রোববার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩

বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে বিদেশি উসকানি

ফারাজী আজমল হোসেন
প্রকাশিত
ফারাজী আজমল হোসেন
প্রকাশিত : ১৩ নভেম্বর, ২০২৩ ১২:৩৯

বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে বারবার উঠে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম। চতুর্থ ধাপে দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। এ ক্ষেত্রে জামায়াত বেশ সাবধানে এগিয়ে গেলেও সরাসরি বাসে অগ্নিসংযোগ, রাস্তায় টায়ার পুড়িয়ে অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুরসহ বেশ কিছু কাজে সরাসরি যুক্ত থাকতে দেখা গেছে বিএনপির বিভিন্ন ইউনিটের নেতা-কর্মীদের। বেশকিছু স্থানে জামায়াত শিবিরের সদস্যকেও গ্রেপ্তার করা হয় অগ্নিসংযোগকালে; কিন্তু কেন নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে এত অনাগ্রহী বিএনপি?

২০১৩-১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত দেশজুড়ে যেই ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তা প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশের মানুষ। জীবন্ত মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারা। ঘুমিয়ে থাকা মানুষসহ গাড়ি ও দোকানে অগ্নিসংযোগ, অ্যাম্বুলেন্সে হামলাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যা সে সময় করেননি বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। এর ফল হিসেবে বিএনপি বিশ্বের বুকে তৃতীয় শ্রেণির সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা দল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আর জামায়াত ২০০১-০৬ সালে তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য আগে থেকেই বিশ্বের বুকে জঙ্গি ও জঙ্গিসংশ্লিষ্ট সংগঠন হিসেবে পরিচিত। জঙ্গি ও সন্ত্রাসের এই মেলবন্ধনের কারণে দেশের মানুষ ২০০৮ সালে প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি-জামায়াতকে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১৪ সালে পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হয় বিএনপি-জামায়াত তাদের জ্বালাও-পোড়াও নীতির কারণে।
এই যখন অবস্থা তখন নিজেদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে ২০১৮ সালে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি; কিন্তু দলটির কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে বড় ব্যবধানে এ নির্বাচনেও হেরে যায় দলটি। জ্বালাও-পোড়াও ও সাধারণ মানুষের সরাসরি ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকায় ২০২২ সালে কিছুটা জনসমর্থন লাভ করে দলটি। তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিগুলো প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের কাছেও প্রশংসা কুড়ায়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার জানানো হয়, শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে বিএনপিকে অংশগ্রহণের জন্য। বিএনপিকে আলোচনার জন্য আহ্বান জানায় নির্বাচন কমিশনও; কিন্তু হঠাৎ করেই নির্বাচনের আগ মুহূর্তে আবারও পুরোনো সন্ত্রাসী রূপে ফেরত যায় বিএনপি; কিন্তু কেন। এর উত্তর মিলবে ২০১৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র তথা যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ মিশন অফিস এবং বিএনপি-জামায়াতের বেশকিছু কর্মকাণ্ডকে আমলে নিলে। ২০১৮ সালের কিছু আগ থেকেই বাংলাদেশের মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে কথা বলে শুরু করেন বিএনপির শাসনামলে অ্যাটর্নি জেনারেল পদে থাকা আদিলুর রহমান। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট বেশকিছু দাতাসংস্থা থেকে অর্থ লাভ করেন তিনি। এরপর বিদেশে থাকা বেশ কিছু সংস্থা ও ওয়েব পোর্টালের সহযোগে একযোগে আওয়াজ তোলা হয় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে। ঠিক এ সময়ই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরপর বিএনপির পলাতক বিভিন্ন নেতা-কর্মীর পরিবারকে নিয়ে শুরু হয় ‘জোরপূর্বক গুম’ নিয়ে আলোচনা। মূলত জ্বালাও-পোড়াও এবং হত্যাসহ বেশ কিছু মামলায় পালিয়ে থাকা বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীদের মুক্তি দিতেই মানবাধিকার নিয়ে বাংলাদেশে কাজ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রসংশ্লিষ্ট বেশ কিছু সংস্থা। এ সময় বিষয়গুলো নিয়ে বেশ সোচ্চার আওয়াজ তোলে নেত্র নিউজ নামে একটি ওয়েব পোর্টাল, যাকে অর্থায়ন করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এনইডি। বিষয়গুলো নিয়ে আরও কথা বলা শুরু করে ‘নাগরিক টিভি’ নামক পোর্টাল, ইলিয়াস, কনক সারওয়ার থেকে শুরু করে জামায়াত-বিএনপির প্রোপাগাণ্ডা মেশিনারিগুলো।
সম্মিলিত এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য ছিল- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিব্রত করা এবং তাদের কিছুটা নিশ্চলতায় রাখার মাধ্যমে নিজেদের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

বিএনপির বর্তমান এই আচরণের জন্য সরাসরি যে ব্যক্তিকে দায়ী করা হয়, তিনি হলেন ঢাকার মার্কিন মিশনের বর্তমান অ্যাম্বাসেডর পিটার ডি হাসকে। মার্চ ২০২২-এ পিটার হাস বাংলাদেশ মিশনে যোগ দেয়ার পর থেকে আরও দৃঢ় চিত্তে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া শুরু করে বিএনপি। বিশেষত বিভিন্ন জেলা ও বিভাগ পর্যায়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশে যোগদানের পর থেকে এ দেশের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপি এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের চাইতে বেশি বার বিএনপির সিনিয়র থেকে শুরু করে তৃণমূলের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর সঙ্গে দেখা করেন পিটার হাস। শুধু তাই নয়, বিএনপির হারিয়ে যাওয়া নেতা-কর্মীদের পরিবারের সঙ্গে সরাসরি গিয়েও দেখা করেন পিটার হাস; কিন্তু তিনি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে শ্রদ্ধা জানাননি গত বছর। সে সঙ্গে বিএনপির শাসনামলে গুম ও খুনের শিকার পরিবারগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে ও বসতেও দেখা যায়নি তাকে। উল্টো নিজেদের আর্জি নিয়ে পিটার হাসের কাছে চাইবার দাবি জানালে বিষয়টিকে ‘নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বাংলাদেশ ইস্যুতে যেকোনো আলোচনা হলেই সবার আগে যেই উক্তিটি করে তা হলো- ‘আমরা সুনির্দিষ্ট কোনো দলকে সমর্থন করি না।’ প্রশ্ন থেকে যায়, পিটার হাস যা করছেন, সে বিষয়ে কি কিছুই জানে না মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর? বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে সকালের নাশতা থেকে শুরু করে রাতের ডিনার পর্যন্ত করেছেন পিটার হাস; কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাকে এত বৈঠক করতে দেখা যায় না। এমনকি বিএনপি ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও এত বৈঠক করতে দেখা যায়নি পিটার হাসকে। এর কারণ কী? তাহলে কি এটা বলা যায় যে, পিটার ডি হাস এক তরফাভাবে বিএনপিকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। আর তার সমর্থনের কারণেই সংলাপ বা আলোচনায় না বসে জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও তার সংশ্লিষ্ট দলগুলো।

সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাধা দিলে সরকারি বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তারা মার্কিন ভিসানীতির আওতায় পড়বেন। সম্প্রতি চতুর্থ ধাপে বিএনপির অবরোধ ও জ্বালাও-পোড়াও শুরুর বেশ আগেই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বিগত ১০-১২ দিন তাদের কার্যক্রমের সমালোচনা করে জানান, এটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। সে সঙ্গে তিনি সবাইকে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ও আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। অথচ বাংলাদেশে অবস্থান করে সরাসরি জ্বালাও পোড়াও কার্যক্রম চোখের সামনে দেখেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি মার্কিন অ্যাম্বাসেডর পিটার ডি হাস। এমনকি যেই বিএনপির সঙ্গে নিয়মিত তার বৈঠক, তাদের এই জ্বালাও-পোড়াও বন্ধের সরাসরি কোনো আহ্বান জানাতেও দেখা যায়নি তাকে। এ দ্বিচারিতামূলক আচরণ কেন পিটার হাসের?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি পেতে দেখা যায় যুদ্ধের আরও ৪০-৫০ বছর পরও। জার্মানে এখনো নাৎসি সমর্থকদের রাজনীতি করা বা ক্ষমতায় আসা নিয়ে কোনো আলোচনা কী রয়েছে? যদি না থাকে, তবে বাংলাদেশে জামায়াত ইসলামের মতো একটি যুদ্ধাপরাধী দলকে কেন মানবাধিকার ও রাজনৈতিক অধিকারের নামে পক্ষপাত আচরণ করবে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এ সময় জামায়াত ইসলাম বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ দেশের অভ্যন্তরে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে শাস্তি হয়েছে এবং এখনো বিচার কার্যক্রম চলছে বেশ কিছু জামায়াত নেতার। জামায়াতে ইসলামকে দেশের আদালত থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত দল হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছে। তাহলে সেই দলকে বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কেন নিজেদের অফিসিয়াল বার্তায় আহ্বান জানাবে যুক্তরাষ্ট্র? একটি দেশের ১৭ কোটি জনগণের মানবাধিকার জলাঞ্জলি দিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের অধিকার প্রতিষ্ঠা আসলে কতটা মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হলো, সেই প্রশ্ন রাখতে চাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট


প্রসঙ্গ : মানবাধিকার ও তার লঙ্ঘন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এম এ মান্নান

তিন শত পঁয়ষট্টি দিনের বছরে গড়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিষয়ে এবং কোনো না কোনো দেশে পালিত হয়ে থাকে নানা দিবস। এর মধ্যে কোনো কোনো দিবস পালিত হয়ে থাকে আন্তর্জাতিকভাবে, আবার কোনো কোনো দিবস পালিত হয়ে থাকে জাতীয়ভাবে। আজ আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে মানবাধিকার দিবস।

মানবাধিকার বলতে আমাদের সাধারণ জ্ঞানে যা বুঝি, তা হলো মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে যেসব অধিকার রয়েছে, তা স্বাধীনভাবে ভোগ করা। এবং এটি তার জন্মগত অধিকার, নাগরিক অধিকার এবং এটি তার সাংবিধানিক অধিকারও। এই অধিকার থেকে যদি কোনো ব্যক্তি বা সমাজ বা কোনো দেশ কাউকে বঞ্চিত করে তবে তা অবশ্যই মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

একটা কথা আছে- জোর যার মুল্লুক তার। এই নিকৃষ্ট ক্ষমতার মোহ বা জেদ বা লোভ যদি কোনো ব্যক্তি, সমাজ, গোষ্ঠী বা দেশের পেয়ে বসে, সেখানে মানবাধিকার বলতে কিছুই থাকে না। তা লঙ্ঘিত হয়। এখন যেমন করা হচ্ছে ইউক্রেনে রাশিয়া কর্তৃক। রাশিয়া যেভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ইউক্রেনে আক্রমণ করে যাচ্ছে এবং হত্যাযজ্ঞ-ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, তা শুধু মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়, চরম নিষ্ঠুরতাও।

কিতাবে আছে, জ্ঞানের জন্য অন্বেষণ করতে হলে যদি সুদূর চীনেও যেতে হয় তবু যাও। তবু জ্ঞান অর্জন করো। চীন জ্ঞানের আধার বলে হয়তো সে দেশে জ্ঞান অন্বেষণ করতে যেতে বলা হতো। বলা যায়, চীন জ্ঞান-বিজ্ঞানে এবং তথ্য-প্রযুক্তিতে ও অর্থনীতিতে বিশ্বসেরা। বলতে দ্বিধা নেই, যে দেশে জ্ঞান অর্জনের জন্য যেতে বলা হতো, শিক্ষা অর্জনের জন্য যেতে বলা হতো, সেই দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখতে পাই, চীনের সরকার সে দেশের মুসলমানদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে। তাদের মসজিদগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। সেখানে অন্য স্থাপনা গড়ে তুলে তা অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং মুসলমানদের ধর্ম পালন থেকে বিরত রাখা হচ্ছে। এসব বিষয় উল্লেখ করেছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তারা বলছে, চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল লিংশিয়াং মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। সেই অঞ্চলের লিয়াও-কিয়াওয়ের ছয়টি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। ২০২১ সালের বিবিসির একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চীনের উইঘুরে শিংজিয়ানের বন্দি শিবিরে মুসলমান নারীরা গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য হলো, বন্দি শিবিরের নারীদের গণধর্ষণসহ নানা অত্যাচার করে তাদের শেষ করে দেওয়া। এরপরও কি আমরা বলব চীনে মানবাধিকার আছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে না। অথচ তারা উন্নত এবং সভ্য জাতি-দেশ।

পৃথিবীর দেশে দেশে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তার মধ্যে আরও বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয় নিচু শ্রেণির মানুষ। আমাদের প্রতিবেশী বিরাট জনবহুল দেশ ভারতেও প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। সেখানে দলিত সম্প্রদায়কে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। দলিত সম্প্রদায়ের লোকদের রক্ষাকল্পে যদিও আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, কিন্তু সেই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে। সরকারি হিসাবে শুধু ২০১৬ সালেই ৪০ হাজারের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের রিপোর্ট রয়েছে পুলিশের খাতায়। এ ছাড়া দলিত সম্প্রদায়ের লোকেরা অকথ্য নির্যাতনের শিকার থেকে রক্ষা পেতে এবং নির্যাতনের প্রতিবাদে কয়েক শ দলিত হিন্দু ধর্মান্তরিত হয়েছে । অন্য একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের গুজরাটের গির সোমনাথ জেলার দুটি গ্রামেরই তিন শতাধিক দলিত হিন্দু জীবন বাঁচাতে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। এই ঘটনাটি ঘটেছে ২০১৮ সালে। বাংলা জার্নালের একটি খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতে প্রতি ১৬ মিনিটে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয় অথবা গণধর্ষণের শিকার হয়। ২০২০ সালে ভারতে দলিত নারীর নির্মম মৃত্যু ভারতজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। এ ছাড়া ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নির্মম নির্যাতন করা হয়। মসজিদের মাইকে আজান দিতে নিষেধ করা হয়, মসজিদে নামাজ পড়তে নিষেধ করা হয়, মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়, গরু জবাই করতে নিষেধ করা হয়, গরু জবাই করলে নির্যাতন করা হয়- এ সবই তো মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

ফিলিস্তিনে এখন যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে, পৃথিবীর আর কোনো দেশে এভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে কি না তা আমাদের কারও জানা নেই। গত ৭ অক্টোবর বিদ্রোহী হামাস ইসরায়েলে হামলা করে এক হাজার ২০০ লোককে হত্যা করে। সেটা নিঃসন্দেহে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং গুরুতর অপরাধ। কিন্তু সেই অপরাধকে কেন্দ্র করে সেদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ইসরায়েল ফিলিস্তিনি উপত্যকায় হামলা করে এখন পর্যন্ত ১৭ হাজার লোককে হত্যা করেছে। তার মধ্যে ১২ হাজারের বেশি নারী ও শিশু রয়েছে।

গত ১২ নভেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গাজায় প্রতি দশ মিনিটে প্রাণ হারায় একটি শিশু। এতে খুব সহজেই আন্দাজ করা যায়, ফিলিস্তিনে কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। গাজার প্রধান হাসপাতাল আল-সিফায় ইনকিউবেটরে থাকা ৩৯ জন শিশু বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। কারণ হাসপাতালটিতে আগে থেকেই বিদ্যুৎব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। পরে জেনারেটরও বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবশেষে হাসপাতালটি বোমা বর্ষণ করে ধ্বংস করা হয়। মারা যায় ইনকিউবেটরে থাকা ৩৯ জন শিশু। গাজায় এভাবে নির্বিচারে শিশু হত্যা বন্ধে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাঁখো প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রতিবাদ জানিছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানসহ বিশ্বের নানা দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। বরং এক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর আরও ভয়ংকরভাবে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।

১৫ নভেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখলাম ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধে ব্যর্থ হওয়ায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। জো বাইডেন ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধে ব্যর্থ নন, বরং তিনি গণহত্যা সংঘটনে সফল। কারণ তিনি ফিলিস্তিনের গাজায় আক্রণের জন্য বরাবরই ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টকে সাহায্য এবং সমর্থন জানিয়ে আসছেন। শুধু তা-ই নয়, ইসরায়েলকে অস্ত্র এবং অর্থ উভয়টি দিয়ে সাহায্য করে আসছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ফলে ইসরায়েল ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে ফিলিস্তিনের ওপর।

বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী নাকি বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও গত ২ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ‘কান্ট্রি রিপোর্ট অন টেররিজম-২০২২’ নামে প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। যে আমেরিকার একান্ত সাহায্য-সহযোগিতায় এবং ইচ্ছায় ফিলিস্তিনে গণতহ্যা সংঘটিত হচ্ছে এবং হাজার হাজার নিরীহ নারী-শিশু নিহত হচ্ছে। জাতিসংঘ যেখানে বলছে গাজায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যে জাতিসংঘ বলছে, গাজায় প্রতি দশ মিনিটে একটি শিশু প্রাণ হারাচ্ছে, আশ্রয় নেওয়া শিবিরে হামলা করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, মসজিদ ধ্বংস করা হচ্ছে, গির্জা ধ্বংস করা হচ্ছে, জাতিসংঘের দপ্তরে আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে সেই দপ্তরে হামলা করা হচ্ছে, স্কুলে থাকা ৫০ জন শিশুসহ স্কুল ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, শিশুখাদ্যের অভাবে শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে, লাখ লাখ লোক উদ্বাস্তু হচ্ছে, সেই মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দোসর আমেরিকা যদি বলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করছে এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, তাহলে সেই আমেরিকাকে এবং ইসরায়েলকে কী বলা যায়? যে আমেরিকা মানবাধিকার নিয়ে মাথা খাটিয়ে অস্থির হচ্ছে, সেই আমেরিকাতেই তো প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সেই আমেরিকাতেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে এবং গণমাধ্যমে তা প্রকাশিতও হচ্ছে।

একটি কথা আছে, আগে নিজেকে জানো। আমেরিকার বড় দোষ হলো সে নিজেকে জানে না। তাই তারা নিজেরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এবং অন্যকে দিয়েও করায়। যা গাছের গোড়ায় বিষ ঢেলে আগায় পানি ঢালার মতো। যা কখনো কাম্য নয়।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক


ব্যাংকিং খাতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল কাজে লাগাতে হবে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রেজাউল করিম খোকন

এই উপমহাদেশে গত ১০০ বছরে কত সীমানা বদলেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হয়েছে জাতি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আবার স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের কঠিন বেড়াজালে বন্দি হয়েছে। আবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার হয়েছে। স্বৈরাচার সামরিক শাসন বিদায় নিয়েছে। জনতার আন্দোলনের মুখে টিকতে পারেনি। এই সময়ে পৃথিবীটাও বদলেছে অনেক। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে গেছে। কিন্তু আমরা এখনো বেশ কিছু জায়গায় অনেক আগের মতো রয়ে গেছি। এই সময়ের চ্যালেঞ্জটাকে আমলে না নিয়ে নির্বিকার বসে থাকার সুযোগ নেই- এটা উপলব্ধি করতে হবে সব পক্ষকেই। এখন ডিজিটাল বেনো জলে ভেসে যাচ্ছে গোটা দুনিয়া। অন্তর্জালের এই সময়ে ডিজিটাল নো ম্যানস ল্যান্ডে মানুষের বসত। তাবৎ দুনিয়ার সিনেমা, টিভি সিরিজ পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আজকের তরুণ-তরুণী। দেশি-বিদেশি নানা কনটেন্ট এখন ইচ্ছমতো তার মোবাইল ফোন সেট, টিভি, ল্যাপটপে দেখতে পারছে অবাধে। দুনিয়াজুড়ে এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আর এর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে জীবনযাপন, শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরন। আমাদের বাংলাদেশেও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ঢেউ লাগতে শুরু করেছে। তবে প্রশ্ন জাগছে, নতুন প্রেক্ষাপটে সামনে এসে দাঁড়ানো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় বাংলাদেশের ব্যাংক খাত কতটা প্রস্তুত? ব্যাংকগুলো যদি এখন থেকে সেভাবে নিজেদের যোগ্য এবং প্রস্তুত করে তুলতে না পারে তাহলে আগামী দিনগুলোতে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী সেবা দিতে ব্যর্থ হবে তারা। বর্তমানে ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবা খাতে প্রচলিত লেনদেন ব্যবস্থায় প্রযুক্তির হাত ধরে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। নগদ লেনদেনের বদলে ডিজিটাল পেমেন্টব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। করোনাকালে সাবধানতা অবলম্বন করতে মানুষ ডিজিটাল লেনদেনে অধিকহারে আকৃষ্ট হয়েছে। করোনার সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক গ্রাহকের সুবিধার জন্য চালু করেছে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের নানা সুবিধা। বিমাযুক্ত আমানত পণ্য চালু, সহজে অনলাইনে টাকা স্থানান্তর, ঘরে বসে সহজে দ্রুত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, অনলাইনে কেনাকাটাসহ বিশেষ কিছু নতুন পদ্ধতি যুক্ত হয়েছে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকে। এভাবে বিভিন্ন ব্যাংক করোনাকালে গ্রাহকদের ব্যাংকে না এসে কীভাবে সেবা দেওয়া যায় তা উদ্ভাবনের নানা প্রক্রিয়া চালু রেখেছে। করোনাকালীন সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো শিখেছে কীভাবে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে প্রযুক্তির মাধ্যমে ভার্চুয়াল মিটিং, ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স ইত্যাদি সম্পন্ন করা যায়। করোনাকালীন সময়ে ব্যাংকগুলো তাদের বোর্ড মিটিংসহ বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) সম্পন্ন করেছে। ভার্চুয়ালি বোর্ড মিটিং, ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স ইত্যাদি সম্পন্ন করার কারণে ব্যাংকগুলোর ব্যয় তুলনামূলকভাবে কমে গেছে। মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং ও অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিয়েছে গ্রাম, দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায়। এ ছাড়া ক্রেডিট কার্ড, এটিএম বুথসহ দিন দিন ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছে। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ছন্দপতন ঘটেছে। করোনাকালে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের জয়জয়কার লক্ষ্য করা গেছে। কেনাকাটা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন যাবতীয় আর্থিক লেনদেন হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। সরকার অসহায় মানুষকে আর্থিক অনুদান দিচ্ছে এ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। করোনায় গরিব মানুষ প্রধানমন্ত্রীর সাহায্যের টাকা পাচ্ছেন হাতে হাতে এবং ঘরে বসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হচ্ছে আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলমান উৎপাদন ও শিল্পব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয় সমসাময়িক সংস্করণ। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আলোচিত নানা বিষয়ের মধ্যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বিষয়টি একটি অন্যতম অনুষজ্ঞ। এ বিপ্লব রোবটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম, কম্পিউটিং, ব্যায়োটেকনোলজি, ইন্টারনেট অব থিংস, থ্রিডি প্রিন্টিং, সম্পূর্ণ স্বচালিত যানবাহন ও উদীয়মান প্রযুক্তির যুগান্তকারী যুগ হিসেবে চিহ্নিত। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব//// এখন বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে। এর ভিত্তি হিসেবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন, বিপণন ও ভোগের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের চিন্তা জগতে পণ্য উৎপাদন ও সেবা প্রদানে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। পৃথিবীর গতিপ্রকৃতি ও মানুষের জীবনধারাকে বদলে দিচ্ছে। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের সক্ষমতাকে বড় ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন করছে। আঠারো শতকের শেষার্ধে ইংল্যান্ডের যে শিল্পোৎপাদনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয় সেটি হচ্ছে শিল্পবিপ্লব। শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ড দেশটি বিশ্বের প্রথম শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তাই কখনো কখনো ইংল্যান্ডকে ‘পৃথিবীর কারখানা’ বলা হতো। ১৭ শতাব্দীতে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে হস্তচালিত শিল্পব্যবস্থাকে মেশিনচালিত পদ্ধতিতে রূপান্তরের মাধ্যমে প্রথম শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছিল। ইউরোপ ও আমেরিকায় বস্ত্রশিল্প, লৌহশিল্প ও কৃষিশিল্পে এর প্রভাব পড়েছিল। তৎকালীন ব্রিটিশশিল্পে ও এর প্রভাব পড়তে শুরু করে। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ও প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল ১৮৭০ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে। এ কালে জ্বালানির উৎসগুলোতে বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস প্রভৃতি উৎপাদিত হয়। রেলপথ ও টেলিগ্রাফ নেটওয়ার্ক ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। মানুষ ও তার চিন্তাভাবনার দ্রুত স্থানান্তরের সুযোগ তৈরি হয়। ক্রমবর্ধমান বৈদ্যুতিকীকরণে কারখানাগুলোতে আধুনিক উৎপাদন লাইনের বিকাশের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরবর্তী সময় কম্পিউটার প্রযুক্তি, সেমি কন্ডাক্টর, মাইক্রোচিপস ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি ও আণবিক শক্তির উদ্ভাবন নিয়ে হয়েছিল তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। এ সময়ে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, ওষুধশিল্প ও ব্যায়োটেকনোলজির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। ইন্টারনেট, মোবাইল যোগাযোগ এ শিল্পবিপ্লবের ফল। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রি- ৪.০০ হচ্ছে আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার। দ্রব্য উৎপাদনের ও সেবা প্রদানে বিপণন ও ভোগের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। শুধু যান্ত্রিক কৌশল নয়; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উচ্চতরপর্যায়ের তথ্যপ্রযুক্তি, রোবটিক্স ও কম্পিউটারের উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহার এ বিপ্লবের অন্যতম অনুষঙ্গ। এতে উৎপাদনের জন্য মানুষের যন্ত্র চালানোর পরিবর্তে যন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরও নিখুঁত ও নির্ভুল কার্যসম্পাদন করার ক্ষেত্র তৈরি করবে। চিকিৎসায়, যোগাযোগে, উৎপাদনে, কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনেও দৃশ্যমান প্রভাব অধিকতর জোরদার হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের জীবনধারার ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। উন্নয়ন ও বাজারব্যবস্থাপনার অবারিত সুযোগ তৈরির আশা জাগিয়েই চলেছে। প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কর্মঘণ্টা হ্রাস এ প্রযুক্তির সহজতর সক্ষমতা। তবে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত ঘাটতির কারণে উন্নয়নশীল দেশ ও উন্নয়নশীলের পথে উত্তরণের দেশগুলো নানা জটিলতা ও বেকারত্বের মতো সমস্যায় পড়তে পারে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্যানুযায়ী, প্রয়োজনীয় দক্ষতার ঘাটতির কারণে বিশ্বের প্রায় ৮০ কোটি মানুষ চাকরি হারাতে পারে। এ সময়কালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে চাকরিরত প্রায় ৫৭ লাখ অদক্ষ শ্রমিক এ প্রযুক্তির সঙ্গে খাপখাওয়াতে ব্যর্থতায় বেকার হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী গতি লক্ষ্য করা গেলেও বিশ্বপ্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে ও বেকারত্ব হ্রাস, বৈষম্য ও দুর্নীতি দূর করতে এবং ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা আনয়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। মানুষের দৈনন্দিন পথচলায় ব্যাংক ও আর্থিক খাত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সময়কালে এ খাতের প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়নে গ্রাহকদের প্রযুক্তির সঙ্গে সুপরিচিত করাও একটি চ্যালেঞ্জ। উন্নত ব্যাংকিং সেবা ও ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য শিক্ষিত ও জনশক্তি তৈরি করাও চ্যালেঞ্জ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রসার লাভ করলে শ্রমশক্তির চাহিদা যে হ্রাস পাবে শুধু তা নয় বরং অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য বর্তমানে বিদ্যমান পেশাগুলোতে চাহিদা দ্রুত কমে আসবে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন এমন পেশায় চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। তাই দ্রুত ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তির চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে ব্যাংকিং খাতের ঋণ আদায়ের গতি ও খেলাপি গ্রাহকদের থেকে অর্থ আদায়ের জন্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের প্রযুক্তি বৈষম্য দূর করতে হবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভবিষ্যতে মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। ফলে মানুষের কর্মক্ষেত্র সংকোচিত হবে, অক্ষসমতা বৃদ্ধি পাবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমবে ও প্রযুক্তি জ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে। এ জন্য আমাদের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে তথ্যপ্রযুক্তির আদলে তৈরি করতে হবে। অনলাইন লেনদেনের ক্ষেত্রে জটিলতা দূর ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক সেবা খাতে প্রযুক্তির হাত ধরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লেনদেন করতে এখন ব্যাংকে সশরীরে না গিয়ে ঘরে বসে স্মার্টফোনেই কাজ করা যায়। বর্তমানে চালু হচ্ছে ওপেন ব্যাংকিং অর্থাৎ অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই)। ভোক্তারা একটি অ্যাকাউন্ট থেকেই ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ সেবা গ্রহণের সুযোগ পাবেন। ডিজিটাল টেকনোলজির মাধ্যমে (ডিএলটি) ব্লক চেইন নেটওয়ার্ক ভোক্তাদের কাছে আস্থা ও স্বচ্ছতা তৈরি করেছে। তবে ব্যাংকিং পরিষেবায় উন্নতি করতেও ভোক্তাদের আরও দ্রুত সেবা দিতে এবং এ খাতের দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ করতে, ঋণ আদায়ের গতি ফিরিয়ে আনতে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সঠিক ডকুমেন্টেশন, ফেইক ডকুমেন্ট ডিটেক্ট এবং ডকুমেন্টস প্রিজারভেশনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে কীভাবে ঝুঁকি কমানো যায় তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদারকি বাড়ানো উচিত। আমাদের ভূমিব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজ করতে হবে। নামজারি, রেজিস্ট্রেশন, খাজনা প্রদান ইত্যাদির ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার জোরদার করা উচিত, যার ফলে ব্যাংক বিনিয়োগ ও মর্গেজকৃত সম্পত্তি সার্চিং ও যাচাই-বাছাইয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে নতুন সম্ভাবনার বিপরীতে ব্যাংকিং খাতে টানা ঝুঁকি ও প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। পাসওয়ার্ড হ্যাকিং, এটিএম বুথ থেকে অর্থ চুরি রোধসহ দেশীয়- আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফান্ড হস্তান্তরের বিষয়গুলো গুরুত্বসহ দেখা উচিত। অর্থ কর্মকাণ্ডে ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল রূপান্তর হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বুনিয়াদ। ব্যাংকিং খাতে ডিজিটাল রূপান্তরের সঙ্গে গ্রাহকদের অন্তর্ভুক্তি করানোসহ সমাজকে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে অভ্যস্ত করা, অদক্ষ শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতি ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তি প্রাপ্তি, শিল্পবিপ্লবের সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জব পলিসি, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নিরাপত্তার জন্য নিয়মনীতির সংস্কার করতে হবে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়ানো যায় তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশে তরুণের সংখ্যা পাঁচ কোটি, যা মোট জনশক্তির ৩০ শতাংশের বেশি। আগামী ৩০ বছরে এ তরুণরা উৎপাদনশীল খাতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল ভোগের বড় হাতিয়ার। ব্যাংকিং বা আর্থিক খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার (ফিনটেক) ভবিষ্যতে প্রথাগত ব্যাংকিং পরিষেবাকে অনেকটা সংকোচিত করে দেবে। ছোট আকারের ফিনটেক প্রতিষ্ঠান অনেক কম খরচে বেশি দক্ষতার সঙ্গে আর্থিক সেবা দিতে সমর্থ হবে। ডিজিটাল যুগে কার্যকর প্রযুক্তি পণ্য ও সেবার চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সুসমন্বয় করতে সক্ষম হবে। প্রযুক্তির আবিষ্কারের সঙ্গে ব্যাংক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। পণ্য ও সেবা উৎপাদন বণ্টনে ব্যয় অভাবনীয়ভাবে হ্রাস পাবে। কারণ মানুষকে সহায়তা করবে মেশিন। স্বল্প সময়ে অধিক উৎপাদন করা সহজ হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। যেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তিকে যত দ্রুত কাজে লাগাতে পারবে তারা তত দ্রুত এর সুফল ভোগ করবে।

২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবনযাপন সব কিছুতেই যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফলগুলো ভালোভাবে আত্তীকরণের মাধ্যমে নতুন সময়, নতুন প্রেক্ষাপটের আলোকে সর্বোত্তম গ্রাহকসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নানা রকম চ্যালেঞ্জ থাকবে। আমাদের প্রত্যাশা, ব্যাংকগুলো সেই চ্যালেঞ্জগুলো সুন্দরভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। বিদ্যমান সুযোগ ও সম্ভাবনাগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য সময়োপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নে মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, সততা, নিষ্ঠা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার সর্বোত্তম প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো আরও বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে যাবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। অর্জিত সাফল্যের ভিত্তিতে আগামী দিনের সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশ ও জাতির কল্যাণে আধুনিক যুগোপযোগী ব্যাংকিং সেবার প্রসার ঘটাবে এবং দিনে দিনে সাফল্য ও সমৃদ্ধির নতুন নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে ব্যাংকিং খাত- তেমন দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সবাইকে একযোগে সর্বোচ্চ উদ্যোগী হয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ মানেই আধুনিক কারিগরি প্রযুক্তির সর্বাত্মক ব্যবহার নয়। একজন মানুষ সে নারী কিংবা পুরুষ হোক না কেন তার সাজসজ্জা পোশাক-আশাক, চলন-বলন কথাবার্তা যতই আধুনিক, ধোপদুরস্ত স্মার্ট হলেই তাকে পরিপূর্ণ স্মার্ট হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। যদি তার চিন্তাভাবনা, মন-মানসিকতা, রুচিবোধ, জীবনদর্শন, সৃজনশীলতা ইত্যাদি স্মার্ট না হয়, তাহলে তাকে কোনোভাবেই স্মার্ট মানুষ বলা যাবে না। এখানে স্মার্টনেস বলতে আমরা বুঝব পুরোনো গতানুগতিক চিন্তাভাবনা, জীবনবোধ, মনমানসিকতা ঝেড়ে ফেলে কুসংস্কার, গোড়ামিমুক্ত মানবিক জীবনদর্শন অনুসরণ। ব্যক্তিজীবনে, পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এখনো অনেক পুরোনো চিন্তাভাবনা, দর্শন, সংস্কার, ধ্যানধারণা জেঁকে বসে আছে। বাইরে থেকে দেখে যতই আধুনিক যুগোপযোগী মনে হোক না কেন ভেতরে ভেতরে সেখানে দীর্ঘ দিন ধরে লালিত চেতনা ও নীতিকে বহন করা হচ্ছে। যে কারণে এখনো সমাজে উপনিবেশিক প্রশাসনিক, বিধিবিধান, বিচারিক আইন-কানুন, বাল্যবিয়ে, প্রাচীন রীতিনীতি ও সংস্কার অনুসরণ প্রতিনিয়ত চরম সংকট ও অস্বস্তির কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক


বেগম রোকেয়ার সাহিত্যে আধুনিকতা আর বিজ্ঞানমনস্কতার প্রভাব

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ডেইজী মউদুদ

পদ্মরাগ, মতিচূর, অবরোধবাসিনী এবং সুলতানার স্বপ্ন- মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের অনবদ্য সৃষ্টি। আজ থেকে দেড় শত বছর আগে কীভাবে এই কিংবদন্তি নারী এমন এক অন্ধকার ও বৈরী পরিবেশে নিজে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং শিক্ষাকে রপ্ত করে আবার সাহিত্য ও সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখেন, তা ভাবলেই অবাক হতে হয়। আজ বেগম রোকেয়া দিবস। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে তার সাহিত্যে আধুনিক চিন্তা চেতনা ও বিজ্ঞানমনস্কতা দিয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব।

বেগম রোকেয়া যে সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন সমাজে মুসলিম নারী শিক্ষার কোনো প্রচলন ছিল না। নারীসমাজ ছিল কঠোর অবরোধ প্রথার শৃঙ্খলে বন্দি। বেগম রোকেয়া বালিকা বয়সেই বুঝতে পেরেছিলেন, যে সমাজে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা, সে সমাজ তার জন্য কোনো মঙ্গল আর কল্যাণের বারতা নিয়ে আসবে না। তাই তিনি চুপি চুপি বড় বোন করিমুন্নেছা ও বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষার পাঠ নিয়েছিলেন। শিক্ষায় রপ্ত হয়ে তিনি ব্রত গ্রহণ করেছিলেন, কীভাবে সমাজের এই কূপমণ্ডূকতা ও কুসংস্কার দূর করা যায়। তিনি লক্ষ করেছেন, পুরো সমাজ নারীদের নানা বাধা ও বেড়াজালের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখে তাদের এগিয়ে চলার পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে। তিনি দেখেছেন, যত বাধা, যত সংস্কার কেবল নারীদের জন্য। একটি ছোট্ট বালিকার শিশুমনে সমাজের যাবতীয় অনিয়ম ও অন্যায়ের দর্পণ অত্যন্ত শক্ত প্রতিবাদের সুর ও হাতিয়ার হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল বলেই নারীসমাজ সেই বেড়াজাল থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল। বেগম রোকেয়াও ইতিহাসে মুসলিম নারী সমাজের জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে কালজয়ী হয়ে গেলেন। সমাজের অন্যায় ও কঠোরতার চিত্র বেগম রোকেয়ার সাহিত্যকর্মের পরতে পরতে উদ্ভাসিত। তিনি তার ‘অবরোধবাসিনী’ গ্রন্থে সমকালীন সমাজের কিছু ঐতিহাসিক ও চাক্ষুষ হাসিকান্নার চিত্র ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ছলে তুলে ধরেছেন। এটি বেগম রোকেয়ার একটি উল্লেখযোগ্য গদ্যগ্রন্থ। চিত্রধর্মী এই ছোট ছোট রচনাগুলোর মধ্যে সমাজের অবরুদ্ধ নারীর মার্মান্তিক জীবনকথা অত্যন্ত সাহিত্যমণ্ডিত হয়ে ফুটে উঠেছে। বেগম রোকেয়া এই গ্রন্থে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, লাহোর, দিল্লি ও আলীগড়ের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত মুসলিম নারীদের কঠোর পর্দা প্রথার নামে অবরোধের ৪৭টি অমানবিক ঘটনার চিত্র অঙ্কন করেন। গ্রন্থ প্রকাশের আগে তার রচনাগুলো কলকাতার মাসিক মোহাম্মদী ও নবনূর পত্রিকায় ছাপানো হতো। ‘অবরোধবাসিনী’ গ্রন্থের কয়েকটি চিত্র যদি তুলে ধরি, তাহলে বোঝা যাবে নারীরা বেগম রোকেয়ার সমকালে কী পরিমাণ কষ্ট আর দুর্ভোগের শিকার হতেন।

১. একটি ঘটনায় লিখেছেন, এক বুড়ি তার নাতি-নাতনিদের নিয়ে শহর দেখতে বের হলেন। একটি গরুর গাড়িতে চেপে বুড়ি সারা দিন শহরে ঘুরলেন বটে, সন্ধ্যায় ঘরে ফিরলে স্বজনরা জিজ্ঞেস করেন, শহর কেমন দেখলেন? বুড়ির উত্তর, কিছুই দেখলাম না, যেহেতেু পর্দার অন্তরালে ছিলাম।

২. আরেক ঘটনায় আছে, বিয়ের কনেকে স্নান করাবে নদীতে। পালকিতে ৭ পরতের আবরণে মুড়িয়ে পালকিসমেত ভেতরে থাকা কনেকে নদীতে চুবানো হলো। ঘরে এসে দেখলেন, সেই কনের আর প্রাণবায়ু নেই। অবরোধের কারণে নদীর জলেই কনের প্রাণ বিসর্জন হলো। এই ধরনের মোট ৪৭টি চিত্র আমরা তার অবরোধবাসিনীতে পাই, যেগুলোর সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম। চিত্রগুলোর ফলে সমাজের দুরবস্থা বুঝতে আর পাঠকের বাকি থাকে না।

বেগম রোকেয়া সুলতানার স্বপ্ন ইংরেজি ‘সুলতানাস ড্রিম’-এর অনুবাদ গ্রন্থ। এটি ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয়। এটি রচনার প্রধান লক্ষ্য ছিল সমাজে পুরুষের কর্তৃত্বকে খর্ব করা। কারণ পুরুষের শাসনে বন্দি থাকার ফলে নারী জাতি মানবজাতির কোনো কল্যাণে আসতে পারছে না। বেগম রোকেয়া বুঝতে পেরেছিলেন এই শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে এলেই নারী মুক্তি সম্ভব। তিনি এই আদর্শ বা ইউটোপিয়ান মুক্তিটি এনেছিলেন তার কল্পনায়, তবে পুরোপুরি ভবিষ্যতের বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে।

এই গ্রন্থে বেগম রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি নারী রাজ্যের। স্বপ্নে তিনি দেখছেন তার বোন সারাহর মতো অপরিচিত এক নারীর সঙ্গে তিনি অন্তঃপুর ত্যাগ করে নতুন এক স্বপ্নের রাজ্যে বিচরণ করছেন। সেই রাজ্য নারী পরিচালিত। সেখানে পুরুষরা গৃহবন্দি। তাদেরকে পর্দার আড়ালে বন্দি রাখা হয়েছে। ওরা লাজুক, ভালো কিছু করতে পারে না। কিন্তু সময়মতো রান্না করে। এবং ঘরদোর পরিষ্কার করে। ফলে দেশে কোনো অপরাধ নেই।

শিক্ষা ও বিজ্ঞান সব সমস্যার সমাধান করতে পারে বলে বিশ্বাসী রানির আদেশেই দেশে অনেক স্কুল ও দুটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। একটিতে সূর্যালোক ও সূর্যতাপের গবেষণা অন্যটিতে নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করে ঘরবাড়ি আলোকিত ও রান্নার কাজে সহযোগিতা করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা একটি পানি বেলুন নির্মাণ করে আকাশ থেকে পানি সংগ্রহ ও সঞ্চিত করে প্রয়োজনে দেশকে খরার কবল থেকে রক্ষা করে দেশে ফলন বাড়িয়ে তুললেন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান চালিকাশক্তি এখানে নারী। তারা কৃষি কাজও করছেন। এখানে কোনো অপরাধ নেই। রাজ্যের প্রচলিত ধর্ম সত্য বলা, প্রেম আর ভালোবাসা। এই তিনের চাদরে মোড়ানো এ যেন এক রূপকথার স্বপ্নরাজ্য। আর এই রাজ্যে তিনি কি দেখেছেন, এই রাজ্যের সবকিছুই যেন এগিয়ে এক শত থেকে দেড় শত বছর এগিয়ে । এখানে তিনি দেখছেন , নারীরা কৃষিকাজে আধুনিক লাঙ্গল ব্যবহার করছে। সৌর বিদ্যুৎতের কথা বলা হয়েছে, আকাশে উড়ছে উড়ন্ত যান, সুইচ টিপেই সেই যান আকাশে উড়ে যাচ্ছে। এসব উদ্ভাবন কিন্তু নারীরাই করেছেন। তবে এই রাজ্যে পুরুষদের বন্দি করা হয়েছিল বল প্রয়োগ করে নয়, বুদ্ধি দিয়ে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে কৌশলের পরিবর্তে ক্ষমতার অধিকারী পুরুষরা অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে দেশকে সক্ষম পুরুষশূন্য করে দিল। তখন মেয়েরা এগিয়ে এল। তবে ওরা যেহেতেু পুরুষের সামনে আসবে না, তাই এদের ঘরে বন্দি করে ফেলা হলো। এরপর মহিলা বিজ্ঞানীরা তখন ঘনীভূত সূর্যালোককে শত্রুর ওপর বর্ষণ করলে ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল। অথচ একটি প্রাণও সংহার হলো না। সেই যে নারীস্থানে পুরুষরা অন্দরমহলে ঠাঁই নিল, আর বাইরে আসতে পারল না। তার সাহিত্যে যে আধুনিকতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় আমরা পাই, তা তো তার কোনো অভিজ্ঞতা থেকে নয়। তিনি তার প্রখর কল্পনা শক্তি দিয়ে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে দিয়েছেন দেড় শত বছর আগে। তার সবকটি কল্পচিত্রের সার্থক প্রয়োগ আমরা আজ বিশ্বব্যাপী পরিলক্ষিত করি। তার সমকালে তিনি পুরুষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নারী জগৎ কল্পনা করে সাহিত্য রচনা করেছিলেন, এই যুগের আধুনিক বিশ্বের পুরুষ জাতি, তার এই আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক সাহিত্যকে কীভাবে গ্রহণ করতেন? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারের যেসব কল্পনা তিনি তার সাহিত্যে ব্যবহার করেছেন, এর কিছুই কিন্তু তিনি স্বচক্ষে দেখেননি। ভারতবর্ষের কোনো বিজ্ঞানীর সঙ্গেও তার কোনো সাক্ষাৎ ঘটার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে প্রশ্ন জাগে কোথা থেকে এই নারী এই চিত্রকল্প তৈরি করেছিলেন। আমরা জানি, বেগম রোকেয়ার শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চায় ভাই ও বোনের পরে তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের অবদান অনস্বীকার্য। তার স্বামী কৃষিবিজ্ঞানে বিলাত থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ফলে স্বামীর অর্জিত জ্ঞান থেকেই বেগম রোকেয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞান আহরণ করে তা তার কল্পনার জগতে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। ফলে গভীর দূরদৃষ্টি এবং প্রখর কল্পনাশক্তির বলে তার সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম আমাদেরকে এগিয়ে দেয় শত বছরের বেশি সময়। এ যেন আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে এক মহাপ্রাপ্তি। বেগম রোকেয়া জীয়ন্তে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় আরোহণকারী নারী ছিলেন না। তিনি এসব নিষ্ঠুর প্রথা ও আচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন বহু আগেই।

লেখক: সাংবাদিক


বাংলাদেশের বিজয় ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. নাসিম বানু

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের জনগণকে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে, কখনো সমরে, কখনো শান্তিতে, কখনো কৌশলে, কখনো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদৃষ্টি দিয়ে। ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন শুধু ধর্মীয় অনুভূতির ওপরে কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ত্ব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না, এর পরেও আবার শুরু হলো শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তাদের মাতৃভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পরিকল্পনা করা হলো, যার ফলে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হলো, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলনে সালাম, বরকত, রফিকসহ আরও বহু ভাষাসৈনিকের প্রাণ গেল। তৈরি হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে বঞ্চিত করা হতো, যেখানে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূলচালিকাশক্তি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক ও কৃষি। পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করছিল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পরেও পাকিস্তান সরকার যখন জনতার রায়কে কার্যকর করল না, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বাঙালিদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ, দায়িত্ববোধ, একাগ্রতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের আহ্বান জানালেন। মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বললেন, রণকৌশলের ধারণা দিলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত্রে যখন বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপরে গণহত্যা চালান হলো, তখন ২৫ মার্চ ভোর রাত্রে অর্থাৎ ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি হলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগারে বন্দি, মুজিবনগর সরকার এবং বাংলাদেশের রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এ তিনটি বিষয়ে সফল সমন্বয় বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহান সম্মোহনী ক্ষমতার অধিকারী নেতার নেতৃত্ব থাকার ফলে সম্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের বিজয়ের গৌরব পূর্ণতা পেল। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭২ সালের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করলেন যার মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পুনর্বাসনের জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলো। সদ্য বিজয় লাভ করা একটি রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করল, এ দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশবিরোধী জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ছিল, ফলে সীমিত অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ ক্ষণস্থায়ী হলো। বিজয়ের গৌরবের উজ্জ্বল অধ্যায় সৃষ্টি এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতি ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য সবাইকে নিয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন, দেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী থাকবে না, চাষাবাদ হবে সমবায় পদ্ধতিতে, দেশের সর্বোচ্চ উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ত্ববিরোধী জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্র ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করলে, বাংলাদেশের বিজয়ের গৌরব প্রস্থান হয়ে যায়, সংবিধানের ৪টি মূলনীতি হুমকির মুখে পড়ে। বাঙালি জাতিকে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এ দুটি শব্দ দিয়ে বিভক্ত করে ফেলা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী সামরিক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে, সংবিধান থেকে সামজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি মুছে ফেলে, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়, স্বাধীনতার অমর স্লোগান ‘জয় বাংলা’ মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। পাকিস্তানি কায়দায় ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনির রব উঠে আসে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ ঘটে, সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি হয়, আদর্শিক রাজনৈতিক চর্চার বিচ্যুতি হয়, যুবসমাজকে নৈতিকতাবিরোধী বৈষয়িক কাজে যুক্ত হতে উৎসাহিত করা হয়। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলো ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের রাষ্ট্রীয় সহায়তায় পুনর্বাসিত করা হয়, দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি নিশ্চিত করা হয়। যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা দিয়ে এবং নীতি-নির্ধারণ পর্যায়ে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবজ্ঞা করা হয়। দেশের অভ্যন্তরে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও চোরাচালান চলতে থাকে। প্রতিযোগী রাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যক্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা করা হয়। সামরিক বাহিনীতে কৌশলে অসন্তোষ ও বিদ্রোহের সূচনা করে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অফিসার, সৈন্যদের একের পর এক হত্যা করা হয়, নেতৃত্বে অমুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ ও মর্যাদায় আসীন করা হয়। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খুনিদের সুরক্ষা দেওয়া হয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অনৈতিক ব্যবহার করে খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মুক্তি দেওয়া হয়, দেশের বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি চালু করা হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকে।

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সংবিধান থেকে ইনডেমনিটি আদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং যুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারকার্য শুরু করে, নির্বাসিত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন, ধর্মের উগ্রবাদ ও অপব্যবহার রোধ করে জাতিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়। সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে ক্যু-হত্যার অবসান ঘটায়। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণকে সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের আওতায় এনে দুর্ভিক্ষ, মন্দা প্রভৃতি দূর এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে বিদ্যুৎ, কর্মসংস্থান ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশকে মুক্ত করে সোনার বাংলা গঠনে উদ্যোগী হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিকল্প একমাত্র দেশরত্ন শেখ হাসিনা। প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস প্রকাশিত বিশ্বের ১০০ (একশত) ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় এবার স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ৪৬তম স্থানে রয়েছে তার নাম। তালিকার ছয়টি শ্রেণির মধ্যে, রাজনীতি ও নীতি-নির্ধারক শ্রেণিতে রয়েছে তার নাম। এই শ্রেণিতে বিশ্বের ১৮ জন ক্ষমতাধর নারী স্থান পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা অসম্ভব দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন রাজনীতিবিদ ও নীতি-নির্ধারক, এটা আজ বিশ্ব স্বীকৃত ও নন্দিত। যে কারণে বাংলাদেশের নির্বাচনবিরোধী আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় স্থায়ী কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার জনসম্পৃক্ততা ও জনপ্রিয়তা দিয়ে সেটা প্রতিরোধ করেছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা এখন দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে একটি গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক ধারা অন্যটি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা, বঙ্গবন্ধুকন্যা গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ৭ জানুয়ারি ২০২৪ বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, ওই দিন দেশের প্রায় ১১ কোটি ৯৭ লাখ ভোটারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিজয় এবং দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে চায়, নাকি অসাম্প্রদায়িক শক্তির বিজয় দেখতে চায়? দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ, আর এ যুদ্ধ শুধু বাংলাদেশের সংবিধানবিরোধী শক্তির সঙ্গে নয়, এটা বাংলাদেশের সার্বভৌত্ববিরোধী আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধেও বিজয় লাভ করতে হবে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই, আর বাংলাদেশের জনগণকে এ লড়াইয়ে বিজয় লাভ করতেই হবে।

লেখক: প্রো-উপাচার্য

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


কোরআনের আলোকে অন্তর্চক্ষু

আপডেটেড ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১৩:০৮
সৈয়দ শাহাদাত হুসাইন

আল্লাহ তাআলা কোরআনুল হাকিম সম্পর্কে বলেন, ‘তারা আপনার কাছে এমন কোনো বিস্ময়কর সমস্যা (প্রশ্ন) নিয়ে আসেনি, যার সঠিক সমাধান ও সুন্দর তাফসির (ব্যাখ্যা) আপনাকে আমি দান করিনি (২৫:৩৩ )।’ হজরত রাসুলে করিম (স.) এরশাদ করেছেন, অর্থ ‘নিশ্চয় কোরআনের এক আয়াত অন্য আয়াতের ব্যাখ্যা করে’। যা শুধু বিষয়ভিত্তিক আয়াত একত্রিকরণের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব। বাসিরুন অর্থ ‍চক্ষু, যা পবিত্র আল কোরআনুল হাকিমে মাদ্দাগতভাবে ৬২টি সুরায় ১৩৯টি আয়াতে ১৪৮ বার রয়েছে। তন্মধ্যে ৬টি আয়াতে অন্তর্দৃষ্টি বা অন্তর্চক্ষুর বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। ফুয়াদ শব্দটির অর্থ অন্তর বা অন্তঃকরণ বা অন্তর্চক্ষু যা ১৩টি সুরায় ১৫টি আয়াতে ১৬ বার রয়েছে। আইনুন যার অর্থ চক্ষু যা পবিত্র কোরআনুল হাকিমে শব্দটি ৪০ বার রয়েছে, যা থেকে অন্তর্চক্ষু সম্পর্কে দুটি আয়াত নিয়েছি। মুতাওয়াছছিমিন যার অর্থ অন্তর্দৃষ্টি বা বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষ, যা পবিত্র কোরানুল হাকিমে একবার রয়েছে। কাশ্ফুন আরবি শব্দ, পবিত্র কোরআনে ২০ বার রয়েছে, যার অর্থ অপসারণ করা, প্রকাশিত হওয়া, অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচিত হওয়া ইত্যাদি। আমি অন্তর্দৃষ্টি-সংক্রান্ত একটি আয়াত নিয়েছি। খাবির শব্দের অর্থ সূক্ষ্ণদর্শী, অবহিত, যা পবিত্র কোরআনুল হাকিমে ১২ বার রয়েছে, যা হতে দুটি আয়াত নিয়েছি। এই ২৭টি আয়াত একত্রিত করে বিষয়গুলোকে সন্নিবেশিত করেছি। যাতে মানুষ অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহর দেয়া সিদ্ধান্ত কোরআন বিল কোরআন উপলব্ধি করতে পারে।

১. নিশ্চয় আয়াতসমূহে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়- আয়াত নিশ্চয়ই দুটো দলের মোকাবিলার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন ছিল। একটি দল আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করে। আর অপর দল ছিল কাফেরদের। এরা স্বচক্ষে তাদের দ্বিগুণ দেখছিল। আর আল্লাহ যাকে নিজের সাহায্যের মাধ্যমে শক্তি দান করেন। নিশ্চয় এতে রয়েছে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্নদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় (০৩:১৩)। আয়াত- ‘আল্লাহ্ রাত্রি ও দিনের পরিবর্তন ঘটান। নিশ্চয় এতে রয়েছে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় (২৪:৪৪)। আয়াত- নিশ্চয় এতে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্নদের জন্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে (১৫:৭৫)।’

২. অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য এ কোরআন জিকির। আয়াত-‘আল্লাহর অনুরাগী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য, এটা জ্ঞান (জ্ঞানচক্ষু) ও উপদেশস্বরূপ (৫০:৮)।’

৩. আল্লাহ বিশ্বাসীদের অন্তর দৃঢ় করে দেন: আয়াত- ‘আর আমি রাসুলগণের সব বৃত্তান্তই তোমাকে বলছি, যদ্বারা তোমার অন্তরকে মজবুত করেছি। আর এভাবে তোমার নিকট মহাসত্য এবং ঈমানদারদের জন্য নসিহত ও স্মরণীয় বিষয়বস্তু এসেছে (১১:১২০)।’ আয়াত- ‘সত্য প্রত্যাখ্যানকারীরা বলে, তার প্রতি সমগ্র কোরআন এক দফায় অবতীর্ণ হলো না কেন? আমি এমনিভাবে অবতীর্ণ করেছি এবং ক্রমে ক্রমে আবৃত্তি করেছি আপনার অন্তকরণকে মজবুত করার জন্যে (২৫:৩২)।’ এ বিষয়ে আরও দুটি আয়াত রয়েছে।

৪. কাফেরদের অন্তরকে পর্দা করে দেন। আয়াত- ‘আমি ঘুরিয়ে দেব তাদের অন্তর বা মন (আফইদাতাহুম) ও দৃষ্টিকে (আবসা-রাহুম), যেমন- তারা এর প্রতি প্রথমবার বিশ্বাস স্থাপন করেনি এবং আমি তাদের অবাধ্যতায় উদভ্রান্ত ছেড়ে দেব (৬:১১০)।’ আয়াত- ‘অতএব, আপনি তাদের এবং তাদের মিথ্যা অপবাদকে মুক্ত ছেড়ে দিন, যাতে কারুকার্যখচিত বাক্যের প্রতি তাদের অন্তর আকৃষ্ট হয় যারা পরকালে বিশ্বাস করে না এবং তারা একেও পছন্দ করে নেয় এবং যাতে ওইসব কাজ করে, যা তারা করছে (৬:১১৩)।’ আয়াত- ‘যাদের চক্ষুসমূহের ওপর পর্দা ছিল আমার স্মরণ থেকে এবং যারা শুনতেও সক্ষম ছিল না (১৮:১০১)।’ এ বিষয়ে আরও একটি আয়াত রয়েছে।

৫. আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন কর্ণ, চক্ষু, অন্তঃকরণ। আয়াত- ‘আল্লাহ তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছেন। তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ দিয়েছেন, যাতে তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার করো (১৬:৭৮)।’

৬. আল্লাহ কর্ণ, চক্ষু, অন্তঃকরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। আয়াত- ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার পেছনে পড়ো না। নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে (১৭:৩৬)।’

৭. নবীগণ অন্তর্চক্ষু দ্বারা জেনে দীনের দাওয়াত দিতেন। আয়াত- ‘বলে দিন, এই আমার পথ। আমি এবং আমার অনুসারীরা আল্লাহর দিকে জেনে-বুঝে দাওয়াত দিই। আল্লাহ পবিত্র। আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই (১২:১০৮)।’

৮. অন্তঃকরণ সম্পর্কে অস্বীকারকারীগণ অকৃতজ্ঞ। আয়াত- ‘তিনি তোমাদের কান, চোখ ও অন্তঃকরণ সৃষ্টি করেছেন; তোমরা খুবই অল্প কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে থাক (২৩:৭৮)।’ আয়াত- ‘অতঃপর তিনি তাকে সুষম করেন, তাতে রূহ সঞ্চার করেন এবং তোমাদের দেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ। তোমরা সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর (৩২:৯)।’ এ বিষয়ে আরও একটি আয়াত রয়েছে।

৯. যারা আয়াত অস্বীকারকারী তাদের অন্তর্চক্ষু কোনো কাজে আসে না। ‘আয়াত- ‘আমি তাদের এমন বিষয়ে ক্ষমতা দিয়েছিলাম, যে বিষয়ে তোমাদের ক্ষমতা দিইনি। আমি তাদের দিয়েছিলাম, কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর, কিন্তু তাদের কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর তাদের কোনো কাজে আসল না, যখন তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করল এবং তাদের সেই শাস্তি গ্রাস করে নিল, যা নিয়ে তারা ঠাট্টা বিদ্রূপ করত (৪৬:২৬)।’

১০. অন্তর্চক্ষু যা দেখে তা মিথ্যা নয়। আয়াত- তার অন্তঃকরণ যা দেখেছে তা মিথ্যা নয় (৫৩:১১)।

১১. অন্তর্চক্ষু জাগ্রত মানুষগণ জাহান্নামও দেখতে পান। আয়াত- ‘তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে, অতঃপর তোমরা জাহান্নাম অবশ্যই দেখবে দিব্য প্রত্যয়ে, (১০২:৬-৭)। হাদিস: হারেসা ইবনে মালেক আনসারি (রা.) বলেন, ‘একদা আমি রাসুলুল্লাহ্ (স.)-এর নিকট আগমন করলে, তিনি (স.) বললেন, হে হারেসা- সকাল বেলা তোমার কী অবস্থায় কেটেছে? হারিসা (রা.) উত্তরে বললেন, সকালে একজন প্রকৃত মুমিন ছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ্ (স.) বললেন, ভেবে দেখেছ কী বলছ? প্রত্যেক বস্তুর হাকিকত আছে, তোমার ঈমানের হাকিকত কী? জবাবে হারেসা (রা.) বললেন, আমার ঈমানের হাকিকত এই যে, আমার নফস দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, রাতে প্রভুকে স্মরণ করি, দিনে রোজা রাখি। কাশফের অবস্থা এই যে, আমি আমার রবের আরশ প্রকাশ্য দেখতে পাচ্ছি। আমি জান্নাতবাসীদের দেখছি। তারা একে অপরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে। জাহান্নামের অধিবাসীদের চিৎকাররত অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (স.) বললেন, হে হারেসা (রা.)! তাহলে তুমি ঈমানের হাকিকতে পৌঁছে গেছ। (এইভাবে তিনবার বললেন)। আমার হারেসা এমন এক বান্দা যার ক্বালবকে আল্লাহ্ তাআলা ঈমানের নুরে নুরান্বিত করেছেন, (সূত্র: তাফসিরে ইবনে কাসির ৮:২, মসনাদে আবদুর রাজ্জাক)।

১২. দোযখের আগুনে অন্তর জ্বলবে। আয়াত- ‘আপনি কি জানেন, পিষ্টকারী (দোযখ) কী? এটা আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত অগ্নি, যা অন্তর পর্যন্ত পৌঁছবে (১০৪:৫-৭)।’

১৩. মৃত্যুর পূর্বে কাফেরদের চোখের পর্দা অপসারিত করবেন। ফলে তারা তাদের কর্মফল ও গন্তব্যস্থান দেখতে পাবে। কোরআনের আয়াত দ্বারা মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে উপনীত ব্যক্তির কাশফ পাওয়াকে বোঝানো হয়েছে। যার ফলে জীবনের অন্তিম মুহূর্তে মানুষের অস্বাভাবিক আচরণ প্রকাশ পায়। আয়াত- ‘তুমি তো এই দিন সম্পর্কে উদাসীন ছিলে। এখন তোমার কাছ থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়েছি। ফলে আজ তোমার দৃষ্টি সূতীক্ষ্ণ (স্পষ্ট) (৫০:২২)।

১৪. কপালের চোখ অন্ধ নয় তাদের অন্তর্চক্ষু অন্ধ। আয়াত- ‘তবে কি তারা দেশ- বিদেশ ভ্রমণ করেনি? তাহলে তারা এমন হৃদয়ের অধিকারী হতো যদ্বারা তারা বুঝতে পারত অথবা তারা এমন কর্ণের অধিকারী হতো যদ্বারা তারা শুনতে পারত। বস্তুত, চক্ষু তো অন্ধ হয় না বরং অন্ধ হয় বক্ষস্থিত হৃদয় (২২:৪৬)।’

১৫. অন্তর্দৃষ্টি বা অন্তর্চক্ষু কীভাবে খুলবেন। আয়াত- ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহভীরু বা মনে তাকওয়া রয়েছে, শয়তানের চিন্তা যখন তাদের স্পর্শ করে, সঙ্গে সঙ্গেই তারা আত্মসচেতন হয়ে আল্লাহর জিকির করে এবং তখনই তাদের অন্তর্চক্ষু জাগ্রত হয় (৭:২০১)।’ এ জিকির আহলে জিকির হতে অবগত হতে হবে।

১৬. আল্লাহ তাআলা নিজে খাবির এবং ওহিপ্রাপ্ত বান্দাগণও খাবির। আয়াত- ‘এবং তিনি আল্লাহ তার বান্দাদের সম্বন্ধে সকল খবর অবহিত, সূক্ষ্ণদর্শী (১৭:৩০)।’ পক্ষান্তরে বিশেষ মানুষ তথা মুমিনগণও খাবির। আয়াত- তার (আল্লাহ্) সম্পর্কে যিনি অবগত (খাবির) তাকে জিজ্ঞেস করো (২৫:৫৯)।’

হজরত ইমাম গাজজালি (রা.) আল মুনকিদ কিতাবের ১৫৪ পৃষ্ঠায় লিখেন, মানুষের বিজ্ঞতার উর্ধ্বে অন্য একটি পথ রয়েছে। সেই পথে অন্য ধরনের এক অন্তর্চক্ষু খুলে যায়, যার মাধ্যমে অদৃশ্য জগতের অনেক কিছু অনুধাবন করতে পারে। সেই চক্ষু দিয়ে ভবিষ্যৎ ঘটমান এবং চিন্তার ঊর্ধ্বে অনেক কিছু দেখতে সক্ষম হয়। এই অন্তর্দৃষ্টি প্রাপ্তদের শ্রেষ্ঠ মানব আমাদের নবী মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ‘রাসুলুল্লাহ্ (স.) পেছনে যা কিছু সব দেখতেন।’ হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় রাসুলুল্লাহ্ (স.) বলেছেন, ‘তোমরা আমার মুখ কিবলার দিকে দেখেছ? আল্লাহর কসম! আমার কাছে না তোমাদের রুকু লুকায়িত এবং না তোমাদের একাগ্রতা। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের আমার পেছন হতেও দেখি (সূত্র: বোখারি শরিফ)। নবী-রাসুলদের পরবর্তী ধাপে কিছু মুমিন রয়েছেন যারা ফিরাসাত বা অন্তর্চক্ষু দ্বারা সবকিছু দেখেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মুমিনের অন্তর্দৃষ্টিকে ভয় করো, কেননা তারা আল্লাহর নুর দ্বারা দেখেন (সূত্র: তাফসিরে ইবনে কাসির ও সুনান তিরমিজি শরিফ)।

লেখক: চেয়ারম্যান, তাসাউফ ফাউন্ডেশন


প্রাচীন বাংলায় এক উন্নত সভ্যতার বিকশিত হওয়ার ইতিকথা

আপডেটেড ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১১:৪৩
ড. এম এ সোবহান পিপিএম

বাংলাদেশ এক প্রাচীন সভ্যতার পাদপীঠ। গ্রিক ঐতিহাসিকদের বিবরণী মোতাবেক প্রাচীন বাংলায় শক্তিশালী গঙ্গাহৃদি রাষ্ট্রের বিকশিত হওয়া, পুণ্ড্রনগরীর সভ্যতা, ওয়ারী বটেশ্বর থেকে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী, ঢাকা কেন্দ্রীয় জাদুঘর, বরেন্দ্র জাদুঘর, কলকাতা জাদুঘর, বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাপ্ত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপি, শিলালিপি, মূর্তি, মুদ্রা এবং অন্যান্য প্রত্নসামগ্রী থেকে প্রতীয়মান হয় প্রাচীন বাংলায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল।

প্রাচীনকালে বাংলা ও বাংলায় স্বাধীন রাষ্ট্রের বিকাশ: ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। এটা থেকে আরও জানা যায়, প্রাচীন বাংলায় সে সময় বঙ্গ, মগধ এবং চের নামক তিনটি দেশ ছিল। তা ছাড়া মহাভারত, রামায়ণ, বিভিন্ন পুরাণসহ আরও অনেক পুরাতন গ্রন্থে বঙ্গ দেশের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য প্রাচীনকালে সমগ্র বাংলাদেশ একক কোনো রাষ্ট্রের শাসনাধীন ছিল না। তখন বঙ্গ বা বঙ্গাল বলতে যে অঞ্চল বুঝাত তা বর্তমান বাংলার একটি অংশ মাত্র। সে সময় বাংলাদেশ নানা পরগণা বা জনপদে বিভক্ত ছিল এবং বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। সে জনপদগুলো হলো গৌড়, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, উত্তররাঢ়, দক্ষিণ রাঢ়, তাম্রলিপি, চন্দ্রদ্বীপ ও বাংলা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতে ‘এক একটি কোমের মানুষ লইয়া এক একটি জনপদ গড়ে উঠেছিল।’ মহাভারতে প্রাচীন বাংলার অনেকগুলো কোমের উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিকের বর্ণনা থেকে প্রাচীনকালে বাংলায় সু-সংগঠিত রাষ্ট্রের কথাও জানা যায়। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রিক ইতিহাস থেকে প্রাচীন বাংলায় সুগঠিত ও শক্তিশালী গঙ্গাহৃদি রাষ্ট্রের বর্ণনা পাওয়া যায়। প্রাচীন বাংলার গঙ্গাহৃদি রাষ্ট্রের শক্তিশালী হস্তিবাহিনী এবং পরিকল্পিত ও সুনিপুণ সেনাবিন্যাসের তথ্য পাওয়া যায়। গ্রিক ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে আরও জানা যায়, গঙ্গাহৃদি রাষ্ট্রের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী কর্তৃক সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় আলেকজান্ডার ভারত থেকে তার সৈন্য ফিরিয়ে নিয়ে যান। ওই সময় গঙ্গাহৃদি রাষ্ট্রের বাহিরে বাংলার অন্যান্য অংশেও রাজ্য ও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে রচিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বাংলার উল্লেখ পাওয়া যায় এবং সে সময়ের বাংলার উন্নত বস্ত্রশিল্পের কথা জানা যায়। মহাভারত ও সিংহলী পুরাণ থেকে জানা যায়, বাংলার প্রাচীন রাজ্যগুলোতেও রাষ্ট্রীয় সচেতনতা ছিল, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ছিল এবং রাজ্যগুলোর কৃষি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, আইনশৃঙ্খলা, যুদ্ধবিগ্রহ, পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর সঙ্গে সমঝোতা, সন্ধি প্রভৃতি সম্পর্কিত সুস্পষ্ট নীতি, কৌশল ও প্রশাসনব্যবস্থা ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, আর্যদের আগমনের পূর্বে বাংলায় আনার্য জাতির লোকেরা সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। ঐ সব জাতির মধ্যে নিষাদ, কিরাত ও দামিল জাতির নাম উল্লেখযোগ্য। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে আর্যদের আসার পূর্বে বাংলায় এক সুসভ্য জাতি বাস করত এবং তাদের সভ্যতায় আর্যরা ঈর্ষান্বিত ছিল। আর্যদের আগমনের পর আর্য-অনার্য সংমিশ্রণে বাংলার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন নুতনভাবে গড়ে ওঠে। জৈনদের গ্রন্থেও বঙ্গ, অঙ্গ, রাঢ় প্রভৃতি জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়।

গৌতম বুদ্ধের ধর্ম প্রচার ও বাংলার জনপদে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব: গৌতম বুদ্ধ তার ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় গমন করেন এবং অনেক সংখ্যক বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী তৈরি করেন। বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাংয়ের বিবরণী থেকে জানা যায়, স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তৎকালীন বাংলার কর্ণসুবর্ণ, কুমিল্লা বা সমতটে যান এবং সমতটের রাজধানীতে কিছুদিন অতিবাহিত করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে অশোকের পূর্বেই বাংলায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয় এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রাধান্য লাভ করে। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে ও প্রসারে প্রাচীন বাংলার সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলে। বৌদ্ধ জাতক নামীয় গ্রন্থে প্রাচীন বাংলার বঙ্গ, রাঢ় ও পুণ্ড্রবর্ধন নামক জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তা ছাড়া বৌদ্ধ সাহিত্যে বঙ্গ ও সুহ্ম নামে দুটি জনপদের উল্লেখ আছে।

মৌর্য শাসন ও বাংলা (৩২২-১৮৫ খ্রি. পূর্ব): মৌর্য আমলে বাংলার উত্তরবঙ্গ মৌর্য রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। পুণ্ড্রনগর, উত্তরবঙ্গের মৌর্য শাসনের রাজধানী ছিল। মৌর্য বংশের রাজা অশোকের সুশাসন ও জনকল্যাণমূলক কাজের কথা জানা যায়। মৌর্য শাসনকালে রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি, বাণিজ্য, প্রশাসন, আইনশৃংখলা, প্রতিরক্ষা, অবকাঠামো, জনকল্যাণ ও সুপরিকল্পিত শাসনব্যবস্থা ছিল। এমনকি সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য রাজকীয় শস্যভাণ্ডার ছিল। যেখানে দুঃসময়ের জন্য শস্য মজুত করে রাখা হতো। এ থেকে বোঝা যায়, মৌর্য আমলে বাংলায় একটি সুনিয়ন্ত্রিত ও সুসংবদ্ধ শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। খ্রিষ্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে পেরিপ্লাস গ্রন্থ ও টলেমির বিবরণী থেকে প্রাচীন বাংলার সুসমৃদ্ধ ও সুবিস্তৃত ব্যবসা-বাণিজ্য সমন্ধে জানা যায়। ঐ সময়ে স্বর্ণ মুদ্রার প্রচলন সম্বন্ধে জানা যায়। তা থেকে স্পষ্ট যে, ঐ সময়ে প্রাচীন বাংলায় রাষ্ট্র ও সমাজজাত শাসন, সুগঠিত প্রশাসন ব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা বর্তমান ছিল। এ ছাড়া দেশের ভেতরে-বাহিরে সুদূরপ্রসারী আন্ত ও বহির্বাণিজ্য এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল।

গুপ্ত শাসন ও বাংলা (৩১৯ থেকে ৪৬৭ খ্রি.): গুপ্ত সাম্রাজ্যে বাংলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের ইতিহাসে গুপ্ত শাসনকালকে স্বর্ণযুগ বলা হয়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়ে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ভারতে আসেন। গুপ্ত শাসন আমলে স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রার প্রচলন হয়। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজধানী ছিল পাটালিপুত্র। এ শাসনকালে কুমারগুপ্ত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গুপ্ত শাসন আমলে চার প্রকারের কর প্রথা ছিল। ঐ সময়ে তাম্রলিপি ছিল বাংলার অন্যতম শহর ও বন্দর। গুপ্ত শাসনকালে তাম্রলিপি শহরে অনেক বৌদ্ধ বিহার ছিল, যা ফা হিয়েনয়ের বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়। ফা হিয়েন তার বর্ণনায় উল্লেখ করেন, সে সময়ে মানুষ সুখী ছিল। রাজা কর্তৃক কোন অত্যাচার-অনাচার ছিল না। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ছিল। জনগণের মধ্যে অধিকাংশ বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিল। সে সময়ে ধনীরা হাসপাতাল তৈরি করত ও অসুস্থদের চিকিৎসা করাত এবং জনগণ উচ্চ মানবিক গুণের অধিকারী ছিল।

গুপ্ত আমলে প্রাচীন বাংলার অধিকাংশ এলাকা গুপ্ত সাম্রাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। গুপ্ত শাসনে এ দেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রাদেশিক রূপ চালু হয়েছিল। গুপ্ত আমলে বাংলার প্রশাসনিক কাঠামো বিভক্ত ছিল ভুক্তি (বিভাগ), বিষয় (জেলা), মণ্ডল (থানা), বীথী (ইউনিয়ন) এবং গ্রাম। বৃহত্তর ভুক্তি-বিভাগ ছিল পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি এবং ক্ষুদ্রতরটি ছিল বর্ধমান ভুক্তি। এ ছাড়া অবশিষ্ট অংশ ছিল সরাসরি কেন্দ্রের অধীন। গুপ্ত সাম্রাজ্যে প্রাদেশিক ও স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল। গুপ্ত সাম্রাজে পূর্বের তুলনায় উন্নত বিচারব্যবস্থা ছিল। এ শাসনকালে কতকগুলো বিচারের বই সংকলিত হয়। গুপ্ত শাসনে সর্বপ্রথম দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা করা হয়। চুরি ও ব্যভিচারকে ফৌজদারি অপরাধ এবং সম্পত্তি-সম্পর্কিত অপরাধকে দেওয়ানি অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হতো। গুপ্ত বংশের শাসকরা পরোপকারী, দয়ালু এবং শান্তি ও নিরাপত্তার পাশাপাশি জনগণের কল্যাণ দেখতেন। মহাসড়কগুলোতে কোনো অপরাধ ছিল না। রাষ্ট্রের আয় ছিল মূলত ভূমি রাজস্ব। সরকারি কর্মচারীদের বেতন ক্যাশ বা নগদ অর্থে পরিশোধ করা হতো এবং তারা জনগণের নিকট থেকে কোনোরূপ উৎকোচ গ্রহণ করত না।

শশাঙ্ক এবং স্বাধীন বাংলা (৬০০-৬২৫ খ্রি.): গুপ্ত শাসনের সমাপ্তির পর সর্ব প্রথম বাংলা স্বাধীনতা লাভ করে। প্রথম স্বাধীন বাংলার রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। তিনিই প্রথম বাংলার বিভিন্ন পরগনা বা জনপদকে একত্রিত করেন এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলা শাসন শুরু করেন। কর্ণসুবর্ণ ছিল সে সময় বাংলার রাজধানী। যদিও ঐ সময়ে বর্তমানের পুরা বাংলাদেশ এ শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। যে সমস্ত এলাকা এ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল তা হলো- পুণ্ড্রবর্ধন (বর্তমান উত্তর বঙ্গ), গৌড় (বর্তমান পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশের অংশ), দণ্ডভুক্তি (পশ্চিম বঙ্গের দক্ষিণ অংশ), কর্ণসুবর্ণ (পশ্চিম বঙ্গের অংশ), বরেন্দ্র (বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গ), রাঢ় (পশ্চিম বঙ্গের দক্ষিণাংশ), সুম্মাডেশা (দক্ষিণ পশ্চিম অংশ, পশ্চিম বাংলার), ভাংগা (মধ্য বাংলাদেশর), ভ্যানগালা (দক্ষিণ বাংলাদেশ), হরিকেল (উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশ), চন্দ্রদ্বীপ (দক্ষিণ-বাংলাদেশ), সুবর্ণ বীথি (মধ্য বাংলাদেশ), নাভ্যাবাকাশিকা (মধ্য এবং দক্ষিণ বাংলাদেশ), রক্ষণাবতী (উত্তর বঙ্গ ও বিহার) এবং সুমাত্রা (পূর্ব বাংলাদেশ)।

পাল বংশ ও বাংলা: অষ্টম শতকের মাঝামাঝি পাল বংশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। গোপাল পাল বংশের প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাংলাদেশে এক নবযুগের সূচনা হয়। প্রায় চারি শত বছর যাবৎ এ রাজবংশ বাংলায় রাজত্ব করে। পাল শাসকরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। পাল শাসন আমলে বাংলায় তিনটি ভুক্তি (বিভাগের) তথ্য জানা যায়। পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি, বর্ধমান ভুক্তি এবং দণ্ডভুক্তি। এই ভুক্তি বা বিভাগ আবার বিভিন্ন শ্রেণি বা ক্ষুদ্র প্রশাসনিক খণ্ডে বিভক্ত ছিল। ভুক্তির প্রধানকে বা শাসন কর্তাকে উপরিক বলা হতো। তিনি রাজ প্রতিনিধি হিসাবেও কাজ করতেন। এ সময়ের রাষ্ট্রবিন্যাসে সুগঠিত বিচার বিভাগ, রাজস্ব বিভাগ, শান্তিরক্ষা বিভাগ ও সৈন্যবিভাগ ছিল। ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় পাল শাসন আমলে বাংলার অনেকগুলো বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। যা পাল বংশের বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার, প্রসার ও শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে কাজ করত। এ সময়ে পাল বংশের শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় শিক্ষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নতি ও প্রসার ঘটে। বাংলা সাহিত্যের আদি রূপ চর্চাপদ এ শাসন আমলে সৃষ্ট।

সেন বংশ ও বাংলা (১০৯৭-১২২৫): বিজয়সেন এ রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। এ শাসন আমলের উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো পুরা বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকা এ শাসনে আসে। নবদ্বীপ ছিল সেন আমলে বাংলার রাজধানী। সেন শাসন আমলে বাংলায় তিনটি ভুক্তি-বিভাগের কথা জানা যায়। পৌণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি, বর্ধমান ভুক্তি এবং কঙ্কগ্রাম ভুক্তির খবর পাওয়া যায়। সেন রাজাদের আমলে পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি বিভাগের সীমা উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের প্রায় সমস্ত জনপদ এবং পূর্ববঙ্গে বৃহৎ একটি অংশ এই বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাল পর্বের বর্ধমান ভুক্তি-বিভাগ ভেঙে লক্ষণ সেনের সময় দুটি বিভাগ সৃস্টি হয়, উত্তরে কঙ্কগ্রাম ভুক্তি এবং দক্ষিণে বর্ধমান ভুক্তি। পাল শাসনের ন্যায় রাষ্ট্রখণ্ডের সব বিভাগ সেন আমলেও বিদ্যমান ছিল।

পরিশেষে, প্রাচীন বাংলার এ সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, সাহিত্য ও প্রশাসন ব্যবস্থা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধিকেই ইঙ্গিত করে।

লেখক: অতিরিক্ত ডিআইজি, কমান্ড্যান্ট, পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল (পিএসটিএস), বেতবুনিয়া, রাঙ্গামাটি

বিষয়:

কৃষিতে বিস্ময়কর সাফল্যের ধারাবাহিকতা দরকার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোতাহার হোসেন

সরকারের কৃষিবান্ধব নানামুখী কর্মসূচির কারণে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এই অসামান্য অবদানের পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী এবং সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত। একই সঙ্গে কৃষিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তগুলো যথাযথ বাস্তবায়নে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে তার মন্ত্রণালয়ের দপ্তরগুলো মাঠ পর্যায়ে কৃষিকাজে জড়িতদের নিরন্তর প্রয়োজনীয় পরামর্শ, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা দেয়ায় কৃষিতে এই অসামান্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে কৃষি উপকরণ, কৃষিতে আধুনিক কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার, আর্থিক প্রণোদনা, বীজ, সার, কীটনাশক প্রদান, সুবিধাবঞ্চিত বর্গাচাষিদের দোরগোড়ায় সময়মতো স্বল্পসুদে জামানতবিহীন কৃষিঋণ কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের রূপান্তরের কৃষিতে অসামান্য অর্জন বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে বিদ্যমান খাদ্য সংকট মোকাবিলায়।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষিপর্যায়ে ঋণ সুবিধা পৌঁছে দিতে সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে ‘বর্গাচাষিদের জন্য কৃষিঋণ’ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ‘কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা’র আওতায় কৃষকদের ঋণ প্রদান করা হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৭.২৯ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৪ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭.৩৬ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২২ হাজার ৪০২ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন। একইভাবে করোনাকালে ৪% রেয়াতি সুদে ৯১৭৫.৯৫ কোটি টাকা কৃষি ঋণ দেওয়া হয় ৯ লাখ গ্রাহককে। তাছাড়া বন্যা, খরা, শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, উজানের ঢল, পাহাড়ি ঢল ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে গত ১৪ বছরে ১ হাজার ৯৩৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা প্রণোদনা দেয়া হয়। এর ফলে ২ কোটি ২৩ লাখ ২১ হাজার কৃষক উপকৃত হয়েছে। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ৪৭ কোটি ৮১ লাখ টাকার প্রণোদনা ৬ লাখ ৪৩ হাজার কৃষককে প্রদান করা হয়। এতে উপকারভোগী কৃষকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি।

খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পরও উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে যেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার টন, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে ৪ কোটি ৭৭ লাখ ৬৮ হাজার টন হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে চাল ৩১৩.১৭ টন এবং ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৪০১.৭৬ টন। একই সময় গম, ভুট্টা, আলু, ডাল, তেলবীজ, সবজির উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ বেশি। বিগত ১৫ বছরে ভুট্টা উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে প্রায় ৯ গুণ, আলু ২ গুণ, ডাল ৪ গুণ, তেলবীজ ২.৫ গুণ ও সবজি ৮ গুণ। ফলে বাংলাদেশের কৃষির সাফল্য বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। দেশের ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি এবং দেশে-বিদেশে বিজ্ঞানীদের উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কারণে এ অর্জন সম্ভব হয়। এ ১৫ বছরে বৈরী পরিবেশে সহনশীল জাতসহ মোট ৬৯৯টি উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল উদ্ভাবন ও ৭০৮ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ সময় ধানের ৮০টি জাত উদ্ভাবন করা হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীরের নেতৃত্বে তার সংস্থার কৃষি বিজ্ঞানী ও গবেষকরা ৬১টি নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে। বিশেষ করে লবণাক্ত সহনীয় জাত ৯, জলমগ্নতা ও জলাবদ্ধতা এবং খরা সহনীয় ৩, জোয়ার-ভাটা সহনীয় ২টি, প্রিমিয়ার কোয়ালিটি ৭, জিঙ্ক সমৃদ্ধ ৭টি জাত রয়েছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) বিগত ১৫ বছরে ১৯টি ধানের জাতসহ বিভিন্ন ফসলের মোট ৮৬ জাত উদ্ভাবন করেছে। বিনা উদ্ভাবিত ধানের জাত হচ্ছে, স্বল্প জীবনকালীন ধান, লবণসহিষ্ণু বোরো ধানের ২টি, জলমগ্নতা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাতের বিনা ধান। এ ছাড়া বিনা গম-১টি, সরিষা, তিল, চিনাবাদাম ও সয়াবিন রয়েছে। মসুর, মুগ, ছোলা, মাষকলাই, খেসারি, টমেটোর বেশ কিছু জাত উদ্ভাবন করা হয়।

জেনম সিক্যুয়েন্সিং আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্বে সর্বপ্রথম তোষা পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন করেন দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা। পরবর্তী সময়ে পাটসহ পাঁচ শতাধিক উদ্ভিদের বিধ্বংসী রোগের জন্য দায়ী ছত্রাকের ও দেশি পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন হয়। ২০১৮ সালে ধইঞ্চার জীবন রহস্যের উন্মোচন করা হয়েছে। উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাত ও সংরক্ষণে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার কাজও চলছে। এর মধ্যে ৪ তলাবিশিষ্ট ১৪,০০০ বর্গফুট করে ৫ জেলায় ৫টি অফিস কাম ট্রেনিং অ্যান্ড প্রসেসিং সেন্টার স্থাপন করা হয়। গাবতলীতে ১টি সেন্ট্রাল মার্কেট, ২১টি পাইকারি বাজার, ৭২টি কৃষকের বাজার, ২৩টি অ্যাসেম্বল সেন্টার ও গৃহপর্যায়ে ৪০টি আলু সংরক্ষণাগার। এ ছাড়াও, শাক-সবজি ফলমূল গৃহ পর্যায়ে দীর্ঘদিন সতেজ রাখার নিমিত্ত সিলেট বিভাগের ৪টি জেলায় ৩০টি জিরো এনার্জি কুল চেম্বার নির্মাণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’। এ লক্ষ্যে ৪৩৮.৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০২৩-এর জুন পর্যন্ত সময়ে বাগানের সংখ্যা ২,৫২,০৯৬টি।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) কর্তৃক ২০০৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত ২০৯টি ফসলের উচ্চ ফলনশীল ও প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ও হাইব্রিডসহ ৩৪৭টি জাত এবং ৪০৩টি ফসল উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। দুর্যোগ, ঝুঁকি হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজন বা খাপ খাওয়ানোর নিমিত্ত আধুনিক লাগসই কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় ব্রিধান-৪৭, ব্রিধান-৫৩, ব্রিধান-৫৪, ব্রিধান-৬১, বিনা ধান-৮ ও বিনা ধান-১০ সম্প্রসারণ, বন্যাপ্রবণ এলাকায় ব্রিধান-৫১, ব্রিধান-৫২ এবং খরা এলাকায় বিনা ধান-৭ ও ব্রিধান-৩৩, ব্রিধান-৩৯, ব্রিধান-৫৬, ব্রিধান-৫৭, কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয়করণ ও সফলভাবে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। গমের তাপসহিষ্ণু জাত বারি গম-২৬, বারি গম-২৭, বারি গম-২৮, বারি গম-৩০ এবং লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাত বারি গম-২৫ সম্প্রসারণের ফলে গমের একর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।

কৃষিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণেও কৃষি সেবাকে সহজে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য সম্ভব হয়েছে। এ জন্য ‘কৃষি বাতায়ন’ তৈরি করা হয়েছে। দেশে মোট ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) স্থাপন করা হয়। যে কোনো ফোন থেকে কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ নম্বরে যোগাযোগ করে কৃষকরা কৃষিতথ্য সেবা গ্রহণ করে। এ ছাড়া, কৃষি কমিউনিটি রেডিও, কৃষক বন্ধু ফোন-৩৩৩১, অনলাইন সার সুপারিশ, ই-সেচ সেবা, রাইস নলেজ ব্যাংক, কৃষি প্রযুক্তি ভাণ্ডার, ই-বালাইনাশক প্রেসক্রিপশন, কৃষকের জানালা, কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা ইত্যাদির মাধ্যমে কৃষকদের দোরগোড়ায় কৃষিতথ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া, ফসল উৎপাদনের এলাকা উপযোগী জায়গা নির্বাচনপূর্বক শস্য আবাদের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কর্তৃক অনলাইন ও জিআইএসভিত্তিক ‘Crop Zoning Website’ এবং ‘খামারি’ মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩৫৫টি উপজেলায় মোট ৭৬টি ফসলের ক্রপ জোনিং কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে।

তাছাড়া রুপান্তরের কৃষিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সংক্রান্ত কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় কৃষিতে অসামান্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে অন্তর্ভুক্ত করে ডিপ্লোমা কৃষি শিক্ষার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বের সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষি খাত উন্নয়নে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ১৫ বছরে দেশের কৃষিতে অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। আবার করোনার অভিঘাত মোকাবিলায়ও কৃষি খাত অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখা জরুরি। একই সঙ্গে সরকারের ধারাবাহিকতা, শেখ হাসিনার সরকারের ভিশন ২০৪১, এসডিজি, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি-২০১৮, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়া উচিত। এসব করার মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব। একই সঙ্গে কৃষিতে অসামান্য অর্জনের নেপথ্যে সত্যিকারের বীর দেশের কৃষক, কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি গবেষকসহ সংশ্লিষ্টদের অবদানেরও যথাযথ মূল্যায়ন দরকার। দরকার কৃষি পণ্যের যথাযথ বাজারমূল্য নিশ্চিত করা।

লেখক: সাংবাদিক


নতুন শিক্ষাক্রম, পুরাতন অপপ্রচার 

আপডেটেড ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১০:৪০
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

যতবারই এ দেশে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ততবারই দেখা গেছে একশ্রেণির মানুষ হইহই, রইরই, গেল গেল সব গেল, শিক্ষা গেল, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ গেল- এমন সব কথা বলে রাস্তায় মিছিল, সভা-সমাবেশ, সেমিনার করে আসছে। চলতি বছরে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার আগে এবং পরেও চারদিকে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেওয়ার নানা উদ্যোগ দেখা গেছে। কোথাও অভিভাবকরা, কোথাও শিক্ষকরা, কোথাও বা বিশেষজ্ঞ নামেও নতুন শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা গেছে। নতুন এ শিক্ষাক্রম অনুযায়ী আগামী নতুন বছরে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধেও অভিভাবক, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন ও সমাবেশ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার, ধর্মীয় উন্মাদনা, মিথ্যাচার ইত্যাদি ছড়িয়ে দিয়ে অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক তথা গোটা জাতিকেই যেন জাগিয়ে তোলা হচ্ছে, বলার চেষ্টা হচ্ছে আপনারা কেন ঘুমিয়ে আছেন, প্রতিবাদ করুণ ইত্যাদি ইত্যাদি। সামনে নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও অনেকে শিক্ষাক্রমকে অপপ্রচারের শিখণ্ডী বানাতে মাঠে নেমে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন সব আজগুবি কথা প্রচার করা হচ্ছে যা উচ্চারণ করাও শোভনীয় নয়।

শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা হতেই পারে; কিন্তু সেটি পাঠ্য বিষয়ের বিভিন্ন সূচি ধরে ধরে গঠনমূলক পদ্ধতি অনুসরণ করেই সাধারণত করা হয়ে থাকে। সেসবের চেষ্টা দেখি না। যা কিছু বলা হয়, তা গড়ে হরিবোল বললেও যেন কম বলা হবে। এভাবে তো কোনো শিক্ষাক্রমকে মূল্যায়ন করা যায় না। শিক্ষাক্রম হচ্ছে শিক্ষার দর্শন, হৃদপিণ্ড যা একজন শিক্ষা বিশেষজ্ঞই বোঝেন। যেমন- একজন হার্ট স্পেশালিস্ট ডাক্তার মানুষের হৃদপিণ্ড সম্পর্কে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাশেষে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেন; কিন্তু আমাদের এখানে পাঠ্যবই নিয়ে রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য সাধনে অনেকেই মাঠে নেমে পড়েন। অনেকের গাইড বইয়ের ব্যবসা লাটে ওঠার আশঙ্কা থেকে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকদের মধ্যে ঘৃতাহুতি দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। আবার অনেক শিক্ষক নিজেদের লাভালাভ হিসাব করেও এর বিপক্ষে অবস্থান নেন। বর্তমান শিক্ষাক্রম নিয়ে কোনো কোনো শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ঢুকে পাঠদানের পরিবর্তে বই ছুড়ে মেরে শিক্ষামন্ত্রীকে গালাগাল করছেন এমন কথাও আমি শুনতে পেয়েছি। সবকিছু মিলিয়ে গোটা বিষয়টাই আমার কাছে খুব বেশি অবাক হওয়ার মতো নয়। কারণ ’৭২ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন থেকে হালের নতুন শিক্ষানীতি এবং শিক্ষাক্রম নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের নানা অবস্থান আমার দেখা বিষয়, বোঝারও বিষয়। স্পষ্টই বুঝতে পারি যে শিক্ষাক্রম নিয়ে যারা বিশেষজ্ঞ তাদের বক্তব্যে থাকে গঠনমূলক সমালোচনা। বাকি যারা উঠেপড়ে সমালোচনা করেন তাদের নানান জনের নানা উদ্দেশ্য, স্বার্থ, অজ্ঞতা এবং দায়িত্ব এড়িয়ে চলার প্রবণতা রয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটি কোনোকালেই জাতীয় শিক্ষানীতি এবং শিক্ষাক্রম দ্বারা গঠিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক নানা ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থাই নানা অব্যবস্থাপনায় আক্রান্ত থেকেছে চিরকালই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শুরুতেই প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন। শিক্ষাকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্বের মধ্যে নিয়ে আসেন। তার উদ্দেশ্য ছিল ’৮০ সালের মধ্যেই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এরপর দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে আসা। কিন্তু কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন দেওয়ার পরই নানা গোষ্ঠী নানা অপবাদে এমন একটি শিক্ষানীতিকে কলঙ্কিত করতে চেয়েছিল যারা এর ভেতরের দর্শনটি বুঝতে অক্ষম ছিল। তাদেরই উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত সফল হলো ’৭৫-এর পর। দেশে তখন থেকে ব্যাঙের ছাতার মতো বিভিন্ন ধারার ও নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে যার মতো করে গড়ে তোলা শুরু করেছে। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এমন হালচাল হলে সেই জাতি কোনোভাবেই শিক্ষার দর্শন দ্বারা গঠিত হতে পারে না। আমরাও সে কারণে হতে পারিনি। আমাদের মধ্যে এতসব বিভাজন সৃষ্টির মূলেই হচ্ছে ‘নামে শিক্ষাব্যবস্থা, বাস্তবে ব্যবসা-বাণিজ্য আর অদক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির অব্যবস্থা’। সেটিই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরের আসল রূপ। আমাদের কোনো স্তরেই শিক্ষাক্রম ঠিক নেই। যে যার মতো করে প্রতিষ্ঠান যেমন গড়ছে, বই-পুস্তক ঠাসা আর পরীক্ষার জাঁতাকলে শিক্ষার্থীদের পিষ্ট করার এক ভয়ংকর তথাকথিত শিক্ষাব্যবস্থায় জাতির কয়েকটি প্রজন্মও তেমনি কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সত্যিকার দক্ষ, জীবন, কর্ম, জ্ঞান ও সৃজনশীলতায় বেড়ে ওঠা শিক্ষিত মানব গড়ে তুলতে আমরা পেরেছি বলে দাবি করতে পারব না। কারণ শিক্ষার দর্শনই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। শিক্ষার দর্শন হচ্ছে কি পড়ব বা পড়াব, কেন পড়ব বা পড়াব, পড়ার অর্জনটা কী হবে বা হবে না- সেটি হাতেনাতে দেখতে পাওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু আমরা কি দাবি করতে পারব যে আমাদের এ ৫ দশকের শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা যুগোপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পেরেছি? যদি পারতাম তাহলে প্রতিবছর হাজার হাজার ধনী ঘরের শিক্ষার্থীরা শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে কেন? একবারও কি আমরা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি? আমাদের করণীয় কী সেগুলো সম্পর্কে কতজনই বা আমরা অবহিত? কিন্তু যখনই দেশে শিক্ষায় পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখনই বিরোধিতাটা প্রবলভাবেই আসে, বিরোধিতাটা যদি গঠনমূলক হতো তাহলে আপত্তির কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু গোটা বিরোধিতাটাই যখন ব্যঙ্গাত্মক, বিদ্রূপাত্মক এবং নানা ধরনের শ্লেষ, মনগড়া, ধর্মকে মিশিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে, তখন বুঝতেই হবে এত বছরের আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে যারা বের হয়ে এসেছেন তাদের বেশির ভাগেরই শিখনফল ব্যঙ্গবিদ্রূপ, তামাশা, অপরাজনীতি ও বিভ্রান্ত করতে যতটা ‘পারদর্শিতা’ অর্জন করেছে, নীতি-নৈতিকতা, যুক্তিবাদী জ্ঞানবিজ্ঞানে দক্ষ ও সৃজনশীল মানুষরূপে গড়ে উঠতে অক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। কারণ সেই শিক্ষাক্রমটাই এতদিনকার শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যুক্ত করা হয়নি। একটা উদাহরণ দিই। শ্রীলঙ্কা আমাদের চেয়ে ছোট দেশ হলেও নানাভাবে তারা শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে গেছে। দেশের প্রায় শতভাগ মানুষই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। সে কারণেই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে গেল বছর তাদের দেশে অর্থনৈতিক যে বিপর্যয় ঘটেছিল তাতে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলন করেছিল। এমনকি সরকারপ্রধানের প্রাসাদও দখল করেছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢুকে কেউ প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কিছুই ধ্বংস করেনি। এর মানে কী? আমরা কি এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেও কোনো ফল বের করতে পারব? এ ধরনের ঘটনা যদি বাংলাদেশে ঘটত তাহলে কি হতো? ভাঙচুর, লুটপাট, মারামারি, কাটাকাটি, কি না হতো? শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের মধ্যে এই পার্থক্যটি টানার কারণ হচ্ছে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ কিছু নীতি-নৈতিকতা, যুক্তি ও বিবেকবোধ দ্বারা পরিচালিত হওয়ার সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সেসবের চর্চা কোথায়? এখানেই বোঝা যায় শিক্ষাক্রমের পার্থক্যের মধ্যেই ভিন্ন জাতি গঠনের কারণ নিহিত থাকার।

বর্তমানে যেই শিক্ষাক্রম সরকার স্কুলপর্যায়ে প্রবর্তন করেছে সেটিকে এক কথায় জীবন, কর্ম ও জ্ঞানমুখী জনশক্তি তৈরি করার আধুনিক ব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন। আমাদের আগের সৃজনশীলব্যবস্থা কিছু কিছু সফলতা দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি। পরীক্ষা আর মুখস্থবিদ্যার পুরাতন পদ্ধতির মধ্যেই আমাদের শিক্ষার্থীরা আটকে ছিল। শিক্ষার্থীরা শেষ বিচারে পরীক্ষার্থীই থেকেছে। পরীক্ষার জন্য তাদের গাইডবই ক্রয় করতে আর টিউটরের কাছে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। তাতে শিক্ষার্থীদের ওপর মুখস্থবিদ্যার চাপ জগদ্দল পাথরের মতো চেপেছিল। গতানুগতিক শিক্ষায় বিশ্বাসী শিক্ষক ও অভিভাবকরা যুগযুগ ধরে এমনটি দেখে এসেছেন, শিখে এসেছেন। তারা জিপিএ-৫ পাওয়ায় সন্তানের ‘উজ্জ্বল’ ভবিষ্যৎ দেখেছেন। কিন্তু বাস্তবে কয়জন সেই ভবিষ্যতের মালিক হতে পেরেছেন ? আমাদের শিক্ষকদের অভিজ্ঞতাও ছিল গতানুগতিক। শ্রেণিপাঠ, মুখস্তবিদ্যা আদায় করা, পরীক্ষার মূল্যায়নও সেভাবে নির্ধারণ করা হতো। আর এর জন্য শিক্ষার্থীদের ওপর পাঠ্যবইয়ের চেয়ে গাইডবই, শ্রেণিপাঠের চেয়ে কোচিং সেন্টার বা শিক্ষকের বাড়ি বাড়ি কোচিং নেওয়ার দৌড়ে ব্যস্ত থাকতে হতো। এটি কোনো অবস্থাতেই শিক্ষার্থীর জ্ঞান, জীবন ও শিক্ষার মানসিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে না। এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা এখন পৃথিবীর বেশির ভাগ রাষ্ট্রেই অচল হয়ে গেছে। আমরা যুগযুগ ধরে সেটাকেই নানা নামে অব্যাহত রেখেছি। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। তাদের জ্ঞান ও কর্মদক্ষতা সেভাবে গড়ে উঠছে না। অথচ দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গড়ে উঠেছে। প্রতিবছরই পাবলিক পরীক্ষায় অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী নেই এমন খবরও প্রকাশিত হচ্ছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী নেই। শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, দক্ষতা এবং শিক্ষকতার পেশায় নিজেদের যুক্ত রাখার প্রবণতায় বিরাট ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এদের একটা বিরাট অংশই আধুনিক শিক্ষাক্রমের সঙ্গে পরিচিত নন। ফলে করোনাকালে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই শিক্ষাক্রম বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু করোনাকাল আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে আগের বোধ, বিশ্বাস আর অভ্যস্ততার মধ্যে গুটিয়ে থাকলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে টিকে থাকা যাবে না। পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতায় আসতে হবে।

নতুন শিক্ষাক্রম কেবলই প্রবর্তিত হয়েছে, হচ্ছে। এর পরিমার্জন, পরিবর্ধন এবং উন্নততর করার আবশ্যকতা থাকতেই পারে; কিন্তু এটিকে বাতিল করে আগের মুখস্থ বিদ্যা এবং গাইডবই, টিউশননির্ভর শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার যারা দাবি করেন তাদের উদ্দেশ্য শিক্ষা নয়, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করা হতে পারে। যে শিক্ষকরা সেখানে ফিরে যেতে চান, তারাও একই দোষে দোষী। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করা প্রতিটি শিক্ষকেরই দায়িত্ব। কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না যে আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরের অনেক শিক্ষকেরই পঠনপাঠনের নিয়মিত অভ্যাস নেই। তথ্যপ্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে নিজেকে আপডেট রাখা ও শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার দায়িত্ব নেওয়ার মানসিকতার অভাব রয়েছে। অথচ শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ এবং নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেই নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী হাতেকলমে শেখন, মূল্যায়ন এবং শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমেই যুগের সঙ্গে যেমন তাল মেলাতে পারেন, শিক্ষার্থীদেরও গড়ে তুলতে অবদান রাখতে পারেন। অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করা নয় বরং সন্তানদের প্রতি মনোযোগী হওয়া, আস্থা রাখা এবং তাদের জীবন, কর্ম ও জ্ঞান দক্ষতায় গড়ে তোলার শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রতি আস্থাশীল হতেই হবে। অপপ্রচার, গুজব, ব্যঙ্গবিদ্রূপ শিক্ষার সঙ্গে যায় না, জীবনের সঙ্গেও নয়। এটাই শিক্ষার দর্শন।

লেখক: ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক


কোনো শিশু অপরাধী হিসেবে জন্মায় না

আপডেটেড ৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১১:৪২
ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম 

খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিবো কীসে? কিংবা আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই, ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই। কখনো বা পার হয়ে কত নদী কত যে সাগর, এই পারে এলি তুই শিশু জাদুঘর। ছেলেবেলায় মায়েরা শিশুদের এ ধরনের অনেক ছড়া বলে ঘুম পাড়ায়। শিশুর ঘুম না আসা পর্যন্ত একটার পর একটা ছড়া বলতে থাকে। শিশুদের নিয়ে তাদের কত স্বপ্ন কত আশা। শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে। অন্যদিকে একটি শিশু পরিপূর্ণ জীবন, সুখ আর আনন্দের প্রত্যাশা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। কিন্তু বাস্তবে শিশুদের অনেকে পরিবার হারিয়ে অথবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে কিংবা বিরূপ পরিবেশের কারণে অপরাধী হিসেবে গড়ে ওঠে।

কোনো শিশু অপরাধী হিসেবে জন্মায় না। বরং সে নিষ্পাপ হিসেবে জন্মায়। পরিবেশ, পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিকতা, পিতা-মাতার আচরণ ইত্যাদি অনেক কারণে তার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দেখা দেয়। শিশুর অপরাধী হওয়ার মূল কারণ তার মধ্যেই নিহিত থাকে। অর্থাৎ অপরাধী হওয়ার প্রাথমিক কারণগুলো শৈশবে সৃষ্টি হয়। অজ্ঞানতার কারণে কিংবা সজ্ঞানে এ অপরাধপ্রবণতা তার মধ্যে বেড়ে চলে। একপর্যায়ে সে অপরাধী হয়ে ওঠে। শিশু অপরাধীরা সাধারণত প্রাথমিক অপরাধী। তবে এদের অনেকে অপরাধ জীবন বয়স্ককাল পর্যন্ত অব্যাহত রেখে প্রকৃত তথা শেষপর্যায়ের অপরাধী হয়। শিশুর চাহিদা পূরণ হলে সফল আর না হলে নিজেকে অসফল মনে করে। অসফলতা তাদের রাগান্বিত, ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত, বিরূপ ভাবাপন্ন ও অসন্তুষ্ট করে। ফলে তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। তিন বছর পর্যন্ত শিশুরা বেড়ে ওঠে। তখন তার মধ্যে ক্রমেই অপরাধপ্রবণতার আবির্ভাব ঘটে।

শিশুর অপরাধের ক্ষেত্রে ধার্য বয়সসীমা নির্ভর করে সে দেশের অপরাধ আইনের ওপর। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৮২ ধারানুযায়ী ৭ বছরের নিচে কোনো শিশুর কাজকে অপরাধমূলক বলে বিবেচনা করা যাবে না। দণ্ডবিধির ৮৩ ধারানুযায়ী ৭ বছরের ঊর্ধ্বে এবং ১২ বছরের নিচে যেকোনো শিশুর কাজকে অপরাধমূলক বলে বিবেচনা করা হবে না যদি সে বিশেষ কোনো সময় বা পরিস্থিতিতে তার কৃতকর্মের প্রকৃতি বা ফলাফল সম্পর্কে বোঝা বা বিচার করার ক্ষমতা অর্জন করে। শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৬ বছরের নিচের বয়সের কিশোর-কিশোরীকে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বয়সি ছেলে বা মেয়ে কর্তৃক সংঘটিত আইন বিরুদ্ধ কাজ শিশু অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এদের বিচার একমাত্র কিশোর আদালতে হবে এবং এরা শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনের সুযোগ পাবে।

শিশুদের চরিত্র গঠনে পিতা-মাতার দায়িত্ব সর্বাধিক। তাদের স্নেহের অভাব শিশু অপরাধী সৃষ্টির অন্যতম কারণ। যে পরিবার অসচ্ছল এবং শান্তি বিরাজ করে না সে পরিবারের শিশুরা সাধারণত অপরাধপ্রবণ হয়। পিতা-মাতার আচরণ যদি খারাপ এবং রূঢ় হয় কিংবা পিতা যদি মদ্যপ হয় কিংবা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে তবে তা সন্তানের মধ্যে প্রতিফলন ঘটতে পারে। এতে শিশুর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে যা ভবিষ্যতে তার সুষ্ঠু বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।

শিশু কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের খবর মাঝেমধ্যে পত্রিকায় আসে। এসব খবর পড়ে আমাদের পিতৃ-মাতৃসুলভ মন হতাশ হয়ে যায়। একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে দীর্ঘ চাকরিজীবনে লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে দেখেছি যে বিভিন্ন সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, পারিপার্শ্বিক এবং পারিবারিক কারণে শিশুরা অপরাধ করে থাকে। আর্থিক অসঙ্গতি এবং দৈন্যতাও শিশু অপরাধী হওয়ার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। খারাপ পরিবেশ এবং দরিদ্রতা শিশু অপরাধী সৃষ্টির অন্যতম কারণ। ফলে তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। কোনো কোনো অপরাধ বিজ্ঞানীর মতে, পাঁচ বছর পর্যন্ত অপরাধীরা শিশু অপরাধী। পাঁচ থেকে আঠারো বছর কিশোর অপরাধী এবং তদূর্ধ্ব অপরাধী বয়স্ক অপরাধী। শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে বয়স্ক অপরাধী হওয়া সম্ভব। কারণ তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। শিশুদের ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত সম্পর্কে কোনো জ্ঞানও থাকে না।

সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার স্নেহ ও তদারকির অভাব, অপূরণীয় আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-দারিদ্র্য, অবিচার, খারাপ ব্যবহার শিশুদের প্রথম জীবনে চরিত্র গঠনে প্রতিবন্ধক। যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মানসিক আঘাত পাওয়া শিশুদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। বয়স অনুযায়ী নির্মমতা, নৃশংসতা এবং দুর্যোগের প্রভাব তার ওপর ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পড়ে। ফলে এসব কারণেও শিশুরা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। পলাতক শিশুদের অপরাধী হতে দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের শাসন না করে স্কুল থেকে পালানোর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। বারবার ঘটলে বুঝতে হবে ওই বালক শিগগির শিশু অপরাধী হবে।

অনেক ক্ষেত্রে শুধু রোম্যান্স ও তামাশা উপভোগ করার জন্য শিশুরা অপরাধ করে থাকে। অপরাধ স্পৃহা দেখা দিলে সংশোধন হওয়া কঠিন। তাই পূর্ব থেকে সতর্ক হতে হবে। অনেক সময় নৈরাজ্য থেকে আক্রমণী স্বভাবের উদ্ভব হয় যা শিশু অপরাধীদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। মধ্যবিত্তরা সন্তানদের চরিত্র গঠনে যতটা যত্নশীল, নিম্নশ্রেণিরা ওই সম্পর্কে ততটা যত্নবান হয় না। নিগৃহ, অবজ্ঞা ও অবহেলা শিশু অপরাধী সৃষ্টির অন্যতম কারণ। শিশু অপরাধী সৃষ্টির জন্য অনেক সময় অভিভাবক ও মাতা-পিতাকে দায়ী করা হয়। তবে অধিকাংশ সময় শিশু বয়সে উপনীত হওয়ার পর তারা শিশু অপরাধী হয়। শিশু অপরাধী হওয়ার মূল কারণ তাদের মধ্যে নিহিত।

শিশুরা ছোটবেলায় যা দেখবে তাই শিখবে। সন্তান যদি পিতা-মাতাকে সবসময় খিটখিটে মেজাজে দেখে তাহলে বড় হলেও তার মধ্যেও এ আচরণ গড়ে উঠবে। সন্তানরা এ খিটখিটে মেজাজের জন্য অপরাধবোধে ভোগেন। শিশুকে বকাবকি, মারধর না করা এবং ভয়ভীতি না দেখানো। শিশুরা ছোটবেলায় যা দেখবে তাই শিখবে। সন্তান যদি পিতা-মাতাকে সব সময় খিটখিটে মেজাজে দেখে বড় হলে তার মধ্যেও এ ধরনের আচরণ গড়ে উঠবে। অবহেলিত উদ্বাস্তু সমাজ এবং ভাঙা সংসার শিশু অপরাধী সৃষ্টির সহায়ক। বিয়ে বিচ্ছেদ, মাতা-পিতার পৃথক অবস্থান, পরিত্যক্ত স্বামী-স্ত্রী, মাতা-পিতার পৃথক সংসার ও বসবাস শিশু অপরাধী সৃষ্টির অন্যতম কারণ। পিতা-মাতার বিয়ে পুনর্বিয়ে বেশির ভাগ শিশু পছন্দ করে না। ঘরভাঙা সংসারে শিশুদের সৎ থাকা কঠিন। শিশুরা সাধারণত অপরাধী পিতার অনুগামী হয়ে থাকে। অবৈধ সন্তানরা বা পিতৃনামহীন সন্তানরা প্রায় নিজেদের ঘৃণিত মনে করে অপরাধী হয়ে ওঠে। শিশুদের বিস্ময়, ক্রোধ, উত্তেজনা, আগ্রহ বা নির্লিপ্ততা, ভাবুকতা, স্পৃহা, লোভ ইত্যাদি লক্ষ্য রাখতে হবে। দারিদ্র্যের মতো প্রাচুর্যও ক্ষতিকর। প্রাচুর্য মানুষকে অলস ও অহংকারী করে। এ অবস্থায় তারা অপরাধমুখী হয়।

শিশু অপরাধীর বিচার শিশু আদালতে হবে এবং তারা শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনের সুযোগ পাবে। শিশু আইন অনুযায়ী দেশের অপরাধপ্রবণ ও উচ্ছৃঙ্খল শিশুদের দোষ-ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ দিলে তারা আগামী দিনে সম্ভাবনাময়, উৎপাদনশীল সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। সুনির্দিষ্ট অপরাধের যেকোনো মামলায় কোনো শিশু গ্রেপ্তর হওয়ার পর থেকে তার জন্য শিশু আইন ২০১৩ প্রযোজ্য হবে। শিশু আইনের ৪৪ ধারানুযায়ী কোনো শিশুকে গ্রেপ্তারের পর কোনো অবস্থাতে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি লাগানো যাবে না।

হাতকড়া নিয়ে পুলিশ প্রবিধানের ৩৩০-এ বলা হয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত এবং বিচারাধীন ব্যক্তিকে তাদের পলায়ন বন্ধ করার জন্য যা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি কড়াকড়ি করা উচিত নয়।

পুলিশ বিভাগে দীর্ঘ দিন চাকরি করার কারণে এবং সমাজবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে বাস্তব দেখেছি, একজন শিশু অপরাধী বয়স্ক অপরাধীর সাহচর্যে থাকার কারণে কিংবা মেলামেশার সুযোগে অথবা আটক থাকার ফলে সংশোধিত না হয়ে ক্রমেই অপরাধীতে পরিণত হয়েছে। আবার এটাও দেখেছি, অপরাধী পরিবার থেকে আসা শিশু অপরাধী ভালো এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছে। তাই সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত।

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে শিশু আইনের আলোকে শিশুবান্ধব পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এখন শিশুবান্ধব কর্মকর্তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। পুলিশের অধীন আটটি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার আছে। সেই ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারগুলোতে শিশুদের সাময়িক আশ্রয়ের ব্যবস্থা দেয়া এবং কাউন্সিলিং করা হয়। এ ছাড়া প্রতিটি জেলায় এবং পুলিশ সদর দপ্তরে আছে মনিটরিং সেল। সেখানে নারী ও শিশুসংক্রান্ত মামলাগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বসহকারে মনিটরিং করা হয়। শিশু প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭, ১৮, ২৭, ২৮ এবং ৩৪-এ সুনির্দিষ্টভাবে বিধান প্রবর্তিত রয়েছে।

সমাজে যাতে শিশু অপরাধীর সৃষ্টি না হয়, আসুন সে বিষয়ে সচেতন হয়ে জনমত ও জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলি। এ ব্যাপারে পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে সর্বস্তরের বিশেষ করে শিক্ষক, সমাজকর্মী, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতারা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে যাতে কোনো শিশু অপরাধী না হয়। কারণ আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার নৈতিক দায়িত্ব প্রত্যেকের ওপর বর্তায়।

লেখক: সাবেক পুলিশ ও র‍্যাব কর্মকর্তা

বিষয়:

নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

আপডেটেড ৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১১:৪০
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও মাঠের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভোট বর্জন করেছে। তবে বিএনপির অনেক নেতাসহ নিবন্ধিত প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দলের অংশগ্রহণ এবং বিপুল সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে রদবদল করে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে বারবার আহ্বান জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তবে তারা সে বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে ক্রমাগত জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি তথা হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির মতো একটি জনসমর্থন থাকা বড় দল নির্বাচন থেকে দূরে থেকে কীভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে টিকে থাকবে, সেটাও এখন অনেকের মনে প্রশ্ন তৈরি করেছে। এ পর্যন্ত যে অবস্থা, তাতে এটা স্পষ্ট যে বিএনপি পরাজয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। বিএনপি আগামী দিনের যেকোনো আন্দোলনের চিন্তাই তাদের জন্য বুমেরাং হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের সামনে অনেক কিছুই এখন পরিষ্কার। বিএনপি জোটের সামনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রই এখন অন্ধকার।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সর্বশেষ বলা হয়েছে, কোনো চাপ নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংহত থাকুক, বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিকশিত হোক। কারণ গণতন্ত্র হলো উন্নয়ন এবং উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। আর সে কারণেই তারা বাংলাদেশে একটি অর্থবহ ও অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়। আওয়ামী লীগ বরাবরই বলে আসছে বলছে, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এমনকি শর্ত প্রত্যাহার সাপেক্ষে বিএনপি সংলাপে এলে আওয়ামী লীগের সে বিষয়ে সম্মতি রয়েছে। উল্লেখ্য, দুটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান এবং দূরত্ব কমিয়ে আনার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো কাজ করছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো উদ্যোগ নেবে না এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকাও গ্রহণ করবে না। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের সংলাপ এবং সমঝোতাকে সমর্থন করে।

বর্তমান যে অবস্থা তাতে পরিষ্কার বিএনপি ছাড়াই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো- তারা যেটা চেয়েছে এবং এখনো চাইছে, কিংবা ভবিষ্যতেও চাইবে মানে সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, সেটাও তো হলো না এবং হচ্ছে না। তাহলে এখন তারা কী করবে? কী হবে এখন তাদের রাজনৈতিক কৌশল? কোন পথে এগোবে তারা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে? মাঝখানে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তারা নির্বাচন হতে দেবে না বলে যে হুংকার দিয়েছিল সে কথা স্মরণে রেখেই বলা যায়, তারা তেমন কিছুই করতে পারবে না। এ ধরনের কর্মসূচি কিংবা লাগাতার অবরোধ-হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দিয়েও নির্বাচন ঠেকানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তাহলে পরবর্তী কর্মসূচি বা দাবি আদায়ের পন্থা কী হবে? বিষয়টি এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। তবে গভীরভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং আলাপ-আলোচনা করা হচ্ছে। তাতে এখন পর্যন্ত যে ফলাফলের কথা জানা যায়, সে অনুযায়ী নির্বাচন পর্যন্ত কঠোর কোনো কর্মসূচি দেয়া সম্ভব না হলে অবরোধ-হরতালের নামকাওয়াস্তে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া হবে। বিএনপির বিভিন্ন পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর, নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণের হার, কী পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তা দেখে নতুন কর্মসূচি দেয়া হবে। এমনকি নির্বাচন যেমনই হোক না কেন, নির্বাচনের পর সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন প্রভৃতি দাবিতে কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হবে বলে জানানো হয়েছে। এর মধ্যে যদি দেখা যায় যে নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ প্রতিনিধিত্বশীল নয়, কিংবা ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রেখে নির্বাচন করা যায়নি, সে ক্ষেত্রে আন্দোলনের কর্মসূচি আরও কঠোর এবং জোরদার করতে পারে বিএনপি। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় তাদের আন্দোলন জোরদার করবে?

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপিকে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। সেটা হলো দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। একটানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির অনেক নেতাই নির্বাচনে যেতে স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহী হয়েছে। ফলে অনেক নেতাই নির্বাচনে আসার প্রক্রিয়ায় শরিক হয়েছেন।

নির্বাচন ঘিরে এখন আওয়ামী লীগের কৌশল কী? বিএনপিসহ বিরোধী শক্তিকে সামাল দিতে আওয়ামী লীগকেও তো পাল্টা কৌশল অবলম্বন করেই চলেছে। এখন পর্যন্ত সেই কৌশলে আওয়ামী লীগ শুধু যে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনকারী শক্তিকে সামাল দিয়েছে তা নয়, নির্বাচন ঘিরে দৃষ্টিকটুভাবে তৎপর হয়ে ওঠা বিদেশি শক্তিকেও সফলভাবে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে। ধারণা করা যায়, নির্বাচন পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে আওয়ামী লীগ। তবে নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ তথা সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক প্রমাণ করার জন্য ভোটারের অংশগ্রহণ বাড়ানো। সে লক্ষ্যে নানামুখী কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, যত বেশিসংখ্যক প্রার্থীকে নির্বাচন করতে দেয়া যায় তার ব্যবস্থা করা।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের নির্বাচিত করে আনা; যা কিছুই বলা হোক না কেন, ওই নেতাদের নির্বাচনে জিতিয়ে আনার দায়িত্ব আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে; কিন্তু এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি দৃশ্যমান, তাতে ১৪-দলীয় জোটের নেতাদের জন্য ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের (নৌকা মার্কার) দুর্বল প্রার্থী দেওয়া হবে। তার ওপর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও আওয়ামী লীগের নেতাদের নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হবে। এসবই করা হবে নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ বাড়ানোর কৌশল হিসেবে; কিন্তু তাতে বাস্তবে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তাতে জোট নেতাদের জিতে আসা শুধু অনিশ্চিত নয়, অসম্ভবও হতে পারে। এমনকি জোট নেতাদের জন্য ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে যদি নৌকা মার্কার প্রার্থী না-ও দেওয়া হয়; কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতাদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে, সে ক্ষেত্রেও জোট নেতাদের বিজয় কঠিন হতে পারে। তেমন পরিস্থিতি আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করবে সন্দেহ নেই। কাজেই নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জগুলোও যথেষ্ট ক্রিটিক্যাল। এখন দেখা যাক, এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ কতটা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়।

বিএনপির ডাকা হরতাল-অবরোধ চলাকালীন বিএনপির মধ্যে থেকেই একটি বড় অংশই এখন মনে করছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে নির্বাচন বর্জন হবে এক ধরনের হঠকারিতা। কারণ সরকার নির্বাচনমুখী প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের যে সাংগঠনিক দৃঢ়তা রয়েছে তাতে বিএনপির পক্ষে নির্বাচন প্রতিরোধ করা সাংগঠনিকভাবে সম্ভব হবে না। কারণ বিএনপি সাংগঠনিকভাবে অনেকটা বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে এক সময় বিএনপির সহসভাপতির দায়িত্বে থাকা শমসের মবিন চৌধুরীর নেতৃত্বে তৃণমূল বিএনপির রাজনৈতিক পদক্ষেপ বিএনপির জন্য আরও একধাপ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির একের পর এক দুর্যোগে দলের ভিত হিসেবে পরীক্ষিত তৃণমূলের নেতাকর্মীরা যেন কোনো আস্থার জায়গা পাচ্ছে না। দলের ভেতর সিদ্ধান্তহীনতা থাকায় কোনো ইস্যুকেই কাজে লাগাতে পারেনি। আগামী দিনে বিএনপির সামনে কঠিন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জকে কত গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে তার ওপরেই নির্ভর করছে তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সম্ভাবনা।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ করতে চায় একটি গোষ্ঠী

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ফারাজী আজমল হোসেন

বিগত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের অর্জন কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে সবার প্রথমে যে কথাটি আসবে তা হলো ‘উন্নয়ন’। ১৫ বছরে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার যে কাজ করেছে, তার প্রশংসা বিশ্বজুড়ে। সরকারের এই অর্জনে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কালিমা লেপনের চেষ্টাও ছিল শুরু থেকেই। পদ্মা সেতু দুর্নীতি নিয়ে গুজব তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। কিন্তু সব সমালোচনা ছাপিয়ে বিশ্বের বুকে ও সাধারণ মানুষের মুখে একটি কথা বেশ স্পষ্ট, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন করে দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ’।

নিশ্চিতভাবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্যভাবে যে বিষয়টি আসছে তা হলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য। কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর (পূর্বে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) নেতৃত্বাধীন ভয়ংকর ইসলামী শক্তিগুলো দেশের উন্নয়ন চায় না। তারা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করতে পথে নেমেছে। গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে চলেছে, সেটা তাদের সহ্য হচ্ছে না।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতায় আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। ২০০৯ সাল থেকেই টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রেখেছে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময়টুকু বাদ দিলে রপ্তানি বৃদ্ধিতে নতুন প্রতিবছর রেকর্ড গড়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। বিশ্ব অর্থনীতিতেই একটি বিরল কীর্তি স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। কারণ এই সময়কালে চীন বা প্রতিবেশী ভারতের রপ্তানিও উত্থান-পতনের সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল স্থিতিশীল ও টেকসই উন্নয়নের পথে।

বিএনপি-জামায়াত দেশকে অশান্ত করতে চায়। ২০২১ সালে যখন বিশ্ব অর্থনীতি ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন পর্যায় অতিক্রম করছিল, ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে বিবেচিত সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে লুট, অগ্নিসংযোগ এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে এই জামায়াত-বিএনপি। এখনো সেই চেষ্টা চলমান। বাংলাদেশে জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। তাই বিএনপি ও জামায়াতের হাত ধরে এ বছর সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চতুর্থ মেয়াদে পুনরায় নির্বাচন করার আর বাকি মাত্র দুই মাস। তাই ঢাকাসহ গোটা বাংলাদেশকেই রণাঙ্গনের চেহারা দিতে চায় তারা। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে সহিংসতা চালিয়েছে জনবিচ্ছিন্ন বিএনপি। নিরাপত্তাকর্মীদের হত্যা, সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহনে বাধা দেওয়া ও ধ্বংস- সবই করেছে তারা। তাদের আক্রোশ থেকে বাদ যায়নি অ্যাম্বুলেন্স অথবা শিশুখাদ্য বহনকারী ভ্যান। বাংলাদেশে শেষবার এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল ২০১৩-১৪ সালে। ২০১৫ সালেও চলে কিছু ধ্বংসযজ্ঞ। তখনো ছিল জাতীয় সংসদের নির্বাচন। সেই বছর জামায়াতকে দেশের সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে নিষিদ্ধ করেছিল।

এটা নিয়েও আপত্তি রয়েছে পশ্চিমা কিছু দেশের। তারা জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে সরকারের কাছে। অর্থাৎ সরকারকে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের কথা বলছে তারা। কিন্তু এই একই দাবি কি তারা নাৎসি বাহিনীর জন্যও প্রদান করবে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে জামায়াতে ইসলামী। রাজনৈতিক দল হিসেবে সরাসরি তাদের নেতা-কর্মীরা খুন, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ও জাতিগত নিধন থেকে শুরু করে জাতিসংঘ সনদ অনুসারে যতগুলো যুদ্ধাপরাধ রয়েছে তার প্রত্যেকটি করেছে জামায়াত ইসলামী। নাৎসি বাহিনীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের মিত্র বাহিনী যেই শাস্তির বিধান করেছে, তা যদি জামায়াতে ইসলামীর ওপর প্রয়োগ করা হয়, তাহলে শুধু রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না সেই শাস্তি। তাদের পরবর্তী বংশধররাও রাজনীতি বা দেশের নীতি-নির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। তারা করতে পারবে না কোনো সরকারি চাকরি। আর সেনা বাহিনীতে চাকরি পাওয়া তো অনেক পরের বিষয়। কিন্তু এত কঠোর শাস্তি কি জামায়াতে ইসলামকে দিতে পেরেছি আমরা? জামায়াতে ইসলামীর যদি খুনি হিসেবে মানবাধিকার থাকে এবং রাজনৈতিক অধিকার থাকে, তাহলে যারা খুনের শিকার হয়েছে তাদের মানবাধিকার কোথায়? সেটা কারা নিশ্চিত করবে? এ বিষয়ে পশ্চিমারা চুপ কেন? ইহুদিদের হলোকাস্ট নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি করলে বা বিকৃত করে কোনো তথ্য উপস্থাপন করলে ইউরোপের ১৩টি দেশে সরাসরি জেল এবং শাস্তির বিধান রয়েছে। তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যারা বিকৃতি করবে, তাদের জন্য শাস্তির বিধান কেন থাকবে না। ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার এই দেশে শহীদের সংখ্যা নিয়ে যারা বিভ্রান্ত ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির আইন ও তার প্রয়োগ আমরা কবে করব? মানবাধিকার কি শুধু পশ্চিমারা যা চায় তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ?

গণতন্ত্রের নামে সহিংসতা অবলম্বন অবশ্যই জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের অংশ এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতোই অপরাধ। বিএনপি-জামায়াত জোট জাতির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিরুদ্ধে কাজ করেছে এবং করে যাচ্ছে। আর এটি করার জন্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের আশ্রয় নেওয়ার ইতিহাস তাদের বহুদিনের। বিএনপি গঠন করেছিলেন সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমান (১৯৭৭-১৯৮১)। এটি এখন তার বিধবা স্ত্রী (খালেদা জিয়া) এবং ছেলে (তারেক রহমান) দ্বারা পরিচালিত হয়। উভয়ই আদালত কর্তৃক দুর্নীতিসহ একাধিক অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) দ্বারা সমর্থিত। জিয়াউর রহমান ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বরকে দমন করতে মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে দ্রুত বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের একটি ধারা তৈরি করেছিলেন জিয়া। পরবর্তীতে সামরিক শাসক এরশাদও ক্ষমতায় টিকে থাকার উদ্দেশ্যে ইসলামপন্থিদের সহায়তা অব্যাহত রেখেছিলেন। বিএনপিও একই উদ্দেশ্যে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে রেখেছে এবং ব্যবহার করেছে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিল জামায়াত। জামায়াতের ৫-৬ শতাংশ ভোট না থাকলেও এ সময় থেকে তাদের ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে তোলে বিএনপি। জামায়াত বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া অনেক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের স্নায়ুকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। হুজি-বি, জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ইত্যাদি সংগঠনের সঙ্গে জামায়াত ও বিএনপির যোগাযোগ ছিল। জঙ্গিবাদীদের অবাধ কার্যকলাপের রাস্তা করে দেয় এই জোট।

হুজি-বি ১৯৮০-এর শেষের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা এবং ২০০১ সালের এপ্রিলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সময় বোমা হামলার জন্য জামায়াত তাদের ব্যবহার করে। জেএমবির জন্ম ১৯৯৮ সালে। তারা ২০০৫ সালের আগস্টে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। সরকারি কর্মকর্তা, বিচারক, এবং শিক্ষাবিদ, যারা গণতন্ত্র রক্ষা করছিলেন তারাই এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো দ্বারা আক্রান্ত হন। সমান্তরালভাবে জামায়াত ভারতেও সন্ত্রাস রপ্তানি করেছে। সরকারের অংশ হিসেবে, ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ সময়কালে, জামায়াত ভারতের উত্তর-পূর্বের জঙ্গিবাদীদের আশ্রয় দিয়ে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। আন্তর্জাতিক সতর্কতায় ২০০৪ সালে বাংলাদেশ থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে পাঠানোর সময় ১০ ট্রাক অস্ত্র বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
বাংলাদেশে গজিয়ে ওঠা জঙ্গিগোষ্ঠী নিয়ে যখন দেশের সব গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয় তখনো জামায়াত-বিএনপির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল- ‘বাংলা ভাই বলে কিছু নেই’। জঙ্গিদের অত্যাচারে দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ যখন ঘর বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে সে সময় সাংবাদিকরা এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন- ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুস’।

বাংলাদেশের দুইবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিএনপির খালেদা জিয়া জামায়াতকে তার সন্ত্রাসী ব্যবসা চালাতে সরাসরি সমর্থন দিয়েছিলেন এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকে হত্যা করেছিলেন। ২০০৪ সালে ভারতের একটি বড় সংস্থা বাংলাদেশে বহু বিলিয়ন ডলারের ইস্পাত কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিল। এখন পর্যন্ত এটি বাংলাদেশে দেওয়া সবচেয়ে বড় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই। খালেদা জিয়া প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করার আগে দুই বছর প্রস্তাব নিয়ে বসেছিলেন। অনানুষ্ঠানিক সূত্র বলছে, খালেদার ছেলে তারেক রহমান এই প্রকল্পের জন্য বিশাল অর্থ ঘুষ হিসাবে চেয়েছিলেন। সেই টাকা দিতে রাজি হয়নি ভারতীয় সংস্থাটি। তাই টালবাহানা করা হয়।

তারেক রহমানের দুর্নীতির প্রমাণ বাংলাদেশকে প্রদান করে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এবং সিঙ্গাপুরের পুলিশ। দেশের আদালতে এ বিষয়ে এফবিআইয়ের পক্ষ থেকে সাক্ষ্যও প্রদান করা হয়। দেশের সব খাত থেকে চাঁদাবাজির জন্য তারেক রহমান ‘মি. টেনপার্সেন্ট’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এ বিষয়ে গোপন তার বার্তা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টকে অবহিত করে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি। উইকিলকসের ফাঁস হওয়া তার বার্তা থেকে এই তথ্য মেলে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে দেশে দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ ও দুঃশাসনে ভীত হয়ে সেই তার বার্তায় তারেক রহমানকে বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য হুমকি স্বরূপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। টানা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।

দুর্নীতি, দুঃশাসন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসসহ সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা বিএনপি-জামায়াতের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে একটি বেহাল অর্থনীতি পেয়েছিলেন। কিন্তু গত ১৫ বছরে সেই বেহাল অর্থনীতিকে হাসিনা পাঁচ গুণ বড় করেছেন। দমন করেছেন দুর্নীতি, দুঃশাসন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে। বাংলাদেশ আজ ভারতের পর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আইটিসি ট্রেড ম্যাপ মিররের তথ্যানুসারে, দেশের রপ্তানি ২০০৯ সালে ১৭ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২ সালে ৬৭ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ রপ্তানি প্রায় চারগুণ বেড়েছে। ২০২২ সালের জুনে বিশ্ব বাণিজ্য মন্দার সম্মুখীন হয়েছিল। এই সময়কালে বাংলাদেশ রপ্তানিতে প্রায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। ২০০৮ সালে ১০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি থেকে, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মুখে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ২৭ বিলিয়ন ডলারে স্থির হওয়ার আগে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়নে পৌঁছেছিল।

এটা বাস্তব, গত এক দশকে দেশটি অবকাঠামোয় বড় ধরনের সংস্কার করেছে। এর সবচাইতে বড় উদাহরণ পদ্মা সেতু। রাস্তা এবং রেলপথ থেকে শুরু করে বেসামরিক বিমান চলাচল পর্যন্ত, অবকাঠামোর প্রতিটি অংশ নতুন করে ভবিষ্যতের জন্য বিশাল বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করেছে। বিএনপি-জামায়াত এই সাফল্যই নষ্ট করতে চায়। তারা সহিংসতা ছড়িয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের বিদেশি ক্রেতাদের যাতায়াত বন্ধ করতে চায়। ডলারের প্রবাহ স্থগিত করারও চেষ্টা করছে তারা। চাইছে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দেশবাসীর সঙ্গে বেইমানি করে ফেলার জঘন্য পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। এখন অর্থনীতির যাবতীয় ক্ষতি সাধনের চেষ্টা রুখে দেওয়াটাই বড় কাজ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে জয়ী করার পাশাপাশি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শত্রু জামায়াত ও বিএনপির যাবতীয় ষড়যন্ত্রকেও প্রতিহত করাও জরুরি।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট


বিজয়ের ৫৩-তে বাংলাদেশ : গৌরবের যা কিছু অর্জন

আপডেটেড ৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১৩:৩১
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সময়কালে বাংলাদেশের অফুরান অর্জন, যা ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সদর্পে এগিয়ে চলছে ইউএনডিপির টেকসই লক্ষ্যমাত্রায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ’৭৫-পরবর্তী সময়ে উল্টোপথে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবারও উন্নতির শিখরে উঠতে শুরু করে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সরকার গঠন করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায় থাকার ফলে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায়, দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। গত ১৩ বছরে দেশের প্রতিটি খাতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মর্যাদাশীল উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ অর্জন করেছে। এটা আমাদের জন্য এক বিশাল অর্জন। বহু কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রায় বিশ্বের বিস্ময়।

দেশের অর্থনীতিকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি বর্তমান সরকারের অদম্য সাফল্য। গত এক দশকে বাংলাদেশের স্থিতিশীল জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন, এমনকি মহামারির সময়ও এ দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারাবাহিকতাকে নির্দেশ করে। আমরা এখন উন্নয়ন মহাযজ্ঞের সুবিশাল যাত্রা অতিক্রমের মহাসন্ধিক্ষণে অবস্থান করছি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানান সূচকে তার বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তিন হাজার ডলার। এ দেশের গড় জিডিপি ৭% প্রায়। শিক্ষার হার ৭৫% এবং শিশু শিক্ষার হার প্রায় ৯৯%। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, যার হার প্রায় শতভাগ। ১২১টি মেগা প্রকল্প এখন চলমান। জিডিপির আকার ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। আগামী ২০২৫ সালে তার আকার হবে ৫০০ বিলিয়ন ডলার।

অনেক অবধারিত উন্নয়ন শোভাবর্ধন করছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য অনেক। লিঙ্গ সমতা, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুন্দ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পগুলো সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপের কারণে।

শত বাধা-প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে দেশ আজ অনন্য স্থানে অভিষিক্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের দিন বদল হয়েছে। তিনিই বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছিলেন ‘রূপকল্প ২০২১’। গত দশকে দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক কর্মপরিকল্পনা দুর্বার গতিতে শুরু হয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ, ঘরে-ঘরে বিদ্যুৎ এসবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ ও অবিচল নেতৃত্বে দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে উন্নয়ন কৌশল ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের ফলে। রূপকল্প ২০২১-এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয়েছে রূপকল্প-২০৪১। রূপকল্প-২০৪১-এর প্রধান অভীষ্ট হলো ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ, যেখানে আজকের মূল্যে মাথাপিছু আয় হবে ১২,৫০০ মার্কিন ডলারেরও বেশি এবং বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, যেখানে দারিদ্র্য হবে সূদুর অতীতের ঘটনা।

চলতি বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে সারা জাতি এক পরম আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লড়াকু জীবন একসূত্রে গাঁথা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। আমাদের দেশের রপ্তানি পণ্য বলতে ভরসা ছিল শুধু পাট, অন্যটি চামড়া। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। মোট রপ্তানিতে পাট ও পাটপণ্যের অবদান ছিল ৮৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ডলারের মোট রপ্তানির মধ্যে পোশাকশিল্প খাত থেকে আয় হয়েছে ৩ হাজার ১৪৬ কোটি ডলার। বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে তৃতীয় অবস্থানে। ব্যবসাবান্ধব বর্তমান সরকার গার্মেন্ট সেক্টরে অনেক প্রণোদনা দিয়ে আসছে। যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে এই শিল্প। আমাদের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক খাত হচ্ছে প্রবাসীদের অর্জিত আয়। প্রতিদিন, প্রতি মাসে, প্রতি বছরে প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। তাতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রবাসীদের আয়ের হিসাবে সপ্তম স্থানে অবস্থান করছে। বাংলাদেশে প্রবাসী আয় হচ্ছে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার।

১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯৪ ডলার। আর ২০২১-২২ সালে আমাদের মাথা পিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২৮২৪ মার্কিন ডলার। মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পরপর দুই বছর ধরে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্য বিমোচনে আমাদের অগ্রগতি হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮৯ শতাংশ। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে তা দাঁড়ায় ২০ শতাংশ।

৫২ বছরে এসে জাতীয় বাজেটের আকার অনেক বেড়েছে। ১৯৭২-৭৩ সালে বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ সালের জাতীয় বাজেট হচ্ছে ৬ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। বৃহৎ এই বাজেট দেশের উন্নয়নে কাজে আসবে। উন্নয়নের ধারায় বাজেটের এই বৃদ্ধি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আমাদের জিডিপি ২.৫ শতাংশ। করোনা মহামারিকালেও আমাদের ২০২০-২১ সালে জিডিপি অর্জিত হয়েছে ৫.৪৭ শতাংশ। আমাদের রাজস্ব আয় বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের ১৯৭২-৭৩ সালে সর্বমোট রাজস্ব আয় হয় ১৬৬ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে আমাদের রাজস্ব অর্জিত হয় ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিশাল অর্জন। রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে ১ হাজার ৫৬৬ গুণ।

গত ৫২ বছরে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে কৃষিতে বিপ্লব হয়েছে। খাদ্যশস্য ১৯৭২ সালে উৎপাদিত হয় ১ দশমিক ২০ কোটি টন। আর ২০২০ সালে উৎপাদিত হয় ৪ দশমিক ২৫ কোটি টন। সবজি উৎপাদনে আমরা পৃথিবীর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছি। সবজি উৎপাদনে পৃথিবীতে প্রথম চীন এবং দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত। বর্তমানে আমরা নিজেদের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে সবজি রপ্তানি করছি। পাট উৎপাদনে এখন আমরা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছি। দেশে এখন নানা রকম পাট পণ্য তৈরি হচ্ছে, রপ্তানিও হচ্ছে।

বর্তমান সরকারের সময়ে স্বাস্থ্য খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। করোনা মহামারির সময় স্বাস্থ্য খাতের চিত্র বিশ্বে ছিল অনুকরণীয়। শিশু সুরক্ষায় বাংলাদেশ এগিয়ে। বাংলাদেশের শিশুরা জন্ম নেয়ার পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ৯৭ শতাংশ বেঁচে থাকে। নবজাতক ও শিশুর মৃত্যুর হার কমেছে। বাংলাদেশের শিশু জন্ম নিতে প্রতি এক লাখ মায়ের মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে ১৭৩ জন। আমাদের গড় আয়ু বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু অনেক বেশি। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ২০২৩ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ দশমিক ৬ বছর। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু যথাক্রমে ৬৭ দশমিক ৭ বছর ও ৬৭ দশমিক ৩ বছর। বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতের সুফল মিলছে গড় আয়ুতে।

শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছে নানা পদক্ষেপ। শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম, নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত উপবৃত্তি ব্যবস্থা প্রশংসার দাবি রাখে। বর্তমান সরকার ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করেছে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা প্রায় শত ভাগে।

সারা দেশ এখন উন্নয়নের বহুমাত্রিক কর্মপ্রকল্পে এগিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু টানেল জাতির ইতিহাসের এক ভিন্নমাত্রার নতুন চমক। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়ে দেশের ৪৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫০০০। দেশের সবকটি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়।

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় অনুষ্ঠিত ২৬তম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৬) মূল অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সাহসী বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় দেশের এনডিসি আপডেট, ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশি বিনিয়োগে ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল এবং ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে নিজস্ব শক্তির ৪০ শতাংশ নেওয়াসহ তাঁর সরকার কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরেন। এ ছাড়াও তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ চালুকরণ প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন। বিশ্ব দরকারে শেখ হাসিনার গ্রহণযোগ্যতা দিনে দিনে বাড়ছে, তিনি বিশ্বনেত্রীতে পরিণত হচ্ছেন।

সামনে বৈশ্বিক যে সংকট আসছে, এ নিয়ে উন্নত দেশগুলোও উদ্বিগ্ন। আমরা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অনেকটাই স্পর্শ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তাঁর উদাত্ত আহ্বানে ন্যূনতম কোনো ভূমি অনাবাদি না রেখে প্রতি ইঞ্চি জমির উর্বরতার যথার্থ ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়া আগামী দিনের সম্ভাব্য খাদ্য সংকট উত্তরণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব বৈশ্বিক সংকট কাটিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, স্বাধীনতার পর গত ৫২ বছরে বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন, তার সিংহভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের হাত ধরেই হয়েছে। আমাদের গর্ব ও গৌরবের এই ধারা অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। তাঁরই সুযোগ্য নেতৃত্বে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যেই ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে পরিণত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্যোতির্ময় অভিযাত্রা যেন কালো অধ্যায়কে আলোক ঝরনাধারায় উদ্ভাসিত করে দিল। এক অদম্য গতিতে অশুভ সংকেতের বাধা-বিপত্তিকে দুমড়ে-মুচড়ে উপড়ে ফেলে যেন নিষ্কণ্টক পথে অপ্রতিহত গতিতে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে চলছে।

লেখক : উপর্চায (চলতি দায়িত্ব), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


শেখ ফজলুল হক মণির জন্মদিন

শেখ ফজলুল হক মণি
আপডেটেড ৪ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১৩:৫৭
ড. মুহম্মদ মনিরুল হক

বর্তমানে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা বাঙালি একটি সংগ্রামী ও সংগ্রামে ঐতিহ্যমণ্ডিত জাতি। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, গৌরব, সুখ, দুঃখ এবং বাংলার মাটি ও মানুষের সম্মিলিত রূপকে আত্মস্থ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি-বাংলাদেশের চূড়ান্ত মুক্তির যে পথ দিয়েছেন, সে পথের পূর্ণাঙ্গ তত্ত্বের নাম মুজিববাদ। সোনার বাংলা তার চূড়ান্ত রূপ। মুজিববাদের আলোকে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রভাবশালী ও নির্ভীক সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি। বঙ্গবন্ধুর পর তিনিই মুজিববাদের প্রধান ধারক-বাহক, তাত্ত্বিক ও প্রচারক। ১৯৩৯ সালে ৪ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় শেখ ফজলুল হক মণি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ নূরুল হক এবং মাতা শেখ আছিয়া বেগম। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ ইচ্ছায় রাজনীতিতে এসেছেন, বঙ্গবন্ধু মুজিব নিজে তাকে রাজনৈতিক দীক্ষা দিয়েছেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও তাকে স্নেহ করতেন। শেখ ফজলুল হক মণিও আজীবন রাজনৈতিক শিক্ষক মুজিবের দর্শন বাস্তবায়নে সচেষ্ট থেকেছেন।

১৩ মার্চ, ১৯৭৩ সালে একটি নিবন্ধে শেখ ফজলুল হক মণি বলেছেন, ‘এ সংগ্রাম অতি দুস্তর, মুজিববাদ কায়েমের সংগ্রাম অতি কঠোর সংগ্রাম।’ সেই কঠিন সংগ্রামকেই তিনি ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। এ জন্য স্বাধীনতার সময় ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষকতার প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেননি, স্বাধীনতার পর মন্ত্রিত্ব বা ক্ষমতার চেয়ারেও বসেননি। মুজিববাদ বাস্তবায়নের জন্য তিনি আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, মুজিববাদের তত্ত্বীয় রূপ বিশ্লেষণের জন্য বারবার কলম ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের তরুণ নেতা-কর্মীদের মধ্যে পড়াশোনা, দেশসেবার দীক্ষা ও সাংস্কৃতিক চেতনা ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন।

শেখ ফজলুল হক মণির মৌলিকত্ব হচ্ছে তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের পাশাপাশি স্বাধীন সমাজব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা মুজিববাদের অন্যতম দর্শন। তার মতে, ‘মুজিববাদের অন্যতম উৎস হচ্ছে সমাজবাদ।’ বঙ্গবন্ধুর ‘প্রস্তাবিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে গণতান্ত্রিক অধিকারকে বিলোপ করার প্রশ্ন ওঠেনি। তাকে সংরক্ষণ করার বিষয়টি অনুভূত হয়েছে সর্বতোভাবে। তাই মুজিবের সমাজবাদী বাংলাদেশ মূলত গণতান্ত্রিক। তার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সমাজবাদী। এটা ইতিহাসের এক নতুন ধারা। সামাজিক দর্শনের একটা নতুন সমন্বয়। এটা কোনোক্রমেই মার্কসবাদী নয়। কারণ মার্কস শুধু বস্তুবাদী, গণতান্ত্রিক নন। জাতীয়তাবাদী নন। এটা মাওবাদী নয়, কারণ মাও মূলত বস্তুবাদী ও জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক নন। এটা লিংকনবাদীও নয়। কারণ লিংকন জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক; সমাজবাদী নন। এটা নতুন এবং সে নতুনত্ব শেখ মুজিবের অবদান। তাই এটা মুজিববাদী।’ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মুজিববাদের চার মূলনীতি।

মুজিববাদের অন্যতম স্তম্ভ ছয় দফা। ১৯৭২ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘স্লোগান ছিল ছয় দফা, এখন চারটা স্তম্ভ।’ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছয় দফা কর্মসূচিকে জনপ্রিয় ও সফল করতে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন শেখ ফজলুল হক মণি। ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনসহ বাঙালির অধিকার বাস্তবায়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তিনি ’৭০-এর নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ওই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জয়লাভের অন্যতম কাণ্ডারিও বলা হয় শেখ মণিকে। মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে তিনি যে মুজিববাহিনী গঠন করেছিলেন, সে বাহিনীরও অন্যতম লক্ষ্য ছিল মুজিববাদের পথে স্বাধীনতা ও যুগপৎ সমাজ বিপ্লব বাস্তবায়ন করা।

মুজিববাদ একটি বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক মতবাদ। শেখ ফজলুল হক মণি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে একটি যুদ্ধ ও একটি সমাজ বিপ্লব যুগপৎ অনুষ্ঠিত হয়েছে।’ সোনার বাংলা কায়েম করার জন্য প্রয়োজন সেই বিপ্লবের সফলতা, যার একমাত্র পথ মুজিববাদ। মুজিববাদকে যথাযথ ব্যাখ্যার জন্য ‘মুজিববাদ দর্শন ও বাস্তবে’ শিরোনামে তিনি নিয়মিত কলাম লিখেছেন। পুঁজিবাদের অসম বিকাশ ও তার ক্ষতিকর দিক এবং ক্ষমতাচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্তদের ভুলত্রুটি চিহ্নিত করে তিনি মুজিববাদী মতবাদের আলোকে সমাধান ও মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। শেখ মণি অপ্রিয় হলেও সত্য ও স্পষ্ট কথা বলতেন। মিমিক্রি ভূমিকার সুবিধাবাদী ও মুখোশধারী রাজনীতিকদের তিনি চরমভাবে ঘৃণা করতেন। ৩০ নভেম্বর, ১৯৭৪ সালে এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘সাবোটাজকারীরা ক্ষমতার আশপাশে এমনই সুকৌশলে ও সুসজ্জিতভাবে জমজমাট বসিয়া রহিয়াছে যে, সাহায্য করিতে গেলেও দণ্ড ভোগ করিতে হইবে।’

সুবিধাবাদীরা অপব্যাখ্যা করলেও শেখ ফজলুল হক মণির সোনার বাংলা এবং মুজিববাদের পথ ধীরÑসংঘাতহীন। এ পথের বিপ্লব রক্তপাতহীন। এ বিপ্লবে সফলতার জন্য প্রয়োজন ধাপে ধাপে অগ্রসর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যাকে ‘সিস্টেম চেইঞ্জ’ বা ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ‘সোনার বাংলা’ ছিল তার লক্ষ্য এবং মুজিববাদ ছিল তার অন্তর্মূলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গৃহীত নতুন পদক্ষেপ বা দ্বিতীয় বিপ্লব বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই একদল খুনি, সামরিক-বেসামরিক ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে, স্ববান্ধব হত্যা করেছিল। ঘাতকরাও বুঝতে পেরেছিল, শেখ মণি জীবিত থাকলে মুজিবাদর্শবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্র বাংলার মাটিতে বাস্তবায়ন করতে পারবে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার কিছু আগে ধানমন্ডির বাসায় গিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী আরজু মণিকে হত্যা করে খুনি ঘাতকচক্র। ভাগ্যগুণে প্রাণে বেঁচে ছিলেন দুই শিশু পরশ ও তাপস। খুনি হায়েনা দল ও তাদের দোসরদের হত্যা, লুটতরাজ ও সন্ত্রাসের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে কখনো আত্মীয়ের বাসায়, কখনো পলাতক থেকে, কখনো অন্য রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়ে বড় হয়েছেন শেখ মণির দুই সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস। তারা মানুষ হয়েছেন, ক্ষমতা পেয়েও মা-বাবার হত্যাকারীদের বিচার আইনের মাধ্যমে চেয়েছেন।

স্বল্পজীবনে শেখ ফজলুল হক মণি আমাদের অনেক দিয়েছেন। ছয় দফা আন্দোলনে, অসহযোগিতার সংগ্রামে, ’৭০-এর নির্বাচনে, মুক্তিযুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধোত্তর রাজনীতি, শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণ সর্বোপরি ‘সোনার বাংলা’ গঠনে। তার জীবনকাহিনি এবং দেশপ্রেমের সাহসী রাজনীতি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বরূপ, মুজিববাদের পরিপূরক এবং ‘সোনার মানুষ’ তৈরির অনন্য পথ। তার প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গ্রন্থ শুধু মুজিববাদের ঐতিহাসিক সম্পদ নয়, সে সময়ের রাজনীতি বিশ্লেষণেরও প্রামাণ্য দলিল। তাকে নতুন প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরা হলে জাতি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আরও বেশি শানিত, মুজিববাদের পথিকরা হবে সমৃদ্ধ, ‘সোনার বাংলা’ ও ‘সোনার মানুষ’ তৈরির পথ হবে পরিশীলিত। শেখ ফজলুল হক মণির জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ

বিষয়:

banner close