সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
৬ আশ্বিন ১৪৩২

পবিত্র আশুরা: বিধান ও ঐতিহাসিকতা

মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন। ফাইল ছবি
মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন
প্রকাশিত
মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন
প্রকাশিত : ২৯ জুলাই, ২০২৩ ০৮:০৬

বিশ্বসভ্যতা ও মানবেতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ও অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হচ্ছে পবিত্র আশুরা। সৃষ্টির সূচনালগ্ন হতে বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত কারবালা প্রান্তরে ফোরাতের তীরে ৬১ হিজরির ১০ মহররম তারিখে সংঘটিত পৈশাচিক, মর্মন্তুদ ও বিয়োগান্তক ঘটনাসহ বিশ্ব-ইতিহাসের নানা বাঁকে তাৎপর্যমণ্ডিত অজস্র ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় সমসাময়িক সমাজ-সভ্যতা নতুন নতুন বার্তা পেয়েছে। বুদ্ধিমানরা সেসব ঘটনা থেকে জীবন-ঘনিষ্ঠ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং গোটা বিশ্বলোক কোনো না কোনোভাবে একেক ঘটনা থেকে একেক ধরনের পয়গাম নিয়ে সভ্যতার উৎকর্ষ বিধানে কাজে লাগিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে সংঘটিত ওই সব ঘটনার কোনোটি হৃদয়বিদারক, কোনোটি চমকপ্রদ আবার কোনোটি বর্বরতা, অমানবিকতা আর নিষ্ঠুরতায় আচ্ছন্ন। তবে মানবেতিহাসে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অবতারণ হয়েছে তার সব ক্ষেত্রেই জানা-অজানা গভীর তাৎপর্য, অনুপম শিক্ষা আর মহান ঐতিহাসিকতা রয়েছে। কোনো কোনো বর্ণনা মতে, আশুরা দিবসে মহান আল্লাহ তাঁর নির্বাচিত দশজন নবী-রাসুলকে বিশেষ অনুগ্রহ ও উন্নত মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন বিধায় এ দিবসকে ‘আশুরা’ হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বলা যায়, পরিকল্পিত বা কাকতালীয় হলেও বিশ্ব-ইতিহাসের ঘটনাসমগ্রের উল্লেখযোগ্য স্মরণীয় ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে পবিত্র আশুরা তথা মহররম মাসের দশম তারিখে। গোটা বিশ্ববাসী বিশেষ করে মুসলিম জগতের কাছে খুবই পবিত্র ও তাৎপর্যময় আশুরার বিধান এবং এ দিবসের শিক্ষা ও ঐতিহাসিকতাই এখানে তুলে ধরা হবে।

আশুরা শব্দটি আরবি আশরুন, আশারা থেকে উদ্গত। যার আভিধানিক অর্থ দশ, দশম বা দশমী। শব্দটি ছিল মূলত ‘আশানুরা’ অর্থাৎ আশুরা দিবসের মর্যাদা রক্ষার বদৌলতে আলোকজ্জ্বল জীবনের অধিকারী। ‘আশানুরা’ হতে ‘নুন’ বাদ দিয়ে শব্দটিকে ‘আশারা’ বা ‘আশুরা’তে রূপান্তরিত করা হয়। ভূমিতে উৎপাদিত শস্য তথা ফল ও ফসলাদির খাজনা বা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির সঙ্গে সংযুক্তির কারণে এক-দশমাংসকে বোঝাতে ‘উশর’ পরিভাষা ব্যবহৃত হয় আবার পৃথিবীতে জীবনযাপন করা অবস্থায়ই পরম স্বর্গের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন অতীব পুণ্যবানকে বোঝাতে ধর্মীয় পরিভাষায় ‘আশারায়ে মুবাশ্বারা’ বলা হয়। তবে পবিত্র আশুরার ক্ষেত্রেই সমগ্র বিশ্বে এই শব্দের বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। কেননা আশুরার ঘটনা যেমন অনেক বেশি, মানবেতিহাসে এর গুরুত্ব এবং তাৎপর্যও তেমনি অপরিসীম। পবিত্র আশুরায় সংঘটিত সব ঘটনার অবতারণা না করে আমরা এখানে ‘আশুরা’ শব্দের প্রতি সুবিচারবশত ইতিহাসের অবিস্মরণীয় দশটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। প্রথমত, আল্লাহপাকের বাণী ‘ইন্নি জায়িলুন ফিল আরদি খালিফাহ’। অর্থাৎ নিশ্চিতরূপে আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি প্রেরণ করব। এই বাণীর আলোকে আশুরা দিবসেই মহান স্রষ্টা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বমানবের আদি পিতা হজরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করেন। বেহেশতে অবস্থান করতে দেয়া, তওবা কবুল করা এবং ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণসহ আদমের (আ.) জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো এই দিবসেই সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, হজরত নুহের (আ.) সময়কালে মহাসত্যে অবিশ্বাসীদের প্রতি প্রলয়ঙ্করী মহাপ্লাবনের সৃষ্টি হলে সর্বব্যাপী ধ্বংসলীলা থেকে শুধু স্বল্পসংখ্যক বিশ্বাসী মানুষ নবী নুহের (আ.) নৌকায় আরওহণের বদৌলতে আশুরা দিবসেই মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে ঐতিহাসিক জুদি পাহাড়ের পাদদেশে মৃত্তিকা স্পর্শ করেন। তৃতীয়ত, মুসলিম মিল্লাতের অবিসংবাদিত পিতা হজরত ইবরাহিমের (আ.) জীবনের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই আশুরা দিবসে সংঘটিত হয়। তাঁর ঘটনাবহুল জন্ম, ‘খালিলুল্লাহ’ তথা আল্লাহর বন্ধু অভিধায় ভূষিত এবং খোদাদ্রোহী নমরুদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ড হতে মুক্তি লাভের ঘটনা আশুরা দিবসেই ঘটেছিল। চতুর্থত, মহান আল্লাহর নির্বাচিত পয়গম্বর মুসা কালিমুল্লাহের (আ.) খোদাবিদ্বেষী বাদশাহ ফেরাউনের নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে মুক্তি, নীল দরিয়ার মধ্য দিয়ে রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা, ফেরাউন ও তার অনুসারীদের সলিল সমাধি এই আশুরা দিবসেই সম্পন্ন হয়েছিল। পরম প্রভু তাঁর প্রিয় রাসুল মুসার (আ.) সঙ্গে ঐতিহাসিক তুর পর্বতে কথোপকথন করেছিলেন আশুরা দিবসেই। পঞ্চমত, নবী ইদ্রিস (আ.)কে মহান প্রভু পরম মমতায় পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে চতুর্থ আসমানে আশুরা দিবসেই উত্তোলন করে নেন। ষষ্ঠত, সৌন্দর্যের আঁধার নবী ইউসুফ (আ.) দীর্ঘ ৪০ বছর স্বীয় পিতা নবী ইয়াকুব (আ.) থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর পিতা-পুত্রের মহামিলন ঘটে এই আশুরা দিবসে। সপ্তমত, আঠারো বছর টানা কঠিন কুষ্ঠরোগ ভোগের পর নবী হজরত আইয়ুব (আ.) নিরাময় লাভ করেন আশুরা দিবসে। অষ্টমত, সাময়িকভাবে বাদশাহী হারানো নবী হজরত সোলায়মান (আ.) ফের মহান সত্তার অশেষ কৃপায় রাজত্ব ফিরে পান এই আশুরা দিবসে। নবমত, টানা চল্লিশ দিন মৎস্যের উদরে অবস্থান করে আশুরা দিবসেই মুক্তি লাভ করেন নবী হজরত ইউনুস (আ.)। দশমত, মহীয়সী মারইয়াম তনয় হজরত ঈসার (আ.) জন্ম এবং তাঁর শত্রুদের হাত থেকে বাঁচাতে মহান আল্লাহ তাঁকে আশুরা দিবসেই দ্বিতীয় আসমানে তুলে নেন। দশজন বিখ্যাত পয়গম্বরের জীবনে সংঘটিত এসব ঘটনা ছাড়াও আশুরা দিবসে মানবেতিহাসের আরও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার অবতারণা হয়েছে। তবে আজকের পৃথিবীতে পবিত্র আশুরার ব্যাপ্তি, গুরুত্ব ও প্রভাবের অন্যতম প্রধান কারণ হলো কারবালার মর্মন্তুদ বিয়োগান্তক ঘটনা, যা আহলে বাইত তথা নবী-পরিবারের শ্রেষ্ঠতম উত্তরাধিকারী এবং মহানবীর (সা.) কলিজার টুকরা দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের শাহাদতের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে।

উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল তাঁর একটি মর্মস্পর্শী শোকগাথা কবিতায় কারবালার ঐতিহাসিক বিয়োগান্তক ঘটনার হৃদয়বিদারক বিবরণ তুলে ধরেছেন। তিনি ইমাম হোসাইনের ভাষায় বলেন, হে কুফাবাসী, আমাকে মুসাফির মনে কর না, আমি নিজে থেকে আসিনি, আমাকে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়েছে। আমি অতিথি হয়ে এসে অত্যাচারিত হয়েছি। আমি স্বেচ্ছায় ক্রন্দন করিনি, বরং আমাকে কাঁদানো হয়েছে। আমার খোদা তা’য়ালাই জানেন এ কেমন আতিথেয়তা, যেখানে বাহাত্তর জন তৃষ্ণার্ত মানুষের জন্য পানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হাউজে কাউসারের সুপেয় পানি পান করা আমার নিয়তিতে ছিল, আমি তো পিপাসিত নই, বরং আমাকে পিপাসার্ত বানানো হয়েছে। যে শির শুধু খোদার দরবারে নত হয়েছিল, সেই শির আজ কারবালার ময়দানে কর্তন করা হলো। আমি তো শাহাদতের মর্যাদাই পেয়ে গেলাম, আমি তো মৃত নই বরং আমাকে তো সম্মানের জীবন দান করা হয়েছে। সুতরাং আমাকে শুধুই একজন মুসাফির ভেব না, আমি নিজ থেকে আসিনি, আমাকে আমন্ত্রণ করেই আনা হয়েছে।

মহররম মাস মুসলিম মিল্লাতের কাছে অতীব পবিত্র ও বরকতময় মাস। কোরআনুল কারিমে যে চারটি মাসকে ‘আশহুরে হুরুম’ তথা সম্মানিত মাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে মহররম তার অন্যতম। এ মাসে কোনো জুলুম বা অন্যায় আচরণ করতে বিশেষভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরকম এক সম্মানিত মাসে আশুরার অবস্থান একে নিঃসন্দেহে আরও মহিমান্বিত করেছে। আর সে জন্যই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্বমানবতার কাছেই আশুরার বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব রয়েছে। মদিনায় হিজরতের পর মহানবী (সা.) যখন দেখতে পেলেন ইহুদিরা আশুরা দিবসের সম্মান করে, এ দিবসে রোজাব্রত পালন করে। তখন তিনি মুসলমানদেরও নির্দেশনা দেন আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করার। এমনকি রাসুল (সা.) আশুরার আগের দিন বা তার পরের দিনও রোজা পালনের আদেশ করেন। এতে করে আশুরা দিবসের ধর্মীয় গুরুত্ব অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর চাইতে মুসলমানদের কাছে অধিক বেড়ে যায়। মুসলিম শরিফের হাদিস মতে, রমজানের রোজার পরেই মর্যাদার দিক থেকে সর্বোত্তম হলো আশুরার রোজা। বুখারি শরিফের বর্ণনা মতে, মহানবী (সা.)কে আশুরা দিবসের রোজা আর রমজানের রোজা পালনের চাইতে অধিক আগ্রহী আর কখনো দেখা যায়নি। সহিহ মুসলিমের অপর হাদিসের ভাষ্য মতে, রাসুলের (সা.) প্রত্যাশা হলো আশুরা দিবসে রোজা পালনের পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী এক বছরের অপরাধ মার্জনা করে দেবেন।

ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল সৃষ্টির ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে আশুরার পবিত্র দিবস। এমনকি পৃথিবীর মহাপ্রলয়ও ঘটবে এই দিবসেই, যা মহানবীর (সা.) ভবিষ্যদ্বাণীতে বিবৃত রয়েছে। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই মহান দিবস। যেকোনো মূল্যে সত্য-ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং সুবিচার তথা আদল-ইনসাফের অনুপম সৌধ নির্মাণের অমোঘ শিক্ষা দেয় এই আশুরা। ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক মূল্যবোধে, সামাজিক রীতিনীতিতে, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে তথা সামগ্রিক পরিমণ্ডলে সত্য, ন্যায়-নীতি-নিষ্ঠা আর সুবিচারের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়ার শিক্ষা পাই আশুরা থেকে। মহাসত্যে বিশ্বাস স্থাপন, সর্বশক্তিমান পরম স্রষ্টার অপার মহিমায় নিজেকে সমর্পণ, তাঁর ক্ষমতার বিশালত্বে আত্মসমর্পণ, নির্ভরশীলতা ও সুদৃঢ় আস্থাজ্ঞাপন, যাবতীয় ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন, সর্বোতভাবে খোদা তা’আলার ঐশী সাহায্যের মুখাপেক্ষিতা, তাঁর সীমাহীন অনুগ্রহ, রহমত আর বরকতের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা এবং জীবনের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে খোদার নির্দেশাবলির সামনে মস্তকাবনত হওয়ার শিক্ষা দেয় আশুরা। আমরা যেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আশুরার বিধান ও ঐতিহাসিকতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরম সত্তার যাবতীয় হুকুম-আহকামের ফরমাবরদার হওয়ার যোগ্যতায় উপনীত হতে পারি- সে তৌফিক প্রার্থনা করছি। (আমিন)

লেখক: অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা চাই

মিজানুর রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

নির্বাচন সামনে এলে সবার আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এর বিষয়টি জোরেসরে উত্তাপিত হয়। অবশ্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি করে? লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর ও কম নয়। নিজেদের হুন্ডা ও গুন্ডা বাহিনী সামলানোর দায়িত্ব নের্তৃবৃন্দের ওপর বর্তায়। দায়িত্বশীল নেতাদের আচারণবিধি ও বহুলাংশে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি করার জন্য উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এর ব্যাপারে দায়িত্বশীল নেতাদের ভূমিকা প্রতিনিয়ত গুরুত্ব পাচ্ছে।

বর্তমানে আওয়ামী লীগবিহীন মাঠে পরিকল্পিতভাবে জামায়াতে ইসলামী বিশাল শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। বিএনপিকে ঠেকাতে ইসলামী আন্দোলন, নেজামে ইসলামী পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি, এবি পার্টি এবং গন অধিকার পরিষদ নিয়ে জোট বাধার প্রক্রিয়া শুরু করছে।নির্বাচনের আগে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি ও তৎপরতা জানান দিতে এবার রাজপথে নামছে জামায়াত জোটবদ্ধ হয়ে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি এবং ফ্যাসিবাদের দূসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি সামনে রেখে মাঠে নামার ঘোষণার মাধ্যমে তিন দিনের কর্মসূচি এরমধ্যে এসেছে। জামায়াত রীতিমতো বিএনপিকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলতে চাচ্ছে। এনসিপি ও এবি পার্টি অবশ্য শেষ পর্যন্ত নিম্নকক্ষের নির্বাচনে পিআর দাবি থেকে কিছুটা পিছুটান হঠলেও জামায়াতের এদের নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা নেই। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্র শিবিরের বিশাল বিজয়ে জামায়াতে ইসলামীর মাঝে আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়েছে। এরা এখন খুব ফুরফুরে মেজাজে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিজয়ে জামায়াতে ইসলামী এসিড টেস্ট হিসেবে দেখছে। জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে জনগণ তাদের পাশে থাকবে বলে এই ধারণাটি তাদের মনোবল অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।

তারেক জিয়া বহুপূর্ব থেকে বলে আসছে আগামী সংসদ নির্বাচন এতটা সহজ নয় খুব কঠিন পরীক্ষা হবে। দেশের বৃহত্তম দল হিসেবে যাদের বিস্তৃতি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সংগঠন আছে বিএনপি ও বসে নেই। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় যারা তাদের সহযোগী ছিল বর্তমানে এদের নিয়েই এগুতে চাচ্ছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আরও আগে থেকেই আগামী সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচনোত্তর সরকার গঠনের ক্ষেত্রে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠনের অঙ্গীকার করেছে। তাছাড়া রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে তারেক জিয়ার ৩১ দফা কর্মসূচি সংস্কারের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে -- এ মনোভাব নিয়ে বিএনপি প্রচারণা চালাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে জনগন বিএনপির সেবা পাবে এই আত্মবিশ্বাস এদের ও কম নয়।

রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত মার্চ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করে আসছে। প্রথম ধাপে দলগুলোর সাথে আলাদাভাবে বসেছিল কমিশন। এরপর দ্বিতীয় ধাপে ৩০টি দল ও জোট নিয়ে ২৩ দিন সংলাপ হয়। দুই ধাপের সংলাপে ৮৪টি বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয় যার ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করেছে কমিশন। কিন্তু বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক না হওয়ায় ঝুলে আছে জুলাই সনদে স্বাক্ষর।

নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কার্যকারিতা হচ্ছে না। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের অনৈক্য ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। দলগুলোর বিশ্বাস -- প্রশাসনকে একটি দলের প্রতি ঝুঁকে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এ জন্য নির্বাচনের সময় কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব এমনকি কেন্দ্র দখলের মত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের শ ঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ভরসা করা যাচ্ছে না।

সম্প্রতি সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারন নিয়ে ভাঙ্গা ও বাগের হাটে চরম অরাজকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা ভাঙ্গা থানা ও নির্বাচন অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। পুলিশ ভয়ে স্থানীয় মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে। পুলিশের এমন ব্যর্থতায় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে কিভাবে নির্ভরশীল হওয়া যায়?

চলতি বছরের শুরুর ৫ মাসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ১৪১টি মব হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫২ জনের প্রাণহানি হয়েছে আহত হয়েছে ২৮৯ জন। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যে তা উঠে এসেছে। পুলিশ কোথায় ছিল?

