রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং বাংলাদেশের উষ্ণতার ইতিকথা ও করণীয়

প্রতিবেদক, দৈনিক বাংলা
প্রকাশিত
প্রতিবেদক, দৈনিক বাংলা
প্রকাশিত : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১০:১৬

মানুষের সৃষ্ট কাজের মাধ্যমে মানুষ এ পৃথিবীর প্রকৃতি ও পরিবেশ প্রতিনিয়তই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সে কারণেই আজ বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জনজীবনে নেমে এসেছে এক অস্বস্তি ও কষ্ট। খেটে খাওয়া মানুষের জন্য এ কষ্টটা একটু বেশি। এ সমস্যা উত্তরণে বিশ্বনেতাদের পাশাপাশি আমাদেরও অনেক সচেতন হতে হবে, অনেক কিছু বর্জন করতে হবে এবং অনেক কাজ করতে হবে। প্রথমে আসা যাক বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়ে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পেছনে অনেক কারণ রয়েছে, এখন সেগুলোর ওপর আলোকপাত করা যাক।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির উৎস ও কারণ

প্রথমেই বলতে হয় গ্রিন হাউস গ্যাসের কথা। গ্রিন হাউস গ্যাস সূর্যের অতিরিক্ত তাপ যেগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকিরণের মাধ্যমে ফিরে আসে সেগুলোকে ট্র্যাপ করে এবং শোষণ করে। ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। গ্রিন হাউস গ্যাস যেমন ওয়াটার ভেপার, ওজোন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, হাউড্রোফ্লোরো কার্বনস, পারফ্লোরো কার্বনস, সালফার হেক্সাফ্লোরাইড, নাইট্রোজেন ট্রাইফ্লোরাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বনস ইত্যাদি এসব গ্যাসগুলো নিঃসরণ হয় পরিবহন খাত, রেফ্রিজারেটর, শীতলীকরণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প-কলকারখানায় ব্যবহৃত কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি থেকে।

এখন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন হাউস গ্যাসের উৎপাদনের পেছনের উৎস বা খাতগুলোর দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক।

পরিবহন খাত

যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন খাত থেকে ২৮% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়। তথ্য মোতাবেক বাস, ট্রাক, কার, জাহাজ, ট্রেন ও বিমানে পেট্রোলিয়াম, ডিজেল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদনের বড় উৎস।

বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত

যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত থেকে ২৫% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৭৯% বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় জীবাস্ম জ্বালানি যেমন পেট্রোলিয়াম, ডিজেল, কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। যেগুলো গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদনের ক্রীড়নক।

শিল্প খাত

যুক্তরাষ্ট্রের ২৩% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয় শিল্প খাত থেকে। এ ছাড়া শিল্পে কিছু কাঁচামাল থেকে পণ্য তৈরি করতে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানোর প্রয়োজন হয় এবং সে সময়ে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়ে থাকে।

বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাত

যুক্তরাষ্ট্রের মোট উৎপাদিত গ্রিন হাউস গ্যাসের ১৩% উৎপাদিত হয় বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাত থেকে। এ খাতেও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয়। তাপ উৎপাদন, আলোক সজ্জা, বৈদ্যুতিক বাতি, রেফ্রিজারেশন এবং শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় এবং বর্জ্য ব্যস্থাপনায়ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয়।

কৃষি খাত

যুক্তরাষ্ট্রের ১০% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয় কৃষি খাত থেকে।

অন্যান্য খাত

ভূমির সার্বিক ব্যবহার এবং অন্যান্য খাত থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ১২% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়।

পৃথিবীতে বর্তমান সময়ে পরিবহনে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে, শিল্প-কারখানায় ও গৃহস্থালির কাজে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণ ও দীর্ঘকালীন ইরাকে যুদ্ধ, ইসরায়েলের সাথে ফিলিস্তিন ও হিজবুল্লাহর যুদ্ধ এবং ওইসব যুদ্ধে ব্যবহৃত বিস্ফোরক ও জীবাশ্ম জ্বালানি বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। ব্রাজিলের আমাজান বনে আগুন, আফ্রিকায় বনভূমি উজাড়করণ, অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে আগুন, এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষ করে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পাহাড়ি বনে আগুন, ভারত-পাকিস্তানের অস্ত্র প্রতিযোগিতা, বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা ও ব্যাপক মাত্রায় বন উজাড়; বিদ্যুৎ উৎপাদন, ইটের ভাটা ও অন্যান্য কাজে কাঠ ও কয়লার ব্যবহার বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।

এ ছাড়া পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা ও বিস্ফোরণ, রাসায়নিক অস্ত্রের পরীক্ষা ও বিস্ফোরণ, শিল্প-কলকারখানার ধোঁয়া, গরম পানি, বর্জ্য, দূষিত পানি ও এফলুয়েন্টের ডাম্পিং, ধূমপানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত ধোঁয়া, বনভূমি ও জলাভূমির বিলুপ্তি, ঝড়, ধূলিঝড়, মরুঝড় ও নির্মাণ কাজ থেকে বাতাসে ধূলিকণা যোগ হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশে পরিবেশ উষ্ণতার উৎস ও করণীয়

গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন

বাংলাদেশেও পরিবহন খাত, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত, শিল্প খাত, বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাতগুলো থেকে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া সিগারেটের কালো ধোঁয়া থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড, রেফ্রিজারেটর থেকে সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরো কার্বন) উৎপাদন হয়। বিভিন্ন সেক্টরে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি, যেমন- পেট্রোলিয়াম, ডিজেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি থেকে বাংলাদেশে গ্রিন হাউস গ্যাসের সিংহভাগ উৎপাদিত হয়ে থাকে।

বৃক্ষ নিধন

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় পৃথিবীব্যাপী প্রতিনিয়ত বৃক্ষ নিধন প্রকাশ্যে এবং নীরবে ও নিভৃতে চলছে। এ অপরিণামদর্শী কাজ এশিয়ার দেশগুলোতে এবং বাংলাদেশেও চলছে। অনেক সংরক্ষিত বনভূমির ভেতরটা বৃক্ষ শূন্য এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মহল এ বৃক্ষ নিধন কর্মে জড়িত বলে একটি সূত্র জানায়। মূল বিষয় হচ্ছে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়ত উৎপাদিত হচ্ছে তার পুরোটা বৃক্ষরাজি, বন-বনানী, গুল্ম, লতা-পাতা ও সামুদ্রিক শৈবাল কর্তৃক শোষণ হচ্ছে না। এ অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে থেকে যাচ্ছে এবং সূর্যের তাপকে শোষণ করছে এবং আটকে রাখছে ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।

ইটভাটার দূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি

বাংলাদেশের ইটভাটায় বিপুল পরিমাণ কাঠ ব্যবহৃত হয়, যার ফলে একদিকে যেমন বৃক্ষরাজি ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ইটভাটা থেকে ফ্লাইঅ্যাশ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে। ফ্লাইঅ্যাশ বায়ুমণ্ডলে ক্ষুদ্র কণা যোগ করে থাকে, যা বায়ু দূষণে বিরাট ভূমিকা রাখে। এ বায়ুর কণা ও কার্বন ডাই-অক্সাইড তাপমাত্রা শোষণ করে ও তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটায়।

জলে নিমজ্জন ধান চাষকরণ

এশিয়ার অনেক দেশে জলে নিমজ্জিত করে ধান চাষ করা হয়। বাংলাদেশেও এরূপ জলে নিমজ্জন ধান চাষ করা হয়ে থাকে; যার ফলে প্রচুর পরিমাণ মিথেন গ্যাস উৎপাদিত হয়ে থাকে। যা পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।

পাহাড় ধ্বংস

পাহাড় ধ্বংসের সাথে সাথে পাহাড়ের বৃক্ষরাজি, লতা, পাতা, পশু, পাখি, অণুজীব এবং তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যায়, যার ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ কমে যায়। প্রকারান্তে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।

যানজট

বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বড় নগরীগুলোতে যানজট দেখা যায়। যানজটের কারণে গাড়িগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানি অধিক পরিমাণে ব্যয়িত হয় এবং প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য দূষিত গ্যাস নির্গত হয়; যা প্রকারান্তরে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।

শিল্প ও কলকারখানা

আমাদের দেশে শিল্প এবং কলকারখানা থেকেও কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস, বর্জ্য এবং দূষক নির্গত ও উৎপাদিত হয় ও পরিবেশে মেশে। তা ছাড়া শিল্প-কলকারখানা থেকে পণ্য তৈরি করার সময় গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গত হয়, যা পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধি করে।

ধূমপান

এ দেশে প্রতিদিন এক বিরাট সংখ্যক ধূমপায়ী ধূমপান করে থাকে। ফলে তাদের সিগারেট ও বিড়ি থেকে কার্বন-মনোক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়ত পরিবেশে মিশছে এবং বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে।

নির্মাণ কাজ থেকে বাতাসে ধূলিকণা যোগ হওয়া

বিশেষজ্ঞদের থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের বাতাসে ধূলিকণার একটা বড় অংশ নির্মাণ কাজ থেকে আসে। ওইসব ধূলিকণা সূর্যের তাপ শোষণ করে এবং বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।

বিশ্বের ও বাংলাদেশের পরিবেশ উন্নয়নে পদক্ষেপগুলো

গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন বন্ধকরণ

বিশ্ব ও বাংলাদেশের উষ্ণতা কমাতে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন কমাতে হবে। এ জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি, বায়ুচালিত শক্তি, বায়োগ্যাসের ব্যবহার ও সোলার এনার্জির ব্যবহারের মাত্রা বাড়াতে হবে।

ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন

অনেক দেশে ট্রাফিক জ্যাম আছে এবং পুরোনো গাড়ি ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশেও বেশি দিনের পুরাতন গাড়ির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং ট্রাফিক জ্যাম কমাতে হবে। ঢাকা শহরের ট্রাফিকের অধিকাংশই উত্তর-দক্ষিণমুখী প্রবাহ; যদি পূর্ব-পশ্চিমমুখী আরেটা বড় প্রবাহ তৈরি করা যায় তাহলে যানজট নিঃসন্দেহে কমতে পারে। যানজট নিরসনে ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টকে অধিক নিরাপদ, আরামদায়ক ও আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে হবে। মানুষকে ট্রাফিক এডুকেশন দ্বারা সচেতন করতে হবে, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করতে হবে ও প্রেষণা দিতে হবে। গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে আরও কঠোরতা অবলম্বন করা যেতে পারে এবং একজনের জন্য একটি গাড়িনীতি পরিহার করে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের দিকে ঝুঁকতে হবে। তাহলে কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন কম হবে এবং বাংলাদেশ তথা বিশ্বে উষ্ণতা কমবে।

বৃক্ষনিধন বন্ধ ও তদারকি

বৃক্ষ কর্তন নিষিদ্ধ থাকলেও বৃক্ষ কর্তন নিষেধাজ্ঞা সঠিকভাবে প্রতিপালন হচ্ছে কি না সে বিষয়ে অধিক মনিটরিং ও সুপারভিশন দরকার। আর প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদান করতে হবে। এ কাজে সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। পরিবেশ-পুলিশ তৈরি করলে তারা এ ক্ষেত্রে সমন্বয় ও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বৃহদাকার বৃক্ষ কেটে ছোট ছোট বৃক্ষ রোপণ করা হচ্ছে; যা ওই বৃহৎ বৃক্ষের তুলনায় কম পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ বা গ্রহণ করতে পারে। তা ছাড়া বিশ্বব্যাপী ডাম্পিংয়ের মাধ্যমে বর্জ্যগুলা সমুদ্রের পানি দূষণ করছে এবং সামুদ্রিক শৈবালও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য পাহাড় ও পাহাড়ি বন-বনানী রক্ষার্থে পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ রোপণ করা জরুরি। তাহলে বৃক্ষরাজি রক্ষা হবে এবং পরিবেশের উষ্ণতা কমবে।

বৃক্ষ, বন, জঙ্গল, লতাপাতা, খড় ও অন্যান্য বস্তুতে অগ্নিসংযোগ পরিহার করা

একটি বিষয় বেশ লক্ষণীয় যে, বিশ্বব্যাপী একরূপ ম্যানিয়া বা রোগ হয়ে গেছে যে, পাহাড়ি বন-বনানী, বৃক্ষের লতাপাতা, জঙ্গল, ধানের খড়, ধানগাছ, গমের খড়, গমগাছ, আখের খেত ইত্যাদি পেলেই সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ করা; যা না করে যান্ত্রিক উপায়ে পাহাড় পরিষ্কার করা যেতে পারে, খড়, জঙ্গল, লতাপাতা নিয়ে কমপোস্ট করা যেতে পারে। যার ফলে একদিকে যেমন জৈব সার তৈরি বৃদ্ধি পাবে এবং অন্যদিকে বন-বনানী রক্ষা পাবে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদন কমে যাবে ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধ করা যাবে।

জলাভূমি সংরক্ষণ

জলাভূমিকে বলা হয়ে থাকে পরিবেশের রক্ত। অথচ আমাদের জলাভূমিগুলো দিন দিন ভরাট হচ্ছে, বিলুপ্তি ঘটছে। কিছু অসাধু লোক এগুলোতে বিভিন্ন রকম স্থাপনা, বিনোদন কেন্দ্র, খামার ও খামারবাড়ি তৈরি করছে। যার ফলে আমাদের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। জলাভূমি রক্ষার মাধ্যমে, বর্ষাকালের বৃষ্টির পানি, উজানের পানি, আন্তর্জাতিক নদী বা অন্য দেশের ওপর দিয়ে আসা পানিকে ধরে রাখা ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে। ফলে পরিবেশের উষ্ণতা কমানো যেতে পারে।

পরিকল্পিত নগরায়ণ

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নিচুভূমি ও জলাভূমিকে উন্নয়ন করে নগরায়ণের পরিকল্পনা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এর ফলে প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন পদ্ধতি ও ওয়াটার টেবিল ধ্বংস হচ্ছে। যা পানির ঘাটতি তৈরি করে থাকে। পানি সংরক্ষণ বা ধরে রাখার জায়গা নষ্ট হলে পরিবেশের উষ্ণতার ওপর এর প্রভাব পড়বে।

শিল্প-কারখানার ওপর তদারকি বৃদ্ধি

কোন শিল্পপ্রতিষ্ঠান কোন ধরনের গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন করছে, সে বিষয়ে বিশ্বব্যাপী মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। সে জন্য শিল্পের ওপর মনিটরিং ও তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশবান্ধবভাবে চলছে না সেগুলো বন্ধ করতে হবে।

পরিকল্পিত ব্যারাজ, বাঁধ, ব্রিজ ও কালভাট নির্মাণ

অপরিকল্পিত ব্যারাজ, বাঁধ, ব্রিজ ও কালভার্ট তৈরি করার কারণে অনেক নদী, খাল ও জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো আর পানি ধরে রাখতে পারে না। ওইগুলো ড্রেজিং করে নাব্যতা ও গভীরতা ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। অপরিকল্পিত ব্যারাজ, বাঁধ, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে এবং সমন্বিতভাবে বিভিন্ন দেশকে একত্রে কাজ করতে হবে।

ব্যাপকভাবে বনায়ন কার্যক্রম চালুকরণ

পৃথিবীব্যাপী বৃক্ষ নিধন বন্ধ করে ব্যাপক মাত্রায় বনায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে বনায়ন, সামাজিক বনায়ন, পারিবারিক বনায়ন, ছাদ কৃষি, আঙিনা কৃষি ও সব পর্যায়ে ব্যাপকভাবে বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যার ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ বৃদ্ধি পাবে ও তাপমাত্রা কমে আসবে।

ধূমপান বন্ধকরণ

ধূমপান বন্ধ করা বা কমিয়ে আনার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদন রোধ করা যাবে। আর তা পরিবেশের তাপমাত্রা হ্রাস করতে সহায়ক হবে।

জলে নিমজ্জিত করে ধান চাষ বন্ধকরণ

যেহেতু এশিয়ার দেশগুলোতে জলে নিমজ্জিত ধান চাষের মাধ্যমে গ্রিন হাউস গ্যাস মিথেন উৎপাদন হয়ে থাকে, সে জন্য জলে নিমজ্জিত করে ধান চাষ বন্ধ করতে হবে। ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা হ্রাস পাবে।

নির্মাণ কাজের সময় স্থাপনা ঢেকে বা ভিজিয়ে কাজ করা

নির্মাণ কাজ থেকে বাতাসে ধূলিকণা যোগ হয়ে বায়ুদূষণ ঘটায়। আর এসব ধূলিকণা তাপমাত্রা শোষণ করে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়ে থাকেন। সে জন্য নির্মাণ কাজ করার সময় যতদূর পারা যায় স্থাপনাগুলো ঢেকে বা ভিজিয়ে কাজ করা। তাহলে ধূলিকণা বাতাসে ছড়াবে না এবং পরিবেশের দূষণ বা বায়ুদূষণ কম হবে। যার ফলে পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটবে না।

বর্তমানে বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সে জন্য প্রাকৃতিক কারণ যদিও কিছু রয়েছে কিন্তু মানবসৃষ্ট কারণই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের নেতাদের এবং নীতি-নির্ধারকদের এ ব্যাপারে আরও সতর্ক, সচেতন ও মানবিক হতে হবে। সর্বোপরি সবারই পরিবেশকে ভালোবাসতে হবে এবং সে মোতাবেক পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই বৈশ্বিক উষ্ণতা ও বাংলাদেশের উষ্ণতা কমবে এবং আমরা একটি সবুজ পৃথিবী ও সহজাত পরিবেশ ফিরে পাব।

লেখক: ড. মো. আব্দুস সোবহান পিপিএম

কমান্ড্যান্ট (অ্যাডিশনাল ডিআইজি)

পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল (পিএসটিএস), বেতবুনিয়া, রাঙামাটি


আর্থিক খাতে পরিবর্তনের হাওয়া

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রেজাউল করিম খোকন

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো আর্থিক খাতে শুরু হয়েছে বড় ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া। পুরো আর্থিক খাতের শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। এখন অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে কোন সংস্কার এখনই শুরু করা দরকার। আর্থিক খাত সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে যেটা করা দরকার, তা এখনই শুরু করতে হবে। না হলে বড় বিপদ আসবে পুরো আর্থিক খাতে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার ও বিদেশ থেকে অবৈধ পথে দেশে টাকা পাঠানোর বিষয়টি। আর এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে হুন্ডির নাম। বলা হচ্ছে, দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে রেমিট্যান্স ঢুকছে মূলত হুন্ডির মাধ্যমে। এর ফলে সরকার একদিকে বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে। পাশাপাশি প্রবাসীরা তাদের আয় দেশে পাঠালেও হুন্ডির কারণে তা যোগ হচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে। সরকারের কোনো পদক্ষেপেই থামছে না হুন্ডির দৌরাত্ম্য। বরং প্রযুক্তির সহায়তা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ফাঁকফোকরে দিন দিন আরও ফুলে ফেঁপে উঠছে হুন্ডির কারবার। হুন্ডিচক্রে বন্দি হয়ে পড়েছে বৈধপথের রেমিট্যান্স। এর ফলে অর্থ পাচারও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে প্রতি ডলারে বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে, যা হুন্ডি প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। হুন্ডিচক্র বিদেশে ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা রেখে দেয় এবং তাদের এজেন্টরা দেশে সুবিধাভোগীদের হাতে টাকা পৌঁছে দেয়। ফলে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। এর ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতি বয়ে আনছে। সাধারণত বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। মূলত শুল্ক ফাঁকি ও অর্থ পাচারের জন্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় কম মূল্য বা বেশি মূল্য দেখানো হয়। অর্থ পাচারের জন্য দেশের বাইরে যে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়ে, তা হুন্ডিচক্র মেটায়। ব্যাংকিং চ্যানেলে কেউ পাঠালেও প্রবাসীর সুবিধাভোগী দেশে টাকা পান। বিদেশি হুন্ডি এজেন্ট প্রবাসীর বৈদেশিক মুদ্রা কিনে এখানে টাকা পরিশোধ করে। ব্যবসার পাশাপাশি যারা বিদেশে বাড়ি বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেন, তারা নানাভাবে হুন্ডি চক্রের দ্বারস্থ হন।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের দুটি প্রধান উপায় হলো পণ্য রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমাদের আমদানি খরচ বেশি। ফলে এই উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার বাড়ানোর সুযোগ কম। সে ক্ষেত্রে প্রবাসী আয়ের ওপরই নির্ভর করতে হয়। প্রবাসী আয়ের একটা বড় অংশ আসে অবৈধ চ্যানেল বা হুন্ডির মাধ্যমে। এতে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হয় । দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশ মালদ্বীপে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিক আছেন দুই লাখের মতো। বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক এক কোটি। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ থেকে কী পরিমাণ প্রবাসী আয় হুন্ডির মাধ্যমে আসে, অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। এই হুন্ডি ব্যবসার পেছনে সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক মুদ্রানীতি ও অর্থ পাচারই মূলত দায়ী। নানা কারণে প্রবাসী শ্রমিকেরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতে বেশি উৎসাহী হন। সরকার প্রণোদনা দিয়েও তাদের ব্যাংকমুখী করতে পারেনি। হুন্ডি ব্যবসা প্রসারের আরেকটি কারণ দেশ থেকে ব্যাপক হারে অর্থ পাচার হওয়া। পাচারকারীরাই মূলত হুন্ডি ব্যবসায়ীদের অর্থের জোগানদাতা। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে পাচারকারীদের ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। সরকার যতই প্রণোদনা দিক না কেন, বাইরের বাজারে তার চেয়ে বেশি দাম পেলে প্রবাসীরা সেখানেই ঝুঁকবেন। বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে হলে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধের বিকল্প নেই। ডলারের বিনিময় হার বাজারের হাতে ছেড়ে না দেওয়ায় দেশ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেওয়া এখন সময়ের দাবি বলে মনে করি।

উপমহাদেশে হুন্ডির উদ্ভব মুঘল আমলে। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রদেশগুলোর দূরত্ব ছিল অনেক বেশি। তাছাড়া পথঘাটও ছিল অনেক দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল। প্রদেশগুলো থেকে আদায় করা রাজস্ব দিল্লিতে প্রেরণের জন্য স্থানীয় মহাজনদের সাহায্য গ্রহণ করতেন বিভিন্ন প্রদেশের মুঘল প্রশাসকরা। এই স্থানীয় মহাজনদের ছিল ভারতজুড়ে নিজস্ব নেটওয়ার্ক। তারা নিজেদের মধ্যে অর্থ বিনিময় করতেন এক ধরনের স্বীকৃতিপত্র বা দলিলের মাধ্যমে, যাকে তুলনা করা যায় আধুনিক ব্যাংকিংয়ের চেকের সাথে। এই দলিলকেই বলা হতো হুন্ডি।ভারতের বিভিন্ন শহরে গড়ে ওঠা মহাজনদের এই নেটওয়ার্ক আবার বজায় থাকতো তাদের পরিচিতি, দীর্ঘদিনের লেনদেন এবং পারস্পরিক বিশ্বস্ততার মধ্য দিয়ে। মুঘল প্রশাসকরা দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানোর জন্য এই মহাজনদের ওপর নির্ভর করতেন। এই মহাজনরাই তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ পৌঁছে দিতেন কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। ১৭৫৭ সালের পলাশী ট্রাজেডির অন্যতম কুশীলব জগৎ শেঠও ছিলেন একজন হুন্ডির মহাজন। পুরো ভারত জুড়ে ছিল তার হুন্ডির কারবার। মুঘল আমলের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ আমলেও জনপ্রিয়তা পায় হুন্ডি। এর কার্যকারিতার জন্য ব্রিটিশরাও একে অর্থ লেনদেনের দেশীয় ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেয়। এমনকি একে বৈধতা দেবার জন্য রানীর সিলসহ স্ট্যাম্প ব্যবহারের প্রচলন করে।

হুন্ডি একটি বৈশ্বিক চক্র। ফলে সারাবিশ্ব থেকে প্রবাসীদের পাঠানোর অর্থ দেশে পরিজনদের পৌঁছে দেন। হুন্ডি কারবারিরা প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন অনেক সময় তারা ব্যাংকে যেতে পারেননা। আবার প্রবাসের সব শ্রমিকের বৈধ কাগজ নেই। যে কারণে চাইলেও অনেকে ব্যাংকে অর্থ পাঠাতে পারেননা। হুন্ডি হলো প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির বাইরের অর্থ লেনদেনের একটি উপায়। একে বাণিজ্যিক আদান প্রদান ও লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক দলিলও বলা যেতে পারে। যার মাধ্যমে দুই পক্ষ বা ব্যক্তির মধ্যে টাকা লেনদেন হয়। বিশ্বের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির অনুসরণ হয়না বলে হুন্ডির লেনদেনে দেশের সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। মধ্যযুগে ভারতে সম্পদ লেনদেনের জন্য প্রথম এই পদ্ধতির সূচনা হয়। বর্তমানে বৈধ পদ্ধতি এড়িয়ে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে দেশে টাকা আনার কাজে হুন্ডি পদ্ধতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে।বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে টাকা পাঠানো ও দেশ থেকে অর্থ পাচার এই দুটো বিষয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় হুন্ডির মাধ্যমে। প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশ থেকে ডলার আনলে বা ডলার এনে ঘোষণা দিলে সেটা বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে যোগ হয়। কিন্তু অনুমোদিত চ্যানেলের বাইরে দেশে অর্থ আসলে সেটা রিজার্ভে জমা হয় না। আবার অবৈধ আয়, চাঁদাবাজি-তদবিরে আয় করা অর্থ, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সাধারণত দেশ থেকে পাচার হয়েছে। এ ছাড়া রপ্তানি মূল্য কম দেখিয়ে এবং আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছে । পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয়েছে হুন্ডির মাধ্যমে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের জন্য দেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক, দেশের মানি এক্সচেঞ্জ, বিদেশি ব্যাংক ও হুন্ডির রেট ভিন্ন ভিন্ন। ব্যাংকের বিনিময় হারের তুলনায় হুন্ডিতে ভালো বিনিময়মূল্য পান বলেই প্রবাসীরা হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর দিকে আগ্রহী হন। এমনকি সরকার ঘোষিত প্রণোদনার পরও হুন্ডিতে অনেক বেশি বিনিময় মূল্য পান প্রবাসীরা। এজন্যই ব্যাংকের বদলে হুন্ডির দিকে ঝুঁকেছেন তারা। বিদেশগামী ছাত্র, ব্যবসায়ী, রোগী কিংবা পর্যটক সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে ডলার কিনতে গেলে নানা হয়রানির শিকার হন। বিদেশ থেকে আনা মুদ্রা বিক্রি করতে গেলে ব্যাংকে অনেক সময়ই বিনিময় মূল্য কম পাওয়া যায়। তাছাড়া ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হয়। এতে ডলার কিনতে আগ্রহী গ্রাহকদের সময় ও কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। বিপরীতে হুন্ডি এজেন্টদের গ্রাহকরা ফোন দিলে তারা গ্রাহকের বাসায় টাকা ও বিদেশি মুদ্রা নিয়ে আসে, পাশাপাশি তাদের দেয়া রেটও ব্যাংকের থেকে ভালো। গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকের থেকে হুন্ডির সেবা তাই সহজ, দ্রুত এবং নিরাপদ।

সামগ্রিকভাবে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রতি উৎসাহী। আরব আমিরাতের দুবাই, শারজা ও আবুধাবিতে কর্মরত আছেন হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিক। তারা দেশে টাকা পাঠাতে আলাদা কোনো ছুটি পাননা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাপস ব্যবহার করে নিজের একাউন্ট প্রবাসে বসেই পরিচালনা করতে পারেন। প্রবাসী শ্রমিকেরা অ্যাপস ব্যবহারে এখনো অনেক পিছিয়ে আছেন। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে ভয়ও কাজ করে। এজন্য তারা এক্সচেঞ্জ হাউসে গিয়ে দেশে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে পারেননা। বাসার পাশেই হুন্ডি করার সুযোগ আছে, এটাই সহজ পথ। আবার এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে পাঠালে যেখানে প্রতি দিরহামে পাওয়া যায় ২৯ টাকা ২০ পয়সা, সেখানে হুন্ডিতে মেলে ৩১ টাকার বেশি। দুই টাকা বেশি পেতে তারা হুন্ডিতে টাকা পাঠান। দুবাইয়ের ডেইরা, লেবার ক্যাম্প-সংলগ্ন মার্কেট ও সবজি বাজার, আবুধাবির আল আইন; শারজার রোলা; আজমানের সবজি বাজার ও লেবার ক্যাম্প প্রভৃতি এলাকায় বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক থাকেন। প্রতিটি জায়গাতেই রয়েছে হুন্ডি করার ব্যবস্থা। ব্যাংকে হয়রানির পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত রেট পাননা তারা। পাশাপাশি বিদেশ থেকে টাকা আনার ক্ষেত্রে ব্যাংকের কাছে অনেক বেশি জবাবদিহি করতে হয় তাদের। অবৈধ হয়ে পড়া প্রবাসীরা হুন্ডি ছাড়া দেশে টাকা পাঠাতে পারেননা। বিদেশে বাংলাদেশের অনেক প্রবাসী শ্রমিকেরই বৈধ কাগজ নেই। ফলে তারা নিজেদের ডকুমেনট দিয়ে ব্যাংকে লেনদেন করতে পারেননা। সেক্ষেত্রে দেশে টাকা পাঠাতে তাদের সহজ সমাধান হুন্ডি। বিমানবন্দরগুলোতে প্রবাসীদের সঙ্গে মার্জিত ব্যবহার করা হয়নি এতদিন । হয়রানির কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের প্রতি প্রবাসীদের মধ্যে এক ধরনের ঘৃণা ও আতঙ্ক বিরাজ করেছে। অনেক প্রবাসীই হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছেন, এর নীরব প্রতিবাদ জানান। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে বিস্তার লাভ করছে হুন্ডি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডি তদন্ত করে জানিয়েছে, বিভিন্ন মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত পাঁচ হাজার এজেন্ট অবৈধ উপায়ে বিদেশ থেকে অর্থ আনা ও বিদেশে অর্থ পাঠানোয় জড়িত। হুন্ডির মাধ্যমে (প্রবাসীদের ভাষায় মোবাইল ফোনে) আসা অর্থ দেশে তাদের পরিবারের কাছে মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) হিসাবে পাঠিয়ে দেয় হুন্ডি চক্রের এদেশীয় অংশীদাররা। ২০২০ সালে করোনায় বন্ধের মধ্যে প্রবাসীদের আয় কমেছিল। অথচ রেমিট্যান্স ব্যাপকভাবে বেড়েছিল। ওই বৃদ্ধি ছিল ক্ষণস্থায়ী। মূলত হুন্ডি চাহিদা কম থাকায় তখন প্রবাসী আয়ের প্রায় পুরোটা বৈধ চ্যানেলে এসেছিল। এ ছাড়া ভ্রমণ চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্যও বিদেশে যাওয়া বন্ধ ছিল। ফলে ডলারের চাহিদা ছিল কম। এখন চাহিদা বেড়েছে। এতে হুন্ডিও বেশি হচ্ছে। এ যাবৎকালের মধ্যে প্রথমবারের মতো রেমিট্যান্স দুই হাজার কোটি ডলারের ঘর অতিক্রম করেছিল করোনায় বিশ্বব্যাপী লকডাউনের মধ্যে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। আগের অর্থবছরের চেয়ে যা ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। অথচ ওই সময় বিশ্বের অনেক দেশে আয় কমেছিল। হুন্ডি প্রবণতা কমানোর উদ্যোগ নিতে বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি লিখেছিল সরকার। পাশাপাশি রেমিট্যান্স কমার কারণ অনুসন্ধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে দুটি টিম পাঠিয়েছিল। ওই প্রতিনিধি দল শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে রেমিট্যান্স কমার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে তুলে ধরে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে বাইরে বেশি অর্থ পাওয়া। তখন রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানো ও অর্থ পাচার ঠেকাতে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। তবে সরকার রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ না কমিয়ে প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে হুন্ডির চাহিদা বন্ধ না করা গেলে অবৈধপথে অর্থ আনা ঠেকানো যাবে না। পাশাপাশি শুধু প্রণোদনা না দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচও কমাতে হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের একের পর এক ভুল নীতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্থিক খাতের নানা অস্থিরতা। ফলে আর্থিক খাতের পরিস্থিতি কেবল নাজুকই হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে আর্থিক খাতকে বের করে আনতে হলে সবার আগে বিদেশে অর্থ পাচার ও হুন্ডি তৎপরতা ঠেকাতে হবে কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে এবং এ কাজ করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক


বর্তমান সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
হায়দার আহমদ খান এফসিএ

সব জাতি, দেশের কিছু ঘটনা, কাজ থাকে যা পরবর্তী প্রজন্মকে উৎসাহ দিয়ে থাকে। এমন একটি কাজ ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ আমাদের উপহার দিয়েছে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন, ১৯৯০ সালে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পাওয়ার সংগ্রামের পর যুক্ত হয়েছে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান আমাদের ইতিহাসে। ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে ঠিকই কিন্তু রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী একটি দেশের স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টার হিসাবের খাতায় বছরের সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের জনগণকে বারবার রক্ত দিতে হচ্ছে। ২০২৪ সালে যে সংখ্যায় বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে তা মনে হলে আমি মুক্তিযোদ্ধা হয়েও নিজকে অপরাধী ভাবতে হয়। যারা আহত, পঙ্গু হয়েছে তাদের কথা চিন্তা করতেও কষ্ট হয় তবে ভরসা এই আমাদের যুবসমাজ গণ-অভ্যুত্থানের পরে ঘরে ফিরে যায় নাই যেভাবে ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরে গিয়েছিল।

সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাপনার জগতে দেখা দিচ্ছে নানাবিধ বৈচিত্র্য। ব্যবসা, সংসার, সমাজ, দেশের ব্যবস্থাপনায় দিন দিন দেখা দিচ্ছে বৈচিত্র্যের সঙ্গে সমস্যাও। ছোট পরিসরে একক ব্যবস্থাপনায় যেমন সুবিধা আছে তেমনি সমস্যাও। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও প্রয়োজন হয় অন্যের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনার। আর তখন বড় পরিসরে ব্যবস্থাপনার জন্য নির্ভর করতে হয় নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের ওপর। এখানেই সমস্যা আমাদের দেশে বর্তমানে। বাংলাদেশের মতো শিক্ষা জগতে অনগ্রসর অবস্থায় দক্ষ জনবল পাওয়ার সমস্যায় ভুগছে পাবলিক, প্রাইভেট সেক্টর। শুধু তাই নয়- বিদেশেও যাচ্ছে অদক্ষ জনবল। ফলে শ্রমিকের চাকরি নিয়ে আমাদের যুবসমাজ এক মানবেতর জীবনযাপন করছে। দক্ষ জনবল পাওয়ার সময় যদি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের লোক নিয়োগ দিয়ে যায় তাহলে যা হওয়ার তাই হবে। যেমন হয়েছে সম্প্রতি বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশ গুলিই করে থেমে থাকেনি, লাশে আগুন দিয়েছে, সে এক অমানুষিক কাজ। আমি বলব জ্ঞানের স্বল্পতার সঙ্গে যোগ হয়েছিল রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। এখানে অবশ্যই মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসবেই। যদি কোনো দেশে সুস্থ রাজনীতি না থাকে তাহলে সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে এমন আচরণ অসম্ভব হয় না। এমন সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনেই দেখা দেয় সমাজে অনিয়ম, দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি। একটি দেশ যখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অধীনে চলে তখন যদি এমন অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি হয় তখন সমাজের গরিব, দুর্বল লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমাজে এমন অবস্থা বিরাজ দীর্ঘদিন করলে গণ-অভ্যুত্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যা আমরা দেখেছি ৫ আগস্ট ২০২৪-এ। এই গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণের যেমন অংশগ্রহণ ছিল তেমনি তার বিজয়ে সবাই আশাবাদী সামনের দিনে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে এই আশায়। এই প্রসঙ্গে চার মুক্তিযোদ্ধার বড় বোনের মন্তব্য উল্লেখ করার মতো। আমার বড়বোনের কথা বলছিলাম ভালোমন্দ নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, তোমরা দেশ স্বাধীন করেছিলে, এবার আদরের ছেলেরা যা অর্জন করেছে তাও তার চেয়ে কম নয়। আমিও একমত এই বিষয়ে।

ভালো কিছু পেতে হলে ক্ষতি বা কিছু ছাড় দিতে হয়। আমাদের ছাত্র-জনতা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এই আগস্টে তার একটি চিত্র সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে আমাদের সামনে এসেছে। সংবাদে শিরোনাম ‘মেরুদণ্ডে বুলেট, চোখের ভেতরে গুলি আর পা হারানো তামিমের গল্প’। এই ছিল সংবাদের ভিতরের অংশে প্রকাশ ‘শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মিরপুরে যে আনন্দ মিছিল হয়, সেটায় অংশ নিয়েছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তামিম হোসেন। একপর্যায়ে মিছিলে পুলিশ গুলি ছুড়লে একটি গুলি এসে পায়ে লাগে তামিমের।’ তার মানে আনন্দ মিছিলে অংশ নিয়ে তামিম একাধিক গুলির সম্মুখীন আমাদের সরকারি কর্মচারী ‘পুলিশের’ হাতে। এমন তামিমের সংখ্যা নিশ্চয়ই এক না। আমরা শুনে আসছি প্রায় প্রতিদিন কেউ না কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীদ হচ্ছেন। দেশের জন্য যারা মারা যান বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বেঁচে থাকবেন তাদের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা তারা বর্তমানে সরকার থেকে মাসিক আর্থিক সহায়তা পাচ্ছি। সরকারকে ধন্যবাদ তবে ১৯৭২ সালে যদি তা শুরু করা যেত তাহলে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো না। এক সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ‘নো ওয়ার্ক, নো পেমেন্ট’-এর আওতায় কাজ হারিয়েছিল, আর তখন সেই সন্তানের পিতা সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুর পর যেন রাষ্ট্রীয় সম্মানে দাফন করা না হয় তা বলেছিলেন (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫/১০/২০১৯)। তবে আশার কথা আমাদের যুবসমাজের প্রতিনিধিরা যাদের সম্পৃক্ততায় আজকের উপদেষ্টা পরিষদ, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেমন- ‘আমরা কখনোই শহিদদের স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না-প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের দায়িত্ব সরকারের-নাহিদ ইসলাম’। সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। উপদেষ্টা পরিষদ সামনের দিনে আরও সুন্দর এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত সময়ে নেবেন সে আস্থা আমার আছে।

বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যা দক্ষ জনবলে। দক্ষ জনবল সৃষ্টি করার প্রথম স্তর শিক্ষা জগতের প্রাথমিক শিক্ষা। আমাদের শিক্ষার উন্নতির যাত্রাপথেই বাধাগ্রস্ত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। আজকের অবস্থাও যেন এমন না হয়। আমাদের সন্তানদের যোগ্য এবং উপযুক্ত নাগরিক হয়ে সামনের দিনে প্রতিযোগিতায় সম্মুখীন হতে হবে। এই ক্ষেত্রে এক দিনও নষ্ট করা ঠিক হবে না। সংবাদে প্রকাশ ‘জবঃঁৎহ ঃড় পষধংংৎড়ড়স, পধসঢ়ঁংবং ঈযরবভ অফারংবৎ ঁৎমবং ংঃঁফবহঃং” (ঞযব ঋরহধহপরধষ ঊীঢ়ৎবংং, ৬ ঝবঢ়ঃবসনবৎ ২০২৪)।

বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ সেই বাংলাদেশের আদিকাল থেকে। সেই অনিয়মের বিরুদ্ধে সরকারের দুর্নীতি দমন দপ্তরের এক সেমিনারের কার্যপত্র উপস্থাপন করেছিলেন আজকের প্রধান উপদেষ্টা। আমি যদি ভুল না করে থাকি তাহলে তার কার্যপত্রের টাইটেল ছিল ‘আমি যদি দুদকের চেয়ারম্যান হতাম’। সেখানে উল্লেখ ছিল, ২০% কাজ করতে হবে অতীত নিয়ে, ২০% কাজ করতে হবে আজকের জন্য আর ৬০% সময় দিতে হবে আগামীর কজে। সেই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি আজ বাংলাদেশ পরিচালনের দায়িত্বে এক বিশেষ সমস্যা সংকুল সময়ে। প্রধান উপদেষ্টার ওপর আস্থা রেখে বলতে চাই বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে। সমাজের অনেক অনিয়মের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম দূর বা নিয়ন্ত্রণ করে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে হবে। দক্ষ জনবল যদি সৃষ্টি করা যায় এবং প্রশাসনে যদি যোগ্য লোক নিয়োগ করা যায় তাহলে সমাজের আসল এবং কার্যকর উন্নতি পরিলক্ষিত হবে। সরকারের কাজ হতে হবে দল নিরপেক্ষ ভাবে, দেশের মানুষের স্বার্থে। বর্তমানে দেশের মানুষ যা আশা করছে। বর্তমান সরকারের সামনে অনেক এজেন্ডা বা দাবি। অনেক সংস্কার করতে হবে। দেশ পরিচালনে যেহেতু রাজনৈতিক দল জড়িত তাই রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই দেশ পরিচালিত হতে হবে দীর্ঘমেয়াদে। বারবার আমাদের যে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে তা একমাত্র রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের জন্য। এ অবস্থার সম্মুখীন আমরা আর হতে চাই না। যা যা করণীয় বা দরকার তা যথসম্ভব দ্রুত করতে হবে। অনেকের মতো আমিও আশাবাদী। আজকে অনেকের সঙ্গে আমিও বলতে চাই ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়ে আমরা আমাদের ভাষার সম্মান দিতে পারি নাই, ১৯৭১ সালে রক্তের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করেও স্বাধীনতার স্বাদ পাই নাই, ১৯৯০ সালে গণতন্ত্রের জন্য রক্ত দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার পাই নাই। সম্প্রতি এক সংবাদে প্রকাশ ‘পটুয়াখালী, বাউফলে আর্থিক অনটনে উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে না গুলিবিদ্ধ সুমনের (প্রথমআলো, ৬/৯/২০৪)। আজ আমাদের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফসল যেন আমরা পাই। আমার জানা মতে আমাদের মতো বয়সের মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কম ছিল, আমি ছিলাম এসএসসি পরীক্ষার্থী। আমিই এখন ৭০ বছরের কাছাকাছি। আর বেশিদিন আমরা বাংলাদেশের আলো-বাতাস নিতে পারব সেই ভরসা নেই। আমাদের তরুণ সমাজ যারা আজকের গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক তাদের কাছে আমার মতো মুক্তিযোদ্ধার দাবি আমরা যা পারি নাই তা তোমরা করবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরের মাথায় আমরা যে অবস্থায় আছি তা ছিল না স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্দেশ্যে এবং লক্ষ্যে। সব শহীদদের রক্তের মূল্য দিতে হবে। শহীদরা জীবন দিয়েছে তাদের জন্য নয়। তারা দেখতে চায় বাংলাদেশের মানুষের শান্তি, উন্নতি।

লেখক: চেয়ারম্যান, এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (ইডিএ)


ক্ষমতার দম্ভ চিরস্থায়ী নয়

আপডেটেড ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৩:৫০
মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী

আওয়ামী সরকারের আমলে নির্বাচনগুলো কি সুষ্ঠুভাবে হয়েছিল? উপজেলা, জেলা বা জাতীয় সব নির্বাচন হয়েছে প্রহসনের। আওয়ামী লীগ সরকার যে জনগণের রায় মানেনি, অর্থাৎ যেনতেন ক্ষমতায় আসা চাই এটাই তাদের লক্ষ্য। এরা মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়াক না কেন, গণতন্ত্র এদের চক্ষুশূল। বারবার একক নির্বাচন দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতিকে হিমাঘরে পাঠিয়েছিল। তখন প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন সবই ছিল তাদের কবজায়। কোথাও কোনো নির্বাচন এলেই তাদের দলীয় নেতা-কর্মী ও ছাত্রলীগের গুণ্ডা বাহিনী ব্যবহার করেছে। ভোটারদের বাড়ি বাড়ি শুধু নয়, নির্বাচনে নিরোধী দলের প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি ঢুকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে প্রার্থীপদ প্রত্যাহারে বাধ্য করা হতো। ভোটের দিন যাচ্ছেতাইভাবে নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়। আওয়ামী সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে চাটুকার দল জাতীয় পার্টি ছাড়া বিরোধী দলের তেমন কোনো দলকে আসতে দেওয়া হতো না। সংসদ নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা সর্বত্র নিজের বা সরকারের সমালোচনার প্রতি সর্বত্র বিরক্তি মনোভাব প্রকাশ করতেন। কর্মক্ষেত্রে তিনি সরকারি বিধি বা নীতিমালা মানতেন না। পরিবার ও দলীয় লোকদের দুর্নীতির কথা উঠলেও তিনি কখনই পাত্তা দিতেন না। অর্থ পাচার ও ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে তার সরকারের নমনীয়তায় দেশের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দুদককে অকার্যকর করে রাখা হয়েছিল। গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল ছাড়া এককভাবে ৯০ শতাংশ আসনে জয়লাভ করে। বিরোধী যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারাও আওয়ামী লীগের লোকজন। প্রতি নির্বাচনে সরকারকে জাতীয় পার্টি সমর্থন দিয়েছিল। তৎকালীন সরকারের প্রতিটি অবৈধ নির্বাচনের জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিরোধী দলের আসন দখল করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। আওয়ামী লীগ নিজেও ভালো করে জানে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে তাদের অস্বিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগ শাসনামলে সব নির্বাচনই হয়েছিল একতরফা; এভাবে কি দেশ চলতে পারে? কিন্তু আর কতদিন? ছাত্র-জনতা যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে গত ৫ আগস্ট গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশছাড়া করে; এতেই প্রমাণিত হয় যে, দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে সকল প্রকার অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে তখন কিন্তু কেউ রেহাই পায় না। বলে রাখা ভালো কোনো সরকারই চিরস্থায়ী নয়।

গত ৫ আগস্ট দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী যিনি ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে তার দল ও দলের নেতা-কর্মীদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে রেখে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে গেলেন, যা একটি অগণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই সম্ভব। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী এভাবে দেশত্যাগ করে নাই, যা শেখ হাসিনা করে দেখালেন। সবার মুখ বন্ধ, ভোট চুরি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দমন-পীড়ন, গুম, শিশুহত্যা, আয়নাঘর তৈরি ইত্যাদি বহু অভিযোগে শেখ হাসিনা অভিযুক্ত। তবে পালানোর সময় তিনি তার দল আওয়ামী লীগের মতো সংগঠনটিকে ধ্বংস করে গেছেন। তার সরকারের আমলে দেশের যা উন্নতি হয়েছিল, তা তার নিজের একগুঁয়েমি, জেদ, হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার-অহমিকা, দম্ভের কারণে তিনি এর সব অর্জন ধ্বংস করে গেছেন। পাশাপশি তার বাবার সম্মানটুকু মাটিতে লুটিয়ে দিয়েছেন। গত ১৫টি বছর শেখ হাসিনার মধ্যে সম্মানিত লোকদের সম্মান বা শ্রদ্ধা করার প্রবণতা হারিয়ে ফেলতে দেখা গিয়েছে। তার মধ্যে এক ধরনের দম্ভও কাজ করতে দেখা গেছে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্বকে তিনি কথায় কথায় কত না অপমান-অপদস্ত করেছেন, যা গণমাধ্যমে দেশের জনগণ দেখেছেন। ছাত্র আন্দোলনের কাছে টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত গণ-অভ্যুত্থানে তার ক্ষমতা আর টিকে রাখা সম্ভব হয়নি। তার বিভিন্ন প্রেস কনফারেন্সে দেখা যেত দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিকদের প্রতি তার ক্ষোভের দৃশ্য। তিনি কথায় কথায় জনগণই তার ক্ষমতার উৎস বললেও আসলে পুলিশ ও প্রশাসন নির্ভরতার ওপর তার অঢেল ভরসা ছিল। আর এতেই তার সরকারের আমলে সীমাহীন দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে; যা ছিল ধরাছোঁয়ার বাহিরে। পারিবারিক দুর্নীতিকে শেখ হাসিনা এতই প্রশ্রয় দিয়েছেন, যা আগে কখনো কোনো সরকারের আমলে দেখা যায়নি। তিনি দিন দিন নিত্যনতুন ডিজিটাল নিরাপওা আইন তৈরি করে সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের গলা চেপে ধরতেন। বহু সাংবাদিক তার আমলে জেল-জুলুম খেটেছেন। তিনি সর্বত্র দেশের গুণীজন, সিভিল সোসাইটি ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর ক্ষেপে থাকতেন। তাদের কখনো মূল্যায়ন করতেন না। মুখের কথার জন্য শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছে। শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবিটি কালক্ষেপণ না করে সঠিক সময়ে মেনে নিতেন তাহলে আজ তাকে দেশছাড়া হতে হতো না। দেশ না ছাড়লে সেদিন শেখ হাসিনাকে লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফী বা ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের মতো পরিণতি হতে পারত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শেখ হাসিনা কখনো ভাবতে পারেনি যে তার কপালে করুণ পরিণতি রয়েছে। সব সময় ভাবতেন তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে রয়েছে। এক্ষেত্রে তার গোয়েন্দা ও দলের তথ্য ছিল ভুল। আর এ ভুলের জন্য শেখ হাসিনার পতন কেউ ঠেকাতে পারেনি। ইহা ছিল জনগণের ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের পঞ্জীভূত ক্ষোভের বহির্প্রকাশ। শেখ হাসিনা পালালেও তার এত মন্ত্রী, এমপিরা কেন গ্রেপ্তার হচ্ছে না এটাই এখন জনমনে প্রশ্ন?

এখানে ছাত্র-জনতার বিজয় হয়েছে। মূলত গণ-আন্দোলনের মুখে বিশ্বের কোনো শাসকই টিকে থাকতে পারে নাই। শেখ হাসিনাকেও সেই অনিবার্য নিয়তি মেনে নিতে হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর ৫০ বছর পর সেই শোকের আগস্ট মাসেই শেখ হাসিনাকে জীবন নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে হলো; এর চেয়ে অপমানের আর কী বা হতে পারে। এটা আওয়ামী সরকার-মন্ত্রীদের দুষ্কর্মের ফল। খালি মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশের সম্মানহানি ও বঙ্গবন্ধুর মানসম্মান ঢুবিয়েছেন তারা। শেখ হাসিনা কখনো খালেদা জিয়া, বিএনপি-জামায়াতকে দেখতে পারত না। তথাকথিত ১৪ দলের কথা শুনে বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে বাহিরে রেখে তিনি সব সময় এককভাবে জাতীয় নির্বাচন করতেন আর লোক দেখাতেন জিতেছি। এটাও এক ধরনের অপরাধ ও প্রতারণা। তিনি ছাত্রদের দাবিকে অগ্রাহ্য করে ছাত্রলীগকে দিয়ে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করাটাই ছিল তার সরকারের চরম ভুল। শেখ হাসিনার পলায়নের পর দেশ এখন অনেকটা শান্তি ও স্বস্তিতে ফিরে আসতে শুরু করছে। আর কোনো হামলা-মামলা বা প্রতিশোধ নয়, দেশকে সুশৃঙ্খল করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারের দায়িত্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নেওয়ার দাবি জানাই।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট


বন্যাপরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

আপডেটেড ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৩:৫০
কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম

বন্যাপরবর্তী কৃষি পুনর্বাসনের সহায়তার জন্য শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠে ধানের চারা উৎপাদন করার জন্য বীজতলা তৈরির কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। বন্যাপরবর্তী সময়ে কৃষকদের সহযোগিতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে এভাবেই লেখেন কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. জামিলুর রহমান। গবেষণা মাঠে ধানের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলা তৈরির এলাকার ছবি জুড়ে দিয়ে তিনি আরও লেখেন, বীজতলায় আমন ধানের বিভিন্ন জাতের চারা যেমন- ব্রি ধান-৭৫, ব্রি ধান-২৩, বিনা ধান-১৭ বপন করা হবে। এ ছাড়া সবজি ফসলের চারা উৎপাদনের কাজও এগিয়ে চলছে। বাণিজ্য মেলায় মাঠে ব্যাপক আকারে বিভিন্ন সবজির চারা উৎপাদন করা হবে। এই পোস্টে নিচে মন্তব্য পড়েছে ৩৩টি এবং ৬৬ জন শেয়ার করেছেন।

লেখা শুরুতেই এ ধরনের উদাহরণ তুলে ধরার কারণ হচ্ছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়া এবং ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের ১১টি জেলা বন্যায় প্লাবিত হয়। ৩১ আগস্ট শনিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আকস্মিক বন্যায় এখন পর্যন্ত ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশের কিছু জেলায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে উল্লেখ করে মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, এখনো দেশের ১১টি জেলায় ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। চলমান বন্যায় দেশের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জমির শাক-সবজি, ধানসহ অন্যান্য ফসল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সবচেয়ে অসুবিধা গবাদিপশুর বাসস্থান নিয়ে। গোয়ালঘরসহ বসতভিটাই পানি উঠাতে গোখাদ্যের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। পশুর অসুখ-বিসুখ বেড়ে গেছে। যাদের পুকুরে মাছ ছিল, সেগুলোও ভেসে গেছে।

সম্প্রতি বন্যাকবলিত আমার নিজ এলাকায় কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা গিয়েছিলাম ত্রাণ দিতে। এ সময় দেখেছি মানুষ কত অসহায়। অনেক বাড়িঘর পানির নিচে চলে যাওয়ায় মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। অনেক আশ্রয়কেন্দ্রের মাঠে গবাদিপশু বেঁধে রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও উঁচু সড়কের ওপর বেঁধে রাখা হয়েছে। দানাদার খাবার খাওয়াতে না পেরে অনেকে কচুরিপানা খাওয়াচ্ছেন। পশুর পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে না পেরে অনেকে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কৃষিবিভাগকে এখনই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের প্রথম কাজ হবে ক্ষতির পরিসংখ্যান ও প্রকৃতি নির্ণয় করা। ২৪ আগস্ট সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বন্যাদুর্গত এলাকায় কৃষি খাতে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ দ্রুত নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা।

চলমান বন্যায় প্রাণিসম্পদ- পোলট্রি, পশুখাদ্য, মাছ এবং অবকাঠামোর দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে মৎস্য খামারিরা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর, জলাধার ও খামারের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯ এবং ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন। এ ছাড়া প্রায় ৩৭৫ কোটি মাছের পোনা ও পোস্ট লার্ভা চিংড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গবাদিপশু খাতে এখন পর্যন্ত ৪৫০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। আকস্মিক বন্যার পানিতে অনেক গবাদিপশু ভেসে গেছে। নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনেক খামারি। বন্যার এই ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব পড়বে আমাদের জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদায়। প্রাণিসম্পদ খাতে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা খামারিদের জন্য সত্যি খুব কঠিন। তাই তাদের ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান একান্তই দরকার।

বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও বন্যা পরবর্তী করণীয় বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় ১২টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সিদ্ধান্তর মধ্যে রয়েছে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় আপদকালীন বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। আরও রয়েছে নাবী জাতের ধানের বীজ দেশের বন্যামুক্ত এলাকা থেকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করা পরামর্শ। আমি মনে করি, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা মাঠে বন্যা পরবর্তী সময়ে কৃষকদের সহযোগিতার জন্য যেভাবে বীজতলা তৈরি করে চারা উৎপাদন করছে। এভাবে কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিংবা দেশের বিত্তশালীরা উঁচু এলাকায় বীজতলা তৈরি করে পরবর্তীতে বন্যাকবলিত এলাকায় দিতে পারবেন।

ইতোমধ্যে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। সেপ্টেম্বর মাসের পর বড় বন্যার প্রকোপ দেখা না গেলে এ ক্ষেত্রে আমন ধান নষ্ট হলেও ধান চারার সংস্থান করা গেলে পুনরায় স্বল্পমেয়াদি আমন ধান যেমন- বিআর-৫, বিআর-২২, বিআর-২৩, ব্রি ধান-৩৪, ব্রি ধান-৪৬, ব্রি ধান-৭৫, বিনা ধান-১৭ জাতগুলো বীজতলায় চারা উৎপাদন করে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোপণ করা যাবে। তবে কোনোভাবেই যেসব জমি থেকে বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও সরে না যায়, সেসব জমিতে আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না। কারণ এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যাবে এবং ওই জমিতে রবিশস্য সঠিক সময়ে চাষ করা যাবে না; কিন্তু যেসব জমির বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের আগেই নেমে যাবে, সেসব জমিতে দ্বিতীয়বার চারা রোপণ উঁচু জমির ধানের কুশি উঠিয়ে প্রতি গোছায় ২-৩টি কুশি রোপণ করা যেতে পারে। যদি কুশির বয়স ১০-১২ দিনের মধ্যে হয় তা হলে মূল গোছার তেমন ক্ষতি হবে না। লক্ষ্য রাখতে হবে যে মূল জমির ধানের যে গোছায় কমপক্ষে ৬-৭টি কুশি আছে সেখান থেকে ২টি কুশি তোলা যেতে পারে। এসব কুশি লাগানো গেলে তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে নতুন কুশির জন্ম দেবে এবং কৃষক কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। এ ছাড়া মাসকালাই জাতীয় ফসল নরম মাটিতে বিনা চাষেই করা যেতে পারে। অন্যদিকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গবাদিপশুর রোগবালাই বেড়ে যায়। রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর মরিচ ও ডালজাতীয় ফসলের বীজ বোনা যেতে পারে। বন্যার পানি নেমে গেলে বিনা চাষে গিমাকলমি, লালশাক, ডাঁটা, পালং, পুঁইশাক, ধনে, সরিষা, খেসারি, মাষকালাই আবাদ করা যেতে পারে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলি জমির রস কমানোর জন্য মাটি আলগা করে ছাই মিশিয়ে এবং সামান্য ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।

মৎস্য চাষিদের প্রথমে পুকুর বা জলাশয়ের পাড় ভেঙে গেছে সেগুলো দ্রুত মেরামত বা সংস্কার করতে হবে। বন্যার পানির সঙ্গে বিভিন্ন অচাষযোগ্য মাছ যদি প্রবেশ করে, তখন ঘন ঘন জাল টেনে মাছগুলো তুলে ফেলতে হবে। বন্যার পানি নেমে গেলে স্থানীয় মৎস্য অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী পুকুরে পরিমাণমতো চুন এবং লবণ প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া বন্যা পরবর্তী সময়ে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির নানা ধরনের রোগবালাই যেমন- গরুর খুরা রোগ, গলাফোলা রোগ, তড়কা, বাদলা, হাঁস-মুরগির রাণীক্ষেত, ছাগল ও ভেড়ার পিপিআর ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।

নানা ধরনের পরজীবী বা কৃমির আক্রমণ বাড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগিকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের সহযোগিতা ও পরামর্শে প্রতিষেধক টিকা প্রদান এবং কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

আগামী রবি ফসলের বাম্পার ফলন না হলে কৃষকের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। কাজেই এখনই কৃষককে রবি ফসল বিশেষ করে গম, ভুট্টা, আলু ও ডালের উন্নত চাষাবাদের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষককে বীজসহ কৃষি উপকরণ আগাম সরবরাহ করতে হবে। চর এলাকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে কৃষি উপকরণের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষির ওপর ভর্তুকি হলো সরকারের প্রকৃত কৃষি বিনিয়োগ। অনেক সময়ই সরকারের কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা দুর্গমে কাজ করতে আগ্রহী হয় না। ফলে নতুন প্রযুক্তি থেকে প্রান্তিক কৃষক বঞ্চিত হয় বা বিলম্বে তা জানতে পারে। মনে রাখতে হবে, প্রান্তিক কৃষক কৃষিকাজ করতে নিরুৎসাহিত হলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তা হবে এক মারাত্মক হুমকি।

কৃষকরা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। রাষ্ট্রের কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতার কারণে কৃষিজমি ও কৃষকরা অবহেলা আর ভোগান্তির মধ্যে আছে। কৃষকরা কী পরিমাণ কষ্ট এবং দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে সেটা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝা যাবে না। কৃষকরা উৎপাদন বন্ধ করে দিলে দেশের উন্নয়ন ভেস্তে যাবে। ব্যবসায়ী, মহাজন সবাই কৃষকদের শোষণ করছে। অবিলম্বে কৃষকদের স্বাস্থ্য বিমার পাশাপাশি কৃষি বিমা চালু করতে হবে। শস্যবিমা করা থাকলে কোনো কারণে ক্ষতি হলে বিমাকারী প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তা দেয়। শুধু শস্যই নয়, কৃষির অন্যান্য উপখাত-গবাদিপশু ও মৎস্য খাতকেও কৃষিবিমার আওতায় আনা প্রয়োজন। যেহেতু নিচু এলাকায় প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয় এবং ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে সেহেতু নিচু এলাকার কৃষি ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত।

সমাজের সবাইকে তার জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। আর এ সবকিছু করতে হবে সবাইকে নিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে। কৃষকদের পুনর্বাসনের জন্য কাউন্সেলিং করাতে হবে। পাশে দাঁড়িয়ে সাহস দিতে হবে। এ পর্যায়ে কৃষকের সবচেয়ে বেশি দরকার হয় আর্থিক ও মানসিক সাহায্য। তাদের টিকে থাকার জন্য গবাদিপশু পালন ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত রাখতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান কৃষকদের সাহায্য করবে, তাদেরও আয়কর কমানোসহ প্রণোদনা দিতে পারে সরকার। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিতে হবে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সরকারকে এখনই বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সর্বস্বান্ত হওয়া কৃষকের জন্য শুধু ত্রাণ যথেষ্ট নয়; বন্যার পরে কৃষককে তার কৃষিকাজের সঙ্গেই যতটা সম্ভব সম্পৃক্ত রাখাটাই আসল। পাশাপাশি আয়ের বিকল্প উৎস তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে হবে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে যেমন উদ্যোগী হতে হবে, তেমনি সার্বিকভাবে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। নদী ও খাল-বিল খননের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ সচল রাখা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

মাধ্যমিকে বিভাগ বিভাজনসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ের

আপডেটেড ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৩:৫০
মাছুম বিল্লাহ

পূর্ববতী সরকারের তথাকথিত নতুন শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের বিভাগ বিভাজন অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য তুলে দেওয়া হয়েছিল। এর পেছনে শক্ত কোনো যুক্তি ছিল না। যে শিক্ষার্থী গণিত বোঝেনা তাকেও গণিত ও বিজ্ঞান পড়তে হবে, যে শিক্ষার্থীর গণিত, বিজ্ঞানে আগ্রহ বেশি তাকেও সাধারণ বিজ্ঞান অর্থাৎ বিজ্ঞানে যাদের আগ্রহ নেই তাদের জন্য দায়সারা গোছের যে বিজ্ঞান সিলেবাস সেই বিজ্ঞান পড়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। একইভাবে বাণিজ্যে পড়ার যাদের কোনোই আগ্রহ নেই সবাইকে সেই বিষয় পড়তে হবে অর্থাৎ জোর করে সবাইকে সবকিছু পড়তে হবে। এটি কোনো সুচিন্তিত মতামত নয়। আমি তৎকালীন মেম্বার কারিকুলামকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বিজ্ঞান শিক্ষার্থীরা যদি বিজ্ঞানের বিষয় আরও বিষদভাবে জানতে চান তাদের সেটি করতে দেওয়া উচিত কিন্তু উনি উত্তরে বললেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়ে আমাদের দেশকে সার্ভ করেনা, তারা আমেরিকাকে সার্ভ করে। অতএব, মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান পড়ার কোনো দরকার নেই। আমি একথার উত্তরে বলেছিলাম বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা আমেরিকা চলে যায় বলে তারা বিজ্ঞান পড়বে না? তার কোনো সদুত্তর পাইনি অর্থাৎ আমাদের কথার কোনো গুরুত্ব তাদের কাছে ছিল না। তারা দুই-চারজন যা ভাবতেন তাই করতেন। যাদের জন্য বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য বিভাগ বা যাদের ছেলেমেয়ে এসব বিভাগে পড়বে তাদের সঙ্গে কথা না বলে এনসিটিবির কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সবাইকে সব বিষয় পড়তেই হবে। যার সাহিত্য ও ইতিহাস ভালো লাগে কিন্তু বিজ্ঞানে আগ্রহ কম কিংবা বোঝে না তাদেরও বিজ্ঞান পড়তে হবে। বিষয়টি নিয়ে বারবার বলেছি, লিখেছি কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। তারা সবাইকে সব বিষয় পড়িয়ে পূর্ণজ্ঞানদান করার কথা বলেছিলেন। আমি বলেছিলাম, যে বিজ্ঞানে পড়েও অনেকে নিজ আগ্রহে সাহিত্য পড়েন কিন্তু জোর করে পড়ানো যায়না। এটি আমি প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি অনেক মেডিকেলের শিক্ষার্থী, বুয়েটের শিক্ষার্থী নিজ আগ্রহে সাহিত্যের বহু বই পড়ে ফেলেছেন। এটি সবাই করবে না। কিন্তু যাদের আগ্রহ আছে তারা করবেনই। তাই বলে জোর করে সবাইকে সবকিছু পড়তে বলার মানে হলো কুইনিন খাওয়ানো। দ্বিতীয়ত, উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে হঠাৎ করে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিকে বিশাল সিলেবাস অনুসরণ করতে পারা অনেক শিক্ষার্থীদের জন্য মানানসই হয় না কারণ উচ্চ মাধ্যমিকে সময় কম, বিষয় ও বিষয়ের কন্টেন্ট অনেক বেশি। ফলে, অনেকেই তা ডাইজেস্ট করতে পারে না। তাই ফল খারাপ করে। এসব কোনো চিন্তাই তাদের টাচ করেনি।

কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মাধ্যমিকে বিভাজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের অনেক বিষয় ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ অনুসারে প্রণীত বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষাভিত্তিক পাঠ্যপুস্তকগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হবে যাতে শিক্ষার্থীরা এক শিক্ষাবর্ষের মধ্যেই পাঠ্যসূচিটি সম্পন্ন করতে পারেন। অর্থাৎ এখন যারা নবম শ্রেণিতে পড়েন তারা বিভাগ বিভাজনের সুযোগ পাননি, তারা দশম শ্রেণিতে উঠে বিভাগ বিভাজনের সুযোগ পাবে যেটি সংক্ষিপ্ত হবে। এটি একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত যা শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষাসংক্রান্ত ব্যক্তিদের দুশ্চিন্তাকে অনেকটাই লাঘব করবে। আরও বলা হয়েছে শিক্ষাবিদ, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট প্রশাসক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও অভিভাবক প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ২০২৫ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম চূড়ান্ত করা হবে, যা ২০২৬ সাল থেকে পরিপূর্ণরূপে কার্যকর করা হবে। এটিও চমৎকার প্রস্তাব কারণ পূর্ববর্তী কারিকুলাম পরিবর্তন বা পরিমার্জনের সময় মুখচেনা কিছু শিক্ষাবিদ যাদের মাঠের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, বর্তমান শ্রেণিকক্ষ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তাদের নিয়ে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। আর বেশি সময়ই শিক্ষা প্রশাসকদের নিয়ে মিটিং করা হতো যাদের বই সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না কারণ এখানে অর্থের ব্যাপার আছে। আমরা আর একটি কথা ভুলে যাই, শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশি হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষা গবেষকরা কারণ তারা দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টির সঙ্গে লেগে থাকেন বলা যায় ৩০-৪০ বছর কিংবা সারাজীবন। শিক্ষা প্রশাসকদের কয়েক বছরের বিশেষ করে মন্ত্রণালয়ে যারা থাকেন। অথচ তাদের সিদ্ধান্তকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তারা এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে ঘুরতেই থাকেন, অতএব শিক্ষার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কিন্তু কম। অথচ পূর্ববর্তী কারিকুলামের কাজের সময় তারাই মিটিং, ওয়ার্কশপে থাকতেন। আবার মাউশি ও এনসিটিবিতে যেসব শিক্ষক ডেপুটেশনে বা বদলি হয়ে আসেন তারাও কিন্তু বই, কারিকুলাম, শ্রেণিকক্ষ এগুলোর কথা ভুলে যান। তারা শিক্ষকের চেয়ে কর্মকর্তা পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বই পড়া, শ্রেণিকক্ষের অবস্থার কথা কিন্তু তারা ভুলে যান। এই শ্রেণিকেও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এগুলো সবই কিন্তু ভুল ও আংশিক সিদ্ধান্ত। তাই, বর্তমান সরকার যা বলেছে তা যুক্তিযুক্ত।

জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২ ও নতুন পুস্তক মুদ্রণ এবং চলমান মূল্যায়ন পদ্ধতি সংক্রান্ত জরুরি নির্দেশনা বিষয়ক এ পরিপত্রে বলা হয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২-এর বিষয়ে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা তথা অংশীজনদের অভিমত, গবেষণা ও জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের অপ্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ঘাটতি, পাঠ্য বিষয়বস্তু ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে অস্পষ্টতা ও নেতিবাচক ধারণা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার প্রকট অভাব ইত্যাদি নানাবিধ বাস্তব সমস্যা বিদ্যমান থাকায় ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় মর্মে প্রতীয়মান। এ বিষয়টিও আমরা বারবার বলেছিলাম, মাঠের চিত্র ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে কিন্তু তারা কেউই কর্ণপাত করেননি। নির্দেশনায় বলা হয় ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চলমান পাঠ্যপুস্তকগুলো ২০২৪ সালব্যাপী বহাল থাকবে। ২০২৫ সালে যথাসম্ভব সংশোধিত ও পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হবে। ২০২৪ সালের অবশিষ্ট সময়েও বার্ষিক পরীক্ষায় ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সংশোধিত ও পরিমার্জিত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হবে এবং তার একটি রূপরেখা শিগগিরই বিদ্যালয়ে পাঠানো হবে। ছয়মাস পর পর একটি করে লিখিত পরীক্ষা হবে এবং প্রশ্ন হবে সৃজনশীল। রূপরেখাটি বিদ্যালয়ে পাঠানোর সঙ্গে সব মিডিয়ায় বেশি বেশি প্রচার করতে হবে যাতে সবাই বিষয়টি ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে পারে। শ্রেণি কার্যক্রমগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির প্রতিটির ৬টি করে বিষয়ভিত্তিক যে মূল্যায়ন কার্যক্রম অসম্পন্ন রয়েছে সেগুলো আর অনুষ্ঠিত হবে না। এই সিদ্ধান্তটি দিতে মন্ত্রণালয়ের একটু বিলম্বই হয়েছে কারণ বিদ্যালয় খোলার পর বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন এবং আমরা বিষয়টির সিদ্ধান্ত দ্রুত জানানোর জন্য অনুরোধ করেছিলাম। যেসব শিক্ষার্থী ২০২৫ সালে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবে, তাদের জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২-এর আলোকে প্রণীত শাখা ও গুচ্ছভিত্তিক সংশোধিত ও পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তকগুলো (বর্তমানে অর্থাৎ ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ব্যবহার করছেন) প্রদান করা হবে। এই শিক্ষার্থীরা নবম ও দশম শ্রেণি মিলিয়ে দুই শিক্ষাবর্ষে সম্পূর্ণ পাঠ্যসূচি শেষে ২০২৭ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। নতুন কারিকুলামে ছিল, শুধু দশম শ্রেণির সিলেবাসে শিক্ষার্থীদের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, সেটিও পরিবর্তন হলো।

নির্দেশনায় প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়- প্রাথমিক স্তরে প্রাক-প্রাথমিক, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে ধারাবাহিকতা রেখে ইতোমধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইগুলোর পাণ্ডুলিপি প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন করে মুদ্রণ করা হবে। নতুন কারিকুলাম যে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে এবং এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়, সেটি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয় যে জন্য আমরা মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাই। শিক্ষার এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এত সহজে অনুধাবন করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক


চিন্তার সংস্কার 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অলোক আচার্য

চিন্তা বলতে আমরা আমাদের মনের ভেতরের কথা বা পরিকল্পনাকে বুঝিয়ে থাকি। আমাদের প্রতিটি চিন্তাই কাজে প্রতিফলন ঘটায় না। কিছু চিন্তা-চেতনা মানুষের কাজে পরিণত হয়। একেক জনের চিন্তা-ভাবনা একেক রকম। কারণ আমরা ভিন্ন ভিন্ন মানুষ। আমাদের বড় হওয়ার পরিবেশও ভিন্ন। শিক্ষা-দীক্ষার পরিবেশ ভিন্ন। সে কারণেই আমাদের একই বিষয়ে কারও চিন্তা ইতিবাচক আবার কারও নেতিবাচক। চিন্তাবিদদের মতে, এক গ্লাস পানির যদি অর্ধেকটা পূর্ণ থাকে তাহলে কেউ বলবে গ্লাসটির অর্ধেকটা খালি আবার কেউ বলবে গ্লাসটির অর্ধেকটা পূর্ণ। যদিও দুটি মতই সঠিক। কিন্তু এখানেও রয়েছে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপার। কারও আবার মাঝামাঝি। ইতিবাচক চিন্তা হচ্ছে এমন এক মানসিক মনোভাব ধারণ করা যার জন্য আমরা প্রতিটি কাজের ভালো ও সন্তোষজনক ফলাফল আশা করি। শৈশবকাল থেকেই আমরা ভাবতে শিখি এবং বলতে শিখি। অন্যভাবে বলতে গেলে ইতিবাচক চিন্তা হচ্ছে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আশাহত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পরিবেশকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার চেষ্টা করে যাওয়া। জীবনকে সুস্থ ও সুন্দর করার জন্য ইতিবাচক চিন্তার কোনো বিকল্প নেই।

চেতনা হলো কর্ম বিকাশের মাধ্যম। আমাদের প্রধান শক্তি হলো চিন্তা বা কল্পনা। আমরা যে বাংলাদেশ চিন্তা করি সেটিই কিন্তু প্রকাশ করি। যা চিন্তা করি না সেটি প্রকাশও করি না। এই যে চিন্তা, আমাদের পাপেরও শুরু এই চিন্তা থেকেই। প্রথমে আমরা চিন্তা করি, তারপর সে অনুযায়ী যদি কুকর্মে প্রবৃত্ত হই তবে সেটি পাপ। কিন্তু এর শুরু হয় চিন্তা থেকেই। একই কথা ভালো কাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাদের নানা অনিয়ম যে শুরু সেখানে যদি পরিবর্তন আনতে পারি, দেশটিকে যদি নিজের ঘর ভাবতে পারি তাহলে পরিবর্তন ইতিবাচক হবেই। আর যদি দেশ ও পরিবার ভিন্ন মনে করি, তাহলে চিৎকার করাই বৃথা, কোনো কাজের কাজ হবে না। সে কারণেই বলছি, আগে চিন্তার সংস্কার করতে শিখুন, পরে সমাজ এবং সবশেষে দেশ। নিজের মস্তিষ্ককেই যদি কুসংস্কার, কার্পণ্য এবং হিংসামুক্ত করতে না পারেন, দেশটিকে কীভাবে এসব থেকে মুক্ত করবেন। প্রথমেই নিজের চেন্তা-চেতনাকে এসব থেকে মুক্ত করতে হবে। তারপর তা ছড়িয়ে দিতে হবে। আপনার চিন্তা যদি সমাজ সংস্কারের কাজে লাগে, তাহলে সেটিই হবে বড় সংস্কার। এর জন্য আহামরি বক্তৃতার প্রয়োজন নেই। ভাবুন এবং তা যাচাই করুন। চিন্তাকে যদি লোভের কাছে বিক্রি না করেন, দেখবেন কাজও বিক্রি করতে হবে না। অতএব সবার আগে চাই চিন্তার সংস্কার।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট


বন্যা-পরবর্তীতে করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

আমাদের বাংলাদেশের অবস্থান গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকায় হওয়ায় এবং বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত বিভিন্ন উপনদীর কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছরই বর্ষাকালে ছোট থেকে মাঝারি আকারের বন্যা হয়ে থাকে।

আমাদের জানা দরকার বন্যা কী?

বন্যা হলো জলের উপচে পড়া বা খুব কমই অন্যান্য তরল যা সাধারণত শুষ্ক জমিকে নিমজ্জিত করে। ‘প্রবাহিত জল’ অর্থে, শব্দটি জোয়ারের প্রবাহের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে।

সাম্প্রতিক বন্যা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের ১২টি জেলার ব্যাপক ক্ষতি করে, বিশেষ করে কৃষি জমিতে ফসল, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, খাল-বিল, পুকুরসহ আবাদি জমি ও গৃহপালিত পশু এবং বাড়িঘর, দেকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল, ব্যাংক-বিমা এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়ও মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব দাবি করছেন, তারা উপদ্রুত এলাকা থেকে মানুষকে আগেভাগে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন, তবে মানুষ আসতে চায়নি।

আবহাওয়া অধিদপ্তর দাবি করেছে, তাদের কাছে থাকা বন্যার আগাম তথ্য তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানিয়েছে, কাজেই দায় তাদের না। তবে একজন পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আবহাওয়া অধিদপ্তর যে ভাষায় বার্তা দেয়, তা মানুষ বোঝে না। তার মতে, বার্তার ভাষাও পাল্টাতে হবে।

বন্যা-পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ও সহায়তা প্রদান করা দরকার।

বর্তমানে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিটি বিভাগসহ সারা দেশের সর্বস্তরের জনগণের এমনকি বিদেশে অবস্থানরত সহৃদয়বান দেশি-বিদেশি জনগণের সবার উচিত বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে সাধ্যমতো সহায়তা করা।

বন্যা-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য সমস্যা এবং সংকট গুরুতর আকার ধারণ করে। বন্যার কারণে পানি দূষিত হয়, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। এই পরিস্থিতিগুলো দ্রুত নিরসন করা না হলে বন্যা প্লাবিত এলাকায় মহামারি আকার ধারণ করতে পারে রোগব্যাধি।

দূষিত পানি পান ও খাদ্যগ্রহণের ফলে ডায়রিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এটি শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এবং সময়মতো চিকিৎসা না পেলে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বন্যা-পরবর্তী সময়ে কলেরা সবচেয়ে বিপজ্জনক, পানিবাহিত রোগগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। দূষিত পানি ও খাবার থেকে এই রোগ ছড়ায় এবং দ্রুত অনেক মানুষের মধ্যে তা সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এ ছাড়া দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে ছড়ানো টাইফয়েড বন্যার পরে খুবই সাধারণ একটি রোগ। রোগ বাড়তে না দিয়ে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে চিকিৎসা না করা হলে তাতে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বন্যার ফলে স্থির পানি জমে থাকা এলাকাগুলো মশার প্রজননের আদর্শ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ কারণে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার জন্য বন্যা-পরবর্তী অবস্থা উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। এটি দ্রুত রোগ ছড়াতে সক্ষম এবং ক্রমান্বয়ে পানিবাহিত এই রোগ মারাত্মক হতে পারে। চিকুনগুনিয়া আরেকটি মশাবাহিত রোগ- যা ডেঙ্গু এবং ম্যালেরিয়ার মতোই বন্যার পরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে পানির সংস্পর্শে থাকার কারণে ত্বকে ফাঙ্গাল ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে ‘এথলেটস ফুট’ এবং অন্যান্য চর্মরোগ উল্লেখযোগ্য। ভেজা মাটি এবং পানিতে হাঁটাহাঁটি করার কারণে পায়ের ত্বকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ হতে পারে, বিশেষ করে যারা জুতা ছাড়া হাঁটেন তাদের মধ্যে। বন্যার পরে আর্দ্র ও ঠাণ্ডা পরিবেশে ঠাণ্ডা, কাশি এবং জ্বরের মতো সমস্যাগুলো বেড়ে যায়। দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এই রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব বাড়িয়ে তোলে। ঘরের ভেতর আর্দ্রতা বাড়ার কারণে অ্যাজমা এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা বাড়তে পারে, বিশেষ করে যারা ধুলা ও আর্দ্রতার প্রতি সংবেদনশীল।

বন্যা উত্তর পরিস্থিতি অল্পদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। বন্যায় বিপৎসীমার ওপরে ওঠা পানি যখন আস্তে আস্তে নেমে আসে, ঠিক তখনই আসল যুদ্ধ শুরু হয়। সাধারণত বন্যার চেয়েও কঠিন হয়ে থাকে বন্যা-পরবর্তী সময় মোকাবিলা করা। সে সময় বর্তমান সময়ের মতো এত মানুষও পাশে থাকে না। তখন সামাল দিতে হয় নিজেদের। মোকাবিলা করতে হয় বন্যা-পরবর্তী সময়ের কঠিন পরিস্থিতিকে।

বন্যা-পরবর্তী সময়ে উপদ্রুত এলাকায় জনগণের স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও নোয়াখালী জেলায় বন্যা-পরবর্তীতে ডায়রিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। জেনারেল হাসপাতালসমূহে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধারণক্ষমতার চেয়ে ১১ গুণ বেশি রোগী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গুরুত্ব সহকারে প্রতিটি বাড়ির টিউবওয়েল, টয়লেট, ড্রেনেজ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায় ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিক অবস্থা, সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় জনগণকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে বিষয়ে সচেতন করতে হবে। এতে বন্যা-পরবর্তী রোগ প্রতিরোধে জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। বেশি বেশি করে রেডিও, টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সচেতনতা বার্তা বারবার প্রচার করা যেতে পারে।

বেসরকারি উদ্যোগেও বন্যা-পরবর্তী সতর্কতামূলক পদক্ষেপসমূহের ব্যাপক প্রচারণা সংকট মোকাবেলায় সহায়ক হবে।

চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব এলাকার মানুষ। লক্ষ করা গেছে, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও মানুষের ঠাঁই হচ্ছে না। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ছোট-বড় সড়ক ও মহাসড়ক এবং রেললাইনও। এমনকি বেশ কিছু স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ আছে। অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন এই ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর বেশির ভাগ লোকজন।

এদিকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ সারা দেশের সঙ্গে সেনাবাহিনী বন্যাকবলিতদের উদ্ধারে এবং সহযোগিতায়, ছাত্র-জনতা ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

বন্যা-পরবর্তী সময়ে বন্যার পানিতে হাঁটা উচিত নয়, সাঁতার কাটাও নিরাপদ নয়; তাছাড়া সাপের উপদ্রব তো আছে। ইদানীং সারা দেশে রাসেল ভাইপার আতঙ্কের কারণেও বন্যা উপদ্রুত এলাকায় ব্যাপক সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তায় স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালানোও ঝুঁকির কারণ। কেননা ৬ ইঞ্চি পানির স্তরেও যেকোনো গাড়িচালক যেকোনো সময় নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন।

ভেজা বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি থেকে দূরে থাকা উচিত, এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি আছে।

বাড়িতে ঢোকার আগে প্রত্যেকের দেখে নেওয়া প্রয়োজন যে, কোনো কাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে কি না।

বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র পরিদর্শন করার আগে কখনোই পাওয়ার চালু করা উচিত না, কারণ যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা।

সাপ ও বিভিন্ন প্রাণী বাড়িতে থাকতে পারে, তাই সবারই সতর্ক থাকা উচিত। সম্ভব হলে গ্লাভস ও বুট পরার অভ্যাস করতে হবে। বন্যা-দূষিত প্রতিটি বাড়ির বিভিন্ন ঘর পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত ও শুকিয়ে রাখতে হবে।

যদি কোনো বিমা থাকে, তাহলে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে, বিমা দাবির নথি হিসাবে ছবি বা ভিডিও আছে কি না।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের করণীয় সম্পর্কে বন্যার পানিতে ভেসে আসা কচুরিপানা, পলি, বালি এবং আবর্জনা যত দ্রুত সম্ভব পরিষ্কার করতে হবে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর ৫-৭ দিন কাদাযুক্ত ধানগাছ পরিষ্কার পানি দিয়ে, প্রয়োজনে স্প্রে মেশিন দিয়ে ধৌত করে দিতে হবে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই সার প্রয়োগ করা ঠিক নয়। এতে ধান গাছ পচে যেতে পারে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার ১০ দিন পর ধানের চারায় নতুন পাতা গজানো শুরু হলে বিঘাপ্রতি ৮ কেজি ইউরিয়া ও ৮ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ব্রি উদ্ভাবিত আলোক সংবেদনশীল উফশী জাত যেমন- বিআর৫, বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৪৬, ব্রি ধান৫৪ এবং নাইজারশাইলসহ স্থানীয় জাতসমূহ রোপণ করতে হবে। এ ছাড়া, ব্রি উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকালসম্পন্ন জাত ব্রি ধান৫৭ ও ব্রি ধান৬২ রোপণ করা যেতে পারে।

বন্যা উপদ্রুত জেলাসমূহের কৃষি সম্প্রসারণ অফিসারদের সমন্বয়ে টিম গঠন করে দুর্যোগ মোকাবেলায় সম্ভাব্য করণীয় নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে; চলমান কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি জোরদার করতে হবে; বন্যার ক্ষতি মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত জাতের আমন ধানের বীজের পর্যাপ্ত সংস্থান ও সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে; অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় আপৎকালীন বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করতে হবে; নাবী জাতের রোপা আমন ধান চাষে কৃষকদের পরামর্শ দিতে হবে; নাবী জাতের ধানের বীজ দেশের বন্যামুক্ত এলাকা হতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; বন্যা কবলিত ঝুঁকিপূর্ণ গুদামে রক্ষিত সার নিরাপদ জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে; আগাম জাতের শীতকালীন সবজি উৎপাদনের বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে; বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতার লক্ষ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ-পূর্বক মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করতে হবে; বন্যা দুর্গত এলাকার কৃষি অফিসসমূহে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা দরকার।

বন্যা দুর্গত এলাকার সার্বক্ষণিক তথ্য সরবরাহের লক্ষ্যে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় উপজেলা, জেলা, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপনপূর্বক হালনাগাদ তথ্য সরবরাহ করতে হবে। বন্যাকবলিত এলাকায় সরকারি অফিসসমূহের মালামাল নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করতে হবে।

সব মিলিয়ে বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি পূর্বাঞ্চলের ওই জেলাসমূহে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

যে যা-ই বলুক বা মনে করুক আমাদের ব্যবস্থা ও প্রতিকার আমাদেরই নিতে হবে। সুদুরপ্রসারী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দ্বারা যথাস্থানে বাঁধ নির্মাণ, ফসলি জমিকে উৎপাদনমুখী, রাস্তাঘাট পুনর্নির্মাণ, পুকুর জলাশয়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে মাছচাষে দ্রুত মনোযোগ ও গরিব অসহায় জনগোষ্ঠীর গৃহ পুনর্নির্মাণে সহায়তা করতে হবে।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

বিষয়:

ইসলামের আলোকে প্রতিহিংসা পরায়ণতার কুফল

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ এনাম-উল-আজিম

মানুষের চরিত্রের সবচেয়ে খারাপ বা বদ গুণগুলোর মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভ অন্যতম। এই কুপ্রবৃত্তিগুলো শুধু সমাজ ও সম্পদকেই ধ্বংস করে না মানুষের জীবনকে বিষময় করে তোলে। পাশাপাশি নিজের ইহকাল ও পরকালের জীবনকেও বরবাদ করে দেয়। সেজন্য ইসলাম সর্বপ্রকার হিংসাবোধকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। আজ আমরা ইসলামের আলোকে এই কুপ্রবৃত্তি কীভাবে আমাদের অন্তরে প্রবেশ করে অন্য ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দেশকে ধ্বংস করছে সেই বিষয়ে আলোকপাত করব।

মানুষ মহান আল্লাহপাকের সেরা সৃষ্টি। জীবনভর মহান প্রভুর ইবাদত-বন্দেগি করে আল্লাহর অধিক নৈকট্য লাভকারী ফেরেস্তাদের আপত্তি সত্ত্বেও আল্লাহপাক মানুষ সৃষ্টি করেছেন তার প্রিয় বান্দা হিসেবে এবং সম্মান দিয়েছেন তার সব সৃষ্টির ওপরে। আল্লাহপাক মানুষকে সৃষ্টি করে তাকে সেজদা করার জন্য ফেরেস্তাদের আদেশ দিলেন। একদল ফেরেস্তা স্রষ্টার আদেশ অমান্য করল। মানুষকে আল্লাহ তৈরি করেছেন মাটি থেকে আর ফেরেস্তাদের সৃষ্টি করেছেন নূর বা আলো থেকে। যার ফলে এক ধরনের অহংকারবোধ খোদার আদেশ অমান্যকারী ফেরেস্তাদের ভেতরে পয়দা হলো এবং তারা মানুষকে সেজদা করল না। এতে অসন্তোষ্ট হয়ে মহান আল্লাহ ওই দলভুক্ত ফেরেস্তাদের অভিশপ্ত করলেন এবং তাদের ইবলিস (শয়তান ) বলে আখ্যায়িত করলেন। তবে চালাক ও পথভ্রষ্ট শয়তান খোদার কাছ থেকে ইনসানকে পথভ্রষ্ট করার সব কৌশল প্রয়োগ করার ক্ষমতা চেয়ে নেয় আর সর্ব শক্তিমান আল্লাহ সব মানুষকে সৎপথ থেকে খোদার আদেশ প্রতিপালনের মাধ্যমে শয়তানের সব প্ররোচনা ও পথভ্রষ্ট করার কৌশলকে পরাস্ত করার শক্তি দান করলেন। পৃথিবীতে মানুষ আসার পূর্বেই শয়তানের অন্তরে যে অহংকারবোধ এবং প্রতিহিংসার জন্ম হলো তা থেকে প্রথম মানব আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়াও রেহাই পেলেন না। ইবলিসের প্ররোচনায় তারা জান্নাতের খোদার নির্দেশিত নিষিদ্ধ ফল খেয়ে খোদার শাস্তিস্বরূপ জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হলেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের অন্তরে শয়তান কুপ্রবৃত্তির অনির্বাণ শিখা প্রজ্বলিত রেখেছে আর আল্লাহর প্রিয় বান্দারা খোদার নির্দেশিত পথে অবিচল থাকার মাধ্যমে শয়তানের এই কুপ্রবৃত্তিকে মোকাবিলা করছেন।

অতএব শয়তানের দ্বারা প্রভাবিত কৃপ্রবৃত্তিগুলোর কারণেই আজ মানুষ পথভ্রষ্ট, অশান্ত ও বিশৃঙ্খল। মানুষের অন্তরে ঢুকেপড়া শয়তানের প্রতিহিংসা, লোভ আর মোহের আগুনে মানুষ পুড়ছে। পুড়াচ্ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে। হারাচ্ছে পরকালের অন্তহীন শান্তি। তাই পৃথিবীর সেরা ধর্ম ইসলাম শুধু নয়, যুগে যুগে আবির্ভূত সব ধর্ম ও ধর্মীয় অবতারদের মূলবাণী ছিল শান্তি ও অহিংসতার স্বপক্ষে। তারা প্রমাণ করে গেছেন পরস্পরের ভ্রাতৃত্ববোধ, মোহ ও হিংসামুক্ত জীবনবোধ সামাজিক ও পারিবারিক জীবনকে কত শান্তির ও সুশৃঙ্খল করতে পারে।

হিংসা-প্রতিহিংসা মানুষকে অন্যায় কাজে লিপ্ত করে সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। অরাজক ও বিশৃঙ্খল সমাজে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। সেখানে আল্লাহর রহমতও উঠে যায়। তাই শান্তিপূর্ণ ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের প্রিয় ধর্ম ইসলামে মহান আল্লাহ সবাইকে হিংসা-প্রতিহিংসা, লোভ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছেন। কারোর ভেতর যদি বিন্দু পরিমাণ তাকওয়া (খোদাভিতি) থাকে সে কখনো হিংসুক, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও অসৎকর্মে লিপ্ত হতে পারবে না।

হিংসা-প্রতিহিংসা বিষয়ে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন সেজন্য কি তারা তাদের ঈর্ষা করে? (সুরা আন নিসা-আয়াত: ৫৪)।’

হিংসাপরায়ণতা মানুষকে কেবলি চরম অধঃপতনের দিকে ধাবিত করে। এই প্রবণতা শুধু ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নয়, পরিবারের সঙ্গে পরিবারের, সমাজের সঙ্গে এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনকেও অশান্তি করে তোলে। আজকের সমাজ ও রাষ্ট্রজুড়ে যে অরাজকতা ও অশান্তি চলছে তার মূলেও রয়েছে খোদার নির্দেশিত পথ থেকে সরে আসা এবং পারস্পরিক বিদ্বেষ। এই বিদ্বেষের উৎপত্তি তো হিংসা বা অন্যের প্রভাব প্রতিপত্তি সহ্য করতে না পারার প্রবণতা থেকেই সৃষ্ট। সমাজে যখন কোনো ব্যক্তি অধিক সম্পদশালী বা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তখন তার আরও শক্তি ও সম্পদ অর্জনের নেশা পেয়ে বসে। তখন সে সেই বাসনা পূরণের জন্য অন্যের সম্পদ ও ক্ষমতা দখলের জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই অন্যায় কাজটি সম্পাদন করতে গিয়ে সে নানা প্রকার বল প্রয়োগ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে যায়, যা শুধু সম্পদহানি নয় জীবনহানির পর্যায়েও চলে যায়। সমাজ ও রাষ্ট্রকে একটা অরাজক বা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির ভেতর ঠেলে দেয়। আমাদের দেশসহ অনেক দেশেই এ রকম পরিস্থিতির উদাহরণ রয়েছে, যা কখনোই কারোর কাম্য হতে পারে না। যে কর্ম অন্যের হক নষ্ট করে এবং সমাজে ও রাষ্ট্রের জন্য অকল্যাণকর তা যেমন কোনো ধর্ম সমর্থন করে না তেমনি কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও তা গ্রহণযোগ্যতা পায় না।

হিংসা-বিদ্বেষ সমাজ ও ব্যক্তির জন্য এতটাই ভয়ংকর যে, স্বয়ং রাসুল (স.) এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বিরত থাক। কেননা, হিংসা মানুষের বদ আমলগুলোকে এমনভাবে খেয়ে ফেলে যেভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়। (আবু দাউদ শরিফ)’

হিংসা মানুষকে এতটাই অধঃপতনের দিকে নিয়ে যায় যে, আক্রোশবশত সীমাহীন হত্যাকাণ্ডও সে জন্য ঘটে যায়।

আলোচনার শুরুতেই বলেছি হিংসার বীজ অন্তরে ঢুকানোর কাজটি বিতাড়িত শয়তানই খুব সুকৌশলে করে। মহান প্রভুর কাছে শয়তানের চেয়ে অধিক শক্তিশালী ও প্রিয় হচ্ছে মানুষ। আমাদের অন্তরে তাকওয়া যদি থাকে এবং মানুষ যদি খোদার রহমত থেকে নিরাশ না হয়, তাহলে শয়তানের সব প্ররোচনা নিষ্ফল হতে বাধ্য। মানুষ তার কালিমামুক্ত আমলের জোরে যেকোনো কুপ্রবৃত্তি বা শয়তানি খেয়ালকে বশীভূত করতে সক্ষম। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব ও প্রভাব খাটানোর কুচিন্তা থেকেই আমাদের জীবনে ঈর্ষা, শত্রুতা, দাম্ভিকতা ও অন্যের সম্পদ ও ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়, যা মারাত্মকভাবে আমাদের জাহান্নামি ও সমাজে অশান্তিকর হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। এজন্য মহানবী (স.) সতর্ক করে বলছেন, ‘তোমরা অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ কর না। কেননা, এরূপ ধারণা জগণ্যতম মিথ্যা। আর কারও দোষ অনুসন্ধান কর না, কারোর গোপনীয় বিষয় খুঁজতে যেও না, একে অন্যকে ধোঁকা দিবে না, পরস্পরের প্রতি হিংসা করবে না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করবে না বরং তোমরা সবাই এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থাকবে।’ (সহি বুখারি ও মুসলিম শরিফ)’

কিন্তু ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রে আমরা হামেশাই তার উল্টো চিত্রটাই দেখছি। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি সম্পদ বা ক্ষমতার লোভ আমাদের ব্যক্তি জীবনকে শুধু নয়, আমাদের জাতীয় জীবন ও সরকার ব্যবস্থাতেও প্রচণ্ডভাবে কুপ্রভাব ফেলছে। আজকের সময়ে সমাজ প্রতিনিধি বা রাজনীতিকদের ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার অদম্য আগ্রহ এবং সেজন্য দেশকে হত্যা ও নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেওয়া বা অকার্যকর করার যে ভয়ংকর প্রবণতা দৃশ্যমান, তা কোনো অবস্থাতেই দেশ-জনতার শান্তি ও সুরক্ষার জন্য কাম্য হতে পারে না।

তাই শান্তিকামী সব মুসলিম-অমুসলিমদের নিকট আহ্বান, ‘আসুন আমরা নিজ নিজ ধর্মের আলোকে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের স্বপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হই। দোজাহানের অন্তহীন কল্যাণের জন্য আসুন অন্তরে তাকওয়া মজুত রাখি এবং দেশ ও জাতির শান্তির জন্য সর্বপ্রকার লোভ ও প্রতিহিংসা পরায়ণতা থেকে নিজকে মুক্ত রাখি। মহান রাব্বুল আল আমিন আমাদের সহায় হউন।’

লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ


রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্ম দেয় না, নাগরিকরাই রাষ্ট্রের জন্ম দেয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সুধীর সাহা

রাজনীতি অনেকটাই দাবার চালের মতো। এক চালেই বাজিমাত হয়ে যেতে পারে, আবার এক চালেই পুরো খেলার রাজা মারা যেতে পারে। রাজনীতির এ দাবার চাল বাংলাদেশে এবার দুটোকেই এক করে দিল। সঠিক এক চালে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছাত্রসমাজ, আর ওই এক ভুল চালেই ক্ষমতার মৃত্যু শেখ হাসিনার। এমন ঘটনা কেবল বাংলাদেশেই নয়, বারবার ঘটেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও। মদের ফোয়ারা, বিলাসের স্বর্গ, অর্থের বন্যা বইয়ে দেওয়া এক পার্টিতেই বদলে গিয়েছিল ইরানের ভাগ্য এক সময়। এক জমকালো ফুর্তির পার্টি বদলে দিয়েছিল সে দেশের ভাগ্য। ১৯৭১ সালের পূর্বে শাহের ইরান ছিল আজকের ইরানের তুলনায় ১৮০ ডিগ্রি ভিন্ন। পশ্চিমা সংস্কৃতির রীতিমতো পীঠস্থান ছিল সেদিনের ইরান। আর আজকের ইরান পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম গোড়া মুসলিম দেশ। ১৯৭১ সালে পারস্য রাজতন্ত্রের ২৫০০ বছর পুর্তিতে একটি জমকালো রাজকীয় পার্টি দিয়েছিলেন সে সময়ের ইরানের রাজা শাহ মহম্মদ রেজা পাহলভি। মরুভূমির বুকে যখন রাজার এ কর্মকাণ্ড চলছে, ইরানের সাধারণ মানুষের দিন কাটছিল তখন অতি কষ্টে। দিনে তিনবেলা খাওয়া হতো না অনেকেরই। সে সময়ে রাজার কট্টর সমালোচক শিয়া ধর্মগুরু হঠাৎই জনসমর্থন পেতে শুরু করেন। সেই ধর্মগুরু আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে জনতার রোষ একটা সময় এতটাই বেড়ে যায়, প্রাসাদ ছেড়ে পালাতে হয় রাজা-রানীকে।

ফরাসি বিপ্লব? তা-ও তো ইতিহাসের শিক্ষার আর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। বিপ্লবের অল্প কয়েক দিন আগেও পুরো দেশের মানুষ এমন একটা বিপ্লবের কল্পনাও করতে পারেনি। দেশে ছিল না কোনো বিরোধ-বিপত্তিÑসবকিছু ছিল সম্রাটের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু রাজপ্রাসাদের খরচ এবং সম্রাজ্ঞীর সীমাহীন বিলাসিতা পূরণ করার ক্ষমতা রাজকোষের ছিল না। ফ্রান্সে চলছে তখন সীমাহীন অর্থনৈতিক সংকট। ঠিক সেসময় হঠাৎ করেই সম্রাটের সরকার রুটির দাম বাড়িয়ে দেয়। বিক্ষোভ করার মতো সাহসী পুরুষ তখন পুরো ফ্রান্সে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে রুটি তৈরির বেলুন ও ব্যালন হাতে ফ্রান্সের মহিলারা রাস্তায় বিক্ষোভ করেন। হঠাৎই রাজার বাস্তিল দুর্গের পতনের মধ্য দিয়ে ফরাসি বিপ্লব সংগঠিত হয়ে যায়। এমন বিপ্লবের আরও কিছু নমুনা ইতোমধ্যে বিশ্বাসী দেখেছে। তবে বাংলাদেশের আগস্ট বিপ্লব অদূর অতীতের সব ইতিহাসকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। শ্রীলংকার সরকারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান, বেলারুশে স্বৈরাচারী লুকাশেংকোর বিরুদ্ধাচারীদের ঠেকাতে সেনা অভিযান কিংবা পাকিস্তানে শাহবাজ শরিফ সরকারের বিরুদ্ধে পিটিআইয়ের বিক্ষোভ কোনো আন্দোলনেই নিহতের সংখ্যা দুই ডজনের বেশি ছিল না। একমাত্র ব্যতিক্রম ২০১১ সালে মিসরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান। সেই আন্দোলনে প্রাণ গিয়েছিল প্রায় ৮৫০ জনের। জাতিসংঘের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের এই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে প্রাণ গিয়েছে ৬৫০ জনের। বাংলাদেশে যা ঘটে গিয়েছে, তাকে বর্বর হত্যাকাণ্ড বলা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এ বর্বরতার শুরু আবু সাঈদকে হত্যার মাধ্যমে।

ইতোমধ্যে দেশবাসী বুঝতে পেরেছে, পরাক্রমশালী শেখ হাসিনাকে কেন এভাবে সব ছেড়েছুড়ে দেশ থেকে পালাতে হলো। কী কী ভুল তিনি করেছেন তা যদি ক্রমানুসারে বলতে যাই, তাহলে বেশ লম্বা হবে সে তালিকা। তবে প্রথমেই আসবে তার চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য। দেশের মানুষকে, ছাত্রসমাজকে সঠিক মূল্যায়ন না করার ঔদ্ধত্য। দ্বিতীয় কারণ নির্বাচন। নির্বাচনকে তিনি প্রহসনে পরিণত করে গণতন্ত্রের শেষ পেরেকটি গেঁথে ফেলেছিলেন। গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠানকে অন্ধআনুগত্য আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করেছিলেন। তৃতীয় জায়গাটি ছিল বিচারবিভাগ। বিচারবিভাগকে তিনি নিজের এবং দলের সুবিধামতো চালনা করেছিলেন। চতুর্থ জায়গাটি ছিল আইনের শাসনের অবলুপ্তি। বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুমকে করে ফেলা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অতি সাধারণ অংশ হিসেবে। পঞ্চম জায়গাটি ছিল দুর্নীতি। ৫০০ টাকার বালিশ কেনা হয় ৫,০০০ টাকায়। সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ পদের ব্যক্তি থেকে শুরু করে একেবারে নিম্নপদ পর্যন্ত ঘুষ ও দুর্নীতির খোলামেলা বিচরণ ঘটেছিল তার শাসনামলে। দেশের অবকাঠামোগত বেশ কিছু উন্নয়ন হলেও তাকে ম্লান করে দিয়েছিল বিপুল পরিমাণ ঘুষ ও দুর্নীতির দানবটি। ষষ্ঠ জায়গাটি ছিল দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি রোধে চরম ব্যর্থতা। সপ্তম জায়গাটি ছিল রাজনীতি ও সমাজে বিভাজন তৈরি করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ এবং বিপক্ষের ধোঁয়া তুলে সমাজজীবনে অযথাই বিভাজন তৈরি করেছিলেন তিনি। এতসব ব্যর্থতা থাকলেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার দল জনগণের কাছে তাদের অবস্থানটা সঠিকভাবে বুঝতে পারেনি কখনো। কাক যেমন নিজে চোখ বুঁজে ভাবে, সবার চোখই বন্ধ আছে- তারাও সবাইকে বোকা ভেবে তৃপ্তির ঢোক গিলতে থেকেছে। অন্ধ হলেই বিপদ বন্ধ হবে, তাদের এমন ভাবনা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ মিথ্যা প্রমাণিত করে দিয়েছে এবার।

এবারের আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক সত্য নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেছে। রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্ম দেয় না- নাগরিকরাই রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। রাষ্ট্র নাগরিক বাছাই করতে পারে না, নাগরিক বরং তার রাষ্ট্র বাছাই করে। অতীতের শিক্ষা নিয়ে আজকের এই আগস্টের বাস্তবতায় ভাবতে বসে আবার কিছুটা শঙ্কায়ও ভুগছি। সাতচল্লিশের আগস্ট হিন্দু-মুসলমান অবিশ্বাস, সন্দেহ ও ঘৃণা দূর করতে পারেনি। পঁচাত্তরের আগস্ট ভাষা-সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে উপহার দিয়েছিল ধর্ম-রাজনীতির বিষাক্ত ছোবল। ২০২৪ সালের আগস্টের বাংলাদেশ হয়ে উঠবে তো বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক আর অসাম্প্রদায়িক এক নতুন বাংলাদেশ? হবে তো আরোপিত অপরিণত সত্তা থেকে মুক্তি লাভ করে আলোকপ্রাপ্তি? পাব তো স্বাধীনতা যুক্তি-বুদ্ধি ব্যবহারের স্বাধীনতা? শাসকের গাত্রবর্ণের বদল নয়- শাসকের ভাবনার শাসন থেকে মুক্তির স্বাধীনতা?

লেখক: কলামিস্ট


কৃষি পুনর্বাসন এখন প্রধান অগ্রাধিকার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. জাহাঙ্গীর আলম

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, মধ্য ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো। আকস্মিক এই বন্যায় ইতোমধ্যেই ভেসেছে ১১টি জেলা। তার আশপাশের জেলাগুলোতেও রয়েছে বন্যার প্রভাব। তাতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ। পানিবন্দি হয়েছে প্রায় ১০ লাখ। এখন পর্যন্ত মারা গেছে ৫৯ জন। দুর্বিসহ ক্ষুধা আর রোগ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আরও অসংখ্য মানুষ। যারা পেরেছে, তারা অপেক্ষাকৃত উঁচুস্থানে, হাটে, স্কুলে, বাঁধে, বড় সড়কে কিংবা রেলস্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে। যারা পারেনি, তাদের চোখের পানি বন্যার পানির সঙ্গে মিশে হয়েছে একাকার। তাদের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। ধানখেত তলিয়ে গেছে। পুকুর পরিণত হয়েছে অথৈ শায়রে। মাছ, হাঁস-মুরগি, গৃহপালিত পশু ভেসে গেছে সবই। তাদের খাদ্যের অভাব, সুপেয় পানির অভাব, ওষুধের অভাব, কাপড়ের অভাব বন্যাকবলিত এলাকায় তারা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। কেউ কেউ আকাশের পানে তাকিয়ে তাদের সৃষ্টি ও পালনকর্তাকে ডাকছে। এরই মধ্যে অনেক মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এগিয়ে এসেছে অসহায় বানভাসি মানুষকে উদ্ধার করার জন্য, তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য। এদের মধ্যে আছে অনেক ছাত্র-যুবক। তারা শুকনো খাবার, পানি, ওষুধ ও কাপড় নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আর্ত মানবতার পাশে। আমরা বুঝতে পারি, এ দেশে এমন অনেকেই আছেন, মানুষের জন্য দুঃসময়ে দুঃখানুভবের মানুষের জন্য দরদ আছে মানুষের বুকে জমা। দুদিন আগে যে ছাত্রসমাজ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রক্ত ঝরিয়েছিল আজ তারা হারমোনিয়াম বাজিয়ে বন্যার্তদের জন্য করুন বন্দনা গাইছে। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখনও ঝড় হয়েছে এবং বন্যা হয়েছে। আমরা নিজেরা সাধ্যমতো চাঁদা দিয়ে অর্থ জুগিয়েছি। তারপর দলবেঁধে চলে গেছি নেত্রকোনার হাওরে, নোয়াখালীর চরে বা আশপাশের দুর্গত এলাকায়। এবার ছাত্রদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে অনেক সাধারণ মানুষ। শুকনো খাবার, নগদ অর্থ নিয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্রদের পাশে। যেন অনেক আস্থা আছে, অনেক ভরসা পাচ্ছে এ প্রজন্মের ওপর।

সাধারণত বন্যা হয় আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে। অতিরিক্ত বর্ষণই বন্যার প্রধান কারণ। এবার বন্যা হয়েছে বিলম্বে, ভাদ্র মাসে। স্বাভাবিক বর্ষাকাল পেরিয়ে শরতের শুরুতে বন্যা। এ সময় নদী, খাল, বিল, পুকুর, ডোবা পানিতে টইটুম্বুর থাকে। তার ওপর অতি বর্ষণ হলে বন্যার রূপ হয় ভয়ঙ্কর। গত ১৮ থেকে ২২ আগস্ট বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে অবিরাম বৃষ্টি হয়েছে। বিরামহীন বৃষ্টি হয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও। এ দুটো অঞ্চলে বৃষ্টির রেকর্ড ছিল ১৫০ থেকে ৩০০ মিলিমিটারেরও অধিক। এমন অতিবৃষ্টিই ছিল চলমান বন্যার প্রধান কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল সাগরের নিম্নচাপ। ত্রিপুরা বাংলাদেশের উজানে থাকায় পানি এসে নেমেছে আমাদের পূর্বাঞ্চলে। সেই সঙ্গে স্থানীয় অতি বৃষ্টি পানির স্তর বাড়িয়ে দিয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করেছে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় এবং সাগরের নিম্নচাপের কারণে বন্যার গভীরতা ও ব্যাপ্তি হয়েছে বেশি। এর আকস্মিকতার কারণ অবশ্য ভিন্ন। আমাদের উজানে ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধের কপাট খুলে দেয়ায় পানির স্তর বৃদ্ধি পায় ভাটির অঞ্চলে। এর কোনো পূর্বাভাস বা সতর্কীকরণ ছিল না। ফলে আমাদের জানমালের ক্ষতি হয়েছে বেশি। তবে বাংলাদেশের মানুষ ঘন ঘন বন্যা মোকাবিলা করে অনেকটাই অভ্যস্ত। এর সঙ্গে অভিযোজনেও পারদর্শী। এর আগে উনিশ শতকে এ দেশে প্রলংকরী বন্যা হয়েছে মোট ৬ বার। বিশ ও একুশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভয়াবহ বন্যা হয়েছে ১৮ বার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমরা বড় বন্যা দেখেছি ১৯৭৪, ১৯৮৪, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৭ এবং ২০১৬ সালে। প্রতিবারই বন্যা শেষে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। এগিয়ে গেছে অর্থনীতি। এবার ২০২৪ সালের বন্যার পরবর্তী সময়েও তার ব্যতিক্রম হবে না।

এবার দুর্গত এলাকায় বন্যার ভয়াবহতা বেশি হলেও এর ব্যাপ্তি তেমন বেশি নয়। দেশের শতকরা প্রায় ২০ ভাগ এলাকা বন্যাকবলিত। অন্যান্য এলাকায় বন্যার তেমন প্রাদুর্ভাব নেই। তবে যেখানে পানি উচ্চতা বেড়েছে, সেখানে গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে সাধারণ মানুষ। তাদের সহায়-সম্বল সবই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সঙ্গী করে সেখানে বেঁচে আছে অসংখ্য মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে আছে ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট। এসব অঞ্চলে নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে। ভাঙন দেখা দিয়েছে বাড়িঘরে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, সেতু-কালভার্ট ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়েছে যোগাযোগ। থেমে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি। কৃষি বহির্ভূত ক্ষুদ্র কারখানা ও কুটিরশিল্পও থেমে গেছে। অনেক স্থানে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট নেই। বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত রয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। বন্যায় কৃষি খাতে যে মহা ক্ষতি হয়েছে তা খুবই দৃশ্যমান। অনেকে এলাকায় পাকা আউশ ধান তলিয়ে গেছে। রোপা আমনের বীজতলা, নতুন রোপণ করা আমন ধানের খেত সবই ডুবে গেছে। বিভিন্ন সবজি যেমন মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, পটল, ঢেঁড়স, করলা, ঝিঙ্গা, বেগুন এবং মসলা ফসল হলুদ, মরিচ তলিয়ে গেছে পানির নিচে। তেলজাতীয় ফসল চীনাবাদাম, তিল, সূর্যমুখী পানির নিচে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফল আম, কাঁঠাল, লেবু, আনারস, কলা, পেঁপে, সফেদা, লটকন, ড্রাগন ফল সবই নষ্ট হয়েছে। তাছাড়া মাছের ঘের বিনষ্ট হয়েছে। বেরিয়ে গেছে পুকুরে চাষ করা মাছ। বাড়িতে পালিত হাঁস-মুরগিগুলো মরে গেছে। গবাদিপশুগুলো খুব কমই বেঁচে আছে। গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক লোকসান অনেক বড়। এর প্রকৃত পরিসংখ্যান ও ক্ষতির প্রকৃতি নির্ণয় করা প্রয়োজন। তাছাড়া স্থানীয় বাজারগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির আকাল পড়েছে। সব পণ্যেরই সরবরাহ কম, দাম বেশি। এই দুঃসময়েও মুনাফা লুটছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এখনো কার্যকর রয়েছে তাদের সিন্ডিকেট। স্থানীয় চিঁড়ামুড়িসহ বিভিন্ন শুকনো খাবারের দাম হচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি। এমনকি নৌকা নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতেও মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে দ্বিগুণ, তিনগুণ। এক মহাকষ্টে দিনাতিপাত করছে বন্যা দুর্গত মানুষ।

অনেকেই বন্যাকে সমর্থন করেন। তারা বলেন, বন্যায় জমির উপরিভাগে পলি মাটির স্তর পড়ে। তাতে বেড়ে যায় মাটির উর্বরতা শক্তি। তাই বন্যার পর ফসল ভালো হয়। এ ক্ষেত্রে বর্ষা ও বন্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ থাকে। বর্ষা এ দেশে প্রতি বছরই আসে। স্বাভাবিক বর্ষায় অপেক্ষাকৃত নিচু জমি তলিয়ে যায়। তাতে পলি জমা হয়। কিন্তু বন্যা হয় মাঝে মাঝে, কয়েক বছর পর একবার। অনেক ক্ষেত্রে এর প্রধান কারণ থাকে উজানের ঢল। তাতেও ঘোলা পানি আসে পলিমাটি সঙ্গে নিয়ে। এ সময় জনগণের ভোগান্তি বেশি হয়। অর্থনৈতিক ক্ষতি সীমা ছাড়িয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে পুনর্বাসন খুবই জরুরি হয়ে পড়ে। তা খুবই কষ্টসাধ্য ও বড় ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। বন্যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতি নির্ভর করে এর স্থায়িত্বের ওপর। ১৯৮৮ সালের বন্যা আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ১৯৯৮ সালের বন্যারও স্থায়িত্ব ছিল প্রায় দুই মাস। এবার অল্প সময়ের ব্যবধানেই পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এর গতি খুবই মন্থর। বন্যার পানি সাগরে নামার পথে প্রতিবন্ধকতা, চরার সৃষ্টি ও নদীর নাব্যতা হ্রাসের প্রধান কারণ। দ্রুত এর সুরাহা প্রয়োজন। বন্যার পর কৃষির পুনর্বাসনই আমাদের বড় অগ্রাধিকার। বন্যার পানি সরে গেলে জমিতে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ শুরু করে গ্রামের কৃষক। কারণ তার খাদ্য নিরাপত্তা দরকার। তাতে সে বিনিয়োগ করে বেশি। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ সময় সরকারি সহায়তা পেলে চাষাবাদে উৎসাহ বেড়ে যায় কৃষকের। অধিক উৎপাদন থেকে বাজারজাত উদ্বৃত্ত বেশি হয়। পণ্যমূল্য হ্রাস পায়। তাতে লাভবান হয় ভোক্তারা।

এবারের বন্যায় রোপা আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে নাবি জাতের রোপা ধান যেমন ব্রি-ধান ২২, ব্রি-ধান ২৩ এবং ব্রি-ধান ৪৬ চাষের সুযোগ এখনো রয়ে গেছে। এখন ভাদ্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ অতিবাহিত হচ্ছে দ্রুত পানি সরে গেলে ভাদ্র মাসের শেষ নাগাদ বিলম্বিত আমনের চারা রোপণ করা যাবে। তাছাড়া বন্যার পানির স্থায়িত্ব ২ সপ্তাহের কম হলে ইতোপূর্বে রোপণ করা জলমগ্নতাসহনশীল ব্রি-ধান ৫১, ব্রি-ধান ৫২, ব্রি-ধান ৭৯ এবং বিনা-ধান ১১ ও বিনা-ধান ১২ জমিতে টিকে থাকবে। শাক সবজির যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে হবে আগাম রবি ফসল আবাদের মাধ্যমে। পানি সরে গেলে অতি দ্রুত স্বল্প জীবনকালীন শাক-সবজি যেমন ডাঁটাশাক, পুঁইশাক ইত্যাদি উৎপাদন সম্ভব হবে। তেল ফসল ও ডাল ফসলের মধ্যে মাসকালাই ও সরিষা বিনা চাষেও জমিতে উৎপাদন করা যাবে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ফসল হলো সামনের বোরো ধান। মোট চাল উৎপাদনের প্রায় ৫৪ শতাংশই আসে বোরো ধান থেকে। এর জন্যও এখন থেকেই উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো রাসায়নিক সারের সীমিত সরবরাহ। বর্তমানে সারের যে মজুত আছে তাতে বড়জোর আগামী সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চলতে পারে। রবি ফসল ও বোরো ধান আবাদের জন্য ন্যূনতমপক্ষে আরও ৪০-৪৫ লাখ মেট্রিক টন সার সংগ্রহ করতে হবে। এর জন্য আমদানির এলসি খোলা সহজতর করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে স্থাপিত পাঁচটি সার কারখানার কাজ চালু করতে হবে পুরোদমে। গত দু’বছরে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক সারের দাম ২ বার বাড়ানো হয়েছে। কারণ ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্যবৃদ্ধি। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম হ্রাস পেয়েছে। তাতে অভ্যন্তরীণ বাজারেও সারের দাম হ্রাস করা প্রয়োজন।

কৃষকের চাষাবাদের খরচ মেটানো এবং বিনিয়োগে সহায়তার জন্য সহজ শর্তে কৃষিঋণ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এ ক্ষেত্রে পি কে এস এফ এবং বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। বর্তমানে বন্যার্ত মানুষের প্রধান সমস্যা হলো নগদ টাকার অভাব। অথচ যে কোনো কাজে প্রয়োজন হচ্ছে নগদ টাকা। এই জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য দিতে হবে নগদ আর্থিক সহায়তা। আমাদের দেশে বিভিন্ন ত্রাণ কমিটি বন্যার্তদের পাশে গিয়ে সাধারণত কিছু শুকনো খাবার, পানি ও কাপড় দিয়ে থাকে। নগদ সহায়তা দেওয়ার কথা তেমন ভাবে না। সরকারিভাবে এ ক্ষেত্রে কিছু নগদ অনুদানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য আমরা প্রায়ই কৃষি বিমার কথা বলে থাকি। তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।

বন্যার পর নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। সাধারণ ভোক্তাদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে। বাংলাদেশ এখন একটি উচ্চ মূল্যস্ফীতিকাল অতিক্রম করছে। গত জুলাই মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতির মাত্রা ছিল ১১.৬৬ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ১৪.১০ শতাংশ। বিগত দশকের মধ্যে এটাই ছিল বড় মূল্যস্ফীতি। বন্যার কারণে এর মাত্রা আরও বাড়তে পারে। তবে ইতোমধ্যেই মূল্যস্ফীতি নিরোধক কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে আমাদের মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতিতে। তাতে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে অদূর ভবিষ্যতে। তবে এর সাফল্য বহুলাংশে নির্ভর করে কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর। বাজারে পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধির ওপর। এ ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা দরকার। সামাজিক সুস্থিরতা নিশ্চিত করা দরকার।

বাংলাদেশে ঘন ঘন বন্যায় মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ লাঘব করতে হলে পানি কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমরা পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে চাই। বৈরিতা দিয়ে তা সম্ভব নয়। সুসম্পর্ক ও সৌহার্দ্যই ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন নদীর পানি বণ্টনে ন্যায্য হিস্যা আদায়ের এবং বর্ষাকালে উজানের পানির তোড় থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় গ্রহণযোগ্য সমঝোতার পথ করে দিতে পারে। এর জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কীভাবে আমরা বন্যা সম্পর্কে ভারতের আগাম সতর্কবার্তা পেতে পারি তারও পথ খুঁজতে হবে। সবচেয়ে বেশি দরকার বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কতা বিষয়ে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তৈরি করা। এ সংক্রান্ত গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। বিভিন্ন সময় বন্যা ও ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে যেসব বার্তা প্রেরণ করা হয় তা যাতে সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা উচিত।

আবহাওয়া উষ্ণায়নের কারণে ইতোমধ্যেই বিশ্বের তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি সেই প্রচণ্ড উত্তাপ আমরা অনুভব করেছি। তা ছাড়া এল নিনো এবং লা নিনার প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের এক প্রান্তে বন্যা হচ্ছে আর অপর প্রান্তে ফসল পুড়ছে দারুন খরায়। তাতে বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে। জাতিসংঘের দুর্যোগ হ্রাস বিষয়ক দপ্তর (ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন-ইউ এন ডি আর আর) পূর্বাভাস দিয়েছে যে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্রা ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। এ বিষয়ে ২০১৫ সালে জাপানের সেন্দাই শহরের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনে টেকসই ব্যবস্থাপনা এবং প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। গত ২২ আগস্ট ২০২৪ সালে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে সেন্দাই ফ্রেম ওয়ার্কের লক্ষ্য থেকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো সরে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা এবং আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলা ও ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম জোরদার করার জন্য তাগিদ অনুভব করা উচিত।

বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এ দেশে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙন ও পাহাড় ধসের মতো বড় দুর্যোগ প্রায়ই আঘাত হানছে। তাতে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। অনেক প্রাণহানি ঘটছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে বিস্তর। এর পরিসংখ্যান হালনাগাদ সংরক্ষণ, দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস ও অভিযোজনের পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য বাজেট প্রণয়ন, অর্থায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন ইত্যাদি এখন সময়ের দাবি। এসব লক্ষ্য অর্জনে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে কাজ করা উচিত।

লেখক: পরিচালক, ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকস এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ


নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে রুয়ান্ডা ড্রকট্রিন: প্রসঙ্গ বাংলাদেশ

ছবি: সংগৃহীত
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্রাট মো. আবু সুফিয়ান

“পৃথিবীতে প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে আপনি যতটা অর্জন করতে পারবেন, তার চেয়ে ঢের বেশি অর্জন করতে পারবেন ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে”- নেলসন ম্যান্ডেলা। আজ বাংলাদেশ এমন একটি ক্লান্তিকালে অবনীত হয়েছে যেখান থেকে উত্তরণের জন্য আমাদেরকে আলোর পথে দিকনির্দেশনা প্রদান করতে পারে ম্যান্ডেলা এবং রুয়ান্ডা ড্রকট্রিন।

ম্যান্ডেলা ড্রকট্রিন এর মূল কথা হচ্ছে সবার জন্য সমান সুযোগ। কোন বর্ণবৈষম্য থাকবে না, কোন জাতিভেদ থাকবে না, সাদা-কালোই কোন পার্থক্য করা যাবে না। আমরা সবাই দক্ষিণ আফ্রিকান, সবাই এদেশের নাগরিক। বর্ণ বৈষম্যের দক্ষিণ আফ্রিকাকে পেছনে ফেলে নতুন এক আফ্রিকা গড়ার কাজটি সহজ ছিল না। হিংসাত্মক, বৈষম্যবাদী, নিপীড়ক এবং চরম বর্ণবাদী সাদা বর্ণের শাসকদের বিরুদ্ধে সারা জীবন সংগ্রাম করে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন এক বর্ণবৈষম্যহীন দক্ষিণ আফ্রিকা গড়ার জন্য। যে বর্ণবাদী অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গ সরকার দীর্ঘ ২৭ বছর (১৯৬২-১৯৯০) কুখ্যাত রুবেন দ্বীপে তাকে কারাবন্দী করে রেখেছিলেন, সেই অত্যাচারী সরকারের সঙ্গেই শান্তি চুক্তি করেছিলেন শুধুমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকাকে বর্ণবাদ মুক্ত করার জন্য, দক্ষিণ আফ্রিকাকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার জন্য, জাতিগত বিভেদ দূর করার জন্য এবং তিনি অনেকাংশেই সফল হয়েছিলেন। তিনি নিপীড়ক অত্যাচারকারী জুলুমকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিবর্তে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং শুরু হল এক নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার পদযাত্রা। ম্যান্ডেলা এমন এক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে এক সঙ্গে থাকতে পারবে, যেখানে থাকবে না কোন কালদের কর্তৃত্ব বা সাদাদের কর্তৃত্ব। এটা হবে এক দক্ষিণ আফ্রিকা, এক জাতি এবং সকল মানুষের মানবাধিকার সমান থাকবে। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন এবং এক নতুন আফ্রিকার স্বপ্নের বীজ বপন করেন। তাই তো ২৭ বছর অবর্ণনীয় নির্যাতন, কারা ভোগের পরও তিনি বলেছিলেন স্বাধীনতা মানে “কেবল শৃঙ্খলহীন হওয়া নয়, বরং স্বাধীন হওয়া মানে শ্রদ্ধা এবং অন্যের স্বাধীনতা বৃদ্ধির সাথে বসবাস”। আমরা স্বাধীনতার স্বাদ তখনই উপলব্ধি করতে পারব, যখন অন্য মতাবলম্বীদের ( ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী, বিভিন্ন জাতী-উপজাতি বা ভিন্ন কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী দল) সাথে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের সহিত বসবাস করার সুযোগ তৈরি করতে পারব, যেখানে সবাই নিজেকে স্বাধীন মনে করবে এবং নিরাপদ অনুভব করবে। তিনি বলতেন " ঘৃণা মনকে অন্ধকার করে দেয়, কৌশলের পথ রুদ্ধ করে দেয়। নেতাদের ঘৃণা করা সাজে না "। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক পৃথিবী গড়তে যেখানে কারোর উপর কারোর কোন কর্তৃত্ব থাকবে না, শুধু গায়ের রঙের ভিত্তিতেই কাউকে অন্যায়ভাবে বিচার করা হবে না, মানুষ তার যোগ্যতা অনুযায়ী অধিষ্ঠিত হবে। তিনি তার আদর্শের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। তিনি বলতেন "আমি সাদাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি এবং আমি কালোদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমি আদর্শিক গণতন্ত্র এবং মুক্ত সমাজের প্রশংসা করি, যেখানে সকল ব্যক্তি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে এবং সমান সুযোগ লাভ করবে। এটি হচ্ছে একটি আদর্শিক অবস্থান, যার মধ্যে দিয়ে বাঁচা দরকার এবং আমি তা অর্জনের আশা করি, কিন্তু এটি এমন এক আদর্শ, যদি প্রয়োজন পড়ে, তার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।"

রুয়ান্ডার গণহত্যা যেটি ছিল মানবতার এক মহা দুর্যোগময় চরম কলঙ্কিত অধ্যায়। এখানে মাত্র ১০০ দিনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল প্রায় ৮ লক্ষ মানুষকে, যাদের বেশিরভাগই ছিল সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের। এই ভয়াবহ নির্যাতন পরিচালনাকারীরা ছিল হুতি সম্প্রদায়ের লোকজন। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল এবং জুনের মাঝামাঝি ১০০ দিনের ব্যবধানে ইতিহাস কুখ্যাত বর্বর এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে এত সংখ্যক মানুষকে অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০০০ মানুষকে হত্যা করার নজির পৃথিবীর মানুষ কেউ কোনদিন কখনো চিন্তাও করতে পারেনি, যা ছিল কল্পনাতীত। যদিও তারা প্রায় দেখতে একই রকম ছিল, তাদের ভাষাও ছিল একই রকম, গায়ের কালারও একই রকম, গায়ের গঠনও প্রায় একই রকম (শুধু তুতসিরা একটু লম্বাটে এবং চিকন গড়নের ছিল) তথাপি খুব ছোট্ট কিছু জাতিগত বিষয় (যেগুলো মূলত বেলজিয়ামের সৃষ্টি। রুয়ান্ডা বেলজিয়ামের কলনী ছিল) নিয়ে তারা এক নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে, যেখানে প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে হত্যা করে, হুতু স্বামী তাদের তুতসি স্ত্রীদের হত্যা করে। এমনকি হুতু ধর্মযাজকরা তুতসিদের হত্যা করার ব্যাপারে প্ররোচনা দিয়েছে, তাদের মনের মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে। অসংখ্য নারী এবং শিশুদের হত্যা করার পাশাপাশি হাজারো তুতসি নারীকে যৌনদাসী করা হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে, তানজানিয়ার আরুশা শহরে বসা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইবুনাল, যেখানে গণহত্যার অভিযোগে দোষীদের বিচার করা হয়। এটি প্রমাণিত সত্য যে অপরাধ করে কেউ সহজে পার পায় না, শুধু একটু ধৈর্য ধরতে হয়। সেই অপরাধের বিচার এই পৃথিবীতেই ঘটে। ইতিহাস থেকে এই সত্যটাই আমরা দেখতে পাই, কিন্তু শিক্ষা গ্রহণ করি না।

ডিসেম্বর/২০২৩ সালে আমার সুযোগ হয়েছিল রুয়ান্ডা ভ্রমণের। এ এক অনন্য রুয়ান্ড, যা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। দেশের প্রতিটা প্রান্তর, প্রতি ইঞ্চি জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, প্রত্যেকটা মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দেশের কোথাও কোন ট্রাফিক পুলিশ সাধারণত দেখা যায় না, কিন্তু মানুষ ট্রাফিক আইন মান্য করছে। কোথাও হেলমেটবিহীন একজন মানুষও পায়নি যে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। মানুষ একান্ত বাধ্য না হলে কখনো গাড়ির হর্ন বাজায় না। মধ্যরাতেও কোন নারী এখানে অনিরাপদ ফিল করে না। কোন টুরিস্ট এখানে কখনো হয়রানির শিকার হওয়া বা কোনরকম সমস্যার সম্মুখীন হয় না। সবাই যার যার কাজে ব্যাস্ত। মনে হচ্ছিল, এত ধ্বংসযজ্ঞের পরেও রুয়ান্ড সেই ফিনিক্স পাখির মতো আজ জেগে উঠেছে। রুয়ান্ডা বর্তমানে একটি স্থিতিশীল এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পৃথিবীতে পরিচিত। তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশটি প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। বর্তমানে তাদের মাথাপিছু আয় প্রায় ১০০০ ডলার যেখানে ১৯৯৫ সালে যেখানে তাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৫ ডলার।

আজ রুয়ান্ডার জেগে ওঠার মূল কারণ হচ্ছে তাদের জনগণ, যাদেরকে এক সময় ডিভাইড করা হয়েছিল। রুয়ান্ডার জনগণের সঙ্গে কথা বলে যে জিনিসটা সুস্পষ্ট মনে হয়েছে যে, আজ তারা না হুতু, না তুতসি, তারা হচ্ছে রুয়ান্ডিয়ান, তারা এই দেশের জনগণ। তারা হুতু-তুতসি পরিচয় ভুলে যেতে চায়। যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয় সে হুতু নাকি তুতসি? আপনি তার কাছে উত্তর পাবেন না, তিনি বলবেন, আমি এই দেশের নাগরিক। তারা আজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ উন্নয়নে অংশগ্রহণ করেছেন। রুয়ান্ডা আজ আফ্রিকা তথা সমগ্র পৃথিবীর একটি নিরাপদ দেশ হিসেবে বিবেচিত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। রুয়ান্ডা আজ গভীরতম ক্ষত থেকে সেরে ওঠার এবং অন্ধকারতম খাদ থেকে জেগে উঠে শক্তিশালী সমাজ গঠনে মানব সক্ষমতার শক্তিশালী সাক্ষ্য হিসেবে দাড়িয়ে আছে।

১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডায় তুতসিদের ওপর গণহত্যার ২৮তম বার্ষিকীর আন্তর্জাতিক প্রতিফলন দিবসে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন "আজ আমাদের অবশ্যই অসহনশীলতা, যুক্তিহীনতা ও গোঁড়ামি প্রতিটা সমাজের জন্য কতটা বিপজ্জনক, তা স্বীকার করে নিতে হবে।"

৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি তা যেন কোনভাবেই ফিকে হয়ে না যায়, আমাদের কোন কর্মকান্ডে যেন তার সেই আলোর দিশা নিভে না যায়। কিন্তু বাস্তবে অনেক কিছুই প্রতিফলিত হচ্ছে না। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পর আমরা যে স্বকীয়তার সন্ধান পেয়েছিলাম, তা আজ তা আমাদের কর্মকান্ডে ম্লান হওয়ার পথে। আমরা যে মুক্ত বাতাসের স্বাদ পেয়েছিলাম, তা আমাদের অতি লোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, অশ্রদ্ধা, অধৈর্য এবং জিঘাংসার জন্য ক্ষতির দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ অন্যান্য মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, আমরা একজন আরেকজনের ধন-সম্পদ লুট করছি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বাড়ি ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছি, প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য বিভিন্ন রকম মামলায় জড়িত করছি, বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখিয়ে গণহারে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। মানুষ গড়ার কারিগর যে শিক্ষকরা তারা আজ বিভিন্নভাবে লাঞ্চিত হচ্ছে। যে ডাক্তার এবং পুলিশরা ২৪ ঘন্টা জনগণের সেবায় নিয়োজিত, তারা আজ ছোট ছোট বিভিন্ন ইস্যুতে আক্রান্ত হচ্ছে। পুলিশের বিভিন্ন স্তরের সদস্যবৃন্দ বিভিন্ন রকম মামলায় আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ পুলিশের মুষ্টিমেয় কিছু রাজনৈতিক পদলেহনকারী দুর্বিত্তায়িত চাটুকার, দুর্নীতি পরায়ণ সিনিয়র কর্মকর্তারা সামগ্রিক এই অবস্থার জন্য আজ দায়ী। কিন্তু আক্রান্ত হচ্ছে অন্যরা। যে পুলিশ সদস্যরা দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে কাজ করবে, তারাই আজ আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের নিজেদেরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন না ঘটলে কোনভাবেই আমরা আমাদের কাঙ্খিত ফলাফল পাবো না। কেউই নিরাপদ থাকবো না। আর এর থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে আমাদের দেশের জনগণ। নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন ২৭ বছর রুবেন দ্বীপের অন্ধকার কারাগারে অসহনীয় নির্মম যন্ত্রণা ভোগের পরও দক্ষিণ আফ্রিকায় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন ঐক্যবদ্ধ দক্ষিণ আফ্রিকা, রুয়ান্ডায় যেমন ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংসের পরেও আজ এক ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়েছে, আমাদেরও সবকিছু ভুলে সবাইকে একসাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের এই নতুন আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমার প্রতিবেশী এবং তার সম্পদ যেন আমার হাতে নিরাপদ থাকে শুধু এইটুকুই নিশ্চিত করতে পারলেই আমরা এগিয়ে যাব। কেউ আমাদের থামাতে পারবে না। যতই কৃত্রিমভাবে উজানের ঢেউ বা উজানের পানি দিয়ে কৃত্রিম বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি করা হোক না কেন এই দেশের জনগণ ঠিকই জেগে উঠবে সেই ফিনিক্স পাখির মত, কেউ আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না, যার প্রমান এদেশে মানুষ বাস্তবিক পক্ষেই বুঝিয়ে দিয়েছে। যে কৃত্রিম বন্যা, যে পানির জোয়ারে বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, দেশের সকল শ্রেণীর মানুষ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, হাতে হাত রেখে একে অন্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারলেই আমরা এগিয়ে যাব।

সত্যিই এক আশা জাগানো খবর, যখন দেখি বন্যার্তদের সার্বিক সহায়তার জন্য আমার ‘রিকশাওয়ালা ভাই তার সারাদিনের আয় দান করে দিচ্ছে, মা-বোনেরা এসে গলার চেইন খুলে বলছে এটা ছাড়া দেওয়ার মত কিছু নেই, হিন্দুরা টাকা দিচ্ছে আস-সুন্নাহতে, বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকেরা ত্রাণ এবং খাবার বিতরণ করছে, পূজার জন্য উত্তোলিত টাকা বন্যা দুর্গতদের সহায়তায় বিতরণ করছে, সম্মিলিত এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে মানুষ নৌকা, স্পিড বোট নিয়ে হাজির হচ্ছে, ইঞ্জিনের জন্য তেল লাগবে, ফুয়েল স্টেশন মালিক তেল ফ্রি করে দিচ্ছে, ত্রাণ কর্মীদের যাতায়াতের জন্য বিভিন্ন বাস কোম্পানি বাস ফ্রি করে দিচ্ছে, নৌকা নিয়ে যাওয়া সম্ভব না- প্রবাসীর হেলিকপ্টার এবং কিছু এজেন্সি থেকে হেলিকপ্টার ফ্রী তে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে দূর্গতদের সাহায্যের জন্য, মোবাইলে নেট/মিনিট নাই? মোবাইল অপারেটর ফ্রি নেট/মিনিট সেবা চালু করে দিচ্ছে, মোবাইলে চার্জ নাই -টাওয়ার কর্তৃপক্ষ চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে, প্রবাসী ভাইয়েরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে।'

দেশের মানুষকে এতটা একতাবদ্ধ কখনো দেখেছেন? সত্যিই এক অভূতপূর্ব ঘটনা, মহামিলন মেলা, মানবতার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশ যে আজ জাতি, ধর্ম ,বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ, এটা তার ওই জ্বলন্ত প্রমাণ। আমরা যদি এই ঐক্যবদ্ধতা বজায় রাখতে পারি, এই সহিষ্ণু আচরণ ধরে রাখতে পারি, তাহলে অবশ্যই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব, নতুবা জাতি হিসেবে আমরা মুখ থুবড়ে পড়বো। দেশ আজ এক নতুন সময় অতিক্রম করছে। আমরা যদি এই সময়ের স্রোতে নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করে না নিতে পারি, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা কখনোই মুখ তুলে উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না। আমার ভাই, আমার প্রতিবেশী যেন আমার দ্বারা আক্রান্ত না হয়, আমরা এই শপথে বলিয়ান হই। আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো অন্যায়কেই কোনদিনই অন্যায় দিয়ে দমন করা যায় না। অন্যায়কে দমন করতে হয়, ন্যায় দিয়ে। যদিও কাজটি কঠিন, হয়তো খুবই কঠিন, তারপরেও সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে ন্যায় দিয়েই অন্যায়কে দমন করতে হবে। অন্যায় দিয়ে দমন করতে গেলে হিংসা তৈরি হবে, বিদ্বেষ তৈরি হবে, সমাজে ভেদাভেদ তৈরি হবে, মানুষে মানুষে জিঘাংসা তৈরি হবে। সমাজ তথা দেশের উন্নয়ন যদি আমরা চাই তাহলে সেটা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেই করতে হবে।

লেখক: পুলিশ সুপার (পুলিশ অ্যাডভাইজার হিসাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন কঙ্গো থেকে ফেরত পদায়নের অপেক্ষায়)


এনসিটিবির বই ছাপানো এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মাছুম বিল্লাহ

জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার নিরিখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে, অভিজ্ঞতাভিত্তিক নতুন কারিকুলাম থাকছে না, শিখনফল তথা পরীক্ষাভিত্তিক কারিকুলামেই আমাদের ফেরত যেতে হচ্ছে। এতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজের ক্ষেত্রে অনেকটা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, শিক্ষা উপদেষ্টা নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের পাশাপাশি বিগত সরকারের সময়ে রচিত পাঠ্যবইয়ের কাভার, কনটেন্ট বদলে ফেলারও ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর ফলে বিগত সময়ে টেন্ডার হওয়া বা পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হওয়া বইগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতেই হচ্ছে। এনসিটিবি এবং ছাপাখানার মালিকরাও জানেন না ‘পাঠ্যবই’ নিয়ে কী হতে যাচ্ছে। পাঠ্যবই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার রেওয়াজ ধরে রাখতে চাইলে সরকার থেকে দ্রুত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে হবে। আমরা জানি নতুন শিক্ষাক্রমের বই ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ২০২৩ সাল থেকে পড়ছেন। ২০২৪ সালে শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই পড়ছেন। আগামী বছরের জন্য চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণির বই লেখার কাজ চলছে। এরই মধ্যে কয়েকটি শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোও টেন্ডার হওয়ার পথে। কিন্তু জুলাই মাস থেকে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে বই প্রণয়নের কাজে ভাটা পড়ে। গত ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বিপাকে পড়ে যায় সরকারি সংস্থাগুলো। ওইদিনের পর থেকেই সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। এ তালিকায় এনসিটিবির চেয়ারম্যানকেও পদত্যাগ করতে হয়েছে।

ঊর্ধ্বতন আরও কয়েকটি পদ ফাঁকা থাকার কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাঠ্যবই নিয়ে ভাবার সময় পায়নি এনসিটিবি। শিক্ষা উপদেষ্টা ইতোমধ্যে বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক দুর্বলতা রয়েছে এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে এটি অনেক দুর্বল। অনেক ধন্যবাদ মাননীয় উপদেষ্টাকে। বিষয়টি আমরা পূর্ববর্তী কর্তৃপক্ষকে কোনোভাবেই যেন বোঝাতে পারছিলাম না। হাতে সময় খুব কম, যতটুকু পারা যায়, পরিবর্তন করা হবে। জানুয়ারিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণ করতে হবে অথচ এখন আগস্ট মাসের শেষ। এই অল্প সময়ের মধ্যে বই তৈরি করতে হবে, কি ধরনের মূল্যায়ন হবে সেটি ঠিক করতে হবে, বইয়ের মলাটসহ ভেতরের অনেক লেখা পরিবর্তন করতে হবে। একটি কমিটি গঠন করে বইয়ের কনটেন্টের পরিবর্তন আনতে হবে। এগুলো সবই সময়সাপেক্ষ ও জটিল কাজ। তারপরেও সরকারকে এগুলো দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে।

দেশের পটপরিবর্তনের কারণে বই ছাপার কাজে রাজি হচ্ছে না প্রেস মালিকরা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এই সময়ে সদ্য সাবেক সরকারের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন তথ্য রয়েছে– এমন কোনো কনটেন্ট বইয়ে থাকলে এবং সেটি ছাপা হলে তাদের সমস্যা হতে পারে। তাই তারা প্রথম কনটেন্ট কি হবে সেটি আগে চাচ্ছেন। তাছাড়া ছাপাখানার মালিকরা টেন্ডারের শিডিউল কিনে রাখায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানা যায়। তাই তারা খুব বেশি পরিবর্তন না করে কিছু কনটেন্ট বাদ দিয়ে বাকিগুলো ঠিক রেখে প্রশ্ন যোগ করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে, ২০২২ সালের বই প্রেস মালিকদের কাছে থাকার কথা। না থাকলেও এনসিটিবিতে আছে। সেই বইগুলো অনুসরণ করা হলে অনেক জটিলতা কমে যাবে। কারণ ওই সময়কার সিলেবাস, বইয়ের কনটেন্ট ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সবই শিক্ষকদের জানা, তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও রয়েছে। এনসিটিবি তথা সরকারকে যেটি করতে হবে, মূল্যায়নের ধরনটি পরিবর্তন করতে হবে। মূল্যায়ন পদ্ধতিটি এমনভাবে করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের আসলেই বই পড়তে হয়, ক্লাস করতে হয়, নিজ থেকে লিখতে হয় এবং বর্ণনা করার ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। প্রতিটি বিষয়ের বইয়ের সঙ্গে প্রশ্নের স্যাম্পল কমপক্ষে দুই ধরনের দিতে হবে যাতে বিদ্যালয়গুলো সেগুলো সরাসরি অনুসরণ করে মূল্যায়ন কাজ করতে পারে। প্রশ্ন যদি এনসিটিবি থেকে কবে ধরন আসবে, আসতে আসতে বছর কেটে গেল যেটি হয়েছিল নতুন কারিকুলামের নামে সেটি যাতে না হয়। এবার যারা নবম শ্রেণিতে পড়েন এবং তাদের দশম শ্রেণির বই যদি ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে থাকে তাহলে একদল বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বারা সেগুলো চেক করাতে হবে যাতে নবম শ্রেণির বইয়ের সঙ্গে অনেকটা মিল থাকে। শুধু মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি যাতে নতুন কারিকুলামে উল্লিখিত অবাস্তব ও এলোমেলো না হয়। সেটি করলেই দশম শ্রেণির অর্থাৎ এসএসসি পর্যন্ত সমাধান হয়ে যাবে।

এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। আমরা দেখি প্রতি বছর ৩৬-৩৭ কোটি বই ছাপা হয়। এনসিটিবির সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী বিষয়টি নিয়ে ব্যস্ত এবং মহাব্যস্ত থাকেন। এনসিটিবিতে গিয়ে দেখা যায় কর্মকর্তারা নেই, তাদের চেয়ার ফাঁকা। কারণ কি? তারা সবাই কোথায় বই ছাপাচ্ছে, কোথায় পেকিং হচ্ছে, কীভাবে ট্রাক ভাড়া করা হচ্ছে, কোথায় কোথায় বই পাঠানো হচ্ছে ইত্যাদি নিয়ে মহাব্যস্ত। কারণ ৩৬ কোটি বই ঠিক করা, কাগজ ক্রয় এবং ছাপানো এবং মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বই ছাপানো, কাগজ ক্রয় করা, প্রেস ভিজিট করা কি এনসিটিবির মূল কাজ? তাদের মূল কাজ হচ্ছে জাতির জন্য একটি সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী কারিকুলাম উপহার দেওয়া। সেই কারিকুলাম অনুযায়ী সঠিকভাবে গ্রাম-গঞ্জে শিক্ষাদান হচ্ছে কি না সেটি পেশাগতভাবে মনিটরিং করা। স্কুল ঘুরে ঘুরে চা-বিস্কুট খেয়ে হাট-বাজার করে ফেরা নয়। সেটি গভীরভাবে দেখা, শিক্ষার্থীরা ডাইজেস্ট করতে পারছেন কি না। শিক্ষকরা ঠিকভাবে ডেলিভার করতে পারছেন কি না। সমস্যা কোথায়। সেগুলো সমাধানের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ কি কি হতে পারে ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। এনসিটিবিতে উন্নতমানের এবং পেশাগত একটি গবেষণা সেল থাকতে হবে। প্রতিটি বিষয় নিয়ে নিরন্তর গবেষণা পরিচালনা করতে হবে। গবেষণার ফল বছরে অন্তত দুইবার সব ধরনের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে পুরো জাতির সামনে উপস্থাপন করতে হবে। বাস্তবমুখী সাজেশন দিতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কোথায় কোথায়, কোন কোন বিষয়ে এবং কেন পরিবর্তন করতে হবে তাও স্টেকহোল্ডারদের জানাতে হবে এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনে কোন কনটেন্ট কিংবা মূল্যায়নে পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। কাউকে কিছু না জানিয়ে অর্থের লোভে বিরাট বিরাট পরিবর্তন নিজেরা বসে বসে করলে চলবে না।

প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর সব বিষয়ের বই বিনামূল্যে দেওয়ার প্রয়োজন আছে কী? এনসিটিবির যে লোকবল বা কাঠামো তাতে আমরা এই কাজ সঠিকভাবে করতে পারি কী? আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা যেহেতু অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক তাই বিনামূল্যের বই শুধু প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করতে পারি এবং সেটি করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। মাধ্যমিকের বই বিনামূলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই, যেভাবে উচ্চ মাধ্যমিকে খোলা বাজারে শিক্ষার্থীরা বই কেনে, সেভাবে করা উচিত। বিনামূল্যে বই দিলে যে সমস্যাগুলো হয় সেগুলো হলো-

(ক) এনসিটিবির ওপর পুরো চাপ পড়ে ফলে প্রতি বছরই বই এলোমেলো হয়। যেমন বাংলা বইয়ের সঙ্গে ইসলামিয়াত, ইংরেজির সঙ্গে গণিত বইয়ের কিয়দংশ চলে আসে।

(খ) বইয়ে প্রচুর মুদ্রণজনিত ও তথ্যগত ভুল থাকে। ভুল দেখার কোনো সময় কেউ পান না। কারণ টার্গেট হচ্ছে জানুয়ারির প্রথম দিন কিংবা প্রথম সপ্তাহ বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো অথচ কোনো বছরই বই মার্চের আগে শিক্ষার্থীদের হাতে সব এলাকায় পৌঁছে না। কোনোভাবেই বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।

(ঘ) বই খোলা বাজারে না পাওয়ার ফলে একজন শিক্ষার্থী বই ছিঁড়ে ফেললে বা হারিয়ে ফেললে বছরের বাকি মাসগুলোতে বই ছাড়া তাদের বিদ্যালয়ে যেতে হয়। তাই বই হতে হবে সবার জন্য উন্মুক্ত।

(ঙ) শিক্ষকতার বাইরেও যারা বই পড়েন, বই নিয়ে ক্রিটিক্যাল কিছু চিন্তা করেন, গবেষণা করেন তারা স্বাচ্ছন্দে এনসিটিবির বই ব্যবহার করতে পারেন না। অনলাইনে বই সব সময় সঠিকভাবে পাওয়া যায় না।

(চ) এনসিটিবি কর্তৃক দুই তিনশ টাকার বইয়ের জন্য মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের পড়া বেধে থাকবে না বরং এতে আরও সমস্যা হচ্ছে। তারা এসব ঝামেলার কারণে কোচিংয়ে, প্রাইভেটে এবং নোট গাইডের পেছনে এনসিটিবির বইয়ের কয়েকগুণ বেশি অর্থ খরচ করে। একান্ত প্রয়োজন হলে হার্ড-টু-রিচ এবং বস্তি এলাকার শিক্ষার্থীদের বিনামূলে বই দেওয়া যেতে পারে। সবার জন্য প্রয়োজন নেই।

এনসিটিবি উন্নতমানের কারিকুলাম ঠিক করে বিভাগ ওয়ারি এক একটি বড় কোম্পানিকে বা সংস্থাকে বই ছাপা ও বিতরণের দায়িত্ব দিলে তাদের মধ্যে এক ধরনের কম্পিটিশন তৈরি হবে কে কত ভালোভাবে, আগে এবং মানসম্মত বই তৈরি করতে পারেন। এনসিটিবিতে শুধু সরকারি কলেজ বা স্কুলের একজন শিক্ষক লোক ধরাধারি করে কিংবা ঘুষ দিয়ে ঢাকায় আসবেন আর ঢাকায় বসানোর জায়গা নেই তাই এনসিটিবিতে পোস্টিং এই প্রথা চিরতরে বন্ধ করতে হবে। কারণ এনসিটিবি হেলাফেলা বা তামাশা করার জায়গা নয়, অমুক অধ্যাপক অমুকের শ্যালক বা দুলাভাই বা বন্ধু তাই তাকে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বা মেম্বার কারিকুলাম হতে হবে। নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকদের পরীক্ষার মাধ্যমে পদায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু সরকারি শিক্ষকদের ডেপুটেশনে আসার ব্যবস্থাও পরিবর্তন করতে হবে কারণ এনসিটিবি হচ্ছে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। দেশের সব ধরনের শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষা গবেষকদের একটি আদর্শ আলয়ে পরিণত করতে হবে এনসিটিবিকে।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

বিষয়:

সরকারের চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক খাতের দুরবস্থা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অসাধারণ গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার যা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি তা-ই ঘটেছে। গণআন্দোলনের তোড়ে প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে আত্মরক্ষার্থে দেশত্যাগ করেছেন। ফলে একটি পরাক্রমশালী সরকারের পতন হয়েছে। ছাত্র-জনতার ইচ্ছায় নোবেলজয়ী খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ শাসন ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছে।

এ সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো দেশের ভেঙে পড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা প্রদান এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।

দেশের অর্থনীতি বেশ কয়েক বছর ধরেই টালমাটাল, এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ব্যাংক খাতে নৈরাজ্য, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, টাকার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রতুলতা ও অর্থ পাচারের মতো বিষয়গুলো দেশের অর্থনীতিকে খাদের কিনারে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে তাতে দেশের অর্থনীতি আরও কঠিন চাপে পড়েছে। আবার সাম্প্রতিক নজিরবিহীন বন্যায় সারা দেশ তলিয়ে গেছে। মানুষের সহায় সম্বল নষ্ট হচ্ছে, ফসলের ক্ষতি হয়েছে, মানুষ খাদ্য ও পানীয় জলের কষ্টে পড়েছে। এত কিছু সামাল দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নতুন সরকারের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ, থিংক ট্যাংক ও সুশীল সমাজ নানা আলোচনা ও লেখালেখির মাধ্যমে বেশ কয়েক বছর ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন; কিন্তু কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাত কারণে এসব সমালোচনা ও পরামর্শ আমলে নেননি, বরং দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা এবং ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রক সংস্থা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভুলভাল ব্যাখ্যা করেছেন এবং একটি চিহ্নিত মহলের স্বার্থে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। সম্প্রতি সংবাদপত্রে একটি খবর চাউর হয়েছে যে একজন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী (পরে অর্থমন্ত্রী) পরিসংখ্যান বিভ্রাটের মাধ্যমে দেশের প্রবৃদ্ধি তথা জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয়, আমদানি-রপ্তানি বেশি দেখাতেন। অন্যদিকে এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণেও গরমিল, পরিসংখ্যান বিভাগের মূল্যস্ফীতির হারসহ অন্যান্য তথ্যও বেঠিক বলে খবর বেরিয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক সূচকগুলো আবার নতুন করে পরিমাপ করতে হবে।

একশ্রেণির ব্যাংক চেয়ারম্যান/পরিচালক ও ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে কত হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছেন তারও সঠিক হিসাব নেই। অবাধে অর্থ পাচার হয়েছে। ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। অর্থ পাচারের যে পরিমাণ বেরিয়ে আসছে তা নজিরবিহীন ও বিপজ্জনক। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১৫ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ বেশ কজন উপদেষ্টা দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, সমাজে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ও প্রশ্নাতীত সততার অধিকারী। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যেসব নীতি পলিসি গ্রহণ করেছেন, সেগুলো সঠিক পথেই এগোচ্ছে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য সিপিডির ফেলো ও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, এ শ্বেতপত্র প্রকাশিত হলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সার্বিক চিত্রের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে একটি দিক-নির্দেশনা পাওয়া যাবে।

ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাসহ অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ঘোষণা করেছেন পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন, যদিও এ কাজটি খুবই কঠিন। তবে পাচারকারী ও অর্থ পাচারকৃত দেশ চিহ্নিত হলে ওই সব দেশের সহযোগিতায় পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনা যেতেও পারে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিয়োগপ্রাপ্ত গভর্নর কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছেন। নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হয়েছে। স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কিছুটা কমতে পারে। তবে আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির ক্রম ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে প্রয়োজন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ চেইন নিয়মিত স্থিতিশীল রাখা ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ বজায় রাখা।

দেশে তেল, চিনি, ভোজ্য তেল, গম, ডাল, আদা, পেঁয়াজ প্রভৃতি দ্রব্যাদি মূলত আমদানিনির্ভর। এসব দ্রব্যের মজুত ও সরবরাহ নিঃশেষ হয়ে আসছে। কতিপয় ব্যাংকের এলসি করার ক্ষমতা স্থগিত এবং সরবরাহকারীর প্রতিনিধি কর্তৃক এলসি গৃহীত না হওয়ায় ইতোমধ্যে সম্পাদিত এলসিগুলো কার্যকর করা যাচ্ছে না। আমদানি বন্ধ বা বিঘ্নিত হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ ঘাটতি হতে পারে যা মূল্যস্ফীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এমন অবস্থায় ছোট-বড় আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে ব্যাংকিং সমস্যা দূরীভূত করে সরবরাহ সচল রাখতে হবে। তা ছাড়া ভোগ্যপণ্য ও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি উৎপাদনের কলকারখানা সচল রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

বড় বড় ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণের জন্য বিগত সরকারকে অর্থনীতিবিদরা নিয়মিত বলে আসছিলেন; কিন্তু কঠোর অবস্থান তো দূরের কথা, বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে তাদের বহু ছাড় এবং অর্থলুট সহজ করে দিয়েছিল। প্রভাবশালী বেশ কজন ঋণখেলাপির হাজার হাজার কোটি টাকা সুদ মওকুফ করা হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব ঋণখেলাপি ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছেন। আপাতত এসব ব্যবসায়ী আত্মগোপনে থাকলেও ব্যবসায়িক স্বার্থ ও আত্মরক্ষার্থে সরকারের কাছে তাদের ধরা দিতেই হবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কতিপয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা পরিবর্তনের এবং এসব ব্যবসায়ীর সম্পত্তিতে ‘হাত’ দেওয়ার পদক্ষেপে অনেকেরই টনক নড়বে। বর্তমান গ্লোবালাইজেশন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা এবং রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাবের কারণে আত্মসাৎ ও পাচারকারীরা বিদেশে গিয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন না। এমন অবস্থায় জবাবদিহিতাবিহীন অবস্থা থেকে কঠোর অবস্থার সম্মুখীন হওয়ায় এসব ব্যবসায়ীর বোধোদয় হোক এটাই জনগণ প্রত্যাশা করে।

এ পর্যন্ত কতিপয় দুর্বল ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অর্থ সহায়তা করে এদের তারল্য টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। নবনিযুক্ত বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর অর্থ সহায়তা বন্ধ করায় এসব ব্যাংক সংকটে পড়েছে। গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। আমানতকারীরা দুশ্চিন্তায় আছেন। আশার কথা, এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও গভর্নিং বডি পরিবর্তন হওয়ায় ব্যাংকগুলো আবার সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংককেও খেয়াল রাখতে হবে কোনো ব্যাংক যাতে দেউলিয়া হয়ে বসে না পড়ে। ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে কার্যক্রম বন্ধ করলে বহু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এরূপ ঘটনা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক হবে।

বিগত সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ও পরিদর্শন, অডিট ইত্যাদি অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে ব্যাংকগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ব্যাংক কমিশন গঠিত হলে ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থা, ব্যাংক পুনর্গঠন, পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতা ইত্যাদি বিষয়ে সার্বিক নির্দেশনা ও পরামর্শ পাওয়া যাবে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু যোগ্য, নির্লোভ ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে, সেহেতু অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে তাদের কিছুটা সময় ও সুযোগ দিতে হবে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। দেশবাসী ও রাজনৈতিক দলগুলো এ সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করলে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্টদূত


banner close