আছে।
দেশের অনেক জেলা পরিষদ পার্কের আজ বেহাল দশা। একসময়ের কোলাহলপূর্ণ, শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত এসব পার্ক এখন যেন এক পরিত্যক্ত প্রান্তর, যা কেবল স্থানীয় বাসিন্দা, বিশেষত শিশু ও তরুণ প্রজন্মের কাছে এক গভীর হতাশার নাম।পার্কের ভেতরে তাকালে চোখে পড়ে ভাঙাচোরা দোলনা, স্লিপার, স্যাঁতসেঁতে ও অপরিষ্কার পথঘাট, আগাছা জন্মানো খেলার জায়গা এবং আবর্জনার স্তূপ। পর্যাপ্ত আলো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে সন্ধ্যার পর এই পার্ক মাদকাসক্ত ও অসামাজিক কার্যকলাপের আখড়ায় পরিণত হয়েছে, যা শিশুদের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এমন একটি পার্কের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে গত ৭ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলা প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘অযত্ন-অবহেলায় বেহাল দশা নওগাঁ জেলা পরিষদ পার্কের’। এ থেকে জানা যায়, নওগাঁ জেলা পরিষদ পার্কটি প্রায় দুই বছর ধরে অযত্ন-অবহেলায় বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। শিশুদের বিনোদনের রাইডগুলো ভাঙাচোরা, নেই পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। সন্ধ্যা নামলেই অন্ধকারে সাপ-পোকামাকড়ের আতঙ্কে থাকেন দর্শনার্থীরা।
শহরের প্রাণকেন্দ্র মুক্তির মোড়ে শতবর্ষ আগে ২ দশমিক ৪৬ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ পার্কটি দীর্ঘদিন ধরে জেলার একমাত্র জনবিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় প্রবীণ ও মধ্যবয়সিরা হাঁটাহাঁটি করতে আসেন এখানে। বিকেলে উন্মুক্ত থাকে সবার জন্য। ছুটির দিনে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সি মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে পার্কটি।
বর্তমানে পার্কের শিশুদের রাইডগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। তিনটি ঢেঁকির সবগুলোই ভাঙা, অধিকাংশ দোলনা অচল, দুটি স্লিপার থাকলেও তাতে মরিচা ধরেছে এবং যেকোনো সময় ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দোলনার নিচে গর্ত হয়ে বৃষ্টির পানি জমে থাকে, ফলে শিশুরা পড়ে কাদা-ময়লায় নোংরা হয়ে যায়। এসব কারণে শিশুদের বিনোদন ব্যাহত হচ্ছে। তা ছাড়া মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হতে হচ্ছে দর্শনার্থীদের। গত দুই বছর ধরে পার্কের বাতিগুলো নষ্ট থাকায় সন্ধ্যার পর পুরো এলাকা অন্ধকারে ঢেকে যায়। এতে হাঁটতে গিয়ে প্রবীণদের প্রায়ই বিপদে পড়তে হয়। অনেকেই সাপ-পোকামাকড়ের ভয়ে সন্ধ্যার পর পার্কে প্রবেশ করেন না। স্থানীয়দের অভিযোগ পার্কটি যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। এছাড়া পার্কের প্রধান ফটকের সামনে মোটরসাইকেল রাখা এবং ফুটপাতে ফাস্টফুডের দোকান বসানোর কারণে পথচারীদের চলাচলে চরম ভোগান্তি তৈরি হয়েছে। উকিলপাড়ার এক গৃহবধূ বলেন, ‘ছুটির দিনে বাচ্চারা পার্কে আসার জন্য জেদ করে। কিন্তু দোলনায় বৃষ্টির পানি জমে থাকে, মইগুলো ভাঙা, স্লিপারেও জং। বছরের পর বছর এমন অবস্থায় রয়েছে। কেউ যেন দেখার নেই। অথচ পার্কটি জেলার একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র হলেও কোনো উন্নয়ন নেই। রাইডগুলো নষ্ট, পুকুরের পাড় ভাঙছে, পানি অপরিষ্কার, ফুলের গাছ নেই। যে পরিবেশে মানুষ বিনোদন পাবে তার কিছুই নেই।
নওগাঁ জেলা পরিষদ পার্কটি বছরের পর বছর ধরে সামান্য রক্ষণাবেক্ষণও করা হয়নি,এটা খুর দুঃখজনক। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনোদন কেন্দ্র যখন এমন দুর্দশায় পড়ে, তখন তা কেবল একটি পার্কের সমস্যা থাকে না, বরং এটি পুরো জনজীবনে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশুরা বাধ্য হয়ে মোবাইল গেমসের প্রতি আসক্ত হচ্ছে, আর বড়রাও পাচ্ছে না একটু নির্মল বিনোদনের সুযোগ। তাই জেলা পরিষদ পার্ককে তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে দিতে হবে। এটি শুধু ইট-পাথরের কাঠামো নয়, এটি আমাদের সুস্থ বিনোদনের জায়গা, আমাদের শিশুদের হাসি-খুশির ঠিকানা। তাই,কর্তৃপক্ষ দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করে পার্কটিকে আবার প্রাণবন্ত করে তোলবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আজকের ছাত্র-ছাত্রীরা হলো গোলাপ, রজনীগন্ধা, রক্তকরবী, কামিনী, কদম, হাসনাহেনা, ডালিয়ার কুঁড়ি। সামান্য ভালোবাসার জল সিঞ্চনে যা হয়ে উঠবে প্রস্ফুটিত ফুল। আজকের অঙ্কুর অচিরেই হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের বনস্পতি। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে লালিত-পালিত হয়ে ওরাই হতে পারে ভবিষ্যতের ‘নেতাজী সুভাসচন্দ্র’, ‘মহাত্মা গান্ধী’, ‘ইন্দিরা’, ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’, ‘সুরেন্দ্রনাথ’, ‘মতিলাল নেহরু’, ‘শেরেবাংলা’, ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘জীবনানন্দ’, ‘নজরুল’। যাদের পদস্পর্শে ধন্য হবে জগৎ, কৃতার্থ হবে বঙ্গ জননী, কৃতার্থ হবে ধরনী।
একখণ্ড ধূসর স্মৃতি মোজাম্মেল স্যর- ১৯৬৪ সাল। তখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি পিরোজপুরের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সম্ভবত সেই বছর থেকে মোজাম্মেল স্যরকে চিনি। তিনি কোন বিষয়ের ওপর ক্লাস নিতেন, তা দীর্ঘ ৬১ বছর পরে আজ আর মনে পড়ছে না। মোজাম্মেল স্যরকে নিয়ে একটি মধুর ঘটনা খুব করে মনে পড়ে। স্কুলে সেদিন আমি পড়া পারিনি। কে যেন এক সহপাঠী, সম্ভবত প্রদীপ মোজাম্মেল স্যরকে বলল, ‘লিয়াকত তো স্কুলে এসে চিত্রনায়ক-নায়িকাদের নিয়ে আলোচনা করে, লেখাপড়া তলানিতে নেমে গেছে ওর।’ প্রদীপের (ক্ষেত্র মোহন মাজি উকিলের ছেলে) এ কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হল, সেও পড়া পারবে না। বেতের পিটুনি থেকে বাঁচার জন্য সে এ ফন্দি করেছিল। ও আরও বললো, ‘স্যর ওর বইয়ের মধ্যে গানের একটি খাতা আছে।’ তৎক্ষণাৎ মোজাম্মেল স্যর আমার বইখাতা তল্লাশি করে তার মধ্যে একটি গানের খাতা পেলেন। গানের খাতাটি হাতে তুলে নিয়ে প্রথম গানটি এক ঝলক দেখে তা উল্লেখ না করে দ্বিতীয় গানটি পড়তে শুরু করলেন, ‘মনে যে লাগে এতো রং ও রঙিলা’- স্যর আমাকে বললেন, ‘ও তুমি ‘রঙিলা’ সেজেছ।’ তিনি গানের খাতাটি নিয়ে গেলেন। সেই খাতাটি তিনি কয়েকদিন পরে আমার আব্বার হাতে দিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার আব্বা আমাকে কিছুই বললেন না। কেননা, আমার সিনেমা দেখা শুরু হয়েছিল আমার আব্বার হাত ধরে। আমি অল্প বয়সে প্রথম সিনেমা দেখি, ‘শেষ উত্তর’। ওই ছবির শুরুতে নায়িকা কানন দেবী গেয়েছিলেন, ‘তুফান মেল যায় তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে’। গানের খাতায় প্রথম গানটি ছিল এটিই। মোজাম্মেল স্যর এ গানটি দেখে ওভারলুক করার কারণ ছিল, সম্ভবত তারও প্রিয় নায়িকা ছিলেন কানন দেবী। অবশ্য সে কথা পরবর্তীতে অন্য একজন স্যরের মুখে শুনেছিলাম। দ্বিতীয় গানটি অর্থাৎ ‘ও রঙিলা মনে যে লাগে এত রং’ গানটি ছিল ‘জোয়ার এলো’ ছবিতে, গেয়েছিলেন ফেরদৌসী রহমান। সেই ১৯৬৪ সালে সবার মুখে মুখে তখন ছিল, ‘ও রঙিলা’। আর এই কারণে মোজাম্মেল স্যর আমাকে বারবার বলেছিলেন, ‘রঙিলা সেজেছ, রঙিলা সেজেছ।’ মোজাম্মেল স্যর একসময় আদর্শ পাড়াতে জায়গা কিনে বাড়ি করলেন। তখন তো তিনি আমাদের প্রতিবেশী হলেন। আমার বড় বোন বকুল আপা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী, সেই ১৯৬৪-৬৫ সালে। মোজাম্মেল স্যর সে কথা আমার কাছেই শুনে একবার আমাদের বাসায় এলেন আমার বড় বোনের সঙ্গে আলাপ করার জন্য। কেননা, মোজাম্মেল স্যর ছিলেন বাংলা সাবজেক্টের ওপর ভীষণ দুর্বল। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, নজরুল, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখের কাব্যগ্রন্থ নিয়ে তিনি আলোচনা করতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি স্কুলে আমাদেরকে শাসন করার পাশাপাশি বাবার মতো স্নেহ দিতেও কার্পণ্য করতেন না। আমাদের যুগে যে কোনও স্যরকে দেখে ভয় পেতাম, দেখামাত্র অন্য পথ দিয়ে চলে যেতাম। মোজাম্মেল স্যরের কথা কোনদিন ভোলা সম্ভব নয়। অমন শিক্ষক কালেভদ্রে জন্মায়।
১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কোনোরকম কেউ অশোভন আচরণ তো দূরের কথা, পা ছুঁয়ে পর্যন্ত সালাম দিতাম। সেই মমিন স্যার, মহসিন স্যার, অদুদ স্যার, জাহানারা ম্যাডাম সহ অন্যান্য স্যারদেরকে সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন, সন্মান জানাতেন। তাদেরকে দেখামাত্র আমরা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিতাম। কি করে ভুলি সেই শিক্ষকদেরকে! তারা এক একজন ছিলেন আমাদের কাছে বাবার মতো, আর আমরা ছিলাম তাদের কাছে সন্তানতুল্য। সেই দিন আর ফিরে আসবে না। যায় দিন ভালো যায়।
লেখক: চিঠিপত্র বিশারদ।
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, যা দেশের বেশিরভাগ আমদানি-রপ্তানি (৭০% এর বেশি) পরিচালনা করে এবং ভারত, নেপাল ও ভুটান ট্রানজিট ব্যবহার করে থাকে; বর্তমানে বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার জন্য বিদেশি কোম্পানি নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে, যা নিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছিল এবং সম্প্রতি একটি বিভক্ত রায় এসেছে, যেখানে একটি টার্মিনাল (লালদিয়া) ডেনমার্কের এপি মোলারকে ৩০ বছরের জন্য দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর আমাদের প্রধান বন্দর। বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত, যা দেশের সিংহভাগ বাণিজ্য পরিচালনা করে। আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করতে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর রিজিওনাল ইকনোমিক হাব হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারত, নেপাল এবং ভুটানের জন্য ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা প্রদান করে। এই গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনালটি বিদেশি কোম্পানিকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে সম্প্রতি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন হয়েছিল।এই রিটের বিষয়ে হাইকোর্ট একটি বিভক্ত রায় দিয়েছে, যেখানে একজন বিচারপতি চুক্তি প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলেছেন এবং অন্যজন দ্বিমত পোষণ করেছেন। ডেনমার্কের এপি মোলার কোম্পানিকে ৩০ বছরের জন্য লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে এর ব্যবহার শুরু, যা নবম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে 'শেটগাং' নামে পরিচিত ছিল এবং ষোড়শ শতাব্দীতে 'পোর্টে গ্র্যান্ড' নামে পরিচিতি পায়। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন নেই; বরং প্রয়োজন আলোচনাকে বাস্তব সমাধানের দিকে নেওয়া।
আজকের বাস্তবতায় বাংলাদেশ যদি ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে যেতে চায়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ ও চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়নের বিলম্ব করার সুযোগ নেই; যদিও কিছু ব্যাপারে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে।এখন এ কথা শুনতে যতটা সহজ, বাস্তবে ততটা নয়। কারণ, বন্দর শুধু একটা অবকাঠামো নয়, বরং এটা দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য, লজিস্টিকস, মুদ্রানীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও প্রশাসনিক সংস্কারের কেন্দ্রবিন্দু। চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের অর্থনীতির প্রধান প্রবেশদ্বার। দেশের ৯২ শতাংশ সমুদ্র–বাণিজ্য ও ৯৮ শতাংশ কনটেইনার কার্গো এখান দিয়ে ওঠানো নামানো হয়। ২০২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন টিইইউ হ্যান্ডল করা হয়েছে। কিন্তু এই বৃদ্ধির মধ্যেও বন্দরের কার্যকারিতা এক জায়গায় আটকে আছে। সিঙ্গাপুর বন্দর বছরে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন টিইইউ হ্যান্ডল করে, কলম্বো ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন টিইইউ। তার তুলনায় চট্টগ্রামের ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন টিইইউ এখনো আঞ্চলিক মানের অনেক নিচে। বিশ্বব্যাংকের কনটেইনার পোর্ট পারফরম্যান্স অনুযায়ী চট্টগ্রামের অবস্থান ৩৩৭তম/৪০৫। টার্মিনালের ক্রেন উৎপাদনশীলতা মাত্র ১৮-২১ মুভ/ঘণ্টায়, যেখানে আন্তর্জাতিক মান ৩৫-৪৫।বিশ্বব্যাংক তার অক্টোবরের প্রতিবেদনেও এ কথা তুলে ধরেছে। এনসিটিতে কিছু নতুন ইকুয়েপমেন্ট ব্যবহার করলেও অনেক ইকুয়েপমেন্ট আছে ২০-৩০ বছরের পুরাতন।
