সম্প্রতি ব্রিকস সম্মেলন শেষ হলো। শত নাটকীয়তা, আলোচনা, পর্যালোচনা, আশা-প্রত্যাশা ও উচ্চাভিলাষের উদ্রেক করা ব্রিকস সম্মেলন ঘিরে যে উচ্চাভিলাষের সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রায় কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। প্রায় ৪০টি রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তি বা সদস্যপদ পাওয়ার কথা শোনা গেলেও শেষমেশ ব্রিকস কেবল ছয়টি রাষ্ট্রকে আগামী বছর থেকে ব্রিকসপ্লাস ফোরামে সদস্যপদ প্রদান করবে। দেশগুলো হলো সৌদি আরব, ইরান, আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। পূর্ব-পশ্চিমের টানাপোড়েন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট জটিলতা, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক শাসনব্যবস্থায় মোড়লগিরি, মার্কিন ডলারের বিশ্ব অর্থব্যবস্থার ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ, যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্ব, বৈশ্বিক সাউথ ও নর্থের মধ্যে বর্ধমান অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্যতা- এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার তুলনামূলক অর্থনৈতিক ও সামরিক দুর্বল দেশগুলোর জন্য ব্রিকস এক অর্থে প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। এ দেশগুলোও এবার বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থায় সাম্যতার ভিত্তিতে অংশগ্রহণের স্বপ্ন দেখছিল।
তবে সেটির কিছুই হয়নি। যে ছয়টি দেশকে ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাদের নিয়ে একটু পর্যালোচনা করা যাক। শুরু করি ইথিওপিয়া নিয়ে। আফ্রিকার নাইজেরিয়া ও কেনিয়া বাদে বাকি সব দেশই এখন পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব পোষণ করছে। অধিকাংশ রাষ্ট্রই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক সমস্যা, রাজনৈতিক বিপত্তির যেকোনো একটি কিংবা এই তিনের কোনো এক মিশ্রণে জর্জরিত। এর মধ্যে ইথিওপিয়ার ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত অবস্থান অনেকটাই এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হর্ন অব আফ্রিকা নামে পরিচিত অঞ্চলের একটি রাষ্ট্র ইথিওপিয়া। অঞ্চলটির তিন পাশে রেড সি, গালফ অব এডেন ও ভারত মহাসাগরের অবস্থান। অর্থাৎ আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়া- এই তিন অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত হর্ন অব আফ্রিকা। ফলে আফ্রিকা থেকে ইথিওপিয়াকে ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তটা স্বাভাবিক।
এই সুবাদে মিসরও এক স্বভাবচরিত সদস্যপ্রত্যাশী। আরব বিশ্ব, আফ্রিকা ও ইসলামিক বিশ্ব- এ তিনটির মিলনস্থল বলা চলে মিসরকে। চীনের বিআরআই উদ্যোগের জন্য যেমন মিসর গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সুয়েজ ক্যানালের রক্ষণাবেক্ষক হিসেবে বৈশ্বিক বাণিজ্য নেটওয়ার্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ পথে অংশগ্রহণের কাণ্ডারিও মিসর। আফ্রিকার মধ্যে ষষ্ঠ সর্ববৃহৎ তেল মজুত মিসরে। প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুতও রয়েছে প্রচুর। প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন স্বর্ণ, রৌপ্য, জিংক, প্লাটিনাম ও আরও কিছু মূল্যবান ধাতুর মজুত রয়েছে তার।
আর্জেন্টিনাকে মধ্যম মানের আঞ্চলিক শক্তি হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়। ব্রাজিলের মতো আর্জেন্টিনাও ইউরোপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার। বৈশ্বিক সাউথ সমষ্টির প্রকৃত মুখপাত্র হিসেবেও আর্জেন্টিনাকে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। ব্রাজিলের মতো আর্জেন্টিনাও জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য ও জ্বালানিনিরাপত্তা খাতে বৈশ্বিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। জ্বালানি মজুত ও কৃষি খাতে আর্জেন্টিনা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বেশ এগিয়ে। উর্বর বিশাল ভূমিরাশি, গ্যাস, লিথিয়ামের মজুত নিয়ে আর্জেন্টিনা নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। আর্জেন্টিনার লিথিয়াম মজুত দিয়ে ২০৩০ অবধি বৈশ্বিক চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব। আর এই ধাতু আধুনিক প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের জন্য অপরিহার্য। খাদ্যশস্য ও গবাদিপশু উৎপাদনেও আর্জেন্টিনা বৈশ্বিক পর্যায়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। পাশাপাশি আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ দক্ষিণ আমেরিকার ওপর সর্বোপরি প্রভাব প্রণয়নে আর্জেন্টিনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিকসে ব্রাজিলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার উপস্থিতি দুজনের জন্য সম্পূরক হয়ে উঠবে।
সৌদি আরব মানেই তেল আর ইসলামিক বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের ওপর কার্যকরী প্রভাবের কথাই মনে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রিকসের প্রতিযোগিতায় মূলত পেট্রোডলারের বিরুদ্ধে ব্রিকসের আপাত লড়াইয়ের জন্য সৌদি আরবের গুরুত্ব অপরিসীম। সৌদি আরব মার্কিন ডলার ছাড়া অন্য মুদ্রায় (সম্প্রতি চীনের ইউয়ানে) তেল বিক্রির সিদ্ধান্ত মার্কিন ডলারের জন্য যথেষ্ট শঙ্কার কারণ। অতএব ব্রিকসে সৌদি আরবের সম্পৃক্ততা যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পর্কও ব্রিকসের কাজে দেবে।
ইরানের অন্তর্ভুক্তি অনেককেই কিছুটা অবাক করলেও সমুদ্রপথে বৈশ্বিক বাণিজ্যের আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগপথ হলো স্ট্রেট অব হরমুজ। ইরান ব্যতীত এই পথে নিরাপদ চলাচল প্রায় অসম্ভব। আর বৈশ্বিক জ্বালানিনিরাপত্তায় ইরানের তেল বেশ কয়েক বছরব্যাপী কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে। ভারতের মতো আরও অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই ইরানের সঙ্গে জ্বালানি বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে। আর রাশিয়া ও চীনের সঙ্গেও ইরানের সম্পর্ক এখন কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত। এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সংযোগকারী বিশাল ইরান রাষ্ট্র কাস্পিয়ান সমুদ্র থেকে পারস্য সাগর ও ভারত মহাসাগর অবধি ইরানের বিস্তৃতি দেশটিতে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও জ্বালানিনিরাপত্তার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
আর আমিরাতের মতো অনন্য রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কারোই তেমন কোনো দ্বিধা ছিল না। চীনের সঙ্গে এর অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং সিরিয়া নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ আমিরাতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। সৌদি আরবের সঙ্গে সুসম্পর্ক দেশটির জন্য গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলে কোনো সমস্যার উদ্রেক করে না। তুরস্কের সঙ্গেও ব্যাপক প্রতিযোগিতার স্থলে ব্যাপক সম্পূরক সম্পর্ক গড়ে তোলার অনন্য কূটনৈতিক সাফল্য দেখিয়েছে আমিরাত।
বলা যায়, ব্রিকসের সম্প্রসারণ অনেকটাই মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। ব্রিকস এমন ছয়টি সদস্যকেই বেছে নিয়েছে, যারা বাণিজ্যিক সংযোগ, জ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিরাপত্তা ও কৌশলগত সহযোগিতা প্রদানে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। ব্রিকসে প্রধান পাঁচ দেশের বর্ধমান অর্থনীতির জন্য এসবই অপরিহার্য। একই সঙ্গে নতুন ছয় সদস্যের জন্য ব্রিকসের প্রধান পাঁচ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্ভাবনাগুলো সম্পূরক ও সহায়ক হবে। সুতরাং সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত মূলত পারস্পরিক সম্পূরক স্বার্থ বিবেচনাতেই হয়েছে বলে প্রতীয়মান।
তবে ব্রিকস সম্মেলন যে পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রত্যাশা জাগিয়েছিল তার পুরোটাতেই গুড়ে বালি। স্বর্ণভিত্তিক নতুন ব্রিকস মুদ্রা প্রণয়নের কোনো নামগন্ধও ছিল না এবার। কেবল ব্রিকস সদস্যরা নিজেদের স্থানীয় মুদ্রায় পরস্পরের সঙ্গে বাণিজ্য ও লেনদেনের বিষয়ে কিছুটা অগ্রগতি দেখিয়েছে। কিন্তু সেটাও কার্যকরী হতে দেশগুলো অর্থব্যবস্থা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বেশ কিছু অবকাঠামোগত ও কারিগরি উৎকর্ষের প্রয়োজন। সেগুলো ঠিক কীভাবে হবে এবং কোন নীতিমালার ভিত্তিতে হবে, সেগুলো নিয়ে এখনো অনেক কাজ বাকি। বিষয়টা মার্কিন ডলারের প্রতি দেশগুলোর নির্ভরতা কিছুটা হ্রাস করলেও এদের স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার যদি মার্কিন ডলারের ওপর ভিত্তি করেই হয়, তাহলে মার্কিন ডলারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণকে আলতো নাড়া দেয়াই হবে কেবল। তবে যেকোনো পরিপ্রেক্ষিতেই সেটা প্রণীত হোক না কেন, রাশিয়ার জন্য বিষয়টা সুবিধাই বয়ে আনবে।
পশ্চিমা তথা যুক্তরাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের মতো বৈশ্বিক সাউথের রাষ্ট্রগুলোর জন্য সমতা প্রণয়ন করে নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রবর্তনের যে আপেক্ষিক প্রতিশ্রুতি ব্রিকস দিয়েছিল, তার অপূর্ণই রইল। এ ক্ষেত্রে ব্রিকস কিছুই করতে পারেনি। এর জন্য ভারত ও ব্রাজিলই অনেকটা দায়ী। বৈশ্বিক পর্যায়ে এবং ব্রিকস ফোরামেও নিজ প্রভাব অটুট ও অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই তাদের এই আচরণ। ব্রিকসে একত্রিত হলেও ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলমান এবং তা সমাধা সহসা হচ্ছে না। বিশেষ করে নায়কোচিত, স্বীয় জনপ্রিয়তাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কৌশল প্রবর্তক মোদির ক্ষমতাকালে তো সেটা আরও সম্ভব নয়। নিজ রাজনৈতিক ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তার যথাযোগ্য প্রবর্তনের জন্য দেশের ভেতরে অথবা বাইরে কিংবা উভয় ক্ষেত্রে শত্রুর প্রয়োজন হয় এ ধরনের রাজনৈতিক নেতাদের। মোদির জন্য চীন অন্যতম। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত ব্যাপক বাণিজিক চুক্তিগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা নেয়া বাকি আছে এখনো মোদির। সে জন্য ব্রিকসে চীন ও রাশিয়া সহায়ক কোনো সিদ্ধান্তই যেমন মোদি সম্মতি প্রকাশে নারাজ, তেমনি বৈশ্বিক সাউথ তথা বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোর মুখপাত্র হয়ে কথা বলতে এগিয়ে যাবেন না তিনি। আর ভারতের স্বভাবচরিত- আমি একমাত্র, আমি প্রথম, বাকিরা পরে- এই বৈশ্বিক সম্পর্ক নীতি নতুন নয়। সুতরাং অন্যদের জন্য এগিয়ে এসে বৈশ্বিক সমতা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা আপাতত রাখবেন না তিনি। রাজনৈতিক বিবেচনায়, ভারতের জন্য বিষয়টা সুবিধা বয়ে আনবে এবং দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এমনটা করায় তাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তবে আঞ্চলিক নেতৃত্ব প্রদানে ভারত যে আবারও ব্যর্থ, সেটা অনস্বীকার্য। একই পরিস্থিতি ব্রাজিলের প্রধানমন্ত্রী লুলার ক্ষেত্রেও। ব্যক্তি জনপ্রিয়তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় আসা লুলার জন্য স্বল্পমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সম্ভাব্য সুবিধা অবশ্যই লোভনীয়। বছরের শুরুতে বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাতে এমনটাই আশ্বাস পেয়েছেন লুলা। তাই যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ব্রিকসে তেমন কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে তার কিছুটা অপারগতা দেখানোয় অবাক হওয়ার কিছু নেই।
সর্বোপরি বলতে হয়, ব্রিকস হতাশ করেছে। যেসব বিবেচনায় তারা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই বিবেচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। বঙ্গোপসাগরে সংযোগপথ ব্যতীত ব্রিকস সদস্যদের সবার জন্য সমানভাবে সুবিধা দেয়ার মতো ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত এবং আর্থিক ও বাণিজ্যিক পরিস্থিতি আপাতত নেই বাংলাদেশের। আর ভূকৌশলগত সুবিধা যেটুকু প্রদান করতে সক্ষম বাংলাদেশ, তা নিয়ে এখনো চীন ও ভারত, তথা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে টানাপোড়েন বিদ্যমান। আর ভারত ব্রিকস সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে পিছপা হওয়ার প্রধান কারণই হলো নতুন সদস্যপদ পাওয়া রাষ্ট্রগুলো যদি না আবার চীনের বলয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। যারা সাম্যতা বজায় রেখে বৈশ্বিক পর্যায়ে ও ব্রিকসের কাঠামোতে কাজ করতে সক্ষম হবে, কেবল তাদেরই এবারের জন্য ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত হতে সর্বসম্মত হয়েছে ব্রিকসের প্রধান পাঁচ রাষ্ট্র। উল্লেখ্য, ব্রিকস কাঠামোতে সব সিদ্ধান্তই সর্বসম্মতিক্রমেই গৃহীত হবে- এমনটাই নিয়ম।
লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
কী হবে আগামী নির্বাচনে? কোন দল ক্ষমতায় আসবে? বাংলাদেশের মানুষ স্বদেশে কিংবা প্রবাসে যে যেখানেই আছে মোটামুটি সকলেই এখন এই রকম একটা প্রশ্নের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। চব্বিশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর ছাত্ররা বিপ্লবী সরকার গঠন করবে, সত্যি সত্যিই ওরা একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তুলবে, এটি ছিল প্রত্যাশা, স্বপ্নটা প্রায় ছুঁয়েই ফেলেছিলাম আমরা। কিন্তু ৮ আগস্টের সরকার যখন ১০৬ ধারার ফাঁক দিয়ে একটি আইনী ব্যাখ্যার বৈধতা নিয়ে গঠিত হলো তখনই সব হিসেব পাল্টে গেল।
এরপর সবাই নিশ্চিত হয়ে গেল ফাঁকা মাঠে এখন গোল দেবে বিএনপি। দেখতে না দেখতে পুরো দেশটাই হয়ে উঠলো বিএনপির ফুটবল মাঠ। তারা টেম্পু স্ট্যান্ড, বাস স্ট্যান্ড, হাট, ঘাট, মাঠ, বাজার, চরের বালু, নদীর পানি, পাহাড়ের পাথর সর্বত্রই গোল দিতে লাগলো। এই গোল দেওয়া নিরস্কুশ করার জন্য সরকারকে উপর্যুপরি চাপ দিতে লাগলো দ্রুত নির্বাচন দেবার জন্য।
নির্বাচনের সময়কালও ঠিক হলো। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। বিএনপি কি এই নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতার মসনদে বসবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য বাংলাদেশের রাজনীতির ডাইনামিক্সটা আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে।
একটি বৃত্ত এঁকে যদি মাঝ বরাবর খাড়া দাগ দিই এবং তারপর রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বৃত্তের ভেতরে বসাই তাহলে দাগের বাঁয়ে দাগ ঘেষে বসবে আওয়ামী লীগ, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ একটি মধ্য বাম মানসিকতার রাজনৈতিক দল। বিএনপি বসবে দাগ ঘেষে দাগের ডানদিকে। অর্থাৎ বিএনপি হচ্ছে মধ্য ডান মানসিকতার রাজনৈতিক দল। সর্বডানে বসবে জামায়াতে ইসলামী এবং একই মানসিকতার ইসলামী দল, সংঘ ও গোষ্ঠীগুলি। সর্ববামে বসবে সিপিবি এবং কম্যুনিস্ট ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলো।
