শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা

স্বকীয়তার এক নয়া নিয়ামক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার টোকিওতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। ছবি: পিএমও
দেলোয়ার হোসেন
প্রকাশিত
দেলোয়ার হোসেন
প্রকাশিত : ২৯ এপ্রিল, ২০২৩ ০৯:৫২

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরের প্রাক্কালে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা’ ঘোষণা করে, যেখানে গঠনমূলক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ, আলোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশের টেকসই অর্থনীতি ও সমৃদ্ধিতে তা ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ২৪ এপ্রিল ২০২৩ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এ রূপরেখা সম্পর্কিত বক্তব্য তুলে ধরেন। বহুল প্রতীক্ষিত এ রূপরেখা বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আর এই রূপরেখায় বাংলাদেশ আবারও সামনে নিয়ে এল তার নিরপেক্ষ ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান, যেখানে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন রয়েছে একেবারে কেন্দ্রে। আর এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সংযুক্ত করতে চায় সম্ভাব্য সবাইকে।

বহু প্রতীক্ষিত এ রূপরেখা সম্পর্কে ঘোষণা এসেছিল বিভিন্ন পর্যায়ে। বাংলাদেশের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আরও বেশ কিছু দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল প্রণয়ন করে। আসিয়ান প্রণয়ন করে রূপরেখা। বাংলাদেশ তাই বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ করে নিজস্ব ধারণাসংবলিত এ রূপরেখা প্রণয়ন করল।

যখন সারা বিশ্ব ইউক্রেন যুদ্ধ, তাইওয়ান-সংকট ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক নতুন রূপ দেখতে পাচ্ছে, যেখানে মেরূকরণ আবারও প্রকট হয়ে উঠেছে, ক্রমশ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা জোট ও সমঝোতা, ঠিক তখন বাংলাদেশ তার অবস্থান স্পষ্ট করল সারা বিশ্বের কাছে; আর তা নিজস্ব ধারণার ওপর নির্ভরশীল থেকে প্রতিষ্ঠিত ভারসাম্যের নীতিতে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করতে পারে বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। তা ছাড়া ঢাকা যুক্তরাষ্ট্র, কোয়াডের অন্যান্য দেশ ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে আন্তরিক ও অংশীদারত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। চীনের সঙ্গেও রয়েছে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগিতার এক কার্যকরী সম্পর্ক। আর তাই এ রূপরেখার গুরুত্ব আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে যেখানে বাংলাদেশের স্বকীয়তা প্রকাশ পেয়েছে আবারও।

এই রূপরেখার দুটি দিক বিশেষ দৃষ্টিপাতের দাবিদার। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার সঠিক অবস্থান বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পেরেছে। বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন মহল বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছিল বহুদিন ধরেই, যেখানে বাংলাদেশকে কোনো একটি নির্দিষ্ট মেরু কিংবা গোষ্ঠীবদ্ধ করে বাকি সব বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটানো ছিল মূল লক্ষ্য। সেখানে বাংলাদেশ এই রূপরেখার মাধ্যমে সামনে নিয়ে এল নিজের স্বকীয় পররাষ্ট্রনীতি চর্চার সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রণয়ন করা নীতিমালার আলোকে নয়, বাংলাদেশের নীতি নিজস্ব ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত- এটিই যেন আরেকবার প্রমাণিত হলো। এই রূপরেখার মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনায় নিজস্ব ধারণার বহিঃপ্রকাশে এক নতুন দলিল পেল। নীতিনির্ধারকদের জন্যও এটি একটি দালিলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে, বিশেষ করে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় যুক্ত হবে এক স্থিতিশীলতা। এর প্রভাব লক্ষ্য করা যাবে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমষ্টিগত অবস্থা আলোচনার ক্ষেত্রেও। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের বিদ্যমান পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক নিয়ামকগুলোকে মাথায় রেখে যেহেতু এটি প্রণীত হয়েছে, তাই এটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মৌলিকতারও একটি নতুন বহিঃপ্রকাশ। তিনটি ভিন্ন দিক থেকে এই রূপরেখার ধারণাটিকে পর্যালোচনা করা যায়।

প্রথমত, যখন বাকি বিশ্ব তাদের কৌশলে বলছে এক অবাধ ও মুক্ত প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের কথা। বাংলাদেশ যুক্ত করেছে আরও কিছু বিষয়। বাংলাদেশ চাইছে সংযুক্ত ও সমৃদ্ধ এক প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল যেখানে উন্নয়ন সংঘটিত হবে সমন্বিতভাবে। কেননা, বাংলাদেশ তার রূপরেখায় যুক্ত করেছে শান্তি, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো। বাংলাদেশ এই অঞ্চলকে আরও বিস্তৃত ও সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের এক অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও বদ্ধপরিকর। তাই বাংলাদেশের কাছে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল হচ্ছে স্বাধীন, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।

দ্বিতীয়ত, এই রূপরেখায় চারটি মূলনীতির কথা বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে নিশ্চিত হবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। প্রথমটি হলো, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদে উল্লিখিত নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধার নীতির ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনার সাংবিধানিক আদেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ পরিত্যাগ এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। তৃতীয়টি, ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘ কনভেনশন (ইউএনসিএলওএস)সহ প্রযোজ্য প্রাসঙ্গিক জাতিসংঘ চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলো মেনে চলা। চতুর্থটি হচ্ছে, টেকসই উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, মানবিক কর্মকাণ্ড এবং মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য গঠনমূলক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। তাই বোঝাই যাচ্ছে, এক সামগ্রিক পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার, যা বিশ্বের অন্য শক্তিগুলোর নীতিমালার থেকে ব্যতিক্রম এর ব্যাপ্তির কারণে।

তৃতীয়ত, এর উদ্দেশ্য। ১৫টি উদ্দেশ্যের কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রচলিত ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে- এমনটাই ধারণা করা যায় এর উদ্দেশ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে। কৌশলগত নিরাপত্তা ও সামরিক বিষয়গুলোর বাইরে গিয়ে উন্নয়নের ধারণাকে দেখার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার শান্তির প্রতি আকাঙ্ক্ষাকে আরও ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, যা এ অংশে তুলে ধরা হলো।

শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা
ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই রূপরেখার ফলে দেখা দেবে অধিকতর স্থিতিশীলতা। কেননা, এই রূপরেখায় আলোচ্য হিসেবে এসেছে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলো। পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা জোরদার করা, অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা গড়ে তোলা এবং সংলাপ ও সমঝোতা জোরদার করার কারণে এই নিরাপত্তা হতে পারে আরও টেকসই। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অস্ত্র অপ্রসারণ, শান্তিরক্ষা এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচেষ্টায় অর্থবহ এবং মূল্য-চালিত অবদান বজায় রাখার মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করবে সামাজিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে এই রূপরেখার বাস্তবায়ন।

আন্তদেশীয় অপরাধ মোকাবিলা ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত
এ অঞ্চলে সংঘটিত আন্তদেশীয় অপরাধ মোকাবিলায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে আদর্শিক এবং ব্যবহারিক উভয় পদক্ষেপের সমর্থনের মাধ্যমে এ অঞ্চল হবে আরও নিরাপদ। যেখানে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ ও সহযোগিতা হবে বেগবান। তা ছাড়া সামুদ্রিক নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিদ্যমানব্যবস্থা জোরদার করা, সমুদ্রে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া এবং অনুসন্ধান, উদ্ধার পরিচালনা, আন্তর্জাতিক আইন, ইউএনসিএলওএস ১৯৮২-এর প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুসারে নেভিগেশন এবং ওভার-ফ্লাইটের স্বাধীনতার অনুশীলনকে সমুন্নত রাখার বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি এগিয়ে নিয়ে যাবে বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতির বিকাশকে।

টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ
টেকসই উন্নয়নের বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে এই রূপরেখায়, সেই লক্ষ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, নিয়মভিত্তিক বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার প্রচার, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নয়নের অধিকার এবং সবার জন্য অভিন্ন সমৃদ্ধির মাধ্যম, যা ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাইরে ন্যায়সংগত, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এসব কিছুর ভিত্তি হিসেবে অবশ্য কাজ করবে ভৌত, প্রাতিষ্ঠানিক, জ্বালানি, ডিজিটাল ও মানবসংযোগ বৃদ্ধি, পণ্য, পরিষেবা, মূলধন ও মানুষের চলাচলকে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সহজতর করাসহ উন্মুক্ত ও সুরক্ষিত সাইবার স্পেস এবং বহির্বিশ্বে প্রযুক্তি হস্তান্তর, উদ্ভাবনে সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো।

তবে এসব কিছুর জন্য প্রয়োজন অবাধ বাণিজ্য। তাই এ অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন ও অবাধ বাণিজ্যপ্রবাহকে উৎসাহিত করতে এবং ভবিষ্যতের সংকট ও বিঘ্নগুলো আরও ভালোভাবে পরিচালনা করতে স্থিতিস্থাপক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মূল্যশৃঙ্খল গড়ে তোলার জন্য অভ্যন্তরীণ কৃষি, উৎপাদন, পরিষেবা ক্ষেত্রগুলোকেও নজরে রাখতে হবে।

পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সম্পদের টেকসই ব্যবহার
এসডিজি-১৪ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিকভাবে সম্মত উন্নয়ন অঙ্গীকারের আলোকে এ অঞ্চলে মহাসাগর, সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ, এর টেকসই ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনাকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন পদেক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে আলোচনা রয়েছে। এর বাইরে এ অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা, জলসংহতি এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের প্রচারে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার বিষয়েও আলোচনা রয়েছে, যার মধ্যে আঞ্চলিক বিভিন্ন অনুশীলন প্রচার করার ব্যবস্থা গৃহীত হবে। এ ছাড়া প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক কনভেনশন এবং প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, সামুদ্রিক দূষণ এবং পরিবেশের ওপর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য, ক্ষতিকারক প্রভাবগুলোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাস্তব কাজ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এই রূপরেখায়। তাই তো পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ সবার জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করার কথা আলোচিত হয়েছে।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং মহামারি নিয়ন্ত্রণ
ভ্যাকসিন, রোগ নির্ণয় এবং অন্যান্য চিকিৎসার মতো বৈশ্বিক জনসাধারণের জন্য নিবেদিত পণ্যগুলো সহজলভ্য করতে ভবিষ্যতের মহামারিগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ার বিকাশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার দিকে নজর দেবে সরকার।

স্মার্ট বাংলাদেশ ও উপ-আঞ্চলিকতার বিকাশ: বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনে সহযোগিতা
আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার এবং পারস্পরিক উপকারী পরিপূরকতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপ-আঞ্চলিক অংশীদার এবং প্রাসঙ্গিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে হবে। এতে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর রূপকল্পের আলোকে সবার অভিন্ন সুবিধার জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা, উদ্ভাবনে সহযোগিতা ও সহযোগিতা জোরদারকরণ হবে সহজতর।

তাই দেখা যাচ্ছে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই রূপরেখা আলোচিত হবে এক সমন্বিত ও কার্যকরী দলিল হিসেবে, যা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলভিত্তিকে। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি তার মূল ধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে না। তবে এখানে খেয়াল রাখতে হবে, এ অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রতিটি রাষ্ট্রের, যাদের সীমান্ত কিংবা নীতি রয়েছে এই অঞ্চলকে ঘিরে, তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর এ লক্ষ্য নিশ্চিত করতেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ের সবকিছুই অবশ্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উপাদান, এই রূপরেখা শুধু এক নতুন মাত্রার সংযোজন নির্দেশ করে। কেননা, বাংলাদেশ তার মূলনীতিতে দাঁড়িয়ে রূপরেখা প্রণয়ন করেছে। এটি তাই স্বকীয়তা প্রকাশের এক নয়া নিয়ামক।

লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


গ্রামের জিয়াফত বা মেমানি  

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আলমগীর খোরশেদ 

ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে দেখতাম অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে মুরুব্বি কেউ মারা গেলে চল্লিশ দিন পর মৃত্যুবার্ষিকী পালনে কিংবা কারোর বিয়ে, মেয়ের কান ফুটা, খৎনা, এলাকার কোনো খেলায় জয় ইত্যাদি উপলক্ষে গ্রামোময় ভোজ বা খাওয়ার যে আয়োজন করত সেটাকেই মেমানি বা মেজবানি বলা হতো। মেমানি বা মেজবানি বলতে আতিথিয়েতা বা গণভোজকে বোঝায়। যা সবার জন্য উন্মুক্ত। ধনী-গরিব সবাই একসঙ্গে বসে মেমানির খাবার খেতো।

বাংলাদেশে মেজবানি বলতে যদিও চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি ঐতিহ্য ভাবা হয়; কিন্তু এটা বৃহত্তর ময়মনসিংহের সব জেলাসহ সিলেট, খুলনা এমনকি দেশের বাইরে ইউরোপ, আমেরিকায়ও মেমানি বা মেজবানি প্রচলিত আছে। গৃহস্থদের ধান মাড়াই শেষ হলে গ্রামের বাড়িতে কাছারি ঘরের সামনে নামা খালি জমিসহ মেমানি বা মেজবানির আয়োজন করা হতো। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে এটাকে ‘জিয়াফত’ বলা হয়ে থাকে। জিয়াফত হলো ফার্সি শব্দ, যার অর্থ হলো ভোজ বা ভোজসভা। তা একটি ঐতিহ্যগত আঞ্চলিক উৎসব। প্রতিবেশী, পাড়া তথা সামর্থ্য অনুযায়ী পুরো গ্রামের লোকজনদের মেমানিতে দাওয়াত দেওয়া হতো। মেমানির যিনি আয়োজক তিনি বা তার লোকজন পাড়াময় হেঁটে হেঁটে বাড়ির মুরুব্বিদের দাওয়াত দিতেন। দাওয়াত দিতে পরিবারের সবাইকেসহ বলতে হতো, না হলে রাগ করে আসত না কেউ।

মেমানির খাবার: মেমানিতে সাদা ভাত, মরিচ ও মসলাসহ গরুর মাংস সঙ্গে ছোট আলুর ঝোল, মাছভাঙ্গা সঙ্গে আলুর ঝোল, মাষকলাইয়ের ডাল আর থাকত মজার জিনিস ‘মিডুরি’। মিডুরি হলো চালের গুঁড়া, আখের গুড়, নারকেল গুঁড়া গরম মসলা সহযোগে তৈরি তরল মিষ্টিজাতীয় খাবার। মিডুরিটা খাবারের শেষে পরিবেশন করা হতো। বাবুর্চির সুনাম নির্ভর করত মিডুরি ও গরুর মাংস রান্নার ওপর। সবশেষে দেওয়া হতো পান সঙ্গে চিকন করে কাটা সুপারি, খয়ের, চুন ও পাতা এবং জর্দা।

মেমানির ডেকোরেশন: তখনকার দিনে এখনকার সময়ের মতো ডেকোরেটর ছিল না। বিয়ে, ওয়াজ মাহফিলে কাপড়ের তৈরি বড় সামিয়ানা টানানো হতো, যাতে কোনো সমিতি বা প্রতিষ্ঠানের নাম, সন তারিখ, সাকিন এসব লাল, নীল সুতো দিয়ে লেখা থাকত। রান্নার জন্য বিভিন্ন পাড়া বা গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি থেকে পিতলের তৈরি বড় ডেকচি যাকে ‘মেমানির ডেক’ বলত, তা আনা হতো। ডেকচির গায়ে ওপরের দিকে ডেকচির মালিকের নাম, সন তারিখ, সাকিন ইত্যাদি পিতল খোদাই করে লেখা থাকত। পাড়া থেকে চেয়ার, প্লেট বা বাসন, সানকি আনা হতো। গ্রামের লোকেরা চাটাই বিছিয়ে তাতে কলাপাতায় মেমানির খাবার খেতো।

মেমানির গরু কেনা: দাওয়াত দেওয়ার পর কর্তাব্যক্তি মেমানির জন্য গরু কেনায় অভিজ্ঞ বা মিডিয়া যে, তাকেসহ পাড়ার ও বাড়ির লোকজন নিয়ে গরু কিনতে বাজারে যেতেন। গরুর দালাল দেখলেই বোঝা যেত, নারিকেল তেল দিয়ে আঁচড়ানো মাথা চকচক করত। লুঙ্গিটা নিচ থেকে উল্টায়ে কোমরে বাঁধা, ছাতাটার বাঁট পিছনে ঘাড়ের কাছে শার্টে ঢুকানো। কখনোই তার চোখ দুটো স্থির নয়। গরুর মালিকের সঙ্গে ও ক্রেতার সঙ্গে এমনভাবে চোখের ভ্রু নামিয়ে উঠিয়ে কথা বলত যে সাধারণ মানুষ ওই চোখের ভাষা বোঝা কঠিন।

মেমানির কাজ ও ব্যস্ততা: অনুষ্ঠানের আগের রাত যেন কর্মযজ্ঞ। এ রাতে বাড়িতে কারোর ঘুম নেই। বিকেল থেকেই বাবুর্চি তার সহযোগী লোকজন, চামচাসহ অন্যান্য উপাদান, চার-পাঁচটা গরু জবাইয়ের কসাই ও তার লোকজন সবাই এসে হাজির হতো। গরু জবাই করে একটার পর একটা টুকরা করে বাবুর্চি মাংস বুঝে নিতো। পুকুর থেকে মাছ ধরার জন্য জেলেকে খবর দেওয়া হলে জেলে এসে পুকুরে জাল ফেলত। পুকুরের এপার থেকে ওপারে জাল টেনে নিলে ওদিকে মাছের লাফালাফি শুরু হতো। বড় বড় কাতল, রুই, মৃগেল, ঘাসকার্প মাছ উঠিয়ে আনা হতো। বাবুর্চি বলে দিত কত কেজি মাছ লাগবে। পেঁয়াজ, মসলা, আদা, রসুন বাটার জন্য মহিলারা শীল-পাটা নিয়ে বসে যেত। গাঁইল চেঁহাইট দিয়ে পেঁয়াজ, রসুন, পেষার কাজ করা হতো। এত লোক রাতে খাবারের জন্য খিচুড়ি পাক করত বাবুর্চি।

