‘শাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়ঃ/ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’- সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা ‘দুর্মর’-এর কথা বারবার মনে পড়ে যায় পদ্মা সেতুর দিকে তাকালে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ভোট জালিয়াতি করে সেবার ক্ষমতা শেখ হাসিনার হাত থেকে লুট করে নেয় বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। এরপর দীর্ঘ ৫ বছর শুধু লুটপাট ও হত্যার রাজনীতি বিএনপির। পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্ন ধ্বংস করতে নতুন করে আরিচা ঘাটের কাছে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রকল্প ঘোষণা করে এই বিএনপি সরকার। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয়ে পদ্মা সেতু তথা দক্ষিণের মানুষের স্বপ্ন বন্দি হয়ে যায় ফাইলে। প্রায় ৯ বছর পর ক্ষমতা গ্রহণের পর আরও একবার পদ্মা সেতুর স্বপ্নকে ফাইলবন্দি গুদাম থেকে সামনে নিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন করে আশাবাদী হয়ে ওঠে দেশের মানুষ।
কিন্তু এরপর শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। পদ্মা সেতু নিয়ে ওঠে দুর্নীতির কল্পিত অভিযোগ। এরপর বিশ্বব্যাংকের মুখ ফিরিয়ে নেয়া, রাজনৈতিক বাদানুবাদ, গুজব, জটিল রকমের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাসহ নানা কিছু পাড়ি দিতে হয়েছে। কিন্তু সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে নিজস্ব অর্থায়নে বাঙালির গর্বের পদ্মা সেতু নির্মাণের একক কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
পদ্মা সেতু নিয়ে প্রথম দুর্নীতির কাল্পনিক অভিযোগ উত্থাপন করে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু কেন তারা এমন কল্পিত অভিযোগ করল? এর উত্তরে পাওয়া যায় যে দুটি নাম, তা হলো শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের নাম। পদ্মা সেতু নিয়ে এই দুইজনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু নিজেদের টাকায় এই সেতু নির্মাণ করে ষড়যন্ত্রকারীদের সমুচিত জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘পদ্মা সেতু সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক এবং অপমানের প্রতিশোধ। এই সেতু শুধু সেতু নয়, এটি প্রকৌশলজগতে এক বিস্ময়’- কথাগুলো ২০২২ সালের ৮ জুন জাতীয় সংসদে পদ্মা সেতু নিয়ে আনা একটি প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের শরিক দলগুলোর সংসদ সদস্যরা বলেন।
জাতীয় সংসদে হওয়া এই আলোচনায় পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আরও স্পষ্ট করে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করেছিল বিশ্বব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) পদে থাকার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করেছিলেন। এর সঙ্গে খুব ভালোভাবে জড়িত ছিলেন একজন সম্পাদক।
ইউনূসকে এমডি পদে রাখতে তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) পরিবারের সদস্যদের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল বলেও জানান তিনি। এমডি পদে ড. ইউনূসকে রাখতে হিলারি ক্লিনটনকে (সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী) দিয়ে ফোন করানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। টনি ব্লেয়ারের (সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) স্ত্রী শেরি ব্লেয়ারকে দিয়ে ফোন করানো হয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিরাও ইউনূসকে ব্যাংকের এমডি রাখতে হবে বলে জানিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন সংসদে আরও জানান, শুধু ফোনকল নয় মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট দুইবার সজীব ওয়াজেদ জয়কে (প্রধানমন্ত্রীর ছেলে) ডেকে নিয়ে হুমকি প্রদান করে। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রকে হুমকি দিয়ে বলা হয়, ‘তোমার মাকে বলো- এমডির পদ থেকে ইউনূসকে সরানো যাবে না।’
পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি, আমার বোন রেহানা, আমার ছেলে- কেউ বাদ যায়নি। ড. মসিউর রহমান, আমাদের সচিব মোশাররফ, মন্ত্রী আবুল হোসেন- এদের ওপর যে জুলুম তারা করেছে এবং যখন অসত্য অপবাদ দিয়ে যখন পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করে দিল, তখন আমরা বললাম, আমরা নিজের টাকায় করব। অনেকে বোধ হয় ভেবেছিলেন, এটা অস্বাভাবিক। কিন্তু আমি বলেছিলাম, আমরা করতে পারব। এই আত্মবিশ্বাস আমার ছিল।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যেন টাকাটা (পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন) বন্ধ করে, তার জন্য বারবার ই-মেইল পাঠানো, হিলারির সঙ্গে দেখা করা, তাঁকে দিয়ে ই-মেইল পাঠানো এবং তাঁর সঙ্গে আমাদের একজন সম্পাদকও ভালোভাবে জড়িত ছিলেন। …এত চাপ। এই মামলা নিয়ে যে সমস্ত খেলা। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি। কার ডায়েরিতে লিখে রাখা ডিডটা হলে পরে অমুক এত পার্সেন্ট, অমুক এত পার্সেন্ট। এখানে মসিউর রহমান সাহেবের নাম, রেহানার নাম, নিক্সনের নাম। তারপর আমাদের আবুল হোসেনের নাম, সচিবের নাম। সবার নাম দিয়ে পার্সেন্টেজ লিখে রেখেছে। আমি যখন ডিমান্ড করলাম আমাকে কাগজ দাও। আমি দুর্নীতির এভিডেন্স চাই। একটা ডায়েরির কাগজ। পেনসিল দিয়ে লেখা। সেখানে তারিখ নেই। কিছু নেই। কোথায় বসে লিখেছে। এটা নাকি ওয়েস্টিন হোটেলে বসে লেখা। আমি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আমেরিকানদের জবাব দিয়ে বলেছিলাম, হ্যাঁ, আমার সঙ্গে তো হিলারি ক্লিনটন দেখা করতে এসেছিল। বলেছিল, এই এই কোম্পানিকে কাজ দিন। এবং ওই কোম্পানিকে কাজ দিলে যে এত পার্সেন্ট পাবে। আমার ডায়েরিতে লেখা আছে। দেব বের করে? তখন চুপ হয়ে গেছে।
একটা এমডি পদের জন্য দেশের এত বড় ক্ষতি! বিস্ময় প্রকাশ করে সেদিন সংসদে এই প্রশ্ন রাখেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে ড. ইউনূসের বেশ কিছু অস্বাভাবিক কাজের তথ্যও তিনি প্রদান করেন এই সংসদে। ড. ইউনূসকে কোনো অপমান করা হয়নি বরং তাঁকে ব্যাংকের উপদেষ্টা ইমেরিটাস হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় গ্রামীণ ব্যাংককে সরকার ৪০০ কোটি টাকা দিয়েছিল। গ্রামীণফোন যখন নেয়, তখন শর্ত ছিল এর লভ্যাংশ গ্রামীণ ব্যাংকে যাবে। কিন্তু একটি টাকাও ব্যাংককে দেয়া হয়নি। …একজন ব্যাংকের এমডি এত টাকার মালিক হয় কীভাবে? দেশে-বিদেশে এত বিনিয়োগ করে কীভাবে? ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে লাখ লাখ ডলার কীভাবে অনুদান দেয়? কার টাকা দিল? কীভাবে দিল, সেটা তো কেউ খোঁজ নিল না।
এর আগে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পে কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনের শীর্ষস্থানীয় তিনজন কর্মকর্তার ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পায়নি বলে রায় দেয় দেশটির আদালত। যার মাধ্যমে আরও স্পষ্ট হয় হিলারি-ইউনূসের কল্পিত দুর্নীতির ইস্যুটি। সিবিসি নিউজের প্রতিবেদনে সে সময় বলা হয়, অন্টারিও সুপিরিয়র কোর্টের বিচারক ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এই মামলাটি খারিজ করে তিন কর্মকর্তাকে খালাস দিয়েছেন।
বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর কাজ পেতে ঘুষ দেয়ার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ ছিল এই তিনজনের বিরুদ্ধে। মামলার একজন মুখপাত্র বলেন, অভিযোগের স্বপক্ষে প্রমাণ না পাওয়ায় অভিযুক্তদের খালাস দেয়া হয়েছে। এই মামলায় এসএনসি-লাভালিনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেসকে ২০১৩ সালে গ্রেপ্তার করা হয়।
অবশ্য ২০১২ সালে পদ্মা সেতুর ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, সেতুর কাজ পেতে বাংলাদেশি ও কানাডিয়ান ফার্মের কর্মকর্তা ও কিছু ব্যক্তি ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্র করেছে- এমন প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে।
ওই বছর বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতি ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্ট প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌস এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ জাবেরের বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা করে। এসএনসি-লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোস্তফা ও সাবেক কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইসমাইল, রমেশ শাহ ও কেভিন ওয়ালেসের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হয়।
বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়, পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পেতে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তারা সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ বেশ কিছু বাংলাদেশি কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার ষড়যন্ত্র করেন। এর তদন্ত শেষে দুদক ২০১৪ সালে আদালতে পেশ করা তদন্ত রিপোর্টে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানায়। যা শেষ পর্যন্ত কানাডার আদালতেও প্রমাণিত হয়।
কিন্তু হিলারি ও ইউনূসের এই ষড়যন্ত্রের সারথি হয়ে থেকেছে বিএনপি-জামায়াত জোট ও হিলারি-ইউনূসের এ দেশীয় কিছু সুশীল নামধারী বিদেশি এজেন্ট। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক সভায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, পদ্মা সেতু এই আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। জোড়াতালি দিয়ে বানানো সেতুতে, কেউ উঠবেও না। এরপর একের পর এক পদ্মা সেতুবিরোধী মন্তব্য আসতে থাকে বিএনপি নেতাদের পক্ষ থেকে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার ১০ মাস পর তথ্য ও যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ প্রমাণ করছে যে, অভিযোগটি সঠিক ছিল। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে তা প্রমাণিত। যদি সে আরও আগে পদত্যাগ করত, তাহলে হয়তো বরাদ্দ বাতিল করা হতো না। অপর এক আলোচনা সভায় মির্জা ফখরুল দাবি করেন, বিশ্বব্যাংক যে তিনজনের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ তুলছে তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, যদি আবুল হোসেন একজন দেশপ্রেমিক হয়ে থাকে, তাহলে কে দেশপ্রেমিক নয়? প্রাথমিক অবস্থায় আবুল হোসেনকে সমর্থন দেয়ায় একটি বার্তাই সাধারণ মানুষ পায়। আর তা হলো, ‘সাধারণ মানুষের টাকা যারা ডাকাতি করে, তাদেরই রাজনীতিতে আসার অধিকার রয়েছে’। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, আবুল হোসেন দেশপ্রেমিক নয়। যিনি একজন নির্লজ্জ ব্যক্তি, যে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ আনার পরও ১০ মাস ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অপর এক সদস্য বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ এস এম হান্নান শাহ বলেছিলেন, আবুল হোসেনকে অনুসরণ করে দেশপ্রেম প্রমাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীরও উচিত পদত্যাগ করা। এ সময় তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা দুর্নীতিগ্রস্ত এক প্রধানমন্ত্রী এবং তারও পদত্যাগের মাধ্যমে একটি উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করা উচিত।
নিজের গুলশান অফিসে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, দেশ স্বাধীনের পর এই প্রথম বিশ্বব্যাংক তার দেয়া বরাদ্দ দুর্নীতির কারণে বাতিল করল। (যদিও তথ্যটি সঠিক নয়, ২০০১-০৬ সালে বিশ্বব্যাংক একাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে)। দুর্নীতি দমন কমিশন আবুল হোসেনকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে বলেও এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করে বিএনপি। যদিও ২০১৭ সালে দুর্নীতি হয়নি বলে কানাডার আদালত রায় প্রদান করলে নিজেদের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয়নি রাজনৈতিক দলের কেউ।
রাজনৈতিক বিরোধিতার পাশাপাশি ছিল সুশীলদের ‘কান নিয়ে গেছে চিলে’- এমন আওয়াজ তোলা। বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছিলেন, দুর্নীতি আমাদের কীভাবে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে, তার আরেকটি উদাহরণ এটি (পদ্মা সেতু)। যা জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বাজে প্রভাব ফেলবে এটি। কেননা দাতারা এখন কোনো বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিষয়ে আরও সচেতন হবে। ‘এ ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। সরকার এখনই বিষয়টি নিয়ে না ভাবলে ভবিষ্যতে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হবে। -তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজুদ্দিন খান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপর সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের কারণে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। যখনই কোনো ঋণদানকারী সংস্থা এ দেশের প্রকল্পে অর্থ প্রদান করবে, তখন সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকবে।
বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর সোশ্যাল অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি (জিপিএসএ) পুরস্কার জয়ী ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ সম্পর্কে বলেছিলেন, এটা খুবই সামান্য ব্যাপার, যা বেশ দেরিতে হয়েছে। আরও কয়েক মাস আগেই এটা করা উচিত ছিল। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ আনার পরই তার পদত্যাগ করা উচিত ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেকজন সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছিলেন, মন্ত্রীর পদত্যাগ প্রমাণ করে, সরকার বিশ্বব্যাংকের তোলা অভিযোগ মেনে নিয়েছে। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে দুর্নীতি হয়েছে। যদিও বেশ দেরিতে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা প্রমাণ করছে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। দুদকের বিচার করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে টিআইবির এই নির্বাহী পরিচালক আরও বলেছিলেন, দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল কোনো প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু কানাডার পুলিশ এসে এ দুর্নীতির প্রমাণ দিয়ে গেছে। এই ঘটনা নিয়ে তদন্ত করার সামর্থ্য আছে কি না দুদকের, সেটি নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। এ ঘটনার তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা তাদের আছে কি না সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত কানাডার আদালত থেকেই দুর্নীতি হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়।
বেসরকারি সংস্থা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না প্রশ্ন তোলেন, কেন প্রধানমন্ত্রী এমন একজন মানুষকে ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে প্রচার করবেন। আর কেনই বা সেটা লন্ডন থেকে করতে হচ্ছে। যদি আসলেই মন্ত্রীর সৎ সাহস থাকত, তাহলে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরপরই সে পদত্যাগ করত। এদিকে সে সময় প্রকাশিত এক কলামে আলী ইমাম মজুমদার লেখেন, পদ্মা ব্রিজ নিয়ে হওয়া দুর্নীতির তদন্ত করার ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যর্থ হয়েছে। যদি দুদক সঠিক কাজটি করত, তাহলে হয়তো বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণের বরাদ্দ বাতিল করত না। দেশ ও জাতির পাশাপাশি উন্নয়ন সহায়ক অংশীদাররাও চায় দুদক তার সঠিক দায়িত্ব পালন করুক। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, সরকারি গাফিলতির কারণে দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে।
সরকার সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করায় দুঃখ পান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেছিলেন, প্রথম অভিযোগ পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের মনোভাব হলো অভিযোগ অস্বীকার করে যাওয়া। অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে, কিছু কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে দাতাগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে পারেনি।
মজার বিষয় হলো, প্রেসক্রিপশন-নির্ভর এসব বক্তব্যের জন্য অধিকাংশরাই পরবর্তী সময়ে দুঃখ প্রকাশ করেনি। কানাডার আদালত সব আসামিকে খালাস প্রদান করলেও তারা দুঃখ প্রকাশ করেনি। এতগুলো মানুষের মানহানি, সময় ও অর্থ-সম্পদ নষ্টের জন্যও তারা দুঃখ প্রকাশ করেনি। এরাই নাকি আবার মানবতার কথা বলেন। এরাই নাকি সুশীল?
‘আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করব’- দৃঢ় কণ্ঠে এই ঘোষণা প্রদান করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালির স্বাধীনতার ডাক দেয়া পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই এটি ছিল বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। বিদেশিদের শিকল ভেঙে নিজস্ব ভঙ্গিমায় বাংলাদেশের কিছু করার চেষ্টা ছিল এটি। দুর্নীতি হয়েছে মর্মে বিশ্বব্যাংক কানাডার আদালতে গিয়েছিল। সেখানে প্রমাণিত হয়েছে যে পদ্মা সেতু নিয়ে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি। আর এ কারণে পদ্মা সেতু আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াবার নাম। আরও একবার যুদ্ধে বিজয়ের নাম। বিদেশি শক্তির মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজস্বতায় জ্বলে ওঠার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে পদ্মা সেতু। গুজব, ভিত্তিহীন অভিযোগ, ষড়যন্ত্র, কিছুই রুখতে পারেনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই দেশের বাঙালিদের দৃঢ়তাকে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাঙালি মরতে শিখেছে, তাদের কেউ দাবাতে পারবে না।
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক বাংলা
‘জনগণ সব ক্ষমতার উৎস’- এটাকে অমোঘ সত্য ধরেই ষাটের দশকের গণজাগরণ স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আটচল্লিশ-বায়ান্ন-চুয়ান্নর ধারাবাহিকতায়ই এসেছিল বাষট্টি-চৌষট্টি-ঊনসত্তর। সহজেই বলা যায়, ওই প্রত্যয়ই আমাদের জাতিকে পাকিস্তানের শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে উদ্বেলিত করেছিল। ছাত্র আন্দোলনে থাকা অবস্থার দিনগুলোর কথা স্মরণ করলে এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ঊনসত্তরের চব্বিশে জানুয়ারি দিনটির কথা। মতিউর-রুস্তম-মকবুল-হারিশ-শহীদ নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানের শাসক-শোষকগোষ্ঠীর সঙ্গে ফয়সালা করতে ঢাকার রক্তাক্ত রাস্তায় জনগণ নেমে এসেছিল।
‘লোক লোক চোখের পাতায় লোক/ হৃদয়ের প্রতিটি স্কোয়ারে লোক’- কবি শামসুর রাহমান এভাবেই ওই দিনের বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন। সরকার সামরিকবাহিনী তলব করে শুক্রবার রাত ৮টা থেকে শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন এবং দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়। প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে এখনো মনে পড়ে, রাতে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে আলোচনার সময় কারফিউ না ভাঙার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। পার্টি বলেছিল, ‘সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিরস্ত্র জনগণের প্রত্যক্ষ লড়াই করার কোনো অর্থ হয় না।’
কিন্তু বস্তিবাসী জনগণ তা মানেনি। প্রচণ্ড ক্ষোভে ইপ্সিত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মিলিটারি-ইপিআর- পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে সংগ্রামের পথকে অবারিত করেছিল। ওই দিনগুলোর রক্তাক্ত স্মৃতি ধারণ করে আছেন, এমন কোনো ব্যক্তিই বোধকরি ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ প্রত্যয়টি থেকে সরে আসতে পারবেন না। ইতোমধ্যে বিগত প্রায় ৫৫ বছরে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে বহু পানি গড়িয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনের অর্জনকে জাতি ধরে রাখতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে, জাতীয় চার নেতা জেলখানায় নিহত হয়েছেন। পাকিস্তানি আমলের ধারায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসন ও হত্যা-ক্যুয়ের বেড়াজালে দেশ পড়েছে।
আবার সংগ্রাম আবারও আশির দশকের গণ-উত্থান। বিজয়-পরাজয়ের চড়াই-উতরাই পার হয়ে আমরা বর্তমানে রয়েছি। এখানে উল্লেখ্য, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-কর্ণফুলী দিয়ে যেমন বহু পানি গড়িয়ে গেছে, তেমনি গঙ্গা-ইয়াংসিকিয়ান-ভলগা-দানিয়ুব মিসিসিপি-নীল দিয়েও পানি গড়িয়ে গেছে সাত সমুদ্রে। আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়ন- এই দুই পরাশক্তির নেতৃত্বে দ্বিকেন্দ্রিক বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর খুব কম সময়ের জন্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল আমেরিকার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্ব। এখন বিশ্ব বহুকেন্দ্রে বিভক্ত হয়ে গেছে।
বর্তমান কালপর্বে বিশ্বব্যাপীই গণতন্ত্র, ন্যায়ভিত্তিক মানবিকতা যেন নির্বাসিত হতে যাচ্ছে। ক্রমেই জাতীয় ও ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব, ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোকে তাঁবে রাখার জন্য নানারূপী অগ্রাসন, লোভ-লালসার পরাক্রম, অর্থনৈতিক-সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতি বিশ্ব রাজনীতিকে গ্রাস করে চলেছে। জনগণ সব ক্ষমতার উৎস কথাটা কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক নানামুখী সংকটের মধ্যে শক্তিধর দেশগুলো ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা এখন রাখডাক বা লাজলজ্জার বালাই রাখছে না। আমেরিকা চাইছে বিশ্ব আধিপত্য ধরে রাখতে আর অন্যান্য শক্তি কেন্দ্রগুলো চাইছে যার যার দেশের প্রভাব বলয় বাড়াতে।
চীন ও রাশিয়া হালে আমেরিকার কর্তৃত্বকে ক্রমেই চ্যালেঞ্জ করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এরই পরিণতি। সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের ঘোষণায় ভারত, সৌদি আরব, আরব অমিরাত, জর্ডান, ইসরায়েল ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে রেল ও সমুদ্রপথে যোগাযোগের নেটওয়ার্ক যে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিপরীত তা বলার অপেক্ষা রাখে। সেংশনসহ এ সব প্রতিযোগিতা নতুনরূপে বিশ্বকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধ তো চলছেই। ওই সম্মেলনের যৌথ ঘোষণায় ‘বর্তমান যুগ যুদ্ধের যুগ হবে না’ বলার ভেতর দিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলো ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’ প্রবাদটি বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
বিশ্ব প্রেক্ষাপেটে ঘটতে থাকা এ সব থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারছি না। পারা যাবে বলে মনে করারও কোনো কারণ দেখি না। ‘রুশ-ভারতের দালালরা হত্যা কর জবাই কর’ কথাটা যেমন শোনা যায় না, তেমনি ‘বিপ্লব বিপ্লব সশস্ত্র বিপ্লব’ স্লোগানটাও শোনা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত জাতীয় চারনীতির একনীতি সমাজতন্ত্রও হয়ে গেছে যেন দূরের বাদ্য। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, জাতীয় চারনীতি আমাদের চারটি খুঁটি। যার ওপরে দেশ দাঁড়াবে। অর্থাৎ আমাদের পূর্বসূরিরা জাতীয় চারনীতিকে একসঙ্গে গেঁথেছিলেন। একটার বিপদ মানে সবটার বিপদ। এ কারণেই বোধকরি সাম্যের চেতনা যেমন, তেমনি জাতীয়তাবাদ- ধর্মনিরপেক্ষতা-গণতন্ত্রও আজ বিপদাপন্ন।
এই অবস্থায় জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে। গুরুত্বপূর্ণ এই দিক থেকে, সমাজজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে সাফল্য ও অর্জন কখনো সামগ্রিক হয় না। এক সমস্যা সমাধান করলে নিয়তির মতো আসে আরেক সমস্যা। কিন্তু নির্বাচনের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অর্জন ও সাফল্য যেমন সমাজের সব ক্ষেত্রকে, সব মানুষের জীবন ও জীবিকাকে উন্নত করে, তেমনি রাষ্ট্র ক্ষমতার বিফলতা- ব্যর্থতা সবৈবভাবে সবাইকে আঘাত করে। বিগত ১০ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান যথার্থভাবেই বলেছেন, ‘সারা দেশে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতির মাত্রা অনেক বেড়েছে।’ কোনো সরকারের আমলে যখন দুর্নীতি-দ্রব্যমূল্য বাড়ে তখন দল-মত নির্বিশেষে সবাইকেই আঘাত করে। আবার বিদ্যুৎপ্রাপ্তি, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, সামাজিক সুরক্ষা যখন বাড়ে তখন কেবল ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের কাছেই সুযোগ অবারিত হয় না, চরম বিরোধীও লাভবান হয়।
সার্বিক বিবেচনায় সরকারের অর্জন ও সাফল্য মানে জাতিরই অর্জন ও সাফল্য। এই অবস্থা আসছে সংসদ নির্বাচন। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসন অর্থাৎ সামরিক শাসনের মধ্যে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে আজ পর্যন্ত সব নির্বাচন সামনে রেখেই সরকার ও বিরোধী দলে টানাপড়েন যেমন হয়েছে, তেমনি বিদেশিদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাও লক্ষ্য করা গেছে। প্রতিবার নির্বাচনের আগে-পরে বিদেশিদের সঙ্গে টানাপড়েন বেড়ে যায়। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, কোভিড দুর্যোগ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভূ-রাজনৈতিক অধিপত্যের বিষয়টাও এবারে পর্বতপ্রমাণ হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু দেশের মাটিতে পা দিয়েই অস্থায়ী শাসনতান্ত্রিক আদেশ জারি করে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে এসে রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শুরু হয়ে যায় শাসনতন্ত্র রচনার কাজ এবং শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচন হয়। তাই কোনো দিক থেকেই বলা যাবে না, স্বাধীনতা উষালগ্নে সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচনে বিদেশের কোনো নাক গলানোর কাণ্ডকারখানা ছিল। এ সবই ছিল জাতীয় পছন্দ এবং জাতীয় অঙ্গীকার বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ। বাম-কমিউনিস্টরা এ সব প্রক্রিয়ায় অংশ নিলেও প্রথমদিকে দেশ সংসদীয় প্রক্রিয়ায় যাক, তা চাইছিল না। ন্যাপ (মোজাফফর) মুক্তিযুদ্ধের সময়ে উপদেষ্টা পরিষদের আদলে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেছিল।
সেটা ভালো হতো না মন্দ হতো সেই বিতর্কে না গিয়ে বলা যায়, আমাদের জাতির যাত্রা শুরু হয়েছিল কোনো বিদেশি শক্তি দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজস্ব জাতীয় ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও অঙ্গীকার অনুযায়ী। সরকার জনগণ সব ক্ষমতার উৎস বিবেচনায় নিয়ে দেশ পরিচালনা করছিল। তাতেই একাত্তরের পরাজিত দেশি-বিদেশি কায়েমি স্বার্থবাদীরা হত্যা-খুন-ক্যু-সামরিক শাসনের পথে পা বাড়িয়েছিল। খুনি মোস্তাকের শাসনামলে সময়কাল খুবই সংক্ষিপ্ত। ওই আমলে নির্বাচন কোনো ইস্যু ছিল না। নিতান্ত অন্ধ না হলেই দেখা যাবে, পশ্চিমা দাতা দেশ ও সংস্থার চাপে বিশেষত ‘মুক্ত দুনিয়ার’ প্রবক্তা আমেরিকার প্রশ্রয়েই সেনাশাসক জিয়া সামরিক শাসনের মধ্যে ‘হুকুমের’ হাঁ-না ভোট, সংসদ নির্বাচন ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করেন। ভোট কীভাবে হলো, কতটা ভোট পড়ল, তাতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কতটুকু কি হলো, তা নিয়ে ‘মুক্ত দুনিয়ার’ কোনো মাথাব্যাথা ছিল না। দরকার ছিল ভোটের সরকার।
সেনাশাসক এরশাদ আমলে ‘মুক্ত দুনিয়ার’ সেই চাপ আরও বাড়ে এবং প্রহসনের সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একথায় ওই দুই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। তখন ‘মুক্ত দুনিয়া’ ছিল সামরিক শাসনের পক্ষে। নব্বইয়ের গণউত্থানের ভেতর দিয়ে আবারও গণমনে আশা জাগ্রত হয়। কিন্তু প্রথমে মাগুরা উপনির্বাচন আর পরে ’৯৬ ফেব্রুয়ারির একদলীয় নির্বাচনের ভেতর দিয়ে নব্বইয়ের গণউত্থানের চেতনা পদদলিত হয়। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ভোট সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়।
২০০১ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। ওই নির্বাচনে শা-ল-সা সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় একটি পেরেক পুঁতে দেয়। ২০০৬ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাতে ওই ব্যবস্থায় শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে যায়। ওই বছর নির্বাচন হতে পারে নাই এবং জরুরি আইনের শাসন আসে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ফলেই। ওই শাসনামলে দুই নেত্রীকে মাইনাস এবং ড. ইউনুসকে দিয়ে কিংস পার্টি গঠন করে দেশ চালানোর পেছনে যে বিদেশিদের বড্ড বেশি নাক গলানো ছিল, তা তো দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট।
অভিজ্ঞতা থেকে এটা তো আজ সুস্পষ্ট, যে কোনো দেশের রাজনীতিতে একবার যদি শক্তিধররা নাক গলানোর সুযোগ পায় কিংবা সুযোগ দেওয়া হয়, তবে তা কাঁঠালের আঠার মতো হয়ে যায়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ যখন কূটনীতির প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন তা হয়েছে অক্টোপাস; তা জীবন্ত ও ক্রিয়াশীল। এ যেন বিধিলিপির মতো অখণ্ডনীয়। ভাবতে অবাক লাগে, আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়া নাক গলাচ্ছে, এমন অভিযোগও আমাদের শুনতে হয়েছে। বড়রাই যদি বড়দের মধ্যে নাক গলায়, তবে আমাদের মতো ছোট দেশগুলো তো এখন নস্যি!
