মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৫
১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

ইলিশ উৎপাদনেও বাংলাদেশ রোলমডেল  

ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ
প্রকাশিত
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ
প্রকাশিত : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১৫:০৩

ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। বাঙালির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইলিশ মাছের চর্বিতে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। উক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রায় ২% ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড- যা মানবদেহের কোলেস্টোরেলের পরিমাণ হ্রাস করে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তা ছাড়া ইলিশ মাছের আমিষের ৯ ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া যায়, যা মানুষের পাকস্থলী তৈরি করতে পারে না। ইলিশের চর্বিতে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন এ এবং ডি থাকে। এ জন্য ইলিশ স্বাস্থ্যবান্ধব মাছ হিসেবে অধিক পরিচিত।

ইলিশের অবাধ প্রজনন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ অনুযায়ী ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর ২০১৮ (বাংলা ২২ আশ্বিন থেকে ১৩ কার্তিক ১৪২৫) মোট ২২ দিন দেশব্যাপী ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সময় ইলিশের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্রের ৭০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা যেমন মিরসরাই উপজেলার শাহেরখালী থেকে হাইতকান্দী পয়েন্ট; তজুমদ্দিন উপজেলার উত্তর তজুমদ্দিন থেকে পশ্চিম সৈয়দ আওলিয়া পয়েন্ট; কলাপাড়া উপজেলার লতা চাপালি পয়েন্ট; কুতুবুদিয়া উপজেলার উত্তর কুতুবুদিয়া থেকে গণ্ডামারা পয়েন্টে ইলিশ মাছসহ সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। এ ছাড়াও দেশের ৩৭ জেলায় যথা চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, শরীয়তপুর, ঢাকা, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং গোপালগঞ্জ জেলার সংশ্লিষ্ট সব নদ-নদীতে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। নিষিদ্ধকালীন সময়ে দেশব্যাপী ‘ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ২০১৮’ পরিচালনা করা হবে। ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ সংক্রান্ত সরকারি নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন; প্রধান প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ রক্ষায় গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং সর্বোপরি অবাধ প্রজননের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও মৎস্য অধিদপ্তর এ উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা হলে ১-২ বছর মেয়াদে জেল কিংবা ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। একই অপরাধ পুনরায় করলে শাস্তির মাত্রা দ্বিগুণ হবে।

ইলিশের জীবনচক্র বৈচিত্র্যময়। এরা সাগরের লোনাপানিতে বসবাস করে; প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়ার জন্য উজান বেয়ে মিঠা পানিতে চলে আসে। একটি ইলিশ ৩ থেকে ২১ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। মিঠাপানিতে ডিম দেয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে। পরে এরা আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ ১-২ বছর বয়সে (২২-২৫ সেন্টিমিটার আকারে পুরুষ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী) প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠাপানির দিকে অভিপ্রয়াণ করে। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশ মাছ অপেক্ষাকৃত বেশি ধরা পড়ে।

ইলিশ মাছ সারা বছরই কম-বেশি ডিম দেয়; তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিন মাসের প্রথম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে ওরা প্রধানত ডিম ছাড়ে। এ জন্য চলতি বছরে আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার দিনসহ পূর্বের ১৭ দিন এবং পরের ৪ দিন (১৭+১+৪) ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুত ও বিনিময় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালিত গবেষণার তথ্যমতে, ২০১৭ সালে মা ইলিশ সঠিকভাবে সংরক্ষণের ফলে প্রায় ৪৭% ইলিশ ডিম দিয়েছে।

ইলিশের মোট আয়ুষ্কাল ৫-৭ বছর। আহরিত ইলিশের শতকরা ৯০ ভাগ ৩০-৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়; এর মধ্যে ২টি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারাজীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর ১টি মিঠাপানি ও লোনাপানিতে জীবন অতিবাহিত করে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৭০% বাংলাদেশ আহরণ করে; দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিয়ানমার (২০-২৫%) এবং তৃতীয় অবস্থানে ভারত (১০-১৫%)। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্যমতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা ও তিস্তা নদী এবং মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওরেও গত বছর ইলিশ পাওয়া গেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঠিক তত্ত্বাবধানে মৎস্য অধিদপ্তর, প্রশাসন ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করায় দেশব্যাপী ইলিশের বিস্তৃতি ও উৎপাদন বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২.৯৮ লাখ টন; ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা হয় ৩.৯৫ লাখ টন। ২০১৬-১৭ সালে তা ৪.৯৬ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ বিগত ৯ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ, যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোলমডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। অন্যদিকে ২০১৬ সালে ইলিশ বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইলিশের স্বত্ব এখন শুধুই বাংলাদেশের। এটা জাতির জন্য গৌরবের।

ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থাপনা বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম। এ লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার চলতি বছর দেশের ২৯টি জেলার ১১২টি উপজেলার মা ইলিশ আহরণে বিরত থাকা ৩,৯৫,৭০৯ জেলে পরিবারের জন্য পরিবার প্রতি ২০ কেজি হারে বিনামূল্যে সর্বমোট ৭,৯১৪ টন ভিজিএফ চাল মঞ্জুর করেছে। মৎস্যবান্ধব বর্তমান সরকারের এসব যুগোপযোগী ও প্রশংসিত কার্যক্রম বিগত কয়েক বছর ধরে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন এবং মা ইলিশ ও জাটকা সুরক্ষার ফলে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ টনে উন্নীত হয়েছে। ইলিশ উৎপাদনের এরূপ সফলতা জেলে সম্প্রদায়ের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। জেলেরা অনেকেই এখন বুঝতে পারছে, জাটকা ও মা ইলিশ সঠিকভাবে সুরক্ষা করতে পারলে বর্ধিত হারে ইলিশ উৎপাদনের সুফল সরাসরি তারা নিজেরাই ভোগ করতে পারবে। এ জন্য জেলেরাও অনেক ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে মা ইলিশ ও জাটকা সুরক্ষা করছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক।

লেখক: বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী


সীমান্ত পারের আগুনে দগ্ধ আমাদের তরুণ সমাজ

ড. আজিজুল আম্বিয়া
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

সীমান্তের ওপার থেকে প্রবাহিত হওয়া মাদকদ্রব্য দেশের আর্থসামাজিক কাঠামোকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। শহর হোক বা গ্রাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক বা হোস্টেল— কোথাও তরুণরা নিরাপদ নয়। হাতে মাদক থাকা আজকাল এত সহজ হয়েছে যে, এক মুহূর্তের ভুল সিদ্ধান্ত একজন তরুণের জীবন, মেধা, নৈতিকতা এবং ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে। মাদক কেবল একটি অপরাধ নয়; এটি আজকের বাংলাদেশের জন্য একটি গভীর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সংকট। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই তরুণ প্রজন্মের উপর। কিন্তু মাদক, অপরাধ এবং সামাজিক অস্থিরতা তরুণ সমাজকে ক্রমশই বিপন্ন করে তুলছে। শুধুমাত্র শাস্তি বা আইনের কঠোরতা নয়, প্রয়োজন সচেতনতা, পরিবারিক তত্ত্বাবধান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজের সক্রিয় ভূমিকা। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব কীভাবে মাদক দেশের যুবসমাজকে বিপন্ন করছে, এর উৎস, প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধান।


মাদকের উৎস: মায়ানমার সীমান্ত
বাংলাদেশে মাদকের সবচেয়ে বড় উৎস হলো মায়ানমার। ইয়াবা, আইস (ক্রিস্টাল মেথ), হেরোইন এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্য একটি সুপরিকল্পিত চক্রের মাধ্যমে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। বিশেষ করে মায়ানমারের পার্বত্য অঞ্চল, যা “গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল” নামে পরিচিত, দীর্ঘদিন ধরে মাদক উৎপাদনের জন্য কুখ্যাত।
মায়ানমারের অর্থনৈতিক দুরবস্থা, সশস্ত্র গোষ্ঠীর সক্রিয়তা এবং স্থানীয় প্রশাসনের দুর্বলতা মাদক উৎপাদনকে অর্থসংগ্রহের প্রধান উপায়ে পরিণত করেছে। এই অঞ্চলগুলি দুর্গম ও পাহাড়ি হওয়ায় নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সেই সাথে সীমান্তবর্তী এলাকায় দুর্নীতি এবং দালালচক্র সক্রিয়ভাবে কাজ করে।
বাংলাদেশে ইয়াবার সবচেয়ে বড় প্রবেশদ্বার হলো টেকনাফ ও কক্সবাজার। এখানে ট্রলার, নৌকা, পাহাড়ি রাস্তা এবং রাতের অন্ধকারে সাঁতরে মাদক আনা হয়। মাদককারবারীরা অত্যন্ত চতুর এবং প্রায়ই স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে চলে। তাই সীমান্তে পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকলে এবং আইন প্রয়োগ না হলে মাদক প্রবাহ বন্ধ করা সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন, সীমান্তে হাইটেক প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ড্রোন, নাইট ভিশন সিসিটিভি, মোশন সেন্সর এবং আধুনিক নজরদারি ব্যবস্থার অভাবে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ দুর্বল।
বাংলাদেশে প্রবেশ করা মাদকের সবচেয়ে বড় উৎস হলো মায়ানমার। বিশেষ করে ইয়াবা, আইস (ক্রিস্টাল মেথ), হেরোইন ইত্যাদি মাদকদ্রব্য সংগঠিত চক্রের মাধ্যমে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে ঢোকে।


কেন মায়ানমার থেকে মাদক সহজে আসে?
মায়ানমারের কিছু পার্বত্য অঞ্চলকে বলা হয় ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’—এ অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে মাদক উৎপাদনের জন্য কুখ্যাত। মায়ানমারের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল; কিছু সশস্ত্র দল উৎপাদনকে অর্থ সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। সীমান্তের কিছু অংশ পাহাড়ি ও দুর্গম হওয়ায় নিয়ন্ত্রণ কঠিন। সীমান্তবর্তী এলাকায় দুর্নীতি এবং দালালচক্র সক্রিয়।
বাংলাদেশে ইয়াবা যে পরিমাণে ঢোকে তার একটি বড় অংশ আসে টেকনাফ ও কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে। ট্রলার, নৌকা, পাহাড়ি রাস্তা, এমনকি রাতের অন্ধকারে সাঁতরে পর্যন্ত মাদক আনানোর কৌশল ব্যবহার করা হয়।


মাদকের আইন: কাঠামো আছে, প্রয়োগ নেই
বাংলাদেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন অত্যন্ত কঠোর।
মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ অনুসারে-নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি ইয়াবা, হেরোইন, কোকেন, আইস বহন বা বেচাকেনা করলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন পর্যন্ত সাজা হতে পারে।
উৎপাদন, পরিবহন, বিতরণ, সংরক্ষণ—সবকিছুই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পুনর্বাসন সুবিধাও রাখা আছে।
তাহলে সমস্যা কোথায়? আইন ব্যবহার হচ্ছে না কেন দুর্নীতি: কিছু জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভ্যন্তরে দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যরা মাদককারবারিদের পক্ষে কাজ করে।রাজনৈতিক ছত্রছায়া: কিছু মাদক ব্যবসায়ী রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে রক্ষা পায়।

জটিল বিচারপ্রক্রিয়া: মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে।
ভয়: সাক্ষীরা মাদকচক্রের ভয় পায় বলে সাক্ষ্য দিতে চায় না।
সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ দুর্বল: সীমান্ত রক্ষী বাহিনী সংখ্যা ও প্রযুক্তির ঘাটতিতে ভোগে। আইন যতই কঠোর হোক, প্রয়োগ না হলে তা কাগজের টুকরোতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
শক্ত আইন কিভাবে কার্যকর করা যায়?
শুধু আইন কঠোর করলেই হবে না, আইন প্রয়োগকে শক্তিশালী করতে হবে।
প্রয়োজন— সীমান্তে হাইটেক নজরদারি, ড্রোন নজরদারি, নাইট ভিশন, সিসিটিভি মোশন, সেন্সর, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাদকের অভিযোগ থাকবে- তাদের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্তির কারণ: বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণরা যে বয়সে স্বপ্ন দেখবে, গবেষণায় মনোযোগী হবে, পরীক্ষা–পরীক্ষায় ভবিষ্যৎ গড়বে, সেই বয়সেই অনেকের হাতে মাদক সহজলভ্য হয়ে পড়ছে। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে।
বন্ধু ও পরিবেশগত প্রভাব: হোস্টেল বা মেসের নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশ, যেখানে তরুণরা একে অপরকে প্রভাবিত করে।
পরিবারের নজরদারির অভাব: অভিভাবকরা অনেক সময় সন্তানের মানসিক অবস্থা বা সামাজিক বন্ধন পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ।
মানসিক চাপ ও হতাশা: প্রতিযোগিতা, একাকিত্ব ও মানসিক চাপ মাদকাসক্তির দিকে ঠেলে দেয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রোপাগান্ডা: বিদেশি ব্লগার ও ভ্লগাররা তরুণদের বিভ্রান্ত করে, নৈতিকভাবে দুর্বল সংস্কৃতি প্রচার করে।
অর্থলাভের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পড়াশোনা ছেড়ে রাজনীতি শর্টকাট হিসেবে নেওয়া, সেশন জট, দুর্বল একাডেমিক পরিবেশ—সব মিলিয়ে ছাত্ররা মাদকের জালে ফসকে পড়ছে।
ছাত্র রাজনীতি: শিক্ষার পরিবর্তে টাকার রাজনীতি
দশক ধরে ছাত্র রাজনীতি ছিল একটি আদর্শিক প্ল্যাটফর্ম—নেতৃত্বের স্কুল। কিন্তু আজ কিছু জায়গায় এটি বরং অপরাধের জন্মভূমি হয়ে উঠেছে।
সমস্যা কোথায়?
অনেকে পড়ে না, বরং রাজনীতিকে দ্রুত টাকা ও প্রভাব অর্জনের শর্টকাট হিসেবে দেখে।
সেশন জট, দুর্বল একাডেমিক পরিবেশ—ছাত্রদের পড়ালেখা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
কিছু সিনিয়র নেতা শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে দুষ্কর্মে লাগায়—চাঁদাবাজি, দখল, ভয়–ভীতি।
সব পরিবেশে মাদক যুক্ত হয়—কারণ মাদক দিয়ে তরুণদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ।
sত্রদের একটি অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, এবং ধীরে ধীরে তারা মেধাহীন, উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে।
ফলাফল— দেশ মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে।
যে তরুণরা দেশের ভবিষ্যৎ, তারা নেশা, অপরাধ আর বিভ্রান্তির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।
একটি মহল তরুণদের ব্যবহার করছে: বিদেশি ব্লগার ও প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ।
বর্তমান ডিজিটাল যুগে বিদেশি ব্লগার, ভ্লগার ও সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলো প্রায়ই অসত্য, ভুল, অতিরঞ্জিত বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে তরুণ সমাজকে ভুল পথে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।

তাদের উদ্দেশ্য—
• সমাজে অস্থিরতা তৈরি করা
• তরুণদের বিভ্রান্ত করা
• নীতিহীন ‘বখাটে সংস্কৃতি’ তৈরি করা
• রাষ্ট্রের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি করা।
কিছু বিদেশি স্বার্থগোষ্ঠী মনে করে— তরুণদের দুর্বল করে দিলে দেশ দুর্বল হবে। এই প্রোপাগান্ডার শিকার হচ্ছে অনেক ছেলেমেয়ে, যারা মনে করছে খারাপ কাজ করাই স্বাধীনতা বা আধুনিকতা। এগুলোর বিরুদ্ধে তীব্র সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা জরুরি।
মাদকাসক্তি বাড়ায় খুন-খারাপি, ধর্ষণ—সমাজের অস্থিরতা চরমে
মাদকসেবনের বড় বিপদ হলো—এটি মানুষের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি নষ্ট করে।
ফলে—খুন ধর্ষণ ছিনতাই পারিবারিক সহিংসতা রাস্তায় বেপরোয়া আচরণ মানসিক বিকার এগুলো দ্রুত বাড়ছে।
মাদকের কারণে তরুণরা যখন নিয়ন্ত্রণ হারায়, তখন তাদের অপরাধ করার প্রবণতা বেড়ে যায়। মাদক–অপরাধ–রাজনীতি—তিনটি মিলেমিশে এক অন্ধকার চক্র তৈরি করছে।


আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও মাদক ব্যবসা:
মাদক ব্যবসা এখন শুধু দেশীয় সমস্যা নয়। এটি আন্তর্জাতিক স্তরে সংগঠিত চক্রের অংশ। সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে উৎপাদিত মাদক আন্তর্জাতিক বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ এই চক্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট জোন। তাই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা ছাড়া সমস্যার সমাধান অসম্ভব।
বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা উল্লেখ করেছে, মাদক প্রবাহ বন্ধে সীমান্ত রক্ষা, আইন প্রয়োগ এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ জরুরি।
সরকার এবং জনগণের করণীয়: পরিত্রাণ কই?
মাদক সমস্যার সমাধান এককভাবে কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এটি হতে হবে সরকার + পরিবার + সমাজ + শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে।
সরকারের করণীয়: সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করা, মাদকের বড় গডফাদারদের চিহ্নিত করে শাস্তি, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদক বিরোধী টাস্কফোর্স, পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোকে উন্নত করা, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভ্রান্তিকর প্রোপাগান্ডা নজরদারি।
পরিবারের করণীয়: সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া, মাদক সম্পর্কে বাস্তব তথ্য দেওয়া, সন্দেহ হলে দ্রুত পরামর্শ গ্রহণ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের করণীয়: হোস্টেলের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কঠোর করা, কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন, মাদকবিরোধী ক্লাব, সেমিনার আয়োজন, ছাত্র রাজনীতিকে শিক্ষাবান্ধব করা।
সমাজের করণীয়: মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট, স্থানীয়ভাবে নজরদারি, তরুণদের খেলাধুলা, সংস্কৃতি, সৃজনশীল কাজে যুক্ত করা।
পরিশেষে বলতে চাই, এখনই সময়—তরুণদের বাঁচানো, দেশকে বাঁচানো, মাদকমুক্ত বাংলাদেশ কেবল একটি স্লোগান নয়; এটি আজকের প্রয়োজন, আগামী দিনের বেঁচে থাকার শর্ত। মাদক কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নয়—এটি একটি জাতিগত সংকট। দেশের শক্তি নির্ভর করে তার তরুণ প্রজন্মের উপর। সুস্থ, শিক্ষিত, সচেতন ও নৈতিকভাবে দৃঢ় যুব সমাজই দেশের স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।
মাদক, অপরাধ, রাজনৈতিক অপব্যবহার এবং বিদেশি প্রোপাগান্ডা—এই চক্র মিলিয়ে আজকের তরুণ সমাজকে ভয়াবহ ঝুঁকিতে ফেলেছে। যদি এখনই আমরা ব্যবস্থা না নিই, তবে আগামী প্রজন্ম একটি অন্ধকার ও বিপন্ন বাংলাদেশকে বংশধর হিসেবে পাবে।
এখনই সময় একযোগে ব্যবস্থা নেওয়ার—সরকারকে কঠোর আইন প্রয়োগ ও সীমান্ত নজরদারিতে মনোযোগ দিতে হবে, পরিবারকে সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহায়ক সম্পর্ক রাখতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ ও পুনর্বাসন ব্যবস্থায় মনোযোগ দিতে হবে, এবং সমাজকে সচেতনতা, খেলাধুলা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
মাদকমুক্ত বাংলাদেশ কেবল একটি লক্ষ্য নয়; এটি আমাদের অস্তিত্বের লড়াই, আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ রক্ষার শর্ত। এখনই সময়—তরুণদের বাঁচানো, দেশকে বাঁচানো।

লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক।


পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮ বছর: অর্জন, অপ্রাপ্তি ও আমাদের দায়

ডা. এ কে এম মাজহারুল ইসলাম খান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বয়স আজ আটাশ বছর। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত এই চুক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠনের এক গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। বহু দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, অবিশ্বাস, মৃত্যু এবং পালিয়ে বেড়ানোর দিনপঞ্জিকে থামিয়ে দিয়ে এই চুক্তি পাহাড়ের মানুষের কাছে এক নতুন ভোরের আশা বয়ে এনেছিল। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব, সশস্ত্র সংগঠন এবং সাধারণ মানুষ তখন মনে করেছিল সহিংসতার পর অবশেষে নতুন করে শুরু হবে শান্তির পথচলা। কিন্তু প্রশ্ন আজও রয়ে গেছে, এই চুক্তি কি সত্যিই শান্তির ভিত্তি স্থাপন করেছে, নাকি এর বাস্তবায়ন এখনো অর্ধসমাপ্ত রয়ে গেছে? যেদিন এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেদিন যে আস্থার বীজ বপন করা হয়েছিল, তা কি আজ শিকড় গেড়ে বৃক্ষে পরিণত হয়েছে? নাকি নানা প্রশাসনিক জটিলতা, রাজনৈতিক অনীহা, ভুল ব্যাখ্যা এবং মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব এখনো সেই আস্থাকে দুর্বল করে রেখেছে?

একজন বাঙালি নাগরিক হিসেবে এ প্রশ্নগুলো করা কঠিন, আবার জরুরিও। কঠিন, কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের জটিল বাস্তবতা বাইরে থেকে দেখা যায় না; জরুরি, কারণ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পাহাড়ের ভবিষ্যতের সঙ্গে সমগ্র বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যুক্ত। পাহাড়ের যেকোনো অস্থিরতা, ক্ষোভ, অসমতা বা বঞ্চনা শেষ পর্যন্ত সমতলের মানুষকেও প্রভাবিত করে। তাই এই চুক্তির সফলতা বা ব্যর্থতা কেবল পাহাড়ের নয়, সমগ্র জাতির মূল্যায়নের বিষয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস কোনোদিনই সরলরৈখিক ছিল না। ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই পাহাড়কে দেখা হয়েছে ‘দূরের ভৌগোলিক সীমানা’ হিসেবে যেখানে রাষ্ট্রের হাত পৌঁছায় দেরিতে, আর মানুষের কণ্ঠ পৌঁছে আরও দেরিতে। পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই বাঁধের নির্মাণ পাহাড়ি ও বাঙালি মানুষের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তোলে কারণ ৫০ হাজারেরও বেশি পাহাড়ি পরিবার কোনো পুনর্বাসন ছাড়াই বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর পাহাড়ের মানুষের আশা ছিল নতুন রাষ্ট্র নিশ্চয়ই তাদের পরিচয়, অধিকার ও ভূমির নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ১৯৭০-এর দশক থেকে পার্বত্য অঞ্চলে সামরিকীকরণ, বাঙালি পুনর্বাসন, ভূমি হারানোর ভীতি এবং সাংস্কৃতিক উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। এরই মধ্যে জন্ম নেয় সশস্ত্র প্রতিরোধের রাজনীতি, আর পাহাড় ঢেকে যায় অন্ধকার সহিংসতায়।

এই প্রেক্ষাপটের মধ্যেই ১৯৯৭ সালের চুক্তি ছিল এক সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যা যুদ্ধের জবাবে যুদ্ধ নয়, বরং সংলাপকে তুলে ধরেছিল পথ হিসেবে। কিন্তু যুদ্ধ থামলেও শান্তি প্রতিষ্ঠা যে কেবল স্বাক্ষরেই হয় না, তা ইতিহাস বহুবার দেখিয়েছে। বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল সুসংগঠিত পরিকল্পনা, দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এবং জনগণের সঙ্গে স্বচ্ছ যোগাযোগ। রাষ্ট্র ও পাহাড়ি নেতৃত্ব উভয়েরই সমন্বিত প্রচেষ্টা নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি বলেই এখনো পাহাড়ে অনিশ্চয়তার ছায়া ঘুরে বেড়ায়।

চুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ভূমি সমস্যা সমাধান। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে ভূমি কেবল অর্থনৈতিক সম্পত্তি নয়; এটি তাদের ভাষা, ঐতিহ্য, পরিচয় এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের ভিত্তি। পার্বত্য সমাজে ভূমির মালিকানা ঐতিহ্যগত রীতি অনুসারে নির্ধারিত হলেও আধুনিক রাষ্ট্রীয় আইন ব্যবস্থা সেই রীতিকে স্বীকৃত দেয়নি। ফলে ভূমি নিয়ে দ্বন্দ্ব শতভাগ অবসান ঘটানো সম্ভব হয়নি। চুক্তিতে ভূমি কমিশন গঠিত হলেও কমিশনের কার্যপদ্ধতি নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। পাহাড়ি এবং বাঙালি উভয় পক্ষের দাবিদাওয়া যাচাই, জমির জরিপ, দলিল পর্যালোচনার মতো মৌলিক কার্যক্রম এখনো কাঙ্ক্ষিত গতিতে হয়নি। কমিশনের ক্ষমতা সীমিত, আইনের ব্যাখ্যা অস্পষ্ট, বন বিভাগ ও ভূমি অফিসের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রবল। সব মিলিয়ে ভূমি কমিশন প্রায় অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে। এতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী আজও বিশ্বাস করতে পারে না যে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাষ্ট্র বৈষম্যমুক্ত ভূমিকা পালন করবে। আর বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের একাংশও দ্বিধাগ্রস্ত, তারা যে জমিতে দুই-তিন প্রজন্ম ধরে বাস করছে, সেটি হঠাৎ করে বিতর্কিত ঘোষিত হলে কী হবে?

এই দ্বিমুখী উদ্বেগই পাহাড়ের বাস্তবতাকে চরম সংবেদনশীল করে তোলে। রাষ্ট্রের উচিত ছিল উভয় জনগোষ্ঠীর কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা কার অধিকার কোথায়, কোন জমির মালিকানা কীভাবে নির্ধারিত হবে, এবং ভবিষ্যতে ভূমি কমিশন কীভাবে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে। এই স্বচ্ছতার অভাবই পাহাড়ে গুঞ্জন, গুজব ও অবিশ্বাসকে প্রলম্বিত করেছে। চুক্তির ওপর আস্থা স্থাপন করতে হলে ভূমি সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধানের বিকল্প নেই।

চুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ছিল প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ। বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো মূলত কেন্দ্রনির্ভর। ঢাকা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, জেলা-উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু পাহাড়ের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, বহুজাতিক সমাজ এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সেখানে স্থানীয় প্রশাসনের শক্তিশালী কর্তৃত্ব থাকা জরুরি ছিল। আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদ গঠন করা হলেও, তারা আজও বাস্তব সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরোপুরি স্বাধীন নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি, স্থানীয় উন্নয়ন এসব ক্ষেত্রের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে আসে। ফলে পাহাড়ের মানুষ মনে করে তাদের নির্বাচিত নেতৃত্ব আসলে দায়িত্বশীল হলেও ক্ষমতাহীন।

এই সমস্যা কেবল পাহাড়ের নয়। দেশের প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান একই সংকটের ভেতর। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন নিজেই বিকেন্দ্রীকরণের চর্চায় দুর্বল, তখন পাহাড়ের মতো স্পর্শকাতর অঞ্চলে ক্ষমতা ভাগাভাগি আরও কঠিন হয়ে ওঠে। তবু পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য এই বাস্তবতা আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রায়ণ শুধুমাত্র প্রশাসনিক সমস্যা নয়, এটি রাজনৈতিক আস্থা ও সাংস্কৃতিক অধিকারের সঙ্গেও সরাসরি যুক্ত। যদি পাহাড়িরা মনে করে যে নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা তাদের নেই, তবে চুক্তির মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়।

চুক্তির আরেকটি অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা হলো পাহাড়ি রাজনীতির ভাঙন। জনসংহতি সমিতির বিভিন্ন অংশে বিভাজন, নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠীর আবির্ভাব, ক্ষমতার প্রতিযোগিতা এসব বিষয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত অবস্থানকে দুর্বল করেছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় একক অবস্থান না থাকলে চুক্তি বাস্তবায়নের তাগিদও দুর্বল হয়। একই সঙ্গে পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ ও সশস্ত্র প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করে। ফলে পরিবেশটা জটিল থেকে যায়। রাষ্ট্রের ওপর যেমন নাগরিকের অনাস্থা থাকে, তেমনি পাহাড়ি রাজনীতির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও মানুষের প্রত্যাশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

তবে এই সব চ্যালেঞ্জের মাঝেও চুক্তির ইতিবাচক দিক অস্বীকার করা যায় না। যুদ্ধ থেমেছে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এখন আর পাহাড়ি গ্রামে গ্রামে গুলির শব্দ শোনা যায় না, মানুষ পালিয়ে বেড়ায় না, হতাশায় ভেঙে পড়ে না। রাঙামাটি-খাগড়ছড়ি-বান্দরবানের বহু এলাকা শিক্ষা, পর্যটন, কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্পে এগিয়ে গেছে। যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হয়েছে, বাজার বিস্তৃত হয়েছে, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বেড়েছে। এসব অর্জন শান্তির ফলেই সম্ভব হয়েছে। যে অঞ্চল এক সময় মানুষের মনে আতঙ্ক ছিল সেখানেই এখন পর্যটকের ভিড় বাড়ছে, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। পাহাড়কে দেশের অর্থনীতির অংশ করে তোলার প্রক্রিয়াও এগিয়েছে।

একজন বাঙালি নাগরিক হিসেবে বলতে হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থিতিশীলতা কেবল পাহাড়ের মানুষের প্রশ্ন নয়, এটি বাংলাদেশের শান্তি, উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার প্রশ্ন। পাহাড়ের প্রতি দায়িত্বশীলতা মানে হলো দেশের ভৌগোলিক ঐক্যকে সম্মান করা, মানবিক মূল্যবোধকে রক্ষা করা, এবং রাজনৈতিক পরিপক্বতা প্রদর্শন করা। আমরা যদি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ন্যায্য দাবি বোঝার চেষ্টা না করি, যদি তাদের নিরাপত্তা-সংস্কৃতি-ভূমির বিষয়ে সংবেদনশীল না হই, তাহলে রাষ্ট্রের নিজস্ব মানবিক চরিত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এখন প্রয়োজন সাহসী সিদ্ধান্ত। ভূমি কমিশনের আইনে যেসব অস্পষ্টতা রয়েছে তা সংশোধন করতে হবে। কমিশনকে সত্যিকারের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড়ে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি কেমন হবে, কোন এলাকায় কী ধরনের ক্যাম্প প্রয়োজন এসব বিষয়ে সরকার, স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে স্বচ্ছ ও যুক্তিনির্ভর আলোচনা করতে হবে। পাশাপাশি পাহাড়ি ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় রাষ্ট্রকে আরও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আটাশ বছর পূর্তিতে তাই আবারও মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন পাহাড় কেবল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উৎস নয় , এটি আমাদের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। পাহাড়ের মানুষকে সমান মর্যাদা দেওয়া মানে দেশের ভবিষ্যৎকে আরও মানবিক, আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে গড়ে তোলা। যেদিন পাহাড়ের মানুষ অনুভব করবে রাষ্ট্র তাদের অধিকার রক্ষা করে, নিরাপত্তা দেয়, ভাষা-সংস্কৃতিকে সম্মান করে এবং তাদের মতামতকে মূল্য দেয় সেদিনই এই চুক্তি প্রকৃত শান্তির প্রতীক হয়ে উঠবে। তখনই পাহাড় এবং সমতল মিলিতভাবে এগিয়ে যাবে আরও ন্যায়ভিত্তিক, বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এবং প্রগতিশীল বাংলাদেশের দিকে। আমাদের সবচেয়ে বড় উপলব্ধি হওয়া উচিত, শান্তি কখনোই এক পক্ষের জন্য নয়; শান্তি সবার জন্য। পাহাড়ি-বাঙালি যতদিন নিজেদের প্রতিপক্ষ ভাববে, ততদিন রাষ্ট্রের উন্নয়ন, সম্মান এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি আমরা বিশ্বাস করি পাহাড়ও বাংলাদেশের, পাহাড়ের মানুষও বাংলাদেশের, এবং তাদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব তাহলে চুক্তিটি শুধু একটি দলিল নয়, বরং ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আলো হয়ে থাকবে।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।


সফলতার জন্য একটা শক্ত অবলম্বন লাগে

মমতা মজুমদার 
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

একটা লতানো গাছও বেড়ে উঠতে গেলে একটা কিছুর অবলম্বন খোঁজে। শক্ত করে গোড়া থেকে মজবুত হতে হলে তাকে অন্য কোনো ডালপালা কিংবা শেকড় বাকরের আশ্রয় নিয়ে উপরে উঠতে হয়। যদি অনেক ঝড়-বৃষ্টিতে সে গাছটা কখনো হেলে পড়ে, তখনও কিন্তু পরম যত্নে তার মালিকের হাতের সাহায্যে গাছটাকে সোজা করে দিতে হয়। নয় তো সে গাছটি বেড়ে ওঠার সুযোগ হারায়।

মানুষের জীবনটাও তদ্রূপ একটা গাছের মতো। তাকে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে গেলে এবং বড় হয়ে সফল মানুষ হতে হলে অনেকের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। বিশেষ করে মা, বাবা ও পরিবারের। তারপর তার চারপাশের সমাজ, বন্ধু-বান্ধব। একজন মানুষ সফল হয় অনেকগুলো পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। যদি তার পাশে শক্ত একটা খুঁটি থাকে। বটবৃক্ষের মতো ছায়া হয়ে কেউ রোজ তাকে ছায়া দেয়। বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়, তবেই সে মানুষটি ওই লতানো গাছটার মতোই একটা শক্ত অবলম্বন পেয়ে ঠিক সফল হয়।

