আজ ১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সম্মুখ সমর অনুষ্ঠিত হয় এই দিবসে। পৃথিবীতে ইসলাম থাকবে কি থাকবে না- এ ফয়সালা হয় বদরের রণাঙ্গনে ঐতিহাসিক এক যুদ্ধের মাধ্যমে। জেহালতের তিমিরাচ্ছন্নতার অবসান ঘটিয়ে একত্ববাদের ঝাণ্ডা নিয়ে শান্তি ও সফলতার চাদরে আচ্ছন্ন ঐশী নূরের আলোকে জগদ্বাসীর জন্য ইসলামের মতো মহান পবিত্র নেয়ামতের সুশীতল ঝর্ণাধারা প্রবহমান থাকার বিষয়টি সুনিশ্চিত হয়েছিল বদরের প্রাঙ্গণ থেকেই; এ জন্যই মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। পবিত্র কোরআনে তাই মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বদর দিবসকে ‘য়াওমুল ফুরকান’ তথা সত্য-মিথ্যার প্রভেদকারী দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বস্তুত মহানবী (সা.) যুদ্ধপ্রবণ মানুষ ছিলেন না। কিন্তু তৎকালীন অমুসলিম শক্তির নানামুখী ষড়যন্ত্র, নির্যাতন আর ইসলামকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়ার অপপ্রয়াসের মোকাবিলায় রাসুলে পাক (সা.)-এর হাতে যুদ্ধ ব্যতীত আর কোনো বিকল্প ছিল না। তাওহিদ ও রেসালতের প্রতি আনুগত্যকারী মোহাজের ও আনসারগণের সমন্বয়ে অসম সাহসী সাহাবায়ে কেরামের এক প্রত্যয়-দীপ্ত বাহিনী বিশ্বনবীর (সা.) নেতৃত্বে নজিরবিহীন বীরত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন বদরের প্রান্তরে। মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গী হয়েছিল মহান আল্লাহপাক প্রদত্ত রহমত, মদদ ও সুসংবাদ-সংবলিত বার্তাবলির অমোঘ শক্তিমত্তা। পবিত্র কোরআনের সুরা আলে ইমরানে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন, ‘ওয়ালাকাদ নাসারাকুমুল্লাহু বিবাদরিন ওয়া আন্তুম আযিল্লা’ অর্থাৎ সুনিশ্চিতভাবেই মহান আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে, যেখানে তোমরা ছিলে ক্ষীণ-শক্তির দুর্বল এক পক্ষ। মূলত মুসলমানদের সংখ্যা, যুদ্ধাস্ত্র, সমর উপরণাদি, শক্তিমত্তা ও সমর-কৌশলের চাইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো মহান প্রভুর সাহায্য ও রহমতের বিষয়; যার ওপর প্রতিটি মুমিন সর্বাবস্থায় ভরসা করবে, নির্ভরতা পাবে। আল্লাহপাক সেজন্যই বলেছেন, ‘ওয়া কানা হাক্কান আলাইনা নাসরুল মুমিনিন’ অর্থাৎ মোমেনদের সহযোগিতা প্রদান করা আমি আল্লাহর জন্য অবশ্য কর্তব্য।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের ১ বছর ৬ মাস ২৭ দিনের মাথায় মদিনা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৮০ মাইল দূরত্বে অনুষ্ঠিত হয় বদরের যুদ্ধ; দিনটি ছিল ২য় হিজরির ১৭ রমজান শুক্রবার। পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, মুসলিম বাহিনীর চাইতে অমুসলিম বাহিনীর সৈন্য-সংখ্যাই ছিল প্রায় তিন গুণ; অমুসলিমদের অন্যান্য রসদ ও উপকরণাদি ছিল আরও বেশি। অমুসলিম সৈন্য-সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও অধিক, সঙ্গে ছিল ১০০ ঘোড়া, শতাধিক উঠ, ছয় শতাধিক লৌহবর্মসহ অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র। পক্ষান্তরে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, সঙ্গে যুক্ত ছিল ৭০টি উঠ ও মাত্র দুটি ঘোড়া; কিন্তু মুসলমানদের ছিল বিশ্বমানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্ব এবং মহান আল্লাহর সাহায্য। এই অসম যুদ্ধে কল্পনাতীত পরাজয় বরণ করে মহাসত্য অস্বীকারকারী কুফর প্রতিপক্ষ এবং অবিশ্বাস্য বিজয় লাভ করেন একত্ববাদের পতাকাবাহী আল্লাহপাকের অনুগত মজলুম বান্দারা। কুফরি শক্তির ৭০ জন হত্যার শিকার হয়, ৭০ জন মুসলমানদের হাতে বন্দি হয় এবং মানবেতিহাসে রচিত হয় মাআজ ও মোআওয়াজ নামের প্রত্যয়-দীপ্ত দুই কিশোর সহোদরের এক অতুলনীয় বীরত্বগাথা! যেই কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কাফেরদের সবচাইতে প্রভাবশালী নেতা আবু জেহেলের মৃত্যু; বদরের প্রান্তরে এই একটি হত্যাকাণ্ড ইসলামের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা অধিক তাৎপর্যের দাবি রাখে। কেননা ইসলামকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়া ও মহানবী (সা.)-কে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় করে দেয়ার জন্যে সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালিয়েছে এই নিকৃষ্ট মানব আবু জেহেল। ইসলামের প্রথম যুদ্ধেই উপরিউক্ত দুই কিশোরের হাতে তার জীবনাবসান ঘটে। ফলে ইসলাম এক দুর্ধর্ষ, চতুর ও অমানবিক পাষণ্ডের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পায়। মাক্কি জীবনে রাসুল (সা.)-এর একান্ত অনুগত হাবশি বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ হজরত বেলালের সঙ্গে অমানবিক নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন ও নির্মম নির্যাতন করেছিল তার মুনিব উমাইয়া ইবন খাল্ফ; বদরের রণাঙ্গনে এই পাষণ্ড উমাইয়া তারই দাস নিপীড়িত ও মাজলুম হজরত বেলাল (রা.)-এর হাতেই নিহত হয়। হজরত উমর (রা.)-এর হাতে নিহত হয় তার আপন মামা; এভাবেই বদরের প্রান্তরে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব থেকে শুরু করে অংশগ্রহণকারী সদস্য পর্যন্ত সকলেই মহান প্রভুর সন্তুষ্টি বিধান, নবপ্রবর্তিত ইসলামের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা এবং তাদের প্রাণাধিক প্রিয় রাসুলে আকরাম (সা.)-এর নির্দেশনা বাস্তবায়নে নজিরবিহীন আনুগত্য ও বীরত্বের পরিচয় দেন।
নব-প্রবর্তিত ইসলাম, মহানবী (সা.) ও মহান আল্লাহপাকের জন্য জীবন উৎসর্গকারী কিছু মকবুল মানুষের বিশ্বাস, কর্তব্য-নিষ্ঠা ও প্রতিশ্রুতির বিস্ময়কর মঞ্চায়ন ঘটেছিল বদরের যুদ্ধে। ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষার এ মরণপণ যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দেন নবিজির চাচা আমির হামজা (রা.), হজরত আলী (রা.) ও হজরত উবায়দা বিন হারেস (রা.)। যুদ্ধের সূচনাপর্বে ব্যক্তি-পর্যায়ে এই তিনজন বীর সেনানীকে মোকাবিলা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল প্রতিপক্ষের শায়বা, ওয়ালিদ ও ওতবা; ইসলামের মহান তিন বীর প্রচণ্ড বিক্রমে এদের তিনজনকে শুরুতেই হত্যা করেন। এরপরই শুরু হয়ে যায় সর্বাত্মক যুদ্ধ; মহানবী (সা.) মুসলিম বাহিনীকে অমিত বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তেজোদীপ্ত, উজ্জীবিত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই কুফর বাহিনীর মধ্যে চরম হতাশা, নৈরাশ্য ও পরাজয়ের লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে; তারা আর কোনোভাবেই টিকে থাকার শক্তি, সাহস ও রসদ খুঁজে পাচ্ছিল না। অবশেষে যুদ্ধের পরিণাম আরও স্পষ্টতর হয়ে যায়, একপর্যায়ে সম্মিলিত কুফর বাহিনী করুণ পরিণতি বরণ করে; এর ফলশ্রুতিতে শুধু মক্কা-মদিনাতেই নয় বরং সমগ্র আরব উপদ্বীপে ইসলাম এক নতুন অভিনব শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং মুসলমানদের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বলতর হয়, যা থেকে পরবর্তীতে তারা অধিকতর উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণামূলক অফুরান শক্তি লাভ করেন। মহান আল্লাহ ভবিষ্যতের জন্য তাওহিদবাদীদের এ যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সুরা আল ইমরানে সুসংবাদ দেন যে, ‘বরং তোমরা যদি সবর এখতিয়ার করো, মহান আল্লাহকে ভয় করার নীতি অবলম্বন করে চলো, তবে বিপক্ষ শক্তি তোমাদের ওপর দ্রুত হামলা করলেও আল্লাহপাক তোমাদের ৫ হাজার ফেরেশতার এক সুবিন্যস্ত বাহিনী দ্বারা সহযোগিতা করবেন।’ মহান আল্লাহ প্রদত্ত ফেরেশতা বাহিনীর এই সহযোগিতার কথা সুরা আনফালেও এসেছে, ‘যদি তুমি দেখতে ফেরেশতারা অবিশ্বাসীদের মুখমণ্ডল ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করে তাদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে এবং বলছে যে, তোমরা এবার দহন যন্ত্রণা ভোগ করো।’
যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে মুসলিম বাহিনী তিন দিনের মাথায় মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে মহানবী (সা.) যে সদ্ব্যবহার ও সুন্দর আচরণ করেছিলেন তা মানবেতিহাসের এক অনবদ্য নজির হয়ে আছে। সাহাবায়ে কেরাম বন্দিদের সঙ্গে নবির নির্দেশনা অনুযায়ী সদাচার চালিয়ে যান। ইতিমধ্যে যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে করণীয় বিষয়ে রাসুলের নেতৃত্বে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়; হজরত উমর (রা.) সে বৈঠকে যুদ্ধবন্দি সবাইকে হত্যার পক্ষে মত দেন। অন্যদের মধ্যে বৈঠকে হজরত আবু বকর (রা.) যে বিজ্ঞজনোচিত মতামত প্রদান করেছিলেন, রাসুলে পাকের কাছে তাই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল; সেটি ছিল, মুক্তিপণ নিয়ে বন্দিদের ছেড়ে দেয়া। সে-মতে বৈঠকে মুক্তিপণ দিয়ে যুদ্ধবন্দিরা মুক্ত হতে পারবে, এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাসুল (সা.) ১ থেকে ৪ হাজার দিনার পর্যন্ত মুক্তিপণের অর্থ নির্ধারণ করে দেন। যুদ্ধবন্দিদের মুক্তিপণের ব্যাপারে মহানবী (সা.) তার দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ চিন্তাধারার আলোকে এক শিক্ষাবান্ধব মন-মানসের পরিচয় দিয়েছেন; সেটি হলো, বন্দিদের মধ্যে যারা শিক্ষিত তারা মুক্তিপণ হিসেবে প্রতিজন মদিনার ১০ জন অশিক্ষিত ব্যক্তিকে শিক্ষাদানের শর্ত লাভ করেন। অবশ্য অপরাধীর ধরন ও অবস্থা বিবেচনায় রাসুলে পাক (সা.) বেশ কজন বন্দিকে কোনো প্রকার মুক্তিপণ ব্যতিরেকেই ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন এবং নাদার ইবনে হারিস ও উকবা ইবনে আবু মুআইত নামে দুজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন।
স্বল্পসংখ্যক প্রত্যয়ী, বিশ্বাসী ও আত্মনিবেদিত মানুষ যে বিশাল শত্রুপক্ষের মোকাবিলায় বিজয় লাভে সক্ষম হতে পারে, ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলাম বদরের সিঁড়ি বেয়ে এভাবেই মহান আল্লাহর রহমত ও মদদে অত্যন্ত দ্রুতবেগে সম্মুখ পানে এগিয়ে চলেছিল এবং পরিণত হয়েছিল জগতের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল এক জীবন-বিধান রূপে। আল্লাহপাকের বাণীÑ ‘নাসুরম্ মিনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারিব’ অর্থাৎ আল্লাহর সাহায্য ও তোমাদের বিজয় অত্যাসন্ন, অতি নিকটে; ইতিহাস সাক্ষী, স্বল্পকালের ব্যবধানেই মহান রবের এ ঘোষণার পরিপূর্ণ সফল বাস্তবায়ন জগদ্বাসী প্রত্যক্ষ করেছিল।
আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ‘আল বদর’ নামে একটি বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এ বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালি, বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা নিধনযজ্ঞে সহযোগিতা এবং মহান মুক্তিসংগ্রামে বাঙালির বিজয়কে রুখে দেয়ার হীন উদ্দেশ্যে; কিন্তু ওই দেশদ্রোহীরা বাহিনীর নামটি দিয়েছিল বদরের যুদ্ধের ঐতিহাসিক চেতনাবোধ থেকে। বস্তুত ধর্মের দোহাই দিয়ে এবং ইসলামকে রক্ষার দায়িত্ব পালনের কথা বলে তারা নিজস্ব সমাজ, দেশ, ধর্ম ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিল। ইসলামে ‘দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ’ বিবেচনা করলেও এরা পাকিস্তানপ্রেম দেখাতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে ইসলামেরই ক্ষতিসাধন করেছে। বদরের মতো ইসলামের এক ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ নামকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে গাদ্দারি করেছে; নিঃসন্দেহে ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের স্বার্থান্ধ ও মতলববাজ কার্যকলাপ খোদ ইসলামকেই বিতর্কিত ও হেয়প্রতিপন্ন করার নামান্তর। পৃথিবীর যেখানেই পবিত্র ইসলামকে স্বীয় স্বার্থসিদ্ধি বা গোষ্ঠীগত ফায়দা হাসিলের হাতিয়ার বানিয়ে নেয় এবং যখনই ইসলামকে ধর্ম-ব্যবসার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের অপপ্রয়াস চালায়, মহান আল্লাহ তাদেরই সমুচিত শিক্ষা দিয়ে থাকেন; এটি যেমন একাত্তরে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ঠিক তেমনি সমসাময়িক কালেও দেখতে পাচ্ছি। তাই আমাদের প্রত্যাশা, ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের প্রভাব, গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে আমরা নিজেদের চিন্তা ও কর্মের মধ্য দিয়ে শান্তি, কল্যাণ ও মানবতার ধর্ম ইসলামের মহানত্ব ও মূল্যবোধকে উচ্চকিত করে তুলি।
লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৫ আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবের সূত্র ধরে অন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতার আসার পর বিশেষ একটি পতিত দল এবং এর দোসর প্রতিবেশী দেশে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেশকে অস্থিতিশীল করতে ওঠে পড়ে লেগেছে। কিছুতেই সুবিধা করতে পারছে না বলে শেষ পর্যন্ত ২ লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ জাল নোট দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য জঘন্য খেলায় মেতে উঠেছে। আর এই চক্রান্ত কাতারভিত্তিক একটি সংবাদ মাধ্যমে জানানো হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে এই অপকর্মে সরাসরি মদদ দিচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশটির নিজস্ব মুদ্রা ছাপানোর ব্যবস্থায় নকল মুদ্রা তৈরি করে দিচ্ছে তারা। এছাড়া বাংলাদেশের টাকশালে ব্যবহৃত মেশিন ও যন্ত্রাংশ ওই দেশেই তৈরি। সেই মেশিনও এ কাজে ব্যবহৃত হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে জাল মুদ্রায় ব্যবহৃত কাগজ এবং বাংলাদেশের নোটের কাগজ একই হওয়ায় সন্দেহ আরও বেড়েছে। বিশাল অঙ্কের জাল নোট তৈরিতে সন্দেহভাজনদের মধ্যে আছেন টাকশালে টাকা তৈরির সাবেক ডিজাইনারসহ ওই পতিত দলের কারিগররা। এরা গোয়েন্দাদের তত্ত্বাবধানে লম্বা সময় নিয়ে জাল টাকা ছাপিয়েছে। এ ধরনের নোট নিজস্ব গোপন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের টাকশালে ছাপা নোটের আদলে নিখুতভাবে তৈরি কাগজের জাল টাকাগুলো পার্শ্ববর্তী দেশে তৈরির পর গোয়েন্দারা চোরাই পথে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এরপর বিভিন্ন হাত ঘুরে এগুলো চলে যাচ্ছে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে। জাল নোট তৈরি এবং দেশে পাঠানো চক্রে গোয়েন্দাদের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশে পলাতক নেতার সরাসরি জড়িত। আর দুপক্ষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা চক্রটি নতুন একটি চেইন তৈরি করেছে; সেখানে ডিলার থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সবাই সেই দলের নীতিতে বিশ্বাসী। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জানান, প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার জাল নোট দেশে অনুপ্রবেশের অভিযোগ সত্য হলে এটি অত্যন্ত উদ্বেগনজক। তবে এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের খুব বেশি কিছু করার নেই। সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে। আর সাধারণ মানুষকেও অনেক সচেতন হতে হবে। তিনি আরও বলেন যে বর্তমানে পুরোনো টাকা বাজারে ছাড়া হচ্ছে না, কেবল বাজারে শুধু নতুন টাকা দেওয়া হচ্ছে। এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, বিগত সরকার আমলের রাষ্ট্রীয়ভাবে কাজটি করা হলে বস্তুত এটা ঠেকানো কারও পক্ষে সম্ভব না। কারণ বিগত ১৫ বছরে টাকশালে নিয়োগ পাওয়া বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীই ছিলেন সেই দলের আদর্শের অনুসারী। আর অনেক মেশিনারিজও নেওয়া হয়েছে পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশ থেকে। তিনি উল্লেখ করেন যে, টাকা ডিজাইনের কারিগর, যারা গত এক-দেড় বছরে অবসরে গেছেন; তাদের দ্রুত নজরদারির আওতায় আনা সমীচীন।
