রোববার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

পরিবেশ দিবস আনুষ্ঠানিকতায় আছে কাজে নেই

নাসির আহমেদ
প্রকাশিত
নাসির আহমেদ
প্রকাশিত : ৬ জুন, ২০২৩ ০৯:২৬

নানা আনুষ্ঠানিকতায় বিশ্বব্যাপী পালিত হলো বিশ্ব পরিবেশ দিবস। বাংলাদেশও যথারীতি পালন করল দিনটি। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সলিউশন অব প্লাস্টিক পলিউশন’। যার অর্থ হচ্ছে ‘অপচনশীল দ্রব্যের সমাধান’। এই প্রতিপাদ্য নিয়েই দিনটি উদযাপিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী নানা আয়োজনে। আমাদের দেশেও এই দিনে নানা রকম আনুষ্ঠানিকতা এবং কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন আমাদের সমাজে ঘটবে- এমন আশা করা কঠিন।

আমাদের দেশে প্লাস্টিকজাত পলিথিন ব্যাগ অনেক বছর আগে নিষিদ্ধ করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি কোথাও। প্রতিদিন হাটবাজারে, বিপণিবিতান থেকে শুরু করে সব দোকানে ব্যবহার করা হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ, যা সম্পূর্ণ অপচনশীল এবং আমাদের মাটি এবং জলাধারের জন্য ভয়াবহ বিপদ বয়ে আনছে প্রতিনিয়ত।

আমাদের শহর-নগরের ড্রেনেজব্যবস্থার যে বিপর্যয়, তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অপচনশীল বর্জ্য। এসব বর্জ্য ড্রেনগুলোতে আটকে থাকার কারণে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও স্বাভাবিক গতি হারাচ্ছে।

রাজধানী ঢাকার কথাই ধরা যাক, এখানে বর্ষা মৌসুমে যে জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়, তার অন্যতম কারণ পলিথিনসহ অপচনশীল প্লাস্টিকবর্জ্য ড্রেন লাইনে আটকে যাওয়া। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে অল্প বৃষ্টিতেও রাজধানী ঢাকায় রাজপথ, অলিগলি ডুবে যায় ড্রেনের উপচে পড়া পানিতে। কারণ আমাদের সুয়্যারেজ লাইন ময়লা আবর্জনা স্বাভাবিক গতিতে বহন করে নিয়ে যেতে পারে না এসব অপচনশীল বর্জ্যের কারণে। গ্রামের খাল নদী এমনকি পুকুর পর্যন্ত ভরাট হয়ে যাচ্ছে এসব অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে। চাষের জমিও উর্বরতা হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত। পরিবেশ কতটা বিপন্ন হচ্ছে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আমাদের সারা দেশের নদ-নদী। রাজধানীর কেন্দ্রে অবস্থিত বুড়িগঙ্গা নদীত প্লাস্টিকবর্জ্যে ভয়ংকরভাবে দূষিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কলকারখানা থেকে নির্গত দূষিত আবর্জনার বর্জ্য। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যাসহ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী সব নদী ভরাট হয়ে গেছে গত তিন দশকে। ভরাট না বলে নদীগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে বললে বেশি বলা হবে না।

প্লাস্টিকবর্জ্যের এই বিপণ্নতার মধ্যে বলতে গেলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বলতে হবে আমাদের ক্রমাগত সবুজহীনতার দিকে চলে যাওয়াকে। উজাড় হয়ে যাচ্ছে দেশের সব বনভূমি।

শুধু বনভূমি নয়, সারা বাংলার লোকালয়ে গাছপালা কেটে সব জনপদ আমরা বৃক্ষহীন করে ফেলছি দিনের পর দিন। ফলে নদ-নদীসহ আমাদের চারপাশের পরিবেশই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। জলবায়ুর এই বিপর্যয়ে তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে জলবায়ুর ভারসাম্যই হারিয়ে ফেলেছি আমরা।

এই বাস্তবতার মধ্যে আমরা পালন করেছি আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব বিশ্ব পরিবেশ দিবস। বিশ্বের কথা যদি বলি মাশুল হাড়ে হাড়ে গুনতে হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বকে। অথচ ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে তারা চরম উদাসীন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো বিশ্ব জলবায়ু তহবিলে অর্থদানে এতটাই বিমুখ হয়েছিলেন যে, বিশ্ব পরিবেশ প্ল্যাটফর্ম থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারই করে নিয়েছিলেন। সারা পৃথিবী অবাক হয়েছিল তার ওই অমানবিক সিদ্ধান্তে। যদিও বাইডেন প্রশাসন এসে সেই অবস্থানে পরিবর্তন এনেছে। জলবায়ু তহবিলে অর্থ দিতে সম্মত হয়েছে বাইডেন সরকার।

বিশ্ব জলবায়ুর প্রসঙ্গ যখন এল, তখন সগর্বেই আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। বিশ্ব পরিবেশ উন্নয়নে নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার পরও বলতে হবে যে, মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে। কিন্তু সেই লক্ষ্য নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে সবাই গুরুত্ব দিয়ে ভাবেন বলে মনে হয় না। যদিও আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশবিষয়ক একাধিক আন্তর্জাতিক ফোরামে নেতৃত্ব দিয়ে পরিবেশের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিলেন। যেমন কানকুন সম্মেলনসহ বিভিন্ন ফোরামে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন তিনি গড়ে তুলেছেন। জলবায়ুর ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ দানে বিশ্বের পরিবেশ ও জলবায়ুর ভারসাম্য নষ্টকারী ধনী দেশগুলোকে চাপ প্রয়োগ করতে তিনি বিশ্বজনমত ব্যাপকভাবে গঠন করতে সক্ষম হয়েছেন।

যারা জ্বালানিজাত কার্বন ছড়িয়ে তেল-গ্যাস পুড়িয়ে নিজেদের ভোগবাদী জীবনযাপনে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন আমাদের মতো দেশগুলোকে তারা কেন ক্ষতিপূরণ দেবেন না? এই যৌক্তিক আন্দোলন দেশে-বিদেশে সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে, প্রশংসিত হয়েছেন আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।

এই সাফল্যের কথা মনে রেখেও যদি আমরা নিজের দেশের দিকে তাকাই তাহলে হতাশ হই। এই লেখার শুরুতেই যে উদাসীনতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলাম

সেদিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা আবহাওয়া-জলবায়ুর প্রতিনিয়ত যেভাবে ধ্বংস করে চলেছি, আমাদের এই আত্মঘাতী প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন। নীতিকথায় কাজ না হলে কঠোরভাবে পরিবেশ রক্ষায় সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় কোনো সরকারই কঠোরভাবে পরিবেশ সংরক্ষণে বাধ্যবাধকতায় যাচ্ছে না।

গত দেড়-দুই দশকে একের পর এক জলোচ্ছ্বাস, বন্যার তাণ্ডবে বারবার ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ। কারণ জলবায়ুর স্বাভাবিকতা বিঘ্নিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন দায়ী। কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস-অক্সাইড, মিথেন, সিএফসি, জলীয়বাষ্প বিভিন্ন গ্যাস নির্গমনের ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।

এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত এ বছরের ভয়াবহ তাপমাত্রার বিপর্যয়। এবার যে দুঃসহ দাবদাহে দগ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশ, তা অতীতে আমরা কখনো দেখিনি। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল বলে পরিচিত এই বাংলাদেশে গ্রীষ্ম মৌসুমে তাপমাত্রা ৪২-৪৩ ডিগ্রিতে পৌঁছাবে, এ কথা কেউ কখনো কল্পনাও করেননি। অথচ সেই অকল্পনীয় দাবদাহে দগ্ধ হতে হচ্ছে আমাদের। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের এশীয় অঞ্চলের দেশগুলো জলবায়ু বিপর্যয়ের চরম শিকার। বাংলাদেশ বলা যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনপদ। জলবায়ু পরিবর্তনের এই অস্বাভাবিক বাস্তবতার কারণেই বাংলাদেশের ঋতুচক্র ওলট-পালট হয়ে গেছে। শীত এবং বর্ষা সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। অতিবর্ষণ আর অনাবৃষ্টি কৃষিক্ষেত্রে বিপুল ক্ষতিসাধন করে চলেছে। নদীর নাব্য হারানো, লবণাক্ততাসহ নানা বিপর্যয় আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

ধরা যাক বৃক্ষনিধনের কথাই। আমাদের দেশে একসময় বিশাল বনভূমি ছিল। দিনের পর দিন বন বিভাগের রাঘববোয়ালরা এই বনভূমি ধ্বংসের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে। আঙুল ফুলে তারা কলাগাছ হয়েছে। বনখেকো রাঘববোয়ালদের বাড়ি থেকে বস্তায় বস্তায় টাকা ধরা পড়েছে। একজন জনসমক্ষে এভাবে উন্মোচিত হয়েছে। কিন্তু এরকম শতজনকে খুঁজে পাওয়া যাবে যারা পরিবেশ বিপন্ন করে নিজেদের আখের গুছিয়েছে বছরের পর বছর ধরে। এই রক্ষকদের ভক্ষক ভূমিকার কারণেই আমাদের বনভূমি উজাড় করেছে অন্যান্য সেক্টর থেকে আসা ভূমিদখলকারী, অরণ্য লুটপাটকারী সন্ত্রাসীরা। লুটেরারাদের লালসার গ্রাসে চলে গেছে আমাদের সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ। পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে সংগত কারণেই বাংলাদেশ আজ এক বিপন্ন জনপদ।

বনভূমির কথা বাদ দিয়ে আমরা যদি গ্রামবাংলার দিকে তাকাই, তাতেও দেখব গ্রামবাংলায় যেটুকু বাগান ছিল মানুষের ঘরবাড়ির চারপাশে, দিন দিন তা-ও শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাগান কেটে, আবাদি ফসলের মাঠ কিনে নিয়ে, খাল ভরাট করে তৈরি হচ্ছে ঘরবাড়ি। উপশহরেও এখন তৈরি হচ্ছে বহুতল ভবন। সবকিছুর কেন্দ্রে কাজ করছে অর্থলিপ্সা আর অধিক মুনাফা। দেশের পরিবেশ এবং সবুজ রক্ষার জন্য যদি সুদূরপ্রসারী চিন্তা করা হয়, তা হলে কঠিন হতে হবে সরকারকে। আইন প্রয়োগ করতে হবে।

যে রাজধানীতে বড়জোর ৩০-৪০ লাখ মানুষ বাস করার কথা, সেখানে এখন বাস করছে দুই কোটির বেশি মানুষ! ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই আজ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। অথচ দেশের যোগাযোগ ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ঢাকার চারপাশে ট্রেন যোগাযোগসহ নানামুখী সড়কব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে। অথচ রাজধানীর জনচাপ কমছে না তাতে। কমছে না বলা যাবে না, কমাতেই হবে। সে জন্য সুদূরপ্রসারী কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে এবং সরকারকেই তা করতে হবে। পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে হলে আইনের কঠোর বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

নগরীর প্রতিটি বাড়ির ছাদে এবং বাড়ির চারপাশে যেটুকু খালি জায়গা আছে সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে বাগান করতে হবে। এই বিধান যদি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জারি করে এবং কঠোরভাবে তা মনিটর করে, তা হলে সবুজ হারানো এই নগরী আবার তার সবুজ ফিরে পেতে পারে।

একই কথা বলা যায় গ্রামবাংলার ক্ষেত্রেও। প্রয়োজনে গাছপালা কাটা হবে। কিন্তু প্রতিটি গ্রামে যদি গাছ কাটার সঙ্গে সঙ্গে একটি গাছ কাটলে দুটি লাগিয়ে দেয়ার বিধান স্থানীয় প্রশাসন ও গ্রাম-প্রশাসন কার্যকর করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ প্রকৃতির এই বিপর্যস্ত বাস্তবতায় কিছুটা হলেও আবার স্বাভাবিকতা ফিরে পাবে। প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযানের মাধ্যমে করা হয়। কিন্তু তার প্রকৃত সুফল ফলে না। গাছ লাগানো এবং বাড়ির চারপাশ সবুজে ভরে তোলার বিষয়টি সামাজিক আন্দোলনে রূপদান করতে হবে। প্রাকৃতিক সবুজ সুরক্ষার পাশাপাশি আমাদের নদ-নদী এবং প্রাকৃতিক জলাধারগুলো রক্ষার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। নদ-নদী, খালবিলসহ জলাধারগুলো রক্ষায় জনসচেতনতার পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব রকম রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে সরকার এবং প্রশাসনকেই জলাধার রক্ষার কাজটি কঠোর হাতে বাস্তবায়ন করতে হবে।

লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক।


মানব পাচার রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা ও আইনের কঠোর প্রয়োগ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

সাধারণত জোরপূর্বক শ্রম, যৌন দাসত্ব অথবা পাচারকৃত মানুষদের ব্যবসায়িক যৌনশোষণমূলক কাজে নিয়োজিত করার জন্য সংঘটিত অবৈধ মানব বাণিজ্যকে মানব পাচার বলে। মানব পাচার একটি দেশের অভ্যন্তরে বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে সংঘটিত হতে পারে। তবে মানব পাচার যেখানে এবং যেভাবেই সংঘটিত হোক না কেন, তা বড় ধরনের অপরাধ। মানব পাচার আইন-২০১২ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির অধিকার হরণ করে জবরদস্তিমূলক শ্রম আদায়, দাসত্বমূলক আচরণ, পতিতাবৃত্তি বা যৌন শোষণ বা নিপীড়নের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে শোষণ বা নিপীড়ন করা হলে তা মানব পাচার হিসেবে গণ্য হবে। আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী, মানব পাচার হচ্ছে মানুষের অধিকারের লঙ্ঘন। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে, যা দুঃখজনক। অভাবের তাড়নায় কিংবা অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে অথবা উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশ থেকে নারী-পুরুষ মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় প্রতিনিয়ত পাচারের শিকার হচ্ছেন। উন্নত জীবন আর ভালো চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পাচার করার পর শেষ পর্যন্ত তাদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। অর্থলোভী, অসৎ ব্যক্তি এবং দালালদের খপ্পরে পড়ে এভাবেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে অনেক মানুষের জীবন। সম্প্রতি ঢাকা ও চুয়াডাঙ্গায় অভিযান চালিয়ে মানব পাচার চক্রের প্রধানসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। সেই সঙ্গে উদ্ধার করা হয় পাচার হতে যাওয়া ২৩ নারীকে। বিদেশে চাকরিসহ নানা প্রলোভনে তাদের পাচার করা হচ্ছিল। গত বছরের ২৭ মে লিবিয়ায় ৩০ জন অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে ২৬ জনই বাংলাদেশের নাগরিক এবং তাদের অধিকাংশই ছিল মানব পাচারের শিকার। ২০১৫ সালের ১ মে থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্যে পাওয়া গিয়েছিল গণকবর। তারপর মালয়েশিয়াতেও পাওয়া যায় গণকবর। আর ওই সব গণকবরে পাওয়া যায় অনেক বাংলাদেশির মরদেহ, যারা অধিকাংশই মানব পাচারের শিকার। ওই বছর ওই দুটি দেশ আর ইন্দোনেশিয়া থেকে মানব পাচারকারীদের নির্যাতনের শিকার ১৭৫ জনকে দেশে ফিরে আনা হয়। এর পরও থেমে নেই মানব পাচার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানব পাচারকারীরা ইউরোপে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দেশের মানুষকে লিবিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে। শীত মৌসুমে সাগর শান্ত থাকায় এ সময় মানব পাচারকারীদের অপতৎপরতা বেড়ে যায়। বর্তমানে মানব পাচারকারীদের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মিয়ানমার থেকে নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। পাচারকারীরা রোহিঙ্গা পুরুষদের চাকরি ও মেয়েদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে পাচারের চেষ্টা করে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলা থেকেই পাচার হয়েছে এক লাখের বেশি লোক। পরবর্তী সময়ে মেয়েদের বিক্রি করে দেয়া হয় যৌনপল্লিতে, আর শিশুদের নিযুক্ত করা হয়েছে অবৈধ ও জবরদস্তি শ্রমে। এমনও দেখা গেছে, ইউরোপে যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে নির্যাতনের কারণে এবং খাদ্যের অভাবে সাগরেই মর্মান্তিকভাবে মারা গেছে। আর এভাবেই উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন ভেসে যায় সাগরে, কখনোবা সেই স্বপ্নের কবর রচিত হয় গহিন বনে অথবা গণকবরে কিংবা পতিতাপল্লিতে।

বাস্তবতা হচ্ছে, মানব পাচারসংক্রান্ত ঘটনায় অনেক মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত এসব মামলার তদন্ত এবং বিচার এগোয় না। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১২ সালে দেশে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হওয়ার পর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মানব পাচারসংক্রান্ত প্রায় ছয় হাজার মামলা করা হয়। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয় ৯ হাজার ৬৯২ জন। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এসব মামলায় সাজা হয় মাত্র ৫৪ জনের। আর মানব পাচারসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির হার খুব-ই কম। মূলত পাচারের শিকার অধিকাংশ পরিবারগুলো সমস্যা আর ভোগান্তির মধ্য দিয়ে দিন যাপন করে। মানব পাচারকারী ও দালালরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিনেমার ‘দাদাভাই’-এর মতো পর্দার অন্তরালে থাকে। ফলে মানব পাচার বন্ধ হয় না। অনেক সময় মানব পাচারসংক্রান্ত মামলার তদন্তে ঘাটতি থাকায় আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। বলাবাহুল্য, আইনের প্রকৃত শাসন থাকলে এত মানুষ পাচারের শিকার হতো না। এটা বন্ধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার প্রয়োজন। বর্তমানে মানব পাচারের সবচেয়ে বড় রুট হচ্ছে কক্সবাজার। এখানে মানব পাচারের মামলা হয়েছে ৬৩৭টি। কিন্তু নিষ্পত্তি হয়েছে দু-একটি। অর্ধেক মামলা তদন্তাধীন রয়েছে আর খারিজ হয়ে গেছে ১৬টি মামলা। ইতিপূর্বে দেশে মানব পাচারবিষয়ক কোনো সুনির্দিষ্ট আইন ছিল না। তখন দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মানব পাচারসংক্রান্ত অপরাধের বিচার করা হতো। সর্বশেষ ২০১২ সালে ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২’ নামক আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ৬ ধারায় মানব পাচার নিষিদ্ধ করে এর জন্য অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। আইনটির ৭ ধারায় সংঘবদ্ধ মানব পাচার অপরাধের দণ্ড মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কমপক্ষে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এ আইনের অধীনে কৃত অপরাধগুলো আমলযোগ্য এবং তা আপস ও জামিনের অযোগ্য অপরাধ।

মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হওয়ার পর গত ৯ বছরে এ-সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ৫ হাজার ৭১৬টি। এ পর্যন্ত মাত্র ২৪৭টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। অর্থাৎ মামলা নিষ্পত্তির হার মাত্র ৪ শতাংশ। অনেক বিচার এখনো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেই হচ্ছে। মানব পাচারসংক্রান্ত মামলা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকার পেছনে এটিও একটি কারণ। আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, মানব পাচার মামলায় আদালতে পুলিশ কর্তৃক সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হওয়া। মানব পাচার মামলায় সাধারণত নিয়মিতভাবে সাক্ষী পাওয়া যায় না। ভুক্তভোগীরা সহায়তা না করলে শেষ পর্যন্ত মামলা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে সবচেয়ে বড় কথা, মানব পাচার রোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ ঘটানো হলে, সরকারিভাবে দেশে বিভিন্ন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে এবং জনগণ কর্তৃক দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার মানসিকতা পরিহার করলে মানব পাচারের সংখ্যা নিঃসন্দেহে কমে আসবে। যেহেতু দেশে মানব পাচারের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে, তাই মানব পাচার রোধে এখন আইনের কঠোর প্রয়োগের বিকল্প নেই। পাশাপাশি মানব পাচার রোধে গণমাধ্যমসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অধিকতর তৎপর হতে হবে। অন্যথায় মানব পাচার বন্ধ হবে না এবং মানব পাচারকারীরাও শাস্তি পাবে না।