বাংলাদেশের মানুষ চিরকাল মধ্য ডান পন্থার পক্ষে থাকে। সেই দিক থেকে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিএনপি জনপ্রিয় দল। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের দল হয়েও ভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে হিমসিম খেতে হয়। এবং সব সময়ই মধ্য বাম থেকে তাদেরকে ডানে কাত হয়ে থাকতে হয়। ছাদ খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে হিজাবে মাথা ঢেকে তসবিহ হাতে নিয়ে শেখ হাসিনার ধর্ম প্রদর্শন, কিংবা কথায় কথায় তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া, হজে যাওয়া, ওমরাহ করা, ফজরের পর কোরআন পাঠ করার কথা ফলাও করে মিডিয়াতে প্রচার করতে হয় তাদের ‘ডানে কাত’ নিশ্চিত করার জন্য। এ কারণেই আসাদুজ্জামান নূরের মতো মানুষকে নির্বাচনী প্রচারণায় টুপি মাথায় দিয়ে এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে হয়, শামীম ওসমানকে বলতে হয় তিনি কত রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন, আওয়ামী লীগকে গঠন করতে হয় জাতীয় ওলামা লীগ।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যখন হাসিনা ও তার দলবল দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেল তখন বাংলাদেশের রাজনীতি-বৃত্তের ভেতরে একটি বড়ো ধরনের শূন্যতা তৈরি হল। আমরা সবাই জানি প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। কোনো এক স্থানের বাতাস যদি উষ্ণ হয় তখন অন্য জায়গা থেকে ঠাণ্ডা বাতাস দ্রুত গতিতে ছুটে এসে সেই স্থান পূরণ করে। এর ফলেই তৈরি হয় ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, বাউকুড়ানি। আওয়ামী লীগ যখন গণসুনামিতে উড়ে গেল, বৃত্তের ফাঁকা জায়গা পূরণ করার জন্য ভেতরের অন্য দলগুলোর মধ্যে ঝড় (বা হুড়োহুড়ি) শুরু হয়ে গেল। এটি খুবই স্বাভাবিক।
বিএনপি গ্রাভেটির টানেই বাঁয়ে সরতে শুরু করল। যেসব বয়ান আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিল, বিএনপি এখন সেইসব বয়ানের ওপর রাজনীতি করছে। অর্থাৎ বিএনপি তার অবস্থান থেকে সরে এসে এখন প্রায় থিতু হয়েছে মধ্যবামে। পুরোপুরি দাগের বামে চলে না গেলেও আমার বিবেচনায় এক-তৃতীয়াংশ দাগের বাঁয়ে চলে গেছে এবং দুই-তৃতীয়াংশ দাগের ডানে আছে কিন্তু তাদের ঝোঁক এখনো বামে, হয়ত আরো খানিকটা বামে সরে যাবে বিএনপি। এবং খুব স্বাভাবিক কারণেই জামায়াতে ইসলামীও প্রকৃতির নিয়ম অনুসরণ করে সর্বডান থেকে সরে এসে মধ্য ডানের দিকে ধাবিত হচ্ছে। জামায়াত এখন আর তাদের কট্টর অবস্থানে নেই। তারা হিন্দুদের মন্দির পাহারা দিচ্ছে, ছাত্রশিবির তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যানেলে ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন মতের মানুষের অন্তর্ভুক্ত করছে। জামায়াতের নেতা বিশিষ্ট আইনজীবী শিশির মনির সেদিন জানালেন, আগামী নির্বাচনে তারা আরো চমক দেখাবেন, হিন্দু প্রার্থীও দিতে পারেন। অনেক অমুসলিম এখন জামায়াতে ইসলামীর প্রশংসা করছে। এইসবই প্রমাণ করে জামায়াত এখন আর কট্টর ডানে নেই, তারা ক্রমশ উদার ডানপন্থী, যেটা বিএনপি ছিল, সেই জায়গায় প্রায় পৌঁছে গেছে।
বাংলাদেশের মানুষ চিরকালই উদার ডানপন্থার সমর্থক। আওয়ামী লীগের ডানে কাত হয়ে থাকা যে প্রতারণা ছিল এটি তারা বুঝতে পেরে হতাশ হয়েছে, বিএনপিকেই প্রকৃত উদার ডানপন্থি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এই দুটি দলকে বাংলাদেশের মানুষ বারবার ক্ষমতায় এনেছে উদার ডানপন্থার কারণেই। কিন্তু এই দুটি দলের মধ্যে মানুষ যা পায়নি তা হচ্ছে সততা এবং দেশপ্রেম। একবার বিএনপির জোট সরকারে জামায়াতে ইসলামীকে পেয়েছিল তখন তাদের সততার প্রমাণ পেয়েছে দেশবাসী। যারা বিএনপি করে, যারা আওয়ামী লীগ করে, যারা কম্যুনিস্ট পার্টি করে তারাও জামায়াতের সততার প্রশংসা করে। এখন সেই সৎ রাজনৈতিক দলটি যদি উদার ডানপন্থী হয়ে ওঠে তাহলে এদেশের মানুষ ভোটের রাজনীতিতে তাদের দিকেই যে ধাবিত হবে এটি দিনের আলোর মত পরিস্কার।
বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিয়ে বারবার হয় আওয়ামী লীগকে না হয় বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছে। তাই এর বাইরে অন্য কিছু ঘটতে পারে তা আমাদের চিন্তায় সহজেই ধরা দেয় না। হয়ত যা আমাদের চিন্তায় ধরা দেয় না তাই ঘটতে যাচ্ছে আগামী নির্বাচনে। মনে রাখতে হবে উদার ডানপন্থা এবং সততা এই দুইয়ের কম্বিনেশনটা কিন্তু খুব শক্তিশালী। বিএনপির মত বড়ো রাজনৈতিক দল যদি খুব দ্রুত এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে তাদের মূল রাজনীতিতে ফিরে না আসে তাহলে হয়ত খুব বড়ো ভুল হয়ে যাবে।
লেখক: কবি, রাজনীতি বিশ্লেষক।
দুর্গা, যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করেন; অন্য মতে, ‘যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন’, তাকে সনাতন হিন্দুরা মহাশক্তির একটি উগ্র রূপ মনে করেন। তার অন্যান্য নামগুলো হচ্ছে চণ্ডিকা, যোগমায়া, অম্বিকা, বৈষ্ণবী, মহিষাসুর সংহারিণী নারায়ণী, মহামায়া, কাত্যায়নী ইত্যাদি। দেবী দুর্গার অনেকগুলো হাত। তার অষ্টাদশভুজা, ষোড়শভুজা, দশভুজা, অষ্টভুজা ও চতুর্ভুজা মূর্তি দেখা যায়। তবে দশভুজা রূপটিই বেশি জনপ্রিয়। তাঁর বাহন সিংহ (কোনো-কোনো মতে বাঘ)। মহিষাসুর মর্দিনী-মূর্তিতে তাকে মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধরতা অবস্থায় দেখা যায়।
হিন্দুধর্মে দেবী দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের জননী এবং কালীর অন্য রূপ। বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলোতে এবং আগমনী গানে দুর্গারূপে শিবজায়া হিমালয় দুহিতা পার্বতীর সপরিবারে পিতৃগৃহে অবস্থানের আনন্দময় দিনগুলোর (দুর্গাপূজা) এবং তার বিবাহিতা জীবনের অপূর্ব বর্ণনা পাওয়া যায়।
দুর্গার আরাধনা বাংলা, অসম, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড এবং বিহারের কোনো-কোনো অঞ্চলে প্রচলিত। ভারতের অন্যত্র দুর্গাপূজা নবরাত্রি উৎসবরূপে উদযাপিত হয়। বছরে দুবার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে — আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজা। সম্ভবত খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় দুর্গোৎসব প্রবর্তিত হয়। জনশ্রুতি আছে, রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ প্রথম মহা আড়ম্বরে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন।
নানা রূপে দেবী দুর্গা:
দুর্গা মূলত শক্তির দেবী। ঋগে দে দুর্গার বর্ণনা নেই, তবে ঋগে দোক্ত দেবী সূক্তকে দেবী দুর্গার সূক্ত হিসেবেই মান্যতা দেয়া হয়। দুর্গার বিশেষ আলোচনা ও পূজা বিধি তন্ত্র ও পুরাণেই প্রচলিত। যে সকল পুরাণ ও উপপুরাণে দুর্গা সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে: মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবী পুরাণ, কালিকা পুরাণ ও দেবী ভাগবত। তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও রূপে পূজিতা হন।
দেবী দুর্গা শাক্ত ধর্মে সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবী, বৈষ্ণব ধর্মে তাকে ভগবান বিষ্ণুর অনন্ত মায়া হিসেবে আখ্যা দেয়া হয় এবং শৈব ধর্মে দুর্গাকে শিবের অর্ধাঙ্গিনী পার্বতী হিসেবে অর্চনা করা হয়। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। কেনোপনিষদে বর্ণিত হৈমাবতীকে দুর্গা হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে; ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের যোগমায়াকে দুর্গা আখ্যা দেয়া হয়েছে, যিনি হরি সহায়িনী তথা হরিভক্তি প্রদায়িনী। এসব ছাড়াও দুর্গা দেবীর বর্ণনা মহাভারতের বিরাট পর্ব ও অন্যান্য পুরাণে পাওয়া যায়। দুর্গা দেবীর ভিন্ন-ভিন্ন অবতারসমূহ হচ্ছে: কালিকা, নন্দা, ভ্রামরী, শাকম্ভরী, রক্তদণ্ডিকা, সতী, পার্বতী, কৌশিকী ইত্যাদি।
কৃষিতে দেবী দুর্গা :
বাংলার কৃষি ও সংস্কৃতির সঙ্গে দেবী দুর্গার সম্পর্ক গভীর ও বহুমাত্রিক। দুর্গা শুধু শাক্তধর্মের শক্তির প্রতীক নন, তিনি বাংলার কৃষি জীবনের সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জড়িত। শরৎকালে যখন ধান গাছে শিষ ধরে, মাঠে সোনালি সম্ভাবনার আভা ছড়িয়ে পড়ে, তখনই দেবী দুর্গার পূজা অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ, কৃষি ও প্রকৃতির চক্রের সঙ্গে দেবী আরাধনার এক সাংস্কৃতিক মিলন ঘটে। সংস্কৃতির দৃষ্টিতে দুর্গা প্রতীক জীবনশক্তি, উর্বরতা ও সৃষ্টির। মহিষাসুর বধ কেবল ধর্মীয় কাহিনি নয়, বরং মানবসমাজ ও কৃষির উৎপাদনক্ষমতাকে ধ্বংসকারী প্রতিকূল শক্তির ওপর বিজয়ের প্রতীক। যেমন কৃষককে খরা, বন্যা, কীটপতঙ্গ কিংবা সামাজিক শোষণের সঙ্গে লড়াই করতে হয়, তেমনি দুর্গা লড়াই করেন অসুর শক্তির সঙ্গে। এভাবে দেবী দুর্গা কৃষকের কাছে সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কৃষিজীবনকে টিকিয়ে রাখতে দুর্গাপূজা এক সাংস্কৃতিক শক্তি হিসেবে কাজ করে। উৎসবকালে গ্রামীণ সমাজে সমবেত শ্রম ও আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা কৃষকদের মানসিক শক্তি জোগায়। আবার নারীর শক্তি, মায়ের ক্ষমতা ও প্রকৃতির সৃজনশীলতাকে দুর্গারূপে দেখা হয়। এতে বোঝা যায়, কৃষি কেবল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, বরং সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও সামাজিক ঐক্যের অংশ। আজকের দিনে এই দৃষ্টিভঙ্গি আরও গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন ও আধুনিক কৃষি চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে কৃষি আবারো সংগ্রামের জায়গায় এসে পৌঁছেছে। দুর্গার প্রতীকী শক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কৃষির প্রতিটি বাধা জয় করা সম্ভব সম্মিলিত চেষ্টায়। তাই দেবী দুর্গা শুধু ধর্মীয় নয়, বরং কৃষির সাংস্কৃতিক রক্ষাকর্ত্রী হিসেবেও প্রতিভাত।
বিদেশে দেবী দুর্গা:
জাপানি দুর্গা বা ‘জুনতেই ক্যানন ১৮ হাতের দুর্গা রূপ। মহাযান পরিব্রাজকদের হাত ধরে দেবীর এই রূপ জাপানে পৌঁছায় ৭০০ শতাব্দীর কাছাকাছি। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে।
সিন্ধু সভ্যতায় তথা ব্যবিলনীয় সভ্যতায় উল্লেখ পাওয়া যায় এই মাতৃপূজার। মাতৃপূজা কেন্দ্রিক সংস্কৃতির আদি পর্ব থেকে শুরু সিংহবাহিনী দেবীর পূজা। মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতায় খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী ইনান্না’র। কুশান রাজা কনিষ্কের মুদ্রাতেও খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী নানার। তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রচলিত ছিল এই দেবীর মাহাত্ম্য। এখনো দেবী চণ্ডী ‘বিবি নানা’ হিসেবে এসব অঞ্চলে পূজিত হন।
শাক্ত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ হয় খ্রিষ্টীয় ৪০০-৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। খ্রিষ্টীয় ৪০০ অব্দে রচিত হয় শাক্ত মহাপুরাণের অন্যতম গ্রন্থ দেবীমাহাত্ম্য। এ সময়েই মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১-৯৩ অধ্যায়গুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় এই গ্রন্থ। দেবীমাহাত্ম্য গ্রন্থেই প্রথম বিভিন্ন নারী দেবতা সংক্রান্ত নানান পুরাণ-কথা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক উপাদানগুলো একত্রিত করা হয়। দেবীমাহাত্ম্য গ্রন্থে বৈদিক পুরুষতান্ত্রিক দেবমণ্ডলীর সঙ্গে সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব নবম সহস্রাব্দ থেকে বিদ্যমান নৃতাত্ত্বিক মাতৃপূজা কেন্দ্রিক সংস্কৃতির এক সম্মিলনের প্রয়াস লক্ষিত হয়। এর পরবর্তী হাজার বছর এই ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। বৌদ্ধ ধর্মের হাত ধরে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তিব্বত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও মঙ্গোলিয়ায়। কম্বোডিয়া আর ইন্দোনেশিয়ায় দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য পূজিত হতে শুরু করে হিন্দু ধর্মের প্রসারের সাথে-সাথে। অ্যাংকর যুগের (১০১০ শতাব্দের) পূর্বে কম্বোডিয়ায় মহিষাসুর মর্দিনীর পূজার প্রচলন ছড়িয়ে পড়ে হিন্দু ধর্মের হাত ধরে। এ সময় যে দুর্গা মূর্তিগুলো কম্বোডিয়া থেকে উদ্ধার হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই চতুর্ভুজা এবং মহিষাসুর মর্দিনী। মূর্তিগুলোর বৈশিষ্ট্যাবলি হচ্ছে, এখানে মহিষাসুর মর্দিনী দুর্গা বিষ্ণুর ক্ষমতা ধারণ করেছেন, যা তার চতুর্ভুজের শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম থেকে প্রতিষ্ঠিত। জাভা ও ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অংশ থেকে উদ্ধার হয়েছে অনেক মহিষাসুর মর্দিনী মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ। এই মূর্তিগুলোর মধ্যে প্রাচীনতমটির তারিখ আনুমানিক অষ্টম শতাব্দী।
ইন্দোনেশিয়ার সেন্ট্রাল জাভাতে রয়েছে নবম শতাব্দীর বিখ্যাত হিন্দু মন্দির প্রাম্বানান। এই মন্দিরে রয়েছে এক জগৎ বিখ্যাত মহিষাসুর মর্দিনী মূর্তি। এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান, ইন্দোনেশিয়ায় বৃহত্তম হিন্দু মন্দির এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বড় মন্দির প্রাঙ্গণ। ১৫শ থেকে ১৬শ শতাব্দীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় মহিষাসুর মর্দিনীর পূজা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইসলামের আগমনের পর দুর্গার আরাধনা পাড়ি জমায় আরো পূর্বদিকে হিন্দু বালিতে।
দেবী দুর্গা পূজা:
দুর্গাপূজা হচ্ছে শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দুর্গা দেবীর উপাসনার উৎসব। দুর্গাপূজা শরৎ (আশ্বিন) এবং বসন্ত (চৈত্র) ঋতুর শুক্ল পক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। মার্কণ্ডেয় চণ্ডী অনুযায়ী, দুর্গাপূজার প্রথম প্রচলন হয়েছিল বসন্ত ঋতুতে, রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি কর্তৃক। দেবী ভাগবত ও কালিকা পুরাণে উল্লেখ আছে, শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্র দুর্গাপূজা করেছিলেন রাবণ বধের নিমিত্তে; এজন্য একে, ‘অকালবোধন’ও বলা হয়ে থাকে।
পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ডে দুর্গা পূজা বহুলভাবে উদ্যাপন করা হয়; উত্তর ভারতে এটি নবরাত্রী হিসেবে পালন করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের একাধিক রাষ্ট্র দুর্গা পূজা পালন করে এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাও সকলে দুর্গাপূজা পালন করে। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ দিন তথা ষষ্ঠী থেকে আরম্ভ করে দশমী পর্যন্ত হয়ে থাকে এই দুর্গোৎসব। এই পাঁচ দিন যথাক্রমে দুর্গা ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। এই পক্ষটিকে দেবীপক্ষ নামেও জানা যায়। পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন এই দেবীপক্ষের সূচনা হয়, একে মহালয়াও বলা হয়ে থাকে; আর পূর্ণিমার দিনটিকে লক্ষ্মীপূজার দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।