উপমহাদেশের দেশগুলোর দিকে তাকালে নস্যি হওয়ার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। পাকিস্তানে ক্ষমতার পরিবর্তনসহ রাজনৈতিক ঘটনাবলি পরিবর্তন হলে বলা হচ্ছে, ইমরানকে সরিয়েছে আমেরিকা আর সেনাবাহিনী আমেরিকার পক্ষে। এত ঘটনা ঘটলেও সে দেশের গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকার নিয়ে আমেরিকারা কার্যত নীরব। শ্রীলঙ্কা সংকটের সময় বলা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ ‘রাজাপাকসে ভ্রাতৃদ্বয়ের আনুকূল্যে চীনের অধিপত্য বেড়েই চলছে।’ এখন শ্রীলঙ্কা ভারসাম্যের নীতি নিয়ে চলছে। মূলত আইএফএমের ঋণে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তবে সেখানকার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চীন ও ভারতের টানাপড়েন লক্ষণীয়।
অটল হিমালয়ের দেশ নেপালের রাজনীতি রয়েছে চরম টানাপড়েনের মধ্যে। কেউ কেউ বলেন ভঙ্গুর। দুই চীনপন্থি মাওবাদী দলের নেতা পুষ্প কমল দাহাল প্রচণ্ড ও খড়্গ প্রসাদ ওলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ২০২২ সালে সরকার গঠন করে। চীন প্রভাবিত এই দুই নেতা সিদ্ধান্ত নেয়, প্রথমে প্রচণ্ড আড়াই বছর এবং পরে ওলি আড়াই বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। আড়াই বছর সামনে রেখে ঐক্য ভেঙে যায়। প্রচণ্ডই প্রধানমন্ত্রী থেকে যান এবং তাঁর সমর্থনে নেপালি কংগ্রেস নেতা রামচন্দ্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রচারিত হচ্ছে, নেপাল এখন ভারতের দিকে ঝুঁকছে।
ভুটান চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মিটাতে চাইছে। এদিকে প্রচার হচ্ছে, সীমান্ত সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে ভারত ফ্যাক্টর। মালদ্বীপ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মোহামেদ সালিহ ভোট কম এবং বিরোধী প্রার্থী মোহাম্মদ মুইজুর বেশি ভোট পেয়েছে। শতকরা ৫০ ভাগ ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফা নির্বাচন হবে। এখন প্রচার হচ্ছে ‘চীনপন্থি নেতা মুইজুর উত্থান, ভারতের জন্য উদ্বেগের।’ মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন জান্তার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক কারোরই অজানা নয়। পর্যবেক্ষণে ধারণা করা যায়, ওই সরকার ভারতকেও ভারসাম্যের মধ্যে রাখছে।
এই অবস্থায় প্রশ্ন হলো- আমাদের দেশের ক্ষমতার রাজনীতি তথা আসন্ন ভোটে যে বিদেশিরা নাক গলিয়ে আছে, তা থেকে আমরা উদ্ধার পেয়ে জাতি জন্মের উৎসমুখে কি যেতে পারব? নিঃসন্দেহে জনগণ চাইবে উৎসমুখে ফিরে যেতে। নাক গলানো বন্ধ করতে। রাজনীতিতে একটা কথা রয়েছে, এখনই যদি বৃত্ত ভাঙা না যায়, তবে বৃত্তের মধ্যে থেকেই বৃত্ত ভেঙে বের হওয়ার পথ খুঁজতে হবে। মুখে কিংবা লেখায় আমরা অনেকে অনেক কথা বলতে পারি। কিন্তু কাজের কথাটা কি? এটা বোধকরি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। এই প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখেই দেশ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে। তবে দেশবাসী চাইবে নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করুক এবং নির্বাচন অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ হোক। জনগণই হোক সব ক্ষমতার উৎস।
লেখক: রাজনীতিক ও কলামিস্ট
এই লেখাটি কোনো একাডেমিক বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পন্ডিতি মানদন্ডে লেখা রচনা নয়, মুক্তিযুদ্ধের মাঠ থেকে শুরু করে চোখে দেখা অর্ধ শতকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অজস্র ঘটনাবলির আলোকে একটি ব্যক্তিগত উপলব্ধি মাত্র। এতে যৎসামান্য ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে উঠে এলেও আত্ম উপলব্ধির বয়ানে সৎ থাকার চেষ্টা করেছি। আমি জানি আমার এই ব্যক্তিক উপলব্ধি হয়তো সকলের কাছে সমানভাবে গ্রহনযোগ্য হবেনা। যদি হয় আনন্দিত হব।
এই রচনার বিষয়বস্তু শেখ হাসিনার সংগ্রাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্যা শেখ হাসিনার সংগ্রাম বিদেশের মাটিতে প্রায় ছয় বছর নির্বাসন শেষে যিনি স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে, এবং সেদিন থেকেই জড়িয়ে পড়েন অন্তহীন রাজনীতির সংগ্রামে । জাতীয় স্বাধীনতার রণাঙ্গনে যুদ্ধাস্ত্রের সঙ্গে কলম ও ক্যামেরা আমার সঙ্গি হয়েছিল। হয়তোবা সে কারণেই দেশ স্বাধীনের পরক্ষণে পেশাদারি সাংবাদিকতায় প্রবেশ করি। সেই সুবাদে সুযোগ ঘটে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তেজগাঁও বিমান বন্দরে উপস্থিত থেকে সেদিনের নবীন সংবাদকর্মি হিসেবে বন্ধুবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর লেখার। স্পষ্ট মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তণের প্রায় বছর দশেক পর তাঁরই কণ্যা যেদিন ঢাকার মাটিতে পা রাখলেন, সেদিন উদ্বেলিত লাখো মানুষ তাদের হৃদয়ের সবটুকু আবেগ দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তকে। গণমানুষের সেই আবেগের মধ্যে ছিল অনেক স্বপ্নভঙ্গের পর নতুন এক স্বপ্নদেখা, নতুন আশায় বুক বাঁধা।
গণমানুষের সেই স্বপ্নভঙ্গ এবং প্রত্যাশার প্রেক্ষাপট কারও অজানা নয় । কেবল দলীয় নেতাকর্মি নন, বঙ্গবন্ধু বিহীন বাংলাদেশে তাঁরই কণ্যাকে স্বাগত জানাতে সেদিন বিমানবন্দরে জড়ো হয়েছিল সর্বস্তরের লাখো মানুষ ; যে মানুষ জাতির পিতার ধমনী বহনকারীকে স্বাগত জানিয়েছে পরিপূর্ণ আবেগ ও ভালোবাসায় ; যে মানুষ জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার চায়, যে মানুষ সেনাপতি শাসন থেকে মুক্তি চায়, যে মানুষ মনেপ্রাণে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পুন:প্রতিষ্ঠা চায়, ফিরে পেতে চায় লাখো শহীদের বাংলাদেশকে।
১৯৭৫ সালে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের হাতে প্রায় স্বপরিবারে নিহত হলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক। ঘুরিয়ে দেওয়া হল সদ্য-স্বাধীন দেশের স্বাভাবিক ইতিহাসের চাঁকা। শুধুমাত্র দেশের বাইরে অবস্থানের কারণেই বেঁচে থাকলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা। ভয়াবহ সে হত্যাকান্ড জাতিকে স্থম্ভিত এবং চরম হতাসায় নিমজ্জিত করে । সেই সুযোগে সেনাপতি শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধের রক্তরঞ্জিত স্বদেশকে ক্ষতবিক্ষত করে চলে ; গুড়িয়ে চলে পাকিস্তানি স্বৈশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির দীর্ঘ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক একটি স্তম্ভ। যে আওয়ামি লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাকে রাষ্ট্রীয় কূটকৌশলে ছিন্নভিন্ন করার প্রচেষ্টা চালায় সামরিক শাসক। চারদিকে এক সর্বগ্রাসী হতাসা তখন, শুধুই প্রশ্ন : বাংলাদেশ কি মুক্তি পাবে ভয়ংকর এই মহাপ্রলয় থেকে ? আছেন কি কোনো ত্রাতা, যিঁনি হাল ধরবেন ঝড়ের উত্তাল সাগরে?
অতএব বঙ্গবন্ধু কণ্যার রাজনীতি অধিষ্ঠানের মধ্যে বহু প্রার্থীত এক জাতীয় নবজাগরণ আছে, রাষ্ট্রের নব অভিযাত্রা আছে, যার ধারাবহিকতায় জাতীয় স্বাধীনতার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের প্রধান সেনাপতি হিসেবে আবির্ভূত হলেন শেখ হাসিনা। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধু কণ্যার স্বদেশে ফিরে আসা বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে নতুন যুগের সূচনা করে ।
ইতিহাসের আর্শিবাদ
স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশি মহলের যোগসাঁজসে রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যা করে বাংলাদেশকে যেভাবে অকেজোÑঅর্থহীন করার চেষ্টা হয়েছিল, যে প্রক্রিয়ায় সদ্যÑস্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাভাবিক যাত্রাপথ রুদ্ধ করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পরাজিত শত্রু ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে যেভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল,বলা বাহুল্য, শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই ভয়ংকর অশুভ ধারার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি সঞ্চয় করে সামরিক ও নবজাগরিত সাম্প্রদায়িক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে । ইতিহাসের সত্য এই যে, বঙ্গবন্ধুর এই জ্যেষ্ঠ কণ্যা জাতির লুণ্ঠিত গৌরব পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অধিনায়কত্ব দান করেছেন যা তাঁর ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সাফল্য।
সে কারণেই তাঁর রাজনীতিতে আসা এক আশির্বাদ, এবং একই সঙ্গে প্রতিপক্ষের জন্যে অভিসাপও। ধানমন্ডীর ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়ে চাঁপ চাঁপ রক্তের দূ:সহ চিহৃ দেখতে হয়েছে তাঁকে বুকভাঙা কান্নায়। অথচ তাঁর শোক করার সময় নেই! সময়ের কষাঘাত বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে তাঁকে ; শোক ও রোদনকে পরিণত করতে হয় শক্তিতে। না, তিনি রোদন করতে আসেননি, এসেছেন বদ্ধ ইতিহাসের দুয়ার খুলে প্রিয় জন্মভূমিকে রাহুমুক্ত করতে; জাতির পিতার স্বপ্নের, মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের রক্তের বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করতে। সে এক সুবিশাল চ্যালেঞ্জ; ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই যা তাঁরই হাতে সমর্পিত। অতএব পিতা,মাতা, ভাই ও ভাতৃবঁধুদের স্মৃতিতে শোক করার সময় কই !
ইতিহাস সাক্ষ দেয়, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটিকে আঘাতের পর আঘাতে জর্জরিত করা হয়েছিল; ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে, বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে। সেই দুর্দিনে দেশের বাইরে অবস্থান করেও আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলেন শেখ হাসিনা। অবিন্যস্থ দলকে সংগঠিত করা যেমন গুরু দায়িত্ব, তেমনি অসীম গুরুত্ববাহী কাজ ঘাতক ব্যষ্টিত শাসককূলের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করা, বিদ্ধস্থ বাংলাদেশকে জাগিয়ে তোলা এবং লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে স্বমহীমায় পুন:প্রতিষ্ঠা করা।
বলা বাহুল্য সেদিনের সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ ছিলো না। মৃত্যুকে বারবার তুচ্ছজ্ঞান করেও শেখ হাসিনা তাঁর অভীষ্ঠ দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন ; ঘাতকের বারংবারের হুমকিÑ আক্রমনেও পিছিয়ে আসেন নি, পথভ্রষ্ঠ হননি; হলে, অধ:পতনের গহবর থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ফিরে পাওয়া সহজ হতোনা ।
রাহুমক্তির পালা
এক মহাদুর্দিনে দিকভ্রান্ত স্বদেশের হাল ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের হাতে জাতির জনকের হত্যাকান্ডের পর যে তমসা রাষ্ট্রকে গহীন কালোয় আচ্ছাদিত করে, সেই তমসা তাড়াতে প্রথম আলোর মশাল জ্বালেন তিনি। সে মশাল, প্রাথমিক সংকটÑসীমাবদ্ধতার পরেও, দিকে দিকে আলোকিত করতে থাকে, শুরু হয় রাহুমুক্তির পালা। সব আবর্জনা দূর করতে নববর্ষের প্রভাতে যেমন বাঙালি একাকার হয়, নব প্রতিশ্রুতিতে সমৃদ্ধ হয়, তেমনি এক শুভ প্রতিশ্রুতির বাতাস বইতে দেখি তাঁর রাজনৈতিক অভিযাত্রায়।
আমার বিবেচনায় শেখ হাসিনার শাসনামলে মোড় ঘুড়ানো অর্জনের মৌলিক স্তরগুলিকে মূলত চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার সংগ্রামে তাঁর সাফল্য। দ্বিতীয়ত, সামরিক ও আধাসামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সফলতা। তৃতীয়ত, জাতির জনকের হত্যাকারী ও মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্তদের আইনের হাতে সোপার্দ করা। এবং চতুর্থত, অর্থনৈতিক ভাবে বাংলাদেশকে প্রগতির সড়কে আনা।
বলা বাহুল্য, এই একেকটি স্তরের সাফল্য আনতে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা অনেক ক্ষেত্রে কঠোর হয়েছেন, কৌশলি হয়েছেন, সামালোচিতও হয়েছেন ; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের পুনর্জাগরিত মঞ্চ গুড়িয়ে দিতে এবং জাতীয় স্বাধীনতার রক্তরঞ্জিত ইতিহাসের প্রতি দৃঢ়চিত্ত অবস্থান থেকে একটিবারের জন্যেও তিনি বিচ্যুত হননি। লক্ষ্যে পৌঁছতে তিনি ছিলেন অবিচল যদিও কিছু পথ ও পদ্ধতির সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন।
বিলক্ষণ জানতেন তিনি, পথচ্যুত বাংলাদেশকে প্রার্থীত রাজণীতিধারায় ফিরিয়ে নিতে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে স্বমহিমায় পুন:প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই জয়বাংলার পুনরাভিযানের, জাতির জনকের হত্যাকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের পাকিস্তানপন্থি ঘাতক যুদ্ধারাধীদের বিচারের । অতএব দেশে ফেরার প্রথম দিন থেকে লক্ষ্য নির্ধারণে ভুল করেন নি তিনি। সে যাত্রাপথ, যতো কণ্টককীর্ণই হোক না কেন, লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছেন তিনি বলা যাবে না একেবারে। প্রথমত সামরিক স্বৈরশাসনের আঘাতে জর্জরিত দলকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন তিনি, সংকটব্যর্থতা ও সাফল্যের সিড়ি বেয়ে সামনে পা বাড়ান। কিন্তু সবকিছুর ছাপিয়ে ওঠে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবী ইতিহাস Ñ যা লুণ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৫ এর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। অতএব, ব্যক্তি বা পারিবারিক ট্রেজেডির বাইরে, জাতীয় ট্রেজেডি মুচনের কারণেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করতে হয়েছে তাঁকে। এই বিচার কেবল জাতীয় কলংককেই মুছে দেয়নি, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র দৃঢ়চিত্ত হয়েছে,সামনে এগুবার সাহস পেয়েছে।
রাজনীতিতে তাঁর অধিষ্ঠান ঘটে জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে যখন মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক শিরোমনি পলাতক গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়,পরীক্ষিত স্বাধীনতা বিরোধীদের পরিকল্পিত ভাবে পুনর্বাসন করা হয়। এরপর ক্ষমতায় বসেন আরেক জেনারেল, হুসেন মুহম্মদ এরশাদ, যিনি তার পূর্বসূরীর পথ ধরেই রাষ্ট্রকে মৌল ইতিহাসধারা থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। এই দুই জেনারেল পালাক্রমে বঙ্গবন্ধুর ঘাতক ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দেন, পুনর্বাসন করেন এবং সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দান করেন। এ সময়, বিশেষত ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসন বিরোধী গণআন্দোলনের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের মনোজগতে এক নীরব বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে, তারা জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাস খুঁজতে চেষ্টা করে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সরব হয়।
কিন্তু ১৯৯১ এর নির্বাচনে শেখ হাসিনার সম্ভাব্য রাষ্ট্রক্ষমতার আরোহকে ঠেকানো হয়, যা তাঁকে পিছিয়ে দেয়। আরও পাঁচ বছর পর, ১৯৯৬ সালে, প্রথমবার রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে ঝড়ের নদীতে নৌকার পাল ধরেন তিনি। দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে। চারদিকে তখন শকুনীদের থাবা। প্রশাসন সহ রাষ্ট্রজীবনের সকল স্তরে বসা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা যে করেই হোক নতুন সরকারকে ব্যর্থ করতে বদ্ধ পরিকর। সে এক সুবিশাল চ্যালেঞ্জ শেখ হাসিনার।
এরই মধ্যে, অনেকটা আকস্মিক ভাবে, জাতীয় সংবাদ সংস্থা অর্থাৎ বাসস-এর হাল ধরতে হলো আমাকে, শুনেছি তাঁরই নির্বাচনে। সংস্থাটিতে তখন পাহাড় সমান সংকট। প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে প্রথম দেখা করতে গেছি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তিনি স্বাগত জানালেন, মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি সংকট বৃত্তান্ত শুনলেন এবং সংস্থায় বাংলা সার্ভিস প্রবর্তণসহ বাসসকে আধুনিকায়নের পথে এগিয়ে নিতে সব পদক্ষেপ নিতে বললেন। তাঁরই প্রতিশ্রুতির ফলে জাতীয় সংবাদ সংস্থার নবগঠিত বাংলা সার্ভিস গতি লাভ করল,যুগপ্রাচীন টেলিপ্রিণ্টার পরিবর্তন হয়ে কম্পিউটার বসল। বহুবিধ বিদেশি বার্তা ও ফিচার সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করা গেল। শেখ হাসিনা অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখলেন।
কিন্তু সংস্থায় আদর্শিক প্রতিপক্ষরা ছিলেন সংগঠিত এবং শক্ত যোগাযোগ সম্পন্ন। অতএব তারা একের পর এক আঘাত হানলেন। সে আঘাত ঠেকাতে শক্ত ভূমিকা নেওয়া ছাড়া উপায় রইলনা আমার। এরই মধ্যে আমার নিয়োগ চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে মামলা করে বসলেন তারা। জাঁদরেল ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ তাঁদের উকিল। সরকার বিরোধী পত্রিকাগুলি সে খবর ছেপে তাদের উৎসাহিত করল। রীটে দাবি করা হল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুড়ো প্রবীনদের বাদ দিয়ে তরুণ একজনকে নিয়োগ দিয়ে আইন ও রীতি ভেঙ্গেছেন। আগে কখনোই আমি মামলামোকাদ্দমায় পড়িনি। সে এক বড় বিরম্বনা ব্যক্তি জীবনের। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অতএব ছুটলাম শ্রদ্ধেয় ব্যারিষ্টার আমীর উল ইসলাম ও ব্যারিষ্টার তানীয়া আমীরের কাছে। গিয়ে শুনলাম, নেত্রী আগেই কথা বলেছেন যাতে আমার পক্ষে মামলাটি তাঁরা হাতে নেন। সেই মামলা চলেছে সাত বছর।
বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০১ সালের নির্বাচনে সুপরিকল্পিত ভাবে হারানো হল আওয়ামী লীগকে। আনা হল বিএনপি জামাতের জোটকে। নির্বাচনে হেরে শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেত্রী হলেন। সরকারের সিদ্ধান্তে বছরের পর বছর আমার বেতনভাতা বন্ধ থাকল। চাকুরিচ্যুতও করা হল। কিন্তু সংস্থার আইনে আমার নিয়োগটি মোটেও অবৈধ ছিলোনা বলে শেষ পর্যন্ত মাননীয় হাই কোর্ট এবং পরবর্তিতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে আমি বিজয়ী হলাম। কিন্তু আর ফেরা হলো না আমার কর্মস্থলে ।
যুদ্ধাপরাধ বিচার ও শেখ হাসিনার দৃঢ়তা
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে বাংলাদেশের মাটিতে যে নির্বিচার নৃসংশতা ঘটে তা ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তিকালে বিশে^র পঞ্চম বৃহতম গণহত্যা। এর শিকার হয়েছে ৩০ লক্ষ বাঙালি। নির্যাতিত হয়েছে কয়েক লক্ষ নারী। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত নির্বিচারে জ¦ালানো হয়েছে ঘরবাড়ি। ফলে ১ কোটি মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ফেলে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে হয়েছে, কাটাতে হয়েছে প্রায় এক বছরের শরণার্থী জীবন।
সে কারণে ন্যায় বিচারের স্বার্থে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় ঘাতক অনুচরদের বিচারের প্রশ্নটি ছিল মানব সভ্যতার দাবি, একই সঙ্গে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি। কিন্তু ১৯৭১ পরবর্তি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সেই খুনি ও ধর্ষকদের আইনের হাতে সোপার্দ করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ফলে বাংলাদেশ যে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী চিহিৃত করে, তারা সহ ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি দেশে ফিরে যায়। এদিকে আইন করে বন্ধ করা হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার। দালাল আইনের আওতায় বিচারাধীন, এমন কি দন্ডিত অপরাধীদেরও জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সেই থেকে দেশে চলতে থাকে বিচারহীনতার এক সংস্কৃতি। একদিকে নির্বিচার গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের কোনো বিচার হয়না, অন্যদিকে বিচার বন্ধ থাকে জাতির পিতার হত্যাকারীদের। অথচ অপরাধের বিচার না হলে মানুষের অপরাধবোধ জেগে ওঠে, সমাজ কুলষিত হয়, সভ্যতা বিপন্ন হয়।
কিন্তু শেখ হাসিনার দৃঢ়চিত্ত নেতৃত্ব বিচারহীনতার অমানবিক সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলে। তিন দশকেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার সম্পন্ন করা ছিল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মানদন্ডে এক বড় দৃষ্টান্ত, যা জাতিকে দায়মুক্তি দিয়েছে, কলংক থেকে মুক্তি দিয়েছে। শেখ হাসিনার সাহসী ও দৃঢ় প্রত্যয়ী নেতৃত্বে জাতির পিতার ঘৃন্য ঘাতকেরা কৃত অপরাধের দায়ে দন্ডিত হয়েছে, যা সমকালীন বাস্তবতায় সাধারণ কাজ ছিলো না। অন্যদিকে, দেশীয় আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়াটি তিনি কেবল শুরু করেন নি, দেশিবিদেশি চাঁপ ও ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত জাল উপেক্ষা করে এগিয়ে নিয়েছেন সাহস ও বিচক্ষণতায়। এই দুটি কাজ, যা অভাবিত ভাবা হতো একসময়, বাঙালি জাতিকে দৃঢ়চিত্ত করেছে, বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে ; একই সঙ্গে জাতীয় স্বাধীনতার লাখো শহীদ ও লাখো বীর সৈনিকদের আত্মাকে সম্মানীত করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর একটি বড় মনস্থাত্তিক সংকট সমাজকে পর্যুদস্থ করতে থাকে। সে সংকট ছিল অসহায়ত্বের, কিছু করতে না পারার। ১৯৮০ দশকের শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আদর্শিক চেতনা পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মনস্তাত্তিক পূণ:জাগরণ লক্ষ্য করা যায়। দীর্ঘকালীন বিচারহীনতা, সামরিক শাসন ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পালাক্রমিক আধিপত্য এই পূণ:জাগরণকে বেগবান করে। ইতিহাস যেন নিজের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে তার সত্যকে আবিস্কার করে। এরই ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবি সোচ্চার হতে থাকে। মোড় ঘুরানো এই পুনর্জাগরণে মূখ্য রাজনৈতিক ভূমিকা রাখেন বঙ্গবন্ধুর কণ্যা। আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার সুষ্পষ্ট অঙ্গিকার আসে । লক্ষণীয়, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে সাংবিধানিক ও আইনগত ভিত্তি দিয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনি রায়, ঠিক একই ভাবে যুদ্ধাপরাধের যুগান্তকরি বিচার শুরু করার পেছনে ভিত্তি জুগিয়েছে আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের রায় Ñ যা অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের শেষ প্রান্তে। সে নির্বাচনে নতুন প্রজন্মের ভোটদাতারা বিপুলভাবে রায় প্রদান করে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের পক্ষে।
নির্বাচনে বিপূলভাবে বিজয়ী হওয়ার পর ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস করা হয়। এরপর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পর, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্তদের বিচারের জন্য গঠন করা হয় ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনারের আওতায় আসে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা, ধর্ষণ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ Ñ যা সারাবিশে^ই আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর, বিশেষ করে মূল অভিযুক্তরা যখন রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক ভাবে সবল ও শক্ত যোগাযোগ সম্পন্ন, তখন তাদের বিরুদ্ধে এমন একটি বিচারিক উদ্যোগ, বলা বাহুল্য, সাধারণ কোনো উদ্যোগ ছিলোনা। বরং তা ছিল বহুলাংশেই এক নতুন মুক্তিযুদ্ধ। অনস্বীকার্য, শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়াটি প্রবল জনসমর্থনে সিক্ত হলেও এর বিরুদ্ধে দেশ ও বিদেশে সমালোচনার সৃষ্টি করা হয়। অভিযুক্তরা বিপূল অর্থ বিনিয়োগ করে ‘লবিষ্ট’ নিয়োগ করে। ফলে নানা দেশে বিচার প্রক্রিয়াটি সমালোচনার মুখে পড়ে। পাকিস্তান প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দেশটি সরকারি ভাবেই কেবল বিচারের বিরোধীতা করেনা, তাদের ন্যাশনাল এসেম্লিতে, সকল আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ভেঙ্গে, বিচারের বিরুদ্ধে প্রস্থাব গ্রহন করা হয়। অন্যদিকে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করতে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক সমর্থক দলগুলি সহিংস পথ অবলম্বন করে। কিন্তু শেখ হাসিনার সুদৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অটল থাকে। ফলে সব চাঁপ উপেক্ষা করে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সামনে এগিয়ে যায়। অনেকেই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে কী অসামান্য সাহসী ভূমিকা গ্রহন করেছিলেন জাতির পিতার এই সাহসী কণ্যা !