তুমি আর আমিও কিন্তু জীবনে সফলভাবে বেড়ে উঠতে চাইলে কারো না কারো আশ্রয় নিতে হবে। বেড়ে ওঠার জন্য শক্ত একটা অবলম্বন খুঁজে নিতে হবে। একদিন সফল হবো এই সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এতে করে আমাদের সফল হওয়ার পিছনে যে মানুষটি প্রকৃত শক্ত খুঁটি হবে, তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। জীবন কখনো ফুলের গালিচা বিছানো মনোরম বিছানা নয় যে, তা মসৃণ হবে। বরং এতে রয়েছে নানান সমস্যা, নানান প্রতিকূল অবস্থা। নানান ঝড়-ঝাপটা।

একজন মানুষ সফল হতে হলেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে এটা ভাবতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই নিঃশ্বাসটুকু আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমিও চেষ্টা করব। একবার না পারলে দশবার চেষ্টা করব। তবুও আমাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছাতে হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই লেগে থাকতে হবে। একটা মাঁচায় টিকে থাকতে হলে গাছের গোড়াটা শক্ত হতে হয়। তোমাকে জীবনে টিকে থাকতে হলেও সাহস সঞ্চয় করতে হবে। দুর্বল মন নিয়ে কখনো এগিয়ে চলা যায় না।

কিন্তু; আমাদের সমাজ কখনো চাইবে না, আমরা সফল হই। এই নিষ্ঠুর সমাজের মানুষগুলোর উপরে এক রূপ, ভেতরে ভিন্ন রূপ। চিন্তা চেতনায় অনেকের মধ্যে ইতিবাচক ভাবনা না ও থাকতে পারে। অধিকাংশ মানুষ বন্ধু হয়ে কাছে থাকলেও মনে মনে তোমার এগিয়ে চলার পথে বাঁধা সৃষ্টি করবে। তোমাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করবে অন্য বন্ধুদের সাথে। এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী আমি নিজেও। আমার দেখা অনেক বন্ধুকে আমি দেখেছি, প্রয়োজন শেষে খোলস ছেড়ে পালিয়ে যেতে। দুনিয়াটা স্বার্থের মোহে ঘুরে। সেক্ষেত্রে তুমি আর আমি কেবলই তামাশার পাত্র ওই হীনমন্য মনের মানুষগুলোর কাছে।

তুমি যে কাজটা সবচেয়ে বেশি ভালো জানো, অন্যেরা কিন্তু তা নাও জানতে পারে। সেটাকেই বরং কাজে লাগাও। কারো হেল্প চাইলেও চাইতে পারো। সফলতা পেতে হলে কারো না কারো সাহায্যের দ্বারপ্রান্তে যাওয়া লাগে। সফল মানুষেরা এভাবেই জীবনে লড়াই করে, কঠোর পরিশ্রমের সাথে অন্যের সাহায্য নিয়ে এগিয়ে গেছেন। যার কাছে একবার গিয়ে ব্যর্থ হবে, ধরে নিও সে মানুষটি তোমার ভালো চায় না। সে তোমার প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী নয়। তুমি এগিয়ে যাও– এটা তার মেনে নিতে কষ্ট হবে বলেই সে তোমাকে সাহায্য করবে না।

তারচেয়ে ভালো, চলে এসো। আবার নতুন কারো দরজায় নক করো। ভাগ্য তোমার সুসম্পন্ন হলে দেখবে, কেউ না কেউ তোমায় ভালোবেসে সাহায্য করবে। তোমাকে সাহস আর অনুপ্রেরণা দিবে। আমিও তার প্রমাণ পেয়েছি কার্যক্ষেত্রে বাস্তব জীবনে। সফলতা যদিও এখনো উপরওয়ালার হাতে। তবে সে মহান মানুষটি আমাকে তার মেয়ের আসনে বসিয়েছেন। আমার দুঃসময়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমাকে সবসময় এগিয়ে যেতে উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আমি তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।


‘বিষাক্ত খাদ্য, ঝুঁকিতে জীবন’

সমীরণ বিশ্বাস
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বিষাক্ত খাদ্য, ঝুঁকিতে জীবন। ভেজাল ও রাসায়নিক দূষণে জনস্বাস্থ্য আজ হুমকির মুখে। খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। এই খাবারই যখন পরিণত হয় বিষে, তখন শুধু জনস্বাস্থ্য নয়, একটি জাতির ভবিষ্যতই চরম সংকটে পড়ে। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে যে উদ্বেগ দীর্ঘদিন ধরেই ছিল, সাম্প্রতিক গবেষণা, টেস্ট রিপোর্ট ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য সেটিকে আরও স্পষ্ট করেছে। প্রতিদিনের চাল, ডাল, সবজি, ফল, দুধ, মাংস, যে খাদ্য আমরা প্রতিনিয়ত খাই, তার উল্লেখযোগ্য অংশেই রয়েছে ক্ষতিকর টক্সিন, ভারী ধাতু এবং নিষিদ্ধ রাসায়নিক উপাদান। বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদানটি তাই এখন হয়ে উঠেছে নীরব ঘাতক।

ভেজাল খাদ্যের ভয়াবহতা: পরিসংখ্যানে প্রকৃত চিত্র:

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (BFSA) সাম্প্রতিক উপাত্ত অনুসারে দেশের বাজারে পাওয়া ৮২টি খাদ্যপণ্যের গড়ে ৪০ শতাংশে ভেজাল বা ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ইউরোপীয় মানের চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি DDT, টক্সিন এবং কীটনাশক শনাক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাজারের ৩৫% ফলে, ৫০% শাকসবজিতে, ১৩টি চালের নমুনায় অতিমাত্রায় আর্সেনিক, ৫টিতে ক্রোমিয়াম, হলুদের ৩০টি নমুনায় সীসা ও ভারী ধাতু, লবণে নিরাপদ মাত্রার চেয়ে ২০–৫০ গুণ বেশি সীসা, মাছ ও মুরগিতে ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি। এই তথ্যগুলো শুধু উদ্বেগজনক নয়, বরং এটিই এখন বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের অন্যতম বড় সংকেত। CAB ও BSTI–এর গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বাজারের ৮৫% ফল পাকানো হয় কার্বাইড, ইথোফেন ও ফরমালিন দিয়ে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বলছে, মানহীন খাদ্যের সংখ্যা এক বছরে ৮১ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৯—যা ভেজালের দ্রুত বিস্তারের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।

রাসায়নিক দূষণ ও বিপজ্জনকতা:

খাদ্যে ব্যবহৃত অধিকাংশ রাসায়নিক, যেমন ফরমালিন, কার্বাইড, ইথোফেন, টেক্সটাইল ডাই, গ্রোথ হরমোন বা নিষিদ্ধ কীটনাশক, মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফরমালিন: মূলত মৃতদেহ সংরক্ষণে ব্যবহৃত রাসায়নিক। মাছ, ফল, মাংস টাটকা রাখতে এটি ব্যবহার করা হলে তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শরীরে ক্যান্সারের কোষ তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়।

কার্বাইড ও ইথোফেন: ফল পাকাতে ব্যবহৃত হলেও এগুলোর সক্রিয় উপাদান শরীরে প্রবেশ করে স্নায়ুতন্ত্রের উপর আঘাত করে, পাকস্থলী ও লিভারের কোষ নষ্ট করে। গ্রোথ হরমোন: মুরগি বা গবাদিপশু দ্রুত বড় করার জন্য অতিরিক্ত গ্রোথ হরমোন দিলে তা মানবদেহে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব, শিশুদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও ত্বকের সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। ভারী ধাতু (সীসা, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম): এসব ধাতু একবার শরীরে গেলে সহজে বের হয় না। ধীরে ধীরে জমে কিডনি, লিভার, হৃদপিণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র ও হাড়ের গঠন নষ্ট করে দেয়। শিশুদের মানসিক বিকাশেও মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

পরিনতি ও ফলাফল:

ক্যান্সার, কিডনি ফেলিওর, লিভার সিরোসিস, হার্ট অ্যাটাক, স্নায়ুরোগ, বন্ধ্যাত্ব, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হওয়া। পুষ্টিবিদদের মতে, এসব ভেজাল খাবার গ্রহণে তাৎক্ষণিকভাবে দেখা দেয় বমি, ডায়রিয়া, পেট ব্যথা, এবং দীর্ঘমেয়াদে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো কার্যক্ষমতা হারায়।

শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে: শিশুদের জন্য তৈরি খাবার, পাউডার দুধ, স্ন্যাকস, জুস, চকলেট, নুডলস, এখন সমানভাবে দূষণের শিকার। শিশুরা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় খুব দ্রুত এসব বিষক্রিয়ার প্রভাব অনুভব করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি এক প্রকার ‘নীরব শিশু হত্যা’, যেখানে শিশুরা অজান্তেই ভবিষ্যতের ক্যান্সার বা দীর্ঘস্থায়ী রোগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আইন আছে, প্রয়োগ নেই:

বাংলাদেশে খাদ্য ভেজাল প্রতিরোধে একাধিক আইন রয়েছে: ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো; আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই, যার ফলে ভেজালকারীরা ধরা পড়লেও সাজা হয় না, অথবা কয়েক দিনের মধ্যেই বের হয়ে পুনরায় কাজ শুরু করে। বিভিন্ন সংস্থা যেমন বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, স্থানীয় প্রশাসন, সবাই দায়িত্বে থাকলেও তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, জনবল সংকট এবং মাঠ পর্যায়ে দুর্বলতা ভেজালের বিস্তারকে আরও সহজ করেছে। বাজারগুলোতে নজরদারির অভাব, অস্বচ্ছ সাপ্লাই চেইন এবং অপরাধীদের রাজনৈতিক ছত্রছায়া থাকায় এ সমস্যা বছর বছর বাড়ছে।

বাজার নজরদারি সীমাবদ্ধতা:

মাছ, মাংস, সবজি, এসবের মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিএসটিআই-এর নয়, ফলে সেখানে ভেজালের ব্যবহার শনাক্ত হলেও আইনি পদক্ষেপ স্পষ্ট নয়। তবুও বিএসটিআই অনেক সময় ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় ফরমালিন ও কার্বাইড পরীক্ষা করে থাকে। কিন্তু বাজারের বিস্তৃত পরিসর, পর্যাপ্ত জনবলের অভাব এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের গোপন কৌশল এই নজরদারিকে অকার্যকর করে দেয়।

সমাজ, রাষ্ট্র ও নাগরিক দায়িত্ব:

খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় সরকার যেমন মূল নেতৃত্ব দেবে, তেমনি ব্যবসায়ী ও ভোক্তা—সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে। নিচে সমস্যা সমাধানের কয়েকটি যৌক্তিক দিক তুলে ধরা হলো; শক্তিশালী আইন প্রয়োগ: ভেজালকারীর বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার, পুনরায় অপরাধ করলে কঠোর শাস্তি, মোবাইল কোর্টের সংখ্যা বৃদ্ধি, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচার।

সাপ্লাই চেইন ট্রেসিং: উন্নত দেশগুলোর মতো ‘খাদ্য ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম’ চালু হলে কোন পণ্যে কোথায় দূষণ হয়েছে তা সহজে শনাক্ত করা যাবে। একক খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ: একাধিক সংস্থার বদলে সমন্বিত একক কর্তৃপক্ষ থাকলে কাজ হবে দ্রুত, সঠিক ও কার্যকরভাবে।

কৃষিতে কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার: প্রশিক্ষণ, মনিটরিং, ক্ষতিকর কীটনাশকের আমদানি বন্ধ, অর্গানিক চাষাবাদে উৎসাহ প্রদান।

জনসচেতনতা বৃদ্ধি: ভোক্তাদের জানাতে হবে, রাসায়নিক দিয়ে পাকানো ফল চিনবেন কিভাবে, অ্যান্টিবায়োটিক মেশানো মুরগি শনাক্ত করার উপায়, ভেজাল পণ্যের ঝুঁকি, অভিযোগ জানানো ও আইনগত সহায়তা পাওয়ার পথ।

গবেষণা ও ল্যাব উন্নয়ন: দেশের সব বিভাগীয় শহরে আন্তর্জাতিক মানের টেস্টিং ল্যাব স্থাপন জরুরি।

ভেজাল স্বাস্থ্যহানি ও অর্থনীতির হুমকি:

ভেজাল খাদ্যের কারণে মানুষ বারবার অসুস্থ হয়, যার ফলে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ে, কর্মক্ষমতা কমে, এবং দীর্ঘমেয়াদে জাতির উৎপাদনশীলতা কমে যায়। ক্যান্সারসহ দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসা ব্যয় একটি পরিবারকে দ্রুত দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ফলে ভেজাল শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, জাতীয় অর্থনীতির ওপরও গুরুতর প্রভাব ফেলে।

এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যৎ আরও ভয়াবহ। বর্তমান পরিস্থিতি প্রমাণ করে, খাদ্য ভেজাল এখন আর বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়, এটি রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত সব কাঠামোকে আক্রান্ত করা একটি মহামারী। যে খাদ্য মানুষের বেঁচে থাকার মূল উপাদান, সেটিই যখন ক্যান্সার, কিডনি ফেলিওর এবং অঙ্গ বিকল হওয়ার কারণ হয়, তখন একটি দেশের জনগোষ্ঠী চরম ঝুঁকিতে পড়ে। খাদ্যে ভেজাল রোধে আইন আছে, গবেষণা আছে, তথ্যও আছে, নেই শুধু কঠোর প্রয়োগ ও সমন্বিত উদ্যোগ। তাই এখনই প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় কঠোরতা, ব্যবসায়িক নৈতিকতা ও

জনসচেতনতার সমন্বয়ে ভেজালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। নাহলে আগামী প্রজন্মকে নিরাপদ খাদ্য নয়, বরং বিষাক্ত ভবিষ্যতই উপহার দিতে হবে। খাদ্য হতে হবে নিরাপদ, পুষ্টিকর ও ভেজালমুক্ত, এটাই শুধু ব্যক্তিগত নয়, জাতীয় উন্নয়নের পূর্বশর্ত।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ।


ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয় চাটুকার বুদ্ধিজীবীরা

অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ্ চৌধুরী
আপডেটেড ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৯:১০
সম্পাদকীয়

আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি বিরাট অংশ নানাভাবে শাসক ও শোষক শ্রেণির পদলেহনে ব্যস্ত। নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তারা শুধু আত্মসমর্পণই করেননি, আত্ম বিক্রিও করেছেন। সত্যের সন্ধান করা, সত্য কথা বলা দূরে থাক, মিথ্যা বলা এবং চাটুকারিতাই তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাসকের মনোরঞ্জন এবং শোষকের সন্তুষ্টি বিধান করে তারা তৃপ্ত হন। অবশ্য এটি তাদের শ্রেণি চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। চাটুকারদের একটি কমন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এরা চরিত্রগতভাবে আত্মসম্মান বিবর্জিত হয়ে থাকেন। চরমভাবে অপমানিত হলেও এরা কিছু মনে করেন না। তাদের কাছে আত্মসম্মান নয়, স্বার্থ উদ্ধারই বড় কথা।

সমাজে দুটি মৌলিক শ্রেণি থাকে, যার একটি উৎপাদনের উপায়ের মালিক শ্রেণি, যারা শাসক, শোষক ও নিপীড়ক। আরেকটি উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা থেকে বঞ্চিত শ্রেণি, যারা প্রধানত উৎপাদন সংগঠনে শ্রম দিয়ে থাকে; তারা শাসিত, শোষিত ও নির্যাতিত। আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের দুটি মৌলিক শ্রেণি হলো-১. পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া শ্রেণি-এরা শাসক ও শোষক শ্রেণি এবং ২. শ্রমিক শ্রেণি বা সর্বহারা শ্রেণি-এরা শাসিত ও শোষিত শ্রেণি।

এ দুটি মৌলিক শ্রেণির বাইরে অমৌলিক শ্রেণির (non-basic class) অবস্থান। বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী তথা বুদ্ধিজীবীরা একটি অমৌলিক শ্রেণি। এরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্গত; আর মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগী, তা এক প্রমাণিত সত্য। পুঁজিবাদী সমাজে তারা বুর্জোয়া শাসক শ্রেণির সহযোগী। শাসক শ্রেণির সব ধরনের শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতনের সহযোগী শক্তি হিসাবে এরা কাজ করে। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে গত দেড় দশকে শাসক শ্রেণির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এরা অনেক বেশি সক্রিয় ও সোচ্চার ছিল। এরা অন্যায় শাসন কায়েমে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল।

এ কথা সত্য, সমাজে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী; যাদের আমরা সাধারণভাবে বুদ্ধিজীবী হিসাবে জানি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সমাজে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যারা শাসক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষায় আত্মনিয়োগ করেছেন এবং শাসকদের স্বার্থে কাজ করার মধ্য দিয়ে তারা হীন স্বার্থ হাসিল করে চলেছেন। স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থের জন্য এরা প্রভু বা শাসকদের পদলেহনে ব্যস্ত। শাসকের মনোরঞ্জন ও স্তুতিতে (পদলেহনে) এরা খুবই দক্ষ ও পটু। পদ-পদবির লোভে এরা নানাভাবে শাসক ও শক্তিধরদের তুষ্ট রাখতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। দালালি ও পদলেহনের প্রতিযোগিতায় যারা অগ্রগামী থাকেন, তারা শাসক-শোষকের নৈকট্য লাভ করেন এবং বড় বড় পদ-পদবি ও পুরস্কার বাগিয়ে নেন। এ প্রতিযোগিতায় যারা পেছনে থাকেন, তারাও ছিটেফোঁটা হালুয়া-রুটি ও ছোটখাটো আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হন না।

