শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

দুর্ঘটনায় উদ্ধারকারীর আইনি সুরক্ষা প্রয়োজন

রাইসুল সৌরভ
প্রকাশিত
রাইসুল সৌরভ
প্রকাশিত : ৩ মে, ২০২৩ ০৯:৩২

সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য প্রথম ঘণ্টাটি জীবন বাঁচাতে বা শারীরিক ক্ষতির ঝুঁকি কমাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই প্রথম ঘণ্টাকে সড়ক দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে গোল্ডেন আওয়ার হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই এক ঘণ্টার মধ্যে জরুরি চিকিৎসাসেবা পেলে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য দুর্ঘটনা-পরবর্তী জরুরি চিকিৎসাসেবা সুবিধা অত্যন্ত অপ্রতুল এবং কিছু ক্ষেত্রে দুষ্প্রাপ্যও বটে। দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের জরুরি চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য নয়; বিশেষত গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই সুবিধা অপর্যাপ্ত। দুর্ঘটনা-পরবর্তী জরুরি চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির শারীরিক অক্ষমতার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, অপরদিকে তার পরিবারের ওপর আর্থিক চাপ বৃদ্ধি করছে।

সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সাধারণত স্থানীয় বাসিন্দা অথবা পথচারীরা দুর্ঘটনাস্থলে প্রথম উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণ করেন। তারা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে কোনো রকম প্রশিক্ষণ বা দক্ষতা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং দুর্ঘটনায় পতিত যাত্রীদের বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য তৎক্ষণাৎ যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। অতঃপর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য কাছের সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিয়ে যান। তাই সড়ক, রেল বা বিমান দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের মৃত্যু এবং বড় ধরনের শারীরিক ক্ষতি এড়াতে স্থানীয় অধিবাসী ও পথচারীদের ভূমিকা অপরিসীম।

ইদানীং অবশ্য কোনো আহত ব্যক্তিকে রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দেখলে সাহায্যের পরিবর্তে পথচারীরা তাদের সঙ্গে থাকা ফোনে ভিডিও রেকর্ড করা এবং কোনো রকম সাহায্য না করে নিজ গন্তব্যে চলে যাওয়া খুবই সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পথচারীরা ভুক্তভোগীদের সহায়তায় তাৎক্ষণিকভাবে এগিয়ে না আসার অন্যতম প্রধান কারণ হলো অযথা পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের ভয়, ফৌজদারি মামলায় জড়ানোর আশঙ্কা, কোর্ট-কাছারির অতিরিক্ত ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রভৃতি। তা ছাড়া প্রায়ই বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ কোনো অপরিচিত পথচারী বা দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসাসেবার জন্য নিয়ে গেলে ফি পাওয়ার নিশ্চয়তা ব্যতীত রোগী ভর্তি করতে চান না এবং এসব ক্ষেত্রে যিনি রোগী নিয়ে হাসপাতালে উপস্থিত হন তাকে নানা রকম হয়রানির শিকার হতে হয়। এ ছাড়া উদ্ধারকারীদের দ্বারা দুর্ঘটনায় পতিত ব্যক্তির কোনো ক্ষতি হলে তার জন্য দেওয়ানি অথবা ফৌজদারি মামলায় জড়ানো এবং পরবর্তী সময়ে পুলিশের দ্বারা হয়রানির আশঙ্কা থেকে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতি জনসাধারণকে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের সাহায্য করা থেকে বিরত থাকতে নিরুৎসাহিত করে এবং যারা স্বেচ্ছায় সাহায্য করতে যেতে চায়, তাদের জন্য নানাবিধ বাধা তৈরি করে।

এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির সহায়তাকারীর (Good Samaritan) সুরক্ষার জন্য একটি আইনি কাঠামো এখন অপরিহার্য; যেন গুড সামারিটানগণ নির্ভয়ে ও কোনো রকম হয়রানি ছাড়া জনগণের বিপদে উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের নির্দ্বিধায় সাহায্য করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের উৎসাহিত করা যায়। কিছু কিছু উন্নত দেশে এমনকি গুড সামারিটানদের সরকারিভাবে অনুপ্রাণিত করতে আর্থিক প্রণোদনাও দেয়া হয়। একজন গুড সামারিটান হলো এমন একজন ব্যক্তি, যিনি অর্থ প্রাপ্তি অথবা পুরস্কারের প্রত্যাশা ছাড়াই বা বিশেষ সম্পর্কজনিত দায়িত্ব ছাড়াই স্বেচ্ছায় কোনো দুর্ঘটনা বা দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিকভাবে সহায়তা বা জরুরি পরিচর্যার জন্য এগিয়ে আসেন।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে সড়ক, রেল ও বিমান দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের নির্দ্বিধায় ও হয়রানিমুক্তভাবে সহায়তা দেয়ার জন্য এই মুহূর্তে গুড সামারিটানদের সুরক্ষায় কোনো আইন নেই। যদিও ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৯২ ধারায় কোনো ব্যক্তির মঙ্গলের জন্য তার সম্মতি ছাড়াই সরল বিশ্বাসে কিছু করলে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না মর্মে বলা হয়েছে। তথাপি, দণ্ডবিধির এই বিধানটি দুর্ঘটনায় সহায়তাকারীদের ফৌজদারি দায় এড়াতে কিছুটা সহায়ক হলেও তাদের পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা দিতে অপারগ; বিশেষত এই আইনের মাধ্যমে দেওয়ানি দায় এবং অন্যান্য হয়রানি থেকে অব্যাহতি পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং, দুর্ঘটনায় সহায়তাকারীদের দেওয়ানি ও ফৌজদারি- উভয় প্রকার দায় থেকে রক্ষা করার জন্য এবং সুরক্ষা নিশ্চিতে ও দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ওপর বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে একটি পৃথক আইন নতুবা ন্যূনতম ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনে একটি আলাদা বিধান সংযোজন করা প্রয়োজন।

বিশ্বব্যাপী গুড সামারিটান আইন সেই সব স্বেচ্ছাসেবকদের সুরক্ষা প্রদান করে, যারা সড়ক, রেল বা বিমান দুর্ঘটনা বা দুর্ঘটনায় আহত, অসুস্থ, বিপদে বা অন্যথায় অক্ষম ব্যক্তিকে যুক্তিসঙ্গত সহায়তা প্রদান করে। এই আইনের লক্ষ্য হলো অসুস্থ বা আহতদের সহায়তার জন্য পার্শ্ববর্তী মানুষজন ও পথচারীদের উৎসাহিত করা এবং পুলিশ, হাসপাতাল বা অন্য কারও দ্বারা হয়রানি না হওয়া থেকে তাদের সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়া। এ ধরনের আইন নিশ্চিত করে যে, পরোপকারী উদ্ধারকারীরা আন্তরিকভাবে কাজ করতে যেয়ে তাদের কোনো অনিচ্ছাকৃত বা অবহেলামূলক কাজ বা কার্যবিরতির কারণে কারও কোনো ক্ষতি বা মৃত্যুর জন্য দায়ী হবেন না।

আদর্শ গুড সামারিটান আইন উদ্ধারকারীকে দুর্ঘটনা বিষয়ে থানায় মামলা দায়ের করতে বা হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবার জন্য ফি প্রদান করতে বাধ্য করে না। এ ছাড়া এ আইনানুসারে গুড সামারিটানকে হাসপাতালে বা থানায় থাকতে বা জিজ্ঞাসাবাদে বাধ্য করা যাবে না। আইন এটাও নিশ্চিত করবে যে, সহায়তাকারী তার নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর বা তার কোনো ব্যক্তিগত তথ্য বা পরিচয় অথবা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পরিচয় দিতে বাধ্য নন। এমনকি একজন উদ্ধারকারী পুলিশের নিকট দুর্ঘটনাবিষয়ক কোনো প্রমাণ দিতেও বাধ্য নন। তবে কেউ যদি স্বেচ্ছায় তদন্ত প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে চায়, তাহলে তার বক্তব্য একক শুনানিতে রেকর্ড করতে হবে এবং তাকে পুনঃপুনঃ হাজিরা দিতে বাধ্য করা যাবে না। তথাপি, পুলিশ বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উদ্ধারকারীর কোনো অভিযোগ থাকলে তা নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের নিকট দায়ের করা যাবে।

আশার কথা হলো- মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৮ সালে সৈয়দ সাইফুদ্দিন কামাল ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ ও অন্যান্য, ১৩ এসসিওবি [২০২০] মামলায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ ও সহায়তাকারীর সুরক্ষা প্রদান নীতিমালা-২০১৮ অনুমোদন করেছেন এবং উক্ত নীতিমালার বহুল প্রচারের জন্যও আদেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া হাইকোর্ট সংসদে এ-বিষয়ক পৃথক আইন প্রণীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নীতিমালাটি আইন হিসেবে বলবৎ থাকবে বলে আদেশ দেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালে সেভ লাইফ ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলায় অনুরূপ মতামত প্রদান করেছিলেন। হাইকোর্টের রায়ে একজন পথচারী দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। তা ছাড়া দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল অথবা ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার পর ফি ব্যতীত তাদের জীবন রক্ষাকারী প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানে অস্বীকৃতি জানানো যাবে না মর্মে আদেশ দেন।

আলোচ্য মামলায় হাইকোর্ট আদর্শ গুড সামারিটান আইনের আলোচিত উপাদানগুলোর বেশির ভাগই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যদিও নীতিমালায় গুড সামারিটানের দায়িত্ব সম্পর্কে তেমন কিছু বলা নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রায় প্রদানের চার বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও আমাদের আইনসভা অদ্যাবধি সড়ক, রেল ও বিমান দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তাকারীদের সুরক্ষায় অথবা তাদের জরুরি চিকিৎসা পরিষেবা নিশ্চিতে কোনো আইন প্রণয়ন করেনি। উপরন্তু, হাইকোর্ট প্রদত্ত এ-সংক্রান্ত নির্দেশাবলি এখনো সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের ও ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। সড়কে প্রতিনিয়ত যে সংখ্যক জীবন ঝরছে তা নিয়ন্ত্রণে এবং এ দেশের জনগণের জীবন রক্ষায় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ ও দুর্ঘটনায় সহায়তাকারীদের সুরক্ষা প্রদানে দ্রুত আইন প্রণয়ন নীতিনির্ধারকদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। তাই অনতিবিলম্বে হাইকোর্টের রায়ানুসারে সড়ক, রেল ও বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতদের নির্দ্বিধায় সাহায্য করার জন্য জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরিতে ও হয়রানি নিরোধে দেশের আপামর গুড সামারিটানদের সুরক্ষায় একটি পূর্ণাঙ্গ আইনি কাঠামো প্রণয়ন এখন অত্যন্ত জরুরি।

লেখক: সড়ক পরিবহন আইন বিশ্লেষক, সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি


বাতাস দূষণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মো. হুমায়ুন কবীর

সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় বাতাস দূষণ সম্পর্কে একটি ভয়াবহ সংবাদ বিবেকবান সব মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। খবরে প্রকাশ বিশ্বের বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৫৫ লাখ মানুষের মুত্যু ঘটে। এ সংখ্যা আমাদের নিকটবর্তী প্রতিবেশী চীন ও ভারতে সবচেয়ে বেশি। এ প্রসঙ্গে একটি পরিসংখ্যানে প্রকাশ, ২০১৩ সালে চীনে বায়ুদূষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ, আবার একই বছরে ভারতে এ সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ।

বাতাস হলো জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। বাতাস না থাকলে আমরা এক মুহূর্তের জন্যও বাঁচতে পারি না। আমাদের নিশ্বাসে ও প্রশ্বাসে শুধু প্রয়োজন বাতাস আর বাতাস। তবে সে বাতাস হওয়া চাই নির্মূল। না হলে দূষণের কারণে এভাবেই পাওয়া যাবে বাতাসে লাশের গন্ধ। ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরের দিকে যে গ্যাসীয় আবরণ সমগ্র পৃথিবীকে বেষ্টন করে রেখেছে তাকে বায়ুমণ্ডল বলে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যতই ওপরে ওঠা যায় বায়ুমণ্ডল ততই হালকা হতে থাকে।

বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উপাদানের ৯৭ শতাংশ পদার্থ ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২৯ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করলেও বিজ্ঞানীদের মতে, বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্বসীমা ভূপৃষ্ট থেকে ১০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের প্রধানত বিশুদ্ধ ও শুষ্ক উপাদান হলো দুটি; আর তা হলো- অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন। বায়ুমণ্ডলের চারটি স্তর রযেছে, সেগুলো হলো- ১. ট্রপোমণ্ডল বা ট্রপোস্ফেয়ার, ২. স্ট্রেটোমণ্ডল বা স্ট্রেটোস্ফেয়ার, ৩. মেসোমণ্ডল বা মেসোস্ফেয়ার ও ৪. তাপমণ্ডল বা থার্মোস্ফেয়ার। বায়ু ছাড়া পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং স্বল্প পরিমাণ নিষ্ক্রিয় গ্যাস যথা- আর্গন, হিলিয়াম, জেনন, ক্রিপ্টন ইত্যাদিকে বায়ু বলা হয়। এ উপাদানগুলো বাতাসের মধ্যে শতকরা হারের নির্দিষ্ট পরিমাণে থাকলে সেই বায়ুকে আদর্শ বায়ু বলা হয়।

আদর্শ বায়ুতে শতকরা হারে আয়ন হিসেবে নাইট্রোজেন-৭৮.০২ শতাংশ, অক্সিজেন-২০.৭১ শতাংশ, নিষ্ক্রিয় গ্যাস-০.৮০ শতাংশ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড-০.০৩ শতাংশ ও বাকি অন্যান্য গ্যাস রয়েছে। জীবের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য আদর্শমাত্রার এ বিশুদ্ধ বায়ু অত্যাবশ্যক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিভিন্ন কারণে প্রতিনিয়তই আমাদের নিত্যব্যবহার্য বায়ুদূষণ ঘটছে। আর বায়ুদূষণ বলতে বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন ধরনের ডাস্ট, ফিউম, গ্যাস, ঘনকুয়াশা, গন্ধ, ধোঁয়া, বাষ্প ইত্যাদি বায়ুদূষকের উপস্থিতিকে বুঝায়।

যে উপাদানগুলো বায়ুতে মিশ্রিত হলে বায়ুদূষণ হয় তাদের দূষক বলে। বায়বীয় দূষক যেমন- কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি। কণাজাতীয় দূষক যেমন- ধোঁয়া, ফিউম, ধুলাবালি, মিস্ট, কুয়াশা, ধোঁয়াশা ও এরোসল ইত্যাদি। রাসায়নিক জৈবদূষক যেমন- হাইড্রোকার্বন, অ্যালডিহাইড, কিটোন, অ্যামিন ও অ্যালকোহল ইত্যাদি। রাসায়নিক অজৈব দূষক যেমন- কার্বনেট, ক্লোরাইড ইত্যাদি।

অজৈব কণার মধ্যে রয়েছে- উড়ন্ত ছাই, বালি, এসবেস্টস, যানবাহনের ধুলাবালি, খনি ও অন্যান্য শিল্পকারখানার ধুলাবালি ইত্যাদি। আরও রয়েছে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও পরাগরেণুর মতো সজীব বায়ুদূষকও। আবার তেজস্ক্রিয় বায়ুদূষক যেমন- তেজস্ক্রিয় গ্যাস ও আলোক রাসায়নিক জারক ইত্যাদিই প্রধান। মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাবগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইসিমা, ফুসফুসে ক্যানসার, বন্ধ্যাত্ব ও জন্মত্রুটি ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব।

২০১৫ সালে প্যারিসে কপ-২১ সম্মেলন চলাকালেই আমাদের পার্শ্ববর্তী দুটি প্রতিবেশী দেশ চীন ও ভারতে বায়ুদূষণের জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হচ্ছিল। সেখানে বায়ুদূষণের বিষয়টি এমন বেগতিক হয়ে উঠেছে যে ঘন কুয়াশা, কলকারখানার কালো ধোঁয়া ও ধূলিকণার প্রভাবে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকায় এক নম্বরে হলো আমাদের এক প্রতিবেশী চীনের নাম, আর সেই তালিকায় দুই নম্বরেই রয়েছে আরেক প্রতিবেশী ভারতের নাম। তারপর তিন নম্বরে যুক্তরাষ্ট্র, চার বা তদোর্ধ্ব হলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশ।

মোট কার্বন নিঃসরণকারী দেশের মধ্যে চীন এককভাবে যোগ করে ২৪ শতাংশ আর ভারত করে থাকে কমপক্ষে ৭ শতাংশ। কিন্তু সে হিসাবে যদিও আমাদের রাজধানী ঢাকার বাতাসে দিল্লি কিংবা চীনের মতো দূষণ নেই, তার পরও একেবারে হাত গুটিয়ে বসে থাকার পরিস্থিতিতেও নেই। জানা যায়, বিগত ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকে ঘন কুয়াশা ও ধোঁয়ায় চীনের আরও ১০টি শহরে সতর্কতা জারির আরেকটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। চীনে ব্যবহৃত চারস্তরের সতর্কতার মধ্যে ‘রেড এলার্ট’ হলো সবচেয়ে গুরুতর ধরনের সতর্কতা।

পরামর্শমূলক সেই সতর্ক বার্তায় বলা হয়েছে, স্কুল বন্ধ এবং গাড়ি চলাচল, কারখানার উৎপাদন, নির্মাণকাজ সীমিত করার কথা। একই সপ্তাহে চীনে দ্বিতীয়বারের মতো এ ধরনের সতর্কতা জারি করা হলো। আগের সপ্তাহের ধারাবাহিকতায় চীনের পরিবেশ মন্ত্রণালযের তরফে মারাত্মক দূষণের কারণে তিয়ান জিন, পুইয়াং, জিনজিয়াং, ডেঝাউ, হান্দান, জিনতাই, লাংফাং, হেংসুই, জিনজি এবং অ্যানইয়াং শহরে এ লাল সতর্কতা জারি করা হলো। সম্প্রতি আরেকটি রিপোর্টে প্রকাশ, চীনের বায়ুদূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেখানে এখন জনস্বাস্থ্য ও টেকসই উন্নয়ন হুমকির সম্মুখীন। সেখানে বেইজিং শহরের পার্শ্ববর্তী প্রায় ১০ কোটি মানুষ অধ্যুষিত হেবি ও তিয়ানজিন শহর এলাকায় কয়লার ব্যবহার কমাতে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) চলতি বছরই বায়ুদূষণ কমাতে ৩০ কোটি ডলার ঋণ দেবে বলে জানিয়েছে। একইভাবে ভারতের রাজধানী দিল্লিসহ আরও কয়েকটি শহরে বায়ুদূষণের ভয়াবহতার কারণে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

সে কারণেই দেখা গেছে এ বছরের গরমকালে ভারতের রাজধানী দিল্লি শহরকে বিশ্বের উষ্ণতম স্থান হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। সেজন্য এবার সেখানে অত্যাধিক গরমে প্রায় সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর আমরা সবাই জানি। বাতাসে যখন দূষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তখন অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রায়ও সমানতালে বাড়তে থাকে। সেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশ, জলবায়ু ইত্যাদির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়। মানুষসহ সব জীবজগৎই এর দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশের ঢাকা শহর হলো বিশ্বের অন্যতম একটি মেগাসিটি। সে কারণে এর বায়ুমণ্ডলের ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনের ওপরই নির্ভর করে এ শহর আসলে নাগরিকদের বসবাসের জন্য কতটুকু নিরাপদ। সম্প্রতি ঢাকা শহরের বাতাসের নমুনা পরীক্ষা করে এতে মারাত্মক ক্ষতিকর কিছু দূষকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা সচেতন নাগরিকদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। শুষ্ক মৌসুম হওয়ার কারণে এখানকার বাতাসে প্রচুর পরিমাণ ধুলাবালি, ঢাকা শহরের কিছু শিল্পাঞ্চল থেকে নির্গত ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া, চামড়াশিল্পের ট্যানারি থেকে ক্ষতিকর দুর্গন্ধ, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী সাভার, আশুলিয়া, মাওয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টঙ্গী ইত্যাদি স্থানগুলো হতে ইটভাটার কালো ধোঁয়া বাতাসে সংযুক্ত হচ্ছে।

ঢাকায় চলাচলকারী মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন পরিবহনের কালো ধোঁয়া, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রী হতে প্রতিনিয়তই ঢাকা শহরের কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, সিসাসহ আরও অনেক ভারী ধাতু (হেভি মেটাল), রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশন হতে সিএফসি, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হয়ে দূষণের মাত্রা বেড়ে গিয়ে পরিবেশ নষ্ট করে চলেছে। তা ছাড়া পরিবেশ নির্দিষ্ট কোনো দেশের একক কোনো সমস্যা নয়। কাজেই যেহেতু আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে চীন ও ভারতে অত্যাধিক পরিমাণ বায়ুদূষণ রয়েছে, তার সামান্য প্রভাব হলেও আমাদের দেশে পড়ছে বা আগামীতে আরও পড়বে।

দেখা গেছে, যদি কোনো কারণে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উৎস থেকে ভারসাম্য বিনষ্টকারী কোনো কঠিন, তরল বা বায়বীয় অবাঞ্ছিত বহিস্থ পদার্থ বায়ুতে প্রচুর পরিমাণে অনুপ্রবেশ করে তাহলে স্বনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে বহিস্থ পদার্থ বা উপাদান নিজ উপাদানের অতিরিক্ত পরিমাণ বায়ু থেকে অপসারিত হয়। ফলে বায়ুর স্বাভাবিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণকারী বায়ুর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটি চরম সীমা রয়েছে। এ সীমার বাইরে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কাজ করে না। ফলে বায়ুতে বহিস্থ ও নিজ উপাদানের মাত্রাধিক সঞ্চয় ঘটে।

বায়ুতে বহিস্থ উপাদানের উপস্থিত ও সঞ্চয় এবং নিজ উপাদানের অতিরিক্ত সঞ্চয় জীবজগৎ ও সম্পত্তির ওপর মন্দ প্রভাব বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে ক্রমবৃদ্ধি অরণ্য ধ্বংস, দ্রুতগতিতে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, কৃষিপদ্ধতির পরিবর্তন এবং নিজ উপাদানের মাত্রাধিক সঞ্চয়ে বায়ু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ক্রিয়াশক্তি বিনষ্টের পথে। মানুষের এ অদূরদর্শী ক্রিয়াকলাপে পৃথিবীর সার্বজনীন বায়ুসম্পদ আজ বিপন্ন এবং মানুষ তথা সমগ্র জীবজগৎ সম্ভাব্য বিপদে আতঙ্কিত। এসব সমস্যা হতে বাঁচতে হলে আমাদের পৃথিবীকে সবুজ করে ফেলতে হবে।

পরিকল্পিত নগরায়ণ সেখানে একটি বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। আর পরিকল্পিত নগরায়ণ হলো কোনো স্থানের মোট আয়তনের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ রাস্তাঘাট থাকা এবং সেই রাস্তাঘাটকে সবুজ বনায়নের আওতায় নিয়ে এসে নগরের ২৫ শতাংশ বনায়ন করা। বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই এ পরমর্শটিই দিয়ে থাকেন নগসবাসীর জন্য। কাজেই ভারত কিংবা চীনের পর্যায়ে যাওয়ার আগেই আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়


যুদ্ধে নয় বরং পৃথিবী রক্ষায় অর্থ ব্যয় করা দরকার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

বর্তমানে পৃথিবীর আলোচিত এবং সংকটময় বিষয়গুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম প্রধান একটি বিষয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন ঘটছে। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমগ্র বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা প্রকারের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, নদীভাঙন, ভূমি ধস, শিলাবৃষ্টি ইত্যাদি। বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও ভূমিকম্প। টঘঋঈঈঈ’র দেওয়া তথ্য বলছে, বিংশ শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ১০-২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং আগামীতে আরও ১৮-৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর এতে মালদ্বীপসহ তলিয়ে যাবে উপকূলবর্তী আমাদের বাংলাদেশ। মালদ্বীপ এবং বাংলাদেশের পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি দেশই জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের ফলে কমবেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বন্ধে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে আমরা ব্যর্থ হলে আজকের পৃথিবী অচিরেই অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক ধারা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী মানুষসহ অন্য প্রাণীদের বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়বে। আগামী প্রজন্মকে সমৃদ্ধ, নিরাপদ এবং বসবাসযোগ্য এক পৃথিবীর নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষ্যে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে যুদ্ধে অর্থ ব্যয়ের পরিবর্তে জলবায়ু প্রভাব মোকাবিলায় তা ব্যয়ের আহ্বান জানিয়েছেন। সোমবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপশন প্ল্যান (ন্যাপ) এক্সপো-২০২৪’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যুদ্ধে অস্ত্র এবং অর্থ ব্যয় না করে সেই টাকাগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে যদি ব্যয় করা হত তো বিশ্বটা রক্ষা পেত।’

বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন যেখানে একটা আতঙ্কের বিষয় সেখানে এই ব্যাপারে উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা হতাশ করার মতো। এই ব্যাপারে তাদের আগ্রহ বলতে শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সম্মেলন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের বিষয়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশ যেখানে চিন্তিত সেখানে উন্নত রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত। যুদ্ধের পিছনে প্রতি বছর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ তারা খরচ করলেও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় অর্থ ব্যয়ে তাদের কোনো ধরনের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, চলমান যুদ্ধ ও নতুন করে সংঘাতের ভয় থেকে বিশ্বে সামরিক ব্যয়ে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। গত বছর তথা ২০২৩ সালে বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় ছিল ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন তথা ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার। যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। সুইডেনের প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সোমবার (২২ এপ্রিল, ২০২৪) এসআইপিআরআই বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এবারের প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বজুড়ে গত বছর সামরিক ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। শুধু তাই নয়- ২০০৯ সালের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বের সব ভৌগোলিক অঞ্চলে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে বিশ্ব যেখানে হুমকির মুখে সেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহের পিছনে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর ক্রমবর্ধমান সামরিক ব্যয়ের চিত্র সত্যিই আমাদের অনেক হতাশ করে। যুদ্ধ-বিগ্রহ পিছনের প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তা যদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ব্যয় করা হতো তাহলে বিশ্ব তার অস্তিত্ব সংকট থেকে রক্ষা পেত।

যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের মাত্রা নিয়ে অবিরাম কথামালা চলতে থাকলেও তা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। তাদের পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের খেসারত টানতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে। বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব নেতৃত্ব আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনানুযায়ী বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে ২০১০ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। এর ট্রাস্টের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- সরকারের উন্নয়ন বা অনুন্নয়ন বাজেটের বাইরে বিশেষ ক্ষেত্র হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় এই ট্রাস্টের তহবিল ব্যবহার করা; জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা; জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তৃণমূলপর্যায়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানবসম্পদ উন্নয়নসংক্রান্ত প্রকল্প বা কর্মসূচি গ্রহণ করা; জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজন, প্রশমন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং অর্থ ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক গবেষণা করা এবং গবেষণালব্ধ ফলাফলের আলোকে উপযুক্ত বিস্তারসহ বা পাইলট কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা; জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং ক্ষতিগ্রস্ততা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এর ভিত্তিতে কর্মসূচি বা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা; পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে স্থাপিত জলবায়ু পরিবর্তন ইউনিটসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এবং পরিবেশ অধিদপ্তরে গঠিত জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত জলবায়ু পরিবর্তন সেল বা ফোকাল পয়েন্টকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সহায়তা করা; জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সম্ভাব্য পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক বা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে উপযুক্ত কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সহায়তা করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী জরুরি কার্যক্রমে সহায়তা করা ইত্যাদি।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিভিন্ন ধরনের কৌশল গ্রহণের পাশাপাশি বাংলাদেশ সব সময়ই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ-বিসিডিপি’ গঠন করা হয়েছে। এতে সব পক্ষ ঐকমত্য হয়েছে। আমরা আশা করি, মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান, ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান, ন্যাশনাল ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন ও বাংলাদেশের রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে বিসিডিপি তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (এনএপি) ২০২২-২০৫০ প্রণয়ন করেছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এটি এইএনএফসিসিসি-তে দাখিল করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ১১টি জলবায়ু ঝুঁকিযুক্ত এলাকাতে ৮টি খাতে ১১৩টি অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম চিহ্নিত করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ আগামী ২৭ বছরে ন্যাপে গৃহীত কর্মপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন। এ জন্য সুনির্দিষ্ট তহবিল ও অতিরিক্ত আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ধনী দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশ্বে জলবায়ুর এই নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার রয়েছে জোরাল অবদান। তিনি জলবায়ুবিষয়ক সর্বোচ্চ বিশ্ব ফোরাম, জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি)-র কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (সিওপি)-এ ২০১৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার এই সম্মাননা ছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর বিশ্ব ফোরামে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মুখপাত্র হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়ার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় অবদান রাখার পাশাপাশি বিশ্বজনীন আলোচনায় স্বীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সদা সচেষ্ট রয়েছে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশন’র (জিসিএ) ঢাকা বৈঠকে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অভিযোজন ও সামলে নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের কিছু ধারণা ও অভিজ্ঞতা আছে বিনিময় করার মতো। আমি শুধু নিজের দেশ নিয়ে ভাবী না। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে অনেক ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ হারিয়ে যাবে। তখন সেখানকার মানুষ কোথায় যাবে, সে কথাও আমাদের ভাবতে হবে।’ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রতিকূলতা ও প্রাকৃতিক দুরে‌্যাগ ব্যবস্থাপনায় অনন্য দক্ষতা ও সাফল্য প্রদর্শনের সুবাদে সমগ্র বিশ্বের কাছে আজ একটি রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে বাংলাদেশ এবং প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। এই ব্যাপারে জাতিসংঘের মহাসচিব জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনের জন্য বাংলাদেশকে একটি মডেল হিসেবে বর্ণনা করে জানিয়েছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনে বাংলাদেশ সেরা শিক্ষক।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে তিনি জানিয়েছেন, ‘শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতাদের মধ্যে অন্যতম যিনি জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি নিয়ে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’

তবে আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে বিশ্বের সব নেতৃত্বকে সমানভাবে এবং সমানতালে এগিয়ে আসা দরকার। কারণ বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্র এবং তাদের নেতাদের সহযোগিতা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে একা এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না। এমতাবস্থায় বিশ্বের সব দেশ ও নেতাদের উচিত যুদ্ধ-বিগ্রহের পিছনে না ছুটে জলবায়ু পরিবর্তনের এই নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় এগিয়ে আসা। যুদ্ধ-বিগ্রহের পিছনে অর্থ ব্যয় না করে জলবায়ু পরিবর্তনের এই নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায়ি ওইসব অর্থ ব্যয় করা। তাহলে জলবায়ুর পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্তির পাশাপাশি যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে সৃষ্ট সমস্যা থেকে বেঁচে যাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত মানুষ। আর পৃথিবী বেঁচে যাবে অস্তিত্ব সংকটের হাত থেকে। বর্তমান বিশ্বে এই মুহূর্তে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলার চেয়ে আর গুরুত্বপূর্ণ কোনো সমস্যা থাকতে পারে না। সুতরাং, আমাদের আগত প্রজন্মকে একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ এবং নিরাপদ পৃথিবী উপহার দিতে হলে বিশ্বের উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোকে যুদ্ধে নয় বরং পৃথিবী রক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অর্থ ব্যয় করা দরকার।

লেখক: উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়


ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

মুসলিম ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জনপদের কিশোরগঞ্জকে ঘিরে রয়েছে অনেক ইতিহাস। প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপত্যের বিখ্যাত নানা দর্শনীয় স্থান রয়েছে এখানে।

আড়াইশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ তারই একটি নিদর্শন। পাগলা মসজিদটি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার হারুয়া নামক স্থানে বর্তমানে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত, যা একসময় নদীর মাঝে ছিল একপাড় থেকে সরু রাস্তা ও অন্য পাড় থেকে বাঁশের সাঁকো দিয়ে মুসল্লিরা চলাচল করত। জনশ্রুতি অনুসারে, ঈশা খানের পরবর্তী আমলে তারই এক বংশধর দেওয়ান জিল কদর খান ওরফে ‘জিল কদর পাগলা’ নামক এই বংশের একজন ব্যক্তি নদীর তীরে বসে নামাজ পড়তেন। তিনি অত্যন্ত মুজ্জফ ছিলেন তিনি দেওয়ান হয়বত খাঁর নাতি দেওয়ান মোহাম্মদ খাঁর ছেলে পরবর্তীতে ওই স্থানটিতে একটি মসজিদ নির্মিত হয়।

জিল কদর পাগলার নামানুসারে মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এই দেওয়ান জিল কদর দাদ খান পাগলা সাহেবের কবর হয়বতনগর বড় গোরস্তানে রয়েছে । অপর জনশ্রুতি অনুসারে, তৎকালীন কিশোরগঞ্জের হয়বতনগর জমিদার পরিবারের ‘পাগলা বিবি’র নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয়।

কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিমে নরসুন্দা নদীর তীরে এই তিনতলা বিশিষ্ট মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটি একসময় নরসুন্দা নদীর প্রায় মাঝেই ছিল, একদিকে বাশের সাঁকো অন্যদিকে সরু রাস্তা দিয়ে লোকজন যাতায়াত করত। নদীর নাব্য কমে যাওয়ায় এখন নদীর হারুয়া পাড়েই মসজিদটি এবং আশপাশে অনেক সুরম্য দালানকোঠায় আবৃত।

যদিও আশির দশকেও এই মসজিদটি ছিল আধাপাকা এবং টিনের ঘর এবং এর মোতোয়ালি ছিলেন হয়বতনগরের সর্বশেষ জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খানের বড় ছেলে, কিশোরগঞ্জ মিউনিসিপ্যালটির (বর্তমান পৌরসভা) চেয়ারম্যান দেওয়ান সাত্তার দাদ খান (সাইয়ারা মিয়া)। সাইয়ারা মিয়াকে সবাই চেয়ারম্যন সাহেব বলেই জানত, তিনি টানা ১৪ বছর চেয়ারম্যন ছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে দেওয়ান ফাত্তাহ দাদ খান ওই মসজিদের মোতোয়ালি নিযুক্ত হন, এ ছাড়াও তিনি তার দাদা কিশোরগঞ্জের অন্যতম জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খানের দানকৃত মাঠ যা বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত সম্পন্ন ঈদগাহ ময়দান, শোলাকিয়া ঈদগাহেরও মোতোয়ালি। মসজিদটি মোগল স্থাপত্যশৈলীর কারুকার্যময় গঠন কাঠামোতে তৈরি করা হয়।