দেবী দুর্গা নাম উৎপত্তি:
হিন্দুশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে: ‘দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ। উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত \ রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ। ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত \’ অর্থাৎ, ‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, ‘গ’ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম বলেছে, ‘দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা’। অর্থাৎ, যিনি দুর্গ নামে অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনি সব সময় দুর্গা নামে পরিচিত। শ্রীশ্রী চণ্ডী অনুসারে যে দেবী ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ’ (সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি), তিনিই দুর্গা।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।
একটি জাতির রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার অভ্যন্তরীণ চালিকাশক্তি এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উভয়েরই প্রতিচ্ছবি। এটি কেবল সরকার গঠন বা নীতিনির্ধারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা এবং জাতীয় ঐক্যকেও প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক তীব্র সংকটের মধ্যে রয়েছে, যা দেশের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করছে। প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং সেই সফরে তার প্রতিনিধি দলের সদস্য আখতার হোসেনের ওপর হামলার ঘটনাটি এই সংকটেরই এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাষ্ট্র সফরটি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক মুহূর্ত। দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান, রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছিল। সফরটি কেবল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার জন্য নয়, বরং একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্যও জরুরি ছিল। কিন্তু এই সফরের শুরুতেই নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ও নিন্দনীয় ঘটনাটি সমস্ত ইতিবাচক দিককে আড়াল করে দিয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সেখানে আখতার হোসেনকে লক্ষ্য করে ডিম নিক্ষেপ ও অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করা হয় এবং এ ঘটনায় একজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে আটকও করা হয়েছে। এই ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবেই দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজন কতটা গভীর, তা আবারও সামনে এনেছে।
এই হামলার পেছনের মূল কারণ রাজনৈতিক বিদ্বেষ। আখতার হোসেন যে দল (জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি) থেকে এসেছেন, তা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং এটি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ‘জুলাই বিপ্লবের’ ফসল হিসেবে দেখা হয়। তাই, হামলায় জড়িতদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আক্রমণকারী একজন যুবলীগ নেতা। এই হামলাকে অনেকেই ‘জুলাই সন্ত্রাসী’ স্লোগান দিয়ে সংঘটিত একটি প্রতিশোধমূলক আক্রমণ হিসেবে দেখছেন। এটি প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক বিরোধিতা এখন আর কেবল আদর্শিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা সহিংস ব্যক্তিগত বিদ্বেষে রূপ নিয়েছে। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাসনিম জারা এই হামলাকে ব্যক্তি আখতার হোসেনের ওপর আক্রমণ না বলে তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে করা হামলা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এটি ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিরুদ্ধে যারা কাজ করছে, তাদের প্রতি পরাজিত শক্তির ভয় ও হতাশার প্রতিফলন বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।
নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় হোসেনের ওপর এই হামলার ঘটনাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং প্রবাসে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন এবং বিশিষ্ট ব্যক্তি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই হামলার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে যে এটি কূটনৈতিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার চরম ব্যর্থতা। তারা এই ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে। বিশেষ করে, তারা নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কনসাল জেনারেলের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবি উত্থাপন করেছে। এনসিপি এই হামলাকে অন্তর্বর্তী সরকারের চরম ব্যর্থতা হিসেবেও আখ্যায়িত করেছে।
শুধু রাজনৈতিক দলই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, ডাকসু গণতন্ত্রকামী জনগণ ও ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার লড়াইয়ে সবসময় দৃঢ় অবস্থানে ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এছাড়াও, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে যে এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর নগ্ন আঘাত। তারা এই হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এই হামলার শিকার হয়েছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। এই সকল প্রতিবাদ ও নিন্দা প্রমাণ করে যে, এই হামলাটি কেবল একটি রাজনৈতিক দলের ওপর আক্রমণ নয়, বরং এটি দেশের সামগ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং ভাবমূর্তির ওপর আঘাত।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবনতি ও ভাবমূর্তির সংকট
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিপক্ষকে দমন করার একটি প্রবণতা দেখা যায়। এই প্রবণতা কেবল দেশের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা প্রবাসেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রবাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে প্রায়শই সভা-সমাবেশ, পাল্টা বিক্ষোভ এবং স্লোগান দেখা যায়। কিন্তু এবার তা ব্যক্তিগত সহিংসতায় রূপ নিয়েছে, যা দেশের সম্মান ও মর্যাদাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। এই ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব এতটাই তীব্র যে তা ভিন্নমতের প্রতি ন্যূনতম সহনশীলতাও দেখাতে পারে না। এই ঘটনাটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি অশনি সংকেত। একটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক বিতর্ক থাকবে, কিন্তু তা কখনই ব্যক্তিগত আক্রমণ বা সহিংসতার রূপ নেবে না।
যখন এই ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটে, তখন তা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি নেতিবাচক বার্তা দেয়। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারী, পর্যটক এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মনে সংশয় সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বুঝতে হবে যে দেশের সম্মান যেকোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য যতই তীব্র হোক না কেন, তা যেন ব্যক্তিগত আক্রমণ বা সহিংসতার রূপ না নেয়, সেদিকে তাদের সচেতন থাকতে হবে।
সরকারের দায় ও প্রবাসে সংঘাত
এই ধরনের ঘটনার দায়ভার পুরোপুরি রাজনৈতিক দল এবং তাদের সমর্থকদের। আওয়ামী লীগের বোঝা উচিত যে সহিংসতা করে জনসমর্থন পাওয়া যায় না। বরং এই ধরনের আচরণ দেশের অভ্যন্তরে থাকা সাধারণ নেতা-কর্মীদের আরও বিপদের মুখে ঠেলে দেবে। যারা প্রবাসে থেকে এসব কাজের ইন্ধন দিচ্ছেন, তাদের বোঝা উচিত যে এই ধরনের সহিংসতা কেবল মানুষের মধ্যে বিরক্তি ও ঘৃণার উদ্রেক করবে।
নিউইয়র্কের ঘটনায়, সরকার ও নিউইয়র্কের বাংলাদেশের কনস্যুলেট অফিস নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া ভিডিওগুলো স্পষ্টভাবে দেখায় যে সেখানে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী রাজনীতিবিদদের নিরাপত্তার অভাব ছিল। এই ঘটনাটি কূটনৈতিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার চরম ব্যর্থতা। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় দেশের অভ্যন্তরেও যে উগ্রতা দেখা যাচ্ছে, তা আশঙ্কাজনক। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার যে আহ্বান কেউ কেউ জানাচ্ছেন, তা ‘পারস্পরিক উগ্রতা’ (reciprocal radicalization)-এর একটি লক্ষণ, যেখানে এক পক্ষের সহিংসতা অপর পক্ষকে আরও উত্তেজিত করে তোলে।
অর্থনীতি ও ভাবমূর্তি
প্রধান উপদেষ্টার সফরের অন্যতম লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আস্থা অর্জন করা। দেশের অর্থনীতি বর্তমানে চাপের মধ্যে। রিজার্ভ সংকট, মুদ্রাস্ফীতি এবং বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটাতে হলে বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। এই বিনিয়োগকারীরা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া হামলার খবর বিনিয়োগকারীদের মনে নতুন করে প্রশ্ন তুলতে পারে – বাংলাদেশ কি সত্যিই স্থিতিশীল হচ্ছে? তারা কি নিরাপদে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারকে দ্রুত দিতে হবে। নইলে সফরের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
রাজনীতির জটিলতা
প্রবাসী সম্প্রদায় প্রায়ই নিজ দেশের রাজনীতির সম্প্রসারণ হিসেবে কাজ করে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘ডায়াসপোরা রাজনীতি’ ‘হোমল্যান্ড পলিটিকস’ ও ‘হোস্টল্যান্ড পলিটিকস’-এর মাঝামাঝি এক অস্বস্তিকর অবস্থানে থাকে। এই অস্বস্তিকর অবস্থানে যদি নেতারা সহিংসতার উসকানি দেন, তবে তার রাজনৈতিক ফলাফল ভালো হয় না। বাস্তবতা হলো, প্রবাসী রাজনৈতিক সহিংসতা শুধু বিদেশে অশান্তি তৈরি করবে না, বরং বাংলাদেশের রাজনীতিকে আরও অস্থিতিশীল করবে। এটি বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা ব্যর্থতাকেও তুলে ধরে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে আরও উসকে দেবে। এই মুহূর্তে বিবদমান পক্ষগুলো এই সহিংসতার মাধ্যমে প্রতীকী ক্ষমতার প্রদর্শন করছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ দেখাতে চাচ্ছে যে প্রবাসের মাটিতে তারা রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম রেখেছে। কিন্তু এতে করে তাদের প্রতি মানুষের ক্ষোভ ও রাগ আর বাড়বে।
নতুন সংঘাতের লক্ষণ ও ভবিষ্যৎ পথ
এই হামলার ঘটনাগুলো আমাদের কয়েকটি প্রশ্নের মুখোমুখি করে। প্রথমত, এই ঘটনার দায় কাদের? উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা সংগঠিতভাবে জুলাই আন্দোলনে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের ও বিশেষ করে যারা সরকারে আছেন, তাদের টার্গেট করে আগ্রাসী বিক্ষোভ করেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই সেটি সহিংস হয়েছে। নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিসের দরজা ভাঙচুর করেন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা, যা প্রবাসে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম রাখার ইচ্ছাকে প্রকাশ করে।
আওয়ামী লীগের বোঝা উচিত, জুলাই-আগস্ট মাসে যে হত্যাযজ্ঞের নেতৃত্ব তারা দিয়েছে, তার স্মৃতি মানুষের মন থেকে সহজে মুছে যাবে না। নিউইয়র্ক বা লন্ডনকে মঞ্চ বানিয়ে ক্ষমতা দেখিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বোঝানো হচ্ছে, তারা এখনো প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। কিন্তু প্রতীকী এই প্রদর্শন জনগণের কাছে উল্টো নেতিবাচক বার্তা দেয়। তারা যদি মনে করে গায়ের জোরে ও সহিংসতা করে তারা রাজনীতিতে ফিরতে পারবে, তবে ভুল করবে। বিগত কয়েক মাসে তাদের প্রতি যদি কোনো সহানুভূতি তৈরি হয়েও থাকে, তবে এ ধরনের আচরণ মানুষের মধ্যে বিরক্তি ও ঘৃণার উদ্রেক করবে।
ভবিষ্যৎ পথ ও প্রত্যাশা
ভবিষ্যতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। এটি কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে সম্ভব নয়, বরং রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। তাদের নিজেদের ভুল থেকে শিখতে হবে এবং পুরোনো রাজনৈতিক বিদ্বেষ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়াতে হবে এবং তরুণ নেতৃত্বকে উৎসাহিত করতে হবে। তরুণ প্রজন্ম যদি একটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি পায়, তবে তারা ভবিষ্যতে দেশকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারবে। দেশের মানুষ একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চায়, যেখানে রাজনৈতিক ভিন্নমত থাকবে কিন্তু কোনো সহিংসতা থাকবে না।
এই হামলার ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে না দেখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহনশীলতার অভাবের প্রতীক হিসেবে দেখা উচিত। প্রধান উপদেষ্টার সফর থেকে যদি কোনো শিক্ষা নেওয়া যায়, তা হলো – আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান শক্ত করতে হলে রাজনৈতিক আচরণে পরিমিতিবোধ আনতে হবে। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি সংস্কৃতি যেখানে ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা, আইনের শাসন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অপরিহার্য। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি সত্যিই দেশের ভাবমূর্তি উন্নত করতে চায়, তবে এখনই সহিংসতা পরিহার করে আলোচনার টেবিলে বসা উচিত। সর্বোপরি, এই সফর বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা। বিদেশে সহিংসতার প্রতিধ্বনি কেবল কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, দেশের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ বিনিয়োগকেও প্রভাবিত করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সময় থাকতে না শিখে, তবে তার মাশুল দিতে হবে গোটা জাতিকে। তাই এখন সময় এসেছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাল্টানোর – সহিংসতা নয়, সংলাপ; প্রতিশোধ নয়, সহযোগিতা। কেবল তবেই বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে একটি দায়িত্বশীল, পরিণত এবং স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হতে পারবে।
রাজু আলীম : কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
মানব্যাধি নেশা বা মাদক এর করাল ছোবল থেকে মুক্তির জন্য আমাদের জনগণের মধ্যে যতেষ্ঠ পরিমাণ সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে এই ভয়াল ক্ষতিকর পরিস্থিতি থেকে দ্রুত উন্নতি হতে পারে। একই সঙ্গে প্রয়োজন পরিবেশ সংশ্লিষ্ট আইনের যথাযথ প্রয়োগ। মানবজাতি আজ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে প্রবেশ করছি আমরা। ঠিক এই সময়ে আমরা মহাবিশ্বে আমাদের একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহটিকে টিকিয়ে রাখার দুশ্চিন্তায় আতঙ্কগ্রস্ত।
সর্বনাশা মাদকের মরণ ছোবলে আক্রান্ত বর্তমান বাংলাদেশের তরুণ ও যুব সমাজ আজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। সারাদেশে মাদক আনাচে কানাচে জন্ম দিচ্ছে একের পর এক ভয়াবহ অপরাধ। যার অন্যতম কারণ মাদক বলে মনে করেন সুশীল সমাজের সংখ্যাগরিষ্ট লোকেরা, মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ঘটে উল্লেখযোগ্যভাবে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে।
মাদকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইয়াবা, গাঁজা, মদ, হেরোইন, আফিম, চরস, বাংলা মদ, গুল, মরফিন, কোকেন, হিরোইন, পেথিডিন, মরফিন, মারিজুয়ানা, এল এস ডি, ইলেক্সার, ফেনসিডিল ইত্যাদি বিগত শতাব্দীর বহুল পরিচিত মাদক বা নেশাদ্রব্য ইতাাদি বেশ পরিচিত ,এগুলোকে মাদকদ্রব্য বলার চেয়ে বরং মরণ বিষ বলাই অধিকতর শ্রেয়। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে মাদক জগতে এক নতুন সদস্যের প্রবেশ ঘটে, নাম তার ইয়াবা,
যা বর্তমানে বাংলাদেশে এক আলোচিত মাদক। তার নীল ছোবল থেকে সমাজের শিশু-বৃদ্ধ, পুরুষ-নারী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সচেতন-অসচেতন,
ধনী-গরিব, যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী কেউই রেহাই পায়নি এবং পাচ্ছেও না। দেশে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখের ওপর, যার ১৫ থেকে ২০ শতাংশই মহিলা।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ-বাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ছে এই ইয়াবা, সবাইকে এক ভয়াবহ ধ্বংস ও বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করছে। এখন নতুন আরও একটি মাদক ব্যবহৃত হচ্ছে, তার নাম আইস। ইয়াবার তুলনায় অন্তত চার-পাঁচ গুণ বেশি মেথএ্যামফিটামিন থাকায় আইস অনেক বেশি বিষাক্ত।
দেশের অনেক তরুণ-যুবক এটি সহজলভ্য হওয়াতে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছে এবং এর ফলে নেশার ঝুঁকি আরও বেশি বেশি হচ্ছে।
কোনো ব্যক্তির ক্রমাগত নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, ব্যর্থতা, দুঃখ-বেদনা, বিষণ্ণতা, মানসিক চাপ ইত্যাদির ফলে জীবনকে করে তোলে হতাশা ও অবসাদগ্রস্ত। এসব থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে এরা জড়িয়ে পড়ে মাদকের ভয়াল থাবায়। এছাড়াও পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক অস্থিরতা, বন্ধু-বান্ধবের অসত্য প্রলোভন ও প্ররোচনা, অর্থনৈতিক সংকট, এমনকি বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে মনোমালিন্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব মাদকাসক্তির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
এদেশে ইয়াবার থাবা মারাত্মক বৃদ্ধি পেয়েছে ‘ইয়াবা‘ মূলত থাই শব্দ, যার অর্থ ‘ক্রেজি মেডিসিন’ বা ‘পাগল ওষুধ’, এটির মূল উপাদান মেথএ্যামফিটামিন। ইয়াবা এক ভয়াবহ মাদক, যা মস্তিষ্ক, হৃদ্যন্ত্র এবং শরীরের যে কোনো অঙ্গকেই আক্রান্ত করতে পারে।
ইয়াবার রয়েছে প্রচণ্ড উত্তেজক ক্ষমতা কেউ কেউ যৌন উত্তেজক হিসেবেও এই মাদক কে অনেকে ব্যবহার করে। যাদের ওজন বেশি তাদের কেউ কেউ স্লিম হওয়ার ওষুধ হিসেবে শুরু করে ইয়াবা সেবন। ঘুম কমিয়ে দেয় বলে সারা রাতের পার্টির আগে ক্লান্তিহীন উপভোগ নিশ্চিত করতে অনেকের পছন্দ ইয়াবা। আবার কিছু শিল্পীও ইয়াবা সেবন করেন তাদের শিল্পকর্মের দক্ষতা বাড়বে মনে করে।
রাত জেগে বেশি বেশি পড়াশোনার জন্য ঘুম কমানোর ওষুধ হিসেবে শিক্ষার্থীরা এই ইয়াবা সেবন করে থাকে।
এভাবে সাময়িক সুখ লাভের এই ট্যাবলেটটি কখন যে তাদের জীবনকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, তা তারা বা সেবনকারীরা টেরও পায় না। অতিরিক্ত আইস সেবনে অনিদ্রা, অতি উত্তেজনা, মানসিক অবসাদ, বিষণ্ণতা, স্মৃতি-ভ্রম, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্ট্রোক, হূদেরাগ, কিডনি ও লিভারের জটিলতা হতে পারে। আবার অনেক মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন এই প্রকার মাদকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে গেলে এবং পরে তা হটাৎ করে বন্ধ করে দিলে , একজন ব্যক্তির তা ছেলেই হোক বা মেয়েই হোক মানসিক অবসাদ বা বিষণ্ণতার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
যে কোন মাদকের ন্যায় ইয়াবা, আইসসহ সব মাদকদ্রব্যই ভয়াবহ। শুরুতে মাদকের ব্যবহার সত্যিই আনন্দদায়ক, উদ্দীপক, উত্তেজক, যা সাময়িকভাবে উচ্ছ্বসিত ও রোমাঞ্চিত করে। কিন্তু শেষ পরিণতি হয় বেদনাদায়ক, মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ও ধ্বংসাত্মক। দেখা যায় কিছুদিন ইয়াবা সেবনের পর শুরু হয় এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কৌতূহল বশত কয়েক দিন সেবনের পরই আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, এটি ছেড়ে দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মাদক ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না। তখন ঐ মাদক পেতে যে কোনো হীন অপকর্ম করতেও হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। প্রথমে কম মাত্রায় এ ট্যাবলেট কাজ করলেও ধীরে ধীরে মাত্রা বাড়াতে হয়। বাড়াতে হয় ট্যাবলেটের পরিমাণ। ক্ষণস্থায়ী আনন্দের পর বাড়তে থাকে ক্ষতিকর নানা উপসর্গও। রাত কাটে নির্ঘুম, শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, গলা-মুখ শুকিয়ে আসে, অনবরত প্রচণ্ড ঘাম আর গরমের অসহ্য অনুভূতি বাড়ে। এর সঙ্গে বাড়ে নাড়ির গতি, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা আর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি। দেহে আসে মানসিক অবসাদ, চিন্তা আর আচরণে বৈকল্য। মেজাজ খিটখিটে হয়, অহেতুক রাগারাগি, ভাঙচুরের প্রবণতা বাড়ে। মানুষ আর মানুষ থাকে না, হয়ে ওঠে হিংস্র, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। ন্যায়-অন্যায় বোধ লোপ পায়, হয়ে ওঠে অপরাধ প্রবণ। বিঘ্নিত হয় সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তা, ব্যাহত হয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্রোতধারা। এতে একদিকে যেমন আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে, তেমনি মাদকাসক্ত অনেক তরুণ-তরুণী সন্ত্রাস, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, এমনকি খুনও করে নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য। মা-বাবার গলায় ছুরি ধরে টাকার জন্য, বুকে বসে ছুরি চালাতেও তার হাত কাঁপে না। নেশার টাকা না পেয়ে নেশাখোর বাবা মাদক সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে ক্রোধে খুন করে নিজ সন্তানকে, এমনকি স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা, মাকে জবাই করা, আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার মতো অমানবিক ঘটনাও ঘটছে হরহামেশা। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এসব ঘটনার দায় পড়ে মাদকসেবীর ঘাড়ে। কিন্তু একটু গভীর দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায়, কোনো কোমল হৃদয় বা মানুষের বিবেক এই খুন বা অপকর্ম করে না, করে এক ভয়ানক সর্বনাশা মাদক, যা জীবন থেকে জীবন আর হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতি কেড়ে নেয়। আলোর পথ ছেড়ে নিয়ে যায় অন্ধকার পথে। স্বাধীন হৃদয় পরিণত হয় নেশার দাসে।
মাদকাসক্তি প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করাই অতি উত্তম। তাই মাদকের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে সামগ্রিক প্রতিরোধ খুবই জরুরি; যেমন—১. আসক্ত ব্যক্তি, যিনি পুনরায় স্বাভাবিক সুস্থ জীবন ফিরে পেতে চান, তার নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। এ কথা মোটেই সত্য নয় যে, তারা আর কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে না। শুধু প্রয়োজন ধৈর্যসহকারে দীর্ঘমেয়াদি চিকিত্সা। একবার কেউ আসক্ত হয়ে গেলে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করে বারবার কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ভালোভাবে বোঝাতে হবে।
কোনোক্রমেই বকাবকি, মারধর, বেঁধে বা তালাবন্ধ করে রাখা অনুচিত।
২. শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসার জন্য মনোরোগ চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
৩. ওষুধ, সাইকোথেরাপি ও অন্যান্য উপায়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক এবং সুস্থ জীবনযাপন-পদ্ধতিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এতে মনোরোগ চিকিত্সক ও মনোবিজ্ঞানীর যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পরিবার, আত্মীয়স্বজন আর প্রকৃত বন্ধুরও। একজন নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি সবার সম্মিলিত সহযোগিতায়ই আবার ফিরে পেতে পারে মাদকমুক্ত সুস্থ জীবন। ৪. মাদকের বিরুদ্ধে প্রথমে পরিবারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বাবা-মাকে সন্তানের মধ্যে এমন বীজ বপন করতে হবে, যাতে সে আত্মপ্রত্যয়ী হয়, অশুভকে চিনতে পারে। বাবা-মায়ের কোনো কলহ-বিবাদ যেন সন্তানকে প্রভাবিত করতে না পারে। তাই পারিবারিক শিক্ষা, যথাযথ অনুশাসন এবং সচেতনতা খুবই জরুরি। ৫. তরুণ প্রজন্মকে মাদক থেকে দূরে রাখতে হলে তাদের জন্য দরকার খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা এবং এগুলো চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করা।
৬. ধর্মীয় অনুশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মচর্চা অনুশীলন করলে অনেক ক্ষেত্রে সর্বগ্রাসী মাদক বর্জন এবং প্রতিকার সম্ভব। ৭. মাদক ব্যবহারের কুফল, এর পাচার প্রতিরোধে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে দেশের শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এবং সংবাদপত্রসহ মিডিয়ার কর্মীদেরও দায়িত্ব অপরিসীম। ৮. মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন এবং চিকিত্সা কার্যক্রমের জন্য সহায়তা করতে রাষ্ট্র, এনজিও এবং কমিউনিটিকে এগিয়ে আসতে হবে।
সামগ্রিক দৃষ্টিতে মাদক সেবনের ক্ষতি অসীম ও অপূরণীয়। এতে পুরো সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা ও অপরাধী হিসেবে বড় করে না দেখে কোথা থেকে, কীভাবে, কারা মাদক সরবরাহকারী, চোরাকারবারি বা কারা এসবের মূল হোতা তাদের বিচার ও শাস্তির আওতায় আনা। প্রয়োজনে যথাযথ আইন প্রণয়ন করা এবং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। তবেই মাদকের ভয়ংকর ছোবল থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ-প্রজন্ম ও কোমল মতি সন্তানদের রক্ষা করা সম্ভব হবে। তাই এখনোই উচিত সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে মাদক বিরোধী স্লোগানে সোচ্চার হয়ে মাদক মুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। মনে রাখতে হবে অপরাধী নয়, অপরাধই ঘৃণার বিষয়। স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে তাদের প্রতি ঘৃণা নয়, বরং সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।আমাদের চারিপাশে সচেতনতা বৃদ্ধি ও এই ভয়াবহ মাদকের করুন পরিনতি নিয়ে পারিবারিক গন্ডি, স্থানীয়ভাবে সমাজের বিভিন্ন স্থানে ও সরকারী উদ্যোগে, নিয়মিতভাবে দৈনিক সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন প্রকার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে এর ব্যপক ক্ষতির বা ঝুঁকির বর্ণনা উল্লেক করে জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠানাদি ঘন ঘন প্রচার চালিয়ে যেতে হবে ।
লেখক : গবেষক, ও প্রাবিন্ধক।
দেশের মোট জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশকে কর্মের বাহিরে রেখে একটি দেশ বা জাতি কখনো সামনে দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। এগিয়ে নিতে হলে দেশের সকল পেশার মানুষকে কর্মমুখী করে তুলতে হবে। দেশের প্রতিটি মানুষকে কর্মমুখী শিক্ষা শিক্ষিত করে তোলাটাই এখন আমাদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষাজীবনের শুরুতে প্রাথমিক স্তর থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের তত্ত্বীয় শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক তথা হাতে-কলমে শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। শিশুদের জন্য এমন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে স্বনির্ভর হতে সহায়তা করে। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সেই শিক্ষা যেন কাজে লাগে। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের যা শেখানো হচ্ছে তা এক ধরনের গৎবাঁধা তাত্ত্বিক শিক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। শিশু শিক্ষার্থীদের কাছে স্কুল আনন্দদায়ক মনে হয় না। শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় প্রাণের স্পন্দন জাগে না। শিক্ষা আনন্দময়। আনন্দঘন পরিবেশে শিশুদের পাঠদান সুনিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠ্যক্রম বহুলাংশে শহর ও গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও জীবনমুখী নয়। দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, শিষ্টাচার, নৈতিকতা, জীবনধর্মী বিষয়াদিসমৃদ্ধ ন্যূনতম পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও চর্চা একান্ত জরুরি।
প্রতি বছরই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তাই শিক্ষার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক নীতি এবং অর্থনীতির গতি প্রকৃতির আলোকে শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় না করলে এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। শিক্ষাকে যদি কর্মমুখী করে তোলা যায়, তবে শিক্ষিত মানুষের চাকরি পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে না।
শিক্ষা হলো সাধারণ শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা। বৃত্তি হলো জীবিকা, কর্ম বা পেশা। বৃত্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাই বৃত্তিমূলক শিক্ষা। যে শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে তাকে বলা হয় বৃত্তিমূলক শিক্ষা। বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যক্তিকে কোনো না কোনো পেশার উপযোগী করে তোলে। সাধারণ পর্যায়ের বৃত্তিমূলক শিক্ষা বলতে বোঝায় কোনো বিষয়ের স্বল্পমেয়াদি ব্যবহারিক শিক্ষা।
এ ধরনের শিক্ষা অল্প সময়ে স্বল্প ব্যয়ে সহজেই গ্রহণ করা যায়। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে মানুষ কৃষিতে, শিল্পে সর্বত্র বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। তাই এসব ক্ষেত্রে কাজ করতে গেলে বৃত্তিমূলক শিক্ষা অত্যাবশ্যক।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তর থেকেই কৃষি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের নিবিড় কৃষিশিক্ষার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং কৃষিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন। ব্যবহারিক কৃষিশিক্ষার জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কৃষি প্রদর্শনী প্লট বা বাগান গড়ে তোলা বাধ্যতামূলক আইন জারি করতে হবে। বিদ্যালয় বাগান হবে কৃষিশিক্ষার জীবন্ত বিদ্যাপীঠ। এখানে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে কৃষিভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ পাবে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা প্রকৃতি পাঠ, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং প্রায়োগিক কৃষিশিক্ষার ওপর বাস্তব ধারণা লাভ করবে। বিদ্যালয়ের সৌন্দর্যবর্ধন ও উন্নয়নের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম স্বনির্ভরতা অর্জনে সক্ষম হবে।
জাতীয় অগ্রগতি, টেকসই উন্নয়ন এবং জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে বর্তমানে প্রচলিত পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষার স্থলে আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি সুদৃঢ় করার জন্য ন্যূনতম আট বছর মেয়াদি শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা অত্যাবশ্যক। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে আট হতে বারো বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষার মেয়াদ চালু রয়েছে। অষ্টম শ্রেণি শিক্ষা শেষে পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন।
মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রাথমিক শিক্ষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। জীবনধর্মী ও কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করা সম্ভব। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হলো শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, মানবিক ও নান্দনিক বিকাশ সাধন এবং তাকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। এ বিশাল লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। পুঁথিগত মুখস্থ বিদ্যার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে হাতে-কলমে দক্ষতা অর্জনের ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে। দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে শিক্ষাই একমাত্র মাধ্যম। আমাদের ন্যায় দরিদ্র ও অনুন্নত দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি জীবনমুখী শিক্ষার মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সামাজিক মাধ্যমসহ পত্র-পত্রিকা খুললেই আত্মহত্যার সংবাদ। পূর্বের তুলনায় বর্তমানে সুযোগ সুবিধাসহ মানুষের জীবনের মান বাড়ালেও এখন কেন এত দুঃখজনক ঘটনা? তাই সংগত কারণেই হাতে কাগজ-কলম তুলে নিয়েছি।
মূলত মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, প্রকৃতিগত শাশ্বত ধারায় কেউ মৃত্যুকে রোধ করতে পারবে না। মেনে নিতে হবে মৃত্যুকে যেভাবেই হোক। তবে এই মৃত্যুর ফয়সালা আমাদের হাতে নয়। আত্মহত্যা বা আত্মহনন হচ্ছে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াবিশেষ। ল্যাটিন ভাষায় সুই সেইডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। যখন কেউ আত্মহত্যা করেন, তখন মানুষ এ প্রক্রিয়াকে আত্মহত্যা করেছে বলে অভিহিত করে থাকে। তথ্যমতে জানা যায় যে, সুদূর প্রাচীনকাল থেকে আত্মহত্যা চলে আসছে। তবে কোন সময় এটি ভালো চোখে দেখা হয়নি। এই ধরনের মৃত্যু নিজেই নিজেকে হত্যা করা। আসলে নির্মমভাবে নিজেকে হত্যার নামই আত্মহত্যা। সুখ-দুঃখ মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। মানুষ অতি আনন্দে ও উচ্ছ্বাসে যেমন বেড়ে উঠে; তেমনি অতি দুঃখে হতাশাগ্রস্ত জীবনের মুখোমুখি হয়ে থাকে। আর এটি প্রায় মানুষের বেলায় এটি চরম সত্য। মানুষ যখন চরম থেকে চরম দুঃসহনীয় সময়ে অতিবাহিত করে। তখন অবস্থাভেদে আবেগে আপ্লুত হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিজেকে নিজেই হত্যা করার মতো বিষয় বেছে নেয়। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো পরিস্থিতি তার আয়ত্তে থাকে না। শুধুই মাথায় ঘুরপাক খায় কিভাবে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। কেবল একই চিন্তা নিজেকে শেষ করতে পারলেই বুঝি বাঁচা গেল। এমন কষ্টের আর দুর্দিনের পরিস্থিতিতেই মানুষ আত্মহত্যার মতো নিকৃষ্ট পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যা যে কত নির্মম, আত্মহত্যা যে কত নিষ্ঠুর-তা যদি একজন আত্মহত্যাকারী তার মৃত্যুর আগে সুস্থ মস্তিষ্কে বুঝতে পারত! তাহলে হয়তো এ পথে কখনও আসত না। এই নিষ্ঠুর ঘটনা হতে পারে একটি পরিবারের স্বপ্ন ভঙ্গের অন্যতম কারণ। যেটি পরে রূপ নেয় ভয়ংকর বিষণ্নতায় মোড়া এক অলীক পরিণতির। কেন এই আত্মহত্যার প্রতি মানুষের এত ঝুঁকে পড়েছে? কেন এই সিদ্ধান্ত নিতে মানুষ একটা মুহূর্তের জন্যও এতটুকু ভেবে দেখে না। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। আর বিশ্বে যে সব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার মধ্যে আত্মহত্যা ১৩তম অবস্থানে। উল্লেখ্য যে, কিশোর-কিশোরী, আর যাদের বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের নিচে, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। পুরুষদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি। তথ্য মতে জানা যায় যে, প্রায় ২৭% থেকে ৯০% এরও বেশি সময় আত্মহত্যার সাথে মানসিক অসুখের সম্পর্ক থাকে। এশিয়াতে মানসিক রোগের হার পশ্চিমা দেশের চেয়ে অনেক কম। বস্তুত আত্মহত্যার মাধ্যমে যারা মারা যায়, তাদের প্রায় অর্ধেকের মধ্যে জটিল ডিপ্রেশন থাকতে পারে। এক্ষেত্রে মানসিক রোগ যেমন বাইপোলার ডিসঅর্ডার আত্মহত্যার জন্য ২০ গুণের বেশি ঝুঁকি বাড়ায়। সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৫% মানুষ আত্মহত্যা করে। তবে ইসলাম ধর্মে উল্লেখ আছে যে, আত্মহত্যা করা কবিরা গুনাহ বা বড় গুনাহ। যা তাওবা ছাড়া মাপ হওয়া সম্ভব না। একমাত্র তাওবার মাধ্যমেই এ গুনাহ থেকে মাফ পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির তাওবার কোনো সুযোগ নেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আমাদের বিষন্ন লাগতেই পারে। মন খারাপ হতে পারে, হতাশা থাকতে পারে। এগুলো কোনো বড় বিষয় নয়। শরীরের রোগের মতো মনের রোগের চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। আমাদের মনের যত্ন নিতে হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে, এ জায়গায় নিজেকে কঠোর থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, জীবনে আঘাত, দুঃখ, বেদনাও কষ্ট আসে জীবনকে শক্ত করার জন্য; মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য নয়। মৃত্যু আমাদের জীবনের লক্ষ্য নয়, বেঁচে থাকাটাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য।
বাংলাদেশে যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন; আবেগ নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা; দাম্পত্য কলহ; উত্ত্যক্তকরণ; প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা; দারিদ্র্য ও বেকারত্ব; আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা; মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে বেশির ভাগ আত্মহত্যা ঘটে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রচার মাধ্যমে আত্মহত্যার সংবাদের অতিপ্রচার, অপপ্রচার বা অদায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনের কারণেও কখনো কখনো আত্মহত্যার ঘটনার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। এভাবে আত্মহত্যার প্ররোচনার অর্থ এমন পরিস্থিতি সচেতনভাবে সৃষ্টি করা, যা পীড়িত মানুষটির সামনে এ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ই অবশিষ্ট থাকে না। এদিকে নিদারুণ অপমানের শিকার হয়ে নীরব প্রতিবাদ হিসেবে বহু মানুষকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে দেখা যায়। এ প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালের প্রথম দিকে একটি আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আত্মহননকারী ব্যক্তি ফেসবুক লাইভে এসে নিজের পরিবারের সদস্য, সহকর্মীদের কাছ থেকে নানা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করে। ওই ব্যক্তি নিশ্চয়ই চরম হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করেছে। ফেসবুকে লাখো-কোটি মানুষ তার আত্মহত্যার ভিডিওটি দেখেছেন। প্রশ্ন হলো, আমাদের মানবিক বোধগুলো কি এতখানি নিচে নেমে গেছে যে, কোনো কিছুই এখন আর আমাদের স্পর্শ করে না। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত করোনাকালে একটি জরিপ করেছিল বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন। তাতে দেখা গেছে, ওই সময় দেশে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। জরিপমতে বিশ্বে পুরুষ আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা বেশি হলেও বাংলাদেশে নারীরা বেশি আত্মহত্যা করে। এক্ষেত্রে নারী ৫৭ শতাংশ, পুরুষ ৪৩ শতাংশ। সাধারণত ঝিনাইদহে অধিক আত্মহত্যা সংঘটিত হয়। আর কোনো ব্যক্তি কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে আত্মহত্যা করেন না। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে।
উল্লেখ্য যে, বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার প্রবণতা কমছে। সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি নানা উদ্যোগের কারণে এ প্রবণতা নিম্নমুখী। কিন্তু বাংলাদেশে কিছুটা কমলেও আত্মহত্যার হার এখনও তুলনামূলক অনেক বেশি। আর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আত্মহত্যাপ্রবণ দেশ। এখানে বয়সভিত্তিক আত্মহত্যার প্রবণতায় দেখা যায়। এক্ষেত্রে ১০ থেকে ২৯ বছর বয়সি নারীর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ আত্মহত্যার হার বাংলাদেশে। এদিকে ভৌগোলিকভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয়। প্রতি লাখ মানুষে ১৯ দশমিক ২ জন আত্মহত্যা করে থাকেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ১১ দশমিক ৪ জন, যা বৈশ্বিক গড়ের (৯ দশমিক ০) চেয়ে বেশি। শুধু তাই নয়, ৩০ থেকে ৪৯ বছর বয়সি নারীর আত্মহত্যার হারও আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। বয়স্কদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতাও কম নয়। ইদানীং তথ্য প্রযুক্তি উন্নতির পথ ধরে মোবাইলে অপসংস্কৃতির কারণে মাঝে মধ্যে আত্মহত্যার কথা শোনা যায়।
সত্যি কথা বলতে কি, দেশে প্রতিবছর গড়ে ২০ হাজারের উপরে আত্মহত্যা করে। তাদের মধ্যে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরী। আর ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। এদিকে আর শহরের চেয়ে এ হার গ্রামে বেশি। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, কিশোর বয়সে নানা কারণে হতাশা তৈরি হয়, যা থেকে বিষন্নতা দেখা দিতে পারে। যথাসময়ে চিকিৎসা বা কাউসেলিং করা না হলে এই বিষন্নতা আত্মহত্যার দিকে টেনে নিয়ে যায়। কিশোরীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, বিশ্বে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। তারা এ বয়সে ব্যর্থতা মোকাবিলা করার শিক্ষা অনেক সময় পরিবার ও সমাজ থেকে পায় না। একটুতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া। তাদের সঙ্গে সময় কাটানো ও অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া। সময়মতো সঠিক সেবা দেওয়া গেলে আত্মহত্যার অনেক ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি, এটি এমন একটি প্রপঞ্চ, চেষ্টা করে নির্মূল করা যাবে না। তবে বিভিন্ন ভাবে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। উল্লেখ্য যে, কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা কম। বেশির ভাগ সময় তাদের ছোটখাটো মানসিক উদ্বেগকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। ফলে বড় ধরনের মানসিক সংকটে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বলতে গেলে দেশে এর মহামারি চলছে। তাই স্কুল পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু এবং শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সমীচীন বলে মনে করি।
লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
দেশে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই হিসাবে ৩৯ হাজার কোটি টাকার কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছ যাগত অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা, যা এ বছর ২.৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষকদের সহায়তা নিশ্চিত করতে এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও কৃষিখাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করাই এর মূল উদ্দেশ্য।নীতিমালায় নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে— প্রাণিসম্পদ খাতে বরাদ্দ ২০ শতাংশ করা, সেচ ও কৃষিযন্ত্রপাতি খাতে ২ শতাংশ বরাদ্দ, ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণের সিআইবি সার্ভিস চার্জ মওকুফ, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আওতা বৃদ্ধি, খিরা, কচুর লতি, বিটরুট, কালোজিরা, আদা, রসুন, হলুদ, খেজুর গুড় ইত্যাদি নতুন ফসল ঋণ নীতিতে অন্তর্ভুক্ত এবং অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদন সম্ভাবনা অনুযায়ী ঋণ বিতরণের নির্দেশনা। বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, কৃষি ও পল্লী খাতে পর্যাপ্ত ঋণ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং টেকসই অর্থনীতি গঠনে এ নীতিমালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
দেশের কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। খাদ্যনিরাপত্তা ও উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা ও কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনীহার ফলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো এখনো সম্ভব হয়নি। হয়।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৯৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। আগের অর্থবছরের ৩৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কৃষিঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা, যা ওই অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ১০৬ দশমিক ১৫ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার শতভাগের বেশি ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকগুলো। তবে গত অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও আগের অর্থবছরের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১৭২ কোটি টাকা। সেই সঙ্গে এক বছরে কৃষিঋণ আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ কৃষকরা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছেন বেশি। পুরো অর্থবছরে কৃষিঋণ আদায় হয়েছে ৩৮ হাজার ২৪ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে আদায়ের পরিমাণ ছিল ৩৫ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। ফলে এক বছরে আদায় বেড়েছে ২ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। সবমিলে গত জুন শেষে কৃষি খাতে বিতরণ করা ঋণের বকেয়া স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ২৩২ কোটি টাক, যা ২০২৪ সালের জুনে ছিল ৫৮ হাজার ১১৯ কোটি টাকা।