প্রায়ই ব্রেকডাউন হয়, স্পেয়ার পার্টসের অভাবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ অচল থাকে। একটি আধুনিক টার্মিনালে যেখানে ৯৫ শতাংশের বেশি আপটাইম থাকে, সেখানে এনসিটির আপটাইম ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। এর মানে হলো, বিদ্যমান অবকাঠামোই আমাদের অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। ২০২৫ সালের আগস্টে এনসিটি একাই রেকর্ড ১ লাখ ২২ হাজার ৫১৭ টিইইউ হ্যান্ডল করেছে আগের একই সময়ে বছরের তুলনায়। জুলাই-সেপ্টেম্বরে এনসিটির ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গেছে। কিন্তু সিডিডিএলের মধ্যস্থতা সত্ত্বেও অপেক্ষার সময় এখনো ৭ দিনের ওপর। যদিও নভেম্বরে জাহাজের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এনসিটির ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গেছে। যদিও নভেম্বরে জাহাজের চাপ কম থাকাতে এবং ম্যানেজমেন্ট ভালো করলে এই ওয়েটং টাইম প্রায় শূন্যতে নিয়ে আসা গেছে। কিন্তু চাপ বাড়লে তখন কতটা ধরে রাখা যাবে, তা সামনে বলা যাবে।ফলাফল একটাই—কোনো জাহাজকে যদি বহির্নোঙরে ৭ থেকে ১০ দিন অপেক্ষা করতে হয়, প্রতিদিন অতিরিক্ত খরচ ১২ থেকে ২০ হাজার ডলার। প্রতি বছর এ বিলম্বে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ১ দশমিক ৫ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ বহন করেন।
এ খরচ শেষ পর্যন্ত পণ্যের দামে, রপ্তানির সময়সীমায় এবং দেশের লজিস্টিক খরচে উঠে আসে। সোজা কথায়, বন্দর জ্যাম মানেই জাতীয় অর্থনীতির জ্যাম। যারা বন্দর পরিচালনা, মেশিনারি রক্ষণাবেক্ষণ, অটোমেশন কিংবা ডিজিটাল টিওএস বোঝেন, তারা জানেন, একটা টার্মিনালের দক্ষতা বাড়ানো মানে শুধু নতুন ক্রেন বসানো নয়। এটা হলো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনা, প্রশিক্ষিত জনবল, ডিজিটালাইজেশন, গ্লোবাল শিপিং নেটওয়ার্কে প্রবেশ এবং দৃঢ় ম্যানেজমেন্ট শৃঙ্খলা। সে জন্যই সরকার এনসিটি ও এলসিটিতে জিটুজি ও পিপিপি মডেলে বিদেশি অপারেটর আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
ডিপি ওয়ার্ল্ডের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলছে, তারা সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে, জাহাজের অপেক্ষার সময় ৪০ শতাংশ কমাতে পারে, ডুয়েল টাইম কমিয়ে আনে এবং পুরো টার্মিনালকে তথ্যভিত্তিক করে তোলে। কর্ণফুলীর ডান তীরে পতেঙ্গায় লালদিয়ার চরের চিত্র। এখানে কনটেইনার টার্মিনাল তৈরির জন্য ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে চুক্তি করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সীমানা প্রাচীরে ঢাকা এই চর ঘাসে ভরা। বর্তমানে ভিয়েতনাম, ভারত, এমনকি শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলোও দ্রুতগতিতে আধুনিক হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর যদি এখনই র্যাডিকেল সংস্কার না করে, তাহলে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সরবরাহশৃঙ্খলে আমরা মার্জিনালাইজড হয়ে পড়ব। শিপিং লাইনগুলো সরাসরি কলম্বো বা ক্ল্যাংয়ে যাবে, সেখান থেকে ফিডার করে ছোট জাহাজে পণ্য বাংলাদেশে আসবে, যা রপ্তানিকারকদের জন্য সময় ও খরচ—দুটিই বাড়িয়ে দেবে।বন্দরের দক্ষতা বাড়লে শুধু জাহাজ দ্রুত লোড-আনলোড হবে না; এর তরঙ্গের প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়ে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রতি বছর ৫ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার বাড়তে পারে। তৈরি পোশাক, কৃষি, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং—সব খাতেই অপেক্ষার সময় কমে যাবে। লজিস্টিক খরচ জিডিপির শূন্য দশমিক ৮ থেকে ১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। আজ বাংলাদেশে রপ্তানিকারকদের লজিস্টিক খরচ ভিয়েতনাম ও ভারতের চেয়ে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি। এই অদক্ষতা যত দিন থাকবে, এফডিআই আসবে না।
চট্টগ্রাম বন্দরের দীর্ঘদিনের একটি সমস্যার নাম অপারেশনাল ধীরগতি। জাহাজের টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনগুলো প্রায়ই বাড়তি খরচ বহন করে, আর এর চাপ পড়ে আমদানিকারক–রপ্তানিকারকদের ওপর। কিন্তু আধুনিক অপারেটরের দক্ষ ব্যবস্থাপনা, অটোমেশন এবং প্রযুক্তিনির্ভর মনিটরিং যুক্ত হলে বন্দরের প্রতিদিনকার কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়বে। দ্রুত লোড–আনলোড, উন্নত লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা ও পণ্য চলাচলের স্বচ্ছতা পুরো অর্থনীতির গতি বদলে দিতে পারে। এতে ব্যবসায়ী ব্যয় কমবে, আমদানি–রপ্তানি প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হবে, এবং বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা বাড়বে। একটি দেশের বন্দরের সক্ষমতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে অন্যতম প্রধান সূচক। এনসিটি ও সিসিটির আধুনিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপারেশনাল পদ্ধতি চালু হলে বাংলাদেশ নতুনভাবে বিনিয়োগের মানচিত্রে জায়গা করে নিতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে এমন স্থানে অবস্থিত যে, চট্টগ্রাম বন্দর সহজেই আঞ্চলিক লজিস্টিক হাবে পরিণত হতে পারে। ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার এই অঞ্চলের বড় বাজার, আর তাদের ট্রানশিপমেন্ট চাহিদা যদি বাংলাদেশ আকর্ষণ করতে পারে, তবে এর আর্থিক লাভ সরাসরি দেশের রাজস্ব, বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং কর্মসংস্থানে প্রতিফলিত হবে। এছাড়া উন্নত বন্দর সুবিধা থাকলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শিল্পকারখানা স্থাপনে আগ্রহী হয়, ফলে ইকোনমিক জোন, গুদাম, লজিস্টিক পার্ক এবং শিল্পাঞ্চল—সব ক্ষেত্রেই নতুন বিনিয়োগ বাড়বে। চুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্ক শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। অনেকের ধারণা এমন চুক্তি হলে শ্রমিক বেকার হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র দেখায়। আধুনিক টার্মিনাল পরিচালনায় নতুন ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন হয়, যা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। শ্রমিকরা তখন আগের তুলনায় উচ্চ দক্ষতা ও বেশি বেতনভিত্তিক কাজে যুক্ত হতে পারেন। পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং, আইটি, লজিস্টিক, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, নেভিগেশনসহ বিভিন্ন পেশায় নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। টার্মিনাল যত সম্প্রসারিত হবে, বন্দরের বাইরের খাত যেমন পরিবহন, গুদাম, সরবরাহ শৃঙ্খল, কাস্টমস ক্লিয়ারিং—সবখানেই বাড়তি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বৃদ্ধির দিকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত আন্তর্জাতিক অপারেটরদের সঙ্গে চুক্তিতে কনসেশন ফি, মুনাফার ভাগ, বন্দর ব্যবহারের ফি এবং কার্গো হ্যান্ডলিং বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে।