উঠানের কোণে লম্বা পরিখা বা মাটি কেটে গর্ত করে লম্বা চুলা বানানো হতো। ধান সিদ্ধ দেওয়ার বড় কড়াইয়ে ভাত রান্না হতো। চাল সিদ্ধ হতেই কড়াই উঠিয়ে নিয়ে গরম ভাত বড় বাঁশের তৈরি খাঁচায় ঢেলে দেওয়া হতো পানি ঝরে যাওয়ার জন্য। পানি ঝরে গেলে ভাত বিছিয়ে রাখা নতুন চাটাইয়ে স্তূপ করে রাখা হতো। চুলা ধরানোর জন্য পাটশোলার আঁটি, কেরোসিন তৈল রাখা হতো, লাকড়ির পাশে। বাড়ির মুরুব্বি যিনি, তাকে দিয়ে চুলা ধরানোর উদ্বোধন করা হতো।

মেমানি খাওয়ানোতে বিভিন্ন গ্রুপ: এত লোকের আয়োজনে নিয়মানুবর্তিতা জরুরি বিধায় লোকজনদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দায়িত্ব দেওয়া হতো। মাটির পেয়ালায় রান্না করা গরুর মাংস, মাছ, ডাল, মিডুরি দেওয়া হতো। এক গ্রুপ মাংস, অন্য গ্রুপ মাছ, অন্যরা ডাল, মিডুরি ও পানি দেবে, এভাবে। বাবুর্চিকে বলা থাকত নির্দিষ্ট লোক বা গ্রুপ ছাড়া তরকারি বা খাবার দেবে না।

শেষকথা: গ্রামে এখন আর মেমানি, মেজবানি বা জিয়াফতের আয়োজন করে না কেউ। একান্নবর্তী পরিবারগুলো হারিয়ে গেছে। সবাই হয়ে গেছে আত্মকেন্দ্রিক। একান্ত নিজের মানুষ ছাড়া কেউ কাউকে এক বেলা খাওয়ায় না এখন। মেমানি, জিয়াফত বা মেজবানি তো অনেক খরচের ব্যাপার। এখনকার বাবা-মা মারা গেলে মেমানি করার মন-মানসিকতা থাকে না সন্তানের। পরিবর্তনের হাওয়ায় সব বদলে গেছে। আজকের প্রজন্ম বুঝবেই না মাটিতে চাটাইয়ে বসে কলাপাতায় ভাত খাওয়ায় কি মজা আর কি আনন্দ। আধুনিকতায় গা ভাসানো ও সংসারের আয়োনিক বন্ধন ভেঙে যাওয়ায় হারিয়ে গেছে মেমানি, মেজবানি বা জিয়াফতের মতো গ্রামীণ ঐতিহ্য। যা কেবল স্মৃতিময় হয়ে আছে মধ্য বয়সি প্রজন্মের।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক


সড়কে মৃত্যুর মিছিল: দায়ী কে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এম এ মান্নান

কথায় আছে যেখানে ঠেকবে সেখানেই শিখবে; কিন্তু আমি এই কথার কোনো সত্যাসত্য খুঁজে পাচ্ছি না। তবে দিব্যজ্ঞানে যেটা ঠাওর করতে পারছি সেটা হলো উল্টো বুদ্ধির লোপ পায় বা হতবুদ্ধি হয় বা বুদ্ধির বৈকল্য ধরা পড়ে। যদি তাই না হতো তাহলে প্রতি বছর এবং বারবার এত এত সড়ক দুর্ঘটনা এবং এত এত অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটবে কেন? এত এত লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটবে কেন? এত এত মানুষ মারা যাবে কেন? কই এর তো কোনো স্থায়ী সুরাহা দেখতে পাচ্ছি না। নাকি এখানে শেখার কিছু নেই। শুধু ঠেকেই যাবে?

দেশে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই কেবল প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসে। ব্যাপারটা এমন যে কাজ নেই তো খই ভাজ। একটি তদন্ত কমিটি হয়। কমিটি আদা-জল খেয়ে কয়েক দিন দৌড়ায়। ওই পর্যন্তই। শুধু শুধু ব্যস্ত হওয়া। ফল যে লাউ সেই কদু। আমরা আশায় থাকি শুধু শুধু।

দেশে কী পরিমাণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি আছে চট্টগ্রাম-১১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২০২১ সালে সংসদের প্রশ্নোত্তর-পর্বে বলেছিলেন, দেশে ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি ফিটনেসবিহীন গাড়ি আছে। এরপরও কি বোঝার বাকি থাকে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ কী? কারা দায়ী? নিশ্চয় এই তিন বছরে ওই ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো ফিটলেস হয়ে গেছে। নতুন করে আরও শত শত গাড়ি ফিটনেস হারাচ্ছে। যেগুলোকে আমরা বলি লক্কর-ঝক্কর, ধাক্কা না দেওয়া পর্যন্ত খাড়াইয়া পড়।

আমরা প্রায়ই দেখতে পাই রাস্তায় গাড়ি বিকল হয়ে যেতে। গাড়ির যাত্রীদের গাড়ি থেকে নেমে ধাক্কা দিতে, নিদেনপক্ষে আরেক গাড়ি এসে তাকে ধাক্কা দিতে। ফাঁকে দেখি গাড়ির মাদকাসক্ত চালককে আরাম-আয়েশ করে মাদক ফুঁকতে। এমনতর ধুঁকে ধুঁকে চলা গাড়ি আর মাদক ফুঁকে চলা চালকের কাছে যাত্রীরা কী নিরাপত্তা পাবে? যেখানে গাড়ির চালক বসেন তার মাথার ওপরে প্রায়ই একটা লেখা চোখে পড়ে। দোয়া কুনুত। লা-ইলাহা...। এখন বুঝতে পারছি এ দোয়ার শানেনজুল কী। গাড়ি এবং চালকের কারও প্রতি যাত্রীদের ভরসা নেই। একমাত্র ভরসা আল্লাহ মালেকশাই।

গোড়ায় গলদ একটা কথা আছে। এটার শানেনজুল আবার একটু তাড়াতাড়ি বুঝতে পারছি। গাড়ির যিনি চালক হবেন তাকে দক্ষ এবং যোগ্য হতে হবে। এবং গাড়ির শতভাগ ফিটনেস থাকতে হবে। এটার ঘাটতি থাকলেই গোড়ায় গলদ। এখানে দুটোরই চরম সংকট। আর বড় গোড়ায় গলদ হলো যারা এসবের অনুমোদন দেন তারা। এর থেকে বড় গলদ আর নেই।

বেশ কয়েক বছর আগে সম্ভবত ২০১৯ সালের ঘটনা। তখন সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু নিয়ে রাজধানী প্রায় অচল করে দিয়েছিল ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা। তাদের উত্তেজনা প্রশমন করতে প্রশাসনকে অসীম বেগ পেতে হয়েছিল। তারা নিজেরাই রাজধানীর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছিল। আর সরকারি চাকুরে ট্রাফিক পুলিশরা অন্দরমহলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অতিশয় আশ্চার ব্যাপার হলো যারা কোনোদিন জানত না ট্রাফিক পুলিশ কী জিনিস, সিগন্যাল কী জিনিস সেই তারাই দায়িত্ব নিয়ে নিল সারা রাজধানীর ট্রাফিকের নিয়ন্ত্রণ। গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না, গাড়ির ফিটসেন আছে কি না। কাগজ ঠিক আছে কি না- এসব তল্লাশি করতে বেশুমার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছিল। অবাক করা কাণ্ড হলো তাদের তল্লাশি থেকে বাদ পড়েনি মন্ত্রী-এমপিদের গাড়ি পর্যন্ত। অনেকে তল্লাশির ভয়ে বিকল্প পথ ধরে পগারপার হয়েছেন। এখানেই বলা যায় যেখানে ঠেকবে সেখানেই শিখবে। তারা ঠেকেছে, তারা শিখেছে, তারা কাজ করে দেখিয়েছে এবং তারা সফল হয়েছে।

কারা ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারেন তাদের পক্ষে কোনো এক মন্ত্রীর সরল উক্তি ছিল, গাছের ছবি দেখে যে বলতে পারবে এটা গাছ, মাছের ছবি দেখে যে বলতে পারবে এটা মাছ সে-ই গাড়ির চালক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবে। অর্থাৎ প্রতীক চিনতে পারলেই তিনি যোগ্য হবেন। অবশ্য কী কারণে যেন ওই মন্ত্রী পরে অনেক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুয়ায়ী গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৩ হাজার ৫৬২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এসব দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৩১৭ জন লোক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫ হাজার ১৭২ জন। গত বছরের তুলনায় এবার সড়ক দুর্ঘনা এবং মৃত্যু দুটোই বেশি। চলতি বছর তিন মাসে প্রায় দেড় হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং নিহত হয়েছে ১৩৬৭ জন।

আমরা সবাই জানি যে প্রতি ঈদের সময় বিপুলসংখ্যক লোক বাড়ি ফেরেন। আবার ঈদপরবর্তী সময়ে বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরেন। ফলে যাওয়া এবং আসার সময় সড়কে যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পায়। এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এটাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামানো- এটা কিন্তু স্বাভাবিক নয়। আরও স্বাভাবিক নয় অদক্ষ-অযোগ্য গাড়ির চালক দিয়ে গাড়ি চালানো; কিন্তু আমরা বাস্তবে তাই দেখতে পাচ্ছি। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের নিত্যসঙ্গী হচ্ছে, রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল ভারী হচ্ছে। যা কখনো কাম্য নয়।

অতি সম্প্রতি দেশে ঘটে গেল ভয়াবহ দুটি সড়ক দুর্ঘটনা। যা গা শিউরে ওঠার মতো। ভয়াবহ ওই সড়ক দুর্ঘটনার একটি ঘটে ফরিদপুরে। ওই ঘটনায় বাস এবং পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে নারী ও শিশুসহ ১৪ জন নিহত হয়েছেন। আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে ঝালকাঠিতে। এতে ট্রাক-প্রাইভেটকার ও ইজিবাইকের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষে ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। এই দুটি ঘটনাই কি দিবালোকের মতো পরিষ্কার নয়, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা কোথায়।

সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা হামেশাই যে কথাটি শুনতে পাই বা দেখতে পাই তা হলো বাসের সঙ্গে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ বা ধাক্কা, বাসের সঙ্গে ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ বা ধাক্কা, নইলে গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কা ইত্যাদি। আর এসবের মূলে যা শুনতে পাই তা হলো গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানো। ফলে বাস বা ট্রাককে প্রায়ই দেখা যায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে বা নদীতে পড়ে থাকতে।

কথায় আছে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? এই যে যত্রতত্র ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে এর জন্য দায়ী কিন্তু অদক্ষ গাড়ির চালক এবং ফিটনেসবিহীন বা মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি। তাই এর দায় কিন্তু প্রশাসন এড়াতে পারবে না। রাস্তায় যেসব গাড়ির চালক গাড়ি চালাচ্ছেন তাদের নিয়ে শঙ্কার শেষ নেই। এসব চালকের বেশির ভাগের গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। আবার যাদের আছে তাদের অনেকের লাইসেন্স জাল। এ ছাড়া আছে অপ্রাপ্ত বয়স্ক গাড়ির চালকও। আবার অনেক চালক আছেন যারা নেশাগ্রস্ত। তারা নেশা করেই গাড়ি চালিয়ে থাকেন। একজন গাড়ির চালক যদি নানা দোষে দুষ্ট থাকেন এবং তিনি যে গাড়িটি চালান সেটি যদি ফিটনেসবিহীন গাড়ি হয়ে থাকে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে থাকে তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে এটাই তো বাস্তবতা, এটাই স্বাভাবিক। অথচ মোটরগাড়ি চালনা আইনের ধারা ৪ এবং ৫-এ উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে। অন্যথায় তিনি আইন লঙ্ঘনের দায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অথবা অনধিক ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন; কিন্তু আমরা কি এসবের বাস্তবতা দেখতে পাই। পাই না।

কাজির গরু নাকি কেতাবে থাকে গোয়ালে থাকে না। আমাদের সড়কে যানবাহন আইনের ক্ষেত্রেও তাই। আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। যদি সড়কে যানবাহন আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হতো এবং দক্ষ ও যোগ্য গাড়ির চালক গাড়ি চালাতেন এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির নিবন্ধন বাতিল করা হতো তাহলে সড়কে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিল রোধ করা যেত; কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে। কিন্তু গত দুই দিনে দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় যে ২৮ জন লোক প্রাণ হারাল এর দায়ভার কে নেবে?

সব শেষে যে কথা বলব তা হলো আইনের সঠিক প্রয়োগ। দেশে লাখ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে। সবার আগে এসব গাড়ির নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। আর যিনি রাস্তায় গাড়ি চালাবেন তাকে অবশ্যই দক্ষ এবং যোগ্য চালক হতে হবে এবং গাড়ি চালানোর বৈধ সনদ থাকতে হবে। আর যে গাড়িটি সড়কে চলবে সেটিও হতে হবে শতভাগ চলাচলের উপযোগী। কোনোভাবেই মেয়াদোত্তীর্ণ নয়।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক


খন্দকার আসাদুজ্জামান: অবিস্মরণীয় একটি নাম

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
খন্দকার হাসানুজ্জামান

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে গঠিত মুজিবনগর সরকারের অর্থসচিব, ভাষাসৈনিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যার অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে, যিনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের লোভনীয় সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধা উপেক্ষা করে মাতৃভূমির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে সর্বদা কাজ করে গেছেন, আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি কেবল ভূমিকাই রাখেননি পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশের উপযোগী প্রশাসন গড়ে তোলার সব পরিকল্পনা ও নীতি-নির্ধারণে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ভাষা আন্দোলনেরও একজন বলিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।

রাজনীতি ও দেশের বৃহত্তর কল্যাণে অগ্রাধিকার বিবেচনায় তিনি তার কর্মপরিকল্পনা সাজিয়ে ছিলেন। শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী হিসেবে তিনি তার এলাকার বাইরেও বৃহত্তর পরিসরে কাজ করে গেছেন। চাকরি জীবনের শুরু থেকেই সৎ এবং কর্মনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে তার সুখ্যাতি রয়েছে। রাজনীতিতেও তিনি যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। তিনি সরকারি চাকরি শেষে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন।

মরহুম খন্দকার আসাদুজ্জামান টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের নারুচী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৫ সালের ২২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তাদের ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি ওই এলাকায় ‘মিয়া বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত। পিতা মরহুম খন্দকার আব্দুস সামাদ এম এ (এলএলবি) ছিলেন বহুমুখী প্রজ্ঞার অধিকারী একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। খ্যাতনামা উকিল হিসেবে তার অবদান ছিল সুদৃঢ়। এলাকায় তো বটেই এমনকি টাঙ্গাইল বারেও তিনি ‘সামাদ উকিল’ হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। খন্দকার আব্দুস সামাদ স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তার মা ছালেমা খাতুন। বর্তমান গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বেরুয়া গ্রামের তৎকালিন ঢাকা জেলার প্রথম মুসলিম ডাক্তার শামসুদ্দিন খান সাহেবের একমাত্র কন্যা। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, ধর্ম পরায়ণ দানশীলতার খ্যাতি ছিল চারদিকে।

মরহুম খন্দকার আসাদুজ্জামানের কর্মজীবন ছিল বেশ বর্ণাঢ্য ও ঘটনা বহুল। ১৯৬০ সালে প্রতিযোগিতামূলক পাকিস্তান সুপ্রিয়র সার্ভিস (সিএসপি) কেডারে যোগদান করেন। প্রায় ৩০ বছর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সর্বত্র তিনি সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৫৮ সালে রাজশাহীতে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের যুগ্ম অর্থ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গঠিত প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অর্থ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। এই কর্মবীর মানুষটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO), এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকে (ADB) বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন একাধিকবার। এমনকি অবসর গ্রহণের পরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে তার মধ্যে WORLD BANK, UNDP অন্যতম।

১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত শিল্প সচিব ১৯৭২-১৯৭৩ পাট সচিব ১৯৭৪-১৯৭৫ এবং ১৯৮৭-১৯৮৯ ভূমি সচিব ১৯৮৬-১৯৮৬ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সচিব ১৯৯০-১৯৯১: পরিকল্পনা সচিব ১৯৯১-১৯৯৩। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে খন্দকার আসাদুজ্জামান একটি অবিস্মরণীয় নাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা জাতি চিরকাল তাকে স্মরণ করবে। সরকারি উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকেও মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। মুজিবনগর সরকারের অর্থ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালান।

মাত্র ৬০০০ টাকা নগদ তহবিল নিয়ে মুজিবনগর সরকারের অর্থবিভাগের দায়িত্ব নেন এবং সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেওয়ার পর তার মনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হয়, তিনি বুঝতে পারেন দেশের অবস্থা খুবই খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে দেওয়ায় তিনি তখন নিশ্চিত হন, রাজনৈতিক দুর্যোগ অতি নিকটে। এই সময়, দেশে চলছে অসহযোগ আন্দোলনে বাঙালি জাতি যে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা লাভের আশায় তাতে তিনি একজন সচেতন নাগরিক ও একজন রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে কীভাবে ভূমিকা পালন করা যায় ভাবছিলেন তখন পরিস্থিতি ক্রমেই জটিলতার দিকে ধাবিত হতে দেখে তিনি আরও কিছু সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন। এই বৈঠক হয় সালাউদ্দিন সাহেবের বাসায়। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সালাউদ্দিন, মুজিবুল হকসহ আরও বেশ কয়েকজন সিএসপি অফিসার। বৈঠকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।

১ মার্চ সংসদ অধিবেশন বন্ধ করে দেয় যা ৩ মার্চ হওয়ার কথা ছিল, বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ হতে ৬ মার্চ সারা দেশে হরতালের কর্মসূচি দেন। ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণে স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, যার কাছে যা আছে তাই নিয়েই প্রস্তুত থাকো, শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। শেষে বললেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’