তৌহিদি জনতার ব্যানারে রাজবাড়ীতে নুরাল পাগলার মাজারে হামলা হয়েছে । কবর থেকে লাশ উঠিয়ে আগুন দিয়ে পুড়ানো-- সংহিতার জঘন্যতম কার্যক্রম দেশের জনগণকে দেখতে হলো। কিন্তু এ ঘটনায় পুলিশ বিন্দুমাত্র ভূমিকা রাখতে পারিনি। ১৮ আগস্ট কুমিল্লার হোমনায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে জনতা ৪টি মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে৷ সেখানেও পুলিশ প্রশাসন নির্বিকার। প্রশাসন এমন দুর্বল হওয়াতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠা থেকে যাচ্ছে। সরকার আরো কঠোর হউক এটা ও জাতীর প্রত্যাশা।

কিন্তু মব যারা করছে এরাতো এদেশের ছাত্র জনতা ও যুব সমাজ। এরা কোনো না কোনো দলের সাথে সম্পৃক্ততা আছে। তা প্রতিহত করতে রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীলরা এগিয়ে আসতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে শঙ্কা থাকলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নির্বাচন কিভাবে হবে। তাইত বিভিন্ন দলগুলো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন।

আগামী নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সবচেয়ে বেশি শষ্কা প্রকাশ করে সোচ্চার জামায়াত। এ বিষয়ে দলটি সরকারের কাছে দাবি ও জানাচ্ছে। ৬ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে জামাতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ‘সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বাহিনী ও সংস্থার কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ও প্রশাসনকে স্বৈরাচারের দোসরমুক্ত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের সব স্তরে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। ১০ আগস্ট নির্বাচন কমিশনের সাথে দেখা করে নির্বাচনের পূর্বে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার আহবান জানান ডা: তাহের। তিনি আরও বলেন এ বিষয় সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে চাই।’

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে চরম অনিশ্চিয়তা কথা জানাচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও। দলটির মুখপাত্র ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান খান বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে পরিবেশ দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং সবার জন্য সমান সুযোগ, তা দেখা যাচ্ছে না।কারণ সরকার একটি পক্ষের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। প্রশাসন ও মনে করছে একটি দল ক্ষমতায় যাবে। আর আমাদের ট্রাডিশন হলো - যারা ক্ষমতায় যাবে তাদের পক্ষে সবাই চলে যায়। এখন সেটাই দেখা যাচ্ছে।

‘নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ‘এখনই কিসের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখন তো নির্বাচন কমিশন ভোটের মাঠেই নামেনি। তবে আমরা চাই একটি গুনগত ও মানসম্পন্ন নির্বাচন যাতে হয়, সে উদ্যেগ নেওয়া। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আশা-নিরাশায় মাঝে আছি। সরকার ইচ্ছা করলে সবকিছু করতে পারবে।’

তবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে এখনই কিছু বলার সময় আসে নি বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা।আমরা সবাই এটাই চাই। আমরা আশা করি সরকার অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যা যা করার করবে। কারণ ড.ইউনূস একটি ইতিহাস সেরা সুন্দর নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি আর ও বলেন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে যারা শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারাই তার কারণ ভালো বলতে পারবেন। এতে কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না সেটাও প্রশ্নের বিষয়।

তবে সরকার দৃঢ়ভাবে বলেছে, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আট লাখের বেশি সদস্য নিয়োজিত থাকবে। সেনাবাহিনী নিয়োজিত থাকবে ৮০ হাজারের বেশি। ড. ইউনূস বলেছেন আসন্ন নির্বাচনটি হবে ইতিহাস সেরা সুন্দর নির্বাচন। এ ধরনের একটি নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করা অপরিহার্য। গত তিনটি নির্বাচনের জন্য দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। ফলে গণঅভ্যুত্থানের পর গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে নির্বাচনের ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।

ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার এ ব্যাপারে আন্তরিক। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করে দেশে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান অবশ্যই সম্ভব হবে বলে অনেকেরই অভিমত।

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছা দরকার। যে কোন দলেই নির্বাচনের বেলায় পেশিশক্তির উত্থানকে নিজেদেরকে প্রতিহত করতে হবে। যারা পেশিশক্তি দেখাবে স্ব স্ব দলগুলো তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি । এ ব্যাপারে আমাদের ছাত্র/ যুব সমাজকে কাজে লাগানো যেতে পারে।যে ছাত্র/যুব সমাজ নিরাপদ সড়ক এর আন্দোলন ও স্বৈরাচার সরকার পতনের ব্যাপারে অগ্রনী ভূমিকা রেখেছে,এরাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির ক্ষেত্রে ভোট কেন্দ্রে নিরাপদ বেষ্টনী গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন নির্বাচনের এত আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে মন্তব্য করার যুক্তি নেই। নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হয়ে গেলে বিষয়টি সামনে আসবে। তাছাড়া এসিড টেস্ট হিসেবে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ গ্রহনযোগ্যভাবে হয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অমনটি হবে সে আশাবাদ আমরা করতেই পারি।

লেখক : মিজানুর রহমান, কলামিস্ট ও সাবেক ব্যাংকার।


ব্যাংক একীভূতকরণ: সমাধান নাকি নতুন সংকট?

আনোয়ার হোসাইন শেখ মুহাম্মদ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ এখন সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিশ্বাস করে দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত হলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বাড়বে। অন্যদিকে সমালোচকরা মনে করছেন, এটি মূল সমস্যাকে আড়াল করার কৌশল হতে পারে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, ব্যাংক একীভূতকরণ আমাদের আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করবে, নাকি আরও বড় ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেবে?

বাংলাদেশের মতো সীমিত ভূখণ্ড ও জনবহুল একটি দেশে বর্তমানে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৬২টি ব্যাংক। অনেক বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ দীর্ঘদিন ধরেই এটিকে অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক বাস্তবতা হিসেবে চিহ্নিত করে আসছেন। হাতের পাঁচটি আঙুল যেমন এক সমান হয় না, তেমনি সব ব্যাংকের পারফরম্যান্স সমানভাবে সফল হবে না, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু সমস্যার জায়গা হলো, কেন কিছু ব্যাংক ধীরে ধীরে সরকারের জন্য এক বিরাট বোঝায় পরিণত হচ্ছে? সরকার তো মূলত জনগণের করের টাকায় পরিচালিত হয়। প্রশ্ন উঠছে, যে সব ব্যাংক দক্ষতার অভাবে, দুর্বল ব্যবস্থাপনা কিংবা খেলাপি ঋণের দুষ্টচক্রে জড়িয়ে টিকে থাকতে পারছে না, তাদের বাঁচাতে কেন সরকারকে এতো তৎপর হতে হচ্ছে? এর পেছনে মূল কারণ হলো, ব্যাংক খাতের প্রতি জনআস্থা ও আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কোনো ব্যাংক হঠাৎ ধসে পড়লে বা বন্ধ হয়ে গেলে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মুখে পড়েন সাধারণ আমানতকারীরা, যাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় এক মুহূর্তে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। আর এ দায়ভার শেষ পর্যন্ত এসে পড়ে সরকারের ওপর, বিশেষত: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর। তাই অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থেই সরকার চায় না ব্যাংক খাত নিয়ে হঠাৎ কোনো বড় ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হোক। কারণ ব্যাংকের পতন কেবল আর্থিক খাতকেই অস্থিতিশীল করে না, বরং শিল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগেও সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেক দেশেই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে বা নতুনভাবে গঠন করতে একীভূতকরণের পথে হেঁটেছে।

বাংলাদেশও শিগগিরই সেই পথেই হাঁটতে যাচ্ছে। নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করলে পরিচালন ব্যয় কমবে, দক্ষতা বাড়বে এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর হবে। পাশাপাশি, দুর্বল ব্যাংকগুলোর কারণে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, তা মোকাবিলায়ও এটি একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। তবে প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুদৃঢ় পরিকল্পনা এবং কঠোর নিয়ন্ত্রক তদারকি অপরিহার্য। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এই উদ্যোগ সফল হবে কি না, তা নির্ভর করছে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও দক্ষতার ওপর। আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ব্যাংক খাতকে সুস্থ-সবল পথে পরিচালিত করাই হওয়া উচিত সরকারের প্রধান লক্ষ্য।

একীভূতকরণের পক্ষে যুক্তি অর্থনীতিতে ‘ইকোনমিজ অব স্কেল’ নামে একটি ধারণা আছে। এর অর্থ, বড় প্রতিষ্ঠানে খরচ তুলনামূলকভাবে কম হয়, কারণ সম্পদ, প্রযুক্তি ও জনবল বেশি পরিসরে ব্যবহার করা যায়। ব্যাংক একীভূত হলে আলাদা আলাদা ভবন, শাখা, আইটি সিস্টেম ও জনবল ধরে রাখার ব্যয় কমবে। এতে কার্যক্রম আরও সাশ্রয়ী হবে। অন্য একটি বড় সুবিধা হলো গ্রাহক আস্থা। দুর্বল ব্যাংক যখন তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন আমানতকারীরা নিশ্চিন্ত বোধ করেন। আমাদের দেশে বারবার ঋণ কেলেঙ্কারি ও খেলাপি ঋণের কারণে আমানতকারীদের মধ্যে ভরসা কমে গেছে। একীভূতকরণ অন্তত কিছুটা হলেও সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।

একীভূতকরণের গোপন ঝুঁকি তবে একীভূতকরণ কোনো জাদুকরী সমাধান নয়। অর্থনীতির আরেকটি বহুল আলোচিত ধারণা হলো ‘ঠু বিগ টু ফেইল এর মানে, কোনো প্রতিষ্ঠান এত বড় হয়ে গেলে তার পতন গোটা অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে যদি দুইটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করা হয়, তাহলে নতুন ব্যাংকটি আরও অস্থির হতে পারে। দুর্বল শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি যদি থেকে যায়, তবে একীভূতকরণের পর সমস্যাগুলো আরও জটিল আকারে ফিরে আসবে। এছাড়া একীভূতকরণের সময় মানবসম্পদ, প্রযুক্তি ও সাংগঠনিক সংস্কৃতি একত্র করা বিশাল চ্যালেঞ্জ। অনেক কর্মী পদ হারানোর আশঙ্কায় আতঙ্কিত হন, আবার এক ব্যাংকের সংস্কৃতি আরেক ব্যাংকের সঙ্গে মেলে না। ফলে নতুন ব্যাংকের ভেতরেই অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।

সাম্প্রতিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

২০২৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকার অনুমোদিত ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিনেন্স’ এর অধীনে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক। সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের মধ্যেই এই একীভূতকরণ সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আমানতকারীদের টাকা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকবে। তবে এক্সিম ব্যাংক বলছে তাদের আর্থিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আছে, তাই তারা একীভূত হওয়ার পক্ষে নয়। তারা স্বাধীনভাবে পুনর্গঠনের পরিকল্পনাও দিয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের একটি বড় অংশ মনে করেন, তুলনামূলক ভালো অবস্থায় থাকা এক্সিম ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে জোর করে যুক্ত করা ঝুঁকিপূর্ণ। এতে আমানতকারীদের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর অনেকে সরাসরি মত দিয়েছে- ‘দুর্বল ব্যাংকগুলো বন্ধ করে দেওয়া ভালো, একীভূত করলেই সমস্যা মিটবে না।’ বাংলাদেশ ব্যাংক এ জন্য প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার পুনর্গঠন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংক এতে সহায়তা করতে পারে বলে আলোচনা চলছে। উদ্দেশ্য একটাই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে স্থিতিশীল করা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।

বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা

ভারতে কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক একীভূত করা হয়েছিল। ভারত সরকার বলেছিলেন এতে দক্ষতা বাড়বে। কিন্তু সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজন সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ‘গভর্নেন্স দুর্বল হলে কেবল ব্যাংক জোড়া লাগিয়ে সমাধান আসে না।’ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেও বড় ব্যাংক একীভূত হওয়ার পর সেগুলো এত বড় হয়ে দাঁড়ায় যে সরকার বাধ্য হয় ট্যাক্সপেয়ারদের অর্থ দিয়ে তাদের বাঁচাতে। এতে নৈতিক ঝুঁকি তৈরি হয়। ব্যাংকগুলো জানে, ব্যর্থ হলেও সরকার উদ্ধার করবে। তাই এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য এটি বড় সতর্ক বার্তা। শাসনব্যবস্থার মূল চাবিকাঠি হিসেবে একটি কথা বলেছেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ডগলাস নর্থ। তার বিখ্যাত উক্তি হলো ‘ইনস্টিটিউশন্স ম্যাটার অর্থাৎ একটি দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা শক্তিশালী, সেটাই তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের আসল নিয়ামক। অপ্রিয় হলেও সত্যি কথাটা হলো, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতার মূলেই আছে শাসনব্যবস্থার সমস্যা, রাজনৈতিক নিয়োগ, দুর্বল বোর্ড, স্বচ্ছতার অভাব এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। এই সমস্যাগুলো সমাধান না করে একীভূতকরণ করলে সেটি কেবল বাহ্যিক রূপ বদলাবে, ভেতরের দুর্বলতা অটুটই থাকবে।

গবেষকদের ধারণা, ব্যাংক একীভূতকরণকে কার্যকর করতে হলে কয়েকটি বিষয় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। শুধুমাত্র দুর্বল ব্যাংক নয়, বরং একে অপরকে পরিপূরক ব্যাংককে একত্র করতে হবে। একীভূত হওয়ার আগে দুর্বল ঋণ আলাদা করে বিশেষ পুনরুদ্ধার সংস্থার কাছে দিতে হবে। কোন ব্যাংক কেন একীভূত হচ্ছে, তা জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। কর্মীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা দূর করতে ন্যায্য সুযোগ ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা ছাড়া একীভূতকরণ শুধু কাগুজে সমাধান হবে। তাই বাংলাদেশের ব্যাংক একীভূতকরণ পরিকল্পনা একই সঙ্গে সুযোগ ও ঝুঁকির সম্ভাবনা তৈরি করছে। তবে সুচিন্তিত ও স্বচ্ছভাবে একীভূত করলে এটি আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করতে পারে, তবে জোরপূর্বক বা রাজনৈতিক প্রভাবে হলে বিপর্যয় ডেকে আনবে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সংখ্যায় কম নয়, মানে ভালো ব্যাংক তৈরি করা, যেখানে আমানতকারী সততা, পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতার ওপর আস্থা রাখতে পারবেন। আমাদের প্রয়োজন কম ব্যাংক নয়, ভালো ব্যাংক। যেখানে জনগণের টাকাই হবে আসল নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।

লেখক ‘ডিজিটাল গভার্নেন্স ইন দ্য ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর’ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.ফিল. ডিগ্রিধারী এবং বর্তমানে পিএইচডি গবেষক। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম), মিরপুর-২, ঢাকার মহাপরিচালকের সচিবালয়ের ফ্যাকাল্টি রিলেশনশিপ উইং-এ মূল্যায়ন ও ডকুমেন্টেশন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।


ফিউচার অব এডুকেশন বা ‘শিক্ষার ভবিষ্যৎ’

সাইদুল ইসলাম মিঠু
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

‘শিক্ষা’ এই শব্দটির মাঝে রয়েছে একটি জাতির ভিত্তি গড়ার শক্তি। যুগে যুগে শিক্ষা বদলেছে, বদলেছে তার পদ্ধতি, কিন্তু শিক্ষা অর্জনের মৌলিক উদ্দেশ্য কখনও বদলায়নি মানুষকে মানুষ করে গড়ে তোলা। মানুষ জন্মগতভাবে কৌতূহলী, আর সেই কৌতূহলের পথ ধরে সে খুঁজে পায় জ্ঞান। শিক্ষা হল সেই আলো, যা মানুষকে অন্ধকার থেকে মুক্ত করে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলে। যুগে যুগে শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে নানা পরিবর্তন। গুহাচিত্রে শেখা থেকে শুরু করে প্রাচীন গুরুকুল, পাঠশালা, আধুনিক বিদ্যালয় ও আজকের ভার্চুয়াল শ্রেণিকক্ষ সবকিছুই সময়ের দাবিতে গড়ে উঠেছে। কিন্তু আজ আমরা এমন এক যুগে প্রবেশ করছি, যেখানে প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), অটোমেশন, এবং গ্লোবাল কানেকটিভিটির প্রভাবে শিক্ষা একটি নতুন রূপ নিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিবর্তন আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? ২১শ শতাব্দীতে এসে আমরা এক পরিবর্তনের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে প্রযুক্তি, তথ্য, ও নতুন চিন্তাধারার প্রভাবে বদলে যাচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা। তাই এখনই সময়, আমরা ভাবি: আগামী দিনে শিক্ষার চেহারা কেমন হবে?

আগামী দিনের শিক্ষা হবে প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষতা-ভিত্তিক এবং আরও বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আমাদের চিন্তা করার ধরন, শেখার প্রক্রিয়া, এমনকি শেখার জায়গাটাও বদলে যাচ্ছে। আধুনিক শিক্ষা আর শুধু বই আর খাতা দিয়ে সীমাবদ্ধ নয় এখন শিক্ষার হাতিয়ার হলো ল্যাপটপ, মোবাইল, ইন্টারনেট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আগের দিনে শিক্ষক ছিলেন মূল জ্ঞানদাতা, আর ছাত্র ছিল শ্রোতা; কিন্তু ভবিষ্যতের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক হবেন একজন গাইড, আর শিক্ষার্থী হয়ে উঠবে নিজের শেখার প্রধান চালক।

  • অনলাইন শিক্ষা: কোভিড-১৯ মহামারী আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে শুধু শ্রেণিকক্ষ নয়, স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ থেকেও শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব। Coursera, Khan Academy, BYJUS, Google Classroom এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের দেখিয়েছে বিশ্বমানের শিক্ষা এখন সবার জন্য উন্মুক্ত।
  • এআই এবং মেশিন লার্নিং: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) শিক্ষার্থীদের শেখার ধরন বুঝে তাদের জন্য কাস্টমাইজড পাঠ তৈরি করতে পারবে। ChatGPT-এর মতো এআই টুলস ইতোমধ্যেই ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর, প্রবন্ধ লেখা, কোড শেখানোসহ অনেক বিষয়ে সাহায্য করছে।
  • ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR): এই প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব অভিজ্ঞতা নিতে পারবে। যেমন ইতিহাসের ক্লাসে তারা ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের ঘটনা ‘দেখতে’ পাবে, কিংবা জীববিজ্ঞানের ক্লাসে মানবদেহের ভিতরের অঙ্গগুলোর ভার্চুয়াল ভ্রমণ করতে পারবে।

প্রতিটি শিক্ষার্থী আলাদা, তাদের শেখার ধরনও ভিন্ন। ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থা একেকজনের সক্ষমতা ও আগ্রহ অনুযায়ী আলাদা পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করবে। কেউ যদি চিত্রকলায় ভালো হয়, তবে সে হয়তো তার পাঠের বড় একটা অংশ সেই শিল্পভিত্তিক দক্ষতায় ব্যয় করবে।

আগে যেখানে পুরো শ্রেণিকক্ষে একটাই পাঠ্যক্রম পড়ানো হতো, এখনকার ও আগামী দিনের শিক্ষা আরও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হবে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর শেখার ধরন, গতি ও আগ্রহ অনুযায়ী তাদের জন্য আলাদা কনটেন্ট ও মেথড থাকবে।

  • যে শিক্ষার্থী দ্রুত শিখতে পারে, সে তার গতিতে এগোতে পারবে।
  • যে একটু ধীরে শেখে, তার জন্য পুনরাবৃত্তিমূলক কনটেন্ট থাকবে।
  • আগ্রহভিত্তিক বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকবে আরও বেশি।

এভাবে শেখা হবে স্বাধীন, উদ্দীপনামূলক ও দারুণ কার্যকর। আগামী ২০ বছরে এমন অনেক পেশা চলে যাবে, যা আজ রয়েছে। আবার এমন অনেক পেশার জন্ম হবে, যার কথা আমরা এখনো জানি না। তাই শিক্ষার লক্ষ্য হতে হবে শুধু তথ্য মুখস্থ করানো নয়, বরং বাস্তব জীবনে টিকে থাকার উপযোগী দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া।

  • প্রযুক্তিগত দক্ষতা: কোডিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ক্লাউড কম্পিউটিং, AI, ডেটা অ্যানালিটিক্স।
  • মানবিক দক্ষতা: সমস্যা সমাধান, বিশ্লেষণী চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা, নেতৃত্ব, যোগাযোগ ও সহানুভূতি।
  • আর্থিক সচেতনতা ও উদ্যোক্তা মনোভাব: ভবিষ্যতের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা দেবে, শুধু চাকরির জন্য প্রস্তুত নয়।

বর্তমানের পরীক্ষা-কেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মাঝে চাপ ও প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দেয়। ভবিষ্যতের শিক্ষা হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ননির্ভর, যেখানে শিক্ষার্থীর মৌলিক চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা, দলগত কাজের ক্ষমতা প্রাধান্য পাবে।

  • প্রকল্পভিত্তিক মূল্যায়ন (Project-based Assessment)
  • ই-পরীক্ষা ও অটোমেটেড মার্কিং
  • 360 ডিগ্রি ফিডব্যাক সিস্টেম – যেখানে শিক্ষক, সহপাঠী এবং নিজের মূল্যায়ন মিলিয়ে দক্ষতা যাচাই হবে।
  • একটা সময় শিক্ষক ছিলেন তথ্য সরবরাহকারী। এখন তথ্য সবার হাতে। গুগল সার্চ করলেই জ্ঞান পাওয়া যায়। তাই আগামী দিনের শিক্ষক হবেন অনুপ্রেরণাদায়ী গাইড, যিনি শিক্ষার্থীর মানসিক, নৈতিক এবং সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
  • শিক্ষক হবেন মানসিক সহায়তাকারী।
  • শিক্ষার্থীর মাঝে অনুসন্ধানী মন তৈরি করবেন।
  • শেখার পরিবেশকে মানবিক ও উৎসাহব্যঞ্জক করবেন।

শুধু দক্ষতা নয়, ভবিষ্যতের সমাজে প্রয়োজন হবে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি। প্রযুক্তির উন্নয়ন যতই হোক, যদি মানুষ মানবতা ভুলে যায়, তবে তা বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই শিক্ষা হবে এমন, যেখানে শেখানো হবে—

  • সহানুভূতি ও সহনশীলতা
  • পরিবেশ সচেতনতা
  • সামাজিক দায়বদ্ধতা
  • দায়িত্ব ও নেতৃত্ববোধ

বাংলাদেশেও শিক্ষার এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগছে। নতুন কারিকুলামে দক্ষতা ও মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম, স্মার্ট স্কুল উদ্যোগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি শিক্ষার প্রসার সবকিছু মিলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে।

তবে, এখানেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  • প্রযুক্তিগত অপ্রতুলতা
  • গ্রাম-শহরের বিভাজন
  • ইন্টারনেট সুবিধার সীমাবদ্ধতা

এসব মোকাবিলা করে আমরা যদি প্রযুক্তি ও মানবিকতাকে একত্রিত করে শিক্ষার পথকে রচনা করতে পারি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ সত্যিই হবে আশাজাগানিয়া। শিক্ষার ভবিষ্যৎ আমাদের হাতেই। এটি হবে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ, মানবিক মূল্যবোধনির্ভর, দক্ষতা ও স্বাধীনচেতা মননের উৎস। পরিবর্তনের এই ঢেউ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। বরং আমাদের উচিত শিক্ষার এই পরিবর্তনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া, শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একটি পথ তৈরি করা, যেখানে তারা কেবল ভালো পরীক্ষার্থী নয় ভালো মানুষ, দক্ষ পেশাজীবী ও সচেতন নাগরিক হয়ে উঠতে পারে।

শেষ কথায়

বিখ্যাত দার্শনিক জন ডিউই বলেছেন

‘If we teach today’s students as we taught yesterday’s, we rob them of tomorrow.’