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; ভিজিটিং প্রফেসর, চণ্ডীগড় ইউনিভার্সিটি (ভারত) এবং লাইসিয়াম অব দ্য ফিলিপিন্স ইউনিভার্সিটি, ফিলিপাইন


অসংক্রামক ব্যাধি: প্রতিরোধের বিকল্প নেই

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

সারাবিশ্বে অসংক্রামক ব্যাধি নীরব ঘাতকের মতো ধেয়ে আসছে এবং আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। অসংক্রামক ব্যাধি এখন মানব জাতির বেঁচে থাকার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে কলেরা, ডায়রিয়া, বসন্ত, যক্ষ্মা, হামের মতো বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি সহজেই চিকিৎসায় নিরাময় হচ্ছে এবং প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপদ পানি, খাদ্য সরবরাহ, রোগ নির্ণয়ে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা পদ্ধতি, কার্যকরী টিকা কর্মসূচি, সর্বোপরি মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংক্রামক ব্যাধি কমছে এবং মানুষের গড় আয়ুও বাড়ছে।

অসংক্রামক ব্যাধি কোনো জীবাণুর মাধ্যমে হয় না এবং একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায় না, অর্থাৎ ছোঁয়াচে না। প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে ছড়ায় না। অসংক্রামক ব্যাধি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন বয়সজনিত কারণে বার্ধক্যজনিত রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, অস্টিওপরোসিস, অস্টিওআর্থাইসিস, উচ্চরক্তচাপ, ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের প্রদাহ এবং মানসিক রোগ। এ ধরনের রোগের প্রকোপ মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, হয়ে উঠছে বড় ঘাতক। ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মানুষের পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনীতির ওপর প্রভাব ও চাপ পড়তে শুরু হয়েছে। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্মেলনে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, যেভাবে অসংক্রামক ব্যাধি বেড়ে চলছে তাতে অর্থনীতির ওপর বিরাট প্রভাব পড়ছে। এর মূল কারণ এ ধরনের রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। গরিব বা নিম্নবিত্ত, এমনকি অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষেও এ রোগের চিকিৎসার ব্যয় বহন করা অসম্ভব। এর আরেকটি অন্যতম কারণ হলো এ ধরনের রোগে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চালাতে হয়।

এ ধরনের ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে তাদের পূর্ব পুরুষের রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে। পারিবারিক বা জিনগত (জেনেটিক) ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে যোগ হয় পরিবেশগত উপাদান, যেমন পরিবেশ দূষণ, অস্বাস্থ্যকর ও বাজে খাদ্যাভ্যাস, কায়িক শ্রমের অভাব, ধূমপান, মানসিক চাপ ইত্যাদি। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমান সময়ে অনেক কম বয়সেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, সারা পৃথিবীজুড়ে অনেকেই কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে এবং চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। সময়মতো সচেতন হলে বংশ পরম্পরায় থাকা এসব রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সংক্রামক ব্যাধির চেয়ে অসংক্রামক ব্যাধির ব্যাপকতা অনেক বেড়ে গেছে এবং বর্তমানে বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৬৫ ভাগের জন্য দায়ী। পূর্বে ধারণা করা হতো, অসংক্রামক ব্যাধি শুধু ধনী দেশে বসবাসকারীদের এবং বয়স্ক লোকের হয়। প্রকৃতপক্ষে এ রোগে আক্রান্তদের অর্ধেকই কম বয়সী এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এ ধরনের ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ দেশে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ৬৫ ভাগ অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত। হাসপাতালে ভর্তির রোগীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে অসংক্রামক ব্যাধি। মৃত্যুর প্রধান দশটি কারণের মধ্যে অধিকাংশই এসব ব্যাধির জন্য দায়ী, যেমন- কিডনি, ফুসফুস ও লিভার প্রদাহ, হৃদরোগ, ক্যানসার, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, সি.ও.পি.ডি বা শ্বাসকষ্টজনিত রোগ ইত্যাদি।

অসংক্রামক ব্যাধির কারণ
মানুষের জীবনযাত্রার মান, সামাজিক অস্থিরতা, খাদ্যাভ্যাস, যান্ত্রিক জীবন সবকিছু মিলিয়েই অসংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির জন্য দায়ী। আর্থিক অসচ্ছলতা, অশিক্ষা এবং চিকিৎসার অপ্রতুলতা এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলছে।
আরও কিছু কারণ যেমন:

* কায়িক শ্রম ও হাঁটাচলা বা ব্যায়াম না করা। ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে।

* অলস জীবনযাপন করা, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া। অধিক ওজন সম্পন্ন লোকদের উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ কোলেস্টোরেলও বেড়ে যেতে পারে।

* খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, শাক-সবজি, ফল-মূল কম খাওয়া, অধিক ক্যালরিসমৃদ্ধ ও অধিক চর্বি-শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস, ফাস্টফুডে আসক্তি, চিনি ও মিষ্টি জাতীয় এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকলেট, আইসক্রিম, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমলপানীয় গ্রহণ।

* ধূমপান, তামাকপাতা, জর্দা, গুল লাগানো, মাদক সেবন।

* অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, এর ফলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে।

* খাদ্যে কেমিক্যাল ও ভেজাল।

* খেলার মাঠের অভাব, বিদ্যালয়ে শরীরচর্চা বা খেলাধুলার সংস্কৃতির বিলোপ।

* মোবাইল, ইউটিউব, টিকটক, ইন্টারনেট, টেলিভিশন, কম্পিউটার গেম ও ফেসবুকের অপব্যবহার। এগুলো ব্যবহারে বাচ্চাসহ যেকোনো বয়সের মানুষের অলস জীবন-যাপনের প্রবণতা বাড়ছে।

* গাড়ি-লিফট-চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহারের প্রবণতা।

* বায়ুদূষণ। ফলে শ্বাসজনিত রোগ, যেমন হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইছিমা বা সিওপিডি, এমনকি জন্মগত ত্রুটি, ক্যান্সার ও হৃদরোগ বেড়ে যাচ্ছে।

* অতিরিক্ত টেনশন, মানসিক চাপ, অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভয়ভীতি, এসবগুলো রক্তচাপ বাড়াতে পারে।

* মানুষের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। শারীরিকভাবে অসুস্থতাবোধ না করলে কেউ চিকিৎসকের কাছে যায় না এবং নিয়মিত চেকআপ করায় না। এ কারণেই অসংক্রামক ব্যাধি মানুষের ওপর ভর করছে।


কীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে
এসব ব্যাধির চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল এবং অনিরাময়যোগ্য হয়ে থাকে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিকার-প্রতিরোধ করার বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

* আমাদের সামাজিক জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কম চর্বি ও কম কোলেস্টোরেলযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকলেট, আইসক্রিম, চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন শরবত, গ্লুকোজ, পায়েস ইত্যাদি পরিহার বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

* লবণ নিয়ন্ত্রণ: তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে।

* কায়িক শ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত হাঁটাচলা, হাটে বাজারে কোথাও গেলে অল্প দূরত্বে রিকশা বা গাড়ি ব্যবহার না করা, অল্প কয়েক তলার জন্য লিফট ব্যবহার না করা। সম্ভব হলে সাঁতার বা জগিং করা, ব্যয়ামাগারে গিয়ে ব্যায়াম করা।

* অতিরিক্ত মোবাইল, ইউটিউব, ফেসবুক, টেলিভিশন আর কম্পিউটার ব্যবহারের প্রবণতা কমাতে হবে।

* যারা বয়স্ক বা অবসরপ্রাপ্ত তারাও নিয়মিত হাঁটাচলা করতে পারেন। এর সঙ্গে বাগান করা এবং পরিচর্যা করতে পারেন।

* নগরবাসীর জন্য ব্যায়াম ও হাঁটার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা।

* বাড়তি ওজন কমাতে হবে। এর জন্য খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করতে হবে।

* ধূমপান, মদ্যপান, মাদকদ্রব্য, তামাকপাতা ও জর্দা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

* বায়ুদূষণের কারণগুলো চিহ্নিত করে এগুলো প্রতিরোধে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে। সবুজায়ন বৃদ্ধির জন্য প্রচুর গাছপালা লাগাতে হবে।

* মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে। নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, নিজের শখের কাজ করা, নিজ ধর্মের চর্চা করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি বেশি হবে।

* শিক্ষা ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা, পাঠ্যপুস্তকে এ সম্পর্কে অন্তর্ভুক্তি করা, মিডিয়ার ব্যবহার, শিক্ষক, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং সামাজিক নেতাদের প্রশিক্ষণ, সমাজকর্মীদের সচেতন করে তোলা, সচেতনতা ক্যাম্প ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

* নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া, নিয়মিত ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি পরীক্ষা করা জরুরি। এমনকি বয়স ৪০ পার হলে প্রতি বছর মেডিকেল চেকআপ করা উচিত।

আমাদের স্বাস্থ্য খাতে সফলতা আছে, সীমাবদ্ধতাও আছে। অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে আমাদের সঠিক পরিকল্পনা করে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে, কারণ এসব ব্যাধি আজ মারাত্মক জনস্বাস্থ্যের সমস্যা, যেগুলো কখনো নির্মূল করা যাবে না। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। রোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের ব্যাপারে বেশি যত্নবান হতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যেহেতু একবার আক্রান্ত হলে এ ধরনের ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না, তাই সচেতনতা ছাড়া প্রতিরোধের বিকল্প নেই।

উপসংহার
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার এবং অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সংক্রামক রোগ-ব্যাধি সম্বন্ধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। পাশাপাশি এ সমস্ত রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি সাধনে আমরা ইতোমধ্যে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করেছি এবং এ ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে এখন হার্টের সার্জারিসহ উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। মানসম্পন্ন নিউরোসার্জিক্যাল চিকিৎসা এবং সার্জারিও বাংলাদেশে এখন পাওয়া যাচ্ছে। অচিরেই বিভিন্ন সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় এ দেশে উল্লেখযোগ্য আরো উন্নতি হবে বলে আমি আশা করি।

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক


দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ : স্বাস্থ্যসেবায় বৈশ্বিক রোলমডেল

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রধানমন্ত্রীর দশটি অসাধারণ উদ্যোগের অন্যতম একটি কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। সমগ্র বিশ্বের স্বাস্থ্যসেবার জন্য এটি যে একটি অনন্য সাধারণ মডেল ও উদ্যোগ তা জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। ‘কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা: সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা অর্জনের লক্ষ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি’ শিরোনামে জাতিসংঘে উত্থাপিত ঐতিহাসিক রেজ্যুলেশনটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক মডেল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ কর্তৃক প্রস্তাবিত রেজ্যুলেশনটিতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল উদ্ভাবনী উদ্যোগের ব্যাপক স্বীকৃতি দিয়ে এই উদ্যোগকে ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে উল্লেখ করে। ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’কে আরও একবার সম্মানে ভূষিত করল যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়ারেন অ্যালপার্ট মেডিকেল স্কুল। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্যবিষয়ক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ওয়ারেন অ্যালপার্ট মেডিকেল স্কুল অব ব্রাউন ইউনিভার্সিটির মেডিসিন অ্যান্ড বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের ডিন মুকেশ কে জৈন দ্য লোটে এই উদ্যোগকে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, এটি কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার একটি সফল মডেল। এটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, কমিউনিটি সম্পৃক্ততা উন্নয়নের মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিধির জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি।

প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশজুড়ে স্থাপিত হয়েছে চৌদ্দ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক, যা গ্রামীণ সমাজের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এনেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। বাংলাদেশের সব মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে এই অনন্য কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যা সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের দোরগোড়ায় সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সুফল সরবরাহে বিপ্লব ঘটিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই বিপ্লব প্রচেষ্টায় অনুপ্রেরণা হিসেবে ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথ। প্রধানমন্ত্রী যে জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়নের জন্য বদ্ধপরিকর তা আরও একবার প্রমাণ করলেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই প্রতিটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে বঙ্গবন্ধু সরকার। তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে বিকেন্দ্রীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মাধ্যমে ধাপে ধাপে তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠনের পর কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প গ্রহণ করেন। গ্রামীণ প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে ক্লিনিক নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। প্রাথমিকভাবে সাড়ে ১৩ হাজার ক্লিনিক নির্মাণের কথা ভাবা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালের পর থেকে এই উদ্যোগ দ্রুত অগ্রসরমান হতে থাকে। ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতি ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করেন।

তবে ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগ ম্লান হতে শুরু করে। স্বাস্থ্য খাতে দলীয় রাজনীতির উদাহরণ হয়ে আছে কমিউনিটি ক্লিনিক। জোট সরকারের শাসনামলে এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সেখানে তখন দিনে গবাদিপশু চরানো হতো আর রাতে বসত মদ আর জুয়ার আসর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ দেশে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে আবারও রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব পেলে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। একে একে চালু করা হয় বিএনপির সময় বন্ধ করে দেয়া ক্লিনিকগুলো আর পাশাপাশি স্থাপন করা হয় আরো নতুন নতুন কমিউনিটি ক্লিনিক। ক্ষমতা গ্রহণের পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মস্তিষ্কপ্রসূত জনকল্যাণমুখী দুটি বিশেষ উদ্যোগ আশ্রয়ণ ও কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিশেষ উদ্যমী হয়ে ওঠেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য উন্নত বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন যা ইতোমধ্যেই শেখ হাসিনার মেধালব্ধ উদ্যোগ হিসেবে কপিরাইট স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার সর্বজনীন মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার উদ্যোগ হিসেবে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার মডেল আন্তর্জাতিকভাবে হলো সমাদৃত। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, আর তা বাস্তবায়ন করেছেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ’ নামের প্রকল্পের আওতায় ক্লিনিকগুলো মেরামত, নতুন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ এবং ওষুধ সরবরাহ করার মাধ্যমে ক্লিনিকগুলো চালু করা হয়েছিল। কমিউনিটি ক্লিনিক হচ্ছে সরকারের সর্বনিম্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো। তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুসারে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় অন্তঃসত্ত্বা নারী প্রসবপূর্ব (প্রতিষেধক টিকাদানসহ) এবং প্রসবপরবর্তী (নবজাতকের সেবাসহ) সেবা প্রদানকারী কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সময়মতো যক্ষ্মা রোগের প্রতিষেধক টিকাদান, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠ, কালা-জ্বর, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করছে। এছাড়া জ্বর, ব্যথা, কাটা/পোড়া, হাঁপানি, চর্মরোগ, ক্রিমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসাও প্রদান করা হচ্ছে। এখান থেকে স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টিসেবা দেয়া হয়। এখান থেকে বিনা মূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ পায় মানুষ। সেখানে রয়েছে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী, ইন্টারনেট সার্ভিস, ই-হেলথ, টেলিমেডিসিনসহ আনুষঙ্গিক সহায়তা। ক্লিনিকগুলো পরিচালনা করেন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার। এ পদে স্থানীয় নারী কর্মীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্রেও এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। প্রধানমন্ত্রীর আরও একটি বিশেষ উদ্যোগ ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ বাস্তবায়নের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করছে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।

বাড়ির কাছেই সহজে, বিনামূল্যে নির্ভরযোগ্য, আস্থাশীল সেবা পাওয়ার কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো গ্রামের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং পরিবারের হাসপাতাল হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ক্লিনিকে প্রতিবছর ১ লাখ ৭০ হাজার টাকারও বেশি ওষুধ বিনা মূল্যে দেয়া হচ্ছে। গত জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত ক্লিনিকগুলোতে মোট ভিজিট হয়েছে প্রায় সাড়ে সাত কোটিরও বেশি। ১০ কোটিরও বেশি মানুষ পেয়েছেন বিনা মূল্যের এই স্বাস্থ্যসেবা। প্রতিদিন প্রতিটি ক্লিনিকে ৭০-৮০ জনেরও বেশি ভিজিট করেন। এর ৮০ শতাংশ নারী ও শিশু। এ পর্যন্ত ৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রায় এক লাখ মায়ের নিরাপদ স্বাভাবিক ডেলিভারি হয়েছে। ৩ কোটি ৭০ লাখেরও বেশি রোগীকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে জরুরি ও জটিলতার কারণে উচ্চতর চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে স্বাস্থ্যসেবাকে ঘিরে সরকার গৃহীত উদ্যোগগুলো। করোনা মহামারিতে সর্বস্তরের জনগণের জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে বিনা মূল্যে করোনার টিকার ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ সরকার সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অন ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন’ প্রধানমন্ত্রীকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিসেবে ভূষিত করে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটের গবেষণায় স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ও মানসূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও আফগানিস্তানের ওপরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যুহার হ্রাস, শিশুমৃত্যুহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক আরও বলেছেন, ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ সব উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবার মান সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ মডেল হিসেবে কাজ করবে।

একসময় স্বাস্থ্য খাতে প্রায় সব সূচকে তলানিতে ছিল বাংলাদেশ। সেই দেশ এখন মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় টপকে গেছে ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ আরো বহু দেশকে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের এই ক্রমোন্নতি পুরো বিশ্বের কাছেই বিস্ময় হয়ে উঠেছে। ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ এখন যেন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য স্বাস্থ্য খাতকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি আদর্শ ‘ব্লুপ্রিন্ট’। কমিউনিটি ক্লিনিক দেশের সর্বিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ সরকার ভবিষ্যতে এ সেবা কার্যক্রম আরও আধুনিকায়নের জন্য প্রয়োজনীয় নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ আরো বাড়ছে। নিশ্চিত হচ্ছে প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার মৌলিক অধিকার।

লেখক: ট্রেজারার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


বাংলাদেশি পণ্যের বড় বাজার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রেজাউল করিম খোকন

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশি পণ্যের বড় বাজার। বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানির ৪৮ শতাংশের গন্তব্য ইইউভুক্ত ২৭ দেশ। বছরে রপ্তানির পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলার। তার বিপরীতে ইইউ থেকে আমদানি ৪০০ কোটি ডলারের কম। ফলে ইইউর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বেশ এগিয়ে বাংলাদেশ। ইইউতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ৯৩ শতাংশই তৈরি পোশাক। অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপির কল্যাণে গত দুই দশকে এই বাজারে পোশাকশিল্প শক্ত জায়গায় পৌঁছেছে।

২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল তালিকায় যুক্ত হলেও পরের তিন বছর সুবিধাটি থাকবে। তারপর ইইউতে শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস পেতে হবে। যদিও বর্তমান নিয়মনীতিতে তা সম্ভব নয়। এ জন্য ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের দেনদরবার চলছে। এমন প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব কণ্ঠভোটে গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারচর্চার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসরণের আহ্বান জানানো হয়েছে।

পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, মানবাধিকারকর্মী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাজের নিরাপদ ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য ইইউর অবাধ বাজার সুবিধা ‘এভরিথিং বাট আর্মসের’ (ইবিএ) পরিসর আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সনদ লঙ্ঘনের মাধ্যমে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মামলাটি একটি পশ্চাৎগামী পদক্ষেপ, যা উদ্বেগের। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা। প্রসঙ্গত, ইবিএ কর্মসূচির মাধ্যমে জিএসপি সুবিধা দেয়া হয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গৃহীত প্রস্তাব দুশ্চিন্তার। মনে রাখতে হবে, এটি বিচ্ছিন্নভাবে আসেনি। ইইউর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় এসব বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।

