বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
৯ আশ্বিন ১৪৩২

‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
প্রকাশিত
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
প্রকাশিত : ৭ মার্চ, ২০২৪ ১১:০৫

৭ মার্চের ভাষণ সব স্বাধীনতাকামী জাতির জন্য এক প্রামাণ্য দলিলস্বরূপ, যার প্রতিটি শব্দ এক একটি পুস্তকসম। এ ভাষণের মাধ্যমে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়, স্বাধীনতার প্রস্তুতি নেয়, যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়, প্রাণ বিসর্জন দেয়, চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে নেয়। আজ থেকে ৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালের এ তারিখে পদ্মা-মেঘনা-যমুনাবিধৌত এ অঞ্চলের মানুষ একটি ভাষণ শুনেছিল। যে মানুষটি ’৪৮ থেকে শুরু করে ’৭১ পর্যন্ত সময়ে ধাপে ধাপে সেই মহাজাগরণের ডাকটি দেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন ইতিহাসের সমান্তরালে আর দেশের মানুষকে প্রস্তুত করেছেন, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এক মহাজাগরণে শামিল হয়ে ইতিহাসে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সময় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে; তিনিই হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উদ্বেলিত মহাসমাবেশে বলিষ্ঠ কণ্ঠে যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, তা বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। বঙ্গবন্ধুর সেই তেজোদীপ্ত উচ্চারণ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, সেই ভাষণ আজও বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করে, অনুপ্রাণিত করে।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৭ মার্চের ভাষণের শুরুতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাদেশের মানুষের নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক অন্যায়ভাবে এবং বিনা কারণে বাংলার মানুষের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, গুলি ও রক্তপাত করা হয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে সমঝোতার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন; কিন্তু তারা সমঝোতা না করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুরে গুলি চালিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে হতাহত করেছে। এরূপ রক্তের করুণ ইতিহাস পুরা পাকিস্তানি শাসনকালজুড়ে বিরাজমান ছিল। সর্বোপরি ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে জাতির পিতা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ২৩ বছর ধরে পাকিস্তানি শাসকদের বাংলাদেশের মানুষের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন। যা বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মানুষের স্বেচ্ছায় যোগদান এবং দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক, যুবক, বৃদ্ধ, শ্রমজীবী সবার সহযোগিতা করার প্রয়াস পেয়েছে।

বাংলার মানুষকে এবং জাতিকে জাগানোর লক্ষ্যে তাদের অসীম সাহস, শক্তি ও বীরত্বকে কাজে লাগানোর নিমিত্তে তিনি বলেছেন আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না। দমন, নিপীড়ন বা চাপ প্রয়োগ করে এ দেশের মানুষকে বশীভূত করে রাখা যাবে না। এরূপ প্রেষণা বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে ও সংগঠিত হতে সহায়তা করেছে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তা অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে।

জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণের পরই মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভাজন এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় ও সমগ্র জাতি স্বাধীনতার জন্য দিকনির্দেশনা পেয়ে যায়। সমগ্র জাতি দেশ স্বাধীন করার নিমিত্তে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এ প্রস্তুতির মধ্যে মানসিক প্রস্তুতি, যুবসমাজকে সংঘটিত করা, অস্ত্র সংগ্রহ, যুদ্ধ যাত্রা, প্রতিরোধ করার অভিপ্রায়, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। যা পুলিশ বাহিনী, সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী, সাংবাদিক, পেশাজীবী, ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ মানুষের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। ১৯৭১ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশ কর্তৃক প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ এ নির্দেশনার ফলস্বরূপ।

বঙ্গবন্ধু বাংলাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড এবং ক্ষুধামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ার। তিনি এক সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে তিনি তৈরি করবেন দক্ষ মানবসম্পদ আর যারা হবে নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান, সুশিক্ষিত নাগরিক। একটি সামাজিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে নিউজ উইক ম্যাগাজিন ওদের একটি কভার স্টোরিতে বঙ্গবন্ধুকে Poet of Politics বলে আখ্যায়িত করে।

বঙ্গবন্ধু শুধু একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন না; তিনি ছিলেন বিশ্বমাপের কূটনীতিবিদ। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সবকিছুকে প্রকাশ করেছেন একজন কূটনীতিবিদের মতো। তিনি বলেছেন, বিগত ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। তিনি ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর নির্বাচন, ’৫৮-এর সামরিক শাসন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনসহ তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালিদের বঞ্চনার কথা জানিয়েছেন; অন্যদিকে যুদ্ধকৌশলও বলে দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন-যদি যুদ্ধ হয়, তবে বাঙালিরা যেন বর্ষাকালকে বেছে নেয় যুদ্ধের জন্য। কিন্তু পাকিস্তানিরা এ বক্তৃতার সারমর্ম বুঝতে পারেনি; বরং তৎকালীন ‘Pakistan Chief Marshal Law Administrator বলেছিলেন, ‘This is the best speech under the circumstances.’

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিশলাকা, যা প্রজ্বালিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই দাবানলের, যার সামনে টিকতে পারেনি শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীরা। ১৯৭১-এর ৭ থেকে ২৫ মার্চ এ ১৮ দিনে এ ভাষণ বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে, স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। জন রিড রচিত বিশ্বখ্যাত ‘Days that shook the world’-যে কটি দিনে রাশিয়ায় মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বাঙালির কাছে ওই ১৮ দিন। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাটি এসেছিল ২৬ মার্চের প্রথমে প্রহরে।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি যদি আমরা সাহিত্য সমালোচনার দৃষ্টিতে বিচার করি, তাহলে সহজেই এর মহাকাব্যিক আঙ্গিক উপলব্ধি করতে পারি। মহাকবিরা সাধারণত কোনো জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তার লেখার উপজীব্য বা বিষয়বস্তু হিসেবে নির্ধারণ করেন, যার মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেন সংশ্লিষ্ট জাতির ইতিহাস, যা পাঠ করে মানুষ আন্দোলিত হয়, অনুপ্রাণিত হয় এবং কোনো মহৎ কর্মে দীক্ষিত হয়। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু কয়েক মিনিটের একটি অলিখিত ভাষণ সেটিরই প্রতিরূপ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি মহাকাব্যিক আবেদন মহাকালই বিচার করবে। লাখো জনতার সামনে একটি অনুপম কবিতার মতো, স্ফুলিঙ্গের মতো ও সাগরের উত্তাল জলরাশির মতো সত্য সুন্দর শব্দগুলো উচ্চারণ করেছেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা মুক্তিকামী মানুষের কাছে লাল-সবুজ পতাকাকে মূর্তিমান করে তোলে। আর এরই মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয়। সাংবাদিক শেরিল ডান বলেছেন, ‘বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলেন একমাত্র নেতা; যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, সংস্কৃতিতে এবং জন্মে একজন পূর্ণাঙ্গ বাঙালি। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অসীম। তার কণ্ঠ বজ্রকঠিন। তার মোহনীয় ব্যক্তিত্বে সহজেই আবিষ্ট হয় সাধারণ মানুষ। তার সাহস এবং অনুপ্রেরণা শক্তি তাকে এ সময়ের অনন্য সেরা মানবে পরিণত করেছে।’

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিস্মরণীয় ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক দলিল; যা ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্বসংস্থা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের মহামূল্যবান দলিল (ডকুমেন্টারি হেরিটেজ) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তার সঙ্গে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিও) এ ভাষণটি সসম্মানে সংগৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রকারান্তরে জাগিয়ে তুলেছিল বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন। আজও ভাষণটি শুনলেই শরীরের ভেতর কেমন যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। তনুমনে রক্তধারা টগবগিয়ে ওঠে। প্রেরণা জোগায় স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার।

৭ মার্চের ভাষণকে বলা যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক দিকনির্দেশনা। পাকিস্তানিদের ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানা দেখেই আওয়ামী লীগের নেতৃবর্গ বুঝতে পেরেছিলেন, কোনোভাবেই আওয়ামী লীগকে জাতীয় পরিষদে সরকার গঠন করতে দেবে না পশ্চিমা শাসকরা। এমতাবস্থায়, দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী দিশেহারা হওয়া শুরু করে। নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরাসরি স্বাধীনতার ডাকও দিতে পারছিল না, আবার পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র মুখ বুজে সহ্য করাও ছিল কঠিন। সে জন্যই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে একটি নির্দেশনামূলক ও যুগান্তকারী ভাষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে মিশে আছে বঙ্গবন্ধুর অবদান। তার অনন্য সাধারণ বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ভাস্বর ওই ভাষণে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে একসূত্রে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- ছিল মূলত নিপীড়িত-নিষ্পেষিত বাঙালির পক্ষে স্বাধীনতার ডাক। ইতিহাস সৃষ্টিকারী সেই জ্বালাময়ী ভাষণের ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির বহুকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন-সাধ-স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তৎকালীন সময়ে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি আমাদের প্রিয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তখন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঘোষণা প্রদান করেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। এসব কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত।

পরিশেষে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সুচারুভাবে বিশ্লেষণ করলে এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিকটি সমান্তরালভাবে চোখে পড়ে। শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সে ভাষণটি প্রদান করেননি। বাঙালি সেদিন তার মাধ্যমে তাকে কেন্দ্র করে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল। তাই, তার প্রতিটি পদক্ষেপ ও বাণী ছিল বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার নিয়ন্ত্রক। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অপ্রতিম ভাষণের গুরুত্ব সব দিক বিবেচনায় অনন্য এবং অসাধারণ কারণ এ ভাষণের মাধ্যমে তিনি সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন; যা তার মতো নরশার্দুল ক্যারিশমাটিক জনগণ নন্দিত নেতার দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল।

লেখক: উপাচার্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

এখন আত্মহত্যার মহামারি চলছে

মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব
আপডেটেড ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২২:১৯
সম্পাদকীয়

সামাজিক মাধ্যমসহ পত্র-পত্রিকা খুললেই আত্মহত্যার সংবাদ। পূর্বের তুলনায় বর্তমানে সুযোগ সুবিধাসহ মানুষের জীবনের মান বাড়ালেও এখন কেন এত দুঃখজনক ঘটনা? তাই সংগত কারণেই হাতে কাগজ-কলম তুলে নিয়েছি।

মূলত মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, প্রকৃতিগত শাশ্বত ধারায় কেউ মৃত্যুকে রোধ করতে পারবে না। মেনে নিতে হবে মৃত্যুকে যেভাবেই হোক। তবে এই মৃত্যুর ফয়সালা আমাদের হাতে নয়। আত্মহত্যা বা আত্মহনন হচ্ছে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াবিশেষ। ল্যাটিন ভাষায় সুই সেইডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। যখন কেউ আত্মহত্যা করেন, তখন মানুষ এ প্রক্রিয়াকে আত্মহত্যা করেছে বলে অভিহিত করে থাকে। তথ্যমতে জানা যায় যে, সুদূর প্রাচীনকাল থেকে আত্মহত্যা চলে আসছে। তবে কোন সময় এটি ভালো চোখে দেখা হয়নি। এই ধরনের মৃত্যু নিজেই নিজেকে হত্যা করা। আসলে নির্মমভাবে নিজেকে হত্যার নামই আত্মহত্যা। সুখ-দুঃখ মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। মানুষ অতি আনন্দে ও উচ্ছ্বাসে যেমন বেড়ে উঠে; তেমনি অতি দুঃখে হতাশাগ্রস্ত জীবনের মুখোমুখি হয়ে থাকে। আর এটি প্রায় মানুষের বেলায় এটি চরম সত্য। মানুষ যখন চরম থেকে চরম দুঃসহনীয় সময়ে অতিবাহিত করে। তখন অবস্থাভেদে আবেগে আপ্লুত হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিজেকে নিজেই হত্যা করার মতো বিষয় বেছে নেয়। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো পরিস্থিতি তার আয়ত্তে থাকে না। শুধুই মাথায় ঘুরপাক খায় কিভাবে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। কেবল একই চিন্তা নিজেকে শেষ করতে পারলেই বুঝি বাঁচা গেল। এমন কষ্টের আর দুর্দিনের পরিস্থিতিতেই মানুষ আত্মহত্যার মতো নিকৃষ্ট পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যা যে কত নির্মম, আত্মহত্যা যে কত নিষ্ঠুর-তা যদি একজন আত্মহত্যাকারী তার মৃত্যুর আগে সুস্থ মস্তিষ্কে বুঝতে পারত! তাহলে হয়তো এ পথে কখনও আসত না। এই নিষ্ঠুর ঘটনা হতে পারে একটি পরিবারের স্বপ্ন ভঙ্গের অন্যতম কারণ। যেটি পরে রূপ নেয় ভয়ংকর বিষণ্নতায় মোড়া এক অলীক পরিণতির। কেন এই আত্মহত্যার প্রতি মানুষের এত ঝুঁকে পড়েছে? কেন এই সিদ্ধান্ত নিতে মানুষ একটা মুহূর্তের জন্যও এতটুকু ভেবে দেখে না। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। আর বিশ্বে যে সব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার মধ্যে আত্মহত্যা ১৩তম অবস্থানে। উল্লেখ্য যে, কিশোর-কিশোরী, আর যাদের বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের নিচে, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। পুরুষদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি। তথ্য মতে জানা যায় যে, প্রায় ২৭% থেকে ৯০% এরও বেশি সময় আত্মহত্যার সাথে মানসিক অসুখের সম্পর্ক থাকে। এশিয়াতে মানসিক রোগের হার পশ্চিমা দেশের চেয়ে অনেক কম। বস্তুত আত্মহত্যার মাধ্যমে যারা মারা যায়, তাদের প্রায় অর্ধেকের মধ্যে জটিল ডিপ্রেশন থাকতে পারে। এক্ষেত্রে মানসিক রোগ যেমন বাইপোলার ডিসঅর্ডার আত্মহত্যার জন্য ২০ গুণের বেশি ঝুঁকি বাড়ায়। সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৫% মানুষ আত্মহত্যা করে। তবে ইসলাম ধর্মে উল্লেখ আছে যে, আত্মহত্যা করা কবিরা গুনাহ বা বড় গুনাহ। যা তাওবা ছাড়া মাপ হওয়া সম্ভব না। একমাত্র তাওবার মাধ্যমেই এ গুনাহ থেকে মাফ পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির তাওবার কোনো সুযোগ নেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আমাদের বিষন্ন লাগতেই পারে। মন খারাপ হতে পারে, হতাশা থাকতে পারে। এগুলো কোনো বড় বিষয় নয়। শরীরের রোগের মতো মনের রোগের চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। আমাদের মনের যত্ন নিতে হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে, এ জায়গায় নিজেকে কঠোর থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, জীবনে আঘাত, দুঃখ, বেদনাও কষ্ট আসে জীবনকে শক্ত করার জন্য; মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য নয়। মৃত্যু আমাদের জীবনের লক্ষ্য নয়, বেঁচে থাকাটাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য।

বাংলাদেশে যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন; আবেগ নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা; দাম্পত্য কলহ; উত্ত্যক্তকরণ; প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা; দারিদ্র্য ও বেকারত্ব; আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা; মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে বেশির ভাগ আত্মহত্যা ঘটে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রচার মাধ্যমে আত্মহত্যার সংবাদের অতিপ্রচার, অপপ্রচার বা অদায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনের কারণেও কখনো কখনো আত্মহত্যার ঘটনার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। এভাবে আত্মহত্যার প্ররোচনার অর্থ এমন পরিস্থিতি সচেতনভাবে সৃষ্টি করা, যা পীড়িত মানুষটির সামনে এ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ই অবশিষ্ট থাকে না। এদিকে নিদারুণ অপমানের শিকার হয়ে নীরব প্রতিবাদ হিসেবে বহু মানুষকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে দেখা যায়। এ প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালের প্রথম দিকে একটি আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আত্মহননকারী ব্যক্তি ফেসবুক লাইভে এসে নিজের পরিবারের সদস্য, সহকর্মীদের কাছ থেকে নানা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করে। ওই ব্যক্তি নিশ্চয়ই চরম হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করেছে। ফেসবুকে লাখো-কোটি মানুষ তার আত্মহত্যার ভিডিওটি দেখেছেন। প্রশ্ন হলো, আমাদের মানবিক বোধগুলো কি এতখানি নিচে নেমে গেছে যে, কোনো কিছুই এখন আর আমাদের স্পর্শ করে না। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত করোনাকালে একটি জরিপ করেছিল বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন। তাতে দেখা গেছে, ওই সময় দেশে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। জরিপমতে বিশ্বে পুরুষ আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা বেশি হলেও বাংলাদেশে নারীরা বেশি আত্মহত্যা করে। এক্ষেত্রে নারী ৫৭ শতাংশ, পুরুষ ৪৩ শতাংশ। সাধারণত ঝিনাইদহে অধিক আত্মহত্যা সংঘটিত হয়। আর কোনো ব্যক্তি কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে আত্মহত্যা করেন না। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে।

উল্লেখ্য যে, বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার প্রবণতা কমছে। সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি নানা উদ্যোগের কারণে এ প্রবণতা নিম্নমুখী। কিন্তু বাংলাদেশে কিছুটা কমলেও আত্মহত্যার হার এখনও তুলনামূলক অনেক বেশি। আর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আত্মহত্যাপ্রবণ দেশ। এখানে বয়সভিত্তিক আত্মহত্যার প্রবণতায় দেখা যায়। এক্ষেত্রে ১০ থেকে ২৯ বছর বয়সি নারীর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ আত্মহত্যার হার বাংলাদেশে। এদিকে ভৌগোলিকভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয়। প্রতি লাখ মানুষে ১৯ দশমিক ২ জন আত্মহত্যা করে থাকেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ১১ দশমিক ৪ জন, যা বৈশ্বিক গড়ের (৯ দশমিক ০) চেয়ে বেশি। শুধু তাই নয়, ৩০ থেকে ৪৯ বছর বয়সি নারীর আত্মহত্যার হারও আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। বয়স্কদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতাও কম নয়। ইদানীং তথ্য প্রযুক্তি উন্নতির পথ ধরে মোবাইলে অপসংস্কৃতির কারণে মাঝে মধ্যে আত্মহত্যার কথা শোনা যায়।

সত্যি কথা বলতে কি, দেশে প্রতিবছর গড়ে ২০ হাজারের উপরে আত্মহত্যা করে। তাদের মধ্যে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরী। আর ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। এদিকে আর শহরের চেয়ে এ হার গ্রামে বেশি। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, কিশোর বয়সে নানা কারণে হতাশা তৈরি হয়, যা থেকে বিষন্নতা দেখা দিতে পারে। যথাসময়ে চিকিৎসা বা কাউসেলিং করা না হলে এই বিষন্নতা আত্মহত্যার দিকে টেনে নিয়ে যায়। কিশোরীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, বিশ্বে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। তারা এ বয়সে ব্যর্থতা মোকাবিলা করার শিক্ষা অনেক সময় পরিবার ও সমাজ থেকে পায় না। একটুতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া। তাদের সঙ্গে সময় কাটানো ও অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া। সময়মতো সঠিক সেবা দেওয়া গেলে আত্মহত্যার অনেক ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি, এটি এমন একটি প্রপঞ্চ, চেষ্টা করে নির্মূল করা যাবে না। তবে বিভিন্ন ভাবে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। উল্লেখ্য যে, কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা কম। বেশির ভাগ সময় তাদের ছোটখাটো মানসিক উদ্বেগকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। ফলে বড় ধরনের মানসিক সংকটে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বলতে গেলে দেশে এর মহামারি চলছে। তাই স্কুল পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু এবং শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সমীচীন বলে মনে করি।

লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।


কৃষিঋণ নীতিমালা ও কৃষকের খাদ্যনিরাপত্তা

ড: মিহির কুমার রায়
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

দেশে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই হিসাবে ৩৯ হাজার কোটি টাকার কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছ যাগত অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা, যা এ বছর ২.৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষকদের সহায়তা নিশ্চিত করতে এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও কৃষিখাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করাই এর মূল উদ্দেশ্য।নীতিমালায় নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে— প্রাণিসম্পদ খাতে বরাদ্দ ২০ শতাংশ করা, সেচ ও কৃষিযন্ত্রপাতি খাতে ২ শতাংশ বরাদ্দ, ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণের সিআইবি সার্ভিস চার্জ মওকুফ, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আওতা বৃদ্ধি, খিরা, কচুর লতি, বিটরুট, কালোজিরা, আদা, রসুন, হলুদ, খেজুর গুড় ইত্যাদি নতুন ফসল ঋণ নীতিতে অন্তর্ভুক্ত এবং অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদন সম্ভাবনা অনুযায়ী ঋণ বিতরণের নির্দেশনা। বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, কৃষি ও পল্লী খাতে পর্যাপ্ত ঋণ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং টেকসই অর্থনীতি গঠনে এ নীতিমালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

দেশের কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। খাদ্যনিরাপত্তা ও উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা ও কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনীহার ফলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো এখনো সম্ভব হয়নি। হয়।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৯৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। আগের অর্থবছরের ৩৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কৃষিঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা, যা ওই অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ১০৬ দশমিক ১৫ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার শতভাগের বেশি ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকগুলো। তবে গত অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও আগের অর্থবছরের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১৭২ কোটি টাকা। সেই সঙ্গে এক বছরে কৃষিঋণ আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ কৃষকরা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছেন বেশি। পুরো অর্থবছরে কৃষিঋণ আদায় হয়েছে ৩৮ হাজার ২৪ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে আদায়ের পরিমাণ ছিল ৩৫ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। ফলে এক বছরে আদায় বেড়েছে ২ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। সবমিলে গত জুন শেষে কৃষি খাতে বিতরণ করা ঋণের বকেয়া স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ২৩২ কোটি টাক, যা ২০২৪ সালের জুনে ছিল ৫৮ হাজার ১১৯ কোটি টাকা।

জানা গেছে, গত অর্থবছরে যেসব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের জরিমানা হিসেবে অনর্জিত অংশ কেটে নিবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কমন ফান্ড (বিবিএডিসিএফ)’ নামে তহবিলে জমা করা হবে এবং জমাকৃত অর্থ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকারী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ করা হবে। । যেসব ব্যাংকের নিজস্ব শাখা পল্লি অঞ্চলে নেই, তাদের ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা বা এনজিওর মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের (এমআরএ) নিবন্ধিত এনজিও সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা হবে এবং তারা যেন অতিরিক্ত সুদ নিতে না পারে, সে জন্য সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, দেশে উৎপাদন বাড়াতে কৃষিঋণ বিতরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য প্রতিবছর কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ঘোষণাকরা হয় এবং লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ৩৮ হাজার কোটি টাকা এবং ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ২ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এবার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা (২০২৫-২৬) বছরেধরা হতে পারে সাড়ে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অভিযোগ আছে, প্রতিবছর কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলেও ব্যাংকগুলোর ছলচাতুরির কারণে তার উল্লেখযোগ্য অংশ কৃষকের কাছে পৌঁছায় না। ব্যাংকগুলো অন্য খাতে ঋণ দিয়ে তা কৃষিঋণ বলে চালিয়ে দেয়। আবার বিভিন্ন ফরমালিটিসের কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া কৃষকের পক্ষে কঠিন। উপরন্তু নেটওয়ার্ক তৈরি করতে না পারায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের কৃষিঋণের অধিকাংশই এনজিও নির্ভরতায় বিতরণ করে।

কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার পেছনে চারটি কারণকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এগুলো হলো- গত বছরের আগস্টে সরকার পতনের পর সৃষ্ট অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সুদের হার বৃদ্ধি ও ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট। সাম্প্রতিক গত বছর দুটি বন্যায় কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার নিত্যপণ্যের বাজারেও রয়েছে অস্থিরতা। এ অবস্থায় কৃষি ঋণ বিতরণ কমে আসায় আসন্ন খরিপ, রবি ও বোরো মৌসুমে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক দুটি বন্যা ও এর আগের খরার প্রভাবে এবার আরো বেশি করে কৃষি ঋণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণ বিতরণে জোর না দেয়ায় ঋণ প্রবাহ কমেছে। এতে উৎপাদন কমে খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি সামনের দিনগুলোয় মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা আরো জোরালো হয়ে উঠতে পারে।যদিও ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, জুলাই-আগস্টের অস্থিরতা ও ব্যাংক খাতে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী অনিশ্চয়তার প্রভাবে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষিতে ঋণপ্রবাহ কমলেও সামনের দিনগুলোয় তা আবারো বাড়বে।এ ব্যাপারে কৃষিঅর্থনীতিবিগন মনে করেন ‘সাম্প্রতিক দুটি বন্যা এবং খরাসহ নানা উপদ্রবে এবার কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই বন্যা-উত্তর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এবার আরো বেশি করে ঋণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না থাকায় ঋণ প্রবাহ কমেছে। ফলে খরিপ /রবি মৌসুমের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য আমদানি নিশ্চিতের পথে বড় বাধা হয়ে উঠেছে ডলার সংকট। তাই সার্বিক কৃষিপণ্য সরবরাহ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরো উস্কে দিতে পারে।’এ ব্যাপারে ব্যাংকারদে র মন্তব্য হলো গত বছর জুলাই-আগস্টে সার্বিক ঋণ প্রভাব কমে এসেছিল। তখন মানুষ বের হতে পারেনি। আবার ১০-১২ ব্যাংক কিছুটা সমস্যায় পড়েছিল। তারাও তখন ঋণ দিতে পারেনি। তাই সার্বিক কৃষি ঋণ বিতরণে এটা প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু কৃষি ঋণের টার্গেট দেয়া থাকায় এটা আমাদের দিতেই হবে। আগামীতে আশা করছি ঋণ বিতরণ বাড়বে।’ কৃষি খাতে ঋণের প্রবাহকে একটি বড় প্রভাবক বলে মনে করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের,তদের মতেঋণ না পেলে প্রান্তিক কৃষক কীভাবে উৎপাদন করবে? গতবার আলু উৎপাদন কম হওয়ায় চালের ওপর চাপ পড়েছে। তাই আগামীতে উৎপাদন বাড়াতে কৃষি ঋণের বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে ।

গত বছরের শেষ দিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় কৃষিঋণ বিতরণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে; বিশেষত জুলাই-আগস্টে ঋণ বিতরণ ও লেনদেন কমে যায়। তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ঋণ বিতরণে গতি ফিরেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইতিবাচক অগ্রগতি থাকলেও আরও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। ব্যাংকগুলোর কৃষি খাতে বিনিয়োগে উৎসাহ বাড়াতে হবে এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি জোরদার করা এবং কাঁচামাল ও উৎপাদন খরচ কমাতে সরকারের বিশেষ নীতিমালা গ্রহণ জরুরি। এখানে উল্লেখ্য যে গত বছরের মত এ বছরও আগের আশঙ্কাটি রয়েই যাবে সম্প্রতি ষোষিত জতিীয় সংসদ ইলেকশনের কারনে যা আগামী রমজানের আগে সংগঠিত হওয়ার কথা রয়েছে ।এই রকম একটা পরিস্থিতিতে কৃষকের মনে স্বস্থি নেই বিধায় কৃষি দেশের সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান খাত হলেও এখানকার উৎপাদকদের জন্য কোনো নির্ধারিত মূল্য নীতি নেই, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। পণ্যের অস্থির বাজারমূল্য, উৎপাদন ব্যয় না ওঠা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনাকে এই সংকটের চরম বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সময়ের আবর্তে এক সময় যেখানে কৃষিকাজে নিয়োজিত হাউজহোল্ডের সংখ্যা ছিল ৯০ শতাংশ, বতর্মানে এসে দাড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে, যা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি। চলতি বছরের বাজেটে কৃষি শস্য খাতের অংশ মাত্র ৩.৪%, যা টাকার অংকে দাড়ায় ২৭ হাজার ২২৪ কোটি। আবার কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। কৃষি খাতের নিম্নগামী প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না। তাই কেবল কৃষি ঋন নয়,তার জন্য নীতি সহায়তা জরুরী যাতে কৃষক বেচে থাকতে পারে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যা সময়ের দাবি ।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা


শিক্ষাঙ্গনে অশান্ত পরিবেশ: এ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিপূর্ণ

ড. দেওয়ান আযাদ রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

শিক্ষা একটি জাতির মৌলিক অধিকার ও উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। শিক্ষিত জাতিই পারে একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলতে।

শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ব্যক্তি জীবনে সংগতি বিধান করা বা সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলার যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করা। বর্তমান সমাজে জীবন যাত্রার প্রক্রিয়া অনেক জটিল। জটিল এ সমাজে চলার জন্য জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার অনেক বেশি সমৃদ্ধ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু শিক্ষা বলতে নির্দিষ্ট কতগুলো বিষয় পাঠদান কে বোঝায় না। এর পাশাপাশি সাফল্যের পথে ভবিষ্যতে সম্মুখীন হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা, প্রবণতা এবং মনোভাব ও মানসিকতা গড়ে তোলা বোঝায়।

শিক্ষাঙ্গন একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের পবিত্র ক্ষেত্র। এখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন করে, নৈতিকতা শেখে এবং ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত হয়।

বর্তমান সময়ে দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না, বরং তাদের ভবিষ্যৎকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।শিক্ষাঙ্গনের এই অস্থিরতা শুধু শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, বরং অভিভাবক, শিক্ষক ও সমগ্র জাতির জন্য একটি অশনিসংকেত।বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বারবার দেখা যাচ্ছে ছাত্র আন্দোলন, শিক্ষক নির্যাতন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, প্রশ্নপত্র ফাঁস, সেশনজট, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষক সংকট ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা।বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ কিংবা স্কুল—প্রতিটি স্তরেই দেখা যাচ্ছে দলাদলি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, শিক্ষকদের নিরপেক্ষতা হারানো, সেশনজট, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ক্রমবৃদ্ধি। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পড়াশোনা করতে পারছে না, তাদের মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে, মানসিক চাপ বাড়ছে এবং তারা হতাশায় ভুগছে। এসবের ফলে একটি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ গড়ে ওঠার পরিবর্তে তৈরি হচ্ছে একটি আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ পরিবেশ।

বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে হানাহানি অশান্তি বিশৃঙ্খলা চলছে এর কারণ মূল্যবোধের অবক্ষয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মর্যাদাবোধ থাকলে অশান্তি ও অস্থিরতা কমে আসত।

শিক্ষাঙ্গনের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত থাকে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়। শিক্ষকদের অবহেলা, অবকাঠামোগত সমস্যাও এই অশান্তির অন্যতম কারণ। একদিকে যেমন পাঠদানে ব্যাঘাত ঘটছে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গনের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে বা বিদেশে চলে যাচ্ছে।

শিক্ষিত হলেও কর্মসংস্থান নেই—এই বাস্তবতা শিক্ষার্থীদের হতাশায় নিমজ্জিত করে তুলছে। ফলে তারা সহজেই প্রতিবাদ, বিশৃঙ্খলা কিংবা হতাশায় নিপতিত হয়।

শিক্ষাঙ্গনের অস্থিরতা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চরম প্রভাব ফেলছে। তারা নিয়মিত ক্লাস করতে পারছে না, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে এবং অজানা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিদেশমুখী হয়ে পড়ছে, ফলে দেশের মেধা পাচার হচ্ছে।

এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দক্ষ, নৈতিক ও যোগ্য নাগরিক হয়ে উঠতে পারবে না। জাতির অগ্রগতি থেমে যাবে। তাই শিক্ষাঙ্গনে স্থিতিশীল, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। রাজনীতি, সহিংসতা, প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও দুর্নীতিকে দূর করে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। প্রশাসন ও শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি রোধে কঠোর নজরদারি ও শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে।

যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক আরও বন্ধুত্বপূর্ণ হতে হবে।পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষা বাদ দিয়ে দক্ষতা, নৈতিকতা ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট ও সহনশীলতার চর্চা শিক্ষার অংশ করতে হবে।

শিক্ষাঙ্গনে অশান্তি একটি জাতির ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।

শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করে, শিক্ষাকে জীবনমুখী করে শিক্ষায়তন থেকে অনাচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও ইভটিজিং দূর করতে হবে.। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতাবিষয়ক শিক্ষা, গণমাধ্যমে সুষ্ঠু প্রচারযোগ্য অনুষ্ঠান ও পারিবারিক মূল্যবোধ তৈরির যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

একটি মেধাভিত্তিক, সুশৃঙ্খল ও সুশাসিত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, আজকের প্রজন্ম একটি অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হবে, যার দায় আমাদের সবাইকেই নিতে হবে।

লেখক: প্রবন্ধকার ও গবেষক।


গামা রেডিয়েশন জীবাণু মুক্তকরণ এখন অপরিহার্য প্রযুক্তি

ড. মোখলেসুর রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছে, যেখানে রপ্তানি এ প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখার প্রধান চালিকাশক্তি। ঐতিহ্যগতভাবে দেশটি প্রস্তুত তৈরি পোশাক (RMG)-এর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছে, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি যোগান দেয়। তবে বর্তমানে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনা এবং নতুন উচ্চমূল্যের বাজারে প্রবেশের চাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ লক্ষ্যে, বাংলাদেশকে শুধু পণ্যের মান উন্নয়নই নয়, বরং আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা মানদণ্ড মেনে চলার ক্ষেত্রেও মনোযোগী হতে হবে। এই মানদণ্ড পূরণে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রযুক্তিগুলির একটি হলো গামা রেডিয়েশন জীবাণু মুক্তকরণ।

গামা রেডিয়েশন এক ধরনের আয়নীভূত বিকিরণ, যা নিরাপদ ও কার্যকর জীবাণুমুক্তকরণ পদ্ধতি হিসেবে ৬০টিরও বেশি দেশে স্বীকৃত। এটি ক্ষতিকর অণুজীব ধ্বংস করে, পণ্যের সংরক্ষণকাল বাড়ায় এবং খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের ভৌত বা পুষ্টিগুণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না এনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) খাদ্য নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের জন্য এই প্রযুক্তিকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে সমর্থন করেছে। গার্মেন্টস ও চিকিৎসা টেক্সটাইলের ক্ষেত্রেও গামা রেডিয়েশন ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর জীবাণুমুক্তকরণ নিশ্চিত করে, যা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কঠোর মানদণ্ড পূরণে সহায়তা করে।

মূল প্রশ্ন হলো: বাংলাদেশ কি গামা রেডিয়েশন জীবাণুমুক্তকরণকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত, এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিযোগিতামূলক রপ্তানিকারক হিসেবে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারবে কি?

বর্তমান প্রেক্ষাপট: রপ্তানি ও মানের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার বর্তমানে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যদিও পোশাক খাত এখনো প্রাধান্য বিস্তার করছে, ফল, শাকসবজি, মসলা, কোমল পানীয় ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি ধীরে ধীরে বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের মসলা ও ফলের চাহিদা বাড়ছে। তবে প্রায়ই রপ্তানি চালান বাতিল হয় মাইক্রোবিয়াল সংক্রমণ, কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ এবং সংরক্ষণের সীমাবদ্ধতার কারণে। প্রচলিত জীবাণুমুক্তকরণ পদ্ধতি যেমন রাসায়নিক ফিউমিগেশন, তাপ চিকিৎসা ও হিমায়ন কিছুটা কার্যকর হলেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাপে পণ্যের স্বাদ ও গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রাসায়নিক অবশিষ্টাংশ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে এবং হিমায়ন পরিবহন ব্যয় বাড়ায়। উপরন্তু, অনেক আমদানিকারক দেশ এখন রাসায়নিক ফিউমিগেশন পরিহার করছে এবং নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে বিকিরণকে বাধ্যতামূলক করছে।

গার্মেন্টস খাতে, বিশেষ করে চিকিৎসা টেক্সটাইল ও সুরক্ষা সামগ্রীর ক্ষেত্রে জীবাণুমুক্তকরণ অপরিহার্য। বর্তমানে বাংলাদেশে বৃহৎ পরিসরে রেডিয়েশন জীবাণুমুক্তকরণের অবকাঠামো প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে রপ্তানিকারকদের বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়, যা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ, এবং প্রতিযোগিতা কমিয়ে দেয়।

কেন গামা রেডিয়েশন জীবাণু মুক্তকরণ গুরুত্বপূর্ণ

প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় গামা রেডিয়েশন বেশ কয়েকটি সুবিধা প্রদান করে:

  • সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি – গামা রেডিয়েশন প্রয়োগে ফল, শাকসবজি ও মসলার সংরক্ষণকাল বাড়ে, পুষ্টিগুণ ও স্বাদ অক্ষুণ্ণ থাকে, যা দূরবর্তী বাজারে রপ্তানির জন্য উপযোগী করে তোলে।

  • মানদণ্ড পূরণ – ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মতো বাজারে কঠোর মাইক্রোবিয়াল নিরাপত্তা মানদণ্ড রয়েছে। গামা রেডিয়েশন এসব মান পূরণের নিশ্চয়তা দেয়।

  • অবশিষ্ট-মুক্ত প্রক্রিয়া – রাসায়নিক ফিউমিগেশনের মতো কোনো অবশিষ্টাংশ থাকে না, ফলে এটি পরিবেশবান্ধব ও ভোক্তাবান্ধব।

  • বহুমুখী ব্যবহার – খাদ্য, কোমল পানীয়, ঔষধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও গার্মেন্টস—সবখানেই এর ব্যবহার সম্ভব।

  • প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা – ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মতো দেশ ইতোমধ্যেই উন্নত বিকিরণ সুবিধা স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকলে বাজার হারানোর ঝুঁকি বাড়বে।

বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ

সম্ভাবনা যতই বড় হোক, বাংলাদেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি:

  • বৃহৎ প্রাথমিক বিনিয়োগ – একটি বাণিজ্যিক বিকিরণ প্ল্যান্ট স্থাপনে কোটি কোটি টাকা প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে কোবাল্ট-৬০ উৎস, সুরক্ষা অবকাঠামো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং দক্ষ জনবল।

  • সীমিত সচেতনতা – অনেক রপ্তানিকারক এখনো এর সুফল সম্পর্কে সচেতন নন। জনগণের মধ্যেও বিকিরণ নিরাপত্তা নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে।

  • নীতিগত কাঠামো – যদিও বাংলাদেশে নিউক্লিয়ার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান আছে, বাণিজ্যিক বিকিরণ সুবিধার জন্য বিস্তারিত নীতি ও নির্দেশিকা এখনো সীমিত।

  • দক্ষ জনবল – একটি বিকিরণ প্লান্ট পরিচালনায় রেডিয়েশন পদার্থবিদ, প্রকৌশলী ও সেফটি অফিসারের প্রয়োজন হয়। BAEC ও MIST-এর মতো প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা থাকলেও বৃহৎ পরিসরে প্রয়োগে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ দরকার।

  • বেসরকারি খাতের অনীহা – বিনিয়োগ ফেরত পেতে দীর্ঘ সময় লাগে, ব্যবসায়িক মডেল এখনো সুস্পষ্ট নয়, এবং সরকারি প্রণোদনা অনিশ্চিত হওয়ায় উদ্যোক্তারা দ্বিধাগ্রস্ত।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সম্ভাবনা ব্যাপক:

  • ফল ও সবজি রপ্তানি – বাংলাদেশ আম, আনারস, লিচু ও শাকসবজির বড় উৎপাদক। বিকিরণ প্রয়োগের মাধ্যমে এগুলো ইউরোপ ও জাপানের মতো বাজারে প্রবেশ করতে পারবে, যেখানে বর্তমানে কঠোর মানদণ্ড বাধা সৃষ্টি করছে।

  • মসলা ও ভেষজ পণ্য – হলুদ, আদা, মরিচের মতো মসলার মান বাড়াতে বিকিরণ কার্যকর। এতে জীবাণু নষ্ট হয় কিন্তু রঙ, গন্ধ ও তেল অক্ষুণ্ণ থাকে।
  • প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও কোমল পানীয় – প্যাকেটজাত খাবার, জুস ও রেডি-টু-ইট পণ্য বিকিরণে দীর্ঘস্থায়ী ও নিরাপদ হয়।

  • গার্মেন্টস ও চিকিৎসা টেক্সটাইল – কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী জীবাণুমুক্ত গার্মেন্টস, মাস্ক ও হাসপাতালের চাদরের চাহিদা বেড়েছে। বাংলাদেশ এ খাতে রপ্তানি বৈচিত্র্য আনতে পারে।

  • সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি মডেল – বিকিরণ সুবিধাগুলো সেবা খাতে পরিণত হতে পারে, যেখানে একাধিক রপ্তানিকারক নির্দিষ্ট ফি দিয়ে এই সুবিধা নেবে।

সরকারের ভূমিকা

এই সুযোগ কাজে লাগাতে সরকারের করণীয়:

  • নীতি সহায়তা – বাণিজ্যিক বিকিরণ কার্যক্রমের জন্য জাতীয় নীতি কাঠামো প্রণয়ন।
  • আর্থিক প্রণোদনা – ভর্তুকি, কর ছাড় ও স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান।

  • অবকাঠামো বিনিয়োগ – ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে পাইলট বিকিরণ কেন্দ্র স্থাপন।
  • সচেতনতা কর্মসূচি – ভোক্তা ও রপ্তানিকারকদের মধ্যে বিকিরণ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি।

  • ক্ষমতা বৃদ্ধি – IAEA-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।

বেসরকারি খাতের ভূমিকা

  • সুবিধা স্থাপন – উদ্যোক্তা ও রপ্তানি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার বা স্বতন্ত্রভাবে বিকিরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করতে পারে।
  • কনসোর্টিয়াম মডেল – মসলা রপ্তানিকারক, ফল উৎপাদক ও গার্মেন্টস প্রস্তুতকারীরা যৌথভাবে বিনিয়োগ করতে পারে।
  • গবেষণা অংশীদারিত্ব – বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা করে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন।

  • বাজার উন্নয়ন – ‘নিরাপদ, রাসায়নিক-মুক্ত ও বৈশ্বিক মানসম্মত’ ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি।

কৌশলগত রোডম্যাপ

  • স্বল্পমেয়াদি (১–৩ বছর) – পাইলট প্ল্যান্ট স্থাপন, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও সচেতনতা বৃদ্ধি।

  • মধ্যমেয়াদি (৩–৭ বছর) – প্রধান রপ্তানি অঞ্চলে সুবিধা সম্প্রসারণ, বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা।

  • দীর্ঘমেয়াদি (৭–১৫ বছর) – বাংলাদেশকে আঞ্চলিক বিকিরণ সেবার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং প্রতিবেশী দেশে প্রযুক্তি রপ্তানি।

উপসংহার

বৈশ্বিক রপ্তানি বাজার ক্রমেই প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে, যেখানে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যবিধি ও মান অগ্রাধিকার পাচ্ছে। গামা রেডিয়েশন জীবাণুমুক্তকরণ এখন আর বিকল্প নয়, বরং অপরিহার্য প্রযুক্তি। বাংলাদেশের জন্য এটি যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি বিরাট সুযোগ। চ্যালেঞ্জ হলো উচ্চ বিনিয়োগ খরচ, নীতি সীমাবদ্ধতা ও জনসাধারণের ভুল ধারণা। তবে সুযোগ আরও বড়—নতুন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ, রপ্তানি বৈচিত্র্য এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান।

সরকারি নেতৃত্ব এবং বেসরকারি বিনিয়োগের সমন্বয়ে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। আজকের সাহসী পদক্ষেপই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রপ্তানি সফলতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

প্রফেসর ড. মোখলেসুর রহমান

পারমাণবিক বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ

মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি


হৃদয়ের সুখী সার্বভৌম ও সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয় কী অপজ্ঞান?

রাজীব কুমার দাশ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

ফিনল্যান্ডের অন্যতম সুন্দর শহর হলো রাজধানী হেলসিঙ্কি, যা আধুনিকতা, নিরাপত্তা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক চমৎকার মিশ্রণ।

সে সুখী দেশ মানুষের, ‘হৃদয় উন্নয়ন জাতীয় দিবস কর্মসূচি’ বিতর্ক প্রতিযোগীতায় থেমে থেমে চলেছে —

‘হৃদয়ের সুখী সার্বভৌম ও সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয় কী অপজ্ঞান?’ শীর্ষক সেমিনার। হেলসিঙ্কি শহুরে প্রোগ্রামে বিশ্বব্যংকের প্রতিনিধি হয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্হাপক হিসেবে থাকছেন,কবি কৌশিক কানাই প্রান্ত।

মি. প্রান্ত একসময় সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। পড়া লেখার পাঠ চুকিয়ে বিশ্বব্যাংকের অধীনে মানব সম্পদ উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, পরিবেশ সুরক্ষা, এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছেন।

বিশ্বব্যাংকের এ জাতীয় প্রোগ্রামগুলোর লক্ষ্য হলো, বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন করা এবং অসুখী সমৃদ্ধ সদস্য দেশগুলোকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করার লক্ষ্যে, সুখী ধনীদের অলস টাকার উপরে প্রচ্ছন্ন চাতুর্য অপ মানবিক কৌশলে চড়া শুল্কহার বসিয়ে দেয়া।

বিশ্বব্যাংকের মূল কাজের সাথে যদিও সরাসরি এ ধরনের প্রোগ্রাম ঠিক যায় না; তদুপরিও বৌদ্ধিক চতুরার্য সত্যের পাশ কাটিয়ে কিছুটা মিশ্র অর্থনীতির মতো —‘মানুষের চির অধরা গুহ্য গুহাবাসী অপ চতুরার্য মন’ অভিসন্দর্ভের প্রয়োজনে মি. প্রান্ত আগবাড়ান আবেগের

তাড়নায়,- আসলে কী বহুমুখি জটিল কুটিল চাতুর্যময় জীবন বন্দনা গানে গানে যাপিত আগামী মানব জীবনে থিতু হতে চাইছেন? প্রয়োজন অপ্রয়োজন নিয়ে পয়ার ত্রিপদী ছন্দে জীবন পুঁথি রচনা করে চলেছেন?। দেশে দেশে নানান দেশে মানুষের সুখ দুঃখ আপেক্ষিক আবেগ বিবেক স্টোরে অপ হৃদয় উন্নয়ন পুঁজি খাটিয়ে পরের ধনে পোদ্দারি ব্যবসার নতুন নতুন সীলমোহর দিয়ে চলেছেন? মানুষের জ্ঞানের মার্গ ও হয় দু'প্রকার। জ্ঞান ও অপজ্ঞান। জ্ঞান খুলে দেয় হৃদয়ের বন্ধ দুয়ার। অপজ্ঞান বন্ধ করে দেয় হৃদয় মহান সকল দুয়ার।

জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০২৫ (World Happiness Report 2025) অনুযায়ী, ফিনল্যান্ড টানা অষ্টম বারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে নিজের স্থান ধরে রেখেছেন।

স্থান: হেলসিঙ্কি

বিশ্ববিদ্যালয় (University of Helsinki)

সেমিনার: সান্তা ক্লজ হল।

সুধী খই ফোটান মুখে, ‘হৃদয়ের সুখী সার্বভৌম ও সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয় কী অপজ্ঞান?’ শীর্ষক বিশ্বের হৃদয় ধস পুরস্কার জেতা সংস্কৃতির আসনে বসে আছেন — ফিনল্যান্ডের ভাগ্য জনগণ। তারা, জাতীয় সুখী ঠিকাদার কিম রাইক্কোনেন, জিন সিবেলিয়াস, রেনি হারলিন, (ডাই হার্ড ২) সান্তা ক্লজ জাতীয় গর্ব চরিত্রে যে যার মতো করে সুখী গর্ব সংজ্ঞা বলে চলেছেন।

‘হৃদয়ের সার্বভৌম ও সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয় কী অপজ্ঞান? শীর্ষক সেমিনার সময় দ্রুত এগিয়ে চলেছে। পৃথিবী অধিরাজ সময়ে রাজ অপমুকুট পরে সুখ ও সুখী দেশ বিচারক কে বা কারা কোথায় বসে আছেন? ধ্রুব চিরসত্য সময়ইবা জেগে আছে কতটুকু.! তা পৃথিবী সময়ে নির্ণিত হবে না কোনোদিন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক প্রাবন্ধিক ও কবি


সব হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা সংখ্যা বাড়ানো জরুরি 

রেজাউল করিম খোকন
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউর সামনে উদ্বিগ্ন স্বজন, প্রিয়জনদের জটলা কিংবা ভিড় লেগেই থাকে রাতদিন। কেউ নিজেকে সম্বরণ করে বুকে পাথর বেঁধে চুপচাপ থাকেন। কিন্তু তাদের দেখলেই অনুমান করা যায় অনেক কষ্ট বেদনা আর দুশ্চিন্তায় বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে সেই অবর্ণনীয় কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে রেখে কোনো ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। কথা বলছেন, হাঁটাচলা করছেন। আইসিইউর ভেতর জীবন-মৃত্যুর সন্নিক্ষণে কারো বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান কিংবা স্ত্রী। কখন যে কী হয়ে যায়, ভেতর থেকে কখন কী খবর আসে? কেউ কেউ নিজেকে সংবরণ করতে পারেন না। অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে ফোঁস ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আর ফুপিয়ে কাঁদেন। এমনিতেই অত্যন্ত সংবেদনশীল জায়গা হিসেবে বিবেচিত আইসিইউর ভেতরে সাধারণের প্রবেশাধিকার অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। মুমূর্ষ রোগীদের জীবন বাঁচাতে সর্বোচ্চ এবং সবশেষ প্রচেষ্টা চলে এখানে। এখানে রোগীর শরীরের সঙ্গে যুক্ত নানা ধরনের এবং যন্ত্রপাতির নলের ছড়াছড়ি। সেই সব যন্ত্রপাতির নানা ধরনের অদ্ভুত শব্দ কানে আসে শুধু। এখানে থাকা ডাক্তার এবং নার্সদের সতর্ক ব্যস্ততা চোখে পড়লেও এক ধরনের নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে থাকে। জানা গেছে, দেশের কমপক্ষে ২২ জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সেবা নেই। মারাত্মক অসুস্থ বা জীবন বিপন্ন- এমন রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ শয্যার দরকার হয়। আইসিইউতে রোগীকে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। রোগীর বিশেষ সহায়তার দরকার হয়। চিকিৎসায় বিশেষ যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পাশাপাশি আইসিইউর নার্সদের থাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ। দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে এই বিশেষায়িত সেবার খরচ তুলনামূলক কম। তাই মানুষের আগ্রহ থাকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক অবস্থা থাকেনা সবার। আত্মীয়দের ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য না থাকায় উপায়হীন আত্মীয়রা মুমূর্ষ রোগীদের নিয়ে ফেরত চলে যান বাড়িতে। তেমন কিছু মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার রুগ্ন চেহারা আবারও আমাদের সামনে চলে আসে। দেশে দুর্ঘটনা বাড়ছে, জটিল রোগে ভোগা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সাথে আইসিইউ সেবার প্রয়োজনও বাড়ছে। কিন্তু মানুষ প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে না। এই সেবা নিয়ে আছে নানা অভিযোগ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ নেই এমন জেলার মধ্যে রয়েছে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, বরগুনা, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়, নাটোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, ভোলা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, শরীয়তপুর, নেত্রকোনা, চুয়াডাঙ্গা ও সুনামগঞ্জ। এ ছাড়া বাগেরহাট ও মাদারীপুর জেলায় সরঞ্জাম থাকলেও আইসিইউ চালু নেই। রাজধানীর একাধিক বড় সরকারি হাসপাতালেও এই শয্যা নেই। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (পঙ্গু হাসপাতাল) এক হাজার শয্যার। সারাদেশের গুরুতর আহত রোগী প্রতিদিন এই হাসপাতালে ভর্তি হয়। জানা গেছে, এই হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। জাতীয় নাক-কান-গলা হাসপাতালেও এ ধরনের কোনো শয্যা নেই। সরকারের লক্ষ্য ছিল, সব জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ চালু করার। করোনা মহামারির সময় সব জেলায় আইসিইউ চালু করা হয়েছিল। প্রায় ৪০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তখনকার আইসিইউকে এখন কাজে লাগাতে কোনো অসুবিধা নেই। ১০ শয্যার আইসিইউ শয্যা চালু করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সেবা চালু থাকবে সপ্তাহে সাত দিনের ২৪ ঘণ্টা। এতে থাকবে নয়টি অত্যাবশ্যকীয় সেবা ও চারটি ঐচ্ছিক বা বাড়তি সেবা। ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিটের জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসক থাকবেন ১৩ জন ও বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসক থাকবেন ৭ জন। সার্বক্ষণিক নার্স থাকবেন ১৬ জন। অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী থাকবেন আরও ১৬ জন। কেন্দ্র চালাতে ছোট-বড় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম লাগবে মোট ৬৩ ধরনের। আর ওষুধ লাগবে ৪৯ ধরনের। আইসিইউ শয্যা আছে এমন প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে রোগীর লম্বা সারি দেখা যায়, মানুষ অপেক্ষায় থাকেন কখন একটি শয্যা খালি হবে। যারা সরকারি হাসপাতালে চেষ্টা করেও শয্যার ব্যবস্থা করতে পারেন না, তারা যান বেসরকারি হাসপাতালে। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক মালিক হাসপাতালের একটি অংশকে আইসিইউ হিসেবে ব্যবহার করেন। যথাযথ অনুমতি নিয়ে আইসিইউ সেবা দেন এমন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক কম। তারা প্রতিদিনের আইসিইউ শয্যা ভাড়া নেন ১৫ হাজার টাকা। চিকিৎসকের ফি, ওষুধের দাম এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় এর বাইরে। দিনে মোট ব্যয় হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। কোনো রোগীকে যদি দুই দিন, তিন দিন বা এক সপ্তাহ আইসিইউতে থাকতে হয়, তাহলে বহু টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যায়। বেসরকারি হাসপাতাল যত বড়, তার আইসিইউর খরচ তত বেশি। এই ব্যয় অনেকের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। অনেকে অর্ধেক পথে চিকিৎসা বন্ধ করেন, অনেকে চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (আইসিইউ) সেবা না পেয়ে মৃত্যুর ঘটনা যেমন অত্যন্ত মর্মান্তিক, তেমনি তা আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার রুগ্ণদশাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরেও কোনো আইসিইউ শয্যা খালি না পেয়ে বলতে গেলে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।

সরকারের নীতিনির্ধারকরা দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন নিয়ে লম্বা লম্বা বক্তৃতা দেন, যার সঙ্গে বাস্তবের মিল খুব কমই আছে। ২২ জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই। মারাত্মক অসুস্থ, জীবন বিপন্ন এমন রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ দরকার হয়। বেসরকারি হাসপাতালে এ বিশেষায়িত সেবার খরচ অনেক বেশি। ফলে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ তো বটেই, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের পক্ষে সেখানে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। যেসব সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা আছে, সেখানকার অবস্থা অনেকটা ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী’। লালমনিরহাট জেলার সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সেবা প্রয়োজন, এমন রোগী এলে তারা রংপুর মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দেন। এ রকম ঘটনা আরও অনেক জেলাতেই ঘটে থাকে। করোনা মহামারির সময় দেখা গেছে দেশে আইসিইউ সমস্যা কত প্রকট। সেই সময় কোনো কোনো হাসপাতালে অস্থায়ীভাবে কিছু আইসিইউ খোলা হয়েছিল। আবার আইসিইউ খুললেই হবে না। এর জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল ও যন্ত্রপাতির জোগানও নিশ্চিত করতে হবে। অনেক হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা থাকলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন না। ১০ শয্যার একটি আইসিইউর জন্য ১৩ জন সার্বক্ষণিক চিকিৎসক প্রয়োজন। ৫ বছর আগে শুরু হওয়া করোনা মহামারির মধ্যেই তখনকার সরকারপ্রধানের নির্দেশনা ছিল প্রতিটি জেলায় আইসিইউ সেবা চালু করার। মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদাসীনতার কারণে জেলায় জেলায় সেই সেবা চালু হয়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক। এ দুর্ভাগ্য দেশবাসীকে আর কত দিন বয়ে বেড়াতে হবে? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ছিল ৫৪৮টি। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে শয্যা ছিল ৩৪৮টি। অর্থাৎ মোট শয্যা ছিল ৮৯৬টি। গত দুই বছরে সরকারি হাসপাতালে আরও আইসিইউ শয্যা যুক্ত হয়েছে। ১০টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ শয্যার করে আইসিইউ চালু করা হয়েছে। একইভাবে ১৩টি জেলা হাসপাতালে ১০ শয্যা করে আইসিইউ চালু করা হয়েছে। সারাদেশে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা এখন ১ হাজার ১২৬টি। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তিরা বলছেন, বেসরকারি পর্যায়ে এমন শয্যা আছে আরও প্রায় এক হাজার।

প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে এ স্বাস্থ্যসেবা খুবই অপ্রতুল। আমরা চাই না আর কোনো অসুস্থ মানুষ আইসিউ সেবা না পেয়ে মারা যান। যেসব জেলা হাসপাতালে আইসিউ নেই, জরুরি ভিত্তিতে তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রয়োজনীয় লোকবল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। কেবল অবকাঠামো দিয়ে তো চিকিৎসা হয় না। প্রায়ই গণমাধ্যমে খবর আসে বছরের বছর যন্ত্রপাতি হাসপাতালে পড়ে থাকে, বসানো হয় না। বসানো হলেও দক্ষ লোকবলের অভাবে কাজে লাগানো যায় না। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা কেন উপেক্ষিত হলো, এর জন্য কারা দায়ী, সেটাও চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। করোনাকালে আমাদের স্বাস্থ্যসেবার যে বেহাল চিত্র বেরিয়ে এসেছিল, তা লজ্জাজনক। এ লজ্জার মাত্রা আর বাড়তে দিতে না চাইলে সরকারের উচিত সমন্বিত ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া। বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ কোনো ফল দেবে না। জেলা শহরের জেনারেল হাসপাতালে হঠাৎ করে নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি হয়। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজনের চিকিৎসার জন্য এখনো ভরসার জায়গা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে সরকারি এই হাসপাতাল। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার আসলে তেমন উন্নয়ন ঘটেনি এখনো সেখানে অনেক অনেক টাকা খরচ করে মোটামুটি আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা সুবিধা পান রোগীরা। কিন্তু এজন্য রোগীর পরিবারকে চরম মূল্য দিতে হয়। অবস্থাপন্ন, স্বচ্ছল-ধনী পরিবারের হয়তো তেমনভাবে গায়ে লাগে না। সেই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সারা জীবনের সঞ্চয় শেষ হয়ে যায়। অনেক কষ্টে তিল তিল করে বানানো নারীর সখের স্বর্ণালংকার বিক্রি করে দিতে হয়। আবার কেউ কেউ জটিল রোগের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে বসতবাড়ি-ঘর, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট পর্যন্ত বিক্রি করে কাড়ি কাড়ি টাকা জোগাড় করেন। তবুও উন্নত চিকিৎসা করে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করে যায় মানুষ। তবে ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে সাধারণ মানুষ অসুস্থ হলে ছুটে যায় সরকারি হাসপাতালে। সেখানে যতটুকু চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু তেমন প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করে যদি ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে তো সংকট বলে ধরে নেওয়া যায়। তখন রীতিমতো দুর্যোগ নেমে এসেছে সাধারণ, অসচ্ছ্বল, দরিদ্র মানুষগুলোর ওপর। সন্তানসম্ভবা বউ-ঝি, অসুস্থ সন্তান, বাবা-মাদের নিয়ে এসে হতাশ হয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দুচোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে তারা। যাদের গাটে টাকা পয়সা আছে, সামর্থ্য রয়েছে, যারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছ্বল তারা বিকল্প হিসেবে শহরের গুটিকতক ক্লিনিক বেসরকারি ছোট হাপাতালে ছুটে যায় হয়তোবা। কারণ, সন্তানসম্ভবা একজন নারীর নানা শারীরিক জটিলতা নিয়ে ঘরে বসে থাকা যায় না। তখন অপেক্ষা করা চলে না। অতএব, বেসরকারি ছোটখাটো ক্লিনিকের শরণাপন্ন হতে হয় বাধ্য হয়েই। এছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকেনা তাদের কাছে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলামিস্ট।


দেশপ্রেম নয়, নিজপ্রেমই এখন জাতির দর্শন?

প্রফেসর ড. ইকবাল আহমেদ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে। ৭১-এ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী নানা আন্দোলন-সংগ্রামে অগণিত শহীদের ত্যাগ আর অসংখ্য মা-বোনের অশ্রুর বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই ভূখণ্ড। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে এসেছে। অথচ আজ প্রশ্ন জাগে—আমরা কি সত্যিই দেশপ্রেমিক জাতি হয়ে উঠতে পেরেছি? নাকি আমরা কেবল নিছক নিজপ্রেমিক, যাদের দর্শন দাঁড়িয়ে আছে—‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম।’

আজকের বাংলাদেশকে ঘিরে যে সব চিত্র আমরা প্রতিদিন দেখি, তাতে এ প্রশ্ন অমূলক নয়। শহরের রাস্তায় নামলেই বোঝা যায় আইন ভাঙা যেন এক ধরনের স্বভাব। ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, যত্রতত্র পার্কিং করা অনেকের কাছে যেন বীরত্বের প্রমাণ। ফুটপাত দখল করে ব্যবসা চালানো, যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা কিংবা বাসে ভাড়া না দেওয়ার জন্য তর্কে জড়ানো—এসবকে আমরা প্রতিদিনের জীবনের অংশ হিসেবেই মেনে নিচ্ছি। অথচ এগুলোই ইঙ্গিত দেয় আমাদের মানসিকতার। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা গড়ে তোলার বদলে আমরা যেন শিখেছি কেবল ব্যক্তিগত সুবিধাটাই আগে দেখতে।

প্রশাসন ও রাজনীতির ছবিটাও ভিন্ন নয়। আমাদের রাজনীতিবিদদের কাছে ‘জনগণের সেবা’ প্রায়শই কেবল একটি স্লোগান। ক্ষমতায় থাকলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় যন্ত্রে রূপ দেওয়া হয়, আর বিরোধী দলে থাকলে রাষ্ট্রকে অচল করার চেষ্টাই মুখ্য হয়ে ওঠে! যে নেতারা জনগণকে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন, তারাই সামান্য সর্দি-জ্বরের জন্য বিদেশে উড়াল দেন, সন্তানদের পড়ান বিদেশি প্রতিষ্ঠানে, এমনকি সম্পদও গড়ে তোলেন বিদেশে!-এইগুলো এখন নিত্য সংবাদ। এইসব নিউজ নিয়মিত স্ক্রল হতে থাকে সাধারণের ঘরে ঘরে আর তখনই মানুষ হতাশ হয়ে প্রশ্ন করে—এই তথাকথিত নেতাদের দেশপ্রেম কোথায়? নাকি তাদের প্রকৃত লক্ষ্য কেবল নিজেদের আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করা?

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। ভেজাল খাবার, নকল ওষুধ, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী—এসবের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষের সীমাহীন মুনাফার লোভ। তারা জানে এর ফলে মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ছে, তবু ব্যক্তিগত লাভের কাছে সব দায়বদ্ধতা গৌণ হয়ে যায়। সমাজে যেকোনো ক্ষতি তাদের কাছে অস্পষ্ট, কারণ তাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ শুধু নিজের লাভক্ষতির খাতায়।

আমি একজন শিক্ষক হিসেবে সবচেয়ে গভীরভাবে যেটি উপলব্ধি করি তা হলো—আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই দেশপ্রেমের বড় ঘাটতি লুকিয়ে আছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো মূলত মুখস্থভিত্তিক ও পরীক্ষামুখী। শিক্ষার্থীরা প্রকৃত জ্ঞানার্জনের বদলে ভালো গ্রেড ও সার্টিফিকেট পাওয়াকেই বড় লক্ষ্য মনে করে। এর ফলে তারা শুধু প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে শেখে, কিন্তু সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্বশীল হতে শেখে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে আমি প্রায়ই দেখি, অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী স্নাতক শেষ করেই স্বপ্ন দেখে বিদেশে পাড়ি জমানোর। বিদেশে পড়াশোনা, চাকরি বা স্থায়ীভাবে বসবাস করাই যেন তাদের জীবনের বড় সাফল্য। অথচ তাদের সেই মেধা ও শ্রম যদি এই দেশেই কাজে লাগত, তাহলে দেশের অর্থনীতি, গবেষণা এবং সামাজিক উন্নয়ন বহুগুণ এগিয়ে যেত। এ প্রবণতা আমাদের জন্য একধরনের ‘ব্রেইন ড্রেইন’ তৈরি করছে অনেকদিন ধরেই।

দেশের প্রাইমারি ও মাধ্যমিক শিক্ষার আরেকটি বড় সমস্যা হলো নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব। পাঠ্যক্রমে দেশপ্রেম বা নাগরিক দায়িত্বের আলোচনা থাকলেও তা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তবে আমরা শিশু-কিশোরদের সমাজসেবা, নাগরিক দায়িত্ব কিংবা জনস্বার্থে কাজ করার সুযোগ খুব কমই দিই-(জাপান কিংবা ফিনল্যান্ডে নৈতিক শিক্ষা এবং দেশপ্রেম শিশুকাল থেকেই চর্চা করা হয়)। ফলে তারা পেশাজীবনে প্রবেশ করে কেবল ব্যক্তিগত উন্নতি ও আর্থিক লাভের দিকে মনোযোগী হয়।

এক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের ভূমিকা জরুরি-বিশেষ করে প্রাইমারি ও মাধ্যমিক পর্যায়ে অল্প বয়সেই শিশু-কিশোরদের মননে দেশপ্রেম ও নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। এবং বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে আমরা যদি কেবল সিলেবাস শেষ করাকে বড় সাফল্য মনে করি, তবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চিন্তাশীলতা, গবেষণা-মনস্কতা বা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা গড়ে উঠবে না। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত প্রশ্ন করার জায়গা, মতামত প্রকাশের জায়গা এবং সৃজনশীলতার জায়গা। আর এই সার্বিক ইনক্লুসিভ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই একজন শিক্ষার্থী সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নাগরিক হয়ে উঠতে পারে।

এখানে পরিবার ও সমাজের ভূমিকাও বড়। আমরা সন্তানদের বলি—ভালো চাকরি করো, ভালো বাড়ি-গাড়ি করো। কিন্তু খুব কমই বলি—ভালো নাগরিক হও, দায়িত্বশীল হও, সমাজ ও দেশের কল্যাণের কথা ভাবো। বরং প্রায়শই শোনা যায়—‘অন্যরা যাই করুক, তুমি কেবল নিজেরটা দেখো।’ এভাবেই প্রজন্ম বেড়ে ওঠে স্বার্থপরতার শিক্ষায়। এর পরিণতিতে দেশপ্রেমের জায়গায় ক্রমে গড়ে ওঠে নিছক নিজপ্রেম।

অবশ্য দিনশেষে, পুরো চিত্র এতটা অন্ধকার নয়-এখনো আমরা দেখি তরুণদের অনেকেই পরিবেশ আন্দোলনে নেমে পড়ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছে কিংবা প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। প্রবাসীরা কঠোর পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছে। এ সবই আশার আলো। তবে এই ছিটেফোঁটা আলোকে বিস্তৃত আলোর স্রোতে রূপ দিতে হলে আমাদের শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।

প্রকৃত দেশপ্রেম মানে কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেওয়া নয়; বরং প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজেই দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়। ট্রাফিক আইন মেনে চলা, কর দেওয়া, মানসম্মত পণ্য তৈরি করা, সৎভাবে দায়িত্ব পালন করা—এসবই দেশপ্রেম। শিক্ষক যদি আন্তরিকভাবে পড়ান, ব্যবসায়ী যদি ন্যায্য মান বজায় রাখেন, রাজনীতিবিদ যদি সত্যিই জনগণের স্বার্থে কাজ করেন—তাহলেই দেশপ্রেম বাস্তব রূপ পাবে।

আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এখন আত্মসমালোচনা। আমরা কি সত্যিই দেশের জন্য কিছু করতে প্রস্তুত, নাকি কেবল নিজেদের স্বার্থেই সব আয়োজন? নিজের ভেতরের সেই নিছক নিজপ্রেমিক মানুষটাকে নিয়ন্ত্রণ করে দেশপ্রেমিক মানুষটাকে জাগিয়ে তুলতে না পারলে উন্নয়ন হবে খণ্ডিত, টেকসই হবে না। শিক্ষা, শিক্ষক এবং শিক্ষালয়গুলোই এখানে সবচেয়ে শক্তিশালী নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। শিক্ষা যদি শিশুকিশোর, তরুণদের শেখাতে পারে—দেশের স্বার্থই আসল স্বার্থ, কেবল নিজের নয়, অন্যের কল্যাণও জরুরি—তাহলেই পরিবর্তন সম্ভব। একেকজন নাগরিক যদি ছোট ছোট দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে, তাহলে সমষ্টিগতভাবে দেশ এগোবে অনেক দূর।

তাই, আজ আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো—নিজস্বতার গণ্ডি ভেঙে দেশকে বড় করে ভাবা। দেশপ্রেম কোনো অলঙ্কার নয়, এটি একটি দায়বদ্ধতা। যদি আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি, তবে আমাদের দেশকে সত্যিই একটি আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

লেখক : অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


যৌতুক: বিস্তার ও প্রবণতা

সুমাইয়া আক্তার
যৌতুক: বিস্তার ও প্রবণতা। নমুনা চিত্র
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলার ঐতিহ্যে এখনো কিছু কিছু পথা বা অন্ধ নিয়ম রয়েছে যা জাহেলিয়া যুগ থেকে হয়ে আসছে। কালের বিবর্তনের মাধ্যমেও এগুলো কে সহজে সমাজ তথা রাষ্ট্র থেকে উৎখাত করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তারই একটি অন্ধ নিয়ম হচ্ছে- যৌতুক। বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে- বিবাহের চুক্তি অনুসারে কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে বা বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে যে সম্পত্তি বা অর্থ দেয় তাকে যৌতুক বা পণ বলে। (বাংলাপিডিয়া ৮/৪৫৫)।

আমাদের সমাজে কিছু মূর্খ, অশিক্ষিত (প্রকৃতপক্ষে তারা শিক্ষিত, কিন্তু কাজে কর্মে শিক্ষার যথেষ্ট অভাব রয়েছে!!!) লোক রয়েছে যারা যৌতুক দেয়া এবং নেয়াকে সমর্থন করেন। কিন্তু তাদের এই ধরনের অহেতুক সমর্থনের পিছনে আদৌ কোন যুক্তি আছে কি না বা থাকলে সেটা কি আমার তা জানা নেই ।

বাংলাদেশের ১৯৮০ সনের যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনে যৌতুকের যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে তা নিম্নরূপ: যৌতুক অর্থ (ক) কোনো এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে, অথবা (খ) বিবাহের কোনো এক পক্ষের পিতামাতা অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক অন্য কোনো পক্ষকে বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিবাহের মজলিসে বা বিবাহের পূর্বে বা পরে যে কোনো সময়ে বিবাহের পণ রূপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ যে কোনো সম্পত্তি বা জামানত। (যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০, আইন নং ০৫)।

বিয়ের সময় একটা মেয়ের যে কি পরিমাণ মানসিক কষ্ট হয় তা শুধু মেয়েরাই বোঝে। একটা মেয়ে কে তার পরিবার, সমাজ, এতদিনের গড়ে ওঠার পরিবেশ সব কিছু ছেড়ে আসতে হয়। তো যখন একটি মেয়েকে নেবার পরও তার বাবা-মা র কাছে যৌতুক চাওয়া হয় তখন পাএ পক্ষ কোন বিবেচনায় সেটা করে? তারা কি মনে করছে যে মেয়েটা ঐ ছেলেটার চেয়ে যোগ্যতায় কম, তাই অর্থ বা সম্পওি দিয়ে মেয়েটা কে ছেলেটার সমান হতে হবে? এর অর্থ কি এই নয় যে ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর সেটা মাপার জন্য মেয়েটাকে অর্থ সহকারে পাল্লাতে ওঠাতে হবে । যাতে দুই পাল্লা সমান হয়!!! আবার এভাবেও ভাবা যায় মেয়েরা ছেলেদেরকে তুচ্ছ ভাবে, আর তাই তাদের কে ওরা নতুন জীবন শুরুর পূর্বেই দান করে ছোট করে রাখে। কিন্তু এভাবে কি আর কেউ ভাববে???

কত অদ্ভূত আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা। আর কত নিকৃষ্ট মানুষের রুচি। যেখানে মেয়েরা মূল্যহীন। মেয়েদের কোনো কিছুর কোনো দাম নেই । পাত্র পক্ষ মনে করে তাদের ছেলেকে তারা টাকা খরচ করে বড় করেছে। আর তাই সেটা বিয়ের সময় করায় গন্ডায় উসুল করে নেবে। তো মেয়েটা কে কি তার বাবা-মা অর্থ ছাড়াই বড় করেছে? সেই টাকা কে দেবে? মেয়ে র বাবা-মায়ের কি কষ্ট হয় না নিজের মেয়েকে কষ্ট করে বড় করে অন্যের কাছে দিয়ে দিতে? নাকি সব কষ্ট শুধু ছেলেদের বেলাতেই? যারা এই ধরনের যৌতুক দাবি করে তারা যে কি পরিমাণ নিচু মানসিকতার, তা ভাবতেও ঘৃণা লাগে। সততাহীন, বিচার বুদ্ধিহীন, রুচিহীন জীবন ওদের। ইসলাম একে কখনোই সমর্থন করেনি। তো সমাজ ওদের মত ঘৃণ্যদের কে আর কত প্রশ্রয় দেবে? আইনত ব্যবস্থা থাকা সত্বেও কেন তা যথাযথ ভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না? এর উওর কোথায়???

আসুন আমরা সবাই এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। কঠোর প্রতিবাদ করি এবং সমস্বরে যৌতুক কে ‘না’ বলি।


সকলের প্রত্যাশা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন

ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চলেছে। বর্তমান সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার নয়। সময়ের প্রয়োজনে কিছু বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য এ সরকার গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এছাড়া বিগত স্বৈরাচারী শাসনামলে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে উদার গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শেষ দুটি দায়িত্ব পালনের জন্য বেশকিছুটা সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। চাইলেই তাৎক্ষণিকভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকার্য সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। এতে বিচারে ত্রুটি থেকে যেতে পারে। বিচারকার্য যাতে গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানের হয়, তা নিশ্চিত করা সরকারের একটি বড় দায়িত্ব। অন্যথায় এ বিচারকার্য নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত থাকতে পারে। আর বড় ধরনের কোনো সংস্কার কার্যক্রম নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়াটাই যৌক্তিক। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের প্রাথমিক কার্যক্রম সূচনা করে যেতে পারে। ভবিষ্যতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার এসে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করবে।

বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশে নানা ধরনের সমস্যা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। বিদ্যমান সমস্যা দিন দিন আরও বাড়ছে এবং গভীরতা লাভ করছে। নতুন নতুন অনাকাঙ্ক্ষিত জটিল সমস্যা এসে যুক্ত হচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধান করা বর্তমান সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যা ও সংকট মোকাবিলায় সরকার হিমশিম খাচ্ছে। স্বার্থান্বেষী মহল নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এতে সরকার বিব্রত হচ্ছে। এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে ঘোষিত সময় মোতাবেক আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা। সরকার তার কৃত অঙ্গীকার মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে তাদের দায়িত্ব শেষ করবে, এটাই জাতির প্রত্যাশা। সরকার সেই গণপ্রত্যাশা পূরণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা বারবার ঘোষণা করেছেন, তার কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। তিনি আগামী নির্বাচনের পর আর কোনোভাবেই সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি বর্তমান দায়িত্ব শেষ করতে পারলেই খুশি।

মহলবিশেষ নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা নির্বাচনের ব্যাপারে জনগণকে সন্দিহান করে তোলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কেউ কেউ এমনও বলার চেষ্টা করছেন যে, নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। তারা নানা ধরনের কল্পকাহিনি প্রচার করছেন। সরকারের বিভিন্ন অর্গানের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমনকি সেনাবাহিনী নিয়েও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

দেশের অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে গণঅধিকার পরিষদের প্রধান নুরুল হক নুরের ওপর বর্বরোচিত হামলার ঘটনা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনা এবং তৎপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধান উপদেষ্টা দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনাকালে প্রধান উপদেষ্টা আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে কথা বলেন। ২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দিনের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনাকালে বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রধমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তিনি আরও বলেন, যারা অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিতে চায় না, তারা নানাভাবে বাধা দেবে। বাংলাদেশের এক সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা বাধা দেবে। তারা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চালাবে, যাতে নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হতে না পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করার জন্য এ মহলটি চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যেই এ ধরনের কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, তারা আরও বেশি তৎপর হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ পরিহার করে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারে, তাহলে সমস্যা শুধু বাড়তেই থাকবে। সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করবে। তাই এ মুহূর্তে সব রাজনৈতিক দল এবং সংশ্লিষ্ট মহলকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ইস্পাত কঠিন দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

আমরা দেশের সাধারণ নাগরিকরাও অনুধাবন করতে পারছি, মহলবিশেষ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। নির্বাচন যতই নিকটবর্তী হবে, এদের তৎপরতা ততই জোরদার হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ থেকে পালিয়ে গেলেও তার বিপুলসংখ্যক স্থানীয় নেতাকর্মী এখনো দেশে রয়েছে। তারা পরিস্থিতির চাপে এখন হয়তো চুপ করে আছে; কিন্তু সুযোগ পেলেই ছোবল মারার জন্য চেষ্টা চালাতে পারে। বিগত সরকার তাদের সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যাপক মাত্রায় দলীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। দলীয় সমর্থকদের অনৈতিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বশীভূত করে রাখা হয়েছিল। স্বৈরাচারী সরকারের সেই সমর্থক কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। তারা বর্তমানে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু সরকারকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতাও করছে না। এদের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সুযোগ পেলেই এসব কর্মকর্তা সরকারের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। যে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রিসাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তারা চাইলেই নির্বাচনকে বিতর্কিত করে তুলতে পারে। বিগত সরকারের প্রতি অনুগত কর্মকর্তাদের যদি প্রিসাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে তারা নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালাতে পারে। তাই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য বিগত সরকারের প্রতি অনুগত কর্মকর্তাদের নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত রাখা যেতে পারে।

গণআন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের এক বছর পরও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিত এখনো স্বাভাবিক হয়নি। বরং পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি ঘটছে। কেন এমনটি হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না থাকে, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব হবে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে বিগত সরকারের অনুগত সদস্য রয়েছে। এরা কোনোভাবেই সরকারকে সফল হতে দিতে চাইবে না। বিভিন্ন স্থানে মব সন্ত্রাস হচ্ছে। এটি স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশে এর আগে কখনোই এভাবে মব সন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করা যায়নি। সফল গণ-আন্দোলনের পর কেন এমন সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটবে? এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা, তা অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন। সরকারের সামান্য উদাসীনতা রাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং মব সন্ত্রাসের ইস্যুটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অশান্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষাঙ্গনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এর ফলে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে। দাবি আদায়ের নামে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসবে, এটি কারও কাম্য হতে পারে না। আন্দোলনের নামে কেউ যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আগামী নির্বাচনের আগে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে চেষ্টা চালানো হতে পারে।

এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে, যে কোনো মূল্যে নির্ধারিত সময়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করা। শত প্রতিকূলতার মাঝেও যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। কোনোভাবেই এর ব্যত্যয় ঘটতে দেওয়া যাবে না। সরকারকে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে কৃত অঙ্গীকারে দৃঢ় ও অবিচল থাকতে হবে। আর রাজনৈতিক দলসহ চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ও সমর্থকদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও ভেদাভেদ ভুলে জাতির এই ক্রান্তিকালে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে; যেমন ঐক্য গড়ে উঠেছিল গত বছর আন্দোলনকালে। আমাদের মনে রাখতে হবে, অপরাধীদের ঐক্য দৃঢ় হয় স্বার্থের কারণে। আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ঐক্য বিনষ্ট হয় উদাসীনতার কারণে। যারা দুর্নীতিবাজ বা নানা ধরনের অপরাধকর্মে যুক্ত, তাদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য গড়ে ওঠে। দেশপ্রেমিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুষ্ট চক্রকে প্রতিহত করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের কাছে দেশ বা জাতির স্বার্থ বড় নয়। তারা স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য যে কোনো কাজ করতে পারে। বর্তমান সরকার যেহেতু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার নয়, তাই এ সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে সমস্যা শুধু বাড়তেই থাকবে। তাই দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিয়ে এ সরকারের দায়িত্ব শেষ করাই হবে যৌক্তিক।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।


লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা চাই

মিজানুর রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

নির্বাচন সামনে এলে সবার আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এর বিষয়টি জোরেসরে উত্তাপিত হয়। অবশ্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি করে? লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর ও কম নয়। নিজেদের হুন্ডা ও গুন্ডা বাহিনী সামলানোর দায়িত্ব নের্তৃবৃন্দের ওপর বর্তায়। দায়িত্বশীল নেতাদের আচারণবিধি ও বহুলাংশে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি করার জন্য উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এর ব্যাপারে দায়িত্বশীল নেতাদের ভূমিকা প্রতিনিয়ত গুরুত্ব পাচ্ছে।

বর্তমানে আওয়ামী লীগবিহীন মাঠে পরিকল্পিতভাবে জামায়াতে ইসলামী বিশাল শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। বিএনপিকে ঠেকাতে ইসলামী আন্দোলন, নেজামে ইসলামী পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি, এবি পার্টি এবং গন অধিকার পরিষদ নিয়ে জোট বাধার প্রক্রিয়া শুরু করছে।নির্বাচনের আগে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি ও তৎপরতা জানান দিতে এবার রাজপথে নামছে জামায়াত জোটবদ্ধ হয়ে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি এবং ফ্যাসিবাদের দূসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি সামনে রেখে মাঠে নামার ঘোষণার মাধ্যমে তিন দিনের কর্মসূচি এরমধ্যে এসেছে। জামায়াত রীতিমতো বিএনপিকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলতে চাচ্ছে। এনসিপি ও এবি পার্টি অবশ্য শেষ পর্যন্ত নিম্নকক্ষের নির্বাচনে পিআর দাবি থেকে কিছুটা পিছুটান হঠলেও জামায়াতের এদের নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা নেই। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্র শিবিরের বিশাল বিজয়ে জামায়াতে ইসলামীর মাঝে আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়েছে। এরা এখন খুব ফুরফুরে মেজাজে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিজয়ে জামায়াতে ইসলামী এসিড টেস্ট হিসেবে দেখছে। জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে জনগণ তাদের পাশে থাকবে বলে এই ধারণাটি তাদের মনোবল অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।

তারেক জিয়া বহুপূর্ব থেকে বলে আসছে আগামী সংসদ নির্বাচন এতটা সহজ নয় খুব কঠিন পরীক্ষা হবে। দেশের বৃহত্তম দল হিসেবে যাদের বিস্তৃতি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সংগঠন আছে বিএনপি ও বসে নেই। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় যারা তাদের সহযোগী ছিল বর্তমানে এদের নিয়েই এগুতে চাচ্ছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আরও আগে থেকেই আগামী সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচনোত্তর সরকার গঠনের ক্ষেত্রে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠনের অঙ্গীকার করেছে। তাছাড়া রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে তারেক জিয়ার ৩১ দফা কর্মসূচি সংস্কারের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে -- এ মনোভাব নিয়ে বিএনপি প্রচারণা চালাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে জনগন বিএনপির সেবা পাবে এই আত্মবিশ্বাস এদের ও কম নয়।

রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত মার্চ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করে আসছে। প্রথম ধাপে দলগুলোর সাথে আলাদাভাবে বসেছিল কমিশন। এরপর দ্বিতীয় ধাপে ৩০টি দল ও জোট নিয়ে ২৩ দিন সংলাপ হয়। দুই ধাপের সংলাপে ৮৪টি বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয় যার ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করেছে কমিশন। কিন্তু বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক না হওয়ায় ঝুলে আছে জুলাই সনদে স্বাক্ষর।

নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কার্যকারিতা হচ্ছে না। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের অনৈক্য ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। দলগুলোর বিশ্বাস -- প্রশাসনকে একটি দলের প্রতি ঝুঁকে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এ জন্য নির্বাচনের সময় কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব এমনকি কেন্দ্র দখলের মত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের শ ঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ভরসা করা যাচ্ছে না।

সম্প্রতি সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারন নিয়ে ভাঙ্গা ও বাগের হাটে চরম অরাজকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা ভাঙ্গা থানা ও নির্বাচন অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। পুলিশ ভয়ে স্থানীয় মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে। পুলিশের এমন ব্যর্থতায় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে কিভাবে নির্ভরশীল হওয়া যায়?

চলতি বছরের শুরুর ৫ মাসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ১৪১টি মব হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫২ জনের প্রাণহানি হয়েছে আহত হয়েছে ২৮৯ জন। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যে তা উঠে এসেছে। পুলিশ কোথায় ছিল?

তৌহিদি জনতার ব্যানারে রাজবাড়ীতে নুরাল পাগলার মাজারে হামলা হয়েছে । কবর থেকে লাশ উঠিয়ে আগুন দিয়ে পুড়ানো-- সংহিতার জঘন্যতম কার্যক্রম দেশের জনগণকে দেখতে হলো। কিন্তু এ ঘটনায় পুলিশ বিন্দুমাত্র ভূমিকা রাখতে পারিনি। ১৮ আগস্ট কুমিল্লার হোমনায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে জনতা ৪টি মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে৷ সেখানেও পুলিশ প্রশাসন নির্বিকার। প্রশাসন এমন দুর্বল হওয়াতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠা থেকে যাচ্ছে। সরকার আরো কঠোর হউক এটা ও জাতীর প্রত্যাশা।

কিন্তু মব যারা করছে এরাতো এদেশের ছাত্র জনতা ও যুব সমাজ। এরা কোনো না কোনো দলের সাথে সম্পৃক্ততা আছে। তা প্রতিহত করতে রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীলরা এগিয়ে আসতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে শঙ্কা থাকলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নির্বাচন কিভাবে হবে। তাইত বিভিন্ন দলগুলো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন।

আগামী নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সবচেয়ে বেশি শষ্কা প্রকাশ করে সোচ্চার জামায়াত। এ বিষয়ে দলটি সরকারের কাছে দাবি ও জানাচ্ছে। ৬ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে জামাতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ‘সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বাহিনী ও সংস্থার কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ও প্রশাসনকে স্বৈরাচারের দোসরমুক্ত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের সব স্তরে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। ১০ আগস্ট নির্বাচন কমিশনের সাথে দেখা করে নির্বাচনের পূর্বে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার আহবান জানান ডা: তাহের। তিনি আরও বলেন এ বিষয় সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে চাই।’

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে চরম অনিশ্চিয়তা কথা জানাচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও। দলটির মুখপাত্র ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান খান বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে পরিবেশ দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং সবার জন্য সমান সুযোগ, তা দেখা যাচ্ছে না।কারণ সরকার একটি পক্ষের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। প্রশাসন ও মনে করছে একটি দল ক্ষমতায় যাবে। আর আমাদের ট্রাডিশন হলো - যারা ক্ষমতায় যাবে তাদের পক্ষে সবাই চলে যায়। এখন সেটাই দেখা যাচ্ছে।

‘নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ‘এখনই কিসের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখন তো নির্বাচন কমিশন ভোটের মাঠেই নামেনি। তবে আমরা চাই একটি গুনগত ও মানসম্পন্ন নির্বাচন যাতে হয়, সে উদ্যেগ নেওয়া। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আশা-নিরাশায় মাঝে আছি। সরকার ইচ্ছা করলে সবকিছু করতে পারবে।’

তবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে এখনই কিছু বলার সময় আসে নি বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা।আমরা সবাই এটাই চাই। আমরা আশা করি সরকার অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যা যা করার করবে। কারণ ড.ইউনূস একটি ইতিহাস সেরা সুন্দর নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি আর ও বলেন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে যারা শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারাই তার কারণ ভালো বলতে পারবেন। এতে কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না সেটাও প্রশ্নের বিষয়।

তবে সরকার দৃঢ়ভাবে বলেছে, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আট লাখের বেশি সদস্য নিয়োজিত থাকবে। সেনাবাহিনী নিয়োজিত থাকবে ৮০ হাজারের বেশি। ড. ইউনূস বলেছেন আসন্ন নির্বাচনটি হবে ইতিহাস সেরা সুন্দর নির্বাচন। এ ধরনের একটি নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করা অপরিহার্য। গত তিনটি নির্বাচনের জন্য দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। ফলে গণঅভ্যুত্থানের পর গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে নির্বাচনের ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।

ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার এ ব্যাপারে আন্তরিক। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করে দেশে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান অবশ্যই সম্ভব হবে বলে অনেকেরই অভিমত।

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছা দরকার। যে কোন দলেই নির্বাচনের বেলায় পেশিশক্তির উত্থানকে নিজেদেরকে প্রতিহত করতে হবে। যারা পেশিশক্তি দেখাবে স্ব স্ব দলগুলো তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি । এ ব্যাপারে আমাদের ছাত্র/ যুব সমাজকে কাজে লাগানো যেতে পারে।যে ছাত্র/যুব সমাজ নিরাপদ সড়ক এর আন্দোলন ও স্বৈরাচার সরকার পতনের ব্যাপারে অগ্রনী ভূমিকা রেখেছে,এরাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির ক্ষেত্রে ভোট কেন্দ্রে নিরাপদ বেষ্টনী গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন নির্বাচনের এত আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে মন্তব্য করার যুক্তি নেই। নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হয়ে গেলে বিষয়টি সামনে আসবে। তাছাড়া এসিড টেস্ট হিসেবে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ গ্রহনযোগ্যভাবে হয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অমনটি হবে সে আশাবাদ আমরা করতেই পারি।

লেখক : মিজানুর রহমান, কলামিস্ট ও সাবেক ব্যাংকার।


ব্যাংক একীভূতকরণ: সমাধান নাকি নতুন সংকট?

আনোয়ার হোসাইন শেখ মুহাম্মদ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ এখন সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিশ্বাস করে দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত হলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বাড়বে। অন্যদিকে সমালোচকরা মনে করছেন, এটি মূল সমস্যাকে আড়াল করার কৌশল হতে পারে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, ব্যাংক একীভূতকরণ আমাদের আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করবে, নাকি আরও বড় ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেবে?

বাংলাদেশের মতো সীমিত ভূখণ্ড ও জনবহুল একটি দেশে বর্তমানে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৬২টি ব্যাংক। অনেক বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ দীর্ঘদিন ধরেই এটিকে অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক বাস্তবতা হিসেবে চিহ্নিত করে আসছেন। হাতের পাঁচটি আঙুল যেমন এক সমান হয় না, তেমনি সব ব্যাংকের পারফরম্যান্স সমানভাবে সফল হবে না, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু সমস্যার জায়গা হলো, কেন কিছু ব্যাংক ধীরে ধীরে সরকারের জন্য এক বিরাট বোঝায় পরিণত হচ্ছে? সরকার তো মূলত জনগণের করের টাকায় পরিচালিত হয়। প্রশ্ন উঠছে, যে সব ব্যাংক দক্ষতার অভাবে, দুর্বল ব্যবস্থাপনা কিংবা খেলাপি ঋণের দুষ্টচক্রে জড়িয়ে টিকে থাকতে পারছে না, তাদের বাঁচাতে কেন সরকারকে এতো তৎপর হতে হচ্ছে? এর পেছনে মূল কারণ হলো, ব্যাংক খাতের প্রতি জনআস্থা ও আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কোনো ব্যাংক হঠাৎ ধসে পড়লে বা বন্ধ হয়ে গেলে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মুখে পড়েন সাধারণ আমানতকারীরা, যাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় এক মুহূর্তে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। আর এ দায়ভার শেষ পর্যন্ত এসে পড়ে সরকারের ওপর, বিশেষত: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর। তাই অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থেই সরকার চায় না ব্যাংক খাত নিয়ে হঠাৎ কোনো বড় ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হোক। কারণ ব্যাংকের পতন কেবল আর্থিক খাতকেই অস্থিতিশীল করে না, বরং শিল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগেও সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেক দেশেই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে বা নতুনভাবে গঠন করতে একীভূতকরণের পথে হেঁটেছে।

বাংলাদেশও শিগগিরই সেই পথেই হাঁটতে যাচ্ছে। নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করলে পরিচালন ব্যয় কমবে, দক্ষতা বাড়বে এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর হবে। পাশাপাশি, দুর্বল ব্যাংকগুলোর কারণে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, তা মোকাবিলায়ও এটি একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। তবে প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুদৃঢ় পরিকল্পনা এবং কঠোর নিয়ন্ত্রক তদারকি অপরিহার্য। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এই উদ্যোগ সফল হবে কি না, তা নির্ভর করছে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও দক্ষতার ওপর। আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ব্যাংক খাতকে সুস্থ-সবল পথে পরিচালিত করাই হওয়া উচিত সরকারের প্রধান লক্ষ্য।

একীভূতকরণের পক্ষে যুক্তি অর্থনীতিতে ‘ইকোনমিজ অব স্কেল’ নামে একটি ধারণা আছে। এর অর্থ, বড় প্রতিষ্ঠানে খরচ তুলনামূলকভাবে কম হয়, কারণ সম্পদ, প্রযুক্তি ও জনবল বেশি পরিসরে ব্যবহার করা যায়। ব্যাংক একীভূত হলে আলাদা আলাদা ভবন, শাখা, আইটি সিস্টেম ও জনবল ধরে রাখার ব্যয় কমবে। এতে কার্যক্রম আরও সাশ্রয়ী হবে। অন্য একটি বড় সুবিধা হলো গ্রাহক আস্থা। দুর্বল ব্যাংক যখন তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন আমানতকারীরা নিশ্চিন্ত বোধ করেন। আমাদের দেশে বারবার ঋণ কেলেঙ্কারি ও খেলাপি ঋণের কারণে আমানতকারীদের মধ্যে ভরসা কমে গেছে। একীভূতকরণ অন্তত কিছুটা হলেও সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।

একীভূতকরণের গোপন ঝুঁকি তবে একীভূতকরণ কোনো জাদুকরী সমাধান নয়। অর্থনীতির আরেকটি বহুল আলোচিত ধারণা হলো ‘ঠু বিগ টু ফেইল এর মানে, কোনো প্রতিষ্ঠান এত বড় হয়ে গেলে তার পতন গোটা অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে যদি দুইটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করা হয়, তাহলে নতুন ব্যাংকটি আরও অস্থির হতে পারে। দুর্বল শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি যদি থেকে যায়, তবে একীভূতকরণের পর সমস্যাগুলো আরও জটিল আকারে ফিরে আসবে। এছাড়া একীভূতকরণের সময় মানবসম্পদ, প্রযুক্তি ও সাংগঠনিক সংস্কৃতি একত্র করা বিশাল চ্যালেঞ্জ। অনেক কর্মী পদ হারানোর আশঙ্কায় আতঙ্কিত হন, আবার এক ব্যাংকের সংস্কৃতি আরেক ব্যাংকের সঙ্গে মেলে না। ফলে নতুন ব্যাংকের ভেতরেই অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।

সাম্প্রতিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

২০২৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকার অনুমোদিত ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিনেন্স’ এর অধীনে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক। সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের মধ্যেই এই একীভূতকরণ সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আমানতকারীদের টাকা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকবে। তবে এক্সিম ব্যাংক বলছে তাদের আর্থিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আছে, তাই তারা একীভূত হওয়ার পক্ষে নয়। তারা স্বাধীনভাবে পুনর্গঠনের পরিকল্পনাও দিয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের একটি বড় অংশ মনে করেন, তুলনামূলক ভালো অবস্থায় থাকা এক্সিম ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে জোর করে যুক্ত করা ঝুঁকিপূর্ণ। এতে আমানতকারীদের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর অনেকে সরাসরি মত দিয়েছে- ‘দুর্বল ব্যাংকগুলো বন্ধ করে দেওয়া ভালো, একীভূত করলেই সমস্যা মিটবে না।’ বাংলাদেশ ব্যাংক এ জন্য প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার পুনর্গঠন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংক এতে সহায়তা করতে পারে বলে আলোচনা চলছে। উদ্দেশ্য একটাই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে স্থিতিশীল করা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।

বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা

ভারতে কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক একীভূত করা হয়েছিল। ভারত সরকার বলেছিলেন এতে দক্ষতা বাড়বে। কিন্তু সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজন সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ‘গভর্নেন্স দুর্বল হলে কেবল ব্যাংক জোড়া লাগিয়ে সমাধান আসে না।’ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেও বড় ব্যাংক একীভূত হওয়ার পর সেগুলো এত বড় হয়ে দাঁড়ায় যে সরকার বাধ্য হয় ট্যাক্সপেয়ারদের অর্থ দিয়ে তাদের বাঁচাতে। এতে নৈতিক ঝুঁকি তৈরি হয়। ব্যাংকগুলো জানে, ব্যর্থ হলেও সরকার উদ্ধার করবে। তাই এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য এটি বড় সতর্ক বার্তা। শাসনব্যবস্থার মূল চাবিকাঠি হিসেবে একটি কথা বলেছেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ডগলাস নর্থ। তার বিখ্যাত উক্তি হলো ‘ইনস্টিটিউশন্স ম্যাটার অর্থাৎ একটি দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা শক্তিশালী, সেটাই তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের আসল নিয়ামক। অপ্রিয় হলেও সত্যি কথাটা হলো, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতার মূলেই আছে শাসনব্যবস্থার সমস্যা, রাজনৈতিক নিয়োগ, দুর্বল বোর্ড, স্বচ্ছতার অভাব এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। এই সমস্যাগুলো সমাধান না করে একীভূতকরণ করলে সেটি কেবল বাহ্যিক রূপ বদলাবে, ভেতরের দুর্বলতা অটুটই থাকবে।

গবেষকদের ধারণা, ব্যাংক একীভূতকরণকে কার্যকর করতে হলে কয়েকটি বিষয় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। শুধুমাত্র দুর্বল ব্যাংক নয়, বরং একে অপরকে পরিপূরক ব্যাংককে একত্র করতে হবে। একীভূত হওয়ার আগে দুর্বল ঋণ আলাদা করে বিশেষ পুনরুদ্ধার সংস্থার কাছে দিতে হবে। কোন ব্যাংক কেন একীভূত হচ্ছে, তা জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। কর্মীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা দূর করতে ন্যায্য সুযোগ ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা ছাড়া একীভূতকরণ শুধু কাগুজে সমাধান হবে। তাই বাংলাদেশের ব্যাংক একীভূতকরণ পরিকল্পনা একই সঙ্গে সুযোগ ও ঝুঁকির সম্ভাবনা তৈরি করছে। তবে সুচিন্তিত ও স্বচ্ছভাবে একীভূত করলে এটি আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করতে পারে, তবে জোরপূর্বক বা রাজনৈতিক প্রভাবে হলে বিপর্যয় ডেকে আনবে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সংখ্যায় কম নয়, মানে ভালো ব্যাংক তৈরি করা, যেখানে আমানতকারী সততা, পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতার ওপর আস্থা রাখতে পারবেন। আমাদের প্রয়োজন কম ব্যাংক নয়, ভালো ব্যাংক। যেখানে জনগণের টাকাই হবে আসল নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।

লেখক ‘ডিজিটাল গভার্নেন্স ইন দ্য ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর’ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.ফিল. ডিগ্রিধারী এবং বর্তমানে পিএইচডি গবেষক। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম), মিরপুর-২, ঢাকার মহাপরিচালকের সচিবালয়ের ফ্যাকাল্টি রিলেশনশিপ উইং-এ মূল্যায়ন ও ডকুমেন্টেশন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।


ফিউচার অব এডুকেশন বা ‘শিক্ষার ভবিষ্যৎ’

সাইদুল ইসলাম মিঠু
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

‘শিক্ষা’ এই শব্দটির মাঝে রয়েছে একটি জাতির ভিত্তি গড়ার শক্তি। যুগে যুগে শিক্ষা বদলেছে, বদলেছে তার পদ্ধতি, কিন্তু শিক্ষা অর্জনের মৌলিক উদ্দেশ্য কখনও বদলায়নি মানুষকে মানুষ করে গড়ে তোলা। মানুষ জন্মগতভাবে কৌতূহলী, আর সেই কৌতূহলের পথ ধরে সে খুঁজে পায় জ্ঞান। শিক্ষা হল সেই আলো, যা মানুষকে অন্ধকার থেকে মুক্ত করে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলে। যুগে যুগে শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে নানা পরিবর্তন। গুহাচিত্রে শেখা থেকে শুরু করে প্রাচীন গুরুকুল, পাঠশালা, আধুনিক বিদ্যালয় ও আজকের ভার্চুয়াল শ্রেণিকক্ষ সবকিছুই সময়ের দাবিতে গড়ে উঠেছে। কিন্তু আজ আমরা এমন এক যুগে প্রবেশ করছি, যেখানে প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), অটোমেশন, এবং গ্লোবাল কানেকটিভিটির প্রভাবে শিক্ষা একটি নতুন রূপ নিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিবর্তন আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? ২১শ শতাব্দীতে এসে আমরা এক পরিবর্তনের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে প্রযুক্তি, তথ্য, ও নতুন চিন্তাধারার প্রভাবে বদলে যাচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা। তাই এখনই সময়, আমরা ভাবি: আগামী দিনে শিক্ষার চেহারা কেমন হবে?

আগামী দিনের শিক্ষা হবে প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষতা-ভিত্তিক এবং আরও বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আমাদের চিন্তা করার ধরন, শেখার প্রক্রিয়া, এমনকি শেখার জায়গাটাও বদলে যাচ্ছে। আধুনিক শিক্ষা আর শুধু বই আর খাতা দিয়ে সীমাবদ্ধ নয় এখন শিক্ষার হাতিয়ার হলো ল্যাপটপ, মোবাইল, ইন্টারনেট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আগের দিনে শিক্ষক ছিলেন মূল জ্ঞানদাতা, আর ছাত্র ছিল শ্রোতা; কিন্তু ভবিষ্যতের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক হবেন একজন গাইড, আর শিক্ষার্থী হয়ে উঠবে নিজের শেখার প্রধান চালক।

  • অনলাইন শিক্ষা: কোভিড-১৯ মহামারী আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে শুধু শ্রেণিকক্ষ নয়, স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ থেকেও শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব। Coursera, Khan Academy, BYJUS, Google Classroom এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের দেখিয়েছে বিশ্বমানের শিক্ষা এখন সবার জন্য উন্মুক্ত।
  • এআই এবং মেশিন লার্নিং: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) শিক্ষার্থীদের শেখার ধরন বুঝে তাদের জন্য কাস্টমাইজড পাঠ তৈরি করতে পারবে। ChatGPT-এর মতো এআই টুলস ইতোমধ্যেই ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর, প্রবন্ধ লেখা, কোড শেখানোসহ অনেক বিষয়ে সাহায্য করছে।
  • ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR): এই প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব অভিজ্ঞতা নিতে পারবে। যেমন ইতিহাসের ক্লাসে তারা ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের ঘটনা ‘দেখতে’ পাবে, কিংবা জীববিজ্ঞানের ক্লাসে মানবদেহের ভিতরের অঙ্গগুলোর ভার্চুয়াল ভ্রমণ করতে পারবে।

প্রতিটি শিক্ষার্থী আলাদা, তাদের শেখার ধরনও ভিন্ন। ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থা একেকজনের সক্ষমতা ও আগ্রহ অনুযায়ী আলাদা পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করবে। কেউ যদি চিত্রকলায় ভালো হয়, তবে সে হয়তো তার পাঠের বড় একটা অংশ সেই শিল্পভিত্তিক দক্ষতায় ব্যয় করবে।

আগে যেখানে পুরো শ্রেণিকক্ষে একটাই পাঠ্যক্রম পড়ানো হতো, এখনকার ও আগামী দিনের শিক্ষা আরও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হবে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর শেখার ধরন, গতি ও আগ্রহ অনুযায়ী তাদের জন্য আলাদা কনটেন্ট ও মেথড থাকবে।

  • যে শিক্ষার্থী দ্রুত শিখতে পারে, সে তার গতিতে এগোতে পারবে।
  • যে একটু ধীরে শেখে, তার জন্য পুনরাবৃত্তিমূলক কনটেন্ট থাকবে।
  • আগ্রহভিত্তিক বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকবে আরও বেশি।

এভাবে শেখা হবে স্বাধীন, উদ্দীপনামূলক ও দারুণ কার্যকর। আগামী ২০ বছরে এমন অনেক পেশা চলে যাবে, যা আজ রয়েছে। আবার এমন অনেক পেশার জন্ম হবে, যার কথা আমরা এখনো জানি না। তাই শিক্ষার লক্ষ্য হতে হবে শুধু তথ্য মুখস্থ করানো নয়, বরং বাস্তব জীবনে টিকে থাকার উপযোগী দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া।

  • প্রযুক্তিগত দক্ষতা: কোডিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ক্লাউড কম্পিউটিং, AI, ডেটা অ্যানালিটিক্স।
  • মানবিক দক্ষতা: সমস্যা সমাধান, বিশ্লেষণী চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা, নেতৃত্ব, যোগাযোগ ও সহানুভূতি।
  • আর্থিক সচেতনতা ও উদ্যোক্তা মনোভাব: ভবিষ্যতের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা দেবে, শুধু চাকরির জন্য প্রস্তুত নয়।

বর্তমানের পরীক্ষা-কেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মাঝে চাপ ও প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দেয়। ভবিষ্যতের শিক্ষা হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ননির্ভর, যেখানে শিক্ষার্থীর মৌলিক চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা, দলগত কাজের ক্ষমতা প্রাধান্য পাবে।

  • প্রকল্পভিত্তিক মূল্যায়ন (Project-based Assessment)
  • ই-পরীক্ষা ও অটোমেটেড মার্কিং
  • 360 ডিগ্রি ফিডব্যাক সিস্টেম – যেখানে শিক্ষক, সহপাঠী এবং নিজের মূল্যায়ন মিলিয়ে দক্ষতা যাচাই হবে।
  • একটা সময় শিক্ষক ছিলেন তথ্য সরবরাহকারী। এখন তথ্য সবার হাতে। গুগল সার্চ করলেই জ্ঞান পাওয়া যায়। তাই আগামী দিনের শিক্ষক হবেন অনুপ্রেরণাদায়ী গাইড, যিনি শিক্ষার্থীর মানসিক, নৈতিক এবং সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
  • শিক্ষক হবেন মানসিক সহায়তাকারী।
  • শিক্ষার্থীর মাঝে অনুসন্ধানী মন তৈরি করবেন।
  • শেখার পরিবেশকে মানবিক ও উৎসাহব্যঞ্জক করবেন।

শুধু দক্ষতা নয়, ভবিষ্যতের সমাজে প্রয়োজন হবে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি। প্রযুক্তির উন্নয়ন যতই হোক, যদি মানুষ মানবতা ভুলে যায়, তবে তা বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই শিক্ষা হবে এমন, যেখানে শেখানো হবে—

  • সহানুভূতি ও সহনশীলতা
  • পরিবেশ সচেতনতা
  • সামাজিক দায়বদ্ধতা
  • দায়িত্ব ও নেতৃত্ববোধ

বাংলাদেশেও শিক্ষার এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগছে। নতুন কারিকুলামে দক্ষতা ও মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম, স্মার্ট স্কুল উদ্যোগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি শিক্ষার প্রসার সবকিছু মিলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে।

তবে, এখানেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  • প্রযুক্তিগত অপ্রতুলতা
  • গ্রাম-শহরের বিভাজন
  • ইন্টারনেট সুবিধার সীমাবদ্ধতা

এসব মোকাবিলা করে আমরা যদি প্রযুক্তি ও মানবিকতাকে একত্রিত করে শিক্ষার পথকে রচনা করতে পারি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ সত্যিই হবে আশাজাগানিয়া। শিক্ষার ভবিষ্যৎ আমাদের হাতেই। এটি হবে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ, মানবিক মূল্যবোধনির্ভর, দক্ষতা ও স্বাধীনচেতা মননের উৎস। পরিবর্তনের এই ঢেউ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। বরং আমাদের উচিত শিক্ষার এই পরিবর্তনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া, শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একটি পথ তৈরি করা, যেখানে তারা কেবল ভালো পরীক্ষার্থী নয় ভালো মানুষ, দক্ষ পেশাজীবী ও সচেতন নাগরিক হয়ে উঠতে পারে।

শেষ কথায়

বিখ্যাত দার্শনিক জন ডিউই বলেছেন

‘If we teach today’s students as we taught yesterday’s, we rob them of tomorrow.’

তাই আজকের শিক্ষা হতে হবে আগামীর জন্য। শিক্ষা যেন হয়ে ওঠে জীবনের জন্য শিক্ষা শুধু পাস করার জন্য নয়।

লেখক: প্রযুক্তিবিদ ও কলামিস্ট


‘সামনে নির্বাচন পুলিশসহ সকলকে সজাগ থাকতে হবে’

সৈয়দ শাকিল আহাদ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

ঢাকাসহ সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে কারিগরি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, দাবি আদায়ের জন্য তেজগাও সাত রাস্তায় আড়াই ঘণ্টা পথরোধ করার রাজধানীবাসী দুর্ভোগে পড়েন। ফেব্রুয়ারিতে জুলাই সনদের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ কয়েক দফা দাবিতে রাজধানী ঢাকায় গত বৃহস্পতিবার একযোগে বিক্ষোভ মিছিল করেছে জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি দল। বিক্ষোভের আগে বায়তুল মোকাররম, জাতীয় প্রেসক্লাবসহ আশপাশের এলাকায় দলগুলো সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেছে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব কর্মসূচি ছিল।
প্রায় অভিন্ন দাবিতে সাতটি দল তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর সব জেলা ও উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি রয়েছে দলগুলোর। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) এই কর্মসূচি পালন করবে। সাতটি দলের কেউ ৫ দফা, কেউ ৬ দফা, কেউ ৭ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলেও সবার মূল দাবি প্রায় অভিন্ন।
দাবিগুলো হচ্ছে :-জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং তার ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান, জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষে (কেউ কেউ উচ্চকক্ষে) সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতি চালু করা।অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার সমান সুযোগ) নিশ্চিত করা

বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। দাবি আদায়ের নামে রাস্তায় আন্দোলন করে জনগণকে দুর্ভোগে ফেলে । সরকার ও প্রশাসনকে বিব্রত পরিস্থিতি ও অস্তিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে যাবার আগে কর্মসূচি প্রণেতাদের ভাবতে হবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কি ? আমরা কোথায় আছি এবং দেশের অর্থনীতি কোথায় যাচ্ছে?
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের বছর পার করার পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন কতটুকু সফল হয়েছে সেইসাথে কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেন ব্যর্থ হতে হচ্ছে তা একটু ভাবতে হবে।
ঢাকায় মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সরকারকে ও দেশবাসীকে তীব্র সমালোচনার মুখে ফেলেছিল যা আমাদের সকলেরই জানা আছে।
দেশে আনাচে কানাচে অযাচিতভাবে
মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা, বিভিন্ন স্থানে হামলা, খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মিটফোর্ডের ঘটনা ছাড়াও খুলনায় যুবদলের এক নেতাকে হত্যার পর পায়ের রগ কেটে দেয়া, চাঁদপুরে মসজিদের ভেতরে ইমামকে চাপাতি দিয়ে কোপানোসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, চাঁদাবাজিসহ বহু ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবে আলোচনায় এসেছে।
এর আগে মার্চ মাসে ঢাকার কাছে মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলায় আপন দুই ভাইসহ তিনজনকে মসজিদের ভেতরে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছিল।
এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে একের পর এক ‘মব সন্ত্রাস’ জনজীবনে আরেক উপসর্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যেসব ঘটনার সময় অনেকে ক্ষেত্রেই সরকার কিংবা পুলিশ দেখেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
জনমনে শংকা ও আমাদের কৌতুহল,
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী যদি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সেই দিনক্ষণ আর বেশি দূরে নয়। বর্তমান ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ ধরলে আগামী পাচ মাস পরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এই সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের পক্ষে থেকে আশার বাণী শোনালেও বাস্তবে তা সন্তোষজনক নয়।
দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে আমাদের মনে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এখনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না বলেই মনে হবে , এখনো মব ভায়োল্যান্স, নির্যাতন, প্রকাশ্যে হত্যা, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা সামনে আসছে। মোহাম্মদপুরে তো ঘটেই চলেছে নতুন নতুন আতংক একের পর এক লোমহর্ষক ঘটনা, ছিনতাই এবং চাদাবাজি, তাছাড়া তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কবে যে ঘুরে দাঁড়াবে সেটাই প্রশ্ন?
জাতীয় নির্বাচনের আগে কি স্বাভাবিক হবে? কবে জনগণ শান্তিতে পথ চলবে?
এমন নানা প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এর প্রভাব পড়বে জাতীয় নির্বাচনে এবং আমাদের অর্থনীতিতে । আগামী সময় এ পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হওয়ার সম্ভাবনার কথা আশংকা করছেন তারা।

এদিকে গণঅভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া অস্ত্রসহ সারাদেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নির্বাচনের আগে এসব অবৈধ অস্ত্র দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্ধার করা হবে বলে সম্প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। যা সন্তোষজনক বলে মনে করেন কেউ কেউ।

পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
তবে বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা নিয়ে স্বয়ং পুলিশ বাহিনীর কেউ কেউ একমত প্রকাশ করেছেন। বাহিনীর সবোর্চ্চ মহল থেকে বলা হচ্ছে, পুলিশ ফোর্সের মোরাল বুস্টআপ তারা এখনো করতে পারেননি। যার ফলে অনেক অপরাধই চোখের সামনে সংঘটিত হলেও কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না।
এসব অপরাধের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকেও সোচ্চার হতে দেখা গেছে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দলই বিভিন্ন ঘটনার পর মব ভায়োল্যান্সের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানিয়েছে। তবে এতকিছুর পরও হামলা, মামলা, নির্যাতন মব ভায়েল্যান্সের মাধ্যমে প্রকাশ্যে হত্যার মতো ঘটনা থামছে না। সর্বশেষ গত ৭ আগস্ট সন্ধ্যায় গাজীপুরে পুলিশের সামনে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তার আগে ১০ জুলাই সন্ধ্যায় রাজধানীর পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে লোকজনের সামনে লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগ (৩৯) নামের এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা যেমন জনমনে দাগ কেটেছে, দেশে বিদেশে আলোচনার-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
অপরাধ সূচক থেকে যা জানা যাচ্ছে
গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত আছে বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির মতে, খুন, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, লুটপাট, অরাজকতা চলছেই। পুলিশ এখনও নির্লিপ্ত, দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ এবং পেশাদারত্বেরও ঘাটতি রয়েছে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত ৪ আগস্ট রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির নিজ কার্যালয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব কথা জানানো হয়।
এবং তাদের দেয়া কিছু পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এ বছর প্রতি মাসেই খুনের ঘটনা বাড়ছে। খুনের ঘটনা বেশি ঘটছে ঢাকা মেট্রোপলিটন, ঢাকা রেঞ্জ ও চট্টগ্রাম রেঞ্জে। অনেক খুনের পেছনে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের মতো ঘটনা কাজ করেছে বলে জানা যাচ্ছে।
খুনের পাশাপাশি সারাদেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ডাকাতি, ছিনতাই, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং অপহরণের মতো অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৬টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৪টি ডাকাতি হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। এছাড়া এ ছয় মাসে ১১ হাজার ৮টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চলমান রয়েছে। এছাড়া সারা দেশে বিশেষ করে অপরাধপ্রবণ এলাকায় পুলিশের বিশেষ টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অপরাধীদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশের বড় বড় শহর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করে অপরাধীদের আটক করা হচ্ছে। দেশব্যাপী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের তৎপরতা অব্যাহত আছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজাদ আলী রাজারবাগে সম্প্রতি এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘বিগত বছরে বিশেষ করে মেট্রোপলিটন পুলিশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। একসময় যে ভঙ্গুর অবস্থায় চলে গিয়েছিল পুলিশ সেখান থেকে এখন অনেকটাই পেশাদারত্বে ফিরে এসেছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। পুলিশ পেশাদারত্ব ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসন্ন নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে একটি দৃষ্টান্তে পরিণত করবে।’
এ প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ওমর ফারুক একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ’সামনে দিন যত যাবে পরিস্থিতি তত খারাপের দিকে যাবে। নির্বাচনকে কেন্দ্রে করে সহিংসতা আরও বাড়তে পারে বলে আমরা আশংকা করছি। মূল সমস্যা হলো সবাই ক্ষমতার পালা বদলে ব্যস্ত। ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্কারে সরকারের কাজগুলো তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। রাজনৈতিক অস্থিরতাটাই মূল কারণ, যেটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। এছাড়া পুলিশবাহিনী এখনও খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এখনো পুলিশ পুরোদমে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ সময়টাকে অপরাধীরা সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়েছে। যার ফলে এসব নৈরাজ্য চলছে।’

এ প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন এর সাথে সহমত প্রকাশ করে বলতে হচ্ছে ‘সামগ্রিকভাবে যদি চেষ্টা করা হয় তাহলে অল্প দিনের মধ্যেই পুলিশকে সেই মর্যাদার জায়গায় নেওয়া সম্ভব। যেখান থেকে পুলিশ জনগণকে সাহায্য ও সহযোগিতা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অবদান রাখতে পারে। সে জন্য পুলিশকে ঢেলে সাজাতে হবে। এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সফল ও স্বার্থক করে তুলতে হবে এটা নির্ভর করছে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তাদের সদিচ্ছা ও আম জনতাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতার ওপর।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন এর সাথে সহমত প্রকাশ করে বলতে হচ্ছে ‘সামগ্রিকভাবে যদি চেষ্টা করা হয় তাহলে অল্প দিনের মধ্যেই পুলিশকে সেই মর্যাদার জায়গায় নেওয়া সম্ভব। যেখান থেকে পুলিশ জনগণকে সাহায্য ও সহযোগিতা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অবদান রাখতে পারে। সে জন্য পুলিশকে ঢেলে সাজাতে হবে। এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সফল ও স্বার্থক করে তুলতে হবে এটা নির্ভর করছে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তাদের সদিচ্ছা ও আম জনতা সহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতার ওপর।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের ভেতর এক ধরনের অনাস্থা কাজ করছে। কারণ বেশ কিছু পুলিশ সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। প্রতিটা হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। আমার ধারণা, এর মধ্যে দিয়ে পুলিশ আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তদের অংশগ্রহণ আমরা লক্ষ্য করছি। রাজনীতিতে দুর্নীতিবাজদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, তারাই আবার মেইন স্ট্রিমে অবস্থান করছে। এখন যেটি দেখা যাচ্ছে-অস্থিতিশীল অবস্থা, চাঁদাবাজি, লুটপাট, নির্যাতন- এর একটা বড় অংশ করছে রাজনৈতিক সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। এগুলো থেকে ফিরে আসতে হবে।’ সামনে নির্বাচন, এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন লেভেল প্লেয়িং হবে কি করে।যদি না সব দলসহ সবাইকে কার্যকর ভূমিকা না রাখতে পারে। তাই দরকার সবাইকে এক ও অভিন্ন দৃষ্টিতে নির্বাচনের জন্য কাজ করা, তাহলেই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। রাজনৈতিক দলগুলো নানা ওচিলায় দাবি আদাযে ব্যস্থ থাকলে, দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সস্ত্রাসবাদ জেগে ওঠবে।, তাহলে লেভেল প্লেইঙ হবে কি করে। এ বিষয়টি রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে ভাবতে হবে।


banner close