বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩

ইলিশ উৎপাদনেও বাংলাদেশ রোলমডেল  

ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ
প্রকাশিত
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ
প্রকাশিত : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১৫:০৩

ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। বাঙালির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইলিশ মাছের চর্বিতে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। উক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রায় ২% ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড- যা মানবদেহের কোলেস্টোরেলের পরিমাণ হ্রাস করে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তা ছাড়া ইলিশ মাছের আমিষের ৯ ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া যায়, যা মানুষের পাকস্থলী তৈরি করতে পারে না। ইলিশের চর্বিতে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন এ এবং ডি থাকে। এ জন্য ইলিশ স্বাস্থ্যবান্ধব মাছ হিসেবে অধিক পরিচিত।

ইলিশের অবাধ প্রজনন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ অনুযায়ী ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর ২০১৮ (বাংলা ২২ আশ্বিন থেকে ১৩ কার্তিক ১৪২৫) মোট ২২ দিন দেশব্যাপী ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সময় ইলিশের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্রের ৭০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা যেমন মিরসরাই উপজেলার শাহেরখালী থেকে হাইতকান্দী পয়েন্ট; তজুমদ্দিন উপজেলার উত্তর তজুমদ্দিন থেকে পশ্চিম সৈয়দ আওলিয়া পয়েন্ট; কলাপাড়া উপজেলার লতা চাপালি পয়েন্ট; কুতুবুদিয়া উপজেলার উত্তর কুতুবুদিয়া থেকে গণ্ডামারা পয়েন্টে ইলিশ মাছসহ সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। এ ছাড়াও দেশের ৩৭ জেলায় যথা চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, শরীয়তপুর, ঢাকা, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং গোপালগঞ্জ জেলার সংশ্লিষ্ট সব নদ-নদীতে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। নিষিদ্ধকালীন সময়ে দেশব্যাপী ‘ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ২০১৮’ পরিচালনা করা হবে। ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ সংক্রান্ত সরকারি নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন; প্রধান প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ রক্ষায় গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং সর্বোপরি অবাধ প্রজননের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও মৎস্য অধিদপ্তর এ উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা হলে ১-২ বছর মেয়াদে জেল কিংবা ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। একই অপরাধ পুনরায় করলে শাস্তির মাত্রা দ্বিগুণ হবে।

ইলিশের জীবনচক্র বৈচিত্র্যময়। এরা সাগরের লোনাপানিতে বসবাস করে; প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়ার জন্য উজান বেয়ে মিঠা পানিতে চলে আসে। একটি ইলিশ ৩ থেকে ২১ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। মিঠাপানিতে ডিম দেয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে। পরে এরা আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ ১-২ বছর বয়সে (২২-২৫ সেন্টিমিটার আকারে পুরুষ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী) প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠাপানির দিকে অভিপ্রয়াণ করে। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশ মাছ অপেক্ষাকৃত বেশি ধরা পড়ে।

ইলিশ মাছ সারা বছরই কম-বেশি ডিম দেয়; তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিন মাসের প্রথম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে ওরা প্রধানত ডিম ছাড়ে। এ জন্য চলতি বছরে আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার দিনসহ পূর্বের ১৭ দিন এবং পরের ৪ দিন (১৭+১+৪) ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুত ও বিনিময় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালিত গবেষণার তথ্যমতে, ২০১৭ সালে মা ইলিশ সঠিকভাবে সংরক্ষণের ফলে প্রায় ৪৭% ইলিশ ডিম দিয়েছে।

ইলিশের মোট আয়ুষ্কাল ৫-৭ বছর। আহরিত ইলিশের শতকরা ৯০ ভাগ ৩০-৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়; এর মধ্যে ২টি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারাজীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর ১টি মিঠাপানি ও লোনাপানিতে জীবন অতিবাহিত করে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৭০% বাংলাদেশ আহরণ করে; দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিয়ানমার (২০-২৫%) এবং তৃতীয় অবস্থানে ভারত (১০-১৫%)। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্যমতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা ও তিস্তা নদী এবং মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওরেও গত বছর ইলিশ পাওয়া গেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঠিক তত্ত্বাবধানে মৎস্য অধিদপ্তর, প্রশাসন ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করায় দেশব্যাপী ইলিশের বিস্তৃতি ও উৎপাদন বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২.৯৮ লাখ টন; ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা হয় ৩.৯৫ লাখ টন। ২০১৬-১৭ সালে তা ৪.৯৬ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ বিগত ৯ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ, যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোলমডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। অন্যদিকে ২০১৬ সালে ইলিশ বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইলিশের স্বত্ব এখন শুধুই বাংলাদেশের। এটা জাতির জন্য গৌরবের।

ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থাপনা বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম। এ লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার চলতি বছর দেশের ২৯টি জেলার ১১২টি উপজেলার মা ইলিশ আহরণে বিরত থাকা ৩,৯৫,৭০৯ জেলে পরিবারের জন্য পরিবার প্রতি ২০ কেজি হারে বিনামূল্যে সর্বমোট ৭,৯১৪ টন ভিজিএফ চাল মঞ্জুর করেছে। মৎস্যবান্ধব বর্তমান সরকারের এসব যুগোপযোগী ও প্রশংসিত কার্যক্রম বিগত কয়েক বছর ধরে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন এবং মা ইলিশ ও জাটকা সুরক্ষার ফলে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ টনে উন্নীত হয়েছে। ইলিশ উৎপাদনের এরূপ সফলতা জেলে সম্প্রদায়ের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। জেলেরা অনেকেই এখন বুঝতে পারছে, জাটকা ও মা ইলিশ সঠিকভাবে সুরক্ষা করতে পারলে বর্ধিত হারে ইলিশ উৎপাদনের সুফল সরাসরি তারা নিজেরাই ভোগ করতে পারবে। এ জন্য জেলেরাও অনেক ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে মা ইলিশ ও জাটকা সুরক্ষা করছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক।

লেখক: বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী


বেতাল হরতাল বোধহীন অবরোধে কী হাসিল হচ্ছে বিএনপির?

আপডেটেড ২৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০৮
মোস্তফা কামাল

রাজনীতিতে খেই হারিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আবার হরতাল-অবরোধেই ভর করেছে বিএনপি। রাজনীতিতে আবেদন-নিবেদন হারিয়ে হরতাল-অবরোধ ভোঁতা হয়ে গেছে সেই কবেই। বাস্তবতা বুঝে বিএনপির দিক থেকেও ঘোষণা ছিল, তারা আর হরতাল-নৈরাজ্যের কর্মসূচি দেবে না। জনভোগান্তি হয় এমন কর্মসূচি দেবে না। অহিংস আন্দোলনের নতুন দৃষ্টান্ত দেখাবে। তাদের ঘোষণাটি জনমনে বেশ আগ্রহ জাগায়। রাজনৈতিক মহলও অপেক্ষমাণ থাকে তাদের নতুন দৃষ্টান্ত দেখার। বিএনপি তা দেখিয়েছে।

পদযাত্রা, শোভাযাত্রা, রোড মার্চ, সেমিনার, জেলা সমাবেশ, বিভাগীয় সমাবেশ ধরনের কর্মসূচিতে বেশ সাড়া তুলতে পারে বিএনপি। বছর দেড়েক ধরে দলের নেতা-কর্মীরাও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটি বাতাবরণ তৈরি হয়। ২৮ অক্টোবর যেন সব ছন্দ হারিয়ে দেয়। আবার হরতাল-অবরোধের তালগোলে চক্কর খাচ্ছে বিএনপি। গত কিছুদিন ধরে কবে হরতাল, কবে অবরোধ তফাৎ করাও কঠিন। এক ভার্চুয়াল ঘোষণাতেই হরতাল বা অবরোধ। এরপর বিরতি দিয়ে আবার ঘোষণা। সেই পুরোনো ব্যারাম।

দৃশ্যত হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারীরা কমজুরি। পলাতক-ফেরারি। তারা অবরোধ ঘোষণা দেন চোরাগোপ্তায় অজ্ঞাত জায়গা থেকে ভার্চুয়ালে। সরবে-প্রকাশ্যে তাদের তৎপরতা নেই। অবরোধের সমর্থনে মাঝেমধ্যে জনাকয়েক মিলে হঠাৎ চোরাগোপ্তা ঝটিকা মিছিল করে চম্পট। জনাকয়েক কথিত সাহসী নেতার নামসহ সেই ভোঁ দৌড়ের ফুটেজ কোনোমতে একটু প্রচারের ব্যবস্থা করতে পারাই তাদের সক্ষমতা। পাকিস্তান বা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে হরতাল-অবরোধ, ঘেরাও ধরনের গুজরাটি আন্দোলন বাজার পেলেও মানুষ খুব ভালোভাবে নেয়নি। তারপরও মেনে নিয়েছে মুক্তির প্রশ্নে। দেশ স্বাধীনের পর বিশেষ করে আশি-নব্বইয়ের দশকে হরতাল-অবরোধ নামের রাজনৈতিক অস্ত্রকে অতিব্যবহারে ছোবলা করে ফেলা হয়েছে। তখন আর এখন বলে কথা নয়; হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারীরা বরাবরই ক্ষমতাসীনদের কাছে দস্যু, সন্ত্রাসী, নৈরাজ্যকারী। আর হরতাল-অবরোধকারীদের কাছে ক্ষমতাসীনরা কেবলই স্বৈরাচার-কর্তৃত্ববাদী, অধিকার হননকারী। এ দুইয়ে মিলে যা হবার তা-ই হয়। দীর্ঘ বিরতির পর আবারও চলছে নতুন করে। আপদের মাঝে বিপদ হয়ে আবারও চেপেছে মানুষের ওপর। এর কুফল পুরোটা ভুগছে সাধারণ মানুষ। দায় চাপছে বিএনপির ঘাড়ে। আর রাজনৈতিক সুবিধার পুরোটা নিচ্ছে সরকার।

রাজনৈতিক কর্মসূচির মাঝে অবরোধ-হরতাল ডাকা সবচেয়ে সোজা কাজ। তেমন পুঁজি লাগে না। রাস্তায়ও নামতে হয় না। এখন আর প্রেস রিলিজিও লাগে না। অনলাইনে ডাকলেই হয়ে যায়। পরে হরতাল-অবরোধ সফল করায় জনগণকে ধন্যবাদও জানায় এর আহ্বানকারীরা। আর প্রতিরোধকারীরা ধন্যবাদ জানায় জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছে দাবি করে। আচানক এই সার্কাসে দফায় দফায় হরতাল-অবরোধের চালান ছাড়ছে বিএনপি। এর জেরে রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতিসহ যাবতীয় নীতি একাকার। ঝাঁকুনি চলছে সব সেক্টরে। স্বাধীনতার বায়ান্ন-তেপ্পান্ন বছরেও রাজনীতি- কূটনীতিকে যার যার রেখে অর্থনীতিকে সবার করার জায়গায় আসতে পারেনি বাংলাদেশ। সেই লক্ষণও নেই। হরতাল-অবরোধ নিয়ে কথামালা অন্তহীন। কারও কাছে অবরোধ ব্যর্থ, কারও কাছে সফল। এর মানদণ্ড খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেন সফল, কেন ব্যর্থ, এর জবাব নেই। যারা বলেন অবরোধ নিরর্থক, দুই দিন বাদে তারাই অবরোধে নানা সেক্টরে সেক্টরে বিশাল ক্ষতির জরিপ দেন। অবরোধ নামক কর্মসূচিটিতে সরকার টলল কি টলল না, তার চেয়ে বেশি মুখ্য হচ্ছে, অর্থনীতির অচলায়তন। যার পুরোটাই হয়ে চলছে গত কদিন। বিএনপি-জামায়াত ভার্চুয়ালে অবরোধ ডেকেই অনেকটা খালাস। অ্যাকচুয়ালে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে যাচ্ছে। এক অর্থে বিএনপির অবরোধ ২০১৫ সাল থেকে চলমানই ছিল। এখন নতুন করে আবার ঘণ্টা বাজানো হয়েছে। ২০১৫ সালের শুরুতে ডাকা লাগাতার অবরোধ সমাপ্তির আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না দিলেও বছরখানেক ধরে শান্তিপূর্ণ তথা অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি একটি নতুন ধারা আনতে পেরেছে গত কয়েক বছরে। দেশি-বিদেশি বিশেষ মহলগুলো বিএনপির নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট জায়গায় সভা-সমাবেশ, পদযাত্রা, শোভাযাত্রার ‘গুডবয়’ কর্মসূচিকে স্বাগতও জানাতে থাকে। উপরন্তু, তাদের এসব কোমল-কুসুম কর্মসূচির কোথাও কোথাও পুলিশ বা সরকারদলীয়দের বাধার সমালোচনা হয় বিভিন্ন মহলে। এতে বিএনপি একধরনের সিমপ্যাথিও পেতে থাকে নানা মহল থেকে। এ ধারাপাতের ছন্দপতনে ২৮ অক্টোবরের ঘটনাবলি এবং পরিণামে আবারও অবরোধ জমানায় ফিরে আসা।

জনগণও এতে কত বিরক্ত, তা জানার দরকারও মনে হচ্ছে না তাদের। এরই মধ্যে অবরোধের ক্ষতি পোষাতে বন্ধের দিনেও দোকান খুলতে শুরু করেছেন দোকানদার-ব্যবসায়ীরা। দিন এনে দিন খাওয়াদের কী দশা যাচ্ছে? যানবাহন ঠিকমতো চলাচল করতে না পারায় বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ কমছে। জিনিসপত্রের দাম আরও চড়ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা অবরোধকে অজুহাত হিসেবে নিয়েছে। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে টোকা পড়ছে। অর্থনীতিতে এমনিতেই অনিশ্চয়তা। তা আরও ভয়াবহতার দিকে ধেয়ে চলছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। স্থিতিশীল পরিবেশ না থাকায় বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে রাখছেন অনেক দিন থেকে। এখন ঘরে উঠে যাচ্ছেন পুরোপুরি। এতে নতুন কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হতে হতে আর সংকুচিত হওয়ার জায়গাও প্রায় শেষ। ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকমতো না চললে প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা দিতে পারবে না- তা বুঝতে অর্থনীতি বিশারদ হওয়া লাগে না। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মী ছাঁটাই চলছে। বছরের শেষপ্রান্তে হরতাল-অবরোধের মতো চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতির মুখে শিক্ষার্থীরা। স্কুল-কলেজের বার্ষিক পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পরীক্ষা নিয়ে বিপাকে তারা। অভিভাবকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বলছে, শিক্ষাবর্ষের শেষ প্রান্তিকে ক্লাস, পরীক্ষা এবং প্রশাসনিক কাজের প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সুযোগ নেই।

জনগণ ও অর্থনীতিকে জিম্মি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অধিকার আধুনিক উগান্ডা-রুয়ান্ডায়ও নেই। বাংলাদেশের চলমান এ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বড় খবর। বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো অবিরাম ডাকদোহাই দিচ্ছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিসহ বড় দুই দলের কাণ্ডকীর্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে অবস্থানকারী তাদের দেশের নাগরিকদের চলাফেরায় সতর্কতা জারি করেছে। বলেছে, বড় সমাবেশ বা কর্মসূচির আশপাশ দিয়েও যাতায়াত না করতে। কূটনৈতিকভাবে এটি বাংলাদেশের জন্য স্থানিক নিউজট্রিটমেন্টে টোটকা বা খুচরা খবর। কিন্তু গুরুত্ব বিচারে দেশের জন্য কত অবমাননকাকর? এত খারাপ হয়ে গেল বাংলাদেশ? এ দেশের কোনো দলের কর্মসূচির পাশ দিয়ে হাটাও মানা? জাতিসংঘ সরকারকে বলেছে, ভীতি প্রদর্শন বন্ধ করতে। নইলে সামনে বাজে পরিস্থিতি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সতর্কবার্তা আরও কঠোর। এর মাঝে আবার ইউনাইটেড এগেইনস্ট টর্চারের বিবৃতিতেও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে টানা হয়েছে ভয়ের কথা। এতে হরতাল-অবরোধকারী বিএনপি ও তার সহযোগীদের অর্জনের খাতায়ও কিছু যোগ হচ্ছে? উতাল-বেতাল না হয়ে বোধ নিয়ে এ প্রশ্ন নিজেরাই নিজেদের করতে পারেন তারা। রাজনৈতিক নাহালতের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কষ্ট, লাখ-লাখ শিক্ষার্থীর অভিশাপে কি পড়ছে না তারা?

