বুধবার, ৭ জুন ২০২৩

স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু

সাজ্জাদুল হাসান
আপডেটেড
২৬ মার্চ, ২০২৩ ১০:০৩
সাজ্জাদুল হাসান
প্রকাশিত
সাজ্জাদুল হাসান

ব্রিটিশ শাসন অবসানের দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পর জনগণ পেয়েছিল পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্র। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর শুরু হয় বাঙালিদের নতুন করে শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেঁধে রাখার ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানি হানাদারদের সেই শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি জাতি। স্বাধীনতা লাভের দৃঢ় প্রত্যয়ে উজ্জীবিত বাঙালির সামনে কোনো মারণাস্ত্রই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বাঙালি জাতিকে মুক্তির এই মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যান ইতিহাসের মহানায়ক, মহাবীর, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত দেশের মুক্তিকামী জনগণকে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। দেশের ৫৩তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস আজ ২৬ মার্চ।

স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর কলকাতার ইসলামীয়া কলেজে (বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন। পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব কোলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন, যার মাধ্যমে তিনি ওই প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন। ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নেই অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তিনি গ্রেপ্তার হন, তারপর ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন- কোথায় নেই বঙ্গবন্ধুর নাম। কারাগারে বন্দি বা বাইরে যেখানেই বঙ্গবন্ধু থেকেছেন সব সময় তিনি ছিলেন নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা ছিল ৬ দফাকেন্দ্রিক এবং নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু হয় ৭ জুন ৬ দফা দিবসেই। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ ৬ দফা কর্মসূচিকে তাদের প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ধাবিত হতে থাকে।

১৯৭১ সালের ৭ জানুয়ারি কানাডার রাজনৈতিক ও বাণিজ্য বিশ্লেষণভিত্তিক পত্রিকা ‘অটোয়া গ্লোব অ্যান্ড মেইল’ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে ‘শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন, যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে আমি বিপ্লবের ডাক দেব।’ ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ‘ব্যাংকক পোস্ট’ লিখেছে, মুজিব বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তান যদি তার দলের ঘোষিত ৬ দফা কর্মসূচি হুবহু গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তিনি এককভাবে অগ্রসর হবেন এবং সংবিধান রচনা করবেন।

২৩ ফেব্রুয়ারি ‘লন্ডন টাইমস’-এর রিপোর্টে বলা হয়, মুজিব ইতিমধ্যেই তার বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান শব্দের পরিবর্তে ‘বাঙালি জাতি’ উল্লেখ করছেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ‘লিভারপুল ডেইলি পোস্ট’ লিখেছে, হোয়াইট হলের (ব্রিটেনের এস্টাবলিশমেন্ট) আশঙ্কা পাকিস্তান ভেঙে যেতে পারে। পূর্ব পাকিস্তান নিজেকে একটি ‘স্বাধীন বাঙালি মুসলিম প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করতে পারে। শেখ মুজিব ইতিমধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে নয়, বাঙালি প্রজাতন্ত্রের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন। ফলে ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে এই উপলব্ধি এসেছে যে, তারা কমনওয়েলথের একটি দেশ ভেঙে যাওয়ার মতো গুরুতর পরিস্থিতি মোকাবিলার সম্মুখীন হচ্ছে। ৭০-এর নির্বাচনকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা যদি সময়ের ডাকে সাড়া দিতে ব্যর্থ হই তাহলে আগামী প্রজন্ম আমাদের দায়ী করবে।’

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের মহিলাসহ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৮৮টি আসনে জয়লাভ করে।

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনপ্রতিনিধিদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগদলীয় সদস্যরা ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি অনুগত থাকার শপথগ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা দিয়ে দুই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে ভুট্টোর দাবির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘ভুট্টো সাহেবের দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ক্ষমতা একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। ক্ষমতার মালিক এখন পূর্ব বাংলার জনগণ।’

অথচ ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা প্রদান করেন। ফলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরি বৈঠক ডেকে ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। এই দিন সারা বাংলায় হরতাল পালিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি দাবি জানান।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্সের ঐতিহাসিক জনসভায় জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হয়ে যায় এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্ববাংলার তথা ভবিষৎ বাংলাদেশের জনগণের মানসিক দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি ইয়াহিয়া খানের সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। পূর্ববাংলার অফিস-আদালত বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার মানুষের সেই অভূতপূর্ব সাড়া ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

৯ মার্চ ১৯৭১ লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর রিপোর্টে বলা হয়, ‘৭ মার্চে মুজিবের ঘোষণা এক পাতলা ছদ্মাবরণে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা। কারণ, মুজিবের দাবিগুলো ইয়াহিয়া খান পূরণ করতে পারেন না।’ একই দিনে লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ একটি সম্পাদকীয়তে লিখেছে, “ইতিমধ্যেই পৃথক রাষ্ট্রের নাম ভেসে আসছে। পূর্ব পাকিস্তান হবে ‘বাংলাদেশ’। বাঙালির ভূখণ্ড। তৈরি করা হয়েছে এই রাষ্ট্রের পতাকা।”

‘দ্য ইকোনমিস্ট’ ১৩ মার্চ লিখেছে, ‘৭ মার্চে দেয়া মুজিবের চার শর্তের মধ্যে দুটি শর্ত অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর কার্যত রাষ্ট্রপতির পক্ষে গ্রহণ করা অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শিগগিরই ঢাকায় যাচ্ছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সেটাই হতে পারে তার শেষ বৈঠক।’

১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। আলোচনার জন্য ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। ২৪ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনা হয়। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনেস।

২৬ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ট্রান্সমিটারযোগে চট্টগ্রাম ইপিআর হেড কোয়াটার্সসহ দেশের অনেক জায়গায় প্রেরণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর উক্ত ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ:

‘This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours.’

[বঙ্গানুবাদ: ‘সম্ভবত এটাই আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনসাধারণকে আহ্বান জানাচ্ছি, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যা-ই তোমাদের হাতে আছে তার দ্বারাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে হবে। যতক্ষণ না পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ ব্যক্তি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবে, তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’]

এর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলায় নিম্নলিখিত একটি ঘোষণা পাঠান: ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ- দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’

এভাবেই হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক যোদ্ধা, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান বেতার যন্ত্র মারফত তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারাদেশে পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রচার করা হয় এবং চট্টগ্রামে সাইক্লোস্টাইল কপি করে ২৬ মার্চ জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার বার্তা প্রেরণের পর পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তাকে বন্দি অবস্থায় ঢাকা সেনানিবাস থেকেই পাকিস্তানে নিয়ে লায়ালপুর (বর্তমানে ফয়সালাবাদ) জেলে বন্দি করে রাখে।

জাতিকে বঙ্গবন্ধু ২৩ বছরের আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন, প্রস্তুত করেছেন। এই বীরোচিত গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। বাঙালির ইতিহাসে প্রথম জাতি-রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এই কারণেই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

তাই স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু একে অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে গরিব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তিনি জেল-জুলুম-হুলিয়া, শত যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট-বেদনাকে সহ্য করে বাংলার কৃষক-শ্রমিক জনতার মুখে হাসি ফোটাতে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে বঙ্গবন্ধু চিরদিন অম্লান থাকবেন এবং বাংলার জনতার হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।

লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়


শহীদের রক্তে লেখা ছয় দফা

তোফায়েল আহমেদ। ফাইল ছবি
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
তোফায়েল আহমেদ

প্রতিবছর ঐতিহাসিক ৭ জুন তথা ‘ছয় দফা দিবস’ আমরা যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করি। এ বছর ৭ জুন তথা ‘ছয় দফা’ দিবসের ৫৭তম বার্ষিকী। বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি ও ছয় দফা দাবির বাস্তবায়নে ’৬৬-এর ৭ জুনের কর্মসূচি পালনে মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ অসংখ্য শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ছয় দফা। ছয় দফা ও ৭ জুন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে বিধায় জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। পরবর্তীতে ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের সূচনালগ্নে এই ছয় দফা দাবি দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলনসমেত এগারো দফা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রবল গণ-আন্দোলন এবং গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তথাকথিত ‘সংখ্যা-সাম্য’ বাতিল করে ‘এক মাথা এক ভোট’ দাবি ও জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের হিস্যা আদায় করে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে রাজনৈতিক বৈধতা নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা এক দফা তথা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

বঙ্গবন্ধু বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতা ছিলেন। তার হৃদয়ের গভীরে সততই প্রবহমান ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছাড়া ভিন্ন কোনো চিন্তা তার ছিল না। জেল-জুলম-অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বাংলাদেশকে তিনি স্বাধীন করেছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবক্তা। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের অভিপ্রায় থেকেই তিনি জাতির উদ্দেশে ছয় দফা কর্মসূচি প্রদান করেছিলেন। যে কারণে ছয় দফাকে বলা হয় ‘জাতির মুক্তি সনদ’।

স্বৈরশাসক আইয়ুব খান এ দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে সংখ্যাগুরু বাঙালি জাতিকে গোলামির শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল। এর বিপরীতে, বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলসমূহ আহূত কনভেনশনে সাবজেক্ট কমিটির সভায় ‘ছয় দফা’ উত্থাপন করে তা বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্তের প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা দাবি অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে ১১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন এবং ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ছয় দফা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে। ছয় দফা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হওয়ার পর জনমত সংগঠিত করতে বঙ্গবন্ধু তার সফরসঙ্গীসহ “১৯৬৬-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের জনসভায় ছয় দফাকে ‘নূতন দিগন্তের নূতন মুক্তিসনদ” হিসেবে উল্লেখ করে চট্টগ্রামবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘একদিন সমগ্র পাক-ভারতের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের জবরদস্ত শাসনব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এই চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়েই বীর চট্টলের বীর সন্তানেরা স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। আমি চাই যে, পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের জন্য দাবি আদায়ে সংগ্রামী পতাকাও চট্টগ্রামবাসীরা চট্টগ্রামেই প্রথম উড্ডীন করুন।’ চট্টগ্রামের জনসভার পর দলের আসন্ন কাউন্সিল সামনে রেখে ছয় দফার যৌক্তিকতা তুলে ধরতে তিনি একের পর এক জনসভা করেন। এরই অংশ হিসেবে ২৭ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর মাইজদি, ওই দিনই বেগমগঞ্জ, ১০ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ১১ মার্চ ময়মনসিংহ সদর ও ১৪ মার্চ সিলেটে অনুষ্ঠিত জনসভায় জনতার দরবারে তার বক্তব্য পেশ করেন।

‘ছয় দফা’ প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট ‘উপকমিটি’ গঠন এবং তারই নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি, ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। একই বছরের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ ছিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। এদিন কাউন্সিল সভায় পুস্তিকাটি বিলি করা হয়। দলের সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গীত হয়। সেদিনের কাউন্সিল সভায় আগত ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করে। ‘ছয় দফা’র ভিত্তিতে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের একটি খসড়াও অনুমোদন করা হয়। ‘ছয় দফা’ কর্মসূচি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে ছয় দফার ভিত্তিতে দলীয় গঠনতন্ত্র এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পরিবর্তন সাধিত হয় তা পরবর্তীকালে ছয় দফার চূড়ান্ত পরিণতি এক দফা তথা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ইঙ্গিতবাহী ছিল। ছয় দফা কর্মসূচি দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিশেষ করে আমাদের মতো অপেক্ষাকৃত তরুণ ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে ছয় দফা এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে এই পুস্তিকা সযত্নে রক্ষিত হয়। ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ বস্তুত, ছয় দফা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র তথা অঙ্কুর। কাউন্সিল অধিবেশনের শেষ দিন অর্থাৎ ২০ মার্চ চরম প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় দলীয় নেতা-কর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘চরম ত্যাগ স্বীকারের এই বাণী লয়ে আপনারা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত প্রদেশের প্রতিটি মানুষকে জানিয়ে দিন, দেশের জন্য, দশের জন্য, অনাগতকালের ভাবী বংশধরদের জন্য সবকিছু জেনে-শুনেই আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা এবার সর্বস্ব পণ করে নিয়মতান্ত্রিক পথে ছয় দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের জন্য এগিয়ে আসছে।’

আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বাঙালির ইতিহাসে বাঁক পরিবর্তন। যা ’৬৯-এর মহান গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ’৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। কাউন্সিল সভার সমাপনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপস নাই। রাজনীতিতেও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নাই। নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামী লীগ আর আস্থাশীল নয়। নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়-এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ছয় দফা আদায় করতে হবে। কোনো হুমকিই ছয় দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ছয় দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তি সনদ।’ স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’ উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘এই আন্দোলনে রাজপথে যদি আমাদের একলা চলতে হয় চলব। ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ।’ সফলভাবে সমাপ্ত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের পর বঙ্গবন্ধু সারা দেশ চষে বেড়ান। ২৬ মার্চ সন্দ্বীপ এবং ২৭ মার্চ সাতকানিয়ার বিশাল জনসভায় ছয় দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা করেন। এরপর ৭ এপ্রিল উত্তরাঞ্চল সফরে পাবনা ও নগরবাড়ির জনসমাবেশে বক্তৃতা করেন। এরপর এপ্রিলের ৮ বগুড়া, ৯ রংপুর, ১০ দিনাজপুর, ১১ রাজশাহী, ১৪ ফরিদপুর, ১৫ কুষ্টিয়া, ১৬ যশোর এবং ১৭ তারিখ খুলনায় বিশাল সব জনসভায় ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বক্তৃতা করেন। এভাবে সারা দেশে ৩৫ দিনে মোট ৩২টি জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। বিপুলসংখ্যক জনতার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় ছয় দফার স্বপক্ষে জনমত প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ওপর নেমে আসে স্বৈরশাসক আইয়ুবের নির্মম গ্রেপ্তার-নির্যাতন। প্রত্যেক জেলায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রদত্ত বক্তৃতার প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুকে প্রত্যেক জেলা থেকে জারিকৃত ওয়ারেন্ট বলে লাগাতার গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

১৭ এপ্রিল রাত ৪টায় খুলনায় এক জনসভায় ভাষণদান শেষে ঢাকা ফেরার পথে রমনা থানার জারিকৃত ওয়ারেন্ট অনুযায়ী পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৪৭ (৫) ধারা বলে পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। যশোর মহকুমা হাকিমের এজলাস হতে তিনি জামিন পান। ওই দিনই রাত ৯টায় সিলেটে গ্রেপ্তার, পুনরায় জামিনের আবেদন এবং ২৩ এপ্রিল জামিন লাভ। ২৪ এপ্রিল ময়মনসিংহে গ্রেপ্তার, ২৫ এপ্রিল জামিন। ছয় দফা প্রচারকালে তিন মাসে বঙ্গবন্ধুকে সর্বমোট আট বার গ্রেপ্তার করা হয়। এভাবেই আইয়ুবের দমননীতি অব্যাহত থাকে। একই বছরের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’ স্মরণে শ্রমিক-জনতার এক বিরাট সমাবেশে শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। ভাষণদান শেষে রাত ১টায় তিনি যখন বাসায় ফেরেন তখন পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২ (১) ‘ক’ ধারা বলে তাকে এবং তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। ছয় দফা দেয়াকে অপরাধ গণ্য করে স্বৈরশাসক আইয়ুব বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করে দেশরক্ষা আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের ওপর অব্যাহত গ্রেপ্তার-নির্যাতন চালায়। সামরিক সরকারের এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ছয় দফার প্রতি গণমানুষের বিপুল সমর্থন প্রকাশ পায়। হাজার হাজার শ্রমিক এদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হরতাল পালন করে এবং পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় উপস্থিত হয়ে সরকারের দমননীতির তীব্র প্রতিবাদ করে। দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেপ্তার করা হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

স্বাধিকারের দাবিতে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি ও নেতৃবন্দের গ্রেপ্তার-নির্যাতনের প্রতিবাদে ’৬৬-এর ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৭ জুন সর্বব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। বাংলার গণমানুষ ৭ জুন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী হরতাল পালন করেছিল। ৭ জুনের হরতালে সমগ্র পূর্ব বাংলা যেন অগ্নিগর্ভ। বিক্ষুব্ধ মানুষ স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী, ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। সর্বজনাব শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, আমীর হোসেন আমু, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আব্দুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে- আমরা সেদিন হরতাল কর্মসূচি পালনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। সেদিনের হরতাল কর্মসূচিতে ধর্মঘটী ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে তেজগাঁয় শ্রমিক মনু মিয়া, আদমজীতে মুজিবুল্লাহসহ ১১ জন শহীদ হন এবং প্রায় ৮০০ লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। তেজগাঁ শিল্পাঞ্চলে হরতাল সফল করার দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী ও নূরে আলম সিদ্দিকী। তারা সেখানে বক্তৃতা করেন। প্রকৃতপক্ষে ৭ জুন ছিল স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথের আরম্ভস্থল তথা যাত্রাবিন্দু। আর আমরা যারা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম, আমাদের স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তিও স্থাপিত হয়েছিল এ দিনটিতেই।

আজ অতীতের সেই সোনালি দিনগুলোর দিকে যখন ফিরে তাকাই স্মৃতির পাতায় দেখি, সেদিনের ছাত্রলীগ ছিল বাংলার গণমানুষের অধিকার আদায় তথা ‘মুজিবাদর্শ’ প্রতিষ্ঠার ভ্যানগার্ড। মূলত বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতৃত্বই সেদিন সারা দেশে ৭ জুনের কর্মসূচি সফলভাবে পালন করে স্বাধিকারের পথে এক অনন্য নজির স্থাপন করে। আর বাংলার মেহনতি মানুষ আত্মত্যাগের অপার মহিমার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীসহ সমগ্র বিশ্বকে জানিয়ে দেয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রদত্ত ছয় দফাই হচ্ছে বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ।

আজ ৭ জুনে অতীতের অনেক স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। বঙ্গবন্ধুর স্নেহে আমার জীবন ধন্য। ৭ জুনের শহীদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে জাতির পিতার সংগ্রামী চেতনার ভিত্তিতে, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ আমরা উন্নয়নের নবদিগন্তের সূচনা করেছি। বর্তমান সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও অনাকাঙ্ক্ষিত বিভিন্ন রকম বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। দেশের অর্থনীতিতেও তার প্রভাব পড়েছে। তবে আমি মনে করি, এটি সাময়িক। ধৈর্য সহকারে বাস্তবভিত্তিক কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করলে এই সংকট উত্তরণ সম্ভব। বর্তমানে বহুল আলোচিত বিষয় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর সফল বাস্তবায়নের পথ ধরেই এবারের লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ কর্মসূচিতে কী আছে এবং কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তা নিয়ে সুধী সমাজে আলোচনা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেননি। সেই কাজটি দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করে চলেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণের স্বপ্ন নিয়ে নবপ্রজন্ম আজ প্রগতির পথে ধাবমান। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় অগ্রগতির এই অভিযাত্রার প্রারম্ভ বিন্দু ছিল ঐতিহাসিক ৭ জুন। আর তাই স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন-চেতনার প্রারম্ভ বিন্দু ঐতিহাসিক ৭ জুনের শহীদদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন আমার পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করি।

লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি


থাইল্যান্ডের নির্বাচনে বার্মা অ্যাক্টের প্রভাব

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সাইমন মোহসিন

একটি দেশের নির্বাচনে যখন তরুণ ভোটারদের সংখ্যা এত বেশি হয়ে যায় যে, শুধু তাদের ভোটেই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হবে। সেই পরিস্থিতি যে কতটা রোমাঞ্চকর সেটা শুধু সমাজবিজ্ঞানীরা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই জানেন। এমন অবস্থা হলে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যে কোনদিকে মোড় নিবে সেটা সঠিকভাবে পূর্বাভাস করার কোনো উপায়ই নেই। এমনি অবস্থা হয়েছিল এবারের মে মাসের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিত থাইল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচনে। থাইল্যান্ডের তারুণ্যের জোয়ারে সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকার বেশ চাপের মুখেই ছিল। কিন্তু তরুণ ভোটাররা সামরিক বাহিনীকে যে কতটা অপছন্দ করে সেটা ভোটের ফলাফলেই পরিষ্কার।

২০১৪ সালে একটি ক্যু’র মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না থাই তরুণসমাজ, সেটা একেবারে পরিষ্কার। দুই বিরোধীদল মিলে নিম্ন হাউসের ৫০০ আসনের ২৯৩টি জয় করেছে। এর মধ্যে ১৫৩ আসন নিয়ে এগিয়ে রয়েছে মুভ ফরওয়ার্ড পার্টির ৪২ বছর বয়সী পশ্চিমা উচ্চডিগ্রিধারী ব্যবসায়ী পিটা লিমজারোয়েনরাত। দ্বিতীয় স্থানে ১৪১ আসন নিয়ে রয়েছেন নির্বাসিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন শিনাওয়াত্রার ৩৬-বছর বয়সী কন্যা পেটংটার্ন শিনাওয়াত্রা।

সাবেক সেনাপ্রধান থেকে প্রধানমন্ত্রীতে পরিণত হওয়া জেনারেল প্রায়ুত চান-ওচা এবং তার মিত্র জেনারেল প্রাভিত ওয়াংসুভান যথাক্রমে ৩৬ ও ৪০টি আসন জয় করেছেন। বোঝাই যাচ্ছে থাইল্যান্ডের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াপ্রেমীদের বিশাল জয় হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল জানা গেলেও ক্ষমতার পটপরিবর্তন হবে কি না, সেটা নির্ধারিত হতে রাজনৈতিক খেলার অনেকটাই মঞ্চায়ন হওয়ার বাকি।

নিম্ন ও উচ্চ হাউসের যথাক্রমে ৫০০ ও ২৫০ আসন থেকে মোট কমপক্ষে ৩৭৬টি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই শুধু একটি দল কিংবা জোট থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে সক্ষম। আইনের এ পরিবর্তনটাও সামরিক বাহিনীর প্ররোচনাতেই ২০১৯ সালে প্রবর্তিত। উচ্চ হাউসের ২৫০ সিনেটররা আবার নির্বাচিত নন, বরং বাছাইকৃত ব্যক্তিবর্গে গঠিত। আপাতত এখানে প্রায় সবাই সেনাসমর্থিত সরকারের সমর্থক কিংবা সুবিধাভোগী। এ কারণে নির্বাচনে বিজয়ীদের জন্য রাজনৈতিক পথ এখনো সুগম নয়। আপাতত থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সব ধরনের কৌশল যাচাই ও প্রবর্তনে সচেষ্ট। তবে, নির্বাচনের ফলাফল সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক অভিলাষের মুখে এক কড়া চপেটাঘাত করেছে। সামরিক বাহিনী প্রায় এক দশকব্যাপী থাইল্যান্ডের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে। বিষয়টি যে থাই জনগণ আর নিতে পারছে না, সেটা নির্বাচনের ফলাফল থেকে পরিষ্কার। নির্বাচনে এগিয়ে থাকা পিটা ইতিমধ্যে কতগুলো সাক্ষাৎকারে থাইল্যান্ডের আগামী রাজনৈতিক পথচলা কেমন হবে, সে বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। এর মধ্যে আঞ্চলিক পর্যায়ে, এমনকি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মিয়ানমারের প্রতি থাইল্যান্ডের ভবিষ্যৎ আচরণ ও সম্পর্কের রূপরেখা নিয়ে তার দেয়া বক্তব্য।

থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী ও তার সমর্থিত সরকার মিয়ানমারের জান্ডার প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। আসিয়ান ফোরামের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এক দ্বিপক্ষীয় নীতি মিয়ানমারের সঙ্গে এ যাবৎ প্রবর্তন করেছে থাই সরকার। এমনকি ২০২১ থেকে এ বছর পর্যন্ত থাই সরকার মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে একাধিক ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের সম্মেলন, বৈঠক, ও দ্বিপক্ষীয় সংলাপও সম্পন্ন করেছে। গত আট বছরে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মিয়ানমার নিয়ে আসিয়ানের সব পদক্ষেপ ও প্রচেষ্টাকে এক অর্থে অবমাননাই করেছে।

পিটা বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠায় থাইল্যান্ডের অগ্রণী ভূমিকা রাখা উচিত। একই সঙ্গে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ফলে সৃষ্ট শরণার্থীদের জন্য থাইল্যান্ডের মধ্য দিয়ে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার কথাও বলেন তিনি। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা অ্যাক্ট নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের এই আইন মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সামরিক জান্তার সঙ্গে লড়ছে এমন নৃগোষ্ঠীয় সংগঠনগুলোকে অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের মধ্যে ও বাইরের সামরিক জান্তা বিরোধী সব শক্তিকে পূর্ণরূপে সহায়তা প্রদানের প্রতি সচেষ্ট। পিটা এই প্রচেষ্টাকে পূর্ণ সমর্থনের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কথা স্পষ্ট করেই ব্যক্ত করেছেন।

এই বার্মা অ্যাক্ট মিয়ানমারে সামরিক জান্তার আধিপত্য ও কর্তৃত্ব দুর্বল করতে পারে এই আশঙ্কা এখন চীনের মধ্যেও দেখা দিয়েছে। এ জন্য এই আইন পাসের পর পরই থাইল্যান্ডের নির্বাচনের আগে, গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের এক বিশেষ দূত মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সাতটি সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাত সংগঠনই জান্তার সঙ্গে সশস্ত্র দ্বন্দ্বে রয়েছে। এই সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে চীন সরকার এই সংগঠনগুলোকে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সহায়তা এবং সংঘাতের কারণে উচ্ছেদ হওয়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। এতে করে চীন এই সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত করার জন্য উদগ্রীব। বার্মা অ্যাক্টের কারণে এই সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ ও সহযোগিতার সম্পর্ক যা গড়ে না ওঠে, সে বিষয়ে বিশেষ নজর রয়েছে চীনের।

এই আইনের বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমারের প্রত্যক্ষ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। তাদের সহায়তার মাধ্যমেই শুধু মিয়ানমারের এই সংগঠনগুলোর কাছে সহায়তা পৌঁছে দেয়া সম্ভব। এই সহায়তার মধ্যে যে অস্ত্র ও সামরিক সহায়তাও থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে, দেশের ওপর চীনের প্রভাব হ্রাস করতে এবং দেশে নিজ আদলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যে অস্ত্র সহায়তা করতেও পিছপা হবে না, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ইতিহাস ঘাঁটলেই পরিষ্কার। আর এই আইনের ভাষাও সে রকমটা জোর ইঙ্গিত দেয়। তাই যখন আইনটি পাস হয়েছিল, তখন বাংলাদেশের বোদ্ধাদের মনে স্বভাবতই শঙ্কার সঞ্চার হয়েছিল। কারণ সে সময় থাইল্যান্ড এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করবে না এটা পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছিল। কারণ থাই সরকার ও মিয়ানমার জান্তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিঘ্নিত করার কোনো ইচ্ছাই থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকারের নেই। ভারতও মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো রকম টানাপোড়েন করতে আগ্রহী নয়, অন্যতম কারণ রাখাইন রাজ্যে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্বার্থ বিদ্যমান। থাকল শুধু মিয়ানমারের আরেক প্রতিবেশী বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সঙ্গে লাগোয়া সীমান্তে এমনিতেই এক জটিল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ও পাবর্ত্য এলাকার পরিস্থিতি, দুটো মিলিয়ে বাংলাদেশে এমনিতেই পরিস্থিতি অনেকটা নাজুক।

এমতাবস্থায় বার্মা অ্যাক্ট প্রণয়নের বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা রাখা কতটা যৌক্তিক বা রোহিঙ্গা পরিস্থিতি বিবেচনায় কতটা প্রয়োজনীয়, এই দুই পক্ষেই সে বিতর্ক অব্যাহত রাখা যায়। তবে এটা ঠিক যে, থাইল্যান্ডের নির্বাচনের আগে পর্যন্ত একমাত্র বাংলাদেশের মাধ্যমেই বার্মা অ্যাক্ট বাস্তবায়ন করাটা সবচেয়ে সুবিধাজনক ছিল। আর এ কারণে যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে, এমনটা দেশের অনেক বিশেষজ্ঞই আশঙ্কা প্রকাশ করেন। কারণ বিষয়টি শুধু বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিই নয়, বরং সীমান্তের ওপারে আরাকান আর্মির মতো সংগঠনগুলোর পরিকল্পনার সঙ্গেও জড়িত। এই সংগঠনগুলো সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়ছে এখন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এরা নিজেদের মধ্যে কতটুকু সাম্য ও সহযোগিতা বজায় রেখে মিয়ানমারের শাসনব্যবস্থায় পরস্পরের সমর্থন দেবে সেটা এক বিশাল প্রশ্ন। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, এরা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে কি না, এবং তাদের প্রত্যাবাসন করবে কি না, সেটাও পরিষ্কার নয়। তা ছাড়া এখন কুকি-চিনের মতো গোষ্ঠীর উৎপত্তি, পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা আরও জটিল করে তুলেছে। এই সংগঠনগুলো একসময় বাংলাদেশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা প্রকট করে তুলতে পারে, সেই আশঙ্কাও রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য বার্মা অ্যাক্ট সমর্থন করার কথা বিবেচনা করাও অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে এখন পরিস্থিতি অনেকটাই পরিবর্তিত।

থাইল্যান্ডে নতুন সরকার এখনো ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত না হতে পারলেও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যে মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে সেটা পিটা পরিষ্কার করেই ব্যক্ত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা অ্যাক্ট প্রবর্তনের ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সহযোগী ভূমিকা রাখবে।

সেনাসমর্থিত থাই সরকার থাইল্যান্ডের ওপর তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারবে কি না, নাকি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার থাইল্যান্ডের প্রশাসনের দায়িত্ব নিবে, সেটা জানতে আমাদের আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে। গণতান্ত্রিকভাবে একটি সরকার গঠনের প্রতি পশ্চিমারাও, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বারোপ করছে। কিন্তু থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। আর পরিস্থিতি যেদিকেই যাক না কেন, সেটা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এই পুরো অঞ্চল, বিশেষ করে বাংলাদেশের ওপর বিশাল প্রভাব ফেলবে।

লেখক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক


শিল্পোন্নয়ন ও বাণিজ্য পণ্যের বহুমুখীকরণ পর্যালোচনা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের দুই অংশে যথা- পূর্ব বাংলা (তথা পূর্ব পাকিস্তান) এবং পশ্চিমাংশের চারটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগে খুব একটা শিল্পকারখানা পড়েনি। বৃহৎ শিল্প গড়ার জন্য ১৯৫২ সালে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (পিআইডিসি) সৃষ্টি হয়। এর অধীনে দুই অংশে যথাক্রমে ইপিআইডিসি ও ডব্লিউপিআইডিসি গঠন করা হয়। মূলত এ করপোরেশন নিজ উদ্যোগে কিংবা কতিপয় শিল্পোদ্যোক্তাকে সহায়তার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে পাট, কাপড় ও চিনি খাতে বেশ কিছু বৃহৎ শিল্পকারখানা গড়ে তোলে। পর্যায়ক্রমে সার, কেমিক্যাল ও স্টিল মিলও প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পোন্নয়নের গোড়াপত্তন করে। ইপিআইডিসি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কতিপয় শিল্পকারখানা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে পরবর্তী সময়ে বিক্রি করে দেয়া হয়। এ ছাড়া গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ক্ষুদ্রশিল্পের বিকাশ ও সহায়তার জন্য পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র শিল্প করপোরেশন (ইপসিক) প্রতিষ্ঠা করা হয়।

স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্থলে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পর প্রথমে বৃহৎ শিল্পগুলো জাতীয়করণ করা হয়। বিশ্বব্যাপী পাটের গুরুত্ব কমে যাওয়ায় এবং প্রশাসনিক অবস্থা ও শ্রমিক বিশৃঙ্খলার কারণে পাটকলগুলো লোকসানে পতিত হয়। পরবর্তী সময়ে বেসরকারীকরণ নীতি গ্রহণের মাধ্যমে বেশ কিছু পাটকল ও কাপড়ের মিল ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করা হয়।

বাংলাদেশে লাভজনক শিল্পোন্নয়নের সূচনা হয় বেসরকারি উদ্যোগে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প বিকাশের মাধ্যমে। এসব শিল্পে কর্মসংস্থান এবং দেশে বিভিন্ন সেবা খাতের সম্প্রসারণের ফলে ভোক্তাশ্রেণির সৃষ্টি হয়। ক্রমান্বয়ে ভোগ্যপণ্য, নির্মাণসামগ্রী, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে থাকে।

১৯৭৯ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস কর্তৃক তৈরি পোশাকের সীমিত রপ্তানির মাধ্যমে এ খাতের রপ্তানির সূচনা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে আরও উদ্যোক্তা রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপন করে রপ্তানি শুরু করে। আশির দশকের প্রথম দিকে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ কার্যক্রমের মাধ্যমে তৈরি পোশাকশিল্পে নীতিসহায়তা চালুর ফলে এ শিল্প বিকাশ লাভ করে। পোশাক খাত থেকে বর্তমানে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশ আসে। মধ্যবিত্ত ও গরিবদের, বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও এ খাত শীর্ষস্থানে রয়েছে। যে দুটি সরকারি নীতিসহায়তার কারণে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে সেগুলো হচ্ছে- শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করে বন্ডেড ওয়্যারহাউসে রাখার সুবিধা এবং বিলম্বে দায় পরিশোধসহ ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা। এ দুটি সুবিধা প্রাপ্তির ফলে বড় অঙ্কের পুঁজি ছাড়াই গার্মেন্টস কারখানা প্রতিষ্ঠা করে উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সরকার করহার কমানো, নগদ সহায়তা প্রদান, ব্যাংকঋণ প্রাপ্তি সহজ ও বন্দর ব্যবহারে অগ্রাধিকার প্রদান করে এ খাত প্রসারের পথ সুগম করেছে।

সরকার এ পর্যন্ত আটটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং প্রতিবছর বার্ষিক বাজেটে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নানা সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে শিল্পায়নে সহায়তা করে আসছে। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সুবিধা প্রভৃতির ফলে শিল্পায়নের পাশাপাশি ভোক্তা বাজার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান প্রায় ৩৩ শতাংশে পৌঁছেছে।

শুরু থেকেই বাংলাদেশে আমদানি-বিকল্প এবং রপ্তানিনির্ভর উভয় প্রকার দ্রব্যসামগ্রী প্রস্তুতের জন্য শিল্পায়ন হচ্ছে। গ্লোবালাইজেশনের প্রসারের ফলে আমাদের আমদানি-রপ্তানি উভয়ই বেড়েছে। তবে উৎপাদনের কাঁচামাল, কেমিক্যালসামগ্রী, উচ্চপ্রযুক্তির দ্রব্যাদি যেমন- মোটরগাড়ি, কলকারখানার যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, সার, জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, চিনি ইত্যাদি অধিক পরিমাণ ক্রয়ের কারণে রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হচ্ছে। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বেশ কিছু ভোগ্যপণ্য উৎপাদন শিল্প, ওষুধ ও কেমিক্যাল প্রস্তুত শিল্প, চামড়া ও প্লাস্টিক শিল্প, সুতা ও কাপড় প্রস্তুত কারখানা এবং স্টিল, ইলেকট্রনিকস, সিমেন্ট প্রভৃতি বৃহৎ শিল্প গড়ে উঠেছে।

যতই দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, ততই বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অন্যতম উৎস। আবার রিজার্ভের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আমদানি দায় পরিশোধে খরচ হয়। পৃথিবীর ১০টি বৃহৎ ভোক্তা বাজারের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। সে কারণে আমাদের আমদানি শুধু শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য সামগ্রীও আমদানি করা হয়। আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম হলে বাণিজ্য ঘাটতি হয়, অর্থাৎ লেনদেনের ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়, যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা দেয়। সে জন্য দেশের সার্বিক উন্নয়নে রপ্তানি বৃদ্ধি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৫৬ শতাংশ এবং পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানির ৭৫ শতাংশের অধিক আসত পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি থেকে। অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি দ্রব্য ছিল চা ও চামড়া।

স্বাধীনতার পরের বছর বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। পাটের পর প্রধান দুটি রপ্তানি পণ্য ছিল চা ও হিমায়িত খাদ্য। কৃত্রিম তন্তুর আবিষ্কার ও ব্যবহার বৃদ্ধির পর পাটের গুরুত্ব কমতে থাকে। সে জন্য পাটের বিকল্প রপ্তানি দ্রব্য অন্বেষণে গুরুত্বারোপ করা হয়।

১৯৮৩-৮৪ সালে মোট রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের হিস্যা ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ১৭-১৮ বছরের ব্যবধানে ২০১০-১১ সালে রপ্তানি আয়ের ৭৮ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। পরবর্তী ১০ বছরে তৈরি পোশাকের অবদান বেড়ে ৮২-৮৪ শতাংশে দাঁড়ায়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। মূলত তৈরি পোশাকের ওপর ভর করে ২০২১-২২ সালে রপ্তানি আয় ৫২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তবে একক পণ্যের ওপর এত অধিক হারে রপ্তানিনির্ভরতা টেকসই বাণিজ্যের জন্য অনুকূল নয়। সে জন্য দুই দশক ধরেই রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

তৈরি পোশাক ব্যতীত বাংলাদেশের অন্য কয়টি উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য হচ্ছে- পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষিজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, হোম টেক্সটাইল, ওষুধ, প্লাস্টিক পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য, হস্তশিল্পজাত পণ্য, বাইসাইকেল ইত্যাদি। পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি মূল্যের দিক থেকে কয়েক বছর দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও গত বছর হোম টেক্সটাইল দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে (প্রায় ৩ শতাংশ)। হিমায়িত চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, কৃষিজ দ্রব্যাদি প্রভৃতির বিশ্ববাজারে চাহিদার তুলনায় আমাদের সরবরাহ অপ্রতুল। তা ছাড়া প্যাকেজিং ও মান নির্ণয়ে আমাদের সমস্যা আছে। পরিবেশবান্ধব ট্যানারি শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা করতে না পারার কারণে বিদেশে আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের চাহিদা কমে গেছে। সীমিত পরিসরে রপ্তানি চালিয়ে গেলেও এলডব্লিউজি সনদের অভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে নানা বিধিনিষেধের আওতায় পড়তে হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

গত মার্চে (২০২৩) প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর রপ্তানির হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৈরি পোশাক ও চামড়া ছাড়া অন্য সব খাতেই রপ্তানি কমেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় সার্বিক রপ্তানি ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৬ শতাংশ, কিন্তু পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, ওষুধ, বাইসাইকেলসহ অন্য খাতে রপ্তানি বেশ কমেছে। ওই সময় মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশই এসেছে পোশাক খাত থেকে। বিগত কয়েক বছরের রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যান লক্ষ করলে দেখা যাবে পোশাক খাতের রপ্তানি ৩০-৩৫ বিলিয়ন ডলার হলেও অন্য কোনো খাতে রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে পারেনি। ২০২১-২২ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বাজার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের সব দেশ, জাপান, চীন, ভারতসহ এশিয়ার দেশগুলো এবং বিশ্বের বহু দেশে বিস্তৃত। সে তুলনায় অন্যান্য খাতের বাজার সীমিত। তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারীরা বিভিন্নভাবে সরকারের নীতিসহায়তা, শুল্ককর সুবিধা, ব্যাংকঋণ ও বন্দর ব্যবহারে যে অগ্রাধিকার পান, অন্যান্য রপ্তানিকারকরা উপরিউক্ত সব সুবিধা পান না। তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজেএমইএ, বিকেএমইএ, এমনকি কাপড়ের মিলগুলোর সংগঠন বিটিএমএ যেভাবে সরকার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রভাব খাটাতে পারে, অন্যান্য খাতের সংগঠনগুলো তেমন শক্তিশালী ও সক্রিয় নয়। এসব পণ্যের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়ার কারণ হলো- উৎপাদকদের ব্যবসায়িক যোগাযোগ কম, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি। অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভর বড় শিল্পকারখানাও গড়ে ওঠেনি। বাজার সীমিত থাকার কারণে এসব খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগও তেমন আসছে না।

যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিতে প্রতিবছরই প্রবৃদ্ধি আছে। কারণ বাংলাদেশ নিম্ন ও মধ্যম দামের পোশাক রপ্তানি করে যার চাহিদা বিদেশি ক্রেতাদের কাছে প্রতিকূল পরিবেশেও বলবৎ রয়েছে। তবে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে যে বৃহৎ বাজার রয়েছে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ মাত্র বৈশ্বিক চাহিদার ৬ দশমিক ২ শতাংশ রপ্তানি করতে পারছে। তৈরি পোশাক খাতেও পণ্যের বহুমুখীকরণ প্রয়োজন। যেমন- আমাদের উদ্যোক্তারা যদি উচ্চমূল্যের পোশাক, মনুষ্য তৈরি তন্তু ব্যবহার (ম্যান মেড ফাইবার) করে প্রস্তুতকৃত পোশাক, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পোশাক ইত্যাদি প্রস্তুত ও বাজার অন্বেষণ করে, তবে পোশাক রপ্তানি আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে, যা ২০২৬ সালে কার্যকর হবে। ২০২৯ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে আর শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে না। তখন ৮-৯ শতাংশ শুল্কারোপিত হলে তৈরি পোশাকের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে, যার ফলে পোশাক রপ্তানি কমে যেতে পারে। সে জন্য আগে থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ডব্লিউওটিওর সঙ্গে যোগাযোগ করে শুল্ক সুবিধার সময় বাড়িয়ে নেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শুল্কমুক্ত চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের মাধ্যমে পারস্পরিক শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগানো যেতে পারে।

তৈরি পোশাকশিল্পে বহুমুখীকরণের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো ছাড়াও রাশিয়া, ভারত, জাপান ও চীনের মতো দেশগুলোর বাজারে রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব বলে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান যে, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি টেকসই করার জন্য জাতীয় আয়ে শিল্পের অবদান ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে। আমদানি-বিকল্প ও রপ্তানিমুখী উভয় শিল্প প্রসারে সরকার ও ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের মনোযোগী হতে হবে। রপ্তানি বাড়ানোর লক্ষ্যে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। নতুন রপ্তানি দ্রব্য ও বাজার অন্বেষণ করতে হবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের মাধ্যমে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি আমাদের রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে পরিবেশের যাতে ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে এবং কলকারখানায়, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, শ্রমিক অধিকার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় শর্তাদি (কমপ্লায়েন্স) মেনে চলতে হবে। সাভার চামড়া শিল্পনগরীকে পরিবেশবান্ধব শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে তুলে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং তৈরি পোশাকের পর চামড়াশিল্পকে দ্বিতীয় বিকল্প রপ্তানি পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ছাড়া প্রতিশ্রুতিশীল রপ্তানি পণ্যগুলোকে তৈরি পোশাকের মতো নীতিসহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান করে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত


পরিবেশ দিবস আনুষ্ঠানিকতায় আছে কাজে নেই

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
নাসির আহমেদ

নানা আনুষ্ঠানিকতায় বিশ্বব্যাপী পালিত হলো বিশ্ব পরিবেশ দিবস। বাংলাদেশও যথারীতি পালন করল দিনটি। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সলিউশন অব প্লাস্টিক পলিউশন’। যার অর্থ হচ্ছে ‘অপচনশীল দ্রব্যের সমাধান’। এই প্রতিপাদ্য নিয়েই দিনটি উদযাপিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী নানা আয়োজনে। আমাদের দেশেও এই দিনে নানা রকম আনুষ্ঠানিকতা এবং কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন আমাদের সমাজে ঘটবে- এমন আশা করা কঠিন।

আমাদের দেশে প্লাস্টিকজাত পলিথিন ব্যাগ অনেক বছর আগে নিষিদ্ধ করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি কোথাও। প্রতিদিন হাটবাজারে, বিপণিবিতান থেকে শুরু করে সব দোকানে ব্যবহার করা হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ, যা সম্পূর্ণ অপচনশীল এবং আমাদের মাটি এবং জলাধারের জন্য ভয়াবহ বিপদ বয়ে আনছে প্রতিনিয়ত।

আমাদের শহর-নগরের ড্রেনেজব্যবস্থার যে বিপর্যয়, তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অপচনশীল বর্জ্য। এসব বর্জ্য ড্রেনগুলোতে আটকে থাকার কারণে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও স্বাভাবিক গতি হারাচ্ছে।

রাজধানী ঢাকার কথাই ধরা যাক, এখানে বর্ষা মৌসুমে যে জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়, তার অন্যতম কারণ পলিথিনসহ অপচনশীল প্লাস্টিকবর্জ্য ড্রেন লাইনে আটকে যাওয়া। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে অল্প বৃষ্টিতেও রাজধানী ঢাকায় রাজপথ, অলিগলি ডুবে যায় ড্রেনের উপচে পড়া পানিতে। কারণ আমাদের সুয়্যারেজ লাইন ময়লা আবর্জনা স্বাভাবিক গতিতে বহন করে নিয়ে যেতে পারে না এসব অপচনশীল বর্জ্যের কারণে। গ্রামের খাল নদী এমনকি পুকুর পর্যন্ত ভরাট হয়ে যাচ্ছে এসব অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে। চাষের জমিও উর্বরতা হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত। পরিবেশ কতটা বিপন্ন হচ্ছে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আমাদের সারা দেশের নদ-নদী। রাজধানীর কেন্দ্রে অবস্থিত বুড়িগঙ্গা নদীত প্লাস্টিকবর্জ্যে ভয়ংকরভাবে দূষিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কলকারখানা থেকে নির্গত দূষিত আবর্জনার বর্জ্য। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যাসহ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী সব নদী ভরাট হয়ে গেছে গত তিন দশকে। ভরাট না বলে নদীগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে বললে বেশি বলা হবে না।

প্লাস্টিকবর্জ্যের এই বিপণ্নতার মধ্যে বলতে গেলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বলতে হবে আমাদের ক্রমাগত সবুজহীনতার দিকে চলে যাওয়াকে। উজাড় হয়ে যাচ্ছে দেশের সব বনভূমি।

শুধু বনভূমি নয়, সারা বাংলার লোকালয়ে গাছপালা কেটে সব জনপদ আমরা বৃক্ষহীন করে ফেলছি দিনের পর দিন। ফলে নদ-নদীসহ আমাদের চারপাশের পরিবেশই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। জলবায়ুর এই বিপর্যয়ে তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে জলবায়ুর ভারসাম্যই হারিয়ে ফেলেছি আমরা।

এই বাস্তবতার মধ্যে আমরা পালন করেছি আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব বিশ্ব পরিবেশ দিবস। বিশ্বের কথা যদি বলি মাশুল হাড়ে হাড়ে গুনতে হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বকে। অথচ ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে তারা চরম উদাসীন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো বিশ্ব জলবায়ু তহবিলে অর্থদানে এতটাই বিমুখ হয়েছিলেন যে, বিশ্ব পরিবেশ প্ল্যাটফর্ম থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারই করে নিয়েছিলেন। সারা পৃথিবী অবাক হয়েছিল তার ওই অমানবিক সিদ্ধান্তে। যদিও বাইডেন প্রশাসন এসে সেই অবস্থানে পরিবর্তন এনেছে। জলবায়ু তহবিলে অর্থ দিতে সম্মত হয়েছে বাইডেন সরকার।

বিশ্ব জলবায়ুর প্রসঙ্গ যখন এল, তখন সগর্বেই আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। বিশ্ব পরিবেশ উন্নয়নে নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার পরও বলতে হবে যে, মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে। কিন্তু সেই লক্ষ্য নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে সবাই গুরুত্ব দিয়ে ভাবেন বলে মনে হয় না। যদিও আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশবিষয়ক একাধিক আন্তর্জাতিক ফোরামে নেতৃত্ব দিয়ে পরিবেশের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিলেন। যেমন কানকুন সম্মেলনসহ বিভিন্ন ফোরামে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন তিনি গড়ে তুলেছেন। জলবায়ুর ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ দানে বিশ্বের পরিবেশ ও জলবায়ুর ভারসাম্য নষ্টকারী ধনী দেশগুলোকে চাপ প্রয়োগ করতে তিনি বিশ্বজনমত ব্যাপকভাবে গঠন করতে সক্ষম হয়েছেন।