বিগত সরকারের আমলে আমরা চাটুকারিতার নগ্ন প্রতিযোগিতা প্রত্যক্ষ করেছি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ আদালত কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাকে চাটুকাররা মানবতার জননী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, উন্নয়নের রূপকার ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। একজন ইসলামি ব্যক্তিত্ব শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে তাকে ‘জান্নাতি মানুষ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। অবশ্য গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সেই ব্যক্তি বলেছেন, তিনি এমন কথা বলেননি। মিডিয়া তার বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ সফর করে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলন করতেন। সেখানে চাটুকার ও স্তাবক সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিযোগিতা শুরু হতো শেখ হাসিনার প্রশংসা কে কতভাবে করতে পারেন। এক সাংবাদিক শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, নেত্রী আপনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। আপনি লবিস্ট নিয়োগ দেন। চাটুকাররা শেখ হাসিনার এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিষয়টি ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। তারা নানাভাবে চাটুকারিতা করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। ছাত্র গণআন্দোলনে পতনের মুখে দাঁড়িয়েও তিনি চাটুকারদের চিনতে পারেননি। তাই তাদের স্তুতি বাক্যে যারপরনাই খুশি হতেন। চাটুকারদের প্রশংসা শেখ হাসিনাকে দেশের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে দেয়নি।

এমন বিরূপ পরিস্থিতিতেও ন্যায় ও সত্যের পূজারি স্বল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিতে দেখা যায়। শত নিপীড়ন ও নির্যাতন উপেক্ষা করে তারা বিশ্বাসে অবিচল থাকেন। সর্বকালে সব সমাজেই এ ধরনের উদাহরণ প্রত্যক্ষ করা যায়। মানব ইতিহাসে চাটুকার ও দালাল বুদ্ধিজীবীদের অনৈতিক কার্যকলাপের যেমন প্রমাণ পাওয়া যায়, তেমনি নির্লোভ, ত্যাগী বুদ্ধিজীবীদের শুভশক্তির পক্ষে অবস্থান গ্রহণের কাহিনিও লিপিবদ্ধ আছে। যুগে যুগে, দেশে দেশে, সমাজ বদলের আন্দোলন-সংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণের বহু উদাহরণ আছে। কিন্তু যারা শোষিত মানুষ তথা সর্বহারা শ্রেণির মুক্তির মহান লক্ষ্য অর্জনে বিপ্লবী আদর্শকে ধারণ করেছেন এবং শ্রেণিস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে শোষিত ও সর্বহারা শ্রেণির সঙ্গে একাত্ম হয়ে শ্রেণিসংগ্রামকে এর যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন, তাদের সংখ্যা বিরল।

দার্শনিক মার্কসের মতে, ‘philosophers have hitherto interpreted history, now the task is to change it’, অর্থাৎ ‘দার্শনিকরা এযাবৎকাল মানব ইতিহাসের ব্যাখ্যা করেছেন, এখন কাজ হবে একে বদলে দেওয়ার।’ দার্শনিক কার্ল মার্কসের এ উক্তির আলোকে এ কথা স্পষ্টতই বলা যায় যে, দার্শনিক তথা লেখক, চিন্তাবিদ, পেশাজীবী, এক কথায় বুদ্ধিজীবীদের কাজ শুধু সমাজ বিকাশের ইতিহাস ব্যাখ্যা করার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখা। এখন প্রয়োজন তাদের সমাজের মৌলিক পরিবর্তনে অংশগ্রহণ করা। বিদ্রোহ-বিপ্লবে তথা সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে যেমন বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণের উদাহরণ মেলে; অন্যদিকে এর বিপরীত স্রোতের বুদ্ধিজীবীদের ভূরি ভূরি উদাহরণও আছে।

১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে কাজ করেছিলেন তখনকার বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশ। মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী বুদ্ধিজীবী যারা এর বিরোধিতা করেছিলেন, তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। কিন্তু আজ প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৯৭১ সালে যারা গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন, তারা বিগত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে গণতন্ত্রের প্রসঙ্গে ছিলেন একেবারেই নিশ্চুপ। বরং সরকারের স্বৈরাচারী আচরণকে তারা নানাভাবে যৌক্তিকতা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন; গণতন্ত্রের প্রশ্নে ছিলেন নীরব। তারা গণতন্ত্রের পরিবর্তে তথাকথিত উন্নয়নের গুণকীর্তনে ছিলেন ব্যস্ত। অনেকে সরকারকে এমন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যে, উন্নয়নের স্বার্থে গণতন্ত্রকে বিসর্জন দেওয়া দোষের কিছু নয়। একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী সরকারের এ বক্তব্যকে জনপ্রিয়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অহর্নিশি। তারা উন্নয়নের কথা বলেন, কিন্তু ভুলে যান গণতন্ত্রহীনতায় যে উন্নয়ন, তা মূলত আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার কৌশল মাত্র। এ ধরনের উন্নয়ন কখনোই টেকসই হয় না, জনকল্যাণ তো নয়ই। গণতন্ত্র ছাড়া যে উন্নয়ন হয় না, তা তারা বুঝেও না বোঝার ভান করেন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানও উন্নয়নের কথা বলতেন। তিনি উন্নয়নের এক দশক পালন করেছিলেন। তখনকার বুদ্ধিজীবী ও জনগণ ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। আইয়ুব খানের নির্যাতন-নিপীড়ন যতই বেড়েছে, আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম ততই বেগবান হয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।

আমাদের দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের গৌরবোজ্জ্বল অবদান রয়েছে। কিন্তু এখনকার বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশই তা বেমালুম ভুলে গেছেন। আইয়ুব ও এরশাদের আমলের বুদ্ধিজীবীদের মতোই তারা দেখেও দেখেন না, শুনেও শোনেন না। বিগত সরকার আমলে আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছি, একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী লজ্জা, বিবেক এবং হিতাহিত জ্ঞান বিসর্জন দিয়ে স্বৈরাচারের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গল্প এবং গীত রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সম্প্রতি এক তরুণ কলামিস্ট এ ধরনের বুদ্ধিজীবীদের নামকরণ করেছেন ‘বুদ্ধিযুক্ত জিহ্বাধারী’। দার্শনিক মার্কসের সমাজ বদলের মর্মবাণী এদের কর্ণকুহরে কখনো প্রবেশ করেছে কিনা জানি না। আর প্রবেশ করলেও তা তাদের গ্রাহ্য করার কথা নয়। সমাজ বদল নয়, তারা সমাজকে আরও পিছিয়ে দিতে সক্রিয়।

আত্মসমর্পিত বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র মুৎসুদ্দী চরিত্র। এদের জাতীয় চরিত্র নেই বিধায় দেশপ্রেমও নেই। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এরা দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিদেশে শাসক ও শোষক শ্রেণির এজেন্ট হিসাবে কাজ করেন। প্রভুদের স্বার্থ রক্ষা এবং মনোরঞ্জন করাই এদের কাজ। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশে এখনো একটি জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থান ঘটেনি। এখানকার বুর্জোয়ারা কম্পারেডর বুর্জোয়া অর্থাৎ মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া। এদের অনুসারী তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবীরা দেশের সম্পদ পাচার বা স্বার্থ বিকিয়ে দিতে মোটেও দ্বিধা করেন না। এদের মাধ্যমেই শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। তবে এত কিছুর পরও কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী আছেন, যারা দেশের স্বার্থে কাজ করে চলেছেন। তারা দেশের সম্পদ রক্ষায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের দেশপ্রেম ও সমাজের প্রতি অঙ্গীকার তরুণ সমাজকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। সূচিত হয়েছে পরিবর্তনের নবযুগ।

লেখক: ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য; বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।


ভূমিকম্প নিয়ে পূর্বাপর কথা

মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

প্রথম অংশ
এই তো গত ২১/১১/২০২৫ইং তারিখ (শুক্রবার) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটের সময় ঢাকা রাজধানীসহ সারাদেশে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। অবশ্য মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার মতে এর মাত্রা ৫ দশমিক ৫। এর উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর মাধবদী; ভূ-পৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে এবং স্থায়িত্ব ছিল ২৬ সেকেন্ড। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, কয়েক দশকের মধ্যে সবেচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে দেশ। তীব্র ঝাঁকুনিতে হেলে পড়েছে বহুতল ভবন, রেলিং ভেঙ্গে এবং দেয়াল ধসে সারাদেশ নিহত হয়েছে ১১ জন এবং আহত হয়েছে প্রায় ৬ শতাধিক। আর এই ভূমিকম্পের ট্রমা কাটতে না কাটতেই গত শনিবার (২২/১১/২০২৫ইং) আবার পর পর তিন দফায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এক্ষেত্রে সকালের দিকে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৩.৩। তৎপর সন্ধ্যায় প্রথমটি ৩.৭ এবং পরেরটি মাত্রা ছিল ৪.৩। যদিও এতে ক্ষয়-ক্ষতি তেমন হয়নি। তবে এক্ষেত্রে সময়ের ব্যপ্তি বেশি হলে মারাত্মক হতো বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
মূলত ভূমিকম্প হলো- ভূ-পৃষ্ঠে সংঘটিত হঠাৎ ও অস্থায়ী কম্পন, যা ভূ-অভ্যন্তরস্থ শিলারাশিতে সঞ্চিত শক্তির বহির্প্রকাশ মাত্র। এটি উক্ত শিলারাশির সঞ্চিত শক্তির অবমুক্তির কারণে সৃষ্ট। আর এ স্পন্দনের মাত্রা মৃদু বা প্রচণ্ড হতে পারে। এটি তরঙ্গ গতির বিশেষ ধরনের শক্তি, যা স্বল্প পরিসরে উদ্ভুত হয়ে উৎস থেকে ছড়িয়ে পড়ে এবং যা কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট বা এর অধিক স্থায়ী হতে পারে। যে বিন্দুতে ভূমিকম্পের তরঙ্গ সূচিত হয়, তাকে কেন্দ্র বা ফোকাস বলে এবং এর থেকে সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ কেন্দ্র থেকে ঠিক এর ভূ-উপরস্থ যে বিন্দুতে অনুভূত হয়, তাকে উপকেন্দ্র বলে। আর এ উপকেন্দ্রেই প্রথম ঝাঁকি অনুভব হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, কেন্দ্রের গভীরতা অনুযায়ী ভূমিকম্পকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন- অগভীর কেন্দ্র (০-৭০ কি.মি.), মাঝারি কেন্দ্র (৭০-৩০০ কি.মি.) এবং গভীর কেন্দ্র (৩০০ কি.মি বা তার চেয়ে বেশী)। এদিকে ভূমিকম্পের আকার ও তীব্রতা মাপার জন্যে প্রচলিত মাপক হচ্ছে রিখটার স্কেল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৩৫ সালে ক্যার্লিফোনিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিশেষজ্ঞ চার্লস রিখটার এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যেটা বিভিন্ন ভূমিকম্পের তুলনামূলক চিত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে এঁকে ফেলতে সক্ষম। আর এ গণিত নির্ভর যন্ত্রটি দিয়ে তখন থেকে ভূকম্পনের মাত্রা পরিমাপের জন্য ব্যবহার হয়ে আসছে। তাই চার্লস রিখটারের নামের সূত্র ধরে এ যন্ত্রটির নাম হয়েছে ‘রিখটার ম্যাগনিচুউড স্কেল’, সংক্ষেপে ‘রিখটার স্কেল’। এ স্কেলে তীব্রতা নির্ধারণে সিসমোগ্রামে সর্বোচ্চ পৃষ্ঠে তরঙ্গ বিস্তার এবং সে সূত্র ধরে প্রাথমিক (চ) ও মাধ্যমিক (ঝ) তরঙ্গ পৌঁছানোর ‘সময়ের পার্থক্য’ কে ভিত্তি করে ‘ভূকম্পন মাত্রা’ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন কারণে ভূমিকম্প হতে পারে। তবে এগুলো প্রধান দুশ্রেণির আওতাভুক্ত। একটি ভূÑগাঠনিক, আর অন্যটি অ-ভূ-গাঠনিক। এদিকে সবচেয়ে মারাত্মক হলো পৃথিবীর প্লেটের তারতম্য হেতু ভয়াবহ সুনামি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এ পৃথিবী ছোট বড় ২৭টি প্লেট নিয়ে গঠিত, এর মধ্যে ৭টি বড় এবং ২০টি ছোট। আর এ প্লেটগুলোর আয়তন কয়েক হাজার হতে কয়েক কোটি বর্গমাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এ প্লেটগুলো সর্বদা চলমান, কখনও বিপরীতমুখী আবার কখনও সমমুখী। সাধারণত দুটি প্লেটের সংঘর্ষে ও অন্যান্য কারণ বশতঃ সাগরতলে প্রচন্ড ভূ-কম্পের সৃষ্টি হয়, যার ফলশ্রুতিতে ভয়াবহ সুনামি ঘটে থাকে। সুনামি শব্দটি এসেছে জাপানি ভাষা থেকে, আর এর আভিধানিক আক্ষরিক অর্থ ‘পোতাশ্রয়ের ঢেউ’। আসলে সমুদ্রের তলদেশে তাপের তারতম্যহেতু ভূ-প্লেট সম্প্রসারিত হলে পচণ্ড কম্পনের সৃষ্টি হয়। এটিই ঢেউ তথা সুনামির সৃষ্টি করে। আর সাধারণত দুটি প্লেটের সংযোগ স্থলে বা অঞ্চলে বা কোন এলাকায় ফাটল থাকলে সেথায় ভূমিকম্প অনিবার্য হয়ে বসে। বাংলাদেশ, ভারত প্লেটের অংশ, যা উত্তর পূর্বে অবস্থিত। তাছাড়া ভূ-তাত্ত্বিক গঠন ও টেকটনিক কাঠামোর কারণে বাংলাদেশ ভূ-কম্পন প্রবণ এলাকা, বিশেষ করে সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যাহোক, আবার সুনামিতে ফিরে আসি। সাধারণত সুনামি বা ঢেউের উৎপত্তি স্থলে এর উচ্চতা কয়েক সেন্টিমিটার। অথচ পরবর্তীতে ৩০ থেকে ৫০ মিটার উচ্চতায় বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলের জনপদ সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ফলশ্রুতিতে ঘর-বাড়ী, দালান-কোঠা ধ্বংস সহ অসংখ্য মানুষ ও প্রাণীর জীবন কেড়ে নেয়। ইতোপূর্বে জাপানে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পজনিত সুনামিহেতু বাংলাদেশে ভূমিকম্পের আশংকায় জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ইতোবাচক দিক পালন করছে। কেননা বঙ্গপোসাগরের মহীসোপান অগভীর বিধায় সুনামি তেমন একটা আঘাত হানতে পারবে না বলে প্রতীয়মান হয়। এদিকে ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে পৃথিবীকে ব্যবচ্ছেদ করলে তিনটি প্রধান অংশ পাওয়া যায়, যেমন কোর বা কেন্দ্র, ম্যান্টেল বা মাঝের অংশ এবং ক্রাস্ট বা পৃষ্ঠ। আবার পৃষ্ঠ দুধরনের, একটি মহাদেশী পৃষ্ঠ এবং অন্যটি সামুদ্রিক পৃষ্ঠ। পূর্বেই উল্লেখ্য করেছি যে, এ অবনীকে ঘিরে অসংখ্য ছোট-বড় প্লেট আছে, যা প্রতিনিয়ত কম্পনশীল। প্লেটগুলো লিথোস্ফেয়ারের উপরের অংশ। আর এর নিচে গলিত অ্যাসথেনোস্কেয়ার, যার উপরে প্লেটগুলো নড়াচড়া অব্যাহত রেখেছে। তবে নড়াচড়া অস্বাভাবিক হলে পরিনতি হয় মারাত্মক। যাহোক, বাংলাদেশে যে সব উৎস থেকে অতীতে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে, আগামীতে সেসব উৎস থেকে আবারও মারাত্মক ভূমিকম্প হতে পারে।
উল্লেখ্য যে, বৈশিষ্ট বা চরিত্রগত দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় পলিমাটি দিয়ে গঠন, ব-দ্বীপ এবং তিনটি প্লেটের ওপর বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ার কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকিটা অনেক বেশি। এই ঝুঁকির আরেকটি প্রাকৃতিক কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ বৃষ্টিবহুল এলাকায় অবস্থিত। এ প্রেক্ষাপটে ঢাকার চারপাশ নদী আর খাল-বিলে ঘেরা। এখানকার গঠন পলিমাটির ওপর। এক্ষেত্রে ঢাকাকে ভৌগলিক অবস্থানের পাশাপাশি মাটির গঠনের কারণে বিপজ্জনক হতে পারে। অবশ্য গোটা বাংলাদেশেই বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। ইউরেশিয়ান, ইন্ডিয়ান এবং বার্মিজ প্লেটের সঙ্গমস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। আর তিনটি প্লেটের পারস্পপারিক সংঘষের কারণে তৈরীপূর্বক ভূমিকম্প হওয়ার আশংকা অনেক বেশি। এদিকে আমাদের শহরগুলো যথাযথ পরিকল্পনাহীন ও অতিবিপজ্জনক হিসেবে গড়ে উঠেছে। যেভাবেই বলি না কেন, আমরা একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প প্রবন এলাকার খুব নিকটবর্তী। তাই কোনো সন্দেহ নেই, নিশ্চিত ভূমিকম্প হবেই, যা কয়েক শত বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয়ে থাকে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে চারটি বড় ধরনের চ্যুতি রয়েছে। আর সে চ্যুতি থেকে মহানগরী ঢাকা রাজধানী মাত্র ২৫ থেকে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান। তাছাড়া অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন সম্প্রসারণ, জনসংখ্যার চাপ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গভীর নলকূপের দ্বারা ভূ-অভ্যন্তর থেকে পানি উত্তোলন, ইত্যাদি। তাই ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে এগুলো খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এদিকে বিশেষজ্ঞদের অভিমত অনুযায়ী ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীতে বড় ধরনের ভূমিকম্প বয়ে আনতে পারে মহাবিপর্যয়। এ প্রসঙ্গে বুয়েটে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের উক্তি অনুযায়ী জানা যায় যে, ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য প্রণীত বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না। একের পর এক তৈরি হচ্ছে উঁচু ইমারত বা ভবন। অবশ্য যে সব ইমারত বিল্ডিং কোড না মেনে তৈরি করা হয়েছে, সে সব ভবনে এক্সর্টানাল জ্যাকেটিং এর মাধ্যমে খুটির শক্তি বাড়ানো সম্ভব। তাছাড়া এ সময় যে সব বিল্ডিংগুলো হচ্ছে, সেগুলোকে ভূমিকম্প প্রতিরোধের জন্যে কন্ট্রোল সিস্টেম সংযোজন করা আবশ্যক। যদিও এটা ব্যয়বহুল, তথাপিও ক্ষয়ক্ষতি ও জান-মালকে বিপদ থেকে বাঁচতে হলে এ ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প আছে বলে আপাতত দৃষ্টিতে মনে হয় না। এটা সত্য যে, প্রকৃতিগত নিয়মে সৃষ্ট ভূমিকম্প রোধ করা সম্ভব নয়, তবে ভূমিকম্পের কারণে উদ্ভুত ক্ষয়-ক্ষতি ও জীবন নাশ কমিয়ে আনা সম্ভব। বড় ভূমিকম্পে ধসে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার মতো ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছে পুরান ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামের বহুসংখ্যক ভবন। বড় ভূমিকম্প হলে ঢাকার ছয় লাখ ভবন, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে, যার বেশির ভাগই পুরান ঢাকায়। পাশাপাশি দেশের অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভূকম্পন এলাকার মধ্যে অন্যতম অবস্থানে রয়েছে সিলেট। পার্শ্ববর্তী ডাউকি ফল্ট ও স্থানীয়ভাবে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পের আওতায় রয়েছে এ জেলা। ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই এখানকার পুরোনো ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। একইভাবে চট্টগ্রাম নগরীতে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১১১টি ভবন আছে, যার মধ্যে ৭০ থেকে ৮৫ শতাংশ ভবনই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার মতো ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের শংকা যে, সামনে রিখটার স্কেলে ৮.২ থেকে ৯.০ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী। জনসংখ্যার ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ, অপ্রশস্ত সড়ক, অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অভাব এ ঝুঁকি তৈরি করেছে। ঢাকায় ৫.৭ মাত্রার যে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে সেটির উৎপত্তিস্থল মধুপুর ফল্ট লাইন, যা এত দিন নিষ্ক্রিয় ছিল। বর্তমানে হঠাৎ করে এটি সক্রিয় হয়ে উঠেছে, যা খুবই উদ্বেগের বিষয়।

লেখক: বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।


অনিশ্চয়তার অর্থনীতি ও কৃষকের সমাজতত্ত্ব

ড. মিহির কুমার রায়
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

অর্থনীতির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক বর্তমানে নিম্নমুখী রয়েছে। যেমন বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি, নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলা এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি—এই সবই বিনিয়োগ স্থবিরতা ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির দীর্ঘায়িত প্রভাব, কারখানায় গ্যাসসংকট ও ডলারের তারল্য সংকট। এরই মধ্যে সাড়ে তিন শরও বেশি ছোট ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান খাতে তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এই দ্বিমুখী ধাক্কার মুখে রাজনৈতিক সংঘাত শুরু হলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অসম্ভব হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। তারা আশঙ্কা করছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়লে ক্ষতিতে চলে যাবে অর্থনীতি। আবার সম্প্রতি আইএমএফ বলেছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও সংস্কারের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তবে দুর্বল কর রাজস্ব, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনীতি এখনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আইএমএফ আরও বলেছে, রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সমস্যা মোকাবিলায় সাহসী নীতি গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। যাতে টেকসই আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করে শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করা যায়। ঝুঁকিও এখনো প্রবল। বিশেষ করে যদি নীতি প্রণয়নে বিলম্ব হয় কিংবা অপর্যাপ্ত নীতি গ্রহণ করা হয়, তাহলে ঝুঁকি থাকবে। আইএমএফ মনে করে, মধ্য মেয়াদে শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করা, যুব বেকারত্ব হ্রাস এবং অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ব্যাপক কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনাকে বাড়াবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।
এ ধরনের একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে ১ লা নভেম্বর জাতীয় কৃষি দিবস ও অগ্রহায়ণ-নবান্ন উৎসব পালিত হলো সারা দেশে। এখানে উল্লেখ্য হাজার বছরের এই কৃষিভিত্তিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে পহেলা দিনটিকে ‘জাতীয় কৃষি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলার হেমন্তকাল মানেই ধান কাটা, নতুন চালের পিঠা-পায়েস আর কৃষকের মুখে হাসি। এই দিনটি কৃষির অগ্রযাত্রা পর্যালোচনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণের এটি এক জাতীয় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি হলেও এর প্রাণপুরুষ সেই কৃষক আজও সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০% কৃষির সঙ্গে যুক্ত, অথচ কৃষির মোট জিডিপি অবদান মাত্র ১৩-১৪%। এর মানে দাঁড়ায়, কৃষকের পরিশ্রমের প্রকৃত আর্থিক মূল্য সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে না। এই বৈষম্যই কৃষকজীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
৮. জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে তাও আবার প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এই সরকার ক্ষমতায় এসেই নানামুখী সংস্কার নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে। ১১টি বিষয়ে সংস্কার সাধনের জন্য তারা কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু কৃষি বা কৃষক বিষয়ে কোনো কমিশন হয়নি। হয়নি হয়তো দুটো কারণে। এক. এটি সরকারের প্রায়োরিটি বিষয় নয় এবং দুই. কৃষি বা কৃষকের কোনো সমস্যা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, কৃষিপ্রধান দেশ হলেও বাংলাদেশে কৃষি কোনো সরকারের আমলেই প্রাধান্য পায়নি। কৃষি দেশের সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান খাত হলেও এখানকার উৎপাদকদের জন্য কোনো নির্ধারিত মূল্য নীতি নেই, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। পণ্যের অস্থির বাজারমূল্য, উৎপাদন ব্যয় না ওঠা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনাকে বক্তারা এই সংকটের চরম বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এখানে উল্লেখ্য সম্প্রতি মেহেরপুরের পেঁয়াজ চাষি সাইফুল শেখ মহাজনী ও এনজিও ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এই কৃষক প্রতি মন পেয়াজ ৬০০ টাকা দরে বিক্রি করার পর যখন দেখেন, সেই পেয়াজ ব্যাপারি সপ্তাহ পর ২০০০ টাকা প্রতিমন দরে বিক্রি করছে, তখন যন্ত্রণাদগ্ধ হওয়ারই কথা। তারপর সাইফুল শেখের কন্যা রোফেজা বলেন, আমার বাবার মতো কৃষক যদি আত্মহত্যা করে তা হলে মানুষের অন্ন জোগান দেবে কে? মাত্র ছয় হাজার টাকা কৃষি ঋণ নিয়ে কৃষক জেলে গেছে, এরকম নজিরও আছে। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পেঁয়াজ চাষি মীর রুহুল আমিন ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবন শেষ করে দিয়েছেন। কারণ সেই একই– পেঁয়াজ চাষে লোকসান। সঙ্গে ঋণের ভার। ১৮ আগস্ট একই জেলার মোহনপুরে পানচাষি আকবর হোসেন নিজের পানের বরজেই গলায় দড়ি দিয়েছেন। জানা যায়, আকবর হোসেন ১১টি এনজিও এবং স্থানীয় সুদের কারবারিদের কাছ থেকে ৬-৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু পরিশোধ করতে পারছিলেন না। ঋণের কিস্তি ছিল প্রতি সপ্তাহে ৫ হাজার টাকা। কিন্তু পানের দাম না পাওয়ায় ঋণ পরিশোধ করতে কষ্ট হচ্ছিল। এদিকে প্রতিদিন কিস্তির জন্য এনজিওর লোকেরা চাপ দিতেন। সে চাপ সহ্য করতে না পেরে অবশেষে গলায় দড়ি দিলেন। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছে একই জেলার পবা উপজেলায়। কৃষক মিনারুল ১৪ আগস্ট স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার আগে রেখে গেলেন একটি চিরকুট। তাতে লেখা– ‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। এত কষ্ট আর মেনে নিতে পারছি না।’
আমাদের এই সমাজে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কথাই কেবল খবরে আসে। তারা কোথায় নাশতা করেন, কোন হোটেলে ঘুমান। কিন্তু কৃষক মরে গেলেই কেবল খবর হয়। তাও সবসময় নয়।কৃষকের আত্মহত্যায় এই সমাজের কারও কিছু যদি যেত বা আসত, এত মৃত্যুর কোথাও না কোথাও প্রতিক্রিয়া হতো। নিদেনপক্ষে একটা মিছিল বা মানববন্ধন। তেমন কিছুই হলো না। খবরের কাগজে সংবাদেই সব শেষ। কারণ কৃষকরা সমাজে এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নন। গুরুত্বপূর্ণ হতে হলে দুটি বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়। এক. ব্যক্তিগত বিপুল অর্থসম্পদের মালিক এবং দুই. শ্রেণিগতভাবে সংগঠিত। আমাদের কৃষকদের এ দুটির কোনোটাই নেই। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও এ দেশে শক্তিশালী কোনো কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। তার মানে কি এই, বর্তমানে কৃষকদের কোনো সমস্যা নেই? তারা খুব সুখে আছেন? তাহলে কিছুদিন পরপর দেশের নানা জায়গায় কৃষকদের গলায় দড়ি পরতে হয় কেন? বলাবাহুল্য, ১৯৯৯ সালে প্রথম জাতীয় কৃষিনীতি প্রণীত হয়। ২০১৩ সালে একবার তা পরিমার্জন করা হয়। ২০১৮ সালে আরেকবার। প্রশ্ন হলো– আমাদের কৃষিনীতিতে কী আছে, তা কি কৃষক জানেন? এ ধরনের যে একটা আইন আছে, সেটাই বা কেউ জানেন? শুধু কৃষক নন; এই যারা কৃষকদের নিয়ে রাজনীতি করেন, তারা কি জানেন? আমি অন্তত গত ৪০ বছরে সংসদে বা অন্য কোথাও আমাদের কৃষিনীতি নিয়ে কোনো বিতর্ক শুনিনি। কোনোদিন কি তারা দেশের কৃষি বা কৃষক নিয়ে কোনো আয়োজন করেছেন? কারণ, আমাদের যে কৃষিনীতি, তা কেবলই উৎপাদনমুখী। উৎপাদন বৃদ্ধিই এর প্রধান লক্ষ্য। উৎপাদনের পেছনে যেসব মানুষ রয়েছেন, তাদের নিয়ে কোনো ভাবনা এই নীতিতে নেই।
পৃথিবীর উন্নত কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে কৃষকের জন্য বিভিন্ন সুরক্ষা কর্মসূচি থাকে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তেমন কর্মসূচি নেই। সময়ের আবর্তে এক সময় যেখানে কৃষিকাজে নিয়োজিত হাউজহোল্ডের সংখ্যা ছিল ৯০ শতাংশ, বতর্মানে এসে দাঁড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে, যা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি। চলতি বছরের বাজেটে কৃষি শস্য খাতের অংশ মাত্র ৩.৪%, যা টাকার অংকে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ২২৪ কোটি। আবার কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। কৃষি খাতের নিম্নগামী প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না। এর একটি কারণ হলো মূল্য নিয়ন্ত্রয়ণের কোনো বিধিবদ্ধ সংন্থা নেই। যার কারণেই কার্যকর কৃষি মূল্য কমিশন গঠনের প্রসঙ্গ এসেছে, যা সময়ের দাবি। সরকার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে একটি কমিশন গঠনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে। পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ থাকলেও কৌশলগত পরিকল্পনা ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষকদের জন্য এ বছর ৩৭ হাজার কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এবং ধান-চালের দাম নির্ধারণে কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা কৃষকদের জন্য শস্য বিমা চালু, আধুনিক সংরক্ষণব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমানোর আহ্বান জানান। তারা বলেন, কৃষি মূল্য কমিশন গঠন শুধু কৃষকদের আত্মহত্যা রোধ করবে না, বরং তা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করে সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। তার মানে প্রাইস কমিশনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এখন প্রশ্ন হলো এই কমিশনের কাঠামো কি হবে? সেটা হতে হবে একটি সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন সংস্থা। সংস্থাটি পণ্যের মূল্য উঠানামা, কৃষি বাজার নিয়ন্ত্রণে পরামর্শ, বাজার ম্যানিপুলেশন ও কৃষকের পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এর অংশ হিসাবে কমিশন বাজারের গতিবিধি বিশ্লেষন, উৎপাদন খরচ বিবেচনা এবং বিভিন্ন কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ (এমএসপি) নির্ণয় করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তাছাড়াও কৃষি সাবসিডি, মূল্য সংযোগ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিও কমিশন দেখবে। এতে কৃষকরা একটি স্থিতিশীল বাজার মূল্য পাবে যা তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য সহায়ক। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্পে কেবল ম্যানুফ্যাকচারিং খাত কিংবা আরএমজির কথা উঠে এসেছে। কারণ এর মাধ্যমে ৪০-৪৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে প্রতি বছর। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক কাঠামোর কথা বললে দেশের প্রকৃত নায়ক হচ্ছেন কৃষক। ঠিকমতো দাম পাক আর না পাক তারাই দেশের প্রকৃত নায়ক। তাই সমন্বিত একটি কৃষিনীতি প্রণয়নে কাজ করা উচিত সরকারের।

লেখক: কৃষি গবেষক ও অর্থনীতিবিদ, সাবেক ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি।


সাংবাদিকতা; হলুদ সাংবাদিকতার সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি

সোমা ঘোষ মণিকা
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

সাংবাদিকতা একটি সভ্য সমাজের আলোকবর্তিকা। যে সমাজে তথ্য গোপন থাকে, যেখানে সত্যকে আড়াল করা হয়, সেখানে সভ্যতার অগ্রগতি থেমে যায়। সংবাদমাধ্যম তাই শুধু সংবাদ পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠান নয়, এটি রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয়ের মধ্যে এক সেতুবন্ধন। একজন সাংবাদিক যখন মাঠে যান, তখন তিনি শুধু খবর সংগ্রহ করেন না বরং সমাজের অদেখা সত্যগুলো খুঁজে বের করেন। এই সত্য প্রতিষ্ঠার দায় থেকেই সাংবাদিকতা আজও গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে সাংবাদিকতার পথচলা দীর্ঘ। ছাপাখানার আবিষ্কার ছিল তথ্য বিপ্লবের প্রথম ধাপ। ইউরোপের নবজাগরণ পর্বে সংবাদপত্র মানুষের চিন্তা ভাবনা পরিবর্তন করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে দৈনিক সংবাদপত্রের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা একটি পূর্ণাঙ্গ পেশায় রূপ নেয়। এরপর কালের পরিক্রমায় সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিক শাসন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম—সবকিছুর সঙ্গেই সাংবাদিকতা এক মিশনে যুক্ত ছিল।