১৯৯২ সালে রাজাকার শিরোমনি পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে জামাতের আমীর ঘোষণা করা হলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতকÑদালাল নির্মূল কমিটি। এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে যে ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়, তার মূল রাজনৈতিক শক্তি ছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁরই প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় সমন্বয় কমিটিতে আওয়ামী লীগ থেকে যুক্ত হন জনাব আব্দুর রাজ্জাক এবং জাসদ থেকে কাজী আরেফ আহমেদ। খালেদা জিয়ার শাসনামলে ঢাকার সোহরাওয়ার্দি বসে ঐতিহাসিক গণআদালত। প্রতীকি সে আদালতে লাখো মানুষের সমর্থণে গোলাম আযমের অপরাধকে মৃত্যুদন্ডতুল্য বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার সরকার নির্মম দমনপীড়ন শুরু করে, ২৪ জন বরেণ্য জাতীয় ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রজু করে। সে পরিস্থিতিতেও দৃঢ়চিত্ত ভূমিকা রাখেন শেখ হাসিনা।
১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে জাতীয় সংসদে তিনি যে বক্তব্য রাখেন, তার কিয়দংশ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। শেখ হাসিনা বলেন, “---- গণআদালত যে রায় দিয়েছে তাতে তারা কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি, মাননীয় স্পীকার। যেহেতু তারা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি সেহেতু নিশ্চয়ই তাদেরকে বেআইনি বলার কোনো অধিকার নেই, কোনো অবকাশ নেই। এই যুদ্ধাপরাধীর (গোলাম আযমের) অপরাধগুলি (গণআদালতের রায়ের কাগজি দেখিয়ে) লিপিবদ্ধ আছে এবং এই সকল অপরাধে যিনি অপরাধী তার শাস্তি মৃত্যুদন্ডতুল্য।--- তাই আমার আবেদন মাননীয় স্পীকার, এখনো সময় আছে দলমত নির্বিশেষে সবকিছুর উর্দ্ধে উঠে আসুন,যেভাবে একমত হয়ে আমরা একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী পাস করেছি,আসুন সেভাবে কাজ করি। যারা স্বজন হারিয়েছেন,স্বজন হারানোর ব্যাথায় যাদের হৃদয় এখনো ব্যথিত, আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেই।”
গণআদালতের রায়কে সমর্থন জানিয়ে তিনি আরও বলেন,--“এই মহান সংসদের অধিকার রয়েছে। জাতি সেই অধিকার দিয়েছে। এই সংসদ সার্বভৌম সংসদ। সেই লক্ষ্যে Ñ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচারণ, যুদ্ধ ও গণহত্যাসহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সাধন,বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের সাথে জড়িত থেকে বাংলাদেশের বিরোধীতা,বিদেশি নাগরিক হওয়া সত্বেও ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ জনগনের যে মতামত প্রতিফলিত হয়েছে, তাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ আন্তর্জাতিক ক্রাইমস এ্যক্ট ১৯৭৩ অনুসারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, তার বিরুদ্ধে আনিত অপরাধ সমূহ বিচারের জন্য, আইনগত পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য আমি আপনার মাধ্যমে এই সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে জনগণের ঐ মতামত প্রতিফলনকারী গণআদালতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে জারীকৃত অসম্মানজনক মামলা দায়ের করার জন্য দু:খ প্রকাশ করে ঐ মামলা প্রত্যাহার করার জন্য আমি আপনার মাধ্যমে সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।”
জাতীয় সংসদে সেদিন দীর্ঘ বিতর্ক চলে গণআদালতের রায় নিয়ে। খালেদা জিয়ার সরকার বাধ্য হয়ে ২৯ জুল ১৯৯২ বিরোধী দলের সঙ্গে ৪Ñদফার চুক্তি স্বাক্ষর করে। সে চুক্তিতে গোলাম আযমের বিচার ও গণআদালতের উদ্য্যোক্তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের কথা ছিল। কিন্তু সে চুক্তির বাস্তবায়ন করেনি সেদিনের সরকার!
মোটকথা, ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ এর ঘাতকদের বিচারের দাবি ছিল সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম,মনুষত্বের সংগ্রাম। এ সংগ্রাম ছিল সভ্যতার বোধ সৃষ্টি ও তাকে সুরক্ষা দেওয়ার সংগ্রাম, যাকে সাহস ও দৃঢ়তায় সম্পন্ন করার বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা।
স্মরণযোগ্য, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যে ‘ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল’ ও ‘টোকিও ট্রায়াল’ বসে, তারও মূল দাবি ছিল সভ্যতার বোধ সৃষ্টি করা। সেই বিচারে মিত্র পক্ষের প্রধান আইনজীবী জাস্টিস জ্যাকসনের ভাষ্য ছিল এ রকম: ‘মানব জাতিকে যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রয়োজন। এই বিচার না হলে সমাজে সভ্যতার বোধ প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা।’ অন্যদিকে গণহত্যার মতো সুপরিকল্পিত ব্যাপক হত্যাকান্ডগুলির বিচার না করা গেলে তা আবারও ফিরে আসে । যেমন দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে ইউরোপের মাটিতে নাজি বাহিনীর বর্বরতার নৃসংসতা মাত্র কয়েক যুগের মাথায় বাংলাদেশ, রুয়ান্ডা,বসনিয়া-হারজেগোভিনা ও কম্বোডিয়াসহ নানা দেশে ফিরে এসেছে।
অনস্বীকার্য, সব দেশেই যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানবতার লড়াই, সভ্যতার লড়াই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরও আছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই, ইতিহাসের লড়াই এবং বাঙালি জীবনের আদর্শিক ভিত্তির লড়াই ও ভবিষ্যত। সে লড়াইকে এগিয়ে নিয়েছে শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ।
উপসংহার
খুব বেশি দেখা বা কথা বলার সুযোগ হয়নি আমার শেখ হাসিনার সঙ্গে । লেখালেখির নিভৃত জীবনযাপনেই স্বাছন্দ আমার। তবে সাংবাদিকতার সুবাদে বার কয়েক দেখা হয়েছে । যতোবার হয়েছে, ততবারই দেখেছি তাঁকে সাবলিল, বঙ্গবন্ধুর পাওয়া মেজাজ ও অন্তরঙ্গতায় ভরা খাটি বাঙালি হিসেবে। এক দুবার নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের দিনে অভ্যাগতদের সঙ্গে প্রাণখোলা কথাবার্তা বলতে দেখেছি তাঁকে। এমনই খোলামেলা যে অনেকেই ভয় পেয়ে যান, বলতে থাকেন, এতোটা খোলামেলা হতে যান কেন তিনি ! কিন্তু শেখ হাসিনা কোনোকিছু লুকোবার চেষ্টা করেন Ñ এমনটা ভাবা ঠিক নয়। যা তিনি ভাবেন Ñ তাকে রাখঢাকের প্রয়োজন বোধ করেন না। এতেই তাঁর সাতন্ত্রতা।
শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি দেখিনে কেবল। প্রধানমন্ত্রী হন অনেকেই, হবেনও। তাঁকে দেখি আমি বাংলাদেশ রাষ্ট্র জনকের বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার একজন হিসেবে, যিঁনি রাষ্ট্রকে তার ছিনতাইকৃত গৌরব ফিরিয়ে দেয়ার মহাসমরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭৫ এর রক্তপাতের পর যে ভয়ংকর স্বদেশ, জেগে ওঠা যে ‘নব্য পাকিস্তান’(!), তারই বিপরীতে বাঙালির রাষ্ট্রকে আজকের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার যে সাহসী ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব তারই সর্বাধিনায়কের নাম শেখ হাসিনা।
আমার বিশ্বাস, সামাজিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি একটি বড় রাজনৈতিক যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন তিনি। সে যুদ্ধ কতটা প্রয়োজনীয়, কতটা ভয়ংকর এবং কতটা ঝুঁকিপূর্ণ Ñ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কাজেই ভয়ংকর ঝুঁকি নিতে হয়েছে তাঁকে । ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের সুখ ও সাচ্ছন্দ পরিত্যাগ করতে হয়েছে । দৃঢ়চিত্তে মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রভাবশালী দেশিবিদেশি মহলের প্রতিরোধ ও প্রতিবন্ধকতা । সেই বিপদসঙ্কূল পথে সামনে এগুবার যে সাহস, এই যে দৃঢ়তা Ñ তার সবটাই দেখাতে পেরেছেন শেখ হাসিনা।
সকলেই জানি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে সরকরের রাজনৈতিক বিরোধীদের স্বাধীন ও উন্মুক্ত কার্যক্রম জরুরি। এ ছাড়া রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক, মানবিক ও আধুনিক হয়না। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য এই যে, পাঁচ দশক পরেও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিরোধীরা আজও সর্বাংশে স্বক্রিয়। গণতান্ত্রিক অধিকারের আবরণে এরা রাষ্ট্রের ইতিহাস ও মৌলিক চেতনার প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের আবির্ভূত করে ; রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিত্যনতুন যুদ্ধ চাঁপিয়ে পুরনো প্রভুর জয়গান করে! কাজেই যে বাংলাদেশ লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত তাকে সুরক্ষা দিতে হবে বৈকি।
অনেক অর্জনের পরেও বাংলাদেশ আজ এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি। অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধ পন্থিদের দীর্ঘ পালাক্রমিক শাসনের পরেও আজও কেন স্বক্রিয় Ñতা ভেবে দেখার দাবি রাখে বৈকি। অতএব আত্মতুষ্টির সুযোগ কম। দীর্ঘস্থায়ি সমরে জেতার প্রস্তুতি প্রয়োজন ; প্রয়োজন আদর্শিক যোদ্ধা তৈরির কৃতিত্ব। রাজনীতি কেবলই শ্লোগান সর্বস্য হয়ে উঠুক Ñ তা কাম্য হতে পারেনা। এই প্রক্রিয়া সাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম বটে, কিন্তু বৃহৎ আক্রমন প্রতিহত করার জন্যে সামর্থ হারায়। ভুলে গেলে চলবেনা, অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্বার প্রতিপক্ষরা প্রাথমিক ভাবে পরাস্থ হলেও তারা দীর্ঘস্থায়ি যুদ্ধে লিপ্ত। অতএব রাজনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে এগিয়ে নেয়ার বিকল্প নেই ; চাই বাঙালি জীবনের নবজাগৃতি।
১৯৮১ সাল থেকে দীর্ঘ পথযাত্রা শেখ হাসিনার। বাংলাদেশের চেহারা আজ সুষ্পষ্ট ভাবেই আলাদা। সে আজ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো সুবৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের সাফল্য অর্জিত হয়েছে দেশে , যা উদভাসিত করেছে জাতীয় আত্মশক্তির, আত্মমর্যাদার। আন্তর্জাতিক মানদন্ডে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের সিঁড়ি পেয়েছে। শেখ হাসিনার পালাক্রমিক রাষ্ট্রশাসনে রাষ্ট্র আজ উন্নয়ন ও প্রগতির মহাসড়কের যাত্রি। বলা বাহুল্য, এরপরেও বঙ্গবন্ধু কণ্যার কাছে জনপ্রত্যাশা অপরিসীম । প্রত্যাশার সীমা এতোটাই যে সকলেই যেন ভুলতে বসেন কী ভয়ংকর কূট পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্মকে ব্যর্থ করা চেষ্টা হয়েছিল ! কিন্তু শেখ হাসিনা ব্যর্থ হননি। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশকে তিনি নতুন জীবন দান করেছেন। প্রবল প্রতিকূলতা মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের লুণ্ঠিত ধারাকে তিনি ফিরিয়ে এনেছেন। এ এক অসামান্য কৃতিত্ব তাঁর।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক,মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় শামিল হয়েছি এবং আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিবাদী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেছি। আমাদের প্রত্যাশা কখনো কখনো আকাশ ছুঁয়েও যেতে পারে। এ কথা মানতে হবে, মানুষের চিন্তা, কল্পনা এবং প্রত্যাশার পেছনে যুক্তি থাকে আস্থা ও নির্ভরতার ভিত্তি থাকে। এই আস্থা ও ভিত্তি কল্পনার রাজ্যে বসবাস করে না। লড়াই, সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্যদিয়েই বাস্তব সত্যে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখেছি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর সংগ্রামী চেতনার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর অঙ্গুলি হেলনে পুরো জাতি তাদের কর্তব্য নির্ধারণে এক মুহূর্তও দেরি করেনি। তাঁরই নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ যখন সব ধ্বংস, বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত ঠিক তখনই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি এবং ক্ষমতালোভীচক্র দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যা শুধু ব্যক্তি মুজিবকে হত্যা নয়-মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং বাংলাদেশকে হত্যার শামিল। ক্ষমতা দখল করেই মোশতাক ও জিয়াচক্র সামরিক শাসন জারি করে, সংবিধানকে কেটে-ছিঁড়ে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বাংলাদেশকে পরিচালিত করার চক্রান্ত শুরু করে। সেই যে শুরু, মোশতাক-জিয়া-খালেদা জিয়া-এরশাদচক্র দীর্ঘ ২১ বছর এবং তারপর আরও সাত বছর একই প্রচেষ্টা ও প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, ইতিহাস, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি সংস্কৃতিকে ক্ষত-বিক্ষত করে ওই শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার জাঁতাকলে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছে আমাদের প্রিয় স্বদেশকে।
১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে প্রণীত দালাল আইন বাতিল করে সব যুদ্ধাপরাধীদের অভিযোগ থেকে মুক্তি এবং কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়। এই সময় বন্দুকের জোরে সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে বানানো হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের রক্ষার জন্য জারি করা হয় কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স। ৭ নভেম্বরে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করে মুজিবনগর সরকারের চার স্তম্ভ বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু সহযোদ্ধা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে। আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনের অধিকাংশ নেতা-কর্মীর জীবনে নেমে আসে জেল-জুলুম-হুলিয়া। নির্যাতন-নিপীড়নে প্রায় বিধ্বস্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। এই সময় জেনারেল জিয়া অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতায় থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। একদিকে স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে তিনি সংগঠিত করেন, অন্যদিকে অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে সুবিধাবাদী পরিচিত মুখদের জড়ো করেন। আবার ভয় দেখিয়ে বহু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকেও তার নয়া দলে যোগ দিতে বাধ্য করেন। স্বৈরশাসন চালিয়ে, ক্ষমতার সর্বশক্তি নিয়োগ করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে রাষ্ট্র এবং সমাজে তার কর্তৃত্ব স্থাপনের এই প্রক্রিয়ার সময়ে ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার হোটেল ইডেনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে দেশ এবং দলের সার্বিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করে দিল্লিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতভাবে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ, দেশে প্রত্যাবর্তনসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ঢাকা থেকে দিল্লিতে যান আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মালেক উকিল, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ আজাদ, ড. কামাল হোসেন, জোহরা তাজউদ্দীন, এম কোরবান আলী, সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আইভি রহমান প্রমুখ। পূর্ব থেকেই সেখানে ছিলেন ডা. এস এ মালেক। তখন ঠিক হয়, শেখ হাসিনা ১৭ কিংবা ২৬ মার্চ দেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু পরবর্তীতে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা এবং পুতুলের জলবসন্ত দেখা দেয়ায় শেখ হাসিনার ঢাকা আসা পিছিয়ে যায়।
অবশেষে ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর নির্ধারিত হয় ১৭ মে ১৯৮১ শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরবেন। সে এক উত্তেজনাকর আবেগময় ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে দেশে নিয়ে আসার জন্য দলের পক্ষ থেকে দিল্লি গেলেন আবদুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী। ১৬ মে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে দিল্লি থেকে কলকাতা এলেন শেখ হাসিনা, কন্যা পুতুল, আবদুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী। ১৭ মে বিকেলে ঢাকায় বিমান থেকে নামেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই প্রথম এলেন। পিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা, তিন ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই আর জীবিত নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুনিদের উন্মত্ততায় নিহত হয়েছেন তারা সবাই। ৩২ নম্বর সড়কের সেই বাড়িটি তখন মৃত্যুপুরী। জেনারেল জিয়ার সরকার বাড়িটিকে তালা মেরে পুরো বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খলিত করতে চেয়েছেন। সেদিন আকাশে ছিল মেঘ, ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। প্রকৃতি যেন শোকের চাদর গায়ে মলিন বদনে শেখ হাসিনার জন্য প্রতীক্ষা করছিল। বিমান থেকে নামার পর শুরু হলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি- যেন শেখ হাসিনার অশ্রু জল হয়ে ভরিয়ে দিল বাংলার প্রতিটি প্রান্তর। লাখ লাখ বঙ্গবন্ধুপ্রেমীর স্লোগানের মধ্যে তিনি খুঁজে ফেরেন স্বজনের মুখ। আবেগজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই’। মুহূর্তের মধ্যে সে ধ্বনি প্রকম্পিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল ৬৪ হাজার গ্রামের প্রতিটি লোকালয়ে। বিমানবন্দর থেকে সংবর্ধনাস্থল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ পর্যন্ত পুরো রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। ১০-১৫ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল সে সংবর্ধনায়।
এরপর শেখ হাসিনার শুরু হলো এক নতুন জীবন। দলকে পুনর্গঠন আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী তখনো কারাগারে বন্দি। মিথ্যা মামলা আর হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনকে ধ্বংস করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তাকে রুখে দিতে হবে। ভয়ভীতি প্রদর্শন আর অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে দল ভাঙা, নেতা-কর্মীদের ক্ষমতাসীন দলে ভেড়ানোর প্রচেষ্টা এবং কখনো কখনো দলীয় কার্যক্রম থেকে নিষ্ক্রিয় রাখার ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করতে হবে। সারাদেশে দলকে পুনর্জীবিত করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। একইসঙ্গে দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রামও শুরু করেন। সামরিক শাসন ও স্বৈরশাসনের ফলে যে সব অবৈধ নির্দেশ ও কালাকানুন জারি করে পরবর্তীতে সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে তা বাতিল এবং পরিবর্তনের দাবি জানান শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সংবিধানের চার মূলনীতি পুনঃস্থাপনের দাবিও উত্থাপন করেন তিনি। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি এবং জেল হত্যাকারীদের বিচার করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের কারাগার ও অভিযোগ থেকে মুক্তি, চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাজনীতি করার সুযোগ দানের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম শুরু করেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, ঘুষ-দুর্নীতি এবং অবৈধ ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও তিনি দেশবাসীকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।
এদিকে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ১৯৮১ সালের ৩০ মে একদল বিক্ষুব্ধ সেনার হাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হলেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান। জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। ১৯৮১ সালের ১২ জুন বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সরকার বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িটি শেখ হাসিনার নিকট হস্তান্তর করে। সরকারি দখলমুক্ত হয়ে বাঙালির প্রাণভোমরার এই ঐতিহাসিক বাড়িটি ফিরে পেলে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানারা এই বাড়িটি এখন বঙ্গবন্ধু জাদুঘর হিসেবে বাঙালির এক তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিদেশিরাও আসেন এই বাড়িটি দেখতে, বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানাতে।
জাতির এ কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো সংগঠিত হওয়ার তাগিদ অনুভব করে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল, রাজবন্দিদের মুক্তি, জেল-জুলুম নির্যাতন প্রতিরোধ, ঘুষ-দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং সীমান্ত সমস্যা সমাধান ও ছিটমহল বিষয়ে ইন্ধিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়নে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর নেতৃত্বে সারাদেশে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা প্রাণ ফিরে পায় এবং সব ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে দল এবং জনগণকে সংগঠিত করার কঠিন সংগ্রামে নিয়োজিত হয়। একই সময়ে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলাম এবং অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো পঁচাত্তরপরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদারিত্ব এবং পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে রাষ্ট্র এবং সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলায় সচেষ্ট হয়। মুক্তিযুদ্ধের মৌল আদর্শ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিপরীতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি, সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং প্রগতির বিপরীতে ধর্মান্ধ এবং পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ এ সময় প্রত্যক্ষ করা যায়। এ সব উদ্যোগকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে বিএনপি এবং পরবর্তীতে জাতীয় পার্টি। জাতির এ ক্রান্তিকালে শেখ হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে প্রতিরোধ, জনজীবনের নানাবিধ সংকট দূরীকরণ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার কঠিন সংগ্রামে নিয়োজিত হন। দেশবাসীও আশায় বুক বেঁধে পাশে এসে দাঁড়ায়, পরবর্তীতে রচিত হয় নতুন ইতিহাস।
কখনো একক, কখনো যুগপৎ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই চলতে থাকে। এ লড়াইয়ে ছাত্র, যুবক, পেশাজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, নারীÑসবাই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখে। প্রেসিডেন্ট সাত্তারের বিদায়ের পর জেনারেল এরশাদের পতন ঘটলে তিন জোটের রূপরেখা মোতাবেক সাহাবুদ্দীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়। যদিও এ নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯৬ সালে নানা ঘটনার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির অধীনের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দীর্ঘ ২১ বছর পর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি এবং ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিচুক্তি সম্পাদন করে তিনি দেশকে দুটি বড় সংকট থেকে রক্ষা করেছিলেন। হতদরিদ্র মানুষের কল্যাণে তাঁর সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিশেষ করে দেশের উন্নয়নে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করেন। সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সন্তানের পরিচয়ে পিতার পাশাপাশি মায়ের নাম লিপিবদ্ধকরণ বাধ্যতামূলক করেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জন করে। তাঁর সরকার কুখ্যাত ইনডেমনিটি বাতিল করে প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ শুরু করে। এ ছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসা, শিল্প, বিদ্যুৎ উন্নয়ন, কৃষিসহ সব গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যাপক উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এবং বিদেশি নানা মহলের আনুকূল্য পেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে জয়লাভ করে। পরে দেশব্যাপী সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির ওপর ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়। বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতায় দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। এই সময় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম, অ্যাডভোকেট মমতাজউদ্দিন, সাংবাদিক মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালুসহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে। এ সব অপকর্মের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ সময় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয় বারবার। বিশেষ করে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা ইতিহাসের এক কালো দিবস হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য এবং নির্মূল করার এ ধরনের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা বিশ্ব আর কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে দলিত মথিত করে বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশে জরুরি অবস্থা সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করে। শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ করে রাজনীতি থেকে বিদায় করার চক্রান্ত করা হয়। কিন্তু অনমনীয় সাহসিকতা এবং বিচক্ষণতায় সব বাধা অতিক্রম করে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনা বিপুল সংখ্যাধিক্ষ্যে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন। তার পরের ইতিহাস বাঙালির গর্ব ও সাহসের ইতিহাস। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সারা পৃথিবীতে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাঁর সততা, সাহসিকতা, দেশপ্রেম এবং বিচক্ষণতায় আমরা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছি স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে অর্জন করেছি সমুদ্রের বিশাল এলাকা। বাংলাদেশের অর্জন আজ আমাদের বিশ্বে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা থাকলেও এ অর্জনের মূল কাণ্ডারি শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা শুধু রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনৈতিক নেতাই নন, তিনি মানবিকতার এক উজ্জ্বল প্রতীক।