যখন একটি বন্দর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক হয়, তখন তার ব্যবহারও বহুগুণ বাড়ে। এতে শুধু রাজস্ব নয়, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও বাড়ে। এ অর্থ দেশের মেগাপ্রকল্প, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সামাজিক বিনিয়োগেও সহায়তা করতে পারে।অন্যদিকে প্রযুক্তি ও দক্ষতা স্থানান্তর দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য বড় সম্পদ হবে। বিদেশি অপারেটররা সাধারণত বিশ্বমানের যন্ত্রপাতি, ট্র্যাকিং সিস্টেম, সফটওয়্যার এবং নিরাপত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তাদের সঙ্গে কাজ করলে স্থানীয় জনশক্তি এসব প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারে। এটি শুধু বর্তমান বন্দরের জন্য নয়, ভবিষ্যতে দেশীয় বন্দর বা টার্মিনাল পরিচালনার সক্ষমতা তৈরিতেও সহায়ক হবে। আধুনিক টার্মিনাল মানেই দ্রুত পণ্য পরিবহন, নির্ভরযোগ্য সাপ্লাই চেইন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আস্থা বৃদ্ধি। আগামী দিনের অর্থনীতি হলো ‘স্পিড ইকোনমি’। যে দেশ যত দ্রুত পণ্য সরবরাহ করতে পারে, সে দেশ তত বেশি রপ্তানি অর্ডার পায়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, ওষুধ, জাহাজ, ইলেকট্রনিক্স—সব রপ্তানি খাতই গতি-নির্ভর। চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন তাই সরাসরি এসব খাতের সক্ষমতা বাড়াবে। সবশেষে বলা যায়, এনসিটি ও সিসিটি পরিচালনার অংশীদারিত্ব চুক্তি বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে পারে। এটি কেবল বন্দর ব্যবস্থাপনার বিষয় নয়; দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক মর্যাদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যদি যথাযথ পরিকল্পনা, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা, রাষ্ট্রীয় তদারকি এবং চুক্তির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়, তবে এই উদ্যোগ দেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরে এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী উন্নীত করতে এর কোনো বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী উন্নীত করা এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি এবং এনসিটি–সিসিটি চুক্তি সেই লক্ষ্য পূরণের বাস্তব সম্ভাবনা প্রদান করতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে চট্টগ্রাম বন্দর কতিপয় শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের খেয়ালখুশির শিকার হয়ে বিপর্যয়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিল। তাদের অযৌক্তিক দাবি দাওয়া, চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য, দখলদারিত্বের কারণে জিম্মি হয়ে থাকতে হয়েছে আমদানিকারক রপ্তানিকারকদের। এখন সেই তুঘলকি রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে নতুন গতিতে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হবে আমাদের প্রধান সমুদ্র বন্দর। বিশ্ব রেংকিংএ বন্দরের মান উন্নত হবে এতে বহি বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাবে এবং অনেক বিদেশি জাহাজ বাংলাদেশে আসার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এর মাধ্যমে উপমহাদেশের সবচেয়ে আধুনিক এবং প্রযুক্তি নির্ভর বন্দর হয়ে উঠতে পারে চট্টগ্রাম।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট।
দেশে ২১ নভেম্বর ২০২৫ সালের ভূমিকম্প শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা ছিল না; এটি সমগ্র সমাজকে নাড়া দেওয়া এক আবেগতাত্ত্বিক অভিঘাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সমাজতত্ত্বের আধুনিক ধারণা-বিশেষত ‘ইমোশন ইকোনমি’-অনুসারে, ভয়, চাপ, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা এখন আর কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়; বরং এগুলো সামাজিক কাঠামোর উৎপন্ন শক্তি, যা সরাসরি অর্থনীতি, রাজনীতি, নগরজীবন এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ধরনকে প্রভাবিত করে।
বিশ্লেষনে দেখা যায় যে বাংলাদেশে ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়টায় এক আবেগতাত্ত্বিক শক্তির প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যখন দেশটিতে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জলবায়ু-ঝুঁকির মতো বহুমাত্রিক চাপের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। একটি সমাজে যেখানে অনিশ্চয়তা জীবনের নিত্যসঙ্গী, সেখানে জনগণের মানসিক অবস্থা সমস্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট আতঙ্ক এবং বিদ্যমান অর্থনৈতিক চাপ মিলে একটি নতুন ‘মানসিকতার অর্থনীতি’ তৈরি করেছে, যা আমাদের সামাজিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিকে দুর্বল করছে।
ইমোশন ইকোনমি তত্ত্ব অনুসারে, যে সমাজে কাঠামোগত অনিশ্চয়তা বেশি, সেই সমাজে জনগণের আবেগও হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের চালিকাশক্তি। আজকের বাংলাদেশে ভূমিকম্প-উদ্ভূত আতঙ্ক শুধু মুহূর্তিক প্রতিক্রিয়া নয়; এটি বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপের সঙ্গে মিশে এক বৃহত্তর আবেগতাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করছে। এই আবেগতাত্ত্বিক কাঠামো তিনভাবে কাজ করে, ১. এটি মানুষের ঝুঁকি-উপলব্ধিকে প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিয়ে সমাজে স্থায়ী উদ্বেগের পরিবেশ তৈরি করে; ২. এটি অনলাইন স্পেসকে তথ্য-ভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার উর্বর জায়গায় রূপান্তরিত করে; ৩. এই আবেগগুলো অর্থনীতি ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। মানুষ ভোগ কমায়, জরুরি জিনিস মজুত করতে শুরু করে, অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়, পরিবারগুলো তরল সঞ্চয়কে অগ্রাধিকার দেয়।
ভূমিকম্পের ভয় সমাজের প্রতিটি সংবেদনশীল গোষ্ঠীকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় আঘাত করে, এবং এর প্রভাব অর্থনীতিতে অনুভূত হয়। স্কুলগামী শিশুরা এই আকস্মিক কাঁপুনিকে ‘জীবনহানির আশঙ্কা’ হিসেবে উপলব্ধি করে, যা দীর্ঘমেয়াদি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস-এ রূপ নিতে পারে। অভিভাবকেরা তখন স্কুল ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সন্তানদের স্কুলে পাঠানো কমিয়ে দিতে পারেন, যা শিক্ষা-অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলে।
অন্যদিকে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জন্য ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা ভিন্ন এক সামাজিক ভয়। তাদের নড়াচড়ার স্বাধীনতা নেই, আর চিকিৎসা সরঞ্জাম, অক্সিজেন লাইন বা লাইফ-সাপোর্ট ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা বাস্তব আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এটি স্বাস্থ্যসেবার প্রতি কাঠামোগত আস্থাহীনতাকে আরও প্রকট করে তোলে এবং জরুরি স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত বিনিয়োগের চাপ তৈরি করে। শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মনে রানা প্লাজার স্মৃতি এখনও তাজা; তাই সামান্য দোলনাও সেখানে গণউৎকণ্ঠার ঢেউ তোলে, যা দ্রুত গুজব ও হুড়োহুড়িতে পরিণত হয়ে উৎপাদন ব্যাহত করে। এই আতঙ্ক কেবল শ্রমিকের নয়, বরং সমগ্র শিল্প খাতের জন্য এক নতুন অনিশ্চয়তার পুঁজি তৈরি করে, যা বিদেশি ক্রেতাদের আস্থাকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও গবেষণা বলছে, বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে দেশে ৩৪৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে। সারাদেশে ঝুঁকির মুখে থাকা ভবন প্রতিস্থাপনে ব্যয় হতে পারে ৩৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক শতকে দেশে অন্তত ২০০টিরও বেশি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ধরনের ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। বছরে গড়ে ২৫ থেকে ৩০টি ক্ষুদ্র ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে, যার বড় অংশ সিলেট, চট্টগ্রাম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। আন্তর্জাতিক সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি-জাইকার এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় ম্যাগনিচিউড ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে ৭০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, দুই লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে এবং সামগ্রিক ক্ষতি হতে পারে ৩০ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার। ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে ওঠা নগরগুলোর একটি হওয়ায় ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণ বাড়তে পারে। একটি বড় ধরনের ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে বহুমাত্রিকÑ অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন টাকা (৩০ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার) ছাড়াতে পারে।
ব্রিজ, কালভার্ট, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল ভায়াডাক্ট, পুরান শহরের নড়বড়ে ভবন, অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস লাইনে আগুন লাগার আশঙ্কা-সব মিলিয়ে নগরবাসীর মনে একটি মৌলিক প্রশ্ন জাগে: ‘এই শহর কি আদৌ নিরাপদ? এই অবকাঠামোতে আমার জীবন কতটা সুরক্ষিত?’ এই প্রশ্নটি কেবল দুর্যোগসংক্রান্ত নয়; বরং এটি নগর-অবকাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি অবহেলা, দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীনতা ও লাগামহীন জনঘনত্বের চাপের ফসল। যখন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও নাগরিকেরা একটি নিরাপদ শহর পান না, তখন এই ভৌত দুর্বলতা তাদের মানসিক নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত করে। এই হতাশা এবং অবিশ্বাসই আবেগের অর্থনীতিকে চালিত করার মূল শক্তি, যা সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল সংস্কারের দিকে ঠেলে দেয়।
সর্বশেষে বলা যায় ভূমিকম্প প্রতিরোধ নয়, ক্ষয়ক্ষতি কমানোই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। এখানে শুধু সরকার নয়, সবারই দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণ বাধ্যতামূলক করা এবং রাজউক, সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সুষম মনিটরিং নিশ্চিত করা জরুরি। পুরনো স্কুল, হাসপাতাল ও আবাসিক ভবনগুলো পুনর্মূল্যায়ন করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা ও রেট্রোফিটিং করা।
দেশে আরও সিসমিক স্টেশন, ভূ-প্রযুক্তি গবেষণাগার ও আঞ্চলিক মনিটরিং সিস্টেম প্রয়োজন। ভূমিকম্প-উদ্ভূত আতঙ্ক বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সামাজিক বার্তা বহন করে। উন্নয়ন শুধু সেতু-ফ্লাইওভার তৈরির বিষয় নয়, বরং একটি নিরাপদ, পরিকল্পিত, মানবিক নগর ও সমাজ গড়ে তোলার ব্যাপার। মানুষের মানসিক নিরাপত্তা রক্ষাই আগামী দিনে রাষ্ট্রের অন্যতম বড় নীতি-চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু ফিজিক্যাল অবকাঠামো মজবুত করলেই চলবে না; প্রয়োজন একটি সমন্বিত উদ্যোগ: তথ্য-ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, দুর্যোগ-পরবর্তী ট্রমা মোকাবিলা এবং মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনিয়োগ করা।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
আমাদের দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানীর বড় বড় স্পট ছাড়াও অলিতে গলিত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য কোচিং সেন্টার। একাডেমিক কোচিং, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং, মেডিকেল কোচিং, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিং, ক্যাডেট কলেজ ভর্তি কোচিং, বিসিএস কোচিং, আমিং-নেভি-বিমান বাহিনীতে চাকরি পাওয়ার কোচিংসহ বহু ধরনের কোচিং সেন্টার। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য রাজধানীতেই মোট ৩৩টি কোচিং সেন্টার আছে বলে একটি জাতীয় দৈনিক খবর প্রকাশ করেছে। প্রশ্ন হচেছ এতসব কোচিং কেন?
আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেছে বহু আগে। ফলে দেশে সৃষ্টি হয়েছে কোচিং বিপ্লব!! বোর্ড থেকে সার্টিফিকেট পাওয়ার মাধ্যম যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না হতো তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যে কি অবস্থা হতো সেটি চিন্তা করতে কষ্ট হয়। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উদীয়মান শিক্ষার্থীরা সামাজিকতা শেখে, সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ ও শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য উপস্থিত বক্তৃতা, নির্ধারিত বক্তৃতা, কবিতা আবৃত্তি, নাটক মঞ্চস্থ করা, বিভিন্ন ধরনের ইনডোর ও আউটডোর গেমস ইত্যাদি নিয়মিতভাবে প্রাকটিস করা কথা। একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠানে একাডেমিক বিষয়ের পাশাপাশি এসব বিষয় সমানভাবে গুরুত্ব পায় কারণ ভবিষ্যৎ জীবনে এগিয়ে যেতে হলে একাডেমিক বিষয়ের সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের জীবনে এগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক’জন চিনে, আর তাদের মধ্যে ক’জন ই বা জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকরী ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন বা রাখতে পেরেছেন? অথচ একজন শিল্পী, একজন খেলোয়াড়, একজন গায়ক, একজন ভালো লেখক দেশ, সমাজ ও বৈশ্বিক মন্ডলে অবদান কার্যকরী ভূমিকা রাখেন, দেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করান। এগুলো দৃশ্যমান বাস্তবতা। কিন্তু আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এসব বিষয়ে খুবই কম গুরুত্ব দেয়! কারণ কি শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? অবশ্যই না। সব ধরনের অভিভাবক চান তার ছেলে বা তার মেয়ে ক’টি বিষয়ে এ প্লাস পেয়েছে, পুরো ফল কি গোল্ডেন জিপিএ না খালি জিপিএ। কোন অভিভাবক চিন্তা করেন না, গুরুত্ব দেননা যে, আমার ছেলেটি বা মেয়েটি বাংলায় ভালভাবে কথা বলতে শিখেছে কিনা, নিজে দুচার কথা বানিয়ে লিখতে পারে কিনা, বিজ্ঞান ও গণিতে বিষয়ে মূল ধারণা নিতে পেরেছে কিনা, ইংরেজিতে কিছু বলতে পারে কিনা। কোন শিক্ষক কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান যদি এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চায়, অভিভাবকগন তখন তাতে উষ্মা প্রকাশ করেন। তারা বলেন, ‘পড়ালেখা বাদ দিয়ে আপনার এসব নিয়ে বেশি ভাবছেন।’ অর্থাৎ তারা সবাই চান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়া দেওয়া হবে, মুখস্থ করানো হবে এবং সেগুলো লিখে শিক্ষার্থীরা ভালো জিপিএ পাবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সেটি কেউই বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করতে চাননা। তারা চান সব শিক্ষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘এক একটি কোচিং সেন্টার হবে!’ তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও সেই চাওয়ার একটা পরিবেশ বিরাজ করছে এবং তার সাথে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কোচিং সেন্টার। সমাজ যা চায় তাইতো হবে!
উচচ মাধ্যমিক পাস করার পর শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রিকালচারাল বিশ্ববিদ্যালয়, সামরিক বাহিনীর পদগুলোতে পরীক্ষা ফেস করতে হয়। এগুলোর মধ্যে কোনগুলোর পরীক্ষা দ্রুত হয়, বাকীগুলোর বেশ কয়েকমাস লাগে। এই সময়টিতে শিক্ষার্থীরা নিজেরা অনেকেই পড়াশোনা করে না। নিজে পড়তে গেলেও নিয়ম শৃংখলার মধ্যে থাকে না। আজ হয়তো আটঘন্টা পড়াশোনা করলো, কাল সিনেমা দেখতে গেল। কিন্তু কোচিং বা এই জাতীয় কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলে একটা নিয়ম শৃংখলার মধ্যে থাকে, পড়াশোনার চাপের মধ্যে থাকে। দ্বিতীয়ত, এগুলোতে নিয়মিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, পরীক্ষার ফল তাদের অগ্রগতির কথা বলে দেয়। তারা মোটামুটি একটা প্রস্তুতির মধ্যে থাকে। তৃতীয়ত, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির জন্য কিছু কমন আর কিছু বিশেষায়িত প্রশ্ন ও সেগুলোর উত্তর দেয়ার স্টাইল থাকে যেগুলোর সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা ঐসব সেন্টারে ভর্তি হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে মাত্র ১২০ দিন ক্লাস হয়, তারমধ্যেও থাকে বহু ধরনের প্রোগ্রাম, পরীক্ষার বন্ধ, বোর্ড পরীক্ষার সেন্টার যেসব প্রতিষ্ঠানে পড়ে সেই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ইত্যাদি কারনে শিক্ষার্থীদের প্রতিটি বিষয়ে যে পরিমাণ পড়াশোনা ও অনুশীলন দরকার তা কোথাও হয়না। আর যেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি সেগুলোর তো কথাই নেই। কিন্তু কোচিং সেন্টারগুলো বড় বড় বন্ধেও তাদের কার্যক্রম খোলা রাখে, কোনগুলো বরং বন্ধের সময় বেশি গুরুত্ব দিয়ে ক্লাস করিয়ে থাকে। ফলে, অভিভাবকগণ সেসব সেন্টারে তাদের সন্তানদের পাঠিয়ে থাকেন। এগুলো সমাজের বাস্তবতা। কাজেই এ নিয়ে আমরা যতই নেগেটিভ কথা বলি, নেগেটিভলি উপস্থাপন করি তাতে কোনো লাভ নেই।
এখানে আর একটি সামাজিক ব্যধি লক্ষণীয়। সেটি হচেছ কোন শিক্ষার্থীই এবং বলা যায় কোন অভিভাবকই কিন্তু তাদের সন্তানদের মূল পড়ালেখা শেখানোর জন্য বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে থাকেন না। তারা পাঠান পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেতে, ভালো গ্রেড পেতে। সেটি যে শিক্ষক, বা যে কোচিং সেন্টার করাতে পারে সেখানে সব শিক্ষার্থী, সব অভিভাবক ভীড় করেন। তারা শুধুমাত্র প্রশ্নপত্র নিয়ে আলোচনা করা, পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়ার টেকনিক নিয়ে আলোচনা করা শিক্ষক ও কোচিংএ ছোটাছুটি করেন।। বিদ্যালয় বা কলেজেও একই অবস্থা। আপনি যদি শিক্ষার্থীদের গণিতের, বিজ্ঞানের বা ইংরেজির বেসিক শেখাতে চান, প্রকৃত পড়াশোনা শেখাতে চান দেখবেন কোন অভিভাবক ঐ শিক্ষক বা ঐসব কোচিং সেন্টারে যাবেনা, বাচ্চাদের পাঠাবেন না। বিদ্যালয়ে যে শিক্ষক কমার্শিয়ালি পড়াতে পারবেন অর্থাৎ প্রশ্ন পত্র কিভাবে আসবে, কিভাবে একটি প্যারাগ্রাফ পরে বাংলা ও ইংরেজিত বেশি নম্বর পাওয়া যায়, গণিতে কিভাবে ৫টি অংক করলে কমন পড়বে, সেইসব শিক্ষকদের কাছে সব অভিভাবক ভীড় করেন, সেই শিক্ষক বা সেই সেন্টারে ঢোকার জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেন। কিন্তু আপনি যদি প্রকৃত শিক্ষক হোন, প্রকৃতঅর্থেই শিক্ষার্থীদের শেখাতে চান, তাদের জীবনের জন্য প্রস্তত করতে চান, দেখবেন আপনার কাছে কেউ যাবেনা। আপনাকে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিাভাবক এমনকি সমাজ কেউ আপনাকে পছন্দ করবে না, চাবেনা।
সমাজের এই ব্যধি দূর করার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে শুধু কোচিং সেন্টারের দোষ দিয়ে আর সরকারকে দায়ী করে লাভ কি?কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য রাজধানীতেই মোট ৩৩টি কোচিং সেন্টার রয়েছে। মেডিক্যাল ও ডেন্টালে ভর্তির জন্য রয়েছে ১৩টি কোচিং সেন্টার। একাডেমিক কোচিং সেন্টার রয়েছে ১৯টি এবং চাকরির কোচিং রয়েছে ১৩টি। বছরে বিশ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কোচিং সেন্টার যা শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এডুকেশন কমিউনিকেশনের জরিপ অনুযায়ী কোচিং সেন্টারগুলোত বছরে ৩০ থেকে ৩৫হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। আর এডুকেশন রিসার্চ কাউন্সিল (ই আরসি) বলছে দেশে আড়াই হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হয়ে থাকে। সন্তানদের জন্য এই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচেছ অভিভাবকদের। পাঁচ বছরে কোচিং ফি বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তিতে বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য আর এগুলোর ভর্তি সহায়ক বাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্ধেক বই বিক্রি করে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার। দেশে নিবন্ধিত কোচিং সেন্টারের সংখ্যা ৬হাজার ৫৮৭টি তবে নিবন্ধনহীন কোচিং সেন্টার দুই লক্ষাধিক। এ বছর উদ্ভাস কোচিং সেন্টারে প্রায় বিশ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে, প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১৫-২০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে, মানে বিশাল বিজনেস! দেশের জাতীয় দৈনিকগুলো কোচিং বাণিজ্যের এই চিত্রগুলো প্রায়ই প্রকাশ করে থাকে কিন্তু এগুলো কেন হচেছ সেটি নিয়ে কথা বলার লোক কম দেখা যাচেছ। কেউ কেউ বলছেন রাষ্ট্রীয় নজারদারির অভাবে এগুলো হচ্ছে। তারা চাচ্ছেন নিয়ম কানুন এখানে চাপিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। রাষ্ট্রীয় নিয়ম বা বিধিনিষেধ দেওয়া মানে হচেছ আইন শৃংখলা বাহিনী, ইনকাম ট্যাক্সসহ অন্যান্য বিভাগগুলোকে বৈধতা দেওয়া যাতে তারা এখান থেকেও নিয়মিত উৎকোছ গ্রহণ করতে পারে। আমাদের দেশের কোন বিষয় সরকারি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা মানে হচেছ কালো টাকার খেলা, দেশ ও জাতির কোন কল্যাণ করার আরও বারোটা বাজানো!
এর মধ্যেও সরকার যে কিছু করেনি বিষয়টি তা নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ২০১২ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। হাইকোর্টের আদেশে ২০১৯ সালে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। যেখানে বলা হয়েছে কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারেন। ঐ নীতিমালা কাগজে কলমেই আছে, অন্ধকার ফাইলের মধ্যে লুকিয়ে আছে, বাস্তবে কোথাও নেই। সরকার তো নিয়ম কাগজে লিখেই খালাস! কে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে? শিক্ষার্থী, অভিভাবক আর সমাজ যেখানে চায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সব কোচিং সেন্টার হোক আর প্রতিষ্ঠানগুলোর আশে পাশে গড়ে উঠুক আরও হাজারো কোচিং, সেখানে রাষ্ট্র কি করবে?
লেখক: সাবেক অধ্যাপক ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, সিলেট, কুমিল্লা ও মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ- ব্র্যাক শিক্ষা, কান্ট্রি ডিরেক্টর-ভাব বাংলাদেশ।
অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস নভেম্বর ১৭ তারিখে জাতির উদ্দেশে ভাষণে উল্লেখ করেন চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কমটেইনার টার্মিনালটি ৩০ বছরের জন্য পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ডেনমার্ক ভিত্তিক শিপিং ও লজিস্টিক প্রতিষ্ঠান এপি মোলার মাসের্স্ক (এপিএ)। তাছাড়া একইদিনে বুড়িগঙ্গার পাড়ে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেনার টার্মিনালকে ২২ বছরের জন্য সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেডেলগের দায়িত্ব দিতে চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন সরকার।
নিউমুড়িং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল। এখানকার ৪৪ শতাংশ কন্টেইনার সামলায় এনসিটি। এই টার্মিনালে এক সঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ও একটি অভ্যন্তরীণ নৌপথের ছোট জাহাজ ভিড়ানো যায়। এনসিটি জাহাজ থেকে বার্ষিক ১০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানো নামানোর স্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে। গত এই টার্মিনাল ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডেল করেছে।
দেশীয় প্রতিষ্ঠান দরপত্রের মাধ্যমে গত ১৭ বছর ধরে এনসিটি টার্মিনালটি পরিচালনা করছে। বর্তমানে এটি পরিচালনা করছে নৌবাহিনী নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেড। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ(সিপিএ) এনসিটি থেকে মোট রাজস্ব আয় করেছে ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। আর ব্যয় বাদে লাভ হয়েছে ৫৭৪ কোটি টাকা। এটিকেও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
তবে এনসিটি পরিচালনা করতে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিদেশি কোম্পানির চুক্তি সম্পর্কিত প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে শুনানী চলছে। নিষ্পত্তি হলে সরকার টার্মিনালটি সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে পরিচালনা করতে দিয়ে দেবে। তার আগ পর্যন্ত বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পর্কিত প্রক্রিয়া চালানো যাবে না বলে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর আগে গত বছরের জুনে চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা টার্মিনালটি পরিচালনার কার্যক্রম শুরু করে সৌদি আরবের রেড সি গ্রেডওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল ( আরএসজিটিআই)। তবে এখনো প্রতিষ্ঠানটি কন্টেইনার পরিচালনায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহের পর্যায়ে আছে।
