সোমবার, ৭ অক্টোবর ২০২৪

ঘাটতি বাজেট ডলারসংকট আরও বাড়িয়ে দেবে

ড. জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস
ড. জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস
প্রকাশিত
ড. জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস
প্রকাশিত : ৩ জুন, ২০২৩ ১১:২০

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজেট তৈরি করা হয়নি। দেড় বছর ধরে দেশে ডলারসংকট। ডলারসংকটের কারণে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হচ্ছে না। এত বড় একটি ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, যা ডলারসংকট আরও বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যালান্স শিট এক্সপ্যান্ড করেছে। ফলে এ অর্থবছরে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাপা হয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়েছে। আবার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়ে দিলেও ডলারসংকটের চাপ একই রকম থাকবে।

ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিলে আবার ঝুঁকি তৈরি হয়। কারণ বর্তমানে ব্যাংক খাতে আমানত কম। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ কমছে না। ব্যাংক থেকে অনেকে টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিনিয়ত ডলার কিনছে। এর বদলে নগদ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। তাই ব্যাংকে এমনিতেই এক রকমের তারল্যসংকট রয়েছে। ব্যাংক খাতের সক্ষমতা আগের চেয়ে কমেছে। তার মধ্যে সরকার বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে। সরকারকে ঋণ দিতে চাইবে ব্যাংক। এটি ব্যাংকের জন্য লাভজনক। কারণ সরকারকে ৭-৮ শতাংশ সুদে ঋণ দিলেও এটি ব্যাংকের জন্য লাভজনক। এতে এই টাকা আবার একটি নির্দিষ্ট সময় চলে আসবে। ব্যাংকের জন্য ঝুঁকি কম। ব্যক্তি খাতে ঋণ দিলে অনেক সময় খেলাপি হয়। তবে ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে আগ্রহী হলেও বেসরকারি খাতে প্রভাব পড়বে। রাজস্ব আয় পরোক্ষ করের ওপর জোর দেয়া হয়েছে বেশি। এমন যদি হয় বাইরের দেশে ডলারের দাম কমে যায় এবং জিনিসপত্রের দাম কমে যায়, তাহলে দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়বে না। তবে এ বছর দেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে কম, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বেশি। এই মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণ ডলারসংকট। এযাবৎকালে এ রকম ডলারসংকট দেখা যায়নি বাংলাদেশে। ১৯৮৭-৮৯ সালে এ রকম ডলারসংকট দেখা দিয়েছিল। ফলে সার্বিক দিক বিবেচনা করলে এটি সময় উপযোগী বাজেট হয়নি।


ব্যাংক সেক্টর সংস্কারে টাস্কফোর্স প্রসঙ্গে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোতাহার হোসেন

অর্থনৈতিক সংকটের আবর্তে পতিত দেশ। এই সংকটে দেশে শিল্পায়ান, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মকভাবে। এ কারণে একদিকে দেশে বেকারত্ব বেড়েছে অন্যদিকে ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ দেশের ব্যাংককিং খাতে অব্যবস্থাপনা, ঋণের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থের লুটপাট, ডলারের চড়াও মূল্য, ডলার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স ঘাটতি, পণ্য আমদানির নামে অতিরিক্ত দাম দেখিয়ে মুদ্রা পাচারে অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতিতে দেশের নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তসহ সাধারণ মানুষকে সীমাহীন কষ্ট সইতে হচ্ছে। বাস্তবে পতিত আওয়ামী সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা শীর্ষপর্যায়ের ৮-৯ জন ব্যবসায়ী শিল্পপতি প্রায় সবরকম নিত্যপণ্যের আমদানি, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন, সরবরাহ, দাম নিয়ন্ত্রণ করায় নিত্যপণ্যের দাম ছিল সর্বসাধারণের লাগামের বাইরে। অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সর্বাধিক বিশৃঙ্খল ও অব্যবস্থায় নিপতিত সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক খাত। বিগত সরকারের সময় সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব ব্যাংক পরিচালিত হয়েছে ব্যক্তি, গোষ্ঠী স্বার্থে। জনগণের টাকার হরিলুট হয়েছে এসব ব্যাংকে। অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তির এখন প্রাণ যায় যায় অবস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনি অবস্থায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে ব্যাংককিং খাত সংস্কারে গঠন করা হয়েছে ব্যাংককিং খাত সংস্কার কমিশন। এই কমিশন ব্যাংক সেক্টরে বিগত ১৬ বছরে লুটপাট, ঋণের নাম অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি, অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে সেসবের শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে কমিশন।

ব্যাংকিং খাত সংস্কারের লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আর্থিক খাত বিষয়ে অভিজ্ঞ ছয়জনকে সদস্য করা হয়েছে। টাস্কফোর্সের সমন্বয়ক হিসেবে রয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। ব্যাংক খাত সংস্কারে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে এই টাস্কফোর্স। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রজ্ঞাপনে এই কমিশন গঠন করা হয়। টাস্কফোর্সের ছয় সদস্য হলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, সাবেক ডেপুটি গভর্নর মুহাম্মদ এ (রুমি) আলী, ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান মেহরিয়ার এম হাসান, বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, জেডএনআরএফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের উপাচার্য এম জুবায়দুর রহমান ও হিসাববিদ কোম্পানি হুদা ভাসি চৌধুরীর অংশীদার সাব্বির আহমেদ।

এই টাস্কফোর্স প্রধানত আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি, মন্দ সম্পদ, প্রধান ঝুঁকিগুলো নিরূপণ করবে। এ ছাড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক পর্যালোচনা, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি নিরূপণ, তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নিট মূলধন নির্ণয়, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ সম্পদকে পৃথকীকরণসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, টাস্কফোর্স সংকটকালীন প্রতিঘাত সক্ষমতা অর্জনে ব্যাংকের সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার প্রক্রিয়ার আওতায় নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার উন্নয়ন, ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক ও করপোরেট প্রভাব সীমিত করা, ব্যাংকের মালিকানা সংস্কার ইত্যাদি সংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করবে। সমস্যায় থাকা ব্যাংকের অর্থ উদ্ধার এবং বিধিকাঠামো ও সংশ্লিষ্ট নীতিমালা প্রস্তুত করা, দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য বিভিন্ন নীতিগত ব্যবস্থা বা পদক্ষেপও গ্রহণ করবে এই টাস্কফোর্স। পাশাপাশি এই টাস্কফোর্স আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন যেমন ব্যাংক কোম্পানি আইন, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার প্রভৃতির সংস্কার এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি, ব্যাংক অধিগ্রহণ ও একীভূতকরণ–সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, সংস্কার ও যুগোপযোগীকরণের প্রস্তাব দেবে এবং ব্যাংকিং খাতের শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাতের সংস্কারে একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে সরকার এখন টাস্কফোর্স গঠন করেছে। ব্যাংক খাত সংস্কারে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বাড়ানোর কাজেও এই ঋণ ব্যয় করা হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকেও সহায়তার আশ্বাস মিলেছে। প্রাথমিকভাবে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে ৪৫ কোটি ডলার করা নিয়ে এখন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে এডিবি ব্যাংক খাত সংস্কারে ১৩০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।

ব্যাংকগুলোর অভিভাবক বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতা বিভাগের তৈরি করা প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর মধ্যে মাত্র ৮টি স্থানীয় ও ৮টি বিদেশি ব্যাংকের অবস্থা সন্তোষজনক বলা হয়েছে। অর্ধবার্ষিক আর্থিক কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসূচক প্রস্তুত করেছে বিভাগটি। তাদের প্রতিবেদন বলছে ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ ৯টি ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। ব্যাংকগুলো হলো- জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা, ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। মূল্যায়িত ৫৪ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ১২টির অবস্থা নাজুক, যার মধ্যে ৯টি ‘রেড জোনে’ চলে গেছে। ব্যাংকগুলোকে কর্মদক্ষতার ওপর তিনটি জোনে ভাগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। লাল, হলুদ ও সবুজ ‘জোন’। সবুজ অঞ্চলে থাকা ১৬টি ব্যাংক কার্যক্রম ভালো। হলুদ অঞ্চল হলো ভালো-মন্দ মিলিয়ে। লাল, হলুদে অবস্থানরত ২৯টি ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো, দুর্বল। এ সংখ্যার মধ্যে ২টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, ১৯টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ৮টি শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাণিজিক ব্যাংক সবুজ জোন অর্থাৎ ভঙ্গুর অবস্থায় পতিত।

অন্যদিকে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তনের হাওয়ায় অস্থির হয়ে উঠেছে ব্যাংকিং খাত। একের পর এক বাণিজ্যিক ব্যাংকে চলছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে দখল হওয়া বিভিন্ন ব্যাংক ফেরত পেতে পুরোনো উদ্যোক্তারা তৎপর হয়ে উঠেছেন। কোনো কোনো ব্যাংকে মালিকদের মধ্যে চলছে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। আবার দীর্ঘদিনের বঞ্চনার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন কোনো কোনো ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এমনিতেই অধিকাংশ ব্যাংকে তারল্যসহ নানা সংকট চলছে। তার ওপর এই অস্থিরতা যুক্ত হওয়ায় ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি বাড়াবে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। তারা বলছেন, গত দেড় দশকে ব্যাংক খাতে দখল, অবৈধ নিয়োগ-পদোন্নতিসহ যেসব অন্যায়-অবিচার ঘটেছে, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে এর প্রতিকার দরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে সরকার প্রায় সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডি পদে পরিবর্তন এনেছেন।

দেশের ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়, ‘ব্যাংককিং সেক্টর থেকে লুটেরা চক্র গত এক দশকে লুটে নিয়েছে প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা। সিপিডি বলেছে, এতদিন বিশেষ ব্যক্তি ও কতিপয় শিল্পগোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হয়েও আইনের প্রয়োগ না করে বিশেষ গোষ্ঠীর তোষণ করেছে। ফলে গত দেড় দশকের বেশি সময় ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় ধরনের কেলেঙ্কারি ঘটেছে। এসব কেলেঙ্কারিতে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বেরিয়ে গেছে। অতি দ্রুত এ খাতের সংস্কার ও জাল-জালিয়াতির বিচার করতে স্বাধীন ব্যাংক সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব সিপিডির। সম্প্রতি রাজধানীতে ‘ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনা, শিগগির কী করতে হবে’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়। ১৫ বছরে শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে দেশের আর্থিক খাতের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এই গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। এ সময় বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিকভাবে লাইসেন্স পাওয়া তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের কিছু ব্যাংক মৃতপ্রায় হয়ে আছে। এগুলোকে জনগণের করের টাকায় বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। এতে শুধু অর্থের অপচয় ও লুটপাট হয়েছে। এসব ব্যাংক বন্ধ বা এগুলো পুনর্গঠন করা হোক। দেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান করতে ব্যাংক কমিশন গঠন করার সুপারিশ জোর করেছে সিপিডি। এ ছাড়া বিবেচনা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। ইতোমধ্যে যেসব লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বিষয়েও পর্যালোচনা করতে হবে।

সিপিডি বলেছে, চট্টগ্রামের প্রভাবশালী গ্রুপ এস আলমের হাতে সাতটি ব্যাংক। এই শিল্প গ্রুপ এসব ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। এক সময় রাতের অন্ধকারে চরদখলের মতো দখল করে নেয় এই ৭ ব্যাংক। দখলের পর এসব ব্যাংক মুমূর্ষু হয়ে গেছে। অবশ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায়, কর্তৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে সিপিডির একজন গবেষক বলেন, ব্যাংকিং সেক্টরের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায়নি যে তাদের স্বাধীনতা নেই; যতটুকু অবশিষ্ট আছে তারা তার ব্যবহার করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক বরং বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থের কথা চিন্তা করে নীতিমালা করেছে। এর আওতায় অনেক সুদ মওকুফ হয়েছে। নানা ছাড় দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এগুলোর সুবিধাভোগী একটি গোষ্ঠী। বিশেষ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে সুদহার বাড়ায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন সময়ে সুদহার বাড়িয়েছে।

সিপিডি বলছে, ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নররা যেসব নীতিমালা গ্রহণ করেছেন, সেগুলো ব্যাংকিং আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেসব ভালো চর্চা ছিল, সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে নতুন নিয়ম তৈরি করে বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এই অনিয়মের মাধ্যমে বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ চলে গেছে। এর প্রতিটি ঘটনা তদন্ত হওয়া উচিত এবং যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা উচিত। পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের মধ্যে যাদের আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতার ঘাটতি আছে, তাদেরও পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেওয়া জরুরি। সিপিডি বলেছে, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে ২৪টি বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে প্রায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

সিপিডির তথ্যানুযায়ী, আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১২ শতাংশ বা জিডিপির দুই শতাংশের সমান। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল-এ সময়ে ধুঁকতে থাকা ব্যাংকগুলোর পুঁজির জোগান দিতে সরকারকে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। অন্যদিকে, গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির এক রিপোর্ট বলছে, ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশ থেকে ৪৭০০ থেকে ৬৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। দেশের ব্যাংক খাতে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বহু অনিয়ম করা হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা হয়েছে, একটি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক, যা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মোট পুঁজির এক-চতুর্থাংশের বেশি। অন্যদিকে ২০১৭ সালে দেশের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক প্রভাবে সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এদিকে, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি নিয়ে এখনো তদন্ত চলছে। এ জন্য তদন্তে সিআইডি ৭৯ বার সময় নিয়েছে। প্রত্যাশা থাকবে, তদন্ত প্রতিবেদন উন্মুক্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যদিকে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আর্থিক আদালতে মামলার সংখ্যা ৭২ হাজার ৫০০টি। টাকার পরিমাণ ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে আর্থিক কেলেঙ্কারি খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

প্রত্যাশা বিগত বছরগুলোয় বড় বড় অন্তত ২৪টি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িতদের বিচার করা দরকার। বিগত ১৬ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য অনেক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিশেষ গোষ্ঠীকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যাংকের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায়, বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম


পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা জরুরি     

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

পাহাড়ের উত্তেজনায় আমরা শঙ্কিত। সাম্প্রতিক সময়ে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সংঘাত-সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনাগুলো অত্যন্ত বেদনাদায়ক। পার্বত্যাঞ্চল অশান্ত হয়ে উঠুক, সেটা আমরা কেউ চাই না। পাহাড়ে অশান্তি আপাতত থামলেও, যে ক্ষোভ ক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে, তা যদি ভবিষ্যতে আরও গভীর হয় তাহলে সেটি অধিকভাবে শঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে পারে। এমনকি সেটি সামাল দেওয়া প্রশাসনের জন্য কঠিন হয়ে উঠবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে যা হয়েছে, যা হচ্ছে, এর সমাধান দরকার। গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে সরকার বিপুল সামরিক বাহিনীর সদস্য পাঠিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চেয়ে পাহাড়ের সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তুলেছিল। তখন সেখানে সশস্ত্র সংঘর্ষও হয়। প্রায় দুই দশকের সশস্ত্র লড়াইয়ের ইতি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে পরে তেমন কোনো আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এক কথায় বলা যায়, দীর্ঘ তিন দশক ধরে পাহাড়ের সমস্যাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে।

শান্তিচুক্তির মূল কথা কথা ছিল, পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং সে জন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হবে। উপজাতীয় আইন এবং সামাজিক বিচারকাজ এই পরিষদের অধীনে থাকবে; পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা; উপজাতীয়দের ভূমি মালিকানা অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া; পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা ইত্যাদি। শান্তি চুক্তির ধারাবাহিকতায় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সে অঞ্চলে গঠন করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার জনসংহতি সমিতি বলছে, প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়েছে বটে কিন্তু সেগুলোর হাতে ক্ষমতা নেই। যেমন- পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হচ্ছেন জনসংহতি সমিতির নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। এই প্রতিষ্ঠানটি কার্যত নিষ্ক্রিয় রয়েছে। শান্তি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় গত প্রায় ২৭ বছরে ছয়টি আঞ্চলিক দলের সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ে। এসব দল নিজেরাও অভ্যন্তরীণ বিরোধেও জড়াচ্ছে। সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থাকা সন্ত্রাসীদের হাতে স্বাধীনতার পর থেকে চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে নিহত, আহত ও অপহরণ কিংবা নিখোঁজের শিকার হয়েছেন অন্তত ৮ হাজার ১৪০ জন। নিহতদের মধ্যে ১ হাজার ১৩৮ জন পাহাড়ি বাঙালি আছেন ১ হাজার ৪৪৬ জন। এই সময়ে বিভিন্ন বাহিনীর ৩৮০ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। আর শান্তি চুক্তি হওয়ার পরও ৮৯৯ জন পাহাড়ি, ৩৯০ বাঙালি এবং সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর ২৬ জনসহ ১ হাজার ৩১৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৮২৩ জন। চুক্তি পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ১৯৮ জন।

আমাদের মনে রাখতে হবে পাহাড় বাংলাদেশের বাইরের কোনো এলাকা নয়। পাহাড়ে বসবাসকারি বাঙালিদের সেটেলার বলে এক ধরনের উসকানি চলে সেখানে। এমনকি অনেক মিডিয়া এবং অ্যাকটিভিস্ট নেতিবাচক প্রচারণা চালায়। পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। পার্বত্য এলাকা যদি বাংলাদেশ ভূখণ্ড হয় সেখানে যদি কেউ জমি কিনে বাস করে তাদের সেটেলার বলা যাবে কি না সেটি একটি বড় প্রশ্ন। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ তৈরির বিষয়টি নিঃসন্দেহে উসকানিমূলক এবং ষড়যন্ত্র। আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। এখানে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র রয়েছে। নানা ধরনের গুজব রয়েছে। নানা ধরনের পক্ষ-বিপক্ষ রয়েছে। পাহাড়িদের স্বাধীন দেশ গঠনের মাধ্যমে তাদের মুক্তি আসবে- এমন চিন্তা ন্যায্য কি না সেটি খুব মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হবে। অযথা কোনো উসকানিকে মাথায় নিয়ে সামনে আগানোর বিষয়টি অনেকক্ষেত্রে বুমেরাং হতে পারে। কোনো অন্যায্য বিষয়কে ন্যায্য এবং ইতিবাচক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি মোটেও শুভ নয়। অযথা ভিন্ন ভিন্ন প্রলোভনে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন করার ষড়যন্ত্রে পা রাখা কোনোভাবেই ন্যায্য কিংবা যুক্তিসঙ্গত হবে না।

সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকার সমান। পাহাড়িদের অবশ্যই সোচ্চার থাকতে হবে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। তারা অবশ্যই তাদের ন্যায্য অধিকার পাবে। এ বিষয়ে ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশা করাটা স্বাভাবিক। কোনোভাবেই তাদের কোনো বৈষম্য করা যাবে না। মূলত নিজেদের নাগরিক অধিকারের দাবিতে পাহাড়িদের সোচ্চার থাকাই তাদের রাজনীতি হওয়া উচিত। নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা এবং যৌক্তিক বিবেচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সাম্প্রতিক সহিংসতা পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সম্পর্ক, সামাজিক সংহতি, শাসনব্যবস্থা, নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। প্রভাবগুলো মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের পাশাপাশি সংঘাতের মূল কারণগুলো সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

আমাদের গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি পরিবেশ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে একেবারেই ভিন্ন। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের ঘটনা দুঃখজনকভাবে আগেও অনেক ঘটেছে। বিভিন্ন কারণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেক ক্ষোভ রয়েছে। আবার বাঙালিদের মধ্যেও রয়েছে ক্ষোভ। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি আস্থার অভাব। ফলে যেকোনো ঘটনা উভয় সম্প্রদায় তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ নিয়ে দৃঢ় অবস্থানে চলে যায়। স্মরণে রাখা দরকার, বিগত সরকার পতনের পর দেশ এখন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে; কিন্তু দেশে নানা ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার ফলে সরকারকে এক প্রকার হিমশিম খেতে হচ্ছে। বলা যেতে পারে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিরাট এক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। এমনকি নানা ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই তাদের কাজ করতে হচ্ছে। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে পার্বত্য অঞ্চলে সৃষ্ট সংঘাত এবং সহিংসতাতেও কোনো না কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। এ কারণে এ বিষয়টি সরকারকে বিশেষভাবে মাথায় রাখতে হবে।

সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগে এক স্কুল শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার পরদিন দুপুর পর্যন্ত বহাল ছিল ১৪৪ ধারা। ধীরে ধীরে শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়। শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচারই পারে পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এমনকি খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চোর সন্দেহে পিটুনিতে এক বাঙালি যুবকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে পার্বত্য অঞ্চল। ছোট ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে বারবার অশান্ত হয়ে ওঠার বিষয়টি কোনোভাবেই স্বাভাবিক না। এর ভেতরে বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সীমান্তের হুমকি মোকাবিলার বিষয়টি খুব সামনে আসছে। বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলার পাশাপাশি ভারতের সেভেন সিস্টার্স ও মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংঘাত ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়গুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটি সমন্বিত নিরাপত্তা উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। দুই দশক আগে লুক ইস্ট বা পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির আওতায় বাণিজ্য অংশীদারিত্ব ও কানেক্টিভিটি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ভারতের প্রভাবে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে এ নীতি থেকে সরে যায়। চলমান বাস্তবতায় সে উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে। চীন-ভারতের মধ্যকার উত্তেজনা ও দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও রোহিঙ্গা সংকটের কূটনৈতিক-রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়াস অব্যাহত রাখার পাশাপাশি মিয়ানমার, চীনসহ পূর্বদিকের দেশগুলোর সঙ্গে কানেক্টিভিটি তথা বহুমুখী যোগাযোগের অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ শুরু করতে হবে। সেভেন সিস্টার্সে অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ অনেক বেড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় হোমওয়ার্কসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। তার আগে সেনাবাহিনীর ভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতার বিষয়গুলো চিহ্নিত করে কমান্ড ও ফোর্স মোবিলাইজেশনে গুণগত পরিবর্তন নিশ্চিত করতে হবে। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থেকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেনাবাহিনীকে জনগণের আস্থাশীল, আধুনিক, শক্তিশালী ও গতিশীল করা জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক কারণেই অত্যাবশ্যক। নিরাপত্তা পর্যবেক্ষকরা আরও মনে করেন, সেনাবাহিনীতে বেশি সংখ্যায় মেধাবীদের নিয়োগ করা প্রয়োজন।

এ সময় সব পক্ষকে ধৈর্য ধরতে হবে। সরকারকে পাহাড়ের সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড়ি ও বাঙালি দল ও সংগঠনগুলো থেকে দায়িত্বশীল ও পরিপক্ব আচরণ কাম্য।

আমরা সবাই দেশের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করি। আমরা অবশ্যই সবাই পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর অধিকারের পক্ষে। কাজেই পাহাড়ে বিদ্যমান পক্ষ-বিপক্ষ সব গোষ্ঠীকে আলোচনায় বসানোর সময় এসেছে। নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে সবাইকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হয় এমন ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব। এক্ষেত্রে সব পাহাড়িকে অধিকার রক্ষার বিষয়ে সচেষ্ট থেকে দেশের অখণ্ডতার প্রশ্নে ঐকমত্য থাকা উচিত। কোনো ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, সব ষড়যন্ত্র থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে আগামীর দিনগুলো আরও ভয়াবহ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংঘাতময় উত্তেজনার ধারা থেকে বের হয়ে আসার পথ-পদ্ধতি অবিলম্বে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাদের সবার। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখা দরকার যে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে না পারলে দেশের শান্তিও বিনষ্ট হবে।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি! লাগাম টানুন

আপডেটেড ৫ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:২১
দেওয়ান নাইম দাদ খান

এ বছর জুলাইতে শুরু হয়ে আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার নানা খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয়ে উদ্যোগ তবে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের বা টিসিবির তথ্যমতে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় দুই মাসে ছয়টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে এবং কমেছে মাত্র দুটির।

বাজারে এখন সবজির দাম ব্যাপক চড়া। ডিমের প্রতি ডজনের দর উঠেছে ১৭০ টাকায়। মুরগি ও মাছের দামেও স্বস্তি নেই। সব মিলিয়ে নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট কমেনি।

দেশের মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে লাগাম তুলে নিয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে সুদের হার বেড়েছে। মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে একটা জায়গায় স্থিতিশীল হয়েছে; কিন্তু সুদের হার ও ডলারের দামের কারণে নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের খরচ বেড়েছে।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে সুদের হারে লাগাম তুলে নেওয়ার পদক্ষেপ ঠিকই আছে, ফলে বাজারে টাকার সরবরাহ কমবে এবং পণ্যের চাহিদাও কমবে অতএব, মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনাও আছে; কিন্তু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এই নীতি ততটা কার্যকর নয়। কারণ, সেসব পণ্যের চাহিদা সব সময়ই থাকে। বাজারে টাকার সরবরাহের ওপর ওই সব পণ্যের চাহিদা, জোগান ও দাম ততটা নির্ভর করে না। এসব পণ্যের দাম কমাতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার- যেমন ডিম। এর দাম উৎপাদন খরচ, চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। যখন মানুষের হাতে টাকা কম থাকে, তখন বরং ডিমের চাহিদা বেড়ে যায়। ডিমের দাম কমাতে সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এক সাংবাদিককে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অব্যাহত উচ্চমূল্য শহর ও গ্রামের সব মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছিল। তখন সরকার কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে বরং উদাসীনতা দেখাত। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থায় সংস্কার দরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো বড় একটি মন্ত্রণালয় সামলানোর পরে উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যথেষ্ট নজর দেওয়ার সুযোগ কম। এই মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক নানা চ্যালেঞ্জ এখন আছে, সামনে আরও বাড়বে। এখানে এককভাবে দায়িত্ব দিয়ে একজন উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন, যিনি গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে কাজ করবেন।

এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ২৫ টাকার নিচে। এক বছর পর এখন একই আলু বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। যা দ্বিগুণের চেয়েও বেশি।

দেশে আলুর মতো বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম এখন চড়া। মূল্যস্ফীতিও বেশি।

দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ দ্রুত সহজ হবে না বিলম্বিত হবে তার কারণ তিনটি- প্রথমত, উৎপাদন ও পরিবহন খাতে খরচ কমাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম কমানো দরকার। এই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সেটি খুবই কঠিন কাজ। দ্বিতীয়ত, আমদানি বাড়িয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানো দরকার; কিন্তু মার্কিন ডলারের সংকটে ব্যবসায়ীরা সহজে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না। ডলারের বাড়তি দামের কারণেও খরচ বেড়েছে। তৃতীয়ত, কিছু কিছু পণ্যে উচ্চহারে শুল্ক-কর রয়েছে। সেখানেও ছাড় দেওয়া সরকারের পক্ষে সহজ নয়। কারণ, সরকার রাজস্ব ঘাটতিতে রয়েছে।

২০২২ সালের মে মাসের দিকে দেশে মার্কিন ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকার আশপাশে। এখন আমদানিতে নির্ধারিত দর ১১৫ টাকারও বেশি যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির ক্ষেত্রে ডলার কিনতে তাদের ১২৯ টাকাও লাগছে। ফলে এ সময়ে শুধু ডলারের দামের কারণে পণ্য আমদানির ব্যয় বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। গম, ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও জিরার মতো নিত্যপণ্য এবং নিত্যব্যবহার্য পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে ডলারের দর।

এ দেশের স্বল্প আয়ের জনগণ ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং শ্রমজীবী ভাই-বোনদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক তার ওপর এদের আয়-রোজগার বাড়ে নাই কিন্তু খরচ বেড়েছে হু হু করে, আবার অতি সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকটি জেলার উওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা মহামানি ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কায় রয়েছেন দেশের একটি বিশাল জনগোষষ্ঠী।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাবেক ছাত্রনেতা


বিশ্ব শিক্ষক দিবস: প্রয়োজন মাধ্যমিক স্তরে সংস্কার

আপডেটেড ৫ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:২১
ড. দেওয়ান আযাদ রহমান

বরাবরের মতো এবারও ৫ অক্টোবর বাংলাদেশসহ প্রায় ১৯১টি দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে Valuing Teacher voices: towards a new social contract for education. পৃথিবীর সব দেশে শিক্ষক সমাজের কাছে এ দিনটি অত্যন্ত গৌরব ও মর্যাদার। ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে একটি ‘শিক্ষক সনদ’ প্রণয়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষক অধিকারসংক্রান্ত চিন্তার উন্মেষ ঘটে। ১৯৪৮ সালে সম্মিলিত জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২৬ অনুচ্ছেদে শিক্ষা মৌলিক অধিকার এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশে এর গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত হয়। বিভিন্ন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী শিক্ষক সম্প্রদায়ের অধিকার ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা এবং সুসংহত করার জন্য ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশেষ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সরকার সম্মেলন ১৩ অধ্যায়ে বিন্যস্ত এবং ১৪৬টি ধারা উপধারা সংবলিত শিক্ষকদের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদাবিষয়ক ঐতিহাসিক ইউনেস্কো, আইএলও সুপারিশ ১৯৬৬’ প্রণীত হয়। এ ঐতিহাসিক দলিলে শিক্ষাকে দেশ, সমাজ ও জাতি গঠনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার, মর্যাদা ও দায়-দায়িত্বের বিষয় সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। পরবর্তীতে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কিত অর্জিত সাফল্যকে সমুন্নত রাখাসহ আরও সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে বিশ্বের ১৬৭টি দেশের ২১০টি জাতীয় সংগঠনের প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ সদস্যের প্রতিনিধিত্বকারী আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠন এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল’ গঠিত হয়। এ আন্তর্জাতিক সংগঠন জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে প্রণীত দলিলটি যথাযথ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করার অর্থবহ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ক্রমাগত অনুরোধ ও আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক এম মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার মাধ্যমে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালনের শুভ সূচনা করা হয়। ১৯৯৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে।

এ বছরের শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়টি খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত। অতিরিক্ত পরিশ্রম, কম উপার্জনের কারণে শিক্ষকরা এ পেশা পরিত্যাগ করছে। কম সংখ্যক যুব সম্প্রদায় এ পেশায় এগিয়ে আসছে। ফলে, বিশ্বব্যাপী ৪৪ মিলিয়ন শিক্ষক সংকট রয়েছে, যা মানসম্মত শিক্ষার জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ঝুঁকি এড়াতে সামাজিক সংলাপের বিকল্প নেই। তাই শিক্ষকদের অধিকারকে মূল্যায়নের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষাকে নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষা কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো মাধ্যমিক শিক্ষা। এ স্তরের শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। প্রাথমিক বিদ্যালয় পুরোপুরি সরকারি খরচে পরিচালিত হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষা বেশির ভাগ বেসরকারিভাবে পরিচালিত। শিক্ষকদের বেতন অপর্যাপ্ত এবং মর্যাদা অপ্রতুল; কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধনে কর্মকুশল জনশক্তি সরবরাহ করা এ স্তরের মূল উদ্দেশ্য। এ স্তরের শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত ছাড়া দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলা অসম্ভব। মাধ্যমিক স্তরে মেধাবী শিক্ষক ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা সম্ভব নয়। মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে তাদের আর্থিক ও পদমর্যাদা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে আলাদা মাধ্যমিক অধিদপ্তর ও শিক্ষকদের পদমর্যাদা নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজন। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে সাধীনতা-উত্তর সব শিক্ষা কমিশনে শিক্ষকদের পদমর্যাদা বৃদ্ধির সুপারিশ পেশ করা হয় যা আন্তর্জাতিক শিক্ষক সনদের সুপারিশের প্রতিফলন। স্বাধীনতা-উত্তর শিক্ষা কমিশনগুলো শিক্ষকদের বেতন-ভাতাদি অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত সমযোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের তুলনায় কম তা স্বীকার করা হয়েছে। ২০০৩ সালে প্রণীত শিক্ষা কমিশনে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ রয়েছে, ‘ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার মর্যাদা দেওয়া হয়। সমযোগ্যতাসম্পন্ন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের মর্যাদা কিন্তু বেশ নিচে।’ উদাহারণ হিসেবে আরও উল্লেখ রয়েছে, ‘১৯৭৭-এর আগে টি ই ও নিযুক্ত ব্যক্তিরা সহকারী শিক্ষকদের এক গ্রেড নিচে বেতন পেতেন। পিটিআই ইনস্ট্রাকটররা সহকারী শিক্ষকদের সমান বেতন পেতেন। ১৯৯৩ সালে এদের সবাইকে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেওয়া হয়; কিন্তু সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের তা দেওয়া হয়নি। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা পদমর্যাদা, পদোন্নতি সব ক্ষেত্রে প্রবঞ্চার শিকার।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উদ্ভূত সংকট সবাইকে বিচলিত করেছে। বর্তমান সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহকারী প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের পদ অসংখ্য শূন্য রয়েছে। এ মহাশূন্যতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা কীভাবে সম্ভব তা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।

এ বিষয়ে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনের মতে, সরকারের অগ্রাধিকার খাতগুলোর মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। শিক্ষার মানোন্নয়নে সদিচ্ছার অভাব না থাকলেও সমন্বিত পদক্ষেপের অভাবে সংকট থেকেই যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষকের আনুপাতিক হার এতই কম, তা হতাশাব্যঞ্জক। তা ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থাকলেও সারা দেশের বিশালসংখ্যক মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করা কঠিন ব্যাপার। প্রশাসনিক সুবিধার্থে ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয় এবং ৬৪টি জেলা শিক্ষা কার্যালয় থাকলেও অধিকাংশ কর্মকর্তার পদ শূন্য রয়েছে। প্রেষণে এনে অদক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে সুষ্ঠুভাবে শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার মতো মাধ্যমিক শিক্ষায় গতিশীলতা নেই। পদোন্নতি ধীর গতি, শূন্যপদ পূরণে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপের অভাব।

বর্তমান সরকার নানা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের মাধ্যমে গতিশীলতা বৃদ্ধিতে খুবই আন্তরিক। ইতোমধ্যে বিতর্কিত কারিকুলাম বাতিল করে যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রণয়নের ধীরতা ব্যক্ত করেছেন। মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন এনে সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে এ স্তরে আরও বেশ কিছু সংস্কার হওয়া প্রয়োজন।

বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, শিক্ষক হিসেবে অ্যান্ট্রি পথ নবম গ্রেড করা আবশ্যক। সরকারি মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে পদোন্নতির নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে শূন্য পদ পূরণ, বঞ্চিত শিক্ষকদের প্রাপ্য টাইম স্কেল ব্যবস্থা এবং সার্বিকভাবে মাধ্যমিক শিক্ষার গতিশীলতা বৃদ্ধিতে আলাদা অধিদপ্তর করার বিকল্প নেই। তাই এসব ক্ষেত্রে সংস্কার করে বাস্তবভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়া অতীব আবশ্যক।

মানসম্মত ও দক্ষ শিক্ষক পেতে হলে তাদের পেশাগত স্বীকৃতি, সম্মানজনক বেতন, পেনশন, সামাজিক প্রাপ্তি ও চমৎকার কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে যে প্রশ্নের অবতারণা হয়েছে তা দূর করতে হলে সরকারকে অবশ্যই আন্তরিক হতে হবে এবং অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, পর্যাপ্ত সংখ্যক যোগ্য শিক্ষক, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষাদানসামগ্রী ও ভৌত অবকাঠামো, যথার্থ শিক্ষন-শিখন পদ্ধতি, কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান এবং গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ ও উপযুক্ত মূল্যায়ন ছাড়া এ লক্ষ্য অর্জন পুরোপুরি সম্ভব নয়। তাই অভীষ্ট সফলতার জন্য মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক সংকট দূর করতে হবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত গ্রহণযোগ্য পর্যায় আনতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত রেখে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে।

লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট, সার্ক টিচার্স ফেডারেশন


পল্লি বাংলার আর্থ-সামাজিক পরিবেশ

আপডেটেড ৫ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:২০
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

আজ থেকে ১৭২ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৫২ সালে বাংলার গ্রাম সম্পর্কে হাউস অব লর্ডস সিলেকশান কমিটির কাছে ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকার সম্পাদক আলেকজান্ডার ডাফ বিবৃতিতে যা বলেছিলেন পল্লি বাংলার আর্থ-সামাজিক পরিবেশ পর্যালোচনায় আজও, এই মুহূর্তে, ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পটপরিবর্তনের পরও তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য প্রতীয়মান হয়। ভারতবর্ষে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের বয়স ৯৫ বছর। সিলেকশান কমিটির কাছে তৎকালীন পল্লি বাংলার সার্বিক অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে ডাফ সাহেব বলেছিলেন, ‘দূর থেকে গ্রামের দৃশ্য দেখে গ্রাম সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা ভ্রান্ত হবে। গ্রামের সুন্দর ছায়াঘেরা বাঁশবন, বেতবন, ঝাউগাছ, পিপুলগাছ, আম, জাম, কাঁঠাল, কলা প্রভৃতি ফলবাগান, মাঠে সবুজ ঘাস ও ফসল হচ্ছে তার বাহ্যিক রূপ, কিন্তু এর অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা বড়ই করুণ, বড়ই বেদনাদায়ক’।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৮৫৯ পর্যন্ত) ভারতে ব্রিটিশ সরকার (১৯৪৭ পর্যন্ত) ও হুকুমতে পাকিস্তান (১৯৭১ পর্যন্ত) এবং পরবর্তীকালের স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ৫২ বছর ব্যবধানে এসে পল্লি বাংলার অর্থ প্রশাসনিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার সাম্প্রতিক অবস্থান নিয়ে লিখতে গিয়ে আলেকজান্ডার ডাফ সাহেবের পর্যবেক্ষণটি কেন জানি বড্ড মনে পড়ে গেল। মনে পড়ত না যদি সাম্প্রতিককালে এ ধরনের ঘটনার প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষিত হতো-

