ইসলামি অর্থনীতির লক্ষ্য সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর মাধ্যম হতে পারে ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থা। ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দারিদ্র্য সমস্যার সমাধানকেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। কারণ ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অধীনে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদান করা হয়। এর মাধ্যমে উল্লিখিত জনগোষ্ঠী মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং নতুন ব্যবসা শুরু ও বৃদ্ধি করতে পারে। যাই হোক, প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো দারিদ্র্য সমস্যার সমাধানে আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারেনি। প্রচলিত ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থা দারিদ্র দূরীকরণের লক্ষ্যে ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত হচ্ছে। মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) তথ্য অনুসারে, গ্রামীণ ব্যাংক, সরকারি ও বে-সরকারি ব্যাংকের অধীনে পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দেশে প্রায় ৭৩৯টি প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধীনে ৬ কোটি ৬৪ লাখ সদস্য ঋণ গ্রহণ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য বিমোচনে সফলতার স্বাক্ষর রাখলে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি পরিলক্ষিত হতো। কিন্তু তা হয়নি। বরং ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা ঋণগ্রহীতার ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে আসছে। দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র হওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে বেশির ভাগ।
কার্যত প্রচলিত ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থা বা এনজিওগুলো সফল না হলেও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (আরডিএস) সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আরডিএস প্রকল্প সফল হওয়ায় ২০১২ সাল থেকে শহুরে দরিদ্রদের জন্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এটি ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়নে বিশ্বের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান। এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রমে ক্রমবর্ধমান প্রকল্প। ২০১৮ সালে এ প্রকল্পের আওতায় সদস্য ছিল ১১ লাখ দরিদ্র মানুষ, যা ২০২২ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৬ লাখ। যাদের অনেকেই বিনিয়োগ নিয়ে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকটির ৪৬২টি শাখা, উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে ৬৪টি জেলায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রকল্পের অধীনে বিনিয়োগ আদায়ের হার ৯৯.০৩ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ছিল ৯৮.৯৩ শতাংশ দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য সফলতা নির্দেশ করে।
দেশের প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা সুদভিত্তিক। ইসলাম সুদকে হারাম করেছে, আর ব্যবসাকে করেছে হালাল। ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থায় ইসলামী শরিয়াহ প্রদত্ত মডেল যেমন ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান চুক্তির মধ্যে রয়েছে ক্রয়-বিক্রয়ভিত্তিক ব্যবস্থা যেমন বাই-মুরাবাহা, বাই-মুআজ্জাল, বাই-সালাম, বাই ইসতিসনা ইত্যাদি; ব্যবসায়িক সহযোগিতাভিত্তিক চুক্তি মুশারাকা ও মুদারাবা; ইজারাভিত্তিক চুক্তি যেমন হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক। ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থায় মুনাফার হারও তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকের ক্ষুদ্র বিনিয়োগের প্রধান লক্ষ্য হলো সুযোগ সৃষ্টির জন্য আর্থিক সুবিধা প্রদান করা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে গ্রামীণ জনগণের আয় বৃদ্ধি। গ্রামীণ এলাকায় কৃষি এবং অ-কৃষি কার্যক্রমে বিনিয়োগ সুবিধা প্রসারিত করা। এই ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রকল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো-প্রকল্পটির কার্যক্রম ব্যাংকের নিকটবর্তী শাখাগুলোর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ বিশেষ করে বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প থেকে দেখা গেছে যে, দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ছোট বিনিয়োগ গ্রহীতারা এগিয়ে; তার পরে মাঝারি ও বড় বিনিয়োগ গ্রহীতারা। দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে একটি ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি। ইসলামী ব্যাংকগুলো কোনো অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে অর্থায়ন করতে সক্ষম। ইসলামী ব্যাংকসমূহ আরও দক্ষতার সঙ্গে সুবিধাজনকভাবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রদান করতে পারে ।
একটি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কর্মসূচির সাফল্য নির্ভর করে এর সদস্যদের আয় বৃদ্ধিতে এবং শেষ পর্যন্ত দরিদ্রদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার তুলনায় ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে অধিক কার্যকর ভূমিকা রাখে।
এই প্রকল্পের অধীনে ক্ষুদ্র বিনিয়োগের জন্য কোনো জামানত প্রয়োজন নেই। সর্বমোট ঋণ (মূল পরিমাণ এবং মুনাফা) সাপ্তাহিক কিস্তিতে এক বছরে পরিশোধ করতে হয়। ইসলামি মাইক্রো ফাইন্যান্সের অন্যতম একটি দিক হলো তদারকি কার্যক্রম। বিনিয়োগ দিয়ে শুধু আদায় নয় বরং তার সফল ও সার্থক ব্যবহার হচ্ছে কি না তা তদারকি করা হয়। প্রায় শতভাগ ঋণ আদায়ের অন্যতম রহস্য এটি। এই স্কিমের সব সদস্যকে ন্যূনতম পরিমাণ সাপ্তাহিক সঞ্চয় করতে হয়। এ ছাড়াও ফিল্ড অফিসাররা সদস্যদের নিয়ে সততা, দায় পরিশোধের গুরুত্বসহ ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ফলে বিনিয়োগ গ্রাহকরা দায় পরিশোধে অনীহা নয় বরং সৎ ও নৈতিকতাসম্পন্ন উদ্যোক্তা হয়ে বিনিয়োগের অর্থ পরিশোধে তৎপর থাকেন।
ইসলামী ব্যাংকের এই প্রকল্পকে সারাবিশ্বে ইসলামী মাইক্রো ফাইন্যান্সের জন্য মডেল হিসেবে গ্রহণ করে অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এ জন্য বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থার পথিকৃৎ বলা হয়। ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো গত প্রায় তিন দশকে দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য এ ধরনের আর কোনো প্রকল্প বা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে আরো ৯টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। এই ব্যাংকগুলো ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু করলে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মতো ইসলামী মাইক্রো ফাইন্যান্সেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সম্ভব। ব্যাংকগুলোর জন্য তুলনামূলক কম মুনাফায় বিনিয়োগ দেয়া সম্ভব। কেননা বিদ্যমান অবকাঠামোতেই এ প্রকল্প পরিচালিত হবে। এ ছাড়াও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোও ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু করতে পারে। এতে একদিকে সুদমুক্ত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে অর্থনীতির প্রকৃত সুফল সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে; সম্ভব হবে সম্পদের সুষম বণ্টন।
এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে মুদারাবা ও মুশারাকার মতো আদর্শ বিনিয়োগ পদ্ধতিগুলোর ওপর জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে কিস্তি পরিশোধের শুরুর সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে পৃথক ‘ইসলামী মাইক্রো ফাইন্যান্স ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে নতুন মাত্রা নিয়ে আসবে। সরকার ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থাকে সহায়তা করলে ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও ২০৪১ সালের লক্ষ্য অর্জনে এক ধাপ এগিয়ে থাকবে। এ জন্য সহায়ক নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: ব্যাংকার
এবারকার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশে নেই কোনো উত্তাপ, নেই কোনো আনন্দ কিংবা কিছু অর্জনের সাফল্যগাধা আর উত্তেজনা। আমরা জানি এসএসসি ও এইচএসসির পড়াশোনা এবং ফলাফলের মধ্যে সাধারণত বড় একটি গ্যাপ থাকে।
যারা এসএসসিতে ভালো ফল লাভ করেন তারা সবাই এইচএসসিতে সেভাবে করেন না, অথচ এবার সেই এসএসসির ফলের ওপরেই এইচএসসির ফল তৈরি করতে হয়েছে। অতএব, কোনো কিছু প্রাপ্তির যে আনন্দ সেটি থেকে শিক্ষার্থীরা যেমন বঞ্চিত হয়েছেন তেমনি প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক এবং সর্বোপরি দেশ ফল লাভের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলো।
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ উপলক্ষে এবার কোনো কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান হয়নি। নিজ নিজ বোর্ড অফিস থেকে ফল প্রকাশ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা প্রতিবছরের মতো এবারও এসএমএস, ওয়েবসাইট ও নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ফল জেনেছেন। সরকারপ্রধান বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা কিংবা শিক্ষা উপদেষ্টা ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে ছিলেন না। এই আনুষ্ঠানিকতা এবার দেখা যায়নি। তবে, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী সব বোর্ড একই সময়ে অর্থাৎ সকাল ১১টায় ওয়েবসাইটে ফল প্রকাশ করেছে।
একই সময়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ফল পেয়ে গেছে। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে ফলাফল টাঙিয়ে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। শিক্ষাবোর্ডগুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের বিশেষ করে প্রশাসনিক ও একাডেমকি বিষয়ে উন্নয়নের জন্য বোর্ডগুলো বোধ করি কোনো ধরনের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে না। এমনকি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার সময়ও দেখা যায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাসচিব সবার উপস্থিতিতে ফল প্রকাশ করা হয় যেখানে বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের কোনো ভূমিকার উল্লেখ থাকে না বা দেখা যায় না, তারা সর্বদাই তটস্থ থাকেন। সেই ট্রাডিশন থেকে এবার বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে, এটিকে সাধুবাদ জানাই।
আমরা জানি, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসএসসি বা সমমান পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে যা ‘বিষয় ম্যাপিং’ নামে পরিচিত মাঝপথে বাতিল হওয়া এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষার ফল তৈরি করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় একজন পরীক্ষার্থী এসএসসিতে একটি বিষয়ে যত নম্বর পেয়েছিলেন, এইচএসসিতে সেই বিষয় থাকলে তাতে এসএসসির প্রাপ্ত পুরো নম্বর বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আর এসএসসি ও এইচএসসি এবং সমমান পরীক্ষার বিষয়ে ভিন্নতা থাকলে বিষয় ম্যাপিংয়ের নীতিমালা অনুযায়ী নম্বর বিবেচনা করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ জুন। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন। ৭টি পরীক্ষা হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে কয়েক দফায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তখন পর্যন্ত ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা বাকি ছিল।
এ ছাড়া ব্যবহারিক পরীক্ষাও বাকি। একপর্যায়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের এক দফায় রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয়, ১১ আগস্ট থেকে নতুন সময়সূচিতে পরীক্ষা নেওয়া হবে; কিন্তু শিক্ষার্থীদের একাংশের দাবির মুখে অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলো বাতিল করে সরকার। আমাদের স্মরণে আছে এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের দাবি নিয়ে শত শত পরীক্ষার্থী নজিরবিহীনভাবে ২০ আগস্ট দুপুরে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে। পরে তাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবশিষ্ট পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে সিদ্ধান্ত হয়, এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে (বিষয় ম্যাপিং) হবে মাঝপথে বাতিল করা এইচএসসি বা সমমানেও পরীক্ষার ফলাফল। ইতোমধ্যে যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়ে গেছে সেগুলোর উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। আর যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি, সেগুলোর ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিষয় ম্যাপিং করে।
এবার এইচএসসি ও সমমানের সব বোর্ডের পাসের গড় হার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ যা গত বছর ছিল ৭৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ অর্থাৎ ফল প্রায় একই। নয়টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে এইচএসসিতে পাসের হার ৭৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ যা গতবার ছিল ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ। গতবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৭৮ হাজার ৫২১জন শিক্ষার্থী। এবার এইচএসসিতে ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৭৬ জন জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এইচএসসি বিএম ভোকেশনালে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৪ হাজার ৯২২ জন। ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ২১ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে ৮১ দশমিক ২৪ শতাংশ, দিনাজপুর বোর্ডে ৭৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে ৮১ দশমিক ৮৫ শতাংশ , সিলেট ৮৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ময়মনসিংহ ৬৩ দশমিক ২২ শতাংশ, কুমিল্লা ৭১ দশমিক ১৫ শতাংশ। এইচএসসি বিএম-ভোকেশনাল বোর্ডে পাসের হার ৮৮ দশমিক ০৯ শতাংশ, আলিমে প্রতি বছরের মতোই সবার ওপরে, এবারও ৯৩ দশমিক ৪০ শতাংশ কিন্তু কীভাবে তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা আমরা পাই না। আলিমে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা ৯ হাজার ৬১৩ জন।
কতিপয় শিক্ষার্থী শিক্ষাবোর্ডে গিয়ে সবাইকে পাস করিয়ে দেওয়ার একটি দাবি তুলেছেন। তরুণ এসব শিক্ষার্থীর আবেগের কাছে বারবার মাথা নত করা যাবে না কারণ সমাজ, বাস্তবতা, বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষায় বারবার এভাবে ছাড় দেওয়া মোটেই ঠিক নয়। শিক্ষার মানের সঙ্গে কোনো আপস নয় আর তাই এখন থেকে কঠোর হতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সব জায়গাতেই মেকি, সব জায়গাতেই অনুপযুক্ত লোক, সর্বত্রই ভুয়াদের দাপট থাকলে সমাজ টিকবে না। পরিশ্রম করে যা অর্জন করা হয়, তাই ঠিক। পরিশ্রমের জন্য কেউ কষ্ট করতে চায় না, পড়াশোনা না করেই সবকিছু পেতে চায়। এখানে সমাজের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। সাত বিষয়ে নম্বরের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হলেও ১৩ বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফলাফল তৈরি করা হয়েছে অর্থাৎ ১৩ বিষয়ে অটোপাস দেওয়া হয়েছে। তার পরেও লাখো শিক্ষার্থীর নাম অকৃতকার্যের খাতায়। কারণ ৯টি সাধারণ বোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত পরীক্ষাগুলোতে এবার অনুপস্থিত ছিলেন ৯৬ হাজার ৯৯৭ জন পরীক্ষার্থী। আর বহিষ্কার হন ২৯৭ জন। নিয়মানুযায়ী পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকলে কিংবা বহিষ্কার হলে সামগ্রিক ফলাফল অকৃতকার্য আসে। পরীক্ষার মাধ্যমে যে সাতটি বিষয়ের ফলাফল তৈরি করা হয়েছে, সেখানে কতজন ফেল করেছেন, সেটা জানা প্রয়োজন। সচিবালয়ে একটা অনভিপ্রেত পরিস্থিতির মধ্যে কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষণিক পরীক্ষাগুলো বাতিলের ঘোষণা দিতে হয়েছিল কিন্তু পরীক্ষাগুলো নিতে পারলে ভালো হতো। এসএসসিতে যারা কোনো বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হওয়ার কারণে পরবর্তী বছরে আবার পরীক্ষার সুযোগ নিয়েছে সে ফলাফলও নেওয়া হয়েছে। কাজেই চূড়ান্ত ফলাফলে যারা উত্তীর্ণ হবেন না, তারা বঞ্চিত হয়েছে বলার সুযোগ নেই।
এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করেন, প্রকৌশল, মেডিকেল, কৃষিসহ সাধারণ শিক্ষায় তারা প্রবেশ করেন। এই দুই স্তরে দুর্বল থাকার কারণে ভর্তি পরীক্ষায় সমস্যা হওয়ার পরে গোটা শিক্ষাজীবনে তার ছাপ পড়ে এবং পিছিয়ে থাকে আন্তর্জাতিক দৌড়ে। পেশাগত জীবনে যখন প্রবেশ করে তখনও আমরা দেখতে পাই তাদের দুর্বলতার চিত্র। যে কাজে যান তাদের মধ্যে নগন্য সংখ্যক পেশায় প্রকৃত পেশাদারিত্বের ছাপ রাখতে পারেন, অধিকাংশ সময়ই তারা ভুল, দুর্বল সিদ্ধান্ত ও অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। সেজন্য জাতিকে অনেক ভুগতে হয়। সেখান থেকে ওপরে ওঠার জন্য অবৈধ সিঁড়ি ব্যবহার করেন।
পেশিশক্তি, রাজনীতির দুষ্টশক্তি ও চক্র ব্যবহার করেন যা পেশাদারিত্ব থেকে বহু দূরে। সারাজীবন চলতে থাকে এর ফল। এখন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যাতে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজে না আসে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। এই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পড়া, পরীক্ষা না দিয়ে ফলের প্রকৃত চিত্র প্রদর্শনের জন্য উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি দায়িত্ব রয়েছে। তারা যদি ভর্তি পরীক্ষাটা ঠিকভাবে নেয় তাহলে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারবে তাদের ভুল, জাতি বুঝতে পারবে যে এ ধরনের সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের এবং পড়াশোনা না করে অটোপাসে যে কত বড় ক্ষতি হয় সেটি। কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতেই হবে, শিক্ষাকে তো এভাবে চলতে দেওয়া যায় না।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক (সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজের শিক্ষক, চিফ অব পার্টি ব্র্যাক এডুকেশন এবং কান্ট্রি ডিরেক্টর-ভাব বাংলাদেশ)
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে স্বস্তিতে আছে বিশ্ববাসী। বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি (এফএও) জানিয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে ছিল। যদিও একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে প্রায় দিশাহারা ছিল বাংলাদেশের মানুষ। কারণ এখানে গত তিন বছরে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আলু, চিনিসহ কয়েকটি পণ্যের দাম ন্যূনতম ১৪ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এই বাড়ার চিত্র খোদ সরকারি হিসাবে, বাস্তবে তা আরও বেশি। সম্প্রতি এফএও তাদের মাসিক ‘ফুড প্রাইস ইনডেক্স’ বা খাদ্যপণ্যের মূল্যসূচক প্রকাশ করেছে। সেই সূচকে দেখা যায়, গত ফেব্রুয়ারিতে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে থাকা খাদ্যপণ্যের মূল্য মার্চ মাসে এসে সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্য মূল্যসূচক ছিল ১১৭ পয়েন্ট (১০০ পয়েন্ট হচ্ছে ভিত্তি)। আর মার্চ মাসেতা সামান্য বেড়ে হয়েছে ১১৮ পয়েন্ট। ফেব্রুয়ারির খাদ্য মূল্যসূচক ১১৭ পয়েন্টে পৌঁছানোর আগে ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য মূল্যসূচক এই স্তরে ছিল। এফএও বলছে, মার্চ মাসে যে বিশ্ববাজারে খাদ্য মূল্যসূচক সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে, এটা মূলত ভোজ্যতেলের বাড়তি চাহিদার কারণেই হয়েছে। তবে এখনো বিশ্ববাজারে বেশির ভাগ পণ্যের দাম কমতির দিকে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
বিশ্ববাজারের ঠিক উল্টো চিত্র দেখা গেছে বাংলাদেশের বাজারে। বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে এখানে কয়েক বছর ধরে জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন বাড়িয়েছেন আমদানিকারকরা। এরই ধারাবাহিকতায় পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বাড়িয়েছেন পণ্যের দাম। রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা টিসিবির ২০২১ সালের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালের ৪ মার্চে সরু চালের কেজিপ্রতি দাম ছিল সর্বোচ্চ ৬৫ টাকা। একই চাল তিন বছর পর ৭৬ টাকায় বিক্রি হয়। দাম বেড়েছে ১৬ দশমিক ৯২ শতাংশ। তিন বছরে খোলা আটার দাম কেজিতে বেড়েছে ৩২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে ৭১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
এ ছাড়া লুজ সয়াবিন তেলের দাম ২৫ শতাংশ, বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ ও পাম অয়েলের দাম বেড়েছে ২৩ দশমিক ৮১ শতাংশ। বড় দানা ডালের দাম বেড়েছে ৫৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। দেশি ডালের দাম বেড়েছে ২৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ আর আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৪০ শতাংশ। দেশি রসুনের দাম বেড়েছে ১২৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর আমদানি করা রসুনের দাম বেড়েছে ৯১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। দেশি আদার দাম বেড়েছে ২২০ শতাংশ। আমদানি করা আদার দাম বেড়েছে ১০৯ শতাংশ।
গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৬৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ, আলুর দাম বেড়েছে ১২৫ শতাংশ ও চিনির দাম বেড়েছে ১০০ শতাংশ। প্রতিবার দাম বাড়ানোর সময় একেক অজুহাত দেখিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কখনো কোভিড, কখনো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আবার ডলারের দর বাড়া। তবে বাজার বিশ্লেষকরা জানান, যতই তারা যুক্তি দেখান না কেন, এখানে অতিমুনাফালোভী চক্র সক্রিয় থাকার কারণেই মূলত জিনিসপত্রের দাম এত লাগামহীন বেড়েছে। কারণ এ সময়ে আমদানি করা পণ্যের দাম যেমন বেড়েছে, একই তালে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়েছে। অথচ এসব পণ্য আমদানিতে ডলার লাগেনি, জাহাজ ভাড়া দিতে হয়নি কিংবা যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থায়ও কোনো বাধা তৈরি হয়নি।
এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘বাংলাদেশে ডলারের বিনিময় হারের যে অস্থিতিশীলতা, জিনিসপত্রের দাম অসহনীয় করার ক্ষেত্রে এটিকে কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আমদানির ঋণপত্র খোলায় সংকটকেও দায়ী করা হয়। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ার পেছনেও বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়া, আমদানি করা কাঁচামালের দাম বাড়া ও পরিবহনের খরচকে দায় দেওয়া হয়। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপ যথাযথ হলে দাম বাড়া আরও সহনীয় মাত্রায় রাখা যেত। এ সময়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা ছিল। সরকার জিনিসপত্রের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে অথচ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাহলে এ দাম ঠিক করে দেওয়ার অর্থ কী? এটি একটি ভুল পথ।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ সময়ে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল কিংবা ভুটানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে। অথচ এ সময়ে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। জিনিসপত্রের অতিরিক্ত দামের কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, জিনিসপত্রের অতিরিক্ত দামের কারণে ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। জানুয়ারিতে এটি ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। বলা যায়, তারও প্রায় এক বছর আগে থেকেই বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির এই উচ্চহার বজায় থাকে।
অথচ এ বছরের জানুয়ারিতে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় হওয়ায় ভারতের মূল্যস্ফীতি ছিল মাত্র ৫.১৯ শতাংশ। প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা রীতিমতো খাদের কিনার থেকে ফিরে এসেছে। দেশটির মূল্যস্ফীতিও ঈর্ষণীয়ভাবে কমেছে। জিনিসপত্রের মূল্যে শক্ত নজরদারির কারণে দেশটির মূল্যস্ফীতি চলতি মার্চে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশে এসে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে দেশটির পরিসংখ্যান অফিস। প্রতিবেশী নেপালের মূল্যস্ফীতির হার চলতি বছরের জানুয়ারিতে হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। একই সময়ে ভুটানের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। শুধু প্রতিবেশী দেশ বলেই নয়, জিনিসপত্রের উত্তাপে পানি ঢেলে দিয়েছে উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও। দেশটিতে ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৩ দশমিক ২ শতাংশে।
বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম এখনো কেন সহনীয় পর্যায়ে আসেনি জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আসলে আমদানি করা পণ্যের দামের পেছনে তো ব্যবসায়ীদের একটা অজুহাত থাকে। তারা দাম বাড়ায়, আমরা কিছু অভিযান করলে আবার দাম কমে আসে। পেঁয়াজ, ডিম, আলুর অবস্থা তো সবাই জানেন। আসলে কেনাকাটায় সবার সচেতন হওয়ার ব্যাপার আছে। মানুষ সচেতনও হচ্ছে। তরমুজের দাম কমে যাওয়া কিন্তু সচেতনতারই ফল। বিগত জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসিন হয় এবং সবাই আশা করেছিল বাজার ব্যবস্থার একটা গুণগত পরিবর্তন হবে। কিন্তু বাস্তবে অবস্থার অবনতি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সবজির বাজারে যেন লাগাম দেওয়ার কেউ নেই। নতুন করে কয়েকটির দাম আরও বেড়েছে।
ফলে হাতেগোনা তিন-চারটি ছাড়া বেশির ভাগ সবজির দর শতক ছাড়িয়েছে। শুধু শহর নয়, উৎপাদন এলাকায়ও চড়া দাম শাকসবজির। ফলে সীমিত আয়ের মানুষের কাছে সবজিও হয়ে উঠেছে অনেকটা বিলাসী পণ্য। তবে চিনি, ডিম ও গরুর মাংসের দাম কিছুটা কমতির দিকে। আবার আগের মতোই উচ্চদরে স্থির রয়েছে চাল, ডাল, তেলসহ কয়েকটি নিত্যপণ্য। তাতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের পরিবারগুলোকে। সবজির দর বাড়ার পেছনে নানা কারণ তুলে ধরছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা, কৃষক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তারা জানিয়েছেন, এ বছর অসময়ে টানা বৃষ্টিতে সবজির চারা ও ফুল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় উৎপাদন কমেছে। পাশাপাশি আগাম শীতকালীন সবজি চাষ করার জন্য অন্য বছরের তুলনায় এবার অধিক পরিমাণ জমি পতিত রাখা হয়েছে। এটিও উৎপাদন কম হওয়ার অন্যতম কারণ।
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর বাজারে সব ধরনের সবজির দর তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছিল। স্বস্তিদায়ক সেই পরিস্থিতি মাসখানেকের মতো ছিল। এরপর থেকেই পুরোনো চেহারায় ফিরেছে সবজির বাজার। সরকারের সংশ্লিষ্টদের দাবি, দাম বাড়ার মূল কারণ টানা বৃষ্টি। তবে প্রতিদিনই বাজার তদারকি হচ্ছে। আমদানির অনুমতি, শুল্ক কমানোসহ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগে ইতোমধ্যে কয়েকটি পণ্যের দর কমতে শুরু করেছে।
ঢাকায় অনেক সবজির সেঞ্চুরি চলছে। বাংলাদেশ পাইকারি কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, এ বছর ঘন ঘন বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও বৃষ্টির পরিমাণ অস্বাভাবিক। তাতে সবজি খেত ডুবে গেছে। উঁচু এলাকায় না ডুবলেও গাছের গোড়ায় পানি জমে গাছ পচে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বছরের এ সময় শীতের কিছু সবজি আগাম বাজারে আসে। যেমন- ফুলকপি, বাঁধাকপি ও শিম। এসব সবজি উত্তরবঙ্গ, নোয়াখালী, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া ও খুলনা অঞ্চলে বেশি হয়। কিন্তু সেসব এলাকায় পানির কারণে বীজ লাগানো যাচ্ছে না। সার্বিকভাবে সবজির সরবরাহ কমছে। তা ছাড়া এ সময় শ্রমিকদের মজুরিও বেশি দিতে হয়। সে জন্য উৎপাদন এলাকায় কৃষকরাও এখন তুলনামূলক দাম বেশি নিচ্ছেন। বগুড়ার মহাস্থানহাটের পাইকাররা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় প্রতিদিন ২৫-৩০ ট্রাক সবজি নিয়ে গেলেও উৎপাদন কম থাকায় এখন পাঁচ-ছয় ট্রাকের বেশি নিতে পারেন না। এখানকার পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিদিন কমপক্ষে তিন ট্রাক সবজি নিয়ে যান ঢাকা কারওয়ান বাজারে।
এখন মাত্র এক ট্রাক নিচ্ছেন। বগুড়া সদরের শেখেরকোলা এলাকার সবজি চাষি বলেন, তিনি পটোল ও বেগুন চাষাবাদ করেন দুই বিঘা জমিতে। লাগাতার বৃষ্টিতে সবজি গাছের ফুল পচে গেছে, তাতে উৎপাদন কমে গেছে। এখন যা উৎপাদন হচ্ছে, তা দিয়ে খরচ উঠছে না। তবে আমদানির উদ্যোগ ও শুল্ক কমানোর খবরে গত তিন দিনে ডিমের ডজনে ২০ টাকার মতো কমে বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়। যদিও পাড়া-মহল্লায় কোনো কোনো ব্যবসায়ী এর চেয়েও বেশি দর নিচ্ছেন। ব্রয়লার মুরগির দর কমেনি। এখনো ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০-২০০ টাকা দরে। তবে অপরিবর্তিত সোনালি জাতের মুরগি।
প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায়। মাসদেড়েক আগে ডিমের ডজন ১৪০ থেকে ১৪৫ এবং ব্রয়লারের কেজি ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। তবে স্বস্তির খবর আছে গরুর মাংসের বাজারে। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৩০ টাকা দরে। দুই মাস আগে মাংসের কেজি ৭৫০ টাকার বেশি ছিল। দুই মাসের বেশি সময় ধরে চালের বাজার বাড়তি। বিআর-২৮ ও পায়জাম জাতের বা মাঝারি আকারের চালের কেজি খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬৪ টাকায়। মোটা চালের (গুটি স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। এ ছাড়া চিকন চাল (মিনিকেট) বিক্রি হচ্ছে কেজি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে। দুই মাস আগে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০, মাঝারি চাল ৫৪ থেকে ৫৮ এবং চিকন চাল ৬৮ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
সম্প্রতি ভারত চাল রপ্তানিতে শর্ত শিথিল করেছে। শুল্ক কমানোর সুপারিশও করেছে ট্যারিফ কমিশন। যদিও শুল্ক এখনো কমানো হয়নি। আমদানির খবরও পাওয়া যায়নি। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি হলে দর কমে যাবে। তবে শুল্ক কমানোর কারণে চিনির কেজিতে তিন টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩৫ টাকায়। কিছুটা কমতির দিকে রয়েছে ভোজ্যতেলের দরও। রপ্তানির শর্ত শিথিল করায় ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা শুরু হয়েছে। কিন্তু দর কমেনি। বরং বেড়েছে কিছুটা। এখনো দেশি পেঁয়াজের কেজি ১১৫ থেকে ১২০ এবং ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি ১০০ থেকে ১১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
নিত্যপণ্যের এমন আগুন দরে দুর্ভোগে পড়েছেন ভোক্তারা। নতুন সরকারের কাছে মানুষ যে আশা করেছিল, তা দেখা যাচ্ছে না। এমন কোনো জিনিসি নেই, যার দর বাড়েনি। মানুষের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। দাম নাগালে রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিদপ্তরের একাধিক টিম বাজার তদারকি করেছ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, পণ্যের ক্রয় রসিদ রাখতে হবে। অযৌক্তিক দরে বিক্রি করলে জরিমানা করা হবে। এ সময় তিনি বলেন, গত কয়েক দিনের তুলনায় ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর দাম কিছুটা কমেছে। আরও কমে আসবে। সারা দেশে নিত্যপণ্যের বাজারে অভিযান চালিয়ে ভোক্তা অধিদপ্তর ৩৯টি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন অপরাধের দায়ে ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। এখন দেখা যাক, পরিস্থিতি উন্নতি হলে সাধারণ ভোক্তার মনে কিছুটা হলেও স্বতি ফিরে আসবে এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাই চড়ি শখের বোটে/ মাঝিরে কন বল তো দেখি, সূর্য কেন ওঠে?/ চাঁদটা কেন বাড়ে-কমে/ জোয়ার কেন আসে/ বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফেলিয়ে হাসে- আজ আমাদের দেশটা বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাইয়ের ভিড় লেগেছে। এসব বিদ্যে জোগাড় হয়েছে সার্টিফিকেটের দৌলতে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, বিদ্যা সহজ শিক্ষা কঠিন, বিদ্যা আবরণে, শিক্ষা আচরণে। কবিগুরুর এই সহজ অথচ গভীর কথা মর্ম উপলদ্ধি করা আজকের সমাজের কাছে প্রায় অসাধ্য। কারণ এরা গুলিয়ে ফেলতে অভ্যস্ত। আবার এত গভীরে গিয়ে কোনো অর্থ বের করার মতো সময়টাও নেই।
আবার কবিগুরুকে নিয়েও সভ্য সমাজের বিদ্যে বোঝাই বহু বাবুমশাইয়ের সন্দেহ রয়েছে। বিদ্যা অর্জন করা বেশ সহজ। বলা যায় একেবারেই সহজ কাজ। বিদ্যে মানুষকে খুব বেশি মানুষ হিসেবে পরিচিত করতে পারে না। যা মানুষকে মানুষের স্বীকৃতি দিতে পারে সেটি হলো শিক্ষা। শিক্ষা হলো একটি পদ্ধতি যা আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক হতে পারে তবে মানুষের আচরণকে একটি স্থায়ী পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়। এবার উদাহরণ দিয়ে বিদ্যা ও শিক্ষার পার্থক্য বুঝিয়ে দিই। খুব ছোটবেলা থেকেই আমাদের বইয়ে এবং পরিবার ও সমাজ আমাদের মিথ্যা না বলার শিক্ষা দেয়। আসলে কিন্তু এটা শিক্ষা না বিদ্যা। এই বিদ্যা পুঁথিগত বা অপুঁথিগত হতে পারে। এটি যদি কোনো পরিবার বা সমাজে চর্চা করা হয় তাহলে এটি পরিণত হয় শিক্ষায়। রবীন্দ্রনাথের কথায় আবরণ এবং আচরণ এই দুইয়ের পার্থক্য এখানেই।
সত্য বলার অভ্যাস পরিবারে হচ্ছে না। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সঙ্গে মিথ্যা বলছে, সন্তান মা-বাবার সঙ্গে মিথ্যা বলছে, সমাজে একে অপরের সঙ্গে মিথ্যা বলছে। নেতারা মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছেন। এই দেখে দেখে একটি শিশু বড় হচ্ছে। সে বইয়ে শিখল এক আর সমাজে চর্চা হচ্ছে আরেক। অর্থাৎ সমাজ চলছে উল্টোপথে। এখন শিশুটি দেখছে সমাজে মিথ্যা বলার লাভ বেশি। সে সেটাই করছে। যদি এর উল্টোটা অর্থাৎ বইয়ে যাই থাক চর্চা হতো সত্য বলার তাহলে কিন্তু শিশু সত্য বলাই শিখত।
আবরণ মানে আমাদের পোশাক-আশাক এবং আচরণ হলো ব্যবহার যা আমরা অন্যের সামনে দেখাই। অবস্থা এমন হয়েছে যে আমি-আপনি যে শিক্ষিত সেটা প্রমাণ করতে সার্টিফিকেট ঝুলিয়ে রাখতে হবে! কারণ মানুষ যত বিদ্বান হচ্ছে, সমাজ তত অসভ্য হচ্ছে। আমরা বিদ্বান হচ্ছি বড়জোর, শিক্ষিত নয়! যারা এই পার্থক্য বুঝতে অক্ষম তিনি ওই বিদ্বান। ফেসবুকে ঢুকলেই দেখা যায় নীতিবাক্যের ছড়াছড়ি। যদি এটা সত্য বলে ধরে নেন মানে সেই ব্যক্তিদের কথা এবং তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি সত্য বলে বিচার করেন তাহলেই আপনি ঠকেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব নীতিবাক্য আওড়ানো মানুষের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিক আচরণ এবং দর্শনের বিস্তর ফারাক রয়েছে। ঘরে ঘরে খুঁজলে সার্টিফিকেটধারী মানুষের কোনো অভাব নেই। বড় বড় ডিগ্রি, বড় বড় কথা অথচ কাজকর্ম নিতান্তই অবিবেচকের মতো।
তারা যে শিক্ষিত হতে পারেননি, আমরা যে মানুষ পাচ্ছি না সেটি কিন্তু শিক্ষার দোষ না, সেটি হলো চর্চার দোষ। এই তো গণমাধ্যমে দেখলাম কারিগরি বোর্ডের সার্টিফিকেটের কেলেঙ্কারি। কতজন পকেটের টাকা খরচ করে সার্টিফিকেট কিনে সমাজে দামি চাকরি করছেন, এখন যদি তাদের আপনি শিক্ষিতভাবে তাহলেই সর্বনাশ! তারা অবশ্য বিদ্বানও না। চুরি করে আর যাই হোক বিদ্বান হওয়া যায় না। কথায় বলে, গুরু মারা বিদ্যা! এই বিদ্যা অর্জন করে শিষ্য গুরুকে মারার ক্ষমতা অর্জন করে। যদিও এই বিদ্যা ভুল এবং অন্যায্য তবুও আছে। শিক্ষককে তো আজ অনেকেই মারছে। গায়ে হাত তুলছে, জোর করে পদত্যাগ করাচ্ছে, লাঞ্ছিত করছে খোলা রাস্তায়। এই বিদ্যা অর্জন তো সেই সব শিক্ষকের বা গুরুর কাছ থেকেই শেখা।
এমন বিদ্যাই শিখেছে যে গুরুকে মারতে দ্বিধাবোধ করছে না। এখন এদেরও যদি শিক্ষিতদের কাতারে ফেলেন তাহলে তো এক দিন সমগ্র সমাজটাই অচল হয়ে যাবে। অথচ দেশ ভরে যাচ্ছে বিদ্বান মানুষে। সার্টিফিকেটধারীদের পদভারে রাজপথ ভারী হচ্ছে। মানুষ তো পাচ্ছি না। মানুষ হলে দেশটা অনেক আগেই আরও সুন্দর হয়ে উঠতে পারত। দেশকে নিয়ে আজ স্বপ্ন দেখা মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। অথচ নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা মানুষের সংখ্যা ভুরি ভুরি। নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবা এবং অন্যকে বোকা ভাবা খুব সহজ কাজ। আমাদের বিদ্বান দরকার না, শিক্ষিত মানুষ দরকার। চর্চায় শিক্ষিত দরকার, স্যুট, টাই পরা ভদ্রলোকের দরকার নেই। তা না হলে সেই বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাইয়ের চাপে দেশের মাটি ধসে পড়তে পারে!
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
যুগে যুগে যেকোনো আন্দোলনে পুরুষের পাশে ছিল নারীরা, আমরা ভাষা আন্দোলনে দেখেছি নারীদের অংশগ্রহণ আর ৭১ সালের তো কথাই আলাদা আর এবারও ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নারীদের বিপুল অংশগ্রহণ নারীর রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা যায়।
গণ-অভ্যুত্থানের পর নারীর প্রতি বিরাজমান সব বৈষম্য দূর করার বিষয়টি রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডায় কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, তা নিয়ে ভাবছেন অনেকেই, তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সৃষ্ট ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ অল্প সময়ের মধ্যে বৈষম্য আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিকৃতি হয়ে উঠেছিল।
পরিণত হয়েছিল সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বিভিন্ন জাতি-ধর্ম পরিচয়ের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এই আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে নারীদের ব্যাপক সাহসী উপস্থিতি এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য সবচেয়ে জরুরি যে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, তা হলো ‘সংস্কার’। পাশাপাশি আরও একটি বিষয় খুব আলোচনা হচ্ছে, তা হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা।
তবে আমরা দেখছি, বেশির ভাগ উদ্যোগ ও আলোচনা থেকে নারী এবং আন্দোলনের নারী সমন্বয়করা যেন ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছেন। তাদের ডাকা হচ্ছে না, কেন এমন হচ্ছে তা জানিনা তাহলে প্রশ্ন জাগে, রাষ্ট্র সংস্কারের আলাপ পারবে কি রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্ত ও সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নারীর হিস্যা ও অংশীদারত্বের বিষয়টি উত্থাপন করতে, পারবে কি নারীর অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে অমীমাংসিত বিষয়গুলোকে সংস্কারের দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে?
রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে সংবিধান সংস্কার নিয়ে। ইতোমধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনও গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে- যেমন ১৯ (১), ১৯ (৩), ২৮ (১) ও ২৮ (২)-এ সর্বজনীন নীতির অধীনে নারীর সমতা এবং সব ক্ষেত্রে সমান অংশগ্রহণের বিষয়টি বিস্তৃত এবং সুরক্ষিত।
উদ্যোগটি থেমে যায়।
সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র সব নাগরিকের সমান গণতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। সংবিধান সংস্কারের এজেন্ডাতে নারীর সমানাধিকার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে পারিবারিক আইনে বৈষম্য সৃষ্টি করে এমন সব বিধান বাতিলের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। এ ছাড়া সিডও সনদ থেকে সব সংরক্ষণ তুলে নেওয়ার বিষয়টিও কাম্য।
সম্প্রতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, সেখানে অবশ্যই সংস্কারের ক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রয়োজনীয় আইনি, প্রশাসনিক ও সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে নারী উন্নয়নের এক উদাহরণ হয়ে উঠেছিল। করোনাপরবর্তী সময়ে নারীর অংশগ্রহণ সেখানে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে; কিন্তু কেন এমনটা হলো, তার কারণ এখনো অস্পষ্ট। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের মাত্রা আসলে বর্তমানে ঠিক কত ভাগ, তা জানার জন্য একটি শ্রম জরিপ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।
সমান কাজে সমান মজুরি নিশ্চিত করা, নারীর জন্য প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও চাকরিতে সমান সুযোগ করে দেওয়া, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রাখা, শ্রম আইন সংস্কার এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী সব অধিকার সুরক্ষা করে নারীর প্রকৃত অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করা এখন অত্যন্ত জরুরি। সংবিধান যেখানে নারীকে রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার দিয়েছে, তার পূর্ণ বাস্তবায়ন কেবল আইন প্রণয়ন নয়, সামাজিক পরিবর্তনের এজেন্ডায় আনার চ্যালেঞ্জটি বর্তমান সরকার নেবে কি?
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশকে বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে সমুন্নত এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। সংস্কার আলোচনাগুলোতে গণপ্রতিনিধিত্ব সংশোধন আদেশ আইন (২০০৯) বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের পরিকল্পনা কী, এটা জানা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়াটা খুব জরুরি। সংস্কারব্যবস্থায় শিগগিরই একটি ‘নারী অধিকার কমিশন’ গঠন করা উচিত। এর মাধ্যমে দেশের সর্বস্তরের নারীদের কাছ থেকে দেশ গঠনে তাদের মতামত নেবে এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করবে। নারীরা যোগ্যতা ও মেধা প্রমাণে নিজেদের মেলে ধরতে পারবেন
মাত্র তিন মাস আগেই, জুলাই অভ্যুত্থানে আমরা দেখেছি মেয়েরা কীভাবে রাজপথগুলোর দখল নিয়েছিল। পথে নেমে এসেছিল নানা বয়সি হাজারো হাজারো মেয়ে। স্লোগানে, স্লোগানে আর গ্রাফিতিতে কাঁপিয়ে দিয়েছিল চারদিক। ৭ জুলাই বাংলা ব্লকেডে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় চোখে পড়ার মতো এর পর তা থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলে আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ।
তখন মিছিলের সামনে থেকেও পুলিশের গুলি ও লাঠির আঘাত থেকে রেহাই পায়নি নারীরা, এতে কয়েকজন নারী নিহতও হয়েছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে দুই তরুণীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া হেলমেট বাহিনীর লাঠির ছবি। আর এক তরুণী কী অসমসাহসে একা দাঁড়িয়ে পড়েছে পুলিশের প্রিজন ভ্যানের সামনে, যেন দুহাত দিয়ে আটকে দেবে সব আগ্রাসন। এই সব ছবি ভাইরাল হয়েছিল দেশে-বিদেশে, প্রেরণা আর সাহস জোগাচ্ছিল সবাইকে।
আমরা দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা তার ছাত্রকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দুহাত দিয়ে আগলে রেখেছেন, পিঠ পেতে দিচ্ছেন পুলিশের লাঠির নিচে। দেখেছি পুলিশের ভ্যানে ওঠানোর সময় টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া সন্তানকে পিঠে চাপড় মেরে সাহস দিচ্ছেন মা। দেশের অন্য অঞ্চলেও প্রতিবাদে বিক্ষোভে মুখর ছিল আমাদের মেয়েরা। স্কুলের বালিকা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণী, পোশাককর্মী, গৃহবধূ, মায়েরা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, চাকরিজীবী, ডাক্তার , আইনজীবী, অভিনেত্রী, শিল্পী, গায়িকা কে ছিল না এই আন্দোলনে?
অথচ কয়েক মাস যেতে না যেতেই এই অভ্যুত্থানের ইতিহাস থেকে যেন মেয়েরা হারিয়ে যেতে শুরু করল। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জুলাই-আগস্টে নিহতদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে। সেখানে ছয়জন বিভিন্ন বয়সি নারীর নাম রয়েছে। অথচ ১৪ আগস্টে প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মায়া ইসলাম (৬০) ও নাছিমা আক্তারের (২৪) নিহত হওয়ার ঘটনা ছবিসহ উল্লেখ থাকলেও তারা বাদ পড়েছেন এই তালিকা থেকে। বাদ পড়েছেন ফেসবুকে দেখা ১৭ বছরের তানহা বা নাফিসা মারওয়া। হয়তো এভাবে বাদ পড়ে গেছেন আরও অনেকে, যারা আহত হয়েছেন বা অঙ্গ হারিয়েছেন। এই বাদ পড়া তালিকাকে পূর্বাবস্তায় পুনঃপ্রকাশ করা জরুরি বলে মনে করেন মৃতের স্বজনরা।
আন্দোলনে অন্য নিহত ছাত্রদের মতো হিরো হয়ে উঠতে পারেনি মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী নাইমা সুলতানা। নাইমার জন্য হওয়া উচিত ছিল কোনো চত্বর বা কোনো সড়ক বা দেয়ালের নাম। মুগ্ধ বা ফারহানকে প্রতিনিয়ত মনে রাখলেও সবাই নাইমারের কথা ভুলে গেছি। অন্য সমন্বয়কদের সঙ্গে ডিবি কার্যালয়ে আটক ছিলেন সমন্বয়ক নুসরাতও, তিনিও যেন কোথায় গায়েব হয়ে গেছেন, কেন এমনটা হলো?
যে মেয়েরা স্লোগানে-বিক্ষোভে-প্রতিবাদে রাজপথ মুখর করে রেখেছিল, যাদের ছাড়া এই আন্দোলন কখনোই সফল হতো না বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা, এখন সেই মেয়েদেরই কেউ খুঁজে পাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, ১৯৩০-৩১ সালে ভারতে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে ৮০ হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৭ হাজার ছিলেন নারী। অথচ ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে কোথাও তাদের নাম বা স্থান মেলেনি। বাংলা ভাষা আন্দোলনে ভাষার দাবিতে ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস স্কুলে কালো পতাকা তুলে রাষ্ট্রিকেট ও শিক্ষা জীবন থেকে বহিষ্কৃত হন ছালেহা বেগম অদ্যাবধি তার সেই বহিষ্কারাদেশ বাতিল করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ এভাবে মেয়েরা পরিসংখ্যান আর তথ্য-উপাত্ত থেকে হারিয়ে যায়। তখন গোটা বিষয়টা শুধু পুরুষদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমাদের সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের পরও আমরা যেন এমনটা ঘটতে দেখছি।
৩ অক্টোবর প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘এই আন্দোলনে মেয়েদের সম্পৃক্ততা ছিল বিরাট। এখন অনেকে ভুলে গেলেও এ কথাটা সত্য যে মেয়েরা না থাকলে এই আন্দোলন কোনোভাবেই সফল হতো না।’
নারীর অবস্থান পরিবর্তনের কোনো সংস্কার পরিকল্পনা চোখে পড়েনি। দেখা যাচ্ছে আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়ার পরও অধিকার আদায়ের বেলায় মেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে ক্রমাগত। ক্রমাগত যেন চলে যাচ্ছে দৃশ্যের বাইরে।
এবারই সব আশঙ্কা, সব দ্বিধা পায়ে মাড়িয়ে বিপুলসংখ্যক সাধারণ নারী পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিজমে জড়িয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে পড়ছেন তারা। সাধারণ নারীরা তো বটেই, যারা আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন, তারাও। অথচ বাস্তবতা হলো এই যে আমাদের দেশে আরও বেশিসংখ্যক নারীর রাজনীতিতে আসা উচিত, সব স্তরে নারীর কণ্ঠ শোনার মতো পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য এটা খুব দরকার। রাষ্ট্র সংস্কারের পর জনসংখ্যার অর্ধেক জুড়ে থাকা এই অদৃশ্য নারীরা হয়তো ভবিষ্যতে দৃশ্যমান হবেন। আমরা অনুরোধ করব সবাইকে প্লিজ পুরুষদের পাশাপাশি যেকোনো আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণকে মূল্যায়ন করুন।
লেখক: স্কুল শিক্ষিকা ও শিক্ষানবিশ আইনজীবী
বিশ্বের মানচিত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র ভুখণ্ড। এই ভুখণ্ডে বসবাসকারী আমজনতার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ও সাধ, আত্মমর্যাদা বিকাশের অধিকার লাভের উদ্দেশ্যে সাম্প্রতিক গণ-আন্দোলনে সাফল্য লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অনন্য ঐক্য গঠনের মাধ্যমে আপনার অধিকার প্রতিষ্ঠা, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানোর, স্বাধীন আশায় পথ চলার এবং আপন বুদ্ধিমতে চলার ক্ষমতা লাভ করে।
স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু এই অধিকার কেউ কাউকে এমনিতে দেয় না, কিংবা ছেলের হাতের মোয়ার মতো নয় তা সহজপ্রাপ্যও, তাকে অর্জন করতে হয়, আদায় করে নিতে হয়। আবার অর্জন করার মতো সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করাও কঠিন। কেননা স্বাধীনতার শত্রুর অভাব নেই। স্বাধীনতা হীনতায় বাঁচতে চায় কে? আবার সুযোগ পেলে অন্যকে নিজের অধীনে রাখতে চায় না কে? বেশি দামে কেনা কম দামে স্বাধীনতা বিক্রির নজির যে নেই তা তো নয়। আপাতত দৃষ্টিতে বাংলাদেশের জনগণ শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে, পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, ইতিহাসের বহু পটপরিবর্তনে চড়াইউতরাই পেরিয়ে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পরিপূর্ণভাবে অর্জন করে তাদের আজন্ম লালিত স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে অশেষ আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিজয় অর্জন তার যথা বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের যৌক্তিকতা ভিন্ন অর্থেই পর্যবসিত হতে পারে।
ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপদেশে এ দেশে আগমন ঘটে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছত্রছায়ায় সাতসমুদ্র তেরো নদী পার থেকে আসা ইংরেজদের। তাদের পূর্বে মগ ও পর্তুগিজরাও অবশ্য এসেছিল এ দেশে। প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনায় এরা পরস্পরের শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। অত্যাচারী মগও পর্তুগিজদের দমনে ব্যর্থপ্রায় সমকালীন শাসকবর্গের সাহায্যে এগিয়ে আসে নৌযুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী ইংরেজ বণিক। ক্রমে তারা অনুগ্রহ ভাজন হয়ে ওঠে সমকালীন বিলাসপ্রিয় উদাসীন শাসকবর্গের আর সেই উদাসীনতার সুযোগেই রাজপ্রাসাদ-অভ্যন্তরে কূটনৈতিক প্রবেশলাভ ঘটে ইংরেজদের। প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁকে হাত করে তারা ক্ষমতাচ্যুত করে নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে। পরবর্তীতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বাংলা বিহার উড়িষ্যার এবং ক্রমে ক্রমে বর্ষের প্রায় গোটা অঞ্চলের। মীর কাসিম খাঁন, টিপু সুলতান প্রমুখ সমকালীন স্বাধীনচেতা রাজন্যবর্গ স্থানীয়ভাবে তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে চাঙ্গা করেও ব্যর্থ হন-বলাবাহুল্য আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু সেখান থেকেই। বিদেশ বিভুঁই এ সাহায্য ও সহানুভূতি পাওয়ার জন্য সম্প্রদায়গত বিভাজন সৃষ্টি করতে আনুকূল্য প্রদর্শনার্থে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তন করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এই নীতির ফলে এদেশীয় স্বাধীনতাকামী জনগণের মধ্যে পৃথক পৃথক অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত হয় এবং ব্রিটিশ শাসকের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে বৃহৎ দুটি সম্প্রদায়। হিন্দু জমিদাররা ইংরেজদের আনুগত্য পেতে থাকে, পক্ষান্তরে রাজ্য হারিয়ে মন মরা মুসলমান সম্প্রদায় (যার অধিকাংশ পরিণত হয় রায়ত কৃষকে) দিন দিন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহেও ইংরেজদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ বেশ কাজ করে, আরও দ্বিধাবিভক্তিতে আচ্ছন্ন হয় উভয় সম্প্রদায়। এরপর স্যার সৈয়দ আহমদ, নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলী, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখের শিক্ষা ও সমাজসংস্কারবাদী কর্মপ্রচেষ্টার ফলে মুসলমান সম্প্রদায় ধীরে ধীরে আধুনিক শিক্ষার আলোক পেয়ে ক্রমান্বয়ে চাক্ষুস্মান হতে থাকে। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস। বর্ষের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে হিন্দুগণ কর্তৃক পরিচালিত ও ভাবাদর্শ নির্মাণকারী এই প্ল্যাটফর্ম স্বসম্প্রদায়ের সত্যই কোনো কল্যাণে আসবে না দেখে ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম লীগ’ নামে আরেকটি রাজনৈতিক সংগঠন। বৃহৎ বর্ষের ব্যাপারে না গিয়ে শুধু এই বাংলাদেশ বিষয়ে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পিছনে যে প্রধান ঘটনা স্থপতি হিসেবে কাজ করেছে তা হলো ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এমন দ্বিধাবিভক্তির প্রেক্ষাপটে প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব থেকেই ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে পূর্ববাংলার নেতা শের-ই-বাংলা ‘উপমহাদেশের মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলো নিয়ে ‘রাষ্ট্র সমূহ’ গঠনের প্রস্তাব করেন। মুসলমান প্রধান পূর্ববাংলাবাসীরা উক্ত প্রস্তাবমতে একটি পৃথক রাষ্ট্রে গঠনের দাবিদার। ১৯৩০ সালে চৌধুরী রহমত আলী ‘পাকিস্তান’ (P for Punjab, A for Afghanistan, K for Kashmir, I for Indus valley and stan for Baluchistan) শব্দটির উৎপত্তি ও রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার কথা যখন প্রথম প্রকাশ করেন তখন তাতে বাংলা নামের কোনো শব্দ বা বর্ণ ছিল না, এমনকি ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের দার্শনিক ভাবনির্মাতা স্যার মুহাম্মদ ইকবাল পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে কল্পনা ব্যক্ত করেন তাতে বাংলা অন্তর্ভুক্তির কোনো কথা ছিল না। এতদসত্ত্বেও ১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেশনে ‘রাষ্ট্রসমূহ গঠনের প্রস্তাবকে’ উপচিয়ে, বিশ্বাসঘাতকতায়, পূর্ব বঙ্গবাসীদের পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বর্ষের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত সহস্রাধিক মাইল ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে একীভূত হয় এবং পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এটা যে পূর্ববঙ্গের প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা প্রাপ্তি ছিল না বরং উপনিবেশবাদের হস্তান্তর মাত্র তা পূর্ব বঙ্গবাসীরা ক্রমে ক্রমে উপলব্ধি করতে পারেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়, যখন বোঝা যায় তাদের মাতৃভাষা ও আবহমান সংস্কৃতির ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত আসছে। এটা বোঝা গিয়েছিল এর ফলে তাদের আত্মপরিচয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তারা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং বিভ্রান্তি তাদের কেটে যায়। তারা বুঝতে পারে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ হয়নি। তারা তাদের সচেতনতার পরিচয় দেয় ১৯৫৪-র নির্বাচনে, ১৯৬২-র ছাত্র আন্দোলনে, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে এবং ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে। এতদিনে পশ্চিম পাকিস্তানি সামন্তবাদী চক্রের আসল মুখোশ উন্মোচিত হয়। পূর্বপাকিস্তানকে এক সময় তারা ব্যবহার করেছিল ইংরেজশাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের স্বার্থে, সেই আন্দোলনের অন্যতম উদ্গাতা ছিল পূর্ব পাকিস্তানিরা। একইভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি বৈষম্যের বিরোধও তেমনি তাদের প্রথমে স্বাধীকার এবং পরে স্বাধীনতার আন্দোলনে উজ্জীবিত করে। ১৯৭১-এর মার্চ মাসে শুরু হয় চূড়ান্ত পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধ। সুদীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর তার বিজয় সুনিশ্চিত হয়। তাই এই বিজয় দিবস ৯ মাসের কিংবা ২৫ বছরের সংগ্রামের বিজয় নয় পূর্ববঙ্গবাসীদের স্বাধীন মনোবৃত্তির, সুদীর্ঘকালের শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বিজয়। এটি ছিল ১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেশনের ঘোষণা বাস্তবায়ন এবং সুদীর্ঘকালের ‘বিশ্বাসঘাতকা ও বিভ্রান্তির’ অবসানের পর বিজয়।
প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন কবীর তার ‘বাংলার কাব্যে’ লিখেছেন, ‘বাংলার পূর্বাঞ্চলের প্রকৃতি ভিন্নধর্মী। পূর্ব বাংলার নিসর্গ হৃদয় তাকে ভাবুক করেছে বটে কিন্তু উদাসী করেনি। দিগন্তপ্রসারী প্রান্তরের অভাব সেখানে নেই কিন্তু সে প্রান্তরেও রয়েছে অহরহ বিস্ময়ের চঞ্চল লীলা। পদ্মা যমুনা মেঘনার অবিরাম স্রোতধারার নতুন জগতের সৃষ্টি ও পুরাতনের ধ্বংস।’ পূর্ব বাংলায় নিসর্গ নন্দনকাননেই শুধু পরিণত করেনি তাদের (বাংলাদেশের জনগণকে) করেছে পরিশ্রমী, সাহসী-শান্ত-সুজন, আত্মবিশ্বাসী, ভাবুক, চিন্তাশীল, আবেগময় ও ঔৎসুক্যপ্রবণ। তাদের রয়েছে নিজস্ব নামে দেশ সৃষ্টির ইতিহাস, ঐতিহ্য, চলনবলন, শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য ইত্যাদি। দৈহিক গড়ন গঠনে আবেগ অনুভূতিতে, রগে রক্তে তারা পৃথিবীর অন্যান্য জাতি ও সম্প্রদায় হতে আলাদা। ভৌগোলিক কারণেও তারা পৃথক ভিন্ন প্রকৃতির। জাতিগত ভাবাদর্শে, রাষ্ট্রীয় আনুগত্য প্রকাশে জাতীয়তাবোধে অন্যান্য রাষ্ট্র ও অঞ্চলে বসবাসকারী স্বধর্মী ও স্বভাসীদের থেকেও তারা স্বতন্ত্র প্রকৃতির। বাংলাদেশের জনগণ শান্তিপ্রিয়। তারা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিজেরাই অর্জন করতে জানে এবং নিয়ন্ত্রণ করে। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় জনগণের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সত্যের আত্মপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সচেতনতা জাতিসত্তার মৌলিক পরিচয়ে সমুন্নত করেছেন।
স্বাধীনতা লাভে বাঙালির জাতীয় জীবনে যে নবদিগন্তের সূচনা হয় তাতে সীমাহীন শোষণ ও সুদীর্ঘকালের অবজ্ঞায় নিষ্পেষিত ঔপনিবেশিক জীবনযাত্রা থেকে মুক্তি পাওয়ার এবং নিজেদের নিয়মে চলার, নিজে পায়ে নিজের দাঁড়ানোর, বাঁচার এবং বিকশিত হওয়ার অধিকার তারা পেয়েছে। বাঙালির অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায়, সাংস্কৃতিক সংকীর্তায়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। নতুন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করার ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রশাসনের সুযোগ লাভ এবং নিজেরাই নিজেদের উন্নতি ও অবনতির নিয়ন্তা, হয়েছে সফলতা ও ব্যর্থতার দাবিদার।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে আমরা কীভাবে নিজের পায়ে নিজেরা দাঁড়াব, দীর্ঘদিনের অবহেলা আর অবজ্ঞার ফলে ধ্বংসপ্রায় আমাদের অর্থনৈতিক জীবনকে আমরা কীভাবে চাঙ্গা করে তুলব, আমরা কীভাবে আমাদের সমাজজীবন থেকে বন্ধ্যানীতি কুসংস্কার আর অপয়া ভাবধারাকে অপসারিত করে আমাদের জাতিসত্তার বিকাশ ঘটিয়ে জাগ্রত জাতিসভায় আমাদের অবস্থান ও গৌরবকে আরও ঐশ্বর্যমণ্ডিত করার সে চেতনা জাগাতে পারে সৃজিত মূল্যবোধগুলো। আমাদের ইতিহাস ও ঘটনা পরিক্রমা এই প্রতীতি জাগাতে পারে যে আমরা গণতান্ত্রিকমনা, আমরা আমাদের স্বাধীনতা রক্ষায় একাগ্র, আমাদের কর্তব্য পালনে আমরা নিরলস এবং অনন্য ঐক্যে বিশ্বাসী ও ধাতস্থ। সুতরাং ছাত্র-জনতার ঐক্যেও আন্দোলনে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে আমাদের মূল্যবোধগুলো, মুক্তিযুদ্ধকালীন একাগ্রতা, আত্মত্যাগের সুমহান সংকল্প নিশ্চয়ই একই ভূমিকা পালন করবে আমাদের সমাজে বৈষম্য নিরসনে অর্থবহ করে তুলতে সহায়তা করবে। কোনোক্রমেই এসব মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়ে বিভ্রান্তিতে জড়িয়ে পড়ায়, দায়িত্বহীনতায়, অলসতায়, একে অন্যের দোষারোপের অবয়বে নিজেদের বিলীন করে দেয়ার প্রবণতা যেন দেখা না দেয়।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ এই একাগ্রতার পরিচয় দিতে যে পিছপা হয়নি, সত্যই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়নি তার সাফল্যগাথা যেমন আছে তেমনি ক্ষেত্রবিশেষে চরিত্রবলের অধঃপতন ও ন্যায়নীতিনির্ভর মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত কারণ থেকে উৎসারিত দুর্নীতি জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মপ্রয়াস মন্থর করে দেওয়ার, অদূরদর্শী পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রারবিঘ্নও বিভ্রাট সৃষ্টি হওয়ার বিষয়গুলোকে যথাসচেতনতায় সজাগ দৃষ্টি দেওয়ার অবকাশও রয়েছে।
অতীতকে আঁকড়ে ধরে থেকে নয় বরং অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বিজয়কে জীবনের সর্বস্তরে উদ্ভাসিত করে তোলার জাগ্রত চেতনায়, সমাজকে পরিছন্ন করে তোলার ব্রত নিয়ে নিজস্ব ভৌগোলিক সীমানায় নিজস্ব বৈশিষ্টের আলোকে দেশিক আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতেই এ দেশ গড়ে তোলার মহান অনুপ্রেরণার সঞ্চারী হোক সকলের প্রত্যয়।
লেখক: সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান
আমাদের বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের অর্থনীতি অনেকটা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আদিকাল থেকেই এ দেশের মানুষ কৃষির ওপর জীবিকা নির্বাহ করত। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের চাহিদাও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করায় খাদ্যের উৎপাদন অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। চাষাবাদে আগের ধ্যান-ধারণা অনেক পাল্টে গেছে। বর্তমানে শিক্ষিত তরুণ-যুবকরা চাষাবাদে নিজেদের নিয়োজিত করে কৃষিকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। দেশের ধানচাষ হতে শুরু করে সবজিচাষে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
তাছাড়া মৎস্য, পোলট্রি, ডেইরিশিল্পেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। দেশের কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে পর্যন্ত রপ্তারি হচ্ছে। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শাক-সবজি, মাছ রপ্তানি হচ্ছে। দেশের বাইরে আমাদের দেশের কৃষিজাত পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। আমরা যদি এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারি তবে দেশের জন্য অনেক মঙ্গল হবে। আয় হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। দেশের তরুণ যুবকরা এখন আর গতানুগতিক চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেরা স্বনির্ভর হওয়ার লক্ষ্যে কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়োজিত করছে। ইতোমধ্যে অনেকেই বেশ সফলতার সঙ্গে এগিয়ে গেছে। সৃষ্টি করেছে অনন্য দৃষ্টান্ত। আমাদের সমাজে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ব্যবস্যায় নিয়োজিত হয়ে স্বনির্ভর হয়ে অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন।
অতীতের তরুণসমাজ আর বর্তমান তরুণসমাজের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বর্তমান সময়ের তরুণরা পড়ালেখার পাশাপাশি আত্মনির্ভর হওয়ার উপায় খোঁজে। যে কারণে আমাদের দেশ এবং জাতি তরুণরা আত্মনির্ভর হতে গিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা করছে, পোলট্রিশিল্প, ডেইরিশিল্প, মৎস্যশিল্পের মতো শিল্পে জড়িত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের অনেক তরুণ জনপ্রিয় মাশরুমচাষে নিয়োজিত হচ্ছে। স্বল্পপুঁজিতে অধিক লাভ হওয়া মাশরুমচাষে দেশের তরুণ সমাজের একটা অংশ নিয়োজিত আছে। মাশরুমচাষ সহজ হওয়ায় নারীরাও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসছেন। মাশরুম চাষ এখন একটা শিল্পে পরিণত হয়েছে। দেশে-বিদেশে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের মধ্যে মাশরুম এখন একটি জনপ্রিয় খাবার। যা আমাদের নানা রকমের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে।
মাশরুমের বিশেষ গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও মাশরুম আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত সহজলভ্য হয়নি। কিন্তু একটু সচেতন হলেই আমরা নিজেরাই আমাদের দৈনন্দিন চাহিদা নিজেরাই পূরণ করতে পারি। আমাদের দেশে সাধারণত খাবারের উপযোগী তিন জাতের মাশরুম চাষ হয়। ক) স্ট্র মাশরুম: ধানের খড়, শিমুল তুলা, ছোলার বেসন ও চাউলের কুড়া ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহার করে স্ট্র মাশরুমের চাষ করা হয়। আমাদের দেশে সাধারণত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এর চাষ করা যায়। খ) ইয়ার মাশরুম: সাধারণত বর্ষাকালে প্রাকৃতিকভাবে আমগাছে ইয়ার মাশরুম পাওয়া যায়। ইয়ার মাশরুম দেখতে কালচে রঙের হয়ে থাকে। ইয়ার মাশরুম সারাবছর চাষ করা গেলেও সাধারণত বর্ষাকালে এর ফলন ভালো হয়। গ) অয়েস্টার মাশরুম: আমাদের দেশে এই জাতের মাশরুমের চাষ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে।
সারা বছরই এই মাশরুম চাষ করা যায় তবে শীত এবং বর্ষাকালে এর ফলন ভালো হয়। অয়েস্টার মাশরুম খুব সহজে চাষ করা যায় এবং এর জন্য খুব অল্পজায়গার প্রয়োজন হয়। মাশরুম উৎপাদন কৌশল এবং চাষের উপযোগী স্থান সম্পর্কে জানা যায় মাশরুম খোলা জায়গায় চাষ করা যায় না আর তার জন্য আবাদি জমির প্রয়োজন পড়ে না। মাশরুম চাষ করার জন্য ছায়াযুক্ত জায়গায় ছন বা বাঁশের চালা দিয়ে ঘর তৈরি করতে হয়। মাটির দেয়াল দিয়েও ঘর তৈরি করা যায়। আবার বাঁশের বেড়াও দেওয়া যায়। ঘরের ভেতরে যাতে আলো প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বাঁশের বেড়ায় মাটি লেপে দিতে হয়। অয়েস্টার মাশরুম চাষ পদ্ধতি: ওয়েস্টার মাশরুম বীজ বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড় করে মাশরুম চাষ করা যাবে। ধাপে ধাপে মাশরুম চাষ করতে হয়। প্রাপ্ত তথ্য থেকে আরও জানা যায় পৃথিবীতে প্রায় ৩ লাখ প্রজাতির মাশরুম রয়েছে।
এগুলোর মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার প্রজাতি খাওয়ার অযোগ্য। আনুমানিক ১০ হাজার মাশরুমের ওপর গবেষণা চলছে। এদের ভেতর ১০ প্রজাতির মাশরুম খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে। মাশরুমচাষে বেশি লাভ হওয়ার কারণে আমাদের দেশে অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক এবং গৃহিণীরা মাশরুমচাষে এগিয়ে আসছেন। মাশরুম চাষ একটি লাভজনক ব্যবসা, ক্ষুদ্র বা ব্যাপক পরিসরে মাশরুম চাষ করা যায়। স্পন থেকে মাশরুম চাষ করা হয়। এই স্পনগুলো ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়। মাশরুম চাষ করতে গেলে সর্বপ্রথম সঠিক কর্মপরিকল্পনা করা প্রয়োজন। সঠিকভাবে কাজ পরিচালনা করার জন্য হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেওয়া জরুরি। কিছু লোক একত্রে মিলেমিশে মাশরুম চাষ করলে দ্রুত লাভবান হওয়া যায়। ঘরে বসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করা যায়।
গ্রাম কিংবা শহরের যুবকরা এই মাশরুম চাষ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন। পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও ঘরে বসে অল্প মূলধন দিয়ে মাশরুম চাষ শুরু করতে পারেন। মাশরুম চাষের জন্য আলোহীন স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ প্রয়োজন। তবে খেয়াল রাখতে হবে ঘরে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে। শহর কিংবা গ্রামে সব জায়গায় মাশরুম চাষ করা সম্ভব। স্পনগুলোকে রাখার জন্য ছোট ছোট মাচা ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো হতে পারে লোহা, বাঁশ কিংবা কাঠের। অতিরিক্ত গরম মাশরুম চাষের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এ জন্য প্রয়োজন হলে ফ্যান ব্যবহার করা যেতে পারে।
পাশাপাশি মাশরুম চাষের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির প্রয়োজন হয়। হ্যান্ড স্প্রে মেশিনের সাহায্যে স্পনগুলোতে নিয়মিত পানি দিয়ে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা করে রাখতে হবে। মাশরুমের উৎপাদন সম্পর্কে জানা যায় সাধারণ ভালো মানের স্পন থেকে গ্রীষ্মকালে প্রতি আড়াই মাসে ৯০ থেকে ১০০ গ্রাম মাশরুম পাওয়া যায়। শীত এবং বর্ষাকালে মাশরুম উৎপাদন অধিক পরিমাণে হয়ে থাকে। এ সময় একটি ভালো মানের স্পন থেকে প্রতি আড়াই মাসে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম মাশরুম উৎপাদন করা সম্ভব। ১০-১২ টাকা মূল্যের এই স্পনগুলো প্রতি আড়াই মাস পরপর পরিবর্তন করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মাশরুমের চাষ করা হচ্ছে। মাশরুম চাষের পাশাপাশি মাশরুম বিপণন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সঠিকভাবে বিপণন করতে না পারলে মাশরুম থেকে অধিক পরিমাণে লাভ করা সম্ভব নয়।
এ জন্য চাষের পাশাপাশি বিপণন বা মার্কেটিং পদ্ধতি ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন বড় বড় হোটেলগুলোতে এবং চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে মাশরুমের ভালো চাহিদা রয়েছে। তা ছাড়া দেশের বড় বড় সুপার শপ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে এবং বাজারে মাশরুম বিক্রি হয়ে থাকে। সাধারণত বাজারে প্রতি কেজি মাশরুম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি করা সম্ভব না হলে তা শুকিয়ে রাখা সম্ভব। এটাকে ড্রাই মাশরুম বলা হয়। বাজারে ড্রাই মাশরুমের দাম প্রতি কেজি ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। ড্রাই মাশরুম পানিতে ভেজালে আবার কাঁচা মাশরুমের মতো হয়ে যায়। বিক্রির অসুবিধা হলে মাশরুম সংরক্ষণ করা সম্ভব বলে এটা একটি লাভজনক ব্যবসা। মাশরুম চাষ এবং প্রশিক্ষণের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সাভারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ‘মাশরুম চাষ সেন্টার’ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে।
এখানে প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণার্থীকে আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এই প্রশিক্ষণের মেয়াদ তিন দিন পর্যন্ত। এখানে প্রশিক্ষণার্থীদের সরকারিভাবে সার্টিফিকেট প্রদানের মাধ্যমে কীভাবে মাশরুম চাষ করা যায়, কীভাবে বিপণন করা যায়, মাশরুম চাষের সমস্যা সুবিধা ইত্যাদি বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করা ছাড়াও বেসরকারি বেশ কিছু এনজিও সংস্থা মাশরুমচাষিদের প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। এ ছাড়া মাশরুম চাষ সম্পর্কে বাজারে অনেক বই পাওয়া যায়। মাশরুম একটি মূল্যবান সবজি। উন্নত বিশ্বে মাশরুম বেশ চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশেও মাশরুমের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। মাশরুম চাষের মাধ্যমে আমাদের দেশের কৃষি বিভাগে নতুন ধারার সৃষ্টি হবে এবং অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি আসবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক
আমাদের দেশে কবি বলেছেন, ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা, ইদানীং আধুনিক কবিরা মনে করেন ‘তেল-গ্যাস আর প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’ উল্লেখ্য, বিগত কয়েক বছর ধরে বিদ্যমান তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎসহ জ্বালানি সংকটের প্রেক্ষাপটে বিগত সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বঙ্গোপসাগরে আমাদের সমুদ্রসীমানায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আন্তর্জাতিক আদালতে দীর্ঘ শুনানির পর প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সুবিস্তৃত সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর কেবল ব্যর্থতার বৃত্তে এতদিন ঘুরপাক খেয়েছে বিষয়টি। বাস্তবে কার্যকর তেমন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও উদ্যোগ গৃহীত হয়নি বললেই চলে।
সাম্প্রতিককালে ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি-হামাস যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল-গ্যাস-এলপিজির দামের ব্যাপক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় আবারও সামনে এসেছে বিষয়টি। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কোম্পানি এক্সন মোবিল, শেভরনসহ কয়েকটি বড় কোম্পানি বাংলাদেশের উপকূলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ প্রকাশ করায় নড়েচড়ে বসেছেন তেল-গ্যাস অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি বা বাপেক্সের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে এখন সাতটি গ্যাসক্ষেত্র উৎপাদনক্ষম আছে। এগুলোতে মোট গ্যাস মজুত আছে ১ দশমিক ৭৭৭২ টিসিএফ। এ ছাড়া এ মুহূর্তে অনুসন্ধান কূপ আছে মোট ১৮টি। পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের সহায়তায় দেশের স্থলভাগে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পাশাপাশি এবার জোর দিয়েছে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ওপরও।
বিগত সরকারের গত দেড় দশকের শাসনামলে দেশের স্থলভাগ ও সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে জরিপ চালানো হয় প্রায় ৫০ হাজার লাইন কিলোমিটার যা জরিপের অধীন এলাকার দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক এলাকায়। স্থানীয় গ্যাসের মজুত খুঁজে বের করতেই এ অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে টুডি, থ্রিডি ও মাল্টিক্লায়েন্ট জরিপের মাধ্যমে। তবে এ জরিপ কার্যক্রম দেশে গ্যাসের নতুন মজুত বৃদ্ধিতে খুব সামান্যই ভূমিকা রাখতে পেরেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জরিপ চালানো হলেও গ্যাসের উত্তোলন বাড়াতে পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস কূপ খনন করা হয়নি, যা আমাদের গ্যাস অধিক পরিমাণে উৎপাদনের ক্ষেত্রে অন্যতম ব্যর্থতার কারণ, দীর্ঘদিন ধরে সারা দেশে গ্যাস খুঁজতে গিয়ে দেশের মূল ভূখণ্ডের বাইরে ভোলা ছাড়া আর কোথাও গ্যাসের বড় কোনো মজুত পাওয়া যায়নি।
জ্বালানি বিভাগের এক হিসাব অনুযায়ী, ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে গ্যাস ক্ষেত্র ছিল ২৩টি। বর্তমানে তা ২৯টিতে উন্নীত হয়েছে। গত দেড় দশকে নতুন যে ছয়টি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সেখানে গ্যাসের বড় কোনো মজুত পাওয়া যায়নি। নতুন আবিষ্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে নোয়াখালীর সুন্দলপুর গ্যাস ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ও নিশ্চিতকৃত মজুত যা টুপি-প্রুভেন অ্যান্ড প্রবাবল রিজার্ভ বলে অভিহিত তার পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ঘনফুট বা বিসিএফ। এ ছাড়া কুমিল্লার শ্রীকাইল গ্যাস ফিল্ডে কিছু গ্যাসের মজুত পাওয়া যায়, পরিমাণ যৎসামান্য অর্থাৎ ১৬১ বিসিএফ, রূপগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডে ৩৩ বিসিএফ, সিলেটের জকিগঞ্জেও সামান্য কিছু গ্যাসের মজুত পাওয়া যায়। এর বাইরে স্থলভাগের মূল ভূখণ্ডে ভোলা জেলায় ভোলা নর্থ ও ইলিশায় অন্তত ৮০০ বিসিএফ গ্যাসের মজুত পাওয়া গেছে। কিন্তু ভোলার এ গ্যাস ক্ষেত্র এখন পর্যন্ত কোনো কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। পাইপলাইন না থাকায় তা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যাচ্ছে না।
বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম কমেছে শতকরা ৫০ ভাগ, যখন ভারত তাদের ভোক্তাদের জন্য গ্যাসের দাম কমিয়েছে ১০১ রুপি, তখন আমরা অবিশ্বাস্য হারে গড়ে ৪৬.৭৫ শতাংশ দাম বাড়াচ্ছি। গ্যাসের বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা সংক্ষেপে বিইআরসি, বিদ্যুৎ, সার, শিল্প, চা-বাগান, ক্যাপটিভ পাওয়ারসহ সব শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতের গ্যাস ব্যবহার, সিএনজি এবং গৃহস্থালি পর্যায় মিলে সব ধরনের গ্যাস ব্যবহারকে অতি উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির আওতায় এনেছে। গড় হিসাবে প্রাথমিক ও মৌলিক জ্বালানি গ্যাসের দাম গড়ে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়ছে। এক অর্থবছরেই প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করা বিদ্যুৎ খাতের গ্যাসের দাম বাড়বে ৪১ শতাংশ, আর ক্যাপটিভ পাওয়ারের গ্যাসে দাম বাড়বে ৪৪ শতাংশ। দেশের কৃষককুল যেখানে উচ্চ উৎপাদন খরচের বিপরীতে অসহনীয় মূল্য বিপর্যয়ে পড়ছেন, কৃষকের ফসল উৎপাদনের অন্যতম উপাদান হলো সার এবং এই সার উৎপাদনের ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে সর্বোচ্চ ৬৪ শতাংশ। এ কারণেই ভারতের কৃষক ধান চাষ করে লাভবান হন, আর আমাদের কৃষক হন ক্ষতিগ্রস্ত। পাশাপাশি শিল্প খাতের গ্যাসে দাম বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। আমাদের অর্থনীতি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ, কৃষি ও শিল্প- এই তিন খাতের ব্যবহৃত গ্যাসের দাম গড়ে ৪৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। প্রাথমিক ও মৌলিক জ্বালানি বলে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে তৈরি পোশাক অর্থাৎ গার্মেনটশিল্প উৎপাদন, বিদ্যুৎ মূল্য ইত্যাদি থেকে শুরু করে জনজীবনের প্রায় সর্বত্র।
বিশ্বের অন্যত্র গ্যাসের দরপতন হচ্ছে তবে তা আমাদের দেশেই হচ্ছে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও তাদের ভোক্তাদের জন্য গ্যাসের দাম ব্যাপক হারে কমিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়ার নতুন নতুন উৎপাদন এবং ব্যাপকভিত্তিক এলএনজি রপ্তানির প্রকল্প হাতে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় ধরনের দরপতন চলছে। গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরের তুলনায় বর্তমানে এশিয়ার বাজারসহ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য কমেছে অর্ধেকেরও কম। এশিয়ার এলএনজি বেঞ্চমার্ক জাপান-কোরিয়া বাজারের মূল্যসূচক অর্ধেকের বেশি নিচে নেমেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে ভর্তুকিযুক্ত এবং ভর্তুকিমুক্ত উভয় ধরনের গ্যাসের দাম কমানো হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক দরপতনের ঠিক বিপরীতে চলছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরের শুরুতেই দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান জ্বালানি গ্যাসের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছিল তৎকালিন সরকারের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছিলেন দেশের সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়বে, তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদন খরচ বাড়বে, পরিবহন ব্যয় বাড়বে, গৃহস্থালির রান্নার ব্যয়ও বাড়বে আর আন্তর্জাতিক বাজারের দরপতনের সুবিধা হরণ করে ভোক্তা অধিকারকেও এতে খর্ব করা হলো বলে প্রতীয়মান হয়।
যখন বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম কমেছে অর্ধেকের মত আর আমরা অবিশ্বাস্য হারে গড়ে ৪৬.৭৫ শতাংশ হারে দাম বাড়িয়েছি, দাম বাড়ানোর তৎকালিন সরকারের যুক্তি ছিল উচ্চ দামে যে এলপিজি বা তরল গ্যাস আমদানি করা হয়, তাতে ভর্তুকির ভার লাঘব করা হবে। এটা অযৌক্তিক এ কারণে যে বিশ্ববাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বিগত সময়ে বাড়েনি, বরং অর্ধেকে নেমে এসেছে। সুতরাং যৌক্তিক হলো আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশেও গ্যাসের দামও কমাতে হবে। অন্তত এলএনজিভিত্তিক সরবরাহের যে খাতগুলো আছে, সেখানে দাম কমানো যেতে পারে। বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে যেখানে এলএনজি ব্যবহৃত হয়, সেখানে তো গ্যাসের দাম কমার কথা। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে সার উৎপাদনের গ্যাসেই সর্বোচ্চ ৬৪ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে।
এটা অগ্রহণযোগ্য এ জন্য যে গ্যাস খাতের দুর্নীতিযুক্ত ব্যবস্থাপনা ঠিক না করে, নতুন উৎপাদনে না গিয়ে, সরবরাহ ও বিতরণব্যবস্থা বা পাইপলাইন ঠিক না করে, গ্যাস চুরির সমস্যা সমাধান না করে শুধু দাম বাড়িয়ে এই খাত টেকসই করা যাবে না। ২০১৫ ও ২০১৭ সালেও বিভিন্ন স্তরে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল, তারপরও আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানিমূল্য কমার পরেও চুরি, সিস্টেম লস, ভর্তুকি কমছে না। মূলত, দুর্নীতিপরায়ণতা, ব্যবস্থাপনায় অদূরদর্শিতা, বিতরণে নৈরাজ্য, গ্যাস চুরি ও অবৈধ সংযোগ, সরবরাহ লাইন থেকেই অবৈধ বিতরণ, ১২ শতাংশ সিস্টেম লস, অন্যায্য মিটারিং, এলএনজি আমদানির খরচ বাড়িয়ে দেখানো, এলএনজি ও গ্যাস পাইপলাইনের প্রকল্পে ধীরতা। এসবের দায় কেন জনগণ নেবে? এমনকি মীমাংসিত সামুদ্রিক ব্লক ও স্থলভাগে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও নতুন উত্তোলন চুক্তিতে ব্যর্থতার কারণেই গ্যাস খাতে ভর্তুকি টানতে হচ্ছে।
গ্যাস উন্নয়ন ও গ্যাস নিরাপত্তা তহবিলে পাঁচ হাজার কোটি টাকা করে জমিয়ে ভর্তুকির চাহিদা জারি রেখেছে, কিন্তু এই তহবিল ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নেই। কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) দুর্নীতির কারণে গ্যাস উন্নয়ন ও গ্যাস নিরাপত্তা তহবিল বিলুপ্ত করার প্রস্তাব দিয়ে ব্যবস্থাপনা নৈরাজ্য দূর করার সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিয়েছে। যেখানে বিতরণ লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে নিয়মিত, সেখানে রান্নার গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলপিজির প্রাপ্তি ও মূল্যকে যৌক্তিক করা হয়নি এখনো। যেখানে কৃষি উৎপাদন ঠিক রাখতে সারের সরবরাহ বৃদ্ধি করা জরুরি, যেখানে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম দিনে দিনে কমছে, সেখানে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান না করে বাজারের সঙ্গে সম্পর্কহীন অতি উচ্চ মূল্যবৃদ্ধি পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন সাধারণ ব্যবহারকারী জনগণের একাংশ।
গত অর্থবছরের শুরুতেই গ্যাসের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি কি তাহলে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ঘাটতি বাজেটের ঘাটতি কমানোর চেষ্টা? এমনিতেই বাজেট ঘোষণার পর ভ্যাটের একটা চাপ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, মৌলিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের দাম গড়ে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়লেও প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশেই স্থির থাকবে কীভাবে? এক অর্থবছরেই বিদ্যুৎ, কৃষি ও শিল্পের ব্যবহৃত গ্যাসের দাম গড়ে ৪৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি নিয়ে কীভাবে প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশে আটকে রাখার চ্যালেঞ্জ উতরানো যাবে? জ্বালানির এই যে বিশাল ধাপের মূল্যবৃদ্ধি, তা কি দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এক অর্থবছরেই জ্বালানি কৃষি ও শিল্পের ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির হার যদি বাজেটের প্রাক্কলিত অন্য সংখ্যাগুলোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ থেকে যায় অথবা উৎপাদন অর্থনীতির গাণিতিক হিসাবে অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে থেকে যায়, আমরা কি ধরে নিতে পারি না যে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি নির্ণয়ের হিসাবে বড়োসড়ো গরমিল আছে! প্রাথমিক ও মৌলিক জ্বালানি গ্যাসের দাম গড়ে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়িয়ে কীভাবে জনজীবন ও মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রাখা হবে?
আমাদের দেশের গ্যাসের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিশিষ্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার রাইটার ও সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাকটিভিস্ট জনাব ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান ‘বিশ্বের দুর্নীতিমুক্ত দেশগুলোর আদলে যেকোনো প্রাথমিক জ্বালানির দাম নির্ধারণের স্থায়ী গাণিতিক মডেল দাঁড় করাতে হবে। তবেই তা টেকসই ও বোধগম্য হবে। এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে দেশীয় চাহিদা, আন্তর্জাতিক দর, বার্ষিক রাজস্ব প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন, মূল্যস্ফীতি, বিকল্প সবুজ জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহদান কিংবা সহযোগী অন্য জ্বালানির দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার ব্যবস্থা। যেখানে দেশে পরবর্তী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ এবং রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ, সেখানে বিদ্যুৎ, কৃষি ও শিল্পের প্রাথমিক জ্বালানি গ্যাসের দাম গড়ে ৪৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে কোন যুক্তিতে, কোন সমীকরণে? এই সমীকরণ না মিললে এটাই প্রতীয়মান হয় যে সরকার তহবিল–ঘাটতি মেটাতে ব্যবসা, উৎপাদন থেকে শুরু করে জনগণের পকেটেও হাত দিতে চাইছে। অর্থবছরের শুরুতেই গ্যাসের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি কি তাহলে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ঘাটতি বাজেটের ঘাটতি কমানোর চেষ্টা?
জালানি বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে স্থলভাগে টুডি সিসমিক সার্ভে করা হয়েছিল ২০ হাজার ১৭ লাইন কিলোমিটার এলাকায়। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত তা উন্নীত হয়েছিল ৩২ হাজার ৩১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এই তথ্যানুযায়ী বিগত ১৮ বছরে মাত্র ১২ হাজার ৩৩৪ লাইন কিলোমিটার টুডি সিসমিক জরিপ হয়েছে এমনকি থ্রিডি সিসমিক সার্ভে আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে মাত্র ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার।
সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিগত সরকারের আমলে মূলত কি পরিমাণ সম্পদ রয়েছে এবং তা কীভাবে উত্তোলন সম্ভব তা নিয়েই যথার্থ রিপোর্ট আশা করা হয়েছিল। কি এক অজানা কারণে তা অদ্যাবধি সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, দেশের এই সংস্কারমূলক কর্মসূচিতে প্রাকৃতিক সম্পদ ‘তেল-গ্যাস অনুসন্ধান’ কর্মসূচি পুনরায় অনুমোদন দিয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে সম্ভাবতা যাচাই করে দ্রুত অধিক পরিমাণে তেল-গ্যাস উত্তোলনের মতো সুসংবাদ নিয়ে আসবে যা আমরা সাধারণ জনগণরা আশা করছি ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক ধাপ সহজ হবে এটাই সর্বসাধারণের কাম্য।
লেখক: প্রাবন্ধিত ও গবেষক
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরেই সোচ্চার ত্রিশোর্ধ্ব বয়সি চাকরি প্রার্থীরা। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নির্ধারিত আছে অনূর্ধ্ব ৩০ বছর। এর আগে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নির্ধারিত ছিল অনূর্ধ্ব ২৭ বছর। ১৯৯১ সালে এটি বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়েছে। এখন আবারও বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি উঠেছে। এই দাবির পক্ষে ও বিপক্ষে রয়েছে বেশ কিছু যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি।
এক. ১৯৯১ সালে যখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর তখন সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর হলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছরই নির্ধারিত আছে। তাই এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো উচিত। এর পাল্টা যুক্তি হচ্ছে, আমাদের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর চেয়ে নিয়মিত অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো অধিক যুক্তিযুক্ত। কারণ ৬০ বছর বয়স হওয়ার পরেও বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ কর্মক্ষম থাকেন। যাদের ফিটনেস থাকে না তাদের কথা ভিন্ন। তাই নিয়মিত অবসরের বয়সের ঊর্ধ্বসীমা ৬২/৬৩/৬৫ হওয়া উচিত। যদিও এতে পদ শূন্য হওয়ার সুযোগ কিছুটা বিলম্বিত হবে।
দুই. সেশন জটের বিরূপ প্রভাবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসনদ অর্জনে বিলম্ব হওয়ার কারণে চাকরি প্রার্থীরা নিয়োগ পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় কম পাচ্ছে। তাছাড়া ৩০ বছর বয়সের মধ্যে উচ্চশিক্ষা অর্জনের পর যতটুকু সময় পাওয়া যাচ্ছে তাতে খুব বেশি সরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হচ্ছে না। তাই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো উচিত। এর পাল্টা যুক্তি হচ্ছে, যেসব কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে সেশন জট তৈরি হয়েছে, হচ্ছে সেসব কারণ নিরসন করা আবশ্যক। বিশেষ করে যে দু-একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বিভাগে/বিষয়ে সেশনজট আছে সেগুলোতে জরুরি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
বর্তমানে কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ও অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট নেই। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালেও যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট থাকবে তাদের শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতির সময় অন্যদের তুলনায় কমই পাবে। তাই এর প্রতিকার ব্যবস্থা ওই প্রতিষ্ঠানেই নিতে হবে। আর সরকারি চাকরিতে যাতে শূন্য পদ দ্রুত পূরণ করা যায় সে ব্যবস্থা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই নেওয়া আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান ভিত্তিক একটা পরিকল্পনা থাকতে হবে। প্রতিটি বিভাগের কর্মচারীরা আগামী ১ থেকে ৫ বছরের মধ্যে কতজন কখন অবসরে যাবেন তার হিসাব নিশ্চয়ই তারা করতে পারবেন এবং সে মতে লোক নিয়োগের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আগাম নিতে পারবেন। পদ শূন্য হওয়ার আগেই সে পদে নিয়োগের জন্য শর্তসাপেক্ষে চূড়ান্ত করতে হবে যোগ্য প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া। প্রয়োজনে পরিমার্জন করতে হবে নিয়োগসংক্রান্ত বিধিবিধান। মনে রাখতে হবে, সরকারি কর্মচারীর পদ যতদিন শূন্য থাকে জনগণ ততদিন সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত থাকে!
তিন. অন্যান্য অনেক দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছরের বেশি নির্ধারিত আছে এবং কোনো কোনো দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারিত নেই। তাই আমাদের দেশেও সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সের কোনো ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারিত থাকা উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে পাল্টা যুক্তি হচ্ছে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের সব অবস্থা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শিক্ষাব্যবস্থা আলাদা। শিক্ষার সঙ্গে চাকরির সম্পর্কের ধরন আলাদা। বিশেষ করে উন্নত দেশে শিক্ষা ও চাকরি পরস্পর এমনভাবে সম্পর্কিত যে চাকরি পাওয়ার জন্য আর পৃথকভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া, স্থায়িত্বকাল ও অবসরসংক্রান্ত বিষয়াদি আমাদের থেকে আলাদা। সরকারি চাকরিপ্রার্থীর তুলনায় উদ্যোক্তা ও বেসরকারি বা প্রাইভেট চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। এমন অনেক দেশ আছে যেখানে চাকরিতে জুনিয়র প্রার্থীর সংখ্যা আমাদের দেশের তুলনায় অনেক অনেক কম। সে দেশে সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। ফলে সেখানে বিভিন্ন পদের/গ্রেডের চাকরিতে মোট প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য প্রবেশের বয়সসীমা অনির্ধারিত রাখার প্রয়োজন পড়ে। এমতাবস্থায় সার্বিক বিবেচনায় আমাদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ও অবসরের বয়সসীমা নির্ধারণসংক্রান্ত বিষয়ে এ দেশের বাস্তবতার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আমাদের বিপুলসংখ্যক জুনিয়র সিটিজেন (যুবশক্তি) অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজে লাগিয়ে আরও দ্রুত উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করা আবশ্যক।
চার. কেউ কেউ বিভিন্ন কারণে লেখাপড়া শেষ করতে বিলম্ব হয় এবং লেখাপড়া শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরিতে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হয়। তদুপরি সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পায় না কিংবা দুয়েকটি চাকরির পরীক্ষা দিয়েও কাঙ্ক্ষিত চাকরি পেতে ব্যর্থ হয়। তাদের সুবিধার্থে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সের ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধি করা উচিত। এক্ষে ত্রে পাল্টা যুক্তি হচ্ছে- তাদের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। তাদের কথা চিন্তা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সের ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধি করা হলে তাদের চেয়ে অন্যরাই অধিক সুবিধা পাবে। সে ক্ষেত্রেও তারা বঞ্চিত হবে। তবে এমন সুবিধা বঞ্চিত কেউ অত্যধিক যোগ্য ও মেধাবী হলে ভিন্ন কথা। তার বা তাদের গুরুত্ব অনেক বেশি। তেমন যোগ্য-মেধাবীদের নিয়োগ দিয়ে উন্নত সেবা কীভাবে সরকারি দপ্তর নিতে পারে তা ভেবে দেখা উচিত।
উল্লিখিত যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির পরেও সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আরও বেশ কিছু একপাক্ষিক যুক্তি বিদ্যমান। অধিক বয়সিদের আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হলে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে, কাজে নিয়োজিত করতে যে বয়স হয়ে যাবে সে বয়সে তাদের শারীরিক সক্ষমতা ও কর্মক্ষমতা ঊর্ধ্বমুখী না থাকাটাই স্বাভাবিক।
আলোচিত বাস্তবতায় বলা যায় যে, সরকারি চাকরিতে কর্মী নিয়োগে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সার্বিক বিবেচনায় তুলনামূলকভাবে কম বয়সি যোগ্য-মেধাবীদের নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং এর পাশাপাশি অধিক দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবী অধিক বয়সিদেরও নিয়োগের সুযোগ দেওয়া আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব হচ্ছে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেসব গ্রেডে/পদে চাকরির আবেদন করার জন্য ন্যূনতম এসএসসি বা এইচএসসি পাস হতে হয় সেসব চাকরির ক্ষেত্রে প্রার্থীদের প্রমাণ (স্ট্যান্ডার্ড) বয়স ২৫ বছর নির্ধারণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কাম্য যোগ্যতা অর্জনের পরে প্রার্থীরা নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সাধারণত কম/বেশি ৫ বছর সময় পাবে এবং একাধিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পাবে। আবার যেসব গ্রেডে/পদে চাকরির আবেদন করার জন্য ন্যূনতম স্নাতক/অনার্স বা মাস্টার্স পাস হতে হয় সে সব চাকরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রার্থীদের প্রমাণ (স্ট্যান্ডার্ড) বয়স ৩০ বছর নির্ধারণ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রেও কাম্য যোগ্যতা অর্জনের পরে প্রার্থীরা নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সাধারণত কম/বেশি ৫ বছর সময় পাবে এবং একাধিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পাবে। উভয় ক্ষেত্রের জন্য প্রস্তাবিত এই স্ট্যান্ডার্ড বয়স উভয় ক্ষেত্রের সাধারণ প্রার্থীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। তবে বিশেষ বিবেচনায় স্ট্যান্ডার্ড বয়সের চেয়ে অধিক বয়সের প্রার্থীদেরও শর্তসাপেক্ষে কাঙ্ক্ষিত সরকারি চাকরির জন্য আবেদনের সুযোগ দেওয়া উচিত।
কেননা, তাদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে অত্যাধিক যোগ্য-মেধাবী কিছু প্রার্থীও নির্ধারিত বয়স সামান্য অতিক্রম করলেই চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় এবং আমরাও তাদের উচ্চ সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হই। এ ক্ষেত্রে তাদের অতিরিক্ত বয়সের জন্য নিয়োগ পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর থেকে বর্তমানে সামান্য নম্বর বিয়োগ করতে হবে যেন নির্ধারিত বয়সের প্রার্থীদের চেয়ে অধিক যোগ্যরাই সুযোগ পায়। স্ট্যান্ডার্ড বয়সের চেয়ে প্রতি ছয় মাস অতিরিক্ত বয়সের জন্য শতকরা এক নম্বর বা আধা নম্বর বিয়োগ করা যেতে পারে। এ শর্ত মেনে নিয়ে যেকোনো বয়সের প্রার্থীরা চাকরির জন্য আবেদনের সুযোগ পেতে পারেন। বাস্তবতা হচ্ছে তারা নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য অন্যদের তুলনায় বেশি সময় পেয়েছেন। আমাদের দেশে উচ্চ প্রতিযোগিতা পূর্ণ কোনো কোনো উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রেও সিনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর থেকে কিছু নম্বর বিয়োগ করার একটা প্রচলন বিদ্যমান। যদি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এমন প্রচলন থাকতে পারে তো চাকরিপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে তা থাকতে পারবে না কেন?
মনে রাখতে হবে, দেশের মানুষের কর্মসংস্থান করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ; এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অধিক যোগ্য ও কর্মক্ষম লোক নিয়োগের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে সর্বাধিক কর্মসম্পাদন করে দেশের অগ্রগতি বৃদ্ধি করা। এই লক্ষ্যেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বারবার পুনর্নির্ধারণ করতে হবে চাকরিতে প্রবেশের ও অবসরের বয়সসীমা এবং এ সংক্রান্ত বিধি-বিধান। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
লেখক: অধ্যক্ষ, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট
কবির ভাষায় চোখেরও মন থাকে। তাই চোখে শুধু কান্না নয়, হাসিও থাকে। একটি গান আছে, ‘যে আঁখিতে এত হাসি লুকানো’। তার মানে চোখ হাসিও লুকাতে পারে। আর এ কারণেই আমাদের দেখায় ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এক একজন এক এক ভাবে দেখি। খোলা চোখে দেখা আর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা এক নয়। ভবিষ্যৎকে সবসময় অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই দেখে মানুষ। কোন দেখার গভীরতা কতটুকু তা নির্ভর করে দেখার ওপর। যে যতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ সে ততটা এগিয়ে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এ কারণেই আমাদের দেখায় ভিন্নতার কথা বললাম।
গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের মাধ্যমে আমাদের একটি বিজয় অর্জিত হলো। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো। এই সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। কেননা বিগত শেখ হাসিনা সরকারের ১৬ বছরের একনায়কতন্ত্র দুঃশাসনে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম। দুর্নীতি আর লুটপাটের অন্ধরাজ্য থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে এখন তৃপ্ত। এই আনন্দ, এই বিজয়ের প্রধান কৃতিত্ব ছাত্র বন্ধুদের। তারা কোটা আন্দোলন দিয়ে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে সফলকাম হয়। জনসাধারণের একাত্মতা বা সম্পৃক্ততা কতখানি ছিল, তা ৫ আগস্টের বাঁধভাঙা জনজোয়ার থেকে অনুধাবণ করা যায়। সেই জুলাইয়ের উত্তাল দিনগুলো কারও ভোলার কথা নয়। কিন্তু এখন যেসব প্রশ্ন উঠছে সেই বিষয়ে দৃষ্টি দিতে চাই।
প্রথমেই রোডম্যাপ প্রসঙ্গ- ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেওয়ার পর থেকেই রোডম্যাপ কথাটি আলোচনায় আসছে। এই সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে না-থাকবে, তাদের দায়িত্ব কী হবে না-হবে এটা নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে না বলেও নানাজন নানা কথা বলছেন। আরেকটি বিষয় নিয়ে অনেক দলের মধ্যে রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়েছে। দ্রুত নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বলা হচ্ছে। বিএনপির অনেক নেতাই এই বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন।
অন্যান্য দলেরও অনেকেই বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এত তাড়া কেন? শেখ হাসিনা সরকারকে জনগণ ম্যান্ডেট না দিলেও তারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অবৈধভাবে ম্যান্ডেট নিয়ে পুনরায় ৫ বছরের জন্য সরকার গঠন করেছিল। সেই হিসেবে ২০২৮ সাল পর্যন্ত তাদের ক্ষমতায় থাকার কথা। প্রিয় ছাত্ররা যদি এই আন্দোলনে সফল হতে না পারত তাহলে বিএনপি-জামায়াত বা অন্য দলগুলো কী করত? তাদের তো কারোরই রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলারও সুযোগ ছিল না। জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। এবং আমি মনে করি ২০২৮ সাল পর্যন্ত কারও টু-শব্দ করার উপায় ছিল না। টু-শব্দ মানেই গুম, খুন, আয়নাঘর, কত কী সেসব কারও অজানা নয়। সুতরাং সব দলেরই উচিত অন্তত ২০২৮ সাল পর্যন্ত এ বিষয়ে কথা না-বলা। না রোডম্যাপ, না ইলেকশন। সরকার যদি এরমধ্যে ৬ মাসে কাজটি করে ফেলতে পারে বা ১ বছরে করে ফেলতে পারে খুবই ভালো। না পারলে, অন্তত আমরা ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময় দিতে পারি। ক্ষতি কী? এর মধ্যে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দলগুলো নিজেদের মতো গুছিয়ে নিতে পারে, একতাবদ্ধ হতে পারে।
বর্তমান সরকারের একটাই চাওয়া সংস্কার। সচেতন নাগরিক হিসেবে এই সংস্কার আমরা কে না-চাই? প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুরু থেকেই বলে আসছেন, বিগত সরকার সব সেক্টর ধ্বংস করে দিয়ে গেছে, অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। তার কথার সূত্র ধরে বলতে পারি, তাহলে কি আমরা সেই ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন একটি নির্বাচিত সরকার দাঁড় করিয়ে দিতে পারি? মোটেই এমনটি কাম্য হতে পারে না। তাহলে আমরা ধ্বংস থেকে মুক্ত হব কীভাবে? আগে ভিত নির্মিত হোক, পরে সেই পাকা ভিতের ওপর এসে নির্বাচিত সরকার দাঁড়াক। যারা দাঁড়াবে তাদেরও দেশের জন্য কাজ করতে সুবিধা হবে। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে, সরকার যে সংস্কারের কথা বলছে তার সঙ্গে আমাদের একই মনোভাব পোষণ করা উচিত। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়েছে।
যেসব বিষয়ে সংস্কারের উদ্দেশে কমিশন গঠন করা হয়েছে, আশা করি সেগুলোর যৌক্তিকতা তুলে ধরার আবশ্যক নেই। বোধ করি, যথাসময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত। তবে দেখার বিষয়, তারা কতটুকু সংস্কার করে কতখানি সুফল অর্জনে সক্ষম হন। এই কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য বর্তমান সরকারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করা উচিত নয়, সময় বেঁধে দেওয়া উচিত নয়, এমনটি বিরক্ত বা বিব্রত করাও উচিত নয়। বারবার যদি প্রশ্ন করা হয় কতদিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দেবেন? রোডম্যাপ দিতে বিলম্ব কেন, তাহলে নিশ্চয়ই সরকার বিব্রতবোধ করবে। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর একমাত্র টার্গেট জাতীয় নির্বাচন। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা হবে। তাহলে প্রথমেই কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমি মনে করি, সরকার যে পথে হাঁটছে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে হাঁটছে এবং পথটি সম্পূর্ণ সঠিক, অন্তত এখন পর্যন্ত।
জুলাই আন্দোলনে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের মদদপুষ্ট প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। ইতোমধ্যে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো হয়েছে এবং সাজানোর কাজ অব্যাহত আছে। বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনকে গোছাতে সরকারকে অনেকটা বেগ পেতে হয়েছে। কেননা দেশের প্রায় সব থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ছিল স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন ব্রিজ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, টাওয়ার ধ্বংস করা হয়েছিল। যুদ্ধে জেতার কৌশল হিসেবে এই ধ্বংসের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকারের উপায় নেই। জনগণের সেবাদানকারী পুলিশকে হাসিনা সরকার ব্যবহার করে জনগণের ওপর গুলি ছুড়তে বাধ্য করেছিল। ফলে থানাগুলো আক্রমণের শিকার হয়। সেই পুলিশকে পুনরায় সংগঠিত করা একটি চ্যালেঞ্জ ছিল এবং সরকার এখানে শতভাগ সফল হয়েছে বলে মনে করি। আনসারের ক্ষেত্রেও একই কথা, যদিও তারা একটি ব্যর্থ আন্দোলনে জড়িয়েছিল। সুতরাং, খুব দ্রুততম সময়ে সরকার সবকিছু স্বাভাবিক করতে সমর্থ হয়েছে মনে করি। তবে একটি বিষয়ে ব্যর্থতার কথা বলতেই হচ্ছে- দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।
বিগত সরকারের সময় সিন্ডিকেট মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। পথে পথে পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি, পণ্য হস্তান্তরে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, নানা কারণে পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে ছিল না। এখন তো চাঁদাবাজি নেই, সেই দৌরাত্ম্য নেই, জ্বালানি তেলের দামও কিছুটা কমানো হয়েছে। তারপরও কেন নিত্যপণ্যের দাম এত বেশি থাকবে? ডিম নিয়ে কেন ডামাডোল থাকবে এখনো? তাহলে কি এই সরকারও সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে? এই দিকটাতে গুরুত্বসহকারে নজর দেওয়া জরুরি।
আরেকটি বিষয়ে একটু খটকা লেগেছে বিধায় এখানে উপস্থাপন করছি সেটা হলো, প্রশংসার কথা যে, বিগত স্বৈরাচারী সরকারের দোসরদের মধ্য থেকে অনেককেই আটক করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে ও জেলে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অনেককে আটক করা এখনো সম্ভব হয়নি। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পালিয়ে গেলেও শেখ পরিবারের অন্যান্য দুর্নীতিবাজদের কাউকেও গ্রেপ্তার করা হয়নি বা আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। আমরা এই পরিবারের সদস্যদের বিশেষভাবে আটকের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। কেননা তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যে দেশের পরিস্থিতি নাজুক হয়েছে।
আমরা মনে করি শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রিপরিষদে যারা ছিলেন বা যারা এমপি ছিলেন সবাই কোনো না-কোনোভাবে দুর্নীতির সাথে, টাকা পাচারের সাথে জড়িত ছিলেন। শেখ হাসিনা বিদেশি আদালতের রায় নিয়ে এলেও, আগের মতো এখনো বিশ্বাস করি পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছিল। সেই সময়ে দৈনিক আমাদের সময়ে ছড়াকলামে একটি ছড়া লিখেছিলাম ‘কার কী এসে যায় মরলে/ আমরা ধুঁকে ধুঁকে,/ ব্যাংক থেকে লুট করা টাকায়/ তোমরা থাকো সুখে।/ পদ্মা সেতু গড়ার আগেই/ পদ্মাকে খাও গিলে/ চোরের মায়ের গলা শুনে/ চমকে ওঠে পিলে/ শেয়ার বাজার ধ্বংস করে/ হাসছো কুটিকুটি/ গরিব মারার ভাও বুঝি না/ আমরা চুনোপুঁটি।’ এরকম সব ছড়া লেখার কারণে তখন এনএসআই থেকে আমাকে সতর্ক করা হয়েছিল। সত্য বলারও সুযোগ ছিল না। সুতরাং সেই দুর্নীতি আর অন্যায়-অবিচার থেকে পরিত্রাণ পেতে সংস্কারের বিকল্প নেই।
খুব অল্প সময়ে সরকার অনেক প্রশংসনীয় কাজ করেছে। যার বেশ কিছু বিষয়ে পূর্বেই তুলে ধরা হয়েছে। সবশেষে একটি বিষয় দিয়ে ইতি টানতে চাই- ৮ জাতীয় দিবস বাতিল প্রসঙ্গে। সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে যে ৮টি জাতীয় দিবস বাতিলের কথা বলেছে তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হতে পারছি না। সরকার সিদ্ধান্ত নিলে সেটা অবশ্যই মেনে নিতে হবে, কিন্তু দ্বিমতের জায়গাটিতে কথা বলার অধিকার দেওয়া হয়েছে বলেই বলছি। ৭ মার্চ এবং ১৫ আগস্ট জাতীয় দিবস হিসেবে গণ্য করা বাঞ্ছনীয় মনে করি। বাকি ৬টি দিবস অবশ্যই বাতিল করার পক্ষে। সেগুলোর কোনো গুরুত্ব নেই। হাসিনা সরকার পরিবারতন্ত্র করার অভিপ্রায়ে এই দিবসগুলো যুক্ত করেছিলেন, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ৭ মার্চ একটি ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। এটাকে অবহেলার সুযোগ নেই বলেই মনে করি। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনেরও পক্ষে। কেননা স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা আমরা অস্বীকার যেতে পারি না। তাহলে শেখ হাসিনা যে ইতিহাস বিকৃতির দোহাই দিয়েছেন, সেই দোষে আমাদেরও কপাল পুড়বে।
রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ভুলত্রুটি বা অদূরদর্শিতাকে দায়ী না-করার হেতু নেই। না-হলে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ জাসদ গঠন করতে যাবেন কেন? এই বিভক্তিকরণ পরবর্তীতে দুই মেরুতে অবস্থান নিয়ে নিল। এখন সেই শৃঙ্খলা ফেরানোর দায়িত্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের, যেহেতু এই সরকার নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ। কিন্তু তারা যদি গলদ রেখে যান তাহলে জাতিকে আবার আন্দোলনে যেতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকে কম তো রক্ত ঝরতে দেখলাম না। ৭১ থেকে ৭৫, ৭৫ থেকে ৮১, ৮১ থেকে ৯০, ৯১ থেকে ৯৬, ৯৬ থেকে ২০০১, ২০০১ থেকে ২০০৭, ২০০৭ থেকে সর্বশেষ ২০২৪ এই সময়ে কত প্রাণহানি আর কত রক্তপাত হয়েছে তার পরিসংখ্যান সবারই জানা। সুতরাং এমন সংঘাত যাতে এই দেশে আর না হয় তার ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এখনই।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ইতিহাস বিকৃতি মানেই আরেকটি সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যাওয়া। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকেই সংগ্রাম শুরু হয়েছে। ‘৫২, ‘৬৬, ‘৬৯, ‘৭১, ‘৯০ থেকে সর্বশেষ ২০২৪- ব্যাপারটা মাথায় রাখা জরুরি। ২০২৪ সালে যে আন্দোলনের ফসল পেলাম সেটাকে যত্ন করে আমাদের ঘরে রাখার ব্যবস্থা করি না কেন, যেন এই বাংলাদেশে আর কোনো প্রাণহানি না হয়, আর কোনো অত্যাচার-নির্যাতন না হয়, আর কোনো একনায়কতন্ত্র কায়েম না হয়। ২০২৪-এর ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয়, এটাও আমাদের কাম্য। আর সেটা করার জন্য প্রকৃত ইতিহাসকে সম্মান প্রদর্শনই হবে প্রধান কাজ।
লেখাটির শুরুতে বলেছিলাম দৃষ্টির কথা বা দৃষ্টিপাতের কথা। কে কীভাবে দেখবে তা নির্ভর করে তার ধীশক্তির ওপর। কেউ বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে দেখতে চাইবে, কেউ চাইবে না। কেউ এখনই জাতীয় নির্বাচন চাইবে, কেউ অপেক্ষা করতে চাইবে। কেউ সংস্কার চাইবে, কেউ চাইবে নির্বাচিত সরকার এসে সংস্কার করুক। দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে এসব ভিন্নতা আছে বলেই আমি শুধু আমার দেখাকে এখানে উপস্থাপন করলাম।
লেখক : কবি, শিশুসাহিত্যিক ও শিশুসংগঠক
এই বাংলার ইতিহাস বয়ে চলেছে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, ভোটচীনীয়, আর্যের পদস্পর্শে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে হোসেন শাহ, মহীপাল, তিতুমীরের মতো মহামানবেরা, যারা বাংলার মাটিকে করেছেন পলি-মাটি-উর্বর, কর্ষিত। বাংলার এই পবিত্র ভূমি জন্ম দিয়েছে রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন, রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দের মতো মহাপুরুষদের।
এই বাংলা চৈতন্যের পবিত্র পদস্পর্শে এক নতুন প্রভাত দেখেছে, পুণ্যতা লাভ করেছে। সেই বাংলা আজও গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, কালীগঙ্গা, নদীয়ার জলবিধৌত হয়ে যৌবনের স্রোতে ভাসছে, নতুন করে উদ্ভাসিত হচ্ছে লালন সাঁইয়ের সুরে, তার গানের মহামিলনে। চৈতন্যসত্তা, অধ্যাত্মসত্তায় ডুবে যাওয়া ব্যষ্টিমানব সুরজলের লালন, কেউ বলেন লালন সাঁইজি। রবীন্দ্রনাথ তার ‘হিবার্ট লেকচার’-এ বাউল এবং লালনের জীবন ও ভাবনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘The Bauls, and Lalon in particular, have shown us the path to spirituality free from ritual, a direct communion with the divine in the simplest of forms. Lalon's songs are like the quiet whispers of a mystic, carrying with them the deepest of spiritual truths.’
লালনজীবনের সূচনা হয়েছিল ১৭৭৪ সালের ১৭ অক্টোবর, কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর তীর ঘেঁষে, ভাড়ারা গ্রামে। লালন ছিলেন তার বাবা শ্রী মাধব কর ও মা শ্রীমতি পদ্মাবতীর একমাত্র সন্তান। শৈশবে বাবাকে হারানোর পর, মায়ের স্নেহের মধুর আঁচল-ছায়ায় বেড়ে ওঠেন লালন সাঁইজি। সেই সঙ্গে ভাড়ারা গ্রামের প্রকৃতির সৌন্দর্যে ঘেরা শান্ত পরিবেশে লালন আদ্দিষ্ট হয়েছিলেন। বর্ষাকালে এই গ্রামের গড়াই নদীর অবাধ জলে ফসলের জমিগুলো সবুজ হয়ে যেত।
সেই পরিবেশে লালনের বাউল সুরের প্রথম উন্মেষ ঘটে, প্রকৃতির মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন জীবনের গভীরতম অর্থ। সুর পূরবীর তারায় লালনের জীবনের প্রতিটি দিন ছিল এক মহামিলনের রূপকথা। প্রকৃতির বুক থেকে উঠে আসা সেই সুরে তিনি বেঁধেছিলেন ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘মিলন হবে কত দিনে’- এ ধরনের গভীর আধ্যাত্মিক ভাবনার গান।
লালনের আধ্যাত্মিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসে তখন, যখন তিনি গঙ্গা স্নানে গিয়ে গুঁটি বসন্তে আক্রান্ত হন এবং সঙ্গীরা তাকে মৃত ভেবে নদীতে ফেলে দেয়। কিন্তু এক মুসলিম নারী তাকে উদ্ধার করে তার জীবন বাঁচায়। এই ঘটনার পরে, লালন তার সমাজে ফিরে গেলেও, ধর্মীয় শুদ্ধতার ধারণার কারণে তাকে সমাজ থেকে ত্যাগ করা হয়। এই বিচ্ছিন্নতা তার মধ্যে গভীর আত্মিক চেতনার জন্ম দেয়, যা পরবর্তীতে তাকে আধ্যাত্মিক সাধকের পথে নিয়ে যায়।
কালীগঙ্গা নদীর তীরে ছেঁউড়িয়ায় বসবাস শুরু করার পর, লালন সেখানে একটি আখড়া প্রতিষ্ঠা করেন, যা তার আধ্যাত্মিক দর্শনের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। ছেঁউড়িয়ার এই আখড়ায় তিনি তার অনুগামীদের নিয়ে বসবাস করতেন এবং বাউল গান, ধ্যান এবং আধ্যাত্মিক চর্চার মাধ্যমে মানবতার সেবা করতেন, শব্দ, সুরের ভাষায়, শিল্পচেতনায়।
প্রকৃতপক্ষে ছেঁউড়িয়ার সেই ধূসর গ্রাম, যেখানে লালনের পদস্পর্শে বাংলার প্রকৃতি সিক্ত হয়েছে, এক দিন ছিল নিস্তরঙ্গ, শান্ত। কিন্তু লালন সাঁইজির সুরের ছোঁয়ায় সেই গ্রাম পেয়ে গেছে এক অমৃতময় জীবনধারা। এখানকার প্রকৃতিদেবী স্বয়ং বৃত, ভরাট হৃদয়ে স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে অটল, বর্ণাঢ্য ছিল লালন সাঁইজির পাশে। গেরুয়া আর ধূসর রঙের সেই সাধকের পোশাক, তার গলায় সাধন গুঞ্জার মালা আর মাদুলি ঝোলানো হাতের একতারায় সুর যেন মহাপ্লাবন- এ যেন এক জীবন্ত ছবি, যেখানে আকাশ, নদী, আর গাছেরা কথা বলে এক সংগীতে।
ছেঁউড়িয়ার সেই আখড়া আজও বাউল সাধকদের জন্য এক পবিত্র স্থান। লালন সাঁইজি তার গানের মাধ্যমে বাউলদের এক নতুন চিন্তার জগতে নিয়ে গেছেন, যেখানে দেহতত্ত্বের সঙ্গে মিলে যায় আধ্যাত্মিকতার গভীরতা। এই বাউল তত্ত্বের মূলমন্ত্র ছিল দেহ আর মনের সমন্বয়, যেখানে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়।
লালনের সাধনক্ষেত্র ছিল ছেঁউড়িয়া, কিন্তু তার সুরের স্পন্দন ছড়িয়ে পড়েছিল নদীয়া, কালীগঙ্গার জলস্রোতেও। এই সুর শুধু নদী আর আকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা প্রবাহিত হয়েছিল মানুষের হৃদয়ে, সরল জীবনযাপনে। বাউল তত্ত্বের এই সুরময় সাধক লালন শুধু একজন গায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দার্শনিক, মানবতার প্রতিভূ, যিনি মানুষের মধ্যে ঈশ্বরকে দেখতেন। তার সুর যেন এক অমৃতধারা, যা মানুষের হৃদয়কে সিক্ত করত, পবিত্র করত। তার কাঁচা শালপাতার সহজিয়া দর্শন ছিল ছায়ানিবিড় বনপথের মতো।
সাঁইজির জীবনের একতারা যখন প্রাণেশ্বর হয়ে বলে: ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়,’ (How does the unknown bird come and go inside the cage?) তখন লালনের এই গানে মানবসত্তা শৈলবৃষ্টির মতো বিস্তৃত হতো আধ্যাত্মিক অভিযাত্রায়। লালনের এই গানটিকে তার দেহতত্ত্বের দার্শনিক ব্যাখ্যায় আলোকিত করেছেন। তিনি মনে করতেন, মানুষের শরীর এক খাঁচা, আর আত্মা সেই অচিন পাখি, যা অন্তহীনভাবে আসা-যাওয়া করে। এই ভাবনার মধ্য দিয়েই তিনি মানুষের দেহকে একটি সাধনার স্থান হিসেবে দেখেছেন।
বাউল সংগীতের উৎপত্তি ১২ থেকে ১৩ শতকের প্রাচীন ভারতীয় মরমি সাধক ও কবিদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়, যারা সমাজ, ধর্ম ও মানবতার গভীর ভাবনা নিয়ে গান রচনা করতেন। এই ধারার মূলমন্ত্র ছিল একদিকে আধ্যাত্মিকতা, অন্যদিকে মানবতাবাদ, যেখানে মানবজাতির সাম্য এবং মুক্তি প্রচারিত হতো। লালন ফকির এই বাউল সম্প্রদায়ের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সাধক হিসেবে পরিচিত হলেও তার দর্শন শুধু বাউল সংগীতের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়।
লালন মানবতাবাদে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন এবং মানুষের অন্তর্নিহিত মহত্ত্বে অবিচল আস্থা রাখতেন। ধর্ম, জাতি, বর্ণ বা গোত্রের বিভাজনকে তিনি মানুষ ও মানবতার স্বাভাবিক ধারার বিরুদ্ধে বলতেন। লালনের গানে তিনি বারবার এ ধারণা তুলে ধরেছেন, মানুষের অন্তরে স্রষ্টার প্রতিচ্ছবি রয়েছে, আর সেই সত্যের সন্ধান করাই তার আধ্যাত্মিকতা।
লালনের বাউল জীবন ছিল অত্যন্ত সরল, কিন্তু সেই সরলতার মধ্যেই ছিল গভীর আধ্যাত্মিকতা। তিনি বলেন: ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে,/ লালন বলে জাতের কি রূপ/ দেখলাম না এই নয়নে রে,’ এই গানে তার দর্শন আমাদের শেখায়, মানবজীবনের প্রকৃত লক্ষ্য হলো- মানুষকে ভালোবাসা, আর সেই ভালোবাসার মাধ্যমেই আমরা ঈশ্বরের নিকটে পৌঁছাতে পারি। লালনের বাউল তত্ত্ব ছিল এক অসাধারণ দার্শনিক চর্চা, যা দেহ আর মনের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল।
বাউল সাধকরা বিশ্বাস করেন, মানুষের মনই হলো সেই স্থান, যেখানে ঈশ্বর বাস করেন। তার গানের প্রতিটি শব্দ যেন আমাদের অন্তরের গভীরে স্পর্শ করে, আমাদের আত্মার গভীরে পৌঁছে যায়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভবে মিলন অভিসারী লালন অনুতপ্ত বুকের গহন হতে যখন বলেন: ‘মিলন হবে কত দিনে, মনের মানুষের সনে,’ তখন উথলে ওঠে কালীগঙ্গা, তখন জল থৈ থৈ বীজধান, বীজতলা। প্রকৃত অর্থে এই গানটি লালনের দেহতত্ত্বের দিগন্তলীন মহারূপের পাহাড়, মনপুরা জীবনের বিশুদ্ধ সত্যবোধের মতো সুন্দর। দেহতত্ত্বের মূলই হচ্ছে এখানে মনের মানুষ, আর এই মনের মানুষ হলো নিগূঢ় ঈশ্বর, এই ঈশ্বরের সঙ্গে অধ্যাত্ম প্রেমদীপ্ত উদার মিলনের আকাঙ্ক্ষা লালনের প্রতিটি গানের মধ্যে প্রকাশিত।
লালনের দার্শনিকতা বাউল মতের গভীর শিকড়ে প্রোথিত, যার ওপর বৈষ্ণব ও সুফি মতবাদেরও রয়েছে এক বিশেষ প্রভাব। চৈতন্যদেব-প্রভাবিত বৈষ্ণব মানবতাবাদ এবং বর্ণপ্রথাবিরোধী চিন্তা বাউল দর্শনের অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠেছে। বৈষ্ণবদের যুগলরূপ ধারণায়, রাধা জীবাত্মার এবং কৃষ্ণ পরমাত্মার প্রতীক; জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনই জীবের চূড়ান্ত সার্থকতা, যা কেবল প্রভুর ইচ্ছায় সম্ভব।
লালনের গানেও এই আধ্যাত্মিক আকুলতা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। তিনি আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার অভিন্নতা উপলব্ধি করতে চেয়েছেন এবং দেহতত্ত্বের মাধ্যমে এই চেতনা আবিষ্কারের সাধনা করেছেন। তার বাউল মতের সাধনায় গুরুতত্ত্ব, যোগ, এবং মৈথুনের মাধ্যমে আত্মার ঊর্ধ্বগতি বা মহাযোগের অভিজ্ঞতা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। লালনের ‘মনের মানুষ’ বা ‘অলখ সাঁই’ অনুসন্ধান সেই চেতনারই প্রতিফলন, যা বৌদ্ধ ধর্মের আদিবুদ্ধ বা সচ্চিদানন্দের সঙ্গে মৌলিকভাবে সংযুক্ত।
তার দর্শন যুক্তিনির্ভর দার্শনিকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে মিশিয়ে এক নতুন ধারার আধ্যাত্মিকতা প্রতিষ্ঠা করেছে, যা আবেগকে ছাড়িয়ে যুক্তির শক্তিতে গড়াই নদীর বুকে আষাঢ়ের ঢল হয়ে যে সুরের ঝংকার লালনের বুকে ধরা পড়েছিল, তা কালীগঙ্গার ঢেউয়ে আরও বহুদূর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছিল। ছেঁউড়িয়ার আখড়ায় বসে লালনের সাধনাগীতি যেন এই দুই নদীর স্রোতের মতো অনন্তের দিকে বয়ে চলছিল, যেখানে জাতপাতের বাধা, ধর্মের বেড়া, আর সমাজের কঠিন নিয়মগুলো ভেঙে ফেলা যায়। নদীয়ার কালীগঙ্গার শান্ত ঢেউ আর কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর উত্তাল স্রোত মিলেমিশে লালনের গানে ধ্বনিত হয়েছে। তার সুর সেই ঢল, যা বয়ে চলে মানুষের আত্মার গভীরে। তিনি তার গানের মধ্য দিয়ে এক মহাসম্মিলনের আহ্বান জানিয়েছেন, যেখানে জাত-পাতের বিচার নেই, নেই ধর্মের ভেদাভেদ, শুধুই মানবতার সুর।
লালনজীবনের অবসান ঘটে ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর, তার জন্মদিনেই। এই আধ্যাত্মিক সাধকের সুরের স্রোত যেমন গড়াই এবং কালীগঙ্গার জলে মিশে আকাশের সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল, তেমনি মৃত্যুর পরেও লালনের সুর অমর, বাউল তত্ত্বের চিরন্তন শক্তি হিসেবে বয়ে চলছে বাংলার মাটিতে আজও, যা মানুষের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আত্মার সারমর্ম খুঁজে বের করতে প্রেরণা দেয়।
লেখক: শিক্ষাবিদ, গবেষক ও গীতিকার বাংলাদেশ বেতার
চলচ্চিত্র নিয়ে সরকারকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে ‘চলচ্চিত্র-বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি’ পুনর্গঠন করেছে সরকার। ২৩ সদস্যের কমিটির নাম প্রকাশ্যে আসার পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মহল। কমিটিতে আমলাদের আধিক্য থাকায় চলচ্চিত্রের অংশীজনেরা নীতিনির্ধারণে কতটা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। পাশাপাশি দশকের পর দশক ধরে পুঞ্জীভূত সংকট নিরসনে এই পরামর্শক কমিটি কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, সেটাও আলোচনায় এসেছে।
রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর সার্টিফিকেশন বোর্ড করেছে সরকার, পুনর্গঠন করেছে চলচ্চিত্র অনুদান কমিটিসহ বেশ কয়েকটি কমিটি। গুরুত্ব বিবেচনায় বাকি কমিটিগুলোর চেয়ে পরামর্শক কমিটিকে তুলনামূলক এগিয়ে রাখতে চাই আমরা। তবে পরামর্শক কমিটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৩ সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশই আমলা। চলচ্চিত্র অঙ্গনের প্রতিনিধি হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ আমলার মধ্যে চলচ্চিত্রের অংশীজনেরা নীতিনির্ধারণে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কমিটিতে চলচ্চিত্রের অংশীজনদের মধ্যে যারা আছেন, তারা প্রত্যেকেই যোগ্য।
তবে অংশীজনের সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার ছিল। কমিটিতে থাকা চলচ্চিত্রের অংশীজনেরা যোগ্য ব্যক্তি। তবে আমলা-নির্ভর কমিটিতে তারা কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। চলচ্চিত্রের কাঠামোগত সংস্কারে পরামর্শক কমিটির জন্য করণীয় কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছেন; এর মধ্যে রয়েছে ফিল্ম সার্টিফিকেশন ও ওটিটি নীতিমালা সংশোধন, ই-টিকেটিং, বক্স অফিস কার্যকর ও চলচ্চিত্রের বণ্টনে ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা।
দেশে সিনেমা ব্যবসার সবচেয়ে বড় সংকট, কত টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে সেই হিসাব পাওয়া যায় না। এ জন্য ই-টিকেটিং ও বক্স অফিসের হিসাব সংরক্ষণের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা দরকার। সঙ্গে সিনেমার টিকিটের টাকার ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা দরকার। এ ছাড়া দেশজুড়ে মাল্টিপ্লেক্স করা; বুসান, সানড্যান্স, বার্লিন, রটারডাম, ফিল্মবাজার স্ক্রিন রাইটার্স ল্যাবের মতো ফিল্ম ফান্ড ও সাপোর্ট সিস্টেম করা এবং অনুদান প্রথার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। পরিবর্তিত অনুদানপ্রথা কেমন হবে, তা ঠিক করা দরকার। অনুদানপ্রাপ্ত নির্মাতাদের মধ্যে অর্ধেক নারী-নির্মাতা থাকতে হবে। অনুদানপ্রাপ্ত নির্মাতাদের স্ক্রিন ল্যাবের মতো ইনকিউবিটরে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মেন্টর দিয়ে সাহায্য করতে হবে।
সাধারণত এফডিসি, সার্টিফিকেশন বোর্ড, আপিল বোর্ড ও ফিল্ম আর্কাইভের মতো চলচ্চিত্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ দায়িত্বে থাকেন আমলারাই। ফলে চলচ্চিত্রের নীতিনির্ধারণে চলচ্চিত্রের অংশীজনেরা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন না। শুধু সার্টিফিকেশন বোর্ড নয়, পরামর্শক কমিটি, আপিল কমিটি, অনুদান কমিটিসহ সবখানেই আমলারাই চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান বা সভাপতি। এফডিসি বা বিসিটিআইয়ের মতো জায়গাগুলোতে যেখানে চলচ্চিত্র উন্নয়ন বা শিক্ষা নিয়ে কাজ-কারবার হওয়ার কথা, সেখানেও পদাধিকারবলে আমলারাই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী।
একটা স্বাধীন দেশে এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে? আমলাতন্ত্র দেখবে চলচ্চিত্রে জাতীয় স্বার্থ, চিন্তা-চেতনা ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি না। চলচ্চিত্রের উন্নতি নিয়ে আমলারা খুব একটা ভাবেন না। ফলে চলচ্চিত্রের ভালো-মন্দ ভাবনার জায়গায় আমলারা নেই। কমিটির কাঠামোই এমন যে নতুন চিন্তা উৎসাহিত হবে না। চলচ্চিত্রের অংশীজনের সংখ্যা কম থাকায় তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন না। ফলে এ ধরনের কমিটি খুব বেশি কার্যকর হয় না। কমিটিতে চলচ্চিত্রের অংশীজনের সংখ্যা কম থাকায় তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন না। ফলে এ ধরনের কমিটি খুব বেশি কার্যকর হয় না।
অন্তর্বর্তী সরকার থাকা অবস্থায় হয়তো আমলারা সহযোগিতাই করবেন, কিন্তু রাজনৈতিক সরকার আসার পরও যদি এসব ভয়াবহ আইন আর আমলাতন্ত্রই থেকে যায়, তাহলে আর সেটাকে সংস্কার বলা যাবে না। তার জন্য পরামর্শক কমিটিকে এখনই ভাবতে হবে। বুনিয়াদি সংস্কারের জন্য প্রথমেই হাত দিতে হবে আইনগুলো আর ক্ষমতা কাঠামোয়। সব প্রতিষ্ঠান বা কমিটি থেকে আমলাদের সরিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে সিনেমার অংশীজনদের। একটা চলচ্চিত্র কাঠামো করা উচিত, যার অধীনে ফিল্ম গ্রান্ট অ্যান্ড সাপোর্ট, ফিল্ম কমিশন, সার্টিফিকেশন বোর্ড, ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড সব চলে আসবে।
এসব বোর্ডের প্রতিনিধি নির্বাচন এবং তাদের কাজের নিয়মিত মূল্যায়নের দায়িত্ব থাকা উচিত পরামর্শক কমিটির। পরামর্শক কমিটিতে সরকারি কর্মকর্তাদের আধিক্যের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। কোনো কিছু হুট করে পরিবর্তন করা যায় না। চলচ্চিত্র নীতিমালা অনুযায়ী পরামর্শক কমিটি হয়েছে। ফলে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নীতিমালাও পরিমার্জন ও সংশোধন করা দরকার। রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে তো সেটা হবে না, তবে রাষ্ট্র কীভাবে তার ভূমিকা রাখবে, সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বুনিয়াদি সংস্কারের জন্য প্রথমেই হাত দিতে হবে আইনগুলো আর ক্ষমতা কাঠামোয়।
সব প্রতিষ্ঠান বা কমিটি থেকে আমলাদের সরিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে সিনেমার অংশীজনদের। জাতীয় পরামর্শক কমিটির কার্য-পরিধির মধ্যে রয়েছে- চলচ্চিত্র নীতিমালার আলোকে চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নে পরামর্শ দেওয়া; নীতিমালা বাস্তবায়নে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া; চলচ্চিত্র নীতিমালা ও চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান আইন, বিধি পরিবর্তন, সংশোধন ও পরিবর্তনের প্রযোজন হলে তা সুপারিশ করা। এখনো কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়নি। চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিশেষ করে ই-টিকেটিং ও বক্স অফিসে জোর দিতে হবে। এগুলো হলে চলচ্চিত্রে স্বচ্ছতা আসবে, চলচ্চিত্র নীতিমালায়ও বিষয়গুলো আছে।
চলচ্চিত্রের নীতিমালায় মত ও বাকস্বাধীনতার পরিপন্থি ধারাগুলো সংশোধন করা উচিত। ‘চলচ্চিত্র-বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি’ বিগত সরকারেও ছিল। ২০১৯ সালে কমিটি পুনর্গঠনের খবর এসেছিল। বিগত সরকারের পরামর্শক কমিটি দৃশ্যমান কোনো কাজ করতে পারেনি। কয়েকটি প্রস্তাব দেওয়া হলেও বিগত সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি। এখন প্রশ্ন, নতুন এই কমিটি কতটা কার্যকর হবে? আমরা অবশ্যই আশাবাদী। দেশে পরিবর্তন এসেছে; চলচ্চিত্রেও সবাই পরিবর্তন চাচ্ছেন। এবার হয়তো পরিবর্তনটা হয়ে যাবে। এটাই সংস্কারের সুযোগ, তবে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজটা করতে হবে এবং সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ও অংশীজনেরা তাদের সহযোগিতা করবেন।
চলচ্চিত্র-বিষয়ক যতগুলো কমিটি হয়েছে, তার মধ্যে পরামর্শক কমিটিই আমাদের বিবেচনায় সবচেয়ে ভালো হয়েছে। এই পরামর্শক কমিটি থেকে পরামর্শ যা যাবে, তা যেন অংশীজনেরাই তৈরি করে দেন। সরকারি কর্মকর্তাদের কেবল সম্পাদনের দিকটা দেখা উচিত। নীতি প্রণয়নে সরকারি কর্মকর্তাদের হাত না দেওয়াই ভালো হবে। কারণ তারা তো চলচ্চিত্র-বিষয়ক সমস্যা ও প্রয়োজনটা জানেন না। এখানে আরেকটা কথা বলা প্রয়োজন, শিল্পকলা একাডেমির জমি আছে মোটামুটি দেশজুড়েই। কমপক্ষে ৩০ জেলায় শিল্পকলার জায়গায় মাল্টিপ্লেক্স করে সেটা দরপত্রের ভিত্তিতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।
যেহেতু আমাদের জাতিগত দুর্নাম ‘আমরা শুরু করি, অব্যাহত রাখি না’, সেহেতু এসব মাল্টিপ্লেক্সকে মনিটরিংয়ে রাখতে হবে এর মেইনটেন্যান্স মানে রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, না হলে লিজ বাতিলের শর্ত থাকতে হবে। এখন ঝামেলা হলো শিল্পকলা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন। আর সিনেমা-টিভি, ওটিটি তথ্য ও সম্প্রচারে। এই দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় করে হলেও এটা করা দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটা হচ্ছে সিনেমার জন্য তহবলিরে সংস্থান করা এবং তার পরিপূর্ণ ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা।
এখন ব্যস্ত জীবনযাপনে অনেকের নির্ভরযোগ্য বিনোদন অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। দর্শকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের কনটেন্ট এ বৈচিত্র্যের সমাহার, আকর্ষণীয় চমক আর নতুনত্বের সম্ভার ঘটাতে বেশ সচেষ্ট। প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে দর্শক বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে প্রতিটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। এসব কারণে কনটেন্ট তৈরির কাজে নিয়োজিতদের মধ্যেও এক ধরনের গা ঝাড়া দেওয়া মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। ধ্বংসের দারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের অনেক নির্মাতা, কলাকুশলী, শিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রী ওয়েব ফিল্ম, ওয়েব সিরিজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন পেশাগত মনোভাব নিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশি নির্মাতার তৈরি অসাধারণ বেশ কিছু কাজ প্রত্যক্ষ করেছি, যেখানে আমাদের মেধাবী অভিনয়শিল্পীদের দুর্দান্ত অভিনয়, চমক লাগানো বিষয়বস্তু, আধুনিক কারিগরি মানের উপস্থিতি লক্ষ করেছি। এভাবে আমাদের বিনোদনশিল্পে নতুন সম্ভাবনার অনেক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। আমাদের চলচ্চিত্র একসময় স্বর্ণযুগ পার করেছে। সময়ের আবর্তনে সেই গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অব্যাহত রাখতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনোযোগী এবং যত্নবান হতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জয়যাত্রা চলছে। বাংলাদেশ তা থেকে বিচ্ছিন্ন নয় কোনোভাবেই।
অনেক সম্ভাবনার আধার বিনোদনের নতুন এই প্ল্যাটফর্মটিকে সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী করতে মেধা ও সৃজনশীলতার পাশাপাশি সুরুচির চর্চাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কনটেন্ট নির্মাণে স্বাধীনতা থাকা মানে যাচ্ছেতাই যেনতেন কিছু একটা বানিয়ে পরিবেশন করা নয়, এটা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে কনটেন্ট নির্মাণে সম্পৃক্তদের। দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, সমাজমনস্কতা, ইতিহাস, রাজনীতিদর্শন- কোনোটিকে অগ্রাহ্য কিংবা জলাঞ্জলি দিয়ে কনটেন্ট নির্মাণ নয়, বরং সমাজমনস্ক, সাহসী আধুনিক রুচি ও মননশীলতার প্রকাশ সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র, ওয়েব সিরিজের মাধ্যমে দর্শকদের মধ্যে নতুন চিন্তা-চেতনার স্ফুরণ ঘটাতে হবে। সমাজে বিদ্যমান অসংগতি, অন্যায়, দুর্নীতি, অবক্ষয় ইত্যাদি বিভিন্ন কনটেন্টের মাধ্যমে তুলে ধরে সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন এবং প্রতিবাদী মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। স্রেফ বিনোদন নয়, ওটিটি হয়ে উঠুক সমাজের দর্পণ, সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার আমরা মনেপ্রাণে প্রত্যাশা করি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট
কথায় কথায় মারধর ও গালমন্দ করা, আইন ভঙ্গ করে নিজের হাতে মনের ঝাল মিটিয়ে মানুষ হত্যা করা। এ গুরুতর অপরাধ দেখতে দেখতে জাতীর গা সহা হয়ে গেল নাকি? প্রবল প্রতিবাদের তোপে বুকফাটা আহাজারি করে প্রতিবাদের লেখনী মিছিল কোনো সুশীলসমাজ প্রতিক্রিয়া দেখাল না।
নির্মমতা চরম প্রকাশ নিরপরাধ মানুষ গায়ের জোরে ধরে পিটিয়ে হত্যা করা। আজব এক মগের মুল্লুকের প্রথা কৃষ্টি উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি। পৌরসের নিরীহ অসহায় মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জেলকে যারা হত্যা করেছে তারা জাতীর শত্রু, মানবতার বিবেচনায় কুলাঙ্গার।
গোঁড়ামি-গুণ্ডামি বৃক্ষের বেয়াড়া ডাল এখনি কেটে ছেটে ফেলতে হবে। নিরীহ বেচারি মানুষের কাছে চেয়ে খেত, টাকা ভিক্ষা করত। এই চাওয়াই তাকে ছাত্র নামের কলঙ্ক নয়া আজরাইলদের হাতে প্রাণ হারাতে হলো। এ নির্মমতা আস্ফালন মানা যায় না, খুনিদের বিচার দাবি করি।
এক মুঠো খাবারের জন্য অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষ তাদের কাছে গেছে আশাবাদী হয়ে। সে ভরসা রেখেছিল দেশের কাণ্ডারিরা এখানে বাস করে, আর যাই হোক তারা তাদের মুখের অন্ন ত্যাগ করে আমাকে বুভুক্ষের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিবে। আরও অভয় দিয়ে বলবে, ভবিষ্যতে কোনো দুর্দিনে এখানে ছুটে আসবা তুমি একা না, তোমার পাশে আমরা সবাই আছি। হায়রা ভ্রান্ত ক্ষুধার্ত হৃদয় হত্তার কোন পর্বে সে ভ্রান্তি কাটল না। ক্ষুধার্ত জলজ্যান্ত মানুষটাকে ছাত্ররা উল্লাস করে ধাপে ধাপে পর্বে পর্বে পিটিয়ে জল্লাদের মতো মেরে ফেলল। জাতীর কপালে চরম দুর্ভোগ শুরুর বার্তা এই অশ্রু গড়ান হত্যাকাণ্ড।
এ কি সেই বাংলাদেশ? দুদিন আগে যার যা ছিল টিএসসি-তে এসে এই ছাত্রদের হাতে সমার্পণ করে গেল অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। কি লজ্জার কাহিনি জাতির আস্থার সেখানেই এক মুঠো খাবারের জন্য অসহায় মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবকের জীবন গেল। সবেমাত্র ভাই হারিয়ে বাবা হারিয়ে একা হয়ে স্মৃতিশক্তি রহিত হয়ে যায়। আপছা আপছা যা মনে ভাসে চেনা পরিচিত সভ্যজনের কাছে হাত পেতে চলত। পরিচিতরা তাকে দেখলে পরম মমতায় তার পরিচর্যা করে মনের জোর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করত।
কি গভীর দাবির আকুতি সে করেছিল ভাবলে মুখে অন্ন উঠে না। আপনাদের হলের খাবার মজা খেতে আইছি ভাই। এক বুক আশা নিয়ে খাবারের জন্য হলে গেল, মানবতার বাতিঘর আমার গর্বের বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দিক হারা আপনজন হারা উদ্ভ্রান্ত যুবক জাতির মেধাবী বিবেকবান দয়ালু ছাত্রদের কাছে সহানুভূতি পাওয়ার আশায়। সেখানেই স্বজনহারা সংসারত্যাগী এই উপেক্ষিত ছেলেটি নির্মম উলঙ্গ চেহারা দেখল শিক্ষিত ছেলেরা। সঙ্গে সঙ্গে জগতের সব অবজ্ঞা উপেক্ষা অনাদর দুঃখ-কষ্টের সংগ্রাম থেকে চিরতরে তার প্রভুর কাছে উড়াল দিল। সভ্যতা এ অসময়ের ব্যথিত আত্মার পরপারে যাত্রার কি কৈফিয়ত দিবে।
বিপ্লবের পর ভাঙা দেশ গড়া সহজ না। সময় লাগে, অর্থ লাগে, ধৈর্য লাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যমদুতেরা পড়ালেখা করে তা কি কেউ আন্দাজ করেছে? কিছু মানুষ ওই যমের মুল্লুকে কি ছিল না? কেউ তোফাজ্জেলকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে পারল না সবাই মজাক দেখছে ভিডিও করছে কি করে মানুষ এমন পাষান হয়। জাতির পোড়া কপাল। ছাত্রদের আন্দোলনের সময় পরিপক্ব মনে হলো। এখন তাদের লক্ষ্যহীন উশৃঙ্খল কর্ম হতাশ করছে। বেমানান মনে হলো শাবির প্রো-ভিসি ও কোষাধ্যক্ষকে শপথবাক্য পাঠ করালেন ছাত্র-নেতারা। এ কেমন রিতি-রেওয়াজ।
ঠুনকো অজুহাতে মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো অভিযোগ তুলে, আইন-কানুন নিজের হাতে তুলে মানুষকে হত্যা করছে, তা দেখার ঠেকানোর কেউ নেই সবাই তামাশা দেখছে। সভ্যতার এই ভয়াবহ কলঙ্কজনক ব্যাপ্তি মানবসমাজে আমাদের দেশের সচেতন নাগরিকদের বিগত কয়েক দিন ধরে যেভাবে অসহাত্ব, নির্বাক আকীর্ণ করছে, তা একই সঙ্গে আতঙ্ক পীড়ন এবং যন্ত্রণার একটা পরিমণ্ডল তৈরি করেছে সামাজিক জীবনে।
বিদ্যা-বুদ্ধি বিবেক জ্ঞান গবেষণা মানবতার প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুনিয়ায় বিশেষ মর্যাদা স্থান অর্জনকারী একটি নিরাপদ জায়গা। সেখানেও আমরা দেখেছি আবেগে উত্তেজিত গণপিটুনি, গণধোলাই দিয়ে অপমান-অপদস্থ করে পালাক্রমে কষ্ট দিয়ে চুরির আবরণে কি নারকীয় বীভৎসতা তৈরি করেছিল। এদের মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন, আপন কেউ থাকলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাক। এরা আরও বড় হিতাহিত জ্ঞানহীন কাণ্ড ঘটাবে।
উন্মাদনা আর রাজনীতিক কানেকশনের জোরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই নানা অছিলায় ধর্ম এবং সামাজিকতার দোহাই দিয়ে মানুষের দ্বারা মানুষকে খুন করার ঘটনা দর্শক হয়ে দেখেই চলেছি আমরা। সেই ষাটের দশকে বর্নি গ্রামের সিদ্দিক আকুঞ্জি খুনের ঘটনার থানাজুড়ে শোক আর ভীতির অজানা শাস্তির আশঙ্কায় মানুষ খাওয়া-ঘুম ছেড়ে দিয়েছিল। পুলিশ বিষ আইন জারি করে সেই এলাকায়। ছিঁচকে অপরাধীরা বছরের পর বছর গা ঢাকা দেয়। এমনকি আমাদের রাজনীতি ও ধর্মের দোহাই দিয়ে গণপিটুনিতে মানুষকে হত্যা করর অভিযোগ খুব কমই গোচরে আসে। নিষ্ঠুর আচরণ সামাজিক এবং রাজনৈতিক আবর্তকে ক্ষত করছে দীর্ণ করছে।
রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সংলগ্ন এলাকা গুলি এবং মফস্বলের বিভিন্ন শহর, গ্রামে যেভাবে গণপিটুনিতে মানুষের দ্বারা মানুষের হত্যাকাণ্ড ঘটছে, তা দেখে আমাদের শিউরে উঠতে হচ্ছে। মানুষের একটা বড় অংশের মধ্যে জিঘাংসা এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, অপছন্দের কোনো লোককে, নানা ধরনের অপবাদ দিয়ে, তাকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করা। এটা একটা সংক্রামক সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ব্যাধি যে আজ হঠাৎ করে নতুনভাবে গজিয়ে উঠেছে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এই ব্যাধি দেশের বুকে দীর্ঘদিন ধরে পরিব্যাপ্ত রয়েছে তা লালন করে রাজনৈতিক দল। বিচারে অপরাধী হলে দল ছাড়িয়ে আনবে এই ক্ষমতার বলে ঘৃণিত জাহেলি কাজে উৎসাহ পায়। সাজার কোনো ডর নেই, দল তো আছেই। একটা সময় ছিল, এ ধরনের ব্যক্তিগত ক্রোধ মানুষ ব্যবহার করত স্থানীয় সালিশ, মামলা-মোকদ্দমা করে, অপছন্দের মানুষটিকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করার জন্য। ক্রমে ক্রমে সেই বিষয়টির সঙ্গে সংযুক্ত হতে শুরু করল রাজনীতির নাম করে এক ধরনের ব্যক্তিগত অসূয়ার পরিমণ্ডল। শাসন ক্ষমতায় যখন যে রাজনীতিকরা থেকেছেন, সেই পরিমণ্ডলের মানুষেরা, চিরদিনই সামাজিকভাবে কিছু বেশি সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেন। আর এই সুযোগ-সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয়গুলো ক্রমশ ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার নিরিখে এসে ঘাঁটি করেছে।
তাই একজন সিকি নেতা সঙ্গে তার বেকার দলবল নিয়ে শাসক-সমর্থক হওয়ায় আইন নিজের মতো কাজে লাগাচ্ছে। এমনকি পাশের বাড়ির সঙ্গে কোনো বিবাদ বিসংবাদ থাকে, তা সেটা সীমানার ভেতর গাছের পাতা পড়া হোক বা জমিজমা-সংক্রান্তই হোক বা অন্য কোনো কারণে, যেমন- নিছক একটা নারিকেল গাছ, কি আম জাম গাছকে নিয়েই হোক, দুই বধূর মধ্যে বাকযুদ্ধ হোক তাহলে যে ক্ষমতাবান, সে ক্ষমতার আগুনের অপব্যবহার ঘটিয়ে প্রতিবেশীকে শায়েস্তা করছে।
এই ট্র্যাডিশন সামাজিক ইতিহাসে রয়েছে অনেক পুরোনো দিন থেকে তা রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, লুতফুর রহমান, বিভূতিভূষণদের সমাজ জীবনের লেখনীর মধ্যে দিয়ে দেখতে পাই। সেই পুরোনো দিনের অপরাধী মনের মধ্যে অন্যের ক্ষতিকর মানসিকতা ছিল। কিন্তু যেটা ছিল না, সেটা হচ্ছে অপছন্দের লোককে প্রাণে মেরে ফেলার মতো সিমারের চরিত্র, যা এখন হরহামেশা হচ্ছে।
এই গণপিটুনির সেকাল-কাল, এটাও সমাজতত্ত্বের আলোচনার একটা বিষয় হয়ে উঠছে ক্রমশ। স্বাধীনতার আগে বা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, কোথাও যে গণপিটুনিতে মানুষ মারা হয়নি, এমনটা নয়। কিন্তু সেদিনের ধারা আর আজকে গণপিটুনির সঙ্গে রাজনীতির নাম করে, ধর্মীয় সুবাতাস-কুবাতাস সংযুক্ত করে দেওয়া। রাজনৈতিক বিদ্বেষকে সংযুক্ত করে দেওয়া এই দুইয়ের মধ্যে যে চরিত্রগত বিরাট ফারাক।
জাতীয় আন্তর্জাতিক স্তরে অর্থনৈতিক কাঠামো যেভাবে গোটা মানব সমাজকে মজবুতভাবে বেঁধে ফেলেছে তার কু-প্রভাব সাধারণ মানুষের শান্তির ওপরে যত দিন যাচ্ছে ততই খুব বেশি করে পড়তে শুরু করেছে।
আমাদের সার্বিক নিচুমানের শিক্ষা আবার ছিটেফোটা যা আছে তা শিক্ষার অনগ্রসরতা এমন একটা জায়গায় গোটা দেশ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যার দাপটে সাধারণ মানুষ যার মধ্যে হয়তো কখনো হিংসার বিষয়টি জোরদার ছিল না সেও আর্থসামাজিক পরিস্থিতির চাপে পড়ে মন, মানসিকতাকে, দৃষ্টিভঙ্গিকে কিছুতেই নিজের বশে রাখতে পারছে না। অর্থনৈতিক সংকট মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তকে এমন একটা জায়গায় ক্রমশ এনে ফেলছে, যার ফলে মানুষ কিছুতেই নিজের মনুষ্যত্বের ধ্যান-ধারণার বিবেকের মধ্যে আটকে থাকতে পারছে না। তার আচার-আচরণ তার জীবনযাপন তার অঙ্গভঙ্গি সবকিছু যেন একটা ক্ষমতার বেসামাল হাব-ভাব।
আমরা কোমল হৃদয়ের মানুষ। অর্থের নেশাই যত নিষ্ঠুরতা আসলে কি তাই। যখন আমরা দেখি এই ভয়ংকর একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে, যে পরিস্থিতিতে ছেলেধরা থেকে শুরু করে, চুরি থেকে শুরু করে, নানা ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, আর সেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ফলশ্রুতি হিসেবে একজন বা একাধিক মানুষ, অভিযুক্তকে মারধর করছে। এমনকি মেরে ফেলছে। তখন আমাদের শিউরে উঠতে হয়।
যদিও শিউরে ওঠার আরও অনেকটাই বাকি থাকে। আমরা যখন দেখি, এই গণধোলাই দেখছে একদল পশুরূপি মানুষ। নীরবভাবে হত্যাযজ্ঞ দেখছে, এরা কি মানুষ! কোনো প্রতিবাদ করছে না। নৃশংসতা উপভোগ করছে। সেই গণধোলাইয়ের ভিডিও নিজের মোবাইলে তুলছে। আবার সেটা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তখন এটাই কেবল মনে হয়, মানব মনস্তত্ত্বের কতখানি অবনমন হলে, মানুষের দ্বারা এ ধরনের একটা পরিস্থিতির বাস্তবায়ন ঘটানো সম্ভব হয়।
হিংসার সঙ্গে রাজনীতি এবং দারিদ্র্যের একটা সম্পর্ক আছে। রাজনীতিকে যারা বিকৃতভাবে প্রয়োগ করতে চান, তাদের কাছে হিংসা হলো একটা বড় অস্ত্র। আর এই অস্ত্র প্রয়োগ করতে তারা ব্যবহার করেন সেই সব মানুষকে, যারা দুবেলা-দুমুঠো খাবার পেটে দিতে নিজেদের বুদ্ধি-বিবেককে বলি দিতে বাধ্য হন। একজন গরিব মানুষকে খুব সহজেই তাতিয়ে দেওয়া যায় আরেকটি লোকের প্রতি হিংস্র হয়ে ওঠার জন্য। প্রশ্ন আসবে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা কি সবাই খালি পেটে থাকা গরিব?
গণপিটুনি খামখেয়ালি হত্যার ঘটনাগুলো ঘটছে তার মধ্যে যেমন রাজনীতির প্রভাব আছে, ঠিক তেমনিই রয়েছে ভয়াবহ দারিদ্র্যতা-অভিশপ্ত বেকার জীবন। একটা কথা খুব জোরের সঙ্গে বলতে হয় সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা শাসকবিরোধী শক্তি যখন প্রতিবাদের শামিল হয় তখন তাদের ওপরে রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্র নির্মম প্রয়োগ করার প্রবণতা নিত্যদিন দেখছি। অপরাধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জাতিই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সামাজিক মুক্তি দিতে পারে। আমরা অন্যায়কে না বলব ও অমানবিকতাকে প্রতিবাদ করব। সম্মিলিত প্রতিবাদে একদিন নির্মম চিত্তের অমানুষ হয়ে উঠবে মানবিক মানুষ।
লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক
চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাঘড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, শেরপুর, কুমিল্লাসহ পাহাড়বেষ্টিত জেলার প্রায় সব পাহাড় ও টিলা নির্বিচারে কাটা হচ্ছে। একই সঙ্গে কাটা হচ্ছে এসব পাহাড়ে থাকা গাছপালাও। এর সঙ্গে রয়েছে দখল ও বসতি স্থাপন। নানা কারণে পাহাড় কাঁদে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষরাজিও কাঁদে।
আবার কখনো কখনো পাহাড় ভয়ে জবুথবু হয়ে কাঁদে সন্ত্রাস ও সহিংসতায়। পাহাড় আর পাহাড়ের বৃক্ষরাজির এভাবে নীরবে নিভৃতে ক্রন্দনে প্রকৃতিও যেন এই কান্নার সমব্যথি হয়ে চরম প্রতিশোধ নেয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে। তবুও পাহাড় কাটা, বন উজাড়, বৃক্ষনিধন, পাহাড়ের কোলে অবৈধ বসতি থামছে না।
এই চিত্র বাংলাদেশের সর্বত্র বিশেষ করে পাহাড়ের টিলাবেষ্টিত সব অঞ্চলে। পাহাড় কাটা, টিলা কাটা, বন উজাড় করায় দেশের মানুষের, প্রকৃতির যে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তার নমুনা দেখতে খুব বেশি দূর যেতে হয় না। নিকট অতীতে পাহাড় ধস, ভূমিধস, পাহাড়ের কোলে বসবাস করা মানুষের মৃত্যু, সম্পদহানি পাহাড়ে অতিমাত্রায় বৃষ্টি, বন্যা প্রভৃতি।
এতকিছুর পরও থামে না পাহাড় কাটা, পাহাড়ের কোলে থাকা বৃক্ষরাজি নিধন। বিশেষ করে এ কারণে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধস, মানুষের প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষতি অব্যাহত থাকে। অবশ্য পাহাড় কাটা, পাহাড়ের বৃক্ষনিধন, পাহাড়ে অবৈধ বসতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্রসাশন লোক-দেখানো অভিযান পরিচালনা করলেও বন্ধ হয় না পাহাড় কাটা, বৃক্ষনিধন, পাহাড়ের অবৈধ বসিত।
বন্দর নগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে থামছে না পাহাড় কাটা। শুধু স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) একাই কাটছে ছোট-বড় ১৫টি পাহাড়। অন্যান্য সংস্থা, শিল্পগোষ্ঠীও প্রশাসনের চত্রছায়ায় বেপরোয়াভাবে পাহাড় কেটে দখল করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলে। গড়ে তোলা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মক্তব, মাদ্রাসা, ক্লাব প্রভৃতি। তারা প্রকাশ্যে পাহাড় কেটে মাটি লুট করছে, মাটি বিক্রি করছে, পাহাড়ের জমি দখল করে গড়ে তুলছে অবৈধ বসতি।
এমনি অবস্থায় বাধ্য হয়ে পাহাড়া, টিলা কাটা বন্ধ ও সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ২০১৭ সালে পাহাড় কাটা নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এ নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে সিলেট জেলার চুনারুঘাট, নবীগঞ্জ, বাহুবল ও মাধবপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে উচ্চ দামে লাল মাটি বিক্রি করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়ে দেওয়া হয়েছে একাধিক লিখিত অভিযোগ।
তবে থানা পুলিশ ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে শিথিলতা বিরাজ করায় কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। কিছু পাহাড়ের ওপরের অংশ ন্যাড়া করে উজাড় করা হয়েছে গাছপালা। কয়েকটি পাহাড় কাটা হয়েছে খাড়াভাবে। আর কিছু কাটা হচ্ছে উঁচু চূড়া থেকে। এভাবে নানা রকম কায়দায় কাটা হচ্ছে পর্যটন শহর কক্সবাজারের পাহাড়। প্রতিনিয়ত পরিবেশের ওপর এই আগ্রাসন চললেও কারও যেন মাথাব্যথা নেই। যেসব পাহাড়ের ওপরের অংশ পরিকল্পিতভাবে উজাড় করা হয়, বৃষ্টি হলে এসব পাহাড়ের মাটি পানির তোড়ে নিচের দিকে নেমে পড়ে।
অনুরূপ শুধু হবিগঞ্জ নয় চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, সিলেট, ময়মনসিংহ, শেরপুর, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাহাড় কাটার প্রতিযোগিতা চলছে। প্রশাসন মাঝেমধ্যে মামলা ও জরিমানা করে পাহাড় কাটা রোধে চেষ্টা চালালেও তা ফলপ্রসূ হয় না।
পরিবেশের মামলায় বেশির ভাগই অর্থদণ্ডে নিষ্পত্তি হয়। এটিও পাহাড় কাটা বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ। শত-সহস্র বছর ধরে সিলেট জেলার যেসব টিলা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, নগর সভ্যতার চাপে গত দুই দশকের মধ্যেই সেগুলো বিলীন হতে বসেছে। নির্বিচারে পাহাড়, টিলা কাটার ফলে সিলেটের প্রকৃতি-পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
পরিবেশবাদীদের দাবি, গত দুই দশকে টিলা কাটার ফলে সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের পরোক্ষ সহযোগিতায় টিলা কাটা হচ্ছে। সরকারি প্রকল্পের জন্য টিলা কাটার কারণে প্রভাবশালীদের আরও সাহস পায় টিলা ধ্বংসে।
১৯৫৬ সালের ভূমি জরিপের আলোকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রস্তুত করা তথ্য অনুযায়ী, সিলেট জেলায় ১ হাজার ২৫টি টিলা ছিল, যার মধ্যে ১৯৯টি টিলা সিলেট নগরী ও এর আশপাশের এলাকায় অবস্থিত। পাহাড় কাটা রোধে পরিবেশ আইনবিদ সমিতিসহ বেলাসহ বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে।
পাহাড় কাটা বন্ধ চেয়ে জনস্বার্থে বেশ কয়েকটি মামলা করেছে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরশেদ বলেন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট জেলায় পাহাড় কাটা বন্ধে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে হাইকোর্টে একাধিক আবেদন করা হয়। আদালত পাহাড় কাটা বন্ধের নির্দেশ দেন। দেখা যাচ্ছে, রায় অমান্য করে পাহাড়গুলো কেটে মাটি বিক্রি করছে স্থানীয় এক শ্রেণির লোকজন।
পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে কার্যকর প্রদক্ষেপ না নেওয়ায় পাহাড় রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। পাহাড় কাটার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশ হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
এরি মধ্যে চলতি বছরের ২ এপ্রিল রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকে পাহাড় কাটা বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ পাহাড় কাটা বন্ধের আদেশ দেন। সাজেকে পাহাড়ের মাটি কাটা সম্পর্কে ২৯ মার্চ গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে জনস্বার্থে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে একটি রিট পিটিশন করা হয়।
আদালত এক অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে প্রশাসনকে মনিটরিং টিম গঠন করার নির্দেশ দেন যাতে কেউ পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ব্যতীত পাহাড় কাটতে না পারে। চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় পাহাড় ও কৃষিজমির মাটি কাটা ৭ দিনের মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ, সংশ্লিষ্ট সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিবাদীদের এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
সেই সঙ্গে পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের পরিচালককে নির্দেশ দেন আদালত। সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানান, হাইকোর্টের রায়ের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর ফের পাহাড় কাটা শুরু হয়। বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হয়েছে।
অন্যদিকে মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জে পাহাড় ও টিলা কাটার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ১৫ ধারা অনুসারে চার সপ্তাহের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে করা এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি শেষে ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। উচ্চ আদালতের রায়ের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের তৎপরতা দেখা যায়নি।
ফলে পাহাড় কাটা অব্যাহত আছে। এ প্রসঙ্গে আইনজীবীর অভিমত, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে পাহাড়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কিন্তু নির্বিচারে পাহাড় নিধন চলছে। এতে পরিবেশের যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি পাহাড় ধসে প্রাণ হারায় এর পাদদেশে বসবাসরত মানুষ। এ জন্য পাহাড়া রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। বাস্তবতা হচ্ছে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য ও মানুষের অসচেতনতায় নির্বিচারে পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না। পরিবেশের ওপর যার ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। শুধু অর্থদণ্ড নয়, অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত না করলে পাহাড় কাটা কিছুতেই থামবে না।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামে ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৫৬০টি পাহাড় কাটার অভিযান পরিচালনা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এসব অভিযানে ৮৫ কোটি ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরে চলতি বছরে পাহাড় কাটার অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তর পাঁচটি মামলা করেছে। আগের বছর মামলা হয় ১০টি। ২০২২ সালে মামলা হয়েছিল ২২টি। বৃহত্তর চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা হয়েছে কক্সবাজার এলাকায়। এ পর্যন্ত এখানে পাহাড় কাটার জন্য ১৮১টি মামলা হয়েছে।
এর মধ্যে ১১৫টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ৬৬টি মামলার তদন্ত চলছে। চট্টগ্রাম জেলা, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে মোট মামলা হয়েছে ৬০টি। এর মধ্যে ৫২টির অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়া বান্দরবানে ২১টি ও কুমিল্লায় পাহাড় কাটার অপরাধে ৯টি মামলা হয়েছে। গত চার মাসেও এসব এলাকায় পাহাড় কাটার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাহাড় কাটা, পাহাড়ের বৃক্ষনিধন বন্ধে কঠোর হস্তে আইনের কার্যকর প্রয়োগ করা জরুরি। তা না হলে পাহাড়ের নীরব কান্না, পাহাড় ধস, ভূমিধস, বৃক্ষনিধন, পাহাড়ে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করা মানুষে মৃত্যু, সম্পদের ক্ষতি বন্ধ করা যাবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।