মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর ২০২৫
২১ আশ্বিন ১৪৩২

আলোর পথযাত্রী কমরেড পঙ্কজ

পঙ্কজ ভট্টাচার্য
আপডেটেড
১ মে, ২০২৩ ১০:০৮
হাবীব ইমন
প্রকাশিত
হাবীব ইমন
প্রকাশিত : ১ মে, ২০২৩ ০৯:৪১

গত শতাব্দীর ষাটের দশক হচ্ছে ইতিহাসের একটি হিরণ্ময় সময়খণ্ড। সে সময় কিছু তরুণ ছাত্র-রাজনৈতিক কর্মীর উত্থান ঘটে, যাদের শরীরজুড়ে ছিল মাটির গন্ধ। দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি শর্তহীন ভালোবাসা দিয়ে রচনা করেছিল মানব মুক্তির সংগ্রাম। তাদের একজন হলেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য- চলে গেলেন আপামরের পঙ্কজদা। ৮৪ বছরের একটি উজ্জ্বল কর্মময় জীবনে নেমে এল যবনিকা, শেষ হলো বামপন্থা আন্দোলনের একটি অংশের গৌরব অধ্যায়। পঙ্কজ ভট্টাচায ছিলেন গণতন্ত্রের পক্ষের মেরুদণ্ডধারী শেষ ব্যক্তিদের অন্যতম- দুঃসহ দুঃখ-জ্বরা-কষ্টকে জয় করা সেই ব্যক্তিপুরুষ, যাদের আদর্শ চিরকাল অনুসরণযোগ্য।

জীবনের প্রথম ৯ বছর ব্রিটিশ শাসনামলে, ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসনামলে আর ৫২ বছর বাংলাদেশে কেটেছে তার। পঙ্কজ ভট্টাচার্যের জন্ম চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে। যেখানে ক্ষণজন্মা পুরুষ অগ্নিযুগের বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনেরও জন্ম। পঙ্কজদার জন্মের পরও নোয়াপাড়া ছিল রাজনীতির একটি উজ্জ্বল পীঠস্থান। তাদের পরিবারও ছিল না এর বাইরে। ফলে আমরা দেখি, পঙ্কজদার জীবন তার স্কুলজীবন থেকেই রাজনীতিমনস্ক হয়ে ওঠে। অচিরেই সেই রাজনীতিমনস্কতা তাকে সক্রিয় করে তোলে। ১৯৫৪ সাল থেকে জড়িয়ে পড়েন তিনি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে। পাকিস্তানের দুঃসহ রাজনৈতিক পরিবেশে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মী হিসেবে তার যে রাজনৈতিক জীবনের উত্থান, সেই জীবনের পথচলা কোনোক্রমেই সহজ ছিল না।

তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেছেন চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। সেই কৈশোরে ১৯৫৭ সালে ছাত্র আন্দোলনের কারণে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলন এবং পরবর্তী সময় ৬ ও ১১ দফা গণ-আন্দোলনের সংগঠক ছিলেন তিনি। ১৯৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধেরও অন্যতম সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ন্যাপের জাতীয় সম্মেলনে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। দুই যুগ তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন গণফোরামেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। পরে ঐক্য ন্যাপ গঠন করে আমৃত্যু তার দায়িত্বে ছিলেন।

প্রগতিশীল ইসলামী রাজনীতিবিদ ও কর্মী থেকে শত গুণ প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়েছেন, শুনতে হয়েছে গালি, নিতে হয়েছে অপবাদের বোঝা। বৈচিত্র্যে ভরা তার জীবন। ছিলেন পেশাদার রাজনীতিবিদ। কিছুদিন চাকরি করলেও তাও ছিল রাজনীতির স্বার্থে। ফিরে এসেছিলেন আবার পেশাদার রাজনীতিতে। সব সময় পুলিশের নজরে থাকতে হয়েছে, জেল খাটতে হয়েছে বারবার, যেতে হয়েছে আত্মগোপনে। ভয়ভীতি, নির্যাতন ও প্রলোভন তাকে টলাতে পারেনি।

প্রথম দিকে রাজনীতিতে তার আগ্রহ ছিল না। তার লেখা ‘আমার সেই সব দিন’ বইয়ে উল্লেখ করেন- ‘সত্যি বলতে কি, প্রথম দিকে রাজনীতিতে তেমন আগ্রহ ছিল না। একটু মানবতাবাদী মনোভাব, একটু পরোপকার করা- এই মনোভাব ছিল বেশি।’ ১৯৫৮ সালে কলেজে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পরই সেনাশাসক আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন। তখন তিনি ছাত্র ইউনিয়নের গোপন কাজে যুক্ত হন। পরবর্তীতে ছাত্র ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন।

নিজের জীবনের নানা বিষয় নিয়ে তার আত্মজীবনী বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “আমার বাবার নাম প্রফুল্ল ভট্টাচার্য, তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্বর্ণপদকসহ এমএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। তার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। পিতার আদেশ প্রফুল্ল ভট্টাচার্য তার শিক্ষক প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পায়ের কাছে নিজের কৃতিত্বের স্বর্ণপদকটি রেখে আশীর্বাদ কামনা করেন। প্রফুল্লচন্দ্র তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি কী হতে চাও?’ উত্তরে তার বাবা বলেছিলেন, বন্ধুরা বলেছিলেন, আমাকে আইসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। প্রিয় শিক্ষক প্রফুল্লচন্দ্র নিজের পায়ের খড়ম তুলে তিরস্কার করে বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশের পা-চাটা ও গোলাম হওয়ার জন্য তো আমি তোমাকে শিক্ষা দিইনি। শিক্ষকতা করে তুমি হাজার হাজার ছাত্রকে শিক্ষিত দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোল।... বাবা তার কথা শুনে সরকারের আরাম ও সম্মান-মর্যাদার চাকরির সুযোগ ছেড়ে শিক্ষকের আর্থিক কষ্টের জীবনই বেছে নিয়েছিলেন।” কর্তব্য আর কষ্ট যে হাত ধরাধরি করেই চলে এই শিক্ষা তিনি বাবার জীবন-সংগ্রাম দেখে শিখেছিলেন আর মায়ের জীবন থেকে শিখে নিয়েছিলেন নীরব দায়িত্ব পালনের দায়।

বাবার জীবন তাকে নিজের জীবন ও মানুষের জীবনযাত্রা দেখতে নতুন দৃষ্টি দিয়েছিল। তাই দীক্ষা নিয়েছিলেন দেশের মুক্তি আর মানুষের মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার। কৈশোরে প্রতিবাদের যে সূচনা করেছিলেন আজীবন সেই পথেই তিনি ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে জীবনে চারবার কারাবরণ করেছেন। তার বিরুদ্ধে ‘স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করা হয়েছিল। এক জেল থেকে আরেক জেলে পাঠানো হতো তাকে। তিনি তার নিজের কথায় বলেছেন, ‘আমার যাপিত জীবনের একটি বড় সময় কেটেছে আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলার কাজে। নিজের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি যাতায়াতের মতো বারবার কারাগারে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। এই রুটিনের বাইরে আত্মগোপনেও থাকতে হয়েছে। এই বিপৎসংকুল দিনযাপনের মধ্যেও অব্যাহত রাখতে হয়েছে দলীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার অভ্যাস।’

ব্রিটিশ গেল, পাকিস্তান গেল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো- পঙ্কজ ভট্টাচার্যের জীবন থেকে বিপদের ছায়া গেল না। সে ছায়া কখনো হালকা হয়েছে, কখনো ঘন আঁধারে পরিণত হয়েছে; পুরোপুরি সরে যায়নি কখনো। এর কারণ তার সমাজ পরিবর্তনের রাজনৈতিক দর্শন।

পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক পরিবেশে ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে পরিবার যখন ভারতে চলে যাচ্ছে, তখন তিনি জেলে। ‘আমার সেই সব দিন’- এ ওই সময়ের এক করুণ ঘটনা আমরা দেখতে পাই। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, “চট্টগ্রাম কারাগার থেকে আমাকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়ার দিন যথারীতি পুলিশবেষ্টিত হয়ে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে পৌঁছালাম। ঢাকাগামী গ্রীণঅ্যারো ট্রেনটি তখন সেখানে অপেক্ষারত। দ্বিতীয় শ্রেণির কম্পার্টমেন্টে ওঠার আগে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছি। হঠাৎ বিপরীত দিকের চাঁদপুরগামী ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে এক অভাবিত দৃশ্যে চোখ আটকে গেল। দেখলাম বাবা-মা-বোনেরা চাঁদপুরগামী ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ওই ট্রেনে ওঠার অপেক্ষায়। অদূরে আমার পাশে দাঁড়ানো নজরুলসংগীত শিল্পী সোহরাব হোসেন। তার জিজ্ঞাসার জবাবে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল একটি বাক্য ‘বাবা-মা-বোনেরা দেশ ছেড়ে দেশান্তরে যাচ্ছেন’ আমি যাচ্ছি জেল থেকে জেলান্তরে। আমার চোখের কোণে জমেছিল অশ্রুকণা; কিন্তু মনের জোরে অশ্রুপাত ঠেকিয়েছি সেদিন। আমাকে এই অবস্থায় দেখে আমার বাবা-মা ও বোনদের অবস্থা কী হয়েছিল, জানি না। এই হলো দেশ ভাগের করুণ পরিণতি ও দৃশ্য।’

মানবমুক্তির এই সংগ্রামী সৈনিকের ঠিকানা আজ স্বদেশের মাটি পোস্তগলা শ্মশানঘাটে, বাবা-মায়ের পাশে নয়। হিন্দু-মুসলমানে ভারত বিভক্তির ফলে এই করুণ বিচ্ছিন্নতা ও যন্ত্রণা এখনো টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

জীবনের শেষ দিনগুলোতে সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে থাকতে হয়েছে তাকে। নাকে নল লাগিয়েই কথা বলেছেন, বাসাতেই মিটিং করেছেন। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে তার সমালোচনা ছিল যতটা তার চেয়েও বেশি সমালোচনা ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের বাগাড়ম্বরের ব্যাপারে। সমালোচনা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ভরসা করেছিলেন দেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ওপরই। অসুস্থতাকে মনের জোর আর ডাক্তারদের পরামর্শে অতিক্রম করতে চেয়েছেন। মৃত্যুর দুদিন আগেও বলেছেন, ও কিছু না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

নিজের অসুস্থতা নয়, রাজনৈতিক অসুস্থতা তাকে পীড়িত করেছে বেশি। আওয়ামী লীগের অতীত রাজনীতির ওপর তার আবেগ ছিল, কিন্তু বর্তমান ভূমিকায় ছিলেন হতাশ ও বিক্ষুব্ধ। অন্যদিকে রাজনৈতিক এই সংকটে বামপন্থিদের ভূমিকা এবং দুর্বলতা নিয়ে তার কষ্ট ছিল, কিছুটা হতাশাও ছিল, সমালোচনাও ছিল যথেষ্ট। তারপরও তিনি ভরসা করতে চেয়েছেন বামপন্থার ওপর। এ ক্ষেত্রে তার ভাবনা ছিল বামদের শক্তিহীনতার কারণ অনুসন্ধান করা এবং দূর করার প্রতি। তিনি মনে করতেন বামপন্থিরা যদি মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে কাছে টেনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিকল্প তৈরি করতে পারে, তাহলে তাদের সফলতা আসবে, দেশের মানুষের ভরসাস্থল তৈরি হবে। তার এই ভাবনা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু ভাবনার কেন্দ্রে যে ছিল শ্রমিক, কৃষক, আদিবাসী প্রান্তিক মানুষের জন্য বৈষম্যহীন নিরাপদ বাংলাদেশ সৃষ্টি তাকে তো কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। দেশের প্রতিটি সংকটকালেই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আর এই দেশেই তার মৃত্যু হলো। স্বপ্ন দেখেছেন স্বাধীন দেশের, লড়াই করেছেন মানুষের স্বাধীনতার জন্য কিন্তু স্বপ্নের পরিপূর্ণতা আসেনি। তিনি যে বেদনা নিয়ে গেলেন তা উজ্জ্বল, কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে তার দর্শন, মতাদর্শকে সামনে রাখতে হবে। তাহলে আমরা আরও সুসংহত হব। শক্তি বৃদ্ধি করতে পারব। সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবমুক্তির বিপ্লবের পথে এগিয়ে চলতে আমাদের সেই লক্ষ্য, সেই সাহস, সেই শক্তি অর্জনে তার জীবন আমাদের অনুপ্রাণিত করুক। বিপ্লবের আকণ্ঠ পিপাসা যে ঐক্যের কথা তিনি বলে গেছেন, সেই ঐক্য কেবল শহীদ মিনারের শ্রদ্ধা জানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে তার স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না, শূন্যতাই থাকবে।

বাতিঘরসদৃশ মানুষটির জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা, নিরন্তর ভালোবাসা। পঙ্কজ ভট্টাচার্য- আমজনতার পঙ্কজদা বিরল ও স্মরণীয় ব্যক্তিপুরুষদেরই একজন। তিনিই আমাদের শিখিয়ে গেছেন- এখানে থেমো না...তব ছিন্ন পালে জয় পতাকা তুলে, সূর্য তোরণ দাও হানা।’

লাল সালাম হে আলোর পথযাত্রী কমরেড পঙ্কজ ভট্টাচার্য।

লেখক: প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন


ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করা কি সম্ভব?