উল্লেখ্য যে, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে পার্শ্ববর্তী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার মদদে বিভিন্ন রুটে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ জাল নোট প্রবেশ করানো হচ্ছে। এসব টাকার কাগজ আর বাংলাদেশের নোটে ব্যবহৃত কাগজ একই হওয়ার কারণে খালি চোখে, এমনকি ব্যাংকের যাচাই মেশিনেও এসব জাল নোট চিহ্নিত করা দুরূহ ব্যাপার। আর নিরাপত্তা সুতাসহ হলোগ্রাম প্রিন্ট সবই নিখুঁতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় দেশটির নিজস্ব মুদ্রা ছাপানোর ফ্যাসিলিটিতে এসব নোট প্রিন্ট করা হয়েছে বলে বিশ্বস্ত মাধ্যমে জানা গেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাত এক প্রকারের ধ্বংস করতে এবং বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যক্রমে অর্থায়নের জন্য এসব নকল নোট অত্যন্ত কম মূল্যে দেশের জাল নোট কারবারিদের কাছে বিশেষ ব্যবস্থায় পৌঁছে দিচ্ছেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্ট সদস্যরা।
এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন যে, ব্যাপকভাবে জাল টাকার প্রবাহ অর্থনীতির কয়েকটি ক্ষেত্রে আঘাত হানবে। অনিয়ন্ত্রিত জাল টাকা অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি তৈরি করবে। এছাড়া জনগণের মধ্যে টাকার প্রতি আস্থা কমে গেলে নগদ গ্রহণ ও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জটিলতা দেখা দেবে। ইতোমধ্যে গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানিয়েছে যে, এ পর্যন্ত অনলাইন মাধ্যমে জাল নোট ব্যবসায়ীদের শতাধিক পেজ ও গ্রুপ শনাক্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, নির্বাচন উপলক্ষে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। সে ক্ষেত্রে জাল নোট ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। সঠিক টাকা চেনার বিভিন্ন নমুনা বা আলামত সংবলিত পোস্টার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবিলম্বে টানিয়ে দেওয়া জরুরি। ইতোমধ্যে জাল নোট চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে জাল নোট বেচাকেনার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। চটকদার অফার দিয়ে ক্রেতা আকৃষ্ট করছে সংঘবদ্ধ চক্রটি। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সিক্রেট গ্রুপ তৈরি করে সেখানে ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করছে। এদিকে জাল টাকা বানানোর প্রসিকিউটর (জাল টাকা বানানো শেখানো হয়) নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে জাল নোটের ভিডিও আপলোড করা হয়েছে।
এটি সত্য যে, অর্থনীতির নিয়মানুযায়ী টাকা ছাপালে সেই টাকার বিপরীতে নিরাপত্তা ডিপোজিট থাকে। এ ক্ষেত্রে তা নেই। তাই অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন যে, একটি অর্থনীতি পঙ্গু করতে হলে অর্থনীতিকে অস্থির করে তুলতে জাল টাকাই যথেষ্ট। এতে অসংলগ্ন গ্যালোপিং মূল্যস্ফীতি হয়। অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। আর মানি মার্কেটের ওপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাস থাকে না। দেশের সব অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন খাতের ওপর পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে নেতিবাচক আঘাত হানে। আর এই টাকার পরিমাণ হিসাবের বাইরে থাকে বলে সঠিক পরিকল্পনা নেওয়াও সম্ভব হয় না। শুধু তাই নয় ব্যাষ্টিক অর্থনীতি এবং সামষ্টিক অর্থনীতি উভয়ই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তা ছাড়া এই ভিত্তিহীন টাকার ভেলোসিটি বেশি থাকে বলে দ্রুত হাত থেকে হাতে ছড়িয়ে যায়। আর একটি কথা, সমগ্র কর্মকাণ্ড ক্যান্সরাস অর্থনীতির আওতার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। তখন আর কিছু করার থাকে না। তাই গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জোর তৎপর হতে হবে। শুধু তাই নয়, আপামর জনসাধারণকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থ উপেক্ষা করে দেশের স্বার্থ বড় করে দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি কথা না বললেই নয়; হয়তো অনেকেই ১৯৭৩-৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কথা অবহিত আছেন। আর এই দুর্ভিক্ষের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল প্রতিবেশী দেশের জাল নোট। পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, এই দুঃখী বাংলাদেশ আপনার, আমার এবং সবার। আর সেই মানসিকতা নিয়ে যেভাবে, যেখানে পারেন, এই জাল নোটকে রুখতে হবে। নতুবা এর পরিণতি হবে ভয়ানক।
লেখক: অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিয়েশন কাউন্সিল উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে এবং কর্মসংস্থান যোগ্য দক্ষতা তৈরিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চাপ দেওয়ার জন্য দুর্দান্ত কাজ করছে। মানসম্মত শিক্ষার উন্নয়নের জন্য, শিক্ষকদের বিদেশে অত্যন্ত দক্ষ জার্নাল প্রকাশ করতে হবে। তবে, সম্মানিত জার্নালে প্রকাশের জন্য রেমিট্যান্সের ওপর ২০% কর একটি উল্লেখযোগ্য বাধা। এই কর গবেষকদের ওপর ভারী আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দেয়। আমলাতান্ত্রিক বাধাগুলো রেমিট্যান্স প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তোলে। আমরা সরকারকে গবেষণা প্রকাশনাকে জাতীয় বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করার এবং এই কর প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাচ্ছি। এর ফলে মান বৃদ্ধি পাবে, আন্তর্জাতিকভাবে দৃশ্যমানতা বৃদ্ধি পাবে এবং উদ্ভাবন উৎসাহিত হবে। আমরা ইউজিসিকে এই উদ্যোগকে সমর্থন করার এবং স্থানীয় জার্নাল র্যাঙ্কিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। গবেষণার করপোরেট পৃষ্ঠপোষকতার জন্য কর ছাড়ের প্রয়োজন: করপোরেশনগুলোর জন্য- কোম্পানিগুলোকে তাদের অবদানের ২০% কেন্দ্রীয়, সরকার-অনুমোদিত ‘জাতীয় গবেষণা ফাউন্ডেশনে’ অথবা প্রকাশনার ফলাফলের সাথে সম্পর্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুদান থেকে সরাসরি কর্তন করার অনুমতি দিন। কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন: গবেষণার স্বীকৃতি তহবিলগুলো- এমন গবেষণা প্রকল্পগুলোর জন্য ব্যবহার করা উচিত যার স্পষ্ট লক্ষ্য যোগ্য জার্নাল তালিকায় প্রকাশ এবং বিশ্ব র্যাঙ্কিং অনুসারে আন্তর্জাতিক মানীকরণ। এই চ্যানেলগুলো জাতীয় লক্ষ্যকে সরাসরি সমর্থন করে জনসাধারণের জ্ঞান সৃষ্টিতে বেসরকারি এবং সরকারি-বেসরকারি খাতের তহবিলকে অগ্রাধিকার দেবে।
একজন শিক্ষকের ভূমিকা শ্রেণিকক্ষের নির্দেশনার বাইরেও বিস্তৃত; এটি সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনাকে অনুপ্রাণিত করা, নৈতিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখা এবং শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। তবে, যখন একজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাদের বিপথে নিয়ে যায় তখন এটি এই মহৎ পেশার প্রতি গভীর অবমাননা। একজন সহকর্মীর ক্যারিয়ারের ক্ষতি করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে দূষিত মিথ্যা ছড়িয়ে দেওয়া - যা একটি শান্তিপূর্ণ ভবনে ‘আগুন’ বলে চিৎকার করার মতো। একটি গুরুতর নৈতিক লঙ্ঘন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ভবনে ‘আগুন’ বলে চিৎকার করার মতো বিদ্বেষপূর্ণ মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে একজন সহকর্মীর ক্যারিয়ার নষ্ট করা একটি গুরুতর নীতিগত লঙ্ঘনের প্রতিনিধিত্ব করে। এই ধরনের আচরণ কেবল একাডেমিক পরিবেশকে বিষাক্ত করে না বরং একটি সুস্থ প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় আস্থা ও সৌহার্দ্যকেও ভেঙে দেয়। আমাদের একাডেমিক সম্প্রদায়ের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে এই ধরনের ক্ষতিকারক আচরণে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহি করা অপরিহার্য। কিন্তু সেই মহিলা শিক্ষিকা সাবেক এক পরিচালকের অধীনে একজন রাজনীতিবিদের ক্ষমতা ব্যবহার করে মাফিয়ার মতো কাজ করেছিলেন। এখন সময়ের সাথে সাথে তিনি পিএইচডিতে কোনো মৌলিক জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও সেই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। সত্যিই এই নিকৃষ্ট মানুষগুলো নিজের ইচ্ছায় শিক্ষকতায় আসেনি বরং চাকরি এবং ব্যবসা পাওয়াই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। মূল ধারণা হলো- একটি দেশের একাডেমিক গবেষণার মান এবং পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য সরাসরি অনুঘটক হিসেবে ২০% কর ছাড় ব্যবহার করা। এটি একটি কৌশলগত বিনিয়োগ: বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত জার্নালে আর্টিকেল প্রসেসিং চার্জ (এপিসি) এবং প্রকাশনা ফি এর কার্যকর খরচ কমানো। উচ্চমানের প্রকাশনা স্থানগুলোকে লক্ষ্য করার জন্য গবেষক এবং প্রতিষ্ঠানগুরোকে উৎসাহিত করা। মা গবেষণা প্রকাশনার জন্য ২০% কর ছাড় নীতি প্রণয়ন: এই প্রসঙ্গে, স্পষ্টতই প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধ। একটি হাইব্রিড পদ্ধতি-বিকল্প A: প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা তহবিলের ওপর কর ছাড়/ছাড়-বিশ্ববিদ্যালয়/গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্য: প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকাশনা সহায়তার জন্য বিশেষভাবে বরাদ্দকৃত তহবিলের ওপর ২০% কর ছাড় অথবা বর্ধিত ১২০% কর্তন দাবি করার অনুমতি দিন। এর মধ্যে রয়েছে এপিসি, পৃষ্ঠা চার্জ এবং রঙের চিত্র ফি।
একটি ‘যোগ্য জার্নাল তালিকা’ অবশ্যই নিম্নলিখিত বিষয়গুলোতে তালিকাভুক্ত জার্নালগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে: স্কোপাস (বিশেষ করে শীর্ষ কোয়ার্টাইলগুলোতে - Q1/Q2) ,ABDC জার্নাল মানের তালিকা (A*, A, B), CABELL এর শ্বেত তালিকা (তাদের কালো তালিকাভুক্ত শিকারি জার্নালগুলোর সম্ভাব্য বাদসহ) একটি ‘গবেষণা প্রকাশনা অনুদান তহবিল’ প্রতিষ্ঠা করুন: প্রতিষ্ঠানের অর্থ বিভাগ এটি পরিচালনা করতে পারে। গবেষকরা APC-এর জন্য অর্থ প্রদানের জন্য এই তহবিল থেকে অনুদানের জন্য আবেদন করেন। কর সুবিধার সূত্রপাত: প্রতিষ্ঠানটি অর্থবছরের শেষে এই তহবিল থেকে বিতরণ করা মোট পরিমাণের ওপর ২০% কর সুবিধা পায়
কর ছাড়ের ফলে নীট খরচ কমবে, তবে অন্যান্য কৌশলগুলো মোট খরচ কমাতে পারে। জাতীয় প্রাতিষ্ঠানিক সাবস্ক্রিপশন: সরকারের উচিত প্রধান প্রকাশকদের (যেমন, এলসেভিয়ার, স্প্রিংগার, উইলি) সাথে দেশব্যাপী ‘পড়ুন এবং প্রকাশ করুন’ চুক্তি নিয়ে আলোচনা করা। এই চুক্তিগুলো প্রায়শই সাবস্ক্রাইব করা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট লেখকদের জন্য ছাড়যুক্ত বা সীমিত APC করে। উন্মুক্ত বিজ্ঞান পরিকাঠামো প্রচার করুন: স্বনামধন্য ডায়মন্ড-প্ল্যাটিনাম ওপেন অ্যাক্সেস জার্নালগুলোতে বিনিয়োগ করুন এবং প্রচার করুন (যা পাঠক এবং লেখকদের জন্য বিনামূল্যে)। স্থানীয় জার্নালগুলোকে পছন্দসই ডাটাবেসে সূচিবদ্ধ করার জন্য সহায়তা করে এটি করা যেতে পারে। প্রাক-জমা পিয়ার পর্যালোচনা পরিষেবা: গবেষকদের জন্য পেশাদার সম্পাদনা এবং পরিসংখ্যানগত পর্যালোচনা পরিষেবাগুলোতে ভর্তুকি দিন। এটি শীর্ষ জার্নালগুলোতে গ্রহণযোগ্যতার হার বৃদ্ধি করে, ব্যয়বহুল একাধিক জমা চক্র এবং প্রত্যাখ্যান রোধ করে। কেন্দ্রীভূত গবেষণা পোর্টাল: গবেষকদের প্রকাশনা প্রক্রিয়া আরও দক্ষতার সাথে নেভিগেট করতে সহায়তা করার জন্য গাইড, জার্নাল ফাইন্ডার সরঞ্জাম এবং টেমপ্লেট সহ একটি ওয়ান-স্টপ পোর্টাল তৈরি করুন।
গুণমান এবং বৈশ্বিক মানদণ্ডে সঞ্চয় পুনর্বিনিয়োগ নিশ্চিত করা কর সুবিধাকে একটি গবেষণা উন্নয়ন পরিকল্পনা (RIP) এর সাথে সংযুক্ত: কর ছাড় দাবিকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে বার্ষিক RIP জমা দিতে হবে। এই পরিকল্পনায় কর ছাড় থেকে প্রাপ্ত সঞ্চয় কীভাবে পুনর্বিনিয়োগ করা হবে তা রূপরেখা দিতে হবে। জাতীয় সার্টিফিকেশন সংস্থাকে এই পরিকল্পনা অনুমোদন করতে হবে। RIP-কে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা মেট্রিক্সের উন্নতি লক্ষ্য করতে হবে: উদ্ধৃতি প্রভাব: উচ্চতর ক্ষেত্র-ওজনযুক্ত উদ্ধৃতি প্রভাব (FWCI) লক্ষ্য করুন। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সাথেসহ লেখক প্রকাশনা বৃদ্ধি। SDG সারিবদ্ধকরণ: জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে গবেষণা অবদান। নতুন গবেষকদের জন্য বীজ অনুদান: তাদের প্রকাশনা রেকর্ড শুরু করার জন্য। প্রশিক্ষণ কর্মশালা: একাডেমিক লেখা, গবেষণা পদ্ধতি এবং পিয়ার-রিভিউ প্রক্রিয়া নেভিগেট করার ওপর। গবেষণা ডাটাবেস এবং সফটওয়্যার ক্রয়: SPSS,Eviews, NVivo, Bloomberg টার্মিনাল ইত্যাদির সাবস্ক্রিপশন।
প্রশিক্ষণ কর্মশালা: একাডেমিক লেখালেখি, গবেষণা পদ্ধতি এবং পিয়ার-রিভিউ প্রক্রিয়া নেভিগেট করার ওপর। গবেষণা ডাটাবেস এবং সফটওয়্যার ক্রয়: SPSS, NVivo, ব্লুমবার্গ টার্মিনাল ইত্যাদির সাবস্ক্রিপশন। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য সহায়তা: গবেষণা উপস্থাপন এবং সহযোগী নেটওয়ার্ক তৈরি করা। প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বার্ষিক প্রকাশনা আউটপুট, প্রদত্ত APC, আদায় করা কর সঞ্চয় এবং কীভাবে সেই সঞ্চয় পুনর্বিনিয়োগ করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে রিপোর্ট করতে হবে। গবেষণা বৃদ্ধির জন্য ধাপে ধাপে কর্মপরিকল্পনা নীতিমালা প্রণয়ন: যোগ্য, উচ্চমানের জার্নালে APC-তে প্রাতিষ্ঠানিক এবং করপোরেট ব্যয়ের জন্য ২০% কর ক্রেডিট প্রদানের জন্য একটি স্পষ্ট আইন প্রণয়ন করুন। একটি গবেষণা সার্টিফিকেশন সংস্থা তৈরি করুন: প্রাতিষ্ঠানিক RIP-গুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং তাদের সম্মতি নিরীক্ষা করার জন্য একটি বিদ্যমান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করুন বা ক্ষমতায়ন করুন। সম্মতি বাস্তবায়ন করুন: কর ছাড় চালু করুন, যোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের RIP জমা দিতে এবং কার্যকর করতে হবে। পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন: দেশের গবেষণা আউটপুট, বিশ্বব্যাপী সূচকগুলোতে (যেমন SCImago) র্যাঙ্কিং এবং নীতির সাথে এর সম্পর্ক ট্র্যাক করুন। তালিকা এবং কৌশল পরিমার্জন করতে এই তথ্য ব্যবহার করুন। এই লক্ষ্যবস্তু নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে, আপনি কেবল খরচ ভর্তুকি দিচ্ছেন না। আপনি একটি পুণ্যচক্র তৈরি করছেন: ভালো জার্নালে সস্তা প্রকাশনা → আরও উচ্চমানের প্রকাশনা → উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক এবং জাতীয় র্যাঙ্কিং → উন্নত প্রতিভা এবং বিনিয়োগের আকর্ষণ → এলডিসি স্নাতকোত্তর পরবর্তী একটি শক্তিশালী, আরও স্থিতিস্থাপক জ্ঞান অর্থনীতি। এটি জাতীয় উন্নয়নের পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োজনীয় বৌদ্ধিক মূলধনে সরাসরি বিনিয়োগ। গবেষণার ভিত্তি হলো- শিক্ষার মান, QS র্যাঙ্কিং এবং টাইমস উচ্চশিক্ষার মান উন্নত করা। মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া উচ্চশিক্ষা আজকাল অর্থহীন, কারণ চাকরি গুরুত্বপূর্ণ এবং নিজ-কর্মসংস্থানের দক্ষতা বজায় রাখতে হবে। বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিয়েশন কাউন্সিল এখন উচ্চশিক্ষার উন্নতির চেষ্টা করছে। কিন্তু শিক্ষকদের অবশ্যই সৎ, নীতিবান এবং রাজনৈতিকভাবে মুক্ত হতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সম্মান পেতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আরও গবেষণামুখী হতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার সাথে কেন্দ্রীভূত শিক্ষাদান প্রয়োজন যাতে শিক্ষার্থীরা যথাযথ শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান দক্ষতা অর্জন করতে পারে। শিক্ষকদের উচিত খারাপ রাজনীতি এবং গীবত করা থেকে বিরত থাকা এবং শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়। একজন বাবা, একজন অনুষদ সদস্য, যিনি একসময় আমার ছাত্র ছিলেন এবং PGDED প্রোগ্রামে পাঁচটি কোর্স করেছেন, কীভাবে আমার ছেলের Rangsit বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি যাত্রা সম্পর্কে এই ভুল তথ্য ছড়াতে পারেন? তিনি দাবি করেন যে আমার ছেলে কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়নি, কিন্তু এটা ভুল। তিনি প্রথমে তার প্রস্তাব জমা দিতে যান এবং তারপর সেখানে তার পিএইচডি কোর্সওয়ার্ক শুরু করেন।
যখন কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির ছুটি মঞ্জুর করে, যার ফলে তারা অনলাইনে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন। আমার ছেলেকে তার পিএইচডির প্রয়োজনীয়তার অংশ হিসেবে SCOPUS-সূচক জার্নাল দুটি প্রবন্ধ এবং থ্রি থাই ইন্ডিক্সেড জার্নালে প্রকাশ করতেও বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই মহিলা আমার ছেলের বিরুদ্ধে আমার ছাত্রদের কাছে গুজব ছড়াচ্ছেন যাতে তার নির্যাতনের শিকার হন। আল্লাহ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।
এই অনুষদ সদস্য মনে হচ্ছে জানেন না যে আমার ছেলে তার পিএইচডির শেষ পর্যায়ে শারীরিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত দিয়ে তিনি তার সুপারভাইজারের সাথে তার চূড়ান্ত খসড়া তৈরিতে কাজ করেছিলেন এবং পরে অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত উভয় সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত একটি পরীক্ষা কমিটির সামনে তার থিসিসটি উপস্থাপিত করেছিলেন এবং ভাইভা, উপস্থাপনা সিরিজ দিয়েছিলেন।
আমার ছেলের পিএইচডি করার সময় রংসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে তিনি যে গুজব ছড়িয়েছেন তা ভিত্তিহীন। একটি সভ্য সমাজে, এই ধরনের ভুল উপস্থাপনার গুরুতর পরিণতি হতে পারে। তার দাবি যাচাই করার জন্য তার পাসপোর্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ছবি , নথিসহ সমস্ত সহায়ক নথি পাওয়া যায়।
শিক্ষকদের উচিত তাদের নির্দিষ্ট মূল্যবোধ, নীতিশাস্ত্র এবং নৈতিকতার সাথে নিজেদের একীভূত রাখা কারণ তারা দেশের ভবিষ্যৎ নেতাদের জন্য রোল মডেল। শিক্ষায় বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। আর্থার ওকুনের মতে, প্রাথমিকভাবে তিনি দেখেছিলেন যে বার্ষিক প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে ২ শতাংশ বৃদ্ধি বেকারত্বের হারে ১ শতাংশ হ্রাসের সাথে সম্পর্কিত। তবে, উৎপাদনশীলতার পরিবর্তন এবং শ্রমবাজারের গতিশীলতার মতো কারণগুলোর কারণে ‘ওকুনের সহগ’ দেশভেদে এবং সময়ের সাথে সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। শিক্ষককে গবেষণার মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যবসা ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
পাহাড় ও অরণ্যের রাখিবন্ধনে চিরসবুজ পার্বত্য চট্টগ্রামের গুরুত্ব বহুমাত্রিক- যা একসময় বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের অধীনে বৃহত্তম একটি জেলা ছিল। আঞ্চলিক, ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চল। ভারত মহাসাগরের প্রবেশপথে বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত। মেরিটাইম রুট ও সমুদ্র বন্দরের গুরুত্ব বিবেচনায় ভূ-খণ্ডটি নিছক একটি ভৌগলিক অঞ্চলই নয়, বরং এর উত্তরে ভারতের অংশবিশেষসহ চীন, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর-পূর্বে ভারতের সেভেন সিস্টার্স এলাকা এবং পূর্বে মায়ানমার তথা আরাকন অঞ্চল- এসব কিছু মিলিয়ে এটি একটি ভূ-কৌশলগত অতিগুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। গত কয়েক দশক থেকে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের শিকার যা এখনো চলমান। পাহাড়কে অশান্ত করার ক্ষেত্রে বার বার আসছে তৃতীয় পক্ষের নাম।
খাগড়াছড়ির গুইমারায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সূত্রপাত হয় খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা এলাকায় মারমা জাতিগোষ্ঠীর এক কিশোরীকে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ থেকে। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর সহায়তায় পুলিশ শয়ন শীল নামে ১৯ বছর বয়সি এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে। কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে প্রথমে বিক্ষোভ ও পরে সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি ডাকা হয়। কর্মসূচির কারণে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি, খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি-সাজেক সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে। পরিস্থিতি অবনতি হলে শনিবার দুপুরে খাগড়াছড়ির গুইমারায় ১৪৪ ধারা জারি করে উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু এর মধ্যেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং রামেসু বাজারে আগুন দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অবরোধকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে হলে তাতে তিনজন নিহত ও সেনাবাহিনীর মেজরসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বিবৃতিতে সহিংসতার জন্য পাহাড়ি সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট–ইউপিডিএফকে দায়ী করে। সেখানে বলা হয়, বিগত কয়েক দিনের ঘটনা পর্যবেক্ষণে এটি স্পষ্ট যে, ইউপিডিএফ এবং তার অঙ্গসংগঠনসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে এলাকার মহিলা এবং স্কুলগামী কোমলমতি শিশুদের বিভিন্ন পন্থায় নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধ্য করছে।
পাহাড়ে হঠাৎ এমন অশান্ত পরিস্থিতিকে দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। গেল কদিন আগে চট্টগ্রাম বন্দর দখলের হুমকি দেন ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজনৈতিক দল ত্রিপুরা মোথা পার্টির শীর্ষ নেতা প্রদ্যুৎ মাণিক্য দেববর্মা। তিনি বাংলাদেশকে ভেঙে ফেলার হুমকিও দেন। যার রেশ কাটতে না কাটতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত, ছড়িয়ে পড়ছে জনমনে নানা বিভ্রান্তি। ভারতীয় মিডিয়াগুলো উসকানিমূলক খবর ও অপতথ্য ক্যাম্পেইন করছে। ভারতীয় মানবাধিকার সংস্থ রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপ (RRAG)-এর মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে। এই মানবাধিকার গোষ্ঠীটি জানিয়েছে যে, গুইমারার ঘটনাটি চলতি সপ্তাহে জেনেভায় অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে তোলা হবে। অভিযোগ আছে দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থাগুলো(এনজিও) দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে কাজ করলেও পাহাড় অশান্তের পেছনে তাদেরও ভূমিকা আছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ১২টি উপজাতি বাস করে। নৃতাত্বিক বিচারে উপজাতি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই মঙ্গোলীয় শ্রেণিভুক্ত। এখানে বসবাসকারী উপজাতিদের সম্মিলিত সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৪৫% (দশমিক চার পাঁচ শতাংশ)। তারা বিভিন্ন কারণে বিশেষত নিরাপদ আশ্রয় লাভের সন্ধানে তিববত, চীন, মায়ানমার এবং ভারতের বিভিন্ন পাহাড়ী অঞ্চল থেকে অনধিক ৪০০ বছর আগে বাংলাদেশের ভূখন্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে আসে। অধিকাংশ চাকমা ও মারমা বৌদ্ধধর্মের অনুসারী, ত্রিপুরার অধিবাসিরা হিন্দু ধর্মের আর মিজো, বম ও থেয়াং খ্রিস্টান। অন্য কিছু গোত্র আত্মা, প্রাণী ও উদ্ভিদের পূজারী। এদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে চাকমারা নবাগত। অনেকেরই নিজস্ব ভাষা থাকলেও এক উপজাতি অন্য উপজাতির ভাষা বুঝে না। এক উপজাতির সদস্য অন্য উপজাতির সাথে কথা বলার সময় বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। প্রতিটি উপজাতি বাংলা ভাষা বুঝে এবং নিজস্ব উপজাতির বাইরে আসলে বাংলা ভাষায় কথা বলে।
ভৌগোলিক আয়তনে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি লেবানন, সাইপ্রাস, ব্রুনাই, কাতার, সিঙ্গাপুর, মরিশাস কিংবা লুক্সেমবার্গের আয়তনের চেয়েও বড়। আর অবস্থানগত গুরুত্ব বিবেচনা করলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরে ও খাগড়াছড়ি জেলার পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড়পুঞ্জ ও মায়ানমারের অংশ, দক্ষিণে মায়ানমার, পশ্চিমে সমতল উপকূলীয় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা অবস্থিত। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৩৬.৮০ কিলোমিটার, মিজোরাম রাজ্যের সাথে ১৭৫.৬৮ কিলোমিটার এবং মায়ানমারের সাথে ২৮৮.০০ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে আন্তঃজেলাগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা, মোবাইল নেটওয়ার্ক, সুপেয় পানির তীব্র সংকট, বিদ্যুাৎ সংকট, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যাবস্থা এখনো কার্যকরভাবে গড়ে উঠেনি- যার ফলে সীমান্ত এলাকা মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান ও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে, যা পাহাড়কে হঠাৎ হঠাৎ অশান্ত করে তুলে। যা পাহাড়ি কিংবা বাঙালি কারোরই কাম্য নয়।
১৯০০ সালের ১ মে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি প্রভাব খর্ব করার লক্ষ্যে এবং ওই এলাকার স্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে ‘নোটিফিকেশন ১২৩ পিডি’ চিটাগাং হিল ট্রাক্টস, রেগুলেশন ১৯০০ (Chittagong Hill Tracts Regulation 1900) চালু করে। বৃটিশ বেনিয়া উপনিবেশিকদের এই কৌশলের কারণ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি প্রভাব ও বসতিস্থাপন প্রক্রিয়া বন্ধ করা এবং সেখানে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করা। প্রায় জনশূন্য এবং সম্পদ সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর বার্মা, আরাকান, চীন ও উত্তর-পূর্ব ভারতের দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আগত বসতি স্থাপনকারী উপজাতিদের যতটুকুই দাবী ছিল, অঞ্চলটির কাছের সংলগ্ন চট্টগ্রামের সমতলবাসী বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওই অঞ্চলটির উপর অধিকার বা দাবি কোনো যুক্তিতেই কম ছিল না। কিন্তু স্বার্থান্বেষী বেনিয়া ইংরেজরা ন্যায়পরায়ণতার যুক্তিকে লঙ্ঘন করে ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করেছিল। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা এখনো লক্ষ্য করছি।
১৯৫৬ সালে পৃথক অঞ্চলের বিধানের সমাপ্তি ঘটে। এই সালে প্রাদেশিক সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করে এবং এর সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র সংবলিত শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে। মৌলিক গণতন্ত্রের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমতলের রাজনৈতিক ধারায় মিশে যাওয়ায় সমতলের শাসন বহির্ভূত অঞ্চল (Excluded Area) এর মর্যাদারও স্বাভাবিক অবসান ঘটে। ঐ বছর ম্যানুয়েলের ৫১ অনুচ্ছেদ রহিত করে পাকিস্তানের সর্বত্র সকল নাগরিকের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করা হয় ঢাকা হাইকোর্টের এক রায়ে। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতি গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি মাত্র বৃহত্তর জেলা ছিলো। ১৯৮৩ সালে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিনটি প্রশাসনিক পার্বত্য জেলায় বিভক্ত করা হয়।
১৯৯৬ সালে যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি করা হয়েছিল তা ছিল পাহাড়কে শান্ত করবার একটি মাত্র পদক্ষেপ মাত্র, যা পাহাড়ে শান্তি স্থাপনের মূল নিয়ামক হয়ে উঠেনি এখনও। তাই পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে পাহাড়ি-বাঙালি ভেদাভেদ ভুলে সকলের সম-অধিকার নিশ্চিতকরণ, ভূমি সংক্রান্ত্র বিরোধের যৌক্তিক নিষ্পত্তি, দল উপদলের আধিপত্যকে যথাযথ আইনের আওতায় আনা, ধর্মীয় উস্কানি কিংবা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দেশি-বিদেশি সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বেকে অটুট রাখতে হবে। পাহাড়-অরণ্যের মেলবন্ধনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে এর আঞ্চলিক গুরুত্ব ও ভৌগোলিক সার্বভৌমত্বকে যথাযথ ব্যবহার করে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব, ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ, বিভিন্ন দল ও উপদলগুলোর চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও উগ্রবাদীগোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব, ধর্মীয় উস্কানি, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ইত্যাদি কারণগুলোই প্রতিবার কোনো না কোনোভাবে পাহাড়কে অশান্ত করছে। পাহাড়ি কিংবা বাঙালি কেউ পাহাড়ে অশান্তি চান না। পাহাড়কে নিয়ে অপরাজনীতি চলছে, ঘুরে ফিরে আসছে তৃতীয় শক্তির নাম- তাই পাহাড়ে শান্তি ফেরানোর দায়িত্ব সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, অংশীজন, বসবাসকারী সব জাতিগোষ্ঠী ও আমাদের সবার।
তানিম জসিম : প্রাবন্ধিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক। সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতি কেবল সমুদ্রকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে নিয়ে আসার একটি গতানুগতিক ধারণা নয়; এটি মানবজাতির জন্য সমুদ্রের সম্পদ ও সেবাকে টেকসই, সমতাভিত্তিক এবং পরিবেশবান্ধব উপায়ে ব্যবহারের একটি সামগ্রিক কৌশলগত দর্শন। ব্লু ইকোনমি'র মূল কথা হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে গিয়ে যেন সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য (Ocean Health) বিন্দুমাত্র বিঘ্নিত না হয়। এই দর্শনটি মৎস্য আহরণ থেকে শুরু করে শিপিং, উপকূলীয় পর্যটন, নবায়নযোগ্য সামুদ্রিক শক্তি এবং মেরিন বায়োটেকনোলজির মতো অ-প্রথাগত খাতগুলির সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় রাষ্ট্রের জন্য এটি একুশ শতকের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে, যেখানে বিশাল জলসীমা বিজয়ের পর আমরা সমুদ্রভিত্তিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। এই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের প্রয়োজন দ্রুত প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে এসে, গভীর সমুদ্রের অফুরন্ত সম্ভাবনা এবং তার টেকসই ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দেওয়া।
আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল জলরাশি এবং এর অন্তর্গত মৎস্য সম্পদ কেবল একটি অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যখন আমরা ব্লু ইকোনমি'র (নীল অর্থনীতি) স্বপ্ন দেখি, তখন এর কেন্দ্রে থাকে এই অপার জলজ সম্পদের টেকসই ও দায়িত্বশীল ব্যবহার। মৎস্য সম্পদের এই টেকসই ব্যবস্থাপনা কোনো বিচ্ছিন্ন ধারণা নয়; এটি সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য, উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, এবং ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা—এই তিনের এক সুসংহত মেলবন্ধন। দেশের মোট জিডিপিতে (GDP) মৎস্য খাতের অবদান প্রায় ৩.৫৭% এবং কৃষিজ জিডিপিতে এই হার ২৫ শতাংশেরও বেশি। দেশের প্রায় ১.৯৫ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই খাতের উপর নির্ভরশীল, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ। খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে, আমাদের দৈনন্দিন প্রাণিজ আমিষের ৬০ শতাংশের বেশি আসে মাছ থেকে।
বর্তমানে, আমাদের মৎস্য খাত একটি দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন: একদিকে, ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর চাপ, অন্যদিকে, অতিরিক্ত মাছ ধরা (Overfishing) এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট পরিবেশগত অবনতি। যদি আমরা এই মূল্যবান সম্পদকে ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত রাখতে চাই, তবে গতানুগতিক মৎস্য আহরণ পদ্ধতি থেকে সরে এসে গভীর সমুদ্রের মৎস্য আহরণ এবং নিয়ন্ত্রিত জলজ চাষ (Aquaculture) এর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কেবল উপকূলের কাছাকাছি মাছের ওপর নির্ভর না করে, আমাদের উচিত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং গবেষণার মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে সম্পদের সন্ধান করা। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গভীর সমুদ্রে আমাদের প্রায় ৪০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বেশি অর্থনৈতিক অঞ্চল অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এর সঠিক ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, এবং আন্তর্জাতিক মানের ফিশিং ট্রলারের ব্যবহার, যা একইসাথে সমুদ্রে নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করবে।
কৃত্রিম প্রজনন ও জলজ চাষের বৈপ্লবিক ভূমিকা (Revolutionary Role of Hatchery and Aquaculture) এই প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি। অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় জলজ চাষের ক্ষেত্রে আমাদের কেবল রুই, কাতলা বা চিংড়ির মতো প্রচলিত প্রজাতির উপর নির্ভর না করে, উচ্চ মূল্যের সামুদ্রিক প্রজাতি (High-Value Marine Species) চাষের দিকে যেতে হবে। এটি ইতিবাচক যে, বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে, যার প্রধান কারণ হলো অভ্যন্তরীণ জলজ চাষে প্রায় ১১ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি। বায়োফ্লক (Biofloc) বা রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়াকালচার সিস্টেম (RAS)-এর মতো প্রযুক্তিগুলি ব্যবহার করে সীমিত জায়গায় মাছের উৎপাদন বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব, যা একইসাথে পানির ব্যবহার কমায় এবং পরিবেশের উপর চাপ হ্রাস করে। এই পদ্ধতিগুলি গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন সুযোগ তৈরি করবে। মৎস্য রপ্তানি থেকে আমাদের বার্ষিক আয় বর্তমানে ৪,০০০ কোটি টাকারও বেশি, যা টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বহুলাংশে বাড়ানো সম্ভব।
টেকসই ব্যবহারের মূল ভিত্তি হলো তথ্য-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা (Data-Driven Management)। কোথায়, কখন, এবং কতটুকু মাছ ধরা হচ্ছে—এই সমস্ত তথ্য নির্ভুলভাবে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য। মৎস্য প্রজাতির প্রজনন সময়কালে কার্যকরভাবে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা এবং সংরক্ষিত সামুদ্রিক অঞ্চল (Marine Protected Areas) প্রতিষ্ঠা করা এই ব্যবস্থাপনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এছাড়াও, ছোট পর্যায়ের জেলেরা যাতে আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ পায়, তা নিশ্চিত করা জরুরি। তাদের প্রথাগত জ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সঙ্গে একত্রিত করে একটি সহ-ব্যবস্থাপনা (Co-management) মডেল তৈরি করতে পারলে স্থানীয় পর্যায়ে সম্পদের অপচয় ও অবৈধ মাছ ধরা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে। অবৈধ, অনিয়ন্ত্রিত ও অনথিভুক্ত (IUU) মৎস্য শিকার রোধ করা এখন সময়ের দাবি। এটি কেবল আমাদের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং পুরো ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। অত্যাধুনিক মনিটরিং ও নজরদারি ব্যবস্থা যেমন স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং (VMS) ব্যবহার করে মাছ ধরার নৌযানগুলোকে সার্বক্ষণিক তদারকির আওতায় আনাটাও জরুরি।
ব্লু ইকোনমি'র পরিপূর্ণ সুফল পেতে হলে সামুদ্রিক দূষণ রোধে কঠোর হতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্য, শিল্পকারখানার বর্জ্য এবং তেল নিঃসরণ আমাদের জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য নীরব ঘাতক। সরকারকে এক্ষেত্রে আরও কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি উপকূলীয় শিল্পগুলিকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে যেতে উৎসাহিত করতে হবে। মৎস্য সম্পদ শুধু পেট ভরানোর উপায় নয়; এটি আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি, যা আমাদের জিডিপি'তে (GDP) উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের উপকূলীয় অবকাঠামোকে আরও সহনশীল করে তুলতে হবে এবং ম্যানগ্রোভ বন (যেমন সুন্দরবন) সুরক্ষার উপর জোর দিতে হবে, যা একদিকে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলকে রক্ষা করে।
এই স্বপ্ন কেবল মাছ ধরার পরিমাণ বাড়ানো নয়; এটি আমাদের সমুদ্রকে সুস্থ রাখা, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা, এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ জলজ উত্তরাধিকার রেখে যাওয়ার অঙ্গীকার। আর এই অঙ্গীকার পূরণের চাবিকাঠি নিহিত আছে মৎস্য সম্পদের ভারসাম্যপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার মধ্যে, যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং নীতিগত দূরদর্শিতা একত্রে কাজ করবে।
লেখক: সাকিফ শামীম
ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার
ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ
বাংলাদেশে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের মাঝে এখন চরম অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে মধ্যবিত্তের দুরবস্থা চরমে মূলত চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ক্রমশ আয় কমে যাওয়া এবং মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খাওয়ার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, যার ফলে যাদের জীবনে একসময় সুখের প্রবাহ ছিল স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, বর্তমানে যাদের চাকরী নাই বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনের পর যাদের কর্মস্থল বন্ধ রয়েছে তারা এখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। আয় না থাকা, কর্মসংস্থান নাহওয়া এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি—এই দুইয়ের প্রভাবে মধ্যবিত্তরা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সবচেয়ে নীরব অথচ গভীর সংকটে নিপতিত হয়েছে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। একসময় যারা ছিল আর্থিকভাবে স্বনির্ভর, আজ তারাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কবলে দিশেহারা। ফলে জীবনের মান রক্ষা তো দূরের কথা, বেঁচে থাকাই এখন তাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। সাথে রয়েছে চিকিৎসা ব্যয় ও সন্তানদের শিক্ষা ব্যয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সন্তানের নিয়মিত ফিসমূহ পরিশোধে ব্যর্থ পিতা মাতা মারাত্মক মানসিক বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে রয়েছেন। সংসারের সরবরাহ মিটিয়ে আগে যেখানে মাস শেষে কিছু সঞ্চয় করে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভাবতেন, তারাই এখন মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাড়ার দোকানে বাকি করছেন। কেননা আয় অপরিবর্তিত এবং কোথাও কোথাও নাই বললেই চলে, অথচ ব্যয় প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বমুখী। ফলে আয় ও ব্যয়ের ব্যবধান দিনে দিনে বাড়ছে, যা মধ্যবিত্তের জীবনে নির্মম দহন সৃষ্টি করেছে।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৮২ শতাংশ পরিবার তাদের প্রয়োজন মাফিক আয় করতে পারছে না। এক-তৃতীয়াংশ পরিবার সংসার চালাতে গিয়ে ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। খাদ্যের পেছনে মাসিক আয়ের ৫৫ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসাভাড়ার মতো মৌলিক খাতেও ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এই পরিসংখ্যান একদিকে যেমন আর্থিক অনিশ্চিয়তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নীতির ব্যর্থতাও উন্মোচন করে। বর্তমানে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ৭.৫৬ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি ৯.৩৮ শতাংশ। টানা তিন বছরের অধিক সময় ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাত সবচেয়ে নির্মমভাবে আঘাত হেনেছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর। যাদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, তারাই আজ মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে। এটি মোকাবিলায় সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বরাবরই সীমিত, দুর্বল এবং ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতায় জর্জরিত। বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যথার্থই বলেছেন- দারিদ্র্য বৃদ্ধির মূল কারণ দুটি : মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থানের সংকট। গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একের পর এক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন উল্লেখ করার মত এক বেক্সিমকো টেক্সটাইলের প্রায় ৪২ হাজার কর্মীসহ এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান আজ প্রায় এক বছর যাবত বন্ধ, গাজী গ্রুপ, নাসা গ্রুপ ও ওই একই কারণে বন্ধ। প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেকারত্বের এই প্রবণতা কেবল অর্থনৈতিক ব্যর্থতাই নয়, এটি জাতীয় উৎপাদনশীলতার ওপরও একটি দীর্ঘমেয়াদি আঘাত। যখন একজন দক্ষ শ্রমিককে পেশা বদলে রিকশাচালক বা ফেরিওয়ালা হতে হয়, তখন তা শুধু ব্যক্তিগত পতন নয়- তা রাষ্ট্রীয় নীতির অন্তঃসারশূন্যতার বহিঃপ্রকাশ।
তার পর রয়েছে কর্মকর্তাদের
পারিবারিক অসম্মান এবং সামাজিক মর্যদাহানী, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সুদের হার বাড়ানো, আমদানি শুল্ক হ্রাস এবং মুদ্রানীতিতে কড়াকড়ি আরোপ করলেও, নিত্যপণ্যের বাজারে এর কার্যকর প্রতিফলন অনুপস্থিত।
বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার অভাব এবং একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট-নির্ভর অপশাসনে জনগণ কার্যত জিম্মি। চাল, ডাল, তেল, চিনি ও পেঁয়াজের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল। এই ব্যবস্থাগত শৈথিল্য ও নীতিগত অবস্থান আগামী দিনে পরিস্থিতিকে আরও দুর্বিষহ করে তুলতে পারে তার উপর রয়েছে করের চাপ, জনগণের আয়ের উৎসই ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেখানে করের সমাধান কি করে স্বাভাবিক হবে আশা করা যায় । মধ্যবিত্তের মুখে হাসি নেই, সামাজিক অনুষ্ঠানমালাতে উপস্থিতিতে তার প্রতিফলন দৃষ্টিগোচর হয়। অধঃপতনের চরম পর্যায়ে ধাবমান আমাদের যুবসমাজসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের জনগণ বিশেষ করে মোবাইলের ব্যবহার সহজলভ্য হওয়াতে যুবক যুবতী কিশোর, শিশু এমন কি বৃদ্ধরাও মোবাইল নির্ভর হয়ে পড়াতে সকলেই এক অজানা কারনে কর্মবিমুখ হয়ে পড়ছেন। বিবেকের কাছে প্রশ্ন করলে উত্তর আসবে, অপারগতা, ব্যর্থতা অযোগ্যতার মূলে রয়েছে অভাব আর এই অভাবের কারণেই হয়তো সমাজে ডিভাইজ নামের বৈজ্ঞানিক অবদানের ফজিলতে আমরা সর্বত্রই বিপর্যস্ত ও নিরাপত্তাহীনতায় ও পংগুত্বে ভুগছি। আমাদের হাত, চোখ ও মস্তিষ্ক ও সময় ওই মোবাইলে সীমাবদ্ধ ফলে বর্তমান সমাজের সকল পর্যায়ে অনেক বেশি সচেতনতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান তৈরি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশে মুল্যস্ফিতি কমানোর দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া অত্যান্ত জরুরি অন্যথায় সমাজে চরম বিপর্যয় আসন্ন।
সমাজের এক বিরাট অংশজুড়ে আছে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। শহরে জীবনের চাপ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক প্রত্যাশার চাপ – এই সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয় মধ্যবিত্তের জীবনে এক অদ্ভুত সংকট। আমি আশাবাদি আজকের লেখাটি মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের কষ্টের বিষয়টি নিয়ে লেখাটি যা অনেকেরই ভালো লাগবে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন অনেক সময় নীরব কষ্টে ভরা থাকে। সমাজের এই শ্রেণির ছেলেমেয়েরা প্রায়শই তাদের আবেগ, ইচ্ছা এবং চাহিদাগুলো প্রকাশ করতে পারে না। তাদের কষ্টগুলো অনেক সময় অদৃশ্যই থেকে যায়।এই অব্যক্ত বেদনার লাঘব কবে হবে তা কারো জানা নাই তবে আমরা আশা করবো দেশ পরিচালনায় ন্যস্ত কর্তা র্যক্তিরা মধ্যবিত্তের অভাব দূরীকরণে ও কর্মসংস্থানে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ সকল প্রকার নাগরিক সুবিধা সহজলভ্য করণে দ্রুত সহায়ক হবেন।
লেখক: প্রবন্ধিক, কলামিস্ট।
বাংলাদেশ এখন সংস্কারের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের খসড়া প্রস্তাবগুলো দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য পুনর্গঠনের সম্ভাবনা দেখালেও বাস্তবায়নমুখী চ্যালেঞ্জ ও আস্থাহীনতা বিদ্যমান রয়েছে। কমিশনের আলোচনায় উঠে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ মেয়াদসীমা সংক্রান্ত বিকল্প-ধারা (এক ব্যক্তি সাধারণত সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন বলে এক বিকল্প প্রস্তাব আলোচনায় এসেছে) এবং নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন, তথ্য কমিশন ও প্রেস কাউন্সিলের মতো সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা বৃদ্ধির ধারণাÑএই মূল প্রস্তাবগুলো গণমাধ্যমে খসড়া আলোচনার সারমর্ম হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে।
এই প্রস্তাবগুলোর আলোচনায় সবচেয়ে গভীর শঙ্কা হলো প্রতিষ্ঠানগত নিরপেক্ষতার অভাব, অর্থাৎ যার ওপর সংস্কার বিশ্বাস করলে ভোটব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও তথ্যমঞ্চের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে কিন্তু যদি নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দলীয় প্রভাব বজায় থাকে তাহলে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ-ক্ষমতা বাড়ানো কেবল কাগজে বিষয় হবে। নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা ও মিডিয়া-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি আস্থা ফিরে না এলে সংবিধানিক পরিবর্তনও টেকসই ফল দেবে না। এই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মানবাধিকার ও প্রশাসনিক সংস্কার রিপোর্টগুলো উল্লেখযোগ্য সতর্কবার্তা দিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সুশাসনের ঘাটতি। দুর্নীতি, প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা, আইনের দুর্বল প্রয়োগ, দলীয়করণ, বিচারব্যবস্থার ওপর রাজনৈতিক প্রভাবÑএসব সমস্যা সংবিধান পরিবর্তন দিয়েই সমাধান করা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানির মতো রাষ্ট্রে সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ওপর এমন আস্থা তৈরি হয়েছে যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এলেও প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা ভাঙতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সেই আস্থা গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে বাস্তবায়নযোগ্য করতে হলে তিনটি স্তরে কাজ করতে হবে।
প্রথমত, রাজনৈতিক সদিচ্ছা: সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের মধ্যে সংলাপের সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। সংলাপের মাধ্যমেই আস্থা পুনর্গঠন সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া: রাষ্ট্রপতির হাতে নিয়োগ ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব থাকলে তা অবশ্যই স্বচ্ছ, বহুপাক্ষিক ও জবাবদিহিমূলক হতে হবেÑযেমন ন্যাশনাল কাউন্সিল বা একটি স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে।
তৃতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি: প্রশাসন, বিচার বিভাগ, তথ্য কমিশন ও গণমাধ্যমের আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করতে হবে যাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ না থাকে।
এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে দরকার একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিÑযেখানে ক্ষমতা ভাগাভাগি, সহনশীলতা এবং বিরোধী মতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে। কেবল সংবিধানের ধারা বদলে গণতন্ত্র টেকসই হয় না; বরং তার প্রয়োগে স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং নাগরিক অংশগ্রহণই মূল চাবিকাঠি।
অতএব, বলা যায়Ñজাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংস্কারগুলো নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আশার আলো জ্বালিয়েছে। তবে এই আশাকে বাস্তব শক্তিতে রূপ দিতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক সহযোগিতা, প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার। যদি এই তিনটি উপাদান নিশ্চিত করা যায়, তবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে পারবে; অন্যথায়, এই সংস্কারগুলোও কেবল কাগজে লেখা প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এবং বাংলাদেশ আবারও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের পুরোনো চক্রে ফিরে যাবে।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ এখন এক ‘পরীক্ষামূলক গণতন্ত্রের’ পর্যায়ে আছেÑযেখানে সাংবিধানিক পরিবর্তনগুলো শুধু আইনি রূপ নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনর্গঠন হিসেবেও দেখা উচিত। কারণ গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা মানে শুধু নির্বাচন নয়, বরং প্রতিষ্ঠান, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং ক্ষমতার ভারসাম্যকে একসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাগুলো এখানে অলোচনা করা যেতে পারে। পাকিস্তানের ২০১০ সালের অষ্টাদশ সংশোধনী একটি তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ। এর আগে প্রেসিডেন্টের হাতে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, যা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়াত। অষ্টাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয় এবং প্রেসিডেন্ট কার্যত আনুষ্ঠানিক প্রধানে পরিণত হন। এর ফলে সংসদ ও প্রধানমন্ত্রী শক্তিশালী হয়, যদিও রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্বলতার কারণে সেই কাঠামোও পুরোপুরি স্থিতিশীল হতে পারেনি। আবার ফ্রান্সের আধা-রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা দেয়। সেখানে যদি প্রেসিডেন্ট এক দলে আর প্রধানমন্ত্রী অন্য দলে থাকেন, তবে এক ধরনের বাধ্যতামূলক ক্ষমতা ভাগাভাগি তৈরি হয়, যাকে কোহ্যাবিটেশন (ফ্রান্সের আধা-রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থায় এমন এক পরিস্থিতি, যখন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে বাধ্য হন) বলা হয়। এ অভিজ্ঞতা দেখায়, সাংবিধানিক কাঠামো কখনো কখনো জটিল পরিস্থিতিতেও ভারসাম্যের পথ খুঁজে নেয়। ইতালিতে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যাতে জনগণ সরাসরি ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করবে। এটি হয়তো গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ বাড়াবে, কিন্তু একইসঙ্গে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত হয়ে যাবে এবং ভারসাম্য নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি হবে। তুরস্কের অভিজ্ঞতা আবার একেবারেই ভিন্ন। ২০১৭ সালে সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী পদই বিলুপ্ত করে দেওয়া হয় এবং প্রেসিডেন্টকে সর্বময় নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এতে প্রেসিডেন্ট একাই নিয়োগ, বাজেট এবং জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। সমালোচকরা বলেন, এ সংস্কার গণতন্ত্রের মৌলিক ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই উদাহরণগুলো বাংলাদেশকে দেখায়, শুধু সংবিধানের ধারা বদলালেই সব সমাধান হয় না, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা জানি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক ধরনের নেকিবাচকতা আছে। আর সেই নেতিবাচকতা কি সহজেই কাগজ কলমে লিখিত আকারে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে করা যাবে? এ বিষয়ে অনেক বড় প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অভিজ্ঞতা আরও স্পষ্ট করে দেয় ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্বাচিত হলেও কংগ্রেস এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ক্রমাগত ক্ষমতার টানাপড়েন বজায় থাকে। প্রেসিডেন্ট কোনোভাবেই এককভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এমনকি কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্টের মধ্যে ক্ষমতার একটি ভারসম্য আছে। যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত প্রভাবশালী হলেও সংসদীয় কমিটি, বিরোধী দলের কঠোর নজরদারি এবং শক্তিশালী গণমাধ্যম তাকে সব সময় জবাবদিহির মধ্যে রাখে। জার্মানিতে বড় কোনো নীতি বা নিয়োগ প্রক্রিয়া দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ছাড়া এগোতে পারে না। সুইডেনে সংসদই কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রক শক্তি। এমনকি জাপানের মতো উন্নত দেশেও প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। কিন্তু প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলীয় কাঠামোর শক্ত নিয়ন্ত্রণ তাকে সীমাবদ্ধ রাখে। এসব উদাহরণ আমাদের বলে দেয়Ñগণতন্ত্র তখনই টেকসই হয় যখন প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয় এবং কোনো একটি পদে বা ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় না।
কিন্তু বাংলাদেশে বাস্তবতা ভিন্ন। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির হাতে যদি নিয়োগের ক্ষমতা বাড়ানো হয়, কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রভাব অটুট থাকে, তবে পরিবর্তনটি কার্যত কাগজে সীমাবদ্ধ থাকবে। বিরোধী দল যদি পুরো প্রক্রিয়ায় আস্থা না রাখে, তবে সংসদীয় কমিটিতে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তও অর্থহীন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন কিংবা আইন কমিশন যদি রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত না হতে পারে, তবে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরবে না। এর সঙ্গে আছে সুশাসনের ঘাটতি। দুর্নীতি, প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা, আইনের দুর্বল প্রয়োগ-এসব সমস্যা শুধু সাংবিধানিক পরিবর্তন দিয়ে সমাধান হয় না। যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানির মতো দেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এতটাই শক্তিশালী যে দলীয় প্রভাব সহজে ঢুকতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করা যায়নি।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করা, যেখানে ক্ষমতার একচ্ছত্রকরণ বন্ধ হবে এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তার সাংবিধানিক দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালন করবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে, সংসদীয় পর্যায়ে বিরোধী দলের মতামতকে সম্মান করতে হবে, এবং বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন ও গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এগুলো সম্ভব হলে তবেই সাংবিধানিক সংস্কারের সুফল পাওয়া যাবে। অন্যথায় ক্ষমতার ভারসাম্যের যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, তা কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
অতএব বলা যায়, বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংস্কার এখন এক ধরনের পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা। এসবের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বিরোধী দলের আস্থা, এবং শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছাড়া এই সংস্কারগুলো কার্যকর হবে না। বিশ্বের অভিজ্ঞতা আমাদের স্পষ্ট বার্তা দেয়- গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু সংবিধান পরিবর্তন নয়, বরং তার বাস্তবায়নে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক সহনশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে এই সংস্কারগুলোও থেকে যাবে আংশিক চেষ্টার প্রতিচ্ছবি, আর বাংলাদেশের গণতন্ত্র আবারও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের দুষ্টচক্রে আটকে পড়বে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
‘প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’।
বঞ্চিত শিশুদের জীবনোন্নয়নের জন্য শিশু দিবস পালন করা হয় । শিশু বলতে জন্মের পর থেকে পনেরো বছরের বালক বালিকাদের বুঝায় । এই সব শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ তাই এই সব ভবিষ্যৎ নাগরীকদের সুরক্ষার এবং সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করবার জন্যেই শিশুদিবস পালন করা হয়ে থাকে। শিশুদের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়াই বিশ্ব শিশু দিবসের মূল লক্ষ্য । ১৯৫৪ সালে এ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার ‘বিশ্ব শিশু দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেদনাদায়ক ও ভয়াবহ স্মৃতি বিশ্ব শিশু দিবসের জন্ম দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে শত শত নিষ্পাপ শিশু মারা যায়। অনেক শিশু অসহায় ও পিতৃমাতৃহীন হয়ে পড়ে। পঙ্গু ও বিকলঙ্গ হয় অনেকে। জাতিসংঘ কল্যাণ তহবিল ইউনিসেফ এই অসহায় শিশুদের কল্যাণ ও নিরাপত্তা বিধানে এগিয়ে আসে এবং বিশ্ববাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৫৪ সালে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই সারা বিশ্বে অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার পালিত হয় ‘বিশ্ব শিশু দিবস’। এই দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুদের নানাবিধ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করে তাদের মৌলিক অধিকার আদায় করা। এজন্য এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকে। আজকের শিশু আগামীদিনে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। একটি নবজাত শিশুর মধ্যে আজ যে প্রাণের সঞ্চার হল তা একদিন ফুলে ফলে প্রস্ফুটিত হবে। বড় হয়ে একদিন সে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন সফল করবে। কবি ওয়ার্ডস ওয়াতের ভাষায়- ‘Child is the father of a nation’. শিশুর মধ্যে নিহিত রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। কারণ, শিশুই একদিন বড় হয়ে দেশ ও সমাজের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তারা হবে দেশের আদর্শ নাগরিক। এ জন্য চাই শিশুর সযত্ন প্রতিপালন; বিকাশ সাধনের সুষ্ঠু পরিবেশ। শিশুদেরকে আদর, সোহাগ, যত্ন ও সুশিক্ষা দিয়ে বড় করে তোলার জন্য চাই অনুকূল পরিবেশ, উপযুক্ত শিক্ষা। উপযুক্ত অভিভাবক পেলে একটি শিশু আদর্শ মানুষরূপে বড় হয়ে উঠতে পারে। কুরুচিপূর্ণ পরিবেশ, অসৎসঙ্গ ও বিবেচনাহীন অভিভাবকের অধীনে বড় হয়ে অমানুষ, বিবেকহীন ও লম্পট চরিত্রের হতে পারে। সম্ভাবনাময় আগামী দিনের এক সুনাগরিক এভাবেই অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। পক্ষান্তরে সুশিক্ষা, সুরুচি, শিক্ষিত বিবেকবান অভিভাবক একটি শিশুর অন্তর সুপ্ত ভবিষ্যতের পিতাকে জাগিয়ে তুলতে পারে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ২৫ ভাগই শিশু।তারাই একদিন সুনাগরিক হয়ে দেশের নেতৃত্ব দেবে। তাই তারা অবহেলিত থাকলে ভবিষ্যাৎ প্রজন্ম মুখ থুবড়ে পড়বে।
অবহেলিত শিশুদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলো দেওয়া পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তাই এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিশেষ যত্নবান হতে হবে ।
মৌলিক অধিকারের মধ্যে মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান শর্ত খাদ্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা-ই আজ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি একের পর এক গবেষণায় বেরিয়ে আসছে ভয়াবহ তথ্য- মাছ, শাকসবজি, ফলমূল, দুধ, ব্রয়লার মুরগি এমনকি টি-ব্যাগেও মিলছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক ও ক্ষতিকর ভারী ধাতু। এসব উপাদান ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাসসহ নানা দুরারোগ্য রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মাছ-মাংস এবং সবজির মতো প্রতিদিনকার অপরিহার্য পণ্যের দাম যখন আগেই নাগালের বাইরে, তখন নতুন করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিঃসন্দেহে জনগণের জন্য ‘গোদের উপর বিষ ফোঁড়া’। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যাদের আয় সীমিত; কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সম্মান রক্ষার কারণে তারা সব দিক থেকে বিপদে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে বোতলজাত ও খোলা উভয় ধরনের সয়াবিন এবং পাম তেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ টাকা বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। তাদের দাবি- আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও মূল্য সমন্বয় প্রয়োজন। অথচ বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থার তথ্য বলছে, আগের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ের তুলনায় জানুয়ারি-মার্চ সময়ে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম নিম্নমুখী ছিল। সেখানে পরবর্তী এপ্রিল-জুন; এমনকি গত জুলাই মাসেও উর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। তবে গত আগস্টে সয়াবিন তেলের বাজার আবার নিম্নমুখী রয়েছে। জুলাইয়ে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিনের দাম ১ হাজার ৩০৭ ডলার ছিল, যা আগস্টে ১ হাজার ২৪৫ ডলারে নেমেছে। তাহলে প্রশ্ন আসে- দাম বাড়ানোর এই তাড়া কোথা থেকে এলো?
বর্তমানে রাজধানীর বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৮৮-১৯০ টাকা, আর খোলা তেল ১৭০-১৭৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বছরে মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১৪-১৬ শতাংশ। এখন যদি আরও ১০ টাকা বাড়ে, তাহলে একটি গড় পরিবারের জন্য মাসিক খরচ বাড়বে উল্লেখযোগ্য হারে। বিশেষ করে যেখানে আয় বাড়েনি, চাকরি বা পেশার স্থায়িত্ব নেই, সেখানে এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধি অনেক পরিবারের আর্থিক ভারসাম্য ভেঙে দিতে পারে।
ভীতিকর আরো বিষয় হলো পাস্তুরিত দুধেও অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে, এমনকি অপাস্তুরিত দুধে ফরমালিন ও ডিটারজেন্ট মিশ্রণের প্রমাণ মিলেছে। টি-ব্যাগেও সিসা, পারদ, আর্সেনিক- যেগুলোর প্রতিটিরই সীমা ছাড়িয়ে গেছে কয়েকগুণ- তা প্রমাণ করে খাদ্য সুরক্ষা আজ কতটা হুমকির মুখে। এখন প্রশ্ন হলো- এত সব গবেষণার ফলাফল সামনে আসার পরও সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ কোথায়?
দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে পণ্যমূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীদের একটি গোপন আঁতাত ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিরবতা অনেক সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিবেচনায় নিলেও সেটি যাচাই- বাছাইয়ে স্বচ্ছতা অনুপস্থিত। ক্যাবসহ অন্যান্য ভোক্তা সংগঠন বহুবার দাবি জানালেও এ ধরনের সিদ্ধান্তে তাদের সম্পৃক্ত করা হয় না। ফলে ভোক্তার স্বার্থরক্ষার বদলে সিদ্ধান্তগুলো ব্যবসায়ী স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। এর ফলে স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোকে প্রতি মাসেই নতুন করে হিসাব কষে সংসার চালাতে হয়। মনে রাখতে হবে- মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণির সমস্যা উচ্চবিত্তর চেয়ে ভিন্ন। তারা উচ্চবিত্তের মতো ব্যয় বহন করতে পারে না। মধ্য বিত্তরা সরকারি সহায়তার আওতায়ও পড়ে না। নিম্নবিত্তের জন্য সহায়তাও অপ্রতুল। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে তাদের হাতে বিকল্প থাকে না। পুষ্টিকর খাদ্য বাদ দিয়ে কমদামি; কিন্তু স্বাস্থ্যহানিকর বিকল্প বেছে নিতে হয়। তাদের সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখতে গিয়ে স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- দাম কমলে কেন তা বাজারে প্রতিফলিত হয় না?
এই খাদ্যদূষণ মানুষের শরীরে ধীরে ধীরে বিষক্রিয়ার মতো কাজ করে। এর প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা না গেলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসার, বন্ধ্যত্ব, শিশুদের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ নানা জটিল রোগ সৃষ্টি করে। তাই এর প্রতিকারে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে, নইলে পরিণতি হবে বিপর্যয়কর। সরকারি পর্যায়ে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ, মৎস্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিএফএসএকে নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে সামগ্রিক পরিকল্পনা নিতে হবে। দূষণের উৎস চিহ্নিত করে তা বন্ধ করতে হবে।
সরকারকে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে এখনই, নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক ভয়ানক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে- যার দায় এড়ানো কারও পক্ষে সম্ভব হবে না।তাই বাস্তবতাকে অনুধাবন করে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি ও খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক গবেষক মানবাধিকারকর্মী।
মানব শরীরের সবচেয়ে দুর্বল অংশ হচ্ছে তার স্নায়ু। এটি এতোটাই নিয়ন্ত্রণহীন যে মানুষ প্রতিনিয়ত সচেতনভাবে যে কাজগুলো থেকে বিরত থাকার প্রতিজ্ঞা করে সে কাজগুলো পুনরায় মুহূর্তেই তার দ্বারা সংগঠিত হয়। মানুষের এই অতি প্রতিক্রিয়াশীল স্নায়ু বর্তমান ফেইসবুক নামক যোগাযোগ মাধ্যমটি দ্বারা সিংহভাগ নিয়ন্ত্রিত। বর্তমানে বিভিন্ন যন্ত্র মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি করেছে যা নানান ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে মানবজীবনে। এর মধ্যে ফেইসবুক সবচেয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল যোগাযোগ মাধ্যম। যদিও এর নাম যোগাযোগ মাধ্যম তবুও এর কাজ অনেক ক্ষেত্রেই মানুষে-মানুষে যোগাযোগ সৃষ্টির পরিবর্তে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করছে। মানুষের মনোজাগতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো তারা অতি দ্রুত ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। এতে অন্যজন ভিন্ন ভিন্নভাবে সে ব্যক্তির উপর ক্রুদ্ধ হন। সমাজে হিংসা- প্রতিহিংসা যদিও সব সময়ই ছিল, তবুও তা ছিল কিছুটা স্তিমিত, ও আভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু এখন প্রায় সবকিছুই উন্মুক্ত। মানুষের বিদ্বেষও এখন ফেইসবুক পোস্টের মাধ্যমে বাইরে আসে যা মানুষকে পূর্বের তুলনায় প্রকাশ্যে আরো বেশি হিংস্র করে তোলে। মানুষকে এখন ফেইসবুক পোস্ট নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে মানুষ ব্যক্তিগত জল্পনা-কল্পনা জুড়ে মনগড়া সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। এতে যে কেবল মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয় তা শুধু নয়, মানুষ এতে হিংস্র ও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠেন। ফেসবুক হয়ে গেছে মানুষের মাঝে বিদ্যমান হিংসা ও ভালোবাসা প্রদর্শনের মাধ্যম যা মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে সকল প্রজন্মের মানুষের কাছে। বর্তমানে অনেকেই ফেসবুক স্বর্বস জীবন যাপন করছেন। ফেইসবুকে তাই চলছে নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত অবাধ প্রতিযোগিতা পূর্ণ প্রদর্শন। মানুষ এখন অনেক বেশি দেখাতে পছন্দ করে। যদিও এটি সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক বা দৃষ্টিকটূ নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে আমাদের প্রদর্শনীটা দৃষ্টিকটূ। এর প্রধান কারণ হলো আমরা ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো নিদিষ্ট প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি না। আমরা ফেসবুকের একটি ওয়ালে ততধিক প্রজন্ম একত্রে থাকি। তাই ফেসবুক পোস্ট করার ক্ষেত্রে প্রাইভেসি রাখি না। এক প্রজন্মের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ বা আনন্দের, অন্য প্রজন্মের কাছে অস্বস্তিকর। এর মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো এখানে অরক্ষিত হয়ে পড়ে। যেহেতু আমরা মোটা দাগে ফেসবুক পোস্ট সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা করি, সেহেতু কারো কোনো উদ্দেশ্যপূর্বক দেওয়া পোস্টকে আমরা প্রায় অনেকেই নিজের গায়ে নেই। অনেকেই মনে করে অমুক তমুক পোস্ট আমাকে নিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিগত দ্বেষ বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভুল বিষয়ে সন্দেহ করেও একেকটি পোস্ট বা কথা একেকটি সম্পর্ককে নষ্ট করে। মানুষ যখন সরাসরি কারো প্রতি কোনো আক্রোশ প্রকাশ করতে পারে না, তখন সে ফেইসবুক পোস্টের মাধ্যমে তা প্রকাশ করে। তখন বিষয়টি ব্যক্তিগত পর্যায় ছাপিয়ে সামষ্টিক অসম্মানের পর্যায়ে চলে যায় যার সুবিধাও নেয় অনেকে। এরই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় মানুষ আত্মহননের পথ পর্যন্ত বেছে নেয়। শুধু তাই নয়, ফেইসবুক পোস্ট বর্তমানে তৈল প্রদানের একটি লাভজনক জায়গায়ও পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে সস্তা জনপ্রিয়তা ও তৈল প্রদান হয়ে উঠেছে মানুষের নিত্যসঙ্গী। মানুষ শত্রুতা প্রকাশও দশজনের সামনে ফেইসবুক পোস্টের মাধ্যমে করে, ভালোবাসা প্রকাশও ঠিক একইভাবে করে। ফলে গোপন থাকে না কিছুই। দানা বাধে নতুন মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। ফেসবুক পোস্ট বর্তমানে জনমত গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। ফেসবুকে সহজেই কিছু একটা দেখে, তার জনপ্রিয়তা দেখে মানুষ অতি সহজে তা বিশ্বাস করে। এটি ভয়ংকর পরিণতির দিকে মানুষকে নিয়ে যায়। কেননা, ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। অহর্নিশি মানুষ ফেইসবুকের সেই পোস্টকে বিশ্বাস করে প্রভাবিত হয় যা দেওয়ার সময় পোস্ট প্রদানকারী ব্যক্তি দু'বারও ভাবে না যে সে কী লিখছে। অর্থাৎ দুর্বল মানসিক অবস্থায় না বুঝে পোস্ট করা বিষয় দ্বারাও একটি বিরাট অংশের মানুষ মনো বিকারে ভোগে। ফেসবুকে পোস্টের আরেকটি ভয়ংকর দিক হলো কমেন্ট করার সহজসাধ্য উপায়। যে বিষয়টিই মানুষের ব্যক্তিগত মতকে সমর্থন করে না সে বিষয়কে কেন্দ্র করে মানুষ অত্যন্ত বিশ্রি ভাষায় অশ্রাব্য উদগীরণ করে যা মানুষে- মানুষে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট করে। জন্ম হয় নতুন ঘৃণার। মানুষ যে মানুষকে এত ঘৃণা করে তা ফেইসবুকই মানুষের সামনে নিয়ে এসেছে। অন্যভাবে বলতে হয়, ফেসবুকে অন্যের গুণগান না জনপ্রিয়তা মানুষের স্নায়ুকে নেতিবাচকভাবে পরিচালিত করে। এ থেকে পাল্টা আক্রমণের স্নায়ু যুদ্ধ হয় যার বিরতি ঘটে তখন যখন অন্য প্রান্তে ভিন্ন যুদ্ধের ডঙ্কা বাজে। এ থেকে মানুষের পরিত্রাণ জরুরি। নয়ত মানুষ যন্ত্রকে নয়, যন্ত্র পরিচালনা করবে মানুষকে। এর ধারাবাহিকতায় ধ্বংস হবে মানবসভ্যতা, যন্ত্রের তলে পৃষ্ঠ হবে মানবতা।
লেখক: শারমিন সুলতানা, শিক্ষক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।
তিস্তা নদী—উত্তর বাংলার প্রাণ। এই নদী শুধু একটি জলধারা নয়, এটি হাজার হাজার কৃষকের জীবিকা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক অর্থনীতির মূল ভিত্তি। কিন্তু প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে এই নদীর জলপ্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প পুরোপুরি কাজে লাগানো যায় না, আর কৃষিজমি শুকিয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র সেচ নয়, বরং এই নদীকে ঘিরে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে হবে—যেমন, উর্বর মাটি ও বিশুদ্ধ পানি রপ্তানির উদ্যোগ।
তিস্তা প্রকল্প ও বর্তমান বাস্তবতা
বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর বিস্তৃতি ২,০০৪ বর্গকিলোমিটার, যা মোট ১২,১৫৯ বর্গকিলোমিটারের নদীবিধৌত এলাকায় পড়ে। দেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প, তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প (TBIP), প্রায় ৭.৫ লাখ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনার লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে। কিন্তু বাস্তবে, পর্যাপ্ত পানির অভাবে প্রতি বছর গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
অর্থাৎ প্রকল্পের সক্ষমতার মাত্র ১০% ব্যবহার হচ্ছে। এর মানে, কোটি কোটি ঘনমিটার পানি প্রয়োজন শুষ্ক মৌসুমে, যা আমরা সংরক্ষণ করতে পারছি না। ফলে তিস্তা অববাহিকার কৃষকরা শস্য উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছেন, জীবিকা হারাচ্ছেন, ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছেন।
সমস্যা থেকে সম্ভাবনার দিকে
এই সংকটকে শুধু ‘সমস্যা’ হিসেবে না দেখে ‘সম্ভাবনা’ হিসেবে দেখাই সময়ের দাবি। আমরা যদি এই পানি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারি, শুধু কৃষক নয়, বরং দেশের অর্থনীতিও লাভবান হতে পারে।
তিস্তা নদীর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে প্রচুর পরিমাণে উর্বর পলি মাটি রয়েছে, যেটা বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। তেমনি বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি যদি আমরা রিজার্ভার, বড় গর্ত বা ভূগর্ভে সংরক্ষণ করতে পারি, তাহলে সেই পানি শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজে ব্যবহারের পাশাপাশি রপ্তানিরও সুযোগ রয়েছে।
নতুন দিগন্ত: মাটি ও পানি রপ্তানির সম্ভাবনা
✅ উর্বর মাটি রপ্তানি:
✅ পানির রপ্তানি:
পানির সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার প্রস্তাবিত পদ্ধতি
১. ✅ ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণ:
বর্ষাকালে তিস্তা নদীর অতিরিক্ত পানি ভূগর্ভে সংরক্ষণের জন্য পেরকোলেশন পিট, চেকড্যাম, ইনফিল্ট্রেশন ওয়েল তৈরি করতে হবে।
নদীর বিভিন্ন অংশে (উজান থেকে ভাটির দিকে) বড় গর্ত বা জলাধার তৈরি করে বর্ষাকালের পানি সঞ্চয় করতে হবে।
তিস্তা নদীর প্রধান চ্যানেল ও শাখা নদীগুলোতে আবার খনন করে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।
o প্রতি হেক্টরে কত কিউবিক মিটার পানি প্রয়োজন,
o বর্ষাকালে কত পানি জমা হয়,
o ভূগর্ভে কতটা পানি প্রবেশ করেছে—এসব পরিমাপ ও মানচিত্রে তুলে ধরতে হবে।
অর্থনৈতিক সুবিধা ও কর্মসংস্থান
ঝুঁকি ও করণীয়:
উপসংহার: তিস্তা শুধু কৃষির জন্য নয়, রপ্তানিরও সম্ভাবনা
তিস্তা নদী বরাবরই কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু এখন সময় এসেছে এই নদীর সম্পদকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করার। সঠিক পরিকল্পনা, বিজ্ঞানভিত্তিক পানি সংরক্ষণ ও পরিবেশবান্ধব মাটি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তিস্তা প্রকল্পকে শুধুই শুষ্ক মৌসুমের সেচ প্রকল্প না বানিয়ে বাংলাদেশের একটি আন্তর্জাতিক রপ্তানি কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে তোলা সম্ভব।
সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন অংশীদার এবং স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তিস্তা হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের পানি ও মাটি ভিত্তিক নতুন অর্থনীতির চালিকাশক্তি।
প্রস্তাবিত পদক্ষেপ
লেখক: Professor Dr Mokhlesur Rahman, Nuclear Science and Engineering, MIST, Dhaka
বর্তমান যুগে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সংবাদ প্রচারের প্রধান মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম প্রতিদিন সীমাহীন সংবাদ পৌঁছে দেয় সাধারণ জনগণের কাছে। বিশেষভাবে তৃণমূল সংবাদ, যা স্থানীয় ও দৈনন্দিন জীবনের খবর নিয়ে গঠিত, এই মাধ্যমগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের এই সুবিধার সঙ্গে রয়েছে গুজবের দ্রুত বিস্তার। কোনো খবরের সত্যতা যাচাই না করেই তা ভাইরাল হওয়ার কারণে সমাজে বিভ্রান্তি, আতঙ্ক এবং কখনও কখনও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। তাই সঠিক তথ্য ও মিথ্যা তথ্যের মধ্যে পার্থক্য বোঝার জন্যে এবং জনগণকে ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রদান এখন সময়ের দাবি। ১. ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উত্থান ও প্রভাবঃ ১.১ সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদ প্রচার: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ফেসবুক: ২০২৫ সালে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫,৫০০,০০০। হোয়াটসঅ্যাপ: গ্রুপ চ্যাট ও ব্রডকাস্টে স্থানীয় খবর দ্রুত ছড়ায়। টুইটার ও ইউটিউব: রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রচারে ব্যবহৃত হয়। সামাজিক মাধ্যমের এই শক্তি জনগণকে সজাগ ও সচেতন রাখার পাশাপাশি তৃণমূল সংবাদ পৌঁছে দেওয়ায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ১.২ প্রভাব: ডিজিটাল সংবাদ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হলেও এর নেতিবাচক প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, গুজবের দ্রুত বিস্তার: যাচাইহীন তথ্যের কারণে বিভ্রান্তি বৃদ্ধি। সামাজিক বিভাজন: ধর্ম, অঞ্চল ও রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে দ্বন্দ্ব। রাজনৈতিক উত্তেজনা: নির্বাচনী সময়ে মিথ্যা সংবাদ প্রচার অস্থিরতা ও সংঘাত সৃষ্টি করে। ২. গুজবের ধরন ও উদাহরণ : গুজব সাধারণত তথ্যের প্রকৃত সত্যতা যাচাই না করেই ছড়িয়ে পড়ে। তা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে- ১. রাজনৈতিক গুজব: নির্বাচনী বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা। ২. সামাজিক গুজব: জনমানসে ভীতি সৃষ্টি করা, যেমন, ছেলেধরা গুজব। ৩. ধর্মীয় বা আঞ্চলিক গুজব: সমাজে বিভাজন ও উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্য। উদাহরণ- ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ছেলেধরা গুজবের কারণে এক নারীকে হত্যা করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে পদ্মা সেতু সংক্রান্ত একটি গুজব সামাজিক মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। এই গুজবের ভিত্তি ছিল ‘সেতু নির্মাণের সময় শিশুদের কাজে লাগানো হবে’- যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ৩. গুজবের বিস্তার ও কারণঃ গুজব ছড়ানোর কারণসমূহ- তথ্য যাচাই না করা: মানুষ যাচাই ছাড়া খবর শেয়ার করে। ভীতি ও কৌতূহল কাজে লাগানো: আতঙ্ক সৃষ্টি করে দ্রুত তথ্য ছড়ানো। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য: প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা। সামাজিক অস্থিরতা: জনমত প্রভাবিত করা। গবেষণা অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশে ৬৫% ডিজিটাল ব্যবহারকারী কোনো না কোনো সময়ে যাচাইহীন সংবাদ শেয়ার করেছেন। ৪. ডিজিটাল সাক্ষরতা ও গুজব প্রতিরোধ : ৪.১ ডিজিটাল সাক্ষরতা: ডিজিটাল সাক্ষরতা বলতে বোঝায় তথ্য যাচাই, সোর্স চেক এবং অনলাইন নিরাপদ ব্যবহার শেখা। কৌশল- সোর্স যাচাই: কোন সংবাদ কোন উৎস থেকে এসেছে তা চেক করা। গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ: ছবি ও ভিডিও যাচাই করতে ব্যবহার করা। ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট: যেমন Bangladesh Fact-Check Network (BFCN)। ৪.২ শিক্ষণীয় উদাহরণ: ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রকল্প চালু করে, যেখানে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল সাক্ষরতা শেখানো হয়। ফলাফল হিসেবে, পরীক্ষার সময় তারা যাচাইহীন সংবাদ চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। ৫. সরকারের ভূমিকা : সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছে, যা গুজব ও মিথ্যা তথ্য প্রতিরোধে সহায়ক। মূল উদ্যোগ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮: গুজব ও মিথ্যা তথ্য শেয়ার প্রতিরোধ। সচেতনতা অভিযান: মিডিয়ার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: স্কুল ও কলেজে ডিজিটাল সাক্ষরতা অন্তর্ভুক্ত করা। তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। ৬. স্থানীয় সংবাদ ও গুজবের সামাজিক প্রভাব : তৃণমূল সংবাদ মূলত স্থানীয় পর্যায়ের খবর প্রচার করে। যখন এই খবরের সঙ্গে গুজব মিশে যায়, তখন এর প্রভাব সমাজে গভীর হয়। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় রাজনৈতিক গুজব: নির্বাচনী এলাকায় বিভাজন ও উত্তেজনা বৃদ্ধি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গুজব: বিদ্যালয় বন্ধ, ভ্যাকসিন গ্রহণে অনীহা। অর্থনৈতিক প্রভাব: বাজারে অযাচিত আতঙ্ক সৃষ্টি, মূল্যবৃদ্ধি ও পণ্য সংকট। ৮.শেষাংশঃ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তৃণমূল সংবাদ জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে যাচাইহীন তথ্য বা গুজবের কারণে বিভ্রান্তি ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। সমাধানমূলক দিক- ১. ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি করা। ২. জনগণকে উৎস যাচাই, তথ্য যাচাই শেখানো। ৩. গণমাধ্যম ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা নিশ্চিত করা। ৫. সরকারের নীতি ও আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা। সতর্ক, সচেতন ও বুদ্ধিমান ব্যবহারকারীর মাধ্যমে গুজব রোধ করা সম্ভব। এভাবেই সমষ্টিগত সচেতনতায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নিরাপদ ও কার্যকর সুফল ব্যবহার সম্ভব হয়ে উঠবে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
বরাবরের মতো এবারও বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ১৯১টি দেশে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো—
‘শিক্ষকতাকে একটি সহযোগী পেশা হিসেবে পুনর্গঠন’, যা শিক্ষক, বিদ্যালয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য সহযোগিতার রূপান্তরমূলক সম্ভাবনা তুলে ধরে।এ বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপনের প্রতিপাদ্য বিষয়ের কেন্দ্রীভূত ধারণা শিক্ষকদের স্কুল এবং শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য সহযোগিতার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেবে। শিক্ষকতাকে স্বাভাবিকভাবে সহযোগী হিসেবে পুনরায় ফ্রেম করা - এমন নীতি, অনুশীলন এবং পরিবেশ দ্বারা সমর্থিত যা পারস্পরিক সমর্থন, ভাগাভাগি করার দক্ষতা এবং যৌথ দায়িত্বকে মূল্যায়ন করে এটি শিক্ষণ, শেখার এবং শিক্ষকদের পেশাগত সন্তুষ্টি শক্তিশালী করার জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের কাছেও এ দিবসটি অত্যন্ত গৌরব ও মর্যাদার।
১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে একটি ‘শিক্ষক সনদ’ প্রণয়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষক অধিকার সংক্রান্ত চিন্তার উদ্ভব ঘটে। ১৯৪৮ সালে সম্মিলিত জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২৬ অনুচ্ছেদে শিক্ষা মৌলিক অধিকার এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশ–এর গুরুত্ব পূর্ণব্যক্ত হয়। বিভিন্ন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী শিক্ষক সম্প্রদায়ের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং সুরক্ষিত করার জন্য ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশেষ আন্ত: রাষ্ট্রীয় সরকার সম্মেলনে ১৩ অধ্যায়ে বিন্যস্ত এবং ১৪৬টি ধারা, উপধারায় সম্মিলিত শিক্ষকদের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদাবিষয়ক ঐতিহাসিক ‘ইউনেস্কো আইএলও সুপারিশ ১৯৬৬ ‘প্রণীত হয়। এ ঐতিহাসিক দলিলে শিক্ষাকে দেশ, সমাজ ও জাতি গঠনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করে শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার, মর্যাদা ও দায়-দায়িত্বের বিষয়টি সুদৃঢ়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। পরবর্তীতে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কিত অর্জিত সাফল্যকে সমুন্নত রাখাসহ আরো সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে বিশ্বের ১৬৭টি দেশের ২১০টি জাতীয় সংগঠনের প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ সদস্যদের প্রতিনিধিত্বকারী আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠন ‘এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল’ গঠিত হয়। এ আন্তর্জাতিক সংগঠন জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে প্রনীত দলিলটি যথাযথ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করার অর্থবহ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ক্রমাগত অনুরোধ ও ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস ঘোষণা দানের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক এম মেয়র যুগান্তকারী ঘোষণা দেন।
এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক পালনের শুভ সূচনা হয়। ১৯৯৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় এ দিবসটি পালন হয়ে আসছে। শিক্ষকদের জন্য প্রণীত ও ঐতিহাসিক দলিলে শিক্ষকতাকে একটি সেবামূলক পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা সংগঠনগুলোকে একটি শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে শিক্ষার অগ্রগতিতে বিদ্যমান অসংগতি দূরীকরণে শিক্ষার মূলনীতি ও কর্মকাণ্ডকে যুগোপযোগী করতে হবে। শিক্ষকের স্বাধীনভাবে পাঠদান ও শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা ভোগের সুযোগ প্রদান এবং পাঠ্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা উপকরণের বিকাশে শিক্ষক সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—শিক্ষা সংগঠনগুলোকে একটি শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে শিক্ষার অগ্রগতিতে বিশেষত শিক্ষানীতি প্রণয়নসহ শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে এ শক্তির অবদান সুনিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকতা পেশায় দায়িত্ব পালনে শিক্ষায়তনে স্বাধীনতা ভোগের সুযোগ প্রদান এবং শিক্ষাক্রম,পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা উপকরণের বিকাশে শিক্ষক সংগঠনগুলোর সুব্যবস্থা থাকতে হবে।
শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে; ১। শিক্ষকদের মর্যাদাকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে প্রদেয় বেতন-ভাতা নিশ্চিতকরণ;২। সমাজে শিক্ষকতার গুরুত্ব প্রতিফলনে অন্যান্য পেশায় সমমানের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রদত্ত বেতনের সাথে অনুকূল তুলনীয়ভাবে ও পরিবার-পরিজনসহ যুক্তিসংগত জীবন যাপনের মান বজায় রাখার নিশ্চয়তা বিধান সাপেক্ষে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সুনির্ধারণ করা;৩। প্রতিষ্ঠিত বেতন স্কেলের ভিত্তিতে শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন পরিশোধ;৪। জীবন ধারণের ব্যয় বৃদ্ধি ও বর্ধিত উৎপাদনশীলতার কারণে ব্যয়ের উর্ধ্বমুখী বিবেচনায় প্রয়োজন অনুসারে বেতন স্কেল পুনঃনির্ধারণ ইত্যাদি। এ দলিলের শিক্ষকদের চাকরি ও কর্মজীবন, পেশাগত স্বাধীনতা ও অধিকার, কর্মঘণ্টা ও ছুটি সামাজিক নিরাপত্তাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যা শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির সহায়ক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি উপরোক্ত সুপারিশ মালার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এর বাস্তবায়ন যথাযথ হচ্ছে না।
সু-শিক্ষার জন্য প্রয়োজন সু-শিক্ষক। সু-শিক্ষককে অনেক গুণাবলির অধিকারী হতে হয়। সু-শিক্ষক পেতে হলে মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন স্কেল হলে উচ্চতর যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা এ পেশায় অংশগ্রহণে আগ্রহী হবেন। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর যতগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে,সবগুলো রিপোর্টে এ বাস্তবতা মেনে নেওয়া হয়েছে। ২০০৩ সালে গঠিত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট মতে, ‘শিক্ষাক্রম যতই উন্নত মানের হোক, বিদ্যালয়ের ঘর দুয়ার যতই চাকচিক্যময় হোক, অবকাঠামগত সুবিধা দিয়ে যতই প্রয়োজন মাফিক হোক না কেন শেষ বিচারের শিক্ষার গুণগত মান নির্ভর করে শিক্ষকদের বিষয় জ্ঞানের পরিধি, তাদের প্রশিক্ষণ, তাদের কাজের আগ্রহ, দক্ষতা ইত্যাদির উপর। প্রকৃতপক্ষে, ভালো শিক্ষক না হলে কখনো ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে না। অপরপক্ষে ভালো শিক্ষক পেতে হলে আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা দেয়া প্রয়োজন। এ কমিশনের স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের উপরও গুরুত্ব দেয়া হয়। ১৯৯৭ সালের অধ্যাপক শামসুল হকের নেতৃত্বে পরিচালিত শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের মতে শিক্ষকরা হচ্ছেন শিক্ষা ব্যবস্থার মূল শক্তি। অতএব শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। ২০০৯ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতেও শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর বেতন স্কেল ও যথাযথ মর্যাদা প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক উপাদান হচ্ছে শিক্ষক। শিক্ষকদের সমস্যার সমাধান করে তাদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষার উন্নয়ন অসম্ভব। তাই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে ও মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে মাধ্যমিক স্তরে এন্ট্রি পদ নবম গ্রেড নিশ্চিত করতে হবে।
অপরদিকে জীবন মান উন্নয়ন ও উন্নত জীবনযাপনের জন্য বিশ্বব্যাপী মানসম্মত শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েই চলছে। শিক্ষা কাঠামোর গুরুত্বপূর্ন স্তর হল মাধ্যমিক শিক্ষা। অনেক উন্নত দেশে মাধ্যমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে প্রাপ্ত মৌলিক শিক্ষাকে সম্প্রসারিত ও সুসংহত করা, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রয়োগ কৌশলে জনশক্তি সরবরাহ করা মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।
এ স্তরের শিক্ষা লাভ করে দেশের বিরাট জনশক্তি আর্থ -সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তাই আমাদের দেশেও মাধ্যমিক শিক্ষার চাহিদা বাড়ছে কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি আশানুরূপ নয়।
মূল্যায়ন পদ্ধতি, শিক্ষক নির্বাচন ও নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, স্কুল সংগঠন ও বিন্যাস, শিক্ষামূলক তত্ত্বাবধান এবং শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধন সম্ভব হয়নি। এ স্তরে শিক্ষার অন্যতম উপকরণ পাঠ্যপুস্তক নির্ভুলভাবে প্রকাশিত হচ্ছে না। পাঠ্যপুস্তকে নানা অসঙ্গতি ধরা পড়ছে, যা শিক্ষার সুষ্ঠু প্রক্রিয়াকে নষ্ট করছে। তাছাড়া আকর্ষণীয় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশেই উন্নতমানের শিক্ষার উপকরণ ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়েছে।
শিক্ষাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষার স্বতন্ত্র অধিদপ্তর গঠনের মাধ্যমে স্তরের সফলতা ক্রমবর্ধমানহারে বেড়েই চলছে। বর্তমানে মাধ্যমিক শিক্ষার পরিধি ও পরিসর ক্রমশই বাড়ছে। মেয়েদের ভর্তির হার বৃদ্ধির জন্য উপবৃত্তি প্রদান, বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি,শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের ফলে মাধ্যমিক স্তরে ভর্তির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। সে তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়েনি।
মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থাকলেও সারাদেশে বিশাল সংখ্যক মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনা দুরূহ। প্রশাসনিক সুবিধার্থে নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয় এবং ৬৪ জেলার শিক্ষা কার্যালয়, ৫১৬টি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, ৬৮৬টি সরকারি কলেজ, ৭০৬টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, এবং ১০৪ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-২০১৪ এর তথ্য মতে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২১২৩২ যার মধ্যে কলেজ ১৫১৪। এ কারণে এ বিশাল সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের জন্য আকাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। অধিকন্তু সরকারি মাধ্যমিকের অধিকাংশ প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, জেলা শিক্ষক অফিসার সহ বিভিন্ন স্থানে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রেষণে এনে অদক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে সুষ্ঠুভাবে শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।ফলে প্রাথমিক শিক্ষার মতো মাধ্যমিক শিক্ষার গতিশীলতা নেই।
মাধ্যমিক স্তরের এ সকল সমস্যা বিবেচনা করে স্বাধীনতা উত্তর বর্ণিত সব শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এর সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষ করে ২০০৩ সালে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশন সুপারিশ করেছিল মাধ্যমিক স্তরের সার্বিক প্রশাসনের জন্য স্বতন্ত্র অধিদপ্তর গঠন করা হোক।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন জানুয়ারি ২০২৫ প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, ‘পৃথক মাধ্যমিক অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। মাধ্যমিক শিক্ষার অধীনে অনেক প্রতিষ্ঠান থাকার কারণে শিক্ষার মান ক্রমশ কমছে। তাই আলাদা অধিদপ্তর গঠন জরুরি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আয়োজিত জাতীয় কর্মশালার সুপারিশের ভিত্তিতে বিয়াম ফাউন্ডেশন গবেষণা ও পরামর্শ সেবা কেন্দ্র একটি প্রতিবেদনে শিক্ষা প্রশাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে দুটি পৃথক অধিদপ্তরে ভাগ করার পরামর্শ দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর সচিব সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি মন্ত্রণালয় /বিভাগের সংস্কার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য মার্চিং অর্ডার দেওয়া হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ২৮ নভেম্বর ২০২৪ -এ দাখিলকৃত সময়নিষ্ঠ সংস্কার পরিকল্পনায় ডিসেম্বর ২০২৫ এর মধ্যে স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অন্তর্ভুক্তি ছিল।
তাই যুগোপযোগী ও মানসম্মত মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে আলাদা অধিদপ্তরের বিকল্প নেই। যদিও বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেষণায় রয়েছে এবং সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার মার্চিং অর্ডারের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের জানুয়ারি -২০২৫ প্রতিবেদন এবং মনিরুজ্জামান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু একটি কুচক্রী মহল এ সফল উদ্যোগকে নস্যাৎ করে বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ সরকার প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক ও রহস্যজনক। তাই স্বতন্ত্র মাধ্যমিক অধিদপ্তর বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজন।
শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়, ব্রতও বটে। শিক্ষকতা একটি শিল্প। যুগ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত নিত্য নতুন পুস্তক লেখা,পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, পাঠ পদ্ধতি শিখন, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের আধুনিক উপকরণ যেমন ওভারহেড প্রজেক্টর, অডিও ভিডিও স্লাইড, রঙ্গিন বোর্ড, চক, ডাস্টার প্রভৃতি কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে তারা শিক্ষাদানকে উপভোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তুলুক, শিক্ষক সমাজ সুশিক্ষিত জাতি গঠনে চমৎকার ভূমিকা পালন করুক এবং সর্বোপরি তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি হোক বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এই প্রত্যাশা সবার।
লেখক: গবেষক, প্রবন্ধকার ও প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ টিচার্স ফেডারেশন (এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল অধিভুক্ত)।
দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠনের লক্ষ্যে পাঁচটি সংকটগ্রস্ত ইসলামি ব্যাংককে একীভূত করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যাকে আর্থিক খাত স্থিতিশীল করার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। নতুন প্রণীত ব্যাংক রেজ্যুলেশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫ এর অধীনে প্রণীত এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আনুমানিক ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা মূলধন প্রয়োজন হবে। একীভূতকরণের জন্য নির্ধারিত পাঁচটি ব্যাংক হলো: ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পুনর্গঠন উদ্যোগ। এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য ব্যয়বহুল লিকুইডেশন বা অবসায়ন প্রক্রিয়া এড়িয়ে চলা এবং শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা। একই সঙ্গে এটি বেসরকারিভাবে পরিচালিত ইসলামি ব্যাংকগুলোর গভীর সংকটকেও তুলে ধরেছে, যেগুলোর অনেকগুলোই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কনগ্লোমারেট বা ব্যবসায়িক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যাদের বিরুদ্ধে তহবিল পাচারের অভিযোগ রয়েছে। সরকারের কমিশন করা ফরেনসিক অডিটে গুরুতর অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখা গেছে— তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৯০ শতাংশেরও বেশি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতে, বছরের পর বছর দুর্বল তদারকির পর একীভূতকরণই এখন একমাত্র কার্যকর উপায়। প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে পরিকল্পনা ও তদারকির জন্য একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আমানতকারীদের স্বার্থকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে। অবসায়ন অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জন্য অনেক বেশি ব্যয়বহুল ও কষ্টকর হবে। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তটি সঠিক। কারণ, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল, যার মধ্যে রয়েছে স্থির বিনিময় হার এবং পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
সংকটে পড়া শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক মিলে একটি বড় ইসলামি ধারার ব্যাংক গঠন করা হচ্ছে। নতুন এই ব্যাংকের যাত্রার শুরুতে মূলধন জোগান দেবে সরকার। ব্যাংকটির প্রধান কাজ হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (এসএমই) অর্থায়ন করা। এই ব্যাংকের অনুমোদন (লাইসেন্স) দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অধীনে এই পাঁচ ব্যাংকের আমানত ও সম্পদ স্থানান্তর করা হবে। এই প্রক্রিয়া খুব শীঘ্রই শুরু হবে। ব্যাংক একীভূত হলেও গ্রাহকদের লেনদেনে কোনো সমস্যা হবে না। তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন ব্যাংকটির গ্রাহক হবেন। এছাড়া শীর্ষ পর্যায় ব্যতীত অন্য ব্যাংকাররা একীভূতকরণের প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত চাকরিতে বহাল থাকবেন। এ প্রক্রিয়া শেষ হতে অন্তত তিন বছর লাগতে পারে বলে জানা গেছে। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫-এর আওতায় এই কার্যক্রম শুরু হবে। আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ হবে। একীভূতকরণের আওতায় ব্যাংকগুলোর যেসব ঋণ খারাপ হয়ে পড়েছে, তা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির (এএমসি) কাছে হস্তান্তর করা হবে। এমনভাবে সম্পদ হস্তান্তর করা হবে, যাতে নতুন ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে থাকে। এতে বিদেশি বাণিজ্যে লেনদেনে খরচ কম হবে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে ব্যাংক টাকা নিতে পারবে। এরপর নতুন একটি ব্যাংকের লাইসেন্স অনুমোদন দেওয়া হবে। পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ ও দায় সেই ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরপর ধীরে ধীরে ব্যাংকের শাখাগুলো একীভূত করা হবে। এ জন্য জনবলও কমানো হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ধার করে আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। দেশে বড় আকারের একটা ইসলামী ধারার ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেশে ইসলামী ব্যাংক খাতের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। অবশ্য জবাবদিহি না ফিরলে ব্যাংক একীভূত করেও ব্যাংক খাত ঠিক হবে না। ব্যাংক যদি রাজনৈতিক লুটপাটের লক্ষ্য হয় এবং আর্থিক খাতের মূল সংস্কারগুলো না হয়, তাহলে কাজ হবে না। এ জন্য আগে সুশাসন, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। গত ৯-১০ মাসেও আর্থিক খাতে পুরোপুরি সুশাসন ফেরেনি। কেন এই সময়ে ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারল না, এটাও বড় প্রশ্ন। ব্যাংক একীভূত করে ভালোভাবে পরিচালনা করা গেলে সেটা ভালো কিছু হবে। এ জন্য কারা পরিচালনা করবে ও সুশাসন কতটা মেনে চলবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের সঙ্গে এই একীভূতকরণের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আশা করা যায়, আগামী সরকারও এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেবে। তবে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংককর্মীদের আশ্বস্ত করতে গিয়ে বলেছেও, এই একীভূতকরণের ফলে কোনো কর্মীকে চাকরি হারাতে হবে না। কর্মীদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। প্রয়োজনে কিছু শাখা পুনর্বিন্যাস করা হবে। যেসব ব্যাংকের শাখা শহর এলাকায় বেশি, সেগুলোর কিছু শাখা গ্রামাঞ্চলে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে বাংলাদেশ ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, ব্যাংকিং খাতের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রক্ষার নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে তা আর্থিক খাতের সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানা হচ্ছে না বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্ট অনেকে। এর ফলে পুরো প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। এই প্রক্রিয়া দিয়ে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধান করা যাবে না। বরং আরো নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে। চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করলেই হবে না। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।রিয়েল অডিট হয়েছে কি না, যাচাই-বাছাই ছাড়া চাপিয়ে দিয়ে একীভূত করলেই ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে এমন ভাবার কারণ নেই। বরং যে ব্যাংকগুলো খারাপ হয়েছে, সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতার অভাবের মতো বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ না করে একীভূত করলে ভালো ব্যাংকগুলো হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা থাকে।বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা করেছে তাতে বলা হয়েছে, খারাপ ব্যাংকের পরিচালকরা ব্যাংক একীভূত হওয়ার পাঁচ বছর পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে পারবে না।এছাড়াও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাঁটাই করার আশঙ্কাসহ নানা অনিশ্চয়তা থাকায় এই প্রক্রিয়া কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশে ব্যর্থতার দায় কেউ স্বীকার করে না। আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রকেরাও ব্যতিক্রম নন। কিন্তু এই ব্যর্থতা পুরো আর্থিক খাতকেই এখন বিপদে ফেলেছে। বেশ কিছু ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়েছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকে পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক হিসেবে নিজস্ব কর্মকর্তা বসিয়েছিল। কিন্তু এরপরও বিশেষ তদারকিতে থাকা বেশির ভাগ ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। দুর্বল ব্যাংকের পরিস্থিতি ভালো হয়নি কেন? এসব ব্যাংকের মালিক ও বড় গ্রাহকদের বেশির ভাগ ছিল সরকারঘনিষ্ঠ। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছে, এটাও বড় প্রশ্ন। কিন্তু ব্যাংক খাতে যে সংকট, ব্যাংক একীভূত করে কি সেই সংকট কাটানো যাবে—এটি একটি বড় প্রশ্ন। এই সংকটের জন্য যারা দায়ী—তা মালিক পক্ষ হোক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কিংবা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, তাদের ব্যাপারে কী করা হচ্ছে, সেটি আরেকটি বড় প্রশ্ন। ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকেই এখন দাবি উঠেছে, তারা ‘লুণ্ঠিত ঋণের’ দায় নিতে চান না। এ দেশে আমানতকারীদের অর্থ যারা লুণ্ঠন করেছেন বা লুণ্ঠনে সহায়তা করছেন, তাদের কোনো শাস্তির মুখে পড়তে হয় না। ব্যাংক একীভূত হয়ে আরও বড় যে ব্যাংক হবে, সেখানে লুটপাট বন্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটা জানাও এখন জরুরি।
লেখক: রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম।