বুধবার, ৪ অক্টোবর ২০২৩
বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা

স্বকীয়তার এক নয়া নিয়ামক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার টোকিওতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। ছবি: পিএমও
দেলোয়ার হোসেন
প্রকাশিত
দেলোয়ার হোসেন
প্রকাশিত : ২৯ এপ্রিল, ২০২৩ ০৯:৫২

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরের প্রাক্কালে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা’ ঘোষণা করে, যেখানে গঠনমূলক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ, আলোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশের টেকসই অর্থনীতি ও সমৃদ্ধিতে তা ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ২৪ এপ্রিল ২০২৩ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এ রূপরেখা সম্পর্কিত বক্তব্য তুলে ধরেন। বহুল প্রতীক্ষিত এ রূপরেখা বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আর এই রূপরেখায় বাংলাদেশ আবারও সামনে নিয়ে এল তার নিরপেক্ষ ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান, যেখানে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন রয়েছে একেবারে কেন্দ্রে। আর এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সংযুক্ত করতে চায় সম্ভাব্য সবাইকে।

বহু প্রতীক্ষিত এ রূপরেখা সম্পর্কে ঘোষণা এসেছিল বিভিন্ন পর্যায়ে। বাংলাদেশের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আরও বেশ কিছু দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল প্রণয়ন করে। আসিয়ান প্রণয়ন করে রূপরেখা। বাংলাদেশ তাই বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ করে নিজস্ব ধারণাসংবলিত এ রূপরেখা প্রণয়ন করল।

যখন সারা বিশ্ব ইউক্রেন যুদ্ধ, তাইওয়ান-সংকট ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক নতুন রূপ দেখতে পাচ্ছে, যেখানে মেরূকরণ আবারও প্রকট হয়ে উঠেছে, ক্রমশ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা জোট ও সমঝোতা, ঠিক তখন বাংলাদেশ তার অবস্থান স্পষ্ট করল সারা বিশ্বের কাছে; আর তা নিজস্ব ধারণার ওপর নির্ভরশীল থেকে প্রতিষ্ঠিত ভারসাম্যের নীতিতে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করতে পারে বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। তা ছাড়া ঢাকা যুক্তরাষ্ট্র, কোয়াডের অন্যান্য দেশ ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে আন্তরিক ও অংশীদারত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। চীনের সঙ্গেও রয়েছে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগিতার এক কার্যকরী সম্পর্ক। আর তাই এ রূপরেখার গুরুত্ব আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে যেখানে বাংলাদেশের স্বকীয়তা প্রকাশ পেয়েছে আবারও।

এই রূপরেখার দুটি দিক বিশেষ দৃষ্টিপাতের দাবিদার। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার সঠিক অবস্থান বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পেরেছে। বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন মহল বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছিল বহুদিন ধরেই, যেখানে বাংলাদেশকে কোনো একটি নির্দিষ্ট মেরু কিংবা গোষ্ঠীবদ্ধ করে বাকি সব বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটানো ছিল মূল লক্ষ্য। সেখানে বাংলাদেশ এই রূপরেখার মাধ্যমে সামনে নিয়ে এল নিজের স্বকীয় পররাষ্ট্রনীতি চর্চার সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রণয়ন করা নীতিমালার আলোকে নয়, বাংলাদেশের নীতি নিজস্ব ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত- এটিই যেন আরেকবার প্রমাণিত হলো। এই রূপরেখার মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনায় নিজস্ব ধারণার বহিঃপ্রকাশে এক নতুন দলিল পেল। নীতিনির্ধারকদের জন্যও এটি একটি দালিলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে, বিশেষ করে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় যুক্ত হবে এক স্থিতিশীলতা। এর প্রভাব লক্ষ্য করা যাবে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমষ্টিগত অবস্থা আলোচনার ক্ষেত্রেও। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের বিদ্যমান পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক নিয়ামকগুলোকে মাথায় রেখে যেহেতু এটি প্রণীত হয়েছে, তাই এটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মৌলিকতারও একটি নতুন বহিঃপ্রকাশ। তিনটি ভিন্ন দিক থেকে এই রূপরেখার ধারণাটিকে পর্যালোচনা করা যায়।

প্রথমত, যখন বাকি বিশ্ব তাদের কৌশলে বলছে এক অবাধ ও মুক্ত প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের কথা। বাংলাদেশ যুক্ত করেছে আরও কিছু বিষয়। বাংলাদেশ চাইছে সংযুক্ত ও সমৃদ্ধ এক প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল যেখানে উন্নয়ন সংঘটিত হবে সমন্বিতভাবে। কেননা, বাংলাদেশ তার রূপরেখায় যুক্ত করেছে শান্তি, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো। বাংলাদেশ এই অঞ্চলকে আরও বিস্তৃত ও সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের এক অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও বদ্ধপরিকর। তাই বাংলাদেশের কাছে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল হচ্ছে স্বাধীন, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।

দ্বিতীয়ত, এই রূপরেখায় চারটি মূলনীতির কথা বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে নিশ্চিত হবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। প্রথমটি হলো, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদে উল্লিখিত নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধার নীতির ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনার সাংবিধানিক আদেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ পরিত্যাগ এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। তৃতীয়টি, ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘ কনভেনশন (ইউএনসিএলওএস)সহ প্রযোজ্য প্রাসঙ্গিক জাতিসংঘ চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলো মেনে চলা। চতুর্থটি হচ্ছে, টেকসই উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, মানবিক কর্মকাণ্ড এবং মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য গঠনমূলক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। তাই বোঝাই যাচ্ছে, এক সামগ্রিক পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার, যা বিশ্বের অন্য শক্তিগুলোর নীতিমালার থেকে ব্যতিক্রম এর ব্যাপ্তির কারণে।

তৃতীয়ত, এর উদ্দেশ্য। ১৫টি উদ্দেশ্যের কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রচলিত ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে- এমনটাই ধারণা করা যায় এর উদ্দেশ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে। কৌশলগত নিরাপত্তা ও সামরিক বিষয়গুলোর বাইরে গিয়ে উন্নয়নের ধারণাকে দেখার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার শান্তির প্রতি আকাঙ্ক্ষাকে আরও ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, যা এ অংশে তুলে ধরা হলো।

শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা
ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই রূপরেখার ফলে দেখা দেবে অধিকতর স্থিতিশীলতা। কেননা, এই রূপরেখায় আলোচ্য হিসেবে এসেছে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলো। পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা জোরদার করা, অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা গড়ে তোলা এবং সংলাপ ও সমঝোতা জোরদার করার কারণে এই নিরাপত্তা হতে পারে আরও টেকসই। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অস্ত্র অপ্রসারণ, শান্তিরক্ষা এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচেষ্টায় অর্থবহ এবং মূল্য-চালিত অবদান বজায় রাখার মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করবে সামাজিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে এই রূপরেখার বাস্তবায়ন।

আন্তদেশীয় অপরাধ মোকাবিলা ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত
এ অঞ্চলে সংঘটিত আন্তদেশীয় অপরাধ মোকাবিলায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে আদর্শিক এবং ব্যবহারিক উভয় পদক্ষেপের সমর্থনের মাধ্যমে এ অঞ্চল হবে আরও নিরাপদ। যেখানে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ ও সহযোগিতা হবে বেগবান। তা ছাড়া সামুদ্রিক নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিদ্যমানব্যবস্থা জোরদার করা, সমুদ্রে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া এবং অনুসন্ধান, উদ্ধার পরিচালনা, আন্তর্জাতিক আইন, ইউএনসিএলওএস ১৯৮২-এর প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুসারে নেভিগেশন এবং ওভার-ফ্লাইটের স্বাধীনতার অনুশীলনকে সমুন্নত রাখার বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি এগিয়ে নিয়ে যাবে বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতির বিকাশকে।

টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ
টেকসই উন্নয়নের বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে এই রূপরেখায়, সেই লক্ষ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, নিয়মভিত্তিক বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার প্রচার, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নয়নের অধিকার এবং সবার জন্য অভিন্ন সমৃদ্ধির মাধ্যম, যা ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাইরে ন্যায়সংগত, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এসব কিছুর ভিত্তি হিসেবে অবশ্য কাজ করবে ভৌত, প্রাতিষ্ঠানিক, জ্বালানি, ডিজিটাল ও মানবসংযোগ বৃদ্ধি, পণ্য, পরিষেবা, মূলধন ও মানুষের চলাচলকে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সহজতর করাসহ উন্মুক্ত ও সুরক্ষিত সাইবার স্পেস এবং বহির্বিশ্বে প্রযুক্তি হস্তান্তর, উদ্ভাবনে সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো।

তবে এসব কিছুর জন্য প্রয়োজন অবাধ বাণিজ্য। তাই এ অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন ও অবাধ বাণিজ্যপ্রবাহকে উৎসাহিত করতে এবং ভবিষ্যতের সংকট ও বিঘ্নগুলো আরও ভালোভাবে পরিচালনা করতে স্থিতিস্থাপক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মূল্যশৃঙ্খল গড়ে তোলার জন্য অভ্যন্তরীণ কৃষি, উৎপাদন, পরিষেবা ক্ষেত্রগুলোকেও নজরে রাখতে হবে।

পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সম্পদের টেকসই ব্যবহার
এসডিজি-১৪ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিকভাবে সম্মত উন্নয়ন অঙ্গীকারের আলোকে এ অঞ্চলে মহাসাগর, সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ, এর টেকসই ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনাকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন পদেক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে আলোচনা রয়েছে। এর বাইরে এ অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা, জলসংহতি এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের প্রচারে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার বিষয়েও আলোচনা রয়েছে, যার মধ্যে আঞ্চলিক বিভিন্ন অনুশীলন প্রচার করার ব্যবস্থা গৃহীত হবে। এ ছাড়া প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক কনভেনশন এবং প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, সামুদ্রিক দূষণ এবং পরিবেশের ওপর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য, ক্ষতিকারক প্রভাবগুলোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাস্তব কাজ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এই রূপরেখায়। তাই তো পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ সবার জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করার কথা আলোচিত হয়েছে।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং মহামারি নিয়ন্ত্রণ
ভ্যাকসিন, রোগ নির্ণয় এবং অন্যান্য চিকিৎসার মতো বৈশ্বিক জনসাধারণের জন্য নিবেদিত পণ্যগুলো সহজলভ্য করতে ভবিষ্যতের মহামারিগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ার বিকাশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার দিকে নজর দেবে সরকার।

স্মার্ট বাংলাদেশ ও উপ-আঞ্চলিকতার বিকাশ: বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনে সহযোগিতা
আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার এবং পারস্পরিক উপকারী পরিপূরকতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপ-আঞ্চলিক অংশীদার এবং প্রাসঙ্গিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে হবে। এতে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর রূপকল্পের আলোকে সবার অভিন্ন সুবিধার জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা, উদ্ভাবনে সহযোগিতা ও সহযোগিতা জোরদারকরণ হবে সহজতর।

তাই দেখা যাচ্ছে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই রূপরেখা আলোচিত হবে এক সমন্বিত ও কার্যকরী দলিল হিসেবে, যা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলভিত্তিকে। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি তার মূল ধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে না। তবে এখানে খেয়াল রাখতে হবে, এ অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রতিটি রাষ্ট্রের, যাদের সীমান্ত কিংবা নীতি রয়েছে এই অঞ্চলকে ঘিরে, তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর এ লক্ষ্য নিশ্চিত করতেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ের সবকিছুই অবশ্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উপাদান, এই রূপরেখা শুধু এক নতুন মাত্রার সংযোজন নির্দেশ করে। কেননা, বাংলাদেশ তার মূলনীতিতে দাঁড়িয়ে রূপরেখা প্রণয়ন করেছে। এটি তাই স্বকীয়তা প্রকাশের এক নয়া নিয়ামক।

লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


অক্টোবরে বিরোধীদের আন্দোলনের তরী তীরে ভিড়বে কি?

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতৃত্বে গত ১ বছর ধরে নামসর্বস্ব বহু দল যুগপৎ আন্দোলন করে আসছে। মূলত আন্দোলনের নেতৃত্বে বিএনপি থাকলেও নেপথ্যে আবার কখনো কখনো প্রকাশ্যে জামায়াত তাদের অবস্থান জানান দেয়। নামসর্বস্ব খুচরা বেশিরভাগই বিএনপির সাবেক, অতিবাম এবং অতিডান কিছু ব্যক্তিও রয়েছেন। বেশিরভাগ দলেরই ঠিকানা কোথায় কেউ জানে না। কিছু উগ্রবাম গণতন্ত্র মঞ্চ নাম ধারণ করলেও গণতন্ত্র তাদের আসল চর্চার বিষয় কখনোই ছিল না। তবে কিছু ছাত্র এবং তরুণকে তাদের পাশে রাখতে পেরেছে। এ নিয়ে সরকারবিরোধী যে আন্দোলন চলছে, তাকে এক নামে যুগপৎ আন্দোলনকারী জোট নামে অভিহিত করা যায়।

তাদের দাবি ক্ষণে ক্ষণে বদলেছে। একসময় ১০ দফা, ১৪ দফা, ১৯ দফা, ২৭ দফা, পরে এসে ৩১ দফায় এক ধরনের রফা নিজেদের মধ্যে হয়েছে। তবে যুগপৎ আন্দোলনকারীরা আগামী নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দাবি জানিয়ে আসছে। গত বছর ১০ ডিসেম্বর তারা ১ দফার একটি রফা করতে চেয়েছিল। সেদিন শেখ হাসিনা সরকারে থাকতে পারবে না বলেও ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ পরিচালনা করবেন বেগম খালেদা জিয়া, যিনি দণ্ডপ্রাপ্ত এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিবেচনায় দণ্ড স্থগিত পেয়ে নিজ গৃহে চিকিৎসা নিচ্ছেন । তা নিয়ে অনেক কাণ্ডই তখন ঘটানোর চেষ্টা হয়েছিল। এরপর এক দফার আন্দোলন ঢাকা থেকে দেশের বিভাগীয় শহর এবং বিভিন্ন জেলায় সমাবেশ, পদযাত্রা ইত্যাদিতে ছড়িয়ে যায়। যুগপৎ আন্দোলনকারীরা সরকার পতনের ডেটলাইন কয়েকবারই দিয়েছিল।

কদিন আগে ৩ অক্টোবরের কথা উচ্চারিত হয়েছিল। এখন এই অক্টোবরেই নাকি তাদের আন্দোলনের বিজয় অর্জিত হবে। তার মানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন। দেশে অসাংবিধানিকভাবে একটা সরকার গঠিত হবে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। তারপর দেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অথচ সংবিধান অনুযায়ী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই শেষ করতে হবে, নতুবা দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। কোনো রাষ্ট্র সাংবিধানিক সংকটে পড়লে জাতীয় জীবনে কতটা বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যুগপৎ আন্দোলনকারীরা গত ১ বছর ধরেই তো আন্দোলনের মার্চ একের পর এক করে এখন অক্টোবর মাসে প্রবেশ করেছে। কিন্তু সরকার পতনের জন্য যে ধরনের গতিবেগ নিয়ে আন্দোলনের তরী ধেয়ে আসার কথা, সেটি কি আদৌও দেখা যায়? শুধু যুগপৎ আন্দোলনকারী দলগুলোর নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে আন্দোলন ঘটলেই সে আন্দোলনে সরকার উৎখাতের মতো শক্তি সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়।

দেশের আপামর জনতার শক্তির সংযোজন ব্যতীত দলীয় শক্তিতে সরকার উৎখাত হওয়ার ইতিহাস খুব একটা নেই। সে কারণেই বর্তমান যুগপৎ আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের তরী অক্টোবরে প্রবেশ করলেও আন্দোলনের শক্তি ও গতি-প্রকৃতি সরকার পতনের মতো বেগ সৃষ্টি থেকে অনেক দূরেই অবস্থান করছে। ফলে অক্টোবর এলেও তরী এখনো তীর থেকে বহু দূরেই মনে হচ্ছে অবস্থান করছে। এরই মধ্যে এক দফার মধ্যে আরও অনেক দফা যুক্ত হতে দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার মুক্তির শর্তও যুক্ত হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে দলীয় নেতারা যা দাবি করছেন, সেটাই গণমাধ্যম প্রচার করছে, দেশের মানুষ জানতে পারছে।

কিন্তু এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকদের বোর্ড এখনো পর্যন্ত তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে কোনো ব্রিফিং দেয়নি। এটি কেন হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। অন্যদিকে এতদিন ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা-১ অনুযায়ী সরকার নির্বাহী আদেশে তার সাজা স্থগিত রেখে বাসায় অবস্থান করা ও চিকিৎসা নেয়ার যে ব্যবস্থা করোনা শুরু হওয়ার প্রাক্কাল থেকে ৬ মাস অন্তর অন্তর বৃদ্ধি করে আসছে, সেটি অতি সম্প্রতিও সর্বশেষ ৬ মাস মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে বিএনপি তার চিকিৎসার ব্যাপারে বিদেশে যাওয়া ছাড়া দেশের চিকিৎসকদের করণীয় কিছু নেই বলে যে দাবি করছে, তা নিয়ে আবারও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। আইনমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পরিবারকে আবারও আবেদন করার কথা বললে সেখানে তার চিকিৎসার জন্য স্থায়ী মুক্তির আবেদন জানানো হয়েছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।

সর্বশেষ এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফৌজদারি কার্যবিধির সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে সরকার নতুন আবেদনপত্র গ্রহণ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে গত ৩-৪ বছর যে ধরনের আইনি বিতর্ক গণমাধ্যমে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মুখ থেকে শোনা হচ্ছে, তার বেশি কিছু সাধারণ মানুষের জানা বা বোঝা সম্ভব হচ্ছে না।

অক্টোবর মাসে যেখানে যুগপৎ আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ছাড়া ঘরে ফিরবে না বলেছিল, সেখানে বেগম খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তির দাবির সংযুক্তি কতটা আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগাবে, তাতে সন্দেহ আছে। সেটির চাইতেও তিনি যদি সত্যি সত্যিই বিএনপির দাবি মোতাবেক ‘জীবন-সন্ধিক্ষণে’ থেকে থাকেন, তাহলে সে ব্যাপারেই বিএনপি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভবের তাড়া দেখাত। কিন্তু সেটি কেন করা হচ্ছে না? সরকার যে যুক্তি দেখাচ্ছে, সেই যুক্তিকে খণ্ডন না করে আইনি এবং মানবিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগের সমন্বয় সাধন করে তার জীবন রক্ষা করাটাকেই বিএনপির দিক থেকে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসা উচিত নয় কি? সরকার যদি তাতে অযৌক্তিক আচরণ করে তা হলেই বরং মানুষের কাছে বিষয়টি অনেক বেশি স্পষ্ট হতো।

সে ক্ষেত্রে সহানুভূতি লাভের ক্ষেত্রে বিএনপি সুবিধা পেত। কিন্তু বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থাকে আন্দোলনের এক দফার ইস্যুর সঙ্গে অক্টোবরে যুক্ত করা যৌক্তিকতা অনেকেই খুঁজে পাচ্ছেন না। বিএনপি যদি আশা করে থাকে যে, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুটি তাদের এক দফার আন্দোলনকে শক্তি জোগাবে তা হলে এর জন্য প্রয়োজন হবে মেডিকেল বোর্ডের সুস্পষ্ট প্রতিবেদন, যা তাদের দাবির সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও তো তেমন কোনো প্রশ্নহীন উদ্যোগ দেখা যায় না। ফলে এই ইস্যুটি সরকার পতনের আন্দোলনের এক দফার সঙ্গে মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়।

বিএনপির চলমান রোডমার্চ কর্মসূচি ৫ তারিখ কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম গিয়ে এ ধাপে শেষ হবে। ওই দিনই নতুন কর্মসূচি অক্টোবরে কী হতে যাচ্ছে তা ঘোষিত হবে। তবে ঢাকা শহরে সারা দেশ থেকে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের অংশগ্রহণে ঢাকা অবরোধসহ নানা ধরনের অবস্থান ধর্মঘট কিংবা হরতাল কর্মসূচির মতো কিছু আসতে পারে- এমনটি তারা আগে উচ্চারণ করেছিল। এখন আন্দোলনের ধরন কী হবে সেটি বোঝা যাবে ৫ তারিখের পরেই । শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি শেষ পর্যন্ত কতটা শান্তিপূর্ণ থাকবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। কারণ রাস্তার কর্মসূচি কখনোই দীর্ঘমেয়াদে কার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। নানা অপশক্তি এর ভেতরে ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এবার যে তা থাকবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। গত এক বছর যুগপৎ আন্দোলনকারীদের আন্দোলন ক্ষণে ক্ষণে গতিপথ পরিবর্তন করে এ পর্যন্ত এক ধরনের শান্তিপূর্ণ চরিত্রেই ছিল। এখন শেষ মুহূর্তে আন্দোলনকারীরা যদি এর চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে তরী তীরে ভেড়ার পরিবর্তে বহু দূরেই গতিপথ পরিবর্তন করে চলে যেতে পারে। আওয়ামী লীগ যুগপৎ আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি নিজেদের শান্তির সমাবেশ নামের কর্মসূচি চালিয়ে এসেছে। তা নিয়ে কারও কারও উষ্মা থাকলেও রাস্তায় সরকার ও বিরোধীদের কোনো সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা যায়নি। বিরোধীরা এক ধরনের সতর্কতা কিংবা চাপ অনুভব করেছে। আওয়ামী লীগও রাস্তায় বক্তৃতার বেশি তেমন কোনো তোড়জোড় দেখায়নি।