সমকালীন বিশ্বে যে কয়জন রাজনীতিবিদ তাদের নীতি-আদর্শ, প্রজ্ঞা, দক্ষতা এবং অনমনীয় দৃঢ়তার জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত, তার অন্যতম ব্যক্তিত্ব আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু বঙ্গবন্ধুর কন্যা নয়, স্বীয় প্রতিভা এবং কর্মগুণেই তিনি আজ বিশ্বনন্দিত। সততা, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দৃঢ়তা তাঁকে এক দক্ষ রাষ্ট্রনায়কে পরিণত করেছে। তাঁর নেতৃত্বে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্র আজ মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করেছে। অর্থনীতির সব সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রায় উন্নত রাষ্ট্রের সমকক্ষ। গড় আয়ের সঙ্গে গড় আয়ু বৃদ্ধিও এক বিস্ময়কর ঘটনা।
তবে সবকিছু ছাড়িয়ে তাঁর মানবিক বোধ এবং বিপন্ন মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা তাঁকে এক বিশেষ উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি সমান দৃষ্টির এক মানবিকবোধের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞে। রাষ্ট্র এবং সমাজজীবনে তাঁর কর্মযজ্ঞের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই এ বক্তব্যের বাস্তবতা দৃশ্যমান হয়।
শেখ হাসিনার থাকার জন্য নিজের নামে কোনো বাড়ি নেই। অথচ সেই তিনি গৃহহীন মানুষের থাকার জন্য নির্মাণ করেছেন আশ্রয়ণ প্রকল্প। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাড়ি এবং স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য নির্মাণ করছেন অসংখ্য ফ্ল্যাট বাড়ি। গরিব মানুষ স্বল্প ভাড়ায় ফ্ল্যাটের মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন আজ। প্রতিবন্ধী, সমাজের পিছিয়ে পড়া হরিজন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন, নমশূদ্র ও বেদে সম্প্রদায়ের আশ্রয়হীনদের জন্য তাঁর দেশব্যাপী আশ্রয়ণ প্রকল্প মানবাধিকার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় প্রবীণরা সম্মানিত হলেও অসচ্ছলরা দারুণ অবহেলিত। পরিবারের বোঝা হিসেবেই অনেকে তাদের বিবেচনা করছেন। ছোটখাটো প্রয়োজন মেটানোর জন্য ১০টি টাকাও তাদের নিজের বলে থাকে না। এই অসহায় প্রবীণদের কল্যাণে শেখ হাসিনা চালু করেছেন মাসিক বয়স্ক ভাতা। এই ভাতা দিয়ে শুধু আর্থিক সহায়তাই করা হলো না, সামাজিক মর্যাদাও তাঁদের ফিরিয়ে দেয়া হলো। রাষ্ট্রের কাছে তাঁরা সম্মানিত, ব্যক্তি সে তো নৈস্য।
পেশাজীবী নারীদের কল্যাণে তিনি প্রসূতি ভাতা, দীর্ঘ ছুটি এবং বাচ্চাদের দেখভালের জন্য ‘ডে কেয়ার সেন্টার’ স্থাপন করেন। মা এবং শিশুর কল্যাণে প্রকৃতপক্ষে মায়ের ভূমিকাই পালন করছেন শেখ হাসিনা।
সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসাসেবাকে দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। প্রতিটি পল্লীতে স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিকে সাধারণ মানুষকে বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ করা হয়। উপজেলাপর্যায়ে সরকারি হাসপাতালের বেড সংখ্যা বৃদ্ধি, আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলা এবং বিভাগীয় শহরে জেনারেল ও বিশেষায়িত চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ঢাকায় নিউরো হাসপাতাল, ইএনটি হাসপাতাল, বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শেখ হাসিনা নিজেও এ সব হাসপাতালের চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন। সম্প্রতি ১০ টাকার টিকেট কেটে শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে তাঁকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে দেখেছি। করোনা সংক্রমণরোধে প্রতিটি নাগরিককে বিনামূল্যে টিকাদান তাঁর বিচক্ষণতা ও মানবিক বোধেরই পরিচয় বহন করে।
গত কয়েক বছর আগে ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত পরিবারের অনাথ কন্যাদের তিনি নিজের সন্তানতুল্য বিবেচনা করে বিয়ের ব্যবস্থা করেন এবং তাদের স্বামীদের চাকরি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাড়িটি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা নিজেরা ব্যবহার না করে ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর নিকট হস্তান্তর করেন। এই ট্রাস্ট থেকে প্রতিবছর অসংখ্য গরিব পরিবারের কন্যার বিয়ে এবং সন্তানদের লেখাপড়ার ভার বহন করা হয়।
শিল্পীদের কল্যাণের জন্য তাঁর দ্বার সবসময়ই উন্মুক্ত। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে থেকে তিনি দেশের খ্যাতিমান শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, লেখকদের চিকিৎসাসেবায় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন। সংস্কৃতিসেবীদের কল্যাণের জন্য তিনি ‘শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন করেন। ক্রীড়াবিদ এবং গার্মেন্ট শিল্পীদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ আমরা বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি।
১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে পুরো দেশ মহাপ্লাবনে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস, ফসল নষ্ট এবং অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। এরমধ্যে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল বিপুল। সরকার এ সময় থেকে চালু করে ভিজিএফ কার্ড। বিপন্ন মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহের এক নতুন উদ্যোগ। প্রায় ৭০ লাখ পরিবারকে ভিজিএফ কার্ডের আওতায় আনা হয় সে সময়। আপদকালীন সময় ছাড়া ঈদের সময় এই দরিদ্র পরিবারগুলোকে সরকার চাল, ডাল, চিনি, সেমাই বিনামূল্যে সরবরাহ করে থাকে। খোলাবাজারে ভর্তুকি দিয়ে কমমূল্যে চাল, আটা এবং কখনো কখনো অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রয় করা হয়, যা সাধারণ মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। আর এ সব পরিকল্পনার মূলে রয়েছে মানুষের প্রতি শেখ হাসিনার গভীর মমত্ববোধ।
শেখ হাসিনা দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের সভাপতি কিংবা রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হলেও তাঁর মধ্যে লুকিয়ে আছে সহজাত বাঙালি চরিত্রের এক মর্মস্পর্শী আবেদন- মমতাময়ী মা। অসহায় মানুষের আহাজারি তাঁর হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দেয়, যা রাজনৈতিক চরিত্রের বাইরে এক মানবিক বোধের বাতাবরণে সবাইকে আবিষ্ট করে। আর সে কারণেই শেখ হাসিনা অসহায় মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল, আমাদের অস্তিত্বের ঠিকানা।
লেখক: গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলার বুকে যে অন্ধকার নেমে এসেছিল, ১৯৮১ সালের ১৭ মে সে অন্ধকারের বুকচিরে আলোর রেখা দেখা গেল। সেদিনই বৃষ্টির অঝোর ধারা লাখো স্বদেশবাসীর সাথে স্বাগত জানিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। নৃশংস এক ঘটনার মধ্য দিয়ে পিতা-মাতা-ভাই-স্বজন হারানো এক কন্যা ফিরে এসেছেন আপন ভূমিতে, মানুষের দুর্দশা ঘোচাতে নেতৃত্ব দেবার জন্যে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ছয় বছর কী সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে কেটেছে প্রাণে বেঁচে যাওয়া দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার, সে ইতিহাস আজ আর আমাদের অজানা নয়।
শেখ হাসিনার সেই ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিকে ধরে রেখেছেন সৈয়দ শামসুল হক এভাবে:
‘এখনো ভুলিনি সেই বৃষ্টিভেজা বৈশাখের দিন,
বাংলার তাপিত প্রাণে বৃষ্টিধারা ঝরে পড়ছিলো,
যেন বৃষ্টি নয় সে তো আপনারই অশ্রুজল ছিলো,
সড়কে সড়কে লক্ষ মানুষের মিছিল সেদিন।
স্বদেশে সেদিন ফেরা আপনার এ মাটিতে আবার,
যে-মাটিতে জনকের রক্তপাত করেছে ঘাতক,
আপনি তো সেই কন্যা, সেই মাতৃভূমির জাতক
চেতনায় উন্মীলিত, ফিরেছেন অটল দুর্বার।
সেই বৃষ্টি সেই অশ্রু আপনার সেই ফিরে আসা
নিমজ্জিত নৌকোটিকে রক্ত থেকে টেনে তুলবেন,
মানুষের দেশে ফের মানুষের সংসার দেবেন
ফিরেছেন বুকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা।’
দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনাকে দীর্ঘ ১৫ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্যে। এ ছিল কঠিন এক সংগ্রাম। কারণ ১৯৭৫ এরপর দেশ আবার উল্টোপথে চলতে শুরু করেছিল। একাত্তরের পরাজিত শক্তি সমাজে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনর্বাসিত হয়েছিল। একদিকে নিজের দল আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করা, অন্যদিকে বৃহত্তর সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া। চরম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তিনি এগিয়ে গেছেন। অবশেষে ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো তিনি সরকার গঠন করতে সক্ষম হলেন।
এ সময়ে তাঁর প্রথম কাজ ছিল ২১ বছর ধরে যে ভ্রান্ত ইতিহাস বাংলাদেশের মানুষের সামনে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে বারবার প্রচার করে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল, তার বিপরীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সত্যিকার ইতিহাস তুলে ধরা। যে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টা হয়েছিল, ইতিহাসের সে মহানায়কের প্রকৃত অবদান জাতির সামনে নিয়ে আসা হলো।
বর্তমানে তৃতীয় মেয়াদে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনায় রয়েছেন। এ সময়ে তাঁর যে বিশাল অর্জন, তার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে আজকের পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন করার মাঝে এ দেশের জন্যে, এ দেশের গবিব দুঃখী মানুষের জন্যে কত কল্যাণকর প্রকল্পের যে বাস্তবায়ন হয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত হয়েছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার মতো একজন প্রজ্ঞাবান রাষ্ট্রনায়কের নেতৃত্বের ফলে।
শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় গুণ মানুষের জন্যে ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধু যেমন সব সময়ই চাইতেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে, তাঁর কন্যাও স্বাভাবিকভাবেই মানবিকতার এ দৃষ্টান্ত বুকে ধারণ করেছেন। তাঁর সকল কাজের চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে সাধারণ মানুষের কল্যাণ। মানবিকতার চূড়ান্ত উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করেছেন ১১ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে। তার জন্যে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছেন ‘মানবতার জননী’ হিসেবে।
পিতার মতোই শেখ হাসিনার সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ সর্বজনবিদিত। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধুর লেখা কথা: ‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম।’
শেখ হাসিনা ছোটবেলা থেকেই একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন। বেগম সুফিয়া কামালের সান্নিধ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ও ছায়ানটের সাংস্কৃতিক আবহ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করেছে। ছায়ানটে তিনি শিখতেন বেহালা আর শেখ কামাল সেতার। ছায়ানটের যে বিশাল ভবন আজ প্রতিষ্ঠানটিকে একটা শক্ত ভিত জুগিয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে তিনি তার জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বলেই। এভাবেই তিনি ছায়ানটের প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন।
বাংলা একাডেমির অনুরোধে বেশ কয়েক বছর আমি অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছি। একবার যখন আমি ঘোষণা করলাম যে, সেবার নিয়ে ১৭ বার তিনি বইমেলা উদ্বোধন করেছেন এবং আশা করা যায় আরও তিনবার তিনি মেলা উদ্বোধন করে একটা রেকর্ড করবেন, তিনি কথাটা শুনে চমৎকৃত হলেন, হেসে তাঁর আনন্দ প্রকাশ করলেন।
বইমেলায় এলে তিনি স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠেন। ছাত্রজীবনে কত স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন মেলায়। কিন্তু এখন নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থেকে তা আর সম্ভব হয় না বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। নিজে তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। হালফিল সাহিত্যের খবর রাখেন। রোজ শোবার সময় তাঁর সঙ্গী বই। শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গ খুব উপভোগ করেন। যখনই কারও চিকিৎসার সমস্যা হয়, সাধ্যমতো চেষ্টা করেন সহায়তা করতে। আমি নিজে কত জনের আবেদন নিয়ে গেছি তাঁর কাছে, কখনো নিরাশ করেননি। বেশ কিছুদিন আগে যাত্রাশিল্পী ভিক্টর দানিয়েলের চিকিৎসা সহায়তার একটা আবেদন নিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর কাছে। তিনি বললেন, এভাবে সহায়তায় কাজ হবে না। তিনি দশ লাখ টাকার স্থায়ী আমানতের ব্যবস্থা করে দিলেন তাঁর নামে। সেখান থেকে মাসে মাসে চিকিৎসার খরচটা আসবে। কতটা চিন্তা করেন তিনি মানুষের জন্যে।
সাম্প্রতিককালে যখনই কোনো শিল্পী-সাহিত্যিকের করোনায় আক্রান্ত হবার কথা তিনি জেনেছেন, তাঁর সহকারীদের নির্দেশ দিয়েছেন যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। সংস্কৃতির উন্নয়নে তিনি সব সময়ই আগ্রহী। গঠন করে দিয়েছেন শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট। সম্প্রতি চলচ্চিত্র শিল্পীদের জন্যেও আলাদা একটি ট্রাস্ট গঠিত হয়েছে। যাত্রার উন্নয়নে নীতিমালা করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে অনুমতির সংকটে যাত্রাশিল্প আজ মৃতপ্রায়। সংস্কৃতি-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ জোগান দেয়া হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে যথাযথ প্রকল্প প্রণয়ন ও তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।
বিদেশে অন্য দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও গণমান্য ব্যক্তিদের সাথে তিনি যে কতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে সহজভাবে মিশতে পারেন, তা প্রত্যক্ষ করেছি ১৯৯৯ সালে। তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে আমার ও ফেরদৌসীর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনে এবং প্যারিসে ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেবার সৌভাগ্য হয়েছিল। কত সাবলীলভাবে তিনি আলাপ-অলোচনা চালিয়ে যান। কথ্য ইংরেজি তাঁর বেশ ভালো। প্যারিসে আমার অনুরোধে তিনি আইটিআইর তদানীন্তন সেক্রেটারি জেনারেল আঁদ্রে লুই পেরিনেত্তি এবং প্রখ্যাত বাংলা ভাষার পণ্ডিত ফ্রাঁস ভট্টাচার্যের সাথে কথা বলার জন্যে আলাদা সময় দিয়েছিলেন। ফরাসি প্রেসিডেন্টের সাথে সেদিন সকালে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখা করেন, তখন ফ্রাঁস ভট্টাচার্য দোভাষীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সম্প্রতি তিনি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছানুসারে আমি তাঁকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। প্যারিসে সেবারই প্রথম আমি ভাস্কর নভেরা আহমেদকে দেখি। শেখ হাসিনার আগ্রহে শিল্পী শাহাবুদ্দিন তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন। পরের দিন শাহাবুদ্দিনকে সাথে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ল্যুভ মিউজিয়াম দেখেছেন আগ্রহ নিয়ে। রাষ্ট্রীয় ব্যস্ততার পাশাপাশি শিল্পের এ অনন্য সম্ভারের জন্যে সময় বরাদ্দ করার কথা ভোলেননি তিনি।
বঙ্গবন্ধুর দুটো বিশেষ গুণ আমরা আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে লক্ষ্য করি। এক. সাহস আর দুই. মানবিকতা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তার রায় বাংলাদেশের মাটিতে আমাদের জীবদ্দশায় কার্যকর হবে, এটা আমাদের প্রজন্ম ভাবতেই পারেনি। কিন্তু সকল প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে শেখ হাসিনা বিচারের উদ্যোগ নিয়েছেন। অপরাধী কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন বিশ্বের কতিপয় শক্তিধর রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতারা। কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁদের অন্যায় আবদার অগ্রাহ্য করার সাহস দেখিয়েছেন।
তাঁর কূটনৈতিক প্রজ্ঞার ফলে বিশ্বের সব বলয়ের দেশগুলোর সাথেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বজায় রয়েছে, কারো সাথে বৈরী সম্পর্ক নেই। চীন ও ভারতের মতো দুই শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা সহজ কাজ নয়।
তিনি কঠোর হাতে জঙ্গিবাদ দমন করে চলেছেন। সাম্প্রদায়িক শক্তি যেন মাথা তুলতে না পারে, সে ব্যাপারে তিনি সজাগ। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে সদা আগ্রহী। এমন সংস্কৃতিমান রাষ্ট্রনায়ক খুব কম দেশেই আছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বাংলাদেশে কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না। ইতোমধ্যে পর্যায়ক্রমে কয়েক লাখ গৃহহীন গরিব মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেয়া হয়েছে। তাদের জীবিকা নির্বাহেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দেশকে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে যা একটা বিশাল অর্জন।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিচার করলে শেখ হাসিনার বিকল্প খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাইতো তিনি আমাদের অনন্ত আশার প্রতীক, একমাত্র ভরসাস্থল।
বঙ্গবন্ধুকে হারানো যেমন বাঙালির চরমতম দুর্ভাগ্য, তেমনি সৌভাগ্য তাঁর রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনাকে পাওয়া যিনি অন্ধকার থেকে আবার আমাদের আলোর সন্ধান দিয়েছেন। তিনি আলোকবর্তিকা হাতে আরও দীর্ঘদিন আমাদের পথ দেখান এটাই আমাদের একান্ত কামনা। যে সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং দুর্নীতি দেশের সকল অর্জনকে ব্যর্থ করে দিতে চাইছে তার বিরুদ্ধে তিনি কঠোর অবস্থান নেবেন, এটাও প্রত্যাশা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যার বড় গুণ তিনি চরম প্রতিকূল পরিবেশেও শান্ত ও অবিচলিত থাকতে পারেন। স্বভাবে বাস্তববাদী, স্বপ্ন দেখতে পারেন, দেখাতেও পারেন। ঠিক যেন পিতারই যোগ্য প্রতিচ্ছবি। গত কয়েক দশকের পরিচয় থেকে দেখেছি, তিনি সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নে অবিচল। তার মেধা-মনন, সততা, নিষ্ঠা, যোগ্যতার পুরোটুকুই দেশ ও দেশের জনগণের জন্য কাজে লাগাচ্ছেন। তার প্রজ্ঞা, দক্ষতা আর সৃজনশীলতায় বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। একসময়ের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে জর্জরিত দেশ আজ বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে চলছে। বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাঙালি জাতি। বাংলাদেশের এ অগ্রযাত্রায় সম্মুখ সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য ও সংগ্রামে অনন্য শেখ হাসিনা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশকে পুরোনো পাকিস্তানের ধারায় চালিয়েছে সামরিক শাসকরা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে একটি পাকিস্তানপন্থি ভাবধারার দেশে পরিণত করেছিলেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী দল এবং পাকিস্তানের দোসর যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুর্নবাসিত করেছিলেন। সব থেকে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তাঁর বেঁচে যাওয়া রক্তের উত্তরসূরি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহেনাকে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত করে রেখেছিল ওই সময়ের জিয়ার সামরিক শাসন। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে দীর্ঘদিন নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয় দেশের বাইরে। কিন্তু সব ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে আবারও মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। সেই সঙ্গে গ্রহণ করেন এ দেশের মানুষের ভাগ্য বদলের ইশতেহার। শপথ করেন প্রাণ থাকতে এ দেশের মানুষকে কখনো দেশবিরোধীদের হাতে ছেড়ে দেবেন না। তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এ দেশের জাতির পিতা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা হওয়া সত্ত্বেও চলার পথ কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না শেখ হাসিনার। বারবার মৃত্যুর কালো ছায়া গ্রাস করে নিতে চেয়েছে তাঁকে। তার এমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আর কঠোর পরিশ্রমের ফলই বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন। এক্কেবারে তৃণমূল জনগণের ভালোবাসা ও সমর্থনে বহু প্রতিকূলতা পদদলিত করে তিনি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন স্বীয় ত্যাগ, তিতিক্ষা ও মহিমায়।
মইনউদ্দিন, ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশকে বিরাজনৈতিকীকরণের উদ্দেশ্যে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের জন্য ১৬ জুলাই ২০০৭ সালের ভোররাতে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে তাঁর বাসভবন সুধাসদন থেকে গ্রেপ্তার করে। কিছু ভুয়া সাজানো চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র করা হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের পূর্বে দেশত্যাগের জন্য ভয়ভীতিসহ বহু ধরনের চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু দেশরত্ন শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোভাবের কারণে সরকার ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। মিথ্যা মামলা সাজিয়ে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
সেই সময়ে একটা থমথমে ভাব, কেউ কোনো কথা বলে না। এর মধ্যেই প্রবাসীদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ‘স্কলার্স বাংলাদশে’ নামের একটি সংগঠন। ‘এনআরবি সম্মেলন’ নামে ওই অনুষ্ঠান চলে ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২৯ ডিসেম্বর। সেই অনুষ্ঠানে সেই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদ আর সেনাপ্রধান যোগদান করতে আগ্রহী হন। আমিও আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এনআরবি সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য আমেরিকা থেকে দেশে আসি। কিন্তু সেখানে ঘটে একটি বিপত্তি। আমাকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হলো না। যদিও বিদেশ থেকে আমাকে সম্মানীত বিশেষ অতিথি হিসেবে দাওয়াত দিয়ে এনেছেন।
তারপর বোস্টনে নিয়ে আসি। নেত্রী বোস্টনে আসলেন। আমি তখন নর্থ ইস্টান ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। সেখানে আমাদের বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের ড. শাহজাহান মাহমুদ কে অনুরোধ করলাম একটা প্রোগ্রাম আয়োজনের জন্য। নেত্রী একটি দলের প্রধান, এটা রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হয়ে যাবে- এমন অজুহাতে তিনি আমার অনুরোধ রাখলেন না।
পরবর্তীতে তৈয়ব উদ্দিন মাহতাব কে অনুরোধ করলাম। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর এসেছিলেন বোস্টন থেকে ওয়াকিটকিসহ নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে। উনি ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রামে সভাপতিত্ব করলেন। অনুষ্ঠানটি খুবই সুন্দর হলো। শত শত লোক সে অনুষ্ঠানে আসে এবং ধৈর্য সহকারে ওনার বক্তব্য শুনেন। তারপর আমরা নেত্রীকে নিয়ে আমরা শহর দেখালাম। এরপর উনি চলে গেলেন।
আমি তখন হোটেলের আরেক প্রান্তে বসে গল্প করছিলাম। আমেরিকা থেকে আগতদের নিয়ে আড্ডা জমে উঠল। কথায় কথায় ওরা বললেন, তুমি শেখ হাসিনার লোক। তোমার খবর আছে। এখন দেশে সেনাশাসন চলছে ঠিক সেই সময়েই দেখি কয়েকজন আর্মি অফিসার বুটের ঠকঠক আওয়াজ তুলে এদিকেই আসছেন। এখানে এসে তারা জানতে চাইলেন, মোমেন সাহেব কে? কেউ আর ভয়ে কথা বলেন না। সবাই চুপ। আমি তখন বললাম, আমিই ড. মোমেন। তারা বললেন, আমাদের সঙ্গে আপনাকে যেতে হবে। আমি তাদের সঙ্গে গেলাম। যাদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, তারা মনে করল, এটাই শেষ, ড. মোমেন আর ফিরবে না।
তারা আমাকে হোটেলের একটা রুমে নিয়ে গেল। রুমে বসে প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকেই আমাকে দীর্ঘ সময় ধরে জেরা করলেন। শেষে তারা আমার হাতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটা কার্ড ধরিয়ে দিলেন।
সম্মেলনের শেষের দিকে প্রবাসীদের নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করতে চাইলে হোটেল কর্তৃপক্ষ ও আয়োজকরা রুম দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। আমার বক্তব্য ছিল এতসব সুপারিশ ও আলোচনা অনর্থক হবে, যদি রাজনীতিবিদদের এতে সম্পৃক্ত না করা হয়। তাই সংবাদ সম্মলেন করতে চাই। পরে আমরা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করি। যারা আমেরিকান নাগরিক ও নির্বাচিত প্রতিনিধি তাদের বিশেষ করে সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তা হিসেবে রেখেছিলাম এ জন্য যে তাদের গ্রেপ্তার করতে ভয় পাবে।
একটা কথা উল্লেখ করার মতো, বর্তমানে যারা আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা, তারাই কিন্তু সেই সময়ে নেত্রীকে মাইনাস ফর্মূলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা হওয়া সত্বেও তারা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে চেয়েছেন। অথচ তারাই আজ আবার আওয়ামী লীগের মিটিংয়ে বড় বড় কথা বলেন, নেত্রীর বড় ভক্ত হিসেবে পরিচয় দিয়ে বেড়ান!
তারপর বোস্টনে নিয়ে আসি। নেত্রী বোস্টনে আসলেন। আমি তখন নর্থ ইস্টান ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। সেখানে আমাদের বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের ড. শাহজাহান মাহমুদ কে অনুরোধ করলাম একটা প্রোগ্রাম আয়োজনের জন্য। নেত্রী একটি দলের প্রধান, এটা রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হয়ে যাবে- এমন অজুহাতে তিনি আমার অনুরোধ রাখলেন না।
পরবর্তীতে তৈয়ব উদ্দিন মাহতাব কে অনুরোধ করলাম। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর এসেছিলেন বোস্টন থেকে ওয়াকিটকিসহ নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে। উনি ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রামে সভাপতিত্ব করলেন। অনুষ্ঠানটি খুবই সুন্দর হলো। শত শত লোক সে অনুষ্ঠানে আসে এবং ধৈর্য সহকারে ওনার বক্তব্য শুনেন। তারপর আমরা নেত্রীকে নিয়ে আমরা শহর দেখালাম। এরপর উনি চলে গেলেন।
পরে নব্বইয়ের দিকে নেত্রী এলেন। আমি তখন একটা আন্দোলন নিয়ে খুব ব্যস্ত। বাংলাদেশের নারী ও শিশু পাচার পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যে, মধ্যপ্রাচ্য অনেক হয় বিশেষ করে ক্যামেল জকি। এসব দেশে ৫-৭ বছরের ছোট বাচ্চাদের উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করে। রেসের সময় এদের অর্ধেকই উট থেকে পড়ে আহত হয় কিংবা মারা যায়। আমি এইটা নিয়ে অনেক তোরজোর করেছি, হইচই করেছি; কিন্তু কোনো ফল মিলেনি। নেত্রী এলে নেত্রীকে বললাম যে, নেত্রী আমরা ১০০ চিঠি লিখলে বা ১০০০ চিঠি লিখলে যে ফল আসবে, আপনার একটা কথাতে তার চেয়ে ভালো ফল মিলবে। আপনি যদি একটা আওয়াজ তোলেন, তাহলে কয়েক লাখ লোক এই বিষয়ে আপনার আওয়াজের সঙ্গে আরও জোরে আওয়াজ তুলবে। নেত্রী বলেন, অবশ্যই আমি দেশে গিয়ে এই শিশু পাচার বিষয়ে, বিশেষ করে ক্যামেল জকির বিষয়টা পার্লামেন্টে তুলব। দেশে ফিরে তিনি তাই করলেন। পার্লামেন্টে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হলো। জোয়ার সৃষ্টি হলো আমার এ ক্যামেল জকি বা উটের দৌড়ের আন্দোলনেও। নেত্রীর বক্তব্যের পরে আন্দোলনে গতি এরো, গান রচনা হলো । এর মধ্যে আমি দেশে আসলাম। একটা দুটো প্রোগ্রাম করলাম, বিটিভিতেও। তখন ম হামিদ বিটিভির প্রযোজক । বিটিভিতে আমাকে নিয়ে প্রোগ্রাম করায় তার চাকরির ট্রান্সফার হয়ে গেল । তাকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হলো। সে আমাকে বলল, মোমেন ভাই, আপনার প্রোগ্রাম করার ফলে আমি এখন ঝামেলায় আছি। তার জন্য আমার খারাপ লেগেছে। এই সময় নেত্রী আমাদের খুব সাপোর্ট দিয়েছিলেন এবং তার ফলে আমি যখন দেশে আসি তখন ওনার কাছে থেকে ভিডিও কমেন্ট নেই। এইগুলো আমার জন্য কাজ দিয়েছিল। পরবর্তী আপনার নেত্রী সবসময় প্রগ্রেসিভ মুভমেন্টে সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। এসব ব্যাপারে কখনো কোনো পথ নাই। অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে নেত্রী বাংলাদেশের সংসদে কথা বলার পর ভারতীয় লোকসভায় উঠল। পরবর্তী সময়ে আমরা মোটামুটিভাবে ক্যামেল জকির সমস্যাটা দূর করতে সক্ষম হই।
নাইন ইলেভেনের পরে মুসলিমদের ওপর সারা বিশ্বজুড়ে বড় ধরনের ধাক্কা আসে। সে সময় আমাদের ধারণা যদি গ্রহণযোগ্য কোনো মুসলিম নেতা পাওয়া যায়, তবে সারাবিশ্বে মুসলমানদের ওপর যে নেতিবাচক ধারণা, এই ধাক্কাটা সামলে ওঠা সম্ভব । এক্ষেত্রে ওআইসি একটা ভূমিকা রাখতে পারে।
আগের বছরই মোটামুটি সিদ্ধান্ত ছিল যে, বাংলাদেশ ওআইসির মহাসচিব হয়ে যাবে। খালেদা জিয়ার সরকার সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ওনাদের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, সেই যুদ্ধ অপরাধী খোকা চৌধুরীর ছেলে সাকা চৌধুরী কে নমিনি করলেন। সিদ্ধান্তটি মোটেও ভালো ছিল না। কারণ এই যে বিএনপির মধ্যে আরও লোক ছিলেন যারা আরো যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য ছিলেন। ওদের বাদ দিয়ে তারা করল সাকা চৌধুরীর মতো একটা উগ্র লোককে প্রতিনিধি। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীর মামলাসহ অনেক অনেক অভিযোগ ও মামলা ছিল। এটা খুবই বাজে সিদ্ধান্ত ছিল। নেত্রীকে বললাম যে, ওর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করতে চাই। এরকম একটা অপরাধী আর কুখ্যাত লোক। তাকে তারা নমিনি করেছে, নেত্রী আমাকে কাজ করতে বললেন। আমি এটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করি। এই আন্দোলনটা খুব জোরদার হয়। চট্টগ্রামের এক ভদ্রলোক (পুলিশ অফিসার) তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমাকে খুব সাহায্য করে। সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৪টি মামলার তথ্য তুলে ধরি, যার মধ্যে ছিল নারী নির্যাতনের মতো সেনসিটিভ মামলাও। তখন তার বিরুদ্ধে আমি আন্দোলন গড়ে তুলি। সেই আন্দোলনটা সফল হয়। তখন প্রথমদিকে কেউ কোনো ক্যান্ডিডেট দেয় না, সাহস করে না। কারণ প্রথমদিকে ঠিক হয়েছিল বাংলাদেশের প্রতিনিধি হবে। ওই নির্বাচনে মরক্কো আর তুরস্কও শেষ পর্যন্ত প্রার্থী দেয়। বাংলাদেশ ওই ইলেকশনে আমার জানামতে দুইটা ভোট পায়। একটা নিজের দেশের আরেকটা পাকিস্তানের। যারা আগে বলেছিল ভোট দেবে, ওরাও পরে বাংলাদেশকে ভোট দেয়নি। কারণ এরকম ক্রিমিনাল লোককে কেউ পছন্দ করে না। তখন নেত্রী আমাকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। ওনার সাহস এবং উনার সাপোর্টের কারণে এই যাত্রায় আমরা এই অর্জন করতে পারি।
শেখ হাসিনার জীবনে বারবার হানা দিয়েছে ঘাতক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে মা-বাবা, ভাইসহ আপনজনদের হারানোর বেদনা বুকে ধারণ করে পরবর্তী সময়ে ছয় বছর তাকে লন্ডন ও দিল্লিতে চরম প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। সব মিলিয়ে ১৮ বার তার ওপর হামলা হয়। তবুও তিনি ভেঙে পড়েননি, হাল ছেড়ে দেননি। ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে যেমন বেঁচে ফেরে অকুতোভয় নাবিক, শেখ হাসিনাও তেমনই ফিরে এসেছেন দেশে। এরপর দীর্ঘ যাত্রায় পার করেছেন নানা চড়াই-উৎরাই। কারাভোগ করেছেন, বানোয়াট কইেসসমূহ ফসে করছেনে, একাধিকবার গৃহবন্দি ছিলেন। এতকিছুর পরও দমে যাননি তিনি। সকল ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে একেএকে চারবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড গড়েছেন। প্রায় চার দশকরে অধকি সময় ধরে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। দেশে সুশাসন প্রবর্তন করেছেন, ফলে উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ বিশ্বের মর্যাদায় আসনপ্রাপ্ত হয়েছে।
শেখ হাসিনা যত দৃঢ়তর অবস্থান নিয়েছেন দেশ ও মানুষের পক্ষে ততই তার ওপর নেমে এসেছে নির্যাতন-নিপীড়নের খড়গ। তার বীরোচিত স্বৈরাচারবিরোধী তৎপরতার কারণে তাকে জনগণের থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র হয়। এত কিছুর করেও দমিয়ে রাখা যায়নি তাকে। শেখ হাসিনা যেন আগুনের ভেতর থেকে জন্ম নেয়া এক ফিনিক্স পাখি। যতবার পোড়ানো হয় তাকে, ততবারই নতুন রূপে, নতুন শক্তিতে এদেশের মানুষের কাছে ফিরে আসেন তিনি।
বারবার মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়া নেতৃত্ব বর্তমান বিশ্বে বিরল। বাংলাদেশের পরম সৌভাগ্য যে, এদেশের মানুষ শেখ হাসিনার মতো ভিশনারি, কর্মঠ ও প্রচণ্ড সৎ এমন বিরল নেতা পেয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের বা উন্নয়নশীল দেশে একজন শেখ হাসিনার মতো নেতা দেশকে কীভাবে দ্রুত এগিয়ে নিতে পারেন তা শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে উল্টোপথে চলা বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ কখনো মসৃণ ছিল না। আর শেখ হাসিনাকে পথ চলতে হয়েছে আরো কঠিন বন্ধুর পথে। বাংলাদেশের উন্নয়নের রাজনীতিতে কখনো স্থিতিশীলতা আসেনি এতখানি যা শেখ হাসিনার সময়ে এসেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো নির্বাচিত বা অনির্বাচিত শাসক শেখ হাসিনার মতো টানা ১৮ বছরেরও অধিক সময় ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। শেখ হাসিনার মতো বিপুল জনপ্রিয়তা এবং জনবান্ধব নেতা হিসেবে টিকে থাকতে পারেননি। এসব দিক বিবেচনা করলে শেখ হাসিনা এমন এক রেকর্ড গড়েছেন, যা এক কথায় অনন্য এবং অসাধারণ। শুধু অসাধারণই নয়, এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা অদ্বিতীয়ও বটে। সামনের দিনেও শেখ হাসিনার মতো বিপুল জনপ্রিয়তা এবং জনসম্পৃক্ততা ধরে রেখে এমন রেকর্ড কেউ করতে পারবে বলে বর্তমানে দেশের কোনো মানুষ বিশ্বাস করে না।
লেখক: পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
সমগ্র জীবনই যার কেটেছে লড়াই-সংগ্রামে। সাধারণ আর দশটা মানুষের মতো তিনি পাননি পরিবারের সান্নিধ্য, ছিল না জীবনের স্বাভাবিক গতিধারাও। সব হারিয়েও যিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায়। বর্ণাঢ্য সেই সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য উত্তরসূরি, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আজ ৭৬তম শুভ জন্মদিন। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের মধুমতি নদী বিধৌত টুঙ্গিপাড়ায় শেখ হাসিনা জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার জ্যেষ্ঠ সন্তান এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি।
শেখ হাসিনার শিক্ষা জীবন শুরু হয় টুঙ্গিপাড়ার এক পাঠশালায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তার পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। পুরান ঢাকায় মোগলটুলির রজনী বোস লেনে বসবাস শুরু করেন। পরে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচিত হলে আবাস স্থানান্তারিত হয় ৩ নম্বর মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে। ১৯৫৬ সালে শেখ হাসিনা ভর্তি হন টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ঢাকার বকশিবাজারের পূর্বতন ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে। কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভানেত্রী (ভিপি) পদে নির্বাচিত হন। একই বছর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় ১৯৬৭ সালে এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের সংসারে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল নামে দুই সন্তান রয়েছে।
১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এরপর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নিজ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আপসহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল স্রোতধারার প্রধান নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি।
তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং অন্য রাজনৈতিক জোট ও দলগুলো ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে বিজয়ী হয়। ১৯৯৬ সালে তাঁর নেতৃত্বেই তৎকালীন বিএনপি সরকারের পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিজয় অর্জন করে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত চার মেয়াদে ক্ষমতাধীন রয়েছে। ১৯৯৬ সালে তার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক নির্বাচনে চার-তৃতীয়াংশ আসনে বিশাল বিজয় অর্জনের ম্যধ্যমে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠিত হয়। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ের পর ১২ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা দ্বিতীয় এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর টানা তৃতীয়বার সরকার গঠিত হয়। এ ছাড়া তিনি তিনবার বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত কমিটি বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ, যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার ইতিহাস। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। তাঁর সাহসী এবং গতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কাঠামোগত রূপান্তর এবং উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে।
শেখ হাসিনা সরকার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। সমুদ্র বিজয়, মহাকাশ বিজয় এবং পদ্মা সেতু বিজয় তো পুরো জাতির সামনে দৃশ্যমান। বিশ্ববাসীর সামনে গত ২৫ জুন জননেত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেন। শান্তিকামী বিশ্ববাসী শেখ হাসিনার আরেকটি অর্জন দেখতে পেলেন। অভিবাদন জননেত্রী। অভিনন্দন জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ পুরো জাতিকে। অভিনন্দন সেই সব শ্রমিকদের, যাদের নিরলস পরিশ্রমে এই স্বপ্ন সেতু নির্মিত হয়েছে। আমাদের টাকায় আমাদের পদ্মা সেতু, আমাদের আবেগের সেতু, আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক। পদ্মা সেতু আমাদের আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। আত্মগৌরবের প্রতীক এই পদ্মা সেতু বাঙালিদের সারা বিশ্বে আরেকবার মহিমান্বিত করেছে।
কিন্তু এমন অনেক কাজ আছে, যা মানুষের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে, যার সুযোগ-সুবিধা মানুষ পাচ্ছে। এই সুযোগ-সুবিধার কারণটা মানুষ সঠিকভাবে জানেও না, জানতে চেষ্টাও করে না। তেমনি একটা ক্ষেত্র হলো স্বাস্থ্য খাত।
মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৬ বছরে উন্নীত হয়েছে। মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, শিশুমৃত্যু হার হ্রাস পেয়েছে। সীমাবদ্ধ সম্পদ ও বিপুল জনগোষ্ঠী নিয়ে এ অর্জন যে প্রশংসনীয় ব্যাপার, তা জাতীয়সহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবাই স্বীকার করেন। স্বাস্থ্য খাতের এই অর্জনের জন্য ৩টি জাতিসংঘ পুরস্কারসহ ১৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত। এর মধ্যে এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন এই সরকারের এক উল্লেখযোগ্য অর্জন। বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পের উন্নয়ন গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করা যায়। আজ নিজ দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে ৪৬ কম্পানির প্রায় ৩০০ রকমের ওষুধ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৬০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
বিশাল এই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ মোটেও সহজ কথা নয়। অনেকেই বিদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার তুলনা করেন। আমাদের দেশের জনসংখ্যা এবং আমাদের আর্থিক সক্ষমতা তারা মাথায় রাখেন না। ডাক্তার-রোগী, ডাক্তার-সেবিকার আনুপাতিক হারের বিষয়টি মাথায় রাখেন না। বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য খাতে অন্যতম পদক্ষেপ হলো কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে এই কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পটি শেখ হাসিনা সরকার গ্রহণ করে এবং প্রায় দশ হাজার ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছিল। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো জনবান্ধব মানবিক উদ্যোগকে শুধু রাজনৈতিক রোষে বন্ধ করে দিয়েছিল। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশব্যাপী বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন অনলাইন জরিপ এবং বিবিএসের তথ্য অনুসারে কমিউনিটি ক্লিনিকের ৯০ শতাংশের বেশি গ্রাহকরা তাদের পরিষেবা ও সুবিধার ক্ষেত্রে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে সুযোগ-সুবিধা। স্থাপন করা হয়েছে হৃদরোগ, কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, নিউরো, চক্ষু, বার্ন, নাক-কান-গলাসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, অব্যাহত নার্সের চাহিদা মেটাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নার্সিং ইনস্টিটিউট। প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি করে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করার কাজ চলছে।
শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে সদস্যের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে ৫০ শয্যায়। মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালগুলোতেও শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশনের উন্নয়ন স্বাস্থ্য খাতকে উন্নত করছে। সব হাসপাতালে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ই-গভর্ন্যান্স ও ই-টেন্ডারিং চালু করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। গোপালগঞ্জের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতালকে কেন্দ্র করে অনলাইন সেবা কার্যক্রম চালু করতে ‘ভিশন সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে।
বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ও মৃত্যুরোধে এখনো পর্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বিনা মূল্যে প্রায় সব মানুষের টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় দেশে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হবে। ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘গুড হেলথ অ্যাট লো কস্ট : টোয়েন্টি ফাইভ ইয়ারস অন’ শীর্ষক বইয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতির যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে ছিল বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খরচে মৌলিক চিকিৎসা চাহিদা পূরণ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, অসংক্রামক রোগগুলোর ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে ব্যাপক উদ্যোগ, পুষ্টি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সূচকগুলোর ব্যাপক অগ্রগতিতে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে অভূতপূর্ব অর্জন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে বহুদূর।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন মানবতার জননী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে, যা মোটেও সহজসাধ্য কাজ নয়। যা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে সম্ভব হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নের প্রস্তুতিসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, পোশাকশিল্প, ওষুধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বৃদ্ধি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি ও পরিশ্রমের ফসল। এ ছাড়া চলমান রয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পগুলো। ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে কমিউনিটি ক্লিনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে, যা সারা বাংলাদেশে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও পপুলেশন ল্যাব হিসেবে পরিচালিত হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বানে আসুন আমরা দলমত-নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যা হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নপূরণের একমাত্র পথ।
এই সময়ের বাংলাদেশে তিনি একজন ব্যক্তি মাত্র নন, ব্যক্তির ঊর্ধ্বে গণমানুষের আশা-জাগানিয়া অভিভাবক, তিনি জনমানুষের জননেত্রী, তিনি দেশরত্ন। নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। সকাল-দুপুর-বিকাল-রাত কেটে যায় দেশ ও মানুষের মঙ্গল চিন্তায়। তিনি দীর্ঘ জীবনের সুস্থতা নিয়ে আমাদের মাঝে সজীব থাকবেন- এই প্রত্যাশা আমাদের। আজ এই বিশেষ দিনে মনে পড়ে প্রয়াত কবি ত্রিবিদ দস্তিদারের কবিতার লাইন-‘আপনিই তো বাংলাদেশ।’
লেখক: উপাচার্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে চলা এক ফিনিক্স পাখি। ২৮ সেপ্টেম্বর ৭৭তম জন্মদিনে বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য বিশ্ববাসীর পক্ষ থেকে তাঁর নেতৃত্বের গৌরবকে তুলে ধরা হচ্ছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরাম থেকে অতীতে যেমন তেমনি ২০২৩ সালেও প্রশংসিত হচ্ছেন তিনি; কিন্তু তাঁর এগিয়ে চলার পথটি ছিল না কুসুমিত। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই চলেছেন শেখ হাসিনা। ‘আমার বাংলাদেশ, আমার ভালোবাসা’- এ অমৃতবাণী বাংলাদেশে তিনিই উচ্চারণ করেছেন। তিনি নানা বিশেষণে বিশেষায়িত। সততা, নিষ্ঠা, রাজনৈতিক দৃঢ়তা, গণতন্ত্র, শান্তি, সম্প্রীতি ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের অনন্য রূপকার আর মানব কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ, তার চেয়েও আরও অনেককিছু তিনি। দরদী এই নেতা দুঃখী মানুষের আপনজন, নির্যাতিত জনগণের সহমর্মী তথা ঘরের লোক। তিনি বলেছেন, ‘বাবার মতো আমাকে যদি জীবন উৎসর্গ করতে হয়, আমি তা করতে প্রস্তুত।’ মানবতার দিশারি শেখ হাসিনা দেশের মানুষের জন্য নিজের প্রাণকে তুচ্ছ করতে পারেন নির্দ্বিধায়। সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভরসার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। তাঁকে কেন্দ্র করে, তাঁর নেতৃত্বে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের সবকিছু।
অবাক করা কথা হলো, শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রচেষ্টা ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, যা বাংলাদেশের মাটিতে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার একটি। এটি ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও নৃশংস হামলা, কারণ রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মূল করার জন্যই এটি চালানো হয়। গ্রেনেড হামলায় আহতদের মধ্যে অনেকেরই জীবন এখনো দুর্বিষহ। তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাদের মানব ঢালের ফলে আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেও, কানে আঘাত পান, যার প্রভাবে আজ পর্যন্ত তিনি ভুগছেন। আসলে শেখ হাসিনাকে হত্যা করে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে নির্মূল করাই ছিল আক্রমণের মূল লক্ষ্য। তবে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এই মামলায় ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ এসেছে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দেশ পরিচালনায় চ্যালেঞ্জগুলোকে সামনে এনেছিল; স্পষ্টভাবে চেনা গেছে তাঁর শত্রুদের। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে বিএনপির আমলে ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদীতে শেখ হাসিনা হত্যা চেষ্টা মামলার রায়ে ৯ জনের ফাঁসির দণ্ড ঘোষিত হয়েছে। উপরন্তু ২৫ জনের যাবজ্জীবন, ১৩ জনের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলার মতোই ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সন্ত্রাসীরা। ওই হামলায়ও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো পাবনার ঈশ্বরদীতে ট্রেন বহরে হামলার ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার; কিন্তু অপরাধীরা পার পায়নি। ২৫ বছর পর হলেও ১৯৯৪ সালের সবচেয়ে বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর এই হামলা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনাকে ২১ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। আর যারা সেই চেষ্টা করেছিল তাদের কাউকে হত্যার চেষ্টা করা হয়নি। এখানেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির পার্থক্য। ২১ বার হত্যা চেষ্টার মধ্যে ১৪টি ঘটনায় মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শুধু চারটি মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। এসব হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৬০ জন দলীয় নেতাকর্মী নিহত হওয়ার হিসাব আছে, আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। এসব ঘটনার মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় যাদের প্রাণহানি ঘটেছে সেই পরিবারগুলো বিচার পায়নি এখনো। শেখ হাসিনাকে যতবার হত্যাচেষ্টা করা হয় তার অনেক ঘটনায় মামলাও হয়নি। এমনকি হামলার পর উল্টো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার নজিরও আছে। যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছিল, তার প্রতিটিরই বিচারে সময় লেগেছে এক যুগেরও বেশি। কোনো কোনোটির ২০ থেকে ২৫ বছর। আবার বিচারিক আদালতে রায় এলেও উচ্চ আদালতে একটিরও মীমাংসা হয়নি এখনো। ১৯৮৯ সালে ধানমন্ডিতে হত্যা চেষ্টার রায় আসে ২০১৭ সালে। সময় লাগে ২৮ বছর। ১৯৯৪ সালে পাবনা ঈশ্বরদীতে হত্যা চেষ্টার মামলায় রায় ২০২১ সালে, সময় লেগেছে ২৫ বছরের বেশি।
২০০০ সালে গোপালগঞ্জে হত্যা চেষ্টার মামলায় রায় আসে ২০১৭ সালে। সময় গেছে ১৬ বছর। তবে চূড়ান্ত রায় আসে ২০২১ সালের ২৩ মার্চ। এদিন ওই মামলায় ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক। ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ কলেজের মাঠে ২০০০ সালের ২১ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের পাশ থেকে ৭৬ কেজি ওজনের একটি বোমা উদ্ধার করা হয়। ওই মাঠেই পরদিন শেখ হাসিনার সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। ওই ঘটনায় কোটালীপাড়া থানার উপ-পরিদর্শক ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলাটি দায়ের করেন। এরপর ২০০১ সালের ১৫ নভেম্বর সিআইডির সাবেক এএসপি আব্দুল কাহার আকন্দ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। এ ঘটনায় হওয়া হত্যাচেষ্টা মামলায় ২০১৭ সালের ঢাকার দ্রুতবিচার আদালত-২ এর বিচারক মমতাজ বেগম ১০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টও আসামিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলায় হত্যা চেষ্টার রায় আসে ২০১৮ সালে। সময় লেগেছে ১৪ বছর। জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা থেকে বেঁচে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা।
১৫ আগস্ট শেখ হাসিনাকে স্পর্শ করতে না পারলেও বুলেট তাঁর পিছু ছাড়েনি। দেশে ফেরার পর পিতার মতো তাঁকেও হত্যার চেষ্টা হয়েছে বারবার। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালে দুটি (১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি, ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট), ১৯৯১ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলে চারটি (১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, ৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, ’৯৫ সালের ৭ মার্চ, ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ), ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে চারটি (২০০০ সালের ২২ জুলাই, ২০০১ সালের ৩০ মে, ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর), ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে চারটি (২০০২ সালের ৪ মার্চ, ২০০২ সালের ২৬ আগস্ট, ২০০৪ সালে ২ এপ্রিল, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট), সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি (২০০৭ সালে ১/১১-পরবর্তী কারাবন্দি থাকা অবস্থায় খাবারে বিষ প্রয়োগ করে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়) এবং আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলে চারটি হত্যা চেষ্টার কথা জানা যায় (২০১১ সালে শ্রীলংকার একটি সন্ত্রাসবাদী দলের প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়)। বঙ্গবন্ধুর খুনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শরিফুল হক ডালিম এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ জন অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য সামরিক অভ্যুত্থানের চক্রান্ত করে। ২০১৪ সালের শেষদিকে প্রশিক্ষিত নারী জঙ্গিদের মাধ্যমে মানববোমায় তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। ২০১৫ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে কারওয়ান বাজার এলাকায় তাঁর গাড়িবহরে বোমা হামলার চেষ্টা চালায় জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যরা। তবে ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়া জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নান শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করেছে।
গোপালগঞ্জে ২০ জুলাই ২০০০, খুলনায় ৩০ মে ২০০১, সিলেটে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০১ এবং ঢাকায় ২১ আগস্ট ২০০৪ সালের চেষ্টা ছিল অন্যতম। আফগানিস্তানের যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হয় মুফতি হান্নান। একপর্যায়ে সে এদেশে ধর্মভিত্তিক উগ্রপন্থার সূচনাকারী হুজি-বির অন্যতম শীর্ষ নেতায় পরিণত হয়। তার নেতৃত্বে এ দেশে হুজি-বি প্রথম বোমা হামলা চালায় ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে। এরপর সাত বছরে অন্তত ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনা ঘটায় তারা। এসব ঘটনায় নিহত ১০১ এবং আহত হয়েছেন ৬০৯ জন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনার পর সে সময় খালেদা-নিজামী জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের তত্ত্বাবধানে একটি তদন্ত কমিটি করে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হয়েছিল; নষ্ট করা হয়েছিল গ্রেনেড হামলার সব আলামত। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে জজ মিয়াদের কোনো দোষ খুঁজে পায়নি। বরং ২০১১ সালের ৩ জুলাই ৫২ জনকে আসামি করে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হলে প্রকৃত অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মনে রাখতে হবে বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়েছিল আইএসআইয়ের সক্রিয় সহযোগী হিসেবে। দল, প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য এ সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে ভূমিকা পালন করে।
উগ্রপন্থিরা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি শেখ হাসিনা তথা এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার নেতৃত্বকে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল। তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ শেখ হাসিনা ফিনিক্স পাখির মতোই ভস্ম থেকে আবার নির্মাণ করেছেন নিজেকে। যে নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। জন্মদিনে তাঁর শতায়ু কামনা করছি।
লেখক: বঙ্গবন্ধু গবেষক, লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email: [email protected])
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তানের স্বৈরশাসন এবং ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী ২১ বছর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামরিক শাসন-শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হবার পরও বাংলাদেশের জনগণ কখনো উন্নত, সমৃদ্ধ ও মহৎ জীবনের স্বপ্ন ত্যাগ করেনি। এক সমৃদ্ধ আনন্দময় জীবন সৃষ্টির জন্য তাঁরা বারবার সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছেন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে কঠোর ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতার নবীন সূর্যের উদয় বাংলাদেশের মানুষের জন্য নবজীবন সৃষ্টির উজ্জ্বল সম্ভাবনার দুয়ার অবারিত করে। এই নবজীবন সৃষ্টির লক্ষ্যে স্বাধীনতার নতুন প্রভাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনসহ বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনের আশায় দেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখে। বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) প্রণয়নের পর ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জিত হয়। কৃষিতে বাম্পার ফলন হয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল খাতে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গৃহীত নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নের সুফল যখন মানুষ পেতে শুরু করে এবং অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়ায় ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশ নিমজ্জিত হয় অমানিশার নিকশ কালো অন্ধকারে। দূরদর্শীতাহীন নেতৃত্ব, রাষ্ট্র পরিচালনার অদক্ষতা এবং সর্বব্যাপী নৈরাজ্য-সন্ত্রাস দেশকে গভীর সংকটের মধ্যে নিপতিত করে। দিশেহারা জনগণ এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এমনই একজন দূরদর্শী ও যোগ্য নেতার প্রতীক্ষায় থাকে, যে নেতা তাদের দেবেন উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনের সন্ধান।
১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনার ভারতে ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে স্বদেশ প্রত্যার্বতনে জনগণের সেই অভাবই যেন পূরণ হয়। তিনি শুরু করেন স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন। দেশের জনগণ তাঁর ওপর আস্থা রাখে এবং আবারও চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। সুদীর্ঘ ২১ বছরের স্বৈরশাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণ তাকে ক্ষমতাসীন করে। শুরু হয় বাংলাদেশের মানুষের জন্য গৌরবময় জীবন এবং উন্নত ও সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তোলার পথে নবযাত্রা। এই অভিযাত্রায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব রাষ্ট্র পরিচালনার সময়কাল ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত। এই সময়ে তিনি বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন অনন্য উচ্চতায়। অতি সম্প্রতি ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৪০ সালে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ ২০টি অর্থনীতির একটি হাব হবে। আর ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) ২০২২ সালেই জানায়, বর্তমান ধারায় অর্থনৈতিক বিকাশ অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বে ২৫তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। প্রশ্ন জাগতে পারে কীভাবে বাংলাদেশর উন্নয়ন বিশ্বের বিস্ময়ে পরিণত হলো? এক কথায় এর উত্তর হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের তিনটি অসাধারণ গুণ- সততা, সাহস ও দূরদর্শিতা।
বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্রটি বোঝার জন্য সংক্ষেপে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শাসনামলের কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে গড় জিডিপি ছিল সাড়ে ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের শাসনসহ আট বছরে অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশের ধারায় ছেদ পড়ে। ২০০৯ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা আবারও ক্ষমতাসীন হন। তার টানা তিন মেয়াদের শাসনের ১৪ বছর পার হয়েছে। এই সময়ে এক যুগে গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ শতাংশের ওপরে এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ শতাংশ অতিক্রম করে। ২০০৫-২০০৬ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ ডলার ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ২ হাজার ৭৬৫ ডলার। ওই সময়ে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ, করোনা মহামারির আগে তা কমে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৫ শতাংশে। ২০০৫-২০০৬ সালে জিডিপির আকার ছিল ৭১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন। বর্তমানে তা ৪৬০ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্য দশমিক ৭৪৪ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১ বিলিয়ন ডলারের কম, বর্তমানে তা ২১ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৬১ হাজার কোটি টাকা, যা বর্তমানে ১০ গুণের বেশি। ঐ সময়ে গড় আয়ু ছিল ৫৯ বছর, বর্তমানে ৭৩ দশমিক ৫৭ বছর। শিশু মৃত্যুর হার ৮৪ থেকে কমে হয়েছে ২১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০০৫-২০০৬ সালে খাদ্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন। আর বর্তমানে তা ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টনের বেশি। ঐ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট আর বর্তমানে তা ২৫ হাজার ২২৭ মেগাওয়াট।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সততা, সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার কথা। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে কোন দুর্নীতি হয়নি বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন তিনি। কানাডার আদালতে তা প্রমাণিত হয়। নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পের বাস্তবায়ন করায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর স্বচ্ছ ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়। দ্বিতীয়ত, তাঁর সাহসিকতা। জেনারেল জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের বৈধতা দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধী এবং পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচারের উদ্যোগ নিয়ে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। দেশি-বিদেশি প্রবল চাপ থাকা সত্ত্বেও সাহসের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী ও পঁচাত্তরের খুনিদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতির চির বিলোপ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তৃতীয়ত, দূরদর্শিতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী চিন্তা ও স্বপ্নের ফসল ডিজিটাল বাংলাদেশ। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার দিন বদলের সনদ রূপকল্প ২০২১-এর মূল উপজীব্য হিসেবে এর আবির্ভাব। খ্যাতিমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয় ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের আর্কিটেক্ট। বিগত প্রায় ১৩ বছর ধরে তিনি সামনে থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা যে একটি আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে কতটা দূরদর্শী ঘোষণা ছিল তার প্রমাণ এর সফল বাস্তবায়ন। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ এমন কোনো খাত নেই, যেখানে প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান হচ্ছে না। দেশে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। দেশের ১৮ কোটির বেশি মানুষ মোবাইল সিম ব্যবহার করে। ১৩ কোটির বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে সরকারি-সেরকারি নানা সেবা। প্রযুক্তি ব্যবহারে মানুষের অভিযোজন ও সক্ষমতায় গ্রাম ও শহরের বৈষম্য দূর হচ্ছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাফল্যের ভর করেই দূরদর্শী, প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন। আমরা সকলেই জানি যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে ডিজিটাল বাংলাদেশ ছিল সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘোষণা। ঠিক একইভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণাও ইতোমধ্যে মানুষের মনে শুধু আলোড়ন সৃষ্টিই করেনি নব আশার সঞ্চার করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি-বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের তত্ত্বাবধানে স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভ- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটির ওপর ভিত্তি করে সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ কতটা আধুনিক একটি কর্মসূচি তা এর চার স্তম্ভের লক্ষ্য থেকেই বোঝা যায়। সম্পূর্ণ পরিকল্পনা শর্টটার্ম, মিডটার্ম এবং লংটার্ম টাইমফ্রেমে সাজানো হয়েছে। বিস্তৃত পরিসরে না গিয়ে সংক্ষেপে চারটি স্তম্ভের ওপর আলোকপাত করা হলো। যেমন: স্মার্ট সিটিজেন হবেন বুদ্ধিদীপ্ত, দক্ষ, উদ্ভাবনী, সৃজনশীল, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত দেশপ্রেমিক এবং সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী মানসিকতা সম্পন্ন নাগরিক। প্রত্যেক নাগরিকের প্রযুক্তিতে অভিযোজন ও অভিগম্যতা নিশ্চিত করা হবে। স্মার্ট ইকোনমিতে গড়ে উঠবে ক্যাশলেস, সার্কুলার (বৃত্তাকার), উদ্যোক্তামুখী, গবেষণা ও উদ্ভাবননির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি। আর্থিক লেনদেন হবে নগদবিহীন। পণ্যের পুনঃব্যবহার করে বৃত্তাকার অর্থনীতি গড়ে তোলা হবে। ফলে শূন্য বর্জ্য উৎপাদন হবে। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই), রোবটিক্স, ব্লকচেইন, ড্রোনসহ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অগ্রসর প্রযুক্তিনির্ভর গবেষণা ও উদ্ভাবনী সমাধান হবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। স্মার্ট গভর্নমেন্ট হবে নাগরিককেন্দ্রিক, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক। কাগজবিহীন, উপাত্তনির্ভর, আন্তঃসংযুক্ত, আন্তঃচালিত, সমন্বিত, স্বয়ংক্রিয়। যোগাযোগে কাগজের ব্যবহার হবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে। অগ্রসর প্রযুক্তির ব্যবহার করে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, বিচার ব্যবস্থার মতো জরুরি খাতগুলো পরিচালিত হবে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে। স্মার্ট সোসাইটি নিশ্চিত করবে বৈষম্যমুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক এক সমাজব্যবস্থা। সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ সহনশীল সমাজ, যা হবে নিরাপদ ও টেকসই। আর্থিকসহ সকল ধরনের সেবায় নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা হবে। এর মাধ্যমে গড়ে তোলা হবে স্মার্ট বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের সুপারিশ পেয়েছে। ন্যায্য, সত্য ও মানুষের কল্যাণের পক্ষে সোচ্চার দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ বিনির্মাণের যে ভিশন ঘোষণা করেছেন তাতে শক্তি, সাহস, সক্ষমতা ও প্রেরণা জুগিয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। আগামী দিনে আবারও ক্ষমতাসীন হলে ২০৪১-এর আগেই বাংলাদেশ হবে বুদ্ধিদীপ্ত, উদ্ভাবনী ও সমৃদ্ধ উচ্চ অর্থনীতির আধুনিক স্মার্ট বাংলাদেশ। আমি প্রধানমন্ত্রীর ৭৭তম জন্মদিনে সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
লেখক: জুনাইদ আহমেদ পলক, এমপি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী
ই-মেইল: [email protected]
আল্লাহর ওহি যাঁর ওপর নাযিল হয়েছে তিনি হলেন আল্লাহর নবী। আর আল্লাহর কেতাব যাঁর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে তিনি হলেন আল্লাহর রাসুল। আল্লাহ মানব জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য যুগে যুগে তাঁর মনোনীত শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন যে, হে ফেরেশতাগণ আমি জগতে মানুষকে আমার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছি। আল্লাহর এই ঘোষণা থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, আল্লাহ যুগে যুগে মানবকুল থেকে নবী বা রাসুল প্রেরণের প্রথা প্রচলিত রেখেছেন। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী সর্বনিকৃষ্ট এবং অশুভ যুগে পরিণত হয়েছিল। হজরত ঈসা (আ.)-এর প্রচারিত আসল ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীতে একত্ববাদের নামগন্ধ পর্যন্ত ছিল না। তখনকার যুগে পৃথিবীতে অন্যায়, পাপ এবং কুসংস্কারের মাত্রা এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, মানুষ তার প্রকৃত লক্ষ্য পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল। আরব দেশ তখন সব ধরনের পাপ আর অধর্মের কেন্দ্রস্থল ছিল। মদ, জুয়া যেমন আরবদের গৌরবের ব্যাপার ছিল, তেমনি খুন-খারাবি, লুটতরাজও তাদের দৈনন্দিন কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ বলে গণ্য করত। তা ছাড়া পরনিন্দা ও আত্মপ্রশংসা তাদের মজ্জাগত স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। মূর্তিপূজায় তারা শত শত মূর্তি স্থাপন করে রেখেছিল। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে তারা সেসব মূর্তির সাহায্য প্রার্থনা করত। এমনি সময় পৃথিবীতে একজন নবীর আবির্ভাব আবশ্যক হয়ে ওঠে। আরব জাতির এমন ভয়াবহ সময়ে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে আরবের শ্রেষ্ঠ কোরায়েশ বংশের সর্দার আবদুল মোতালেবের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র হজরত আবদুল্লাহ (রা.)-এর ওরসে বিবি আমিনার গর্ভে যে সন্তান জন্মলাভ করে তিনি হলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মাতৃগর্ভে থাকতেই এ পৃথিবীর বুকে অনেক আলৌকিক এবং আশ্চর্য ধরনের ঘটনা ঘটে যায়। স্বপ্নযোগে বিবি আমেনাকে জানানো হলো যে, তিনি সৃষ্টির সেরা মানবকে গর্ভে ধারণ করেছেন। যখন তিনি ভূমিষ্ঠ হন তখন তাঁর নাম ‘মুহাম্মদ’ রাখার জন্যও স্বপ্নাদেশ পেলেন বিবি আমেনা। বিবি আমেনা বলেন, ‘হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন ভূমিষ্ঠ হয় তখন তাঁর সঙ্গে এমন এক অপূর্ব আলো বিচ্ছুরিত হয়, যা পৃথিবীর পূর্ব এবং পশ্চিমদিকের সবকিছুকে আলোকিত করে ফেলে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মাতৃগর্ভে থাকতেই অথবা তার বহু আগে এ পৃথিবীতে তাঁর শুভাগমন সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের তারিখ এবং সময়কাল সম্পর্কে জানা যায়, ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার ভোরে তিনি মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের পূর্বে তার পিতা হজরত আবদুল্লাহ ব্যবসার উদ্দেশে সিরিয়া গিয়েছিলেন। কিন্তু ফেরার পথে তিনি অসুস্থ হয়ে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মের পর থেকে তখনকার আরবি প্রথা অনুযায়ী ধাত্রীদের হাতে তিনি পালিত হন। বিধবা হালিমা নামে একজন ধাত্রী তাঁকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত লালন-পালন করেন। তিনি যখন পাঁচ বছর বয়সে উপনীত হন, তখন তাঁর মাতা বিবি আমিনা ইন্তেকাল করেন। মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। কিন্তু তিনি তাঁর দাদার আদরও বেশিদিন লাভ করতে পারেননি। দাদার মৃত্যুকালে বালক হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দায়িত্ব তাঁর চাচা আবুতালেব গ্রহণ করেন। কিন্তু আর্থিক অসুবিধার কারণে তাঁর চাচা তাঁকে লেখাপড়া করার সুযোগ দিতে পারেননি। মেষ, ছাগল চরানোর কাজে হজরত মুহাম্মদ (সা.) সব সময় নিয়োজিত থাকতেন। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি যখন চাচার সঙ্গে ব্যবসায়িক কাজে সিরিয়া যাচ্ছিলেন, তখন পথিমধ্যে বোহায়রা নামক একজন খ্রিষ্টান পাদ্রী তাঁদের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত শেষ নবীর গুণাবলি তাঁর মাঝে দেখতে পেয়ে তাঁর চাচার কাছে বলেন, এই বালকের মাঝে শেষ নবীর লক্ষণগুলো বিরাজমান। কাজেই ইহুদি সমাজ তাঁকে পাওয়া মাত্রই হত্যা করবে। এ কথা শোনার পর তাঁর চাচা আবুতালেব সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) যৌবনে পদার্পণ করার পর তাঁর চালচলন, আচার-ব্যবহার, কার্যকলাপে মক্কাবাসীর মন জয় করেন। তখনই মক্কাবাসী তাঁকে আল-আমিন উপাধিতে ভূষিত করেন। যখন তিনি চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হন, তখন হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সুরা ইকরার প্রথম পাঁচটি আয়াত পড়ার জন্য বলেন। তিনি বলেন, ‘আমি তো পড়তে জানি না’। তখন হজরত জিব্রাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বারবার আলিঙ্গন করেন। এ সময় তাঁর সমস্ত শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে যায়। অবশেষে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পাক জবান থেকে হঠাৎ করে ওই পাঁচটি আয়াত বের হয়ে যায়। এ হলো পৃথিবীতে অবতীর্ণ সর্বপ্রথম কোরআন শরিফের অংশ। এই অভাবনীয় ও জ্যোর্তিময় ফেরেশতা দেখে রাসুলুল্লাহ (সা.) ভীত হয়ে পড়েন। পরবর্তী সময়ে ক্রমান্বয়ে ওহির মাধ্যমে তাঁর ওপর পবিত্র কোরআন নাযিল হতে থাকে এবং তিনি কোরআনের বাণী তাঁর আপন লোকদের কাছে প্রচার করতে শুরু করেন। নামাজ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই বলেছেন ‘এমন মনোযোগ সহকারে নামাজ পড়, যেন তুমি স্বয়ং খোদাকে দেখেছ। যদি তাও সম্ভব না হয়, তবে অন্তত মনে কর খোদা তোমাকে দেখছেন।’ হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সশরীরে মেরাজে গমনের কথা সর্বপ্রথম সত্য বলে স্বীকার করে (সত্যবাদী) উপাধিতে ভূষিত হন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুয়ত প্রাপ্তির পর ১০/১২ বছর পর্যন্ত মক্কায় ছিলেন এবং গোপনে খোদার বাণী প্রচার করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আহ্বানে যখন মানুষ ইসলামের পতাকাতলে সমেবেত হতে থাকে, তখন বিধর্মীরা ইসলামের প্রচার রোধ করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারীকে বিভিন্নভাবে অত্যাচার করতে থাকে। তাদের অত্যাচারের সীমা যখন ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য খ্রিষ্টান রাজা নাজ্জাশীর রাজ্য আবিসিনিয়ায় পাঠিয়ে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) খোদার আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত মক্কায় অবস্থান করেন। মক্কার বিধর্মীরা রাজা নাজ্জাশীর কাছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উপস্থাপন করেন। কিন্তু সেসব অভিযোগ রাজার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। রাজা নাজ্জাশী তাঁর রাজ্যের মুসলমানদের শান্তিতে বসবাস করার অনুমতি প্রদান করেন। ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহকে (সা.) যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তার দৃষ্টান্ত বিরল। বিধর্মীরা ইসলাম ধর্ম প্রচার রোধে নানা ষড়যন্ত্র, অত্যাচার, গুজব প্রচার করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তখন আল্লাহ আদেশ জারি করেন যে, ‘আমার দ্বীন রক্ষার্থে কেবল তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ কর, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে। মুসলমানদের সঙ্গে বির্ধমীদের বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বদরের যুদ্ধ, ওহুদের যুদ্ধ, খন্দকের যুদ্ধ, খায়বারের যুদ্ধ, মক্কা বিজয়, হোনাইনের যুদ্ধ, তাবুকের যুদ্ধ। এসব যুদ্ধে মুসলমানদের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। হিজরির দ্বিতীয় বর্ষে আল্লাহ সর্বপ্রথম জেহাদের হুকুম দেন এবং হিজরির নবম বর্ষে তাবুকের যুদ্ধই হলো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের শেষ যুদ্ধ। এই দীর্ঘ আট বছরের সংগ্রামে মুসলমান এবং বিধর্মীদের উভয় পক্ষের প্রায় এক হাজার আঠারো জনের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু এর ফলে লাখ লাখ মানুষের জীবন ও রক্ষা পেয়েছে। সামান্য কারণে-অকারণে গোত্রে গোত্রে বংশানুক্রমে যুদ্ধে যে শতসহস্র প্রাণহানি ঘটত, তা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। সমাজ থেকে লুন্ঠন, হত্যা, অযথা দাঙ্গা-হাঙ্গমা ও খুন-খারাবি সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হলো। জুয়া, মদ, পরনারী হরণ ইত্যাদি লোপ পেল। দেবদেবী ও মূর্তিপূজার অবসান ঘটল। দুর্ধর্ষ আরব বেদুইনরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আদর্শ চরিত্রবান হয়ে পড়ল। ন্যায়বিচারের ভিত্তি স্থাপিত হলো। এ ধরনের আমূল পরিবর্তন একমাত্র হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কারণে সম্ভব হয়েছে। সর্বশেষ নবী হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে দীর্ঘ ২৩ বছর খোদার বাণী প্রচার করেন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার জোহরের নামাজের সময় মাত্র ৬৩ বছর বয়সে এই পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিলেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এই দিনটি মুসলমানদের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীর সব মুসলমান যথাযথ মর্যদার সঙ্গে দিনটি পালন করে থাকে।
লেখক: প্রাবন্ধিক।
জনগণের একান্ত প্রার্থনা, গভীরতম কামনার অভীষ্ট ফলস্বরূপ আপনি আজ যুগপ্রবর্তক জননেতা হিসেবে পরিগণিত। বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রার অগ্রভাগে থেকে আপনি জনগণকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, সুস্থতা ও শিক্ষায় মানোত্তীর্ণ স্বদেশ প্রতিষ্ঠার দিকে। এ যাত্রাপথে কোনো বাধা, প্রতিবন্ধতা, বৈরিতা, জেল-জুলুম, প্রাণসংশয়কারী হামলা কিছুই আপনাকে দমাতে পারেনি, কখনো পারবেও না। বরং যতই আপনার ওপর আঘাত আসবে, যতই বাধা-বিপত্তি এসে আপনার পথরোধ করতে চাইবে, ততই আপনি আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবেন। আপনার সুবিবেচনাপ্রসূত ও সুনিপুণ নেতৃত্বের অনুসরণে গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চলতে চলতে আমরা এসব কথা জেনে গিয়েছি। আমরা জানি, আপনার জাদুস্পর্শে সব নেতিবাচকতা রূপান্তরিত হয়ে যায় নবযুগ সৃজনকারী ইতিবাচকতায়।
ভারতে জি-২০টিতে অংশগ্রহণসহ আমেরিকায় জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদান করার জন্য আপনার এ বছরের জন্মদিন নানাভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সফর দুটি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
আপনার পিতা, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন একজন আদর্শ যুগপ্রবর্তক নেতা। শ্যামলবাংলার জলে-হাওয়ায় পরিপুষ্ট এই নেতা উঠে এসেছিলেন সরাসরি বাঙালির সামষ্টিক মুক্তির গূঢ়ৈষণা হৃদয়ে ধারণ করে। জাতির সে চাওয়া তিনি পূর্ণ করেছিলেন, যার প্রমাণ তাঁর জীবনেতিহাসের পরতে পরতে। কিন্তু জাতির কতিপয় বিপথগামী সন্ত্রাসী পিতার সেই কালজয়ী অবদানের প্রতিদান দিয়েছে চরম কৃতঘ্নতায়।
পিতৃহত্যার মহাপাতকের পর জাতি আবার ডুবে গিয়েছিল নৈরাশ্যের এক অতলান্ত কৃষ্ণবিবরে, আর তার বুকের ভেতর থেকে আবারও গুমরে গুমরে উঠছিল আলোর আকাঙ্ক্ষা। আবারও আপামর বাঙালির প্রাণ আকুল হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল আরেকজন নেতাকে, যিনি তাদের তমসাবৃত জীবনকে আবার আলোকের অভিযাত্রী করে তুলতে পারবেন, জাতির পিতার মতোই।
সমগ্র জাতি যখন শোকে, ভয়ে মুহ্যমান, দুঃশাসনের জগদ্দল পাথর যখন তাদের বুকের ওপর চাপা, তখন কেউই তাদের সেই প্রার্থনাকে পূর্ণ করতে পারেনি, সেই অনির্দেশ্য ভবিতব্যের তমসাবৃত প্রহেলিকায় বঙ্গবন্ধুর রক্তই জবাব দিল সে প্রার্থনার। বঙ্গবন্ধুর ঔরসজাত কন্যা, আজকের প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা, আপনি এসে জাতির হাল ধরলেন। পিতার প্রতিষ্ঠিত দল আওয়ামী লীগের প্রতীক ‘নৌকা’ আরও একবার সার্থকনামা হয়ে উঠল, আরও একবার জাতিকে পৌঁছে দিল অকূল থেকে কূলে। সবাই দেখতে পেল, স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির নৌকায় আবারও যাত্রী হয়েছে এ দেশের লাখো কোটি নাঙ্গা ভুখা, লাঞ্ছিত-নিপীড়িত মানুষ, আর আরও একবার ‘সেই নাওয়েতে হাল ধরেছে গোপালগঞ্জের মাঝি’, যাঁর নাম শেখ হাসিনা, প্রভাতসূর্যের মতো যাঁর ‘আঁধার বিদার উদার অভ্যুদয়’।
প্রিয় নেত্রী, জাতির পিতার মতোই আকাশচুম্বী আত্মবিশ্বাস নিয়ে হাজারো বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আপনি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে। জনকল্যাণমুখী কাজের মধ্য দিয়ে আপনি গণমানুষের অন্তরের অন্তস্থলে ঠাঁই করে নিয়েছেন। আপনি আমাদের আত্মার আত্মীয়, আস্থার প্রতীক, উন্নয়নের উৎসমুখ। এ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে বিশিষ্টজন, প্রত্যেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে আপনার নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দু’দশক আর একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দু’দশকজুড়ে আপনার সংগ্রাম আর নেতৃত্বের যে সোনাঝরা ইতিহাস রচিত হয়েছে, তা কালের প্রেক্ষাপটে মহাকাব্যিক। আপনি আজ বিশ্বের বিস্ময়, ‘নিউ স্টার অব দা ইস্ট’, একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, সংগঠক ও মনস্বী লেখক।
আপনি বলেছিলেন, ‘আমার রাজনীতি হচ্ছে জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করা। আমরা তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করতে চাই, যেখানে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগণ এক মানবেতর জীবনযাপন করে।’ আপনার সে-কথা আপনি রেখেছেন। পিতার মতোই দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সার্বক্ষণিক চিন্তা আপনার। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনি দরিদ্র মানুষের অবস্থার উন্নতির জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প, আদর্শ গ্রাম, গৃহায়ণ তহবিল, ঘরে ফেরা কর্মসূচি ইত্যাদি বহু কল্যাণমুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ দেশে আপনিই সর্বপ্রথম চালু করেছেন বয়স্ক ভাতা, দুস্থ, স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের ভাতা আর বিধবা ভাতা।
বিশ্ব নেতৃত্বের প্রসারিত ক্ষেত্রেও আপনি আজ সুউচ্চ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত। বিশ্ব জলবায়ু নিয়ে সাহসী ও সময়োপযোগী বক্তব্য দিয়ে আপনি সবার সপ্রশংস নজর কেড়েছেন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনে বিশেষ জাতিসংঘ পুরস্কার অর্জন করেছেন। শিশুমৃত্যু হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য আপনার বাংলাদেশকে এ পুরস্কার দিয়েছিল জাতিসংঘ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই এ পুরস্কার পেয়েছে। এখন আপনার সুযোগ্য নেতৃত্বে এসডিজি অর্জনের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে দৃঢ় নিশ্চিত পায়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
একজন দূরদর্শী নেতা হিসেবে এখন আপনি ২১০০ সালের বাংলাদেশ নির্মাণের কথা ভেবে ‘ডেল্টা প্ল্যান’ মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন। সেই লক্ষ্যে সুদূরপ্রসারী সুফল দিতে পারে এমন বৃহৎ পরিধির প্রকল্প গ্রহণে আপনার সাহসিকতা আপনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের স্বনির্ভরতার আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে। সেই অনির্বাণ সাহসের রূপায়ণ ঘটেছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সার্থক বাস্তবায়নে, যা আপনার এক অদম্য মহাকাব্যিক সাফল্যের প্রতীক।
আপনার হাত ধরেই জাতির গর্ব ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে মহাকাশেও চলছে দেশের জয়যাত্রা। আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বহির্বিশ্বে সমীহ আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। আপনার আমলে বিদ্যুৎ সেক্টরে আজ আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ সমস্যার স্থায়ী সমাধানকল্পে দ্রুত এগিয়ে চলেছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণকাজ। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ অচিরেই বাস্তবায়িত হবে। আপনার সফল দিকনির্দেশনায় নির্মাণকাজ সুসম্পন্ন হয়ে উদ্বোধনের অপেক্ষায় ঢাকায় মেট্রোরেল ও চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল। আপনার কর্মকাণ্ড একের পর এক পাচ্ছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আপনি আজ ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বমানবতার জননী হয়ে উঠেছেন।
বিশ্বমানবতার জননী, মহান জননেতা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আজ ৭৬তম জন্মবার্ষিকী। আপনার অতল কৃতিত্বের কথা শতমুখে বলেও শেষ করা যাবে না। জীবনের এই পরিণত বয়সে পৌঁছেও আপনার অবিশ্রান্ত জনকল্যাণকামী কর্মযজ্ঞের বিরাম নেই। আমরা আপনার সুস্থ, নীরোগ, কর্মময় শতায়ু কামনা করি।
লেখক: কলামিস্ট, গবেষক, শিক্ষাবিদ, ফোকলোরিস্ট, অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ ও সাবেক উপউপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশন চলছে। কীর্তিমানদের সেই আসরে দ্যুতি ছড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর অনন্য উচ্চারণে ভাষণের একপর্যায়ে বললেন, ‘বাংলাদেশ ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হবে। আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান বৈশ্বিক সঙ্কটগুলো আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। তবুও উন্নয়ন সহযোগী এবং উন্নত দেশগুলোকে আমাদের এ যাত্রায় তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি; যা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় আমাদের জন্য সহায়ক হবে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য বিশেষ সুবিধাসমূহ আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যাপ্তিকাল মোতাবেক প্রদান করার জন্য আমি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এ বছরের মার্চ মাসে কাতারের দোহাতে অনুষ্ঠিত এলডিসি-৫ সম্মেলনে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য অপেক্ষমান দেশগুলোকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। আমি জাতিসংঘ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের দোহা কর্মসূচির সম্পূর্ণ ও কার্যকর বাস্তবায়নের আহ্বান জানাচ্ছি।’
উল্লেখ্য, প্রথম দফায় ২০১৮ সালের মার্চে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্য হিসেবে সিডিপির সুপারিশ লাভ করে। নিয়ম হচ্ছে- এলডিসি থেকে বের হতে সিডিপির পরপর দুটি পর্যালোচনায় উত্তরণের স্বীকৃতি পেতে হয়। এ স্বীকৃতি পাওয়ার পর আরও তিন বছর এলডিসি হিসেবে থাকে একটি দেশ। তারপর উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু হয়।
অর্থাৎ হিসাব করেই দূরদর্শী নেত্রী সেদিন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা তুলে ধরেছেন। জাতিসংঘ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। উপরন্তু সেদিন জননেত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করে মানবজাতির কল্যাণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সম্প্রতি বিএনপি-জামায়াতসহ বেশকিছু অপশক্তির অপতৎপরতায় বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষার বিষয় নিয়ে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব সোচ্চার হয়েছে। গত সাড়ে ১৪ বছরে শাসনকার্য পরিচালনায় সাংবিধানিক স্বচ্ছতার কথা সবসময় বিদেশিদের কাছে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন শেখ হাসিনা। বিশ্বের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপ্রধানরা বিশেষ গোষ্ঠী বা দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয় হওয়ায় তিনি জাতিসংঘে উপস্থাপিত তাঁর দিকনির্দেশনামূলক ভাষণে বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন- ‘এই বছর (২০২৩) আমরা সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ৭৫তম বার্ষিকী পালন করছি। এই মাহেন্দ্রক্ষণে বিশ্ব মানবতার প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে সবার জন্য সমতা, ন্যায্যতা, স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি যাতে উন্নয়নশীল দেশের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টিতে ব্যবহৃত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান সবার মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করে। সবাইকে আইনগত সুরক্ষা প্রদান ও সুবিচার নিশ্চিতকরণে গত এক দশকে বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থার তাৎপর্যপূর্ণ সংশোধন করা হয়েছে। একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে, জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় আমরা সম্পূর্ণরূপে অঙ্গীকারাবদ্ধ। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আমরা সারা বিশ্বের আপামর জনগণের মানবাধিকার সংরক্ষণে অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। আজ এই অধিবেশনে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করতে চাই, বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যাবে।’
লেখা বাহুল্য, ‘বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত’ করে চলেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর গতিশীল ও সাহসী নেতৃত্বে বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশটি এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়ন চমক ও উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে উঠেছে। কারণ সবক্ষেত্রে এ দেশের অসাধারণ সাফল্য বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
২.
২৮ সেপ্টেম্বর সংগ্রামী ও দরদি জননেত্রী শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পথযাত্রায় তিনি বিশ্বনেত্রী এবং অন্যতম সফল রাষ্ট্রনায়ক। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ৬ জানুয়ারি, ২০০৯ সালে সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণের পর বছর শেষে ১৫ বছর পূর্ণ করতে চলেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
শেখ হাসিনা একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, একজন দার্শনিক এবং একজন দূরদর্শী নেত্রী। তিনি ২০০৮ সালে জনপ্রিয় দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ভিশন ২০২১’ রাখার মধ্যদিয়ে একজন সত্যিকারের নেতা হিসেবে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। জয়ী হওয়ার পর ২০০৯ সালে লিখেছিলেন, ‘রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম আমার। পিতা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যদিয়ে বড় হয়েছি। এক দিন যে আমাকেও তাঁর মতো রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে দেশ পরিচালনা করতে হবে ভাবিনি। সময়ের দাবি আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আমি এই আদর্শ নিয়ে বিগত ২৮ বছর ধরে জনগণের সেবক হিসেবে রাজনীতি করে যাচ্ছি।’ (ভূমিকা, শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র ১)
‘জনগণের সেবক হিসেবে রাজনীতি করার এই মানসিকতা শেখ হাসিনাকে অনন্য করে তুলেছে। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পরবর্তী তাঁর পথযাত্রা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। কবি লিখেছেন- ‘শেখ হাসিনা, আপনার বেদনা আমি জানি। /আপনার প্রত্যাবর্তন আজও শেষ হয়নি।/ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে/আপনি পা রেখেছেন মাত্র। /আপনার পথে পথে পাথর ছড়ানো। /পাড়ি দিতে হবে দুর্গম গিরি, কান্তার মরুপথ।’ কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘পথে পথে পাথর’ কবিতায় অভিব্যক্ত এই কথাগুলোর সত্যতা রয়েছে শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যাচেষ্টার ঘটনায়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রচেষ্টা ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। যা বাংলাদেশের মাটিতে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার একটি। এটি ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও নৃশংস হামলা, কারণ রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মূল করার জন্যই বিএনপি-জামায়াত গং গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল।
৩.
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করতে একজন ব্যক্তির সাহস, সংকল্প এবং আত্মোৎসর্গের প্রয়োজন হয়। একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনার এ সব গুণ রয়েছে। তিনি দেশ ও জনগণের উন্নতির জন্য তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছেন। তিনি হাসিনা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণা ঘোষণা করেছিলেন তা এখন বাস্তবতার পথ অতিক্রম করে স্মার্ট বাংলাদেশের আঙিনায় উপস্থিত হয়েছে। পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল উদ্বোধন, দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সারা দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বড় সাফল্য। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ যখন বাংলাদেশকে এলডিসি গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করেছিল তখন দারিদ্র্যের হার ছিল ৮৩ শতাংশ। বর্তমানে তা ২০ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আওয়ামী লীগ সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদা থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের জন্য দেশের অবস্থান উন্নত হয়েছে। বাংলাদেশ ৩৯৭ বিলিয়ন ডলার জিডিপি নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে ৪১তম অবস্থানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২০২২ সালে তৈরি এক তালিকায় বিশ্বের ৫০টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়া দেশগুলোর মধ্যে শুধু ভারত ও বাংলাদেশ রয়েছে। গত সাড়ে ১৪ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময় এ দেশ বিদ্যুৎ খাতে বিশাল অর্জন করেছে। দেশের জনসংখ্যার শতভাগকে বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে যা ২০০৯ সালে ছিল ৪৭ শতাংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করেছে যা ২০০৯ সালে ছিল ৫ হাজার মেগাওয়াটের নিচে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বড় সাফল্য, বিশেষ করে শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বের প্রতিফলন। আওয়ামী লীগ সরকার সারা দেশে প্রায় ৫০ লাখ গৃহহীন মানুষের জন্য ঘর নির্মাণ করেছে। এটা এই সরকারের গণমুখী অবস্থানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য আমার সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগ ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার পরিবারের ৫০ লাখ মানুষকে বিনামূল্যে ঘর দেওয়া হয়েছে।’
অনেক আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ পাকিস্তান ও ভারত উভয়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দেশের স্বাধীনতার ৫২ বছরে মাথাপিছু আয় ২৭ গুণ বেড়েছে (৯৪ ডলার থেকে ২৫৫৪ ডলার)। বাংলাদেশে আয়ু এখন ৭২.৬ বছর যেখানে ভারতে ৬৯.৬৬ বছর এবং পাকিস্তানে ৬৭.২৭ বছর। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সব অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপের পাশাপাশি হুমকিকে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে জাতি সেই কলঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় সরকারের আমলে দেশে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পায়; কিন্তু শেখ হাসিনা ধর্মীয় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের সবচেয়ে গতিশীল এবং বহুমুখী রাজনৈতিক নেতা এবং নীতি-নির্ধারক, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মতো কিছু স্বল্পমেয়াদি কৌশলের পাশাপাশি আরও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যগুলোর একটি সিরিজ নির্ধারণ করেছেন। বাংলাদেশের জনগণের জন্য তার একটি মূল পরিকল্পনা হলো ভিশন ২০৪১, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের ধারাবাহিকতা, যা জাতিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যেতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসাধারণ সামাজিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন গৌরবে মহিমান্বিত।
উন্নয়নের জন্য নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতির পিতার স্বপ্নকে অন্তর্ভুক্ত করে শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। আসলে তিনিও বঙ্গবন্ধুর মতো দূরদর্শী নেত্রী। তিনি জাতির পিতার বাংলাদেশকে এশিয়ার সুইজারল্যান্ডে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ সঠিক পথে হাঁটছে। বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। মুক্তিযুদ্ধের পর যে অর্থনীতিকে একসময় ‘বেঁচে থাকার কোনো আশা ছাড়া তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল, তা এখন বিশ্বব্যাপী একটি ‘উন্নয়ন অলৌকিক’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রাইসওয়াটার হাউসকুপারসের উদ্ধৃতি দিয়ে, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ২০১৭ সালে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার হবে বিশ্বে ২৩তম। তখন জিডিপির আকার দাঁড়াবে ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। বিনিময় হারের ভিত্তিতেও বড় হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
৪.
শেখ হাসিনা এখন বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর নারী হিসেবে পরিচিত। তিনি তাঁর দূরদর্শিতা, বুদ্ধিমত্তা এবং কৌশলী কূটনীতির জন্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী আইকনে পরিণত হওয়া এই নেত্রী এখন বিদেশে রয়েছেন। প্রতি বছরই তাঁর জন্মদিন জাতিসংঘ ও বিদেশের মাটিতে নানা ব্যস্ততায় অতিবাহিত হয়। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি এবং স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১ বাস্তবায়নে একটি উদ্ভাবনী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সামনের দিনগুলোতে কাজ করতে হবে। আমাদের তরুণ সমাজ যত বেশি ‘স্মার্ট নাগরিক’ হবে এবং ডিজিটাল ডিভাইসগুলো ব্যবহার করতে শিখবে, তত দ্রুত তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। ডিজিটাল বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে স্বাধীন বাংলাদেশে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের অগ্রগতি তারাই সাধন করতে পারবে।
১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার সময় থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনা শত বাধা ও প্রাণনাশের হুমকি সত্ত্বেও সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে জনগণের ভোট ও সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। শেখ হাসিনার অপরিসীম ত্যাগের ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে। ৭৭তম জন্মদিনে কেবল বলব তিনি দীর্ঘজীবী হবেন এবং দেশ পরিচালনায় আরও অনেক দিন সক্রিয় থাকবেন। নেত্রীকে নিয়ে লেখা ‘তিনি আমাদেরই লোক’ কবিতায় কবি রফিক আজাদ লিখেছেন- ‘এই গরিব দেশের প্রতিটি বৃক্ষ ও মাটি তার জন্য কান্না ধরে রাখে নিজস্ব নিয়মে; আমি কি পাথর নাকি- তার জন্য এই দুই চোখে কোনো জল ধরে কি রাখব না?’ নেত্রীর জন্য অশ্রুময় আঁখি নিয়ে দেশপ্রেমের দীক্ষায় প্রতিজ্ঞায় অবিচল থাকব আমরা; কাজ করব আগামী দিনগুলোতে।
লেখক
কোষাধ্যক্ষ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সব বঞ্চনা, শোষণ, নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশের গণপরিষদে গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানটি আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি আদর্শ দলিল হিসাবে বিশ্বে বিবেচিত ও নন্দিত হয়। কল্যাণকামী প্রগতির সহায়ক এই সংবিধানটির মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই মূলনীতিগুলো স্থির করার মধ্যেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের পটভূমির ন্যায্যতা, অপরিহার্যতা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আর তাই বিশ্ব বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে দ্রুত মেনে নিতে ও স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করেনি। বিভিন্ন স্বার্থপরতার সংশোধনীর মাধ্যমে এই ৪টি মূলনীতি এখন কিছু অস্পষ্টতায় ছেয়ে আছে। সংবিধানের সংশোধনী কোনো ব্যতিক্রমী বিষয় নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ও জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে সংবিধান সংশোধনীর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। স্বাধীনতার পরে জনআকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে গণহত্যা, যদ্ধাপরাধীসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা। এই লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী আনা হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পুনর্বাসন, উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কোনো সহজ কাজ ছিল না। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তুলতে বেশ তৎপর ছিল আর এ প্রচেষ্টায় তৎকালীন কথিত অতিডান এবং অতিবাম রাজনীতিবিদরাও সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করে। প্রকাশ্যে জনপ্রতিনিধিদের হত্যা, সরকারি সম্পদে অগ্নিসংযোগ, ডাকাতি, রাহাজানি, টেন্ডারবাজি প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে তারা সদ্যস্বাধীন ও নবগঠিত রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। এ ধরনের একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করা এবং সাধারণ জনগণের মনে স্বস্তি প্রদানের জন্য সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে সংকটকালীন সময়ে অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ গোলোযোগ বা বহিরাক্রমণে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বাধাগ্রস্ত হলে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। তৃতীয় সংশোধানটি করা হয় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন এবং চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময় অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারত সীমানা নির্ধারণ ও তৎসংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এবং অতিডান-বাম রাজনীতির অপতৎরতা রোধ করে বাংলাদেশের প্রগতি ও সমৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের জীবনের মান উন্নয়ন ও ভাগ্য পরিবর্তনে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের জনগণকে দ্বিতীয় বিপ্লবে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। দ্বিতীয় বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা, স্থানীয় সমবায় প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থাপনায় সমবায়ের মাধ্যমে প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষক অর্থাৎ বাংলাদেশের আপামর জনগোষ্ঠীর উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তাদের ভাগ্য উন্নয়ন করা। আর এ কারণে দ্বিতীয় বিপ্লবের আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই বহুল আলোচিত সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনেছিলেন। এই চতুর্থ সংশোধনীর পরেই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ও তাদের সহযোগীরা মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রেখে বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার তাদের কোনো অপতৎপরতাই সফল হবে না। তাই তারা সুযোগ সৃষ্টি করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। অবৈধ দখলদারিত্বকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হয়। স্বার্থান্বেষী শাসকগোষ্ঠী ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করে, পাকিস্তানি চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসের জায়গা থেকে সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংশোধনী বাস্তবায়ন করে। এই সংশোধনী দুটির কোনো রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক তাৎপর্য ছিল না, সম্পূর্ণ ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীস্বার্থ এর পেছনে কাজ করেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত পরে এই সংশোধনী দুটি অবৈধ ঘোষণা করেছে।
সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা পুনরায় প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু তখনো রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ বন্ধ হয়নি, বরঞ্চ তারা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে অস্ত্র চোরাচালান, প্রগতিশীল রাজনৈতিক সমাবেশে হামলা, রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা এবং স্বাধীনতার চেতনা নির্মূল করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছিল। সরকার গণতান্ত্রিক আবরণে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার ও ভোটের অধিকর ধ্বংস করার অপপ্রয়াস চালায়। তবে গণআন্দোলনের মুখে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অনেকটা ত্রুটিপূর্ণ অনির্বাচিত সরকার পদ্ধতি প্রচলন করার বিধান সৃষ্টি করা হয়। ব্যবস্থাটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় উচ্চ আদালতের রায়ে জাতীয় সংসদ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা বিলুপ্ত করে। সংবিধানের মোট ১৭টি সংশোধনীর মধ্যে অন্যগুলো মূলত সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসন এবং রাষ্ট্রীয় আচারবিষয়ক।
২০০৯ সাল থেকে পর পর তিনবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির সহযোগিতায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে স্বাধীনতা যুদ্ধে গণহত্যা, যুদ্ধ অপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধন করে, যার সুফল দেশের সাধারণ মানুষ ভোগ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উচ্চ আয়ের রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে যা বিশ্বে বহুলভাবে প্রশংসিত এবং আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও প্রগতিবিরোধী শক্তি বসে নেই, তারা একত্রিত হয়ে আবার সংবিধানিক সংশোধনী এনে অনির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা কায়েম করে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এ প্রচেষ্টা সফল হলে দেশে আবার স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী পরিবেশ ফিরে আসতে পারে, নির্বাচন ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে, এমনকি দেশের সাধারণ জনগণ তাদের ভোটদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে এ আশঙ্কা থেকে যায়। তাই শুধু ভোট ব্যবস্থাপনা পরিচালনা, তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্য সংবিধানের আর সংশোধনীর প্রয়োজন নেই। বর্তমান সংবিধানের আওতায় আগামীতে কীভাবে একটি স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন অংশগ্রহণমূলক, ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা যায়, সে লক্ষ্যে দেশের প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে কাজ করবে, এটাই এখন দেশের সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা। সাধারণ মানুষের এ প্রত্যাশা পূরণ হলেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মর্যাদা এবং সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন থাকবে।
লেখক : প্রো-উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের অস্থির বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ১৪ সেপ্টেম্বর খুচরা বাজারে প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকা, আলুর দাম প্রতি কেজি ৩৫ টাকা থেকে ৩৬ টাকা এবং পেঁয়াজের দাম ৬৪ টাকা থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাস্তবচিত্র পুরোই উল্টো। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পর থেকে বাজারে নতুন দর কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও এই তিন পণ্যই বিক্রি হচ্ছে আগের বাড়তি দামেই। উপরন্তু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দাপটে কোথাও কোথাও পণ্যের সরবরাহও আগের মতো নেই। বিশেষত আলু নিয়ে তো রীতিমতো তুঘলকি কারবার শুরু হয়েছে।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান মুন্সীগঞ্জের হিমাগার পরিদর্শনের পর দেখতে পান চলতি বছরের এপ্রিলে এই আলুই ২৫ টাকা করে বিক্রি করা হলেও এখন তা ৪০ টাকা কেজি হিসেবে পাইকারি বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে খুচরা বাজারে এই আলুই কোনো কোনো স্থানে ৫০ টাকা বা তার অধিক দরেও বিক্রি হচ্ছে। এ সময় তিনি আলু ২৬ থেকে ২৭ টাকা দরে বিক্রি করতে হবে এমন নির্দেশনা দেন। আর এরপরই দেশের বিভিন্ন জেলায় খুচরা বাজারে আলু বিক্রি বন্ধ করে দেয় আলু মজুতদাররা।
জানা যায়, সরকারি বেঁধে দেয়া দামে আলু বিক্রি করবেন না এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আলু বিক্রি বন্ধ করে দেয় আলু মজুতদার সিন্ডিকেট। এতে পুরো দেশে আলুর সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে অন্যান্য সবজির দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টির দ্রুত সমাধান করতে পারবে এমনটিও অনেকে মনে করছেন না। কারণ ইতিপূর্বেও দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা নানাভাবে জনসাধারণকে জিম্মি করে ভোগান্তিতে ফেলেন। যার জন্য সরকার ও প্রশাসনকে নানারকম বিব্রতকর পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য সিন্ডিকেট ভাঙার মতো সরকার যদি আলু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আলু আমদানির মতো সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেন তবে অবাক হবো না।
কারণ এর আগেও দেখা গেছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার শেষপর্যন্ত আমদানির পথই বেছে নিয়েছে এবং তা প্রতিবারই তাৎক্ষণিকভাবে তা ফলপ্রসূ হয়েছে। তবে ডলার সংকটের এই দুঃসময়ে সরকার যখন ডলার সাশ্রয়ে নানা প্রকল্প কাটছাঁট করছে, তখন পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও কেবল সিন্ডিকেটের কবল থেকে সাধারণ মানুষকে রেহাই দিতে সরকার যখন আমদানির পথ বেছে নেয়, তখন জনমনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, বাজার সিন্ডিকেট কি সরকারের চেয়ে বেশি শক্তিশালী?
আসুন বিষয়টির আরো গভীরে যাওয়া যাক।
কোভিডপরবর্তী সময়ে বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থাকে তালমাতাল করে যে সংকটটি সেটি হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সংকটটি আরো গভীর হয় যখন রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র দেশগুলো বিধিনিষেধ আরোপ শুরু করে। এ সময় থেকেই মূলত ডলার সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করতে শুরু করে। আর এতে দেশে খাদ্যপণ্য আমদানি আগের চেয়ে কমে যায়। মসলা, ফলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু কিছু খাদ্যপণ্যের আমদানি কম হওয়ায় বাজার ব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়।
আর এই সুযোগে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম হুট করে আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে, যার ভুক্তভোগী হয় আপামর জনগণ। এতে বিশেষত মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রশ্রেণি তীব্র সমস্যার সম্মুখীন হয়।
এমতাবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নেয়। এ সব উদ্যোগের মধ্যে ছিল নিয়মিত বাজার মনিটর করা, পণ্যের দাম বেঁধে দেয়া, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করা, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে মাঠপর্যায়ে তদারকি করা প্রভৃতি।
কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে একবার যে পণ্যের দাম বেড়েছে তা আর সহজে কমছে না। ফলে বাধ্য হয়েই সরকারকে বিকল্প পথে হাঁটতে হয়। আর এই বিকল্প পথটিই হচ্ছে পণ্য আমদানি করার উদ্যোগ নেয়া। আর এতেই ম্যাজিকের মতো কাজ হচ্ছে। রাতারাতি যে সব পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে পড়েছিল, তা আমদানির ঘোষণা হওয়ামাত্রই কমতে শুরু করে। আর এতেই বোঝা যাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা আসলে চাইলেই পণ্যের দাম কমাতে পারেন। কিন্তু তারা অধিক লাভের জন্যই জনগণের পকেট কাটছেন।
এখন প্রশ্ন হলো- বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানিই কি তাহলে একমাত্র সমাধান?
এই প্রশ্নের ব্যাপকতা এতই বেশি যে এর উত্তর এক বা দুই কথায় পাওয়া যাবে না। এর জন্য আরো গভীরে যেতে হবে।
খুব সাম্প্রতিক একটি বিষয় দিয়েই উদাহরণ দেয়া যাক। দেশে ডিমের দাম হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। কোনো বড় ধরনের বিপর্যয় না ঘটলে কোনো পণ্যের সংকট বা দাম হুট করে বাড়াটা অস্বাভাবিক। ডিমের ক্ষেত্রে তাই এই অস্বাভাবিকতাকেই সরকার আমলে নিয়ে প্রথমে ডিমের দাম বেঁধে দেয়। তবে তাতেও কাজ না হওয়ায় ৪ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি প্রদান করে।
এ প্রসঙ্গে ১৮ সেপ্টেম্বর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য দেশের বাজারে ডিমের দাম কমিয়ে আনা। সে জন্য চারটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি এক কোটি করে ডিম আমদানি করবে। ডিমের দাম না কমা পর্যন্ত আমরা এটা চালিয়ে যাব।’
এর আগে দেশে ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ার পর কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ডিম আমদানি করতে অনুমতি চেয়েছিল। বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে বাজারে ডিমের দাম না কমলে আমদানির অনুমতি দেয়া হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির এ অনুমতি দেয়। আর প্রতিটি ডিমের বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ টাকা।
জানা যায়, ডিম আমদানির ঘোষণার পরই বাজারে ডিমের দাম হালিপ্রতি দুই টাকা করে কমে গেছে। তবে এটা সহজেই অনুমেয়, যে কোনো আমদানি হুট করেই করা যায় না। এ জন্য ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান আমদানি করার জন্য অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যেতে হয়। ফলে চার কোটি ডিম হুট করেই যে দেশে চলে আসবে সেটিও বলা যাচ্ছে না। তাহলে আমদানি ঘোষণার পর পরই কেন অনেক স্থানে ডিমের দাম কমে গেল? এটা কি তাহলে ব্যবসায়ীদের তৈরি করা কৃত্রিম সংকট? অবস্থাদৃষ্টে কিন্তু সেটাই সবার কাছে মনে হবে।
অন্যদিকে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে প্রতিদিন চার কোটি ডিমের চাহিদা রয়েছে। ডিমের ওই চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে এক দিনের চাহিদা পূরণ করা যায়, শুরুতে সেই সংখ্যক ডিম আমদানি করা হবে। আমদানি করা ডিম বাজারে সরবরাহ বাড়াবে এবং অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী দাম কমিয়ে আনবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট মুরগির খামারের সংখ্যা ২ লাখ ৫ হাজার ২৩১টি। এর মধ্যে নিবন্ধিত খামারের সংখ্যা ৮৫ হাজার ২২৭টি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনা মহামারির আগে দেশে দৈনিক পাঁচ কোটি পিস ডিম উৎপাদন হতো। করোনার সময়ে বেশকিছু মুরগির খামার বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিলের তথ্যানুযায়ী, আগস্ট মাসে ডিমের উৎপাদন চার কোটি পিসের নিচে নেমে যায়।
তবে ডিম আমদানির সিদ্ধান্তকে ভুল সিদ্ধান্ত মনে করে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘ডিম আমদানি না করে পোল্ট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চা আমদানি করা যেতে পারে। এতে উৎপাদন খরচ কমবে, ডিমের দামও কমবে।’ [সময় টিভি অনলাইন: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩]
আমদানি করা ডিমের দামের বিষয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ অবশ্য বলেছেন, দাম আসলে অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে, এখন যদি অনেক বেশি আমদানি করতে দেয়া হয়, তাহলে দাম কমতেও পারে। আর দাম কম না হলে যিনি আমদানি করবেন, তিনি তা করবেন না। কারণ তাকে তো ডিম বাজারে বিক্রি করতে হবে। আমরা যদি মনে করি, ডিম নির্ধারিত দামের নিচে বিক্রি করা যাচ্ছে না, তাহলে আরো আমদানির অনুমোদন দেয়া লাগতে পারে।
তবে বাণিজ্য সচিব এটিও বলেন, অবশ্যই আমরা দেশের যুবসমাজের কর্মসংস্থান দেখব। দেশের মানুষের আর্থিক উন্নয়নে এই শিল্প দেশে গড়ে উঠুক, তা সবাই চায়। সরকারেরও মূল লক্ষ্য এটি। কিন্তু যখন এই সুযোগে বাজার থেকে কেউ বেশি মূল্য নিতে চায় বা ভোক্তাদের জন্য নিত্যপণ্য কেনা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়, তখন আমদানির কথা ভাবতে হবে। আমি মূলত বোঝাতে চাচ্ছি, আমরা আরো আমদানির অনুমতি দেবো কি না, তা বাজার পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। আমরা প্রতিনিয়তই বাজার মনিটরিং করছি। দরকার হলে আরো আমদানি অনুমতি দেবো, দরকার না হলে নাও দিতে পারি। দেশের উৎপাদিত ডিমকে প্রাধান্য দিতে চাই।
একই ঘটনা এর আগে চলতি বছরের মাঝামাঝি আমরা আদার ক্ষেত্রেও দেখেছিলাম। আদার দাম তখন ৪০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এরপর আদা আমদানি শুরু হলেই বাজারে আদার দাম চলে আসে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা কেজিতে। [দৈনিক কালের কণ্ঠ: ২২ মে]
অনুরূপভাবে চলতি বছরেরই জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম হুট করে বেড়ে ৮০ টাকা হয়ে যায়। সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগেও যখন আর কাজ হচ্ছিল না তখন সরকার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়। আর সে ঘোষণার পরপরই পেঁয়াজের দাম রাতারাতি কমে যায়। কারণ ভারত থেকে দেশের তিনটি স্থলবন্দর দিয়ে তখন আমদানি করা পেঁয়াজ আসে গড়ে ১৫ টাকা কেজি দরে।
তিন স্থলবন্দরের কাস্টমস স্টেশনের তথ্যে দেখা যায়, প্রতি চালানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ১৩ থেকে ১৬ সেন্টে। ডলারের বিনিময়মূল্য ১০৮ টাকা ১৭ পয়সা ধরে মানভেদে আমদানিমূল্য দাঁড়ায় ১৪ থেকে ১৭ টাকা ৩০ পয়সা। গড়ে দাম পড়ে কেজিপ্রতি প্রায় সাড়ে ১৫ টাকা। প্রতি কেজিতে করভার গড়ে সাড়ে ৩ টাকা। এ হিসাবে শুল্ক-করসহ পেঁয়াজ আমদানিতে খরচ পড়ে প্রায় ১৯ টাকা।
দৈনিক প্রথম আলোর ৬ জুনের এক প্রতিবেদনে হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি ও খান ট্রেডার্সের কর্ণধার হারুন-উর রশীদ তখন জানিয়েছিলেন, গরমের কারণে পেঁয়াজ নষ্ট হচ্ছে বেশি। সবকিছু ধরেও প্রতি কেজি ২৫-৩০ টাকার কাছাকাছি খরচ পড়তে পারে। ভোক্তাপর্যায়ে এই পেঁয়াজের দাম ৪০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
একই সুরে সুর মিলিয়ে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইদ্রিসও বলেন, ভারতীয় পেঁয়াজ এখনো খাতুনগঞ্জে বাজারজাত শুরু হয়নি। তবে আমদানির প্রভাবে দেশীয় পেঁয়াজের দাম ৮০-৮৫ থেকে কমে এখন ৫০-৬০ টাকায় নেমে এসেছে।
উল্লেখ্য, পেঁয়াজ আমদানি করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংঘনিরোধ বিভাগ থেকে অনুমতি নিতে হয়। এই অনুমতি নিয়েই ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে পারেন আমদানিকারকরা। জানা যায়, কৃষকদের স্বার্থে চলতি বছরের মার্চ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া বন্ধ করে দেয় কৃষি বিভাগ। তাই গত ১৫ মার্চ থেকে ৪ জুন পর্যন্ত দেশের বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি হয়নি। আর এ কারণেই দেশে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা, যারা পরবর্তীতে আবারও পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলে পেঁয়াজের দাম কমিয়ে দেয়।
এখন তাহলে প্রশ্ন হলো, এই যে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি করা হলো ও পরবর্তীতে আমদানি শুরু হলে কমিয়ে দেয়া হলো সেটির নেপথ্য কি? আদৌ কি কোনো সংকট ছিল? নাকি কৃত্রিম সংকটের অজুহাতে মুনাফার হার দ্বিগুণ-তিনগুণ করাই ছিল অসাধু ব্যবসায়ীদের মূল উদ্দেশ্য?
তবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই, আমদানির মাধ্যম এ সব অসাধু ব্যবসায়ীদের পরিকল্পনা বানচাল করা সবসময় সম্ভব হয়। হয়তো সাময়িকভাবে জনসাধারণের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা যায়, কিন্তু পরে এই সিন্ডিকেটই আবারও বাজারকে অশান্ত করে তোলে। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ কিন্তু এই পেঁয়াজই!
১১ আগস্ট ২০২৩-এর দৈনিক ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, জুন-জুলাই মাসে ৩ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির পরও বাজারে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়ে পেঁয়াজ আমদানির সময় যেরকম দাম ছিল সেটির কাছাকাছি দামেই পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে।
অথচ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত কয়েক বছর ধরে দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন ৩৫ লাখ টনের বেশি। আর পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৮ লাখ টন। উৎপাদন বেশি হলেও আমদানি করতে হয়, কারণ ২৫ শতাংশ বা তারও বেশি উৎপাদিত পেঁয়াজ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা জটিলতায় নষ্ট হয়ে যায়। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, আমদানিকারকরা গত দুই মাসে ১২ লাখ ৩৪ হাজার টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নিয়েছে। যেখান থেকে আমদানি হয়েছে ২৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। এতে বাজারে ঘাটতি হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাজারে পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে ও দাম বৃদ্ধি করে অধিক মুনাফা করছে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। আর এ সব ঘটনা তখনই বন্ধ হবে যখন আমদানি ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী ও প্রশাসন পুরোপুরি তৎপর হবে। বিচ্ছিন্নভাবে দুই-এক জায়গায় হানা দিয়ে লাভ হবে না। বরং বিশেষত সিন্ডিকেট ভাঙতে পারার মতো সাহসী ভূমিকা নিতে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদেরই বেশি উদ্যোগী হতে হবে। এতে নানাবিধ চাপ আসবে, তবুও সরকারকেই এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। দেশের সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যখন নিত্যপণ্যেও অস্বাভাবিক মূল্য বাড়াতে ব্যবসায়ীদের সংযমী হওয়ার কথা বলেন, তখন প্রশাসনের তো উচিত তার কথাকে গুরুত্বসহকারে নিয়ে এ সব সিন্ডিকেটের শেকড় উপড়ে ফেলা।
এর পাশাপাশি মন-মানসিকতাতেও ব্যবসায়ীদের আরো উদার হতে হবে। উচ্চ মুনাফা করার বা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করার মানসিকতাও তাদের বদলাতে হবে। পেঁয়াজ ব্যবসায়ী হয়তো সিন্ডিকেট বা সংকট সৃষ্টি করে উচ্চ মুনাফা করল কিন্তু অন্য একটি পণ্যের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে তাকেও হয়তো অতিরিক্ত দাম দিতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে লাভের গুড় কিন্তু পিঁপড়াতেই খাবে। আর তাই নিজেদের সংশোধন করার কোনো বিকল্প নেই।
আর এ সবকিছু সম্ভব হলেই কেবল আমদানি ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে ও জনগণ স্বস্তিতে থাকবে।
লেখক: রেজাউর রহমান রিজভী, নৃবিজ্ঞানী ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক।