রোববার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৩
রক্তে ভেজা ২৭ সেপ্টেম্বর

শহীদ ময়েজউদ্দিনের ৩৯তম প্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

শহীদ ময়েজ উদ্দিন: ফাইল ছবি
আপডেটেড
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ২২:২১
মো. আমজাদ খান
প্রকাশিত
মো. আমজাদ খান
প্রকাশিত : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ২২:২১

ত্রিশ লাখ শহিদের রক্ত ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ও স্বাধীনতাকামী বাঙালির আত্মত্যাগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। স্বাধীনতা অর্জনের পর গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য ধাপে ধাপে আন্দোলন-সংগ্রামে বহু বীরকে আবার রক্ত দিতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’র পৃষ্ঠা ১০৮-এ লিখেছেন ‘ময়েজউদ্দিন, তিতাস, রমিজ, বাসুনিয়া, চন্নু এমনি হাজার আত্মাহুতির প্রয়োজন হলো গণতন্ত্রের জন্য অধিকারের লড়াইয়ে।’ ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। সমগ্র দেশব্যাপী ২২ দল আহুত হরতাল চলছে। কালীগঞ্জে ময়েজউদ্দিনের নেতৃত্বে মিছিল বের হয়। আর তখনই স্বৈরশাসকের লেলিয়ে দেওয়া আজম খান ও তার পালিত সন্ত্রাসী তাঁর ওপর হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই তিনি শাহাদাতবরণ করেন। কালীগঞ্জের রাজপথ তাঁর পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয়।

১৯৩০ সালের ১৭ মার্চ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার মোক্তারপুর ইউনিয়নের বড়হরা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে শহীদ ময়েজউদ্দিনের জন্ম। কালীগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৮ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫০ সালে আইএ, ১৯৫৩ সালে অনার্স, রাষ্ট্রবিজ্ঞান (ঢাবি) ও ১৯৫৫ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৬ সালে সিএসপি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরিতে যোগদান করেন নাই। ১৯৬০ সালে (ঢাবি) থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন দিয়েই ময়েজউদ্দিনের রাজনৈতিক জীবন শুরু ও বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য। ১৯৬২ - ৬৩ সালে শহীদ ময়েজউদ্দিন ঢাকা পৌরসভার অধীনে কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদে প্রথমে মৌলিক গণতন্ত্রী (বেসিক ডেমোক্র্যাট) মেম্বার পরে তিনি এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যাপক সহযোগিতা করেন। ১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে। তখন শহিদ ময়েজউদ্দিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা করার জন্য গঠিত ‘মুজিব তহবিল’-এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন।

শহিদ ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানায় নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে খন্দকার মোশতাক আহমেদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর জায়গা দখল এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রধান অবস্থানে এসে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নেতৃত্বের সঙ্গে আপস করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে সরে এসে সবকিছু ভণ্ডুল করতে চেয়েছিলেন। খন্দকার মোশতাক দলের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সভার আয়োজন করে কলকাতার থিয়েটার রোডের মুজিবনগর সরকারের সচিবালয় ভবনের ছাদে। সেই সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের ভোটাভুটির জন্য ডিভিশন চাওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। তখন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সত্তরের নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন চিৎকার করে বক্তৃতা দিলেন- ‘কোনো ডিভিশন নয়, কিসের ডিভিশন, মুক্তিযুদ্ধে যে কোনো মূল্যে দলের অবস্থান যা আছে তা-ই থাকবে, কোনো নতুন নেতৃত্বের প্রশ্নই ওঠে না।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে খুনিচক্র খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতায় বসায়। এরপর মোশতাক সংসদ সদস্যদের সভা ডেকে ঘাতকদের সব অপকর্মের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন। সেই সভায়ও সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন সবাইকে হতবাক করে চিৎকার করে বলেছিলেন- ‘খন্দকার মোশতাক আহম্মেদ অবৈধ প্রেসিডেন্ট, তার কোনো নেতৃত্ব মানি না, সে খুনি, ষড়যন্ত্রকারী। আওয়ামী লীগ তার কোনো নেতৃত্ব মানতে পারে না।’ তিনি যখন এই বক্তব্য দেন তখন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা অস্ত্র হাতে পেছনের সারিতে দাঁড়ানো। বলার অপেক্ষা রাখে না সেই মুহূর্তে তাঁর মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল শতভাগ। কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল। বক্তব্য শেষ করে আত্মরক্ষার্থে তিনি বাসায় না ফিরে কয়েক দিনের জন্য গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

১৯৬৯ সালের ঘটনা। জেনারেল আইয়ুব খানের আহ্বানে পূর্ব বাংলার নেতৃস্থানীয় কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানে যান রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যোগদান করার জন্য। তাঁদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন প্রমুখ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ মুহূর্তে শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ ময়েজউদ্দিনকে বললেন, তুমি লাহোর থেকে আজই করাচি দিয়ে দেশে গিয়ে এই চিরকুটটি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নিকট পৌঁছিয়ে দেবে এবং বলবে তিনি যেন অতিসত্তর জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর নিকট চিরকুটটি পৌঁছিয়ে দেন। তখনই তিনি দেশে রওনা হয়ে গেলেন। ঢাকা কমলাপুর এসেই বেবিটেক্সিযোগে তিনি বেগম মুজিবের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান। এই হলো শহিদ ময়েজউদ্দিন। পর বঙ্গবন্ধুর বেকসুর খালাসের পর লাহোর গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে যে ১০ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন শহিদ ময়েজউদ্দিন ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন।

ময়েজউদ্দিন ১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। একাধারে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি এফপিএ বির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু নিয়ে জাতিসংঘ তথা সমগ্র বিশ্বে আজ ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ৮০-র দশকেই এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তখনই তিনি কালীগঞ্জে নিজ জায়গায় তিনটি মাতৃসদন স্থাপন করে গেছেন। ওই একই সময়ে সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ ছাড়া শহিদ ময়েজউদ্দিন বহুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। সমাজসেবক হিসেবে পৃথিবীর বহুদেশে সভা-সেমিনার এবং সম্মেলনে যোগদান করেছেন তিনি। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, জর্দান, মালয়েশিয়া, বার্মা, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইজারল্যান্ড, রুমানিয়া, কেনিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইরাক, ইরান, কুয়েত, কাতার, চীন, জাপান ও ফিলিপাইন উল্লেখযোগ্য।

১৯৮২ সালে সামরিকবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ধীরে ধীরে রাজপথে আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। ধাপে ধাপে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন প্রবল গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও নির্দেশে রাজধানীর রাজপথ থেকে কালীগঞ্জের রাজপথে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন শহিদ ময়েজউদ্দিন। কালীগঞ্জে সামরিক শাসকের দোসররা ততদিনে উপলব্ধি করতে থাকে, ময়েজউদ্দিনের উপস্থিতিতে কালীগঞ্জের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কালীগঞ্জের ক্ষমতায় আসার জন্য সামরিক শাসকের সঙ্গে ময়েজউদ্দিনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য ময়েজউদ্দিন নিজ নির্বাচনী এলাকা গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জে চলে যান। মিছিলে নেতৃত্বদানের সময় দিনের আলোতে তাকে হত্যা করা হয়। শহিদ ময়েজউদ্দিনের এই হত্যাকাণ্ড সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। দেশ-বিদেশে তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তবে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ময়েজউদ্দিনের আত্মদান ধীরে ধীরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। শহিদ ময়েজউদ্দিনের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা প্রবল গণ-আন্দোলন অবশেষে সামরিক শাসকের পতনকে অনিবার্য করে তোলে। গণতন্ত্রের জয় হয়।

কালীগঞ্জের সাধারণ মানুষের নিকট তিনি গণমানুষের নেতা হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। শহিদ ময়েজউদ্দিন একুশে পদকে ভূষিত হন। গণতন্ত্রের জন্য জীবন দেয়া শহিদ ময়েজউদ্দিনের কথা স্মরণ রেখেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী ময়েজউদ্দিন কন্যা মেহের আফরোজ চুমকীকে ১৯৯৬ সালে গাজীপুর-নরসিংদী জেলার সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি মনোনীত করেছিলেন। পরবর্তীতে নিষ্ঠা, সততা, কর্মদক্ষতা, যোগ্যতা ও দূরদর্শিতার কারণে তিনি পরপর তিনবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং দুইবার দক্ষতার সঙ্গে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলাবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং মেহের আফরোজ চুমকী ‘শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পদক ২০২৩’-এ ভূষিত হন।

‘কালীগঞ্জের রাজনীতিতে শহিদ ময়েজউদ্দিনের মতো নির্ভীক দেশপ্রেমিক আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না।’ (সাবেক এম এল এ ফয়জোর রহমান খান ১৯৫৪, কালীগঞ্জ, গাজীপুর)

তাই আজ ৩৯তম শাহাদাতবার্ষিকীতে শহিদ ময়েজউদ্দিনসহ সব শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: মো. আমজাদ খান, সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ ঢাকা


বলিউড শাহেনশাহর ৩৭০০ কোটি টাকার সম্পত্তির ভাগাভাগি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
বিনোদন ডেস্ক

গত সপ্তাহেই ভারতীয় গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করে, প্রতীক্ষা বাংলোটি কন্যা শ্বেতা বচ্চনের নামে লিখে দিয়েছেন বলিউডের শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চন। এরপরই জানা যায়, নিজের সব সম্পত্তি সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে দিচ্ছেন ‘বিগ বি’। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে মুখ খুলেছেন অমিতাভ নিজেই। খবর ভারতীয় গণমাধ্যম ফ্রি প্রেস জার্নালের।

কয়েক মাস ধরেই ক্রমাগত আলোচনায় রয়েছে বচ্চন পরিবার। তবে সম্পত্তির ভাগাভাগি নয়, আলোচনার কারণ ছিল ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চনের সঙ্গে বচ্চন পরিবারের কথিত দূরত্ব। এমনকি ঐশ্বরিয়া-অভিষেকের বিচ্ছেদের গুঞ্জনও চাউর হয়েছিল। তবে এবার সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনায় বচ্চন পরিবার। তবে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ২ হাজার ৮০০ কোটি রুপির (প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা) সম্পত্তির ভাগ কীভাবে হবে, জানালেন অমিতাভ বচ্চন।

অমিতাভ জানান, তার সম্পত্তি দুই সন্তানের মধ্যে সমান ভাগ করে দিয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই ছেলে ও মেয়ের মধ্যে কোনো তফাৎ করেননি। তাই সম্পত্তির ক্ষেত্রেও দুই সন্তান সমান ভাগ পেয়েছেন।

সদ্য দীপাবলির উপহার হিসেবে অমিতাভ ‘প্রতীক্ষা’ বাংলোটি মেয়ের নামে লিখে দেন, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ৫০ কোটি রুপি। শোনা যায়, এ বাংলো বেশ পছন্দের ছিল ঐশ্বরিয়া রাইয়ের। তবে ‘বিগ বি’ নিজের মেয়ে শ্বেতাকে দিলেন ‘প্রতীক্ষা’।

মুম্বাইয়ের ভিট্টালনগর কো-অপারেটিভ হাউসিং সোসাইটির ‘প্রতীক্ষা’ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ ৬৭৪ বর্গমিটারের, আরেকটি ৮৯০ বর্গমিটারের। এটিই নাকি বিগবির প্রথম সম্পত্তি। মা-বাবার সঙ্গে এখানেই বেড়ে ওঠা অভিনেতার। এ বাংলো ছাড়াও জুহুতে তিনটি বাংলো রয়েছে বচ্চনদের। তবে ছেলে অভিষেকের ভাগ্যে পড়েছে কোন কোন সম্পত্তি, তা গোপন রেখেছে বচ্চন পরিবার।


শান্তি চুক্তি পার্বত্য জনপদে উন্নয়ন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মো. রেজুয়ান খান

যুগ যুগ ধরে পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বর্ণিল জীবনাচার, ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি পার্বত্য অঞ্চলের রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি- এই তিন জেলাকে বিশেষভাবে করেছে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ অঞ্চলকে নিয়ে বারবার বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন সময় শান্তির পরিবর্তে সংঘাতকে উসকে দিয়েছিল। এই সংঘাতময় পরিস্থিতি নিরসনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী, সুদক্ষ ও প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্বে কোনো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটির পক্ষে তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে পার্বত্য জেলাসমূহে বিরাজমান দীর্ঘ সংঘাতের অবসান হয় এবং অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন পরিবেশের অবতারণা হয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও আন্তরিকতার কারণেই অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সেখানকার বিভিন্ন ভাষাভাষী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ সবার জীবনে শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির অভিযাত্রায় পাহাড়ি জনপদে বর্তমানে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলে ১৫ জুলাই ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। সেই থেকেই গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। সংসদ সদস্য আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে আহ্বায়ক (মন্ত্রী পদমর্যাদা) করে ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি তিন সদস্যবিশিষ্ট চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কমিটি ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে। গঠন করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ ছাড়া গঠন করা হয় ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন-সংক্রান্ত টাস্কফোর্স। পার্বত্য চট্টগ্রামকে উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে ইতোপূর্বে গঠন করা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড।

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ইতোমধ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৪টি ধারার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়েছে এবং বাকি ধারাগুলোর বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে বাকি ধারাগুলোরও বাস্তবায়ন চলমান।

পার্বত্য চট্টগ্রাম তার অনন্য সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলাদেশের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এই অঞ্চলের সম্ভাবনা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়ে পাহাড়ে বসবাসকারী জনগণের জীবনকে উন্নত করার প্রতিশ্রুতিতে অটল রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনকেন্দ্রিক উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবনে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। উন্নয়ন কৌশলের অন্যতম ভিত্তি হলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন। রাস্তা, সেতু এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যক সংযোগ প্রকল্পগুলো কেবলমাত্র পরিবহনের সুবিধাই দেয়নি বরং প্রত্যন্ত অঞ্চলকেও সংযুক্ত করেছে এবং শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে ব্যবধান কমিয়েছে। অবকাঠামোর উন্নতি শুধু পার্বত্যবাসীদের জীবনকে সহজ করেনি বরং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিয়েছে। বিশেষ করে উঁচু-নিচু পাহাড়ের গা ভেসে সরীসৃপের মতো নির্মিত হয়েছে শত শত কিলোমিটারের ঝিগঝাগ পিচঢালা মসৃণ পাহাড়ি সড়ক। সড়কের পাশাপাশি বড় বড় ব্রিজ-কালভার্ট এক পাহাড়কে আরেক পাহাড়ের সঙ্গে যুক্ত করেছে। যারা বান্দরবানের থানচি ভ্রমণ করেছেন, তারা এর স্বাদ গ্রহণ করেছেন। থানচিতে যেখানে যাওয়া-আসায় দুই-তিন দিনের পথ ছিল, এখন সে পথ মাত্র দুই-তিন ঘণ্টার ব্যবধানে দাঁড়িয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির দলিল স্বাক্ষরের কারণে। পাহাড়ি জনপদের কাছে তা এখন স্বপ্নের মতো। যাত্রীবাহী চাঁদের গাড়ি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস, মাইক্রোবাস, জিপ অনায়াসেই চলাচল করছে এ সড়কগুলোয়। পার্বত্য দুর্গম এলাকায় যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। আর এর সুফল ভোগ করছেন স্থানীয় জনগণ। সরকারের ২০০৯-২০২৩ শাসনামলে অসংখ্য স্কুল, কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যা এ অঞ্চলের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান এবং জ্ঞান দিয়ে তাদের ক্ষমতায়ন করেছে। পার্বত্যাঞ্চলের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অবদানের কারণেই পার্বত্যবাসীরা পার্বত্যাঞ্চলের বিশাল উন্নয়নের সমঅংশীদার হতে পেরেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১৬১টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে বিগত ২৬ বছরে পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলায় নানামুখী অবকাঠামে উন্নয়ন হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় নারী উন্নয়ন, আয়বর্ধক কর্মকাণ্ড, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকার ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। ৪ হাজার ৮০০ পাড়াকেন্দ্রে শিশু ও তাদের পরিবারের নিকট মৌলিক সামাজিক সেবাগুলো পৌঁছে দিতে পাড়াকেন্দ্র নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীরা আধুনিক প্রযুক্তির সহযোগিতায় এখন সরকারের সব সেবা ভোগ করতে পারছে, যা গত এক যুগ আগেও সম্ভব ছিল না। ১ লাখ ২০ হাজার শিশুকে প্রাক শৈশব স্তরের শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। ২ লাখ ৬ হাজার পাহাড়ি পরিবারের শিশু, কিশোরী ও মহিলাদের রক্তস্বল্পতা ও পুষ্টি ঘাটতিজনিত সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে সরকারের সেবা প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। চারটি আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থীকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আয়বর্ধক কর্মসূচি হিসেবে উন্নত জাতের বাঁশ উৎপাদন, অসচ্ছল ও প্রান্তিক পরিবারের নারী উন্নয়নে গাভী পালন প্রকল্প, সুগারক্রপ চাষাবাদ জোরদারকরণ প্রকল্প, কফি ও কাজু বাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্প, তুলা চাষ বৃদ্ধি ও কৃষকদের দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প, প্রত্যন্ত এলাকায় সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ, মিশ্র ফল চাষ, উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থানের জন্য সরকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য এক অপার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ১ হাজার ২১২ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৭০০ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে- যা পরবর্তীতে পাকাকরণের মাধ্যমে জনগণের যাতায়াতের দুর্গম পথকে সুগম করে দিতে বদ্ধপরিকর রয়েছে এ সরকার।

