শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
২৯ ভাদ্র ১৪৩২

তরবারির চেয়ে উদারতার প্রভাব অনেক বেশি

ছবি: সংগৃহীত
দৈনিক বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত
দৈনিক বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত : ১৪ অক্টোবর, ২০২২ ০৯:০১

মো. আবু সালেহ সেকেন্দার

মক্কার অতি পরিচিত মুখ আল-আমিন বলে খ্যাতি লাভকারী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হঠাৎ করে সবার চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। তার নতুন প্রচারিত মতবাদ চারদিকে শোরগোল ফেলে দেয়। মক্কার ধর্মনেতারা মহা চিন্তাগ্রস্ত। কারণ হজরত মুহাম্মদ প্রচারিত মতবাদ তাদের প্রচারিত মতবাদের বিপরীত। ফলে হজরত মুহাম্মদের মতবাদ জনগণ গ্রহণ করলে তাদের ধর্মব্যবসা লাটে উঠবে। তাই তারা জনমনে হজরত মুহাম্মদ সম্পর্কে নানা অপবাদ প্রচার করতে শুরু করে। তাদের এমন অপপ্রচারের লক্ষ্য, জনগণকে বিভ্রান্ত করা। জনগণ যাতে হজরত মুহাম্মদের মতবাদ গ্রহণ না করে বা ওই মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত না হয় সে জন্য ধর্মনেতারা অপপ্রচারকে হজরত মুহাম্মদের মতবাদ দমনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।

সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মধ্যে ধর্মনেতাদের প্রভাব থাকায় মক্কায় হজরত মুহাম্মদকে নিয়ে অপপ্রচার সহজেই শোরগোল তোলে। মক্কা ছাড়াও মক্কার সঙ্গে বাণিজ্যে যুক্ত প্রতিবেশী অঞ্চলেও ওই খবর পৌঁছে যায়। অবশ্যই ওই অপপ্রচার সাময়িকভাবে হজরত মুহাম্মদ নামের তরুণ যুবকের জীবন অতিষ্ঠ করে তুললেও এর ফল তার জন্য শুভ হয়। অতি সহজে মক্কাসহ তার প্রতিবেশী অঞ্চলে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। তিনি আসলে কী মতবাদ প্রচার করছেন ওই বিষয়ে মানুষের জানার কৌতূহল জাগে। ফলে দলে দলে মানুষ প্রকৃত সত্য জানতে তার কাছে আসে এবং তার কথায় মুগ্ধ হয়ে তাদের অনেকে তার প্রচারিত মতবাদ ইসলাম গ্রহণ করেন।

ধর্মনেতা ও তাদের সমর্থকরা হজরত মুহাম্মদ সম্পর্কে শুধু অপপ্রচার করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা হজরত মুহাম্মদ সম্পর্কে নোংরা কথা ও গালিগালাজ করত। তবে তাদের ওইসব অপপ্রচার, নোংরা কথাবার্তা ও গালিগালাজ সাধারণ মানুষকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে পারছিল না। যে কারণে ধর্মনেতা ও তার সমর্থকরা তাদের প্রতিপক্ষ হজরত মুহাম্মদ প্রচারিত মতবাদকে দমনে তাদের কৌশল বদলায়। ইসলাম ধর্মের প্রচারক হজরত মুহাম্মদের ওপর শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকায় ছিল আবু জাহেল ও তার স্ত্রী হিন্দা এবং আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মু জামিল। মুহাম্মদ ও তার সাহাবিদের প্রতি এসব ব্যক্তির ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও নির্যাতনের ধরন এত ভয়াবহ ছিল যে, তা পরবর্তী সময়ে ইতিহাসে কুখ্যাতি অর্জন করে। তবে অমানসিক শারীরিক নির্যাতন সত্ত্বেও হজরত মুহাম্মদ ও তার সাহাবিরা ওই সব নির্যাতনকারীদের সঙ্গে সহনশীল আচরণ করেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, হজরত মুহাম্মদ যখন কাবা প্রাঙ্গণে নামাজ আদায় করতেন, তখন প্রায়ই আবু জাহেল নামাজরত হজরত মুহাম্মদের ওপর উটের নোংরা নাড়িভুঁড়ি নিক্ষেপ করত। ফুৎহুল বারী গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, এক দিন বিবি ফাতেমা পিতার ওই অবস্থার সংবাদ শুনে নিজেই কাবায় উপস্থিত হন এবং বহু কষ্টে পিতার পিঠ থেকে ওই নোংরা জিনিসগুলো ফেলে দেন। কিন্তু নবীকন্যা ফাতেমা ওই ঘৃণ্য কাজ করার জন্য আবু জাহেলকে শারীরিকভাবে আঘাত করেননি। তিনি তার পিতা হজরত মুহাম্মদের আদর্শ অনুসরণ করে পিতার মতোই প্রতিপক্ষের প্রতি উদারতা দেখিয়েছেন।

উকবা বিন আবি মুয়াইত নামক আর এক অমুসলিম তার চাদর দিয়ে হজরত মুহাম্মদের গলায় এমনভাবে ফাঁস দেন যে, হজরত মুহাম্মদের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তখন হজরত আবু বকর আকস্মিক উপস্থিত হয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার হাত থেকে হজরত মুহাম্মদকে উদ্ধার করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি তার ধর্মগুরু হজরত মুহাম্মদের নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করে উদারতার পরিচয় দেন। তিনি প্রতিপক্ষকে পাল্টা আঘাত করেননি। তিনি কথার মাধ্যমে উকবা বিন আবি মুয়াইতের উপর্যুক্ত ঘৃণ্য কাজের প্রতিবাদ করেন। তিনি উকবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আল্লাহকে নিজের মালিক বলে ঘোষণা করার কারণে তোমরা কি একটা মানুষকে খুন করে ফেলবে?

হজরত মুহাম্মদ সম্পর্কে বিদ্রূপকারী আরও একজন অমুসলিম ব্যক্তি হলেন নাজর ইবনে হারিছ ইবনে আলকামা ইবনে কালদা ইবনে আবদ মানাফ ইবনে আবদুদ্দার ইবনে কুসাঈ। যখনই কোনো মজলিসে বসে হজরত মুহাম্মদ মানুষকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানাতেন, কোরআন পাঠ করতেন এবং আল্লাহর বাণী অমান্য করায় মানবসভ্যতার ভিন্ন জাতি যেসব ভয়াবহ গজবে পতিত হয়েছিল সেই বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করতেন। তখন ওই ইসলামবিদ্বেষী ব্যক্তি মজলিসে উপস্থিত হয়ে উপস্থিত লোকদের পারস্যবীর রুস্তম, ইসফানদিয়ার ও প্রাচীন পারস্যের রাজা-বাদশাদের গল্প শুনিয়ে বলতেন, ‘আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ আমার চাইতে ভালো বর্ণনাকারী নয়। তার বর্ণনা তো অতীত যুগের উপকথা মাত্র। তার মতো ওইগুলো আমিও লিখে রেখেছি।’

ইবনে কুসাঈ যদি এ যুগের মুসলিমদের সামনে হজরত মুহাম্মদ ও কোরআন নিয়ে এমন অযাচিত মন্তব্য করতেন তাহলে কি হতো? ইবনে কুসাঈয়ের ঘাড়ে মাথা থাকত কি? নিঃসন্দেহে ইবনে কুসাঈকে হত্যার জন্য ফতোয়া দেয়া উলামার অভাব হতো না। কিন্তু হজরত মুহাম্মদ অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ইবনে কুসাঈকে কখনো কিছুই বলেননি এবং তার আদর্শে উজ্জীবিত সাহাবিরাও ওই বিষয়টি নিয়ে ইবনে কুসাঈকে কখনো শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা তো দূরের কথা গালমন্দ পর্যন্ত করেননি। তিনি ও তার সাহাবিরা এ ক্ষেত্রেও প্রতিপক্ষের প্রতি উদারতা দেখিয়েছেন।

একদা নাজর ইবনে হারিছ মজলিসে উপস্থিত হয়ে হজরত মুহাম্মদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। নাজর ইবনে হারিছের ওই মনোভাব আঁচ করতে পেরে হজরত মুহাম্মদ তাকে যুক্তির মাধ্যমে নিরুত্তর করে দিতে সক্ষম হন। ওই ঘটনা নিয়ে পরবর্তী সময়ে কবি আবু যুওয়ায়ব একটি কবিতা লেখেন, ‘তুমি আগুন নিভাও; তা প্রজ্বলিত করে তুমি তাতে ইন্ধন দিও না। কারণ শত্রুর আগুনের লেলিহান শিখা তোমাকেও গ্রাস করবে।’

হজরত মুহাম্মদের কাছে নাজর ইবনে হারিছ যুক্তিতে হেরে গেছে শুনে আবদুল্লাহ ইবনে যিবারি হজরত মুহাম্মদকে হেয় করতে উপস্থিত জনতার সামনে গর্ব করে বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আবদুল মুত্তালিবের নাতি এই মাত্র নাজরকে নির্বাক করে দিয়েছে। দেখ আমি যদি তাকে পেতাম, তবে নির্ঘাত হারিয়ে দিতাম।’

আবদুল্লাহ্ বিন যিবারির ওই ইচ্ছা হজরত মুহাম্মদের কাছে সাহাবিরা উত্থাপন করলে হজরত মুহাম্মদ আবদুল্লাহকে ওই সুযোগ প্রদানে সম্মত হন এবং যুক্তির মাধ্যমে তাকেও পরাজিত করেন।

হজরত মুহাম্মদের উদারতার আরও একটি বড় প্রমাণ পাওয়া যায় বদরের যুদ্ধ ও তার পরবর্তী ঘটনায়। বদরের যুদ্ধে বন্দিরা হজরত মুহাম্মদের মক্কায় বাসকালীন সময়ে তার প্রচারিত আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করে, তার নামে অপপ্রচার করে, তার প্রচারিত মতবাদের মূল দাবি আল্লাহ ও তার প্রেরিত কিতাব কোরআনকে গালি দেয় এবং তাকে ও তার অনুসারীদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। এ ছাড়া বদরের যুদ্ধে যুদ্ধবন্দিদের অপরাধ ছিল- ১. আল্লাহ ও তার নবীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অস্ত্র ধারণ করা ও বদর যুদ্ধে ১৪ জন সাহাবিকে হত্যা বা হত্যার সহযোগিতা করা। কিন্তু উপর্যুক্ত অপরাধ সত্ত্বেও হজরত মুহাম্মদ তাদের প্রতি উদারতা দেখান। সে সময় তিনি মক্কায় বাসকালীন সময়ের মতো রাজনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে হীনবল ছিলেন না। তিনি ছিলেন মদিনায় প্রতিষ্ঠিত নতুন সমাজের প্রধান। সদ্য যুদ্ধবিজেতা। সুতরাং বদর প্রান্তর থেকে বন্দি হওয়া প্রতিপক্ষ মক্কাবাসীদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলে তার ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে মদিনাবাসী ও তার সাহাবিদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হতো না। কিন্তু তিনি প্রতিপক্ষকে বন্দি অবস্থায় পেয়ে হত্যা করেননি। রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠেননি। বরং তিনি প্রতিপক্ষের প্রতি উদারতা দেখান। যুদ্ধের ময়দানে হজরত মুহাম্মদের একনিষ্ঠ সাহাবিদের হত্যাকারী, তাকে গালি দেয়া, তাকে ও তার সাহাবিদের শারীরিকভাবে নির্যাতনকারীদের তিনি ক্ষমা করে দেন। তিনি তাদের সঙ্গে যে উদার আচরণ করেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা পরবর্তী সময়ে খ্যাতি লাভ করে।

বদর যুদ্ধে বন্দিদের সঙ্গে উদারতা প্রদর্শন করার ফলও শুভ হয়। মক্কায় ফিরে গিয়ে ওই সব বন্দিরা হজরত মুহাম্মদ ও তার সাহাবিদের; তথা মদিনার আপামর জনতার প্রশংসায় মেতে ওঠেন। তারা মক্কাবাসীদের বলেন, ‘মদিনাবাসীরা সুখে থাক। তারা নিজেরা পায়ে হেঁটে আমাদেরকে উটে চড়তে দিয়েছে। আটা যখন ফুরিয়ে আসে তখন তারা শুধু খেজুর খেয়েছেন আর আমাদের রুটি খেতে দিয়েছেন।’

ইসলাম উদারতার ধর্ম হলেও এবং হজরত মুহাম্মদ ও তার সাহাবিরা তাদের জীবনে উদারতার চর্চা করলেও আজ অনেক মুসলিমই ব্যক্তিজীবনে প্রতিপক্ষের প্রতি উদারতার চর্চা করেন না। কারণ হজরত মুহাম্মদ ও রাশিদুল খলিফাদের পরবর্তী সময়ে ইসলাম ধর্মের নেতৃত্বে থাকা রাজতান্ত্রিক শাসকরা তাদের রাজ্যবিস্তার ও একনায়কতান্ত্রিক শাসনের প্রয়োজনে প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের উদারতার নীতি, আদর্শ ও বাণী ওইভাবে প্রচার করেননি। নিজের সিংহাসন রক্ষার স্বার্থে তারা প্রতিপক্ষকে কঠোর হস্তে দমন করেছেন। ফলে তাদের ওই চরমপন্থি শাসনব্যবস্থায় বিকাশমান ইসলামে উদারতার বদলে চরমপন্থার আদর্শের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। আর চরমপন্থিদের প্রভাবে হজরত মুহাম্মদ ও তার সাহাবিদের উদারতা ও অন্যের মতের প্রতি সহনশীলতা উগ্রপন্থিদের মতাদর্শের প্রভাবের নিচে চাপা পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে মানবেন্দ্র নাথ রায় যথার্থই বলেছেন- ‘যে নাম দিয়ে মুহাম্মদ তার মতাদর্শে দীক্ষিত করেন তার সঙ্গে আজকের ধারণা অনেক দূরে এবং বিরোধী।’ নাড়ি

পরিশেষে বলি, তরবারির প্রভাবের চেয়ে উদারতার প্রভাব বেশি। তরবারির মাধ্যমে ভূমি জয় করা যায়। কিন্তু মানুষের মন জয় করা যায় কেবল উদারতার মাধ্যমে। হজরত মুহাম্মদ ও তার সাহাবিরা ওই সত্য বুঝেছিলেন বলেই তা তারা ব্যক্তিজীবনে চর্চা করেছেন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়


তাফসীরে হিদায়াতুল কোরআন

ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক
আপডেটেড ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২২:৩৩
সম্পাদকীয়

অনুবাদ:

(১০) তারা বলে, আমরা যখন মাটিতে মিশে যাব, তখন কি আমাদেরকে আবার নতুনভাবে সৃষ্টি করা হবে? আসলে তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতকেই অস্বীকার করে। (১১) ( হে নবী,) বলে দাও: তোমাদের জীবন হরণ করবে মৃত্যুর ফেরেশতা, যাকে তোমাদের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। অতঃপর তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরিয়ে নেওয়া হবে। (১২) তুমি যদি তাদের দেখতে, যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে নতশিরে দণ্ডায়মান হবে! (তারা বলবে,) হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম ও শোনলাম। এখন আমাদেরকে (একবার দুনিয়াতে) পাঠিয়ে (সুযোগ) দিন, আমরা সৎকাজ করবো। আমরা (এখন) দৃঢ় বিশ্বাসী। (১৩) আমি চাইলেই প্রত্যেক ব্যক্তিকে হিদায়াত দিয়ে দিতাম। কিন্তু আমার কথাই সত্যে পরিণত হবে যে, ‘নিশ্চয়ই আমি জিন ও মানবজাতি উভয়ের দ্বারা জাহান্নাম ভরে দেব।’ (১৪) সুতরাং তোমরা যে এ দিবসের সাক্ষাত ভুলে গিয়েছিলে, তার স্বাদ গ্রহণ কর। আমিও তোমাদের ভুলে গেলাম এবং তোমাদের কর্মের দরুন অনন্তকালের শাস্তি ভোগ করতে থাক।

মর্ম ও শিক্ষা-

ইতোপূর্বে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, তার কিতাব কোরআন এবং রিসালাতের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়েছে। তারপর এখানে আলোচ্য আয়াতগুলোতে ঈমানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। তা হলো কিয়ামত ও আখিরাত। দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়, বরং এরপর সবাইকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে। সবারই পুনরুত্থান হবে। কিয়ামত হবে, আখিরাত আছে। তখন প্রতিটি মানুষকে দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি কর্মের হিসাব দিতে হবে।

বাতিলপন্থিদের আখিরাতে অবিশ্বাস ও অস্বীকৃতি-

অবিশ্বাসী ও বাতিলপন্থিরা মনে করে, মৃত্যুর পর তারা যখন মাটিতে মিশে যাবে, তখন তাদেরকে আর পুনরুত্থিত করা হবে না তারা মনে করে, দুনিয়ার জীবনই শেষ। দুনিয়ার মৃত্যুই শেষ। এরপর আর পুনর্জীবন নেই। সুতরাং দুনিয়াতে তারা যে কর্মই করুক, সে ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। তাদেরকে আল্লাহর সম্মুখীন হতে হবে না। কোনো কিছুর হিসাব দিতে হবে না। এ জবাবদিহির চেতনা ও অনুভূতি না থাকার কারণে, তারা যা ইচ্ছা তা করতে পারে।

ফেরেশতাদের মাধ্যমে মানুষের জীবন হরণ-

সকল প্রাণীরই মৃত্যু আছে। নির্দিষ্ট সময়ে সবকিছুই মারা যাবে, কিন্তু মানুষের মরণ এবং অন্যান্য প্রাণীর মরণের মধ্যে পার্থক্য আছে। মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা। সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান ও সম্মানিত সকল প্রাণীকে আল্লাহই প্রাণ দেন, কিন্তু শুধু মানুষের বেলায় বলা হয়েছে, আল্লাহ নিজের নিকট থেকে মানুষের জীবন সঞ্চার করেন। আর এখানে আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, যখন মৃত্যুর সময় হবে তখন অন্য প্রাণীর মতো মানুষের প্রাণ বায়ু এমনিতে উড়ে যাবে না বরং ফেরেশতা এসে তার জান কবজ করবেন। আল্লাহর নিকট থেকে মানুষের প্রাণ সঞ্চার করার কথা বলে যেমন সম্মান দেয়া হয়েছে, তেমনি মৃত্যুর সময়ও মানুষের বিশেষ সম্মান দেয়া হয়েছে। মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইলের হাতেই মানুষের জান কবজ হবে।

কিয়ামতে পুনরুত্থান-

কিন্তু মৃত্যুই শেষ নয়। আয়াতে বলা হয়েছে, অতঃপর তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরিয়ে নেয়া হবে। অর্থাৎ মৃত্যু এলো, কবর দেয়া হলো, দিনে দিনে মানুষের লাশ পচে গলে মাটির সাথে মিশে গেলো, এটাই শেষ নয়। বরং এক নির্দিষ্ট সময়ে কিয়ামত আসবে। আল্লাহর নির্ধারিত ফেরেশতা সিঙ্গায় ফুৎকার দিবেন। সেই আওয়াজে কবর থেকে সকল মানুষ পুনরুজ্জীবিত হয়ে কিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে। সৃষ্টির প্রথম মানুষ থেকে শেষ মানুষ সবাই হাশরের মাঠে একত্রিত হবে। তা হবে অগণিত মানুষের বিরাট সমাবেশ।

কিয়ামতের দিনের হিসাব ও বিচার-

কিয়ামতের দিনের সেই বিরাট সমাবেশের এক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। সেদিন সকল মানুষ আল্লাহর সম্মুখীন হবে, সবাই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে। প্রতিটি মানুষের প্রতিটি কাজের হিসাব হবে। আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে)। উল্লেখ্য, মানুষকে শুধু আল্লাহর ইবাদতের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্য পালনে সে কতটুকু স্বার্থক হলো, আর কতটুকু ব্যর্থ হলো, তার হিসাব দিতে হবে। যারা মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করে কিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে, সেদিন আল্লাহর বিচারের রায় তাদের পক্ষে যাবে। তারা মুক্তি পাবে এবং অনন্তকালের জান্নাতের শান্তির স্থান পাবে। যারা মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে, তারা সেদিন কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হবে। আল্লাহর বিচারের রায় তাদের বিপক্ষে যাবে। তারা অনন্তকালীণ শাস্তির দোযখে পতিত হবে।

সময় থাকতে শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া উচিত-

কিয়ামতের দিন অবিশ্বাসী ও বাতিলন্থীদের কি পরিণাম হবে, এখানে আল্লাহ আগেই বলে দিয়েছেন। একথাও বলা হয়েছে, সময় ফুরিয়ে গেলে পরে আফসোসে কোন কাজ হবে না। শত আকুতি মিনতি করলেও লাভ হবে না। এখান থেকে আল্লাহ একথাটি বুঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, সময় থাকতে শুভ বুদ্ধির উদয় হওয়া উচিত। সময় শেষ হয়ে গেলে কান্না কাটি করেও লাভ নেই। কাজেই দুনিয়ার জীবনে সত্যপথ গ্রহণ করা উচিত এবং আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করা উচিত।

আখিরাতে বিশ্বাস, জবাবদিহিতা এবং তদনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা-

এখানে শুধু অবিশ্বাসী ও বাতিলপন্থিদের জন্যই শিক্ষা নয়, বরং সত্যপন্থি ও ঈমানদারদের জন্যও শিক্ষা রয়েছে। তা হলো এই যে, তারা যখন কিয়ামত ও আখিরাতের জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করে, তখন তাদের উচিত আল্লাহর দেয়া জীবনাদর্শ ও জীবন-বিধানকে শক্তভাবে আকড়ে ধরা এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করা। অলসতায় গা ভাসিয়ে দেয়া ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, শুধু বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়, বরং বিশ্বাস অনুযায়ী আমল ও কর্ম হতে হবে। ঈমানের দাবি অনুযায়ী জীবন চালালেই আখিরাতে মুক্তি পাওয়া যাবে। তা না হলে মুক্তি পাওয়া কঠিন হবে। উল্লেখ্য, কারো যদি ঈমান থাকে এবং তার কর্ম ঈমানের দাবি অনুযায়ী না হয়, বরং বিচ্যুতি ও অপরাধই বেশি হয়, তাহলে তার শাস্তি হতে পারে। ঈমানের কারণে আল্লাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন, কিন্তু অবহেলাজনিত অপরাধ থাকলে যদি ক্ষমা পাওয়া না যায় তাহলে শাস্তি ভোগ করতে হবে। তবে দোযখে শাস্তি ভোগ করার পর ঈমানের কারণে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া যাবে। কাজেই এ শাস্তি থেকেও আত্মরক্ষার জন্য ঈমানের দাবী অনুযায়ী জীবন যাপন করা উচিত।

সত্যগ্রহণে মানুষের স্বাধীনতা-

আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে প্রত্যেককে হিদায়াত দিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। আর তা করেননি যৌক্তিক কারণে। আল্লাহ যদি বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে হিদায়াত দিয়ে দিতেন, তাহলে সৎপথে চলার পুরস্কার এবং বাতিলের পথে চলার শাস্তির কোন অর্থ থাকে না। কারণ তখন কেউ বাতিলের পথে চলবে না। কাজেই শাস্তির প্রশ্নই উঠে না। আর যেহেতু বাধ্যতামূলকভাবে সবাই সৎ পথে চলে, সেহেতু পুরস্কারেরও কোন অর্থ থাকে না। এজন্যই ফেরেশতাদের জন্য পুরস্কার বা শাস্তি নেই। কারণ তারা বাধ্যতামূলকভাবেই আল্লাহর অনুগত। শুধু মানুষ ও জিন জাতিকেই মত ও পথ গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কোন্ পথে চললে আল্লাহ খুশি হন তা কুরআনে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। আর কোন্ পথে চললে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, তারও বর্ণনা রয়েছে তাতে। এছাড়া সত্য পথে চললে কি পুরস্কার রযেছে, আর বাতিলের উপর চললে কি শাস্তি রয়েছে, তাও বলে দেয়া হয়েছে। এসব বলে দেয়ার পর মানুষ ও জিন জাতিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। তারা বুঝে-শুনে নিজ পথ বেছে নিতে পারে। এ ব্যাপারে তাদের পূর্ণ স্বাধীনাত দেয়া হয়েছে।

কিয়ামতে অপরাধীদের প্রতি তিরস্কার-

কিয়ামতের দিন অবিশ্বাসী, বাতিলপন্থী ও মুশরিকরা শুধু শাস্তিই পাবে না, বরং তাদেরকে তিরস্কার করা হবে। তারা দুনিয়াতে যেভাবে সত্যপন্থিদের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রূপ করত, কিয়ামতের দিন তাদের প্রতি বিদ্রূপ করা হবে। যেমন তাদের বলা হবে, তোমরা তো আখিরাতকে ভুলে গিয়েছিলে, এখন মজা ভোগ করো। বলাবাহুল্য, শাস্তির মজা বা স্বাদ ভোগ করার কথা বলা বিদ্রূপাত্মক। শাস্তি কখনো মজা হতে পারে না।

আখিরাত অস্বীকার করাই বিপথে চলা ও শাস্তির মূল কারণ-

অবিশ্বাসী বাতিলপন্থিরা নবী, রাসূল, আল্লাহর কিতাব কোরআন, রাসূলের আদর্শ ও ইসলামী জীবনাদর্শের সবকিছুকেই অস্বীকার করে অথবা প্রত্যাখ্যান করে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো আল্লাহর কাছে আখিরাতের জবাবদিহিতাকে অস্বীকার করা। এ বিষয়টিকেই এখানে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। কারণ আখিরাত অস্বীকার করলে জবাবদিহিতার কোন ভয় থাকে না, শাস্তি বা পুরস্কারের প্রশ্ন উঠে না। সুতরাং যারা আখিরাতকে অস্বীকার করে, তাদের নিকট অন্যায় ও মন্দ পথ ছেড়ে ভালো পথে চলার কোন অনুপ্রেরণাই থাকে না। মন্দ পথে চললে যদি দুনিয়ার স্বাচ্ছন্দ ও শন্তি পাওয়া যায়, তাহলে তাদের জন্য এটাই তো ভালো, কারণ আখিরাত তো নেই। কাজেই যারা আখিরাত অবিশ্বাস করে তারা তাদের পক্ষে মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক। অপরদিকে যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে, এ বিশ্বাস তাদের সকল কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করে। কারণ যখন তারা কোন কাজ করতে চায়, তখনই তার বিবেক প্রশ্ন করে, এটা ভালো কি মন্দ। মন্দ হলে আখিরাতে জবাব দিতে হবে। এভাবে কিয়ামত ও আখিরাতে বিশ্বাস মানুষের আচার ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডের উপর বিরাট প্রভাব ফেলে।

ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক, সূরা সাজদাহ, পর্ব ৩


জনগণের কাঙ্খিত ব্যাংকিং চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে রাষ্ট্রায়ত্ত সর্ববৃহৎ ইসলামি ব্যাংক

লেখক: মো. খায়রুল হাসান সিএসএএ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
দৈনিক বাংলা ডেস্ক

সংকটাপন্ন পাঁচ ইসলামি ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক একীভূত করে দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। একীভূত ব্যাংকের সম্ভাব্য নামও নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’। ফলে এই ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের মাঝে ইতোমধেই স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে এবং অন্তবর্তী সরকারের এই উদ্যোগকে দেশের আর্থিকখাত স্থিতিশীল করার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, নতুন প্রণীত ব্যাংক রেজোল্যুশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫ এর অধীনে প্রণীত এই একীভূত প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে আনুমানিক ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা মূলধন প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা দেবে সরকার এবং বাকী ১৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে প্রাতিষ্ঠানিক তহবিল ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে রূপান্তরের মাধ্যমে। একীভূত কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ইতোমধ্যেই আট সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির কাজ হলো ব্যাংকগুলোর একীভূত কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা এবং নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য লাইসেন্স, আরজেএসসি থেকে নিবন্ধনসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমের সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহন করা।

কমিটির আহ্বায়ক হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহাম্মদ। অন্য সদস্যরা হলেন- অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ রাশেদুল আমিন ও উপসচিব ফরিদ আহমেদ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দুই যুগ্ম সচিব শেখ ফরিদ ও মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক রেজল্যুশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জহির হোসেন এবং একই বিভাগের দুই অতিরিক্ত পরিচালক কাজী আরিফ উজ জামান ও মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন। কমিটির পক্ষ থেকে দাবী বলা হচ্ছে যে, একীভূত করণের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং অক্টোবরের মধ্যেই অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন হবে।

সরকারের সিদ্ধান্ত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা তৎপরতা দেখে স্পষ্টতই ধারণা করা যায় ব্যাংকগুলোর একীভূত প্রক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পুনর্গঠন উদ্যোগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো আমানতকারীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সমস্যাগ্রস্থ ব্যাংকগুলোর লিকুইডেশন বা অবসায়ন প্রক্রিয়া এড়িয়ে চলা, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ব্যাংকগুলোর কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

একীভূত হওয়ার জন্য নির্ধারিত চারটি ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ও সোশ্যাল ইসলামী—এর আগে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অভিযোগ রয়েছে, তারা বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে শেল কোম্পানির মাধ্যমে তহবিল অন্যত্র সরিয়ে নেয়। অন্যদিকে, এক্সিম ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ করেছেন নাসা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক লুটপাটের কারণে উক্ত পাঁচটি ইসলামি ব্যাংক মাত্রাতিরিক্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০২৪ সালের আগস্টে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকের পুরোনো বোর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন বোর্ড নিয়োগ করে। বৈশ্বিক অডিট ফার্ম দিয়ে করানো ফরেনসিক অডিটে তাদের নাজুক আর্থিক অবস্থার চিত্র উঠে আসে। অডিটে উঠে আসা খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায়—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামীতে ৯৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকে ৯৭ দশমিক ৮ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামীতে ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামীতে ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকে ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকারের সম্মতি পাওয়ায় এবার ব্যাংকগুলোর পর্ষদ বাতিল করে আলাদা একটি পর্ষদ গঠন করা হবে। নতুন ব্যাংকটির সরকারের পক্ষে পরিচালনগত দিক দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভিন্ন পর্যায় থেকে তহবিল নিয়ে ব্যাংকটি তিন থেকে পাঁচ বছর সরকারি মালিকানায় চলবে। এরপর ব্যাংকটি লাভজনক পর্যায়ে আসার পর এটিকে বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক বহুজাতিক কোনো সংস্থা নতুন ব্যাংকের মালিকানায় যুক্ত হতে পারে। ব্যাংকটি বিক্রির পর মুনাফাসহ সরকারের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংকটির জন্য ইসলামী ব্যাংকিং, আর্থিক খাত, তথ্যপ্রযুক্তি এবং আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে স্বতন্ত্র একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নিয়ে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞ একজনকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেবে। পাঁচটি ব্যাংকের অনেক ক্ষেত্রে একই এলাকায় একাধিক শাখা রয়েছে। এই শাখাগুলো বন্ধ করা হলে এতে করে কর্মী ছাঁটাইয়ের একটি প্রশ্ন আসবে। কর্মীদের গণহারে যাতে ছাঁটাই করতে না হয়, সে লক্ষ্যে এই ব্যাংকগুলোর শহর এলাকার বাড়তি শাখাগুলো গ্রামীণ এলাকায় স্থানান্তর করা হবে।

জানা যায়, দেশের মোট উপজেলার প্রায় ৩০০টি উপজেলায় এই পাঁচটি ব্যাংকের কোন শাখা নেই। সুতরাং সেসব উপজেলাগুলোতে নতুন ব্যাংকের শাখা খোলার যথেষ্ট সুযোগ থাকবে নতুন এই ব্যাংকটির। এতে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ সহজেই ইসলামি ব্যাংকিং সেবা পাবেন এবং দেশের আর্থিক অন্তর্ভূক্তি প্রক্রিয়া ত্বান্বিত হবে। একটি পরিসংখ্যানে জানা যায়, সারাদেশে এই পাঁচটি ব্যাংকের ৭৬০টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং ৯৭৫টি এটিএম বুথ রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী একটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এটি। একীভূত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে আরেকটি শক্তিশালী ইসলামি ব্যাংক গঠন করা হলে এর প্রতি আমানতকারী, অন্যান্য গ্রাহক এবং সাধারণ মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি শরিয়াহ ব্যাংকিংয়ের একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হবে।

দেশের মানুষের নিকট শরিয়াহসম্মত ব্যাংকিং সেবার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন ব্যাংকটি প্রকৃত অর্থে একটি শরিয়াহ পরিপালনকারী ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হলে মানুষের কাঙ্খিত ব্যাংকিং চাহিদা পূরণ হবে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সুনিশ্চিত হবে। তবে এ জন্য শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবিড় তত্তাবধান ও কঠোর নজরদারির মাধ্যমে এই ব্যাংকটিতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে। শরিয়াহর নীতিমালা পরিপালনে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে।

দেশব্যাপি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ও বৈচিত্রপূর্ণ ইসলামি ব্যাংকিং প্রোডাক্ট ও সার্ভিস এবং সার্বিক কল্যাণের বার্তা নিয়ে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে ব্যাংকিং সেবা দিতে পারবে এই নতুন ব্যাংক। ইসলামি শরিয়াহর উদ্দেশ্যের আলোকে বিনিয়োগ বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় আমানত স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (এসএমই) অগ্রাধিকার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নতুন উদ্যোক্তা উন্নয়নে অবদান রাখবে ব্যাংকটি। এতে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং খাত আরো সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হবে। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা আরো বৃদ্ধি পাবে।

লেখক: সার্টিফায়েড শরিয়াহ অ্যাডভাইজর অ্যান্ড অডিটর এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের হেড অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন্স।


এসসিও সম্মেলন ও তিয়ানজিন ঘোষণা

হাসান জাবির
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

সাংহাই ফাইভ গ্রুপ - ১৯৯৬ সালে রাশিয়া, চীন কাজাকিস্থান, কিরগিজস্থান তুর্কেমেনিস্থানের সমন্বয়ে গঠিত একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ফোরাম। যে ফোরামের মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ইউরেশিয়ান অঞ্চলের সীমান্ত নিরাপত্তা সুরক্ষা। এতদ উদ্দেশে ১০৯৭ সালে মস্কোতে ওই দেশের শীর্ষ নেতারা মিলিত হয়ে সংশ্লিষ্ট সীমান্তগুলো থেকে সামরিক শক্তি কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ৯০ পরবর্তী সমিকরণে সাংহাই ফাইভ গ্রুপের উদ্যোগটি রাশিয়া চীনের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপ অভিমুখী সম্প্রসারণ নীতির ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে ইউরেশিয়ান অঞ্চলকে নিরাপদ রাখতে সহায়তা করে। এ পর্যায়ে রাশিয়া ও চীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি বহুমেরুভিত্তিক নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন। মস্কো ও বেইজিংয়ের এই অঙ্গীকারের সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক নিরাপত্তার ধারনায় আসে গুণগত পরিবর্তন। ফলে ইউরেশিয়ান অঞ্চল, ককেশাস, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুত্রপাত হয়। এ ধরনের নানা রাজনৈতিক রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে ২০০১ সালে সাংহাই ফাইভ গ্রুপে যোগ দেয় উজনেকিস্থান। ফলে এটি সাংহাই সিক্স গ্রুপ হিসেবে পরিচিতি পায়। এ পর্যায়ে সাংহাই সিক্স গ্রুপের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আরও বিস্তৃত পরিসরে নেয়ার উদ্যোগ নেয় সদস্য দেশগুলো। উপরোক্ত ধারণাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে ২০০১ সালের ১৫ জুন চীনের সাংহাইয়ে সাংহাই সিক্স গ্রুপের শীর্ষ নেতারা মিলিত হয়ে এসসিও ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করলে জন্ম নেয় একটি নতুন আন্তর্জাতিক সংগঠন। যার নাম সাংহাই কো অপারেশন অর্গানাইজেশন সংক্ষেপে এসসিও। পরবর্তীতে ভারত ও পাকিস্তান এবং ইরান ও বেলারুশ এই সংস্থায় যোগ দিলে এর সদস্য সংখ্যা দশে উন্নিত হয়। রাশিয়া ও চীনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় গঠনমূলক ভূমিকার উপযোগিতায় বিস্তৃত করা হয় এই ফোরামের পরিধি। এক্ষেত্রে প্রথম থেকেই সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সামরিক কর্মকাণ্ডের সমন্বয় দেখা গেছে। ওই আলোকেই ধারণা করা হচ্ছিল যে এসসিওকে একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক জোট হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে সদস্য দেশগুলো। যেখানে রাশিয়া ও চীন নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ। একপক্ষীয় বিশ্ব ব্যবস্থার বিপরীতে রুশ চীন প্রস্তাবিত বহুমেরুভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থা বাস্তবায়নে এসসিও এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সর্বশেষ চীনে অনুষ্ঠেয় এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের ফোকাস এ সংক্রান্ত স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে। দুইদিন ব্যাপী এবারের এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের যুগপৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আশিতম বার্ষিকী উপলক্ষে চীনের সুবিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ ছিল পশ্চিমা বিশ্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানো। এই দুই ইভেন্টে অংশ নিতে গত সপ্তাহে বেইজিংয়ে বিশ্ব নেতাদের ঢল নেমেছিল। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম লিডার কিম জং উন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়াও বেইজিংয়ে জড়ো হয়েছিলেন পশ্চিমা একাধিপত্যবাদের কড়া সমালোচক অনেক দেশের নেতারা। একইসঙ্গে ন্যাটো সদস্য তুরস্ক, ইইউ এর সদস্য স্লোভাকিয়া এবং ইউরোপের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ সার্বিয়ার নেতাদের অংশগ্রহণ এই সম্মেলনের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। যা চীন ও রাশিয়ার প্রস্থাবিত বহুমেরুভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থার কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সাধারণভাবে এই আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য শুধুমাত্র এসসিও"র পূর্ণাঙ্গ সদস্য দেশগুলোর চিন্তা ভাবনার ওপর নির্দিষ্ট। তথাপি এসসিও সম্মেলন সমাপ্তীর মাত্র একদিন পরেই চীনের ভিক্টরি ডে প্যারেড অনুষ্টিত হওয়া, সেইসঙ্গে এসসিওর পর্যবেক্ষক সদস্য দেশ, সংলাপ অংশিদার সহ বহু দেশের রাষ্ট ও সরকার প্রধানের ব্যপক উপস্থিতির কারণে এবারের এসসিও শীর্ষ সম্মেলন আরও বিস্তৃত পরিসরে আলোচনার দাবি রাখে। বৈশ্বিক অস্থিরতার নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে অনুষ্ঠেয় এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের শুরুতেই গত জুনে ইরানে ইসরায়েল মার্কিন যৌথ হামলার তীব্র নিন্দা জানায় সদস্য দেশগুলো। অন্যদিকে সম্মেলনের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে তিয়ানজিং ঘোষনাপত্রে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন পূর্বক প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। এছাড়া কোনো দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। শক্তি প্রয়োগের প্রবণতা রোধ, একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরোধিতা করা হয় তিয়ানজিন ঘোষনায়। একপক্ষীয় বিশ্ব ব্যবস্থায় বিদ্যমান উপরোক্ত প্রবণতাগুলো প্রতিরোধে একটি সমন্মিত নীতি গ্রহণের ব্যপারে সম্মত হয়েছে এসসিও। যা সদস্য দেশগুলোর আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডের পথকে করবে সহজ। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় একটি সহজতর প্রক্রিয়া অনুসরণের পদ্ধতি প্রস্তুত করেছে এসসিও। যা শেষ পর্যন্ত গ্লোবাল সাউথের সমস্যা উত্তরণেও গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও গ্লোবাল সাউথের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিশেষ কিছু নীতি গ্রহণের ব্যাপারে এসসিও নেতারা আগে থেকেই একমত ছিলেন। গ্লোবাল সাউথকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর পর্যায়ে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ মুলক নীতি বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে রাশিয়া ও চীনের পূর্বতন চিন্তা ভাবনাগুলো এসসিওর মাধ্যমে সম্পন্ন করার পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবার। ফলে অর্থনৈতিক সাহায্যের আড়ালে গ্লোবাল সাউথের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার পশ্চিমা প্রচেষ্টাগুলোকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। এমনটি হলে পশ্চিমাদের প্রভাব মুক্ত পরিবেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনায় স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে উন্নয়নশীল বিশ্ব। বলা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডকে নানাভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেই ফেলেছে এসসিও। আগামী দশ বছর ধরে এসসিওকে আরও উপযোগী করার অঙ্গিকার করেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা অর্জনের মাধ্যমে মানবিক, রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে ২০৩৫ সালের মধ্যে এসসিওকে পূর্ণাঙ্গ বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রস্তুত করার কথা বলেছেন তিনি। এক্ষেত্রে চীনের প্রস্থাবিত আরেকটি ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ সফল হলে সেটি খুবই কার্যকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। চীনে এই সংস্থার শীর্ষ সম্মেলন সত্যিকার অর্থেই উম্মুক্ত করেছে বৈশ্বিক পরিবর্তনের বহু পথ। যদিও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সামরিক লক্ষ্য কি সেটি স্পষ্ট করা হয়নি। তথাপি এসসিওর সামরিক লক্ষকেই আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। কেননা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের আলোচনায় এসসিওকে মনে করা হয় ন্যাটোর প্রতিদ্বন্দ্বী জোট হিসেবে। এ কথা সত্য হিসেবে ধরে নেয়ার অনেক কারণ আছে। বিশেষত গত দশকে এসসিও সদস্য দেশসমূহ নিয়মিতভাবে বেশ কয়েকটি যৌথ সামরিক মহড়া সম্পন্ন করেছিল। যেগুলো তখনকার প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত সংবেদনশীল ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এসসিও এ ধরনের কর্মকাণ্ডের শিথিলতা লক্ষ্য করা গেলেও এই সংস্থার একটি বিস্তৃত সামরিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। যা তারা হয়তো আপাতত ফোকাস করতে চাইছেন না। এই অবস্থায় এসসিও এর কর্মকাণ্ড ঘিরে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে পশ্চিমা বিশ্বে । গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা, ইরান- ইসরায়েল যুদ্ধের আশঙ্কা, রুশ- ইউক্রেনীয় যুদ্ধের ভয়াবহতা সেইসঙ্গে এশিয়া প্রশান্ত মহসাগরীয় অঞ্চলে বিদ্যমান সামরিক উত্তেজনার আলোকে এসসিওর সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে রীতিমতো উদ্বেকে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার যুক্তরাষ্ট্র ও তার নেতৃত্বে পরিচালিত পশ্চিমি শক্তিগুলো অনেকটাই অপ্রস্তুত। যে কারণে সম্ভাব্য যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাদের নয়া কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে ন্যাটো রাশিয়া যুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে সংস্লিষ্ট ইস্যুতে এসসিও হঠাৎ কোনো যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভেস্তে দিতে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসের সমস্ত পরিকল্পনা। একইকথা প্রযোজ্য ইরান ইসরায়েল যুদ্ধ, তাইওয়ান ও কোরিয় উপদ্বীপের ক্ষেত্রেও। এ ধরনের বাস্তবতার কারণে সাংহাই কো অপারেশন অর্গানাইজেশনই এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক অঙ্গণের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। চীনের সর্বশেষ সম্মেলন সাংহাই সহযোগীতা সংস্থার লক্ষ ও উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ওই আলোকে এটি খুবই পরিস্কার যে স্নায়ুযুদ্ধ উত্তর দূনিয়ায় পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো কিংবা অন্যান্য কাঠামোর বিরুদ্ধে প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি করার শক্তি অর্জন করেছে এসসিও। সময়ের পরিক্রমায় এসসিওর ভূমিকা সম্প্রসারিত হবে এটিই বিশেষজ্ঞদের ধারনা। সদস্য দেশগুলোর সমন্বিত নীতির আলোকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করবে সাংহাই সহযোগীতা সংস্থা।

এসসিও সম্মেলন ও তিয়ানজিন ঘোষণা, হাসান জাবির, বিশ্লেষক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা


দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে

রেজাউল  করিম খোকন 
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বিএনপি ৪৭ বছরে পা দিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম করা দলটি এখন এক নতুন যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ১৫ বছরের কঠিন সংগ্রামের পর শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক এবং মাফিয়াবাদী শাসনতন্ত্র উৎখাতের মধ্যে দলটি এবং দলের নেতা-কর্মীরা অনেকদিন পর একটু স্বস্তির জায়গায় পৌঁছেছে। আসন্ন নির্বাচনে জিতলে আবারও দলটির নতুনভাবে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (যার সুযোগ নিতে আমরা এতদিন চরমভাবে ব্যর্থ), আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নতুন যুগ, দেশের পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য যেই ক্ষমতায় আসুক, তাকে দায়িত্ব নিতেই হবে। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দলটি আমাদের দিয়েছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। আমরা এখন জোর গলায় বলতে পারি, আমরা বাংলাদেশপন্থি মানুষ। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমাদের দেশে শুধু বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দলগুলোই আছে, যার শুরুটা বিএনপির হাত দিয়েই। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরত যাওয়ার মতো পুরো ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়েছিল বিএনপির হাত দিয়েই। আসলে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন বা সংস্কারগুলো এখন পর্যন্ত বিএনপির হাত দিয়েই হয়েছে। বাকশালের পর বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফেরত এনেছিল বিএনপিই। এরপর এনেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। অনেক নতুন জিনিস এসেছিল বিএনপির হাত দিয়েই। যেমন ভ্যাট ব্যবস্থা প্রবর্তন। বাংলাদেশের আয় এক ধাক্কায় বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এই আইন।

বাংলাদেশ তার রাজনীতিতে এখনো- একজন জিয়াউর রহমানকে খুঁজে বেড়ায়। স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে নিজের মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষণা করা, যুদ্ধে আহত হওয়া- বাংলাদেশের একমাত্র সেনা অফিসার, যিনি দুদেশের জীবিতদের মধ্যে একমাত্র সর্বোচ্চ খেতাবধারী ছিলেন। খাল খনন এবং আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের আমদানি তিন ভাগের দুই ভাগ কমিয়ে এনেছিলেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথাও তার মাথা থেকে আসে, যা এখন চরমভাবে ব্যর্থ। গার্মেন্ট দিয়ে দেশের পুরো অর্থনীতির মোড় ঘোরানোর শুরু তার হাতে। আবার ছিলেন সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম জিয়ার চরিত্রহননের বহু গল্প বানালেও তার সততাকে কখনোই প্রশ্ন করতে পারেনি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর একজন গৃহিণী বেগম খালেদা জিয়া দায়িত্ব নেন। সেই খালেদা জিয়াই এখন বাংলাদেশের ঐক্যের প্রতীক। তার আপসহীন এবং হার না মানা চিন্তা-ভাবনা থেকে দেশের মানুষের অনেক কিছু শেখার আছে। তার শাসনামলের প্রধান লক্ষ্যই ছিল- দেশকে শিক্ষা এবং অর্থনীতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। অসুস্থ খালেদা জিয়ার পর দলের হাল এখন তারেক রহমানের হাতে। তার সবচেয়ে বড় সাফল্য দলকে এত অত্যাচারের মধ্যেও এক রাখতে পারা এবং দলকে একটা উদারপন্থি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে টিকিয়ে রাখা। ৩১ দফা ঘোষণার মাধ্যমে দেশের সংস্কার যে প্রয়োজন তা আসলে বিএনপিরই ঘোষণা।

বিএনপির সবচেয়ে বড় দুই সমস্যার একটি লাগামছাড়া তৃণমূল। প্রতিটি আসনে দুয়ের অধিক প্রার্থী। নিজেদের দলাদলিতে ভুক্তভোগী হচ্ছে মানুষ। তারা তিন হাজারের বেশি বহিষ্কার করেছে, তাও পারছে না। মানুষ ভাবছে এটা একমাত্র সম্ভব তারেক রহমান দেশে এসে দলের দায়িত্ব নিলে। বিএনপির উচ্চ আত্মবিশ্বাস আরেকটা ক্ষতি হতে পারে। ফলে অনেকেই ধরাকে সরা জ্ঞান করে, অনেকে ভোটারদের বিরক্তের কারণ হচ্ছে। এই সমস্যাগুলো কিন্তু বিএনপি দল হিসেবেই কিছুটা সমাধান করতে পারত। তাদের যদি একটা রেজিস্টার্ড মেম্বার লিস্ট থাকত এবং যা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা থাকত, বাইরের থেকে কেউ এসে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করে যেতে পারত না। এদিকে দলে অনেকদিন কাউন্সিল না হওয়ায় নেতাদের মধ্যে মানুষের কাছে জবাবদিহির কালচারটাও হারিয়ে গেছে। জিয়াউর রহমানের সময়ে দলের ভেতরের গণতন্ত্র অনেক বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। দলে তরুণ নেতৃত্ব আনতে হবে, করতে হবে পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে মূল্যায়ন। ডাকসুতে যেমন চমৎকার একটা প্যানেল হয়েছে, এ রকম প্রার্থী হতে হবে দেশজুড়েই। বিএনপিকে জনমানুষের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। রাজনৈতিক দল মানেই গণমানুষের, তাই সবাই যাতে যোগাযোগ করতে পারে, একটা হেল্প সেন্টার, সঙ্গে ই-মেইল অ্যাকসেস থাকতে হবে। সেই অনুযায়ী নিতে হবে ব্যবস্থা। বাংলাদেশের ভালো থাকা আসলে কীভাবে জানি বিএনপির সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে। তাই আমাদের ভালোর জন্যই বিএনপির ভালো করতে হবে, ভালো থাকতে হবে এখন। খেয়াল করে দেখবেন, বিএনপির সফলতার লিস্টে কোনো উন্নয়নকাজ নেই, বরং সব কাজই সংস্কারমূলক। এবারও বিএনপি প্রায় সব বড় সংস্কারসহ ৯৪ শতাংশ প্রস্তাব পুরোপুরি বা আংশিক মেনে নিয়েছে। একটাই বড় সংস্কারে দ্বিমত আছে- আনুপাতিক উচ্চকক্ষ, কে জানে এখন পর্যন্ত একমাত্র প্রমাণিত সংস্কারক দল বিএনপির হাত ধরেই হয়তো আনুপাতিক উচ্চকক্ষ আসবে, কিন্তু কারও প্রেশারে নয়। দলের গঠনতন্ত্র সংস্কারসহ গণতন্ত্রে ফিরে আসাসহ আমরা হয়তো আগামী ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আগেই অনেক নতুন কিছু দেখতে পাব।

অতীতের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। দেশে যেন একক ব্যক্তির স্বৈরাচারী শাসন ফিরে আসতে না পারে, সে জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন হবে। অতীতে যা ঘটেছিল, সেগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। অপশাসন, বিচারহীনতা, দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচার যেন না ঘটে। যারা এসব অন্যায় করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারের জন্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করতে হবে। বিকৃত, নিম্নমানের, প্রতিহিংসামূলক ও ল্যাং মারার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বদল আনতে হবে। এটি পরিবর্তন দুরূহ ও কষ্টসাধ্য। কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন, এ বিষয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকারের বরখেলাপ করে। ২০০৮ সালের আগেও দলগুলো রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলের কথা বলেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারে সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্ব আসেনি । ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধি নেই। প্রশাসন যারা ভালো বোঝেন, এমন কেউ নেই। গণমাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এটাকে আরও সম্প্রসারিত করা সম্ভব। পরিবর্তিত পটভূমিতে মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ ও অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। তাই রাষ্ট্র সংস্কারের প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য যৌক্তিকভাবে যতটুকু সময় প্রয়োজন হবে, তা রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নিতে হবে। তারপর ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতেই হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির নতুন করে সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশের তরুণেরা ২০২৪ সালের আগের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশকে ফিরে যেতে দেবে না। আগামীর বাংলাদেশে তরুণেরাই রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ও গুণগত পরিবর্তন আনবে। বাংলাদেশে শিক্ষাগত বৈষম্য সবচেয়ে গুরুতর। এখানে অল্প একটা গোষ্ঠী উন্নত শিক্ষা পেয়ে থাকে। এর থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো শুরু করা না গেলে এই সংকট আগামী দশকেও এই অঞ্চলের মানুষকে ভোগাবে । তাই রোহিঙ্গাদের নিয়ে আগামী সাত-আট বছর সামনে রেখে একটি পরিকল্পনার ওপর জোর দিতে হবে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক দক্ষিণের জন্য আশার আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের শ্রমিকনির্ভর অর্থনীতির ওপর নির্ভর না করে জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে । সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশের বিপুল যে সম্ভাবনা রয়েছে তা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু ঝুঁকির প্রশ্নে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা আসিয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ইতিবাচক সম্ভাবনা রয়েছে । রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশ আসিয়ানকে পাশে পাবে।

আমলাতন্ত্রকে আরও বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করতে হবে। একজন সচিব কী সুবিধা পান, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, পদায়ন- প্রশাসনে এসব ছোট বিষয়। আমলাতন্ত্রকে আরও বৃহৎ পরিসরে দেখা উচিত। বিশ্ববাণিজ্য সংস্কার (ডব্লিউটিও) সম্মেলনে সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ভূমিকা রাখতে পারছেন কি না, অন্যান্য বড় চুক্তি ও সম্মেলনে সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ভূমিকা রাখতে পারছেন কি না, তা দেখা উচিত। রাজনৈতিক সংস্কার বাদ দিয়ে প্রশাসনকে সংস্কার করা যাবে না। রাজনৈতিক দলেই জবাবদিহি নেই। তাহলে প্রশাসন কার কাছে জবাবদিহি করবে। সিটি করপোরেশন থাকতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রয়োজন কেন?

প্রশাসনে সংস্কার আনতে হলে আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সদিচ্ছা থাকতে হবে। দেশে এত বিসিএস ক্যাডারের প্রয়োজন নেই। প্রশাসনে রাজনীতিকরণের কারণে গত দেড় দশকে কী হয়েছে তা , বিগত সময়ে সংস্কার কমিশন থেকে সুন্দর সুন্দর প্রস্তাব এসেছে; কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। প্রশাসন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারা নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। বিগত সময়ের সংস্কার কমিশনের সুপারিশ কেন বাস্তবায়িত হয়নি, তা খতিয়ে দেখা। নতুন করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের কোনো দৃশ্যমান বৈঠক দেখা যায়নি। এসব সুপারিশ নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করবে। তাই রাজনৈতিক দলকে নিয়ে কমিশনকে বসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধসহ দেশে অনেক যুদ্ধ ও সংগ্রাম হয়েছে; কিন্তু আমরা সেসব সংগ্রামের ফসল তুলতে পারিনি। দেশ স্বাধীনের পর ২৬ বার জনপ্রশাসন সংস্কারে কমিশন হয়েছে; কিন্তু সেসব কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। এসব সুপারিশকে বাস্তবায়ন করবে? রাজনৈতিক দল করবে। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠিত হয়নি। দেখা গেল, সংস্কার কমিশন হয়তো বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরল। কিন্তু সেটা যদি বাস্তবায়ন না করে বসে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যদি কানে তুলা দিয়ে বসে থাকে। হয়তো তারা কান থেকে তুলা খুলে বলবে, কিছু শুনিনি। তাই সবার আগে রাজনৈতিক সংস্কার জরুরি। রাজনৈতিক দলের সংস্কার ছাড়া জনপ্রশাসনের সংস্কার হবে না। জনপ্রশাসনে সংস্কার আনতে হলে রাজনৈতিক দলে সংস্কার আনতে হবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।


পুরুষমনের অযত্ন ও যত্নের পরিসংখ্যান 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

ভাবুন তো, সংবাদে, প্রচারণায়, সভা-সমাবেশে, বিশ্বসাহিত্য ও চলচ্চিত্রে পুরুষের মনোজগত কতটা স্থান পেয়ে এসেছে ভেবে দেখুনতো! অনেকে হয়তো বলবেন ‘স্থান পেয়েছে বৈকি! পুরুষের বীরত্বগাঁথা, দুর্বার প্রেম, ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ-হানাহানি-রক্তপাত, রাজ্য পরিচালনার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সবই তো আছে বহু প্রাচীন সময় থেকে! শুধু তাই নয়, পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি, বহুগামীতা, পরকীয়া, বিশ্বাসঘাতকতা, কিংবা কাপুরুষোচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এসবও তো বাদ যায়নি!’ একথা নিঃসন্দেহে সত্য। কিন্তু এতে পুরুষের বাহিরটা যতোটা প্রকাশিত হয়, অন্তরের সংশয়, বাহ্যিক চাপের ফলে হওয়া ভীষণ অসহায়তা, শরীর ও মনের বিস্তর গোলকধাঁধায় তার নিয়ত অপ্রকাশ্য সংকটের কথা কতটা জেনেছে এ বিশ্ব?

ভাবুন, পথের পাঁচালিতে সর্বজয়ার প্রতিটি নৈমিত্তিক যাতনা ও অনুভূতি যেভাবে সিনেমায় তুলে ধরা হলো, হরিহরবাবুর কাজের সন্ধানে খেয়ে না খেয়ে জায়গায় জায়গায় হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ানো, তার জ্ঞানানুরাগের হতভাগ্য বিসর্জন কিন্তু দেখানো হলো না। কোথাও যেনো মনে হলো ‘পুরুষ মানুষ চাকরি খুঁজছে এ আর এমনকি?’ এভাবেই পুরুষ তার কর্মের ও চিন্তার মহত্বের জন্য যথোপযুক্ত সম্মানিত না হতে হতে, সংসারের জন্য দিনরাত খেটেও প্রতিদান হিসেবে তার ত্যাগের স্বীকৃতি না পেতে পেতে, প্রশংসিত না হতে হতে একসময় নিজের কথা নিজের মধ্যে রাখতে শুরু করে। তার জন্য ঘর ও বাহির সমান হয়ে ওঠে। মেশে সবার সাথে কিন্তু মনকে আবেগহীন করতে শুরু করে। কাউকে মনের কথা বলতে না পারায় সে কখনো সৌম্য, আবার কখনো রাগী বা বদরাগী রূপে প্রতীয়মান হয়।

আবার দেখি শেক্সপিয়ারের ওথেলোর প্রিয়তমা ডেসডিমনাকে হত্যা করার মতো নৃশংস অপরাধ। এর বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এর জন্য দায়ী ওথেলোর সরল মনের বিশ্বাস এবং জীবন জটিলতার প্রতি তার অজ্ঞতা। তাতে এটা বলা যায় যে, অনেক বড় অপরাধের পেছনে সূক্ষ্ম সরলতা থাকাটা অসম্ভব নয়। পরিণত ভিলেনদের দেখে তিরস্কার করি সবাই। কিন্তু এ পথে তাদের আসার রাস্তায় পরিবার, বন্ধুমহল, সমাজ ও সমাজব্যবস্থা থেকে পাওয়া অবহেলা, অনাদর, অযত্ন এবং তিরস্কারের মতো অজস্র কন্টকে রক্ত ঝরাতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রে অগোচরে থেকে যায়।

পরিবার ও সমাজ দ্বারা প্রতি পদক্ষেপে একটি ছেলে ‘আমি মেয়ে নই, আমি ছেলে। আর তাই আমাকে পুরুষ হিসেবেই সম্মানিত হতে হবে’ এই ধরনের একটা বিশ্বাস অর্জন করে। মনোবিজ্ঞানে যাকে বলা হয় Traditional Masculinity, যা শৈশব থেকে অঘোষিতভাবেই তার উপর আরোপিত হয়।

মনোবিজ্ঞানী রবার্ট ব্র্যানন (Robert Brannon) পৌরুষত্বের চারটি সাধারণ আদর্শ নিয়ে আলোচনা করেছেন যার একটি হলো: ‘No Sissy Stuff’। বাংলায় একে বলা যায় ‘মেয়েলিপনাকে না’। এই No Sissy Stuff পুরুষদেরকে আবেগ প্রকাশে এবং দুর্বলতা প্রকাশে নিরুৎসাহিত করে। অধিকাংশ ছেলে সেই ছোট্টবেলা থেকে বড় হতে হতে বারবার লাভ করে কিছু বিশেষ দিকনির্দেশনা যেমন-

‘তুমি কি মেয়ে, যে নেলপলিশ আর আলতায় হাত মাখাচ্ছো?’,

‘কী কাণ্ড দেখো, ছেলে কাঁদছে! তুই কি মেয়ে যে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছিস? ছেলেদের কাঁদতে নেই।’

‘তুই না পুরুষ মানুষ! সংসারের সব দায়িত্ব তোকে নিতেই হবে, তা সে যেকোনো প্রকারেই হোক।’

‘প্রথমবার প্রেমিকাকে শপিং এ নিয়ে যাওয়াটা তোর কর্তব্য। সে চাইলো কি না চাইলো গাড়িভাড়া, রেস্টুরেন্ট, শপিং সবেতেই আগে তুই মানিব্যাগ বের করবি, বুঝলি? তবেই তো তুই পুরুষ!’

‘এতগুলো বছর তো কম পড়ানো হয়নি, এবার কিছু একটা তো কর! পুরুষমানুষ ঘরেবসে থাকার জন্য পড়ালেখা করেনা। ছোটবোনটার পড়াও প্রায় শেষ, তার বিয়ের সব দায়িত্ব তোকেই তো নিতে হবে, না কি?’

শুধু কি তাই? একটি টিন-এজ মেয়ের মনের বিষয়ে মা টি যতো বোঝেন, ছেলেটির মন তার অজানা। ছেলেটি কেনো একটু একটু করে একটি ঘরকে তার নিজের গন্ডি বানিয়ে ফেলছে, কেনো কম কথা বলতে চাইছে, আত্মীয়স্বজন এলে দূরে দূরে থাকছে এ বিষয়গুলি মায়েদের, বোনেদের, বড় ভাইদের অজানা। তারা বরং ভেবে বসেন, ‘ছেলেটা যত বড় হচ্ছে ততোই অসামাজিক-অভদ্র আর একগুঁয়ে হয়ে যাচ্ছে। হয়তো কখনো এই ছেলেটির এই অবস্থার একমাত্র বিনোদন হতে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া। আর এই বয়সের শারীরিক চাহিদার প্রতি কৌতুহল কখনও হয়তো তাকে নিয়ে যায় পর্ণগ্রাফির দিকে। আবার তাকে কেবল বাজর থেকে খুচরো বাজার বা ইলেক্ট্রিসিটি বিল পরিশোধে বা বোন কলেজে যাবে জন্য তার রিকশা ডাকা বা তার সাথে যাওয়া, কিংবা বড়জোর লেখাপড়ার খবরাখবর নেওয়ার জন্যই যখন গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, সে তার মনের জগতে দ্রুত রুক্ষ ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি মনঃক্ষুণ্ন ও অভিমানি হতে হতে কখনও কখনও ভেতর ভেতর মমত্বহীন হয়ে পড়ে। এটা সবার ক্ষেত্রে না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো না কোনোরূপে সত্য হয়ে ওঠে।

একটি মেয়ের একাধিক পোশাকের একাধিক ম্যাচিং যেমন সত্য, তেমনি সেই মমত্বহীন ছেলেগুলোর দুই তিনটি যেনোতেনো শার্ট বা টিশার্ট দিয়ে স্টুডেন্টলাইফ পাড় করাও কিন্তু অসত্য নয়! এটা টাকার অভাব বা বাবামার ইচ্ছাকৃত বৈষম্য নয়, বরং তারা জানেনই না যে ছেলেটিরও এ ব্যাপারে ইচ্ছা বা চয়েজ থাকতে পারে। এটা খুব স্বাভাবিক হিসেবেই মেনে নিতে পারে ছেলেরা। কারণ তার বন্ধুরাও ওই দুই তিন রকম যেনতেন শার্ট বা টিশার্টই মেনে নিতে শিখে যায়। এবার সে আর একা নয়। তার বন্ধুমহলের অধিকাংশই সেই ‘যেনতেন'র কাতারে। এভাবে বাড়ির সবার সাথে অমিলের দুঃখটা বন্ধুদের সাথে মিলের আনন্দে সে কিছুটা ভুলে যেতে শুরু করে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী জীবন। এই ছেলেগুলি পারিবারিক উদাসীনতার ফলে ভীষণরকম ইট্রোভার্ট হিসেবে তৈরি হয়। মেয়েদের সাথে এদের মনোকষ্টের একটা বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। মেয়েরা দাদি, নানি, মা বা বোন বা বড় ভাইয়ের বউ এর কাছে বা প্রতিবেশী মেয়েদের কাছে বা সহপাঠীদের সাথে কিংবা পার্লারের মহিলাদের সাথে অনায়াসে তাদের শরীর ও মনের নানাবিধ সমস্যা ও আবেগ-অনুভূতির কথা শেয়ার করে হালকা বোধ করতে পারে। কিন্তু ছেলেরা পরিবার বা সংসারের প্রতি শত অভিমান থাকলেও তারা নিজেদের পরিবার বা সংসারের কথা দশ জায়গায় উন্মোচন করতে চায়না। শুধু তাই নয়, তারা একজন আরেকজনের প্রতি গোপনীয়তার বিষয়ে গভীরভাবে বিশ্বস্ততা দেখায়। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় পুরুষের এই মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় ‘Bro code’, যার অর্থ হলো বন্ধু হিসেবে ছেলেরা একে অপরের সাথে এতটাই শক্তিশালীভাবে যুক্ত হয় যে তারা পরস্পরের গোপনীয়তাকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে। ফলে খেলা, দেশবিদেশের খবর ইত্যাদি হয়ে ওঠে এদের আড্ডার বিষয়।

একইরকম যেনতেন জীবনে বৈচিত্র্য খুঁজতে খুঁজতে এদেরই কেউ কেউ হয়তো হয়ে ওঠে নারীকামী, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, ইভটিজার। সাধারণভাবে পরিবারের মেয়ে সদস্য বা মেয়ে সহপাঠীদের সাথে তাদের এতোদিনের ইন্ট্রোভার্সিটির কারণে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তাই নারীদেহ নিয়ে তার চিন্তা ও কামনা বিকৃত রুচির রূপ নেয়। ফলে, হয়তো কখনো কখনো এদেরই কেউ মনের মধ্যে ধর্ষণের মতো বর্বরোচিত বিষয়কেও জায়গা দিয়ে ফেলে। বর্বর ধর্ষক হয়ে ওঠে সেই সুন্দর পরিবারে জন্ম নেওয়া কোমলমতি শিশুটি! নষ্ট হয়ে গিয়েছিল যার শিশুস্বত্ত্বা, নষ্ট হয়েছিল যার বয়োঃসন্ধিকাল, নষ্ট হয়েছিলো যার আবেগ-মমতা-করুণা, অসৎসঙ্গে নষ্ট হলো তার লেখাপড়া, নষ্ট হলো তার চাকরি করে কিছু হয়ে ওঠার স্বপ্ন, পাপাচারে-নৃসংসতায়-বর্বরতায় আক্রান্ত হলো তার এক একটি নিউরন! তবু হয়তো তার মনে কোনো ‘পাপবোধ’ জাগলোই না! সে জানলোই না যে, তার এই নষ্ট ও বিকৃত মস্তিষ্ক সে তার মায়ের গর্ভ থেকে পায়নি, ভূমিষ্ঠ হয়েও নয়, দুই পায়ে হাটিহাটি পা পা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখার সময় থেকে নয়, দুপায়ে পিতার বা বড় ভাইয়ের বড়বড় জুতোগুলো পড়ার বারংবার চেষ্টা করার সময় থেকেও নয়। সে কিন্তু জানে সে প্রথম কখন সিগারেট হাতে নিয়ে জ্বালিয়েছিল, সে জানে সে প্রথম কখন নেশাকে সঙ্গী করেছিল। অথচ সে জানেইনা প্রথম কখন বা কীভাবে নষ্ট হতে শুরু করেছিলো তার ‘মন ও মস্তিষ্ক’। সেও তো সুন্দর সুস্থধারার জীবন যাপন করতে পারতো! সেও তো সংসারের Big Wheel হয়ে প্রমাণ করতে পারত তার বীরোচিত পুরুষত্ব।

প্রত্যেকটি সন্তানের প্রতি সমান বিবেচনা প্রয়োজন। হরমোনজনিত কারণে মেয়ে ও ছেলে শিশুর বাহ্যিক আচরণে পার্থক্য হয়। কিন্তু মন ও মস্তিষ্কে সকলের একটাই চাওয়া থাকে পরিবারে কাছে। আর তা হলো তার ‘মনের যত্ন’। খাদ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, রোগনিরাময় এই বিষয়গুলিতে বাবা-মা প্রায় সমান যত্নবান হয়ে থাকেন। কিন্তু অযত্ন হয় প্রাণপ্রিয় সন্তানের মনের প্রতি। বোনটির হাতের পোষাবিড়াল দৌঁড়ে পালিয়ে লুকালে সে সারাদিন কেঁদেকেটে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিতে পারে, কিন্তু ভাইটির হাত কেটে রক্ত ঝরলেও তার শব্দ করে কাঁদার কথা আমরা ভাবতে পারি না। তাকে যেন ওই অবস্থায় চোখ শুষ্ক রেখে প্রমাণ করতে হয় যে সে পুরুষ। সে শুধু ঢাল-তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধজয়ের সেই ‘বীরপুরুষ’!

আমাদের অনেকেই চাই আমাদের ছেলে সন্তান দায়িত্ববান The Sturdy Oak হয়ে উঠুক। ওক গাছের মতো শক্ত হোক। তাহলে কেনো এই শক্ত গাছটির কাছে আমরা নমনীয়তা আশা করি?

সন্তান বাইরে মহিরুহ হলেও, সন্তানের মনকে নিয়মিত আদরযত্নের বারিধারা দিয়ে সিক্ত ও নরম রাখা প্রয়োজন। পরিবার ও সমাজ পর্যাপ্ত যত্ন না করলে বাহিরের বাকলের মতো ভেতরেও সে শুষ্ক হতে হতে অযান্তেই প্রণোবন্ত মহিরুহটি নিশ্চিতভাবেই জীবের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে একটি ‘অ-জীব’ বা ‘অ-প্রাণীতে’ পরিণত হতে পারে। যা আমাদের কাম্য নয়।

ঊর্মিলা চক্রবর্তী, ৩৩ তম বিসিএস (ইংরেজি), রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী।


সংস্কার এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ কি একই রাস্তায় চলছে

ড. সুলতান মাহমুদ রানা
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তীব্র অনিশ্চয়তা ও সহিংসতা তৈরি হলেও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের বিকল্প নেই- এমন বার্তাই সর্বমহলে আলোচিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ, বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরে সংঘর্ষ, মিডিয়ার ওপর হামলা ইত্যাদি গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ইতোমধ্যেই সংকটে ফেলছে। এ অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক সংলাপই পারে স্থিতিশীল ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যা দেশের গণতন্ত্র ও বৈশ্বিক ভাবমূর্তির জন্য অপরিহার্য। সম্প্রতি মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেটি হলো আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে, ছাব্বিশের ফেব্রুয়ারি মাসে যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা আছে, সে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করা, সাহায্য করা।’ সংস্কার কমিশনগুলো যে সংস্কার প্রস্তাব করেছে, সেখানে বিএনপি সব ধরনের সহযোগিতা করেছে বলেও জানান তিনি। কিন্তু নির্বাচনের বিষয়ে বিভিন্ন শর্ত নিয়ে অন্যান্য কিছু রাজনৈতিক দল এখনো একমত হতে পারেনি। এমনকি নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর যথাযথ কমিটমেন্ট খুব বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে না। এক ধরনের অস্থিতিশীলতা নির্বাচন বানচাল করতে পারে এমন শঙ্কা অনেকের মনেই জেগেছে।

বিশ্বের বহু দেশে নির্বাচনী সংস্কার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বারবার কমিটমেন্ট করছে- নির্বাচনকে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার বিষয়ে। এমনকি এমন কমিটমেন্টট বাংলাদেশেও ইতোপূর্বে কয়েকবার হয়েছে। তারপরও কোনো না কোনোভাবে নির্বাচন প্রভাবিত হচ্ছে এবং প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে। কাজেই এখানেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামেই চয়েস করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন, অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্যমানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন এবং নিজেদের উৎকৃষ্ট ভাবার প্রবণতা অধিকভাবে লক্ষণীয়।

মোটাদাগে বলতে গেলে বলা যায় রাজনৈতিক দলগুলোর বিদ্যমান টানাপড়েনের পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের। উদার গণতন্ত্রের উপাদানগুলো সবসময়ই অনুপস্থিত। আর এই দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিত উপাদানগুলোর যথাযথ সংস্কার রাতারাতি সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের চলার পথ মসৃণ করতে হলে অতীতের ভুল চিহ্নিত করে শিক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইতিপূর্বে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় বিধি বিধানের অসমাঞ্জস্যতায় দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের পথ মসৃণ হয়নি। নানা প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চাই, তার জন্য দরকার আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি আলোচনার বিষয় হলো ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের সীমিত অংশগ্রহণ। সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় উঠে আসা বেশ কিছু সাংবিধানিক সংস্কার এখন রাজিনীতির মূল বিষয়বস্তু হয়েছে। আলোচনার ভিত্তিতে বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী আর সর্বোচ্চ দশ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না; নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন, তথ্য কমিশন এবং প্রেস কাউন্সিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির সরাসরি নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হবে; এবং সংসদের কয়েকটি প্রভাবশালী কমিটিতে বিরোধী দলের নেতৃত্ব নিশ্চিত করা হবে। এ ধরনের পরিবর্তন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছুটা ভারসাম্য আনার উদ্যোগ। তবে সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন উঠছে, এগুলো কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রের জন্য কতটা টেকসই হবে। প্রস্তাবগুলো যথেষ্ট আশার সঞ্চার করলেও সংকট পুরোপুরি কেটে যাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। ইতোমধ্যেই আমরা লক্ষ্য করেছি, বিএনপি এবং আরও কয়েকটি জোট এসব প্রস্তাব নিয়ে ভিন্নমত জানিয়েছে। তারা চাইছে একটি ন্যাশনাল সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন অথবা দ্বিকক্ষ সংসদের ব্যবস্থা, যা ক্ষমতার আরও বড় ধরনের ভারসাম্য নিশ্চিত করতে পারে। ফলে কমিশনের খসড়া প্রস্তাব এখনো পূর্ণাঙ্গ সমাধান হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং রাজনৈতিক সমঝোতার অভাবে অনেকটাই অনিশ্চিত থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাগুলো এখানে অলোচনা করা যেতে পারে। পাকিস্তানের ২০১০ সালের অষ্টাদশ সংশোধনী একটি তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ। এর আগে প্রেসিডেন্টের হাতে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, যা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়াত। অষ্টাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয় এবং প্রেসিডেন্ট কার্যত আনুষ্ঠানিক প্রধানে পরিণত হন। এর ফলে সংসদ ও প্রধানমন্ত্রী শক্তিশালী হয়, যদিও রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্বলতার কারণে সেই কাঠামোও পুরোপুরি স্থিতিশীল হতে পারেনি। আবার ফ্রান্সের আধা-রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা দেয়। সেখানে যদি প্রেসিডেন্ট এক দলে আর প্রধানমন্ত্রী অন্য দলে থাকেন, তবে এক ধরনের বাধ্যতামূলক ক্ষমতা ভাগাভাগি তৈরি হয়, যাকে কোহ্যাবিটেশন (ফ্রান্সের আধা-রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থায় এমন এক পরিস্থিতি, যখন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে বাধ্য হন) বলা হয়। এ অভিজ্ঞতা দেখায়, সাংবিধানিক কাঠামো কখনো কখনো জটিল পরিস্থিতিতেও ভারসাম্যের পথ খুঁজে নেয়। ইতালিতে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যাতে জনগণ সরাসরি ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করবে। এটি হয়তো গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ বাড়াবে, কিন্তু একইসঙ্গে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত হয়ে যাবে এবং ভারসাম্য নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি হবে। তুরস্কের অভিজ্ঞতা আবার একেবারেই ভিন্ন। ২০১৭ সালে সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী পদই বিলুপ্ত করে দেওয়া হয় এবং প্রেসিডেন্টকে সর্বময় নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এতে প্রেসিডেন্ট একাই নিয়োগ, বাজেট এবং জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। সমালোচকরা বলেন, এ সংস্কার গণতন্ত্রের মৌলিক ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই উদাহরণগুলো বাংলাদেশকে দেখায়, শুধু সংবিধানের ধারা বদলালেই সব সমাধান হয় না, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা জানি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক ধরনের নেকিবাচকতা আছে। আর সেই নেতিবাচকতা কি সহজেই কাগজ কলমে লিখিত আকারে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে করা যাবে? এ বিষয়ে অনেক বড় প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।

উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অভিজ্ঞতা আরও স্পষ্ট করে দেয় ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্বাচিত হলেও কংগ্রেস এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ক্রমাগত ক্ষমতার টানাপড়েন বজায় থাকে। প্রেসিডেন্ট কোনোভাবেই এককভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এমনকি কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্টের মধ্যে ক্ষমতার একটি ভারসম্য আছে। যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত প্রভাবশালী হলেও সংসদীয় কমিটি, বিরোধী দলের কঠোর নজরদারি এবং শক্তিশালী গণমাধ্যম তাকে সব সময় জবাবদিহির মধ্যে রাখে। জার্মানিতে বড় কোনো নীতি বা নিয়োগ প্রক্রিয়া দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ছাড়া এগোতে পারে না। সুইডেনে সংসদই কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রক শক্তি। এমনকি জাপানের মতো উন্নত দেশেও প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। কিন্তু প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলীয় কাঠামোর শক্ত নিয়ন্ত্রণ তাঁকে সীমাবদ্ধ রাখে। এসব উদাহরণ আমাদের বলে দেয়Ñগণতন্ত্র তখনই টেকসই হয় যখন প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয় এবং কোনো একটি পদে বা ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় না।

কিন্তু বাংলাদেশে বাস্তবতা ভিন্ন। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির হাতে যদি নিয়োগের ক্ষমতা বাড়ানো হয়, কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রভাব অটুট থাকে, তবে পরিবর্তনটি কার্যত কাগজে সীমাবদ্ধ থাকবে। বিরোধী দল যদি পুরো প্রক্রিয়ায় আস্থা না রাখে, তবে সংসদীয় কমিটিতে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তও অর্থহীন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন কিংবা আইন কমিশন যদি রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত না হতে পারে, তবে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরবে না। এর সঙ্গে আছে সুশাসনের ঘাটতি। দুর্নীতি, প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা, আইনের দুর্বল প্রয়োগ-এসব সমস্যা শুধু সাংবিধানিক পরিবর্তন দিয়ে সমাধান হয় না। যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানির মতো দেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এতটাই শক্তিশালী যে দলীয় প্রভাব সহজে ঢুকতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করা যায়নি।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করা, যেখানে ক্ষমতার একচ্ছত্রকরণ বন্ধ হবে এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তার সাংবিধানিক দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালন করবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে, সংসদীয় পর্যায়ে বিরোধী দলের মতামতকে সম্মান করতে হবে, এবং বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন ও গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এগুলো সম্ভব হলে তবেই সাংবিধানিক সংস্কারের সুফল পাওয়া যাবে। অন্যথায় ক্ষমতার ভারসাম্যের যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, তা কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

অতএব বলা যায়, বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংস্কার এখন এক ধরনের পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা। এসবের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বিরোধী দলের আস্থা, এবং শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছাড়া এই সংস্কারগুলো কার্যকর হবে না। বিশ্বের অভিজ্ঞতা আমাদের স্পষ্ট বার্তা দেয়- গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু সংবিধান পরিবর্তন নয়, বরং তার বাস্তবায়নে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক সহনশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে এই সংস্কারগুলোও থেকে যাবে আংশিক চেষ্টার প্রতিচ্ছবি, আর বাংলাদেশের গণতন্ত্র আবারও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের দুষ্টচক্রে আটকে পড়বে।

লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


যেমন যোগ্য শিক্ষক তেমন যোগ্য জাতি

মো. রহমত উল্লাহ্
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

অধিক যোগ্যরা শিক্ষকতায় আসতে আগ্রহী না হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই পাওয়া যাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত মানসম্পন্ন শিক্ষক অথবা শূন্য থাকছে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক পদ। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এনটিআরসিএ বার বার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও পূর্ণ করতে পারছে না শূন্য পদ। ফলে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, শিক্ষক পদে কাঙ্ক্ষিত আবেদন পাওয়া যাচ্ছে না কেন, নিয়োগের জন্য যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না কেন?

এ প্রশ্নের উত্তর যতভাবেই আমরা ঘুরিয়ে দেই না কেন শেষ কথা হচ্ছে, বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা-মর্যাদা এতই কম যে, যারা অন্য কোনো চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন তারা শিক্ষক হতে আসছেন না। প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থীর ‘এইম ইন লাইফ’ এ শিক্ষকতা নেই। বাধ্য হয়ে কেউ শিক্ষকতায় এলেও থাকতে চাচ্ছেন না। থাকলেও শিক্ষকতাকে একমাত্র পেশা হিসেবে জীবন ধারণ করতে পারছেন না। তাই মনেপ্রাণে শিক্ষক হয়ে উঠতে পারছেন না। এসব বিবেচনায় তুলনামূলক কম যোগ্যরা বেসরকারি শিক্ষক হবার জন্য আবেদন করছেন ও হচ্ছেন। অথচ আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৯৫% শিক্ষার্থীর পাঠদানে নিয়োজিত বেসরকারি শিক্ষক। বড়ই উদ্ভূত আমাদের প্রত্যাশা! তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষক দিয়ে আমরা তৈরি করতে চাই অধিক যোগ্য নাগরিক-কর্মী। এটি কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। বিশ্বের দেশে দেশে যে জাতি যত উন্নত সে জাতির শিক্ষক তত শিক্ষিত। শিক্ষক যদি মানুষ গড়ার কারিগর হয় তো একজন অযোগ্য বা কম যোগ্য শিক্ষক সারা জীবনে তৈরি করবেন অগণিত অযোগ্য বা কম যোগ্য মানুষ এটিই স্বাভাবিক, এটিই সত্য। অথচ এই কঠিন বাস্তবতা অনুধাবন করতে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই ব্যর্থ! একজন ভালো শিক্ষক আজীবন লালন করেন জানার এবং জানানোর ঐকান্তিক ইচ্ছা। জ্ঞানার্জনে হন নিরলস। অত্যন্ত সমৃদ্ধ হন নির্ধারিত বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে। শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি অত্যন্ত ভালোভাবে জানেন শিক্ষার সংজ্ঞা, শিক্ষার উদ্দেশ্য ও শিক্ষাদানের আধুনিক পদ্ধতি। আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানে হন সমৃদ্ধ। জানেন আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার, সুফল-কুফল এবং সে আলোকে শিক্ষার্থীকে দেন সঠিক দিকনির্দেশনা। শিক্ষালাভে সদা-সর্বদা থাকেন সক্রিয়। হন বই ও প্রকৃতির একনিষ্ঠ পাঠক এবং সেভাবেই গড়ে তুলেন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষক নিজে হন সবচেয়ে বড় শিক্ষার্থী। কেননা, শিক্ষাদান শিক্ষকের একান্ত কর্তব্য। শিক্ষাগ্রহণ শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত ভালো ছাত্রদেরই ভালো শিক্ষক হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যে ব্যক্তি শিক্ষাজীবনে পড়ুয়া থাকে, পরিশ্রমী থাকে, মেধাবী থাকে, নম্রভদ্র থাকে, ধৈর্যশীল থাকে, ক্লাসে উপস্থিত থাকে, পরীক্ষায় এগিয়ে থাকে, সহশিক্ষায় আগ্রহী থাকে, ভালো কাজে উদ্যমী থাকে; সে স্বেচ্ছায় শিক্ষক হলে ভালো শিক্ষক হয়ে উঠবার সম্ভাবনা যতটা বেশি থাকে, এর বিপরীত বৈশিষ্ট্যের কেউ শিক্ষক হলে ভালো শিক্ষক হয়ে উঠবার সম্ভাবনা ততটাই কম থাকে। শিক্ষক যত বেশি জ্ঞানী-গুণী থাকেন, শিক্ষার্থীদের তত বেশি জ্ঞানী-গুণী হবার সুযোগ-সম্ভাবনা থাকে।

যতই আধুনিক শিক্ষা উপকরণ যুক্ত করা হোক, উন্নত সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বহুতল ভবন নির্মাণ করা হোক; শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা খুবই কঠিন কাজ বিশেষ করে আমাদের দেশে যেখানে সর্বোচ্চ মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসেননি, আসছেন না যুগ যুগ ধরে। টাকা হলে রাতারাতি শিক্ষা উপকরণ বদল করা যায়, পুরনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা যায়; কিন্তু শিক্ষকদের বদল বা মান বৃদ্ধি করা যায় না। শিক্ষকের মান বৃদ্ধি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। শিক্ষকের বেতন সর্বোচ্চ নির্ধারণ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সব শিক্ষকের মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে যাবে এমনটি অবাস্তব। কেননা, এই আমি যতদিন আছি ততদিন দিয়েই যাব ফাঁকি, রেখেই যাব কম দক্ষতার স্বাক্ষর। তথাপি বৃদ্ধি করতে হবে আমার তথা শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা। শিক্ষকতায় আনতে হবে সর্বোচ্চ মেধাবীদের, জ্ঞানীদের, গুণীদের।বারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও যখন যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় না তখন শূন্য পদ পূরণের কৌশল যদি এমন হয় যে, কম যোগ্যদেরই নিয়োগ দেওয়া হবে তো সেটি নিশ্চয়ই কম মঙ্গলজনক হবে। কেননা, বর্তমানে শিক্ষকতায় যাদের আবেদন পাওয়া যায় তাদের অধিকাংশই অন্য পেশা/চাকরি পেতে হয়ে আসেন। অন্য পেশার তুলনায় কম যোগ্য শিক্ষক বারবার নিয়োগ দিতে হলে, এদের সংখ্যা লাখ লাখ হলে, দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়। একজন কম যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের কুফল ২৫-৩০ বৎসর অর্থাৎ তিনি যতদিন কর্মরত থাকেন ততদিন দীর্ঘায়িত হয়। এ কুফল বিস্তৃত হয় দেশ ও সমাজের সর্বত্র। তথাপি আমরা বৃদ্ধি করতে চাই না বেসরকারি শিক্ষকদের মান। অনেকেই মনে করি, বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা-মর্যাদা সবচেয়ে কম থাকবে, বেসরকারি শিক্ষকগণ তুলনামূলক কম যোগ্য-দক্ষ থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। কেননা, তারা তো বেসরকারি। কিন্তু আমরা এটি ভাবি না যে, এ বেসরকারি শিক্ষকগণই কোনো না কোনো পর্যায়ে পাঠদান করেন দেশের প্রায় সকল শিক্ষার্থীদের এবং ওই শিক্ষার্থীরাই নিয়োজিত হয় দেশের সকল কর্মক্ষেত্রে। এরাই নেতা হয়, কর্মী হয়, আমলা হয়, মন্ত্রী হয়, দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত হয়।

যুগ যুগ ধরে আমরা অনুভব করতে পারিনি/করিনি উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করে অধিক যোগ্য নাগরিক-কর্মী তৈরির জন্য অধিক যোগ্য শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা। তাই আমরা বৃদ্ধি করিনি শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা-মর্যাদা, নিশ্চিত করিনি অধিক যোগ্যদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার সঠিক ও কার্যকর ব্যবস্থা। বরং এক্ষেত্রে আমরা করেছি উল্টো কর্মকাণ্ড! অন্যান্য পেশার তুলনায় কমিয়েছি শিক্ষক হবার যোগ্যতা। এখনো একটি তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি গ্রহণযোগ্য শিক্ষকতায়। ছাড় দিয়েছি শিক্ষকতায় প্রবেশের বয়সে। এখনো ৩৫ বছর বয়সে আবেদন করা যায় শিক্ষকতায় প্রবেশের জন্য; যা অন্য অনেক পেশায় সম্ভব নয়। বিসিএসসহ অন্যান্য অনেক নিয়োগ পরীক্ষার তুলনায় সহজ করা হয় শিক্ষক নিয়োগের বাছাই পরীক্ষা। এক কথায় সবই করা হয় তুলনামূলক কম যোগ্যদের শিক্ষকতায় আনার জন্য। তথাপি বৃদ্ধি করা হয় না শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা-মর্যাদা, নিশ্চিত করা হয় না অতি আগ্রহে অধিক যোগ্যদের শিক্ষকতায় আগমন ও আত্মনিবেদন। তাই পাওয়া যায় না যোগ্য শিক্ষক, শূন্য থাকে শিক্ষকতার পদ। প্রাপ্য শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় আমাদের সন্তানেরা। কোনো রকম কোটা সংরক্ষণ করে, যোগ্যতা কম নির্ধারণ করে, বয়স বেশি নির্ধারণ করে, বাছাই প্রক্রিয়া শিথিল করে, তুলনামূলক কম যোগ্যদের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ দেওয়া মোটেও উচিত নয়। কেননা, শিক্ষক অযোগ্য হলে জাতি অযোগ্য হয়। আমাদের সর্বাধিক মেধাবী ও যোগ্য সন্তানরা যেদিন সাগ্রহে এসে দখল করবে আমাদের স্থান সেদিনই নিশ্চিত হতে পারে আমাদের শিক্ষকদের কাঙ্ক্ষিত মান। শিক্ষকতায় যোগ্যতা কমিয়ে তুলনামূলক কম যোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে নয়; বরং বেতন, মর্যাদা, ক্ষমতা ও নিরাপত্তা বাড়িয়ে, কর্মপরিবেশ ও বাছাই প্রক্রিয়া উন্নত করে, অধিক যোগ্যদের নিয়োগ দিয়েই বৃদ্ধি করতে হবে শিক্ষার প্রকৃত মান, নিশ্চিত করতে হবে দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতি।

লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট


বাংলাদেশের পলির অবস্থা, উৎস, প্রভাব ও ফলাফল

ড. এম. এ. সোবহান পিপিএম
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

গ্যাবেন মালয়েশিয়ার পাহাং স্ট্যাটের একটি শহর। যেখানে বিভিন্ন প্রকারের শিল্প রয়েছে। আর তানগুক নদী ঐ শিল্পাঞ্চলের পাশ দিয়া বয়ে যাওয়া এক নদী। যেটি শিল্পের বর্জ্য ও বর্জ্যপানি ফেলে নদীর পানি ও পলি দূষিত করে থাকে। সাধারণত: পলিসমূহ (সেডিমেন্টস) দূষিত হয় শিল্প এবং শিল্পের বর্জ্য ও বর্জ্যপানির মাধ্যমে। পলি দূষণের বড় ক্ষতিকর দিক হলো জলজ প্রাণী কর্তৃক পলি ভঙ্গন এবং খাদ্যচক্রে দূষকের অনুপ্রবেশ। মানুষের অযাচিত কার্যক্রমের প্রভাব এবং শিলা ও খনিজ (প্যারেন্ট ম্যাটেরিয়াল) থেকে আসা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ এবং অবক্ষয় প্রক্রিয়া (ওয়েদারিং) এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে পলিতে হেভিমেটাল অর্থাৎ (As, Cd, Pb, Cr... প্রভৃতি) সঞ্চিত হয়ে থাকে। হেভিমেটাল দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে থাকে এবং তার ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে অনেক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। হেভিমেটালসমূহ সহজে রাসায়নিক ও জৈব প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করা যায় না। বর্তমান সময়ে মালয়েশিয়ায় হেভিমেটালের দূষণ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এখন আসা যাক বাংলাদেশের পলি তথা সেডিমেন্টের স্ট্যাটাস বা অবস্থার বিষয়ে। বাংলাদেশের পলিসমূহ ও পলিসমূহের দূষণ নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন মর্মে এক বিজ্ঞানী মতামত পোষণ করেন। উক্ত বিজ্ঞানী অবশ্য বলছিলেন সেডিমেন্ট স্যামপিলিং (Sampling) একটা সমস্যা। উচ্চতর গবেষণায় সেডিমেন্ট নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি সেডিমেন্ট স্যামপিলিং খুবই সহজ এবং এতে খুবই কম খরচ হয়ে থাকে। এমনকি বলতে গেলে যাতায়াত খরচ ছাড়া কোন খরচই হয় না। তাছাড়া সেডিমেন্টের ইন-সিটু (In-Situ) কোনো প্যারামিটার নির্ণয় না করলেও চলে। আর কেবল PH ও EC নির্ণয়ের জন্য সহজে বহন যোগ্য এবং কম খরচের ইক্যুইপমেন্ট নেয়া যেতে পারে অথবা এক প্রকারের কলমের মত একটি ইক্যুইপমেন্ট আছে যার দ্বারা PH ও EC দুটিই নির্ণয় করা যায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশের নদী বা অন্যান্য পলি নিয়ে তেমন কোন গবেষণা হয় নাই। কোনো বই বা প্রকাশিত জার্নাল পেপারও পাওয়া যায় না বা প্রকাশিত হয় নাই। এতদভিন্ন, এ বিষয়ে অনেক গবেষণা বা কাজ করার সুযোগ রয়েছে এবং সংশ্লিষ্ঠদের এদিকে একটু দৃষ্টি দেয়া উচিত মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। এতদভিন্ন, পলি দূষণের উৎস্যসমূহ খুঁজে বের করতে হবে এবং প্রয়োজনে দূষণের সংগে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। সেজন্য আমাদের দেশের শিল্প কারখানার পার্শ্বের নদী, জলাশয় এবং অন্যান্য জলাশয় এর পলি পরীক্ষা করা ও দূষণ নিয়ে কাজ করা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ।

তানগুক নদীর পলি দূষণ ও পলির অবস্থা:

তানগুক নদীর পলির আর্সেনিক, কোবাল্ট, ক্রোমিয়ায়, বেরিয়াম, নিকেল, জিংক, কপার, মারকারী ও লেড এর মাত্রা নির্ণয়ের লক্ষ্যে ৯টি স্থান থেকে পলির নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। বিশ্লেষিত ফলাফলে হেভিমেটালসমূহের কতকগুলো স্টেশন বা স্থানের নমুনার পরিমাণ অনুমোদিত মাত্রা থেকে বেশি এবং কয়েকটি অনুমোদিত মাত্রার কাছাকাছি পাওয়া যায়।

১) আর্সেনিক (As) দূষণ : বিশ্লেষিত নমুনায় আর্সেনিকের পরিমাণ পাওয়া যায় ২.৫৫ থেকে ২৪.৬৭ মিলিগ্রাম/গ্রাম এবং যাদের গড় মান ছিল ১০.২২ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম। সর্বোচ্চ মাত্রায় আর্সেনিকের পরিমাণ ছিল ২৪.৬৭ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম। যা অনুমোদিত মাত্রার থেকে তিনগুনেরও বেশি এবং গড় মানের আর্সেনিকের মানও ছিলো অনুমোদিত মাত্রা থেকে বেশি (সূত্র: ক্যানাডিয়াম সেডিমেন্টস গাইডলাইন)। অপরদিকে সব থেকে কম পরিমাণ অর্থাৎ ২.৫৫ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম আর্সেনিক পাওয়া যায় একটি স্টেশনের পলিতে। যা কম সতর্ক মাত্রা (Low Alert Level) এর থেকেও বেশি।

২) কোবাল্ট (Co) দূষণ: তানগুক নদীর পলির নমুনায় কোবাল্টের পরিমাপ পাওয়া যায় ০.১৩ থেকে ১৩৮৩.৮৫ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম এবং গড় মান পাওয়া যায় ৪৯২.৭৪ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম। প্রাপ্ত ফলাফল থেকে দেখা যায়, যে তাংগুক নদীর পলির গড় মান অনুমোদিত মাত্রা থেকে বেশি এবং সর্বোচ্চ মানটি অনুমোদিত মাত্রা থেকে ৭০ গুন বেশি। যা খুবই মারাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ।

৩) মারকারী (Hg) দূষণ: গবেষণা দ্বারা মারকারী দূষণের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। পলির নমুনায় মারকারীর মাত্রা পাওয়া যায় ০.২১৮ থেকে ৪.৭৯৩ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম এবং গড় মান ছিলো ০.৯১৯ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম। ৯ (নয়) টি স্টেশনের নমুনার সকল বিশ্লেষিত ফলাফলের মারকারী মাত্রা অনুমোদিত মাত্রা থেকে অনেক বেশি পাওয়া যায়। উপরুন্ত, সর্বোচ্চ মারকারী দূষণের পরিমান পাওয়া যায় অনুমোদিত মাত্রা থেকে ৩১.৯ গুন বেশি। যা অত্যন্ত বেশি এবং ঝুঁকিপূর্ণ।

৪) লেড (Pb) দূষণ: গবেষণায় ব্যবহৃত পলির নমুনার বিশ্লেষিত ফলাফলে লেড বা সীসা পাওয়া যায় ১.৬৮ থেকে ১১৫.২৭ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম। সকল পলির নমুনার লেডের মাত্রা ‘কম সতর্ক মাত্রা’ অর্থাৎ ‘Low Alert Level’ এর উপরে পাওয়া যায়। এছাড়া সর্বোচ্চ লেডের মাত্রাটি লেড দূষণের অনুমোদিত মাত্রা থেকে ১৬ গুন বেশি বলে বিবেচিত। যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও মারাত্মক।

৫) ক্রোমিয়াম (Cr) দূষণ: গবেষণায় ব্যবহৃত পলির নমুনার বিশ্লেষিত ফল থেকে ক্রোমিয়ামের মাত্রা ৮.৪৭ থেকে ২৫.১৮ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম এবং গড় মান পাওয়া যায় ১৭.৭৩ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম পাওয়া যায়। সর্বোচ্চ মান পাওয়া যায় ২৫.১৮ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম অথচ প্রাপ্ত নিম্নমান ছিল ৮.৪৭ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম। সেডিমেন্ট কোয়ালিটি গাইডলাইন মোতাবেক বিশ্লেষিত ফলাফলের গড় মান ‘কম সতর্ক মাত্রা’ অর্থাৎ ‘Low Alert Level’ থেকে বেশি।

৬) বেরিয়াম (Ba) দূষণ: গবেষণার পলির বিশ্লেষিত ফলাফলে বেরিয়ামের মাত্রা ৫.৯৩ থেকে ১২৫.৬৯ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম পাওয়া যায়। তাছাড়া বেরিয়ামের গড় মাত্রা পাওয়া যায় ৪৬.৬৩ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম। বেরিয়ামের এই গড় মান ‘কম সতর্ক মাত্রা’ বা ‘Low Alert Level’ এর বেশি।

৭) নিকেল (Ni) দূষণ: তানগুক নদীর পলির নমুনায় নিকেলের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম অর্থাৎ ০.৫০ থেকে ১৪.১৭ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম। যার গড় মান ছিল ৩.৫৩ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম। উপরুন্ত, গবেষণার পলির নমুনার নিকেলের গড় মান ‘কম সতর্ক মাত্রা’ বা ‘Low Alert Level’ এর বেশি।

৮) ক্যাডমিয়াম (Cd) দূষণ: গবেষণায় ব্যবহৃত পলির বিশ্লেষিত নমুনায় ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম মাত্রায় পাওয়া যায়। পলিতে ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ ০.০১ থেকে ০.২৭ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম এবং ক্যাডমিয়ামের গড় মান ছিল ০.০৮ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম। সেডিমেন্ট কোয়ালিটি গাইডলাইন অনুসারে ৬টি স্থানের পলির নমুনায় ক্যাডমিয়ামের মাত্রা ‘কম সতর্ক মাত্রা’ অর্থাৎ ‘Low Alert Level’ এর উপরে পাওয়া যায়।

৯) জিংক (Zn) দূষণ: গবেষণায় ব্যবহৃত পলির নমুনার বিশ্লেষিত ফলাফলে জিংকের মাত্রা ২.৭১ থেকে ৬৩.৬৩ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম পাওয়া যায়। উপরুন্ত, নমুনার পলিতে জিংকের গড় মান পাওয়া যায় ৩০.৭৯ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম। বিশ্লেষিত পলির জিংকের গড় মান ‘কম সতর্ক মাত্রা’ অর্থাৎ ‘Low Alert Level’ এর উপরে পাওয়া যায়।

১০) কপার দূষণ: তাংগুক নদীর বিশ্লেষিত পলির নমুনায় কপারের মাত্রা ০.৩৬ থেকে ১৭.২৪ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম এবং গড় মান ৬.৮৭ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম পাওয়া যায়। তিনটি স্টেশনের কপারের মাত্রা ‘কম সতর্ক মাত্রা’ বা ‘Low Alert Level’ এর উপরে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের পলির অবস্থা: একটি সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের শিতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীর পলিতে ক্রোমিয়ামের মাত্রা বেশি। আবার বুড়িগঙ্গা নদীর পলিতে লেড ও ক্যাডমিয়ামের মাত্রা অনুমোদিত মাত্রা থেকে বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া আর্সেনিক, জিংক ও কপারের পরিমাণও বেশি পাওয়া যায়। সেজন্য আমাদের দেশের পলিসমূহের নমুনা পরীক্ষা করে দূষণের মাত্রা জানা অতীব প্রয়োজন। কেননা জলজ প্রাণীর মাধ্যমে এ সকল হেভী মেটাল (আর্সেনিক, লেড, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম... ইত্যাদি) ‘ফুড চেইনে’ চলে আসতে পারে।

বাংলাদেশের পলি (সেডিমেন্ট) এর হেভিমেটালের উৎসসমূহ:-

১) শিল্প নির্গত উৎস: বাংলাদেশের হাজারীবাগ ও সাভারের ট্যানারি শিল্প থেকে অপরিশোধিত (Unrefined) ক্রোমিয়াম, লেড এবং অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য সমৃদ্ধ বর্জ্য, ওয়েস্ট ওয়াটার (বর্জ্য পানি) ও এফলুয়েন্ট সরাসরি বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা প্রভৃতি নদীতে নিক্ষেপ করা হয়ে থাকে মর্মে সূত্র থেকে জানা যায়।

২) কৃষিক্ষেত্র থেকে: এদেশে কৃষিক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিমাণ রাসায়নিক সার, পেস্টিসাইড, ইনসেক্টিসাইড, হার্বিসাইড ব্যবহৃত হয়। বর্ষাকালে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার, পেস্টিসাইড, ইনসেক্টিসাইড ও হার্বিসাইডসমূহ বৃষ্টির পানিতে মিশে এবং ক্ষেত থেকে ঐগুলি ধূয়ে জলাশয়ে চলে যায় এবং সেগুলি পলির উপর পতিত হয়।

৩) শহর ও নগরীর বর্জ্য থেকে: ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, যশোর ও চট্টগ্রামের মতো বড় বড় নগরী থেকে প্রতিদিন ব্যাপক পরিমাণ কঠিন এবং তরল বর্জ ও বর্জপানি উৎপাদিত হয়। এদের অধিকাংশই অপরিশোধিত এবং সেগুলি বিভিন্ন জলাশয় ও নদীর পলিতে জমা হয়।

৪) জাহাজ ভাংগা কার্যাবলি: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাংগা শিল্প হলো বিশ্বের অন্যতম বড় জাহাজ ভাংগা শিল্প। এখান থেকে বিভিন্ন প্রকারের তৈল, রাসায়নিক দ্রব্য এবং হেভিমেটাল যেমন: লেড, মারকারী, অ্যাসবেসটাস ইত্যাদি সামুদ্রিক পলিতে মিশ্রিত হচ্ছে।

৫) প্রাকৃতিক জিওজেনিক উৎস: বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের একটা বড় অংশ হিমালয় ও উজান থেকে আসা শিলা, খনিজ, মৃত্তিকা ও পলি থেকে উৎপত্তি হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে হিমালয়ের শিলা ও খনিজে আর্সেনিক ও অন্যান্য ধাতু রয়েছে। উপরুন্ত, এগুলো বিভিন্ন কারণে ক্ষয় বা ভেংগে নদী দ্বারা প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে।

হেভিমেটালের প্রভাব এবং ফলাফল: দূষিত পলি এবং পলির হেভিমেটাল মানুষ, জলজউদ্ভিদ, জলজপ্রাণী, অন্যান্য উদ্ভিদ, অন্যান্য প্রাণী, খাদ্য ও অনুজীবে বিষক্রিয়া ঘটায়। তাছাড়া দূষিত পলি জলজ খাদ্য চক্র ব্যাহত করে এবং অনুজীবের আবাসস্থল ধ্বংস করে থাকে। তাছাড়া অতিমাত্রায় হেভিমেটাল সর্বক্ষেত্রে বিষাক্ততা ছড়ায় এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে।

১) মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি : হেভিমেটাল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয়ভাবেই মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে থাকে। প্রথমত: মানুষ সরাসরি ত্বকের মাধ্যমে হেভিমেটাল দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। তাছাড়া পলি ও পলির পানি দ্বারা শিশুরা ও মৎস্যজীবীরা সহজেই হেভিমেটাল দূষণের প্রত্যক্ষ শিকার হয়ে থাকে। আর পরোক্ষভাবে: হেভিমেটাল সমূহ জলজপ্রাণী যেমন: মাছ, শামুক, ঝিনুক এবং ধান ও চালের মাধ্যমে মানুষের খাদ্যচক্রে চলে আসে। পূন: পূন: হেভিমেটালের সংস্পর্শ ও শরীরে অনুপ্রবেশের ফলে ক্যানসার, কিউনি ড্যামেজ, ত্বকের ক্ষত, শ্বাস-কষ্ঠ, স্নায়বিক ব্যাধি প্রভৃতি হতে পারে।

২) পানির গুনাগুনের অবনতি: পলি থেকে দূষকসমূহ পানিতে মিশে যায় এবং খাবার পানি, কৃষিতে ও অন্যান্য ব্যবহার্য পানি এবং পানি প্রবাহে চলে আসে ও পানির বিশুদ্ধকরণে বড় অন্তরায় সৃষ্টি করে।

৩) জীবন ও জীবিকার উপর প্রভাব: পলি দূষণ মাছ, খাদ্যদ্রব্য, জলজপ্রাণী ও কৃষিক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে মানুষের জীবন ও জীবিকা অর্থাৎ খাদ্য, কর্মসংস্থান ও কাজের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। পলির দূষণ খাদ্যের উৎপাদনকে হ্রাস করে এবং কৃষি জমিকে অনুর্বর করে তোলে।

বর্তমান বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর পরিবেশের কমপোনেন্ট বা উৎপাদনসমূহ অর্থাৎ পানি, বাতাস, শব্দ, মৃত্তিকা, পলি ইত্যাদি ক্রমাগতভাবে দূষিত হচ্ছে। তাছাড়া মানুষের অযাচিত আচরণের কারনে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমণ হচ্ছে। ফলসরুপ বৈষিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বরফ গলন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি সৃষ্টি হচ্ছে এবং যার ফলে, মানুষ, প্রাণীকূল, উদ্ভিদ, জলজপ্রাণী, অনুজীব, ফোনা ও ফ্লোরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যা এ সুন্দর পৃথিবীকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

লেখক: কমান্ড্যান্ট (অ্যাডিশনাল ডিআইজি), পরিবেশ বিজ্ঞানী

পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল (পিএসটিএস), বেতবুনিয়া, রাঙ্গামাটি


ফিরিয়ে দাও নির্মলতা

সাকিব রায়হান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

তখন ক্লাস ফাইভ অথবা সিক্সে পড়ি। সবে সকালের আলো ফুটেছে। আম্মা আমাকে ডেকে তুললেন। আব্বা এবং মতিন কাকা উঠানে অপেক্ষা করছেন। আমরা একসাথে হাটে যেয়ে আম, কাঁঠাল কিনে আনব। এক্সাইটমেন্ট থেকে দ্রুত বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে উঠানে চলে এলাম। উঠানের পশ্চিম পাশে মতিন কাকার নৌকা বাঁধা। আব্বা এবং কাকা এর মধ্যেই নৌকায় উঠে পড়েছেন। আমি কাঁচুমাচু করে ভদ্র ছেলের মতো নৌকায় উঠে বসলাম। মতিন কাকা নৌকা বাওয়া শুরু করেছেন। আমাদের নৌকা উত্তর দিকের বিল ধরে চলা শুরু করেছে। দক্ষিণ দিক থেকে আসা সোঁ সোঁ বাতাস পানিতে বৈঠা এবং নৌকার সম্মুখভাগের আছড়ে পড়া পানির শব্দের সেই মাদকতা যারা কখনো উপভোগ করেনি তারা বুঝতে পারবে না। যাই হোক, কয়েকটি বিল এবং একটি বড় খাল ও একটা ছোট নদীর কিছুটা অংশ পাড়ি দিয়ে অবশেষে আমরা হাটে পৌঁছলাম। ছোট একটা দ্বীপের মত এলাকায় হাটটি। উপরে পাতার ছাউনি দেয়া এবং চারিদিকে খোলা বেশ কিছু দোকান মিলে এই হাট। খাল, নদীর তাজা মাছ, আশ পাশের এলাকা থেকে উৎপন্ন টাটকা সবজি এবং আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, লিচুতে ভরপুর।আমরা আম, কাঁঠাল কিনে আবার দুই/তিন কিলোমিটারের সেই টলটলে পানি ভেদ করে বাসায় ফিরে আসলাম।

উপরের লেখাটা এ পর্যন্ত পড়ে নিশ্চয়ই ভাবছেন যে আমি কোন এলাকার গ্রামের কথা বলছি? আবার অনেকে হয়তো নিজের বা নানাবাড়ির গ্রামের সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। মজার বিষয় কি জানেন? আমি যে এলাকা এবং হাটের কথা বললাম সেটা ঢাকা শহরেই অবস্থিত। আমি মাদারটেক থেকে বনশ্রীর মেরাদিয়া হাটে যাওয়া আসার কথা বললাম। অনেকের কাছে কল্পকাহিনী মনে হলেও এটা একদমই সত্য। তখন মূল ঢাকা শহর খুব অল্প জায়গায় বিস্তৃর ছিল। চার দিকে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষাসহ কয়েকটা নদী এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক খাল এবং বিল। মার্চের শেষের দিকে নদীর পানি বিভিন্ন নিচু এলাকায় খালের মাধ্যমে ঢুকে যেত। অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত পানিতে ভেসে থাকতো অনেক এলাকা। রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার সংক্ষেপে আর ডি আর সির প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা শহরে প্রায় ১৭৫টি খাল, লেক এবং পানি প্রবাহের চ্যানেল ছিল। বর্তমানে ৮০টির কোন অস্তিত্ব নেই এবং পনেরটি নামে মাত্র টিকে আছে। ১৮৮০ থেকে ১৯৪০ এর সি এস ম্যাপ অনুযায়ী ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে পানি প্রবাহ ছিল প্রায় ৩২৬ কিমি যা ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০৬ কিমি। অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ পানি প্রবাহের চ্যানেল বিলীন হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে সেগুলো গেল কোথায় বা তার বর্তমান অবস্থা কি? উত্তর খুব সহজ। দখল হয়ে গেছে, কেনা বেচা হয়ে গেছে। যাদের দেখার দায়িত্ব ছিল তারা অদৃশ্য হয়ে গেছে। এরচেয়ে বেশী কিছু বললে মানহানির মামলায় পড়ে যেতে পারি।

ছোটবেলায় দুপুরের খাওয়ার পর থেকে বিকেলের আসরের আযান হওয়া পর্যন্ত এক ধরণের উৎকণ্ঠায় থাকতাম। আযান পড়লেই খেলার মাঠের উদ্দেশে দৌড়। ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটা এলাকাতেই খেলা ধুলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ছিল। বিকাল পড়লেই ছোট ছেলে মেয়েদের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে দারুণ একটা আবহ তৈরি হতো। ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন,সাতচারা ইত্যাদি খেলার আয়োজন। পরীক্ষা চলাকালীন সময় ছাড়া কেউ বিকেলের খেলা মিস করতে চাইতো না।এখন এই শহরে বাচ্চারা খুব একটা খেলে না। কিছু ছেলে মেয়ে হয়তো কিছু টাকা দিয়ে কোন একাডেমী বা ক্লাবের আন্ডারে খেলে; কিন্তু সেই সবাই এক হয়ে খেলার পরিবেশ আর নেই। সবচেয়ে বড় কথা খেলবেটা কোথায়? বর্তমানে হাতে গোণা কিছু মাঠ। তাও দেখি মাঠগুলো উন্মুক্ত না। ভাড়ায় চলে।

আমরা ছোটবেলায় যে ঢাকা শহর দেখেছি সে ঢাকার চেয়ে এই ঢাকা অনেক আধুনিক, অনেক সুসজ্জিত। বড় বড় অট্টালিকায় ঢাকার আকাশ এখন ছেয়ে গেছে।হাজার হাজার গাড়িতে রাজপথ পরিপূর্ণ। যেটা নেই সেটা হচ্ছে বসবাসের উপযোগিতা। ধুলা বালি আর কালো ধোঁয়ায় একাকার। রাস্তায় হাটলে কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে বুক ভরা নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য বাতাস খোঁজা লাগে।

একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখেন তো, ঢাকা শহরে মোটামুটি সুস্থ্যভাবে বসবাসের জন্যে এখন সবচেয়ে বেশি কি কি প্রয়োজন? আমি মনে করি প্রথমে দরকার একটা সহনীয় পরিবেশ। ঢাকার পানি খারাপ, ঢাকার বাতাস খারাপ, ঢাকায় স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভাব। ঢাকায় যে কয়েকটা লেক বা পানি প্রবাহের চ্যানেল আছে সেগুলার দিকে একটু তাকান। দেখলে মনে হবে ময়লা, আবর্জনা, প্লাস্টিকে ঢাকা রাস্তা। কিছু বছর আগেও যেসব খাল দিয়ে টলটলে পানি প্রবাহিত হয়ে যেত, যে সব খালে আমরা ডুব সাঁতার খেলেছি সেগুলো এখন নিছক ড্রেন হিসাবে পড়ে আছে। এই দৃশ্য যে কতটা মর্মান্তিক সেটা শুধু তারাই বুঝবে যারা এই দুটো বৈপরীত্য নিজ চোখে দেখেছে।

বাচ্চারা যখন বিকেলে খেলাধুলা করে তখন এক ধরনের কিচির মিচির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে যেটাতে অনেকটা শেষ বিকেলে পাখিরা ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নেয়ার সময় যে আওয়াজ করে তার সাথে মিল পাওয়া যায়। বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থ্যতায়, মনের প্রশান্তিতে এবং পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার জন্যে বিকেলে খেলা ধুলা করা যে কতটা প্রয়োজনীয় সেটা আমরা অনেকেই জানি। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে নজর না দিয়ে নগরায়নের নামে মাঠ দখল করা বা খেলার মাঠে স্থাপনা কতটা অযৌক্তিক সেটা বলার প্রয়োজন নেই। সমস্যা হচ্ছে, আমরা কেন যেন অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে যাই। প্রতিটা এলাকায় প্রয়োজনীয় খেলার মাঠের দাবিতে আমরা এক হতে পারছি না। বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের অভাব হলে অন্যসব উন্নয়ন যে অকার্যকর হবে সেটা আগে অনুধাবন করতে হবে।

আমার মনে হয় ঢাকা শহর উন্নয়নে সবার আগে মনোযোগ দিতে হবে অভ্যন্তরের নদী, খাল এবং পানি প্রবাহের চ্যানেল কার্যকরী করা এবং প্রয়োজনীয় খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা। যেসব নদী এবং খালের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেগুলো আদৌ পুনরুদ্ধার করা সসম্ভব কিনা সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ সেসব জায়গায় রাস্তা এবং বড় বড় ইমারত গড়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসাবে আমরা নড়াই নদীর কথা বলতে পারি। আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা যে বর্তমানের পান্থপথের নীচ দিয়ে এক সময় নড়াই নদী প্রবাহিত ছিল। প্রথমে নড়াই নদী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মোহাম্মদপুর এবং সাত মসজিদ রাস্তা নির্মাণের সময়। আগে নড়াই নদী বুড়িগঙ্গা এবং তুরাগ নদীর সাথে সংযোজিত ছিল। বিচ্ছিন্ন নড়াই নদী মৃত হয়ে যায় পান্থপথ তৈরির মাধ্যমে। এরকম অনেক নদী ও খাল উন্নয়নের নামে রাস্তায় পরিণত হয়েছে। কি ভয়াবহ আমাদের এই উন্নয়ন!

এখন উদ্যোগ নিতে হবে ঢাকা শহরের ভিতর ও বাইরে দিয়ে পুনরায় পানি প্রবাহের চ্যানেল তৈরি করা। হাজার হাজার কোটি টাকার নগরায়নের চেয়ে এই উদ্যোগ অনেক বেশী প্রয়োজনীয়। যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নদী, খাল ভরাটের মাধ্যমে লাভবান হয়েছে তাদের কাছ থেকে যথাসম্ভব ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিতে হবে। জলাবদ্ধতা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাওয়ার আগে এটাই হয়তো আমাদের শেষ সুযোগ। দখল হয়ে যাওয়া খেলার মাঠ, পার্ক এবং লেক আবার সাধারণ মানুষের কাছে ফিরিয়ে নিতে হবে।

বিভিন্ন ব্যাক্তি ও সংগঠন এর জন্যে লড়ে যাচ্ছে। আমাদের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। যে উন্নয়ন জলাশয়, খেলার মাঠ দখল করে হয় সেটাকে কোনোভাবেই উন্নয়ন বলা যেতে পারে না। যে উন্নয়নে পরিবেশ দুষিত হয় সেটা উন্নয়ন না পতন।আমাদের প্রাণের ঢাকা শহর হোক আগের সেই ঢাকা। যখন প্রতিটা ঋতুর আগমন উপলব্ধি করা যেত। যখন দিনের পর দিন বৃষ্টি হলেও রাস্তা জলাবদ্ধতায় ঢেকে যেত না। যখন ছেলে মেয়েদের কোলাহলে প্রতিটা বিকাল মুখরিত থাকত। এর মধ্যেই আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। যদি এখনই ঢাকা শহর পুনরুদ্ধারে অগ্রসর না হই তাহলে কিন্তু এই শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে। ঢাকার উন্নয়ন হোক নির্মলতা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে।

লেখক: কথাশিল্পী ও নাট্যকার


গণতন্ত্র, গণমানস ও জনগণের শান্তির উপকরণ

রেজা নুর
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে যে রায়ের জয় হয়, তার উপরে শাসনের অধিকার বর্তায়। ৪৯ শতাংশের মত গ্রহণীয় হয় না। তাদের প্রতিপক্ষের প্রতি অসস্তুষ্ট নিয়ে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত আশায় দিন কাটাতে হয়। এই সময়টাতে দেশের ভালো চিন্তার চেয়ে দলের অবস্থান, নিজেদের আখের গোছানোর পথ তালাশে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এই সাদা কথাটা সত্যি হয়ে দেখা দেয় প্রায় প্রতিটি দেশের বেলায়। বলা হয়, পক্ষ প্রতিপক্ষের সুস্থ ও গঠনমূলক সমালোচনা প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে যোগ্য রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক। কিন্তু এই প্রক্রিয়া যুগে যুগে জনভোগান্তি, জনবিভাজন ও অর্থ অপচয়ের পন্থা হিসেবে পরিলক্ষিত হয়ে এসেছে।

বিপরীত চিত্রও ভাবা যায়। জনগণ একটা সচেতন মানবগোষ্ঠির নাম। তাদের মতো ও পথের মূল্য আছে। রাষ্ট্রের শাসন-কাঠামো, কতৃত্বের ভার তারা তাদের হাতেই দেবেন যারা এই আমানত রক্ষার যোগ্য। নিজ ঘরের সিঁড়ি থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাটির পথের সংগে পরিচয় থাকবে রাষ্ট্র-কর্তার। প্রতিটি পদক্ষেপে, দৃষ্টিতে ভেসে আসবে পড়ে থাকা পাতা, ধুলোর আস্তরণ কিংবা কর্কশ কংকর। মানুষ হিসেবে নিজের ব্যথা বা একান্ত কথার মতো সবার আনন্দ বেদনার আয়নায় সাজানো থাকবে তার একান্ত ঘর। একটি আসনই তার জন্য বড় হয়ে উঠবে না, বরং চেয়ায়ের নিচের জমিনই হবে তার বিবেকের বিস্তর উপত্যকা। সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশের সেই জমিটুকু অতীব মূল্যবান আর তার ওপরের তৃণরূপ জন-প্রাণ তার কাছে অমিয়র মতো অমূল্য। তাদের লালন পালনে থাকবে পিতৃত্বের তৃপ্তি, মায়ের উজ্জ্বল চোখের মতো চির দীপ্তি।

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন শাসকের দেখা মেলে বটে, তবে খুবই কম।

হৃদয়বান রাষ্ট্রনায়কের যে ছবি আমাদের মানসপটে ভাসে, তার অধিকাংশই দূর অতীতের। রাজার উপর রাজ্যভার সঁপে দিয়ে প্রজারা নিশ্চিন্তে দিন কাটাতেন। প্রাসাদ থেকে নিয়ে দূর গ্রামের ভালো-মন্দ ভালো করে জানা থাকত রাজার। দুদিন পর পর শাসক বদলাবার ঝামেলা পোহাতে হতো না প্রজাদের। আজকের মতো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকলেও মুখে মুখে রটে যেত ভালো মানুষের সুনাম। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হতেন জনগণের কল্যাণের কান্ডারী। তবে, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারের ইতিহাস সবসময়ই সরব। ইতিহাস বইয়ের পাতা উল্টালে হাতে উঠে আসে এখনো রক্তের ছোপ। নতুন সবুজ জমিনের খোঁজ পেলে লোভী রাজার হানা থেকে বাঁচতে পারত না ছোট ছোট রাজ্যগুলো। বাইরের আক্রমণের দিকটাই বড় হয়ে দেখা যেত সেই জামানায়।

আজ জগত বদলেছে। মানুষের অধিকার সচেতনতা এখন মুখ্য বিষয়। সেই অধিকারকে সাকার করবার লক্ষ্যে রাষ্ট্রচালকের পদটি কে পাবেন তার জন্য আবিষ্কার হয়েছে গণতন্ত্র। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করা সেই ব্যক্তিত্বকে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটিও যে খুব সুখকর তা বলা যায় না। নির্বাচিত হবার পর তিনিই এবং তার দলই সবকিছু এই প্রবণতা ও মানসিকতা পরিলক্ষিত হয় কাজকর্মে।

জনরায় পাবার জন্যে জনতোষামোদের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে তাদের চেহারা বদলে যায়। তবু নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জনগণের আর কিছুই করার থাকে না। ভাবে, পরেরবার দেখে নেবে ব্যালটের মাধ্যমে। কিন্তু তাদের দেখা আর হয় না। বরং তাদেরকেই দেখতে হয় দুর্দিন।

এইচিত্র, আর্থিক ও সমরশক্তিতে উন্নত দেশগুলোতেও একই। পৃথিবীর মোট ১৯৫ টি দেশের কোন্ রাষ্ট্রনায়ক তার দেশ ও সীমানার বাইরের সম্মানিত তা বলা মুশকিল। গোত্রতন্ত্রের কথা আলাদা। সেখানে ঐক্য অসম্ভব। কিন্তু একটা রাষ্ট্র যখন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়, তখন সেই রাষ্ট্রের বুকে থাকে অমিত বল, শক্তি ও সামর্থ্য। বিশাল বটবৃক্ষের মতো ছায়া মেলে দিয়ে শীতল করতে সক্ষম দেশের সমস্ত অঞ্চল। কথা হলো, এইরকম বৃক্ষ আমরা পাব কোথায়? প্রথমত, সচেতন জনগণ প্রয়োজন, এরপরে আসে কার্যকরী সরকার কাঠামো। অভাবের দায়ে হতদরিদ্র কেউ যখন চুরিতে নামে, তার শাস্তির ব্যাপারে যেমন জনসাধারণ দারুণ সচেতন, রাষ্ট্রীয় পদে আসীন কোনো অসৎ বা দুর্জনের বেলায় কি তারা তেমন? সেজন্য, অপরাধ অনুপাতে দ্রুত বিচার শেষ করাবার পথ থাকতে হবে।

সম্প্রতি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমাদের ব্যথিত করে বেশি করে। দৃঢ় বিশ্বাস, দেশের সব বিবেকবান মানুষেরই একই অনুভব। স্বাভাবিক ভাবনা, আজ তো বৃটিশ নেই, পাকিস্তান নেই, শুধু আমরাই। একে অপরের প্রতিবেশি, পরমাত্মীয় ---- একই জনপদের মানুষ। এক উঠোনে আমাদের পাটিপেতে জোসনারাতে গল্প করবার স্মৃতি। তবু কেন এই হানাহানি!

মানুষ বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন হলেও একটি সমাজ বা দেশ যে নির্ভেজাল শান্তির হবে তা নয়। লোভ, বিদ্বেষ বা অধিক প্রাপ্তির আশা সেই বিবেকের ওপরে পর্দা ফেলে দেয়। তখন স্বার্থ প্রাপ্তিই হয়ে ওঠে প্রধান। সেই সময়, ন্যায় অন্যায় জ্ঞান হয়ে পড়ে শূন্য। সেটা যে সীমা পরিহার, তা ভাববার মতো হুঁশ আর থাকে না। এজন্য, দেশে দেশে স্কুলঘর যেমন আছে, তেমন রয়েছে জেলঘর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন বৃদ্ধি পায়, শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে এর অঙ্গন, তার জন্য ব্যাপক, বিস্তারিত, বিশুদ্ধ ও বাস্তবে রূপায়িত পদ্ধতি কার্যকর করতে হবে। তবেই, জেলখানা কমে আসবে, বাড়বে বিদ্যায়তন।

দেশের ক্ষমতায় কারা যাবে, এই চর্চা, ধ্যান-জ্ঞান এখন আকাশে বাতাসে। দুষ্কর্মের দোষারোপ দলগুলোর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সবাই ভাবছে,তার দলই সেরা। তার দলের সবাই ফেরেশতা। অন্যায় যত করে সব অন্যরা। এই কারণে, সত্যিকার জবাদিহিমূলক সরকার কাঠামো দরকার। কোনো নির্দিষ্ট দল, গোষ্ঠী বা পরিবারের কাছে দেশ যেন বন্দি হয়ে না পড়ে। তাহলে, যথেচ্ছাচার বন্ধ হতে পারে। এক্ষেত্রে আমেরিকার উদারহণ আনা যায়। যদিও ঘুরে ফিরে দুটো দলই ক্ষমতায় আসে --- হয় রিপাবলিকান নয়ত ডেমোক্র্যাট। তবু এখানে ব্যক্তি বা পরিবারের প্রভাব গৌণ। সিস্টেমই সেই প্রবণতার মানুষগুলোকে বেঁধে রাখে আঁটোসাঁটো করে। নড়াচড়া করবার সুযোগ মেলে কম। আরেকটা বিষয় হলো, কোনো দূর অজানা প্রান্তের অখ্যাত কেউ, যোগ্যতার বলে অল্পদিনেই সুখ্যাতির সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দিতে পারে। ডিবেইট বা রাজনৈতিক বিতর্কে নেমে, তিনি তার যোগত্যার স্বাক্ষর রাখতে পারেন। নিজের পরিকল্পনা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে পারেন। সমস্ত দেশের মানুষ টেলিভিশনে তাকে দেখে, তার কথা শুনে, আচরণ পর্যবেক্ষণ ক’রে, তার দেশ-উন্নয়নের পরিকল্পনার তালিকা বুঝে নিয়ে তাকে ভোট দেন। বারাক ওবামা তেমন এক উজ্জ্বল উদাহরণ। সোসাল অর্গানাইজার থেকে শিকাগো সিটের সেনেটর (আইনপ্রণেতা) --- এর পর প্রেসিডেন্ট। ২০০৪ সালের আগে, তাকে তেমন করে আমেরিকার মানুষ চিনতো না। সেই তিনি দুবারের প্রেডিডেন্ট হলেন।

আমাদের বাংলদেশেও এমন একটা সিস্টেমের স্বপ্ন দেখা যায়। যদিও তথাকথিত গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা তেমন নেই। তবু মন্দের ভালো হিসেবে যে পদ্ধতি অবলম্বন করা যায় তা হলো:

১. তৃণমূল পর্যায় থেকে পোড় খাওয়া, সৎ, যোগ্য, স্ব স্ব ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও দেশগড়ার অবদানে খ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে বিতর্কের ব্যবস্থা করা। নিজ নিজ এলাকায়, তাদের কথা ও পরিকল্পনা শুনে, জেনে, বুঝে তারপর জনগণ সিদ্ধান্ত নেবেন, কাকে তারা তাদের নেতা বা সমসাময়িক, যুগোপযোগি ও প্রাসঙ্গিক আইনপ্রণেতা বানাবেন।

২. দেশের যে কোনো স্থান থেকে নির্দিষ্ট বয়সের যে কেউ নিয়ম মেনে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তে ফরম জমা দিতে পারবেন।

৩. রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রেসিডেন্ট পদের মনোনয়নের জন্য দল বা ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থীতা প্রতিযোগিতার বির্তকে অংশ নেবেন। জনগণ সবার কথা ও পরিকল্পনা বিবেচনা করে চূড়ান্ত প্রার্থিকে চূড়ান্ত নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করবেন নির্দিষ্ট সময়ে জন্য। সেটা হতে পারে চার বছর, কিংবা পাঁচ বছর। কেউ দুইবারের বেশি সরকার প্রধান হতে পারবেন না।

৪. জবাবদিহিতা মূলক নিয়মে নির্বাচিত সরকার প্রধান যদি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন বা গড়িমসি করেন, তবে আইনপ্রণেতাগণ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার মতো সক্ষমতা রাখবেন।

৫. সরকারে থাকা অবস্থায় স্বজন-প্রীতি পরিহার, দুর্নীতিমুক্ত ও সব অবস্থায় জনগণ এবং দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নে কাজ করে যাবেন। মেয়াদ শেষে, নির্বাচনের পরে নির্বাচিত জনপ্রতিধির হাতে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

তাদের একথা মনে রাখা আবশ্যক:

‘The boast of heraldry, the pomp of power,

And all that beauty, all that wealth ever gave,

Awaits alike the inevitable hour.

The paths of glory lead but to the grave.’

[Elegy: Thomas Gray]

উপলব্ধির বিষয়, ক্ষণজীবনে এমন সময় পাওয়া অত্যন্ত দুর্লভ ও মূল্যবান যখন কেউ ক্ষমতার মসনদে বসে। সেসময় হাওয়ার বুকে নিজের নাম লিখে যাবার সুযোগ আসে। সিদ্ধান্ত তার যে, তিনি তার নামটা ইতিহাসের স্বর্ণখচিত পাতায় লিখবেন নাকি তার নামটা আবর্জনার মতো উচ্চারিত হবে।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রবন্ধকার।

সাবেক প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, ঝিকরগাছা মহিলা কলেজ, যশোর।


ইয়ানবী সালামু আলাইকা

সৈয়দ এনাম-উল-আজিম
আপডেটেড ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২২:১০
সম্পাদকীয়

আজ সেই মহিমান্বিত দিন। সারা জাহানের মুসলমানদের জন্য অতি আনন্দ আর রহমতের দিন। দোজাহানের শান্তি ও কল্যাণের দূত নবীকুল শিরোমণি , আখেরি জমানার শেষ নবী, হাবিব এ খোদা, মহানবী হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পৃথিবীর বুকে আগমণ ও ইন্তেকালের অবিস্মরণীয় দিন ১২ রবিউল আউয়াল। মুসলমানদের কাছে বিশেষ মর্যাদা আর গুরুত্ববহ, সব ঈদের সেরা ঈদ ‘ঈদ এ মিলাদুন নবী’ বা নবী দিবসের আনন্দের দিন।

দিনটি শুধু মুসলমানদের কাছে নয়, সমস্ত পৃথিবীর মানবজাতির কল্যাণ ও পরকালের মুক্তির দূত হিসেবে মহান রাব্বুল আলামিনের রহমত স্বরূপ তিনি ধরা পৃষ্টে অবতীর্ণ হন। মহান আল্লাহ সব নবীদের উদ্দেশ্য যাকে আল্লাহর রহমত বা রহমাতুল্লিল আলামীন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তার শান আর কুদরতকে সবার সমগ্র মানবজাতির পথ প্রদর্শক ও পরকালীন মুক্তির জন্য শাফায়াতকারী হিসেবে খোদার পক্ষ থেকে স্বীকৃত হয়েছেন। সুবহানাল্লাহ।

আজ সেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব, দোজাহানের শান্তি ও মুক্তির কান্ডারি হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম তিথিতে সমস্ত প্রকৃতি ও মানব সমাজ যেন সমস্বরে গাইছে:

ইয়ানবী সালামু আলাইকা

ইয়া রাসুল সালামু আলাইকা

ইয়া হাবীব সালামু আলাইকা

সালাওয়া তুল্লা আলাইকা।

অনেকগুলো কারণেই নবীজির জন্মদিনটি তামাম পৃথিবীতে, সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি মহিমান্বিত দিন।

হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মা আমেনার কোল আলোকিত করে যখন আরবের ধূসর মরুভূমিতে শান্তির বারি হয়ে ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট, সোমবার, চন্দ্রমাসের ১২ রবিউল আউয়ালে জন্ম গ্রহণ করেন তখন সমগ্র আরব দেশ ও আরব জাতি ছিল জঘন্য বর্বরতা আর পাপাচারে নির্মগ্ন। পৃথিবীর ইতিহাসের ওই সময়টাকে বলা হতো- আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগ। গোত্র বিদ্বেষ, বর্ণবিরোধ, হানাহানি, খুনখারাপি, কন্যা শিশু হত্যা, ব্যাভিচার, পরস্পরের প্রতি সম্মান, সহানুভূতি, মানবতা প্রদর্শন না করা ছিল নৈমিত্তিক কাণ্ড। বিশেষত পোত্তলিকতা আর নারীবিদ্বেষ ছিল চরম পর্যায়ের। তারা পূর্ববর্তী নবীদের দেখানো পথ থেকে দূরে সরে গিয়ে একেশ্বরবাদীতার স্থলে বহু ঈশ্বর বাদীতায় লিপ্ত হয়ে পরকাল ভুলে গিয়ে ছিল। খোদার শাস্তির কথা মনে না রাখায় কঠিন কঠিন পাপের বোঝায় তারা লিপ্ত হয়ে যায়। আরব ও বিশ্ববাসীর এমন এক পঙ্কিল সময়ে বিশ্বমানবতা আর পরকালের মুক্তির দূত হিসেবে মহান রাব্বুল আলামিন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন মা আমেনার কোলে সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহর রহমত ও হেদায়েত হিসেবে। আলহামদুলিল্লাহ। একটা অন্ধকার যুগে আলোর প্রদীপ হয়ে জন্ম নেয়া এই মহা মানবের আবির্ভাবের দিনটি তাই সমগ মুসলিম জাহানে সব চেয়ে আনন্দের দিন। ঈদ এ মিলাদুন নবী।

যার আগমন ঘিরে এমন একটি শুভ ও আনন্দময় দিন আমরা পেলাম আজ সেই মহা মানবের জীবনী নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) আমার প্রিয় নেতা। কেননা তিনি আইয়ামে জাহেলিয়ার সেই অন্ধকার যুগে এসেও আরবের বুকে সত্যের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে সকল অন্ধকার দূর করেছেন। যখন মানবসমাজ এক চরম অধঃপতনে পৌঁছেছিল, তখন তিনি মুক্তির দ্যূত হয়ে এ ধরাধামে আগমন করেছিলেন। মানব কল্যাণে তার অবদান অতুলনীয়।

জন্ম ও বংশ পরিচয়:

৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট সোমবার সুবহে সাদেকের সময় পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। আরবের সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশের কুল শ্রেষ্ঠ হাশেমী গোত্রে তার জন্ম।

আদর্শ সমাজ সংস্কারক নেতা মহানবী (সা.):

মানব সভ্যতার ইতিহাসে মহানবী (সা.) বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নেতা ও আদর্শ সমাজ সংস্কারক তা সর্বজনস্বীকৃত। একটি অধঃপতিত আরব জাতিকে সুসভ্য জাতিতে পরিণত করার বিরল কৃতিত্ব কেবল তারই।

জাহেলিয়াতের ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত আরব সমাজকে তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানামুখী সংস্কারের মাধ্যমে একটি আদর্শ সমাজে পরিণত করতে সক্ষম হন। একটি আদর্শ সমাজ নির্মাণে মহানবী (সা.) যেসব গুণ অর্জন ও সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন তা নিচে উপস্থাপন করা হলো:

আল আমীন উপাধি লাভ:

একজন আদর্শ নেতার প্রধান গুণ সততা। আর ছোটকাল থেকেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) এ গুণের অধিকারী ছিলেন। সততা, মহত্ত্ব, ন্যায়পরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার কারণে আরববাসী তাকে ‘আল আমীন’ বলে ডাকত।

মদিনায় হিজরত:

কুরাইশদের অত্যাচারের মাত্রা যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন মহানবী (সা.) আল্লাহর নির্দেশে স্বদেশ ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেন। ফলে ইসলাম প্রচারে যোগ হয় নতুন মাত্রা। শুরু হয় মহানবী (সা.)-এর মাদানী জীবন।

রাজনীতিবিদ:

মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বকালের সেরা রাজনীতিবিদ। বিশৃঙ্খলাপূর্ণ আরব সমাজে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কার সাধন করেন। মদিনায় রাষ্ট্র গঠন, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, মদিনা সনদ, হোদায়বিয়ার সন্ধি প্রভৃতি তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক।

কয়েকটি যুদ্ধ:

মদিনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে মক্কার কুরাইশরা শঙ্কিত ও ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র গঠন ও মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তার প্রতিরোধকল্পে বিধর্মীরা ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কয়েকটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর জীবন অনেক বৈচিত্রময়। যেমন পূর্ণময় আর পবিত্র তেমনি অমানবিক কষ্ট আর লাঞ্ছনার। নবুয়ত্ব লাভের পর থেকে ইসলাম প্রতিষ্ঠা, প্রচার ও প্রসারের জন্য নবীজির প্রাণান্তর প্রচেষ্টা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। তিনি নবুয়ত প্রাপ্তির আগ থেকেই যেমন ছিলেন নিষ্পাপ, বিশ্বাসী আর ঈমানদার। নবুয়ত প্রাপ্তির পর সেটা আরও বেড়ে যায়। মহান আল্লাহর প্রতি মানুষের বিশ্বাস আর পরকালের আজাবের প্রতি ভিতি তৈরির কাজটা ওই কাফের আর জাহেলিয়াত যুগে খুব সহজ ছিল না। নিজের এবং সাহাবীদের জীবন বাজী রেখে তাকে ইসলাম প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হয়েছে। সে জন্য শারীরিক ও মানসিক আঘাতের কোনো কমতি ছিল না। সব সহ্য করে নবীজি ইসলামকে আরব মরুভূমিতে সভ্যতার , মানবতা আর পরকালের মুক্তির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

তার এই ত্যাগ আর আলোকিত জীবনকে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখতে পৃথিবীতে এই দিনটিকে মুসলমানরা বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উদযাপন করে। এই উপলক্ষে দোয়া-দরুদ, মিলাদ মাহফিল, নফল রোজা রাখার পাশাপাশি আনন্দ মিছিল বা জসনে জুলুসে বের হয়। এই ধরনের উদযাপন নিয়ে মুসলমানদের মাঝে তাই মত-বিরোধও ইদানীং লক্ষণীয়। কারণ, নবী সাহাবা বা খেলাফত যুগে দিবসটি এভাবে পালিত হতো না। তখন সোমবার দিন বা ১২ রবিউল আউয়ালে নবীজির মতো রোজা রাখা হতো। আর ছিল দোয়া-দরুদ। সালাম। কিন্তু ১২০০ শতাব্দীর পর থেকে মিসর ও তুরস্ক ও কিছু আরব ভূমিতে দিনটিকে ঈদের মর্যাদা দিয়ে উদযাপন শুরু হয়। কাল ক্রমে এটি অন্যান্য মুসলিম দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আনন্দ মিছিল বা জসনে জুলুস বের করার প্রবণতা এখন বাংলাদেশসহ পাকিস্তান, ভারত, আফগান, ইরান, ইরাকসহ অনেক মুসলিম দেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যার সঙ্গে দ্বিমত করছেন বহু আলেম ও স্কলারস। তাদের বক্তব্য হচ্ছে নবীজি যা করেননি বা করতে বলেননি তা ইসলামে জায়েজ নয়। ইসলামে বহু নবী-রাসুলের আগমন ঘটেছে কিন্তু কারোরই জন্মদিন পালনের নজীর নেই।

অন্যপক্ষ মনে করেন ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার নবীজির তিরোধান দিবসও বটে। পৃথিবীকে পূর্ণতার আলোয় ভরিয়ে দিতে যে নবীজি এলেন সেই নবী সমগ্র মানবজাতিকে এতিম করে, কাঁদিয়ে যেদিন চির বিদায় নিলেন সেই দিনটি আনন্দের হয় কী করে?

সে যাক আমরা কোনো তর্কে না গিয়ে বলতে পারি যে প্রক্রিয়ায় নবীজিকে উপযুক্ত মর্যাদা আর শান্তির প্রতীক হিসেবে সবার শীর্ষে আসীন রাখা যায় আমাদের সেই পথটাই অনুসরণ করতে হবে। এমন কিছুতেই উৎসাহিত করা ঠিক না যা নবীর মেহনত ও ইসলামের মর্যাদাকে খাটো করতে পারে।

আমাদের বিশ্বাস করতেই হবে যে, বড় সমাজ সংস্কারক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, মানবাধিকারের প্রবক্তা বিশ্বে আর দ্বিতীয় কেউ নেই। এ জন্য বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিরাও একথা স্বীকার করেছেন, রাসূল (সা.) ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মানুষ। বর্তমানেও তার এ নীতি অনুসরণের মাধ্যমেই কেবল পৃথিবীর যেকোনো সমাজকে আদর্শ সমাজে পরিণত করা সম্ভব।

আমরা সব সময় বলি:

‘তুমি না এলে দুনিয়ায়, আঁধারে ডুবত সবি।’ মহান আল্লাহ আমাদের সেই প্রিয় নবীর সঠিক মর্যাদা আর ইসলামকে সমুন্বত রাখার তৈফিক দিন। আমিন।

পরিশেষে দরুদ সেই পবিত্র স্বত্বার নবী মোহাম্মদের প্রতি:

বালাগাল উলা বি কামালিহি

কাসা ফাদ্দুজা বি জামালিহি

হাসানাত জামিয়্যু খেছালিহি

সাল্লা আলাইহি ওয়া আলিহি।

লেখক: কবি ও কলামিস্ট।


তাফসীরে হিদায়াতুল কোরআন ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

সূরা সাজদাহ, পর্ব ২

অনুবাদ

(৪) আল্লাহ হলেন সেই সত্তা, যিনি আসমান ও জমীন এবং উভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তা ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমাসীন হন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবকও নেই এবং সুপারিশকারীও নেই। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? (৫) তিনি আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত সবকিছু পরিচালনা করেন। অতঃপর সবকিছু (বিচারের জন্য) তারই নিকট উপস্থাপিত হবে এমন এক দিনে যার দৈর্ঘ্য হবে তোমাদের হিসাবমতে এক হাজার বছর। (৬) তিনিই অদৃশ্য ও দৃশ্যমানের জ্ঞানী। তিনি মহাপরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। (৭) যে জিনিসই তিনি সৃষ্টি করেছেন উত্তমরূপে সৃষ্টি করেছেন এবং মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদা মাটি দিয়ে। (৮) অতঃপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস থেকে। (৯) তারপর তিনি তাকে সুঠাম-সুডৌল করেছেন এবং নিজের নিকট থেকে তাতে জীবন সঞ্চার করেন। তিনি তোমাদের দিয়েছেন কান, চোখ ও হৃদয়। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।

মর্ম ও শিক্ষা

ইতোপূর্বে আল্লাহর কিতাব কুরআন নাজিলের বর্ণনা ছিল, যার মাধ্যমে রাসূল (স) মানুষকে সত্যের দাওয়াত দেন এবং আল্লাহর নাফরমানী সম্পর্কে সতর্ক করেন। তারপর এখানে আলোচ্য আয়াতসমূহে সে দাওয়াতী কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এতে রয়েছে আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদ, আল্লাহর সৃষ্টি, প্রতিপালন ও ব্যবস্থাপনা, কিয়ামত, আখিরাত ও আখিরাতের জবাবদিহিতার আলোচনা।

আল্লাহ গোটা সৃষ্টির স্রষ্টা

আল্লাহ হলেন সেই সত্তা যিনি আসমান, জমীন ও তার মধ্যে যা কিছু আছে অর্থাৎ গোটা সৃষ্টিতে যা কিছু আছে সবই সৃষ্টি করেছেন। গোটা সৃষ্টি জগত ও তার বাইরে এমন কেউ নেই যারা একটি জিনিসও সৃষ্টি করতে পারে। একটা তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র জিনিস সৃষ্টি করার ক্ষমতা কারো নেই। যিনি পৃথিবী, সৌরজগত ও মহা সৃষ্টির স্রষ্টা, তিনি আল্লাহ।

ছয় দিনে সৃষ্টির দ্বারা উদ্দেশ্য

আয়াতে ছয় দিনে সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ ছয় দিনে কেনো সৃষ্টি করেছেন, অনেকে এর ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন। কারণ আল্লাহ হও বললেই হয়ে যায়। নিমিষেই সব কিছু হয়ে যায়, তাহলে ছয়দিনের কিসে প্রয়োজন। আসলে এ বিষয়টি অন্য জগতের বিষয়। আমাদের পৃথিবীর জ্ঞান অনুযায়ী তা প্রকৃত কারণ জানা কঠিন। তাই কোনো ব্যাখ্যায় না গিয়ে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে আল্লাহ ছয়দিনে বা সময়ের ছয়টি এককে সৃষ্টি করেছেন। এর প্রকৃত অর্থ কি তা আল্লাহই ভালো জানেন।

আরশে আরোহণের মর্ম

গোটা জগতের সৃষ্টির পর আল্লাহ আরশে সমাসীন হন। সাধারণত দুনিয়ার দৃষ্টিতে আরশ হলো রাজা বাদশাদের সিংহাসন। কিন্তু এ সিংহাসন আর সেই সিংহাসন এক না। আরশের প্রকৃত অবস্থা পার্থিব জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ বলেন এটি একটি নূরানী সত্ত্বা। কিন্তু এর মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ ইসলামী জীবন-বিধান অনুসরণ করা আরশের অবস্থা জানার উপর নির্ভর করে না। এরপরে কথা হলো আরশে সমাসীন হওয়া প্রসঙ্গে। কোরআনে সাত জায়গায় আরশে সমাসীন হওয়ার কথা এসেছে। কিন্তু তার মর্ম নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক আছে। তা কি দৈহিক নাকি রূপক, এ নিয়ে অনেক কথা আছে। কেউ কেউ বলেন, আল্লাহর আরশে সমাসীন হওয়া দৈহিক, তিনি সদেহে আরশে আরোহন করেছেন। আর কেউ বলেন, আল্লাহর আরশে সমাসীন হওয়া দৈহিক নয়, কারণ আল্লাহ আরশের গন্ডি ও আওতার মধ্যে সীমিত নন। এছাড়া আরশ হলো আল্লাহর সৃষ্ট, অথচ তিনি আরশের পূর্ব থেকেই আছেন। যাই হোক এ ব্যাপারে বিতর্কের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এটা আমাদের পার্থিব জ্ঞানের বাইরে। আমাদের শুধু বিশ্বাস করতে হবে, আল্লাহ আছেন, তিনি এক ও একক, তিনি যেভাবে যেখানে আছেন, তাতেই আমরা বিশ্বাস করি।

কিয়ামত দিবস কতটুকু দীর্ঘ হবে

আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, কিয়ামত দিবস বা হিসেবের দিন হবে দুনিয়ার হিসেবে এক হাজার বছরের সমান। কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, তা হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। এ দুটির সংখ্যা দুই রকম হলেও ব্যাপারটি আসলে সাংঘর্ষিক নয়। বিভিন্ন মুফাসসির বিভিন্নভাবে এর ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথম, কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ এই যে কিয়ামতের দিনের দৈর্ঘ্য হবে এক হাজার বছরের সমান, তবে কিয়ামতের দিবসটি এতো কঠিন হবে যে তা মানুষের নিকট পঞ্চাশ হাজার বছরের সমানই মনে হবে। দ্বিতীয়, কিয়ামত দিবসের দৈর্ঘ্য বিভিন্ন মানুষের উপর নির্ভর করবে। যারা সৎ কর্মশীল তাদের জন্য সময় কম লাগবে। আর যারা পাপিষ্ঠ ও নাফরমান, তাদের সময় হবে অনেক বেশি।

আল্লাহ একই সঙ্গে মহাপরাক্রশালী এবং দয়ালু

আল্লাহ হলেন মহাপরাক্রশালী এবং পরম দয়ালু। যারা আল্লাহর অবাধ্য হয়, যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো শরিক স্থাপন করে, যারা আল্লাহর দ্বীনের বিরোধিতা করে এবং যারা সত্যপন্থিদের উপর নির্যাতন চালায়, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ অত্যন্ত কঠিন। তাদের জন্য আল্লাহর শাস্তি হবে অত্যন্ত কঠিন। অপরদিকে যারা মন-প্রাণ দিয়ে আল্লাহর পথে চলতে চায়, আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখতে চায়, কিন্তু তবুও মানবীয় দুর্বলতার কারণে তাদের বিচ্যুতি হয়ে যায়, আল্লাহ তাদের প্রতি হবেন করুণাময়। তাদেরকে করুণা করে ক্ষমা করে দিবেন। আর আল্লাহর এ দুটি গুণ দুনিয়ার বেলায়ও প্রযোজ্য। কোনো জাতি যখন সীমালঙ্ঘন করে যায়, আল্লাহ তাদেরকে ধরেন এবং পাকড়াও করেন। অনেক জাতি এভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। যেমন, লূত (আ)-এর জাতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে এবং তার ধ্বংসাবশেষ এখনও জর্ডানের মৃত সাগরে বিদ্যমান আছে। অপরদিকে যারা দুনিয়াতেও আল্লাহর পথে থাকে, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে, আল্লাহ তাদের বিপদে সাহায্য করেন, করুণা করেন, বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।

আল্লাহর গোটা সৃষ্টিই নান্দনিক

আল্লাহ প্রতিটি সৃষ্টিকে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যে গড়ে তুলেছেন। মানবদেহের অঙ্গ থেকে শুরু করে প্রকৃতির প্রাণী-পক্ষী ও সমুদ্রের জীবজন্তু-সবকিছুতেই তার নিখুঁত কুদরতের নিদর্শন ফুটে ওঠে। বাহ্যিক রূপের মতোই অভ্যন্তরীণ গঠনও বিস্ময়করভাবে সাজানো। আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য ভালোবাসেন এবং মানুষের কাছ থেকে সুন্দর আচরণ ও সুন্দর ইবাদত কামনা করেন।

মানব সৃষ্টির সূচনা

আল্লাহ মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন মাটি দিয়ে। আল্লাহ আদম (আ)-কে মাটি দিয়ে তৈরী করেন। এরপর আদম সন্তানকে সৃষ্টি করেন শুক্র কণা থেকে, যা তৈরি হয় মানুষের খাবার ও রক্ত থেকে। বলাবাহুল্য, এ খাবারও মাটিতেই উৎপন্ন হয়। কাজেই প্রথম মানবের সৃষ্টি এবং পরের মানবের সৃষ্টির উৎসমূলে রয়েছে মাটি।

মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়

আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ মানুষকে সঠিক অবয়ব দান করেছেন এবং জীবন দিয়েছেন, পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়েছেন। আল্লাহ মানুষকে তৈরি করেছেন সুন্দরতম অবয়বে। মানুষকে মেধা দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। এ মেধা দিয়ে ছোট্ট একটা মানুষ অনেক বড় প্রাণীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। মানুষ নতুন নতুন উদ্ভাবন করতে পরে। যদিও মানুষের মেধার মধ্যে এ উদ্ভাবণী শক্তি আছে, কিন্তু তাও মানুষ স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারে না। যখন যতটুকু উদ্ভাবণী শক্তি প্রয়োজন হয়, তখন আল্লাহ সে উদ্ভাবণী শক্তিকে ব্যবহারের যোগ্যতা দান করেন এবং মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে। আল্লাহ বলেছেন, সকল প্রাণীর জীবিকা আল্লাহর দায়িত্বে। এখন থেকে শতাব্দী পূর্বেও কোনো কোনো দেশ বলেছে, মানুষের প্রবৃদ্ধি যেভাবে হচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে তাদের খাবার থাকবে না এবং মানুষ উপোষ করে মারা যাবে। কিন্তু আল্লাহ মানুষের উদ্ভাবণী শক্তিকে কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তার ফলে যেখানে মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে, তিনগুণ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদন হচ্ছে তার চেয়েও বেশি। এ সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য।


জাতীয় রাজনীতি ও ডাকসু নির্বাচন

রাজু আলীম
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪ বছরের ইতিহাস কেবল শিক্ষার ইতিহাস নয়, বরং এ দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। এই ইতিহাসের কেন্দ্রে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, ডাকসু। ১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে শুরু হওয়া ডাকসুর পথচলা দীর্ঘ শতাব্দী ধরে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার, নেতৃত্ব বিকাশ ও জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখার এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও শত বছরের মধ্যে হয়েছে মাত্র ৩৭ বার। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে নির্বাচনের সংখ্যা মাত্র সাতবার। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে কতটা অবহেলা, দলীয় প্রভাব ও দখলদারিত্বের কারণে একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রথমদিকে ডাকসু মূলত সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণকেন্দ্রিক একটি মঞ্চ ছিল। কিন্তু পঞ্চাশের দশক থেকে এটি পরিণত হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্মভূমিতে। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান কিংবা মুক্তিযুদ্ধ—সবখানেই ডাকসুর ভূমিকাই ছিল কেন্দ্রীয়। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, পরবর্তীকালে ছাত্রদল—সব সংগঠনের নেতারা ডাকসুর মঞ্চ থেকে উঠে এসেছেন। সে কারণে ডাকসু কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সংসদ নয়, বরং জাতীয় রাজনীতিরও প্রতিফলন। ডাকসুর রাজনৈতিক উত্থানের সূচনা হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই আন্দোলনের মূল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ডাকসুর তৎকালীন নেতারা সামনের সারিতে ছিলেন। এরপর ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, যার সূত্রপাতও হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হাত ধরে, ডাকসুর নেতৃত্বেই তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই আন্দোলনের তীব্রতা এতটাই ছিল যে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ডাকসুর ভূমিকা ছিল আরও সুদূরপ্রসারী। তৎকালীন ডাকসুর মঞ্চে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়েছিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিতে। এই সময়ের ডাকসু নেতারা কেবল ছাত্রনেতা ছিলেন না, তারা ছিলেন জাতির মুক্তির দিশারী।

স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক দলগুলোর দখলদারিত্ব ডাকসুকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেয়। ১৯৭২-৭৩ শিক্ষাবর্ষের নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মাহবুব জামান ভিপি-জিএস নির্বাচিত হলেও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়নি। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের দ্বন্দ্ব নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ভেঙে দেয়। এর পর থেকে অনিয়ম, সহিংসতা ও স্থগিতকরণই হয়ে ওঠে ডাকসুর নিয়তি। সত্তর ও আশির দশকে ডাকসুতে নেতৃত্ব দিয়েছেন আমান উল্লাহ আমান, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মনসুর আহমদ প্রমুখ, যারা পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্র ফিরে এলেও ডাকসু নিয়মিত নির্বাচনের মুখ দেখেনি। কারণ সহজ—ক্ষমতাসীন দলগুলো ভয় পেত, নির্বাচনে তাদের ছাত্রসংগঠন হারলে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ হারাবে। গত তিন দশকের অভিজ্ঞতাই সেই আশঙ্কা সত্য করেছে। ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুরু করে। গেস্টরুম ও গণরুম সংস্কৃতি চালু হয়, যেখানে নতুন শিক্ষার্থীরা জোরপূর্বক রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে বাধ্য হয়। শিক্ষার্থীদের ওপর দলীয় চাপ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এক নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা তাদের কণ্ঠস্বর প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হারিয়ে ফেলে, এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় দলীয় প্রভাব বিস্তারের একটি কেন্দ্রে।

দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হলেও তা আস্থাহীনতার জন্ম দেয়। সহিংসতা, কারচুপি এবং প্রশাসনিক পক্ষপাতের অভিযোগে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপার ভর্তি ব্যাগ পাওয়ার ঘটনা, এবং নির্বাচনের দিন বিভিন্ন কেন্দ্রে ছাত্রলীগের বহিরাগতদের উপস্থিতি ও বলপূর্বক ভোট দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। নুরুল হক নুর ভিপি নির্বাচিত হলেও ছাত্রলীগ অধিকাংশ পদে জয়ী হয়। নির্বাচনের পর ডাকসু প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের মৌলিক সমস্যা সমাধানে খুব একটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেননি, যার ফলে শিক্ষার্থীরা মনে করে ডাকসু আর তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে না, বরং এটি দলীয় স্বার্থের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই ব্যর্থতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্ররাজনীতি ও ডাকসু সম্পর্কে এক গভীর হতাশা তৈরি করে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গণঅভ্যুত্থান ক্ষমতার সমীকরণ পাল্টে দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দীর্ঘ দখলদারিত্ব ভেঙে পড়ে। শিক্ষার্থীরা গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতি, জোরপূর্বক মিছিলে অংশগ্রহণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। এ পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের নতুন করে প্রত্যাশা তৈরি করেছে। এবারকার নির্বাচনের মূল ইস্যু হলো দখলদারিত্বের অবসান, গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতির সমাপ্তি, সুলভ মূল্যে ক্যানটিনে খাবার, এবং একটি শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাস। নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আহমেদ সজীবের ভাষায়, ‘সবাই যাতে প্রথম বর্ষে এসেই হলে সিট পান, গণরুম-গেস্টরুম যাতে আর ফিরে না আসে, ক্যানটিনে সুলভ মূল্যে ভালো খাবার পাওয়া যায়—এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন, এমন প্রতিনিধিই আমরা চাই।’ এই বক্তব্যটি কেবল একজন শিক্ষার্থীর নয়, এটি হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মনের কথা।

এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ৩৯,৭৭৫ জন। ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৭১ জন প্রার্থী, এর মধ্যে ৬২ জন নারী। সদস্য পদে প্রার্থী সংখ্যা সর্বাধিক—২১৭ জন। পাশাপাশি ১৮টি হল সংসদে মোট ১,০৩৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রতিটি পদে একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যা গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার বার্তা বহন করে। এই নির্বাচনের মূল বিষয়গুলো কেবল রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা সরাসরি শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের একক আধিপত্যে ক্যাম্পাসে যে গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতি, রাজনৈতিক চাপ ও সহিংসতা ছিল, তার অবসানই এবারের নির্বাচনের প্রধান এজেন্ডা। বিভিন্ন প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের প্রচারে এই বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন।

ভিপি পদের জন্য এবার ৪৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আবিদুল ইসলাম খান (ছাত্রদল), উমামা ফাতেমা (স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য), সাদিক কায়েম ও ইয়াসিন আরাফাত। জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৯ জন, যার মধ্যে রয়েছেন আবু বাকের মজুমদার (বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ), তানভীর বারী হামিম, এস এম ফরহাদ এবং অন্যরা। এই বিশালসংখ্যক প্রার্থীর মধ্যে কে বিজয়ী হবেন, তা বলা কঠিন, তবে শিক্ষার্থীদের মূল মনোযোগ হলো এমন প্রার্থীদের দিকে, যারা দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে পারবেন। স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা তার বক্তব্যে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ এবং ডাকসুর হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচিত হলে সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীতের স্বাক্ষর রাখার চেষ্টা করব। তবে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানকেন্দ্রিক বিষয়গুলোকে আমরা অগ্রাধিকার দেব।’ উমামার এই বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে তারা কেবল বড় রাজনৈতিক ইস্যুতেই নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদা যেমন—হলগুলোতে সিট নিশ্চিত করা, ক্যানটিনে মানসম্পন্ন ও সুলভ মূল্যে খাবার সরবরাহ, এবং একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস পরিবেশ তৈরির দিকেও গুরুত্ব দেবেন। অন্যদিকে, ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান সরাসরি গণরুম ও গেস্টরুম সংস্কৃতির নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হলে প্রথম কাজ হবে ক্যাম্পাসে এবং হলগুলোতে আর কখনো গণরুম ও গেস্টরুমের সংস্কৃতি ফিরে আসতে দেব না।’ আবিদুলের এই বক্তব্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে, কারণ এই সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের এক প্রধান উৎস ছিল। আরেকজন ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম তার প্রার্থিত্বকে শিক্ষার্থীদের মূল সমস্যা সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করার প্রতিশ্রুতি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে ক্যাম্পাসের সকল শিক্ষার্থী যেন সমান সুযোগ পান, বিশেষ করে হল সিট বরাদ্দ ও ক্যানটিনের সুলভ খাবার সংক্রান্ত ক্ষেত্রে। এছাড়া তিনি শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার এবং গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতি নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইয়াসিন আরাফাত নামের আরেকজন ভিপি প্রার্থী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়ন, সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার বিকাশ এবং হল সংসদ কার্যক্রমকে আরো কার্যকর করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের সমস্যা ও দাবি সমাধানের জন্য প্রতিনিয়ত কার্যক্রম গ্রহণ এবং সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্যানেল, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের জিএস প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার ডাকসুকে তার পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ডাকসুকে সেই পুরোনো গৌরবের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে চাই।’ এই প্যানেল মূলত জুলাই মাসের গণআন্দোলনের চেতনাকে সামনে রেখে গঠিত হয়েছে এবং তাদের মূল লক্ষ্য হলো ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা।

ডাকসুর গঠনতন্ত্র শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক, ক্রীড়া, সামাজিক কার্যক্রম ও প্রকাশনা কাজে জোর দেয়। ২০২৫ সালের জুনে সিন্ডিকেট নতুন তিনটি সম্পাদকীয় পদ সংযোজন করেছে—মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক এবং ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক। বয়সসীমাও তুলে নেওয়া হয়েছে। এসব পরিবর্তন ডাকসুকে আরও সময়োপযোগী করে তুলতে পারে। প্রশ্ন একটাই—এ নির্বাচন কি সত্যিই সুষ্ঠু হবে? দলীয় প্রভাব কি আবারও গ্রাস করবে? স্বাধীনতার পর থেকে অন্তত ৭৫টি খুন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যার বড় অংশ দলীয় দখলদারিত্বের ফল। সাড়ে ১৫ বছর ছাত্রলীগের দখলে নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তাই এবারের নির্বাচন শিক্ষার্থীদের মুক্তির পথ হতে পারে। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তবে ডাকসু আবারও শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠতে পারে। অন্যথায় এটি আরেকটি দলীয় যন্ত্রে পরিণত হবে।

ডাকসু নির্বাচন কেবল শিক্ষার্থীদের ভোটের লড়াই নয়, বরং হারানো গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণের সন্ধিক্ষণ। এটি শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণের লড়াই, দখলদারিত্বমুক্ত ক্যাম্পাসের লড়াই এবং আগামী দিনের নেতৃত্ব গড়ে তোলার লড়াই। যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, তবে ডাকসু আবারও হয়ে উঠবে সেই কেন্দ্র যেখানে গড়ে উঠবে আগামী দিনের জাতীয় নেতৃত্ব, বিকশিত হবে সংস্কৃতি ও ক্রীড়া, এবং গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক। আর যদি ব্যর্থ হয়, তবে শিক্ষার্থীদের আস্থাহীনতা আরও গভীর হবে, যা দেশের ভবিষ্যতের জন্যও অশনিসংকেত।

রাজু আলীম

কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব


banner close