ড. সুলতান মাহমুদ রানা
আপডেটেড ৬ অক্টোবর, ২০২৫ ২৩:১৭
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ এখন সংস্কারের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের খসড়া প্রস্তাবগুলো দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য পুনর্গঠনের সম্ভাবনা দেখালেও বাস্তবায়নমুখী চ্যালেঞ্জ ও আস্থাহীনতা বিদ্যমান রয়েছে। কমিশনের আলোচনায় উঠে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ মেয়াদসীমা সংক্রান্ত বিকল্প-ধারা (এক ব্যক্তি সাধারণত সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন বলে এক বিকল্প প্রস্তাব আলোচনায় এসেছে) এবং নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন, তথ্য কমিশন ও প্রেস কাউন্সিলের মতো সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা বৃদ্ধির ধারণাÑএই মূল প্রস্তাবগুলো গণমাধ্যমে খসড়া আলোচনার সারমর্ম হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে।

এই প্রস্তাবগুলোর আলোচনায় সবচেয়ে গভীর শঙ্কা হলো প্রতিষ্ঠানগত নিরপেক্ষতার অভাব, অর্থাৎ যার ওপর সংস্কার বিশ্বাস করলে ভোটব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও তথ্যমঞ্চের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে কিন্তু যদি নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দলীয় প্রভাব বজায় থাকে তাহলে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ-ক্ষমতা বাড়ানো কেবল কাগজে বিষয় হবে। নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা ও মিডিয়া-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি আস্থা ফিরে না এলে সংবিধানিক পরিবর্তনও টেকসই ফল দেবে না। এই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মানবাধিকার ও প্রশাসনিক সংস্কার রিপোর্টগুলো উল্লেখযোগ্য সতর্কবার্তা দিয়ে এসেছে।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সুশাসনের ঘাটতি। দুর্নীতি, প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা, আইনের দুর্বল প্রয়োগ, দলীয়করণ, বিচারব্যবস্থার ওপর রাজনৈতিক প্রভাবÑএসব সমস্যা সংবিধান পরিবর্তন দিয়েই সমাধান করা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানির মতো রাষ্ট্রে সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ওপর এমন আস্থা তৈরি হয়েছে যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এলেও প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা ভাঙতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সেই আস্থা গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে বাস্তবায়নযোগ্য করতে হলে তিনটি স্তরে কাজ করতে হবে।

প্রথমত, রাজনৈতিক সদিচ্ছা: সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের মধ্যে সংলাপের সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। সংলাপের মাধ্যমেই আস্থা পুনর্গঠন সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া: রাষ্ট্রপতির হাতে নিয়োগ ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব থাকলে তা অবশ্যই স্বচ্ছ, বহুপাক্ষিক ও জবাবদিহিমূলক হতে হবেÑযেমন ন্যাশনাল কাউন্সিল বা একটি স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে।

তৃতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি: প্রশাসন, বিচার বিভাগ, তথ্য কমিশন ও গণমাধ্যমের আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করতে হবে যাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ না থাকে।

এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে দরকার একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিÑযেখানে ক্ষমতা ভাগাভাগি, সহনশীলতা এবং বিরোধী মতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে। কেবল সংবিধানের ধারা বদলে গণতন্ত্র টেকসই হয় না; বরং তার প্রয়োগে স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং নাগরিক অংশগ্রহণই মূল চাবিকাঠি।

অতএব, বলা যায়Ñজাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংস্কারগুলো নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আশার আলো জ্বালিয়েছে। তবে এই আশাকে বাস্তব শক্তিতে রূপ দিতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক সহযোগিতা, প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার। যদি এই তিনটি উপাদান নিশ্চিত করা যায়, তবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে পারবে; অন্যথায়, এই সংস্কারগুলোও কেবল কাগজে লেখা প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এবং বাংলাদেশ আবারও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের পুরোনো চক্রে ফিরে যাবে।

এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ এখন এক ‘পরীক্ষামূলক গণতন্ত্রের’ পর্যায়ে আছেÑযেখানে সাংবিধানিক পরিবর্তনগুলো শুধু আইনি রূপ নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনর্গঠন হিসেবেও দেখা উচিত। কারণ গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা মানে শুধু নির্বাচন নয়, বরং প্রতিষ্ঠান, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং ক্ষমতার ভারসাম্যকে একসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করা।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাগুলো এখানে অলোচনা করা যেতে পারে। পাকিস্তানের ২০১০ সালের অষ্টাদশ সংশোধনী একটি তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ। এর আগে প্রেসিডেন্টের হাতে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, যা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়াত। অষ্টাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয় এবং প্রেসিডেন্ট কার্যত আনুষ্ঠানিক প্রধানে পরিণত হন। এর ফলে সংসদ ও প্রধানমন্ত্রী শক্তিশালী হয়, যদিও রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্বলতার কারণে সেই কাঠামোও পুরোপুরি স্থিতিশীল হতে পারেনি। আবার ফ্রান্সের আধা-রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা দেয়। সেখানে যদি প্রেসিডেন্ট এক দলে আর প্রধানমন্ত্রী অন্য দলে থাকেন, তবে এক ধরনের বাধ্যতামূলক ক্ষমতা ভাগাভাগি তৈরি হয়, যাকে কোহ্যাবিটেশন (ফ্রান্সের আধা-রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থায় এমন এক পরিস্থিতি, যখন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে বাধ্য হন) বলা হয়। এ অভিজ্ঞতা দেখায়, সাংবিধানিক কাঠামো কখনো কখনো জটিল পরিস্থিতিতেও ভারসাম্যের পথ খুঁজে নেয়। ইতালিতে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যাতে জনগণ সরাসরি ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করবে। এটি হয়তো গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ বাড়াবে, কিন্তু একইসঙ্গে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত হয়ে যাবে এবং ভারসাম্য নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি হবে। তুরস্কের অভিজ্ঞতা আবার একেবারেই ভিন্ন। ২০১৭ সালে সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী পদই বিলুপ্ত করে দেওয়া হয় এবং প্রেসিডেন্টকে সর্বময় নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এতে প্রেসিডেন্ট একাই নিয়োগ, বাজেট এবং জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। সমালোচকরা বলেন, এ সংস্কার গণতন্ত্রের মৌলিক ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই উদাহরণগুলো বাংলাদেশকে দেখায়, শুধু সংবিধানের ধারা বদলালেই সব সমাধান হয় না, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা জানি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক ধরনের নেকিবাচকতা আছে। আর সেই নেতিবাচকতা কি সহজেই কাগজ কলমে লিখিত আকারে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে করা যাবে? এ বিষয়ে অনেক বড় প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অভিজ্ঞতা আরও স্পষ্ট করে দেয় ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্বাচিত হলেও কংগ্রেস এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ক্রমাগত ক্ষমতার টানাপড়েন বজায় থাকে। প্রেসিডেন্ট কোনোভাবেই এককভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এমনকি কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্টের মধ্যে ক্ষমতার একটি ভারসম্য আছে। যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত প্রভাবশালী হলেও সংসদীয় কমিটি, বিরোধী দলের কঠোর নজরদারি এবং শক্তিশালী গণমাধ্যম তাকে সব সময় জবাবদিহির মধ্যে রাখে। জার্মানিতে বড় কোনো নীতি বা নিয়োগ প্রক্রিয়া দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ছাড়া এগোতে পারে না। সুইডেনে সংসদই কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রক শক্তি। এমনকি জাপানের মতো উন্নত দেশেও প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। কিন্তু প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলীয় কাঠামোর শক্ত নিয়ন্ত্রণ তাকে সীমাবদ্ধ রাখে। এসব উদাহরণ আমাদের বলে দেয়Ñগণতন্ত্র তখনই টেকসই হয় যখন প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয় এবং কোনো একটি পদে বা ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় না।

কিন্তু বাংলাদেশে বাস্তবতা ভিন্ন। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির হাতে যদি নিয়োগের ক্ষমতা বাড়ানো হয়, কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রভাব অটুট থাকে, তবে পরিবর্তনটি কার্যত কাগজে সীমাবদ্ধ থাকবে। বিরোধী দল যদি পুরো প্রক্রিয়ায় আস্থা না রাখে, তবে সংসদীয় কমিটিতে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তও অর্থহীন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন কিংবা আইন কমিশন যদি রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত না হতে পারে, তবে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরবে না। এর সঙ্গে আছে সুশাসনের ঘাটতি। দুর্নীতি, প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা, আইনের দুর্বল প্রয়োগ-এসব সমস্যা শুধু সাংবিধানিক পরিবর্তন দিয়ে সমাধান হয় না। যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানির মতো দেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এতটাই শক্তিশালী যে দলীয় প্রভাব সহজে ঢুকতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করা যায়নি।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করা, যেখানে ক্ষমতার একচ্ছত্রকরণ বন্ধ হবে এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তার সাংবিধানিক দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালন করবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে, সংসদীয় পর্যায়ে বিরোধী দলের মতামতকে সম্মান করতে হবে, এবং বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন ও গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এগুলো সম্ভব হলে তবেই সাংবিধানিক সংস্কারের সুফল পাওয়া যাবে। অন্যথায় ক্ষমতার ভারসাম্যের যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, তা কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

অতএব বলা যায়, বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংস্কার এখন এক ধরনের পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা। এসবের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বিরোধী দলের আস্থা, এবং শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছাড়া এই সংস্কারগুলো কার্যকর হবে না। বিশ্বের অভিজ্ঞতা আমাদের স্পষ্ট বার্তা দেয়- গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু সংবিধান পরিবর্তন নয়, বরং তার বাস্তবায়নে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক সহনশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে এই সংস্কারগুলোও থেকে যাবে আংশিক চেষ্টার প্রতিচ্ছবি, আর বাংলাদেশের গণতন্ত্র আবারও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের দুষ্টচক্রে আটকে পড়বে।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


শিশুদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে

এস ডি সুব্রত
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

‘প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’।

বঞ্চিত শিশুদের জীবনোন্নয়নের জন্য শিশু দিবস পালন করা হয় । শিশু বলতে জন্মের পর থেকে পনেরো বছরের বালক বালিকাদের বুঝায় । এই সব শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ তাই এই সব ভবিষ্যৎ নাগরীকদের সুরক্ষার এবং সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করবার জন্যেই শিশুদিবস পালন করা হয়ে থাকে। শিশুদের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়াই বিশ্ব শিশু দিবসের মূল লক্ষ্য । ১৯৫৪ সালে এ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার ‘বিশ্ব শিশু দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেদনাদায়ক ও ভয়াবহ স্মৃতি বিশ্ব শিশু দিবসের জন্ম দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে শত শত নিষ্পাপ শিশু মারা যায়। অনেক শিশু অসহায় ও পিতৃমাতৃহীন হয়ে পড়ে। পঙ্গু ও বিকলঙ্গ হয় অনেকে। জাতিসংঘ কল্যাণ তহবিল ইউনিসেফ এই অসহায় শিশুদের কল্যাণ ও নিরাপত্তা বিধানে এগিয়ে আসে এবং বিশ্ববাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৫৪ সালে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই সারা বিশ্বে অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার পালিত হয় ‘বিশ্ব শিশু দিবস’। এই দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুদের নানাবিধ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করে তাদের মৌলিক অধিকার আদায় করা। এজন্য এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকে। আজকের শিশু আগামীদিনে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। একটি নবজাত শিশুর মধ্যে আজ যে প্রাণের সঞ্চার হল তা একদিন ফুলে ফলে প্রস্ফুটিত হবে। বড় হয়ে একদিন সে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন সফল করবে। কবি ওয়ার্ডস ওয়াতের ভাষায়- ‘Child is the father of a nation’. শিশুর মধ্যে নিহিত রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। কারণ, শিশুই একদিন বড় হয়ে দেশ ও সমাজের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তারা হবে দেশের আদর্শ নাগরিক। এ জন্য চাই শিশুর সযত্ন প্রতিপালন; বিকাশ সাধনের সুষ্ঠু পরিবেশ। শিশুদেরকে আদর, সোহাগ, যত্ন ও সুশিক্ষা দিয়ে বড় করে তোলার জন্য চাই অনুকূল পরিবেশ, উপযুক্ত শিক্ষা। উপযুক্ত অভিভাবক পেলে একটি শিশু আদর্শ মানুষরূপে বড় হয়ে উঠতে পারে। কুরুচিপূর্ণ পরিবেশ, অসৎসঙ্গ ও বিবেচনাহীন অভিভাবকের অধীনে বড় হয়ে অমানুষ, বিবেকহীন ও লম্পট চরিত্রের হতে পারে। সম্ভাবনাময় আগামী দিনের এক সুনাগরিক এভাবেই অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। পক্ষান্তরে সুশিক্ষা, সুরুচি, শিক্ষিত বিবেকবান অভিভাবক একটি শিশুর অন্তর সুপ্ত ভবিষ্যতের পিতাকে জাগিয়ে তুলতে পারে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ২৫ ভাগই শিশু।তারাই একদিন সুনাগরিক হয়ে দেশের নেতৃত্ব দেবে। তাই তারা অবহেলিত থাকলে ভবিষ্যাৎ প্রজন্ম মুখ থুবড়ে পড়বে।

অবহেলিত শিশুদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলো দেওয়া পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তাই এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিশেষ যত্নবান হতে হবে ।


ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি ও খাদ্যে ভেজাল

আতিক আজিজ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

মৌলিক অধিকারের মধ্যে মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান শর্ত খাদ্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা-ই আজ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি একের পর এক গবেষণায় বেরিয়ে আসছে ভয়াবহ তথ্য- মাছ, শাকসবজি, ফলমূল, দুধ, ব্রয়লার মুরগি এমনকি টি-ব্যাগেও মিলছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক ও ক্ষতিকর ভারী ধাতু। এসব উপাদান ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাসসহ নানা দুরারোগ্য রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মাছ-মাংস এবং সবজির মতো প্রতিদিনকার অপরিহার্য পণ্যের দাম যখন আগেই নাগালের বাইরে, তখন নতুন করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিঃসন্দেহে জনগণের জন্য ‘গোদের উপর বিষ ফোঁড়া’। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যাদের আয় সীমিত; কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সম্মান রক্ষার কারণে তারা সব দিক থেকে বিপদে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে বোতলজাত ও খোলা উভয় ধরনের সয়াবিন এবং পাম তেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ টাকা বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। তাদের দাবি- আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও মূল্য সমন্বয় প্রয়োজন। অথচ বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থার তথ্য বলছে, আগের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ের তুলনায় জানুয়ারি-মার্চ সময়ে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম নিম্নমুখী ছিল। সেখানে পরবর্তী এপ্রিল-জুন; এমনকি গত জুলাই মাসেও উর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। তবে গত আগস্টে সয়াবিন তেলের বাজার আবার নিম্নমুখী রয়েছে। জুলাইয়ে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিনের দাম ১ হাজার ৩০৭ ডলার ছিল, যা আগস্টে ১ হাজার ২৪৫ ডলারে নেমেছে। তাহলে প্রশ্ন আসে- দাম বাড়ানোর এই তাড়া কোথা থেকে এলো?

বর্তমানে রাজধানীর বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৮৮-১৯০ টাকা, আর খোলা তেল ১৭০-১৭৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বছরে মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১৪-১৬ শতাংশ। এখন যদি আরও ১০ টাকা বাড়ে, তাহলে একটি গড় পরিবারের জন্য মাসিক খরচ বাড়বে উল্লেখযোগ্য হারে। বিশেষ করে যেখানে আয় বাড়েনি, চাকরি বা পেশার স্থায়িত্ব নেই, সেখানে এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধি অনেক পরিবারের আর্থিক ভারসাম্য ভেঙে দিতে পারে।

ভীতিকর আরো বিষয় হলো পাস্তুরিত দুধেও অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে, এমনকি অপাস্তুরিত দুধে ফরমালিন ও ডিটারজেন্ট মিশ্রণের প্রমাণ মিলেছে। টি-ব্যাগেও সিসা, পারদ, আর্সেনিক- যেগুলোর প্রতিটিরই সীমা ছাড়িয়ে গেছে কয়েকগুণ- তা প্রমাণ করে খাদ্য সুরক্ষা আজ কতটা হুমকির মুখে। এখন প্রশ্ন হলো- এত সব গবেষণার ফলাফল সামনে আসার পরও সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ কোথায়?

দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে পণ্যমূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীদের একটি গোপন আঁতাত ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিরবতা অনেক সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিবেচনায় নিলেও সেটি যাচাই- বাছাইয়ে স্বচ্ছতা অনুপস্থিত। ক্যাবসহ অন্যান্য ভোক্তা সংগঠন বহুবার দাবি জানালেও এ ধরনের সিদ্ধান্তে তাদের সম্পৃক্ত করা হয় না। ফলে ভোক্তার স্বার্থরক্ষার বদলে সিদ্ধান্তগুলো ব্যবসায়ী স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। এর ফলে স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোকে প্রতি মাসেই নতুন করে হিসাব কষে সংসার চালাতে হয়। মনে রাখতে হবে- মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণির সমস্যা উচ্চবিত্তর চেয়ে ভিন্ন। তারা উচ্চবিত্তের মতো ব্যয় বহন করতে পারে না। মধ্য বিত্তরা সরকারি সহায়তার আওতায়ও পড়ে না। নিম্নবিত্তের জন্য সহায়তাও অপ্রতুল। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে তাদের হাতে বিকল্প থাকে না। পুষ্টিকর খাদ্য বাদ দিয়ে কমদামি; কিন্তু স্বাস্থ্যহানিকর বিকল্প বেছে নিতে হয়। তাদের সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখতে গিয়ে স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- দাম কমলে কেন তা বাজারে প্রতিফলিত হয় না?

এই খাদ্যদূষণ মানুষের শরীরে ধীরে ধীরে বিষক্রিয়ার মতো কাজ করে। এর প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা না গেলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসার, বন্ধ্যত্ব, শিশুদের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ নানা জটিল রোগ সৃষ্টি করে। তাই এর প্রতিকারে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে, নইলে পরিণতি হবে বিপর্যয়কর। সরকারি পর্যায়ে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ, মৎস্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিএফএসএকে নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে সামগ্রিক পরিকল্পনা নিতে হবে। দূষণের উৎস চিহ্নিত করে তা বন্ধ করতে হবে।

সরকারকে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে এখনই, নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক ভয়ানক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে- যার দায় এড়ানো কারও পক্ষে সম্ভব হবে না।তাই বাস্তবতাকে অনুধাবন করে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি ও খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক গবেষক মানবাধিকারকর্মী।


ফেসবুক পোস্ট ও মানুষের স্নায়ুযুদ্ধ

শারমিন সুলতানা
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

মানব শরীরের সবচেয়ে দুর্বল অংশ হচ্ছে তার স্নায়ু। এটি এতোটাই নিয়ন্ত্রণহীন যে মানুষ প্রতিনিয়ত সচেতনভাবে যে কাজগুলো থেকে বিরত থাকার প্রতিজ্ঞা করে সে কাজগুলো পুনরায় মুহূর্তেই তার দ্বারা সংগঠিত হয়। মানুষের এই অতি প্রতিক্রিয়াশীল স্নায়ু বর্তমান ফেইসবুক নামক যোগাযোগ মাধ্যমটি দ্বারা সিংহভাগ নিয়ন্ত্রিত। বর্তমানে বিভিন্ন যন্ত্র মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি করেছে যা নানান ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে মানবজীবনে। এর মধ্যে ফেইসবুক সবচেয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল যোগাযোগ মাধ্যম। যদিও এর নাম যোগাযোগ মাধ্যম তবুও এর কাজ অনেক ক্ষেত্রেই মানুষে-মানুষে যোগাযোগ সৃষ্টির পরিবর্তে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করছে। মানুষের মনোজাগতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো তারা অতি দ্রুত ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। এতে অন্যজন ভিন্ন ভিন্নভাবে সে ব্যক্তির উপর ক্রুদ্ধ হন। সমাজে হিংসা- প্রতিহিংসা যদিও সব সময়ই ছিল, তবুও তা ছিল কিছুটা স্তিমিত, ও আভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু এখন প্রায় সবকিছুই উন্মুক্ত। মানুষের বিদ্বেষও এখন ফেইসবুক পোস্টের মাধ্যমে বাইরে আসে যা মানুষকে পূর্বের তুলনায় প্রকাশ্যে আরো বেশি হিংস্র করে তোলে। মানুষকে এখন ফেইসবুক পোস্ট নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে মানুষ ব্যক্তিগত জল্পনা-কল্পনা জুড়ে মনগড়া সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। এতে যে কেবল মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয় তা শুধু নয়, মানুষ এতে হিংস্র ও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠেন। ফেসবুক হয়ে গেছে মানুষের মাঝে বিদ্যমান হিংসা ও ভালোবাসা প্রদর্শনের মাধ্যম যা মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে সকল প্রজন্মের মানুষের কাছে। বর্তমানে অনেকেই ফেসবুক স্বর্বস জীবন যাপন করছেন। ফেইসবুকে তাই চলছে নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত অবাধ প্রতিযোগিতা পূর্ণ প্রদর্শন। মানুষ এখন অনেক বেশি দেখাতে পছন্দ করে। যদিও এটি সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক বা দৃষ্টিকটূ নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে আমাদের প্রদর্শনীটা দৃষ্টিকটূ। এর প্রধান কারণ হলো আমরা ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো নিদিষ্ট প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি না। আমরা ফেসবুকের একটি ওয়ালে ততধিক প্রজন্ম একত্রে থাকি। তাই ফেসবুক পোস্ট করার ক্ষেত্রে প্রাইভেসি রাখি না। এক প্রজন্মের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ বা আনন্দের, অন্য প্রজন্মের কাছে অস্বস্তিকর। এর মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো এখানে অরক্ষিত হয়ে পড়ে। যেহেতু আমরা মোটা দাগে ফেসবুক পোস্ট সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা করি, সেহেতু কারো কোনো উদ্দেশ্যপূর্বক দেওয়া পোস্টকে আমরা প্রায় অনেকেই নিজের গায়ে নেই। অনেকেই মনে করে অমুক তমুক পোস্ট আমাকে নিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিগত দ্বেষ বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভুল বিষয়ে সন্দেহ করেও একেকটি পোস্ট বা কথা একেকটি সম্পর্ককে নষ্ট করে। মানুষ যখন সরাসরি কারো প্রতি কোনো আক্রোশ প্রকাশ করতে পারে না, তখন সে ফেইসবুক পোস্টের মাধ্যমে তা প্রকাশ করে। তখন বিষয়টি ব্যক্তিগত পর্যায় ছাপিয়ে সামষ্টিক অসম্মানের পর্যায়ে চলে যায় যার সুবিধাও নেয় অনেকে। এরই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় মানুষ আত্মহননের পথ পর্যন্ত বেছে নেয়। শুধু তাই নয়, ফেইসবুক পোস্ট বর্তমানে তৈল প্রদানের একটি লাভজনক জায়গায়ও পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে সস্তা জনপ্রিয়তা ও তৈল প্রদান হয়ে উঠেছে মানুষের নিত্যসঙ্গী। মানুষ শত্রুতা প্রকাশও দশজনের সামনে ফেইসবুক পোস্টের মাধ্যমে করে, ভালোবাসা প্রকাশও ঠিক একইভাবে করে। ফলে গোপন থাকে না কিছুই। দানা বাধে নতুন মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। ফেসবুক পোস্ট বর্তমানে জনমত গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। ফেসবুকে সহজেই কিছু একটা দেখে, তার জনপ্রিয়তা দেখে মানুষ অতি সহজে তা বিশ্বাস করে। এটি ভয়ংকর পরিণতির দিকে মানুষকে নিয়ে যায়। কেননা, ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। অহর্নিশি মানুষ ফেইসবুকের সেই পোস্টকে বিশ্বাস করে প্রভাবিত হয় যা দেওয়ার সময় পোস্ট প্রদানকারী ব্যক্তি দু'বারও ভাবে না যে সে কী লিখছে। অর্থাৎ দুর্বল মানসিক অবস্থায় না বুঝে পোস্ট করা বিষয় দ্বারাও একটি বিরাট অংশের মানুষ মনো বিকারে ভোগে। ফেসবুকে পোস্টের আরেকটি ভয়ংকর দিক হলো কমেন্ট করার সহজসাধ্য উপায়। যে বিষয়টিই মানুষের ব্যক্তিগত মতকে সমর্থন করে না সে বিষয়কে কেন্দ্র করে মানুষ অত্যন্ত বিশ্রি ভাষায় অশ্রাব্য উদগীরণ করে যা মানুষে- মানুষে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট করে। জন্ম হয় নতুন ঘৃণার। মানুষ যে মানুষকে এত ঘৃণা করে তা ফেইসবুকই মানুষের সামনে নিয়ে এসেছে। অন্যভাবে বলতে হয়, ফেসবুকে অন্যের গুণগান না জনপ্রিয়তা মানুষের স্নায়ুকে নেতিবাচকভাবে পরিচালিত করে। এ থেকে পাল্টা আক্রমণের স্নায়ু যুদ্ধ হয় যার বিরতি ঘটে তখন যখন অন্য প্রান্তে ভিন্ন যুদ্ধের ডঙ্কা বাজে। এ থেকে মানুষের পরিত্রাণ জরুরি। নয়ত মানুষ যন্ত্রকে নয়, যন্ত্র পরিচালনা করবে মানুষকে। এর ধারাবাহিকতায় ধ্বংস হবে মানবসভ্যতা, যন্ত্রের তলে পৃষ্ঠ হবে মানবতা।

লেখক: শারমিন সুলতানা, শিক্ষক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।


শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা প্রকল্পের নতুন সম্ভাবনা—চাষাবাদ, মাটি ও পানি রপ্তানি

ড. মোখলেসুর রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

তিস্তা নদী—উত্তর বাংলার প্রাণ। এই নদী শুধু একটি জলধারা নয়, এটি হাজার হাজার কৃষকের জীবিকা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক অর্থনীতির মূল ভিত্তি। কিন্তু প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে এই নদীর জলপ্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প পুরোপুরি কাজে লাগানো যায় না, আর কৃষিজমি শুকিয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র সেচ নয়, বরং এই নদীকে ঘিরে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে হবে—যেমন, উর্বর মাটি ও বিশুদ্ধ পানি রপ্তানির উদ্যোগ।

তিস্তা প্রকল্প ও বর্তমান বাস্তবতা

বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর বিস্তৃতি ২,০০৪ বর্গকিলোমিটার, যা মোট ১২,১৫৯ বর্গকিলোমিটারের নদীবিধৌত এলাকায় পড়ে। দেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প, তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প (TBIP), প্রায় ৭.৫ লাখ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনার লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে। কিন্তু বাস্তবে, পর্যাপ্ত পানির অভাবে প্রতি বছর গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

অর্থাৎ প্রকল্পের সক্ষমতার মাত্র ১০% ব্যবহার হচ্ছে। এর মানে, কোটি কোটি ঘনমিটার পানি প্রয়োজন শুষ্ক মৌসুমে, যা আমরা সংরক্ষণ করতে পারছি না। ফলে তিস্তা অববাহিকার কৃষকরা শস্য উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছেন, জীবিকা হারাচ্ছেন, ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছেন।

সমস্যা থেকে সম্ভাবনার দিকে

এই সংকটকে শুধু ‘সমস্যা’ হিসেবে না দেখে ‘সম্ভাবনা’ হিসেবে দেখাই সময়ের দাবি। আমরা যদি এই পানি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারি, শুধু কৃষক নয়, বরং দেশের অর্থনীতিও লাভবান হতে পারে।

তিস্তা নদীর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে প্রচুর পরিমাণে উর্বর পলি মাটি রয়েছে, যেটা বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। তেমনি বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি যদি আমরা রিজার্ভার, বড় গর্ত বা ভূগর্ভে সংরক্ষণ করতে পারি, তাহলে সেই পানি শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজে ব্যবহারের পাশাপাশি রপ্তানিরও সুযোগ রয়েছে।

নতুন দিগন্ত: মাটি ও পানি রপ্তানির সম্ভাবনা

✅ উর্বর মাটি রপ্তানি:

  • সিঙ্গাপুর, কাতার, দুবাই সহ অনেক দেশ নিজেরা কৃষিকাজ বা নগরায়নের জন্য বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ থেকে উর্বর মাটি বা বালি আমদানি করে।
  • তিস্তা অঞ্চলের নদী তীরবর্তী পলি মাটি কৃষির জন্য যেমন উপযোগী, তেমনি রপ্তানির ক্ষেত্রেও বাজারযোগ্য।
  • বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই একটি ‘মাটি ও বালি রপ্তানি নীতিমালা’ প্রণয়নের পথে আছে (সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন)। এই নীতিমালার আলোকে তিস্তার অতিরিক্ত মাটি, পরিবেশসম্মতভাবে উত্তোলন করে রপ্তানি করা সম্ভব।

✅ পানির রপ্তানি:

  • বিশুদ্ধ, প্রাকৃতিক পানির আন্তর্জাতিক চাহিদা বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ বিশুদ্ধ খাবার পানি বা বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য পানি আমদানি করে।
  • যদি তিস্তা অঞ্চলে সাশ্রয়ী মূল্যে পানি সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি (যেমন: ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জ, রিজার্ভার, বড় গর্ত তৈরি) অবলম্বন করা যায়, তাহলে অতিরিক্ত পানি বোতলজাত বা ট্যাঙ্কারে রপ্তানি করা সম্ভব।
  • এতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন দিগন্ত খুলবে, তবে শর্ত হচ্ছে—রপ্তানির আগে দেশীয় কৃষি ও জনগণের প্রয়োজন আগে পূরণ করতে হবে।

পানির সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার প্রস্তাবিত পদ্ধতি

১. ✅ ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণ:

বর্ষাকালে তিস্তা নদীর অতিরিক্ত পানি ভূগর্ভে সংরক্ষণের জন্য পেরকোলেশন পিট, চেকড্যাম, ইনফিল্ট্রেশন ওয়েল তৈরি করতে হবে।

  1. ✅ বড় গর্ত বা কৃত্রিম রিজার্ভার:

নদীর বিভিন্ন অংশে (উজান থেকে ভাটির দিকে) বড় গর্ত বা জলাধার তৈরি করে বর্ষাকালের পানি সঞ্চয় করতে হবে।

  1. ✅ নদী পুনঃখনন ও শাখা নদী পরিষ্কার:

তিস্তা নদীর প্রধান চ্যানেল ও শাখা নদীগুলোতে আবার খনন করে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

  1. ✅ বিজ্ঞানভিত্তিক হিসাব ও মানচিত্রায়ন:

o প্রতি হেক্টরে কত কিউবিক মিটার পানি প্রয়োজন,

o বর্ষাকালে কত পানি জমা হয়,

o ভূগর্ভে কতটা পানি প্রবেশ করেছে—এসব পরিমাপ ও মানচিত্রে তুলে ধরতে হবে।

অর্থনৈতিক সুবিধা ও কর্মসংস্থান

  • এই প্রকল্পগুলোতে কাজ করার মাধ্যমে স্থানীয় যুবকদের কর্মসংস্থান হবে।
  • মাটি ও পানি রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।
  • কৃষিজ উৎপাদন বাড়বে, ফলে খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।
  • দীর্ঘমেয়াদে এই প্রকল্প জলবায়ু সহনশীলতা ও টেকসই কৃষির ভিত্তি তৈরি করবে।

ঝুঁকি ও করণীয়:

  • পানি ও মাটি রপ্তানির আগে পরিবেশগত প্রভাব বিচার করতে হবে।
  • স্থানীয় কৃষক ও জনগণের প্রয়োজন আগে নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক।
  • রপ্তানি কার্যক্রমে সরকারকে সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
  • আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে পরীক্ষাগার ও সার্টিফিকেশন সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে।

