১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের দুই অংশে যথা- পূর্ব বাংলা (তথা পূর্ব পাকিস্তান) এবং পশ্চিমাংশের চারটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগে খুব একটা শিল্পকারখানা পড়েনি। বৃহৎ শিল্প গড়ার জন্য ১৯৫২ সালে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (পিআইডিসি) সৃষ্টি হয়। এর অধীনে দুই অংশে যথাক্রমে ইপিআইডিসি ও ডব্লিউপিআইডিসি গঠন করা হয়। মূলত এ করপোরেশন নিজ উদ্যোগে কিংবা কতিপয় শিল্পোদ্যোক্তাকে সহায়তার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে পাট, কাপড় ও চিনি খাতে বেশ কিছু বৃহৎ শিল্পকারখানা গড়ে তোলে। পর্যায়ক্রমে সার, কেমিক্যাল ও স্টিল মিলও প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পোন্নয়নের গোড়াপত্তন করে। ইপিআইডিসি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কতিপয় শিল্পকারখানা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে পরবর্তী সময়ে বিক্রি করে দেয়া হয়। এ ছাড়া গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ক্ষুদ্রশিল্পের বিকাশ ও সহায়তার জন্য পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র শিল্প করপোরেশন (ইপসিক) প্রতিষ্ঠা করা হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্থলে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পর প্রথমে বৃহৎ শিল্পগুলো জাতীয়করণ করা হয়। বিশ্বব্যাপী পাটের গুরুত্ব কমে যাওয়ায় এবং প্রশাসনিক অবস্থা ও শ্রমিক বিশৃঙ্খলার কারণে পাটকলগুলো লোকসানে পতিত হয়। পরবর্তী সময়ে বেসরকারীকরণ নীতি গ্রহণের মাধ্যমে বেশ কিছু পাটকল ও কাপড়ের মিল ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করা হয়।
বাংলাদেশে লাভজনক শিল্পোন্নয়নের সূচনা হয় বেসরকারি উদ্যোগে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প বিকাশের মাধ্যমে। এসব শিল্পে কর্মসংস্থান এবং দেশে বিভিন্ন সেবা খাতের সম্প্রসারণের ফলে ভোক্তাশ্রেণির সৃষ্টি হয়। ক্রমান্বয়ে ভোগ্যপণ্য, নির্মাণসামগ্রী, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে থাকে।
১৯৭৯ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস কর্তৃক তৈরি পোশাকের সীমিত রপ্তানির মাধ্যমে এ খাতের রপ্তানির সূচনা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে আরও উদ্যোক্তা রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপন করে রপ্তানি শুরু করে। আশির দশকের প্রথম দিকে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ কার্যক্রমের মাধ্যমে তৈরি পোশাকশিল্পে নীতিসহায়তা চালুর ফলে এ শিল্প বিকাশ লাভ করে। পোশাক খাত থেকে বর্তমানে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশ আসে। মধ্যবিত্ত ও গরিবদের, বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও এ খাত শীর্ষস্থানে রয়েছে। যে দুটি সরকারি নীতিসহায়তার কারণে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে সেগুলো হচ্ছে- শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করে বন্ডেড ওয়্যারহাউসে রাখার সুবিধা এবং বিলম্বে দায় পরিশোধসহ ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা। এ দুটি সুবিধা প্রাপ্তির ফলে বড় অঙ্কের পুঁজি ছাড়াই গার্মেন্টস কারখানা প্রতিষ্ঠা করে উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সরকার করহার কমানো, নগদ সহায়তা প্রদান, ব্যাংকঋণ প্রাপ্তি সহজ ও বন্দর ব্যবহারে অগ্রাধিকার প্রদান করে এ খাত প্রসারের পথ সুগম করেছে।
সরকার এ পর্যন্ত আটটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং প্রতিবছর বার্ষিক বাজেটে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নানা সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে শিল্পায়নে সহায়তা করে আসছে। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সুবিধা প্রভৃতির ফলে শিল্পায়নের পাশাপাশি ভোক্তা বাজার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান প্রায় ৩৩ শতাংশে পৌঁছেছে।
শুরু থেকেই বাংলাদেশে আমদানি-বিকল্প এবং রপ্তানিনির্ভর উভয় প্রকার দ্রব্যসামগ্রী প্রস্তুতের জন্য শিল্পায়ন হচ্ছে। গ্লোবালাইজেশনের প্রসারের ফলে আমাদের আমদানি-রপ্তানি উভয়ই বেড়েছে। তবে উৎপাদনের কাঁচামাল, কেমিক্যালসামগ্রী, উচ্চপ্রযুক্তির দ্রব্যাদি যেমন- মোটরগাড়ি, কলকারখানার যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, সার, জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, চিনি ইত্যাদি অধিক পরিমাণ ক্রয়ের কারণে রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হচ্ছে। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বেশ কিছু ভোগ্যপণ্য উৎপাদন শিল্প, ওষুধ ও কেমিক্যাল প্রস্তুত শিল্প, চামড়া ও প্লাস্টিক শিল্প, সুতা ও কাপড় প্রস্তুত কারখানা এবং স্টিল, ইলেকট্রনিকস, সিমেন্ট প্রভৃতি বৃহৎ শিল্প গড়ে উঠেছে।
যতই দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, ততই বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অন্যতম উৎস। আবার রিজার্ভের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আমদানি দায় পরিশোধে খরচ হয়। পৃথিবীর ১০টি বৃহৎ ভোক্তা বাজারের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। সে কারণে আমাদের আমদানি শুধু শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য সামগ্রীও আমদানি করা হয়। আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম হলে বাণিজ্য ঘাটতি হয়, অর্থাৎ লেনদেনের ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়, যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা দেয়। সে জন্য দেশের সার্বিক উন্নয়নে রপ্তানি বৃদ্ধি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৫৬ শতাংশ এবং পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানির ৭৫ শতাংশের অধিক আসত পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি থেকে। অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি দ্রব্য ছিল চা ও চামড়া।
স্বাধীনতার পরের বছর বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। পাটের পর প্রধান দুটি রপ্তানি পণ্য ছিল চা ও হিমায়িত খাদ্য। কৃত্রিম তন্তুর আবিষ্কার ও ব্যবহার বৃদ্ধির পর পাটের গুরুত্ব কমতে থাকে। সে জন্য পাটের বিকল্প রপ্তানি দ্রব্য অন্বেষণে গুরুত্বারোপ করা হয়।
১৯৮৩-৮৪ সালে মোট রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের হিস্যা ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ১৭-১৮ বছরের ব্যবধানে ২০১০-১১ সালে রপ্তানি আয়ের ৭৮ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। পরবর্তী ১০ বছরে তৈরি পোশাকের অবদান বেড়ে ৮২-৮৪ শতাংশে দাঁড়ায়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। মূলত তৈরি পোশাকের ওপর ভর করে ২০২১-২২ সালে রপ্তানি আয় ৫২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তবে একক পণ্যের ওপর এত অধিক হারে রপ্তানিনির্ভরতা টেকসই বাণিজ্যের জন্য অনুকূল নয়। সে জন্য দুই দশক ধরেই রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
তৈরি পোশাক ব্যতীত বাংলাদেশের অন্য কয়টি উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য হচ্ছে- পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষিজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, হোম টেক্সটাইল, ওষুধ, প্লাস্টিক পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য, হস্তশিল্পজাত পণ্য, বাইসাইকেল ইত্যাদি। পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি মূল্যের দিক থেকে কয়েক বছর দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও গত বছর হোম টেক্সটাইল দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে (প্রায় ৩ শতাংশ)। হিমায়িত চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, কৃষিজ দ্রব্যাদি প্রভৃতির বিশ্ববাজারে চাহিদার তুলনায় আমাদের সরবরাহ অপ্রতুল। তা ছাড়া প্যাকেজিং ও মান নির্ণয়ে আমাদের সমস্যা আছে। পরিবেশবান্ধব ট্যানারি শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা করতে না পারার কারণে বিদেশে আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের চাহিদা কমে গেছে। সীমিত পরিসরে রপ্তানি চালিয়ে গেলেও এলডব্লিউজি সনদের অভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে নানা বিধিনিষেধের আওতায় পড়তে হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত মার্চে (২০২৩) প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর রপ্তানির হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৈরি পোশাক ও চামড়া ছাড়া অন্য সব খাতেই রপ্তানি কমেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় সার্বিক রপ্তানি ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৬ শতাংশ, কিন্তু পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, ওষুধ, বাইসাইকেলসহ অন্য খাতে রপ্তানি বেশ কমেছে। ওই সময় মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশই এসেছে পোশাক খাত থেকে। বিগত কয়েক বছরের রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যান লক্ষ করলে দেখা যাবে পোশাক খাতের রপ্তানি ৩০-৩৫ বিলিয়ন ডলার হলেও অন্য কোনো খাতে রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে পারেনি। ২০২১-২২ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বাজার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের সব দেশ, জাপান, চীন, ভারতসহ এশিয়ার দেশগুলো এবং বিশ্বের বহু দেশে বিস্তৃত। সে তুলনায় অন্যান্য খাতের বাজার সীমিত। তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারীরা বিভিন্নভাবে সরকারের নীতিসহায়তা, শুল্ককর সুবিধা, ব্যাংকঋণ ও বন্দর ব্যবহারে যে অগ্রাধিকার পান, অন্যান্য রপ্তানিকারকরা উপরিউক্ত সব সুবিধা পান না। তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজেএমইএ, বিকেএমইএ, এমনকি কাপড়ের মিলগুলোর সংগঠন বিটিএমএ যেভাবে সরকার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রভাব খাটাতে পারে, অন্যান্য খাতের সংগঠনগুলো তেমন শক্তিশালী ও সক্রিয় নয়। এসব পণ্যের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়ার কারণ হলো- উৎপাদকদের ব্যবসায়িক যোগাযোগ কম, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি। অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভর বড় শিল্পকারখানাও গড়ে ওঠেনি। বাজার সীমিত থাকার কারণে এসব খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগও তেমন আসছে না।
যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিতে প্রতিবছরই প্রবৃদ্ধি আছে। কারণ বাংলাদেশ নিম্ন ও মধ্যম দামের পোশাক রপ্তানি করে যার চাহিদা বিদেশি ক্রেতাদের কাছে প্রতিকূল পরিবেশেও বলবৎ রয়েছে। তবে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে যে বৃহৎ বাজার রয়েছে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ মাত্র বৈশ্বিক চাহিদার ৬ দশমিক ২ শতাংশ রপ্তানি করতে পারছে। তৈরি পোশাক খাতেও পণ্যের বহুমুখীকরণ প্রয়োজন। যেমন- আমাদের উদ্যোক্তারা যদি উচ্চমূল্যের পোশাক, মনুষ্য তৈরি তন্তু ব্যবহার (ম্যান মেড ফাইবার) করে প্রস্তুতকৃত পোশাক, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পোশাক ইত্যাদি প্রস্তুত ও বাজার অন্বেষণ করে, তবে পোশাক রপ্তানি আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে, যা ২০২৬ সালে কার্যকর হবে। ২০২৯ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে আর শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে না। তখন ৮-৯ শতাংশ শুল্কারোপিত হলে তৈরি পোশাকের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে, যার ফলে পোশাক রপ্তানি কমে যেতে পারে। সে জন্য আগে থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ডব্লিউওটিওর সঙ্গে যোগাযোগ করে শুল্ক সুবিধার সময় বাড়িয়ে নেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শুল্কমুক্ত চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের মাধ্যমে পারস্পরিক শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগানো যেতে পারে।
তৈরি পোশাকশিল্পে বহুমুখীকরণের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো ছাড়াও রাশিয়া, ভারত, জাপান ও চীনের মতো দেশগুলোর বাজারে রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব বলে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান যে, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি টেকসই করার জন্য জাতীয় আয়ে শিল্পের অবদান ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে। আমদানি-বিকল্প ও রপ্তানিমুখী উভয় শিল্প প্রসারে সরকার ও ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের মনোযোগী হতে হবে। রপ্তানি বাড়ানোর লক্ষ্যে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। নতুন রপ্তানি দ্রব্য ও বাজার অন্বেষণ করতে হবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের মাধ্যমে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি আমাদের রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে পরিবেশের যাতে ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে এবং কলকারখানায়, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, শ্রমিক অধিকার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় শর্তাদি (কমপ্লায়েন্স) মেনে চলতে হবে। সাভার চামড়া শিল্পনগরীকে পরিবেশবান্ধব শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে তুলে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং তৈরি পোশাকের পর চামড়াশিল্পকে দ্বিতীয় বিকল্প রপ্তানি পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ছাড়া প্রতিশ্রুতিশীল রপ্তানি পণ্যগুলোকে তৈরি পোশাকের মতো নীতিসহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান করে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে গুম সংক্রান্ত ‘মানবতা বিরোধী অপরাধের’ মামলায় একযোগে ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি-- এমন ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রায় নজিরবিহীন। বিশেষ করে তাদের মধ্যে ১৫ জন বর্তমানে কর্মরত হওয়ায় বিষয়টি শুধু সেনা সদর নয় পুরো দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
এ বিষয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য স্পষ্ট করে জানান। ‘আমরা সব সময় ন্যয়ের পক্ষে। ইনসাফের সঙ্গে কোন আপস নেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল।’ আদালতের আদেশ পাওয়ার পরই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দেখিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত ১৬ কর্মকর্তাকে স্বেচ্ছায় হেফাজতে আত্মসমর্পণের নির্দশ দেয়।তাদের মধ্যে ১৫ জন ইতোমধ্যে সেনা হেফাজতে এসেছেন একজন অনুপস্থিত রয়েছেন।
-তবে একই সঙ্গে সেনা সদর স্বীকার করে হঠাৎ এ ধরনের ঘটনা সেনা সদস্যদের মনোবলে সাময়িক প্রভাব ফেলেছে এবং তাদের দিয়েই ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের ভাষ্য মোতাবেক ইতিহাসের সেরা নির্বাচন করার পরিকল্পনা ও রয়েছে।
সেনা সদর মনে করে বিচার প্রক্রিয়া যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তা অনেক সময় একটি প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
এ বিষয়ে সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের অভিমত হলো কেউ অপরাধ করে থাকলে আইন অনুসারে তার বিচার হবে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তি হবে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যেভাবে বিঢয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে বিচারের আগেই শাস্তির ঘটনা ঘটছে। সেনাবাহিনীকে মিডিয়া ট্রায়ালের স্বীকার করা হচ্ছে।
অথচ অভিযুক্তরা ঘটনার সময় কেউ কেউ ডিজিএফআই ও সরকারী অন্যান্য সংস্থায় কর্মরত ছিলেন এসব সংস্থায় পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে।
‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাহেদুর রহমান বলেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের --সেটি সশস্ত্র বাহিনী হোক, বিচার বিভাগ হোক, বা প্রশাসন বিভাগ হোক সবার নিজস্ব মর্যাদা আছে, দেশের জন্য দশের জন্য ভূমিকা আছে। আমরা যখন সেই প্রতিষ্ঠানের কোনো সদস্যের কৃতকর্মের জন্য ঢালাওভাবে সেই প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করি অথবা তার ইমেজকে সংকটে ফেলে দিই তখন সেই প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।সেই প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের কর্মস্পৃহা উদ্দীপনা হ্রাস পায়। আমরা বর্তমানে যে ঘটনা যে দেখছি সশস্ত্র বাহিনীর যেসব সদস্য গুম বা এ সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি মামলায় এসেছেন। মামলা হওয়াটা স্বাভাবিক। আসতেই হবে। কেউ তার কৃতকর্মের জন্য দায়মুক্তি পেতে পারেন না। সেটি আইনের বরখেলাপ হবে।দেশের মানুষের প্রতি অন্যায় করা হবে। অবশ্যই অপরাধ করে থাকলে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়াকে আমি স্বাগত জানাই। সশস্ত্র বাহিনী ও এটাকে স্বাগত জানিয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী ও একটি নিয়মের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে, যাতে সুষ্ঠুভাবে তাদের বিচারের সামনে দাঁড় করানো যায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি আমরা সশস্ত্র বাহিনীকেই কালিমা লিপ্ত করি তাহলে দেশের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর যে অবদান সেটিকে প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আমার পর্যবেক্ষণ ---ব্যক্তিকে দোষারোপ করব প্রতিষ্ঠানকে নয়। কিছু গণমাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনকের বক্তব্য শুনেছি। এতে দুঃখজনক ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। আমি ৩৪ বছর সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ করেছি। কেউ অপরাধ করে থাকলে তাকে দায় নিতে হবে। আমি অপরাধ করলে আমি কি বলব--- প্রতিষ্ঠান এটা আমাকে শিখিয়েছে। অবশ্যই শিখায়নি। লোভে হউক রাজনৈতিক চাপে হউক আমি লেজুড়বৃত্তি করে থাকলে আমার বিচার হবে। আমার প্রশিক্ষণ প্রণোদনায় ভুল ছিল না। বাহিনী আমাকে অপরাধ করতে শিখিয়ে দেয়নি। আমি আমার প্রতিষ্ঠানের শেখানো মন্ত্রের বাহিরে গিয়ে কাজ করে থাকলে তার দায় আমাকেই নিতে হবে। আমরা যেন চেষ্টা করি শুধু সশস্ত্র বাহিনী নয় যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে ---যারা দেশের কাজে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত সেই প্রতিষ্ঠানকে যেন দোষারোপ না করি।’
অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিচার কোন আইনে হবে--সেনা আইন নাকি আইসিটি আইনে-এ নিয়ে কোন সাংঘর্ষিক অবস্থান আছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেছেন ‘আইসিটি আইন বনাম সেনা আইন- এটা না বলাই ভালো মুখোমুখি বিষয়টি না বলাই ভালো।
তিনি আরও বলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-আইসিটি আইনে বলা আছে যে ---অভিযোগ পত্রে নাম উঠলে চাকরি চলে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো অভিযুক্ত কি আসলে সাজাপ্রাপ্ত? সাজা হওয়ার পরও কিন্তু আপিলের সুযোগ থাকে। আপিল নিষ্পত্তির পর যদি সাজা বহাল থাকে তখনই তাকে সাজাপ্রাপ্ত বলা যাবে। আবার দেখা যাবে কেউ খালাস পেয়ে গেলেন----তাহলে আইন অনুযায়ী তিনি আবার সার্ভিসে ফিরে যেতে পারবেন।
মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন অনেকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে।কেউ মানসিকচাপে অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন, কেউ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন---- এসব মানবাধিকার লঙ্গন নয়, এই প্রশ্ন ও আছে।
সেনাবাহিনীতে চলমান নিয়মের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন,’ কোন কর্মকর্তার বিচার চলাকালীন সময়ে তার বয়স শেষ হয়ে গেলে তিনি অবসরে যাবেন। তখন খালাস পেলেও তাকে চাকরিতে ফেরানো যাবে না। তাই ট্রাইব্যুনাল আইনের বিষয়ে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চাইব। চার্জসিটে নাম থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সেনা আাইনে কোন পদক্ষেপ নেওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন গুম সংক্রান্ত একটি জাতীয় কমিশন আছে যাদের আমরা সর্বত্মক সহযোগিতা করে আসছি। সেনাবাহিনী আলাদা করে কোন কমিশন করিনি। বাংলাদেশ আর্মি ন্যায়বিচারের প্রতি অটল----যা ন্যায়সঙ্গত হবে আর্মি তার পক্ষেই থাকবে।
তিনি আরও বলেন গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। আমাদের কিছু কর্মকর্তা হয়তো ব্যাব বা ডিজিএফআইয় এ ছিলেন, কিন্তু তখন তারা আর্মিতে সক্রিয় দায়িত্বে ছিলেন না।ব্যাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজিএফআই প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে। বর্তমানে এটি উপদেষ্টা পরিষদের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।’
অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার সামরিক আইনে করা যেতে পারে কিনা--- সে প্রশ্ন রয়েছে। এ বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ সাজ্জাদ সিদ্দিক (সেনাবাহিনীর সাবেক জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল) বলেন সেনা আইনের ৫৭(২)ধারা অনুসারে গুমের সঙ্গে যেহেতু খুনের বিষয়টি ও জড়িত সে কারণে অভিযুক্তদের বিচার সামরিক আদালতে করা যাবে না। মুহাম্মদ সাজ্জাদ সিদ্দিক তার পেজবুক পেজে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।
সেনাকর্মকর্তাদের বিচারের ব্যাপারে এরি মধ্যে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মতবাদ ব্যক্ত করেছেন যেমনটি বিএনপির বক্তব্যে এসেছে --বিএনপি যুগ্ন মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বিষয়টি নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরা হয়।উল্লেখ করেন বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল –‘বিএনপি বিশ্বাস করে, দেশের গণতন্ত্র মানবাধিকার ও সেনাবাহিনীর পেশাদারি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট অপরাধের সুষ্ঠু ও নির্মোহ বিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায়বিচার শুধু অতীতের ঘটনাগুলোর শাস্তির নিশ্চয়তা দেয় না বরং ভবিষ্যতে যেন কেউ এমন অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি না ঘটায় সেই নিশ্চয়তা দেয়।আইন ও মানবাধিকারের প্রতি পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধা রেখেই হতে পারে একটি শান্তিপূর্ণ জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তি।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কিছু চিহ্নিত ব্যক্তির দায় যেমন কোন প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপানো উচিত নয়, তেমনি তাদের অপকর্মের কারণে সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ও অনুচিত। একজন মানুষের কাজের ভালো মন্দের দায় বিশেষত গুরুতর অপরাধের শাস্তি একান্তই তার নিজের।’
জামায়াত যা বলেছে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে পেজে লিখেছেন, ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে নিয়ে বাংলাদেশের জনগন গর্বিত থাকতে চান। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাহিনীর কিছু সদস্য দেশের বিদ্যমান আইন ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছেন। ফ্যাসিষ্ট সরকারের প্ররোচনায় প্রতিপক্ষ নিধনের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা অন্ধ সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। ফলে গুম ও খুনের একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সুনির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির অপরাধের কারণে পুরো প্রতিষ্ঠানকে কলংকিত হতে দেওয়া যায় না। অপরাধের দায় কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপরই বর্তাবে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী এই বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা করার ঘোষণা দিয়েছে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হেফাজতে নিয়েছে। আমরা সেনাবাহিনীর এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।’
দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষা করা ও দেশের ক্লান্তি লগ্নে সবার আগে এগিয়ে আসা, জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে অবদান রাখা আমরা কোনটাই তাদের অবদানকে খাটো করে দেখতে চাই না। বিচারের নামে মিডিয়া ট্রায়াল যা কিছু বলি না কেন সেনাবাহিনী আমাদের গর্বের।ফ্যাসিবাদী সরকারের অবসানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কম নয় বরং অগ্রনী ভূমিকা ছিল বলেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এসেছে। বর্তমানে আমাদের সেনাবাহিনী দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে মাঠে অতন্দ্র প্রহরীর মত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে যারা অপরাধী তাদের বিচার হবে এটা স্বাভাবিক কিন্তু বিচারের নামে যেন প্রহসন না হয় সেইদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।দেশে আইনের শাষন প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে নিরপেক্ষভাবে বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদন করা লক্ষ্যে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে যেন অযথা মন্তব্য বা বিতর্কে আমরা না জড়াই এটাই হবে নাগরিক হিসেবে সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক : কলামিস্ট ও ব্যাংকার।
নকল আর ভেজালের সর্বগ্রাসী থাবা আজ আমাদের সমাজদেহের প্রতিটি পরতে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, মানুষের জীবন ও জীবিকা উভয়ই আজ এক গভীর সংকটের মুখে। একুশ শতকের এই তথাকথিত আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়েও যখন খাদ্য থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী, এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজালের রমরমা কারবার চলে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, জাতিগতভাবে আমরা এক ভয়াবহ নৈতিক স্খলনের মধ্য দিয়ে চলেছি। এই ভেজাল সংস্কৃতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন করে না, বরং মানুষের স্বাস্থ্য, বিশ্বাস এবং সামাজিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়ে একটি জাতিকে নিঃস্বতার দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।
মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হলো নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা। কিন্তু বাজারে আজ যে খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায়, তার কতটুকুই বা নির্ভেজাল? কৃষিপণ্যে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ব্যবহার থেকে শুরু করে ফল পাকাতে কার্বাইড, মাছ তাজা রাখতে ফরমালিন, দুধে সাবান বা স্টার্চের মিশ্রণ, মসলায় ইটের গুঁড়ো, এই তালিকা যেন অন্তহীন। মুনাফা লাভের এক অন্ধ প্রতিযোগিতায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মানুষের জীবন নিয়ে নির্দ্বিধায় ছিনিমিনি খেলছে। এই ভেজাল খাবার খেয়ে মানুষ আপাতদৃষ্টিতে হয়তো পেট ভরাচ্ছে, কিন্তু বিনিময়ে তাদের শরীরকে ঠেলে দিচ্ছে দুরারোগ্য ব্যাধির দিকে। ক্যান্সার, কিডনি ফেইলিওর, লিভারের মারাত্মক সমস্যা এবং অন্যান্য জটিল রোগ আজ ঘরে ঘরে। আর এসব রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সাধারণ মানুষ তাদের সঞ্চয়, সম্পত্তি এমনকি ভিটেমাটিও হারাচ্ছে। একসময় যারা সচ্ছল ছিল, তারাও চিকিৎসার বিপুল ব্যয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। রোগভোগের শারীরিক কষ্টের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের যন্ত্রণা।
দীর্ঘমেয়াদে এই ভেজাল সংস্কৃতি একটি জাতিকে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত উভয় দিক থেকেই পঙ্গু করে দেয়। স্বাস্থ্যখাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে রোগ প্রতিরোধের পরিবর্তে রোগ নিরাময়ের দিকে। অথচ এই অর্থ যদি শিক্ষা, গবেষণা বা অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করা যেত, তবে দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধি আরও দ্রুত হতো। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা জাতির ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত। শিশুরা সঠিক পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাদের মেধা ও কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে দেশের মানবসম্পদকে দুর্বল করে দেবে। অর্থাৎ, ভেজাল চক্র কেবল বর্তমান প্রজন্মকে নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও নিঃস্ব করে দিচ্ছে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি বহুমুখী এবং সমন্বিত উদ্যোগ। প্রথমেই দরকার কঠোর আইনের প্রয়োগ এবং নিয়মিত মনিটরিং। ভেজালকারীদের জন্য দ্রুত বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অন্যরা এমন জঘন্য কাজ করার সাহস না পায়। আদালত এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোকে এক্ষেত্রে শূন্য সহনশীলতা নীতি অবলম্বন করতে হবে। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং বড় বড় ভেজাল কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের জনসম্মুখে নিয়ে আসতে হবে। শুধু জরিমানা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের মতো কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা সবাই যদি একযোগে এই ভেজালের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই, তবেই কেবল সম্ভব একটি সুস্থ ও নিরাপদ সমাজ গঠন করা। অন্যথায়, এই নকল ও ভেজালের সর্পিল চক্রের জালে আবদ্ধ হয়ে মানুষ তার অর্থ, স্বাস্থ্য এবং সর্বোপরি জীবনের শান্তি হারিয়ে কেবলই নিঃস্ব হতে থাকবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আর দেরি করা নয়, এখনই প্রয়োজন জাতীয় চেতনার উন্মেষ এবং সম্মিলিত প্রতিরোধের মাধ্যমে এই ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিকে চিরতরে নির্মূল করা। এই সংগ্রাম কেবল অর্থনৈতিক বা আইনি নয়, এটি মূলত মানবতা ও নৈতিকতার পক্ষে এক ঐতিহাসিক লড়াই। এই লড়াইয়ে জয়ী না হলে আমাদের আগামী প্রজন্ম এক অসুস্থ, প্রতারণাপূর্ণ এবং নিঃস্ব সমাজে বড় হবে, যা কারও কাম্য হতে পারে না। এই ভয়াবহ জাল থেকে মুক্তিই এনে দিতে পারে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক মর্যাদা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
জীবনের প্রতিটি স্তরই মূল্যবান এবং চ্যলেঞ্জিং।
প্রতিটা পর্বেরই আলাদা আলাদা চাহিদা আলাদা প্রাপ্তি। কোনটার সাথে কোনটার সাযুজ্যের সূত্র থাকলেও মোটা দাগে ফাঁরাক বিস্তর।
বার্ধক্য বা প্রবীণকাল মূল্যবান তো বটেই, এটা শুধু ভাগ্যবানরাই ভোগ করতে পারেন। তারা বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে বলে প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠে প্রাকৃতিকভাবেই।
সমাজ এই প্রাজ্ঞতাকে গ্রহণ করে নানাভাবে।
প্রবীনের অভিজ্ঞতা জ্ঞান এবং নবীনের কর্মক্ষমতা একত্রে গড়ে তোলে সমৃদ্ধ সমাজ।
প্রবীনের অভিজ্ঞতা জ্ঞান কাজে লাগলেও একসময় প্রবীণ হয়ে পরে অবহেলিত।
নতুন প্রভাতের সূর্য আর সন্ধ্যায় অস্তমিত সূর্যের রূপ রঙ ভিন্ন আবহ ভিন্ন, প্রাকৃতিকভাবে এর আবেদন গুরুত্বপূর্ণ হলেও জীবনের সূর্য অস্তমিত সময়ে এর গুরুত্ব অবহেলিত। অথচ এটা হবার কথা নয়।
তবে সবার ক্ষেত্রে এই অবস্থাও ভিন্ন হয়।
দেশের জনসংখ্যার দর্শণীয় একটা অংশ প্রবীণ অতি প্রবীণ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মোট জনসংখ্যা প্রায় এক চতুর্থাংশ প্রবীণ। গড় আয়ুর বৃদ্ধির সাথে সাথে এই সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়।
প্রবীণ জীবনের জন্য আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রবীণদের কোনো প্রস্তুতি থাকে না বা থাকার কোন উপায়ও থাকে না।
প্রবীণদের মধ্যে সবক্ষেত্রের অবস্থা অবস্থান এক নয়।
সরকারি চাকরিজীবিদের কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে পেনশন থাকে।
মোটামুটি কেউ কেউ বাড়িঘর তৈরি করে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পরে। ধনী প্রবীণদের সঞ্চয় থাকে। নিম্নবিত্ত আর বিত্তহীন প্রবীনরাই সবচেয়ে দুর্বিষহ অবহেলিত প্রবীণ জীবনযাপন করে।
সরকারি ভাতা আছে বটে সেটা এতোই অপ্রতুল এবং সব সরকারের আমলেই সেটা ভোট বিবেচনায় ব্যবহৃত হতো। নানা অনিয়মে দুষ্ট ছিল। তবুও মন্দের ভালো যে ভাতা প্রাপ্ত প্রবীণরা পরিবারে কিছুটা সম্মান পেত।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবহেলিত মোট জনগণ এখানে আলাদা করে প্রবীণদের কথা কি আর বলা যায়।
খাদ্য বস্তু বাসস্থান চিকিৎসার সংকটের সাথে বিনোদন সম্মান সংকট প্রবীণদের প্রয়োজন এটা তো জোর দিয়েই বলা যায়।
শুধুমাত্র সন্তানদের উপর নির্ভরশীল প্রবীণরা সংসার ও সমাজের জন্যও বোঝা হয়ে যায় কখনো কখনো।
বৃদ্ধাশম তৈরি হয়েছে সরকারি বেসরকারি এবং মানবিক বিবেচনায়।
কোন কোন বৃদ্ধাশ্রম সংগত কারণেই ব্যয়বহুল হতে হয়। স্বাস্থ্যকর খাবার উপযুক্ত চিকিৎসা এবং যথোপযুক্ত সেবার মূল্য এরসাথে ধরা থাকে।
এটা একমাত্র ধনীদের জন্য।
এগুলোর ব্যবসায়িকভাবেই তৈরি হয়েছে এবং যার প্রয়োজন সেই পরিবারই গ্রহণ করে। মূলকথা পরিবারের প্রবীণজন যেন সুস্থ ও সুন্দর সেবায় থাকে। তারাও নিশ্চিতভাবে দেশবিদেশ তাদের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করতে পারে।
মানবিকভাবে তৈরি বৃদ্ধাশ্রমগুলোর খাদ্য পোশাক চিকিৎসা বাসস্থান কিছুটা নিম্নমানের এটা বলাই বাহুল্য। তবুও আশ্রয় খাদ্য জুটছে প্রবীণদের এটাও গুরুত্বপূর্ণ।
গ্রামীণ প্রবীণদের জীবন অনেক সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত। দুর্গম এলাকায় না আছে রাস্তাঘাট না আছে চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র পারিবারিক আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক। নিজের জন্য তৈরি ঘরটাও অন্যদের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়।
অধিক সন্তানের মুখেই আহার জোটানো প্রশ্নের সম্মুখীন সেখানে প্রবীণের চাহিদা পূরণ সাধ্যের বাইরে । তবু তো বাঁচে প্রবীণ চিকিৎসাবিহীন খাদ্যহীন আশ্রয়হীন। ধুঁকে ধুঁকে চলে জীবন।
যে কারণেই অপ্রতুল ভাতার একটা ঠেকা দেয়া আছে সেটা কার্যহীন।
প্রবীণদের জন্য ভাতা নয় তারা কাজ করতে চায় খাদ্যের জন্য চিকিৎসার জন্য সম্মানের জন্যও।
এমত অবস্থায় তাদের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মের ব্যবস্থা গড়ে তাদের জীবন মান উন্নত করতে হবে।
তাদের জন্য উপযুক্ত কর্ম হলো গরু ছাগল হাঁস মুরগি লালন পালন শাক সবজি ফলানো, বাঁশবেতের কাজ দড়ি তৈরি সহ এমন অনেক কিছু তারা করতে পারে, এতে সমাজে পরিবারে তারা অন্যের গলগ্রহ হবে না। হারিয়ে যাওয়া কুটিরশিল্পের বিকাশ হতে পারে।
গ্রামীণ প্রবীণদের জন্য স্পেশাল খাবারের তেমন প্রয়োজন হয় না।
প্রখর সূর্যালোক থেকেই পায় ভিটামিন ডি, লতাপাতা কুড়িয়ে খাদ্য থেকেই শরীরের প্রয়োজনীয় মিনারেল ভিটামিন সংগ্রহ করে। নিজের পালা মুরগী থেকে সপ্তাহে দুই তিনটি ডিম মাসে একবার মুরগী ঝোলে ভাত এগুলো খেয়েই তারা বছরের পর বছর পারি দিচ্ছে জীবন তরী।
এর জন্য চাই সমন্বিত পরিকল্পনা। খুব বড় বাজেটও নয় সুষ্ঠ বাস্তবায়ন হলে গ্রামীণ প্রবীণদের জন্য সুবিধা জনক জীবন এবং দেশের জন্য সমৃদ্ধ সমাজ হতে পারে।
আমি গ্রামীণ প্রবীণদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি শুধু সঠিক মমতাময় পরিকল্পনা এবং সুস্ঠ বাস্তবায়নের অভাবে এটা হচ্ছে না।
গ্রামে ভিক্ষা বৃত্তিকে এবং চেয়েচিন্তে চলাকে খুব ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ চোখে দেখা হয়।
অতি প্রবীণও ছাগলের জন্য ঘাস কাটে মুরগীর জন্য দানাপানির ব্যবস্থা করে।
গাছের অনেক ফল তারা পোলাপইনা খাবার বলে এড়িয়ে যায়, এটার প্রয়োজন বুঝতে পারে না।
এ বিষয়ে কাউন্সিলিং করালে কোন ফলের কোন কার্যকারিতা বোঝাতে হবে।
কর্মের হাত সম্মানের হাত। ভাতার চেয়ে জরুরি যথোপযুক্ত কর্ম।
‘হাসি আনন্দের সাথে আসুক বয়সের রেখা’
উইলিয়াম সেক্সপিয়ার যথার্থই বলেছেন।
কর্ম থাকলে তার কিছুটা আয় থাকবে তখন জীবনের অপ্রাপ্তিগুলো প্রকট আর প্রখর হয়ে ধরা দেবে না প্রবীণের কাছে, কঠিনকেও সহজ করে মেনে ও মনে নিতে চাইবে।
তারা দেশের অর্থনীতির এক অদৃশ্য নায়ক। দিনরাতের পরিশ্রম, একাকীত্ব, দূরদেশের কঠিন জীবন, সবকিছুকেই সহ্য করে তারা রেমিট্যান্স পাঠায়, পরিবারকে বাঁচায়, দেশের চাকা ঘুরিয়ে রাখে। কিন্তু দেশে ফিরে এসে তাঁর কী পান? প্রায়শই-অবহেলা, উপেক্ষা, সমাজের অসহযোগিতা। প্রশ্ন হলো প্রবাসী শ্রমিকরা কি শুধুই টাকা আনার যন্ত্র? তাদের জন্য কি আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজে কোনো সম্মান নেই? যারা বিদেশে ‘গাধার মতো’ কাজ করে দেশের জন্য অর্থ উপার্জন করে, তাদের অবদানকে আমরা কতটা মূল্যায়ন করি, তা বিবেচনা করা উচিত। ঘর ফিরলেও অনেকে পান না নিরাপদ আশ্রয়, পান না মানসিক শান্তি, প্রায়শই তারা রাষ্ট্রীয় বৈষম্যেরও শিকার হন। এই বাস্তবতা আমাদের সামনে তুলে ধরে একটি প্রশ্ন: দেশের উন্নয়নে যারা অবদান রাখে, তারা কি শুধুই একটি পরিসংখ্যানের সংখ্যা, নাকি তারা আমাদের সমাজের মর্যাদাপূর্ণ অংশ? প্রবাসীদের কষ্ট, ত্যাগ ও অবদানকে সম্মান দিতে না পারা, আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। আমার এই লেখা পাঠককে ভাবতে বাধ্য করবে- কেন আমরা সেই হাতগুলোর কষ্ট ও অবদানকে শুধুই হিসাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি, যখন সত্যিকার সম্মান দেওয়া উচিত তাদের মানবিক মর্যাদার সাথে?