এখন বিরোধীরা কেমন কর্মসূচি দেবে তার ওপর ভিত্তি করেই আওয়ামী লীগের কর্মসূচি থাকবে বলে তারা ঘোষণা দিয়েছে। সুতরাং অক্টোবরের মধ্যে এক দফার ফয়সালা হবে নাকি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিরোধীরাও চ্যালেঞ্জ নেবে সেটি দেখার বিষয়। এবার পরিস্থিতি ২০১৩-এর মতো নয়। সরকারি দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্ত অবস্থানেই রয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলও বাংলাদেশের ওপর গভীর পর্যবেক্ষণ করছে বলে দাবি করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে নির্বাচনে বাধাদানকারী ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও পক্ষকে তারা ভিসা না দেয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছে। গোটা বিষয়টি নিয়ে এখন নানা এলোমেলো মতামত ঘুরপাক খাচ্ছে। এটি আমাদের কারও জন্যই মর্যাদা বহন করে না।

অথচ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানে এবার নির্বাচন কমিশন আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্ত অবস্থানে আছে। সুতরাং বিরোধীদের অংশগ্রহণ নির্বাচনকে শক্তির ভারসাম্য দেবে, যা সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষেই কাজ করবে। দেশে এখন সরকার পতন আন্দোলনের যৌক্তিকতা যুগপৎ আন্দোলনকারীদের বাইরের সাধারণ মানুষের কাছে খুব একটা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারও অভিজ্ঞতায় একটি ব্যর্থ ব্যবস্থা বলে প্রমাণিত হয়েছে। সে কারণে মানুষের আগ্রহ তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। শেখ হাসিনার পদত্যাগ সমস্যার সমাধান দেবে না বরং রাষ্ট্রকেই সংকটে ফেলে দেবে। বিরোধীরা নির্বাচনে অংশ না নিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিতর্কিত বলে অভিহিত করতে চাইতে পারে। কিন্তু সরকার ও নির্বাচন কমিশন সে সুযোগ বোধ হয় এবার নির্বাচনে সৃষ্টি করবে না। সুতরাং যুগপৎ আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের অক্টোবর পর্বটি দেশীয় এবং বিদেশি নানা বাস্তব পরিস্থিতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ তরী তাই তীরের ধারেকাছে আদৌও আসতে পারবে কিনা সেটিই দেখার বিষয়।


ঢাকা মেট্রো : শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশের পথে যাত্রা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মাহবুব আলম

রাজধানীর যানজট নিরসন, সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার প্রতিবিধান, নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত, আরামদায়ক গণপরিবহন, বহুমাধ্যমভিত্তিক সুসমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয় বর্তমান সরকার। ঢাকার যানজট নিরসনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পায়। এরই আলোকে মেট্রো রেল এখন দৃশ্যমান। বিআরটি ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। যার নির্মাণ সম্পন্ন হলে যাত্রাপথে আর ভোগান্তিতে পড়তে হবে না মানুষকে।

গণপরিবহনের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম মেট্রো ঢাকায় নবীন হলেও ১৮৬৩ সালে লন্ডনে প্রথম দ্রুত ট্রানজিট সিস্টেম চালু করা হয়েছিল, যা এখন ‘লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর একটি অংশ। ১৮৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এনওয়াইতে এর প্রথম দ্রুত ট্রানজিট রেল ব্যবস্থা চালু করে এবং ১৯০৪ সালে নিউইয়র্ক সিটি সাবওয়ে প্রথমবারের জন্য খুলে দেয়। আর এশিয়ার মধ্যে জাপান হলো প্রথম দেশ, যেখানে ১৯২৭ সালে একটি পাতাল রেল নির্মাণ করা হয়। ভারত ১৯৭২ সালে কলকাতায় মেট্রোরেল নির্মাণ শুরু করে; যা চালু হয় ১৯৮৪ সালে। এখন দেশটি চেন্নাই, দিল্লিসহ অন্যান্য শহরেও মেট্রো তৈরি করেছে। বর্তমানে বিশ্বের ৫৬টি দেশের ১৭৮টি শহরে ১৮০টি পাতাল রেল চালু রয়েছে।

ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা নতুনত্ব আনতে শুরু হয় মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার ‘ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে, ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট তথা মেট্রোরেল প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পাস হয়। গঠিত হয় মেট্রোর পরিচালন প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।

শুরুতে প্রকল্পের জন্য মোট ৫টি রুট লাইন প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে এমআরটি লাইন ১, ২, ৪, ৫, এবং ৬। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এর অর্থায়নে ‘দ্য ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট সার্ভে (ডিএইচইউটিএস ১)’ মূল্যায়ন করা হয় এবং ‘এমআরটি লাইন-৬’ নামে মেট্রো রেলের জন্য প্রথম এমআরটি রুট নির্বাচন করা হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় আনুমানিক ২.৮২ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে জাইকা ০.০১ শতাংশ সুদের হারে প্রায় ৭৫ শতাংশ বা ২.১৩ বিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে। বাকি ২৫ শতাংশ তহবিল দেয় বাংলাদেশ সরকার।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের জুনে নির্মাণ কাজের সূচনা করেন। প্রাথমিকভাবে, ‘এমআরটি লাইন ৬’-এর দৈর্ঘ্য ২০.১ কিলোমিটার হিসেবে প্রস্তাব করা হয়, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত, যা পরে কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। ফলে রুটটির দৈর্ঘ্য আরও ১.১৬ কিলোমিটার বেড়ে মোট দৈর্ঘ্য হবে ২১.২৬ কিলোমিটার। রুটে মোট ১৭টি স্টেশন থাকবে এবং রুটে ২৪টি ট্রেন সেট চলাচল করবে।

করোনাকালেও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নির্মাণকাজ চলে। এর আগে হলি আর্টিজান হামলায় কিছুদিন কাজ স্থবির ছিল। ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট প্রথম ট্রেনটির ট্রায়াল রান দিয়াবাড়ি থেকে উত্তরা পর্যন্ত পরিচালিত হয়। অবশেষে ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম দিকে দিনে চার ঘণ্টা চলাচল করবে। উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলাচলে মাঝে কোনো স্টেশনে থামবে না, তবে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য স্টেশনে থামবে মেট্রো।

তথ্যমতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মেট্রোরেলে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৬০,০০০ যাত্রী বা প্রতিদিন ৯৬০,০০০ জন যাত্রীর যাতায়াত করা সম্ভব হবে। তবে এখন উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত দৈনিক চলাচল করতে পারবেন। এখন সর্বোচ্চ ২০০ যাত্রী নিয়ে চলবে মেট্রোরেল। পরে চলাচল এবং যাত্রী বাড়ানো হবে। মেট্রো চালুর ফলে চরম বিরক্তির পর্যায়ে গিয়ে ঠেকা ঢাকার রাস্তায় নিত্য যাতায়াতকারীদের একটি অংশ অন্তত স্বস্তি পাবেন। গণপরিবহনে চলতে গিয়ে অহর্নিশ নারী যাত্রীদের হয়রানির খবর পত্রিকায় পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে নিরাপদ চলাচলে ভূমিকা রাখতে পারে মেট্রোরেল। এতে নারীর ক্ষমতায়ন যেমন বাড়াবে, তেমনই চলাচলে স্বস্তিও পারবেন তারা। জানা গেছে, এই রেলের একটি বগি নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। ফলে চলাচলে ভোগান্তি কমবে এবং শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক বেড়ে যাবে।

ঢাকা মেট্রোরেল নির্মাণে সহযোগিতা করছে জাপান। একটি দেশের গণপরিবহনব্যবস্থা যে কতটা সুশৃঙ্খল আর কার্যকর হতে পারে, জাপান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। টোকিও শহরে জনবসতি ঢাকার চেয়েও বেশি। কিন্তু অফিসের দিনেও রাস্তা দেখা যায় ফাঁকা। প্রতিটি নাগরিকেরই অন্তত একটি গাড়ি আছে, কিন্তু তা ক্বচিৎ ব্যবহার করে থাকেন তারা। অফিসে যান মেট্রো বা পাতালরেলে। দেশটি ভ্রমণকারী সহকর্মী-বন্ধুদের ভাষ্যমতে, সাধারণত ছুটির দিনে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে যান অধিবাসীরা।

দেখা যায়, কারও অফিস টোকিও। কিন্তু অন্য শহরে বাস করেও দৈনিক ৭০-৮০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত রেলে যাওয়া-আসা করেন। বাড়ি থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত আসা হয় সাইকেলে চড়ে। এরপর সেই রেলস্টেশনেই আছে বিশাল বড় সাইকেল পার্কিং জোন। অতঃপর ট্রেনে চেপে টোকিওতে এসে নির্দিষ্ট আরেকটি স্টেশনে আছে তার আরেকটি সাইকেল। এতে চেপে অফিসে ডান। বিদ্যুচ্চালিত রেল আর পদচালিত সাইকেল—এই দুয়ের কোথাও কোনো বায়ুদূষণ নেই। ফলে বাতাস থাকে নির্মল! ঢাকা মেট্রোরেলের কাজটিও করেছে জাপান। সেদিক থেকে মেট্রোরেলটির মান ও সুযোগ-সুবিধাদি ও চালনা কৌশল জাপানের অনেক পুরোনো রেলসিস্টেম বা স্টেশনের তুলনায় অনেক উন্নত ও আধুনিক মানের।

এর মেঝেতে টাইলস নয়, ব্যবহার করা হয়েছে গ্রানাইট পাথর। প্রতিটি স্টেশনে লিফট আছে কয়েকটি, যা উন্নত দেশেও অনেক ক্ষেত্রে বিরল। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের সচেতন জরুরি। যা উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রীও তার বক্তব্যে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘অনেক টাকা খরচ করে মেট্রোরেল করা হয়েছে। এই মেট্রোরেল সংরক্ষণ করা সবার দায়িত্ব। যাতে মেট্রোরেলের কোনো কিছু নষ্ট না হয়, সে জন্য সবাইকে মেট্রোরেল নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যবহারের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৯ ডিসেম্বর ২০২২) তার এই আহ্বানে সাড়া দিতে হবে। নয়তো এই সুন্দর স্থাপনাগুলো একসময় হয়তো বা আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়ে উঠতে পারে। যা আমরা বাংলাদেশ রেলওয়ের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে দেখি।

বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ বড় শহরগুলোতে মেট্রোরেল তথা এ ধরনের গণপরিবহন চালুর অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষের যোগাযোগকে সহজ ও সময় সাশ্রয়ী করা। এতে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতিও বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়। এসব দিক বিবেচনায় রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল চালু হওয়া একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার।
মেট্রোরেল যানজট এড়িয়ে আমাদের গণমানুষের যাতায়াতের সময় বাঁচাবে। এর ফলে অনেক কর্মঘণ্টা আমরা পাব। যে কর্মঘণ্টাগুলো মানুষ কোনো না কোনো কাজে লাগাতে পারবে। এমনকি মানুষ যদি বিশ্রামও নেয়, তাতে তাদের অন্য কাজের গতিশীলতাও বাড়বে। অর্থাৎ মেট্রোরেলের মাধ্যমে শুধু যে তাৎক্ষণিক যাতায়াতের সময় বাঁচবে তা নয়, গণমানুষের কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতাও বাড়বে।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন অর্থনৈতিক, গতিশীলতা ও বৃহত্তর উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও তার দূরদর্শী চিন্তায় সমন্বিত, টেকসই ও গতিশীল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কারণেই উন্নত অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছে দেশ। তিনি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছেন। উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন মানুষের জীবনযাত্রা অনেক সহজ, সুন্দর আর নিরাপদ। বিগত ১৪ বছরের পথ পরিক্রমায় মধ্যম আয়ের দেশ থেকে আমরা এখন উন্নত দেশের অভিযাত্রী।

এরই ধারাবাহিকতায় দেশবাসীর জন্য আসছে একের পর এক নতুন অভিজ্ঞতার সুযোগ। নতুন সবকিছুর সঙ্গে একটা অভ্যস্ততার বিষয় থাকে। উন্নত স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি উন্নত আচরণে অভ্যস্ত হওয়াও তাই সময়ের দাবি। যানজট থেকে মুক্তি আর পরিবেশের মানোন্নয়নে এই মেট্রোরেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর ২০৪১ সালের জননেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প অনুযায়ী ৫৬ হাজার বর্গমাইলেই এই বদ্বীপ হয়ে উঠুক স্মার্ট বাংলাদেশ— এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।


পরিবেশবান্ধব ঢাকা, টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ফারাজী আজমল হোসেন

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নিয়ামক হিসেবে পরিবেশবান্ধব বিবিধ উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বিশেষত সবুজ বিপ্লবের কথা বর্তমানে অন্যতম গবেষণা ও আলোচনার বিষয়। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গবেষণা চলছে দেশে। তবে তার থেকেও বেশি যে উদ্যোগ প্রয়োজন তা হলো পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা। এবার তেমনি এক প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)।

রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসন ও পরিবহন ব্যবস্থা শৃঙ্খলা নিয়ে আসার মাধ্যমে গতিশীল এক পরিবহন খাত তৈরির উদ্যোগ হিসেবে ঢাকায় প্রায় ৪৫০টি নতুন বাস চালুর উদ্যোগ নেয় বিআরটিসি। পরে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের জন্য ৩৪০টি সিএনজিচালিত শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাস ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, এই উদ্যোগের হাত ধরে ব্যাপক উন্নতি ঘটতে চলেছে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থার। এই বাস শুধু যানবাহনের সমস্যাই মেটাবে না, শহরের দূষণবৃদ্ধি প্রতিরোধেও কাজ করবে। অর্থাৎ দূষণমুক্তিতেও শহরবাসীর স্বার্থে কাজে লাগবে বিআরটিসির নতুন বাস ক্রয়ে পরিকল্পনা।

বিশ্বের জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় প্রথমসারির নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু সংকট ও পরিবেশ রক্ষার জন্য তাগাদা দেয়ার পাশাপাশি দেশেও নবায়নযোগ্য ও দূষণমুক্ত জ্বালানি ও পরিবহন ব্যবস্থার জন্য কাজ করছেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় দূষণমুক্ত পরিবহন অগ্রাধিকার পাচ্ছে গোটা দেশেই।

দেশের উন্নয়নের ধারা গতিশীল করলেও বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের বিষয়টি মাথায় রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। তাই তিনি দূষণমুক্ত পরিবহনকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সরকারও দলীয় নেত্রীর নির্দেশে দূষণরোধে তৎপর। দূষণরোধে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কথাই ফুটে ওঠে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক অধিবেশনেও। সেখানে তিনি বলেছেন, বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের ০.৪৭ শতাংশেরও কম অবদান রাখলেও বাংলাদেশ জলবায়ুজনিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য মারাত্মক হুমকি। এর সমাধানের লক্ষ্যে জরুরি, সাহসী এবং উচ্চাভিলাষী সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।...জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের উন্নয়ন চাহিদার কথা বিবেচনা করতে হবে। আমরা ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত তহবিলের জরুরি বাস্তবায়ন চাই।

তবে তহবিল বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা না করেই বাংলাদেশ সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। নতুন বাসগুলো, চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে পৌঁছানোর কথা। বিআরটিসি তাদের বহরের বর্তমান বাসগুলোকে প্রতিস্থাপন করার জন্যই এই উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ বর্তমানে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাসগুলোর একটি বড় অংশ বহুদিন ধরে চলছে এবং সেগুলো ব্যবহারের অনুপযুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে। দূষণরোধে সেই বাসগুলোকে বাতিল করে নতুন বাস চালু করা জরুরি হয়ে উঠেছে বলে বিআরটিসির অভ্যন্তরীণ বেশকিছু প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। আমাদের রাস্তা থেকে অযোগ্য যানবাহন তুলে নিয়ে নতুন বাস চালুর জন্য গণমাধ্যমে বহু লেখালেখিও হয়েছে। সরকার সেই বাস পরিবর্তনের মাধ্যমে শহরবাসীর দীর্ঘ দিনের চাহিদা মেটাতে চলেছে। পুরোনো বাসগুলো কেবল পরিবেশের জন্যই ভয়ঙ্কর নয়, যাত্রী নিরাপত্তায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সজ্জিত না হওয়ার কারণে ঝুঁকিপূর্ণও।

পরিবেশবান্ধব বাস চালু করা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর ফলে একটি টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে, ঢাকা তার সামগ্রিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে অবদান রাখবে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনেও আমাদের ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হবে। তা ছাড়া পরিবেশবান্ধব বাসের সম্ভাবনাকে সর্বাধিক করার জন্য, একটি ব্যাপক পদ্ধতির প্রয়োজন।

বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে যানজট এবং পরিবেশ দূষণের জোড়া চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মোকাবেলা করছে এবং এই বাসগুলোর প্রবর্তন আশার আলো জাগাচ্ছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং ব্যবহারকারীদের মধ্যে। বিআরটিসির এই উদ্যোগকে একটি বাস্তব ও টেকসই সমাধান হিসেবে দেখছেন অনেকেই। যানজট এবং পরিবেশগত উদ্বেগ উভয়ই দূর করতে সাহায্য করবে এ ধরনের উদ্যোগ। কারণ সময় এসেছে টেকসই শহরে গতিশীলতার পথে এই অঞ্চল এবং এর বাইরে অন্য শহরগুলোর জন্য একটি উদাহরণ স্থাপন করা।

সিএনজিচালিত একতলা এসি বাসগুলো আমদানিতে খরচ হবে এক হাজার কোটি টাকা। এর জন্য প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ দেবে দক্ষিণ কোরিয়া। বাসগুলোর সঙ্গে আনা হচ্ছে ১৫ শতাংশ খুচরা যন্ত্রাংশ ও রক্ষণাবেক্ষণ সরঞ্জাম। প্রতিটি বাসের পেছনে গড়ে খরচ হবে ৩ কোটি টাকা। ঢাকার পাশাপাশি বিভিন্ন বড় শহরে চলাচল করবে এসব বাস।

বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম জানান, ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে বিআরটিসি দেশে বৈদ্যুতিক বাস আমদানিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু ওই প্রকল্পের ঋণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তাই পুরোনো বাসগুলোকে বাতিল করে পরিবেশবান্ধব পরিবহনের স্বার্থে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই সিএনজিচালিত বাস আমদানি করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, উন্মুক্ত দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতার কাছ থেকে বাস কেনা হবে। বাসগুলো সাত বছর চললেই পুরো ঋণের খরচ উঠে যাবে।

ঢাকার রাজপথের সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাজধানীজুড়ে বিআরটিসির কিছু এসিবিহীন বাস চলছে। কিন্তু সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আবার প্রচণ্ড গরমে নন-এসি বাসগুলো কাঙ্ক্ষিত যাত্রীও পাচ্ছে না। এসি বাসের স্বল্পতায় এসি প্রাইভেট কার বাড়ছে, যা যানজট ও বায়ুদূষণ বাড়াচ্ছে।
এই পর্যবেক্ষণ থেকেই স্পষ্ট যে আরামদায়ক গণপরিবহনের নিশ্চয়তায় বিআরটিসির জন্য যে এসি বাস কেনা হচ্ছে এই সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক। কিন্তু বিআরটিসির এই উদ্যোগের সমালোচনাও রয়েছে। তবে সবকিছু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় সরকার বাস্তব চাহিদার কথা মাথায় রেখেই এমন বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বিবেচনায় রেখে মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যকেই বর্তমান সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। তাই টেকসই অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন তারই ইঙ্গিত বহন করে এবং পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর কিছুই আওয়ামী লীগের সরকার গ্রহণ করতে চায় না। তাদের উন্নয়নের মূল নীতিই হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন। সেই লক্ষ্যেই মেয়াদাত্তীর্ণ বাস বাতিল করে নতুন সিএনজিচালিত পরিবেশবান্ধব বাসের আমদানি। ভবিষ্যতে বিদ্যুৎেচালিত বাসও নিয়ে আসার প্রকল্প রয়েছে বিআরটিসির। কিন্তু সেই বাস কিনতে আরও কিছু সময় লাগবে। তাই আপাতত নতুন বাস কিনে এনে রাজধানীর পরিবহন সংকট হ্রাস এবং পরিবেশকে সামাল দেয়ার পাশাপাশি দেশের গণপরিবহনে নতুন মাত্রা যোগ করছে বিআরটিসি।