সুস্থ সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি হলো সত্য, নিরপেক্ষতা এবং অনুসন্ধান। সাংবাদিকতা কখনো শুধু ঘটনার বিবরণ নয়, বরং ঘটনার পেছনের কারণ, প্রেক্ষাপট এবং তার সামাজিক প্রভাব তুলে ধরার কলা। বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে সাংবাদিকতার নৈতিকতা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। তথ্য যাচাই, বিভিন্ন সূত্রের মতামত গ্রহণ, পর্যালোচনা, প্রমাণভিত্তিক বিশ্লেষণ—এসব নিয়ম অনুসরণ করেই গড়ে ওঠে বিশ্বাসযোগ্য সাংবাদিকতা।

বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতার সূচক প্রতি বছর দেখায় কোন রাষ্ট্রে সাংবাদিকরা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন। যেখানে সাংবাদিকতা স্বাধীন সেখানে সমাজে বা স্বচ্ছতা বজায় থাকে ,রাষ্ট্রক্ষমতা জবাবদিহিতার আওতায় থাকে এবং জনগণের মতো প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়। কিন্তু যে দেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা সংকুচিত হয় সেখানকার গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে।

একসময় সংবাদপত্র ছিল মানুষের তথ্য জ্ঞানের প্রধান উৎস। পরবর্তীতে রেডিও টেলিভিশন এবং বর্তমানে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যুক্ত হওয়ায় সাংবাদিকতার বিস্তার বেড়েছে বহুগুণ। এখন সংবাদ ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না মুহূর্তের বেশি। এই গতির সঙ্গে এসেছে প্রতিযোগিতা আর সেই প্রতিযোগিতাই কখনো কখনো সংবাদমাধ্যমকে টেনে নিয়ে গেছে অপসংস্কৃতির দিকে।

এই অপসংস্কৃতির সবচেয়ে পরিচিত নাম হলো হলুদ সাংবাদিকতা। হলুদ সাংবাদিকতার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে দুই সংবাদপত্র মালিকের তীব্র প্রতিযোগিতা থেকে। তারা পাঠক বাড়ানোর জন্য এমন সব শিরোনাম তৈরি করতে শুরু করেন যা ভয় উদ্বেগ বা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এতে তথ্যের সত্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা উপেক্ষিত হতে থাকে। শিরোনাম বড় হতে থাকে সংবাদ ছোট হতে থাকে অথচ পাঠকের অনুভূতিকে উত্তেজিত করার কৌশল হয়ে ওঠে প্রধান লক্ষ্য।

হলুদ সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য সহজেই চেনা যায়। প্রথমত এতে অতিরঞ্জিত শিরোনাম ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয়ত তথ্য যাচাই খুব কম দেখা যায়। তৃতীয়ত অজানা বা গোপন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তেজক সংবাদ তৈরি করা হয়। চতুর্থত অপরাধ যৌনতা রক্তক্ষয় স্ক্যান্ডাল ইত্যাদি বিষয় অধিক গুরুত্ব পায়। পঞ্চমত সংবাদকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয় যাতে পাঠকের মনে আকস্মিক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। ইতিহাসে দেখা গেছে অতিরঞ্জিত সংবাদ কখনো কখনো যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরির ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছে। রাজনৈতিক বিভাজন বাড়ানোর ক্ষেত্রে হলুদ সাংবাদিকতা অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেক সময় রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে জনমত প্রভাবিত করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হওয়া সাম্প্রতিক সময়ের বড় উদাহরণ।

সারসংক্ষেপে বলা যায় সাংবাদিকতা সমাজের বিবেক আর হলুদ সাংবাদিকতা সেই বিবেকের ওপর আঘাত। সুস্থ সংবাদমাধ্যম একটি জাতিকে আলোকিত করতে পারে আর অসুস্থ সংবাদমাধ্যম জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে। তাই দায়িত্বশীল সাংবাদিকতাই আমাদের পথ দেখাবে উন্নত মানবিক সমাজের দিকে।


এভাবে কি ফেরা যায়?

ডা. এ কে এম মাজহারুল ইসলাম খান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ এমন এক সময় এসেছে যখন একটি প্রশ্ন চারদিকে ভাসছে—৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ যে আচরণ ও কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে, এই উপায়ে কি তারা আবার ফিরে আসতে পারবে? একসময় স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী, ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠা এই দলটি আজ যেভাবে হুমকি, উসকানিমূলক বক্তব্য, প্রতিশোধের রাজনীতি এবং আগুন সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়েছে, তাতে জনগণের মনে প্রশ্ন—এই দল কি সত্যিই আবার রাজনীতির মূলধারায় জায়গা করে নিতে পারবে, নাকি নিজেদের ভুল স্বীকার করে আত্মসমালোচনার পথে না হাঁটলে তাদের রাজনৈতিক পুনর্জন্ম আর সম্ভব নয়?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস কখনোই সহিংসতামুক্ত ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকে ক্ষমতার পালাবদলের প্রতিটি অধ্যায়ে দমননীতি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, গ্রেপ্তার, মামলা ও হামলা ছিল এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় যে ভয়াবহ সহিংসতার জন্ম হয় এবং তার পরপরই যে প্রতিশোধপরায়ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে নতুন এক দাগ এঁকে দেয়। শেখ হাসিনার পতনের পর যখন মানুষ ভেবেছিল একটি শান্তিপূর্ণ নতুন অধ্যায় শুরু হবে, তখন দেশের নানা জায়গায় আওয়ামী লীগের অংশবিশেষ অনুসারীরা উসকানিমূলক ভাষণ, হুমকি এবং আগুন সন্ত্রাসের মতো কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়। এটি কেবল ক্ষমতা হারানোর প্রতিক্রিয়া নয়; এটি ছিল এক মানসিক প্রতিক্রিয়া, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় ‘authoritarian relapse’ বা স্বৈরাচারী মানসিকতার পুনরুত্থান। ক্ষমতা হারানোর পর সহিংসতায় ফিরে যাওয়ার এই প্রবণতা শুধু বাংলাদেশের নয়, অনেক দেশের ইতিহাসেই দেখা গেছে। লাতিন আমেরিকার চিলি, আফ্রিকার রোয়ান্ডা কিংবা মিশর—সব জায়গায় ক্ষমতা হারানো দলগুলো নিজেদের হারানো নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য প্রথমে হুমকি ও ভয়কে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এই পথ কোনো দলকেই টিকিয়ে রাখতে পারেনি। চিলির সামরিক শাসক অগাস্টো পিনোচের পতনের পর তার অনুসারীরা যখন পুনরায় রাজনীতিতে ফিরতে চাইল, তখন জনগণ তাদের মনে রেখেছিল রক্তপাতের স্মৃতি। সেই দল পরে ক্ষমতার কাছে নয়, বরং অনুশোচনার কাছে ফিরে গিয়েই টিকে থাকতে পেরেছিল।

দক্ষিণ আফ্রিকার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)–এর উদাহরণও এখানে প্রাসঙ্গিক। নেলসন ম্যান্ডেলার পর দলটি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে জড়িয়ে পড়ে। জনগণের আস্থা হারিয়ে যখন দলটি সংকটে পড়ে, তখন সিরিল রামাফোসা প্রকাশ্যে আত্মসমালোচনার পথ নেন, দলের ভেতরে ‘আত্মশুদ্ধি কমিশন’ গঠন করেন। এই অনুশোচনাই এএনসিকে টিকিয়ে রেখেছিল। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের জন্যও সেই আত্মশুদ্ধির মুহূর্ত এখন অপরিহার্য।রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘legitimacy crisis’ বা বৈধতার সংকট বলে একটি ধারণা আছে—যখন কোনো দল রাজনৈতিক বৈধতা হারায়, তখন তাদের পুনরাগমন সম্ভব হয় দুটি শর্তে: প্রথমত, তারা হিংসা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে সরে এসে বিশ্বাসের রাজনীতিতে ফিরে আসে; দ্বিতীয়ত, তারা জনগণের সামনে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং নতুন সামাজিক চুক্তি প্রতিষ্ঠা করে। আজ আওয়ামী লীগের পুনরাবর্তন এই দুই শর্তের ওপরই নির্ভর রাজনীতি আসলে স্মৃতির প্রতিযোগিতা। জনগণ কখনও ভুলে যায় না কে তাদের ভয় দেখিয়েছিল, কে তাদের বঞ্চিত করেছিল। তাই যারা জনগণের মনে ভয় তৈরি করে, তারা পরবর্তীতে ক্ষমা চাইলেও সহজে গ্রহণযোগ্য হয় না। জনগণের কাছে আবার হতে হলে ভয় নয়, সহানুভূতির স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে হয়। বিএনপি ২০০৭ সালে সেনাশাসনের পর যখন জনগণের আস্থা হারিয়েছিল, তখন আত্মসমালোচনার জায়গায় তারা অভিযোগের পথে গিয়েছিল—ফলাফল ছিল দীর্ঘ রাজনৈতিক নির্বাসন। রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানে বলা হয়, মানুষ ভুল করে কিন্তু অনুশোচনা করলে ক্ষমা করতে পারে। জার্মানির নাৎসি-পরবর্তী রাষ্ট্রগঠনে এই তত্ত্বের সফল প্রয়োগ দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির সমাজে যেসব ব্যক্তি নাৎসি দলের সদস্য ছিল, তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করে নেয় নিজেদের ভুল, অংশ নেয় পুনর্গঠনে, শেখে গণতন্ত্র। ফলাফল—জার্মানি আজ ইউরোপের স্থিতিশীল গণতন্ত্রগুলোর একটি। ক্ষমা ও আত্মসমালোচনার শক্তিই সেখানে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের মূলভিত্তি হয়েছিল।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগও যদি নিজের অতীতের দায়—দমননীতি, গণগ্রেফতার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, এবং আগুন-সন্ত্রাসের ঘটনাগুলোর জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করে, তবে তার মধ্য দিয়েই নতুনভাবে রাজনীতির সূচনা সম্ভব। কিন্তু যদি তারা অস্বীকারের রাজনীতি চালিয়ে যায়, যদি অহংকার ও প্রতিশোধকে রাজনীতির ভাষা করে তোলে, তবে ইতিহাসের চাকা আর তাদের পক্ষে ঘুরবে না।মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড বা আর্জেন্টিনার পেরোনিস্টদের অভিজ্ঞতাও তাই বলে। ক্ষমতা হারিয়ে তারা প্রথমে সহিংস প্রতিরোধে নেমেছিল, কিন্তু পরে উপলব্ধি করেছিল, জনগণের সঙ্গে সংঘর্ষ করে নয়, বরং জনগণের পাশে দাঁড়িয়েই টিকে থাকা যায়। আওয়ামী লীগ যদি শেখে, রাজনীতিতে ভয় নয়, বিশ্বাসই টিকে থাকার একমাত্র পথ—তবে এখনো তাদের জন্য দরজা বন্ধ হয়নি। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বাংলাদেশ এখন এক ‘রাজনৈতিক আঘাতপ্রাপ্ত সমাজ’—যেখানে মানুষ রাজনীতির নাম শুনলে আতঙ্কিত হয়। দীর্ঘ দেড় দশক ধরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, প্রশাসনিক নিপীড়ন ও দলীয় কর্তৃত্ব মানুষকে রাজনীতি থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন করেছে। জনগণ এখন রাজনীতিতে ফিরে চায় আশ্বাস—আমি কি নিরাপদ? আমার ভোট কি গণ্য হবে? আমার মতো প্রকাশের স্বাধীনতা কি থাকবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারলেই কোনো দল নতুন করে জনগণের মন জয় করতে পারে।

এখানে ফেরা মানে আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া নয়; ফেরা মানে নতুন হয়ে ফেরা। আওয়ামী লীগ যদি তাদের পুরনো গৌরব—স্বাধীনতার দল, সংবিধান প্রনয়ণের সাথে সম্পৃক্ত দল, জনগণের প্রতিনিধি—এই মূল্যবোধগুলো পুনরুদ্ধার করতে চায়, তবে তাদের আগে ভয় ও দমননীতির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মানুষ এখন আর অন্ধভাবে অনুসারী নয়; তারা বিচার করে, তারা স্মরণ রাখে, তারা পরিবর্তনের দাবিদার। তবু আশার জায়গা আছে। বাংলাদেশের রাজনীতি বহুবার ভেঙে পড়েছে, তবু প্রতিবারই উঠে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতির নতুন নৈতিক রূপান্তরও অসম্ভব নয়। কিন্তু সেই পরিবর্তন আসবে কেবল তখনই, যখন ক্ষমতা নয়, নৈতিকতা হবে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু।

রাজনীতি শেষ পর্যন্ত মানুষের বিশ্বাসের শিল্প। ক্ষমতা ধরে রাখা যায় ভয় দিয়ে, কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে টিকে থাকা যায়। আওয়ামী লীগের জন্য এখন মূল প্রশ্ন—তারা কোনো পথ বেছে নেবে? তারা কি নিজেদের ভুলের দায় স্বীকার করে, জনগণের সামনে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাইবে, নাকি প্রতিহিংসার পথে থেকেই ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়ে হারিয়ে যাবে? উত্তরটি এখনো সময় দেয়নি, কিন্তু ইতিহাসের সূত্র খুব স্পষ্ট—যে দল আত্মউপলব্ধি করে, সে ফিরে আসে; যে দল অহংকারে অন্ধ হয়, সে মুছে যায়। তাই প্রশ্নটি আজও অমীমাংসিত থেকে যায়—এভাবে কি ফেরা যায়?

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।


মাদক আমাদের শেষ করে দিচ্ছে

সৈয়দ শাকিল আহাদ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

মরণব‍্যাধী নেশা ড্রাগ বা মাদক এর করাল গ্রাস থেকে মুক্তির জন‍্য আমাদের সন্তানদের সহ সমাজের বিভিন্ন স্বরের শ্রেণিপেশার জনগণের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ সচেতনতা সৃষ্টি ও ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে পারলে এই ভয়াল অধঃপতন থেকে নিজ পরিবারকে, সমাজকে ও দেশকে দ্রুত উন্নত করে তোলা সম্ভব হতে পারে। একই সঙ্গে প্রয়োজন পরিবেশসংশ্লিষ্ট উদ্যোগ, প্রশাসনের সক্রিয়তায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও মাদক ব‍্যবহার ও ব‍্যবসায়ীদের ধরে দৃষ্টান্ত মুলক শাস্তি ও জরিমানা আদায়। মানবজাতি আজ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে প্রবেশ করছি আমরা। ঠিক এই সময়ে মহাবিশ্বে আমাদের একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহটিকে টিকিয়ে রাখার দুশ্চিন্তায় আতঙ্কগ্রস্ত।
সর্বনাশা মাদকের মরণ ছোবলে আক্রান্ত বর্তমান বাংলাদেশের তরুণ ও যুব সমাজ আজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। সারা দেশে মাদকের ব‍্যবসা ও প্রয়োগ দেশের অভ‍্যন্তরে আনাচে কানাচে জন্ম দিচ্ছে একের পর এক ভয়াবহ অপরাধ। এই প্রকার ঘৃনিত অপরাধ সমূহের অন‍্যতম কারণ মাদক বলে মনে করেন সুশীল সমাজের সংখ‍্যাগরিষ্ট লোকেরা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহ, সকলেই জানি মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটে উল্লেখযোগ্যভাবে নেতিবাচক পরিবর্তন এবং ঐ দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে।