সেসবের ধারাবাহিকতায় এই প্রস্তাব এসেছে। ইইউ আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের বড় অংশীদার। তারা বড় বিনিয়োগকারী। ঋণ সহায়তাও দেয়। ইইউ বাংলাদেশি পণ্যের বড় বাজার (একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশি পণ্যের শীর্ষ আমদানিকারক হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র)। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইইউতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫২৩ কোটি ডলার। ছয় বছর আগে অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই বাজারে রপ্তানি ছিল ২ হাজার ১৩৩ কোটি ডলার। পরের বছর রপ্তানি ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তারপর করোনার কারণে রপ্তানি কমে আসে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এই বাজারে রপ্তানি ঘুরে দাঁড়ায়। ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির বাজারে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে মোট রপ্তানি ১৩ শতাংশ বা ৭০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় জার্মানিতে। তারপর স্পেনে ৩৬৮, ফ্রান্সে ৩২৯, পোল্যান্ডে ১৮৫, নেদারল্যান্ডসে ২০৯, ইতালিতে ২৩৯, ডেনমার্কে ১৩১ ও বেলজিয়ামে ৯৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।

বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্য হলেও ইইউ থেকে আমদানি তুলনামূলক কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের মোট পণ্য আমদানি ছিল ৭ হাজার ৫৬০ কোটি ডলারের। এই আমদানির ২৫ শতাংশ চীন থেকে এসেছে। দ্বিতীয় ভারত, ১৮ শতাংশ। আর ইইউ থেকে আমদানি ৫ শতাংশের কম। ইউরোপিয়ান কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে ইইউ বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ইউরোর আমদানির বিপরীতে রপ্তানি করেছে মাত্র ২২০ কোটি ইউরোর পণ্য। তখন ইইউর বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ১৩০ কোটি ইউরো। পরের বছর সেই ঘাটতি বেড়ে ১ হাজার ২৯০ কোটি ইউরোতে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২২ সালে বাণিজ্য ঘাটতি পৌঁছেছে ২ হাজার ২০ কোটি ইউরো। ইইউতে বাংলাদেশি পণ্যের মোট রপ্তানির মধ্যে ৯৩ শতাংশই হচ্ছে তৈরি পোশাক।

গত অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের পোশাক, যা মোট পোশাক রপ্তানির ৫০ শতাংশের বেশি। তৈরি পোশাক ছাড়াও এই বাজারে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুতা, বাইসাইকেল ইত্যাদি জিএসপি সুবিধার আওতায় পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি হয়। ইইউর দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১১৬ কোটি ডলার। তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বোচ্চ ৪১০ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছে। ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নেদারল্যান্ডস থেকে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে, ১২৬ কোটি ডলার। ২০২৯ সালের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাসের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তবে ২০২৪-৩৪ সালের জন্য জিএসপির নতুন নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে ইউরোপীয় কমিশন। সেটি ইইউ পার্লামেন্টে এখনো অনুমোদন হয়নি।

জিএসপি প্লাসের খসড়াটি হুবহু ইইউ পার্লামেন্টে অনুমোদিত হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এই সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শর্তেই আটকে যাবে। তখন প্রায় ১২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ইইউতে পোশাক রপ্তানি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র উভয় দেশের উচ্চপর্যায়ে সমঝোতার মাধ্যমেই সম্ভব। জিএসপি প্লাস না পেলে পোশাক রপ্তানির কী হবে? জিএসপি সুবিধা না থাকলে ইইউর বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ধস নামবে। কারণ, বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ১-২ শতাংশ দাম কমবেশির কারণে আমরা ক্রয়াদেশ হারাই। সেখানে জিএসপি সুবিধা না থাকলে শুল্কের কারণে তৈরি পোশাকের দাম ১০-১২ শতাংশ বেড়ে যাবে। এই বাড়তি দাম কেন দিতে চাইবে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ইইউর বাজারে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, উজবেকিস্তান, বলিভিয়াসহ আটটি দেশ জিএসপি প্লাস সুবিধা পায়।

আর বাংলাদেশসহ ৪৬টি স্বল্পোন্নত দেশ জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে। দেশের মোট রপ্তানি আয়ে সমজাতীয় পণ্যসহ তৈরি পোশাকের হিস্যা এখন ৮৬ শতাংশ। এ পণ্যগুলোর প্রধান বাজার ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। বাংলাদেশের পোশাকের বাজার হিসেবে ইইউর হিস্যা ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইইউ বাজারের গুরুত্ব প্রমাণ করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বেশ কিছু সুবিধায় ইইউতে পোশাক রপ্তানি আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এমনকি মাত্র সাত বছর অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যেই এটি ৬ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইইউতে ২ হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে।

ইইউ জোটে পোশাক রপ্তানি বাড়াতে একসঙ্গে এখন অনেক সম্ভাবনার দুয়ার বাংলাদেশের সামনে খোলা। যেমন ইইউভুক্ত দেশগুলোতে পোশাকের চাহিদা গড়ে ৩ শতাংশ হারে বাড়ছে। বর্তমান বাজার ২০০ বিলিয়ন ডলারের। বর্ধিত এ চাহিদায় বাংলাদেশের হিস্যা একরকম একচেটিয়া। কারণ জোটে চীনা আধিপত্য ক্রমে কমছে। মার্কিন বৈরিতা সূত্রে তাদের মিত্র ইইউর বাজারে চীনা পণ্য অনুৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রায় একই নিয়তি বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনামেরও। নিজস্ব নীতির কারণেও পোশাক বাণিজ্য থেকে সরে আসছে চীন। সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিসংখ্যান সে কথাই বলছে। গত ২০২২ পঞ্জিকা বছরে ইইউ জোটের দেশগুলোতে পরিমাণে বেশি পোশাক রপ্তানিতে প্রথমবারের মতো শীর্ষস্থান দখলে এনেছে বাংলাদেশ। বছরটিতে ১৩৩ কোটি কেজি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। চীন করেছে ১৩১ কোটি কেজি। পরিমাণের হিসাবে বাংলাদেশের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির হার চীনের প্রায় দ্বিগুণ। পরিমাণের হিসাবে আগের বছরের চেয়ে গত বছর রপ্তানি বেশি হয়েছে ২১ শতাংশ, চীনের যা ১২ শতাংশের কম। অর্থমূল্যে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে চীনের দ্বিগুণ হারে।

অর্থমূল্যে গত বছর বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ, যেখানে চীনের এ হার ১৭ শতাংশ। ইইউতে রপ্তানিতে সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিই সবচেয়ে বেশি। পোশাকের রপ্তানি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলা ভিয়েতনাম আরও বড় ব্যবধানে পিছিয়ে আছে। ইইউতে পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামের অবস্থান পঞ্চম। ইইউতে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের মজবুত ভিত্তির আরও একটি উদাহরণ হচ্ছে দরের হিসাব। সাম্প্রতিক সময়ে চীন-ভিয়েতনামের পোশাকের চেয়ে বাংলাদেশের পোশাকের দাম বেড়েছে বেশি হারে। আগের বছরের চেয়ে গত বছর ইইউতে বাংলাদেশের পোশাকের দাম বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। যেখানে চীনের পোশাকের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশের কিছু কম। ভিয়েতনামের বেড়েছে ৩ শতাংশের মতো। ওই বছর ইইউভুক্ত দেশগুলোতে পোশাকের দাম বেড়েছে গড়ে ৩ শতাংশ হারে। অর্থাৎ দেশের চেয়ে ইইউতে বাংলাদেশের পোশাকের দাম বেশি হারে বাড়ছে। ইইউর সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের প্রতিবেদন ঘেঁটে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশের মজবুত এ ভিত্তির পেছনে অন্যতম শক্তি পোশাকের পশ্চাৎসংযোগ শিল্প। বিশেষ করে নিট ক্যাটেগরির পোশাকই ইইউতে বেশি রপ্তানি হয়। নিটের সুতা ও কাপড়ের প্রায় শতভাগ স্থানীয়। পোশাক খাতের জন্য ইইউ শুধু বড় বাজারই নয়; একই সঙ্গে সুবিধাজনক বাজার। কারণ নিট পোশাক সাধারণত ওজনে কিছুটা ভারী হয়ে থাকে। এ কারণে ফ্রেইট কস্ট বা পরিবহন ব্যয় বেশি। সেদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা দীর্ঘ পথের অন্যান্য দেশে পরিবহন সাশ্রয়ী হয় না। তুলনামূলক কাছের হওয়ায় ইউরোপে রপ্তানি সুবিধাজনক। এ ছাড়া শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানিতে ইইউতে উৎস বিধির শর্ত অন্য যেকোনো বাজারের চেয়ে অনুকূল। যেকোনো দেশের কাঁচামাল এনে পোশাক রপ্তানি করা যায়। ইইউর মতো বড় বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার এখনো করতে পারেনি বাংলাদেশ। সম্ভাবনার অন্তত ৪০ শতাংশ এখনো অব্যবহৃত। রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য না থাকায় এত বড় বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগছে না।

২০৩০ সালের মধ্যে ইইউর বাজারে ৬০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করা সম্ভব। বর্তমান অবস্থায়ও ইইউতে বাড়তি ১৮ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। তবে সক্ষমতার অভাব এবং পণ্যের বৈচিত্র্যহীনতার কারণে সুযোগ কাজে লাগছে না। ইইউ জোটে রপ্তানি পণ্যের ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক। পোশাকবহির্ভূত বড় পণ্যের সম্ভাবনার ২৫০ কোটি ডলার কম রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এসব পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাদুকা, চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইলস, চিংড়ি ও মাছ। ইইউর বাজার সম্পর্কে তথ্য-উপাত্তের অভাব রয়েছে। জোটের কোন দেশে কী সম্ভাবনা, কোন মৌসুমে কী রঙের পোশাকের চাহিদা থাকে- এ বিষয়ে জানা-বোঝার স্বল্পতা রয়েছে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানের প্রশ্নে উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টিও বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আবার রপ্তানির বিপরীতে সরকারের দেয়া নগদ সহায়তা সব পণ্যের ক্ষেত্রে সমান নয়। এ কারণে অনেক পণ্যের উদ্যোক্তা রপ্তানিতে উৎসাহিত নন। তুলনামূলক লাভজনক দামে স্থানীয় বাজারেই বিক্রিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তারা। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) ক্ষেত্রে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। সরবরাহ চেইনে বিভিন্ন সেবার সহজলভ্যতার অভাবেও বৈচিত্র্য আনার বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এলডিসি হিসেবে পাওয়া শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা আর থাকবে না। রপ্তানি উৎসাহিত এবং সক্ষমতা বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া নগদ সহায়তা বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে তিন ধরনের কাঠামোতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হয় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে। আটটি পণ্যে ২০ শতাংশসহ ৩৮টি পণ্যে বিভিন্ন হারে নগদ সহায়তা রয়েছে। এসব বিধিবিধান পরিপালনের কারণে রপ্তানি সক্ষমতা কমতে পারে। ২০২৬ সালে এলডিসির পরিচয় ঘুচবে বাংলাদেশের। ইইউ জোটের ২০২৯ সাল পর্যন্ত এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) কর্মসূচির অধীন যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত থাকবে। ইবিএ হচ্ছে সবচেয়ে সহজ শর্তে শুল্কমুক্ত সুবিধা, যা এলডিসিগুলো পেয়ে থাকে। পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ এলডিসি-উত্তর পরবর্তী সময়ে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়েছে।

রাষ্ট্রদূত এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফোরামের সঙ্গে আলোচনায় বিজিএমইএ এ দাবি তুলে ধরেছেন। তারা আশাবাদী, শেষ পর্যন্ত একটি স্বস্তিদায়ক অবস্থায় যেতে পারবেন। বিজিএমইএর এ আবেদন আমলে নেয়া না হলেও ‘জিএসপি প্লাস’ নামে ইইউর আরেকটি শুল্কমুক্ত সুবিধার স্কিম রয়েছে, যাতে প্রায় একই রকম সুবিধা ভোগ করার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। তবে এ জন্য কিছুটা কঠিন শর্ত পরিপালন করতে হবে। এ-সংক্রান্ত ৩২টি কনভেনশন অনুমোদন করার শর্ত রয়েছে। এ পর্যন্ত ২০টি কনভেনশন অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ। বাকি ১২টিও অনুমোদন করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা, নির্যাতন ও অন্যান্য নৃশংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি।

সুশাসন, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের পাশাপাশি পরিবেশ, সামাজিক ও সুশাসন (ইএসজি) কমপ্লায়েন্সের শর্ত যদি জুড়ে দেয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়বে। বাংলাদেশ ইইউতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেলে তারপর তা রক্ষা করার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে। মানবাধিকার, শ্রম অধিকার কিংবা অন্য যেকোনো ইস্যুতে অগ্রগতি সন্তোষজনক মনে না করলে যেকোনো সময় শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহারের এখতিয়ার রয়েছে ইইউর। এ ছাড়া কার্বন করও বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের হুমকি। ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৫৫ শতাংশ কমানো এবং ২০৫০ সালের মধ্যে তা শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি পথনকশা করেছে ইইউ। ‘ইইউ গ্রিন ডিল’ নামের এ পদক্ষেপের আওতায় কয়েকটি খাতের পণ্যের ওপর কার্বন কর আরোপ করার কাজ চলছে। ২০২৬ সালে আমদানি পর্যায়ে এ শুল্ক আরোপ করা হবে।

আটটি আমদানি পণ্যের ওপর এটি আরোপ করা হতে পারে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা প্রাথমিক তালিকায় রাখা হয়নি। তবে ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের এই তিন পণ্যে কার্বন কর আরোপ হতে পারে। এ কর আরোপ হলে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। ইইউ কখনোই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক ইস্যুকে জড়ায়নি। যদিও এবারের বিষয়টি কোন দিকে যাচ্ছে, তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের প্রত্যাশা, তারা (ইইউ) রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য জড়াবে না।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাব নিয়ে ইইউর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে ইইউ পার্লামেন্টে জিএসপি সুবিধা চালু রাখা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সেটি অবশ্যই অস্বস্তিকর। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গৃহীত প্রস্তাবটি সরকারের গুরুত্ব নেয়া উচিত। তৈরি পোশাকশিল্পের মাধ্যমে আমরা প্রত্যন্ত এলাকার নারীদের পাশাপাশি বিশাল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছি। আমরা মনে করি, ইইউর নেতৃত্ব চাইবে না এ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হোক। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবের কারণে জিএসপি প্লাসের আলোচনায় বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে থাকতে পারে।

লেখক: রেজাউল করিম খোকন, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক


ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রম ও ইসলামী ব্যাংকিং

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আবুল কালাম আজাদ

ইসলামি অর্থনীতির লক্ষ্য সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর মাধ্যম হতে পারে ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থা। ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দারিদ্র্য সমস্যার সমাধানকেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। কারণ ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অধীনে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদান করা হয়। এর মাধ্যমে উল্লিখিত জনগোষ্ঠী মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং নতুন ব্যবসা শুরু ও বৃদ্ধি করতে পারে। যাই হোক, প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো দারিদ্র্য সমস্যার সমাধানে আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারেনি। প্রচলিত ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থা দারিদ্র দূরীকরণের লক্ষ্যে ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত হচ্ছে। মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) তথ্য অনুসারে, গ্রামীণ ব্যাংক, সরকারি ও বে-সরকারি ব্যাংকের অধীনে পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দেশে প্রায় ৭৩৯টি প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধীনে ৬ কোটি ৬৪ লাখ সদস্য ঋণ গ্রহণ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য বিমোচনে সফলতার স্বাক্ষর রাখলে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি পরিলক্ষিত হতো। কিন্তু তা হয়নি। বরং ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা ঋণগ্রহীতার ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে আসছে। দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র হওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে বেশির ভাগ।

কার্যত প্রচলিত ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থা বা এনজিওগুলো সফল না হলেও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (আরডিএস) সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আরডিএস প্রকল্প সফল হওয়ায় ২০১২ সাল থেকে শহুরে দরিদ্রদের জন্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এটি ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়নে বিশ্বের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান। এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রমে ক্রমবর্ধমান প্রকল্প। ২০১৮ সালে এ প্রকল্পের আওতায় সদস্য ছিল ১১ লাখ দরিদ্র মানুষ, যা ২০২২ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৬ লাখ। যাদের অনেকেই বিনিয়োগ নিয়ে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকটির ৪৬২টি শাখা, উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে ৬৪টি জেলায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রকল্পের অধীনে বিনিয়োগ আদায়ের হার ৯৯.০৩ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ছিল ৯৮.৯৩ শতাংশ দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য সফলতা নির্দেশ করে।

দেশের প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা সুদভিত্তিক। ইসলাম সুদকে হারাম করেছে, আর ব্যবসাকে করেছে হালাল। ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থায় ইসলামী শরিয়াহ প্রদত্ত মডেল যেমন ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান চুক্তির মধ্যে রয়েছে ক্রয়-বিক্রয়ভিত্তিক ব্যবস্থা যেমন বাই-মুরাবাহা, বাই-মুআজ্জাল, বাই-সালাম, বাই ইসতিসনা ইত্যাদি; ব্যবসায়িক সহযোগিতাভিত্তিক চুক্তি মুশারাকা ও মুদারাবা; ইজারাভিত্তিক চুক্তি যেমন হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক। ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থায় মুনাফার হারও তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকের ক্ষুদ্র বিনিয়োগের প্রধান লক্ষ্য হলো সুযোগ সৃষ্টির জন্য আর্থিক সুবিধা প্রদান করা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে গ্রামীণ জনগণের আয় বৃদ্ধি। গ্রামীণ এলাকায় কৃষি এবং অ-কৃষি কার্যক্রমে বিনিয়োগ সুবিধা প্রসারিত করা। এই ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রকল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো-প্রকল্পটির কার্যক্রম ব্যাংকের নিকটবর্তী শাখাগুলোর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।

ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ বিশেষ করে বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প থেকে দেখা গেছে যে, দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ছোট বিনিয়োগ গ্রহীতারা এগিয়ে; তার পরে মাঝারি ও বড় বিনিয়োগ গ্রহীতারা। দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে একটি ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি। ইসলামী ব্যাংকগুলো কোনো অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে অর্থায়ন করতে সক্ষম। ইসলামী ব্যাংকসমূহ আরও দক্ষতার সঙ্গে সুবিধাজনকভাবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রদান করতে পারে ।

একটি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কর্মসূচির সাফল্য নির্ভর করে এর সদস্যদের আয় বৃদ্ধিতে এবং শেষ পর্যন্ত দরিদ্রদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার তুলনায় ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে অধিক কার্যকর ভূমিকা রাখে।

এই প্রকল্পের অধীনে ক্ষুদ্র বিনিয়োগের জন্য কোনো জামানত প্রয়োজন নেই। সর্বমোট ঋণ (মূল পরিমাণ এবং মুনাফা) সাপ্তাহিক কিস্তিতে এক বছরে পরিশোধ করতে হয়। ইসলামি মাইক্রো ফাইন্যান্সের অন্যতম একটি দিক হলো তদারকি কার্যক্রম। বিনিয়োগ দিয়ে শুধু আদায় নয় বরং তার সফল ও সার্থক ব্যবহার হচ্ছে কি না তা তদারকি করা হয়। প্রায় শতভাগ ঋণ আদায়ের অন্যতম রহস্য এটি। এই স্কিমের সব সদস্যকে ন্যূনতম পরিমাণ সাপ্তাহিক সঞ্চয় করতে হয়। এ ছাড়াও ফিল্ড অফিসাররা সদস্যদের নিয়ে সততা, দায় পরিশোধের গুরুত্বসহ ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ফলে বিনিয়োগ গ্রাহকরা দায় পরিশোধে অনীহা নয় বরং সৎ ও নৈতিকতাসম্পন্ন উদ্যোক্তা হয়ে বিনিয়োগের অর্থ পরিশোধে তৎপর থাকেন।