তাই আজকের শিক্ষা হতে হবে আগামীর জন্য। শিক্ষা যেন হয়ে ওঠে জীবনের জন্য শিক্ষা শুধু পাস করার জন্য নয়।

লেখক: প্রযুক্তিবিদ ও কলামিস্ট


‘সামনে নির্বাচন পুলিশসহ সকলকে সজাগ থাকতে হবে’

সৈয়দ শাকিল আহাদ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

ঢাকাসহ সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে কারিগরি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, দাবি আদায়ের জন্য তেজগাও সাত রাস্তায় আড়াই ঘণ্টা পথরোধ করার রাজধানীবাসী দুর্ভোগে পড়েন। ফেব্রুয়ারিতে জুলাই সনদের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ কয়েক দফা দাবিতে রাজধানী ঢাকায় গত বৃহস্পতিবার একযোগে বিক্ষোভ মিছিল করেছে জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি দল। বিক্ষোভের আগে বায়তুল মোকাররম, জাতীয় প্রেসক্লাবসহ আশপাশের এলাকায় দলগুলো সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেছে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব কর্মসূচি ছিল।
প্রায় অভিন্ন দাবিতে সাতটি দল তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর সব জেলা ও উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি রয়েছে দলগুলোর। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) এই কর্মসূচি পালন করবে। সাতটি দলের কেউ ৫ দফা, কেউ ৬ দফা, কেউ ৭ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলেও সবার মূল দাবি প্রায় অভিন্ন।
দাবিগুলো হচ্ছে :-জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং তার ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান, জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষে (কেউ কেউ উচ্চকক্ষে) সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতি চালু করা।অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার সমান সুযোগ) নিশ্চিত করা

বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। দাবি আদায়ের নামে রাস্তায় আন্দোলন করে জনগণকে দুর্ভোগে ফেলে । সরকার ও প্রশাসনকে বিব্রত পরিস্থিতি ও অস্তিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে যাবার আগে কর্মসূচি প্রণেতাদের ভাবতে হবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কি ? আমরা কোথায় আছি এবং দেশের অর্থনীতি কোথায় যাচ্ছে?
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের বছর পার করার পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন কতটুকু সফল হয়েছে সেইসাথে কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেন ব্যর্থ হতে হচ্ছে তা একটু ভাবতে হবে।
ঢাকায় মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সরকারকে ও দেশবাসীকে তীব্র সমালোচনার মুখে ফেলেছিল যা আমাদের সকলেরই জানা আছে।
দেশে আনাচে কানাচে অযাচিতভাবে
মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা, বিভিন্ন স্থানে হামলা, খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মিটফোর্ডের ঘটনা ছাড়াও খুলনায় যুবদলের এক নেতাকে হত্যার পর পায়ের রগ কেটে দেয়া, চাঁদপুরে মসজিদের ভেতরে ইমামকে চাপাতি দিয়ে কোপানোসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, চাঁদাবাজিসহ বহু ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবে আলোচনায় এসেছে।
এর আগে মার্চ মাসে ঢাকার কাছে মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলায় আপন দুই ভাইসহ তিনজনকে মসজিদের ভেতরে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছিল।
এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে একের পর এক ‘মব সন্ত্রাস’ জনজীবনে আরেক উপসর্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যেসব ঘটনার সময় অনেকে ক্ষেত্রেই সরকার কিংবা পুলিশ দেখেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
জনমনে শংকা ও আমাদের কৌতুহল,
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী যদি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সেই দিনক্ষণ আর বেশি দূরে নয়। বর্তমান ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ ধরলে আগামী পাচ মাস পরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এই সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের পক্ষে থেকে আশার বাণী শোনালেও বাস্তবে তা সন্তোষজনক নয়।
দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে আমাদের মনে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এখনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না বলেই মনে হবে , এখনো মব ভায়োল্যান্স, নির্যাতন, প্রকাশ্যে হত্যা, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা সামনে আসছে। মোহাম্মদপুরে তো ঘটেই চলেছে নতুন নতুন আতংক একের পর এক লোমহর্ষক ঘটনা, ছিনতাই এবং চাদাবাজি, তাছাড়া তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কবে যে ঘুরে দাঁড়াবে সেটাই প্রশ্ন?
জাতীয় নির্বাচনের আগে কি স্বাভাবিক হবে? কবে জনগণ শান্তিতে পথ চলবে?
এমন নানা প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এর প্রভাব পড়বে জাতীয় নির্বাচনে এবং আমাদের অর্থনীতিতে । আগামী সময় এ পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হওয়ার সম্ভাবনার কথা আশংকা করছেন তারা।

এদিকে গণঅভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া অস্ত্রসহ সারাদেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নির্বাচনের আগে এসব অবৈধ অস্ত্র দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্ধার করা হবে বলে সম্প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। যা সন্তোষজনক বলে মনে করেন কেউ কেউ।

পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
তবে বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা নিয়ে স্বয়ং পুলিশ বাহিনীর কেউ কেউ একমত প্রকাশ করেছেন। বাহিনীর সবোর্চ্চ মহল থেকে বলা হচ্ছে, পুলিশ ফোর্সের মোরাল বুস্টআপ তারা এখনো করতে পারেননি। যার ফলে অনেক অপরাধই চোখের সামনে সংঘটিত হলেও কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না।
এসব অপরাধের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকেও সোচ্চার হতে দেখা গেছে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দলই বিভিন্ন ঘটনার পর মব ভায়োল্যান্সের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানিয়েছে। তবে এতকিছুর পরও হামলা, মামলা, নির্যাতন মব ভায়েল্যান্সের মাধ্যমে প্রকাশ্যে হত্যার মতো ঘটনা থামছে না। সর্বশেষ গত ৭ আগস্ট সন্ধ্যায় গাজীপুরে পুলিশের সামনে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তার আগে ১০ জুলাই সন্ধ্যায় রাজধানীর পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে লোকজনের সামনে লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগ (৩৯) নামের এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা যেমন জনমনে দাগ কেটেছে, দেশে বিদেশে আলোচনার-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
অপরাধ সূচক থেকে যা জানা যাচ্ছে
গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত আছে বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির মতে, খুন, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, লুটপাট, অরাজকতা চলছেই। পুলিশ এখনও নির্লিপ্ত, দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ এবং পেশাদারত্বেরও ঘাটতি রয়েছে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত ৪ আগস্ট রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির নিজ কার্যালয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব কথা জানানো হয়।
এবং তাদের দেয়া কিছু পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এ বছর প্রতি মাসেই খুনের ঘটনা বাড়ছে। খুনের ঘটনা বেশি ঘটছে ঢাকা মেট্রোপলিটন, ঢাকা রেঞ্জ ও চট্টগ্রাম রেঞ্জে। অনেক খুনের পেছনে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের মতো ঘটনা কাজ করেছে বলে জানা যাচ্ছে।
খুনের পাশাপাশি সারাদেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ডাকাতি, ছিনতাই, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং অপহরণের মতো অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৬টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৪টি ডাকাতি হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। এছাড়া এ ছয় মাসে ১১ হাজার ৮টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চলমান রয়েছে। এছাড়া সারা দেশে বিশেষ করে অপরাধপ্রবণ এলাকায় পুলিশের বিশেষ টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অপরাধীদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশের বড় বড় শহর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করে অপরাধীদের আটক করা হচ্ছে। দেশব্যাপী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের তৎপরতা অব্যাহত আছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজাদ আলী রাজারবাগে সম্প্রতি এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘বিগত বছরে বিশেষ করে মেট্রোপলিটন পুলিশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। একসময় যে ভঙ্গুর অবস্থায় চলে গিয়েছিল পুলিশ সেখান থেকে এখন অনেকটাই পেশাদারত্বে ফিরে এসেছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। পুলিশ পেশাদারত্ব ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসন্ন নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে একটি দৃষ্টান্তে পরিণত করবে।’
এ প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ওমর ফারুক একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ’সামনে দিন যত যাবে পরিস্থিতি তত খারাপের দিকে যাবে। নির্বাচনকে কেন্দ্রে করে সহিংসতা আরও বাড়তে পারে বলে আমরা আশংকা করছি। মূল সমস্যা হলো সবাই ক্ষমতার পালা বদলে ব্যস্ত। ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্কারে সরকারের কাজগুলো তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। রাজনৈতিক অস্থিরতাটাই মূল কারণ, যেটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। এছাড়া পুলিশবাহিনী এখনও খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এখনো পুলিশ পুরোদমে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ সময়টাকে অপরাধীরা সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়েছে। যার ফলে এসব নৈরাজ্য চলছে।’

এ প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন এর সাথে সহমত প্রকাশ করে বলতে হচ্ছে ‘সামগ্রিকভাবে যদি চেষ্টা করা হয় তাহলে অল্প দিনের মধ্যেই পুলিশকে সেই মর্যাদার জায়গায় নেওয়া সম্ভব। যেখান থেকে পুলিশ জনগণকে সাহায্য ও সহযোগিতা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অবদান রাখতে পারে। সে জন্য পুলিশকে ঢেলে সাজাতে হবে। এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সফল ও স্বার্থক করে তুলতে হবে এটা নির্ভর করছে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তাদের সদিচ্ছা ও আম জনতাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতার ওপর।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন এর সাথে সহমত প্রকাশ করে বলতে হচ্ছে ‘সামগ্রিকভাবে যদি চেষ্টা করা হয় তাহলে অল্প দিনের মধ্যেই পুলিশকে সেই মর্যাদার জায়গায় নেওয়া সম্ভব। যেখান থেকে পুলিশ জনগণকে সাহায্য ও সহযোগিতা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অবদান রাখতে পারে। সে জন্য পুলিশকে ঢেলে সাজাতে হবে। এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সফল ও স্বার্থক করে তুলতে হবে এটা নির্ভর করছে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তাদের সদিচ্ছা ও আম জনতা সহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতার ওপর।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের ভেতর এক ধরনের অনাস্থা কাজ করছে। কারণ বেশ কিছু পুলিশ সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। প্রতিটা হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। আমার ধারণা, এর মধ্যে দিয়ে পুলিশ আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তদের অংশগ্রহণ আমরা লক্ষ্য করছি। রাজনীতিতে দুর্নীতিবাজদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, তারাই আবার মেইন স্ট্রিমে অবস্থান করছে। এখন যেটি দেখা যাচ্ছে-অস্থিতিশীল অবস্থা, চাঁদাবাজি, লুটপাট, নির্যাতন- এর একটা বড় অংশ করছে রাজনৈতিক সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। এগুলো থেকে ফিরে আসতে হবে।’ সামনে নির্বাচন, এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন লেভেল প্লেয়িং হবে কি করে।যদি না সব দলসহ সবাইকে কার্যকর ভূমিকা না রাখতে পারে। তাই দরকার সবাইকে এক ও অভিন্ন দৃষ্টিতে নির্বাচনের জন্য কাজ করা, তাহলেই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। রাজনৈতিক দলগুলো নানা ওচিলায় দাবি আদাযে ব্যস্থ থাকলে, দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সস্ত্রাসবাদ জেগে ওঠবে।, তাহলে লেভেল প্লেইঙ হবে কি করে। এ বিষয়টি রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে ভাবতে হবে।


সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা আবশ্যক

মো. রহমত উল্লাহ্
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বিশ্বের প্রতিটি দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাক্রমে বা কারিকুলামে শিক্ষামূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ কারিকুলাম অনুসারে নির্ধারিত শ্রেণির নির্ধারিত পাঠ্যক্রমের বিষয়/অধ্যায় পাঠদান চলাকালে বা সমাপ্তিতে শিক্ষার্থীদের অর্জিত শিক্ষা মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত পাঠের অধ্যয়ন ও অনুশীলন দ্বারা শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশিত জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির কতটুকু অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তা যাচাই করার উপায় হচ্ছে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন। পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করেই জানা যায় শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি আছে কিনা, ঘাটতির পরিমাণ কতটুকু, কোন ক্লাসে কে পড়ার উপযোগী। ঘাটতি চিহ্নিত করা গেলেই সে ঘাটতি পূরণের জন্য নেওয়া যায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এটি অনেকটা রোগ নির্ণয়ের মতই। রোগ নির্ণয় ভুল হলে, ত্রুটিপূর্ণ হলে, অসম্পন্ন হলে যেমন সঠিক চিকিৎসা করা সম্ভব নয়, রোগী সুস্থ-সবল করা সম্ভব নয়; তেমনি শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা চিহ্নিত করে সেটি কাটিয়ে ওঠার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথাযথভাবে শিক্ষা মূল্যায়ন তথা পরীক্ষা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যত দ্রুত শিক্ষার্থীর দুর্বলতা চিহ্নিত করা যায় তত দ্রুত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা নেওয়া যায় এবং অধিক সফলতা অর্জন করা যায়। পাঠদানের ও মূল্যায়নের দুর্বলতার কারণে শিখন ঘাটতি নিয়ে শিক্ষার্থীরা উপরের ক্লাসে উঠতে থাকলে পরবর্তীতে এ ঘাটতি আর পূর্ণ করা সম্ভব হয় না অনেকের ক্ষেত্রেই।

আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের উপর ভরসা করে একজন শিক্ষার্থীকে টানা ১০ বছর পর্যন্ত উপরের ক্লাসে উঠতে দেওয়া হলে অর্থাৎ প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত যেতে দেওয়া হলে সেটি কতটা যৌক্তিক হবে, মঙ্গলজনক হবে তা গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখা উচিত। যেখানে আমাদের দেশের গ্রামে, শহরে, উপশহরে অবস্থিত কেজি স্কুল, প্রাইভেট স্কুল, সরকারি স্কুল, বেসরকারি স্কুল, মাদ্রাসা, বাংলা মাধ্যম স্কুল, ইংলিশ ভার্সন স্কুল ইত্যাদির পরিবেশ, অবকাঠামো, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষার মান, সহশিক্ষার মান, মূল্যায়নের মান, সব ক্ষেত্রেই আকাশ-পাতাল ব্যবধান এবং যেখানে হাজার হাজার অনুমোদনহীন স্কুল-মাদ্রাসা অন্য স্কুল-মাদ্রাসা থেকে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন করায়, সরকারি পরীক্ষা দেওয়ায়; সেখানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন শ্রেণিতে অর্জিত ও কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার জাতীয় মান নির্ধারণ শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের মাধ্যমে কোনভাবেই সম্ভব নয়। বর্তমানে সারাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাস করে না, ঠিকভাবে লেখাপড়া করে না, শিক্ষকদের মান্য করে না, সকল পরীক্ষা দেয় না, দিলেও পাশ করে না; তথাপি প্রমোশন চায়, পায়!! অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকগণ প্রমোশন দিতে বা গ্রেট বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হন।

অপরদিকে শিক্ষকদের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও প্রতিষ্ঠানের অনুমতি/ স্বীকৃতি বজায় রাখার জন্য কাম্যসংখ্যক শিক্ষার্থী ধরে রাখতে হয়। অথচ এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে শিক্ষার্থীদের কড়াকড়ি করা হলে, পরীক্ষায় প্রশ্ন কঠিন করা হলে, নম্বর বেশি দেওয়া না হলে, উপরের ক্লাসে প্রমোশন দেওয়া না হলে, অন্য স্কুলে বা মাদ্রাসায় চলে যায়। তখন শিক্ষকগণের বেতন বন্ধ হবার ও চাকরি চলে যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই ওই সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের প্রমোশন দেওয়ার জন্য, ভালো ফলাফল দেখানোর জন্য, শিক্ষা মূল্যায়নে ব্যাপক অনিয়মকেই নিয়মে পরিণত করেন! আমাদের দেশে এমন অভিভাবকের সংখ্যাও কম নয় যারা সন্তানদের ক্লাসে ভালো শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে পরীক্ষায় বেশি নম্বর দিলেই খুশি হন, ভালো মনে করেন।

এমন কঠিন বাস্তবতায় সারাদেশের শিক্ষার্থীরা ১০টি শ্রেণি অতিক্রম করার পরে এসএসসি ও সমমানের সরকারি পরীক্ষার মাধ্যমে দেশের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর ব্যাপক দুর্বলতা বা শিখন ঘাটতি চিহ্নিত করা হলে সে ঘাটতি পূর্ণ করার কোন উপায় থাকবে বলে আমি মনে করি না। শিক্ষা গবেষণায় সম্পৃক্ত প্রায় সবাই আমার সঙ্গে একমত হবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। তদুপরি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা মূল্যায়নের মাধ্যমে একদিকে ক্ষুদ্র পরিসরে শিক্ষার্থীর, শিক্ষকের ও পাঠদানের মূল্যায়ন হয়ে থাকে; অপরদিকে বৃহৎ পরিসরে পাঠ্যপুস্তক, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন হয়ে থাকে। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাক্রমের মান বৃদ্ধির জন্যও যৌক্তিক সময়ের পরপর জাতীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন আবশ্যক হয়। এ সকল বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে আমাদের দেশের বাস্তবতার ভিত্তিতে জাতীয়ভাবে শিক্ষামূল্যায়নের যৌক্তিক স্তর নির্ধারণ করা উচিত।

শিক্ষায় প্রভাব বিস্তারকারী ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক, বৈশ্বিক ইত্যাদি বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে যুক্তরাজ্যে শিক্ষার্থীদের ষষ্ঠ শ্রেণিতে SATs পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারিভাবে মূল্যায়ন করা হয়। তানজানিয়া, উগান্ডা, জাম্বিয়াতে শিক্ষার্থীদের সপ্তম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা হয়। আমাদের নিকটবর্তী চীন, ভারত, পাকিস্তান, নেপালে শিক্ষার্থীদের অষ্টম শ্রেণিতে প্রাদেশিক বা জাতীয়ভাবে পাবলিক পরীক্ষা হয়ে থাকে। ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে প্রভৃতি দেশে প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের উন্নত পরিবেশ অর্জিত হওয়ায় পাবলিক পরীক্ষা আরো পরে হয়ে থাকে। লক্ষনীয় যে, বিভিন্ন দেশের সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের সঠিক পাঠদান ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করার জন্য পাবলিক পরীক্ষার যৌক্তিক স্তর নির্ধারিত হয়ে থাকে। সবদিক বিবেচনা করে আমাদের দেশেও শিক্ষার্থীদের সপ্তম বা শ্রেণিতে জাতীয়ভাবে মূল্যায়নের একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা আবশ্যক। শুধুমাত্র বাছাইকৃত স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য বৃত্তি পরীক্ষার আয়োজন করে তা সম্ভব নয়। সারাদেশের সকল শিক্ষার্থীর জন্য একই মানদন্ডে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। সে মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে মেধাবৃত্তিও দেওয়া যাবে। মেধাবৃত্তির পাশাপাশি দরিদ্রবৃত্তি চালু করার কথাও ভাবতে হবে।

আমাদের দেশের বাস্তবতায় যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মেধাবৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নকে কেউই নির্ভরযোগ্য মনে করেন না; সেহেতু পরোক্ষভাবে প্রায় সবাই জাতীয় বা সরকারি মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। তাই আবারও বলছি, আমাদের দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের ও মানের প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে বেশিদূর নিয়ে যাওয়া মোটেও মঙ্গলজনক নয়। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের অর্জিত শিক্ষার মান জাতীয়ভাবে মূল্যায়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেক বিস্তৃত। প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিপূর্ণভাবে অর্জন অসম্ভব। তাই বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্তরে জাতীয়ভাবে বা সরকারিভাবে শিক্ষামূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। জাতীয় মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে জাতীয়ভাবে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। আমাদেরও তাই করতে হবে। সার্বিক বাস্তবতার উপর ভিত্তি করেই নির্ধারণ করতে হবে জাতীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের প্রথম ও পরবর্তী বিভিন্ন স্তর। অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা যদি ষষ্ঠ/সপ্তম/অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে নির্ভয়ে প্রথম অংশ নিতে পারে জাতীয় মূল্যায়নে তাহলে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা পারবে না কেন? আমাদের শিক্ষার্থীদের চাপ মুক্ত রাখার কথা বলে বলে জাতীয় মান নির্ধারণী পরীক্ষামুক্ত রাখতে গিয়ে কম/বেশি শিক্ষামুক্ত রাখছি কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে গভীরভাবে!

লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাগবেষক ও শিশুসাহিত্যি।


তাফসীরে হিদায়াতুল কোরআন

ড. আবুল হাসান সাদেক
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

সুরা সাজদাহ, পর্ব ৪

অনুবাদ

(১৮) যে ব্যক্তি মুমিন, সে কি ফাসিকের মতো হতে পারে? তারা সমান নয় । (১৯) যারা ঈমান আনে ও নেক কাজ করে, তাদের বাসস্থান হলো জান্নাত, তাদের নেক আমলের প্রতিদানমূলক আতিথেয়তা হিসেবে। (২০) আর যারা অপরাধ করে, তাদের বাসস্থান হলো জাহান্নাম। যখনই তারা সেখান থেকে বেরুতে চাইবে, তাদেরকে তাতে ঠেলে দেওয়া হবে, আর বলা হবে: তোমরা দোযখের মজা ভোগ করো, যাকে তোমরা অস্বীকার করতে। (২১) আমি তাদেরকে বড় শাস্তির পূর্বে (দুনিয়াতে) ছোট শাস্তির স্বাদ ভোগ করাবো, যেনো তারা (সুপথে) ফিরে আসে। (২২) তার চেয়ে বড় যালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার প্রতিপালকের আয়াতের মাধ্যমে উপদেশ দেওয়া হয়, কিন্তু তারপরও সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নিশ্চয়ই আমি অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করব।

মর্ম ও শিক্ষা:

ইতোপূর্বে দুনিয়া ও আখিরাতে বাতিলপন্থি ও সত্যপন্থিদের অবস্থা আলাদা আলাদাভাবে বর্ণিত হয়েছে। তারপর এখানে বলা হয়েছে, বাতিলপন্থি ও সত্যপন্থিদের অবস্থা সমান নয়। তারা আখিরাত ও দুনিয়া উভয় স্থানে দুই রকম অবস্থার সম্মুখীন হবে। বাতিলপন্থিদের জন্য রয়েছে কঠিন পরিণতি। আর সত্যপন্থিদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।

মুমিন ও ফাসেক সমান নয়:

আয়াতে বলা হয়েছে, মুমিন আর ফাসেক কখনো সমান নয়। মুমিন তারা, যারা ঈমানের দাবী অনুযায়ী জীবন যাপন করে। ফাসেক হলো অবিশ্বাসী ও শিরককারী, যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে। কিয়ামতের দিন ফাসেকরা ভয় ও আতঙ্কে ছুটোছুটি করবে, সন্তান-সন্ততিও কাউকে উপকারে আসবে না। তারা দোযখের কঠিন শাস্তি পাবে এবং মুক্তি পেতে চাইবে, কিন্তু ফের জাহান্নামেই ফিরিয়ে দেওয়া হবে। অন্যদিকে মুমিনরা কিয়ামতে শান্তিতে থাকবে এবং জান্নাতে সম্মানিত অতিথির মতো মর্যাদাপূর্ণভাবে গ্রহণ করা হবে।

মুমিনের বাসস্থান জান্নাত:

মুমিন ও ফাসেক সমান নয়, একথা বলার পর প্রথমে মুমিনদের অবস্থা বর্ণনা শুরু হয়েছে। মুমিনরা আল্লাহর দেয়া কল্যাণময় জীবনাদর্শ ও জীবন-ব্যবস্থা অনুসরণের কারণে দুনিয়াতেও কল্যাণ পায়, আর আখিরাতেও রয়েছে তাদের জন্য জান্নাত। জান্নাতে আছে শান্তি আর শান্তি। সেখানে কোন অশান্তি নেই। দুঃখ-দুর্দশার কিছু নেই। মানুষ সেখানে যা চায় তাই পায়। জান্নাতে মানুষ এমন নিয়ামতের অধিকারী হবে যা দুনিয়াতে তারা কল্পনাও করতে পারেনি, চোখেও দেখেনি এবং কানেও শুনেনি। আর সেই জান্নাত হবে অনন্তকালের।

ফাসিকের বাসস্থান জাহান্নাম: আখিরাতের শাস্তি:

আখিরাতে মুমিনদের অবস্থা বর্ণনার পর ফাসেকের অবস্থা বর্ণনা শুরু হয়েছে। যারা অপরাধ করে অর্থাৎ যারা ফাসেক তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম। জাহান্নাম হলো চরম অশান্তি ও কঠিন শাস্তির স্থান। সেখানে জাহান্নামবাসী আগুনে জ্বলবে। আগুনের ইন্ধন হয়ে জ্বলতে থাকবে। আগুনে তাদের দেহের চামড়া গলে যাবে। এরপর আবার চামড়া তৈরি হবে। তা আবার আগুনে জ্বলবে ও গলবে। এভাবে চলতেই থাকবে, এবং এভাবে তারা থাকবে ভীষণ কষ্টের মধ্যে। অবিশ্বাসী বাতিলপন্থিদের সে শাস্তি হবে অনন্তকালের।

ফাসিকদের দুনিয়ার শাস্তি:

আয়াতে আল্লাহ বলেন, তিনি ফাসিকদেরকে বড় শাস্তির পূর্বে দুনিয়াতে ছোট শাস্তি ভোগ করাবেন। এর একাধিক অর্থ হতে পারে। প্রথম, ফাসিকরা দুনিয়াতেও বাতিলের পথে অনৈতিক, অশ্লীল, উচ্ছৃংখল জীবনযাপন করে, যা তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে অশান্তি ও ধ্বংস নিয়ে আসে। তারা মানুষের চোখেও হেয় প্রতিপন্ন হয়। অনেক সময় আইনের হাতে ধরা পড়ে শাস্তি পায়। দ্বিতীয়, আল্লাহর পক্ষ থেকেও তাদের উপর শাস্তি আসে, গজব আসে। অনেক সময় আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ধ্বংস করেন। এদিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, মানুষের কর্মের দরূণ জলে-স্থলে ফাসাদ ছড়িয়ে পড়েছে। কোরআনের বিভিন্ন স্থানে সীমালংঘনকারীদের ধ্বংসের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।

ছোট শাস্তি দিয়ে সতর্ক করা:

দুনিয়াতে বড় শাস্তির পূর্বে ছোট শাস্তি দেয়ার আরেকটি উদ্দেশ্য হলো অপরাধী ও বাতিলপন্থিদেরকে সতর্ক করা, যেন তারা সুপথে ফিরে আসে। অর্থাৎ ছোট খাট শাস্তি দিয়ে তাদের সতর্ক করা হয় যে, এটা হলো তোমাদের কুকর্মের কিছুটা শাস্তি। তোমাদের সতর্ক হয়ে যাওয়া উচিত। বাতিল পথ ত্যাগ করে সত্য পথে আসা উচিত। যাদের মধ্যে বিবেক ও জ্ঞান আছে তারা তা বুঝতে পারে এবং সত্য পথে ফিরে আসে। আর যারা হঠকারিতার কারণে সত্য-প্রত্যাখ্যানে অবিচল থাকে, তারা আরো বড় শাস্তির সম্মুখীন হয়। তাদের পক্ষে হিদায়াত সম্ভব হয় না।

শাস্তি সংশোধন ও হিদায়াতের সহায়ক:

আলোচ্য আয়াত ও উপরের বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, দুনিয়ার শাস্তি অনেক সময় হিদায়াতের জন্য সহায়ক হয়। দুনিয়ায় কোনো বিপদ এলে মানুষ আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। আল্লাহকে ডাকে এবং কৃত পাপ ও অপকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থী হয়। এভাবে কমপক্ষে বিপদের সময় তারা আল্লাহর পথে চলে। এরপর বিপদ থেকে উত্তরণের পরও অনেকে সত্য উপলদ্ধির মাধ্যমে সত্য পথে থেকে যায়। এভাবে দুনিয়ার বিপদ-আপদ হিদায়াতের সহায়ক হিসাবে কাজ করে। দুনিয়ার বৈষয়িক জীবনেও তা প্রযোজ্য। সন্তানকে আদর করতে হবে, কিন্তু প্রয়োজনে সংশোধনের জন্য শাস্তিও ফলপ্রসূ হতে পারে। একইভাবে সামাজিক ও জাতীয় জীবনেও সংশোধনের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা প্রযোজ্য।

বিপদ আপদে তওবা ও সংশোধন:

আলোচ্য আয়াতে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যারা সুস্থ বিবেকের অধিকারী তারা বিপদের সময় তওবা ও সংশোধন হয়ে যায়। অপরাধ, গুনাহ ও পাপ কাজ করতে করতে হৃদয়ে কাল দাগ পড়ে যায়। তাদের বিবেক অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাদের চিন্তা শক্তি লোপ পায়। বিপদ এলে তা আবার জীবন্ত হয়ে উঠে। তখন সুস্থ বিবেকের সাথে তাওবা করা উচিত এবং সংশোধন হয়ে যাওয়া উচিত। সারকথা, বিপদ এলে প্রতিটি মানুষকে চিন্তা করে দেখা উচিত, সে জীবনে কি কি অপরাধ করেছে, কি কি মাত্রায় বাতিলের পথে চলেছে। সে অনুযায়ী আল্লাহর কাছে তাওবা করা উচিত এবং সংশোধন হওয়া উচিত।

বাতিলপন্থিদের বিদ্রূপের বদলায় বিদ্রূপ:

বাতিলপন্থিরা দুনিয়াতে মুমিনদের সাথে ঠাট্টা ও বিদ্রূপের আচরণ করে, তাদেরকে সেকেলে ও বোকা বলে এবং প্রগতির বিরোধী বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। শুধু সত্যপন্থিদের সাথেই নয় বরং নবীদের সাথেও সকল যুগের বাতিলপন্থিরাই ঠাট্টা বিদ্রূপ করেছে। কোরআনে আল্লাহ আফসোস করে বলেন, আমার বান্দার জন্য আফসোস, তাদের নিকট এমন কোন রাসূল আসেনি যাদের সাথে তারা বিদ্রূপ করেনি। বাতিলপন্থিরা দুনিয়ার এ বিদ্রূপের বদলায় আখিরাতে বিদ্রূপাত্মক আচরণ পাবে। তাদেরকে কঠিন শাস্তির মধ্যে ফেলে বলা হবে, এবার দোযখের মজা ভোগ করো। নিঃসন্দেহে দোযখে মজা নেই, আর তা ভোগ করার ব্যাপারও নয়। বরং তা হলো চরম কষ্টের জেল খাটার মতো। এভাবে দুনিয়ায় যেভাবে তারা সত্যপথ, সত্যপন্থি ও নবীদের প্রতি বিদ্রূপ করত, কিয়ামতের দিন তারা নিজেরাই সেভাবে বিদ্রূপের সম্মুখীন হবে।

কোরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া অপরাধ:

আয়াতে বলা হয়েছে, তার চেয়ে বড় যালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার প্রতিপালকের আয়াতের মাধ্যমে উপদেশ দেয়া হয়। কিন্তু তারপর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের উচিত নিজ উদ্যোগেই সত্যের সন্ধান করা, আল্লাহর কিতাব অধ্যায়ন করা, প্রকৃতিতে আল্লাহর যে নিদর্শন রয়েছে তা অনুধাবন করতে চেষ্টা করা। এভাবে সত্যপথের অনুসন্ধান করা এবং সে পথে চলা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। কিন্তু সে যদি তা না করে বরং সত্যপন্থিরা তাদের কাছে আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমে সত্য কে উপস্থাপন করে, তখন তাদের জন্য আরো বেশি কর্তব্য হয়ে পড়ে সত্য পথে আসা এবং সত্য পথে চলা। কিন্তু এরপরও যদি কেউ সত্যপথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার চেয়ে বড় যালেম আর কেউ হতে পারে না। সে এভাবে নিজের উপর যুলুম করে। সে দুনিয়াতেও বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। আর আখিরাতে তার কষ্টের সীমা থাকবে না।

শাস্তির সাধারণ কারণ: সত্য-প্রত্যাখ্যান:

আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন, নিশ্চয় তিনি অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। এখান থেকে একটা মূলনীতি পাওয়া যায় যে মানুষের উপর যে বিপদ ও শাস্তি আসে তার একটা সাধারণ কারণ হলো সত্য-প্রত্যাখ্যান ও অপরাধ। কেউ যদি সত্যকে অস্বীকার করে, প্রত্যাখ্যান করে এবং বাতিলের পথে চলে, সে শাস্তির সম্মুখীন হবে। দুনিয়াতে তার শাস্তির মাত্রা যদি ছোট হয়, তাহলে সে হয়তো অনুধাবন নাও করতে পারে, কিন্তু যদি শাস্তির মাত্রা বেশি হয়, তখন নিশ্চয় তার পক্ষে অনুভব করা উচিত। আর আখিরাতে সে শাস্তির কথা তো বলাই বাহুল্য।

আল্লাহ বাতিলপন্থিদের উপর প্রতিশোধ নেন:

এখানে আয়াতের একটা বিশেষ শব্দের প্রতি লক্ষ্য করা উচিত। একথা বলা হয়নি যে আল্লাহ অপরাধীদের শাস্তি দিবেন, বরং বলা হয়েছে যে, আল্লাহ অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। শাস্তি দেয়ার চেয়ে অনেক কঠিন হলো প্রতিশোধ গ্রহণ করা। শাস্তির মধ্যে অসন্তুষ্টির ইঙ্গিত থাকে। আর প্রতিশোধের মধ্যে থাকে চরম অসন্তুষ্টি, ভীষণ ক্রোধ, প্রতিশোধ প্রবণ মানসিকতা ইত্যাদি। বিশেষ করে দুটি মাত্রার অপরাধে এরূপ প্রতিশোধমূলক শাস্তির অবস্থা থাকে। একটি হলো আল্লাহকে অস্বীকার করা ও নাস্তিকতা, এবং অন্যটি হলো আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরিক করা। এ দুটি অপরাধের মাত্রা ব্যতীত যদি কোন মুমিন অপরাধ করে ফেলে, তাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বটে, কিন্তু সেখানে প্রতিশোধ গ্রহণ করার মতো শাস্তির মাত্রা নেই বলে ধারণা করা যায়।


নিজেকে জানার পথ

সাকিব রায়হান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

তখন আমার বয়স নয়-দশ বছর হবে। একটা গ্রামের রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে গন্তব্যে যাচ্ছিলাম। গ্রামের সাথে উপজেলা সদরের একমাত্র সংযোগ রাস্তাটি ইট বিছানো ছিল। যানবাহন বলতে সাইকেল, সাইকেল, ভ্যান, গরুর গাড়ি এবং সারাদিনে দুই-চারটে মোটরসাইকেল। কয়েক বছর এভাবে চলতে চলতে রাস্তার ইটগুলো ক্ষয়ে যেয়ে বালু এবং ইটের সুক্ষ গুড়ো মিলে রাস্তার ওপর এক-দেড় ইঞ্চির লালচে ধুলোবালির আস্তরণ জমা হতো। যানবাহনের চলাচল এবং বাতাসে ধুলো উড়ে রাস্তার দুধারের গাছগুলোর পাতা লালচে হয়ে থাকত। যাই হোক, ভর দুপুরে একা হাঁটতে হাঁটতে এক ধরনের মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। রাস্তার পাশের খেত থেকে পোকা-মাকড়ের শব্দ ছাড়া একদম নীরবতা। দুই-তিন মিনিট ধরে হাঁটছি; কিন্তু একজন মানুষেরও দেখা মিলছে না। কিছুক্ষণ পরপর পেছনে তাকিয়ে লাল ধুলোয় নিজের ফেলে আসা পায়ের চিহ্ন দেখে মজা পাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো ‘আমি কে?’ ওই পায়ের ছাপ ফেলে আসা মানুষটা আমি নাকি যে পায়ের ছাপটা দেখছে সে আমি? জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে মুহূর্তটাই প্রথম যখন আমার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রথম প্রশ্ন জেগেছিল। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে সেদিন থেকে আমি আজ পর্যন্ত আমার সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি যে আমি আসলেই কে।

এ পর্যন্ত পড়ে হয়তো অনেকেই মনে মনে ভাবছেন এটা আবার কেমন কথা, আমি কে সেটা আমি জানব না? কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে পৃথিবীর দর্শনের সবচেয়ে মৌলিক এবং জটিল প্রশ্ন এটাকেই ধরা হয় যে ‘আমি কে?’ আমি কে সেটা জানার আগে নিজেকে পরিষ্কার করতে হবে যে আমি আসলে কোন মতবাদে বিশ্বাসী। অনেকের মতে আমার শরীরই আমি। অর্থাৎ আমিত্বর মধ্যে আধ্যাত্মিক বা কাল্পনিক বা আনুমানিক কিছু নেই। যাকে দেখা যাচ্ছে সেই আমি। আমাদের শরীর যখন অকার্যকর হয়ে যায় তখন সেটাকে আমরা মৃত্যু বলি। এই মৃত্যুর সাথে সাথে আমার অস্তিত্ব এ মহাজগৎ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যদিও এর মধ্যে আরেক প্রকারের চিন্তক আছেন যারা মনে করেন যে মৃত্যুর পর আমাদের যে এনার্জি আছে সেটা এই মহাবিশ্বের অন্যান্য এনার্জির মধ্যে ছড়িয়ে যায়। আরেকটু ব্যাপকভাবে আমাদের মৃত্যুর মাধ্যমে আমদের কনশাসনেস বা চৈতন্য বিলুপ্ত হলেও আমাদের এনার্জি মহাজগতের সাথে মিশে এটারনিটি পেয়ে যায়। এখানে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, আমার চৈতন্য শেষ হয়ে গেলে আত্মিকভাবে ইনট্যাক্ট আমি কিন্তু আর থাকতে পারব না।

আরেকটা মতবাদ হচ্ছে আমাদের শরীর এবং আত্মা দুটো ভিন্ন কিছু । এই মতবাদে শরীর হচ্ছে নশ্বর এবং আত্মা অবিনশ্বর। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে আত্মা ছাড়া শরীর টিকতে পারে না; কিন্তু শরীর ছাড়া আত্মা টিকতে পারে। বর্তমানে আরেক ধাপ এগিয়ে অনেকে বডি, সউল এবং স্পিরিট এই তিন ভাগেও আমাদের বিভাজিত করে যার ভিন্ন ভিন্ন উপস্থিতি রয়েছে। আজকে আর সে আলোচনায় যেতে চাচ্ছি না।

এবার আসেন আমরা আবার আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে যাই। আমি কে? আপনারা যে আমাকে দেখছেন সেটাই কি আমি নাকি যে আমি আজকের লিখাটা চিন্তা করেছি সেটাই আমি? অথবা যে আপনি পত্রিকা হাতে নিয়ে বসে আছেন সেটাই কি আপনি, নাকি যে এই লেখাটা পড়ে কল্পনা করছে সেটা আপনি? অনেকে হয়তো ভাবছেন, যে আমি হেঁটে যাই তাকেই তো মানুষ নাম ধরে ডাকে। আমার শরীর দেখেই তো মানুষ আমাকে চিনে, আমার আত্মাকে কি কেউ দেখেছে, নাকি চিনে? আমার শরীরকেই তো মানুষ নাম দেয়, আত্মাকে না। হয়তো তাই; কিন্তু এ বিষয়ে আমার কিছু প্রশ্ন আছে।

মনে করেন, আমরা লতিফ নামে একজনকে জানি বা চিনি। কোনো এক দুর্ঘটনায় যদি সেই লতিফের একটা হাত কেটে যায় তাহলে সেই অবস্থাকে আমরা কী বলব? হাতটাকে কি কোনোভাবে লতিফ বলা যাবে? বা হাত ছাড়া কি লতিফের ভিন্ন কোনো পরিচিতি হবে? একইভাবে যদি দুহাত এবং দুপা কেটে যায় তাহলে কী অবস্থা হবে? আমরা বরং আরও সরাসরি একটা অবস্থাতে যাই। সেই লতিফ যদি মারা যায় তাহলে আমরা কী বলি? সাধারণত বলি যে লতিফ মারা গেছে। প্রথমত লতিফ তো উধাও হয়ে যায়নি, তার শরীরটা তো রয়েছে। তারপরেও কেন আমরা বলি যে লতিফ মারা গেছে? তারচেয়ে বড় কথা তার শরীরটাকে লাশ বা বডি বলি কেন? কেন আমরা মৃত মানুষকে সরাসরি নাম ধরে সম্বোধন করতে অস্বস্তি বোধ করি? মারা যাওয়া বলতে আমরা আসলেই কী বোঝাই?