মাদকের মধ‍্যে উল্লেখযোগ‍্য ইয়াবা, গাঁজা, মদ, হেরোইন, আফিম, চরস, বাংলা মদ, গুল, মরফিন, কোকেন, হিরোইন, পেথিডিন, মরফিন, মারিজুয়ানা, এল এস ডি, ইলেক্সার, ফেনসিডিল ইত্যাদি বিগত শতাব্দীর বহুল পরিচিত মাদক বা নেশাদ্রব্য ইতাাদি বেশ পরিচিত, এগুলোকে মাদকদ্রব্য বলার চেয়ে বরং মরণ বিষ বলাই অধিকতর শ্রেয়। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে মাদক জগতে এক নতুন সদস্যের প্রবেশ ঘটে, নাম তার ইয়াবা,
যা বর্তমানে বাংলাদেশে এক আলোচিত মাদক। তার নীল ছোবল থেকে সমাজের শিশু-বৃদ্ধ, পুরুষ-নারী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সচেতন-অসচেতন,
ধনী-গরিব, যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী কেউই রেহাই পায়নি এবং পাচ্ছেও না। দেশে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখের ওপর, যার ১৫ থেকে ২০ শতাংশই মহিলা।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ-বাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ছে এই ইয়াবা, সবাইকে এক ভয়াবহ ধ্বংস ও বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করছে। এখন নতুন আরও একটি মাদক ব্যবহৃত হচ্ছে, তার নাম আইস। ইয়াবার তুলনায় অন্তত চার-পাঁচ গুণ বেশি মেথএ্যামফিটামিন থাকায় আইস অনেক বেশি বিষাক্ত।
দেশের অনেক তরুণ-যুবক এটি সহজলভ্য হওয়াতে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছে এবং এর ফলে নেশার ঝুঁকি আরও বেশি বেশি হচ্ছে।
কোন ব‍্যক্তির ক্রমাগত নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, ব্যর্থতা, দুঃখ-বেদনা, বিষণ্ণতা, মানসিক চাপ ইত্যাদির ফলে জীবনকে করে তোলে হতাশা ও অবসাদগ্রস্ত। এসব থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে এরা জড়িয়ে পড়ে মাদকের ভয়াল থাবায়। এছাড়াও পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক অস্থিরতা, বন্ধু-বান্ধবের অসত্য প্রলোভন ও প্ররোচনা, অর্থনৈতিক সংকট, এমনকি বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে মনোমালিন্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব মাদকাসক্তির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ইয়াবার রয়েছে প্রচণ্ড উত্তেজক ক্ষমতা কেউ কেউ যৌন উত্তেজক হিসেবেও এই মাদক কে অনেকে ব্যবহার করে। যাদের ওজন বেশি তাদের কেউ কেউ স্লিম হওয়ার ওষুধ হিসেবে শুরু করে ইয়াবা সেবন। ঘুম কমিয়ে দেয় বলে সারা রাতের পার্টির আগে ক্লান্তিহীন উপভোগ নিশ্চিত করতে অনেকের পছন্দ ইয়াবা। আবার কিছু শিল্পীও ইয়াবা সেবন করেন তাদের শিল্পকর্মের দক্ষতা বাড়বে মনে করে।
যে কোনো মাদকের ন‍্যায় ইয়াবা, আইসসহ সব মাদকদ্রব্যই ভয়াবহ। শুরুতে মাদকের ব্যবহার সত্যিই আনন্দদায়ক, উদ্দীপক, উত্তেজক, যা সাময়িকভাবে উচ্ছ্বসিত ও রোমাঞ্চিত করে। কিন্তু শেষ পরিণতি হয় বেদনাদায়ক, মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ও ধ্বংসাত্মক। দেখা যায় কিছুদিন ইয়াবা সেবনের পর শুরু হয় এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কৌতূহল বশত কয়েক দিন সেবনের পরই আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, এটি ছেড়ে দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মাদক ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না। তখন ঐ মাদক পেতে যে কোনো হীন অপকর্ম করতেও হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। প্রথমে কম মাত্রায় এ ট্যাবলেট কাজ করলেও ধীরে ধীরে মাত্রা বাড়াতে হয়। বাড়াতে হয় ট্যাবলেটের পরিমাণ। ক্ষণস্থায়ী আনন্দের পর বাড়তে থাকে ক্ষতিকর নানা উপসর্গও। রাত কাটে নির্ঘুম, শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, গলা-মুখ শুকিয়ে আসে, অনবরত প্রচণ্ড ঘাম আর গরমের অসহ্য অনুভূতি বাড়ে। এর সঙ্গে বাড়ে নাড়ির গতি, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা আর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি। দেহে আসে মানসিক অবসাদ, চিন্তা আর আচরণে বৈকল্য। মেজাজ খিটখিটে হয়, অহেতুক রাগারাগি, ভাঙচুরের প্রবণতা বাড়ে। মানুষ আর মানুষ থাকে না, হয়ে ওঠে হিংস্র, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। ন্যায়-অন্যায় বোধ লোপ পায়, হয়ে ওঠে অপরাধ প্রবণ। বিঘ্নিত হয় সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তা, ব্যাহত হয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্রোতধারা। এতে একদিকে যেমন আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে, তেমনি মাদকাসক্ত অনেক তরুণ-তরুণী সন্ত্রাস, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, এমনকি খুনও করে নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য। মা-বাবার গলায় ছুরি ধরে টাকার জন্য, বুকে বসে ছুরি চালাতেও তার হাত কাঁপে না। নেশার টাকা না পেয়ে নেশাখোর বাবা মাদক সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে ক্রোধে খুন করে নিজ সন্তানকে, এমনকি স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা, মাকে জবাই করা, আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার মতো অমানবিক ঘটনাও ঘটছে হরহামেশা। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এসব ঘটনার দায় পড়ে মাদকসেবীর ঘাড়ে। কিন্তু একটু গভীর দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায়, কোনো কোমল হৃদয় বা মানুষের বিবেক এই খুন বা অপকর্ম করে না, করে এক ভয়ানক সর্বনাশা মাদক, যা জীবন থেকে জীবন আর হূদয়ের আবেগ-অনুভূতি কেড়ে নেয়। আলোর পথ ছেড়ে নিয়ে যায় অন্ধকার পথে। স্বাধীন হূদয় পরিণত হয় নেশার দাসে।

মানসিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি একসময়ে শরীরেও প্রভাব পড়তে শুরু করে। হৃদ্যন্ত্র, ফুসফুস, লিভার, কিডনি থেকে শুরু করে শরীরে সব অঙ্গই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইয়াবা খেলে উচ্চ রক্তচাপ হয়, মস্তিষ্কের ভেতরকার ছোট রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে। মাদকাসক্ত তরুণদের নিউরো জটিলতায় ভোগার প্রবণতা বেশি থাকে। আইস, কোকেন, ইয়াবা, ফেনসিডাইল সেবন করলে স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ে। যৌন-উদ্দীপক হিসেবে গ্রহণ করা হলেও আসলে যৌনক্ষমতা হারিয়ে যায়, এমনকি শুক্রাণু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সন্তান উত্পাদনক্ষমতাও কমে যায়। মেয়েদের ঋতুস্রাবেও সমস্যা হয়। বেশি পরিমাণে ইয়াবা সেবনের ফলে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম নষ্ট করে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।
মাদকাসক্তি প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করাই অতি উত্তম। তাই মাদকের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে সামগ্রিক প্রতিরোধ খুবই জরুরি; যেমন—
১. আসক্ত ব্যক্তি, যিনি পুনরায় স্বাভাবিক সুস্থ জীবন ফিরে পেতে চান, তার নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। এ কথা মোটেই সত্য নয় যে, তারা আর কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে না। শুধু প্রয়োজন ধৈর্যসহকারে দীর্ঘমেয়াদি চিকিত্সা। একবার কেউ আসক্ত হয়ে গেলে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করে বারবার কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ভালোভাবে বোঝাতে হবে। কোনোক্রমেই বকাবকি, মারধর, বেঁধে বা তালাবন্ধ করে রাখা অনুচিত।

২. শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসার জন্য মনোরোগ চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
৩. ওষুধ, সাইকোথেরাপি ও অন্যান্য উপায়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক এবং সুস্থ জীবনযাপন-পদ্ধতিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এতে মনোরোগ চিকিত্সক ও মনোবিজ্ঞানীর যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পরিবার, আত্মীয়স্বজন আর প্রকৃত বন্ধুরও। একজন নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি সবার সম্মিলিত সহযোগিতায়ই আবার ফিরে পেতে পারে মাদকমুক্ত সুস্থ জীবন। ৪. মাদকের বিরুদ্ধে প্রথমে পরিবারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বাবা-মাকে সন্তানের মধ্যে এমন বীজ বপন করতে হবে, যাতে সে আত্মপ্রত্যয়ী হয়, অশুভকে চিনতে পারে। বাবা-মায়ের কোনো কলহ-বিবাদ যেন সন্তানকে প্রভাবিত করতে না পারে। তাই পারিবারিক শিক্ষা, যথাযথ অনুশাসন এবং সচেতনতা খুবই জরুরি। ৫. তরুণ প্রজন্মকে মাদক থেকে দূরে রাখতে হলে তাদের জন্য দরকার খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা এবং এগুলো চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করা।

৬. ধর্মীয় অনুশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মচর্চা অনুশীলন করলে অনেক ক্ষেত্রে সর্বগ্রাসী মাদক বর্জন এবং প্রতিকার সম্ভব। ৭. মাদক ব্যবহারের কুফল, এর পাচার প্রতিরোধে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে দেশের শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এবং সংবাদপত্রসহ মিডিয়ার কর্মীদেরও দায়িত্ব অপরিসীম।
৮. মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন এবং চিকিৎসা কার্যক্রমের জন্য সহায়তা করতে রাষ্ট্র, এনজিও এবং কমিউনিটিকে এগিয়ে আসতে হবে।

সামগ্রিক দৃষ্টিতে মাদক সেবনের ক্ষতি অসীম ও অপূরণীয়। এতে পুরো সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা ও অপরাধী হিসেবে বড় করে না দেখে কোথা থেকে, কীভাবে, কারা মাদক সরবরাহকারী, চোরাকারবারি বা কারা এসবের মূল হোতা তাদের বিচার ও শাস্তির আওতায় আনা। প্রয়োজনে যথাযথ আইন প্রণয়ন করা এবং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। তবেই মাদকের ভয়ংকর ছোবল থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ-প্রজন্ম ও কোমল মতি সন্তানদের রক্ষা করা সম্ভব হবে। তাই এখনোই উচিত সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে মাদক বিরোধী স্লোগানে সোচ্চার হয়ে মাদক মুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। মনে রাখতে হবে অপরাধী নয়, অপরাধই ঘৃণার বিষয়। স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে তাদের প্রতি ঘৃণা নয়, বরং সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের চারিপাশে সচেতনতা বৃদ্ধি ও এই ভয়াবহ মাদকের করুন পরিনতি নিয়ে পারিবারিক গন্ডি, স্হানীয়ভাবে সমাজের বিভিন্ন স্হানে ও সরকারী উদ্দোগে, নিয়মিতভাবে দৈনিক সংবাদপত্র সহ বিভিন্ন প্রকার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে এর ব‍্যপক ক্ষতির বা ঝুঁকির বর্ননা উল্লেক করে জনসচেতনতা মূলক অনুষ্টানাদি ঘন ঘন প্রচার চালিয়ে যেতে হবে ।
লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক।


ফুলের নদী: কেউকেনহফ

শাকেরা বেগম শিমু
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

নদী বলতে বুঝায় বহমান স্বচ্ছ পানির ধারা যা গিয়ে শেষ হয়েছে কোন সাগর বা মহাসাগরে। যদিও নদীর মধ্যে কখনো রং বেরঙের পানিও প্রবাহিত হয় যেমন কলোম্বিয়ার ‘রেইনবো রিভার’। যেখানে একসাথে রংধনুর সাতটি রং এর পানি প্রবাহিত হয়। তাই অনেকে একে রংধনু নদী নামেও অভিহিত করে থাকে। কিন্তু এখন যে নদীটির কথা বলতে যাচ্ছি সেটা রঙিন বা স্বচ্ছ কোনরকম পানির নদীই নয়। সেটা হচ্ছে ‘ফুলের নদী’! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। বিচিত্র এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে যা দেখলে স্রষ্টার সৃষ্টি নিয়ে মন ভাবনায় পড়তে বাধ্য। তবে এ সবই একমাত্র মহান রবের কুদরতের নিশানা। আজ পরিচয় করিয়ে দেব এরকমই এক নদীর সাথে যেখানে কোন পানি নেই। আছে শুধু ফুল আল ফুল। এতে আছে চেরি, নীল অপরাজিতা, টিউলিপ ও নদীর মতো বেয়ে আসা ছোট ছোট নীল ফুলের সারি। চমৎকার এই নীলাভ ফুলটি এক ধরনের ঘাসফুল যা হাঁটার সময় পায়ের তলায় চুরচুর করে ভেঙে পড়তে চায়। এই পুষ্পদ্বয়ের দোলায়িত দীর্ঘ ও প্রশস্ত বাগান দেখলে যে কেউ ই ভাববে এটা কোন ফুলের নদীই হবে, যা বয়ে চলেছে কোন পুষ্পসাগরে মিলিত হবার জন্য।

অবস্থান: অপূর্ব, অসাধারণ, অপরূপা সুন্দর এই ফুলের বাগানটি অবস্থিত ইউরোপ মহাদেশের নেদারল্যান্ডস এর ‘কেউকেনহফ’ শহরে। এ জায়গাটি পুষ্পসম্ভারে এতোই মনোরম ও মনোমুগ্ধকর যে, তা যে কারো স্বপ্নকেও হার মানায়। এখানে আছে নানা প্রজাতির রঙ-বেরঙের হাজার নয় লক্ষ লক্ষ টিউলিপ ফুলের বাগান।এ ফুলগুলো সাদা, লাল, গোলাপী, নীল, হলুদ, দুধে-আলতা প্রভৃতি হরেক রং এর হয়ে থাকে। এই এলাকা থেকে প্রতি বছর এসব টিউলিপ ফুল আমেরিকা ও জাপানে রপ্তানি করা হয়। এছাড়াও আরো অনেক ফুলপ্রেমি দেশ ও রাজ্য নেদারল্যান্ডস এর এই ‘কেউকেনহফ’ থেকে টিউলিপ আমদানি করে নিয়ে যায়। একে ফুলপ্রেমিদের জন্য একটি ফুলের স্বর্গই বলা যায়। যেদিকে চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। অনেকে এই ফুলের সমাহারের সৌন্দর্য্য পুরোপুরি উপভোগ করার জন্য এই কেউকেনহফ শহরে এসে অনেকদিন থেকেও যায়।

বসন্তে এর রূপ: একে তো এই অঞ্চলটি ফুলের জন্য বিখ্যাত, তারউপর বসন্ত এলে এখানে যেন ফুলপরীরা অসংখ্য ডানামেলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বসন্তে এর রূপ অনন্যা হয়ে চোখে ধরা দেয়। সাথে মন-মাতানো সৌরভে চারদিকের বাতাস ভরভর করে। আর তাই এসময় এখানে পর্যটকের সংখ্যাও স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেকটা বেড়ে যায়। যেদিকে চোখ যায় শুধু রঙ-বেরঙের আর নানা প্রজাতির ফুল যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তখন দূর থেকে ‘কেউকেনহফ’ এর ঘরবাড়িগুলো কে দেখলে মনে হবে ফুলের এক মহাসাগরের মাঝখানে ছোট ছোট কয়েকটি মাত্র দ্বীপ গড়ে উঠেছে। বাকি পুরোটাই ভর্তি শুধু চোখ ধাঁধানো রঙ-বেরঙের ফুল আর ফুলের সমাহারে।

নদীতে ভ্রমণ: ‘কেউকেনহফ’ এ এলে শুধু ফুল দেখেই যে চোখ জুড়াবে তা নয়, এখানে ফুলের স্বর্গীয় নদীর পাশাপাশি আছে ছোট ছোট সত্যিকারের নদী যেগুলোর দুই তীর শুধু বাহারী রঙের ফুলে ফুলে সজ্জিত। এ নদীতে নৌকায় করে ভ্রমণ করলে আশেপাশের প্রকৃতি দেখে মনে হবে এটা হয়তো পৃথিবীর বাইরের অন্য কোন জগতে চলে এসেছি।

ফুলের চাষ: প্রতি বছর এ অঞ্চলে প্রায় সত্তর লক্ষের মতো ফুলের বীজ ও চারাগাছ রোপণ করা হয়। স্বভাবতো সেজন্যই এটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাগান হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এখানে ফুলের আকর্ষণে আগত পর্যটকদের জন্য উপযুক্ত সময়টা হলো মার্চ মাস থেকে শুরু করে মধ্য মে পর্যন্ত। মার্চের শেষের দিক থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্ত সময়টা।লো টিউলিপ ফুটার উপযুক্ত সময়। এসময় ‘কেউকেনহফে’র প্রধান বাগান যেটা প্রায় আড়াইশ বিঘা জমির উপরিভাগ জুড়ে রয়েছে, তার উপরিভাগ পুরোটাই জুড়ে থাকে শুধু এই হরেক রঙের টিউলিপ ফুলের সমাহার। এর সাথে নদীর তীরে, পার্কে, বা মাঠে রয়েছে অজস্র অপরাজিতা, চেরি বা নীলাভ রঙের ঘাসফুলের বাহার। সবকিছু মিলিয়ে এ ‘কেউকেনহফ’ কে শুধু ‘ফুলের নদী’ নয় পুরো একটি ফুলের সাগরও বলা যায়।


সহিষ্ণুতা ও সমঅধিকারের সমাজ

আপডেটেড ২৬ নভেম্বর, ২০২৫ ২৩:১১
সম্পাদকীয়

সুবর্ণ ভূমির কোমল পলির মতো বাঙালির মনোভূমি। আমাদের অর্থনীতি চিরকাল কৃষিভিত্তিক। জীবন ও জীবিকা একসময় ছিলো নদীকেন্দ্রিক। গভীর রাতে কিংবা অলস দুপুরে উদাও কন্ঠে বাউল ভাটিয়ালি গানের সুর আমাদের জনজীবনকে মুখরিত করে তুলত। যাত্রাপালার দর্শক হয়ে নিপীড়িতের উপর নির্যাতন দেখে বাঙালি অঝোর ধারায় কাঁদত একসময়। যাত্রার বিবেক বাঙালির বিবেক হয়ে নৈতিক কথা বলতো। শ্যাক্সপিয়রের কিংবা এলিয্যবেথান যুগের নাটকে ‘কোরাস’ যে ভূমিকা পালন করত আমাদের যাত্রাগানের বিবেকও সে ভূমিকা পালন করে গেছে। আমাদের অকৃত্রিম সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য শাখা ছিল যাত্রা পালা।

এক সময় ‘পঞ্চায়েত’ গ্রামের সুখ দুঃখের সকল অনুষ্ঠান, বিচার ব্যবস্থা, সমাজের কল্যাণ মূলক কাজের দায়িত্ব স্বতঃপ্রণোদিত গ্রহণ করত। আধুনিক উন্নয়ন বিজ্ঞান যাকে বলে জননেতৃত্বে সামাজিক কর্মকাণ্ড।

বাঙালির ধৈর্য, স্থৈর্য সীমাহীন। পরার্থে জীবন দানের অগণন নজির আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে। আবার এই ভীতু, কোমল বাঙালি বুক পেতে দাঁড়িয়ে যায় মাতৃভূমির মুক্তির যুদ্ধে। আমেরিকা থেকে সপ্তম নৌবহর আসার খবর বিচলিত করেনা লাঠি হাতে প্রতিরোধ করা বাঙালিকে।

কী হলো কোমল স্বভাবের বাঙালির। হঠাৎ করে এত অস্থিরতা, চিত্তে এত চাঞ্চল্য। বাঙালির অনুভুতিও কী কিছুটা ভোঁতা হয়ে গেল। মিরপুরের গার্মেন্টস ও ক্যামিকেল কারখানার অগ্নিকান্ডে তরতাজা ষোলটা মানুষ প্রাণ হারালো এ নিয়ে মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক বেদনাবোধ লক্ষ্য করা গেল না। সামজিক মাধ্যমে এ নিয়ে উল্লেখ করার মতো আবেগ প্রকাশিত হতেও দেখা গেলো না।

সামাজিক অস্থিরতা, মানবিকতাহীনতা ও অসহিষ্ণুতা যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। পারিবারিক

সংঘাত, সংঘর্ষ, গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ, স্থানীয় আধিপত্য, রাস্তাঘাটে মারামারি ইত্যাদি নানা ঘটনা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। মানুষ এমনিতেই নানা কারণে বিষাদগ্রস্ত। এসব ঘটনা মানুষকে আরও বিষাদগ্রস্ত করে তুলছে। সামাজিক এসব অনাচার ও বিশৃঙ্খলার ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। এ কারণেই বোধ হয় সুযোগ পেলেই মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশও ঘটাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণাবাচক মন্তব্য, রাজনৈতিক মতভেদে শত্রুতা, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ে বৈষম্য–এসবই প্রশ্ন তোলে, আমরা কি জাতিগতভাবে অমানবিক ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি?

সহিষ্ণুতা আসলে কী। সহিষ্ণুতা কী শুধু নৈতিক গুণ। সভ্য, সমঅধিকারের সমাজে সহিষ্ণুতা হলো টিকে থাকার সবচেয়ে বড় শর্ত। সমতা, সমদৃষ্টির, বহুত্ববাদী সমাজ গড়ার সব চেয়ে বড় হাতিয়ার হলো সহিষ্ণুতা। সহিষ্ণুতার কী কোন সূচক আছে জাতিসংঘে, আমার জানা নেই। সূচক থেকে থাকলে আমাদের চিন্তার কোন কারণ নেই। সাম্প্রতিককালে আমাদের যে সহিষ্ণুতার মান, সেই মান নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামলে নিচের সারিতে আমাদের অবস্থান ঠেকায় কে। ব্যক্তি, পরিবার কিংবা সমাজকে বিবেচনা করলে আমাদের অবস্থা তপ্ত কড়াইয়ের মতো। পানি কিংবা তৈল যা কিছু ঢালা হোক না কেনো আমরা ধুম্র সহ জ্বলে উঠব। সেই জ্বলা এতই তীব্র কখনো কখনো বড় অট্টালিকাও জ্বালিয়ে দিতে পারি আমরা নির্ভয়ে। জাতি হিসেবেও আমরা অগ্নিশর্মা। সহিষ্ণুতার অভাবে যে অগ্নি সংযোগ ঘটে, সেটিই হলো প্রকৃত মবদন্ড বা মব জাস্টিস।

জাতিগতভাবে আমরা যে অসহিষ্ণু ছিলাম না তা ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপকে বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যাবে। আমাদের স্বদেশপ্রেম, স্বাধিকারের দাবির জন্য আক্রমন আসলে আমরা প্রতিহত করেছি। এসব ক্ষেত্রে আমরা সতত আপসহীন ছিলাম। আমাদের মানসজগত মূলত লালন, হাসন, রাধারমণ, আরকুম শাহ সহ সকল মরমী কবিদের চেতনায় সমৃদ্ধ। বৈচিত্র্য, বহুত্ববাদের দর্শন আমরা প্রকৃতিগত ভাবে ধারণ করি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের আগমনের পূর্বে বাঙালি মানসে সামান্য পরিমাণও সাম্প্রদায়কতার প্রকাশ দেখা যায়নি। সমাজকে বিভাজিত করার যে কূটকৌশল গ্রহণ করেছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক এর প্রভাবে পাকিস্তানের স্বাধীনয়াত্র অব্যবহিত পূর্বে এবং পাকিস্তানত্তোর সময়ে কিছুটা সাম্প্রদায়িক মনোমালিন্য, দাঙ্গার নজির সৃষ্টি হয়েছিলো। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন উদার, বহুত্বভাদ, প্রগতিবাদী এক সমাজের ধারণা সফল ভাবে বাঙালি হৃদয়ে প্রোথিত করতে সমর্থ হয়। বায়ান্নের আন্দোলনের মালিকানা ছিল বাংলাদেশের জনগণের। তাই এই মহান আন্দলনের স্বরূপ আন্বেষন করলে বাঙালি মননের প্রকৃত রূপ দর্শন করা যায়।

ফিরে আসি সহিষ্ণুতার আলোচনায়। সহিষ্ণুতার প্রতিফলন দেখা যায় সব চেয়ে বেশি শাসক এবং রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম, আচার আচারণে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, চর্চার ভেতরে মুক্তোর মতো ঝিনুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকে সহিষ্ণুতা। কিছুটা কাব্যিক শুনাতে পারে, তবে সহিষ্ণুতার ভেতরেই সমতা, সমদৃষ্টি, সমঅধিকারের বীজ লুক্কায়িত থাকে। উদার, সহিষ্ণু একটি রাজনৈতিক দল সব সময় সমাজের প্রান্তিক, বিপন্ন, অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য লড়াই করে যায় সেটি নির্ভর করে দলটির দর্শনে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আমরা যেমন সমাজের প্রতিটি সদস্যের দিকে ‘সমদৃষ্টি’ দিতে সক্ষম হইনি একইভাবে রাজনৈতিক দলের ভেতরে নিবেদিত, নেতৃত্বগুণে সমৃদ্ধ সকল শ্রেণিপেশার মানুষের প্রতি দৃষ্টির নীতিকেও অনুসরণ করতে পারিনি। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে যেমন পদ পদবী ক্ষমতার চর্চা হয়েছে, একইভাবে শাসক দলগুলোর ভেতরে ক্ষমতার লড়াই বহমান ছিলো। ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতা শাসকদলের ভেতরে এমনভাবে রোপণ করা হয়েছে যে বীজ থেকে ক্রমান্বয়য়ে ক্ষমতার লড়াই আকারে বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতা অর্জনের লড়াই যখন প্রবল হয়ে যায় তখন সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে নির্বাসিত হতে থাকে।

আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই, দেখতে পাব-সহিষ্ণুতা রাতারাতি জন্মায়নি, বরং এটি দীর্ঘ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার ফল। সমাজের আচরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের আচরণকে প্রভাবিত করে। ক্ষমতা যখন রাজনৈতিক দলের একমাত্র আরাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন সমাজেও এর প্রবল চর্চা হতে থাকে। সমাজের আচরণ এবং রাজনৈতিক দলের আচরণকে বিভক্ত করা কঠিন। সমাজের আচরণ রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সমাজের চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। মূলত রাজনৈতিক দলের আচরণের সংস্কৃতি গণমুখী, কল্যাণকামী, সমদৃষ্টি সম্পন্ন না হলে সমাজের সকল স্তরে অস্থিরতা এবং বিভাজন চলতে থাকে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মানসিক পরিশুদ্ধতা, উন্নত রুচি ও সংস্কৃতি বারবার প্রত্যাশা করেছে মানুষ। প্রত্যাশা করেছে, দেশ ও জাতি গঠনে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে এদের মাধ্যমে বড় ধরনের জাগরণ ঘটবে। দেশের উন্নয়নসহ হতদরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা শুধুই হতাশায় রূপ নিচ্ছে। দেশটা কিছুতেই সামনের দিকে এগোতে পারছে না। জনগণ শুধু অসহায়ের মতো লক্ষ্য করছে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ একে অন্যের প্রতি আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ লিপ্ত হয়ে রয়েছে। আক্রোশ আক্রোশ আক্রমণের মধ্যে দলীয় ব্যর্থতার চেয়ে ব্যক্তি বিদ্বেষ, ব্যক্তি কুৎসা অতিমাত্রায় দৃশ্যমান বলে মনে হয়। পারস্পরিক এই যে দ্বন্ধ এ দ্বন্দ্বের পেছনে প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া মানুষকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার যে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা তা’ কাজ না করে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার প্রবল কামনাই প্রধান হয়ে ওঠে।

সমাজ, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের সহিষ্ণুতা একই সূত্রে গাঁথা। সামজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয় সহিষ্ণুতাকে প্রভাবিত করে। আবার রাষ্ট্রীয় সহিষ্ণুতা সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার চাহিদাকে অনুসরন করে। স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থা আবার কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করেনা। একমাত্র নিরবিচ্ছিন্ন গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমেই যেমন সকল মানুষের প্রতি সমদৃষ্টি প্রদানের সংস্কৃতি জাগ্রত করা যায় একই সাথে মানুষের সহিষ্ণুতার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে সহিষ্ণুতা মূলত একটি নৈতিক গুণ যা সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে কোন ভাবেই আরোপ করা যায়না। ক্ষমতার রাজনীতি থেকে যদি সকল মানুষের প্রতি মমতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায় তাহলে ধীরে ধীরে আমরা সহিষ্ণুতার মতো নৈতিক গুণ অর্জন করতে সক্ষম হব। সহিষ্ণু সমাজ গণতন্ত্রকে খুব দ্রুত সংস্কৃতির অংশ হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। আর প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় জন অংশগ্রহণ স্থিতিশীল সমাজ, স্থিতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম বলে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন। আমরা কি সে পথে এগোতে পারবো। এই পারা না পারার উপর জাতি হিসেবে টিকে থাকার উপাদান গুলো নিহিত আছে বলে মনে করি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক


জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কীভাবে হবে 

মিজানুর রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে মতানৈক্য ছিল। এ নিয়ে মিটিং মিছিল বেশ হয়েছে। মাঠ ও উত্তপ্ত হয়েছে। বিএনপি দাবি ছিল সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হতে হবে। আর জামায়াতের বক্তব্য হলো নভেম্বরে গণভোট হতে হবে অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে গণভোট চাই। জুলাই অভ্যুত্থানে প্রথম সারির সৈনিক এনসিপি বলছে জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে জুলাই সনদের জন্য অধ্যাদেশ জারি করতে হবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো মতৈক্য পৌঁছাতে না পারায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। ১৩ নভেম্বরে উপদেষ্টা পরিষদে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন অধ্যাদেশ, ২০২৫ অনুমোদন করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করেন। সকল জল্পনা ও কল্পনার অবসান ঘটিয়ে উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তগুলো ঘোষণা করেন।
সরকার জুলাই সনদ যেভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য পরিকল্পনা নিয়েছেন যেমন:-সনদ বাস্তবায়নে জুলাই জাতীয় সনদ(সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারি। আদেশে গণভোট ও গণভোটের প্রশ্ন এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন সংক্রান্ত বিধান আছে। গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য আইন (অধ্যাদেশ) করা হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করা হবে।গনভোটে হ্যাঁ জয়ী হলে আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। সংবিধান সংস্কার হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চ কক্ষ গঠন করবে। নিম্ন কক্ষ বা সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চ কক্ষে আসন বণ্টন। উচ্চ কক্ষের মেয়াদ নিম্ন কক্ষের মেয়াদের সাথে শেষ হবে।
কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে গণভোটের প্রশ্নমালার ও রূপরেখা দিয়েছেন যেমন
প্রথম প্রশ্ন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্নিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন আাগামী সংসদ হবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চ-কক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চ কক্ষের সংখ্যা গরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
তৃতীয় প্রশ্ন সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন প্রধান মন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরন রাষ্টপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
চতুর্থ প্রশ্ন জুলাই সনদে বর্নিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
বাংলাদেশের ২২% লোক নিরক্ষর। তাদের কাছে এই ৪টি প্রশ্ন সহজবোধ্য হবে কি? যারা কম লেখাপড়া জানে তাদের কাছে বিষয়টি এতটা সহজতর নয়।যাদের সক্ষমতা আছে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে ৪টি বিষয় পড়ে ভোট কার্যসম্পাদন করতে কমপক্ষে ৫/৬ মিনিট সময় ব্যয় হবে। তাহলে ভোটদান প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। জাতীয় পর্যায়ে ভোট কাস্টিং কম হবে। সুতারাং প্রশ্নগুলো সহজ করতে না পারলে ভোটাররা অন্ধকারে

থেকে যাবে। যেহেতু জুলাই সনদে ইতোপূর্বেই রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছে সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি অঙ্গীকারনামা রয়েছে। জুলাই সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে জাতির কাছে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হলো। আমরা অবগত ৯০ এ এরশাদ বিরোধী আন্দোলন এর সময় তিন জোট একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে ছিলেন। অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার পতনের পর তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী গনভোট হয়েছিল। তখনকার আন্দোলনকারী ও বিশ্লেষকদের মতে এটি ছিল ‘ক্ষমতা হস্তান্তর ও রাজনীতি রাষ্ট্র পরিচালনার দলিল যা পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি।’
রাজনৈতি বিশ্লষকদের মতে ওই রূপরেখার সাফল্য হলো এরশাদের পতন ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হওয়া কিন্তু পরে দুই প্রধান দল নিজেদের রূপরেখা থেকে শুধুই উপেক্ষা করেননি বরং অনেক ক্ষেত্রে উল্টো কাজ করেছে। বিশ্লেষকরা আরও বলেন,তিন জোটের রূপরেখা অঙ্গীকার ১৯৯১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত দলগুলো মেনে চললেও পরে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন ছাড়া আর কিছুই হয়নি বরং উল্টোপথে গেছে দলগুলো, যার পরিনতি হলো ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে।
শংকা থেকেই যাচ্ছে এবার ও যদি অমনটি হয়?এমনটি হওয়ার কি সুযোগ আছে?কিন্ত ২৫টি রাজনৈতিক দল ১৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অঙ্গীকার নামায় যে স্বাক্ষর কার্য সম্পাদন করেছেন যে কর্মটি দেশের জনগণ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে তা থেকে সরে আসাটা কঠিন। তাই অঙ্গীকারনামা বাস্তবায়ন না করে উপায় নেই। সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ

বলেছেন ‘অঙ্গীকার নামায় যা আছে তা বাস্তবায়ন করতে বিএনপি বদ্ধপরিকর’ তাহলে জাতীর সামনে কি অঙ্গীকার করা হয়েছিল? যদি ফিরে তাকাই :-- (:ক) জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই - আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ- তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জন- আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রণীত ও ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব।
(খ) যেহেতু জনগণ এই রাষ্ট্রের মালিক তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সেহেতু রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আলাপ-আলোচনা ভিত্তিতে জনগনের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ গ্রহন করেছি বিধায় এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করব।
(গ)জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করবো না উপরোক্ত উক্ত সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করব। (ঘ) গণতন্ত্র মানবাধিকার ও আইনের শাষণ প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করব।
(ঙ)গণঅভ্যুত্থান পূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই আগষ্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংগঠিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনবার্সনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।
(চ) জুলাই সনদ ২০২৫ এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা তথা সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান এবং বিদ্যমান আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমামার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করব।
(ছ) জুলাই জাতীয় সনদ২০২৫ এর ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যে সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো কোন প্রকার কালক্ষেপন না করেই দ্রুততম সময়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।

দলগুলো যদি একসাথে বসে অঙ্গীকারনামা করে থাকে ক্ষমতায় এসে ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন করা না হলে জাতির সাথে প্রতারণা হবে। তাহলেত আমরা আবার পুরানো ধারায় চলে গেলাম। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত গনভোট বা জুলাই সনদ নিয়ে দলাদলি না করে তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সবাই সোচ্চার থেকে আগামী সংসদ সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে গণতন্ত্রের ধারায় দেশ ফিরে আসুক ধীরে ধীরে জুলাই জাতীয় সনদ ও বাস্তবায়ন হউক সেটাই জাতির প্রত্যাশা।

লেখক: কলামিস্ট ও ব্যাংকার।


banner close