প্রবাসীদের পরিশ্রম, ত্যাগ ও বঞ্চনার গল্পগুলো আমাদের ভাবিয়ে তোলে। আমাদের সচেতন হতে হবে, যাতে তারা শুধু রেমিট্যান্সের যন্ত্র হয়ে না থাকেন, বরং যথাযথ সম্মান পান। প্রবাসীরা উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছাড়েন, কিন্তু তাদের বাস্তবতা ভয়াবহ। প্রতিদিন ১২-১৬ ঘণ্টা খেটে মাটির সঙ্গে মিশে থাকেন। নির্মাণশ্রমিক, কারখানা শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ড্রাইভার কিংবা অফিস সহকারী—যে কাজই হোক না কেন, অধিকাংশই শারীরিক শ্রমের কাজ করেন। আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র—যেখানেই থাকুন না কেন, প্রবাসীদের জীবন সংগ্রামের এক ভয়ানক চিত্র। অনেকেই কর্মস্থলে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হন। শ্রম আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা, দূতাবাসগুলোর উদাসীনতা এবং বিদেশি নিয়োগদাতাদের শোষণের কারণে ন্যায্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হন। তবুও তারা সব সহ্য করেন, কারণ পরিবার বাঁচাতে হবে, স্বজনদের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।
পরিবারের সুখের জন্যই তারা সর্বস্ব ত্যাগ করেন। একজন প্রবাসী বিদেশে যান পরিবারের জন্য। তিনি সংসারের প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে ওঠেন। বাবার চিকিৎসা, ভাই-বোনের পড়াশোনা, ঘরবাড়ির উন্নয়ন—সব খরচ একাই বহন করেন। ঈদ, পূজা কিংবা বিশেষ দিনে দেশে দান-অনুদান পাঠিয়ে সবাইকে খুশি রাখেন। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, তাদের আত্মত্যাগকে পরিবার অনেক সময় স্বাভাবিকভাবে নেয়। একজন প্রবাসী যতই অর্থ পাঠান, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা খুব কমই দেখানো হয়। অনেকে শেষ বয়সে এসে দেখেন, তার নিজের জন্য কিছুই নেই। সন্তানরা বড় হয়ে তাকে ভুলে যায়, স্ত্রী-বাবা-মাও তাকে বোঝা মনে করেন।
দেশে ফিরে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ:
প্রবাসীরা যৌবন ও শ্রম বিদেশে ব্যয় করেন। কিন্তু যখন দেশে ফেরেন, তখন আর কাজের উপযুক্ত থাকেন না। চাকরির সুযোগ সীমিত, ব্যবসা করতে গেলে পুঁজি থাকে না, ফলে অনেকে হতাশায় ভোগেন। দেশে ফিরলে পরিবারও আগের মতো যত্নশীল থাকে না। তিনি তখন আর অর্থের যোগানদাতা নন, বরং বোঝা হয়ে যান। সমাজেও তখন তার গুরুত্ব কমে যায়। অথচ বিদেশে থাকাকালে তিনি ছিলেন পরিবারের ‘হিরো’।
রেমিট্যান্সে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি প্রবাসীদের অবদান নতুন উচ্চতায়:
একজন প্রবাসী দেশের জন্য জীবনের সেরা সময়টা বিদেশে কাটান। কিন্তু দেশে ফেরার সময় বিমানবন্দরে তার যে অভিজ্ঞতা হয়, তা অপমানজনক। লাগেজ তল্লাশির নামে হয়রানি। কাস্টমস কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার। ঘুষ না দিলে অতিরিক্ত ফি আরোপ। অপরাধীদের মতো জিজ্ঞাসাবাদ। বিদেশে বছরের পর বছর কষ্ট করে টাকা এনে দেশের ব্যাংকে জমা করেন, অথচ দেশে ফেরার সময় তার সঙ্গে এমন আচরণ করা হয় যেন তিনি অপরাধী! সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে প্রবাসীরা সম্মানজনক অভিজ্ঞতা পান।
প্রবাসীদের জন্য রাষ্ট্রের করণীয়:
কূটনৈতিকভাবে প্রবাসীদের অধিকার রক্ষা করা। পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র সহজলভ্য করা। বিদেশে মৃত্যুবরণকারী প্রবাসীদের মরদেহ দেশে আনার সহজ ব্যবস্থা করা। ব্যাংকিং সুবিধা বাড়ানো ও বিনিয়োগে প্রণোদনা দেওয়া। রাষ্ট্র প্রবাসীদের জন্য আর যা করতে পারে।
১. প্রবাসীদের জন্য আইনি সহায়তা :
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে যান। তবে অনেকেই আইনি জটিলতায় পড়েন, বিশেষ করে শ্রমিকরা। বিদেশে কাজের পরিবেশ, চুক্তিভঙ্গ, বেতন না পাওয়া, নির্যাতন এবং অবৈধ অভিবাসনের কারণে তারা নানা সমস্যায় পড়েন। তাই দেশে এবং বিদেশে তাদের জন্য শক্তিশালী আইনি সহায়তা ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বিএমইটি (বাংলাদেশ ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং ব্যুরো) শ্রমিকদের আইনগত সহায়তা দিতে পারে। তবে বাস্তবে অনেক শ্রমিক প্রতারিত হয়, কারণ- ১. মধ্যস্থতাকারী (দালাল) ব্যবস্থার অপব্যবহার ২. স্পষ্ট আইনি পরামর্শের অভাব ৩. শ্রমিকদের আইন বিষয়ে অসচেতনতা।
সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে প্রবাসী আইন সহায়তা কেন্দ্র তৈরি করা হলে শ্রমিকরা দেশে থাকতেই প্রয়োজনীয় আইনি দিকনির্দেশনা পেতে পারেন।
বিদেশে আইনি সহায়তা ব্যবস্থা: বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর আইনি শাখা থাকলেও অনেক সময় তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। তাই প্রতিটি দূতাবাসে শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করতে হবে। ২৪/৭ কল সাপোর্ট লাইন চালু করতে হবে, যেখানে শ্রমিকরা যেকোনো সমস্যায় ফোন করতে পারবেন। প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড গঠন করে প্রতিটি দেশে শ্রমিকদের আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা দরকার। প্রবাসী শ্রমিকদের আইনি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে তাদের শোষণ বন্ধ হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
প্রবাসীদের জন্য রাষ্ট্রীয় পেনশন ব্যবস্থা:
প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা বিদেশে কঠোর পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠান, যা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখে। কিন্তু অনেক প্রবাসী কর্মক্ষম সময় শেষে দেশে ফিরে আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন হন, কারণ তাদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট পেনশন ব্যবস্থা নেই।
একটি রাষ্ট্রীয় পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হলে প্রবাসীরা প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সরকার-নির্ধারিত তহবিলে জমা রাখতে পারবেন। দীর্ঘমেয়াদি এই সঞ্চয় পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা কর্মক্ষম সময় শেষে নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছালে মাসিক পেনশন সুবিধা পাবেন। এটি তাদের বার্ধক্যে আর্থিক নিশ্চয়তা দেবে এবং পরিবারকে সহায়তা করবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় একটি স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য পেনশন তহবিল গঠন করা দরকার। এ ধরনের একটি ব্যবস্থা চালু হলে অনেক প্রবাসী আগ্রহী হবেন এবং বিদেশে কর্মরতদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ হবে।
প্রবাসী কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন:
প্রবাসীদের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করা জরুরি। প্রবাসীরা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হন—কখনো অর্থনৈতিক সংকট, কখনো দুর্ঘটনা, কখনো আইনি জটিলতা বা অসুস্থতা। এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় একটি কল্যাণ ট্রাস্ট কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এই ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রবাসীরা নির্দিষ্ট হারে অর্থ জমা দিতে পারেন, যা পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা হিসেবে বিতরণ করা হবে। যারা আর্থিক সংকটে পড়বেন বা কোনো দুর্ঘটনার শিকার হবেন, তারা এই ট্রাস্ট থেকে অনুদান পেতে পারেন। এছাড়া, দেশে ফেরার পর যদি কোনো প্রবাসী চরম অর্থসংকটে পড়েন, তাহলে এই তহবিল থেকে তাকে সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। এই কল্যাণ ট্রাস্ট সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোগের মাধ্যমে পরিচালনা করা হলে এটি আরও কার্যকর হতে পারে। স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে এটি প্রবাসীদের জন্য এক অনন্য সহায়তা হতে পারে।
পরিবারের দায়িত্ব:
প্রবাসীদের পরিশ্রম শুধু পরিবারের জন্যই নয়, দেশের জন্যও। তারা পরিবারকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সার্বিক কল্যাণের দিকেও নজর দেওয়া জরুরি। পরিবারের সদস্যদের উচিত: ১. অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা: প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহারের জন্য পরিকল্পিত বাজেট তৈরি করা উচিত। শুধু খরচ নয়, কিছু অর্থ সঞ্চয় করা ও বিনিয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে ভবিষ্যতে তারা দেশে ফিরে টিকে থাকার সুযোগ পাবেন। মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া: দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার ফলে অনেকে বিষণ্নতায় ভোগেন। তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া ও পরিবারের সিদ্ধান্তে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন: অনেক সময় দেখা যায়, পরিবারের সদস্যরা শুধু অর্থ পাঠানোর দিকেই মনোযোগ দেন, কিন্তু তাদের আবেগ-অনুভূতিকে তেমন গুরুত্ব দেন না। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। পরিবারের উচিত তাদের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করা। দেশে ফেরার পর পাশে থাকা: দীর্ঘ প্রবাস জীবনের পর দেশে ফিরে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হতে পারে। পরিবারকে উচিত তাদের পুনর্বাসনে সাহায্য করা, যাতে তারা আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন।
সমাজের দায়িত্ব:
প্রবাসীরা দেশের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেন, সমাজের উচিত তা যথাযথভাবে স্বীকার করা এবং তাদের যথোপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া। সমাজের সদস্যদের উচিত সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। প্রবাসীরা শুধুমাত্র নিজেদের জন্য নয়, দেশের জন্যও পরিশ্রম করেন। তাদের অবদানকে সম্মান জানানো সমাজের কর্তব্য। প্রবাসীদের কষ্ট উপলব্ধি করা: অনেক সময় প্রবাসীদের জীবনকে আরামদায়ক মনে করা হয়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তারা পরিবার থেকে দূরে থেকে, প্রতিকূল আবহাওয়া ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেন। এই বিষয়গুলো সমাজের বোঝা উচিত।
দেশে ফেরার পর অবহেলা না করা: অনেক প্রবাসী দেশে ফেরার পর সমাজের অবহেলার শিকার হন। তাদের সামাজিক পুনর্বাসনে সহযোগিতা করা এবং তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। প্রবাসীদের জন্য নীতি-সহায়তা: সরকার ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রবাসীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, বিনিয়োগের সুযোগ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম নিশ্চিত করা উচিত।
উপসংহার:
প্রবাসীরা শুধু অর্থ উপার্জনের মেশিন নন। তারা আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা, দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু এই প্রবাসীরা শুধু অর্থ পাঠানোর মাধ্যম নয়, তারা আমাদের পরিবার ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের কষ্ট, আত্মত্যাগ ও সংগ্রামকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। পরিবার ও সমাজের প্রতি তাদের কিছু প্রত্যাশা থাকে, যা পূরণ করা আমাদেরই কর্তব্য। তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। সরকারকে তাদের অধিকার রক্ষায় কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে, পরিবারকে তাদের আত্মত্যাগের মূল্য দিতে হবে, সমাজকে তাদের সম্মান জানাতে হবে। একজন প্রবাসী যেন কেবল অর্থের উৎস হয়ে না থাকেন, বরং তিনি যেন স্বীকৃতি, ভালোবাসা ও মর্যাদা পান এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।
আমরা সাধারণ জনগণ এক স্থান থেকে অন্যস্থানে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য চলাফেরা করতে পছন্দ করি, আর এই যোগাযোগের সহজ পথ হলো সড়কপথ তাই সড়ক পথে চলি। এই পথ চলার মাঝে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক হলে ঢাকা সিলেট রোড, এই সড়কটি মূলত বাংলাদেশের জাতীয় মহাসড়ক যা রাজধানী ঢাকা এবং সিলেট বিভাগের সিলেট শহর অতিক্রম করেও তামাবিলকে সংযুক্ত করেছে, এবং নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ এ জেলাগুলোকে সংযুক্ত করেছে। এটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক নামে পরিচিত।
যা বর্তমানে বেহাল অবস্থায় রয়েছে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দ্রুত সংস্কার ও যাতায়াতের দুর্ভোগ দূর করার দাবিতে সিলেটে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে গত এক সপ্তাহ ধরে একের পর এক কর্মসূচি পালিত হচ্ছে, বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, টিভি টকশো ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা অব্যাহত আছ। একই দাবিতে সারাদেশে বিশেষ করে রাজধানী ও দেশের বাইরে অর্থাৎ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিলেটের লোকজন প্রতিবাদী কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন এবং পালন করে চলেছেন একের পর এক নতুন নতুন কর্মসূচিব। সম্প্রতি ঢাকাস্থ সিলেটবাসীদের নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে পালিত হয়েছে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দীর্ঘ মানববন্ধন। উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার জনগণ।
এই সড়কপথে চলাচলকারী জনগণের দুর্ভোগ এখন চরমে ও অবর্ননীয়, বিশেষ করে আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড পর্যন্ত পথটুকুতেই সবচেয়ে বড় বিপর্যয় পরিলক্ষিত হচ্ছে শাহাবাজপুর থেকে শাহাজাদপুর প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথই যেন গলার কাঁটা।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে ৬ লেনে উন্নীত করার একটি প্রকল্প চলমান আছে, কিন্তু এর কাজ অত্যান্ত ধীরগতিতে চলছে। প্রকল্পটি ‘এশিয়ান হাইওয়ে’র আদলে তৈরি করা হচ্ছে, যা ঢাকা ও সিলেট বিভাগের মধ্যে আন্তঃনগর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাবে। প্রকল্পের একটি অংশ, সিলেট ও তামাবিলের মধ্যে বিদ্যমান জাতীয় মহাসড়ক N2 কে উন্নত করা হবে।
যদিও প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে অনেক আগে। এখনো পুরো কাজ শেষ হয়নি এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হবে এমন নিশ্চয়তাও নেই ফলে বেড়েছে দুর্ভোগ। এই পথে চলাচলকারীদের যেখানে ছয় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হতো তা এখন লাগছে ১৬-২২ ঘণ্টা, এটা যেন নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে এখন সাধারণ
বিষয়ে পরিনত হয়েছে। অথচ বিষয়টি দেখার কেউ নাই, সমস্যটি বলার কোনো মুখ নাই, দুঃখ দুর্দশা লাঘবের কোন সুব্যবস্থা বা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার জায়গাটা যে কোথায় তাও জানেনা এই এলাকার চলাচলকারী কোনো সাধারণ জনগণ।
সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের নাজুক অবস্থার অবসানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন সিলেট বিভাগের আপামর স্থানীয় জনগণ ও সুশীল সমাজ একই সঙ্গে সিলেটের সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দাবি জানিয়েছেন সকলেই, সড়কপথের বেহাল অবস্থা হওয়ায় বিত্তশালীরা আকাশপথে ও সাধারণ মধ্যবিত্তরা রেলপথে চলাচল করছেন। সেই সুযোগে বেড়েছে টিকিট কালো হাজারীদের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, এই কালোবাজারি রোধের নামে আবার প্রশাসনের কোন কোন কর্তাব্যক্তি চাচ্ছেন ট্রেনে চলাচলের জন্য অবশ্যই জাতীয় পরিচয় পত্র বহন করতে হবে, একজনের এন আইডি দিয়ে অন্যজন ভ্রমণ করতে পারবেন না, এটা কতটুকু বাস্তবে পালিত হবে তা জানি না। যাত্রীদের কেউ কেউ আবার দাবি করেছেন অধিক ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হবে, দাবি জোরদার করার লক্ষ্যে দলেবলে রেল লাইনের উপর শুয়ে পরে ট্রেন বন্ধ করে দেবার হুমকি দিয়ে চলেছেন এবং দুই এক জায়গায় চেষ্টাও করেছেন যার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে।, ‘ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হলেও এটি আজ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে, জনভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।’
সড়কের বেহাল অবস্থার দ্রুত প্রতিকারের দাবি জানিয়ে গত ১২ অক্টোবর সিলেট নগরে এক ঘণ্টার প্রতীকী কর্মসূচি পালিত হয় ওইদিন নগরের দোকানপাট বন্ধ রাখা হয় এবং যানবাহন চলাচলে এক ঘণ্টার কর্মবিরতি পালিত হয়।
বিশেষ করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড় হয়ে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। তবে উন্নয়নকাজের ধীরগতির কারণে বেহাল অবস্থা এই সড়কের একেবারেই চলাচলের ও অনুপোযোগী, মহাসড়কটির বিভিন্ন স্থানে গর্তের কারণে যান চলাচলের কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই
গর্তে গাড়ি আটকে গিয়ে প্রায় সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজটের। এতে প্রতিনিয়ত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে চলাচলকারীদের। বেহাল ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নিয়ে কত কথাই না হচ্ছে তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন এখানে যে কিছু হচ্ছে না তা নয় , হচ্ছে তা অত্যান্ত্য অপ্রতুল এবং মন্থর গতিতে।
আশুগঞ্জ থেকে সরাইল—মাত্র সাড়ে ১১ কিলোমিটার সড়কপথের জন্য পুরো সিলেট বিভাগ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠে গেছে। ভারতীয় ঠিকাদার সময়মতো কাজ শেষ করেনি। স্বাভাবিক মেরামতও বন্ধ। ফলে খানাখন্দের কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের এই অংশে প্রতিদিনই যানজট, ভোগান্তি হচ্ছে।
এই ভোগান্তি লাঘবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরকে সময় বেঁধে দিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়।
আর কাজ তদারকির জন্য গঠন করা হয়েছে ১২ সদস্যের একটি কমিটি।
সড়ক পরিবহন সমন্ত্রণালয়
সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সরাইলে স্থাপন করা হয়েছে ক্যাম্প অফিস। এই ক্যাম্প অফিসে প্রকৌশলীদের অবস্থান করে সার্বক্ষণিক মেরামত ও নির্মাণকাজ তদারকির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মহাসড়কের কাজ ও সবশেষ পরিস্থিতি দেখতে গত বুধবার আশুগঞ্জ যান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি নিজেও এই পথ পাড়ি দিয়েছেন মোটর সাইকেলে চড়ে, যার ছবি ভাইরাল হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ও পত্রপত্রিকায়। মহাসড়কটির দূরবস্থা নিরসনে ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আমরাও আশা করবো শিগগিরই সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্যোগে এই পথের চলাচলকারী সকলের দুর্ভোগ লাঘব হবে। রাস্তা ভালো হবে, নিয়ম মতো স্বাচ্ছন্দ্যে সকল প্রকার যানবাহন চলবে সেই সাথে বর্তমানে চলাচলকারী আমাদের সকল শ্রেণির গাড়িচালক ভাইদেরকে একটু সচেতনতার সাথে গাড়ি চালানোর জন্য অনুরোধ করব, কারণ নিয়ম মেনে চললে এই পথে হয়তো এতটা কষ্ট করতে হবে না।
সূরা আহযাব, পর্ব ৩
অনুবাদ:
(৬) এই নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের চেয়েও ঘনিষ্টতর ও অগ্রগণ্য এবং তার স্ত্রীগণ তাদের মা। আর আল্লাহর বিধান অনুযায়ী (উত্তরাধিকারে) সাধারণ মুমিন ও মুহাজিরদের চেয়ে আত্মীয়-স্বজনরা একে অপরের বেশি নিকটতর, তবে যদি তোমরা বন্ধুবান্ধবের সাথে দয়ার আচরণ করতে চাও, করতে পার। এটা আল্লাহর কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। (৭) আর (স্মরণ কর,) যখন আমি অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম সকল নবীর নিকট থেকে, তোমার নিকট থেকে, এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মারইয়াম-পুত্র ঈসা থেকেও; আর তাদের নিকট থেকে গ্রহণ করেছিলাম মযবূত অঙ্গীকার, (৮) যাতে করে (কিয়ামতের দিন আল্লাহ) সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আর আল্লাহ কাফিরদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক আযাব প্রস্তুত করে রেখেছেন।
মর্ম ও শিক্ষা:
ইসলামে নবীর মর্যাদা ও গুরুত্ব:
আলোচ্য আয়াতে নবীর মর্যাদা ও গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। ইসলামী জীবনাদর্শের নবী ও রাসূলের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ আল্লাহ তাদেরকে সমস্ত মানবতার মধ্য থেকে নবুওয়তের জন্য নির্বাচন করেছেন। তাদের মাধ্যমেই আল্লাহ তার জীবনাদর্শ মানুষের নিকট পৌঁছে দেন। তাদের সম্মান যদি না দেয়া হয় এবং তাদের আনুগত্য যদি না করা হয়, তাহলে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে। সেহেতু কোরআনে বলা হয়েছে, হে মানুষ, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো। অর্থাৎ মর্যাদা ও সম্মানের দিক দিয়ে আল্লাহর পরেই রাসূলের স্থান। আল্লাহর আনুগত্য যেমন অপরিহার্য, তেমনি রাসূলের আনুগত্য অপরিহার্য।
মুহাম্মদ (স.) মুমিনদের নিজেদের প্রাণের চেয়েও অগ্রগণ্য :
আয়াতে বলা হয়েছে, মুমিনদের নিকট নবী মুহাম্মদ (স) তাদের নিজেদের জীবনের চেয়েও বেশি অগ্রগণ্য। কারণ নবী মুহাম্মদ (স) তাদের আদর্শিক নেতা। তিনি তাদের কল্যাণের দিকে খেয়াল রাখেন। মানুষ প্রবৃত্তির টানে এই দুনিয়ার জীবনে যা ইচ্ছা তা করতে পারে। প্রবৃত্তির আকর্ষণে মানুষের মন এমন কিছু চাইতে পারে, যা তার জন্য ক্ষতিকর। রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ এক্ষেত্রে তাকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। অর্থাৎ রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ তাকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ক্ষতি, কষ্ট ও দুর্ভোগ থেকে বাঁচায়। সুতরাং রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ প্রাণের চেয়ে অগ্রগণ্য, কারণ তার আদর্শ প্রাণ রক্ষা করে। পিতা যেমন সন্তানকে ক্ষতিকর বিষয় থেকে ফিরিয়ে রাখে, রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ তেমনি মানুষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
বৈষয়িক স্বার্থ থেকে আদর্শিক স্বার্থ অগ্রগণ্য
আখিরাতের বিবেচনায়ও রাসূল (স) ও তার আদর্শ মুমিনের নিজের প্রাণের চেয়ে অগ্রগণ্য। কারণ, মানুষের মন এমন কিছু কামনা করতে পারে, যা দুনিয়ার স্বাদ লাভে সহায়ক, কিন্তু আখিরাতে শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং বৈষয়িক স্বার্থ থেকে আদর্শিক স্বার্থ তথা রাসূলের আদর্শ অগ্রাধিকার পাবে। কারো বৈষয়িক স্বার্থ আর আদর্শিক বা দীনি স্বার্থ যদি সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে আদর্শিক স্বার্থই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। বলাবাহুল্য, রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শই দীনি স্বার্থ। কাজেই রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ যদি প্রাণের চেয়ে অগ্রণী হন, তাহলে নিজের বৈষয়িক স্বার্থ ত্যাগ করে আদর্শিক স্বার্থকেই গ্রহণ করা উচিত।
নবীর স্ত্রীগণ মায়ের মতো সম্মানিত:
রাসূল (স.) যদি পিতার মতো অথবা পিতার চেয়েও বেশি সম্মানিত হন, তাহলে মুহাম্মদ (স.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ হবেন মুমিনদের মায়ের মতো (আয়াত ৬)। মাকে যেমন সম্মান ও মর্যাদা দিতে হয়, মুহাম্মদ (স.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণকেও তেমনি বা তার চেয়ে বেশি সম্মান দিতে হবে। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই যে, নবী মুহাম্মদ (স.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ তার সাথে বসবাস করার দরুন পারিবারিক অসংখ্য মাসয়ালা তারা জানতেন। অন্যরা রাসূল (স.)-এর পবিত্র স্ত্রীদের কাছ থেকেই জেনে নিতেন। কারণ অনেক সময় এমন বিষয়ের প্রশ্ন থাকতো, যা রাসূল (স.)-কে জিজ্ঞেস করতে তারা লজ্জা পেতেন। মুহাম্মদ (স.)-এর মৃত্যুর পর তার পবিত্র স্ত্রীগণকেও বিয়ে করা যাবে না, যেমন মাকে বিয়ে করা জায়েয নয়। তবে অন্যান্য বিষয়ে মাতৃত্বের সম্পর্ক প্রযোজ্য নয়, যেমন তাদের মেয়ে বোন হয়ে যায় না, এবং তাদের বোন খালা হয়ে যায় না এবং তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির ওয়ারিশী অংশ পাওয়া যাবে না ইত্যাদি। যেমন যুবায়ের (রা.) মা আয়েশার বোন আসমাকে বিয়ে করেছিলেন। যদি রাসুল (স.)-এর স্ত্রীর বোন হওয়ার কারণে তিনি খালা হয়ে যেতেন তাহলে তাকে বিয়ে করা জায়েয হতো না।
ইসলামি ভ্রাতৃত্ব:
এখানে আনসার ও মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের চেয়ে নিকটাত্মীয়ের সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের প্রেক্ষাপটে ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের বিষয়টি উপলদ্ধি করা উচিত, যা ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের গভীরতা প্রকাশ করে। রাসূল (স.)-এর সাথে এবং তার পরে অনেক সাহাবী মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। তারা তাদের সহায়-সম্পদ আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে মক্কা থেকে মদীনায় যান খালি হাতে। রাসূল (স.) তখন একজন মুহাজিরের সাথে একজন আনসারের ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে দেন। সে বন্ধন এতো গভীর ছিল যে তারা একে অপরের উত্তরাধিকারী হতেন। এরপর যখন হিজরতকারীদের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন মদীনায় চলে আসে এবং স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে, তখন আলোচ্য আয়াত দ্বারা সে মাত্রার ভ্রাতৃত্ব রহিত হয়ে যায়। অর্থাৎ আনসার ও মুহাজিররা ভাই ভাই থাকে, কিন্তু একে অপরের উত্তরাধিকারী হওয়ার নিয়ম রহিত হয়ে যায়। আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, আনসার ও মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের চেয়ে আত্মীয়ের বন্ধন অধিকতর মজবুত। কাজেই আত্মীয় স্বজনই একে অপরের উত্তরাধিকারী হবে, এবং আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের কারণে আর কেউ কারো উত্তরাধিকারী হবে না।
রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দের অধিকার :
আলোচ্য আয়াতের বক্তব্য থেকে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়ের অধিকার সম্পর্কে বুঝা যায়। কোরআনে বারবার আত্মীয়ের অধিকার প্রদানের কথা বলা হয়েছে। আত্মীয়ের বিশেষ অধিকারের কথা কোরআনের আরেকটি বর্ণনা থেকে উপলদ্ধি করা যায়। আখিরাতে জান্নাতিরা তাদের পরিচিত জাহান্নামীদের প্রশ্ন করবে, দুনিয়াতে আমরা একসাথে ছিলাম, এখন তোমরা কি কারণে দোযখে গেলে? তখন জাহান্নামীরা একটা একটা করে সেসব কারণ বলবে এবং তাদের মধ্যে একটা কারণ হলো আত্মীয়ের সাথে ভালো ব্যবহার না করা এবং তাদের সাথে সুসম্পর্ক না রাখা। অর্থাৎ আত্মীয়ের সাথে সুসম্পর্ক না রাখা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ।
রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে উত্তরাধিকার বণ্টন:
ইসলামী জীবনাদর্শে মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টনের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেয়া হয়েছে। উত্তরাধিকার বণ্টন হবে আত্মীয়তার নৈকট্যের ভিত্তিতে। কোন্ আত্মীয় কতটুকু পাবে, তা বিস্তারিত বর্ণনা আছে, যা বাধ্যতামূলক। উত্তরাধীকারী তার নির্ধারিত অংশের বেশি পাবে না। তার জন্য বাড়তি কিছু ওসীয়ত করে যাওয়া নিষেধ। ওসীয়ত করা যাবে শুধু উত্তরাধিকারীর বাইরে, অন্যের জন্য, যার সর্বাধিক পরিমাণ হলো সম্পদের এক তৃতীয়াংশ। তৎকালীণ মদীনার আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের প্রেক্ষাপটে এই দাঁড়াল যে, তাদের কিছু ওসীয়ত করা যেতে পারে। তবে তা কখনো সম্পদের এক তৃতীয়াংশের বেশি হবে না। বাকীটুকু অবশ্যই কুরআনে নির্ধারিত বণ্টন নীতি অনুযায়ী নৈকট্যের ভিত্তিতে বণ্টিত হবে। আসলে এটা হলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে সুষম সম্পদ বণ্টনের একটি সুন্দর ব্যবস্থা, যা অন্য কোনো ধর্মে বা ব্যবস্থায় এভাবে নেই। কোন কোন ধর্মে শুধু পুত্র সন্তান উত্তরাধিকারী হয়। আর কোন ব্যবস্থায় উত্তরাধিকারী বণ্টনের ব্যবস্থাই নেই, বরং মৃত ব্যক্তি যাকে যতটুকু খুশি তাকে ওসিয়ত বা উইল করে দিতে পারে।
কিয়ামতের দিন নবীদের দায়িত্বের জবাবদিহিতা:
বলা হয়েছে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন সত্যবাদীদেরকে তাঁদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। এর একাধিক মর্ম হতে পারে। তন্মধ্যে একটি হলো, কিয়ামতের দিন আল্লাহ নবীদেরকে তাদের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। তাদের যে জীবন-ব্যবস্থা দেয়া হয়েছিল, তারা তা তাদের জাতির নিকট পৌঁছে দিয়েছেন কিনা, এ ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। আলোচ্য জবাবদিহিতার আরেকটি অর্থ হলো, আল্লাহ নবীদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, তাদের জাতি তাদের দাওয়াতে কেমন সাড়া দিয়েছিল। অর্থাৎ নবীগণকে তাদের জাতির সাক্ষ্য হিসাবে দাঁড় করানো হবে। তারা সাক্ষ্য দেবেন, কারা তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিল, আর কারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। এসব তথ্য সহকারে সাক্ষ্য দেওয়া তাদের জন্য কঠিন হওয়ার কথা, কিন্তু আল্লাহই তাঁদেরকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবেন।
নবীদের জিজ্ঞাসার মাধ্যমে বাতিলপন্থীদের ভ্রান্তি প্রমাণ করা:
খ্রিষ্টানসহ কোন কোন জাতি নবীগণকে প্রভু বা প্রভুপুত্র হিসাবে বিশ্বাস করে এবং উপাসনা করে। আল্লাহ কিয়ামতের দিন সংশ্লিষ্ট নবীদের জিজ্ঞেস করবেন, তারা কি তাদের জাতিকে এ দাওয়াত দিয়েছিলেন যে তারা তাদেরকে প্রভু বা প্রভুপুত্র হিসাবে গ্রহণ করুক এবং তাদের উপাসনা করুক। তখন নবীগণ নেতিবাচক উত্তর দিবেন। বলবেন, তারা তা কখনো করেন নি। যদি করে থাকেন, তাহলে আল্লাহই ভালো জানতেন। এভাবে নবীগণকে প্রশ্নের মাধ্যমে বাতিলপন্থিদের ভুল প্রমাণিত হবে।
এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকা। যান চলাচলে এই ধীরগতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের শহরে গতি কম। অন্যান্য দরিদ্র দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গতি কম গড়ে ২০ শতাংশ। নাগরিক গতির একটি নির্ধারক বড় রাস্তা। বড় রাস্তা ভিড় কমায় বিষয়টি এমন নয়, বরং বড় রাস্তা গতি বাড়ায়। দ্বিতীয়ত, শহরে বহু মানুষ কর্মক্ষেত্র, স্কুল ও বিনোদন কেন্দ্রের হাঁটার দূরত্বে বসবাস করে না। তারা দ্রুতগতির এবং বিশ্বস্ত যাতায়াত ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে চায়। আধুনিক মহানগরের প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে দ্রুতগতির যান্ত্রিক যান। জটিল উৎপাদন নেটওয়ার্ক ও বিচিত্র ভোগের বর্তমান শহরে হেঁটে যাতায়াতের চিন্তা মধ্যযুগীয়। তৃতীয়ত, পরিবার ও সরকার প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করে নগর যাতায়াতের ক্ষেত্রে। কিন্তু একটি শহর ভ্রমণ বা চলাফেরার জন্য কতটা সুন্দর, তা কমই জানা থাকে। নগর–পরিকল্পনাবিদেরা খুব কমই জানেন যে একই ধরনের শহরের তুলনায় তাদের শহরটি কতটা পিছিয়ে বা কেন পিছিয়ে। মানুষের চলাচল একটি জরুরি বিষয়। শহর গড়ে উঠেছে এ কারণে যে অল্প জায়গায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদনের সুবিধা থাকবে। মানুষ দ্রুত চলাচল করে সেই সুবিধা নিতে পারবে। ঢাকায় দ্রুত চলাচলের সুবিধা নেই। দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনার বদলে স্বল্পমেয়াদে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা এখানে করা হয়েছে। এখন বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা ছাড়া শুধু উন্নয়ন প্রকল্প দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। শহরে ছোট গাড়ি, রিকশা ও মোটরসাইকেল কমাতে হবে। তা না করে আমরা কাজ করছি উল্টো। এর ফলে বিপুল ব্যয়ে প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা যাচ্ছে না।
রাজধানীর যানজট পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না। সব সড়কেই এখন যানজট আগের মতোই। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোতে যানজটের ভয়াবহতা বেশি। কথা হলো- রাজধানীর এই নাগরিক দুর্ভোগ অনেকটাই কমে আসবে, এমন প্রত্যাশা ছিল সবার মধ্যে। এ সমস্যা সমাধানে গত দুই দশকে নানা পরিকল্পনা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যেগুলো বাস্তবায়নে আলোর মুখ দেখেছে তা দিয়ে কি প্রকৃত অর্থেই এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব? একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এমন প্রশ্ন যে কারও হতে পারে। তেমনি বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারীর দৃষ্টি এখন ঢাকার দিকে। তারা যখন এই শহরে আসা মাত্রই যানজটের ভোগান্তিতে পড়েন তখন উৎসাহে কিছুটা হলেও ধাক্কা লাগা স্বাভাবিক। এসব বিবেচনায় প্রশ্ন উঠতেই পারে, এটা কেমন শহর! যে শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় যানজটের কারণে বসে থাকতে হয়। সমস্যা সমাধানে শত ছাপিয়ে হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার প্রতিটি অংশ- সড়ক নির্মাণ, আইন প্রয়োগ, চালকের লাইসেন্স, যানবাহনের ফিটনেস, নগর-পরিকল্পনা, জরুরি সেবা, জনসচেতনতা- এই সবই বর্তমানে ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের হাতে দেওয়া আছে। কিন্তু কোনো সংস্থা এককভাবে এই বহুমুখী সমস্যাগুলোর সমাধান করার জন্য পর্যাপ্ত ক্ষমতা, অর্থায়ন বা সমন্বয়ের সুযোগ পায় না। বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার বড় সমস্যা হলো- অকার্যকর দায়িত্বের বিভাজন। বিআরটিএ ড্রাইভারদের লাইসেন্স দেয় এবং গাড়ি নিবন্ধন করে; কিন্তু তারা রাস্তায় আইন প্রয়োগ করতে পারে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে; কিন্তু সড়ক নকশা বা বাস রুট নির্ধারণে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। সিটি করপোরেশন রাস্তা সংস্কার ও ফুটপাত মেরামতের কাজ করে; কিন্তু গণপরিবহন পরিকল্পনা থেকে তারা প্রায়ই বাদ থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দুর্ঘটনার পর জরুরি সেবা বা ট্রমা কেয়ার সিস্টেমের কোনো অংশ নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও গণমাধ্যমকে এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সচেতনতা বা শিক্ষামূলক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এ অবস্থায় দুর্নীতি ও স্বার্থান্বেষী মহল সহজেই প্রভাব বিস্তার করে। মালিক সমিতি বা শ্রমিক সংগঠনের চাপ, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় আর ঘুষের সংস্কৃতি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে বারবার বিফল বা স্তিমিত করে। এর ফলে জনগণের জীবন ঝুঁকিতে থেকেও কার্যকর কোনো জবাবদিহি নেই।
এই মুহূর্তে ঢাকা শহরটাকে এক ধরনের নরকে পরিণত করেছে নতুন আপদ হিসেবে বিবেচিত ব্যাটারিচালিত রিকশা। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী শহর। এই শহরের সৌন্দর্য, সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, এই শহরের রাস্তায় নির্বিঘ্নে নিরাপদে চলাফেরা, এই শহরের আভিজাত্য, এই শহরের আন্তর্জাতিক মান- সব সবকিছুই ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা। একসময় এই ব্যাটারিচালিত রিকশা শহরের প্রধান সড়কে চলাচল করতে পারত না। কেবলমাত্র পাড়া-মহল্লার অলি-গলিতে চলাচল সীমাবদ্ধ ছিল। বিগত শেখ হাসিনার শাসনামলে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা চালক-মালিকরা মিলে আন্দোলন করে শহরের সব রাস্তায় এগুলোর অবাধ চলাচলের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করলেও তারা শহরের প্রধান সড়কে এই সব ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি পায়নি। তখন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল এদের চলাচল। কিন্তু শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চলা জুলাই আন্দোলনের সময় এই ব্যাটারিচালিত রিকশা কোনো আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে ঢাকা মহানগরীর সব রাস্তায় অবাধে চলাচল শুরু করে দেয়। তখন নিয়ম শৃঙ্খলা ছিল না দেশে। কেউ বাধা দেয়নি তাদের। কিন্তু সেই থেকে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা গেড়ে বসেছে যেন, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহরের সব প্রধান রাস্তা। এদের দাপটে রাস্তায় অন্যান্য সব যানবাহন ঠিকঠাক মতো চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। অদক্ষ, অপরিপক্ব, অনভিজ্ঞ, উৎশৃঙ্খল চালকের কারণে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। এইসব ব্যাটারিচালিত রিকশায় যারা যাত্রী হচ্ছেন তাদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় যাতায়াত করতে হচ্ছে। আজকাল পায়ে প্যাডেলচালিত রিকশা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে ওই আপদ ব্যাটারিচালিত রিকশা দোর্দণ্ড দাপটে। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই যেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না তাদের। এক ধরনের অসহায়ত্ব ভাব ফুটে উঠেছে নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়। সবাই দেখছেন, উপলব্ধি করছেন, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এই ব্যাটারিচালিত রিকশা অবাধে চলাচলের কারণে সৃষ্ট যানজট, যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ইত্যাদি। অথচ কেউই কিছু করতে পারছেন না। এর চলাচল শুধু পাড়া-মহল্লার অলি-গলিতে সীমাবদ্ধ থাকার কঠিন আইনের বিধান বলবৎ করার জোর দাবি জানাচ্ছি। এরা ট্যাক্স, ভ্যাট ছাড়া প্রধান সড়কগুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । একসময় পুরো রাস্তা যেন তাদের দখলে চলে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। তখন আর কিছু করার থাকবে না। বাংলাদেশ পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ যদি এদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা না নেয় একসময় আর ট্রাফিক পুলিশের প্রয়োজন হবে না রাস্তায়।
যত বড় কাঠামোই তৈরি করা হোক, তা সফল হবে না, যদি না আমাদের নাগরিক আচরণ বদলায়। বর্তমানে বাংলাদেশের রাস্তায় প্রভাবশালী মানেই জয়ী। লালবাতি মানা হয় না, অ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকে, পথচারী হয় বিপন্ন। একটি নতুন সড়ক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে পথচারীর অধিকার সংরক্ষিত হবে; অ্যাম্বুলেন্সকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে; শিশুরা নিরাপদে বাইসাইকেল চালাতে পারবে; বয়স্করা নিশ্চিন্তে ফুটপাতে হাঁটতে পারবে; এসব শুধু দুর্ঘটনা কমাবে না, নাগরিক জীবনে সহমর্মিতা ও আস্থাও ফিরিয়ে আনবে। রাষ্ট্রকে কখনো না কখনো ভাবতেই হয়, নগরের সড়ক এবং উন্মুক্ত স্থানগুলোয় নাগরিকদের কী দেওয়া উচিত অথবা সর্বসাধারণের এসব থেকে কী পাওয়ার কথা? আমরা তো আমাদের রাস্তাঘাটকে দৈনন্দিন অবিচার বা নৈরাজ্যের প্রতীক হয়ে থাকতে দিতে পারি না। কিন্তু এই সবই অর্থহীন হবে যদি আমরা বর্তমান বিশৃঙ্খলতার ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় থাকি। কারণ, দিন শেষে সড়ক ও যানজট আসল সমস্যা নয়- এসবের ব্যাপারে অবজ্ঞাই হলো মূল সমস্যা। এবং আমরা সবাই মিলে এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ বেছে নিতে পারি। এটি শুধু যানজট কিংবা সড়কের প্রশ্ন নয়, বিশ্বায়নের এই যুগে এটি আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রশ্ন। সিদ্ধান্ত এখন আমাদের হাতে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলামিস্ট।
পরিমিতিবোধ সবসময় সুখকর। সীমার বাইরে সবকিছু প্রত্যাশার অতীত। জল যেমন দুকূলের ভেতর দিয়ে বয়ে গেলে নদী হয়, কূল ছাপালে বন্যায় রূপ নেয়, একসময়ের শান্ত, সুদৃশ্য প্রিয় দরিয়া হয়ে ওঠে বেদনা-দায়ী, সর্বনাশী বানভাসী জলের উচ্ছ্বাস.. আগুনের ব্যাপারও তেমন। অল্পতাপে শীতের আরাম। বেশি শিখায় বন পুড়ে ছাই। সে হোক না মন কিংবা সঘন পাতার, বৃক্ষঘন বন। তবে অল্প, নিয়ন্ত্রিত আগুন-রূপী আলো অন্ধকারের বিপরীতে স্বচ্ছ-উদার।
কথায় আছে, “Keep a little fire burning, however small, however hidden.”(Cormac McCarthy)./ “The most powerful weapon on earth is the human soul on fire” (Ferdinand Foch / “One must never let the fire go out in one’s soul, but keep it burning.” (Vincent Van Gogh)| প্রেরণার আগুন প্রজ্জ্বলিত রাখা শুধু উচিতই নয়, আবশ্যকও। সেই উদ্দীপনার শিখা যত ছোট কিংবা যত গোপন হোক না কেন, তা জীবন্ত রাখা জরুরি। যে জিনিসে চলমানতা নেই, চঞ্চলতা যার স্বভাবের সংগে সামঞ্জস্য বয়ে আনে না, তাতে অবসন্ন সময়ের শেওলা জমে। থির পাথরের মতো পড়ে থাকে গহীন অরণ্যে কিংবা জানার বাইরে, সবার চোখের আড়ালে। এইকথা প্রযোজ্য হয়, ব্যক্তি-প্রতিভা থেকে নিয়ে পরিবার, সমাজ অথবা আরও বড় পরিসরে।
তবে সমস্যা হয় তখনই, যখন উৎসাহ-রূপ উত্তাপ রূপ নেয় সীমাহীন স্বার্থপরতায়। আত্মতুষ্টির অশান্ত আগ্রহে উপকারী উপাদানটিকে ব্যবহার করে ফেরে শোভন-সীমা না মনে রেখেই। চুলোর আগুন চালে নিয়ে আসে স্বার্থপরেরা। সম্প্রতি দেশে ধারাবাহিক আগুন-ঘটনা এবং জান ও মালের বিস্তর ক্ষতিতে কোনো অন্তর অক্ষত থাকতে পারে না। দুর্ঘটনা কারও মুখ চেয়ে আসে না। তবে যেসব ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত অশান্তি সৃষ্টির ইশারা মেলে, সেগুলো তদন্তের দাবি রাখে। চোখের দীপ্তি নিভে গিয়ে অপরাধীদের হৃদয়ে জ্বলতে থাকে সর্বনাশের শিখা। সেখানে তারা আপন-পর দেখে না। নিজ দেশের, নিজ জাতির মানুষ, কিংবা স্বদেশের সুরক্ষিত সম্পদ তাদের কাছে ছাই মনে হয়। বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ পরায়ণতায় ভুলে যায় মানুষ হিসেবে হিতকর কী কী করণীয় তাদের সৃষ্টি জগতের প্রতি। নিশ্চিত না জেনে, কাউকে সন্দেহবশত দোষারোপ করা সঠিক নয়। তবে ঘটনা-পরম্পরা ও প্রকৃতি আভাস দেয়, এ নিছক দুর্ঘটনা নাও হতে পারে। তখনই আসে, ব্যাপক তদন্ত ও কারণ অনুসন্ধানের।
একসময় দেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে ঘন ঘন আগুন লেগে যেত। কত যে নিরিহ শ্রম-প্রাণ নারী-পুরুষ পুড়ে মারা গিয়েছেন তার সঠিক খবর নেই। গুমোট পরিবেশ, বিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগ ব্যবস্থা, বিপদে-নিরাপদে কর্মচারীদের দ্রুত বের হয়ে আসার অপর্যাপ্ত ও অব্যবস্থা, ইত্যাদি কারণে গার্মেন্ট বা অন্যান্য মিল কারখানাগুলোতে আগুন লেগে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির খবর ছড়িয়ে পড়ত প্রায়ই। অনার্স প্রথম বর্ষের সময় ধানমন্ডি ভূতের গলিতে থাকাকালে, পাশেই দেখতাম, হামিদ গার্মেন্টে কীভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। সেখানে, নারীরাই কাজ করতেন বেশি। টিউব লাইটের আলোয়, নানা রঙের কাপড় খণ্ডের সংগে সংগে তাদের শ্রমজীর্ণ মুখমণ্ডলও চিক চিক করে উঠত ঘামে, উজ্জ্বল আগুনের শিখার মতো। সৌভাগ্য ও সুখের বিষয়, সেই স্থানে সবসময় সুন্দর, সাবলীল ও শালীন পরিবেশ দেখেছি। আগুন তাদের স্পর্শ করতে পারেনি।
মাটির বাড়ির খড়ের চালে আগুন ধরে যাওয়া একসময় সাধারণ দৃশ্য ছিল গ্রাম গ্রামান্তরে। বিশেষ করে রান্নাঘর থেকে শুরু হতো আগুন। চুলায় রান্না রেখে হয়তো মা দুধের শিশু ঘুম থেকে উঠে পড়ার কারণে, তাকে আনতে গিয়েছেন, বা আবার ঘুম পাড়াতে গিয়েছেন অন্য ঘরে, এদিকে পাটকাঠির ফেঁসো (পাটের ছাল ছুলে নেওয়ার পরে, পাটকাঠির গায়ে লেগে থাকা নরোম, ফোলা ফোলা পাট-সুতো, পাটের আঁশ বা সুতোর সূক্ষ্ম অংশ) বেয়ে চিলিক মেরে উঠে গিয়েছে আগুন চাল অবধি। অথবা খোলা উনুনের ফুলকি হাওয়ায় ভেসে খড়ের গাদায় গিয়ে পড়ে আগুনের উৎস হতো। কিংবা বালকেরা পাটকাঠির আগায় আগুন লাগিয়ে খেলার ছলে অগ্নিকাণ্ড ঘটাত। তখন পাড়ার লোকজন চিৎকার শোনে এগিয়ে আসত। যে যা হাতের কাছে পেত, তাতে পানি ভরে ছুঁড়ে দিত উপরে, আগুনের অস্থির দগ্ধ-লোলুপ জিহবার ওপরে। এ রকম অগ্নিকাণ্ড অপরাধহীন ও সত্যিকার দুর্ঘটনা। পরিস্থিতি ও নির্দোষ অসতর্কতার ফল। আর পাড়া প্রতিবেশীও দ্রুত ছুটে আসতেন বিপদ উদ্ধারে। কিন্তু, এমনও ইতিহাস আছে, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের চালে আগুন দিতে দ্বিধা করত না কেউ কেউ। থানায় গিয়ে মামলা করে আসত। এগুলো, নিরেট সত্য ঘটনা কোনো কোনো স্থানের। কথা হলো, অনিচ্ছাকৃত, অসতর্কতাবশত, ও পরিস্থিতির শিকারে অগ্নি-ঘটনা এবং ইচ্ছাকৃত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পরিকল্পিত অগ্নি-সংযোগের মধ্যে মিল হতে পারে না।
বৃষ্টির শীতল শান্ত আকাশে বজ্র আসে। এ এমন প্রচণ্ড শক্তিধর যে এর উৎসের এলাকায় যদি খুব ভারী প্রকাণ্ড লোহার বাক্সও এসে যায়, মুহূর্তে তা চ্যাপ্টা হয়ে যায়। এই বিদ্যুৎ আকাশে আকাশে ভেসে বেড়ালে মাটির ওপরের প্রাণী, আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। আমরা এর শব্দে, ক্রোধ-গর্জনে, আলোর চমকে ভীত হয়ে কান বন্ধ করব মাত্র। অনিষ্ট থেকে রেহাই পাবার মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকব। নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য ছুটব বড়জোর অঝোর বৃষ্টিতে পাতার স্নান দেখব। গর্জন ও আগুন বৃষ্টির জলের কুয়াশায় মিশে যাওয়ার পরে, আবারও ছড়া কাটতে কাটতে ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন করতে পারব। কিংবা, উঠোনে, নিজস্ব বৃষ্টির জল-সুতোয় বেঁধে নেব আমরা নিজেকে। উচ্ছল হাসিতে ভরে উঠবে আমাদের প্রিয় গৃহকোণ। মনে পড়ে, “you do not own the rain, or the trees, or the laws which pertain to them.” (Mary Oliver : Her Grave)
কিন্তু বিপত্তি তখন, যখন বোমার আকারে আগুন উড়ে আসে আকাশ থেকে। হিরোশিমা, নাগাসাকির কথা পৃথিবী জানে। হয়তো তখন শিশুরা ছিল ঘুমে বা স্কুলে, চাকরিজীবীরা পথে, অফিসে। বয়স্করা ফুলঘেরা বারান্দায় চায়ে মগ্ন। তখনই অবরুদ্ধ আগুন এসে ফেটে পড়ল জাপানের এই দুই জনপদে। কীরকম নিষ্ঠুরতা পোষণ করলে, এমন কাজ করা সম্ভবপর হয়! যে ব্যক্তি পারমানবিক বোমা ফেলছে, সে তো জানছে, এর পরিণতি। মুহূর্তে ঝলসে যাবে, মাটি, মানুষ, গাছপালা, আশেপাশের সবকিছু। কতটা কাল বিকলাংগ হয়ে জন্ম নিয়েছিল শিশুরা এই শহরে। তবু আমরা মানবতার কথা শুনি এইসব মানুষ-রূপীদের মুখে।
আকাশের উল্কা আমাদের দৃষ্টিতে আসে। এই উড়ন্ত আগুনের নদী-স্রোত পৃথিবীর কোথাও বয়ে গেলে সেখানে গভীর ক্ষত হয়। মাটির বুকে দীর্ঘ কলঙ্ক হয়ে দগ্ধতার দাগ এঁকে দেয়। কিছু উল্কা বা ধুমকেতু আকাশেই বিলীন হয়ে যায়। তখন তা আর আমাদের ক্ষতির কারণ হয় না। রাতের গভীরে ঝিকিমিকি তারকারাজিও আমাদের মুগ্ধ করে। তাদের গা আগুনে ভরা। অতিদূরে নিজের পথে তারা ক্রমধাবমান। এক নিরন্তর, নির্ধারিত পথে তাদের বিচরণ। আমাদের অতিআপন নিকট-আগুনের গোলক হলো সূর্য। সেও সারা অঙ্গে আগুন মেখে ঘুরে বেড়ায়। নিজের মতো করে। কখনো সুদীর্ঘ শিখা ছুঁড়ে মারে। তবে তা পৃথিবীর আাকাশে আসে না। আসে, তার প্রাণশক্তি আর প্রণোদনা। সূর্য দূর থেকেই ধরণীর প্রাণের চঞ্চলতার চিহ্ন আঁকে। সে জন্য তার অগ্নি-আশির্বাদের। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আামাদের পৃথিবী চারদিক থেকে আগুনে ঘেরা। তবু এক অপার রহস্যে, স্রষ্টার করুণায় আমাদের নিরাপদ বলয়ে বাস।
পাহাড়ের লাভা লুকোনো তার তলায়। কেউ জানে না পর্বতের ঘুমের আড়ালে কী অঢেল তরল আগুনের তৃষ্ণা। মৃত্তিকা, বনভূমি, প্রান্তর, উপত্যকা, নদী-জলাশয়, সাগর ও সমূহ সৃষ্টি.. এসবের অনড় পেরেক হয়ে, অবিশ্রান্ত প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে পর্বতমালা। তাই নিরাপদে আমাদের মালা বিনিময় হয়। সুখ-উল্লাস-হাসিতে ঘর ভরা থাকে। তবে, যখন পাহাড়ের কান্না আসে, ওঠে আসে ক্রোধরূপ লাভার উত্তাপ, তখন পুড়ে যায় ইটালির হাসি-উচ্ছ্বল পম্পেই শহর।
মানুষ বড় বিপজ্জনক প্রাণী। বাঘ, সিংহ তাদের স্বভাবগত তাড়নায়, প্রয়োজনে অন্যপ্রাণী শিকার করে। তাদের মাংস খায়। আর মানুষ পরিকল্পিতভাবে, প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ বুদ্ধির বলে নানা কৌশলে অন্যের ক্ষতি করে। প্রসঙ্গত, গাজা পরিস্থিতি বিশ্ব জানে। আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল প্রতিদিন। প্যালেসটাইনের কোনো স্থান নিরাপদ নয়। বছরের পর বছর আঁটকে রেখে অত্যাচার ও হত্যা তাদের উল্লাসের বিষয়। তবু সমগ্র পৃথিবী আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। কোনো কার্যকর কথা বা পদক্ষেপের, পন্থার বাস্তবায়ন নেই। অত্যাচারীরা ভাবে, তাদের কেউ দেখার নেই। কারও কাছেই কৈফিয়ত দিতে হবে না। তারা ভুলে যায় এইকথা ভাবতে, “See how the violets are opening, and the leaves unfolding, the streams gleaming and the birds singing. What does it make you think of?”
আমরা যেন সর্বনাশের আগুনকে নিরাপদ দূরত্বে রাখি। উপকার পাবার আশা করা যাবে তখনই। প্রকৃত শিক্ষার প্রয়োজন সে জন্য। উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস্ যেমনটা বলেছেন, “Education is not the filling of a pail, but rather the lighting of a fire.” আর নাম না জানা অন্য একজনের ভাষ্য, “Talent is a flame, Genius is a fire.” এই প্রতিভা, আগুনরূপে ধ্বংসকরভাবে ছড়ানোর নয়, বরং মানুষ হিসেবে আমাদের মনপাত্র যেন পরিপূর্ণ থাকে কল্যাণকর আগুনের আভায়। “The mind is not a vessel to be filled but a fire to be kindled.”
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রবন্ধকার।
প্রাক্তন প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, ঝিকরগাছা মহিলা কলেজ, যশোর।
পতিতাবৃত্তি শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়; এটি বৈশ্বিক অর্থনীতি, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়ে গভীর প্রভাব ফেলে। দারিদ্র্য, লিঙ্গ বৈষম্য এবং পাচার এর মূল চালিকা শক্তি।
পতিতাবৃত্তি বা যৌন ব্যবসা মানব সভ্যতার প্রাচীনতম পেশাগুলোর মধ্যে একটি। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিসর, গ্রিস ও রোমান সভ্যতায় যৌনকর্মীরা সমাজ ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। মেসোপটেমিয়ার ‘মন্দিরী’রা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, শিক্ষা এবং স্থানীয় অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকত। রোমান সাম্রাজ্যে যৌনকর্মীরা করদাতা হিসেবে নিবন্ধিত ছিলেন, এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা সীমিত হলেও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে বর্ডেল সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দারিদ্র্য, লিঙ্গ বৈষম্য এবং সামাজিক শোষণ পতিতাবৃত্তিকে প্রবলভাবে চালিত করত। ফ্রান্স, ইতালি এবং ইংল্যান্ডের শহরগুলিতে নির্দিষ্ট এলাকায় বর্ডেল পরিচালিত হতো এবং তা সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এটি কখনও ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়মের সঙ্গে সংযুক্ত, কখনও দরিদ্রতা এবং শিক্ষার অভাবে প্রসার লাভ করত।
একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়নের প্রভাবে পতিতাবৃত্তি স্থানীয় সীমা অতিক্রম করে, আন্তর্জাতিক মানবপাচার, শিশু শোষণ, মাদক ও অস্ত্র বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান এতে বিশেষভাবে প্রভাবিত। ঢাকার কাপ্তান বাজার, মুম্বাইয়ের মাদারসির বাজার, কাঠমান্ডুর স্থানীয় বর্ডেলগুলো আন্তর্জাতিক পাচারের কেন্দ্র। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও জাপান পর্যটন ও বৈধ যৌনবাণিজ্যের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে যুক্ত।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, জোরপূর্বক শ্রম ও যৌনকর্ম থেকে বছরে প্রায় ২৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়, যার ৭৩% আসে যৌনকর্ম থেকে। অর্থনৈতিক প্রভাব দুটি ভাগে দেখা যায় যা বৈধ ও অবৈধ যৌনপেশা।
নেদারল্যান্ডস (১৯৯৯), জার্মানি (২০০২), নিউজিল্যান্ড (২০০৩) যৌনকর্মকে নিয়ন্ত্রিত ও বৈধ করেছে। স্বাস্থ্যসেবা, কর এবং আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও জাপান পর্যটন এবং ‘ফাস্ট এন্টারটেইনমেন্ট’ শিল্পের মাধ্যমে বৈধকৃত যৌনবাণিজ্য পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডায় সীমিত বৈধ যৌনকর্ম রয়েছে।
বৈধ যৌনপেশা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, রাজস্ব বৃদ্ধি করে এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, নেদারল্যান্ডসে বৈধ যৌনবাণিজ্য থেকে প্রতি বছর প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ইউরো রাজস্ব আসে। জার্মানিতে এই খাত সরকারকে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ইউরো কর আয় দেয়। তবে মানবিক মর্যাদা বজায় রাখা, মানসিক চাপ হ্রাস এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।
দক্ষিণ এশিয়ার উদাহরণ: বাংলাদেশে কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন প্রকল্প চালু হয়েছে। ভারতের মুম্বাই এবং দিল্লিতে যৌনকর্মীদের জন্য পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এমন কেন্দ্রগুলো মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করে।
অবৈধ যৌনকর্ম মানবপাচার, মাদক, অস্ত্র ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র নারী ও শিশু উন্নত দেশে পাচার হয়। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে শিশু ও কিশোরদের যৌনশ্রমে ব্যবহার হয়। পূর্ব ইউরোপ থেকে নারীরা পশ্চিম ইউরোপে পাচার হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ নারী পাচারের শিকার হয়। এটি দরিদ্র দেশগুলোর মানবসম্পদকে ধনী দেশের যৌনবাণিজ্যের জন্য ‘পণ্য’ বানায়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক NGO যেমন Hope for Justice এবং ECPAT এ ধরনের চক্র ভাঙতে সক্রিয়। তবে সীমিত বাজেট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক সঙ্গতি নেই এমন এলাকায় প্রতিরোধ কার্যকর হয় না।
জাতিসংঘের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ৭০,০০০ এরও বেশি মানুষ মানব পাচারের শিকার, যার ৩৮% শিশু এবং ৩৯% নারী। মূল কারণ: দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শিক্ষার অভাব, লিঙ্গ বৈষম্য, যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং অভিবাসনের অপব্যবহার।
বাংলাদেশ: প্রায় ১ লাখ নারী যৌনপেশায় নিযুক্ত, বিশেষ করে ঢাকার কাপ্তান বাজার ও চট্টগ্রামের বর্ডেল।
ভারত: ৫ লাখের বেশি যৌনকর্মী, বিশেষত মুম্বাই, কলকাতা, দিল্লি ও হায়দ্রাবাদে।
নেপাল ও পাকিস্তান: নারী বিদেশে বিক্রি হয়, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে।
ভুটান: সীমিত, ভারতীয় বাজারে বিক্রি।
আফ্রিকা: নাইজেরিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় শিশু ও কিশোরদের জোরপূর্বক যৌনপেশায় নামানো হয়।
মধ্যপ্রাচ্য: সৌদি আরব, UAE, কাতারে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমিকদের যৌনশোষণ হয়।
ইউরোপ ও আমেরিকা: পূর্ব ইউরোপ থেকে নারীরা পশ্চিম ইউরোপে পাচার হয়।
কেস স্টাডি: ২০২৩ সালে নাইজেরিয়ার ১৪ বছর বয়সি একটি মেয়ে ইউরোপে পাচারের পরে উদ্ধার হয়। সে জানিয়েছে, ‘আমাকে দিনের পর দিন কাজ করানো হতো, না খেয়ে থাকতে হতো, মারধর হতো।’
যৌনপেশা প্রায়ই আন্তর্জাতিক অপরাধী নেটওয়ার্কের অর্থ ধোয়ার মাধ্যম। যৌনকর্মীরা প্রায়ই মাদকাসক্ত করা হয় নিয়ন্ত্রণের জন্য।
দক্ষিণ এশিয়া: আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে হেরোইন চোরাচালান যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত।
বাংলাদেশ: ফেনসিডিল ও ইয়াবা বাণিজ্য সক্রিয়।
আফ্রিকা ও ইউরোপ: যৌনপেশার অর্থ দিয়ে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়।
এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ও অবৈধ অর্থনৈতিক প্রবাহের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে। এমন চক্রের কারণে দরিদ্র দেশগুলোতে যৌনশ্রমী এবং শিশু ‘বিক্রয়ের পণ্য’ হয়ে যায়।
২০২৩ সালে Amnesty International এর জরিপে দেখা গেছে, ৬০% যৌনকর্মী একাধিকবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার।
মানসিক প্রভাব: বিষণ্নতা, PTSD, উদ্বেগ, আত্মহত্যার ঝুঁকি। শিশুদের শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এসব নির্যাতন ও মানসিক চাপ সমাজে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে।
কেস স্টাডি: বাংলাদেশের কাপ্তান বাজারের একজন যৌনকর্মী জানিয়েছেন, ‘প্রতিদিন নির্যাতন, অপমান ও মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। কোনো নিরাপত্তা নেই। স্বাস্থ্যের সমস্যা হলে সাহায্য নেই।’
নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বিকৃত হয়, শরীরকে পণ্য হিসেবে দেখা হয়। যৌনতার বাণিজ্যিকীকরণ সমাজে ভোগবাদী মানসিকতা তৈরি করে। এটি লিঙ্গ বৈষম্যকে শক্তিশালী করে এবং সমাজে নারীকে সমান মর্যাদা দেয়ার প্রচেষ্টা ব্যাহত করে।
নেতিবাচক: মানবাধিকার লঙ্ঘন, শিশু ও নারী নির্যাতন, অপরাধ বৃদ্ধি, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, অবৈধ অর্থনৈতিক প্রবাহ।
ইতিবাচক (সীমিত): স্বাস্থ্যসেবা, আইনগত তদারকি, কর্মসংস্থান, পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ সুবিধা। উদাহরণস্বরূপ, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির বৈধ যৌনবাণিজ্য কিছু অংশে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। তবে এটি মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট নয়।
আইনগত সংস্কার: কঠোর আইন প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন। যৌনকর্মীদের সুরক্ষা, পুনর্বাসন ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা।
সামাজিক সচেতনতা: শিক্ষার প্রসার, গণমাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি, নারীর মর্যাদা ও লিঙ্গ সমতার প্রতি মনোযোগ।
অর্থনৈতিক বিকল্প: দরিদ্রতা দূরীকরণের জন্য ক্ষুদ্রঋণ, স্বনির্ভর উদ্যোগ এবং যুবসমাজের কর্মসংস্থান।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: UNODC, IOM, ECPAT, CATW, UNICEF, ILO, Hope for Justice এর মাধ্যমে যৌথ কর্মসূচি।
উদাহরণস্বরূপ, IOM এবং UNICEF যৌথভাবে শিশুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র এবং পুনর্বাসন প্রকল্প চালায়।
পতিতাবৃত্তি বৈশ্বিক নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, বৈষম্য ও লিঙ্গভিত্তিক শোষণ এটিকে টিকিয়ে রাখে। মানবপাচার, মাদক ও অস্ত্র বাণিজ্যের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
কঠোর আইন প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং নারীর মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতি সম্মান নিশ্চিত করলে পতিতাবৃত্তি ও যৌনশোষণের অবসান সম্ভব। যে সমাজ নারীকে মর্যাদা দেয়, সেই সমাজেই এই অশুভ চক্র থেকে মুক্তি আসবে।
লেখক : আইনজীবী ও গবেষক।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত ইস্যুগুলোর একটি হচ্ছে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি। আগস্টের রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংঘটিত গুম, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এখন বিচারিক কাঠামোয় প্রবেশ করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ, র্যাবের দুই সাবেক মহাপরিচালকসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। এই তালিকায় ১৪ জন বর্তমান ও ১০ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার নাম রয়েছে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
এই সিদ্ধান্তে জনমনে যেমন এক ধরনের স্বস্তি এসেছে যে দীর্ঘদিনের অবিচারের দায় এখন বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে, তেমনি উদ্বেগও বেড়েছে এই বিচার যেন রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসা বা কোনো গোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রতিশোধে পরিণত না হয়। বিশেষ করে সেনাবাহিনীকে নিয়ে যেন কোনো প্রহসণ না ঘটে, সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেনাবাহিনী শুধু একটি বাহিনী নয়, এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রতীক, যার প্রতি জনগণের আস্থা দীর্ঘদিনের।
অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে সেনাবাহিনীকে যে পরিসরে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আগামী দুই মাসের জন্য বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৯৮ সালের ১২(১) ধারার অধীনে প্রদত্ত এই ক্ষমতা জনস্বার্থে অবিলম্বে কার্যকর হয়েছে। এর ফলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এখন ফৌজদারি কার্যবিধির ৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ ও ১৪২ ধারার অধীনে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। তবে তারা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে দায়িত্ব পালন করবেন।
সাবেক সচিব এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার এই সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী বলে মন্তব্য করেছেন। তার মতে, দেশের স্বার্থে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার প্রয়োজনে এমন সিদ্ধান্ত অতীতেও নেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি একই সঙ্গে সতর্ক করে বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী যেন বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকে, এবং যা প্রয়োজন শুধু সেটুকুই প্রয়োগ করে।’ এই বক্তব্যের মধ্যেই নিহিত আছে মূল উদ্বেগের জায়গা—ক্ষমতার সীমা ও ব্যবহারের ভারসাম্য।
অন্যদিকে, সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে যে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, সেটিকে কেন্দ্র করে দেশে এখন বিতর্ক তুঙ্গে। কেউ বলছেন, এটি অতীতের অপরাধের ন্যায্য বিচার; কেউ আবার দেখছেন এতে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা। বিশেষ করে যখন ১৫ জন কর্মরত কর্মকর্তা হেফাজতে নেয়া হয়, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় গুজব ও প্রচারণা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেছেন, ‘এই ঘটনাটি যেভাবে জনসম্মুখে প্রচার করা হয়েছে, তাতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।’ তার মতে, সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছে, তা রক্ষায় এখন সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রয়োজন।
অন্যদিকে বিশ্লেষক ড. আব্দুর রব খান ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখছেন। তার মতে, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, এবং এতে সেনাবাহিনীকে আলাদা করে দেখার কোনো কারণ নেই। বরং আইনানুগ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করে সেনাবাহিনী প্রশংসা কুড়াবে।’
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, সেনা কর্মকর্তাদের বিচার করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের রয়েছে। তার ভাষায়, ‘আইনের সাধারণ বিধান হচ্ছে, আসামিকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হয়। এরপর আদালতই নির্ধারণ করবেন তারা কোথায় থাকবেন।’
এই বক্তব্য কিছুটা আশ্বাসবাণী হলেও, একটি মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যায়—সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য যদি অপরাধে অভিযুক্ত হন, তবে তার বিচারের এখতিয়ার কোথায়? সামরিক আদালত নাকি বেসামরিক আদালত? সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এ বিষয়ে স্পষ্ট বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীর সদস্য পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অপরাধ করলে তার বিচার সামরিক আইনে হবে। কিন্তু সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ করলে তাকে বেসামরিক আদালতে বিচার করা যাবে। অতীতে নারায়ণগঞ্জ সাত খুন ও বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় এমন নজির আছে।’
অর্থাৎ, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিচার প্রক্রিয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে বাস্তবতার দিক থেকে এটি সংবেদনশীল। সেনাবাহিনী একটি শৃঙ্খলাপরায়ণ প্রতিষ্ঠান, যেখানে আস্থার বন্ধনই সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই আস্থায় আঘাত লাগলে পুরো প্রতিষ্ঠানের মনোবল দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তাই বিচারপ্রক্রিয়া যতটা আইনি, ততটাই রাজনৈতিক ও নৈতিক সংবেদনশীলও।
বিএনপির অবস্থানও এখানে দেখার বিষয়। দলটি বলেছে, ‘সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য এই দেশের গর্বিত সন্তান। সীমা লঙ্ঘনকারীরা বিচারের মুখোমুখি হোক, যাতে কোনো সরকার ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীকে অন্যায় কাজে ব্যবহার করতে না পারে।’ এই বক্তব্যে যেমন ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থান দেখা যাচ্ছে, তেমনি সেনাবাহিনীর মর্যাদা রক্ষার ইঙ্গিতও আছে।
অতীতের উদাহরণ স্মরণ করলে দেখা যায়, জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন বা বিডিআর বিদ্রোহ—সব ক্ষেত্রেই সামরিক ও বেসামরিক আদালতের এখতিয়ারের প্রশ্নে দেশ একাধিকবার বিতর্কে পড়েছে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই আদালত নীতিগতভাবে বলেছে, সাধারণ নাগরিকের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার বেসামরিক আদালতেই হতে পারে।
তবে এবার বিষয়টি শুধু আইনি নয়, রাজনৈতিকভাবে গভীরতর। কারণ, শেখ হাসিনা সরকারের সময় যেসব গুম-নির্যাতন ও নিখোঁজের অভিযোগ উঠেছিল, তা শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং রাজনৈতিক দমননীতির অংশ ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে অভিযুক্তদের মধ্যে সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতি অনিবার্যভাবে প্রশ্ন তোলে তারা কী কেবল নিজেরা দায়ী, নাকি রাজনৈতিক নির্দেশে দায়িত্ব পালন করেছিলেন?
