রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন বিআরটিসিতে ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব মো. তাজুল ইসলাম। তার যোগদানের দুই বছরের মধ্যে বিআরটিসি এখন উদাহরণে পরিণত হয়েছে। তিনি প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক বিষয়ে কথা বলেছেন দৈনিক বাংলার সঙ্গে। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তৌফিকুল ইসলাম।
দৈনিক বাংলা: কেমন আছে বিআরটিসি?
তাজুল ইসলাম: বিআরটিসির মূল্যায়নের ভারটি আমি জনগণের ওপরেই রাখছি। তবে আগের থেকে ভালো চলছে বিআরটিসি। শুধু যাত্রী পরিবহন নয়, বিআরটিসি অনেকগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করে। আমাদের মেরামত কারখানাগুলোকে অনেক শক্তিশালী করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ দিয়ে চালক, টেকনিশিয়ান ও ইঞ্জিনিয়ারদের দক্ষ করে তৈরি করা হয়েছে। আমরা আমাদের অবস্থান তৈরি করেছি। বিভিন্ন জায়গা থেকে এখন বিআরটিসির লোকদের বিশেষজ্ঞ হিসেবে রাখা হয়। এতেই বোঝা যায়, বিআরটিসি একটি ভালো অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছে। বিআরটিসি জনগণের আস্থায় ফিরেছে। আর্থিক টানাপোড়ন মিটিয়ে সুদিনে আমরা। বিআরটিসি এখন পুরোপুরি স্বাবলম্বী।
দৈনিক বাংলা: আগে আর্থিক সংকট ছিল কেন প্রতিষ্ঠানটিরতে?
তাজুল ইসলাম: আমার যতটুকু মনে হয়েছে সেটা হয়েছিল সেই সময়ের ম্যানেজমেন্টের সমস্যার কারণেই। ২০২০-২১ সালে বিআরটিসিতে নতুন গাড়ি এসেছিল, তখন বিআরটিসি লাভ করতে পারিনি, বেতন-বোনাস দিতে পারিনি। কিন্তু এখন পুরান গাড়ি দিয়ে কীভাবে বিআরটিসি লাভবান হলো সেই প্রশ্ন আমিও রেখে গেলাম। আগের অনেক টাকা বেতন বাকি ছিল, আমি আসার পরে সেগুলো পরিশোধ করেছি। আমার সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো টাকা আনতে হয়নি। যেভাবে আমরা আগাচ্ছি, যেখান থেকে আগামী দুই বছরেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের টাকা নিতে হবে না।
দৈনিক বাংলা: চালক প্রশিক্ষণে কী কাজ করছেন?
তাজুল ইসলাম: চালকদের ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মেইনটেনেন্সেরও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। চালকদের আমরা নিরাপদ গাড়ি চালানোর জন্য মোটিভেশনাল ট্রেনিং করাচ্ছি। বিআরটিসির যে চারটা স্তম্ভ আছে, তার মধ্যে ট্রেনিংকেই আমি এক নম্বর স্তম্ভ হিসেবে দেখছি। দক্ষ লোক তৈরি করতে হলে ট্রেনিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং চালক প্রশিক্ষণে আমরা গুরুত্বপূর্ণভাবে কাজ করছি। বিআরটিসির যদি বাস সার্ভিস এবং ট্রাক নাও থাকে তবে বিআরটিসি ট্রেনিং করেও তার প্রতিষ্ঠান চালাতে পারবে।
দৈনিক বাংলা: বিআরটিসির ট্রাক কী সেবা দিচ্ছে দেশের?
তাজুল ইসলাম: আমি আসার পরে জ্বালানি তেলের দাম দুই দফা বেড়েছে। তারপরও কিন্তু অনেক কম টাকায় সার ও খাদ্য পরিবহন করি আমরা। অর্থাৎ কৃষির বাম্পার ফলনের পেছনে বিআরটিসির অবদান অনেক বেশি। করোনার সময় যখন বেসরকারি কোম্পানির ট্রাকগুলো পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন কিন্তু বিআরটিসিই একমাত্র সার ও কীটনাশক পরিবহন করেছে। করানোর সময় দেশ, সরকার এবং জনগণের স্বার্থে আমরা এসব পরিবহন করেছি। তবে এক সাইডে লোকসান করলেও অন্য সাইডে লাভ করে সেটা পুষিয়ে নেয়ার মতো সক্ষমতা বিআরটিসির এখনো হয়েছে। বিআরটিসির ট্রাকের আয় কিন্তু ডাবল হয়েছে।
দৈনিক বাংলা: বিআরটিসিতে ডিজিটালাইজেশন হয়েছে কত ভাগ?
তাজুল ইসলাম: ট্রাকে আমরা ভিটিএস সিস্টেম চালু করেছি। এতে গাড়িগুলো কোথায় আছে সেটা জানতে পারি। এই ধরনের অনেক কার্যক্রম চলছে। বিআরটিসি ৯০ ভাগ কাজ ডিজিটালাইজড হয়েছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ডিজিটালাইজ কাজ আমাদের এখানে অনেক বেশি হচ্ছে। বাসের ই-কিটিং করেছি। আমি আমার দপ্তরে বসে বিআরটিসি সারা দেশের ডিপোর তথ্য পাচ্ছি। বিআরটিসির সব কিছু আমি এখান থেকে মনিটর করতে পারছি। কোনো ফাইল এখন পড়ে থাকে না। প্রতিদিনের ফাইলের কাজ প্রতিদিনেই শেষ। আরেকটি কাজ আমরা করছি, হিউম্যান রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট একটা সফটওয়্যারের কাজ শুরু হয়ে গেছে। আশা করছি আমরা এক মাসের মধ্যে সেটিও চালু করতে পারব।
দৈনিক বাংলা: বাসের সংকট আছে কি না?
তাজুল ইসলাম: বিআরটিসির ইতিহাসে ক্রমেই গাড়ির সংখ্যা কমেছে। কিন্তু আমি আসার পরে সেই গাড়ির সংখ্যা বাড়িয়েছি। ৯০০ গাড়ি থেকে আমি এখন ১৩০০ গাড়ি আমার বহরে আছে। এগুলো কিন্তু সব পুরোনো গাড়ি। আমার আমলে নতুন কোনো গাড়ি কেনা হয়নি। সব পুরোনো গাড়ি মেরামত করে চালু করা হয়েছে। দুই বছর আগেও বিআরটিসি বহরে এত গাড়ি ছিল না। এখন সব রুটে বিআরটিসির গাড়ি দেখতে পাবেন। আমাদের আরো গাড়ির চাহিদা আছে। আরো গাড়ি পেলে নতুন নতুন রুটে আমরা যাত্রী পরিবহন করতে পারব।
দৈনিক বাংলা: বিআরটিসির যাত্রী সেবার মান কি বেড়েছে?
তাজুল ইসলাম: যাত্রীসেবার মান অবশ্যই বেড়েছে। তবে এখনো আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই এতে। সব বাসের ফ্যানগুলো সচল করা হয়েছে। প্রতিটি বাসের ফ্যান চলে এখন, বাসে কিন্তু আর ফ্যান বন্ধ থাকে না। মতিঝিল বাস কাউন্টারে একটি অত্যাধুনিক কাউন্টার করা হয়েছে। আগে বাসের এসিগুলো নষ্ট হয়ে থাকত, এখন সেগুলো নষ্ট হয়ে থাকে না। বিআরটিসির যাত্রী সেবার মান বাড়াতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
দৈনিক বাংলা: বিআরটিসি কি প্রকাশনা করে?
তাজুল ইসলাম: আগে কখনো বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতো না। আমি আসার পর থেকে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আমি আমার মেয়াদের দুই বছরে দুটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। এ ছাড়া নিয়মিত প্রকাশনা বের হচ্ছে। এতে বিআরটিসি কী করছে সবাই জানতে পারবে।
দৈনিক বাংলা: স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য বিআরটিসি তাদের কীভাবে স্মার্ট করছে?
তাজুল ইসলাম: স্মার্ট বাংলাদেশের সঙ্গে বিআরটিসি অনেক আগেই নিজেদের স্মার্ট করার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে। বাসের মধ্যে ক্যামেরা চালু করেছি। এ ছাড়া বিআরটিসির কিছু বাসে ফ্যাটিগ সতর্কীকরণ ডিভাইস লাগানো হয়েছে। আগে ডেস্ক অফিসারদের কাছে কোনো কম্পিউটার ছিল না। এখন প্রত্যেক ডেস্ক অফিসারের কাছে ল্যাপটপ কম্পিউটার দেয়া হয়েছে ।
দৈনিক বাংলা: বিআরটিসির পরিচালনা পর্ষদ চালু করলেন কেন?
তাজুল ইসলাম: প্রায় সাত বছর পরিচালনা পর্ষদ ছিল না। আমি আসার পরে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেছি এবং নিয়মিত বৈঠক করা হচ্ছে। পরিচালনা পর্ষদ থাকলে প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হয়। সেজন্যই আমি বিআরটিসিতে পরিচালনা পর্ষদ চালু করেছি।
দৈনিক বাংলা: বিআরটিসি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
তাজুল ইসলাম: বিআরটিসির বহরের নতুন গাড়ি যুক্ত করতে চাই। সেজন্য কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। ইলেকট্রিক গাড়ির যুগেও আমরা প্রবেশ করাতে চাই বিআরটিসিকে। একই সঙ্গে স্বচ্ছ, আধুনিক ও স্মার্ট বিআরটিসি আমরা গড়ে তুলব। বিআরটিসিকে অনেক প্রতিষ্ঠান ফলো করতে পারে, কীভাবে আমরা লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছি। আমরা এখন ধারাবাহিকভাবে লাভ করে যাচ্ছি। এ ধারা আমরা বজায় রাখতে চাই।
দৈনিক বাংলা: আপনি না থাকলে বিআরটিসির এই ধারা কীভাবে অব্যাহত থাকবে?
তাজুল ইসলাম: মাঠপর্যায়ে এবং ডিজিটালভাবে এমন কিছু কাজ আমরা করে যাচ্ছি যাতে ভবিষ্যতেও স্বচ্ছতা থাকার কথা। নিয়মিত প্রকাশনা বের হচ্ছে, তাতে কিন্তু আমাদের লস লাভের হিসাব থাকছে। নতুন কেউ এসে যদি এসব বন্ধ করে দেন সেক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি। তবে নতুন চেয়ারম্যান যারাই আসবেন তারা যদি জবাবদিহির মধ্যে থাকেন, তাহলে বিআরটিসি পেছনে যাওয়ার সুযোগ নেই।
দৈনিক বাংলা: আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
তাজুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।