সড়ক পরিবহন বিশ্লেষকদের ভাষ্যমতে, গণপরিবহনের ওপর সাধারণ মানুষের নির্ভরতা যত বাড়ছে তত প্রাইভেট বা রেন্টে চলা গাড়ির পরিমাণ হ্রাস পাবে। এভাবে একই সঙ্গে যেমন পরিবেশের উন্নয়ন হবে, তেমনি যানজট কমবে রাজধানীর বুকে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট


দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার 

প্রতিদিন লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দ্রব্যের মূল্য। সে তুলনায় বৃদ্ধি পাচ্ছে না সাধারণ মানুষের আয়। প্রতিনিয়ত হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন যুক্তি উত্থাপন করা হলেও মানুষের মাঝে আশার সঞ্চার হচ্ছে না। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজের অবস্থা আরও বেগতিক। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা মাইকে গলা ফাটিয়ে বক্তব্য দিলেও কোনো কাজে আসছে না বরং দেখে মনে হচ্ছে, সবকিছুই যেন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে ব্যবসায়ীরা অবৈধ মুনাফা অর্জনের নেশায় মত্ত হয়ে পড়েছে।

সবমিলিয়ে বর্তমান অবস্থা এতটা নাজুক যে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে অতীতের সঞ্চয়কে নষ্ট করছে কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলোর সমন্বয় সাধন করছে। বাজারের নিত্যপণ্যের মধ্যে চাল-ডাল-তেল-মসলা-সিলিন্ডার গ্যাসের সমন্বয় করতে গিয়েই সারা মাসের বাজেট ব্যয় করতে হচ্ছে। করোনার প্রভাব কাটিয়ে যখন স্বাভাবিক পথে ফিরে আসছিল সারা পৃথিবীর অর্থনীতি, সে সময় আবার ধাক্কা লাগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আমদানি-রপ্তানিতে পড়ে ব্যাপক প্রভাব। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেসব প্রভাবের ফলেই কি কেবল সবকিছুর দাম বাড়ছে নাকি সরকারের কম নজরদারির সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা? এ অন্যায়ভাবে দাম বৃদ্ধি থেকে সরকার কখনো তার দায় এড়াতে পারে না।

এমনিতেই আমরা কান কথা বিশ্বাস করি খুব বেশি। বাজারে বিভিন্ন পণ্যের ঘাটতি দেখা দিতে পারে এমন সংবাদের ফলে সামর্থ্যবান মানুষ অধিক পরিমাণে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে থাকে যার ফলে বাজারে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় এবং সে সুযোগটা নেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা। যুদ্ধ ও করোনার ফলে আমদানিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে বলে অন্যায়ভাবে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত অথচ অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে যার মাঝে আমদানির প্রভাব পড়ার কথা না। দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কিন্তু সেটা যদি হয় লাগামছাড়া তাহলে মানুষের মাঝে অস্থিরতা তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক। বেশি কষ্ট হলো যাদের আয় সীমিত এবং প্রতিনিয়ত আয়ের পরিবর্তন হচ্ছে না, তাদের পক্ষে হিসাব মেলানো অনেক কঠিন। মাসের শুরুতে সারা মাসের খরচের জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয় তা দিয়ে সারা মাসের খরচ মেটানো যাচ্ছে না যার ফলে গচ্ছিত টাকা ও ঋণের মাধ্যমে ব্যালেন্স করতে হচ্ছে নতুবা প্রয়োজনীয়তাকে জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে।

পরিবারের খরচ মেটাতে না পারার কারণে অনেকেই যেমন হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে অন্যদিকে বিভিন্ন অপকর্মেও পা দিচ্ছে। তা ছাড়াও সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর যেসব ব্যবস্থা রয়েছে তাও সঠিকভাবে আয়ের দিক দিয়ে নিম্নশ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছছে না। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সরকারের প্রদত্ত সেবার বাইরে মানুষকে অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে। যেসব পণ্যের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ থাকে না, সেসব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের বেলায় সরকারকে আরো বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে। অন্যদিকে জনসাধারণকে কিছুটা কষ্ট স্বীকার করে মিতব্যয়ী হতে হবে এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় বিশেষ নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমদানিনির্ভরতা কমাতে না পারলে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে হলে কেবল সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয় সেই সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত হতে হবে। অন্যদিকে সরকারকেও অর্থনীতি শক্তিশালী করার জন্য রপ্তানির নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে, না হলে অর্থনীতির ভারসাম্য তৈরি হবে না। যেসব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে, সে সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে রপ্তানি বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে কথাটি না বললেই নয়, তা হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করতে হবে। ইতোমধ্যে নির্বাচন সামনে রেখে শুরু হয়েছে নতুন নতুন চক্রান্ত, সেদিকে নজর দেয়া জরুরি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে সবচেয়ে আগে বাঁচাতে হবে এ দেশের কৃষক সমাজকে, যারা আমাদের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ।

কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের খরচ যেন বৃদ্ধি না পায় এবং উৎপাদনের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সমস্যাটা হচ্ছে বিশ্ববাজারের অজুহাত, কখনো ডলার সংকট আবার গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের অজুহাতে দাম বৃদ্ধি করা হয় কিন্তু সংকট কেটে গেলে দাম আর কমে না। বর্তমানে সরকারের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আশ্বাস দিচ্ছেন যে, দাম আর বাড়বে না কিন্তু ব্যাপারটা এ রকম যে, কে শুনে কার কথা। সর্বোপরি সরকারের সব বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে যেন নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা যায়। সেই সঙ্গে নিত্যপণ্যের বাজার যেন জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে সে জন্য নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতে হবে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে কেউ যেন কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে, সেজন্য কঠিন হস্তে বাজার মনিটরিং করতে হবে।

লেখক: শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী


মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রেজাউল করিম খোকন

মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে। এ জন্য বাংলাদেশের সার্বিক সংস্কার প্রয়োজন। বিশ্বের বহু দেশ এ ফাঁদে পড়েছে। আবার অনেক দেশ সাফল্যের সঙ্গে উত্তরণ করেছে। যেমন- সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া। আবার গ্রিস ও আর্জেন্টিনার মতো দেশ এই ফাঁদে পড়েছে। উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে বাংলাদেশের সার্বিক সংস্কার প্রয়োজন। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তেমনি রাজস্ব-জিডিপি বাড়াতে সংস্কার দরকার। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন হলেই তা টেকসই হবে। জনগোষ্ঠীর বড় অংশের জীবনমানের উন্নয়ন করতে না পারলে তা কাজে আসবে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপরও জোর দিতে হবে । গত পাঁচ দশকে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে অন্যতম দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এগুলো হলো নারীর ক্ষমতায়ন, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর অভিযোজন।

বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি বিঘ্নিত হচ্ছে। আবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া বাংলাদেশের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৭৪ গুণ বেড়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, আবার গড় আয়ুও বেড়েছে। মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে বাজারনির্ভর অর্থনীতি, বেসরকারি খাতে সহায়তা, প্রযুক্তি পরিবর্তন, মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে গোটা পাঁচেক শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ। কারণ দেশটি মাত্র ১০ বছরেই মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছিল। কোরিয়া কীভাবে দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হলো? ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের আয়বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মাথাপিছু আয় ১২ হাজার মার্কিন ডলার অতিক্রম করায় উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করে কোরিয়া। আর ২০২১ সালে ২৬ বছরে দেশটির জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ৯৯৮ ডলার। এর বদৌলতে কোরিয়া এখন বিশ্বের দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে।

কোরিয়ার এই উন্নয়নের সামগ্রিক প্রক্রিয়া থেকে বাংলাদেশ পাঁচটি শিক্ষা নিতে পারে। এগুলো হলো বাজারনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের টেকসইভাবে সহায়তা প্রদান, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, মানবসম্পদের উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সংস্কার সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি। মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়িয়ে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হতে কোরিয়া থেকে আমরা শিখতে পারি। রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হতে হলে আমাদের বাণিজ্যনীতি নতুন করে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। রপ্তানি ঝুড়িতে পোশাক খাতের বাইরের পণ্য বাড়াতে হবে।এ ছাড়া উদ্ভাবন, দক্ষ শ্রমিক ও উচ্চ উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে আমরা এই ফাঁদ এড়াতে পারব। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ান তা প্রমাণ করেছে। আবার এই দুটো জিনিসের অভাবে আর্জেন্টিনার আটকে পড়াকে অনেকেই ফাঁদ ভেবে সান্ত্বনা নিচ্ছে। পুরোটাই দেশগুলোর নিজস্ব গতিময়তা বা কুশাসনের ফল।

যে রাষ্ট্রে মাথাপিছু আয় ১,০৮৬ ডলারের কম, তা নিম্ন আয়ের অর্থনীতিতে হিসাবে পরিগণিত। মাথাপিছু আয় ১,০৮৬ থেকে ১৩,২০৫ ডলারের মধ্যে থাকলে তাকে মধ্যম আয়ের দেশ বলা হয়। মাথাপিছু আয় ১৩,২০৫ ডলারের ওপরে তুলতে পারলেই সে দেশ উচ্চ আয়ের বাসিন্দা। মধ্যম আয়ের প্রথম ধাপকে নিম্ন মধ্যম আয় বলা হয়, যেখানে মাথাপিছু আয়ের বন্ধনী ১,০৮৬ থেকে ৪,২৫৫ ডলার। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ মানে তার মাথাপিছু আয় ৪,২৫৬ থেকে ১৩,২০৫ পর্যন্ত। এ সংখ্যাগুলো সময়ে সময়ে বাড়ানো হয় মূলত মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করে।

মধ্যম আয়ের ফাঁদ বলতে প্রায় ১ হাজার ১০০ থেকে ১৩ হাজার ডলারের মাথাপিছু আয়ের মধ্যে আটকে থাকার ঘটনাকে বোঝানো হয়েছে। বাংলাদেশের সামনে ধাপ দুটো। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া, যার জন্য দরকার প্রায় ৪ হাজার ৩০০ ডলার মাথাপিছু আয় করা। তারপর উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়া, যার জন্য দরকার হবে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার ডলার মাথাপিছু আয় অর্জন। বর্তমানের ২ হাজার ৮০০ ডলারের আয় নিয়ে ৫-৬ ভাগের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে এ দেশ ৭ থেকে ৯ বছরের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ে পৌঁছাতে পারবে, যা ঘটবে ২০৩১ সালের পর। কিন্তু উন্নত দেশ বা উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে কমপক্ষে ২৭ বছর সময় লাগবে, যদি মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৬ ভাগ। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, জনসংখ্যার বৃদ্ধি ১ দশমিক ৩ ভাগ ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৭ দশমিক ৩ ভাগ।

এ থেকে এক ভাগ কমিয়ে ধরলে উচ্চ আয়ের দেশ হতে ৩২ বছরের মতো সময় লাগবে। কে যে ২০৪১-কে উন্নত দেশ হওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে দিলেন? ২৭-৩২ বছরের হিসাবে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশ হবে ২০৫১ সাল অর্থাৎ স্বাধীনতার ৮০ বছর পূর্তির বছর বা তার পর। কিন্তু মেধাভিত্তিক সবল প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুললে এ মাহেন্দ্রক্ষণের আগমন হবে আরও বিলম্বিত। কোভিড-১৯ মহামারি আঘাত হানার আগে ২০২৬ সালের নভেম্বরে এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে চমৎকারভাবে এগোচ্ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মহামারির কারণে গত এক দশকের টেকসই উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও অন্যান্য অর্জন স্থবির হয়ে পড়ে। মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা শুরু করতেই নতুন করে আবারও বাধা আসে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। ওলট-পালট হয়ে যায় পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট বইয়ে ভারসাম্যের হিসাব ও উন্নত প্রবৃদ্ধি অর্জনের কৌশলগত প্রচেষ্টা। বিশ্ব-অর্থনীতির ইতিহাসে চোখ বুলালে দেখা যায়, এ যাত্রাটা কখনো এক শতকের হতে পারে আবার এক দশকের মধ্যেই একটি রাষ্ট্র মাথাপিছু আয়ের উত্তরণ ঘটাতে পারে। বিষয়টি নির্ভর করে কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়, তার ওপর। নিম্ন মাথাপিছু আয় থেকে উচ্চ মাথাপিছু আয়ে পৌঁছাতে এশিয়ার দেশগুলো ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে কম সময় নিয়েছে। আবার অনেক দেশ আছে যেগুলো মাথাপিছু আয়ের একটি পর্যায়েই পড়ে আছে কয়েক দশক ধরে। এহেন পরিস্থিতিকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হচ্ছে ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদ’।

মধ্যম আয়ের দেশগুলোর উচ্চ আয়ের পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য যে নীতিমালা প্রয়োজন, তা প্রণয়ন করা দুষ্কর। বিশেষত প্রতিটি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার স্বাতন্ত্র্য এ কাজটিকে আরও কঠিন করে তোলে। অর্থনীতিবিদদের দেখানো বিভিন্ন প্রমাণ অনুযায়ী, নিরবচ্ছিন্ন উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মধ্যম আয়ের ফাঁদ এড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনামূলক অল্প সময়ের ব্যবধানে আয়সীমায় দুইবার সফল উত্তরণের অভিজ্ঞতা থেকেই বিষয়টি নিশ্চিত বলে প্রতীয়মান হয়। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের জন্য বিভিন্ন সতর্কবার্তা এখন অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে। বর্তমান মন্দা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা এবং ২০৩১ ও ২০৪১ সালের মধ্যে যথাক্রমে উচ্চ-মধ্যম ও উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্নের পেছনে ছোটার রাস্তায় অবিচল থাকার জন্য বাংলাদেশকে এখন তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন সংকট সমাধানের জন্য সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বানই রয়েছে ওইসব সতর্কতবার্তায়। এ স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশের সামনে এখনো অসংখ্য বাধা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তারপরও এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব যদি দেশের অর্থনৈতিক খাতকে খোলনলচে বদলানো ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে খারাপ প্রভাবের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনার প্রবল ইচ্ছা থাকে। কিন্তু সবার আগে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণে সৃষ্ট বর্তমান ক্ষত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে।

সাম্প্রতিক কয়েক দশকে দেশের অর্থনীতি বর্তমান সময়ের মতো কঠিন পরিস্থিতির মাধ্যমে যায়নি, ফলে এর আগে কখনো সংস্কারে প্রয়োজনীয়তাও এত বেশি জরুরি মনে হয়নি। অর্থনৈতিক খাতে, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও ঘুষের মচ্ছব থাকলেও করোনা মহামারির আগে গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির দারুণ প্রবৃদ্ধি ঘটছিল। ওই দশকটি ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কিছু বৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারির মিশ্র দশক। কিন্তু এ সময়ে এসে অনেক কিছুই বদলে গেছে। মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দ্বৈত ধাক্কা দেশের অর্থনীতির দুর্বলতাগুলোকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এসব ধাক্কার কারণে বাংলাদেশ এখন বিশাল পরিমাণ খেলাপি ঋণ ও ব্যালান্স অব পেমেন্টের চাপের সঙ্গে লড়াই করছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পর্যাপ্ত রাখার জন্য সরকারকে আমদানির ওপর বিধিনিষেধ জারি করতে হয়েছে। অর্থনৈতিক খাতে সুশাসন ও মান উন্নয়নে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়িক নেতারা দীর্ঘদিন ধরেই কর্তৃপক্ষকে সংস্কারের কথা বলছেন।

সরকারের এজেন্ডায় সংস্কার উদ্যোগ মাঝেমধ্যে ছিল, তবে তা কখনোই অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল না। বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে জরুরি ঋণ নিচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে বিশ্বব্যাংকের কাছে আরও তহবিল চাইছে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে: আর্থিক ব্যবস্থায় সংস্কার। সম্প্রতি দুটো পৃথক সফরে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলাদেশকে রাজস্ব-নীতি, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, কর প্রশাসনে ব্যাপক সংস্কার করার আহ্বান জানিয়েছেন। মানবপুঁজিতে সরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম। তাই স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতসহ বিভিন্ন সামাজিক খাতের উন্নয়নে অনেক কাজ করতে হবে। কম সরকারি বিনিয়োগের ফলে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকছে। দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য অনেক বেশি। সরকারের উচিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের মান নিশ্চিতে বাজেটে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

ধনী-দরিদ্র বৈষম্য কমাতে এবং মানবসম্পদ ও পুষ্টি সূচকসমূহের মান বাড়াতে বাজেটারি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে যেতে প্রস্তুত বাংলাদেশের এসব সমস্যার সমাধান করা দরকার। বিশ্বব্যাংক এখন বলছে, মাথাপিছু জিডিপি ১৩ হাজার ২০০ ডলার হলেই চলবে না, ক্রয়ক্ষমতাও আমেরিকার তুলনায় ৫ শতাংশ থেকে ৪৩ শতাংশের মধ্যে হতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চলমান মন্দা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং মহামারিপূর্ব প্রবৃদ্ধিতে ফিরে যেতে হবে। মহামারির আগে বেশ কয়েক বছর এ প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ ছিল। করোনা হানা দেয়ার আগের বছরে তো প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ অতিক্রম করেছিল। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে পরের পাঁচ বছরে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে পৌঁছার স্বপ্ন দেখছে। নিম্ন-মধ্যম আয় থেকে সফলভাবে উচ্চ-মধ্যম আয়ের কাতারে পৌঁছানো সম্ভব হলে, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলোর বছরের পর বছর আটকে থাকা মধ্যম আয়ের ফাঁদ থেকে বেরোতে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক


আদিলুরের রায় ও বাস্তবতা

মো. সাখাওয়াত হোসেন। ফাইল ছবি
আপডেটেড ১ অক্টোবর, ২০২৩ ২২:১১
মো. সাখাওয়াত হোসেন

৫ মে ২০১৩, মতিঝিলের শাপলা চত্বর। এ দিনটির প্রসঙ্গ এলেই সাধারণ জনতার মধ্যে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার ঘটে। দিনটিকে উপজীব্য করে গুজবের জালিয়াতিতে নেমে পড়ে একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী। বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বের কাছে খাটো করার নিমিত্তে একটি গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মৃত্যুর সংখ্যাকে গুজবে পরণত করে সমগ্র দেশের মধ্যে একটি অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছিল। মূলত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের নাস্তিক, মুরতাদ ঘোষণা করে তাদের শাস্তির দাবিতে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ঘোষিত ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি সমাবেশের তারিখ ছিল ৫ মে ২০১৩। সারা দেশ থেকে কওমি মাদ্রাসার লাখো নিরীহ শিক্ষার্থীকে এই সমাবেশে হাজির করে হেফাজতে ইসলাম। সমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হয় সংবিধানবিরোধী ও মধ্যযুগীয় ১৩ দফা। দেয়া হয় সরকার পতনের হুংকার। শুধু সমাবেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না হেফাজতের কর্মসূচি। ওই দিন সকাল থেকেই ঢাকার প্রবেশ মুখগুলোতে অবরোধের পাশাপাশি জিপিও, বায়তুল মোকাররম মারকেট, ট্রাফিক পুলিশের কার্‌যালয়, হাউস বিল্ডিং ভবন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়রে পরিবহন পুল, মুক্তি ভবনসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ও দোকান পাটের অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায় হেফাজতের কর্মীরা। অর্থাৎ সরকারি সম্পদ লুটপাট ও বিনষ্টের পাঁয়তারা থেকেই হেফাজতে ইসলাম অন্যদের সহযোগিতায় ধ্বংসাত্মক কার্যালয় পরিচালনা করতে সমর্থ হয়। সরকার পতনের দাবি স্বপ্ন দেখতে তাদের এ আন্দোলনকে সহায়তা প্রদান করে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। খোদ তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের হেফাজতের সমাবেশে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান।