আমার মনে হয় আমাদের শরীরটা এ পৃথিবীর উপাদান এবং আত্মাটা ভিন্ন এক পৃথিবী বা জগতের উপাদান। মায়ের গর্ভাশয়ে ভ্রূণ থেকে যখন শরীরটা ক্রমশ পূর্ণতার দিকে যেতে থাকে এবং যে মুহূর্তে সেই শরীর আমাদের আত্মাকে ধারণ করার ক্ষমতা অর্জন করে তখন আমাদের আত্মা আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এই শরীর এবং আত্মার সমন্বয়ে আমি। একটা দৃশ্যমান এবং আরেকটা অদৃশ্য উপাদানের এক রহস্যজনক মিশ্রণে এই আমি। কেন এবং কীভাবে এই আত্মা এসে শরীরে ভর করে এবং কোন প্রক্রিয়ায় একটা আত্মা আরেকটা শরীরকে নির্ণয় বা পছন্দ করে নেয় সেটা আরেক রকমের দর্শন এবং এর সাথে কিছু ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় ব্যাখ্যাও আছে। আপাতত সেদিকে যাচ্ছি না।

বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ ফিলোসফার এবং বিজ্ঞানী ডেয় কাট (Descartes) তার চিন্তা-শক্তি নিয়ে একটা কথা বলেছিলেন যেটা এখন একটা বিখ্যাত ফিলোসফিক্যাল আইডিয়া এবং ডেয় কাটের মূল দর্শনের ভিত্তি। যদিও তিনি ফ্রেঞ্চ ভাষায় লিখেছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে ল্যাটিন ভাষায় ‘কজিটো এরগো স্যুম’ বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর বাংলা ভাবার্থ হচ্ছে, ‘আমি আমার অস্তিত্ব উপলব্ধি করি কারণ আমি চিন্তা করতে পারি’। ডেয়কাটের মতে আমাদের চিন্তা-শক্তিই আমাদের উপস্থিতি জানান দেয়। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে আমরা যে চিন্তা করি সেটা আসলে কার উপলব্ধি। আমাদের আত্মার, নাকি আমাদের শরীরের, নাকি আমাদের ব্রেইনের। আমাদের চিন্তা এবং অনুমান; কিন্তু জটিল থেকে জটিলতর হওয়া শুরু করেছে।

আমার মনে হয় আমাদের আত্মা এ পৃথিবীর কোনো উপাদান দিয়ে তৈরি না। এ কারণেই এ পৃথিবীর কোনো ফিজিক্স বা সায়েন্স দিয়ে আমাদের আত্মাকে ব্যাখ্যা করাত সম্ভবই না, এমনকি আত্মা সম্পর্কে কিছু অনুমান করাও অনেকটাই অসম্ভব। অন্য অজানা ফিজিক্সের অংশ আমাদের এই আত্মা নিজেকে প্রকাশ করতে এ পৃথিবীর উপাদানের সাহায্য নিতে হয়। আমাদের শরীর হচ্ছে সেই উপাদান। আমরা জানি যে আমাদের সকল চিন্তা, অনুমান, কাজ, উপলব্ধি কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। আমাদের আত্মার সাথে আমাদের মস্তিষ্কের সম্পর্কটাই আমাদের মেনিফেস্টেশন। আমাদের আত্মা এবং মস্তিষ্কের সাথে যত ভালো সমন্বয় থাকবে তত সুন্দরভাবে আমরা নিজেদের প্রকাশ করতে পারব। অন্যভাবে বললে, আমাদের অপার্থিব আত্মাকে এই পৃথিবীর সাথে সমন্বয় ঘটায় আমাদেরই পার্থিব মস্তিষ্ক। আমার মতে আমাদের আত্মা এবং মস্তিষ্কের সমন্বয়হীনতা বা বিচ্ছিন্নতাকেই আমরা মৃত্যু বলি।

আমাকে দেখে আমাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, আমার শরীরটা আমার বডি বা লাশ। সেই বডি নিজে থেকে কিছু করতে পারে না যতক্ষণ না আত্মা মস্তিষ্কের মাধ্যমে নির্দেশনা দেয়। তাই আমার শরীরের কর্ম আসলে আমার আত্মার কর্ম। আমার মুখের কথা আসলে আত্মার কথা। আমার শরীর একটা কন্ট্রোল পুতুল ছাড়া আর কিছুই না। যার আত্মার সাথে তার শরীরের সমন্বয় যত ভালো সে তত জ্ঞানী। এটাকে উল্টিয়ে বললে দাঁড়ায়, যে যত জ্ঞানী সে তত ভালোভাবে তার আত্মার সাথে শরীরের সমন্বয় ঘটাতে পারে। একারণেই যুগ যুগ ধরে মনিষীরা বলে গেছেন ‘নিজেকে জানো’। এই নিজেকে জানা মানে কিন্তু অনেক ব্যাপক কিছু। শুধু নিজের নাম, পরিচয়, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানা না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের আত্মা এবং মস্তিষ্কের মধ্যে ভালো সমন্বয় নেই বলে আমরা জানি না পরের মুহূর্তে আমরা কী করব বা কী ভাবব। এই সমন্বয়হীনতার জন্যেই আমাদের নিজেদের ওপর নিজেদের কন্ট্রোল নেই। ভালো কাজ এবং মন্দ কাজের পার্থক্য বোঝতে পেরেও মন্দ কাজকে বেছে নেই। আসুন আমাদের আত্মা এবং মস্তিষ্কের একটা দারুণ সমন্বয় ঘটানোর জন্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাই। শেষ পর্যন্ত এই বডিটাকে রেখেই তো উড়াল দিতে হবে, তাই না?

লেখক: কথাশিল্পী ও নাট্যকার।


নতুন উন্নয়ন সূচকের ভিত্তি নির্ভর করে মোবাইল ফোন 

অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক যাত্রার এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে, কয়েক দশকের চিত্তাকর্ষক জিডিপি প্রবৃদ্ধি থেকে টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের একটি নতুন দৃষ্টান্তে রূপান্তরের জন্য প্রস্তুত। যদিও দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য উল্লেখযোগ্য, প্রকৃত সমৃদ্ধি পরিমাণগত মেট্রিক্সের বাইরেও বিস্তৃত। এই নতুন পর্যায়ে কেবল কৌশলগত অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন নেই বরং আমরা কীভাবে অগ্রগতি পরিমাপ করি তার একটি মৌলিক পুনর্বিবেচনারও প্রয়োজন- যা প্রতিটি নাগরিকের জীবিত অভিজ্ঞতা, নিরাপত্তা এবং কল্যাণকে ধারণ করে। বাংলাদেশে অপরাধ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং জাতীয় অগ্রগতির বিষয়ে আপনার প্রতিফলন কয়েক দশক ধরে চলমান গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে। এখানে বিবেচনা করার জন্য কিছু মূল বিষয় রয়েছে- জাতীয় অগ্রগতির সূচক হিসেবে রয়েছে ।

১ অপরাধের ধারণা: মোবাইল ফোন চুরি, ডাকাতি এবং ছিনতাই প্রায়শই একটি জাতির নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার সূচক হিসেবে দেখা হয়। উচ্চ অপরাধের হার অন্তর্নিহিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো প্রতিফলিত করতে পারে।

২. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ১৯৮২ সালের আপনার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে অপরাধ কীভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয় এবং রিপোর্ট করা হয় তা নিয়ে উদ্বেগ দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ব্যবহৃত পরিভাষা জনসাধারণের ধারণা এবং মামলাগুলোর গুরুত্বকে প্রভাবিত করতে পারে।

দীর্ঘকাল ধরে, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) জাতীয় সাফল্যের প্রাথমিক বারোমিটার হিসেবে কাজ করেছে। তবুও, এই সূচকটি একটি অসম্পূর্ণ বর্ণনা প্রদান করে। এটি অর্থনৈতিক উৎপাদন পরিমাপ করে কিন্তু বৈষম্য, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং জীবনযাত্রার মানের বিষয়ে নীরব থাকে। একটি দেশ ক্রমবর্ধমান জিডিপি পরিসংখ্যান নিয়ে গর্ব করতে পারে যখন তার নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতা, সীমিত সুযোগ এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা ক্ষয় নিয়ে লড়াই করে। বাংলাদেশের এখন সুযোগ রয়েছে উন্নয়নের জন্য আরও সামগ্রিক এবং মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের মাধ্যমে একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেওয়ার- যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কল্যাণ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক লক্ষ্য নয়, বরং একই মুদ্রার দুটি দিক।

উন্নয়নের সাধনা অর্থনৈতিক উৎপাদনের চেয়েও বেশি কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে- এতে মানুষের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং সুখ অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এই কারণেই একটি নতুন উন্নয়ন সূচকের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজন যা সামাজিক আস্থা, নিরাপত্তা এবং ন্যায়সঙ্গত সুযোগের হিসাব করে জিডিপির পরিপূরক হবে। কল্পনা করুন এমন একটি সূচক যা অন্ধকারের পরে বাড়ি ফেরার একজন মহিলার আত্মবিশ্বাস, আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে বিনিয়োগকারী একজন ছোট ব্যবসার মালিকের আস্থা, অথবা একটি পরিবার তাদের সম্প্রদায়ের প্রতি যে সুরক্ষা বোধ করে তা প্রতিফলিত করে। এই ধরনের কাঠামো গ্রহণের মাধ্যমে, বাংলাদেশ প্রকৃত অগ্রগতির অর্থ কী তা পুনর্নির্ধারণে বিশ্বব্যাপী অগ্রগামী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আইন প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ- পুলিশিং কার্যকারিতা: আপনার মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগ করার সময় পুলিশ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের অভাব সম্পর্কে আপনার বক্তব্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকারিতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতা সম্পর্কে চলমান উদ্বেগগুলো তুলে ধরে। প্রযুক্তির ব্যবহার: তদন্তে সিসিটিভি ফুটেজের ওপর নির্ভরতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনার অভিজ্ঞতা পুলিশ পদ্ধতির পর্যাপ্ততা এবং উপলব্ধ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য তাদের ইচ্ছা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে।

৩. জনসাধারণের আস্থা: যদি নাগরিকরা মনে করেন যে তাদের উদ্বেগগুলো পর্যাপ্তভাবে সমাধান করা হয়নি, তাহলে এটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর আস্থা হ্রাস করতে পারে এবং নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতিতে অবদান রাখতে পারে।

উল্লিখিত বিষয়গুলো কেবল অতীতের অবশিষ্টাংশ নয়; এগুলো ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় চলমান চ্যালেঞ্জগুলো প্রতিফলিত করে। এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য প্রয়োজন: পুলিশিং অনুশীলনে সংস্কার: পুলিশ বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং কার্যকারিতা উন্নত করা।

সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা: আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা তৈরি করা।

প্রযুক্তির ব্যবহার: অপরাধ প্রতিরোধ এবং সমাধানে সহায়তা করার জন্য প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার। ১৯৮২ সালের পর থেকে কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও, এই চ্যালেঞ্জগুলোর স্থায়িত্ব ইঙ্গিত দেয় যে বাংলাদেশে নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য আরও কাজ করা প্রয়োজন। জাতীয় অগ্রগতি বৃদ্ধি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনসাধারণের আস্থা বৃদ্ধির জন্য এই বিষয়গুলোর সমাধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই নতুন সূচকের একটি প্রতিশ্রুতিশীল উপাদান হলো আলী (২০২৫) দ্বারা প্রস্তাবিত দৈনিক নিরাপত্তা সূচক (ডিএসআই), যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণকে ব্যাহত করে এমন অপরাধগুরো ট্র্যাক করবে- বিশেষ করে মোবাইল ফোন চুরি। আজকের ডিজিটাল যুগে, একটি স্মার্টফোন একটি যোগাযোগ যন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি; এটি আর্থিক পরিষেবার প্রবেশদ্বার, ব্যক্তিগত ও পেশাদার তথ্যেরভাণ্ডার এবং সম্প্রদায় এবং সুযোগের জন্য একটি জীবনরেখা। একটি ফোন হারানো বা চুরি কেবল বস্তুগত বঞ্চনা নয় বরং একজনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থার ভাঙনের প্রতিনিধিত্ব করে। ডিএসআই হ্রাস এমন একটি সমাজের ইঙ্গিত দেবে যেখানে আইনের শাসন শক্তিশালী, সামাজিক আস্থা বেশি এবং নাগরিকরা ডিজিটাল অর্থনীতিতে অবাধে এবং নিরাপদে জড়িত হতে পারে। ব্যাংকিং খাতের চেয়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আর কোথাও এত স্পষ্ট নয়। আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন (২০২৪) অনুসারে, দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৭.৫৬ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে- যা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের সমগ্র জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান। এটি কেবল একটি চক্রাকার মন্দা নয় বরং গভীর কাঠামোগত সমস্যার লক্ষণ: অপর্যাপ্ত তদারকি, অযৌক্তিক ঋণদান পদ্ধতি এবং জবাবদিহিতার অভাব।

এই দুর্বলতাগুলো জনসাধারণের আস্থা হ্রাস করেছে, বেসরকারি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করেছে এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতাকে রোধ করেছে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি ঘাটতি এবং রপ্তানি বৈচিত্র্যের অভাবের ফলে এই চ্যালেঞ্জগুলো দশকের অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার হুমকি দিচ্ছে। তবে, এই চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যেই পুনর্বিকরণের সুযোগ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকিং সংকট ব্লকচেইন এবং রিয়েল-টাইম অডিটিং সিস্টেমের মতো স্বচ্ছ, প্রযুক্তি-চালিত সমাধান গ্রহণকে অনুঘটক করতে পারে। একইভাবে, জ্বালানি ঘাটতি পুনর্বিকরণযোগ্য উৎস এবং দেশীয় জ্বালানি স্থিতিস্থাপকতার দিকে উত্তরণকে ত্বরান্বিত করতে পারে। বাংলাদেশ টাকা কোড সঠিক, কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে আমরা বাংলাদেশি টাকা ব্যবহার করছি। বাংলাদেশ ব্যাংক এটি রক্ষার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

স্বয়ংক্রিয় প্রতিবেদন, স্বাধীন তদারকি এবং ফিনটেক উদ্ভাবনের প্রবর্তন স্বচ্ছতা এবং আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারে। একটি স্থিতিশীল ব্যাংকিং ব্যবস্থা কেবল সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যই নয়, বরং উদ্যোক্তা, ছোট ব্যবসা এবং তৃণমূল পর্যায়ের উদ্ভাবকদের ঋণ প্রবাহকে সক্ষম করার জন্যও অপরিহার্য। ফিনটেক সমাধান গ্রহণের মাধ্যমে, বাংলাদেশ বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করতে পারে, একটি দক্ষ এবং নিরাপদ আর্থিক বাস্তুতন্ত্র তৈরি করতে পারে। এই রূপান্তর জনসাধারণের আস্থা বৃদ্ধি করবে এবং ডিজিটাল আর্থিক সম্পদ রক্ষা করে একটি উচ্চতর দৈনিক নিরাপত্তা সূচক (DSI) তৈরিতে অবদান রাখবে।

বাংলাদেশের শক্তিশালী সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং প্রবাসী সম্প্রদায়গুলো অমূল্য সম্পদ। রেমিট্যান্স, যা প্রায়শই অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রণোদনা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ব্যবহার করা যেতে পারে। তদুপরি, সামাজিক ব্যাংকিং মডেলগুলো বিকাশ করা- আর্থিক মধ্যস্থতাকারীরা যা ক্ষুদ্র-সঞ্চয়কে ক্ষুদ্র-বিনিয়োগে রূপান্তরিত করে- সম্প্রদায়গুলো ক্ষমতায়ন করতে পারে, মহিলা উদ্যোক্তাদের সমর্থন করতে পারে এবং নিচ থেকে অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা জোরদার করতে পারে। এই পদ্ধতিটি নিষ্ক্রিয় সঞ্চয়কে সক্রিয় বিনিয়োগে রূপান্তর করতে পারে, সাম্প্রদায়িক বন্ধনকে উৎসাহিত করতে পারে এবং দৈনিক নিরাপত্তা সূচককে উন্নত করতে পারে।

পূর্ববর্তী সরকারের আমলে, একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর আমার জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে শরীয়তপুর জেলায় আদালতে রিপোর্ট করার সময় তাদের নিজস্ব জাতীয় পরিচয়পত্রের রেকর্ডের সাথে মিল রেখেছিলেন। এই ধরনের ব্যক্তিদের আইনের অধীনে জবাবদিহি করতে হবে, কারণ জনসাধারণকে এই ধরণের কাজের জন্য কষ্ট ভোগ করতে হবে না। অনেক সাধারণ নাগরিক সবসময় অভিযোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে ইচ্ছুক নন। মনে হচ্ছে আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্য পরিবর্তনের বিষয়ে আপনি একটি গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এই ধরনের অসদাচরণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি অন্যদেরও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হওয়া থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করতে পারে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং এই ধরনের অসদাচরণ যাতে জনসাধারণের ওপর প্রভাব না ফেলে তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।

স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে সরে এসে ঐকমত্যভিত্তিক, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক কৌশলের দিকে অগ্রসর হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নীতিগত পূর্বাভাসযোগ্যতা, প্রাতিষ্ঠানিক অখণ্ডতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা বিনিয়োগকারীদের আস্থা এবং টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি। সুশাসনকে অগ্রাধিকার দিয়ে, বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে পারে যা দেশীয় এবং বিদেশি উভয় বিনিয়োগকেই উৎসাহিত করে। ডিএসআই বাস্তবায়ন কেবল নিরাপত্তা পরিমাপের চেয়েও বেশি কিছু করবে- এটি এটি তৈরিতে সহায়তা করবে। ফোন-সম্পর্কিত অপরাধ হ্রাসের ওপর মনোযোগ দেওয়ার ফলে পুলিশিং, ন্যায়বিচার প্রদান এবং সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার উন্নতি প্রয়োজন। এটি ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে উদ্ভাবনকেও উৎসাহিত করবে, নিশ্চিত করবে যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সকলের উপকার করবে। তদুপরি, ডিএসআই বৃহত্তর উন্নয়নমূলক লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ এবং বিশ্বস্ত ব্যাংকগুলো ভৌত এবং ডিজিটাল নিরাপত্তায় অবদান রাখে। একইভাবে, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সুযোগ অপরাধের জন্য প্রণোদনা হ্রাস করে। এইভাবে, ডিএসআই কেবল উন্নয়নের ফলাফল নয়- এটি এর জন্য একটি অনুঘটক।