নামাজির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৮২ সালে সংস্করণ ও কলেবর বৃদ্ধির জন্যে পুরোনো কাঠামো ভেঙে সামনের অংশ পুনর্নির্মাণ করা হয়। ’৯০-এর দশকে ১১ তলা সুউচ্চ মিনারসহ বর্তমান কাঠামোয় রূপান্তর করা হয়। মসজিদ-সংলগ্ন ১৩২ কেভি বিদ্যুৎ লাইনের কারণে কলেবর বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বিদ্যুৎ লাইন মসজিদের খরচে স্থানান্তরিত করে এর আরও উন্নয়ন করা হবে। মসজিদের আয়তন বহুগুণে বাড়িয়ে জানাজা- ঈদগাহ-কবরস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।

এর পাঁচতলা সুউচ্চ মিনারটি বহুদূর থেকে সহজেই দৃষ্টি কাড়ে। পাগলা মসজিদের ইমরাত খুবই সুন্দর এবং নির্মাণশৈলীও বেশ চমৎকার। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত পাগলা মসজিদটি নানা ধরনের ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থাপনা হিসেবে খ্যাত।

অন্য একটি মহলে জনশ্রুতি আছে যে, পাগলবেশী এক আধ্যাত্মিক পুরুষ, হয়বতনগর বাড়ির এক বংশধর জিল কদর পাগলা একদিন খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর মধ্যস্থলে মাদুর পেতে ভেসে এসে বর্তমান মসজিদের কাছে স্থিতু হন এবং তাকে ঘিরে আশপাশে অনেক ভক্তকুল সমবেত হন। ওই পাগলের মৃত্যুর পর তার সমাধির পাশে পরবর্তীতে এই মসজিদটি গড়ে ওঠে। ফলে কালক্রমে মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ’ নামে পরিচিত পায়।

অত্র অঞ্চলের সহজ সরল মানুষের বদ্ধমূল ধারণা কোনো বিপদে পড়লেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে এই মসজিদে নামাজ পড়া ও শিরনি দেওয়ার নিয়ত করলেই আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন তা কবুল করবেন এবং সেই বিশ্বাসের মূলেই এই মসজিদে সবধর্মের জনগণেরই পবিত্রতা প্রকাশে

ব্যাকুলভাবে সাড়া দিয়ে আসছেন ।

ফলে সাধারণ মানুষ এমন বিশ্বাসের আলোকে পাগলা মসজিদে প্রচুর দান-খয়রাত করে থাকেন এবং ক্রমেই তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ মসজিদের আয় দিয়ে কমপ্লেক্সের বিশাল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মসজিদের আয় থেকে বিভিন্ন সেবামূলক খাতে অর্থ সাহায্য করা হয়।

মসজিদটি কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিমে হয়বতনগর সংলগ্ন হারুয়া নামক এলাকায় অবস্থিত। শহরের যেকোনো স্থান থেকে রিকশাযোগে বা পায়ে হেঁটে বা অন্য যে কোনো পরিবহনযোগে সহজেই এই মসজিদে যাওয়া যায়।


গরমের বিপদ হিটস্ট্রোক: ঝুঁকি এড়াতে করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ

সারা দেশে প্রচণ্ড দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে, গরম বেড়ে চলছে। দেশের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। সারা দেশেই গরমে হাঁসফাঁস এবং নাভিশ্বাস অবস্থা, আর গরমের উৎপাতে দিশেহারা মানুষ এবং প্রাণীকুল। এ ছাড়া নানা রকম অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই। তবে কয়েক দিনে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

হিটস্ট্রোক কী : গরমের সময়ের একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যগত সমস্যার নাম হিটস্ট্রোক। চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী, প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, তাকে হিটস্ট্রোক বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় রক্ত দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। কোনো কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ত্বকের রক্তনালি প্রসারিত হয় এবং অতিরিক্ত তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। গরম বাড়লে শরীরও ঘামতে শুরু করে, ঘাম বাষ্পীভূত হলে শরীর ঠাণ্ডা হয় এবং ঘামের মাধ্যমেও শরীরের তাপ কমে যায়। কিন্তু প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র পরিবেশে বেশি সময় অবস্থান বা পরিশ্রম করলে তাপ নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভব হয় না। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপদসীমা ছাড়িয়ে যায়, খাম বন্ধ হয়ে যায় এবং হিট

স্ট্রোক দেখা দেয়।

হিট স্ট্রোক কাদের বেশি হয় : প্রচণ্ড গরমে ও আর্দ্রতায় যে কারও হিটস্ট্রোক হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যেমন-
১. শিশু ও বৃদ্ধদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিরা যেহেতু প্রায়ই বিভিন্ন রোগে ভোগেন যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার বা হার্টের রোগী, স্ট্রোক বা ক্যানসারজনিত রোগে যারা ভোগেন, এমনকি যেকোনো কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা নানা ওষুধ সেবন করেন, যা হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

২. যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। যেমন কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক।

৩. শরীরে পানিস্বল্পতা হলে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।

৪. কিছু কিছু ওষুধ হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষ করে প্রস্রাব বাড়ানোর ওষুধ, বিষণ্নতার ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ ইত্যাদি।

হিটস্ট্রোকের লক্ষণগুলো কী : তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে হিটস্ট্রোকের আগে অপেক্ষাকৃত কম মারাত্মক হিট ক্র্যাম্প অথবা হিট এক্সহসশন হতে পারে। হিট ক্র্যাম্পে শরীরের মাংসপেশিতে ব্যথা হয়, শরীর দুর্বল লাগে এবং প্রচণ্ড পিপাসা পায়। এর পরের ধাপে হিট এক্সহসশনে দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস, মাথাব্যথা, ঝিমঝিম করা, বমিভাব, অসংলগ্ন আচরণ ইত্যাদি দেখা দেয়। এই দুই ক্ষেত্রেই শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ঠিক থাকে এবং শরীর অত্যন্ত ঘামতে থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এর লক্ষণ গুলো হলো-
১. শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়।

২. ঘাম বন্ধ হয়ে যায়।

৩. ত্বক শুষ্ক ও লালচে হয়ে যায়।

৪. নিশ্বাস দ্রুত হয়।

৫. নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়।

৬. রক্তচাপ কমে যায়।

৭. খিঁচুনি, মাথা ঝিমঝিম করা, অস্বাভাবিক আচরণ, হ্যালুসিনেশন, অসংলগ্নতা ইত্যাদি।

৮. প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়।

৯. রোগী শকেও চলে যায়। এমনকি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

প্রতিরোধের উপায় কী : গরমের দিনে কিছু সতর্কতা মেনে চললে হিটস্ট্রোকের বিপদ থেকে বেঁচে থাকা যায়। এগুলো হলো-
১. হালকা, ঢিলেঢালা পোশাক পরুন। কাপড় সাদা বা হালকা রঙের হতে হবে। সুতি কাপড় হলে ভালো।

২. যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকুন।

৩. বাইরে যেতে হলে মাথার জন্য চওড়া কিনারাযুক্ত টুপি, ক্যাপ বা ছাতা ব্যবহার করুন।

৪. বাইরে যারা কাজকর্মে নিয়োজিত থাকেন, তারা মাথায় ছাতা বা মাথা ঢাকার জন্য কাপড়জাতীয় কিছু ব্যবহার করতে পারেন।

৫. প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল পান করুন। মনে রাখবেন, গরমে ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ দুই-ই বের হয়ে যায়। তাই পানির সঙ্গে সঙ্গে লবণযুক্ত পানীয় যেমন-খাবার স্যালাইন, ফলের রস, লাচ্ছি ইত্যাদিও পান করতে হবে। পানি অবশ্যই বিশুদ্ধ হতে হবে।

৬. তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী পানীয় যেমন- চা ও কফি যথাসম্ভব কম পান করা উচিত।

৭. রোদের মধ্যে শ্রমসাধ্য কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। এসব কাজ সম্ভব হলে রাতে বা খুব সকালে করুন। যদি দিনে করতেই হয়, তবে কিছুক্ষণ পরপর রোদ থেকে সরে গিয়ে ছায়াযুক্ত স্থানে বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর লবণযুক্ত পানি ও স্যালাইন পান করতে হবে।

আক্রান্ত হলে কী করণীয় : প্রাথমিকভাবে হিটস্ট্রোকের আগে যখন হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সহসশন দেখা দেয়, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হিটস্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই যা করতে পারেন তা হলো-
১. দ্রুত শীতল কোনো স্থানে চলে যান। যদি সম্ভব হয়, ফ্যান বা এসি ছেড়ে দিন।

২. ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে ফেলুন। সম্ভব হলে গোসল করুন।

৩. প্রচুর পানি ও খাবার স্যালাইন পান করুন। চা বা কফি পান করবেন না।

কিন্তু যদি হিটস্ট্রোক হয়েই যায়, তবে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে, ঘরে চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে রোগীর আশপাশে যারা থাকবেন তাদের করণীয় হলো-

৪. রোগীকে দ্রুত শীতল স্থানে নিয়ে যান।

৫. তার কাপড় খুলে দিন।

৬. শরীর পানিতে ভিজিয়ে দিয়ে বাতাস করুন। এভাবে তাপমাত্রা কমাতে থাকুন।

৭. সম্ভব হলে কাঁধে, বগলে ও কুঁচকিতে বরফ দিন।

৮. রোগীর জ্ঞান থাকলে তাকে খাবার স্যালাইন দিন।

৯. দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

১০. সব সময় খেয়াল রাখবেন হিটস্ট্রোকে অজ্ঞান রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস এবং নাড়ি চলছে কি না। প্রয়োজন হলে কৃত্রিমভাবে নিশ্বাস ও নাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হতে পারে। হিটস্ট্রোকে জীবন বিপদাপন্ন হতে পারে। এমনকি রোগী মারাও যেতে পারেন। গরমের এই সময়টায় সবাইকে সাবধানে থাকতে হবে। দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও হাসপাতালে ভর্তি করে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া গেলে বেশির ভাগ রোগীই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।

১১. গরমে শিশুদের জন্য ঝুঁকিটা বেশি। বাচ্চাদের বেশি বেশি পানি খাওয়াতে হবে। তারা যেন রোদের মধ্যে অনেক বেশি দৌড়ঝাঁপ না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সবাইকে মনে রাখতে হবে, এই গরমে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে এর থেকে বেঁচে থাকা উচিত।

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক


প্রতিদিনের সাত হজ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মুফতি আলী হুসাইন

আপনি কি হজ না করেও হজের নেকি অর্জন করতে চান? আপনার সামর্থ্য নেই মক্কা যাওয়ার, নেই আর্থিক সংগতি তারপরও কি আপনি একজন হাজির মর্যাদা অর্জন করতে আগ্রহী? যারা অর্থ ও শ্রম দিয়ে কাবা শরিফ পৌঁছেছেন; অশেষ নেকি অর্জনে সক্ষম হয়েছেন; মহান রবের নৈকট্য লাভ করেছেন; কাবা চত্বরে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি তুলেছেন আর আপনি দেশের সীমানা অতিক্রম করেননি কিন্তু সাধ্য না থাকলেও মনে বড় স্বাদ আছেÑ তাদের মতো বিপুল নেকি অর্জন করবেন বলে। তা হলে এবার আপনাকে জানতে হবে এমন কি আমল যার দ্বারা আপনি হজ না করেও হজের নেকি লাভ করবেন। বাইতুল্লাহ শরিফে না গিয়েও হাজিদের মর্যাদা অর্জন করবেন।

আপনার বিশ্বাস হোক আর না-হোক

* মাত্র তিন মিনিট সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজের সাওয়াব লেখা হবে।

* মাত্র ছয় মিনিট সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পরিপূর্ণ একটি ওমরার সাওয়াব লিখা হবে।

* মাত্র ১৫ মিনিট সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজের সাওয়াব লেখা হবে।

* মাত্র এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজের সাওয়াব লেখা হবে।

* মাত্র দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজ ও ওমরার সাওয়াব লেখা হবে।

এখন নিশ্চয়ই আপনার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, এটা জানার জন্য যে, কি সেই আমল? যে আমল করলে এতগুলো হজ ও ওমরার সাওয়াব লেখা হবে। তাহলে এখনই জেনে নিন, সেসব আমল সম্পর্কে, যেগুলোর মাধ্যমে হজ না করেও হজের নেকি পাওয়া যায়; মক্কায় না গিয়েও হাজিদের সমান মর্যাদা ও নেকি অর্জন করা যায়।

এক. জামাতের সঙ্গে ফরজ নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে বের হলে পরিপূর্ণ একটি হজের সাওয়াব হাসিল হয়।

হাদিসে এসেছে, আবু উমামা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ফরজ নামাজ জামাতের সঙ্গে আদয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়, তার এক হজের সমান নেকি লাভ হয়। আর যে ব্যক্তি কোনো নফল নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে বের হয়, তার জন্য একটি পরিপূর্ণ ওমরার সাওয়াব লেখা হয়। [মুসনাদে আহমাদ: ২২৩০৪]

এক ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করলে পরিপূর্ণ একটি হজের সাওয়াব অর্জন হয়, তাহলে যে ব্যক্তি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে, নিঃসন্দেহে তার পাঁচটি পরিপূর্ণ হজের সাওয়াব অর্জন হবে। তারপরও মানুষ কি করে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা থেকে দূরে থাকে! অথচ মাত্র ১৫ মিনিটের ব্যাপার!

দুই. যে ব্যক্তি ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে জায়নামাজে বসে থেকে যিকির-আযকার, দোয়া-দরুদ বা কোরআন তিলাওয়াতে লিপ্ত থাকে, তারপর সূর্য একটু ওপরে ওঠে গেলে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নেয়, তাহলে তার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজ ও পূর্ণ একটি ওমরার সাওয়াব লিখে দেওয়া হয়।

হাদিসে এসেছে, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে। অতঃপর সূর্য ওঠা পর্যন্ত জায়নামাজে বসে যিকির-আযকার করতে থাকে, তারপর (সূর্য একটু ওপরে ওঠে গেলে বা ইশরাকের সময়) দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নেয়, তার জন্য পরিপূর্ণ একটি হজ ও ওমরার সওয়াব অর্জন হয়। রাসুলুল্লাহ শেষোক্ত শব্দটি তিনবার বলেন- পরিপূর্ণ হজ ও ওমরা, পরিপূর্ণ হজ ও ওমরা, পরিপূর্ণ হজ ও ওমরা। [তিরমিযি: ৫৮৬]

মানুষ ও জিন জাতির জন্য কি সুবর্ণ সুযোগ! মাত্র দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করেই হজ ও ওমরার সাওয়াব অর্জন করতে পারে।

তিন. যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ৩৩ বার আল্লাহু আকবার, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ পাঠ করবে, তার আমলনামায় একটি হজ, একটি ওমরা এবং আল্লাহর রাস্তায় দান করার নেকি লাভ করবে।

আবু হুরাইরা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনÑ

একদল দরিদ্র মুহাজির সাহাবিগণ রাসুলুল্লাহর নিকট এসে অনুযোগ করল, ধনী ব্যক্তিরা উচ্চমর্যাদাও নায-নেয়ামতে আমাদের থেকে অগ্রগামী। তিনি বললেন এটা কীভাবে? তারা বলল, আমরা যেভাবে সালাত আদায় করি তারাও সেভাবে সালাত আদায় করে, আমরা যেভাবে সওম পালন করি তারাও সেভাবে সওম পালন করে। তারা দান-সাদাকাহ করে, আমরা দান-সাদাকা করি না, তারা গোলাম আজাদ করে আমরা করি না। রাসুলুল্লাহ বললেন, আমি তোমাদেরকে এমন কিছু শিখিয়ে দেব কি? যার দ্বারা তোমরা তোমাদের অগ্রগামীদের মর্যাদায় পৌঁছতে পারবে এবং তোমাদের পশ্চাৎগামীদের আগে যেতে পারবে। কেউ তোমাদের অগ্রগামী হতে পারবে না। তবে তোমাদের মতো কেউ আমল করলে ভিন্ন কথা। তারা বলল, আপনি বলুন ইয়া রাসুলাল্লাহ!। রাসুলুল্লাহ তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা প্রত্যেক সালাতের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল-হামদুলিল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। বর্ণনাকারী আবু সালেহ বলেন, অতঃপর দরিদ্র মুহাজিরগণ আবার রাসুলুল্লাহর নিকট এসে অবহিত করলেন যে, আমাদের সম্পদশালীরা তো আমাদের আমলের কথা শুনে তারাও তদ্রূপ আমল শুরু করেছে। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বললেনÑ

এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছে তা দান করেন। [বুখারি: ৮৪৩, মুসলিম: ৫৯৫]

এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, আবু হুরাইরা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন,Ñ

যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ এবং ৩৩ বা র আলহামদুলিল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবার, মোট ৯৯ বার পাঠ করবে এবং ১০০ বার নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করবেÑ

‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লাশারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহুয়া আলা কুল্লিশাইন কাদির’

তাহলে তার সমস্ত গোনাহ মিটিয়ে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনারাশির সমপরিমাণ হয়। [মুসলিম:৫৯৭ ]

মাত্র তিন মিনিট সময় ব্যয় করে কি বিপুল পরিমাণ নেকি অর্জন করা যায়!

