১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের দুই অংশে যথা- পূর্ব বাংলা (তথা পূর্ব পাকিস্তান) এবং পশ্চিমাংশের চারটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগে খুব একটা শিল্পকারখানা পড়েনি। বৃহৎ শিল্প গড়ার জন্য ১৯৫২ সালে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (পিআইডিসি) সৃষ্টি হয়। এর অধীনে দুই অংশে যথাক্রমে ইপিআইডিসি ও ডব্লিউপিআইডিসি গঠন করা হয়। মূলত এ করপোরেশন নিজ উদ্যোগে কিংবা কতিপয় শিল্পোদ্যোক্তাকে সহায়তার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে পাট, কাপড় ও চিনি খাতে বেশ কিছু বৃহৎ শিল্পকারখানা গড়ে তোলে। পর্যায়ক্রমে সার, কেমিক্যাল ও স্টিল মিলও প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পোন্নয়নের গোড়াপত্তন করে। ইপিআইডিসি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কতিপয় শিল্পকারখানা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে পরবর্তী সময়ে বিক্রি করে দেয়া হয়। এ ছাড়া গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ক্ষুদ্রশিল্পের বিকাশ ও সহায়তার জন্য পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র শিল্প করপোরেশন (ইপসিক) প্রতিষ্ঠা করা হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্থলে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পর প্রথমে বৃহৎ শিল্পগুলো জাতীয়করণ করা হয়। বিশ্বব্যাপী পাটের গুরুত্ব কমে যাওয়ায় এবং প্রশাসনিক অবস্থা ও শ্রমিক বিশৃঙ্খলার কারণে পাটকলগুলো লোকসানে পতিত হয়। পরবর্তী সময়ে বেসরকারীকরণ নীতি গ্রহণের মাধ্যমে বেশ কিছু পাটকল ও কাপড়ের মিল ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করা হয়।
বাংলাদেশে লাভজনক শিল্পোন্নয়নের সূচনা হয় বেসরকারি উদ্যোগে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প বিকাশের মাধ্যমে। এসব শিল্পে কর্মসংস্থান এবং দেশে বিভিন্ন সেবা খাতের সম্প্রসারণের ফলে ভোক্তাশ্রেণির সৃষ্টি হয়। ক্রমান্বয়ে ভোগ্যপণ্য, নির্মাণসামগ্রী, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে থাকে।
১৯৭৯ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস কর্তৃক তৈরি পোশাকের সীমিত রপ্তানির মাধ্যমে এ খাতের রপ্তানির সূচনা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে আরও উদ্যোক্তা রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপন করে রপ্তানি শুরু করে। আশির দশকের প্রথম দিকে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ কার্যক্রমের মাধ্যমে তৈরি পোশাকশিল্পে নীতিসহায়তা চালুর ফলে এ শিল্প বিকাশ লাভ করে। পোশাক খাত থেকে বর্তমানে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশ আসে। মধ্যবিত্ত ও গরিবদের, বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও এ খাত শীর্ষস্থানে রয়েছে। যে দুটি সরকারি নীতিসহায়তার কারণে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে সেগুলো হচ্ছে- শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করে বন্ডেড ওয়্যারহাউসে রাখার সুবিধা এবং বিলম্বে দায় পরিশোধসহ ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা। এ দুটি সুবিধা প্রাপ্তির ফলে বড় অঙ্কের পুঁজি ছাড়াই গার্মেন্টস কারখানা প্রতিষ্ঠা করে উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সরকার করহার কমানো, নগদ সহায়তা প্রদান, ব্যাংকঋণ প্রাপ্তি সহজ ও বন্দর ব্যবহারে অগ্রাধিকার প্রদান করে এ খাত প্রসারের পথ সুগম করেছে।
সরকার এ পর্যন্ত আটটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং প্রতিবছর বার্ষিক বাজেটে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নানা সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে শিল্পায়নে সহায়তা করে আসছে। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সুবিধা প্রভৃতির ফলে শিল্পায়নের পাশাপাশি ভোক্তা বাজার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান প্রায় ৩৩ শতাংশে পৌঁছেছে।
শুরু থেকেই বাংলাদেশে আমদানি-বিকল্প এবং রপ্তানিনির্ভর উভয় প্রকার দ্রব্যসামগ্রী প্রস্তুতের জন্য শিল্পায়ন হচ্ছে। গ্লোবালাইজেশনের প্রসারের ফলে আমাদের আমদানি-রপ্তানি উভয়ই বেড়েছে। তবে উৎপাদনের কাঁচামাল, কেমিক্যালসামগ্রী, উচ্চপ্রযুক্তির দ্রব্যাদি যেমন- মোটরগাড়ি, কলকারখানার যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, সার, জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, চিনি ইত্যাদি অধিক পরিমাণ ক্রয়ের কারণে রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হচ্ছে। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বেশ কিছু ভোগ্যপণ্য উৎপাদন শিল্প, ওষুধ ও কেমিক্যাল প্রস্তুত শিল্প, চামড়া ও প্লাস্টিক শিল্প, সুতা ও কাপড় প্রস্তুত কারখানা এবং স্টিল, ইলেকট্রনিকস, সিমেন্ট প্রভৃতি বৃহৎ শিল্প গড়ে উঠেছে।
যতই দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, ততই বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অন্যতম উৎস। আবার রিজার্ভের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আমদানি দায় পরিশোধে খরচ হয়। পৃথিবীর ১০টি বৃহৎ ভোক্তা বাজারের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। সে কারণে আমাদের আমদানি শুধু শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য সামগ্রীও আমদানি করা হয়। আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম হলে বাণিজ্য ঘাটতি হয়, অর্থাৎ লেনদেনের ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়, যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা দেয়। সে জন্য দেশের সার্বিক উন্নয়নে রপ্তানি বৃদ্ধি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৫৬ শতাংশ এবং পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানির ৭৫ শতাংশের অধিক আসত পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি থেকে। অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি দ্রব্য ছিল চা ও চামড়া।
স্বাধীনতার পরের বছর বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। পাটের পর প্রধান দুটি রপ্তানি পণ্য ছিল চা ও হিমায়িত খাদ্য। কৃত্রিম তন্তুর আবিষ্কার ও ব্যবহার বৃদ্ধির পর পাটের গুরুত্ব কমতে থাকে। সে জন্য পাটের বিকল্প রপ্তানি দ্রব্য অন্বেষণে গুরুত্বারোপ করা হয়।
১৯৮৩-৮৪ সালে মোট রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের হিস্যা ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ১৭-১৮ বছরের ব্যবধানে ২০১০-১১ সালে রপ্তানি আয়ের ৭৮ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। পরবর্তী ১০ বছরে তৈরি পোশাকের অবদান বেড়ে ৮২-৮৪ শতাংশে দাঁড়ায়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। মূলত তৈরি পোশাকের ওপর ভর করে ২০২১-২২ সালে রপ্তানি আয় ৫২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তবে একক পণ্যের ওপর এত অধিক হারে রপ্তানিনির্ভরতা টেকসই বাণিজ্যের জন্য অনুকূল নয়। সে জন্য দুই দশক ধরেই রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
তৈরি পোশাক ব্যতীত বাংলাদেশের অন্য কয়টি উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য হচ্ছে- পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষিজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, হোম টেক্সটাইল, ওষুধ, প্লাস্টিক পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য, হস্তশিল্পজাত পণ্য, বাইসাইকেল ইত্যাদি। পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি মূল্যের দিক থেকে কয়েক বছর দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও গত বছর হোম টেক্সটাইল দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে (প্রায় ৩ শতাংশ)। হিমায়িত চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, কৃষিজ দ্রব্যাদি প্রভৃতির বিশ্ববাজারে চাহিদার তুলনায় আমাদের সরবরাহ অপ্রতুল। তা ছাড়া প্যাকেজিং ও মান নির্ণয়ে আমাদের সমস্যা আছে। পরিবেশবান্ধব ট্যানারি শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা করতে না পারার কারণে বিদেশে আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের চাহিদা কমে গেছে। সীমিত পরিসরে রপ্তানি চালিয়ে গেলেও এলডব্লিউজি সনদের অভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে নানা বিধিনিষেধের আওতায় পড়তে হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত মার্চে (২০২৩) প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর রপ্তানির হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৈরি পোশাক ও চামড়া ছাড়া অন্য সব খাতেই রপ্তানি কমেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় সার্বিক রপ্তানি ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৬ শতাংশ, কিন্তু পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, ওষুধ, বাইসাইকেলসহ অন্য খাতে রপ্তানি বেশ কমেছে। ওই সময় মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশই এসেছে পোশাক খাত থেকে। বিগত কয়েক বছরের রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যান লক্ষ করলে দেখা যাবে পোশাক খাতের রপ্তানি ৩০-৩৫ বিলিয়ন ডলার হলেও অন্য কোনো খাতে রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে পারেনি। ২০২১-২২ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বাজার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের সব দেশ, জাপান, চীন, ভারতসহ এশিয়ার দেশগুলো এবং বিশ্বের বহু দেশে বিস্তৃত। সে তুলনায় অন্যান্য খাতের বাজার সীমিত। তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারীরা বিভিন্নভাবে সরকারের নীতিসহায়তা, শুল্ককর সুবিধা, ব্যাংকঋণ ও বন্দর ব্যবহারে যে অগ্রাধিকার পান, অন্যান্য রপ্তানিকারকরা উপরিউক্ত সব সুবিধা পান না। তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজেএমইএ, বিকেএমইএ, এমনকি কাপড়ের মিলগুলোর সংগঠন বিটিএমএ যেভাবে সরকার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রভাব খাটাতে পারে, অন্যান্য খাতের সংগঠনগুলো তেমন শক্তিশালী ও সক্রিয় নয়। এসব পণ্যের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়ার কারণ হলো- উৎপাদকদের ব্যবসায়িক যোগাযোগ কম, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি। অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভর বড় শিল্পকারখানাও গড়ে ওঠেনি। বাজার সীমিত থাকার কারণে এসব খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগও তেমন আসছে না।
যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিতে প্রতিবছরই প্রবৃদ্ধি আছে। কারণ বাংলাদেশ নিম্ন ও মধ্যম দামের পোশাক রপ্তানি করে যার চাহিদা বিদেশি ক্রেতাদের কাছে প্রতিকূল পরিবেশেও বলবৎ রয়েছে। তবে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে যে বৃহৎ বাজার রয়েছে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ মাত্র বৈশ্বিক চাহিদার ৬ দশমিক ২ শতাংশ রপ্তানি করতে পারছে। তৈরি পোশাক খাতেও পণ্যের বহুমুখীকরণ প্রয়োজন। যেমন- আমাদের উদ্যোক্তারা যদি উচ্চমূল্যের পোশাক, মনুষ্য তৈরি তন্তু ব্যবহার (ম্যান মেড ফাইবার) করে প্রস্তুতকৃত পোশাক, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পোশাক ইত্যাদি প্রস্তুত ও বাজার অন্বেষণ করে, তবে পোশাক রপ্তানি আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে, যা ২০২৬ সালে কার্যকর হবে। ২০২৯ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে আর শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে না। তখন ৮-৯ শতাংশ শুল্কারোপিত হলে তৈরি পোশাকের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে, যার ফলে পোশাক রপ্তানি কমে যেতে পারে। সে জন্য আগে থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ডব্লিউওটিওর সঙ্গে যোগাযোগ করে শুল্ক সুবিধার সময় বাড়িয়ে নেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শুল্কমুক্ত চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের মাধ্যমে পারস্পরিক শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগানো যেতে পারে।
তৈরি পোশাকশিল্পে বহুমুখীকরণের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো ছাড়াও রাশিয়া, ভারত, জাপান ও চীনের মতো দেশগুলোর বাজারে রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব বলে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান যে, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি টেকসই করার জন্য জাতীয় আয়ে শিল্পের অবদান ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে। আমদানি-বিকল্প ও রপ্তানিমুখী উভয় শিল্প প্রসারে সরকার ও ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের মনোযোগী হতে হবে। রপ্তানি বাড়ানোর লক্ষ্যে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। নতুন রপ্তানি দ্রব্য ও বাজার অন্বেষণ করতে হবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের মাধ্যমে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি আমাদের রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে পরিবেশের যাতে ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে এবং কলকারখানায়, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, শ্রমিক অধিকার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় শর্তাদি (কমপ্লায়েন্স) মেনে চলতে হবে। সাভার চামড়া শিল্পনগরীকে পরিবেশবান্ধব শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে তুলে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং তৈরি পোশাকের পর চামড়াশিল্পকে দ্বিতীয় বিকল্প রপ্তানি পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ছাড়া প্রতিশ্রুতিশীল রপ্তানি পণ্যগুলোকে তৈরি পোশাকের মতো নীতিসহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান করে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত
মানুষের সৃষ্ট কাজের মাধ্যমে মানুষ এ পৃথিবীর প্রকৃতি ও পরিবেশ প্রতিনিয়তই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সে কারণেই আজ বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জনজীবনে নেমে এসেছে এক অস্বস্তি ও কষ্ট। খেটে খাওয়া মানুষের জন্য এ কষ্টটা একটু বেশি। এ সমস্যা উত্তরণে বিশ্বনেতাদের পাশাপাশি আমাদেরও অনেক সচেতন হতে হবে, অনেক কিছু বর্জন করতে হবে এবং অনেক কাজ করতে হবে। প্রথমে আসা যাক বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়ে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পেছনে অনেক কারণ রয়েছে, এখন সেগুলোর ওপর আলোকপাত করা যাক।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির উৎস ও কারণ
প্রথমেই বলতে হয় গ্রিন হাউস গ্যাসের কথা। গ্রিন হাউস গ্যাস সূর্যের অতিরিক্ত তাপ যেগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকিরণের মাধ্যমে ফিরে আসে সেগুলোকে ট্র্যাপ করে এবং শোষণ করে। ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। গ্রিন হাউস গ্যাস যেমন ওয়াটার ভেপার, ওজোন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, হাউড্রোফ্লোরো কার্বনস, পারফ্লোরো কার্বনস, সালফার হেক্সাফ্লোরাইড, নাইট্রোজেন ট্রাইফ্লোরাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বনস ইত্যাদি এসব গ্যাসগুলো নিঃসরণ হয় পরিবহন খাত, রেফ্রিজারেটর, শীতলীকরণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প-কলকারখানায় ব্যবহৃত কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি থেকে।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন হাউস গ্যাসের উৎপাদনের পেছনের উৎস বা খাতগুলোর দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক।
পরিবহন খাত
যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন খাত থেকে ২৮% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়। তথ্য মোতাবেক বাস, ট্রাক, কার, জাহাজ, ট্রেন ও বিমানে পেট্রোলিয়াম, ডিজেল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদনের বড় উৎস।
বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত
যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত থেকে ২৫% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৭৯% বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় জীবাস্ম জ্বালানি যেমন পেট্রোলিয়াম, ডিজেল, কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। যেগুলো গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদনের ক্রীড়নক।
শিল্প খাত
যুক্তরাষ্ট্রের ২৩% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয় শিল্প খাত থেকে। এ ছাড়া শিল্পে কিছু কাঁচামাল থেকে পণ্য তৈরি করতে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানোর প্রয়োজন হয় এবং সে সময়ে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়ে থাকে।
বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাত
যুক্তরাষ্ট্রের মোট উৎপাদিত গ্রিন হাউস গ্যাসের ১৩% উৎপাদিত হয় বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাত থেকে। এ খাতেও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয়। তাপ উৎপাদন, আলোক সজ্জা, বৈদ্যুতিক বাতি, রেফ্রিজারেশন এবং শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় এবং বর্জ্য ব্যস্থাপনায়ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয়।
কৃষি খাত
যুক্তরাষ্ট্রের ১০% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয় কৃষি খাত থেকে।
অন্যান্য খাত
ভূমির সার্বিক ব্যবহার এবং অন্যান্য খাত থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ১২% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়।
পৃথিবীতে বর্তমান সময়ে পরিবহনে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে, শিল্প-কারখানায় ও গৃহস্থালির কাজে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণ ও দীর্ঘকালীন ইরাকে যুদ্ধ, ইসরায়েলের সাথে ফিলিস্তিন ও হিজবুল্লাহর যুদ্ধ এবং ওইসব যুদ্ধে ব্যবহৃত বিস্ফোরক ও জীবাশ্ম জ্বালানি বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। ব্রাজিলের আমাজান বনে আগুন, আফ্রিকায় বনভূমি উজাড়করণ, অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে আগুন, এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষ করে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পাহাড়ি বনে আগুন, ভারত-পাকিস্তানের অস্ত্র প্রতিযোগিতা, বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা ও ব্যাপক মাত্রায় বন উজাড়; বিদ্যুৎ উৎপাদন, ইটের ভাটা ও অন্যান্য কাজে কাঠ ও কয়লার ব্যবহার বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
এ ছাড়া পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা ও বিস্ফোরণ, রাসায়নিক অস্ত্রের পরীক্ষা ও বিস্ফোরণ, শিল্প-কলকারখানার ধোঁয়া, গরম পানি, বর্জ্য, দূষিত পানি ও এফলুয়েন্টের ডাম্পিং, ধূমপানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত ধোঁয়া, বনভূমি ও জলাভূমির বিলুপ্তি, ঝড়, ধূলিঝড়, মরুঝড় ও নির্মাণ কাজ থেকে বাতাসে ধূলিকণা যোগ হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে পরিবেশ উষ্ণতার উৎস ও করণীয়
গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন
বাংলাদেশেও পরিবহন খাত, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত, শিল্প খাত, বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাতগুলো থেকে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া সিগারেটের কালো ধোঁয়া থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড, রেফ্রিজারেটর থেকে সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরো কার্বন) উৎপাদন হয়। বিভিন্ন সেক্টরে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি, যেমন- পেট্রোলিয়াম, ডিজেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি থেকে বাংলাদেশে গ্রিন হাউস গ্যাসের সিংহভাগ উৎপাদিত হয়ে থাকে।
বৃক্ষ নিধন
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় পৃথিবীব্যাপী প্রতিনিয়ত বৃক্ষ নিধন প্রকাশ্যে এবং নীরবে ও নিভৃতে চলছে। এ অপরিণামদর্শী কাজ এশিয়ার দেশগুলোতে এবং বাংলাদেশেও চলছে। অনেক সংরক্ষিত বনভূমির ভেতরটা বৃক্ষ শূন্য এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মহল এ বৃক্ষ নিধন কর্মে জড়িত বলে একটি সূত্র জানায়। মূল বিষয় হচ্ছে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়ত উৎপাদিত হচ্ছে তার পুরোটা বৃক্ষরাজি, বন-বনানী, গুল্ম, লতা-পাতা ও সামুদ্রিক শৈবাল কর্তৃক শোষণ হচ্ছে না। এ অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে থেকে যাচ্ছে এবং সূর্যের তাপকে শোষণ করছে এবং আটকে রাখছে ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।
ইটভাটার দূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি
বাংলাদেশের ইটভাটায় বিপুল পরিমাণ কাঠ ব্যবহৃত হয়, যার ফলে একদিকে যেমন বৃক্ষরাজি ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ইটভাটা থেকে ফ্লাইঅ্যাশ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে। ফ্লাইঅ্যাশ বায়ুমণ্ডলে ক্ষুদ্র কণা যোগ করে থাকে, যা বায়ু দূষণে বিরাট ভূমিকা রাখে। এ বায়ুর কণা ও কার্বন ডাই-অক্সাইড তাপমাত্রা শোষণ করে ও তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটায়।
জলে নিমজ্জন ধান চাষকরণ
এশিয়ার অনেক দেশে জলে নিমজ্জিত করে ধান চাষ করা হয়। বাংলাদেশেও এরূপ জলে নিমজ্জন ধান চাষ করা হয়ে থাকে; যার ফলে প্রচুর পরিমাণ মিথেন গ্যাস উৎপাদিত হয়ে থাকে। যা পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
পাহাড় ধ্বংস
পাহাড় ধ্বংসের সাথে সাথে পাহাড়ের বৃক্ষরাজি, লতা, পাতা, পশু, পাখি, অণুজীব এবং তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যায়, যার ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ কমে যায়। প্রকারান্তে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
যানজট
বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বড় নগরীগুলোতে যানজট দেখা যায়। যানজটের কারণে গাড়িগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানি অধিক পরিমাণে ব্যয়িত হয় এবং প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য দূষিত গ্যাস নির্গত হয়; যা প্রকারান্তরে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।
শিল্প ও কলকারখানা
আমাদের দেশে শিল্প এবং কলকারখানা থেকেও কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস, বর্জ্য এবং দূষক নির্গত ও উৎপাদিত হয় ও পরিবেশে মেশে। তা ছাড়া শিল্প-কলকারখানা থেকে পণ্য তৈরি করার সময় গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গত হয়, যা পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধি করে।
ধূমপান
এ দেশে প্রতিদিন এক বিরাট সংখ্যক ধূমপায়ী ধূমপান করে থাকে। ফলে তাদের সিগারেট ও বিড়ি থেকে কার্বন-মনোক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়ত পরিবেশে মিশছে এবং বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে।
নির্মাণ কাজ থেকে বাতাসে ধূলিকণা যোগ হওয়া
বিশেষজ্ঞদের থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের বাতাসে ধূলিকণার একটা বড় অংশ নির্মাণ কাজ থেকে আসে। ওইসব ধূলিকণা সূর্যের তাপ শোষণ করে এবং বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।