ইসলামী ব্যাংকের এই প্রকল্পকে সারাবিশ্বে ইসলামী মাইক্রো ফাইন্যান্সের জন্য মডেল হিসেবে গ্রহণ করে অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এ জন্য বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থার পথিকৃৎ বলা হয়। ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো গত প্রায় তিন দশকে দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য এ ধরনের আর কোনো প্রকল্প বা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে আরো ৯টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। এই ব্যাংকগুলো ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু করলে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মতো ইসলামী মাইক্রো ফাইন্যান্সেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সম্ভব। ব্যাংকগুলোর জন্য তুলনামূলক কম মুনাফায় বিনিয়োগ দেয়া সম্ভব। কেননা বিদ্যমান অবকাঠামোতেই এ প্রকল্প পরিচালিত হবে। এ ছাড়াও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোও ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু করতে পারে। এতে একদিকে সুদমুক্ত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে অর্থনীতির প্রকৃত সুফল সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে; সম্ভব হবে সম্পদের সুষম বণ্টন।

এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে মুদারাবা ও মুশারাকার মতো আদর্শ বিনিয়োগ পদ্ধতিগুলোর ওপর জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে কিস্তি পরিশোধের শুরুর সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে পৃথক ‘ইসলামী মাইক্রো ফাইন্যান্স ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে নতুন মাত্রা নিয়ে আসবে। সরকার ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থাকে সহায়তা করলে ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও ২০৪১ সালের লক্ষ্য অর্জনে এক ধাপ এগিয়ে থাকবে। এ জন্য সহায়ক নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: ব্যাংকার


ভারতের চন্দ্র বিজয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
প্রদীপ মালাকার

গত ২৩ আগস্ট ভারতের নিজেদের তৈরি চন্দ্রযান-৩ সফলভাবে চাঁদের দক্ষিণভাগে অবতরণ করে। তার আগে ১৪ জুলাই ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের হরিকোটায় অবস্থিত সতিশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে নভোযানটি উৎক্ষেপণ করা হয়। ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইসরো) চন্দ্রযান-৩ পৃথিবী ও চন্দ্রের কক্ষপথ পেরিয়ে প্রায় ৪২ দিনে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে প্রথম দেশ ও চন্দ্রপৃষ্ঠে নভোযান নামানো চতুর্থ দেশ। এর আগে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন চন্দ্রপৃষ্ঠে নভোযান অবতরণ করেছে। চন্দ্রযান-৩ সফল অবতরণের পর ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, বাংলাদেশের মানুষের উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া ও পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া দিতে দেখা যায়।

পাকিস্তানের জনগণের দাবি, পাকিস্তানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (সুপারকো) কেন সাস্কসেস হতে পারল না? অনেকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ভারত চাঁদে গেছে তো কি হয়েছে, আমরা তো চাঁদেই আছি। চাঁদে তো জল নেই, গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই, পাকিস্তানের বহু এলাকাতেও এখন সেরকমই অবস্থা। তাহলে ভারতের দেখাদেখি হিংসা করে কি এবার পাকিস্তানও সুপারকোর উন্নতির জন্য লেগে পড়বে? আবার বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকে দাবি করেন, আমরা ৫২ হাজার কোটি টাকার মেট্রো রেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। যার খরচ দিয়ে মোট ৫৭টারও বেশি চন্দ্রযান পাঠাতে পারি বিভিন্ন মেরুতে। আবার ৩৬ হাজার কিমি দূরে স্যাটেলাইট পাঠিয়েই ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে আমাদের সক্ষমতা দেখিয়েছি। আরও কত কি?

পাঠক, তিন দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করলেই আমরা বুঝতে পারব, মহাকাশ গবেষণায় কার কতটুকু সক্ষমতা আছে বা গবেষণায় এগিয়ে আছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত দক্ষ বলা যায়। সারা বিশ্বেই এখন ভারতের শিক্ষিত আইটি পেশাদারদের মেধাবৃত্তিক কাজে দেখা যাচ্ছে। ভারতের বর্তমান আইটি সেক্টরের অংশ ভারতের জিডিপির প্রায় নয় শতাংশ। ভারতের আইটি বাজারের মূল্য ১৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৫ সাল নাগাদ সাড়ে ৩০০ বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই পটভূমিতে পাকিস্তানের গণমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে, ভারতের চন্দ্রযান-৩ তো চাঁদে পৌঁছেছে, তাহলে পাকিস্তানের চন্দ্রযান কোথায়?

বর্তমানে পাকিস্তান মহাকাশ গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যান একজন সেনাকর্মকর্তা এবং তার অধীনে ১৫-২০ জনের অবৈজ্ঞানিক জনবল নিয়ে সংস্থাটি টিকে আছে। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠা হয় পাকিস্তানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। ‘স্পেস অ্যান্ড আপার অ্যাটমুস্ফিয়ার রিসার্চ কমিশন’, যার সংক্ষেপে নাম (সুপারকো), পদার্থবিদ ও নোবেল বিজয়ী ড. আব্দুস সালামের নেতৃত্বে এই গবেষণা কেন্দ্র শুরু হয়েছিল। কিন্তু চীনের সাহায্য ছাড়া মহাকাশ গবেষণার উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ করেনি পাকিস্তান। পাকিস্তান ১৯৬২ সালে এশিয়ার তৃতীয় দেশ হিসেবে রকেট রেহবার-১ উৎক্ষেপণ করে। পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারমাণবিক গবেষণা চালিয়েছে অনেক বছর।

নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তান পারমাণবিক গবেষণায় সাফল্য পেলেও সেই ধারাবাহিকতা অন্যসব ক্ষেত্রে পাকিস্তান সামগ্রিকভাবে স্থির হয়ে আছে। প্রথমদিকে এত এগিয়ে থাকার পরও ইসরো থেকে কয়েকশ গুণ পিছিয়ে সুপারকো। শিক্ষা খাতে তহবিল বরাদ্দের অভাব ও বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য অর্জনে সামরিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বের বারবার হস্তক্ষেপের কারণে আজ এই হাল। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কলহের কারণে বিকাশ কম হচ্ছে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহরু মহাকাশ গবেষণার উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কাজ শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ভারত মহাকাশ গবেষণার জন্য জাতীয় কমিটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। ভারত ১৯৬৯ সালের ১৫ আগস্ট, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) প্রতিষ্ঠা করেছিল। নাসার চন্দ্র বিজয়ের মাত্র ২৫ দিনের মধ্যেই ‘ইসরো’ (ইসরো) চালু হয়। এই গবেষণা সংস্থার মূল উদ্দেশ্য মহাকাশ প্রযুক্তির বিকাশ ও মহাকাশ অধ্যয়নের জন্য গবেষণা ও জ্ঞান প্রয়োগ করা। এ ছাড়া বিভিন্ন খেয়াযান উৎক্ষেপণ বা উৎক্ষেপণ-উপকরণের প্রয়োজন মেটাতে কাজ করার লক্ষ্যে এর যাত্রা। বহুমুখী স্যাটেলাইট কক্ষপথে প্রেরণ থেকে শুরু করে কল্পবিজ্ঞানের বহির্জাগতিক জীবন অনুসন্ধানের জন্য মহাকাশ মিশন পাঠানোর লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা এক হন (ইসরো)-এর মাধ্যমে। বর্তমানে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম মহাকাশ সংস্থা এটি।

তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ভারত ‘ইসরো’-কে অনেক বছর ধরেই শক্তিশালী করে তুলছে। ইসরো স্যাটেলাইট যোগাযোগ, স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং ও ন্যাভিগেশন, রিমোট সেন্সিইন, মহাকাশ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ, গ্রাউন্ড স্টেশন অপারেশন ও ডেটা বিশ্লেষণ এবং প্রক্রিয়াকরণে সহায়তানির্ভর নানান কাজে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছে। চন্দ্রযান-৩ যা বিক্রম ল্যান্ডার নামে পরিচিত, যার পেট থেকে প্রজ্ঞান নামে একটি রোভার বের হয়ে ১৪ দিন চাঁদের মাটিতে অন্বেষণ করে মিশন শেষ করবে।

পাকিস্তান বহু আগে চীনের সহযোগিতায় ৬টি স্যাটেলাইট আকাশে প্রেরণ করেছে। সেখানে বাংলাদেশ এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও ব্যবহার শুরুর কাজ। দেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর ধরন নির্ধারণের জন্য ফ্রান্সের প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার স কে নিয়োগ দিয়েছে বিএসসিএল। ২০১৮ সালে ১২ মে নাসার সাহায্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের অভিজাত ক্লাবে নাম লেখায় বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশের খরচ হয় ২ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ হাইব্রিড স্যাটেলাইট হতে পারে। এই স্যাটেলাইট আবহাওয়া, নজরদারির বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত হবে। সেই ষাটের দশকে টাটা ইন্ডাস্ট্রিজের সাহায্যে ভারতে আইটি শিল্পের বিকাশ ঘটে ১৯৬৭ সালে মুনবাইতে। সান্তাক্রজ ইলেকট্রনিক্স এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন নামে প্রথম সফটওয়্যার রপ্তানি অঞ্চল ১৯৭৩ সালে মুনবাইতে যাত্রা শুরু করে। এই স্থাপনাগুলো হলো আধুনিক দিনের আইটি পার্কের অগ্রদূত।

বাংলাদেশ শুধু মহাকাশ নয়, সব ধরনের গবেষণাতেই পিছিয়ে আছে। একমাত্র কৃষি গবেষণাতে তুলনামূলক একটু ভালো অবস্থায় আছে। এই পিছিয়ে থাকার মূল কারণ হচ্ছে-গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ না থাকা এবং পর্যাপ্ত ফান্ডের অভাব ও কাঠামোগত সমস্যা তাদের নিরুৎসাহিত করে। অন্যান্য দেশ যেখানে তাদের বাজেটের একটি বড় অংশ গবেষণার পিছনে খরচ করে, সেখানে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাৎসরিক বাজেটের দিকে তাকালেই দৈন্যদশা চোখে পড়ে। সরকারি প্রণোদনা ছাড়া গবেষণা চলে না, কারণ বাংলাদেশের মতো দেশে বেসরকারি খাত কখনই গবেষণায় খুব একটা খরচ করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার জন্য প্রণোদনা তো দূরের কথা, গবেষণা কাজ চালানোর জন্য সরকারের তরফ থেকে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ খুবই নগণ্য।

এবার আসি মহাকাশ গবেষণার দিকে, বাংলাদেশে এর প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় ৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে। বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন কেন্দ্র, সংক্ষেপে যার নাম ‘স্পারসো’ গঠিত হয় ১৯৮০ সালে। কিন্তু তার পরের ৪০ বছরে প্রতিষ্ঠানটির দিকে কতটুকু নজর দেওয়া হয়েছে তা তাদের পোর্টফলিও দেখলেই বোঝা যায়। তাদের উইকিপেডিয়া পেজে তাদের বলার মতো কোনো প্রজেক্ট খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তবে হাঁ একটি আর্টিকেল খুঁজে পাওয়া গেছে যাতে ‘স্পারসো’র দৈন্যদশাই ফুটে উঠেছে। পাকিস্তানে যেমন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যানের পদ অলংকৃত করে আছে একজন সেনাকর্মকর্তা, বাংলাদেশেও গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যানের পদ অলংকৃত করে আছে এক কৃষিকর্তা। কাজেই গবেষণার ক্ষেত্রে কতটুকু এগিয়ে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

এবার তাদের পোর্টফলিওটি দেখা যাক, অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১৬৯টি। বর্তমানে কর্মরত আছেন ৮৪ জন। শূন্যপদের সংখ্যা ৮৫টি। মোট পদের অর্ধেকেরও বেশি পদ শূন্য। এরকম পরিস্থিতিতে চলছে প্রায় ১৫ বছর। জনবলের অভাবে প্রতিষ্ঠানটির চেইন অফ কমান্ড প্রায় ভেঙে পড়েছে। মহাকাশ গবেষণাতেও নেই কোনো উদ্যোগ। টানা ১৫ বছর প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো ধরনের নিয়োগ হয়নি। অন্যদিকে ভারতের ইসরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে, বাংলাদেশের ‘স্পারসো’ গঠিত হওয়ার ১১ বছর আগে। কিন্তু তারও আগে থেকেই ভারতে মহাকাশ গবেষণায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছিল। ইসরোর মাধ্যমে ভারত সরকার সব প্রজেক্টকে সেন্ট্রালাইজ করে।

পরবর্তী দশকগুলোতে ভারতে মহাকাশ গবেষণার ভালো ক্ষেত্র তৈরি হয়, দক্ষ জনশক্তি তৈরি হয়, তাতে অনেক সময় যথেষ্ট ফান্ড না থাকলেও সংশ্লিষ্টদের দৃঢ়তায় কাজ এগিয়ে যায়। আর এখনকার সময়ে ইসরো বিশাল একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে, আর একসঙ্গে নানামুখী প্রোজেক্ট চলমান। ২০২১-২২-এ তাদের বাজেট প্রায় ১৪ হাজার কোটি রুপি, আর তাদের অ্যামপ্লয়ির সংখ্যা ১৭০০০-এর অধিক। .৮৪ জন আন্ডরফান্ডেড অ্যামপ্লয়ি নিয়ে কি ১৭০০০ জনের সঙ্গে পাল্লা দেয়া যায়? এহেন পরিস্থিতিতে, সরকার যদি মহাকাশ গবেষণায় পর্যাপ্ত অর্থবরাদ্দের পাশাপাশি বিজ্ঞান শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও আইটি সেক্টরে জোর দেন। সেই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও ঢেলে সাজিয়ে এবং পাঠ্যপুস্তকে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে অন্তর্গত করে ব্যবস্থা নিলে আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি অনেকটাই পরিবর্তন সম্ভব, এমনই মত পোষণ করেন বিশেষজ্ঞরা।

লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী শিক্ষাবিদ ও গবেষক


বাংলাদেশের ধনী রাষ্ট্র হওয়া অসম্ভব কিছু নয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রায়হান আহমেদ তপাদার

স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছরে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী দেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়েছে। বিভিন্ন বৈশ্বিক ফোরামে বাংলাদেশ এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় অনুযায়ী এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। আয়তনে ছোট ও সীমিত সম্পদ নিয়ে ৫১ বছরের মাথায় অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করেছে। উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যাওয়ার সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর চাপ উপেক্ষা করে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে সই করেছে বাংলাদেশ। ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা- ওআইসিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্বের অন্যতম মুসলিম দেশ হিসেবে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ৫২ বছরে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গেও কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। বাংলাদেশ এখন রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা করছে। ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশটি বর্তমানে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির দেশ। অর্থনীতির গতিময়তায় দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন সারা বিশ্বে তার পরিচিতি। গত বছর শ্রীলঙ্কার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তামূলক ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ। একটি দরিদ্র সাহায্যপ্রার্থী দেশ থেকে আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশ হওয়ার পথে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। ১৯৭১-এ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সময় বাংলাদেশ ছিল আপাত সম্ভাবনাহীন পৃথিবীর দরিদ্রতম একটি দেশ, যাকে হেনরি কিসিঞ্জার তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ ১৮ কোটি মানুষের একটি সমৃদ্ধ দেশ।

যাদের আছে রপ্তানিনির্ভর এক বিশাল অর্থনীতি। দারিদ্র্য দূর করায় তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতির স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৩ সালে ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড’ পায়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পিডব্লিউসির পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০৫০-এর মধ্যে বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। এ ছাড়া, দ্য গোল্ডম্যান স্যাচ পূর্বাভাস দিয়েছে, ব্রিকসের পর যে ১১টি দেশ আগামী পৃথিবীর অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ তার একটি। এদিকে ভারতের অর্থনীতির চেয়ে চীনের অর্থনীতি কয়েক গুণ বড়। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হওয়ার পরও কখনোই কোনো সূচকে চীনকে টপকাতে পারেনি ভারত। বাংলাদেশের অর্থনীতির ১০ গুণ বড় ভারতের অর্থনীতি। অথচ কয়েকটি সূচকে ভারতকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। নারীর ক্ষমতায়ন, নারী শিক্ষার হার, নবজাতক ও ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনায় বাংলাদেশের সূচক ভারতের চেয়ে অনেক ওপরে। বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠা এবং করোনাকালে উন্নয়নধারাকে অব্যাহত রাখার পারদ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ ওপরে। এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস দিয়েছে মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে পেছনে ফেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ এবং ২০০৯ সাল থেকে বিচক্ষণ আর্থিক ও ঋণ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে গত চার দশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে। ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার গড় জিডিপি ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। অথচ সে বছর বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ এখন ভারতের তুলনায় রাজস্ব ঘাটতি, বাণিজ্য ভারসাম্য, ঋণ ও জিডিপির সঙ্গে আনুপাতিক বিনিয়োগ হারের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে।

বাংলাদেশের জিডিপিতে সাধারণ কৃষি খাতের অবদান ছিল এক-তৃতীয়াংশ। তবে ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তা কমে জিডিপির ১৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। অন্যদিকে একই সময় জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান এক-পঞ্চমাংশের কম থেকে বেড়ে এক-তৃতীয়াংশ হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে জিডিপিতে উৎপাদন খাতের অবদান দ্বিগুণ হয়েছে। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশক থেকে রপ্তানি ২০ গুণ বেড়ে ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। অধিক রেমিট্যান্স থেকে কম মজুরির শ্রমিকরাও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। ২০১৯ সালে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৬৪০ কোটি ডলার। এ ছাড়া শক্তিশালী রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও কৃষির কল্যাণে বাংলাদেশ ২০২৬ সাল পর্যন্ত মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২০ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২ হাজার ৯৮ ডলার থেকে কমে হয় ১ হাজার ৯২৯ ডলার। অর্থনীতির আকার ২ লাখ ৮৭ হাজার কোটি থেকে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি ডলারে। একই বছর মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। টানা ১৫ বছর ধরে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ওই বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৩৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। আর মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৯৬১ ডলার। ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এভাবে বাড়তে থাকে। এর আগে শুধু ২০১৭ সালে যখন ভারতের প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে, তখন ভারতের চেয়ে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার আগে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ভারতের অর্ধেক। তবে ২০১৪ সালের মধ্যে তা ৭০ শতাংশ বাড়ে। ২০২০ সালে করোনার কারণে ভারতের অর্থনীতির ৭ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল। তবে একই বছর বাংলাদেশর অর্থনীতির আকার বাড়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন কর্মসূচি, বিশেষত মেয়েদের শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে জন্মহার ও বাল্যবিবাহ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। গড় আয়ু, জন্মহার ও শিশুপুষ্টির মতো মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির ব্যাপক সুফল পাচ্ছে। সেই তুলনায় ভারত অনেকটা পিছিয়ে। বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে এ দেশের জনগণের জীবনমান বৃদ্ধি পেয়েছে, যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বিগত ৫০ বছরে প্রায় ২৭০ গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ অথবা এর কম থাকছে। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। রপ্তানিভিত্তিক শিল্প-কলকারখার সংখ্যা বৃদ্ধির কল্যাণে বাংলাদেশ এমন অবস্থানে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের অধিকাংশই বস্ত্র, তৈরি পোশাক ও পাদুকা পণ্য (ফুটওয়্যার)। তবে এসব শিল্পের অধিকাংশ শ্রমিক অদক্ষ বা আধা দক্ষ।

বাংলাদেশের অধিকাংশ রপ্তানিপণ্য মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সুবিধা ভোগ করছে। উদ্ভাবন ও স্বল্প বেতন হওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক ক্রেতা ভারতের বদলে বাংলাদেশকে বেছে নিচ্ছে। ভারতের ষষ্ঠ বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৮০ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯৫০ কোটি ডলার। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির আলোকে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বাণিজ্য সম্ভাবনা রয়েছে, তার সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর। সম্প্রতি নিত্যপণ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি, সেবা ও জ্বালানি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও আন্তসীমান্ত বিনিয়োগ উৎসাহিত করাসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