জানা গেছে, গত অর্থবছরে যেসব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের জরিমানা হিসেবে অনর্জিত অংশ কেটে নিবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কমন ফান্ড (বিবিএডিসিএফ)’ নামে তহবিলে জমা করা হবে এবং জমাকৃত অর্থ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকারী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ করা হবে। । যেসব ব্যাংকের নিজস্ব শাখা পল্লি অঞ্চলে নেই, তাদের ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা বা এনজিওর মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের (এমআরএ) নিবন্ধিত এনজিও সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা হবে এবং তারা যেন অতিরিক্ত সুদ নিতে না পারে, সে জন্য সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, দেশে উৎপাদন বাড়াতে কৃষিঋণ বিতরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য প্রতিবছর কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ঘোষণাকরা হয় এবং লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ৩৮ হাজার কোটি টাকা এবং ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ২ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এবার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা (২০২৫-২৬) বছরেধরা হতে পারে সাড়ে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অভিযোগ আছে, প্রতিবছর কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলেও ব্যাংকগুলোর ছলচাতুরির কারণে তার উল্লেখযোগ্য অংশ কৃষকের কাছে পৌঁছায় না। ব্যাংকগুলো অন্য খাতে ঋণ দিয়ে তা কৃষিঋণ বলে চালিয়ে দেয়। আবার বিভিন্ন ফরমালিটিসের কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া কৃষকের পক্ষে কঠিন। উপরন্তু নেটওয়ার্ক তৈরি করতে না পারায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের কৃষিঋণের অধিকাংশই এনজিও নির্ভরতায় বিতরণ করে।
কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার পেছনে চারটি কারণকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এগুলো হলো- গত বছরের আগস্টে সরকার পতনের পর সৃষ্ট অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সুদের হার বৃদ্ধি ও ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট। সাম্প্রতিক গত বছর দুটি বন্যায় কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার নিত্যপণ্যের বাজারেও রয়েছে অস্থিরতা। এ অবস্থায় কৃষি ঋণ বিতরণ কমে আসায় আসন্ন খরিপ, রবি ও বোরো মৌসুমে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক দুটি বন্যা ও এর আগের খরার প্রভাবে এবার আরো বেশি করে কৃষি ঋণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণ বিতরণে জোর না দেয়ায় ঋণ প্রবাহ কমেছে। এতে উৎপাদন কমে খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি সামনের দিনগুলোয় মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা আরো জোরালো হয়ে উঠতে পারে।যদিও ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, জুলাই-আগস্টের অস্থিরতা ও ব্যাংক খাতে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী অনিশ্চয়তার প্রভাবে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষিতে ঋণপ্রবাহ কমলেও সামনের দিনগুলোয় তা আবারো বাড়বে।এ ব্যাপারে কৃষিঅর্থনীতিবিগন মনে করেন ‘সাম্প্রতিক দুটি বন্যা এবং খরাসহ নানা উপদ্রবে এবার কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই বন্যা-উত্তর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এবার আরো বেশি করে ঋণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না থাকায় ঋণ প্রবাহ কমেছে। ফলে খরিপ /রবি মৌসুমের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য আমদানি নিশ্চিতের পথে বড় বাধা হয়ে উঠেছে ডলার সংকট। তাই সার্বিক কৃষিপণ্য সরবরাহ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরো উস্কে দিতে পারে।’এ ব্যাপারে ব্যাংকারদে র মন্তব্য হলো গত বছর জুলাই-আগস্টে সার্বিক ঋণ প্রভাব কমে এসেছিল। তখন মানুষ বের হতে পারেনি। আবার ১০-১২ ব্যাংক কিছুটা সমস্যায় পড়েছিল। তারাও তখন ঋণ দিতে পারেনি। তাই সার্বিক কৃষি ঋণ বিতরণে এটা প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু কৃষি ঋণের টার্গেট দেয়া থাকায় এটা আমাদের দিতেই হবে। আগামীতে আশা করছি ঋণ বিতরণ বাড়বে।’ কৃষি খাতে ঋণের প্রবাহকে একটি বড় প্রভাবক বলে মনে করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের,তদের মতেঋণ না পেলে প্রান্তিক কৃষক কীভাবে উৎপাদন করবে? গতবার আলু উৎপাদন কম হওয়ায় চালের ওপর চাপ পড়েছে। তাই আগামীতে উৎপাদন বাড়াতে কৃষি ঋণের বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে ।
গত বছরের শেষ দিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় কৃষিঋণ বিতরণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে; বিশেষত জুলাই-আগস্টে ঋণ বিতরণ ও লেনদেন কমে যায়। তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ঋণ বিতরণে গতি ফিরেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইতিবাচক অগ্রগতি থাকলেও আরও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। ব্যাংকগুলোর কৃষি খাতে বিনিয়োগে উৎসাহ বাড়াতে হবে এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি জোরদার করা এবং কাঁচামাল ও উৎপাদন খরচ কমাতে সরকারের বিশেষ নীতিমালা গ্রহণ জরুরি। এখানে উল্লেখ্য যে গত বছরের মত এ বছরও আগের আশঙ্কাটি রয়েই যাবে সম্প্রতি ষোষিত জতিীয় সংসদ ইলেকশনের কারনে যা আগামী রমজানের আগে সংগঠিত হওয়ার কথা রয়েছে ।এই রকম একটা পরিস্থিতিতে কৃষকের মনে স্বস্থি নেই বিধায় কৃষি দেশের সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান খাত হলেও এখানকার উৎপাদকদের জন্য কোনো নির্ধারিত মূল্য নীতি নেই, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। পণ্যের অস্থির বাজারমূল্য, উৎপাদন ব্যয় না ওঠা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনাকে এই সংকটের চরম বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সময়ের আবর্তে এক সময় যেখানে কৃষিকাজে নিয়োজিত হাউজহোল্ডের সংখ্যা ছিল ৯০ শতাংশ, বতর্মানে এসে দাড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে, যা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি। চলতি বছরের বাজেটে কৃষি শস্য খাতের অংশ মাত্র ৩.৪%, যা টাকার অংকে দাড়ায় ২৭ হাজার ২২৪ কোটি। আবার কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। কৃষি খাতের নিম্নগামী প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না। তাই কেবল কৃষি ঋন নয়,তার জন্য নীতি সহায়তা জরুরী যাতে কৃষক বেচে থাকতে পারে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যা সময়ের দাবি ।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
শিক্ষা একটি জাতির মৌলিক অধিকার ও উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। শিক্ষিত জাতিই পারে একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলতে।
শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ব্যক্তি জীবনে সংগতি বিধান করা বা সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলার যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করা। বর্তমান সমাজে জীবন যাত্রার প্রক্রিয়া অনেক জটিল। জটিল এ সমাজে চলার জন্য জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার অনেক বেশি সমৃদ্ধ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু শিক্ষা বলতে নির্দিষ্ট কতগুলো বিষয় পাঠদান কে বোঝায় না। এর পাশাপাশি সাফল্যের পথে ভবিষ্যতে সম্মুখীন হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা, প্রবণতা এবং মনোভাব ও মানসিকতা গড়ে তোলা বোঝায়।
শিক্ষাঙ্গন একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের পবিত্র ক্ষেত্র। এখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন করে, নৈতিকতা শেখে এবং ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত হয়।
বর্তমান সময়ে দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না, বরং তাদের ভবিষ্যৎকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।শিক্ষাঙ্গনের এই অস্থিরতা শুধু শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, বরং অভিভাবক, শিক্ষক ও সমগ্র জাতির জন্য একটি অশনিসংকেত।বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বারবার দেখা যাচ্ছে ছাত্র আন্দোলন, শিক্ষক নির্যাতন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, প্রশ্নপত্র ফাঁস, সেশনজট, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষক সংকট ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা।বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ কিংবা স্কুল—প্রতিটি স্তরেই দেখা যাচ্ছে দলাদলি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, শিক্ষকদের নিরপেক্ষতা হারানো, সেশনজট, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ক্রমবৃদ্ধি। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পড়াশোনা করতে পারছে না, তাদের মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে, মানসিক চাপ বাড়ছে এবং তারা হতাশায় ভুগছে। এসবের ফলে একটি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ গড়ে ওঠার পরিবর্তে তৈরি হচ্ছে একটি আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ পরিবেশ।
বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে হানাহানি অশান্তি বিশৃঙ্খলা চলছে এর কারণ মূল্যবোধের অবক্ষয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মর্যাদাবোধ থাকলে অশান্তি ও অস্থিরতা কমে আসত।
শিক্ষাঙ্গনের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত থাকে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়। শিক্ষকদের অবহেলা, অবকাঠামোগত সমস্যাও এই অশান্তির অন্যতম কারণ। একদিকে যেমন পাঠদানে ব্যাঘাত ঘটছে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গনের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে বা বিদেশে চলে যাচ্ছে।
শিক্ষিত হলেও কর্মসংস্থান নেই—এই বাস্তবতা শিক্ষার্থীদের হতাশায় নিমজ্জিত করে তুলছে। ফলে তারা সহজেই প্রতিবাদ, বিশৃঙ্খলা কিংবা হতাশায় নিপতিত হয়।
শিক্ষাঙ্গনের অস্থিরতা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চরম প্রভাব ফেলছে। তারা নিয়মিত ক্লাস করতে পারছে না, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে এবং অজানা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিদেশমুখী হয়ে পড়ছে, ফলে দেশের মেধা পাচার হচ্ছে।
এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দক্ষ, নৈতিক ও যোগ্য নাগরিক হয়ে উঠতে পারবে না। জাতির অগ্রগতি থেমে যাবে। তাই শিক্ষাঙ্গনে স্থিতিশীল, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। রাজনীতি, সহিংসতা, প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও দুর্নীতিকে দূর করে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। প্রশাসন ও শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি রোধে কঠোর নজরদারি ও শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে।
যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক আরও বন্ধুত্বপূর্ণ হতে হবে।পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষা বাদ দিয়ে দক্ষতা, নৈতিকতা ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট ও সহনশীলতার চর্চা শিক্ষার অংশ করতে হবে।
শিক্ষাঙ্গনে অশান্তি একটি জাতির ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করে, শিক্ষাকে জীবনমুখী করে শিক্ষায়তন থেকে অনাচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও ইভটিজিং দূর করতে হবে.। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতাবিষয়ক শিক্ষা, গণমাধ্যমে সুষ্ঠু প্রচারযোগ্য অনুষ্ঠান ও পারিবারিক মূল্যবোধ তৈরির যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
একটি মেধাভিত্তিক, সুশৃঙ্খল ও সুশাসিত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, আজকের প্রজন্ম একটি অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হবে, যার দায় আমাদের সবাইকেই নিতে হবে।
লেখক: প্রবন্ধকার ও গবেষক।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছে, যেখানে রপ্তানি এ প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখার প্রধান চালিকাশক্তি। ঐতিহ্যগতভাবে দেশটি প্রস্তুত তৈরি পোশাক (RMG)-এর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছে, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি যোগান দেয়। তবে বর্তমানে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনা এবং নতুন উচ্চমূল্যের বাজারে প্রবেশের চাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ লক্ষ্যে, বাংলাদেশকে শুধু পণ্যের মান উন্নয়নই নয়, বরং আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা মানদণ্ড মেনে চলার ক্ষেত্রেও মনোযোগী হতে হবে। এই মানদণ্ড পূরণে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রযুক্তিগুলির একটি হলো গামা রেডিয়েশন জীবাণু মুক্তকরণ।
গামা রেডিয়েশন এক ধরনের আয়নীভূত বিকিরণ, যা নিরাপদ ও কার্যকর জীবাণুমুক্তকরণ পদ্ধতি হিসেবে ৬০টিরও বেশি দেশে স্বীকৃত। এটি ক্ষতিকর অণুজীব ধ্বংস করে, পণ্যের সংরক্ষণকাল বাড়ায় এবং খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের ভৌত বা পুষ্টিগুণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না এনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) খাদ্য নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের জন্য এই প্রযুক্তিকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে সমর্থন করেছে। গার্মেন্টস ও চিকিৎসা টেক্সটাইলের ক্ষেত্রেও গামা রেডিয়েশন ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর জীবাণুমুক্তকরণ নিশ্চিত করে, যা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কঠোর মানদণ্ড পূরণে সহায়তা করে।
মূল প্রশ্ন হলো: বাংলাদেশ কি গামা রেডিয়েশন জীবাণুমুক্তকরণকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত, এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিযোগিতামূলক রপ্তানিকারক হিসেবে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারবে কি?