উপসংহার: তিস্তা শুধু কৃষির জন্য নয়, রপ্তানিরও সম্ভাবনা

তিস্তা নদী বরাবরই কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু এখন সময় এসেছে এই নদীর সম্পদকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করার। সঠিক পরিকল্পনা, বিজ্ঞানভিত্তিক পানি সংরক্ষণ ও পরিবেশবান্ধব মাটি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তিস্তা প্রকল্পকে শুধুই শুষ্ক মৌসুমের সেচ প্রকল্প না বানিয়ে বাংলাদেশের একটি আন্তর্জাতিক রপ্তানি কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে তোলা সম্ভব।

সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন অংশীদার এবং স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তিস্তা হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের পানি ও মাটি ভিত্তিক নতুন অর্থনীতির চালিকাশক্তি।

প্রস্তাবিত পদক্ষেপ

  1. তিস্তা অববাহিকার ভূগোলভিত্তিক মানচিত্র ও ডেটা সংগ্রহ
  2. পাইলট প্রকল্প হিসেবে কয়েকটি অঞ্চলে রিজার্ভার ও গর্ত নির্মাণ
  3. তিস্তা নদী ও শাখা নদীগুলো পুনঃখনন
  4. নতুন নীতিমালা—পানি ও মাটি রপ্তানির জন্য
  5. আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি সম্ভাবনার গবেষণা
  6. তহবিল ও বিনিয়োগ পরিকল্পনা প্রস্তুত।

লেখক: Professor Dr Mokhlesur Rahman, Nuclear Science and Engineering, MIST, Dhaka


ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সংবাদ : গুজব বনাম বাস্তবতা

স্বাধীন চৌধুরী
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বর্তমান যুগে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সংবাদ প্রচারের প্রধান মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম প্রতিদিন সীমাহীন সংবাদ পৌঁছে দেয় সাধারণ জনগণের কাছে। বিশেষভাবে তৃণমূল সংবাদ, যা স্থানীয় ও দৈনন্দিন জীবনের খবর নিয়ে গঠিত, এই মাধ্যমগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের এই সুবিধার সঙ্গে রয়েছে গুজবের দ্রুত বিস্তার। কোনো খবরের সত্যতা যাচাই না করেই তা ভাইরাল হওয়ার কারণে সমাজে বিভ্রান্তি, আতঙ্ক এবং কখনও কখনও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। তাই সঠিক তথ্য ও মিথ্যা তথ্যের মধ্যে পার্থক্য বোঝার জন্যে এবং জনগণকে ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রদান এখন সময়ের দাবি। ১. ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উত্থান ও প্রভাবঃ ১.১ সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদ প্রচার: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ফেসবুক: ২০২৫ সালে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫,৫০০,০০০। হোয়াটসঅ্যাপ: গ্রুপ চ্যাট ও ব্রডকাস্টে স্থানীয় খবর দ্রুত ছড়ায়। টুইটার ও ইউটিউব: রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রচারে ব্যবহৃত হয়। সামাজিক মাধ্যমের এই শক্তি জনগণকে সজাগ ও সচেতন রাখার পাশাপাশি তৃণমূল সংবাদ পৌঁছে দেওয়ায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ১.২ প্রভাব: ডিজিটাল সংবাদ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হলেও এর নেতিবাচক প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, গুজবের দ্রুত বিস্তার: যাচাইহীন তথ্যের কারণে বিভ্রান্তি বৃদ্ধি। সামাজিক বিভাজন: ধর্ম, অঞ্চল ও রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে দ্বন্দ্ব। রাজনৈতিক উত্তেজনা: নির্বাচনী সময়ে মিথ্যা সংবাদ প্রচার অস্থিরতা ও সংঘাত সৃষ্টি করে। ২. গুজবের ধরন ও উদাহরণ : গুজব সাধারণত তথ্যের প্রকৃত সত্যতা যাচাই না করেই ছড়িয়ে পড়ে। তা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে- ১. রাজনৈতিক গুজব: নির্বাচনী বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা। ২. সামাজিক গুজব: জনমানসে ভীতি সৃষ্টি করা, যেমন, ছেলেধরা গুজব। ৩. ধর্মীয় বা আঞ্চলিক গুজব: সমাজে বিভাজন ও উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্য। উদাহরণ- ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ছেলেধরা গুজবের কারণে এক নারীকে হত্যা করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে পদ্মা সেতু সংক্রান্ত একটি গুজব সামাজিক মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। এই গুজবের ভিত্তি ছিল ‘সেতু নির্মাণের সময় শিশুদের কাজে লাগানো হবে’- যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ৩. গুজবের বিস্তার ও কারণঃ গুজব ছড়ানোর কারণসমূহ- তথ্য যাচাই না করা: মানুষ যাচাই ছাড়া খবর শেয়ার করে। ভীতি ও কৌতূহল কাজে লাগানো: আতঙ্ক সৃষ্টি করে দ্রুত তথ্য ছড়ানো। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য: প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা। সামাজিক অস্থিরতা: জনমত প্রভাবিত করা। গবেষণা অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশে ৬৫% ডিজিটাল ব্যবহারকারী কোনো না কোনো সময়ে যাচাইহীন সংবাদ শেয়ার করেছেন। ৪. ডিজিটাল সাক্ষরতা ও গুজব প্রতিরোধ : ৪.১ ডিজিটাল সাক্ষরতা: ডিজিটাল সাক্ষরতা বলতে বোঝায় তথ্য যাচাই, সোর্স চেক এবং অনলাইন নিরাপদ ব্যবহার শেখা। কৌশল- সোর্স যাচাই: কোন সংবাদ কোন উৎস থেকে এসেছে তা চেক করা। গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ: ছবি ও ভিডিও যাচাই করতে ব্যবহার করা। ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট: যেমন Bangladesh Fact-Check Network (BFCN)। ৪.২ শিক্ষণীয় উদাহরণ: ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রকল্প চালু করে, যেখানে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল সাক্ষরতা শেখানো হয়। ফলাফল হিসেবে, পরীক্ষার সময় তারা যাচাইহীন সংবাদ চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। ৫. সরকারের ভূমিকা : সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছে, যা গুজব ও মিথ্যা তথ্য প্রতিরোধে সহায়ক। মূল উদ্যোগ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮: গুজব ও মিথ্যা তথ্য শেয়ার প্রতিরোধ। সচেতনতা অভিযান: মিডিয়ার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: স্কুল ও কলেজে ডিজিটাল সাক্ষরতা অন্তর্ভুক্ত করা। তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। ৬. স্থানীয় সংবাদ ও গুজবের সামাজিক প্রভাব : তৃণমূল সংবাদ মূলত স্থানীয় পর্যায়ের খবর প্রচার করে। যখন এই খবরের সঙ্গে গুজব মিশে যায়, তখন এর প্রভাব সমাজে গভীর হয়। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় রাজনৈতিক গুজব: নির্বাচনী এলাকায় বিভাজন ও উত্তেজনা বৃদ্ধি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গুজব: বিদ্যালয় বন্ধ, ভ্যাকসিন গ্রহণে অনীহা। অর্থনৈতিক প্রভাব: বাজারে অযাচিত আতঙ্ক সৃষ্টি, মূল্যবৃদ্ধি ও পণ্য সংকট। ৮.শেষাংশঃ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তৃণমূল সংবাদ জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে যাচাইহীন তথ্য বা গুজবের কারণে বিভ্রান্তি ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। সমাধানমূলক দিক- ১. ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি করা। ২. জনগণকে উৎস যাচাই, তথ্য যাচাই শেখানো। ৩. গণমাধ্যম ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা নিশ্চিত করা। ৫. সরকারের নীতি ও আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা। সতর্ক, সচেতন ও বুদ্ধিমান ব্যবহারকারীর মাধ্যমে গুজব রোধ করা সম্ভব। এভাবেই সমষ্টিগত সচেতনতায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নিরাপদ ও কার্যকর সুফল ব্যবহার সম্ভব হয়ে উঠবে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।


বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রত্যাশা : স্বতন্ত্র মাধ্যমিক অধিদপ্তর

ড. দেওয়ান আযাদ রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বরাবরের মতো এবারও বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ১৯১টি দেশে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো—
‘শিক্ষকতাকে একটি সহযোগী পেশা হিসেবে পুনর্গঠন’, যা শিক্ষক, বিদ্যালয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য সহযোগিতার রূপান্তরমূলক সম্ভাবনা তুলে ধরে।এ বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপনের প্রতিপাদ্য বিষয়ের কেন্দ্রীভূত ধারণা শিক্ষকদের স্কুল এবং শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য সহযোগিতার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেবে। শিক্ষকতাকে স্বাভাবিকভাবে সহযোগী হিসেবে পুনরায় ফ্রেম করা - এমন নীতি, অনুশীলন এবং পরিবেশ দ্বারা সমর্থিত যা পারস্পরিক সমর্থন, ভাগাভাগি করার দক্ষতা এবং যৌথ দায়িত্বকে মূল্যায়ন করে এটি শিক্ষণ, শেখার এবং শিক্ষকদের পেশাগত সন্তুষ্টি শক্তিশালী করার জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের কাছেও এ দিবসটি অত্যন্ত গৌরব ও মর্যাদার।
১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে একটি ‘শিক্ষক সনদ’ প্রণয়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষক অধিকার সংক্রান্ত চিন্তার উদ্ভব ঘটে। ১৯৪৮ সালে সম্মিলিত জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২৬ অনুচ্ছেদে শিক্ষা মৌলিক অধিকার এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশ–এর গুরুত্ব পূর্ণব্যক্ত হয়। বিভিন্ন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী শিক্ষক সম্প্রদায়ের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং সুরক্ষিত করার জন্য ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশেষ আন্ত: রাষ্ট্রীয় সরকার সম্মেলনে ১৩ অধ্যায়ে বিন্যস্ত এবং ১৪৬টি ধারা, উপধারায় সম্মিলিত শিক্ষকদের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদাবিষয়ক ঐতিহাসিক ‘ইউনেস্কো আইএলও সুপারিশ ১৯৬৬ ‘প্রণীত হয়। এ ঐতিহাসিক দলিলে শিক্ষাকে দেশ, সমাজ ও জাতি গঠনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করে শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার, মর্যাদা ও দায়-দায়িত্বের বিষয়টি সুদৃঢ়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। পরবর্তীতে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কিত অর্জিত সাফল্যকে সমুন্নত রাখাসহ আরো সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে বিশ্বের ১৬৭টি দেশের ২১০টি জাতীয় সংগঠনের প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ সদস্যদের প্রতিনিধিত্বকারী আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠন ‘এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল’ গঠিত হয়। এ আন্তর্জাতিক সংগঠন জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে প্রনীত দলিলটি যথাযথ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করার অর্থবহ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ক্রমাগত অনুরোধ ও ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস ঘোষণা দানের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক এম মেয়র যুগান্তকারী ঘোষণা দেন।
এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক পালনের শুভ সূচনা হয়। ১৯৯৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় এ দিবসটি পালন হয়ে আসছে। শিক্ষকদের জন্য প্রণীত ও ঐতিহাসিক দলিলে শিক্ষকতাকে একটি সেবামূলক পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা সংগঠনগুলোকে একটি শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে শিক্ষার অগ্রগতিতে বিদ্যমান অসংগতি দূরীকরণে শিক্ষার মূলনীতি ও কর্মকাণ্ডকে যুগোপযোগী করতে হবে। শিক্ষকের স্বাধীনভাবে পাঠদান ও শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা ভোগের সুযোগ প্রদান এবং পাঠ্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা উপকরণের বিকাশে শিক্ষক সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—শিক্ষা সংগঠনগুলোকে একটি শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে শিক্ষার অগ্রগতিতে বিশেষত শিক্ষানীতি প্রণয়নসহ শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে এ শক্তির অবদান সুনিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকতা পেশায় দায়িত্ব পালনে শিক্ষায়তনে স্বাধীনতা ভোগের সুযোগ প্রদান এবং শিক্ষাক্রম,পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা উপকরণের বিকাশে শিক্ষক সংগঠনগুলোর সুব্যবস্থা থাকতে হবে।
শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে; ১। শিক্ষকদের মর্যাদাকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে প্রদেয় বেতন-ভাতা নিশ্চিতকরণ;২। সমাজে শিক্ষকতার গুরুত্ব প্রতিফলনে অন্যান্য পেশায় সমমানের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রদত্ত বেতনের সাথে অনুকূল তুলনীয়ভাবে ও পরিবার-পরিজনসহ যুক্তিসংগত জীবন যাপনের মান বজায় রাখার নিশ্চয়তা বিধান সাপেক্ষে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সুনির্ধারণ করা;৩। প্রতিষ্ঠিত বেতন স্কেলের ভিত্তিতে শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন পরিশোধ;৪। জীবন ধারণের ব্যয় বৃদ্ধি ও বর্ধিত উৎপাদনশীলতার কারণে ব্যয়ের উর্ধ্বমুখী বিবেচনায় প্রয়োজন অনুসারে বেতন স্কেল পুনঃনির্ধারণ ইত্যাদি। এ দলিলের শিক্ষকদের চাকরি ও কর্মজীবন, পেশাগত স্বাধীনতা ও অধিকার, কর্মঘণ্টা ও ছুটি সামাজিক নিরাপত্তাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যা শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির সহায়ক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি উপরোক্ত সুপারিশ মালার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এর বাস্তবায়ন যথাযথ হচ্ছে না।
সু-শিক্ষার জন্য প্রয়োজন সু-শিক্ষক। সু-শিক্ষককে অনেক গুণাবলির অধিকারী হতে হয়। সু-শিক্ষক পেতে হলে মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন স্কেল হলে উচ্চতর যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা এ পেশায় অংশগ্রহণে আগ্রহী হবেন। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর যতগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে,সবগুলো রিপোর্টে এ বাস্তবতা মেনে নেওয়া হয়েছে। ২০০৩ সালে গঠিত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট মতে, ‘শিক্ষাক্রম যতই উন্নত মানের হোক, বিদ্যালয়ের ঘর দুয়ার যতই চাকচিক্যময় হোক, অবকাঠামগত সুবিধা দিয়ে যতই প্রয়োজন মাফিক হোক না কেন শেষ বিচারের শিক্ষার গুণগত মান নির্ভর করে শিক্ষকদের বিষয় জ্ঞানের পরিধি, তাদের প্রশিক্ষণ, তাদের কাজের আগ্রহ, দক্ষতা ইত্যাদির উপর। প্রকৃতপক্ষে, ভালো শিক্ষক না হলে কখনো ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে না। অপরপক্ষে ভালো শিক্ষক পেতে হলে আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা দেয়া প্রয়োজন। এ কমিশনের স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের উপরও গুরুত্ব দেয়া হয়। ১৯৯৭ সালের অধ্যাপক শামসুল হকের নেতৃত্বে পরিচালিত শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের মতে শিক্ষকরা হচ্ছেন শিক্ষা ব্যবস্থার মূল শক্তি। অতএব শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। ২০০৯ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতেও শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর বেতন স্কেল ও যথাযথ মর্যাদা প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক উপাদান হচ্ছে শিক্ষক। শিক্ষকদের সমস্যার সমাধান করে তাদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষার উন্নয়ন অসম্ভব। তাই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে ও মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে মাধ্যমিক স্তরে এন্ট্রি পদ নবম গ্রেড নিশ্চিত করতে হবে।
অপরদিকে জীবন মান উন্নয়ন ও উন্নত জীবনযাপনের জন্য বিশ্বব্যাপী মানসম্মত শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েই চলছে। শিক্ষা কাঠামোর গুরুত্বপূর্ন স্তর হল মাধ্যমিক শিক্ষা। অনেক উন্নত দেশে মাধ্যমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে প্রাপ্ত মৌলিক শিক্ষাকে সম্প্রসারিত ও সুসংহত করা, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রয়োগ কৌশলে জনশক্তি সরবরাহ করা মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।
এ স্তরের শিক্ষা লাভ করে দেশের বিরাট জনশক্তি আর্থ -সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তাই আমাদের দেশেও মাধ্যমিক শিক্ষার চাহিদা বাড়ছে কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি আশানুরূপ নয়।
মূল্যায়ন পদ্ধতি, শিক্ষক নির্বাচন ও নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, স্কুল সংগঠন ও বিন্যাস, শিক্ষামূলক তত্ত্বাবধান এবং শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধন সম্ভব হয়নি। এ স্তরে শিক্ষার অন্যতম উপকরণ পাঠ্যপুস্তক নির্ভুলভাবে প্রকাশিত হচ্ছে না। পাঠ্যপুস্তকে নানা অসঙ্গতি ধরা পড়ছে, যা শিক্ষার সুষ্ঠু প্রক্রিয়াকে নষ্ট করছে। তাছাড়া আকর্ষণীয় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশেই উন্নতমানের শিক্ষার উপকরণ ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়েছে।
শিক্ষাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষার স্বতন্ত্র অধিদপ্তর গঠনের মাধ্যমে স্তরের সফলতা ক্রমবর্ধমানহারে বেড়েই চলছে। বর্তমানে মাধ্যমিক শিক্ষার পরিধি ও পরিসর ক্রমশই বাড়ছে। মেয়েদের ভর্তির হার বৃদ্ধির জন্য উপবৃত্তি প্রদান, বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি,শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের ফলে মাধ্যমিক স্তরে ভর্তির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। সে তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়েনি।
মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থাকলেও সারাদেশে বিশাল সংখ্যক মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনা দুরূহ। প্রশাসনিক সুবিধার্থে নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয় এবং ৬৪ জেলার শিক্ষা কার্যালয়, ৫১৬টি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, ৬৮৬টি সরকারি কলেজ, ৭০৬টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, এবং ১০৪ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-২০১৪ এর তথ্য মতে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২১২৩২ যার মধ্যে কলেজ ১৫১৪। এ কারণে এ বিশাল সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের জন্য আকাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। অধিকন্তু সরকারি মাধ্যমিকের অধিকাংশ প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, জেলা শিক্ষক অফিসার সহ বিভিন্ন স্থানে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রেষণে এনে অদক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে সুষ্ঠুভাবে শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।ফলে প্রাথমিক শিক্ষার মতো মাধ্যমিক শিক্ষার গতিশীলতা নেই।
মাধ্যমিক স্তরের এ সকল সমস্যা বিবেচনা করে স্বাধীনতা উত্তর বর্ণিত সব শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এর সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষ করে ২০০৩ সালে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশন সুপারিশ করেছিল মাধ্যমিক স্তরের সার্বিক প্রশাসনের জন্য স্বতন্ত্র অধিদপ্তর গঠন করা হোক।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন জানুয়ারি ২০২৫ প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, ‘পৃথক মাধ্যমিক অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। মাধ্যমিক শিক্ষার অধীনে অনেক প্রতিষ্ঠান থাকার কারণে শিক্ষার মান ক্রমশ কমছে। তাই আলাদা অধিদপ্তর গঠন জরুরি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আয়োজিত জাতীয় কর্মশালার সুপারিশের ভিত্তিতে বিয়াম ফাউন্ডেশন গবেষণা ও পরামর্শ সেবা কেন্দ্র একটি প্রতিবেদনে শিক্ষা প্রশাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে দুটি পৃথক অধিদপ্তরে ভাগ করার পরামর্শ দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর সচিব সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি মন্ত্রণালয় /বিভাগের সংস্কার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য মার্চিং অর্ডার দেওয়া হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ২৮ নভেম্বর ২০২৪ -এ দাখিলকৃত সময়নিষ্ঠ সংস্কার পরিকল্পনায় ডিসেম্বর ২০২৫ এর মধ্যে স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অন্তর্ভুক্তি ছিল।
তাই যুগোপযোগী ও মানসম্মত মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে আলাদা অধিদপ্তরের বিকল্প নেই। যদিও বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেষণায় রয়েছে এবং সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার মার্চিং অর্ডারের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের জানুয়ারি -২০২৫ প্রতিবেদন এবং মনিরুজ্জামান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু একটি কুচক্রী মহল এ সফল উদ্যোগকে নস্যাৎ করে বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ সরকার প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক ও রহস্যজনক। তাই স্বতন্ত্র মাধ্যমিক অধিদপ্তর বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজন।
শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়, ব্রতও বটে। শিক্ষকতা একটি শিল্প। যুগ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত নিত্য নতুন পুস্তক লেখা,পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, পাঠ পদ্ধতি শিখন, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের আধুনিক উপকরণ যেমন ওভারহেড প্রজেক্টর, অডিও ভিডিও স্লাইড, রঙ্গিন বোর্ড, চক, ডাস্টার প্রভৃতি কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে তারা শিক্ষাদানকে উপভোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তুলুক, শিক্ষক সমাজ সুশিক্ষিত জাতি গঠনে চমৎকার ভূমিকা পালন করুক এবং সর্বোপরি তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি হোক বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এই প্রত্যাশা সবার।
লেখক: গবেষক, প্রবন্ধকার ও প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ টিচার্স ফেডারেশন (এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল অধিভুক্ত)।