ভারতের ছোট প্রতিবেশী হয়েও বাংলাদেশ এভাবে উন্নতি করছে। তবে উন্নতি করার মতো আরও অনেক বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার তারকার খ্যাতি উপভোগ করছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সামরিক সক্ষমতাও বৃদ্ধিতেও সহায়তা করছে। চীন-রাশিয়ার মতো পুরোনো উৎস বাদ দিয়ে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী কিছু বড়সড় কেনাকাটা করতে যাচ্ছে। তারা ইতোমধ্যে তুরস্ক থেকে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সামরিক যান কিনেছে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী আমেরিকান এফ-১৬ অথবা ইউরো ফাইটার টাইফুন কেনার চিন্তা করছে।

এদিকে ধীরে ধীরে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক হাব হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বড় বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর ফলে লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনীতির উন্নতি হবে। এতে বদলে যাবে দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ২০১৮ সালে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস আইন প্রণীত হয়েছে, ফলে বিনিয়োগকারীরা একই পয়েন্ট থেকে সব ধরনের সেবা পাবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা তিন মেয়াদের সরকার ও জনগণের দূরদর্শী পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ ও কঠোর পরিশ্রম বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের সাফল্য এনে দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ ভারতকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং বন্ধুপ্রতিম দেশ বলেই গণ্য করে। প্রতিবেশী এ দেশসহ অন্যান্য ক্ষমতাধর দেশের সঙ্গে গঠনমূলক সুসম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে বাংলাদেশ আস্থাশীল। দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ দেশগুলোকে অংশীদার হিসেবে মনে করে। এমন প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের এই উত্থানের কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে। এটি বুঝতে হলে পেছন ফিরে তাকাতে হবে।

তবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কুটিরশিল্পগুলোকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিলে দেশের মানুষ বহুমুখী কর্মযজ্ঞে সচল রাখবে দেশের অর্থনীতির চাকা। গ্রামের জিনিস শহরে আসবে-যাবে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে। সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সিঙ্গাপুরের চেয়ে বাংলাদেশের ধনী দেশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আশপাশের দেশগুলোকে তাদের যোগাযোগ রক্ষা করতে হলে বাংলাদেশকে মাধ্যম হিসেবে নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অথচ আমরা জানি মাত্র ৫০ বছর আগেও সিঙ্গাপুর ছিল একটি হতদরিদ্র দেশ। সে সময় সিঙ্গাপুরকে কলোনি অব কুলিজ বলে উপহাস করত। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান নিজের লেখা বইতে বলেছেন, মালয়েশিয়া যখন সিঙ্গাপুরকে পৃথক করে দিল, তখন মনে হলো ইট বিকাম এ হার্ট উইদাউট বডি। কিন্তু সেই অনিশ্চিত সিঙ্গাপুর দরিদ্র অবস্থান থেকে কতটা ওপরে উঠে এসেছে, তা রীতিমতো অভাবনীয়। এখন দুনিয়ায় সিটি স্টেট বলতে সিঙ্গাপুরকেই বোঝায়। সিঙ্গাপুরের এমন ঈর্ষণীয় সাফল্যের মূলে রয়েছে ব্যবসাকেন্দ্র, যার দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি। বলা যায়, সিঙ্গাপুরের সমৃদ্ধির নেপথ্য মূলত বন্দরকে কেন্দ্র করেই। আমাদের বাংলাদেশেরও সমুদ্র বন্দর আছে। আমরা চাইলে এই বন্দরগুলোকে বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আর সত্যিই যদি তা পারা যায় তাহলে সিঙ্গাপুরের চেয়ে বাংলাদেশের ধনী রাষ্ট্র হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট


একে একে দুই মিলিয়ে তৃতীয় পথের কৌশল

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সাইমন মোহসিন

মঙ্গোলিয়া থেকে বিরল খনিজ পদার্থ ক্রয় হোক, আর বাংলাদেশে এয়ারবাস উড়োজাহাজ বিক্রয় হোক, এশিয়া অঞ্চলে ফ্রান্সকে তৃতীয় পরাশক্তি বা তৃতীয় পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেকদূর এগিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। বাংলাদেশে দুদিনের সফরের মাধ্যমে এশিয়া অঞ্চলে ফ্রান্সের কৌশলের নতুন রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন তিনি।

এশিয়ায় চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যখন মত্ত, তখন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে বিকল্প সহযোগী ও অংশীদার পরাশক্তি হিসেবে ফ্রান্সকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্রিয় মাখোঁ। মাখোঁর ভাষ্যমতেই, নব্য সাম্রাজ্যবাদের সম্মুখীন এ অঞ্চলকে ফ্রান্স একটি তৃতীয় পথের প্রস্তাবনা দিতে আগ্রহী। তাহলে বুঝতেই হয় যে, ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিবলয়ের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। বিষয়টি আরেকটু পর্যালোচনা করা যাক।

ইউরোপের সার্বভৌমত্ব ও কৌশলগত স্বতন্ত্রতা বৃদ্ধির কথা প্রেসিডেন্ট মাখোঁ বেশ অনেক সময়ব্যাপীই জোর দিয়ে বলে আসছেন। ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও পরাশক্তিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষাপট যখন বিস্তর পরিবর্তনশীল, তখন কৌশলগত স্বতন্ত্র ইউরোপের অপরিহার্যতা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলেই মনে করেন ফরাসি কূটনীতিকরা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক ভূমিকার ক্ষেত্রে এ বিষয়টা আরো জরুরি হয়ে উঠেছে বলেই ফরাসি প্রশাসনের বিশ্বাস। ২০১৯ সালেই মাখোঁ ন্যাটো সংস্থার অকার্যকারিতার কথা বলেছিলেন। একই সুরে ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে ইউরোপের স্বতন্ত্রতা বৃদ্ধির প্রতি জোর দিচ্ছিলেন তিনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ন্যাটো নিয়ে তার মতবাদ কিছুটা পরিবর্তন হলেও ইউরোপের কৌশলগত স্বতন্ত্রতার বিষয়ে ফ্রান্সের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো অপরিবর্তিত। তবে, ইইউর অন্যান্য রাষ্ট্রের এই মতবাদে সন্তুষ্ট করতে ফ্রান্সকে এখনো অনেক বেগ পেতে হবে। কিছুদিন আগেই মাখোঁ ও জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্যারেনবাওয়ারের মধ্যে মতবিরোধের মধ্য দিয়েই ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মতভেদের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর গত প্রায় পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিবর্তনের ফলে ফ্রান্স অধিকতর সার্বভৌম ও কৌশলগত স্বতন্ত্র ইউরোপের কথা আরো জোর দিয়ে বলে এসেছে। তার মূল কারণ হলো ফ্রান্সের মতে, ভূরাজনৈতিক বিবর্তনের ফলে ইউরোপের নিরাপত্তা পরিস্থিতির কেবল অবনতিই হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের মাটিতে রাশিয়া সর্ববৃহৎ যুদ্ধের অবতারণা করাতে ইউরোপিয়ানদের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতার দুর্বলতাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে বিষয়টা যেমন ইউরোপ নিয়ে ফ্রান্সের মতামতকে পোক্ত করে, তেমনি ন্যাটো নিয়ে ফ্রান্সের সন্দেহ ও শঙ্কা এখন অত্যন্ত অসঙ্গত ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আর যাই হোক, এখন আপাতত ইউরোপের সামরিকভাবে ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তাই বলে মাখোঁ পরোক্ষভাবে এখনো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মধ্যবর্তী টানাপোড়েনে ইউরোপের অযথা শিকার হওয়ার বিষয়টি ক্রমশই বলে চলেছেন। অর্থাৎ ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত এই বিশাল খেলায় ইউরোপ যে কেবল একটি দাবার গুটি, হয়তো গুরুত্বপূর্ণ একটি গুটি হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটা মাখোঁ যতটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছেন, সেটা হয়তো অন্যরা অনুধাবনই করতে পারছে না। ফ্রান্সের এই পররাষ্ট্রনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মতভেদের সঙ্গে আফ্রিকায় ফ্রান্সের প্রভাবের সংকোচন ফ্রান্সের জন্য আরো মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আফ্রিকায় প্যারিসের যেমন দৌরাত্ম্যের অবনতি হয়েছে, তেমনি ফ্রান্সের প্রতি আফ্রিকানদের ক্ষোভের বহির্প্রকাশ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর নেপথ্যে অনেক কারণই রয়েছে। গত কয়েক দশকব্যাপী আফ্রিকার ওপর ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ও অনেকাংশে সাংস্কৃতিক শোষণ অবশ্যই এর প্রধান কারণ। আফ্রিকায় ফরাসি উপনিবেশ-পরবর্তী সময়েও ফ্রান্স আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর ওপর যে অসঙ্গতিপূর্ণ ও অন্যায় শোষণ প্রক্রিয়া প্রণয়ন করেছে, তার ব্যাখ্যার জন্য আরো যে সময় ও জায়গা প্রয়োজন, সেটা এই লেখার পরিধিবহির্ভূত। তা নিয়ে আরেক লেখায় কথা বলা যাবে। এটা ছাড়া ফ্রান্সে ক্রমশ ডানপন্থিদের উত্থান এবং ফরাসি ভাষাভাষি আফ্রিকান রাষ্ট্র টোগো, চাদ, ক্যামেরুন, কঙ্গো-ব্রাজাভিল, গাবন- এসব রাষ্ট্রের একনায়কতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক আফ্রিকাতে ফ্রান্সের স্ববিরোধী আচরণের প্রমাণ বহন করে। একদিকে ফ্রান্স গণতন্ত্রের কথা বলে আরেকদিকে একনায়কতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন করে। অদক্ষ ও অপ্রিয় সরকারের সঙ্গে একদিকে ফ্রান্স সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করে, অন্যদিকে ওই দেশের সুশীল সমাজ ও যুবক সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে। ফ্রান্সের এই বিপরীতমুখী আচরণ আফ্রিকানদের মুগ্ধ নয়, বৈকি বিরক্তই করে তুলেছে। আফ্রিকার যুবক সমাজ ফ্রান্সকে এখন দুর্নীতিবাজ সরকারব্যবস্থার ধারকবাহক মনে করে যে কেবল নিজ স্বার্থ সিদ্ধির প্রতি নিবিষ্ট। আফ্রিকার ও আফ্রিকান সমাজের সঠিক ও সম্যক উন্নয়নের বাস্তবায়ন যে ফ্রান্সের পক্ষে সম্ভব নয়, সেটা আফ্রিকানরা ক্রমশই অনুধাবন করতে পেরেছে।

মধ্যপ্রাচ্যেও পরিস্থিতি জটিল। লেবাননে পরিস্থিতি সমাধানের কোনো সঠিক পথ বা উত্তর আপাতত মাখোঁ কাছে নেই। লেবাননের সমস্যার জন্য মাখোঁ দেশটির রাজনৈতিক অভিজাতগোষ্ঠীকে দোষারোপ করায় ফ্রান্সের প্রতি তাদের মনোভাবের অবনতিই হয়েছে কেবল, কারণ তারাই এখন দেশটির শাসন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ধারকবাহক। আলজেরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও ফ্রান্সের সঙ্গে আলজেরিয়ার সম্পর্কের অবনতি করেছে। আর ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সমস্যা সমাধানের চেষ্টা ফ্রান্স অনেক আগেই ত্যাগ করেছে। সুতরাং ফ্রান্স এখন আর গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার মূল্যবোধের কথা অতটা জোর দিয়ে বলতে পারে না। সৌদি আরব কিছুটা ও আরব আমিরাতের সঙ্গে বেশ সুসম্পর্ক বিদ্যমান ফ্রান্সের। এটুকুই ইতিবাচক কেবল! কিন্তু ফ্রান্সের ক্রমশ মুসলিমবিরোধী ঘরোয়া নীতিসমূহ সেখানে চিড় ধরাতে পারে। যেমনটা মুসলিম বিশ্বে ইতোমধ্যেই অনেকটা করেছে। আর সাম্প্রতিক স্কুলে মুসলিম পোশাক নিষিদ্ধ করা মুসলিমবিরোধী আরেকটি নীতি এই সুসম্পর্কে নতুন সমস্যার উদ্রেক করবে।

ফ্রান্সের রাজনৈতিক আলোচনায় এখন শরণার্থী ও অভিবাসীরা ফরাসি শত্রু, এবং ইসলাম ফরাসি মূল্যবোধের জন্য হুমকি- এ দুটো বার্তাই লক্ষণীয়। মানবাধিকারের প্রসারে সচেষ্ট ফ্রান্স এখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষী নীতি প্রবর্তনকারী হিসেবেই পরিচিত হয়ে উঠেছে।

মাখোঁর জন্য তাই প্রাধিকার হলো বৈশ্বিক পর্যায়ে ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কিছু নতুন ইতিবাচক পদক্ষেপ ও প্রয়াসের অবতারণা করা। জলবায়ু পরিবর্তন কাজ করার চেষ্টা করছে ফ্রান্স। বৈশ্বিক পর্যায়ে যুবক সমাজের জন্য পরিবেশ ও জলবায়ু গুরুত্বপূর্ণ প্রাধিকার। এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিয়ে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ফ্রান্সের সুখ্যাতি কিছুটা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন মাখোঁ। একই সঙ্গে বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থার প্রসারের বিষয়টা মাখোঁর জন্য আরেকটি প্রাধিকার উদ্যোগ। ক্রমশ মেরুকরণের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থার টেকসই ও স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্নের ও শঙ্কার কোনো শেষ নেই। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স এক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারলেও এককভাবে কোনো টেকসই পরিবর্তন করতে পারবে না। সুতরাং অন্যান্য রাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়ে বৈশ্বিক মতবাদ সৃষ্টিতেও ফ্রান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এই লেখাকালীনই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তুতি চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে নিশ্চয়ই ফ্রান্স এ বিষয়ে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব এড়িয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ের সংঘাত থেকে বিরত রাখতে ফ্রান্স, জার্মানির মতোই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এসব ক্ষেত্রেই মাখোঁ ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট। তবে বৈশ্বিক পর্যায়ে অবনতি হওয়া ফ্রান্সের সফট পাওয়ার পুনরুদ্ধার করতে হবে আগে।

এ জন্যই ফ্রান্স এখন এশিয়ার প্রতি মনোনিবেশ করেছে। মঙ্গোলিয়া, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও পাপুয়া নিউগিনি- এই চার দেশে এ বছর সফর করে ফ্রান্স এশিয়াতে তার প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশের যেসব খাতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের বিনিয়োগ রয়েছে, সেসব খাতে ফ্রান্সের বিনিয়োগ অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। পাঠকরা সে বিষয়ে ভালোই অবগত। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, মাখোঁর সফর করা বাকি তিন এশীয় রাষ্ট্র প্রায় একই রাজনৈতিক, এমনকি অর্থনৈতিকভাবেও বাংলাদেশের মতোই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

সেখানেও সরকারদলীয় নেতারা জনগণ ও বিশ্ববাসীর সমর্থন সংগ্রহ করতে মরিয়া। শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি রাজনৈতিক সমস্যায়ও জর্জরিত। মঙ্গোলিয়া ও পাপুয়া নিউগিনিতেও সুশাসনের সংকট ও সরকার পক্ষের সমর্থন ও অনেক ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। পাপুয়া নিউগিনিতে অনুষ্ঠিত গত বছরের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই। নির্বাচনের ন্যায্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। মঙ্গোলিয়ার আর্থিক খাত বাংলাদেশের মতোই অপরিশোধিত ঋণে জর্জরিত। চীন ও রাশিয়ার মাঝখানে অবস্থিত মঙ্গোলিয়া তার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে যেমন দুশ্চিন্তায়, তেমনি সরকার পক্ষ জ্বালানি খাতে দুর্নীতির জন্য অভিযোগে জর্জরিত। ফ্রান্সের মাখোঁ যে সফরের জন্য এ চারটি দেশকে বেছে নিয়েছেন, তার নেপথ্যে একটি পরিষ্কার ছক লক্ষণীয়- যেসব সরকার পশ্চিমা সমর্থন পেয়ে নিজ রাজনৈতিক ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পারবে, ফ্রান্স সেসব রাষ্ট্রই বেছে নিয়েছে। ফ্রান্সের এই কৌশল বাছাইকৃত রাষ্ট্রগুলোর জন্য অনেক অর্থনৈতিক সুযোগ বয়ে আনার পাশাপাশি সরকার পক্ষের জন্য রাজনৈতিক সুবিধাও প্রদান করবে। বিশ্ব রাজনীতির চলমান মেরুকরণ চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফ্রান্সের এ কৌশল অবশ্যই ফলাফল বয়ে আনবে। যেমনটা আমরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি। এই কৌশল দিয়ে ফ্রান্স নিজেকে এশিয়াতে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ছাড়া তৃতীয় অংশীদার হিসেবে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে।

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক


গৌরবের বাংলা ভাষা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এম এ মান্নান

‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন’ বাংলা ভাষার দুর্দশার কথা চিন্তা করেই হয়তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন উক্তি করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলা ভাষা একটি পরিশুদ্ধ এবং পরিশীলিত ভাষা হোক। তাই আজ শত বছর পরও এই কথা অতি প্রাসঙ্গিক। বাংলা ভাষা কখন থেকে শুরু হয়েছে এবং কারা প্রথম শুরু করেছেন তার সঠিক কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। এটা থাকার কথাও না। কারণ ভাষার উৎপত্তি তো কোনো আনুষ্ঠানিতার মধ্য দিয়ে শুরু হয়নি। শুধু বাংলা ভাষা কেন, পৃথিবীর কোনো ভাষারই উৎপত্তিস্থলের কোনো সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ নেই। তখন ভাষার আদান-প্রদান বলতে যা বোঝানো হতো তা ছিল মুখের ভাষা এবং শরীরের ভাষা। কালে কালে তা সাংকেতিক ভাষা এবং লেখ্য ভাষায় রূপ নিতে থাকে। তা সেটা পাথরে খোদাই করেই হোক আর পাতায় লেখাই হোক। হোক তা ছালে-বাকলে।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রসঙ্গ বইয়েও এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো দালিলিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে বাংলা ভাষা যে অতি প্রাচীন এবং হাজার বছরের প্রাচীন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রসঙ্গ বইয়ে বাংলা ভাষাতত্ত্বের ইতিহাস অংশে তা প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর বাঙালি যখন তার আবেগ-অনুভূতি ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে শুরু করেছে সেই সময়টিকে প্রায় ১৩ শ বছরের পুরোনো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত বাংলা ভাষার গাঁথুনি তখন থেকেই শুরু। আর সেটাকেই বলা যায় চর্চাপদ। যা পণ্ডিত হরপ্রসাদ সাস্ত্রী আবিষ্কার করেছেন।

নদী যেমন বহমান, ভাষাও তদ্রূপ। পরিবর্তিত হয়, পরিশীলিত হয়, ঋদ্ধ হয়। তাই বাংলা ভাষার পণ্ডিতগণ ভাষার গতি-প্রকৃতি-অবস্থানকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। শ্রেণিবিন্যাস করেছেন। এখন আমরা বাংলা ভাষাকে যে অবস্থানে পেয়েছি, যেভাবে ব্যবহার করছি এই সময়টাকে বলা হয় নব্য যুগ। মানে আধুনিক যুগ। এর আগে যে যুগ ছিল তার নাম ছিল মধ্য যুগ। মধ্য যুগের আগে যে যুগ ছিল সেটি ছিল সন্ধি যুগ। সন্ধি যুগের আগে যে যুগ ছিল তার নাম প্রাচীন যুগ। সব যুগেরই একটিই প্রয়াস ছিল, সেটা হলো বাংলা ভাষাকে লালন করা এবং মনে-প্রাণে ধারণ করা।

বাংলা সাহিত্যের চরমতম উত্থান ঘটে নব্য যুগে বা আধুনিক যুগে। এই যুগেরই শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি ১৫৭টি গীতি কবিতা সংকলিত করে নাম রাখেন গীতাঞ্জলি। যা ১৯১০ সালে কাব্যগ্রন্থ রূপে প্রকাশিত হয়। এটিই পরে ‘সং অফারিংস’ নামে ইংরেজি অনুবাদ করা হলে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করে। যার মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন বিশ্ব কবি, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি। বাংলা ভাষাকে গানের মাধ্যমে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি ছাড়া আরও যারা অবদান রেখেছেন তারা হলেন লালন শাহ, কাজী নজরুল ইসলাম, হাসন রাজাসহ নানা সংগীত সাধক, কবি ও সাহিত্যিক।

ভাষা ও সংস্কৃতি একটি জাতির প্রধান অনুষঙ্গ। পৃথিবীর কোনো দেশই তার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির বাইরে নয়। তাই পৃথিবীতে দেখা যায় শত শত জাতি-গোষ্ঠী শত শত ভাষা-সংস্কৃতি। এটাই ঐতিহ্য, এটাই তার অস্তিত্ব। আর সেই অস্তিত্বে আঘাত বা অবক্ষয় কোনোভাবেই ঘটতে দেয়া হয় না। মানুষ তার নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষায় ব্যাপৃত হয়ে ওঠেন।

পৃথিবীতে নানা সময়ই নানা আগ্রাসন দেখা দিয়েছে। সেই আগ্রাসন আগেও ছিল এখনো আছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ধুয়া তুলে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালেই আমাদের পূর্ব বাংলার ওপর শুরু হয় ভাষার আগ্রাসন। ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। ২১ মার্চ এ কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে পাকিস্তানের প্রধান কায়েদে আজম জিন্নাহ মূলত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ তখন সারা পাকিস্তানে উর্দু ভাষাভাষির লোকের সংখ্যা ছিল খুবই কম। মাত্র ছয় শতাংশের কাছাকাছি। সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় হলো, যে জিন্নাহ ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রাভাষা হবে উর্দু সেই জিন্না নিজেও উর্দু ভাষায় কথা বলতেন না। তার মানে এটা পরিষ্কার যে, তার বাংলা ভাষার প্রতি বিরোধিতা ছিল শুধুই বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা। তাই বাঙালি জাতি এটা আঁচ করতে পেরে তার এই অযাচিত চাপিয়ে দেয়া অগ্রহণযাগ্য উর্দু ভাষা মেনে নিতে পারেনি। তাই জিন্নার এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই শুরু হলো ভাষার জন্য আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন। বাংলা ভাষার আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সেই ভাষা আন্দোলনে শহীদ হলেন আমাদের নিরীহ বাঙালি । প্রতিষ্ঠা লাভ করল বাংলা ভাষা। কিন্তু আগ্রাসন থেমে থাকল না। এবার ভিন্ন আগ্রাসন দেখা দিল। এই আগ্রাসন আমাদের স্বাধীনতার ওপর আগ্রাসন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তারও অবসান হয়। আমরা হই স্বাধীন জাতি।

বাংলা ভাষাকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় প্রথম ভাষণ দেন। যা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দেন। বঙ্গবন্ধুর পর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।

আধুনিককালে এসে বাংলা ভাষা যে আন্তর্জাতিকা লাভ করবে তা আমাদের কারও ধারণায় ছিল না। ভিন দেশে থেকেও যে মানুষ স্বদেশের ভাষার জন্য কাজ করবে সেটাও ছিল ধারণার বাইরে। রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম দুজনেই বাস করেন কানাডার ভ্যাংকুবার শহরে। নিজেদের তাড়না থেকেই তারা ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য জাতিসংঘের মহাসসচিব কফি আনানের কাছে আবেদন করেন। সেই আবেদন বিফলে যায়নি। পরের বছরই ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ইউনেসকোর প্যারিস অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আর ২০১০ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বিশ্বব্যাপী তা পালিত হচ্ছে।

বাংলাদেশে দাপ্তরিক কাজে যাতে সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয় তার জন্য ১৯৮৭ সালে একটি আইন সংসদে পাস করা হয়। সেই আইনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল জবাব ও অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিতে হবে। এবং বাংলা বাদে অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করলে তা বেআইনি বা অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে।’ এই আইন পাস করার পরও ৩৭ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। কিন্তু এই আইনের যথাথ প্রয়োগ এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। এখানে ভাষা শহীদদের আত্মদানকে অবমাননা করা হয়েছে। যা মোটেও কাম্য নয়।

‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’। ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বর্তমান বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ভাষার মাসে মাসব্যাপী চলে বইমেলা। পৃথিবীর মধ্যে এটাও একটা বড় নজির যে, ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে মাসব্যাপী বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। শত শত প্রকাশক তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে হাজির হন একুশের বইমেলায়। বইমেলা সারা মাস প্রাণবন্ত থাকে লেখক-প্রকাশক-পাঠক আর দর্শনার্থীদের ভিড়ে। প্রতি বছর শত শত নতুন বই প্রকাশিত হয়, আর হাজার হাজার বই বিক্রি হয় এ মেলায়। যা বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার এক চিরন্তন প্রয়াস।

ভাষার জন্য সংগ্রাম করা, ভাষার জন্য জীবন দেয়া এবং সেই ভাষাকে মাতৃভাষা বা রাষ্ট্রভাষায় প্রতিষ্ঠিত করার নজিরও পৃথিবীতে হয়তো আর দ্বিতীয়টি নেই। একুশ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ তথা সারা বিশে^ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। যেটা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়, অনন্য মর্যাদায়। এখন দরকার এই ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করা, আরও ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটানো। মনে সন্তুষ্টি জাগে এই ভেবে যে, নিজ দেশে ভাষা বিকৃতির নৈরাজ্য চলার পরও পৃথিবীর নানা দেশে বাংলা ভাষা চর্চার আগ্রহ বাড়ছে। যেখানে পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, সেখানে বাংলা ভাষা চর্চার আগ্রহ বাড়া সুখবরই বটে। একটা গানে আমরা শুনতে পাই ‘আমরা বাঙালি ছিলাম রে’। ভিন দেশি বাদ্যযন্ত্রনির্ভর ভিন দেশি গানচর্চার আধিক্যের কারণেই এই গান গাওয়া। যা আমাদের ভিন দেশি সংস্কৃতি থেকে ফিরে আসতে আহ্বান করে। আমরা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি লালন করব এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক


বিবৃতিতে ইউনূসের চেয়ে নির্বাচনকে প্রাধান্য দেয়া কীসের ইঙ্গিত

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মো. সাখাওয়াত হোসেন

ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি প্রদান করে বিশ্বনেতারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে হুলস্থূল কাণ্ড ফেলে দিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন বিবৃতিদাতারা। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ও আইন-কানুনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হুমকি প্রদানের জন্যই বিবৃতিটি এসেছে। এ কথাও বাস্তবিক অর্থে সত্য যে, ড. ইউনূসের প্রত্যক্ষ আবেদন ও অনুরোধে বিবৃতিটি বিবৃতিদাতারা প্রদান করেছেন। তবে বিবৃতিটি যদি ড. ইউনূসকে নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে বিষয়টিকে একটি দৃষ্টিকোণ দিয়ে আলোচনা করা যেত। কিন্তু এর সঙ্গে যখন বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে ইঙ্গিত প্রদান করা হয়, সে ক্ষেত্রে বিষয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের সংযুক্তির বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। যেহেতু বিবৃতি ড. ইউনূসের অনুরোধে এসেছে কিংবা বিশ্বনেতাদের পক্ষ থেকে ড. ইউনূসের বিষয়ে এসেছে, সেহেতু নির্বাচনের ব্যাপারেও ইউনূসের আগ্রহকে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বনেতারা মন্তব্য প্রদান করেছেন।

এর মানে বিষয়টি দাঁড়ায়- বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইউনূসের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে, বিদেশি হস্তক্ষেপে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে চান। ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ড. ইউনূসের কাছে প্রস্তাব এসেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হওয়ার, কিন্তু এত অল্প সময়ের জন্য তিনি সরকারের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তার মানে দাঁড়ায়, রাজনীতিতে ড. ইউনূস ব্যাপক আগ্রহ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়নের সময় শীর্ষ রাজনীতিবিদরা যখন জেলে সে সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে ড. ইউনূস রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করেন এবং পত্রিকাতে খোলা চিঠি লিখে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তার এ বিষয়টিকে চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করে এবং শেষমেষ তিনি তার আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে সরে আসেন এবং দেশে ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রামের ভিত্তিতে ৩ মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২ বছর অতিক্রান্ত করে নির্বাচন আয়োজনে বাধ্য হয়।

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় বিবৃতিকে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছেন এ দেশের জনতা। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন ড. ইউনূস, এ ধরনের কাজ একজন নোবেলবিদ কীভাবে করতে পারেন, সে বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আপামর জনসাধারণ। দেশের বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে প্রকাশ্যে বিশ্বনেতাদের বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক সময় দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গোপনীয়তা রক্ষা করে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের সঙ্গে বিশ্বনেতাদের আলাপচারিতা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু যেভাবে একেবারে প্রকাশ্যে বিচারকাজ বন্ধে বিশ্বনেতাদের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রদান করা হলো তা চরম ধৃষ্টতার শামিল। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন এবং অ্যাটর্নি জেনারেল সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ঘটনার ফ্যাক্ট না জেনেই বিশ্বনেতারা এমন মন্তব্য করেছেন। মামলার প্রকৃত ঘটনা জানলে বিশ্বনেতারা কখনোই এ ধরনের বিষয়ের সঙ্গে জড়িত হতেন না।

ড. ইউনূস একজন সম্মানিত ব্যক্তি, তিনি কীভাবে এ ধরনের কাজ করেন বিষয়টা কোনোভাবেই মেনে নেয়ার মতো নয়। যে বিষয়গুলো নিয়ে মামলা হয়েছে, মামলার ফ্যাক্ট বুঝে তিনি আইনজীবী নিয়োগ করে আইনগত প্রক্রিয়ায় মামলা মোকাবিলা করবেন- বিষয়টি এমন হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি উল্টো কাজটি করলেন, দেশের বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মানসেই তিনি বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে বিবৃতি নিয়ে আসলেন। অথচ কিছুদিন আগে রাজস্ব বোর্ডের মামলায় কর ফাঁকির অভিযোগে ড. ইউনূসকে সাড়ে ১২ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে। তাহলে ধরে নেয়া যায়, চলমান মামলাতেও তিনি পরাজিত হবেন সে আশঙ্কা থেকেই তিনি বিবৃতি নিয়ে এসেছেন। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতাদের দায় রয়েছে এবং তাদের ইমেজও ক্ষতিগ্রস্ত ও খাটো হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, অন্যান্য জায়গায় তাদের ভূমিকা নিয়ে মানুষ প্রশ্ন তুলছে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে- ড. ইউনূস বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের নাগরিক। তিনি বাংলাদেশে রাজনীতি করবেন এটা একটি স্বাভাবিক ইচ্ছা এবং কোনোভাবেই দোষের নয়। কিন্তু দোষের হচ্ছে তিনি বাংলাদেশে রাজনীতি করবেন বিদেশিদের ফর্মুলায়। এটি কি কোনোদিন বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেবে, যেমনটি মেনে নেয়নি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ড. ইউনূসের প্রচেষ্টাকে। আবার এটিও বলা যায়, রাজনীতিতে আগ্রহের বিষয়ে তিনি যে সময়কালকে বেছে নেন, সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বনেতাদের বিবৃতিতে এটি খুব সহজেই প্রতীয়মান হয়, রাজনীতিতে ইউনূসের আগ্রহ রয়েছে এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রণীত হলে ইউনূসের রাজনীতিতে সম্পৃক্তায়নের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। না হলে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচার বন্ধের পাশাপাশি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিশ্বনেতাদের বিবৃতি প্রদানের কথা নয়। কাজেই বিষয়গুলো কিন্তু একটির সঙ্গে অন্যটি পরিপূরক এবং বাংলাদেশের মানুষ এ বিষয়গুলোতে অবগত যে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় প্রত্যেককে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, দেশের স্বার্থে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।

তা না হলে বিদেশিরা বাংলাদেশকে আঁকড়ে ধরতে পারে, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে রুখে দিতে পারে। মোটামুটিভাবে বাংলাদেশের মানুষ এ ক্ষেত্রে সজাগ ও সচেতন, বিদেশি প্রভাবকে তারা কখনোই মেনে নেবে না। বাংলাদেশের সরকারপ্রধানও সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, দেশ পরিচালিত হবে দেশের আইন-কানুনের মাধ্যমে, কোন বিদেশি ফর্মুলায় দেশ পরিচালিত হতে পারে না। বিদেশিরা ড. ইউনূসের পক্ষে বিৃবতি দিয়েছেন সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার কিন্তু বিদেশিদের বিবৃতিতে বিচারকাজ কখনো বন্ধ হতে পারে না। উল্টো তিনি বিদেশিদের ইউনূসের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগের পরামর্শ প্রদান করেছেন।

বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে একটি পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জায়গায় বিদেশিরা সরাসরি তত্ত্বাবধায়কের কথা না বলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজনের জন্য দেন-দরবার করছেন। আবার এর মধ্যে পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় অনেকেই বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানাচ্ছে। পক্ষগুলোর দাবি মূলত অনির্বাচিতদের হাতে সরকারের শাসনভার ন্যস্ত করে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করা। অবশ্য নির্বাচন নিয়ে কাজ করে দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে অভিজ্ঞ এমন অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পূর্ব অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়কে ফিরে যাওয়া কোনোভাবেই সমীচীন হবে না।

বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও বারবার বলছেন, দেশের প্রচলিত আইন মেনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়কের কোনো বিধান নেই, সরকার নির্বাচন কমিশনের জন্য নতুন আইন করেছে। নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা রয়েছে এবং ইতোপূর্বে বর্তমান কমিশন গ্রহণযোগ্য বেশ কিছু নির্বাচন আয়োজন করেছে। সে জায়গায় বিদেশিদের নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার তাগাদার ব্যাপারটি সরকার আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ড. ইউনূসের পক্ষে বিদেশিদের বিবৃতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন উঠে আসায় বিষয়টিতে অনেকেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে। বিষয়টি যদি ড. ইউনূসকে নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে এক কথা ছিল কিন্তু বিষয়টি আরও অনেকদূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে বিধায় ষড়যন্ত্রের আভাস পরিলক্ষিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। আবার লবিস্টের মাধ্যমে বিবৃতি প্রদানের বিষয়ে প্রায় সবাই অবগত, এ জায়গায় এমনটিও হয়ে থাকতে পারে।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশের জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচন সামনে রেখে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হতে পারে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই এ দেশের জনসাধারণকে সচেতন থাকতে হবে, দেশবিরোধী চক্রকে প্রতিহত করতে হবে। সরকারকেও দুষ্ট চক্র দমনে উদ্যোগী হতে হবে, যেকোনো মূল্যে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত রাখতে হবে। বিদেশি কোনো অপশক্তির হাতে বাংলাদেশ কখনোই মাথা নত করতে পারে না। শিরদাঁড়া উঁচু করে বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত সোপানে অগ্রসর হবে আগামী দিনে- আমাদের এমনটিই প্রত্যাশা।

লেখক : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ

আপডেটেড ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১০:০০
নিরঞ্জন রায়

আমরা আজ যে গৌরবের বাংলাদেশ নিয়ে গর্ব করছি, সেই দেশ জন্মের শুরু থেকেই গৌরবের বাংলাদেশ হিসেবে পথচলা শুরু করে অর্ধ শতাব্দী পার করে সামনে এগিয়ে চলছে। মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক নেতৃত্বে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে যেভাবে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, তার নজির পৃথিবীতে বিরল। এটিই গৌরবের বাংলাদেশ এবং এখান থেকেই আজকের গৌরবের বাংলাদেশের পথচলা। তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে, এই গৌরবের বাংলাদেশেও কিছু কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার কলঙ্কজনক অধ্যায়ের গ্লানি আমাদের বয়ে চলতে হবে আজীবন। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারার উল্টোপথে চালিত করা এবং মাঝের দেড় দশকের সামরিক শাসন না থাকলে গৌরবের বাংলাদেশ আরও উন্নত অবস্থানে থাকতে পারত। তার পরও অনেক উত্থান-পতনের পর এবং অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের হাল ধরায়, বিশেষ করে বিগত দেড় দশক একটানা রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পাওয়ায় দেশের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। এক সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের তকমা দেয়া তলাবিহীন ঝুড়ি তার জীবদ্দশাতেই আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে এবং এটাই হচ্ছে আমাদের গৌরবের বাংলাদেশ।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব এবং সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক খাতে ব্যাপক উন্নতি সাধন করতে পেরেছে। এই উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে দেশের সর্বত্র। প্রায় সব সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে যথেষ্ট সন্তোষজনকভাবে। জিডিপির আকার যেমন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই সঙ্গে মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় তিন হাজার ডলারের কাছে পৌঁছে গেছে। যদিও বিগত তিন বছর উন্নয়নের গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে, কারণ দুই বছরের করোনা মহামারি এবং গত বছর থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সমগ্র বিশ্বই একটি সংকটকাল অতিক্রম করছে, যার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক এবং পড়েছেও। বিশেষ করে ডলার সংকট এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে। তারপরও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছে এবং প্রবৃদ্ধির হার এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ছয় শতাংশের ওপরেই আছে, এটাই আশার কথা।

একটি বিষয় এখানে খুবই প্রণিধানযোগ্য, তা হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে, তা মূলত সম্পন্ন হয়েছে বিগত ১৫ বছরে। অথচ এই ১৫ বছরে বিশ্ব অর্থনীতি যে পুরোমাত্রার ভালো অবস্থানে ছিল তা মোটেই বলা যাবে না। ২০০৮ সালের আমেরিকায় সারপ্রাইম মর্টগেজ কেলেঙ্কারির কারণে সেখানে মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, যা মুর্হূতের মধ্যে সমগ্র বিশ্বে, বিশেষকরে ইউরোপের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। উন্নত দেশগুলোর সরকার সর্বশক্তি নিয়ে এই মন্দা মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বেইল-আউট প্যাকেজের নামে শত শত বিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে ঢেলে শেষ রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। এত ব্যাপক সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে মন্দা আটকানো গেলেও অর্থনীতি সেভাবে আর কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। অধিকাংশ উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতি সুদের হার বা বেঞ্চমার্ক রেট শূন্যের কাছে রেখেছিল সেই ২০০৮ সাল থেকে, কিন্তু তারপরও তাদের অর্থনীতি মন্দা-পূর্ববর্তী অবস্থায় কখনোই ফিরে যায়নি। এ রকম একটি প্রতিকূল বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থায় বাংলাদেশ এই অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। এখানেই বাংলাদেশের উন্নতির বিশেষত্ব, যা অনেকেই সেভাবে বিবেচনায় নেয়ার চেষ্টা করে না।

দেশের এই অভূতপূর্ব উন্নতি যে এমনি এমনি হয়েছে, তেমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এই উন্নতির পেছনে রয়েছে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্ত। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর নেতৃত্বে ছিলেন এবং তিনি যথেষ্ট সাহসিকতার সঙ্গে কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ উন্নতির এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছে। বিশেষ করে তিনি দেশে অবকাঠামো নির্মাণে বৈপ্লবিক সব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অসংখ্য সাধারণ মানের অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি প্রায় এক ডজনেরও বেশি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে দীর্ঘমেয়াদি সব অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। এসব মেগা প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে (১) পদ্মা সেতু, (২) ঢাকায় মেট্রোরেল, (৩) এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, (৪) বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল, (৫) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, (৬) পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, (৭) কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ, (৮) চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, (৯) যমুনা নদীর ওপর পৃথক স্বতন্ত্র রেলওয়ে ব্রিজ নির্মাণ, (১০) দেশের মহাসড়ক চার এবং ছয় লেনে রূপান্তর, (১১) দেশের অধিকাংশ অঞ্চল রেলপথের আওতায় নিয়ে এসে ডাবল লাইন নির্মাণ, (১২) কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক মানের বৃহত্তম বিমানবন্দর নির্মাণ, এবং (১৩) দেশব্যাপী ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট লাইন স্থাপন। এসব মেগা প্রকল্প যে শুধু গৃহীত হয়েছে এবং উদ্বোধন করা হয়েছে এমন নয়, যা একসময় আমাদের দেশে চিরাচরিত রেওয়াজ ছিল। এসব দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণের উদ্দেশ্যে গৃহীত মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত গতিতে একযোগে এগিয়ে চলেছে। বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে চালুও হয়েছে। যার মধ্যে পদ্মা সেতু, ঢাকার মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অন্যতম। খুব শিগগির কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের কাজ এবং বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষ হবে এবং জনগণের ব্যবহারের জন্য খুলেও দেয়া হবে বলেই জানা গেছে।

এক দশক সময়ের মধে এতগুলো দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করার নজির সমসাময়িক বিশ্বের আর কোনো দেশে আছে কি না আমার জানা নেই। উন্নত-অনুন্নত অনেক দেশ একটি বা দুটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতেই হিমশিম খায়। আমার জানামতে বাংলাদেশ ছাড়া বর্তমান সময়ে বিশ্বের আর দুটি দেশে আধুনিক ট্রানজিট সিস্টেম নির্মাণের উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছিল এবং সেগুলো হচ্ছে কানাডার টরন্টোতে লাইট-রেল এবং চিলির রাজধানী সান্টিয়াগোতে মেট্রোরেল। টরন্টো লাইট-রেল প্রকল্প শুরু হয় ২০০৭ সালে। ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রেল নেটওয়ার্ক নির্মাণ করার ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩.৫০ বিলিয়ন ডলার এবং নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে এবং সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। একাধিকবার পিছিয়ে ২০২২ সালে চালু হওয়ার কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হয়নি। এখন কর্তৃপক্ষ আর নির্দিষ্ট করে জানাতে পারছে না যে, কবে নাগাদ এটি চালু হবে। ইতোমধ্যে এর নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৪০ বিলিয়ন ডলার। চিলির রাজধানী সান্টিয়াগোতে ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০১৭ সালে। নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ২.৫০ বিলিয়ন ডলার। এই লাইন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৭ সালে। এর বাইরে সে রকম উল্লেখযোগ্য বৃহৎ এবং দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণের খবর আমরা সেভাবে শুনিনি।

অবকাঠামো সম্পর্কে অর্থনীতিতে একটি তত্ত্ব আছে যে, অবকাঠামো হচ্ছে দেশের উন্নয়নের সোপান। অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়ে থাকে। অবকাঠামো কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি শুধু নিশ্চিতই করে না, এই উন্নতি ত্বরান্বিতও করে। যত বেশি অবকাঠামো, তত বেশি উন্নতি। অবকাঠামো তৈরি করতে পারলে, তাকে কেন্দ্র করে বাকি উন্নতি এমনিতেই হতে থাকবে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি অনেক বেশি পরিষ্কার হবে। একটি হতদরিদ্র এবং পশ্চাৎপদ গ্রাম, যেখানে একটি ভালো রাস্তাও নেই, সে রকম একটি গ্রামে যদি একটি ভালো রাস্তা করে দেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে সেই গ্রামের বাসিন্দারাই নিজ উদ্যোগে রাস্তায় অনেক যানবাহন নামাবে ভাড়ায় চালানোর জন্য। সেখানকার মানুষের চলাচলে গতি আসবে, রাস্তার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠবে অনেক হাটবাজার, গ্রামের উৎপাদিত পণ্য অনেকে শহরে নিয়ে বিক্রি করবে, আবার অনেকে শহর থেকে শিল্পজাত পণ্য এনে গ্রামে বিক্রি করবে। এতসব কর্মকাণ্ডের কারণে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে। ফলে সেই গ্রামে দ্রুত উন্নতির ছোঁয়া লাগবে এবং গ্রামের চেহারাই বদলে যাবে। একই অবস্থা একটি দেশের ক্ষেত্রে। যে দেশে অনেক বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব হবে, সেই দেশ তত বেশি উন্নতি করবে এবং দেশের চেহারাই একসময় বদলে যাবে। অর্থনীতির এই মূলমন্ত্রটি পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো খুব ভালোভাবে রপ্ত করতে পেরেছে এবং তারা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নতমানের দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। এই কারণে সেসব দেশ উন্নতিও করেছে যথেষ্ট। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনীতির এই মূলমন্ত্র সেভাবে রপ্ত করতে পারেনি। এদিক থেকে বিগতদের যুগে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই ব্যতিক্রম। এই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটানা দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছেন এবং তিনি যথার্থই অর্থনীতির এই তত্ত্বের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। আর এ কারণেই তিনি অসংখ্য মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে উন্নত বিশ্বের আদলে সব অবকাঠামো নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে একটি-দুটির বেশি দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি, সেখানে বাংলাদেশ এতগুলো দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণের উদ্দেশ্যে মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে তার সফল বাস্তবায়ন কাজ শেষ করে এনেছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি চালুও হয়ে গেছে এবং জনগণ তা থেকে ব্যাপক সুবিধা পেতে শুরু করেছে। বাকিগুলোর অগ্রগতি দৃশ্যমান এবং খুব সহসাই চালু হবে, ফলে সেখান থেকেও জনগণ সুবিধা পেতে শুরু করবে। গৌরবের বাংলাদেশের জন্য কিছু বিশেষ বিশেষ সময় আছে, যা নিয়ে সত্যিকার অর্থেই গর্ব করার মতো। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সময়কাল ছিল আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের দশক। আবার ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সময়কাল ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দশক। ঠিক তেমনি ২০১০ থেকে ২০২৩ সময়কাল হচ্ছে দেশে অবকাঠামো নির্মাণের দশক। বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, আর সেই স্বাধীন দেশে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিয়ে নির্মাণ করে দিয়েছেন অসংখ্য অবকাঠামো। বঙ্গবন্ধু চরম ত্যাগের বিনিময়ে যে গৌরবময় বাংলাদেশ আমাদের এনে দিয়েছেন, সেই গৌরবময় বাংলাদেশেই তাঁর সুযোগ্য কন্যা গড়ে তুলেছেন গর্ব করার মতো সব অবকাঠামো। এক কথায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত আমাদের গৌরবের বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্মিত গৌরবের অবকাঠামো।

লেখক: সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা


গৌরবের বাংলাদেশ

ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

দেশসহ বিশ্ববাসী সম্যক অবগত আছেন; দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামক ভঙ্গুর এক সামরিক-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছিল। স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাকে মাতৃভাষা মর্যাদাদানের দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে এর খণ্ডিত কাঠামোর স্বরূপ উন্মোচিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান আইন সভার সদস্য কুমিল্লার বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির জোরালো কণ্ঠ ধর্মের মোড়কে পাকিস্তান সৃষ্টির অযৌক্তিকতাকেই সুস্পষ্ট করেছে। পাকিস্তানের তৎকালীন মোট জনসংখ্যার শতকার ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিবাদ-আন্দোলন-সংগ্রাম শুধু ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে মহিমান্বিত করেনি, দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল পটভূমিও রচনা করেছে। যদিও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম সূচনাপাঠ হয়েছিল ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক প্রবর্তিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাধ্যমে। সে সময় রবীঠাকুর রচিত আজকের আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ শুধু বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অকুণ্ঠ সমর্থনকে শাণিত করেনি, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পুণ্য হোক পুণ্য হোক পুণ্য হোক হে ভগবান’ ইত্যাদি রচনা বাঙালি জাতীয়তাবোধের সঞ্চারণকে অভিনব চেতনায় উদ্ভাসিত করেছে।

ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য সত্য হচ্ছে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই উজ্জীবিত অপরিসীম আত্মত্যাগের মহিমা, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মিছিল-মিটিং, পিকেটিং, বিক্ষোভ ইত্যাদির সমন্বিত প্রয়াস জাতিকে স্বাধিকার আন্দোলনের নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৯৫৫ সালে ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ ২১ দফা ঘোষিত হয়। ২৩ জুন আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদের সভায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা না হলে দলীয় সদস্যদের আইন সভা থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার করণীয় সম্পর্কে যুক্তি উত্থাপন করেন। ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। মূলত ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে যে দাবানল প্রজ্বলিত হয় তারই আলোকে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়চেতা নেতৃত্বে পরবর্তী সব আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নির্মিত হয়।

১৯৫৬ সালের ১৪ জুলাই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রদেশ প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বকে পরিহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগের সভায় প্রস্তাব পেশ করেন। ৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিল বের করা হলে চকবাজার এলাকায় পুলিশ ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৫৮ সালে ৭ অক্টোবর রাজনীতি নিষিদ্ধ করে সামরিক শাসন জারির পর থেকে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ সময় জেলবন্দি জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৬০ সালের ৭ ডিসেম্বর জেল থেকে মুক্তিলাভ করে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করার লক্ষ্যে বিশিষ্ট ছাত্রনেতাদের সম্পৃক্ত করে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। আবারো ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালে বিভিন্ন সময় কঠিন জেল-জীবনযাপনের পর মুক্ত হয়ে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন।

বস্তুতপক্ষে প্রস্তাবিত এই ৬ দফাই ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। একই বছর ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটপরিক্রমায় এক নতুন যাত্রার শুভসূচনা ঘটে। বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের জন্য ভয়ংকর বিপদ-আতঙ্কে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৯৬৯-এর ৫ জানুয়ারি গঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায় এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিকে প্রচণ্ডভাবে বেগবান করে। এই আন্দোলনের ফলে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মামলা প্রত্যাহারসহ শাসকগোষ্ঠী মুক্তিদানে বাধ্য হয়। প্রায় দশ লাখ ছাত্র-জনতার সমাবেশ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা ও ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলিক ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিকতায় পরিপূর্ণ দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ও প্রত্যাশিত বাঙালি জাতিসত্তার মূল্য ও ঐতিহ্যবোধসমৃদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এর মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের রোডম্যাপ রচিত করে ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের অতুলনীয় প্রাণ বিসর্জন ও ত্যাগের ইতিহাস রচনায় বাঙালি জাতি অর্জন করেছে স্বাধীন সার্বভৌম মাতৃভূমি। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির পদে ইস্তফা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তাঁর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনার মূলমন্ত্র ছিল শোষণমুক্ত জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতাকে পরিপূর্ণভাবে অর্থবহ করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অপরিমেয় সাফল্যগাঁথায় অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিতে বাংলাদেশ যখন নতুন অভিযাত্রায় পদার্পণ করেছিল, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতার হিংসার কৌশলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে সংঘটিত হয় সভ্যসমাজের ইতিহাসে সর্বনিকৃষ্ট, নৃশংস ও বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গমাতা, শিশু শেখ রাসেলসহ প্রায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেড় মাস অতিক্রমকালে খন্দকার মোশতাক ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএইচ রহমান স্বাক্ষরিত ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ শিরোনামে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়। ১৯৭৫ সালের ৫০নং অধ্যাদেশ হিসেবে পরিচিত আইনটি ১৯৭৯ সালে সংসদ কর্তৃক অনুমোদন দেওয়া হয় এবং পঞ্চম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই জঘন্য আইন প্রবর্তন করার পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া।

১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে পরাজিত অন্ধকারের অশুভ অপশক্তি অতি সূক্ষ্ম চতুরতায় দেশকে পুনরায় পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার সব অপকৌশল অবলম্বনে দেশব্যাপী অরাজক-নিষ্ঠুর সামগ্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়। বিরাজিত সব অসঙ্গতি-বিভ্রান্তি-অন্ধকারের শক্তির সব কদর্য পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা পুনরুদ্ধার সংকল্পের কঠিন ব্রতে দেশরত্ন শেখ হাসিনা দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছরের চরম কষ্টের নির্বাসিত জীবনযাপন শেষে দেশ ও দলের কঠিন দুঃসময়ে সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞাকে অবজ্ঞা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে অকুতোভয় সংগ্রামী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। বাংলার মানুষের হারিয়ে যাওয়া অধিকার আদায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বৈর-সামরিক সরকারবিরোধী গণআন্দোল গড়ে তোলেন।

জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯০ সালের ঐতিহাসিক গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে স্বৈরচারী সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ২৩ জুন সরকার গঠনের পর জাতির জনকের হত্যার বিচার দাবি এবং ঐতিহাসিক এই বিচারিক রায়ের কার্যকর বাস্তবায়নের মতো অবিনস্বর কার্যক্রমের জন্য তিনি চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। মহান জাতীয় সংসদে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলকরণ ছিল জননেত্রী শেখ হাসিনার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অমীমাংসিত আন্তর্জাতিক গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন, পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধে সরকার এবং জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি ও ২১ ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতিসহ দেশ ও জনকল্যাণমূলক অনেক কর্মযজ্ঞের সফল ও সার্থক বাস্তবায়ন।

২০০৯ সালে পুনরায় নির্বাচিত দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দক্ষ সরকার দুর্নীতিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং সবক্ষেত্রে সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছিলেন বলেই ২০১৭ সাল নভেম্বর মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের ১৭৩টি দেশের সরকারপ্রধানদের মধ্যে সততার জন্য বিশ্ব শীর্ষ পাঁচটি আসনের মধ্যে নিজেকে তৃতীয় স্থানে অধিষ্টিত করেছেন। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মাদক ও অপকর্ম-অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত নিজ দল, দলের অঙ্গ-সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিকলীগসহ আপন আত্মীয়-স্বজন হলেও কাউকেও ছাড় না দেয়ার ঘোষণায় দেশের সব সচেতন-সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও আকাশচুম্বী প্রশংসায় নেত্রী নন্দিত হয়েছেন। সম্ভাষিত নতুন পালকে অবিসংবাদিত মুকুটে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বনন্দিত ও বরেণ্য সফল রাষ্ট্রনায়কের উপমা তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। বিশ্বে ধরিত্রী-সমুদ্র-সীমান্ত-মঙ্গা-মহাকাশ-পরিবেশ বিজয়ে সফল ও সার্থক রূপায়ণ তাঁর নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছে।

ধারাবাহিকভাবে দেশ পরিচালনায় দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন উঁচুমাত্রিকতায় সমাসীন করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষাসহ বিভিন্ন নীতির আলোকবর্তিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। নানামুখী বৈশ্বিক সমস্যা-সংকট উত্তরণে তাঁর অনুপম ভূমিকা এবং সামগ্রিক বিষয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে। বহু-দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক উপ-আঞ্চলিকসহ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অধিকতর অত্যুজ্জ্বল। নারী নেতৃত্ব-নারী উন্নয়ন-নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল ও সংস্থার শীর্ষ বিশ্বনেতৃত্বের স্বীকৃতি শুধু নেত্রীকে নয়; প্রবোধিত আত্মপ্রত্যয় ও আত্মমর্যাদায় বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের অবস্থানকে বিশ্বপরিমণ্ডলে করেছে সুমহান মর্যাদায় সমাসীন। স্বীয় ও রাষ্ট্রের উঁচুমার্গের খ্যাতিকে সুদৃঢ় করার এবং জনগণের প্রত্যাশিত আস্থা ও বিশ্বাস অটুট রাখার স্বার্থেই দুরূহ কিছু সিদ্ধান্তের দৃশ্যমান বাস্তবায়ন বস্তুতপক্ষে তাঁর ধীশক্তির বিকাশ ও বিস্তার প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনার পরিচায়ক। বলিষ্ঠচিত্তে নির্ভীক স্বাধীনসত্তায় আত্মপ্রত্যয়ী এ মহীয়সী নেত্রী তথাকথিত উন্নত বিশ্বের শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু ও অপপ্রচারণা এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব অশুভ চক্রান্ত-প্ররোচনাকে উপেক্ষা করে ইতিমধ্যে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে প্রতিস্থাপন করেছেন। বিশ্বব্যাংকের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র এবং পদ্মা সেতু নির্মাণে মিথ্যা নাটকের অবসান ঘটিয়ে ‘আমরাও পারি’ ব্রত গ্রহণ করে পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান অবয়বে অবিস্মরণীয় এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ৫০ বছরের অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কর্মযজ্ঞকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন পরিক্রমা তথা আশু-স্বল্প-দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা কার্যকরণ রোডম্যাপে অগ্রসরমান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, লিঙ্গ সমতা, দরিদ্রতার হার হ্রাস, মাথাপিছু আয় ও গড় আয়ু বৃদ্ধি, শ্রমঘন রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, বিশেষায়িত ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব উন্নয়ন, পোশাক ও ঔষধশিল্পকে রপ্তানিমুখীকরণ ইত্যাদি আজ দেশের আর্থ-সামাজিক দৃশ্যপটে যুগান্তকারী অভিধায় সমুজ্জ্বল। অন্যদিকে ভৌত অবকাঠামো, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদিকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, নিজস্ব অর্থায়ানে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, পরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলাবদ্ধতা নিরসন, সুপেয়-ব্যবহারযোগ্য পানি ও স্যুয়ারেজ প্রকল্পের মতো বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের অব্যাহত বাস্তবায়নসহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের সফলতা-সক্ষমতা অর্জনে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব পরিমণ্ডলে উন্নয়ন-অগ্রগতির রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত।

জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ গরিব মেহনতি জনতার সুগভীর দরিদ্রতাকে উৎপাটন করে একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সুখীসমৃদ্ধ রাষ্ট্র বিনির্মাণের যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন; তারই আলোকে তাঁর সুযোগ্য কন্যা ইতিমধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেছেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে দেশের ভূমি-গৃহহীন পরিবারের হাতে জমি ও সেমিপাকা বাড়ির দলিল প্রদান সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শুধু বিরল নয়; দৃশ্যমান মানবকল্যাণে বিশ্বশীর্ষ পটভূমি নির্মাণ করেছেন। অতিসম্প্রতি দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনপ্রবাহ বিবেচনা করে বহুল আলোচিত-প্রতীক্ষিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে সামাজিক সুরক্ষায় এক মাঙ্গলিক অধ্যায় রচিত হয়েছে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনায় দেশের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ২০৪১ সালে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করার জন্য প্রতিনিয়ত রোডম্যাপ বা রূপকল্প প্রণয়ন/কার্যকর করার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়ার দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। গৌরবদীপ্ত বাংলাদেশ বিশ্বপরিমণ্ডলে শুধু গৌরবোজ্জ্বল ভূখণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি; উন্নয়ন অগ্রগতির বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নির্মাণ করেছে এক অনুপম অধ্যায়। উন্নয়নের রোলমডেলখ্যাত দেশের প্রধান কাণ্ডারি জননেত্রী শেখ হাসিনা অবিচল নিষ্ঠা-দৃঢ়চেতা-প্রজ্ঞার অসাধারণ স্মারকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ সফল ও সার্থক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তাঁর নেতৃত্বে গৌরবের উঁচুমাত্রিকতায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের লালসবুজের পতাকা চিরকাল সমুজ্জ্বল মর্যাদায় উড্ডীন থাকবেই- নিঃসন্দেহে তা দাবি করা মোটেও অমূলক নয়।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