দিনভর চলা হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়। হেফাজতে ইসলামকে বারবার অনুরোধ জানানো হয় নির্ধারিত সময়ে সমাবেশ শেষ করে ঘরে ফিরে যাওয়ার। বিকেলে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হেফাজতে ইসলামের নর্তকিদের কর্মসূচি শেষে ঢাকা ছাড়ার আলটিমেটাম জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের সরলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না। রাতের মধ্যেই আপনারা ঘরে ফিরে যাবেন।’ সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের পরপরই হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ মঞ্চ থেকে সরকারকেই ঢাকা ছাড়া করার হুমকি দিয়ে শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বারবার করা শান্তিপূর্ণ আহ্বানকে উপেক্ষা করায় জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি রক্ষায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ৫ মে রাতে অভিযান শুরু করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের কমলাপুর স্টেশনে যাওয়ার রাস্তা এবং বঙ্গভবনের পাশের রাস্তা ফাঁকা রেখে দৈনিক বাংলা মোড়, দিলকুশা, ফকিরাপুল ও নটর ডেম কলেজের সামনে অবস্থান নেয়। অভিযানে হেফাজতের কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে ব্যবহার করা হয় সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাস। কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই হেফাজতের নেতা-কর্মীরা শাপলা চত্বর ত্যাগ করে। হতাহতের ঘটনা এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও পুলিশের পক্ষ থেকে ওই অভিযানে এগারো জন নিহত হয়েছে বলে জানানো হয়, যার মধ্যে হেফাজতের কর্মীর পাশাপাশি ছিলেন পথচারী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। যাদের বেশির ভাগই দিনব্যাপী চলা সংঘর্ষে নিহত হন।

শাপলা চত্বরের অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে সরকার পতনের স্বপ্ন বিফল হওয়ার পর হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় তাদের আড়াই হাজার নেতাকর্মী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযোগে নিহত হয়েছে। প্রচার করা হয় রাতের আঁধারে ট্রাকে শত শত লাশ সরিয়ে নেয়া হয়েছে। অভিযোগকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য বিভিন্ন দেশের নানান দুর্ঘটনায় নিহতের ছবি গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। হাইতির দুর্ঘটনায় নিহতের মরদেহ সরানোর ছবিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহতদের ছবি প্রচারণা চালানো হয়। আর এই কাজে তাদের একযোগে শামিল হয় বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এই প্রচারণার মূল উদ্দেশ্যই ছিল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা এবং দেশের সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি করা। হেফাজতের প্রচারণায় তথ্য প্রমাণে ঘাটতির কারণে তা যখন মুখ থুবড়ে পড়ে তখন মাঠে নামেন আদিলুর রহমান।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আদিলুর রহমানের এনজিও ‘অধিকার’ এনজিওটি গুম-খুনসংক্রান্ত নানান প্রতিবেদনে প্রকাশ করে দূতাবাস এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে পরিচিতি লাভ করেছিল। এই সংস্থার ওয়বেসাইটেই ১০ জুন, ২০১৩ তারিখে ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সমাবেশ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন’ শিরোনামে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়। বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষায় প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে দাবি করা হয় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ৬১ জন নিহত হয়েছে যাদের বিস্তারিত তথ্য সংবলিত তালিকা অধিকার সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া এই রিপোর্টে আরও দাবি করা হয় প্রায় আড়াই হাজার মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। অধিকারের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হওয়ার পর সেটিকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে আল জাজিরা, সিএনএন, বিবিসিসহ দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোয় নানান নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যা রাষ্ট্রের ভাবর্মূতি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন করে।

স্বাভাবিকভাবেই অধিকারের ‘৬১ জন নিহত’ হওয়ার দাবিকে যাচাই করতে উদ্যোগী হয় সরকার। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ১০ জুলাই, ২০১৩ তারিখে তথ্য অধিকার আইনে নিহতের তালিকা চাওয়া হয়। কিন্তু অধিকার সেই তালিকা প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাদের উদ্দশ্যমূলক অপপ্রচার অব্যাহত রাখে। ফলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয় আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। ১০ আগস্ট, ২০১৩ তারিখে গুলশান থানায় ডিবি পুলিশের পরিদর্শক আশরাফুল ইসলাম একটি জিডি করে সেই জিডির আলোকে অধিকারের কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে আদিলুর রহমানকে গ্রেপ্তার এবং প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যবহৃত তিনটি ল্যাপটপ ও দুটি সিপিইউ জব্দ করা হয়। জব্দকৃত ডিভাইসগুলোর ফরেনসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ৬১ জন নিহতের নাম সংবলিত একটি তালিকা পাওয়া যায়। পুলিশের পক্ষ থেকে উক্ত তালিকা যাচাই-বাছাই করার জন্য বিস্তারিত তদন্ত পরিচালনা করা হয়। তদন্তকালে দেখা যায়, নিহতের তালিকায় উল্লেখিত চারজন জীবিত রয়েছেন, ভিন্ন ঘটনায় নিহত সাতজনকে হেফাজতের সমাবেশে নিহত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মৃত পাঁচজন ব্যক্তির নাম দুইবার করে উল্লেখ করা হয়েছে, ১১ জনের কাল্পনিক নাম যুক্ত করা হয়েছে যাদের কোনো ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি, সাতজনের নামের পাশে ভুল তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল ২৭ জনের নামের পাশে ‘ইয়েট টু কনফার্ম’ লেখা থাকলেও ‘অধিকার’ কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাদের মৃত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিতে হীনউদ্দেশ্য নিয়ে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান এবং পরিচালক নাসিরউদ্দিন এলান একটি বানোয়াট ও মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরি এবং তা দেশে-বিদেশে প্রচার করেছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা ৪ সেপ্টেম্বরে, ২০১৩ সালে ঢাকার সিএমএম আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন এবং ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে এটি মামলা (মামলা নং-০১/২০১৩) হিসেবে গৃহীত হয়।

মামলা দায়েরের পর থেকে অভিযুক্ত আদিলুর রহমান ও নাসিরউদ্দিন এলান সম্ভাব্য সব রকম আইনি সুবিধা ভোগ করে এবং তাদের আইনজীবীরা মামলাটি দীর্ঘায়িত সম্ভাব্য সব আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করে। আদিলুর রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিত উচ্চ আদালত এবং সুপ্রিম কোর্টের দেয়া নির্দেশে মামলাটি প্রায় সাড়ে আট বছর স্থগিত অবস্থায় ছিল। উপরন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সত্ত্বেও আদিলুর রহমান দুই মাসের মাথায় উচ্চ আদালত হতে জামিন লাভ করেন এবং নাসিরউদ্দিন এলান মামলার কার্যক্রম শুরুর আগেই আগাম জামিন পান। সব আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২০২১ সালের ৫ অক্টোবর সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। প্রায় দুই বছর ধরে শুনানিকালে মামলার মোট ২৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনকে আদালতে হাজির করে প্রসিকিউশন। চারজন সাক্ষী মারা যাওয়ায় সাক্ষ্য দিতে পারেননি। এ ছাড়া সাক্ষ্য দিতে আসেননি আদিলুর রহমানের স্ত্রী এবং কর্মচারী।

অবশেষে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সালে মামলা দায়েরের সুদীর্ঘ ১০ বছর পর রায় ঘোষণা করেন সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালত। মামলার সংক্ষপ্তি রায়ে বিচারক সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন প্রসিকিউশন তাদের আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ওই অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা জরিমানা। আদিলুর রহমান এবং নাসিরউদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও বিজ্ঞ বিচারক মাত্র দুই বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে শাস্তি ঘোষণা করেন। তর্কাতীতভাবেই এটিকে ‘গুরু পাপে লঘু দণ্ড’ বলা চলে।

তারপরও এই রায়কে একটি যুগান্তকারী রায় বলা চলে, কেননা এই রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি নির্জলা মিথ্যা পরাজিত হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে, হেফাজতের দাবি করা আড়াই হাজার তো দূরের কথা- অধিকারের প্রতিবেদন প্রকাশিত ৬১ জন নিহতের খবর সম্পূর্ণ ভুয়া এবং উদ্দশ্য প্রণোদিতভাবে তৈরি। আদুলির রহমান যদি আদালতে ৬১ জন নিহতের তালিকা দিতে পারত তা হলেই তো তাকে কোনো সাজার সম্মুখীন হতে হয় না। দশ বছরেও তা সে কিংবা তার আইনজীবীরা আদালতে দিতে পারেনি। রাষ্ট্রের ঘাড়ে যে মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিল আদুলির রহমান, আদালতের রায়ে সেই কলঙ্ক মোচনের প্রাথমিক ধাপ সম্পন্ন হলো।

এই মামলা চলাকালে এবং মামলার রায় ঘোষণার পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বাংলাদেশে অবস্থিত পশ্চিমা দেশের দূতাবাসগুলো মামলাটি বাতিল এবং আদিলুর রহমান ও নাসিরউদ্দিন এলানের মুক্তি চেয়ে বিবৃতি প্রদান করেছে। তালিকায় জাতিসংঘের হিউম্যান রাইট কমিশন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, অ্যামনেস্টি ইন্ট্যারন্যাশনাল ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো সংস্থা। এ ছাড়া এটি নিয়ে প্রতিবেদন এবং খবর প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের শীর্ষ সব গণমাধ্যমে। একজন মানবাধিকার কর্মীকে কারাদণ্ড দেয়ায় তারা উদ্বেগ প্রকাশ করলে বাংলাদেশের ভাবর্মূতি ক্ষুণ্ন হওয়ার সময় তাদের কোনো বিকার দেখা যায়নি। আমাদের মনে রাখতে দেশের স্বার্থ সর্বদাই ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে এই মামলায় আদালত কোনো মানবাধিকার কর্মীকে সাজা দেয়নি। সাজা দিয়েছে একজন মিথ্যাবাদীকে যে কি না উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মিথ্যা তথ্য প্রচারের মাধ্যমে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্টের ঘৃণ্য প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল, যে কি না হীন দলীয় স্বার্থে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করার একজন ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছিল। সব প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে যেভাবে এই মামলা পরিণতি পেয়েছে তাতে এই রায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।

লেখক:
চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


দেশের পরিবেশ রক্ষায় গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্যোগ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আঞ্জু আরা বেগম

ভালো নেই পৃথিবী। ভালো নেই বিশ্ববাসী। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আর চাহিদা মেটানোর আকাঙ্ক্ষায় পরিবেশের ওপর চরম অবহেলায় আমরা যে স্বার্থপর পৃথিবী গড়ে তুলেছি, সেখানে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে জলবায়ুর প্রভাবজনিত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খরা-বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, তীব্র দাবদাহ, অতিবৃষ্টি, দাবানল, বজ্রপাতসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেড়েই চলেছে বিশ্বব্যাপী প্রাণহানি আর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ।

জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) তথ্যানুসারে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গত ৫০ বছরে অন্তত ২০ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে যার ৯০ শতাংশই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঘটেছে।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নির্দোষ স্বীকার। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে অবদান নগণ্য (বৈশ্বিক নির্গমনের ০.৪৭% এর কম) থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমাদের অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষিশিল্পসহ সার্বিক অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্র পৃষ্ঠের গড় উচ্চতা প্রতিবছর ৩.৮-৫.৮ মিমি বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে এই শতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ১২.৩৪%-১৭.৯৫% উপকূলীয় অঞ্চল সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। অনুসন্ধানে আরও দেখা যায় যে ৫.৮%-৯.১% ধান উৎপাদন হ্রাসের জন্য শুধু সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি দায়ী হবে।

পরিবেশবিদদের মতে, প্রকৃতির ওপর মানুষের বিরূপ আচরণ বন্ধ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে জরুরিভাবে কার্যকর কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সিএফসি নির্গত হয়- এমন যন্ত্রপাতির ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে, সৌরশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সন্ধান করতে হবে। বনভূমি ধ্বংস বন্ধ করে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন বাড়াতে হবে।

দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে পাঁচ দশক ধরে সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায়ও নিয়েছে নানাবিধ উদ্যোগ। নোবেল বিজয়ী এই প্রতিষ্ঠানটির দারিদ্র্য বিমোচনের ১৮ সিদ্ধান্তের অন্যতম একটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে চারা রোপণের মৌসুমে পরিবেশ রক্ষা এবং নিজস্ব সম্পদ তৈরিতে যতটা সম্ভব চারা রোপণ করা। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ২০২০ সালের জুন মাস থেকে গ্রামীণ ব্যাংক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শুরু করে এবং ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল মজিদের নেতৃত্বে গ্রামীণ ব্যাংক সর্বপ্রথম দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করে।

একই বছর শেখ রাসেল দিবসে ৯৪ লাখ গাছের চারা লাগানো হয়। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে ৭ কোটি ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৪৪১টি ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। ২০২১-২০২২ সালে গ্রামীণ ব্যাংক দেশজুড়ে সর্বমোট ১৮ কোটি ৮৭ লাখ ১৮ হাজার ৬৯টি গাছের চারা রোপণ করেছে।

চলতি বছর দেশব্যাপী ২০ কোটি গাছের চারা লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে গ্রামীণ ব্যাংক। ২০ জুন, প্রধান কার্যালয় চত্বরে চারা রোপণের মাধ্যমে এই কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্যোগে সারা দেশে ৩৪.৭১ কোটি গাছের চারা লাগানো হয়েছে।

জাতীয় দিবসগুলোয় (যেমন: বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী, জাতীয় শোক দিবস, শেখ রাসেল দিবস প্রভৃতি) বিভিন্ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক বরাবরই অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা, এরিয়া ও জোনাল অফিস এবং সদস্যদের বাড়ির আঙিনায় বৃক্ষরোপণের এ উদ্যোগ চলমান রাখা হয়েছে পুরো বছরব্যাপী।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ও পরিবেশ রক্ষায় গ্রামীণ ব্যাংকের এক কোটিরও বেশি ঋণগ্রহীতাদের নিয়ে বৃক্ষরোপণের এই কর্মসূচি সামাজিক বনায়নের প্রতি আগ্রহের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি করছে জনসচেতনতা। গ্রামীণ ব্যাংক আশা করে, বৃক্ষরোপণের এই কর্মসূচি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির সম্ভাবনা কমিয়ে,ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপহার দেবে সবুজের মধ্যে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার নতুন এক পৃথিবী।

লেখক: মিডিয়া প্রধান, গ্রামীণ ব্যাংক

বিষয়:

আত্মহত্যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম 

সম্প্রতি একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে জানা যায়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কয়েকজন মেধাবী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। খবরটি বেশ উদ্বেগজনক। কারণ এমন সম্ভাবনার মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আধুনিক সমাজে বিভিন্ন সামাজিক সংহতির ভিত্তিতে আত্মহত্যা লক্ষ্য করা যায়। আত্মহত্যা কোনো ব্যক্তিগত, মানসিক, বংশগত, ভৌগোলিক বা দৈহিক কারণে ঘটে না বরং সামাজিক সংহতির মধ্যে নিহিত থাকে। আত্মহত্যা হচ্ছে যান্ত্রিক সংহতির নেতিবাচক ফলশ্রুতি। আত্মহত্যা শব্দটির মধ্যে একটি অপরাধজনক ভাব রয়েছে। আত্মহত্যার সঠিক কারণ পুরোপুরি জানা সম্ভব নয়। তবে এর প্রধান কারণ মানসিক চাপ, বিষণ্নতা ও অব রিস্টার্ট মেন্টাল হেলথ সার্ভিসের সিইও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদ আনোয়ার রানা বলেন, করোনাপরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা আত্মহত্যাপ্রবনতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এ বছর তাদের প্রতিষ্ঠান অনলাইন ও অফলাইনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী ৩৬১ জনের মধ্যে শতকরা ৬৩ ভাগই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ২৩৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যা যে শুধু শিক্ষার্থীরা করেন এমন নয়। বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মানুষের মধ্যেই এ প্রবণতা বিদ্যমান। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এরমধ্যে স্কুল-কলেজপর্যায়ে ৪৪৬ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬ জন। এই হিসেবে প্রতি মাসে ৪৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।

ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানশেন রোজ জানান, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে তারা এ তথ্য পেয়েছেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই পারিবারিক কলহ, পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল করতে না পারা, মানসিক অবসাদ, আর্থিক সংকট, চাকরি না পাওয়া, প্রেমে ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন কারণে বিষণ্নতায় ভোগেন। একপর্যায়ে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তবে মানসিক অবসাদে কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি দীর্ঘদিনের হতাশার ফল। অনেক ক্ষেত্রে ত্বরিত সিদ্ধান্তেও অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

জীবনটা নিজের হলেও আত্মহত্যার মাধ্যমে এ জীবন নষ্ট করার অধিকার কারও নেই। আত্মহত্যা কার্যক্রমটি এক ধরনের অপরাধ। এ ধরনের অপরাধকে আমরা ভিকটিমলেস ক্রাইম বলে চিহ্নিত করি, যেখানে আত্মহত্যাকারী নিজেই অপরাধী ও ভিকটিম। ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা প্রকাশে বিঘ্ন সৃষ্টি হলে একদিকে যেমন সামাজিক সংহতি রক্ষায় বিঘ্ন ঘটে, অন্যদিকে তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ সামাজিক সংহতির ওপর আত্মহত্যা নির্ভরশীল। মানুষ যখন কোনো দুঃখে আক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যা করে তখন এটি ব্যক্তিগত বিষয় থাকে না। কেননা তার দুঃখবোধ সমাজ থেকে সৃষ্ট।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মহত্যা মহাপাপ। নেপোলিয়নের মতে, আত্মহত্যাই জীবনের সবচেয়ে বড় কাপুরুষতার পরিচয়। সেন্ট অগাস্টিনের অভিমত হলো- আত্মহত্যা অন্যায় ও নিকৃষ্ট কাজ। জীবনের অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রচেষ্টায় নিকৃষ্ট কাজ আত্মহত্যা। দার্শনিক কান্ট মনে করতেন, আত্মহত্যা অন্যায় কাজ। কেননা, আত্মহত্যা মানবতার আদর্শের পরিপন্থি, আত্মহত্যার বেলায় মানুষ তার মনুষ্যত্বের অবমাননা করে। সুনীল কুমার নাগের মতে, আত্মহত্যা নীতির চোখে অন্যায়, আইনে অপরাধ। এমিল ডুর্খেইমের তত্ত্ব অনুসারে, নারীর চেয়ে পুরুষের আত্মহত্যার হার বেশি। অবিবাহিতদের তুলনায় বিবাহিতদের মধ্যে আত্মহত্যা কম। বিবাহিতদের তুলনায় বিধবা- সিঙ্গেলদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। সাধারণত আমরা দেখতে পাই, কোনো একটি বিশেষ প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হলেই পরিবারের অভ্যন্তরে নারীরা আত্মহত্যা করে। নিজের জীবন শেষ করে সমাধান করতে চায় বিষাদগ্রস্ত জীবনের। আমাদের সমাজে অনেক সময় স্বামীর সঙ্গে কলহ, ডিভোর্স, পরকীয়া ইত্যাদি কারণও অনেক নারীকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পথ থেকে ফেরাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের মানসিক উন্নয়নে কাজ করতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে পর্যাপ্ত শিক্ষা উপদেষ্টা। নিয়মিত তাদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া দৃঢ় করতে হবে পারিবারিক সামাজিক বন্ধন। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা যাতে বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়, সে জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হলে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কমবে। ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, স্ট্রেস, প্যানিক, ফোবিয়া, মনোযৌন সমস্যাসহ বেশকিছু মানসিক সমস্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব বেশি। বিষণ্নতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রত্যাশিত একাডেমিক পরিবেশ ও জীবন মান না পাওয়া, ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তা, আর্থিক সামর্থ্যের অভাব, খারাপ সিজিপিএ, প্রেমঘটিত সমস্যা, কাঙ্ক্ষিত জীবনসঙ্গীকে না পাওয়া, অডিও-ভিডিও এবং ছবির মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলের শিকার, সংসারে অশান্তি, মা-বাবার মধ্যে সমস্যা, পরিবারে নিজের গুরুত্ব না থাকা, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে না পারা। বিষণ্নতা ও হতাশা শিক্ষার্থীদের মূল কারণ বলে সমাজবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছেন। ব্যক্তি বিশেষে আলাদা কারণেও অনেক শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা।

কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি জীবনের খারাপ সময়গুলোকে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা ও আত্মবিশ্বাস, সমস্যা সমাধানের কার্যকর দক্ষতা এবং প্রয়োজনে অন্যের কাছ থেকে ইতিবাচক সহায়তা লাভের চেষ্টা- এগুলোকে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে রক্ষাকারী বা প্রতিরোধী বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়। সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি, অনুশাসন, ভালো-মন্দ, প্রতিবেশী ও সহকর্মীদের সঙ্গে সামাজিক সুসম্পর্ক প্রভৃতিও আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাসে সহায়তা করে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত মানুষের পাশে থাকা।

আত্মহত্যা কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য নয়, আত্মহত্যা কোনো ব্যক্তির অধিকার হতে পারে না। আত্মহত্যায় কোনো পৌরষত্ব বা বীরত্ব নেই, আছে কাপুরুষোচিত বর্বরতা আর অনৈতিক আত্মগ্লানির বহির্প্রকাশ। আত্মহত্যাকারীর স্বামী বা স্ত্রী, পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়েসহ আত্মীয়স্বজনরা যে দুঃখ, ব্যথা, বেদনা, অশান্তি, হতাশা এবং কান্নার মধ্যে নিমজ্জিত হন তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহাল থাকে। বরং কখনোই তা শেষ হওয়ার মতো নয়। প্রতিটি আত্মহত্যাই হৃদয়ে বেদনা জাগিয়ে মনকে আশাহত ও বেদনাতুর করে তোলে। আত্মহত্যাকারীর জন্য আত্মীয়স্বজনকে কখনো কখনো সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়। আত্মহত্যা কেন করে এর সঠিক কারণ শনাক্তপূর্বক এ থেকে উত্তরণের জন্য মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলিং-এর পাশাপাশি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর কুফল বর্ণনাসহ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তবেই এর সুফল পাওয়া যাবে, নচেৎ নয়।

লেখক: কলামিস্ট


রোহিঙ্গা সংকটে ত্রাণ সহায়তার নিম্নমুখী প্রবণতা রোধে কার্যকর উদ্যোগ জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শামসুদ্দীন

দীর্ঘ ৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা নিম্নমুখী এবং এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে এই বৈশ্বিক সংকটটির গুরুত্ব কমে আসার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মানবিক দিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সে মহানুভবতার কথা বিবেচনায় না নিয়ে, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ইদানীং বাংলাদেশের সমালোচনা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা কারও কাম্য নয়। এ বছর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা ৩৩% কমিয়ে প্রতি মাসে মাথাপিছু ৮ ডলারে নামিয়ে এনেছে, ফলে ৪৫% রোহিঙ্গা পরিবার পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না এবং কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতিসংঘের কোর্ডিনেশন অব হিউমেনিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্সের পরিসংখ্যান মতে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এ বছর জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের (জেআরপি) ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার চাহিদার বিপরীতে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৬৮ মিলিয়ন সহায়তা পাওয়া গেছে, যা চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ। এ পরিস্থিতি নিরসনে, মানবাধিকার সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি জানায় যে, দাতাদেশগুলোর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের সুযোগ নিশ্চিত করা উচিত।

বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মতে ২০২২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার বিষয়টি সর্বোচ্চ আর্থিক মানবিক সহায়তার মধ্যে ছিল। বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যাটি আনুষ্ঠানিকভাবে জরুরি পরিস্থিতি নয় এবং তারা একে এখন প্রলম্বিত পরিস্থিতি হিসেবে মনে করে। ফলে মানবিক জরুরি তহবিল এখন বিশ্বজুড়ে চলমান অন্যান্য জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে অনেক জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হলেও প্রধান দাতা দেশগুলোর সামগ্রিক সাহায্য বাজেট কমে যাওয়ায় অনেক মানবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

২০২২ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক রোহিঙ্গা সহায়তা তহবিলের ৪০% আসত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরিমাণ ছিল ৩৩৬ মিলিয়ন ডলার, এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের থেকে সহায়তা কমে ১০০ মিলিয়ন আসায় তহবিল সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা এবং তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ১.৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে এবং তাদের এই সমর্থন চলমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমারের অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানায় এবং সমগ্র অঞ্চলজুড়ে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ কমাতে সম্ভাব্য সব বিকল্প খুঁজতে অবিচল থাকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের সহায়তায় মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জন্য অতিরিক্ত ১১ কোটি ৬০ লাখ ডলার মানবিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এই সংকট মোকাবিলায় দেশটি এ পর্যন্ত মোট ২.২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা প্রদান করেছে।

যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির প্রথম নারী সভাপতি এলিসিয়া কিয়ার্নস বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়ে জানান যে, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপের মাধ্যমে মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে আরও কাজ করা প্রয়োজন। যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) স্থায়ী আন্ডার সেক্রেটারি স্যার ফিলিপ বার্টন জানান যে, মিয়ানমারে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা স্থানীয়দের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা সমস্যার একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য মিয়ানমারে চাপ অব্যাহত রেখেছে, যাতে রোহিঙ্গারা নিরাপদ, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণভাবে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে। এফসিডিও কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যবিধি এবং স্যানিটেশন পরিষেবা ও রান্নার জ্বালানি নিশ্চিত করতে ৩০ লাখ পাউন্ড প্রদানের ঘোষণা দেয়, এই সহায়তা কার্যক্রম ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা বাংলাদেশি মানুষের জন্য ৩৬৫ মিলিয়ন পাউন্ড আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইউএনএইচসিআর, হিউম্যান রাইট ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এবং এনজিওগুলোর মতো বিশ্বসম্প্রদায়ও মিয়ানমারকে কার্যকরভাবে চাপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই সংকট আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও অস্থিতিশীল করে তুলছে। মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ টম অ্যান্ড্রুজ জানায় যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও রোহিঙ্গাদের পর্যাপ্ত সমন্বিত সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর আর্থিক অনুদান কমিয়ে দেয়ায় রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে জেনেভাতে আসন্ন গ্লোবাল রিফিউজি ফোরামে রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিতে অংশীদারদের আহ্বান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর। এটি একটি বৃহত্তর মানবিক সংকটে আর্থিক সহায়তার হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরে।

বাংলাদেশ, মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি চলমান রাখার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা যেন বিশ্ব ভুলে না যায় সেজন্য বৈশ্বিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামনে রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ চলমান রেখেছে। ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার ভিসা সেবা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) অধীনে কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা অব্যাহতি পুনর্বহাল করা হয়েছে। এ সমঝোতা স্মারকের অধীনে উভয় দেশের কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীরা ভিসার প্রয়োজন ছাড়াই সর্বাধিক ৯০ দিনের জন্য ভ্রমণ করতে পারবে। এ সিন্ধান্তের ফলে সরকারি সফর সহজতর হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চলমান উদ্যোগের প্রস্তুতি হিসেবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে একটি ট্রানজিট ক্যাম্প ও একটি রিপ্যাট্রিয়েশন ক্যাম্প নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে বলে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তসংলগ্ন এলাকা থেকে আসা রোহিঙ্গাদের তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে ফেরত পাঠানো হবে। প্রত্যাবাসন শুরু হলে রোহিঙ্গাদের প্রথমে ঘুমধুমের ট্রানজিট ক্যাম্পে আনার পর সেখান থেকে রিপ্যাট্রিয়েশন ক্যাম্পে নেয়া হবে। সেখানে দুই দেশের দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন হলে তাদের মিয়ানমারে পাঠানো হবে।

সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানান যে, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থা চলমান থাকলে এটি আমাদের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে সেখানে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে আগ্রহী, সে জন্য রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে যাওয়া নিশ্চিত করতে তিনি সবার কাছে আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন চেয়েছেন। ফ্রান্স, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক ও মালদ্বীপ- এই সাতটি দেশ মামলার প্রতি সম্মতি দিয়েছে।

২০ সেপ্টেম্বর, ১৮তম এশিয়া কো-অপারেশন ডায়লগ (এসিডি) পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন চলমান রোহিঙ্গা সংকট ও মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায়। রোহিঙ্গারা যাতে দ্রুত তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্য সমাধান খুঁজে বের করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং রোহিঙ্গা সংকটের ইস্যু আলোচ্যসূচির শীর্ষে রাখতে অনুরোধ জানান। কক্সবাজারে থাকা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপদ প্রত্যাবাসনে জাপানের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। জাপানের সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য এবং জাপানের বিদেশি সহায়তা কমিটির (ওডিএ) প্রধান নাকানিশি ইয়োসুকে সেপ্টেম্বরে তার বাংলাদেশ সফরের সময় এ আহ্বান জানানো হয়। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য বন্ধুপ্রতীম দেশগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। একই সঙ্গে তারা রোহিঙ্গাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করে মিয়ানমারে তাদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের জন্য প্রস্তুত করতে পারে। চলমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রগুলো তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা চলমান রাখার জন্য খাদ্য ও অর্থের সংস্থান নিশ্চিত করতে পারে।

সম্প্রতি দি ইয়থ কংগ্রেস রোহিঙ্গা (ওয়াই সি আর) নামে রোহিঙ্গাদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করা একটা সংগঠনের কথা জানা যায়। এই সংগঠনটি প্রায় এক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এই সংগঠনটি প্রত্যাবাসন ও রোহিঙ্গাদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং মিয়ানমারে তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির দিকে গুরুত্ব না দিয়ে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর ও আরও কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের নেয়া পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তায় তাদের সক্ষমতার বিষয়ে প্রতিবেদন থেকে কিছু জানা যায়নি। বহু দশক ধরে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়েছিল ও তাদের নাগরিক অধিকারসহ অন্যান্য মানবিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে এ অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ অবশ্যই সম্ভব এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কর্মক্ষম শক্তিতে পরিণত করা যেতে পারে। এ সংগঠনটি এসব উদ্যোগ নিতে পারে।

আশা করা যায়, তারা রোহিঙ্গাদের ক্রমহ্রাসমান আর্থিক ও খাদ্য সহায়তার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ইতিবাচক ভূমিকা রেখে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের আগ্রহ ও সহানুভূতির বাস্তব রূপ দেবে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এ অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে তৎপর। এখানে রোহিঙ্গা সমস্যার মতো একটা জটিল সমস্যা চলমান থাকবে তা কারও কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে এ সংকট সমাধানে আঞ্চলিক, বৈশ্বিকসহ সব ধরনের উদ্যোগে সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হওয়া বিবেচনায় রাখতে হবে। চলমান প্রেক্ষাপটে এসব উদ্যোগের পাশাপাশি ত্রাণ সহায়তার নিম্নমুখী প্রবণতা রোধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি এই সংকটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

লেখক: এনডিসি, এএফ ডব্লিউসি, পিএসসি, এমফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক


তোয়াব খান: শ্রদ্ধায় স্মরণ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এম. নজরুল ইসলাম

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে ‘তোয়াব খান’ নামটি সবসময় উচ্চারিত হয়েছে পরম শ্রদ্ধায়। নির্মোহ-নির্লোভ মানুষটিকে একবার দেখে ভেতরের মানুষটিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব ছিল না। আপাত গাম্ভীর্যের আড়ালে যে সংবেদনশীল মানুষটির বাস ছিল, সহজ ছিল না তাকে আবিষ্কার করা। তার জীবনটা ছিল চলমান এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনকালে শুরু সে পথের। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন। এ জন্যই তিনি ছিলেন সব সময়ের জন্য সমসাময়িক। ইতিহাসের সাক্ষী ছিলেন তিনি। জন্মেছিলেন ব্রিটিশ ভারতে। এরপর পাকিস্তানি শাসন পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ। সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেছেন। দেখেছেন একাত্তর। ধারণ করেছেন একাত্তরের চেতনা। অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে, একজন বিপ্লবী কলম সৈনিক হিসেবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত হতো তার ‘পিণ্ডির প্রলাপ’। তার জীবনকে কোনো মামুলি জীবন ছিল না। ইতিহাসের সাক্ষী হতে হতে তিনি নিজেই এক ইতিহাসে পরিণত হয়েছিলেন। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে নানা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করেছিলেন নিজেকে।

তার জীবনখাতার পাতাগুলোও ছিল বর্ণিল। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল তারকা। সাংবাদিকদের সাংবাদিক ছিলেন তিনি। পেশাগত জীবনে ছয় দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে তিনি নিজেই এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন যথার্থ আধুনিক। সেই আধুনিকতার প্রতিফলন ঘটেছিল তার পেশা ও ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পরতে। পাঠক হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, তিনি লিখেছেন কম, লিখিয়েছেনই বেশি। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরির্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন। তার চেতনায় ছিল একাত্তর, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। সাংবাদিক হিসেবে তিনি পরিবর্তনগুলো যেমন দেখেছিলেন, তেমনি সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবেও দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে। খুব কাছ থেকে স্বাধীনতার মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছেন। ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুই বেছে নিয়েছিলেন তাকে। ছিলেন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের প্রেস সচিব। ১৯৮০ ও ১৯৮৭ সালে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। পালন করেছেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্বও।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার সাতক্ষীরার রসুলপুরে। পড়েছেন সাতক্ষীরার সার্ধশত বছরেরও বেশি পুরোনো পিএন (প্রাণনাথ) স্কুলে। ঢাকায় কলেজে পড়তে আসা। বছর না ঘুরতেই ভাষা আন্দোলনে উত্তাল দেশ। ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় হলেন। এরপর থেকেই ভেতরে ভেতরে একটা পরিবর্তনের হাওয়া। অজান্তে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দীক্ষা। বদলে যায় জীবনের গতিপথও। পেয়ে বসে বিপ্লবের নেশা। ১৯৫৩ সালে কেজি মুস্তফার সঙ্গে বের করেন সাপ্তাহিক জনতা। এর মধ্য দিয়ে হাতেখড়িও হয়ে যায় তার সাংবাদিকতা জীবনের। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন সংবাদে। ১৯৬১ সালে ছিলেন সংবাদের বার্তা সম্পাদক। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে। ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। সত্যবাক নামে দৈনিক বাংলায় শুরু করেন ‘সত্যমিথ্যা, মিথ্যাসত্য’ শিরোনামের বিশেষ কলাম। এ কলামে উঠে আসে একটি স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক চিত্র। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একেকটি মাইলফলক রচিত হয়েছে তারই নেতৃত্বে। প্রথম চাররঙা সংবাদপত্র এর মধ্যে একটি। তার একমাত্র বই ‘আজ এবং ফিরে দেখা কাল’। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ‘সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান’ বলতে যা বোঝায় তার শেষ সলতে ছিলেন তিনি।

২০১৬ সালে একুশে পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তাকে। অগ্রসর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সাংবাদিকতাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি। বহুদর্শী মানুষটি নামের পেছনে ছোটেননি কখনো। অদ্ভুত আড়ালচারিতা ছিল তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন যে মানুষটি, তিনি হলেন তোয়াব খান। আজ তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের এ দিনে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তাকে, জানাই প্রণতি।

লেখক: সভাপতি, সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ


নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশিদের নাক গলানো প্রসঙ্গ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
শেখর দত্ত

‘জনগণ সব ক্ষমতার উৎস’- এটাকে অমোঘ সত্য ধরেই ষাটের দশকের গণজাগরণ স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আটচল্লিশ-বায়ান্ন-চুয়ান্নর ধারাবাহিকতায়ই এসেছিল বাষট্টি-চৌষট্টি-ঊনসত্তর। সহজেই বলা যায়, ওই প্রত্যয়ই আমাদের জাতিকে পাকিস্তানের শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে উদ্বেলিত করেছিল। ছাত্র আন্দোলনে থাকা অবস্থার দিনগুলোর কথা স্মরণ করলে এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ঊনসত্তরের চব্বিশে জানুয়ারি দিনটির কথা। মতিউর-রুস্তম-মকবুল-হারিশ-শহীদ নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানের শাসক-শোষকগোষ্ঠীর সঙ্গে ফয়সালা করতে ঢাকার রক্তাক্ত রাস্তায় জনগণ নেমে এসেছিল।

‘লোক লোক চোখের পাতায় লোক/ হৃদয়ের প্রতিটি স্কোয়ারে লোক’- কবি শামসুর রাহমান এভাবেই ওই দিনের বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন। সরকার সামরিকবাহিনী তলব করে শুক্রবার রাত ৮টা থেকে শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন এবং দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়। প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে এখনো মনে পড়ে, রাতে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে আলোচনার সময় কারফিউ না ভাঙার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। পার্টি বলেছিল, ‘সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিরস্ত্র জনগণের প্রত্যক্ষ লড়াই করার কোনো অর্থ হয় না।’

কিন্তু বস্তিবাসী জনগণ তা মানেনি। প্রচণ্ড ক্ষোভে ইপ্সিত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মিলিটারি-ইপিআর- পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে সংগ্রামের পথকে অবারিত করেছিল। ওই দিনগুলোর রক্তাক্ত স্মৃতি ধারণ করে আছেন, এমন কোনো ব্যক্তিই বোধকরি ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ প্রত্যয়টি থেকে সরে আসতে পারবেন না। ইতোমধ্যে বিগত প্রায় ৫৫ বছরে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে বহু পানি গড়িয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনের অর্জনকে জাতি ধরে রাখতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে, জাতীয় চার নেতা জেলখানায় নিহত হয়েছেন। পাকিস্তানি আমলের ধারায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসন ও হত্যা-ক্যুয়ের বেড়াজালে দেশ পড়েছে।

আবার সংগ্রাম আবারও আশির দশকের গণ-উত্থান। বিজয়-পরাজয়ের চড়াই-উতরাই পার হয়ে আমরা বর্তমানে রয়েছি। এখানে উল্লেখ্য, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-কর্ণফুলী দিয়ে যেমন বহু পানি গড়িয়ে গেছে, তেমনি গঙ্গা-ইয়াংসিকিয়ান-ভলগা-দানিয়ুব মিসিসিপি-নীল দিয়েও পানি গড়িয়ে গেছে সাত সমুদ্রে। আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়ন- এই দুই পরাশক্তির নেতৃত্বে দ্বিকেন্দ্রিক বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর খুব কম সময়ের জন্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল আমেরিকার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্ব। এখন বিশ্ব বহুকেন্দ্রে বিভক্ত হয়ে গেছে।

বর্তমান কালপর্বে বিশ্বব্যাপীই গণতন্ত্র, ন্যায়ভিত্তিক মানবিকতা যেন নির্বাসিত হতে যাচ্ছে। ক্রমেই জাতীয় ও ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব, ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোকে তাঁবে রাখার জন্য নানারূপী অগ্রাসন, লোভ-লালসার পরাক্রম, অর্থনৈতিক-সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতি বিশ্ব রাজনীতিকে গ্রাস করে চলেছে। জনগণ সব ক্ষমতার উৎস কথাটা কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক নানামুখী সংকটের মধ্যে শক্তিধর দেশগুলো ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা এখন রাখডাক বা লাজলজ্জার বালাই রাখছে না। আমেরিকা চাইছে বিশ্ব আধিপত্য ধরে রাখতে আর অন্যান্য শক্তি কেন্দ্রগুলো চাইছে যার যার দেশের প্রভাব বলয় বাড়াতে।

চীন ও রাশিয়া হালে আমেরিকার কর্তৃত্বকে ক্রমেই চ্যালেঞ্জ করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এরই পরিণতি। সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের ঘোষণায় ভারত, সৌদি আরব, আরব অমিরাত, জর্ডান, ইসরায়েল ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে রেল ও সমুদ্রপথে যোগাযোগের নেটওয়ার্ক যে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিপরীত তা বলার অপেক্ষা রাখে। সেংশনসহ এ সব প্রতিযোগিতা নতুনরূপে বিশ্বকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধ তো চলছেই। ওই সম্মেলনের যৌথ ঘোষণায় ‘বর্তমান যুগ যুদ্ধের যুগ হবে না’ বলার ভেতর দিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলো ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’ প্রবাদটি বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

বিশ্ব প্রেক্ষাপেটে ঘটতে থাকা এ সব থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারছি না। পারা যাবে বলে মনে করারও কোনো কারণ দেখি না। ‘রুশ-ভারতের দালালরা হত্যা কর জবাই কর’ কথাটা যেমন শোনা যায় না, তেমনি ‘বিপ্লব বিপ্লব সশস্ত্র বিপ্লব’ স্লোগানটাও শোনা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত জাতীয় চারনীতির একনীতি সমাজতন্ত্রও হয়ে গেছে যেন দূরের বাদ্য। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, জাতীয় চারনীতি আমাদের চারটি খুঁটি। যার ওপরে দেশ দাঁড়াবে। অর্থাৎ আমাদের পূর্বসূরিরা জাতীয় চারনীতিকে একসঙ্গে গেঁথেছিলেন। একটার বিপদ মানে সবটার বিপদ। এ কারণেই বোধকরি সাম্যের চেতনা যেমন, তেমনি জাতীয়তাবাদ- ধর্মনিরপেক্ষতা-গণতন্ত্রও আজ বিপদাপন্ন।

এই অবস্থায় জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে। গুরুত্বপূর্ণ এই দিক থেকে, সমাজজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে সাফল্য ও অর্জন কখনো সামগ্রিক হয় না। এক সমস্যা সমাধান করলে নিয়তির মতো আসে আরেক সমস্যা। কিন্তু নির্বাচনের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অর্জন ও সাফল্য যেমন সমাজের সব ক্ষেত্রকে, সব মানুষের জীবন ও জীবিকাকে উন্নত করে, তেমনি রাষ্ট্র ক্ষমতার বিফলতা- ব্যর্থতা সবৈবভাবে সবাইকে আঘাত করে। বিগত ১০ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান যথার্থভাবেই বলেছেন, ‘সারা দেশে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতির মাত্রা অনেক বেড়েছে।’ কোনো সরকারের আমলে যখন দুর্নীতি-দ্রব্যমূল্য বাড়ে তখন দল-মত নির্বিশেষে সবাইকেই আঘাত করে। আবার বিদ্যুৎপ্রাপ্তি, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, সামাজিক সুরক্ষা যখন বাড়ে তখন কেবল ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের কাছেই সুযোগ অবারিত হয় না, চরম বিরোধীও লাভবান হয়।

সার্বিক বিবেচনায় সরকারের অর্জন ও সাফল্য মানে জাতিরই অর্জন ও সাফল্য। এই অবস্থা আসছে সংসদ নির্বাচন। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসন অর্থাৎ সামরিক শাসনের মধ্যে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে আজ পর্যন্ত সব নির্বাচন সামনে রেখেই সরকার ও বিরোধী দলে টানাপড়েন যেমন হয়েছে, তেমনি বিদেশিদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাও লক্ষ্য করা গেছে। প্রতিবার নির্বাচনের আগে-পরে বিদেশিদের সঙ্গে টানাপড়েন বেড়ে যায়। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, কোভিড দুর্যোগ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভূ-রাজনৈতিক অধিপত্যের বিষয়টাও এবারে পর্বতপ্রমাণ হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু দেশের মাটিতে পা দিয়েই অস্থায়ী শাসনতান্ত্রিক আদেশ জারি করে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে এসে রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শুরু হয়ে যায় শাসনতন্ত্র রচনার কাজ এবং শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচন হয়। তাই কোনো দিক থেকেই বলা যাবে না, স্বাধীনতা উষালগ্নে সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচনে বিদেশের কোনো নাক গলানোর কাণ্ডকারখানা ছিল। এ সবই ছিল জাতীয় পছন্দ এবং জাতীয় অঙ্গীকার বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ। বাম-কমিউনিস্টরা এ সব প্রক্রিয়ায় অংশ নিলেও প্রথমদিকে দেশ সংসদীয় প্রক্রিয়ায় যাক, তা চাইছিল না। ন্যাপ (মোজাফফর) মুক্তিযুদ্ধের সময়ে উপদেষ্টা পরিষদের আদলে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেছিল।

সেটা ভালো হতো না মন্দ হতো সেই বিতর্কে না গিয়ে বলা যায়, আমাদের জাতির যাত্রা শুরু হয়েছিল কোনো বিদেশি শক্তি দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজস্ব জাতীয় ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও অঙ্গীকার অনুযায়ী। সরকার জনগণ সব ক্ষমতার উৎস বিবেচনায় নিয়ে দেশ পরিচালনা করছিল। তাতেই একাত্তরের পরাজিত দেশি-বিদেশি কায়েমি স্বার্থবাদীরা হত্যা-খুন-ক্যু-সামরিক শাসনের পথে পা বাড়িয়েছিল। খুনি মোস্তাকের শাসনামলে সময়কাল খুবই সংক্ষিপ্ত। ওই আমলে নির্বাচন কোনো ইস্যু ছিল না। নিতান্ত অন্ধ না হলেই দেখা যাবে, পশ্চিমা দাতা দেশ ও সংস্থার চাপে বিশেষত ‘মুক্ত দুনিয়ার’ প্রবক্তা আমেরিকার প্রশ্রয়েই সেনাশাসক জিয়া সামরিক শাসনের মধ্যে ‘হুকুমের’ হাঁ-না ভোট, সংসদ নির্বাচন ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করেন। ভোট কীভাবে হলো, কতটা ভোট পড়ল, তাতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কতটুকু কি হলো, তা নিয়ে ‘মুক্ত দুনিয়ার’ কোনো মাথাব্যাথা ছিল না। দরকার ছিল ভোটের সরকার।

সেনাশাসক এরশাদ আমলে ‘মুক্ত দুনিয়ার’ সেই চাপ আরও বাড়ে এবং প্রহসনের সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একথায় ওই দুই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। তখন ‘মুক্ত দুনিয়া’ ছিল সামরিক শাসনের পক্ষে। নব্বইয়ের গণউত্থানের ভেতর দিয়ে আবারও গণমনে আশা জাগ্রত হয়। কিন্তু প্রথমে মাগুরা উপনির্বাচন আর পরে ’৯৬ ফেব্রুয়ারির একদলীয় নির্বাচনের ভেতর দিয়ে নব্বইয়ের গণউত্থানের চেতনা পদদলিত হয়। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ভোট সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়।

২০০১ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। ওই নির্বাচনে শা-ল-সা সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় একটি পেরেক পুঁতে দেয়। ২০০৬ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাতে ওই ব্যবস্থায় শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে যায়। ওই বছর নির্বাচন হতে পারে নাই এবং জরুরি আইনের শাসন আসে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ফলেই। ওই শাসনামলে দুই নেত্রীকে মাইনাস এবং ড. ইউনুসকে দিয়ে কিংস পার্টি গঠন করে দেশ চালানোর পেছনে যে বিদেশিদের বড্ড বেশি নাক গলানো ছিল, তা তো দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট।

অভিজ্ঞতা থেকে এটা তো আজ সুস্পষ্ট, যে কোনো দেশের রাজনীতিতে একবার যদি শক্তিধররা নাক গলানোর সুযোগ পায় কিংবা সুযোগ দেওয়া হয়, তবে তা কাঁঠালের আঠার মতো হয়ে যায়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ যখন কূটনীতির প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন তা হয়েছে অক্টোপাস; তা জীবন্ত ও ক্রিয়াশীল। এ যেন বিধিলিপির মতো অখণ্ডনীয়। ভাবতে অবাক লাগে, আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়া নাক গলাচ্ছে, এমন অভিযোগও আমাদের শুনতে হয়েছে। বড়রাই যদি বড়দের মধ্যে নাক গলায়, তবে আমাদের মতো ছোট দেশগুলো তো এখন নস্যি!

উপমহাদেশের দেশগুলোর দিকে তাকালে নস্যি হওয়ার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। পাকিস্তানে ক্ষমতার পরিবর্তনসহ রাজনৈতিক ঘটনাবলি পরিবর্তন হলে বলা হচ্ছে, ইমরানকে সরিয়েছে আমেরিকা আর সেনাবাহিনী আমেরিকার পক্ষে। এত ঘটনা ঘটলেও সে দেশের গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকার নিয়ে আমেরিকারা কার্যত নীরব। শ্রীলঙ্কা সংকটের সময় বলা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ ‘রাজাপাকসে ভ্রাতৃদ্বয়ের আনুকূল্যে চীনের অধিপত্য বেড়েই চলছে।’ এখন শ্রীলঙ্কা ভারসাম্যের নীতি নিয়ে চলছে। মূলত আইএফএমের ঋণে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তবে সেখানকার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চীন ও ভারতের টানাপড়েন লক্ষণীয়।

অটল হিমালয়ের দেশ নেপালের রাজনীতি রয়েছে চরম টানাপড়েনের মধ্যে। কেউ কেউ বলেন ভঙ্গুর। দুই চীনপন্থি মাওবাদী দলের নেতা পুষ্প কমল দাহাল প্রচণ্ড ও খড়্গ প্রসাদ ওলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ২০২২ সালে সরকার গঠন করে। চীন প্রভাবিত এই দুই নেতা সিদ্ধান্ত নেয়, প্রথমে প্রচণ্ড আড়াই বছর এবং পরে ওলি আড়াই বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। আড়াই বছর সামনে রেখে ঐক্য ভেঙে যায়। প্রচণ্ডই প্রধানমন্ত্রী থেকে যান এবং তাঁর সমর্থনে নেপালি কংগ্রেস নেতা রামচন্দ্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রচারিত হচ্ছে, নেপাল এখন ভারতের দিকে ঝুঁকছে।

ভুটান চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মিটাতে চাইছে। এদিকে প্রচার হচ্ছে, সীমান্ত সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে ভারত ফ্যাক্টর। মালদ্বীপ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মোহামেদ সালিহ ভোট কম এবং বিরোধী প্রার্থী মোহাম্মদ মুইজুর বেশি ভোট পেয়েছে। শতকরা ৫০ ভাগ ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফা নির্বাচন হবে। এখন প্রচার হচ্ছে ‘চীনপন্থি নেতা মুইজুর উত্থান, ভারতের জন্য উদ্বেগের।’ মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন জান্তার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক কারোরই অজানা নয়। পর্যবেক্ষণে ধারণা করা যায়, ওই সরকার ভারতকেও ভারসাম্যের মধ্যে রাখছে।

এই অবস্থায় প্রশ্ন হলো- আমাদের দেশের ক্ষমতার রাজনীতি তথা আসন্ন ভোটে যে বিদেশিরা নাক গলিয়ে আছে, তা থেকে আমরা উদ্ধার পেয়ে জাতি জন্মের উৎসমুখে কি যেতে পারব? নিঃসন্দেহে জনগণ চাইবে উৎসমুখে ফিরে যেতে। নাক গলানো বন্ধ করতে। রাজনীতিতে একটা কথা রয়েছে, এখনই যদি বৃত্ত ভাঙা না যায়, তবে বৃত্তের মধ্যে থেকেই বৃত্ত ভেঙে বের হওয়ার পথ খুঁজতে হবে। মুখে কিংবা লেখায় আমরা অনেকে অনেক কথা বলতে পারি। কিন্তু কাজের কথাটা কি? এটা বোধকরি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। এই প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখেই দেশ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে। তবে দেশবাসী চাইবে নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করুক এবং নির্বাচন অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ হোক। জনগণই হোক সব ক্ষমতার উৎস।

লেখক: রাজনীতিক ও কলামিস্ট


বাংলাদেশের পুনরুত্থান ও শেখ হাসিনার  সংগ্রাম 

হারুন হাবীব
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
হারুন হাবীব

এই লেখাটি কোনো একাডেমিক বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পন্ডিতি মানদন্ডে লেখা রচনা নয়, মুক্তিযুদ্ধের মাঠ থেকে শুরু করে চোখে দেখা অর্ধ শতকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অজস্র ঘটনাবলির আলোকে একটি ব্যক্তিগত উপলব্ধি মাত্র। এতে যৎসামান্য ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে উঠে এলেও আত্ম উপলব্ধির বয়ানে সৎ থাকার চেষ্টা করেছি। আমি জানি আমার এই ব্যক্তিক উপলব্ধি হয়তো সকলের কাছে সমানভাবে গ্রহনযোগ্য হবেনা। যদি হয় আনন্দিত হব।

এই রচনার বিষয়বস্তু শেখ হাসিনার সংগ্রাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্যা শেখ হাসিনার সংগ্রাম বিদেশের মাটিতে প্রায় ছয় বছর নির্বাসন শেষে যিনি স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে, এবং সেদিন থেকেই জড়িয়ে পড়েন অন্তহীন রাজনীতির সংগ্রামে । জাতীয় স্বাধীনতার রণাঙ্গনে যুদ্ধাস্ত্রের সঙ্গে কলম ও ক্যামেরা আমার সঙ্গি হয়েছিল। হয়তোবা সে কারণেই দেশ স্বাধীনের পরক্ষণে পেশাদারি সাংবাদিকতায় প্রবেশ করি। সেই সুবাদে সুযোগ ঘটে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তেজগাঁও বিমান বন্দরে উপস্থিত থেকে সেদিনের নবীন সংবাদকর্মি হিসেবে বন্ধুবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর লেখার। স্পষ্ট মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তণের প্রায় বছর দশেক পর তাঁরই কণ্যা যেদিন ঢাকার মাটিতে পা রাখলেন, সেদিন উদ্বেলিত লাখো মানুষ তাদের হৃদয়ের সবটুকু আবেগ দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তকে। গণমানুষের সেই আবেগের মধ্যে ছিল অনেক স্বপ্নভঙ্গের পর নতুন এক স্বপ্নদেখা, নতুন আশায় বুক বাঁধা।

গণমানুষের সেই স্বপ্নভঙ্গ এবং প্রত্যাশার প্রেক্ষাপট কারও অজানা নয় । কেবল দলীয় নেতাকর্মি নন, বঙ্গবন্ধু বিহীন বাংলাদেশে তাঁরই কণ্যাকে স্বাগত জানাতে সেদিন বিমানবন্দরে জড়ো হয়েছিল সর্বস্তরের লাখো মানুষ ; যে মানুষ জাতির পিতার ধমনী বহনকারীকে স্বাগত জানিয়েছে পরিপূর্ণ আবেগ ও ভালোবাসায় ; যে মানুষ জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার চায়, যে মানুষ সেনাপতি শাসন থেকে মুক্তি চায়, যে মানুষ মনেপ্রাণে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পুন:প্রতিষ্ঠা চায়, ফিরে পেতে চায় লাখো শহীদের বাংলাদেশকে।

১৯৭৫ সালে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের হাতে প্রায় স্বপরিবারে নিহত হলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক। ঘুরিয়ে দেওয়া হল সদ্য-স্বাধীন দেশের স্বাভাবিক ইতিহাসের চাঁকা। শুধুমাত্র দেশের বাইরে অবস্থানের কারণেই বেঁচে থাকলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা। ভয়াবহ সে হত্যাকান্ড জাতিকে স্থম্ভিত এবং চরম হতাসায় নিমজ্জিত করে । সেই সুযোগে সেনাপতি শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধের রক্তরঞ্জিত স্বদেশকে ক্ষতবিক্ষত করে চলে ; গুড়িয়ে চলে পাকিস্তানি স্বৈশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির দীর্ঘ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক একটি স্তম্ভ। যে আওয়ামি লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাকে রাষ্ট্রীয় কূটকৌশলে ছিন্নভিন্ন করার প্রচেষ্টা চালায় সামরিক শাসক। চারদিকে এক সর্বগ্রাসী হতাসা তখন, শুধুই প্রশ্ন : বাংলাদেশ কি মুক্তি পাবে ভয়ংকর এই মহাপ্রলয় থেকে ? আছেন কি কোনো ত্রাতা, যিঁনি হাল ধরবেন ঝড়ের উত্তাল সাগরে?

অতএব বঙ্গবন্ধু কণ্যার রাজনীতি অধিষ্ঠানের মধ্যে বহু প্রার্থীত এক জাতীয় নবজাগরণ আছে, রাষ্ট্রের নব অভিযাত্রা আছে, যার ধারাবহিকতায় জাতীয় স্বাধীনতার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের প্রধান সেনাপতি হিসেবে আবির্ভূত হলেন শেখ হাসিনা। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধু কণ্যার স্বদেশে ফিরে আসা বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে নতুন যুগের সূচনা করে ।

ইতিহাসের আর্শিবাদ

স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশি মহলের যোগসাঁজসে রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যা করে বাংলাদেশকে যেভাবে অকেজোÑঅর্থহীন করার চেষ্টা হয়েছিল, যে প্রক্রিয়ায় সদ্যÑস্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাভাবিক যাত্রাপথ রুদ্ধ করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পরাজিত শত্রু ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে যেভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল,বলা বাহুল্য, শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই ভয়ংকর অশুভ ধারার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি সঞ্চয় করে সামরিক ও নবজাগরিত সাম্প্রদায়িক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে । ইতিহাসের সত্য এই যে, বঙ্গবন্ধুর এই জ্যেষ্ঠ কণ্যা জাতির লুণ্ঠিত গৌরব পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অধিনায়কত্ব দান করেছেন যা তাঁর ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সাফল্য।

সে কারণেই তাঁর রাজনীতিতে আসা এক আশির্বাদ, এবং একই সঙ্গে প্রতিপক্ষের জন্যে অভিসাপও। ধানমন্ডীর ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়ে চাঁপ চাঁপ রক্তের দূ:সহ চিহৃ দেখতে হয়েছে তাঁকে বুকভাঙা কান্নায়। অথচ তাঁর শোক করার সময় নেই! সময়ের কষাঘাত বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে তাঁকে ; শোক ও রোদনকে পরিণত করতে হয় শক্তিতে। না, তিনি রোদন করতে আসেননি, এসেছেন বদ্ধ ইতিহাসের দুয়ার খুলে প্রিয় জন্মভূমিকে রাহুমুক্ত করতে; জাতির পিতার স্বপ্নের, মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের রক্তের বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করতে। সে এক সুবিশাল চ্যালেঞ্জ; ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই যা তাঁরই হাতে সমর্পিত। অতএব পিতা,মাতা, ভাই ও ভাতৃবঁধুদের স্মৃতিতে শোক করার সময় কই !

ইতিহাস সাক্ষ দেয়, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটিকে আঘাতের পর আঘাতে জর্জরিত করা হয়েছিল; ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে, বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে। সেই দুর্দিনে দেশের বাইরে অবস্থান করেও আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলেন শেখ হাসিনা। অবিন্যস্থ দলকে সংগঠিত করা যেমন গুরু দায়িত্ব, তেমনি অসীম গুরুত্ববাহী কাজ ঘাতক ব্যষ্টিত শাসককূলের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করা, বিদ্ধস্থ বাংলাদেশকে জাগিয়ে তোলা এবং লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে স্বমহীমায় পুন:প্রতিষ্ঠা করা।

বলা বাহুল্য সেদিনের সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ ছিলো না। মৃত্যুকে বারবার তুচ্ছজ্ঞান করেও শেখ হাসিনা তাঁর অভীষ্ঠ দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন ; ঘাতকের বারংবারের হুমকিÑ আক্রমনেও পিছিয়ে আসেন নি, পথভ্রষ্ঠ হননি; হলে, অধ:পতনের গহবর থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ফিরে পাওয়া সহজ হতোনা ।

রাহুমক্তির পালা

এক মহাদুর্দিনে দিকভ্রান্ত স্বদেশের হাল ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের হাতে জাতির জনকের হত্যাকান্ডের পর যে তমসা রাষ্ট্রকে গহীন কালোয় আচ্ছাদিত করে, সেই তমসা তাড়াতে প্রথম আলোর মশাল জ্বালেন তিনি। সে মশাল, প্রাথমিক সংকটÑসীমাবদ্ধতার পরেও, দিকে দিকে আলোকিত করতে থাকে, শুরু হয় রাহুমুক্তির পালা। সব আবর্জনা দূর করতে নববর্ষের প্রভাতে যেমন বাঙালি একাকার হয়, নব প্রতিশ্রুতিতে সমৃদ্ধ হয়, তেমনি এক শুভ প্রতিশ্রুতির বাতাস বইতে দেখি তাঁর রাজনৈতিক অভিযাত্রায়।

আমার বিবেচনায় শেখ হাসিনার শাসনামলে মোড় ঘুড়ানো অর্জনের মৌলিক স্তরগুলিকে মূলত চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার সংগ্রামে তাঁর সাফল্য। দ্বিতীয়ত, সামরিক ও আধাসামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সফলতা। তৃতীয়ত, জাতির জনকের হত্যাকারী ও মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্তদের আইনের হাতে সোপার্দ করা। এবং চতুর্থত, অর্থনৈতিক ভাবে বাংলাদেশকে প্রগতির সড়কে আনা।

বলা বাহুল্য, এই একেকটি স্তরের সাফল্য আনতে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা অনেক ক্ষেত্রে কঠোর হয়েছেন, কৌশলি হয়েছেন, সামালোচিতও হয়েছেন ; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের পুনর্জাগরিত মঞ্চ গুড়িয়ে দিতে এবং জাতীয় স্বাধীনতার রক্তরঞ্জিত ইতিহাসের প্রতি দৃঢ়চিত্ত অবস্থান থেকে একটিবারের জন্যেও তিনি বিচ্যুত হননি। লক্ষ্যে পৌঁছতে তিনি ছিলেন অবিচল যদিও কিছু পথ ও পদ্ধতির সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন।

বিলক্ষণ জানতেন তিনি, পথচ্যুত বাংলাদেশকে প্রার্থীত রাজণীতিধারায় ফিরিয়ে নিতে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে স্বমহিমায় পুন:প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই জয়বাংলার পুনরাভিযানের, জাতির জনকের হত্যাকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের পাকিস্তানপন্থি ঘাতক যুদ্ধারাধীদের বিচারের । অতএব দেশে ফেরার প্রথম দিন থেকে লক্ষ্য নির্ধারণে ভুল করেন নি তিনি। সে যাত্রাপথ, যতো কণ্টককীর্ণই হোক না কেন, লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছেন তিনি বলা যাবে না একেবারে। প্রথমত সামরিক স্বৈরশাসনের আঘাতে জর্জরিত দলকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন তিনি, সংকটব্যর্থতা ও সাফল্যের সিড়ি বেয়ে সামনে পা বাড়ান। কিন্তু সবকিছুর ছাপিয়ে ওঠে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবী ইতিহাস Ñ যা লুণ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৫ এর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। অতএব, ব্যক্তি বা পারিবারিক ট্রেজেডির বাইরে, জাতীয় ট্রেজেডি মুচনের কারণেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করতে হয়েছে তাঁকে। এই বিচার কেবল জাতীয় কলংককেই মুছে দেয়নি, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র দৃঢ়চিত্ত হয়েছে,সামনে এগুবার সাহস পেয়েছে।

রাজনীতিতে তাঁর অধিষ্ঠান ঘটে জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে যখন মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক শিরোমনি পলাতক গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়,পরীক্ষিত স্বাধীনতা বিরোধীদের পরিকল্পিত ভাবে পুনর্বাসন করা হয়। এরপর ক্ষমতায় বসেন আরেক জেনারেল, হুসেন মুহম্মদ এরশাদ, যিনি তার পূর্বসূরীর পথ ধরেই রাষ্ট্রকে মৌল ইতিহাসধারা থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। এই দুই জেনারেল পালাক্রমে বঙ্গবন্ধুর ঘাতক ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দেন, পুনর্বাসন করেন এবং সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দান করেন। এ সময়, বিশেষত ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসন বিরোধী গণআন্দোলনের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের মনোজগতে এক নীরব বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে, তারা জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাস খুঁজতে চেষ্টা করে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সরব হয়।

কিন্তু ১৯৯১ এর নির্বাচনে শেখ হাসিনার সম্ভাব্য রাষ্ট্রক্ষমতার আরোহকে ঠেকানো হয়, যা তাঁকে পিছিয়ে দেয়। আরও পাঁচ বছর পর, ১৯৯৬ সালে, প্রথমবার রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে ঝড়ের নদীতে নৌকার পাল ধরেন তিনি। দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে। চারদিকে তখন শকুনীদের থাবা। প্রশাসন সহ রাষ্ট্রজীবনের সকল স্তরে বসা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা যে করেই হোক নতুন সরকারকে ব্যর্থ করতে বদ্ধ পরিকর। সে এক সুবিশাল চ্যালেঞ্জ শেখ হাসিনার।

এরই মধ্যে, অনেকটা আকস্মিক ভাবে, জাতীয় সংবাদ সংস্থা অর্থাৎ বাসস-এর হাল ধরতে হলো আমাকে, শুনেছি তাঁরই নির্বাচনে। সংস্থাটিতে তখন পাহাড় সমান সংকট। প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে প্রথম দেখা করতে গেছি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তিনি স্বাগত জানালেন, মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি সংকট বৃত্তান্ত শুনলেন এবং সংস্থায় বাংলা সার্ভিস প্রবর্তণসহ বাসসকে আধুনিকায়নের পথে এগিয়ে নিতে সব পদক্ষেপ নিতে বললেন। তাঁরই প্রতিশ্রুতির ফলে জাতীয় সংবাদ সংস্থার নবগঠিত বাংলা সার্ভিস গতি লাভ করল,যুগপ্রাচীন টেলিপ্রিণ্টার পরিবর্তন হয়ে কম্পিউটার বসল। বহুবিধ বিদেশি বার্তা ও ফিচার সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করা গেল। শেখ হাসিনা অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখলেন।

কিন্তু সংস্থায় আদর্শিক প্রতিপক্ষরা ছিলেন সংগঠিত এবং শক্ত যোগাযোগ সম্পন্ন। অতএব তারা একের পর এক আঘাত হানলেন। সে আঘাত ঠেকাতে শক্ত ভূমিকা নেওয়া ছাড়া উপায় রইলনা আমার। এরই মধ্যে আমার নিয়োগ চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে মামলা করে বসলেন তারা। জাঁদরেল ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ তাঁদের উকিল। সরকার বিরোধী পত্রিকাগুলি সে খবর ছেপে তাদের উৎসাহিত করল। রীটে দাবি করা হল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুড়ো প্রবীনদের বাদ দিয়ে তরুণ একজনকে নিয়োগ দিয়ে আইন ও রীতি ভেঙ্গেছেন। আগে কখনোই আমি মামলামোকাদ্দমায় পড়িনি। সে এক বড় বিরম্বনা ব্যক্তি জীবনের। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অতএব ছুটলাম শ্রদ্ধেয় ব্যারিষ্টার আমীর উল ইসলাম ও ব্যারিষ্টার তানীয়া আমীরের কাছে। গিয়ে শুনলাম, নেত্রী আগেই কথা বলেছেন যাতে আমার পক্ষে মামলাটি তাঁরা হাতে নেন। সেই মামলা চলেছে সাত বছর।

বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০১ সালের নির্বাচনে সুপরিকল্পিত ভাবে হারানো হল আওয়ামী লীগকে। আনা হল বিএনপি জামাতের জোটকে। নির্বাচনে হেরে শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেত্রী হলেন। সরকারের সিদ্ধান্তে বছরের পর বছর আমার বেতনভাতা বন্ধ থাকল। চাকুরিচ্যুতও করা হল। কিন্তু সংস্থার আইনে আমার নিয়োগটি মোটেও অবৈধ ছিলোনা বলে শেষ পর্যন্ত মাননীয় হাই কোর্ট এবং পরবর্তিতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে আমি বিজয়ী হলাম। কিন্তু আর ফেরা হলো না আমার কর্মস্থলে ।

যুদ্ধাপরাধ বিচার ও শেখ হাসিনার দৃঢ়তা

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে বাংলাদেশের মাটিতে যে নির্বিচার নৃসংশতা ঘটে তা ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তিকালে বিশে^র পঞ্চম বৃহতম গণহত্যা। এর শিকার হয়েছে ৩০ লক্ষ বাঙালি। নির্যাতিত হয়েছে কয়েক লক্ষ নারী। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত নির্বিচারে জ¦ালানো হয়েছে ঘরবাড়ি। ফলে ১ কোটি মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ফেলে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে হয়েছে, কাটাতে হয়েছে প্রায় এক বছরের শরণার্থী জীবন।

সে কারণে ন্যায় বিচারের স্বার্থে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় ঘাতক অনুচরদের বিচারের প্রশ্নটি ছিল মানব সভ্যতার দাবি, একই সঙ্গে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি। কিন্তু ১৯৭১ পরবর্তি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সেই খুনি ও ধর্ষকদের আইনের হাতে সোপার্দ করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ফলে বাংলাদেশ যে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী চিহিৃত করে, তারা সহ ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি দেশে ফিরে যায়। এদিকে আইন করে বন্ধ করা হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার। দালাল আইনের আওতায় বিচারাধীন, এমন কি দন্ডিত অপরাধীদেরও জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সেই থেকে দেশে চলতে থাকে বিচারহীনতার এক সংস্কৃতি। একদিকে নির্বিচার গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের কোনো বিচার হয়না, অন্যদিকে বিচার বন্ধ থাকে জাতির পিতার হত্যাকারীদের। অথচ অপরাধের বিচার না হলে মানুষের অপরাধবোধ জেগে ওঠে, সমাজ কুলষিত হয়, সভ্যতা বিপন্ন হয়।

কিন্তু শেখ হাসিনার দৃঢ়চিত্ত নেতৃত্ব বিচারহীনতার অমানবিক সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলে। তিন দশকেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার সম্পন্ন করা ছিল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মানদন্ডে এক বড় দৃষ্টান্ত, যা জাতিকে দায়মুক্তি দিয়েছে, কলংক থেকে মুক্তি দিয়েছে। শেখ হাসিনার সাহসী ও দৃঢ় প্রত্যয়ী নেতৃত্বে জাতির পিতার ঘৃন্য ঘাতকেরা কৃত অপরাধের দায়ে দন্ডিত হয়েছে, যা সমকালীন বাস্তবতায় সাধারণ কাজ ছিলো না। অন্যদিকে, দেশীয় আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়াটি তিনি কেবল শুরু করেন নি, দেশিবিদেশি চাঁপ ও ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত জাল উপেক্ষা করে এগিয়ে নিয়েছেন সাহস ও বিচক্ষণতায়। এই দুটি কাজ, যা অভাবিত ভাবা হতো একসময়, বাঙালি জাতিকে দৃঢ়চিত্ত করেছে, বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে ; একই সঙ্গে জাতীয় স্বাধীনতার লাখো শহীদ ও লাখো বীর সৈনিকদের আত্মাকে সম্মানীত করেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর একটি বড় মনস্থাত্তিক সংকট সমাজকে পর্যুদস্থ করতে থাকে। সে সংকট ছিল অসহায়ত্বের, কিছু করতে না পারার। ১৯৮০ দশকের শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আদর্শিক চেতনা পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মনস্তাত্তিক পূণ:জাগরণ লক্ষ্য করা যায়। দীর্ঘকালীন বিচারহীনতা, সামরিক শাসন ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পালাক্রমিক আধিপত্য এই পূণ:জাগরণকে বেগবান করে। ইতিহাস যেন নিজের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে তার সত্যকে আবিস্কার করে। এরই ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবি সোচ্চার হতে থাকে। মোড় ঘুরানো এই পুনর্জাগরণে মূখ্য রাজনৈতিক ভূমিকা রাখেন বঙ্গবন্ধুর কণ্যা। আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার সুষ্পষ্ট অঙ্গিকার আসে । লক্ষণীয়, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে সাংবিধানিক ও আইনগত ভিত্তি দিয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনি রায়, ঠিক একই ভাবে যুদ্ধাপরাধের যুগান্তকরি বিচার শুরু করার পেছনে ভিত্তি জুগিয়েছে আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের রায় Ñ যা অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের শেষ প্রান্তে। সে নির্বাচনে নতুন প্রজন্মের ভোটদাতারা বিপুলভাবে রায় প্রদান করে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের পক্ষে।

নির্বাচনে বিপূলভাবে বিজয়ী হওয়ার পর ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস করা হয়। এরপর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পর, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্তদের বিচারের জন্য গঠন করা হয় ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনারের আওতায় আসে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা, ধর্ষণ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ Ñ যা সারাবিশে^ই আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর, বিশেষ করে মূল অভিযুক্তরা যখন রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক ভাবে সবল ও শক্ত যোগাযোগ সম্পন্ন, তখন তাদের বিরুদ্ধে এমন একটি বিচারিক উদ্যোগ, বলা বাহুল্য, সাধারণ কোনো উদ্যোগ ছিলোনা। বরং তা ছিল বহুলাংশেই এক নতুন মুক্তিযুদ্ধ। অনস্বীকার্য, শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।

যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়াটি প্রবল জনসমর্থনে সিক্ত হলেও এর বিরুদ্ধে দেশ ও বিদেশে সমালোচনার সৃষ্টি করা হয়। অভিযুক্তরা বিপূল অর্থ বিনিয়োগ করে ‘লবিষ্ট’ নিয়োগ করে। ফলে নানা দেশে বিচার প্রক্রিয়াটি সমালোচনার মুখে পড়ে। পাকিস্তান প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দেশটি সরকারি ভাবেই কেবল বিচারের বিরোধীতা করেনা, তাদের ন্যাশনাল এসেম্লিতে, সকল আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ভেঙ্গে, বিচারের বিরুদ্ধে প্রস্থাব গ্রহন করা হয়। অন্যদিকে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করতে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক সমর্থক দলগুলি সহিংস পথ অবলম্বন করে। কিন্তু শেখ হাসিনার সুদৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অটল থাকে। ফলে সব চাঁপ উপেক্ষা করে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সামনে এগিয়ে যায়। অনেকেই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে কী অসামান্য সাহসী ভূমিকা গ্রহন করেছিলেন জাতির পিতার এই সাহসী কণ্যা !

১৯৯২ সালে রাজাকার শিরোমনি পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে জামাতের আমীর ঘোষণা করা হলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতকÑদালাল নির্মূল কমিটি। এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে যে ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়, তার মূল রাজনৈতিক শক্তি ছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁরই প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় সমন্বয় কমিটিতে আওয়ামী লীগ থেকে যুক্ত হন জনাব আব্দুর রাজ্জাক এবং জাসদ থেকে কাজী আরেফ আহমেদ। খালেদা জিয়ার শাসনামলে ঢাকার সোহরাওয়ার্দি বসে ঐতিহাসিক গণআদালত। প্রতীকি সে আদালতে লাখো মানুষের সমর্থণে গোলাম আযমের অপরাধকে মৃত্যুদন্ডতুল্য বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার সরকার নির্মম দমনপীড়ন শুরু করে, ২৪ জন বরেণ্য জাতীয় ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রজু করে। সে পরিস্থিতিতেও দৃঢ়চিত্ত ভূমিকা রাখেন শেখ হাসিনা।

১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে জাতীয় সংসদে তিনি যে বক্তব্য রাখেন, তার কিয়দংশ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। শেখ হাসিনা বলেন, “---- গণআদালত যে রায় দিয়েছে তাতে তারা কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি, মাননীয় স্পীকার। যেহেতু তারা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি সেহেতু নিশ্চয়ই তাদেরকে বেআইনি বলার কোনো অধিকার নেই, কোনো অবকাশ নেই। এই যুদ্ধাপরাধীর (গোলাম আযমের) অপরাধগুলি (গণআদালতের রায়ের কাগজি দেখিয়ে) লিপিবদ্ধ আছে এবং এই সকল অপরাধে যিনি অপরাধী তার শাস্তি মৃত্যুদন্ডতুল্য।--- তাই আমার আবেদন মাননীয় স্পীকার, এখনো সময় আছে দলমত নির্বিশেষে সবকিছুর উর্দ্ধে উঠে আসুন,যেভাবে একমত হয়ে আমরা একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী পাস করেছি,আসুন সেভাবে কাজ করি। যারা স্বজন হারিয়েছেন,স্বজন হারানোর ব্যাথায় যাদের হৃদয় এখনো ব্যথিত, আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেই।”

গণআদালতের রায়কে সমর্থন জানিয়ে তিনি আরও বলেন,--“এই মহান সংসদের অধিকার রয়েছে। জাতি সেই অধিকার দিয়েছে। এই সংসদ সার্বভৌম সংসদ। সেই লক্ষ্যে Ñ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচারণ, যুদ্ধ ও গণহত্যাসহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সাধন,বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের সাথে জড়িত থেকে বাংলাদেশের বিরোধীতা,বিদেশি নাগরিক হওয়া সত্বেও ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ জনগনের যে মতামত প্রতিফলিত হয়েছে, তাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ আন্তর্জাতিক ক্রাইমস এ্যক্ট ১৯৭৩ অনুসারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, তার বিরুদ্ধে আনিত অপরাধ সমূহ বিচারের জন্য, আইনগত পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য আমি আপনার মাধ্যমে এই সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে জনগণের ঐ মতামত প্রতিফলনকারী গণআদালতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে জারীকৃত অসম্মানজনক মামলা দায়ের করার জন্য দু:খ প্রকাশ করে ঐ মামলা প্রত্যাহার করার জন্য আমি আপনার মাধ্যমে সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।”

জাতীয় সংসদে সেদিন দীর্ঘ বিতর্ক চলে গণআদালতের রায় নিয়ে। খালেদা জিয়ার সরকার বাধ্য হয়ে ২৯ জুল ১৯৯২ বিরোধী দলের সঙ্গে ৪Ñদফার চুক্তি স্বাক্ষর করে। সে চুক্তিতে গোলাম আযমের বিচার ও গণআদালতের উদ্য্যোক্তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের কথা ছিল। কিন্তু সে চুক্তির বাস্তবায়ন করেনি সেদিনের সরকার!

মোটকথা, ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ এর ঘাতকদের বিচারের দাবি ছিল সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম,মনুষত্বের সংগ্রাম। এ সংগ্রাম ছিল সভ্যতার বোধ সৃষ্টি ও তাকে সুরক্ষা দেওয়ার সংগ্রাম, যাকে সাহস ও দৃঢ়তায় সম্পন্ন করার বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা।

স্মরণযোগ্য, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যে ‘ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল’ ও ‘টোকিও ট্রায়াল’ বসে, তারও মূল দাবি ছিল সভ্যতার বোধ সৃষ্টি করা। সেই বিচারে মিত্র পক্ষের প্রধান আইনজীবী জাস্টিস জ্যাকসনের ভাষ্য ছিল এ রকম: ‘মানব জাতিকে যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রয়োজন। এই বিচার না হলে সমাজে সভ্যতার বোধ প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা।’ অন্যদিকে গণহত্যার মতো সুপরিকল্পিত ব্যাপক হত্যাকান্ডগুলির বিচার না করা গেলে তা আবারও ফিরে আসে । যেমন দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে ইউরোপের মাটিতে নাজি বাহিনীর বর্বরতার নৃসংসতা মাত্র কয়েক যুগের মাথায় বাংলাদেশ, রুয়ান্ডা,বসনিয়া-হারজেগোভিনা ও কম্বোডিয়াসহ নানা দেশে ফিরে এসেছে।

অনস্বীকার্য, সব দেশেই যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানবতার লড়াই, সভ্যতার লড়াই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরও আছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই, ইতিহাসের লড়াই এবং বাঙালি জীবনের আদর্শিক ভিত্তির লড়াই ও ভবিষ্যত। সে লড়াইকে এগিয়ে নিয়েছে শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ।

উপসংহার

খুব বেশি দেখা বা কথা বলার সুযোগ হয়নি আমার শেখ হাসিনার সঙ্গে । লেখালেখির নিভৃত জীবনযাপনেই স্বাছন্দ আমার। তবে সাংবাদিকতার সুবাদে বার কয়েক দেখা হয়েছে । যতোবার হয়েছে, ততবারই দেখেছি তাঁকে সাবলিল, বঙ্গবন্ধুর পাওয়া মেজাজ ও অন্তরঙ্গতায় ভরা খাটি বাঙালি হিসেবে। এক দুবার নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের দিনে অভ্যাগতদের সঙ্গে প্রাণখোলা কথাবার্তা বলতে দেখেছি তাঁকে। এমনই খোলামেলা যে অনেকেই ভয় পেয়ে যান, বলতে থাকেন, এতোটা খোলামেলা হতে যান কেন তিনি ! কিন্তু শেখ হাসিনা কোনোকিছু লুকোবার চেষ্টা করেন Ñ এমনটা ভাবা ঠিক নয়। যা তিনি ভাবেন Ñ তাকে রাখঢাকের প্রয়োজন বোধ করেন না। এতেই তাঁর সাতন্ত্রতা।

শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি দেখিনে কেবল। প্রধানমন্ত্রী হন অনেকেই, হবেনও। তাঁকে দেখি আমি বাংলাদেশ রাষ্ট্র জনকের বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার একজন হিসেবে, যিঁনি রাষ্ট্রকে তার ছিনতাইকৃত গৌরব ফিরিয়ে দেয়ার মহাসমরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭৫ এর রক্তপাতের পর যে ভয়ংকর স্বদেশ, জেগে ওঠা যে ‘নব্য পাকিস্তান’(!), তারই বিপরীতে বাঙালির রাষ্ট্রকে আজকের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার যে সাহসী ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব তারই সর্বাধিনায়কের নাম শেখ হাসিনা।

আমার বিশ্বাস, সামাজিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি একটি বড় রাজনৈতিক যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন তিনি। সে যুদ্ধ কতটা প্রয়োজনীয়, কতটা ভয়ংকর এবং কতটা ঝুঁকিপূর্ণ Ñ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কাজেই ভয়ংকর ঝুঁকি নিতে হয়েছে তাঁকে । ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের সুখ ও সাচ্ছন্দ পরিত্যাগ করতে হয়েছে । দৃঢ়চিত্তে মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রভাবশালী দেশিবিদেশি মহলের প্রতিরোধ ও প্রতিবন্ধকতা । সেই বিপদসঙ্কূল পথে সামনে এগুবার যে সাহস, এই যে দৃঢ়তা Ñ তার সবটাই দেখাতে পেরেছেন শেখ হাসিনা।

সকলেই জানি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে সরকরের রাজনৈতিক বিরোধীদের স্বাধীন ও উন্মুক্ত কার্যক্রম জরুরি। এ ছাড়া রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক, মানবিক ও আধুনিক হয়না। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য এই যে, পাঁচ দশক পরেও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিরোধীরা আজও সর্বাংশে স্বক্রিয়। গণতান্ত্রিক অধিকারের আবরণে এরা রাষ্ট্রের ইতিহাস ও মৌলিক চেতনার প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের আবির্ভূত করে ; রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিত্যনতুন যুদ্ধ চাঁপিয়ে পুরনো প্রভুর জয়গান করে! কাজেই যে বাংলাদেশ লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত তাকে সুরক্ষা দিতে হবে বৈকি।

অনেক অর্জনের পরেও বাংলাদেশ আজ এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি। অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধ পন্থিদের দীর্ঘ পালাক্রমিক শাসনের পরেও আজও কেন স্বক্রিয় Ñতা ভেবে দেখার দাবি রাখে বৈকি। অতএব আত্মতুষ্টির সুযোগ কম। দীর্ঘস্থায়ি সমরে জেতার প্রস্তুতি প্রয়োজন ; প্রয়োজন আদর্শিক যোদ্ধা তৈরির কৃতিত্ব। রাজনীতি কেবলই শ্লোগান সর্বস্য হয়ে উঠুক Ñ তা কাম্য হতে পারেনা। এই প্রক্রিয়া সাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম বটে, কিন্তু বৃহৎ আক্রমন প্রতিহত করার জন্যে সামর্থ হারায়। ভুলে গেলে চলবেনা, অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্বার প্রতিপক্ষরা প্রাথমিক ভাবে পরাস্থ হলেও তারা দীর্ঘস্থায়ি যুদ্ধে লিপ্ত। অতএব রাজনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে এগিয়ে নেয়ার বিকল্প নেই ; চাই বাঙালি জীবনের নবজাগৃতি।

১৯৮১ সাল থেকে দীর্ঘ পথযাত্রা শেখ হাসিনার। বাংলাদেশের চেহারা আজ সুষ্পষ্ট ভাবেই আলাদা। সে আজ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো সুবৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের সাফল্য অর্জিত হয়েছে দেশে , যা উদভাসিত করেছে জাতীয় আত্মশক্তির, আত্মমর্যাদার। আন্তর্জাতিক মানদন্ডে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের সিঁড়ি পেয়েছে। শেখ হাসিনার পালাক্রমিক রাষ্ট্রশাসনে রাষ্ট্র আজ উন্নয়ন ও প্রগতির মহাসড়কের যাত্রি। বলা বাহুল্য, এরপরেও বঙ্গবন্ধু কণ্যার কাছে জনপ্রত্যাশা অপরিসীম । প্রত্যাশার সীমা এতোটাই যে সকলেই যেন ভুলতে বসেন কী ভয়ংকর কূট পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্মকে ব্যর্থ করা চেষ্টা হয়েছিল ! কিন্তু শেখ হাসিনা ব্যর্থ হননি। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশকে তিনি নতুন জীবন দান করেছেন। প্রবল প্রতিকূলতা মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের লুণ্ঠিত ধারাকে তিনি ফিরিয়ে এনেছেন। এ এক অসামান্য কৃতিত্ব তাঁর।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক,মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।


মমতাময়ী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও প্রাসঙ্গিক কথা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
গোলাম কুদ্দুছ

বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় শামিল হয়েছি এবং আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিবাদী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেছি। আমাদের প্রত্যাশা কখনো কখনো আকাশ ছুঁয়েও যেতে পারে। এ কথা মানতে হবে, মানুষের চিন্তা, কল্পনা এবং প্রত্যাশার পেছনে যুক্তি থাকে আস্থা ও নির্ভরতার ভিত্তি থাকে। এই আস্থা ও ভিত্তি কল্পনার রাজ্যে বসবাস করে না। লড়াই, সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্যদিয়েই বাস্তব সত্যে পরিণত হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখেছি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর সংগ্রামী চেতনার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর অঙ্গুলি হেলনে পুরো জাতি তাদের কর্তব্য নির্ধারণে এক মুহূর্তও দেরি করেনি। তাঁরই নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ যখন সব ধ্বংস, বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত ঠিক তখনই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি এবং ক্ষমতালোভীচক্র দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যা শুধু ব্যক্তি মুজিবকে হত্যা নয়-মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং বাংলাদেশকে হত্যার শামিল। ক্ষমতা দখল করেই মোশতাক ও জিয়াচক্র সামরিক শাসন জারি করে, সংবিধানকে কেটে-ছিঁড়ে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বাংলাদেশকে পরিচালিত করার চক্রান্ত শুরু করে। সেই যে শুরু, মোশতাক-জিয়া-খালেদা জিয়া-এরশাদচক্র দীর্ঘ ২১ বছর এবং তারপর আরও সাত বছর একই প্রচেষ্টা ও প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, ইতিহাস, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি সংস্কৃতিকে ক্ষত-বিক্ষত করে ওই শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার জাঁতাকলে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছে আমাদের প্রিয় স্বদেশকে।

১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে প্রণীত দালাল আইন বাতিল করে সব যুদ্ধাপরাধীদের অভিযোগ থেকে মুক্তি এবং কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়। এই সময় বন্দুকের জোরে সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে বানানো হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের রক্ষার জন্য জারি করা হয় কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স। ৭ নভেম্বরে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করে মুজিবনগর সরকারের চার স্তম্ভ বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু সহযোদ্ধা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে। আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনের অধিকাংশ নেতা-কর্মীর জীবনে নেমে আসে জেল-জুলুম-হুলিয়া। নির্যাতন-নিপীড়নে প্রায় বিধ্বস্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। এই সময় জেনারেল জিয়া অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতায় থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। একদিকে স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে তিনি সংগঠিত করেন, অন্যদিকে অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে সুবিধাবাদী পরিচিত মুখদের জড়ো করেন। আবার ভয় দেখিয়ে বহু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকেও তার নয়া দলে যোগ দিতে বাধ্য করেন। স্বৈরশাসন চালিয়ে, ক্ষমতার সর্বশক্তি নিয়োগ করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে রাষ্ট্র এবং সমাজে তার কর্তৃত্ব স্থাপনের এই প্রক্রিয়ার সময়ে ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার হোটেল ইডেনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে দেশ এবং দলের সার্বিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করে দিল্লিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতভাবে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ, দেশে প্রত্যাবর্তনসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ঢাকা থেকে দিল্লিতে যান আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মালেক উকিল, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ আজাদ, ড. কামাল হোসেন, জোহরা তাজউদ্দীন, এম কোরবান আলী, সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আইভি রহমান প্রমুখ। পূর্ব থেকেই সেখানে ছিলেন ডা. এস এ মালেক। তখন ঠিক হয়, শেখ হাসিনা ১৭ কিংবা ২৬ মার্চ দেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু পরবর্তীতে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা এবং পুতুলের জলবসন্ত দেখা দেয়ায় শেখ হাসিনার ঢাকা আসা পিছিয়ে যায়।

অবশেষে ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর নির্ধারিত হয় ১৭ মে ১৯৮১ শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরবেন। সে এক উত্তেজনাকর আবেগময় ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে দেশে নিয়ে আসার জন্য দলের পক্ষ থেকে দিল্লি গেলেন আবদুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী। ১৬ মে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে দিল্লি থেকে কলকাতা এলেন শেখ হাসিনা, কন্যা পুতুল, আবদুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী। ১৭ মে বিকেলে ঢাকায় বিমান থেকে নামেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই প্রথম এলেন। পিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা, তিন ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই আর জীবিত নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুনিদের উন্মত্ততায় নিহত হয়েছেন তারা সবাই। ৩২ নম্বর সড়কের সেই বাড়িটি তখন মৃত্যুপুরী। জেনারেল জিয়ার সরকার বাড়িটিকে তালা মেরে পুরো বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খলিত করতে চেয়েছেন। সেদিন আকাশে ছিল মেঘ, ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। প্রকৃতি যেন শোকের চাদর গায়ে মলিন বদনে শেখ হাসিনার জন্য প্রতীক্ষা করছিল। বিমান থেকে নামার পর শুরু হলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি- যেন শেখ হাসিনার অশ্রু জল হয়ে ভরিয়ে দিল বাংলার প্রতিটি প্রান্তর। লাখ লাখ বঙ্গবন্ধুপ্রেমীর স্লোগানের মধ্যে তিনি খুঁজে ফেরেন স্বজনের মুখ। আবেগজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই’। মুহূর্তের মধ্যে সে ধ্বনি প্রকম্পিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল ৬৪ হাজার গ্রামের প্রতিটি লোকালয়ে। বিমানবন্দর থেকে সংবর্ধনাস্থল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ পর্যন্ত পুরো রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। ১০-১৫ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল সে সংবর্ধনায়।

এরপর শেখ হাসিনার শুরু হলো এক নতুন জীবন। দলকে পুনর্গঠন আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী তখনো কারাগারে বন্দি। মিথ্যা মামলা আর হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনকে ধ্বংস করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তাকে রুখে দিতে হবে। ভয়ভীতি প্রদর্শন আর অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে দল ভাঙা, নেতা-কর্মীদের ক্ষমতাসীন দলে ভেড়ানোর প্রচেষ্টা এবং কখনো কখনো দলীয় কার্যক্রম থেকে নিষ্ক্রিয় রাখার ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করতে হবে। সারাদেশে দলকে পুনর্জীবিত করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। একইসঙ্গে দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রামও শুরু করেন। সামরিক শাসন ও স্বৈরশাসনের ফলে যে সব অবৈধ নির্দেশ ও কালাকানুন জারি করে পরবর্তীতে সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে তা বাতিল এবং পরিবর্তনের দাবি জানান শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সংবিধানের চার মূলনীতি পুনঃস্থাপনের দাবিও উত্থাপন করেন তিনি। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি এবং জেল হত্যাকারীদের বিচার করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের কারাগার ও অভিযোগ থেকে মুক্তি, চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাজনীতি করার সুযোগ দানের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম শুরু করেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, ঘুষ-দুর্নীতি এবং অবৈধ ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও তিনি দেশবাসীকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।

এদিকে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ১৯৮১ সালের ৩০ মে একদল বিক্ষুব্ধ সেনার হাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হলেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান। জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। ১৯৮১ সালের ১২ জুন বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সরকার বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িটি শেখ হাসিনার নিকট হস্তান্তর করে। সরকারি দখলমুক্ত হয়ে বাঙালির প্রাণভোমরার এই ঐতিহাসিক বাড়িটি ফিরে পেলে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানারা এই বাড়িটি এখন বঙ্গবন্ধু জাদুঘর হিসেবে বাঙালির এক তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিদেশিরাও আসেন এই বাড়িটি দেখতে, বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানাতে।

জাতির এ কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো সংগঠিত হওয়ার তাগিদ অনুভব করে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল, রাজবন্দিদের মুক্তি, জেল-জুলুম নির্যাতন প্রতিরোধ, ঘুষ-দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং সীমান্ত সমস্যা সমাধান ও ছিটমহল বিষয়ে ইন্ধিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়নে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর নেতৃত্বে সারাদেশে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা প্রাণ ফিরে পায় এবং সব ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে দল এবং জনগণকে সংগঠিত করার কঠিন সংগ্রামে নিয়োজিত হয়। একই সময়ে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলাম এবং অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো পঁচাত্তরপরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদারিত্ব এবং পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে রাষ্ট্র এবং সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলায় সচেষ্ট হয়। মুক্তিযুদ্ধের মৌল আদর্শ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিপরীতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি, সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং প্রগতির বিপরীতে ধর্মান্ধ এবং পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ এ সময় প্রত্যক্ষ করা যায়। এ সব উদ্যোগকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে বিএনপি এবং পরবর্তীতে জাতীয় পার্টি। জাতির এ ক্রান্তিকালে শেখ হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে প্রতিরোধ, জনজীবনের নানাবিধ সংকট দূরীকরণ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার কঠিন সংগ্রামে নিয়োজিত হন। দেশবাসীও আশায় বুক বেঁধে পাশে এসে দাঁড়ায়, পরবর্তীতে রচিত হয় নতুন ইতিহাস।

কখনো একক, কখনো যুগপৎ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই চলতে থাকে। এ লড়াইয়ে ছাত্র, যুবক, পেশাজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, নারীÑসবাই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখে। প্রেসিডেন্ট সাত্তারের বিদায়ের পর জেনারেল এরশাদের পতন ঘটলে তিন জোটের রূপরেখা মোতাবেক সাহাবুদ্দীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়। যদিও এ নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯৬ সালে নানা ঘটনার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির অধীনের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দীর্ঘ ২১ বছর পর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি এবং ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিচুক্তি সম্পাদন করে তিনি দেশকে দুটি বড় সংকট থেকে রক্ষা করেছিলেন। হতদরিদ্র মানুষের কল্যাণে তাঁর সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিশেষ করে দেশের উন্নয়নে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করেন। সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সন্তানের পরিচয়ে পিতার পাশাপাশি মায়ের নাম লিপিবদ্ধকরণ বাধ্যতামূলক করেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জন করে। তাঁর সরকার কুখ্যাত ইনডেমনিটি বাতিল করে প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ শুরু করে। এ ছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসা, শিল্প, বিদ্যুৎ উন্নয়ন, কৃষিসহ সব গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যাপক উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এবং বিদেশি নানা মহলের আনুকূল্য পেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে জয়লাভ করে। পরে দেশব্যাপী সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির ওপর ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়। বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতায় দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। এই সময় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম, অ্যাডভোকেট মমতাজউদ্দিন, সাংবাদিক মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালুসহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে। এ সব অপকর্মের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ সময় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয় বারবার। বিশেষ করে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা ইতিহাসের এক কালো দিবস হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য এবং নির্মূল করার এ ধরনের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা বিশ্ব আর কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে দলিত মথিত করে বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশে জরুরি অবস্থা সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করে। শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ করে রাজনীতি থেকে বিদায় করার চক্রান্ত করা হয়। কিন্তু অনমনীয় সাহসিকতা এবং বিচক্ষণতায় সব বাধা অতিক্রম করে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনা বিপুল সংখ্যাধিক্ষ্যে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন। তার পরের ইতিহাস বাঙালির গর্ব ও সাহসের ইতিহাস। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সারা পৃথিবীতে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাঁর সততা, সাহসিকতা, দেশপ্রেম এবং বিচক্ষণতায় আমরা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছি স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে অর্জন করেছি সমুদ্রের বিশাল এলাকা। বাংলাদেশের অর্জন আজ আমাদের বিশ্বে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা থাকলেও এ অর্জনের মূল কাণ্ডারি শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা শুধু রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনৈতিক নেতাই নন, তিনি মানবিকতার এক উজ্জ্বল প্রতীক।

সমকালীন বিশ্বে যে কয়জন রাজনীতিবিদ তাদের নীতি-আদর্শ, প্রজ্ঞা, দক্ষতা এবং অনমনীয় দৃঢ়তার জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত, তার অন্যতম ব্যক্তিত্ব আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু বঙ্গবন্ধুর কন্যা নয়, স্বীয় প্রতিভা এবং কর্মগুণেই তিনি আজ বিশ্বনন্দিত। সততা, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দৃঢ়তা তাঁকে এক দক্ষ রাষ্ট্রনায়কে পরিণত করেছে। তাঁর নেতৃত্বে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্র আজ মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করেছে। অর্থনীতির সব সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রায় উন্নত রাষ্ট্রের সমকক্ষ। গড় আয়ের সঙ্গে গড় আয়ু বৃদ্ধিও এক বিস্ময়কর ঘটনা।

তবে সবকিছু ছাড়িয়ে তাঁর মানবিক বোধ এবং বিপন্ন মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা তাঁকে এক বিশেষ উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি সমান দৃষ্টির এক মানবিকবোধের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞে। রাষ্ট্র এবং সমাজজীবনে তাঁর কর্মযজ্ঞের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই এ বক্তব্যের বাস্তবতা দৃশ্যমান হয়।

শেখ হাসিনার থাকার জন্য নিজের নামে কোনো বাড়ি নেই। অথচ সেই তিনি গৃহহীন মানুষের থাকার জন্য নির্মাণ করেছেন আশ্রয়ণ প্রকল্প। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাড়ি এবং স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য নির্মাণ করছেন অসংখ্য ফ্ল্যাট বাড়ি। গরিব মানুষ স্বল্প ভাড়ায় ফ্ল্যাটের মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন আজ। প্রতিবন্ধী, সমাজের পিছিয়ে পড়া হরিজন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন, নমশূদ্র ও বেদে সম্প্রদায়ের আশ্রয়হীনদের জন্য তাঁর দেশব্যাপী আশ্রয়ণ প্রকল্প মানবাধিকার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আমাদের সমাজব্যবস্থায় প্রবীণরা সম্মানিত হলেও অসচ্ছলরা দারুণ অবহেলিত। পরিবারের বোঝা হিসেবেই অনেকে তাদের বিবেচনা করছেন। ছোটখাটো প্রয়োজন মেটানোর জন্য ১০টি টাকাও তাদের নিজের বলে থাকে না। এই অসহায় প্রবীণদের কল্যাণে শেখ হাসিনা চালু করেছেন মাসিক বয়স্ক ভাতা। এই ভাতা দিয়ে শুধু আর্থিক সহায়তাই করা হলো না, সামাজিক মর্যাদাও তাঁদের ফিরিয়ে দেয়া হলো। রাষ্ট্রের কাছে তাঁরা সম্মানিত, ব্যক্তি সে তো নৈস্য।

পেশাজীবী নারীদের কল্যাণে তিনি প্রসূতি ভাতা, দীর্ঘ ছুটি এবং বাচ্চাদের দেখভালের জন্য ‘ডে কেয়ার সেন্টার’ স্থাপন করেন। মা এবং শিশুর কল্যাণে প্রকৃতপক্ষে মায়ের ভূমিকাই পালন করছেন শেখ হাসিনা।

সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসাসেবাকে দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। প্রতিটি পল্লীতে স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিকে সাধারণ মানুষকে বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ করা হয়। উপজেলাপর্যায়ে সরকারি হাসপাতালের বেড সংখ্যা বৃদ্ধি, আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলা এবং বিভাগীয় শহরে জেনারেল ও বিশেষায়িত চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ঢাকায় নিউরো হাসপাতাল, ইএনটি হাসপাতাল, বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শেখ হাসিনা নিজেও এ সব হাসপাতালের চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন। সম্প্রতি ১০ টাকার টিকেট কেটে শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে তাঁকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে দেখেছি। করোনা সংক্রমণরোধে প্রতিটি নাগরিককে বিনামূল্যে টিকাদান তাঁর বিচক্ষণতা ও মানবিক বোধেরই পরিচয় বহন করে।

গত কয়েক বছর আগে ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত পরিবারের অনাথ কন্যাদের তিনি নিজের সন্তানতুল্য বিবেচনা করে বিয়ের ব্যবস্থা করেন এবং তাদের স্বামীদের চাকরি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাড়িটি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা নিজেরা ব্যবহার না করে ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর নিকট হস্তান্তর করেন। এই ট্রাস্ট থেকে প্রতিবছর অসংখ্য গরিব পরিবারের কন্যার বিয়ে এবং সন্তানদের লেখাপড়ার ভার বহন করা হয়।

শিল্পীদের কল্যাণের জন্য তাঁর দ্বার সবসময়ই উন্মুক্ত। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে থেকে তিনি দেশের খ্যাতিমান শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, লেখকদের চিকিৎসাসেবায় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন। সংস্কৃতিসেবীদের কল্যাণের জন্য তিনি ‘শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন করেন। ক্রীড়াবিদ এবং গার্মেন্ট শিল্পীদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ আমরা বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি।

১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে পুরো দেশ মহাপ্লাবনে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস, ফসল নষ্ট এবং অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। এরমধ্যে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল বিপুল। সরকার এ সময় থেকে চালু করে ভিজিএফ কার্ড। বিপন্ন মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহের এক নতুন উদ্যোগ। প্রায় ৭০ লাখ পরিবারকে ভিজিএফ কার্ডের আওতায় আনা হয় সে সময়। আপদকালীন সময় ছাড়া ঈদের সময় এই দরিদ্র পরিবারগুলোকে সরকার চাল, ডাল, চিনি, সেমাই বিনামূল্যে সরবরাহ করে থাকে। খোলাবাজারে ভর্তুকি দিয়ে কমমূল্যে চাল, আটা এবং কখনো কখনো অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রয় করা হয়, যা সাধারণ মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। আর এ সব পরিকল্পনার মূলে রয়েছে মানুষের প্রতি শেখ হাসিনার গভীর মমত্ববোধ।

শেখ হাসিনা দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের সভাপতি কিংবা রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হলেও তাঁর মধ্যে লুকিয়ে আছে সহজাত বাঙালি চরিত্রের এক মর্মস্পর্শী আবেদন- মমতাময়ী মা। অসহায় মানুষের আহাজারি তাঁর হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দেয়, যা রাজনৈতিক চরিত্রের বাইরে এক মানবিক বোধের বাতাবরণে সবাইকে আবিষ্ট করে। আর সে কারণেই শেখ হাসিনা অসহায় মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল, আমাদের অস্তিত্বের ঠিকানা।

লেখক: গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব


banner close