যারা জ্বালানিজাত কার্বন ছড়িয়ে তেল-গ্যাস পুড়িয়ে নিজেদের ভোগবাদী জীবনযাপনে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন আমাদের মতো দেশগুলোকে তারা কেন ক্ষতিপূরণ দেবেন না? এই যৌক্তিক আন্দোলন দেশে-বিদেশে সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে, প্রশংসিত হয়েছেন আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।

এই সাফল্যের কথা মনে রেখেও যদি আমরা নিজের দেশের দিকে তাকাই তাহলে হতাশ হই। এই লেখার শুরুতেই যে উদাসীনতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলাম

সেদিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা আবহাওয়া-জলবায়ুর প্রতিনিয়ত যেভাবে ধ্বংস করে চলেছি, আমাদের এই আত্মঘাতী প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন। নীতিকথায় কাজ না হলে কঠোরভাবে পরিবেশ রক্ষায় সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় কোনো সরকারই কঠোরভাবে পরিবেশ সংরক্ষণে বাধ্যবাধকতায় যাচ্ছে না।

গত দেড়-দুই দশকে একের পর এক জলোচ্ছ্বাস, বন্যার তাণ্ডবে বারবার ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ। কারণ জলবায়ুর স্বাভাবিকতা বিঘ্নিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন দায়ী। কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস-অক্সাইড, মিথেন, সিএফসি, জলীয়বাষ্প বিভিন্ন গ্যাস নির্গমনের ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।

এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত এ বছরের ভয়াবহ তাপমাত্রার বিপর্যয়। এবার যে দুঃসহ দাবদাহে দগ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশ, তা অতীতে আমরা কখনো দেখিনি। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল বলে পরিচিত এই বাংলাদেশে গ্রীষ্ম মৌসুমে তাপমাত্রা ৪২-৪৩ ডিগ্রিতে পৌঁছাবে, এ কথা কেউ কখনো কল্পনাও করেননি। অথচ সেই অকল্পনীয় দাবদাহে দগ্ধ হতে হচ্ছে আমাদের। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের এশীয় অঞ্চলের দেশগুলো জলবায়ু বিপর্যয়ের চরম শিকার। বাংলাদেশ বলা যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনপদ। জলবায়ু পরিবর্তনের এই অস্বাভাবিক বাস্তবতার কারণেই বাংলাদেশের ঋতুচক্র ওলট-পালট হয়ে গেছে। শীত এবং বর্ষা সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। অতিবর্ষণ আর অনাবৃষ্টি কৃষিক্ষেত্রে বিপুল ক্ষতিসাধন করে চলেছে। নদীর নাব্য হারানো, লবণাক্ততাসহ নানা বিপর্যয় আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

ধরা যাক বৃক্ষনিধনের কথাই। আমাদের দেশে একসময় বিশাল বনভূমি ছিল। দিনের পর দিন বন বিভাগের রাঘববোয়ালরা এই বনভূমি ধ্বংসের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে। আঙুল ফুলে তারা কলাগাছ হয়েছে। বনখেকো রাঘববোয়ালদের বাড়ি থেকে বস্তায় বস্তায় টাকা ধরা পড়েছে। একজন জনসমক্ষে এভাবে উন্মোচিত হয়েছে। কিন্তু এরকম শতজনকে খুঁজে পাওয়া যাবে যারা পরিবেশ বিপন্ন করে নিজেদের আখের গুছিয়েছে বছরের পর বছর ধরে। এই রক্ষকদের ভক্ষক ভূমিকার কারণেই আমাদের বনভূমি উজাড় করেছে অন্যান্য সেক্টর থেকে আসা ভূমিদখলকারী, অরণ্য লুটপাটকারী সন্ত্রাসীরা। লুটেরারাদের লালসার গ্রাসে চলে গেছে আমাদের সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ। পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে সংগত কারণেই বাংলাদেশ আজ এক বিপন্ন জনপদ।

বনভূমির কথা বাদ দিয়ে আমরা যদি গ্রামবাংলার দিকে তাকাই, তাতেও দেখব গ্রামবাংলায় যেটুকু বাগান ছিল মানুষের ঘরবাড়ির চারপাশে, দিন দিন তা-ও শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাগান কেটে, আবাদি ফসলের মাঠ কিনে নিয়ে, খাল ভরাট করে তৈরি হচ্ছে ঘরবাড়ি। উপশহরেও এখন তৈরি হচ্ছে বহুতল ভবন। সবকিছুর কেন্দ্রে কাজ করছে অর্থলিপ্সা আর অধিক মুনাফা। দেশের পরিবেশ এবং সবুজ রক্ষার জন্য যদি সুদূরপ্রসারী চিন্তা করা হয়, তা হলে কঠিন হতে হবে সরকারকে। আইন প্রয়োগ করতে হবে।

যে রাজধানীতে বড়জোর ৩০-৪০ লাখ মানুষ বাস করার কথা, সেখানে এখন বাস করছে দুই কোটির বেশি মানুষ! ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই আজ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। অথচ দেশের যোগাযোগ ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ঢাকার চারপাশে ট্রেন যোগাযোগসহ নানামুখী সড়কব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে। অথচ রাজধানীর জনচাপ কমছে না তাতে। কমছে না বলা যাবে না, কমাতেই হবে। সে জন্য সুদূরপ্রসারী কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে এবং সরকারকেই তা করতে হবে। পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে হলে আইনের কঠোর বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

নগরীর প্রতিটি বাড়ির ছাদে এবং বাড়ির চারপাশে যেটুকু খালি জায়গা আছে সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে বাগান করতে হবে। এই বিধান যদি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জারি করে এবং কঠোরভাবে তা মনিটর করে, তা হলে সবুজ হারানো এই নগরী আবার তার সবুজ ফিরে পেতে পারে।

একই কথা বলা যায় গ্রামবাংলার ক্ষেত্রেও। প্রয়োজনে গাছপালা কাটা হবে। কিন্তু প্রতিটি গ্রামে যদি গাছ কাটার সঙ্গে সঙ্গে একটি গাছ কাটলে দুটি লাগিয়ে দেয়ার বিধান স্থানীয় প্রশাসন ও গ্রাম-প্রশাসন কার্যকর করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ প্রকৃতির এই বিপর্যস্ত বাস্তবতায় কিছুটা হলেও আবার স্বাভাবিকতা ফিরে পাবে। প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযানের মাধ্যমে করা হয়। কিন্তু তার প্রকৃত সুফল ফলে না। গাছ লাগানো এবং বাড়ির চারপাশ সবুজে ভরে তোলার বিষয়টি সামাজিক আন্দোলনে রূপদান করতে হবে। প্রাকৃতিক সবুজ সুরক্ষার পাশাপাশি আমাদের নদ-নদী এবং প্রাকৃতিক জলাধারগুলো রক্ষার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। নদ-নদী, খালবিলসহ জলাধারগুলো রক্ষায় জনসচেতনতার পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব রকম রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে সরকার এবং প্রশাসনকেই জলাধার রক্ষার কাজটি কঠোর হাতে বাস্তবায়ন করতে হবে।

লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক।


পরিবেশ ভাবনায় আমরা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান

পৃথিবী নামক গ্রহে প্রাণী বসবাসের উপযোগী পরিবেশের কারণেই আমরা এই পৃথিবীর বাসিন্দা। পরিবেশ বলতে আমাদের আশপাশের সব কিছুকেই বোঝায়। এই পরিবেশে আছে মানুষ, পশু-পাখি অর্থাৎ সব ধরনের প্রাণী, মাটি, পানি, বায়ু, গাছপালা, বনজঙ্গল, চন্দ্র, সূর্য, মেঘমালা, পাহাড়, খাল, বিল, নদী, সাগর ইত্যাদি। এ সব কিছু নিয়েই প্রাকৃতিক পরিবেশ। আর মানুষের সৃষ্ট পরিবেশ হলো- জীবনের চাহিদা মেটাতে মানুষ প্রতিনিয়ত যা গড়ে তুলছে। যেমন- ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, যানবাহন, পুল-সাঁকো, কলকারখানা, দীঘি, নালা, পুকুর, কুয়া, খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, ব্যবসাকেন্দ্র, নগর, বন্দর প্রভৃতি। এ ছাড়াও রয়েছে সামাজিক পরিবেশ। সব মিলিয়ে বলা যায়, আমরা পরিবেশ দিয়েই ঘেরা।

পরিবেশ সংরক্ষণের কথা আগে শুরু হলেও, ১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম র‌্যাচেল কারসন সুনির্দিষ্টভাবে পরিবেশের কথা তুলে ধরলেন তার সাইলেন্ট স্প্রিং (Silent Spring) বইতে। তিনি বললেন, বসন্ত নীরব হতে চলেছে। পাখি আর গাইবে না। তাই পাখির কলতানে মুখরিত হবে না বসন্তের দিনগুলো। কেননা, বিষাক্ত কীটনাশক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের ফলে ফসল তোলার পর ক্ষেতে পড়ে থাকা শস্য খেয়ে পাখি প্রাণ হারাবে। এমনি ভাবে আরও কত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। এ থেকেই জন্ম নিল এক নতুন ভাবনা। আর তা হলো পরিবেশ ভাবনা।

১৯৬২ সালে লেখিকা র‌্যাচেল কারসন যে ভাবনার সূত্রপাত করলেন সে ভাবনার সম্প্রসারণে, ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের ডাকে বিশ্বের ৯৩টি দেশের প্রতিনিধিরা স্টকহোমে বসলেন বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে। দীর্ঘ আলোচনার পর ২৬টি ধারাসংবলিত ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করলেন অংশগ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিরা। স্টকহোমের এ ঘোষণাপত্রই হলো বিশ্ব পরিবেশের ম্যাগনাকার্টা। এর প্রথম ধারাতে বলা হয়েছে বিশুদ্ধ নির্মল পরিবেশ মানুষের জন্মগত অধিকার। এর দ্বিতীয় ধারায় রয়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থাৎ বায়ু, পানি, মাটি, উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা। এমনি ভাবে বিভিন্ন ধারায় রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জীবনের মান উন্নয়নের জন্য অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য প্রদান, অত্যাবশ্যক পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা, উন্নয়ন কার্যক্রম ও পরিবেশ রক্ষায় দ্বন্দ্ব দূর করে যুক্তিসঙ্গত পরিকল্পনা গ্রহণ, সম্পদের সঙ্গে সংগতি রেখে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা ও গণমাধ্যমে পরিবেশের গুরুত্বারোপ করা, উন্নত পরিবেশ সৃষ্টিতে গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ, পরিবেশের উন্নয়নের আন্তরাষ্ট্রীয় পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করা এবং মানব প্রজাতি ও পরিবেশকে রক্ষা করতে পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারসহ ধ্বংসলীলায় ব্যবহৃত সব অস্ত্র বিলুপ্ত করা। আর তারই ধারাবাহিকতায় মানুষকে পরিবেশ-সচেতন করে তুলতে ‘একটি পৃথিবী’ এ বক্তব্য সামনে রেখে, ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালনের যাত্রা শুরু হয়।

সৃষ্টির রহস্য এমনই যে পৃথিবীর সব কিছুতেই রয়েছে অপূর্ব সমন্বয় ও ছন্দ এবং চমৎকার ভারসাম্য, যা মানুষের বসবাসের অনুকূল ও উপযোগী অবস্থা গড়ে তুলেছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশে সবকিছুর প্রয়োজন রয়েছে, যা একে অন্যের সম্পূরক ও পরিপূরক। গাছপালা ও পশু-পাখি থেকে আমরা বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্য পাই। আবার বিভিন্ন জীবজন্তুর জন্যও রয়েছে খাদ্যের ব্যবস্থা। যেমন- গরু-ছাগলের জন্য মাঠে মাঠে ঘাস, পাখির জন্য গাছের ফল ও পোকামাকড়, মাছের জন্য রয়েছে ছোট ছোট পোকামাকড় ইত্যাদি। মানুষ, জীবজন্তু ও গাছপালার জন্য রয়েছে পানি, বাতাস, আলো। গাছ সব প্রাণীকে বেঁচে থাকার জন্য দিচ্ছে অফুরন্ত অক্সিজেন আর গাছের জন্য মানুষ দিচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড। বাঁচার জন্য যা কিছু প্রয়োজন মানুষ পৃথিবীর এ অনুকূল পরিবেশ থেকে তা গ্রহণ করছে। পৃথিবী ছাড়া চন্দ্র, মঙ্গল গ্রহ বা অন্য কোনো উপগ্রহে মানুষ বা কোনো প্রাণীর বসবাসের মতো এমনকি বাঁচার মতো অনুকূল পরিবেশ নেই। তাই তো আমাদের এই পৃথিবী সুন্দর ও আদর্শ পরিবেশের অধিকারী। যত দিন এ পরিবেশের ভারসাম্য থাকবে তত দিন এ পৃথিবী সুন্দর থাকবে এবং আমরা সুখ-শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারব। এ কথা আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে, আমরা যে পরিবেশ ব্যবহার করছি তা আমাদের পূর্বপুরুষরা রেখে গেছেন। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এ পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সবার। কোনো অবস্থাতেই একে নষ্ট করার অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু বিশ্ব পরিবেশ আজ এক অস্বাভাবিক অবস্থার মুখোমুখি। বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশের পরিবেশ বিভিন্নমুখী সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে এক ভয়াবহ অবস্থার দিকে এগিয়ে চলেছে, যা আমাদের জীবনে বয়ে আনছে চরম দুর্ভোগ। এর মূলে রয়েছে সাময়িক লাভের জন্য পরিবেশের প্রতি অসতর্কতা, অযত্ন, অবহেলা ও জ্ঞান-বুদ্ধি-বিচার বিবর্জিত ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী আচরণ। অপরিকল্পিতভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। কারণ বর্ধিত জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্নভাবে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ায় এক অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ক্রমে এ ভূখণ্ড বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে উন্নয়নশীল দেশের প্রায় ৮০ ভাগ বনভূমি উজাড় হয়েছে এবং বাস্তব রীতির ভারসাম্য রক্ষাকারী প্রাণীসহ প্রায় ৭০ ভাগ বন্য প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেছে।

যেকোনো দেশে স্বাভাবিকভাবে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি প্রয়োজন। আর আমাদের মতো জনবহুল দেশে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হলে কমপক্ষে দেশের এক-তৃতীয়াংশ বনভূমি আবশ্যক। কিন্তু নির্বিচারে ব্যাপকভাবে গাছপালা কেটে উজাড় করে ফেলায় আমাদের বনভূমি কমে ১০ শতাংশেরও নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে অক্সিজেনের অভাবে আমাদের নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে। গাছপালা কেটে ফেলায় বনভূমির অভাবে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে এবং আবহাওয়া হচ্ছে উত্তপ্ত। বাড়তি জমি লাভের জন্য পুকুর, দীঘি, জলাশয় ইত্যাদি ভরাট করায় ক্ষতিকর শুষ্ক ও রুক্ষ পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক গতি-প্রবাহকে রোধ করার ফলে চর পড়ে নদী শুকিয়ে ব্যাপক অঞ্চলে মরুকরণের প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ মরুকরণের প্রক্রিয়ার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় জমির উপরিভাগে লবণাক্ততা বাড়ছে ও সেচব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষিকাজ অসম্ভব হয়ে পড়ছে।

শিল্প বিপ্লব আমাদের সভ্যতার অগ্রগতিতে নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। কিন্তু বর্ধিত মানুষের জীবনের চাহিদা মেটাতে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র কলকারখানা নির্মিত হওয়ার ফলে পরিবেশ ব্যাপকভাবে দূষিত হচ্ছে। কলকারখানা ও ইটভাটার চিমনির ধোঁয়ায় বাতাস দূষিত হচ্ছে। কলকারখানার আবর্জনা ও ব্যবহৃত ময়লা নদীতে ফেলার ফলে পানি দূষিত হয়ে মাছসহ অন্যান্য প্রাণী মারা যাচ্ছে। অসংখ্য মানুষের যাতায়াতের জন্য রেল, মটরগাড়ি, লঞ্চ, স্টিমার, বিমান চলাচল করছে এবং এগুলোর বিকট শব্দ ও হর্নের শব্দ আমাদের রক্তচাপ বাড়াচ্ছে, যা হৃদরোগের অন্যতম কারণ। আবার এগুলোর কালো ধোঁয়া ফুসফুসের রোগ সৃষ্টি করে। অনেক সময় অতিরিক্ত যাত্রী ও মালবোঝাই করায় দুর্ঘটনা ঘটে, যার ফলে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হয়।

অপরিকল্পিত জনসংখ্যার চাপে প্রকৃতি ক্রমশই বিপর্যয়ের দিকে এগুচ্ছে। শিল্প ও অন্যান্য বর্জ পরিশোধনের ক্ষমতা ক্রমেই প্রকৃতি হারিয়ে ফেলছে। আবার অক্সিজেন তৈরির অন্যতম স্থান বনভূমি প্রতি বছর অন্ততপক্ষে ১ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়া রোধ করা না গেলে একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অক্সিজেনের দারুণ ঘাটতি দেখা দেবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বৃক্ষনিধন, শুষ্কতা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির কারণে মরুকরণ প্রক্রিয়ায় বিশ্বের ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার অর্ধেকই হলো এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সৃষ্টিনির্ভর কৃষিভূমি, সেচভূমি, চারণভূমি ও বনভূমির প্রায় ৩৩ লাখ বর্গমাইল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য প্রোটেকশন অব নেচার’-এর হিসাব মতে, গত প্রায় ১০০ বছরে পৃথিবী থেকে ৭৬ প্রজাতির প্রাণী, কয়েক হাজার রকমের গাছপালা বিলুপ্ত হয়েছে। আরও প্রায় ২৬ প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির পথে। প্রতি বছর ২০ কোটি টনের বেশি মনো-অক্সাইড, ৫ কোটি টন হাইড্রো কার্বন, ১২ কোটি টন ছাই ও ১৫ কোটি টন সালফার ডাই-অক্সাইড, কলকারখানা থেকে নির্গত হয়ে পৃথিবীর পরিবেশকে আক্রান্ত করছে (নিউ টাইমস থেকে)।

পরিবেশ বিনষ্টের সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর দিক হলো, ওজোনস্তরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ওজোনস্তর ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। বায়ুদূষণের ফলে এক ধরনের গ্যাস বায়ুমণ্ডলের নির্দিষ্ট স্তরে ওজোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যা সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পারমাণবিক বিস্ফোরণের কারণে ওজোনস্তর অতি উত্তপ্ত হলে বায়ুমণ্ডলে অন্যতম উপাদান নাইট্রোজেন ভেঙে যায় এবং প্রচুর পরিমাণ নাইট্রিক অক্সাইড সৃষ্টি হয়, যা ওজোন প্রতিবন্ধকতায় ফাটল ধরায়। এ প্রক্রিয়ায় ওজোনের ক্ষতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তা ছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে অসহনীয় আবহাওয়া, অস্থিতিশীল জলবায়ু ও অস্বাভাবিক তাপমাত্রা ওঠানামা করার ফলে সামুদ্রিক প্রাণী ও গাছপালা বিলপ্ত হয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

পরিশেষে, সুখী-সুন্দর প্রগতিশীল জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়ভাবে অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন। যেহেতু আমরা পরিবেশের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। তাই পরিবেশ সংরক্ষণ ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের উন্নয়নের জন্য, প্রগতির জন্য, সমৃদ্ধির জন্য, শান্তির জন্য, সর্বোপরি অস্তিত্বের জন্য একটিই লক্ষ্য হবে- সুষ্ঠু পরিবেশ সংরক্ষণ। সরকারি ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হলে সুষ্ঠু পরিবেশ সংরক্ষণ সম্ভব। সে লক্ষ্যেই আমাদের কাজ করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। শিক্ষার আলোই মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারে। শিক্ষিতজনই দেশ ও জাতির সমস্যা সমাধানের কথা ভাবতে পারে, পথনির্দেশ করতে পারে। তাই শিক্ষার মাধ্যমেই পরিবেশ সংরক্ষণের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হবে, এ প্রত্যাশাই করি।

লেখক: অধ্যাপক ও সাবেক ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়


ভূস্বর্গ কাশ্মীরে মুগ্ধ জি-২০ দেশগুলো

আপডেটেড ৫ জুন, ২০২৩ ১১:৫৭
ফারাজী আজমল হোসেন

ভূস্বর্গ কাশ্মীরে জি-২০ সম্মেলন আয়োজনকে কেন্দ্র করে কম সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি ভারতকে। কিন্তু সম্মেলন শেষে নিন্দুকদের সমালোচনার বদলে গুরুত্ব পেয়েছে জি-২০ দেশগুলোর ভারতের কাশ্মীর নিয়ে করা ইতিবাচক সব আলোচনা। কাশ্মীর উপত্যকার সৌন্দর্যের পাশাপাশি উন্নয়নে মুগ্ধ তারা।

জি-২০ সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা ভূস্বর্গ বলে পরিচিত কাশ্মীরের উন্নয়নে ভারত সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলোরও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জঙ্গিদের হুমকি উপেক্ষা করে নির্বিঘ্নেই সম্মেলন শেষ হয় উপত্যকায়। পর্যটনের বিকাশে এই সম্মেলনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয় ভারত সরকার। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষও মুখিয়ে ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অতিথিদের স্বাগত জানাতে। অতিথিদের বরণ করতে ছিল না কোনো কার্পণ্য। অতিথিরাও স্থানীয়দের আতিথেয়তায় নিজেদের খুশির কথাই শুনিয়েছেন। সব মিলিয়ে উৎসবে মেতে উঠেছিল ভারতের গোটা কাশ্মীর উপত্যকা।

বিশ্বের ২০টি অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত দেশ মিলে গঠিত হয় জি-২০ বা গ্রুপ অব টোয়েন্টি। বিশ্বের ২০টি দেশের অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা এই গোষ্ঠীর সদস্য। ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক আর্থিক স্থিতিশীলতা উন্নয়ন-সম্পর্কিত নীতি নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যেই এই জি-২০ গঠিত হয়। বিশ্বের ১৯টি ধনী দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত এই গোষ্ঠীর সদস্যরা হলো আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। ২২ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রস্তুতি বৈঠকে ১৬টি দেশের ৬০ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দেন। তবে সৌদি আরব, তুরস্ক, মিসর ও চীন এই সম্মেলন বয়কট করে। কিন্তু তাদের বয়কটও সম্মেলনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, জঙ্গিবাদীদের পাকিস্তানি মদদের বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে ধরা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সামনে খুলে গেছে পাকিস্তানের মুখোশ। চীনও কূটনৈতিকভাবে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে এই সম্মেলনে যোগ না দিয়ে।

জি-২০ গোষ্ঠীর সদস্য নয় বাংলাদেশ। তবে আয়োজক দেশ ভারতের আমন্ত্রণে এই সম্মেলনে অতিথি সদস্য হিসেবে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশও। সম্মেলনের ফাঁকে বিভিন্ন আলোচনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপক প্রশংসা হয়। জি-২০ বৈঠক বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশেও বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ভারতীয় কূটনীতিকদের মতে, দিল্লি চিরকালই ঢাকাকে পরম বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করে। তাই জি-২০ সম্মেলনের আয়োজনেও বাংলাদেশকে বিশেষ আমন্ত্রিত দেশ হিসেবে যুক্ত করেছে। বাংলাদেশও সেই সুযোগ হাতছাড়া করেনি।

এই সম্মেলনের আয়োজন প্রসঙ্গে ভারতের পর্যটন সচিব অরবিন্দ সিং বলেন, জম্মু-কাশ্মীরকে দুনিয়ার পর্যটন মানচিত্রে নতুন করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এই সম্মেলন কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে সম্মেলন দারুণ সফল। পর্যটন বিকাশে অবকাঠামো ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে ভারত কাশ্মীরের বর্তমান উন্নততর অবকাঠামো এবং উপত্যকায় জঙ্গিবাদকে পরাস্ত করে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে ভারত। সব দেশের প্রতিনিধিদের মুখে তাই কাশ্মীরের প্রশংসা শোনা যাচ্ছে এখন। পশ্চিমা দেশগুলোও বুঝতে পারছে, সীমান্তের ওপার থেকে চীনের বন্ধুদেশ পাকিস্তান ভারতীয় নাগরিকদের ওপর কীভাবে প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে। মুসলিম দেশ হয়েও কাশ্মীরের নিরীহ মুসলিমদের ওপর ক্রমাগত আঘাত হানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক স্তরে জঙ্গিবাদীদের মদদদাতা ইসলামাবাদ।

শ্রীনগরে সম্মেলনের মূল বিষয় ছিল, ‘কাশ্মীর ও সিনেমাশিল্প’। কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে বহু ভালো সিনেমা তৈরি হয়েছে। তবে সেখানে কিছুদিনের জন্য জঙ্গিবাদীদের অপতৎপরতায় সিনেমাশিল্পে ভাটা আসে। পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে এখন। আবারও লেন্সবন্দি হচ্ছে ভূস্বর্গের সৌন্দর্য। তাই ভারতের কেন্দ্রীয় পর্যটন প্রতিমন্ত্রী তথা জম্মুর ভূমিপুত্র, জিতেন্দ্র সিং বলেছেন, গত কয়েক বছরে কতটা বদল এসেছে আবহাওয়ায় এই বৈঠকের আয়োজনই হচ্ছে তার বড় প্রমাণ। নির্বিঘ্নে সম্মেলন শেষ হওয়ার জন্য তিনি পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্থানীয় নাগরিকদেরও ধন্যবাদ জানান। উধমপুর থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সদস্য জীতেন্দ্র সিং বলেন, কাশ্মীরের মানুষই উপত্যকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কাশ্মীরের অবদান বলে শেষ করা যাবে না বলে মনে করেন ভারতের পর্যটন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বহু ছবির শুটিং হয়েছে এখানে। কিন্তু বিদেশি শক্তির মদদে আচমকা ১৯৯০ সাল থেকে সিনেমাশিল্প থমকে যায়। তবে বর্তমান সরকারের চেষ্টায় আবার সেই সময় ফিরে এসেছে। সিনেমার মধ্য দিয়ে এখানকার অর্থনীতিকে চাঙা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পাশাপাশি বিদেশিদেরও কাশ্মীরের সৌন্দর্যকে সেলুলয়েডে বন্দি করার আমন্ত্রণ জানান তিনি। ভারতের পর্যটন প্রতিমন্ত্রী জীতেন্দ্র সিং আরও জানান, কাশ্মীরে নতুন করে কেউ সিনেমা করতে চাইলে সরকার সব রকম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

৩৭০ ধারা বাতিলের পর জম্মু ও কাশ্মীর এখন উন্নয়নের শিখরে রয়েছে। ভারত সরকার সরাসরি মন দিয়েছে কাশ্মীরের উন্নয়নে। বেকারদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে অবকাঠামোর উন্নয়নকে দেয়া হয়েছে সর্বাধিক গুরুত্ব। শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ঢেলে সাজানো হয়েছে কাশ্মীরের পর্যটনশিল্পকেও। স্থানীয় হস্তশিল্পের পাশাপাশি বিশ্ববিখ্যাত আপেল বাগানেও এখন খুশির হাওয়া বইছে। জঙ্গিবাদকে পরাস্ত করে আসলে কাশ্মীরের মানুষ এখন ভারত সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছেন। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে যোগাযোগব্যবস্থারও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বেড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার মানও। বিদেশিরা কাশ্মীরের পরিস্থিতি সরেজমিন দেখে অভিভূত। আরও বেশি করে পর্যটক আসবেন কাশ্মীরে, এই সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় খুব খুশি সাধারণ হোটেল ব্যবসায়ীরাও। সব মিলিয়ে কাশ্মীরে জি-২০ সম্মেলন ঘিরে রয়েছে বাড়তি এক উন্মাদনা।

সেপ্টেম্বরেই ভারতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনের আগে কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর ভূখণ্ডের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরার প্রয়াস ১০০ শতাংশ সফল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পশ্চিমাদের মনে কাশ্মীর নিয়ে কিছুটা সন্দেহ থাকলেও এখন তা পরিষ্কার হয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন। কারণ তারা পাকিস্তানের জঙ্গিবাদকে মদদ দেয়ার বিষয়টি যেমন বুঝতে পেরেছেন, তেমনি চীনের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবও টের পেয়েছেন। তাই সবদিক থেকেই শ্রীনগরের সম্মেলন সফল।

সেপ্টেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিশা দিতে পারবে বলেও কূটনৈতিক মহলের অনুমান। ভারতের সভাপতিত্বে জি-২০ ইতিমধ্যেই সদস্য দেশগুলোর মনে আলাদা দাগ কাটতে শুরু করেছে।

ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর ঘিরে বারবার অপতৎপরতা চালানোর চেষ্টা করেছে পাকিস্তান। এই অঞ্চলে ধর্মের নামে তারা যেই জঙ্গিবাদ চালায়, তা তিরস্কারের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন এই অঞ্চলের স্থানীয়রা। বিশেষত ৩৭০ ধারা বাতিলের পর থেকে এই অঞ্চলে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতার পথ সহজ হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থা প্রবর্তনের টানেল পথ থেকে শুরু করেই এই অঞ্চলকে স্বাবলম্বী করতে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি অন্যান্য সেবা কার্যক্রম নিশ্চিত করেছে ভারত।

সেই সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ব্যবসা ও চাকরির সুযোগের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি পর্যটকদের সাদরে আমন্ত্রণ জানাতে সক্ষম হয়েছেন জম্মু ও কাশ্মীরের অধিবাসীরা। একসময় শীতে কাশ্মীরে প্রবেশ করা ছিল বেশ দুর্গম ও অসম্ভব। কিন্তু এখন আপনি-আমি চাইলে বছরের যেকোনো সময় যেতে পারব কাশ্মীরে। সেই সঙ্গে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ পাকিস্তান ও তার জঙ্গিবাদকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করায় বিরাজমান রয়েছে এক শান্তিময় অবস্থা।

ভারতীয় উপমহাদেশে ভূস্বর্গখ্যাত কাশ্মীর জি-২০ সম্মেলন শেষে আরও একবার বিশ্বের বুকে পরিচিত হয়ে উঠছে ভূস্বর্গ হিসেবে। আশা করা হচ্ছে, এই সম্মেলনের মাধ্যমে আবারও পর্যটন ও সিনেমা খাতে আগের জৌলুস ফিরে পাবে জম্মু ও কাশ্মীর।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট


ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
জিয়াউদ্দীন আহমেদ

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ আয়োজিত ‘ব্যাংকিং অন ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার উল্লেখ করেন, খেলাপি ঋণ কমানো ও করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে ব্যাংকের ব্যবসার বৈচিত্র্য বাড়বে বলেও তিনি বিশ্বাস করেন। অন্যদিকে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের অভিমত হচ্ছে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা এককভাবে তফসিলি ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়, এই কাজের জন্য সামাজিক প্রতিশ্রুতি দরকার। তাদের আরও বক্তব্য হচ্ছে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে এবং এ খাতে লোকবল বাড়াতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের। বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাই ব্যাংক খাতের জন্য এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। ব্যাংকাররা হতাশ হয়ে এখন আইনি কাঠামো শক্ত করে চোর ডাকাতের মতো ব্যবসায়ীদের শাস্তি দিতে চাচ্ছে, জেলজরিমানা করে খেলাপিদের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টির পরিবেশ তৈরির প্রত্যাশা করছে। কিন্তু আদালতে মামলা হলে ঋণখেলাপি স্বস্তি পায়, ঋণ গ্রহীতার মৃত্যু পর্যন্ত মামলা চলতেই থাকে। কারণ অর্থ ঋণ আদালতে কোনো মামলায় ব্যাংক বিজয়ী হলেও সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য আরেকটি মামলা করতে হয়। অন্যদিকে খেলাপি গ্রাহকের উচ্চ আদালতে রিট করার সুযোগ তো সব সময়ই থাকে। গভর্নর বলছেন, খেলাপি ঋণ কমানোর দায়িত্ব ব্যাংকের শীর্ষ নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন তাদেরই নিতে হবে। ব্যাংকের শীর্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নেয়া উচিত। কারণ প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের বেতন কাঠামোর সঙ্গে জাতীয় বেতন স্কেলের কোনো সঙ্গতি নেই, ঈর্ষণীয় বেশি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় এত উচ্চ বেতনের কর্মকর্তার দায়িত্বও উচ্চ থাকা অপরিহার্য। উচ্চ বেতন কাঠামোর কর্মকর্তাদের দায় ও দায়িত্ব অর্পণযোগ্য নয়। মামলা ঠুকে দিয়ে দায় ও দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল বন্ধ করা জরুরি।

গভর্নরের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের শুধু ‘দূরদর্শী নীতিমালা’ প্রণয়নে আবদ্ধ থাকার মধ্যে সমাধান নিহিত নয়। বর্তমান গভর্নর বহু বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণের সঙ্গে জড়িত। তিনি গভর্নর হওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের পরিচালক ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণে পরিচালক পর্ষদের সম্মতি অপরিহার্য। তিনি নিশ্চয়ই যথাযথ ভূমিকা পালন করেছেন। আমার ধারণা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদের কিছু সদস্য নিজস্ব দাপ্তরিক কাজে এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে, পর্ষদ সভায় উপস্থাপিত স্মারকগুলো পড়ে দেখার সময়ও পান না। অনেকে অফিস থেকে সভায় আসার পথে ট্রাফিক জ্যামে গাড়িতে বসে একটু চোখ বুলিয়ে নেন। এসব পর্ষদের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, আমলারা সেনাসদস্যদের মতো বড় কর্মকর্তাদের সমীহ করেন, সিনিয়র আমলার মতের বিরোধিতা করে পর্ষদ সভায় ঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অধস্তন আমলারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ যথাযথ ভূমিকা পালন করলে ব্যাংকিং জগত নিয়ে সরকারকে এত বিব্রত হতে হয় না। আর্থিক কেলেঙ্কারি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার খবর অহরহ মিডিয়ায় আসছে।

করোনা-উত্তর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাসসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে প্রতিটি দেশেই মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। শুধু মূল্য বাড়ার কারণে বেশি অর্থ দিয়ে আগের তুলনায় এখন কম পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভোক্তার চাহিদা কমছে, চাহিদা কমায় আমাদের রপ্তানি কমছে। একই যুক্তিতে আমাদের চাহিদা এবং আমদানি কমার কথা। কিন্তু তা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে হচ্ছে না। কারণ নিত্যব্যবহার্য পণ্য, জ্বালানি তেল এবং পোশাকশিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমানোর কোনো উপায় নেই। বিশ্বমন্দায় বস্ত্রের চাহিদা কমে গেলে পোশাক শিল্পের ওপর অতিনির্ভরতা আমাদের অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এবং অবরোধ আরোপের হিড়িক বন্ধ না হলে দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে যাবে, ব্যাংকে অলস টাকা ও খেলাপি ঋণ আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংকের দূরদর্শী নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন।

সরকার এবং ব্যাংক কৃচ্ছ্রসাধন করছে বলে মনে হয় না। ইন্টারনেটের যুগে তথ্য সংগ্রহে ব্যক্তিকে সশরীরে বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। কোথায় কী সমস্যা তা চিহ্নিত করা সম্ভব হলে সমাধান ঘরে বসেও করা সম্ভব। উন্নত দেশগুলোতে এখনো লোকজন ঘরে বসে নেটের মাধ্যমে অফিসের কাজ করছে। আর বাংলাদেশে এখনো বিভিন্ন অজুহাত সৃষ্টি করে সরকারের লোকজন বিদেশে যাচ্ছেন। বিদেশি ঋণে বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্পে বিদেশ ভ্রমণের অপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ থাকেই। বিদেশে না গেলে অর্থ অব্যয়িত থেকে যাবে, এই কারণ দেখিয়ে অসংখ্য কর্মকর্তা এখনো অহরহ বিদেশ ভ্রমণ করছেন। জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কর্মশালা, সেমিনার বা প্রশিক্ষণে যোগদান বর্তমান প্রেক্ষিত বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয়। স্বাভাবিক অর্থনৈতিক অবস্থায় এগুলোরও প্রয়োজন আছে, কিন্তু এখন নয়। রেমিট্যান্স বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে বিদেশে বক্তৃতা দিতে যারা যাচ্ছেন তাদের পক্ষে সামান্যতম অবদান রাখা সম্ভব হচ্ছে বলে মনে হয় না। কারণ হুন্ডির লাভ বক্তৃতা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হচ্ছেন অসংখ্য ব্যবসায়ী, সাংবাদিক। তাদের জন্য সরকারের খরচ না হলেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা কিন্তু ব্যয় হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে বিপিএল ক্রিকেটের আয়োজন জরুরি ছিল বলে মনে হয় না। আনন্দ আর বিনোদনেও অগণিত লোক বিভিন্ন দেশ নিজের টাকায় ভ্রমণ করছেন, চিকিৎসা করতে তো যাচ্ছেনই। দূরদর্শী নীতি প্রণয়নে এসব সাধারণ বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

ঋণের মান কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তা হলে কি এত দিন যথাযথ আঙ্গিকে যাচাই করা হতো না? না হলে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে না কেন? প্রতিটি ব্যাংকে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ রয়েছে, নিয়মিত নিরীক্ষণ হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও নিয়মিত পরিদর্শন হয়। দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালক পর্ষদে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক থাকেন। পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষা বা পরিদর্শন কোনোটাই কাজে আসছে না। কাজে আসলে এত বেশি খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হতো না। বাংলাদেশ ব্যাংকে যারা পরিদর্শন করে রিপোর্ট তৈরি করেন তাদের প্রতীতি হচ্ছে, নীতিনির্ধারকরা আপস করেন, আপস করেন বলেই চূড়ান্ত অনুমোদিত রিপোটে পরিদর্শিত ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র থাকে না। তবে জাতীয় স্বার্থে মাঝে মাঝে আপস করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই আপসের সঙ্গে দুর্নীতি থাকলে খেলাপি ঋণ বাড়বেই। দুর্নীতি ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল তদারকির কথা অস্বীকার করা যাবে না। তাই বলে পরিদর্শন ও তদারকির নামে ভয়ভীতি সৃষ্টি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয়। প্রতিটি লোন কেস যথাযথভাবে যাচাই করা সমীচীন। কিন্তু যাচাইয়ের নামে কালক্ষেপণ অপরাধ, বিলম্বিত সিদ্ধান্তে পরিস্থিতির পরিবর্তনে প্রকল্পে বিনিয়োগ অলাভজনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণে অযাচিত বিলম্বে দুর্নীতি বাসা বাঁধতে সহায়তা করে।

পর্যাপ্ত জামানত না নিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় লোন দেয়া হলে লোন আদায়ের ঝুঁকি বাড়ে। বর্তমান গভর্নর আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ইমেজ একটু বেড়েছে। বর্তমান গভর্নর অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকছেন, কারও তোষামোদিতে বিগলিত হচ্ছেন না, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয় তা তফসিলি ব্যাংকের এখতিয়ারে ছেড়ে দিচ্ছেন। পুনঃতফসিল বা বড় লোনগুলোর অনুমোদন এখন সব ব্যাংক তাদের নিজ দায়িত্বে করে থাকে। তবে প্রতিটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা, সততা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও দায়িত্ব রয়েছে, মন্ত্রণালয়ের প্রতি আস্থা স্থাপন করলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। মনে রাখা দরকার, খেলাপি ঋণের কারণে শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোই সমস্যায় পড়ছে না, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বহু দিন আগে ঋণ অবলোপন করে ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্সশিট পরিষ্কার করা হয়েছিল। কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কমানো হয়েছিল। কিন্তু এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বারবার খেলাপি ঋণ কমানো সঠিক নয়, কারণ অবলোপন করার পর তা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়, ব্যাংকাররাও তা আদায়ের কথা ভুলে যান। খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে থাকলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, প্রকৃত উদ্যোক্তা ঋণ পাবে না। বাজার অর্থনীতির কাজ হচ্ছে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মধ্যস্বত্বার সৃষ্টি করা, এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ে, কর্মসংস্থান হয়। ব্যাংকের ব্যর্থতায় সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন করে খেলাপি ঋণ আদায় জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দাভাব তা কাটিয়ে উঠতে হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মানুষের আয় বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বাড়াতে হলে অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হলে প্রকৃত উদ্যোক্তাকে সময়মতো প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান দিতে হবে। ঋণের জোগান দিতে হলে খেলাপি ঋণ হ্রাস করতে হবে। ব্যাংকের সংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি, তাই বড় বড় কোম্পানিগুলোকে লোন দেয়ার জন্য ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতা করে নিজের অবস্থান দুর্বল করছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো জিইয়ে রাখার কোনো মানে হয় না, বড় ও শক্তিশালী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত করে দেয়াই শ্রেয় হবে। ঘটনা ঘটার বৎসরাধিক পরে পরিদর্শনপূর্বক আরও বৎসরাধিক কাল অতিবাহিত করে সংশ্লিষ্ট পরিদর্শিত ব্যাংককে অনিয়ম নিয়মিত করার জন্য নির্দেশনা দেয়ার বিলম্বিত রীতি বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিবর্তন করতে হবে।

লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক বাংলাদেশ ব্যাংক


মার্কিন ভিসানীতি বিএনপির জন্যও সতর্কবার্তা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মো. সাখাওয়াত হোসেন

অগ্নিসন্ত্রাসের প্রসঙ্গ এলেই সাধারণ জনতার মধ্যে এক ধরনের ভয়, শঙ্কার আবির্ভাব ঘটে থাকে। অর্থাৎ যারা অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনা স্বচক্ষে অবলোকন করেছে কেউই ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি চায় না। এক ধরনের অস্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশের সৃষ্টির মাধ্যমে অরাজকতা আনয়নের চেষ্টায় একটি পক্ষ চেষ্টা চালিয়েছিল। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো পৃথিবীর মানুষ অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনা অবলোকন করেছে। কেবল বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ নয়, পুরো পৃথিবীর মানুষ অগ্নিসন্ত্রাসীদের প্রত্যাখ্যান করেছে, অগ্নিসন্ত্রাসীরা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বাংলাদেশে নির্বাচন আসন্ন, নির্বাচন সামনে রেখে দেশের সব জায়গায় নির্বাচন প্রক্রিয়া, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিদেশি বন্ধুদের ভূমিকা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটুকু সহনীয় পর্যায়ে থাকতে পারে- এ বিষয়গুলো নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

এ আলোচনার মধ্যেই সাম্রাজ্যবাদে বিশ্বাসী আমেরিকা বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। নতুন ভিসানীতি কার্যত সরকারের বাইরে যারা আছে তাদের জন্য অনেকাংশে শাপেবরের ন্যায়। সরকারের বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে, তাদের ধারণা ছিল আসন্ন নির্বাচনে বিদেশি বন্ধুরা হস্তক্ষেপ করবে এবং এ মর্মে জনগণের সঙ্গে একাত্ম্য না হয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে অভিযোগ দিয়ে আসছিল। কখনো কখনো বিদেশি কূটনীতিকরা কূটনৈতিক শিষ্টাচার না মেনে এ দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে আলোচনার উত্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে ভিয়েনা কনভেনশনের শর্তানুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয় এবং কূটনীতিকরাও খানিকটা হলেও সাবধানতা অবলম্বন করে বক্তব্য দিচ্ছেন।

এহেন পরিস্থিতিতে আমেরিকার ভিসানীতি সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সংকট ব্যতিরেকে কিছু নয়। ভিসানীতিতে বলা আছে, নির্বাচনে বাধা সৃষ্টিকারী, ভোটারদের ভয় দেখানো, নাশকতা সৃষ্টি করা ও অগ্নিসন্ত্রাসকারীরা ভিসা পাবে না। সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো এক দফায় তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডাকে নির্ধারণ করেছে। সেখানে উল্লেখ আছে- দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না, নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। কিন্তু নির্বাচনকালীন প্রশ্নে বরাবরেই মতোই নীরব কূটনীতিকরা। কূটনীতিকদের প্রত্যাশা হচ্ছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কাজেই নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বিদেশি বন্ধুদের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা বাংলাদেশের কতিপয় রাজনৈতিক দলের, এখন রাজনৈতিক দলগুলো যদি বিদেশিদের ওপর নির্ভর করে এই মর্মে; বিদেশিদের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থার সমসাময়িক রীতির পরিবর্তন হবে, তাহলে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। কূটনীতিকরা কোনোভাবেই দেশের প্রচলিত আইনের পরিবর্তনের জন্য অনুরোধ জানাতে পারবে না, কেননা এটি রীতিবিরুদ্ধ হবে। বিদেশিরা যেটি করতে পারে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাতে পারে। সরকার কিন্তু এ বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে, যেকোনো মূল্যে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যদি আপনি দেখেন সরকারের মেয়াদে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রত্যেকটি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হচ্ছে এবং সরকার নির্বাচনে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করছে না। এ থেকে সহজেই অনুমেয়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর।

কেননা বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কোনোরূপ সংকট নিশ্চয় সরকার চাইবে না। বর্তমান সরকারের প্রধান বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, জনগণ চাইলে আছি, না চাইলে নাই। এ কথা থেকেই প্রতীয়মান হয়, সরকার চাচ্ছে জনগণের ভোটাধিকারের মাধ্যমেই আগামীর নতুন সরকার গঠিত হোক। আবার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করার ক্ষেত্রেও সরকার বদ্ধপরিকর। অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন পরিচালিত হবে। বর্তমানে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান নেই। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করতে চাইলে সংসদে উত্থাপিত এ-সংক্রান্ত বিলে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটের প্রয়োজন রয়েছে। সংসদের বাইরে যারা এক দফা দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে, তাদের সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই। কাজেই নিয়মানুযায়ী আওয়ামী লীগ বাদে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সংসদে তত্ত্বাবধায়ক বিল প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের সুযোগ নেই।

সুতরাং ভিসানীতি ও বিদ্যমান সংবিধান সাংঘর্ষিক নয়। ভিসানীতিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে হবে, আর নির্বাচন নির্বিঘ্নে পরিচালিত হতে হবে। যারা সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দেবে এবং নাশকতা সৃষ্টি করবে, অগ্নিসন্ত্রাস করবে তাদের যুক্তরাষ্ট্র ভিসা প্রদান করবে না। অতীতে দেখা গেছে, সরকার নিয়মানুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে এবং একটি গ্রুপ তাদের তত্ত্বাবধায়কের দাবি উত্থাপন করে নির্বাচনের বিরোধিতা করে অগ্নিসন্ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে, স্বাভাবিক কাজে যারা ঘর থেকে বের হয়েছে তাদেরও নানা ফ্যাসাদে ফেলে কুপ্রবৃত্তি মানসিকতার বিকাশ ঘটিয়েছে। আর্থিক ও মানসিকভাবে সাধারণ জনগণের ওপর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে খাটো করেছে। এ পরিস্থিতির যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটাতে পারে ওই পক্ষটি; সে জন্যই আমেরিকা ভিসানীতিতে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে।

ভিসানীতি ও বিএনপির এক দফা আন্দোলন সাংঘর্ষিক। বিএনপির এক দফা দাবি হচ্ছে- তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে। ভিসানীতিতে কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়া কেমন হবে সে বিষয়ে বলা নেই। আবার সরকার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনে বদ্ধপরিকর। এখন বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে, তাহলে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যে অরাজকতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, পুনরায় এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েই যায়। সে জায়গা থেকে নির্বাচনের আগে আমেরিকার ভিসানীতিতে এ বিষয়টির অন্তর্ভুক্তি বিএনপির জন্য একটি সতর্কবার্তা বটে। কেননা নির্বাচন ঘিরে অরাজকতার সৃষ্টি হলে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। কোনো দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে গেলে বৈশ্বিক রাজনীতির ব্যানারে সেসব মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুতরাং আসন্ন নির্বাচনে সব পক্ষকেই সতর্ক অবস্থানে থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি প্রকৃত অর্থে সরকার ও সরকারের বিরোধী জোটের জন্যই সতর্কবার্তা। এ ক্ষেত্রে সরকারের ইচ্ছার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার সামঞ্জস্যতা রয়েছে। এ হিসেবে সরকারি দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের জন্য ভিসানীতি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আবার যারা আওয়ামী জোটের বাইরে রয়েছে, সেসব দলকে প্রকারান্তরে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য পরোক্ষ নির্দেশনা বটে। নির্বাচনের রেসের বাইরে থেকে নির্বাচন আয়োজনে যারা বাধার সৃষ্টি করবে, মূলত তাদের জন্যই ভিসানীতি দুশ্চিন্তার। তথাপি আমেরিকার কর্তৃত্ববাদের বিষয়টি কিন্তু আবারও সমস্বরে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, নির্বাচনিক প্রক্রিয়া, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ইত্যাদি সংক্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের ছবক দেয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয় (যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্যানুযায়ী), দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ, রাজনৈতিক নেতৃত্বে এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতায়।

কাজেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের উচিত হবে, একসঙ্গে আলোচনায় বসে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা। ভিন্ন দেশের ছবক গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ আমাদেরই গড়তে হবে, সেখানে অন্যরা কোনোভাবেই আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে না। কিছু রাষ্ট্র রয়েছে যারা শুধু মোড়লগিরি করে বেড়ায়, কিন্তু কার্যত কাজের কাজ কিছুই করে না। সমস্যাকে কীভাবে জিইয়ে রাখা যায়, সে জায়গা থেকে চেষ্টা করে মধ্যস্থতার নামে ওই রাষ্ট্রটির বিভিন্ন জায়গা থেকে অলিখিত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যায় কথিত মোড়লরা। সবার কাছে প্রত্যাশা থাকবে, আসন্ন নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় আগামীর নতুন সরকার গঠিত হবে এবং ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবে রূপদানের মাধ্যমেই স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ সম্ভব।

লেখক: চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


ঘাটতি বাজেট ডলারসংকট আরও বাড়িয়ে দেবে

ড. জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজেট তৈরি করা হয়নি। দেড় বছর ধরে দেশে ডলারসংকট। ডলারসংকটের কারণে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হচ্ছে না। এত বড় একটি ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, যা ডলারসংকট আরও বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যালান্স শিট এক্সপ্যান্ড করেছে। ফলে এ অর্থবছরে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাপা হয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়েছে। আবার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়ে দিলেও ডলারসংকটের চাপ একই রকম থাকবে।

ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিলে আবার ঝুঁকি তৈরি হয়। কারণ বর্তমানে ব্যাংক খাতে আমানত কম। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ কমছে না। ব্যাংক থেকে অনেকে টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিনিয়ত ডলার কিনছে। এর বদলে নগদ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। তাই ব্যাংকে এমনিতেই এক রকমের তারল্যসংকট রয়েছে। ব্যাংক খাতের সক্ষমতা আগের চেয়ে কমেছে। তার মধ্যে সরকার বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে। সরকারকে ঋণ দিতে চাইবে ব্যাংক। এটি ব্যাংকের জন্য লাভজনক। কারণ সরকারকে ৭-৮ শতাংশ সুদে ঋণ দিলেও এটি ব্যাংকের জন্য লাভজনক। এতে এই টাকা আবার একটি নির্দিষ্ট সময় চলে আসবে। ব্যাংকের জন্য ঝুঁকি কম। ব্যক্তি খাতে ঋণ দিলে অনেক সময় খেলাপি হয়। তবে ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে আগ্রহী হলেও বেসরকারি খাতে প্রভাব পড়বে। রাজস্ব আয় পরোক্ষ করের ওপর জোর দেয়া হয়েছে বেশি। এমন যদি হয় বাইরের দেশে ডলারের দাম কমে যায় এবং জিনিসপত্রের দাম কমে যায়, তাহলে দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়বে না। তবে এ বছর দেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে কম, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বেশি। এই মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণ ডলারসংকট। এযাবৎকালে এ রকম ডলারসংকট দেখা যায়নি বাংলাদেশে। ১৯৮৭-৮৯ সালে এ রকম ডলারসংকট দেখা দিয়েছিল। ফলে সার্বিক দিক বিবেচনা করলে এটি সময় উপযোগী বাজেট হয়নি।


সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা কমানো উচিত

সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

এ বাজেট গতানুগতিক বাজেট। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ বাজেট দিয়ে অর্থনীতির অস্থিরতা রোধ করা সম্ভব হবে না। এ সময়ের জন্য একটি বাস্তবধর্মী বাজেট হওয়া দরকার ছিল। রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত নয়। ফলে সামগ্রিকভাবে এ বাজেট দিয়ে অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আনা সম্ভব নয়। এবারের বাজেটে আগের চেয়ে সরকার ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ আগামী অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হবে বেসরকারি খাত। এটি অযোক্তিক।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। গত ১০ মাসের নিট বিক্রি নেগেটিভ। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙার পরিমাণ বেশি। সরকারের কোষাগার থেকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে। বিভিন্ন বিধিনিষেধ বাড়ানো এবং আরোপ করার কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সামাজিক সুরক্ষা বিবেচনায় এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হয়নি। কারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর নির্ভর করে সংসার চালিয়ে থাকেন। নানা রকমের বিধি আরোপ করার কারণে সুদ কমে গেছে।

আর সুদের টাকা বেশি দিলেও তো মানুষের জন্যই তো এ ব্যয়। তাই সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা কমিয়ে আনা উচিত। ব্যাংকনির্ভরতা বাড়ালে সমস্যা দেখা দেবে। বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ পেলেও ছোট ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবেন না। কারণ ব্যাংকে এক ধরনের তারল্যসংকট তৈরি হবে।

অর্থনীতিতে নানা রকমের ইন্ডিকেটর রয়েছে। সেই ইন্ডিকেটর মোতাবেক একটি সূচক আরেকটি সূচকের ওপর নির্ভর করে। ফলে সামষ্টিকভাবে পর্যালোচনা করলে এই বাজেট বাস্তবসম্মত নয়।


গাছ কেটে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সম্প্রতি সাতমসজিদ রোড এলাকার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে সড়ক বিভাজন তৈরি করতে গিয়ে সেখানে গাড়ির চাপ ও যানজট বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন গাছ কাটার প্রতিবাদ জানালেও জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া গাছ কাটার প্রক্রিয়া কয়েক মাস বন্ধ রাখার পর গত ৮ মে থেকে রাতের আঁধারে আবার চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এলাকার বট, বরই, বকুল, কৃষ্ণচূড়া শিরীষগাছসহ ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম এলাকার পাখি, পতঙ্গ ও সরীসৃপের মতো জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া প্রকৃতির এসব অনুষঙ্গ দীর্ঘকাল এলাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, যা ধ্বংস না করেই সেখানকার সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন সম্ভব ছিল বলে অভিমত পরিবেশবাদী সংগঠনের। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রখ্যাত পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিকল্পনা কার্যকর করতে গাছ কাটার মহোৎসবের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে কিছুদিন আগে। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’ নামের এক প্রকল্পের আওতায় নাকি সহস্রাধিক গাছও কেটে ফেলা হয়েছে! নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যে নানা প্রজাতির প্রাণী ও পাখির বিচরণ ছিল, বৃক্ষ নিধনের ফলে তা হুমকির মুখে পড়বে বলে পরিবেশবিদদের অভিমত। মানুষের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে নগরায়ণ আর উন্নয়নকাজে গাছ কাটার প্রয়োজন হতেই পারে। তবে তা কখনো প্রকৃতিকে ধ্বংস করে হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নগরায়ণ কার্যক্রমকে সফল করতে বিভিন্ন অঞ্চলে কাছ কাটা হয়েছে। বিশেষ করে মানুষের লোভের কবলে পড়ে দেশে নির্বিচারে নানা প্রজাতির গাছপালা নিধন করা হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে। একটি অসাধু চক্র উন্নত প্রজাতির পুরোনো গাছ কেটে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে মুনাফা লুটেছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের কারণেও বিনষ্ট হচ্ছে বিপুল বনসম্পদ, বিপন্ন হয়েছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ।

জীববৈচিত্র্য রক্ষার লক্ষ্যে গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বহুবার। এই আদেশবলে কোনোক্রমেই বনভূমি থেকে কোনো গাছ কাটা যাবে না। এমনকি ঝড়ের কবলে অথবা মড়কে আক্রান্ত হয়ে বনাঞ্চলে যেসব গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, সেগুলোও কেউ সংগ্রহে নিতে পারার কথা নয়। কিন্তু কোনো আইনকানুন-বিধিনিষেধ আরোপ করেও বৃক্ষনিধন বন্ধ করা যায়নি। লুকিয়ে নয়, প্রকাশ্যে, লোকচক্ষুর সামনেই চলছে গাছ কাটার মহাযজ্ঞ।

সারা দেশে এমনই বৃক্ষ নিধনের মহাযজ্ঞে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতীক পাহাড় কাটার পাশাপাশি পাহাড়ের বন উজাড় ও বৃক্ষ নিধনের ফলে জীববৈচিত্র্য হচ্ছে হুমকির সম্মুখীন, বন্য প্রাণী হারাচ্ছে আবাসস্থল। প্রকৃতি হয়ে পড়ছে ভারসাম্যহীন। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হিসাবমতে, বাংলাদেশে বর্তমান বনভূমির পরিমাণ ১১ দশমিক ২ শতাংশ, যা বিশ্বের কম বনাঞ্চলের দেশ হিসেবে এশিয়ায় অবস্থান তৃতীয়। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সময় দেশে যে আয়তনের বনাঞ্চল ছিল, এখন তার অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বৃক্ষ এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। দেশে বর্তমানে মোট ভূমির পরিমাণ ১ কোটি ৪০ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে ১২ লাখ হেক্টর রয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯০ সাল থেকে ১০ বছর মেয়াদে সংরক্ষিত বনে গাছ কাটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর বেশ কয়েকবার এর মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় বৃক্ষ কাটা থেমে থাকেনি। ভাওয়াল গড়, মধুপুর গড় দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। একসময় বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ বনভূমি কেটে ফেলে আবাসস্থল তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু এর বিপরীতে নতুন করে অধিক পরিমাণ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়নি বহুকাল ধরে। উপরন্তু দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অবিরাম চলছে নগর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। মানুষের নিত্যনতুন চাহিদা মেটাতে তৈরি হতে থাকে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা। আর এসব করতে গিয়ে কেটে ফেলা হয় প্রচুর পরিমাণ গাছপালা।

প্রাকৃতিক নিয়মেই উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়ে গঠিত জীববৈচিত্র্য অপরের সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকে। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিতভাবে অবদান রাখে। বাংলাদেশের পাহাড় অঞ্চল, সমতল ভূমি এবং উপকূলীয় এলাকার সামান্য বনাঞ্চল, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড় এলাকার বনের কিছু গর্জন, সেগুন, জারুল এবং গামারিজাতীয় বৃক্ষ, দিনাজপুর, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের বনাঞ্চলের গাছপালা প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় অনেকটা সহায়তা করছে। বাংলাদেশের অহংকার তথা বিশ্বের প্রধান ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির গাছের ১০৬টির অস্তিত্ব ইতিমধ্যে বিলুপ্তপ্রায়। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমে খুলনা ও পটুয়াখালীজুড়ে অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন দীর্ঘকাল ধরে দেশের জীববৈচিত্র্য তথা পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রেখে চলেছে। প্রায় ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশের মোট বনভূমির প্রায় ৪৪ শতাংশজুড়ে এ বনের সুন্দরী, গেওয়া এবং কেওড়াগাছ রয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় সুন্দরবনের বিপুল পরিমাণ গাছপালা ও পশুপাখির ভূমিকা অপরিসীম। কারণ উপকূলীয় বনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে বাতাসে আর্দ্র থাকে। বনভূমি যেকোনো উৎস থেকে আসা পানিপ্রবাহের চাপ কমায় এবং ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস থেকে দেশের মাটিকে রক্ষা করে। অধিকন্তু গাছপালা বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ কমিয়ে দিয়ে বাতাসে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে এবং বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়। ঝড়ঝঞ্জা, সাইক্লোন, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে। বাংলাদেশের ওপর স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলো দেশের বিভিন্ন স্থানসহ উপকূলীয় এলাকার বিশাল একটি অংশ লণ্ডভণ্ড করে দেয়। বিশেষ করে দেশের অমূল্য সম্পদ সুন্দরবন উপকূলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকার বন বিনষ্ট হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে সুন্দরবনের অবস্থানের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বিশাল জনবসতি এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। সুন্দরবনই ঝড়ের গতিবেগ রোধ করে ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ প্রকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করেছে। বাঁচিয়েছে উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য মানুষকে।

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে বনভূমি উজাড়, বন্য প্রাণীর বিলুপ্তিসহ অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পকারখানার দূষণকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এটি অনস্বীকার্য যে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়ে দেশের পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করতে অধিকতর বনাঞ্চল সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক। এ ক্ষেত্রে উপকূলীয় বনায়নেরও কোনো বিকল্প নেই। দেশের অরক্ষিত বিশাল চরাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বনাঞ্চল সৃষ্টি করে সবুজবেষ্টনী গড়ে তোলা জরুরি। উপকূলীয় বনভূমি সুরক্ষাসহ উপকূলীয় এলাকায় নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি জোরদার করা হলে তা ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক থেকে দেশকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। পুরোনো বন সংরক্ষণ, নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি এবং সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করে দেশের বনভূমিকে আশাব্যঞ্জক পর্যায়ে উন্নীত করা অবশ্যই সম্ভব। পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়কে গুরুত্ব যতদূর সম্ভব গাছপালা, বনভূমি উজাড় না করে উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলমান রাখা জরুরি। উন্নয়নের পথে অগ্রসরমাণ বাংলাদেশের পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করে উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে বন্ধ করতে হবে বৃক্ষ নিধন। গাছ কাটা একটি আইনগত অপরাধ। রাজধানী ঢাকায় ইমারত নির্মাণ, সড়কসহ নানা ধরনের নগর অবকাঠামো তৈরির প্রক্রিয়ার ফাঁদে গাছপালা, জলাধার রক্ষা ব্যাপারটি উপেক্ষিত থাকার ফলাফল ইতিমধ্যেই টের পাওয়া গেছে।

পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়ার আগেই বৃক্ষ নিধন, জলাধার ভরাট বন্ধ করে এক বাসযোগ্য নগরী গড়ে তুলতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আগামীতে রাজধানীসহ দেশের যেকোনো অঞ্চলে গাছ কাটা বন্ধসহ পরিবেশ রক্ষায় দেশের প্রত্যেক মানুষকে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী


বাজেট ২০২৩-২৪: একটি তাৎক্ষণিক পর্যালোচনা

এম এ খালেক
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এম এ খালেক

একাদশ জাতীয় সংসদের সর্বশেষ বাজেট অধিবেশনে গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি হচ্ছে সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট। এই বাজেট বাস্তবায়নকালেই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কাজেই এবারের বাজেট নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এটি হচ্ছে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উপস্থাপিত পঞ্চম জাতীয় বাজেট এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩তম বাজেট। এর মধ্যে ৫২টি পূর্ণাঙ্গ বাজেট এবং একটি ছিল খণ্ডিত বা আংশিক সময়ের জন্য বাজেট। এর মধ্যে আজকে যে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে সেটিসহ আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বিভিন্ন সময় সর্বাধিক ২৫টি বাজেট উপস্থাপন করছে। বিএনপি আমলে বিভিন্ন সময় মোট ১৭টি বাজেট উপস্থাপন করা হয়। আর সেনাশাসক এরশাদ আমলে মোট ৯টি বাজেট প্রণীত হয়। বাংলাদেশে সর্বাধিক ১২টি করে বাজেট প্রণয়ন করেন বিএনপি-দলীয় অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও আওয়ামী লীগ-দলীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য প্রথম বাজেট প্রণয়ন করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সেই বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য যে বাজেট বর্তমানে বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে, তার আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।

আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেট আজ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার সার্বিক আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রস্তাবিত বাজেট চরিত্রগত দিক থেকে সম্প্রসারণমূলক বাজেট। বাজেটে রাজস্বপ্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশের মতো। মোট রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে রাজস্ব আসবে ৪ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করার জন্য আগামী বাজেট বাস্তবায়নকালে বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের যে অবস্থা তাতে বাড়তি ৪৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা বেশ কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে। উল্লেখ্য, অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে। কাজেই আগামী অর্থবছরের জন্য এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা সংশয় প্রকাশ করছেন। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত সূত্র থেকে সরকার ঋণ গ্রহণ করবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণ পাওয়া যাবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জন্য যে বাজেট প্রস্তাবনা জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা এমন একসময় প্রণয়ন করা হয়েছে যখন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। এখনো বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার শুরু হয়নি। তবে যেকোনো সময় মন্দা দেখা দিতে পারে। নানা ধরনের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি স্তিমিত হয়ে পড়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি এখনো তিন বছর ধরে চলা করোনা অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে ২০২২ সালের সূচনালগ্নে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যে এতটা দীর্ঘমেয়াদি হবে, তা অনেকেই অনুধাবন করতে পারেননি। বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব হয়েছে অতি ভয়ংকর। ফলে এক দেশের অর্থনীতিতে সংকট সৃষ্টি হলে তার প্রভাব অন্য দেশের ওপরও পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়েছে তার প্রভাব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পড়েছে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রচণ্ডভাবে পড়েছে। অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই নিম্নমুখী রয়েছে। অর্থবছরের সমাপ্ত হওয়া ১০ মাসের অর্থনীতির যে চিত্র তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। একমাত্র রেমিট্যান্স ও পণ্য রপ্তানি খাতের আয় কিছুটা ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। অবশিষ্ট প্রায় সব খাতের অবস্থাই এখন অত্যন্ত খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। কথায় বলে, উচ্চ রিজার্ভ এবং ব্যক্তি খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ একটি দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অবস্থা। এমনকি তুলনামূলক কম স্ফীত রিজার্ভ এবং ব্যক্তি খাতে উচ্চমাত্রায় বিনিয়োগও কাম্য হতে পারে। কিন্তু বিনিয়োগবিহীন রিজার্ভ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যক্তিবিনিয়োগ এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ উভয়ই নিম্নমুখী রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপির ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল ২৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। পরবর্তী তিন অর্থবছরে এটি ছিল যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ ও ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ানো না গেলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পেতে পেতে গত মে মাসে ৩ হাজার ১৭ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। অথচ জুলাই, ২০২২-এ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৯৫৯ কোটি ডলার। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে পরিসংখ্যান প্রদান করে আইএমএফ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা তার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে পরিমাণ প্রদর্শন করে তার মধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ডে দেয়া ৭ বিলিয়ন ডলারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু যে অর্থ আমার হাতে নেই তাকে কোনোভাবেই রিজার্ভ অর্থ হিসেবে প্রদর্শনের সুযোগ নেই। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমার কারণে সরকারকে তার উন্নয়ন ব্যয় মেটানোর জন্য ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। সরকার যদি ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণ করে, তাহলে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক-ঋণপ্রবাহ নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে। বিনিয়োগ কার্যক্রম ব্যাহত হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে ৭৯ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) সরকারের ব্যাংকঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে সরকার ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকাসহ অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে মোট ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করবে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করবে। চলমান মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। গত আগস্টে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ শিল্প ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমেছে ৫৬ শতাংশ। আর মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ৩১ শতাংশ। কাঁচামাল আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ শিল্প খাতে এক ধরনের স্থবিরতা রিরাজ করছে। কিন্তু ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি সেই হারে কমছে না। তার অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণ নিয়ে একটি মহল অন্যত্র প্রবাহিত করছে। এমনকি বিদেশে পাচার করছে বলে অনেকেই মনে করেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অস্বাভাবিক উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি। আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। এপ্রিলে এসে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো, এমনকি ভারতও তাদের উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্য প্রদর্শন করতে পারছে না। এই অবস্থায় আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়ে দিয়ে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত এক বছরে অন্তত তিনবার পলিসি রেট বাড়িয়েছে। আগে পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ, এখন তা ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু পলিসি রেট বাড়ানোর এই উদ্যোগ বাজারে অর্থ সরবরাহ কমানোর ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বাড়ালেও ব্যাংকঋণের সুদের আপার ক্যাপ (৯ শতাংশ) প্রত্যাহার করেনি। ফলে ব্যাংকঋণ গ্রহণ করা এখন আরও সহজ এবং সস্তা হয়েছে।

আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এই হার খুব একটা উচ্চাভিলাষী বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ উচ্চমাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের সাময়িক হিসাব অনুসারে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কমিয়ে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে সাড়ে ৬ শতাংশের কাছাকাছি। তবে এই মুহূর্তে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাজেটে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বল্পমূল্যে খাবার জোগানসহ নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিধি বাড়ানো হয়েছে।

নিকট-অতীতে কখনোই সরকার রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে তেমন একটা সাফল্য প্রদর্শন করতে পারেনি। তাই রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অথচ নেপালের মতো দেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে ২৩ শতাংশ। কাজেই আমাদের এ ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে হবে। আগামী অর্থবছরে ট্যাক্স আদায় বৃদ্ধির জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেয়া হলেও এই সুযোগ কেউ গ্রহণ করেননি। তাই আগামী অর্থবছরে এই সুযোগ আর থাকছে না। এটি খুব ভালো একটি উদ্যোগ। কারণ পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার সুযোগ দিলেও খুব বেশিসংখ্যক মানুষ এই সুযোগ গ্রহণ করেনি। এ ছাড়া টাকা পাচারকারীদের শাস্তিদানের পরিবর্তে সামান্য ট্যাক্স প্রদানের বিনিময়ে অবৈধ অর্থ দেশে ফেরত আনতে দেয়াটা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, করমুক্ত আয় পুরুষদের ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ লাখ টাকা এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৪ লাখ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। আগামী অর্থবছর থেকেই সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা হবে। যারা টিআইএনধারী, তারা রিটার্ন দাখিল করলেই ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

বিষয়:

কাবাঘর নির্মাণের ইতিহাস এবং তার মাহাত্ম্য

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোহাম্মদ হাননান

দুনিয়ার সপ্তম আশ্চর্যের যারা আবিষ্কারকর্তা, তারা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ঘর কাবাকে এ তালিকায় স্থান দেননি। বস্তুত কাবাঘরের সৌন্দর্যও অপরূপ রূপের, যা হাজার হাজার বছর ধরে দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে মানুষকে আকর্ষণ করে রেখেছে। প্রতিটি বছর আর কোনো স্থাপনাকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি মানুষের আবর্তনের ঘটনা দুনিয়ায় আর একটিও নেই।

এ ঘরের অনেক নাম রয়েছে। প্রথমত কাবা, যার অর্থ ‘সম্মুখ’ বা ‘সামনে’। আর একটি রয়েছে বায়তুল্লাহ, এর অর্থ আল্লাহর ঘর। একে হারাম শরিফও বলা হয়। কারণ এখানে যেকোনো প্রকার গুনাহ এবং যাবতীয় নাজায়েজ কাজ হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঝগড়া-বিবাদ, যুদ্ধও এখানে নিষেধ।

ইবনে কাসির হাদিস শরিফ বায়হাকির উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, ‘আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া দুনিয়ায় আগমনের পর আল্লাহতাআলা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে তাদের কাবাঘর নির্মাণের আদেশ দেন। ঘর নির্মিত হয়ে গেলে তাদের তা তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করার নির্দেশ দেয়া হয়।’ এ সময় আল্লাহ দুনিয়ার প্রথম নবী আদম (আ.)-কে বলেন, ‘হে আদম আপনি দুনিয়ার প্রথম মানুষ এবং এ গৃহ মানবজাতির জন্য প্রথম ঘর।’ (তাফসির ইবনে কাসির)।

মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলবি তার কিতাবে এ ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেন, আল্লাহতাআলা যখন আদম (আ.)-কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় নামিয়েছেন, তখন তার সঙ্গে আল্লাহ তার নিজের ঘরও নামিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘হে আদম, আমি আপনার সঙ্গে আমার নিজের ঘরও নামাচ্ছি। দুনিয়ায় এর তাওয়াফ করা হবে, যেমনটা আমার আরশে এর তাওয়াফ করা হয় এবং এর দিকে ফিরে এমনভাবে নামাজ পড়া হবে যেমন আমার আরশের দিকে ফিরে নামাজ পড়া হয়ে থাকে।’ (ফাজায়েলে হজ, অনুবাদ: মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের, দ্বীনি প্রকাশনী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ১৪৪০ হিজরি, পৃষ্ঠা ৮)।

কাবাঘরের এ স্থাপনা হজরত নূহ (আ.)-এর যুগ পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। কিন্তু নূহের যুগে যে মহাপ্লাবন সংঘটিত হয়, তাতে কাবাঘরের এ স্থাপনাও বিধ্বস্ত হয়। পরে হজরত ইব্রাহিম (আ.) প্রাচীন ভিত্তির ওপরই এ গৃহ পুনর্নির্মাণ করেন। মুফতি শাফি (র.) তার পবিত্র কোরআন তাফসির কিতাবে লিখেছেন, ‘ইব্রাহিম (আ.) এবং ইসমাইল (আ.) কাবার প্রাথমিক ভিত নির্মাণ করেননি, বরং আগের ভিতের ওপরই কাবাঘর পুনর্গঠন করেন।’ (পবিত্র কোরআনুল করিম, মুফতি শাফি (র.) তাকসিরকৃত, কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, মদিনা, ১৪১৩ হি. পৃষ্ঠা ১৮৮)। সুরা হজেও উল্লিখিত হয়েছে, ‘যখন আমি ইব্রাহিমের জন্য কাবাঘরের স্থান ঠিক করে দিলাম।’ (সুরা হজ, আয়াত : ২৬)। এ থেকে আলেমরা সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে, কাবাঘরের জায়গা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। কোনো কোনো কিতাবে বলা হয়েছে, ইবারাহিম (আ.)-কে কাবাঘর নির্মাণের আদেশ দেয়ার পর ফেরেশতাদের মাধ্যমে বালুর স্তূপের নিচে পড়ে থাকা কাবাঘরের পূর্বের ভিতকে চিহ্নিত করে দেয়া হয়।

পরবর্তীকালে এক দুর্ঘটনায় প্রাচীর ধসে গেলে কাবার পাশে বসবাসকারী জুরহাম গোত্রের লোকেরা একে পুনর্নির্মাণ করেন। এভাবে কয়েকবার বিধ্বস্ত হওয়ার পর একবার আমালেকা সম্প্রদায় ও একবার কোরাইশরা এ গৃহ নির্মাণ করে। সর্বশেষ এ নির্মাণে মহানবী (সা.)-ও শরিক ছিলেন এবং তিনিই ‘হাজরে-আসাওয়াদ’ স্থাপন করেছিলেন।

কিন্তু ইসলাম-পূর্ব যুগে কোরাইশদের এ নির্মাণের ফলে ইব্রাহিম (আ.)-এর মূল ভিত্তি সামান্য পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রথমত, একটি অংশ এর ‘হাতিম’ কাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, ইব্রাহিম (আ.)-এর নির্মাণে কাবা গৃহের দরজা ছিল দুটি, একটি প্রবেশের জন্য এবং অন্যটি পশ্চাৎমুখী হয়ে বের হওয়ার জন্য। কিন্তু কোরাইশরা শুধু পূর্ব দিকে একটি দরজা রাখে। তৃতীয়ত, তারা সমতল ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে দরজা নির্মাণ করে, যাতে সবাই সহজে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। বরং তারা যাকে অনুমতি দেয়, সে-ই যেন প্রবেশ করতে পারে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার হজরত আয়েশা (রা.)-কে বলেন, ‘আমার ইচ্ছা হয়, কাবাগৃহের বর্তমান নির্মাণ ভেঙে দিয়ে ইব্রাহিমের নির্মাণের অনুরূপ করে দিই। কিন্তু কাবা গৃহ ভেঙে দিলে নতুন মুসলিমদের মনে ভুল-বোঝাবুঝি দেখা দেয়ার আশঙ্কার কথা চিন্তা করেই বর্তমান অবস্থা বহাল রাখছি।’ হজরত আয়েশা রাজিয়াল্লাহু আনহার ভাগ্নে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) মহানবী (সা.)-এর উপরোক্ত ইচ্ছা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদিনের পর যখন মক্কার ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি ওপরে ওই ইচ্ছাটি কার্যে পরিণত করেন এবং কাবাঘরের নির্মাণ ইব্রাহিম (আ.)-এর নির্মাণের অনুরূপ করে দেন। মাওলানা আমিনুল ইসলাম তার তাফসির কিতাবে আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়েরের এ সংস্কারকাজ ৬৪ হিজরির ২৭ রমজানে শেষ হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। (তাফসিরে নূরুল কোরআন, আলবালাগ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পঞ্চম মুদ্রণ, ২০১২, পৃষ্ঠা ৪৪৫)।

কিন্তু হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর ইসলাম-পূর্ব জাহেলিয়াত আমলের কোরাইশরা যেভাবে নির্মাণ করেছিল, সেভাবেই পুনর্নির্মাণ করেন। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের পর কোনো কোনো বাদশাহ উল্লিখিত হাদিস অনুযায়ী কাবাঘরকে ভেঙে আবার নির্মাণ করার ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন ইমাম হজরত মালেক ইবনে আনাস (রা.) ফতোয়া দেন যে, ‘এভাবে কাবাঘরের ভাঙাগড়া অব্যাহত থাকলে পরবর্তী বাদশাহদের জন্য একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়ে যাবে এবং কাবাঘর তাদের হাতে একটি খেলনায় পরিণত হবে। কাজেই বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে, সে অবস্থায়ই থাকতে দেয়া উচিত।’ গোটা মুসলিম সমাজ তার এ ফতোয়া গ্রহণ করে নেয়। তবে মেরামতের প্রয়োজনে ছোটখাটো কাজ সব সময়ই অব্যাহত থাকে। মাওলানা আমিনুল ইসলাম তার তাফসির কিতাবে লিখেছেন, ‘কোশাই বিন কিলাব নামে একজন কাবাঘরের সংস্কার করেছিলেন এবং তিনি প্রথম কাবাঘরকে গিলাফ দ্বারা আবৃত করেন।’ (তাফসিরে নূরুল কোরআন, প্রথম খণ্ড, আলবালাগ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পঞ্চম মুদ্রণ, ২০১২, পৃষ্ঠা ৪৪৪)।

কাবাঘর বানানোর পর আল্লাহতাআলা এ ঘর এবং এ ঘরের চারপাশকে ‘নিরাপদ’ বলে ঘোষণা করেন:

১. ‘ওরা কি দেখে না আমি কাবাঘরের চারপাশ যা হারাম শরিফ বলে পরিচিত, তাকে নিরাপদ বলে ঘোষণা করেছি।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৬৭)।

২. ইব্রাহিম (আ.)-ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ, মক্কাকে নিরাপদ শহর করে দিন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১২৬)।

৩. ‘যে কেউ কাবাঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ।’ (সুরা আল-ই-ইমরান, আয়াত: ৯৬-৯৭)।

৪. ‘মসজিদ-উল-হাবামের কাছে (কাবার কাছে) যুদ্ধ করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯১)।

৫. ‘আমার ঘরকে পবিত্র রেখো।’ (সুরা হজ, আয়াত: ২৬)।

৬. ‘আমি কাবাঘরকে মানুষের মিলনক্ষেত্র ও আশ্রয়স্থল হিসেবে তৈরি করেছি।’ [সুরা বাকারা, আয়াত: ১২৫)।

তাই কাবাঘর হলো দুনিয়ার মধ্যে একটি বিশেষ নিরাপদ স্থান। দুনিয়ায় এ রকম আরেকটি দৃষ্টান্তও নেই। এটি ইমানদারদের জন্য একটি মিলনক্ষেত্র এবং আশ্রয়স্থলও। তবে যারা অবিশ্বাসী, ইমানহীন এবং আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে, আল্লাহর অংশীদার বানায়, তারা কাবাঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। (সুরা তওবা, আয়াত: ২৮)।

লেখক: গবেষক ও ইতিহাসবিদ


banner close