সেই সঙ্গে হরতাল-অবরোধ অর্থনীতির যে ক্ষতি করে ছাড়ছে, তা কাটানোর সাধ্য কি হবে তাদেরও? রাষ্ট্রের ক্ষতি করে বিকৃত সুখানুভূতি হলে সেটা ভিন্ন জিনিস। তাহলে এতক্ষণ করা প্রশ্নগুলো কামার দোকানে কোরআন পড়ারই নামান্তর। উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর উদাহরণ। এরপরও সাফল্য হিসেবে তাদের হরতাল-অবরোধ নিত্যপণ্যের বাজারে ছুটে চলা পাগলাঘোড়াকে টোকা দিতে পেরেছে। ‘খেলা হবে-খেলা হবে’ করতে করতে খেলাটা চলে গেছে বাজারে। এ বাজারি খেলায় ধুলা ওড়াচ্ছে কথিত সিন্ডিকেট। আজ ডিম, কাল লবণ-মরিচ। পেঁয়াজ-আদা, চাল-ডাল-তেল। কিছুতেই ছাড় নেই। তাদের ওড়ানো ধুলায় চোখে অন্ধকার, মুখে বোবা কান্না নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের। এ চক্র আচ্ছা খেলোয়াড়। এ খেলার মধ্যে ধুলা ওড়ানো অতি খেলোয়াড়রা সমানে পেনাল্টিতে মারছে মানুষকে। ঘায়েল করছে সরকারকেও। চাল, ডাল, তেল, নুন, চিনি, আটা, ময়দা, আদা, পেঁয়াজ, রসুন, চামড়া, আমড়া সবকিছু নিয়েই খেলছে সমানে। ফ্রি স্টাইলে ধুলা ওড়াচ্ছে। দুই হাতে অর্থ হাতানোর এ পদ্ধতিতে চাহিদা, জোগানের পরিমাণ; কে সরবরাহকারী-বিপণনকারী, কে ভোক্তা; এসবের কোনো বালাই নেই। শিকার ধরাই আসল। বাজার নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের কাছে বাদবাকিরা কেবলই শিকারের বস্তু। বাজার চড়ানোর পেছনে শীত-গরম, বৃষ্টি-খরা, মন্দা-যুদ্ধসহ হরেক অজুহাত তারা হাতে হাতেই রাখে। তাদের এখনকার টাটকা অজুহাত হরতাল-অবরোধ। এর ছুতায় বাজারে চাহিদার বিপরীতে জোগান কমে যাচ্ছে নাকি কমিয়ে দেয়া হচ্ছে- বোঝা মুশকিল। দৃশ্যত সব পণ্যেরই মজুত আছে। কিন্তু নাটক চলছে কৃত্রিম সংকটের। পরিস্থিতিটা এই চক্রের জন্য আশীর্বাদের। বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী, সমর্থক এবং জনগণের দোয়া পায়েদলে বিএনপি এখন সহযোগী বিবেচনায় বাজার সিন্ডিকেটের দোয়া কামাবে? রাজনীতি আর ব্যবসা উভয়ের মন-মনন এক হয়ে গেলে দেবালয় আর লোকালয়ের তফাৎও থাকে না। তখন রাজনীতি-অর্থনীতি-কূটনীতিসহ সব সেক্টরের ধড়িবাজরা আগোয়ান হয় সেই আলোকেই। যার মধ্য দিয়ে তারা হয়ে ওঠেন শেয়ানের ওপর শেয়ান, চতুর। বিশাল কর্মী-সমর্থকের দল বিএনপি কেন নিজেদের নেবে সেই কাতারে?

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন


ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং দেশপ্রেমিক নেতা: সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ

অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সফল মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
মোহাম্মদ হানিফ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোহা. হাবিবুল ইসলাম সুমন

ঢাকার রাজনীতির মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর মোহাম্মদ হানিফ। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত সফল মেয়র ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সফল সভাপতি।

চার শ বছরের প্রাচীন শহর রাজধানী ঢাকা। ঐতিহ্য আর নানা সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের কারণে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মেগা সিটি। সেই শহরের গৌরবের অপর নাম মোহাম্মদ হানিফ। ১৯৪৪ সালে ১ এপ্রিল পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা আবদুল আজিজ আর মাতা মুন্নি বেগমের ছোট ছেলে হানিফ। আদর করে সবাই তাকে ‘ধণী’ নামে ডাকত। শিশু হানিফ ছোটবেলায় মমতাময়ী মাকে হারান। মায়ের মৃত্যুর পর ফুফু আছিয়া খাতুনের কাছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য আর আদর্শে বেড়ে উঠেন মোহাম্মদ হানিফ। ঢাকার প্রখ্যাত পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি আলহাজ মাজেদ সরদার ছিলেন ঢাকার শেষ সরদার। মোহাম্মদ হানিফের বহুমুখী প্রতিভা তাকে মুগ্ধ করে। তাই ১৯৬৭ সালে মাজেদ সরদার প্রিয়কন্যা ফাতেমা খাতুনকে মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গে বিয়ে দেন। এই দম্পতির একজন পুত্র ও দুই কন্যাসন্তান রয়েছে।

পুত্র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন পিতার আদর্শ ধারণ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন।

মোহাম্মদ হানিফ যৌবন থেকে আমৃত্যু আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। দলীয় রাজনীতি করলেও তার উদার চিন্তা-চেতনা ও সংবেদনশীল মনোভাবের কারণে দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল অসামান্য। তাঁর জীবন ছিল কর্মময়, ধ্যান-ধারণা ছিল অত্যন্ত সুন্দর, ব্যক্তিগত চরিত্রে ছিলেন সজ্জন ও সততা-সৌরভে উজ্জ্বল। একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ‘নগর পিতা’ খ্যাত যিনি নগরবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম নির্বাচিত একজন সফল মেয়র। নিজ বিশ্বাসে অটল থেকে তা অকপটে প্রকাশ করতে পারা একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন ঈমানদার ও ধার্মিক মুসলমান। একই সঙ্গে ইসলামের মর্যাদা এবং দ্বীন প্রচারেও ছিলেন সোচ্চার। তিনি তাঁর স্বপ্নের প্রিয় ঢাকা নগরীকে ইসলামী স্থাপত্যকলায় সাজিয়ে তুলতে সহায়তা করেছেন। যার সুবাদে মুসলিমপ্রধান দেশের রাজধানীতে বিদেশি মেহমান কেউ নেমেই যেন বুঝতে পারেন তারা কোথায় এসেছেন। বুকে হাজারো স্বপ্ন থেকে তা বাস্তবে রূপায়নের জন্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সচেষ্ট থেকেছেন। তিনি মুসলিম হলেও অন্যান্য ধর্মালম্বীদের কাছে ছিলেন পরমপ্রিয়। দুর্গাপূজা কিংবা বড়দিন অথবা অন্য কোনো উৎসবে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন। তার সহায়তায় অসংখ্য মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা সংস্কার করা হয়।

মোহাম্মদ হানিফ ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে পরবর্তীতে তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে (শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিএ পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে কিছুদিন আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের পর গঠিত প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার করে ২৪ ঘণ্টার নোটিশে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুনন্নেসা মুজিব ও তার পরিবারকে মন্ত্রীপাড়ার বাসা ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয় পাকিস্তান সরকার। সে সময় কেন্দ্রীয় সরকারের রক্তচক্ষু, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে মোহাম্মদ হানিফের পরিবারে পুরান ঢাকার ৭৯ নম্বর নাজিরা বাজার বাসায় অবস্থান নেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব ও তার পরিবার। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মোহাম্মদ হানিফকে খুব স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। তিনি সব সময় চাইতেন মোহাম্মদ হানিফ যেন সর্বদাই বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকেন। মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ঘনিষ্ঠতা কোনো দিন কমেনি বরং মুজিব পরিবারের বিশ্বস্ত হিসেবে আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে থেকে মোহাম্মদ হানিফের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়। ১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে অত্যন্ত সফলতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন। তিনি একান্ত সচিব থাকাকালীন ছয় দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি, ছয় দফা মুক্তি সনদ প্রণয়ন এবং প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর জাতীয় নির্বাচন এবং ৭১-এ মহান মুক্তি সংগ্রামে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সান্নিধ্য পাওয়া মোহাম্মদ হানিফ ১৯৯৪ সালে ৩০ জানুয়ারি অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ বিপুল ভোটের ব্যবধানে ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। তার আমলে ঢাকার উন্নয়নে রাস্তাঘাট, নর্দমা, ফুটপাত উন্নয়ন ও সংস্কার, নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, আন্ডারপাস, সেতু, ফুটভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়। পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় ধানমন্ডি লেক এবং আশপাশের এলাকা। ঢাকাবাসীর সুপেয় পানির চাহিদা পূরণে তিনি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ঢাকার সৌন্দর্য বাড়ানো ও নগরবাসীর চাহিদা পূরণে নগরীতে বিজলি বাতি স্থাপন, নগর সৌন্দর্যবর্ধনে ফোয়ারা নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি, পুরান ঢাকার আউটফলে ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ করেন।

নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ছিলেন মেয়র হানিফ। নারীশিক্ষা বিস্তারে লক্ষ্মীবাজারে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ। এ ছাড়া মহিলাদের মাতৃত্বকালীন সময়ে পরিচর্যার জন্য নগরীতে বেশ কয়েকটি মাতৃসদন নির্মাণ করেন। শিশুবান্ধব ঢাকা গড়তে নিরলস কাজ করেছেন নগরপিতা হানিফ। শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য পৌর শিশুপার্ক নির্মাণ ও পুরাতন পার্কগুলোতে প্রাণ ফিরিয়ে আনা, এ ছাড়া বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করে গেছেন।

মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ঢাকাবাসীর কষ্ট লাঘব করতে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা, মশক নিধন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। তার আমলে তিলোত্তমা নগরী গড়ার লক্ষ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়িয়েও মহানগরীর উন্নয়ন সম্ভব ঢাকাবাসীর কাছে তারই নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ হিসেবে তিনি কাজে প্রমাণ করে গেছেন।

১৯৯৬-এর মার্চের শেষ সপ্তাহে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে মোহাম্মদ হানিফ তার নেতৃত্বে ‘জনতার মঞ্চ’ গঠন করেন, যা তৎকালীন বিএনপি সরকারের পতনসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট তৈরি করে এবং যার ফলে ৯৬-এর ১২ জুন দেশের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে দেশ পরিচালনার জন্য মোহাম্মদ হানিফের প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ততার বড় প্রমাণ দিয়েছেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ এবং হাওয়া ভবনের নেতৃত্বে পরিচালিত গ্রেনেড হামলার মূল টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা এবং সে সময়কার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা।

২০০৪ সালের ভয়াল ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের ট্রাক মঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর নারকীয় গ্রেনেড হামলার সময় নিজের জীবন তুচ্ছ করে মানবঢাল রচনা করে তার প্রিয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে রক্ষার প্রাণান্তর চেষ্টা করেন মোহাম্মদ হানিফ। একের পর এক ছোড়া গ্রেনেডের সামনে নির্ভয়ে পেতে দিলেন নিজেকে, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রাণে রক্ষা পেলেও মারাত্মক আহত হন তিনি। মস্তিষ্কসহ দেহের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ঘাতক স্প্লিন্টার ঢুকে পড়ে। দীর্ঘ দিনের চিকিৎসাতেও কোনো ফল হয়নি বরং মাথার গভীরে বিঁধে থাকায় ও অস্ত্রোপ্রচার করেও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেই রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকেছেন মোহাম্মদ হানিফ।

জনগণের কল্যাণই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। আর রাজনীতির উজ্জ্বল ধ্রুবতারা ছিলেন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। একজন প্রকৃত নেতা হিসেবে জাতির প্রতিটি ক্রান্তিতে এই অকুতোভয় সৈনিক রাজপথে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজধানীর প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৬ এর ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পূর্বে মাথায় বিদ্ধ হওয়া স্প্লিন্টারের প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী সময়ে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা শেষে ২৮ নভেম্বর ২০০৬ দিবাগত রাতে ৬২ বছর বয়সে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মোহাম্মদ হানিফ। অবশেষে চির অবসান ঘটে তার কর্মময় রাজনৈতিক জীবনের।

২৮ নভেম্বর তার ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। মোহাম্মদ হানিফ চলে গেলেন জাতির এক চরম দুঃসময়ে। তার মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। দেশের রাজনীতিতে তার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। একজন সফল রাজনৈতিক এবং সকল গুণাবলির অধিকারীসম্পন্ন মোহাম্মদ হানিফ তার কর্মের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।


দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সামাজিক সুরক্ষা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. সুলতান মাহমুদ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিসর অনেক বাড়িয়েছে। এ কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষাবলয়ের আওতায় নানারকম ভাতা দিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। এতে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ছাড়াও বয়স্ক ভাতা, স্বামী নিগৃহীতা, বিধবা, দরিদ্র মায়ের মাতৃত্বকালীন ভাতা, শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সম্মানী ভাতা, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ভাতা রয়েছে। এ ছাড়াও কৃষি প্রণোদনা পাচ্ছে কৃষক। শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা চলে যাচ্ছে অভিভাবকদের মোবাইলে।

বর্তমান সরকার গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকে জমিসহ বাড়ি দিচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি বিরল। সরকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, হোটেলের কর্মচারী, ড্রাইভারসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে করোনাকালে সহায়তা দিয়েছে, এই সহায়তা থেকে কেউ বাদ যায়নি। সংবিধানে ১৫(ঘ) ধারার বাধ্যবাধকতাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি শুরু হয় খাদ্য ও নগদ অর্থ সাহায্য রিলিফ হিসেবে প্রদানের মাধ্যমে। সত্তর দশকে মূলত রিলিফ কাঠামোর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আটকে ছিল। সত্তর দশকের শেষে সীমিত পরিসরে ও আশির দশকে কাজের বিনিময়ে খাদ্য, অর্থ প্রদানের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ১৯৯৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যার সময় দেশব্যাপী খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রথমবারের মতো দেশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে বয়স্ক, শারীরিকভাবে অক্ষম ও দুস্থ মহিলাদের জন্য মাসিক ভাতার প্রচলন করা হয়।

তারই ধারাবাহিকতায় পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবারও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে এবং জীবনমানের উন্নয়নে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকারের এ অঙ্গীকার বিধৃত হয়েছে জাতীয় সংবিধান, রূপকল্প ২০২১, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলে। এসব দলিলে বর্ণিত প্রতিশ্রুতিগুলোর অভীষ্ট লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য হ্রাসে এরই মধ্যে অর্জিত অগ্রগতিকে ভিত্তি করে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দারিদ্র্যের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন ও তার টেকসই সমাধান। পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদের ঝুঁকি কমানোর মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসের অগ্রযাত্রাকে যাতে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায়, এ ভাবনাকে সামনে রেখেই সরকার জাতীয় সামজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে, যাতে গণদারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে বের হয়ে আসতে পারে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মোট বরাদ্দ ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার মধ্যে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ করা হয়, যা মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দের তুলনায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ১৩ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা বেশি। গত কয়েক অর্থবছরের বাজেটে সুরক্ষা কার্যক্রমে বরাদ্দের পরিমাণ পযালোচনা করলে দেখা যায়, প্রত্যেক বছর বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।

সরকারের পরিকল্পিত নীতিকৌশল বাস্তবায়নের ফলে কোভিড-১৯ অতিমারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। খানা আয় ও ব্যয় জরিপ, ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বর্তমানে দারিদ্রের হার ১৮.৭ শতাংশ এবং অতি দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশ। দারিদ্র্য দূরীকরণে কৌশলগুলো যেমন দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সম্প্রসারণ, আর্থিক প্রণোদনা, ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে উৎসাহ প্রদান, কার্যকর দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কর্মসূচি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা প্রভৃতিতে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর কেড়েছে।

কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মূল কর্তব্য হচ্ছে জনগণকে সেবা দেয়া। বিশেযত জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে বা যারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা দেয়াই হচ্ছে রাষ্ট্রের মূল কাজ। আমরা বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অসংখ্য কর্মসূচি বাস্তবায়িত হতে দেখেছি। তবে এই ধরনের সুবিধা উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় দেয়া হলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এর অনুশীলন তেমন দেখা যেত না। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর দূরদর্শী জ্ঞান থেকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে গঠনমূলক রূপদানে সক্ষম হয়েছেন।

২০০৮ সালের পূর্বে বাংলাদেশের কোনো সরকারই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় এত ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয়ার সাহস দেখায়নি। দিনবদলের সনদকে সামনে রেখে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার বিভিন্ন ব্যাতিক্রমী কর্মসূচি হাতে নেয়। এরই অংশ হিসেবে দরিদ্র এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করার অভিপ্রায়ে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেয়ার কর্মসূচি হাতে নেয় বর্তমান সরকার।

২০০৯ সালের বাস্তবতায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত কর্মসূচির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর সুবিধাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ। গত প্রায় ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের যে কয়েকটি সিদ্ধান্ত জনগণের হৃদয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে দাগ কেটেছে, তার মধ্যে সমাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধাগুলো অন্যতম।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রায় ১৪০টির মতো সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে দেশজুড়ে। বাজেটের মাধ্যমে বিপুল বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দরিদ্রবান্ধব মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

করোনা অতিমারির সময়ে এই কর্মসূচিগুলোতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে সরকার। অতিমারি চলাকালীন খেটে খাওয়া মানুষের দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি এককালীন নগদ সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ২০২০ সালে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার চারটি প্রধান মোবাইল আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার (নগদ, বিকাশ, রকেট এবং শিওরক্যাশ) মাধ্যমে করোনভাইরাস দ্বারা প্রভাবিত নিম্ন আয়ের ৫০ লাখ পরিবারকে (প্রধানত শহর ও গ্রামীণ উভয় ক্ষেত্রেই দরিদ্র এবং দুস্থ) ২৫০০ টাকা এককালীন নগদ সহায়তা দিয়েছে। পরে আরও ৩৬ লাখ পরিবারকে এই এককালীন নগদ সহায়তা দেয়া হয়। এই কর্মসূচির একটি বৈশিষ্ট্য ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মোবাইলে এই সহায়তার অর্থ সরাসরি দেয়া।

বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে গেছেন শেষ দিন পর্যন্ত। তাঁর জীবনের মূল দর্শন ছিল বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। বাবার আর্দশকে ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় চেষ্টা করে চলেছেন দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন অব্যাহত থাকুক। এমনকি এ ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচির ভিত্তিতে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মেধা ও শ্রম দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে ক্রমেই। উপকারভোগী ব্যক্তি ও পরিবার হীনমন্যতা কাটিয়ে একটি সন্মানজনক জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার স্বপ্ন দেখছে, যা একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুতপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুগ্ম সম্পাদক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।


কাঁচা ফুলের রপ্তানি ক্রমেই বাড়ছে

আপডেটেড ২৭ নভেম্বর, ২০২৩ ১৩:৫০
আবুল কাসেম ভূইয়া

আমাদের দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের চাষ শুরু হয় সত্তর দশকের গোড়ার দিকে। আশির দশকে এসে তা ব্যাপকতা লাভ করে। প্রাথমিক অবস্থায় যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলায় সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের চাষ শুরু হয়। পরবর্তী পর্যায়ে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে যশোর, সাভার, চুয়াডাঙ্গা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ফুল উৎপাদনকারী ফুল উৎপাদন করছে। দেশের ৭০ ভাগ ফুল যশোরে উৎপাদন করছে। ফুল উৎপাদনের সঙ্গে প্রায় ৩৫ হাজার পরিবার যুক্ত আছে। ফুল উৎপাদন, বিপণন, বিক্রি এবং রপ্তানি কাজে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ২ লাখ লোক নিয়োজিত আছে। বর্তমানে আমাদের দেশে কাঁচা ফুল একটি অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। আমাদের দেশে কাঁচা ফুলের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন উৎসব, পার্বণে কাঁচা ফুলের ব্যবহার হচ্ছে। শুধু তাই নয়- বাংলাদেশের কাঁচা ফুল এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় কাঁচা ফুলের নাম উঠে এসেছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত কাঁচা ফুল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ফুল রপ্তানি করে প্রতি বছর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে বিভিন্ন কৃষিজান পণ্যের মধ্যে কাঁচা ফুল ইতোমধ্যে বিশেষ স্থান দখল করেছে। ফুল চাষে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক। বাংলাদেশের জমি এবং জলবায়ু কাঁচা ফুল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের ফুল উৎপন্ন হয়। এসব ফুলের মধ্যে গ্লাডিউলাস, রজনীগন্ধা, গোলাপ, গাঁদা, লিলিয়াম, থাইঅর্কিড, কার্নেশন, শর্বারা, গ্লোবাল প্রভৃতি ফুল রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশের কাঁচা ফুল মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, পাকিস্তান, ভারত, ইতালি, কানাডা, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সে রপ্তানি করা হচ্ছে। এসব ফুলে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বল্প পরিসরে রপ্তানি করা হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসেবে দেখা যায়- ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এ দেশ থেকে ফুল রপ্তানি হয়েছিল ২৭৬ কোটি ৯ লাখ টাকা, ২০০৯-২০১০ সালে ৩২৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, ২০১০-২০১১ সালে ৩৬২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা আয় হয়েছিল। ২০১৩ সালে কাঁচা ফুল রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ১৬.৫৮ মিলিয়ন ডলার। দিন দিন ফুল রপ্তানি ক্রমেই বাড়ছে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে এ আয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। ফুল উৎপাদনে দেশের প্রায় ৪ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে কাঁচা ফুলের চাষ করা হচ্ছে। সারা দেশে খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজারের মতো। এমন একটি সম্ভাবনাময় খাতের ব্যাপারে সরকারের কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে পরিমাণ ফুলের চাহিদা রয়েছে সে পরিমাণ ফুল রপ্তানি করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক নবদিগন্তের সূচনা হতো। ফুল চাষের ব্যাপারে ফুলচাষিদের অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিদিন। সর্বপ্রথম ফুল চাষের ব্যাপারে ফুলচাষিরা সরকারের কাছ থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে না। ফুল উৎপন্ন করে ফুলচাষিরা প্রকৃত মূল্য পাচ্ছে না। পরিবহন, বাজারজাতকরণ এবং বিপণন সমন্বয় না থাকায় ফুলচাষিদের বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তা ছাড়া আমাদের দেশে ফুলচাষিদের ফুল চাষের ব্যাপারে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই, ফুল রপ্তানিতে যে সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো বাংলাদেশ বিমানে কোনো কার্গো সুবিধা না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রুত পচনশীল পণ্য পাঠানো সম্ভব হয় না, এখানে নেই কোনো উন্নত প্যাকেজিং এবং সংরক্ষণের জন্য হিমাগার, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ফ্রিজার ভ্যান, স্বল্প ভাড়ায় বিমানে করে ফুল রপ্তানি ব্যবস্থা। ফুলকে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় কীটনাশক পায় না ফুলচাষিরা। বাংলাদেশে উৎপাদিত কাঁচা ফুল বিদেশে রপ্তানির ব্যাপারে এবং এ খাত থেকে কোটি কোটি ডলার আয় করার লক্ষ্যে কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, বিশ্বের যেসব দেশে ফুলের বড় বড় মার্কেট আছে সেসব দেশের সঙ্গে রপ্তানি পণ্য তালিকায় কাঁচা ফুলের নাম অন্তর্ভুক্ত করা। পরিবহন সমস্যা যেমন বিমানের ভাড়া কমানোসহ কার্গো নিশ্চিত করা। কোল্ড ভেসেলের ব্যবস্থা করে রপ্তানিতে সহায়তা করা। ঢাকা শহরে প্যাকেজিং গ্রেডিং-এর জন্য মার্কেটসংলগ্ন শ্লেল্টার তৈরি করা। ফুল সতেজ এবং তরতাজা রাখা এবং বীজ সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপন করা। ফুল উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং রপ্তানি নীতিমালা প্রণয়ন করা। বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি গবেষণায় ল্যাবরেটনি স্থাপন, ফুলচাষি, ফুল ব্যবসায়ী, ডিজাইনারদের জন্য পোস্ট হারবেস্ট ম্যানেজমেন্টের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। একটি আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ করার জন্য স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। সম্ভাবনাময় রপ্তানিপণ্য কাঁচা ফুল চাষ এবং রপ্তানির ব্যাপারে ফুলচাষি, রপ্তানিকারকদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এ খাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক: প্রাবন্ধিক।


যেকোনো মূল্যে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে হবে

আপডেটেড ২৭ নভেম্বর, ২০২৩ ১৩:৪৪
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

শহীদ ডা. মিলন। একটি অবস্মরণীয় নাম। একটি ইতিহাস। গণতন্ত্রের জন্য আত্মত্যাগের এক মহিমান্বিত নাম। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের সময় তৎকালীন সরকারের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীদের গুলিতে ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিহত হন। এই শোকাবহ ঘটনার স্মরণে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর শহীদ ডা. মিলন দিবস পালিত হয়ে আসছে। ডা. মিলনের মধ্য দিয়ে তখনকার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। অল্প কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।

হাজারো সংগ্রাম, অসংখ্য আত্মত্যাগ ও মানবতার সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের একমাত্র জাতীয় ঐতিহাসিক সংগঠন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। চিকিৎসক ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুমূর্ষু মানুষের সেবায় সদাব্যস্ত এ সংগঠনের সদস্যরা।

এ দেশের মানুষের কাছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পথিকৃত বিএমএ। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ঢাকা মেডিকেলের পাশে সুউচ্চ শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা, ’৬৯-এর গণ-আন্দোলন এবং ’৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এ সংগঠনের সংগ্রামী সেনারা নির্ভীক আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত। পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বোচ্চ রক্তদানকারী চিকিৎসকরা অন্যদের সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছে। সে গৌরবময় ইতিহাস ও পূর্বসূরিদের অনুপ্রেরণায় ডা. শামসুল আলম খান মিলনসহ আমরা সেই বিএমএর সদস্য হতে পেরে সত্যিই গর্বিত।

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময় অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স তখন মাত্র ২০ বছর। যে লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭১ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এদেশের ছাত্র-যুবক, শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষক, শ্রমিক, জনতাসহ সব পেশার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন; স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশি-বিদেশি চক্রান্তের সেই জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে লক্ষ্যচ্যুত হয় বাংলাদেশ।

আবারও এদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসন। সেই স্বৈরশাসকের নাগপাশ ছিন্ন করে গণতন্ত্র উত্তরণের বছর হিসেবে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছিল ১৯৯০ সাল। ১৯৯০ সাল ঢাকার রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে এসেছিল সব মতের, পেশার মানুষ। লক্ষ্য একটাই ছিল স্বৈরশাসকের পতন, গণতন্ত্রের উত্তরণ। তাই ঢাকা শহর সে সময় পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে।

বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও চিকিৎসা পেশার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ২৩ দফার ভিত্তিতে যখন অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সামরিক স্বৈরাচারের দোসর ডা. জাফর উল্লাহ গংদের সহায়তায় ১৯৯০ সালে এদেশের জনগণের ওপর টিক্কা খান সরকারের মতো চাপিয়ে দেয়া হয় গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে চিকিৎসক সমাজ অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে অন্য সব পেশাজীবীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনকে আরও বেগবান করে। এরপর এলো ২৭ নভেম্বর, ১৯৯০। সারা দেশে স্বৈরাচার সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিএমএর নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারাদেশে চলছিল চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চলছিল বিএমএ আহুত চিকিৎসক সমাবেশ। এতে যোগদানের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে রিকশাযোগে শাহবাগ পিজি হাসপাতালের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন তৎকালীন বিএমএর মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও যুগ্ম সম্পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলন।

পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সংলগ্ন টিএসসি মোড় অতিক্রমের সময় তাদের রিকশা লক্ষ্য করে গুলি চালায় সামরিক জান্তাবাহিনী। বুকে গুলি লেগে রিকশা থেকে লুটিয়ে পড়েন ডা. মিলন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে রিকশায় করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে। সেখানে জরুরি চিকিৎসা করেও বাঁচানো যায়নি তাকে। সবাইকে কাঁদিয়ে তার প্রিয় মেডিকেল কলেজেই শহীদের বেশে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। অথচ এই কলেজেই তিনি পড়েছিলেন মেধাবী ছাত্র হিসেবে, পড়িয়েছিলেন বিনয়ী শিক্ষক হিসেবে, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রাঞ্জল সদালাপী পরম সহিষ্ণু ব্যক্তি হিসেবে। ডা. মিলন শহীদ হওয়ার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হয় এবং অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে প্রাথমিক বিজয় সূচিত হয়। স্বার্থক হয় মিলনের আত্মদান।

শহীদ ডা. মিলন এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্বের নাম। ১৯৫৭ সালের ২৯ জানুয়ারি বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে ১৯৮৩ সালে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কর্মময় জীবন শুরু করেছিলেন তিনি। ঢাকা মেডিকেলে ইন্টার্নশিপ চলাকালে তিনি ইন্টার্ন চিকিৎসক সংগঠনের আহ্বায়ক হয়েছিলেন। শিক্ষক হিসেবেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

ডা. শামসুল আলম খান মিলনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল ১৯৮৮ সাল থেকে। তখন বিএমএ নির্বাচনে মিলন যুগ্ম সম্পাদক ও আমি দপ্তর সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই। সেই থেকে একই সঙ্গে সংগঠনের হয়ে কাজ করতাম। দুটি ভিন্ন প্যানেল থেকে আমরা নির্বাচিত হলেও বিএমএর কাজে বা পেশাগত কোনো বিষয়ে আমাদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি। একে অপরের সহযোগী বা পরিপূরক হিসেবে পেশার জন্য অটল থেকে কাজ করেছি। চিকিৎসকদের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণ চিকিৎসকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি, যা তার নির্বাচিত হয়ে আসা থেকেই প্রতীয়মান হয়।

১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই বিএমএর বিশেষ বার্ষিক সাধারণ সভায় গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি ও স্বৈরশাসকের অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদে সব চিকিৎসক সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন মঞ্চ থেকে নেমে আমি আর মিলন এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। ওই সময় বিবিসি রেডিও থেকে টেলিফোনে বিএমএ নেতাদের একটি সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই রাতে বিবিসি রেডিওতে আমার যে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়, তাতে মিলন পাশে থেকে বিভিন্ন বিষয় কথা বলতে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন।

শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের ২৭তম শাহাদাতবার্ষিকীতে আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। ডা. মিলনের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। এ আত্মদান ছিল দেশের সাধারণ ও বৃহত্তর মানুষের মঙ্গলের জন্য। তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় একজন সমাজ সচেতন মানুষ। এদেশের হাজার হাজার চিকিৎসকের প্রতি, চিকিৎসা পেশার প্রতি, সাধারণ মানুষের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল। মাঝে মধ্যে হোঁচট খেলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্র আজ সুসংহতি। ডা. মিলন যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংগ্রাম করতে করতে আত্মহুতি দিয়েছিলেন, অনেক হতাশার পর ১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৮ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তিন মেয়াদে দায়িত্বরত জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক সরকার তার অনেকটাই বাস্তবায়ন করেছে।

এই দিবসে প্রত্যাশা-বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার অচিরেই বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে নিয়োজিত চিকিৎসক কর্মকর্তার সঙ্গে অন্যান্য পেশা বা ক্যাডারের মধ্যে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করবে। কর্মস্থলে চিকিৎসকদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান প্রয়োজন ও চিকিৎসা অবকাঠামো নির্মাণসহ স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বৃদ্ধি প্রয়োজন। এ ছাড়া চিকিৎসকদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রবর্তন, স্বাস্থ্য বিমা গঠন সময়ের দাবি। গ্রামীণ জনপদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে উন্নত চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য ও সম্প্রসারিত হবে। মিলনের বিদেহী আত্মার শান্তিতে থাকুক এই কামনা নিরন্তর। একই সঙ্গে জোর দিয়ে বলতে চাই যে শহীদ ডা. মিলন দিবস বর্তমান প্রেক্ষাপটেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গণতন্ত্রকে ব্যাহত করতে দেশি-বিদেশি নানা তৎপরতার সঙ্গে রয়েছে অশুভ শক্তির অফতৎপরতা। যে কারণে দেশে গণতন্ত্র আজ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছে। একমাত্র সংবিধান অনুযায়ী যথাযথ সময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই রক্ষা পাবে গণতান্ত্রিক ধারা। আমাদের দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। এই হোক আজকের দিনে শহীদ ডা. মিলন দিবসে শপথ।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর

আপডেটেড ২৬ নভেম্বর, ২০২৩ ১৩:৪৫
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় লক্ষ করা যায়, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা লাভের অপেক্ষায় থেকে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চেয়ে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কে নিজেদের তরফে রোগ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সচেতনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার বিকল্প নেই। প্রিভেনশান ইজ বেটার দ্যান কিওর- প্রতিরোধ নিরাময়ের চেয়ে শ্রেয়।

আজ থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগে মশহুর মার্কিন আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসন (১৮৪৭-১৯৩১) যথার্থই বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতের চিকিৎসক রোগীকে ওষুধ না দিয়ে তাকে শেখাবেন শরীরের যত্ন নেয়া, সঠিক খাদ্য নির্বাচন, রোগের কারণ নির্ণয় ও তা প্রতিরোধের উপায়’। গ্রামে উচ্চশিক্ষিত এবং উপযুক্ত ট্রেনিংপ্রাপ্ত চিকিৎসক যখন সুদুর্লভ, শহরে ও গ্রামে প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসাব্যবস্থা ও সেবা কার্যক্রম যখন ব্যবসায়িক মন-মানসিকতার হাতে বন্দি, বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যের বেড়াজালে সাশ্রয়ী মূল্যে দেশীয় ওষুধ শিল্প উৎপাদন যখন তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন, চিকিৎসাসেবায় নীতি ও নৈতিকতা যখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, তখন আমাদের নিজে নিজের স্বাস্থ্য সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার শরণাপন্ন হওয়ার যৌক্তিকতা বেড়ে যায়। এডিসন যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা আজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলেও সুস্থ ও সুন্দর জীবন যাপনে শরীরের যত্ন, খাদ্য-অখাদ্য বিচার ও রোগ ঠেকানোর ব্যাপারে আমাদের আরও যথেষ্ট সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

সুস্থ ও সুন্দর জীবন বলতে আমরা প্রকৃতপক্ষে কী বুঝি? একজন মানুষ দৈহিকভাবে, মানসিকভাবে, সামাজিকভাবে এবং আত্মিকভাবে যদি ভালো থাকে বা ভালো বোধ করে, তাহলে তাকে পরিপূর্ণ সুস্থ বলা যেতে পারে। তার জীবনযাপন সুন্দর, অর্থবহ, উপভোগ্য, সৃজনশীল, কর্মউপযোগী হওয়ার জন্য তাকে ব্যক্তিগতভাবে উপরোক্ত চারভাবে বা প্রকারে সুস্থ হওয়ার বা থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেউ দৈহিক বা শারীরিকভাবে হয়তো সুঠাম, নিরোগ এবং সুস্থ কিন্তু তার মানসিক অবস্থা, তার পরার্থপরতা, নীতি-নৈতিকতা, ন্যায়নীতি-নির্ভরতা তথা সততার সঙ্গে সামাজিক অবস্থান বা সুনাম বিতর্কিত বা প্রশ্ন সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ালে এবং একই সঙ্গে তার আধ্যাত্মিক বা আত্মিক অবস্থা ভালো না হলে ওই ব্যক্তিকে পুরোপুরি সুস্থ বা তার জীবন সুন্দর বলা যাবে না। আবার আধ্যাত্মিকতায় উন্নত, সামাজিকভাবে সুপরিচিত কিংবা মানসিকভাবে শক্তিশালী, এমন সুস্থ-সবল ব্যক্তি যদি দৈহিক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ, অক্ষমতায় আপতিত হয়, তাহলে তাকেও সুস্থ বা স্বাস্থ্যবান বিবেচনা করা যাবে না। অর্থাৎ পরিপূর্ণভাবে পুরোপুরি সুস্থ ও সুন্দর জীবনের অধিকারী হতে হলে দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিকভাবে সব দিক দিয়ে সবল হতে হবে। বস্তুত সুস্থ ও সুন্দর জীবনের পূর্বশর্ত হলো দেহ, মন, সামাজিক সুনাম আর আত্মার উৎকর্ষতাই পরিপূর্ণ সুস্থতা। সে জীবন অর্জনের জন্য, সে জীবন যাপনের জন্য সাধনার প্রয়োজন। প্রয়োজন সুশৃঙ্খল জীবন যাপন।

সুস্থ ও সুন্দর জীবনের স্বার্থে এ চার পর্ব বা পর্যায়ের প্রতি মনোযোগী হওয়া দরকার। শারীরিক বা দৈহিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে শারীরিক সব অঙ্গের চলাচলের শক্তি বজায় থাকা এবং কোনো কাজ সম্পাদনে যেন বাধার সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। শরীর একটি মেশিনের মতো, একে কার্যকর রাখতে প্রয়োজন উপযুক্ত জ্বালানির, এর চলৎশক্তিকে সক্রিয় রাখতে শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যকার পরস্পর সহযোগিতার স্বাভাবিক কার্যকারিতা বেগবান রাখতে হবে। অর্থাৎ শরীরকে সচল রাখতে হবে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম (১৯১৭-১৯৮৯) প্রায়ই বলতেন, ‘গাড়িকে গতিশীল ও কার্যকর রাখতে বা পেতে এর নিয়মিত সার্ভিসিং দরকার। আমাদের বড় দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা গাড়ি খারাপ হলে তারপর গ্যারেজে নিয়ে আসি। নিয়মিত সার্ভিসিং হলে এক ধরনের বেকায়দা অবস্থায় মেরামতখানায় নেয়ার প্রয়োজন পড়ত না। আমাদের শরীরের অবস্থাও তাই। একে ঠিকমত যত্ন করতে হবে, নিয়মিত চেক আপে রাখতে হবে। শরীরকে রোগ বালাইয়ের হাত থেকে অর্থাৎ একে নিরোগ রাখতে সময় মতো এর পরিচর্যা প্রয়োজন।’ মানসিকভাবে সুস্থতার জন্য মনকেও সুরক্ষা দিতে হবে, মনকেও সক্রিয় ও সুস্থ রাখতে হবে, সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে, সবার সঙ্গে সহযোগিতা-সখ্যতা সমুন্নত রাখতে হবে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি সকৃতজ্ঞতায় তাঁর নির্দেশাবলি পালন ও অনুসরণের মাধ্যমে পরমাত্মার প্রতি একাত্ম হতে হবে। সবকিছুই একটি অন্যটির ওপর নির্ভরশীল, একটির অবর্তমানে অপরটি অচল।

উপযুক্ত ব্যায়াম ও খাদ্যাভ্যাস এবং প্রফুল্ল মনই হচ্ছে সুস্থ থাকার চাবিকাঠি। আসলে আমাদের জীবনে এত দুশ্চিন্তা, টানাপড়েন বা টেনশন থাকে যে, আমরা ইচ্ছে করলেও সব সময় হাসিখুশি থাকতে পারি না। অথচ কথায় আছে, ক্যানসার যত না কবর ভরেছে, তার চেয়ে বেশি ভরেছে টেনশনে। সুতরাং ভালোভাবে বাঁচতে চাইলে মনকে প্রফুল্ল রাখতে হবে। এ জন্য ভালো চিন্তা ও ভালো ভালো কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে নিজেকে জড়াতে হবে কোনো সৃজনশীল কাজের সঙ্গে। খাদ্যবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘আপনি যা খান আপনি তা-ই।’ আজকাল অনেক জটিল রোগ আমাদের পিছু নিয়েছে, তার একটা বড় কারণ হলো কৃত্রিম সার ও কীটনাশক ব্যবহারের এ যুগে খাদ্যের আদি বিশুদ্ধতা অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে। তার ওপরে রয়েছে নানা রকম প্রক্রিয়াজাত, ভেজাল মিশ্রিত ও রাসায়নিক উপায়ে সংরক্ষিত খাদ্য, যা কোনোভাবেই খাঁটি ও টাটকা খাবারের সমকক্ষ হতে পারে না। ফ্রিজে দীর্ঘদিন রাখা খাদ্যও ক্ষতিকর। সুস্থ জীবকোষের জন্য বিশুদ্ধ রক্ত দরকার, যা শুধু খাঁটি ও টাটকা খাবার থেকেই তৈরি হয়। এসব ভেজাল ও রসায়ন মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণ করার ফলে দেশে নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। নীতিনির্ধারক মহলে, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো খাবার, অপরিপক্ব খাদ্যকে অসময়ে পাকানোর ব্যবসায়িক দুষ্টবুদ্ধি দ্বারা প্রক্রিয়াজাত খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য দারুণ ক্ষতিকর। অজৈব সার ও রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় অধিক পরিমাণে হাইব্রিড খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে ঠিকই, বর্ধিত চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত সরবরাহ সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং স্বাভাবিকভাবে এ জন্য আর্থিকভাবে নমিনাল টার্মে লাভবান হচ্ছে জিডিপি, অর্থনীতি, কিন্তু এসব খাদ্য গ্রহণে যে জটিল রোগের উদ্ভব ঘটছে, ব্যক্তি ও সামষ্টিক জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার শুমার ও তুলনা করলে দেখা যাবে প্রকারান্তরে স্বাস্থ্য বাজেট ব্যয় বৃদ্ধির মাত্রা ও প্রবণতাই বেশি।

স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরেও বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখনো কল্যাণমুখী অবস্থা হিসেবে গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থার পেছনে নানা কারণ রয়েছে, যা দূর করতে সরকার সচেতন ও সক্রিয়, তবে জনগণেরও রয়েছে কমবেশি দায়িত্ব ও চেষ্টা-প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা।

আমরা সবাই জানি, চিন্তা থেকে কাজের উৎপত্তি। ইন্না মায়াল আমালু বিন নিয়্যাত। মানুষের চলাচলের ও কাজকর্মের প্রেরণা প্রথমে জাগে তার মনে, ভাবনায়। চেতনার আশ্রয় যে দেহ, সেই দেহ নিয়েই আমাদের মনোযোগ যেন সবল থাকে। ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন’- কথাটি যেন আমরা ভুলে না যাই। আমরা অনেকে অনেক অসুখে ভুগি। অসুখ জটিল হলে রোজগারি মানুষের রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের অন্য কেউ এ রকম অসুস্থ হলেও অনেকের পক্ষে ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালানো সম্ভব হয় না। সব মিলিয়ে একটি অনিশ্চিত ও অসহায় পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া বিচিত্র নয়। তবে এ পরিস্থিতি অনিবার্য নয়, যদি আমরা সঠিক নিয়মনির্ভর হই। যেহেতু প্রকৃতি হচ্ছে এমন নিয়মের রাজ্য, যেখানে রোগের সঙ্গে লড়াই করার জন্য প্রতিটি প্রাণীর দেহেই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে। সেহেতু এটিকে ঠিক রাখতে প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। অধিকাংশ অসুখই হচ্ছে কোনো না কোনোভাবে এ নিয়ম ভাঙার ফল। দেখা গেছে যে, হাজারো রোগের মূল কারণ স্থূলতাকে এড়াতে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ, যা মূলত তেল-চর্বি-চিনি-ময়দাযুক্ত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার বর্জন করে প্রকৃতিজাত সুষম খাবার গ্রহণ। কারণ ভেজালযুক্ত, বিষ মেশানো ও বাসি-পচা-নোংরা খাবারই আমাদের একমাত্র শত্রু নয়। ধূমপান ও অন্যান্য পন্থায় তামাকসহ সব মাদক সেবন পরিত্যাগ করা। বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম, প্রয়োজনীয় কায়িক পরিশ্রম প্রয়োজন। অ্যাকিউপ্রেশার এবং নানা রকম লোভ ও দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলার মতো মানসিক শক্তি অর্জনের জন্য মনোসংযোগ বা ধ্যান অভ্যাস করা। মনের গভীরে জমে ওঠা দুঃখের কথাগুলো সহানুভূতিশীল ও বিশ্বস্ত কাউকে বলতে পেরে নিরোগ থাকা যায়। কঠিন অসুখ হলেও চিকিৎসার পাশাপাশি এসব নিয়ম মেনে রোগের প্রকোপ কমানো সম্ভব। তাই আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্লোগান, সেই বহুল প্রচলিত কিন্তু উপেক্ষিত বাক্যটি: ‘প্রতিরোধ নিরাময়ের চেয়ে শ্রেয়’ আমাদের কাছে প্রাতঃস্মরণীয় হওয়া উচিত।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

বিষয়:

বিরোধী দলগুলোর উচিত নির্বাচনে ফেরা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এম এ মান্নান

কথায় বলে ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’। এ কথাটি আবারও সত্য বলে প্রমাণ করে দেখাল বিএনপি। অনেক দিন ধরে বিএনপি যে নর্তন-কুর্দন করে আসছিল, তাতে দেশবাসী মনে করেছিল ২৮ অক্টোবর দেশে নিশ্চয়ই বড় ধরনের কোনো একটি অঘটন ঘটে যাবে। সেই অঘটনে আওয়ামী লীগ সরকারের গদি নড়বড়ে হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের জায়গায়ই আছে, দেশও দেশের জায়গায় আছে। তবে বিএনপি ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ-আন্দোলনের নামে যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে, তা নিষ্ঠুরতম বর্বরতা ছাড়া আর কী-বা বলা যায়। যেমনটি তারা করেছিল ২০১৪ সালে। মেতে উঠেছিল অগ্নি-সন্ত্রাসের এক নিষ্ঠুরতম খেলায়। যে খেলায় পোড়ানো হয় যানবাহনকে, নির্মম নির‌্যাতন করা হয় সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয় পুলিশকে।

আওয়ামী লীগের নেতারা যখন বিএনপিকে অগ্নিসন্ত্রাসী বলে সমালোচনা করতেন বা এখনো করেন তখন মনে মনে কষ্ট পেতাম এই ভেবে যে, একটা দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা হয়ে কেমন করে আরেকটি দলকে বা দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকে এত কটাক্ষ করতে পারেন। কিন্তু এখন দেখি আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপি নেতাদের যে সমালোচনা করেন তা খুব বেশি নয়, বরং খুব কম।

২৮ অক্টোবর ছিল বিএনপির ‘এক দফা এক দাবি, সরকার তুই কবে যাবি’- এই ধরনের সমাবেশ বা চরম আন্দোলন। মানে সরকার পতনের এক দফা দাবি। দ্বিতীয় আর কোনো দফা নেই। এই আন্দোলনেই সরকার কুপোকাত। কিন্তু রাজনীতি যে ছেলে খেলা নয় বা মাথা গরম করার পার্টি নয়, তা বিএনপি ভুলে গেছে, নয়তো জানেই না। তাই তারা শুরুতেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

কথায় বলে আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। ২৮ অক্টোবর যেটা ঘটে গেল সেটা শুধু আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া হয়নি, আইনের লোককেই নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ সরকারের বাহিনী বলেই কি তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে। একটা পুলিশকে বিএনপির কর্মীরা যেভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে তা অতি নিষ্ঠুরতম, অতি বর্বরোচিত। এটা জাহেলিয়াতের যুগের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে।

পুলিশ তুমি কার- এ কথার সঠিক উত্তর তো বিএনপিরই ভালো করে জানা উচিত। কারণ, তারা যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা পুলিশকে রাজনীতির ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। আওয়ামী লীগ যদি এখন দেশের যানমালের নিরাপত্তায় বা জনগণের নিরাপত্তায় পুলিশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে তাহলে দোষটা কোথায়।

‘নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা’ একটি বহুল প্রচলিত কথা আছে। এবার ২৮ অক্টোবরে বিএনপি যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে তাতে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা ছাড়া আর কী-বা বলা যায়। দলনিরপেক্ষ সাধারণ লোক যারা, তারা এবার চেয়েছিলেন বিএনপি ক্ষমতায় আসুক। কিন্তু ২৮ অক্টোবরে তারা যেভাবে জ্বালাও-পোড়াও নামের অগ্নি-সন্ত্রাসে চলে গেল তাতে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি যে আস্থা খুঁজতে ছিল, তা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সাংবাদিককে পিটিয়ে হত্যা করা, পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা, যানবাহনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা, লোহার ফটক টপকে এবং পরে ভেঙে বিচারপতির বাসভবনে প্রবেশ করা এবং ক্ষতিসাধন করা- এসব কি রাজনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে? যদি না পড়ে তাহলে সাধারণ মানুষ কেন বিএনপির প্রতি আস্থা রাখবে। তাদের প্রতি সমর্থন করবে?

একটি কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ বিএনপির নিজেদের দোষে ব্যর্থ হয়ে যায়। চরম পর্যায়ের মারমুখী অবস্থান এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে পল্টন ময়দানে তারা যে রাজনীতির মঞ্চ তৈরি করেছিল তা পরিত্যক্ত হয়ে যায়। আর তখন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হ্যান্ডমাইক নিয়ে প্রথমে ৭২ ঘণ্টার হরতাল ঘোষণা করেন। সেই হরতালও অগ্নি-সন্ত্রাসের কর্মসূচি নামে পালিত হলো। এরপর থেকে তারা না-পালন হওয়া লাগাতার হরতাল-অবরোধের কর্মসূচির পথ বেছে নিয়েছে, যা এখনো চলমান। এই লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি তাদের দলের জন্য মঙ্গল বয়ে না এনে অমঙ্গল ডেকে আনছে। কারণ এই অবরোধ দেশের মানুষ মেনে নেয়নি। তারা এই অবরোধ প্রত্যাখ্যান করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাই সড়ক-মহাসড়কে অবাধে যান চলাচল করছে। কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে একটি সমস্যা হচ্ছে এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেটি হলো চোরাগোপ্তা হামলা। এই চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে বিএনপির নেতা-কর্মীরা অলিগলিতে লুকিয়ে থেকে হঠাৎ করে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আবার অলিগলিতে লুকিয়ে পড়ছে। ক্ষতিসাধন করছে যান ও মালের। আতঙ্কিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে যারা আছেন ‘তারা শ্যাম রাখি না কুল রাখি’- ধরনের মহাসংকটে পড়ে গেছেন। রাজনীতি ভালোভাবে করতেও পারছেন না, আবার হালও ছেড়ে দিতে পারছেন না। তাই লোকদেখানো রাজনীতির কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে বড় বড় নেতা অন্দরমহলে ঢুকে পড়ছেন। সেখানে তারা ঘরে বসে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন আর আতি-পাতি নেতারা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন, যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন, খাতায় নাম তুলছেন আগামী দিনের সন্ত্রাসী নেতা হবেন বলে।

বিএনপির নেতৃস্থানীয় যেসব নেতা আছেন তাদের মস্তিষ্ক যে অনুর্বর বা তারা যে মানসিক বৈকল্যে ভুগছেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। যদি তাই না হতো তাহলে ২৮ অক্টোবর জো বাইডেনের কথিত উপদেষ্টার আবির্ভাব ঘটে কেন এবং কীভাবে। এত বড় মিথ্যাচার কি দেশের মানুষ বিশ্বাস করবে। কোথায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আর কোথায় তার উপদেষ্টা বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত মাইদুল ইসলাম মিয়া। মিয়া সাহেবের তো এখন টানাটানি জান নিয়া। মাইদুল ইসলাম মিয়া যখন ফাঁদে আটকা পড়বেন বলে বুঝে গেছেন, তখন তিনি পগার পার হতে গিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকা পড়েন। অবশেষে তিনি পল্টন থানা হয়ে কারাগারে আছেন। একেই বলে ‘কীসের মধ্যে কী, পান্তাভাতে ঘি’। মাইদুল ইসলাম মিয়া আমেরিকার প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হলে তিনি বুঝি বাংলাদেশের কারাগারে আটকা থাকবেন আর আমেরিকার জো বাইডেন কর্তৃপক্ষ বসে বসে নেবনচুস-ললিপক খাবে। তার কোনো খোঁজখবর রাখবে না। আর তিনি জো বাইডেনের উপদেষ্টা হলে বুঝি বিএনপির সমাবেশে এসে যোগদান করবেন। বিএনপির নেতাদের এর চেয়ে ন্যক্কারজনক মিথ্যাচার আর কী হতে পারে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের সেই কবেকার পুরোনো ক্যাসেট বছরের পর বছর ধরে একটানা বাজিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যখন বারবার বলে আসছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মরে গেছে, তাকে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে, সে আর কখনো কবর থেকে ফিরে আসবে না। তখন তো আর তার অপেক্ষায় থেকে সময় নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কিন্তু বিএনপি সেই অবাস্তব আশায় বুক বেঁধে আছে, যদি কবর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার উঠে আসে। এ জন্যই তো ওবায়দুল কাদের বলে থাকেন, বিএনপি এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের খোয়াব দেখে চলেছে। যে খোয়াব সত্যি হওয়ার নয়।

২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর এবং বিএনপি দল হিসেবে ব্যর্থ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমরা এবার সেমিফাইনাল খেলায় জয়লাভ করেছি। এখন আমরা ফাইনাল খেলার জন্য প্রস্তুত। ২৮ অক্টোবরের খেলায় সত্যিকার অর্থে বিএনপির পরাজয় হয়েছে। আর গাড়ি পুড়িয়ে, সাংবাদিক হত্যা করে, পুলিশকে হত্যা করে, বিচারপতির বাড়ি ভাঙচুর করে তারা একের পর এক হলুদ কার্ড-লাল কার্ড খেয়ে মাঠ ছাড়া হয়েছে। গোল তো যা খাবার তারা শুরুতেই খেয়ে নিল।

এর আগের আন্দোলনে একবার ধুয়া তোলা হয়ছিল যে এখন থেকে খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে। ওটাও ছিল অনুর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত কথা। বছরের পর বছর নির্বাচন বয়কট করবেন, দুর্নীতির মামলার আসামি হয়ে জেলে থাকবেন আর রাষ্ট্র করে বেড়াবেন খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে তা তো হবার নয়। দেশ কার কথায় চলবে তার দায়িত্ব তো দেশের জনগণের। জনগণ যাদের ভোট দেবেন তারাই দেশ চালাবেন।

সবশেষে যেটা বলতে চাই, তা হলো বিএনপিকে রাজনীতি করতে হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত। সরকারের পদত্যাগ চেয়ে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন চেয়ে গো ধরে বসে থাকলে চলবে না। বিগত দিনগুলোতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় বিএনপির অনেক ক্ষতি হয়েছে এবং তারা অনেক পিছিয়ে গেছে। এবারও যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে তাদের দল অস্তিত্বসংকটে পড়বে, যা বিএনপির জন্য চরম পরিণতি।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক


বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের গতি-প্রকৃতি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মিহির কুমার রায়

গত ১ জুন নতুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য সামনে রেখে মহান জাতীয় সংসদে নতুন বছরের বাজেট পেশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী; যার আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে আর এডিপিসহ মোট উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা (যা মূল বাজেটের ৪২.৭৩%)। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় থাকা বিদেশি ঋণ (প্রকল্প সাহায্য) ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখনো খরচের খাতা খুলতে পারেনি ছয় মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। অন্যদিকে সরকারি উৎসের (জিওবি) বরাদ্দ থেকে খরচের খাতা খুলতে না পারা মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা তিনটি। সব মিলিয়ে গত চার মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গত আট অর্থবছরের একই সময়ের মধ্যে যা সবচেয়ে কম। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর চেয়ে কম হারে বাস্তবায়নের রেকর্ড রয়েছে। ওই অর্থবছরে বাস্তবায়নের হার ছিল ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ (উৎস: পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রতিবেদন )। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং গবেষকরা মনে করেন, সরকারের অর্থ সংকটের কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এই স্থবিরতা। প্রকল্পে সরকারের অর্থের জোগান দেয়া সম্ভব হয় না বলে প্রকল্প সাহায্যের বাস্তবায়নেও গতি কমেছে। কারণ ভূমি অধিগ্রহণের মতো কাজগুলো সরকারকে করে দিতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীরা ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়ে ঋণ দেবে না। সরকারের অর্থের টানের কারণে ভূমি অধিগ্রহণের মতো ব্যয়ে অর্থ জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার মৌসুমি একটা ব্যাপারও আছে। অবশ্য পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের মতো মেগা অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কারণে হাতে বড় ব্যয়ের প্রকল্প কম। নতুন মেগা প্রকল্পও নেয়া হচ্ছে না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের এই স্থবিরতার কারণে কর্মসংন্থান কাঙ্ক্ষিত হারে হবে না। অর্থের সরবরাহ কমবে। সার্বিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।

আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলমান অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে এডিপির আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের হার ছিল ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে ব্যয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৬৬ কোটি টাকা কম। গত চার মাসে ব্যয় হয়েছে ৩১ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ৩২ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। গত এক মাসের হিসাবেও গত অক্টোবরে এডিপি বাস্তবায়নের হার কমেছে। গত মাসে বাস্তবায়নের হার ৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবরে যা ছিল ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। সাধারণত প্রতি অর্থবছরেই আগের অর্থবছরের তুলনায় এডিপির আকার বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছর এডিপি বরাদ্দ গত অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। মোট আকার ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। ১ হাজার ৩৪০টি প্রকল্পের বিপরীতে এ বরাদ্দ রয়েছে। আইএমইডির প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত চার মাসে প্রকল্প সাহায্যের বাস্তবায়নের হার ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হার ছিল ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। গত চার মাসে বিদেশি ঋণের এই উৎস থেকে প্রকল্পগুলোতে ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১৩ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। গত চার মাসে প্রকল্প সাহায্যের এক টাকাও ব্যয় করতে না পারা ছয় মন্ত্রণালয় ও বিভাগ হচ্ছে– পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। এডিপিতে ব্যয়ে সরকারি উৎসের (জিওবি) অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, চার মাসে যে তিনটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এক টাকাও খরচ করতে পারেনি সেগুলো হচ্ছে– জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন। অন্যদিকে সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংস্থাগুলো তাদের নিজস্ব অর্থায়ন থেকে এক টাকাও খরচ করতে পারেনি। অথচ অতীতের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, নির্বাচনী বছরে এডিবির বরাদ্দ তুলনামূলক বেশি থাকে, যা চলতি বছরেও রয়েছে এবং ব্যয়ের দিক থেকেও প্রায় শতভাগের কাছাকাছি চলে যায় সত্যি, চলতি বছরে তার ব্যতিক্রম ঘটছে বলে প্রতীয়মান হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সরকার শুধু দাপ্তরিক রুটিন কাজ পরিচালনা করবে এবং সরকারি কর্মকর্তারা নির্বাচনী কাজে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে। তফসিল ঘোষণার পর আন্দোলন আরও জোরদারের চেষ্টা থাকবে। সরকার পক্ষ অবশ্য মনে করে, ততদিনে তাদের শক্তি-সামর্থ্য ফুরিয়ে যাবে। এ অনুমান যে একেবারে ভুল, তা মনে হয় না। ১৫-১৭ বছর টানা চাপে থাকা বিএনপির পক্ষে আর কত শক্তি প্রদর্শনই-বা সম্ভব! অন্যদিকে কেবল দক্ষ নজরদারির কারণেই পুরোনো ধাঁচের আন্দোলন রচনা এখন কঠিন। প্রশাসনও অদৃষ্টপূর্ব মাত্রায় অনুগত এবং আন্দোলন দমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ অবস্থায় বিএনপি ও তার মিত্ররা অবশ্য সাধ্যমতো বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে। ভোটের দিনও হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি থাকবে নিশ্চয়ই। তাতে জনমনে ভয়ভীতি থাকায়ও ভোট পড়বে সীমিত প্রত্যাশার চেয়েও কম। অবশ্য শোনা যাচ্ছে, এরই মধ্যে ভোটারদের উৎসাহিত করে, খাতির করে কেন্দ্রে নিয়ে আসার কিছু উদ্যোগ থাকবে। তাতে ক্ষেত্রবিশেষে ভোটের হার বাড়লেও জাতীয়ভাবে সেটা উৎসাহব্যঞ্জক কিছু হবে না। সত্যি বলতে, আইনশৃঙ্খলার বেশি অবনতি ঘটতে না দিয়ে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সেরে ফেলার দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবে সরকার। অগত্যা ইসিরও উদ্দেশ্য হবে এটাই। এ অবস্থায় দলীয় প্রতীক না দিয়ে ‘যে জিতে আসতে পারো আসো’ বলে কিছু আসন ছেড়ে দেয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। আরেকটি মেয়াদের জন্য সরকার গঠনটাই যদি লক্ষ্য হয়, তাতে কোনো ‘রোমান্টিসিজম’ না রাখাই সংগত বলে বিবেচিত হবে।

সে যাই হউক না কেন, দেশে একটি রাজনৈতিক সরকার এখনো ক্ষমতায় রয়েছে এবং অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, গত দেড় দশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও অবকাঠামোসহ সব ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে এবং তার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি টেকসই ভিত্তি স্থাপিত হছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে প্রধানমন্ত্রীর চিন্তাপ্রসূত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের উদ্যোগগুলো প্রশংসার দাবি রাখে সত্যি কিন্তু এর বাস্তবায়ন শতভাগ না করা গেলে কাঙ্ক্ষিত অর্জন সম্ভব নয়। তার জন্য সরকারের ধারাবাহিকতার প্রয়োজন রয়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন, যা নিয়ে ঘরে-বাইরে আলোচনা, সরগরম মাঠ-ময়দান। রাজনীতি বর্তমানে দেশের অঙ্গন ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিচরণ করছে, যা নিয়ে সমাজের মানুষের ভাবনার শেষ নেই। বাজারে মূল্যবৃদ্ধি রয়েছে, সমাজের মানুষের কষ্ট আছে, তবুও সরকারের মানবিক সুবিধাগুলো পেয়ে তার কিছুটা হলেও স্বস্তিতে রয়েছে। বাজেট আসবে বাজেট যাবে, সরকার আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এর মধ্যেই দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যারা বর্তমানে ক্ষমতায় রয়েছে তাদের বিগত ১৫ বছরের অধিক পথ পরিক্রমায় দেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে । কাজেই আগামীতে সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে আগামীতেও সরকার পরিচালনায় সহায়তা করি- এই প্রত্যাশা রইল।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা


শতবর্ষ পরও প্রাসঙ্গিক

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সুধীর সাহা

রবীন্দ্রনাথ ১৯২৩ সালে নাটকটির প্রথম খসড়া রচনা করেন। নামটি- ‘যক্ষপুরী’, ‘নন্দিনী’ এবং সবশেষে ‘রক্তকরবী’ হিসেবে পরিবর্তন করেন। নাটকটি প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। মানবাত্মার অপমানের প্রতিবাদের বিপ্লবী উদ্যোগ এটি রবীন্দ্রনাথের। লোভ-লালসার মরীচিকার পেছনে অবিরাম ছুটে চলা সমাজ থেকে হারিয়ে যায় মনুষ্যত্ব। খনি থেকে তাল তাল সোনা তুলে আনার সেই জীবনে থাকে না সোনার ঝিলিক। সেই ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথের নাটকে যা ছিল সামাজিক অসুস্থতার লক্ষণ, শতবর্ষ পর আজকের সমাজেও সেই অসুস্থতার লক্ষণই আছে। যক্ষপুরীর লোহার জালের আড়ালে যে অসুস্থ মানসিকতার শক্তি বাস করত সেদিন, সেই দরজা ভাঙার চেষ্টা করে যাচ্ছে নন্দিনীরা শতবর্ষ ধরেই; কিন্তু আজও সমাজে সেই কালো শক্তিরই দাপট। সেই সেদিনও রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, ধর্মশক্তির থাবায় লঙ্ঘিত হয়েছিল মানবাত্মা, আজও আমরা দেখি সেই মানবাত্মাহীন সমাজকেই। নাটকের সেই ফাগুলালের বক্তব্য ‘ওদের ভাঁড়ার, অস্ত্রশালা আর মন্দির একেবারে গায়ে গায়ে’ আজও প্রাসঙ্গিক। নন্দিনীকে নাম-গান শুনিয়ে গোসাইজি বেপথে নিতে চেয়েছিল আর নন্দিনী রাজনৈতিক ধর্মকে অস্বীকার করেছিল। গোসাই ক্ষেপে গিয়ে বলেছিল, দেবতার চেয়ে মানুষের ওপর তোমার বিশ্বাস বেশি? নন্দিনীর সেই উত্তরÑ ‘মানুষের প্রাণ ছিঁড়ে নিয়ে তাকে নাম দিয়ে ভুলানোর ব্যবসা তোমার।’ আজও নন্দিনীরা এমন উত্তর দেয়। ধর্মশক্তির বিচ্ছিন্ন মানসিকতা, ক্ষমতার লোভ, মানুষে-মানুষে বিভেদের মন্ত্রণা আজও আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। কী প্রাসঙ্গিক রক্তকরবীর বিশু পাগলার জীবন আজও। নন্দিনী বিশু পাগলাকে বলছে, ‘কেন তাকে বেঁধে নিয়ে গেল?’ বিশু বলে, ‘এতদিন পর আজ সত্য কথা বলেছিলুম।’

চিরদিনই সত্য, আজও সত্য ধনী ও উচ্চবিত্তদের যাপিত জীবনে স্বাধীনতা ও পরাধীনতার মধ্যে যতটা ফারাক থাকে, তার থেকে অনেক বেশি ফারাক থাকে মধ্য ও নিম্নবিত্তদের এবং দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জীবনে। গত শতাব্দীর চার দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝাপটায় দুনিয়াজুড়ে যে দুর্ভিক্ষের আবহ তৈরি হয়েছিল, ২০১৯-২২ এর করোনাকালেও সেই পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল। ধনীরা আরও ধনী হয়েছে এবং এক শ্রেণির নব্যধনীর জন্ম হয়েছে। ১৯৪২-এর ৮ আগস্ট। মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভায় বিপুল ভোটে পাস হয় গান্ধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আগামীকাল (৯ আগস্ট) থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হবে এবং ইংরেজ ভারত না ছাড়া পর্যন্ত তা চলবে। ভারত স্বাধীন করব অথবা মৃত্যুবরণ করব।’ ব্রিটিশ ভারত ছেড়েছে ৭৬ বছর আগে। ১৯৭১ সালে আর একবার বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৭১ সালে মুক্তিও মিলেছিল বাংলাদেশের পাকিস্তানের হাত থেকে; কিন্তু সেই ভারত কিংবা বাংলাদেশকে ছাড়েনি দুর্নীতি এবং বৈষম্য। গণতন্ত্রের নামে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও অর্থায়নকে। ধ্বংস করা হয়েছে মানবাত্মার অস্তিত্ব। পদে পদে দলিত হয়েছে বহুত্বের ধারণা। সৌন্দর্য হারিয়েছে তার চারদিক ঝলমল করা আলো। তাইতো কোথাও সৌন্দর্যায়ন হবে শুনলেই আজকাল বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে। মনে ভয় জাগে, অর্থের নয়-ছয়েই তার শেষ নয়, নিশ্চিত অতি কুৎসিত কিছু একটা খাড়া করা হবে। তারও ততোধিক অপ্রয়োজনীয় ‘উন্মোচন’-এ কোনো প্রসন্ন ক্ষমতাবান গোলাপি-সোনালি ফিতা কেটে জিজ্ঞেস করবেন, ‘সুন্দর হয়েছে তো?’ স্তাবকরা মাথা নাড়বেন ‘অপূর্ব’। এমন কুদর্শন শুধু এখানেই থেমে থাকে না, প্রচার তোড়ণ, পোস্টার-ব্যানার, অনুষ্ঠান স্মারক, উৎসবমঞ্চ, আমন্ত্রণ পত্র, রাজনৈতিক দেয়াল লিখন, পাড়ায় পাড়ায় রাস্তার মোড়ে কদর্য ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক পতাকাধারী নব্যনেতা প্রমুখের ভেতর কুৎসিতের চলছে মহাযজ্ঞ। রবীন্দ্রনাথ সেখানেও সেই কবেই বলে গিয়েছিলেন ‘আমাতে তোমার আনন্দ হোক, তুমি স্বত আমাকে গ্রহণ করো।’ সুন্দর আমাদের আনন্দ দেয় আর সেই আনন্দ বিশ্ব জগতের মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলে; কিন্তু সেই সৌন্দর্য আজ কোথায়?

সেলুলয়েডের পর্দায় ভারত সম্রাট আকবরের সামনে ঠিকই আনারকলি গাইছেন, ‘পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া’। আমাদেরও যে সেই একই অবস্থা! বান্দাদের এত দাপট যে, মানুষ তাতে হারিয়ে যাচ্ছে। আরেক দল সুবিধাভোগী স্তাবকরা নেতার প্রশংসায় বলছে, ‘উনি যদি মনে করতেন ক্ষমতায় গিয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠব, এত এত টাকা কামাবো তা তো উনি করেননি ...।’ যেন প্রতিনিধি হলেই এমনটা করা যায়, এটাই স্বাভাবিক। ভারত ভাগের আগে লর্ড কার্জন ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ঢাকায় এসে মুসলমানদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনাদের একজোট’ হওয়ার সময় এসেছে। ততদিনে ছক কষে ফেলেছিলেন তিনি। বিপ্লবীদের সংখ্যা যে হারে বাংলায় বাড়ছিল, একে দু’ভাগ না করলে সামাল দেয়া মুশকিল হবে। ১৯০৫ সাল। সেটা ছিল শুরু। কার্জন বুঝেছিলেন, ডিভাইড অ্যান্ড রুল। এটাই ফর্মুলা। ভেঙে দাও বাংলাকে। হিন্দু-মুসলিম দু’পক্ষকেই দেখিয়ে দাওÑ এক বলে কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথও বুঝেছিলেন। তাই তিনি লিখেছিলেন- ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল/বাংলার বায়ু, বাংলার ফল/পুণ্য হোক পুণ্য হোক হে ভগবান।’ তিনি বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাংলার প্রত্যেক মানুষকে এক হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। ‘বাঙালির পণ, বাঙালির আশা/বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা/সত্য হোক...।’ আজও বাঙালির ঐক্যের পথে সেই রবীন্দ্রনাথেরই গান আমাদের সাহস জোগায়, শান্তি জোগায়।

সেদিনও ছিল যা, আজও আছে তা। কম জানা, না জানা লোকের অভাব নেই। আর তারাই বেশি মাত্রায় দেশ ও জাতির নানা বিষয় নিয়ে মন্তব্য করে থাকে। ছিন্ন বসন, মলিন অঙ্গ, ম্লান মুখ সন্তানদের নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় নারীর ছবিটি তাদের চোখে পড়ে না। ওই ছিন্নমূল নারীর অভুক্ত দৃষ্টি যেদিকে স্থির, সেখানেই থরে থরে সাজানো থাকে বস্তাবন্দি খাদ্যশস্য বিপণনের আশায়। তাই আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠলেও, সেই চাঁদে চড়কা-কাটা বুড়িকে দেখেও কবিতা আসে না ক্ষুধার্ত মানুষের; তখনও আসেনি, আজও আসে না।

লেখক: কলামিস্ট


আটাশতম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন: বাস্তবতা সম্বন্ধে কিছু কথা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

২৮তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৮) আগামী (অর্থাৎ ২০২৩-এর) ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। এবার দুবাইতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবারের মতো সব দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করবেন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যে নানা দিক আছে, সেগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও দেনদরবার করবেন। কিছু বিষয় অধিকতর পরিষ্কার করা হবে এবং কিছু ক্ষেত্রে মতৈক্যও হয়তো হবে। আগে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন কতটুকু হলো বা নাহলো তাও মূল্যায়ন করা হবে। এই সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিভিন্ন আঙ্গিকে (গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ, অভিযোজন, অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, সক্ষমতা বৃদ্ধি, ক্ষয়ক্ষতি ইত্যাদি) বর্তমান বাস্তবতা অর্থাৎ এ পর্যন্ত কোন ক্ষেত্রে কী করা হয়েছে ও কতটা অগ্রগতি হয়েছে বা হয়নি এবং বিভিন্ন দেশ ও দেশগোষ্ঠী তাদের অঙ্গীকারগুলো কতটা বাস্তবায়ন করেছে আর কাজগুলো তারা কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে করেছে, এসবের একটি মূল্যায়ন বিবেচনা করা। মূল্যায়িত বাস্তবতায় আগামী সময়ে কী করতে হবে, তা আলোচনা করা হবে। কোন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে; আবার কোন কোন বিষয়ে হবে না, পরবর্তী কপ-এ আলোচনার জন্য বা অন্য কোন প্রক্রিয়ায় বিষয়টি বিচার-বিশ্লেষণ করে পরবর্তী কোনো কপ-এ বিবেচনার জন্য রেখে দেয়া হবে। সিদ্ধান্ত হলেও অনেক সময় বাস্তবায়িত হয় না বা খণ্ডিতভাবে হয়, যেমন- ২০০৯ সাল থেকে ঐকমত্য ছিল যে, উন্নত বিশ্ব উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ২০২০ সাল থেকে জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেবে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে বছরে এখন মাত্র ২০-২২ বিলিয়ন ডলারের মতো দিচ্ছে যদিও দাবি করা হচ্ছে যে, তারা বছরে ৮০ বিলিয়ন বা ততধিক ডলার দিচ্ছেন। এভাবেই চলে আসছে এবং আগামী সময়ে হয়তো এভাবেই চলতে থাকবে। আর জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুত খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে।

একদিকে আমরা আলোচনা করেই যাচ্ছি, প্রতিবেদনও বের হচ্ছে- শুধু প্রতিবছর কপ-এই নয় আলোচনা ও দেনদরবার হচ্ছে জাতিসংঘে, আঞ্চলিকভাবে, বিভিন্ন দেশে এবং দেশে দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এগুলোর ওপর ভিত্তি করে অসংখ্য রিপোর্টও বের হচ্ছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর উষ্ণায়ন জুলাই ২০২৩-এ যতদিন থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে তার মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। ইউরোপে ২০২৩ গ্রীষ্মকাল একইভাবে উষ্ণতম ছিল।

উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে। অর্থাৎ ক্রমবর্ধমান হারে বরফ গলছে, সমুদ্রপীঠ স্ফীত হচ্ছে এবং পৃথিবীর সর্বত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে চলেছে। প্রকৃতির দুর্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণিঝড়, আনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি,

বন্যা, খরা, দাবানল, নদীভাঙন, জলবায়ু উদ্বাস্তু সৃষ্টি। প্রত্যকটির প্রকোপ বেড়েই চলেছে, সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতি সাধন উভয় দিক থেকে পৃথিবীর সর্বত্র।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করছি যে, ঘূর্ণিঝড় এ বছরেই তিনটি হয়ে গেল, আগে কয়েক বছর পরপর ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতো। এ বছরের ঘূর্ণিঝড়গুলো তেমন শক্তিশালী না হলেও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। একটি ঘূর্ণিঝড়ের অভিঘাত থেকে উত্তরণের আগেই আরেকটা হয়ে যাচ্ছে। জলোচ্ছ্বাস ঘন ঘন ঘটছে এবং ফলে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ব্যাপকভাবে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ঘটছে। নদীভাঙন দ্রুত বাড়ছে। উদ্বাস্তু হচ্ছে অসংখ্য মানুষ।

জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ, যার বায়ুমণ্ডলে পুঞ্জীভূত হওয়ার পরিমাণ বর্তমানে দুই মিলিয়ন বছরে সর্বোচ্চ এবং নিঃসরণ বেড়েই চলেছে। কাজেই অবস্থা যে আরও খারাপের দিকে যাবে তা অবধারিত। ২০১৫ সালে গৃহীত প্যারিস চুক্তিতে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় যে, এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ প্রথম শিল্পবিপ্লব-পূর্ব সময়ের তুলনায় পৃথিবীর উষ্ণায়ন বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা হবে। এ লক্ষ্য এখন অবাস্তব আশাবাদ। ইতোমধ্যে পৃথিবী ১ দশমিক ১ ডিগ্রি উষ্ণতর হয়ে গেছে, কোনো কোনো তথ্যে দেখা যায় উষ্ণায়ন ১ দশমিক ৪ ডিগ্রিতে পৌঁছে গেছে অতিসম্প্রতি। ধারণা করা হচ্ছে পৃথিবীর সব দেশ যতটা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাবে বলে প্রস্তাব করেছে, তা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলেও পৃথিবী এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি বা ততধিক উষ্ণতর হবে।

বিজ্ঞানভিত্তিক দিকনির্দেশনা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে যদি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ২০১৯ সালের তুলনায় ৪৩ শতাংশ কমানো না যায়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ হয়ে পড়বে। আর এভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত খারাপ হতে থাকলে, কতদিন বাংলাদেশের মতো একটি দেশ অভিযোজন করে যেতে পারবে? অবস্থা খারাপ হতে থাকবে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে এবং মানুষের দুর্ভোগ বাড়তে থাকবে। কাজেই আসন্ন কপ-এ সর্বাধিক গুরুত্বপ্রাপ্ত দাবি হবে বিজ্ঞানভিত্তিক তাগিদ অনুযায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা, যাতে মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে বর্তমান উন্নত বিশ্বকে, অবশ্য অন্য সব দেশকেও দায় ও সক্ষমতা অনুসারে এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে হবে। বাংলাদেশকে এ বিষয়ে খুবই সোচ্চার হতে হবে।

অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অভিযোজন এবং অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন এবং অন্যান্য উপকরণ (প্রযুক্তি, সক্ষমতা)। প্রকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে তাই অভিযোজনের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত ও গভীর হচ্ছে। ফলে অভিযোজনের জন্য অর্থের প্রয়োজন বাড়ছে। অর্থের ক্ষেত্রে শুধু পরিমাণ বাড়ানো নয়, ছাড়করণ প্রক্রিয়াও সহজতর করতে হবে। সবুজ অর্থায়ন তহবিল (গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড) একটি প্রকল্প মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যন্ত ৪-৫ বছর পর্যন্ত সময় লাগায়। ইতোমধ্যে বাস্তবতা অনেক পরিবর্তিত হয়ে যায়- সাধারণত অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত প্রকল্প গৃহীত হলেও এর উপযুক্ততা সীমাবদ্ধতায় পড়তে পারে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশকে সোচ্চার হতে হবে।

এই জলবায়ু বিশ্ব সম্মেলনের উৎপত্তি ১৯৯২ সালে। ওই সালে ব্রাজিলের রিয়োতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ আয়োজিত ধরিত্রী সম্মেলনে ইউএনএফসিসিসি (ইউনাইটেড ন্যাশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ)) গৃহীত হয়। এই কনভেনশনের আওতায় জলবায়ু বিশ্ব সম্মেলন বা কপ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ) প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৫ সালে।

এরপর ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে (করোনার কারণে ২০০০ সাল ছাড়া), বিভিন্ন দেশে। ইউএনএফসিসিসির মূল দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছিল গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা বা প্রশমন। এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক দিন ধরে প্রতিবছর কপ-এ, ২০০৬ সাল পর্যন্ত। তারপর ২০০৭ সালে ১৩তম কপ-এ যুক্ত হয়েছে অভিযোজন, জলবায়ু অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রশমনের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করার জন্য উন্নত বিশ্ব থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থ প্রদান, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ব্যবস্থা গ্রহণ আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

কিন্তু যখন কপ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে তখন জলবায়ু পরিবর্তনের যে পরিস্থিতি ছিল অর্থাৎ পৃথিবীর উষ্ণায়ন এবং ফলে প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ যেমন ছিল, তা থেকে বর্তমান বাস্তবতা অনেক খারাপ।

বাংলাদেশ জলবায়ু ব্যবস্থাপনায় বছরে ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বার্ষিক বাজেট থেকে খরচ করে সাম্প্রতিক সময়ে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে বছরে এক বিলিয়ন ডলারের মতো পায়। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনেক গুণ বেশি অর্থের প্রয়োজন, যে পরিমাণ অর্থ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এমতাবস্থায় নিজেদের সম্পদ এবং যা বাইরে থেকে পাওয়া যায়, তাই দিয়ে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে মানুষকে বাঁচানো এবং তাদের সংকট মোচনের জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। পাশাপাশি অর্থায়ন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির জন্য কপ এবং সংশ্লিষ্ট সব ফোরামে আরও সোচ্চার হতে হবে। প্রযুক্তি হস্তান্তর, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে পুনর্জাগরণে সহযোগিতা এবং অন্যান্য বিষয়েও আলোচনা ও দেনদরবার অব্যাহত রাখতে হবে, জোরদার করতে হবে।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ


বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক অর্জনের প্রত্যাশা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোতাহার হোসেন

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশে অতিমাত্রায় গরম, অতিবৃষ্টি, বিলম্বিত-প্রলম্বিত বৃষ্টি, শীত প্রভৃতির কারণও এ জন্য দায়ী। এমনি অবস্থায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে আসন্ন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৮) বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বাস্তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি বা ঝুঁকি নিরসনে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রত্যক্ষ হয়নি বিগত কপগুলোতে। বরং এ নিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ভূমিকায় হতাশ বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। অথচ উন্নত বিশ্ব অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে জলবায়ু ঝুঁকি তৈরি করলেও ঝুঁকি নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। বরং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, ক্ষতি নিরসনে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রতিশ্রুতিও মিথ্যা ফানুসে পরিণত হচ্ছে। প্রায় প্রতিবছর জাতিসংঘের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস’ (কপ)-এ বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর সরকারপ্রধানরা এসে কার্বন নিঃসরণ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণে প্রয়োজনীয় অর্থ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। অন্যান্যবারের মতো এবারও সংযুক্ত আবর আমিরাতের দুবাইতে আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত কপ-২৮ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

এমনি অবস্থায় প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১.৫ ডিগ্রিতে সম্ভব হলে তাপমাত্রা ১.৪ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ রাখা এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজের জন্য পৃথক তহবিল গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারকে জোরালো অবস্থান নেয়ার দাবি অধিকারভিত্তিক নাগরিক সমাজের। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তাঁরা এ দাবি জানান। কপ-২৮ জলবায়ু সম্মেলন: সরকার ও নাগরিক সমাজের অভিমত শীর্ষক সেমিনার যৌথভাবে আয়োজন করে ৩১টি সংগঠন ।

সেমিনারে বলা হয়, এই সম্মেলনে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি সংগ্রহ ও যাচাই করা হবে, আর এতে সেই চুক্তির অনেক লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ব্যর্থতার চিত্র উঠে আসবে। বৈশ্বিক উষ্ণতার লক্ষ্যমাত্র ১.৫-এর ভেতর রাখা এবং জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ধনী দেশগুলোর সমালোচনা করা হয় সেমিনারে। লস অ্যান্ড ড্যামেজের বিষয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সমালোচনা করা হয়। জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ দলের কাছে সম্মেলনে কয়েক বিষয়ে কিছু সুপারিশ করেন। তা হলো: ১. কার্বন উদ্‌গীরণকারী বড় দেশগুলোকে ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য উদ্‌গীরনের লক্ষ্য নিয়ে তাদের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে, ২. একটি স্বতন্ত্র লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল গঠন করা, ৩. জলবায়ু অর্থায়নের একটি নতুন ব্যবস্থা যা হবে অনুদাননির্ভর, ঋণনির্ভর নয় এবং অতি বিপদাপন্ন দেশগুলোকে রক্ষায় বিশেষ সহায়তা দিতে হবে।

সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষ দূত সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ইউএনএফসিসিসির বর্তমান প্রক্রিয়ার বেশ কয়েকটি ঘাটতির কথা উল্লেখ করে বলেন, কোথাও কোনো বিষয়ে কোনো একটি দেশ সম্মতি না দিলে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। এ প্রক্রিয়া সংস্কারের সুপারিশ তার। কারণ বিদ্যমান পরিস্থিতি বিশ্বকে একটি গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং অর্জিত সাফল্য হ্রাস করছে। তিনি বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রিতে রাখার লক্ষ্য পূরণের সাম্প্রতিক অবস্থার ওপর বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তথ্য সংগ্রহ খুব জরুরি। সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনাকে বিশাল লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে সীমিত অর্জন সমৃদ্ধ একটি ডুবন্ত জাহাজ হিসেবে উল্লেখ করেন। এর মূল কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এই সম্মেলনে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতে খুব দায়সারাভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা সবাই গ্রহণ করবে।

মনে রাখা উচিত কার্বন নির্গমন হ্রাসকে সামনে রেখেই আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক বিকল্পগুলোর ওপর ভিত্তি করে জাতীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু তহবিলের নামে অনেক ঋণ আসছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ঋণের ফাঁদ তৈরি করছে। এমনি অস্থায় জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে কার্বন নির্গমনকারী বড় দেশগুলোর বিরুদ্ধে জলবায়ু-কূটনৈতিক লড়াইয়ের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে জন্য একটি কাঠামোগত আইনি ব্যবস্থা দরকার। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বকে বাঁচাতে এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে ২০২৫ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক শক্তিতে বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে। সম্প্রতি রাজধানীতে আয়োজিত জলবায়ুবিষয়ক আসন্ন বৈশ্বিক সম্মেলন কনফারেন্স অব পার্টিস ২৮-তে বাংলাদেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশ দুদিনব্যাপী মাল্টিস্টেকহোল্ডার কপ-২৮ প্রস্তুতি কর্মশালার আয়োজন করে। সেখানেও নানা সুপারিশ উঠে আসে। তাতে বলা হয়, ‘ফসিল ফুয়েল ফেজ আউট করে পৃথিবীর বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাতিল করতে হবে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক শক্তিতে বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে। এ নিয়ে যদি ঐকমত্য হতে পারে তাহলে আমাদের জলবায়ু অভিযোজনের ওপর বিশাল প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৈশ্বিক তাপমাত্রাতে জলবায়ুজনিত কী প্রভাব পড়ছে, তা ভাবতে হবে। প্রতিবছরই আমাদের অভিযোজন খরচ বাড়ছে। গত বছর ৩.৪ মিলিয়ন ডলার নিজেদের থেকে দেয়া হচ্ছে। এবং এই খরচ প্রতি বছর বাড়ছে। এ ছাড়া জলবায়ু তহবিলে ১০০ বিলিয়ন ডলারের কথা বলা হয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশসহ অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো পাবে। কিন্তু এই সংখ্যাটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, এটাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে নির্ধারণ করা জরুরি।’

জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য বিদ্যমান যে বরাদ্দ রয়েছে, বাংলাদেশের তা অপেক্ষা অনেক বেশি অর্থায়ন প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। অবশ্য উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে জীবন ও জীবিকার সুরক্ষার লক্ষ্যে এবং এই কাঠামো প্রণয়ন করা ও একে কার্যোপযোগী করার ক্ষেত্রে জলবায়ু সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় বিদ্যমান বিভিন্ন সম্পদ কাজে লাগানোর পাশাপাশি আরও ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে সরকারকে সহায়তার জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে কর্মশালায় চারটি সেশনে কার্বন ট্যাক্স, জলবায়ু অর্থনীতি; জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন; বৈশ্বিক স্টকটেকিং; জীবাশ্ম জ্বালানি যুগ বাতিল করা, বিকল্প ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা (জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন), চ্যালেঞ্জ ও করণীয় বিষয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি কপ-২৮-এ কীভাবে সিভিল সোসাইটি সরকারের সহায়ক হিসেবে এ প্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে পারে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া দরকার।

আসন্ন কপ-২৮-এ বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, প্যারিস এগ্রিমেন্টে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের রূপরেখা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের কার্যক্রমকে বেগবান করার লক্ষ্যে আসন্ন কপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় নেয়া ৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিষ্পত্তিতে আমাদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথম গ্লোবাল স্টকটেক অবশ্যই ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কার্যক্রমের অগ্রগতি মূল্যায়ন, ভবিষ্যৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং কংক্রিট মাইলফলকসহ সুস্পষ্ট পদক্ষেপ প্রদানের পাশাপাশি অধিক বিপদাপন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ এড্রেস করার লক্ষ্যে কপ-২৮-এ ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড অপারেশনালাইজ করা’ এবং এর ‘ডিটেইল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ ঠিক করার ওপর জোর দেবে বাংলাদেশ। অভিযোজন সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্য ‘গ্লোবাল গোল অন এডাপটেশন’-এর কাঠামো ঠিক করা এবং ২০২৫ পরবর্তী সময়ে জলবায়ু অর্থায়নের জন্য ‘নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফাইড গোল অন ক্লাইমেট ফাইন্যান্স’ আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনের প্রত্যাশা তার।

অবশ্য প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী প্রতিশ্রুত অর্থ ও প্রযুক্তি সহায়তা জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে দেয়ার দৃশ্যমান অগ্রগতি প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। এই পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের সফলতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। একইভাবে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ নেগোসিয়েশন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা জরুরি। পাশাপাশি জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রাপ্ত অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং এ জন্য প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

ঢাকায় ইতোমধ্যে সরকারি ও এনজিও সংস্থাগুলোর উদ্যোগে আসন্ন কপ নিয়ে বাংলাদেশের করণীয় এবং বৈশ্বিক ফ্ল্যাটফরমে কী ভূমিকা হওয়া উচিত, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অনেক কিছু পাস কাটানো হয়। ঠিক এবারও হয়তো এর ব্যতিক্রম হবে না। বাংলাদেশ সর্বাধিক জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে কীভাবে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করবে, অর্থের জোগান কে দেবে, পরিবেশ ক্ষতির জন্য বেশি দায়ী দেশগুলোর করণীয় কী, এর স্পষ্ট দিকনির্দেশনা ঠিক করা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কার্যক্রমে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা, সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য টেকসই, সবুজ ও প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান অর্জনে জ্ঞান, গবেষণা, সক্ষমতা তৈরি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর বাড়ানোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে আসন্ন কপে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ইতিবাচক অর্জন বয়ে আনবে।

লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।


একমাত্র শক্তির উৎস এ দেশের গণতন্ত্রমনস্ক জনগণ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

একটা মানুষ তার নিজ দেশের জনগণের কল্যাণে কতটা উৎসর্গ করতে পারে তার একমাত্র দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এ দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি এতটাই দায়িত্বশীল যে এ দেশের মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছে নিজের পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে। নিজের জীবনেও অনেক ঝুঁকি নিয়েছেন। সেই সঙ্গে নিজের জীবনকে মৃত্যুর হাতে সঁপে দিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন এ দেশের দরিদ্র ও অসহায় জনগোষ্ঠীসহ সব শ্রেণির মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে। বিএনপি-জামায়াত জোটের অধীনে তাদের কুশাসনে পদদলিত বাঙালি জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে গত প্রায় ১৫ বছরে কঠোর পরিশ্রম করে বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে উন্নয়নের রুল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণ, এ দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বার্থে দীর্ঘ ১৫ বছর একটানা কাজ করে সাধারণ মানুষের ভরসাস্থল হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপি তাদের জ্বালাও-পোড়াও এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে যেখানে জনবিচ্ছিন্ন একটি দলে পরিণত হয়েছে সেখানে আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের স্বার্থে কাজ করে এ দেশের অসহায় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভরসাস্থল হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন। শেখ হাসিনার সততা, নিষ্ঠা, দৃঢ় মনোবল, প্রজ্ঞা ও অসাধারণ নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে অন্যরকম উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং তিনি অর্জন করেছেন এ দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থন ও সহায়তা, যা বিএনপির মতো বিশ্বে পরিচিত সন্ত্রাসী সংগঠনের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে শেখ হাসিনা বিএনপি-জামায়াতের আক্রোশের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিচালনায় আছে বলেই এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত-স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে কাজ করছে। এ জন্য প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০৪১ প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে পেরেছে। দেশ আজ খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০২২ সালে দেশে ৪ কোটি ৪ লাখ টন চালসহ ৪ কোটি ৭২ লাখ টন দানাদার শস্য উৎপাদিত হয়েছে। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, সবজি, ফলসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। মাথাপিছু আয় ৫৪৩ ডলার থেকে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। সাক্ষরতার হার ৪৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭৫ দশমিক ২ ভাগ। মাতৃমৃত্যু এবং শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিচালনায় আছে বলেই এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের এত এত উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ঈর্ষান্বিত সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপি বাংলাদেশের এতসব উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে ব্যাহত করে পিছনের দরজা দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতায় যেতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মতো অপরাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশের অসহায় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একমাত্র ভরসাস্থল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে চিরতরে শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি।

শুধু ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলাই নয়, বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন কায়দায় প্রায় ২১ বার হামলা হয়েছে। কখনো নিজ বাসভবনে, কখনো জনসভায়, আবার কখনো তার গাড়ির বহরে। বর্তমান বিশ্বের কোনো দেশের রাষ্ট্রনায়ককে এতবার হত্যা চেষ্টার নজির নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিদেশে থাকার কারণে বোন শেখ রেহানাসহ বেঁচে গেলেও দেশে ফেরার পর থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে বারবার। আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ১৯৮১ সালের মে মাসে দেশে ফেরার পর থেকেই তার ওপর একের পর এক হামলা হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে এতবার হামলা করেও শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন নতুন করে বিদেশের মাটিতে হত্যা করতে বিভিন্নভাবে অপপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি তথা সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপির মূল সন্ত্রাসী তারেক জিয়া। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যাকে বারবার হত্যার চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। একাত্তরের পরাজিত শক্তি, পঁচাত্তরের ঘাতক ও দেশি-বিদেশি মৌলবাদী গোষ্ঠী তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। আর এভাবে পরাজিত শক্তি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে মুছে দিতে চাইছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসীন হয়ে পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন, যাতে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাকেই বারবার হত্যার চেষ্টা নেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত। শেখ হাসিনাকে হত্যা করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র থেকেই শেখ হাসিনার ওপর দেশের ভিতরে ও দেশের বাইরে বারবার হামলা করা হচ্ছে। তাদের লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের ধারাকে পদানত করা ও শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে না পারলে এ ধারাকে পদানত করা সম্ভব নয়। সবাইকে তারা কিনতে পারছে বা পারবে হয়তো, কিন্তু শেখ হাসিনাকে নয়, এ জন্যই তাকে হত্যা করতে হবে। শেখ হাসিনা ফিনিক্সের মতো। ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ার পরও আবার স্বমূর্তিতে জেগে উঠেছেন। শেখ হাসিনার স্বমূর্তিতে জেগে ওঠার মূল শক্তি এ দেশের জনগণ ও তাদের ভালোবাসা। জনগণের সমর্থন সব সময় ছিল এবং আছে বলেই তাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা সত্ত্বেও দমিয়ে রাখা যায়নি।

বিশ্ব নেতারা যখন শেখ হাসিনার যুগান্তকারী নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করছেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন, তখনই বিএনপি ও তার দোসর রাজনৈতিক দলগুলোর গাত্রদাহ হয়ে উঠেছেন সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী ও দৃঢ়চেতা নেতা শেখ হাসিনা। তাই তারা বারবার নতুন করে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাজনীতিতে পরাস্ত হয়ে, দেশে-বিদেশে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রলাপ বকছে বিএনপি দলটির অধিকাংশ নেতা-কর্মী। কখনো ২৭ দফা, কখনো ১০ দফা আর কখনো ১ দফার নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত রয়েছে। এসব দফা অবৈধ, অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দেশকে আবার জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করার অপকৌশল মাত্র। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে দেশের মানুষকে অন্ধকারের জিঞ্জির পরানো হবে যার চূড়ান্ত পরিণতি। শুধু দেশেই নয়- সমগ্র বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যার অদম্য চেষ্টা, সেই শেখ হাসিনাকেই বারবার ষড়যন্ত্রকারীরা টার্গেট করছে এবং বিভিন্নভাবে দেশে ও বিদেশে হত্যার অপপ্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

বাবা-মা-ভাই এবং আত্মীয়স্বজন এসব কিছু হারিয়ে পরিবার বলতে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বুঝেছিল এই বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণকে। সেই মানসিকতা নিয়ে এবং সেই আন্তরিকতা নিয়েই তিনি দেশের জন্য তথা দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এ দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে বারবার শেখ হাসিনার ওপর আঘাত এসেছে। সব ধরনের আঘাত সহ্য করে নিজ দেশের এবং দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখনো বারবার হামলা হচ্ছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও তাকে হত্যার অপপ্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে সন্ত্রাসী তারেক জিয়ার নেতৃত্বে।

বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা এখন শুধু বাংলাদেশের নয় বরং সারা বিশ্বের একজন শক্তিশালী ও সুপরিচিত নেত্রী। বাংলাদেশের জনগণই তার এই শক্তির মূল উৎস। এ দেশের জনগণের সমর্থন ও ভোটের শক্তিতে বিশ্বাসী প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দক্ষ ও সুকৌশলী নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রার যে স্তরে উন্নীত করেছেন তার জন্য এ দেশের আপামর জনসাধারণ প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ধারাবাহিকতাই রক্ষা করতে চাইছেন। এমতাবস্থায়, বাঙালি জনগণের একমাত্র ভরসাস্থল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিদেশি ভাড়াটে করা খুনি দিয়ে হত্যার অপপ্রচেষ্টা এ দেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ কোনো দিনও মেনে নেবে না। শেখ হাসিনা এ দেশের সাধারণ জনগণের একটা আবেগ ও ভালোবাসার জায়গা। তারেক জিয়ার নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিগুলো শেখ হাসিনাকে যতবার হত্যার চেষ্টা করবে এ দেশের জনগণ ততবারই ঢাল হয়ে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করবে। দেশের অভ্যন্তরে অথবা বিদেশের মাটিতে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা বা হত্যার চেষ্টা করলে শেখ হাসিনার একমাত্র শক্তির উৎস এ দেশের গণতন্ত্রমনস্ক জনগণ কোনো দিনও সহ্য করবে না। সবাই একতাবদ্ধ হয়ে এসব স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠাবে এ দেশের জনগণ।

লেখক: উপাচার্য (রুটিন দায়িত্ব)

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান

ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


রাজনীতির নামে অর্থনীতির চাকা অচল করতে চায় তারা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ফারাজী আজমল হোসেন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপ থেকে আজ একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এ কারণে শেখ হাসিনার অর্থনীতির দর্শন সারাবিশ্বে একটি রোল মডেল, যা বাংলাদেশকে কেবল মর্যাদাকর আসন দেয়নি, জনগণের জীবনমানেরও ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়েছে। এই অগ্রযাত্রায় বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন উগ্রপন্থি ইসলামী দলগুলো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের ধারণা এভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে নেয়া অব্যাহত থাকলে জনগণ তাদের নাম-নিশানা মুছে ফেলবে। এ কারণে তারা ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দেশ গঠনের পরিবর্তে তারা দেশের অর্থনীতির চাকা স্থবির করে দিতে জ্বালাও-পোড়াও কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে।

শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয়লাভের পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এরপর থেকে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কোভিড সময়কাল বাদ দিলে প্রতিবছরই ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। এমনকি কোভিডের সময়ও যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, বিশাল অর্থনীতির দেশ চীন বা ভারত তার কাছাকাছিও আসতে পারেনি।

বিএনপি ও তাদের দোসর জামায়াত এই অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার জন্য অব্যাহতভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে তাদের নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে চাচ্ছে। গত বছর বিশ্ব অর্থনীতি ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করার সময় তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের সমর্থক ও সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পদ লুট, অগ্নিসংযোগ এবং তাদের ওপর সহিংসতা চালায়। আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে থেকেই এই চক্র তাদের সহিংসতার মাত্রা কয়েক গুণ বাড়িয়ে চলেছে। শেখ হাসিনা চতুর্থ মেয়াদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার দুই মাস আগে থেকেই রাজধানীকে কার্যত: রণক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। অক্টোবরের শুরু থেকে চলতি নভেম্বরের প্রথম পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী সহিংসতায় রাজধানী প্রকম্পিত হয়েছে। পুলিশ হত্যা এবং সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহনে বাধা দেয়া পর্যন্ত ঘটনা ছিল ব্যাপক। রাজধানী ঢাকা সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের শেষ দিকে এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে। ওই বছরই দেশের সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে।

গণতন্ত্রের নামে সহিংসতা একটি বর্বর ধারণা। কিন্তু এটি জাতির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিরুদ্ধে কাজ করা এবং সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়া বিএনপি-জামায়াত জোটের অঘোষিত নীতি। ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পদত্যাগের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিএনপি-জামায়াত জোট একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক নীতিমালা অনুসরণ করছে। বিএনপি গঠন করেছিলেন সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমান (১৯৭৭-১৯৮১)। এটি এখন তার বিধবা স্ত্রী খালেদা জিয়া এবং ছেলে তারেক রহমান দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। উভয়ই একাধিক অপরাধে দোষীসাব্যস্ত হয়ে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এবং পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অবদমিত করতে তাদের দ্রুত বেড়ে ওঠায় সাহায্য করেছিলেন স্বয়ং জেনারেল জিয়াউর রহমান।

ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে জিয়াউর রহমান একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারার জন্ম দিয়েছিলেন। স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ একই উদ্দেশে ইসলামপন্থিদের ব্যবহার করেন। পরবর্তী সময় বিএনপিও একই পথ অনুসরণ করে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে জামায়াত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সুযোগ পায়। জামায়াতের জনসমর্থন ৫ থেকে ৬ ভাগের বেশি না হলেও বিএনপি নিজ স্বার্থে তাদের একটি দানবে পরিণত করে। এই সুযোগে অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জামায়াত ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। সেই সঙ্গে জামায়াত, হরকতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি) এবং জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)’র মতো সন্ত্রাসী সংগঠেনের মূল শক্তিতে পরিণত হয়।

হরকতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি) আশির দশকের শেষ দিকে গঠিত হয়। ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা এবং ২০০১ সালের এপ্রিলে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের সময় বোমা হামলার জন্য জামায়াত তাদের ব্যবহার করে। অন্যদিকে জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)’র জন্ম ১৯৯৮ সালে। তারা ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে সিরিজ বোমা এবং সরকারি কর্মকর্তা, বিচারক ও শিক্ষাবিদসহ গণতন্ত্রমনা পেশাজীবীদের ওপর উপর্যুপরি রক্তক্ষয়ী হামলা চালায়। একই সঙ্গে জামায়াত ভারতেও সন্ত্রাসী পাঠায়। বিএনপি সরকারের অংশ হিসেবে ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ সময়কালে, জামায়াত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের আশ্রয় এবং অস্ত্র সরবরাহ করে। ২০০৪ সালে গোপন সূত্রে খবর পাওয়ার কারণে বাংলাদেশ থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে ১০ ট্রাক অস্ত্র পাঠানোর আগে তা জব্দ করা সম্ভব হয়। এই অস্ত্র চালানের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট নেতাদের যোগসাজশ ছিল।

বাংলাদেশের দুইবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাবার ছাড়পত্র দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে হত্যা করেছিলেন। ২০০৪ সালে, শীর্ষস্থানীয় একটি ভারতীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বহু বিলিয়ন ডলারের ইস্পাত কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। এখন পর্যন্ত এটি বাংলাদেশকে দেয়া সবচেয়ে বড় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব। খালেদা জিয়া প্রস্তাবটি নাকোচ করতে দুই বছর সময় নেন। অসমর্থিত সূত্রমতে, খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বিষয়টি নিয়ে দেন-দরবার করেন। তিনি ভারতীয় কোম্পানির কাছে বিরাট অঙ্কের সুবিধা চেয়েছিলেন, যা তাদের পক্ষে মিটানো সম্ভব হয়নি।

পরবর্তী সময় শেখ হাসিনা উত্তরাধিকার সূত্রে একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি লাভ করেন এবং নিজের ও সরকারের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৫ বছরে তা পাঁচ গুণ বড় করেন। বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ‘আইটিসি ট্রেড ম্যাপের’ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২০০৯ সালের ১৭ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২ সালে প্রায় চার গুণ বেড়ে ৬৭ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্ববাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়। এ সময়েও বাংলাদেশ রপ্তানিতে প্রায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। ২০০৮ সালে ১০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৩ বছর পর ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। তবে বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার কারণে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তা নেমে ২৭ বিলিয়ন ডলারে স্থিত হয়।

এটা কোনো আজগুবি কথা নয়. গত এক দশকে দেশে বিশাল বিশাল অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে, যা ছিল দেশের মানুষের কল্পনার বাইরে। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পদ্মা সেতু। রাস্তা ও রেলপথ থেকে শুরু করে বেসামরিক বিমানবন্দর পর্যন্ত বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য বিশাল প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট এই অর্জনকে ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তারা সহিংসতার মাধ্যমে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের বিদেশি ক্রেতা এবং ডলারের প্রবাহ স্থগিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। এভাবে তারা অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে চাইছে। এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার এক জঘন্য প্রয়াস। এখন শেখ হাসিনার উচিত হবে তার অতিযত্নে লালিত অর্থনীতির যেকোনো ধরনের ক্ষতিসাধনের অপচেষ্টাকে বলিষ্ঠ হাতে দমন করা।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট


banner close