৬১৪ কিলোমিটার বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে। পার্বত্য তিন জেলায় ৯ হাজার ৮৩৯ মিটার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু রাঙামাটি জেলাতেই নির্মাণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৯২৮ মিটার ব্রিজ। একই সঙ্গে কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে ১৪১ মিটার। ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক দুর্গম পাহাড়ি জনপদের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপকে বাস্তবায়ন করেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার।

পার্বত্য চুক্তির আগের পার্বত্যাঞ্চল ও চুক্তি উত্তর পার্বত্যাঞ্চলের চিত্র সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে তুলে ধরা হলো:

পার্বত্য চুক্তির আগে পার্বত্য তিন জেলায় উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ১৯৬টি। চুক্তির ২৬ বছরে সেখানে উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০৪টিতে। কলেজ ছিল যেখানে ২৫টি, সেখানে এখন কলেজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫১টি। পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিন পার্বত্য জেলায় নতুনভাবে গড়ে উঠেছে তিনটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। রাঙামাটিতে একটি মেডিক্যাল কলেজ এবং বান্দরবান জেলায় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়। পার্বত্য তিন জেলায় চুক্তির আগে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ছিল মাত্র ৯১টি। চুক্তির পর স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২১২-তে ‍উন্নীত করা হয়। ছোট-মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল মাত্র ১৭টি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর মাঝারি-বড় ৪৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। ক্ষুদ্র-কুটির শিল্পের সংখ্যা যেখানে ছিল ২ হাজার ২৬৬টি মাত্র, চুক্তির পর সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ২৯৯টি। এ ছাড়া মসজিদ, মন্দির, কিয়াং, গির্জা সমহারে স্থাপনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক এ সরকার সব ধর্মের প্রতি সমান আন্তরিকতার পরিচয় রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শিশু পার্ক, বিনোদন পার্ক, বাস টার্মিনাল, ঈদগাহ্, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, বাঁধ, স্টেডিয়াম, ফুড বেকারি, হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, পর্যটনকেন্দ্র ইত্যাদি স্থাপনের মাধ্যমে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাসহ সব প্রকার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে দিয়েছে সরকার।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে শান্তিচুক্তির পটভূমিতে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, পর্যটন ইত্যাদি সব দিক থেকে পার্বত্য অঞ্চল এখন আরও বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ জনপদে পরিণত হয়েছে বলে দাবি রাখে।

লেখক: তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়


সঠিক জীবনবোধই সফলতার সোপান

আপডেটেড ২ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১২:২১
প্রফেসর ড. মো. নাছিম আখতার

আপনি কেমন জীবন চান? স্রষ্টা যদি আপনাকে এই প্রশ্নটা করতেন এবং আপনাকে চারটি অপশন দিতেন, যার প্রত্যেকটি অপশনই কষ্টের। তাহলে আপনি কোন অপশনটি বেছে নিতেন? গভীরভাবে চিন্তা করুন, একটি বাচ্চা যখন স্কুলে যাচ্ছে, তখন সে স্কুলে যেতে চায় না। যিনি চাকরি করছেন, তার অফিসে যেতে ভালো লাগে না। কিন্তু বেকার থাকাটা আরও অনেক বেশি কষ্টকর। একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য গর্ভকালীন সময়টা খুবই কষ্টকর। অন্য একজন মহিলা যার কোনো সন্তান নেই, কিন্তু সন্তান চাচ্ছেন। সেটা তার জন্য আরও বেশি কষ্টকর। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখুন, দেখবেন আমাদের জীবনের অপশনগুলো সব সময় কষ্টের। তাহলে জীবনের কোন কষ্টটা নেব? বা আদৌ কষ্টটা নেব কেন? আমি কষ্টটা নেব, কারণ এ ছাড়া আমার কোনো বিকল্প নেই। আমি সেই কষ্টটাই নেব, যেটা আমার জীবনকে অর্থবহ করে তোলে।

তরুণ বয়সে অনেকেরই মনে হয়, পড়ালেখাটা অনেক কষ্টকর। কিন্তু এই কষ্টটা একজন মানুষের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। তাই এই কষ্ট করাটা বুদ্ধিমানের কাজ। পড়া, লেখা, বই-জীবনের এই তিনটি অনুষঙ্গ শ্বাস, প্রশ্বাস ও অক্সিজেনের সঙ্গে তুলনীয়। পড়া হচ্ছে শ্বাস নেয়া, লেখা হচ্ছে প্রশ্বাস, আর বই হচ্ছে অক্সিজেন। জীবকোষে অক্সিজেনের ঘাটতি হলে যেমন কোষে পচন ধরে, তেমনি বই পড়া কমিয়ে দিলে আত্মার পরিশুদ্ধতার পরিসমাপ্তি ঘটে। একজন শিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকের মধ্যে পার্থক্য হলো শিক্ষিত ব্যক্তি তার জ্ঞান, চিন্তাভাবনা, অভিব্যক্তি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিপিবদ্ধ করে যেতে পারেন; কিন্তু অশিক্ষিত ব্যক্তিরা তা পারেন না।

বই জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার অন্যতম মাধ্যম কেন? একটি ভালো মানের বই লেখা নিরন্তর সাধনার বিষয়। এ কাজে লেখকের মাস, বছর, এমনকি যুগ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। বই অনুরাগী হলে সে বইটি আমরা দুই দিন থেকে ১ সপ্তাহের মধ্যে পড়ে শেষ করতে পারি। শেষ করার অর্থ হলো একজন জ্ঞানী এবং বিচক্ষণ মানুষের বহুদিনের নিরবচ্ছিন্ন ভাবনার সংকলনকে আমরা নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারলাম। শিক্ষকতা পেশায় আমি দীর্ঘদিন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ‘কোর্থ’-এর লেখা ‘ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ বইটি পড়িয়েছি। বইটি লেখকের অনেক বছরের তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক গবেষণার প্রতিফলন। অথচ মাত্র এক অ্যাকাডেমিক সেমিস্টারে লেখকের অভিজ্ঞতালব্ধ এই জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠদানের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। এর ফলে লেখকের বহু বছর ধরে গবেষণালব্ধ জ্ঞান শিক্ষার্থীর মানসিক বয়সকে বাড়িয়ে দেয়। সে জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়।

শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিতে গিয়ে আমি শিক্ষার্থীদের প্রায়ই বলতাম, বই যত মোটা বা স্বাস্থ্যবান হোক না কেন তার মধ্যে মূল বিষয় বা চুম্বক অংশ থাকে ৩০ শতাংশ। আর ওই চুম্বক অংশ ফুটিয়ে তোলার জন্য আনুষঙ্গিক ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হয় বাকি ৭০ শতাংশ। সুতরাং তোমাদের মনে রাখতে হবে ৩০ শতাংশ। এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মন ওইভাবে ভাবতে শুরু করত। ফলে বই পড়াটা তাদের কাছে আনন্দঘন হয়ে উঠত। আমার মতে পাঠ্যবইকে পড়ে এর সারাংশ বের করতে পারাটাই সৃজনশীলতা।

ইতিহাস বলে, ইতিবাচক কর্মের দ্বারা সফল মানুষগুলো তাদের জীবদ্দশায় প্রচুর বই পড়তে পছন্দ করতেন। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন বারো বছর বয়সে জীবনযুদ্ধে নামতে বাধ্য হন। পোর্ট হেরন থেকে ডেট্রয়েটের মধ্যে প্রতিদিন চলাচলকারী ট্রেনে তিনি খাবার ও পত্রিকা বিক্রি করতেন। ডেট্রয়েটে ট্রেনটি অনেকক্ষণ অবস্থান করত। সে সময় তিনি সেখানকার একটি লাইব্রেরিতে বসতেন এবং বই পড়তেন। এভাবে তিনি ওই লাইব্রেরির সমস্ত বই পড়ে শেষ করেছিলেন। তার প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মূলে রয়েছে বইয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।

গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে আলো, বাতাস ও পানির প্রয়োজন। আর অন্তরকে বাঁচিয়ে রাখতে পড়াশোনার প্রয়োজন। অন্তরকে সজীব ও প্রসারিত রাখার মাধ্যম হলো শিক্ষা। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের মিলিওনিয়ার ও বিলিওনিয়ারদের শতকরা ৮৫ ভাগ প্রথম প্রজন্মের। শুধু ১৫ ভাগ উত্তরাধিকার সূত্রে ধনী। প্রথম প্রজন্মের ধনীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ‘এত অল্প সময়ে কীভাবে আপনারা আর্থিক সফলতা অর্জন করেছেন’? তারা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমরা বই পড়ি’। ওয়ারেন বাফেট দিনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা বই পড়েন। বিল গেটস একজন ভালো পাঠক। ইলন মাস্ক রকেট সায়েন্সের বিদ্যা বই পড়ার মাধ্যমেই অর্জন করেছেন। বই পড়া স্বল্প সময়ে অনন্য সাধারণ মানুষের ভাবনার সারাংশ আত্মস্থ করার মাধ্যমে আত্মোন্নয়ন ঘটায়। আলোকিত মন জীবন ধারণের জন্য যেকোনো ইতিবাচক সৃজনশীল কর্ম খুঁজে নিতে পারে।

আমরা বইয়ে যা পড়ছি, তা মূলত কারও বিশেষ জ্ঞান কিংবা অভিজ্ঞতা থেকেই লেখা। সেই জ্ঞান আমাদের সফলতাকে ত্বরান্বিত করবে। বইয়ে একটি সঠিক পথ অবলম্বন করার জন্য আমাদেরকে উপদেশ দেয়া হয়। জীবনের ভুলগুলোকে চিহ্নিত করে দেয়া হয়। বিভিন্ন বইয়ে লেখক তার জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করেন। আমরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে জানতে পারি কোন পথে গেলে ভুলের সম্ভাবনা কমে আসে। জীবন খুব ছোট, ভুলের পুনরাবৃত্তি করা সফলকাম হওয়ার অন্তরায়। সফলদের একজন হতে চাইলে তাদের অতীত থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্যও বই অপরিহার্য।

তরুণ প্রজন্মের যাকেই জিজ্ঞাসা করি, সেই-ই জানায় সে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করবে। পৃথিবীতে তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়াও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য অনেক বিষয় রয়েছে। নবপ্রজন্মের মধ্যে এই উপলব্ধিবোধ জাগ্রত করতে হবে। যেকোনো বিষয়েই মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করলে মাস্টার্স বা পিএইচডির মতো গবেষণা অন্য বিষয়েও করা সম্ভব। এ সম্পর্কে আমি নোবেল বিজয়ী ফরাসি অধ্যাপকের কথা বলছি। নাম তাঁর ড. জ্যঁ তিরল। তিনি সমাবর্তন বক্তা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। তাঁর স্নাতক ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, কিন্তু তিনি পিএইচডি করেছেন অর্থনীতিতে। পরবর্তীতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন অর্থনীতিতে। পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকলে স্নাতক ডিগ্রি এক বিষয়ে হলেও অন্য বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ভূগোল বিষয়ে অধ্যয়ন করে পরবর্তী সময়ে নাসাতে গবেষণার সুযোগ পেয়েছেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, যেকোনো বিষয়ে পড়াশোনা করেই জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। যদি থাকে অদম্য ইচ্ছাশক্তি।

বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে শিশুকাল থেকে। পাঠ্যবইসহ গল্প-উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, বিজ্ঞান ও গণিতভিত্তিক যেকোনো বই-ই মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ জন্য প্রতিটি পরিবারে গড়ে তুলতে হবে সর্বোপরিসরে ছোট আকারের পাঠাগার। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে অনুশীলন করতে হবে সফলতার সঠিক জীবনবোধ। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলেই মানুষকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব। সে নিজেই হতে পারে জ্ঞানের বিশ্বকোষ। এভাবেই গড়ে উঠবে জাতি, সমৃদ্ধ হবে দেশ। সফলতার সুষমায় উদ্ভাসিত হবে প্রতিটি জীবন ও পরিবার।

লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


সমুদ্রের শক্তি থেকে বিদ্যুৎ

আপডেটেড ১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১৫:৩০
প্রদীপ সাহা

বিদ্যুতের সমস্যা শুধু আমাদের দেশেই নয়, উন্নয়নশীল সব দেশেই আছে। আর এর কারণ হিসেবে সহজ একটি উত্তর সচরাচরই শোনা যায়, চাহিদা অনুযায়ী/বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না বা সরবরাহ হচ্ছে না ইত্যাদি। বিদ্যুতের এ সমস্যা প্রতিরোধে বিজ্ঞানীরা ইউরোপে সমুদ্রপৃষ্ঠ ও সমুদ্রের গভীরে তাপমাত্রার পার্থক্য কাজে লাগিয়ে নতুন একটি প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করে তারা সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বাস্তবে পরিণত করেছেন। বিশেষ করে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য ও জ্বালানির মূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বার্থেই বিকল্প জ্বালানির চাহিদা ও ব্যবহার বেড়েই চলেছে। জ্বালানির জন্য বিকল্প শক্তি ব্যবহারের ভাবনা নতুন নয়। শুধু বিভিন্ন কারণে তা বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। জার্মানির মতো দেশে বিদ্যুতের মূল্য যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে এসব বিকল্প পথে বিদ্যুৎ উৎপাদনের আগ্রহ বাড়ছিই। সমুদ্রের উত্তাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা ভাবছেন তারা। সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা সাধারণত ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর চেয়েও বেশি। অন্যদিকে ১ হাজার মিটার গভীরে সমুদ্রের তাপমাত্রা প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ দুই স্তরের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য ২০ ডিগ্রিরও বেশি। বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের এ পার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব বলে জানিয়েছেন।

সমুদ্রশক্তি থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করার এ প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘ওশান থার্মাল এনার্জি কনভার্শন’ বা ‘ওটেক’। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদ্ধতিও বেশ সহজ। প্রথমে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পাইপের মধ্য দিয়ে সমুদ্রের গভীরের ঠাণ্ডা পানি সমুদ্রপৃষ্ঠে পাম্প করা হয়। এ ঠাণ্ডা পানি এক বিশেষ ধরনের গ্যাসকে তরল পদার্থে পরিণত করে। পরিশেষে এ তরল গ্যাস সমুদ্রপৃষ্ঠের গরম পানির সংস্পর্শে এসে ফুটতে থাকে। এ প্রক্রিয়া চালু রাখলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার টার্বাইন বা বিশাল চাকা ঘোরানো সম্ভব। কয়লার সাহায্যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রায় একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তবে ‘ওটেক’-এর ক্ষেত্রে তাপমাত্রা অনেক কম থাকে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় কোনোরকম কার্বন-ডাই অক্সাইডের নির্গমন ঘটে না। আর তাই এ প্রযুক্তিটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। সমুদ্রের উষ্ণতা বা সমুদ্রশক্তি থেকে বিদ্যুৎ তৈরিতে যারা কাজ করছে তাদের মধ্যে আছে ফ্রান্সের একটি জাহাজ নির্মাণ সংস্থা ‘ডিসিএনএস’। এর প্রতিনিধি এমানুয়েল ব্রশার বলেন, বায়ুশক্তি বা সৌরশক্তির ক্ষেত্রে সব সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। অপেক্ষা করতে হয় বাতাস বা রোদের জন্য। অথচ সমুদ্রের এ শক্তি কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই টানা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।

সমুদ্রশক্তিচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ উদ্যোগটি সর্বপ্রথম শুরু হয় আশির দশকে। বেশ কিছু প্রাথমিক যন্ত্রও তৈরি হয়েছিল সে সময়; কিন্তু তেলের দাম কম থাকায় খরচে পোষায়নি। এখন তেলের দাম বেড়ে চলায় ও পরিবেশের ক্ষতির কারণে ‘ওটেক’ পদ্ধতি আবার আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। তারা প্রাথমিক স্তরে একটি কেন্দ্র গড়ে তুলেছে, যা থেকে ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। ২০১৫ সালে কেন্দ্রটি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে সক্ষম হয়েছে। প্রকল্পটি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ মিটার ব্যাসের এক কৃত্রিম দ্বীপের মতো। এতে রয়েছে একটি লম্বা পাইপ, যা সমুদ্রের নিচে প্রায় ১ হাজার মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এ ছাড়া আছে বাষ্পচালিত একটি টার্বাইন যন্ত্র। এমন এক উৎপাদন কেন্দ্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এমন এক প্ল্যাটফর্ম ঠিক কোথায় বসানো হচ্ছে, সে অনুযায়ী প্ল্যাটফর্মের আকার ও আয়তন স্থির করতে হয়। যেমন ভারত মহাসাগরে সমুদ্রের ঢেউয়ের উচ্চতা ক্যারিবীয় সাগরের তুলনায় অনেক বেশি। ভাসমান এই এক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সেই ধাক্কা সামলাতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পাইপ নিয়ে, যা দিয়ে সমুদ্রের গভীরের ঠাণ্ডা পানি তোলা হবে। এ পাইপ হতে হবে স্থিতিশীল এবং দামেও সস্তা। সমুদ্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে নিঃসন্দেহে তা হবে একটি চমৎকার ও উজ্জ্বল প্রযুক্তি; কিন্তু এ প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে সেই এলাকার উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। তবে যেসব বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা কঠিন, এমন বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়।

লেখক: বিজ্ঞানবিষয়ক কলামিস্ট


পরিবর্তিত বিশ্বে উচ্চশিক্ষা ও বাংলাদেশ

আপডেটেড ১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১৫:২৯
ড. রাশিদ আসকারী

প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক, বক্তা এবং শিক্ষাবিদ স্যার কেন রবিনসন তার সাড়া জাগানো Out of Our Minds-(2011) গ্রন্থে বলেছেন, ‘The more complex the world becomes, the more creative we need to be to meet its challenges’- অর্থাৎ পৃথিবী যতই জটিল হয় তার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য আমাদের ততই সৃষ্টিশীল হওয়া দরকার। বর্তমান বিশ্বের শিক্ষাঙ্গনে এবং কর্মক্ষেত্রে রবিনসনের এই তত্ত্ব বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। সফল হতে হলে মানুষকে এখন সৃষ্টিশীল হতেই হয়। কিন্তু সাফল্যের ধারণা যেহেতু পরিবর্তনশীল তাই শিক্ষা পদ্ধতিকেও বারবার পরিবর্তিত অর্থাৎ যুগোপযোগী করতে হয়। বিশ শতকের শিক্ষাব্যবস্থায় অবশ্য সৃষ্টিশীলতার চাইতে অনুবর্তিতা (Compliance) এবং সাদৃশ্য (Comformity)-এর গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। একটা পেশাদার করপোরেট পরিবেশে যুগ যুগ ধরে ভালো চাকরির নিশ্চয়তার জন্য বিশ্বস্ত গুণাবলি হিসেবে কাজ করেছে এই অনুবর্তিতা এবং সাদৃশ্য। কিন্তু দ্রুততম পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তির অভাবিত উন্নয়নের যুগে এবং প্যানডেমিকের মতো বৈশ্বিক বিপর্যয়ের চরম অনিশ্চয়তার যুগে জীবন ও জগৎ টিকিয়ে রাখতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার।

আমরা এক নজিরবিহীন প্রযুক্তিগত উন্নয়নের যুগে বাস করছি। আমাদের হাতে রয়েছে এক বিশাল ও বিস্ময়কর তথ্যবিশ্বের চাবি। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ (প্রায় ৫ বিলিয়ন) ইন্টারনেট ব্যবহার করে। প্রায় ৪ বিলিয়ন গুগল সার্চ হয় প্রতি মিনিটে। প্রতি দুই দিনে আমরা এত তথ্য সৃষ্টি করি, যা সভ্যতার শুরু থেকে ২০০৩ পর্যন্ত সৃষ্ট তথ্যরাশির সমান অর্থাৎ ৫ এক্সাবাইট। বিশ্ব তথ্যভাণ্ডারের ৯০ শতাংশ সৃষ্টি হয়েছে মাত্র গত দুই বছরে। এই দ্রুতমভাবে বর্ধনশীল সংযোগ ব্যবস্থা, নজিরবিহীন প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণ ক্ষমতা, সীমাহীন তথ্য প্রবেশাধিকার এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবোটিকস, ইন্টারনেট অব থিংস, অটোনোমাস ভেইকেলস, থ্রিডি প্রিন্টিং ন্যানোটেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রভৃতি যুগান্তকারী প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন মানুষের অস্তিত্ব ও বিকাশের অনুকূলে কাজে লাগাতে হলে উচ্চশিক্ষাকে সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ হিসেবে দেখতে হবে।

একুশ শতকের শিক্ষাঙ্গনে সব স্তরে শিক্ষার্থী হিসেবে যারা জ্ঞানর্জন করছে, তাদের বলা হচ্ছে ডিজিটাল অধিবাসী (Digital Natives)। এরা দুটো প্রজন্ম ধরে গড়ে উঠেছে। প্রথমটি জেনারেশন জেড- যারা ১৯৯৫ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে জন্মলাভ করেছে এবং স্কুলজীবন থেকেই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, আইপ্যাড, স্মার্টবোর্ড প্রভৃতি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করছে। দ্বিতীয়টি জেনারেশন আলফা- যারা ২০১০-এরপর জন্মলাভ করেছে। এই প্রজন্মের কাছে ডিজিটাল ডিভাইস ডাল-ভাতের মতো ব্যাপার। এই দুই জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের আঙুলের ডগায় রয়েছে বিশ্ব-তথ্যভাণ্ডার। দেশভেদে এই ডিজিটাল নেটিভদের অবস্থাগত তারতম্য থাকলেও পৃথিবীর সব দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে যুগপ্রসূন এই প্রজন্মদ্বয়ের কথা মাথায় রাখতে হবে।

সময়ের পরিবর্তন ও পরিস্থিতির অনিবার্যতার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের অস্তিত্ব ও বিকাশের অনুষঙ্গী হিসেবে শিক্ষার তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, দ্রুত এবং নিয়ত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন শিক্ষার্থীদের হস্তান্তরযোগ্য/স্থানান্তরযোগ্য দক্ষতার (transferable skills) অধিকারী করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রাপ্ত তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং তৃতীয়ত, ২১ শতকের বৈশ্বিক লোকবলের (Digital workforce) উপযোগী করে পুরো প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে। এই তিন মূল লক্ষ্যকে মাথায় রেখেই উচ্চশিক্ষার রূপরেখা প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন প্রাজ্ঞ শিক্ষাবিদরা। তাই বলে, দেশ-সমাজ ও সংস্কৃতিভেদে নতুন সংযোজনকে নিরুৎসাহিত করা হয়নি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা বিভাগ ২১ শতকের দক্ষতাকে শিক্ষায় রূপান্তরিত করার জন্য ‘Partnership for 21st Century Learning’ নামে একটি মডেল (P21 Framework) প্রস্তাব করে, সেখানে আজকের শিক্ষার্থীদের জন্য চারটি মৌলিক দক্ষতার কথা বলা হয়। এক. সৃজনশীলতা/উদ্ভাবন (Creativity/Innovation) দুই. সমালোচনামূলক চিন্তন (Critical Thinking), তিন. যোগাযোগ (Communication) এবং চার. সহযোগিতা (Collaboration)। সৃষ্টিশীলতা বলতে তথ্য ও উদ্ভাবনকে নতুনভাবে প্রয়োগ করা বোঝাবে। সমালোচনামূলক চিন্তার দ্বারা নানা মাত্রিকভাবে তথ্য বিশ্লেষণ এবং উত্থাপিত দাবিগুলোকে সমালোচনা করা হয়। তথ্য সরবরাহ অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করার জন্য যোগাযোগ দরকার। আর সহযোগিতা বলতে টিমওয়ার্ক বা পার্টনারশিপ বোঝায়, যা যেকোনো অর্জনকে টেকসই করার জন্যে এক অনিবার্য উপাদান। সে কারণেই সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ১৭ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে পার্টারশিপ। এসব দক্ষতা অর্জনের সুতিকাগার হলো উচ্চশিক্ষাঙ্গন অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়। এই চারটি দক্ষতা অর্জন করা ছাড়া একজন শিক্ষার্থী নিজেকে ২১ শতকের উপযোগী শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে না।

সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী দক্ষতাসম্পন্ন সমালোচনামূলক চিন্তনের অধিকারী যোগাযোগক্ষম এবং সহযোগিতার মান এবং মানসিকতাসম্পন্ন শিক্ষার্থী উৎপাদন উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের অপরিহার্য উপাদান। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে কিংবা শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ কিংবা স্মার্ট বাংলাদেশ কিংবা ডেলটা প্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নের কারিগর হিসেবে কাজ করবে এই চার দক্ষতায় ঋদ্ধ শিক্ষার্থীরা। শেখ হাসিনা সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ একটি সুপরিকল্পিত, সুসমন্বত এবং সুদূরপ্রসারী শিক্ষানীতি। এখানে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন, বাংলাদেশ সংবিধানের আর্টিকেল ১৭, জাতিসংঘের এডুকেশন ফর অল পলিসি, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস এবং অন্যান্য শিক্ষাসংক্রান্ত বৈশ্বিক ঘোষণাপত্রের প্রভাব রয়েছে। এই শিক্ষানীতির মৌলিক দিকগুলো অক্ষুণ্ন রেখে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বায়নের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বাংলাদেশের স্নাতকদের একুশ শতকের উপযোগী ওয়ার্ক ফোর্স হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের উচ্চশিক্ষা কাঠামোকে বারবার আধুনিকায়ন করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিকীকরণ এবং শিক্ষার্থীর বিশ্বায়ন ছাড়া সম্ভবপর নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ মূলত চারটি স্তম্ভের ওপর নির্ভরশীল: এক. মানবসম্পদ উন্নয়ন, দুই. নাগরিকদের সংযুক্তকরণ, তিন. ডিজিটাল প্রশাসন এবং চার. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন।

মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য ইতোমধ্যে অনেক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। দক্ষ ও ডিজিটাল-রেডি লোকবল সৃষ্টির জন্য প্রতি বছর ৫ লাখ স্নাতকের মধ্যে ৭০ হাজারকে ITES (Information Technology Enabled Services) পেশাদার হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অনলাইন লোকবল সরবরাহ করে। নাগরিক সংযুক্তকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে শতভাগ সংযুক্তি স্থাপনে সক্ষম হবে বলে আশাবাদী। বর্তমানে ৯৫ মিলিয়ন ইন্টারনেট এবং ১৬৫ মিলিয়ন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী জনসংখ্যা বাংলাদেশকে এশিয়া প্যাসিফিকের মধ্যে পঞ্চম মোবাইল মার্কেট এবং বিশ্বের মধ্যে নবম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড (BSCCL) বাংলাদেশের মানুষকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ফাইবার অপটিক সাবমেরিন ক্যাবল ব্যান্ডউইথ এবং সর্বাধুনিক ইন্টারনেট ট্রানজিট সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্তি করেছে। আরও উত্তেজনাকর খবর হলো বাংলাদেশ অচিরেই তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে সংযুক্ত হতে যাচ্ছে, যার ফলে আমরা প্রতি সেকেন্ডে ৬ টেরাবাইট (৬০০০ গিগাবাইট) ব্যান্ডউইথ পাব, যা প্রায় অবিশ্বাস্য। ই-গভর্ন্যান্সেও আমরা ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটির স্বীকৃতি পেয়েছি। দেশজুড়ে ৮ হাজার ২৮০টি ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে, যা ডিজিটাল ডিভাইস সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের চতুর্থ স্তম্ভ আইসিটি ক্ষেত্রেও অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে, যা জনগণকে আর্থিক, টেলিযোগাযোগ এবং স্বাস্থ্যসেবায় সহায়তা দিচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ১২০টি কোম্পানি বিশ্বের ৩৫টি দেশে ICT দ্রব্যাদি রপ্তানি করে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করছে, যা অতিশিগগিরই ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। ICT শিল্পের টেকসই উন্নয়ন বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল অর্থনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে জ্ঞান অর্থনীতিতে (knowledge economy) উন্নীত করবে।

বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত সময়ের আগেই উন্নয়নশীল দেশের স্ট্যাটাস পেয়েছে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শিল্পোৎপাদনে গতিশীলতা এসেছে। কিন্তু কেবল কৃষি আয় শিল্পোন্নয়ন দিয়ে উন্নত দেশে উত্তরণ সম্ভব নয়। সার্ভিস সেক্টরের উন্নয়ন দরকার। বিশ্ব অর্থনীতির বৃহত্তম খাত হলো সেবা খাত। বাসন পরিষ্কার করা থেকে বিমান চালনা, রক কনসার্ট থেকে ব্রেইন সার্জারি কিংবা সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট সবই সার্ভিস সেক্টরের ভেতরে পড়ে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সবগুলোই অর্থনৈতিক ভিত, মূলত এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের যে বিশাল জনশক্তি রয়েছে, তাকে বৈশ্বিক জনসম্পদে রূপান্তরিত করে বাংলাদেশের সার্ভিস সেক্টরের উন্নয়ন ঘটানো যাবে। সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নতুন নতুন ভূমিকা পালন প্রয়োজন। ইনোভেশন হার, একাডেমিক ইনকিউবেটর হিসেবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রস্তুত করতে যাবে। সিলিকন ভ্যালি স্পিরিট অর্থাৎ হাইটেকনোলজি, ইনোভেশন, ভেনচার ক্যাপিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়ার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উদ্ভাবক, গবেষক, উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। কেবল সার্টিফিকেটধারী সরকারি চাকরিপ্রত্যাশী সনাতনী স্নাতক বনে থাকার দিন অনেক আগেই শেষ হয়েছে। চারটি মৌলিক প্রবণতা বর্তমান বিশ্বের সমাজ-সভ্যতা-রাষ্ট্র সবকিছুকে প্রভাবিত করছে। প্রথমত, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা; দ্বিতীয়ত, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দায়; তৃতীয়ত, দ্রুত নগরায়ণের প্রকোপ মোকাবিলা এবং চতুর্থত, চতুর্থ শিল্পবিপ্লরের অভিঘাত মোকাবিলা। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার নীতিনির্ধারণে এবং বাস্তবায়নে বিষয়গুলো মাথায় রাখাতে হবে।

মোদ্দা কথা হলো, বাংলাদেশে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর সর্বজনীন মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেখানে কোর্স-কারিকুলাম আমাদের জাতীয় ভিশন-মিশন-লক্ষ্য-পরিকল্পনা প্রভৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে প্রণীত হবে। এর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য থাকবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবসহ সব অনিবার্য বিশ্বপরিস্থিতির মোকাবিলা করা- বাংলাদেশের উন্নয়নেরে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এবং বৈশ্বিক জ্ঞান অর্থনীতিতে অবদান রাখা। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তাহলে উচ্চশিক্ষা জাতির মস্তিষ্ক। মস্তিষ্ক পরিচালনা করে সব দেহকাণ্ডকে। মস্তিষ্ক আবার সক্রিয় থাকে চর্চায়, অনুশীলনে। আর সেই অনুশীলনের সবচাইতে উপযুক্ত ক্ষেত্র হোলো উচ্চশিক্ষা।

ড. রাশিদ আসকারী: দ্বিভাষিক লেখক, অনুবাদক এবং সাবেক উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।


দক্ষিণ এশিয়ায় পোলিওর ‘সুপার-স্প্রেডর হতে পারে পাকিস্তান

আপডেটেড ৩০ নভেম্বর, ২০২৩ ১৮:৪১
ফারাজী আজমল হোসেন

রক্ষণশীলতা আর কুসংস্কারে আচ্ছন্নতাই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাল হচ্ছে। একুশ শতকে এসেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত ভয় হয়ে জেঁকে আছে পোলিও। অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের আরও ছয়টি জেলার পরিবেশগত নমুনায় নতুন করে পোলিও ভাইরাস নিশ্চিত করা হয়েছে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, গত ১০ নভেম্বর করাচি থেকে চারটি এবং চমন থেকে দুটি নমুনায় পোলিও ভাইরাস নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া পেশোয়ার, কোহাট এবং নওশেরা থেকে একটি করে নমুনায়ও ভাইরাসটির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এমন স্বাস্থ্যসংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও পোলিও টিকাবিরোধী একটার পর একটা পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বকে হতবাক করে চলেছে দেশটির কট্টরপন্থিরা। খুব সম্ভবত পাকিস্তানের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তানকেও ছাড়িয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য এটি বড় এক উদাহরণ। মৌলবাদীদের প্রশ্রয় না দেয়ার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কতটা এগিয়ে দিয়েছেন তার এক দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচনা করা যায় পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রণহীন পোলিও সংক্রামণের বিষয়টি।
চলতি বছরেই আগস্টে পাকিস্তানে পোলিও টিকাদান প্রচারাভিযানে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, শিশুদের পোলিওমুক্ত করার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে পাকিস্তান এখন বিশ্বব্যাপী একটি হুমকি। রক্ষণশীল পাকিস্তানের গ্রামীণ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে পোলিও টিকা দেয়ার প্রচারণার বিরোধিতা করে আসছে কট্টরপন্থি ধর্মীয় দলগুলো। পোলিও টিকাদান কর্মসূচিকে তারা দেখেছে মুসলিম শিশুদের বন্ধ্যত্বকরণের একটি চক্রান্ত হিসেবে। এ ছাড়া পোলিও টিকাদানকারীদের সরকারি গুপ্তচর হিসেবে দেখে রাষ্ট্রবিরোধী জঙ্গিরা। পাকিস্তান এবং তার প্রতিবেশী আফগানিস্তানই বিশ্বের একমাত্র দুটি দেশ যেখানে শিশুদের স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলেছে পোলিও।

আবিষ্কৃত ভাইরাসের সর্বশেষ ধরনটি আফগানিস্তানের ‘ওয়াইবি৩এ’ ভাইরাস ক্লাস্টারের অন্তর্গত উল্লেখ করে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. নাদিম জান বলেন, প্রতিটি শিশু ভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের আজীবন পঙ্গু করে দিতে পারে ভাইরাসটি। গত ২ অক্টোবর অভিভাবকদের নিজেদের বাড়িতে পোলিওকর্মীদের স্বাগত জানাতে এবং তাদের সন্তানদের আজীবন অক্ষমতা থেকে রক্ষা করতে টিকা দেয়ার অনুরোধ করেছিলেন তিনি। ৫ বছরের কম বয়সী ৪৪ মিলিয়ন শিশুকে টিকা দেয়ার প্রয়াসে দ্বিতীয়বারের মতো দেশব্যাপী পোলিওবিরোধী অভিযান চলছিল এ সময়। সম্প্রতি সংগৃহীত নয়টি পরিবেশগত নমুনার মধ্যে টাইপ-১ ওয়াইল্ড পোলিও-ভাইরাসও (ডব্লিউপিভি১) রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেও পোলিওর প্রচারাভিযানে গিয়ে হামলার শিকার হচ্ছেন ভ্যাকসিনকর্মী ও তাদের সুরক্ষার জন্য নিযুক্ত পুলিশ। জঙ্গিরা এ টিকাদান কর্মসূচিকে প্রচার করছে পাকিস্তানি শিশুদের বন্ধ্যাকরণের একটি পশ্চিমা ষড়যন্ত্র বলে। মাত্র সপ্তাহ দেড়েক আগেই হাঙ্গুর উপকণ্ঠ সরোজাইতে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের হাতে নিহত হয়েছেন ওরাকজাই নামে পোলিও দলের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এক পুলিশ সদস্য। এর আগে, একই বছরের আগস্টে পোলিও টিকাদানকারীদের ওপর আরেকটি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানে। ওই হামলায় প্রাণ হারান দুই পুলিশ সদস্য। বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটায় জাতীয় টিকাদান অভিযানের সময় গুলি চালানোর এ ঘটনাটি ঘটে। স্থানীয় নাওয়া কিলি এলাকায় তখন শিশুদের পোলিওর ডোজ খাওয়াচ্ছিলেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। হঠাৎ একটি মোটরসাইকেলে এসে দুই ব্যক্তি তাদের ওপর গুলি চালায় এবং ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। গুলিতে দুই পুলিশ মারা গেলেও পোলিও টিকাদানকারীরা অক্ষত অবস্থায় রক্ষা পান। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা মারওয়াত জানান, ওই এলাকায় পোলিও অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। প্রাণঘাতী এ হামলার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে কোনো দায় স্বীকার করা হয়নি, তবে পোলিওকর্মীদের ওপর জঙ্গি হামলা পাকিস্তানে অস্বাভাবিক নয়। সহিংসতায় বহু স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন এবং নিরাপত্তা বাহিনী তাদের রক্ষা করছে। পোলিও অভিযানে নারী-পুরুষ, পুলিশ এবং নিরাপত্তাকর্মীসহ ২০০ জনেরও বেশি পোলিও দলের কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন গত কয়েক বছরে। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক আহতও হয়েছেন এসব সহিংসতায়।

২০১২ সাল থেকে এক খাইবার পাখতুনখোয়া (কেপিকে) প্রদেশেই ৭০ জন পোলিওকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের মার্চে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনের একটি গবেষণা নিবন্ধে বিষয়টির উল্লেখ আছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে কোয়েটায় একটি আত্মঘাতী হামলায় মারা যান আরও কয়েকজন পোলিওকর্মী। একই শহরের আরেকটি হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ৬ জন নারী পোলিওকর্মী। পোলিও প্রচারাভিযানকালে ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সমগ্র পাকিস্তানজুড়ে ৬৮ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আরেকটি সূত্র। শুধু গোলাগুলিই নয়- পোলিও সচেতনতা ছড়ানোর দায়ে অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনাও নেহাত কম নয়। করাচি এবং কেপিকে প্রদেশে মৌখিক ও শারীরিক নির্যাতনের একাধিক ঘটনায় প্রতিবেদনও হয়েছে অতীতে। পোলিও অভিযানে জড়িত থাকায় খাইবার এজেন্সি থেকে অপহরণ করা হয়েছিল ১১ জন শিক্ষককে। এভাবে, সমস্যার স্কেল বেশ ভয়ংকর।
অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসটি নির্মূল করার জন্য চলতি বছরের আগস্ট থেকে তার সর্বশেষ পোলিও টিকাদান অভিযান শুরু করে পাকিস্তান। সপ্তাহব্যাপী অভিযানের লক্ষ্য ছিল বেলুচিস্তানসহ ৬১টি জেলাজুড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৮ মিলিয়ন শিশুকে টিকা দেয়া। লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ৬৫ হাজার কর্মী মোতায়েন করেছিল প্রাদেশিক সরকার। পাকিস্তানে ২০২৩ সালে এ পর্যন্ত পোলিও পক্ষাঘাতের তিনটি ঘটনা ঘটেছে। গত বছর আক্রান্ত হয়েছিল ২০ জন। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত পাকিস্তানে প্রতি বছর হাজার হাজার শিশুকে পঙ্গু করে দিত অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসটি। এতসব বাধা পেরিয়ে পোলিও নির্মূলে সরকার যখন টিকা প্রচারাভিযান শুরু করল ঠিক তখনই আরেকটি নতুন স্ট্রেইনের আত্মপ্রকাশ বড় এক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানের জন্য। একইসঙ্গে ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে প্রচারণা, জঙ্গি হামলা এবং মারাত্মক পঙ্গু রোগ নির্মূল করার জন্য পাকিস্তানের প্রচেষ্টাকেও পিছিয়ে দিয়েছে এ কারণটি। পোলিওবিরোধী টিকাদানে বাধা সৃষ্টিকারী প্রাথমিক কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের শিশুদের টিকা দিতে দ্বিধাগ্রস্ত। ২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি নিবন্ধ দুটি কারণের কথা উল্লেখ করেছে ল্যানসেট। পাকিস্তানে শিশুদের ডব্লিউএইচও দ্বারা সুপারিশকৃত সংখ্যার চেয়ে বেশি ডোজ দেয়া হয়। কিন্তু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বুস্টার ডোজের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা না থাকা এটি জনসাধারণের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা বাড়াচ্ছে। উপরন্তু, স্টোরেজ এবং পরিবহনের সময় ভ্যাকসিনের ভুল ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, পোলিও টিকা দেয়ার পরে শত শত শিশুকে পেটে ব্যথা ও বমির উপসর্গ দেখা দেয়ায় এবং অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে গুজব রটানো হয় ২০১৯ সালে। খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে একটি স্বাস্থ্য-পরিচর্যা কেন্দ্র পুড়িয়ে দিয়েছে ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা। পাকিস্তান সরকার পরে গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত মূল ষড়যন্ত্রকারীকে গ্রেপ্তার করে পরিস্থিতি সামাল দেয়। এরপরও এ ঘটনার ফলে অনেক অভিভাবকের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। পোলিও টিকাদানকারীদের প্রতি এ বৈরী মনোভাব এবং ধর্ম ও পোলিও ভ্যাকসিন সম্পর্কে ভুল ধারণা একটি বড় জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তান সরকারের জন্য।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো রাষ্ট্রগুলোর কারণে পোলিওমুক্ত হওয়ার পরও ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০০৬ সালে (১৮ জন) পোলিও রোগী পাওয়া গিয়েছিল বাংলাদেশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার সফলতায় বাংলাদেশ পোলিওমুক্ত হলেও এখনো ঝুঁকিমুক্ত নয়। কারণ, ভাইরাস বহনকারী শিশুটি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, ভাইরাসটি অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
ডব্লিউএইচও ২০১৪ সালে বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার ১১টি দেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করে। এ ছাড়া ২০০০ সালের আগে প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ জনের মতো প্যারালাইজড পোলিও রোগী পাওয়া যেত। ২০০০ সালের পর দীর্ঘদিন দেশে কোনো পোলিও রোগী পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন পোলিওমুক্ত ঘোষণার অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ডব্লিউএইচও বাংলাদেশকে তখনো একটি সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে। ২০০৬ সালে পোলিওমুক্ত ঘোষণার সময় এলেও সেই বছর হঠাৎই দেশে ১৮ জন পোলিও রোগী পাওয়া যায়। এরপর বাংলাদেশে আর কোনো পোলিও আক্রান্ত রোগী পাওয়া না গেলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পোলিও সংক্রমণ পাওয়া যাওয়ার কারণে আরও আট বছর লেগে যায় পোলিওমুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি পেতে। ১৯৭০-এর শুরু থেকে পোলিও নির্মূলে কাজ করে সফলতার মুখ দেখতে ২০ বছর লেগে যায় দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের। পাকিস্তানের মতো শিশুদের টিকা খাওয়ানোর ব্যাপারে অনাগ্রহ ও দ্বিধা ছিল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অভিভাবকদের মধ্যেও। পোলিওর বিরুদ্ধে সফলতা খুব একটা সহজ ছিল না। একটা সময় এমনও ছিল যখন মানুষ তার সন্তানকে টিকা খাওয়াতে চাইত না। গ্রামাঞ্চলের মানুষকে বিষয়টি সম্পর্কে অনুধাবন করাতে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। সঠিক ও সুকৌশলী কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে পোলিও নির্মূলে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের সফলতা এসেছে বেশ দ্রুতগতিতে। তা ছাড়া সতর্কতামূলক কার্যক্রম হিসেবে নিয়মিত প্রতি বছর টিকাদান কর্মসূচি চালু আছে, যাতে আর কোনো শিশু পোলিওতে আক্রান্ত না হয়। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে গড়া কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাপনা। মানুষের ঘরের কাছে টিকা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে এ কমিউনিটি ক্লিনিক। শুধু তাই নয়- নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শিশুমৃত্যু হ্রাসে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে কমিউনিটি ক্লিনিক।
তবে এর মধ্যেও আশঙ্কাজনক ব্যাপার হচ্ছে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে কিছু পোলিও রোগী এখনো পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিবছর এখনো দুই থেকে তিনজন রোগী পাওয়া যাচ্ছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে অনেক মানুষ এ দেশে আসা-যাওয়া করে। এদের মধ্যে জীবাণু বহনকারী যে কারও মাধ্যমে পোলিও রোগ ছড়াতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যখন ১৯৮৮ সালে বিশ্ব পোলিও নির্মূলীকরণ উদ্যোগটি নেয়, তখন পর্যন্ত আনুমানিক ৩ লাখ ৫০ হাজার শিশু পোলিওর কারণে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। বর্তমান বিশ্বে শুধু পাকিস্তান ও আফগানিস্তানেই স্থানীয়ভাবে ছড়ায় সংক্রামক ভাইরাসটি। ফলে বিশ্বের অন্যান্য অংশে পোলিও সংক্রমণের উৎস হতে পারে দেশ দুটি। পাকিস্তান অবশ্য বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতীয় জরুরি কর্মপরিকল্পনার অধীনে কার্যকর কৌশলের রূপরেখা দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এ পরিকল্পনায় পোলিওকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য কোনো নীতি ও কৌশলগত অগ্রাধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সর্বশেষ গৃহীত কার্যকর কৌশলের রূপরেখা সফল না হলে পোলিওর পরবর্তী ‘সুপার-স্প্রেডর’ হতে পারে পাকিস্তান।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বিষয়:

গ্রামের কুয়া বা ইন্দারা  

আপডেটেড ৩০ নভেম্বর, ২০২৩ ১৮:৩৩
আলমগীর খোরশেদ 

আগের দিন মানুষের সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানি পানের জন্য পুকুর, জলাশয়, নদী-নালার পানিই ছিল একমাত্র ভরসা। সমাজে যারা বিত্তবান তারা কুয়া বানাতেন। ১০ থেকে ১৫ ফুট গোল গর্ত, ৫০ থেকে ৬০ ফুট নিচ পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে ইন্দারা, কুয়া বা কুপ তৈরি করা হতো। পুরোনো দিনে জমিদার, রাজা, বাদশা রানীরা তাদের প্রজাদের পানির ব্যবস্থা করে দিতেন পুকুর, কুয়া বা ইন্দারা স্থাপনের মাধ্যমে। ষাটের দশকেও যাদের জন্ম, তাদের অভিজ্ঞতায় সুপেয় পানির অভাব, পুকুরের জলাশয়ের পানি পান করে কলেরা, টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা থাকার কথা। কুয়া বা ইন্দারা সারাবিশ্বে পানীয় জলের একমাত্র উৎস হিসেবে জানত মানুষ। আমাদের নবী করিমের (সা.) বিভিন্ন বর্ণনায় কুয়া চলে এসেছে। নবী ইউসুফ (আ.)-কে ভাইদের দ্বারা কুপে নিক্ষেপের কাহিনি সর্বজন বিদিত। তার মানে কুয়া বা ইন্দারা অনেক ঐতিহ্যপূর্ণ পুরোনো এক সংস্কৃতি। যার মূল্যবান ইতিহাস পাওয়া যায়। দৈনন্দিন কাজে পান করা ছাড়াও পানির বহুবিদ ব্যবহার অস্বীকার করা যায় না। গ্রীষ্মকালে পুকুর, খাল, বিল, নদী-নালা শুকিয়ে যেত। তখন এসবের পানি নোংরা হয়ে যেত, যা পান করার মতো থাকত না। ফলে কুয়া নির্মাণ করার প্রয়োজন দেখা দিত।

যারা বিত্তবান, তারা সান বাঁধানো বিশাল পানির ইন্দারা বানিয়ে নিতেন।

কুয়া ও ইন্দারার মধ্যে পার্থক্য হলো, ইন্দারার নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত ইট বা মাটির তৈরি রিং যা ইটের মতো আগুনে পোড়ানো ও বেশ শক্ত হতো। আর কুয়া লম্বা করে গভীর গর্তই থাকত, কোনো রূপ বাঁধাই করা হতো না। ইন্দারা অনেক জায়গা ধারণ নিয়ে তৈরি হয়। শহরে, গ্রামে সব জায়গাতেই ইন্দারা ও কুয়া দেখা যেত। ইন্দারার ওপর চাকা লাগানো হতো, যা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ইন্দারা থেকে পানি উত্তোলনের জন্য কপিকল ব্যবহার করা হতো। সন্ধ্যা ও সকালে পাড়ার বৌ-ঝিরা কলসি কাঁকে নিয়ে ইন্দারা বা কুয়া পাড়ে জমা হতেন পানি নেয়ার জন্য। রশিতে ছোট বালতি বেঁধে কুয়া বা ইন্দারা থেকে পানি উঠানো হতো। পানির জন্য রশি পচে গিয়ে বালতিটি কুয়া বা ইন্দারার ভিতর কখনো বা কখনো পড়ে যেত। বালতি উঠানোর জন্য বড়শির মতো কাঁটাওয়ালা লোহার তৈরি হুক ব্যবহার করা হতো। হুকটি লম্বা কাঁটা মানে চিকন লম্বা নলি বাঁশের মাথায় বেঁধে কুয়ার ভিতর একদম নিচে আস্তে আস্তে ঘুরাতে থাকলে বালতিটি বড়শির মতো থাকা কাঁটায় আটকে যেত। তখন আস্তে আস্তে নলি বাঁশটি টেনে তুললে বালতিও সঙ্গে চলে আসত। গোল রিং দেয়া কাঁচা বা পাতি কুয়ার ভিতরের দিকে পা রাখার খাবিকাটা মানে রিংয়ের বধির্ত অংশ থাকত, যা দিয়ে সাহসীরা কুয়ার নিচে বেয়ে বেয়ে নামতে পারতেন।

ইন্দারা বা কুয়ার মুখে নিচ দিকে চেয়ে জোরে চিৎকার করে উঠলে সেই শব্দটা কুয়া বা ইন্দারার ভিতর প্রতিধ্বনি হতো, কুয়ার ভিতর কোনো কিছু ফেললে তার শব্দটাও ইকো হয়ে কানে লাগত, যা ছোটবেলার একটা খেলা বলে মনে হতো।

কুয়া বা ইন্দিরার পানি খুব ঠাণ্ডা থাকে। ফলে তীব্র গরমের দিনে ইন্দারা বা কুয়ার পানি উঠিয়ে গোসল করা খুব আরাম দায়ক ছিল। বৃটিশ আমলে প্রতিটা রেলস্টেশনে, আদালত চত্বরে, থানা চত্বরে সরকারিভাবে ইন্দারা বা কুয়া নির্মাণ করে দেয়া হতো। প্রতিটা হিন্দু বাড়িতে একটা কুয়া অপরিহার্যভাবে থাকত। পাশেই হয়তো করমচা গাছ, কামরাঙা গাছ, তুলসীর বেদী, জবাফুলের গাছ। কুয়ার কাজটায় সাধ্যমতো পাকা করে দেয়া হতো, পানি সংগ্রহে সুবিধার জন্য। সকাল-সন্ধ্যায় পাড়ার মহিলারা পানি নিতে কুয়া পাড়ে আসতেন। ফলে পুরো পাড়ার সব খবরাখবর এক কান থেকে দুই কান হয়ে ছড়িয়ে পড়ত। এখানেও চলত নানান সামাজিক দায় ও ভিলেজ পলিটিক্স।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সেনারা রাজাকারদের সহযোগিতায় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে বড় কুয়া বা ইন্দারায় ফেলে দিয়েছিল। ফলে সেই সব ইন্দারা বা কুয়া আজও বধ্যভূমি হয়ে আছে। যদিও সেইসব কুয়া এমনিতেই ভরাট হয়ে গেছে। কুয়া বা ইন্দারা নিয়ে সাহিত্যে অনেক গল্প, উপন্যাস রচিত হয়েছে।

এখনকার দিনে সারা গ্রাম হেঁটে এলেও একটা কুয়া বা ইন্দারা খোঁজে পাওয়া যাবে না। সুপেয় পানির নিশ্চয়তায় টিউবওয়েল চলে এসেছে অনেক আগেই। বিদ্যুৎ আসায় এখন গ্রামেও পানির পাম্প ব্যবহার করে, ট্যাঙ্কে পানি ধারণ করে পাইপের দ্বারা পানির টেপের মাধ্যমে মানুষ সহজ করে নিয়েছে তাদের প্রাত্যহিক জীবন। অতীত সবসময়ই বর্তমানকে পথ দেখায়। কুয়া বা ইন্দারা আমাদের হাজার বছর আগের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এমন একদিন আসবে, পরবর্তী প্রজন্ম কুয়া বা ইন্দারা কি, কীভাবে তৈরি হয়, কি কাজে ব্যবহৃত হয়, তার আদ্যোপান্ত কিছুই জানবে না।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক ও গবেষক


এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল

আপডেটেড ৩০ নভেম্বর, ২০২৩ ১৮:৩৩
সম্পাদকীয়

গত ২৬ নভেম্বর রোববার ২০২৩ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এ বছর গড়ে পাসের হার ১১টি শিক্ষা বোর্ডে ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আমরা যদি করোনাভাইরাসের সময় থেকে পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব, ২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষাই হয়নি। ভিন্ন মূল্যায়নে তখন সবাই পাস করেছিল। পরের বছর শুধু বিভাগভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছিল। তখন পাসের হার হয়েছিল প্রায় ৯৬ শতাংশ। আর গতবার মানে ২০২২ সালে পরীক্ষা হয়েছিল এক একটি বিষয়ে অর্ধেক নম্বরের ভিত্তিতে। তখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে পরীক্ষাই হয়নি। তাতে পাসের হার ছিল ৮৪ শতাংশের বেশি। কিন্তু এবার পুনর্বিন্যাস করা পাট্যসূচিতে পরীক্ষা হলেও একটি বাদে সব বিষয়ের পরীক্ষা শেষ সময়ে এসে ১০০ নম্বরের পরিবর্তে ৭৫ নম্বরে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এবার আগের তিন বছরের তুলনায় ফল বেশ খারাপ হয়েছে। পাসের হার গত বছরের চেয়ে ৮ শতাংশ কমে গেছে। আর ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ কমেছে গত বছরের চেয়ে অর্ধেকের বেশি।

নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় এবার মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১১ লাখ ১২ হাজার ৩৭২ জন। এর মধ্যে পাস করেছে ৮ লাখ ৪৪ হাজার ২৬৯ জন। পাসের হার ৭৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭৮ হাজার ৫২১ জন পরীক্ষার্থী। নয়টি সাধারণ বোর্ডের মধ্যে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ, কুমিল্লা বোর্ডে ৭৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে ৭৮ দশমেক ৪৬ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে ৮০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, সিলেট বোর্ডে ৭৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, ময়মনসিংহ বোর্ডে ৭০ দশমিক ৪৪ শতাংশ, দিনাজপুর বোর্ডে ৭০ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং যশোর বোর্ডে পাসের হার ৬৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। পাশাপাশি এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে। ফলাফলে দেখা গেছে, এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষায় অংশ নেয়া সাড়ে ১৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯২ হাজার ৩৬৫ জন। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। সেই হিসাবে এ বছর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৮৩ হাজার ৯১৭ জন। দেশের ৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো শিক্ষার্থী পাস করেনি। অন্যদিকে দেশের ৯৫৩টি প্রতিষ্ঠান শতভাগ পাসের গৌরব অর্জন করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, শূন্য পাসের প্রতিষ্ঠান গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। গত বছর ৫০টি প্রতিষ্ঠানের কেউই পাস করেনি।

এবারের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কোনো প্রতিষ্ঠানে কেউই পাস করেনি। এটা খুবই দুঃখজনক। যেসব প্রতিষ্ঠান পাস করেনি, সেসব প্রতিষ্ঠানে কেন পাস করেনি, এর কারণ বের করতে হবে। ভালো ছাত্র কি ছিল না, নাকি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ভালো ছিল না, নাকি স্কুলের পরিবেশ ভালো ছিল না, নাকি অন্য কিছু- বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে নজরে আনতে হবে। আর যারা পাস করেছে, তাদেরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি আর যারা ফেল করেছে তারা যাতে সামনে ভালো করতে পারে, সেদিকে শিক্ষকদের নজর দিতে হবে। তাই এবারের পরীক্ষা নিয়ে কর্তৃপক্ষের বিশ্লেষণ করা উচিত বলে মনে করি। যারা শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করেন, যারা শিক্ষা নিয়ে পর্যলোচনা করেন, সেসব পর্যবেক্ষকদের উচিত কোথায় এর গলদ রয়েছে, সেটা পর্যক্ষেণ করে এর কারণ বের করা। এবং সে বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষের নজরে দেয়া, যেন আগামীতে সবাই পাস করে বের হতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠান যেন শূন্য না থাকে এবং সবাই যেন কৃতকার্য হয়ে ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে, এই প্রত্যাশা সবার।

বিষয়:

চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার অর্থনীতি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আতিউর রহমান

চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার নিশ্চয় একটি অর্থনৈতিক মূল্য বাংলাদেশকে গুনতে হচ্ছে। প্রতিদিন আমাদের গড় জিডিপি যদি দেড় বিলিয়ন ডলার হয় তাহলে এর এক-তৃতীয়াংশ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার। এর মূল্য ৫-৬ হাজার কোটি টাকার কম নয়। আর এ মূল্যের বেশির ভাগই গুনছেন উদ্যোক্তা। বিশেষ করে (অনানুষ্ঠানিক), শ্রমজীবী মানুষ এবং পরিবহনকর্মীরা। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা যখন তৈরি হয়, তখন এক ধরনের ভীতির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এ ভীতির সংস্কৃতির ফলে বিশেষ করে নগরে মানুষ ঘর থেকে খুব একটা বের হতে চায় না। যারা ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত, তারাও খুব সতর্ক থাকেন। বিশেষ করে পরিবহন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কখন তাদের পরিবহনটি ভাঙচুর হয় কিংবা আগুনে পুড়ে যায় সেই দুর্ভাবনায় কুঁকড়ে থাকেন তারা। চালক ও সহায়ককর্মীদের দুশ্চিন্তা আরও বেশি। কাজ নেই। আয়ও নেই। তদুপরি আছে আহত হওয়ার শঙ্কা। অনানুষ্ঠানিক খাত যেটাকে বলা হয়, সেটিতে খুব প্রভাব পড়ে। দেশের ৮০-৮৫ শতাংশ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনানুষ্ঠানিক খাতেই প্রবাহিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ এসব কাজের সঙ্গে জড়িত। ফলে যেটা হয় অনানুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে যারা ছোট ব্যবসা করে, রাস্তার পাশে চায়ের দোকান করে কিংবা নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে সারা দিন ব্যবসা করে বিকেলবেলা চলে যায়, এ খাতের মানুষ বড় বিপদে পড়েছে। প্রথমত, তাদের জন্য পণ্য সংগ্রহ করা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা এখন খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এতে তাদের উপার্জনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এরকম ভয়ের সমাজে পরিবহন সংকটের কারণে সরবরাহে সংকট দেখা দেয়। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া কঠিন হয়ে যায়। এ ভয়ের একটা প্রিমিয়াম আছে। ভয়ের মধ্যে কাজ করতে চাইলে বিশেষ করে ভ্যান, ছোট ছোট ট্রাক, তারা যদি ভয় পায় তাদের বাহন পুড়িয়ে দেবে, তাহলে তারা বেশি ভাড়া চাইবে। কারণ তাদের তো বীমা করা নেই। বীমা থাকলে এত ভয় পেত না। আবার পরিবহন ব্যবস্থা নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। দূরপাল্লার পরিবহন চালু রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সবাই ভয় পাওয়ায় ট্রাকওয়ালারা নামতে চাইছে না। নামতে চাইলেও অনেক ভাড়া দাবি করছে। এ কারণে শহরে গ্রাম থেকে আসা জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, অবরোধের আগে আদা, রসুন কিংবা পেঁয়াজের যে দাম ছিল, এখন খোঁজ নিলে জানা যাবে কি পরিমাণ দাম বেড়েছে। অথচ গ্রামের কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য কম দামে বেচতে হচ্ছে। অন্যদিকে শহর থেকে যাওয়া পণ্য গ্রামে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলেই এমনটি হচ্ছে। সরবরাহের ঘাটতি অর্থনীতিকে এ অবস্থায় উপনীত করেছে। তবে ধীরে ধীরে মানুষ এ ভয়কে জয় করে রাস্তায় বের হতে শুরু করেছেন। দূরপাল্লার পরিবহন চলাচল আগের চেয়ে বাড়ছে। তবে পরিবহনে বিচ্ছিন্ন অগ্নিসংযোগ এখনো চোখে পড়ছে।

ছোটখাটো বিনিয়োগ করতে গেলেও তো অর্থ জোগাড় করতে হবে। আর অনিশ্চিত অবস্থায় কীভাবে বিনিয়োগ করবে? যেমন কেউ যদি তার প্রবাসী কোনো আত্মীয়-স্বজনের কাছে ছোট একটা দোকান দেয়ার জন্য ১০০-২০০ ডলার চায়, তাহলে তাকে বলা হবে এখন থাক, পরিস্থিতি আগে শান্ত হোক। যতক্ষণ পর্যন্ত শান্ত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা কোনো বিনিয়োগ নতুন করে করবেন না। এ পরিস্থিতিতে বড় বিনিয়োগকারীদেরও সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে রপ্তানি খাতে তারা পণ্য বন্দরে নিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছেন। অনেক কাভার্ড ভ্যান পোড়ানো হচ্ছে। আবার আমাদের রপ্তানি খাতের ৮০ শতাংশ আমদানি খাতের সঙ্গে জড়িত। বিদেশ থেকেও অনেক কাঁচামাল ও মধ্যম জিনিসপত্র আমদানি করতে হয়। সুতরাং, দুই দিক থেকেই সংকট তৈরি হচ্ছে। গাড়ি নিয়মিত বন্দরে যাচ্ছে না, পণ্য রপ্তানি সম্ভব হচ্ছে না। অনেক উদ্যোক্তাই সময়মতো রপ্তানি আদেশ পূরণ করতে পারছেন না। এ নিরাপত্তাহীনতা একটা প্রভাব তো পড়বেই। তা ছাড়া এসবের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতির ওপর। যা এখনো অস্বস্তিকর। অক্টোবরেও গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯৩ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশেরও বেশি।

মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক নিচ্ছে। তারা ছয় সপ্তাহ আগে ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছিল। ঋণ গ্রহীতার জন্য আরও ৫০ বেসিস পয়েন্ট ঋণের হার বাড়িয়েছে। এটার একটা প্রভাব পড়া শুরু করেছে। অর্থাৎ, বাজার থেকে অনেক টাকা উঠে গেছে। বাজারটা কনট্রাকশনারি একটা মনিটরি অবস্থায় আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক তার নীতি সুদ হার আরও ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছে। এটি বিচক্ষণ পদক্ষেপ। মূল্যস্ফীতি বাগে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এটি সেই বার্তা। আরও আগে থেকে এই বার্তা দেয়ার প্রয়োজন ছিল। তবে দেরিতে হলেও এ বার্তা দেয়ার ভঙ্গিটি যথার্থ। আরও কিছু দিন তা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করি। তবে মূল্যস্ফীতির ওপর এর কার্যকর প্রভাব পড়তে আরও একটু সময় লাগবে। এখন নিশ্চিতভাবে রাজনৈতিক কারণে এ অপারেশনগুলো করা যাচ্ছে না। কেননা টাকার অভাব এখন বড় না, এখন ভরসার অভাব বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ বাজারে কিছু বিক্রি করতে ও কিনতেই যেতে ভয়ে আছেন। অনেকেই হিসেব করে পা ফেলছেন। যে কারণে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলার যে বিষয়টি মনিটরি পলিসিতে করার কথা ছিল, সেটা অনেক সময় অর্থনীতির বাইরের কারণে নিউট্রালাইজ হয়ে যাচ্ছে। কারণ এখন ডিমান্ড সাইডের চেয়ে সাপ্লাই সাইড বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। এ কারণে জিনিসপত্রের দাম কমানো বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আগে সুদহার বিশেষ করে ডিপোজিটের বিপরীতে সুদহার মূল্যস্ফীতির চেয়ে অনেক কম ছিল। যে কারণে লোকেরা ব্যাংকে টাকা রাখত না। বর্তমানে সুদহার একটু একটু করে বাড়ানোর কারণে আবার ব্যাংকে টাকা ফেরা শুরু করেছে। মূল্যস্ফীতিকে চাহিদার দিক দিয়েও যেমন আক্রমণ করতে হবে, সাপ্লাইয়ের দিক দিয়েও আক্রমণ করতে হবে। ডিমান্ড সাইডের চাপ কমছে। কিন্তু রাজনৈতিক সংকটের কারণে সাপ্লাই চেইনে নতুন করে সমস্যা তৈরি হয়েছে। সাপ্লাই সাইড শুধু দেশের ভেতরে না, বিদেশ থেকে যে পণ্যগুলো আসে সেগুলোর খরচও বেড়ে গেছে। পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির হার খুব একটা নামানো যাচ্ছে না।

আমরা যেটা বলতে পারি এই যে অনানুষ্ঠানিক খাতে যারা কাজ করেন, যারা খুব বিপদের মধ্যে আছেন, তাদের জন্য আরও বাড়তি কিছু সামাজিক সুরক্ষা সুযোগ তৈরি করা। যেমন- আগে টিসিবির যে কয়টা ট্রাকে ন্যায্যমূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রি করত, সেই ট্রাকের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দেয়া। এ পণ্য সংগ্রহের সুযোগটা আরও খানিকটা বাড়িয়ে দেয়া দরকার। দরকার হলে একটা স্পটে বিক্রি হচ্ছে, পাশেই আরও একটা স্পটে তা বিক্রি হোক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এসব ট্রাকে রাজনৈতিকভাবে যারা বিরোধিতা করছে তারাও আগুন দেবে না। কারণ এ আগুন তাদের ভাবমূর্তির কাপড়েই গিয়ে লাগবে। সুতরাং কম আয়ের মানুষের জন্য আমাদের পণ্যের সাপ্লাই সাইডটা বাড়িয়ে দেয়া উচিত। তা না হলে যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে তাতে মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। একদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হচ্ছে, আবার নিম্ন আয়ের মানুষ সেভাবে জিনিসপত্র কিনতেও পারছেন না। তাই তাদের জন্য খানিকটা কম দামে পণ্য কেনার সুযোগ আরও বাড়ানোর দরকার রয়েছে। এসবই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আমাদের এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। যদি সহসাই রাজনৈতিক সমঝোতা না হয় তাহলে সমাজে অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে। এর প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে বাধ্য। আমাদের অর্থনীতির আনুষ্ঠানিক খাতে মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কর্মসংস্থান হয়। তা ছাড়া আনুষ্ঠানিক খাতে যথেষ্ট জনবল এখন আছে। তাদের একটা অংশের কর্মচ্যুতি ঘটার আশংকাও দেখা দিয়েছে। এ রাজনৈতিক অচলবস্থা দীর্ঘ হলে তা হতেই পারে। অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিক খাতে যদি মানুষের আয় কমে যায় তাহলে বড় সমস্যা তৈরি হবে। দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাবে। অন্যদিকে কৃষকদের ভোগান্তি তো হচ্ছেই। তারা ফসল উৎপাদন করছেন তবে সেটা নির্বিঘ্নে বাজারজাত করতে পারছেন না। সঠিক মূল্য না পাওয়ার কারণে কোথাও কোথাও খামারিরা দুধ বিক্রি করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এসব সমস্যা স্বল্পমেয়াদি হলেও এগুলো সমাধান করা জরুরি। প্রশাসনিকভাবে এ সমস্যা দূর করতে না পারলে স্থানীয়ভাবে হলেও এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। এর আগে কোভিডের সময় আমি একটা প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম সেটিই আবার দিচ্ছি। যেহেতু কৃষকদের উৎপন্ন সবজি দূর-দূরান্তে পৌঁছানো যাচ্ছে না সেক্ষেত্রে স্থানীয় বাজারে এসব সবজি বিক্রি বৃদ্ধি করা যায় কি না সে ব্যাপারে আমাদের সম্ভাব্যতা দেখতে হবে।

স্থানীয়পর্যায়ে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন- কারাগার, হাসপাতাল। এসব প্রতিষ্ঠানে খাদ্যের যে চাহিদা রয়েছে, সেটা মেটাতে যদি স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে বাড়তি সবজি সংগ্রহ করা যায় তাহলে কৃষকরা লাভবান হবে। তারা উপযুক্ত দাম পাবেন।

আসল কথা হচ্ছে- রাজনীতির সংকট রাজনৈতিকভাবেই খুঁজতে হবে। তবে বিরোধী দলগুলোর প্রতি আমার আহ্বান হচ্ছে তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কষ্টের সম্মুখীন না হয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে- রাজনৈতিক সক্রিয়তা মানে এই নয় যে আমরা অর্থনীতির পায়ে বেুড়ি দেবো। কারণ হচ্ছে- এতে ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। নিরুৎসাহিত হন উদ্যোক্তা শ্রেণি। তারাও তো কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক। তাদের বিষয়টি না দেখলে এ রাজনীতিকে মানবিক বলা যাবে না। তবে এটা যে শুধু রাজনৈতিক সংকট ব্যাপারটা এমনও নয়, এর পেছনে সামগ্রিকভাবে সমাজের কিছু করার দায় রয়েছে। নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক সংকটের দ্রুত সমাধান দরকার। তা নাহলে অর্থনীতি মার খাবে। এ ক্ষেত্রে সেতুবন্ধন তৈরির কেউ নেই। রাজনৈতিক সমাধান আনতে বিদেশিরা মধ্যস্থতার চেষ্টা করছেন। সেটি আমাদের জন্য মোটেও গৌরবের নয়। সেক্ষেত্রে আমি বলতে চাচ্ছি দেশের মধ্যে এমন কাউকে দরকার যিনি এসব বিষয়ে মধ্যস্থতা করবেন। আমরা নব্বইয়ের দশকে এমন একটি চিত্র দেখেছিলাম। আমার মনে আছে অধ্যাপক রেহমান সোবহান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ফয়েজ আহমেদের মতো মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। এখন সে মাপের মানুষও নেই, আর সেভাবে একত্রে বসানোর উদ্যোগও নেই। সে জন্যই পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার দিকেই যাচ্ছে। যার প্রভাব অর্থনীতির ওপর নিশ্চয় পড়বে। অলরেডি পড়তে শুরু করেছে।

ব্যাংকিং খাতে আগের চেয়ে খানিকটা আস্থা ফিরেছে। মানুষ ব্যাংকে বেশি হারে আমানত রাখছেন। এর আগেও বলেছি মনিটরি পলিসি খানিকটা সংশোধনের চেষ্টা করা হচ্ছে। সর্বশেষ নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরও সক্রিয়তা দেখিয়ে যেতে হবে। এখন প্রথম কাজ হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে বাজার নির্ভরশীলতা আরও বাড়াতে হবে। এর আগে সুদহার এবং বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বাজারের পরিস্থিতি না বুঝেই কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। যার ফলে বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের তার কোনো সংযোগ ছিল না; কিন্তু এখন বাজারের সঙ্গে ব্যাংকিং-এর সম্পর্ক খানিকটা হলেও ফিরতে শুরু করেছে। এ সম্পর্ক সর্বদাই ধরে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি কিছুটা কাজ শুরু হয়েছে, ফলে ডিপোজিট এমনকি রেমিট্যান্সও আসতে শুরু করেছে। বিনিময় হার বাজার দরের কাছাকাছি আনার একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে কাজ এখনো অনেকটাই বাকি। তাই বলব এই যে আমাদের বাজারমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, এটা যেন অব্যাহত থাকে। এতে অন্তত তারল্যের যে সংকট সেটি হবে না।

আর দ্বিতীয় যে কারণটা আগেও বলেছি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে খেলাপি ঋণ কিন্তু বাড়বে। যারা প্রকৃতপক্ষে ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে চায়, তারাও ব্যবসা-বাণিজ্যে ভালো করতে না পারলে সময়মতো অর্থ ফেরত দিতে পারবেন না। তাই এসব ক্ষেত্রে আমাদের অনেক উদ্ভাবনীমূলক মনিটরি/ফিসক্যাল পলিসি বাস্তবায়ন করতে হবে। অর্থনীতিবিদ, নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে রেগুলেটর যে আলোচনা শুরু হয়েছে তা চালিয়ে যেতে হবে। আশার কথা নতুন করে মনিটরি পলিসি বোর্ড গঠিত হয়েছে এবং সেটি কাজ শুরু করেছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরের অর্থনীতিবিদরাও সদস্য হিসেবে অবদান রাখছেন। এভাবেই ম্যাক্রো অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। এভাবেই আগামীতে বড় ধরনের সংস্কারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কেননা আর্থিক খাতের খোলনলচেই হয়তো বদলে ফেলতে হবে। সে জন্য ‘হোমওয়াক’ এক্ষুণি করতে হবে।

*ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।


প্রতীক ও স্বতন্ত্র প্রার্থিতা নির্বাচনী ফলাফলে কতটা ঝুঁকি সৃষ্টি করবে?

আপডেটেড ৩০ নভেম্বর, ২০২৩ ১৬:৫৪
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে দেশে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট ছাড়াও বেশ কিছু রাজনৈতিক দল অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতদিন যুগপৎ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারবিরোধী অবস্থান ছেড়ে কয়েকটি দলও নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও আন্দোলনরত দলগুলোর স্থানীয় পর্যায়ের বেশ কিছু নেতা নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। তফসিল অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ দিন। এ দিনই বোঝা যাবে কোন কোন দল ও দলবহির্ভূত এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরূপে কারা কারা নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত দলের সংখ্যা হিসাব করলে নিবন্ধিত দলের মধ্যে বেশি সংখ্যকই নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। ফলে দেশে নির্বাচনের পক্ষে শুধু দলই নয়, ভোটারদেরও আগ্রহ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। সব দলের প্রার্থীরা মাঠে নামার পর নির্বাচনী আবহ সৃষ্টি হবে বলেই মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দলগুলো মনোনয়নপত্র জমা দেয়া নিয়েই ব্যস্ত। গণমাধ্যমগুলো সেসব খবরাখবর প্রচার করছে। দেশের মানুষও জানতে পারছে নির্বাচনে কারা আসছে, কারা আসছে না। ৩০ তারিখের পর মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই হবে ১-৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ৬-১৫ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তের প্রতি যারা একমত হবেন না, তারা আপিল ও শুনানি করার সুযোগ পাবেন। এরপর ১৭ তারিখ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার শেষে চূড়ান্ত তালিকা নির্ধারিত হবে। কোনো আচরণবিধি অনুযায়ী ততদিন পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেয়ার সুযোগ কোনো দল বা প্রার্থীরই থাকবে না। ১৮ তারিখ থেকেই দৃশ্যপট পালটে যেতে থাকবে।

তফসিল অনুযায়ী আজ ৩০ নভেম্বর প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। সবার আগে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী মনোনীত করতে পেরেছে। প্রার্থীরা এরই মধ্যে তাদের মনোনয়নপত্র জমাও দিয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন কোনো আসনে যেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ নির্বাচিত হতে না পারেন। সে জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও আপত্তি থাকবে না। যে সময় তিনি এমন মনোভাব ব্যক্ত করেছেন তখনো স্পষ্ট ছিল না কতটি দল নির্বাচনে আসছে এবং সব আসনে সবাই প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে কি না? কিন্তু এরই মধ্যে জাতীয় পার্টি, বিএনএম, তৃণমূল বিএনপি, কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, লিবারেল ইসলামিক জোটসহ বেশ কিছু দলের প্রার্থী দেয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টি সব আসনেই প্রার্থী দিয়েছে। অন্যান্য দল এবং জোটও তাদের দলীয় বা জোটের অবস্থান অনুযায়ী প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। তাতে সব আসনেই আওয়ামী লীগের বিপরীতে কমপক্ষে দুই-তিনজন দলীয় প্রার্থী থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া আন্দোলনরত দলগুলো থেকে সরে গিয়ে অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে যাচ্ছেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ রয়েছে। এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে বাদ পড়াদের মধ্যে অনেকেই মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছেন বলে গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী ফ্রি স্টাইল হবে না।’ কিন্তু দলের মনোনীত প্রার্থীর পাশে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় থাকার খবর শুনে এরই মধ্যে অনেকেই তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও এই সংখ্যা এতটাই বেশি যে, তা নিয়ে দলের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে কি না সেটি এখনই ভাবা দরকার। ৪ ডিসেম্বরই বোঝা যাবে প্রতিটি আসনে কতজন এবং কারা কারা প্রার্থী হয়েছেন। প্রার্থীদের দলীয় ও ব্যক্তিগত পরিচয় দেখেই আওয়ামী লীগকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে দলীয় মনোনীত প্রার্থীর বাইরে সব আসনেই কাউকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে দেয়া সমীচীন হবে কি না। যেসব আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনীত প্রার্থীর ব্যাপারে সাধারণ ভোটারদের তেমন নেতিবাচক কোনো অবস্থান নেই। বিরোধী দলের প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে দলীয় কোনো ব্যক্তির স্বতন্ত্র প্রার্থীরূপে থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার কথা নয়। যদি কেউ থেকে যান, তাহলে দলীয় মনোনীত প্রার্থী আসন হারাতে পারেন। আবার যেসব আসনে দলীয় মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে সাধারণ ভোটার ও দলীয় ভোটারদের সমর্থন আওয়ামী লীগের কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতি বেশি দেখা গেলে তখন হিসাব-নিকাশটি কীভাবে করা হবে, তা দলকে এখন থেকেই নির্ধারণ করতে হবে। আবার কোথাও কোথাও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী দুই-তিনজনের অধিক হয়ে গেলে ভোট ভাগাভাগি, কাটাকাটিতে পড়ে বিরোধী দলের কোনো প্রার্থীই বিজয়ী হয়ে চলে আসতে পারে। দলের মনোনীত কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থীও হেরে যেতে পারে। কোথাও কোথাও ১০-এর অধিক স্বতন্ত্র দলীয় প্রার্থী হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এ ধরনের আসনে দলীয় মনোনীত প্রার্থীর পরাজয় আগেই নিশ্চিত হয়ে যাবে। সে ধরনের ঘটনা যাতে বেশিদূর গড়াতে না পারে তা শুরুতেই টেনে ধরা দরকার বলে মনে হয়, নির্বাচনী মাঠে প্রার্থীরা একবার নেমে গেলে তখন সবাই নিজের জয়ের ব্যাপারে অতিমাত্রায় আশাবাদী হয়ে পড়ে। সমর্থকদের অনেকেই সে ধরনের ‘কানপড়া’ দিতে কার্পণ্য করেন না। একটি আসনে যদি বেশি সংখ্যক আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী একে অপরের বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন, তখন পরিস্থিতি দলের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও ভোটারদের জন্য খুবই বিব্রতকর হয়ে উঠতে পারে। নিকট অতীতে স্থানীয় সরকার বিভিন্ন নির্বাচনে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাই ঘটে গেছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই যথেষ্ট অবগত আছেন। এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বেশি প্রদর্শন জরুরি। বিভাজন কোনো মতেই বাড়তে দেয়া উচিত হবে না। দলীয় প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। এই নির্বাচন সুষ্ঠু এবং জনগণের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠান করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কোনো একটি আসনে যদি দলের নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে নির্বাচনে কাউকে কাউকে জেতানোর জন্য মরিয়া হয়ে যান, তখন অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা দলীয় শৃঙ্খলা কতটা অনুসরণ করেন তা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে আশা করি স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। কিন্তু একটি আসনের একটি কেন্দ্রেও যদি নেতা-কর্মীদের মধ্যে দলাদলি এবং উচ্ছৃঙ্খলতার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয় তাতে ঘি ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার লোকের অভাব ঘটবে না। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষকরা এবার খুঁত ধরার জন্য কতটা তৈরি থাকবেন তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। সে কারণে ৪-৫ তারিখের পরই আওয়ামী লীগকে আসনভিত্তিক দলীয়, স্বতন্ত্র এবং বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের অবস্থান নিয়ে দ্রুত পর্যালোচনা, পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন চূড়ান্ত করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা জরুরি হয়ে পড়বে। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় নামার আগেই আসনভিত্তিক প্রার্থিতার পক্ষে অবস্থান নেয়ার নীতিকৌশল নির্ধারণ করার কোনো বিকল্প নেই।

১৯৯১ সালে ৮ দল এবং ৫ দল একত্রে নির্বাচন করেছিল। সেই নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ থাকা সত্ত্বেও মনোনয়ন মানা না মানার ব্যাপারটি পরাজয়ের বড় কারণ হয়েছিল যে তা অনেকেরই স্মরণে থাকার কথা। নৌকা প্রতীকে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার পরও কাস্তে, হাতুড়িসহ অন্যান্য মার্কা নিয়েই একই আসনে দুই-তিনজন অতিরিক্ত প্রার্থী দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। যাদের দলীয় ভোটার খুব বেশি নেই তারাও তখন নৌকার বিরুদ্ধে মাঠে প্রচার-প্রচারণা করেছিলেন। ভোটশেষে তারা যে ভোট পেয়েছেন, তাতে তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে কিন্তু নৌকা মার্কার প্রার্থী অল্প ভোটে হেরেছেন- এমন আসনের সংখ্যাও যথেষ্ট ছিল। সেই নির্বাচনে যদি জোটের প্রার্থীরা জোটের সব দলের পুরোপুরি সমর্থন পেতেন, তাহলে আওয়ামী লীগ তথা ৮ ও ৫ দলীয় জোট ১৫১টির বেশি আসন পেত বলে পরে বোঝা গেছে। দুই-তিন শ ভোটের ব্যবধানেও অনেকে হেরে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ এবং জোটের সেই হারাটি বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতায় যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে তা পরবর্তীকালে বিষক্রিয়ায় গোটা সমাজ ও রাজনীতিকেই এমন একটি জায়গায় এনে দিয়েছে, যেখানে থেকে আমরা এখনো মুক্তি পাইনি। ১৯৯১ এবং সাম্প্রতিক নিকট অতীতের দলীয় অভিজ্ঞতাকে মনে রেখে আসন্ন নির্বাচনটিকে আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলীয় জোট শতভাগ সিরিয়াসলি নেবে- এমনটিই রাজনীতি-সচেতন মহল মনে করে। ১৪ দলীয় জোটের কে কে প্রার্থী হবেন, কাকে জোট থেকে মনোনয়ন দেয়া হবে, সেটি এখনো নির্ধারণ না করে ১৮ তারিখ কীভাবে চূড়ান্ত করা হবে তা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। নৌকা প্রতীকে যাদের একবার মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তাদের মধ্য থেকে কাউকে সরিয়ে এখন ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী করতে যাওয়ার মধ্যে যথেষ্ট ঝুঁকির সম্ভাবনা রয়ে গেছে। যিনি নৌকা পেয়ে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন, তাকে ১৭ তারিখের আগের নতুন কোনো সিদ্ধান্তের কথা বললে সেটি কয়জন সহজভাবে নেবেন, তা বোধগম্য নয়। বিষয়টি নিয়ে আগেই সমঝোতা এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেত। এখন যেভাবে বলা হচ্ছে সেটা কতটুকু পারস্পরিক আস্থার মধ্যে থাকবে, মন কষাকষি বা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হবে না, তা ঘটলেই মঙ্গল। আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের মধ্যে যে আদর্শগত ঐক্য গত দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে, সেটি আরও দৃঢ়তর হওয়ার প্রয়োজনীয়তা সবাই অনুভব করছে। এই নির্বাচনে সেই ঐক্য যেন আরও সুদৃঢ় হয়- সেটি সব পক্ষ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করবে বলেই আমরা আশা রাখি।

লেখক: ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

বিষয়:

বেতাল হরতাল বোধহীন অবরোধে কী হাসিল হচ্ছে বিএনপির?

আপডেটেড ২৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০৮
মোস্তফা কামাল

রাজনীতিতে খেই হারিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আবার হরতাল-অবরোধেই ভর করেছে বিএনপি। রাজনীতিতে আবেদন-নিবেদন হারিয়ে হরতাল-অবরোধ ভোঁতা হয়ে গেছে সেই কবেই। বাস্তবতা বুঝে বিএনপির দিক থেকেও ঘোষণা ছিল, তারা আর হরতাল-নৈরাজ্যের কর্মসূচি দেবে না। জনভোগান্তি হয় এমন কর্মসূচি দেবে না। অহিংস আন্দোলনের নতুন দৃষ্টান্ত দেখাবে। তাদের ঘোষণাটি জনমনে বেশ আগ্রহ জাগায়। রাজনৈতিক মহলও অপেক্ষমাণ থাকে তাদের নতুন দৃষ্টান্ত দেখার। বিএনপি তা দেখিয়েছে।

পদযাত্রা, শোভাযাত্রা, রোড মার্চ, সেমিনার, জেলা সমাবেশ, বিভাগীয় সমাবেশ ধরনের কর্মসূচিতে বেশ সাড়া তুলতে পারে বিএনপি। বছর দেড়েক ধরে দলের নেতা-কর্মীরাও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটি বাতাবরণ তৈরি হয়। ২৮ অক্টোবর যেন সব ছন্দ হারিয়ে দেয়। আবার হরতাল-অবরোধের তালগোলে চক্কর খাচ্ছে বিএনপি। গত কিছুদিন ধরে কবে হরতাল, কবে অবরোধ তফাৎ করাও কঠিন। এক ভার্চুয়াল ঘোষণাতেই হরতাল বা অবরোধ। এরপর বিরতি দিয়ে আবার ঘোষণা। সেই পুরোনো ব্যারাম।

দৃশ্যত হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারীরা কমজুরি। পলাতক-ফেরারি। তারা অবরোধ ঘোষণা দেন চোরাগোপ্তায় অজ্ঞাত জায়গা থেকে ভার্চুয়ালে। সরবে-প্রকাশ্যে তাদের তৎপরতা নেই। অবরোধের সমর্থনে মাঝেমধ্যে জনাকয়েক মিলে হঠাৎ চোরাগোপ্তা ঝটিকা মিছিল করে চম্পট। জনাকয়েক কথিত সাহসী নেতার নামসহ সেই ভোঁ দৌড়ের ফুটেজ কোনোমতে একটু প্রচারের ব্যবস্থা করতে পারাই তাদের সক্ষমতা। পাকিস্তান বা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে হরতাল-অবরোধ, ঘেরাও ধরনের গুজরাটি আন্দোলন বাজার পেলেও মানুষ খুব ভালোভাবে নেয়নি। তারপরও মেনে নিয়েছে মুক্তির প্রশ্নে। দেশ স্বাধীনের পর বিশেষ করে আশি-নব্বইয়ের দশকে হরতাল-অবরোধ নামের রাজনৈতিক অস্ত্রকে অতিব্যবহারে ছোবলা করে ফেলা হয়েছে। তখন আর এখন বলে কথা নয়; হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারীরা বরাবরই ক্ষমতাসীনদের কাছে দস্যু, সন্ত্রাসী, নৈরাজ্যকারী। আর হরতাল-অবরোধকারীদের কাছে ক্ষমতাসীনরা কেবলই স্বৈরাচার-কর্তৃত্ববাদী, অধিকার হননকারী। এ দুইয়ে মিলে যা হবার তা-ই হয়। দীর্ঘ বিরতির পর আবারও চলছে নতুন করে। আপদের মাঝে বিপদ হয়ে আবারও চেপেছে মানুষের ওপর। এর কুফল পুরোটা ভুগছে সাধারণ মানুষ। দায় চাপছে বিএনপির ঘাড়ে। আর রাজনৈতিক সুবিধার পুরোটা নিচ্ছে সরকার।

রাজনৈতিক কর্মসূচির মাঝে অবরোধ-হরতাল ডাকা সবচেয়ে সোজা কাজ। তেমন পুঁজি লাগে না। রাস্তায়ও নামতে হয় না। এখন আর প্রেস রিলিজিও লাগে না। অনলাইনে ডাকলেই হয়ে যায়। পরে হরতাল-অবরোধ সফল করায় জনগণকে ধন্যবাদও জানায় এর আহ্বানকারীরা। আর প্রতিরোধকারীরা ধন্যবাদ জানায় জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছে দাবি করে। আচানক এই সার্কাসে দফায় দফায় হরতাল-অবরোধের চালান ছাড়ছে বিএনপি। এর জেরে রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতিসহ যাবতীয় নীতি একাকার। ঝাঁকুনি চলছে সব সেক্টরে। স্বাধীনতার বায়ান্ন-তেপ্পান্ন বছরেও রাজনীতি- কূটনীতিকে যার যার রেখে অর্থনীতিকে সবার করার জায়গায় আসতে পারেনি বাংলাদেশ। সেই লক্ষণও নেই। হরতাল-অবরোধ নিয়ে কথামালা অন্তহীন। কারও কাছে অবরোধ ব্যর্থ, কারও কাছে সফল। এর মানদণ্ড খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেন সফল, কেন ব্যর্থ, এর জবাব নেই। যারা বলেন অবরোধ নিরর্থক, দুই দিন বাদে তারাই অবরোধে নানা সেক্টরে সেক্টরে বিশাল ক্ষতির জরিপ দেন। অবরোধ নামক কর্মসূচিটিতে সরকার টলল কি টলল না, তার চেয়ে বেশি মুখ্য হচ্ছে, অর্থনীতির অচলায়তন। যার পুরোটাই হয়ে চলছে গত কদিন। বিএনপি-জামায়াত ভার্চুয়ালে অবরোধ ডেকেই অনেকটা খালাস। অ্যাকচুয়ালে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে যাচ্ছে। এক অর্থে বিএনপির অবরোধ ২০১৫ সাল থেকে চলমানই ছিল। এখন নতুন করে আবার ঘণ্টা বাজানো হয়েছে। ২০১৫ সালের শুরুতে ডাকা লাগাতার অবরোধ সমাপ্তির আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না দিলেও বছরখানেক ধরে শান্তিপূর্ণ তথা অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি একটি নতুন ধারা আনতে পেরেছে গত কয়েক বছরে। দেশি-বিদেশি বিশেষ মহলগুলো বিএনপির নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট জায়গায় সভা-সমাবেশ, পদযাত্রা, শোভাযাত্রার ‘গুডবয়’ কর্মসূচিকে স্বাগতও জানাতে থাকে। উপরন্তু, তাদের এসব কোমল-কুসুম কর্মসূচির কোথাও কোথাও পুলিশ বা সরকারদলীয়দের বাধার সমালোচনা হয় বিভিন্ন মহলে। এতে বিএনপি একধরনের সিমপ্যাথিও পেতে থাকে নানা মহল থেকে। এ ধারাপাতের ছন্দপতনে ২৮ অক্টোবরের ঘটনাবলি এবং পরিণামে আবারও অবরোধ জমানায় ফিরে আসা।

জনগণও এতে কত বিরক্ত, তা জানার দরকারও মনে হচ্ছে না তাদের। এরই মধ্যে অবরোধের ক্ষতি পোষাতে বন্ধের দিনেও দোকান খুলতে শুরু করেছেন দোকানদার-ব্যবসায়ীরা। দিন এনে দিন খাওয়াদের কী দশা যাচ্ছে? যানবাহন ঠিকমতো চলাচল করতে না পারায় বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ কমছে। জিনিসপত্রের দাম আরও চড়ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা অবরোধকে অজুহাত হিসেবে নিয়েছে। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে টোকা পড়ছে। অর্থনীতিতে এমনিতেই অনিশ্চয়তা। তা আরও ভয়াবহতার দিকে ধেয়ে চলছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। স্থিতিশীল পরিবেশ না থাকায় বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে রাখছেন অনেক দিন থেকে। এখন ঘরে উঠে যাচ্ছেন পুরোপুরি। এতে নতুন কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হতে হতে আর সংকুচিত হওয়ার জায়গাও প্রায় শেষ। ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকমতো না চললে প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা দিতে পারবে না- তা বুঝতে অর্থনীতি বিশারদ হওয়া লাগে না। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মী ছাঁটাই চলছে। বছরের শেষপ্রান্তে হরতাল-অবরোধের মতো চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতির মুখে শিক্ষার্থীরা। স্কুল-কলেজের বার্ষিক পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পরীক্ষা নিয়ে বিপাকে তারা। অভিভাবকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বলছে, শিক্ষাবর্ষের শেষ প্রান্তিকে ক্লাস, পরীক্ষা এবং প্রশাসনিক কাজের প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সুযোগ নেই।

জনগণ ও অর্থনীতিকে জিম্মি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অধিকার আধুনিক উগান্ডা-রুয়ান্ডায়ও নেই। বাংলাদেশের চলমান এ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বড় খবর। বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো অবিরাম ডাকদোহাই দিচ্ছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিসহ বড় দুই দলের কাণ্ডকীর্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে অবস্থানকারী তাদের দেশের নাগরিকদের চলাফেরায় সতর্কতা জারি করেছে। বলেছে, বড় সমাবেশ বা কর্মসূচির আশপাশ দিয়েও যাতায়াত না করতে। কূটনৈতিকভাবে এটি বাংলাদেশের জন্য স্থানিক নিউজট্রিটমেন্টে টোটকা বা খুচরা খবর। কিন্তু গুরুত্ব বিচারে দেশের জন্য কত অবমাননকাকর? এত খারাপ হয়ে গেল বাংলাদেশ? এ দেশের কোনো দলের কর্মসূচির পাশ দিয়ে হাটাও মানা? জাতিসংঘ সরকারকে বলেছে, ভীতি প্রদর্শন বন্ধ করতে। নইলে সামনে বাজে পরিস্থিতি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সতর্কবার্তা আরও কঠোর। এর মাঝে আবার ইউনাইটেড এগেইনস্ট টর্চারের বিবৃতিতেও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে টানা হয়েছে ভয়ের কথা। এতে হরতাল-অবরোধকারী বিএনপি ও তার সহযোগীদের অর্জনের খাতায়ও কিছু যোগ হচ্ছে? উতাল-বেতাল না হয়ে বোধ নিয়ে এ প্রশ্ন নিজেরাই নিজেদের করতে পারেন তারা। রাজনৈতিক নাহালতের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কষ্ট, লাখ-লাখ শিক্ষার্থীর অভিশাপে কি পড়ছে না তারা?

সেই সঙ্গে হরতাল-অবরোধ অর্থনীতির যে ক্ষতি করে ছাড়ছে, তা কাটানোর সাধ্য কি হবে তাদেরও? রাষ্ট্রের ক্ষতি করে বিকৃত সুখানুভূতি হলে সেটা ভিন্ন জিনিস। তাহলে এতক্ষণ করা প্রশ্নগুলো কামার দোকানে কোরআন পড়ারই নামান্তর। উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর উদাহরণ। এরপরও সাফল্য হিসেবে তাদের হরতাল-অবরোধ নিত্যপণ্যের বাজারে ছুটে চলা পাগলাঘোড়াকে টোকা দিতে পেরেছে। ‘খেলা হবে-খেলা হবে’ করতে করতে খেলাটা চলে গেছে বাজারে। এ বাজারি খেলায় ধুলা ওড়াচ্ছে কথিত সিন্ডিকেট। আজ ডিম, কাল লবণ-মরিচ। পেঁয়াজ-আদা, চাল-ডাল-তেল। কিছুতেই ছাড় নেই। তাদের ওড়ানো ধুলায় চোখে অন্ধকার, মুখে বোবা কান্না নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের। এ চক্র আচ্ছা খেলোয়াড়। এ খেলার মধ্যে ধুলা ওড়ানো অতি খেলোয়াড়রা সমানে পেনাল্টিতে মারছে মানুষকে। ঘায়েল করছে সরকারকেও। চাল, ডাল, তেল, নুন, চিনি, আটা, ময়দা, আদা, পেঁয়াজ, রসুন, চামড়া, আমড়া সবকিছু নিয়েই খেলছে সমানে। ফ্রি স্টাইলে ধুলা ওড়াচ্ছে। দুই হাতে অর্থ হাতানোর এ পদ্ধতিতে চাহিদা, জোগানের পরিমাণ; কে সরবরাহকারী-বিপণনকারী, কে ভোক্তা; এসবের কোনো বালাই নেই। শিকার ধরাই আসল। বাজার নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের কাছে বাদবাকিরা কেবলই শিকারের বস্তু। বাজার চড়ানোর পেছনে শীত-গরম, বৃষ্টি-খরা, মন্দা-যুদ্ধসহ হরেক অজুহাত তারা হাতে হাতেই রাখে। তাদের এখনকার টাটকা অজুহাত হরতাল-অবরোধ। এর ছুতায় বাজারে চাহিদার বিপরীতে জোগান কমে যাচ্ছে নাকি কমিয়ে দেয়া হচ্ছে- বোঝা মুশকিল। দৃশ্যত সব পণ্যেরই মজুত আছে। কিন্তু নাটক চলছে কৃত্রিম সংকটের। পরিস্থিতিটা এই চক্রের জন্য আশীর্বাদের। বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী, সমর্থক এবং জনগণের দোয়া পায়েদলে বিএনপি এখন সহযোগী বিবেচনায় বাজার সিন্ডিকেটের দোয়া কামাবে? রাজনীতি আর ব্যবসা উভয়ের মন-মনন এক হয়ে গেলে দেবালয় আর লোকালয়ের তফাৎও থাকে না। তখন রাজনীতি-অর্থনীতি-কূটনীতিসহ সব সেক্টরের ধড়িবাজরা আগোয়ান হয় সেই আলোকেই। যার মধ্য দিয়ে তারা হয়ে ওঠেন শেয়ানের ওপর শেয়ান, চতুর। বিশাল কর্মী-সমর্থকের দল বিএনপি কেন নিজেদের নেবে সেই কাতারে?

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন


ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং দেশপ্রেমিক নেতা: সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ

অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সফল মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
মোহাম্মদ হানিফ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোহা. হাবিবুল ইসলাম সুমন

ঢাকার রাজনীতির মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর মোহাম্মদ হানিফ। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত সফল মেয়র ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সফল সভাপতি।

চার শ বছরের প্রাচীন শহর রাজধানী ঢাকা। ঐতিহ্য আর নানা সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের কারণে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মেগা সিটি। সেই শহরের গৌরবের অপর নাম মোহাম্মদ হানিফ। ১৯৪৪ সালে ১ এপ্রিল পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা আবদুল আজিজ আর মাতা মুন্নি বেগমের ছোট ছেলে হানিফ। আদর করে সবাই তাকে ‘ধণী’ নামে ডাকত। শিশু হানিফ ছোটবেলায় মমতাময়ী মাকে হারান। মায়ের মৃত্যুর পর ফুফু আছিয়া খাতুনের কাছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য আর আদর্শে বেড়ে উঠেন মোহাম্মদ হানিফ। ঢাকার প্রখ্যাত পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি আলহাজ মাজেদ সরদার ছিলেন ঢাকার শেষ সরদার। মোহাম্মদ হানিফের বহুমুখী প্রতিভা তাকে মুগ্ধ করে। তাই ১৯৬৭ সালে মাজেদ সরদার প্রিয়কন্যা ফাতেমা খাতুনকে মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গে বিয়ে দেন। এই দম্পতির একজন পুত্র ও দুই কন্যাসন্তান রয়েছে।

পুত্র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন পিতার আদর্শ ধারণ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন।

মোহাম্মদ হানিফ যৌবন থেকে আমৃত্যু আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। দলীয় রাজনীতি করলেও তার উদার চিন্তা-চেতনা ও সংবেদনশীল মনোভাবের কারণে দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল অসামান্য। তাঁর জীবন ছিল কর্মময়, ধ্যান-ধারণা ছিল অত্যন্ত সুন্দর, ব্যক্তিগত চরিত্রে ছিলেন সজ্জন ও সততা-সৌরভে উজ্জ্বল। একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ‘নগর পিতা’ খ্যাত যিনি নগরবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম নির্বাচিত একজন সফল মেয়র। নিজ বিশ্বাসে অটল থেকে তা অকপটে প্রকাশ করতে পারা একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন ঈমানদার ও ধার্মিক মুসলমান। একই সঙ্গে ইসলামের মর্যাদা এবং দ্বীন প্রচারেও ছিলেন সোচ্চার। তিনি তাঁর স্বপ্নের প্রিয় ঢাকা নগরীকে ইসলামী স্থাপত্যকলায় সাজিয়ে তুলতে সহায়তা করেছেন। যার সুবাদে মুসলিমপ্রধান দেশের রাজধানীতে বিদেশি মেহমান কেউ নেমেই যেন বুঝতে পারেন তারা কোথায় এসেছেন। বুকে হাজারো স্বপ্ন থেকে তা বাস্তবে রূপায়নের জন্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সচেষ্ট থেকেছেন। তিনি মুসলিম হলেও অন্যান্য ধর্মালম্বীদের কাছে ছিলেন পরমপ্রিয়। দুর্গাপূজা কিংবা বড়দিন অথবা অন্য কোনো উৎসবে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন। তার সহায়তায় অসংখ্য মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা সংস্কার করা হয়।

মোহাম্মদ হানিফ ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে পরবর্তীতে তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে (শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিএ পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে কিছুদিন আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের পর গঠিত প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার করে ২৪ ঘণ্টার নোটিশে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুনন্নেসা মুজিব ও তার পরিবারকে মন্ত্রীপাড়ার বাসা ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয় পাকিস্তান সরকার। সে সময় কেন্দ্রীয় সরকারের রক্তচক্ষু, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে মোহাম্মদ হানিফের পরিবারে পুরান ঢাকার ৭৯ নম্বর নাজিরা বাজার বাসায় অবস্থান নেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব ও তার পরিবার। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মোহাম্মদ হানিফকে খুব স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। তিনি সব সময় চাইতেন মোহাম্মদ হানিফ যেন সর্বদাই বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকেন। মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ঘনিষ্ঠতা কোনো দিন কমেনি বরং মুজিব পরিবারের বিশ্বস্ত হিসেবে আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে থেকে মোহাম্মদ হানিফের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়। ১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে অত্যন্ত সফলতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন। তিনি একান্ত সচিব থাকাকালীন ছয় দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি, ছয় দফা মুক্তি সনদ প্রণয়ন এবং প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর জাতীয় নির্বাচন এবং ৭১-এ মহান মুক্তি সংগ্রামে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সান্নিধ্য পাওয়া মোহাম্মদ হানিফ ১৯৯৪ সালে ৩০ জানুয়ারি অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ বিপুল ভোটের ব্যবধানে ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। তার আমলে ঢাকার উন্নয়নে রাস্তাঘাট, নর্দমা, ফুটপাত উন্নয়ন ও সংস্কার, নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, আন্ডারপাস, সেতু, ফুটভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়। পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় ধানমন্ডি লেক এবং আশপাশের এলাকা। ঢাকাবাসীর সুপেয় পানির চাহিদা পূরণে তিনি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ঢাকার সৌন্দর্য বাড়ানো ও নগরবাসীর চাহিদা পূরণে নগরীতে বিজলি বাতি স্থাপন, নগর সৌন্দর্যবর্ধনে ফোয়ারা নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি, পুরান ঢাকার আউটফলে ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ করেন।

নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ছিলেন মেয়র হানিফ। নারীশিক্ষা বিস্তারে লক্ষ্মীবাজারে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ। এ ছাড়া মহিলাদের মাতৃত্বকালীন সময়ে পরিচর্যার জন্য নগরীতে বেশ কয়েকটি মাতৃসদন নির্মাণ করেন। শিশুবান্ধব ঢাকা গড়তে নিরলস কাজ করেছেন নগরপিতা হানিফ। শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য পৌর শিশুপার্ক নির্মাণ ও পুরাতন পার্কগুলোতে প্রাণ ফিরিয়ে আনা, এ ছাড়া বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করে গেছেন।

মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ঢাকাবাসীর কষ্ট লাঘব করতে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা, মশক নিধন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। তার আমলে তিলোত্তমা নগরী গড়ার লক্ষ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়িয়েও মহানগরীর উন্নয়ন সম্ভব ঢাকাবাসীর কাছে তারই নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ হিসেবে তিনি কাজে প্রমাণ করে গেছেন।

১৯৯৬-এর মার্চের শেষ সপ্তাহে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে মোহাম্মদ হানিফ তার নেতৃত্বে ‘জনতার মঞ্চ’ গঠন করেন, যা তৎকালীন বিএনপি সরকারের পতনসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট তৈরি করে এবং যার ফলে ৯৬-এর ১২ জুন দেশের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে দেশ পরিচালনার জন্য মোহাম্মদ হানিফের প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ততার বড় প্রমাণ দিয়েছেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ এবং হাওয়া ভবনের নেতৃত্বে পরিচালিত গ্রেনেড হামলার মূল টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা এবং সে সময়কার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা।

২০০৪ সালের ভয়াল ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের ট্রাক মঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর নারকীয় গ্রেনেড হামলার সময় নিজের জীবন তুচ্ছ করে মানবঢাল রচনা করে তার প্রিয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে রক্ষার প্রাণান্তর চেষ্টা করেন মোহাম্মদ হানিফ। একের পর এক ছোড়া গ্রেনেডের সামনে নির্ভয়ে পেতে দিলেন নিজেকে, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রাণে রক্ষা পেলেও মারাত্মক আহত হন তিনি। মস্তিষ্কসহ দেহের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ঘাতক স্প্লিন্টার ঢুকে পড়ে। দীর্ঘ দিনের চিকিৎসাতেও কোনো ফল হয়নি বরং মাথার গভীরে বিঁধে থাকায় ও অস্ত্রোপ্রচার করেও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেই রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকেছেন মোহাম্মদ হানিফ।

জনগণের কল্যাণই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। আর রাজনীতির উজ্জ্বল ধ্রুবতারা ছিলেন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। একজন প্রকৃত নেতা হিসেবে জাতির প্রতিটি ক্রান্তিতে এই অকুতোভয় সৈনিক রাজপথে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজধানীর প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৬ এর ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পূর্বে মাথায় বিদ্ধ হওয়া স্প্লিন্টারের প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী সময়ে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা শেষে ২৮ নভেম্বর ২০০৬ দিবাগত রাতে ৬২ বছর বয়সে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মোহাম্মদ হানিফ। অবশেষে চির অবসান ঘটে তার কর্মময় রাজনৈতিক জীবনের।

২৮ নভেম্বর তার ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। মোহাম্মদ হানিফ চলে গেলেন জাতির এক চরম দুঃসময়ে। তার মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। দেশের রাজনীতিতে তার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। একজন সফল রাজনৈতিক এবং সকল গুণাবলির অধিকারীসম্পন্ন মোহাম্মদ হানিফ তার কর্মের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।


দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সামাজিক সুরক্ষা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. সুলতান মাহমুদ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিসর অনেক বাড়িয়েছে। এ কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষাবলয়ের আওতায় নানারকম ভাতা দিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। এতে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ছাড়াও বয়স্ক ভাতা, স্বামী নিগৃহীতা, বিধবা, দরিদ্র মায়ের মাতৃত্বকালীন ভাতা, শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সম্মানী ভাতা, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ভাতা রয়েছে। এ ছাড়াও কৃষি প্রণোদনা পাচ্ছে কৃষক। শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা চলে যাচ্ছে অভিভাবকদের মোবাইলে।

বর্তমান সরকার গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকে জমিসহ বাড়ি দিচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি বিরল। সরকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, হোটেলের কর্মচারী, ড্রাইভারসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে করোনাকালে সহায়তা দিয়েছে, এই সহায়তা থেকে কেউ বাদ যায়নি। সংবিধানে ১৫(ঘ) ধারার বাধ্যবাধকতাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি শুরু হয় খাদ্য ও নগদ অর্থ সাহায্য রিলিফ হিসেবে প্রদানের মাধ্যমে। সত্তর দশকে মূলত রিলিফ কাঠামোর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আটকে ছিল। সত্তর দশকের শেষে সীমিত পরিসরে ও আশির দশকে কাজের বিনিময়ে খাদ্য, অর্থ প্রদানের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ১৯৯৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যার সময় দেশব্যাপী খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রথমবারের মতো দেশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে বয়স্ক, শারীরিকভাবে অক্ষম ও দুস্থ মহিলাদের জন্য মাসিক ভাতার প্রচলন করা হয়।

তারই ধারাবাহিকতায় পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবারও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে এবং জীবনমানের উন্নয়নে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকারের এ অঙ্গীকার বিধৃত হয়েছে জাতীয় সংবিধান, রূপকল্প ২০২১, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলে। এসব দলিলে বর্ণিত প্রতিশ্রুতিগুলোর অভীষ্ট লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য হ্রাসে এরই মধ্যে অর্জিত অগ্রগতিকে ভিত্তি করে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দারিদ্র্যের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন ও তার টেকসই সমাধান। পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদের ঝুঁকি কমানোর মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসের অগ্রযাত্রাকে যাতে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায়, এ ভাবনাকে সামনে রেখেই সরকার জাতীয় সামজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে, যাতে গণদারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে বের হয়ে আসতে পারে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মোট বরাদ্দ ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার মধ্যে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ করা হয়, যা মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দের তুলনায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ১৩ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা বেশি। গত কয়েক অর্থবছরের বাজেটে সুরক্ষা কার্যক্রমে বরাদ্দের পরিমাণ পযালোচনা করলে দেখা যায়, প্রত্যেক বছর বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।

সরকারের পরিকল্পিত নীতিকৌশল বাস্তবায়নের ফলে কোভিড-১৯ অতিমারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। খানা আয় ও ব্যয় জরিপ, ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বর্তমানে দারিদ্রের হার ১৮.৭ শতাংশ এবং অতি দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশ। দারিদ্র্য দূরীকরণে কৌশলগুলো যেমন দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সম্প্রসারণ, আর্থিক প্রণোদনা, ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে উৎসাহ প্রদান, কার্যকর দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কর্মসূচি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা প্রভৃতিতে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর কেড়েছে।

কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মূল কর্তব্য হচ্ছে জনগণকে সেবা দেয়া। বিশেযত জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে বা যারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা দেয়াই হচ্ছে রাষ্ট্রের মূল কাজ। আমরা বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অসংখ্য কর্মসূচি বাস্তবায়িত হতে দেখেছি। তবে এই ধরনের সুবিধা উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় দেয়া হলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এর অনুশীলন তেমন দেখা যেত না। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর দূরদর্শী জ্ঞান থেকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে গঠনমূলক রূপদানে সক্ষম হয়েছেন।

২০০৮ সালের পূর্বে বাংলাদেশের কোনো সরকারই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় এত ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয়ার সাহস দেখায়নি। দিনবদলের সনদকে সামনে রেখে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার বিভিন্ন ব্যাতিক্রমী কর্মসূচি হাতে নেয়। এরই অংশ হিসেবে দরিদ্র এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করার অভিপ্রায়ে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেয়ার কর্মসূচি হাতে নেয় বর্তমান সরকার।

২০০৯ সালের বাস্তবতায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত কর্মসূচির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর সুবিধাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ। গত প্রায় ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের যে কয়েকটি সিদ্ধান্ত জনগণের হৃদয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে দাগ কেটেছে, তার মধ্যে সমাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধাগুলো অন্যতম।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রায় ১৪০টির মতো সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে দেশজুড়ে। বাজেটের মাধ্যমে বিপুল বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দরিদ্রবান্ধব মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

করোনা অতিমারির সময়ে এই কর্মসূচিগুলোতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে সরকার। অতিমারি চলাকালীন খেটে খাওয়া মানুষের দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি এককালীন নগদ সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ২০২০ সালে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার চারটি প্রধান মোবাইল আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার (নগদ, বিকাশ, রকেট এবং শিওরক্যাশ) মাধ্যমে করোনভাইরাস দ্বারা প্রভাবিত নিম্ন আয়ের ৫০ লাখ পরিবারকে (প্রধানত শহর ও গ্রামীণ উভয় ক্ষেত্রেই দরিদ্র এবং দুস্থ) ২৫০০ টাকা এককালীন নগদ সহায়তা দিয়েছে। পরে আরও ৩৬ লাখ পরিবারকে এই এককালীন নগদ সহায়তা দেয়া হয়। এই কর্মসূচির একটি বৈশিষ্ট্য ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মোবাইলে এই সহায়তার অর্থ সরাসরি দেয়া।

বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে গেছেন শেষ দিন পর্যন্ত। তাঁর জীবনের মূল দর্শন ছিল বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। বাবার আর্দশকে ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় চেষ্টা করে চলেছেন দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন অব্যাহত থাকুক। এমনকি এ ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচির ভিত্তিতে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মেধা ও শ্রম দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে ক্রমেই। উপকারভোগী ব্যক্তি ও পরিবার হীনমন্যতা কাটিয়ে একটি সন্মানজনক জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার স্বপ্ন দেখছে, যা একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুতপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুগ্ম সম্পাদক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।


banner close