আজ গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো নির্ধারণ করবে যে বাংলাদেশ স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে কেস স্টাডি হয়ে ওঠে নাকি পুরোনো মডেল এবং মেট্রিক্স দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। দৈনিক নিরাপত্তা সূচকের মতো উদ্ভাবনী পদক্ষেপ গ্রহণ, শাসনব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, বৈচিত্র্যকরণে বিনিয়োগ এবং জনগণের ক্ষমতা কাজে লাগানোর মাধ্যমে, বাংলাদেশ এমন একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তোলতে পারে যেখানে সমৃদ্ধি কেবল অর্থনৈতিক উৎপাদনের মাধ্যমে নয়, বরং মানবিক মর্যাদা এবং নিরাপত্তার মাধ্যমেও পরিমাপ করা হবে।

আগামী যাত্রার জন্য দূরদৃষ্টি, সহযোগিতা এবং সাহসের প্রয়োজন। স্থিতিস্থাপকতা এবং উদ্ভাবনের ক্ষমতার ইতিহাসের সাথে, বাংলাদেশ একটি নতুন যুগের জন্য সমৃদ্ধিকে পুনর্নির্ধারণ করার জন্য অনন্য অবস্থানে রয়েছে- এবং বিশ্বকে দেখানোর জন্য যে প্রকৃত উন্নয়ন মানে প্রতিটি নাগরিক নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং অন্তর্ভুক্ত বোধ করে। তৃণমূল পর্যায়ে দুর্নীতি দূর করার ওপর মনোনিবেশ করে এবং কৌশলগত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে, বাংলাদেশ তার সকল নাগরিকের জন্য একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করতে পারে, নিশ্চিত করে যে প্রতিটি ব্যক্তির একটি ন্যায়সঙ্গত এবং প্রাণবন্ত সমাজে উন্নতির সুযোগ রয়েছে।

ক্ষুদ্রঋণ এবং আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য অর্থায়নের সুযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি অবকাঠামো এবং যৌথ উদ্যোগের জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব গড়ে তোলাও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়িক পদ্ধতি সহজীকরণ এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা জোরদার করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্কার, পাশাপাশি বৈচিত্র্যের সুযোগ চিহ্নিত করার জন্য বাজার গবেষণা উদ্যোগ অপরিহার্য। সবুজ প্রযুক্তি প্রণোদনা এবং বৃত্তাকার অর্থনীতি অনুশীলনের মাধ্যমে টেকসইতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং স্থানীয় চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করার জন্য সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা কর্মসূচি তৈরি করতে হবে, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়নে। এই কৌশলগুলো গ্রহণের মাধ্যমে, বাংলাদেশ কার্যকরভাবে তার অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করতে পারে, একটি একক খাতের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করতে পারে এবং আরও স্থিতিস্থাপক এবং টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলতে পারে। ১৯৮২ সালের পর থেকে কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও, এই চ্যালেঞ্জগুলোর স্থায়িত্ব ইঙ্গিত দেয় যে বাংলাদেশে নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য আরও কাজ করা প্রয়োজন। জাতীয় অগ্রগতি বৃদ্ধি এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনসাধারণের আস্থা বৃদ্ধির জন্য এই বিষয়গুলো মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যবসা ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


অস্থিতিশীলতা নয়, দরকার স্থিতিশীল পরিবর্তন

ড. সুলতান মাহমুদ রানা
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ আজ এমন এক সময়ের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করছে, যাকে সহজভাবে বলা যায়- ‘ইতিহাসের মোড়।’ জুলাই আন্দোলনের পর রাজনৈতিক অঙ্গন, রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে যে রূপান্তর ঘটেছে, তা আমাদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। একইসাথে, সেই সম্ভাবনার ভেতরেই লুকিয়ে আছে নানা শঙ্কা। আমরা কেউই কোনো অস্থিতিশীলতা কামনা করি না। প্রশ্ন হলোÑআমরা কোন পথে হাঁটব? পরিবর্তনের পথে? নাকি অস্থিতিশীলতার পথে? গত এক সপ্তাহের সংবাদপত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, এই প্রশ্ন এখন কেবল রাজনীতিবিদদের নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের মনে।

জুলাই আন্দোলনকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বড় বাঁক বলা যায়। এটি কেবল একটি সরকারের পতন ঘটায়নি, বরং দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অসন্তোষ ও ক্ষোভকে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। মানুষ নেমেছিল রাজপথে, দাবি ছিল ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু আন্দোলনের পরপরই প্রশ্ন উঠছে- এই অর্জন কি টেকসই হবে? ইতিহাসে আমরা দেখেছি, আন্দোলনের পর আস্থা না ফিরলে পরিবর্তন ভেঙে পড়ে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার পরপর রাজনৈতিক বিভাজন এবং আস্থার সংকট দেশকে বিপর্যস্ত করে তোলে। একইভাবে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম কয়েক বছরে গণতন্ত্র নিয়ে আশাবাদ থাকলেও পরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ও বিরোধী দলের অনুপস্থিতি সেই আস্থাকে ক্ষয় করেছে।

আজকের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও একই শঙ্কা সামনে এসেছে- যদি আস্থা ফিরিয়ে আনা না যায়, তবে পরিবর্তনের শক্তি আবারও দুর্বল হয়ে যাবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে আরেকটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছেÑ‘ষড়যন্ত্র নিয়ে নানা বক্তব্য। এক পক্ষ বলছে, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ মহল সক্রিয়। অন্য পক্ষ বলছে, সরকারের ভেতরের অদৃশ্য শক্তিই স্থিতিশীলতার পথে বাঁধা। এ ধরনের পারস্পরিক সন্দেহ সমাজকে বিভক্ত করছে।

এখানে আন্তর্জাতিক উদাহরণ টানা যায়। আরব বসন্তের সময় মিসর ও লিবিয়ার জনগণ গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছিল। কিন্তু আন্দোলনের পর বিভাজন ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এতটাই বেড়ে যায় যে, কয়েক বছরের মধ্যে দেশগুলো আবারও অরাজকতার দিকে চলে যায়। মিসরে সেনাশাসন ফিরে আসে, লিবিয়া এখনো গৃহযুদ্ধ থেকে বের হতে পারেনি। বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা হলো- শুধু আন্দোলন যথেষ্ট নয়, আন্দোলনের পর স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করাই সবচেয়ে বড় কাজ।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মাঝেই এসেছে একটি সুখবরÑবাংলাদেশ জাতিসংঘের শর্ত পূরণ করে ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক অর্জন। স্বাধীনতার পর যে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হয়েছিল, সেই দেশ এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছে উন্নয়নশীল হিসেবে।

কিন্তু একইসাথে, সাধারণ মানুষের জীবনে চাপ বাড়ছে। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম লাগামছাড়া, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, কর্মসংস্থানের সংকট তীব্র। তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ বেকার। গ্র্যাজুয়েট বেকারত্ব দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলেÑঅর্থনৈতিক অর্জন তখনই স্থায়ী হয়, যখন তা মানুষের জীবনে প্রতিফলিত হয়। ভুটান উদাহরণ হতে পারে- সেখানে জিডিপি দিয়ে নয়, বরং গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস দিয়ে উন্নয়ন পরিমাপ করা হয়। অর্থাৎ মানুষের জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সম্প্রীতি- এসবকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশ যদি শুধুমাত্র LDC থেকে উত্তরণকে গর্বের বিষয় বানায়, অথচ মানুষের দৈনন্দিন কষ্ট কমাতে না পারে, তবে সেই উত্তরণ অর্থহীন হয়ে পড়বে।

আজকের বাংলাদেশে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশাল প্রভাব ফেলছে। জনগণ দ্রুত খবর পাচ্ছে, কিন্তু একইসাথে গুজব ও বিভ্রান্তিও দ্রুত ছড়াচ্ছে। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা দেখেছি, অনেক ভুয়া খবর মুহূর্তের মধ্যে হাজারো মানুষকে প্রভাবিত করেছে। তাই গণমাধ্যমের দায়িত্ব এখন আগের চেয়ে বেশি। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও অনলাইন পোর্টালকে দায়িত্বশীল হতে হবে। সত্য সংবাদ প্রচার, গুজব প্রতিরোধ এবং স্বচ্ছ তথ্য প্রকাশের মাধ্যমেই আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো সংলাপের অভাব। বিরোধী দল ও সরকার একসাথে বসে সমস্যার সমাধান করতে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে দ্বন্দ্ব অস্থিরতায় পরিণত হয়। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়েছিল। এটি একটি ইতিবাচক নজির। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনগুলোতে বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকায় গণতন্ত্র দুর্বল হয়েছে, অস্থিরতা বেড়েছে। আজকের প্রেক্ষাপটে তাই সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো সংলাপের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। সরকার, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমÑসবাইকে মিলেই একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে হবে।

এক্ষেত্রে বেশ কিছু করণীয় রয়েছে। সেগুলো হলো-১. স্বচ্ছ নির্বাচন: স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া এবং সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; ২. ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা: অতীতের অপরাধ ও দুর্নীতির বিচার দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে করতে হবে; ৩. অর্থনৈতিক সমতা: উন্নয়ন যেন কেবল পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং মানুষের জীবনে প্রতিফলিত হয়।

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয়তে অস্থিতিশীলতা কাম্য নয় শিরোনামের এই কথাটি আজ শুধু একটি সম্পাদকীয়র সতর্কবার্তা নয়, বরং পুরো জাতির আকাঙ্ক্ষা। মানুষ পরিবর্তন চায়, কিন্তু সেই পরিবর্তন যেন অরাজকতা, সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলায় না গড়ায়। পরিবর্তন হোক ন্যায়নিষ্ঠ, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক। বাংলাদেশের ইতিহাসে অস্থিরতা বারবার আমাদের উন্নয়নকে ব্যাহত করেছে। এবার আমাদের সামনে সুযোগ আছে ভিন্ন ইতিহাস লেখার। যদি আমরা আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারি, এবং অর্থনীতিকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারি, তবে এই পরিবর্তন সত্যিই স্থিতিশীল হবে।

কারণ উন্নয়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক সূচক নয়, উন্নয়ন মানে মানুষের আস্থা, ন্যায়বিচার ও শান্তি। আর সেখানেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আজকের বৈশ্বিক আলোচনায় একটি বড় প্রশ্ন সামনে এসেছে। এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন, কোন দেশ গণতন্ত্রের মডেল হতে পারে? একসময় ইউরোপ এবং আমেরিকা ছিল বিশ্বের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা সুইডেনকে দেখে অনেক দেশ ভেবেছিল- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা একসঙ্গে এগোতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হতো ‘গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা’। আর এখন কেনেথ ভোগেলের মতো বিশ্লেষকরা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডমোক্র্যাসি’কে বলেন ‘ডলারোক্র্যাসি’। রাতারাতি এখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কীভাবে হুমকির মুখে পড়তে পারে, সেটি বিশ্বেও বিভন্ন রাষ্ট্র দেখে অনুমান করা যায়। ইউরোপও আজ আর সেই শক্তি বা আত্মবিশ্বাস দেখাতে পারছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অভ্যন্তরীণ বিভাজনে জর্জরিত, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মতো দেশ পিছিয়ে যাচ্ছে, আর রাশিয়া ও চীনের কর্তৃত্ববাদী শাসন গর্বের সঙ্গে বিশ্বে বিকল্প বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

তাহলে আজকের তরুণেরা গণতান্ত্রিক রোল মডেল খুঁজবে কোথায়? আশ্চর্যের বিষয়, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো রাষ্ট্র আমাদের শেখাচ্ছে যে কঠিন বাস্তবতার মাঝেও গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে। জ্যাকব জুমা বা জাইর বলসোনারোর মতো নেতাদের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা সত্ত্বেও জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরোধ দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলকে আবারো সঠিক পথে ফিরিয়ে এনেছে। তাইওয়ান, উরুগুয়ে, মরিশাস কিংবা বতসোয়ানার মতো ছোট দেশও প্রমাণ করছে, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা বা ভৌগোলিক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী রাখা সম্ভব।

এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে? স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা নিয়ে পথচলা শুরু করলেও বারবার হোঁচট খেয়েছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচন ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে এবং মানুষ নতুন আশা নিয়ে ভোট দেয়। কিন্তু সমস্যা এখানেই শেষ হয়নি। পরবর্তী তিন দশকেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র আস্থার জায়গায় পৌঁছায়নি। দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরকে শত্রু হিসেবে দেখে রাজনীতিকে শূন্য-যোগের খেলায় পরিণত করেছে। নির্বাচনী অনিয়ম, সহিংসতা, প্রশাসনিক পক্ষপাত এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা গণতন্ত্রের মেরুদণ্ডকে দুর্বল করেছে। ২০০৭-০৮ সালের জরুরি অবস্থা দেখিয়েছে, রাজনৈতিক সংকট কতটা ভয়াবহ হতে পারে। সেই সময়ে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয় এবং গণতন্ত্র সাময়িকভাবে স্থগিত হয়। যদিও ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও গণতন্ত্রে ফেরা হয়, কিন্তু এরপরের কয়েকটি নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থেকে গেছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন যেখানে অধিকাংশ দল অংশ নেয়নি, অথবা ২০১৮ সালের নির্বাচন যেখানে ভোটাধিকার সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এসব ঘটনা গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়েছে।

তবুও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক দিকও আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এখনো মানুষের রক্তে প্রবাহিত। দেশের তরুণ প্রজন্ম গণতন্ত্র, অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি আগ্রহী। সিভিল সোসাইটি, সাংবাদিক, মানবাধিকার সংগঠন এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখনো গণতন্ত্রের আশা বাঁচিয়ে রেখেছে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া যেমন নতুন সুযোগ তৈরি করেছে, তেমনি তরুণ প্রজন্মের জন্য গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরির স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্রকে টেকসই করতে বড় কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। প্রথমত, দুর্বল প্রতিষ্ঠান: নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা ও গণমাধ্যম প্রভাবমুক্ত হতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, দলীয় সংস্কৃতির আধিপত্য রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থকে জনগণের চেয়ে অগ্রাধিকার দেয়। তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক বৈষম্য একদিকে ধনী শ্রেণি ক্ষমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, অন্যদিকে দরিদ্র জনগণ বঞ্চিত থাকে। চতুর্থত, রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রতিহিংসা যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধ্বংস করা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই গণতন্ত্র কেবল আইন বা নির্বাচনের মাধ্যমে সীমিত থাকে, বাস্তব জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে না।

বিশ্ব যখন গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণে ভুগছে, তখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদি বাংলাদেশ একটি সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে এটি একটি নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে। পাকিস্তান যেখানে বারবার সামরিক হস্তক্ষেপে বিপর্যস্ত, আর শ্রীলঙ্কা যেখানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে, সেখানে বাংলাদেশ যদি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে পারে, তবে এটি শুধু দেশের ভেতরে নয়, বরং গোটা অঞ্চলের জন্য একটি আলোকবর্তিকা হতে পারে।

লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


ফেসবুক থেকে আয়: সুযোগ, চ্যালেঞ্জ ও নৈতিকতা

আপডেটেড ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২২:৪৭

বর্তমান যুগে ফেসবুক শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং আয়-উপার্জনেরও একটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। অনেকেই আজ ফেসবুক ব্যবহার করে কনটেন্ট তৈরি, ব্যবসা প্রচার, অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং, বিজ্ঞাপন কিংবা অনলাইন শপ পরিচালনার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন। সত্যি বলতে কি, সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে এটি কর্মসংস্থান তৈরির একটি ভালো সুযোগ।
কিন্তু বাস্তবে ফেসবুক থেকে আয় করা কি এতই সহজ! আমার বোঝা মতে মোটেও সহজ নয়। নিয়মিত মানসম্মত কনটেন্ট তৈরি করা, দর্শককে আকৃষ্ট করা, ফলোয়ার বাড়ানো এবং ফেসবুকের কঠোর নীতিমালা মানা—এসবই অনেক সময় ও পরিশ্রম দাবি করে। অনেকেই দীর্ঘ সময় চেষ্টা করার পরও কাঙ্ক্ষিত ফল পান না। অ্যালগরিদম পরিবর্তন, ভুয়া অনুসারী, কিংবা মনিটাইজেশনের শর্ত পূরণে ব্যর্থতা- এসব কারণে অনেকের বহুদিরেন চেষ্টা কষ্ট পুরোই বৃথা হয়ে যায়। ফলে এটি শুধু সহজ টাকা রোজগারের রাস্তা নয়, বরং ধৈর্য, কৌশল ও পরিশ্রমের একটি ক্ষেত্র।
বেশকিছু দিন ফেসবুকের এই ইনকামের বিষয়টা মাথায় খুব ঘুর ঘুর করছে। তবে ইনকাম করার জন্য নয়, মানুষ যেভাবে ইনকাম করার জন্য হুমড়ী খেয়ে পড়েছে সেটা। লাইক, কমেন্ট, শেয়ার, লাইভের নেশায় ছেলে বুড়ো, নারী, শিশু, ঘরের মেয়ে-বউ, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছে তাতে বিষয়টি আমার কাছে খুব অ্যালার্মিং মনে হচ্ছে। আর একটা বিষয় হলো মডেলিং এবং ফ্যাশন ডিজাইন এই জিনিসগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে একেবারে মানুষের ঘরে ঘরে পৌছে দিতে পেরেছে। এক শ্রেনীতো একেবারে প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকার জন্য নিষিদ্ধ এবং গোপনীয় বিষয়গুলোকে উন্মুক্ত করার প্রতিযোগীতায় নেমেছে। যা খুবই দৃষ্টিকটু। মুরব্বী বা বাচ্চাদের সামানে ফেসবুক ওপেন করা রীতিমত ভয়ের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।
কেউ কেউ হয়তো এই লেখায় মনক্ষুন্ন হতে পারে, প্রকৃতপক্ষে কাউকে আঘাত করার জন্য বা উদ্দেশ্যপ্রনোদিত হয়ে এ লেখা নয়। আমার কাছে বিষয়টি খুবই উদ্বেগের মনে হচ্ছে। আমরা যদি ধর্মীয় দিক বিবেচনা করি, তাহলে ভেবে দেখেন হয়তো আপনার স্ত্রী বা মেয়ের যে পুরুষের সাথে কোনদিন কোনভাবেই দেখা হতো না, নামই জানতো না। যার বউকে আপনি কোনদিনও চিনতেন না। তাকে আপনি প্রতিদিন দেখছেন। যেভাবে দেখা যেত না, সেভাবেও দেখছেন! আর যারা মডেলিং ও ফ্যাশনকে ঘরে নিয়ে গিয়েছে তাদের কথাতো বাদ, তারাতো নিজেকে আকর্ষণীয় এবং মোহনীয় করেই উপস্থাপন করছেন। অনেকে পাগলই হয়ে গিয়েছে, কি করছে, কি পোস্ট করছে, কি বলছে, কি লিখছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
আর ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে যদি বলি। ইনকামের আশায় অনেকেই সেটা জলাঞ্জলী দিয়েছে, তার ব্যক্তিত্বের সাথে যেটা যায় না, তাও সে সেটা করছে। একজন লোক চলনে বলনে বেশ ভুশায় সব কিছু, পুরাই ইসলামিক কিন্তু ইনকামের আশায় উনি এমন কিছু করছেন যা তার সাথে বেমানান। উনি হয়তবা সেটা বুঝতেও পারছেন না। অনেকের এই ধরনের ভিউ বাড়ানোর পোস্টের জন্য অহংকার, অহমিকা, ধনীত্ব, বড়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। এটা কি ইসলাম সমর্থন করে? আজকে কি কি খেয়েছেন- লোভনীয় সব খাবারের ছবিসহ পোস্ট করে দিলেন। ঘরে কি কি রান্না হয়েছে লোভনীয় সুন্দর সুন্দর খাবার সব পোস্ট করে দিলেন। এটাতো সারা দেশ জুড়ে অনেকেই দেখছেন, একবারও ভেবেছেন এর মধ্যে অনেকেই আছে যার কাছে খাবারটি কাঙ্খিত কিন্তু কিনতে পারছে না। এমন লোকও থাকতে পারে যে ঐদিন তার বাসায় খাবারই নেই! মচৎকার চমৎকার দামি ড্রেস পোস্ট দিলেন, অনেক বাচ্চা তার বাবার কাছে একটি নতুন ড্রেসের জন্য বায়না করে বহুদিন অপেক্ষা করছে। বাবা দিতে পারছে না, বাচ্চাও পাচ্ছে না- তারাওতো আপনার পোস্টটি দেখেছে, হয়তো সে আপনার আত্মীয়।
কি আলিশান বাড়ি করেছেন! কি চমৎকার ফ্লাট! কি সাজ সজ্জা! দামী দামী ফার্নিচার! পোস্ট করে দিলেন। একবারও ভেবেছেন অনেকের কাছেই জিনিসগুলো খুব কাঙ্খিত, কিন্তু তিনি এসব করতে পারছেন না। এমনকি অনেকেই আছেন আপনার আত্মীয় বা ফেসবুক ফ্রেন্ড তার সাথে বাড়িওয়ালা জঘণ্য ব্যবহার করেছে অল্প কয়টা টাকা বাড়ি ভাড়া বাকি আছে বিধায়। এগুলো কি অহংকার, অহমিকা, ধনীত্বর প্রচার নয়! আবার এমনও আছে সে কিসে চাকুরী করে কয় টাকা বেতন পায় সবাই জানে, কিন্তু যে বাড়ি বা ফ্লাটের পোস্ট দিচ্ছে তা তার সারা জীবনের বেতন দিয়েও কেনা সম্ভব নয়। ভাবে না যে মানুষ কি ভাববে, আমি এটা কিভাবে কিনলাম! সারা জীবন দুই নাম্বারী টাকা ইনকাম করছে, ঘুষ খেয়ে খেয়ে বাড়ি গাড়ি সবই করছে যা সর্বজন স্বীকৃত। অবসরে গিয়ে চলে গেলেন হজ্জ করতে বা ওমরা করতে। প্রতিদিন পোস্ট দেয় আজকে এই করলাম, কালকে এই করলাম। আরে পরিচিত মানুষের যখন চোখে পড়ে মানুষ তখন কি ভাবে, একবার ভেবেছেন! দোয়া করে! না বরং উল্টা গালি দেয়।
ভিউ বাড়ানোর নেশায় অনেকের দেখলাম সম্পর্কে তার ভাগনী বা খালা বা ফুফু, দেখতে সুন্দর, আকর্ষনীয় বেশ তার সাথে ছবি একটা তুলে দিয়ে দিল। এমন পোজ মনে হয় যে নায়ক নায়িকা। ভাল ব্যক্তিত্ববান লোক, সুযোগ পেয়েছে একটু খোলামেলা বা দৃষ্টিকাড়া পোশাকে কোন পরিচিত নারী বা সেলিব্রেটি, বেশ একটা ফটো তুলে দিয়ে দিল। আমাদের একটু এসব বিষয়গুলো ভাবা দরকার।
আমাদের দেশে মানুষ একেবারে ফেসবুকের ইনকামের প্রতি হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, বিশেষ করে অনেক নারী সংসারের দায়িত্ব অবহেলা করে ফেসবুকে অতিরিক্ত সময় দিচ্ছেন, যা পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি করছে। লজ্জাশীলতা বজায় রাখা, সময়ের সঠিক ব্যবহার এবং পরিবারের দায়িত্ব পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ ফেসবুকের কারণে কেউ লজ্জাহীন হয়ে পড়ে বা সংসারের প্রতি উদাসীন হয়, তবে তা ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়।
ফেসবুক থেকে আয় করা সম্ভব এবং এটি নতুন প্রজন্মের জন্য সুযোগের দরজা খুলে দিয়েছে। তবে একে সহজ মনে না করে কঠোর পরিশ্রম, সৃজনশীলতা ও ধৈর্যের সাথে চেষ্টা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ফেসবুক ব্যবহার যেন আদর্শ, লজ্জাশীলতা, পরিবারের দায়িত্ব এবং নৈতিকতার ক্ষতি না করে—এটা নিশ্চিত করা জরুরি। সঠিক নিয়তে ও সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে ফেসবুক উপকারী হবে, আর ভুল পথে ব্যবহার করলে এটি দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।


গণতন্ত্রের ব্যয়: রাষ্ট্র না জনগণ, না দুর্নীতি?

মোহাম্মদ আব্দুল মুবিন
আপডেটেড ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২৩:১৩
সম্পাদকীয়

রাজনীতি যে শুধু আদর্শের লড়াই নয়, বরং এক জটিল অর্থনৈতিক কাঠামো, তা আজ আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। রাজনীতিকে কার্যকর রাখতে দল চালানোর খরচ, নির্বাচনী প্রচারণা, কর্মী পরিচালনা এবং প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যয় ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপুল অর্থ আসে কোথা থেকে? এবং এর ওপর জনগণের ও রাষ্ট্রযন্ত্রের কতটা নজরদারি রয়েছে?

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাস মূলত সংগ্রাম, প্রতিরোধ ও পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতার নাম। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে সামরিক শাসন, একদলীয় শাসন ও গণআন্দোলনের উত্তাল সময় পেরিয়ে দেশে যে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের কাঠামো গড়ে উঠেছে, তা ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে চরম মূল্য পরিশোধের ফল। কিন্তু এই কাঠামোর ভিত মজবুত হওয়ার পরিবর্তে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েছে অর্থনৈতিক এবং নৈতিক দিক থেকে। রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থনৈতিক নকশা, অনুদান আহরণের পদ্ধতি ও নেতৃত্বের আচরণগত চরিত্র। রাজনীতি আজ আর জনসেবার ব্রত নয় বরং তা এক ধরনের উচ্চ ব্যয়ের ‘পেশায়’ পরিণত হয়েছে, যেখানে ক্ষমতা দখলই মুখ্য লক্ষ্য, আর আদর্শ, নৈতিকতা কিংবা জনস্বার্থ প্রায়শই পেছনের সারিতে ঠাঁই পায়। ফলে দল চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে নানা অনিয়ন্ত্রিত উৎস, যার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, ব্যবসায়িক প্রভাব ও অপরাধমূলক জোট। এই বাস্তবতায় রাজনীতি এখন এমন এক প্রতিযোগিতার মঞ্চ, যেখানে নীতির চেয়ে পুঁজি, আদর্শের চেয়ে পৃষ্ঠপোষকতা, আর গণমানুষের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ক্ষমতা অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

রাজনৈতিক অর্থায়নের বাস্তবতা-

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক অর্থায়ন নিছক একটি প্রশাসনিক প্রয়োজন নয়; বরং এটি রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নৈতিক মানদণ্ডের প্রতিফলন। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই অর্থায়ন একটি সুসংহত নীতিমালার অধীনে পরিচালিত হয়, যার মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষমতার রাজনীতি যেন আর্থিক স্বেচ্ছাচার কিংবা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর করায়ত্ত না হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার, আর ভারতে ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার - যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচনী ব্যয় ছিল প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। এই পরিসংখ্যান কেবল নির্বাচনী প্রচারণার নয়, বরং রাজনৈতিক অর্থনীতির জটিলতা ও বিস্তৃত কাঠামোর দিকেও ইঙ্গিত করে। এই বিপুল ব্যয়ের মধ্যেও একটি মৌলিক পার্থক্য রয়ে গেছে। যেখানে উন্নত বিশ্ব অর্থায়নের প্রতি তৈরি করেছে জবাবদিহিমূলক কাঠামো, দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ রাষ্ট্র সেখানে দাঁড়িয়ে আছে নিয়ন্ত্রণহীনতা ও স্বচ্ছতার অভাবে। যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল ইলেকশন কমিশন (FEC), যুক্তরাজ্যে ইলেকটোরাল কমিশন এমনকি ভারতের নির্বাচন কমিশনও তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর আয়-ব্যয়ের ওপর কঠোর নজরদারি আরোপ করে, অনুদান গ্রহণে নির্দিষ্ট বিধিমালা নির্ধারণ করে দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুদান ও তার উৎস জনসমক্ষে প্রকাশ বাধ্যতামূলক করে। যদিও ভারতে এ সংক্রান্ত কাঠামো থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ে ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’-এর মতো ব্যবস্থার মাধ্যমে অনুদানদাতার পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যা এই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে আবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির মডেল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের হার ও সদস্যসংখ্যার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় অনুদান পায়। শর্ত হিসেবে দলগুলোকে বছরের শেষে পূর্ণাঙ্গ অডিট রিপোর্ট জমা দিতে হয় এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হয়। এই নীতিগত কাঠামো রাজনৈতিক অর্থায়নে একটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। এই তুলনায় বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রাজনৈতিক অর্থের উৎস ও ব্যয়ের কাঠামোতে ব্যাপক অস্বচ্ছতা, করপোরেট প্রভাব ও পক্ষপাতমূলক সুবিধা প্রদানের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থায়ন কাঠামো একদিকে যেমন অস্বচ্ছ, তেমনি ভয়াবহভাবে অনিয়ন্ত্রিত। নির্বাচনী ব্যয়ে নির্ধারিত সীমা থাকলেও বাস্তবতায় তা কেবল কাগুজে নিয়মেই সীমাবদ্ধ। একাধিক পরিসংখ্যান বলছে, অনেক ক্ষেত্রেই ঘোষিত ব্যয়ের তুলনায় প্রকৃত ব্যয় পাঁচ থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বেশি হয়ে থাকে। ফলে একটি মৌলিক প্রশ্ন দাঁড়ায়- এই অতিরিক্ত অর্থের উৎস কী? এবং কারা এর মূল সুবিধাভোগী? এই ধরনের প্রশ্নের গভীরে আমরা যে ধরনের উৎস ও সুবিধাভোগী শ্রেণি দেখি-

প্রথমত, দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী শ্রেণি এ সব রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রধান অর্থদাতা। তাদের দেওয়া অনুদান কোনো নিছক দাতব্য কাজ নয়, বরং এটি এক ধরনের বিনিয়োগ, যার বিপরীতে তারা প্রত্যাশা করে রাজনৈতিক সুবিধা। সরকারি নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার, প্রকল্প বরাদ্দ, কর রেয়াত, আমদানি-রপ্তানিতে ছাড়, এমনকি নৈতিক জবাবদিহিতাহীন বাণিজ্যিক পরিবেশ, সবই এর আওতায় পড়ে।

দ্বিতীয়ত, সরকারি প্রকল্প ও উন্নয়ন বরাদ্দের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করা। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম করে যে অতিরিক্ত অর্থ আত্মসাৎ করে, তার একটি অংশ সরাসরি রাজনৈতিক তহবিলে চলে যায়। ফলে দুর্নীতিকে শুধু ব্যক্তি নয়, বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও দলীয় কাঠামোর মধ্যেই যুক্ত করে ফেলা হয়।

সম্ভাব্য সমাধান-

রাজনৈতিক অর্থায়নের অস্বচ্ছতা ও অনিয়ন্ত্রিত প্রবণতা যদি গণতন্ত্রের এক মারাত্মক অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তবে এর উত্তরণও হতে হবে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে। একক কোনো সমাধান নয়, বরং একটি সমন্বিত ও বহুমাত্রিক উদ্যোগই পারে রাজনৈতিক অর্থনীতিকে জবাবদিহিমূলক ও জনবান্ধব করতে।

১. রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য বৈধ বেতন কাঠামো প্রবর্তন: প্রতিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে তাদের তৃণমূল কর্মী ও সাংগঠনিক নেতাদের জন্য নির্দিষ্ট হারে সম্মানী বা বেতন প্রদান বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হবে এবং চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব বা সহিংসতায় জড়ানোর প্রলোভন থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। এই উদ্দেশে দলীয় আয়-ব্যয়ের পূর্ণ স্বচ্ছতা ও বার্ষিক নিরীক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।

২. অনুদানের বাধ্যতামূলক প্রকাশ ও নথিভুক্তি: যেকোনো ব্যক্তি বা করপোরেট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ৫,০০০ টাকার অধিক অনুদান নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। এতে অনুদানের উৎস ও প্রভাব উন্মুক্ত থাকবে, এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গোপন লেনদেনের অবকাশ কমবে।

৩. নির্বাচনী ব্যয়ের ডিজিটাল ট্র্যাকিং ও নিরীক্ষা: নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের প্রতিটি খরচের ডিজিটাল রসিদ সংরক্ষণ ও নির্বাচন কমিশনের আওতায় তা অডিটের আওতায় আনা আবশ্যক। মোবাইল অ্যাপ, ব্লকচেইনভিত্তিক ট্র্যাকিং ব্যবস্থা বা অনলাইন রিপোর্টিং সিস্টেম চালু করে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

৪. সরকার-নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক অনুদান তহবিল (State Funding): উন্নত বিশ্বের অনুকরণে যদি সম্ভব হয় বাংলাদেশেও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি সরকার-নিয়ন্ত্রিত তহবিল চালু করা। ভোটের হার, সাংগঠনিক কার্যক্রম ও সদস্যসংখ্যার ভিত্তিতে দলগুলো নির্ধারিত অনুদান পাবে। এর বিনিময়ে দলগুলোকে বছরে একাধিকবার আয়-ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ হিসাব কমিশনে দাখিল করতে হবে এবং জনসমক্ষে তা প্রকাশ করতে হবে। এতে বেসরকারি অনুদানের নির্ভরতা কমে যাবে এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অবৈধ অর্থের প্রবাহ হ্রাস পাবে।

৫. নির্বাচন কমিশনের কাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি: এই সকল পদক্ষেপ কার্যকর করতে হলে, প্রথমেই প্রয়োজন একটি স্বাধীন, দক্ষ ও আধুনিকায়নপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশন। বর্তমানে দলীয় আর্থিক অডিট, অনুদান পর্যবেক্ষণ বা নিয়মভাঙায় শাস্তি প্রদানে কমিশনের ভূমিকা অত্যন্ত দুর্বল। কমিশনকে প্রযুক্তি-নির্ভর, আইনগত ক্ষমতাসম্পন্ন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে একটি স্বতন্ত্র ‘রাজনৈতিক অর্থায়ন পর্যবেক্ষণ সেল’ গঠন করা যেতে পারে, যারা নিরবচ্ছিন্নভাবে দলগুলোর আয়-ব্যয়ের ওপর নজরদারি রাখবে।

এই সমাধানগুলো কেবল কল্পনাপ্রসূত ধারণা নয়; অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশেও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এ ধরনের কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। বরং সময়ের দাবি হচ্ছে-রাজনীতি ও দুর্নীতির মধ্যে যে আর্থিক জোট, তা ভেঙে দিয়ে গণতন্ত্রকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।

শেষ কথা-

গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি হলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনঅংশগ্রহণ। কিন্তু রাজনৈতিক অর্থনীতির যখন নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অদৃশ্য, অনিয়ন্ত্রিত এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক উৎসের হাতে; তখন গণতন্ত্র রূপ নেয় নির্বাচনের মোড়কে মোড়ানো এক বিত্তবানদের খেলায়। যতদিন রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থনীতি গোপন, অনিয়ন্ত্রিত ও ক্ষমতানির্ভর থাকবে, ততদিন গণতন্ত্র জনগণের নয়, বরং অর্থবানের নিয়ন্ত্রণেই আবদ্ধ থাকবে।রাজনৈতিক অর্থায়নের সংস্কার ছাড়া দুর্নীতি দূর করা যাবে না। একটি ন্যায্য ও কার্যকর গণতন্ত্র গঠনের জন্য দলীয় অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং নিয়মতান্ত্রিকতা আনা জরুরি। রাজনীতি যদি একটি ‘পেশা’ হয়, তবে এর জন্য বৈধ ‘বেতন’ ও ‘অর্থের উৎস’ থাকা আবশ্যক। না হলে রাজনীতি একটি দুর্নীতির পাইপলাইনে পরিণত হবে, যার খেসারত দেবে গোটা জাতি।

লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট।


মূল্যস্ফীতি এখন সংসারের আতঙ্ক: প্রতিকার কিভাবে?

ড. মিহির কুমার রায়
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাজারে সবজির সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। অথচ আলু-পেঁপে আর মিষ্টিকুমড়ো ছাড়া ১০০ টাকার নিচে ভালো সবজি মিলছে না। সামুদ্রিক মাছের ভরা মৌসুম, অথচ মাছের দাম চড়া। ডিম-মাংস, শুকনো নিত্যপণ্যের দামও ঘুরছে বাড়া-কমার চক্রে। বাজারের এমন অস্থির পরিস্থিতিতে ক্রেতার ত্রাহি অবস্থা। নিত্যপণ্যের বাজারে এমন ঊর্ধ্বগতির কারণে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারা বলছেন, বাজারে অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ‘বাজার করতে হবে শুনলেই চোখে অন্ধকার আসে। একটা পণ্যের দাম কমলে পাঁচটার দাম বাড়ে। মাসের পর মাস ধরে এমন অবস্থা চলছে। যদি মাছ-মাংসের দাম বেশি হয়ে সবজির দাম কম থাকতো কিংবা সবজির দাম বেশি হলেও অন্য পণ্যের দাম কম থাকত, তা-ও কোনোমতে মানিয়ে নেয়া যেত। এখন যে অবস্থা, সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। বাজারের ওপর কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চলছে। আমরা মধ্য আয়ের মানুষ কেমন আছি, কীভাবে চলছি, কেউ জানতেও চায় না, কেউ ভাবেও না। সবকিছুর দাম বাড়ছে, কিন্তু আয় তো বাড়েনি।’

কাঁচাবাজারে সবজির মধ্যে কাঁকরোল, ঝিঙা, পটল, ঢ্যাঁড়স, শসা, করলা প্রতিকেজি ৯০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। বরবটি ১২০ টাকা, বেগুন ৮০ থেকে ১০০ টাকা, টমেটো ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কচুরমুখী, লাউ, মূলা কেজিপ্রতি ৬০ থেকে ৮০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। কচুর লতি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। গাজর ১৬০ টাকা, হাইব্রিড শসা ৬০ টাকা, কাঁচা কলার হালি ৪০ টাকা, শালগম ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফুলকপি ও বাঁধাকপি ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি আলু মানভেদে ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। আর মিষ্টি কুমড়োর দাম ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। কাঁচামরিচ ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, ধনেপাতা প্রতি কেজি ১৫০ টাকা আর শাকের মধ্যে কচুশাক ৪০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া শাক ৫০ টাকা, পুঁইশাক ৪০ টাকা ও লালশাক ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছের মধ্যে লইট্যা ও ফাইস্যা ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, আবার মানভেদে ২২০ টাকা, পোয়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, শাপলা পাতা মাছ ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, কোরাল ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা, রূপচাঁদা ৩৫০ থেকে ৭০০ টাকা, আইড় ৪০০ থেকে ৬৫০ টাকা, চিংড়ি (বাগদা ও গলদা) আকারভেদে ৬৫০ থেকে ১২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। খুচরা বাজারে এক-দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ২০০০ থেকে ২৪০০ টাকা, ৫০০-৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১৫০০ টাকা, এক কেজির কিছু কম ওজনের ইলিশ ১৮০০-২০০০ টাকা এবং জাটকা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায়। দুই-আড়াই কেজি ওজনের বড় ইলিশ মাছ প্রতি কেজি তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া খাল-নদী ও চাষের মাছের মধ্যে রুই ও কাতলা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, পাবদা ছোট আকারের ৪০০ টাকা, মাঝারি সাইজের ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, শিং ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, টেংরা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, পুঁটি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, সরপুঁটি ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা, তেলাপিয়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, নাইলোটিকা ২২০ থেকে ২৮০ টাকা, কৈ ২০০ থেকে ২২০ টাকা এবং পাঙাস, সিলভার কার্প মিলছে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায়। ছোট চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা দরে। বিক্রেতারা জানালেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে সামুদ্রিক ও খাল-নদীর কয়েকটি মাছের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা।

বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম আবার বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা দরে, যা গত সপ্তাহের চেয়ে ১০ টাকা বেশি। সোনালি মুরগির দাম কিছুটা কমে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা, পাকিস্তানি কক ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা, দেশি মোরগ ৬৫০ টাকা এবং জাতভেদে প্রতি পিস হাঁস বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়। অন্যান্য মাংসের মধ্যে গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৯৫০ টাকা, খাসি ও পাঁঠা ছাগলের মাংস ১২০০ থেকে ১২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ডজন প্রতি ১০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। দেশি মুরগির ডিম ১৮০ টাকা ও হাঁসের ডিম ২৩০ টাকা ডজন প্রতি বিক্রি হচ্ছে।

এমতাবস্তায় এখন নীতি সহায়তায় বাজারে সাপ্লাই ঠিক রাখতে হলে ডিলার ও বাজারে সবসময় পর্যাপ্ত পণ্য মজুদ রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে বিভিন্ন কারণে সক্ষম ডিলার ও বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য মজুদ রাখা সম্ভব হয় না। ফলে মিল থেকে পাঁচ-সাত দিন সরবরাহ কিছু কম হলেই বাজারে তার প্রভাব পড়ে। ভোগ্যপণ্যগুলো মূলত কৃষিপণ্য, এগুলোর উৎপাদন অনেকটাই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। কোনো বছর উৎপাদন বেশি হয় আবার কোনো বছর উৎপাদন কম হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যের অস্তিরতা তৈরি হয়। বর্তমান বিশ্বে ভোগ্যপণ্যের বাজারে প্রায়ই অস্থিরতা বিরাজ করে। এ অস্থিরতা থেকে ঝুঁকিমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে কমোডিটি মার্কেট চালু হয়েছে, যা কার্যকর করা জরুরি। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য উৎপাদনের পূর্বাভাসের ওপর ভিত্তি করে সময়ভিত্তিক নীতিসহায়তা দরকার। তাছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতি বাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করবে। পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ না করে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া অতীব জরুরি। খাদ্যনিরাপত্তায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিক মান বজায় রেখে সরবরাহ নিশ্চিত রাখা। আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় বাধা হলো আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা। যেমন বলা যেতে পারে বিএসটিআই নীতির সঙ্গে পিউর ফুডের অনেক নীতির মিল নেই। আবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়মনীতির সঙ্গেও সমন্বয়হীনতা আছে, যা উৎপাদন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সমন্বয়হীনতা দূর করা জরুরি। এই মুহূর্তে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা দূর করা প্রথম ও প্রধান কাজ। যেমন ভোক্তা অধিদপ্তর, বিএসটিআই, সিটি করপোরেশন, পিউর ফুড, ফুড সেইফটি অথরিটিসহ সবার উচিত একক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক একক নীতির মাধ্যমে ব্যবসাকে পরিচালিত করা। দুগ্ধজাত দ্রব্য ও প্রাণিজ আমিষের (মাছ, মাংস, ডিম) দাম কমানোর সুযোগ সীমিত। এখানে দুটি মূল বিষয় হলো—প্রথমত, বাজার অর্থনীতিতে চাহিদা-জোগানের ওঠাপড়ার ওপর দাম নির্ভর করে। আর মৌসুমভেদে নানা রকম কারণে দামের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। তাছাড়া সারাটা বছর তো আর এক রকম যায় না। বন্যা, খরাসহ নানা রকম দুর্যোগের শিকারও হতে হয়। সেজন্য আমরা ‘সারা বছরের জন্য এক পরিকল্পনা’ করতে পারি না । কেন আমরা পোলট্রির দাম নির্ধারণের জন্য সারা বছরের পরিকল্পনা করতে পারি না? শুধু এ হিসাবে না গিয়ে আমরা যদি উৎপাদনকারীদের জন্য বাজার ও মূল্যসহায়তা (মার্কেট ও প্রাইস সাপোর্ট) নিয়ে কাজ করি সেটাও বাজারে ভারসাম্য আনতে সাহায্য করবে। উৎপাদনকারীদের ন্যূনতমভাবে বেঁচে থাকার মতো সক্ষমতার ব্যবস্থা করা উচিত। কেননা, অনেক সময় দাম এতটা পড়ে যায় যে তার সঙ্গে মিল রেখে উৎপাদন খরচ একদমই কমেনি। বিদ্যুতের রেট কমেনি, খাদ্য-ওষুধ ও শ্রমের মজুরিও আগের মতোই আছে; তাহলে উৎপাদন খরচ না কমে বরং আগের মতো বা তার চেয়ে বেশিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু অন্যদিকে দাম কমানোর ফলে উৎপাদনকারীদের, ব্যবসায়ীদের আয় কমে যাচ্ছে। এ আয়ে তাদের খরচই উঠছে না। এছাড়া ভর্তুকি দেয়ারও একটা বিষয় আছে। ধরা যাক, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত যখন বাজারে চাহিদা বেশি থাকে, ব্যবসায়ীরা অনেক আয় করেন। কিন্তু আবার বছরের যে সময়টাতে ওদের এ আয়-ইনকাম থাকবে না তখন সাবসিডি দেয়া যায় কিনা। এতে ক্রেতারাও ভালো থাকবেন আবার আমাদের ব্যবসায়ীরাও ভালো থাকবেন। কিন্তু ব্যবসায়ীকে মেরে ফেলে ক্রেতাকে সুবিধা দেয়ার যে সামগ্রিক ক্ষতি; সেটা নিয়ে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। একই কথা কৃষি ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন বাম্পার ফলন হলে কৃষককে অতি অল্প দামে—২ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করতে হয়, সেই আলু আবার ৪০ টাকা কেজিতে ঢাকায় বিক্রি হয়। পণ্যমূল্যের ওপর কোনো নীতি প্রণয়ন করা অথবা পণ্যমূল্য নির্ধারণ করা যায় কিনা সেটা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কৃষিদ্রব্য যেহেতু দ্রুত পচনশীল তাই দাম নির্ধারণীতে সেটা শিল্পপণ্যের মতো কাজ করবে না। সেজন্য আমার মূল চেষ্টার জায়গাটি হলো, উৎপাদন খরচের জায়গায় কিছু কাজ করা। কেননা, এটা কমাতে পারলে কৃষিপণ্যে আর মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির দরকার হবে না। কৃষিতে যন্ত্রপাতির দাম কমানো, বাজার সুরক্ষা, ফিডসহ গবাদিপশু খাদ্যের দাম কমানো, সরকারিভাবে চারা, পোনা সরবরাহ—এগুলো করা প্রয়োজন । সিন্ডিকেট করে ফিডের দাম বাড়ানো, এমনকি দেখা যায় অনেক সময় বাজার কোম্পানি দ্বারা নয়, ডিলারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এ জায়গাগুলোয় শক্তিশালী রেগুলেটরি ম্যাকানিজম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ভাবে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রন সম্ভব হতে পারে।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


প্লাস্টিকের বোতল: একটি নীরব পরিবেশগত মহামারির সুদূরপ্রসারী পরিণতি

সৈয়দ মাহবুব আহসান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

আমরা প্রতিদিন অসংখ্য প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করি। মিনারেল ওয়াটার, কোল্ড ড্রিংক, জুস কিংবা বিভিন্ন বেভারেজের জন্য এই বোতলগুলো আমাদের কাছে স্বাচ্ছন্দ্য ও আধুনিক জীবনের প্রতীক। কিন্তু এই ক্ষণিকের সুবিধার পিছনে যে ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী মূল্য আমরা দিতে চলেছি তা অনেকেই গভীরভাবে ভেবে দেখি না। প্লাস্টিকের বোতল কেবল মাত্রাবিহীন বর্জ্য নয়; এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ভয়ংকর বিষদাঁতের মতো যা পরিবেশ, অর্থনীতি এবং মানব স্বাস্থ্যকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। একটি বিপজ্জনক চক্র প্লাস্টিক বোতলের জীবনচক্রটি শুরু হয় জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল ও গ্যাস) থেকে। এর উৎপাদন প্রক্রিয়াই অত্যন্ত সম্পদ-নিঃশেষকারী এবং দূষণকারী।

একটি একলিটার প্লাস্টিকের বোতল তৈরি করতে প্রায় ২৫০ মিলিলিটার তেল, ৩ লিটার পানি এবং প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। এই প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস (কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন) নিঃসরণ হয় যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করে। আশ্চর্যজনকভাবে একটি প্লাস্টিকের বোতল তৈরি করতে যতটা পানি খরচ হয় অনেক সময় তার চেয়ে বেশি পানি বোতলটি প্যাকেজিং এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ায় ব্যয় হয়। এটি পানির একটি চরম অপচয়। ল্যান্ডফিল, নদী ও সমুদ্রের দূষণ প্লাস্টিক বোতলের সবচেয়ে বড় এবং দৃশ্যমান সমস্যা হলো এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।

অবিশ্বাস্য পরিমাণ বর্জ্য- বিশ্বজুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি প্লাস্টিকের বোতল বিক্রি হয়। এর মধ্যে মাত্র ৯%-এর মতো রিসাইকেল হয়। বাকি ৯১% বোতল যায় ল্যান্ডফিলে পোড়ানো হয় বা সরাসরি প্রকৃতিতে (নদী-নালা, খাল-বিল, সমুদ্র) পড়ে থাকে। প্লাস্টিকের বোতল প্রকৃতিতে কখনও সম্পূর্ণভাবে পচে না। এটি শত শত বছর হাজার বছর পর্যন্ত টিকে থাকে এবং ধীরে ধীরে ছোট ছোট টুকরোয় ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক-এ পরিণত হয়। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক মাটি, পানির উৎস এবং সমুদ্রে মিশে যায় যা পুরো ইকোসিস্টেমকে বিষিয়ে তোলে।
সমুদ্রের জীবন ধ্বংস: প্রতি বছর ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে পতিত হয়। সামুদ্রিক প্রাণীরা (কচ্ছপ, তিমি, ডলফিন, সামুদ্রিক পাখি) এগুলোকে খাদ্য ভেবে খেয়ে ফেলে যা তাদের পেটে আটকে থেকে ধীরে ধীরে তাদের মৃত্যুর কারণ হয় অথবা তারা দূষিত হয়।

মানব স্বাস্থ্যের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে এই নীরব ঘাতক প্লাস্টিক বোতল, শুধু পরিবেশের জন্যই নয় আমাদের নিজেদের স্বাস্থ্যের জন্যও একটি বড় হুমকি। রাসায়নিক মাইগ্রেশন করে বেশিরভাগ প্লাস্টিকের বোতল PET (Polyethylene Terephthalate) বা অন্যান্য প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি, যাতে শিল্প রাসয়নিক বিসফেনল BPA (Bisphenol-A) এবং Phthalates (থ্যালেটস)-এর মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে। এই রাসায়নিকগুলো বোতলে রাখা পানিতে এবং অবশেষে আমাদের দেহে মিশে যায় বিশেষ করে যদি বোতলটি গরম পরিবেশে থাকে বা পুনরায় ব্যবহার করা হয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে BPA এবং Phthalates (থ্যালেটস) মানবদেহের জন্য এন্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টর (হরমোনের ভারসাম্য নষ্টকারী)। এগুলো ক্যান্সার (বিশেষ করে ব্রেস্ট ও প্রোস্টেট ক্যান্সার), বন্ধ্যাত্ব, শিশুদের বিকাশগত সমস্যা, ডায়াবেটিস, এবং অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে জড়িত। আমরা মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষিত পানি ও খাদ্য (বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, লবণ) এর মাধ্যমে সরাসরি আমাদের দেহে গ্রহণ করছি। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো আমাদের রক্তস্রোত, ফুসফুস প্লাসেন্টাতেও পাওয়া গেছে, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ। অর্থনৈতিক বোঝা- অদৃশ্য খরচ-প্লাস্টিকের বোতলের সস্তা দামটি একটি বিভ্রম। এর আসল খরচ আমরা অন্য খাতে গুনি। নদী, ড্রেন, সৈকত, এবং রাস্তাঘাট থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার করতে সরকার এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। প্লাস্টিক দূষণ ও রাসায়নিক এক্সপোজার থেকে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটে একটি বিশাল চাপ তৈরি হয়। দূষিত সৈকত ও নদী পর্যটকদের আকর্ষণ হারায়, যা স্থানীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতির কারণ। একইভাবে প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাছের মজুত কমে যাওয়া মৎস্য খাতকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

প্লাস্টিক বোতলের অদৃশ্য বিষ- আরও গভীরে যে ক্ষতিগুলো জানা হয়নি-প্লাস্টিক বোতলের ক্ষতি শুধু যে দৃশ্যমান দূষণ সেখানেই সীমাবদ্ধ নয় এর প্রভাব আরও গভীর, সূক্ষ্ম ও সুদূরপ্রসারী। আগের আলোচনায় যেসব দিক আসেনি, সেগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করা হলো:
বায়ু দূষণ ও বিষাক্ত নিঃসরণ: শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যেই ঝুঁকি
* পোড়ানোর সময় বিষাক্ত গ্যাস: যখন প্লাস্টিকের বোতলগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে পুড়িয়ে ফেলা হয় (যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণ ঘটনা), তখন তা ডাইঅক্সিন (Dioxin), ফুরান (Furan) এবং অন্যান্য মারাত্মক কার্সিনোজেনিক (ক্যান্সার সৃষ্টিকারী) যৌগ নির্গত করে। এই বিষাক্ত গ্যাসগুলি বায়ুতে মিশে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে এবং ফুসফুসের রোগ, হরমোনের ব্যাঘাত ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
* উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দূষণ: প্লাস্টিক বোতল তৈরির কারখানা থেকে নিয়মিত ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড (VOCs) এবং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক বাতাসে মিশে। এর ফলে কারখানার আশেপাশের জনবসতিতে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগের ব্যাপকতা বেড়ে যায়।
* মাটির গঠন ও উর্বরতা হ্রাস: ল্যান্ডফিলে বা প্রকৃতিতে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বোতল ধীরে ধীরে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক-এ পরিণত হয়। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মাটির ভৌত গঠন পরিবর্তন করে, এর জল ধারণক্ষমতা এবং বায়ু চলাচলের সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এটি মাটির স্বাস্থ্য ও উর্বরতার উপর গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মাটি দূষণ ও কৃষির উপর প্রভাব ফেলে মাটির উর্বরতা নষ্ট করে দেয়।
* কীটপতঙ্গ ও রোগের আবাস: পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতলে বৃষ্টির পানি জমে থাকে, যা মশা (如 ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া) এবং অন্যান্য রোগের বাহক পোকামাকড়-এর প্রজননক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি।
* রাসায়নিক মাটির গভীরে প্রবেশ: প্লাস্টিক থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর রাসায়নিক (BPA, Phthalates (থ্যালেটস) মাটিতে শোষিত হয়ে ভূগর্ভস্থ পানির উৎসকে দূষিত করে এমনকি ফসল তাদের শিকড় মাধ্যমে-এ প্রবেশ করে, যা অবশেষে আমাদের খাদ্য চেইনে -এ পৌঁছায়।
সামাজিক ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন: দূষণের অসম বোঝা
* পরিবেশগত বর্ণবাদ (Environmental Racism): প্লাস্টিক বোতলের ল্যান্ডফিল, পুনর্ব্যবহারকারী কারখানা এবং বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্লান্ট-গুলি সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষ যেখানে বসবাস করে সেখানে হয়। এর ফলে এই কমিউনিটির মানুষ অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেশি বায়ু দূষণ, পানি দূষণ এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।
* অনানুষ্ঠানিক বর্জ্য বাছাইকারী এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি: অনেক উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ এবং প্রাথমিক প্রক্রিয়াকরণ কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক বর্জ্য বাছাইকারীগণ। তারা প্রায়ই কোনো সঠিক নিরাপত্তা গিয়ার, গ্লাভস, মাস্ক) ছাড়াই কাজ করেন। এর ফলে তারা সরাসরি ক্ষতিকর রাসায়নিক এবং প্যাথোজেন-এর সংস্পর্শে আসেন, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি।
অর্থনীতির উপর অদৃশ্য খরচ: উত্পাদনশীলতার ক্ষতি
* কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন হ্রাস: মাটি ও পানি দূষণের ফলে কৃষি ও মৎস্য খাত-এর উত্পাদনশীলতা কমে যায়। পান। এটি সরাসরি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা এবং এই সেক্টরের উপর নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ মানুষদের জীবনযাত্রা হুমকিতে ফেলে দেয়।
* স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধি: প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কিত রোগ (শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সার, হরমোনজনিত ব্যাধি)-এর চিকিৎসা করতে সরকার এবং ব্যক্তিকে -কে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। এটি একটি বিশাল অর্থনৈতিক বোঝা যা প্রায়শই অচেনা থেকে যায়।
* জৈব বৈচিত্র্যের উপর Cascade (ক্যাসকেড প্রভাব) খাদ্য শৃঙ্খলে বিঘ্ন যখন ছোট প্রাণী বা প্লাঙ্কটন-মাইক্রোপ্লাস্টিক খায়, তখন এটি পুরো খাদ্য শৃঙ্খল অভ্যাসে পরিনথ হয়। বড় প্রাণরা যখন এই দূষিত ছোট প্রাণীগুলো খায়, তখন তাদের শরীরেও টক্সিন জমা হয়। এটি সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করতে পারে এবং বিপন্ন প্রজাতিদের বিলুপ্তির ঝুঁকি বাড়ায়।
আমাদের করণীয় –
আমরা যদি আজই সচেতন না হই, তাহলে আমাদের সন্তান-সন্ততিদের একটি বিষাক্ত, দূষিত ও দুর্বিষহ পৃথিবী উপহার দেবো। তাদেরকে বিশুদ্ধ পানি ও বায়ুর জন্য সংগ্রাম করতে হবে, দূষণজনিত নানা রোগে ভুগতে হবে, এবং একটি বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করতে হবে। এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব যে আমরা তাদের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাই। এই সুদূরপ্রসারী ক্ষতি রোধ করতে আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। সরকার, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি প্রত্যেককেই ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে পুনঃব্যবহারযোগ্য বোতল (স্টিল, কাচ, বিপিএ মুক্ত) ব্যবহার করা এটি সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর সমাধান।
একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বোতল এড়িয়ে চলুন।
বাড়িতে ও বাইরে ওয়াটার পিউরিফাই বা ফিল্টার ব্যবহার করুন।
যদি প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে সঠিকভাবে রিসাইক্লিং এর ব্যবস্থা করুন।
সচেতনতা তৈরি করুন, পরিবার ও বন্ধুদের উদ্ধুদ্ধ করুন।

শিল্প ও সরকারি পর্যায়ে বর্ধিত উৎপাদক দায়িত্ব (ইপিআর) চালু করা অর্থাৎ উৎপাদকদেরকে তাদের পণ্যের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা।
একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা বা উচ্চ কর আরোপ করা।
রিসাইক্লিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার আরও শক্তিশালী ও ব্যাপকভাবে উন্নয়ন করা।
বিকল্প প্যাকেজিং বায়ো-ডিগ্রেডেবল উপাদানের গবেষণা ও ব্যবহারকে উৎসাহিত করা।

একদমশেষে বলা যায়, প্লাস্টিকের বোতল আমাদের আধুনিক জীবনের একটি বিভ্রমমাত্র। এটি আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের নামে আমাদের পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং ভবিষৎতকে গিলে খাচ্ছে। এই সুদূরপ্রসারী ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে আমাদের আজই -এই মুহূর্তেই সচেতন হতে হবে এবং পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের ছোট ছোট পদক্ষেপই আমাদের এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে।


লেখক: মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট, ক্রিলিক-এলজিইডি।


banner close