বিশ্বের ও বাংলাদেশের পরিবেশ উন্নয়নে পদক্ষেপগুলো
গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন বন্ধকরণ
বিশ্ব ও বাংলাদেশের উষ্ণতা কমাতে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন কমাতে হবে। এ জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি, বায়ুচালিত শক্তি, বায়োগ্যাসের ব্যবহার ও সোলার এনার্জির ব্যবহারের মাত্রা বাড়াতে হবে।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন
অনেক দেশে ট্রাফিক জ্যাম আছে এবং পুরোনো গাড়ি ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশেও বেশি দিনের পুরাতন গাড়ির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং ট্রাফিক জ্যাম কমাতে হবে। ঢাকা শহরের ট্রাফিকের অধিকাংশই উত্তর-দক্ষিণমুখী প্রবাহ; যদি পূর্ব-পশ্চিমমুখী আরেটা বড় প্রবাহ তৈরি করা যায় তাহলে যানজট নিঃসন্দেহে কমতে পারে। যানজট নিরসনে ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টকে অধিক নিরাপদ, আরামদায়ক ও আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে হবে। মানুষকে ট্রাফিক এডুকেশন দ্বারা সচেতন করতে হবে, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করতে হবে ও প্রেষণা দিতে হবে। গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে আরও কঠোরতা অবলম্বন করা যেতে পারে এবং একজনের জন্য একটি গাড়িনীতি পরিহার করে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের দিকে ঝুঁকতে হবে। তাহলে কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন কম হবে এবং বাংলাদেশ তথা বিশ্বে উষ্ণতা কমবে।
বৃক্ষনিধন বন্ধ ও তদারকি
বৃক্ষ কর্তন নিষিদ্ধ থাকলেও বৃক্ষ কর্তন নিষেধাজ্ঞা সঠিকভাবে প্রতিপালন হচ্ছে কি না সে বিষয়ে অধিক মনিটরিং ও সুপারভিশন দরকার। আর প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদান করতে হবে। এ কাজে সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। পরিবেশ-পুলিশ তৈরি করলে তারা এ ক্ষেত্রে সমন্বয় ও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বৃহদাকার বৃক্ষ কেটে ছোট ছোট বৃক্ষ রোপণ করা হচ্ছে; যা ওই বৃহৎ বৃক্ষের তুলনায় কম পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ বা গ্রহণ করতে পারে। তা ছাড়া বিশ্বব্যাপী ডাম্পিংয়ের মাধ্যমে বর্জ্যগুলা সমুদ্রের পানি দূষণ করছে এবং সামুদ্রিক শৈবালও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য পাহাড় ও পাহাড়ি বন-বনানী রক্ষার্থে পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ রোপণ করা জরুরি। তাহলে বৃক্ষরাজি রক্ষা হবে এবং পরিবেশের উষ্ণতা কমবে।
বৃক্ষ, বন, জঙ্গল, লতাপাতা, খড় ও অন্যান্য বস্তুতে অগ্নিসংযোগ পরিহার করা
একটি বিষয় বেশ লক্ষণীয় যে, বিশ্বব্যাপী একরূপ ম্যানিয়া বা রোগ হয়ে গেছে যে, পাহাড়ি বন-বনানী, বৃক্ষের লতাপাতা, জঙ্গল, ধানের খড়, ধানগাছ, গমের খড়, গমগাছ, আখের খেত ইত্যাদি পেলেই সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ করা; যা না করে যান্ত্রিক উপায়ে পাহাড় পরিষ্কার করা যেতে পারে, খড়, জঙ্গল, লতাপাতা নিয়ে কমপোস্ট করা যেতে পারে। যার ফলে একদিকে যেমন জৈব সার তৈরি বৃদ্ধি পাবে এবং অন্যদিকে বন-বনানী রক্ষা পাবে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদন কমে যাবে ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধ করা যাবে।
জলাভূমি সংরক্ষণ
জলাভূমিকে বলা হয়ে থাকে পরিবেশের রক্ত। অথচ আমাদের জলাভূমিগুলো দিন দিন ভরাট হচ্ছে, বিলুপ্তি ঘটছে। কিছু অসাধু লোক এগুলোতে বিভিন্ন রকম স্থাপনা, বিনোদন কেন্দ্র, খামার ও খামারবাড়ি তৈরি করছে। যার ফলে আমাদের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। জলাভূমি রক্ষার মাধ্যমে, বর্ষাকালের বৃষ্টির পানি, উজানের পানি, আন্তর্জাতিক নদী বা অন্য দেশের ওপর দিয়ে আসা পানিকে ধরে রাখা ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে। ফলে পরিবেশের উষ্ণতা কমানো যেতে পারে।
পরিকল্পিত নগরায়ণ
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নিচুভূমি ও জলাভূমিকে উন্নয়ন করে নগরায়ণের পরিকল্পনা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এর ফলে প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন পদ্ধতি ও ওয়াটার টেবিল ধ্বংস হচ্ছে। যা পানির ঘাটতি তৈরি করে থাকে। পানি সংরক্ষণ বা ধরে রাখার জায়গা নষ্ট হলে পরিবেশের উষ্ণতার ওপর এর প্রভাব পড়বে।
শিল্প-কারখানার ওপর তদারকি বৃদ্ধি
কোন শিল্পপ্রতিষ্ঠান কোন ধরনের গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন করছে, সে বিষয়ে বিশ্বব্যাপী মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। সে জন্য শিল্পের ওপর মনিটরিং ও তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশবান্ধবভাবে চলছে না সেগুলো বন্ধ করতে হবে।
পরিকল্পিত ব্যারাজ, বাঁধ, ব্রিজ ও কালভাট নির্মাণ
অপরিকল্পিত ব্যারাজ, বাঁধ, ব্রিজ ও কালভার্ট তৈরি করার কারণে অনেক নদী, খাল ও জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো আর পানি ধরে রাখতে পারে না। ওইগুলো ড্রেজিং করে নাব্যতা ও গভীরতা ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। অপরিকল্পিত ব্যারাজ, বাঁধ, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে এবং সমন্বিতভাবে বিভিন্ন দেশকে একত্রে কাজ করতে হবে।
ব্যাপকভাবে বনায়ন কার্যক্রম চালুকরণ
পৃথিবীব্যাপী বৃক্ষ নিধন বন্ধ করে ব্যাপক মাত্রায় বনায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে বনায়ন, সামাজিক বনায়ন, পারিবারিক বনায়ন, ছাদ কৃষি, আঙিনা কৃষি ও সব পর্যায়ে ব্যাপকভাবে বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যার ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ বৃদ্ধি পাবে ও তাপমাত্রা কমে আসবে।
ধূমপান বন্ধকরণ
ধূমপান বন্ধ করা বা কমিয়ে আনার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদন রোধ করা যাবে। আর তা পরিবেশের তাপমাত্রা হ্রাস করতে সহায়ক হবে।
জলে নিমজ্জিত করে ধান চাষ বন্ধকরণ
যেহেতু এশিয়ার দেশগুলোতে জলে নিমজ্জিত ধান চাষের মাধ্যমে গ্রিন হাউস গ্যাস মিথেন উৎপাদন হয়ে থাকে, সে জন্য জলে নিমজ্জিত করে ধান চাষ বন্ধ করতে হবে। ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা হ্রাস পাবে।
নির্মাণ কাজের সময় স্থাপনা ঢেকে বা ভিজিয়ে কাজ করা
নির্মাণ কাজ থেকে বাতাসে ধূলিকণা যোগ হয়ে বায়ুদূষণ ঘটায়। আর এসব ধূলিকণা তাপমাত্রা শোষণ করে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়ে থাকেন। সে জন্য নির্মাণ কাজ করার সময় যতদূর পারা যায় স্থাপনাগুলো ঢেকে বা ভিজিয়ে কাজ করা। তাহলে ধূলিকণা বাতাসে ছড়াবে না এবং পরিবেশের দূষণ বা বায়ুদূষণ কম হবে। যার ফলে পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটবে না।
বর্তমানে বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সে জন্য প্রাকৃতিক কারণ যদিও কিছু রয়েছে কিন্তু মানবসৃষ্ট কারণই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের নেতাদের এবং নীতি-নির্ধারকদের এ ব্যাপারে আরও সতর্ক, সচেতন ও মানবিক হতে হবে। সর্বোপরি সবারই পরিবেশকে ভালোবাসতে হবে এবং সে মোতাবেক পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই বৈশ্বিক উষ্ণতা ও বাংলাদেশের উষ্ণতা কমবে এবং আমরা একটি সবুজ পৃথিবী ও সহজাত পরিবেশ ফিরে পাব।
লেখক: ড. মো. আব্দুস সোবহান পিপিএম
কমান্ড্যান্ট (অ্যাডিশনাল ডিআইজি)
পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল (পিএসটিএস), বেতবুনিয়া, রাঙামাটি
বর্তমানে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় একীভূত শিক্ষা ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযোগী প্রায় সব শিশুকেই এনরোলমেন্টের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণার মূল জানতে পেছনের ইতিহাস আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন এ দেশের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের সন্তানদের শিক্ষিত করতে না পারলে দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করা যাবে না। তিনি তাই তাঁর প্রত্যয়দীপ্ত আত্মবিশ্বাস থেকে শূন্য হাতেই ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। তাঁর পথ অনুসরণ করে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন।
স্বাধীনতার পর শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে তিনি বিনামূল্যে খাতা, পেন্সিল, জামা-কাপড় ইত্যাদি দেয়ার উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খাবার হিসেবে প্রতিটি বিদ্যালয়ে দুধ, ছাতু ইত্যাদি বিনামূল্যে বিতরণ চালু করেন। সেই চিন্তা, সেই ধারাবাহিকতায় আজকের রূপ মিড ডে মিল, মায়ের হাতের খাবার, পিছিয়ে পড়া দরিদ্র অঞ্চলে শিশুদের মাঝে পুষ্টি বিস্কুট সরবরাহ ইত্যাদি। সে সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিদ্যালয় গৃহের নির্মাণের জন্য দ্রুততার সঙ্গে দেয়া হয়েছে টিন। জাতির পিতার সেই শিক্ষা দর্শন বাস্তবায়নে তাঁরই সুযোগ্য কন্যার হাত দিয়ে বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণ, পুনর্নির্মাণসহ সংস্কারের নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। আজ প্রত্যন্ত অঞ্চলের সবচেয়ে সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন ভবনটি হলো ওই গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ ছাড়া শিশুদের জন্য নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা, স্যানিটেশন এবং ওয়াশবক্স স্থাপনসহ অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে দৃষ্টিনন্দন সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে। বিদ্যালয়গুলো যাতে নিজেরাই চাহিদাভিত্তিক ছোট ছোট কাজ করতে পারে এ জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়কেই ক্ষুদ্র মেরামত বাবদ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। তারা নিজেরাই নিজেদের চাহিদাভিত্তিক ভবন মেরামত, রঙ করা, চিত্ত বিনোদনের জন্য উপকরণ ক্রয়, স্থাপন, বাগান, স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, বঙ্গবন্ধু কর্নারসহ নানা আকর্ষণীয় কাজ করতে পারছে।
প্রাথমিক শিক্ষার যে অগ্রযাত্রা জাতির পিতা শুরু করেছিলেন, তা উজ্জীবিত হয় ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার সরকার প্রথমবার দায়িত্ব গ্রহণের পর শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করাসহ প্রাথমিক শিক্ষাবান্ধব নানা উদ্যোগের মাধ্যমে। সে ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি চূড়ান্ত রূপ পায়। দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার সরকার ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ণ করে। ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ এর আলোকে একটি আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন জাতি গঠনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে ইতোমধ্যে আমরা ‘ভিশন-২০২১’ শীর্ষক লক্ষ্য অর্জন করেছি।
প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রযাত্রায় আরেকটি মাইলফলক হলো বই উৎসব। ২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর প্রায় দুই কোটি শিক্ষার্থীর হাতে চার রঙের, আকর্ষণীয়, সম্পূর্ণ নতুন বই বছরের প্রথম দিনই শিশুদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। বই বিতরণ আজ দেশব্যাপী উৎসবে পরিণত হয়েছে। সে সঙ্গে শিশুদের মেধা বিকাশের পাশাপাশি তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে ও নেতৃত্বের গুণাবলি তৈরির জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ উপবৃত্তি প্রদান, মিড ডে মিল চালু, স্টুডেন্ট কাউন্সিল গঠন, কাব-স্কাউট দল গঠন, ক্ষুদে ডাক্তার দল গঠন, সাবেক শিক্ষার্থী অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠন, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন, জাতীয় পর্যায়ে আন্তঃপ্রাথমিক বিদ্যালয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন অন্যতম। মেধাবী এবং আরও মানসম্পন্নরাও যাতে শিক্ষকতায় আগ্রহী হন এ জন্য ২০১৪ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের পদটিকে দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছে। তাছাড়া ২০১৬ সাল থেকে পিএসসির মাধ্যমে বিসিএস উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে নন-ক্যাডার পদে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে একাডেমিক সহায়তা প্রদান ও শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য উপজেলা পর্যায়ে প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা রিসোর্স সেন্টার প্রতিষ্ঠা (ইউআরসি) করা হয়েছে। এ ছাড়া নেপ এবং পিটিআইগুলোর আধুনিকায়ন এবং এগুলোতে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়েছে। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ভালো কাজে উৎসাহিত করতে ও উজ্জীবিত করতে প্রতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও কর্মকর্তাসহ ১৩টি ক্ষেত্রে ‘প্রাথমিক শিক্ষা পদক’ প্রদান করা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা সফরের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তিগত বিভিন্ন সুবিধা ব্যবহার করে যুগোপযোগী প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন শিক্ষা সহায়ক টুলস প্রণয়নসহ অ্যাপসভিত্তিক অনলাইন কার্যক্রম চালু হয়েছে। মাঠপর্যায়ে গুগল মিট ও জুম অ্যাপস ব্যবহার করে নিয়মিত বিদ্যালয়, ক্লাস্টার ও উপজেলাভিত্তিক পারস্পরিক যোগাযোগ, তথ্য আদান-প্রদান, সভা-সেমিনার, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিদ্যালয়, উপজেলা বা জেলাভিত্তিক অনলাইন স্কুল কার্যক্রম চালু হয়েছে। সংসদ বাংলাদেশ টিভিসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, রেডিওতে কোমলমতি শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে।
আধুনিক ও মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রাথমিক শিক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিভিন্ন আইসিটি বেইজড প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। বিদ্যালয়গুলোতে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়ার যন্ত্রপাতি প্রদান করা হয়েছে, পাশাপাশি ইন্টারনেট সংযোগ করে আইসিটি বেইজড শ্রেণিকক্ষ চালু করা হয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষকরা নিজেরাই ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করতে পারছেন। একথা হয়তো আমরা অনায়াসেই বলতে পারি, সেদিন আর বেশি দূরে নেই, যেদিন আমাদের শিশুরা ই-বুক রিডারে তাদের পাঠ্যবই পড়বে, ভার্চুয়ালি লেখবে। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক প্রতিটি ক্লাস পর্যবেক্ষণ করবেন। আগামী প্রজন্মের শিশুরা তথ্যপ্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করে খেলায় খেলায়, আনন্দ-উৎসবে, দেশের গৌরবময় ইতিহাস ও সংস্কৃতি জেনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। আমরা যদি সবাই মিলে জাতির পিতার শিক্ষা দর্শন বুকে ধারণ করে, অন্তরে লালন করে তা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষায় ন্যায্যতা ও একীভূততা অর্জনের পাশাপাশি জীবনব্যাপী শিক্ষা নিশ্চিত করতে একযোগে কাজ করি তবেই আমাদের দেশের পিছিয়ে পড়া, বঞ্চিত মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটবে এবং স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক: উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পূর্বধলা, নেত্রকোনা
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। বাঙালির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইলিশ মাছের চর্বিতে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। উক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রায় ২% ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড- যা মানবদেহের কোলেস্টোরেলের পরিমাণ হ্রাস করে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তা ছাড়া ইলিশ মাছের আমিষের ৯ ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া যায়, যা মানুষের পাকস্থলী তৈরি করতে পারে না। ইলিশের চর্বিতে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন এ এবং ডি থাকে। এ জন্য ইলিশ স্বাস্থ্যবান্ধব মাছ হিসেবে অধিক পরিচিত।
ইলিশের অবাধ প্রজনন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ অনুযায়ী ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর ২০১৮ (বাংলা ২২ আশ্বিন থেকে ১৩ কার্তিক ১৪২৫) মোট ২২ দিন দেশব্যাপী ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সময় ইলিশের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্রের ৭০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা যেমন মিরসরাই উপজেলার শাহেরখালী থেকে হাইতকান্দী পয়েন্ট; তজুমদ্দিন উপজেলার উত্তর তজুমদ্দিন থেকে পশ্চিম সৈয়দ আওলিয়া পয়েন্ট; কলাপাড়া উপজেলার লতা চাপালি পয়েন্ট; কুতুবুদিয়া উপজেলার উত্তর কুতুবুদিয়া থেকে গণ্ডামারা পয়েন্টে ইলিশ মাছসহ সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। এ ছাড়াও দেশের ৩৭ জেলায় যথা চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, শরীয়তপুর, ঢাকা, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং গোপালগঞ্জ জেলার সংশ্লিষ্ট সব নদ-নদীতে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। নিষিদ্ধকালীন সময়ে দেশব্যাপী ‘ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ২০১৮’ পরিচালনা করা হবে। ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ সংক্রান্ত সরকারি নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন; প্রধান প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ রক্ষায় গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং সর্বোপরি অবাধ প্রজননের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও মৎস্য অধিদপ্তর এ উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা হলে ১-২ বছর মেয়াদে জেল কিংবা ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। একই অপরাধ পুনরায় করলে শাস্তির মাত্রা দ্বিগুণ হবে।
ইলিশের জীবনচক্র বৈচিত্র্যময়। এরা সাগরের লোনাপানিতে বসবাস করে; প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়ার জন্য উজান বেয়ে মিঠা পানিতে চলে আসে। একটি ইলিশ ৩ থেকে ২১ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। মিঠাপানিতে ডিম দেয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে। পরে এরা আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ ১-২ বছর বয়সে (২২-২৫ সেন্টিমিটার আকারে পুরুষ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী) প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠাপানির দিকে অভিপ্রয়াণ করে। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশ মাছ অপেক্ষাকৃত বেশি ধরা পড়ে।
ইলিশ মাছ সারা বছরই কম-বেশি ডিম দেয়; তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিন মাসের প্রথম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে ওরা প্রধানত ডিম ছাড়ে। এ জন্য চলতি বছরে আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার দিনসহ পূর্বের ১৭ দিন এবং পরের ৪ দিন (১৭+১+৪) ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুত ও বিনিময় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালিত গবেষণার তথ্যমতে, ২০১৭ সালে মা ইলিশ সঠিকভাবে সংরক্ষণের ফলে প্রায় ৪৭% ইলিশ ডিম দিয়েছে।
ইলিশের মোট আয়ুষ্কাল ৫-৭ বছর। আহরিত ইলিশের শতকরা ৯০ ভাগ ৩০-৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়; এর মধ্যে ২টি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারাজীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর ১টি মিঠাপানি ও লোনাপানিতে জীবন অতিবাহিত করে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৭০% বাংলাদেশ আহরণ করে; দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিয়ানমার (২০-২৫%) এবং তৃতীয় অবস্থানে ভারত (১০-১৫%)। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্যমতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা ও তিস্তা নদী এবং মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওরেও গত বছর ইলিশ পাওয়া গেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঠিক তত্ত্বাবধানে মৎস্য অধিদপ্তর, প্রশাসন ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করায় দেশব্যাপী ইলিশের বিস্তৃতি ও উৎপাদন বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২.৯৮ লাখ টন; ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা হয় ৩.৯৫ লাখ টন। ২০১৬-১৭ সালে তা ৪.৯৬ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ বিগত ৯ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ, যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোলমডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। অন্যদিকে ২০১৬ সালে ইলিশ বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইলিশের স্বত্ব এখন শুধুই বাংলাদেশের। এটা জাতির জন্য গৌরবের।
ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থাপনা বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম। এ লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার চলতি বছর দেশের ২৯টি জেলার ১১২টি উপজেলার মা ইলিশ আহরণে বিরত থাকা ৩,৯৫,৭০৯ জেলে পরিবারের জন্য পরিবার প্রতি ২০ কেজি হারে বিনামূল্যে সর্বমোট ৭,৯১৪ টন ভিজিএফ চাল মঞ্জুর করেছে। মৎস্যবান্ধব বর্তমান সরকারের এসব যুগোপযোগী ও প্রশংসিত কার্যক্রম বিগত কয়েক বছর ধরে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন এবং মা ইলিশ ও জাটকা সুরক্ষার ফলে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ টনে উন্নীত হয়েছে। ইলিশ উৎপাদনের এরূপ সফলতা জেলে সম্প্রদায়ের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। জেলেরা অনেকেই এখন বুঝতে পারছে, জাটকা ও মা ইলিশ সঠিকভাবে সুরক্ষা করতে পারলে বর্ধিত হারে ইলিশ উৎপাদনের সুফল সরাসরি তারা নিজেরাই ভোগ করতে পারবে। এ জন্য জেলেরাও অনেক ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে মা ইলিশ ও জাটকা সুরক্ষা করছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক।
লেখক: বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী
বাংলাদেশ সমগ্র পৃথিবীতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে এক রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত। এই দেশের উন্নয়নের সামগ্রিক চিত্র প্রতিফলিত হয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সূচকসমূহের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রার মাধ্যমে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটি দেশের প্রতিটি নাগরিককে পরিতৃপ্ত করেছে এবং সেই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার আশা জাগ্রত করছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য দেশের সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন একান্ত জরুরি। মূলত যে সব শিল্প অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটায় তাদের ভূমিকা উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। পর্যটনশিল্পই একমাত্র শিল্প যা কোনো সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটায়।