চার. যে ব্যক্তি দীন শিক্ষা করা বা শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করে, তার আমলনামায় একটি পরিপূর্ণ হজের সাওয়াব দান করেন।

হাদিসে এসেছে, আবু উমামা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি শুধু কল্যাণ শিক্ষা লাভ কিংবা কল্যাণ শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করবে, তাকে পরিপূর্ণরূপে হজ পালনকারীর ন্যায় প্রতিদান দেওয়া হবে। [তাবরানি কাবির: ৭৪৭৩]

সৌভাগ্যবান ওই ব্যক্তি, যে মসজিদে গমন করে কোরআন হিফজ করার জন্য কিংবা করানোর জন্য, ধর্মীয় জ্ঞানার্জন বা শিক্ষা প্রদান অথবা জুমআর খোৎবা শ্রবণের উদ্দেশ্যে। অতঃপর পরিপূর্ণ হজের সাওয়াব নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। মাত্র এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেই এই মহৎ নেকি অর্জন সম্ভব। তারপরও কি এব্যা পারে অলসতা করা উচিত?

পাঁচ. রমাদানের এক ওমরা এক হজের সমান।

হাদিসে এসেছে, ইবনে আব্বাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন,Ñ নিশ্চয়ই রমাদান মাসের ওমরা পালনে হজের সমান নেকি হাসিল হয়। [বুখারি ও মুসলিম]

হে দীনি ভাই ও বন্ধুগণ! নেক কাজে আর বিলম্ব নয়। এখনই ছুটে আসুন, রমাদান মাসে ওমরা পালনের জন্য, আপনি একটি পরিপূর্ণ একটি কবুল হজের সমান নেকি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন। সেই সঙ্গে আছে পাপমুক্তির পরোয়ানা। ইনশাআল্লাহ!।

ছয়. হাজিদের সাহায্য করলে হজের সওয়াব পাওয়া যায়।

যায়েদ বিন খালিদ আল-জুহানি [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো যোদ্ধাকে যুদ্ধের সরঞ্জামের জোগান দেবে বা যোদ্ধার পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করবে কিংবা কোনো হাজির আসবাপত্রের জোগান দেবে অথবা কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার-ও অনুরূপ নেকি অর্জন হবে কিন্তু উদ্যোক্তার সামান্য পরিমাণ নেকিও কমবে না। [নাসাঈ: ৩১৮০]

সুতরাং হাজিদের হজ পালনের প্রস্তুতিতে সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। এই নেকি অর্জনের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহী হওয়া উচিত। বিশেষত আমরা যারা হজ করতে সামর্থ্য রাখি না।

এখন তিনটি উপঢৌকন সম্পর্কে কথা বলে আলোচনা শেষ করব।

এক. যে ব্যক্তি নিজ বাড়ি বা কর্মস্থলে অজু করে মসজিদে কোবায় আগমন করব, অতঃপর সেখানে নামাজ আদায় করবে, তার আমলনামায় একটি ওমরা করার নেকি অর্জন হবে।

সাহল ইবনে হুনাইফ [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নিজ ঘরে অজু করে মসজিদের কোবায় গিয়ে নামাজ পড়ে, তার একটি ওমরার সাওয়াব হাসিল হয়। [নাসাঈ: ৬৯৯]

আমরা যা জানতে পারলাম

* প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ আলহামদুল্লিাহ, ৩৩ আল্লাহু আকবার পাঠ করতে সর্বোচ্চ তিন মিনিট সময় ব্যয় হবে, বিনিময়ে আপনি পাবেন একটি হজ ও একটি ওমরার সাওয়াব।

* মাত্র ছয় মিনিট সময় ব্যয় করে আপনি মসজিদে কোবায় দুই রাকাত নামাজ আদায় করুন, বিনিময়ে পাবেন পূর্ণ একটি ওমরা পালনের নেকি।

* ১৫ মিনিট সময় ব্যয় করে আপনি জামাতের সঙ্গে ফরজ নামাজ আদায় করুন, বিনিময়ে পাবেন একটি কবুল হজের সওয়াব।

* এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে আপনি মসজিদে গিয়ে কিছু ধর্মীয় জ্ঞান বা কল্যাণকর কিছু শিখুন কিংবা জুমার খুতবা শ্রবণ করুন, বিনিময়ে আপনি পাবেন একটি কমপ্লিট একটি কবুল হজের সাওয়াব।

* ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে, জায়নামাজে বসে থেকে যিকির-আযকার করতে থাকুন, তারপর সূর্য উঠে গেলে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নিন, বিনিময়ে পাবেন একটি পরিপূর্ণ হজ ও পরিপূর্ণ ওমরার সাওয়াব।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই জানতে পেরেছেন যে, কীভাবে একজন মুসলিম প্রতিদিন সাতটি হজ পালনের নেকি লাভ করবে?

* ঘরে অজু করে মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে পাঁচটি কবুল হজের নেকি লাভ হয়।

* ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে, জায়নামাজে বসে থেকে যিকির-আযকার করতে থাকুন, তারপর সূর্য ওঠে গেলে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নিন, বিনিময়ে পাবেন একটি পরিপূর্ণ হজ ও পরিপূর্ণ ওমরার সাওয়াব।

* এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে আপনি মসজিদে গিয়ে কিছু ধর্মীয় জ্ঞান বা কল্যাণকর কিছু শিখুন কিংবা জুমার খুতবা শ্রবণ করুন, বিনিময়ে আপনি পাবেন একটি কমপ্লিট কবুল হজের সাওয়াব।

আপনার প্রাত্যহিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক কবুল হজের ছক

প্রতিদিন ৭ হজ

প্রতি সপ্তাহে ৭ˣ৭= ৪৯

প্রতি মাসে ৭ ˣ ১০=২১০

প্রতিবছর ৩৬৫ ˣ ১২=২৫৫৫

প্রতিদানের দিক দিয়ে ওহুদ পাহাড়ের চেয়ে বৃহৎ। কোনো বিবেকবান মুসলিম ব্যক্তির জন্য অবহেলা করা উচিত নয়।


গ্রামের জিয়াফত বা মেমানি  

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আলমগীর খোরশেদ 

ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে দেখতাম অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে মুরুব্বি কেউ মারা গেলে চল্লিশ দিন পর মৃত্যুবার্ষিকী পালনে কিংবা কারোর বিয়ে, মেয়ের কান ফুটা, খৎনা, এলাকার কোনো খেলায় জয় ইত্যাদি উপলক্ষে গ্রামোময় ভোজ বা খাওয়ার যে আয়োজন করত সেটাকেই মেমানি বা মেজবানি বলা হতো। মেমানি বা মেজবানি বলতে আতিথিয়েতা বা গণভোজকে বোঝায়। যা সবার জন্য উন্মুক্ত। ধনী-গরিব সবাই একসঙ্গে বসে মেমানির খাবার খেতো।

বাংলাদেশে মেজবানি বলতে যদিও চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি ঐতিহ্য ভাবা হয়; কিন্তু এটা বৃহত্তর ময়মনসিংহের সব জেলাসহ সিলেট, খুলনা এমনকি দেশের বাইরে ইউরোপ, আমেরিকায়ও মেমানি বা মেজবানি প্রচলিত আছে। গৃহস্থদের ধান মাড়াই শেষ হলে গ্রামের বাড়িতে কাছারি ঘরের সামনে নামা খালি জমিসহ মেমানি বা মেজবানির আয়োজন করা হতো। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে এটাকে ‘জিয়াফত’ বলা হয়ে থাকে। জিয়াফত হলো ফার্সি শব্দ, যার অর্থ হলো ভোজ বা ভোজসভা। তা একটি ঐতিহ্যগত আঞ্চলিক উৎসব। প্রতিবেশী, পাড়া তথা সামর্থ্য অনুযায়ী পুরো গ্রামের লোকজনদের মেমানিতে দাওয়াত দেওয়া হতো। মেমানির যিনি আয়োজক তিনি বা তার লোকজন পাড়াময় হেঁটে হেঁটে বাড়ির মুরুব্বিদের দাওয়াত দিতেন। দাওয়াত দিতে পরিবারের সবাইকেসহ বলতে হতো, না হলে রাগ করে আসত না কেউ।

মেমানির খাবার: মেমানিতে সাদা ভাত, মরিচ ও মসলাসহ গরুর মাংস সঙ্গে ছোট আলুর ঝোল, মাছভাঙ্গা সঙ্গে আলুর ঝোল, মাষকলাইয়ের ডাল আর থাকত মজার জিনিস ‘মিডুরি’। মিডুরি হলো চালের গুঁড়া, আখের গুড়, নারকেল গুঁড়া গরম মসলা সহযোগে তৈরি তরল মিষ্টিজাতীয় খাবার। মিডুরিটা খাবারের শেষে পরিবেশন করা হতো। বাবুর্চির সুনাম নির্ভর করত মিডুরি ও গরুর মাংস রান্নার ওপর। সবশেষে দেওয়া হতো পান সঙ্গে চিকন করে কাটা সুপারি, খয়ের, চুন ও পাতা এবং জর্দা।

মেমানির ডেকোরেশন: তখনকার দিনে এখনকার সময়ের মতো ডেকোরেটর ছিল না। বিয়ে, ওয়াজ মাহফিলে কাপড়ের তৈরি বড় সামিয়ানা টানানো হতো, যাতে কোনো সমিতি বা প্রতিষ্ঠানের নাম, সন তারিখ, সাকিন এসব লাল, নীল সুতো দিয়ে লেখা থাকত। রান্নার জন্য বিভিন্ন পাড়া বা গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি থেকে পিতলের তৈরি বড় ডেকচি যাকে ‘মেমানির ডেক’ বলত, তা আনা হতো। ডেকচির গায়ে ওপরের দিকে ডেকচির মালিকের নাম, সন তারিখ, সাকিন ইত্যাদি পিতল খোদাই করে লেখা থাকত। পাড়া থেকে চেয়ার, প্লেট বা বাসন, সানকি আনা হতো। গ্রামের লোকেরা চাটাই বিছিয়ে তাতে কলাপাতায় মেমানির খাবার খেতো।

মেমানির গরু কেনা: দাওয়াত দেওয়ার পর কর্তাব্যক্তি মেমানির জন্য গরু কেনায় অভিজ্ঞ বা মিডিয়া যে, তাকেসহ পাড়ার ও বাড়ির লোকজন নিয়ে গরু কিনতে বাজারে যেতেন। গরুর দালাল দেখলেই বোঝা যেত, নারিকেল তেল দিয়ে আঁচড়ানো মাথা চকচক করত। লুঙ্গিটা নিচ থেকে উল্টায়ে কোমরে বাঁধা, ছাতাটার বাঁট পিছনে ঘাড়ের কাছে শার্টে ঢুকানো। কখনোই তার চোখ দুটো স্থির নয়। গরুর মালিকের সঙ্গে ও ক্রেতার সঙ্গে এমনভাবে চোখের ভ্রু নামিয়ে উঠিয়ে কথা বলত যে সাধারণ মানুষ ওই চোখের ভাষা বোঝা কঠিন।

মেমানির কাজ ও ব্যস্ততা: অনুষ্ঠানের আগের রাত যেন কর্মযজ্ঞ। এ রাতে বাড়িতে কারোর ঘুম নেই। বিকেল থেকেই বাবুর্চি তার সহযোগী লোকজন, চামচাসহ অন্যান্য উপাদান, চার-পাঁচটা গরু জবাইয়ের কসাই ও তার লোকজন সবাই এসে হাজির হতো। গরু জবাই করে একটার পর একটা টুকরা করে বাবুর্চি মাংস বুঝে নিতো। পুকুর থেকে মাছ ধরার জন্য জেলেকে খবর দেওয়া হলে জেলে এসে পুকুরে জাল ফেলত। পুকুরের এপার থেকে ওপারে জাল টেনে নিলে ওদিকে মাছের লাফালাফি শুরু হতো। বড় বড় কাতল, রুই, মৃগেল, ঘাসকার্প মাছ উঠিয়ে আনা হতো। বাবুর্চি বলে দিত কত কেজি মাছ লাগবে। পেঁয়াজ, মসলা, আদা, রসুন বাটার জন্য মহিলারা শীল-পাটা নিয়ে বসে যেত। গাঁইল চেঁহাইট দিয়ে পেঁয়াজ, রসুন, পেষার কাজ করা হতো। এত লোক রাতে খাবারের জন্য খিচুড়ি পাক করত বাবুর্চি।

উঠানের কোণে লম্বা পরিখা বা মাটি কেটে গর্ত করে লম্বা চুলা বানানো হতো। ধান সিদ্ধ দেওয়ার বড় কড়াইয়ে ভাত রান্না হতো। চাল সিদ্ধ হতেই কড়াই উঠিয়ে নিয়ে গরম ভাত বড় বাঁশের তৈরি খাঁচায় ঢেলে দেওয়া হতো পানি ঝরে যাওয়ার জন্য। পানি ঝরে গেলে ভাত বিছিয়ে রাখা নতুন চাটাইয়ে স্তূপ করে রাখা হতো। চুলা ধরানোর জন্য পাটশোলার আঁটি, কেরোসিন তৈল রাখা হতো, লাকড়ির পাশে। বাড়ির মুরুব্বি যিনি, তাকে দিয়ে চুলা ধরানোর উদ্বোধন করা হতো।

মেমানি খাওয়ানোতে বিভিন্ন গ্রুপ: এত লোকের আয়োজনে নিয়মানুবর্তিতা জরুরি বিধায় লোকজনদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দায়িত্ব দেওয়া হতো। মাটির পেয়ালায় রান্না করা গরুর মাংস, মাছ, ডাল, মিডুরি দেওয়া হতো। এক গ্রুপ মাংস, অন্য গ্রুপ মাছ, অন্যরা ডাল, মিডুরি ও পানি দেবে, এভাবে। বাবুর্চিকে বলা থাকত নির্দিষ্ট লোক বা গ্রুপ ছাড়া তরকারি বা খাবার দেবে না।

শেষকথা: গ্রামে এখন আর মেমানি, মেজবানি বা জিয়াফতের আয়োজন করে না কেউ। একান্নবর্তী পরিবারগুলো হারিয়ে গেছে। সবাই হয়ে গেছে আত্মকেন্দ্রিক। একান্ত নিজের মানুষ ছাড়া কেউ কাউকে এক বেলা খাওয়ায় না এখন। মেমানি, জিয়াফত বা মেজবানি তো অনেক খরচের ব্যাপার। এখনকার বাবা-মা মারা গেলে মেমানি করার মন-মানসিকতা থাকে না সন্তানের। পরিবর্তনের হাওয়ায় সব বদলে গেছে। আজকের প্রজন্ম বুঝবেই না মাটিতে চাটাইয়ে বসে কলাপাতায় ভাত খাওয়ায় কি মজা আর কি আনন্দ। আধুনিকতায় গা ভাসানো ও সংসারের আয়োনিক বন্ধন ভেঙে যাওয়ায় হারিয়ে গেছে মেমানি, মেজবানি বা জিয়াফতের মতো গ্রামীণ ঐতিহ্য। যা কেবল স্মৃতিময় হয়ে আছে মধ্য বয়সি প্রজন্মের।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক


সড়কে মৃত্যুর মিছিল: দায়ী কে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এম এ মান্নান

কথায় আছে যেখানে ঠেকবে সেখানেই শিখবে; কিন্তু আমি এই কথার কোনো সত্যাসত্য খুঁজে পাচ্ছি না। তবে দিব্যজ্ঞানে যেটা ঠাওর করতে পারছি সেটা হলো উল্টো বুদ্ধির লোপ পায় বা হতবুদ্ধি হয় বা বুদ্ধির বৈকল্য ধরা পড়ে। যদি তাই না হতো তাহলে প্রতি বছর এবং বারবার এত এত সড়ক দুর্ঘটনা এবং এত এত অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটবে কেন? এত এত লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটবে কেন? এত এত মানুষ মারা যাবে কেন? কই এর তো কোনো স্থায়ী সুরাহা দেখতে পাচ্ছি না। নাকি এখানে শেখার কিছু নেই। শুধু ঠেকেই যাবে?

দেশে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই কেবল প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসে। ব্যাপারটা এমন যে কাজ নেই তো খই ভাজ। একটি তদন্ত কমিটি হয়। কমিটি আদা-জল খেয়ে কয়েক দিন দৌড়ায়। ওই পর্যন্তই। শুধু শুধু ব্যস্ত হওয়া। ফল যে লাউ সেই কদু। আমরা আশায় থাকি শুধু শুধু।

দেশে কী পরিমাণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি আছে চট্টগ্রাম-১১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২০২১ সালে সংসদের প্রশ্নোত্তর-পর্বে বলেছিলেন, দেশে ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি ফিটনেসবিহীন গাড়ি আছে। এরপরও কি বোঝার বাকি থাকে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ কী? কারা দায়ী? নিশ্চয় এই তিন বছরে ওই ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো ফিটলেস হয়ে গেছে। নতুন করে আরও শত শত গাড়ি ফিটনেস হারাচ্ছে। যেগুলোকে আমরা বলি লক্কর-ঝক্কর, ধাক্কা না দেওয়া পর্যন্ত খাড়াইয়া পড়।

আমরা প্রায়ই দেখতে পাই রাস্তায় গাড়ি বিকল হয়ে যেতে। গাড়ির যাত্রীদের গাড়ি থেকে নেমে ধাক্কা দিতে, নিদেনপক্ষে আরেক গাড়ি এসে তাকে ধাক্কা দিতে। ফাঁকে দেখি গাড়ির মাদকাসক্ত চালককে আরাম-আয়েশ করে মাদক ফুঁকতে। এমনতর ধুঁকে ধুঁকে চলা গাড়ি আর মাদক ফুঁকে চলা চালকের কাছে যাত্রীরা কী নিরাপত্তা পাবে? যেখানে গাড়ির চালক বসেন তার মাথার ওপরে প্রায়ই একটা লেখা চোখে পড়ে। দোয়া কুনুত। লা-ইলাহা...। এখন বুঝতে পারছি এ দোয়ার শানেনজুল কী। গাড়ি এবং চালকের কারও প্রতি যাত্রীদের ভরসা নেই। একমাত্র ভরসা আল্লাহ মালেকশাই।

গোড়ায় গলদ একটা কথা আছে। এটার শানেনজুল আবার একটু তাড়াতাড়ি বুঝতে পারছি। গাড়ির যিনি চালক হবেন তাকে দক্ষ এবং যোগ্য হতে হবে। এবং গাড়ির শতভাগ ফিটনেস থাকতে হবে। এটার ঘাটতি থাকলেই গোড়ায় গলদ। এখানে দুটোরই চরম সংকট। আর বড় গোড়ায় গলদ হলো যারা এসবের অনুমোদন দেন তারা। এর থেকে বড় গলদ আর নেই।

বেশ কয়েক বছর আগে সম্ভবত ২০১৯ সালের ঘটনা। তখন সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু নিয়ে রাজধানী প্রায় অচল করে দিয়েছিল ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা। তাদের উত্তেজনা প্রশমন করতে প্রশাসনকে অসীম বেগ পেতে হয়েছিল। তারা নিজেরাই রাজধানীর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছিল। আর সরকারি চাকুরে ট্রাফিক পুলিশরা অন্দরমহলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অতিশয় আশ্চার ব্যাপার হলো যারা কোনোদিন জানত না ট্রাফিক পুলিশ কী জিনিস, সিগন্যাল কী জিনিস সেই তারাই দায়িত্ব নিয়ে নিল সারা রাজধানীর ট্রাফিকের নিয়ন্ত্রণ। গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না, গাড়ির ফিটসেন আছে কি না। কাগজ ঠিক আছে কি না- এসব তল্লাশি করতে বেশুমার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছিল। অবাক করা কাণ্ড হলো তাদের তল্লাশি থেকে বাদ পড়েনি মন্ত্রী-এমপিদের গাড়ি পর্যন্ত। অনেকে তল্লাশির ভয়ে বিকল্প পথ ধরে পগারপার হয়েছেন। এখানেই বলা যায় যেখানে ঠেকবে সেখানেই শিখবে। তারা ঠেকেছে, তারা শিখেছে, তারা কাজ করে দেখিয়েছে এবং তারা সফল হয়েছে।

কারা ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারেন তাদের পক্ষে কোনো এক মন্ত্রীর সরল উক্তি ছিল, গাছের ছবি দেখে যে বলতে পারবে এটা গাছ, মাছের ছবি দেখে যে বলতে পারবে এটা মাছ সে-ই গাড়ির চালক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবে। অর্থাৎ প্রতীক চিনতে পারলেই তিনি যোগ্য হবেন। অবশ্য কী কারণে যেন ওই মন্ত্রী পরে অনেক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুয়ায়ী গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৩ হাজার ৫৬২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এসব দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৩১৭ জন লোক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫ হাজার ১৭২ জন। গত বছরের তুলনায় এবার সড়ক দুর্ঘনা এবং মৃত্যু দুটোই বেশি। চলতি বছর তিন মাসে প্রায় দেড় হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং নিহত হয়েছে ১৩৬৭ জন।

আমরা সবাই জানি যে প্রতি ঈদের সময় বিপুলসংখ্যক লোক বাড়ি ফেরেন। আবার ঈদপরবর্তী সময়ে বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরেন। ফলে যাওয়া এবং আসার সময় সড়কে যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পায়। এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এটাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামানো- এটা কিন্তু স্বাভাবিক নয়। আরও স্বাভাবিক নয় অদক্ষ-অযোগ্য গাড়ির চালক দিয়ে গাড়ি চালানো; কিন্তু আমরা বাস্তবে তাই দেখতে পাচ্ছি। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের নিত্যসঙ্গী হচ্ছে, রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল ভারী হচ্ছে। যা কখনো কাম্য নয়।

অতি সম্প্রতি দেশে ঘটে গেল ভয়াবহ দুটি সড়ক দুর্ঘটনা। যা গা শিউরে ওঠার মতো। ভয়াবহ ওই সড়ক দুর্ঘটনার একটি ঘটে ফরিদপুরে। ওই ঘটনায় বাস এবং পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে নারী ও শিশুসহ ১৪ জন নিহত হয়েছেন। আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে ঝালকাঠিতে। এতে ট্রাক-প্রাইভেটকার ও ইজিবাইকের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষে ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। এই দুটি ঘটনাই কি দিবালোকের মতো পরিষ্কার নয়, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা কোথায়।

সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা হামেশাই যে কথাটি শুনতে পাই বা দেখতে পাই তা হলো বাসের সঙ্গে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ বা ধাক্কা, বাসের সঙ্গে ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ বা ধাক্কা, নইলে গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কা ইত্যাদি। আর এসবের মূলে যা শুনতে পাই তা হলো গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানো। ফলে বাস বা ট্রাককে প্রায়ই দেখা যায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে বা নদীতে পড়ে থাকতে।

কথায় আছে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? এই যে যত্রতত্র ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে এর জন্য দায়ী কিন্তু অদক্ষ গাড়ির চালক এবং ফিটনেসবিহীন বা মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি। তাই এর দায় কিন্তু প্রশাসন এড়াতে পারবে না। রাস্তায় যেসব গাড়ির চালক গাড়ি চালাচ্ছেন তাদের নিয়ে শঙ্কার শেষ নেই। এসব চালকের বেশির ভাগের গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। আবার যাদের আছে তাদের অনেকের লাইসেন্স জাল। এ ছাড়া আছে অপ্রাপ্ত বয়স্ক গাড়ির চালকও। আবার অনেক চালক আছেন যারা নেশাগ্রস্ত। তারা নেশা করেই গাড়ি চালিয়ে থাকেন। একজন গাড়ির চালক যদি নানা দোষে দুষ্ট থাকেন এবং তিনি যে গাড়িটি চালান সেটি যদি ফিটনেসবিহীন গাড়ি হয়ে থাকে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে থাকে তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে এটাই তো বাস্তবতা, এটাই স্বাভাবিক। অথচ মোটরগাড়ি চালনা আইনের ধারা ৪ এবং ৫-এ উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে। অন্যথায় তিনি আইন লঙ্ঘনের দায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অথবা অনধিক ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন; কিন্তু আমরা কি এসবের বাস্তবতা দেখতে পাই। পাই না।

কাজির গরু নাকি কেতাবে থাকে গোয়ালে থাকে না। আমাদের সড়কে যানবাহন আইনের ক্ষেত্রেও তাই। আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। যদি সড়কে যানবাহন আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হতো এবং দক্ষ ও যোগ্য গাড়ির চালক গাড়ি চালাতেন এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির নিবন্ধন বাতিল করা হতো তাহলে সড়কে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিল রোধ করা যেত; কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে। কিন্তু গত দুই দিনে দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় যে ২৮ জন লোক প্রাণ হারাল এর দায়ভার কে নেবে?

সব শেষে যে কথা বলব তা হলো আইনের সঠিক প্রয়োগ। দেশে লাখ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে। সবার আগে এসব গাড়ির নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। আর যিনি রাস্তায় গাড়ি চালাবেন তাকে অবশ্যই দক্ষ এবং যোগ্য চালক হতে হবে এবং গাড়ি চালানোর বৈধ সনদ থাকতে হবে। আর যে গাড়িটি সড়কে চলবে সেটিও হতে হবে শতভাগ চলাচলের উপযোগী। কোনোভাবেই মেয়াদোত্তীর্ণ নয়।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক


খন্দকার আসাদুজ্জামান: অবিস্মরণীয় একটি নাম

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
খন্দকার হাসানুজ্জামান

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে গঠিত মুজিবনগর সরকারের অর্থসচিব, ভাষাসৈনিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যার অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে, যিনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের লোভনীয় সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধা উপেক্ষা করে মাতৃভূমির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে সর্বদা কাজ করে গেছেন, আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি কেবল ভূমিকাই রাখেননি পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশের উপযোগী প্রশাসন গড়ে তোলার সব পরিকল্পনা ও নীতি-নির্ধারণে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ভাষা আন্দোলনেরও একজন বলিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।

রাজনীতি ও দেশের বৃহত্তর কল্যাণে অগ্রাধিকার বিবেচনায় তিনি তার কর্মপরিকল্পনা সাজিয়ে ছিলেন। শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী হিসেবে তিনি তার এলাকার বাইরেও বৃহত্তর পরিসরে কাজ করে গেছেন। চাকরি জীবনের শুরু থেকেই সৎ এবং কর্মনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে তার সুখ্যাতি রয়েছে। রাজনীতিতেও তিনি যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। তিনি সরকারি চাকরি শেষে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন।

মরহুম খন্দকার আসাদুজ্জামান টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের নারুচী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৫ সালের ২২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তাদের ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি ওই এলাকায় ‘মিয়া বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত। পিতা মরহুম খন্দকার আব্দুস সামাদ এম এ (এলএলবি) ছিলেন বহুমুখী প্রজ্ঞার অধিকারী একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। খ্যাতনামা উকিল হিসেবে তার অবদান ছিল সুদৃঢ়। এলাকায় তো বটেই এমনকি টাঙ্গাইল বারেও তিনি ‘সামাদ উকিল’ হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। খন্দকার আব্দুস সামাদ স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তার মা ছালেমা খাতুন। বর্তমান গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বেরুয়া গ্রামের তৎকালিন ঢাকা জেলার প্রথম মুসলিম ডাক্তার শামসুদ্দিন খান সাহেবের একমাত্র কন্যা। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, ধর্ম পরায়ণ দানশীলতার খ্যাতি ছিল চারদিকে।

মরহুম খন্দকার আসাদুজ্জামানের কর্মজীবন ছিল বেশ বর্ণাঢ্য ও ঘটনা বহুল। ১৯৬০ সালে প্রতিযোগিতামূলক পাকিস্তান সুপ্রিয়র সার্ভিস (সিএসপি) কেডারে যোগদান করেন। প্রায় ৩০ বছর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সর্বত্র তিনি সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৫৮ সালে রাজশাহীতে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের যুগ্ম অর্থ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গঠিত প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অর্থ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। এই কর্মবীর মানুষটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO), এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকে (ADB) বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন একাধিকবার। এমনকি অবসর গ্রহণের পরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে তার মধ্যে WORLD BANK, UNDP অন্যতম।

১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত শিল্প সচিব ১৯৭২-১৯৭৩ পাট সচিব ১৯৭৪-১৯৭৫ এবং ১৯৮৭-১৯৮৯ ভূমি সচিব ১৯৮৬-১৯৮৬ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সচিব ১৯৯০-১৯৯১: পরিকল্পনা সচিব ১৯৯১-১৯৯৩। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে খন্দকার আসাদুজ্জামান একটি অবিস্মরণীয় নাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা জাতি চিরকাল তাকে স্মরণ করবে। সরকারি উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকেও মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। মুজিবনগর সরকারের অর্থ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালান।

মাত্র ৬০০০ টাকা নগদ তহবিল নিয়ে মুজিবনগর সরকারের অর্থবিভাগের দায়িত্ব নেন এবং সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেওয়ার পর তার মনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হয়, তিনি বুঝতে পারেন দেশের অবস্থা খুবই খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে দেওয়ায় তিনি তখন নিশ্চিত হন, রাজনৈতিক দুর্যোগ অতি নিকটে। এই সময়, দেশে চলছে অসহযোগ আন্দোলনে বাঙালি জাতি যে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা লাভের আশায় তাতে তিনি একজন সচেতন নাগরিক ও একজন রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে কীভাবে ভূমিকা পালন করা যায় ভাবছিলেন তখন পরিস্থিতি ক্রমেই জটিলতার দিকে ধাবিত হতে দেখে তিনি আরও কিছু সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন। এই বৈঠক হয় সালাউদ্দিন সাহেবের বাসায়। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সালাউদ্দিন, মুজিবুল হকসহ আরও বেশ কয়েকজন সিএসপি অফিসার। বৈঠকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।

১ মার্চ সংসদ অধিবেশন বন্ধ করে দেয় যা ৩ মার্চ হওয়ার কথা ছিল, বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ হতে ৬ মার্চ সারা দেশে হরতালের কর্মসূচি দেন। ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণে স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, যার কাছে যা আছে তাই নিয়েই প্রস্তুত থাকো, শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। শেষে বললেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’

ঢাকা, জয়দেবপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে এবং এমভি সোয়াতে অস্ত্র আনাতে পাকিস্তানি সরকারের কুমতলব সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ খন্দকার আসাদুজ্জামান তার নিজ জেলা শহর টাঙ্গাইলে চলে আসেন। সেখানে গিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ২৪ মার্চ তার এক আত্মীয় ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে আসেন তার মাধ্যমে ঢাকা একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে জানতে পারেন। ২৫ মার্চ আলোচনা ভেঙে যায়।

টাঙ্গাইলে বসেই তিনি ঢাকার সব ঘটনার তথ্য পান। ২৬ মার্চ সকালেই তিনি টাঙ্গাইলের সব রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে আলোচনায় বসেন এবং আগামী দিনের কর্মসূচি সম্পর্কে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ওই দিনই টাঙ্গাইল জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আর এই সংগ্রাম পরিষদের পরামর্শ দাতা হিসেবে খন্দকার আসাদুজ্জামানকে উপদেষ্টা নির্বাচিত করা হয়। তিনি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে ওই দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আরও শক্তিশালী করে তোলার জন্য ঝড়ের বেগে বিভিন্ন স্থানে চষে বেড়ান, অস্ত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের জন্য ময়মনসিংহ যান। সেখানে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা রফিকউদ্দিন ভূইয়া, সৈয়দ আব্দুস সুলতান সহনবেশ কয়েকজন নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেন জেলা প্রশাসকের বাসায়।

তিনি সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার চেষ্টা বেশ প্রশংসনীয়। তারপর তিনি জয়পুরহাট ও হিলি হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছে তিনি মালদা জেলার ডিসির সঙ্গে দেখা করেন এবং সংবাদ পান আরও কিছু নেতৃত্ব স্থানীয় নেতারা ভারতে আসছেন। তিনি কলকাতা গিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামরুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন। সরকার গঠনের বিষয়েও আলাপ-আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে নেতারা খন্দকার আসাদুজ্জামান ও নুরুল কাদের খানকে একটি সরকারের কাঠামো তৈরি করার দায়িত্ব দেন।

মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের অপরাধে সরকার খন্দকার আসাদুজ্জামানকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং তাকে ধরার জন্য ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। তার সঙ্গে আরও ১২ জন সিএসপি অফিসারের ও বিচার করে একই মেয়াদের কারাদণ্ড প্রদান করে। সঙ্গে সঙ্গে দণ্ডিত অফিসারদের সম্পত্তির ৫০ ভাগ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে খন্দকার আসাদুজ্জামানের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে চিরদিনের জন্য লেখা থাকবে।

রাজনীতি: ১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর বৃহত্তর গণমানুষের কল্যাণে কাজ করার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এ ক্ষেত্রে তিনি হয়ে ওঠেন গণমানুষের মধ্যমণি, বিশেষ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটি আশার আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখা দেন। সেই ১৯৭৩-এর পর থেকে ১৯৯১-এর জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত এই আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া ছিল।

স্বীয় যোগ্যতা ও বাবার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তিনি চলে আসেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে টাঙ্গাইল ২ গোপালপুর -ভূয়াপুর আসন থেকে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘদিন পর আসনটি পুনরুদ্ধার করেন।

কারাবরণ : দেশের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকায় খন্দকার আসাদুজ্জামান তার বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হন একাধিকবার। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ৯২-এর ক ধারা বলে গভর্নর শাসন ও জরুরি ঘোষণার পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে কারাবরণ করতে হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর পাকিস্তানিদের দোসর তৎকালিন খুনি সরকার তার ওপরও নির্মম খড়গ চালায়। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় চার নেতার সঙ্গে তাকেও কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।