বর্তমান প্রেক্ষাপট: রপ্তানি ও মানের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার বর্তমানে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যদিও পোশাক খাত এখনো প্রাধান্য বিস্তার করছে, ফল, শাকসবজি, মসলা, কোমল পানীয় ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি ধীরে ধীরে বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের মসলা ও ফলের চাহিদা বাড়ছে। তবে প্রায়ই রপ্তানি চালান বাতিল হয় মাইক্রোবিয়াল সংক্রমণ, কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ এবং সংরক্ষণের সীমাবদ্ধতার কারণে। প্রচলিত জীবাণুমুক্তকরণ পদ্ধতি যেমন রাসায়নিক ফিউমিগেশন, তাপ চিকিৎসা ও হিমায়ন কিছুটা কার্যকর হলেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাপে পণ্যের স্বাদ ও গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রাসায়নিক অবশিষ্টাংশ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে এবং হিমায়ন পরিবহন ব্যয় বাড়ায়। উপরন্তু, অনেক আমদানিকারক দেশ এখন রাসায়নিক ফিউমিগেশন পরিহার করছে এবং নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে বিকিরণকে বাধ্যতামূলক করছে।
গার্মেন্টস খাতে, বিশেষ করে চিকিৎসা টেক্সটাইল ও সুরক্ষা সামগ্রীর ক্ষেত্রে জীবাণুমুক্তকরণ অপরিহার্য। বর্তমানে বাংলাদেশে বৃহৎ পরিসরে রেডিয়েশন জীবাণুমুক্তকরণের অবকাঠামো প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে রপ্তানিকারকদের বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়, যা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ, এবং প্রতিযোগিতা কমিয়ে দেয়।
কেন গামা রেডিয়েশন জীবাণু মুক্তকরণ গুরুত্বপূর্ণ
প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় গামা রেডিয়েশন বেশ কয়েকটি সুবিধা প্রদান করে:
বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ
সম্ভাবনা যতই বড় হোক, বাংলাদেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি:
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সম্ভাবনা ব্যাপক:
সরকারের ভূমিকা
এই সুযোগ কাজে লাগাতে সরকারের করণীয়:
বেসরকারি খাতের ভূমিকা
কৌশলগত রোডম্যাপ
উপসংহার
বৈশ্বিক রপ্তানি বাজার ক্রমেই প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে, যেখানে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যবিধি ও মান অগ্রাধিকার পাচ্ছে। গামা রেডিয়েশন জীবাণুমুক্তকরণ এখন আর বিকল্প নয়, বরং অপরিহার্য প্রযুক্তি। বাংলাদেশের জন্য এটি যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি বিরাট সুযোগ। চ্যালেঞ্জ হলো উচ্চ বিনিয়োগ খরচ, নীতি সীমাবদ্ধতা ও জনসাধারণের ভুল ধারণা। তবে সুযোগ আরও বড়—নতুন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ, রপ্তানি বৈচিত্র্য এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান।
সরকারি নেতৃত্ব এবং বেসরকারি বিনিয়োগের সমন্বয়ে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। আজকের সাহসী পদক্ষেপই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রপ্তানি সফলতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
প্রফেসর ড. মোখলেসুর রহমান
পারমাণবিক বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ
মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি
ফিনল্যান্ডের অন্যতম সুন্দর শহর হলো রাজধানী হেলসিঙ্কি, যা আধুনিকতা, নিরাপত্তা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক চমৎকার মিশ্রণ।
সে সুখী দেশ মানুষের, ‘হৃদয় উন্নয়ন জাতীয় দিবস কর্মসূচি’ বিতর্ক প্রতিযোগীতায় থেমে থেমে চলেছে —
‘হৃদয়ের সুখী সার্বভৌম ও সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয় কী অপজ্ঞান?’ শীর্ষক সেমিনার। হেলসিঙ্কি শহুরে প্রোগ্রামে বিশ্বব্যংকের প্রতিনিধি হয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্হাপক হিসেবে থাকছেন,কবি কৌশিক কানাই প্রান্ত।
মি. প্রান্ত একসময় সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। পড়া লেখার পাঠ চুকিয়ে বিশ্বব্যাংকের অধীনে মানব সম্পদ উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, পরিবেশ সুরক্ষা, এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছেন।
বিশ্বব্যাংকের এ জাতীয় প্রোগ্রামগুলোর লক্ষ্য হলো, বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন করা এবং অসুখী সমৃদ্ধ সদস্য দেশগুলোকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করার লক্ষ্যে, সুখী ধনীদের অলস টাকার উপরে প্রচ্ছন্ন চাতুর্য অপ মানবিক কৌশলে চড়া শুল্কহার বসিয়ে দেয়া।
বিশ্বব্যাংকের মূল কাজের সাথে যদিও সরাসরি এ ধরনের প্রোগ্রাম ঠিক যায় না; তদুপরিও বৌদ্ধিক চতুরার্য সত্যের পাশ কাটিয়ে কিছুটা মিশ্র অর্থনীতির মতো —‘মানুষের চির অধরা গুহ্য গুহাবাসী অপ চতুরার্য মন’ অভিসন্দর্ভের প্রয়োজনে মি. প্রান্ত আগবাড়ান আবেগের
তাড়নায়,- আসলে কী বহুমুখি জটিল কুটিল চাতুর্যময় জীবন বন্দনা গানে গানে যাপিত আগামী মানব জীবনে থিতু হতে চাইছেন? প্রয়োজন অপ্রয়োজন নিয়ে পয়ার ত্রিপদী ছন্দে জীবন পুঁথি রচনা করে চলেছেন?। দেশে দেশে নানান দেশে মানুষের সুখ দুঃখ আপেক্ষিক আবেগ বিবেক স্টোরে অপ হৃদয় উন্নয়ন পুঁজি খাটিয়ে পরের ধনে পোদ্দারি ব্যবসার নতুন নতুন সীলমোহর দিয়ে চলেছেন? মানুষের জ্ঞানের মার্গ ও হয় দু'প্রকার। জ্ঞান ও অপজ্ঞান। জ্ঞান খুলে দেয় হৃদয়ের বন্ধ দুয়ার। অপজ্ঞান বন্ধ করে দেয় হৃদয় মহান সকল দুয়ার।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০২৫ (World Happiness Report 2025) অনুযায়ী, ফিনল্যান্ড টানা অষ্টম বারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে নিজের স্থান ধরে রেখেছেন।
স্থান: হেলসিঙ্কি
বিশ্ববিদ্যালয় (University of Helsinki)
সেমিনার: সান্তা ক্লজ হল।
সুধী খই ফোটান মুখে, ‘হৃদয়ের সুখী সার্বভৌম ও সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয় কী অপজ্ঞান?’ শীর্ষক বিশ্বের হৃদয় ধস পুরস্কার জেতা সংস্কৃতির আসনে বসে আছেন — ফিনল্যান্ডের ভাগ্য জনগণ। তারা, জাতীয় সুখী ঠিকাদার কিম রাইক্কোনেন, জিন সিবেলিয়াস, রেনি হারলিন, (ডাই হার্ড ২) সান্তা ক্লজ জাতীয় গর্ব চরিত্রে যে যার মতো করে সুখী গর্ব সংজ্ঞা বলে চলেছেন।
‘হৃদয়ের সার্বভৌম ও সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয় কী অপজ্ঞান? শীর্ষক সেমিনার সময় দ্রুত এগিয়ে চলেছে। পৃথিবী অধিরাজ সময়ে রাজ অপমুকুট পরে সুখ ও সুখী দেশ বিচারক কে বা কারা কোথায় বসে আছেন? ধ্রুব চিরসত্য সময়ইবা জেগে আছে কতটুকু.! তা পৃথিবী সময়ে নির্ণিত হবে না কোনোদিন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক প্রাবন্ধিক ও কবি
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউর সামনে উদ্বিগ্ন স্বজন, প্রিয়জনদের জটলা কিংবা ভিড় লেগেই থাকে রাতদিন। কেউ নিজেকে সম্বরণ করে বুকে পাথর বেঁধে চুপচাপ থাকেন। কিন্তু তাদের দেখলেই অনুমান করা যায় অনেক কষ্ট বেদনা আর দুশ্চিন্তায় বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে সেই অবর্ণনীয় কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে রেখে কোনো ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। কথা বলছেন, হাঁটাচলা করছেন। আইসিইউর ভেতর জীবন-মৃত্যুর সন্নিক্ষণে কারো বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান কিংবা স্ত্রী। কখন যে কী হয়ে যায়, ভেতর থেকে কখন কী খবর আসে? কেউ কেউ নিজেকে সংবরণ করতে পারেন না। অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে ফোঁস ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আর ফুপিয়ে কাঁদেন। এমনিতেই অত্যন্ত সংবেদনশীল জায়গা হিসেবে বিবেচিত আইসিইউর ভেতরে সাধারণের প্রবেশাধিকার অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। মুমূর্ষ রোগীদের জীবন বাঁচাতে সর্বোচ্চ এবং সবশেষ প্রচেষ্টা চলে এখানে। এখানে রোগীর শরীরের সঙ্গে যুক্ত নানা ধরনের এবং যন্ত্রপাতির নলের ছড়াছড়ি। সেই সব যন্ত্রপাতির নানা ধরনের অদ্ভুত শব্দ কানে আসে শুধু। এখানে থাকা ডাক্তার এবং নার্সদের সতর্ক ব্যস্ততা চোখে পড়লেও এক ধরনের নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে থাকে। জানা গেছে, দেশের কমপক্ষে ২২ জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সেবা নেই। মারাত্মক অসুস্থ বা জীবন বিপন্ন- এমন রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ শয্যার দরকার হয়। আইসিইউতে রোগীকে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। রোগীর বিশেষ সহায়তার দরকার হয়। চিকিৎসায় বিশেষ যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পাশাপাশি আইসিইউর নার্সদের থাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ। দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে এই বিশেষায়িত সেবার খরচ তুলনামূলক কম। তাই মানুষের আগ্রহ থাকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক অবস্থা থাকেনা সবার। আত্মীয়দের ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য না থাকায় উপায়হীন আত্মীয়রা মুমূর্ষ রোগীদের নিয়ে ফেরত চলে যান বাড়িতে। তেমন কিছু মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার রুগ্ন চেহারা আবারও আমাদের সামনে চলে আসে। দেশে দুর্ঘটনা বাড়ছে, জটিল রোগে ভোগা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সাথে আইসিইউ সেবার প্রয়োজনও বাড়ছে। কিন্তু মানুষ প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে না। এই সেবা নিয়ে আছে নানা অভিযোগ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ নেই এমন জেলার মধ্যে রয়েছে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, বরগুনা, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়, নাটোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, ভোলা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, শরীয়তপুর, নেত্রকোনা, চুয়াডাঙ্গা ও সুনামগঞ্জ। এ ছাড়া বাগেরহাট ও মাদারীপুর জেলায় সরঞ্জাম থাকলেও আইসিইউ চালু নেই। রাজধানীর একাধিক বড় সরকারি হাসপাতালেও এই শয্যা নেই। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (পঙ্গু হাসপাতাল) এক হাজার শয্যার। সারাদেশের গুরুতর আহত রোগী প্রতিদিন এই হাসপাতালে ভর্তি হয়। জানা গেছে, এই হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। জাতীয় নাক-কান-গলা হাসপাতালেও এ ধরনের কোনো শয্যা নেই। সরকারের লক্ষ্য ছিল, সব জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ চালু করার। করোনা মহামারির সময় সব জেলায় আইসিইউ চালু করা হয়েছিল। প্রায় ৪০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তখনকার আইসিইউকে এখন কাজে লাগাতে কোনো অসুবিধা নেই। ১০ শয্যার আইসিইউ শয্যা চালু করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সেবা চালু থাকবে সপ্তাহে সাত দিনের ২৪ ঘণ্টা। এতে থাকবে নয়টি অত্যাবশ্যকীয় সেবা ও চারটি ঐচ্ছিক বা বাড়তি সেবা। ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিটের জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসক থাকবেন ১৩ জন ও বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসক থাকবেন ৭ জন। সার্বক্ষণিক নার্স থাকবেন ১৬ জন। অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী থাকবেন আরও ১৬ জন। কেন্দ্র চালাতে ছোট-বড় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম লাগবে মোট ৬৩ ধরনের। আর ওষুধ লাগবে ৪৯ ধরনের। আইসিইউ শয্যা আছে এমন প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে রোগীর লম্বা সারি দেখা যায়, মানুষ অপেক্ষায় থাকেন কখন একটি শয্যা খালি হবে। যারা সরকারি হাসপাতালে চেষ্টা করেও শয্যার ব্যবস্থা করতে পারেন না, তারা যান বেসরকারি হাসপাতালে। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক মালিক হাসপাতালের একটি অংশকে আইসিইউ হিসেবে ব্যবহার করেন। যথাযথ অনুমতি নিয়ে আইসিইউ সেবা দেন এমন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক কম। তারা প্রতিদিনের আইসিইউ শয্যা ভাড়া নেন ১৫ হাজার টাকা। চিকিৎসকের ফি, ওষুধের দাম এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় এর বাইরে। দিনে মোট ব্যয় হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। কোনো রোগীকে যদি দুই দিন, তিন দিন বা এক সপ্তাহ আইসিইউতে থাকতে হয়, তাহলে বহু টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যায়। বেসরকারি হাসপাতাল যত বড়, তার আইসিইউর খরচ তত বেশি। এই ব্যয় অনেকের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। অনেকে অর্ধেক পথে চিকিৎসা বন্ধ করেন, অনেকে চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (আইসিইউ) সেবা না পেয়ে মৃত্যুর ঘটনা যেমন অত্যন্ত মর্মান্তিক, তেমনি তা আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার রুগ্ণদশাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরেও কোনো আইসিইউ শয্যা খালি না পেয়ে বলতে গেলে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন নিয়ে লম্বা লম্বা বক্তৃতা দেন, যার সঙ্গে বাস্তবের মিল খুব কমই আছে। ২২ জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই। মারাত্মক অসুস্থ, জীবন বিপন্ন এমন রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ দরকার হয়। বেসরকারি হাসপাতালে এ বিশেষায়িত সেবার খরচ অনেক বেশি। ফলে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ তো বটেই, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের পক্ষে সেখানে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। যেসব সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা আছে, সেখানকার অবস্থা অনেকটা ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী’। লালমনিরহাট জেলার সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সেবা প্রয়োজন, এমন রোগী এলে তারা রংপুর মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দেন। এ রকম ঘটনা আরও অনেক জেলাতেই ঘটে থাকে। করোনা মহামারির সময় দেখা গেছে দেশে আইসিইউ সমস্যা কত প্রকট। সেই সময় কোনো কোনো হাসপাতালে অস্থায়ীভাবে কিছু আইসিইউ খোলা হয়েছিল। আবার আইসিইউ খুললেই হবে না। এর জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল ও যন্ত্রপাতির জোগানও নিশ্চিত করতে হবে। অনেক হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা থাকলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন না। ১০ শয্যার একটি আইসিইউর জন্য ১৩ জন সার্বক্ষণিক চিকিৎসক প্রয়োজন। ৫ বছর আগে শুরু হওয়া করোনা মহামারির মধ্যেই তখনকার সরকারপ্রধানের নির্দেশনা ছিল প্রতিটি জেলায় আইসিইউ সেবা চালু করার। মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদাসীনতার কারণে জেলায় জেলায় সেই সেবা চালু হয়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক। এ দুর্ভাগ্য দেশবাসীকে আর কত দিন বয়ে বেড়াতে হবে? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ছিল ৫৪৮টি। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে শয্যা ছিল ৩৪৮টি। অর্থাৎ মোট শয্যা ছিল ৮৯৬টি। গত দুই বছরে সরকারি হাসপাতালে আরও আইসিইউ শয্যা যুক্ত হয়েছে। ১০টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ শয্যার করে আইসিইউ চালু করা হয়েছে। একইভাবে ১৩টি জেলা হাসপাতালে ১০ শয্যা করে আইসিইউ চালু করা হয়েছে। সারাদেশে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা এখন ১ হাজার ১২৬টি। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তিরা বলছেন, বেসরকারি পর্যায়ে এমন শয্যা আছে আরও প্রায় এক হাজার।
প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে এ স্বাস্থ্যসেবা খুবই অপ্রতুল। আমরা চাই না আর কোনো অসুস্থ মানুষ আইসিউ সেবা না পেয়ে মারা যান। যেসব জেলা হাসপাতালে আইসিউ নেই, জরুরি ভিত্তিতে তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রয়োজনীয় লোকবল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। কেবল অবকাঠামো দিয়ে তো চিকিৎসা হয় না। প্রায়ই গণমাধ্যমে খবর আসে বছরের বছর যন্ত্রপাতি হাসপাতালে পড়ে থাকে, বসানো হয় না। বসানো হলেও দক্ষ লোকবলের অভাবে কাজে লাগানো যায় না। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা কেন উপেক্ষিত হলো, এর জন্য কারা দায়ী, সেটাও চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। করোনাকালে আমাদের স্বাস্থ্যসেবার যে বেহাল চিত্র বেরিয়ে এসেছিল, তা লজ্জাজনক। এ লজ্জার মাত্রা আর বাড়তে দিতে না চাইলে সরকারের উচিত সমন্বিত ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া। বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ কোনো ফল দেবে না। জেলা শহরের জেনারেল হাসপাতালে হঠাৎ করে নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি হয়। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজনের চিকিৎসার জন্য এখনো ভরসার জায়গা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে সরকারি এই হাসপাতাল। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার আসলে তেমন উন্নয়ন ঘটেনি এখনো সেখানে অনেক অনেক টাকা খরচ করে মোটামুটি আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা সুবিধা পান রোগীরা। কিন্তু এজন্য রোগীর পরিবারকে চরম মূল্য দিতে হয়। অবস্থাপন্ন, স্বচ্ছল-ধনী পরিবারের হয়তো তেমনভাবে গায়ে লাগে না। সেই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সারা জীবনের সঞ্চয় শেষ হয়ে যায়। অনেক কষ্টে তিল তিল করে বানানো নারীর সখের স্বর্ণালংকার বিক্রি করে দিতে হয়। আবার কেউ কেউ জটিল রোগের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে বসতবাড়ি-ঘর, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট পর্যন্ত বিক্রি করে কাড়ি কাড়ি টাকা জোগাড় করেন। তবুও উন্নত চিকিৎসা করে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করে যায় মানুষ। তবে ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে সাধারণ মানুষ অসুস্থ হলে ছুটে যায় সরকারি হাসপাতালে। সেখানে যতটুকু চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু তেমন প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করে যদি ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে তো সংকট বলে ধরে নেওয়া যায়। তখন রীতিমতো দুর্যোগ নেমে এসেছে সাধারণ, অসচ্ছ্বল, দরিদ্র মানুষগুলোর ওপর। সন্তানসম্ভবা বউ-ঝি, অসুস্থ সন্তান, বাবা-মাদের নিয়ে এসে হতাশ হয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দুচোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে তারা। যাদের গাটে টাকা পয়সা আছে, সামর্থ্য রয়েছে, যারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছ্বল তারা বিকল্প হিসেবে শহরের গুটিকতক ক্লিনিক বেসরকারি ছোট হাপাতালে ছুটে যায় হয়তোবা। কারণ, সন্তানসম্ভবা একজন নারীর নানা শারীরিক জটিলতা নিয়ে ঘরে বসে থাকা যায় না। তখন অপেক্ষা করা চলে না। অতএব, বেসরকারি ছোটখাটো ক্লিনিকের শরণাপন্ন হতে হয় বাধ্য হয়েই। এছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকেনা তাদের কাছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলামিস্ট।
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে। ৭১-এ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী নানা আন্দোলন-সংগ্রামে অগণিত শহীদের ত্যাগ আর অসংখ্য মা-বোনের অশ্রুর বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই ভূখণ্ড। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে এসেছে। অথচ আজ প্রশ্ন জাগে—আমরা কি সত্যিই দেশপ্রেমিক জাতি হয়ে উঠতে পেরেছি? নাকি আমরা কেবল নিছক নিজপ্রেমিক, যাদের দর্শন দাঁড়িয়ে আছে—‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম।’
আজকের বাংলাদেশকে ঘিরে যে সব চিত্র আমরা প্রতিদিন দেখি, তাতে এ প্রশ্ন অমূলক নয়। শহরের রাস্তায় নামলেই বোঝা যায় আইন ভাঙা যেন এক ধরনের স্বভাব। ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, যত্রতত্র পার্কিং করা অনেকের কাছে যেন বীরত্বের প্রমাণ। ফুটপাত দখল করে ব্যবসা চালানো, যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা কিংবা বাসে ভাড়া না দেওয়ার জন্য তর্কে জড়ানো—এসবকে আমরা প্রতিদিনের জীবনের অংশ হিসেবেই মেনে নিচ্ছি। অথচ এগুলোই ইঙ্গিত দেয় আমাদের মানসিকতার। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা গড়ে তোলার বদলে আমরা যেন শিখেছি কেবল ব্যক্তিগত সুবিধাটাই আগে দেখতে।
প্রশাসন ও রাজনীতির ছবিটাও ভিন্ন নয়। আমাদের রাজনীতিবিদদের কাছে ‘জনগণের সেবা’ প্রায়শই কেবল একটি স্লোগান। ক্ষমতায় থাকলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় যন্ত্রে রূপ দেওয়া হয়, আর বিরোধী দলে থাকলে রাষ্ট্রকে অচল করার চেষ্টাই মুখ্য হয়ে ওঠে! যে নেতারা জনগণকে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন, তারাই সামান্য সর্দি-জ্বরের জন্য বিদেশে উড়াল দেন, সন্তানদের পড়ান বিদেশি প্রতিষ্ঠানে, এমনকি সম্পদও গড়ে তোলেন বিদেশে!-এইগুলো এখন নিত্য সংবাদ। এইসব নিউজ নিয়মিত স্ক্রল হতে থাকে সাধারণের ঘরে ঘরে আর তখনই মানুষ হতাশ হয়ে প্রশ্ন করে—এই তথাকথিত নেতাদের দেশপ্রেম কোথায়? নাকি তাদের প্রকৃত লক্ষ্য কেবল নিজেদের আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করা?