চট্রগ্রাম বন্দরের বাকি দুটি টার্মিনাল দেশীয় বেসরকারি বার্থ অপারেটর পরিচালনা করছে… চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি)ও জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি)এর মধ্যে সিসিটি মোট কনটেইনারের ১৯ শতাংশ এবং জিসিবি ৩৭ শতাংশ হ্যান্ডেল করে।
বন্দরে কন্টেইনার কম বা বেশি পরিবহন হয় মূলত বৈদেশিক বাণিজ্য কম বেশির ওপর। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর যা দেশের আমদানি রপ্তানি ৯০ শতাংশের বেশি হ্যান্ডেল করে। বন্দরের প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক ২০২৩ সালে এই বন্দরে ৩০ লাখ ৫০ হাজার ৭৯৩ একক কনটেইনার পরিবহন হয়েছে। ২০২৪ সালে তার তুলনায় সোয়া দুই লাখ বেড়ে এর পরিমাণ হয়েছে ৩২ লাখ ৭৫ হাজার একক কনটেইনার। এ হিসাবে কনটেইনার পরিবহন বেড়েছে ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
সরকার দেশের বিনিয়োগ এর পরিবেশ আরও গতিশীল করতে বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়ানোর অংশ হিসাবে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে ।
বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তির বিপক্ষে দেশের স্বার্থ রক্ষাসহ কৌশলগত অর্থনৈতিক এবং প্রক্রিয়াগত নানা উদ্বেগ দেখিয়ে জোড় সমালোচনা চলছে নানা পক্ষ থেকে। গত ১৭ নভেম্বর সম্পাদিত চুক্তিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাষ্টমস কী পরিমাণ ট্যারিফ মাসুল, চার্জ,শুল্ক কর ইত্যাদি পাবে,সেই বিষয়গুলো গোপন রাখা হয়েছে।
এ নিয়ে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বলেছে লালদিয়া এবং পানগাঁও ও বন্দর পরিচালনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হওয়া চুক্তিটি নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (গোপনচুক্তি)। তাই এ নিয়ে তথ্য প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
ননডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট(নন ডিএ) তখনই জরুরি হয় যখন দুই- ততোধিক পক্ষের মধ্যে গোপন তথ্য বিনিময় হয়। যেই তথ্য ফাঁস হলে ব্যবসায়িক আর্থিক আইনি বা ব্যক্তিগত ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
এই বিষয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে বিডা নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, কোন দেশের সরকারই পিপিপি চুক্তির দলিল জনসম্মুখে প্রকাশ করবে না আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে। সরকারি ক্রয় নীতি ও পিপিপি গাইড লাইন অনুযায়ী পূর্ণ প্রকাশ নিরাপদ নয় সেই সঙ্গে বেসরকারি অংশীদারদের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি তিনি জানান।
বন্দর বিদেশি অপারেটর বাছাইয়ের আগে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা উচিত বলে মনে করেন অনেকে। এই প্রক্রিয়া মানা হয়নি বলে আসা অভিযোগের ও জবাব দিয়েছেন আশিক চৌধুরী। তিনি ওই পোষ্টে আরও লেখেন পিপিপি নীতিমালার জিটুজি পদ্ধতির আলোকে টেন্ডার আহব্বান প্রাক- যোগ্যতা যাচাই টেকনিক্যাল ও ফিনান্সিয়াল মূল্যায়ন এবং ডিউ ডিলিজেন্সের মাধ্যমে অপারেটর চূড়ান্ত করা হয়েছে।
কিন্ত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কনটেইনার টার্মিনালগুলো পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে চলছে জোড় আলোচনা। কিন্তু বিষয়টি কেউ তলিয়ে না দেখে সমালোচনা করছেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তে যেমন একদিকে বন্দরের কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি অন্যদিকে স্বচ্ছতার অভাব জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে সরকারের অভিমত পজেটিভ।সরকার যুক্তি দিচ্ছে… সীমিত বন্দর সক্ষমতা সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং দক্ষতা বাড়াতেই বিশ্বমানের অপারেটর আনা হচ্ছে। দুর্নীতি ও অদক্ষতাকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সচরাচর পণ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে এতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। বন্দরের সূত্র মতে যেমনটি জানা যায়,
চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজ বার্থিংয়ের জন্য গড়ে তিন চারদিন অপেক্ষা করে যেখানে সিঙ্গাপুরে সময় লাগে মাত্র ১৪ থেকে ২৪ ঘন্টা। কনটেইনার খালাসে ও ৮ থেকে ১২ দিন সময় লাগে, যা আন্তর্জাতিক মানের( ২--৩ দিন) চেয়ে অনেক বেশি। বিদেশি অপারেটররা তাদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্দরের এই টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম কমিয়ে দক্ষতা বাড়াতে পারবে বলে আশা করছে সরকার।
লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ডেনমার্কের কোম্পানিটি প্রায় ৬ হাজার ৭০০কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এর চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই ২৫০ কোটি টাকা সাইনিং মানি হিসাবে পেয়েছে দেশ।পানগাঁও টার্মিনালে সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৪৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। সুইজারল্যান্ড সাইনিং মানি হিসাবে দিয়েছে ১৮ কোটি টাকা। এতে করে দেশের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার না করে বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে অবকাঠামো তৈরি হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে কোন অর্থ ব্যয় করতে হবে না। যা সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। চুক্তি সই অনুষ্ঠানে জানানো হয়, লালদিয়া টার্মিনালে বছরে নয় থেকে দশ লাখ কনটেইনার ওঠা নামার সক্ষমতা থাকবে। বাড়ার ক্ষেত্রে আট লাখ পর্যন্ত প্রতি একক কনটেইনারে ২১ডলার করে পাবে বাংলাদেশ। আর আট লাখের বেশি কনটেইনার ওঠানো নামানো হলে প্রতি একক কনটেইনারের জন্য পাবে ২১ থেকে ২৩ ডলার করে।অন্যদিকে পানগাঁও নৌ টার্মিনালে ১ লাখ ৬০ হাজার একক কনটেইনার হ্যান্ডেলিং হবে বলে জানিয়েছে মেডলগ। প্রতি একক কনটেইনার থেকে ২৫০ টাকা করে পাবে সরকার।
মালামাল লোডিং আনলোডিং সময় কম লাগবে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে দেশ উন্নত হবে। করের অবকাঠামো উন্নয়ন হবে বহুলোকের কর্মসংস্থান হবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে। বন্দরের বিশ্ব মানদণ্ডের কাঠামো উন্নয়ন হবে। গুনগত মান বৃদ্ধির ফলে বিদেশি জাহাজের আগমন বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে এই উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বন্দর হবে চট্টগ্রাম। বন্দরের দুর্নীতি বন্ধে এই প্রক্রিয়া বিশেষ অবদান রাখবে বলে আমার ও ধারণা।
লেখক: কলামিস্ট ও ব্যাংকার।