এখানেই নৈতিক প্রশ্নটি বড় হয়ে দাঁড়ায়। সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সবচেয়ে শৃঙ্খলাপরায়ণ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান। এমন একটি বাহিনীকে নিয়ে যখন বিচারিক প্রক্রিয়া চলে, তখন সেটি শুধু আইনের প্রশ্ন নয়, রাষ্ট্রের মর্যাদা ও জনগণের আবেগের প্রশ্নেও পরিণত হয়। বিচার অবশ্যই হতে হবে, কিন্তু তা যেন কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা প্রতীকী প্রদর্শনের রূপ না নেয়—এই সতর্কতা এখন সবচেয়ে জরুরি।
পাঁচ দশকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী শুধু দেশের নিরাপত্তা রক্ষাই করেনি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তারা বিশ্বের অন্যতম প্রশংসিত বাহিনী। আফ্রিকার কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান, মালি, সিয়েরা লিওন কিংবা লেবাননে তারা শান্তিরক্ষী হিসেবে যেমন পরিচিত, তেমনি মানবিক সহায়তার দূত হিসেবেও সুনাম অর্জন করেছে। ফলে ‘বাংলাদেশ’ নামটি আজ আন্তর্জাতিক পরিসরে নৈতিক বিশ্বাস, শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বের প্রতীক।
দেশের অভ্যন্তরেও সেনাবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় কিংবা মহামারির সময় এই বাহিনী সর্বাগ্রে মানবিক সহায়তা নিয়ে হাজির হয়েছে। ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারির সময় তাদের মাঠপর্যায়ের দায়িত্ব পালন ও সচেতনতা কার্যক্রম ছিল অনন্য। তার আগেও ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যা ও ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরে তারা মানুষের জীবন বাঁচাতে যে আত্মত্যাগ দেখিয়েছে, তা আজও জাতির স্মৃতিতে অমলিন।
এই ধারাবাহিকতা সেনাবাহিনীকে দেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। এমন একটি বাহিনীকে হঠাৎ বিচারিক বিতর্কের কেন্দ্রে এনে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে তা কেবল আইনি প্রক্রিয়াকেই নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা স্থিতিশীলতাকেও প্রভাবিত করতে পারে। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে বিচার প্রক্রিয়াকে এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে আইন, ন্যায়বিচার ও মর্যাদার ভারসাম্য রক্ষা পায়।
২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কিংবা ২০২৪ সালের সংকটকালেও সেনাবাহিনী দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে—তারা জনগণের পাশে থেকেছে, সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করেছে, প্রশাসনকে সহায়তা করেছে। আন্তর্জাতিক মহলেও স্বীকৃত, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পেশাদার ও স্থিতিশীল বাহিনীগুলোর একটি। এই বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার যদি হয়, তা হতে হবে প্রমাণনির্ভর, স্বচ্ছ এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রক্রিয়ায়।
সেনাবাহিনীর অতীত গৌরব, বর্তমান পেশাদারিত্ব এবং ভবিষ্যতের দায়িত্ববোধ এই তিনটি দিক বিবেচনায় নিয়ে বিচারের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে। সেনাবাহিনী কোনো রাজনৈতিক দলের নয়, এটি জাতির। জনগণের আস্থা টিকে থাকলেই রাষ্ট্রের ভিত্তি অটুট থাকবে। তাই আজ সবচেয়ে প্রয়োজন ন্যায়বিচার ও মর্যাদার সমন্বয়। সেনাবাহিনীকে বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ করা যেতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক কৌশলের অংশ বানানো চলবে না।
বিচার যদি হয়, তা হতে হবে নিখুঁত ও নিরপেক্ষ, যেন তা প্রতিশোধ নয়, ন্যায়বিচার হয়। বিচারের নামে যদি কোনো প্রহসণ ঘটে, তবে তাতে কেবল সেনাবাহিনী নয়, গোটা রাষ্ট্রীয় কাঠামোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি, জাতীয় নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক আস্থা, সবই তখন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব এখন বেশ কয়েক দিকে। একদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর মর্যাদা ও পেশাগত শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ণ রাখা। এর জন্য প্রয়োজন আইনি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক সংযম, এবং সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ন্যায়বিচারের প্রতি আন্তরিকতা। সেনাবাহিনীকে বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ করা যেতে পারে, কিন্তু তাকে কোনো রাজনৈতিক নাটকের অংশ করা চলবে না।
বিচার হবে, কারণ অপরাধের দায় এড়ানো যায় না। কিন্তু সেই বিচার যেন হয় প্রমাণভিত্তিক, ন্যায়নিষ্ঠ, ও জনস্বার্থে পরিচালিত, এটাই আজকের জাতীয় দাবি। কারণ, বিচার যদি প্রহসণে পরিণত হয়, তবে তা শুধু সেনাবাহিনীর ক্ষতি নয়, বরং স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার ওপরই চরম আঘাত হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবে।
ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী নয়, এটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, সার্বভৌমত্ব ও মানবিক দায়িত্বের এক অবিচ্ছেদ্য প্রতীক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই এই বাহিনী দেশের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়ে এই বাহিনীর সদস্যরা প্রতিষ্ঠা করেছেন বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদার ভিত্তি।
লেখক: রাজু আলীম: কবি, সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
আমাদের গ্রিনরোডের বাসার ছাদ বাগানে প্রায় দশ বছর আগে একটি কলমের আমড়া গাছ লাগিয়েছিলাম। এই গাছ দিনে দিনে বড় হয়ে উঠে এবং বলতে গেলে বারো মাস ধরে এই ফল হতো। গত ১১/১০/২০২৫ইং তারিখ শনিবার সকালে দেখলাম গাছটির পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে অনেকে বলতে লাগলো যে, গাছে পানি বেশি দেয়া হয়েছে বলে শেকড় পচে গিয়েছে বিধায় গাছ মরে যাচ্ছে। এতে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। কেননা এতটি বছর ধরে গাছটি পরিচর্যাসহ আগলিয়ে রেখেছিলাম। তাই এর উপর বেশ মায়া হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া এই আমড়া তুলনামূলক মিষ্টি ছিল এবং ফলের দিক দিয়ে অনেকাংশে বাসার সবার চাহিদা মেটাতো। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, ছাদে নানা গাছ থাকলেও এই গাছটির প্রতি কেমন যেন বিশেষ টান ও মায়া ছিল। যাহোক, কয়েকদিনের মধ্যে গাছটি পুরোপুরি মারা গেলো। এতে মনটা এত খারাপ হলো যে কেমন যেন উদাসী হয়ে পড়লাম। বাসার সবাই বলতে লাগলো যে, মন খারাপ করে লাভ নেই; বরং এর স্থলে অন্য একটি গাছ এনে লাগাও। আমি বললাম হয়তো তাই হবে। কিন্তু এই গাছটির প্রতি, যে এতো ভালোবাসা ও মায়া; তাই এর কথা কভু ভুলতে পারবো না। এর মধ্যে ভাবলাম, এই গাছটির কথা স্মরণীয় করে রাখতে সামগ্রিকভাবে আমড়া নিয়ে একটি আর্টিকেল লেখব। আর সেই মতে হাতে কাগজ-কলম তুলে নিলাম।
বস্তুত আমড়া মৌসুমি ফল। এখানে একটি কথা বলে রাখা শ্রেয় যে, মৌসুমি গাছ পালা ও ফলের সাথে পৃথিবীর জীব হিসেবে মানুষের মিথস্ক্রিয়ার আবর্তে একটি মিল আছে। তাই মৌসুমি ফল খেলে স্বভাবতই মানুষ অনেকাংশে সুস্থ থাকে। আরেকটি কথা, আমড়া এমন একটি ফল দেখলেই তেুঁতলের মতো জিব্বায় পানি আসে। আর এই টক মিষ্টি ফল স্থানীয় ফল হিসেবে দামি ও বিদেশি আপেলের চেয়ে গুণাগুণের দিক দিয়ে তুলনামূলক বেশি এবং সস্তা। আর এতে আপেলের চেয়ে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রনের পরিমাণ অধিক। আমড়া একপ্রকার পর্ণমোচী বৃক্ষ। এর বৈজ্ঞানিক নাম স্পনডিয়াস মমবিন। এই গাছগুলো ২০-৩০ ফুট উঁচু হয়। আর প্রতিটি যৌগিক পাতায় ৮-৯ জোড়া পত্র থাকে পত্রদণ্ডে যা ৮-১২ ইঞ্চি লম্বা। কাঁচা ফল টক বা টক-মিষ্টি হয়, তবে পাকলে টকভাব কমে আসে এবং বেশ মিষ্টি এবং সুস্বাদু হয়ে উঠে। ফলের বীজ কাঁটাযুক্ত। অবশ্য ৫-৭ বছরেই মধ্যেই গাছ ফল দেয়। এই ফল কাঁচা ও পাকা রান্না করে বা আচার বানিয়ে খাওয়া যায়। এই ফল আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জন্মে। আর বাংলাদেশসহ আফ্রিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং ইন্দোনেশিয়ায় এই গাছটি পরিলক্ষিত হয়।
আমড়া কষ ও অম্ল স্বাদযুক্ত ফল। এতে প্রায় ৯০% পানি, ৪-৫% কার্বোহাইড্রেট ও সামান্য পরিমাণ প্রোটিন থাকে। আর ১০০ গ্রাম আমড়ায় ভিটামিন-সি পাওয়া যায় ২০ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ২৭০ মাইক্রোগ্রাম, সামান্য ভিটামিন-বি, ক্যালসিয়াম ৩৬ মিলিগ্রাম এবং আয়রন ৪ মিলিগ্রাম। এদিকে আমড়ায় যথেষ্ট পরিমাণ পেকটিনজাতীয় ফাইবার এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টজাতীয় উপাদান থাকে। আমড়ার পুষ্টিগুণ কোনো অংশে কম নয়। এক্ষেত্রে সম্যক ধারণার জন্য প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্য উপযোগী আমড়ার পুষ্টিগুণ।
বস্তুত আমড়া বেশ উপকারী ফল। কেননা এই ফল ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ; কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ওজন কমাতে সহায়তা করে; রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়; অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট জাতীয় উপাদান থাকায় আমড়া বার্ধক্যকে প্রতিহত করে; আমড়াতে প্রচুর আয়রন থাকায় রক্ত স্বল্পতা দূর করতে বেশ কার্যকর; বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে আমড়া উপকারী; দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া, দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়ার মতো সমস্যা প্রতিরোধে আমড়ার ভূমিকা অনন্য; আমড়ায় প্রচুর ভিটামিন সি থাকে বিধায় এই ভিটামিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। বিভিন্ন রকমের ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, সর্দি, কাশি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে দূরে রাখে উপকারী এই ফল; হাড় ও দাঁতের গঠনে সহায়তা করে আমড়ায় থাকা ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সি। এছাড়া ভিটামিন সি ত্বক সুস্থ রেখে বয়সের ছাপও কমায়; আমড়া খেলে মুখে রুচি বাড়ে, দূর হয় বমি বমি ভাবও; আয়রন শরীরের জন্য অপরিহার্য একটি অত্যাবশ্যক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ও রক্ত স্বল্পতা এবং অন্যান্য রক্তের সমস্যা প্রতিরোধ করে। এছাড়া হিমোগ্লোবিন এবং মায়োগ্লোবিন তৈরি করতে সাহায্য করে আয়রন, যা শরীরের সমস্ত সিস্টেমে অক্সিজেন স্থানান্তর করে; আর আমড়ায় ফ্যাট ও সোডিয়াম নেই। এতে অনেক ভিটামিন ‘কে’ থাকে, যা হাড় মজবুত করতে সহায়তা করে। তাছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে যে আমড়ায় কপার থাকে বলে হাড় ও শরীরের জন্য উপকারী; আমড়া পিত্তনাশক ও কফনাশক এবং থিয়ামিন নামের একটি উপাদান থাকে, যা মাংসপেশী গঠনে ভূমিকা রাখে। এই উপাদানের ঘাটতি হলে পেশী দুর্বল হওয়াসহ বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়।
বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় বলতে গেলে আমড়া গাছ জন্মে। তবে সিলেট বিভাগের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ; খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর ও বরগুনা; চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও রাঙ্গামাটি; ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেত্রকোনো, শেরপুর ও জামালপুর এবং ঢাকা ও আশে-পাশের অঞ্চল যেমন- নরসিংদী, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে অধিক জন্মে। মজার ব্যাপার হলো যে, ঢাকা রাজধানীসহ জেলা শহরের অনেক ছাদ-বাগানে অন্যান্য গাছের সাথে আমড়ার চাষ হয়ে থাকে। বস্তুত বাংলাদেশের গাছগাছালির আশে পাশে ও বাগানে মিশ্র চাষ হয়ে থাকে। মূলত উঁচু ও মাঝারি জমিতে ভালো জন্মে। এদেশে আমড়া গাছে বর্ষায় ফুল আসে। তারপর বড় হতে থাকে এবং অক্টোবর পর্যন্ত থাকে। সত্যি কথা বলতে কি, এই ফল হেমন্ত ঋতুর প্রথম সময়কাল পর্যন্ত দেখা যায়। আর এই সময় ফল পাকে। মজার ব্যাপার হলো যে, কিছুটা বড় হলে বাজারে আসতে থাকে, যা অক্টোবর পর্যন্ত বাজারে পরিলক্ষিত হয়। ফলের দোকানে অন্যান্য ফলের সংগে এটি শোভা পায়। এই ফল মুখরোচক এবং দামে সস্তা বলে বাঙালিরা বেশ তৃপ্তি সহকারে খেয়ে থাকে। আর পরিবারের ছোট বড় সবারই পছন্দ। আরেকটি কথা, শহর-বন্দর, বাস ও রেলওয়ে স্টেশনে কিছু ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা আমড়াগুলো ফুলের মতো কেটে, তাতে লবন ও মসলা মিশিয়ে পিচ আকারে বিক্রি করে থাকে।
পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, দেশি ফল হিসেবে আমড়াকে গুরুত্ব দেয়া সমীচীন। কেননা গুণাগুণের দিক দিয়ে আঙ্গুর ও আপেলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাই এই আমড়া গাছ চাষে আমাদের আরও মনোযোগী হওয়া অপরিহার্য।
লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার এখনও বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি- ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ভুটানের মূল্যস্ফীতি হবে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারতের ৪ শতাংশ, মালদ্বীপের ২ দশমিক ৫ শতাংশ, নেপালের ৪ দশমিক ২ শতাংশ। শ্রীলংকায় গত অর্থবছর মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১ দশমিক ২ শতাংশ, চলতি বছরে দেশটিতে কোনো মূল্যস্ফীতি নাও হতে পারে। মালদ্বীপ ও নেপাল মূল্যস্ফীতির লাগাম টানায় এগিয়ে রয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনামের মূল্যস্ফীতি হবে ৩ দশমিক ২ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়ার ২ দশমিক ৯ শতাংশ যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। অপরদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। করোনা মহামারির আঘাত ও বৈশ্বিক মন্দার ছোবল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারেনি। দেশকে এখনো নিম্ন জিডিপির প্রবৃদ্ধির গতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ভুটানের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারতের ৬ দশমিক ২ শতাংশ, নেপালের ৫ দশমিক ২ শতাংশ। রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ যা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের সমান প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার জন্য। দেশটির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অতছ বাংলাদেশ এখনো ৪ শতাংশের রয়েছে। আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখনও প্রাইমারি ব্যালেন্সের স্থিতি চলতি অর্থবছরেও নেতিবাচক থাকবে। বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতিতেও চাপে থাকতে হবে।
অপরদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শেষে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ হবে। যা আগামী ২০২৬ সালে অর্থবছর শেষে ৫ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। যদিও পোশাক রপ্তানি স্থিতিশীল রয়েছে, তবুও ধীর প্রবৃদ্ধির অনুমান চলমান মূলত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে। অন্যদিকে বারবার বন্যা, শিল্প শ্রমিক বিরোধ এবং ক্রমাগত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে দেশীয় চাহিদা হ্রাস পেয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। এডিবি জানায়, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার ওপর এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধি নির্ভর করবে। বাংলাদেশের বাণিজ্যের ওপর মার্কিন শুল্কের প্রভাব এখনো দেখা যায়নি এবং ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা রয়ে গেছে। উচ্চতর অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা অর্জনের জন্য এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা অপরিহার্য। ২০২৬ অর্থবছরের দৃষ্টিভঙ্গির কিছু নেতিবাচক ঝুঁকি রয়ে গেছে। বাণিজ্য অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং সম্ভাব্য নীতিগত স্থিতিস্থাপকতা অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বিচক্ষণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বজায় রাখা এবং কাঠামোগত সংস্কার ত্বরান্বিত করা জরুরি। মূলত টেকসই উন্নয়নে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এডিবি আরও জানায়, পাইকারি বাজারে সীমিত প্রতিযোগিতা, অপর্যাপ্ত বাজার তথ্য, সরবরাহ শৃঙ্খলের সীমাবদ্ধতা এবং টাকার দুর্বলতার কারণে মুদ্রাস্ফীতি ২০২৪ অর্থবছরের ৯ দশমিক ৭ ৭ শতাংশ থেকে ২০২৫ অর্থবছরে ১০ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি হিসাবে ২০২৫ অর্থবছরে জিডিপির ০ দশমিক ০৩ শতাংশের সামান্য উদ্বৃত্ত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা ২০২৪ অর্থবছরে জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশ ঘাটতি থেকে বেশি, যা বাণিজ্য ব্যবধান সংকুচিত এবং শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ দ্বারা সমর্থিত।