অবদান: নিজ এলাকা দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার নানাবিধ অবদান আজ স্বীকৃত। মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সুবিদিত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও দেশের হয়ে কাজ করেছেন সুনাম ও সাফল্যের সঙ্গে। এলাকার উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা তার চাকরি জীবনের শুরু থেকেই। তিনি টাঙ্গাইলে বিশেষ করে গোপালপুর ভূঞাপুরের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা।

সন্তান : তার জ্যেষ্ঠপুত্র খন্দকার মাহবুব উজ্জামান ২০০৮ সালের ৭ মে তারিখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তিনি কম্পিউটার সায়েন্সের একজন উচ্চতর ডিগ্রিধারী ছিলেন। তিনি জেম নিট ওয়ারের এমডি ছিলেন। ছোট ছেলে খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল বিকম (অনার্স) এমকম করেন। তিনি বেশ কয়েকবার বিজিএমইএ-এর সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। বহুবার FBCCI প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী ঢাকা ক্লাবের দুইবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।

বড় মেয়ে অপরাজিতা হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ এমএ করেছেন। তিনি সংরক্ষিত মহিলা আসনের টাঙ্গাইলের এমপি। বড় মেয়ে অপরাজিতা হকের স্বামী বিশিষ্ট সাংবাদিক, একাত্তর টিভির সিইও মোজাম্মেল হক বাবু। ছোট মেয়ে তামান্না জামানের স্বামী কমিউনিটি ব্যাংকের এমডি ও সিইও মাশিহুল হক চৌধুরী। ছোট মেয়ে তামান্না জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে বিএসসি অনার্সসহ এমএসসি(ফার্স্ট ক্লাস) তিনি ১৯৯৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তিনি তখন মুজিবনগর সরকারি কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন।

তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার মিন্টু রোডের বাসায় এবং তার নির্দেশ মোতাবেক ১৯৯৬-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শুধু টাঙ্গাইল ২ গোপালপুর-ভূঞাপুরে নয়- সারা বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে, সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন, স্বাধীনতার চেতনার কথা বলেন, কি কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, কি কারণে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, জাতির জনকের কি স্বপ্ন ছিল,

অনেক সময় বক্তব্য দিতে গিয়ে এতটা আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন যে তার মনের অজান্তেই দুচোখ ছলছলে করে উঠত এবং এটা দেখে ওই সভারও অনেকেরই দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত বিশেষ করে জাতির জনকের পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা যখন বলতেন। দেশের স্বার্থে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানান। পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল ২ গোপালপুর-ভূঞাপুর থেকে দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ১৯৭৩-এর পর থেকে আওয়ামী লীগের এই আসনটি হাতছাড়া হয়েছিল, সেই আসনটি ১৯৯৬-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে আসনটি পুনরুদ্ধার করেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

পরবর্তীতে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। সাফল্যের সঙ্গে তিনি এই অর্পিত দায়িত্ব পালন করে প্রশংসিত হন। সাফল্যেরই নন্দিত নাম যেন মরহুম খন্দকার আসাদুজ্জামান। তিনি ২৫ এপ্রিল ২০২০ সালে ইন্তেকাল করেন। আমরা তার বিদেহি আত্মার শান্তি ও জান্নাত কামনা করি। আমিন।

লেখক: পরিবেশবিদ ও কলামিস্ট


তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সমীরণ বিশ্বাস

সূর্যের জ্বলন্ত রশ্মিতে যেন টগবগে আগুন ঝরছে। নিজের উত্তাপ শক্তিমত্তা জানান দিতে বিন্দুমাত্র ছাড় দিচ্ছে না শহর, গ্রাম, পথ-ঘাট, সড়ক-মহাসড়ক সবখানেই সূর্যের খরতা! পিচঢালা পথ যেন জ্বলন্ত উনন! জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা এ জীবন যেন ওষ্ঠাগত! গত কয়েক দিন, দেশজুড়ে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহে তেতে উঠেছে প্রাণিকুলও। বাতাসেও আগুনের ছটা। মৌসুমের প্রথম তাপপ্রবাহই চলতি মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। টানা কয়েক দিন ধরেই তাপমাত্রার পারদ চড়াই হয়ে উঠেছে চুয়াডাঙ্গায়। এখন থেকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড সীমান্তবর্তী এ জেলায়। তাপমাত্রার উত্তাপ ছড়িয়েছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে- যা অতি তীব্র দাবদাহ! এরই প্রভাবে কোথাও কোথাও গলে যাচ্ছে রাস্তার পিচ! দেশের অন্য জেলাগুলোও পুড়ছে খরতাপে। পশ্চিম-দক্ষিণ অঞ্চলে বয়ে যাচ্ছে ৪১ ডিগ্রি তীব্র দাবদাহ। দেশের অন্য জেলাগুলোও পুড়ছে অতি তাপপ্রবাহে। এদিকে প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে না পেরে অনেকেই অচেতন হয়ে পড়ছেন। দেখা দিচ্ছেন নানাবিধ রোগব্যাধি ও স্বাস্থ্য সমস্যা। তীব্র গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। প্রয়োজন ছাড়া কেউই বের হচ্ছে না ঘর থেকে। অনেকেই বের হচ্ছেন ছাতা নিয়ে। গরমে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন কর্মজীবীরা। আবহাওয়া অফিসের মতে দেশজুড়ে গরমের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে।

আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটাকে মৃদু দাবদাহ বলে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে গেলে ধরা হয় মাঝারি দাবদাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে ধরা হয় তীব্র দাবদাহ চলছে। ঢাকায়, চুয়াডাঙ্গা ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে তীব্র দাবদাহ চলছে।

আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরসহ সারা দেশই আজ শ্যামল সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তরের অত্যন্ত অভাব; কিন্তু বিদেশে এমনটি হয় না। সেখানে নগর পরিকল্পনার সময়ে উদ্যান ও প্রান্তরের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়। সুতরাং মানুষকে বাঁচতে হলে তার আদিম জীবনের প্রতিবেশী গাছ-তরুলতাকেও বাঁচাতে হবে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে তাই বিজ্ঞানীরা রব তুলেছেন, পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে গাছ-তরুরাজির শ্যামল ছায়ায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে তাই বৃক্ষ রোপণের প্রয়োজনীয়তা আছে।

ঐতিহ্যের শহর ঢাকা। চার শ বছরের পুরাতন ঢাকাকে বলা হয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের নগরী। ১৩৪ বর্গ মাইলের এ শহরে বাস করে ১ কোটি ৪১ লাখ মানুষ। বর্তমানে জনসংখ্যা আরও অনেক বেশি। ধারণা করা হয় প্রায় ২ কোটির কাছাকাছি। প্রতি বর্গ মাইলে ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষের বসবাস বলা চলে এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। বিশ্ব ব্যাংক বলছে ২০৩৫ সাল নাগাদ জনসংখ্যা ৩ কোটি ৫০ লাখ হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাল, নদী, ডোবা, বৃক্ষ নিধন করে ঘর-বাড়ি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে ফলে পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। কমে যাচ্ছে সবুজের পরিমাণ।

জাপানের কিয়োটো ও হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন গবেষক ঢাকা শহরের সবুজ নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের মতে ১৯৯৫ সালে ঢাকার সবুজ অঞ্চল ছিল ১২ %, ২০১৫ সালে ৮% এবং বর্তমানে ৬-৭%-এর বেশি না। ঢাকায় যত পরিমাণে গাছ কাটা হয় তার অল্প পরিমাণই রোপণ করা হয়। বৃক্ষ নিধনের ফলে ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বত্রই এই একই চিত্র বিরাজমান।

প্রকৃতির এই আগুনঝরা তীব্র দাবদাহ বাড়িয়ে দিয়েছে; দেশজুড়ে বৈধ-অবৈধ ইটের ভাটা, শহর ও নগর অঞ্চলে মিল-কারখানা, শপিংমল, দোকান, মার্কেট, হোটেল-মোটেল, বাসাবাড়ি, সর্বক্ষেত্রে এসির ব্যবহার প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গিয়েছে। তারই সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অপরিকল্পিত বৈধ-অবৈধ ব্যাটারি, সিএনজি, ডিজেল, পেট্রোলচালিত গাড়ি, রিকশা, অটোরিকশা বিভিন্ন যানবাহন, যার প্রতিটি কর্মকাণ্ড তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কার্যকর প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন রকমের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহারের ফলেও প্রতিনিয়ত উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। দেশজুড়ে নদী-নালা,খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, ভরাটের যেন একটি মহোৎসব চলছে! এসব কর্মকাণ্ডই আজকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত তীব্র তাপপ্রবাহের জন্য দায়ী। আমাদের দৈনিক কৃতকর্ম সংবরণ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা কষ্টসাধ্য এবং চ্যালেঞ্জিং হবে। শুধু বৃক্ষ রোপণ করেই এই সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন করা কঠিন হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটগুলো ফসলের উপকারী পোকামাকড়ের অস্তিত্বকেও এখন হুমকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে কৃষিতে নির্বিচারে রাসায়নিক ও কীটনাশক প্রয়োগ। যার ফলে এই অযাচিত কীটনাশক ফসলের মাটিতে মিশে মাটির কার্বন নিঃসরণকে বাড়িয়ে তুলছে; যার কারণে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে।

দাবদাহে কৃষি খাতে বিপর্যয়ের শঙ্কা ও করণীয়

তীব্র দাবদাহে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের কৃষি খাত। দিন দিন দেশব্যাপী তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। ৩৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা ধানের জন্য অসহনীয়, দেশে চলছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা! যা সার্বিক ধান উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় অন্তরায়! এই অতি দাবদাহে ধান ছাড়াও আম, কাঁঠাল, লিচু ও তুলাসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। ভুট্টা ও সোয়াবিন উৎপাদনেও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তীব্র দাবদাহে ফল-ফসলের ব্যবস্থাপনা

বোরো ধানে হিটশক ( তাপজনিত ক্ষতি) বা গরম বাতাস (৩৫ ডিগ্রি C+) প্রবাহ হলে ধান চিঁটা হতে পারে। তাই জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি, কাইচথোড় (Panicle stage of rice) হতে ফুল ফোটা পর্যায় পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে। আম, কাঁঠাল এবং লিচুগাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত (৭ থেকে ১০ দিন অন্তর) সেচ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে গাছের শাখা-প্রশাখায় পানি স্প্রে করে দিতে হবে। প্রয়োজনে প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া যেতে পারে। এতে ফল ঝরে পড়া কমবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া মাটিতে রস ধরে রাখার জন্য সেচের পর গাছের গোড়ায় মালচিং দেওয়া যেতে পারে।

তীব্র দাবদাহে সবজি ফসলের ব্যবস্থাপনা

ফল এবং পাতাজাতীয় সবজির জমিতে আগামী এক সপ্তাহে মাটির ধরন বুঝে প্রয়োজনীয় দুই থেকে তিনটি সেচ ব্যবস্থা করতে হবে। জৈব সারের পানি ধারণক্ষমতা বেশি, সে জন্য জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। ফল এবং সবজির চারাকে তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য মালচিং ও সেচ নিশ্চিত করতে হবে। চলমান তাপপ্রবাহের কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিতে হবে।

তীব্র দাবদাহে প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনা

প্রাণিসম্পদের তাপপ্রবাহজনিত পীড়ন (স্ট্রেস) সহনশীল করতে, গবাদিপশু, পোলট্রির ঘর শীতল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। গবাদিপশুকে দিনে একাধিকবার গোসল করিয়ে দিতে হবে অথবা পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। গবাদিপশুকে পানির সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ, ভিটামিন সি এবং গ্লোকোজ ইত্যাদি মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। দাবদাহের এই সময় গবাদিপশুকে ঘরে আবদ্ধ না রেখে গাছের বা প্রাকৃতিক ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। গবাদিপশুকে এই সময় শুকনো খড় না দিয়ে কচি সবুজ ঘাস খেতে দিতে হবে। অতি দাবদাহে খাবার কমিয়ে দিতে হবে। প্রচণ্ড গরমের সময় গবাদিপশুকে কৃমিনাশক, টিকা কিংবা প্রাণীর পরিবহন পরিহার করতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি হলে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

তীব্র দাবদাহে মৎস্য সম্পদ বাঁচাতে ব্যবস্থাপনা

তুলনামূলক কম গভীরতার পুকুরে নতুন পানি যোগ করে গভীরতা কমপক্ষে ৫ ফুট করতে হবে যাতে নিচের পানি কিছু ঠাণ্ডা থাকে এবং মাছ সেখানে থাকতে পারে। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে পানির মধ্যে মাচা করে লাউজাতীয় গাছ লাগিয়ে পুকুরে ছায়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পুকুরের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ জায়গায় চারদিকে বাঁশের ঘেরাও দিয়ে কচুরিপনা/ নারকেলগাছের পাতা রাখা যেতে পারে। দিনের বেলায় রোদের সময় অর্থাৎ দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গভীর নলকূপ থেকে পানির সরবরাহ করে কমপক্ষে ৫ ফুট বা তার বেশি পানির উচ্চতা বজায় রাখতে হবে। সকালবেলায় শতকে ২০০-২৫০ গ্রাম লবণ বা ১০০ গ্রাম ভেট স্যালাইন গুলে পুকুরে ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। রাতের বেলায় এরেটর/ব্লোয়ার/মেশিন (পুকুরের পানিকে ফোয়ারা বা ঘুরনি তৈরি করে বাতাসের অক্সিজেনকে পানিতে দ্রুত মেশাতে সহায়তা করে) চালিয়ে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে অন্যথায় শতকে ১০ গ্রাম হারে অক্সিজেন ট্যাবলেট পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরের পানি স্বাভাবিক ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত পুকুরে খাবার সরবরাহ কমিয়ে দিতে হবে বা প্রয়োজনে সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে। সকালে এবং সন্ধ্যার পর খাবার অল্প করে দিতে হবে। ভিটামিন-সি মিশিয়ে (৭-৮ গ্রাম/কেজি খাদ্যে) খাদ্যের সঙ্গে খাওয়াতে হবে তাপমাত্রা স্বভাবিক না হওয়া পর্যন্ত। এ সময় দিনের বেলায় মাছ/পোনা স্থানান্তর বন্ধ রাখতে হবে বা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। গত কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মারাত্মক দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। তাই আসুন আমরা সবাই সতর্ক হই এবং অন্যকে সতর্ক করি।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ


সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তোয়াব খান

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এম নজরুল ইসলাম

ইতিহাসের সাক্ষী তিনি। সেই কবে থেকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখছেন সময়ের বয়ে চলা ও পরিবর্তন। জন্ম ব্রিটিশ ভারতে। এরপর পাকিস্তানি শাসন পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ। সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেছেন। দেখেছেন একাত্তর। ধারণ করে চলেছেন একাত্তরের চেতনা। অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে, একজন বিপ্লবী কলম সৈনিক হিসেবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত হতো তার ‘পিণ্ডির প্রলাপ’। তার জীবনকে কোনো মামুলি জীবন বলা চলে না। ইতিহাসের সাক্ষী হতে হতে তিনি আজ নিজেই তো এক ইতিহাস। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে নানা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এক মানুষ তিনি। তার জীবনখাতার পাতাগুলোও তো কম বর্ণিল নয়। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে তিনি এক উজ্জ্বল তারকা। সাংবাদিকদের সাংবাদিক তিনি এতে কোনো সন্দেহ নেই। পেশাগত জীবনে ছয় দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসে আজ তিনি নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। সব সময়ে সমসময়ের প্রতিনিধি। তাই যথার্থ আধুনিক। সেই আধুনিকতার প্রতিফলন তার পেশা ও ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পরতে।

একালের গায়ক নচিকেতার গানে আছে, ‘অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন/ শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন’। ৮৫ বছরের মুখর জীবনে মিডিয়ার মহীরুহপ্রতিম এই মানুষটির পথচলাও যেন অন্তবিহীন। ব্যক্তি জীবনে যেমন স্মার্ট আর স্টাইলিশ তিনি; তার লেখনীও তেমন নির্মেদ আর তীক্ষ্ণ। যদিও পাঠক হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, তিনি লিখেছেন কম, লিখিয়েছেনই বেশি। আপাত গম্ভীর এই মানুষটিকে আবিষ্কারই করতে হয়। এই আবিষ্কারের আরেকটি গূঢ় কারণ হচ্ছে, তার জীবন তো কোনো মামুলি জীবন নয়। চলমান এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনকালে শুরু যে পথের, তা আজও বহমান। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে নিজেকে সঠিক খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এ জন্যই তিনি সমসাময়িক। আধুনিক।

তিনি এক অসাধারণ গল্পকথক। অনুপুঙ্খ বলে যান আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। দীর্ঘ সময়ের প্রতিটি ঘটনা তার নখদর্পণে। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগই নেই। তার চেতনায় একাত্তর, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। সাংবাদিক হিসেবে তিনি পরিবর্তনগুলো যেমন দেখেছেন, তেমনি সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবেও দেখেছেন খুব কাছ থেকে। খুব কাছে থেকে স্বাধীনতার মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছেন। ১৯৭৩-৭৫-এ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুই বেছে নিয়েছিলেন তাকে। ছিলেন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের প্রেস সচিব। ১৯৮০-৮৭-তে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। পালন করেছেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্বও।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার সাতক্ষীরার রসুলপুরে। পড়েছেন সাতক্ষীরার সার্ধশত বছরেরও বেশি পুরোনো পিএন (প্রাণনাথ) স্কুলে। স্কুলের পাট চুকিয়ে ঢাকায় কলেজে পড়তে আসা। বছর না ঘুরতেই ভাষা আন্দোলনে উত্তাল দেশ। ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় হলেন। এর পর থেকেই ভেতরে ভেতরে একটা পরিবর্তনের হাওয়া। অজান্তে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দীক্ষা। বদলে যায় জীবনের গতিপথও। ক্রমেই শিকেয় উঠছে পড়াশোনা। পেয়ে বসে বিপ্লবের নেশা। ১৯৫৩ সালে কেজি মুস্তফার সঙ্গে বের করেন সাপ্তাহিক জনতা। এর মধ্য দিয়েই হাতেখড়িও হয়ে যায় তার সাংবাদিকতা জীবনের। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন সংবাদে। ১৯৬১ সালে সংবাদের বার্তা সম্পাদক। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে। বার্তা সম্পাদক হিসেবেই। ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। সত্যবাক নামে দৈনিক বাংলায় শুরু করেন ‘সত্যমিথ্যা, মিথ্যাসত্য’ শিরোনামে বিশেষ কলাম। এ কলামে উঠে আসে একটি স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক চিত্র। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একেকটি মাইলফলক রচিত হয়েছে তারই নেতৃত্বে। প্রথম চাররঙা সংবাদপত্র এর মধ্যে একটি। ‘সবসময়েই পাঠকরাই আমার প্রাইমারি কনসার্ন’, এ কথা সব সময় বলেন তিনি। তার একমাত্র বই ‘আজ এবং ফিরে দেখা কাল’।

বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ‘সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান’ বলতে যা বোঝায়, তার শেষ সলতে তিনি। না, নিজেকে মানিক মিয়া কিংবা জহুর হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তুলনা করেন না কখনো। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ওরা যে-সাংবাদিকতা করেছেন, তার ধারে-কাছেও আমরা নেই।’ কিন্তু আমরা জানি, সাংবাদিক হিসেবে সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য কর্মজীবন তার। সম্পাদকদের সম্পাদক তিনি। দেশের সংবাদপত্র জগতের প্রিয়মুখ। ২০১৬ সালে একুশে পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে তাকে। একই বছর ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমি সম্মানিত ফেলো হিসেবে নির্বাচিত করেছে। অগ্রজপ্রতিম সাংবাদিক হিসেবে দেশের সব সংবাদকর্মীর মনে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনটিও তো জাতীয় প্রেস ক্লাবের এই আজীবন সদস্যের দখলে।

এই নির্মোহ-নির্লোভ মানুষটির নাম তোয়াব খান। নামটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র যে মানুষটির চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তাকে একবার দেখে ভেতরের মানুষটিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। আপাতগাম্ভীর্যের আড়ালে যে সংবেদনশীল মানুষটির বাস, তাকে আবিষ্কার করা সহজ নয়। এর জন্য সময় ও শ্রম দিতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তোয়াব খান নিজে কয়জনের কাছে উন্মোচিত করেছেন নিজেকে? গুরুগম্ভীর তোয়াব খানের আড়ালে যে স্নেহময় মানুষটি লুকিয়ে, তাকে কি তিনি প্রকাশ করেছেন সবার সামনে? তবে, আপাতগম্ভীর এই মানুষটির সাহচর্য যারা পেয়েছেন, তারা জানেন, ওই গাম্ভীর্যের খোলস খসে পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না। আর সে কারণেই বলা যেতে পারে একজন তোয়াব খানকে আবিষ্কারই করতে হয়। এই আবিষ্কারের আরেকটি গূঢ় কারণ হচ্ছে, তার জীবন তো কোনো মামুলি জীবন নয়। চলমান এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনকালে শুরু যে পথের, তা আজও বহমান। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এ জন্যই তিনি সমসাময়িক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে ‘তোয়াব খান’ নামটি উচ্চারিত হয় পরম শ্রদ্ধায়।

অগ্রসর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সাংবাদিকতাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন তিনি। বহুদর্শী মানুষটি নামের পেছনে ছোটেননি কখনো। অদ্ভুত আড়ালচারিতা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে লড়াই এখনো চলছে, সে লড়াইয়ে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তোয়াব খান।

আজ তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন তোয়াব ভাই। আপনার স্নেহছায়ায় আরও অনেকটা পথ হাঁটতে চাই আমরা।

লেখক: সভাপতি সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ


পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোতাহার হোসেন

পাহাড়, আর পাহাড়ের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া পানির ঝর্ণাধারা ও গাছগাছালির অপরূপ শোভায় প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা বান্দরবানের নৈস্বর্গিকতাকে গ্রাস করছে সহিংসতা এবং আতঙ্কের কালো মেঘে। বান্দরবানের রুমা, থানছিতে গত কয়েক দিন ধরে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সশস্ত্র সহিংসতা, মসজিদে হামলা, ব্যাংক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের টাকা ও থানার অস্ত্র লুঠের ঘটনায় পাহাড়ের কোলে প্রকৃতির নৈস্বর্গিকতায় গড়ে ওঠা বান্দরবানের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ,আতঙ্ক বিরাজ করছে। বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন, তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরত দেখা দেয়। শঙ্কার মধ্যে সরকারের ঐকান্তিকতায় যৌথবাহিনী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবের নিরন্তর প্রচেষ্টায় পার্বত্য ঐতিহ্য বৈষাবি এবং বাংলা নববর্ষে বৈশাখী উৎসব, মুসলমানদের পবিত্র ঈদ উৎসবের সব আয়োজন সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি ঈদ, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে টানা সরকারি ছুটিকে কেন্দ্র করে ভ্রমণপিপাসু মানুষ এই তিন জেলার প্রকৃতির অপরূপ শোভামণ্ডিত এবং নয়নাভিরাম পর্যটন স্পট ভ্রমণ সীমিত আকারে হয়েছে। এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের শীর্ষমহল থেকে শুরু করে গোয়েন্দা সংস্থা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, আমাদের চৌকস সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগ অব্যাহত রাখা দরকার। তবে এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে দেশের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও শান্তি রক্ষায় প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য ও সিদ্ধান্ত।

উল্লেখ্য পাহাড়ি জনপদ বান্দরবানে কেএনএফএর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুধু পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের জন্য নয় একই সঙ্গে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য নতুন করে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। প্রসঙ্গত গত ২ এপ্রিল সন্ধ্যার পর রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে হানা দেয় কেএনএফ। এ সময় তারা পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ১৪টি অস্ত্র এবং ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক নেজামউদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ১৬ ঘণ্টা না যেতেই ৩ এপ্রিল দুপুরে একই সশস্ত্রগোষ্ঠী থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ১৭ লাখ টাকা লুট করে। পরদিন ৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে কেএনএফ। অবশ্য ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে তাদের জেলে পাঠিয়েছে। চলছে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান। উদ্ধার হয়েছে অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজার; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেএনএফের সঙ্গে বান্দরবানের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির দফায় দফায় আলোচনার মধ্যে কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো? অন্যটি হচ্ছে: সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফেলতিতে রুমা ও থানচিতে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অবতারণা কি না- এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখা দরকার।

বিগত দিনে দেখা গেছে, যখনই পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো আর্থিক অস্ত্র সংকটে পড়ে তখন তারা নিজেরা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে, জড়িয়ে পড়ে। আর তখনই চাঁদাবাজি, লুঠরাজ ও সহিংসতায় লিপ্ত হয় এবং তখন তাদের শক্তি, সার্মথ্য, সক্ষমতা জানান দিতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিগত দিনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনায় এমনটি প্রমাণ হয়। যদি তাই না হয় তাহলে শান্তি আলোচনার আড়ালে কেএনএফ ব্যাংক, থানা লুঠ, মসজিদে হামলা করবে কেন? তারা অর্থ সংগ্রহে মনোযোগী হলো কেন? এ কারণে তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার পাশাপাশি শতভাগ সতর্কতা বজায় রেখে সংকট নিরসনে মনোযোগ দেওয়া দরকার ছিল; কিন্তু তা সম্ভবত করা হয়নি। কারণ থানা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় আগ থেকে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিলে হয়তো ব্যাংক লুঠ ও থানায় হামলা, অস্ত্র লুঠ ঠেকানো যেত। আর এ কারণেই রুমা ও থানছি এসব ঘটনাকে নিছক ‘ব্যাংক ডাকাতি’ বা ‘আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা’ হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এসব সহিংসতার মধ্য দিয়ে কেএনএফ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। কাজেই এর নেপথ্যে তাদের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, আন্তর্জাতিক সংযোগ, আঞ্চলিক ও চীন-মিয়ানমারের ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে তা খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ এই নব্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও সামরিক শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে শুধু সাময়িক অভিযানে সুফল মিলবে না।

প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাহাড়ের বিবাদমান রক্তক্ষয়ী সংঘাত, সহিংসা বন্ধে আমাদের সেনাবাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। কারণ বিগত সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান পরিচালনার প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রয়েছে। এদিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ওই অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি ’ স্বাক্ষরিত হয়। পরে পার্বত্য শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ি জনগণের বিশেষ অবস্থান ও মর্যাদার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে পাহাড়ের রক্তাত্ত জনপদে প্রত্যাশিত শান্তি ফিরে আসে একই সঙ্গে পাহাড়ি বাঙালির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চলে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ।

অবশ্য ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি, র‌্যাব, বিজিবি, সেনাপ্রধান বান্দরবান সফর করে পাহাড়ি জনপদে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে কেএনএফ নির্মূলে সাড়াশি অভিযানের ঘোষণা দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও সেখানে অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযানে কেএনেএফের প্রধান নাথান বমের ঘনিষ্ঠ কেএনএফের ‘প্রধান সমন্বয়কারী’ চেওসিম বমসহ দুজন র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। এ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন এই তথ্য জানিয়েছেন।

অন্যদিকে, বম জনগোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন নাগরিক বলেছেন, চেওসিম বমের শ্যারণপাড়ার বাড়িতে কেএনএফ প্রধান নাথান বমের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার প্রধান সমন্বয়কারী শামীম মাহফুজের বৈঠক হয়েছিল। ২০২১ সালের শেষে ও ২০২২ সালের প্রথম দিকে এমন বৈঠক হয়। কারও কারও মতে তার বাড়িতেই কেএনএফের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী শারক্কীয়ার চু্ক্তি হয়েছিল। মাসিক তিন লাখ টাকার চুক্তিতে জঙ্গিদের কেএনএফ সদস্যরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল।

অন্যদিকে, কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটি গঠন করা হয় গত বছরের মে মাসে। ওই কমিটির সঙ্গে গত ৫ মার্চ দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয় বেথেল পাড়ায়। শান্তি আলোচনার মধ্যেই ২ এপ্রিল বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে ও পরদিন ৩ এপ্রিল থানচির সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে ১৭ লাখ টাকা, দুটি লাইট মেশিনগানসহ (এলএমজি) ১৪টি অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায় কেএনএফ সদস্যরা। পাশাপাশি সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় তারা। পরপর দুই উপজেলায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী।

খবর অনুযায়ী কেএনএফ ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে তৎপরতা শুরু করে। পাহাড়ে তাদের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এর আগেও গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। সেই আস্তানায় গত বছর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া ও কেএনএফের বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। সংশ্লিষ্ট মহলের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন কেএনএফকে কারা অস্ত্র সরবরাহ, অর্থ, বৈদেশিক সাহায্য দিচ্ছে। কাজেই কেএনএফকে অস্ত্র, অর্থ ও জনসমর্থন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। এটা করা না গেলে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অপূর্ণতা থেকে যাবে। তাই নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য বান্দরবানে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শান্তি আলোচনা ভেস্তে গেলেও সরকারের উচিত সংলাপের জন্য পথ উন্মুক্ত রাখা। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলের মানুষের মৌলিক চাহিদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের মতো সংগঠনের সঙ্গেও এদের যোগাযোগ আছে।

আগের মতো পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার স্বার্থে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিতে পারে। পাশাপাশি বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ তাদের নিয়মিত টহল, তল্লাশিতে নিয়োজিত করা দরকার। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, যে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের যেন ক্ষতি না হয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি পাহাড়, বন, নদীনির্ভর। তাদের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, অধিকার সমুন্নত থাকলে কেএনএফের মতো কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী অপতৎপরতা চালাতে সাহস করবে না। প্রত্যাশা পাহাড়ে শান্তি আসবে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।

লেখক: সাংবাদিক


আস্থাই আসল

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

মানুষ তার নিজের বোধ বিশ্বাসের বিশ্বে বাস করতে চায়। সে তার সব পদক্ষেপকে নিজের নিরীখেই যৌক্তিক ভাবতে ভালোবাসে। জগৎ ও সংসার সংক্রান্ত উপলব্ধি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো যার যেমন চিন্তাচেতনা তদানুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। মনসচক্রবালের চৌহদ্দীভেদে দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য হয়ে থাকে।

নৃতত্ত্ববিদ আর সমাজতত্ত্ববিদ যথাক্রমে পৌরুষ ও পরিবেশকে মানুষের বোধ বিশ্বাস সৃষ্টির নিয়ামক ভেবে থাকেন। উভয়ের মতবাদের মধ্যে বৈরিতা নেই- বরং পরিপূরকের সম্পর্ক আছে। অস্থি-মজ্জার সঙ্গে মিশে থাকা জাত্যাভিমানে এবং পরিবেশ প্রভাবের মেলবন্ধনে যে অয়োময় প্রতীতি গড়ে ওঠে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে তা ব্যষ্টি ও সমষ্টির সমাজকে গতিদান করে। সমাজ এগোচ্ছে না পিচুচ্ছে - ভাঙছে না গড়ছে তা শনাক্তকরণের কাজে নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিকের সমীক্ষা সমীকরণের বিকল্প নেই।

সবার ওপর মানুষ সত্য এ উপলব্ধিরও কোনো বিকল্প নেই। মানুষই নিজকে ও সবাইকে, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের অবয়বে সময়কে, পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণকে নিয়ন্ত্রণ করে। অবকাঠামো গড়ে যে সভ্যতা সংস্কৃতির বিকাশ সে ঘটায়, তার ধ্বংসের কারণও আবার সেই সৃষ্টি করে। মুক্তবুদ্ধি মানুষ যেমন দৃষ্টির প্রসারে আলোকিত হয়, অবরুদ্ধ চিন্তা-চেতনায় বন্ধ্যিত্ব বরণের ফলে অন্ধকারে ডুবে যাওয়াও তার ভাগ্যে ঘটতে পারে। ভালো পথ যাচাই ও গ্রহণ বর্জনের প্রশ্নটিও আদিকাল থেকেই অব্যাহতভাবে অমীমাংসিত আছে বলেই জীবন ও সমাজ গতিশীল। বৈধ-অবৈধর প্রতি আসক্তি ও আকর্ষণের তারতম্যের মধ্যে সমাজের পরিবেশ-পরিচয় প্রকাশ পায়।

সৃজনশীলতা মানুষের অন্যতম ধর্ম। প্রকৃতির অপার সম্পদ ও সৌন্দর্যকে রূপান্তর ও বহুমাত্রিক ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে মানুষ তার মেধা ও মননকে কাজে লাগায়। মানুষের মধ্যে যে সুকুমার বৃত্তিগুলো সৃজন সম্ভাবনায় উন্মুখ হয়ে আছে উপযুক্ত পরিবেশের পরিপোষক সমর্থনে ফল্গুধারার মতো তা বেরিয়ে আসতে পারে। এখানেও সৃজনশীলতা গঠন ও ধ্বংসের উভয়পর্যায়েই হতে পারে। সৃজনশীলতা গঠন না ধ্বংসের তা নির্ভর করে পরিবেশের প্রযত্ন প্রয়াস ও চাহিদার ওপর। ঘটনার প্রকৃত কারণ নিহিত থাকে নেপথ্যে। যার দ্বারা ঘটনা ঘটে সে উপলক্ষ মাত্র, যে কারণে ঘটনা ঘটে কিংবা যে ঘটনা ঘটায় সেটিই মুখ্য। ভাড়াটিয়া খুনিকে দোষী সাব্যস্ত করার পাশাপাশি কার দ্বারা এবং কেন খুনি ভাড়া করা হলো তার যথাযথ হদিস হওয়া বাঞ্ছনীয় সমস্যার প্রকৃত নিষ্পত্তির লক্ষ্যেই। নইলে সমাজের নৈতিক ভারসাম্য আর মূল্যবোধের প্রতি আস্থার ভিত্তিতে ধরতে পারে ভাঙন। এটা প্রকৃতির অমোঘ বিধান যে- অন্যায়-অনিয়মের পরিবেশ সৃষ্টিকারী ও ইন্ধনদাতা অন্যায়কারীর চেয়ে বেশি দায়ী। একে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই- কেননা প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘনকারীর অনিবার্য পরিণতিও অলঙ্ঘনীয়। কার্যকারণ ছাড়া কোনো কিছু যেমন ঘটে না তেমনি কোনো ক্রিয়াই প্রতিক্রিয়াহীন থাকে না।

মানবকল্যাণ কামিতার আদর্শ সময় ও সমাজভেদে নানান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে থাকে। মানবকল্যাণধর্মী মূল্যবোধের বিকাশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত জরুরি, শত বাধা-বিপত্তি সংশয়-সংকট সন্ধিক্ষণেও সত্য-সুন্দরের সনাতন উপলব্ধি থাকবে জাগ্রত। বিভ্রান্তির বেড়াজালে শাশ্বত মূল্যবোধ হারিয়ে যাবে কি না কিংবা নিরুদ্দিষ্ট হবে কি না তা নির্ভর করে ব্যষ্টি ও সমষ্টির আকাঙ্ক্ষার আকৃতি আর সজাগ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃতির ওপর। জনকল্যাণের নামে, সংস্কারের নামে কুশাসন-শোষণ মুক্তির নামে নানান মতবাদ-উপায়-উপলব্ধির অবয়বে শাশ্বত মূল্যবোধের ভাঙাগড়া চলে। শুভ উদ্যোগে বিশ্বাস ও প্রত্যয় হয় সুদৃঢ়। আত্মমর্যাদাবোধের বিকাশ আর কল্যাণকামিতায় আসে প্রাণ প্রাচুর্য। পক্ষান্তরে ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তাচেতনা দ্বারা তাড়িত পদক্ষেপে সৃষ্ট হতবাক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেয় সব ক্ষেত্রে। বিশ্বাস আর আস্থায় ধরে ভাঙন। মানুষ বিশ্বাসের বিশ্বে নিরাপত্তা নির্ভরতায় বাস করতে চায়। আস্থা নিজের প্রতি, সমাজের প্রতি অতীব প্রয়োজন। আস্থার অবর্তমানে কিংবর্তব্যবিমূঢ় ব্যক্তি সমাজে জগদ্দল পাথর হয়ে দাঁড়ায় এবং কিয়ৎকাল পরে তার চলৎশক্তির গতিধারায় ঘটতে পারে অশুভ দিকপরিবর্তন। নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাফিক যেমন পদে পদে কারণে-অকারণে অহেতুক যানজটের হেতুতে পরিণত হয়। অসহিষ্ণুতা আর পারস্পরিক দোষারোপের বেড়াজালে সহযোগিতা সহমর্মিতার মেলবন্ধন হয়ে পড়ে সুদূর পরাহত। রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি যেমন বহু রোগ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে, আত্মস্বার্থ উদ্ধারের ভেদবুদ্ধি প্রবল হলে ব্যষ্টি ও সমষ্টির সর্বনাশের সঙ্গে নিজের সর্বনাশও যে জড়িত- এ উপলব্ধিটাও হারিয়ে গেলে সমূহ বিপদ।

সমাজে নানান উপায় ও উপলক্ষে এমন সব ঘটনাবলির উদ্ভব হয় যা সমাজের গতিপ্রকৃতির দিকনির্দেশ করে। গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে সমাজ সমৃদ্ধ হয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের দ্বারা বিজ্ঞান ও সভ্যতার অনেক সুযোগ সহজে হাতের কাছে এসে যায়- ধ্যান-ধারণায় তা যেমন নতুন মাত্রা যোগ করে, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠান ক্ষেত্রেও সূচিত হয় নানান সুযোগ। শোষণ বঞ্চনা বৈষম্যের অবসান ঘটাতে মানুষ সংগ্রাম করে- শোষণহীন বঞ্চনা বৈষম্যরহিত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায় বুক বাঁধে। প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে দেখলে সংগ্রামের সার্থকতা সে খুঁজে পায়, উদ্দীপ্ত চেতনায় দীপান্বিত হয়ে ওঠে। তার এবং সবার ঐকান্তিক প্রয়াস প্রচেষ্টায় উন্নয়ন ও সংহতি সুদৃঢ় হয়ে ওঠে। আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণের পরিতৃপ্তিতে তুষ্ট জনগোষ্ঠীকে কোনো বাদ বিসংবাদ বিভ্রান্ত করতে পারে না। আগে যেমন বলা হয়েছে- মানুষ তার কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতা খুঁজে ফিরে নিয়ত নিজের নিরীখে। যদি দেখা যায় ক্ষুদ্র ও খণ্ডিত স্বার্থবাদিতায় নানান বিভ্রান্তি ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে তার আত্মত্যাগের মহৎ উদ্দেশ্যগুলো তা হলে তার সক্রিয় অংশগ্রহণের যৌক্তিকতার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য-অভিপ্রায়ের, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ানের আঙিনায় অপব্যাখ্যার আগাছা জন্ম হয়। প্রয়োজনে অনুরূপ সে আগাছা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের চলৎশক্তির জন্য সেটা এক দারুণ দুঃসংবাদ।

অথচ ব্যষ্টি ও সমষ্টির মধ্যে নিয়ত এ প্রয়াস প্রত্যাশিত থেকে যায় যে তীব্র প্রতিযোগিতাময় প্রাগ্রসরমান বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে তালমিলিয়ে তুলনামূলক সমৃদ্ধি অর্জনের। এটা অত্যন্ত জরুরি ও প্রয়োজন, প্রতিনিয়ত সফলতা-ব্যর্থতার খতিয়ান পর্যালোচনা, ভুল পদক্ষেপকে শনাক্ত করে শ্রেয়তর পদক্ষেপ গ্রহণের ঐকান্তিকতার পরিপোষণ এবং বিভ্রান্তি ও বিভক্তি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র প্রশ্রয় পেয়ে যাতে উন্নয়নের ধারায় বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র একসূত্রে গাঁথা এবং তার বর্তমান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যমণ্ডিত অতীতকে সফল বর্তমানে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে পারলেই তা সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের সোপান হিসেবে স্বীকৃত হবে। আজকের বর্তমানও এক দিন ইতিহাসের বিবেচ্য বিষয় হবে। সব সময় অতীত বন্দনা ও প্রতিষ্ঠায় দৃষ্টি ও মনোযোগ নিবদ্ধ থাকলে বর্তমানের কী হবে? কোন পরিচয়ে বর্তমান ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে সে বিবেচনাও যথেষ্ট জরুরি। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই বর্তমানকে বিনির্মাণ প্রয়াস প্রচেষ্টার দ্বারা সোনালি ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সার্থক হতে পারে।

অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্র নির্বাচন ও পন্থা নির্ধারণেও সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। অতীতের উদাহরণ এনে বর্তমানের ভুল-ভ্রান্তিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টার চেয়ে আত্মঘাতী প্রতারণা আর নেই। গুড প্রিসিডেন্স বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে সমৃদ্ধ হতে যতখানি সহায়তা করে ব্যাড প্রিসিডেন্স তার চেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতীতেও এমনটি করা হয়েছে এই বলে যদি বর্তমানের অপকর্মের যৌক্তিকতা দাঁড় করানো ও সাফাই বন্দনা শুরু হয় তাহলে গঠনমূলক মূল্যবোধের বিকাশকে অসম্ভবই শুধু করে তোলা হবে না, চক্রবৃদ্ধি হারে তার মাশুল গুণতে হয় অতীতের মতো ভবিষ্যৎকেও। অথচ কথা ছিল ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’

৫৩ বছরে পা দেওয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে এই সময় ও সমাজে বয়স, বর্ণ, পর্যায় ও প্রকারভেদে নানান কিসিমের মানুষ এখনো রীতি-পদ্ধতি, নীতি ও নিয়মে ঔপনিবেশিত। শ্রমজীবী কর্মক্লান্ত মানুষের পাশাপাশি অতি চালাক ফিটফাট ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও কর্মী, শিক্ষাবিহীন শিক্ষিতের সমারোহের পাশে প্রযুক্তি প্রখর মেধাবী মুখ, মুক্তবুদ্ধি শান্ত সমাহিত চিন্তাচেতনার সারিতে সহসা মৌলবাদী চেহারার মানুষ, উন্নয়নকর্মীর পাশাপাশি নিজের আখের গোছাতে তৎপর এনজিও কর্ণধার, সন্ত্রাসীর ভয়ে আতঙ্কিত মানুষ, চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী আত্মোৎসর্গীকৃত সেই পুলিশ সার্জেন্ট, ষড়যন্ত্রের শিকার গৃহহীন মানুষ, খবরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে হাসিমুখের মানুষের পাশাপাশি বানভাষী মানুষ, নিঃস্বার্থ ত্রাণকর্মীর পাশে সুযোগসন্ধানী- অসৎ উদ্দেশ্য অভিলাষী চোখের মানুষ, কোণঠাসা সৎ ও নিষ্ঠাবান চাকুরে, ধান্দাবাজ আর আত্মস্বার্থের শর্করা সমৃদ্ধ জনস্বার্থসেবী আমলা, অবিবেচক বাসের হেলপার, ট্রাকের মাতাল ড্রাইভার, নীল, সাদা অধ্যাপক, একচোখা আতেল, রাজনৈতিকশিল্পী, ঋণখেলাপি, ব্রিফকেসবাহী নতুন শিল্পপতি, নকল সরবরাহকারী, উদ্ধত ছাত্রনেতার সামনে অসহায় অধ্যক্ষ, জামিনপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী, কুকুরের মাংস বিক্রেতা আর অ্যাসিডে দগ্ধ তরুণীর দেশে সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটার।

লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক


হাড়ে হাড়ে বুঝছি, উষ্ণায়ন কী? 

প্রতীকী ছবি
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
লিয়াকত হোসেন খোকন 

যত দিন যাচ্ছে, আমরা যেন হাড়ে হাড়ে বুঝছি, উষ্ণায়ন কাকে বলে। উষ্ণায়নের গ্রাসে পৃথিবী তলিয়ে যাওয়া এক প্রকার নিশ্চিত। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান সেই মতকেই প্রবল সমর্থন জোগাচ্ছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের আবহাওয়া-সংক্রান্ত রিপোর্টে যেমন স্পষ্ট হয়েছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে রেকর্ড হারে। সেই হার এতটাই বেশি, ২০২৩ সালটি উষ্ণায়নের পুরোনো সব রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা গত বছরে গড়ে প্রায় ১.৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।

২০১৫ সালে প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো সম্মিলিতভাবে স্থির করেছিল পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রিতে আটকে রাখার। এটাই বিপদ-মাত্রা। ফেলে আসা বছরটি দেখিয়ে দিল, পৃথিবীর এই বিপদ-মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে।

এমনটা যে অপ্রত্যাশিত, তা নয়। দীর্ঘ দিন ধরে একটু একটু করে জলবায়ু পরিবর্তনের চিহ্নগুলো স্পষ্ট হয়েছে। প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনগুলো তো বটেই, অন্যান্য আন্তর্জাতিক মঞ্চেরও মূল আলোচ্য হয়ে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার ক্ষতিকর প্রভাব ঠেকাতে সম্ভাব্য পথগুলো।

জলবায়ু পরিবর্তন কোনো একটিমাত্র দেশের নিজস্ব সমস্যা নয়, সুতরাং প্রতিরোধের পথগুলোও ঐকমত্যের ভিত্তিতে একযোগে নেওয়া প্রয়োজন; কিন্তু এত দিন ধরে এত অর্থ ব্যয়ে যে আলোচনা, প্রতিশ্রুতি পর্ব চলে এসেছে, তা একটি বৃহদাকার অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে মাত্র। কার্বন নিঃসরণের মাত্রার দ্রুত হ্রাস এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্পগুলোর ওপর অধিক গুরুত্বারোপ উষ্ণায়ন প্রতিরোধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে বিভিন্ন সময় ধার্যও করেছে বিভিন্ন দেশ; কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাপেক্ষে সেই লক্ষ্যমাত্রাও ক্রমশ অধরা মনে হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির এমন হার অব্যাহত থাকলে ইতোমধ্যেই যে বিপুল জলবায়ুগত পরিবর্তনের আশঙ্কা, তার মোকাবিলা করার মতো পর্যাপ্ত সময় হাতে থাকবে তো?

উন্নত দেশগুলো তাদের অর্থ এবং পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জোরে যে দ্রুততায় কার্বন-শূন্য লক্ষ্যমাত্রার দিকে যেতে পারে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পক্ষে তা অর্জন করা কঠিন।

পৃথিবীর অনেক দেশই এখনো কয়লার ওপর অতি নির্ভরশীল। পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উপযোগী পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তার জোগান আসবে কোথা থেকে?

উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপানির তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। দ্রুততর হচ্ছে হিমবাহ গলনের প্রক্রিয়া। ক্রমশ বাড়ছে সমুদ্রপানির উচ্চতা। বিপদের মুখে অগণিত উপকূলবাসী। বিপদ অন্যত্রও। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বৃদ্ধি পেলে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা আগামী দিনে বাড়বে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট। খামখেয়ালি আবহাওয়ায় কৃষিকাজ ব্যাহত হলে আগামী দিনে খাদ্যসংকট ঘনীভূত হবে। এর কোনো কথাই কিন্তু নতুন নয়। প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসের বাইরে বিশ্ব কোনো কার্যকর পথের সন্ধান দিতে পারল না, সেটা উষ্ণায়নের চেয়ে কম উদ্বেগের নয়।

বিশ্ব উষ্ণায়ন শব্দ দুটো কয়েক বছর আগেও আমাদের কাছে অচেনা ছিল। মাঝেমধ্যে কথাটা শুনতাম। মানে বুঝতাম না। ভাবতাম, এটা বোধহয় বিশেষজ্ঞদের ব্যাপার। আমাদের না বুঝলেও চলবে! অবশেষে তাই বুঝতে হলো, উষ্ণায়ন কী, হাড়ে হাড়ে বুঝছি আজ।

পানিও ফুরিয়ে আসছে-

ভূ-গর্ভের পানিও এখন ব্যাপকভাবে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে ভূ-গর্ভের পানিও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ভূ-গর্ভের পানিতেও আর্সেনিক ইত্যাদি বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। ফলে ভূ-গর্ভের পানিও এখন আর সুপেয় নয়।

কাজেই ভূ-পৃষ্ঠ এবং ভূ-গর্ভের পানি সংরক্ষণের এবং পানি ব্যবহারে মিতব্যয়িতার এখন বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো এ জন্য বিশেষ বৈজ্ঞানিক কৌশল অবলম্বন করছে। এ ছাড়া ব্যবহৃত পানিও শোধন করে পুনর্ব্যবহার যোগ্য করে তোলার এখন বিশেষ প্রয়াস শুরু হয়েছে।

আমাদের দেশে বিশেষ করে পানি সংরক্ষণ, পানি পুনর্ব্যবহার যোগ্যকরণ ইত্যাদি প্রকল্প তো দুরস্ত, এখনো ৭০ শতাংশ মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে পারেনি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চল, দুর্গম পাহাড়ি, গ্রামাঞ্চল ইত্যাদি এলাকার মানুষ খাল, বিল, নদী-নালার দূষিত পানি পান করেই নানা অসুখ-বিসুখ সঙ্গে করে জীবনধারণ করে আছে।

ঘুম থেকে ওঠার পরই প্রথম প্রয়োজন পানীয়জল। বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও শুধু সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে এবং দুর্নীতির জন্য সেই বিশাল পরিমাণ টাকার অপচয় হয়ে আসছে স্বাধীনতার পর থেকেই। পানি সম্পদ প্রকল্পের নামে প্রচুর টাকা বরাদ্দ হলেও চাহিদা বিন্দুমাত্র মিটছে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া মানুষ, জীবজন্তু, গাছ বাঁচতে পারে না। শুধু বাঁচার প্রশ্নই নয়, পানিছাড়া সম্পূর্ণভাবে জীবনযাপনই অচল হয়ে পড়ে। কৃষিতে প্রধান অবলম্বন পানি। সেই পানির অভাবের সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তায় মানুষ।

ভূ-পৃষ্ঠের পানি খুব শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে। বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানীয়জল ভূ-পৃষ্ঠে দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। নদী, নালা, খাল, বিলে যে পানি রয়েছে তাও চরমভাবে দূষিত। দুর্গম ও গ্রামীণ এলাকার মানুষ নদী-নালার দূষিত পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ ছোট-বড় নদীর পানিই দূষিত ও বিষাক্ত। এই বিষ ক্রমশ বাড়ছে। নদী-নালা-খাল-বিল ইত্যাদির দূষিত পানি কৃষি কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদনেও খুব দ্রুত মিশে যাচ্ছে বিষাক্ত নানা রাসায়নিক। খাদ্যসহ ওইসব কৃষি উৎপাদন খেয়েই মানুষ দৈনন্দিন জীবন ধারণ করছে। এর ফলে সারা বিশ্বেই নিত্য-নতুন নানা অসুখ-বিসুখের প্রভাব ঘটছে।

এদিকে বিশ্বজুড়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রকাশ, আগামী অর্ধশতকের মধ্যেই ভূ-পৃষ্ঠের এই দূষণমুক্ত পানিও ফুরিয়ে যাবে। আবহাওয়ার পরিবর্তন, উষ্ণায়ন ইত্যাদি এর কারণ। তখন মানুষের কী হবে?

লেখক: পরিবেশবিদ ও চিঠি বিশেষজ্ঞ


banner close