পাঁচটি ব্যাংক একীভূত হয়ে যে ব্যাংক হবে, সেখানে লুটপাট বন্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?

রেজাউল করিম খোকন
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠনের লক্ষ্যে পাঁচটি সংকটগ্রস্ত ইসলামি ব্যাংককে একীভূত করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যাকে আর্থিক খাত স্থিতিশীল করার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। নতুন প্রণীত ব্যাংক রেজ্যুলেশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫ এর অধীনে প্রণীত এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আনুমানিক ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা মূলধন প্রয়োজন হবে। একীভূতকরণের জন্য নির্ধারিত পাঁচটি ব্যাংক হলো: ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পুনর্গঠন উদ্যোগ। এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য ব্যয়বহুল লিকুইডেশন বা অবসায়ন প্রক্রিয়া এড়িয়ে চলা এবং শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা। একই সঙ্গে এটি বেসরকারিভাবে পরিচালিত ইসলামি ব্যাংকগুলোর গভীর সংকটকেও তুলে ধরেছে, যেগুলোর অনেকগুলোই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কনগ্লোমারেট বা ব্যবসায়িক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যাদের বিরুদ্ধে তহবিল পাচারের অভিযোগ রয়েছে। সরকারের কমিশন করা ফরেনসিক অডিটে গুরুতর অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখা গেছে— তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৯০ শতাংশেরও বেশি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতে, বছরের পর বছর দুর্বল তদারকির পর একীভূতকরণই এখন একমাত্র কার্যকর উপায়। প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে পরিকল্পনা ও তদারকির জন্য একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আমানতকারীদের স্বার্থকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে। অবসায়ন অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জন্য অনেক বেশি ব্যয়বহুল ও কষ্টকর হবে। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তটি সঠিক। কারণ, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল, যার মধ্যে রয়েছে স্থির বিনিময় হার এবং পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
সংকটে পড়া শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক মিলে একটি বড় ইসলামি ধারার ব্যাংক গঠন করা হচ্ছে। নতুন এই ব্যাংকের যাত্রার শুরুতে মূলধন জোগান দেবে সরকার। ব্যাংকটির প্রধান কাজ হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (এসএমই) অর্থায়ন করা। এই ব্যাংকের অনুমোদন (লাইসেন্স) দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অধীনে এই পাঁচ ব্যাংকের আমানত ও সম্পদ স্থানান্তর করা হবে। এই প্রক্রিয়া খুব শীঘ্রই শুরু হবে। ব্যাংক একীভূত হলেও গ্রাহকদের লেনদেনে কোনো সমস্যা হবে না। তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন ব্যাংকটির গ্রাহক হবেন। এছাড়া শীর্ষ পর্যায় ব্যতীত অন্য ব্যাংকাররা একীভূতকরণের প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত চাকরিতে বহাল থাকবেন। এ প্রক্রিয়া শেষ হতে অন্তত তিন বছর লাগতে পারে বলে জানা গেছে। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫-এর আওতায় এই কার্যক্রম শুরু হবে। আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ হবে। একীভূতকরণের আওতায় ব্যাংকগুলোর যেসব ঋণ খারাপ হয়ে পড়েছে, তা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির (এএমসি) কাছে হস্তান্তর করা হবে। এমনভাবে সম্পদ হস্তান্তর করা হবে, যাতে নতুন ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে থাকে। এতে বিদেশি বাণিজ্যে লেনদেনে খরচ কম হবে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে ব্যাংক টাকা নিতে পারবে। এরপর নতুন একটি ব্যাংকের লাইসেন্স অনুমোদন দেওয়া হবে। পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ ও দায় সেই ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরপর ধীরে ধীরে ব্যাংকের শাখাগুলো একীভূত করা হবে। এ জন্য জনবলও কমানো হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ধার করে আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। দেশে বড় আকারের একটা ইসলামী ধারার ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেশে ইসলামী ব্যাংক খাতের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। অবশ্য জবাবদিহি না ফিরলে ব্যাংক একীভূত করেও ব্যাংক খাত ঠিক হবে না। ব্যাংক যদি রাজনৈতিক লুটপাটের লক্ষ্য হয় এবং আর্থিক খাতের মূল সংস্কারগুলো না হয়, তাহলে কাজ হবে না। এ জন্য আগে সুশাসন, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। গত ৯-১০ মাসেও আর্থিক খাতে পুরোপুরি সুশাসন ফেরেনি। কেন এই সময়ে ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারল না, এটাও বড় প্রশ্ন। ব্যাংক একীভূত করে ভালোভাবে পরিচালনা করা গেলে সেটা ভালো কিছু হবে। এ জন্য কারা পরিচালনা করবে ও সুশাসন কতটা মেনে চলবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের সঙ্গে এই একীভূতকরণের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আশা করা যায়, আগামী সরকারও এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেবে। তবে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংককর্মীদের আশ্বস্ত করতে গিয়ে বলেছেও, এই একীভূতকরণের ফলে কোনো কর্মীকে চাকরি হারাতে হবে না। কর্মীদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। প্রয়োজনে কিছু শাখা পুনর্বিন্যাস করা হবে। যেসব ব্যাংকের শাখা শহর এলাকায় বেশি, সেগুলোর কিছু শাখা গ্রামাঞ্চলে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে বাংলাদেশ ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, ব্যাংকিং খাতের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রক্ষার নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে তা আর্থিক খাতের সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানা হচ্ছে না বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্ট অনেকে। এর ফলে পুরো প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। এই প্রক্রিয়া দিয়ে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধান করা যাবে না। বরং আরো নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে। চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করলেই হবে না। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।রিয়েল অডিট হয়েছে কি না, যাচাই-বাছাই ছাড়া চাপিয়ে দিয়ে একীভূত করলেই ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে এমন ভাবার কারণ নেই। বরং যে ব্যাংকগুলো খারাপ হয়েছে, সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতার অভাবের মতো বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ না করে একীভূত করলে ভালো ব্যাংকগুলো হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা থাকে।বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা করেছে তাতে বলা হয়েছে, খারাপ ব্যাংকের পরিচালকরা ব্যাংক একীভূত হওয়ার পাঁচ বছর পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে পারবে না।এছাড়াও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাঁটাই করার আশঙ্কাসহ নানা অনিশ্চয়তা থাকায় এই প্রক্রিয়া কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশে ব্যর্থতার দায় কেউ স্বীকার করে না। আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রকেরাও ব্যতিক্রম নন। কিন্তু এই ব্যর্থতা পুরো আর্থিক খাতকেই এখন বিপদে ফেলেছে। বেশ কিছু ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়েছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকে পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক হিসেবে নিজস্ব কর্মকর্তা বসিয়েছিল। কিন্তু এরপরও বিশেষ তদারকিতে থাকা বেশির ভাগ ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। দুর্বল ব্যাংকের পরিস্থিতি ভালো হয়নি কেন? এসব ব্যাংকের মালিক ও বড় গ্রাহকদের বেশির ভাগ ছিল সরকারঘনিষ্ঠ। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছে, এটাও বড় প্রশ্ন। কিন্তু ব্যাংক খাতে যে সংকট, ব্যাংক একীভূত করে কি সেই সংকট কাটানো যাবে—এটি একটি বড় প্রশ্ন। এই সংকটের জন্য যারা দায়ী—তা মালিক পক্ষ হোক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কিংবা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, তাদের ব্যাপারে কী করা হচ্ছে, সেটি আরেকটি বড় প্রশ্ন। ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকেই এখন দাবি উঠেছে, তারা ‘লুণ্ঠিত ঋণের’ দায় নিতে চান না। এ দেশে আমানতকারীদের অর্থ যারা লুণ্ঠন করেছেন বা লুণ্ঠনে সহায়তা করছেন, তাদের কোনো শাস্তির মুখে পড়তে হয় না। ব্যাংক একীভূত হয়ে আরও বড় যে ব্যাংক হবে, সেখানে লুটপাট বন্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটা জানাও এখন জরুরি।

লেখক: রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম।


গ্রামীণ অর্থনীতি জন্য ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি জরুরি