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এক অনগ্রসর গ্রামের কলেজ পড়ুয়া ছেলে অতি দরিদ্র পিতামাতার ভবিষ্যতের একমাত্র স্বপ্ন। ফুটবল খেলতে গিয়ে তার হাঁটুতে চোট লাগে। হাঁটুর ভেতরে ক্ষতচিহ্নে ইন্টারন্যাল হ্যামোরেজে জায়গাটি বেশ ফুলে ওঠে। ব্যথা হয়। কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিকের এ ব্যাপারে করার কিছু ছিল না, থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক শুধু ব্যথা কমানোর সাধারণ মানের ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেয়, কাজ হয় না। পাশের উপজেলায় ব্যক্তি বিশেষের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ট্রমা চিকিৎসার প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কোনো সদুপদেশ মেলে না। জেলা সদরের সরকারি হাসপাতালে প্রবেশ ও পরামর্শলাভ সুদূর পরাহত প্রতীয়মান হওয়ায় বেসরকারি ব্যবসায়ী ডাক্তার সাধারণ মানের এক্স-রে করে হাঁটুর ভেতরে ফ্যাপসা অংশ দেখার পরও সাধারণ মান ও মাত্রার ওষুধ দেয় তেমন কোনো কার্যকর উপদেশ ও প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা ছাড়াই। দরিদ্র পিতা ছেলেটিকে নিয়ে ঢাকায় সরকারি পঙ্গু হাসপাতালে যায়। সেখানে দালাল ও বাটপারের পাল্লায় পড়ে হাসপাতাল প্রশাসন পর্যন্ত পৌঁছানো তার ভাগ্যে জোটেনি। ফলে ‘সিট খালি নেই’ জাতীয় কথা শুনে বাড়িতে ফিরে আসে। একমাত্র সম্বল ১০ কাঠা জমি বন্দক রেখে টাকা জোগাড় করে ছেলেকে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে পাঠানো হয় খুব কাছের মহানগর কলকাতায়। ছেলেটির পাসপোর্ট না থাকায় ভিন্ন একনামে তাকে ভর্তি করা হয় সেখানকার ক্লিনিকে। ১০-১২ দিন চিকিৎসার পর ওই ক্লিনিকের অমনোযোগী ‘টেকনিশিয়ান’ ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন ‘মনে হয় ক্যানসার হয়েছে’। তাকে সেখানকার এক ক্যানসার হাসপাতালে পাঠানো হয়। তারা ইনডেপথ পরীক্ষা ও চিকিৎসার পথ না বাতলিয়ে অত্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ের একটা টেস্ট করে জানিয়ে দেয় ‘ক্যানসারের’ (সাইনোভিয়াল সারকোমা) সম্ভাবনা বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজন’। টাকা-পয়সা ফুরিয়ে আসায় ছেলেটি গ্রামে ফিরে আসে। সারা গ্রাম রটে যায় ছেলেটার ক্যানসার হয়েছে। পা ফুলে একাকার এবং অসম্ভব বেদনার বিবরে সবাই হতচকিয়ে যায়। অবশেষে গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার ছুরি চালিয়ে ক্ষতস্থানে পুঞ্জীভূত পুঁজ অপসারণে ‘অপারেশন’ করে। এরপর রক্ত বন্ধ হয় না। এ পর্যায়ে গ্রামেরই একজন যিনি এই মুহূর্তে ঢাকায় একটি সমাজসেবাধর্মী বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত আছেন ঊর্ধ্বতন পদে চাকরি করেন তিনি ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে জানতে পারেন বিষয়টি। তিনি ছেলেটিকে অবিলম্বে ঢাকায় এনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসার পরামর্শ দেন। গোটা গ্রামের লোকেরা মুষ্টিভিক্ষার চাল তুলে কিছু অর্থ দিয়ে অবশেষে ছেলেটাকে পুনরায় ঢাকায় পাঠায় ওই সুহৃদ ব্যক্তির কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে। প্রথমে বারডেম হাসপাতালের অর্থপেডিক্স বিভাগের চিকিৎসকরা ছেলেটিকে দেখে শুধু বিস্মিত বিহ্বলই হন না তারা প্রমাদ গোনেন। তারা অনতিবিলম্বে রোগীকে জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটে রেফার করেন। বিশেষ অনুরোধে ও সুপারিশে জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে ছেলেটির জরুরি চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গত সপ্তাহে ছেলেটার পা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে এবং নিবীড় পরীক্ষায় ধরা পড়েছে অবহেলায়, কুচিকিৎসায়, যথাসময়ে প্রযোজ্য শল্য চিকিৎসার ব্যবস্থা না হওয়ায় সত্যই তার ক্যানসার হয়েছে! পা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে ক্যানসারের অধিক বিস্তার থেকে আপাত নিষ্কৃতি পাওয়ার প্রয়াস হিসেবে। এখন বেশ কিছু কাল চিকিৎসা (কেমো ও অন্যান্য) প্রয়োজন হবে পায়ের ক্ষতে জন্মানো দুরারোগ্য ব্যাধির অন্যত্র সংক্রামণের সুনিয়ন্ত্রণের স্বার্থে। দরিদ্র পিতামাতার ভবিষ্যতের স্বপ্ন ছেলেটি এখন পূর্ণ নিরাময়ের অনিশ্চয়তার মধ্যে পঙ্গুত্ব বরণ করে কাটাবে বাকি জীবন।

সুদূর গ্রাম পর্যন্ত মানুষের দোরগোড়ায় শিক্ষা, বৈষম্যবিহীন জনসেবা, পরিসেবা তথা চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে যেতে বিগত ৫২ বছরের কথাই যদি ধরি পল্লি বাংলায় এখনো ওপরে বর্ণিত অবস্থা দুঃখজনকভাবে বিরাজ করছে। এখনো দরিদ্র পিতা তার কলেজ পড়ুয়া ছেলের সাধারণ প্রকৃতির একটি দুর্ঘটনা প্রসূত ক্ষত চিহ্নের চিকিৎসায় দিশাহীন হয়ে অবজ্ঞা অবস্থায় ঘুরে ঘুরে প্রবঞ্চিত হচ্ছে। এই সেদিন নোয়াখালীতে এক সম্পন্ন গ্রামে অশীতিপর ভদ্র মহিলা বয়োবৃদ্ধতায় হঠাৎ বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় আনতেই হবে কিন্তু তার রক্তের ইলেকট্রোলাইটস ও লিপিড প্রোফাইলট টেস্ট করার তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও ধারে-কাছে এমনকি জেলা সদরেও নির্ভরযোগ্যভাবে সে পরীক্ষা করানোর কোনো ব্যবস্থাদি খুঁজে পাওয়া গেল না। এই সেদিন শহর খুলনা থেকে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স খবর দিয়ে নিয়ে আসার আগে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। খুলনা কেন ঢাকার অদূরে কোথাও হৃদরোগের চিকিৎসা তো দূরের কথা প্রাথমিক পরিচর্যার ব্যবস্থাটি পর্যন্ত এখনো গড়ে ওঠেনি। হাজার হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক, ৫০০-র মতো থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদরগুলোতে সরকারি হাসপাতাল, ব্যাঙের ছাতার মতো অলি-গলিতে গড়ে ওঠা প্রাইভেট ক্লিনিক ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা সত্ত্বেও কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা সুদূর পরাহত থেকে যাচ্ছে।

শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষাপ্রদান ব্যবস্থাপনার পরিবীক্ষণ তথা দেখভাল করা শিক্ষার গুণগতমান বজায় রাখা বা প্রয়োগসংক্রান্ত অবস্থা ব্যবস্থার কথা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। শিক্ষায় সব সময় সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ মিলেছে ব্যয়ও চলছে; কিন্তু আমজনতার শিক্ষাব্যবস্থায় উপযুক্ত, প্রযোজ্য ও টেকসই শিক্ষা পরিবেশ গড়ে তোলাটা এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে যেমন রয়েছে তেমনি দেশের স্বাস্থ্য খাতেও অনুরূপ সীমাবদ্ধতার সঙ্গে সংগ্রামে রত সরকার, সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ এবং এর বিপরীতে স্বাস্থ্যসেবা প্রত্যাশীরা সুযোগ-সুবিধার নাগালের বাইরে থেকেই যাচ্ছে যেমনটি ওপরের বাস্তব ঘটনায় ফুটে উঠেছে।

তবে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাংলাদেশের সাফল্য অবশ্যই আছে অনেক ক্ষেত্রে যেমন- নবজাত শিশু ও প্রসূতি মায়েদের মৃত্যুর হার কমেছে, এ জন্য নামকরা পুরস্কারের শিকেও ছিঁড়েছে দেশের ভাগ্যে- সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার রোধ ও ক্ষেত্রবিশেষে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। দূষিত পানি অধিকাংশ রোগের কারণ বিধায় সুপেয় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনায় সাফল্য অবশ্যই ঘটেছে। সরকারের বাইরে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মতৎপরতায় এসব ইন্টারভেনশনে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে। তবে এটা এখনো বাস্তব ও বিব্রতকর যে স্বাস্থ্যসেবা খাতে সরকারের বাজেটে বিপুল বরাদ্দ এবং তা ব্যয় সত্ত্বেও মানুষের দোরগোড়ায় ন্যায় ও প্রযোজ্য চিকিৎসাসুবিধা পৌঁছানো যায়নি, যাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের উপস্থিতি, উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার, চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ সরবরাহের অতি দরিদ্র ও অপারগ পরিস্থিতি স্বাস্থ্যসেবা প্রশাসন ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা, অপারগতা ও অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে।

সমস্যার গভীরে যাওয়া দরকার। ব্রিটিশ ভারতে এমনকি পাকিস্তান আমলেও গ্রামে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক এলএমএফ পর্যায়ে পেশা দারিত্বের ব্যবস্থা ছিল। মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসা তাদের কাছে পেত। স্বাধীন বাংলাদেশে সেই প্যারা মেডিকেল ব্যবস্থা এলএমএফ চিকিৎসকরা আর নেই। এমবিবিএস পাস করা উচ্চ শিক্ষিতরাই তাদের স্থলাভিষিক্ত হবেন এমন ধরনের ব্যবস্থাপনার বিবরে বর্তমানে পল্লি চিকিৎসাব্যবস্থায় সমন্বয়হীনতা ও শূন্যতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কেননা এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসকরা গ্রামে গড়া ওঠা সরকারি চিকিৎসালয়ে তো দূরের কথা গ্রামে পদায়িতই হতে চান না। এর কারণ অবশ্যই আছে– গ্রামে নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসহ পেশাগত দায়িত্ব পালনের অনুকূল পরিবেশ পাওয়া দুষ্কর। ফলে অতিমাত্রায় সাংগঠনিক শক্তিতে বলবান ও একাট্টা হয়ে তারা পল্লিতে যাওয়ার যৌক্তিকতায় আর নিজেদের পান না। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গ্রামে অনেক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও কাঠামো গড়ে তোলা হলেও সেখানে চিকিৎসক মিলছে না। অথচ এক সময়কার ব্যক্তিপর্যায়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেই চিকিৎসাব্যবস্থার স্বীকৃতি তুলে দিয়ে উচ্চশিক্ষিত চিকিৎসককে সেখানে স্থলাভিষিক্তকরণ পর্বে এসে প্রচণ্ড অপারগতার ভাইরাস পল্লির পুরো চিকিৎসা কাঠামোকে সংকটাপন্ন করে তুলেছে। ইউনিয়নপর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের সরকারি উদ্যোগটি নিয়োগ বাণিজ্যে ও সরকার পরিবর্তনে দলীয় রাজনীতিকীকরণের পাল্লায় পড়েছে। পরিবার পরিকল্পনা ও কল্যাণ কর্মসূচিটি আজ অতি অমনোযোগিতার শিকার অথচ এক বিশাল কর্মীবাহিনী ও পরিদপ্তর রয়েছে বহাল তবিয়তে। এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই পল্লি স্বাস্থ্যসেবায় এখন দেশি-বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো নানান বরণে ও ধরনে চিকিৎসাসেবা বাণিজ্য বজরা নিয়ে ফিরছে।

৫ আগস্টের পর গ্রাম-বাংলায় অতি সম্প্রতি পরিদর্শন কাজে গিয়ে জানা গেল গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা এমনকি জেলা পরিষদ নির্বাচন দলীয়ভাবে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দলীয় রাজনীতি তৃণমূলপর্যায়ে এমনভাবে গেঁথে গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দলীয় দাপট দেখিয়ে দলীয় ও দায়িত্বহীন পুলিশের সহায়তায় চাঁদাবাজি করেছে এমনভাবে যে তার বা তাদের এখন টিকিটি এখন মিলছে না। দলীয় কমিটির প্রশ্রয়ে নামকরা স্কুলের হেডমাস্টার শত অপকর্ম করে নৈতিকতা স্খলনের দায়ে অভিযুক্ত হেডমাস্টার এখনো বহাল তবিয়তে আছে। মাত্র দেড় বছর আগে মেরামত করা উপজেলা গ্রোথ সেন্টার সড়ক এখনই এবড়ো-খেবড়ো হয়ে পড়েছে, দলীয় কন্ট্র্রাক্টর ও এলজিডি ইঞ্জিনিয়ারদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

অনস্বীকার্য যে স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক উন্নয়ন একটি দীর্ঘমেয়াদি ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অথচ দুঃখজনক এই দীর্ঘ সময়ের প্রয়াস প্রচেষ্টায় অর্জিত সাফল্যকে ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের তাৎক্ষণিক সাফল্য বলে দাবি করেন। মহামারি আকারে ধেয়ে আসা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যানসারের মতো অসংক্রামক ব্যাধি বিস্তার রোধকল্পে সময় থাকতে উপযুক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং সে কাজে সরকারের তরফে নীতিমালা প্রণয়ন, কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দেখভাল আবশ্যক হবে, গণস্বাস্থ্য উন্নয়নে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সবার অংশগ্রহণের অনিবার্য আবশ্যকতা রয়েছে। নীতি কৌশল বাস্তবায়নে দলীয় বা সংগঠন গত দৃষ্টিভঙ্গির বিবরে সীমাবদ্ধ হয়ে গেলে সাফল্যকে বিলম্বিত করবে মাত্র। আর্থ-সামাজিক পরিবেশ উন্নয়নে জনস্বাস্থ্য একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। একে উপেক্ষা কিংবা এখাতে অপারগতার অবকাশ খুব কম।

লেখক: সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের চেয়ারম্যান


শিক্ষককে সম্মান জানালে সমাজ সুন্দর ও মসৃণ হয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মিজানুর রহমান

বিশ্ব শিক্ষক দিবস ৫ অক্টোবর। ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে শিক্ষকদের একটি সম্মেলন হয়।এ সম্মেলনে শিক্ষকদের অধিকার দায়িত্ব এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা হয়েছিল। সে দিন শিক্ষকদের কথা চিন্তা করে ইউনেস্কো এবং আইএলও কিছু পরামর্শে স্বাক্ষর করেন। তারপর ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হলে ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর শিক্ষকদের অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি দিতে শিক্ষকদের স্মরণে শিক্ষকদের অধিকার কল্যাণে সম্মানার্থে সারা বিশ্বব্যপী বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে। ইউনেস্কোর মতে বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসমান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পালন করা হয়।

বিশ্বের ১০০টি দেশে এ দিবস পালন করা হয়। এই দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১ সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারন করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকতা পেশার অবদানকে ও স্মরণ করিয়ে দেয়।