সরকারি হিসাবে প্রায় এক দশক ধরে দেশের প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৭ শতাংশের ওপরে, যা ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চীন ও ভারতসহ উন্নয়নশীল প্রায় সব দেশের প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যায়। এর সুবাদে বাংলাদেশকে ‘এশিয়ান টাইগার’ খেতাবও দেয়া হয়। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকলেও সে অনুপাতে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়েনি। শিল্পের প্রসারও সেভাবে চোখে পড়েনি। আবার বিশ্বব্যাংক ও এডিবিরি মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা সময়ে প্রশ্ন তুলেছিল। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যেই গড়ে সাড়ে ৩ শতাংশীয় পয়েন্টের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ যখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতার মুখ দেখছে, তখন বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) বৃদ্ধির পরিকল্পনা বর্তমান পরিস্থিতিতে কতটা যৌক্তিক তা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন। কারণ, এমন উদ্যোগ মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দিতে পারে, ফলে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় না হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণের সুদহার এবং নীতি সুদহার প্রায় দ্বিগুণ করেছে। এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী হলেও, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সেভাবে কার্যকর হয়নি। বরং মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। তদুপরি, আইএমএফের শর্ত পূরণে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। একই সঙ্গে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য নয়, বরং রাজস্ব বাড়ানোর স্বার্থেই ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে ৪৩টি পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে নিত্যপণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১৩.৮০ শতাংশ। যদিও জুলাইয়ে এটি ছিল ১৪.১০ শতাংশ, সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ১১.৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ, গত বছরের নভেম্বরে ১০০ টাকায় যে পণ্য পাওয়া যেত, এ বছরের নভেম্বরে সেটি কিনতে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা প্রয়োজন। অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভারতের মতো দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতির হার ৭০ শতাংশে পৌঁছালেও এখন তা ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এক বছর আগে ২৭ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতি এখন কমে ৯.৬৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম মূল্যস্ফীতি বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় (০.৫ শতাংশ)। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন মালদ্বীপে (১.৪ শতাংশ)। এরপর ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তান রয়েছে। ভারতের মূল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশে স্থিতিশীল। বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকট কাটাতে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও বৈদেশিক মুদ্রাবাজার কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারকদের আরও সতর্কভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা, যাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দাম কমাতে বেশ কিছু পণ্যের শুল্ক ছাড়সহ আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, পাশাপাশি বাজার অভিযান জোরদার করেছে। একসঙ্গে মাঠে নামানো হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তিন উপসচিবের নেতৃত্বে তিনটি টিম। জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের টিমও ঢাকাসহ সারাদেশে নিয়মিত বাজার তদারকি করছে। এছাড়া প্রতিযোগিতা কমিশন, বিএসটিআই, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও নড়েচড়ে বসেছে। একই সঙ্গে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কম দামে বেশ কিছু নিত্যপণ্য বিক্রি শুরু করেছে এবং খাদ্য অধিদপ্তর ভর্তুকি মূল্যে চাল-আটা বিক্রি শুরু করেছে। আবার সরকার প্রতিবেশী দেশ থেকে ডিম, আলু, পেঁয়াজ, চাল এবং কাঁচামরিচের আমদানিও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তবুও সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আসছে না পেঁয়াজ ও আলুর দাম। এরই মধ্যে আমদানি করা পেঁয়াজে কাস্টমস শুল্ক ও রেগুলেটরি শুল্ক অব্যাহতি এবং আলুর আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার পাশাপাশি ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক তুলে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরপরও খুচরা বাজারে চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ দুই পণ্য।এখানে উল্লেখ্য যে সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপড়েন ভারত থেকে খাদ্যপণ্য আমদানিতে বাধা সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিঢয়ছে যা বাজার পরিস্থিতিকে আরও সমস্যায় ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে । বাজারে আমনের নতুন ধান উঠেছে। উৎপাদনও আশানুরূপ। ১০ দিনের মধ্যে ধানের দাম মণপ্রতি কমেছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা। এরপরও চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে ক্ষোভ বাড়ছে ভোক্তাদের। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ বাড়ানো জরুরি। শুল্ক কমানো হলো; কিন্তু আমদানি বাড়ল না- তাতে সুফল পাওয়া যাবে না। চাল, পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের বাজারে শুল্ক কমানোর পরও আশানুরূপ আমদানি না আসায় বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না বলে মনে করেন তারা। এ ব্যাপারে (ক্যাব) সাবেক সভাপতি বলেন, কর কমানো একটি উপায় হলেও বেশির ভাগ সময় তা সুফল দেয় না। আমি মনে করি, নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা ও এ ব্যাপারে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনাটা জরুরি। চাঁদাবাজিও বন্ধ করতে হবে। একদল চাঁদাবাজি করে চলে গেছে, আরেক দল চাঁদাবাজি করার দায়িত্বে এসেছে- এটাকে যদি সরকার স্বাভাবিকভাবে নেয়, তাহলে আমার বলার কিছু নেই। সরকারের পরিবর্তন হলেও খেলোয়ারের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে মহান মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের সদস্য অসামান্য অবদান রেখে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের সবাই সেনাবাহিনীরই সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই থেকে শুরু করে জাতির বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে জাতির ভরসা এই সেনাবাহিনী এগিয়ে এসেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সবার আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছে। এখন কোথাও কোনো সমস্যা সংকট সৃষ্টি হলে সবাই সেখানে সেনবাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সেই সংকট নিরসনে সেই সংকট থেকে উত্তরণে তাদের শক্তিশালী ভূমিকা পালন প্রত্যাশা করে একান্তভাবে। ঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় , নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অপরাধী, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে সেনাবাহিনী সবসময় প্রশংসনীয় অবদান রেখে দেশের সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে এক গৌরবময় আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। প্রশংসা ও সুনাম বয়ে এনেছে দেশের জন্য। চব্বিশের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারী ছাত্র জনতাকে জোর করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমনের জন্য স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারি দুঃশাসনের প্রধান হোতা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার অন্যায়মূলক নির্দেশ উপেক্ষা করে ছাত্র জনতার আন্দোলনকে সফল করতে ঐতিহাসিক গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশ ও জাতির স্বার্থে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন।
আজকাল সেই সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে নানা ধরনের গুজব, অপপ্রচার, ষড়যন্ত্রমূলক খবর প্রচার চালানো হচ্ছে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। যা দুঃখজনক। আমাদের সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে এমন সব খবর ছড়ানো হচ্ছে যার কোনো সত্যতা নেই। ভিত্তিহীন, বানোয়াট খবর প্রচার করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। জনমনে সেনাবাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে একটি মহল। এটা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, শান্তি, শৃঙ্খলা, সংহতি, স্থিতিশীলতা বিনষ্টের লক্ষ্যে সুগভীর চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।
পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম সরকারের তাবেদারি করায় গণমাধ্যমের খবরের প্রতি মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতায় ভাটা পড়ে। মত প্রকাশ, কথা বলা এবং ভাবের আদান-প্রদানে সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ অনেকগুলো আন্দোলন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণায় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণায় দলমত নির্বিশেষে রাস্তায় নেমেছিল। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সমাজ জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে এই প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহারও কম হচ্ছে না। যা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। এক শ্রেণির মানুষ সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে অপপ্রচার, কুৎসা রটানো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার, সহিংসতার ভুল তথ্য প্রচারে গুজব ছড়াচ্ছে। এতে সমাজে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর পর থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় অসংখ্য ‘গুজব বাহিনী’ গড়ে তোলা হয়েছে। তারা কখনো পতিত স্বৈরাচার হাসিনার হয়ে কখনো দিল্লির হয়ে কখনো দেশের একাধিক রাজনৈতিক দলের হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একের পর এক গুজব ছড়াচ্ছে। খুবই পরিকল্পিত এবং সুচিন্তিতভাবেই কখনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের গুজব, কখনো অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে গুজব, কখনো প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের মধ্যে বিরোধের গুজব, কখনো ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে গুজব, কখনো মহামান্য প্রেসিডেন্টকে নিয়ে গুজব, বিভিন্ন সময় নানা ঢংয়ে ছড়ানো হয়। গুজববাজরা অনেকটা কবি শামসুর রাহমানের ‘কান নিয়েছে চিলে’ কবিতার মতোই গুজব ছড়াচ্ছে এবং এক শ্রেণির মানুষ সেটাকে ইস্যু করে প্রচার প্রচারণায় শরিক হয়ে লাইক, শেয়ার ও মন্তব্যজুড়ে দিচ্ছেন। এই ঘৃণ্য গুজব বাহিনীর সর্বশেষ টার্গেট হয়ে উঠেছে আমাদের গৌরব বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সেনাবাহিনীর সাবেক ১০ জন এবং বর্তমানে কর্মরত ১৫ জন মোট ২৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। চিহ্নিত কিছু গুজববাজ কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ইউটিউবার, বিদেশে অবস্থানরত কয়েকজন সাংবাদিক, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও দেশের একাধিক রাজনৈতিক দলের বট বাহিনী ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার, ইউটিউবার প্রচারণা চালায় অন্তর্বর্তী সরকার আর সেনাবাহিনী মুখোমুখি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কয়েকজন সেনা সদস্যকে আসামি করায় সেনাবাহিনী ক্ষেপে গেছে। যে কোনো সময় দেশে অঘটন ঘটে যেতে পারে। ইত্যাদি, ইত্যাদি। বিদেশি আধিপত্যবাদী শক্তির এজেন্ডায় ছড়ানো এ গুজব প্রচার করে শেষ পর্যন্ত গুজববাজরা ধরা খেয়েছে। তাদের মুখে ছাই দিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। খোলাখুলি কথা বলে তারা সেনাবাহিনীর অবস্থান সুস্পষ্ট করেছেন। এক আদেশের মাধ্যমে চাকরিরত ১৫ জন এবং এলপিআর ভোগরত ১ জনসহ মোট ১৬ কর্মকর্তাকে ৯ অক্টোবরের মধ্যে সেনা হেফাজতে আসতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এলপিআর ভোগরত কর্মকর্তাসহ ১৫ জনকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেনা হেফাজতে নিয়ে আসা হয়েছেও। সেনাবাহিনীর এই স্মার্ট সিদ্ধান্তের ফলে তথাকথিত গুজববাজদের দেশে বিশৃংখলা সৃষ্টির স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে।
সেনাবাহিনী একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ। দেশের প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে বারবার সেনাবাহিনী এগিয়ে এসেছে। বিশাল সংখ্যার সেনাবাহিনীতে কয়েকজন কর্মকর্তার অপরাধের দায় কখনো সেনাবাহিনী নেয়নি। এবারও নিচ্ছে না। সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেছেন, সংবিধান স্বীকৃত বাংলাদেশের সব আইনের প্রতি সেনাবাহিনী শ্রদ্ধাশীল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ও সেনা আইন মুখোমুখি নয়। একটা বনাম আরেকটা এই দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা দেখা উচিত হবে না। সেনাবাহিনী দ্ব্যর্থহীনভাবে বিচারের পক্ষে অবস্থান করে। সেনাবাহিনী ন্যায়বিচারের পক্ষে। আমরা বিশ্বাস করি, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। গুমের শিকার পরিবারগুলোর প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।
আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী দেশ ভারতের অ্যাজেন্ডা বস্তবায়নে ভার্চুয়াল এ মিডিয়াগুলো এখন যেন গুজবের কারখানায় পরিণত হয়েছে। পতিত স্বৈরাশাসক শেখ হাসিনা যেমন ১৪০০ ছাত্রজনতাকে হত্যা করে পালিয়ে দিল্লি যাওয়ার পর থেকে তার এবং দোসরদের পাচার করা অর্থ ব্যয়ে বট বাহিনী গঠন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে; তেমনি ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কন্টেন্ট ক্রিয়েটর অন্তর্বর্তী সরকার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যেতে পারবে না দেশের এমন রাজনৈতিক দল। তারা কখনো আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে দিল্লির এজেন্ডা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, গণভোট ইত্যাদির ইস্যুতে মাঠ গরম করছে। পাশাপাশি তারাও দেশ-বিদেশে বিশাল বট বাহিনী তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের পক্ষে এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। এটা করতে গিয়ে তারা কার্যত আইনের শাসন, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে।
এই মুহূর্তে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে নিরাপদে থেকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, তার দোসর এবং দেশের কিছু জনসমর্থনহীন রাজনৈতিক শক্তি আসন্ন নির্বাচনে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধার সৃষ্টি, সেনাবাহিনী, অন্তর্বর্তী সরকার এমনকি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে বিশেষ কিছু গোষ্ঠীকে মাঠে নামিয়েছে। তারা পরিকল্পিতভাবে একের পর এক গুজব ছড়াচ্ছে। আসন্ন নির্বাচন বিলম্বিত করতে নতুন নতুন ইস্যু সৃষ্টি করছে এবং সেটা নিয়ে দেশি-বিদেশে অবস্থানরত ষড়যন্ত্রকারী বাহিনীকে গুজব ছড়ানোর প্রচারণায় নামাচ্ছেন। আবার পাশাপাশি এই গুজব বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রচারণা চালাচ্ছে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখানে চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে একাধিক নেটিজেন লিখেছেন, পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি মাঠে মারা যাওয়ায় অনেকেই নির্বাচন পেছাতে আইন-শৃংখলার অবনতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টায় উদ্দেশ্যমূলক ভাবে গুজব ছড়াতে পারে। কেউ লিখেছেন, নির্বাচন যখন দরজায় কড়া নাড়ছে এবং মানবতা বিরোধী শত শত মামলার কার্যক্রম শুরু হয়নি তখন ভোটের আগে সেনাবাহিনী বিক্ষুব্ধ হতে পারে এমন মামলাকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার রহস্য কি? কেউ লিখেছেন, কুড়িগ্রামের বড়াই বাড়ির ঘটনার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ভারত ভালো চোখে দেখে না। ২০০৯ সালে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে সেনা হত্যা তার প্রমাণ। তাছাড়া আরাকান আর্মিকে করিডোর দেয়ার বিরোধিতা করেছে সেনাবাহিনী; এটা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত পছন্দ করেনি। অন্যদিকে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে প্রকাশ্য ও গোপনে একের পর এক বৈঠক করছেন। আবার অন্যদিকে রিফাইন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে। এ সবই কি আসন্ন নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করার চেষ্টা? নেটিজেনদের কেউ কেউ এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলামের মামলার আসামি সেনাসদস্যদের গ্রেপ্তারের দাবি, বিএনপির বিবৃতি এবং একদিন পর জামায়াতের বিবৃতি নিয়েও মন্তব্য করেন। ১১ জুলাই বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বিএনপি বিশ্বাস করে, দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব রক্ষায় সংশ্লিষ্ট অপরাধের সুষ্ঠু ও নির্মোহ বিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ন্যায়বিচার শুধু অতীতের ঘটনাগুলোর শাস্তির নিশ্চয়তা দেয় না, বরং ভবিষ্যতে যেন কেউ এমন অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি না ঘটায়, সেই নিশ্চয়তাও দেয়। আইন ও মানবাধিকারের প্রতি পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধাই হতে পারে একটি শান্তিপূর্ণ, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তি। একটি দেশের চলা উচিত ‘ল অফ দ্যা ল্যান্ড’ অনুযায়ী। কিছু চিহ্নিত ব্যক্তির দায় যেমন কোনো প্রতিষ্ঠানের উপর চাপানো উচিত নয়, তেমনি তাদের অপকর্মের কারণে সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করাও অনুচিত। আজকাল কেউ কেউ সারাক্ষণ বলে চলেছেন, তারা বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান চায় না। এরাই মূলত জনগণকে উস্কানি দিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে সামরিক অভ্যুত্থান তৈরির বা অতীতের মতো ১/১১ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। তেমন পটভূমি সৃষ্টি করতে চাইছে। এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার পেছনে কাজ করছে পার্শ্ববর্তী দেশের একটি সুসংগঠিত চক্র। তারা এমনভাবে খেলছে যে, খালি চোখে মনে হতে পারে, এরা দেশের মঙ্গলের পক্ষে কথা বলছে। কিন্তু এরা বাস্তবে সাধারণ মানুষকে উস্কে দিয়ে আত্মঘাতী কাজ করিয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে চায়। এটাই তাদের মাস্টারপ্ল্যান। সুতরাং কারও পাতানো ফাঁদে পা না দিয়ে, নিজেই সত্যমিথ্য যাচাই-বাছাই করতে হবে আমাদের সবাইকে। আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো, অপরাধ যেই করুক তার বিচার হওয়া উচিত। বিগত দিনে সেনাবাহিনীর অভিযুক্ত সদস্যের বিচার সিভিল আদালতে হয়েছে। এবারও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত সাবেক ও বর্তমান সেনা সদস্যদের বিচার হবে। নানা গুজবের মধ্যেও সেনাবাহিনী অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি নেয়ায় সহায়তা করছে। এতে সেনাবাহিনীর সম্মান বাড়বে এবং সেনাপ্রধান হিসেবে অবশ্যই জেনারেল ওয়াকার উজ জামান প্রশংসিত হবেন। সেনাবাহিনীর উজ্জ্বল ইমেজ অক্ষুন্ন রাখতে ষড়যন্ত্রকারীদের সব অশুভ তৎপরতা বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। ধ্বংস করে দিতে হবে তাদের সব নেটওয়ার্ক। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবময় ঐতিহ্য মর্যাদা ও সন্মান অটুট রাখতে আমাদের মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী সচেতন হবেন, সতর্ক থাকবেন, এটা আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।