মানুষের সৃষ্ট কাজের মাধ্যমে মানুষ এ পৃথিবীর প্রকৃতি ও পরিবেশ প্রতিনিয়তই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সে কারণেই আজ বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জনজীবনে নেমে এসেছে এক অস্বস্তি ও কষ্ট। খেটে খাওয়া মানুষের জন্য এ কষ্টটা একটু বেশি। এ সমস্যা উত্তরণে বিশ্বনেতাদের পাশাপাশি আমাদেরও অনেক সচেতন হতে হবে, অনেক কিছু বর্জন করতে হবে এবং অনেক কাজ করতে হবে। প্রথমে আসা যাক বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়ে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পেছনে অনেক কারণ রয়েছে, এখন সেগুলোর ওপর আলোকপাত করা যাক।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির উৎস ও কারণ
প্রথমেই বলতে হয় গ্রিন হাউস গ্যাসের কথা। গ্রিন হাউস গ্যাস সূর্যের অতিরিক্ত তাপ যেগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকিরণের মাধ্যমে ফিরে আসে সেগুলোকে ট্র্যাপ করে এবং শোষণ করে। ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। গ্রিন হাউস গ্যাস যেমন ওয়াটার ভেপার, ওজোন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, হাউড্রোফ্লোরো কার্বনস, পারফ্লোরো কার্বনস, সালফার হেক্সাফ্লোরাইড, নাইট্রোজেন ট্রাইফ্লোরাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বনস ইত্যাদি এসব গ্যাসগুলো নিঃসরণ হয় পরিবহন খাত, রেফ্রিজারেটর, শীতলীকরণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প-কলকারখানায় ব্যবহৃত কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি থেকে।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন হাউস গ্যাসের উৎপাদনের পেছনের উৎস বা খাতগুলোর দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক।
পরিবহন খাত
যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন খাত থেকে ২৮% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়। তথ্য মোতাবেক বাস, ট্রাক, কার, জাহাজ, ট্রেন ও বিমানে পেট্রোলিয়াম, ডিজেল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদনের বড় উৎস।
বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত
যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত থেকে ২৫% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৭৯% বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় জীবাস্ম জ্বালানি যেমন পেট্রোলিয়াম, ডিজেল, কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। যেগুলো গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদনের ক্রীড়নক।
শিল্প খাত
যুক্তরাষ্ট্রের ২৩% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয় শিল্প খাত থেকে। এ ছাড়া শিল্পে কিছু কাঁচামাল থেকে পণ্য তৈরি করতে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানোর প্রয়োজন হয় এবং সে সময়ে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়ে থাকে।
বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাত
যুক্তরাষ্ট্রের মোট উৎপাদিত গ্রিন হাউস গ্যাসের ১৩% উৎপাদিত হয় বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাত থেকে। এ খাতেও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয়। তাপ উৎপাদন, আলোক সজ্জা, বৈদ্যুতিক বাতি, রেফ্রিজারেশন এবং শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় এবং বর্জ্য ব্যস্থাপনায়ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয়।
কৃষি খাত
যুক্তরাষ্ট্রের ১০% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয় কৃষি খাত থেকে।
অন্যান্য খাত
ভূমির সার্বিক ব্যবহার এবং অন্যান্য খাত থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ১২% গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়।
পৃথিবীতে বর্তমান সময়ে পরিবহনে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে, শিল্প-কারখানায় ও গৃহস্থালির কাজে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণ ও দীর্ঘকালীন ইরাকে যুদ্ধ, ইসরায়েলের সাথে ফিলিস্তিন ও হিজবুল্লাহর যুদ্ধ এবং ওইসব যুদ্ধে ব্যবহৃত বিস্ফোরক ও জীবাশ্ম জ্বালানি বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। ব্রাজিলের আমাজান বনে আগুন, আফ্রিকায় বনভূমি উজাড়করণ, অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে আগুন, এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষ করে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পাহাড়ি বনে আগুন, ভারত-পাকিস্তানের অস্ত্র প্রতিযোগিতা, বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা ও ব্যাপক মাত্রায় বন উজাড়; বিদ্যুৎ উৎপাদন, ইটের ভাটা ও অন্যান্য কাজে কাঠ ও কয়লার ব্যবহার বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
এ ছাড়া পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা ও বিস্ফোরণ, রাসায়নিক অস্ত্রের পরীক্ষা ও বিস্ফোরণ, শিল্প-কলকারখানার ধোঁয়া, গরম পানি, বর্জ্য, দূষিত পানি ও এফলুয়েন্টের ডাম্পিং, ধূমপানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত ধোঁয়া, বনভূমি ও জলাভূমির বিলুপ্তি, ঝড়, ধূলিঝড়, মরুঝড় ও নির্মাণ কাজ থেকে বাতাসে ধূলিকণা যোগ হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে পরিবেশ উষ্ণতার উৎস ও করণীয়
গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন
বাংলাদেশেও পরিবহন খাত, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত, শিল্প খাত, বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাতগুলো থেকে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া সিগারেটের কালো ধোঁয়া থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড, রেফ্রিজারেটর থেকে সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরো কার্বন) উৎপাদন হয়। বিভিন্ন সেক্টরে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি, যেমন- পেট্রোলিয়াম, ডিজেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি থেকে বাংলাদেশে গ্রিন হাউস গ্যাসের সিংহভাগ উৎপাদিত হয়ে থাকে।
বৃক্ষ নিধন
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় পৃথিবীব্যাপী প্রতিনিয়ত বৃক্ষ নিধন প্রকাশ্যে এবং নীরবে ও নিভৃতে চলছে। এ অপরিণামদর্শী কাজ এশিয়ার দেশগুলোতে এবং বাংলাদেশেও চলছে। অনেক সংরক্ষিত বনভূমির ভেতরটা বৃক্ষ শূন্য এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মহল এ বৃক্ষ নিধন কর্মে জড়িত বলে একটি সূত্র জানায়। মূল বিষয় হচ্ছে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়ত উৎপাদিত হচ্ছে তার পুরোটা বৃক্ষরাজি, বন-বনানী, গুল্ম, লতা-পাতা ও সামুদ্রিক শৈবাল কর্তৃক শোষণ হচ্ছে না। এ অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে থেকে যাচ্ছে এবং সূর্যের তাপকে শোষণ করছে এবং আটকে রাখছে ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।
ইটভাটার দূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি
বাংলাদেশের ইটভাটায় বিপুল পরিমাণ কাঠ ব্যবহৃত হয়, যার ফলে একদিকে যেমন বৃক্ষরাজি ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ইটভাটা থেকে ফ্লাইঅ্যাশ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে। ফ্লাইঅ্যাশ বায়ুমণ্ডলে ক্ষুদ্র কণা যোগ করে থাকে, যা বায়ু দূষণে বিরাট ভূমিকা রাখে। এ বায়ুর কণা ও কার্বন ডাই-অক্সাইড তাপমাত্রা শোষণ করে ও তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটায়।
জলে নিমজ্জন ধান চাষকরণ
এশিয়ার অনেক দেশে জলে নিমজ্জিত করে ধান চাষ করা হয়। বাংলাদেশেও এরূপ জলে নিমজ্জন ধান চাষ করা হয়ে থাকে; যার ফলে প্রচুর পরিমাণ মিথেন গ্যাস উৎপাদিত হয়ে থাকে। যা পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
পাহাড় ধ্বংস
পাহাড় ধ্বংসের সাথে সাথে পাহাড়ের বৃক্ষরাজি, লতা, পাতা, পশু, পাখি, অণুজীব এবং তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যায়, যার ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ কমে যায়। প্রকারান্তে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
যানজট
বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বড় নগরীগুলোতে যানজট দেখা যায়। যানজটের কারণে গাড়িগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানি অধিক পরিমাণে ব্যয়িত হয় এবং প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য দূষিত গ্যাস নির্গত হয়; যা প্রকারান্তরে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।
শিল্প ও কলকারখানা
আমাদের দেশে শিল্প এবং কলকারখানা থেকেও কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস, বর্জ্য এবং দূষক নির্গত ও উৎপাদিত হয় ও পরিবেশে মেশে। তা ছাড়া শিল্প-কলকারখানা থেকে পণ্য তৈরি করার সময় গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গত হয়, যা পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধি করে।
ধূমপান
এ দেশে প্রতিদিন এক বিরাট সংখ্যক ধূমপায়ী ধূমপান করে থাকে। ফলে তাদের সিগারেট ও বিড়ি থেকে কার্বন-মনোক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়ত পরিবেশে মিশছে এবং বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে।
নির্মাণ কাজ থেকে বাতাসে ধূলিকণা যোগ হওয়া
বিশেষজ্ঞদের থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের বাতাসে ধূলিকণার একটা বড় অংশ নির্মাণ কাজ থেকে আসে। ওইসব ধূলিকণা সূর্যের তাপ শোষণ করে এবং বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।
বিশ্বের ও বাংলাদেশের পরিবেশ উন্নয়নে পদক্ষেপগুলো
গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন বন্ধকরণ
বিশ্ব ও বাংলাদেশের উষ্ণতা কমাতে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন কমাতে হবে। এ জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি, বায়ুচালিত শক্তি, বায়োগ্যাসের ব্যবহার ও সোলার এনার্জির ব্যবহারের মাত্রা বাড়াতে হবে।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন
অনেক দেশে ট্রাফিক জ্যাম আছে এবং পুরোনো গাড়ি ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশেও বেশি দিনের পুরাতন গাড়ির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং ট্রাফিক জ্যাম কমাতে হবে। ঢাকা শহরের ট্রাফিকের অধিকাংশই উত্তর-দক্ষিণমুখী প্রবাহ; যদি পূর্ব-পশ্চিমমুখী আরেটা বড় প্রবাহ তৈরি করা যায় তাহলে যানজট নিঃসন্দেহে কমতে পারে। যানজট নিরসনে ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টকে অধিক নিরাপদ, আরামদায়ক ও আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে হবে। মানুষকে ট্রাফিক এডুকেশন দ্বারা সচেতন করতে হবে, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করতে হবে ও প্রেষণা দিতে হবে। গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে আরও কঠোরতা অবলম্বন করা যেতে পারে এবং একজনের জন্য একটি গাড়িনীতি পরিহার করে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের দিকে ঝুঁকতে হবে। তাহলে কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন কম হবে এবং বাংলাদেশ তথা বিশ্বে উষ্ণতা কমবে।
বৃক্ষনিধন বন্ধ ও তদারকি
বৃক্ষ কর্তন নিষিদ্ধ থাকলেও বৃক্ষ কর্তন নিষেধাজ্ঞা সঠিকভাবে প্রতিপালন হচ্ছে কি না সে বিষয়ে অধিক মনিটরিং ও সুপারভিশন দরকার। আর প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদান করতে হবে। এ কাজে সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। পরিবেশ-পুলিশ তৈরি করলে তারা এ ক্ষেত্রে সমন্বয় ও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বৃহদাকার বৃক্ষ কেটে ছোট ছোট বৃক্ষ রোপণ করা হচ্ছে; যা ওই বৃহৎ বৃক্ষের তুলনায় কম পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ বা গ্রহণ করতে পারে। তা ছাড়া বিশ্বব্যাপী ডাম্পিংয়ের মাধ্যমে বর্জ্যগুলা সমুদ্রের পানি দূষণ করছে এবং সামুদ্রিক শৈবালও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য পাহাড় ও পাহাড়ি বন-বনানী রক্ষার্থে পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ রোপণ করা জরুরি। তাহলে বৃক্ষরাজি রক্ষা হবে এবং পরিবেশের উষ্ণতা কমবে।
বৃক্ষ, বন, জঙ্গল, লতাপাতা, খড় ও অন্যান্য বস্তুতে অগ্নিসংযোগ পরিহার করা
একটি বিষয় বেশ লক্ষণীয় যে, বিশ্বব্যাপী একরূপ ম্যানিয়া বা রোগ হয়ে গেছে যে, পাহাড়ি বন-বনানী, বৃক্ষের লতাপাতা, জঙ্গল, ধানের খড়, ধানগাছ, গমের খড়, গমগাছ, আখের খেত ইত্যাদি পেলেই সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ করা; যা না করে যান্ত্রিক উপায়ে পাহাড় পরিষ্কার করা যেতে পারে, খড়, জঙ্গল, লতাপাতা নিয়ে কমপোস্ট করা যেতে পারে। যার ফলে একদিকে যেমন জৈব সার তৈরি বৃদ্ধি পাবে এবং অন্যদিকে বন-বনানী রক্ষা পাবে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদন কমে যাবে ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধ করা যাবে।
জলাভূমি সংরক্ষণ
জলাভূমিকে বলা হয়ে থাকে পরিবেশের রক্ত। অথচ আমাদের জলাভূমিগুলো দিন দিন ভরাট হচ্ছে, বিলুপ্তি ঘটছে। কিছু অসাধু লোক এগুলোতে বিভিন্ন রকম স্থাপনা, বিনোদন কেন্দ্র, খামার ও খামারবাড়ি তৈরি করছে। যার ফলে আমাদের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। জলাভূমি রক্ষার মাধ্যমে, বর্ষাকালের বৃষ্টির পানি, উজানের পানি, আন্তর্জাতিক নদী বা অন্য দেশের ওপর দিয়ে আসা পানিকে ধরে রাখা ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে। ফলে পরিবেশের উষ্ণতা কমানো যেতে পারে।
পরিকল্পিত নগরায়ণ
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নিচুভূমি ও জলাভূমিকে উন্নয়ন করে নগরায়ণের পরিকল্পনা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এর ফলে প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন পদ্ধতি ও ওয়াটার টেবিল ধ্বংস হচ্ছে। যা পানির ঘাটতি তৈরি করে থাকে। পানি সংরক্ষণ বা ধরে রাখার জায়গা নষ্ট হলে পরিবেশের উষ্ণতার ওপর এর প্রভাব পড়বে।
শিল্প-কারখানার ওপর তদারকি বৃদ্ধি
কোন শিল্পপ্রতিষ্ঠান কোন ধরনের গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন করছে, সে বিষয়ে বিশ্বব্যাপী মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। সে জন্য শিল্পের ওপর মনিটরিং ও তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশবান্ধবভাবে চলছে না সেগুলো বন্ধ করতে হবে।
পরিকল্পিত ব্যারাজ, বাঁধ, ব্রিজ ও কালভাট নির্মাণ
অপরিকল্পিত ব্যারাজ, বাঁধ, ব্রিজ ও কালভার্ট তৈরি করার কারণে অনেক নদী, খাল ও জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো আর পানি ধরে রাখতে পারে না। ওইগুলো ড্রেজিং করে নাব্যতা ও গভীরতা ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। অপরিকল্পিত ব্যারাজ, বাঁধ, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে এবং সমন্বিতভাবে বিভিন্ন দেশকে একত্রে কাজ করতে হবে।
ব্যাপকভাবে বনায়ন কার্যক্রম চালুকরণ
পৃথিবীব্যাপী বৃক্ষ নিধন বন্ধ করে ব্যাপক মাত্রায় বনায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে বনায়ন, সামাজিক বনায়ন, পারিবারিক বনায়ন, ছাদ কৃষি, আঙিনা কৃষি ও সব পর্যায়ে ব্যাপকভাবে বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যার ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ বৃদ্ধি পাবে ও তাপমাত্রা কমে আসবে।
ধূমপান বন্ধকরণ
ধূমপান বন্ধ করা বা কমিয়ে আনার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদন রোধ করা যাবে। আর তা পরিবেশের তাপমাত্রা হ্রাস করতে সহায়ক হবে।
জলে নিমজ্জিত করে ধান চাষ বন্ধকরণ
যেহেতু এশিয়ার দেশগুলোতে জলে নিমজ্জিত ধান চাষের মাধ্যমে গ্রিন হাউস গ্যাস মিথেন উৎপাদন হয়ে থাকে, সে জন্য জলে নিমজ্জিত করে ধান চাষ বন্ধ করতে হবে। ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা হ্রাস পাবে।
নির্মাণ কাজের সময় স্থাপনা ঢেকে বা ভিজিয়ে কাজ করা
নির্মাণ কাজ থেকে বাতাসে ধূলিকণা যোগ হয়ে বায়ুদূষণ ঘটায়। আর এসব ধূলিকণা তাপমাত্রা শোষণ করে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়ে থাকেন। সে জন্য নির্মাণ কাজ করার সময় যতদূর পারা যায় স্থাপনাগুলো ঢেকে বা ভিজিয়ে কাজ করা। তাহলে ধূলিকণা বাতাসে ছড়াবে না এবং পরিবেশের দূষণ বা বায়ুদূষণ কম হবে। যার ফলে পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটবে না।
বর্তমানে বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সে জন্য প্রাকৃতিক কারণ যদিও কিছু রয়েছে কিন্তু মানবসৃষ্ট কারণই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের নেতাদের এবং নীতি-নির্ধারকদের এ ব্যাপারে আরও সতর্ক, সচেতন ও মানবিক হতে হবে। সর্বোপরি সবারই পরিবেশকে ভালোবাসতে হবে এবং সে মোতাবেক পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই বৈশ্বিক উষ্ণতা ও বাংলাদেশের উষ্ণতা কমবে এবং আমরা একটি সবুজ পৃথিবী ও সহজাত পরিবেশ ফিরে পাব।
লেখক: ড. মো. আব্দুস সোবহান পিপিএম
কমান্ড্যান্ট (অ্যাডিশনাল ডিআইজি)
পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল (পিএসটিএস), বেতবুনিয়া, রাঙামাটি
আমরা সাধারণ জনগণ এক স্থান থেকে অন্যস্থানে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য চলাফেরা করতে পছন্দ করি, আর এই যোগাযোগের সহজ পথ হলো সড়কপথ তাই সড়ক পথে চলি। এই পথ চলার মাঝে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক হলে ঢাকা সিলেট রোড, এই সড়কটি মূলত বাংলাদেশের জাতীয় মহাসড়ক যা রাজধানী ঢাকা এবং সিলেট বিভাগের সিলেট শহর অতিক্রম করেও তামাবিলকে সংযুক্ত করেছে, এবং নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ এ জেলাগুলোকে সংযুক্ত করেছে। এটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক নামে পরিচিত।