মানুষের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে, তা কিন্তু জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে তা বিকশিত হয়। শিক্ষা মানব জীবনের পরিবর্তন এনে দেয়। শিক্ষার মাধ্যমে জাতীর উন্নতি অবনতি সবই নির্ভর করে। তাই তো শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। বাবা মা জন্ম দেওয়ার পর সন্তানের বিকশিত বা শিক্ষার দীক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষকের। দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষকের ওপর বর্তায়। ছাত্রের দক্ষতা ও সততা নিষ্ঠাবান তা নির্ভর করে শিক্ষকের ওপর। মেধাবী ও দায়িত্বশীল শিক্ষকরাই মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা বিস্তারের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সংকট উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যারা শিক্ষা দেয় তাদের আর্থিক অবস্থা কেমন যদি জানতে চাওয়া হয়- চাকরি ক্ষেত্রে বিরাট বৈষম্য দেখা যাবে। শিক্ষক সমাজ কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সামাজিকভাবে বেশ অবহেলিত। পারিবারিক জীবনে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এদের শখ-আহ্লাদগুলো ডুবে ডুবে মরছে। এ দেশের ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই লাইব্রেরি গবেষণাগার ও খেলার মাঠ। যেখানে আছে- তা মানসম্মত নয়। নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষা উপকরণ ও আসবাবপত্র। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত নন। এদের অবস্থা আরও করুণ। যেসব শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়েছেন তাদের অধিকাংশের চাকরির শুরু থেকে এমপিওভুক্ত হয়নি। অথচ এমপিওভুক্তির তারিখ থেকে শিক্ষক ও কর্মচারীদের অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরা হয়। কেউ কেউ বছরের পর বছর শিক্ষা দিয়ে এমপিওভুক্তির খবর নেই অনেকে পেনশনে চলে যায় কিন্তু এমপিওভুক্ত হচ্ছে না। বেসরকারি কলেজের প্রভাষকদের পদোন্নতির বিষয়টি আরও জটিল ও অমানবিক। বর্তমানে বেসরকারি কলেজে শিক্ষকদের এমপিও নীতিমালা ২০১৮ অনুযায়ী উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের শিক্ষকরা পদোন্নতি পেয়ে হবেন জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। এই জটিল নিয়মের কারণে অনেককে প্রভাষকের পদ থেকেই অবসর নিতে হয়। অথচ সরকারি কলেজে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপকের পদোন্নতি আরও সহজতর করা হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান থেকে কর্মচারী পর্যন্ত বাড়িভাড়া ভাতা মাত্র ১০০০ টাকা। বিষয়টি একেবারে বেমানান। বোনাসের ক্ষেত্রে পান মূল বেতনের ২৫%। সবাই একতরফাভাবে চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা। আর্থিক শত প্রতিকূলতার মাঝে তার শিক্ষা কার্যক্রমে কোনো গাফিলতি নেই। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অনবরত শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষকতা সবার কাছে মহান পেশা হিসেবে বিবেচিত। সে জন্য সবচেয়ে সম্মানের জায়গাটা কিন্তু শিক্ষকই দখল করে আছে। যুগ যুগ ধরে শিক্ষককে গুরুজন হিসেবে মেনে আসছে। শিক্ষকের সঙ্গে বেয়াদবি করা যায় না ‘অভিশাপের ব্যাপার আছে তো’। এ কথাটি বহুল প্রচলিত। তা অস্বীকার করার কারণ নেই। রাস্তায় শিক্ষকের আচমকা দেখা মিললে তার ছাত্র/ছাত্রীরা শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। শিক্ষক আর্থিক দৈন্যতায় থেকে ও পরম তৃপ্তি পায়, ‘আমার ছাত্র অনেক বড় কর্মকর্তা হয়েছে তাকে গড়ার কারিগর তিনি ছিলেন বলে’। এটাই তার বড় সান্ত্বনা। দু-একটি ঘটনায় আমাদেরকে পীড়া দিচ্ছে। যেমন- বাংলাদেশের একটি জেলা নওগাঁর হাঁপানিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল ইসলামের পদত্যাগের দাবিতে তার কার্যালয়ে বিক্ষোভ করছিল শিক্ষার্থীরা। ২৮ আগস্ট সকাল থেকে অধ্যক্ষকে অবরোধ করে এই বিক্ষোভ শুরু হয়। অবরুদ্ধ অবস্থায় বেলা ৩টার দিকে অধ্যক্ষ অসুস্থ হয়ে এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর তাকে উদ্ধার করে প্রথমে নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে ও পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অধ্যক্ষের বড় ভাই আবু নাসের আহমেদ বলেন, বিক্ষুব্ধ জনতা একত্রিত হয়ে হিসাব-নিকাশ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন, তিনি হিসাব বুঝিয়ে দেওয়ার লগ্নে বিক্ষুব্ধ জনতা অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজে অশোভনীয় আচরণে অধ্যক্ষ হতবিহ্বল হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

ঘটনা দুই: ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে ঢুকে তাকে চেয়ার থেকে নামতে ও পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করতে জোরাজুরি করছেন একদল শিক্ষার্থী। এক পর্যায়ে শিক্ষিকা জোরাজুরি করা এক ছাত্রীকে চড় মারেন। তবুও শিক্ষার্থীরা তাকে চেয়ার থেকে নামানোর চেষ্টা চালিয়ে যান। এ নিয়ে শুরু হয় উত্তেজনা। ঘটনাটি ঘটেছে জামালপুর সরিষাবাড়ী উপজেলার সালেমা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে।

ঘটনা: তিন: শিক্ষকদের এই পদত্যাগ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে গত তিন বছর আগে ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের সময় মো. আমান উল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল তিনি বিএনপি-জামায়াতের অনুসারী। ধীরে ধীরে এ তকমা লেগে ও ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর ‘আওয়ামী লীগের লোক’ বলে একটি গ্রুপ অভিযোগ করছেন। সেখানে বিক্ষোভ হয়েছে। তার পদত্যাগের দাবিতে কলেজের একটি মহলের হাত রয়েছে বলে জানা যায়।

ঘটনা চার : প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ এনে তার পদত্যাগের দাবিতে ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ করছিল শিক্ষার্থীরা। সারাদিন নিজের কক্ষে অবরুদ্ধ থাকার পর বিকেলে প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যান প্রধান শিক্ষক। এর পরেই তার চেয়ারে বসে পরে দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। এ ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেরিয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঘটনাটি ঘটেছে গত বুধবার কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরদিন ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাজী আলমগীর হোসেনের চেয়ারে ছাত্র বসে থাকার ছবি। ছবিতে দেখা যায় টেবিলে কাজী আলমগীর হোসেনের নেমপ্লেটের ছবি। বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি জানিয়েছেন, ছাত্রটির বিরুদ্ধে দ্রুত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এগুলোর ব্যাপারে সরকারের কঠোর নজরদারি দরকার।

ঘটনা পাঁচ : নোয়াখালী জয়নাল আবেদীন মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাবু শিমুল চন্দ্র স্যারের দীর্ঘ ৩৬ বছর ১ মাস ১৯ দিনের শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিনটি অন্যরকম ছিল। তিনি নোয়াখালী অঞ্চলের দুইবারের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। বাড়িতে যাওয়ার গাড়ি ফুলদিয়ে সাজিয়েছে ছাত্র/ছাত্রীরা। দুই পাশে সারিবদ্ধ ভাবে ছাত্র/ছাত্রীরা দাঁড়িয়ে স্যারের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন এবং অনেককে কদমবুসি করতেও দেখা গেছে। মাইকে বাজছিল কবিগুরুর বিখ্যাত গান ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এ ঘাটে তখন বাইব আর খেয়াতরী এ ঘাটে।’ এ দৃশ্যপটে ছাত্র /ছাত্রী অভিভাবক এবং আমি নিজেও দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। সেরা শিক্ষকের বিদায় এমনই হয়। শিক্ষক হিসেবে তার বড় সান্ত্বনা। শিক্ষকদের অবহেলা না করে এ সম্মানটুকু আমরা কি দিতে পারি না?
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন কর এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শিখ এবং যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন কর তাকে সম্মান কর।’ ( হাদিস নং ৬১৮৪)

প্রিয় নবী আরও বলেন, ‘সর্বোত্তম দান হলো কোন মুসলমান নিজে কোনো বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে পরে তা অপর মুসলমান ভাইকে শিক্ষা দেয়।’

‘আমাদের মনে রাখতে হবে একটি বই একটি কলম একটি শিশু এবং একজন শিক্ষক বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারে’ (মালালা ইউসুফ জাই)।

বিগত সরকারের সময় তাদের জন্মদিন-মৃত্যুদিন পালন করতে করতে সবাই ক্লান্ত ছিল। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন, ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য কার্যালয়ে বিগত সরকারের নিজেদের ভাইবোনদের জন্মদিন-মৃত্যু দিবস পালন করতে হয়েছে। এটার জন্য প্রতিষ্ঠান দায়ী? জোর করে করানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সবার মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এ অপরাধের জন্য আমরা কেন শিক্ষককে দায়ী করব? সমাজের সকল স্তরেই এ ধারা অব্যাহত ছিল। ছাত্র/ছাত্রীরা শিক্ষকদের ওপর যদি চড়াও হয় তাহলে সবাই ভাববে সামাজিক অবক্ষয় হয়েছে। আমরা এটা বলতে নারাজ। কোনো অশুভ শক্তি হয়তো বিভ্রান্ত করছে তোমাদেরকে। জাতির স্বার্থে ছাত্ররা কেন বিভ্রান্ত হবে। শিক্ষক দোষ করলে কমিটি দেখবে- আমরা সেটার জন্য অপেক্ষা করতে ক্ষতি কী? শিক্ষককে সম্মান জানালে আমাদের সমাজ আরও সুন্দর ও মসৃণ হবে। আমরা কি এটা আশা করতে পারি না?

লেখক : সাবেক ব্যাংকার ও কলামিস্ট


রাম দুষছে শ্যামকে, শ্যাম যদুকে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সুধীর সাহা

ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) সাম্প্রতিক রিপোর্টে বিশ্বের বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ১৭৩টি শহরের মধ্যে বাংলাদেশের ঢাকা শহরের অবস্থান ১৬৮তম। ঢাকা শহরের যানজট, পরিবেশদূষণ, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা যে চরমভাবে প্রশ্নের দাবি রাখে, তা এই রিপোর্টই সাক্ষী দিচ্ছে। অবকাঠামোর মেট্রোরেলে মনোযোগ আছে, উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণে মনোযোগ আছে; কিন্তু ঢাকার মানুষের বসবাসের মানোন্নয়নের প্রতি মনোযোগ কিংবা দায়বদ্ধতা নেই কর্তৃপক্ষের। তাই ঢাকার এই করুণ অবস্থা। ঢাকায় কিছু বৃষ্টি হয়েছে, যা এ সময়ের পক্ষে স্বাভাবিক। টানা ছয় ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি। কিন্তু এর ফলেই বুড়িগঙ্গা আর আশপাশের জায়গাগুলো ত্রাসমূর্তি ধারণ করেছে। জলে ডুবে গিয়েছিল ঢাকার সিংহভাগ এলাকা, রাস্তা-অলিগলি। কোথাও হাঁটুজল, কোথাও কোমরসমান জল। অচল হয়ে পড়েছিল গোটা রাজধানী। রাস্তায় বাস আর অটোরিকশা নয়, নৌকা দিয়ে চলাচলের কথা ভাবছিল রাজধানীবাসী।

আধুনিক শহরে বৃষ্টি বরং কিছুটা অবাঞ্ছিত অতিথি। আমরা তার জন্য প্রস্তুত থাকি না কখনো। তারপরও দেখছি আকাশ থেকে ঝেঁপে বৃষ্টি পড়ছে এবং ঢালুর দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। নিচুর দিকে ক্রমাগত যাওয়াই জলের নিয়ম। সেই নিয়মের দরুণই স্থলভাগকে ঘিরে অতল মহাসাগর, সাগরের রক্ষাবন্ধন আর স্থলভাগে প্রাণরক্ষক জলাশয় তৈরি হয়। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ নানাভাবে আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টিকে ধরে রাখতে মাটিতে ছোট-বড় গর্ত খুঁড়েছে। কিন্তু তারপর? তার আর পর নেই। জলাশয় ভরে উঠেছে দালান-কোঠায়। খাল-বিল আর দেখা যায় না চোখের সীমানায়। নিয়মিত উদাসীনতার ফলে গত কয়েক দশক ধরে শহরে মোটামুটি দু-তিন ঘণ্টা স্বাভাবিক বৃষ্টি পড়লেও জল জমা শুরু হচ্ছে। প্রবল বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই! ঢাকাসহ কিছু শহরের নিচু অংশে জল আগেও জমত; কিন্তু পরে তা নেমেও যেত। এখন প্রায় পুরো শহরেই জল জমে এবং তা বেরোতে পারে না। জল বয়ে যাওয়ার জায়গা আর খালি নেই। তৈরি হয়েছে উঁচু রাস্তা এবং পাকা বাড়িঘর। মাটির নিচে জল গড়িয়ে পড়ার পথ বন্ধ। ফলে জল জমে থাকায় বিপদ বাড়ছে, নিয়মিত জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হচ্ছে। তবে থেমে থাকে না কর্তৃপক্ষের প্রজেক্ট। প্রজেক্ট হয়, বাজেট অনুমোদন হয়, বন্যায় উদ্ধারকাজ হয়; কিন্তু জল জমার কোনো সমাধান হয় না। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বসবাসের অভ্যস্ত নিয়মকে চূড়ান্ত অদূরদর্শিতায় যথেচ্ছ লঙ্ঘন করার উন্নয়নমূলক কাজে কেউই আর এখন পিছিয়ে থাকছে না।

ভারতের সুনীল গঙ্গোপধ্যায় হয়তো ভাগ্যবানই ছিলেন। এমন লেখার পরও তাকে জেলে যেতে হয়নি। তার কারণ সম্ভবত মানুষের ভাবাবেগ কিছুদিন আগেও আজকের মতো এত আঘাতপ্রবণ ছিল না। তিনি লিখেছিলেন, ‘এতগুলো শতাব্দী গড়িয়ে গেল, মানুষ তবু ছেলেমানুষ থেকে গেল/কিছুতেই বড় হতে চায় না/ এখনো বুঝল না, ঈশ্বর নামে কোনো বড়বাবু এই বিশ্বসংসার চালাচ্ছেন না/ ধর্মগুলো সব রূপকথা/ যারা সেই রূপকথায় বিভোর হয়ে থাকে/ তারা প্রতিবেশীর উঠোনের ধুলোমাখা শিশুটির কান্না শুনতে পায় না।’ সুনীল গঙ্গোপধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন ২০১২ সালে; তবে মানুষ এখনো ছেলেমানুষই থেকে গিয়েছে। আর ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে সেটা ভারী সুবিধার। ছেলেমানুষ বলেই দেশাত্মবোধের মোড়কে উগ্র মেরুকরণ, বিদ্বেষ, ভাষা ও সংস্কৃতিগত বহুত্বের প্রতি অনাস্থার ঝোঁক দিয়ে আমাদের কয়েদ করে রাখা যায় বোধশূন্যতার অন্ধকারে; সে আমরা সমাজের যে স্তরেই থাকি বা যত শিক্ষিতই হই না কেন। সবচেয়ে ভয়ানক বোধ হয় সমাজের শিক্ষিততম অংশ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর এই অন্ধকারে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাওয়া দেখে। বোধ বিলীন হবে না কেন? তারা সবসময় ভাবে, সব বেয়াড়া লোকজনকে প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দি থেকে দূর করতে পারলে করপোরেট প্রভুদের মনপছন্দ রোবট তৈরি করার কাজটি সহজ হয়। তাই তারা উপরমহলকে খুশি রাখতে ঠিক যেমনভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা উচিত, রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষবিন্দুতে আরোহণকারী ছেলেমানুষরা সেভাবেই চালিয়ে যাবেন। অন্যরাও তালে তাল দিয়ে চলবেন, অন্তত নিজের গায়ে আচ না-লাগা পর্যন্ত। তাই যা আমরা সহজেই প্রচুর পাই, সেই বৃষ্টিধারাকে অবহেলায় বয়ে যেতে বাধা দেওয়ার সংকটের কারণে পাশাপাশি তৈরি হয়েছে মাটির সঞ্চিত জলভাণ্ডার থেকে বেহিসাব জল তোলা। তুমুল বর্ষাকালের দেশের মানুষ তাই তীব্র জলসংকটের সম্মুখীন আজ।

কিন্তু পরিবেশ তো বসে নেই। আমরা ভুল করে তাকে যে বেপরোয়া করে দিয়েছিÑ তার গতিপথ এখন আটকাব কী করে? ইতোমধ্যেই দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সামনের দিনগুলো আরও ভয়াবহ হতে পারে। এই অস্বাভাবিকতা, প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনা একেবারেই ইদানীংকালের নিয়ম। এমন অবস্থা শুধু বাংলাদেশের নয়- এ অবস্থা চলছে সারা পৃথিবীতে। একাধারে চলছে তীব্র দাবদাহ, অসহনীয় গরম; অন্যদিকে চলছে ঝড়-বৃষ্টির তাণ্ডবতা। সাগর আছড়ে পড়ছে দুপারের মানুষের ওপর ঘূর্ণাবর্ত হয়ে। প্রকৃতির এ বিরূপ অবস্থার কারণ আমাদের সবারই জানা। জানা পরিত্রাণের উপায়ও। কিন্তু পরিত্রাণের পথে কারও কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। রাম দুষছে শ্যামকে, শ্যাম যদুকে, যদু তাকায় মধুর দিকে, আর মধু উদাসীন ও নির্বিকার।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ক্লাইমেট চেঞ্জ, বিশ্ব উষ্ণায়ন কিংবা জলবায়ু সংকট শব্দগুলো এখন শিশু থেকে বাড়ির রান্নাঘরেও ছড়িয়ে গিয়েছে। সব দেশের সব সরকার প্রতি বছরই এ নিয়ে সম্মেলনে বসে; কিন্তু পরিস্থিতি শোধরায় না, কেউ হাল ধরে না। সবাই শুধু পরামর্শ দেয়- এভাবে না ওভাবে। কিন্তু কাজটা কেউ করে না। আর প্রকৃতিও সেই সুযোগটাই নেয়। গরিব তো এমনিতেই আধামরা, তার ওপর এই গাফিলতি তার জন্য মৃত্যুসম হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মানুষ তাই একটু বেশিই অসহায়। কেননা, বাংলাদেশে পাল্লা দিয়ে চলে নদীগর্ভ থেকে অবাধে বালু-পাথর উত্তোলন, বনবাদাড় উজাড় করা। চলে অযথাই পানীয় জলের অপচয়, প্লাস্টিকের ব্যবহার। কত নদী যে ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে, আর সামনে যে আরও কত নদী হারিয়ে যাবে! এই সেদিনও এ দেশে কম-বেশি ৭০০টি নদী প্রবাহিত ছিল। এখন সরকারি হিসাবে বেঁচে আছে ৪০৫টি নদী। বাস্তবে হয়তো আরও অনেক কম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সচল নদীপথ ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার; আর আজ ২০২৪ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটার। বন-বাদাড়ের অবস্থা আরও ভয়াবহ। নদী হারালে, বন হারালে মানুষের জীবনে অসহায়ত্ব আসবে তা বুঝতে কোনো বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের হেঁসেলে বসা গৃহিণীও তা বুঝতে পারে; কিন্তু আমি-আপনি অসহায়। যাদের বুঝ এখানে কাজে দিত, তারা তো বেশ ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই দিন-রাত কাটাচ্ছেন; এখনো তাদের পালে বাতাস লাগছে না। আর লাগবেই-বা কী করে! আমরাও তো নিজেরা সচেতন নই। কাঠবিড়ালীর ভূমিকায় আমরাও নামতে পারছি না। গাছকাটা বন্ধ করতে পারছি না, জলের অপচয় রুখে দিতে পারছি না, প্লাস্টিক ব্যবহার না করে থাকতে পারছি না, জলাধার ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে পারছি না, নদীকে বাঁচাতে পারছি না, সচেতন জনপ্রতিনিধিকে বেছে নিতে পারছি না। তাই প্রকৃতি আমাদের ওপর চরমভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে।

লেখক: কলামিস্ট


ডেঙ্গুর ভয়াবহতা: সচেতনতা বাড়েতে হবে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

যে কেউ যেকোনো সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত আমার এক বোনের অনুরোধে আজ ডেঙ্গু নিয়ে কিছু একটা লেখার তাগিদ অনুভব করছি। বোনটি সিলেটি, একজন ব্যাংকার সেখান থেকে অনুরোধ করল ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অনুভব করে এর প্রতিরোধের জন্য কিছু লিখতে, আমি বললাম আমি তো ডাক্তার নই আমি এই বিষয়ে তেমন ভালো কিছু জানি না, কীভাবে লিখব? আর আমার লেখা পাঠকরা পড়বেইবা কেন?