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। ভেজাল খাবার, নকল ওষুধ, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী—এসবের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষের সীমাহীন মুনাফার লোভ। তারা জানে এর ফলে মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ছে, তবু ব্যক্তিগত লাভের কাছে সব দায়বদ্ধতা গৌণ হয়ে যায়। সমাজে যেকোনো ক্ষতি তাদের কাছে অস্পষ্ট, কারণ তাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ শুধু নিজের লাভক্ষতির খাতায়।
আমি একজন শিক্ষক হিসেবে সবচেয়ে গভীরভাবে যেটি উপলব্ধি করি তা হলো—আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই দেশপ্রেমের বড় ঘাটতি লুকিয়ে আছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো মূলত মুখস্থভিত্তিক ও পরীক্ষামুখী। শিক্ষার্থীরা প্রকৃত জ্ঞানার্জনের বদলে ভালো গ্রেড ও সার্টিফিকেট পাওয়াকেই বড় লক্ষ্য মনে করে। এর ফলে তারা শুধু প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে শেখে, কিন্তু সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্বশীল হতে শেখে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে আমি প্রায়ই দেখি, অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী স্নাতক শেষ করেই স্বপ্ন দেখে বিদেশে পাড়ি জমানোর। বিদেশে পড়াশোনা, চাকরি বা স্থায়ীভাবে বসবাস করাই যেন তাদের জীবনের বড় সাফল্য। অথচ তাদের সেই মেধা ও শ্রম যদি এই দেশেই কাজে লাগত, তাহলে দেশের অর্থনীতি, গবেষণা এবং সামাজিক উন্নয়ন বহুগুণ এগিয়ে যেত। এ প্রবণতা আমাদের জন্য একধরনের ‘ব্রেইন ড্রেইন’ তৈরি করছে অনেকদিন ধরেই।
দেশের প্রাইমারি ও মাধ্যমিক শিক্ষার আরেকটি বড় সমস্যা হলো নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব। পাঠ্যক্রমে দেশপ্রেম বা নাগরিক দায়িত্বের আলোচনা থাকলেও তা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তবে আমরা শিশু-কিশোরদের সমাজসেবা, নাগরিক দায়িত্ব কিংবা জনস্বার্থে কাজ করার সুযোগ খুব কমই দিই-(জাপান কিংবা ফিনল্যান্ডে নৈতিক শিক্ষা এবং দেশপ্রেম শিশুকাল থেকেই চর্চা করা হয়)। ফলে তারা পেশাজীবনে প্রবেশ করে কেবল ব্যক্তিগত উন্নতি ও আর্থিক লাভের দিকে মনোযোগী হয়।
এক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের ভূমিকা জরুরি-বিশেষ করে প্রাইমারি ও মাধ্যমিক পর্যায়ে অল্প বয়সেই শিশু-কিশোরদের মননে দেশপ্রেম ও নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। এবং বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে আমরা যদি কেবল সিলেবাস শেষ করাকে বড় সাফল্য মনে করি, তবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চিন্তাশীলতা, গবেষণা-মনস্কতা বা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা গড়ে উঠবে না। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত প্রশ্ন করার জায়গা, মতামত প্রকাশের জায়গা এবং সৃজনশীলতার জায়গা। আর এই সার্বিক ইনক্লুসিভ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই একজন শিক্ষার্থী সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নাগরিক হয়ে উঠতে পারে।
এখানে পরিবার ও সমাজের ভূমিকাও বড়। আমরা সন্তানদের বলি—ভালো চাকরি করো, ভালো বাড়ি-গাড়ি করো। কিন্তু খুব কমই বলি—ভালো নাগরিক হও, দায়িত্বশীল হও, সমাজ ও দেশের কল্যাণের কথা ভাবো। বরং প্রায়শই শোনা যায়—‘অন্যরা যাই করুক, তুমি কেবল নিজেরটা দেখো।’ এভাবেই প্রজন্ম বেড়ে ওঠে স্বার্থপরতার শিক্ষায়। এর পরিণতিতে দেশপ্রেমের জায়গায় ক্রমে গড়ে ওঠে নিছক নিজপ্রেম।
অবশ্য দিনশেষে, পুরো চিত্র এতটা অন্ধকার নয়-এখনো আমরা দেখি তরুণদের অনেকেই পরিবেশ আন্দোলনে নেমে পড়ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছে কিংবা প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। প্রবাসীরা কঠোর পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছে। এ সবই আশার আলো। তবে এই ছিটেফোঁটা আলোকে বিস্তৃত আলোর স্রোতে রূপ দিতে হলে আমাদের শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।
প্রকৃত দেশপ্রেম মানে কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেওয়া নয়; বরং প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজেই দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়। ট্রাফিক আইন মেনে চলা, কর দেওয়া, মানসম্মত পণ্য তৈরি করা, সৎভাবে দায়িত্ব পালন করা—এসবই দেশপ্রেম। শিক্ষক যদি আন্তরিকভাবে পড়ান, ব্যবসায়ী যদি ন্যায্য মান বজায় রাখেন, রাজনীতিবিদ যদি সত্যিই জনগণের স্বার্থে কাজ করেন—তাহলেই দেশপ্রেম বাস্তব রূপ পাবে।
আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এখন আত্মসমালোচনা। আমরা কি সত্যিই দেশের জন্য কিছু করতে প্রস্তুত, নাকি কেবল নিজেদের স্বার্থেই সব আয়োজন? নিজের ভেতরের সেই নিছক নিজপ্রেমিক মানুষটাকে নিয়ন্ত্রণ করে দেশপ্রেমিক মানুষটাকে জাগিয়ে তুলতে না পারলে উন্নয়ন হবে খণ্ডিত, টেকসই হবে না। শিক্ষা, শিক্ষক এবং শিক্ষালয়গুলোই এখানে সবচেয়ে শক্তিশালী নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। শিক্ষা যদি শিশুকিশোর, তরুণদের শেখাতে পারে—দেশের স্বার্থই আসল স্বার্থ, কেবল নিজের নয়, অন্যের কল্যাণও জরুরি—তাহলেই পরিবর্তন সম্ভব। একেকজন নাগরিক যদি ছোট ছোট দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে, তাহলে সমষ্টিগতভাবে দেশ এগোবে অনেক দূর।
তাই, আজ আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো—নিজস্বতার গণ্ডি ভেঙে দেশকে বড় করে ভাবা। দেশপ্রেম কোনো অলঙ্কার নয়, এটি একটি দায়বদ্ধতা। যদি আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি, তবে আমাদের দেশকে সত্যিই একটি আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
লেখক : অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলার ঐতিহ্যে এখনো কিছু কিছু পথা বা অন্ধ নিয়ম রয়েছে যা জাহেলিয়া যুগ থেকে হয়ে আসছে। কালের বিবর্তনের মাধ্যমেও এগুলো কে সহজে সমাজ তথা রাষ্ট্র থেকে উৎখাত করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তারই একটি অন্ধ নিয়ম হচ্ছে- যৌতুক। বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে- বিবাহের চুক্তি অনুসারে কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে বা বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে যে সম্পত্তি বা অর্থ দেয় তাকে যৌতুক বা পণ বলে। (বাংলাপিডিয়া ৮/৪৫৫)।
আমাদের সমাজে কিছু মূর্খ, অশিক্ষিত (প্রকৃতপক্ষে তারা শিক্ষিত, কিন্তু কাজে কর্মে শিক্ষার যথেষ্ট অভাব রয়েছে!!!) লোক রয়েছে যারা যৌতুক দেয়া এবং নেয়াকে সমর্থন করেন। কিন্তু তাদের এই ধরনের অহেতুক সমর্থনের পিছনে আদৌ কোন যুক্তি আছে কি না বা থাকলে সেটা কি আমার তা জানা নেই ।
বাংলাদেশের ১৯৮০ সনের যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনে যৌতুকের যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে তা নিম্নরূপ: যৌতুক অর্থ (ক) কোনো এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে, অথবা (খ) বিবাহের কোনো এক পক্ষের পিতামাতা অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক অন্য কোনো পক্ষকে বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিবাহের মজলিসে বা বিবাহের পূর্বে বা পরে যে কোনো সময়ে বিবাহের পণ রূপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ যে কোনো সম্পত্তি বা জামানত। (যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০, আইন নং ০৫)।
বিয়ের সময় একটা মেয়ের যে কি পরিমাণ মানসিক কষ্ট হয় তা শুধু মেয়েরাই বোঝে। একটা মেয়ে কে তার পরিবার, সমাজ, এতদিনের গড়ে ওঠার পরিবেশ সব কিছু ছেড়ে আসতে হয়। তো যখন একটি মেয়েকে নেবার পরও তার বাবা-মা র কাছে যৌতুক চাওয়া হয় তখন পাএ পক্ষ কোন বিবেচনায় সেটা করে? তারা কি মনে করছে যে মেয়েটা ঐ ছেলেটার চেয়ে যোগ্যতায় কম, তাই অর্থ বা সম্পওি দিয়ে মেয়েটা কে ছেলেটার সমান হতে হবে? এর অর্থ কি এই নয় যে ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর সেটা মাপার জন্য মেয়েটাকে অর্থ সহকারে পাল্লাতে ওঠাতে হবে । যাতে দুই পাল্লা সমান হয়!!! আবার এভাবেও ভাবা যায় মেয়েরা ছেলেদেরকে তুচ্ছ ভাবে, আর তাই তাদের কে ওরা নতুন জীবন শুরুর পূর্বেই দান করে ছোট করে রাখে। কিন্তু এভাবে কি আর কেউ ভাববে???
কত অদ্ভূত আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা। আর কত নিকৃষ্ট মানুষের রুচি। যেখানে মেয়েরা মূল্যহীন। মেয়েদের কোনো কিছুর কোনো দাম নেই । পাত্র পক্ষ মনে করে তাদের ছেলেকে তারা টাকা খরচ করে বড় করেছে। আর তাই সেটা বিয়ের সময় করায় গন্ডায় উসুল করে নেবে। তো মেয়েটা কে কি তার বাবা-মা অর্থ ছাড়াই বড় করেছে? সেই টাকা কে দেবে? মেয়ে র বাবা-মায়ের কি কষ্ট হয় না নিজের মেয়েকে কষ্ট করে বড় করে অন্যের কাছে দিয়ে দিতে? নাকি সব কষ্ট শুধু ছেলেদের বেলাতেই? যারা এই ধরনের যৌতুক দাবি করে তারা যে কি পরিমাণ নিচু মানসিকতার, তা ভাবতেও ঘৃণা লাগে। সততাহীন, বিচার বুদ্ধিহীন, রুচিহীন জীবন ওদের। ইসলাম একে কখনোই সমর্থন করেনি। তো সমাজ ওদের মত ঘৃণ্যদের কে আর কত প্রশ্রয় দেবে? আইনত ব্যবস্থা থাকা সত্বেও কেন তা যথাযথ ভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না? এর উওর কোথায়???
আসুন আমরা সবাই এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। কঠোর প্রতিবাদ করি এবং সমস্বরে যৌতুক কে ‘না’ বলি।