ড. মিহির কুমার রায়
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

গ্রামীণ অর্থনীতি দেশের সার্বিক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকলেও যা বর্তমানে অচলায়তনে রূপ নিয়েছে যা সাম্প্রতিক তথ্য উপাত্ত থেকে উঠে এসেছে । জিডিপিতে গ্রামীণ অর্থনীতির ভরকেন্দ্র কৃষি খাতের অবদানও কমে এসেছে। টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়ছে অর্থনীতিতে প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান রাখা গ্রামীণ উদ্যোগগুলোর। সব মিলিয়ে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির স্থবিরতায় এখন দুশ্চিন্তা বাড়ছে অর্থনীতিবিদদের। গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম বড় শক্তি কৃষি খাত। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপিতে খাতটির অবদানও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। প্রথম প্রান্তিকে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল দশমিক ১৬ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে জিডিপিতে এ খাতের অবদান ছিল দশমিক ৩৫ শতাংশ। এবার বন্যা ও রাজনৈতিক ডামাডোলে কৃষির অবদান কমেছে। আর সার্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ২ শতাংশে নেমে এসেছে।
গ্রামীণ অঞ্চলে ঋণপ্রবাহ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের তৃতীয় প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশের গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংক খাতের মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণ স্থিতি কমেছে প্রায় ১ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে এ ঋণ স্থিতি ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ৭৩৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। আগের পঞ্জিকাবর্ষের দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) শেষে এ স্থিতির পরিমাণ ১ লাখ ২৬ হাজার ১৫০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।এ সময়ে দেশে ব্যাংক খাতের মাধ্যমে মোট বিতরণকৃত ঋণ স্থিতিতে গ্রামীণ ঋণের অবদানও কমেছে। গত পঞ্জিকাবর্ষের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা আগের অর্থবছর শেষে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের কৃষি খাতে ৩৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এর মধ্যে বিতরণ করতে পেরেছে ৬ হাজার ৪৫৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে কৃষি খাতে মোট ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৮২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ২৬ দশমিক ৮২ শতাংশ।
কৃষি ঋণ বিতরণের উপখাতভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত অর্থবছরের তুলনায় এবার মোট কৃষি ঋণ বিতরণে শস্যের অবদান গত অর্থবছরের ৪৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৪৩ শতাংশে। আর দারিদ্র্য দূরীকরণে ঋণ বিতরণের অংশ ৮ শতাংশ নেমে এসেছে ৪ শতাংশে। তবে মোট ঋণ বিতরণে মৎস্য এবং পশুপালন ও পোলট্রি খাতের বিতরণের অবদান গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্য ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোকে ১২ হাজার ৬১৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য দেয়া হয়েছে। বাকি ২৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করবে দেশের বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে গত মাসে বিদেশি ব্যাংকগুলো থেকে কৃষি ঋণের প্রবাহ কমেছে প্রায় ৭১ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় এ হার ছিল ৩১ শতাংশ। আর সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কৃষি ঋণ কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি। তবে ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রভাবে কৃষি ঋণ বিতরণ কিছুটা কমেছে। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ঋণ পরিশোধের দিক থেকে বরাবরই সেরা পারফরম্যান্স আসে কৃষি খাত থেকে। খাতভিত্তিক ঋণ বিতরণের অনুপাতে আদায়ের হারের দিক থেকে কৃষির অবস্থান প্রতি বছরই শীর্ষে। এবারো এ খাতে ঋণ বিতরণ কমলেও ঋণ আদায় আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ আদায় হয়েছে ৯ হাজার ২০৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ আদায় হয়েছিল ৮ হাজার ১৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এদিকে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গ্রামীণ ব্যাংক এবং বড় ১০টি এনজিও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কৃষি খাতে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া হয়েছে ১৫ হাজার ৭১০ কোটি ৮৮ লাখ টাকার, যা গত অর্থবছরের তুলনায় দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। এনজিওগুলো ঋণ বিতরণের প্রভাব ঠিক রাখতে পারলেও পিছিয়ে পড়েছে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) চার দিনব্যাপী বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনের শেষদিনে এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জমির উর্বরতা ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত উর্বরতা শক্তি কিছুটা বেড়ে হয়েছিল ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। কিন্তু ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ব্যাপক কমে উর্বরতা শক্তি দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সার, কীটনাশক এবং ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক ব্যবহার পরিবেশের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। গবেষণায় আরও বলা হয়, ধীরে ধীরে কমছে শ্রমিকের দক্ষতাও। গবেষণায় বলা হয়েছে, ধানের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। প্রতি কেজি চালের উৎপাদন খরচ ২০১২ সালে ছিল ১০ টাকা ৫১ পয়সা। সেটি বেড়ে ২০১৫ সালে হয়েছে ১১ টাকা ৬৭ পয়সা, ২০১৮ সালে ১২ টাকা ৮৮ পয়সা। অন্যদিকে এক কেজি চাল বিক্রি করে লাভ হতো ২০১২ সালে ১৬ টাকা ১৭ পয়সা; ২০১৫ সালে ১৬ টাকা ৫২ পয়সা এবং ২০১৮ সালে ১৭ টাকা ৪৮ পয়সা। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে ধান উৎপাদন করে কৃষকের লাভের অংশ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। সম্মেলনে উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের কৃষি খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা হয়। তবে কৃষি খাতে বিদ্যমান নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এ খাতের টেকসই উন্নয়ন অব্যাহত রাখা সম্ভব। টেকসই উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে এ খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষকবান্ধব বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। ফসল উৎপাদনের মৌলিক উপাদান মাটি ও পানির দূষণ ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা সমস্যার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আগামীতে এ ধরনের আরও যেসব সমস্যা ফসল উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে, তা চিহ্নিত করে সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। শস্যের নতুন জাত আবিষ্কার করতে হবে। জমির উর্বরা শক্তি বাড়াতে মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করা দরকার। বস্তুত এ সবকিছুর জন্য প্রয়োজন গবেষণা বাড়ানো। উর্বরতা পুনরুদ্ধারে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, কৃষকদেরও সে বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। সময়মতো সহজ শর্তের ঋণ ও প্রশিক্ষণ না পেলে কৃষকদের কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব হবে না। কৃষক যাতে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পান, এটাও নিশ্চিত করতে হবে। এ খাতের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। নতুন করে দেশ পুনর্গঠনের বিভিন্ন দাবি উঠলেও, দুঃখজনকভাবে কৃষকদের অধিকারের প্রশ্ন তথা গ্রামীণ অর্থনীতি অনেকাংশেই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতি বন্যায়গ্রামগুলোর যে ক্ষতি হয়েছে, তা জাতির সামনে জ্বলন্ত বাস্তবতা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতে, বন্যায় সরাসরি আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৩৭ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর, যার কারণে অর্থনীতির ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই বিপুল ক্ষতি গ্রামীন জনপদে জীবনের ওপর যে আঘাত হেনেছে, তা পুষিয়ে নেওয়া সহজ হবে না।

লেখক: গবেষক ও শিক্ষাবিদ


নারী উন্নয়নে প্রয়োজন মূল্যবোধের পরিবর্তন

প্রসপারিনা সরকার
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

যে সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, নারী উন্নয়ন ব্যতিত সে সমাজ জাতির অগ্রগতি, স্থায়ীত্বশীল সার্বিক উন্নয়ন কখনও সম্ভব নয়। সুতরাং নারী প্রয়োজন হচ্ছে নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা, প্রতিবন্ধকতা, নিরাপত্তাহীনতা, বৈষম্য দূর করা, নারীর অর্থনৈতিক সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানসহ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এই নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে নারী আন্দোলন সংগ্রাম নারী অধিকার ও ক্ষমতায়ন শুধুমাত্র নারীদের সচেতনতা এবং আন্দোলনের বিষয় নয়। ইহা জাতি সমাজ পরিবার তথা ব্যক্তি পর্যায়ে সমাজের সকল স্তরের মানুষের সচেতনতা ও চিন্তা চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

২. বর্তমান সমাজে সংখ্যাগত দিক থেকে নারী শিক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু গুণগত দিক থেকে নারীর প্রকৃত উন্নয়ন বৃদ্ধি পায়নি। প্রকৃতপক্ষে নারী উন্নয়ন হচ্ছে -নারী শিক্ষার পাশাপাশি নারীর অর্থনৈতিক সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ নারী সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা । নারীর প্রতি সকল প্রকার শোষণ বৈষম্য প্রতিবন্ধকতা রোধ করে সমাজ ও জাতি গঠনে নারীর অগ্রণী ভূমিকা পালনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের চিন্তা-চেতনা মানসিকতার আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি তার অর্থনৈতিক মূল্যের ভিত্তিতে নিরাপদ কর্ম নিশ্চিত করতে হবে। তবেই সমাজ সংসারে নারীর উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পাবে। এর ব্যত্যয় হলে যুগ যুগ ধরে শোষিত নারীর চিত্রের ন্যায় অপরিবর্তিতরবে এবং নারী উন্নয়ন নারীর ক্ষমতায়নের নিয়ম নীতিমালা কেবল কাগজের ভাজা ভাজে রয়ে যাবে

বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীরা অধিক পরিমাণে নির্যাতন বৈষম্য এবং ভোগের শিকার হচ্ছে। আমাদের সমাজের পরিবারের অনেক নীতি নির্ধারক কর্তা ব্যক্তিরা নিয়ম নীতি বাস্তবায়ন পলিসি লেখেন, বাহিরে সভা মঞ্চে নারী স্বাধীনতা ও নারী জাগরণের কথা বলে বাহবা নেন। কিন্তু এই মহান কর্তা ব্যক্তিরাই তাদের ব্যক্তি জীবনে তারা প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে নারীকে শাসন শোষণ করতে পছন্দ করেন ভালোবাসেন। এর ফলে নারী শিক্ষা সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেও নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষা ও সচেতনতা পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক নিরাপত্তা নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের অন্যতম শর্ত।

সর্বোপরি নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক নিরাপত্তা একটি জীবনমুখী ইতিবাচক মূল্যবোধ। যে মূল্যবোধ দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে সমাজের কুসংস্কার ও ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত। তাই নারী উন্নয়ন ও সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নারী আন্দোলন শুধুমাত্র নারী সচেতনতা নয়, প্রয়োজনে সমাজের সকল স্তরের মানুষের সম্মলিত আন্দোলন, গণসচেতনতা, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের আমুল পরিবর্তন আনতে হবে। তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের মাধ্যমে স্থায়িত্বশীল উন্নত সমাজ ও জাতি।


নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের অবস্থান

রাজু আলীম
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক মহলে এক গভীর অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে যে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে, তা আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করবে। এটি কেবল দুটি দলের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং আদর্শিক অবস্থান, জোটবদ্ধতা এবং জনগণের প্রত্যাশার একটি জটিল সমীকরণ।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি প্রশ্ন ক্রমেই গুরুত্ব পাচ্ছে—আগামী নির্বাচনে বিএনপি কোথায় দাঁড়াবে এবং জামায়াত কীভাবে নতুন করে প্রভাব বিস্তার করবে। ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অনেকে ভেবেছিলেন, বিএনপি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ পেলে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে। কিন্তু কয়েক মাসের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং বিরোধী শক্তির নতুন জোটের কারণে এখন আর বিষয়টি এতটা সরল নয়।

সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল ঢাকায় সফরকালে জামায়াতে ইসলামীর আমিরের কাছে জানতে চেয়েছে, দলটি যদি ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পায়, তাদের মূল এজেন্ডা কী হবে। প্রশ্নটি নিছক সৌজন্যবশত করা হয়েছিল নাকি বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্ভাবনা বিবেচনায় রাখা হয়েছিল—সেটি এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জামায়াত তাদের অগ্রাধিকারে তিনটি বিষয় তুলে ধরেছে: শিক্ষাব্যবস্থাকে নৈতিকতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পুনর্গঠন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ। এসব প্রতিশ্রুতি শুনতে নতুন নয়, তবে একটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলকে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা রাষ্ট্রক্ষমতার সম্ভাব্য অংশীদার ধরে প্রশ্ন করছে—এটিই রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিবর্তনের বড় ইঙ্গিত।

অন্যদিকে বিএনপি এখনো প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হলেও তাদের জন্য নির্বাচনি পরিস্থিতি সহজ নয়। অভ্যুত্থানের পরপরই যেটি অনুমান করা হয়েছিল—আওয়ামী লীগের পতনের ক্ষণিক সুবিধা নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। তা এখন আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটছে না। কারণ, বিএনপি আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতির সুবিধা পাবে এমনটা না বরং জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রভৃতি শক্তির সঙ্গেও ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে।

বিএনপি অতীতে জামায়াতকে জোটসঙ্গী করেই ক্ষমতায় গিয়েছিল। আজকের প্রেক্ষাপটে সেই সিদ্ধান্ত তাদের জন্য একদিকে রাজনৈতিক আশীর্বাদ, অন্যদিকে বোঝা। আশীর্বাদ এই অর্থে যে, জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলনে সাথে ছিল, যা কোয়ালিশন রাজনীতিতে বিএনপিকে সহায়তা করতে পারে। আবার বোঝা, মুক্তিযুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা বিএনপির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বক্তব্যের সুযোগ করে দেয়। এবার যদি জামায়াত ও অন্যান্য ধর্মীয় দলগুলো আলাদা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, তাহলে বিএনপির পক্ষে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, সেটিও এখনো অনিশ্চিত। যদি তারা বাইরে থাকে, তবে তাদের ভোট স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিএনপির ঘরে যাবে—এমন নিশ্চয়তা নেই। মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিএনপির ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুইং ভোটার বা আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির সমর্থকরা বিএনপিকে ভোট দিতে অনাগ্রহী হলে তাদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে যাবে। এ অবস্থায় বিরোধী পক্ষের মধ্যে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যেখানে জামায়াত প্রধান স্টেকহোল্ডার হয়ে উঠতে পারে।

জামায়াতকে নিয়ে আরেকটি বাস্তবতা হলো, দলটি নির্মূল হওয়ার পরিবর্তে নানা কৌশলে টিকে আছে। আওয়ামী লীগ গত দেড় দশকে তাদের আইনি ও প্রশাসনিকভাবে সংকুচিত করার চেষ্টা করলেও আদর্শিক লড়াইয়ে প্রবেশ করেনি। বরং রাজনীতি ও শাসনে ব্যর্থতা জনগণের ক্ষোভ বাড়িয়েছে, যা জামায়াতকে নতুন জায়গা করে দিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম, যারা তিনটি বড় দলের শাসনকাল দেখেছে এবং প্রত্যেকটির সঙ্গেই দুর্নীতি ও অগণতান্ত্রিক আচরণের অভিযোগ জড়িত, তারা হয়তো এবার বিকল্প খুঁজতে চাইবে। এই বিকল্পের তালিকায় জামায়াত কিংবা এনসিপি উভয়ই থাকতে পারে।

তবে জামায়াতের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা এখনো অনেক দূরের সমীকরণ। বাংলাদেশে স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরে যদি একটি মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ের প্রশ্নবিদ্ধ দল বা জোট সত্যিই সরকার গঠন করে, তার দায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের ওপরই বর্তাবে। বিএনপি একসময় জামায়াতকে ক্ষমতার অংশীদার করেছে, আবার আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে তাদের নির্মূল করার চেষ্টা করেছে। ফলে জামায়াত নানা কৌশলে শক্তিশালী হয়েছে।

বিএনপির বর্তমান অবস্থান হলো, তারা প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হলেও এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার সমীকরণে অনিশ্চয়তা কোথাও থেকেই যাচ্ছে। জামায়াতের অবস্থান হলো, তারা একদিকে বিএনপির সম্ভাব্য মিত্র, আবার অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী। নির্বাচনে এই দ্বৈত সম্পর্কই সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা তৈরি করবে।

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অতীতের কোনো নির্বাচনের মতো হবে না। অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা এবং জনগণের আস্থা হারানো রাজনৈতিক দলের পরিণতি সব দলের জন্য শিক্ষা। শুধু জামায়াতকে স্বাধীনতাবিরোধী বলে আক্রমণ করলেই তাদের ভোট কমবে, এ নিশ্চয়তা নেই। আবার বিএনপির জন্যও কেবল আওয়ামী লীগের পতনের ফায়দা তুললেই চলবে না। গণতন্ত্র, সুশাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যে দাবি জনগণ করছে, সেটি পূরণের বিশ্বাসযোগ্য রূপরেখা না দিলে কোনো দলই স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় যেতে পারবে না।

সুতরাং জামায়াত ও বিএনপির অবস্থান এখন এক অদ্ভুত টানাপড়েনে। বিএনপি একদিকে জামায়াতের ঐতিহাসিক মিত্র, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। জামায়াত একদিকে ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার সুযোগ খুঁজছে, অন্যদিকে এককভাবে টিকে থাকার কৌশল নিচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব ও সম্ভাবনার মধ্যেই আগামী নির্বাচনের বাস্তব অঙ্ক নির্ধারিত হবে। বাংলাদেশি ভোটাররা বহু বছরের ব্যর্থতা ও হতাশার পর নতুন কিছু চান। কিন্তু সেই নতুন কী রূপ নেবে—বিএনপির পুনরুত্থান, জামায়াতের চমক, নাকি অন্য কোনো বিকল্প শক্তির উত্থান—সেটিই এখনো সময়ের কাছে অমীমাংসিত প্রশ্ন।

বিএনপির জন্য নতুন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

বিএনপির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করা। গত দেড় দশকের দমন-পীড়ন সত্ত্বেও দলটি টিকে ছিল মূলত আওয়ামী লীগবিরোধী একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে। কিন্তু এখন শুধু এই পরিচয়েই তাদের জয় নিশ্চিত হবে না। তাদেরকে জনগণের সামনে একটি সুসংহত ও বিশ্বাসযোগ্য উন্নয়ন রূপরেখা তুলে ধরতে হবে। অতীতে বিএনপি সরকার পরিচালনার সময় নানান অভিযোগ নিয়ে জনগণের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হয়েছিল, তা এখনো পুরোপুরি দূর হয়নি। এ অবস্থায় বিএনপি যদি শুধু আওয়ামী লীগের ভুলত্রুটি তুলে ধরে রাজনীতি করে, তবে তাদের ওপর থেকে তরুণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশের আস্থা উঠে যেতে পারে, যারা পরিবর্তন চাইলেও অতীতের পুনরাবৃত্তি দেখতে চান না। এই শ্রেণির ভোটাররা কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন চান না, বরং তারা চান এমন একটি দল, যারা সত্যিকার অর্থেই জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে।

জামায়াতের কৌশল ও ভবিষ্যৎ

অন্যদিকে, জামায়াত কৌশলগতভাবে তাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। সরাসরি রাজনৈতিক মাঠে কোণঠাসা হলেও দলটি তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবকে কাজে লাগাচ্ছে। বিশেষ করে, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তাদের যে দীর্ঘদিনের কার্যক্রম রয়েছে, তা এখনো অটুট। জামায়াতের এই সাংগঠনিক শক্তি ভোটের সময় নীরব সমর্থন বা ভোটব্যাংক হিসেবে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। উপরন্তু, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গেসাক্ষাৎ ইঙ্গিত দেয় যে আন্তর্জাতিক মহলেও তারা নিজেদের একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। এই কৌশল জামায়াতকে কেবল বিএনপি বা অন্য দলের ছায়ায় নয়, বরং একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করছে।

জামায়াত অতীতে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় এলেও তাদের মূল লক্ষ্য ছিল নিজস্ব আদর্শিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন। এবার যদি তারা স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন পায়, তাহলে তারা কেবল বিএনপির মিত্রই নয়, বরং সরকার গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দরকষাকষির শক্তি হয়ে উঠবে। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াত হয়তো বিএনপিকে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের শর্তে সমর্থন দিতে চাইবে, যা বিএনপির জন্য এক নতুন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে।

জনগণের প্রত্যাশা ও বিকল্প শক্তির উত্থান

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নয়, বরং জনগণের মধ্যেও এক ধরনের দ্বিধা কাজ করছে। অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগের পতন গণতন্ত্রের জন্য একটি শুভ লক্ষণ। কিন্তু একই সময়ে তারা চিন্তিত এই ভেবে যে, এর ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে। জনগণের একটি অংশ জামায়াতকে তাদের আদর্শিক অবস্থানের জন্য সমর্থন করে, আবার আরেক অংশ তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি মনে করে। অন্যদিকে, বিএনপির প্রতি জনগণের সহানুভূতি থাকলেও তাদের নেতৃত্ব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এখনো প্রশ্ন থেকে গেছে। আগামী নির্বাচন তাই কেবল একটি দলীয় বিজয় বা পরাজয় নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আদর্শ ও ভবিষ্যতের একটি বড় পরীক্ষা। এটি কেবল ভোটের অঙ্ক নয়, বরং জনগণের দীর্ঘদিনের হতাশা ও নতুন করে কিছু পাওয়ার আকুলতার প্রতিফলন।

এই পরিস্থিতিতে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানও একটি সম্ভাবনা। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো দলগুলো যদি জনগণের মধ্যে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে, তবে তারা আগামী নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। এই দলগুলো তরুণ ও মধ্যবিত্ত ভোটারদের আকর্ষণ করতে পারে, যারা চিরাচরিত বড় দলগুলোর উপর আস্থা হারিয়েছেন। এদের উত্থান বিএনপির জন্য যেমন একটি নতুন চ্যালেঞ্জ, তেমনি জামায়াতের জন্যও একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কারণ, এই দলগুলো মূলত একই ধরনের ভোটব্যাংকের ওপর নির্ভর করে।

সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামী নির্বাচন একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যেকার সম্পর্ক, তাদের নিজস্ব কৌশল এবং জনগণের প্রত্যাশার উপর ভিত্তি করে এই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হবে। এই টানাপোড়েন ও অনিশ্চয়তার মধ্যেই আগামী দিনের রাজনৈতিক বাস্তবতা নির্ধারিত হবে।

রাজু আলীম: কবি, লেখক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।


তাফসীরে হিদায়াতুল কোরআন

ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

সূরা সাজদাহ, পর্ব ৬

অনুবাদ

(২৬) এসব (ঐতিহাসিক ঘটনাবলি) দ্বারাও কি তাদের হিদায়াত হলো না যে, তাদের পূর্বে আমি অনেক প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছি, যাদের বাসভূমিতে (আজ)-এরা চলাফেরা করছে। এতে নিশ্চয়ই অনেক নিদর্শন রয়েছে। এরা কি শুনতে পায় না? (২৭) তারা কি লক্ষ্য করে না যে, আমি শুষ্ক ভূমিতে পানি প্রবাহিত করি, অতঃপর তা দ্বারা ফসল ফলাই, যা থেকে তাদের পশুরা ও তারা নিজেরা খাদ্য গ্রহণ করে? তারা কি দেখে না? (২৮) তারা বলে: সে ফায়সালা কখন হবে, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো? (২৯) বলে দাও: যারা কুফরিকরেছে, ফায়সালার দিন ঈমান আনলে তাদের কোন লাভ হবে না। আর তাদেরকে কোন অবকাশও দেওয়া হবে না। (৩০) সুতরাং তাদেরকে (তাদের অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে) এড়িয়ে যাও। আর তুমি অপেক্ষা করো, তারাও অপেক্ষমানই আছে।

মর্ম ও শিক্ষা

গোটা সূরাতে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, আল্লাহর কিতাব, রিসালাত, আখিরাত ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। তারপর এখানে এ সূরাটির উপসংহার টানা হয়েছে। এ উপসংহারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপরের সবকয়টি বিষয়ের দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। সর্বশেষে বলা হয়েছে, এরপরে যদি বাতিলপন্থিরা পথে না আসে, তাহলে তাদের পিছনে সময় নষ্ট করা অথবা এর জন্য মর্মাহত হওয়ার কারণ নেই। রাসূল ও সত্যপন্থিদের উচিত হবে, তাদের এড়িয়ে যাওয়া এবং নিজ কাজে মনোনিবেশ করা। তারা অপেক্ষা করতে থাকুক, দেখুক তাদের কি পরিণতি হয়।

ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহ থেকে শিক্ষা গ্রহণের তাগিদ

এখানে আল্লাহ বিস্ময় প্রকাশ করছেন, পূর্বে যেসব জাতি সত্য-প্রত্যাখ্যান ও সীমালঙ্ঘনের কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে, সেগুলো দেখেও তারা কিভাবে উদাসীন আছে এবং শিক্ষা গ্রহণ করে না। এ তাগিদের সারমর্ম হলো এই যে, অতীত জাতিসমূহের পতনের ইতিহাস চর্চা করা, কি কারণে তাদের পতন হয়েছে তা খতিয়ে দেখা এবং সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। কোরআনে বার বার বলা হয়েছে, কোন জাতি যখন সত্য-প্রত্যাখ্যান পূর্বক সীমালঙ্ঘন করে গেছে, তখন তাদেরকে প্রথম দিকে অবকাশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এরপরেও যখন তারা পথে আসেনি বরং সীমালঙ্ঘনে অটল ও অবিচল রয়েছে, তাদের অনেক জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সে ইতিহাসগুলো তাদের পাঠ করা উচিত, এবং সেখান থেকে তাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

পূর্ব জাতিসমূহের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া: দেশ ভ্রমণের একটা নতুন উদ্দেশ্য

পূর্ব জাতিসমূহের ধ্বংস ও পতনের পুঁথিগত ইতিহাসই শুধু নয়, বরং অনেক স্থানে তাদের পতনের চিহ্ন রয়েছে। তা দেখার জন্য দেশ ভ্রমণ করা উচিত। আয়াতে বলা হয়েছে, মক্কার লোকেরা তৎকালীন শাম দেশ ও আশে পাশের এলাকায় বিভিন্ন জাতির পতনের চিহ্ন দেখতে পায়। এসব এলাকায় তারা ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য চলাফেরা করে। এসব দেখেও তারা কিভাবে চুপ থাকে? কুরআনের অন্যত্র মানুষকে অতীত জাতিসমূহের ধ্বংসাবশে দেখতে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। সুতরাং শুধু নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ভ্রমণ নয়, বরং অতীত জাতিসমূহের ধ্বংসাবশেষ দেখা এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভ্রমণ করা উচিত। এখানে দেশ ভ্রমণের একটা আদর্শিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। অতীত জাতিসমূহের ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের ইতিহাস পাঠ করা উচিত। চিন্তা করে দেখা উচিত, কি কি কারণে তারা ধ্বংস হয়েছে।

শ্রবণশক্তিকে ঠিকভাবে কাজে লাগানো

বলা হয়েছে, এরা কি শুনতে পায় না? অর্থাৎ ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের ইতিহাস ও ধ্বংসাবশেষের মধ্যে সত্য-প্রত্যাখ্যানের পরিণতির সাক্ষ্য রয়েছে, তদুপরি সত্যপন্থীরা সত্যের দাওয়াত দেয়, কিন্তু তবু বাতিলপন্থীরা কর্ণপাত করে না। তাদের কান আছে, কিন্তু শুনে না। অথচ কান দেয়া হয়েছে শুনার জন্য। এজন্যই আল্লাহ বিস্ময়ের সুরে বলেছেন, এরা কি শুনতে পায় না? সুতরাং শ্রবণ শক্তিকে কাজে লাগানো উচিত।

পুনরুত্থান, কিয়ামত ও আখিরাতের প্রাকৃতিক প্রমাণ

আয়াতে বলা হয়েছে, তারা কি এ বিষয়টি লক্ষ্য করে দেখে না যে, আল্লাহ শুষ্ক মৃত ভুমিকে আকাশের পানি দ্বারা পুনর্জীবন দান করেন। এতে করে মৃত ভুমি আবার জীবন্ত হয়ে উঠে। সেখানে ফল ও ফসল উৎপন্ন হয়। যা তারা নিজেরাও খায়, পশু পাখীরাও খায়। যখন শুষ্ক মৃত ভূমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণের পর সিক্ত হয়ে উঠে, জীবন্ত হয়ে উঠে, তখন তারাই তো সেখানে চাষ করে। এ ঘটনাটি তাদের চোখের সামনে ঘটে। এখান থেকে কি তারা বুঝতে পারে না, যে আল্লাহ শুষ্ক মৃত জমিকে জীবন্ত করে তুলতে পারেন, তিনি একজন মৃত মানুষকেও পুনর্জীবিত করতে পারবেন। অর্থাৎ কিয়ামত ও পুনর্জীবন সম্ভব, এবং তা অকাট্য সত্য, যার দলীল-প্রমাণ প্রকৃতির মধ্যেও রয়ে গেছে। মানুষ যদি একটু বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করে, তাহলে তা বুঝতে পারবে।

দাওয়াত ও চ্যালেঞ্জ: বিজয় অনিবার্য

কোন কোন তাফসীরকার মৃত শুষ্ক ভূমিকে বৃষ্টির পানি দ্বারা জীবন্ত করে তোলা এবং তাতে ফসল ফলানোর আরেক রূপক ধরনের ব্যাখ্যা করেছেন। তা হলো এই যে, রাসূল ও সত্যপন্থিরা যখন মানুষের নিকট সত্যের দাওয়াত নিয়ে যায়, তখন অনেকেই তাকে প্রত্যাখ্যান করে। কোন কোন সময় মনে হয় তাদের দাওয়াত নিষ্ফল হয়ে গেছে, তাদের হৃদয় যেনো মৃত, যাতে সত্যের বীজ অংকুরিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এখানে আল্লাহ ঘোষণা করছেন, নিরাশ হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। দাওয়াতী কর্মকাণ্ড দ্বারা আল্লাহ মৃত হৃদয়েও জীবন সঞ্চালন করবেন। সেখানে দীনের চারা অঙ্কুরিত হবে। ফুলে ফলে ভরে উঠবে সে মৃত ভুমি। কাজেই সত্যপন্থীদের উচিত নিজ দায়িত্ব পালন করে যাওয়া।

আখিরাতের ব্যাপারে বাতিলপন্থীদের বিদ্রুপাত্মক প্রশ্ন

অনেক বাতিলপন্থি কিয়ামত ও আখিরাত অস্বীকার করে। তাদের নিকট যখন ঈমান ও আখিরাতের কথা বলা হয়, তখন তারা বিদ্রুপের সুরে বলে, কিয়ামত যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তা কখন আসবে। তার দিনক্ষণ আমাদেরকে বলো। এখানে আল্লাহ তাদের এমন কথার এ জবাব দিতে পরামর্শ দিয়েছেন যে, সে ফায়সালার দিন অবশ্যই আসবে। তখন তারা সত্যিই চাক্ষুস দেখতে পারবে যে আখিরাতের ওয়াদা সত্য ছিল। তখন তারা ঈমান আনতে চেষ্টা করবে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হবে না।

সময় শেষ হয়ে গেলে শুভ বুদ্ধিতে কোন লাভ নাই

এখান থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো এই যে, যার যে দায়িত্ব তা সময় থাকতেই পালন করতে হবে। কেউ যদি সে কর্ম ও দায়িত্বকে অস্বীকার করে অথবা অস্বীকার না করা সত্ত্বেও উদাসীন ভাবে সময় কাটিয়ে দেয়, তাহলে সময় শেষ হয়ে গেলে শুভ বুদ্ধির উদয় হলেও কোনো লাভ নেই। কোরআনে বার বার বলা হয়েছে, সময় শেষ হয়ে গেলে যখন মৃত্যু সমাগত তখন ঈমান আনলেও লাভ নেই। কিয়ামতের দিন অনেক বাতিলপন্থি মানুষ আল্লাহর সামনে ভুল স্বীকার করে মিনতি করবে যেনো তাদেরকে একটু অবকাশ দেয়া হয়। যেনো আবার দুনিয়াতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। তাহলে তারা তাদের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করবে এবং বেশি বেশি ইবাদত করে ক্ষতিপূরণ করবে। কিন্তু তাদের অনুমতি দেয়া হবে না বরং বলা হবে তোমরা এখন অনন্তকালের শাস্তি ভোগ করো।

দুনিয়ার জয়-পরাজয়ের ফায়সালা আল্লাহর হাতে

কেউ কেউ আয়াতটির অন্যরূপ ব্যাখ্যাও করেছেন। তা হলো এই যে, বাতিলপন্থিরা সত্যপন্থি মুমিন মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস দেখে প্রশ্ন করত, যদি তোমরা সত্যিই ঠিক হয়ে থাকো, আর যদি মনে করো শেষ পর্যন্ত তোমারাই বিজয়ী হবে, তাহলে সে বিজয় কবে আসবে? তোমরা তো মার খেয়েই চলেছো? সে প্রসঙ্গে এখানে বলা হয়েছে, ফায়সালা আল্লাহর হাতে। আল্লাহ যখন এবং যে সময়কে উপযুক্ত মনে করবেন, তখনই জয় দিবেন। তবে জয়ের পূর্বে জয়ের শর্ত পূরণ করতে হবে। তা হলো ধৈর্য, সীসা ঢালা প্রাচীরের মতো সত্যের পথে সংগ্রাম, বলিষ্ঠ ঈমান ও ঐক্য। যখন এসব শর্ত পূরণ হবে তখনই বিজয় আসবে। অসত্যের পরাজয় হবে।

দুনিয়ার জীবনে বাতিলপন্থিদের সম্ভাব্য পরাজয় ও শাস্তি

আয়াতে সত্যপন্থিদের বলা হয়েছে, তারা যেন অপেক্ষা করে, আর বাতিলপন্থিরাও যেন অপেক্ষায় থাকে। এর একটি অর্থ এই যে, বাতিলপন্থিরা ফায়সালার জন্য অপেক্ষা করুক। তারা দুনিয়াতেই তাদের পরিণতি দেখতে পারে। তারা আল্লাহর নিকট থেকে শাস্তির সম্মুখীন হতে পারে, সমূলে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, অথবা পরাজিত হতে পারে। সুতরাং মক্কার বাতিলপন্থীরা করুণ পরাজয় স্বীকার করেছিল।

কিয়ামতের বাতিলপন্থিদের করুণ পরিণতি

বাতিলপন্থিরা ফায়সালার জন্য অপেক্ষা করুক, এর আরেকটি অর্থ হলো এই যে তারা দুনিয়ায় আনন্দ করে কাটাক এবং কিয়ামতের দিন আল্লাহর ফায়সালার জন্য অপেক্ষা করুক। কিয়ামতের দিন তারা অত্যন্ত কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হবে।


রাশি চক্রের আদি কথা ও রহস্য

মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বহুদিন ধরে ভাবছি, রাশিচক্র নিয়ে স্বল্প পরিসরে কিছু একটা লিখব। কিন্তু এটি সম্পর্কে অতটা স্বচ্ছ জ্ঞান না থাকায় ফার্মগেটস্থ ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের জ্যোতিষীকে জেড আই এর শরণাপন্ন হই। শুধু তাই নয়, এ ব্যাপারে চৈতী জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী এ সম্পর্কে অভিজ্ঞ রতন কুমার পাইকের দিকনির্দেশনা নেই এবং তাদের সাথে বিভিন্ন আঙ্গিকে আলাপ-আলোচনা করি। তা ছাড়া এ ব্যাপারে ‘কিরো’ এর বই সহ আরও কিছু বইও জোগার করে স্ট্রাডি করি। অবশ্য আমাদের মুসলিম সমাজে এই জ্যোতিষ শাস্ত্রকে খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। কারণ এর সাথে ধর্মীয় নীতি বিরোধী ভাগ্য গণনা জড়িত। মজার ব্যাপার হলো যে, এই জ্যোতিষ শাস্ত্রের উদ্ভব অতি প্রাচীনকালে অর্থাৎ যীশু খৃষ্টের জন্মের অনেক আগে কালাডীয় সভ্যতার প্রাক্কালে। প্রাচীনকালে জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান অভিন্ন বলে বিবেচিত হতো। পাশ্চাত্য সপ্তদশ শতকীয় দর্শনে বিজ্ঞানীদের দ্বারা জ্যোতিষশাস্ত্র প্রত্যাখ্যাত হলে দুটি বিদ্যা ক্রমে পৃথক হয়ে যায়। মধ্যযুগের পরবর্তী পর্যায়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে মনে করা হতো সেই ভিত্তি, যার উপর দাঁড়িয়ে জ্যোতিষবিদ্যার কাজ চলতে পারে।

বস্তুত সেই প্রাচীনকালে রাশির স্বকীয়তা ও অবস্থান চিহ্নকল্পে সম্যক ধারণার নিমিত্তে একটি বিশেষ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, যে গ্রহসহ তারামণ্ডলগুলোর মধ্য দিয়ে ভূকক্ষ অতিক্রম করে তার প্রতিটিকেই সেই প্রাচীনকালে কোনো না কোনো জন্তুর আকৃতি দেওয়া হয়েছিল। আর এই কারণে প্রাচীন গ্রিসের অধিবাসীরা রাশিচক্রকে অভিহিত করত ‘জোডিয়াকোস কিকলোস’ বা ‘জন্তুদের বৃত্ত’। অবশ্য রাশিচক্রে মোট গ্রহসহ তারামণ্ডলের সংখ্যা এবং তাদের আকৃতি আগে অনেকাংশে নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব হতো না। তবে গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যার গোড়াপত্তনের পর তারামণ্ডলগুলোর সীমানা নির্দিষ্ট করা হয়। আর রাশিচক্রে মোট যে গ্রহসহ ১২টি তারকামণ্ডল আছে, তা হলো- অশ্বিনী, রোহিণী, সোমতারা, পুষ্যা, মঘা, চিত্রা, বিশাখা, জ্যেষ্ঠা, কাউস অস্ট্রেলিস, দেনেব আলগেদি, শতভিষা ও মৎস্যমুখ এবং আপাতভাবে বলা যায় যে, সূর্য এই ১২টি তারামণ্ডলসহ গ্রহের মধ্য দিয়েই অতিক্রম করে থাকে বিধায় কোনো মণ্ডলে সূর্য কতদিন অবস্থান নিয়ে থাকে, তাও নির্দিষ্টভাবে জানা যায়।

সত্য কথা বলতে কী, এই জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে বির্তকের শেষ নয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তিবাদীরা বলেন যে, এটি বিজ্ঞান নয়, বলতে গেলে এটি অপবিজ্ঞান। তারা আরও উল্লেখ করেন যে, কর্ম দ্বারা ভাগ্য নিয়ন্ত্রত হয়। ভাগ্য লেখা থাকলেই যে হবে, তা তারা বিশ্বাস করেন না। আর সবকিছু প্রকৃতি তথা স্রষ্টা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই সৃষ্টি তথা মানুষ হিসেবে জ্যোতিষীরা যে ভাগ্য গণনা করতে পারে। এটি কেমন কথা? মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর জবাবে জ্যোতিষীরা বলেন, যে শাস্ত্র জ্যোতি অর্থাৎ আলোর পথ ধরে এই ভূমণ্ডলে যা কিছু ঘটছে তারই পথ নির্দেশনা করে, তাই জ্যোতিষশাস্ত্র। আর বিজ্ঞান হচ্ছে বিশেষ জ্ঞান। পথ নির্দেশনাকারী বিশেষ জ্ঞানই হচ্ছে জ্যোতিষশাস্ত্র, যা সদূর পাঁচ হাজার বছর আগে বৈদিক যুগে এই উপমহাদেশেই প্রথম চর্চা শুরু হয়। সনাতনী ধর্মের আওতায় চতুর্বেদের অন্যতম অথর্ববেদের অঙ্গ এই জ্যোতিষ শাস্ত্র। এ শাস্ত্র হাজার হাজার বছর ধরে বহু ঘটনার মূর্ত প্রতীক হিসেবে সনাতনী ধর্মীয় অঙ্গের ধারায় গৃহীত। শুধু তাই নয়, শিক্ষণীয় উপদেশমূলক জ্ঞানের সম্ভার। এ দিকে চলমান জীবনে অনুসরণীয় পঞ্জিকার কথা ধরুন। এখানে চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, অমাবস্যা, পূর্ণিমা ইত্যাদির কথা দণ্ড, তিথি, পল, অনুপল অনুসারে যেভাবে বর্ণিত থাকে, বাস্তবে তার এতোটুকু গরমিল কী ধরা পড়েছে? কোনো ব্যতিক্রম কী কোন সময় হয়েছে? এ প্রেক্ষাপটে পাঠক সমাজই বিচার করুন এটি বিজ্ঞানভিত্তিক শাস্ত্র কি না? আর ভাগ্য বলে কিছু একটা যে আছে যুক্তিবাদীরা বিশ্বাস করেন না। তারা বলেন, মনুষ্য জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় ব্যক্তির কর্ম, শ্রম ও সাধনার দ্বারা। এ বিষয়ে জ্যোতিষীদের ফলিত অভিমত ভিন্নতর। অবশ্য এটি বোঝার সুবিধার্থে একটি উদাহরণের সাহায্যে নিচ্ছি। মনে করি এক বিত্তশালী অভিজাত পরিবারে যে সময় একটি শিশুর জন্ম হলো, ঠিক সেই সময় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে এবং দরিদ্র পরিবারে দুটি শিশু জন্মগ্রহণ করল। এই তিনটি শিশুই ক, একইভাবে লালিত-পালিত হবে? সবাই কী একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে? কিন্তু বাস্তবে তা হওয়ার নয়; তাহলে এমন অবস্থান কার নিয়ন্ত্রণে?

সাধারণত জ্যোতিষীরা গণনার ক্ষেত্রে হাতের রেখার উপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। অথচ অনেকে বলে থাকেন যে, মাতৃগর্ভে সন্তান থাকাকালে হাত কুঁকড়ে থাকে বলে ওই দাগ পড়বেই, রেখাটেখা বলে কিছু নেই। এ সম্পর্কে জ্যোতিষীরা ভিন্নমত পোষণ করেন। তারা বলেন, মাতৃগর্ভেই শিশুর হাত মুষ্টিবদ্ধ থাকে বলে রেখা হলে তা পাশাপাশিই হতো, লম্বালম্বি রেখাগুলো হতো না। আর তাই যদি হয়, তবে প্রতিটি মানুষের রেখা ভিন্নতর হয় কেন? রেখার গতি-প্রকৃতি একজনের সাথে অন্য জনের মেলে না কেনো? আপন দুই ভাইয়ের হাতের রেখা এক হয় না কেন? জ্যোতিষীরা যে রত্ন (যেমন- পান্না, হীরা, রুবী, রক্ত প্রবাল, গোমেদ, মুক্তা, ক্যাটসআই, পোখরাজ, ফিরোজা, ইন্দ্রনীলা, টোপাজ, ইত্যাদি) ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেন, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু কথা আছে। এই মহাবিশ্ব এতটাই আজব ও রহস্যপূর্ণ যে অনেক কিছু আমাদের জ্ঞানের বাইরে। তথাপিও যতটুকু জানা গিয়েছে, তাতে প্রতীয়মান হয়েছে যে, অতি ক্ষুদ্র পরামাণু বলেন, আর সৌর মণ্ডলের গ্রহ বা উপগ্রহ বলেন। সবই শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে যার যার মতো করে চলছে। এর এতটুকু ব্যতিক্রম নেই। আর প্রত্যেকটির বস্তুর নিজস্বতার আড়ালে মহাজাগিতক রাশি বিচ্ছুরিত করে। অনেক ক্ষেত্রে এই মহাজাগতিক রাশি ঘণীভূত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করে। তা ছাড়া এই রশি যখন কোনো বস্তুর উপর পড়ে তখন বিকিরণ ঘটায়। এদিকে মানুষ যে রত্ন ব্যবহার করে, তার উপর বাইরে থেকে আসা রাশি ন্যানো তরঙ্গে প্রতিফলিত করে। আর রত্নের অনু-পরামাণু এমনভাবে বিনস্ত, সে এটি বাইরে থেকে রশি তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে আড়ালে পৃথক পৃথকভাবে শুভ ও অশুভ নির্ধারণপূর্বক শুভকে গ্রহণ করে এবং অশুভকে বর্জন করে থাকে। আরেকটি কথা, ব্যবহৃত রত্নের আবার নিজস্ব বিকিরণ শক্তি আছে। এটি সবসময় পজিটিভ। আর বাইরে থেকে আসা অশুভ রাশির কম্পন বা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস নেগেটিভ থাকে। এ ক্ষেত্রে রত্নের পজিটিভ এবং বাইরের পজিটিভ মিলে বিশেষ শক্তি উৎপন্ন করে অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করে থাকে। আর রত্নের বিকিরণ রাশি শুধু উপকারী নয়, রত্ন বর্ণেরও উপকারিতা আছে। মানবজীবনে সব রকমের দেহ বা মনের রোগ বর্ণ বৈষম্যেরই পরিণতি। প্রত্যেকটি বর্ণই তার আপন কাজে ব্যস্ত। যেকোনো একটি বর্ণের ক্ষেত্রে সেই বর্ণের রত্ন ব্যবহার অপরিহার্য। এভাবে রত্ন অশুভ গ্রহের প্রভাব দূর করে মানবজীবনে কল্যাণ সাধন করতে পারে।

ছোটবেলা থেকে কতগুলো বচন শুনে আসছি, যেমন- কপালের লিখন, না যায় খণ্ডন এবং মানুষ তার নিজের ভাগ্যের কারিগর বা নির্মাতা, ইত্যাদি। আসলে এ দুটি বচন সাংসর্ষিক এবং তাদের দৃষ্টিকোন থেকে সবাই ঠিক। আর অত্র প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো জ্যোতিষশাস্ত্র। এতে ভাগ্য গণনাপূর্বক আগত সময়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। এটা সত্য যে, এ বিশ্বে মানুষ সমান নয়। কেউ বোকা, আর কেউ বুদ্ধিমান। মূলত বুদ্ধিমানদের আইকিউ লেভেল উপরে থাকে। সাধারণত জ্যোতিষীরা বুদ্ধিমান হয়ে থাকে। এ দিকে জন্ম তারিখভিত্তিক কতগুলো বৈশিষ্ট্য প্রাচীনকাল থেকে নির্ধারিত। তাই আমি মনে করি জন্ম তারিখভিত্তিক বৈশিষ্ট্য ও আগত জাতকের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্ব, চিন্তাধারা, স্বভাব, আকাঙ্ক্ষা, ইত্যাদি জেনে জ্যোতিষীরা সম্ভাবনার কথা বলে থাকেন। এটি অনেক ক্ষেত্রে সঠিক হয়। আবার অনেক সময় সঠিক হয় না। তবে সামগ্রিক বিষয়াদি বিবেচনায় আনলে জ্যোতিষীদের ভূমিকা ফেলনা নয় বিধায় ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।

লেখক: বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।


banner close