উত্তরে বোনটি জানাল, ‘তুমি চেষ্টা করলে তথ্য সংগ্রহ করে ভালো লিখতে পারবে আর তোমার লেখা অনেকেই পড়ে।’ সাহস পেলাম তাই চেষ্টা করছি, শুরুতেই জানিয়ে রাখি ডেঙ্গু কি এবং এর সূত্রপাত কোথায়?

সম্ভাব্য ডেঙ্গু জ্বরের ঘটনার প্রথম বিবরণ পাওয়া জিন বংশের, ২৬৫-৪২০ খ্রিষ্টাব্দে এক চীনা মেডিকেল এনসাইক্লোপিডিয়ায় বা বিশ্বকোষে যেখানে উড়ন্ত পতঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ‘জলীয় বিষ’-এর কথা বলা হয়েছে। সেখানে ১৭০০ শতাব্দীর এক মহামারির বিবরণও পাওয়া যায়; কিন্তু ডেঙ্গু মহামারির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় ১৭৭৯ ও ১৭৮০-তে, যখন এই মহামারির কবলে পড়েছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ।

তখন থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত মহামারি অনিয়মিত ছিল।

১৯০৬ সালে ‘এডিস ইজিপ্তাই’ নামক মশার পরিবাহিতা সম্পর্কে সবাই নিশ্চিত হয়, এবং ১৯০৭ সালে ভাইরাস ঘটিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু হয়ে ওঠে দ্বিতীয় ইয়েলো ফিভার।

এর কিছুদিন পরেই জন বার্টন ক্লেল্যান্ড এবং জোসেফ ফ্র্যাঙ্কলিন সিলার নামক দুই গবেষক আরও গবেষণা চালিয়ে ডেঙ্গু পরিবাহিতার মূল প্রতিপাদ্য সম্পূর্ণ করেন।

তাদের গবেষণায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও তারপর ডেঙ্গুর লক্ষণীয় বিস্তারের কারণ হিসাবে পরিবেশগত ধ্বংসের কথা বিশেষভাবে জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয়। একই প্রবণতা রোগের বিবিধ সেরোটাইপের নতুন নতুন এলাকা বিস্তারে এবং ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভারের উদ্ভবে দেখা যায়। রোগের এই চরম রূপের বিবরণ ১৯৫৩ সালে প্রথম ফিলিপাইন্সে পাওয়া যায়; ১৯৭০-এ এটি শিশু মৃত্যুর এক প্রধান কারণ হয়ে ওঠে এবং আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ১৯৮১ সালে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম প্রথম পরিলক্ষিত হয়, ডেঙ্গু জ্বরের সমার্থক ভিন্ন বানান হচ্ছে ডেঙ্গি, যা একটি ‘এডিস’ নামক মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমেই এই ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে সাধারণত শরীরে ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। এই রোগের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি।

সঠিক পরিচর্যন্তর ফলে দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে থাকে তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষরী জ্বর বা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়ে থাকে এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনোবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়।

মনে রাখা প্রয়োজন যে কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী বা স্ত্রী মশাই হলো ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধানতম। ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া যায়। ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে, কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। পরবর্তীতে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। কয়েক ধরনের টেস্টের মাধ্যমে, যেমন- ভাইরাসটি বা এর আরএনএ প্রতিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি দেখেও ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয় করা সহজ হয়।

ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধী টিকা কয়েকটি দেশে অনুমোদিত হয়েছে তবে এই টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর।

প্রধানত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায় বলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন তাই জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আঁধারে, যেমন- প্রতিটি বাড়িতে বিভিন্ন স্থানে আনাচে-কানাচে কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি দ্রুত অপসারণ করতে হবে। চলাফেরা ও জীবন যাত্রায় শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বর হলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে এবং বেশি বেশি করে তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল দেওয়া হয়। তবে হাসপাতালে ভর্তি করলে দেখা যায় প্রায়শই রোগীর শিরায় স্যালাইন দিতে হতে পারে।

মারাত্মক রূপ ধারণ করলে রোগীকে রক্ত দিতে হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে কোনো ধরনের এন্টিবায়োটিক ও ননস্টেরয়েডাল প্রদাহপ্রশমী ওষুধ সেবন করা যাবে না, করলে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কালে ডেঙ্গু একটি বৈশ্বিক আপদে পরিণত হয়েছে। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, ভারত এবং বাংলাদেশসহ অন্যান্য মহাদেশের ১১০টির অধিক দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়। প্রতি বছর পাঁচ থেকে পঞ্চাশ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয় এবং তাদের মাঝে দশ থেকে বিশ হাজারের মতো মারা যায়। এ দেশে ১৭৭৯ সালে ডেঙ্গুর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। বিংশ শতকের প্রথমভাগে ডেঙ্গুর ভাইরাস উৎস ও সংক্রমণ বিশদভাবে জানা যায়। মশক নিধনই বর্তমানে ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। সরাসরি ডেঙ্গু ভাইরাসকে লক্ষ্য করে ওষুধ উদ্ভাবনের গবেষণা চলমান রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশটি অবহেলিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগের একটি হিসেবে ডেঙ্গু চিহ্নিত করেছে।

সাধারণভাবে, ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তরা হয় উপসর্গবিহীন শতকরা ৮০ ভাগ অথবা সাধারণ জ্বরের মতো সামান্য উপসর্গ। বাকিদের রোগ হয় আরও জটিল শতকরা ৫ ভাগ এবং স্বল্প অনুপাতে এটি প্রাণঘাতী হয়।

ইনকিউবিশন পিরিয়ড বা উপসর্গগুলোর সূত্রপাত থেকে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময় স্থায়ী হয় ৩-১৪ দিন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা হয় ৪-৭ দিন। অতএব, আক্রান্ত এলাকা-ফেরত পর্যটকদের ডেঙ্গু হয় না যদি ঘরে ফেরার ১৪ দিনের বেশি পরে জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ শুরু হয়।

বাচ্চাদের প্রায়ই এই উপসর্গগুলো হয় যা সাধারণ সর্দি এবং গ্যাস্ট্রোএন্টারাটাইটিস বা বমি এবং ডায়েরিয়ার সমান, আর সাধারণত ছোটদের ক্ষেত্রে বড়দের চেয়ে উপসর্গের তীব্রতা কম হয়; কিন্তু রোগের জটিলতার শিকার বেশি পরিমাণে হয়।

ডেঙ্গু উপসর্গের বৈশিষ্ট্য হলো হঠাৎ জ্বর হওয়া, মাথাব্যথা সাধারণত দু’চোখের মাঝে মাংসপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা এবং র‍্যাশ বেরোনো। ডেঙ্গুর আরেক নাম ‘হাড়-ভাঙা জ্বর’ যা এই মাংশপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা থেকে এসেছে। মেরুদণ্ড ও কোমরে ব্যথা হওয়া এ রোগের বিশেষ লক্ষণ। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর শরীরে ছোট ছোট লাল বিন্দু দেখা যায় যেগুলো ত্বকে চাপ দিলে অদৃশ্য হয় না, যেগুলোর আবির্ভাব হয় ত্বকে চাপ দিলে এবং এর কারণ হচ্ছে ভগ্ন রক্তবাহী নালি এই জায়গায় আবির্ভূত হতে পারে এবং কারোর মুখ ও নাকের মিউকাস মেমব্রেন থেকে অল্প রক্তপাতও হতে পারে।

কিছু লোকের ক্ষেত্রে অসুখটি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যার কারণে প্রবল জ্বর হয় এবং সাধারণত এক থেকে দুই দিন স্থায়ী হয়। এই পর্যায়ে প্রচুর পরিমাণে তরল বুক

এবং অ্যাবডোমিনাল ক্যাভিটিতে বর্ধিত ক্যাপিলারি শোষণ ও লিকেজের কারণে জমে। এর ফলে রক্তপ্রবাহে তরলের পরিমাণ কমে যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ হ্রাস পায়।

ডেঙ্গুর সাপেক্ষে অন্যান্য নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারের বিষয়ে জানা গেছে যেমন- ট্রান্সভার্স মায়েলিটিস এবং গুলেন-বারে সিনড্রোম, দুর্লভতর জটিলতার মধ্যে আছে হৃৎপিণ্ডে সংক্রমণ এবং অ্যাকিউট লিভার ফেইলিওর।

দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে কমপক্ষে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের যেকোনো মাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু এটি। এর মধ্যে রয়েছে আটটি শিশু। গত সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয় গত বছর তখন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। আর মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। গত বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ৩৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল সেপ্টেম্বরে। ওই সময় ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন।

অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩০ হাজার ৯৩৬ জন। আর এ বছর এডিস মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৬৩ জনের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮৮ ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন হাসপাতালে। এরপর ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন হাসপাতালে। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ নারী ও ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ।

এ বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছে ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সিরা। এই বয়সি ব্যক্তিদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ হাজার ৩৬৪। আর মারা যাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ১৯। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে ৬৩ শতাংশ পুরুষ ও ৩৭ শতাংশ নারী।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে সর্বোচ্চ ২৬৭ রোগী ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ২২৮ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ২০৬, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮৩, খুলনা বিভাগে ১৩৪, বরিশাল বিভাগে ৭৪, রাজশাহী বিভাগে ৫৩, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৮ ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ২৮ জন ভর্তি হয়েছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয় গত বছর। তখন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। আর মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। গত বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ৩৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল সেপ্টেম্বরে। ওই সময় ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন।

সম্প্রতি আমার পরিচিতদের একজন ছিলেন আকলিমা আক্তার, যাকে পরিবারের সদস্যরা সুখী নামে ডাকতেন। তিনি হাসিখুশি সুখী সবাইকে সুখে রাখতে চাইতেন। সেই সুখী মাত্র সাত দিন আগে গত বুধবার সকালে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। বিকেলেই আকলিমার লাশ নিয়ে তার ব্যাংকার স্বামী সাইফুল ইসলাম ঢাকা থেকে ছুটে যান নোয়াখালীতে, এই দম্পতির দুই বছরও না হওয়া একমাত্র সন্তান সামিহা বিনতে ইসলামও জ্বর নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকা ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপে ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস পদে কর্মরত ছিলেন আকলিমা আক্তার।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের প্রত্যেককে তার নিজস্ব আঙিনায় এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকেই সম্মিলিত উদ্যোগে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে এবং আরও বেশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রতিরোধের জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রচারমাধ্যমে অধিক পরিমাণে ব্যাপক প্রচারণা ও আক্রান্ত রোগীদের সেবায় স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের সুস্থ করে তোলার উদ্যোগী হওয়া, রক্তদান কর্মসূচি সফল করা ইত্যাদি বেশি বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক


বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলা নয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রেজাউল করিম খোকন

ছাত্রজীবনে আমাদের সবাইকে ‘মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য’ রচনাটি অনেকবার পড়তে হয়েছে। অনেক পরীক্ষায় রচনাটি লিখতে হয়েছে। এখনো ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ‘মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য’ রচনাটি। মানবজীবনে মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের অপরিসীম কর্তব্য রয়েছে। সংসারে মানুষকে অনেক রকম দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়। কারণ মানবজীবন কর্তব্যকর্মে বিধৃত। সেসব কর্তব্য পালনের মাধ্যমে মানুষকে তার চরিত্রের স্বরূপ প্রকাশ করতে হয়। যেসব কর্তব্যের বেড়াজালে মানুষ আবদ্ধ তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য বরং এ কর্তব্যকে অন্যকোনো কর্তব্যের সঙ্গে তুলনা করা সমীচীন নয়। কারণ এই কর্তব্যের সঙ্গে মানবজীবন এমনভাবে জড়িত যে এই কর্তব্যকে অবহেলা করলে মানুষের মনুষ্যত্ববোধ থাকে না তখন সে অমানুষ হয়ে যায়। জন্মলাভের পর একটি শিশু যাকে আপন করে পায় তিনি হলেন মা। যাকে একান্ত করে পায় তিনি বাবা। বিখ্যাত মনীষী, উইলিয়াম পেন বলেছেন, ‘পৃথিবীতে ঈশ্বরের পরবর্তী স্থানই হলো মাতা-পিতার। মাতা লালন করেন আর পালন করেন পিতা। তাদের ঋণ কোনোভাবেই শোধ করা যায় না।’ প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ এ প্রসঙ্গে সেই জনপ্রিয় গানের লাইন ‘মায়ের একধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম পাপোস বানাইয়া দিলে শোধ হবে না’ স্মরণ করতে হয়। পৃথিবীতে আমরা যখন জন্মগ্রহণ করেছিলাম তখন কত অসহায় ছিলাম। নিজের পায়ে দাঁড়াতে অনেক দিন সময় লেগেছে। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে একটা পর্যায়ে পৌঁছেছি। কিন্তু সেই পর্যায়ে পৌঁছতে অনেকটা সময় বড় অবলম্বন হয়ে সর্বদা পাশে থেকেছেন আমাদের মা-বাবা। নিজের সুখ ও আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে আমাদের তিল তিল করে বড় করে তুলেছেন তারা। সব সময়ই শিক্ষা-দীক্ষা, খাবার-দাবার, বিভিন্ন আবদার মেটানো বিষয়েসহ তারা সব সময়ই ভেবেছেন, সাধ্যমতো যা করা প্রয়োজন তাই করেছেন। বাবা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে উপার্জন করেছেন আমাদের সুখ এবং ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য। মা আমাদের বড় করে তুলতে কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। শিশু অবস্থায় আমাদের জন্য মা কত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। আমরা অসুস্থ হলে সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন হয়ে বিছানার পাশে বসে সেবা-যত্ন করেছেন। আরোগ্য লাভের জন্য যা করা প্রয়োজন তাই করেছেন সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। মা-বাবার এত ত্যাগ, মহান অবদান কোনো সন্তান অস্বীকার করতে পারবে না। মা-বাবা নিজে না খেয়ে সন্তানকে অমঙ্গল বাবা-মা কোনোভাবেই কামনা করতে পারেন না। এমনকি বিপথগামী ও অবাধ্য সন্তানের জন্যও মা-বাবার সহানুভূতি ও ভালোবাসার কমতি থাকে না। সন্তান প্রতিবন্ধী, পঙ্গু হলেও মা-বাবা তার প্রতি কম স্নেহ অনুভব করেন না, তাদের হৃদয়ে ভালোবাসা ও আদরের ঘাটতি থাকে না। মা-বাবার কষ্ট ধৈর্য, সাধনা ও শ্রমের ফল হিসেবে সন্তানের সুন্দর জীবন গড়ে ওঠে। সেই মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য কোনোভাবেই অবহেলা করা যায় না।

পরিবারের সার্বিক সুখ-শান্তি আর উচ্ছ্বাসকে মূল্য দিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করে মা ও সন্তানের মধ্যে। এই সম্পর্কটি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আত্মিক রক্তের বাধনে বাঁধা। স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক নানা ঝড়ে উড়ে যেতে পারে; কিন্তু সন্তানের সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক আমৃত্যু বজায় থাকে। কোনো কারণে যদি পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদ রচিত হয় তবুও সম্পর্কের অদৃশ্য সুতা ঠিকই রয়ে যায়। সত্যিকার অর্থেই একজন সন্তান; পুত্র কিংবা কন্যা তার জীবনে প্রথম নারী হচ্ছে মা। জন্মের পর পরই শালদুধ খাওয়ানোর সময় মায়ের মুখ শিশুসন্তানের দিকে কিছুটা ঝুঁকে থাকে। মায়ের এই মুখ সন্তানের মনে গেঁথে যায়। সুখী সমৃদ্ধ পরিবারে সন্তানের দুরন্তপনায় মা-ই সন্তানের শেষ আশ্রয়স্থল। তাই সন্তানের সব চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে সবার আগে অবগত হন মা। একজন মা-ই পারেন একটি সুখী পরিবারের জন্য যোগ্য সন্তান গড়ে তুলতে। এ ক্ষেত্রে মা ও ছেলের সম্পর্ক হয় মাতৃকেন্দ্রিক জগতের নানা মায়ায়। মা খুব সহজেই সন্তানকে নানা পরিস্থিতি বোঝাতে সক্ষম হন। ওদিকে যার ওরসে সন্তানের পৃথিবীতে আগমন সেই বাবা সন্তানের জন্য যেন এক নিবিড় ছায়া। যার কাজ দুঃখ-কষ্ট থেকে সরিয়ে সন্তানকে ভালোবাসার আর্দ্রতা উপহার দেওয়া। রক্তের বাধনে বাঁধা চমৎকার সম্পর্ক বাবা ও সন্তানের। সন্তান ও বাবার সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে শ্রদ্ধা। বেশির ভাগ সন্তানের কাছে বাবাই শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন। পুত্র জীবন পথে বাবাকে মূলত সেনাপতি হিসেবেই দেখে যার শাসনাধীনে চালিত হয় তার যাপিত জীবন। শৈশব-কৈশোরে পিতাই হন পুত্রের ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড অন্যদিকে পুত্রের মাঝে পিতা সাধারণত নিজের ছায়া দেখতে পান কিংবা দেখতে চান নিজের অনেক অপ্রাপ্তি, ব্যর্থ স্বপ্ন বা সাধ পূরণ করতে চান বাবা সন্তানের মাধ্যমেই। আর সন্তানও অনেক সময় প্রভাবিত হয় বাবার ব্যত্তিত্বের ছায়ায়।

আসলেই পরিবার একজন মানুষকে ধাপে ধাপে তৈরি করে। একটা মানুষকে ভালো কিংবা মন্দভাবে গড়ে উঠতে পরিবারই বড় ভূমিকা পালন করে। একজন মানুষ সেভাবেই বেড়ে উঠবে পরিবার তাকে যেভাবে গড়ে তুলবে। প্রকৃত পক্ষে শিশুর সঠিক মানসিক বিকাশের জন্য পরিবারের সান্নিধ্য খুবই প্রয়োজনীয়। স্নেহ, মায়া, যত্ন এবং প্রয়োজনে শাসন তো প্রথমে পরিবার থেকে আসে। মা-বাবার আদর, সোহাগ এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। একক পরিবারের আধিপত্য। আজ যৌথ পরিবারের ধারণা ভেঙে একক পরিবার তৈরি হচ্ছে। একক পরিবার গঠনের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে- যৌথ পরিবারে ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকে না, পরিবারের পারিবারিক সম্পর্কগুলো সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারে না। সম্পর্কে ভাঙন ধরে একক পরিবারে খুব সহজেই। আজকাল সামাজিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের অধঃপতনের জন্য একক পরিবারের নানা সংকটই দায়ী। এ জন্য প্রায়ই ঘটছে নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। মানসিক দ্বন্দ্বের কারণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হাতাশা তীব্র হচ্ছে। এর ফলে নিরাপত্তাহীনতা, ইমোশনাল ডিপ্রাইভেশন ও আইডেন্টি ক্রাইসিসও বাড়ছে। এ ধরনের বিপর্যয় ঠেকাতে পরিবারে বয়োবৃদ্ধ সদস্যরা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। কারণ এই একক পরিবারগুলোতে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ঠাঁই হচ্ছে না, তাদের গ্রামের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। অনাদরে, অযত্নে, অবহেলায় অনেকটা অসহায় মানবেতর জীবন-যাপন করতে হয়। কারও মা-বাবার স্থান হচ্ছে দূরে নিভৃত এলাকার বৃদ্ধাশ্রমে। ফলে নাতি-নাতনির, দাদা-দাদির স্নেহের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়ে ভেতরে ভেতরে কেঁদে মরছে। তারা জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কোনো ধরনের গভীর জ্ঞান লাভ করতে পারছে না অভিজ্ঞ হননের অনুপস্থিতিতে। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্ত্রীর আপত্তি কিংবা অনাগ্রহের কারণে বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিজের সংসারে ঠাঁই দিতে পারে না অনেক মানুষ। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের নানা টানাপড়েন ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এর কারণ কমিউনিকেশন গ্যাপ, আর্থিক ও পারিবারিক নানা বিষয়। আধুনিক ও সচেতন মানুষ হিসেবে সন্তানকেই এ ক্ষেত্রে পিতা-মাতার সঙ্গে সম্পর্ক সুন্দর ও স্বাভাবিক করতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মহাকাব্যে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের অবদান কম নয়, সম্পর্কের ব্যাখ্যায় তা যাই হোক না কেন। পরিবার মানেই ভালোবাসার অটুট বন্ধন। একক কিংবা একান্নবর্তী ধরনটা যাই হোক না কেন; সবাই চায় পরিবারটা হয় যেন সুখের সমুদ্র। যাতে ভাসবে আপন মানুষের সুখভরা প্রতিচ্ছবি। এ হবে এমন এক মরুদ্যান যাতে সবাই খুঁজে পাবে অপর সুখের সন্ধান। পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের যথাযথ দায়িত্ব পালন এবং বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের যত্নবান হওয়াটা মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হলেও তা পালনে আন্তরিক ও সচেষ্ট নন অনেক মানুষ। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খোঁজখবর রাখেন না অনেক ছেলেমেয়ে। নানা কষ্টে-দুর্ভোগে অসহায়ভাবে জীবন-যাপন করেন তারা, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। পিতা-মাতার প্রতি সন্তানদের দায়িত্ববান করতে সংসদে আইন পাস হয়েছে। পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলাকারীদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই আইন অনেককে দায়িত্ববান এবং সিরিয়াস করবে হয়তো বা। তবে এ ক্ষেত্রে আইনের চেয়ে হৃদয়ের একান্ত আবেগ অনুভূতিটাই বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। সন্তানের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত মাতা-পিতার সব রকম সুখের দিকে লক্ষ্য রাখা। পিতা-মাতার শারীরিক, মানসিক সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে সন্তানের দৃষ্টি দিতে হবে। মাতা-পিতার মনে আঘাত লাগে তেমন কর্মকাণ্ড থেকে সব সময় বিরত থাকতে হবে। মাতা-পিতার ভরণপোষণের দায়িত্বটাকে কোনোভাবেই বোঝা না ভেবে এটাকে জীবনের একটি প্রধান দায়িত্ব বিবেচনা করতে হবে। মা-বাবা যখন বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছেন তখন তারা কর্মজীবন থেকে অবসর জীবনে পৌঁছে যান। অনেকেই তখন সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হন। এই অবস্থায় তাদের সব রকমের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা সন্তানের কর্তব্য। নিজের জীবনে অভাব, অভিযোগ, সমস্যা, সংকট যতই থাকুক না কেন তার পরও পিতা-মাতার সুখ স্বাচ্ছন্দের বিষয়টাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কোনোভাবেই তাদের অবাধ্য হওয়া যাবে না। তাদের স্বাস্থ্যের দিকে দৃষ্টি রাখতে। অনেক বাবা-মা নিজে অশিক্ষিত হলেও সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করেন অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে। কর্মজীবনে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর অনেক সন্তান অশিক্ষিত বাবা-মাকে স্বীকার করতে লজ্জা পান, তাদের পরিচয় দিতে বিব্রতবোধ করেন। তাদের মতো নরাধম আর কেউ হতে পারে না। সেই সব নরাধমের জন্য করুণা হয়। আসুন, আমরা সবাই যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করি, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের সেবা-যত্নে নিজেদের সর্বোতভাবে উৎসর্গ করি।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট


কৃষিজমি হ্রাস ও খাদ্যের অপচয় রোধ করুন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. জাহাঙ্গীর আলম

বাংলাদেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন লাগাতার বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে বছরে গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। তারপরও বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমরা আমদানি করছি প্রতি বছর। এর মধ্যে আছে চাল, গম ও ভুট্টাসহ অন্যান্য পণ্য। শুধু দানাদার খাদ্যশস্যের আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টন। এর সঙ্গে অন্যান্য কৃষিপণ্য যেমন- ডাল, তেলবীজ, চিনি, মসলা ও দুগ্ধজাত পণ্য যোগ করা হলে মোট আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯০ থেকে ১০০ লাখ টন। টাকার অঙ্কে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮০ থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকা। তারপরও দেশে খাদ্য নিরাপত্তার ঘাটতি আছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। বর্তমানে দেশের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এটি দূর করতে হলে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চায়তা বিধান করতে হলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন আরো দ্রুত বাড়াতে হবে। তার মাত্রা হতে হবে ন্যূনপক্ষে বছরে গড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। সেই সঙ্গে বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে হবে। কৃষিপণ্যের বাজারজাত উদ্বৃত্ত আরও বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ অনেক। উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে কৃষিজমি হ্রাস, আবাদযোগ্য জমি চাষের বাইরে ফেলে রাখা, জমির উর্বরতা হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, খাদ্য অপচয় এবং অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা ইত্যাদি।

বাংলাদেশে চাষাধীন জমির পরিমাণ কম। মোট ১ কোটি ৮৬ লাখ একর বা ৭৫ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। জনপ্রতি প্রাপ্যতা মাত্র ১১ শতক। দ্রুত এর পরিমাণ কমছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯২০ লাখ হেক্টর। ১৯৯৬ সালে তা ৮২ লাখ, ২০০৮ সালে ৭৭ লাখ এবং ২০১৯ সালে তা ৭৫ লাখ হেক্টরে হ্রাস পায়। শতকরা হিসেবে আবাদি জমি হ্রাসের গড় হার ছিল ১৯৮৪ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ০.৯৭ শতাংশ, ১৯৯৬ থেকে ২০৮ সাল পর্যন্ত ০.৭৪ শতাংশ এবং ২০০৮ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ০.২১ শতাংশ। ১৯৮০ সালে কৃষি জমির পরিমাণ ছিল মোট জমির ৬৫.৬৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা ৫৯.২৮ শতাংশে হ্রাস পায়। এভাবে কৃষিজমি হ্রাসের প্রধান কারণ হলো- শিল্পায়ন, নগরায়ন, নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ, নতুন বসতবাড়ি স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, ইটভাটা স্থাপন, নদীভাঙন ইত্যাদি। সম্প্রতি জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের ফলে জমি হ্রাসের প্রবণতা কিছুটা কমে আসছে। কিন্তু তা এখনো উদ্বেগজনক ও বিপদাশঙ্কাপূর্ণ। আগামীতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কৃষিজমি অন্য খাতে ব্যবহারের সুযোগ সীমিত করতে হবে। বিশেষ করে তিন ও দোফসলি জমি কোনোক্রমেই অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করা যাবে না। এক ফসলি জমি অন্য খাতে ব্যবহার করতে হলেও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ বিষয়ে আইনপ্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা দরকার।

কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আর একটি বাধা হলো আবাদযোগ্য পতিত জমির আধিক্য। বর্তমানে এর পরিমাণ ৪ লাখ ৫২ হাজার ৪৩০ হেক্টর। মোট আবাদযোগ্য জমির ৫.১৩ শতাংশ হচ্ছে পতিত জমি। দেশের বিভিন্ন চিনিকল, পাটকল, বস্ত্রকল ও রেল বিভাগে চাষযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ বেশি। তা ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মচর্চা কেন্দ্র, সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনস্থল এবং ব্যক্তিগত ঘরবাড়ি ও শিল্প-কারখানার চারপাশেও অনেক আবাদযোগ্য জমি পতিত অবস্থায় পড়ে আছে। সরকারি বা বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য যে পরিমাণ জমি দখলে নেওয়া হয় তার বেশির ভাগই স্থাপনা নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হয় না। বাকি জমি ফেলে রাখা হয় খালি। ঢাকা মহানগরের চারপাশে আবাসন কোম্পানিগুলোর অসংখ্য সাইনবোর্ড দেখা যায়। তার চারপাশে পতিত ফেলে রাখা হয়েছে শত শত একর আবাদি জমি। ঢাকার বাইরেও চোখে পড়ে এমন অনেক দৃশ্য। অপেক্ষাকৃত উঁচু, নিচু ও সমস্যাসংকুল অঞ্চলে আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ বেশি। এরূপ জমি অপচয়ের শীর্ষে অবস্থানকারী জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে বান্দরবান, সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, সিলেট, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ। সম্প্রতি কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির কারণেও চাষের আওতাভুক্ত কিছু জমি পতিত ফেলে রেখেছেন অনেক কৃষক। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণেও অনেক সময় কৃষকরা চাষাবাদে অনীহা পোষণ করেন। তাতে ফসলের উৎপাদন হয় কম। এমতাবস্থায় সব পতিত জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে শস্য বহুধাকরণ, স্বল্প সময়ের শস্য আবাদ, শস্যক্রমের বিন্যাস পরিবর্তন। হাওরাঞ্চলের জন্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন ফল, কাজুবাদাম ও কফি চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। বছরের বিভিন্ন সময়ে মাঠের জমি যাতে অনাবাদি না থাকে সে বিষয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা দরকার। প্রয়োজনে কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জমি পতিত রাখার জন্য কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হয় (সেট এ সাইড পলিসি)। তাতে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ হ্রাস পায় এবং বিশ্ববাজারে কৃষি পণ্যের মূল্য পতন ঠেকানো যায়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো খাদ্য নিরাপত্তা সংকটে থাকা একটি দেশে পতিত জমি আবাদের জন্য কৃষকদের সহায়তা দেওয়া হবে খুবই যুক্তিসঙ্গত।

চাষযোগ্য মাটির গুনাগুন হ্রাস কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আর একটি বড় অন্তরায়। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার জমি অনুর্বর হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের মোট জমির শতকরা ৭৬.২ ভাগ এখন মোটামুটি অনুর্বর। এর পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০০ সালে ১.০৭ কোটি হেক্টর জমি উর্বরতা হারিয়েছে বলে ধারণা করা হতো। বর্তমানে তা ১.১২৪ কোটি হেক্টরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে হুমকি। এর কারণ বহুবিধ। তন্মধ্যে জমিতে অতিরিক্ত পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ, চিংড়ি চাষের জন্য মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বৃক্ষ নিধন ও বনভূমি উজাড় করা এবং জমিতে শিল্প ও ওষুধ বর্জ্য ফেলা অন্যতম। জমি গুণমান হারানোর ফলে শস্যের পুষ্টিমান হ্রাস পায় এবং বন্যা ও খরায় তা ফসল উৎপাদনের জন্য ঘাতোপযোগিতা হারায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিকার হিসেবে জমিতে ফসল চক্রের পরিবর্তন, জৈব সার প্রয়োগ, শিল্প বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকা, বনভূমির গাছ কাটা থেকে নিবৃত হওয়া এবং ফসলি জমিতে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণে নিরোৎসাহিত করা দরকার। তাছাড়া তামাক চাষ সম্প্রসারণ লাভজনক হলেও পরিবেশ ও মাটির গুনাগুন সংরক্ষণের জন্য তা পরিহার করা উচিত।

বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে খুবই সংবেদনশীল। এর প্রভাবে বন্যা ও খরার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বেড়ে যায়। উপকূল এলাকায় জলমগ্নতা ও লবণাক্ততার সম্প্রসারণ ঘটে। নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায় অনেক কৃষিজমি। সম্প্রতি বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা প্রায় দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। তাতে মরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে এবং পানির স্তর নিচে নেমে গিয়েছে। বিঘ্নিত হয়েছে পানি সেচ। উপযুক্ত অভিযোজন কর্মসূচি বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে লাগসই কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনে যত্নবান হওয়া দরকার। ইতোমধ্যেই বন্যা, খরা, জলমগ্নতা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু বেশ কিছু ফসলের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। এগুলোর ক্রমাগত উন্নয়ন সাধন ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়ানো আবশ্যক। তাছাড়া জমির ফসলক্রম পরিবর্তন এবং শস্য বহির্ভূত কৃষি খাতের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। কৃষি বিমা চালু করতে হবে।

আমাদের দেশে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্যের অপচয়। এটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বড় বাঁধা। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি বা ইউনেপের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গড়ে একজন ব্যক্তি বছরে ৮২ কেজি খাবার অপচয় করছেন। খাদ্য অপচয়ের এ পরিমাণ ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট-২০২৪ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি বছরে গড়ে ভারতে ৫৫ কেজি, যুক্তরাজ্যে ৭৬, যুক্তরাষ্ট্রে ৭৩ এবং রাশিয়ায় ৩৩ কেজি খাবার অপচয় করছেন। ২০১৯ সালের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ২০২১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী একজন বাংলাদেশি বছরে ৬৫ কেজি খাদ্য নষ্ট করেছিলেন। তাতে বাংলাদেশে খাদ্য অপচয়ের প্রবণতা বছরের পর বছর বেড়েছে বলে প্রতীয়মান। অনুরূপ খাদ্য অপচয় মাঠপর্যায়ে ফসল উৎপাদন থেকে বিপণন ও গ্রাহকপর্যায়ে পৌঁছা পর্যন্ত এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, পরিবেশন ও খাবার টেবিল পর্যন্ত বিস্তৃত। দানাদার শস্যের ক্ষেত্রে অপচয় কম। ফলমূলের ক্ষেত্রে অপচয়ের পরিমাণ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ এবং মাছের ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ। কারণ এগুলো দ্রুত পচনশীল। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে অপচয়ের পরিমাণ ৩০ শতাংশ এবং আলুতে ২০ শতাংশ। বাসা-বাড়িতে এবং হোটেল রেস্টুরেন্টে অপচয় হয় অনেক বেশি খাবার। কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে খাদ্যের অপচয়ের পরিমাণ ৫ থেকে ১৩ শতাংশ। রেস্টুরেন্টে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ অপচয় হয়। নিম্ন থেকে উচ্চ আয়ের মানুষের অপচয়ের মাত্রা বেশি। আগের রিপোর্ট অনুযায়ী ফসলের মাঠ থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত প্রতিবছর বাংলাদেশে ৩৭ লাখ টনের বেশি খাবার নষ্ট হয়। অন্যদিকে বাড়িতে এবং হোটেল রেস্টুরেন্টের টেবিলে খাবার অপচয়ের বার্ষিক পরিমাণ দাঁড়ায় ১.০৭ কোটি টন। সর্বসাকুল্যে বার্ষিক অপচয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৪৪ লাখ টন, যা দিয়ে বাংলাদেশের সব মানুষকে ৩ মাস খাওয়ানো সম্ভব। এ অপচয় রোধ করা সম্ভব হলে খাদ্যশস্য আমদানির কোনো প্রয়োজন হতো না। বাংলাদেশে উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে যখন গরিব ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে তখন অতিমাত্রায় খাদ্য অপচয় মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অতএব, এখনই তা রোধ করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার জনসচেতনতা সৃষ্টি, ফসল কর্তন ও সংরক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়ন, ইঁদুরের উপদ্রব হ্রাস, খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবেশনে ভালো প্রশিক্ষণ প্রদান। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর একটি হলো কৃষি উৎপাদনে টেকসই তা বাড়িয়ে ২০৩০-এর মধ্যে খাদ্য অপচয় অর্ধেক কমিয়ে আনা। এ লক্ষ্যে সরকার ও জনগণকে একযোগে কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত।

কৃষি উপকরণ যোগানে আমদানি নির্ভরতা আমাদের আর একটি বড় সমস্যা। এক সময় দেশের মোট প্রয়োজনের প্রায় ৭০ শতাংশ রাসায়নিক সারের চাহিদা দেশের উৎপাদন থেকেই মেটানো হতো। এখন তা নেমে এসেছে ২০ শতাংশেরও নিচে। দেশের ৫টি সার কারখানার মধ্যে মাত্র একটি এখন চালু আছে। বাকি ৪টি গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ সার মজুত আছে তাতে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে। এরপর শুরু হবে রবিশস্যের আবাদ ও বোরো ধানের চাষ। ইতোমধ্যে আমন ধানের উপরি প্রয়োগ করতে যত পরিমাণ সারের প্রয়োজন শেষকালে তারও কিছুটা ঘাটতি হতে পারে। রবি ও বোরো ফসলের জন্য লাগবে প্রায় ৪০ লাখ টন সার। এদিকে ডলার সংকটের কারণে সার আমদানির জন্য এলসি খোলা প্রায় বন্ধ রয়েছে। বকেয়া পরিশোধে অপারগতার কারণে বেসরকারি আমদানিকারকরা সার আনতে পারছে না বিদেশ থেকে। এমতাবস্থায় বিশেষ বিবেচনায় সার আমদানির ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার। তারও বেশি দরকার দেশের বন্ধ সার কারখানাগুলো চালু করা। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত প্রতি টন ইউরিয়া সারের খরচ দাঁড়ায় ৩২ থেকে ৩৩ হাজার টাকা। এর আমদানি খরচ দাঁড়ায় প্রতি টন ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। সুতরাং রাসায়নিক সার দেশে উৎপাদন করা অনেক বেশি লাভজনক। পানি সেচ ও মাটি কর্ষণের যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এসব যন্ত্রের উৎপাদন বাংলাদেশেই হতে পারে। প্রয়োজনে বিদেশের সঙ্গে সমঝোতা করে যন্ত্রপাতি উৎপাদনের কারখানা স্থাপনে তাদের সহযোগিতার নেওয়া যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।

আমাদের কৃষি পণ্যের বাজার অদক্ষ। এখানে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহযোগিতাই বেশি, প্রতিযোগিতা কম। সে কারণে বাজারে পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও মূল্য থাকে চড়া। ব্যবসায়ীদের অশুভ আঁতাত এর জন্য দায়ী। তাতে কম আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টভোগ করেন। তাদের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ঠকেন কৃষকরা। বাজার শৃঙ্খলের এই দুই প্রান্তে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য বাজার দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নিরন্তর কাজ করে যাওয়া উচিত।

লেখক: পরিচালক, ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকস এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ


পরিশুদ্ধ রাজনীতি হোক জাতীয় অঙ্গীকার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
বিপ্লব বড়ুয়া

বিংশ শতাব্দীর ২০ থেকে ৭০ দশক পর্যন্ত রাজনীতিতে ছিল দেশাত্মবোধের অনন্য জাগরণ। সাধারণ জনগণের সঙ্গে রাজনীতিকদের সম্পর্ক ছিল সমান্তরাল। ৪৭-এর দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে নানা ইস্যুতে দূরত্বের দানা বাঁধতে শুরু করে। তখন দুই পাকিস্তানের মধ্যে যে বিষয়টি নিয়ে বৈষম্যের বিষবাষ্প ছড়ায়, তার প্রধান এবং প্রথম কারণ ছিল ভাষার দূরত্ব। একে তো পশ্চিম পাকিস্তানিরা সরকারের সব প্রশাসনিক দপ্তর ছিল তাদের কবজায়; তার ওপর উর্দু ভাষাভাষি পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে বাংলা ভাষাভাষি পূর্ববঙ্গের জনগণ (বর্তমান বাংলাদেশ) সরকারি-বেসরকারি চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়। অতকিছুর পরেও উদার মানবিক সৃষ্টিশীল প্রজ্ঞাবান চেতনার অধিকারী বাঙালির গুটিকয়েক রাজনীতিকরা সুদূরপ্রসারী চিন্তার গুণে সৃষ্টি হয় ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যূত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার মুক্তিযুদ্ধ। তখন রাজনীতি ছিল অনেকটা স্বচ্ছ এবং রাজনীতিকরা ছিলেন একেকজন সম্মানের অধিকারী। জনগণের জন্য ছিল সেবার সর্বোচ্চ মানসিকতা। সেই রাজনীতির নীতি-আদর্শ এখন নির্বাসিত! রাজনীতিতে এখন সম্মানীদের চেয়ে অসম্মানীদের কদর ছিল বেশি। নীতিহীন ধূর্ত কপট মানুষরা হয়ে ওঠে রাজনীতির চালিকাশক্তি! যে যত বেশি অপকর্ম করতে পারে তার কদর হয় তোলা তোলা। অপরাজনীতির ছলাকলা দেখতে দেখতে দেশের মানুষের মতো আমি নিজেও ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি। রাজনীতি হয়ে ওঠেছে অনেকের কাছে খেতের ফসলের মতো; সেবার পরিবর্তে পকেট মোটাতাজা করার প্রধান ক্ষেত্র। পেশিশক্তি আর পুঁজিবাদীদের দৌরাত্ম্য। রাজনীতির গডফাদার খ্যাতদের নজরে কোনো রকমে একবার নিজেকে উন্মোচন করতে পারলে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না।

বিশ্বরাজনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতির কোনো মিল নেই। বিশ্বরাজনীতি এগিয়ে যায় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে আর আমাদের দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয় অস্ত্রবাজ, টেন্ডারবাজ, মাদক কারবারি, গুণ্ডা, ঘাড়-মোটাদের এবং যারা নেতাকে অর্থবিত্তসহ বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে তুষ্ট করতে পারা হোমরা-চোমরাদের নিয়ে। আমাদের দেশের রাজনীতি হয়ে উঠেছে পরিবার কেন্দ্রিক। এ ধারা বিস্তৃতি ঘটেছে কেন্দ্র থেকে মফস্বলে পর্যন্ত। যে ব্যক্তি এমপি, মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বার হয়, সে প্রতিবারই হতেই থাকে। পাঁচ বছর মেয়াদের সময়ে একেকজন ৮ বার পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হওয়ারও রেকর্ড আছে। একজন লোক যদি ৮ বার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় তার মেয়াদকাল দাঁড়ায় ৪০ বছর। এই ৪০ বছর একজন ব্যক্তি শাসন করার ফলে এলাকায় জারি হয় এক অঘোষিত একনায়কতন্ত্র। এতে করে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে পারে না। মেধাবী দেশপ্রেমিক জনগণ বঞ্চিত হয় অধিকার থেকে। এর ফলে অনেকের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ, অশ্রদ্ধা জন্ম নেয়। কোনো রকমে একবার সরকারি জনপ্রতিনিধির খাতায় নাম লেখাতে পারলে তাকে আর ঠেকানোর উপায় থাকে না। ভাব দেখায় এলাকাটা যেন তার লিজ নেওয়া। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের পর থেকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের এমন হাল অবস্থা দেখতে দেখতে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনে ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে। ছলে-বলে, কৌশলে কিংবা অপকৌশলে একবার ক্ষমতায় আরোহণ করতে পারলে জনগণ হয়ে যায় তাদের কাছে ছক্কার ঘুঁটি। শাসকরা মনে করতে থাকেন দেশের সব মানুষ তাদের হাতের পুতুল ‘যেমন করে নাচাবে, তেমনি নাচবে’। সোজাকথা কোনো সরকারই জনগণের স্বার্থের পক্ষে ছিলেন না। তাদের কর্মকাণ্ড ছিল সীমাহীন জনবিরোধী। সাধারণ জনগণকে শাসক ও তাদের সমর্থনপুষ্ট নেতা-কর্মীরা নানাভাবে শোষণ করে। এখন সময় এসেছে এ জাতীয় রাজনীতিক ও তাদের দোসরদের প্রত্যাখ্যাত করার।

রাজনীতিতে এখন নতুন উদ্যোম শুরু হয়েছে। দেশের মেধাবী ছাত্ররাই এর মূল উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে অনেকের মনে নতুন আশা সঞ্চারিত হয়েছে। বিশ্বরাজনীতির গতি-প্রকৃতির আদলে গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, উন্নত জীবনের ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি ব্যর্থ হয় তাহলে এই বাংলাদেশের অদূর ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন! শেখ হাসিনার সরকারকে পতন করার মধ্যে দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরাসরি দুজন তরুণ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হয়ে দেশের রাজনীতিক অঙ্গনে নবধারা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। এ ছাড়া ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে যুক্ত হয়েও বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এই ব্যাপারটি বাংলাদেশ শুধু নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বলা যায় একটি নতুন মডেল। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় গিয়ে ছাত্র, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়ের মধ্যে দিয়ে তৃণমূলের আশা-আকাঙ্ক্ষা জানা ও বুঝার চেষ্টা করছে। যা রাজনীতিক অঙ্গনে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হবে।

দেশে পরিশুদ্ধ রাজনীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এখন খুব জরুরি। রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে প্রথমে রাজনীতিক, রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংস্কার প্রয়োজন। মানুষকে শুদ্ধতার পাঠ নিতে হবে, রাজনীতিতে শুদ্ধতার চর্চা শুরু করতে হবে। পেশিশক্তি পরিহার করতে হবে। এ কথা সত্য যে, রাজনীতির মধ্যে দুর্বৃত্তায়নগোষ্ঠী বাসা বেঁধেছে। গুণী রাজনীতিকদের স্থলে চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের অনেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে দেশকে নষ্টদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। যেকোনো প্রকারে রাজনীতি থেকে দুর্বৃত্তায়ন ও পুঁজিবাদীগোষ্ঠীকে উৎখাত করে সুস্থ ধারার রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে।

ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেধাবী তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিকরা এমপি নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হওয়ার মতো গৌরব অর্জন করেছে। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের দেশের মেধাবী তরুণ প্রজন্মদের গড়ে তুলতে সেরকম কোনো পদ্ধতি বা পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। আমি মনে করি, আমাদের তরুণ প্রজন্মের সন্তানরা অন্যান্য দেশে যেহেতু তাদের কর্মদক্ষতা দেখাতে পারছে এখানেও পারবে। তরুণদের নতুন নতুন চিন্তাশক্তি কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক


অপচয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলেখ্য

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

নিত্যদিনের সকালের কাজ হিসেবে প্রত্যহ প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে থাকি। আসলে এই ভ্রমণ আমার জীবনের সঙ্গে অপরিহার্য নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে যে কথাটি উঠে আসে, তা হলো চিকিৎসা বিজ্ঞানমতে প্রাতঃভ্রমণে দেহ মন সজীব পূর্বক কর্মক্ষম করে তোলে। আর এটাই স্বাভাবিক কথা। কিন্তু আমি মনে করি যে এর সঙ্গে আরও একটি বিশেষ দিক সংযোজিত আছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, ভ্রমণের প্রাক্কালে আশপাশের অনেক কিছু দেখি, যা এমনভাবে ঢেউ খেলে যায়, তাতে হৃদয় আঙিনা আলোড়িত করে তোলে বিধায় এগুলো না প্রকাশ করা পর্যন্ত ঘূর্ণিপাকের মতো মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। কোনো সময় কিছু ঘটনা দেখে দুঃখ লাগে। আবার কোনো সময় হাসির উদ্রেক করে থাকে এবং কোনো সময় শিক্ষণীয় অনেক কিছু চোখে পড়ে। এদিকে মনুষ্য চিরায়ত বৈশিষ্ট্য হলো, বুদ্ধিমান জীব হিসেবে ‘জানতেও চায় এবং জানাতেও চায়’। আর এ সারথি ধরে আমিও ব্যতিক্রম নই। যা হোক, সেই রকম একটি ঘটনার কথা বলছি। আমার বাসা ফার্মগেটের অনতিদূরে মোস্তফা রোডে, যেখানে রাস্তার দুপাশে বেশ কটি মহিলা হোস্টেলে শত শত ছাত্রীদের আনাগোনা। ভোরে বাসা থেকে বের হতেই যা প্রথমে চোখে পড়ে, তা হলো একটি কিংবা দুটি মিনি ট্রাক এবং এতে হোস্টেলের সব বাসি খাবার ভর্তি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদে জেনেছি যে এগুলো জিনজিরায় নিয়ে যাওয়া হবে এবং মাগুর মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। শুনে তো মাথায় হাত; এত খাবার নষ্ট হচ্ছে? এ দিয়ে তো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দুঃখী মানুষের রাতের খাবার দিব্যি হয়ে যেত। যা হোক, এরপর থেকে প্রত্যহ সকালে ট্রাকে বাসি খাবার বোঝাই করতে দেখি। তাই এখন কোনো প্রশ্ন করা নিষ্প্রয়োজন বলে মনে করি। অবশ্য একটি তথ্য আমার মাথায় ছিল, বাংলাদেশসহ এই বিশ্বে প্রতি বছর ১০০ কোটি টনেরও বেশি খাবার নষ্ট তথা অপচয় হয়। যা হোক, যেহেতু আমি একজন লেখক। সেহেতু ভাবলাম, এ নিয়ে লিখলে মন্দ হয় না। দেশের লোক জানুক, কীভাবে অপচয় হচ্ছে? তাই কাগজ-কলম হাতে তুলে নিই।

সাধারণত আমরা বাংলাদেশিরা তুলনামূলক অধিক অপব্যয় করে থাকি। তবে আরব বিশ্বেও কম নয়। জাপানি ও ইংরেজরাও বেশ মিতব্যয়ী। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কথা যদি বলি, তাতে মিতব্যয়িতার বেশ আভাস মেলে। যেমন- যদি একটি পরিবারে পাঁচজন লোক থাকে। তাহলে তারা বাজার থেকে ছয় টুকরা মাছ কেনে। পুরা মাছ কেনে না। এ ক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয় পুরা মাছ প্রয়োজনাতিরিক্ত হিসেবে অপচয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে তারা মনে করে থাকে। অবশ্য বাংলাদেশিরা এ বিষয়টি নিয়ে অনেক ঠাট্টা-তামাসা করে থাকে। এদিকে সঙ্গত কারণেই আমার চোখে দেখা বাংলাদেশের গ্রাম্য জনপদে দু-একটি ঘটনা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছি। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, কোনো ব্যক্তি মেয়েকে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছে বলে তার প্রতিবেশীর মর্যাদা সমুন্নত রাখতে তার মেয়েকেও জমি বিক্রি করে সেভাবে বিয়ে দিয়ে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে টাকা দিয়ে সেই জমি ফিরিয়ে নিতে বা অন্যত্র সে পরিমাণ জমি কিনতে সক্ষম হয়নি। একই ভাবে ছেলেকে জমি বিক্রি করে বিদেশে পাঠিয়েছে। অথচ ছেলে প্রবাসে পরিশ্রম করে টাকা কামিয়ে দেশে এসে অযথা খরচ করে বলে সেই জমি আর উদ্ধার করতে পারেনি। এ ধরনের ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। আসলে আমরা অধিকাংশ বাংলাদেশিরা অযথা খরচ করে আলগা ফুটানি দেখাই; যার কোনো বাস্তবসম্মত ভিত্তি নেই। আমি এ ব্যাপারে কিছু খণ্ড চিত্রের ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা জানি। সে পরিবারের একমাত্র ছেলেসন্তান। তাই তার আবদারের শেষ নেই। বিগত পবিত্র রমজানের ঈদে বন্ধু-বান্ধবের দেখাদেখি ছেলে জিদ ধরেছে, সে বসুন্ধরা মার্কেট থেকে পাঞ্জাবি কিনবে। বাবা-মা তাদের টানাটানি সংসারের আর্থিক অবস্থা নিয়ে কথা বললেও, তা সে কর্ণপাত করে না। দেখা গেল ছেলেটি যে পাঞ্জাবি বসুন্ধরা মার্কেট থেকে ১৮০০ টাকায় কিনেছে, তা খোলা মার্কেটে মাত্র ৬০০ টাকা। এ তো গেল একদিক। অন্যদিকে গত কোরবানি ঈদে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দেখেছি। তাদের কাছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ত্যাগের কোনো বালাই নেই। তারা লোক দেখানোর নামে আট/দশ লাখ টাকায় কোরবানি গরু কেনে, তা আবার ফেসবুকে নিজেদের নাম ফলাও করছেন। যেহেতু প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করাই অপচয়, সেহেতু সব ধরনের বিলাসিতাই অপচয়। এ ছাড়া শখও অপচয়ের কারণ হতে পারে।

আমি পূর্বেই বলেছি, বিভিন্ন ক্ষেত্র ধরে অপচয় নিয়ে যদি লিখি, তা হলে প্রবন্ধের কলেবর বই হয়ে দাঁড়াবে, যা এই আর্টিকেলে সঙ্গত কারণেই সম্ভব নয়। যা হোক, বাংলাদেশের খাদ্যের অপচয় নিয়ে একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় গত ৩১/০৩/২০২৪ তারিখে একটি প্রতিবেদন দেখেছিলাম, যার অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে বিশ্বে ২০২২ সালে বাসাবাড়ি, খাদ্য সেবা ও খুচরা পর্যায়ে ১০০ কোটি টনের বেশি খাবার অপচয় হয়েছে, যা মোট খাদ্যের প্রায় ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশে গড়ে এক ব্যক্তি বছরে ৮২ কেজি খাবার অপচয় করছেন। অপচয়ের এ প্রবণতা ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ৬০ শতাংশ খাদ্য অপচয় হয়েছে বাসাবাড়িতে। ওই বছর প্রতিদিন বিশ্বে ১০০ কোটি মানুষের একবারের খাবার নষ্ট করা হয়েছে, যেখানে ৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ খাদ্যাভাবে ছিলেন। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি বা ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট-২০২৪ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন সম্প্রতি ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে প্রকাশ হয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বাসাবাড়িতে বছরে গড়ে একজন ভারতীয় ৫৫ কেজি, ব্রিটিশ ৭৬ কেজি, মার্কিনি ৭৩ কেজি ও রুশ ৩৩ কেজি খাবার অপচয় করেন। তবে এ হিসাবে খাবারের সবচেয়ে বেশি অপচয় হয় মালদ্বীপে; সেখানে এক ব্যক্তি বছরে ২০৭ কেজি খাবার অপচয় করেন। আর সবচেয়ে কম হয় মঙ্গোলিয়ায়- ১৮ কেজি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান খাদ্য অপচয় নিয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং ঢাকায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে উচ্চ আয়ের পরিবারগুলোতে বেশি খাদ্য নষ্ট বা অপচয় হয়। এ ব্যাপারে গবেষকরা বলছেন, সাধারণভাবে খাবার সম্পূর্ণ না খেয়ে ফেলা দেওয়াটাই খাদ্য অপচয়। উৎপাদন বা আহরণের পর সে পরিমাণ খাদ্য গ্রাহক পর্যায়ে না পৌঁছানোটাও অপচয়ের আওতায় পড়ে। এ ছাড়া যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে খাবার নষ্ট হলে সেটাও অপচয় বলে ধরে নেওয়া হয়। এ প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, কমিউনিটি সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৫-১৩ শতাংশ খাবার নষ্ট বা অপচয় হয়। বাসাবাড়ি ও হোটেল-রেস্টুরেন্টে অনেক খাবার নষ্ট হয়। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ধনাঢ্যদের বাসায় একজন ব্যক্তি সপ্তাহে দুই কেজির বেশি খাবার অপচয় করেন। এ ছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্ডার দেওয়া ও সব খাবার একটু চেখে দেখার প্রবণতাই রেস্তোরাঁগুলোতে খাবার অপচয়ের বড় কারণ। মূলত এসব কারণেই যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে খাদ্য বেশি অপচয় হয় বলে ধারণা গবেষকদের। দুঃখের বিষয় হলো যে বাংলাদেশে খাদ্য অপচয়ের বিষয়টি দেখার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। আর এর পেছনে যে নেতিবাচক বিষয়াদি পরিলক্ষিত হয়, তা হলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত রান্না; প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত কিনে তা ব্যবহার না করতে পারা এবং যথাযথভাবে সংরক্ষণের অভাব। মূলত খাদ্য নষ্ট হয় খাদ্য চক্রের (ঋড়ড়ফ ঠধষঁব ঈযধরহ) প্রথম দিকে। আর এই চক্রের শেষের দিকেও কম নয়। এদিকে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মৌসুমী ফল-ফলাদি ও সবজি নষ্ট হয়, যার পরিমাণ প্রায় ১৭ থেকে ৩২ শতাংশ।

কথায় বলে, ‘আয় করা সহজ; কিন্তু সঠিকভাবে ব্যয় করা কঠিন’। কেননা এর পেছনে থাকে পরিস্থিতি ও ভাবাবেগ। বস্তুত জীবনধারণের জন্য অর্থ উপার্জন করা এবং সম্পদ ভোগ করার সুযোগ বা অনুমতি ও নির্দেশ প্রত্যেক ধর্ম ও ছোট-বড় ২৭টি সভ্যতায় মোটামুটিভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অন্যকোনো ধর্ম বা সভ্যতায় ইসলামের মতো আয়-ব্যয়কে নিয়ম-নীতির আদলে আবদ্ধ করা হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে ইসলামে একদিকে যেমন হালাল উপায়ে অর্থ উপার্জনের নির্দেশ রয়েছে; অন্যদিকে তেমনই উপার্জিত অর্থ-সম্পদ বৈধ পথে ব্যয় করারও জোরাল নির্দেশ দিয়েছে। মূলত ইসলাম মানুষকে বিভিন্নভাবে অপচয় ও অপব্যয় করতে নিষেধ করেছে। কেননা অপচয়ের কারণে দরিদ্র্যের কবলে পড়ে; হারাম উপার্জনে উদ্বুদ্ধ করে ও পাপের চর্চার পথ সৃষ্টি করে ইত্যাদি। উল্লেখ্য, মানবসমাজে অর্থ ও সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপচয় ও অপব্যয় বর্তমানে একটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অথচ ইসলাম এটিকে স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেছে। এদিকে পূর্বেই বলেছি, অপচয়ের প্রকারভেদের সীমা নেই। এই ধরুন, সবুজ তরুরাজি ধ্বংসের ফলে বহুমাত্রিক ক্ষতি হচ্ছে। গাছ কমে যাওয়ার ফলে বায়ুদূষণ বাড়ছে, বাড়ছে তাপমাত্রা। তা ছাড়া তরু-পল্লবের সঙ্গে বৃষ্টিপাতের সম্পর্ক রয়েছে। যেখানে সবুজ থাকে; সেখানে বায়োডারভারসি থাকে, অর্থাৎ গাছপালা থাকলে বিহঙ্গের আনাগোনা থাকে। আসলে সব মিলে সবুজ গাছ-পালা ধ্বংসের ফলে প্রকারান্তরে মনুষ্য জীবের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, তথাকথিত সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ঢাকা রাজধানীতে দেদার গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হিসেবে যেখানে গাছপালা ২৫% থাকার কথা, সেখানে আছে মাত্র ৮%। তথাপিও কাটা থেমে নেই।

পরিশেষে এই বলে সমাপ্তি টানছি, ব্যক্তি বা পরিবার বা সমাজ বা দেশ বা বিশ্বের সবার প্রতি এই মর্মে অনুরোধ করব, শুধু অর্থ বা খাদ্যদ্রব্য নয়, সর্বক্ষেত্রে অপচয় নামক ক্ষতিকর কার্যক্রম থেকে সর্বসময়ে শত হাত দূরে থাকব, তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের সবার জীবনে মঙ্গল বয়ে আসবে। অবস্থাভেদে অনেক সময় আমাদের আওতার মধ্যে না থাকলেও যতদূর সম্ভব, এই অনাহুত কার্যক্রমটির ব্যাপারে নিজেদের সংযত রাখব। আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, কোনো ব্যাপারে ব্যয় যেন স্বর্ণ বিন্দু ছেদ করে লাগাম ছাড়া হয়ে অপচয়ের রূপ না নেয়। এ ক্ষেত্রে আবেগ ও পরিস্থিতির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে নবী করিম (স.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে, সে কখনো দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত হয় না। এখন যে কথাটি বলব, তা অন্যভাবে নেবেন না। এটি ধ্রুবসত্য ও আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, মনুষ্য নিজ দেহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার বা অপচয় করা যাবে না। এখানে এই কথা দাঁড়ায় যে কাম্য ঘুম ও আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে দেহ-মনকে ক্ষতি করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদি প্রকৃতির দান এই মূল্যবান দেহ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন তথা অপচয় করেন, তাহলে তো বুঝতেই পারছেন, দুপুর না হতেই তিমিরাচ্ছন্ন সন্ধ্যা।

লেখক: বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।


শ্রীলঙ্কার শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে কিছু কথা

আপডেটেড ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১১:২৩
মাছুম বিল্লাহ

ব্রিটিশ কাউন্সিল শ্রীলঙ্কা এবং শ্রীলঙ্কান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ আয়োজনে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হলো শিক্ষা ও ইংরেজি ভাষা উন্নয়নবিষয়ক সেমিনার। তাদের আমন্ত্রণে সেই সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছি। এ নিয়ে শ্রীলঙ্কায় আমার দ্বিতীয় ভ্রমণ, দুবারের উদ্দেশ্য প্রায় একই। শ্রীলঙ্কা শিক্ষা-দীক্ষায় যেহেতু আমাদের চেয়ে এগিয়ে তাই সেখানকার শিক্ষা নিয়ে কিছু কথা এখানে তুলে ধরছি। শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার বয়স্ক সাক্ষরতার হার ২০২১ সালে ছিল ১০০%। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা দেশের কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক পরিষদ উভয়েরই নিয়ন্ত্রণাধীন। কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ কিছু দায়িত্ব বহন করে এবং প্রাদেশিক পরিষদ অন্যগুলোর জন্য স্বায়ত্তশাসনের অধীনে দায়িত্বপ্রাপ্ত। শ্রীলঙ্কায় প্রথম শ্রেণি থেকে একদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক। তবে, প্রাক-প্রাথমিকে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয় এবং প্রাক-প্রাথমিকের ৮০ শতাংশ বিদ্যালয় রাষ্ট্র পরিচালিত নয়। এগুলোর ৭১ শতাংশ ব্যক্তি পর্যায়ে বা সংস্থা পরিচালিত, ৭ শতাংশ ধর্মীয় সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে আর ৩ শতাংশ এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) পরিচালিত। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক অর্থাৎ একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ৯০ শতাংশ বিদ্যালয়ই রাষ্ট্র পরিচালিত।

১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে দেশের সব বিদ্যালয় রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়, সামান্য কিছু প্রতিষ্ঠান যারা নিজেরাই বেসরকারি থেকে যায়। যারা প্রাইভেট বিদ্যালয় নামে পরিচিত। আশির দশকের প্রথমদিকে আন্তর্জাতিক স্কুল নামে আর এক ধরনের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিকমানের পরীক্ষা পরিচালনা করে থাকে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত নয়। শ্রীলঙ্কার প্রাইভেট স্কুল হচ্ছে তিন ধরনের। সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত প্রাইভেট স্কুল, সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত নয় এবং আন্তর্জাতিক স্কুল।সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত স্কুলগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন। এসব স্কুলে শিক্ষকদের বেতন রাষ্ট্র প্রদান করে থাকে। স্কুলে শিক্ষার্থীদের নামমাত্র একটা ফি প্রদান করতে হয়। এজাতীয় অধিকাংশ স্কুলই বোর্ড অব ম্যানেজমেন্ট দ্বারা পরিচালিত। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পুরোপুরি সুপারভিশন করে থাকে বিধায় প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন খুবই কম। প্রাইভেট বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে দ্বিতীয় ক্যাটগরির হচ্ছে যেসব স্কুল সরকার থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা নেয় না। তারা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নিয়ে চলে। তারা ভর্তি ফি এবং টিউশন ফি দুটোই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করে। এসব বিদ্যালয়ও একটি বোর্ড অব ম্যানেজমেন্ট দ্বারা পরিচালিত। স্কুলগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধনকৃত আর তাই সরকারি সুপারভিশন তাদের মানতে হয়। তবে এসব বিদ্যালয়ের ম্যানজেমেন্ট কমিটি প্রচুর স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। ১৯৭৭ সালে শ্রীলঙ্কায় উদার অর্থনৈতিক পলিসির গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্কুলের ধারণাটি চলে আসে এবং ১৯৭৮ সালে বিদেশি বিজনেসের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় খোলার জন্য নিবন্ধন করার অনুমতি প্রদান করা হয়। ২০০৭ সাল থেকে দেশীয় কোম্পানিগুলোকেও আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় খোলার অনুমতি প্রদান করা হয়। আন্তর্জাতিক স্কুলগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধনকৃত নয় আর তাই সরকারি সুপারভিশনও এখানে নেই। এই স্কুলগুলোর ম্যানেজমেন্ট কমিটিগুলো সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত, সহায়তাপ্রাপ্ত নয় এমন সব স্কুলের কমিটির চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে।

শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সরাসরি ‘জাতীয় বিদ্যালয়গুলো অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারি বিদ্যালয়গুলো যার সংখ্যা মোট বিদ্যালয় তিন শতাংশ, এগুলো অত্যন্ত রিসোর্সফুল। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা এগুলোতে রয়েছে। এর কিছুটা তুলনা চলে আমাদের সরকারি বিদ্যালয়ের সঙ্গে। আমাদের সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যাও কিন্তু ৩%। রাষ্ট্র পরিচালিত বিদ্যালয়ের বিশাল অংশই নিয়ন্ত্রণ করে প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এখানে নয়টি প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় রয়েছে। এগুলোর শিক্ষকরা যদিও প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বেতন পান কিন্তু বিদ্যালয়গুলো জাতীয় বিদ্যালয়গুলোর চেয়ে কম রিসোর্সফুল, কম সুবিধাপ্রাপ্ত। প্রাইভেট বিদ্যালয়গুলোতে স্থানীয় কারিকুলাম সিংহলী কিংবা তামিল অনুসরণ করা হয়। অথবা ইংরেজি কারিকুলাম অনুসরণ করা হয়। বর্তমানে ইংরেজি কারিকুলামের দিকেই বেশি অভিভাবক ও শিক্ষার্থী ঝুঁকছে এবং সরকারও ইংরেজি কারিকুলামের বিদ্যালয় সম্প্রসারণের কাজ ত্বরান্বিত করছে। অটোনোমাস স্কুল, সরকারি স্কুল, বেসরকারি স্কুল সব বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূলে বই, পোশাকসহ আরও কিছু সুবিধা রাষ্ট্র থেকে সরবরাহ করা হয়। ইন্টরন্যাশনাল স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়েই চলছে তার কারণ হচ্ছে এখানকার কারিকুলাম আন্তর্জাতিক এবং শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। এখানকার শিক্ষার্থীরা দেশে কিংবা বিদেশে উচ্চ শিক্ষা ও চাকরির জন্য বেশি সুবিধা পেয়ে থাকে। তাই এলিট অভিভাবক, ধনী অভিভাবক ছাড়াও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া কিন্তু সচেতন অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের আশায় ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পাঠিয়ে থাকেন যদিও এখানকার পড়াশোনার খরচ অনেক বেশি। বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় মোট শিক্ষার্থীরা ৩২ শতাংশই ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়াশোনা করছে।

শ্রীলঙ্কায় সরকারি স্কুলের শিক্ষক হতে হলে ন্যাশনাল কলেজ অব এডুকেশন (বিদ্যাপীঠ) থেকে তিন বছরের প্রি-সার্ভিস টিচার এডুকেশন-এর প্রি-সার্ভিস কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। আর সেখানে ভর্তি হতে জিসিই ( অ্যাডভান্সড লেভেল) পরীক্ষা এবং জিসিই অর্ডিনারি লেভেলের বিষয়গুলোতে পাস করে ন্যাশনাল কলেজেস অব এডুকেশনে ভর্তি হতে হয়। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাদেশিক কাউন্সিল তাদের জন্য শিক্ষকতা পেশা অফার করে থাকে। আন্তর্জাতিক বিদ্যালয়গুলোও শিক্ষকতা করা যায় গ্র্যাজুয়েশনের পর। প্রাইভেট বিদ্যালয়েও শিক্ষকতা পেশা শুরু করা যায়। সেখানে গ্রেড-৫ শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি পরীক্ষার ক্লাস, ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেলের ক্লাস পরিচালনা করতে হয়। তবে পড়ানোর বিষয়সমূহ, প্রশ্নপত্রের ধরন এবং পেশাগতভাবে শিক্ষাদান করার সঙ্গে ভালো পরিচিতি প্রয়োজন হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা পাস করেন শিক্ষক হওয়ার জন্য তাদের শিক্ষায় ডিপ্লোমা কোর্স অবশ্যই সম্পন্ন করতে হয়। আর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে শিক্ষায় ডিপ্লোমা নিয়ে যারা পাস করেন তারা সরাসরি টিচিং-এ ঢুকতে পারেন। তবে ওইসব শিক্ষকরা শুধু গ্রেড ওয়ান থেকে অর্ডিনারি লেভেল পর্যন্ত পড়াতে পারেন, তার ওপরে তাদের ক্লাস দেওয়া হয় না। অর্থাৎ অ্যাডভান্সড লেভেলে পড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করতে হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কায় শিক্ষক হতে হলে টিচার্স এডুকেশন প্রোগ্রাম সম্পন্ন করতে হয় একটি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে। সেটি হতে পারে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে শিক্ষায় ডিগ্রি নেওয়া কিংবা টিচার ট্রেইনিং সম্পন্ন করা। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক কিছু শর্তাবলিও পূরণ করতে হয়। যেমন নির্দিষ্ট কয়েকটি পরীক্ষায় পাস করা, টিচিং সার্টিফিকেট অর্জন করা, নির্দিষ্ট বয়স থাকা ইত্যাদি। আমাদের দেশে এনটিআরসিএ- কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগের পূর্বে যেভাবে শিক্ষক নিয়োগ হতো তাতে যে কেউ শিক্ষক হতে পারতেন সেই বিষয়টি শ্রীলঙ্কায় নেই এবং ছিল না।

শ্রীলঙ্কায় শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬০ বছর, তবে ইচ্ছে করলে ৫৫ থেকে ৬০ এর মধ্যেও তারা অবসরে যেতে পারেন। অবসরে যাওয়ার পর প্রাইভেট স্কুলে তারা আবার শিক্ষকতা শুরু করতে পারেন। মানসম্পন্ন শিক্ষক ও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের চাহিদা শ্রীলঙ্কা প্রচুর। আর তাই এটি স্বীকৃত, অবসরের পর তারা পুনরায় যেকোনো বেসরাকরি বিদ্যালয়ে চাকরি করতে পারেন। ইংরেজি শিক্ষক, বিজ্ঞান শিক্ষক, গণিত শিক্ষক ও আইসিটি শিক্ষকদের প্রচুর চাহিদা ও মূল্য রয়েছে শ্রীলঙ্কায় যেমনটি আমাদের দেশেও দেখা যায়। একজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষককে একাধিক স্কুলে কাজ করতে হয় কারণ বিষয় বিশেষজ্ঞ শিক্ষক সব স্কুলে থাকে না। এটি একটি চমৎকার সিস্টেম। একজন বিষয় বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের সার্ভিস বহু শিক্ষার্থী পেয়ে থাকেন, ওই শিক্ষকেরও ভালো লাগে কারণ হচ্ছে তার কাজের, পরিচিতির পরিধি হয় তখন বৃহত্তর। রাষ্ট্রীয় রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট অনুযায়ী খরচ কম হয়।

কোন দেশের শিক্ষকরাই গ্রাম ও পিছিয়ে পড়া এলাকায় যেতে চান না। শ্রীলঙ্কায়ও একই অবস্থা। গ্রামীণ এলাকায়, অনুন্নত এলাকায় শিক্ষকদের পোস্টিং দিলে তারা যাতে সেখানে যান এবং চাকরি ছেড়ে না দিয়ে শিক্ষকতায় থাকেন তাই শ্রীলঙ্কান সরকার ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে একটি পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছে। পিছিয়ে পড়া ও অনুন্নত এলাকার বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট এমনিতেই লেগে থাকে। তাই যেসব শিক্ষকদের ওইসব এলাকায় পোস্টিং দেওয়া হয় তাদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা সহজে লোন দেওয়া ও বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি শিক্ষকদের বাসস্থানের ব্যবস্থাও করা হয়, পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। যেমন- তাইওয়ানের ডাক্তার যারা গ্রামে চাকরি করেন তাদের বেতন দ্বিগুণ। এটি একটি চমৎকার পদ্ধতি।

অনেকের প্রশ্ন যে, শ্রীলঙ্কায় আমাদের দেশের মতো প্রাইভেট টিউশন আছে কি না। প্রচুর আছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ১৯৪৩ সাল থেকেই সেখানে প্রাইভেট টিউশনি চলে এসেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই টিউশনির হার শহরের চেয়ে গ্রাম এলাকায় বেশি। তার একটি কারণ হচ্ছে গ্রামীণ এলাকায় মানসম্মত শিক্ষক পাওয়া যায় কম। তাই শিক্ষার্থীদের ঘাটতি মেটানোর জন্য তাদের প্রাইভেট পড়তে হয়। আমি দেখেছি গ্রামে সন্ধ্যার পরও শিক্ষার্থীরা নিজেরা কিংবা বাবা-মার সঙ্গে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে বাসায় ফিরছে। প্রাইভেটের আর একটি কারণ হচ্ছে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রচুর পড়তে হয়। আর আমাদের এসএসসি ও এইচএসসির মতো তাদের ‘ও’ লেভেল ও ‘এ’ লেভেল নামক পাবলিক পরীক্ষায় ভালো করার জন্যও প্রচুর প্রাইভেট পড়তে হয়। সবশেষ কারণটি হচ্ছে শিক্ষকরা বাড়তি ইনকামের জন্য প্রাইভেট পড়িয়ে থাকেন এবং এটি একটি ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে। এটি স্বীকৃত। রাষ্ট্র পরিচালিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তারা তাদের বেতনভাতা নিয়ে খুশি। তাদের অনেক বেশি (দ্বিগুণ এমনকি তিনগুণ বেতনে) বেসরকারি বিদ্যালযে নিতে চায় কিন্তু তারা সেখানে অনেকে যান না তার একটি কারণ হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালিত বিদ্যালয়ের পেনশন সুবিধা। আমাদের দেশের মতো এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) সিস্টেম সেখানে নেই। এটি আমাদের দেশের বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য একটি অস্থায়ী পদ্ধতি যেটি সামরিক শাসকরা করে গিয়েছিলেন কুইক সমাধানের জন্য। এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয় অথচ এটিকেই আমরা স্থায়ী ব্যবস্থা ধরে নিয়েছি। কোনো শিক্ষক সংগঠন কিংবা আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এই অস্থায়ী পদ্ধতিটি নিয়ে তেমন কিছু বলছে না যা রহস্যজনক মনে হয়। বিএনপি আমলে একজন শিক্ষামন্ত্রী গর্ব করে বলেছিলেন, বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য যে চমৎকার পদ্ধতি আমাদের দেশে বিদ্যমান পৃথিবীর কোনো দেশে তা নেই। অস্থায়ী পদ্ধতি অন্য দেশে থাকবে কেন?

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক


banner close