কেটে যাচ্ছে মেঘের ঘনঘটা সুদিন আসতে শুরু করেছে পর্যটনশিল্পে। আগস্ট মাস থেকে ধাপে ধাপে খুলে দেয়া হয়েছে দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, এয়ারলাইন্স, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেশন ও অন্যান্য পর্যটন সংশ্লিস্ট কার্যক্রম। যুক্তরাজ্য সরকার ৩২টি দেশের ভ্রমণের অনুমতি দিয়েছে। ভারত ১৫ অক্টোবর থেকে বিদেশি পর্যটকদের জন্য ভিসা সেবা দেবে। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলো ভ্রমণের ওপর বিধিনিষেধ তুলে নিতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ এদিক থেকে পিছিয়ে থাকবে কেন, তাই তো সরকার পর্যটনকে গতিশীল করতে হাতে নিয়েছে বিভিন্ন যুগোপযোগী প্রকল্প। ইতোমধ্যে পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে গেছে। লাখ লাখ পর্যটকে মুখরিত হচ্ছে দেশের পর্যটন স্থানগুলো।
অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে টেকসই প্রবৃদ্ধি হিসেবে দেখা হয়- যা অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ করবে এবং এই সুযোগগুলোতে ব্যাপক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করবে যাতে সমাজের সদস্যরা অংশ নিতে পারে এবং প্রবৃদ্ধিতে উপকৃত হতে পারে। পর্যটনকে চাকরি বৃদ্ধির একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এর ফলে অনেক উদীয়মান অর্থনীতি মানুষের কল্যাণকে সমর্থন করে। অন্তর্ভুক্তিমূলক পুনরুদ্ধারে পর্যটনের ভূমিকা থাকবে যে ক্ষেত্রগুলোতে কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য পর্যটনের মাধ্যমে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি, পর্যটন এসডিজির যে কয়েকটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করছে- লক্ষ্যমাত্রা ১- দরিদ্রতা দূরীকরণ, ২- লিঙ্গসমতা, ৩- শালীনকাজ এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, ৪- বৈষম্য কমানো, টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ এজেন্ডার দ্বিতীয় নীতি এবং এর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) হলো ‘কাউকে পেছনে ফেলবেন না’, অন্তর্ভুক্তিমূলক পর্যটন সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখা, নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র, চাকরি সৃষ্টি, উদীয়মান অর্থনীতি মানুষের কল্যাণে কাজ করা, সব শ্রেণির মানুষ পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারা।
পর্যটনশিল্প হতে পারে সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একটি হাতিয়ার যা শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে না বরং নাগরিকদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। পর্যটনশিল্প সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির একটি দ্রুততম ও ক্রমবর্ধমান খাত হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং সেই সঙ্গে আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য স্বীকৃত হয়েছে। অর্থনৈতিক বিচিত্রতা আনায়নে ও অন্যান শিল্পসমূহের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পর্যটনশিল্প উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যাপক সফলতা বয়ে আনছে।
বাংলাদেশে পর্যটনের যাত্রা অনেক আগে শুরু হলেও নানা প্রতিকূল অবস্থা পেরিয়ে আজকে আশার আলো ছড়াচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাসমূহের নৈমিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপার সম্ভাবনাময় আমাদের এই বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার একটি আদর্শ পর্যটন নগরী, যা শুধু অর্থনৈতিক চাকাকে সচল করবে না সেই সঙ্গে বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরবে। বাংলাদেশ পর্যটন পুলিশের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ছোট-বড় প্রায় ৮০০-র বেশি পর্যটন স্থান রয়েছে। এ সব স্থানকে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত করা গেলে তা এই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।
২০১৮ সালে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অ্যান্ড ট্রাভেল কাউন্সিলের প্রতিবেদন মোতাবেক ২০১৭ সালে পর্যটন খাত বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মোট কর্মসংস্থানের শতকরা ৩ দশমিক ৮ ভাগ অবদান রাখে। অন্যদিকে মোট জিডিপিতে শতকরা ৪ দশমিক ৩ ভাগ অবদান রাখে। পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) হিসাব অনুযায়ী, বছরে ৫০ থেকে ৬০ লাখ পর্যটন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যান। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নাগরিকদের পর্যটনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করছে।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ ও আধুনিক অর্থনীতিনির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে বর্তমান সরকারের যে ‘ভিশন ২০২১’ লক্ষ্য স্থাপন করেছে, তার প্ৰতিফলনস্বরূপ ডিজিটাল বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্যে শিক্ষা খাতের উন্নতি, স্বাস্থ্য সুবিধার উন্নতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং চূড়ান্তভাবে দারিদ্র্যসীমা হ্রাস করা, প্রতিটি ধাপে তথ্যপ্রযুক্তির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এগুলোকে বেশি প্রধান্য দেয়া হয়েছে যা পর্যটন শিল্প বিস্তারের সঙ্গে অর্জনের দিক থেকে সামান্তরিক। অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো পর্যটন হতে পারে ২০২১ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের একটি নিখুঁত হাতিয়ার। এটি এমন একটি শিল্প যা সমাজের সব নাগরিকের ওপর বহুমাত্রিক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ২০২১ সালের লক্ষ্য অর্জনে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে পর্যটনশিল্পের বিকাশ হতে পারে একটি আদর্শ ক্ষেত্র, কেননা প্রশিক্ষণের জন্য কম অবকাঠামোগত সুবিধা ও দক্ষতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ এই শিল্পে আগ্রহ বেশি সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে বিশ্বব্যাপী প্রচারের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার ‘পর্যটন আইন-২০১০’-এর মাধ্যমে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় পর্যটন সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি) গঠন করেছে। এরই সঙ্গে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের পর্যটন প্রসারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে পর্যটকদের আবাসন ও সেবাপ্রদানের উদ্দেশে গত ১০ বছরে মোট ২৫টি পর্যটন মোটেল, হোটেল ও রেস্তোরাঁ গড়ে তুলেছে। আর এই নিজস্ব স্থাপনাসমূহ ছাড়াও পর্যটন সেবা দিতে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেবার মান বাড়াতে নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে এবং সেই সঙ্গে দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে পর্যটন করপোরেশনের নিয়ন্ত্রিত প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নকে কাজে লাগিয়ে পর্যটনের প্রচার ও প্রসারে বৃদ্ধির জন্য বর্তমান সরকারের গৃহীত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার পদক্ষেপগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
বর্তমানে পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকার এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে আসছে। যার ফলে পর্যটনশিল্পে নীরব বিপ্লব সংগঠিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ সব উন্নয়ন পরিকল্পনার মাঝে সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড় বেঁধে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ অন্যতম। এর ফলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে দেবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেছে বর্তমান সরকার। প্রতিবছরে এতে বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এই তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হলো সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। এ সব স্থানে প্রায় ৪০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
পর্যটন খাতের উন্নয়নের প্রশ্নে বর্তমান সরকার বার্ষিক জাতীয় বাজেটে এই খাতকে একটি সময়ে গুরুত্বের সঙ্গে দেখলেও সে অবস্থার বিপরীত দিকও উঠে এসেছে নীতি-নির্ধারকদের সিদ্ধান্তে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৮১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১৩-১৪ সালে তা কমে ৬৮৩ কোটিতে দাঁড়ায়। পরের বছর ২০১৫-১৬-তে ৩৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। তারপরের বছর ২০১৬-১৭ সালে মাত্র ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে বর্তমান সরকারের কিছু পদক্ষেপ বিশেষ করে নাফ ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার ঘোষণা পর্যটন বিকাশকে ত্বরান্বিত করবে মনে হচ্ছে। কারণ এতে বিনিয়োগ করছে থাইল্যান্ডের বিখ্যাত কোম্পানি সিয়াম ইন্টারন্যাশনাল, প্রাথমিকভাবে কোম্পানিটি ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। ২৭১ একর জায়গাজুড়ে প্রায় ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি ১২ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থান জোগাবে। আর এই নাফ ট্যুরিজম পার্ক উন্নয়নের প্রকল্প ব্যয় ১৭০ কোটি টাকা এবং এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৯ সাল। ইতোমধ্যে বেজা কর্তৃপক্ষ নাফ ট্যুরিজম পার্কের উন্নয়ন কাজ হাতে নিয়েছে। অন্যদিকে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনে প্রয়োজনীয় সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। অন্যদিকে সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা )সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে। এ ছাড়া কক্সবাজারের টেকনাফে প্রস্তাবিত নাফ ও সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের অবকাঠামো উন্নয়নে ১ শতাংশ সুদে ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে এ ঋণ নেবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।
যেকোনো ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পাদনের লক্ষ্যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ব্যবহার পারে টেকসই উন্নয়ন সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে। তাই গবেষণাধর্মী কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে উপযোগী তথ্যের উদ্ঘাটন ও সংরক্ষণপূর্বক তা নিঃসন্দেহে জনকল্যাণে সমৃদ্ধি আনায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। অপার সম্ভাবনাময় ও প্রাকৃতিকভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও মহান স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছরেও আমরা পুরোপুরি সক্ষম হয়নি পর্যটন খাতকে ঢেলে সাজাতে। তবে বর্তমান বছরগুলোতে সরকারসহ বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান পর্যটনকে অর্থনৈতিক একটি কার্যকর খাত হিসেবে রূপান্তরে সচেষ্ট হয়েছে। তাই পর্যটনশিল্পের বিকাশে গবেষণাধর্মী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যটনের ওপর উচ্চশিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থাসহ বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত অনুমোদন দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় পর্যটনশিল্পের সংযোজন শুধু আর্থিক সুফলতা বয়ে আনবে না সেই সঙ্গে প্রান্তিকপর্যায়ে এর সুফল ছড়িয়ে দেবে স্থানীয়দের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পর্যটনশিল্প বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠতে পারে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের উন্নয়নভাবনায় পর্যটনশিল্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া।
লেখক: কোষাধ্যক্ষ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল
শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার গ্রহণ করেছে বিভিন্ন উদ্যোগ ও পরিকল্পনা। এর শুরুটা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ১৯৫৭ সালে তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের শ্রম, শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন নামে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান গঠনের লক্ষ্যে তদানীন্তন গণপরিষদে বিল উত্থাপন করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৭ সালের ৩০ মে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়, যা স্বাধীনতা-উত্তর Bangladesh Small and Cottage Industries Corporation (BSCIC) বা বিসিক নাম ধারণ করে। বিসিক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে নীতিগত এবং কারিগরি সহায়তা প্রদান করা। এর ভিত্তিতে ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে এবং চট্টগ্রামে বেশকিছু শিল্পায়ন হয়। কয়েকটি বিসিক এলাকা সফল হয়েছে, আবার কিছু জায়গায় প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য আসেনি। তবে এটি ছিল শিল্পায়নের পথে প্রথম পদক্ষেপ। বিদেশি বিনিয়োগে গতি আনয়নে প্রায় ৪২ বছর আগে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনস অথরিটি (BEZA বা বেপজা) অ্যাক্ট, ১৯৮০ গৃহীত হয় এবং বেপজা প্রতিষ্ঠা করা হয়। বেপজা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের প্রত্যাশা অনেকটা পূরণ হয়েছে। বেপজা বর্তমানে তাদের ৮টি ইপিজেডের মাধ্যমে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ নিশ্চিত করছে। গত ৪২ বছরে বেপজার আওতায় প্রায় ২,৩০০ একর ভূমি উন্নয়ন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের ফলে বিগত সময়ে সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি ও গার্মেন্ট শিল্পে দেশের উল্লেখযোগ্য।
একটি অংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এর অন্যতম প্রধান কারণ। এই দুটি কারণে মাথাপিছু আর উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং এ সুযোগকে কাজে লাগানোর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। আবার একই সঙ্গে আমদানি বিকল্প শিল্প প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান যেমন- গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মোংলা, পাবনা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার স্থাপিত হয় বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। এভাবে শিল্পায়ন ক্রমেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু দ্রুত শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় অপরিকল্পিত শিল্পায়নের একটি ধারা, যা সরকার এবং আশপাশের এলাকার জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা তথা পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য পৃথক ব্যবস্থাপনা তৈরির ফলে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত বাজেট-বরাদ্দের। তাছাড়া যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থাপনার অভাবে এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটেছে। বিশ্ব বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ প্রেক্ষাপটে দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি ত্বরান্বিতকরণে এবং পরিকল্পিত শিল্পায়নকে উৎসাহিত করতে ২০১০ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (BEZA বা বেজা) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয় দেশে পরিকল্পিত শিল্পায়ন, বিনিয়োগ বিকাশ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। বেজা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে ২০১৩ সালের শেষ দিকে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সাল থেকে বেসরকারি খাতকে পরিকল্পিত শিল্পায়নের ধারায় সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে, যেখানে পর্যায়ক্রমে যুক্ত হয় এ কে খান গ্রুপ, আব্দুল মোনেম লিমিটেড, মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, নিটল-নিলয় গ্রুপ, আমান গ্রুপ ও বে গ্রুপের মতো বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী। একই বছরের শেষদিকে বেজা শুরু করে দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পনগরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর প্রতিষ্ঠার কাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর দেশের সর্বপ্রথম পরিকল্পিত ও স্মার্ট নগর, যার মোট আয়তন প্রায় ৩৩ হাজার একর এবং এটি হবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শিল্পনগর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসন অনুযায়ী এ শিল্পনগরের মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করা হয় ২০ অক্টোবর, ২০১৯ সালে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী এ শিল্পনগরকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করা হয়েছে, যেখানে থাকবে হালকা, মাঝারি ও ভারীসহ সব ধরনের শিল্প। এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আবাসিক, প্রশাসনিক ও বিজনেস হাব, সার্ভিস জোন ও পুনর্বাসন এলাকা। সমুদ্রপথের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে নির্মাণ করা হবে একাধিক জেটি ও লজিস্টিক সুবিধা। এ ছাড়া জলাশয়, খেলার মাঠ, সবুজ পার্ক উন্মুক্ত এলাকাসহ জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য শিল্পনগরকে কেন্দ্র করে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের বেষ্টনী ও বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। আর এসব উদ্যোগের কারণেই এ শিল্পনগর ইতোমধ্যে বিনিয়োগের এক অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। এখন পর্যন্ত শুধু এ শিল্পনগরেই বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ শিল্পনগরসহ সব অর্থনৈতিক অঞ্চলে এ যাবৎ মোট বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে প্রায় ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
জিটুজি (সরকার থেকে সরকার ব্যবস্থায়) অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা বেজার একটি অন্যতম উদ্ভাবন (innovation)। প্রধানমন্ত্রীর সানুগ্রহ-অনুপ্রেরণায় বেজা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে এ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। বেজা ২০১৬ সালে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে। জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় ৬ ডিসেম্বর ২০২২ সালে, উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে বেজা ডেভেলপার হিসেবে নিয়ে আসে জাপানভিত্তিক বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান সুমিতমো করপোরেশনকে। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইতোমধ্যে শিল্প নির্মাণ শুরু করেছে। তুরস্কের সিংগার, জার্মানির রুডলফের মতো প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া প্রায় ২৫টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান এ অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এ ছাড়া ২০১৭ সালে শুরু হয় চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চৈনিক বা চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের প্রায় ১,০০০ একর জমিতে ২০২১ সালে শুরু হয়েছে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ। এসব জিটুজি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো আগামীতে বিদেশি বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে এবং বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচন করবে। এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশে সরকারি সফরে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে জিটুজিসহ অন্য সব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন, যা বেজার ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশনের ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে ।
বেজা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে শিল্পকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া। এরই অংশ হিসেবে বেলা জামালপুর সদর উপজেলায় প্রায় ৪৩৬ একর জমিতে প্রতিষ্ঠা করেছে জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল। এখানে শিল্প নির্মাণ শুরু করেছে তুরস্কের একটি প্রতিষ্ঠানসহ বেশ কয়েকজন বিনিয়োগকারী। কক্সবাজারের মহেশখালীতে প্রায় ২,৯০০ একর জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ শুরু করা হয়েছে, যেখানে বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপ। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলেই নির্মিত হচ্ছে দেশের বৃহৎ তেল পরিশোধনাগারসহ পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প। এটি প্রতিষ্ঠিত হলে তেল পরিশোধন ও মজুদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাশে প্রায় ১,০০০ একর জমিতে স্থাপিত হচ্ছে দেশের বৃহত্তম বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল সিরাজগঞ্জ, অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ ছাড়া সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার সংযোগস্থল শেরপুরে নির্মিত হয়েছে শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল, যা পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে। বাগেরহাটের মোংলায় নির্মাণ করা হচ্ছে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং দ্বিতীয় ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল। বেসরকারি উদ্যোগে কিশোরগঞ্জে নির্মিত হচ্ছে কিশোরগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং গাজীপুরে উৎপাদন শুরু করেছে বে অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেখানে বিনিয়োগ করেছে চীন ও তাইওয়ানের ২টি প্রতিষ্ঠান। মুন্সীগঞ্জে উৎপাদন শুরু করেছে হোসেন্দি ও আব্দুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চল। আব্দুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছে জাপানের হোন্ডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় রয়েছে মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোন, যেখানে নির্মিত হয়েছে ৭টি বিদেশি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ১৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ এসেছে জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে।
শুধু শিল্পের বিকাশ নিয়েই নয়, বেজা একই সঙ্গে কাজ করছে পর্যটন খাত উন্নয়নে। ইতোমধ্যে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের কাজ শুরু করা হয়েছে, যেখানে এখন পর্যন্ত ১৯টি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বজায় রেখে সীমিত স্থাপনার মাধ্যমে সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্ক প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন করেছেন। পাশাপাশি দ্বীপভিত্তিক ট্যুরিজম পার্ক উন্নয়নে নাফ ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের সর্বাধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন ক্যাবল কার নেটওয়ার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশে শিল্প স্থাপন করার ক্ষেত্রে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর থেকে নানা বিষয়ে অনুমোদন গ্রহণ করতে হয়। এসব অনুমোদন গ্রহণ-প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ এবং জটিল বিধায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অনেক ক্ষেত্রেই বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হন। বেজা এসব সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার’ গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগী ভূমিকায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন, ২০১৮ পাস করা হয়। এ আইনের আওতায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ)।
বিধিমালা, ২০১৮ জারি করা হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাসময়ে সেবা প্রদানের বাধ্যবাধকতার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে বেজা ওএসএস সেন্টার থেকে ৫০টি অনলাইনসহ ১২৫ ধরনের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। আগামীতে সব সেবা অনলাইনে প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে জাইকার সঙ্গে টেকনিক্যাল প্রজেক্টের কাজ চলমান রয়েছে। বেজা বিশ্বাস করে, ওএসএস কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের কারণে "Ease of Doing Business" এ আগামীতে বাংলাদেশের অবস্থান আরও উন্নত হবে। ফলে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট হবেন।
বেজা মনে করে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে বেসরকারি ব্যবসায়িক খাত। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মতে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা দক্ষ জনবলের অভাব। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সঠিকভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজন দক্ষ জনবলের। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বেজা কর্তৃক বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে Private Investment and Digital Entrepreneurship (PRIDE) প্রকল্পের আওতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে স্কলি ভাউচার প্রোপ্রামের মাধ্যমে আগামীতে ২২ হাজার দক্ষ জনবল গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এ কর্মসূচি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষ জনবল তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বেজা বর্তমানে ২৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে এবং ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে উৎপাদন শুরু হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিষ্ঠাকল্পে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হয়েছে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে এ পর্যন্ত শিল্প উৎপাদন শুরু করেছে মোট ৩৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং নির্মাণাধীন রয়েছে আরও ৭০টি। বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার লোকের। বেজার এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে শিল্প স্থাপনে নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ অন্যান্য পরিষেবা পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে হবে। শিল্প উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প স্থাপনসহ বিনিয়োগের পরামর্শ দিতে হবে। এ বিষয়ে এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে।’
পরিকল্পিত শিল্পায়ন, বিনিয়োগ বিকাশ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন হলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথ সহজ হবে। তাই অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ বেগবান করার জন্য সরকারের নিয়মিত বাজেট থেকে বেজাকে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন। কারণ বেজা একটি বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তুলনামূলক কম মূল্যে অর্থাৎ ভর্তুকি দিয়ে জমি বরাদ্দ করছে। এ ছাড়া বেজার সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগ যেমন-সড়ক বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগকে সমন্বিতভাবে প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করে অবকাঠামো নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় পরিকল্পনা অনুযায়ী ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিলম্ব হতে পারে।
বিনিয়োগবান্ধব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বেজা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করে থাকে। বিনিয়োগ বিকাশে বেজা বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যা পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের তুলনায় আকর্ষণীয়। বেজা বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাছে অভূতপূর্ব গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ব্যবসায়ীরা যেন দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহ ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তা নিশ্চিত করতে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ করে যেতে হবে। যেসব সরকারি কর্মকর্তা বেজায় কর্মরত রয়েছেন তাদের শিল্প, শিল্প স্থাপনের প্রক্রিয়া, শিল্পের রূপান্তর ও সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। বিশেষত, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অংশ হিসেবে আমাদের যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন জনবল সৃষ্টিতে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
আমি মনে করি, বিনিয়োগ বিকাশ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো ভবিষ্যতে দেশকে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরে খুবই আত্মপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পকার থেকে শুরু করে জাপানি, চৈনিক ও ভারতীয় এবং মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে আমরা অনেক বড় পরিসরে প্রস্তুত করছি এবং আমাদের সঙ্গে কাজ করছে উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বেসরকারি খাত। বেজা শিল্পায়নের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করছে এবং ব্যবসা প্রক্রিয়া সহজ করে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করছে। তবে এ লক্ষ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, বিভিন্ন প্রণোদনা ও ভর্তুকি প্রদানের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিজেদের প্রতিযোগিতা-সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: সদস্য, শিল্প ও বাণিজ্য উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
কদিন আগে উদযাপন হলো বাংলা নববর্ষ। সামনে রোজার ঈদ বা ঈদুল ফিতর। বিগত দুটি বছরে করোনা সংকটের কারণে বাংলা নববর্ষ কিংবা ঈদ কোনো উৎসবই পুরোদমে পালন করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন করোনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। সরকারের টিকা ও আর্থিক প্রণোদনা ব্যবস্থাপনাকে সে জন্য কৃতিত্ব দিতেই হবে। আর এ কারণেই ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন করে জেগে ওঠার বাতাস বইছে। মার্চ মাসে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়- দুই-ই বেশ বেড়েছে। এই আয় আমাদের ভোগের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করছে। এবার তাই বাংলা নববর্ষ এবং রোজার ঈদকে ঘিরে জনসাধারণের আগ্রহ-উদ্দীপনা বেশি থাকবে তেমনটিই ভাবা হয়েছিল। এই উৎসব উদযাপনের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তো রয়েছেই। এগুলোর অর্থনৈতিক প্রভাব ও গুরুত্বও আলাদা মনোযোগের দাবি রাখে। বিশেষত একদিকে করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার চলমান থাকা এবং অন্যদিকে বৈশ্বিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে নিত্যপণ্যের বাজারে যে চাপ রয়েছে তার প্রেক্ষাপটে এই উৎসবগুলোকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্লেষণ আরও বেশি জরুরি। পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির দিকে বেশি করে জোর দেয়ার কথাও কেউ কেউ বলছেন। তবে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গতিময়তার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ভোগ ও চাহিদার যে গভীর সম্পর্ক আছে তা তো মানতেই হবে। সেই বিচারে বাংলাদেশ দুই পায়েই বেশ আস্থার সঙ্গে হাঁটছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের কৃষির সাফল্য। আর অর্থনীতির এই ত্রয়ী শক্তির প্রভাবে দেশের মানুষের অভ্যন্তরীণ ভোগ ও চাহিদা- দুই-ই বাড়ন্ত। এ সবের প্রভাব তো উৎসবের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি অনেকটা নির্ধারণ করবেই।
যে দুটি উৎসবের কথা বললাম দুটির ক্ষেত্রেই আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদাটিই মুখ্য বিবেচ্য। আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক আলোচনা ও সংলাপে রপ্তানি যতটা মনোযোগ পায়, আমি লক্ষ করেছি অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ ততটা গুরুত্ব এখনো পাচ্ছে না। এর একটি কারণ হতে পারে দেশের অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিকতা। অনানুষ্ঠানিকতার কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা এবং সেই চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে হিসাব করা জটিল বটে। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত তথ্যের ঘাটতি যে আছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবুও একে কম গুরুত্ব দেয়া সমীচীন নয় মোটেও। রবীন্দ্রনাথ সব সময় সমাজের ‘আত্মশক্তি’র ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। একইভাবে বঙ্গবন্ধুও বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতা যতটা সম্ভব কমিয়ে দেশকে আত্মনির্ভরশীল করার পক্ষে ছিলেন। স্বাধীনতার পরপর তার নেয়া অর্থনৈতিক পদক্ষেপ থেকে শুরু করে, তাঁর তৈরি প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেও এমন জোরই দেখি। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও দেশের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে যাচ্ছেন শুরু থেকেই। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ২০০৮-০৯ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকেও একই পথে হেঁটে মন্দা মোকাবেলা করে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার কৌশল গ্রহণ করেছিলাম। সে সময়ও আমরা অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেগবান করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলাম। ঋণপ্রবাহ যেন ‘রিয়েল ইকোনমি’তে যায় তা নিশ্চিত করতে কৃষি, কুটির-ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই), এবং নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে বিভিন্ন উদ্ভাবনী উদ্যোগ সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছিল। ফলস্বরূপ অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেগবান করা সম্ভব হয়েছিল এবং আমরা কেবল বৈশ্বিক মন্দা ভালোভাবে মোকাবেলা করেছিলাম তাই নয়, বরং অর্থনীতিতে নতুন গতিও সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে শুরু করা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ওই ‘নীরব বিপ্লব’ একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সফল হয়েছে- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তার একযুগ পরে আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি আবারও একই রকম চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবারও অভ্যন্তরীণ চাহিদাই আমাদের রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে। সে বিচারেই এবারের বাংলা নববর্ষ আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভেবে দেখুন এই সার্বজনীন সাংস্কৃতিক উদযাপনকে কেন্দ্র করে করোনাজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থায় ঝিমিয়ে পড়া খাতগুলোতে গতি সঞ্চার হলে তা পুরো অর্থনীতির জন্য কতটা ইতিবাচক হতে পারে। মধ্য ও উচ্চবিত্তের কথা না হয় নাই বললাম, শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ যারা, ধরা যাক গার্মেন্ট শ্রমিকদের কথা তারা সবাই যদি পরিবারের জন্য নববর্ষ উপলক্ষে কিছু কেনাকাটা করেন তাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হওয়ার কথা। গ্রামেও তো এখন সেবা খাতের ব্যাপ্তি অনেক। আয়ের ৬০ শতাংশই আসছে অকৃষি খাত থেকে। কাজেই নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামের অকৃষি খাতের উদ্যোক্তারাও বাড়তি বেচাকেনার মুখ দেখবেন। দেশব্যাপী টাকার এই লেনদেনের ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মীদেরও আয়-রোজগার বাড়বে। তাদের জন্য নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির চাপ মোকাবেলা কিছুটা হলেও সহজতর তো হবেই। করোনার দুর্দশা কাটিয়ে দুই বছর বাদে পুরো মাত্রায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন অর্থনীতির জন্য সুখবরই বটে।
বিশেষ করে দেশীয় কুটির-ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের জন্য বাংলা নববর্ষ উদযাপন বেশি সহায়ক হবে বলে মনে করি। উদাহরণ হিসেবে দেশের ছোট ছোট পোশাক প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারীদের কথা ধার যায়। ১০-১৫ বছর আগেও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পোশাক কেনা অত বেশি ছিল না। কিন্তু করোনা আসার আগে আগে ২০১৯ সালের পহেলা বৈশাখকে ঘিরে ১৫ হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি। এই পোশাক কিন্তু কেবল বিপণি বিতানে বিক্রি হয়েছে এমন নয়। বরং ফুটপাথের বিক্রেতাসহ অনানুষ্ঠানিক বিক্রয়কেন্দ্র থেকেও এর একটি বড় অংশ বিক্রি হয়েছে। ২০১৯ সালের আগের হিসাব বলছে এই বিক্রির পরিমাণ বছরে গড়ে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। করোনাকালে এই প্রবৃদ্ধি নিশ্চয়ই ধাক্কা খেয়েছে। তবে এবারের নববর্ষে নিশ্চয়ই আমরা পুরোপুরি আগের ধারায় না ফিরলেও গত দুই বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পোশাক বিক্রি বাড়তে দেখব। কেবল ছোট পোশাক প্রস্তুতকারকরাই নন, বড় বড় ফ্যাশন হাউসগুলোও জানিয়েছে যে তাদের মোট বিক্রির এক-চতুর্থাংশের বেশি হয় এই বাংলা নববর্ষেই। আর শুধু পোশাক বিক্রি কেন, হালখাতা অনুষ্ঠানের জন্য মিষ্টি দোকানের যে ব্যবসা হয় তাও তাদের সারা বছরের বিক্রির চার ভাগের এক ভাগ। সরকারের ‘আমার গ্রাম আমার শহর’নীতি আর ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর কারণে গ্রামাঞ্চলে উৎসবকেন্দ্রিক চাহিদা দ্রুত আরও বাড়বে। ফলে আগামীতে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রবৃদ্ধির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। আর মধ্যবিত্তের রেস্তোরাঁয় খাওয়ার যে অভ্যাস গড়ে উঠেছে তারও প্রভাব অভ্যন্তরীণ ভোগ-বাণিজ্যে নিশ্চয় পড়বে।
আর মাত্র কয়েক দিন পরেই ঈদুল ফিতর। কাজেই বলা যায় চলতি এপ্রিল মাসের পুরো দ্বিতীয়ার্ধজুড়েই বাজার সরগরম থাকবে। চারদিকে কেনাকাটা অনেকটাই জমে উঠেছে। ঈদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুফলও পৌঁছে যাবে সব স্তরে। ফলে অর্থনীতির গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় এই দুটি সপ্তাহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হবে- এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ব্যবসায়ীরা, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এবং নতুন যুক্ত হওয়া অনলাইন উদ্যোক্তারা যেন এ সময়টায় নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন সে জন্য সর্বাত্মক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক চরিত্রের কারণেই হোক বা অন্য কারণে হোক এখনো উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের যথাযথ পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। এদিকটিতে এখনই নজর দেয়া চাই। উৎসবের কেনাবেচার ধারা ভালোভাবে লক্ষ্য করে সে অনুসারে নীতি-উদ্যোগ নিতে পারলে আগামীতে উৎসবে উদ্যোক্তাদের জন্য আরও সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। সরকার বাজার মনিটরিং এবং সাপ্লাই চেইন মেরামতের কাজ মোটামুটি ভালোই করছে। এর ইতিবাচক প্রভাব উৎসবের বাজারের ওপর পড়তে শুরু করেছে। আমাদের উৎসবের অর্থনীতির কলেবর বরাবরই অনেক বড়। ঈদের আগে নতুন কোনো প্রাকৃতিক বৈরী পরিবেশ তৈরি না হলে নববর্ষ ও ঈদ উৎসবের অর্থনীতির ধারায় ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা নিজেদের বেশ গুছিয়ে নিতে পারবে। সবাইকে অগ্রিম ঈদের শুভেচ্ছা।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।’ ছেলেবেলায় যখন কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দেশাত্মবোধক কবিতার চরণগুলো পড়তাম তখন মনে হতো তিনি হয়তো একটু বাড়িয়েই লিখেছেন। কিন্তু জীবনের পথপরিক্রমায় দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতা থেকে এখন উপলব্ধি করি যে তিনি প্রকৃতপক্ষে অতিরঞ্জিত কোনো কথা বলেননি। আবহমানকালের ইতিহাস বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের সমসাময়িককালে আমাদের দেশ তথা পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল অর্থনৈতিক শক্তির শীর্ষে।
আর মোগল আমলে সেই অবস্থান নেমে এসেছিল চতুর্থে। এর ফলে প্রাচীন আমলের সেই স্বর্ণযুগে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ এখানে এসেছে বাণিজ্যের অন্বেষণে। আবার কখনো কখনো তারা কূটকৌশল অবলম্বন করে এ দেশের শান্তিপ্রিয়, উদার, সরল-সাধারণ মানুষকে প্রবঞ্চিত করে শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ দেশের জলবায়ু, আবহাওয়া, প্রকৃতি- সবই ছিল মানব বসবাসের ক্ষেত্রে অনুকূল; আর তাই তো এ দেশের মানুষ বেড়েছে জ্যামিতিক হারে।
এ দেশ আমাদের, দেশমাতৃকার পলিবাহিত মাটিতে জন্মগ্রহণ করে আমরা গৌরববোধ করি।
গর্বের প্রথম কারণ, আমাদের সভ্যতার ইতিহাস অতি প্রাচীন। সনাতন ধর্মের উৎপত্তি ঘটেছিল এই ভূখণ্ডে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। তাই পশ্চিমা বিশ্বের মানুষকে যদি আমরা সভ্য বলি, তাহলে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধিশীল জীবনের যে চিরায়ত বাস্তবতা সে ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের সুসভ্য জাতি বলে গৌরববোধ করতেই পারি।
দ্বিতীয় কারণ, প্রাকৃতিক ধন-সম্পদের ভাণ্ডার আমাদের এই ভূখণ্ড। প্রকৃতি আমাদের উজাড় করে দিয়েছে তার অবারিত ধনভাণ্ডার। আমাদের প্রকৃতি যেমন সমৃদ্ধ, ঠিক তেমনি আমাদের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ়। এই ছোট জায়গায়ই বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপাদান, তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি ব্যবস্থা হচ্ছে। আজ আমরা আমদানিনির্ভর জাতির কলঙ্ক মুছে রপ্তানিমুখী জাতির গৌরবে অভিষিক্ত হচ্ছি।
তৃতীয় কারণ, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের বিপুল সম্ভাবনায় আমরা পেয়েছি ষড়ঋতুর সমাহার। এই ষড়ঋতুর কারণে আমাদের দেশে পর্যায়ক্রমে আসে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। ছয় ঋতুতে আমাদের প্রকৃতি ছয়টি নতুন সাজে সজ্জিত হয়। এই অপরূপ প্রকৃতি আমাদের দিয়েছে অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত মন ও হৃদয়। ঋতুবৈচিত্র্য আমাদের জীবনকে যেমন সহজ করেছে ঠিক তেমনি সমৃদ্ধও করেছে।
চতুর্থ কারণ, পারিবারিক বন্ধন আমাদের আবহমানকালের চিরন্তন ঐতিহ্য। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে এমন মায়া-মমতা, ভালোবাসা বিশ্বের অনেক দেশেই বিরল। এই নিবিড় বন্ধন শুধু মানুষের মধ্যে আত্মিক প্রশান্তিই আনে না, এর সঙ্গে জীবনের স্বাদ ও কর্মস্পৃহাকে অর্থবহ করে তোলে। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বিশেষ করে বন্যা মোকাবিলায় সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের যে আত্মিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা কাজ করে তা বিদেশের কৃত্রিম সমাজের মধ্যে দেখা মেলা ভার।
বর্তমান সরকারের গতিশীল ও পরিকল্পিত চিন্তাধারার মাধ্যমে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। নিজের দেশের পণ্যের বিজ্ঞাপন যখন ভিনদেশি টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়, তখন মানুষ হিসেবে মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। যখন শুনি আমাদের তৈরি ওষুধ পৃথিবীর ১০৪টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে, তখন গর্ববোধ করি। যখন জানি পদ্মা নদীর ওপর নিজস্ব অর্থায়নে হয়েছে পদ্মা সেতু, তখন ভালো লাগার মাত্রায় যোগ হয় এক অনির্বচনীয় গর্ব ও প্রত্যাশা। আগামীর সম্ভাবনাময় চোখে যখন দেখি আমাদের আইটি সেক্টর গার্মেন্ট সেক্টরকেও পেছনে ফেলবে তখন বিস্ময়ে অভিভূত হই। কৃষিতে শাক-সবজি, ফলমূল উৎপাদনে আমাদের সমকক্ষ দেশ পৃথিবীতে খুবই কম। আমরাই পারি আমাদের কৃষিদ্রব্যের বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে কীটনাশকমুক্ত কৃষিপণ্যের বিশাল বিদেশি বাজার সৃষ্টি করতে। যার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বছরে ছয় ফসলি চাষ পদ্ধতি।
কখনো কখনো খাদ্যে ভেজাল, নারী ও শিশু নির্যাতন, কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতি, চাকরিতে নিয়োগে অস্বচ্ছতাসহ বহু নেতিবাচক কার্যকলাপ আমাদের সোনার বাংলার এই ইতিবাচক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। আমরা উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলেও কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। আর তা হচ্ছে জীবন ও কর্মক্ষেত্রে আমাদের নৈতিকতার অভাব। কাজেই এই রাহুগ্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নৈতিকতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, বিশ্বাস ও সততাই ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। এই সেতুবন্ধ যত মজবুত হবে উন্নতিও ততটাই টেকসই হবে। পরিবার, সমাজ, জাতি যখন সৎ ও নৈতিকতার চর্চা করবে ও তার প্রতি বিশ্বাস রাখবে, তখন দেশের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে থাকবে প্রাণ ও প্রাচুর্যের ছোঁয়া।
সুস্বাস্থ্যের জন্য যেমন সুষম খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি সুন্দর ও সুখী জীবনের জন্য প্রয়োজন আত্মা ও মন পরিতুষ্ট করা। আত্মা ও মন উভয়েরই খাদ্যের প্রয়োজন। আত্মা ও মন উভয় ভিন্ন ভিন্ন সত্তা এবং উভয়ের মধ্যে রয়েছে সূক্ষ্ম পার্থক্য। মন নৈতিক-অনৈতিক উভয় কাজেই আনন্দ পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ হিংসাবশত অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে মন তাৎক্ষণিকভাবে আনন্দিত হয়। কিন্তু আত্মার তুষ্টির উপাদান শুধুই ভালো চিন্তা ও সৎ কর্ম। ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় ধারণা করা হয়, মন ও দেহকে তুষ্ট করতে পারলেই মানুষ সুখী। কিন্তু এই ধারণা যে কতটা ভুল, তা সুখের মাপকাঠিতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পরাশক্তির আনুক্রমিক অবস্থানের দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায়। বিশ্বের এক নম্বর ধনী বিল গেটস মানবদরদি হিসেবে পরিচিত। তিনি তাঁর অর্জিত সম্পদের বেশির ভাগ অংশই দান করেছেন মানবকল্যাণে; দানের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন আত্মার তুষ্টি। আর আমরা সাধারণ মানুষ আত্মার তুষ্টি খুঁজতে পারি নিজের গণ্ডির মধ্যে থেকে ভালো কাজের মাধ্যমে, আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে, মা-বাবা, শিক্ষক ও গুরুজনদের শ্রদ্ধা করে, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনকে সাহায্য করে, নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বুকে লালন করে, দেশকে ভালোবেসে এবং দেশের উন্নতিতে অবদান রেখে। তেমনি নৈতিকতাবিবর্জিত শুষ্ক জীবনের স্বাদ কতটুকু, তা ভাবার বিষয়।
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ও রাজনীতিবিদ Lord Macaulay ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা গভর্নর কাউন্সিলের একজন আইন সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ সম্পর্কে দেওয়া তাঁর বক্তব্যে তিনি আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নৈতিক গুণাবলির শ্রেষ্ঠত্ব অকপটে স্বীকার করেছিলেন। শাসকের ভূমিকায় টিকে থাকার জন্য ব্রিটিশ নীতি-নির্ধারকদের প্রতি তাঁর যে উপদেশ ছিল, তা সচেতন ও দেশপ্রেমিক বাংলাদেশিদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস। শিক্ষার মূল ভিত্তি নৈতিকতাকে অক্ষুণ্ন রেখে জীবনধারণ ও কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে যেকোনো শিক্ষাই মর্যাদাপূর্ণ ও আত্মিক প্রশান্তির প্রতীক। তাই আমাদের উচিত শৈশবকালীন শিক্ষা থেকে উচ্চতর শিক্ষা পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নৈতিক শিক্ষার বিষয়টিকে শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে ইতিবাচক বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবায়ন করা, যাতে দেশ থেকে নেতিবাচক দিকগুলো দূর হয়ে যায় এবং আমরা পরিণত হই সুখী ও সুষমভাবে সমৃদ্ধ জাতিতে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন পণ্ডিত ড. মো. শহীদুল্লাহর মতো আমরাও বিশ্বাস করতে চাই, ‘মাতা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা এই তিনটি জিনিস প্রত্যেক মানুষের কাছেই গৌরবের বস্তু।’
লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫২ বছর পার করে তেপ্পান্ন বছরে পদার্পণ করতে চলেছে। একটি দেশের জন্য ৫২ বছর তেমন কোনো সময় নয়। আবার একেবারে যে কম সময় তাও বলা যাবে না। কেননা এ সময়ের মধ্যে দুটি প্রজন্ম তাদের কর্মক্ষম সময় পার করে ফেলেছে। বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতি আজ সারাবিশ্বেই প্রশংসিত। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ যে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নতি অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে তার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ১. বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশ পরিচালনার সুযোগ, ২. প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব এবং যুগান্তকারী সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ৩. ছোটখাটো কিছু ঘটনা বাদ দিলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আমাদের দেশের ৫২ বছরের পথচলা হলেও দেশের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে বিগত দেড় দশকে। এই সময় দেশের অর্থনীতির সব খাত এগিয়েছে সমানতালে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- দেশের কৃষি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য এগিয়েছে সমানতালে। যখন দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, তখন দেশে খাদ্য ঘটতি ছিল। অথচ আজ ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। একইভাবে একসময় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, অথচ ব্যবসা-বাণিজ্য এখন দেশের সব মানুষের পেশায় পরিণত হয়েছে।
দেশে করপোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের যেমন প্রসার ঘটেছে, তেমনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরও প্রসার ঘটেছে। একসময় আমাদের দেশে হাতেগোনা দু-একটি করপোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। বর্তমানে দেশে অসংখ্য করপোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং এদের মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান আবার সুনামের সঙ্গে বিদেশেও পণ্য রপ্তানি করছে। তৈরি পোশাক বাদ দিলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কোনো পণ্য নিজ দেশের কোম্পানির নামে বাজারজাত করার কাজটি ছিল দুরূহ এবং প্রায় অসম্ভব। আগে অনেক বাংলাদেশিকে এখানে ব্যবসা পরিচালনা করতে হয়েছে আমাদের প্রতিবেশী দেশের নাম দিয়ে। যারা ব্রিটেন বা লন্ডনে থাকেন তারা আরও বেশি ভুক্তভোগী। কেননা সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিরা নিজেদের মূলধন বিনিয়োগ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করে ইন্ডিয়ান দোকান বলে পরিচয় করিয়ে দিতে হতো। এখন আর সেদিন নেই। এখন বাংলাদেশি দোকান হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছে। তৈরি পোশাকের কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশে উৎপাদিত অনেক পণ্য এখন এখনকার মূলধারার শপিং মলে বিক্রি হয়। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগিয়েছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃহৎ ও করপোরেট ব্যবসা সেভাবে অগ্রসর হতে পারেনি।
দেশের বৃহৎ এবং করপোরেট ব্যবসা প্রসারের পাশাপাশি ক্ষুদ্র এবং আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। দেশের অধিকাংশ জনগণ এখন কোনো না কোনো ব্যবসায়িক কাজে নিয়োজিত। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন বাড়ির সংখ্যা খুবই কম, যে বাড়ির কোনো সদস্য ব্যবসায়িক কাজে জড়িত নেই। গ্রামের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। গ্রামের রাস্তার মোড়ে মোড়ে দোকানপাট গড়ে উঠেছে এবং সেখানে বেচাকেনাও হয় উল্লেখ করার মতো। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এখন আর গ্রামের দোকানদারদের শহর বা বাজারে গিয়ে বিক্রির জন্য পণ্যসামগ্রী কিনে আনতে হয় না। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের বিক্রয় প্রতিনিধির মাধ্যমে সরাসরি সেসব পণ্য দোকানে সরবরাহ করে থাকে। দেশে ক্ষুদ্র এবং আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যবসা প্রসারের ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটে গেছে। সমস্যা হচ্ছে এসব ব্যবসার তেমন কোনো স্বীকৃতি বা প্রাতিষ্ঠানিক নিবন্ধন নেই। ফলে জানার উপায় নেই যে, কী পরিমাণ ক্ষুদ্র এবং আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যবসা সমগ্র দেশে চালু আছে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এই ক্ষুদ্র এবং আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যবসাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির একটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। এসব ক্ষুদ্র এবং আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা হয়তো সেভাবে বিনিয়োগ করে না বা তাদের পরিচালিত ব্যবসা হয়তো সেরকম কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করে না; কিন্তু দেশের জিডিপিতে তাদের সম্মিলিত অবদান যে উল্লেখযোগ্যই হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ কথা আজ বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতিতে যে কয়টি খাত গ্রোথ ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কৃষি, ক্ষুদ্র ও আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যবসা। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার সত্যিই গর্ব করার মতো; কিন্তু এতে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে একে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকার কিছু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ১. ২০৩০ সাল নাগাদ দেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা, ২. ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশের অর্থনীতিকে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে রূপান্তর করা এবং ৩. ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নতসমৃদ্ধ দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়া। তাছাড়া আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই মর্মে প্রাক্কলন (ফোরকাস্ট) করেছে যে, আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২০টি অর্থনীতির একটি হবে। আগামীতে বাংলাদেশের এই যে অপার সম্ভাবনার সুযোগ, তাকে সফলভাবে এগিয়ে নিতে হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার অব্যাহত রাখতে হবে। আবার এ সম্ভাবনার সব সুযোগ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যই থাকবে সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থানে। এসব কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে কোনোরকম বিরতি দেয়ার সুযোগ একেবারেই নেই। তাছাড়া উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের পথচলা সব সময়ই বিরামহীন। একজন বিনিয়োগকারী কখনই বলতে পারবেন না যে, তার বিনিয়োগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাই তিনি আর বিনিয়োগ করবেন না। নির্দিষ্ট একটি ব্যবসার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছতে পারে; কিন্তু উদ্যোক্তা হিসেবে তার বিনিয়োগ অব্যাহতই থাকে।
দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় সমান অংশীদার হিসেবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে দেখতে হলে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে যেমন বিনিয়োগ এবং ব্যবসা প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকেও এ খাতের অগ্রযাত্রায় সহায়ক ভূমিকায় থাকতে হবে। প্রথমেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত যে কোটি কোটি ক্ষুদ্র ও আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যবসা বিস্তৃত আছে সেসব ব্যবসাকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সরকারি সহযোগিতার আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র এবং আত্মকর্মসংস্থানে পরিচালিত ব্যবসা সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে যে- এসব ব্যবসায়ের ৪০ শতাংশ ব্যবসা চালু হওয়ার পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণেই এ ধরনের ব্যবসাকে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের সহায়তার আওতায় রাখতে হয়। আমাদের দেশের ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) এ কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে। টিসিবিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে যুগপৎ দুটি উদ্দেশ্য সফল হবে। প্রথমত দেশের বেকার সমস্যার সমাধান হবে এবং দ্বিতীয়ত দ্রব্যমূল্য নিয়ে যে কারসাজি বা সিন্ডিকেটের অভিযোগ রয়েছে তা অনেকটাই ভেঙে যাবে।
দেশে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক বিস্তার ঘটাতে একদিকে যেমন আমদানি বিকল্প শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, অন্যদিকে তেমনি রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয় সেই মানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটাতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তা শ্রেণির যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি সরকারেরও বড় ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের ব্যবসায়ীদের তৈরি পোশাক রপ্তানির পাশাপাশি অন্যান্য প্রচলিত এবং অপ্রচলিত পণ্যের নতুন রপ্তানিবাজার ধরতে হবে। আমেরিকা-কানাডাসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে এখন অনলাইন কেনাকাটার রমরমা অবস্থার কারণে কাগজের ব্যাগ এবং কার্টন বক্সের ব্যাপক চাহিদা আছে, যার অধিকাংশ মেটানো হয় তাইওয়ান এবং ভিয়েতনাম থেকে। এখানকার আমদানিকারকরা সব সময় এসব পণ্যের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটার ঝুঁকির মধ্যে থাকে দু-একটি দেশের ওপর নির্ভর করার কারণে। একইভাবে পশ্চিমাবিশ্ব পরিবেশের জন্য হুমকি হওয়ায় প্লাস্টিক ব্যাগ উঠিয়ে দিতে শুরু করলেও এর বিকল্প পরিবেশবান্ধব কোনো ব্যাগ সেভাবে বাজারে আসেনি। অথচ পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগ হতে পারে এর ভালো বিকল্প, যা বাংলাদেশের একচেটিয়া বাজার হতে পারে। একইভাবে কিছু সবজি, ফলমূল, গুঁড়া মসলা এবং বেকারি পণ্যের বিশাল বাজার আমেরিকা-কানাডাসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সৃষ্টি হয়েছে। কারণ আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নাগরিকরা এসব পণ্যের প্রধান গ্রাহক, যা বর্তমানে একটি বিশাল বাজার। আমাদের দেশে উৎপাদিত এসব পণ্য এখানকার বাজারের পণ্যের চেয়ে অনেক উন্নতমানের। ফলে বাংলাদেশ এসব পণ্যের মার্কেট খুব ভালোভাবেই ধরতে পারে এবং দেশের রপ্তানি আয় বহুগুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে।
এর পাশাপাশি নতুন বাজার হিসেবে লাতিন আমেরিকা এবং পূর্ব ইউরোপের দেশে রপ্তানি সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। কারণ এসব দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাওয়ায় ভোগ্যপণ্যের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এসব নতুন বাজার ধরতে হলে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের ব্যবসার ধরন পরিবর্তন করতে হবে। উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ আমদানিকারক এখন আর এলসি দিয়ে পণ্য আমদানি করেন না। উল্টো রপ্তানিকারকরা নিজ উদ্যোগে পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে বিদেশের আমদানিকারকদের গুদামে পৌঁছে দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, অনেক ক্ষেত্রে আমদানিকারকের বিক্রয়কেন্দ্র পর্যন্ত সাজিয়ে দিয়ে আসে। অথচ আমাদের দেশের রপ্তানিকারকরা এখনো বসে থাকে, যে কখন বিদেশের আমদানিকারক কোম্পানি তাদের কাছে এলসি পাঠিয়ে পণ্য প্রেরণের অনুরোধ জানাবে। সেদিন এখন শেষ হওয়ার পথে। তাই আমাদের ব্যবসায়ীদের তাদের রপ্তানি বাণিজ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। নিজ উদ্যোগে নিজেদের পণ্যের মার্কেটিং করতে হবে, সরবরাহ আদেশ সংগ্রহ করতে হবে এবং প্রয়োজনে আমদানিকারকের গুদামে পণ্য পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
আরও একটি বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিকে ত্বরান্বিত এবং টেকসই করতে হলে দেশের ব্যাংকিং খাতের মান উন্নতির কোনো বিকল্প নেই। দুর্বল ব্যাংকিং খাতের জন্য যেমন শক্তিশালী অর্থনীতিও ধাক্কা খেতে পারে, আবার শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থার কারণে ছোট অর্থনীতিও ভালো উন্নতি করতে পারে। ইউরোপের একটি বৃহৎ অর্থনীতির দেশ জার্মানিকে তাদের ব্যাংকিং খাতের সমস্যার কারণে ভালো ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে। আবার ইউরোপের ছোট অর্থনীতির দেশ স্পেন ভালো ব্যাংকিং ব্যবস্থার কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। তাই আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে এ খাতের মান একটি পর্যায় পর্যন্ত নিতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি দেশে একটি কার্যকর বন্ড মার্কেট গড়ে তুলতে হবে, যাতে দেশের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে সমস্যার সম্মুখীন না হয়।
দীর্ঘ ৫২ বছরের পথ চলায় বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক দূর এবং আগামীতে আরও বেশি অগ্রসর হওয়ার সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। একইভাবে বর্তমান সরকার যে দেশকে আগামীতে মধ্যম আয় এবং উন্নতসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সেই লক্ষ্য অর্জনে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা অব্যাহত রাখতে হবে। আবার এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে যে সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে তাও ব্যবসায়ীদের গড়ে তুলতে হবে। আর এ কারণেই আগামী দিনগুলোতে দেশের সরকার এবং ব্যবসায়ীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একযোগে হাঁটতে হবে, তাহলেই আমাদের দেশের উন্নতির অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে এবং উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য অর্জিত হবে।
লেখক: সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা
মুদ্রাস্ফীতির অতি সহজ ব্যাখ্যা হচ্ছে বিগত সময়ে ১০০ টাকা দিয়ে আমি যে পণ্য পেতাম এখন ১০০ টাকা দিয়ে একই পণ্য আরও কম পাচ্ছি। এতে সীমিত আয়ের লোকদের জীবন নির্বাহ করতে হিমশিম খেতে হয়। অনেক পণ্য কেনাকাটা বাদ দিতে হয় অথবা কম কিনতে হয়। বর্তমানে স্তিমিত তিন বছর মেয়াদি ‘ওমিক্রন সংক্রমণ’ এবং পরবর্তীতে চলমান ‘ইউক্রেন সংকটের’ কারণে সৃষ্ট বিশ্ব সরবরাহ ব্যবস্থার বিপত্তি, জ্বালানি ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এই মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ। মূল্যস্ফীতির প্রভাব অর্থনীতি এবং সমাজজীবনে ব্যাপক। মুদ্রাস্ফীতির সুফল এবং কুফল দুটোই আছে। এ বিষয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির ছাত্রদের পরীক্ষায় প্রশ্নও আসে। মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ এবং এর পরিমাপ পদ্ধতি নিয়েও বিতর্ক আছে। সরকারি হিসাবেই আমাদের চলমান মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশে। পৃথিবীর অনেক দেশে এই হার ৩০, ৫০, ৭০ এবং ১৩০ শতাংশ পর্যন্ত আছে।
বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে এমনটি হচ্ছে এ বিষয়টি সরকার এবং ব্যবসায়ের পক্ষ থেকে জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করা হলেও যেহেতু এই বিষয়টি দ্বারাই জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, এই বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসছে এবং
সরকার ও ব্যবসায়কে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। ব্যাংকের টাকা লুটপাট এবং কথিত বিদেশে পাচার, ঋণ খেলাপির পরিমাণ বাড়লেও এতে সাধারণ জনগণের আপাতত সরাসরি কোন ক্ষতি হচ্ছে না। একজন গ্রাহকও বলতে পারবে না, সে ব্যাংকের টাকা রেখেছিল, কিন্তু ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গিয়ে টাকা পায়নি। সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের কারণে শতকরা একজন লোক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমনটি বলা যাবে না। প্রস্তাবিত উপাত্ত সংরক্ষণ আইনের কারণে ব্যক্তিবিশেষ তাঁর উপাত্ত চুরি হওয়ার আতঙ্কেও নেই। বিভিন্ন প্রকল্পের বড় বড় দুর্নীতি এবং ঘুষ দ্বারা দেশের ক্ষতি হলেও ক্ষীণদৃষ্টিতে ব্যক্তি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত মনে করে না। মুদ্রাস্ফীতির কারণে যারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাঁরা এ বিষয়টাকেই বেশি মনে রাখবে। বিদ্যুৎ, সড়ক, সেতু, ট্যানেল, যোগাযোগ ও সরকারের অন্যান্য পরিসেবা থেকে যে উপকার পাচ্ছে সেটাকে ছাড়িয়ে যাবে মুদ্রাস্ফীতির ক্ষতি। মানুষ উপকার অপেক্ষা অপকার বেশি মনে রাখে। ২০০২ সালে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল ক্যায়েনম্যান বলেছেন, ‘মানুষ ঝুঁকি নিতে চায় না, লাভের চেয়ে ক্ষতিকে অনেক বেশি ঘৃণা করে। উপকারের চেয়ে অপকারকে বেশি গুরুত্ব দেয়। ... মানুষ পুরাতন অতীত ভুলে যায়, বর্তমানের প্রতি বেশি সংবেদনশীল’।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে আলোচনায় গণমাধ্যম এবং টেলিভিশনে অধিকাংশ আলোচনাতেই ক্রেতাদের দুর্দশার কথাই উঠে আসে। অন্য পক্ষগুলো যেমন শিল্প উৎপাদনকারী, ছোট ব্যবসায়ী, ছোট ও নুতন উদ্যোক্তা, এমনকি ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমস্যা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়। সীমিত আয়ের ক্রেতাদের মুদ্রাস্ফীতিজনিত দুর্দশার প্রতি সহানুভূতি রেখেই আজকের বিষয় উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট মার্কেটারদের সমস্যা আলোচনা করা।
বর্তমানে যে মুদ্রাস্ফীতি চলছে তা সহসা আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না। বৈশ্বিক পর্যায়ে সেটা ১৯৮০ দশকের মুদ্রাস্ফীতিকেও ছাড়িয়ে যাবে। ব্যবসায়ী এবং ক্রেতা উভয়ের জন্যই এটা একটা দারুণ সংকট। ৪০ বছর আগে যারা (আকিজ সাহেব) এই মুদ্রাস্ফীতি দেখেছিলেন তাঁদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই, এখন যারা ব্যবসা করছেন তাঁরা (নাসির, বশির) কখনো এমন দুরবস্থা মোকাবেলা করেনি। বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপকগণ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা সময় অতিক্রম করছেন। একসময় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ১৪-১৫ শতাংশ হারে ব্যাংকের ঋণ পেলেও বলতো, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। এখন সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদেও ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে চাচ্ছেন না (যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি সেজে বিদেশে টাকা পাচার করতে চায়, তাদের বাদ দিতে হবে। তবে ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়লেও এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কিছু ব্যবস্থাও দেখা যাচ্ছে। গত ১ এপ্রিল দৈনিক সমকাল পত্রিকায় খবরে বলা হয়েছে, ‘জেল থেকে বাঁচতে এবং আদালত কর্তৃক রিসিভার নিয়োগ এবং দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা এড়ানোসহ পাঁচ কারণে বাধ্য হয়ে চট্টগ্রামের ৫৪২ জন ঋণখেলাপি ১২শ কোটি টাকা ব্যাংকে ফেরত দিয়েছে)।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাজারজাতকরণের সাথে সংশ্লিষ্টজনদের ইতিহাসের নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এই কান্তিকালে কোম্পানির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ক্রেতা কি আচরণ করছে বা করবে এবং এর সাথে বাজারজাতকরণ কৌশলের সমন্বয় করে তাঁদের নিকট ভ্যালু পৌঁছে দেয়া এবং প্রতিযোগীদের সাথে তার ভিন্নতা বজায় রাখা। এই সংকট মোকাবেলায় একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগকেই এই সমস্যার সমাধানে নেতৃত্ব দিতে হবে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময় কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের লোকদের কাজ হচ্ছে ক্রেতার অবস্থা অনুধাবন করে, ক্রেতার অবস্থা মূল্যায়ন করে উপযুক্ত কর্মকৌশল নির্ধারণ।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে টিকে থাকার সবচেয়ে বড় কৌশলী হচ্ছে, 'কম খরচে ব্যবসা করা'। অধ্যাপক Michael Porter যেটাকে বলেছেন, "overall cost leadership"। এর জন্য যা করতে হবে:
(১) নির্মোহভাবে খরচ ও মুনাফা পর্যালোচনা করতে হবে।
(২) magnifying glass দিয়ে খরচকে দেখতে হবে। ইতোমধ্যেই না করে থাকলে খরচ পর্যালোচনার জন্য প্রয়োজনে "QuickBook"-এর মতো সফটওয়্যার ব্যবহার হবে।
(৩) সৃজনশীল হোন। প্রয়োজনে খরচ স্থিতিশীল রাখার জন্য পণ্য ও সেবার সংখ্যা কমিয়ে দিন। যেমন সাপ্তাহে একদিন সার্ভিস সেন্টার বন্ধ রাখুন। ক্রেতাদের জন্য সেলফ সার্ভিসের ব্যবস্থা করুন। যেমন রেস্টুরেন্টে QR পদ্ধতিতে বিল পরিশোধের ব্যবস্থা করুন। (Domino's ক্রেতা এসে পিজ্জা নিয়ে গেলে ডিসকাউন্ট দেয়। কিছু কিছু হোটেল অতিথি অনুরোধ জানালেই কেবল হোটেলের পক্ষে পরিচ্ছন্নতাকর্মী পাঠায়।)
(৪) লেনদেন প্রক্রিয়াটিকে সংক্ষিপ্ত এবং স্বয়ংক্রিয় করুন। প্রযুক্তির সাহায্যে কি কোন কাজ করা যাবে, যা আপনি বা আপনার কর্মচারী করছে? বড় ধরনের প্রভাব না হলে কিছু কাজ কি বাদ দেয়া যাবে?
(৫) কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়ান। কর্মীদের সন্তুষ্টও রাখতে হবে। কর্মী হারানোর ঝুঁকি নেয়া যাক ঠিক হবে না। তাঁদের জন্য কার্যসম্পাদন ভিত্তিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।
(৬) অপচয় রোধ করে নির্মোহভাবে খরচ কমাতে হবে। এমন কিছু ক্রয় করবেন না, যা থাকলে আপনার ভালো লাগে (nice to have)। জিনিসটা কি কাজে লাগে তা পরখ করে দেখুন। এমন কিছু কি কিনেছেন যা আপনি সহসায় ব্যবহার করবেন না। কোথাও কি এমন চাঁদা দিচ্ছেন, যাদের সেবাটি এ সময়ে আপনার না নিলেও চলে।
(৭) জুম মিটিং করুন। সামনাসামনি ভ্রমণ করা বা দেখা হওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা ভেবে দেখুন। কৌশলগত খরচ এবং মামুলি ধরনের খরচের পার্থক্য নির্ণয় করুন।
(৭) যদি নিশ্চিত হন দাম আরো বাড়বে সেক্ষেত্রে সুযোগ থাকলে এখনই কাঁচামাল মজুত করুন।
বাল্ক/লট ধরে কিনুন।
(৮) মুদ্রাস্ফীতির সময় নগদ টাকা ধরে রাখলে লোকসান বাড়বে, নগদ দ্রুত অবমূল্যায়িত হয়। অপব্যবহারযোগ্য নগদ থাকলে ভবিষ্যতে ব্যবহারযোগ্য সম্পদ সংগ্রহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করুন। মুদ্রাস্ফীতি স্বল্প বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, তবে চিরস্থায়ী হবে না। সুযোগ থাকলে ঋণ বা বাকিতে ক্রয়ের পরিশোধ বিলম্বিত করুন। এতে আপনার আর্থিক দায় পরিষদের পরিমাণ কমে যাবে। সরকার বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই সময়ে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, সুযোগ থাকলে সেটা নেয়ার চেষ্টা করুন
(৮) কোম্পানির বর্তমান ক্রেতাদের প্রণোদিত করুন। নতুন ক্রেতা ধরার চেয়ে পুরাতন ক্রেতাকে ধরে রাখার খরচ অনেক কম। কাস্টমার লয়ালিটি প্রোগ্রাম, বাট্টা এবং অন্যান্য অফার অব্যাহত রাখুন (Mitchell Leiman, 2022)।
বাজারজাতকরণ মিশ্রণ কৌশল
(১) পণ্য (product): উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময়ে পণ্য এবং ব্যবসায় খাতের সমন্বয় অব্যাহত রাখতে হবে। যেকোনো ব্র্যান্ডের মধ্যমণি হচ্ছে পণ্য। ব্র্যান্ডের অবস্থানের জন্য মৌলিক উপাদানই হচ্ছে পণ্য। এ সময়ের উদ্ভাবনই হতে পারে মূল ভরসা। ক্রেতার কথা শুনতে হবে, পণ্য হচ্ছে ক্রেতার সমস্যার একটি সমাধান। Big data বিশ্লেষণ করে ক্রেতাদের মনোভাব ট্র্যাকিং করা এখন অনেক সহজ। যেমন সুপার শপ থেকে পণ্য ক্রয়ের সময় ক্রেতারা কোন্ দিক থেকে কোন্ দিকে ঝুঁকছে তা আজকাল সহজেই জানা যায়। সেই অনুযায়ী পণ্য পোর্টফলিও সমন্বয় করতে হবে। উদ্ভাবনের জন্য বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। পণ্য বা সেবা কোন ক্ষেত্রেই উদ্ভাবনের বিকল্প নেই। যেহেতু আর্থিক চাপ সামলাতে গিয়ে ভোক্তাদের পছন্দ বদলে যাচ্ছে তাই পণ্যকে আপডেট রাখা আরো বেশি প্রয়োজন। উদ্ভাবনী কাজে ভোক্তাকে ‘কো-ক্রিয়েটর’ হিসেবে গ্রহণ করুন। এতে নতুন উদ্ভাবিত পণ্য ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে।
অস্থিরতা (volatility) অনেক সময় সুযোগ নিয়ে আসে। ভিন্ন সেগমেন্টে কম খরচের সরবরাহকারী হিসেবে যাওয়ার কথা ভাবুন। ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দিতে বিরক্ত হবেন না। এতে আপনার দৃষ্টির বাইরে থাকা ক্রেতার সন্ধান পেয়ে যেতে পারেন। এটা বাজারজাতকরণ প্রচেষ্টা কমানোর সময় নয়। ক্রেতাকে প্রদেয় আবশ্যকীয় সেবার ব্যাপারে অবহেলা করা যাবে না। বহু শিল্পে কাস্টমার সার্ভিসের উপরেই ক্রেতার সন্তুষ্টি বহুলাংশে নির্ভর করে।
(২) মূল্য (Price): সাম্প্রতিক সময়ে কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের মূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে। মূল্যবৃদ্ধিকে ক্রেতা, ডিলার, এমনকি নিজস্ব বিক্রয় কর্মীরাও ভালোভাবে নেয় না; তা জেনেশুনেই কোম্পানিগুলো মূল্য বৃদ্ধি করছে। মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে উৎপাদন ও বিতরণ খরচ বেড়ে যাওয়া। ক্রমবর্ধমান খরচ কোম্পানির মুনাফাকে কমিয়ে দেয়, আর কোম্পানি তখন বাধ্য হয় নিয়মিত মূল্য বাড়াতে থাকে। কোম্পানি অনেক সময় খরচ আরো বৃদ্ধি পাবে এ আশঙ্কায় যতটুকু খরচ বেড়েছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণে মূল্য বাড়ায়। কোম্পানিগুলো এ সময়ে সাধারণত তার ক্রেতাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী মূল্য চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চায় না। কারণ তাঁদের ভয় থাকে খরচ বৃদ্ধির কারণে মুনাফা নাও হতে পারে। অন্য যে উপাদানটি অবদান রাখে তা হচ্ছে বিভিন্ন উৎসবকে (রোজা, ঈদ, পূজা) উপলক্ষ করে মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা। যখন কোন কোম্পানি তার ক্রেতাদের চাহিদার পরিমাণে সরবরাহ করতে পারে না তখন মূল্য বাড়িয়ে দেয়। কখনো কখনো ক্রেতাদের জন্য পণ্যের কোটা নির্ধারণ করে দেয়। ক্রমবর্ধমান খরচের সঙ্গে তাল রাখার উদ্দেশ্যে কোম্পানির মূল্য বৃদ্ধির জন্য অনেকগুলো পথ খোলা আছে। যে পণ্যটি বেশি চলে তার বাট্টা প্রত্যাহার করে এবং পণ্য লাইনে বেশি দামি পণ্য যোগ করে প্রায় অদৃশ্যভাবেই মূল্যবৃদ্ধি করা যায়। অথবা খোলাখুলিভাবে পণ্যের মূল্য বাড়ানো যায়। অতিরিক্ত বর্ধিত মূল্য ক্রেতাদের নিকট থেকে আদায় করার সময় পণ্যটি যেন ‘বাটালি’ বা ‘মূল্য ডাকাতের’ ভাবমূর্তি না পায় সেদিকে কোম্পানিকে লক্ষ রাখতে হবে। কোম্পানি কেন মূল্য বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছে তা ব্যবসায়ী এবং শিল্প ক্রেতাদেরকে (business and industrial buyers) জানানোর জন্য যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। কোম্পানির বিক্রয়কর্মীদের উচিত ক্রেতারা কিভাবে পণ্যটি মিতব্যয়িতার সাথে পেতে এবং ব্যবহার করতে পারে সে ব্যাপারে তাঁদের পরামর্শ দেয়া।
অনেক কোম্পানি মূল্যবৃদ্ধি না করেও উচ্চ খরচ অথবা চাহিদাকে মোকাবেলা করে। কোম্পানি পণ্যটিকে সংকুচিত করতে পারে। মিষ্টি বা চকলেটের ক্ষেত্রে প্রায়ই এমনটি করা হয়। বিগত বছরগুলোতে দুধের দাম কয়েক গুণ বেড়ে গেলেও ঢাকা শহরের কিছু দোকানে রসগোল্লার একক প্রতি দাম বাড়েনি, ক্রমশ আকৃতি ছোট হচ্ছে। আগের দামে প্যাকেটে কম পণ্য দেয়া কৌশলটাকে বাণিজ্যিক পজিশন হিসেবে ‘shrinkflation’ বলা হয়। দাম না বাড়িয়ে খরচ কমানোর জন্য আরও যেসব পদক্ষেপ নেয়া যায় সেগুলো হচ্ছে কম দামি উপকরণ ব্যবহার করা (পুস্তকের ক্ষেত্রে অফসেট কাগজের বদলে সাধারণ সাদা কাগজ বা নিউজ প্রিন্ট ব্যবহার করা), পণ্যের কিছু বৈশিষ্ট্য বাদ দিয়ে তৈরি (খাবারের ক্ষেত্রে দুই-একটি মসলা বাদ দেয়া), প্যাকেজিং খরচ কমানো (কন্টেইনারের বদলে সাদামাটা পলিথিনের প্যাকেট ব্যবহার) অথবা সেবার পরিমাণ কমিয়ে দেয়া (বিনা খরচায় ক্রেতার বাড়িতে পণ্য পৌঁছে দেয়ার বদলে ক্রেতাকে দোকান থেকে পণ্য নিয়ে যেতে বলা), অথবা কোম্পানিটি তার পণ্য ও সেবার একক বান্ডিল খুলে পণ্য ও সেবা প্রত্যেকটির জন্য পৃথক মূল্য ধার্য করা (যেমন IBM এখন প্রশিক্ষণের জন্য পৃথক মূল্য ধার্য করে, আগে যা কম্পিউটারের বান্ডেলে অন্তর্ভুক্ত ছিল), অনেক রেস্টুরেন্ট ডিনারভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ থেকে সরে এসে মূল্য নির্ধারণের cafeteria approach, ‘যা খাবেন তার মূল্য দিতে হবে’ ব্যবহার করছে। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ক্রেতার ব্যয়ের ইচ্ছা অনুধাবন (willingness to pay)। বর্ধিত দামে ক্রেতা কতটুকু পণ্য কিনবে, সেটা নির্ভর করবে পণ্যটি তাঁর নিকট যতটা গুরুত্বপূর্ণ(ভ্যালু)। প্রতিযোগীর পণ্যের সাথে তুলনা করেই তাঁরা কোন কোম্পানির পণ্যকে ‘বেটার অপশন’ হিসেবে নির্বাচন করবে। মূল্য সমন্বয়ের যথার্থ কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চাহিদার স্থিতিস্থাপকতা (মূল্য, আয় ও আড়াআড়ি) যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। বিক্রেতা তাঁর পণ্যের মূল্য এক ধাপে অথবা দফায় দফায় বাড়াতে পারে। যেখানে পণ্যের ব্যাপক মানোন্নয়ন সম্ভব নয় সেখানে একধাপে বাড়ানোই ভালো। ক্রেতার সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ থাকলে তার নিকট মূল্যবৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, অন্যথায় ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। B2C এর তুলনায় B2B ক্ষেত্রে মূল্য-সংক্রান্ত ব্যাখ্যা প্রদান বেশ ফলপ্রসূ। মূল্যসংক্রান্ত যোগাযোগ সচ্ছ হতে হবে, ঘোষণা আকারে প্রকাশ করতে হবে এবং মূল্যবৃদ্ধির গল্পটা ক্রেতার নিকট বোধগম্য হতে হবে। মূল্যস্ফীতিকে দোষারোপ করবেন না। নতুন বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করুন। পণ্য সংক্রান্ত দুই একটি গোপন তথ্য থাকলে বলুন, যা আগে বলেননি। উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে দায়ী না করে পণ্যে নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত করে মূল্য সম্পর্কে ক্রেতাকে অবহিত করুন। উচ্চমূল্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন না।
বিনীতভাবে শর্তগুলো বর্ণনা করুন। আপনার বার্তা স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার হতে হবে এতে গ্রাহকের আস্থা বাড়বে। তাঁদের জানিয়ে দিন (এসএমএস করুন)। একটি নতুন বিষয়বস্তু বা বৈশিষ্ট্য অফার করুন যা ইতিমধ্যেই ছিল, কিন্তু গ্রাহকদের জানানো হয়নি। আপনি যে মান অফার করেন তার উপর ফোকাস করুন। পণ্যের গুণমান হাইলাইট করুন। ক্ষমাপ্রার্থনা না করেও বিনয়ী হোন; একটি প্রশংসিত উপায়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করুন।
(৩) স্থান (place): উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে পণ্য সুবিধাজনক স্থানে পাওয়া ব্র্যান্ড সফলতার অন্যতম শর্ত। মুদ্রাস্ফীতির কারণে ক্রেতা ভিন্ন খুচরা চ্যানেলে চলে যেতে পারে। করোনা কালের মত ই-কমার্স বাড়তে পারে। নিম্ন চ্যানেলে ক্রেতা চলে যেতে পারে (এই সময় ফুটপাতে ক্রেতার সংখ্যা বাড়ে)।
(৪) প্রমোশন (promotion): উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময়ও বিজ্ঞাপন খাতে বিনিয়োগ বন্ধ করা যাবে না। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভোক্তার সাথে কোম্পানির আবেগীয় বন্ধন সুদৃঢ় রাখা যায়। বিজ্ঞাপনে ব্যয় হ্রাস বা বন্ধ করলে ব্র্যান্ডের অপরনীয় ক্ষতি হতে পারে। মার্কেট শেয়ার কমে যাওয়া, ক্রেতা সচেতনতাকে দুর্বল করা, বাজারে অবস্থান এবং ক্রেতার সংযোগ দুর্বল করে দিতে পারে। ২০১৮ সালে পরিচালিত Ehrenburg -Brand Institute এর এক গবেষণায় দেখা গেছে দীর্ঘদিন যাবত যে সকল ব্র্যান্ড বিজ্ঞাপন বন্ধ রেখেছে তাদের গড় বিক্রি কমেছে প্রথম বছরে ১৬ শতাংশ, দুই বছরে ২৫ শতাংশ কমে গেছে । মুদ্রাস্ফীতির সময় প্রমোশনের চ্যানেল সমন্বয়ের প্রয়োজন হতে পারে। সংকটের সময় ক্রেতারা যে মিডিয়া বেশি ব্যবহার করে সে অনুযায়ী মিডিয়ার প্ল্যান সমন্বয় করতে হবে। ক্রেতারা আবেগীয় পণ্য সহজে ছাড়তে পারে না। অপর দিকে এময়ে আর্থিক সংকটে থাকা ক্রেতারা নিম্নস্তরের ব্র্যান্ডের পণ্য কেনে, যেগুলো গ্রহণযোগ্য মানের। বিজ্ঞাপনে গল্প বলার সময় ক্রেতা যে দুর্ভোগে পড়েছে তার প্রতি সহমর্মিতা(empathy) দেখাতে হবে (যেমন- ‘এ মাসে দুধ আর মাসের বাজারের টাকা একসাথেই শেষ হয়েছে...’)। দুরবস্থার সময় ক্রেতা তাঁর নিকটজনের সাথে পরামর্শ করে। 'Word-of-mouth' এ সময়ে খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ব্যবহারকারীর নির্মিত কনটেন্ট ব্যবহার করে ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিংয়ের উপর জোর দিতে হবে (Rafael Schwarz, 2022)।
ক্রেতার অগ্রাধিকার জেনে এবং সে অনুযায়ী সাড়া দিয়েই এই দুর্মূল্যের বাজারে টিকে থাকতে হবে। ক্রেতাকে জানাই হচ্ছে মার্কেটিংয়ের মূল কেন্দ্রবিন্দু। মুদ্রাস্ফীতি এক পর্যায়ে কমে যাবে, যদিও গত কয়েক মাস ধরে এটা দেখা যাচ্ছে না। কিছু সমন্বয় করে এবং এজাইল থেকে ব্যবসায় চালিয়ে নেয়া এবং ব্যবসায় বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখুন এই দুঃসময়ে।
লেখক: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সাধিত হওয়ার পর সারা বিশ্বের অর্থনীতিদের মধ্যে উন্নয়ন কৌশল নিয়ে একধরনের পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যক্ষ করা যায়। আগে মনে করা হতো- কৃষি একমাত্র কৃষির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমেই জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারে। জনগণের চাহিদা মিটিয়ে কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব একমাত্র কৃষির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর এই চিরাচরিত ধারণা সম্পূর্ণরূপে পাল্টে যায়। শিল্প বিপ্লবের অনুসারীরা এটা বোঝাতে বা প্রমাণ করতে সক্ষম হন, কৃষি নয় একমাত্র শিল্পের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমেই একটি দেশ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জন করতে পারে। তারা এটাও প্রমাণ করে দেখান যে, কৃষি উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে। অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৫ এভাবে ক্রমান্বয়ে। আর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। অর্থাৎ ১, ২, ৪, ৮, ১৬ এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে। শিল্পোৎপাদনও বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। ফলে বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য এবং অন্যান্য চাহিদা পূরণের জন্য শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই। একটি দেশ শিল্পে সমৃদ্ধ হলে সে তার জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য অন্যদেশ থেকেই আমদানি করতে পারবে। সেই থেকে বিশ্বের প্রতিটি দেশই শিল্পায়নের ওপর জোর দিয়ে চলেছে। যে সব দেশ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে তারা উন্নত দেশ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বে সম্ভবত এমন একটি দেশও দেখানো যাবে না যারা শিল্পায়নকে অবজ্ঞা করে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নতি অর্জন করতে পেরেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলো তো শিল্পায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব না দিয়েই উন্নতি অর্জন করেছে। তাহলে শিল্পায়নের প্রয়োজন কেন? মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর বিষয়টি আলাদা। তারা প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদে পরিপূর্ণ। তারপরও তারা শিল্পায়নের জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা যদি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শিল্পায়ন সাধন করতে পারত তাহলে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো ভালো হতে পারত। শিল্পায়নের অর্থই হচ্ছে প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদের রূপান্তর, পরিমার্জন এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে তাকে আরো বেশি উপযোগী করে গড়ে তোলা। যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে বিশ্বের একটি দেশও নেই যারা শিল্পায়ন সাধন করেছে অথচ দরিদ্র রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে শিল্পায়নের এই গুরুত্ব আমরা উপলব্ধি করে চলেছি। তারপরও দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো শিল্পায়নের গুরুত্ব উপলব্ধি করলেও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করেছে সামান্যই। দরিদ্রতা এবং শিল্পবিমুখতা পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলে। দরিদ্র দেশগুলোর একটি সমস্যা হচ্ছে তাদের উদ্যোক্তারা সর্বাবস্থায় পুঁজি সংকটে ভোগে। তারা চাইলেই শিল্প স্থাপনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পুঁজি সংগ্রহ করতে পারে না। আমাদের মতো পুঁজি স্বল্পতার জনপদে কোন ধরনের শিল্প উপযোগী তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, যে কোনো দেশের জন্য বৃহৎ শিল্পের কোনো বিকল্প নেই। বৃহৎ শিল্পে উৎপাদন বেশি হয়। অধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। কিন্তু তারা এটা বুঝতে চান না, বৃহৎ শিল্প শুধু মুখে বললেই স্থাপন করা যায় না। এ জন্য আনুষঙ্গিক নানা সুবিধার প্রয়োজন হয়। আর বৃহৎ শিল্প স্থাপন ও পরিচালনার জন্য অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার প্রয়োজন রয়েছে। কেউ একজন চাইলেই বৃহৎ শিল্প পরিচালনা করতে পারবেন না। এ জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। কেউ কেউ হয়তো সরাসরি বৃহৎ শিল্পে যুক্ত হয়ে অথবা স্থাপন করে সফলতা অর্জন করতে পারেন কিন্তু তারা ব্যতিক্রম। আর ব্যতিক্রম কখনোই উদাহরণ হতে পারে না। আমাদের মতো দেশের জন্য উদ্যোক্তাদের প্রথমেই ক্ষুদ্র পরিসরে শিল্প স্থাপনকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। তারা ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্প স্থাপন করে অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা অর্জনের পর বৃহৎ শিল্পে আত্মনিয়োগ করবে। মনে রাখতে হবে, কোনো কিছুই অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধু আবেগ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ সফলতা অর্জন করা যায় না। একই সঙ্গে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প স্থাপনের ওপর জোর দিতে হবে। জাপানের মতো দেশে বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন কার্যক্রমের জন্য আবশ্যিক উপকরণ ছোট ছোট কোম্পানি থেকে সংগ্রহ করে। তারা নমুনা দিয়ে দেয়। ছোট কোম্পানিগুলো সেই নমুনা অনযায়ী যন্ত্রাংশ তৈরি করে মূল কোম্পানিতে সরবরাহ করে। মূল কোম্পানি সেই যন্ত্রাংশ ব্যবহার চূড়ান্ত উৎপাদনকার্য সম্পন্ন করে। এতে বড় কোম্পানির পাশাপাশি ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সুযোগ পায়।
আমরা যদি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পায়নের বিষয়টি লক্ষ্য করি তাহলে দেখব, স্বাধীনতার পূর্বে এবং অব্যবহিত পরে বাংলাদেশ ছিল সর্বাংশে একটি কৃষিনির্ভর দেশ। এ দেশে শিল্পায়ন যেটুকু হয়েছিল তার মূলে ছিলেন অবাঙালি উদ্যোক্তারা। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে অথবা তারপর অবাঙালি উদ্যোক্তারা তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে যান। ফলে শিল্প ক্ষেত্রে এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। সেই সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়ে অবাঙালিদের ফেলে যাওয়া শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসেন। তখন এর চেয়ে সুন্দর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতির অন্যতম সমাজতন্ত্রের সঙ্গে সমন্বয় বিধানের জন্যও উৎপাদন যন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অচিরেই এ অবস্থার কুফল জাতি প্রত্যক্ষ করতে শুরু করে। এক সময় যে সব শিল্প-কারখানা লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছিল সেগুলো রাতারাতি লোকসানি কোম্পানিতে পরিণত হয়। যাদের এ সব শিল্প-কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় তারা নানাভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এ সব শিল্পকে ব্যবহার করতে শুরু করে। বাংলাদেশের প্রথম শিল্পনীতিতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। এমনকি বিদেশি উদ্যোক্তাদেরও সরাসরি বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়নি। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই সরকার এই অবস্থান থেকে সরে আসেন। ১৯৭৩ সালে ঘোষিত শিল্পনীতিতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়। একই সঙ্গে বিদেশি উদ্যোক্তাদেরও বাংলাদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়। ১৯৭৪-৭৫ সালে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হয়। পরে ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে জাতির পিতা কতিপয় বিপদগামী সেনাসদস্যের হাতে নিহত হওয়র পর ক্ষমতাসীনরা ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ এবং বিদেশি বিনিয়োগকে সাংঘাতিকভাবে উৎসাহিত করতে শুরু করেন। এ সময় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিল্প-কারখানা ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে এ সব শিল্প-কারখানা ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়। দলীয় সমর্থক,আত্মীয়-স্বজনদের পানির দামে এ সব প্রতিষ্ঠান দিয়ে দেয়া হয়। এতে রাষ্ট্রের বিরাট আর্থিক ক্ষতি হয়। জাতীয় পার্টির শাসনামলে একপর্যায়ে বিদেশি উদ্যোক্তাদের পুঁজি বিনিয়োগকারীদের বিনিময়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের বিধান করা হয়। কিন্তু তারপরও বিদেশি উদ্যোক্তারা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আসেনি। উল্লেখ্য, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হচ্ছেন শীতের অতিথি পাখির মতো। শীতের অতিথি পাখি যেমন কোনো জলাশয়ে পর্যাপ্ত খাবার এবং জীবনের নিশ্চিত নিরাপত্তা না পেলে আশ্রয় গ্রহণ করে না বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ঠিক তেমনি কোনো দেশে পুঁজির নিরাপত্তা এবং পর্যাপ্ত মুনাফার নিশ্চয়তা না পেলে বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হচ্ছে স্বাধীন সত্তা। তারা চাইলেই যে কোনো দেশে চলে যেতে পারেন। কিন্তু স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা চেষ্টা করলেও সব সময় দেশের বাইরে বিনিয়োগ করতে পারেন না।
এখন প্রশ্ন হলো- একজন বিদেশি উদ্বৃত্ত পুঁজির মালিক বাংলাদেশে কেন বিনিয়োগ করবেন? স্থানীয় বিনিয়োগকারীই বা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবেন কেন? বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনাই বা কতটুকু? বাংলাদেশ স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে, বিশেষ করে পশ্চিমা দুনিয়ায় যেখানে আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে বড় কিন্তু জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এমনকি তিন/চারটি দেশ মিলেও বাংলাদেশের মতো এত বিপুল সংখ্যক মানুষ নেই। বেশি মানুষ থাকা অর্থই হচ্ছে সেখানে পণ্য ও সেবা বিপণনের একটি চমৎকার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে দ্রুত উন্নয়নশীল একটি দেশ। বিশ্বব্যাংকের রেটিংয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০৩৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ কার্যকর উন্নত দেশে পরিণত হবে। জাতিসংঘের রেটিংয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক মর্যাদা লাভ করেছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হবে। গত তিন দশকের মধ্যে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারের সংখ্যা ১২ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। ভোগ ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষপর্যায়ে রয়েছে। এমন সম্ভাবনাময় একটি দেশে যে কোনো উদ্যোক্তাই বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন এতে সন্দেহ কি। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় উৎপাদন ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। বাংলাদেশ হতে পারে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের পণ্য জোগানের একটি বিশেষ মাধ্যম। বাংলাদেশে রয়েছে বিপুল সংখ্যক সৃজনশীল মানুষ। কাজেই আমাদের এই বিপুল জনসংখ্যাকে প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ করে গড়ে তোলা গেলে শ্রমশক্তির অভাব কখনোই হবে না। কিন্তু এখানে একটি সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশ বিপুল সংখ্যক মানুষের বিচরণ ক্ষেত্র ঠিকই; কিন্তু এই মানুষকে কি আমরা প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ করে গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নিয়েছি? জনসংখ্যা হচ্ছে এমনই এক উৎপাদন উপকরণ যা প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ হলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদে পরিণত হতে পারে। আর কোনো কারণে জনসংখ্যাকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ও উপযুক্ত করে গড়ে তোলা না গেলে তা একটি জাতির জন্য সবচেয়ে বোঝা বা বার্ডেনে পরিণত হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে আমরা স্থানীয়ভাবে জনসংখ্যাকে প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি জ্ঞানে শিক্ষিত করে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করতে সমর্থ হচ্ছি না। বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্যদিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। একটি দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি যখন কর্মক্ষম অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্য বয়সী হয় তখন সেই অবস্থাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। বাংলাদেশ ২০০০ সাল থেকে এই অবস্থার মধ্যদিয়ে সময় পার করছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে এ অবস্থাকে তেমন একটা মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, একটি জাতির জীবনে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা একবারই আসে। আবার কারো কারো মতে, হাজার বছরে একবার আসে। যারা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ কাজে লাগাতে না পারে তারা কখনোই উন্নতি অর্জন করতে পারে না। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা শেষ হলে একটি দেশে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়। সেই অবস্থায় উন্নয়নের গতি স্তিমিত হয়ে পড়তে বাধ্য। আমরা উদাহরণ হিসেবে জাপানের কথা উল্লেখ করতে পারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাপানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেই অবস্থার সুযোগ কাজে লাগিয়ে জাপান বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় শীর্ষ শক্তি হিসেবে অবস্থান করে নেয়। এই অবস্থান তারা ৪৪ বছর ধরে অব্যাহত রাখে। জাপান ইতোমধ্যেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা অতিক্রম করে এসেছে। জাপানে এখন বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বেশি। চীন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইতোমধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতিতে জাপানকে অতিক্রম করে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে। বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থান অবসান ঘটবে ২০৩৩ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে। তারপর বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ক্রমশ মন্থর হতে থাকবে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের অনেক দেশ ও অঞ্চল থেকে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা পেয়ে থাকে। এটাও বিদেশি বিনিয়োগ আহরিত হওয়ার জন্য একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করতে পারে। যে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান জাপানে শিল্প-কারখানা স্থাপন করে পণ্য উৎপাদন করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি করলে ১২ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। সেই প্রতিষ্ঠানই যদি বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করে পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি করে তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশে প্রবেশের জন্য কোনো শুল্ক দিতে হবে না। আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কোনো শুল্ক প্রদান করতে হয় না। কিন্তু একই অঞ্চলে ভিয়েতনাম থেকে পণ্য রপ্তানি করতে হলে ১২ শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে ভিয়েতনামের তৈরি পোশাক রপ্তানি পিছিয়ে পড়ার এটিই সবচেয়ে বড় কারণ। কয়েক বছর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভিয়েতনামকে জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) সুবিধা অনুমোদন করেছে। এই সুবিধা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হলে ভিয়েতনাম মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে অতিক্রম করে যাবে এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অসুবিধা আছে। বাংলাদেশের এক শ্রেণির উদ্যোক্তা আছেন যারা নতুনের সন্ধান না করে পুরনোকে ঘিরেই টিকে থাকতে চান। যে কোনো পুঁজির মালিক নতুন একটি শিল্প স্থাপন করার কথা বিবেচনা করলেই তিনি প্রথমে ভাবেন একটি তৈরি পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠার কথা। কিন্তু তৈরি পোশাক কারখানার চেয়েও যে সম্ভাবনাময় আরো কোনো শিল্প স্থাপন করা যেতে পারে তা বিবেচনায় নেন না। ফলে একটি বা দুটি ক্যাটাগরির শিল্পের অতি উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে এটি সর্বাংশেই আমদানিকৃত কাঁচামালনির্ভর একটি শিল্প। বাংলাদেশকে তৈরি পোশাকশিল্পের প্রধান উপকরণ সুতা তৈরির জন্য ব্যবহার্য তুলার ৯৮ শতাংশই আমদানির মাধ্যমে মেটাতে হয়। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ রপ্তানি আয় হয় তার অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই কাঁচামাল আমদানিতে আবার দেশের বাইরে চলে যায়। ঠিক একই কথা বলা যেতে পারে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ থেকে বর্তমান প্রায় দেড় কোটি মানুষ বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান করছে। কিন্তু এদের অধিকাংশই অপ্রশিক্ষিত এবং অদক্ষ শ্রমিক। ফলে তারা বিদেশে গিয়ে মজুরি পায় অন্যদেশের শ্রমিকদের তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় বড় শিল্প-কারখানায় মধ্যপর্যায়ে অনেক বিদেশি কর্মরত রয়েছেন। এরা প্রতিবছর প্রায় ছয় থেকে সাড়ে ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়ে যাচ্ছে মজুরিবাবদ। আমরা যদি প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরি করতে পারতাম তাহলে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশেই থেকে যেত।
বাংলাদেশে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের জন্য যে নীতিমালা রয়েছে তা অত্যন্ত উদার এবং আকষর্ণীয়। কিন্তু তারপরও বিনিয়োগ সেভাবে আহরিত হচ্ছে না। এর কারণ হলো, খাতা-কলমে বিনিয়োগের জন্য যে সুবিধা দেয়া হচ্ছে তার বাস্তব প্রয়োগ তেমন একটা নেই। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের কার্যকর পরিবেশ খুব একটা ভালো নয়। জাপানি একটি প্রতিষ্ঠান খুব সম্প্রতি জরিপ চালিয়ে দেখেছে বাংলাদেশে যে সব জাপানি প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে তাদের অন্তত ৭৬ শতাংশই এ দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। জাতিসংঘের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রতিবছর ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতো (বর্তমানে প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধ রয়েছে)। সেই প্রতিবেদনের সর্বশেষ সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছিল, বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ খুব একটা ভালো নয়। মোট ১৯০টি দেশের মধ্যে বিনিয়োগবান্ধবতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। তার অর্থ হচ্ছে বিনিয়োগ পরিবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে তলানিতে। বাংলাদেশে যে সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের সবগুলোতেই সুশাসনের অভাব রয়েছে প্রচণ্ডভাবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এমন একটি প্রতিষ্ঠানও পাওয়া যাবে না যারা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে উদ্যোক্তাদের সেবা দিয়ে থাকে। একটি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত অন্তত ৩২ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করা না হলে সেবা পাওয়া যায় না। এই হচ্ছে বাস্তবতা। অনেকেই আগ্রহ নিয়ে বিনিয়োগের জন্য আসেন; কিন্তু শেষপর্যন্ত তাদের আগ্রহ বহাল থাকে না। নানা রকম হযরানির শিকার হয়ে তারা চলে যেতে বাধ্য হয়। অনেক দিন বিনিয়োগ বোর্ড থেকে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়েছিল বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়নের ওপর। সেখানে দেখা গিয়েছিল, বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধনের পর বাস্তবায়ন পর্যন্ত ৬১ শতাংশ প্রকল্পের কোনো অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ যে সব প্রকল্প প্রস্তাব বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত হয়েছিল তার মধ্যে মাত্র ৩৯ শতাংশ শেষপর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছিল। এই অবস্থার যে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে তা কি নিশ্চিত করে বলা যাবে?
আঙ্কটাডের প্রতিবেদন মোতাবেক, ২০২২ সালে বাংলাদেশে যে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে তার পরিমাণ হচ্ছে ৩৪৮ কোটি মার্কিন ডলার। এটা বিগত ৩৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শেষপর্যন্ত এই বিনিয়োগের কতটা বাংলাদেশে থাকবে? চলতি অর্থবছরের জন্য বাস্তবায়নাধীন জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই অর্জনযোগ্য নয়। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে কোনো বছরই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির এক শতাংশের বেশি বাড়ে-কমেনি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যক্তি বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপির ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ২৪ দশমিক ০২ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপির ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে এটা ছিল ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। গত অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এই অবস্থায় এক বছরের ব্যবধানে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ২৭ শতাংশে উন্নীত করা ঠিক সম্ভব হবে? দেশের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান একই বৃত্তে আবর্তিত হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যক্তি জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে এটা ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ১১ দশমিক ৪১ শতাংশে নেমে আসে। চলতি অর্থবছরে জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান ৯ দশমিক ২৩ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ক্রমশ কমে যাচ্ছে। চলতি পঞ্জিকা বছরের জানুয়ারি মাসে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা ১২ দশমিক ১৪ শতাংশে নেমে আসে। মার্চ মাসে ১২ দশমিক ০৩ শতাংশ, এপ্রিল মাসে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, জুন মাসে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং জুলাই মাসে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি দৃষ্টে দেশের বিনিয়োগ কার্যক্রমের অবস্থা অনুমান করা যায়। কারণ আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়ে থাকে। আগের মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে শিল্পে ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমেছিল ৭৬ শতাংশ। কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছিল ১৪ শতাংশ। তাহলে ব্যক্তি খাতে যে ব্যাংক ঋণ দেয়া হয়েছিল তা কোথায় গিয়েছে? ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে অথবা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য যে সব কারণ দায়ী তার মধ্যে ব্যক্তি খাতের নামে দেয়া ঋণ ভিন্ন খাতে প্রবাহিতকরণ একটি উল্লেখযোগ্য কারণ কিন্তু বিষয়টি সেভাবে আলোচিত হচ্ছে না।
বাংলাদেশের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল একটি দেশের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বিনিয়োগ আহরণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা পর্বত প্রমাণ। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য ব্যক্তি খাতে কি পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন হতে পারে বা বিনিয়োগের অনুপাত কেমন হওয়া উচিত। ব্যক্তি খাতে কি পরিমাণ বিনিয়োগ হলে তাকে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ বলা যাবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বাংলাদেশ যদি দ্রুত এবং টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে চায় তাহলে জিডিপির অন্তত ৪০ শতাংশ বিনিয়োগ হওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন সময় বিনিয়োগের জন্য যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তা অনার্জিতই থেকে যায়। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। কিন্তু তা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়ার জন্য বিভিন্ন কারণ দায়ী। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সর্বস্তরে বিরাজমান ব্যাপক মাত্রার দুর্নীতি এবং দুর্নীতিকে বিভিন্নপর্যায় থেকে আনুকূল্য বা সমর্থন দেয়া। আমি দায়িত্ব নিয়েই বলতে পারি, রাষ্ট্রীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিপর্যায়ে দুর্নীতি যদি সহনীয়পর্যায়ে নামিয়ে আনা যেত তাহলে বিনিয়োগ অনেকটাই বৃদ্ধি পেত। আমি দীর্ঘ দিন একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে চাকরির সুবাদে দুর্নীতিবাজদের অপতৎপরতা প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছি। দুর্নীতিবাজদের মধ্যে কোনো দলমত নেই। তারা সবাই একই চরিত্রের মানুষ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন অথচ কোনোপর্যায়েই ঘুষ প্রদান করেননি এমন নজির সম্ভবত একটিও দেখানো যাবে না। এখানে আমার দেখা একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করব- গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে স্পেন থেকে একজন বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী আসেন। ভদ্রলোকের নাম মি. মুরাদ। তিনি স্পেন শিল্প ও বণিক সমিতির সদস্য। মুরাদ সাহেব ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক নিয়ে স্পেনের বাজারে বিক্রি করতেন। তিনি এক সময় ভাবলেন, আমি তৈরি পোশাক আমদানি করি। তার পরিবর্তে বাংলাদেশে যদি একটি তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপন করি তাহলে অনেক সুবিধা হবে। তিনি বাংলাদেশে এলেন। আমি যে ব্যাংকে কর্মরত সেই ব্যাংকে তিনি ঋণের জন্য আবেদন করেন। ঋণ পেতে তাকে প্রতিটিপর্যায়েই উৎকোচ দিতে হয়। একজন পিয়ন তার মেয়ের বিয়ের কথা বলে ভদ্রলোকের নিকট থেকে ১২ বার টাকা নিয়েছেন। যাহোক ঋণ মঞ্জুর হয়ে গেল। ভদ্রলোক টঙ্গির ভাদামে জমি ক্রয় করতে গেলেন কারখানার জন্য। স্থানীয় মাস্তানরা অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে তাকে জমি ক্রয় করতে বাধ্য করেন। তিনি জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করতে গেলেন। স্থানীয় মাস্তানরা তার নিকট গিয়ে হাজির। তাদের দাবি হচ্ছে ভবন নির্মাণের জন্য যে সব ম্যাটেরিয়াল ক্রয় করা হবে তা তাদের দিয়ে কেনাতে হবে। তিনি অনেকটা বাধ্য হলেন তাদের দাবি মেনে নিতে। এরপর গাজিপুরের একজন স্থানীয় নেতা নির্বাচনের জন্য মুরাদ সাহেবের নিকট বড় অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন। তিনি চাঁদা দিতে রাজি হননি। একপর্যায়ে দেখা গেল তার নির্মাণাধীন কারখানার একটি অংশ রহস্যজনকভাবে আগুনে পুড়ে যায়। ভদ্রলোক এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে যান। তিনি ভাবলেন, বাংলাদেশে অবস্থান করলে যে কোনো মুহূর্তে তার জীবন নাশ হতে পারে। তাই তিনি নির্মাণাধীন কারখানা বন্ধ করে ব্যাংকের অনুমোদিত এবং ছাড়কৃত ঋণ সারেন্ডার করে স্পেনে চলে গেলেন। এই হচ্ছে বাংলাদেশের বিনিয়োগ বাস্তবতা। শুধু বিদেশে ‘রোড শো’ করলেই বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য দৌড়ে আসবে না। বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের জন্য ‘রোড শো’ করা হচ্ছে শুনলেই হাসি পায়। আমরা পাবলিককে কতই না বোকা মনে করি। বিদেশে অনেকবারই বিনিয়োগ আহরণের জন্য ‘রোড শো’ করে কি পরিমাণ বিনিয়োগ আহরিত হয়েছে তা কি কর্তৃপক্ষ বলবেন? শুধু সুন্দর সুন্দর আইন প্রণয়ন এবং বিদেশে ‘রোড শো’ বিনিয়োগ আহরিত হবে না। এ জন্য অভ্যন্তরীণভাবে কার্যকর বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজদের কঠোর হস্তে শায়েস্তা করতে না পারলে কোনো দিনই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিনিয়োগ আহরিত হবে না।
বিশ্ব ইতিহাসে যে কয়টি বিপ্লব জনগণের মনে জনসমাজে আর শিল্প-সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে তার সূতিকাগার ফরাসি বিপ্লব। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯) হলো ইউরোপ এবং পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং তারই সঙ্গে দেশটির রোমান ক্যাথলিক চার্চ নিজেদের সব গোঁড়ামি ত্যাগ করে নিজেকে পুনর্গঠন করতে বাধ্য হয়। এই বিপ্লবকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের ইতিহাসের একটি জটিল সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যার মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতা নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র থেকে নাগরিকত্বের যুগে পদার্পণ করে। ঐতিহাসিকরা এই বিপ্লবকে মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করেন।
ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতি ছিল ‘স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী’। এই স্লোগানটি বিপ্লবের চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। যার মাধ্যমে সামরিক ও অহিংস উভয়বিধ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে গোটা পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্লোগানটি তখন সব কর্মীর প্রাণের কথায় পরিণত হয়েছিল।
ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গেই বদলে যায় ইতিহাস। সংস্কৃতিও নতুন রক্তধারায় জেগে ওঠে। যাদের আমরা প্রান্তিক বা গরিব বলে মনে করি সেসব শ্রেণির মানুষ এর আগে সাহিত্যে প্রধান চরিত্র হতে পারে তা কেউ ভাবেনি। ভিক্তর হুগো দ্য মিজারেবেলে সে ধারণা চুরমার করে দেন। আমি কোনো সাহিত্যের লেখা লিখছি না। শুধু বলছি, সেই ইতিহাসের উজ্জ্বলতম দেশের প্রেসিডেন্ট ঘুরে গেলেন বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগবিরোধী কারও চোখে এর গুরুত্ব ধরা পড়ল না। কারণ ফরাসি বিপ্লব হোক আর যাই হোক, তারা অন্ধ থাকবেন এটাই তাদের সিদ্ধান্ত।
১৯৮৭ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরা কলকাতা এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়কে তাঁদের দেশের সেরা সম্মান ‘লিজিয়ন অব অনার’ প্রদান করতে। ৩৬ বছর পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাঁখো এলেন ঢাকায়। গেলেন জলের গানের রাহুল আনন্দের ডেরায়। ডেরাই বটে। ওইটুকু বাড়িতে এক কাপ রং চা পান করার পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র পরখ করা সুর ও গান শোনা সবই করেছেন তিনি।
এ নিয়ে ট্রল হচ্ছে, হবে। কিন্তু একটা বিষয় মনে হলো অদৃশ্যেই থেকে যাচ্ছে।
আমাদের দেশটি কীভাবে মুক্ত হয়েছিল, কে বা কারা তখন পাশে ছিল, আর কারা বিরোধিতা করেছিল- তরুণ প্রজন্ম জানেই না। অলিখিত ভাবে বিভক্ত তখনকার ইউরোপের পূর্ব দিকের দেশগুলো ছিল পক্ষে। পশ্চিম ইউরোপ- যাতে সব ধনী ও সচ্ছল দেশ, তারা কেউ ছিল বিপক্ষে, কেউ চুপ।
ফ্রান্স কখনোই বিরোধিতা করেনি। তাদের সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান না নিলেও তারা পক্ষে ছিলেন।
সবচেয়ে বড় কথা ফরাসি বিপ্লবের দেশ, দুনিয়া বদলে দেয়া দ্য মিজারেবলের দেশ ও সমাজ পক্ষে না থেকে পারে? বাংলাদেশের মানুষ যে বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, তারা যে একটি মুক্তিযুদ্ধ করছে, এ কথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানাতে ভারতের দিল্লিতে অহিংস নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্যোগ নেন। এ জন্য জুলাইয়ের শেষ দিকে ফরাসি চিন্তাবিদ মালরোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন জয়প্রকাশ। কাছাকাছি সময়ে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ‘বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে সভায় অংশগ্রহণের বিষয়ে মালরোকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেন।
এরই মধ্যে পাকিস্তান প্রচার করল, অস্ত্র সাহায্যের জন্য বাংলাদেশের দূত ইসরায়েলে গেছে! ‘বাঙালিরা ইহুদিদের কাছ থেকে সাহায্য নিচ্ছে’- ছড়িয়ে দেয়া হলো এই মিথ্যা প্রচারণা। বিভ্রান্তিকর এ সময়টিতে আজীবন বিপ্লবী মানুষের পক্ষাবলম্বনকারী অঁদ্রে মালরোর একটি বিবৃতি ঘটনায় নতুন মোড় আনে। ১৮ সেপ্টেম্বরের এ বিবৃতিতে মালরো বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর আগেও মালরো স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের হয়ে সম্মুখসমরে লড়াই করেছিলেন বিপ্লবীদের পক্ষে। এবার তিনি একটি আন্তর্জাতিক ব্রিগেড তৈরি করার আহ্বান জানান।
অঁদ্রে মালরো সুবিখ্যাত এই মানুষটি ১৯৭১-এর অক্টোবর মাসে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি কোনো ফাঁকা বুলি আওড়ান না। তাই মুক্তিযুদ্ধে ট্যাংক বাহিনীতে অংশ নেবেন তিনি। ষাটোর্ধ্ব এই বিখ্যাতজন সে বয়সে এমন কোনো কাজ নাই যা করেননি। এতটাই আবেগ আর ভালোবাসা ছিল যে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘আমরা ওদের তাড়াবই’। কতটা ভালোবাসা থাকলে একজন মানুষ আমরা বলতে পারেন, এই মালরোই চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির ভিত্তিপ্রস্তর শিলান্যাস করেছিলেন। জানি না এখনকার প্রজন্ম সে খবর রাখে কি না…
আর একজন অকুতোভয় ফরাসি মুক্তিযোদ্ধার কথা বলি। জঁ নামের এই ২৮ বছরের যুবক ’৭১-এর ৩ ডিসেম্বর জ্যঁ ক্যার পি আই-এর একটি বিমান অপহরণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তাঁর এক দাবি, ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী না পাঠালে তিনি এটি হাইজ্যাক করবেন। মুক্তিপণ ওই চিকিৎসা সামগ্রী। জীবন বাজি রাখা এই ফরাসি যুবকের জেল হয়েছিল। কারাগার ও শাস্তি ভোগ করেও মাথা না নোয়ানো জঁকে চিনে বাংলাদেশ? হাজার হাজার কোটি টাকার মালিকরা জানে এই দেশ মুক্ত করার জন্য কত দেশি-বিদেশি মানুষ রক্ত দিয়েছিলেন, ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন? জঁকে দেখতে গিয়ে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নায়ক বাঘা যতীনের নাতি পৃথিন্দ্রনাথও জেলে গিয়েছিলেন সেই সময়। ফ্রান্স সরকারের তখনকার মন্ত্রী অঁদ্রে মালরো এদের পাশে না দাঁড়ালে কী হতো কে জানে?
সে দেশটির প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। আজ এত বছর পর আবার সে ভালোবাসার নজির রাখলেন তাদের প্রেসিডেন্ট । ভদ্রলোক আপাদমস্তক খাঁটি বলেই সৌজন্য আর আন্তরিকতায় ঘাটতি রাখেননি। মাতৃতুল্য মায়ের বয়সী আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তিনি আন্তরিকভাবে বিদায় নিয়েছেন। এখন আমাদের অন্ধ সমাজে এর প্রতিফলন কী হবে বা হবে না তা আমাদের জানা। কিন্তু তাতে কি? ইতিহাস ও সময় কি থেমে থাকে? সে তার গতিতে এগোয়। আজকের বাংলাদেশ মাথা উঁচু করা এক দেশ। অভ্যন্তরে সব দেশেই কিছু ঝামেলা থাকে । বিশ্বব্যাপী খাবারের দাম চড়া। তার প্রভাবে প্যারিসেও আন্দোলন হয়। তাতে এটা প্রমাণ হয় না যে আমাদের দেশ থমকে আছে । বরং তার উন্নতি আর অগ্রগতির কারণেই আজ বড় বড় দেশের নেতারা ঢাকায় আসেন। এই অর্জনকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই।
ব্যবসা-বাণিজ্য আর পারস্পরিক স্বার্থ থাকে বলেই দেশে দেশে এমন যোগাযোগ হয় । এক দেশ আরেক দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ভারতের অর্জন আর সমৃদ্ধি নিয়ে বিচলিত আমাদের চুলকানিবাজেরা সে দেশকে হিংসা করেন বটে কিন্তু কোনো শিক্ষা নিতে নারাজ। ভারত এভাবেই আজ শিখরে পৌঁছে গেছে । আমাদের সবে যাত্রা হলো শুরু। নেগেটিভ চিন্তা পরিহার করে ফ্রান্সের মতো দেশের সঙ্গে চললেই বরং বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক সভ্য ও সুন্দর হয়ে উঠবে। যার পেছনে থাকবে আদর্শ আর সমৃদ্ধি। শেখ হাসিনার এসব কৃতিত্ব একদিন ইতিহাস বিচার করবেই। ’৭১-এর বাংলাদেশে যাদের অবদান শেষ পর্যন্ত তারাই আছে, তারাই থাকবে। কারণ, এরাই আমাদের জন্মবন্ধু । এটা ঐতিহাসিকভাবেও প্রমাণিত।
বহুকাল পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সুদর্শন অমায়িক ভদ্রলোক এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। আমাদের মরচে পড়া স্মৃতিও উসকে দিলেন। সমাজ, রাজনীতি, যা হোক যেমন হোক দেশটি যে রক্তে ফোটা বিজয়ী কুসুম এটাই ইতিহাস। বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্রান্সের মৈত্রী যেমন আশাপ্রদ, তেমনি গণতান্ত্রিক দেশে ভাবমূর্তি বিস্তারেও এই সফর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
সিডনি
বাংলাদেশের উন্নয়নে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও পরিকল্পিত শিল্পায়নের পথে অগ্রযাত্রায় গ্রহণ করা হয় বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ। এর শুরুটা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি স্বাধীনতা-পূর্ববতী ১৯৫৭ সালে তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের শ্রম, শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন নামে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান গঠনের লক্ষ্যে তদানীন্তন গণপরিষদে বিল উত্থাপন করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৭ সালের ৩০ মে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়, যা স্বাধীনতা উত্তরকালে BSCIC বা বিসিক নাম ধারণ করে। বিসিক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে নীতিগত এবং কারিগরি সহায়তা প্রদান করা। এর ভিত্তিতে ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে এবং চট্টগ্রামে বেশকিছু শিল্পায়ন হয়। কয়েকটি বিসিক এলাকা সফল হয়েছে, আবার কিছু কিছু জায়গায় প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য আসেনি। তবে এটি ছিল শিল্পায়নের পথে প্রথম সূচনা। বিদেশি বিনিয়োগে গতি আনয়নে প্রায় ৪২ বছর আগে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনস অথরিটি অ্যাক্ট, ১৯৮০-এর মাধ্যমে বেপজা প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বেপজা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের প্রত্যাশা অনেকটা পূরণ হয়েছে। বেপজা বর্তমানে তাদের ৮টি ইপিজেডের মাধ্যমে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ১৯% নিশ্চিত করছে। গত ৪২ বছরে বেপজার আওতায় প্রায় ২৩০০ একর ভূমি উন্নয়ন করা হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বেপজা কর্তৃক যতগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় হচ্ছে বেজার সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে প্রায় ১১৩৮ একর জমিতে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা।
বাংলাদেশ সরকারের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের ফলে বিগত সময়ে সাধারণ জনগণের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি ও গার্মেন্ট শিল্পে দেশের উল্লেখযোগ্য একটি অংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এর অন্যতম প্রধান কারণ। এই দুটি কারণে মাথাপিছু আয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ সুযোগকে কাজে লাগানোর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। আবার একই সঙ্গে শুরু হয় আমদানি বিকল্প শিল্প প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান যেমন গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মোংলা, পাবনা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় স্থাপিত হয় বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এভাবে শিল্পায়ন ক্রমশই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু দ্রুত শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় অপরিকল্পিত শিল্পায়নের একটি ধারা যা সরকার এবং আশপাশের এলাকার জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যত্রতত্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা তথা পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য পৃথক ব্যবস্থাপনার তৈরির ফলে সরকারের প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত বাজেটের। তাছাড়া যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থাপনার অভাবে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত না হওয়া অনেক জায়গায় পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটেছে। বিশ্ববাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ প্রেক্ষাপটে দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ত্বরান্বিতকরণে এবং পরিকল্পিত শিল্পায়ন উৎসাহিত করতে ২০১০ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রতিষ্ঠিত হয়।
অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দেশে পরিকল্পিত শিল্পায়ন, বিনিয়োগ বিকাশ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। বেজা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে ২০১৩ সালের শেষ দিকে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সাল থেকে বেসরকারি খাতকে পরিকল্পিত শিল্পায়নের ধারায় সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে, যেখানে পর্যায়ক্রমে যুক্ত হয় এ কে খান গ্রুপ, আব্দুল মোনেম লিমিটেড, মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, নিটল-নিলয় গ্রুপ, আমান গ্রুপ ও বে গ্রুপের মতো বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী। একই বছর শেষে দিকে বেজা শুরু করে দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পনগরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর প্রতিষ্ঠার কাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর দেশের সর্বপ্রথম পরিকল্পিত ও স্মার্টনগর, যার মোট আয়তন প্রায় ৩৩ হাজার একর এবং এটি হবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শিল্পনগর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসন অনুযায়ী এই শিল্পনগরের মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করা হয় গত ২০ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী এ শিল্পনগরকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করা হয়েছে যেখানে থাকবে হালকা, মাঝারি ও ভারীসহ সব ধরনের শিল্প। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আবাসিক, প্রশাসনিক ও বিজনেস হাব, সার্ভিস জোন ও পুনর্বাসন এলাকা। সমুদ্রপথের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে নির্মাণ করা হবে একাধিক জেটি ও লজিস্টিক সুবিধা। এ ছাড়াও জলাশয়, খেলার মাঠ, সবুজ পার্ক ও উন্মুক্ত এলাকাসহ জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য শিল্পনগরকে কেন্দ্র করে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের বেষ্টনী ও বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। আর এসব উদ্যোগের কারণেই এ শিল্পনগর ইতোমধ্যে বিনিয়োগের এক অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। এখন পর্যন্ত শুধু এই শিল্পনগরেই বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই শিল্পনগরসহ সব অর্থনৈতিক অঞ্চলে এ যাবৎ মোট বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে প্রায় ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
জিটুজি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা বেজার একটি অন্যতম ইনোভেশন। প্রধানমন্ত্রীর সানুগ্রহ অনুপ্রেরণায় বেজা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। বেজা ২০১৬ সালে জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে। জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্প নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় গত ৬ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে, যার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে বেজা ডেভেলপার হিসেবে নিয়ে আসে জাপানভিত্তিক বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান সুমিতমো করপোরেশনকে। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইতোমধ্যে শিল্প নির্মাণ শুরু করেছে তুরস্কের সিংগার, জার্মানির রুডলফের মতো প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া আরো প্রায় ২৫টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এ ছাড়া ২০১৭ সালে শুরু হয় চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চাইনিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের প্রায় ১০০০ একর জমিতে ২০২১ সালে শুরু হয়েছে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ। এসব জিটুজি অর্থনৈতিক অঞ্চল আগামীতে বিদেশি বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে এবং বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচন করবে। এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দেশে সরকারি সফরে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে জিটুজিসহ অন্যান্য সব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন, যা বেজার ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশনের ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে।
বেজা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে শিল্পকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া। এরই অংশ হিসেবে বেজা জামালপুর সদর উপজেলায় প্রায় ৪৩৬ একর জমিতে প্রতিষ্ঠা করেছে জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল। এখানে শিল্প নির্মাণ শুরু করেছেন তুরস্কের একটি প্রতিষ্ঠানসহ বেশ কয়েকজন বিনিয়োগকারী। কক্সবাজারের মহেশখালীতে প্রায় ২৯০০ একর জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ শুরু হয়েছে, যেখানে বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপ। এই অর্থনৈতিক অঞ্চলেই নির্মিত হচ্ছে দেশের বৃহৎ তেল পরিশোধানাগারসহ পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প। এটি প্রতিষ্ঠিত হলে তেল পরিশোধন ও মজুতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাশে প্রায় ১০০০ একর জমিতে স্থাপিত হচ্ছে দেশের বৃহত্তম বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ ছাড়া সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার সংযোগস্থল শেরপুরে নির্মিত হয়েছে শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল, যা পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতিতে গতি আনয়ন করবে। বাগেরহাটের মোংলায় নির্মাণ করা হচ্ছে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং দ্বিতীয় ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল। বেসরকারি উদ্যোগে কিশোরগঞ্জে নির্মিত হচ্ছে কিশোরগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং গাজীপুরে উৎপাদন শুরু করেছে বে অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেখানে বিনিয়োগ করেছে চায়না ও তাইওয়ানের দুটি প্রতিষ্ঠান। মুন্সীগঞ্জে উৎপাদন শুরু করেছে হোসেন্দি ও আব্দুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চল। আব্দুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প নির্মাণ করেছে জাপানের হোন্ডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় রয়েছে মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোন যেখানে নির্মিত হয়েছে ৭টি বিদেশি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ১৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ এসেছে জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে।
শুধু শিল্পের বিকাশ নিয়েই নয়, বেজা একই সঙ্গে কাজ করছে পর্যটন খাত উন্নয়নে। ইতোমধ্যে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের কাজ শুরু করা হয়েছে, যেখানে এখন পর্যন্ত ১৯টি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বজায় রেখে সীমিত স্থাপনার মাধ্যমে সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্ক প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন করেছেন। পাশাপাশি দ্বীপভিত্তিক ট্যুরিজম পার্ক উন্নয়নে নাফ ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের সর্বাধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন কেবল কার নেটওয়ার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশে শিল্প স্থাপন করার ক্ষেত্রে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর থেকে নানা বিষয়ে অনুমোদন গ্রহণ করতে হয়। এসব অনুমোদন গ্রহণ প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ এবং জটিল বিধায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অনেক ক্ষেত্রেই বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হন। বেজা এসব সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার’ গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগী ভূমিকায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন, ২০১৮ পাস করা হয়। এ আইনের আওতায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ) বিধিমালা, ২০১৮ জারি করা হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাসময়ে সেবা প্রদানের বাধ্যবাধকতার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে বেজা ওএসএস সেন্টার থেকে ৫০টি অনলাইনসহ ১২৫ ধরনের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। আগামীতে সব সেবা অনলাইনের প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে জাইকার সঙ্গে টেকনিক্যাল প্রজেক্টের কাজ চলমান রয়েছে। বেজা বিশ্বাস করে ওএসএস কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের কারণে ‘Ease of Doing Business’-এ আগামীতে বাংলাদেশের অবস্থান আরো উন্নত হবে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন।
বেজা মনে করে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে বেসরকারি ব্যবসায়িক খাত। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মতে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা দক্ষ জনবল। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সঠিকভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্যও প্রয়োজন দক্ষ জনবলের। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বেজা কর্তৃক বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে Private Investment and Digital Entrepreneurship (PRIDE) প্রকল্পের আওতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে স্কিল ভাউচার প্রোগ্রামের মাধ্যমে আগামীতে ২২ হাজার দক্ষ জনবল গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এ কর্মসূচি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষ জনবল গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বেজা বর্তমানে ২৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে এবং ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে উৎপাদন শুরু হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে বিভিন্ন পর্যায়ের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে শিল্প উৎপাদন শুরু করেছে মোট ৩৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং নির্মাণাধীন রয়েছে আরও ৭০টি। বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার লোকের। বেজার এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে শিল্প স্থাপন নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ অন্যান্য পরিষেবা পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে হবে। শিল্প উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প স্থাপনসহ বিনিয়োগের পরামর্শ প্রদান করতে হবে। এ বিষয়ে এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে।’
পরিকল্পিত শিল্পায়ন, বিনিয়োগ বিকাশ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়িত হলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথ সহজ হবে। তাই অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ বেগবান করার জন্য সরকারের নিয়মিত বাজেট থেকে বেজাকে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন। কারণ বেজা একটি বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তুলনামূলক কম মূল্যে ভর্তুকি দিয়ে জমি বরাদ্দ করছে। এ ছাড়াও বেজার সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগ যেমন সড়ক বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগকে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করে অবকাঠামো নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় পরিকল্পনা অনুযায়ী ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বিলম্ব হতে পারে।
বিনিয়োগবান্ধব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বেজা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করে থাকে। বিনিয়োগ বিকাশে বেজা বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যা পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের তুলনায় আকর্ষণীয়। বেজা বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, দাতা সংস্থা, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাছে অভূতপূর্ব গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ব্যবসায়ীরা যেন দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহী ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তা নিশ্চিত করতে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ করে যেতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা যারা বেজায় কর্মরত রয়েছে তাদের শিল্প, শিল্প স্থাপনের প্রক্রিয়া, শিল্পের রূপান্তর ও সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। বিশেষত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অংশ হিসেবে আমাদের মানবসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
আমি মনে করি, বিনিয়োগ বিকাশের মাধ্যমে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর থেকে শুরু করে জাপানিজ, চাইনিজ ও ভারতীয় এবং মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে আমরা অনেক বড় পরিসরে প্রস্তুত করছি এবং আমাদের সঙ্গে কাজ করছে উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বেসরকারি খাত। বেজা শিল্পায়নের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করছে এবং ব্যবসা প্রক্রিয়া সহজীকরণ করে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করছে। তবে এ লক্ষ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, বিভিন্ন প্রণোদনা ও ভর্তুকি প্রদানের পাশাপাশি নিজেদের প্রতিযোগিতা সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)
সম্প্রতি স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়েছে বাংলাদেশ। একজন তরুণ হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বর্তমানে একবিংশ শতকের চলমান অবধি অনেক কিছুই আমার অবলোকনের সৌভাগ্য হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা পাওয়া বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে ‘উন্নয়নের রোল মডেল।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে সোনার বাংলা। এ পথে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে তা অতিক্রম করা সম্ভব।
অর্থনীতিবিদগণ ‘উন্নয়ন’ বলতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এমন একটি প্রক্রিয়াকে বুঝিয়ে থাকেন। তবে সাধারণভাবে যেকোনো ইতিবাচক পরিবর্তনকেই উন্নয়ন বলে মনে করা হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ-সমতা, সুশাসন, স্বাধীনতা, সক্ষমতা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি সবকিছুই উন্নয়ন ধারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উন্নয়ন হলো একটি পদ্ধতি যা একই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামোগত পরিবর্তন, পরিবেশগত পরিশুদ্ধিসহ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিষয়ের ইতিবাচক পরিবর্তনকে নির্দেশ করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা উন্নয়ন বা ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছি। বিশেষত, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, আইসিটি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মকাষেণ্ডর মধ্যে অনেকগুলো অবকাঠামো নির্মাণ উল্লেখ করার মতো। যেমন- কর্ণফুলী নদীতে টানেল, তৃতীয় পায়রা বন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি। এ ছাড়া মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলেই সম্ভব হচ্ছে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নযজ্ঞ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ জটিলতার অবসান ঘটিয়ে প্রমত্ত পদ্মার বুকে দীর্ঘ সেতু নির্মাণ সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়নের বড় উদাহরণে পরিণত হয়েছে। পদ্মা সেতু আমাদের গৌরব ও সক্ষমতার প্রতীক। ভাবা যায়, দাতা সংস্থাগুলো যখন এই প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সেই সময়ে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন- আমরা নিজস্ব অর্থে পদ্মার বুকে সেতু তৈরি করব! তিনি তা করে দেখিয়েছেন। ২৫ জুন ২০২২ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন। বিশাল এই সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য যেমন গর্বের, তেমনি বিশ্বের মানচিত্রেও স্থান পেয়েছে বৈচিত্র্যময় এই পদ্মা সেতু।
সড়ক পরিবহনে ভোগান্তি কমাতে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে দীর্ঘমেয়াদি যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার মধ্যে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অন্যতম। সম্প্রতি উদ্বোধন হয়েছে এক্সপ্রেসওয়েটি। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার রাস্তা ব্যবহারের জন্য চালু করা হয়েছে। মাত্র ১০ মিনিটে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট যাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই দীর্ঘস্থায়ী বা টেকসই উন্নয়ন ভাবনা সন্নিহিত ছিল। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদা ও মানবিক মূল্যবোধের অঙ্গীকার করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, বিশ্ব শান্তি, পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে এসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও পরবর্তীতে ২০০১ সাল থেকে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা শুরু করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন এবং ইতোমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় মেয়াদ পার করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এমডিজি) ২০০০ অর্জনে বাংলাদেশ যথেষ্ট সাফল্য দেখিয়েছে। এসডিজি অর্জনেও চলছে জোরালো কর্মযজ্ঞ।
আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর উন্নয়ন দর্শনে যুক্ত করেছেন অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ভাবনা এবং নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত বিশেষ বিশেষ উদ্ভাবনী উদ্যোগ। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশ উন্নয়নের প্রতি সমান গুরুত্ব প্রদান করেছেন। পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উন্নয়ন কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্তকরণ ও তাদের মধ্যে এর সুফল পৌঁছাতে ও তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারপ্রধান গ্রহণ করেছেন বিশেষ সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ ও কর্মসূচি।
সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান সরকার বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিনা মূল্যে বই বিতরণসহ দরিদ্র ছাত্রদের জন্য উপবৃত্তি প্রবর্তনের মাধ্যমে এই সরকারের আমলেই প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করা হয়েছে। প্রায় ১৪,২০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন প্রান্তিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। এতে করে শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাকালীন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ভ্যাকসিনেশনে বাংলাদেশ অত্যন্ত সফল হয়েছে। উন্নয়নের মূলধারায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে গ্রামীণ রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান উন্নয়নেও নেয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ। ডিজিটাল সেবা প্রাপ্তির লক্ষ্যে প্রতিটি ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার’। যার সুফল আমরা পাচ্ছি।
আমাদের গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.২৫%। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়ও। বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। এ কথা সত্য যে, যুদ্ধ ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে সংকট তৈরি হওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি ও নানা কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ সমস্যায় পড়েছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতেও বিভিন্ন সেক্টরে প্রভাব পড়ছে। তবে সরকার তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় আছে। সরকার এখন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।
২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভিশন ২০২১ ’-এর মূল ভিত্তি হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেন। বর্তমানে সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ দৃশ্যমান। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় সব খানেই ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে জনগণের তথ্য-উপাত্ত, কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রাপ্তিসহ প্রাত্যহিক জীবন-যাপন এবং অসংখ্য কাজ সহজ হয়েছে। বর্তমান সরকার ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিল, যা আমরা বাস্তবে প্রত্যক্ষ করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০২২’ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে বলেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরিত করা হবে। সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার চারটি ভিত্তি- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি সফলভাবে বাস্তবায়নে কাজ করছে। বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরে তরুণ প্রজন্মকে ২০৪১ সালের সৈনিক হিসেবে স্মার্ট নাগরিক হিসেবে প্রস্তুত হতে হবে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। আসন্ন নির্বাচনেও এই ঘোষণা একটি অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসেবেই নেবে তারা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের যুব সমাজের ওপর খুবই আশাবাদী। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে তিনি বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নতি করতে চান। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। এখন অপেক্ষা উন্নত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ দেখার। আমরাও আশাবাদী সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে। আমরা দেখে যেতে পারব। এজন্য তারুণ্যের সর্বোত্তম ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।
বর্তমান বাংলাদেশের বড় অংশের জনগোষ্ঠী কিশোর-তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট। ইউএনডিপি-এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বা এর নিচে। অর্থাৎ- ৪৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ। দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ। মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ কর্মক্ষম। এই তরুণরাই আগামীর বাংলাদেশের রূপকার। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের কাণ্ডারি। এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে সুস্থ রাখতে হবে। কিন্তু শঙ্কা জেগেছে, আদৌ আমরা তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারব কি না! কারণ, তামাক ও মাদকের আগ্রাসনে তরুণরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকাসক্তি পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেজনক। সামাজিক অবক্ষয়সহ প্রায় সকল অপরাধের পেছনে অন্যতম প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে মাদক। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, দেশে প্রায় কোটি মানুষ মাদকাসক্ত রয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ তরুণ-কিশোর। অপরদিকে মাদকাসক্তির বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে ধূমপান। ধূমপান হচ্ছে মাদকের রাজ্যে প্রবেশের মূল দরজা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯৮ শতাংশ ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে তারা প্রথমে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়, তারপর মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরবর্তীকালে তারা গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, সিসা, হেরোইন, কোকেনসহ বিভিন্ন মরণ নেশায় আসক্ত হয়। বর্তমানে কিশোর-তরুণদের অনেকে বন্ধুদের প্ররোচনায় ধূমপান শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে এর একটি বিরাট অংশ মাদক সেবন ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
কিশোর-তরুণদের মধ্যে এহেন বাজে অবস্থাকে আরও উসকে দিচ্ছে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলো। বলা যায়, আগুনে ঘি ঢালছে! সিগারেট কোম্পানিগুলো শহরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে (যেখানে কিশোর-তরুণদের যাতায়াত বেশি) ধূমপানের স্থান তৈরি করে দিচ্ছে। যেখানে বসে ধূমপান থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকও সেবন করা হয়ে থাকে। তরুণদের মধ্য থেকে সামাজিক রীতি-নীতি, মূল্যবোধ উঠে যাচ্ছে। পাশাপাশি এসব স্থানে পরিবার-পরিজন নিয়ে উপভোগ্য সময় কাটাতে আসা মানুষজন ভয়াবহ স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ধূমপানের আখড়া তৈরি করে ব্যবসার প্রসার করাই মূল উদ্দেশ্য সিগারেট কোম্পানির। ভয়েস এর গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক কোম্পানিগুলো এসব ‘স্মোকিং জোন’ তৈরিতে অবস্থান অনুসারে রেস্টুরেন্ট মালিককে এককালীন ৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নগদ অর্থ সুবিধা দেয়। এসব জোনে তামাক কোম্পানির বিজ্ঞাপন সামগ্রী প্রদর্শন করা হয়।
আশঙ্কার বিষয় হলো- সিগারেট কোম্পানিগুলোর মিথ্যা প্রচারণা ও প্রলুব্ধকরণ কার্যক্রমে আশঙ্কাজনক হারে দেশে বাড়ছে ই-সিগারেট, ভেপ ও হিটেট টোব্যাকো প্রোডাক্টসমূহের ব্যবহার। সাধারণ সিগারেটের তুলনায় কম ক্ষতিকর ও সিগারেটের বিকল্প হিসেবে ই-সিগারেটকে সামনে আনছে তারা। মূলত, সাধারণ সিগারেটের চাইতে ই-সিগারেট ১০ গুণ বেশি ক্ষতিকর। অধিকাংশ মানুষ (বিশেষ করে তরুণরা) ই-সিগারেটের ক্ষতিকর দিক জানেন না। ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে দেশে এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট আইন, নীতি না থাকা এবং অসচেতনতা মানুষের মধ্যে প্রাণঘাতী এসব নেশা দ্রব্যের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার অন্যতম কারণ এবং মাদকাসক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যারা বর্তমানে মাদকাসক্ত রয়েছে তাদের রোগ নির্ণয় এবং নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে সুস্থ করা এখন বড় কাজ, নতুবা তাদের মাধ্যমে নতুন মাদকাসক্ত তৈরি হবে।
মাদক ও তামাকবিরোধী আইন আছে, প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশ থেকে তামাক নির্মূল করতে ঘোষণা দিয়েছেন। মাদকের বিরুদ্ধেও তিনি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছেন। এসব পদক্ষেপ হলো- উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করার যে রসদ সেটাকে সমুন্নত রাখা। অর্থাৎ তরুণদের সুরক্ষিত রাখা, যেদিকে তিনি সদাতৎপর।
সুতরাং, তরুণ জনগোষ্ঠীকে তামাকের দীর্ঘদিনের ভোক্তা বানাতে কোম্পানিগুলো যে অপতৎপরতা চালাচ্ছে তা রুখতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন করতে হলে মাদকাসক্তি প্রতিরোধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সুতরাং, আগামী প্রজন্মকে রক্ষার জন্য দায়িত্ব সবার। এ ক্ষেত্রে সবাইকে সক্রিয় হতে হবে। শিশু-কিশোর, তরুণেরা ধূমপানের মাধ্যমে ভয়াবহ মাদকের নেশায় নীল হয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াক, এটা কোনো সচেতন, বিবেকবান মানুষের কারও কাম্য হতে পারে না।
লেখক: অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ।