রবিউল কমল
বলকান যুদ্ধের ভয়াবহতার ৩০ বছর পর ইউরোপের মাটিতে সংঘাত মোকাবিলায় পশ্চিম ইউরোপের অক্ষমতা যেন আবারও প্রকাশ পেয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন প্রমাণ করছে পরিস্থিতির আসলে কতটা পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া যখন বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে, তখন লুক্সেমবার্গের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক পুস আশাবাদী মন্তব্য করেছিলেন, ‘এটি ইউরোপের সময়, আমেরিকানদের নয়’।
তারপর অনেক সময় পার হয়েছে। কিন্তু ইউরোপ কেন একটি সামরিক শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে- তা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে অনুসন্ধান চলছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ মন্ত্রের সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ ও জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল উভয়েই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ইইউ আর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে পারছে না।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউরোপের সবচেয়ে বড় দেশটির বিরুদ্ধে আগ্রাসন শুরু করেছে। ফ্রান্স ও জার্মানি ইউক্রেনের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সাত মাস ধরে ওয়াশিংটনের ওপর সামরিকভাবে নির্ভর করে আসছে ও ব্রিটেনের ওপর কিছুটা হলেও নির্ভর করছে। কিয়েল ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার্ল্ড ইকোনমির মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ২৫ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং যুক্তরাজ্য ৪ বিলিয়ন ইউরোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিপরীতে জার্মানি ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ইউরোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যখন কিয়েভের জন্য ফ্রান্সের সামরিক সমর্থন মাত্র ২৩৩ মিলিয়ন ইউরো। ব্রিটেন ৫ হাজার ইউক্রেনীয় সেনাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং ফ্রান্স ১০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদন ১৪ ট্রিলিয়ন ইউরো এবং সম্মিলিত প্রতিরক্ষা বাজেট ২৩০ বিলিয়ন ইউরো। ফ্রান্স অবশ্য জোর দিয়ে বলেছে, তারা যুদ্ধে ‘সহযোগী’ হতে চায় না। অন্যদিকে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ এই সংঘাতে জড়ানোয় ঝুঁকির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এখন সবার নজর- তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে কি না এবং ইউরোপের অর্থনৈতিক কিংপিন জার্মানি ও ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নের একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত শক্তি লেপার্ড-২ ও লেক্লার্ক ট্যাংক পাঠাতে সম্মত হবে কি না। ইউক্রেন নিজেই এখন আরও অস্ত্রের জন্য একটি আবেদন করছে। কারণ, পুতিন এই যুদ্ধে আরও হাজার হাজার সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয়দের মধ্যে ব্যয়ের পার্থক্য ইইউ নেতাদের সামনে প্রশ্ন তোলে যে, যদি তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতেন তাহলে কিয়েভের পরিস্থিতি কি এমন হতো? এ মাসে এক বক্তৃতায় জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী ল্যামব্রেখট স্বীকার করেন, পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। তিনি বলেন, জার্মানি ও ইউরোপীয়রা একটি শান্তিশৃঙ্খলার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু তারা নিজেরাই তার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। এর একটি কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্র ক্রমবর্ধমানভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দিকে ‘তার মনোযোগ’ ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ওয়াশিংটন হয়তো আর অতীতের মতো ইউরোপের প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। উপসংহারটি পরিষ্কার- আমরা ইউরোপীয়রা এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে জার্মানদের নিজেদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের সক্ষমতা অর্জনে আরও বেশি কিছু করতে হবে। যেন অন্য শক্তিগুলো আক্রমণ করার কথা চিন্তাও না করে।
তবুও এই শব্দগুলো কোনো উদ্যোগ অনুসরণ করে বলা কি না তা অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তার সমালোচকরা অবশ্য পরে বলেন, সাবেক চ্যান্সেলর মর্কেল ২০১৭ সালে একই কথা বলেছিলেন। মিউনিখে একটি পার্টিতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ইউরোপীয়দের আমাদের ভাগ্য আমাদের নিজের হাতে তুলে নিতে হবে।’ অবশ্য পরে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি।
জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের ক্লডিয়া মেজর বলেন, ‘এটি এমন একটি ঘটনা যা দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষাকে জর্জরিত করেছে। ইতিমধ্যে আমাদের সামনে আবার নব্বইয়ের দশক ফিরে এসেছে। আমরা সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করব, এটি হতে পারে না।’ ক্লডিয়া মেজর ১৯৯৮ সালের ফ্রাঙ্কো-ব্রিটিশ সেন্ট মালো ঘোষণার কথা উল্লেখ করেছিলেন, যা বলকান যুদ্ধের ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া ছিল। যেখানে জোর দেয়া হয়েছিল যে, ইউরোপের অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য সামরিক বাহিনী দ্বারা সমর্থিত স্বায়ত্তশাসিত ব্যবস্থার থাকতে হবে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। কারণ, প্রধান ইউরোপীয় শক্তিগুলো সামরিকভাবে হুমকি বোধ করে না এবং কেবল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে।
ব্রাসেলস ইউরোপীয় দেশগুলোকে তাদের প্রতিরক্ষা প্রকল্পে যোগ দিতে নানাভাবে চেষ্টা করছে, কিন্তু অগ্রগতি খুবই কম। গত মে মাসে ইউরোপীয় কমিশন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সামরিক ব্যয় সমন্বয়ের জন্য একটি নতুন পরিকল্পনা প্রস্তাব করে। দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনবে নাকি ইউরোপীয় কিনবে তা আলোচনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক জোসেপ বোরেল জোর দিয়ে বলেন, ইউরোপ তার প্রয়োজনের প্রায় ৬০ শতাংশ ব্লক থেকে কিনে নেয়।
এই প্রস্তাবটি এখন কাউন্সিলের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, এটি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে যাওয়ার আগে নভেম্বরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের ডেস্কে পাঠানো হতে পারে। যাই হোক, কূটনীতিকরা বিশ্বাস করেন না, এ ধরনের একটি সময়রেখা সম্ভব। কারণ, আলোচনাটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণও খুবই কম। কমিশন দুই বছরের মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব করছে, যাতে তারা যৌথ অস্ত্র সংগ্রহে সহায়তা করতে পারে, যা ইউরোপের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খুবই সামান্য।
কূটনীতিকদের একজন বলেন, ‘অবশ্যই আমরা এখনো কোনো গেম চেঞ্জার নই। কমিশনের কাছ থেকে আরও উচ্চাভিলাষী প্রস্তাব আশা করা হচ্ছে।’ তবে এটি ঠিক কখন করা হবে তা স্পষ্ট নয়। আরেকজন সিনিয়র কূটনীতিক বলেন, ‘আমরা কেবল ইউরোপীয় শিল্প থেকে কেনার জন্য ইউরোপীয় পণ্য কিনতে পারি না।’ যাই হোক, মৌলিক বিষয় হলো সদস্য দেশগুলোকে প্রথমে নিশ্চিত হতে হবে তারা সর্বোত্তম প্রযুক্তিতে নির্মিত অত্যাধুনিক পণ্য কিনছে।
মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধের তীব্রতা শেষ পর্যন্ত ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে মিল আনতে পারে। গত মাসে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ ‘একটি শক্তিশালী, আরও সার্বভৌম ও ভূ-রাজনৈতিক ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। প্যারিসে শোলজের বিবৃতিটি ম্যাখোঁর ২০১৭ সালের ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের’ আহ্বানের বিলম্বিত উত্তর হিসেবে মনে করা হচ্ছে। ম্যাখোঁ ইউরোপের প্রতিরক্ষা নীতিকে পুনরায় সক্রিয় করার আশা প্রকাশ করেন এবং ‘একটি বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাজেট ও মতবাদ’ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন।
কিন্তু কূটনৈতিক সৌজন্যের বাইরে শোলজ বা ম্যাখোঁ কেউ-ই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারেননি। ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড বা নর্ডিক ও বাল্টিক দেশগুলোর ইউরোপীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা বরাবরই থেমে গেছে।
বেশ কয়েকজন ফরাসি কর্মকর্তা বলেছেন, সামরিক অনুদানের সংখ্যাগুলো অকার্যকর ছিল। কারণ, ফ্রান্স তার সব অনুদান প্রকাশ করেনি। ইনস্টিটিউট মন্টেইনের একজন পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিশেষজ্ঞ ফিলিপ মেজে-সেনসিয়ারের মতে, যদি তাই হয়, তবে এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত, যা ব্যাকফায়ার করেছে।
মেজে-সেনসিয়ার বলেন, ‘আমরা কমিউনিকেশন গেম না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইউরোপের প্রতিরক্ষার নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা বৈধ নই।’ তিনি মনে করেন, এই সংঘাতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে ম্যাখোঁর অতীতের প্রচেষ্টা, ফ্রান্সকে ইউক্রেনের ওপর ‘ভারসাম্য রক্ষাকারী’ হিসেবে প্রচার করা, তার দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্যগুলোর ওপর সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। ক্রেমলিনের সঙ্গে তার যোগাযোগের পথ খোলা রাখার সিদ্ধান্ত অনেক অংশে ইইউকে উপহাস করার শামিল।
মেজে-সেনসিয়ার বলেন, ইউক্রেন নিয়ে আমাদের অবস্থানের কারণে ফ্রান্স বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, নর্ডিক দেশ, বাল্টিক রাজ্য এবং পূর্ব ইউরোপের আমাদের বন্ধুরা হতাশা বোধ করেছে এবং এমনকি তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছে।
লেখক: সহসম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার
রহমত, মাগফেরাত আর নাজাতের পয়গাম নিয়ে হাজির হলো মাহে রমজানুল মুবারক। আত্মোপলব্ধি, আত্মসংযম, আত্মশোধন আর নিজেকে সব ধরনের কলুষতা থেকে মুক্ত রেখে মহাসত্যের পথে আত্মপ্রতিষ্ঠার এক সুবর্ণ সুযোগের মাস পবিত্র রমজান। লালসা, কামনা, বাসনা, অসহনশীলতা, অসহিষ্ণুতা আর অমানবিকতার কবর রচনার ভিত সৃষ্টি করে দেয় রমজান। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অভাব, মুখাপেক্ষিতা আর বঞ্চিতের কষ্ট অনুধাবনের প্রকৃষ্ট মৌসুমও এই রমজান। প্রতিবছরের মতো এবারও আমাদের অজস্র কালিমা থেকে মুক্তিদানের তরে সমুপস্থিত হয়েছে পবিত্র রমজান; তাই তাকে নিষ্ঠার সঙ্গে স্বাগত ও মোবারকবাদ জানাই।
মানবতার পরম সুহৃদ মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) স্বয়ং পবিত্র এ মাসের প্রাক্কালে এর বরকতপূর্ণ আগমনী বার্তা ঘোষণা করতেন; যা রমজানের তাৎপর্যকে অধিকতর মহিমাময় করতো। শাবান মাসের শেষ তারিখে তিনি মর্যাদাশীল ও বরকতমণ্ডিত এ মাসের খোশ আমদেদ জানান দিতেন; নাতিদীর্ঘ কথামালায় রমজানের কার্যাবলি ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করতেন। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে রমজান অনেক বড় এক নেয়ামত ও পুরস্কার বটে। তাই তিনি বলেন, লোকেরা যদি জানত যে, রমজান কী জিনিস, তাহলে সারা বছরই যেন এই রমজানের অনুশীলন থাকে সে জন্য আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করত। রমজানের সিয়াম সাধনা মানুষের অন্তঃকরণের আবর্জনা এবং যাবতীয় বিভ্রান্তি নিরসন করে দেয়।
পবিত্র কোরআনের ভাষ্যমতে, রমজান কোনো আকস্মিক বা নতুন ইবাদত-পদ্ধতির নাম নয়। ইতিহাসের নানা বাঁকে অপরাপর উম্মতের জন্যও এ রমজানের নির্দেশনা ছিল; যার মূল লক্ষ্য হলো তাকওয়া তথা খোদাভীতি অর্জন করা। মহান আল্লাহর যাবতীয় নির্দেশের ফরমাবরদারি এবং তাকে ভয় ও ভালোবাসার অনুভূতি অর্জিত হওয়াই রমজানের আসল উদ্দেশ্য। সর্বত্র পরাক্রমশালী মহান প্রভুর অস্তিত্ব ও তার ক্ষমতার বিশালত্বকে স্বীকৃতি দানের এক পরম যোগ্যতা নসিব হয় এই রমজানের মাধ্যমে। কেউ দেখে না কিন্তু আল্লাহ দেখেন, কেউ জানে না বা জানতে পারে না এমন সব বিষয় মহান আল্লাহ জানেন এবং সর্বদাই জানতে, সবকিছু বুঝতে, পর্যবেক্ষণ করতে সর্বোতভাবে তিনি সক্ষম- এই বোধ আমাদের মধ্যে প্রবলতর হয় রমজানের মধ্য দিয়ে।
সীমাহীন বরকত আর পুণ্য লাভের মহিমাময় মাস পবিত্র রমজানকে আমাদের উচিত সত্যিকার অর্থে কাজে লাগানো এবং এ মাসের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা। এ মাসে ইবাদতের ব্যাপারে আগ্রহ ও উদ্দীপনার সর্বোচ্চ ঘোষণাটি এসেছে মানবতার পরম বন্ধু বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে। তিনি বলেছেন, ‘মান সামা রামাদান ইমানান ওয়া ইহতিসাবান গুফিরা লাহু মা তাকাদ্দামা মিন যানবিহি’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও কর্তব্য-নিষ্ঠার সঙ্গে মাহে রমজানের সিয়াম পালন করবে তার জীবনের সমস্ত পাপকার্য ক্ষমার ঔদার্যে বিবেচনা করা হবে, মাফ করে দেয়া হবে। তাই আসুন, আমরা সবাই রমজানের পবিত্রতা বজায় রাখি এবং সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমাদের জীবনে এ মাসের সর্বোচ্চ কল্যাণ অর্জনে ব্রতী হই।
মাহে রমজানের প্রকৃত শিক্ষা আমাদের মধ্যে প্রতিফলিত হোক, পবিত্র রমজান আমাদের জন্য বরকতময় হোক এবং সিয়ামব্রত পালনের মধ্য দিয়ে আমরা যথোপযুক্ত গুণাবলি ধারণপূর্বক নিজেদের সর্বোন্নত মানবসত্তায় পরিণত করতে পারি- মহান আল্লাহ সকলকে সেই তাওফিক দান করুন (আমিন)।
লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইসলামী ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং খাতের অন্যতম একটি নাম। ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ প্রতিষ্ঠিত এ ব্যাংক ৪০ বছর অতিক্রম করছে। সুদের অভিশাপ থেকে মুক্তি, বণ্টনমূলক সুবিচার ও সামাজিক কল্যাণমুখী অর্থনীতি গড়া ছিল ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য। দেশীয় উদ্যোক্তা ও বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ ব্যাংক ইসলামি শরিয়াহর ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক একের পর এক নতুন সাফল্য নিয়ে আমানত, বিনিয়োগ, আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স আহরণ, শিল্পায়ন, এসএমই বিনিয়োগ, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, পল্লি উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়নসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সাফল্যের মডেলে পরিণত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের অংশীদার ইসলামী ব্যাংক রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অন্যতম বৃহৎ করদাতা প্রতিষ্ঠান।
দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট আমানত ও বিনিয়োগের প্রায় ১০ শতাংশ, বৈদেশিক বাণিজ্যের বড় অংশ এককভাবে এ ব্যাংক পরিচালনা করছে। বৈদেশিক রেমিট্যান্সের প্রায় ২২ শতাংশ এ ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে আসে। এ ব্যাংকের হাত ধরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, গড়ে উঠেছে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। দেশের ছয় হাজারের বেশি শিল্পকারখানা ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে, কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৮৫ লাখ মানুষের। বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম দুই স্তম্ভ তৈরি পোশাকশিল্প ও বৈদেশিক রেমিট্যান্সপ্রবাহ ইসলামী ব্যাংকের হাত ধরেই গড়ে উঠেছে।
বিগত ৪০ বছরে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। বৈধ পথে রেমিট্যান্স আহরণের জন্য ইসলামী ব্যাংক সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, সৌদি আরব, কাতার, জর্ডান ও সিঙ্গাপুরে ৩১ জন প্রতিনিধির মাধ্যমে কাজ করছে। বিশ্বের ৫৯৪টি ব্যাংকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। এ ছাড়া ১৫৫ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের রেমিট্যান্স অ্যারেঞ্জমেন্ট রয়েছে।
প্রবাসীদের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত। এসব দেশ থেকে বাংলাদেশে আগে টাকা পাঠানোর সহজ, নিরাপদ ও দ্রুত উপায় না পেয়ে প্রবাসীরা অবৈধ উপায় গ্রহণ করতেন। ইসলামী ব্যাংক নিয়মিত বিশেষ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মানুষকে বৈধ চ্যানেলে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত করে। যার সুফল ভোগ করছে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে আসছে নিরাপদে। বিনিয়োগ হচ্ছে জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ খাতে।
ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সব মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের অনন্য প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এই ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা ব্যবহারকারীর সংখ্যা দেশের ব্যাংকিং খাতের শীর্ষে। গ্রাহকদের অবিচল আস্থা, ভালোবাসা ও সহযোগিতার ফলেই ইসলামী ব্যাংক আজকের এই অবস্থানে।
ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ কার্যক্রমে অধিকসংখ্যক মানুষের কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। সবুজ ও পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ কার্যক্রমকে এ ব্যাংক অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো পণ্যে ইসলামী ব্যাংক বিনিয়োগ করে না। বিলাসদ্রব্যের চেয়ে এ ব্যাংক মৌলিক প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিনিয়োগ পরিচালনা করে। সর্বসাধারণের কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনা করেই ইসলামী ব্যাংক বিনিয়োগ করে থাকে।
ইসলামী ব্যাংক ১৯৯৫ সালে পল্লি উন্নয়ন প্রকল্প (আরডিএস) চালু করে। এ প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি, দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ, সঞ্চয় গঠন, বিভিন্ন আয়-উৎসারী কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ কার্যক্রম রয়েছে। শহর এলাকার বস্তিবাসীসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ২০১২ সাল থেকে ‘নগর দরিদ্র উন্নয়ন প্রকল্প’ কাজ করছে। ৩১ হাজার গ্রামে বিস্তৃত এ প্রকল্পের সদস্য ১৬ লাখ। যার ৯৪ শতাংশই নারী।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবা ইসলামী ব্যাংকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দেশের মোট স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্টের ২১ শতাংশ এখন ইসলামী ব্যাংকের। হজ সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট, ক্যাশ ওয়াক্ফ অ্যাকাউন্ট, কারখানা শ্রমিক হিসাবসহ নানা সঞ্চয় হিসাবের মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় এনেছে ইসলামী ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংক বর্তমানে ৩৯৪টি শাখা, ২২৯টি উপশাখা, ২ হাজার ৭০০টি এজেন্ট আউটলেট, ২ হাজার ৫০০টি এটিএম/সিআরএম বুথের মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবা প্রদান করছে।
ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম নিজস্ব সফটওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালিত। ব্যাংকের কোর ই-আইবিএস সফটওয়্যার এই ব্যাংকের তরুণ প্রকৌশলীদের দ্বারা নির্মিত। ইসলামী ব্যাংক তার গ্রাহকদের জন্য ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, বিকল্প ব্যাংকিং চ্যানেল, ই-কমার্স ইত্যাদি প্রযুক্তিনির্ভর সেবা বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন অ্যাপ ব্যবহার করে গ্রাহকরা সব ধরনের লেনদেন করতে পারেন সহজেই।
ইসলামী ব্যাংকিং মূলত একটি সামাজিক দায়বদ্ধ উদ্যোগ। গরিব, দুস্থ, অসহায় মানুষের কল্যাণে ১৯৮৪ সালে ‘সাদাকাহ ফান্ড’ গঠিত হয়। পরে ব্যাপকভিত্তিক কাজের জন্য ‘ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার অধীন ১৯টি হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নার্সিং ইনস্টিটিউটসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে অগণিত মানুষ। সব মানুষের কাছেই পৌঁছে যাচ্ছে ইসলামী ব্যাংকের কল্যাণমুখী সেবা।
ইসলামী ব্যাংকের সফলতার অন্যতম নিয়ামক হলো এ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা। ইসলামী ব্যাংকের দক্ষ পরিচালনা পরিষদ ও নিবেদিত জনশক্তির পাশাপাশি গ্রাহকদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও সমর্থন, সব রেগুলেটরি অথরিটির পরামর্শ ও সহায়তায় ইসলামী ব্যাংক সফলতার শীর্ষে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছে।
এ ব্যাংকের যাত্রার শুরুতে অনেক অনিশ্চয়তা, অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকালে একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, ‘ইসলামী ব্যাংক তাত্ত্বিক যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে, এখন পরিচালনগত যুদ্ধে জয়ী হতে হবে।’ বিগত ৪০ বছরের পথচলায় নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এ ব্যাংক সামনে এগিয়ে চলেছে। ইসলামী ব্যাংকিং এখন সফল বাস্তবতা। ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকরা এ ব্যাংককে নিজেদের সন্তানের মতো ভালোবাসেন। তারা ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অনেক গ্রাহকের কাছে ইসলামী ব্যাংকিং অক্সিজেনের প্রবাহের মতো অনুভূত হয়।
ইসলামী ব্যাংকের অনুসরণে মোট ১০টি পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংক পরিচালিত হচ্ছে। আর অনেকগুলো ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো ও শাখার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এটি ইসলামী ব্যাংকের সফলতারই অংশ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা।
ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে এখনো কিছু ভুল ধারণা ও বিরূপ প্রচার-প্রচারণা রয়েছে। সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক নিয়ে যেসব বিরূপ প্রচারণা চোখে পড়েছে, তার উত্তরে ইসলামী ব্যাংকের পক্ষ থেকে মিডিয়ায় বলা হয়েছে ব্যাংকের সব কার্যক্রম সঠিক নিয়মে চলছে।
ইসলামী ব্যাংকের আমানত-বিনিয়োগ-বৈদেশিক বাণিজ্য-রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক রেমিট্যান্স কার্যক্রমসহ সব কার্যক্রমে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। সূর্যের আলো, চাঁদের কিরণ, বাতাস ও পানি যেমন সব মানুষের জন্য, ইসলামী ব্যাংকের কল্যাণমুখী সেবাও ঠিক তেমনি সব মানুষের জন্য। তাই ইসলামী ব্যাংক তার অনবদ্য সেবার মাধ্যমে হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। সব মানুষের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এ ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংকের কল্যাণধর্মী কার্যক্রমের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে দেশের অর্থনীতি, এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরও মজবুত করতে ইসলামী ব্যাংকের এই অগ্রযাত্রাকে বেগবান করার দায়িত্ব এখন সরকারসহ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের। দুই কোটি গ্রাহকের আস্থার এই ব্যাংক তার গতিতে এগিয়ে যাবে- এটিই সবার প্রত্যাশা।
লেখক: ব্যাংকার
বাংলাদেশের অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষের মধ্যে বর্তমানে পূর্ব ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশের মতো রোমানিয়ায় যাওয়ার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে দুই শ্রেণির লোক দেখা যায়। একটি শ্রেণি হলো, তারা ইউরোপের স্বপ্ন-সাধ রোমানিয়া গমনের মাধ্যমে পূরণ করে থাকেন। আরেক শ্রেণির অভিবাসনপ্রত্যাশী হলো, যারা ফ্রান্স, পর্তুগাল, ইতালি, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে ইত্যাদি সেনজেনভুক্ত দেশে পাড়ি জমানোর প্রথম ধাপ হিসেবে রোমানিয়া যান। আলোচ্য শেষোক্ত শ্রেণির অভিবাসীরাই রোমানিয়ার শ্রমবাজারকে হুমকির মুখে ফেলেছেন।
বলকান যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রোমানিয়ায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকার সফল কূটনৈতিক তৎপরতার কল্যাণে ২০২০ সাল থেকে ফের কর্মী নেয়া শুরু করে দেশটি। তখন থেকে দেশটিতে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে কর্মীরা যাচ্ছেন। রোমানিয়া বাংলাদেশিদের জন্য ২০২০ সালে ৫৮০টি, ২০২১ সালে দুই হাজার ৮৬৯টি আর ২০২২ সালে ১২ হাজার ৯৬০টি ভিসা দিয়েছে। তবে সেখানে এখন অবস্থান করছেন মাত্র তিন হাজার ৯৬ জন বাংলাদেশি কর্মী। বেশির ভাগই রোমানিয়া থেকে তাদের কাজের মেয়াদ শেষ না করেই অন্য দেশে, বিশেষ করে ইউরোপের তৃতীয় কোনো দেশে প্রবেশ করছেন। কেউ কেউ রোমানিয়ায় গিয়ে ১০-২০ দিন কিংবা এক-দুই মাস পরেই ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানিতে পালাচ্ছেন।
সবাই যে নিরাপদে পালাতে সক্ষম হন তাও নয়। অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে দেশে ফেরত আসছেন শূন্য হাতে। পালিয়ে যাওয়া কর্মীরা ধরা পড়লে সাজা হিসেবে পাঁচ বছর পর্যন্ত কালো তালিকাভুক্ত হচ্ছে। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই ঢাকাকে তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছে বুখারেস্ট। সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসও এর সত্যতা স্বীকার করেছে, ঢাকার বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি এসেছে।
রোমানিয়ার ছয় সদস্যের একটি কনস্যুলার প্রতিনিধিদল গত ৫ মার্চ ঢাকায় এসেছে। তারা ৭ মার্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজও শুরু করেছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অবস্থান করবে প্রতিনিধিদলটি। এ সময় দেশটি ১৫ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশিকে ভিসা দেয়ার কথা রয়েছে। এর আগে গত বছর (২০২২) রোমানিয়া থেকে একটি কনস্যুলার প্রতিনিধিদল ঢাকায় তিন মাস অবস্থান করে প্রায় ৫ হাজার ৪০০ ভিসা দেয়। এর ধারাবাহিকতা হিসেবেই নয়া কনস্যুলার দলের ঢাকায় আগমন। প্রতিনিধিদলটি রোমানিয়া থেকে যারাই ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে আসবে তাদের ভিসা দেবে। বাংলাদেশে রোমানিয়ার স্থায়ী দূতাবাস নেই। রোমানিয়াগামী শ্রমিকদের ভিসা স্ট্যাম্পিংয়ের জন্য রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের আগে দিল্লিতে যেতে হতো।
সাবেক এ কমিউনিস্ট দেশটি চলতি ২০২৩ সালে ১ লাখ বিদেশি কর্মী নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মী নেবে বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু তাদের ভিসা ও বিশ্বাসের মর্যাদা দলিত-মথিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বড় অংশ একটা অসদুদ্দেশ্য নিয়েই রোমানিয়া গিয়ে নামকাওয়াস্তে কাজে যোগ দিয়ে বা কাজ না করেই সেখান থেকে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। এতে রোমানিয়া সরকার যেমন ভিসা দিয়েও কর্মী না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের ইমেজও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের কর্মীদের পক্ষ থেকে মোটা দাগে কয়েকটি ‘অভিযোগ’ তোলা হয়- রোমানিয়ায় বেতন কম, শ্রম আইনের লঙ্ঘন করে খারাপ ও বেশি কর্মঘণ্টা কাজ করানো, থাকার পরিবেশ আরামদায়ক না হওয়া, চুক্তি অনুযায়ী বেতন না পাওয়া ইত্যাদি। কর্মীদের এসব ‘অভিযোগ’ অমূলক না হলেও বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কোনো কর্মী সরকারি বা বেসরকারি যে মাধ্যমেই রোমানিয়া গমন করুন না কেন, তাকে সতর্কতার সঙ্গে ও সচেতনভাবে ওয়ার্ক পারমিট দেখে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাংলাদেশ ত্যাগ করা প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য।
ইউরোপের অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে রোমানিয়াকে তুলনা করলে চলবে না। যদিও অনেকে আবেগের বশবর্তী হয়ে রোমানিয়া সম্পর্কে না জেনেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আবার অনেকের সুপ্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে রোমানিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে স্বপ্নের কোনো দেশে চলে যাওয়ার। অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি, দালাল-সিন্ডিকেটও রোমানিয়া সম্পর্কে প্রলুব্ধমূলক কথাবার্তা বলে থাকে। এতে বিদেশ গমনেচ্ছু, অভিবাসনপ্রত্যাশীরা বিভ্রান্তি ও প্রতারণার শিকার হয়ে থাকে।
যেসব বাংলাদেশি কর্মী জীবন ও সম্মানের ঝুঁকি নিয়ে রোমানিয়া থেকে ইউরোপের অন্য দেশে চলে যান তাদের বেশির ভাগকেই কর্মহীন বা ফেরারি জীবনযাপন করতে হয়। করোনাভাইরাসের তাণ্ডব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কারণে চলমান বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে অনেক দেশই বিদেশি কর্মী নেয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের কর্মী প্রেরণের গন্তব্য দেশগুলোর অনেকেই মুখে না বললেও আরোপিত শর্তের বেড়াজালে কর্মী পাঠানো যাচ্ছে না। এমন সময়ে রোমানিয়ার শ্রমবাজার নতুন আশার আলো বৈকি!
পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ব্যবহার করে ইউরোপের ধনী দেশগুলোতে প্রবেশের প্রবণতা বাড়ছে, যেটা ‘নিয়মিত অভিবাসন’ নয়। এটা রীতিমতো ‘মানব পাচার’। এ ক্ষেত্রে পশ্চিম ইউরোপের চেয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকেই বেছে নেয়া হচ্ছে। রোমানিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে কাজের সুযোগ খুব একটা থাকে না। এমনকি এসব দেশে দীর্ঘমেয়াদে অর্থাৎ দুই, চার কিংবা পাঁচ বছর মেয়াদে ভিসাও দেয়া হয় না। রোমানিয়ায় প্রাথমিকভাবে সাধারণত তিন মাসের ওয়ার্ক পারমিট পাওয়া যায়। তারপর স্থায়ী ওয়ার্ক পারমিটের আবেদন করতে হয়।
ইউরোপ মহাদেশের দ্বাদশ বৃহত্তম রাষ্ট্র রোমানিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত হলেও এখনো সেনজেনভুক্ত হয়নি। অথচ একশ্রেণির এজেন্সি রোমানিয়াকে ‘খুব শিগগির সেনজেনভুক্ত হয়ে যাবে এবং তখন প্রসেসিং চার্জ বেড়ে যাবে’ বলে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। প্রকৃত সত্য হলো, সেনজেনভুক্ত অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও স্বার্থের কারণে রোমানিয়া আটকে আছে। ২০২৪ সালে রোমানিয়া সেনজেনভুক্ত হতে পারে বলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে আভাস দেয়া হলেও চূড়ান্ত অনুমোদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। ইইউয়ের অনুমোদনের পরও অন্য সেনজেনভুক্ত সদস্যের শর্ত ও স্বার্থের কারণে বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে পারে। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ক্রোয়েশিয়া। গত ডিসেম্বরে ইইউ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে অনুমোদন মিললেও কিছু সংস্কার সাপেক্ষে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ক্রোয়েশিয়া ২৭তম সেনজেনভুক্ত দেশ হিসেবে নবযাত্রা শুরু করতে পারে। সেনজেন চুক্তি অনুযায়ী, এসব দেশের আন্তসীমানা অকার্যকর হয়ে গিয়ে সেনজেনভুক্ত সব রাষ্ট্রের মানুষ অবাধে যাতায়াত করতে পারে।
ইউরোপ মহাদেশের অন্য দেশগুলো থেকে রোমানিয়া তুলনামূলকভাবে কম সচ্ছল অর্থনীতির দেশ। আর এ কারণে এ দেশের জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানও ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষের চেয়ে নিম্নমানের। তবে রোমানিয়ার মানুষেরা খুবই পরিশ্রমী এবং এ কারণেই দেশটি খুব দ্রুত উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
রোমানিয়ার মানুষ তাদের বন্ধুসুলভ আচরণ এবং অতিথি আপ্যায়নের জন্য বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে খুবই সমাদৃত। এসব বিবেচনায় রোমানিয়া বাংলাদেশের জন্য খুব ভালো শ্রমবাজার হতে পারে। বাংলাদেশি কর্মীরা রোমানিয়ায় গিয়ে চুক্তি অনুযায়ী কাজ করলে সে দেশে দেশের ইমেজ ভালো থাকবে। আর সেটা হলে, বাংলাদেশ থেকে আরও কর্মী রোমানিয়া যাওয়ার সুযোগ পাবেন।
দুই দেশের কর্তৃপক্ষের উচিত, নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ম মেনে হলেও বাংলাদেশে রিক্রুটিং এজেন্সির কথা এবং রোমানিয়ায় বাস্তবতায় কোনো মিল না থাকার বিষয়টি প্রয়োজনীয় তদন্ত সাপেক্ষে জরুরিভিত্তিতে ন্যায্য সমাধান করা। রিক্রুটিং লাইসেন্স ছাড়াই কিছু ব্যক্তি ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে লোক পাঠানোর চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে কর্মীদের প্রতারিত ও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এসব প্রতারক নামধারী ব্যবসায়ীদের দ্রুত চিহ্নিত করতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্সের অভিযান চালানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
দেশটিতে দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ করার পাশাপাশি অবশ্যই কর্মী পালানো বন্ধ করতে দূতাবাসের মাধ্যমে রোমানিয়া অভিবাসীদের তালিকা সংরক্ষণ ও মনিটরিংসহ সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকেও অভিবাসন খাতে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠিত করতে আন্তরিক হতে হবে। আর বিদেশগমনেচ্ছু ও অভিবাসীদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে রোমানিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে সে দেশটিতে অবস্থানকাল পর্যন্ত। প্রবাসীরা অতি লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিহার করে রোমানিয়াতেই থাকুন। এর সঙ্গে দেশের অর্থনীতি ও মানমর্যাদা দুটোই নিবিড়ভাবে জড়িত। কোনো কারণেই যেন রোমানিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ না হয়!
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) শুধু নয়, পৃথিবীর অনেক দৃশ্য এবং অনেক বস্তুই অহরহ আমাদের মন ভোলায়। তার মধ্যে বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে একটি বিজ্ঞাপন।
বিজ্ঞাপন প্রচারের সবচেয়ে প্রাচীন মাধ্যম বোধকরি সংবাদপত্র। তারপর এসেছে বেতার এবং সবশেষে টেলিভিশন। কিন্তু লক্ষ করা গেছে, প্রাচীন বা আদিযুগের সংবাদপত্রের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বিজ্ঞাপন। তাই সেকালে অনেক নামীদামি সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠার প্রায় পুরোটায় থাকত বিজ্ঞাপন। বাংলার প্রাচীন পত্রিকার ক্ষেত্রেও দেখা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত দৈনিক বাংলা সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর (১৮৪০ খ্রি.) প্রথম পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন শিরোনাম যুক্ত দুটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার প্রথম যুগের সাময়িকপত্র ‘রংপুর দিক প্রকাশ’ (১৮৬০ খ্রি.) পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রায় পুরোটায় ছিল বিজ্ঞাপন।
বিজ্ঞাপন যেহেতু আয়ের অন্যতম উৎস, সে কারণে সংবাদপত্রের প্রচলনের শুরু থেকেই বেতার বা টেলিভিশনেও বিজ্ঞাপনের অনুপ্রবেশ ঘটে। সে কালের নামীদামি কবি ও সাহিত্যিকরাও বিজ্ঞাপন প্রচারের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং একদা এক বিশিষ্ট কালো কালির প্রশংসা করে লিখেছিলেন, ‘এর কালিমা বিদেশি কালির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।’ রবীন্দ্রনাথের হস্তলিখিত প্রশংসাপত্রটি ব্লক করে বিজ্ঞাপন রূপে বহুল প্রচারিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ জীবিতকালে বিজ্ঞাপনে নানাভাবে হাজির হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর পরও তার ভাষ্য, বাণী, প্রতিকৃতি, হস্তাক্ষর, স্বাক্ষর ব্যবহার হয়েছে নানা পণ্যের বিজ্ঞাপনে। এসব বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দ বাজার, বসুমতী, শনিবারের চিঠি, বিশ্ব ভারতীসহ নানা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে। বলা হয়, তিনি বিজ্ঞাপনের মডেল হতে রাজি হয়েছিলেন, মূলত স্বদেশী আন্দোলনের যুগে স্বদেশী পণ্যবস্তু প্রসারের জন্য।
দ্য ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেটের ১৯৪১ সালের অমল হোম সম্পাদিত ‘Tegore memorial’ সংখ্যায় ডোয়ার্কিন কোম্পানি বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের ১২৯৫ বঙ্গাব্দের ৭ আশ্বিন সংখ্যার প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথ ঘোষকে একটি চিঠি ছাপে ‘মহাশয়েষু/আপনাদের ডোয়ার্কিন ফ্লুট পরীক্ষা করিয়া বিশেষ সন্তুষ লাভ করিয়াছি, ইহার ছাপার অতি সহজেই চালান যায়- ইহার সুর প্রবল ও সুমিষ্ট। ইহাতে অল্পের মধ্যে সকল প্রকার সুবিধাই আছে। দেশীয় সঙ্গীতের পক্ষে আপনাদের এই যন্ত্র যে বিশেষ উপযোগী তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি এই যন্ত্র ক্রয় করিতে ইচ্ছা করি। আমাকে ইহার মূল্য লিখিয়া পাঠাইবেন (শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)”। বিজ্ঞাপনটি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ৫৩ বছর পর চিঠিসহ প্রকাশিত হয়।
হেমেন্দ্রনাথ বসু বিখ্যাত কুন্তলীন কেশতেলে রবীন্দ্র প্রতিকৃতির নিচে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাক্ষরসহ লেখা থাকত “কুন্তলীন তৈল আমরা ২ মাস কাল পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। আমার কোনো আত্মীয়ের বহুদিন হইতে চুল উঠিয়া যাইতেছিলো ‘কুন্তলীন’ ব্যবহার করিয়া ১ মাসের মধ্যে তাহার নতুন কেশোদাম হইয়াছে। এই তৈল সুবাসিত এবং ব্যবহার করিলে ইহার গন্ধ ক্রমে দুর্গন্ধে পরিণত হয় না।’ স্বাক্ষর: শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আশ্বিন ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ।
আরও কত বিচিত্রভাবে যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনতে পারি। সেকালে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রে তিনি মডেল হয়েছেন। যেমন- দীপালি পত্রিকার প্রথম বর্ষ ২৪ সংখ্যায় (১৯ জুন ১৯৩৭ খ্রি.), বোর্নভিটা কোম্পানির পূর্ণ পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের ছবিসহ রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে ‘বোর্নভিটা সেবনে উপকার পাইয়াছি’ লেখা বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া কেশতেল, সুরভী ক্রিম, কাজল কালি, উন্মাদ রোগের ওষুধ, লিপটন চা, ফিলিপস রেডিও, মার্টিন বান, রেল দপ্তর প্রভৃতি বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথকে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে।
প্রথম দিকে চায়ের বিজ্ঞাপনে তিনি যে রচনাটি ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন:
‘হায় হায় হায় দিন চলে যায়।
চা- স্পৃহ চঞ্চল চাতল দল চল,
টগবগ উচ্ছল কাথলি তল-জল
এল চীন গগন হতে পূর্ব পবন স্রোতে
শ্যামল রস ধর পুঞ্জ॥
শ্রাবণ বাসরে রস ঝর’ ঝর’ ঝরে
পূর্ব পবন স্রোতে
ভূঞ্জ হে ভূঞ্জ দলবলহে।
চল’ চল’ হে ॥
কল’ কল’ হে।’
বিখ্যাত একজন কবি সেকালে চাতকতুল্য চা-রসিক সবাইকে চা-পানে আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞাপনে লিখেছিলেন, ‘চায়ের পেয়ালা যদি সাগর হতো, সাঁতার কাটিতাম আমি মনের মতো।’ বিদ্রোহী কবি নজরুলও সেকালে বিজ্ঞাপনমূলক কিছু কিছু কবিতা লিখেছিলেন। ‘ডোয়ার কিন অ্যান্ড সন্স’ কোম্পানির হারমোনিয়ামের বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছিলেন,
‘কি চান? ভাল হারমোনি?
কাজ কি গিয়ে-জার্মানি?
আসুন দেখুন এই খানে
সেই সুরে আর সেই গানে,
গান না কেন, দিব্যি তাই,
মিলবে আসুন এই হেথাই?
কিনবি কিন ‘ডোয়ার কিন’।
‘বাহাদুর কোম্পানি’-এর সেকালের এক বিজ্ঞাপনে নজরুল লিখেছিলেন-“মিষ্টি ‘বাহা বাহা’ সুর, চান তো কিনুন বাহাদুর, দু’দিন পরে বলবে না কেউ ‘দুর দুর’।” ১৮৯৬ সালে জনৈক হেমেন্দ্র মোহন বসু তার প্রস্তুত পণ্যদ্রব্য ‘কুন্তলীন কেশ তেল’-এর নামানুসারে এক সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করেন। এটি ছিল ছোটগল্প রচনার প্রতিযোগিত। বার্ষিক এই প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ তার ‘কর্মফল’ গল্পটি লিখে পাঠান। ছদ্মনামে পাঠানো শরৎচন্দ্রের প্রথম গল্প ‘মন্দির’ কুন্তলীন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল। হেমেন্দ্র মোহন বসু প্রতিবছর প্রতিযোগিতার জন্য প্রাপ্ত গল্পগুলো সংকলন কবে সেকালে ‘কুন্তলীন সাহিত্য পুরস্কার’ নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বিজ্ঞাপন রচনায়ও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তার রচিত এমনি একটি বিজ্ঞাপন:
‘কেশে মাখো কুন্তলীন
অঙ্গবাসে দেলখোস,
পানে খাও তাম্বলীন
ধন্য হোক এইচ বোস।’
পরবর্তীকালে অনেক পুরস্কারের সঙ্গে, সে সাহিত্য পুরস্কারই হোক বা অন্য কোনো বিষয়ই হোক, বিজ্ঞাপন পণ্যের নাম সংযুক্ত হতে দেখা যায়।
আমাদের দেশে সাময়িকপত্রের বিজ্ঞাপনে রমণীর চিত্র ব্যবহারের আদি ইতিহাস আমার জানা নেই। তবে ১৯৩৪ সালের ‘সচিত্র ভারত’ পত্রিকার একটি প্রসাধন দ্রব্যের বিজ্ঞাপনে অভিনেত্রী ‘সাধনা বসু’-এর প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়েছিল। বিজ্ঞাপনটি ছিল ‘ওয়াটিন ক্রিমের’ একটি মুখে মাখা ক্রিম। তখন মডেলিংয়ের বিশেষ প্রচলন না হওয়ায় বিজ্ঞাপনে সাধারণ অভিনেত্রীদেরই আলোকচিত্র শোভা পেত। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনেও দেখা গেল বিরাট পরিবর্তন। শুরু হলো রঙিন চিত্র প্রযুক্তির যুগ। তাই বিজ্ঞাপনের পণ্য ছাপিয়ে প্রাধান্য হয়ে উঠল রঙিন চিত্রের বাহার, আর মডেলিংয়ের বদৌলতে নানা রমণীর সুদৃশ্য চিত্রের জৌলুস। একালে আলোকচিত্রশিল্পী এবং চিত্রকর সম্মিলিতভাবে বিজ্ঞাপনকে সুশোভিত ও আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। আবার কোনো কোনো বিজ্ঞাপন আছে যা বাধ্যতামূলক। যেমন পাসপোর্ট বা পরীক্ষার সার্টিফিকেট হারিয়ে গেলে ডুপ্লিকেট ইস্যু করার জন্য খবরের কাগজে অবশ্যই বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে হয়।
বিজ্ঞাপনে বলতে হয় আমার অমুক নম্বর পাসপোর্ট অথবা অমুক পরীক্ষার সার্টিফিকেট হারিয়ে গেছে। বিজ্ঞাপনদাতা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাদের যে শুধু আকৃষ্ট করেন তা নয়, মাঝেমধ্যে তার পণ্যক্রয়ে প্রলুব্ধও করে থাকেন এবং ক্রেতাকে ‘ফাও’ কিছু দেয়ার রেওয়াজ প্রয়োগ করে থাকেন। বিজ্ঞাপনের শিল্পরসে অনেক সময় চমক থাকে। অনেক সময় সুকৌশলে সাসপেন্স সৃষ্টি করা হয়। আমাদের দেশে প্রচলিত বিজ্ঞাপনগুলো তিন শ্রেণির ভাগ করা যায়- (১) দেশীয় (২) সম্পূর্ণ বিদেশি (৩) বিদেশীয়, কিন্তু ভাষান্তরিত। কোনো কোনো বিজ্ঞাপন আমাদের ভাষা জ্ঞান বা বিবেক ও অনুভূতিকে বিপন্ন করে তোলে, বহুদিন আগে কোনো এক বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, এক কিশোরী বিশেষ পণ্যের কৌটাতে আঙ্গুল ডুবিয়ে তা মুখে দিয়ে চুষতে শুরু করল। আর একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, এক প্রণায়াকাঙ্ক্ষী তরুণী তার প্রিয়জনকে অভিমানের সুরে বলে- ‘আমারে পছন্দ না হলেও আমার চা-রে পছন্দ হবে ।’
তা ছাড়া বিজ্ঞাপনে আরেকটি বিষয় লক্ষ করা যায়, সেরা, শ্রেষ্ঠ এবং উৎকৃষ্ট- এ জাতীয় বিশেষণ যে হারে সব পণ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে কোন পণ্যটি সেরা ও কোনটি সেরা নয়, তা নির্ণয় করা দুরূহ কঠিন হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে আমরা অবলীলাক্রমে বলতে পারি, সব পণ্যই যদি সেরা হয় তাহলে যেকোনো একটি পণ্য কিনলেই তো আমাদের চলে। এ নিয়ে আর কোনো ভালো-মন্দ নেই।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
এক দিন আগে আমরা পালন করলাম মহান স্বাধীনতা দিবস। একাত্তরে পুরো সময় আমি ছিলাম ঢাকা শহরেই। দেখেছি রক্তগঙ্গা সাঁতরিয়ে ছিনিয়ে আনা বিজয়ের সেই দিন। সেই উত্তাল অধ্যায়ের অনেক স্মৃতি এখনো মনে হলে শিউরে উঠি। এর মধ্যে একটা খণ্ডিত দুঃসহ স্মৃতি হলো- একজন মুক্তিযোদ্ধার রক্তাক্ত লাল ঊরু এবং একটি বিচ্ছিন্ন পা (বাম)। আসলে স্মৃতি নয়; হৃদয়ের গভীর থেকে একজোড়া ভিন্ন চোখ দিয়ে দেখা স্মৃতির মতো উজ্জ্বল। চোখ বুজলে সেই না-দেখা দৃশ্য ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। এর প্রায় দুই দশক পর ১১ নম্বর সেক্টরসহ আরও নানা ঘটনা নিয়ে যে উপন্যাসটি লিখি তার নাম ‘যুদ্ধ’। আর সেই অসাধারণ মাকে নিয়ে লিখি ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। স্বাধীনতা দিবস আমার স্মৃতির ঊর্ধ্বে মুক্তিযুদ্ধের অম্লান বিজয়গাথা। সেদিকে তাকিয়ে দেখি- কথা কয় ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ও নেতৃত্বে স্বাধীনতার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে থাকে বীর বাঙালি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের সেই কালজয়ী ভাষণের পর থেকেই।
বঙ্গবন্ধু ফাঁসির মঞ্চের খুব কাছে থেকে ফিরে এসেছিলেন স্বাধীন দেশে। তার সংগ্রাম-চিন্তা-চেতনা-আদর্শ-মূল্যবোধ- মুক্তির সব স্বপ্ন ধারণ করেছিল স্বাধীন দেশে প্রণীত বাহাত্তরের সেই সংবিধান। কিন্তু স্বজাতদ্রোহী কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা-সদস্য ও রাজনীতিকের যোগসাজশে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে সপরিবারে তাকে হত্যা করে ঘাতকরা যে বিয়োগান্তক অধ্যায়ের সৃষ্টি করে; এর মধ্য দিয়ে আমাদের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। উল্টোপথে যাত্রা শুরু করে রক্তস্নাত বাংলাদেশ। আইন করে রুদ্ধ করে দেয়া হয় ঘাতকদের বিচার। উপরন্তু তাদের নানাভাবে করা হয় পুরস্কৃত। বিলম্বে হলেও এর অবসান ঘটানো গেছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার একে একে সব ক্ষয় ও ক্ষতের উপশমে পদক্ষেপ নেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারসহ জাতীয় চার নেতা হত্যা অর্থাৎ জেলহত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ প্রশস্ত হয়। এই বিচারে দণ্ডিত অনেকেরই চূড়ান্ত দণ্ড কার্যকর হলেও এখনো অনেকে বিদেশে পলাতক। বিজয়ের ৫২ বছরের দরজায় দাঁড়িয়ে আমাদের দাবি- ওদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করার সব ব্যবস্থার জন্য নেয়া হোক আরও জোরালো উদ্যোগ। ৫২ বছরের বাংলাদেশ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে- এমন প্রশ্ন সামনে আসে। এ কথা সত্য, আমাদের অর্জন ৫২ বছরে কম নয়। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-প্রত্যয়েরই তো প্রতিফলন ঘটেছিল বাহাত্তরের সংবিধানে। সংবিধানে হারিয়ে যাওয়া মূলনীতির অনেকটা ফিরে এলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রয়ে গেছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই জায়গা থেকে ফিরে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার প্রসার বা বিকাশসহ বেশ কিছুতে রয়েছে আমাদের বড় অর্জন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সূচকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা ভারত-পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে। তার পরও অনার্জিত রয়ে গেছে আরও অনেক কিছু, যা দেশ-জাতির জন্য অপরিহার্য। বৈষম্য, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনার বৈরী ছায়া এখনো দৃশ্যমান। প্রতিক্রিয়াশীল চক্র হীন তৎপরতায় লিপ্ত। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এখনো আক্রান্ত হচ্ছে নানাভাবে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপরেও কখনো কখনো নিপীড়ন-নির্যাতন কিংবা তাদের অধিকার-বঞ্চনার খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। রাজনীতির নামে অপরাজনীতির ছায়াও কম বিস্তৃত নয়। মোটা দাগে বলতে গেলে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ থেকে এখনো আমরা বেশ দূরে। অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, আরও বিকশিত গণতান্ত্রিক কিংবা মানবিক মূল্যবোধের বাংলাদেশ গড়তে হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধরে তার নির্দেশিত পথেই আমাদের হাঁটতে হবে।
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে লাহোরে এক রাজনৈতিক বৈঠকে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। লাহোর থেকে ঢাকায় ফিরে তিনি ওই ৬ দফার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ৬ দফা পর্যায়ক্রমে বাঙালির মুক্তির সনদ বলে আন্দোলন-সংগ্রামের পথে প্রতিষ্ঠিত হয়। ৬ দফা থেকে স্বাধীনতা আমাদের গৌরবের ইতিহাস। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও বঙ্গবন্ধুর সেই দূরদর্শী চিন্তা-চেতনার গুরুত্ব উপলব্ধি করি আমরা। আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সাম্যসহ মানবিক যা কিছু দরকার সবকিছু নিশ্চিত করতে হবে, যদি আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে চাই। সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিকতাহীনতা, মূল্যবোধের ধস ক্রমেই আমাদের সমাজকে যেভাবে বিষিয়ে তুলছে, এর নিরসন ঘটাতে না পারলে সভ্য, মানবিক সমাজ হিসেবে রক্তস্নাত এ দেশের স্বর্ণোজ্জ্বল পরিচিতিটাই ম্লান হয়ে যাবে। সুকুমারবৃত্তির চর্চা করার মধ্য দিয়ে নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে রাখার জোরদার প্রচেষ্টা খুব জরুরি।
এখন ইতিহসের প্রসঙ্গে আসা যাক, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসেন। বাড়িতে প্রথমে না গিয়ে তিনি সরাসরি জনগণের কাছে আসেন। এখানেই বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের উদাহরণ স্পষ্ট হয়। পরিবারের প্রিয়জনের কাছে যাওয়ার আগে গণমানুষের কাছে। তারাও তার প্রিয়জন। তার একটি অসাধারণ উক্তি ‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না।’ সেদিন তার ফেরার প্রতীক্ষায় ছিল দেশের লাখ লাখ মানুষ। তিনি বক্তৃতা মঞ্চে ওঠেন। শুরু হয় ভাষণ। একপর্যায়ে বলেন, ‘আপনারা আরও জানেন যে, আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল। আমি মুসলমান। আমি জানি, মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।’
নিজের জাতিসত্তা এবং গণমানুষের আইডেনটিটির প্রশ্নে এমনই ছিল তার রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনবোধ। বিশ্বের কোনো আধুনিক রাষ্ট্রই নিজের আপন পরিচয়ের বাইরে থাকতে পারে না। একমাত্র ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে নতজানু রাষ্ট্রই নিজ আত্মপরিচয়কে শৃঙ্খলিত করে রাখতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু তার জাতিসত্তার পরিচয়ে ছিলেন আপসহীন। পাকিস্তান সরকারের নাকের ডগায় তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান না বলে আমাদের ভূখণ্ডকে পূর্ববাংলা বলুন। পূর্ব পাকিস্তান বলতে হলে বাঙালির গণভোটের ব্যবস্থা করুন। তিনি সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সভায় পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন দেশটির নাম রাখা হলো বাংলাদেশ।
অন্যদিকে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় নারীদের মন্ত্রিত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে মুসলিম বিবাহ এবং বিবাহ রেজিস্ট্রিকরণ আইন প্রণীত হয়েছিল। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের সমতার কথা উল্লেখ আছে। আজকের বাংলাদেশের স্বপ্ন সহিংসতা নয়, নারী-পুরুষের সমতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য।
শোষণহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। দুঃখী মানুষদের ন্যায্য মজুরির চিন্তা করতেন তিনি। ১৯৭২ সালের ১ মে বঙ্গবন্ধু মে দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন- “আমার প্রিয় শ্রমজীবী ভাই ও বোনেরা, স্বাধীন বাংলার মুক্ত মাটিতে এবারই সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক মে দিবস পালিত হচ্ছে। ...আপনারা অতীতে বারবার আমার ডাকে সাড়া দিয়ে নির্ভীক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আমার বিশ্বাস, এবারও আপনারা আমার আহ্বানে মনে-প্রাণে এগিয়ে আসবেন। অতীতে আমরা একটি মর্মান্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিগড়ে বাধা পড়ে গিয়েছিলাম। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী জাতীয় সম্পদ ও শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদন নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। দেশ আজ স্বাধীন। সম্পদের মালিক জনগণ। তাই কোনো শ্রেণিবিশেষের ভোগ-লালসার জন্য এবং লোভ চরিতার্থ করার নিমিত্ত এই সম্পদকে অপচয় করতে দেয়া হবে না। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজতন্ত্র কায়েম করা। এই ব্যবস্থায় দেশের সমুদয় উৎপাদিত ও প্রাকৃতিক সম্পদ কৃষক-শ্রমিক ও সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে সুষমভাবে বণ্টন করা হবে। যদিও বাধা অনেক, সমস্যার শেষ নেই, তবুও লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে।”
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ থেকে বোঝা যায় তিনি শ্রেণিবৈষম্যের অবসান চেয়েছিলেন। পুঁজিবাদী অর্থনীতি শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ করে এবং এর ফলে সামাজিক আদর্শ গড়ে ওঠে না। শোষক-শোষিকের বঞ্চনায় বৈষম্যের সমাজ তৈরি হয়। তিনি বাংলাদেশের সংবিধানে চারটি মূলনীতির উল্লেখ রেখেছিলেন। সেগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তিনি কাল মার্ক্সের তাত্ত্বিক মূল্যায়ন থেকে সমাজতন্ত্রের উল্লেখ করেননি। পাকিস্তান আমলের তেইশ বছরের শোষণ-বঞ্চনা থেকে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন এটি ছিল সেই মূল্যায়নের বড় দিক। সেজন্য তিনি ১ মের ভাষণে আরও উল্লেখ করেন, ‘আমার গরিব শ্রমিক ভাই ও বোনেরা, আপনারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের উপযোগী সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করুন। আমাদেরকে পরিশ্রম করতে হবে, উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। দেশের সম্পদ বাড়িয়ে আমরা জীবনযাত্রার প্রকৃত মান উন্নয়ন করতে সফল হব। আজকের এই মে দিবসে আসুন আমরা এই শপথ গ্রহণ করি যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য আমরা অবিরাম সংগ্রাম করে যাব।’
তাহলে কেন স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমাদের রাজনীতি নিয়ে যেসব নেতিবাচক কথা শুনতে হয়, দেখতে হয়, তা তো কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। আমাদের সব অর্জনের পেছনে রয়েছে রাজনীতির ব্যাপক ভূমিকা। রাজনীতিই ছিল সব অর্জনের নিয়ামকশক্তি- এ সত্য অস্বীকারের কোনো পথ নেই। সেই রাজনীতি কেন, কাদের কারণে শ্রীহীন হলো, তাও সচেতন মানুষমাত্রেরই জানা। যেকোনো মূল্যে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন রোধে শুভবোধসম্পন্ন রাজনীতিকদের হতে হবে যূথবদ্ধ। গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশে ও হৃত ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যেতে হবে আরেকটি মাইলফলকের দিকে। আর এ কাজে প্রজন্মকে সঙ্গী করে মূল ভূমিকাটা নিতে হবে প্রগতিশীল রাজনীতিকদেরই। আমাদের যে অর্জনের বিসর্জন ঘটেছে, তা উদ্ধার করতেই হবে দেশ-জাতির সামগ্রিক স্বার্থ ও প্রয়োজনে। আমরা যেন আমাদের অঙ্গীকার ভুলে না যাই।
লেখক: কথাশিল্পী ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি
নিরাপদ যাত্রার আশায় রাস্তায় বেরিয়ে যাত্রীকে লাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে ঘরে। যাত্রী বহনকারী বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের বেসামাল চালকের গাড়ির মাত্রাতিরিক্ত গতির কারণে সড়ক দুর্ঘটনার রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না। এমনই এক দুর্ঘটনায় গত ১৯ মার্চ ভোরবেলা মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় ইমাদ পরিবহন মাত্রাতিরিক্ত গতির কারণে বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে ১৪ জন যাত্রী ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান। সেই সঙ্গে আহতদের হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান ৫ জন।
গবেষণা বলছে, যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে সড়কে দুর্ঘটনার হার ৬১ দশমিক ৮০ শতাংশ। ফুটপাতে, আইল্যান্ডে দাঁড়ালেও দ্রুতবেগে যমদূত এসে পিষে মেরে দেবে। যানবাহনে চড়লে কখন বেপরোয়া চালক লাগামহীন গতিতে গাড়ি চালিয়ে, বেআইনিভাবে ওভারটেক করে মুখোমুখি সংঘর্ষ বাধিয়ে প্রাণ কেড়ে নেবে। সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিজুড়ে সারা দেশে ৪৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৮৭ জন এবং আহতের সংখ্যা ৭১২ জন। গবেষণা বলছে, বিগত ৮ বছরে সড়কপথে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে ২০২২ সালে। সম্প্রতি নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) প্রতিবেদনে জানা যায়, বিগত বছরে ৫ হাজার ৭০টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৭৬০ জন। আহত হন ৭ হাজার ৩৩১ জন। ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৯৬৯ জন। দেখা যায়, সড়কে নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে সড়কে দুর্ঘটনা ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে এবং প্রাণহানি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনার ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে অথবা চাপা মেরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে, এমন একটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে।
গত আট বছরে নিবন্ধিত যানবাহন, বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা চার গুণ বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া সরকারি আদেশ অমান্য করে ইজিবাইক, মোটরসাইকেল-জাতীয় এবং মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় এক দিনে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে গত বছরের ২৯ জুলাই। সেদিন ২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন নিহত এবং ৮৩ জন আহত হয়েছেন। মূলত চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া যানবাহন চালানো সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। গণপরিবহনে বাড়তি যাত্রী সামাল দিতে গতিসীমার বাইরে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বেশি ট্রিপ দেয়ার অশুভ প্রতিযোগিতায় পরিবহন সংস্থাগুলো চালকদের অনেক বেশি কর্মঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে চালকের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ে, যা প্রকারান্তরে দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, ফিটনেসবিহীন যান, পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন, হেলপার দ্বারা যানবাহন চালানো, মহাসড়কে অটোরিকশা, নছিমন-করিমন ও মোটরসাইকেল অবাধে চলাচল এবং ব্যস্ত সড়কে ওভারটেকিং, ওভারলোডিং, সড়কে যানবাহনের গতিসীমা মনিটরিং না করা, এগুলো সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বড় ঝুঁকি।
গাড়িচালকরা তাদের খেয়ালখুশিমতো যেখানে-সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী নামান। কোনো স্টপেজের ধার ধারেন না তারা। যাত্রী না নামতেই গাড়ি স্টার্ট দেন, ছিটকে পড়ে যান যাত্রী। কখনো আহত হন, কখনোবা বাসের তলায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ দেন। ২০২২ সালে দুর্ঘটনায় পড়েছেন ৩ হাজার ৯০ জন চালক, ১ হাজার ৫০৩ জন পথচারী, ৭৪২ জন পরিবহন শ্রমিক, ৮৮৫ জন শিক্ষার্থী। এ ছাড়া রয়েছেন শিক্ষক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, নারী-শিশু, সাংবাদিক, চিকিৎসক এবং অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ।
২০১৮ সালে ঢাকার বিমানবন্দর সড়ক এলাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া খানমের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর প্রবল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাস হয়। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া তড়িঘড়ি করে মাত্র ৭ দিনের মাথায় মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত করা হয়। সড়ক-মহাসড়কে অব্যাহত দুর্ঘটনায় বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু রোধে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী ৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলো ছিল চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, দূরপাল্লার বাসযাত্রায় বিকল্প চালক রাখা ও পাঁচ ঘণ্টা পর পর চালক পরিবর্তন করা, চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করা, চালকদের জন্য মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণ এবং সিগন্যাল না মেনে যানবাহন চালানোর ওপর কড়াকড়ি আরোপ। কিন্তু সেই নির্দেশনা প্রতিপালিত হয়নি বলেই ১৭ জানুয়ারি শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মা সেতু টোল প্লাজা এলাকায় ট্রাক ও অ্যাম্বুলেন্সের সংঘর্ষে রোগী, তার স্বজন, স্বাস্থ্যকর্মীসহ অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও তার সহযোগীকে নির্মম এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ দিতে হলো।
অ্যাম্বুলেন্সচালক টানা ২৮ ঘণ্টা গাড়িতে থাকায় তিনি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন এবং তার ঘুমই আরও পাঁচ আরোহীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১৯টি সিদ্ধান্ত মোতাবেক লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি চলাচল বন্ধ করা এবং মহানগরীতে মালিক ও চালকদের মধ্যে চুক্তিভিত্তিক বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন না করে সড়কে শৃঙ্খলা এনে দুর্ঘটনা রোধে কমিটি প্রণীত সুপারিশযুক্ত প্রতিবেদনে আশু করণীয় ৫০টি, স্বল্পমেয়াদি ৩২টি এবং দীর্ঘমেয়াদি ২৯টি প্রস্তাব আনা হয়েছিল। আধুনিক, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব এবং প্রযুক্তিনির্ভর সড়ক পরিবহন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ অনুসমর্থনকারী হিসেবে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহত মানুষের সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত ও সুপারিশের বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। দেশের হাইওয়েগুলোতে রয়েছে বেশ কিছু বিপজ্জনক বাঁক। এসব স্থানে নিরাপদে গাড়ি চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় দৃশ্যমান দূরত্ব কম থাকে। তাই দ্রুতগতিসম্পন্ন গাড়ি একটি অপরটিকে ওভারটেক করতে গিয়ে বিপরীতমুখী গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ বাধিয়ে দেয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, ২০২২ সালে দুর্ঘটনার ২৭ দশমিক ৭২ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৫২ দশমিক ২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে এবং ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ ফিডার রোডে ঘটেছে। যানবাহনে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে দেয়ার বিধিনিষেধ মানেন না গাড়ির চালক। মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়ানো ১০ লাখ থ্রি-হুইলার, নছিমন, ভটভটি চলাচল বন্ধ করা যায়নি।
এসব অনিয়ম, অব্যবস্থা, আইন মেনে না চলার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। সড়কের ওপর হাটবাজার বসানো যাবে না। বাড়াতে হবে হাইওয়ে পুলিশের কর্মদক্ষতা ও নজরদারি। অপেশাদার চালক যেন কোনোভাবে গণপরিবহন চালাতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থের বিনিময়ে ভুয়া লাইসেন্স প্রদানকারী বিআরটিএর অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সারা দেশে ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন ট্রাক, বাস, কাভার্ড ভ্যান চলাচল বন্ধ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে আইনানুগ শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। গণপরিবহনব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোসহ পথচারীবান্ধব ফুটপাত, ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। সঠিক লাইনে প্রতিটি গাড়ি চলাচল, ফুটপাত দখল উচ্ছেদসহ সড়কের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা চাই।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী
কিছুদিন আগে আমি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম ব্যক্তিগত কাজে। একদিন সকালে আমার মালিকানাধীন একখণ্ড জমি দেখতে যাই। আমি জমি দেখতে থাকা অবস্থায় সেখানে একজন কৃষক এসে উপস্থিত। তিনি আমাকে সালাম দিয়ে বললেন, মামা আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত অবস্থায় তার দিকে তাকাতেই তিনি নিজে বললেন, আমি অনেক দিন আগে আপনাদের বাড়িতে ছিলাম। আমি আপনাদের বাড়িতে কাজ করতাম। তখন আমি কিছুটা চিনতে পারি। আমি জিজ্ঞাসা করি, এখন কী করছেন? তিনি বললেন, আমি জমিজমা দেখাশোনা করি। আমার ছেলে বিদেশে গিয়েছিল। সে ফিরে এসে বেশ কয়েক বিঘা জমি ক্রয় করেছে। আপনার পাশের জমিও আমার ছেলে ক্রয় করেছে। তার বর্ণনা শুনে বুঝতে পারলাম তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা এখন পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি এখন নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছেন।
তার এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাহিনি শুনে বেশ ভালো লাগল। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে একধরনের ইতিবাচক রূপান্তর ঘটে চলেছে অনেকটা নীরবেই। একসময় যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ছিলেন, এখন তাদের অনেকেই নিজ অবস্থান হারিয়ে দরিদ্র শ্রেণিতে পরিণত হচ্ছেন। আর যারা একসময় মধ্যবিত্ত অথবা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থায় প্রচণ্ড প্রতাপ নিয়ে অবস্থান করছিলেন, তাদের অনেকেই এখন সম্পদ হারিয়ে দরিদ্র শ্রেণিতে শামিল হচ্ছেন। এটা সম্ভব হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের কারণে।
যেসব বাংলাদেশি বিদেশে কর্মসংস্থান করছেন, তাদের বেশির ভাগই গ্রাম এলাকার বাসিন্দা। দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পেরে তাদের অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে খুব বেশি বেতন-ভাতা পান তা নয়। কিন্তু বিদেশে উপার্জিত অর্থ দেশে প্রেরিত হয়ে স্থানীয় মুদ্রায় কনভার্ট করার পর তা বিপুল পরিমাণ অর্থে পরিণত হয়। যেমন কোনো একজন বাংলাদেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান করে যদি এক মার্কিন ডলার আয় করেন, তাহলে সেই অর্থ দেশে প্রেরণের পর স্থানীয় মুদ্রায় তার পরিমাণ দাঁড়াবে ১০৫ মার্কিন ডলার। তেমিন সৌদি আরবে কোনো বাংলাদেশি এক রিয়াল আয় করলে তিনি বাংলাদেশি মুদ্রায় পাবেন প্রায় ২৯ টাকা। কাজেই যারা গ্রাম থেকে বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যান তারা উপার্জিত অর্থ দেশে প্রেরণের পর স্থানীয় বেনিফিশিয়ারিরা অনেক টাকা পেয়ে থাকেন। যে পরিবার থেকে কেউ একজন বিদেশে কর্মসংস্থান উপলক্ষে গমন করতে পারেন সেই পরিবারের আর্থিক চিত্র পাল্টে যায়। পরিবারটি রাতারাতি নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হতে পারে। বিদেশ থেকে উপার্জিত অর্থ দেশে প্রেরণের পর সেই অর্থ সাধারণত আয়বর্ধক কোনো কাজ, যেমন, ব্যবসায়-বাণিজ্য বা শিল্পে ব্যবহৃত হয় না। এই টাকা তারা মূলত জমিজমা ক্রয়, বাড়িঘর নির্মাণ, ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে ব্যবহার করে থাকেন।
গ্রামীণ সমাজে একসময় যারা উচ্চ মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে গ্রামীণ সমাজে অবস্থান করছিলেন, তাদের অনেকেরই অবস্থা এখন খুবই করুণ। গ্রামীণ সমাজে কর্মসংস্থানের উপযুক্ত পরিবেশ নেই। কাজ পাওয়া গেলেও তার মজুরির হার খুবই কম। মধ্যবিত্ত পরিবারের স্থান ক্রমশ দখল করে নিচ্ছে একসময়ের দরিদ্র শ্রেণির পরিবারগুলো। বিশেষ করে যেসব পরিবার থেকে একজন বা দুজন বিদেশে কর্মসংস্থান করেছেন। গ্রামীণ অর্থনীতি এবং সমাজব্যবস্থার এই রূপান্তর সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকেই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার দিকে দৃষ্টি দিলে একধরনের মিশ্র অবস্থা প্রত্যক্ষ করা যায়। গ্রামীণ অর্থব্যবস্থায় রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে পরিবর্তন ঘটছে তার পেছনে মূলত কাজ করেছে দরিদ্র শ্রেণির পরিবার থেকে বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রবণতা।
শহুরে সমাজব্যবস্থায়ও রূপান্তর প্রক্রিয়া ঘটছে। তবে সেটা কতটা নৈতিক পথে তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে। শহুরে সমাজব্যবস্থায় দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর একটি প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকেই আছেন যারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে নানা রকম অনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে নিজেদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন। তবে সাধারণভাবে বলা যেতে পারে, একসময় যারা বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষা করতেন সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবস্থা এখন খুবই শোচনীয়। এমনকি এসব মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই এখন বিলীন হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। সমাজে কার্যকর এবং শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতি খুবই জরুরি। মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিত্তবান এবং বিত্তহীন পরিবারের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে।
আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি তা হলে দেখব, মোগল আমলে বাংলাদেশ বা তৎকালীন ভারতে কার্যকর এবং বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতি লক্ষ করা যেত না। ইংরেজরা এ দেশের ক্ষমতা দখল করার পর তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে একটি কার্যকর মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটানোর চেষ্টা করে। এ জন্য তারা জমিদার শ্রেণিকে বেছে নেন। মোগল আমলে জমিদার শ্রেণি ছিলেন বংশানুক্রমিক রাজস্ব সংগ্রাহক। তারা সম্রাটের পক্ষ থেকে রাজস্ব আদায় করতেন। বিনিময়ে কিছু অর্থ তাদের দেয়া হতো। ইংরেজরা জমিদার শ্রেণিকে জমির মালিক বলে ঘোষণা করে। তারা জমিদার শ্রেণিকে জমির মালিকানা দিয়ে ইংরেজদের বশংবদ শ্রেণিতে পরিণত করে। জমিদার শ্রেণি ইংরেজদের এই দয়ার কথা কখনো ভুলেনি। ইংরেজরা বিদায় নেয়ার আগে পর্যন্ত জমিদার শ্রেণি তাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন। পরবর্তী সময়ে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করার ফলে জমিদারদের দাপট কমে যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম উপলক্ষ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন একটি সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। যেখানে মানুষ তার উপযুক্ত মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় উৎপাদিত সম্পদ ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টিত হবে। স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে বাংলাদেশে ধনবৈষম্য ছিল অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে। বর্তমানে তা অসহনীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিক্সের বৈশ্বিক অসমতা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সম্পদের মালিকানা নিয়ে যে অসমতা তা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
২০২১ সালে বাংলাদেশের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনী ব্যক্তির আয়ের পরিমাণ ছিল জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। গত ২০ বছরে দেশের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের আয় কিছুটা কমলেও তার পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়। অথচ একই সময়ে দেশের মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৭ গুণ। দেশের শীর্ষ ১ শতাংশ বিত্তবানের আয়ের পরিমাণ মোট জিডিপির ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। আর নিচের সারিতে বাস করা ৫০ শতাংশ মানুষের উপার্জিত আয়ের পরিমাণ মোট জিডিপির ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। শীর্ষ ১ শতাংশ মানুষের অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। আর নিচের দিকে বসবাসকারী ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদের পরিমাণ হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম উদ্দীষ্ট লক্ষ্য সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।
কোনো দুর্বিপাক ঘটলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন দরিদ্র মানুষগুলো। কারণ তাদের অবস্থা খুবই ভঙ্গুর। তাই সাধারণ কোনো আঘাতেই তাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী যে করোনা অতিমারির আঘাত প্রত্যক্ষ করা গেছে, তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিত্তহীন ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষগুলো। একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, করোনার কারণে বাংলাদেশের অন্তত ৩ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন। এরা দারিদ্র্যসীমার সামান্য ওপরে অবস্থান করছিলেন। এদের কোনোভাবেই দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলে আনা যাচ্ছে না।
করোনার প্রভাব থেকে অর্থনীতি যখন উত্তরণের পথে ছিল, তখন শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক উত্তরণ প্রক্রিয়া আবারও থমকে যায়। ইউনাইটেড ন্যাশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী ৭ কোটি ১০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। এদের বেশির ভাগই উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাসিন্দা। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার ধাক্কা এখনো বিশ্ব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করবে। এতে আরও বলা হয়, করোনা মহামারির আগে খাদ্যের তীব্র অনিরাপত্তার মধ্যে ছিলেন ১৩ কোটি মানুষ। পরে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ কোটি ৬০ লাখে। ইউক্রেন সংকটের কারণে তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তার মধ্যে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৩৪ কোটি ৫০ লাখে উন্নীত হয়েছে। আর ৪৫টি দেশের ৫ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে মাত্র এক কদম দূরে অবস্থান করছেন।
করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের মানুষও বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি শঙ্কার মধ্যে আছেন মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। টিসিবির ট্রাক সেলের পণ্য ক্রয় করার জন্য লাইন ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। যারা সৎভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উঠে আসছেন তাদের বিকশিত হওয়ার পাশাপাশি যেসব মধ্যবিত্ত পরিবার অস্তিত্বসংকটে রয়েছে, তাদের টিকে থাকার জন্য সহায়তা করা একান্ত জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে, সমাজে কার্যকর মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতি নিশ্চিত করা না গেলে সেই সমাজ টেকসই হতে পারে না। এ ব্যাপারে জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
ব্রিটিশ শাসন অবসানের দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পর জনগণ পেয়েছিল পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্র। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর শুরু হয় বাঙালিদের নতুন করে শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেঁধে রাখার ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানি হানাদারদের সেই শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি জাতি। স্বাধীনতা লাভের দৃঢ় প্রত্যয়ে উজ্জীবিত বাঙালির সামনে কোনো মারণাস্ত্রই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বাঙালি জাতিকে মুক্তির এই মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যান ইতিহাসের মহানায়ক, মহাবীর, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত দেশের মুক্তিকামী জনগণকে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। দেশের ৫৩তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস আজ ২৬ মার্চ।
স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর কলকাতার ইসলামীয়া কলেজে (বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন। পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব কোলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন, যার মাধ্যমে তিনি ওই প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন। ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নেই অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তিনি গ্রেপ্তার হন, তারপর ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন- কোথায় নেই বঙ্গবন্ধুর নাম। কারাগারে বন্দি বা বাইরে যেখানেই বঙ্গবন্ধু থেকেছেন সব সময় তিনি ছিলেন নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা ছিল ৬ দফাকেন্দ্রিক এবং নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু হয় ৭ জুন ৬ দফা দিবসেই। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ ৬ দফা কর্মসূচিকে তাদের প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ধাবিত হতে থাকে।
১৯৭১ সালের ৭ জানুয়ারি কানাডার রাজনৈতিক ও বাণিজ্য বিশ্লেষণভিত্তিক পত্রিকা ‘অটোয়া গ্লোব অ্যান্ড মেইল’ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে ‘শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন, যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে আমি বিপ্লবের ডাক দেব।’ ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ‘ব্যাংকক পোস্ট’ লিখেছে, মুজিব বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তান যদি তার দলের ঘোষিত ৬ দফা কর্মসূচি হুবহু গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তিনি এককভাবে অগ্রসর হবেন এবং সংবিধান রচনা করবেন।
২৩ ফেব্রুয়ারি ‘লন্ডন টাইমস’-এর রিপোর্টে বলা হয়, মুজিব ইতিমধ্যেই তার বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান শব্দের পরিবর্তে ‘বাঙালি জাতি’ উল্লেখ করছেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ‘লিভারপুল ডেইলি পোস্ট’ লিখেছে, হোয়াইট হলের (ব্রিটেনের এস্টাবলিশমেন্ট) আশঙ্কা পাকিস্তান ভেঙে যেতে পারে। পূর্ব পাকিস্তান নিজেকে একটি ‘স্বাধীন বাঙালি মুসলিম প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করতে পারে। শেখ মুজিব ইতিমধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে নয়, বাঙালি প্রজাতন্ত্রের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন। ফলে ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে এই উপলব্ধি এসেছে যে, তারা কমনওয়েলথের একটি দেশ ভেঙে যাওয়ার মতো গুরুতর পরিস্থিতি মোকাবিলার সম্মুখীন হচ্ছে। ৭০-এর নির্বাচনকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা যদি সময়ের ডাকে সাড়া দিতে ব্যর্থ হই তাহলে আগামী প্রজন্ম আমাদের দায়ী করবে।’
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের মহিলাসহ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৮৮টি আসনে জয়লাভ করে।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনপ্রতিনিধিদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগদলীয় সদস্যরা ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি অনুগত থাকার শপথগ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা দিয়ে দুই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে ভুট্টোর দাবির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘ভুট্টো সাহেবের দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ক্ষমতা একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। ক্ষমতার মালিক এখন পূর্ব বাংলার জনগণ।’
অথচ ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা প্রদান করেন। ফলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরি বৈঠক ডেকে ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। এই দিন সারা বাংলায় হরতাল পালিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি দাবি জানান।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্সের ঐতিহাসিক জনসভায় জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হয়ে যায় এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্ববাংলার তথা ভবিষৎ বাংলাদেশের জনগণের মানসিক দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি ইয়াহিয়া খানের সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। পূর্ববাংলার অফিস-আদালত বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার মানুষের সেই অভূতপূর্ব সাড়া ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
৯ মার্চ ১৯৭১ লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর রিপোর্টে বলা হয়, ‘৭ মার্চে মুজিবের ঘোষণা এক পাতলা ছদ্মাবরণে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা। কারণ, মুজিবের দাবিগুলো ইয়াহিয়া খান পূরণ করতে পারেন না।’ একই দিনে লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ একটি সম্পাদকীয়তে লিখেছে, “ইতিমধ্যেই পৃথক রাষ্ট্রের নাম ভেসে আসছে। পূর্ব পাকিস্তান হবে ‘বাংলাদেশ’। বাঙালির ভূখণ্ড। তৈরি করা হয়েছে এই রাষ্ট্রের পতাকা।”
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ ১৩ মার্চ লিখেছে, ‘৭ মার্চে দেয়া মুজিবের চার শর্তের মধ্যে দুটি শর্ত অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর কার্যত রাষ্ট্রপতির পক্ষে গ্রহণ করা অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শিগগিরই ঢাকায় যাচ্ছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সেটাই হতে পারে তার শেষ বৈঠক।’
১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। আলোচনার জন্য ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। ২৪ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনা হয়। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনেস।
২৬ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ট্রান্সমিটারযোগে চট্টগ্রাম ইপিআর হেড কোয়াটার্সসহ দেশের অনেক জায়গায় প্রেরণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর উক্ত ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ:
‘This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours.’
[বঙ্গানুবাদ: ‘সম্ভবত এটাই আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনসাধারণকে আহ্বান জানাচ্ছি, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যা-ই তোমাদের হাতে আছে তার দ্বারাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে হবে। যতক্ষণ না পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ ব্যক্তি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবে, তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’]
এর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলায় নিম্নলিখিত একটি ঘোষণা পাঠান: ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ- দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’
এভাবেই হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক যোদ্ধা, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান বেতার যন্ত্র মারফত তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারাদেশে পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রচার করা হয় এবং চট্টগ্রামে সাইক্লোস্টাইল কপি করে ২৬ মার্চ জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার বার্তা প্রেরণের পর পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তাকে বন্দি অবস্থায় ঢাকা সেনানিবাস থেকেই পাকিস্তানে নিয়ে লায়ালপুর (বর্তমানে ফয়সালাবাদ) জেলে বন্দি করে রাখে।
জাতিকে বঙ্গবন্ধু ২৩ বছরের আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন, প্রস্তুত করেছেন। এই বীরোচিত গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। বাঙালির ইতিহাসে প্রথম জাতি-রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এই কারণেই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
তাই স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু একে অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে গরিব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তিনি জেল-জুলুম-হুলিয়া, শত যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট-বেদনাকে সহ্য করে বাংলার কৃষক-শ্রমিক জনতার মুখে হাসি ফোটাতে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে বঙ্গবন্ধু চিরদিন অম্লান থাকবেন এবং বাংলার জনতার হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের নন, আন্তর্জাতিক বিশ্বের মহান নেতা ছিলেন। তিনি প্রথমে নিজেকে, পরে আওয়ামী লীগকে, তারপর বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে তৈরি করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি উপলব্ধি করেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে স্বার্থান্বেষী মহল কুতর্ক জারি রেখেছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যদি বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ না করতেন বা যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেতেন, তাহলে স্বাধীনতা ঘোষণা করার সুযোগ পেতেন না, অথবা হয়তো পেতেন তবে অনেক পরে। বঙ্গবন্ধুকে অনেকেই বলেছিলেন, ‘এলএফওর (লিগাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার) অধীনে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গিয়ে কোনো লাভ হবে না।’ তাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এলএফও! এই নির্বাচনকে গণভোট হিসেবে আখ্যায়িত করে আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো এবং প্রমাণ করবো কে এই দেশের নেতা। আর নির্বাচনের পর আমি এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবো।’ জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘The Legal Framework Order irked Mujib sorely. He was particularly irritated at Sections 25 and 27 which vested powers of authentication of the future constitution in the President. It implied that Mujib would not be free to implement his six points, even if he obtained majority seats in the National Assembly (Parliament) unless his Constitution Bill received the President’s approval. It is on the issue that Mujib said, I shall tear the LFO in the pieces after the election.’ (পৃষ্ঠা-১৬-১৭) এলএফওতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব মেনে নেয়া হয়।
জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি (সংরক্ষিত নারী আসনসহ) আসনের মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে আমরা পেলাম ১৬৯টি আসন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যাতে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে না পারেন সে জন্য এলএফওতে বিতর্কিত ২৫ ও ২৭ নম্বর দুটি অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করেন। এলএফওতে সন্নিবেশিত দুটি ধারাই ছিল আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী দলকে ঠেকানোর অপপ্রয়াস। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সত্যিকার অর্থেই নির্বাচনকে গণভোটে রূপান্তরিত করে বিজয়ী হন। নির্বাচনের পরপরই ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএকে নিয়ে শপথ অনুষ্ঠান করে বলেছিলেন, ‘এই গণভোটের মাধ্যমে ৬ দফা আজ আমার না, আমার দলেরও না, ৬ দফা আজ জনগণের সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যদি কেউ ৬ দফার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে তাকে জ্যান্ত কবর দেয়া হবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ এভাবে তিনি ৬ দফাকে আপসহীন অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু জানতেন ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করবে। সেজন্য বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগিয়েছেন। এই নির্বাচনে সারা দেশ সফর করে তিনি বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ১ মার্চ যখন ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন, মানুষ রাজপথে নেমে আসে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার এক মোহনায় দাঁড় করিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তরিত করেন। নির্বাচনের পরপরই ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ডেকে চার জাতীয় নেতার সামনে আমাদের চারজনকে- মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই ও আমাকে- একটি ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ভারতে গেলে আমরা কোথায় আশ্রয় পাব, থাকব, সে জন্য আমাদের চার টুকরা কাগজ দিয়ে বলেছিলেন মুখস্থ করো। কাগজে ঠিকানা লেখা ছিল, ‘সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এই ঠিকানায় আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি। অর্থাৎ বহু আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা করেন। সেই ১৯৬২ সালে তিনি দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা নিয়ে আগরতলা গিয়েছিলেন। আগরতলা মামলা তো মিথ্যা ছিল না। কিন্তু পরিকল্পনামতো কাজ হয়নি। আগরতলা মামলায় যারা অভিযুক্ত তারা তো আসলেই স্বাধীনতার জন্য একটি সশস্ত্র পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এটা সত্য। যার জন্য ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বললে যারা অভিযুক্ত তারা অসন্তুষ্ট হন। তারা বলেন, ‘আমরা তো ষড়যন্ত্র করিনি। আমরা তো দেশের স্বাধীনতার জন্যই একটি পরিকল্পনা করেছিলাম।’
বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তার বড় প্রমাণ ৬ দফা। তিনি বিচক্ষণ নেতা ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে নির্বাচন পেছালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকার সুযোগ পাই। নির্বাচনের দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। সেদিন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আপনি কয়টি আসন পাবেন?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি অবাক হবো যদি আমি দুটি আসন হারাই।’ বিস্ময়ের ব্যাপার দুটি আসনই আমরা হারিয়েছিলাম। একটিতে নুরুল আমিন, অন্যটিতে রাজা ত্রিদিব রায় জয়ী হন। নির্বাচনের পরই তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনার ছক এঁকেছিলেন যখন তিনি ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে লন্ডন সফরে যান। সেখানে ভারতীয় প্রতিনিধি ফনীন্দ্র নাথ মুখার্জি, তথা পিএন মুখার্জি- যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘মিস্টার নাথ’ বলে সম্বোধন করতাম- বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লন্ডনে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ভূমিকা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। যেগুলো পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়িত হয়। বঙ্গবন্ধু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তবেই স্বাধীনতা ঘোষণা করার রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করেন।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে বক্তব্য পেশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু সব সময় চেয়েছেন তিনি আক্রান্ত হবেন, কিন্তু আক্রমণকারী হবেন না। সে জন্যই ২৫ মার্চ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পূর্ব প্রস্তুতি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যেটা সিদ্দিক সালিক তার বইতে লিখেছেন, ‘When the first shot had been fired, ‘the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wavelength close to that of the official Pakistan Radio. In what must have been, and sounded like, a pre-recorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the ‘People’s Republic of Bangladesh.’ It said, ‘This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh, wherever you are and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৭৫)
প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এ রকম একটি চূড়ান্ত ঘোষণায় পৌঁছতে বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ ২৪টি বছর বাঙালি জাতিকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য স্থির করে, ধাপে ধাপে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে, শাসকগোষ্ঠীর সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, জেল-জুলুম-হুলিয়া-ফাঁসির মঞ্চকে উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছে। এক দিনে হয়নি। বহু বছর ধরে, অগণিত মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাকে শিরোধার্য জ্ঞান করেছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত এই ঘোষণাটিই ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৬ নম্বর প্যারায় অনুমোদিত হয়ে সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করেছে। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণাই ২৬ মার্চ দুপুর দেড়টায় চট্টগ্রাম বেতার থেকে এম এ হান্নানের কণ্ঠে বারবার প্রচারিত হয়েছে। ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের ঘোষণার কোনো রেকর্ড নেই। এমনকি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ‘প্রামাণ্যকরণ কমিটি’র চেয়ারম্যান মফিজউল্লাহ কবীর ও হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র’ সংকলনের ৩ নম্বর খণ্ডে আছে, ‘জিয়াউর রহমান মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মার্চ ঘোষণা দেন।’ কিন্তু ২৬ তারিখ তো যুদ্ধ শুরু হয়েছে। জেনারেল শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, মেজর রফিক ইতিমধ্যে ডিফেক্ট করে যুদ্ধ শুরু করেছেন। সুতরাং ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের ঘোষণার কথা মোটেও সত্য না। যারা ২৬ মার্চ জিয়ার ঘোষণার কথা বলেন, তারা অসত্য কথা বলেন। বাস্তবের সঙ্গে যার কোনো মিল নেই।
ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চের ভাষণে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করে একজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘সপ্তাহ খানেক আগেই আমার উচিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা...। ...কেননা কয়েকটি শর্ত দিয়ে সে আমাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সে আক্রমণ করেছে- এই অপরাধ বিনা শাস্তিতে যেতে দেয়া হবে না।’ এবং এই একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে সামরিক আদালতে বিচার হয়। সামরিক শাসক কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল যে, আমার মতো একজন ক্ষুদ্র কর্মীকেও আমার অনুপস্থিতিতে সামরিক আদালতে বিচার করল। ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, আবিদুর রহমান ও আমাকে মার্শাল ল কোর্টে হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়। পরে ২৭ এপ্রিল আমাদের অনুপস্থিতিতে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। আজকাল বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম দাবি করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছাড়া আমরা ছাত্রলীগের কেউ কিছু করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় নেতা হিসেবে যা করতে পারতেন না, আওয়ামী লীগের অগ্রগামী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তা পালন করতো। কোনোটাই বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন ছাড়া হয়নি।
১৯৭১ সালের শহীদ দিবস ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ দিন মধ্যরাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই বাংলার স্বাধিকার-বাংলার ন্যায্য দাবীকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে। এখনও চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। কিন্তু বাংলার সাত কোটি মানুষ আর বঞ্চিত হতে রাজী নয়। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন হলে আরো রক্ত দেবো। আর শহীদ নয়, এবার গাজী হয়ে ঘরে ফিরবো। বাংলার ঘরে ঘরে আজ দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে হবে আমাদের সংগ্রাম। মানুষ জন্ম নেয় মৃত্যুর জন্য; আমি আপনাদের কাছে বলছি এই বাংলার মানুষ রক্ত দিয়ে আমাকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছে, আমিও আপনাদের জন্য নিজের রক্ত দিতে দ্বিধা করবো না। বাংলার সম্পদ আর লুট হতে দিবো না।’ ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার মন্ত্রিসভা বাতিল করেন এবং পিন্ডিতে গভর্নর ও সামরিক প্রশাসকদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে, লারকানা ও রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকে গৃহীত গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘...গত সপ্তাহে জাতি যে ধরনের নাট্যাভিনয় প্রত্যক্ষ করেছে, তা বন্ধ হওয়া দরকার। জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালের উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। ...পাকিস্তানে যখনই জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণে উদ্যত হয়েছে তখনই এই তামস শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই গণবিরোধী শক্তি ১৯৫৪ সনে পূর্ব বাংলার নির্বাচিত শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ১৯৫৬ সনের আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়, ১৯৫৮ সনে দেশে সামরিক আইন জারী করে এবং তারপর প্রতিটি গণআন্দোলন ব্যর্থ করার জন্য হস্তক্ষেপ করে। এই ষড়যন্ত্রকারী শক্তি যে আবার আঘাত হানার জন্য তৈরী হচ্ছে, জাতীয় পরিষদের তারিখ ঘোষণার পর যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলো থেকেই এটা প্রতীয়মান হয়। জনাব জেড এ ভুট্টো ও পিপল্স পার্টি আকস্মিকভাবে এমন সব ভঙ্গিমা ও উক্তি করতে শুরু করেছে যা জাতীয় পরিষদের স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি করে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি বানচালের প্রবণতাই উদঘাটন করে। এভাবে জনসাধারণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। ...বাংলাদেশের জাগ্রত জনতাকে, কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র ও জনগণকে বিজয় বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ...আমরা যে ক্ষমতাকে স্বীকার করি, তা হচ্ছে জনগণের ক্ষমতা। জনগণ সকল স্বৈরাচারীকেই নতি স্বীকারে বাধ্য করেছে। কারণ স্বৈরাচারীর ক্ষমতার দম্ভ জাগ্রত জনগণের সংকল্পবদ্ধ আঘাতের কাছে টিকে থাকতে পারেনি। ...আমরা আজ প্রয়োজন হলে আমাদের জীবন বিসর্জন করারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি-যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের একটি কলোনীতে বাস করতে না হয়। যাতে তারা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সম্মানের সাথে মুক্ত জীবন যাপন করতে পারে, সে প্রচেষ্টাই আমরা চালাবো।’
এই দীর্ঘ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যৎ বংশধরদের যাতে একটি কলোনিতে তথা উপনিবেশে বসবাস করতে না হয়, তার অংশ হিসেবে ‘একটি স্বাধীন দেশের’ কথা বলছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত করতে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে সার্বিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক সাব-ডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল’ এবং বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ বেলা ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত করেন। পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা বক্তব্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরীসহ সমগ্র বাংলাদেশ। এ দিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয় এবং ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারা দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রাম করেই মুক্তি আনবো। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।’
এরপর আসে বাঙালির ইতিহাসের পরমাকাঙ্ক্ষিত দিন ৭ মার্চ। সেদিন ছিল রোববার। সংগ্রামী বাংলা সেদিন অগ্নিগর্ভ, দুর্বিনীত। বঙ্গবন্ধু যখন ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে বক্তৃতা শুরু করেন জনসমুদ্র পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে যায়। সে দিন নেতার বক্তৃতার শেষাংশ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বস্তুত এটাই ছিল বীর বাঙালির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা।
লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
আমাদের যে স্বাধীনতা অর্জন সেটি কোনো কিছুর সঙ্গেই বিনিময়যোগ্য নয়। একটি জাতি যখন স্বাধীনতা পায় তার আর কিছু পাওয়ার অপূর্ণতা থাকে না। আমরা মনে করি, আমরা সব কিছুই পেয়েছি। তারপরও বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার সুফল সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, বাংলাদেশকে সাম্যের বাংলাদেশে রূপান্তরিত করতে হবে। সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলব। বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলব।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্যই আমরা অবিরাম চেষ্টা করে চলেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে দীর্ঘ একটা সময় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তার আদর্শকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। তার দর্শন এ দেশ থেকে তারা মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। সে কারণে এর মূল যে অর্জন স্বাধীনতা সেটি আমরা পেয়েছি এবং অক্ষুণ্ন রেখেছি। বায়ান্ন বছর ধরে স্বাধীন জাতি হিসেবে বসবাস করছি। কিন্তু স্বাধীনতার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা অবিরাম চেষ্টা করে চলেছেন স্বাধীনতার সুফল সবার কাছে পৌঁছে দিতে। আমরা দেখেছি, তিনি মুজিববর্ষে ঘোষণা দিয়েছেন, দেশের একটি পরিবারও গৃহহীন থাকবে না। সে লক্ষ্যেই তিনি দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। অতি সম্প্রতিও তিনি বেশ কয়েকটি জায়গায় গৃহহীন মানুষের মধ্যে ঘর হস্তান্তর করেছেন।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে যদি পেছনে ফিরে তাকাই তাহলে বহু অগ্রগতি, উন্নতিসাধন করেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য যে মানুষের কথা বলেছিলেন সেই মানুষ তৈরি করতে এখনো আমরা সফল হইনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বৈপ্লবিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে যে সোনার মানুষ গড়ে তোলা, এটি আমাদের এখন একমাত্র আরাধ্য বলে আমি মনে করি। এটি এখন আমাদের প্রথম কাজ বলে আমি মনে করি।
অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন, স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক মুক্তি অর্থহীন হয়ে যাবে যদি না আমরা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে না পারি। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যেই আমরা অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার সম্প্রসারণ সব ক্ষেত্রেই কাজ করে চলেছি। কিন্তু অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বহু বাধাবিপত্তি আমাদের রয়েছে। কারণ আজকের পৃথিবী একটি বিশ্বপল্লিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে কোনো দেশই অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রতিটি দেশ পারস্পরিকভাবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। আমরা উৎপাদন করছি কিন্তু সেই পণ্য যদি রপ্তানি করতে না পারি বা আমাদের আমদানি যদি কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে ধরনের একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন এখন সারা পৃথিবী।
একবিংশ শতাব্দীকে আমরা মনে করেছিলাম সৌভাগ্য হিসেবে দেখব। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য একবিংশ শতাব্দীতে এসে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ দেখতে হচ্ছে। পৃথিবীর এক দেশ আরেক দেশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা দেখতে পাচ্ছি। এগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জনে বাধার সৃষ্টি করছে। তবে আমরা বাঙালিরা আশাবাদী মানুষ। যে জাতি ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছে সেই জাতি কখনো পিছিয়ে থাকবে না, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এটি আমিও বিশ্বাস করি। অতএব বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে যে সাময়িক অর্থনৈতিক বাধাবিপত্তি চলছে সেগুলো কাটিয়ে উঠে অচিরেই আমরা সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধু যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলতেন, সে রকম বাংলাদেশ গড়ে তুলব।
স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে আমার চাওয়া একটাই- সেটা হলো বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হিসেবে যেটা চাইতেন সেটাই, স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন স্বাধীন বাংলাদেশ আমি দেখতে চেয়েছিলাম, আমি সেটা গড়ে তুলেছি। আমি সোনার বাংলা গড়তে চাই, সে কারণে আমি সোনার মানুষ দেখতে চাই। বঙ্গবন্ধুর মতোই আমিও চাই বাংলাদেশের মানুষ সোনার মানুষে রূপান্তরিত হোক। বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে যারা আগামী দিনে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে তারা যেন সত্যিকার অর্থে সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ সৎ সুনাগরিক এবং একইসঙ্গে উদার মন-মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ধারণ করা মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে। এমন মানুষ আমি সমাজে দেখতে চাই। সেই লক্ষ্যে আমি নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই।
(সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
মতৈক্য আর মতনৈক্যের মাঝখানে বিভেদের যে দেয়াল, সে দেয়াল ভালো ও মন্দ উভয়েরই জন্য সংকট সৃষ্টি করে। ভালোকে ভালো থাকতে না দেয়া আর মন্দকে আরও মন্দ হতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে এই সংকটের সুনাম সুবিদিত। উভয়সংকটে পড়ে শুভচিন্তারা শুভ উদ্যোগের পাড়া থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়ে। আর নানা ধরনের অশুভ আচার-আচরণে পাড়া মাত করে ফেরে। ভালো আর মন্দকে একসঙ্গে এক পাড়ায় বসবাস করতে দিয়ে ভালোর আলোয় মন্দকে কলুষমুক্ত হতে সাহায্য করা যেখানে উচিত, সেখানে ভালোকে পত্রপাঠ মাঠ থেকে সাজঘরে পাঠিয়ে দিয়ে ওয়াকওভারের পরিবেশ সৃষ্টি করা সবল হোক আর দুর্বল হোক যেকোনো অর্থনীতির জন্য সংকট সৃষ্টি করে থাকে।
সমাজ ও অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়ন ও অগ্রগতির অভীপ্সা-আকাঙ্ক্ষায় সব পক্ষ ও অনুষঙ্গকে নিরবচ্ছিন্ন নিঃশর্ত ঐকমত্যে পৌঁছানোর তাগিদে সবাইকে বিচ্যুতির পরিবর্তে অন্তর্ভুক্তির অবয়বে আসার অবকাশ রয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়ন ভাবনায় সমন্বিত উদ্যোগের প্রেরণা ও মতবাদ হিসেবে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি, তথা সার্বিক সামাজিক অন্তর্ভুক্তির দর্শন বিশেষ বিবেচনা ও ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসছে। স্থান-কাল-পাত্রের পর্যায় ও অবস্থানভেদে উন্নয়ন ও উৎপাদনে সবাইকে একাত্মবোধের মূল্যবোধে উজ্জীবিত করার প্রেরণা হিসেবে শিল্পোন্নত বিশ্বে অন্তর্ভুক্তিকরণের দর্শনকে ব্যাপক বিবেচনা করা হচ্ছে। দারিদ্র্য নিরসন থেকে শুরু করে সমাজে সম্পদের বণ্টনবৈষম্য দূরীকরণ এবং এমনকি সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও সবাইকে দল-মত-ধর্ম-লিঙ্গ অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে এক শামিয়ানার নিচে শামিল করতে অন্তর্ভুক্তিকরণকে মন্ত্র হিসেবে মানতে ও মানাতে আগ্রহ-উদ্যোগের অভাব থাকতে নেই।
বিচ্যুতির অবকাশকে নাকচ করে দিয়ে যেকোনো যৌথ সংসারে কিংবা কায়কারবারে সবার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশের সুযোগ, কর্তব্য পালনে দৃঢ়চিত্ত মনোভাব পোষণ, উদ্দেশ্য অর্জন তথা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোয় ঐকান্তিক প্রয়াসে সমর্পিতচিত্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস জরুরি বিবেচনা করা হচ্ছে। এ কথা বলা বাহুল্য যে, জাতীয় উন্নয়ন প্রয়াস-প্রচেষ্টাতেও সমন্বিত উদ্যোগের আবশ্যকতাও একইভাবে অনস্বীকার্য। জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগে থাকা চাই প্রতিটি নাগরিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবদান। দুর্নীতি দমন, অপচয়-অপব্যয় রোধ, লাগসই প্রযুক্তি ও কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বনের দ্বারা সীমিত সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণে সবার মধ্যে অভ্যাস, আগ্রহ ও একাগ্রতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার। নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা ও উপলব্ধির জাগৃতিতে অনিবার্য হয়ে ওঠে যে নিষ্ঠা ও আকাঙ্ক্ষা, তা অর্জনের জন্য সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন ত্যাগ স্বীকারের। নেতিবাচক মনোভাবের দ্বারা এবং দায়-দায়িত্ব পালন ছাড়া গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সুফল ভোগের দাবিদার হওয়া বাতুলতামাত্র। ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’ কথাটি এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য এ জন্য যে, উৎপাদনে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করেই ফসলের অধিক অধিকারপ্রত্যাশী হওয়াটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক এবং সংগত কর্ম ও ধর্ম নয়। কোনো কিছু অর্জনে বর্জন বা ত্যাগস্বীকার যেমন জরুরি, তেমনি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে বাস্তবতা এ জানান দেয় যে, ‘বিনা দুঃখে সুখ লাভ হয় কি মহিতে?’ ন্যায়নীতিনির্ভর, নিরপেক্ষ ও নির্ভার কাণ্ডজ্ঞানের বিকাশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অর্থবহ ও কার্যকর উপস্থিতির আবশ্যকতা অনস্বীকার্য।
সংসার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে সবার সচেতন ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে অর্থবহ করতে ঐকান্তিক নিষ্ঠার দরকার। দরকার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির। সংসারে নানা বাদ-প্রতিবাদে মানুষ বেড়ে ওঠে, তার দায়-দায়িত্ব তদনুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং তা যথাযথভাবে পালনে সংসারের গতির চাকা সচল থাকে নির্দিষ্ট নিয়মে। দেশ, সমাজ, অর্থনীতি এভাবেই প্রবৃদ্ধির পথে যাবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি সব অনুষঙ্গকে সঙ্গ করে সুনিশ্চিত হওয়া দরকার, মাথাপিছু আয়ের হিসাব বৃদ্ধি সব কাণ্ডজ্ঞান ও কর্মকাণ্ডের সমন্বিত অবয়বে হওয়া উচিত। ভোগবাদী সমাজে কতিপয়ের প্রচুর উন্নতির অঙ্ক সমষ্টির সঙ্গে কাগজে-কলমে বিভাজন দেখিয়ে তথাকথিত উন্নতির অবয়ব দেখানোর সংস্কৃতি আত্মপ্রবঞ্চনার প্রতীক।
মানবসম্পদ সৃষ্টি, গণসুস্থতা আর আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠার সরোবরে উন্নয়ন অর্থনীতির ফুল বিকশিত হয়। যে সমাজে শিক্ষকতা, চিকিৎসা আর আইন ব্যবসা মহৎ পেশা হিসেবে বিবেচনার সুযোগ দিনে দিনে তিরোহিত হয়, সে সমাজে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ও সমাজসেবার আদর্শ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে ওঠে, সেখানে সামাজিক সুবিচার ও গণকল্যাণ আকাঙ্ক্ষায় চিড় ধরতে বাধ্য। সুশাসন ও জবাবদিহিতার পরিবেশ পয়মাল হতে হতে সমূহ সর্বনাশও সহনশীল হয়ে ওঠে। পরীক্ষায় উত্তরণনির্ভর বিদ্যাচর্চায় বাস্তব শিক্ষার লেশমাত্র যে থাকে না, সে উপলব্ধি করতে রূঢ় বাস্তবের মোকাবিলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়লেই দেশে শিক্ষার উন্নতিসহ জনসম্পদ বৃদ্ধি ঘটে না, বরং তাতে স্বল্পশিক্ষিত বেকারের বিকারজনিত সমস্যারই উদ্ভব ঘটে। অসম্পন্ন শিক্ষা সমাধান আনে না, বরং সমস্যা বাড়ায়। শিক্ষা খাতে জিডিপির সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ মিললেও শিক্ষা জনসাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে কি না, দেশের অধিকাংশ অধিবাস যে পল্লিতে, সেই পল্লির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে শহরের হাইব্রিড বিদ্যাচর্চার ব্যবধান বাড়ছে কি না সে বিচার-বিবেচনা আবশ্যক।
প্রাথমিক, জুনিয়র, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে শহর আর গ্রামের পাসের হারের ব্যাপক ব্যবধান আসন্ন সমাজে ব্যাপক বিচ্যুতির ফাটল স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। যে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের করের টাকায় বেতন পান, তার বিনিময়ে তার যে দায়িত্ব পালনের কথা তা পালন না করে বরং তার শিক্ষকতার পরিচয়কে পুঁজি করে অত্যধিক পারিশ্রমিকে গৃহশিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারই শুধু করেন না, গণশিক্ষার ব্যয় বাড়িয়ে চলেন। সমাজের কাছে যে সম্মান ও সমীহ তার প্রাপ্য, তা তার এই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে দ্রবীভূত হয়ে যায়। অথচ এই একই সমাজে এই কিছুদিন আগেও, এমনকি ঔপনিবেশিক পরাধীন পরিবেশেও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে (তখন সরকারি অনুদান ছিল যৎসামান্য) শিক্ষাদান ছিল নিঃস্বার্থ জ্ঞানদানের বিষয় এবং আত্মত্যাগের আদর্শে ভাস্বর। আর সে সুবাদে শিক্ষক পেতেন সমাজের সর্বোচ্চ সমীহ ও সম্মান। শিক্ষক দায়িত্ববোধের আদর্শ হতেন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের মনে জ্ঞানের আলো জ্বালানোকে ব্রত মনে করতেন শিক্ষকরা। আর আজ শিক্ষকের মনের দীনতা অধিক অর্থ উপার্জনের অভীপ্সায় অন্তর্লীন। চিকিৎসাবিদ্যার প্রধান লক্ষ্যই যেখানে হওয়ার কথা দুস্থ-পীড়িতজনকে রোগমুক্তির সন্ধান দেয়া, সেখানে স্রেফ ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কেন মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে এ মহৎ পেশায়। অসুস্থ ব্যক্তির উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়া যেখানে মৌলিক অধিকার, সেখানে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসাব্যবস্থা এতই নাজুক ও অবহেলায় ন্যুব্জ যে ক্লিনিকের কসাইয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে অগণিত অসহায়-অসুস্থ মানুষকে। এনজিও দ্বারা কমিউনিটি চিকিৎসাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, সেখানে হাসিমুখে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে নবীন-প্রবীণ স্বাস্থ্যকর্মী। কিন্তু সরকার পরিচালিত চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে কেন সেবার মান আদৌ উন্নত হবে না, যদিও সেখানে বাজেটের বিপুল বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় দেখানো হয়ে থাকে।
জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাজেটে বিপুল ব্যয় বরাদ্দ দেখানো হবে আর সেই সেবা পাওয়ার জন্য আবার বাড়তি ব্যয়ের বোঝা কেন বহন করতে হবে রাষ্ট্রের নাগরিককে। অন্যায়-অবিচারের প্রতিকার প্রার্থীর পক্ষাবলম্বনের জন্য আইনজীবী হবেন আসামি-বাদী-বিবাদীর বন্ধু। আইনের মারপ্যাঁচে নিজের ন্যায্য দাবি যাতে হারিয়ে না যায়, সে সহায়তা চেয়েই তো অসহায় অশিক্ষিত মক্কেল আসে আইনজীবীর দ্বারে। নিজের পেশাগত দায়িত্ব ও মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্রেফ ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অনুক্ষণ-অনুযোগ বিচারপ্রার্থীর বোবাকান্নার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশ ও সমাজের স্বার্থকে থোড়াই কেয়ার করে অনেকে বিদেশি বহুমুখী কোম্পানির অনেক অন্যায্য দাবির সপক্ষে লবিং করেন স্রেফ পেশাগত ও ব্যবসায়িক স্বার্থে। ‘সেবা পরম ধর্ম’ কিংবা ‘সততা সর্বোত্তম পন্থা’ এ মহাজন বাক্যরা কি শুধু নীতিকাহিনিতে ঠাঁই পাবে, বাস্তবে তাদের সাক্ষাৎ মিলবে না?
রাষ্ট্রাচারে বিধিবিধান অনুসরণ যেহেতু দায়িত্ব ও কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে, সেহেতু রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয় পক্ষেরই পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপারটি গুরুত্ববহ। রাষ্ট্র ও নাগরিকের পারস্পরিক স্বার্থে বিষয়টি অনেকটা ডিম আগে না মুরগি আগের মতো। রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সেবার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করবে এবং এর জন্য নাগরিক রাষ্ট্রকে পাথেয় পরিশোধ করবে। রাষ্ট্র ধারকর্জ করে নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি করলে কৃতজ্ঞ নাগরিক পাথেয় পরিশোধ করবে না, নাগরিক আগে সব পরিশোধ করলে রাষ্ট্র সুযোগ-সুবিধা তৈরিতে হাত দেবে, কোনটি আগে? যেকোনো ক্ষেত্রেই সৃষ্ট জটিলতা, অসম্পূর্ণতা, অস্বচ্ছতা পুরো পরিবেশটাকে প্রশ্নবোধক করে তুলতে পারে। পাথেয় তথা রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়ায় অনুপ্রেরণাপ্রদায়ক সহজ-সাবলীল ব্যবস্থা যেমন থাকা দরকার, আবার সে সহজীয় সুযোগের অসদ্ব্যবহার যাতে না হয়, তা নিশ্চিতকরণার্থে প্রতিবিধানের ব্যবস্থাও থাকা দরকার।
করদাতা যাতে হয়রানির শিকার হয়ে নিরুৎসাহিত না হন এটা দেখাও যেমন জরুরি, যেমন জরুরি কর প্রদান এড়িয়ে চলার বা ফাঁকিজুকি দিয়ে পার পাওয়ার প্রতিরোধাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ, তেমন জরুরি জবাবদিহির পরিবেশে নাগরিকের সব মৌলিক অধিকার ও দাবি পূরণে রাষ্ট্রের স্বচ্ছতাসুলভ আচরণ ও সেবা সুনিশ্চিত করা। সেবাপ্রাপ্তি সুনিশ্চিত হলে পাথেয় পরিশোধের পালে বাতাস বইবে। পারস্পরিক বিচ্যুতিতে নয়, অন্তর্ভুক্তির সরোবরে ফুটুক সাফল্যের শাপলা।
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, এনবিআর ও উন্নয়ন অর্থনীতির লেখক
মহামারি, মহাদুর্যোগ কখনো বলে-কয়ে আসে না, আচমকায়ই আঘাত হানে। এখানেই প্রকৃতির রহস্য; যে রহস্য বিজ্ঞান এখনো উন্মোচন করতে সক্ষম হয়নি। তবে বিজ্ঞানের কল্যাণে কিছু দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া গেলেও মহামারি অথবা অতিমারির ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায়নি আজ অবধি। অথবা সেই ধরনের কোনো প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি পূর্বাভাস দেয়ার মতো। আবহাওয়ার ক্ষেত্রে পূর্বাভাস পাওয়া গেলেও ভূমিকম্প-সুনামি কিংবা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত সম্পর্কে ততোধিক নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। তার পরও বিজ্ঞানের কল্যাণে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামান্য তথ্য জানতে পারে মানুষ।
কিন্তু মহামারি অথবা অতিমারির ক্ষেত্রে সেই ধরনের তথ্য প্রদান করে আজ অবধি মানুষকে সহযোগিতা করতে পারেনি বিজ্ঞান। ভাবা যায়, এ ক্ষেত্রে কতটা অসহায় বিজ্ঞান! হয়তো চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে মহামারির প্রতিষেধক অথবা ভ্যাকসিন বানাতে সক্ষম হয়েছে মানুষ, কিন্তু ততদিনে লাখ লাখ প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটে গেছে বিশ্বে। মোটের ওপরে মহামারির ক্ষেত্রে পূর্বাভাস দেয়া যায় না; মহামারির ক্ষেত্রে অনুমান করা যায় যে পাশের দেশ অথবা পাশের গ্রামের মানুষের মাঝে সংক্রমিত হয়েছে, এখন নিজ দেশ অথবা নিজ গ্রামেও সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী মহামারি সংক্রমিত হবে এতদিনের মধ্যেই, সেই ধরনের কোনো তথ্য দেয়ার ক্ষমতা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অথচ মানুষ চন্দ্র বিজয় করেছে, মহাশূন্যে টমেটো চাষ করে খাচ্ছে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে বেড়ানোর পাঁয়তারা করছে, সমুদ্রের তলদেশ থেকে নুড়িপাথর কুড়িয়ে আনছে। আরও কত কী যে মানুষ করেছে, তার হিসাব দেয়ার প্রয়োজন নেই বোধ করি। সেই হিসাব দাখিল করলে লেখার প্রসঙ্গটাও ব্যাহত হতে পারে। তাই আপাতত সেদিকে না গিয়ে মূল আলোচনায় যাচ্ছি আমরা।
আমরা মহামারির কথা বলছি; বলছি একটি অণু-জীবাণুর কথা, একটি ভাইরাসের কথা। যাকে পিষে ফেলতে হলে (যদি চোখে দেখা যেত) প্রয়োজন হতো না এক দিন বয়সের একটি শিশুর শক্তিও। অথচ শক্তিতে এতটাই দুর্বল একটি জীবাণু মানুষকে মুহূর্তেই ঘায়েল করে ছাড়ছে। বিশ্ববাসীকে আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে। বিশ্বের শীর্ষ ধনী থেকে শুরু করে দরিদ্র মানুষকেও পরাস্ত করছে; ঘটাচ্ছে প্রাণের বিনাশও। সেই অসহায় একটি ভাইরাসের শক্তির কাছে বিশ্ববাসী পরাজিত হয়েছিলও। যেই ভাইরাসটি ১৯৬০ দশকেই প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল। তারই একটি প্রজাতি কোভিড-১৯, যা ২০১৯ সালে চীনে শনাক্ত হয়েছে পুনরায়। ওই কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসটি ২০২০ সালে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটিয়েছিল। সারা বিশ্বের সরকারি হিসাবে অর্ধকোটির ওপর মৃতের সংখ্যা নিরূপণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশে সেই সংখ্যা ২৭ হাজার ছাড়িয়েও গিয়েছিল। ভ্যাকসিন নিলেও যে সম্পূর্ণ নিরাপদ তাও কিন্তু বলা যাচ্ছে না এখনো; তা ছাড়া ভ্যাকসিন গ্রহণকারী সর্বোচ্চ এক বছরের সুরক্ষা পাবে, এমনটিই জেনে আসছি আমরা।
বিশ্ব মহামারি ২০১৯ সালেই প্রথম নয়; শত শত বছর আগেও বিশ্বে দফায় দফায় মহামারি হানা দিয়েছিল। কেড়ে নিয়েছিল কোটি কোটি প্রাণ। কত সভ্যতাকে যে ধ্বংস করে দিয়েছিল তার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। ২০২০ সালের বিশ্ব মহামারির আগে সর্বশেষ আমাদের দেশে হানা দিয়েছিল গুটিবসন্ত ও কলেরা। সেসব থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ফলে। ততদিনে অবশ্য দেশে বহুসংখ্যক লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। আবার দেখা গেছে, গুটিবসন্ত আক্রান্তের পরও বেঁচে থাকা কিছু মানুষের মুখে বড় বড় গর্ত বা দাগ রয়ে গেছে। আবার অনেক মানুষ অন্ধত্ববরণ করেও দিনাতিপাত করছে। সেই ভয়ংকর ভাইরাসেরও বিনাশ ঘটেছে। মানুষের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের কাছেই পরাজিত হয়েছিল গুটিবসন্ত ও কলেরা। তদ্রূপ করোনাভাইরাসও একদিন সম্পূর্ণ পরাজিত হবে বিজ্ঞানের কাছে। সেদিন হয়তো খুব বেশি দূর নয়, ততদিনে আরও বহুসংখ্যক প্রাণহানি ঘটে যাবে বিশ্বে, আর সেটিই হবে তখন আমাদের জন্য বড় ধরনের আফসোস। তবু আমরা বলতে পারি, ভ্যাকসিন নেয়ার ফলে অনেকটাই মানুষ এখন সুরক্ষা পাচ্ছে।
শুরুতেই আমরা বলেছি যে মহামারি বলে-কয়ে আসে না, এটি প্রকৃতি প্রদত্ত। শুধু তা-ই নয়, আমরা বলব এটি প্রকৃতির প্রতিশোধও বটে। আমরা নানা কারণে প্রকৃতির ওপর জোরজুলুম অব্যাহত রেখেছি। অপ্রয়োজনে প্রকৃতিকে খুন করছি; প্রকৃতিকে জব্দ করছি অকারণে। যার ফলে আজ নিজেরাই জব্দ হয়ে পড়েছি প্রকৃতির কাছে। অথচ সেই অঙ্কের যোগফল মেলাতেও ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, একটি জীবাণু বা ভাইরাস এমনি এমনি উৎপত্তি হয়নি কিংবা মানুষের মাঝে নিজ থেকেই ছড়িয়ে পড়েনি। এর জন্য ভাইরাস কোনোভাবে দায়ী নয়; দায়ী হচ্ছে মানুষ। দুভাবে দায়ী মানুষ। যেমন, বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কথা ধরা যাক আগে। বড় বড় শিল্পকারখানা, পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ, নির্বিচারে বন উজাড়, নদীশাসন ইত্যাদির ফলে দারুণভাবে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সারা বিশ্বে।
শিল্পোন্নত দেশগুলোর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সিএফসি গ্যাস, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের নির্গমন বেড়ে গেছে। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে বরফ গলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে এবং চলমান তাপমাত্রায় বেঁচে থাকার জন্য নতুন প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে। এভাবেই নতুন নতুন জীবাণুর উৎপত্তি ঘটছে। অন্যদিকে টিকে থাকতে না পারা প্রাণিকুল চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন হারিয়েছিল ডাইনোসর; একইভাবে মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটাও বৈচিত্র্যের কিছু নয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পেতে একসময় আমাদের প্রিয় গ্রহ বাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে এমনিই, তখন জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে আমাদের বেঁচে থাকার স্বাদ মিটে যাবে মুহূর্তেই। কারণ তখন নতুন প্রজাতির জীবাণু বা প্রাণিকুলেরই বিশ্বময় দাপট থাকবে; সেখানে আমরা অসহায় হয়ে পড়ব। যার ফলে আমাদের আর করার কিছুই থাকবে না।
প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, নতুন জীবাণু উৎপত্তি হলেও আমাদের মাঝে কীভাবে তা ছড়িয়ে পড়বে? আসলে ব্যাপারটি তত জটিল নয়, খুবই সোজা হিসাব। যতটা জানা যায়, এসব জীবাণু প্রথমে সংক্রমিত হয় বন্য প্রাণীদের শরীরে। সেখান থেকে খুব সহজেই মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেটি হচ্ছে, অবাধে বন্য প্রাণী নিধনের কারণে। তার প্রমাণও আমরা বার-কয়েক পেয়েছি। বার্ড ফ্লু, ইবোলা, প্লেগ, নিপা ভাইরাসসহ আরও অনেক ভাইরাস দ্বারা মানুষ সংক্রমিত হয়েছে বন্য প্রাণীর মাধ্যমে। বলে রাখা ভালো, এসব বন্য প্রাণী তেড়ে এসে আমাদের গায়ে ভাইরাস ছিটিয়ে যায়নি, বরং আমরাই ওদের কাছে গিয়েছি, বিভিন্নভাবে বিরক্ত করছি অথবা বন্য প্রাণী নিধন করে খাবারের তালিকায় নিয়ে এসেছি। ফলে ভাইরাস অতিসহজে সংক্রমিত হতে পেরেছে আমাদের শরীরে।
সর্বশেষ করোনাভাইরাস সম্পর্কেও এমনটি ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংবাদমাধ্যমেও জানা গেছে, চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরে বন্য প্রাণীর বড় পরিসরের বাজার রয়েছে। যেখানে নানা ধরনের বন্য প্রাণী ক্রয়-বিক্রয় করা হচ্ছে দেদার। ধারণা করা হচ্ছে, সেই বাজারে চোরাপথে আসা বনরুই অথবা বাদুড় থেকে করোনাভাইরাস মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়েছে; পরে যা সারা বিশ্বে পর্যায়ক্রমে ছড়িয়েও পড়েছে। সেই ধারণাটি একেবারেই অমূলক নয়। কারণ চীনের অধিকাংশ মানুষ অর্ধসেদ্ধ খাবার খেতে পছন্দ করে, আবার কেউ কেউ কাঁচা খাবারও খেয়ে থাকে। এসব আমরা ইউটিউব মারফত দেখতে পাচ্ছিও। সেই ভিডিও দেখে উপলব্ধি করা যায়, যেকোনো ভাইরাস-ই খুব সহজে সংক্রমিত হতে পারে মানবদেহে।
যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে কী আমরা বলতে পারি না যে এটি হচ্ছে অবাধে বন্য প্রাণী নিধনের জের। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃতি আমাদের ওপর রুষ্ট হয়েছে! যার কারণে রিসাইকেলের মতো আমরা নিজেরাই সেই শিকারে পরিণত হয়েছি! সুতরাং আমাদের বেঁচে থাকতে হলে অবাধে বন্য প্রাণী শিকার করা এবং শিকারে পরিণত হওয়ার বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তা না হলে গোটা মানবজাতিকে চিরতরে এই গ্রহ থেকে বিতাড়িত হতে হবে অচিরেই।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট
আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে, যার সঙ্গে দুগ্ধ সামগ্রীর চাহিদাসহ উৎপাদন বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২০১৯ তথ্য মতে, দেশে প্রতি বছর ৯০ লাখ ২৪ হাজার টন দুধ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু চাহিদা রয়েছে ১ কোটি ৫৮ লাখ টন। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ টনের কিছু বেশি। এর মানে হলো বাংলাদেশ তার মোট প্রয়োজনের মাত্র ৬৩ শতাংশ উৎপাদন করছে এবং বাকি ৩৭ শতাংশ ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতিবছর প্রায় এক হাজার পাঁচশ কোটি টাকার দুধ আমদানি করছে।
সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন, যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা গুঁড়োদুধ আমদানিতে ব্যয় হয় তা যদি স্থানীয় দুগ্ধ উন্নয়নে ঋণ কিংবা প্রণোদনা হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তা হলে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হতো। কিন্তু দেশে দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির পথে প্রধান অন্তরায়গুলো হলো জমির দুষ্প্রাপ্যতা, গবাদিপশুর পর্যাপ্ত খাবারের স্বল্পতা ও গরুর উৎপাদন ক্ষমতা। সার্বিক ব্যবস্থাপনা তথা নীতি-সহায়তা পেলে বাংলাদেশ যে দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতিজনের প্রতিদিন ২৫০ মিলিমিটার দুধ পান করা প্রয়োজন। অথচ সেখানে একজন মানুষের প্রাপ্তির মাত্রা ৪০ মিলিমিটার। সেই হিসেবে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে, সারা দেশে প্রতিদিন মাথাপিছু দুধের চাহিদা ১৪ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন টন এবং একই সময়ে উৎপাদন হয় ৬ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন টন অর্থাৎ প্রতিদিনের ঘাটতি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৫১ মিলিয়ন টন। এই বিশাল ঘাটতি পূরণের জন্য এখন আমদানি বাণিজ্যই একমাত্র ভরসা। অথচ এসব পণ্যে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে তা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না। অথচ এই শিল্পের বিকাশে বাংলাদেশে যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে তা বাস্তবায়িত করা গেলে দেশ পুষ্টিতে স্বয়ম্ভর হবে।
গণমাধ্যমে জানা যায়, প্রতিনিয়তই খবর আসছে, নামেই তরল দুধ খাচ্ছি কেমিক্যাল, যার কারণে শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যানসারসহ মরণব্যাধি। ভেজাল দুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী জড়িত, যাদের দুধ উৎপাদনের কোনো প্রয়োজন হয় না, গবাদিপশুর খামারও তৈরির কোনো তাগিদ থাকে না, একটা ব্লেন্ডার মেশিনে হাফ কেজি খাঁটি দুধ দেয়া হয়, তার সঙ্গে জেলি, ডিটারজেন্ট পাউডার, হাফ কেজি সয়াবিন তেল, চিনি, স্যালাইন, লবণ, গুঁড়োদুধসহ পরিমাণমতো বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে ব্লেন্ডিং করে তৈরি হয় ভেজাল দুধ, যা খাঁটি দুধ হিসেবে বাজারে আসছে ভোক্তাদের মাঝে।
গবেষকরা বলছেন, এই দুধ পান করে জটিল রোগের বিস্তার ঘটছে। যেমন কিডনি জটিলতা, লিভার ক্যানসার ইত্যাদি মানুষকে নীরবে হত্যা করছে, যা মেনে নেয়া যায় না। বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকা দুগ্ধপল্লি নামে পরিচিত। যেমন সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জেয়ালা গ্রাম। যেখানে ভেজাল কারবারিদের কারণে স্থানীয় দুগ্ধ খামারিরা ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এভাবে খামারিরা টিকে থাকবেন কীভাবে? এ ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ তেমন কিছুই করতে পারছে না, প্রভাবশালী কোম্পানির কারণে। মজার ব্যাপার যে, এসব ভেজাল কারবারিরা তাদের দুধ, বিশেষত নামীদামি কোম্পানির কাছে সরবরাহ করে থাকে বলে জানিয়েছে এদের জন্য গঠিত মোবাইল কোর্ট। দেশে ক্যানসার বৃদ্ধির মূল কারণ খাদ্যে ভেজাল, যার মধ্যে দুধ অন্যতম। প্রতিদিন তিন হাজার রোগী আসে ক্যানসার ইনস্টিটিউটে সেবা নেয়ার জন্য ও ভেজাল খাদ্যের কারণে। শিশু থেকে সব বয়সের রোগীর পাকস্থলীতে ক্যানসারের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এখন জাতিকে রক্ষা করতে হলে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।
বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের লক্ষ্য ভোক্তার কাছে মানসম্মত ও গ্রহণযোগ্য মানের দুগ্ধ উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রাণিসম্পদ ও দুগ্ধ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। দুধকে একটি আদর্শ খাদ্য বলা হয় যেখানে পুষ্টির সব গুণাবলি রয়েছে, যা বিশেষ করে শিশুদের শারীরিক গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই দুধের পবিত্রতা রক্ষা করা সবারই দায়িত্ব, বিশেষ করে উৎপাদক (চাষি), ব্যবসায়ী (ঘোষ) ও প্রক্রিয়াজাতকরণ (কোম্পানি) পর্যায়ে যার সঙ্গে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত রয়েছে। বর্তমান সময়ে খাদ্যে নিরাপত্তায় ভেজাল একটি বহুল আলোচিত বিষয় এবং পত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশনের টকশোতে একটি জনপ্রিয় ফিচার বলে আলোচিত। এখন মানুষ খুব স্বাস্থ্য সচেতন। বিশেষত ভোজালমুক্ত খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে। সম্প্রতি সরকার ৫২টি কোম্পানির পণ্যকে ভেজাল পণ্য হিসেবে নিষিদ্ধ করেছে। আরও মজার ব্যাপার, রমজান মাস এলেই এসব ভেজালবিরোধী অভিযানের নিবিড়তা বেড়ে যায় এবং বিভিন্ন কোম্পানিকে ভেজাল খাদ্যের জন্য লাখ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ‘বাংলাদেশ দুধসংকট ২০১৯’ এই নামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউশন তাদের জারি করা প্রত্যয়নের আওতায় দেশের যে ১৪ কোম্পানি পাস্তুরিত দুধের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, দৈবচয়নের মাধ্যমে দুধের নমুনা সংগ্রহ করে দেশের চারটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে নির্ধারিত বিষয়ে আদালতে তার প্রতিবেদন দিতে হবে। এসব কোম্পানির দুধে অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যাকটেরিয়া, ফরমালিন, ডিটারজেন্ট, কলিফর্ম, অম্লতা ও স্টেফাইলোকক্কাস- এসব ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে কিনা? এ কারণে বাজারে প্রচলিত পাস্তুরিত প্যাকেটজাত দুধের বিশুদ্ধতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে বর্তমান প্রজন্ম সবল শরীর নিয়ে বেড়ে উঠবে তা কীভাবে আশা করা যায়? তা হলে কী দুগ্ধসংকট কাটছে না? দেশে বিদ্যাশিক্ষায়ও প্রযুক্তির অনেক প্রসার হয়েছে, জাতীয় প্রবৃদ্ধি তথা আয় বেড়েছে, মানব উন্নয়ন সূচকে ঊর্ধ্বগমন ঘটেছে কিন্তু ব্যবসায় লাভের আশায় দুধে ভেজাল মেশাতে আমাদের এতটুকু দ্বিধা মনে হয় না, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য বিশেষ হুমকি। আমরা চায়নিজ দুধ স্ক্যান্ডাল ২০০৮-এর কথা শুনেছি, যেখানে দুজনের মৃত্যুদণ্ড ও তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে ছিল। তাদের অপরাধ ছিল মেলামাইনযুক্ত প্রোটিন পাউডার উৎপাদন ও বিক্রি, যা দুধে মিশ্রিত হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হলো, পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে দুধের অবদান অনস্বীকার্য এবং পুষ্টিবিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় এটি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ দুগ্ধ শিল্পের ওপর শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ খুবই সীমিত। যদিও দেশে একটি ভেটেরাইনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়সহ দুটি-তিনটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় কিংবা পশুপালন অনুষদে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রমে কিছু গবেষণা পরিচালিত হয়ে থাকে। এসব গবেষণার ফল দেশের দুগ্ধশিল্পের বিকাশে কতটুকু অবদান রাখছে তার সম্প্রসারণ ও প্রচারের দায়িত্ব সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত। এই সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকটি ডেইরি ফার্ম সরকারি কাঠামোতে পরিচালনা করছে, যার মধ্যে সাভার ডেইরি ফার্ম উল্লেখযোগ্য। যার উদ্দেশ্য প্রজনন, উৎপাদন, গবেষণা ও সম্প্রসারণ। এই খামারের উৎপাদিত দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ঢাকা শহরে বিপণন করা হয় যা সাভার ডেইরি হিসেবে পরিচিত। তা ছাড়া মিল্কভিটা দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণের ও দুগ্ধ সামগ্রী বিতরণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। দেশে সরকারের পাশাপাশি ১৪ সরকারি কোম্পানি দুগ্ধ উৎপাদন প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত যাদের পণ্য সামগ্রী তরল দুধ, মিল্কপাউডার, ঘি, ছানা, পনির, মাখন ইত্যাদি। দেশীয় কোম্পানিগুলো মনে করে বর্তমানে প্রচলিত দেশীয় শিল্পনীতিকে সহায়তা দিলে দেশে গ্রামে অবস্থিত দুগ্ধ খামারি ও শহরকেন্দ্রিক কোম্পানিগুলো তরল কিংবা গুঁড়ো দুধের চাহিদা মেটাতে পারবে। আবার দুধ আমদানিতে বছরে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে তা যদি দেশীয় শিল্পে বিনিয়োগ করা যেত তা হলে এই শিল্পে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারত।
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, সিটি ইউনিভার্সিটি