যা বর্তমানে বেহাল অবস্থায় রয়েছে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দ্রুত সংস্কার ও যাতায়াতের দুর্ভোগ দূর করার দাবিতে সিলেটে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে গত এক সপ্তাহ ধরে একের পর এক কর্মসূচি পালিত হচ্ছে, বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, টিভি টকশো ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা অব্যাহত আছ। একই দাবিতে সারাদেশে বিশেষ করে রাজধানী ও দেশের বাইরে অর্থাৎ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিলেটের লোকজন প্রতিবাদী কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন এবং পালন করে চলেছেন একের পর এক নতুন নতুন কর্মসূচিব। সম্প্রতি ঢাকাস্থ সিলেটবাসীদের নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে পালিত হয়েছে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দীর্ঘ মানববন্ধন। উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার জনগণ।
এই সড়কপথে চলাচলকারী জনগণের দুর্ভোগ এখন চরমে ও অবর্ননীয়, বিশেষ করে আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড পর্যন্ত পথটুকুতেই সবচেয়ে বড় বিপর্যয় পরিলক্ষিত হচ্ছে শাহাবাজপুর থেকে শাহাজাদপুর প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথই যেন গলার কাঁটা।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে ৬ লেনে উন্নীত করার একটি প্রকল্প চলমান আছে, কিন্তু এর কাজ অত্যান্ত ধীরগতিতে চলছে। প্রকল্পটি ‘এশিয়ান হাইওয়ে’র আদলে তৈরি করা হচ্ছে, যা ঢাকা ও সিলেট বিভাগের মধ্যে আন্তঃনগর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাবে। প্রকল্পের একটি অংশ, সিলেট ও তামাবিলের মধ্যে বিদ্যমান জাতীয় মহাসড়ক N2 কে উন্নত করা হবে।
যদিও প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে অনেক আগে। এখনো পুরো কাজ শেষ হয়নি এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হবে এমন নিশ্চয়তাও নেই ফলে বেড়েছে দুর্ভোগ। এই পথে চলাচলকারীদের যেখানে ছয় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হতো তা এখন লাগছে ১৬-২২ ঘণ্টা, এটা যেন নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে এখন সাধারণ
বিষয়ে পরিনত হয়েছে। অথচ বিষয়টি দেখার কেউ নাই, সমস্যটি বলার কোনো মুখ নাই, দুঃখ দুর্দশা লাঘবের কোন সুব্যবস্থা বা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার জায়গাটা যে কোথায় তাও জানেনা এই এলাকার চলাচলকারী কোনো সাধারণ জনগণ।
সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের নাজুক অবস্থার অবসানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন সিলেট বিভাগের আপামর স্থানীয় জনগণ ও সুশীল সমাজ একই সঙ্গে সিলেটের সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দাবি জানিয়েছেন সকলেই, সড়কপথের বেহাল অবস্থা হওয়ায় বিত্তশালীরা আকাশপথে ও সাধারণ মধ্যবিত্তরা রেলপথে চলাচল করছেন। সেই সুযোগে বেড়েছে টিকিট কালো হাজারীদের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, এই কালোবাজারি রোধের নামে আবার প্রশাসনের কোন কোন কর্তাব্যক্তি চাচ্ছেন ট্রেনে চলাচলের জন্য অবশ্যই জাতীয় পরিচয় পত্র বহন করতে হবে, একজনের এন আইডি দিয়ে অন্যজন ভ্রমণ করতে পারবেন না, এটা কতটুকু বাস্তবে পালিত হবে তা জানি না। যাত্রীদের কেউ কেউ আবার দাবি করেছেন অধিক ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হবে, দাবি জোরদার করার লক্ষ্যে দলেবলে রেল লাইনের উপর শুয়ে পরে ট্রেন বন্ধ করে দেবার হুমকি দিয়ে চলেছেন এবং দুই এক জায়গায় চেষ্টাও করেছেন যার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে।, ‘ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হলেও এটি আজ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে, জনভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।’
সড়কের বেহাল অবস্থার দ্রুত প্রতিকারের দাবি জানিয়ে গত ১২ অক্টোবর সিলেট নগরে এক ঘণ্টার প্রতীকী কর্মসূচি পালিত হয় ওইদিন নগরের দোকানপাট বন্ধ রাখা হয় এবং যানবাহন চলাচলে এক ঘণ্টার কর্মবিরতি পালিত হয়।
বিশেষ করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড় হয়ে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। তবে উন্নয়নকাজের ধীরগতির কারণে বেহাল অবস্থা এই সড়কের একেবারেই চলাচলের ও অনুপোযোগী, মহাসড়কটির বিভিন্ন স্থানে গর্তের কারণে যান চলাচলের কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই
গর্তে গাড়ি আটকে গিয়ে প্রায় সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজটের। এতে প্রতিনিয়ত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে চলাচলকারীদের। বেহাল ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নিয়ে কত কথাই না হচ্ছে তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন এখানে যে কিছু হচ্ছে না তা নয় , হচ্ছে তা অত্যান্ত্য অপ্রতুল এবং মন্থর গতিতে।
আশুগঞ্জ থেকে সরাইল—মাত্র সাড়ে ১১ কিলোমিটার সড়কপথের জন্য পুরো সিলেট বিভাগ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠে গেছে। ভারতীয় ঠিকাদার সময়মতো কাজ শেষ করেনি। স্বাভাবিক মেরামতও বন্ধ। ফলে খানাখন্দের কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের এই অংশে প্রতিদিনই যানজট, ভোগান্তি হচ্ছে।
এই ভোগান্তি লাঘবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরকে সময় বেঁধে দিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়।
আর কাজ তদারকির জন্য গঠন করা হয়েছে ১২ সদস্যের একটি কমিটি।
সড়ক পরিবহন সমন্ত্রণালয়
সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সরাইলে স্থাপন করা হয়েছে ক্যাম্প অফিস। এই ক্যাম্প অফিসে প্রকৌশলীদের অবস্থান করে সার্বক্ষণিক মেরামত ও নির্মাণকাজ তদারকির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মহাসড়কের কাজ ও সবশেষ পরিস্থিতি দেখতে গত বুধবার আশুগঞ্জ যান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি নিজেও এই পথ পাড়ি দিয়েছেন মোটর সাইকেলে চড়ে, যার ছবি ভাইরাল হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ও পত্রপত্রিকায়। মহাসড়কটির দূরবস্থা নিরসনে ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আমরাও আশা করবো শিগগিরই সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্যোগে এই পথের চলাচলকারী সকলের দুর্ভোগ লাঘব হবে। রাস্তা ভালো হবে, নিয়ম মতো স্বাচ্ছন্দ্যে সকল প্রকার যানবাহন চলবে সেই সাথে বর্তমানে চলাচলকারী আমাদের সকল শ্রেণির গাড়িচালক ভাইদেরকে একটু সচেতনতার সাথে গাড়ি চালানোর জন্য অনুরোধ করব, কারণ নিয়ম মেনে চললে এই পথে হয়তো এতটা কষ্ট করতে হবে না।
সূরা আহযাব, পর্ব ৩
অনুবাদ:
(৬) এই নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের চেয়েও ঘনিষ্টতর ও অগ্রগণ্য এবং তার স্ত্রীগণ তাদের মা। আর আল্লাহর বিধান অনুযায়ী (উত্তরাধিকারে) সাধারণ মুমিন ও মুহাজিরদের চেয়ে আত্মীয়-স্বজনরা একে অপরের বেশি নিকটতর, তবে যদি তোমরা বন্ধুবান্ধবের সাথে দয়ার আচরণ করতে চাও, করতে পার। এটা আল্লাহর কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। (৭) আর (স্মরণ কর,) যখন আমি অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম সকল নবীর নিকট থেকে, তোমার নিকট থেকে, এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মারইয়াম-পুত্র ঈসা থেকেও; আর তাদের নিকট থেকে গ্রহণ করেছিলাম মযবূত অঙ্গীকার, (৮) যাতে করে (কিয়ামতের দিন আল্লাহ) সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আর আল্লাহ কাফিরদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক আযাব প্রস্তুত করে রেখেছেন।
মর্ম ও শিক্ষা:
ইসলামে নবীর মর্যাদা ও গুরুত্ব:
আলোচ্য আয়াতে নবীর মর্যাদা ও গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। ইসলামী জীবনাদর্শের নবী ও রাসূলের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ আল্লাহ তাদেরকে সমস্ত মানবতার মধ্য থেকে নবুওয়তের জন্য নির্বাচন করেছেন। তাদের মাধ্যমেই আল্লাহ তার জীবনাদর্শ মানুষের নিকট পৌঁছে দেন। তাদের সম্মান যদি না দেয়া হয় এবং তাদের আনুগত্য যদি না করা হয়, তাহলে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে। সেহেতু কোরআনে বলা হয়েছে, হে মানুষ, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো। অর্থাৎ মর্যাদা ও সম্মানের দিক দিয়ে আল্লাহর পরেই রাসূলের স্থান। আল্লাহর আনুগত্য যেমন অপরিহার্য, তেমনি রাসূলের আনুগত্য অপরিহার্য।
মুহাম্মদ (স.) মুমিনদের নিজেদের প্রাণের চেয়েও অগ্রগণ্য :
আয়াতে বলা হয়েছে, মুমিনদের নিকট নবী মুহাম্মদ (স) তাদের নিজেদের জীবনের চেয়েও বেশি অগ্রগণ্য। কারণ নবী মুহাম্মদ (স) তাদের আদর্শিক নেতা। তিনি তাদের কল্যাণের দিকে খেয়াল রাখেন। মানুষ প্রবৃত্তির টানে এই দুনিয়ার জীবনে যা ইচ্ছা তা করতে পারে। প্রবৃত্তির আকর্ষণে মানুষের মন এমন কিছু চাইতে পারে, যা তার জন্য ক্ষতিকর। রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ এক্ষেত্রে তাকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। অর্থাৎ রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ তাকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ক্ষতি, কষ্ট ও দুর্ভোগ থেকে বাঁচায়। সুতরাং রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ প্রাণের চেয়ে অগ্রগণ্য, কারণ তার আদর্শ প্রাণ রক্ষা করে। পিতা যেমন সন্তানকে ক্ষতিকর বিষয় থেকে ফিরিয়ে রাখে, রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ তেমনি মানুষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
বৈষয়িক স্বার্থ থেকে আদর্শিক স্বার্থ অগ্রগণ্য
আখিরাতের বিবেচনায়ও রাসূল (স) ও তার আদর্শ মুমিনের নিজের প্রাণের চেয়ে অগ্রগণ্য। কারণ, মানুষের মন এমন কিছু কামনা করতে পারে, যা দুনিয়ার স্বাদ লাভে সহায়ক, কিন্তু আখিরাতে শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং বৈষয়িক স্বার্থ থেকে আদর্শিক স্বার্থ তথা রাসূলের আদর্শ অগ্রাধিকার পাবে। কারো বৈষয়িক স্বার্থ আর আদর্শিক বা দীনি স্বার্থ যদি সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে আদর্শিক স্বার্থই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। বলাবাহুল্য, রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শই দীনি স্বার্থ। কাজেই রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ যদি প্রাণের চেয়ে অগ্রণী হন, তাহলে নিজের বৈষয়িক স্বার্থ ত্যাগ করে আদর্শিক স্বার্থকেই গ্রহণ করা উচিত।
নবীর স্ত্রীগণ মায়ের মতো সম্মানিত:
রাসূল (স.) যদি পিতার মতো অথবা পিতার চেয়েও বেশি সম্মানিত হন, তাহলে মুহাম্মদ (স.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ হবেন মুমিনদের মায়ের মতো (আয়াত ৬)। মাকে যেমন সম্মান ও মর্যাদা দিতে হয়, মুহাম্মদ (স.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণকেও তেমনি বা তার চেয়ে বেশি সম্মান দিতে হবে। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই যে, নবী মুহাম্মদ (স.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ তার সাথে বসবাস করার দরুন পারিবারিক অসংখ্য মাসয়ালা তারা জানতেন। অন্যরা রাসূল (স.)-এর পবিত্র স্ত্রীদের কাছ থেকেই জেনে নিতেন। কারণ অনেক সময় এমন বিষয়ের প্রশ্ন থাকতো, যা রাসূল (স.)-কে জিজ্ঞেস করতে তারা লজ্জা পেতেন। মুহাম্মদ (স.)-এর মৃত্যুর পর তার পবিত্র স্ত্রীগণকেও বিয়ে করা যাবে না, যেমন মাকে বিয়ে করা জায়েয নয়। তবে অন্যান্য বিষয়ে মাতৃত্বের সম্পর্ক প্রযোজ্য নয়, যেমন তাদের মেয়ে বোন হয়ে যায় না, এবং তাদের বোন খালা হয়ে যায় না এবং তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির ওয়ারিশী অংশ পাওয়া যাবে না ইত্যাদি। যেমন যুবায়ের (রা.) মা আয়েশার বোন আসমাকে বিয়ে করেছিলেন। যদি রাসুল (স.)-এর স্ত্রীর বোন হওয়ার কারণে তিনি খালা হয়ে যেতেন তাহলে তাকে বিয়ে করা জায়েয হতো না।
ইসলামি ভ্রাতৃত্ব:
এখানে আনসার ও মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের চেয়ে নিকটাত্মীয়ের সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের প্রেক্ষাপটে ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের বিষয়টি উপলদ্ধি করা উচিত, যা ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের গভীরতা প্রকাশ করে। রাসূল (স.)-এর সাথে এবং তার পরে অনেক সাহাবী মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। তারা তাদের সহায়-সম্পদ আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে মক্কা থেকে মদীনায় যান খালি হাতে। রাসূল (স.) তখন একজন মুহাজিরের সাথে একজন আনসারের ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে দেন। সে বন্ধন এতো গভীর ছিল যে তারা একে অপরের উত্তরাধিকারী হতেন। এরপর যখন হিজরতকারীদের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন মদীনায় চলে আসে এবং স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে, তখন আলোচ্য আয়াত দ্বারা সে মাত্রার ভ্রাতৃত্ব রহিত হয়ে যায়। অর্থাৎ আনসার ও মুহাজিররা ভাই ভাই থাকে, কিন্তু একে অপরের উত্তরাধিকারী হওয়ার নিয়ম রহিত হয়ে যায়। আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, আনসার ও মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের চেয়ে আত্মীয়ের বন্ধন অধিকতর মজবুত। কাজেই আত্মীয় স্বজনই একে অপরের উত্তরাধিকারী হবে, এবং আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের কারণে আর কেউ কারো উত্তরাধিকারী হবে না।
রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দের অধিকার :
আলোচ্য আয়াতের বক্তব্য থেকে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়ের অধিকার সম্পর্কে বুঝা যায়। কোরআনে বারবার আত্মীয়ের অধিকার প্রদানের কথা বলা হয়েছে। আত্মীয়ের বিশেষ অধিকারের কথা কোরআনের আরেকটি বর্ণনা থেকে উপলদ্ধি করা যায়। আখিরাতে জান্নাতিরা তাদের পরিচিত জাহান্নামীদের প্রশ্ন করবে, দুনিয়াতে আমরা একসাথে ছিলাম, এখন তোমরা কি কারণে দোযখে গেলে? তখন জাহান্নামীরা একটা একটা করে সেসব কারণ বলবে এবং তাদের মধ্যে একটা কারণ হলো আত্মীয়ের সাথে ভালো ব্যবহার না করা এবং তাদের সাথে সুসম্পর্ক না রাখা। অর্থাৎ আত্মীয়ের সাথে সুসম্পর্ক না রাখা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ।
রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে উত্তরাধিকার বণ্টন:
ইসলামী জীবনাদর্শে মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টনের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেয়া হয়েছে। উত্তরাধিকার বণ্টন হবে আত্মীয়তার নৈকট্যের ভিত্তিতে। কোন্ আত্মীয় কতটুকু পাবে, তা বিস্তারিত বর্ণনা আছে, যা বাধ্যতামূলক। উত্তরাধীকারী তার নির্ধারিত অংশের বেশি পাবে না। তার জন্য বাড়তি কিছু ওসীয়ত করে যাওয়া নিষেধ। ওসীয়ত করা যাবে শুধু উত্তরাধিকারীর বাইরে, অন্যের জন্য, যার সর্বাধিক পরিমাণ হলো সম্পদের এক তৃতীয়াংশ। তৎকালীণ মদীনার আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের প্রেক্ষাপটে এই দাঁড়াল যে, তাদের কিছু ওসীয়ত করা যেতে পারে। তবে তা কখনো সম্পদের এক তৃতীয়াংশের বেশি হবে না। বাকীটুকু অবশ্যই কুরআনে নির্ধারিত বণ্টন নীতি অনুযায়ী নৈকট্যের ভিত্তিতে বণ্টিত হবে। আসলে এটা হলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে সুষম সম্পদ বণ্টনের একটি সুন্দর ব্যবস্থা, যা অন্য কোনো ধর্মে বা ব্যবস্থায় এভাবে নেই। কোন কোন ধর্মে শুধু পুত্র সন্তান উত্তরাধিকারী হয়। আর কোন ব্যবস্থায় উত্তরাধিকারী বণ্টনের ব্যবস্থাই নেই, বরং মৃত ব্যক্তি যাকে যতটুকু খুশি তাকে ওসিয়ত বা উইল করে দিতে পারে।
কিয়ামতের দিন নবীদের দায়িত্বের জবাবদিহিতা:
বলা হয়েছে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন সত্যবাদীদেরকে তাঁদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। এর একাধিক মর্ম হতে পারে। তন্মধ্যে একটি হলো, কিয়ামতের দিন আল্লাহ নবীদেরকে তাদের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। তাদের যে জীবন-ব্যবস্থা দেয়া হয়েছিল, তারা তা তাদের জাতির নিকট পৌঁছে দিয়েছেন কিনা, এ ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। আলোচ্য জবাবদিহিতার আরেকটি অর্থ হলো, আল্লাহ নবীদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, তাদের জাতি তাদের দাওয়াতে কেমন সাড়া দিয়েছিল। অর্থাৎ নবীগণকে তাদের জাতির সাক্ষ্য হিসাবে দাঁড় করানো হবে। তারা সাক্ষ্য দেবেন, কারা তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিল, আর কারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। এসব তথ্য সহকারে সাক্ষ্য দেওয়া তাদের জন্য কঠিন হওয়ার কথা, কিন্তু আল্লাহই তাঁদেরকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবেন।
নবীদের জিজ্ঞাসার মাধ্যমে বাতিলপন্থীদের ভ্রান্তি প্রমাণ করা:
খ্রিষ্টানসহ কোন কোন জাতি নবীগণকে প্রভু বা প্রভুপুত্র হিসাবে বিশ্বাস করে এবং উপাসনা করে। আল্লাহ কিয়ামতের দিন সংশ্লিষ্ট নবীদের জিজ্ঞেস করবেন, তারা কি তাদের জাতিকে এ দাওয়াত দিয়েছিলেন যে তারা তাদেরকে প্রভু বা প্রভুপুত্র হিসাবে গ্রহণ করুক এবং তাদের উপাসনা করুক। তখন নবীগণ নেতিবাচক উত্তর দিবেন। বলবেন, তারা তা কখনো করেন নি। যদি করে থাকেন, তাহলে আল্লাহই ভালো জানতেন। এভাবে নবীগণকে প্রশ্নের মাধ্যমে বাতিলপন্থিদের ভুল প্রমাণিত হবে।
এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকা। যান চলাচলে এই ধীরগতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের শহরে গতি কম। অন্যান্য দরিদ্র দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গতি কম গড়ে ২০ শতাংশ। নাগরিক গতির একটি নির্ধারক বড় রাস্তা। বড় রাস্তা ভিড় কমায় বিষয়টি এমন নয়, বরং বড় রাস্তা গতি বাড়ায়। দ্বিতীয়ত, শহরে বহু মানুষ কর্মক্ষেত্র, স্কুল ও বিনোদন কেন্দ্রের হাঁটার দূরত্বে বসবাস করে না। তারা দ্রুতগতির এবং বিশ্বস্ত যাতায়াত ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে চায়। আধুনিক মহানগরের প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে দ্রুতগতির যান্ত্রিক যান। জটিল উৎপাদন নেটওয়ার্ক ও বিচিত্র ভোগের বর্তমান শহরে হেঁটে যাতায়াতের চিন্তা মধ্যযুগীয়। তৃতীয়ত, পরিবার ও সরকার প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করে নগর যাতায়াতের ক্ষেত্রে। কিন্তু একটি শহর ভ্রমণ বা চলাফেরার জন্য কতটা সুন্দর, তা কমই জানা থাকে। নগর–পরিকল্পনাবিদেরা খুব কমই জানেন যে একই ধরনের শহরের তুলনায় তাদের শহরটি কতটা পিছিয়ে বা কেন পিছিয়ে। মানুষের চলাচল একটি জরুরি বিষয়। শহর গড়ে উঠেছে এ কারণে যে অল্প জায়গায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদনের সুবিধা থাকবে। মানুষ দ্রুত চলাচল করে সেই সুবিধা নিতে পারবে। ঢাকায় দ্রুত চলাচলের সুবিধা নেই। দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনার বদলে স্বল্পমেয়াদে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা এখানে করা হয়েছে। এখন বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা ছাড়া শুধু উন্নয়ন প্রকল্প দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। শহরে ছোট গাড়ি, রিকশা ও মোটরসাইকেল কমাতে হবে। তা না করে আমরা কাজ করছি উল্টো। এর ফলে বিপুল ব্যয়ে প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা যাচ্ছে না।
রাজধানীর যানজট পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না। সব সড়কেই এখন যানজট আগের মতোই। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোতে যানজটের ভয়াবহতা বেশি। কথা হলো- রাজধানীর এই নাগরিক দুর্ভোগ অনেকটাই কমে আসবে, এমন প্রত্যাশা ছিল সবার মধ্যে। এ সমস্যা সমাধানে গত দুই দশকে নানা পরিকল্পনা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যেগুলো বাস্তবায়নে আলোর মুখ দেখেছে তা দিয়ে কি প্রকৃত অর্থেই এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব? একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এমন প্রশ্ন যে কারও হতে পারে। তেমনি বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারীর দৃষ্টি এখন ঢাকার দিকে। তারা যখন এই শহরে আসা মাত্রই যানজটের ভোগান্তিতে পড়েন তখন উৎসাহে কিছুটা হলেও ধাক্কা লাগা স্বাভাবিক। এসব বিবেচনায় প্রশ্ন উঠতেই পারে, এটা কেমন শহর! যে শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় যানজটের কারণে বসে থাকতে হয়। সমস্যা সমাধানে শত ছাপিয়ে হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার প্রতিটি অংশ- সড়ক নির্মাণ, আইন প্রয়োগ, চালকের লাইসেন্স, যানবাহনের ফিটনেস, নগর-পরিকল্পনা, জরুরি সেবা, জনসচেতনতা- এই সবই বর্তমানে ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের হাতে দেওয়া আছে। কিন্তু কোনো সংস্থা এককভাবে এই বহুমুখী সমস্যাগুলোর সমাধান করার জন্য পর্যাপ্ত ক্ষমতা, অর্থায়ন বা সমন্বয়ের সুযোগ পায় না। বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার বড় সমস্যা হলো- অকার্যকর দায়িত্বের বিভাজন। বিআরটিএ ড্রাইভারদের লাইসেন্স দেয় এবং গাড়ি নিবন্ধন করে; কিন্তু তারা রাস্তায় আইন প্রয়োগ করতে পারে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে; কিন্তু সড়ক নকশা বা বাস রুট নির্ধারণে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। সিটি করপোরেশন রাস্তা সংস্কার ও ফুটপাত মেরামতের কাজ করে; কিন্তু গণপরিবহন পরিকল্পনা থেকে তারা প্রায়ই বাদ থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দুর্ঘটনার পর জরুরি সেবা বা ট্রমা কেয়ার সিস্টেমের কোনো অংশ নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও গণমাধ্যমকে এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সচেতনতা বা শিক্ষামূলক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এ অবস্থায় দুর্নীতি ও স্বার্থান্বেষী মহল সহজেই প্রভাব বিস্তার করে। মালিক সমিতি বা শ্রমিক সংগঠনের চাপ, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় আর ঘুষের সংস্কৃতি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে বারবার বিফল বা স্তিমিত করে। এর ফলে জনগণের জীবন ঝুঁকিতে থেকেও কার্যকর কোনো জবাবদিহি নেই।
এই মুহূর্তে ঢাকা শহরটাকে এক ধরনের নরকে পরিণত করেছে নতুন আপদ হিসেবে বিবেচিত ব্যাটারিচালিত রিকশা। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী শহর। এই শহরের সৌন্দর্য, সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, এই শহরের রাস্তায় নির্বিঘ্নে নিরাপদে চলাফেরা, এই শহরের আভিজাত্য, এই শহরের আন্তর্জাতিক মান- সব সবকিছুই ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা। একসময় এই ব্যাটারিচালিত রিকশা শহরের প্রধান সড়কে চলাচল করতে পারত না। কেবলমাত্র পাড়া-মহল্লার অলি-গলিতে চলাচল সীমাবদ্ধ ছিল। বিগত শেখ হাসিনার শাসনামলে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা চালক-মালিকরা মিলে আন্দোলন করে শহরের সব রাস্তায় এগুলোর অবাধ চলাচলের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করলেও তারা শহরের প্রধান সড়কে এই সব ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি পায়নি। তখন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল এদের চলাচল। কিন্তু শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চলা জুলাই আন্দোলনের সময় এই ব্যাটারিচালিত রিকশা কোনো আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে ঢাকা মহানগরীর সব রাস্তায় অবাধে চলাচল শুরু করে দেয়। তখন নিয়ম শৃঙ্খলা ছিল না দেশে। কেউ বাধা দেয়নি তাদের। কিন্তু সেই থেকে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা গেড়ে বসেছে যেন, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহরের সব প্রধান রাস্তা। এদের দাপটে রাস্তায় অন্যান্য সব যানবাহন ঠিকঠাক মতো চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। অদক্ষ, অপরিপক্ব, অনভিজ্ঞ, উৎশৃঙ্খল চালকের কারণে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। এইসব ব্যাটারিচালিত রিকশায় যারা যাত্রী হচ্ছেন তাদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় যাতায়াত করতে হচ্ছে। আজকাল পায়ে প্যাডেলচালিত রিকশা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে ওই আপদ ব্যাটারিচালিত রিকশা দোর্দণ্ড দাপটে। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই যেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না তাদের। এক ধরনের অসহায়ত্ব ভাব ফুটে উঠেছে নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়। সবাই দেখছেন, উপলব্ধি করছেন, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এই ব্যাটারিচালিত রিকশা অবাধে চলাচলের কারণে সৃষ্ট যানজট, যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ইত্যাদি। অথচ কেউই কিছু করতে পারছেন না। এর চলাচল শুধু পাড়া-মহল্লার অলি-গলিতে সীমাবদ্ধ থাকার কঠিন আইনের বিধান বলবৎ করার জোর দাবি জানাচ্ছি। এরা ট্যাক্স, ভ্যাট ছাড়া প্রধান সড়কগুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । একসময় পুরো রাস্তা যেন তাদের দখলে চলে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। তখন আর কিছু করার থাকবে না। বাংলাদেশ পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ যদি এদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা না নেয় একসময় আর ট্রাফিক পুলিশের প্রয়োজন হবে না রাস্তায়।
যত বড় কাঠামোই তৈরি করা হোক, তা সফল হবে না, যদি না আমাদের নাগরিক আচরণ বদলায়। বর্তমানে বাংলাদেশের রাস্তায় প্রভাবশালী মানেই জয়ী। লালবাতি মানা হয় না, অ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকে, পথচারী হয় বিপন্ন। একটি নতুন সড়ক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে পথচারীর অধিকার সংরক্ষিত হবে; অ্যাম্বুলেন্সকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে; শিশুরা নিরাপদে বাইসাইকেল চালাতে পারবে; বয়স্করা নিশ্চিন্তে ফুটপাতে হাঁটতে পারবে; এসব শুধু দুর্ঘটনা কমাবে না, নাগরিক জীবনে সহমর্মিতা ও আস্থাও ফিরিয়ে আনবে। রাষ্ট্রকে কখনো না কখনো ভাবতেই হয়, নগরের সড়ক এবং উন্মুক্ত স্থানগুলোয় নাগরিকদের কী দেওয়া উচিত অথবা সর্বসাধারণের এসব থেকে কী পাওয়ার কথা? আমরা তো আমাদের রাস্তাঘাটকে দৈনন্দিন অবিচার বা নৈরাজ্যের প্রতীক হয়ে থাকতে দিতে পারি না। কিন্তু এই সবই অর্থহীন হবে যদি আমরা বর্তমান বিশৃঙ্খলতার ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় থাকি। কারণ, দিন শেষে সড়ক ও যানজট আসল সমস্যা নয়- এসবের ব্যাপারে অবজ্ঞাই হলো মূল সমস্যা। এবং আমরা সবাই মিলে এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ বেছে নিতে পারি। এটি শুধু যানজট কিংবা সড়কের প্রশ্ন নয়, বিশ্বায়নের এই যুগে এটি আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রশ্ন। সিদ্ধান্ত এখন আমাদের হাতে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলামিস্ট।
পরিমিতিবোধ সবসময় সুখকর। সীমার বাইরে সবকিছু প্রত্যাশার অতীত। জল যেমন দুকূলের ভেতর দিয়ে বয়ে গেলে নদী হয়, কূল ছাপালে বন্যায় রূপ নেয়, একসময়ের শান্ত, সুদৃশ্য প্রিয় দরিয়া হয়ে ওঠে বেদনা-দায়ী, সর্বনাশী বানভাসী জলের উচ্ছ্বাস.. আগুনের ব্যাপারও তেমন। অল্পতাপে শীতের আরাম। বেশি শিখায় বন পুড়ে ছাই। সে হোক না মন কিংবা সঘন পাতার, বৃক্ষঘন বন। তবে অল্প, নিয়ন্ত্রিত আগুন-রূপী আলো অন্ধকারের বিপরীতে স্বচ্ছ-উদার।
কথায় আছে, “Keep a little fire burning, however small, however hidden.”(Cormac McCarthy)./ “The most powerful weapon on earth is the human soul on fire” (Ferdinand Foch / “One must never let the fire go out in one’s soul, but keep it burning.” (Vincent Van Gogh)| প্রেরণার আগুন প্রজ্জ্বলিত রাখা শুধু উচিতই নয়, আবশ্যকও। সেই উদ্দীপনার শিখা যত ছোট কিংবা যত গোপন হোক না কেন, তা জীবন্ত রাখা জরুরি। যে জিনিসে চলমানতা নেই, চঞ্চলতা যার স্বভাবের সংগে সামঞ্জস্য বয়ে আনে না, তাতে অবসন্ন সময়ের শেওলা জমে। থির পাথরের মতো পড়ে থাকে গহীন অরণ্যে কিংবা জানার বাইরে, সবার চোখের আড়ালে। এইকথা প্রযোজ্য হয়, ব্যক্তি-প্রতিভা থেকে নিয়ে পরিবার, সমাজ অথবা আরও বড় পরিসরে।
তবে সমস্যা হয় তখনই, যখন উৎসাহ-রূপ উত্তাপ রূপ নেয় সীমাহীন স্বার্থপরতায়। আত্মতুষ্টির অশান্ত আগ্রহে উপকারী উপাদানটিকে ব্যবহার করে ফেরে শোভন-সীমা না মনে রেখেই। চুলোর আগুন চালে নিয়ে আসে স্বার্থপরেরা। সম্প্রতি দেশে ধারাবাহিক আগুন-ঘটনা এবং জান ও মালের বিস্তর ক্ষতিতে কোনো অন্তর অক্ষত থাকতে পারে না। দুর্ঘটনা কারও মুখ চেয়ে আসে না। তবে যেসব ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত অশান্তি সৃষ্টির ইশারা মেলে, সেগুলো তদন্তের দাবি রাখে। চোখের দীপ্তি নিভে গিয়ে অপরাধীদের হৃদয়ে জ্বলতে থাকে সর্বনাশের শিখা। সেখানে তারা আপন-পর দেখে না। নিজ দেশের, নিজ জাতির মানুষ, কিংবা স্বদেশের সুরক্ষিত সম্পদ তাদের কাছে ছাই মনে হয়। বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ পরায়ণতায় ভুলে যায় মানুষ হিসেবে হিতকর কী কী করণীয় তাদের সৃষ্টি জগতের প্রতি। নিশ্চিত না জেনে, কাউকে সন্দেহবশত দোষারোপ করা সঠিক নয়। তবে ঘটনা-পরম্পরা ও প্রকৃতি আভাস দেয়, এ নিছক দুর্ঘটনা নাও হতে পারে। তখনই আসে, ব্যাপক তদন্ত ও কারণ অনুসন্ধানের।
একসময় দেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে ঘন ঘন আগুন লেগে যেত। কত যে নিরিহ শ্রম-প্রাণ নারী-পুরুষ পুড়ে মারা গিয়েছেন তার সঠিক খবর নেই। গুমোট পরিবেশ, বিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগ ব্যবস্থা, বিপদে-নিরাপদে কর্মচারীদের দ্রুত বের হয়ে আসার অপর্যাপ্ত ও অব্যবস্থা, ইত্যাদি কারণে গার্মেন্ট বা অন্যান্য মিল কারখানাগুলোতে আগুন লেগে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির খবর ছড়িয়ে পড়ত প্রায়ই। অনার্স প্রথম বর্ষের সময় ধানমন্ডি ভূতের গলিতে থাকাকালে, পাশেই দেখতাম, হামিদ গার্মেন্টে কীভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। সেখানে, নারীরাই কাজ করতেন বেশি। টিউব লাইটের আলোয়, নানা রঙের কাপড় খণ্ডের সংগে সংগে তাদের শ্রমজীর্ণ মুখমণ্ডলও চিক চিক করে উঠত ঘামে, উজ্জ্বল আগুনের শিখার মতো। সৌভাগ্য ও সুখের বিষয়, সেই স্থানে সবসময় সুন্দর, সাবলীল ও শালীন পরিবেশ দেখেছি। আগুন তাদের স্পর্শ করতে পারেনি।
মাটির বাড়ির খড়ের চালে আগুন ধরে যাওয়া একসময় সাধারণ দৃশ্য ছিল গ্রাম গ্রামান্তরে। বিশেষ করে রান্নাঘর থেকে শুরু হতো আগুন। চুলায় রান্না রেখে হয়তো মা দুধের শিশু ঘুম থেকে উঠে পড়ার কারণে, তাকে আনতে গিয়েছেন, বা আবার ঘুম পাড়াতে গিয়েছেন অন্য ঘরে, এদিকে পাটকাঠির ফেঁসো (পাটের ছাল ছুলে নেওয়ার পরে, পাটকাঠির গায়ে লেগে থাকা নরোম, ফোলা ফোলা পাট-সুতো, পাটের আঁশ বা সুতোর সূক্ষ্ম অংশ) বেয়ে চিলিক মেরে উঠে গিয়েছে আগুন চাল অবধি। অথবা খোলা উনুনের ফুলকি হাওয়ায় ভেসে খড়ের গাদায় গিয়ে পড়ে আগুনের উৎস হতো। কিংবা বালকেরা পাটকাঠির আগায় আগুন লাগিয়ে খেলার ছলে অগ্নিকাণ্ড ঘটাত। তখন পাড়ার লোকজন চিৎকার শোনে এগিয়ে আসত। যে যা হাতের কাছে পেত, তাতে পানি ভরে ছুঁড়ে দিত উপরে, আগুনের অস্থির দগ্ধ-লোলুপ জিহবার ওপরে। এ রকম অগ্নিকাণ্ড অপরাধহীন ও সত্যিকার দুর্ঘটনা। পরিস্থিতি ও নির্দোষ অসতর্কতার ফল। আর পাড়া প্রতিবেশীও দ্রুত ছুটে আসতেন বিপদ উদ্ধারে। কিন্তু, এমনও ইতিহাস আছে, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের চালে আগুন দিতে দ্বিধা করত না কেউ কেউ। থানায় গিয়ে মামলা করে আসত। এগুলো, নিরেট সত্য ঘটনা কোনো কোনো স্থানের। কথা হলো, অনিচ্ছাকৃত, অসতর্কতাবশত, ও পরিস্থিতির শিকারে অগ্নি-ঘটনা এবং ইচ্ছাকৃত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পরিকল্পিত অগ্নি-সংযোগের মধ্যে মিল হতে পারে না।
বৃষ্টির শীতল শান্ত আকাশে বজ্র আসে। এ এমন প্রচণ্ড শক্তিধর যে এর উৎসের এলাকায় যদি খুব ভারী প্রকাণ্ড লোহার বাক্সও এসে যায়, মুহূর্তে তা চ্যাপ্টা হয়ে যায়। এই বিদ্যুৎ আকাশে আকাশে ভেসে বেড়ালে মাটির ওপরের প্রাণী, আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। আমরা এর শব্দে, ক্রোধ-গর্জনে, আলোর চমকে ভীত হয়ে কান বন্ধ করব মাত্র। অনিষ্ট থেকে রেহাই পাবার মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকব। নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য ছুটব বড়জোর অঝোর বৃষ্টিতে পাতার স্নান দেখব। গর্জন ও আগুন বৃষ্টির জলের কুয়াশায় মিশে যাওয়ার পরে, আবারও ছড়া কাটতে কাটতে ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন করতে পারব। কিংবা, উঠোনে, নিজস্ব বৃষ্টির জল-সুতোয় বেঁধে নেব আমরা নিজেকে। উচ্ছল হাসিতে ভরে উঠবে আমাদের প্রিয় গৃহকোণ। মনে পড়ে, “you do not own the rain, or the trees, or the laws which pertain to them.” (Mary Oliver : Her Grave)
কিন্তু বিপত্তি তখন, যখন বোমার আকারে আগুন উড়ে আসে আকাশ থেকে। হিরোশিমা, নাগাসাকির কথা পৃথিবী জানে। হয়তো তখন শিশুরা ছিল ঘুমে বা স্কুলে, চাকরিজীবীরা পথে, অফিসে। বয়স্করা ফুলঘেরা বারান্দায় চায়ে মগ্ন। তখনই অবরুদ্ধ আগুন এসে ফেটে পড়ল জাপানের এই দুই জনপদে। কীরকম নিষ্ঠুরতা পোষণ করলে, এমন কাজ করা সম্ভবপর হয়! যে ব্যক্তি পারমানবিক বোমা ফেলছে, সে তো জানছে, এর পরিণতি। মুহূর্তে ঝলসে যাবে, মাটি, মানুষ, গাছপালা, আশেপাশের সবকিছু। কতটা কাল বিকলাংগ হয়ে জন্ম নিয়েছিল শিশুরা এই শহরে। তবু আমরা মানবতার কথা শুনি এইসব মানুষ-রূপীদের মুখে।
আকাশের উল্কা আমাদের দৃষ্টিতে আসে। এই উড়ন্ত আগুনের নদী-স্রোত পৃথিবীর কোথাও বয়ে গেলে সেখানে গভীর ক্ষত হয়। মাটির বুকে দীর্ঘ কলঙ্ক হয়ে দগ্ধতার দাগ এঁকে দেয়। কিছু উল্কা বা ধুমকেতু আকাশেই বিলীন হয়ে যায়। তখন তা আর আমাদের ক্ষতির কারণ হয় না। রাতের গভীরে ঝিকিমিকি তারকারাজিও আমাদের মুগ্ধ করে। তাদের গা আগুনে ভরা। অতিদূরে নিজের পথে তারা ক্রমধাবমান। এক নিরন্তর, নির্ধারিত পথে তাদের বিচরণ। আমাদের অতিআপন নিকট-আগুনের গোলক হলো সূর্য। সেও সারা অঙ্গে আগুন মেখে ঘুরে বেড়ায়। নিজের মতো করে। কখনো সুদীর্ঘ শিখা ছুঁড়ে মারে। তবে তা পৃথিবীর আাকাশে আসে না। আসে, তার প্রাণশক্তি আর প্রণোদনা। সূর্য দূর থেকেই ধরণীর প্রাণের চঞ্চলতার চিহ্ন আঁকে। সে জন্য তার অগ্নি-আশির্বাদের। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আামাদের পৃথিবী চারদিক থেকে আগুনে ঘেরা। তবু এক অপার রহস্যে, স্রষ্টার করুণায় আমাদের নিরাপদ বলয়ে বাস।
পাহাড়ের লাভা লুকোনো তার তলায়। কেউ জানে না পর্বতের ঘুমের আড়ালে কী অঢেল তরল আগুনের তৃষ্ণা। মৃত্তিকা, বনভূমি, প্রান্তর, উপত্যকা, নদী-জলাশয়, সাগর ও সমূহ সৃষ্টি.. এসবের অনড় পেরেক হয়ে, অবিশ্রান্ত প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে পর্বতমালা। তাই নিরাপদে আমাদের মালা বিনিময় হয়। সুখ-উল্লাস-হাসিতে ঘর ভরা থাকে। তবে, যখন পাহাড়ের কান্না আসে, ওঠে আসে ক্রোধরূপ লাভার উত্তাপ, তখন পুড়ে যায় ইটালির হাসি-উচ্ছ্বল পম্পেই শহর।
মানুষ বড় বিপজ্জনক প্রাণী। বাঘ, সিংহ তাদের স্বভাবগত তাড়নায়, প্রয়োজনে অন্যপ্রাণী শিকার করে। তাদের মাংস খায়। আর মানুষ পরিকল্পিতভাবে, প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ বুদ্ধির বলে নানা কৌশলে অন্যের ক্ষতি করে। প্রসঙ্গত, গাজা পরিস্থিতি বিশ্ব জানে। আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল প্রতিদিন। প্যালেসটাইনের কোনো স্থান নিরাপদ নয়। বছরের পর বছর আঁটকে রেখে অত্যাচার ও হত্যা তাদের উল্লাসের বিষয়। তবু সমগ্র পৃথিবী আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। কোনো কার্যকর কথা বা পদক্ষেপের, পন্থার বাস্তবায়ন নেই। অত্যাচারীরা ভাবে, তাদের কেউ দেখার নেই। কারও কাছেই কৈফিয়ত দিতে হবে না। তারা ভুলে যায় এইকথা ভাবতে, “See how the violets are opening, and the leaves unfolding, the streams gleaming and the birds singing. What does it make you think of?”
আমরা যেন সর্বনাশের আগুনকে নিরাপদ দূরত্বে রাখি। উপকার পাবার আশা করা যাবে তখনই। প্রকৃত শিক্ষার প্রয়োজন সে জন্য। উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস্ যেমনটা বলেছেন, “Education is not the filling of a pail, but rather the lighting of a fire.” আর নাম না জানা অন্য একজনের ভাষ্য, “Talent is a flame, Genius is a fire.” এই প্রতিভা, আগুনরূপে ধ্বংসকরভাবে ছড়ানোর নয়, বরং মানুষ হিসেবে আমাদের মনপাত্র যেন পরিপূর্ণ থাকে কল্যাণকর আগুনের আভায়। “The mind is not a vessel to be filled but a fire to be kindled.”
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রবন্ধকার।
প্রাক্তন প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, ঝিকরগাছা মহিলা কলেজ, যশোর।
পতিতাবৃত্তি শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়; এটি বৈশ্বিক অর্থনীতি, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়ে গভীর প্রভাব ফেলে। দারিদ্র্য, লিঙ্গ বৈষম্য এবং পাচার এর মূল চালিকা শক্তি।
পতিতাবৃত্তি বা যৌন ব্যবসা মানব সভ্যতার প্রাচীনতম পেশাগুলোর মধ্যে একটি। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিসর, গ্রিস ও রোমান সভ্যতায় যৌনকর্মীরা সমাজ ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। মেসোপটেমিয়ার ‘মন্দিরী’রা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, শিক্ষা এবং স্থানীয় অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকত। রোমান সাম্রাজ্যে যৌনকর্মীরা করদাতা হিসেবে নিবন্ধিত ছিলেন, এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা সীমিত হলেও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে বর্ডেল সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দারিদ্র্য, লিঙ্গ বৈষম্য এবং সামাজিক শোষণ পতিতাবৃত্তিকে প্রবলভাবে চালিত করত। ফ্রান্স, ইতালি এবং ইংল্যান্ডের শহরগুলিতে নির্দিষ্ট এলাকায় বর্ডেল পরিচালিত হতো এবং তা সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এটি কখনও ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়মের সঙ্গে সংযুক্ত, কখনও দরিদ্রতা এবং শিক্ষার অভাবে প্রসার লাভ করত।
একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়নের প্রভাবে পতিতাবৃত্তি স্থানীয় সীমা অতিক্রম করে, আন্তর্জাতিক মানবপাচার, শিশু শোষণ, মাদক ও অস্ত্র বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান এতে বিশেষভাবে প্রভাবিত। ঢাকার কাপ্তান বাজার, মুম্বাইয়ের মাদারসির বাজার, কাঠমান্ডুর স্থানীয় বর্ডেলগুলো আন্তর্জাতিক পাচারের কেন্দ্র। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও জাপান পর্যটন ও বৈধ যৌনবাণিজ্যের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে যুক্ত।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, জোরপূর্বক শ্রম ও যৌনকর্ম থেকে বছরে প্রায় ২৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়, যার ৭৩% আসে যৌনকর্ম থেকে। অর্থনৈতিক প্রভাব দুটি ভাগে দেখা যায় যা বৈধ ও অবৈধ যৌনপেশা।
নেদারল্যান্ডস (১৯৯৯), জার্মানি (২০০২), নিউজিল্যান্ড (২০০৩) যৌনকর্মকে নিয়ন্ত্রিত ও বৈধ করেছে। স্বাস্থ্যসেবা, কর এবং আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও জাপান পর্যটন এবং ‘ফাস্ট এন্টারটেইনমেন্ট’ শিল্পের মাধ্যমে বৈধকৃত যৌনবাণিজ্য পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডায় সীমিত বৈধ যৌনকর্ম রয়েছে।
বৈধ যৌনপেশা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, রাজস্ব বৃদ্ধি করে এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, নেদারল্যান্ডসে বৈধ যৌনবাণিজ্য থেকে প্রতি বছর প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ইউরো রাজস্ব আসে। জার্মানিতে এই খাত সরকারকে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ইউরো কর আয় দেয়। তবে মানবিক মর্যাদা বজায় রাখা, মানসিক চাপ হ্রাস এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।
দক্ষিণ এশিয়ার উদাহরণ: বাংলাদেশে কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন প্রকল্প চালু হয়েছে। ভারতের মুম্বাই এবং দিল্লিতে যৌনকর্মীদের জন্য পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এমন কেন্দ্রগুলো মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করে।
অবৈধ যৌনকর্ম মানবপাচার, মাদক, অস্ত্র ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র নারী ও শিশু উন্নত দেশে পাচার হয়। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে শিশু ও কিশোরদের যৌনশ্রমে ব্যবহার হয়। পূর্ব ইউরোপ থেকে নারীরা পশ্চিম ইউরোপে পাচার হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ নারী পাচারের শিকার হয়। এটি দরিদ্র দেশগুলোর মানবসম্পদকে ধনী দেশের যৌনবাণিজ্যের জন্য ‘পণ্য’ বানায়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক NGO যেমন Hope for Justice এবং ECPAT এ ধরনের চক্র ভাঙতে সক্রিয়। তবে সীমিত বাজেট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক সঙ্গতি নেই এমন এলাকায় প্রতিরোধ কার্যকর হয় না।
জাতিসংঘের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ৭০,০০০ এরও বেশি মানুষ মানব পাচারের শিকার, যার ৩৮% শিশু এবং ৩৯% নারী। মূল কারণ: দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শিক্ষার অভাব, লিঙ্গ বৈষম্য, যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং অভিবাসনের অপব্যবহার।
বাংলাদেশ: প্রায় ১ লাখ নারী যৌনপেশায় নিযুক্ত, বিশেষ করে ঢাকার কাপ্তান বাজার ও চট্টগ্রামের বর্ডেল।
ভারত: ৫ লাখের বেশি যৌনকর্মী, বিশেষত মুম্বাই, কলকাতা, দিল্লি ও হায়দ্রাবাদে।
নেপাল ও পাকিস্তান: নারী বিদেশে বিক্রি হয়, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে।
ভুটান: সীমিত, ভারতীয় বাজারে বিক্রি।
আফ্রিকা: নাইজেরিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় শিশু ও কিশোরদের জোরপূর্বক যৌনপেশায় নামানো হয়।
মধ্যপ্রাচ্য: সৌদি আরব, UAE, কাতারে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমিকদের যৌনশোষণ হয়।
ইউরোপ ও আমেরিকা: পূর্ব ইউরোপ থেকে নারীরা পশ্চিম ইউরোপে পাচার হয়।
কেস স্টাডি: ২০২৩ সালে নাইজেরিয়ার ১৪ বছর বয়সি একটি মেয়ে ইউরোপে পাচারের পরে উদ্ধার হয়। সে জানিয়েছে, ‘আমাকে দিনের পর দিন কাজ করানো হতো, না খেয়ে থাকতে হতো, মারধর হতো।’
যৌনপেশা প্রায়ই আন্তর্জাতিক অপরাধী নেটওয়ার্কের অর্থ ধোয়ার মাধ্যম। যৌনকর্মীরা প্রায়ই মাদকাসক্ত করা হয় নিয়ন্ত্রণের জন্য।
দক্ষিণ এশিয়া: আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে হেরোইন চোরাচালান যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত।
বাংলাদেশ: ফেনসিডিল ও ইয়াবা বাণিজ্য সক্রিয়।
আফ্রিকা ও ইউরোপ: যৌনপেশার অর্থ দিয়ে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়।
এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ও অবৈধ অর্থনৈতিক প্রবাহের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে। এমন চক্রের কারণে দরিদ্র দেশগুলোতে যৌনশ্রমী এবং শিশু ‘বিক্রয়ের পণ্য’ হয়ে যায়।
২০২৩ সালে Amnesty International এর জরিপে দেখা গেছে, ৬০% যৌনকর্মী একাধিকবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার।
মানসিক প্রভাব: বিষণ্নতা, PTSD, উদ্বেগ, আত্মহত্যার ঝুঁকি। শিশুদের শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এসব নির্যাতন ও মানসিক চাপ সমাজে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে।
কেস স্টাডি: বাংলাদেশের কাপ্তান বাজারের একজন যৌনকর্মী জানিয়েছেন, ‘প্রতিদিন নির্যাতন, অপমান ও মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। কোনো নিরাপত্তা নেই। স্বাস্থ্যের সমস্যা হলে সাহায্য নেই।’
নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বিকৃত হয়, শরীরকে পণ্য হিসেবে দেখা হয়। যৌনতার বাণিজ্যিকীকরণ সমাজে ভোগবাদী মানসিকতা তৈরি করে। এটি লিঙ্গ বৈষম্যকে শক্তিশালী করে এবং সমাজে নারীকে সমান মর্যাদা দেয়ার প্রচেষ্টা ব্যাহত করে।
নেতিবাচক: মানবাধিকার লঙ্ঘন, শিশু ও নারী নির্যাতন, অপরাধ বৃদ্ধি, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, অবৈধ অর্থনৈতিক প্রবাহ।
ইতিবাচক (সীমিত): স্বাস্থ্যসেবা, আইনগত তদারকি, কর্মসংস্থান, পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ সুবিধা। উদাহরণস্বরূপ, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির বৈধ যৌনবাণিজ্য কিছু অংশে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। তবে এটি মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট নয়।
আইনগত সংস্কার: কঠোর আইন প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন। যৌনকর্মীদের সুরক্ষা, পুনর্বাসন ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা।
সামাজিক সচেতনতা: শিক্ষার প্রসার, গণমাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি, নারীর মর্যাদা ও লিঙ্গ সমতার প্রতি মনোযোগ।
অর্থনৈতিক বিকল্প: দরিদ্রতা দূরীকরণের জন্য ক্ষুদ্রঋণ, স্বনির্ভর উদ্যোগ এবং যুবসমাজের কর্মসংস্থান।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: UNODC, IOM, ECPAT, CATW, UNICEF, ILO, Hope for Justice এর মাধ্যমে যৌথ কর্মসূচি।
উদাহরণস্বরূপ, IOM এবং UNICEF যৌথভাবে শিশুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র এবং পুনর্বাসন প্রকল্প চালায়।
পতিতাবৃত্তি বৈশ্বিক নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, বৈষম্য ও লিঙ্গভিত্তিক শোষণ এটিকে টিকিয়ে রাখে। মানবপাচার, মাদক ও অস্ত্র বাণিজ্যের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
কঠোর আইন প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং নারীর মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতি সম্মান নিশ্চিত করলে পতিতাবৃত্তি ও যৌনশোষণের অবসান সম্ভব। যে সমাজ নারীকে মর্যাদা দেয়, সেই সমাজেই এই অশুভ চক্র থেকে মুক্তি আসবে।
লেখক : আইনজীবী ও গবেষক।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত ইস্যুগুলোর একটি হচ্ছে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি। আগস্টের রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংঘটিত গুম, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এখন বিচারিক কাঠামোয় প্রবেশ করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ, র্যাবের দুই সাবেক মহাপরিচালকসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। এই তালিকায় ১৪ জন বর্তমান ও ১০ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার নাম রয়েছে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
এই সিদ্ধান্তে জনমনে যেমন এক ধরনের স্বস্তি এসেছে যে দীর্ঘদিনের অবিচারের দায় এখন বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে, তেমনি উদ্বেগও বেড়েছে এই বিচার যেন রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসা বা কোনো গোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রতিশোধে পরিণত না হয়। বিশেষ করে সেনাবাহিনীকে নিয়ে যেন কোনো প্রহসণ না ঘটে, সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেনাবাহিনী শুধু একটি বাহিনী নয়, এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রতীক, যার প্রতি জনগণের আস্থা দীর্ঘদিনের।
অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে সেনাবাহিনীকে যে পরিসরে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আগামী দুই মাসের জন্য বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৯৮ সালের ১২(১) ধারার অধীনে প্রদত্ত এই ক্ষমতা জনস্বার্থে অবিলম্বে কার্যকর হয়েছে। এর ফলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এখন ফৌজদারি কার্যবিধির ৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ ও ১৪২ ধারার অধীনে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। তবে তারা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে দায়িত্ব পালন করবেন।
সাবেক সচিব এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার এই সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী বলে মন্তব্য করেছেন। তার মতে, দেশের স্বার্থে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার প্রয়োজনে এমন সিদ্ধান্ত অতীতেও নেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি একই সঙ্গে সতর্ক করে বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী যেন বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকে, এবং যা প্রয়োজন শুধু সেটুকুই প্রয়োগ করে।’ এই বক্তব্যের মধ্যেই নিহিত আছে মূল উদ্বেগের জায়গা—ক্ষমতার সীমা ও ব্যবহারের ভারসাম্য।
অন্যদিকে, সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে যে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, সেটিকে কেন্দ্র করে দেশে এখন বিতর্ক তুঙ্গে। কেউ বলছেন, এটি অতীতের অপরাধের ন্যায্য বিচার; কেউ আবার দেখছেন এতে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা। বিশেষ করে যখন ১৫ জন কর্মরত কর্মকর্তা হেফাজতে নেয়া হয়, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় গুজব ও প্রচারণা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেছেন, ‘এই ঘটনাটি যেভাবে জনসম্মুখে প্রচার করা হয়েছে, তাতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।’ তার মতে, সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছে, তা রক্ষায় এখন সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রয়োজন।
অন্যদিকে বিশ্লেষক ড. আব্দুর রব খান ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখছেন। তার মতে, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, এবং এতে সেনাবাহিনীকে আলাদা করে দেখার কোনো কারণ নেই। বরং আইনানুগ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করে সেনাবাহিনী প্রশংসা কুড়াবে।’
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, সেনা কর্মকর্তাদের বিচার করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের রয়েছে। তার ভাষায়, ‘আইনের সাধারণ বিধান হচ্ছে, আসামিকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হয়। এরপর আদালতই নির্ধারণ করবেন তারা কোথায় থাকবেন।’
এই বক্তব্য কিছুটা আশ্বাসবাণী হলেও, একটি মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যায়—সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য যদি অপরাধে অভিযুক্ত হন, তবে তার বিচারের এখতিয়ার কোথায়? সামরিক আদালত নাকি বেসামরিক আদালত? সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এ বিষয়ে স্পষ্ট বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীর সদস্য পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অপরাধ করলে তার বিচার সামরিক আইনে হবে। কিন্তু সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ করলে তাকে বেসামরিক আদালতে বিচার করা যাবে। অতীতে নারায়ণগঞ্জ সাত খুন ও বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় এমন নজির আছে।’
অর্থাৎ, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিচার প্রক্রিয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে বাস্তবতার দিক থেকে এটি সংবেদনশীল। সেনাবাহিনী একটি শৃঙ্খলাপরায়ণ প্রতিষ্ঠান, যেখানে আস্থার বন্ধনই সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই আস্থায় আঘাত লাগলে পুরো প্রতিষ্ঠানের মনোবল দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তাই বিচারপ্রক্রিয়া যতটা আইনি, ততটাই রাজনৈতিক ও নৈতিক সংবেদনশীলও।
বিএনপির অবস্থানও এখানে দেখার বিষয়। দলটি বলেছে, ‘সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য এই দেশের গর্বিত সন্তান। সীমা লঙ্ঘনকারীরা বিচারের মুখোমুখি হোক, যাতে কোনো সরকার ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীকে অন্যায় কাজে ব্যবহার করতে না পারে।’ এই বক্তব্যে যেমন ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থান দেখা যাচ্ছে, তেমনি সেনাবাহিনীর মর্যাদা রক্ষার ইঙ্গিতও আছে।
অতীতের উদাহরণ স্মরণ করলে দেখা যায়, জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন বা বিডিআর বিদ্রোহ—সব ক্ষেত্রেই সামরিক ও বেসামরিক আদালতের এখতিয়ারের প্রশ্নে দেশ একাধিকবার বিতর্কে পড়েছে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই আদালত নীতিগতভাবে বলেছে, সাধারণ নাগরিকের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার বেসামরিক আদালতেই হতে পারে।
তবে এবার বিষয়টি শুধু আইনি নয়, রাজনৈতিকভাবে গভীরতর। কারণ, শেখ হাসিনা সরকারের সময় যেসব গুম-নির্যাতন ও নিখোঁজের অভিযোগ উঠেছিল, তা শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং রাজনৈতিক দমননীতির অংশ ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে অভিযুক্তদের মধ্যে সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতি অনিবার্যভাবে প্রশ্ন তোলে তারা কী কেবল নিজেরা দায়ী, নাকি রাজনৈতিক নির্দেশে দায়িত্ব পালন করেছিলেন?
এখানেই নৈতিক প্রশ্নটি বড় হয়ে দাঁড়ায়। সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সবচেয়ে শৃঙ্খলাপরায়ণ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান। এমন একটি বাহিনীকে নিয়ে যখন বিচারিক প্রক্রিয়া চলে, তখন সেটি শুধু আইনের প্রশ্ন নয়, রাষ্ট্রের মর্যাদা ও জনগণের আবেগের প্রশ্নেও পরিণত হয়। বিচার অবশ্যই হতে হবে, কিন্তু তা যেন কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা প্রতীকী প্রদর্শনের রূপ না নেয়—এই সতর্কতা এখন সবচেয়ে জরুরি।
পাঁচ দশকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী শুধু দেশের নিরাপত্তা রক্ষাই করেনি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তারা বিশ্বের অন্যতম প্রশংসিত বাহিনী। আফ্রিকার কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান, মালি, সিয়েরা লিওন কিংবা লেবাননে তারা শান্তিরক্ষী হিসেবে যেমন পরিচিত, তেমনি মানবিক সহায়তার দূত হিসেবেও সুনাম অর্জন করেছে। ফলে ‘বাংলাদেশ’ নামটি আজ আন্তর্জাতিক পরিসরে নৈতিক বিশ্বাস, শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বের প্রতীক।
দেশের অভ্যন্তরেও সেনাবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় কিংবা মহামারির সময় এই বাহিনী সর্বাগ্রে মানবিক সহায়তা নিয়ে হাজির হয়েছে। ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারির সময় তাদের মাঠপর্যায়ের দায়িত্ব পালন ও সচেতনতা কার্যক্রম ছিল অনন্য। তার আগেও ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যা ও ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরে তারা মানুষের জীবন বাঁচাতে যে আত্মত্যাগ দেখিয়েছে, তা আজও জাতির স্মৃতিতে অমলিন।
এই ধারাবাহিকতা সেনাবাহিনীকে দেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। এমন একটি বাহিনীকে হঠাৎ বিচারিক বিতর্কের কেন্দ্রে এনে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে তা কেবল আইনি প্রক্রিয়াকেই নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা স্থিতিশীলতাকেও প্রভাবিত করতে পারে। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে বিচার প্রক্রিয়াকে এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে আইন, ন্যায়বিচার ও মর্যাদার ভারসাম্য রক্ষা পায়।
২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কিংবা ২০২৪ সালের সংকটকালেও সেনাবাহিনী দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে—তারা জনগণের পাশে থেকেছে, সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করেছে, প্রশাসনকে সহায়তা করেছে। আন্তর্জাতিক মহলেও স্বীকৃত, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পেশাদার ও স্থিতিশীল বাহিনীগুলোর একটি। এই বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার যদি হয়, তা হতে হবে প্রমাণনির্ভর, স্বচ্ছ এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রক্রিয়ায়।
সেনাবাহিনীর অতীত গৌরব, বর্তমান পেশাদারিত্ব এবং ভবিষ্যতের দায়িত্ববোধ এই তিনটি দিক বিবেচনায় নিয়ে বিচারের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে। সেনাবাহিনী কোনো রাজনৈতিক দলের নয়, এটি জাতির। জনগণের আস্থা টিকে থাকলেই রাষ্ট্রের ভিত্তি অটুট থাকবে। তাই আজ সবচেয়ে প্রয়োজন ন্যায়বিচার ও মর্যাদার সমন্বয়। সেনাবাহিনীকে বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ করা যেতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক কৌশলের অংশ বানানো চলবে না।
বিচার যদি হয়, তা হতে হবে নিখুঁত ও নিরপেক্ষ, যেন তা প্রতিশোধ নয়, ন্যায়বিচার হয়। বিচারের নামে যদি কোনো প্রহসণ ঘটে, তবে তাতে কেবল সেনাবাহিনী নয়, গোটা রাষ্ট্রীয় কাঠামোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি, জাতীয় নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক আস্থা, সবই তখন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব এখন বেশ কয়েক দিকে। একদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর মর্যাদা ও পেশাগত শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ণ রাখা। এর জন্য প্রয়োজন আইনি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক সংযম, এবং সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ন্যায়বিচারের প্রতি আন্তরিকতা। সেনাবাহিনীকে বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ করা যেতে পারে, কিন্তু তাকে কোনো রাজনৈতিক নাটকের অংশ করা চলবে না।
বিচার হবে, কারণ অপরাধের দায় এড়ানো যায় না। কিন্তু সেই বিচার যেন হয় প্রমাণভিত্তিক, ন্যায়নিষ্ঠ, ও জনস্বার্থে পরিচালিত, এটাই আজকের জাতীয় দাবি। কারণ, বিচার যদি প্রহসণে পরিণত হয়, তবে তা শুধু সেনাবাহিনীর ক্ষতি নয়, বরং স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার ওপরই চরম আঘাত হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবে।
ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী নয়, এটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, সার্বভৌমত্ব ও মানবিক দায়িত্বের এক অবিচ্ছেদ্য প্রতীক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই এই বাহিনী দেশের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়ে এই বাহিনীর সদস্যরা প্রতিষ্ঠা করেছেন বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদার ভিত্তি।
লেখক: রাজু আলীম: কবি, সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
আমাদের গ্রিনরোডের বাসার ছাদ বাগানে প্রায় দশ বছর আগে একটি কলমের আমড়া গাছ লাগিয়েছিলাম। এই গাছ দিনে দিনে বড় হয়ে উঠে এবং বলতে গেলে বারো মাস ধরে এই ফল হতো। গত ১১/১০/২০২৫ইং তারিখ শনিবার সকালে দেখলাম গাছটির পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে অনেকে বলতে লাগলো যে, গাছে পানি বেশি দেয়া হয়েছে বলে শেকড় পচে গিয়েছে বিধায় গাছ মরে যাচ্ছে। এতে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। কেননা এতটি বছর ধরে গাছটি পরিচর্যাসহ আগলিয়ে রেখেছিলাম। তাই এর উপর বেশ মায়া হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া এই আমড়া তুলনামূলক মিষ্টি ছিল এবং ফলের দিক দিয়ে অনেকাংশে বাসার সবার চাহিদা মেটাতো। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, ছাদে নানা গাছ থাকলেও এই গাছটির প্রতি কেমন যেন বিশেষ টান ও মায়া ছিল। যাহোক, কয়েকদিনের মধ্যে গাছটি পুরোপুরি মারা গেলো। এতে মনটা এত খারাপ হলো যে কেমন যেন উদাসী হয়ে পড়লাম। বাসার সবাই বলতে লাগলো যে, মন খারাপ করে লাভ নেই; বরং এর স্থলে অন্য একটি গাছ এনে লাগাও। আমি বললাম হয়তো তাই হবে। কিন্তু এই গাছটির প্রতি, যে এতো ভালোবাসা ও মায়া; তাই এর কথা কভু ভুলতে পারবো না। এর মধ্যে ভাবলাম, এই গাছটির কথা স্মরণীয় করে রাখতে সামগ্রিকভাবে আমড়া নিয়ে একটি আর্টিকেল লেখব। আর সেই মতে হাতে কাগজ-কলম তুলে নিলাম।
বস্তুত আমড়া মৌসুমি ফল। এখানে একটি কথা বলে রাখা শ্রেয় যে, মৌসুমি গাছ পালা ও ফলের সাথে পৃথিবীর জীব হিসেবে মানুষের মিথস্ক্রিয়ার আবর্তে একটি মিল আছে। তাই মৌসুমি ফল খেলে স্বভাবতই মানুষ অনেকাংশে সুস্থ থাকে। আরেকটি কথা, আমড়া এমন একটি ফল দেখলেই তেুঁতলের মতো জিব্বায় পানি আসে। আর এই টক মিষ্টি ফল স্থানীয় ফল হিসেবে দামি ও বিদেশি আপেলের চেয়ে গুণাগুণের দিক দিয়ে তুলনামূলক বেশি এবং সস্তা। আর এতে আপেলের চেয়ে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রনের পরিমাণ অধিক। আমড়া একপ্রকার পর্ণমোচী বৃক্ষ। এর বৈজ্ঞানিক নাম স্পনডিয়াস মমবিন। এই গাছগুলো ২০-৩০ ফুট উঁচু হয়। আর প্রতিটি যৌগিক পাতায় ৮-৯ জোড়া পত্র থাকে পত্রদণ্ডে যা ৮-১২ ইঞ্চি লম্বা। কাঁচা ফল টক বা টক-মিষ্টি হয়, তবে পাকলে টকভাব কমে আসে এবং বেশ মিষ্টি এবং সুস্বাদু হয়ে উঠে। ফলের বীজ কাঁটাযুক্ত। অবশ্য ৫-৭ বছরেই মধ্যেই গাছ ফল দেয়। এই ফল কাঁচা ও পাকা রান্না করে বা আচার বানিয়ে খাওয়া যায়। এই ফল আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জন্মে। আর বাংলাদেশসহ আফ্রিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং ইন্দোনেশিয়ায় এই গাছটি পরিলক্ষিত হয়।
আমড়া কষ ও অম্ল স্বাদযুক্ত ফল। এতে প্রায় ৯০% পানি, ৪-৫% কার্বোহাইড্রেট ও সামান্য পরিমাণ প্রোটিন থাকে। আর ১০০ গ্রাম আমড়ায় ভিটামিন-সি পাওয়া যায় ২০ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ২৭০ মাইক্রোগ্রাম, সামান্য ভিটামিন-বি, ক্যালসিয়াম ৩৬ মিলিগ্রাম এবং আয়রন ৪ মিলিগ্রাম। এদিকে আমড়ায় যথেষ্ট পরিমাণ পেকটিনজাতীয় ফাইবার এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টজাতীয় উপাদান থাকে। আমড়ার পুষ্টিগুণ কোনো অংশে কম নয়। এক্ষেত্রে সম্যক ধারণার জন্য প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্য উপযোগী আমড়ার পুষ্টিগুণ।
বস্তুত আমড়া বেশ উপকারী ফল। কেননা এই ফল ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ; কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ওজন কমাতে সহায়তা করে; রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়; অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট জাতীয় উপাদান থাকায় আমড়া বার্ধক্যকে প্রতিহত করে; আমড়াতে প্রচুর আয়রন থাকায় রক্ত স্বল্পতা দূর করতে বেশ কার্যকর; বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে আমড়া উপকারী; দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া, দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়ার মতো সমস্যা প্রতিরোধে আমড়ার ভূমিকা অনন্য; আমড়ায় প্রচুর ভিটামিন সি থাকে বিধায় এই ভিটামিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। বিভিন্ন রকমের ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, সর্দি, কাশি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে দূরে রাখে উপকারী এই ফল; হাড় ও দাঁতের গঠনে সহায়তা করে আমড়ায় থাকা ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সি। এছাড়া ভিটামিন সি ত্বক সুস্থ রেখে বয়সের ছাপও কমায়; আমড়া খেলে মুখে রুচি বাড়ে, দূর হয় বমি বমি ভাবও; আয়রন শরীরের জন্য অপরিহার্য একটি অত্যাবশ্যক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ও রক্ত স্বল্পতা এবং অন্যান্য রক্তের সমস্যা প্রতিরোধ করে। এছাড়া হিমোগ্লোবিন এবং মায়োগ্লোবিন তৈরি করতে সাহায্য করে আয়রন, যা শরীরের সমস্ত সিস্টেমে অক্সিজেন স্থানান্তর করে; আর আমড়ায় ফ্যাট ও সোডিয়াম নেই। এতে অনেক ভিটামিন ‘কে’ থাকে, যা হাড় মজবুত করতে সহায়তা করে। তাছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে যে আমড়ায় কপার থাকে বলে হাড় ও শরীরের জন্য উপকারী; আমড়া পিত্তনাশক ও কফনাশক এবং থিয়ামিন নামের একটি উপাদান থাকে, যা মাংসপেশী গঠনে ভূমিকা রাখে। এই উপাদানের ঘাটতি হলে পেশী দুর্বল হওয়াসহ বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়।
বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় বলতে গেলে আমড়া গাছ জন্মে। তবে সিলেট বিভাগের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ; খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর ও বরগুনা; চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও রাঙ্গামাটি; ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেত্রকোনো, শেরপুর ও জামালপুর এবং ঢাকা ও আশে-পাশের অঞ্চল যেমন- নরসিংদী, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে অধিক জন্মে। মজার ব্যাপার হলো যে, ঢাকা রাজধানীসহ জেলা শহরের অনেক ছাদ-বাগানে অন্যান্য গাছের সাথে আমড়ার চাষ হয়ে থাকে। বস্তুত বাংলাদেশের গাছগাছালির আশে পাশে ও বাগানে মিশ্র চাষ হয়ে থাকে। মূলত উঁচু ও মাঝারি জমিতে ভালো জন্মে। এদেশে আমড়া গাছে বর্ষায় ফুল আসে। তারপর বড় হতে থাকে এবং অক্টোবর পর্যন্ত থাকে। সত্যি কথা বলতে কি, এই ফল হেমন্ত ঋতুর প্রথম সময়কাল পর্যন্ত দেখা যায়। আর এই সময় ফল পাকে। মজার ব্যাপার হলো যে, কিছুটা বড় হলে বাজারে আসতে থাকে, যা অক্টোবর পর্যন্ত বাজারে পরিলক্ষিত হয়। ফলের দোকানে অন্যান্য ফলের সংগে এটি শোভা পায়। এই ফল মুখরোচক এবং দামে সস্তা বলে বাঙালিরা বেশ তৃপ্তি সহকারে খেয়ে থাকে। আর পরিবারের ছোট বড় সবারই পছন্দ। আরেকটি কথা, শহর-বন্দর, বাস ও রেলওয়ে স্টেশনে কিছু ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা আমড়াগুলো ফুলের মতো কেটে, তাতে লবন ও মসলা মিশিয়ে পিচ আকারে বিক্রি করে থাকে।
পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, দেশি ফল হিসেবে আমড়াকে গুরুত্ব দেয়া সমীচীন। কেননা গুণাগুণের দিক দিয়ে আঙ্গুর ও আপেলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাই এই আমড়া গাছ চাষে আমাদের আরও মনোযোগী হওয়া অপরিহার্য।
লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার এখনও বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি- ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ভুটানের মূল্যস্ফীতি হবে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারতের ৪ শতাংশ, মালদ্বীপের ২ দশমিক ৫ শতাংশ, নেপালের ৪ দশমিক ২ শতাংশ। শ্রীলংকায় গত অর্থবছর মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১ দশমিক ২ শতাংশ, চলতি বছরে দেশটিতে কোনো মূল্যস্ফীতি নাও হতে পারে। মালদ্বীপ ও নেপাল মূল্যস্ফীতির লাগাম টানায় এগিয়ে রয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনামের মূল্যস্ফীতি হবে ৩ দশমিক ২ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়ার ২ দশমিক ৯ শতাংশ যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। অপরদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। করোনা মহামারির আঘাত ও বৈশ্বিক মন্দার ছোবল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারেনি। দেশকে এখনো নিম্ন জিডিপির প্রবৃদ্ধির গতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ভুটানের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারতের ৬ দশমিক ২ শতাংশ, নেপালের ৫ দশমিক ২ শতাংশ। রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ যা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের সমান প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার জন্য। দেশটির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অতছ বাংলাদেশ এখনো ৪ শতাংশের রয়েছে। আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখনও প্রাইমারি ব্যালেন্সের স্থিতি চলতি অর্থবছরেও নেতিবাচক থাকবে। বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতিতেও চাপে থাকতে হবে।
অপরদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শেষে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ হবে। যা আগামী ২০২৬ সালে অর্থবছর শেষে ৫ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। যদিও পোশাক রপ্তানি স্থিতিশীল রয়েছে, তবুও ধীর প্রবৃদ্ধির অনুমান চলমান মূলত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে। অন্যদিকে বারবার বন্যা, শিল্প শ্রমিক বিরোধ এবং ক্রমাগত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে দেশীয় চাহিদা হ্রাস পেয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। এডিবি জানায়, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার ওপর এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধি নির্ভর করবে। বাংলাদেশের বাণিজ্যের ওপর মার্কিন শুল্কের প্রভাব এখনো দেখা যায়নি এবং ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা রয়ে গেছে। উচ্চতর অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা অর্জনের জন্য এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা অপরিহার্য। ২০২৬ অর্থবছরের দৃষ্টিভঙ্গির কিছু নেতিবাচক ঝুঁকি রয়ে গেছে। বাণিজ্য অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং সম্ভাব্য নীতিগত স্থিতিস্থাপকতা অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বিচক্ষণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বজায় রাখা এবং কাঠামোগত সংস্কার ত্বরান্বিত করা জরুরি। মূলত টেকসই উন্নয়নে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এডিবি আরও জানায়, পাইকারি বাজারে সীমিত প্রতিযোগিতা, অপর্যাপ্ত বাজার তথ্য, সরবরাহ শৃঙ্খলের সীমাবদ্ধতা এবং টাকার দুর্বলতার কারণে মুদ্রাস্ফীতি ২০২৪ অর্থবছরের ৯ দশমিক ৭ ৭ শতাংশ থেকে ২০২৫ অর্থবছরে ১০ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি হিসাবে ২০২৫ অর্থবছরে জিডিপির ০ দশমিক ০৩ শতাংশের সামান্য উদ্বৃত্ত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা ২০২৪ অর্থবছরে জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশ ঘাটতি থেকে বেশি, যা বাণিজ্য ব্যবধান সংকুচিত এবং শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ দ্বারা সমর্থিত।
সরকারি হিসাবে প্রায় এক দশক ধরে দেশের প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৭ শতাংশের ওপরে, যা ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চীন ও ভারতসহ উন্নয়নশীল প্রায় সব দেশের প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যায়। এর সুবাদে বাংলাদেশকে ‘এশিয়ান টাইগার’ খেতাবও দেয়া হয়। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকলেও সে অনুপাতে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়েনি। শিল্পের প্রসারও সেভাবে চোখে পড়েনি। আবার বিশ্বব্যাংক ও এডিবিরি মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা সময়ে প্রশ্ন তুলেছিল। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যেই গড়ে সাড়ে ৩ শতাংশীয় পয়েন্টের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ যখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতার মুখ দেখছে, তখন বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) বৃদ্ধির পরিকল্পনা বর্তমান পরিস্থিতিতে কতটা যৌক্তিক তা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন। কারণ, এমন উদ্যোগ মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দিতে পারে, ফলে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় না হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণের সুদহার এবং নীতি সুদহার প্রায় দ্বিগুণ করেছে। এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী হলেও, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সেভাবে কার্যকর হয়নি। বরং মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। তদুপরি, আইএমএফের শর্ত পূরণে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। একই সঙ্গে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য নয়, বরং রাজস্ব বাড়ানোর স্বার্থেই ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে ৪৩টি পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে নিত্যপণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১৩.৮০ শতাংশ। যদিও জুলাইয়ে এটি ছিল ১৪.১০ শতাংশ, সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ১১.৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ, গত বছরের নভেম্বরে ১০০ টাকায় যে পণ্য পাওয়া যেত, এ বছরের নভেম্বরে সেটি কিনতে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা প্রয়োজন। অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভারতের মতো দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতির হার ৭০ শতাংশে পৌঁছালেও এখন তা ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এক বছর আগে ২৭ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতি এখন কমে ৯.৬৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম মূল্যস্ফীতি বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় (০.৫ শতাংশ)। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন মালদ্বীপে (১.৪ শতাংশ)। এরপর ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তান রয়েছে। ভারতের মূল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশে স্থিতিশীল। বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকট কাটাতে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও বৈদেশিক মুদ্রাবাজার কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারকদের আরও সতর্কভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা, যাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দাম কমাতে বেশ কিছু পণ্যের শুল্ক ছাড়সহ আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, পাশাপাশি বাজার অভিযান জোরদার করেছে। একসঙ্গে মাঠে নামানো হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তিন উপসচিবের নেতৃত্বে তিনটি টিম। জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের টিমও ঢাকাসহ সারাদেশে নিয়মিত বাজার তদারকি করছে। এছাড়া প্রতিযোগিতা কমিশন, বিএসটিআই, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও নড়েচড়ে বসেছে। একই সঙ্গে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কম দামে বেশ কিছু নিত্যপণ্য বিক্রি শুরু করেছে এবং খাদ্য অধিদপ্তর ভর্তুকি মূল্যে চাল-আটা বিক্রি শুরু করেছে। আবার সরকার প্রতিবেশী দেশ থেকে ডিম, আলু, পেঁয়াজ, চাল এবং কাঁচামরিচের আমদানিও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তবুও সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আসছে না পেঁয়াজ ও আলুর দাম। এরই মধ্যে আমদানি করা পেঁয়াজে কাস্টমস শুল্ক ও রেগুলেটরি শুল্ক অব্যাহতি এবং আলুর আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার পাশাপাশি ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক তুলে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরপরও খুচরা বাজারে চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ দুই পণ্য।এখানে উল্লেখ্য যে সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপড়েন ভারত থেকে খাদ্যপণ্য আমদানিতে বাধা সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিঢয়ছে যা বাজার পরিস্থিতিকে আরও সমস্যায় ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে । বাজারে আমনের নতুন ধান উঠেছে। উৎপাদনও আশানুরূপ। ১০ দিনের মধ্যে ধানের দাম মণপ্রতি কমেছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা। এরপরও চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে ক্ষোভ বাড়ছে ভোক্তাদের। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ বাড়ানো জরুরি। শুল্ক কমানো হলো; কিন্তু আমদানি বাড়ল না- তাতে সুফল পাওয়া যাবে না। চাল, পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের বাজারে শুল্ক কমানোর পরও আশানুরূপ আমদানি না আসায় বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না বলে মনে করেন তারা। এ ব্যাপারে (ক্যাব) সাবেক সভাপতি বলেন, কর কমানো একটি উপায় হলেও বেশির ভাগ সময় তা সুফল দেয় না। আমি মনে করি, নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা ও এ ব্যাপারে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনাটা জরুরি। চাঁদাবাজিও বন্ধ করতে হবে। একদল চাঁদাবাজি করে চলে গেছে, আরেক দল চাঁদাবাজি করার দায়িত্বে এসেছে- এটাকে যদি সরকার স্বাভাবিকভাবে নেয়, তাহলে আমার বলার কিছু নেই। সরকারের পরিবর্তন হলেও খেলোয়ারের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে মহান মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের সদস্য অসামান্য অবদান রেখে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের সবাই সেনাবাহিনীরই সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই থেকে শুরু করে জাতির বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে জাতির ভরসা এই সেনাবাহিনী এগিয়ে এসেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সবার আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছে। এখন কোথাও কোনো সমস্যা সংকট সৃষ্টি হলে সবাই সেখানে সেনবাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সেই সংকট নিরসনে সেই সংকট থেকে উত্তরণে তাদের শক্তিশালী ভূমিকা পালন প্রত্যাশা করে একান্তভাবে। ঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় , নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অপরাধী, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে সেনাবাহিনী সবসময় প্রশংসনীয় অবদান রেখে দেশের সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে এক গৌরবময় আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। প্রশংসা ও সুনাম বয়ে এনেছে দেশের জন্য। চব্বিশের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারী ছাত্র জনতাকে জোর করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমনের জন্য স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারি দুঃশাসনের প্রধান হোতা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার অন্যায়মূলক নির্দেশ উপেক্ষা করে ছাত্র জনতার আন্দোলনকে সফল করতে ঐতিহাসিক গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশ ও জাতির স্বার্থে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন।
আজকাল সেই সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে নানা ধরনের গুজব, অপপ্রচার, ষড়যন্ত্রমূলক খবর প্রচার চালানো হচ্ছে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। যা দুঃখজনক। আমাদের সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে এমন সব খবর ছড়ানো হচ্ছে যার কোনো সত্যতা নেই। ভিত্তিহীন, বানোয়াট খবর প্রচার করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। জনমনে সেনাবাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে একটি মহল। এটা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, শান্তি, শৃঙ্খলা, সংহতি, স্থিতিশীলতা বিনষ্টের লক্ষ্যে সুগভীর চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।
পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম সরকারের তাবেদারি করায় গণমাধ্যমের খবরের প্রতি মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতায় ভাটা পড়ে। মত প্রকাশ, কথা বলা এবং ভাবের আদান-প্রদানে সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ অনেকগুলো আন্দোলন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণায় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণায় দলমত নির্বিশেষে রাস্তায় নেমেছিল। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সমাজ জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে এই প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহারও কম হচ্ছে না। যা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। এক শ্রেণির মানুষ সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে অপপ্রচার, কুৎসা রটানো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার, সহিংসতার ভুল তথ্য প্রচারে গুজব ছড়াচ্ছে। এতে সমাজে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর পর থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় অসংখ্য ‘গুজব বাহিনী’ গড়ে তোলা হয়েছে। তারা কখনো পতিত স্বৈরাচার হাসিনার হয়ে কখনো দিল্লির হয়ে কখনো দেশের একাধিক রাজনৈতিক দলের হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একের পর এক গুজব ছড়াচ্ছে। খুবই পরিকল্পিত এবং সুচিন্তিতভাবেই কখনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের গুজব, কখনো অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে গুজব, কখনো প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের মধ্যে বিরোধের গুজব, কখনো ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে গুজব, কখনো মহামান্য প্রেসিডেন্টকে নিয়ে গুজব, বিভিন্ন সময় নানা ঢংয়ে ছড়ানো হয়। গুজববাজরা অনেকটা কবি শামসুর রাহমানের ‘কান নিয়েছে চিলে’ কবিতার মতোই গুজব ছড়াচ্ছে এবং এক শ্রেণির মানুষ সেটাকে ইস্যু করে প্রচার প্রচারণায় শরিক হয়ে লাইক, শেয়ার ও মন্তব্যজুড়ে দিচ্ছেন। এই ঘৃণ্য গুজব বাহিনীর সর্বশেষ টার্গেট হয়ে উঠেছে আমাদের গৌরব বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সেনাবাহিনীর সাবেক ১০ জন এবং বর্তমানে কর্মরত ১৫ জন মোট ২৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। চিহ্নিত কিছু গুজববাজ কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ইউটিউবার, বিদেশে অবস্থানরত কয়েকজন সাংবাদিক, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও দেশের একাধিক রাজনৈতিক দলের বট বাহিনী ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার, ইউটিউবার প্রচারণা চালায় অন্তর্বর্তী সরকার আর সেনাবাহিনী মুখোমুখি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কয়েকজন সেনা সদস্যকে আসামি করায় সেনাবাহিনী ক্ষেপে গেছে। যে কোনো সময় দেশে অঘটন ঘটে যেতে পারে। ইত্যাদি, ইত্যাদি। বিদেশি আধিপত্যবাদী শক্তির এজেন্ডায় ছড়ানো এ গুজব প্রচার করে শেষ পর্যন্ত গুজববাজরা ধরা খেয়েছে। তাদের মুখে ছাই দিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। খোলাখুলি কথা বলে তারা সেনাবাহিনীর অবস্থান সুস্পষ্ট করেছেন। এক আদেশের মাধ্যমে চাকরিরত ১৫ জন এবং এলপিআর ভোগরত ১ জনসহ মোট ১৬ কর্মকর্তাকে ৯ অক্টোবরের মধ্যে সেনা হেফাজতে আসতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এলপিআর ভোগরত কর্মকর্তাসহ ১৫ জনকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেনা হেফাজতে নিয়ে আসা হয়েছেও। সেনাবাহিনীর এই স্মার্ট সিদ্ধান্তের ফলে তথাকথিত গুজববাজদের দেশে বিশৃংখলা সৃষ্টির স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে।
সেনাবাহিনী একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ। দেশের প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে বারবার সেনাবাহিনী এগিয়ে এসেছে। বিশাল সংখ্যার সেনাবাহিনীতে কয়েকজন কর্মকর্তার অপরাধের দায় কখনো সেনাবাহিনী নেয়নি। এবারও নিচ্ছে না। সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেছেন, সংবিধান স্বীকৃত বাংলাদেশের সব আইনের প্রতি সেনাবাহিনী শ্রদ্ধাশীল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ও সেনা আইন মুখোমুখি নয়। একটা বনাম আরেকটা এই দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা দেখা উচিত হবে না। সেনাবাহিনী দ্ব্যর্থহীনভাবে বিচারের পক্ষে অবস্থান করে। সেনাবাহিনী ন্যায়বিচারের পক্ষে। আমরা বিশ্বাস করি, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। গুমের শিকার পরিবারগুলোর প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।
আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী দেশ ভারতের অ্যাজেন্ডা বস্তবায়নে ভার্চুয়াল এ মিডিয়াগুলো এখন যেন গুজবের কারখানায় পরিণত হয়েছে। পতিত স্বৈরাশাসক শেখ হাসিনা যেমন ১৪০০ ছাত্রজনতাকে হত্যা করে পালিয়ে দিল্লি যাওয়ার পর থেকে তার এবং দোসরদের পাচার করা অর্থ ব্যয়ে বট বাহিনী গঠন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে; তেমনি ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কন্টেন্ট ক্রিয়েটর অন্তর্বর্তী সরকার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যেতে পারবে না দেশের এমন রাজনৈতিক দল। তারা কখনো আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে দিল্লির এজেন্ডা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, গণভোট ইত্যাদির ইস্যুতে মাঠ গরম করছে। পাশাপাশি তারাও দেশ-বিদেশে বিশাল বট বাহিনী তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের পক্ষে এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। এটা করতে গিয়ে তারা কার্যত আইনের শাসন, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে।
এই মুহূর্তে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে নিরাপদে থেকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, তার দোসর এবং দেশের কিছু জনসমর্থনহীন রাজনৈতিক শক্তি আসন্ন নির্বাচনে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধার সৃষ্টি, সেনাবাহিনী, অন্তর্বর্তী সরকার এমনকি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে বিশেষ কিছু গোষ্ঠীকে মাঠে নামিয়েছে। তারা পরিকল্পিতভাবে একের পর এক গুজব ছড়াচ্ছে। আসন্ন নির্বাচন বিলম্বিত করতে নতুন নতুন ইস্যু সৃষ্টি করছে এবং সেটা নিয়ে দেশি-বিদেশে অবস্থানরত ষড়যন্ত্রকারী বাহিনীকে গুজব ছড়ানোর প্রচারণায় নামাচ্ছেন। আবার পাশাপাশি এই গুজব বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রচারণা চালাচ্ছে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখানে চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে একাধিক নেটিজেন লিখেছেন, পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি মাঠে মারা যাওয়ায় অনেকেই নির্বাচন পেছাতে আইন-শৃংখলার অবনতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টায় উদ্দেশ্যমূলক ভাবে গুজব ছড়াতে পারে। কেউ লিখেছেন, নির্বাচন যখন দরজায় কড়া নাড়ছে এবং মানবতা বিরোধী শত শত মামলার কার্যক্রম শুরু হয়নি তখন ভোটের আগে সেনাবাহিনী বিক্ষুব্ধ হতে পারে এমন মামলাকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার রহস্য কি? কেউ লিখেছেন, কুড়িগ্রামের বড়াই বাড়ির ঘটনার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ভারত ভালো চোখে দেখে না। ২০০৯ সালে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে সেনা হত্যা তার প্রমাণ। তাছাড়া আরাকান আর্মিকে করিডোর দেয়ার বিরোধিতা করেছে সেনাবাহিনী; এটা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত পছন্দ করেনি। অন্যদিকে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে প্রকাশ্য ও গোপনে একের পর এক বৈঠক করছেন। আবার অন্যদিকে রিফাইন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে। এ সবই কি আসন্ন নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করার চেষ্টা? নেটিজেনদের কেউ কেউ এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলামের মামলার আসামি সেনাসদস্যদের গ্রেপ্তারের দাবি, বিএনপির বিবৃতি এবং একদিন পর জামায়াতের বিবৃতি নিয়েও মন্তব্য করেন। ১১ জুলাই বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বিএনপি বিশ্বাস করে, দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব রক্ষায় সংশ্লিষ্ট অপরাধের সুষ্ঠু ও নির্মোহ বিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ন্যায়বিচার শুধু অতীতের ঘটনাগুলোর শাস্তির নিশ্চয়তা দেয় না, বরং ভবিষ্যতে যেন কেউ এমন অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি না ঘটায়, সেই নিশ্চয়তাও দেয়। আইন ও মানবাধিকারের প্রতি পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধাই হতে পারে একটি শান্তিপূর্ণ, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তি। একটি দেশের চলা উচিত ‘ল অফ দ্যা ল্যান্ড’ অনুযায়ী। কিছু চিহ্নিত ব্যক্তির দায় যেমন কোনো প্রতিষ্ঠানের উপর চাপানো উচিত নয়, তেমনি তাদের অপকর্মের কারণে সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করাও অনুচিত। আজকাল কেউ কেউ সারাক্ষণ বলে চলেছেন, তারা বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান চায় না। এরাই মূলত জনগণকে উস্কানি দিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে সামরিক অভ্যুত্থান তৈরির বা অতীতের মতো ১/১১ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। তেমন পটভূমি সৃষ্টি করতে চাইছে। এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার পেছনে কাজ করছে পার্শ্ববর্তী দেশের একটি সুসংগঠিত চক্র। তারা এমনভাবে খেলছে যে, খালি চোখে মনে হতে পারে, এরা দেশের মঙ্গলের পক্ষে কথা বলছে। কিন্তু এরা বাস্তবে সাধারণ মানুষকে উস্কে দিয়ে আত্মঘাতী কাজ করিয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে চায়। এটাই তাদের মাস্টারপ্ল্যান। সুতরাং কারও পাতানো ফাঁদে পা না দিয়ে, নিজেই সত্যমিথ্য যাচাই-বাছাই করতে হবে আমাদের সবাইকে। আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো, অপরাধ যেই করুক তার বিচার হওয়া উচিত। বিগত দিনে সেনাবাহিনীর অভিযুক্ত সদস্যের বিচার সিভিল আদালতে হয়েছে। এবারও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত সাবেক ও বর্তমান সেনা সদস্যদের বিচার হবে। নানা গুজবের মধ্যেও সেনাবাহিনী অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি নেয়ায় সহায়তা করছে। এতে সেনাবাহিনীর সম্মান বাড়বে এবং সেনাপ্রধান হিসেবে অবশ্যই জেনারেল ওয়াকার উজ জামান প্রশংসিত হবেন। সেনাবাহিনীর উজ্জ্বল ইমেজ অক্ষুন্ন রাখতে ষড়যন্ত্রকারীদের সব অশুভ তৎপরতা বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। ধ্বংস করে দিতে হবে তাদের সব নেটওয়ার্ক। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবময় ঐতিহ্য মর্যাদা ও সন্মান অটুট রাখতে আমাদের মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী সচেতন হবেন, সতর্ক থাকবেন, এটা আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের আকাশপথের প্রাণকেন্দ্র। এই বিমানবন্দর শুধু যাত্রী চলাচলের মাধ্যম নয়, বাংলাদেশের রপ্তানি-আমদানির অর্থনীতিরও মূল প্রবেশদ্বার। গত শনিবার বিকেলে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ এলাকায় হঠাৎ লাগা ভয়াবহ আগুন সেই কেন্দ্রটিকেই এক মুহূর্তে স্তব্ধ করে দেয়। ধোঁয়ার কালো স্তম্ভ আকাশে উঠে দৃশ্যমান হয় শহরের বহু স্থান থেকে। একে একে স্থগিত হয় সব ফ্লাইট, বন্ধ হয়ে যায় টার্মিনাল কার্যক্রম, দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় দমকল, নিরাপত্তা ও বিমান কর্তৃপক্ষের। এই দৃশ্য কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি, নিরাপত্তা-পরিকল্পনা ও দায়বদ্ধতার এক নির্মম পরীক্ষা।
বিমানের কার্গো টার্মিনালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা শাখাও ঘটনাস্থলে যুক্ত হয়। একটি জাতীয় কৌশলগত স্থাপনায় একাধিক বাহিনীর দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। উন্নত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ‘ইন্টার-এজেন্সি কো-অর্ডিনেশন’ বা সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রতিক্রিয়া যেভাবে অনুশীলিত হয়, সেদিকে বাংলাদেশের এই প্রতিক্রিয়া একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত রাখে। তবে ঘটনাটির প্রকৃত কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কার্গো ভিলেজের কোনো ইলেকট্রিক্যাল প্যানেল বা স্টোরেজ ইউনিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। যে এলাকায় আগুন লাগে, সেখানে বিপুল পরিমাণ রপ্তানিযোগ্য পণ্য, প্যাকেজিং সামগ্রী ও কাঠের বাক্স রাখা ছিল। এসব দাহ্য বস্তু দ্রুত আগুন ছড়িয়ে দেয়, ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগেছে দীর্ঘ। এখানেই প্রথম বড় প্রশ্ন- কার্গো টার্মিনালের মতো উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় আগুন নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধের ব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত ছিল? আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর ‘ফায়ার রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট’ প্রতিবছর হালনাগাদ করা হয়। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নিয়মিতভাবে এই মূল্যায়ন করা হয় এবং প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ জোনে থাকে স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংকলার, সেন্সরভিত্তিক অ্যালার্ম সিস্টেম ও আগুনের বিস্তার রোধক দেয়াল। শাহজালাল বিমানবন্দরের এই ঘটনায় দেখা গেছে, আগুনের খবর পাওয়া এবং প্রথম ফায়ার ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সময় লেগেছে প্রায় ১৫ মিনিট। এই সময়ই আগুন ছড়িয়ে পড়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
দুর্ঘটনার পরপরই বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ একটি ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। এই কমিটির মধ্যে রয়েছেন বিমানের ফ্লাইট সেফটি বিভাগের প্রধান, সিএএবি প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন কারিগরি বিশেষজ্ঞ। এটি প্রশাসনিকভাবে সঠিক পদক্ষেপ হলেও প্রশ্ন রয়ে যায়- এই রিপোর্ট কেবল অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনায় সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি জনসমক্ষে প্রকাশিত হবে? উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে যেমন যুক্তরাজ্য, জাপান বা কানাডায় এ ধরনের দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ্যে দেওয়া হয়। তাতে দায় নির্ধারণ, ক্ষতি নিরূপণ ও ভবিষ্যৎ প্রতিরোধের সুপারিশ তুলে ধরা হয়। জনজবাবদিহিতার সেই সংস্কৃতি এখনো আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় অনুপস্থিত।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘রয়টার্স’ ও ‘ইকোনমিক টাইমস’-এর খবরে দেখা যায়, আগুনের পর অন্তত আটটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল ও চারটি বিকল্পভাবে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে স্থানান্তর করা হয়। কয়েক ঘণ্টা স্থগিত থাকে সমগ্র বিমান চলাচল। এতে শুধু যাত্রীই নয়, বিপুল পরিমাণ রপ্তানি পণ্যÑবিশেষ করে তৈরি পোশাক ও ঔষধ সামগ্রীÑঅবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অর্থনীতির এই প্রভাব হয়তো এখনো পরিসংখ্যান দিয়ে মাপা যায়নি, কিন্তু ক্ষতিটা বাস্তবে গুরুতর। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে, যার অধিকাংশ পণ্য বিমানযোগে পাঠানো হয়। একটি বিমানবন্দর ঘন্টার পর ঘন্টা অচল থাকলে এর অভিঘাত পড়ে সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, ক্রেতা আস্থা এবং সরবরাহ-চেইন ব্যবস্থায়।
এই দিক থেকে দেখলে, একটি আগুনের ঘটনা আসলে আমাদের প্রশাসনিক পরিকল্পনার গভীর প্রশ্ন তুলে ধরে। বিমানবন্দর কেবল যাত্রীবাহী নয়, এটি অর্থনৈতিক প্রবাহের কেন্দ্রবিন্দু। অথচ তার কার্গো বিভাগে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার যথাযথ প্রস্তুতি না থাকা, নিরাপত্তা তদারকি যথাসময়ে না করা- এসবই আমাদের দীর্ঘদিনের ‘রিঅ্যাকটিভ’ প্রশাসনের প্রতিফলন। উন্নত রাষ্ট্রগুলো “প্রোঅ্যাকটিভ” ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে, অর্থাৎ দুর্ঘটনা ঘটার আগেই সম্ভাব্য ঝুঁকি শনাক্ত, প্রশিক্ষণ ও মহড়া সম্পন্ন, জরুরি বাজেট বরাদ্দ এবং বিকল্প পরিকল্পনা নির্ধারণ করে রাখে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে, হঠাৎ ফ্লাইট বাতিল ও দেরিতে তথ্যপ্রদান নিয়ে যাত্রীদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়। কেউ কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরে আটকে ছিলেন, অনেকে জানতেন না কখন ফ্লাইট ছাড়বে। আমরা দেশ হিসেবে ডিজিটালি এখনো কেন পিছিয়ে আছি, কেন রিয়েল-টাইম তথ্য ব্যবস্থার অভাব এই ঘটনার মধ্যেও চোখে পড়ে? উন্নত দেশগুলোতে বিমানবন্দরের যেকোনো সংকট মুহূর্তে যাত্রীদের মোবাইল বার্তা, অ্যাপ ও অনলাইন নোটিফিকেশনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক আপডেট দেওয়া হয়। আমাদের এখনো সে রকম নাগরিক সহায়ক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
তবে সব দিকই হতাশার নয়। এই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের শতাধিক সদস্য, বিমানবাহিনীর বিশেষ ইউনিট ও সিভিল এভিয়েশন কর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। কোনো প্রাণহানি হয়নি- এটিই সবচেয়ে বড় স্বস্তির বিষয়। দ্রুত বিমান চলাচল পুনরায় চালু করার যে প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে, তা বাংলাদেশের সক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়; উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে এমন প্রতিক্রিয়াকে নিয়মিত রূপ দিতে হবে, কেবল একবারের জন্য ঘটনাপ্রতিক্রিয়া হিসেবে নয়।
প্রসঙ্গত বলা যায়, বিমানবন্দর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় সিঙ্গাপুর, কাতার ও জাপান আদর্শ উদাহরণ। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে বছরে অন্তত ছয়বার অগ্নিনির্বাপণ মহড়া হয়, যেখানে দমকল, পুলিশ, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, এমনকি বেসরকারি এয়ারলাইনসমূহও অংশ নেয়। তাদের প্রতিটি টার্মিনালে তিন স্তরের সেফটি জোন, স্বয়ংক্রিয় সেন্সর-ভিত্তিক ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম এবং ‘ইনস্ট্যান্ট রেসপন্স প্রোটোকল’ সক্রিয় থাকে। আমাদের শাহজালাল বিমানবন্দরে যদি এমন ব্যবস্থাপনা থাকত, তাহলে হয়তো আগুনের ক্ষতি অনেকটাই কমানো যেত।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার প্রশ্নও নতুনভাবে সামনে এসেছে। যেহেতু বিমানবন্দর একটি কৌশলগত স্থাপনা, তাই এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল সিএএবি বা বিমানের দায়িত্ব নয়; বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তার অংশ। রাষ্ট্র যদি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়- বিদ্যুৎকেন্দ্র, বন্দর, শিল্পাঞ্চল-সমন্বিত নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, তাহলে যেকোনো দুর্ঘটনা মোকাবিলা সহজতর হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ‘ক্রিটিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোটেকশন ফ্রেমওয়ার্ক’ নামে এমনই একটি নীতি অনুসরণ করে, যেখানে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তাদের ঝুঁকি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা বার্ষিকভাবে সরকারের কাছে জমা দেয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমন কাঠামো এখন অত্যাবশ্যক।
অগ্নিকাণ্ডের আরেকটি মাত্রা হলো, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিমা ব্যবস্থার কার্যকারিতা। বিমানের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কার্গোতে থাকা পণ্যের একটি অংশ বীমাকৃত ছিল, তবে পুরো ক্ষতি কাভার করা সম্ভব হবে না। উন্নত রাষ্ট্রে শিল্প-বাণিজ্যিক বিমা কার্যক্রম অনেক বেশি সক্রিয় থাকে; এমনকি দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় যাতে তাদের উৎপাদন ও রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমাদের দেশে বিমা ব্যবস্থার সেই গতিশীলতা এখনো গড়ে ওঠেনি।
পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, এই ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া। উন্নত রাষ্ট্র মানে নিখুঁত রাষ্ট্র নয়, বরং ভুল থেকে দ্রুত শেখার রাষ্ট্র। জাপানের তোহোকু ভূমিকম্পের পর দেশটি তার পুরো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১-এর পর বিমান নিরাপত্তা নীতিতে বিপ্লব এসেছে। বাংলাদেশকেও এখন সেই শিক্ষা নিতে হবে- শুধু বিমানবন্দর নয়, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর জন্য ঝুঁকি মূল্যায়ন ও প্রস্তুতি প্রোটোকল তৈরি করতে হবে।
এই আগুনের ঘটনায় প্রাণহানি না ঘটায় আমরা আপাতত স্বস্তি পেতে পারি, কিন্তু এই স্বস্তিই যেন আত্মতুষ্টিতে পরিণত না হয়। আমাদের প্রশাসনকে আরও দ্রুত, সমন্বিত ও স্বচ্ছ হতে হবে। তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে, দায় নির্ধারণ করতে হবে, এবং দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তা সংস্কারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। জনগণের জানার অধিকার ও নিরাপত্তা দুটোই রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির অংশ। আজকের আগুন আমাদের জন্য কেবল আতঙ্ক নয়, বরং এক বাস্তব আয়না, যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আমরা কতটা প্রস্তুত, আর কতটা পিছিয়ে। সেই আয়নায় নিজেদের সৎভাবে দেখার সাহসটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। কারণ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া শুধু বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে নয়, বরং এমন সংকট মুহূর্তে দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা ও সময়মতো প্রতিক্রিয়া দেখানোর মাধ্যমেই সম্ভব।
লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
আমি তখন কলেজে পড়ি। স্যারের বাসায় যত সিনসিয়ারলি যাই তত সিনসিয়ারলি পড়ালেখা করি না। পুরা শহর ঘুরে বেড়ানোয় যত মনোযোগ ততটা মনোযোগ কলেজে যাওয়ায় না। তবে নিঃসন্দেহে দারুণ সময় পার করছিলাম। একদিন আমি কোনো এক কাজে রিকশায় করে ফরেস্ট ঘাটের দিকে যাচ্ছিলাম। যথারীতি রিকশা চালকের সাথে নানবিধ গল্প করছি। রাজনীতি, শহর, দেশসহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই আমাদের আলোচনায় স্থান পাচ্ছিল। রিকশা চালকের চিন্তা এবং জ্ঞান দেখে আমি বেশ মুগ্ধই হয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম যে আমাদের সমাজে আসলেই অনেক সুচিন্তাশীল মানুষ আছে যারা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটলো যেটা আমার চিন্তাশক্তিকে কিছুক্ষণের জন্যে অবশ করে দিলেও পরবর্তীতে একটা কঠিন সত্যকে জানতে সাহায্য করেছিল। ফরেস্ট ঘাটের কাছাকাছি একটা জায়গায় পৌঁছেতেই কিছু দূরে একটা জটলা মত পেলাম এবং একজন পথচারীর কাছ থেকে জানতে পারলাম তিনি আর কেউ না, শহরের সবচেয়ে কুখ্যাত টেরর (যার নাম বললে আপনারা সবাই চিনবেন)। আমি কেন যেন আর অগ্রসর হতে চাইলাম না। রিকশা চালককে ওখানেই আমাকে নামিয়ে দিতে বললাম। ঘৃণা থেকেই হোক বা অজানা শঙ্কায় হোক সে মুহূর্তে ওই মানুষটার কাছাকাছি যেতে আমার ইচ্ছা হচ্ছিল না। আমি রিকশা থেকে নেমে যখন ভাড়া মিটাচ্ছিলাম তখন দেখি আমার সেই রিকশাচালক বেশ রাগান্বিত হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক রিকশা চালককে তার হাতের বিড়িটা ফেলে দিতে বলছে। প্রায় ধমকের স্বরেই বলেছিল, ‘বিড়ি ফ্যাল ব্যাটা। সামনে একজন সম্মানিত মানুষ দেখা যায় সেটার খেয়াল নেই?’ আমি বেশ ভালো রকমের ধাক্কা খেলাম। অনেকটা বিড়বিড় করে বললাম, ‘সামনে কোনো সম্মানিত লোক আছে যে এখানে দাঁড়িয়ে এই রিকশাচালক বিড়ি খেতে পারবে না?’ তখন আমার সেই রিকশাচালক আমার উপর বিরক্ত হয়েই বলেছিল, ‘ভাইরে চিনেন না?’ আমি আর কোন কথা না বলে যতটা সম্ভব দ্রুত হেঁটে বিপরীত দিকে চলে গিয়েছিলাম। মজার বিষয় হচ্ছে আমাদের রিকশা থেকে সেই সম্মানিত(!) লোক এতটুকু দুরুত্বে ছিল যে আরেকজন রিকশাচালক বিড়ি খেলে সেটা দেখতে পাবে না। তার মানে সে ভয় থেকে কথাটা বলে নি। বরং তার চোখে মুখে এক ধরনের মুগ্ধতা দেখেছিলাম। কিছুক্ষণ আগেও যে রিকশাচালককে আমি বুদ্ধিমান, বিবেকবান মনে করেছিলাম তার প্রতি আমার দৃষ্টি ভঙ্গিটাই মুহূর্তে পালটে গিয়েছিল।
এটুকু পড়ে হয়তো অনেকেই ভাবছেন এটাতে কি আর এমন ঘটনা আছে যে এত বছর পরে এসে আমাকে লিখতে হবে? আসলে এটা আমার একটা ভিন্ন চিন্তা শক্তিকে উন্মুক্ত করেছিল। এরপর থেকে একটা বিষয় আমি খুব ভালোভাবে বুঝার চেষ্টা করি। আমরা কম বেশি সবাই নীতি কথা বলি, বিবেকের কথা বলি; কিন্তু অসৎ এবং খারাপ মানুষদের কেন এক গোপন সমর্থন দিয়ে যাই? কেন অনেক ক্ষেত্রেই সমাজের সবচেয়ে খারাপ মানুষদের একজনকে ভোট দিয়ে আমরা নির্বাচিত করি? কোনো এক ব্যাক্তি যদি অশ্লীল কথা বলে তারপরেও কেন আমরা তাকে পছন্দ করি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে ফলো করে যাই? তারচেয়েও যেটা আমাকে বেশি ভাবতে সাহায্য করেছিল যে আমাদের চোখের সামনে পরিষ্কার অনিয়ম, অন্যায় দেখতে পেলেও কেন আমরা তার প্রতিবাদ তো করিই না বরং কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা তার নীরব সমর্থনও দিয়ে যাই? আর এই অনিয়মের অংশ কিন্তু মূর্খ, জ্ঞানহীন বা অবুঝ মানুষজনই শুধু না বরং শিক্ষিত, মার্জিত, বুদ্ধিমানেরাও। কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কেন আমরা সম্মিলিতভাবে অন্যায়কে মেনে নেই?
আমরা সবসময় আমাদের স্বার্থ নিয়েই ভাবি। আমাদের কম্ফোর্ট নষ্ট হয় এমন কিছুকে ইচ্ছা করেই এড়িয়ে চলি। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে আমরা সত্য খুঁজি না, আমাদের কম্ফোর্ট খুঁজি। অর্থাৎ, যে ঘটনা বা তথ্য আমাদেরকে ডিসকম্ফোর্ট দিবে সেটাকে আমরা দেখেও না দেখার ভাণ করি। মনে করেন আপনি একটা গাড়িতে বসে আছেন। সেই গাড়িটা যদি ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করে বা কাউকে বোকা বানিয়ে আপনাকে বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে দেয় তখন কিন্তু আপনি মনে মনে খুশী হবেন। আবার ঠিক বিপরীতভাবে, আপনার পাশ দিয়ে আপনাকে বোকা বানিয়ে যদি আরেকটা গাড়ি নিয়ম ভঙ্গ করে কোন ব্যানিফিট নেয় তাহলে তার উদ্দেশে নৈতিক কথা বলবেন এবং সে যে অন্যায় করেছে সেটার জন্যে আপনি কথা শুনিয়ে দিবেন। তার মানে ন্যায় এবং সত্য আপনার স্বার্থের সাথে সমন্বয় করে চলে। কোনো অসৎ এবং খারাপ মানুষের কাছ থেকে আপনি যদি সুবিধা পেয়ে থাকেন তাহলে তার সেই অসততা আপনি মনে মনে মেনে নেবেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে তাহলে কি সবাই অন্যায়ের সাথেইে আপস করে চলে? না, সবাই আপস করে না। সংখ্যায় খুব অল্প হলেও অনেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মতামত প্রদান করে। তবে এর ফলে তাকে অনেকটাই সমাজচ্যুত হতে হয়। এখন হয়তো ভাবছেন কয়টা বিষয়ে কজনা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে? এই প্রতিবাদ শুধুমাত্র আন্দোলনে না। এর অনেক রূপ আছে। মজার বিষয় হচ্ছে সেসব প্রতিবাদীরা আইসোলোটেড হয়ে যায়, কারণ আমি আপনিই নিয়মের জালে তাদের একলা করে দেই। সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্টিং মিডিয়া সব জায়গায় দেখবেন চটুল লোকদের জয়জয়কার। যারা ন্যায়ের কথা বলছে, সমাজ ও দেশের কথা বলছে তাদের অস্তিত্ব থাকছে না। সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে ন্যায়ের কথা বলা লোকজনেরা শুধুমাত্র কোণঠাসাই হয় না, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রমণের স্বীকারও হয়।
ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে সবচেয়ে ভালো ও জনপ্রিয় ছাত্রটিই সাধারনত সবচেয়ে ভালো মিথ্যাবাদী। অন্যভাবে বললে যে যত সুন্দরভাবে গুছিয়ে এবং কনভিন্সিংলি মিথ্যা বলতে পারে সে তত জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এমনকি গবেষকরা বলেছেন যে বর্তমান সমাজে বুঝিয়ে মিথ্যা বলতে পারাটা দারুণ একটা স্কিল হিসাবে গন্য হতে পারে। যারা এই মতবাদে বিশ্বাসী না তাদের অনুরোধ করব একটু ভালো করে আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। অনেক ক্ষেত্রেই ডিসিভাররা দারুণভাবে জনপ্রিয়। তারা সুন্দরভাবে গুছিয়ে মিথ্যা বলে আমাদেরকে মিথ্যা গিলিয়ে দিচ্ছে। তাদের মিথ্যা ধরার মতো ক্ষমতা বেশিরভাগ মানুষেরই নেই। যারা মিথ্যাকে ধরতে পারছে তারা প্রতিবাদ করছে না কারণ এতে করে তারা আক্রমণের স্বীকার হবে। এটাই আমাদের সমাজের অদ্ভুত নিষ্ঠুরতা। সত্য যখন আমাদেরকে ডিসকম্ফোর্ট দেয় কিংবা আনসেটেল্ড করে দেয় তখন আমরা সত্যবাদীকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আক্রমণ করে বসি।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে কেন সত্যের চেয়ে মিথ্যা বেশি প্রসারিত এবং জনপ্রিয়। এর সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা হচ্ছে, সত্য উপলব্ধি করার জন্যে জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, সত্যকে যাচাই করে নিতে হয়। সত্য কখনো কখনো রূঢ় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্য আমাদের ডিস্কম্ফোর্ট দেয়, আমাদের স্বার্থে আঘাত হানে। অন্যদিকে মিথ্যা হচ্ছে সহজ এবং চটুল। মিথ্যাকে যাচাই করতে হয় না, মিথ্যাকে ধারণ করার জন্যে কোন জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। মিথ্যার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে মিথ্যা আপনাকে কম্ফোর্ট দিবে, কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করে দিবে না। সত্য র্যাশিওনাল আর্গুমেন্টকে উৎসাহিত করে আর মিথ্যা আবেগকে ম্যানিপুলেট করে। যেটা আবেগকে ম্যানিপুলেট করতে পারে তার জয় তো হবেই, তাই না?
কগনিটিভ ডিসোন্যান্স নামে সাইকলোজিতে একটা পরিস্থিতি আছে। এটা হচ্ছে নিজের ভেতরে নিজের আরেকটা ভিন্নমত। আমার মনে হয় কম বেশি আমরা সবাই এই সমস্যাতে ভুগি। এটার মাত্রা বেড়ে গেলে তখন হয়তো রোগাক্রান্ত হিসাবে বিবেচিত হয়। অনেক সত্যই আমরা জানি কিন্তু সেই সত্যকে আরেকটা যুক্তি দিয়ে আমরা নিজের কাছে নিজেই আশ্বস্ত হতে চাই। একটা উদাহরণ দেই যেটা আমাদের আগে আলোচনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একজন অসৎ এবং খারাপ মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই আমরা নেতা হিসাবে মেনে নেই। একজন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজকে দেখবেন পিএইচডি করা এক ব্যাক্তি ভোট দিচ্ছে। এসবই হচ্ছে কম্ফোর্ট দেয়া মিথ্যার আশ্রয় নেয়া। একজন খারাপ মানুষকে যখন আমরা সমর্থন করি তখন নিজের কাছে নিজেই যুক্তি দেই যে, অমুক তো এর চেয়েও বেশি খারাপ কাজ করেছে। তমুক তো, এই ভালো কাজটা করেনি। অতএব, আমি যে খারাপ মানুষটাকে সমর্থন করছি সেটা করাই যায়। আমাদের সমাজ নৈতিক অবক্ষয়ের এক চূড়ান্ত জায়গায় এসে উপনীত হয়েছে। আমরা নিজ স্বার্থে মিথ্যাকে আকড়ে ধরে পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে বসবাস অনুপযোগী এক সমাজ ব্যবস্থা রেখে যাচ্ছি। আমরা সম্মিলিতভাবে মিথ্যাকে মেনে নিয়েছি। আমরা সবাই কগনিটিভ ডিসোন্যান্সে সংক্রমিত।
লেখক: কথাশিল্পী ও নাট্যকার।
বর্তমানে আমাদের এই বাংলাদেশে জনসংখ্যার দিক দিয়ে পুরুষেরা এগিয়ে থাকলেও ভোটার হিসেবে পিছিয়ে আছে নারী ভোটাররা।
নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তালিকানুসারে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৬৩ লাখ ৭ হাজার ৫০৪ জন। এর মধ্যে নারী ৬ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার ৮১৯ জন আর পুরুষ ৬ কোটি ৪১ লাখ ৪৫৫ জন।
অর্থাৎ নারী ভোটারের চেয়ে পুরুষ ভোটার সংখ্যা বেশি , মাত্র ১৯ লাখ ৪ হাজার ৬৩৬ জন।
নির্বাচন কমিশন আরো বলছেন, ভোটার করার কার্যক্রম এখনো চলমান আছে। উনদের পক্ষ থেকে সর্বস্তরের জনগণকে ভোটার হতে উৎসাহিত করতে ব্যপক প্রচারণাও চালানো হয়েছে। অন্যদিকে নারী নেতৃবৃন্দরা মনে করেন, নারীরা ভোটার হলে রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণে আগ্রহ বাড়বে।তবে ভোটার বাড়লেই ক্ষমতায়ন বাড়বে এই কথা কতটুকু সত্য তা অনুমেয়। এখন শুরু হয়েছে সারাদেশে সর্বত্র নির্বাচনী প্রচারণা এবং এই প্রচারণার সর্বস্তরেই পুরুষ ভোটার দের আকৃষ্ট করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার সম্ভাব্য নমিনেশন এর আশায় দৌড়ঝাঁপ রত নেতারা, জনসভা, পথসভা, মিছিল, মিটিং ও কর্মীদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালাতে দল বদ্ধ ভাবে দাওয়াত এ অংশগ্রহণ ইত্যাদি চলছে হর হামেশা বিশেষ করে একটি দলের নেতাদের সালাম দোওয়া ও শুভেচ্ছায় ছবি সম্বলিত পোস্টারে, ব্যানারে ছেয়ে গেছে পথ ঘাট, ওলি, গলি, সমগ্র দেশের আনাচে কানাচের দেওয়াল ও পিলার এমন কি গাছ গাছালী পর্যন্ত। সেখানে নারী ভোটার দের আকৃষ্ট করার জন্য তেমন কোনো নজর কারা উদ্যোগ খুব একটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী এখনো অনেক পেছনে। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে পরিলক্ষিত হয়েছে একজন প্রধানমন্ত্রী একজন বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিয়ে নারীর সামগ্রিক রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে তা বলা যায় না। কারণ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী দলে প্রতি কমিটিতে নারীর অংশগ্রহণ ৩৩ শতাংশের এখনো পূরণে তেমন কোনো অগ্রগতি চক্ষুগোচর হয়নি।
৭১ সাল থেকে সংরক্ষিত আসনে নারীর সংখ্যা বেড়েছে তুলনামূলকভাবে তা অনেক কম। নারীকে মনোনয়ন দিতে নারীর ভোটার বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন নারী নেতৃবৃন্দ।
নারীরা ভোটার হলে এবং ভোট দিলে রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহ বাড়বে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। তার মতে সাধারণ আসনে নারীকে মনোনয়ন দিতে চায়না পুরুষতন্ত্র। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন হয় না। তাই ভোটারদের সংখ্যা বাড়ালেও পুরো রাজনৈতিক কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি নারী সংস্কার কমিশনের সদস্য কল্পনা আক্তার বলেন, রাতের ভোট, ভোট চুরি, ডাকাতি এসব নানা কারণে ভোটার হওয়া ওপর আগ্রহ নেই একশ্রেণির মানুষের। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করা নারীদের নিবন্ধনজনিত কার্যক্রমের জন্য পুরুষের ওপর নির্ভরশীল করে রেখেছে সমাজ।
ফলে তারা নিজেরা নিবন্ধন করে ভোটার হতে পারে না। আবার এক-দুই দিনে ছুটি নিয়ে বেতন কেটে গ্রামের বাড়ি গিয়ে ভোটার হওয়া তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। ফলে এই শ্রেণির অর্থাৎ
গার্মেন্টস শ্রমিক নারীরা ভোটার হন কম।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ গত আগষ্ট মাসে এক সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন নির্বাচনে ভোটার করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। ভোটার হতে উৎসাহিত করতে প্রচারণাও চালিয়েছে নির্বাচন কমিশন। বস্তি এলাকাসহ ভাসমান ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করতে বেদে, যাযাবর গোষ্ঠীকেও ভোটার করার কার্যক্রমও নির্বাচন কমিশনের আছে। তবে কাউকে জোর করে নির্বাচন কমিশন ভোটার বানাতে পারে না। এখনো সময় আছে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যে নাগরিকের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে সে ভোটার হতে পারবে।
জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে নারী আসন বাড়িয়ে সরাসরি ভোট, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও নির্বাচনী ব্যয় কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের অধিকাংশ প্রতিনিধিরা। সম্প্রতি গাইবান্ধায় জেলা পর্যায়ের সংলাপে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতকরণে নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তারা এ আহ্বান জানান।
ভোটের ইতিহাস খুঁজে জানা যায়, বাংলাদেশের নারীরা ১৯৪৬ সালে সীমিত ভোটাধিকার লাভ করে, কিন্তু ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তারা প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন যদিও অবিভক্ত বাংলায় ১৯২১ সাল থেকে সীমিত ভোটাধিকার ছিল, পাকিস্তান সৃষ্টির পর এবং পরবর্তীকালে স্বাধীনতার পর প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভোটাধিকারের সুযোগ আসে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিধানে একটি অতি আধুনিক সংযোজন এবং এমন একটি ধারণা যা বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বা অবদানকে স্বীকৃতি দেয়। উন্নয়নে নারী বলতে বুঝায় যে নারীরা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত এবং উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণের পরিবেশ অনুকূল করা অত্যাবশ্যক।
বাংলাদেশের নারীরা বরাবরই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার সনাতনী ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ এবং লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি ও সুশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক বহু সুযোগ সুবিধা থেকে প্রায়শ তারা বঞ্চিত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যোগ্য নারী নেতৃত্ব তৈরি হয়নি, সমাজে প্রচলিত আছে নারীরা সন্তান ধারণ করে, সন্তান জন্ম দেয়, তাদের প্রতিপালন করে এবং সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম করে, কিন্তু কখনো তারা নিজেদের কাজের জন্য যথোপযুক্ত মজুরি ও স্বীকৃতি পায় না।
চাকরির ক্ষেত্রে কোনো প্রকার আইনি বা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা নারীরা পায় না। গ্রামীণ পর্যায়ে ৮৪% এবং শহরে ৫৯% নারী অবৈতনিক গৃহ পরিচালিকা হিসেবে কর্মরত থাকে এবং প্রকৃত দায়িত্ব পালন করে থাকে।
বাংলাদেশের নারীরা পুরুষের তুলনায় সপ্তাহে গড়ে ২১ ঘণ্টা বেশি সময় কাজ করে। যদিও ঘর গৃহস্থালীর কাজে যুক্ত নারীশ্রমকে অর্থনৈতিক মানদণ্ডে কর্মকাণ্ড হিসেবে ধরা হয়েছে, কিন্তু এর অর্থমূল্য এখন পর্যন্ত জাতীয় আয় গণনায় হিসাব করা হয় না।
নারীর শ্রেণি পরিচিতি সবসময় নির্ধারিত হয় পরিবারের পুরুষ সদস্যের পেশা ও সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে।
এমন কি পরিবারের মধ্যে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় নারীরা কম খাদ্য গ্রহণ করে, স্বাস্থ্যসেবা এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ, সন্তান গ্রহণ, বৈবাহিক সিদ্ধান্ত ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের সুযোগ তাদের জন্য কম। সাংবিধানিকভাবে নারী ও পুরুষ উভয়েরই সমানাধিকার স্বীকৃত থাকলেও পারিবারিক ও ধর্মীয় আইন নারীর সার্বভৌম সত্ত্বা ও অধিকারকে খর্ব করে রেখেছে। বাংলাদেশের নারী অধিকার আন্দোলন, অসংখ্য নারী অধিকার দল বাংলাদেশের সকল মানুষের জন্য এক ও অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের দাবিতে সোচ্চার রয়েছে।
এদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল তাদের বিগত নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছে। অনেক সেমিনার ও কর্মশালা শেষে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সর্বপ্রথম ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোডের একটি ড্রাফট মডেল তৈরি করে এবং অন্যান্য নারী সংগঠনের সহায়তায় মডেলটির উৎকর্ষ সাধন করে।
বর্তমান আইনি প্রক্রিয়াতে জটিলতা থাকা সত্ত্বেও নারীর জন্য কিছু আইন প্রণীত হয়েছে। মিডিয়েশন কোর্ট প্রতিষ্ঠা, এসিড নিক্ষেপ আইন প্রণয়ন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশ সরকারের একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে ক্ষমতা প্রদান যেকোন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি মৌলিক বিষয়। এক্ষেত্রে প্রশাসনের সর্বনিম্ন স্তর ইউনিয়ন পরিষদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে নারীদের প্রতিনিধিত্বও অস্থায়ী ও অকার্যকর। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪৬ সালে নির্বাচিত এবং মনোনীত উভয় ধরনের সদস্য নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয়। কিন্তু সেখানে নারীদের মনোনয়নের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান ছিল না। বস্তুত ১৯৫৬ সালে প্রথম বারের মতো নারীরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটাধিকার লাভ করে। তখন প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন থেকে সম্পত্তির মালিকানা, খাজনা প্রদান ও শিক্ষাগত যোগ্যতা স্থানীয় সরকার কাঠামোতে ভোট দানের যোগ্যতা হিসেবে গণ্য করা হয়নি। স্বাধীনতার পরই এদেশের ইতিহাসে প্রথম স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তরে নারীরা প্রতিনিধিত্ব করার মর্যাদা লাভ করে।
সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, দেশের নারী জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত করতে এবং তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। নারী সংগঠনগুলি নারী নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ সংস্থা হিসেবে কাজ করে, বিশেষ করে নারীদের দাবি দাওয়ার সঠিক চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যায়। বিভিন্ন সেমিনার, কর্মশালা এবং লেখালেখির মধ্য দিয়ে তারা তুলে ধরেন সরকারি নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা বা দুর্বল দিক যা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রভাব ফেলে। তবে ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব এবং নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তাদের দাবিগুলি পুরুষ নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ধীর ধীরে নাড়া দিচ্ছে। নারীদের বিভিন্ন বিষয় জাতীয় এজেন্ডা হিসেবে তুলে ধরার জন্য এখনও কোনো জাতীয় মোর্চা গড়ে উঠেনি। কোনো সংগঠন বা সংগঠনগুলির এমন কোনো সংঘবদ্ধ রূপ বা ঐক্য গড়ে উঠেনি যা জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সম্ভাবনাময় নারী প্রার্থীদের নির্বাচনে সহযোগিতা দিতে সত্যিকারভাবে এগিয়ে আসবে। নারী সংগঠনগুলির রাজনীতিকীকরণ এধরনের ঐক্য মোর্চা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে নারী সমাজের কণ্ঠকে জোরালো করার ক্ষেত্রে তাদের অবদানকে অতিরঞ্জিত করার অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মূলধারায় নারী সমাজকে যুক্ত করার গতি ধীর, জটিল এবং প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ। ক্ল্যাসিক্যাল গণতন্ত্র, সামাজিকভাবে পিতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব ও সহজে অপরিবর্তনীয় রাষ্ট্রীয় বিধান রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণকে কঠিন করে তুলেছে। ফলে দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত নারীরা এই ব্যবস্থায় এগিয়ে আসতে পারছে না। তবে রাষ্ট্রের সম্প্রতি গৃহীত কিছু উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। অতএব সকলের উচিত আসন্ন নির্বাচনে নারী ভোটারদের নিরাপদে ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করা। পরিশেষে কবি কাজী নজরুল ইসলামের নারী কবিতার শেষ দুই লাইন স্বরণ করছি
‘সেদিন সুদূর নয় যেদিন ধরনী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয় ।’
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক কৌশলগত গুরুত্ব এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধনের ভূমিকা দেশটিকে উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া আয়োজনের মাধ্যমে তার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা জোরদার করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথ মহড়া অপারেশন ‘প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল’ ২৫-৩ আন্তর্জাতিক মহলে যথেষ্ট আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ইন্ডিয়া টুডে সহ কিছু ভারতীয় সংবাদমাধ্যম পরামর্শ দিয়েছে যে এই ধরনের মহড়া ভারতের পূর্ব সীমান্তে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। বাস্তবে এই ধরনের উদ্বেগ ভিত্তিহীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিমান বাহিনী নিয়মিতভাবে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত প্রশিক্ষণ মহড়া পরিচালনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই ধরনের যৌথ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অভূতপূর্ব নয়। বছরের পর বছর ধরে উভয় দেশই তাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর সাথে যৌথ মহড়ায় অংশগ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী তাদের পঞ্চম যৌথ মহড়ায় অংশগ্রহণ করেছে যার লক্ষ্য ছিল সামুদ্রিক কৌশলগত সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। সম্প্রতি ২০২২ সালেও একই ধরনের মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, সর্বশেষ মহড়াটি ১৪-১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে চট্টগ্রামের বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হক-এ অনুষ্ঠিত হয়। এই ধরনের সম্পৃক্ততা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি, প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব জোরদার এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে গঠনমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটায় এবং এই উদ্যোগগুলি তার প্রতিবেশীদের জন্য হুমকিস্বরূপ নয়, তা নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশ - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যৌথ সামরিক মহড়ার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি মেনে চলে আসছে। দেশটি কোনও সামরিক জোটের সদস্য নয় এবং দীর্ঘদিন ধরে ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈষম্য নয়’ এই বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করে আসছে। এই নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়মিত অবদান রেখে আসছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও জোরদার করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের প্রথম প্রধান যৌথ সামরিক মহড়া ১৯৯০-এর দশকে শুরু হয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে বেশ কয়েকটি মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কোঅপারেশন অ্যাফ্লোট রেডিনেস অ্যান্ড ট্রেনিং (CARAT), টাইগার শার্ক, প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এবং সাম্প্রতিকতম এক্সারসাইজ ডিজাস্টার রেসপন্স অ্যান্ড হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স। এই মহড়াগুলি সাধারণত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ, নৌ ও বিমান প্রতিরক্ষা কৌশল, মানবিক ও চিকিৎসা সহায়তা, সেইসাথে সন্ত্রাসবাদ দমন এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা মহড়ার মতো বিস্তৃত ক্ষেত্রগুলিতে মনোনিবেশ করেছে। অতি সম্প্রতি ২০২৫ সালে অনুষ্ঠিত অপারেশন প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল ২৫-৩-এ কেবল বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, অংশগ্রহণকারী দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি এই সত্যকে প্রতিফলিত করে যে, এই ধরনের উদ্যোগগুলি আর কেবল দ্বিপাক্ষিক নয় বরং বৃহত্তর আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কাজ করে।
উল্লেখযোগ্য যৌথ মহড়া
টাইগার শার্ক: ২০০৯ সাল থেকে ফ্ল্যাশ বেঙ্গল সিরিজের অংশ হিসেবে পরিচালিত একটি যৌথ বিশেষ বাহিনীর প্রশিক্ষণ মহড়া। এই কর্মসূচিতে টহল নৌকা পরিচালনা এবং স্বল্পপাল্লার অস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে দক্ষতা বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
টাইগার লাইটনিং: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্যাসিফিকের সাথে জড়িত একটি বাস্তবসম্মত মাঠ প্রশিক্ষণ মহড়া। এটি এখন টানা চার বছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা স্থল যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং কৌশলগত সমন্বয়ের ক্ষেত্রে টেকসই অংশীদারিত্বের উপর জোর দেয়।
প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল: প্রাথমিকভাবে একটি মানবিক সহায়তা এবং দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া মহড়া, অনুসন্ধান ও উদ্ধার (SAR) অভিযান এবং বিমান চিকিৎসা স্থানান্তরের উপর জোর দেওয়া হয়। এই উদ্যোগটি বাংলাদেশের দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং সংকট প্রতিক্রিয়া ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করে।
কো অপারেশন অ্যাফ্লোট রেডিনেস অ্যান্ড ট্রেনিং (CARAT): ২০১০ সাল থেকে এই বার্ষিক বহুজাতিক মহড়াটি বঙ্গোপসাগরে পরিচালিত হয়ে আসছে। এর লক্ষ্য সামুদ্রিক ক্ষেত্র সচেতনতা উন্নত করা এবং শক্তিশালী নৌ সহযোগিতা গড়ে তোলা।
স্টেট পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম (এসপিপি): ২০০৮ সাল থেকে অনুষ্ঠিত এই প্রোগ্রামটি বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন ন্যাশনাল গার্ডের মধ্যে স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলে, দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং জ্ঞান ভাগাভাগি সহজতর করে।
যৌথ মহড়ায় বাংলাদেশের আগ্রহ এবং উদ্দেশ্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিমান বাহিনী প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত প্রশিক্ষণ মহড়া পরিচালনা করে। বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা এবং সংকটের সময় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার এবং পরিবহন বিমান প্রায়শই মোতায়েন করা হয়। অপারেশন প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল ২৫-৩ প্রতিকূল এবং জরুরি পরিস্থিতিতে এই সম্পদের অপারেশনাল প্রস্তুতি বৃদ্ধির উপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছিল। এই মহড়ার সময় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একটি C-130J পরিবহন বিমান এবং একটি MI-17 হেলিকপ্টার মোতায়েন করে- যেখানে মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিমান বাহিনীর দুটি C-130J পরিবহন বিমান অবদান রাখে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মোট ১৫০ জন কর্মী এবং মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিমান বাহিনীর ৯২ জন কর্মী অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীর সদস্যরাও অংশগ্রহণ করেন, যা মহড়ার বহুমাত্রিক প্রকৃতির উপর জোর দেয়। এই ধরনের মহড়ায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সামরিক দক্ষতা বৃদ্ধি, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা সক্ষমতা জোরদার, দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া এবং মানবিক সহায়তা, সামুদ্রিক নিরাপত্তা রক্ষা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য কাজ করে।
ভারতের উদ্বেগের অন্তর্নিহিত কারণ
যদিও ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রধান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে রয়ে গেছে, তবুও সম্প্রতি বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশের সাথে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিক পরিবর্তন, পাকিস্তানের সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা এবং পাকিস্তানের সাথে অপারেশন সিন্দুরের মতো যৌথ উদ্যোগ নয়াদিল্লিতে অস্বস্তি তৈরি করেছে। বাংলাদেশের উপর ভারতের নিজস্ব বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং শিলিগুড়ি করিডোর নিয়ে উদ্বেগ দ্বিপাক্ষিক গতিশীলতাকে আরও জটিল করে তুলেছে। অভ্যন্তরীণভাবে মণিপুর এবং লাদাখে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন ভারতের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাগুলিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বাহ্যিকভাবে তিস্তা নদী প্রকল্পে চীনের জড়িত থাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে মার্কিন আগ্রহ ভারতের আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। নয়াদিল্লির জন্য ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন কৌশলগত অগ্রাধিকারগুলিকে- বিশেষ করে যখন বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করা হয় তখন তা ভূ-রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল হিসাবে দেখা হয়। ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করে যে, যৌথ সামরিক মহড়ার আড়ালে বাংলাদেশ হয়তো আঞ্চলিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করতে পারে, পাশাপাশি বৈশ্বিক শক্তির সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গভীরতর করতে পারে।
অধিকন্তু ভারত দক্ষিণ এশিয়াকে তার ঐতিহ্যবাহী প্রভাব বলয় হিসেবে দেখে। তাই এই অঞ্চলে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলির তাদের পদচিহ্ন সম্প্রসারণের সম্ভাবনাকে তাদের কৌশলগত অবস্থানের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই পটভূমিতে ভারতীয় গণমাধ্যমের কিছু অংশ বাংলাদেশ-মার্কিন মহড়াকে ভারতের সামরিক ঘেরাওয়ের অংশ হিসেবে অতিরঞ্জিত করে তুলেছে। এই বর্ণনার সাথে যুক্ত হয়েয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ভুল তথ্য এবং গুজব; যা প্রায়শই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলিতে সমালোচনামূলকভাবে পুনরুৎপাদন করা হয়েছে- যা বাস্তবতা থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন একটি চিত্র তৈরি করেছে।
ভারতের উদ্বেগ কেন ভিত্তিহীন?
বাস্তবসম্মতভাবে মূল্যায়ন করলে দেখা যায় যে, এই ধরনের মহড়া ভারতের জন্য কোনও হুমকি নয়। বাংলাদেশ কখনও অন্য দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনও সামরিক জোটে যোগ দেয়নি এবং যৌথ মহড়ায় তাদের অংশগ্রহণ কেবল পেশাদার দক্ষতা বৃদ্ধির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। ২০২৫ সালের মহড়ায় আক্রমণাত্মক সামরিক পদক্ষেপের পরিবর্তে দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া, চিকিৎসা সহায়তা এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রশিক্ষণের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। তদুপরি মহড়াগুলি কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না- দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলিও অংশগ্রহণ করেছিল; যা কোনও একক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নকশার পরিবর্তে সহযোগিতামূলক এবং আঞ্চলিক উদ্যোগের প্রকৃতি তুলে ধরে। এটিও লক্ষণীয় যে, ভারত নিজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নিয়মিত যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করে। এই পটভূমিতে ওয়াশিংটনের সাথে বাংলাদেশের অনুরূপ মহড়ায় ক্ষেত্রে ভারতের উদ্বেগ অযৌক্তিক বলে মনে হয়। তদুপরি বাংলাদেশ এবং ভারতের সশস্ত্র বাহিনী নিয়মিত দ্বিপাক্ষিক যৌথ মহড়া পরিচালনা করে, চলমান প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বজায় রাখে। এটি এই সত্যকে তুলে ধরে যে, বাংলাদেশ ভারতের জন্য হুমকি নয় বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রচারে অংশীদার।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এবং ভারতের অর্থনীতি পরস্পর নির্ভরশীল। যদিও ২০২৫ সালে ভারতের একতরফা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আঘাত হানে, তবুও এর প্রভাব উভয় পক্ষের উপরই পড়ে। বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতি প্রায় ৭.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারতীয় রপ্তানিও প্রায় ৬.২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এটি এই বাস্তবতাকে তুলে ধরে যে, যদি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে অবিশ্বাস অব্যাহত থাকে, তাহলে উভয় দেশই তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। অতএব পারস্পরিক বিশ্বাস ভাগাভাগি করা সমৃদ্ধি রক্ষার একমাত্র কার্যকর পথ।
আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি এবং বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান একে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগরের সংযোগস্থলে স্থাপন করেছে। দেশটি তিনটি প্রধান শক্তির মধ্যে কৌশলগত প্রতিযোগিতার একটি অঞ্চলে অবস্থিত: ভারত তার আঞ্চলিক নেতৃত্ব বজায় রাখতে চায়; চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে; এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসাবে দেশের জন্য আরও বেশি কৌশলগত তাৎপর্যপূর্ণ। এই প্রতিযোগিতার মধ্যে বাংলাদেশ ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়- কোনও একক শক্তির সাথে একচেটিয়াভাবে জোটবদ্ধ না হয়ে বরং ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’ এই নির্দেশক নীতি মেনে চলতে চায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। বাংলাদেশ-মার্কিন সামরিক মহড়াকে হুমকি হিসেবে দেখার পরিবর্তে, একে সহযোগিতার সুযোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে ভারতই উপকৃত হবে।
উপসংহার
বাংলাদেশ-মার্কিন কৌশলগত সামরিক মহড়া বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধির বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ। এই উদ্যোগগুলি কোনোভাবেই ভারতের বিরুদ্ধে নয়। বরং তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হল দুর্যোগ মোকাবিলা, মানবিক সহায়তা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার করা। ভারত যদি এই ধরনের মহড়াকে হুমকি হিসেবে নয় বরং সহযোগিতার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখতে চায়, তাহলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার হতে পারে। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য পারস্পরিক বিশ্বাসের চেতনায় বাংলাদেশের অনন্য ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে কাজে লাগানো অপরিহার্য হবে।
*তানিম জসিম: প্রাবন্ধিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক। সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ১০০০।