ঢাকা, জয়দেবপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে এবং এমভি সোয়াতে অস্ত্র আনাতে পাকিস্তানি সরকারের কুমতলব সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ খন্দকার আসাদুজ্জামান তার নিজ জেলা শহর টাঙ্গাইলে চলে আসেন। সেখানে গিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ২৪ মার্চ তার এক আত্মীয় ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে আসেন তার মাধ্যমে ঢাকা একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে জানতে পারেন। ২৫ মার্চ আলোচনা ভেঙে যায়।

টাঙ্গাইলে বসেই তিনি ঢাকার সব ঘটনার তথ্য পান। ২৬ মার্চ সকালেই তিনি টাঙ্গাইলের সব রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে আলোচনায় বসেন এবং আগামী দিনের কর্মসূচি সম্পর্কে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ওই দিনই টাঙ্গাইল জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আর এই সংগ্রাম পরিষদের পরামর্শ দাতা হিসেবে খন্দকার আসাদুজ্জামানকে উপদেষ্টা নির্বাচিত করা হয়। তিনি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে ওই দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আরও শক্তিশালী করে তোলার জন্য ঝড়ের বেগে বিভিন্ন স্থানে চষে বেড়ান, অস্ত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের জন্য ময়মনসিংহ যান। সেখানে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা রফিকউদ্দিন ভূইয়া, সৈয়দ আব্দুস সুলতান সহনবেশ কয়েকজন নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেন জেলা প্রশাসকের বাসায়।

তিনি সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার চেষ্টা বেশ প্রশংসনীয়। তারপর তিনি জয়পুরহাট ও হিলি হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছে তিনি মালদা জেলার ডিসির সঙ্গে দেখা করেন এবং সংবাদ পান আরও কিছু নেতৃত্ব স্থানীয় নেতারা ভারতে আসছেন। তিনি কলকাতা গিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামরুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন। সরকার গঠনের বিষয়েও আলাপ-আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে নেতারা খন্দকার আসাদুজ্জামান ও নুরুল কাদের খানকে একটি সরকারের কাঠামো তৈরি করার দায়িত্ব দেন।

মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের অপরাধে সরকার খন্দকার আসাদুজ্জামানকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং তাকে ধরার জন্য ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। তার সঙ্গে আরও ১২ জন সিএসপি অফিসারের ও বিচার করে একই মেয়াদের কারাদণ্ড প্রদান করে। সঙ্গে সঙ্গে দণ্ডিত অফিসারদের সম্পত্তির ৫০ ভাগ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে খন্দকার আসাদুজ্জামানের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে চিরদিনের জন্য লেখা থাকবে।

রাজনীতি: ১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর বৃহত্তর গণমানুষের কল্যাণে কাজ করার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এ ক্ষেত্রে তিনি হয়ে ওঠেন গণমানুষের মধ্যমণি, বিশেষ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটি আশার আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখা দেন। সেই ১৯৭৩-এর পর থেকে ১৯৯১-এর জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত এই আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া ছিল।

স্বীয় যোগ্যতা ও বাবার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তিনি চলে আসেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে টাঙ্গাইল ২ গোপালপুর -ভূয়াপুর আসন থেকে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘদিন পর আসনটি পুনরুদ্ধার করেন।

কারাবরণ : দেশের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকায় খন্দকার আসাদুজ্জামান তার বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হন একাধিকবার। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ৯২-এর ক ধারা বলে গভর্নর শাসন ও জরুরি ঘোষণার পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে কারাবরণ করতে হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর পাকিস্তানিদের দোসর তৎকালিন খুনি সরকার তার ওপরও নির্মম খড়গ চালায়। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় চার নেতার সঙ্গে তাকেও কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।

অবদান: নিজ এলাকা দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার নানাবিধ অবদান আজ স্বীকৃত। মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সুবিদিত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও দেশের হয়ে কাজ করেছেন সুনাম ও সাফল্যের সঙ্গে। এলাকার উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা তার চাকরি জীবনের শুরু থেকেই। তিনি টাঙ্গাইলে বিশেষ করে গোপালপুর ভূঞাপুরের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা।

সন্তান : তার জ্যেষ্ঠপুত্র খন্দকার মাহবুব উজ্জামান ২০০৮ সালের ৭ মে তারিখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তিনি কম্পিউটার সায়েন্সের একজন উচ্চতর ডিগ্রিধারী ছিলেন। তিনি জেম নিট ওয়ারের এমডি ছিলেন। ছোট ছেলে খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল বিকম (অনার্স) এমকম করেন। তিনি বেশ কয়েকবার বিজিএমইএ-এর সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। বহুবার FBCCI প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী ঢাকা ক্লাবের দুইবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।

বড় মেয়ে অপরাজিতা হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ এমএ করেছেন। তিনি সংরক্ষিত মহিলা আসনের টাঙ্গাইলের এমপি। বড় মেয়ে অপরাজিতা হকের স্বামী বিশিষ্ট সাংবাদিক, একাত্তর টিভির সিইও মোজাম্মেল হক বাবু। ছোট মেয়ে তামান্না জামানের স্বামী কমিউনিটি ব্যাংকের এমডি ও সিইও মাশিহুল হক চৌধুরী। ছোট মেয়ে তামান্না জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে বিএসসি অনার্সসহ এমএসসি(ফার্স্ট ক্লাস) তিনি ১৯৯৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তিনি তখন মুজিবনগর সরকারি কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন।

তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার মিন্টু রোডের বাসায় এবং তার নির্দেশ মোতাবেক ১৯৯৬-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শুধু টাঙ্গাইল ২ গোপালপুর-ভূঞাপুরে নয়- সারা বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে, সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন, স্বাধীনতার চেতনার কথা বলেন, কি কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, কি কারণে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, জাতির জনকের কি স্বপ্ন ছিল,

অনেক সময় বক্তব্য দিতে গিয়ে এতটা আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন যে তার মনের অজান্তেই দুচোখ ছলছলে করে উঠত এবং এটা দেখে ওই সভারও অনেকেরই দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত বিশেষ করে জাতির জনকের পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা যখন বলতেন। দেশের স্বার্থে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানান। পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল ২ গোপালপুর-ভূঞাপুর থেকে দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ১৯৭৩-এর পর থেকে আওয়ামী লীগের এই আসনটি হাতছাড়া হয়েছিল, সেই আসনটি ১৯৯৬-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে আসনটি পুনরুদ্ধার করেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

পরবর্তীতে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। সাফল্যের সঙ্গে তিনি এই অর্পিত দায়িত্ব পালন করে প্রশংসিত হন। সাফল্যেরই নন্দিত নাম যেন মরহুম খন্দকার আসাদুজ্জামান। তিনি ২৫ এপ্রিল ২০২০ সালে ইন্তেকাল করেন। আমরা তার বিদেহি আত্মার শান্তি ও জান্নাত কামনা করি। আমিন।

লেখক: পরিবেশবিদ ও কলামিস্ট


তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সমীরণ বিশ্বাস

সূর্যের জ্বলন্ত রশ্মিতে যেন টগবগে আগুন ঝরছে। নিজের উত্তাপ শক্তিমত্তা জানান দিতে বিন্দুমাত্র ছাড় দিচ্ছে না শহর, গ্রাম, পথ-ঘাট, সড়ক-মহাসড়ক সবখানেই সূর্যের খরতা! পিচঢালা পথ যেন জ্বলন্ত উনন! জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা এ জীবন যেন ওষ্ঠাগত! গত কয়েক দিন, দেশজুড়ে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহে তেতে উঠেছে প্রাণিকুলও। বাতাসেও আগুনের ছটা। মৌসুমের প্রথম তাপপ্রবাহই চলতি মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। টানা কয়েক দিন ধরেই তাপমাত্রার পারদ চড়াই হয়ে উঠেছে চুয়াডাঙ্গায়। এখন থেকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড সীমান্তবর্তী এ জেলায়। তাপমাত্রার উত্তাপ ছড়িয়েছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে- যা অতি তীব্র দাবদাহ! এরই প্রভাবে কোথাও কোথাও গলে যাচ্ছে রাস্তার পিচ! দেশের অন্য জেলাগুলোও পুড়ছে খরতাপে। পশ্চিম-দক্ষিণ অঞ্চলে বয়ে যাচ্ছে ৪১ ডিগ্রি তীব্র দাবদাহ। দেশের অন্য জেলাগুলোও পুড়ছে অতি তাপপ্রবাহে। এদিকে প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে না পেরে অনেকেই অচেতন হয়ে পড়ছেন। দেখা দিচ্ছেন নানাবিধ রোগব্যাধি ও স্বাস্থ্য সমস্যা। তীব্র গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। প্রয়োজন ছাড়া কেউই বের হচ্ছে না ঘর থেকে। অনেকেই বের হচ্ছেন ছাতা নিয়ে। গরমে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন কর্মজীবীরা। আবহাওয়া অফিসের মতে দেশজুড়ে গরমের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে।

আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটাকে মৃদু দাবদাহ বলে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে গেলে ধরা হয় মাঝারি দাবদাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে ধরা হয় তীব্র দাবদাহ চলছে। ঢাকায়, চুয়াডাঙ্গা ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে তীব্র দাবদাহ চলছে।

আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরসহ সারা দেশই আজ শ্যামল সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তরের অত্যন্ত অভাব; কিন্তু বিদেশে এমনটি হয় না। সেখানে নগর পরিকল্পনার সময়ে উদ্যান ও প্রান্তরের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়। সুতরাং মানুষকে বাঁচতে হলে তার আদিম জীবনের প্রতিবেশী গাছ-তরুলতাকেও বাঁচাতে হবে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে তাই বিজ্ঞানীরা রব তুলেছেন, পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে গাছ-তরুরাজির শ্যামল ছায়ায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে তাই বৃক্ষ রোপণের প্রয়োজনীয়তা আছে।

ঐতিহ্যের শহর ঢাকা। চার শ বছরের পুরাতন ঢাকাকে বলা হয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের নগরী। ১৩৪ বর্গ মাইলের এ শহরে বাস করে ১ কোটি ৪১ লাখ মানুষ। বর্তমানে জনসংখ্যা আরও অনেক বেশি। ধারণা করা হয় প্রায় ২ কোটির কাছাকাছি। প্রতি বর্গ মাইলে ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষের বসবাস বলা চলে এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। বিশ্ব ব্যাংক বলছে ২০৩৫ সাল নাগাদ জনসংখ্যা ৩ কোটি ৫০ লাখ হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাল, নদী, ডোবা, বৃক্ষ নিধন করে ঘর-বাড়ি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে ফলে পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। কমে যাচ্ছে সবুজের পরিমাণ।

জাপানের কিয়োটো ও হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন গবেষক ঢাকা শহরের সবুজ নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের মতে ১৯৯৫ সালে ঢাকার সবুজ অঞ্চল ছিল ১২ %, ২০১৫ সালে ৮% এবং বর্তমানে ৬-৭%-এর বেশি না। ঢাকায় যত পরিমাণে গাছ কাটা হয় তার অল্প পরিমাণই রোপণ করা হয়। বৃক্ষ নিধনের ফলে ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বত্রই এই একই চিত্র বিরাজমান।

প্রকৃতির এই আগুনঝরা তীব্র দাবদাহ বাড়িয়ে দিয়েছে; দেশজুড়ে বৈধ-অবৈধ ইটের ভাটা, শহর ও নগর অঞ্চলে মিল-কারখানা, শপিংমল, দোকান, মার্কেট, হোটেল-মোটেল, বাসাবাড়ি, সর্বক্ষেত্রে এসির ব্যবহার প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গিয়েছে। তারই সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অপরিকল্পিত বৈধ-অবৈধ ব্যাটারি, সিএনজি, ডিজেল, পেট্রোলচালিত গাড়ি, রিকশা, অটোরিকশা বিভিন্ন যানবাহন, যার প্রতিটি কর্মকাণ্ড তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কার্যকর প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন রকমের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহারের ফলেও প্রতিনিয়ত উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। দেশজুড়ে নদী-নালা,খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, ভরাটের যেন একটি মহোৎসব চলছে! এসব কর্মকাণ্ডই আজকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত তীব্র তাপপ্রবাহের জন্য দায়ী। আমাদের দৈনিক কৃতকর্ম সংবরণ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা কষ্টসাধ্য এবং চ্যালেঞ্জিং হবে। শুধু বৃক্ষ রোপণ করেই এই সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন করা কঠিন হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটগুলো ফসলের উপকারী পোকামাকড়ের অস্তিত্বকেও এখন হুমকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে কৃষিতে নির্বিচারে রাসায়নিক ও কীটনাশক প্রয়োগ। যার ফলে এই অযাচিত কীটনাশক ফসলের মাটিতে মিশে মাটির কার্বন নিঃসরণকে বাড়িয়ে তুলছে; যার কারণে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে।

দাবদাহে কৃষি খাতে বিপর্যয়ের শঙ্কা ও করণীয়

তীব্র দাবদাহে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের কৃষি খাত। দিন দিন দেশব্যাপী তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। ৩৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা ধানের জন্য অসহনীয়, দেশে চলছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা! যা সার্বিক ধান উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় অন্তরায়! এই অতি দাবদাহে ধান ছাড়াও আম, কাঁঠাল, লিচু ও তুলাসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। ভুট্টা ও সোয়াবিন উৎপাদনেও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তীব্র দাবদাহে ফল-ফসলের ব্যবস্থাপনা

বোরো ধানে হিটশক ( তাপজনিত ক্ষতি) বা গরম বাতাস (৩৫ ডিগ্রি C+) প্রবাহ হলে ধান চিঁটা হতে পারে। তাই জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি, কাইচথোড় (Panicle stage of rice) হতে ফুল ফোটা পর্যায় পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে। আম, কাঁঠাল এবং লিচুগাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত (৭ থেকে ১০ দিন অন্তর) সেচ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে গাছের শাখা-প্রশাখায় পানি স্প্রে করে দিতে হবে। প্রয়োজনে প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া যেতে পারে। এতে ফল ঝরে পড়া কমবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া মাটিতে রস ধরে রাখার জন্য সেচের পর গাছের গোড়ায় মালচিং দেওয়া যেতে পারে।

তীব্র দাবদাহে সবজি ফসলের ব্যবস্থাপনা

ফল এবং পাতাজাতীয় সবজির জমিতে আগামী এক সপ্তাহে মাটির ধরন বুঝে প্রয়োজনীয় দুই থেকে তিনটি সেচ ব্যবস্থা করতে হবে। জৈব সারের পানি ধারণক্ষমতা বেশি, সে জন্য জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। ফল এবং সবজির চারাকে তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য মালচিং ও সেচ নিশ্চিত করতে হবে। চলমান তাপপ্রবাহের কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিতে হবে।

তীব্র দাবদাহে প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনা

প্রাণিসম্পদের তাপপ্রবাহজনিত পীড়ন (স্ট্রেস) সহনশীল করতে, গবাদিপশু, পোলট্রির ঘর শীতল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। গবাদিপশুকে দিনে একাধিকবার গোসল করিয়ে দিতে হবে অথবা পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। গবাদিপশুকে পানির সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ, ভিটামিন সি এবং গ্লোকোজ ইত্যাদি মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। দাবদাহের এই সময় গবাদিপশুকে ঘরে আবদ্ধ না রেখে গাছের বা প্রাকৃতিক ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। গবাদিপশুকে এই সময় শুকনো খড় না দিয়ে কচি সবুজ ঘাস খেতে দিতে হবে। অতি দাবদাহে খাবার কমিয়ে দিতে হবে। প্রচণ্ড গরমের সময় গবাদিপশুকে কৃমিনাশক, টিকা কিংবা প্রাণীর পরিবহন পরিহার করতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি হলে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

তীব্র দাবদাহে মৎস্য সম্পদ বাঁচাতে ব্যবস্থাপনা

তুলনামূলক কম গভীরতার পুকুরে নতুন পানি যোগ করে গভীরতা কমপক্ষে ৫ ফুট করতে হবে যাতে নিচের পানি কিছু ঠাণ্ডা থাকে এবং মাছ সেখানে থাকতে পারে। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে পানির মধ্যে মাচা করে লাউজাতীয় গাছ লাগিয়ে পুকুরে ছায়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পুকুরের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ জায়গায় চারদিকে বাঁশের ঘেরাও দিয়ে কচুরিপনা/ নারকেলগাছের পাতা রাখা যেতে পারে। দিনের বেলায় রোদের সময় অর্থাৎ দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গভীর নলকূপ থেকে পানির সরবরাহ করে কমপক্ষে ৫ ফুট বা তার বেশি পানির উচ্চতা বজায় রাখতে হবে। সকালবেলায় শতকে ২০০-২৫০ গ্রাম লবণ বা ১০০ গ্রাম ভেট স্যালাইন গুলে পুকুরে ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। রাতের বেলায় এরেটর/ব্লোয়ার/মেশিন (পুকুরের পানিকে ফোয়ারা বা ঘুরনি তৈরি করে বাতাসের অক্সিজেনকে পানিতে দ্রুত মেশাতে সহায়তা করে) চালিয়ে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে অন্যথায় শতকে ১০ গ্রাম হারে অক্সিজেন ট্যাবলেট পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরের পানি স্বাভাবিক ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত পুকুরে খাবার সরবরাহ কমিয়ে দিতে হবে বা প্রয়োজনে সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে। সকালে এবং সন্ধ্যার পর খাবার অল্প করে দিতে হবে। ভিটামিন-সি মিশিয়ে (৭-৮ গ্রাম/কেজি খাদ্যে) খাদ্যের সঙ্গে খাওয়াতে হবে তাপমাত্রা স্বভাবিক না হওয়া পর্যন্ত। এ সময় দিনের বেলায় মাছ/পোনা স্থানান্তর বন্ধ রাখতে হবে বা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। গত কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মারাত্মক দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। তাই আসুন আমরা সবাই সতর্ক হই এবং অন্যকে সতর্ক করি।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ


সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তোয়াব খান

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এম নজরুল ইসলাম

ইতিহাসের সাক্ষী তিনি। সেই কবে থেকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখছেন সময়ের বয়ে চলা ও পরিবর্তন। জন্ম ব্রিটিশ ভারতে। এরপর পাকিস্তানি শাসন পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ। সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেছেন। দেখেছেন একাত্তর। ধারণ করে চলেছেন একাত্তরের চেতনা। অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে, একজন বিপ্লবী কলম সৈনিক হিসেবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত হতো তার ‘পিণ্ডির প্রলাপ’। তার জীবনকে কোনো মামুলি জীবন বলা চলে না। ইতিহাসের সাক্ষী হতে হতে তিনি আজ নিজেই তো এক ইতিহাস। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে নানা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এক মানুষ তিনি। তার জীবনখাতার পাতাগুলোও তো কম বর্ণিল নয়। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে তিনি এক উজ্জ্বল তারকা। সাংবাদিকদের সাংবাদিক তিনি এতে কোনো সন্দেহ নেই। পেশাগত জীবনে ছয় দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসে আজ তিনি নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। সব সময়ে সমসময়ের প্রতিনিধি। তাই যথার্থ আধুনিক। সেই আধুনিকতার প্রতিফলন তার পেশা ও ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পরতে।

একালের গায়ক নচিকেতার গানে আছে, ‘অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন/ শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন’। ৮৫ বছরের মুখর জীবনে মিডিয়ার মহীরুহপ্রতিম এই মানুষটির পথচলাও যেন অন্তবিহীন। ব্যক্তি জীবনে যেমন স্মার্ট আর স্টাইলিশ তিনি; তার লেখনীও তেমন নির্মেদ আর তীক্ষ্ণ। যদিও পাঠক হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, তিনি লিখেছেন কম, লিখিয়েছেনই বেশি। আপাত গম্ভীর এই মানুষটিকে আবিষ্কারই করতে হয়। এই আবিষ্কারের আরেকটি গূঢ় কারণ হচ্ছে, তার জীবন তো কোনো মামুলি জীবন নয়। চলমান এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনকালে শুরু যে পথের, তা আজও বহমান। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে নিজেকে সঠিক খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এ জন্যই তিনি সমসাময়িক। আধুনিক।

তিনি এক অসাধারণ গল্পকথক। অনুপুঙ্খ বলে যান আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। দীর্ঘ সময়ের প্রতিটি ঘটনা তার নখদর্পণে। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগই নেই। তার চেতনায় একাত্তর, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। সাংবাদিক হিসেবে তিনি পরিবর্তনগুলো যেমন দেখেছেন, তেমনি সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবেও দেখেছেন খুব কাছ থেকে। খুব কাছে থেকে স্বাধীনতার মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছেন। ১৯৭৩-৭৫-এ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুই বেছে নিয়েছিলেন তাকে। ছিলেন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের প্রেস সচিব। ১৯৮০-৮৭-তে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। পালন করেছেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্বও।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার সাতক্ষীরার রসুলপুরে। পড়েছেন সাতক্ষীরার সার্ধশত বছরেরও বেশি পুরোনো পিএন (প্রাণনাথ) স্কুলে। স্কুলের পাট চুকিয়ে ঢাকায় কলেজে পড়তে আসা। বছর না ঘুরতেই ভাষা আন্দোলনে উত্তাল দেশ। ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় হলেন। এর পর থেকেই ভেতরে ভেতরে একটা পরিবর্তনের হাওয়া। অজান্তে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দীক্ষা। বদলে যায় জীবনের গতিপথও। ক্রমেই শিকেয় উঠছে পড়াশোনা। পেয়ে বসে বিপ্লবের নেশা। ১৯৫৩ সালে কেজি মুস্তফার সঙ্গে বের করেন সাপ্তাহিক জনতা। এর মধ্য দিয়েই হাতেখড়িও হয়ে যায় তার সাংবাদিকতা জীবনের। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন সংবাদে। ১৯৬১ সালে সংবাদের বার্তা সম্পাদক। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে। বার্তা সম্পাদক হিসেবেই। ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। সত্যবাক নামে দৈনিক বাংলায় শুরু করেন ‘সত্যমিথ্যা, মিথ্যাসত্য’ শিরোনামে বিশেষ কলাম। এ কলামে উঠে আসে একটি স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক চিত্র। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একেকটি মাইলফলক রচিত হয়েছে তারই নেতৃত্বে। প্রথম চাররঙা সংবাদপত্র এর মধ্যে একটি। ‘সবসময়েই পাঠকরাই আমার প্রাইমারি কনসার্ন’, এ কথা সব সময় বলেন তিনি। তার একমাত্র বই ‘আজ এবং ফিরে দেখা কাল’।

বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ‘সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান’ বলতে যা বোঝায়, তার শেষ সলতে তিনি। না, নিজেকে মানিক মিয়া কিংবা জহুর হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তুলনা করেন না কখনো। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ওরা যে-সাংবাদিকতা করেছেন, তার ধারে-কাছেও আমরা নেই।’ কিন্তু আমরা জানি, সাংবাদিক হিসেবে সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য কর্মজীবন তার। সম্পাদকদের সম্পাদক তিনি। দেশের সংবাদপত্র জগতের প্রিয়মুখ। ২০১৬ সালে একুশে পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে তাকে। একই বছর ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমি সম্মানিত ফেলো হিসেবে নির্বাচিত করেছে। অগ্রজপ্রতিম সাংবাদিক হিসেবে দেশের সব সংবাদকর্মীর মনে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনটিও তো জাতীয় প্রেস ক্লাবের এই আজীবন সদস্যের দখলে।

এই নির্মোহ-নির্লোভ মানুষটির নাম তোয়াব খান। নামটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র যে মানুষটির চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তাকে একবার দেখে ভেতরের মানুষটিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। আপাতগাম্ভীর্যের আড়ালে যে সংবেদনশীল মানুষটির বাস, তাকে আবিষ্কার করা সহজ নয়। এর জন্য সময় ও শ্রম দিতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তোয়াব খান নিজে কয়জনের কাছে উন্মোচিত করেছেন নিজেকে? গুরুগম্ভীর তোয়াব খানের আড়ালে যে স্নেহময় মানুষটি লুকিয়ে, তাকে কি তিনি প্রকাশ করেছেন সবার সামনে? তবে, আপাতগম্ভীর এই মানুষটির সাহচর্য যারা পেয়েছেন, তারা জানেন, ওই গাম্ভীর্যের খোলস খসে পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না। আর সে কারণেই বলা যেতে পারে একজন তোয়াব খানকে আবিষ্কারই করতে হয়। এই আবিষ্কারের আরেকটি গূঢ় কারণ হচ্ছে, তার জীবন তো কোনো মামুলি জীবন নয়। চলমান এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনকালে শুরু যে পথের, তা আজও বহমান। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এ জন্যই তিনি সমসাময়িক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে ‘তোয়াব খান’ নামটি উচ্চারিত হয় পরম শ্রদ্ধায়।

অগ্রসর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সাংবাদিকতাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন তিনি। বহুদর্শী মানুষটি নামের পেছনে ছোটেননি কখনো। অদ্ভুত আড়ালচারিতা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে লড়াই এখনো চলছে, সে লড়াইয়ে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তোয়াব খান।

আজ তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন তোয়াব ভাই। আপনার স্নেহছায়ায় আরও অনেকটা পথ হাঁটতে চাই আমরা।

লেখক: সভাপতি সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ


পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোতাহার হোসেন

পাহাড়, আর পাহাড়ের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া পানির ঝর্ণাধারা ও গাছগাছালির অপরূপ শোভায় প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা বান্দরবানের নৈস্বর্গিকতাকে গ্রাস করছে সহিংসতা এবং আতঙ্কের কালো মেঘে। বান্দরবানের রুমা, থানছিতে গত কয়েক দিন ধরে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সশস্ত্র সহিংসতা, মসজিদে হামলা, ব্যাংক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের টাকা ও থানার অস্ত্র লুঠের ঘটনায় পাহাড়ের কোলে প্রকৃতির নৈস্বর্গিকতায় গড়ে ওঠা বান্দরবানের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ,আতঙ্ক বিরাজ করছে। বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন, তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরত দেখা দেয়। শঙ্কার মধ্যে সরকারের ঐকান্তিকতায় যৌথবাহিনী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবের নিরন্তর প্রচেষ্টায় পার্বত্য ঐতিহ্য বৈষাবি এবং বাংলা নববর্ষে বৈশাখী উৎসব, মুসলমানদের পবিত্র ঈদ উৎসবের সব আয়োজন সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি ঈদ, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে টানা সরকারি ছুটিকে কেন্দ্র করে ভ্রমণপিপাসু মানুষ এই তিন জেলার প্রকৃতির অপরূপ শোভামণ্ডিত এবং নয়নাভিরাম পর্যটন স্পট ভ্রমণ সীমিত আকারে হয়েছে। এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের শীর্ষমহল থেকে শুরু করে গোয়েন্দা সংস্থা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, আমাদের চৌকস সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগ অব্যাহত রাখা দরকার। তবে এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে দেশের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও শান্তি রক্ষায় প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য ও সিদ্ধান্ত।

উল্লেখ্য পাহাড়ি জনপদ বান্দরবানে কেএনএফএর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুধু পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের জন্য নয় একই সঙ্গে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য নতুন করে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। প্রসঙ্গত গত ২ এপ্রিল সন্ধ্যার পর রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে হানা দেয় কেএনএফ। এ সময় তারা পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ১৪টি অস্ত্র এবং ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক নেজামউদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ১৬ ঘণ্টা না যেতেই ৩ এপ্রিল দুপুরে একই সশস্ত্রগোষ্ঠী থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ১৭ লাখ টাকা লুট করে। পরদিন ৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে কেএনএফ। অবশ্য ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে তাদের জেলে পাঠিয়েছে। চলছে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান। উদ্ধার হয়েছে অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজার; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেএনএফের সঙ্গে বান্দরবানের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির দফায় দফায় আলোচনার মধ্যে কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো? অন্যটি হচ্ছে: সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফেলতিতে রুমা ও থানচিতে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অবতারণা কি না- এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখা দরকার।

বিগত দিনে দেখা গেছে, যখনই পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো আর্থিক অস্ত্র সংকটে পড়ে তখন তারা নিজেরা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে, জড়িয়ে পড়ে। আর তখনই চাঁদাবাজি, লুঠরাজ ও সহিংসতায় লিপ্ত হয় এবং তখন তাদের শক্তি, সার্মথ্য, সক্ষমতা জানান দিতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিগত দিনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনায় এমনটি প্রমাণ হয়। যদি তাই না হয় তাহলে শান্তি আলোচনার আড়ালে কেএনএফ ব্যাংক, থানা লুঠ, মসজিদে হামলা করবে কেন? তারা অর্থ সংগ্রহে মনোযোগী হলো কেন? এ কারণে তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার পাশাপাশি শতভাগ সতর্কতা বজায় রেখে সংকট নিরসনে মনোযোগ দেওয়া দরকার ছিল; কিন্তু তা সম্ভবত করা হয়নি। কারণ থানা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় আগ থেকে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিলে হয়তো ব্যাংক লুঠ ও থানায় হামলা, অস্ত্র লুঠ ঠেকানো যেত। আর এ কারণেই রুমা ও থানছি এসব ঘটনাকে নিছক ‘ব্যাংক ডাকাতি’ বা ‘আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা’ হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এসব সহিংসতার মধ্য দিয়ে কেএনএফ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। কাজেই এর নেপথ্যে তাদের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, আন্তর্জাতিক সংযোগ, আঞ্চলিক ও চীন-মিয়ানমারের ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে তা খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ এই নব্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও সামরিক শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে শুধু সাময়িক অভিযানে সুফল মিলবে না।

প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাহাড়ের বিবাদমান রক্তক্ষয়ী সংঘাত, সহিংসা বন্ধে আমাদের সেনাবাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। কারণ বিগত সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান পরিচালনার প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রয়েছে। এদিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ওই অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি ’ স্বাক্ষরিত হয়। পরে পার্বত্য শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ি জনগণের বিশেষ অবস্থান ও মর্যাদার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে পাহাড়ের রক্তাত্ত জনপদে প্রত্যাশিত শান্তি ফিরে আসে একই সঙ্গে পাহাড়ি বাঙালির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চলে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ।

অবশ্য ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি, র‌্যাব, বিজিবি, সেনাপ্রধান বান্দরবান সফর করে পাহাড়ি জনপদে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে কেএনএফ নির্মূলে সাড়াশি অভিযানের ঘোষণা দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও সেখানে অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযানে কেএনেএফের প্রধান নাথান বমের ঘনিষ্ঠ কেএনএফের ‘প্রধান সমন্বয়কারী’ চেওসিম বমসহ দুজন র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। এ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন এই তথ্য জানিয়েছেন।

অন্যদিকে, বম জনগোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন নাগরিক বলেছেন, চেওসিম বমের শ্যারণপাড়ার বাড়িতে কেএনএফ প্রধান নাথান বমের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার প্রধান সমন্বয়কারী শামীম মাহফুজের বৈঠক হয়েছিল। ২০২১ সালের শেষে ও ২০২২ সালের প্রথম দিকে এমন বৈঠক হয়। কারও কারও মতে তার বাড়িতেই কেএনএফের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী শারক্কীয়ার চু্ক্তি হয়েছিল। মাসিক তিন লাখ টাকার চুক্তিতে জঙ্গিদের কেএনএফ সদস্যরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল।

অন্যদিকে, কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটি গঠন করা হয় গত বছরের মে মাসে। ওই কমিটির সঙ্গে গত ৫ মার্চ দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয় বেথেল পাড়ায়। শান্তি আলোচনার মধ্যেই ২ এপ্রিল বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে ও পরদিন ৩ এপ্রিল থানচির সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে ১৭ লাখ টাকা, দুটি লাইট মেশিনগানসহ (এলএমজি) ১৪টি অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায় কেএনএফ সদস্যরা। পাশাপাশি সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় তারা। পরপর দুই উপজেলায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী।

খবর অনুযায়ী কেএনএফ ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে তৎপরতা শুরু করে। পাহাড়ে তাদের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এর আগেও গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। সেই আস্তানায় গত বছর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া ও কেএনএফের বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। সংশ্লিষ্ট মহলের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন কেএনএফকে কারা অস্ত্র সরবরাহ, অর্থ, বৈদেশিক সাহায্য দিচ্ছে। কাজেই কেএনএফকে অস্ত্র, অর্থ ও জনসমর্থন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। এটা করা না গেলে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অপূর্ণতা থেকে যাবে। তাই নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য বান্দরবানে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শান্তি আলোচনা ভেস্তে গেলেও সরকারের উচিত সংলাপের জন্য পথ উন্মুক্ত রাখা। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলের মানুষের মৌলিক চাহিদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের মতো সংগঠনের সঙ্গেও এদের যোগাযোগ আছে।

আগের মতো পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার স্বার্থে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিতে পারে। পাশাপাশি বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ তাদের নিয়মিত টহল, তল্লাশিতে নিয়োজিত করা দরকার। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, যে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের যেন ক্ষতি না হয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি পাহাড়, বন, নদীনির্ভর। তাদের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, অধিকার সমুন্নত থাকলে কেএনএফের মতো কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী অপতৎপরতা চালাতে সাহস করবে না। প্রত্যাশা পাহাড়ে শান্তি আসবে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।

লেখক: সাংবাদিক


আস্থাই আসল

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

মানুষ তার নিজের বোধ বিশ্বাসের বিশ্বে বাস করতে চায়। সে তার সব পদক্ষেপকে নিজের নিরীখেই যৌক্তিক ভাবতে ভালোবাসে। জগৎ ও সংসার সংক্রান্ত উপলব্ধি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো যার যেমন চিন্তাচেতনা তদানুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। মনসচক্রবালের চৌহদ্দীভেদে দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য হয়ে থাকে।

নৃতত্ত্ববিদ আর সমাজতত্ত্ববিদ যথাক্রমে পৌরুষ ও পরিবেশকে মানুষের বোধ বিশ্বাস সৃষ্টির নিয়ামক ভেবে থাকেন। উভয়ের মতবাদের মধ্যে বৈরিতা নেই- বরং পরিপূরকের সম্পর্ক আছে। অস্থি-মজ্জার সঙ্গে মিশে থাকা জাত্যাভিমানে এবং পরিবেশ প্রভাবের মেলবন্ধনে যে অয়োময় প্রতীতি গড়ে ওঠে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে তা ব্যষ্টি ও সমষ্টির সমাজকে গতিদান করে। সমাজ এগোচ্ছে না পিচুচ্ছে - ভাঙছে না গড়ছে তা শনাক্তকরণের কাজে নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিকের সমীক্ষা সমীকরণের বিকল্প নেই।

সবার ওপর মানুষ সত্য এ উপলব্ধিরও কোনো বিকল্প নেই। মানুষই নিজকে ও সবাইকে, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের অবয়বে সময়কে, পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণকে নিয়ন্ত্রণ করে। অবকাঠামো গড়ে যে সভ্যতা সংস্কৃতির বিকাশ সে ঘটায়, তার ধ্বংসের কারণও আবার সেই সৃষ্টি করে। মুক্তবুদ্ধি মানুষ যেমন দৃষ্টির প্রসারে আলোকিত হয়, অবরুদ্ধ চিন্তা-চেতনায় বন্ধ্যিত্ব বরণের ফলে অন্ধকারে ডুবে যাওয়াও তার ভাগ্যে ঘটতে পারে। ভালো পথ যাচাই ও গ্রহণ বর্জনের প্রশ্নটিও আদিকাল থেকেই অব্যাহতভাবে অমীমাংসিত আছে বলেই জীবন ও সমাজ গতিশীল। বৈধ-অবৈধর প্রতি আসক্তি ও আকর্ষণের তারতম্যের মধ্যে সমাজের পরিবেশ-পরিচয় প্রকাশ পায়।

সৃজনশীলতা মানুষের অন্যতম ধর্ম। প্রকৃতির অপার সম্পদ ও সৌন্দর্যকে রূপান্তর ও বহুমাত্রিক ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে মানুষ তার মেধা ও মননকে কাজে লাগায়। মানুষের মধ্যে যে সুকুমার বৃত্তিগুলো সৃজন সম্ভাবনায় উন্মুখ হয়ে আছে উপযুক্ত পরিবেশের পরিপোষক সমর্থনে ফল্গুধারার মতো তা বেরিয়ে আসতে পারে। এখানেও সৃজনশীলতা গঠন ও ধ্বংসের উভয়পর্যায়েই হতে পারে। সৃজনশীলতা গঠন না ধ্বংসের তা নির্ভর করে পরিবেশের প্রযত্ন প্রয়াস ও চাহিদার ওপর। ঘটনার প্রকৃত কারণ নিহিত থাকে নেপথ্যে। যার দ্বারা ঘটনা ঘটে সে উপলক্ষ মাত্র, যে কারণে ঘটনা ঘটে কিংবা যে ঘটনা ঘটায় সেটিই মুখ্য। ভাড়াটিয়া খুনিকে দোষী সাব্যস্ত করার পাশাপাশি কার দ্বারা এবং কেন খুনি ভাড়া করা হলো তার যথাযথ হদিস হওয়া বাঞ্ছনীয় সমস্যার প্রকৃত নিষ্পত্তির লক্ষ্যেই। নইলে সমাজের নৈতিক ভারসাম্য আর মূল্যবোধের প্রতি আস্থার ভিত্তিতে ধরতে পারে ভাঙন। এটা প্রকৃতির অমোঘ বিধান যে- অন্যায়-অনিয়মের পরিবেশ সৃষ্টিকারী ও ইন্ধনদাতা অন্যায়কারীর চেয়ে বেশি দায়ী। একে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই- কেননা প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘনকারীর অনিবার্য পরিণতিও অলঙ্ঘনীয়। কার্যকারণ ছাড়া কোনো কিছু যেমন ঘটে না তেমনি কোনো ক্রিয়াই প্রতিক্রিয়াহীন থাকে না।

মানবকল্যাণ কামিতার আদর্শ সময় ও সমাজভেদে নানান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে থাকে। মানবকল্যাণধর্মী মূল্যবোধের বিকাশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত জরুরি, শত বাধা-বিপত্তি সংশয়-সংকট সন্ধিক্ষণেও সত্য-সুন্দরের সনাতন উপলব্ধি থাকবে জাগ্রত। বিভ্রান্তির বেড়াজালে শাশ্বত মূল্যবোধ হারিয়ে যাবে কি না কিংবা নিরুদ্দিষ্ট হবে কি না তা নির্ভর করে ব্যষ্টি ও সমষ্টির আকাঙ্ক্ষার আকৃতি আর সজাগ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃতির ওপর। জনকল্যাণের নামে, সংস্কারের নামে কুশাসন-শোষণ মুক্তির নামে নানান মতবাদ-উপায়-উপলব্ধির অবয়বে শাশ্বত মূল্যবোধের ভাঙাগড়া চলে। শুভ উদ্যোগে বিশ্বাস ও প্রত্যয় হয় সুদৃঢ়। আত্মমর্যাদাবোধের বিকাশ আর কল্যাণকামিতায় আসে প্রাণ প্রাচুর্য। পক্ষান্তরে ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তাচেতনা দ্বারা তাড়িত পদক্ষেপে সৃষ্ট হতবাক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেয় সব ক্ষেত্রে। বিশ্বাস আর আস্থায় ধরে ভাঙন। মানুষ বিশ্বাসের বিশ্বে নিরাপত্তা নির্ভরতায় বাস করতে চায়। আস্থা নিজের প্রতি, সমাজের প্রতি অতীব প্রয়োজন। আস্থার অবর্তমানে কিংবর্তব্যবিমূঢ় ব্যক্তি সমাজে জগদ্দল পাথর হয়ে দাঁড়ায় এবং কিয়ৎকাল পরে তার চলৎশক্তির গতিধারায় ঘটতে পারে অশুভ দিকপরিবর্তন। নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাফিক যেমন পদে পদে কারণে-অকারণে অহেতুক যানজটের হেতুতে পরিণত হয়। অসহিষ্ণুতা আর পারস্পরিক দোষারোপের বেড়াজালে সহযোগিতা সহমর্মিতার মেলবন্ধন হয়ে পড়ে সুদূর পরাহত। রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি যেমন বহু রোগ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে, আত্মস্বার্থ উদ্ধারের ভেদবুদ্ধি প্রবল হলে ব্যষ্টি ও সমষ্টির সর্বনাশের সঙ্গে নিজের সর্বনাশও যে জড়িত- এ উপলব্ধিটাও হারিয়ে গেলে সমূহ বিপদ।

সমাজে নানান উপায় ও উপলক্ষে এমন সব ঘটনাবলির উদ্ভব হয় যা সমাজের গতিপ্রকৃতির দিকনির্দেশ করে। গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে সমাজ সমৃদ্ধ হয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের দ্বারা বিজ্ঞান ও সভ্যতার অনেক সুযোগ সহজে হাতের কাছে এসে যায়- ধ্যান-ধারণায় তা যেমন নতুন মাত্রা যোগ করে, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠান ক্ষেত্রেও সূচিত হয় নানান সুযোগ। শোষণ বঞ্চনা বৈষম্যের অবসান ঘটাতে মানুষ সংগ্রাম করে- শোষণহীন বঞ্চনা বৈষম্যরহিত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায় বুক বাঁধে। প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে দেখলে সংগ্রামের সার্থকতা সে খুঁজে পায়, উদ্দীপ্ত চেতনায় দীপান্বিত হয়ে ওঠে। তার এবং সবার ঐকান্তিক প্রয়াস প্রচেষ্টায় উন্নয়ন ও সংহতি সুদৃঢ় হয়ে ওঠে। আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণের পরিতৃপ্তিতে তুষ্ট জনগোষ্ঠীকে কোনো বাদ বিসংবাদ বিভ্রান্ত করতে পারে না। আগে যেমন বলা হয়েছে- মানুষ তার কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতা খুঁজে ফিরে নিয়ত নিজের নিরীখে। যদি দেখা যায় ক্ষুদ্র ও খণ্ডিত স্বার্থবাদিতায় নানান বিভ্রান্তি ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে তার আত্মত্যাগের মহৎ উদ্দেশ্যগুলো তা হলে তার সক্রিয় অংশগ্রহণের যৌক্তিকতার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য-অভিপ্রায়ের, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ানের আঙিনায় অপব্যাখ্যার আগাছা জন্ম হয়। প্রয়োজনে অনুরূপ সে আগাছা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের চলৎশক্তির জন্য সেটা এক দারুণ দুঃসংবাদ।

অথচ ব্যষ্টি ও সমষ্টির মধ্যে নিয়ত এ প্রয়াস প্রত্যাশিত থেকে যায় যে তীব্র প্রতিযোগিতাময় প্রাগ্রসরমান বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে তালমিলিয়ে তুলনামূলক সমৃদ্ধি অর্জনের। এটা অত্যন্ত জরুরি ও প্রয়োজন, প্রতিনিয়ত সফলতা-ব্যর্থতার খতিয়ান পর্যালোচনা, ভুল পদক্ষেপকে শনাক্ত করে শ্রেয়তর পদক্ষেপ গ্রহণের ঐকান্তিকতার পরিপোষণ এবং বিভ্রান্তি ও বিভক্তি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র প্রশ্রয় পেয়ে যাতে উন্নয়নের ধারায় বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র একসূত্রে গাঁথা এবং তার বর্তমান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যমণ্ডিত অতীতকে সফল বর্তমানে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে পারলেই তা সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের সোপান হিসেবে স্বীকৃত হবে। আজকের বর্তমানও এক দিন ইতিহাসের বিবেচ্য বিষয় হবে। সব সময় অতীত বন্দনা ও প্রতিষ্ঠায় দৃষ্টি ও মনোযোগ নিবদ্ধ থাকলে বর্তমানের কী হবে? কোন পরিচয়ে বর্তমান ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে সে বিবেচনাও যথেষ্ট জরুরি। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই বর্তমানকে বিনির্মাণ প্রয়াস প্রচেষ্টার দ্বারা সোনালি ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সার্থক হতে পারে।

অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্র নির্বাচন ও পন্থা নির্ধারণেও সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। অতীতের উদাহরণ এনে বর্তমানের ভুল-ভ্রান্তিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টার চেয়ে আত্মঘাতী প্রতারণা আর নেই। গুড প্রিসিডেন্স বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে সমৃদ্ধ হতে যতখানি সহায়তা করে ব্যাড প্রিসিডেন্স তার চেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতীতেও এমনটি করা হয়েছে এই বলে যদি বর্তমানের অপকর্মের যৌক্তিকতা দাঁড় করানো ও সাফাই বন্দনা শুরু হয় তাহলে গঠনমূলক মূল্যবোধের বিকাশকে অসম্ভবই শুধু করে তোলা হবে না, চক্রবৃদ্ধি হারে তার মাশুল গুণতে হয় অতীতের মতো ভবিষ্যৎকেও। অথচ কথা ছিল ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’

৫৩ বছরে পা দেওয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে এই সময় ও সমাজে বয়স, বর্ণ, পর্যায় ও প্রকারভেদে নানান কিসিমের মানুষ এখনো রীতি-পদ্ধতি, নীতি ও নিয়মে ঔপনিবেশিত। শ্রমজীবী কর্মক্লান্ত মানুষের পাশাপাশি অতি চালাক ফিটফাট ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও কর্মী, শিক্ষাবিহীন শিক্ষিতের সমারোহের পাশে প্রযুক্তি প্রখর মেধাবী মুখ, মুক্তবুদ্ধি শান্ত সমাহিত চিন্তাচেতনার সারিতে সহসা মৌলবাদী চেহারার মানুষ, উন্নয়নকর্মীর পাশাপাশি নিজের আখের গোছাতে তৎপর এনজিও কর্ণধার, সন্ত্রাসীর ভয়ে আতঙ্কিত মানুষ, চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী আত্মোৎসর্গীকৃত সেই পুলিশ সার্জেন্ট, ষড়যন্ত্রের শিকার গৃহহীন মানুষ, খবরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে হাসিমুখের মানুষের পাশাপাশি বানভাষী মানুষ, নিঃস্বার্থ ত্রাণকর্মীর পাশে সুযোগসন্ধানী- অসৎ উদ্দেশ্য অভিলাষী চোখের মানুষ, কোণঠাসা সৎ ও নিষ্ঠাবান চাকুরে, ধান্দাবাজ আর আত্মস্বার্থের শর্করা সমৃদ্ধ জনস্বার্থসেবী আমলা, অবিবেচক বাসের হেলপার, ট্রাকের মাতাল ড্রাইভার, নীল, সাদা অধ্যাপক, একচোখা আতেল, রাজনৈতিকশিল্পী, ঋণখেলাপি, ব্রিফকেসবাহী নতুন শিল্পপতি, নকল সরবরাহকারী, উদ্ধত ছাত্রনেতার সামনে অসহায় অধ্যক্ষ, জামিনপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী, কুকুরের মাংস বিক্রেতা আর অ্যাসিডে দগ্ধ তরুণীর দেশে সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটার।

লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক


হাড়ে হাড়ে বুঝছি, উষ্ণায়ন কী? 

প্রতীকী ছবি
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
লিয়াকত হোসেন খোকন 

যত দিন যাচ্ছে, আমরা যেন হাড়ে হাড়ে বুঝছি, উষ্ণায়ন কাকে বলে। উষ্ণায়নের গ্রাসে পৃথিবী তলিয়ে যাওয়া এক প্রকার নিশ্চিত। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান সেই মতকেই প্রবল সমর্থন জোগাচ্ছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের আবহাওয়া-সংক্রান্ত রিপোর্টে যেমন স্পষ্ট হয়েছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে রেকর্ড হারে। সেই হার এতটাই বেশি, ২০২৩ সালটি উষ্ণায়নের পুরোনো সব রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা গত বছরে গড়ে প্রায় ১.৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।

২০১৫ সালে প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো সম্মিলিতভাবে স্থির করেছিল পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রিতে আটকে রাখার। এটাই বিপদ-মাত্রা। ফেলে আসা বছরটি দেখিয়ে দিল, পৃথিবীর এই বিপদ-মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে।

এমনটা যে অপ্রত্যাশিত, তা নয়। দীর্ঘ দিন ধরে একটু একটু করে জলবায়ু পরিবর্তনের চিহ্নগুলো স্পষ্ট হয়েছে। প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনগুলো তো বটেই, অন্যান্য আন্তর্জাতিক মঞ্চেরও মূল আলোচ্য হয়ে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার ক্ষতিকর প্রভাব ঠেকাতে সম্ভাব্য পথগুলো।

জলবায়ু পরিবর্তন কোনো একটিমাত্র দেশের নিজস্ব সমস্যা নয়, সুতরাং প্রতিরোধের পথগুলোও ঐকমত্যের ভিত্তিতে একযোগে নেওয়া প্রয়োজন; কিন্তু এত দিন ধরে এত অর্থ ব্যয়ে যে আলোচনা, প্রতিশ্রুতি পর্ব চলে এসেছে, তা একটি বৃহদাকার অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে মাত্র। কার্বন নিঃসরণের মাত্রার দ্রুত হ্রাস এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্পগুলোর ওপর অধিক গুরুত্বারোপ উষ্ণায়ন প্রতিরোধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে বিভিন্ন সময় ধার্যও করেছে বিভিন্ন দেশ; কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাপেক্ষে সেই লক্ষ্যমাত্রাও ক্রমশ অধরা মনে হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির এমন হার অব্যাহত থাকলে ইতোমধ্যেই যে বিপুল জলবায়ুগত পরিবর্তনের আশঙ্কা, তার মোকাবিলা করার মতো পর্যাপ্ত সময় হাতে থাকবে তো?

উন্নত দেশগুলো তাদের অর্থ এবং পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জোরে যে দ্রুততায় কার্বন-শূন্য লক্ষ্যমাত্রার দিকে যেতে পারে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পক্ষে তা অর্জন করা কঠিন।

পৃথিবীর অনেক দেশই এখনো কয়লার ওপর অতি নির্ভরশীল। পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উপযোগী পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তার জোগান আসবে কোথা থেকে?

উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপানির তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। দ্রুততর হচ্ছে হিমবাহ গলনের প্রক্রিয়া। ক্রমশ বাড়ছে সমুদ্রপানির উচ্চতা। বিপদের মুখে অগণিত উপকূলবাসী। বিপদ অন্যত্রও। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বৃদ্ধি পেলে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা আগামী দিনে বাড়বে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট। খামখেয়ালি আবহাওয়ায় কৃষিকাজ ব্যাহত হলে আগামী দিনে খাদ্যসংকট ঘনীভূত হবে। এর কোনো কথাই কিন্তু নতুন নয়। প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসের বাইরে বিশ্ব কোনো কার্যকর পথের সন্ধান দিতে পারল না, সেটা উষ্ণায়নের চেয়ে কম উদ্বেগের নয়।

বিশ্ব উষ্ণায়ন শব্দ দুটো কয়েক বছর আগেও আমাদের কাছে অচেনা ছিল। মাঝেমধ্যে কথাটা শুনতাম। মানে বুঝতাম না। ভাবতাম, এটা বোধহয় বিশেষজ্ঞদের ব্যাপার। আমাদের না বুঝলেও চলবে! অবশেষে তাই বুঝতে হলো, উষ্ণায়ন কী, হাড়ে হাড়ে বুঝছি আজ।

পানিও ফুরিয়ে আসছে-

ভূ-গর্ভের পানিও এখন ব্যাপকভাবে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে ভূ-গর্ভের পানিও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ভূ-গর্ভের পানিতেও আর্সেনিক ইত্যাদি বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। ফলে ভূ-গর্ভের পানিও এখন আর সুপেয় নয়।

কাজেই ভূ-পৃষ্ঠ এবং ভূ-গর্ভের পানি সংরক্ষণের এবং পানি ব্যবহারে মিতব্যয়িতার এখন বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো এ জন্য বিশেষ বৈজ্ঞানিক কৌশল অবলম্বন করছে। এ ছাড়া ব্যবহৃত পানিও শোধন করে পুনর্ব্যবহার যোগ্য করে তোলার এখন বিশেষ প্রয়াস শুরু হয়েছে।

আমাদের দেশে বিশেষ করে পানি সংরক্ষণ, পানি পুনর্ব্যবহার যোগ্যকরণ ইত্যাদি প্রকল্প তো দুরস্ত, এখনো ৭০ শতাংশ মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে পারেনি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চল, দুর্গম পাহাড়ি, গ্রামাঞ্চল ইত্যাদি এলাকার মানুষ খাল, বিল, নদী-নালার দূষিত পানি পান করেই নানা অসুখ-বিসুখ সঙ্গে করে জীবনধারণ করে আছে।

ঘুম থেকে ওঠার পরই প্রথম প্রয়োজন পানীয়জল। বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও শুধু সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে এবং দুর্নীতির জন্য সেই বিশাল পরিমাণ টাকার অপচয় হয়ে আসছে স্বাধীনতার পর থেকেই। পানি সম্পদ প্রকল্পের নামে প্রচুর টাকা বরাদ্দ হলেও চাহিদা বিন্দুমাত্র মিটছে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া মানুষ, জীবজন্তু, গাছ বাঁচতে পারে না। শুধু বাঁচার প্রশ্নই নয়, পানিছাড়া সম্পূর্ণভাবে জীবনযাপনই অচল হয়ে পড়ে। কৃষিতে প্রধান অবলম্বন পানি। সেই পানির অভাবের সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তায় মানুষ।

ভূ-পৃষ্ঠের পানি খুব শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে। বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানীয়জল ভূ-পৃষ্ঠে দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। নদী, নালা, খাল, বিলে যে পানি রয়েছে তাও চরমভাবে দূষিত। দুর্গম ও গ্রামীণ এলাকার মানুষ নদী-নালার দূষিত পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ ছোট-বড় নদীর পানিই দূষিত ও বিষাক্ত। এই বিষ ক্রমশ বাড়ছে। নদী-নালা-খাল-বিল ইত্যাদির দূষিত পানি কৃষি কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদনেও খুব দ্রুত মিশে যাচ্ছে বিষাক্ত নানা রাসায়নিক। খাদ্যসহ ওইসব কৃষি উৎপাদন খেয়েই মানুষ দৈনন্দিন জীবন ধারণ করছে। এর ফলে সারা বিশ্বেই নিত্য-নতুন নানা অসুখ-বিসুখের প্রভাব ঘটছে।

এদিকে বিশ্বজুড়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রকাশ, আগামী অর্ধশতকের মধ্যেই ভূ-পৃষ্ঠের এই দূষণমুক্ত পানিও ফুরিয়ে যাবে। আবহাওয়ার পরিবর্তন, উষ্ণায়ন ইত্যাদি এর কারণ। তখন মানুষের কী হবে?

লেখক: পরিবেশবিদ ও চিঠি বিশেষজ্ঞ


হুম সাহিত্য-নির্ঘুম জীবন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রাজীব কুমার দাশ

মানুষ কেন! প্রাণীকে কোনোকিছু শিখিয়ে দিতে হয় না। বংশগতি সংরক্ষণ ও বাঁচার প্রয়োজনে সে সব কিছু শিখে নেয়। হোক সেটা সংঘর্ষ শান্তি, শ্রান্তি, বিনোদন, দারিদ্র্য বিমোচন।

অনলাইনে পড়ালেখা, সিনেমা নাটক প্রেম, বিরহ, সংসার, চাকরি; পাতি নেতা, বড় নেতা হওয়ার বাসনা, রান্না, কান্না, খুড়ি, আপু হয়ে ধর্মগুরুর উপদেশ রিল; ইউটিউবার সেলিব্রেটি হতে দেখা উপলব্ধি নিয়ে মানিকনগর গ্রামের বেকার যুবক সাকলাইন নারী-পুরুষ স্বাবলম্বী হতে অনলাইন হাতেখড়ি স্কুল খুলে দিলেন। চ্যাট অপশনের শত শত সাংকেতিক ইমোজি স্টিকার হাসি, কান্না, ঘৃণা ভাষা রপ্ত করেন। মুখ বেঁকিয়ে গাল ফুলিয়ে কোমর নিতম্ব সাপের মতন দুলিয়ে দুর্দান্ত রিল ব্যবসায়ী হতে রিচলিত স্খলিত শরীরী ভাষা প্রশিক্ষণ দিতে লাগলেন। ‘হুম’ শব্দের প্রায়োগিক দুর্দশা নিয়ে হাতে-কলমে ইশারা তালি তালিম মিশেল ভাবনায় রয়ে-সয়ে একাকার জীবন গড়ে নিলেন। মানিকনগর বর্ধিষ্ণু গ্রামের সরল-গরল ঘরানা মানুষের চিত্র-বিচিত্র রংধনু মনের রং, ঢং, সঙ, জীবন ধীরে ধীরে ক্ষীয়মাণ হতে হতে হুম সাহিত্যে হাত পাকিয়ে- পাস্তুরায়ন নিরুপদ্রব অন্তর্জাল জীবন সাহিত্যে যে যার মতন একা একা ইমোজি স্টিকার জীবন বেছে নিলেন।

মানিকনগর গ্রামে চা দোকানের বাগড়া-ঝগড়া, বিবাদ, মারামারি থেমে গেল। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হাট-বাজার হয়ে গেল- রাক্ষস-খোক্ষসপুরী। সবার কানে কানে লাগানো ব্লুটুথ হেডফোন। নেই হাঁকডাক চিৎকার-চেঁচামেচি, অট্টহাসি কোলাহল। গাজীপুর পুবাইল সিনেপাড়ার শুটিং স্পট ভাড়াটে উপকরণ ঘরবাড়ি জমিজিরাত বউ-বাচ্চার মতন পাল্টে গেছে এখানেও রাতারাতি মানুষের জীবনাচার। নতুন করে হাতেখড়ি জীবনাচারের সুফল পেতে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে কিছুদিন। তবে এটা ঠিক, বর্তমান হয়ে আগামী দিনের ফেসবুকীয় শুদ্ধাচার সবাই মেনে নেন। মানিকনগর গ্রামের মানুষজন এখন পারতপক্ষে কথা বলেন কম। মৌনতা বাড়িয়ে দেয় দীর্ঘজীবন,- রহস্য জেনে কুশল বিনিময়েও তারা সংহত সংযত। দরিদ্র্যতা একমাত্র নরক অভিশাপ জেনে তারা পারতপক্ষে ফেসবুকীয় মনিটাইজেশন শুদ্ধাচারের বাইরে হাঁটেন কম।

এবারের এমপি প্রার্থী মানিকনগর গ্রামের চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন। ফেসবুকীয় মনিটাইজেশন দয়াপানে তাকিয়ে কোনোমতে সংসার চালান। ফেসবুক আছে যার পৃথিবী তার, মুখে স্লোগান হাতে বুড়ো আঙুল ঘষে ঘষে পরশুরাম লাঙল চষে বেড়ান -আট ইঞ্চি চার ইঞ্চি টাচ স্ক্রিনে।

গর্ব করে চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন বলেন- এ ব-দ্বীপের আলম, আদম, রতন, স্বপন, মুরগি-ছাগল চোর, কলম চোর, প্রজেক্ট চোর, ছেচড়া প্রতারক বাটপার যেখানে এমপি হয়ে টেবিল চাপড়ে ভিআইপি হতে পারেন; পুলিশ পাহারায় সাইরেন বাজিয়ে পুলিশ পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে দিতে পারেন; সে তুলনায় আমি তো ভিআইপি প্রার্থী। কারোর টাকা মেরে খাইনি, দেশের টাকা পাচারের বদনাম নেই, সন্ত্রাস করিনা, দখল বে-দখলে রাখিনি ব্যক্তিগত কিংবা সংখ্যাগুরু লঘু কারোর সম্পদ কিংবা সম্পত্তি। কারোর বউ, মেয়ে ভাগিয়ে বিয়ে করিনি। নারী নিয়ে লটর-পটরের বদনাম নেই। নাচি, গাই, খাই, দাই, এটা-ওটা দেখাই। বানরের মতন লম্পঝম্প দিয়ে ফরেন টাকা ডলারে আনি। দেশের মান-ইজ্জত রুজি-বরকত বাড়িয়ে দিয়েছি সোমালিয়া জলদস্যুদের মতন কয়েকগুণ বেশি। সোমালিয়া নৌবাহিনী সদস্যরা যেমন সরকারি চাকরি শেষে রিটায়ার্ড করে জলদস্যু টিমে কাজ করেন; আমিও আগামী বছর পাঁচেক পরে ফ্রিল্যান্সিং পেশা বেছে নিতে পারব।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়ন পরীক্ষা জিতে হুম স্টিকার প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে জনমত জরিপে চৌধুরী ময়েজ উদ্দিনের পক্ষে ইউটিউবার অপু ভাই রাঁধুনি শেফালি খালা ভাড়াটিয়া জিহ্বাস্ত্র নিয়ে সেফুদার আকাশচুম্বী স্বপ্ন দেখানো ভোট বিজ্ঞাপন যুদ্ধে ইউটিউবার এমপি প্রার্থী চৌধুরী ময়েজ উদ্দিনই এগিয়ে রইলেন। সবার দেওয়া এটা-ওটা প্রতিশ্রুতি বিজ্ঞাপন যুদ্ধের ডামাডোলে চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন অনলাইন অফলাইনে বললেন, - প্রিয় মানিকনগর কাঞ্চননগর পাইন্দং বেড়াজালী রাঙ্গামাটিয়া নিবাসী, যদি এমপি পদে নির্বাচিত হতে পারি; ইন্টারনেট সেবা ফ্রি পাবেন। সার-কীটনাশক ফ্রির পাশাপাশি মাঠে-ঘাটে সিনেমা-নাটক দেখবেন, ভিডিও কলে কথা বললেন মন চাইলে প্রেম করবেন। পরিবারের সবাইকে চোখে চোখে রাখবেন।

চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন প্রতিশ্রুতি প্রতিজ্ঞা বিজ্ঞাপন দিয়ে বাজিমাত করে সবার মন জিতে এমপি চেয়ারপানে অপেক্ষা করতে থাকেন। মেম্বার হতেও যেরকমের উতলা টেনশন কাজ করে; তার চেয়েও সহজ মনে চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন বিপুল ভোট পেয়ে এমপি হয়ে গেলেন। ছোটখাটো কালভার্ট ব্রিজ অনলাইনে উদ্বোধন করেন। উপজেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিং নিয়ে ওসি উপজেলা চেয়ারম্যান ইউএনও নিয়ে আমিত্ব অহঙ্কার নেই বললেই চলে। নিজেও সরকারি কাজের বাইরে অনলাইনে আয় করেন। পার্থক্য এটুকুন, সরকারের টাকা নয়ছয়
করেন না।

চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন- মার্কিন লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সে বিখ্যাত উক্তি- সুযোগ ও পার পেয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা থাকলে সবাই খারাপ ব্যবহার করেন; নিয়ে বেশ সতর্ক ও সংযত। সে সুযোগ পারতপক্ষে এমপি সাহেব কাউকে দেন না। যথারীতি এমপি চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন নিজ এলাকায় হুম অনলাইন হাতেখড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। হুম একাডেমি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দিকে দিকে হুম প্রেম হুম বিচ্ছেদ নির্ঘুম জীবন গতিধারা গড়ে হুম সাহিত্যে- রাতারাতি প্রথাবিরোধী এমপি অমরত্ব এনে দেন।

চিরকালই মানুষ চেয়েছে সুখ-শান্তি। জাগতিক সুখ-দুঃখের বাইরে একমাত্র প্রথাবিরোধী হাতে গোনা কজন ছাড়া হেঁটেছেন কম। লাখো মানুষেতেও প্রথাবিরোধী মানুষ নেই বললেই চলে। তাই তো মানুষের কাছে সুখের বিপরীতে সম্পর্কের গুরুত্ব কম। শখ সুখ আয়েশী জীবনের বিপরীতে মানুষের নির্ঘুম জীবন। হোক না বাবা-মা, সন্তান, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বকীয়া-পরকীয়া অজাচার নিষিদ্ধ সম্পর্ক বন্ধু সুজন-কুজন। যেকোনো প্রকারেই হোক না কেন মানুষের সুখ চাই। সে অয়োময় মরীচিকা সুখের খোঁজে মানুষ সময়ের সঙ্গে গা ভাসিয়ে হয়েছেন, যুগে যুগে দেশান্তরী সুখান্তরী। সুখের ধ্রুপদী মহোৎসবে কেউ হয়েছেন মহারাজ সম্রাট; কেউবা পিছিয়ে পড়ে হয়েছেন নিষণ্ন নিষাদী।

সংসদ অধিবেশন সপ্তাহখানেক ধরে মুলতবী। এমপি হোস্টেল ছেড়ে চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন নিজের এলাকা পরিদর্শন করতে যাচ্ছেন। হুম হুম অধিবেশন স্পিকার মুখে হুম হুম জয়যুক্ত হয়েছে টেবিল চাপড়িয়ে এরই মাঝে দেশ-বিদেশের ভাইরাল মুখ ময়েজউদ্দিন। এমপি হয়েও ফেসবুকীয় শুদ্ধাচার মনিটাইজেশন সাহিত্যের বাইরে পারতপক্ষে যেতে চান কম। ফ্রি ইন্টারনেট পাওয়ার পরে রাতারাতি পাল্টে গেছে মানিকনগর গ্রামের হালচাল।

কেউ কারোর সঙ্গে মেসেঞ্জার হোয়াটসঅ্যাপ টেলিগ্রাম ছাড়া পারতপক্ষে অধরওষ্ঠ এক করে কথা বলেন কম। বিয়ে-শাদি কনে দেখা হয়ে প্রেম-বাসর দেন-দরবার পর্যন্ত ফেসবুক রিল মনিটাইজেশন বাণিজ্যে সবকিছু সেরে নেন। এলাকায় এমপি হয়ে আসার পরেও কদর নেই তেমন। দান-দয়া নিতেও কেউ আসেন না তেমন। গ্রামের মুরব্বি ছাড়া যুবশক্তি কেউ দেখা করতে চাইছেন না দেখে এমপি চৌধুরী ময়েজউদ্দিন সাহেব বেশ চিন্তিত। কেউ কেউ সরবে নীরবে বলাবলি করে বলেন,- নেই আমাদের পারিবারিক সনাতনী বন্ধন। নেই পরিবার সংসার। নেই বউ-বাচ্চা। মুরব্বিরা ক্রন্দন করে বলেন, বাবা আমাদের বেশি টাকার দরকার নেই। আমরা ইন্টারনেট সংসার চাই না। এনে দাও ঠিক আগের মতন অটুট পারিবারিক বন্ধন। সবকিছু এনে দাও আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম যেমন।

এমপি সাহেবের সরকারি গাড়িতে জাতীয় পতাকা। কানে ব্লুটুথ পরে হেলেদুলে সিংঘম রাজকীয় থোরাই কেয়ার না করে হেঁটে চলেছেন, কিছু কিশোর গ্যাং। সাইট না পেয়ে ফেসবুকীয় শুদ্ধাচার মনিটাইজেশন ধনী কিশোর গ্যাং চোখে চোখ রেখে এমপি সাহেবকে বলেন, ‘আপনি এমপি তাতে আমাদের কী? আপনার কাজ- জনগণের সেবা করা।’ এমপি চৌধুরী ময়েজউদ্দিন প্রটেকশন পুলিশের দিকে তাকালেন। কিশোর গ্যাং এবার- সহজ প্রশিক্ষণ বিশাল মনিটাইজেশন বাণিজ্য যুদ্ধ জেতা গেরিলা কৌশলে মোবাইলে লাইভ চালু রেখে বলেন, আপনারা দেশপ্রেম বোঝেন না; দেশপ্রেমিক মনিটাইজেশন রেমিট্যান্স যোদ্ধা চেনেন না। আপনাদের কে বেতন দেয়? কোথা থেকে আসে বেতন? আপনারা এমপি পুলিশের বেতন এ সহজ-সরল ফেসবুক মনিটাইজেশন যোদ্ধাদের নিকট হতে আসে।

এ কী! মিনিট কয়েকের মাঝে হাজার লক্ষ আবেগীয় পর্যবেক্ষক এমপি পুলিশ নিয়ে নয়ছয় বলে চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে লাইক-শেয়ারে সারি সারি ফোরাত কারবালা বেদনাশ্রু বইয়ে দিচ্ছেন। কিশোর গ্যাং বেধনাস্ত্র হয়ে অনেক টাকা কামাই করে নিলেন। ফেসবুকীয় পৃথিবী দ্বীপের ভরাট বেদনার। ব-দ্বীপের ঘরে ঘরেও চলছে ফেসবুকীয় লাভ বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। সে ট্রায়াঙ্গলে নেই লজ্জা-শরম নামের কোনো নৌযান সাগরযান কিংবা ডুবোযান। ঘরে ঘরে চলছে অন্তর্জাল চিৎকার হাহাকার। সংসার নেই, সংসার কই আমার? ক্রন্দন। কোথায় স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, পরিজন প্রেমিক-প্রেমিকা আমার-তোমার-তার?

ঢাকা মোহাম্মদপুর তাজমহল সড়কের সি ব্লক, গোশালা কোচিং সেন্টারে চলছে ফেসবুক মনিটাইজেশন শোকের মাতম। গোশালা মালিক পি সরকার, সংসার কই? আমার সংসার কই? বলে হাপিত্যেশ করে চলেছেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, তার ফেসবুকীয় মনিটাইজেশন সংসারে অন্য কেউ সংসার পেতে বসে আছেন। মাঝেমধ্যে টেস্টোস্টেরন হরমোন মেডিসিন গিলে আবেগহীন দায়সারা কণ্ঠে চিৎকার করে বলেন- শিমুল, তুমি কই? তুমি কই? কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না কেন যেন তোমায়! দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে তোমার দেহ-মন; আমি সুখের সংসার করতে চাই। পৃথিবীদ্বীপ ব-দ্বীপের ঘরে ঘরে চলছে সুখে সংসার করার তীব্র হাহাকার শোকের মাতম।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ।


গুণগত রাজনৈতিক সংস্কৃতিচর্চার সংকট

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

যেকোনো নির্বাচন সামনে এলেই গুণগত রাজনীতির প্রসঙ্গ চলে আসে। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে রাজনীতি এখন বেশ চাঙ্গা। ইতোমধ্যেই উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা ও আচরণবিধিমালায় বেশকিছু সংশোধনী এসেছে। সংশোধনীতে চেয়ারম্যান পদে জামানতের পরিমাণ ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা করা হয়েছে। আর ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামানত পাঁচ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রাার্থী হতে ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনসূচক সইয়ের যে তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হতো, এবার তা বাদ দেওয়া হয়েছে। আসন্ন উপজেলা নির্বাচন থেকেই এসব বিধান কার্যকর হবে।

ধারণা করা যাচ্ছে, জামানত বাড়ানোর ফলে সৎ লোকদের প্রার্থী হতে বেগ পেতে হবে। যারা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিংবা যাদের আয়ের অন্য কোনো উৎস রয়েছে শুধু তাদের জন্যই সহজ হবে। উপজেলা নির্বাচনে সাদাকালোর পাশাপাশি রঙিন পোস্টার ও ব্যানার করতে পারবেন প্রার্থীরা। এতে ধনীদের প্রার্থিতায় বেশ সুবিধা পাবে। এতে নির্বাচনে বৈষম্য তৈরি হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। মূলত যারা সচ্ছল তাদের জন্য তো এটা কোনো বিষয় নয়, কিন্তু অনেক প্রার্থী আছেন, যাদের জনগণ পছন্দ করে, তারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল, অন্যান্য দিক দিয়ে ভালো। তাদের জন্য বেশ অসুবিধাই হবে। ইতোমধ্যেই আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজনদের প্রার্থী হতে নিষেধ করেছেন দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় কোন্দল নিরসন এবং নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে দায়িত্বশীল নেতাদের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হওয়া গেছে।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ছেলে, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের শ্যালক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের ভাগ্নেকে নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার জন্য ফোন করে দলের হাইকমান্ড থেকে জানানো হয়েছে। পরক্ষণেই এটাও আমরা লক্ষ্য করেছি যে, সংশ্লিষ্টদের কেউ কেই তাদের আত্মীয়কে ভোটে প্রার্থী না হতে বলেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো চূড়ান্ত সমাধান নয়। এমপি-মন্ত্রীদেও আত্মীয়-পরিজন নিজ যোগ্যতাতেই দলীয় পদ-পদবি পেতে পারেন। অথবা তারা নির্বাচনের জন্য যোগ্য হতে পারেন। কিন্তু প্রভাবশালী আত্মীয়ের প্রভাবমুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি ভোট বর্জন করায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকায় অনেকের অর্থবিত্তের পরিমাণ বাড়ায় অনেকেই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে চান। এখন যারা অর্থবিত্ত কিংবা সম্পদশালী তাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দলের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সখ্য বাড়িয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কেউ কেউ প্রার্থী হিসেবে ফেভার পাচ্ছেন। সম্প্রতি সাধারণত লক্ষ্য করা যাচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা প্রভাব বিস্তার করার জন্য নানা মেকানিজম করে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, প্রকৃত নিবেদিত নেতা যারা তারা অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচিত হতে পারেন না। অর্থনৈতিকভাবে এবং পেশিশক্তিতে বলিয়ানরাই নির্বাচিত হয়ে আসে। কারণ তারা মাঠ পর্যায়ে অনৈতিকভাবে মেকানিজম প্রয়োগ করে ভোট তাদের নিজেদের ফেভারে নিয়ে আসতে পারে।

রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ক্ষমতা পাশাপাশি অবস্থান করায় শক্ত প্রতিপক্ষ ক্রমেই দুর্বল হওয়ায় নিজের দলের মধ্যে দ্ব›দ্ব, সংঘাত ও কোন্দলের মাত্রাও বেড়েছে যথেষ্ট। বিশেষ করে একই ব্যক্তি বারবার সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় এবং দলের অন্যান্য নিবেদিত বঞ্চিত হওয়ায় এ ধরনের প্রতিযোগিতার মাত্রা বেড়েছে। জাতীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজ অঙ্গ সংগঠনগুলোতেও এমন প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ কথা বলার অবকাশ নেই যে, সরকার পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে রয়েছে। সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য-বিবৃতি, কার্যক্রম এবং অর্জন আত্মবিশ্বাসের বিষয়টি প্রমাণ করছে বারবার। তবে একদিকে যেমন আত্মবিশ্বাস বাড়ছে অন্যদিকে নিজেদেরকে যথাযথভাবে মজবুত করতে না পারার দীর্ঘশ্বাসও দীর্ঘ হচ্ছে। দলের অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা সচেতন মহলকেও যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে। সঙ্গত কারণেই আগামী দিনগুলোতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির মাঠে নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ানোর শঙ্কা তৈরি করেছে।

আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে এবং জাতি হিসেবে নিজেদেরকে এগিয়ে নিতে হলে বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার বিকল্প নেই। আর এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন হবে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে উপযুক্ত পদ্ধতি গ্রহণ করা। পদ্ধতিই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাবে। আর মানসিকতার পরিবর্তন হলেই আচরণ বদলাবে এবং আচরণ বদলালেই রাজনীতিতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহযোগিতাভিত্তিক সংস্কৃতি সৃষ্টির পথ প্রশস্ত হবে, ঘৃণাবোধের অবসান ঘটবে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনীতিতে প্রতিহিংসাপরায়নতা ও ঘৃণাবোধের পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন যে, চোখের বদলে চোখ নিলে সারা পৃথিবী অন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে একটি বিষয় খুব সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ক্ষমতায় থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতা এবং ক্ষমতায় না থাকলে তাদের মানসিকতা স্ববিরোধী আচরণের শামিল। রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ গুণগত পরিবর্তন মোটামুটিভাবে আমাদের একটি জাতীয় অঙ্গীকার ও সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। সাধারণ জনগণও মনে-প্রাণে তা চায়। কিন্তু তা সত্তে¡ও সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে ঘৃণা বা প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করার কোনো উদ্যোগই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং মনে হয় যে, মাননীয় সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে সকল নেতা-কর্মী দলীয় প্রধানকে খুশি করার জন্যই যেন এমন অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন। গোটা জাতি আজ এমন অশুভ প্রতিযোগিতায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যারা যান, তারা রাতারাতি রাষ্ট্রের সবকিছুর ‘মালিক’ বনে যান। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে শুরু করে বাস টার্মিনাল পর্যন্ত সবকিছুই দখলে নিয়ে নেন। আর এগুলো অনেক ক্ষেত্রে তারা কর্মী-সমর্থক ও আপনজনদের মধ্যে ফায়দা হিসেবে বিতরণ করেন। এভাবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের ধারক-বাহক না হয়ে বহুলাংশে সিন্ডিকেটের রূপ ধারণ করে। একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই দলের প্রয়োজন হয়। দলের সৃষ্টি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে সুনির্দিষ্ট আদর্শ বা কর্মসূচি বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিজেদের সমর্থকদের মধ্যে বিতরণ নয়। তাই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দলবাজি এবং ফায়দাবাজির কোনো অবকাশ নেই। কারণ রাষ্ট্রের সব সম্পদের মালিক জনগণ এবং সরকারের দায়িত্ব ‘রাগ বা বিরাগের বশবর্তী’ না হয়ে দল-মত নির্বিশেষে নাগরিকদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা। ক্ষমতাসীনরা অনেকক্ষেত্রেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি-দুবৃর্ত্তায়নে লিপ্ত হয়ে পার পেয়ে যান। রাজনীতিকে যারা জনকল্যাণের পরিবর্তে ব্যবসায়িক হাতিয়ারে পরিণত করেছেন, তাদের করাল গ্রাস থেকে রাজনীতিকে মুক্ত না করতে পারলে এর বিপরীতে অগণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতায়ন আসবে। যা ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন হবে রাজনীতিবিদদের সর্বক্ষেত্রে নৈতিক আচরণ। নৈতিকতা বিবর্জিত রাজনীতি ভণ্ডামির শামিল। রাজনীতিতে অনৈতিকতার অবসান ঘটলেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলের পথ সুগম হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের জন্য একই সঙ্গে প্রয়োজন হবে গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য উপযুক্ত ডিজাইন গ্রহণ করা। সে জন্য গণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ পদ্ধতি চালু হলে রাজনীতিতে জনগণের ক্ষমতায়নের যাত্রা শুরু হবে। পদ্ধতিই দুর্নীতিবাজ-দুবৃর্ত্তদেরকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিতাড়িত করবে। সে সঙ্গে রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা ও শিষ্টাচারসহ রাজনীতিতে অনৈতিকতার অবসান, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতিষ্ঠা পাবে। এখন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য আরও বেশি প্রয়োজন সময়োপযোগী বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা চালু করা।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন করা সকলের দায়িত্ব

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
হীরেন পণ্ডিত

নির্বাচন হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের মতামত প্রতিফলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন এবং প্রতিনিধির মাধ্যমেই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়ে থাকে। একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন নির্বাহী বিভাগসহ জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকায় মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ শান্তিতে বিশ্বাস করে, সংঘাতে নয়। সেই শান্তি বজায় রাখার জন্য যা যা করণীয় প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতে হবে।

আপনি কেন ভোট দেবেন? ভোট আপনার সংবিধানিক অধিকার, ভোট দিয়ে আপনার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা আপনার নাগরিক দায়িত্ব। আপনার পছন্দের প্রার্থী বেছে নিতে হবে, আপনার এলাকার উন্নয়নের জন্য নিবেদিত এমন প্রার্থী বাছাই করতে হবে। আপনার এলাকার উন্নয়নের জন্য আপনাকে সহযোগিতা করতে হবে। আপনার দায়িত্ব দেশের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত ও সুসংহত করা। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক প্রতিহত করতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। শান্তি ও উন্নয়নের পক্ষে ভোট দিয়ে আপনার স্বাধীনতা, আপনার নাগরিক অধিকার, আপনার ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উন্নয়নকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে সকলকেই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ অর্থাৎ আজ পর্যন্ত আমাদের দেশের উন্নয়ন ও জীবন মান উন্নত হয়েছে, উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সবার দায়িত্ব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে হত্যা ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বন্ধ করেছে। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়েছে। গণতন্ত্র সুরক্ষিত ও সুসংহত হয়েছে। আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার ভোটের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।

উন্নয়নের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ধারাও অব্যাহত রাখার প্রয়োজন রয়েছে। দেশে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একসঙ্গে চলে। সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি নির্বাহী বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব রয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সাংবিধানিক রীতি-নীতি ও বিধিবিধান অনুসরণ করে কমিশনকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

২০০৮ সালে নির্বাচনের পর থেকে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকায় মানুষের ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলবে। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে সরকার। অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে, পদ্মা সেতুর মতো সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করে সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না’, বাঙালিদের কেউ দাবায়া রাখতে পারেনি-পারবে না।'

২০০৮ সালে নির্বাচনের পর এই ২০২৪ সাল চলমান এই সময়ে দেশে একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজমান, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত বলেই আজকে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে, ভাতের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক ধারা নিশ্চিত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত আজকে আমাদের অগ্রগতি স্থিতিশীল পরিবেশের জন্যই সম্ভব হয়েছে, এ কথাটা সকলকে মনে রাখতে হবে। স্থিতিশীল শান্তিপূর্ণ পরিবেশই পারে একটি দেশকে উন্নয়নের ধারায় গতিশীল করতে এবং উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশ আজকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে জাতির পিতা আমাদের অন্তত একটা জায়গায় এনেছিলেন। আমরা সেখান আজকে উত্তরণ ঘটিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ, ২০২৬ সাল থেকে আমরা তা বাস্তবায়ন করব। আর ২০৪১ সালের মধ্যে এই বাংলাদেশ হবে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। আগামীর উদীয়মান অর্থনীতি ও বিশ্বরোল মডেলে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে উন্নয়নের গণতন্ত্র নামে নতুন যে শ্লোগান চালু হয়েছে তা অব্যাহত থাকবে।

গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন প্রতিনিধি নির্বাচন করে। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সমান ভোটাধিকার থাকে। খাদ্য-বস্ত্রসহ অন্য অধিকারগুলোর মতো ভোট দেয়ার অধিকারও এক ধরণের নাগরিক অধিকার। সবার ওপরের দিকের নাগরিক অধিকারগুলোর মধ্যে ভোট দেয়ার অধিকার অন্যতম। প্রত্যেক নাগরিক চায় ১৮ বছর হলে দেশ কার দ্বারা পরিচালিত হবে, আমি কার দ্বারা পরিচালিত হবো, আমার শহরটা, আমার এলাকাটা কার দ্বারা পরিচালিত হবে। ওরকম একটা জায়গা থেকে ভোটের অধিকারটা অনেক বড় একটা বিষয়।

ভোটের পুরো আয়োজনটাই ভোটারদের জন্য। প্রার্থীরা যখন নির্বাচনে অংশ নেন তখন ভোটারদের কাছেই ভোট চাইতে যান। এটাই নির্বাচনের মূল স্পিরিট। নির্বাচনের আইন অনুযায়ী, ভোটের দিন ভোটাররা কেন্দ্রে আসবেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা পরিচয় নিশ্চিত করার পর একজন ভোটার তার পছন্দের প্রার্থী বাছাই করতে ভোট দিবেন।

গত ১৫ বছরে পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, নতুন ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, টানেল, নতুন-নতুন রাস্তা, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য নিরলস চেষ্টা চলছে, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার লক্ষ্যে কাজ করছে, বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে প্রচেষ্টা চলছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করার জন্য কাজ চলছে এবং তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের চেহারা বদলে দিয়েছেন, তা একসময় ছিল অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় ছিলো। এবারের ১১টি খাতকে চিহ্নিত করে পরিবর্তন আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সেটি দেশবাসীকে নতুনভাবে আশান্বিত করেছে ও জনগণ সেই সফল পেতে শুরু করেছে।

বিশ্ব অর্থনীতি চারটি বড় চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, জলবায়ু পরিবর্তন, যুবদের কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিশ্বায়নের গ্রহণযোগ্য কাঠামোর অনুসন্ধান। নতুন সৃজনশীল কার্যকর সমাধানের পথ খুঁজে বের করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। জলবায়ু পরিবর্তন সবচেয়ে ভীতিকর অবস্থায় রয়েছে তা দূর করার জন্য কাজ করছে।

সামাজিক রূপান্তর ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সাহায্য করতে পারে, তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিকদের জন্য ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিও গুরুত্বপূর্ণ। বেশি বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য কাজ চলছে। দুর্নীতি ও সুশাসনকেও বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, কর্মযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন, লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষিব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা, সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ,

সাম্প্রদায়িকতা ও সব ধরনের সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ রোধ করা এবং সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানোর জন্য সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগুলো সবার প্রশংসা লাভ করেছে।

দুর্নীতি এখনো বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু সরকার এ অঙ্গীকার পূরণকে খুব একটা সফলতার মুখ দেখেনি। তবে ২০২৪ এর নির্বাচনে জয়লাভের পর দুর্নীতি বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। বিশ্বব্যাপী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি ও ডলার-জ্বালানিসংকটে জনজীবন বিপর্যস্ত। রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধসহ নানামুখী সমস্যায় বৈশ্বিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা পর্যুদস্ত। এ সংকট খুব শিগগিরই দূরীভূত হওয়ার নয়।

দেশের অর্থনীতিকে মোটামুটি সচল রাখা পোশাকশিল্পেও নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে দেখা যায়। কতিপয় সুযোগসন্ধানী অনাকাক্সিক্ষত কর্মকান্ড চালানোর চেষ্টা করেছে। একের পর এক হরতাল-অবরোধে পণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় একসঙ্গে যতগুলো সংকট এসেছে, তা অতীতে কখনো মোকাবিলা করতে হয়নি। সেটারই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের ওপর। বাইরের এ ধরনের সংকট এলে আমরা ঠেকাতে পারব না। আমরা কোনো রকম রাজনৈতিক অস্থিরতা চাই না, হরতাল-অবরোধ চাই না। এসব করে অর্থনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করা হয়েছে। কাজেই দেশের স্বার্থে, শিল্পের স্বার্থে সংকটগুলো সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

নির্বাচনের পর নতুন সরকারকে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে তা না হলে রিজার্ভ-রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ছাড়াও রাজস্ব ও ব্যাংক খাত নিয়ে যে ভয়াবহ উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন হবে। অর্থনীতিকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসাই হবে নতুন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।

দ্রব্যমূল্য, মুদ্রার বিনিময় হার এবং ব্যাংকঋণের সুদের হার নিয়ে কাজ করতে হবে। কিছু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের ব্যাংক বা অন্য কোনো খাতে যেন কাঠামোগত সংকট দেখা না দেয় এবং বৈদেশিক দায়দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রেও যেন কোনো সমস্যা তৈরি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

সরকার আইএমএফ ও অন্য দাতাদের কাছ থেকে যেসব সংস্কারের শর্তে ঋণ পাচ্ছে, নির্বাচনের পর সেগুলো বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো ব্যাপারে শঙ্কা তৈরি হতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়। বড় ধরনের কোনো সংস্কার ছাড়া অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হবে। কাজেই অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে হলে বেশ কিছু নতুন পদক্ষেপ প্রয়োজন, তার ওপরই অর্থনীতির সংকট উত্তরণ নির্ভর করবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন।

আমাদের মানসম্মত ও কারিগরী শিক্ষার ওপর নজর দিতে হবে। শিক্ষা শেষ করে লাখ লাখ তরুণ দক্ষতার অভাবের কারণে চাকরি খুঁজে পায় না। দেশের অভ্যন্তরে যেমন শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, প্রবাসেও বাংলাদেশ থেকে দক্ষ প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন জনসম্পদের চাহিদা রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে শৃঙ্খলা, ব্যবস্থাপনা, দক্ষ ও মেধাবী প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।

আমাদের কৃষিব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে বহুমুখী ফসল উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণনব্যবস্থা, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং আধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োগ করেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। কৃষিব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে বাজারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে।

সংকট দূর করে উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে অনুকূল পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ও সহিষ্ণুতা না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনো টেকসই হয় না। নানা ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে সচল রাখতে হলে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সুশাসন দরকার। যেকোনো সমস্যা সমাধানে যৌক্তিক আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতায় দল-মতনির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিককে নিজের অবস্থান থেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতার পাশাপাশি জনমত গঠন জরুরি। সব অপতৎপরতা
প্রতিরোধ করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দেশ গঠনে মনোযোগ দিতে হবে।

বাংলাদেশকে শুধু তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরশীল না থেকে শিল্পের বহুমুখীকরণের দিকে এখনই গুরুত্ব দিতে হবে এবং রপ্তানী বহুমুখী করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন তৈরি করেছেন। সেগুলোকে কীভাবে কাজে লাগানো, বিদেশি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করা ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা যায়, সে বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় অংশীজনদের সঙ্গে কাজ করতে পারে। আমাদের সমাজে দুর্নীতি নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজে যোগ্য মেধাবী, দক্ষ ও অভিজ্ঞরা ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সব ধরনের প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, সেবা, পরিষেবায় স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক


আর কত সালমান আজাদীর সড়কে ঘটবে প্রয়াণ?

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আমিরুল ইসলাম বাপন

বেঁচে থাকার চেয়ে বড় কোনো সাফল্য নেই। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার এই সাফল্যের পেছনে ছুটে ছুটে যেতে হয় নানা জায়গায়, চড়তে হয় গাড়িতে। তাতে কখনো স্বপ্রাণে ফেরা হয় কখনোবা প্রাণহীন নিথর দেহ ফেরে বাড়িতে। প্রাণহানি আর লাশ টানাটানির আহাজারিতে কান্নায় ফেটে পড়া স্বজনের করার থাকে না কিছুই। কখনো করার থাকলেও তা হয় নির্লাভ শ্রম ও সময়ব্যয়; কিন্তু যাদের করার আছে বা করার থাকে, তাদের উদ্বেগহীন ও নিষ্ক্রিয়তায় ঝরতে থাকা এসব অকাল প্রয়াণের দায় কার?

জীবন কেড়ে নেওয়া এমনই এক মরনফাঁদে পরিণত হওয়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। প্রায় প্রতি মাসেই একাধিক দুর্ঘটনায় আহত-নিহতের সংখ্যায় ভারি হয়ে আছে খবরের কাগজ। কদিন পরপরই পত্রিকার পাতায় কিংবা ফেইসবুকের নিউজফিড স্ক্রলে সামনে ভেসে আসা এমন খবরে আঁতকে উঠতে হয়। স্বজন হারানোর উৎকণ্ঠায় এমন খবর পড়া কিংবা ছবি খোঁজার ঘটনা সত্যিই হৃদয়বিদারক।

যেমনভাবে সেদিন হঠাৎ করেই ফেসবুকের নিউজফিডে চোখ আটকে থ-খেয়ে যেতে হলো। ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে বের হওয়া নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংগীতশিল্পী সালমান আজাদী ময়মনসিংহ পৌঁছালেও ছিল না দেহে প্রাণ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মৃত ঘোষণার খবরে স্বজন-প্রিয়জনের আহত কণ্ঠে বাজে কান্নার গান। এভাবে আর কত সালমান আজাদীর সড়কে ঘটবে প্রয়াণ?

যার যায় চিরতরেই যায় কিংবা থাকলেও হয় চির ভোগান্তির কারণ। জীবন, পরিবার ও সমাজকে দুর্বিষহ করে নেমে আসা এসব বিপর্যয় আত্মীয়-স্বজনসহ পুরো পরিবারের বুকে শেলের মতো বিঁধে থাকে আজীবন, যেই শোকের জীবনব্যাপী স্মৃতিচারণ মৃত্যুর চেয়েও মারে অধিক মারণ। আর মৃত্যু খেয়ে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্বকে ধারণ করে বাঁচার বিরুদ্ধে লড়তে হয় আমরণ ।

কর্মক্ষম ব্যক্তির পঙ্গুত্বে বা হারানোর শোকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পরিবার হেরে গিয়েও অভাবকে রুখতে দাঁড়ায়, কিন্তু এ দাঁড়ানোয় কতটুকুই রুখতে পারে আর? ভাগ্যের চাকায় ধাক্কা খেয়ে খেয়ে কোনোভাবে এগোয় এসব দুর্ভিক্ষের সংসার। এ রকম কোনো অসহায় পরিবার কখনো কোথাও ঠাঁই পায় কি না সে খবর জানা থাকে না কারোর। ঠাঁই না পেলেইবা কি আসে যায় কার; কিন্তু যায়, দেশ হারায় জাতির কোনো সম্ভাবনাময় কর্ণধার।

সড়ক দুর্ঘটনায় রাষ্ট্রিক ক্ষতির পরিমাণও কি সামান্য? দেখা যায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পৌঁছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকায়। এমন দুর্ঘটনার প্রভাবে দেশ বছরে জিডিপির ২-৩ শতাংশ হারায়। এরপরেও কিভাবে রোধের চেয়ে এসব দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়? কারণ সড়ক দুর্ঘটনা রোধের নেই কোনো যথাযথ ব্যবস্থা বা কার্যকর উপায়।

ঢাকা-ময়মনসিংহ ১২০ কিলোমিটার দূরত্বের এই মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলো হচ্ছে শিকারিকান্দা, কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সীমানা, বইলর বাজারের পূর্বাংশ, ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে, ত্রিশাল জিরো পয়েন্ট, চেলের ঘাট, ভরাডোবা, ভালুকা ডিগ্রি কলেজের সামনের ইউটার্ন ও ভালুকা পল্লি বিদ্যুৎ অফিসের সামনের অংশ। এসব এলাকায় গাড়ির গতি সব সময় সীমিত রাখার নির্দেশনা থাকলেও চালকে না মানায় নিয়ম করেই ঘটে চলছে দুর্ঘটনা।

মহাসড়কে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার অবৈধ যানের অবাধ চলাচলকেই এই মরণফাঁদ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটানো গাড়িগুলো হচ্ছে সিএনজি-ট্রাক-বাস, অটোরিকশা-ট্রাক-বাস, মোটরসাইকেল-ট্রাক-বাস, কাভার্ডভ্যান-ট্রাক-বাস।

কাভার্ডভ্যান, সিএনজি, অটো রিকশার বেপরোয়া গতিতে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে চাওয়ার কারণেই ঘটছে এসব দুর্ঘটনা, যার জন্য দায়ী বেগতিক চালক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহ বিভাগে মোট ৬৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬১ জন নিহত ও ৮১ জন আহতের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে মোটরযান, কাভার্ডভ্যান এবং অটো-রিকশা দুর্ঘটনা ও এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা।

এখনই সজাগ না হলে, উপযোগী ব্যবস্থা না নিলে এসব দুর্ঘটনা ও ক্ষতির পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। যা শুধু ব্যক্তি, পরিবার কিংবা নির্দিষ্ট কোনো এলাকার জন্যই হুমকি নয় বরং গোটা রাষ্ট্রের জন্যও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ। কাজেই কর্তা ব্যক্তিদের টনক নড়ার শেষ সময় এখনই বয়ে যায়।

এসব সমস্যার সমাধানকল্পে শঙ্কাজনক জায়গাগুলোতে সার্বক্ষণিক তদারকি ও পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করা, নিয়মনীতিহীনভাবে চলা গাড়িগুলোকে নিয়মের আওতায় আনা, তিন চাকার অবৈধ যান চলাচল বন্ধ করা, গতি নিয়ন্ত্রণ করানো ও অতিরিক্ত মাল বহন রোধ করা জরুরি। আয় বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় চালকের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি না করে পরিবহণ মালিকরাও এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। চালক যাতে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে বাড়তি ট্রিপ দিতে যেয়ে দুর্ঘটনা না ঘটায় সে জন্য তারা কড়া সতর্কতা দিতে পারেন। পরিবহন মালিক, পুলিশবাহিনীসহ সবার অধিক তৎপরতায় রোধ করা যেতে পারে এসব সড়ক দুর্ঘটনা, নিরাপদ হতে পারে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে চলাচলকারীদের যাত্রা। আর তাতেই বাঁচবে অজস্র প্রাণ।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়


আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে জোর দিতে হবে উৎপাদনে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্যে তাজা সবজির চরম সংকট দেখা দিয়েছে এমন খবর আলোড়ন তুলেছিল। তবে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ানে’র বরাতে যে প্রতিবেদনের কথা বলা হয়েছিল, পরবর্তীতে তারাই বলছে, এ রকম কোনো প্রতিবেদন তারা ছাপেনি। হয়তো এই ঘটনা পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত থাকতে পারে। আসলে, যুক্তরাজ্যে এ ঘটনা কাল্পনিক আকারে আমি আমার দেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু।

একবার ভাবুন, আপনার সঙ্গে অনেক টাকা। আদরের সন্তান আবদার করল বাজারে গিয়ে টাটকা শাক-সবজি কিনে আনবে। সন্তানকে নিয়ে গেলেন বাজার করতে; কিন্তু একি, বাজারে গিয়ে দেখলেন কিছুই নাই। চাহিদামতো সবজি কিনতে পারছেন না। এমনকি মিলছে না তিনটির বেশি টমেটো। শুধু সবজিই নয়- আলু, পেঁয়াজ কিংবা ডিমেও দেখা দিয়েছে হাহাকার। বর্ণিত প্রেক্ষাপট কাল্পনিক বাস্তবতা। হয়তো সে দুর্দিন এখনো আমাদের আসেনি। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে-এমন পরিস্থিতি এসেও যেতে পারে। এখন বলি এতসব নাটকীয় প্রারম্ভিকতার কারণটুকু কি।

এখন বৈশাখ মাস। প্রচণ্ড গরম। ফুলকপি বা বাঁধাকপির মতো সবজি এখন বাজারে দেখলে কেউ চমকে ওঠে না। কারণ, চলতি বছর শীত গেছে; কিন্তু বাজার থেকে যায়নি এই সবজিটি। টমেটোর নাম তো মৌসুমি সবজির খাতা থেকে উঠে গেছে গত কয়েক বছরে। কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণা আর মাঠপর্যায়ে চাষিদের পরিশ্রম। সঙ্গে ঝুঁকি গ্রহণের ইচ্ছার সুফল এটি। তাপসহিষ্ণু শীতকালীন সবজির উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরাই। এ জন্য শীতের সবজি সারা বছর পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া কৃষি বিজ্ঞানীদের উচ্চফলনশীল ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু নতুন নতুন জাত আর প্রযুক্তির উদ্ভাবন ফলে খাদ্যশস্য, সবজি ও ফল উৎপাদনে বৈচিত্র্য এসেছে। ফসল উৎপাদনে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে।

শুধু অগ্রগতি হয়নি, আমরা বিশ্বে মাছ, আলু, পেঁয়াজ, শাক-সবজিসহ ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে আছি শীর্ষ দশে; কিন্তু প্রশ্ন- সরবরাহ বাড়লে, পণ্য উদ্বৃত্ত হলে স্বাভাবিকভাবেই এসবের দাম কম হওয়ার কথা। স্বস্তি পাওয়ার কথা সাধারণ মানুষের। কিন্তু দৃশ্যত দেখা যাচ্ছে উৎপাদন বৃদ্ধি, সরবরাহ বৃদ্ধি ও উদ্বৃত্তের কোনো সুবিধা আমরা পাচ্ছি না। আমাদের সবচেয়ে উদ্বৃত্তের ফসল হচ্ছে আলু। উৎপাদন মৌসুম শেষ হতে না হতেই এবার আলুর বাজার চড়া, ভারত থেকেও আসছে আলু। তবুও ঈদের ছুটিতে সরবরাহ কমের অজুহাতে ফের চড়তে শুরু করেছে আলুর বাজার; খুচরায় প্রতি কেজির দাম উঠেছে ৬০ টাকায়। পাশাপাশি সরবরাহ ঠিক থাকলেও খুচরা বাজারে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে ক্রেতার এসব পণ্য কিনতে বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। তবে কি আমদানিকারক, পাইকারি ব্যবসায়ী, ফড়িয়া-দালাল ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সব সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে?

এক সময় আমরা চাল, আলু রপ্তানির গল্প শুনতাম। আর এখন রপ্তানি রপ্তানি বলে আমরা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছি। এমন অবস্থায় চাল, গম, চিনি, তেল, আটা, রসুন, ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিপত্রের জন্য আমরাও আমদানিনির্ভর। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার গত ২৩ ডিসেম্বরের ঘোষণা অনুসারে বিশ্বে খাদ্য আমদানিতে বাংলাদেশ তৃতীয় শীর্ষ দেশ।

এটা ঠিক যে, কোনো একক দেশের পক্ষে তার সব প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন করা সম্ভব নয়। বাবা-দাদার মুখে শুনতাম স্বনির্ভর কৃষকের গল্প। সে স্বনির্ভর কৃষকও দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে- যিনি এক সময় তার প্রয়োজনীয় সবকিছু নিজে উৎপাদন করতেন। দেশগুলোও তেমনি। তারা এখন আমদানি-রপ্তানি করে পরস্পরের প্রয়োজন মেটায়। এটা এমন এক বাস্তবতা, যুদ্ধের মধ্যেও বাণিজ্য চলে। ইউক্রেনে যুদ্ধ হচ্ছে; আবার সেখান থেকে পণ্যসামগ্রী রপ্তানি অব্যাহত আছে, বিশেষত কৃষিপণ্য। মূলত ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সরকার যেকোনো পণ্য আমদানি কিংবা রপ্তানি করে থাকে। যখন স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদনে ঘাটতি হয়, তখন সরবরাহ কমে আসায় সে পণ্যের মূল্য বাড়ে। তখন সরকার ভোক্তার স্বার্থে সে পণ্য আমদানি করে। আর অর্থনীতির সূত্রই হচ্ছে, পণ্যের সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে, আবার সরবরাহ বাড়লে দাম কমে। কিন্তু আমদানির পরও যে তা দামের ওপরে সব সময় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, সে কথাও বলা যাচ্ছে না।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী চলতি বছর দেশে ১ কোটি ৪ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। বাংলাদেশের চাহিদা ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। অন্যদিকে পেঁয়াজের উৎপাদন বছরে সাড়ে ৩৬ লাখ টন, চাহিদা ২৫ লাখ টন। সে ক্ষেত্রে আলু এবং পেঁয়াজের চাহিদা স্থানীয়ভাবে মিটিয়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমদানি হচ্ছে। আমদানি করা হচ্ছে ভরা মৌসুমে। এ অবস্থায় আলু এবং পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করার ফলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এটাই স্বাভাবিক।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অধ্যাপকের কাছ থেকে শুনেছি, জাপানে চালের দাম তুলনামূলকভাবে একটু বেশিই। চালের দামের ব্যাপারে সে দেশের একজন মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনারা বাইরে থেকে কম মূল্যে কেন চাল আমদানি করেন না এবং কৃষকদের কাছ থেকে অনেক বেশি মূল্যে ক্রয় করতে হচ্ছে কেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, বাইরে থেকে চাল আমদানি করলে অবশ্যই অনেক কমে চাল পাওয়া যাবে। তখন তাকে আবার প্রশ্ন করা হয়েছিল তাহলে কেন আমদানি করছেন না? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, আমাদের দেশের সবদিকে সমুদ্র। যুদ্ধসহ যেকোনো দুর্যোগে আমরা বিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারি এবং তখন আমরা বাইরে থেকে চাল আমদানি করতে পারব না। তাই আমাদের দেশের কৃষকদের বাঁচাতে হবে এবং যুদ্ধের কারণে যদি বহির্বিশ্ব থেকে জাপানে খাবার আমদানি বন্ধ হয়ে যায় তখন কী আমরা টয়োটা গাড়ি খেতে থাকব?

উন্নয়নশীল বিশ্বের এমন অনেক দেশ আছে যারা কেবল তাদের দেশের কৃষককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, তাদের কৃষি পেশা থেকে বিমুখ না হওয়ার জন্য নানাবিদ প্রণোদনা দিয়ে থাকে। দেশি কৃষক যেন কৃষি পেশাতে সম্মানের সঙ্গে থাকতে পারেন সে জন্য তারা আমদানি পণ্যের সস্তা মূল্য পাওয়া সত্যেও আমদানি করে না। বাজারব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য প্রান্তিক কৃষকের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বাজারে এনে বিক্রি করার ব্যবস্থা করে দেয় সরকার। কৃষককে তার উৎপাদন, শ্রম আর লভ্যাংশের প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দিয়ে তবেই সে পণ্যের বাজারদর নির্ধারণ করে। তবে এটা ঠিক- বর্তমানে কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কৃষিঋণ, কৃষিপ্রণোদনা, প্রশিক্ষণ, ফসল বিমাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা প্রদান করছে। সেই সঙ্গে কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে এনজিও এবং বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। তারপরেও কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোনো পরিবর্তন আসছে না বলে আমি মনে করছি। এর কারণ হচ্ছে- কৃষকরা এসব সুবিধা ঠিকমতো পাচ্ছেন না। আর এ পেশাটাই তাদের কাছে অলাভজনক হয়ে উঠছে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না উপরিউক্ত সেই কাল্পনিক বাস্তবতার কথা। যেখানে, কৃষি ও কৃষকের অস্থিত্ব বিলীন মানেই হলো আমাদেরই অস্থিত্ব সংকট। তাই বাজার চাহিদানুযায়ী কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও লাভজনক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে করণীয় বিষয়গুলো: প্রথমত বাজার চাহিদা অনুযায়ী ফসল নির্বাচন করতে হবে। সেই সঙ্গে জমি এবং আবহাওয়া নির্বাচিত ফসলের উপযোগী কি না তা অবশ্যই যাচাই করতে হবে। ফসল নির্বাচনে মাটির উর্বরতার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে মাটির উর্বরতা উন্নয়নে ফসল ধারায় একই ফসল বারবার চাষ না করে শস্যপর্যায় অবলম্বন করতে হবে এবং বছরে জমিতে কমপক্ষে একটি শিমজাতীয় ফসল যেমন- ডালজাতীয় ফসল (মসুর, ছোলা, খেসারি, মুগ এবং মাষকলাই ইত্যাদি), শিম এবং বাদাম ইত্যাদি চাষ করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় কোনো একটি ফসল চাষে বেশি লাভ হলে সবাই মিলে ওই ফসলের চাষ শুরু করে, ফলে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বাজারমূল্য কমে যায়। তখন সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ওই ফসল চাষ থেকে বিরত থাকে। ফলে পরবর্তীতে বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারমূল্য বেড়ে যায়। ফসল চাষে এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো- কৃষকদের তাদের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে। ফসলের মাঠ কেটে পুকুর করা বন্ধ করতে হবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সব খাল ও নদী উদ্ধার করে সচল করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কৃষিই বাংলাদেশের শেকড় এবং শেকড়কে ভুলে গেলে পতন অনিবার্য। আমদানিনির্ভর খাদ্যনীতি থেকে বের হতে প্রয়োজন কমপক্ষে ১০ বছরমেয়াদি উপযুক্ত পরিকল্পনা!

আসুন- কৃষি, কৃষক আর কৃষি পেশাকে দেখি এক অনন্য উচ্চতায়। কেননা, এ দেশের কৃষি আর কৃষক বাঁচলেই কেবল বেঁচে থাকতে পারব আমি আপনি, আমরা সবাই। স্বপ্নে বোনা ফসলের খেতে, রাগ, দুঃখ আর অভিমানে সেই স্বপ্ন নিজের হাতেই জ্বালিয়ে দিয়ে সে কৃষকের আর্তনাদ আমরা আর দেখতে চাই না। নচেৎ, এই লজ্জা আমাদের সকলের, এই ব্যর্থতা এ জাতির প্রতিটি সন্তানের।

২০১৪ সালে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ করে দেয়। আর সেটাই হয়েছে বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। এখন বাংলাদেশ গবাদিপশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। আমি মনে করি আমদানি কমিয়ে উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম, উপ-পরিচালক (শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)


banner close