ডিজিটাল অর্থায়নের কোনো বিকল্প নেই

আতিউর রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আতিউর রহমান

করোনা সংকটকালে আমরা ঠেকে শিখলাম যে, প্রকৃত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চাঙ্গা রাখতে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের কোনো বিকল্প নেই। সবার কাছে সহজেই সাশ্রয়ী মূল্যে অর্থ পৌঁছানোর আরেক নাম অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশ ঘটায় এ লক্ষ্য পূরণ আগের চেয়ে অনেকটাই সহজ হয়েছে। বিশেষ করে মোবাইল ফোনের সংযোগ বেড়ে যাওয়ায় তাকে ঘিরে নয়া ধাঁচের আর্থিক সেবা প্রদানের সুযোগ অভাবনীয়ভাবে বেড়েছে। ২০০৭-০৮-এর বিশ্ব আর্থিক সংকটের পর থেকেই বিশ্বের অনেক দেশই প্রকৃত অর্থনীতি তথা কৃষি, খুদে ও মাঝারি শিল্প এবং রপ্তানিমুখী শিল্পের বিকাশে তাদের কাছে বাড়তি অর্থপ্রবাহের গুরুত্ব বেশি বেশি অনুভূত হতে থাকে। বাংলাদেশ অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে গভীরভাবে অনেকের কাছে অর্থ পৌঁছে দেয়ার প্রয়োজনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে নয়া ধাঁচের অর্থ লেনদেনের ওপর জোর দিতে শুরু করে। বিশ্ব আর্থিক সংকটের সময় শুধু স্বল্পমেয়াদি আর্থিক পণ্য বা সেবা দিয়ে উন্নত বিশ্ব যেভাবে নয়া উদারনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে, তাতে প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর তেমন কোনো প্রভাবই পড়েনি। অর্থনৈতিক বৈষম্য এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, ‘আমরা ৯৯ শতাংশ বনাম ওরা ১%’ শিরোনামে ওয়ালস্ট্রিটনির্ভর আর্থিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। মুষ্টিমেয় ধনিকের হেলিকপ্টারে করে টাকা নেয়ার এ কৌশলের বিপরীতে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অনেক দেশেই গরুর গাড়িতে করে কৃষক, খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছে অর্থ নিয়ে যাওয়ার এক নয়া কৌশল গ্রহণ করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং কৌশল চালু করে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে তার প্রধান ব্যাংকিং কৌশল হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দশ টাকার হিসাব খোলা, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ব্যাংকিং সুযোগ সৃষ্টি করা, মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং সূচনা করা, কৃষি ঋণ দিতে ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোকেও ‘প্রণোদনা ও নির্দেশনা’ দিয়ে মাঠে নামানো এবং আর্থিক খাতের সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূল ধারায় নিয়ে আসার মাধ্যমে এক নয়া ধাঁচের উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের নয়া মডেল দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। এর সুফল বাংলাদেশের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হওয়ায় বিশ্ব আর্থিক সংকটের ঝাপটা আমাদের অর্থনীতিতে সেভাবে লাগেনি। ভোগের পরিমাণ কমেনি। বরং বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদাও সে কারণে বেড়েছে। আর তাই মাথাপিছু নমিনাল জিডিপির হার পুরো এশিয়ায় সর্বোচ্চ থেকেছে বাংলাদেশ। ২০১১-২০১৮ সময়টায় এ হার ৯.৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশের ম্যাক্রো অর্থনীতি বেশ স্থিতিশীল ছিল পুরো ২০১০-এর পরের দশকজুড়েই। এ সময়টায় কৃষি ও এসএমই ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। রপ্তানি খাতে বিশেষ সমর্থন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইডিএফসহ বিভিন্ন আর্থিক সমর্থন দিয়ে। তা ছাড়া প্রবাসী আয় বাড়ানোর জন্য নিয়মনীতি সহজ করা হয়। হুন্ডিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। ফলে এ সময়টায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাঁচগুণের মতো বেড়ে যায়। তা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি পাঁচ থেকে ছয় শতাংশের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে। যদিও হালে তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বিশ্ববাজারে তেল ও অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। তা ছাড়া কোভিড মোকাবিলার জন্য অর্থনীতিতে প্রচার তারল্য ঢালতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এবং সরকারকে। এসবের চাপও মূল্যস্ফীতির ওপর পড়তে শুরু করেছে।

এতকিছুর পরও বাংলাদেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিয়ে এখনই বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের চাকা বেশ দ্রুতলয়েই ঘুরছে। তবে রেগুলেটরদের চোখ-কান সর্বদাই খোলা রাখতে হবে। বাংলাদেশের এ নয়া ধাঁচের কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছে আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞ মহল। লন্ডনের ‘ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে’র সহযোগী ‘দ্য ব্যাংকার’ এবং ‘ইউরোমানি’র সহযোগী ‘দ্য ইমার্জিং মার্কেটস’ ২০১৫ সালে এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের সেরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে পুরস্কৃত করেছিল। ২০১৩ সালে বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেরাল্ড এপস্টেইন ‘রিভিউ অব কেইনসিয়ান ইকোনমিক্স’ নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং বিষয়ে একটি আগ্রহ উদ্দীপক লেখা লিখেছেন। ওই লেখায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর একটি ‘কেস স্টাডি’ ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, নয়া-উদারনৈতিক ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য যে নয়া ধাঁচের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের কৌশল বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক চালু করেছে তা সারাবিশ্বেই ছিল অগ্রণী। বিশ্ব আর্থিক সংকট মোকাবিলায় এ কৌশল খুবই কাজে লেগেছিল। তার মতে, এ কৌশলের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল : আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অভিযান, কৃষি ঋণ বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া, বর্গাচাষিদের জন্য বিশেষ ঋণের উদ্ভাবন, সবুজ ঋণের প্রতি সমর্থন, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য পুনঃঅর্থায়ন, রপ্তানি শিল্পের জন্য বিশেষ ঋণ সমর্থন, সবুজ ব্যাংকিংয়ের জন্য গাইডলাইন জারি করা এবং সর্বোপরি এসব উদ্ভাবনীমূলক ঋণ সত্যি সত্যি উদ্যোক্তাদের কাছে যাচ্ছিল কিনা তার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। যেসব প্রতিষ্ঠান সাফল্য দেখাতে পেরেছিল তাদের নয়া শাখা খোলার অনুমতি ত্বরান্বিত করা এবং আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অধ্যাপক এপস্টেইন এ অভিজ্ঞতা থেকে সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়গুলোও চিহ্নিত করেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে : জাতীয় প্রয়োজনে বাস্তবানুগ উদ্যোগ নেয়া যায়, বিশেষ বিশেষ এলাকা ও জনগোষ্ঠীর দিকে ঋণকে প্রবাহিত করা সম্ভব, শুধু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নয় আরও বড় উন্নয়ন পরিসরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করতে পারে এবং সেজন্য নতুন সব ‘রেগুলেটরি টুলস’ ব্যবহার করতে পারে, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা প্রকাশের মতো উন্নয়নধর্মী লক্ষ্যমাত্রাও (যেমন কৃষি ঋণ প্রবৃদ্ধি, সবুজ ঋণ প্রবৃদ্ধি, সিএসআর ও এসএমইর প্রবৃদ্ধি, নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রাপ্যের হার ইত্যাদি) নির্ধারণ করতে পারে, সরকারের অন্যান্য ম্যাক্রো অর্থনৈতিক নীতি এবং উন্নয়ন কৌশলগুলোর সমন্বয় জোরদার করতে সহায়ক হতে পারে, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের মাঝে সম্পর্কটা কেমন হবে তা অনুধাবনে সাহায্য করা এবং ব্যাংকিং খাতের সক্ষমতার সঙ্গে অন্য অংশীদারদের সক্ষমতার মেলবন্ধন ঘটানোরও বেশ প্রয়োজন রয়েছে।

অর্থনীতির বিশ্বখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্নালে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের এ প্রশংসা নিঃসন্দেহে আশাজাগানিয়া। তবে এক দিনেই তো আমাদের আর্থিক খাতের এসব উদ্ভাবন সম্ভব হয়নি। ধীরে ধীরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে করেই আমাদের এগোতে হয়েছে। এখনো যে সে ধারাটি চালু রাখা গেছে সেটিই মুখ্য বিষয়। তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা নেই। অবশ্য খেলাপি ঋণের রকমফের, পরিচালনা পর্ষদের অনিয়ম, কতিপয় ব্যাংকারের অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সুশাসনের অভাব অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পেছনে ব্যাংকিং খাত, বিশেষ করে সুদূরপ্রসারী কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের ভূমিকা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

এ প্রেক্ষাপটেই আজও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল অর্থায়নের কৌশল নিয়ে ব্যাংকিং খাত এগিয়ে চলেছে। আছে সীমাবদ্ধতা। আছে দুর্নীতি। আছে অনিয়ম। তবুও তো সমাজের পিরামিডের নিচের দিকের মানুষের কাছে প্রচলিত ও নয়া ধাঁচের লেনদেন ব্যবস্থায় প্রচুর অর্থ যাচ্ছে। কৃষি ঋণ বাড়ছে। প্রবাসী আয় অল্প সময়েই উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এমনকি একজন ভিক্ষুকও এখন মোবাইল ব্যাংকিং করছে। রিকশাওয়ালারা তো হরহামেশায় ব্যাংকিং করছে। স্কুলের বাচ্চারা, পরিবেশ কর্মীরা, পথশিশুদের জন্যও ব্যাংকিং করার অধিকার প্রসারিত করা সম্ভব হয়েছে।

এই যে নয়া যুগের নয়া ধাঁচের ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের এতটা প্রসার ঘটেছে বলেই না করোনা সংকটকালেও গরিব মানুষসহ প্রায় সবাই তাদের লেনদেন চব্বিশ ঘণ্টাই চালু রাখতে পেরেছেন। আর্থিক লেনদেনের এ অসাধারণ গতি আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেও তাই এতটা গতিময় করে রেখেছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমনটা সম্ভব হয়নি। কী করে আমাদের আর্থিক খাতের এ নবধারার সূচনা হলো?

মনে পড়ছে ২০০৯ সালের শুরুর দিকের কথা। সেই সময়টায় উন্নত কয়েকটি দেশের বেসামাল অর্থায়নের কারণে বিশ্ব আর্থিক সংকট মধ্যগগনে। আমরা সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ অভিযানের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের কৌশল গ্রহণ করেছিলাম। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং পুরো ব্যাংকিং খাতকে জড়িয়ে সংশ্লিষ্ট জনসম্পদের মন বদলের উদ্যোগ নিয়েছিল। সে ধারা এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের লক্ষ্য ছিল মাটিকে স্পর্শ করা। উৎপাদনশীল খাতকে চাঙ্গা রাখা। অভ্যন্তরীণ ভোগ ও চাহিদাকে ঝিমিয়ে না পড়তে দেয়া। এ কৌশল আমরা আমাদের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ করেছিলাম। ব্যাংকার ছাড়াও অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব অংশীদারদের আলাপ করে মুদ্রানীতি ও ঋণনীতির (বিশেষ করে কৃষি ও এসএমই ঋণনীতি) কৌশল নির্ধারণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। যেসব খাত বা গোষ্ঠীর কাছে অর্থ যাচ্ছিল না, সেসব খাত বা গোষ্ঠীর দিকে নতুন করে অর্থপ্রবাহের নয়া উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম আমরা। নয়া জামানার নয়া প্রযুক্তি এ ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংকিং খাতের তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়নে আমরা ব্রতী হই। ফলে শাখাবহির্ভূত অনলাইন/মোবাইল ফোন/স্মার্টকার্ডনির্ভর আর্থিক সেবা প্রদানের দুয়ার দ্রুতই খুলতে থাকে। পাশাপাশি এ নয়া ধাঁচের ব্যাংকিংয়ের জন্য নয়া নয়া গাইডলাইন/প্রজ্ঞাপন তৈরির আগে অংশীদারদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। একই সঙ্গে গ্রামীণ শাখা/উপশাখা/বুথ এবং এজেন্টদের মাধ্যমে মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের পরিধি বাড়াতে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সবুজ অর্থায়নের জন্য ‘ম্যাক্রো প্রুডেন্সিয়াল’ বা সামষ্টিক বিচক্ষণতা প্রয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়। এসএমই ও সবুজ উদ্যোক্তাদের জন্য কম খরচের পুনঃঅর্থায়নের কৌশল গ্রহণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এ কৌশল এবারের অতিমারির সময় খুবই কাজে লেগেছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রণোদনা কর্মসূচিগুলোর বাস্তবায়নে ডিজিটাল অর্থায়নের কৌশলগত ব্যবহারে তাদের পারদর্শিতা দেখিয়েছে। আর তাই এ সংকট থেকে পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ আশপাশের অনেক দেশ থেকে ভালো করছে। এ পুনরুদ্ধারের গতি আরও বাড়ানো যেত যদি আমরা সময়মতো টিকা পেতাম। এ জায়গায় বিশ্ব তার নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তবুও আমাদের নেতৃত্ব যেভাবেই পারেন টিকা সংগ্রহে কখনই দ্বিধান্বিত ছিলেন না। এর সুফলও আমাদের অর্থনীতি পাচ্ছে। এ সংকটকালে ব্যাংকিং খাতকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করে সরকার তার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। এখনো কোভিড-১৯ ঘিরে অনিশ্চয়তা পুরোপুরি কাটেনি। উন্নত বিশ্বে এ রোগের সংক্রমণ বাড়ছে। আর উন্মুক্ত সীমান্তের এ পাড়ে বাংলাদেশকেও তাই খুবই সতর্ক থাকতে হবে। সে কারণেই আমাদের সরকার ও উদ্যোক্তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির দিকে বেশি বেশি নজর দিতে হবে। খাদ্য উৎপাদন ভালো ছিল বলেই এ সংকটকালেও আমরা বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে এগিয়ে যেতে পেরেছি। এ অর্জন ধরে রাখতে হবে। সে কারণেই আমাদের অর্থনীতির রক্ষাকবচ কৃষির দিকে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রখর নজর বজায় রাখতে হবে। সরকারের হাতেও বাড়তি অর্থ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার ‘ব্যালেন্সশিট’ সম্প্রসারণ করে যেভাবে সক্রিয় ছিল, সে ধারা থেকে সরে আসার সময় এখনো আসেনি। টাকার ওপর চাপ বাড়ছে। আমদানি বাড়ছে বলে ডলারের দাম বাড়ন্ত। রেমিট্যান্সও আগের বছরের মতো আসছে না। তাই অনেক বেশি বিচক্ষণতার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার বিদেশি মুদ্রার লেনদেন নিশ্চিত করে যেতে হবে। প্রয়োজনে ডলার বিক্রির বর্তমান ধারা আরও কিছুদিন অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশে যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির হার বেড়েছে সারা বিশ্বই এখন তা জানে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৫০ শতাংশেরই কোনো না কোনো আর্থিক সেবা গ্রহণের সুযোগ ছিল। ২০১৩ সাল থেকে এ সুযোগ ৫৭ শতাংশ বেড়েছিল ওই বছর। এখন হয়তো আরও বেশি। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারকে ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইলভিত্তিক আর্থিক উদ্যোগ বা ‘ফিনটেক’কে কাজের সুযোগ করে দেয়। যারা প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সেবা পাচ্ছিলেন না তাদের কাছে টাকা পৌঁছানোর এ অভিনব উদ্যোগ পুরো আর্থিক ‘ল্যান্ডস্কোপ’টাকেই বদলে ফেলেছে।

ডিজিটাল অর্থায়নের সুযোগ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণের অংশ হিসেবে স্বয়ংক্রিয় সিআইবি, ক্লিয়ারিং হাউস, ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ, বিএফটিএন, আরটিজিএস, ইলেক্ট্রনিক কেওয়াইসি, অনলাইন সমন্বিত সুপারভিশন, এডি ব্রাঞ্চগুলোর হাতে অনেক ক্ষমতা হস্তান্তর, মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং গাইডলাইন চালু করাসহ অসংখ্য নীতি-উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসবের সুফল আমরা এখন বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করছি। কোনো কোনো ব্যাংক এরই মধ্যে ব্লকচেইন প্রযুক্তিও গ্রহণ করতে শুরু করেছে। সব ব্যাংকই এখন কোর ব্যাংকিং সলিউশন ব্যবহার করছে। ফলে আর্থিক সেবা প্রদানে বাংলাদেশ তার সাফল্য দেখিয়েই চলেছে। আইএমএফের সর্বশেষ ‘ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকসেস সার্ভে’ থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য ২০২০ সালে ৮.৯৯টি ব্যাংক শাখা আছে। ২০১৪ সালে তা ছিল ৮.৬১টি। একই পরিমাণ জনগোষ্ঠীর জন্য এটিএম সংখ্যা ২০২০ সালে ১০.১৮টি। ২০১৫ সালে তা ছিল ৭.০৯টি। এক হাজার কিলোমিটারের মধ্যে ২০২০ সালে মোবাইল এজেন্ট ছিল ৮,১৪১টি। ২০১৫ সালে তা ছিল ৪,৪০৮টি। ২০২০ সালে মোবাইল লেনদেনের পরিমাণ ছিল জিডিপির ২০.৪৫ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা ছিল ১১.০২৬%। এ ছাড়া দুই কোটি কৃষি ও অতিদরিদ্র মানুষের রয়েছে দশ টাকার ব্যাংক হিসাব। আর মোবাইল ব্যাংকের হিসাব তো রয়েছে ঘরে ঘরেই। তাই লকডাউনের সময় পোশাক শ্রমিক ছাড়াও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে থাকা প্রান্তজনের কাছে সরকারি সহায়তা পাঠাতে অসুবিধা হয়নি। আর মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ফলে তো আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে মিনি বিপ্লবই ঘটে গেছে। এ ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্তিশালী নেতৃত্বের কথা না বললেই নয়। ২০২০ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর সময়ে দেড় কোটি নতুন মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলেছেন। এখন প্রায় দশ কোটি মানুষের এ হিসাব রয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রসারও সমান তালেই ঘটেছে। ২০২০ সালে ১৪ হাজার এজেন্ট আউটলেট ছিল। এক বছর আগেও তা ছিল দশ হাজার।

ওপরের এ বর্ণনা থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশে ডিজিটাল অর্থায়ন কী গতিতে প্রসারিত হয়ে সামাজিক পিরামিডের পাটাতনকে শক্তিশালী করে তুলছে। আমরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির এ অভিনব অভিযাত্রায় করে করেই শিখেছি। এখনো শিখছি। তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডিজিটাল অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে বরাবরই যত্নবান থাকতে হবে। বিভিন্ন আর্থিক সেবা যাতে ‘ইন্টার অপারেবল’ করা যায়, সেদিকে সর্বদাই নীতি-নজর থাকা জরুরি। গ্রাহকদের সুবিধা ও আস্থা ধরে রাখার জন্যই তা জরুরি। নয়া বাস্তবতায় গ্রাহকরাই যেন সর্বোচ্চ সুরক্ষা পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। ই-কমার্স জগতে কিছু সংখ্যক জালিয়াতকারীর বাড়াবাড়িতে গ্রাহক আস্থায় বেশ খানিকটা চিড় ধরেছে। সরকার অবশ্য এ অবস্থার পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এত কষ্ট করে গড়ে তোলা ডিজিটাল অর্থায়নের সক্ষমতা ও সুনাম যাতে কোনোমতেই নষ্ট না হয় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি কপ-২৬-এ বাংলাদেশ ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’য় অর্থায়নের যে রূপরেখা পেশ করেছে তাকেও বাস্তবায়ন করার জন্য বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবুজায়নের উদ্যোগগুলোকে আরও জোরদার করতে হবে। আমাদের পুঁজিবাজারও দীর্ঘমেয়াদি সবুজ বন্ড পরিচালনাসহ খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে উৎসাহী করতে পারে। সব মিলেই আমাদের জলবায়ুবান্ধব অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের পথে হাঁটতে হবে।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর


banner close