বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪

শব্দদূষণ রোধের নতুন প্রযুক্তি কোয়েটপ্রো 

প্রদীপ সাহা  
প্রকাশিত
প্রদীপ সাহা  
প্রকাশিত : ২৬ মার্চ, ২০২৪ ১২:২৮

পরিবেশ দূষণের ব্যাপারে আমরা সবাই এখন অবগত। ক্রমাগত বিভিন্নভাবে আমরা এর শিকার হচ্ছি-Ñ এ কথা বলার অপেক্ষায় রাখে না। তবে পরিবেশ দূষণ হিসেবে শুধু বায়ুদূষণ, পানিদূষণ কিংবা মাটিদূষণের কথা বেশি ভাবলেও আমরা শব্দদূষণের কথা কম ভাবছি। শব্দদূষণ প্রতিরোধে আমরা কার্যকর ব্যবস্থাও কম নিচ্ছি; কিন্তু এর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবের কথা অবশ্যই আমাদের গভীরভাবে ভাবা উচিত। নরওয়ে শব্দদূষণের হাত থেকে বাঁচাতে এক চমৎকার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। ইউরোপের সবচেয়ে তেলসমৃদ্ধ দেশ নরওয়ের উত্তর সাগরের বুকে রয়েছে অসংখ্য তেল উত্তোলন ক্ষেত্র। আর এই তেল উত্তোলন ক্ষেত্রগুলোতে বিকট শব্দের মাঝে কাজ করতে গিয়ে অধিকাংশ শ্রমিক তাদের শ্রবণশক্তি হারাচ্ছেন। জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর কমপক্ষে ৬ শ শ্রমিকের ক্ষেত্রেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। নরওয়ের মূল ভূখণ্ড থেকে তেলক্ষেত্রগুলোতে যাওয়া-আসার জন্য একমাত্র বাহন হচ্ছে হেলিকপ্টার। আর এর ফলে তেল উত্তোলন ক্ষেত্রের অন্যান্য জোরালো শব্দের সঙ্গে হেলিকপ্টারের বিকট শব্দ সেখানকার কর্মীদের নিত্যসঙ্গী। উত্তর সাগরের এই উচ্চ শব্দের মধ্যেই কাজ করছেন স্টেলে আস। তিনি বলেন, প্রতিটি তেলক্ষেত্রেই রয়েছে ঘূর্ণায়মাণ যন্ত্রপাতি, পানির তোড়ে ঘোরতে থাকা মোটরের চাকা, কপাটক এবং উত্তোলক যন্ত্রসহ আরও অনেক ধরনের যন্ত্রপাতির তীব্র শব্দ। এই উচ্চমাত্রার শব্দদূষণের মধ্যে তার কাজ করার বিরাট অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর তাই নিজের শ্রবণক্ষমতার সমূহ ঝুঁকির ব্যাপারে তিনি বেশ সচেতন।

নরওয়ের বৃহত্তম তেল কোম্পানি হচ্ছে ‘স্টাটওয়েল’। তারা বিকট শব্দ থেকে কর্মীদের বাঁচাতে ‘কোয়েটপ্রো’ নামের এক বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এটি কানে ব্যবহার করার মতো একটি ডিজিটাল প্লাগ। এটি ১২০ ডেসিবেল মাত্রার বিকট আওয়াজকে মাত্র ৩০ ডেসিবেলে নামিয়ে এনে শ্রবণ উপযোগী করে কানে পৌঁছায়। শুধু শব্দের মাত্রা সহনীয় করে তোলা নয়, পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও এটি দ্বিগুণ কাজ করে। প্রযুক্তির কার্যকরিতা নিয়ে কাজ করছেন মি. মেলভ্যার। তিনি বলেন, এই প্রযুক্তির প্লাগটি বাহিরের শব্দের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম। এ প্লাগ যেমন হেলিকপ্টার উড্ডয়নের সময় সৃষ্ট বিকট আওয়াজকে কানে পৌঁছতে দেয় না, তেমনি এটিকে সাধারণ শ্রবণযন্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। শুধু তাই নয়, ব্যবহারকারী স্পষ্টভাবে শুনতে পাবে তার কাছে পাঠানো রেডিও বার্তা এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত মাইক্রোফোনের মাধ্যমে অন্য প্রান্তে বার্তা ফেরতও পাঠানো যাবে।

বিমান কিংবা একটু গোলমালের মধ্যে ভালো ঘুমের জন্য যেসব ইয়ার প্লাগ ব্যবহার করা হয়, এটিও সেরকমই একটি প্লাগ। শুধু এর সঙ্গে তার দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে একটি ছোট পকেট কম্পিউটার, যা সেকেন্ডের মধ্যেই বাইরের শব্দের মাত্রা বিশ্লেষণ করে তাকে কানের উপযোগী করে আবার মাইক্রোফোনের মাধ্যমে পাঠানো বার্তা অপর প্রান্তে সরবরাহ করে। তেলক্ষেত্রগুলোতে কর্মরত মানুষদের জন্য এটি এখন জীবন রক্ষাকারী যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। মেলভ্যারের মতে, মানুষের শ্রবণশক্তি সুরক্ষায় বিশ্বে এটিই প্রথম যন্ত্র, যা ব্যবহারকারীদের কানের পর্দায় পৌঁছানো শব্দের সঠিক মাত্রা নির্ণয় করতে পারে। শুধু তাই নয়, এটির সাহায্যে নির্ধারিত সময়ে শব্দ শ্রবণের মাত্রা মেপে পরবর্তীতে কারো শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাসের ঘটনাও নির্ণয় করা সম্ভব। এর ফলে একজন মানুষের জন্য কতটুকু মাত্রার শব্দ সহনীয় এবং কতটুকু মাত্রা অসহনীয় সেটিও নিঁখুতভাবে নির্ণয় করা যায়। নরওয়ের মতো আমরাও কি পারি না শব্দদূষণের হাত থেকে এভাবে নিজেকে বাঁচাতে?

লেখক: বিজ্ঞান ও পরিবেশবিষয়ক কলামিস্ট


মশামাছির মুখপোড়া 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আলমগীর খোরশেদ 

আবহমান গ্রামবাংলা হাজারো ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক হয়ে আজও টিকে আছে স্মৃতি জাগানিয়া হয়ে। নানা ধরনের পূজা, পার্বণ, আচার, পালন করত ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে। সংস্কার, আচার, লোকাচার যাই বলিনা কেন, তখনকার লোকজন তা মানত। সংস্কৃতি মানেই একটি জাতি বা গোষ্ঠীর যাপিতজীবন চারণ। দুর্গা পুজোতে পাড়ার হিন্দু লোকজন চাঁদা ধরে প্রতিমা গড়তেন। কোনো জাতির আয়না হয়ে সমুজ্জ্বল থাকে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। কার্তিকের শেষে ভোলা সংক্রান্তি যা ভোলাভুলি উৎসব বা মশামাছির মুখ পোড়া নামে পূজা ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পালন করা হতো। হিন্দু মুসলমান সবাই পালন করত এটা। বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ধরে রাখার বয়স প্রায় দুই হাজার বছরের মূলে প্রোথিত। বঙ্গ বা বাংলা ছিল সম্পদে প্রাচুর্যে ভরপুর এক জনপদ। ফলে বারবার আঘাত এসেছে, যুদ্ধ হয়েছে, শত বছর ধরে বাঙালি সংস্কৃতিকে শুকুনের মতো খামছে ধরেছে ঔপনিবেশিক শাসন। আঘাত করেছে বর্গীরা। বিভিন্ন জাতির বসবাস হয়ে শংকর জাতির বারোয়ারি উপদ্রব সইতে হয়েছে চোখ বুঁজে। বারো মাসে তেরো পার্বণে একটি হলো মশামাছির মুখপোড়া বা ভোলাভুলি পূজা। খড়-বাঁশ দিয়ে তৈরি ভোলার প্রতিকৃতি বানিয়ে তাতে মশামাছি রেখে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর কেউ সেটা উঁচু করে ধরে দৌড়ে যেত আর চিৎকার করে বলত,

‘ভালা আইয়ে বুড়া যা, মশা-মাছির মুখ পোড়া যা।’

বাড়িতে ঠাট্টা সম্পর্কীয় ভাবী, বেয়াই, দাদা, দাদি, বেয়াইনরা কলাগাছের ডাগ্গোয়া কেটে পিছন থেকে পিঠে বারি দিয়ে বলত,

‘ভোলা ছাড় ভুলি ছাড়, বার মাইয়া পিছা ছাড়’। কেউ কেউ বাঁশের নতুন কুলা পিঠে পিটাইয়া দৌড়ানো দিত। বলত,

‘মশা মাছি বাইর অ, টাকা-পয়সা ঘর ল, জঞ্জাল সব দূর হ’।

সবাই মিলে কাঁচা তেঁতুল পেড়ে এই আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া হতো। খড়, দড়ি, শোলা, কাপড়, কলাগাছের ডাগ্গোয়া, প্রয়োজন পড়ত এই কাজে। জনমনে ধারণা ছিল, খড়ের আগুনে এবং কলাগাছের ও কুলা দিয়া পিটিয়ে ঘর বা সংসারের যাবতীয় বদ বা খারাপি দূর হয়ে যাবে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মাসব্যাপী পূজা করত। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের লোকজন কার্তিক মাসে প্রতিদিন সকালে স্নান করে দেবতাকে ভোগ দিত। বাড়িতে মাইক বাজিয়ে গান হতো, লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি, কাগজ, ত্রিকোণাকৃতি করে কেটে পাটের সুতলীতে আঁটা দিয়ে লাগিয়ে বাড়ি-ঘর সাজাত মানুষ। কার্তিক পূজা করা হতো এ মাসেই। মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে। পুজোতে প্রসাদ দেয়, আতপ চাল ভিজিয়ে তাতে কলা মাখিয়ে। সাথে আখ টুকরা করে কেটে দেওয়া হতো। ঢোল, খঞ্জনি, কাঁসা বাজিয়ে কীর্তন গাইত পূজারী ও তার লোকজন। অন্যরা সাথে কোরাস গাইত। মেহমান, মেয়ে নাইওর আসত বাবার বাড়িতে। আজকের প্রজন্ম ইন্টারনেট মোবাইলে বুঁদ হয়ে সামাজিকতা ভুলে গেছে। গুছিয়ে কথাই বলতে জানে না। সংস্কৃতি ঐতিহ্য নিয়ে তাদের জ্ঞান খুব নগণ্য। বিভিন্ন সামাজিক আচার, মশামাছির মুখপোড়া কিংবা ভোলাভুলির পূজা কি তা জানেই না। দল বেঁধে খড়ের মূর্তি বানিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে হৈ-হুল্লোড় করার মানুষ নেই আর। সেই মন-মানসিকতা হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। বাঙালির গ্রামীণ ঐতিহ্যের ইতিহাস হাজার বছরের লালিত স্বপ্নমোড়ানো ইতিহাস। যা যুগ যুগ ধরে, কাল থেকে মহাকাল রচনা করে যাবে নীরবে নিভৃতে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক

বিষয়:

গোলাপি শার্ট পরা ওই লোকটা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সুধীর সাহা

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। কলেজে পড়ার সময় যা ছিল মুখে মুখে এবং বিশ্বাসে, আজ তা-ই হয়ে দাঁড়িয়েছে ম্যাজিক স্লেটের লেখা। আপনি ইচ্ছেমতো লিখবেন, মুছবেন, আঁকবেন, মুছবেন আর সুর করে বলবেন ‘কুমির, তোমার জলে নেমেছি; পারলে আমায় ধরে দেখাও।’ অথবা গম্ভীর গলার হুঙ্কারÑ ‘ক্যাচ মি, ইফ ইউ ক্যান’। এটি আজকের দিনে হয়ে দাঁড়িয়েছে ম্যাজিক স্লেটের গল্প। এখন মনে হয় প্রজা যে তন্ত্র নির্মাণ করেছে, সেই তন্ত্রের চালিকাশক্তি কি প্রকৃতই প্রজার হাতে থাকে? নাকি এ তন্ত্রে প্রজার প্রেরিত প্রতিনিধি আর শাসক দল এক দুরূহ অন্তরালে নিজেদের ঢেকে রাখে যাকে সবাই দেখতে পায় না; শুধু কোনো অজ্ঞাত নির্দেশ বা কোনো অলীক সম্মোহনে রথের চাকাগুলো অবিরাম ঘুরতে থাকে, যার সামনে হুজুর মাই-বাপ বলে হাঁটু মুড়ে বসা ছাড়া প্রজার আর কোনো গতি নেই।

ধরুন, আপনার পাড়ায় একজন কুঁড়েঘরে থাকে। হঠাৎ এক দিন দেখলেন, বাড়িটা প্রাসাদ হয়ে গেল। তার আগে থেকেই আপনি দেখছিলেন, লোকটি শাসক দলের সঙ্গে ওঠাবসা করছে, নেতার পিছনে হাত কচলাচ্ছে, তার মোটরবাইক হচ্ছেÑ এক দিন সে জনপ্রশাসক হলো কিংবা জনপ্রতিনিধি হলো। আপনার ফুটপাত বাঁধানো হলো, কলে পানি এল, রাস্তায় বাতি জ্বলল, আর তার বাড়িটা হঠাৎ প্রাসাদ হয়ে গেল। আপনি খোঁজ নিলেন। জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারের কর্তাব্যক্তিটির বেতন, পরিবারের আয়, খরচ সবকিছু মিলিয়েও আপনি হিসাব মেলাতে পারলেন না; কিন্তু এ অবস্থায় আপনি কী করবেন? আপনার কী মনে হবে মাস্টারমশাই তো বটেই, কারও কিছু করার নেই। আপনি বড়জোর, সবকিছু ম্যাজিক স্লেটে লিখে রাখতে পারেন; কিন্তু ম্যাজিক স্লেটের ওই লেখা দেখে আপনার পোষা বিড়ালটাও কিন্তু ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে হেসে উঠবে। বাকি সবাই বলবে, মাস্টার মশাই এবং আপনি দুজনেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন। আপনি বলতে থাকবেন, স্লেটে সব লেখা আছে; কিন্তু সময়মতো দেখলেন, সেই ম্যাজিক স্লেটটিও ফাঁকা। শয়তান বেড়ালটা থাবা দিয়ে ম্যাজিক বাটনটা টিপে দিয়ে স্লেটটি ফাঁকা করে দিয়েছে ততক্ষণে। আপনার রাগ হলে কোনো লাভ নেই; কেননা এমন ঘটনা এখন থেকে আপনার জীবনে ঘটতেই থাকবে, আর ঘটতেই থাকবে। যেমন কিছু লোক জেলে যাবে, কিছু লোক জেলে যাবে না বিদেশে যাবে। যেমন কিছু লোক বিদেশেই থাকবে, জেলে যাবে না। আরও শুনতে চান? ঠিক আছে, না-হয় আরও একটু বলি। আপনি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দেখলেন, একটা লোককে অনেকে মাটিতে ফেলে পেটাচ্ছে। আপনি দৌড়ে গেলেন সেখানে; কিন্তু গায়ের জোরে পারবেন না ওদের সঙ্গে। পরে যখন পুলিশ আপনাকে ডাকবে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে, আপনি চিনতে পারবেন কারা মেরেছিল লোকটিকে; কিন্তু পুলিশসহ কেউ আপনাকে মানবে না। গোলাপি শার্ট পরা ওই লোকটাই যে রাস্তার প্রধান গুণ্ডা ছিল, সে আপনি বললেই হলো? প্রমাণ কোথায়? গোলাপি শার্ট তো কত মানুষই পরে। যতসব ভুল-ভাল কথাবার্তা। আপনি মাথা নিচু করে থানা থেকে বেরিয়ে আসবেন। আপনি ওই মাস্টার মশাইয়ের মতো কিছুই দেখেননি অথবা যা দেখেছেন, তা আপনি আসলে দেখছেন না। অতএব হে পাঠক, হে মহামান্য পাঠকÑআপনারা এতক্ষণ যা পড়লেন, এই এতগুলো শব্দ আসলে আপনারা পড়েননি; একটা সাদা পাতা দেখেছেন শুধু। আর ভেবেছেন, এগুলো আপনি পড়েছেন। পাড়ার লোকটার প্রাসাদোপম বাড়ির জন্য, ওই গোলাপি শার্ট পরা লোকটার বিরুদ্ধে লেখার জন্য যদি কখনো আমার দিকে কেউ আঙুল তোলে, আমি কিন্তু বলব যে লেখে, সে আমি নই। সে ম্যাজিক স্লেটের ম্যাজিক লেখক- অন্য কেউ।

লজ্জার মতো অপরাধবোধ এবং কলঙ্কের মতো ভয়ও সমাজে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমার যদি মনে হয়, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে অপরাধবোধে ভুগব কিংবা কলঙ্কের ভয়ে সারাক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকব, তাহলে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার আগে আমি বহুবার ভাবব। অন্যদিকে, সমাজে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত আমাদের অপরাধবোধ এবং কলঙ্কের ভয় কমায়। সমাজের অধিকাংশ লোক দুর্নীতিতে যুক্ত না থাকলে দুর্নীতিতে না জড়ানোটাই তখন সমাজের আদর্শ হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে কেউ সামান্য দুর্নীতিতে যুক্ত হলেই সে অপরাধবোধে ভোগে, কলঙ্কের ভয়ে থাকে। কিন্তু সমাজে যদি সবাই দুর্নীতিতে যুক্ত হয়, তাহলে দুর্নীতিটাই ‘আদর্শ আচরণ’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে যায়। সেই দুর্নীতিতে আর অপরাধবোধ থাকে না, কলঙ্কের ভয় থাকে না। তখন দুর্নীতিতে এমনিতেই জড়িয়ে পড়ার মানসিক জরিমানার অঙ্কটা কমতে থাকে। এক সময় দুর্নীতি হয়ে পড়ে ‘স্বাভাবিক’। এমন সমাজব্যবস্থায় বেঁচে থাকার জন্য দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়াটাই মানুষের পক্ষে হয়ে ওঠে যুক্তিযুক্ত। অন্তত এমন যুক্তিই দাঁড় করিয়ে ফেলে দুর্নীতিগ্রস্তরা। খুব প্রণিধানযোগ্য প্রশ্ন হলো- এমন সমাজ হয়ে গেলে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? উত্তরটা কারও জানা থাকে না সেই বাস্তবতায়। তবে এর মাঝখানে যেটা সবার জানা আছে তা হলো, সরকার বা রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্দরে যে ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে সেটা ক্রমাগত অস্বীকার করলে কিংবা সমাজের স্বাভাবিক আচরণ বলে মেনে নিলে সেই দুর্নীতি থেকে বেরোনো যাবে না কোনোদিনই।

মাস্টার মশাই, এত কথাই বা কেন বলতে যাবেন? আমাকেও তেমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। কী দায় এত আমার কিংবা মাস্টার মশাইয়ের? যখন অন্যরা চোখ বুঁজে আছে, তখন বাপু তোমার এত বাড়বাড়ন্ত কেন? তুমি কী দেখছ না- চারদিকে কী ঘটছে? পাঁচ বছর পর পর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে সরকারের সরে আসার উদ্যোগ ইতোমধ্যেই গোচরীভূত হয়েছে। নতুন আইন হয়ে যাওয়ার পথে সরকার হাঁটছে, যেখানে পাঁচ বছর পর

পর আর ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী দিতে হবে না। সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জবাবদিহি থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার রাস্তা নিশ্চিত হয়ে যাবে। দুর্নীতিকে সুরক্ষিত ও উৎসাহিত করার এর চেয়ে ভালো পন্থা আর কি-বা হতে পারে। আপনি যা-ই ভাবেন, যেভাবেই ভাবেন ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবীদের পাঁচ বছর পর পর সম্পত্তি বিবরণের বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে সংশোধন সংসদে আসছে শিগগিরই। সংশোধনী আনার পক্ষের যুক্তি তো অকাট্য। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তার সম্পদের হিসাব রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দেওয়া বার্ষিক আয়কর রিটার্ন থেকে নেওয়া যাবে। সরাসরি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কেন এ বিপদের মধ্যে ফেলা! আপনি যতই বলবেন, এ সংশোধনী আনা হলে এতে অসাধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উৎসাহিত হবে দুর্নীতি করতে। যারা এখনো সাধু হওয়ার স্বপ্নে আছে, তারাও অচিরেই ভুল পাল্টে অধিক সংখ্যার মানুষের কাতারে যোগ দেবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান নেই। বাঃ! দারুণ ব্যাপার। নির্ভয়ে দুর্নীতি করুন, নির্ভয়ে অবৈধ সম্পদ বাড়িয়ে চলুন- ভয়ের চিহ্ন নেই, কেউ আর পিছুটানে আটকে যাবেন না। স্বদম্ভে এগিয়ে যাও তুমি দুর্নীতি। ম্যাজিক স্লেটে যা লেখা হচ্ছে, মুছে দিয়ে এগিয়ে যাও স্বদর্পে। গোলাপি শার্ট পরে ধুলো দেওয়া মানুষটির মতো এগিয়ে চলো হে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কেউ দেখছে না তোমাদের। দেখলেও ওদের দেখায় বিশ্বাস করে কে? বিবরণী দিয়ে আটকে যেও না। সংশোধনী পাস করিয়ে নাও জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে। তারপর মাণিকজোড় হয়ে চলো একসঙ্গে, একপথে।

লেখক: কলামিস্ট


সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের জন্য তরুণদের দক্ষ করে তোলা জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন থেকে তরুণ যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু তরুণদের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার কারণে এ বিষয়ে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই তরুণদের পড়াশোনার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখে নিজেকে প্রস্তুত করতে আহ্বান জানান। কোনোমতে সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য পড়াশোনা না করে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলার আহ্বানও প্রধানমন্ত্রী অসংখ্যবার জানিয়েছেন; কিন্তু আমাদের দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী সেদিকে মোটেও মনোযোগ দিচ্ছে না। এমনকি অসংখ্য তরুণ যারা পড়াশোনা এবং কর্মসংস্থান নিয়ে হতাশ এবং উদাসীন রয়েছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস, ২০২৩ জরিপে উঠে এসেছে যে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই আছেন নিষ্ক্রিয় অবস্থায়। অর্থাৎ তারা পড়াশোনা, কর্মসংস্থান কিংবা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণে নেই। বাংলাদেশের ছেলেদের চেয়ে এই নিষ্ক্রিয়তার হার আবার তিনগুণেরও বেশি মেয়েদের ক্ষেত্রে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি মেয়েদের নিষ্ক্রিয়তার হার শতকার ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বিপরীতে ছেলেদের এই হার ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছেলে। মেয়েদের বাল্যবিয়ে, দক্ষতার অভাব, শিক্ষার মানের ঘাটতি, জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা কিংবা মূল্যস্ফীতির কারণেই তরুণদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তা বাড়ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ পাওয়া যায়।

গত ১১ মে দেশে প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রত্যয় নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নাটোরে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বাংলাদেশের কোনো তরুণ-তরুণী আর কর্মহীন ও বেকার থাকবে না। যদি আমরা তাদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।’ যৌক্তিকভাবেই এখন যোগ্যতা এবং দক্ষতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তরুণদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের দেশ একধাপ এগিয়ে যাবে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নানাভাবে দক্ষ করে তুলতে উদ্যোগ এবং উৎসাহ থাকলেও তারা নিজেদের দক্ষ করে তুলতে একধাপ পিছিয়ে রয়েছে। তারা শুধুই চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় নেমেছে; কিন্তু নিজেদের কীভাবে দক্ষ করে দেশের উন্নয়নের ধারক হওয়া যায়- সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা তারা গ্রহণ করে না বললেই চলে।

গত ১৪ মে গণমাধ্যমসূত্রে জানতে পারলাম, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের অর্থায়নে বাংলাদেশসহ চার দেশের তরুণ উদ্যোক্তা ও উদ্যোক্তা উন্নয়নে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রতি বছর প্রো-ফেলোস কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের জন্য আবেদনপত্র গ্রহণ চলছে। ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সি ক্ষুদ্র বা মাঝারি ব্যবসার প্রতিষ্ঠাতা, ব্যবসার উদ্যোক্তা, স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তারা এ ফেলোশিপের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এ ধরনের ফেলোশিপের মাধ্যমে বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে। বাংলাদেশে বসে যারা কাজ করছেন, তাদের অনেক সম্ভাবনা আছে। যারা বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছেন, তাদের জন্য এই ফেলোশিপ ভীষণ কার্যকর হতে পারে; কিন্তু এর জন্য নিজের দক্ষতা এবং যোগ্যতাকে প্রমাণ করতে হবে।

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-বিবেচনায় প্রাধান্যের ভিত্তিতে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে যেসব মানুষ পারদর্শী ও পেশাদার, তাদের কদর পৃথিবীব্যাপী বেড়েই চলেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ৩ লাখ মানুষ সক্রিয়ভাবে আইসিটি খাতে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া ৫ লাখ রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সার আইসিটি বিষয়ে কাজ করছেন। আমরা জানি, বিদেশের শ্রমবাজারেও রয়েছে দক্ষ জনশক্তির বিরাট চাহিদা। দেশের অভ্যন্তরেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তির বৃদ্ধির চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।

আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের স্লোগান ছিল ‘দিন বদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’, ২০১৮ সালের ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ স্লোগানে নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলাসহ মোট ১১টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক কৃষি, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং রোবোটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ন্যানো টেকনোলজিসহ গ্রামীণ অকৃষিজ খাতের উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন মোকাবিলায় উপযুক্ত কর্মকৌশল গ্রহণ করার বিষয়ে সুস্পষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষি গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপের বিষয়টিও ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ কর্মরত রয়েছেন। যাদের ৮৮ শতাংশই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া অর্থাৎ প্রায় ৭৬ লাখ প্রবাসীর কাজের প্রশিক্ষণ নেই। আমাদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে হলে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, ফিজিক্যাল ইন্টেলিজেন্স, সোশ্যাল ইন্টেলিজেন্স, কনটেস্ট ইন্টেলিজেন্সের মতো বিষয়গুলো মাথায় প্রবেশ করাতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবিলায় বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরে জাতিসংঘের ই-গভর্ন্যান্স উন্নয়ন সূচকে সেরা ৫০টি দেশের তালিকায় থাকার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশে অনেক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু করা, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প। বাংলাদেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণ, উন্নয়ন ও মুক্তির পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার।

তরুণ-যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে কী করণীয়, সে বিষয়ে সবাই সজাগ থাকলেও ফলপ্রসূভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষতা এবং উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা সম্ভব না হলে দেশের জন্য আশানুরূপ উন্নয়ন সফলতা পাওয়া কঠিন হবে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগই এখন তরুণ যুবগোষ্ঠী। বাংলাদেশে তরুণরা সংখ্যায় বিশাল হলেও তাদের কতটা ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। বিগত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে যুবশক্তিকে যথাযথভাবে জনশক্তি হিসেবে কাজে লাগানো যায়নি। এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রমবাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য এবং বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত যুবক প্রতি বছর শ্রমবাজারে যুক্ত হলেও সে অনুপাতে সরকারি-বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়া।

আমরা সবাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যাশা করি; কিন্তু কীভাবে সেই উন্নয়ন হবে তা নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন হওয়া না হওয়া নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। দেশের তরুণ-যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে, দেশকে কোনোভাবেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ এই তরুণগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল এবং কর্মক্ষম। তাদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দ্রুততর এবং টেকসই করা সম্ভব। আর এ জন্য শুধু রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ নয়, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু আমরা ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দেশে বিনিয়োগের কার্যকর অনুকূল পরিবেশ নেই। অন্যদিকে সরকারি খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে, এটি ঠিক; কিন্তু সরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অর্থই হচ্ছে দুর্নীতির হার বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ যদি আগামী দিনের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায়, তাহলে অবশ্যই যুব সম্প্রদায়কে যথাযথ এবং দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি আন্তরিক দৃষ্টি স্থাপন করতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


ক্রলিং পেগ মুদ্রাস্ফীতি রোধ, রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের জন্যও ইতিবাচক

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
হীরেন পণ্ডিত

ক্রলিং পেগ পদ্ধতি কী? যার মাধ্যমে বাড়ল ডলারের দাম। একলাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে ডলারের নতুন দাম নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতদিন ১১০ টাকায় থাকা ডলারের অফিসিয়াল দাম একদিনে ১১৭ টাকায় উন্নীত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্প্রতি একটি সার্কুলার জা‌রি করে এ দাম ঘোষণা করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। ক্রলিং পেগ হচ্ছে দেশিয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ভোজ্য তেল, মসুর ডাল ও চিনি-পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্য আমদানি করতে ব্যাংক থেকে ডলার কিনে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হয়। সাধারণত ডলারের দাম যখন বেড়ে যায়, দেশের বাজারেও পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। আবার ডলারের দাম কমে গেলে সে অনুযায়ী পণ্যের দাম কমে যায়। গত দুই বছরে বাজারে ডলারের প্রকৃত যে রেট ছিল, সেই তুলনায় অফিসিয়াল রেট ছিল ভিন্ন। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর আগেও রেমিট্যান্স ও আমদানি বাবদ ডলারমূল্য নির্ধারিত ছিল ১১০ টাকায়। অথচ অধিকাংশ ব্যাংককে রেমিট্যান্স কিনতে হয়েছে ১১৫-১১৬ টাকার বেশি দামে। ব্যাংক আমদানিকারকদের কাছে লোকসানে ডলার বিক্রি করেনি। তারা এরচেয়ে ১-২ টাকা বেশি দরে ডলার বিক্রি করেছে। কোনো কোনো ব্যাংক আমদানি এলসি নিষ্পত্তিতে ১২০ টাকা বেশি ডলারের দর নিয়েছে। বিনিময় হার অস্থিতিশীল হওয়ার প্রবণতা থাকলে এবং মূল্যস্ফীতি উচ্চ হারে থাকলে কোনো দেশ ক্রলিং পেগ পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশ এখন এই পরিস্থিতির মধ্যেই আছে।

নতুন ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ব্যবসায়ীদের পণ্যের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারণ করছে, এটাই প্রকৃত মার্কেট রেট। তবে নতুন করে এই রেট বাড়ানো হলে তখন পণ্যমূল্য বাড়ার সম্ভাবনা থাকবে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর ফলে ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধা হয়েছে। আমদানিকারকরা এখন যেকোনো ব্যাংক থেকে নির্ধারিত দামে ডলার পেতে পারবেন। নতুন ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের দাম বাড়েনি। উল্টো গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের তুলনায় দাম কম রয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের জোগান বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে অবস্থায় আছে, তা যে কোনো সময় বিপদের কারণ না হতে পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকদিন ধরেই কৃত্রিমভাবে ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বাজারের ওপর সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। শুধু অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেই সরকার বাজারের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু শুরু থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার পরোক্ষভাবে হলেও নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল।

ক্রলিং পেগ পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক আসলে মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি হচ্ছে এ রকম এ ব্যবস্থায় ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি করিডর সৃষ্টি করা হবে। সেই করিডরের ভেতওে থেকে ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার কোম্পানিগুলোকে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক শিডিউল ব্যাংকের জন্য ডলারের বিনিময় হার

বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এ মুহূর্তে ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে, তাহলে ডলারের বিপরীতে টাকা যে অতিমূল্যায়িত হয়ে আছে তা কমে আসবে। ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলেও আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে-এ ধারণা সত্য নয়। কারণ, বর্তমানে আমদানিকারকদের অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে চাহিদামতো ডলার কিনতে না পেরে কার্ব মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে ডলার সংগ্রহ করে তাদের চাহিদা পূরণ করছেন।

কাজেই ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলেই যে বাজারে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে, তা নয়। যদি ডলারের উচ্চ বিনিময় হারের কারণেই স্থানীয় বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কেন বাড়ছে? স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার পেছনে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিই একমাত্র কারণ নয়। এজন্য বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতাই বেশি দায়ী।

বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবছর যে পরিমাণ পণ্য ভোগ করে, এর মাত্র ২৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং বাজারজাত করা হয়। তাহলে এসব পণ্যের মূল্য যখন তখন বাড়ে কেন? দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একক বৃহত্তম খাত হচ্ছে পণ্য রপ্তানি। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবার ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করেছে এ খাত থেকে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকসামগ্রী রপ্তানি করে অর্জিত হয়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলারের মতো।

এ খাতটি আমদানিনির্ভর বিধায় জাতীয় অর্থনীতিতে এর মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। এ খাত থেকে যে অর্থ আয় হয়, তার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে পুনরায় বিদেশে চলে যায়। এছাড়া তৈরি পোশাক শিল্পে যেসব বিদেশি বিশেষজ্ঞ কাজ করেন।

বাংলাদেশের প্রকৌশলী এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ কর্মীরা বিদেশে গিয়ে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। আমাদের দেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে দক্ষ লোকবল তৈরির চেয়ে দক্ষ জনশক্তি আমদানির প্রতি বেশি ঝোঁক লক্ষ করা যায়। দীর্ঘ মেয়াদে এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসজাত পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। যেহেতু বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে, তাই বাংলাদেশ ব্যাংক বিলাসজাত ১২২টি পণ্যের একটি তালিকা প্রণয়ন করে এসব পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করে। এর উদ্দেশ্য ছিল লেনদেনের ভারসাম্যকে অনুকূল অবস্থায় নিয়ে আসা। দেখা গেল, আমদানি ব্যয় অনেকটাই কমে এসেছে।

আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যকে পরিকল্পিতভাবে ঢেলে সাজানো দরকার। যাতে এ খাতের সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যায়। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি। এ খাতে যে অর্থ আয় হয় তার প্রায় শতভাগই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। এছাড়া প্রায় দেড় কোটি মানুষের বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে এ খাত। কিন্তু এ খাতটি সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে। গত বছর ১৩ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে গিয়েছে কর্মসংস্থানের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি খাতে আয় করেছে ২৩ বিলিয়ন ডলার।

তাহলে বাংলাদেশিরা কি পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ দেশে প্রেরণ করেনি? তারা অবশ্যই দেশে অর্থ পাঠিয়েছে। কিন্তু তা বৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠিয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ দেশে প্রেরণ করা হলে প্রতি ডলারে গড়ে ১২ থেকে ১৪ টাকা বেশি পাওয়া যায়। এজন্য ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রবাসী আয়ের ওপর দেওয়া নগদ আর্থিক প্রণোদনা বহাল রাখা যেতে পারে। তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ চ্যানেলে অর্থ দেশে প্রেরণে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।

এদিকে ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার আগে এই পদ্ধতি চালুকে কার্যকরী একটি পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেন বেসরকারি ব্যাংকের সাথে সংশ্লিষ্ট। ব্যাংকগুলো এখন ১১৭ টাকার নিচে বা ওপরে ডলারের কেনাবেচা করতে পারছে। তবে এই দরের চেয়ে খুব বেশি কম বা বেশি দামে ডলারের লেনদেন করা যাবে না। প্রতিদিন কত দামে ডলার কেনাবেচা করছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সেটা জানিয়ে দিতে হবে। এছাড়া ক্রলিং পদ্ধতি চালুর ফলে চলমান ডলার-সংকট অনেকটা কেটে যাবে বলে মনে করেন এই ব্যাংকার।

এদিকে ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এতদিন ডলার পাওয়া নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছিল এবং দাম তুলনামূলক কম ছিল। এখন ডলারের দাম একবারে ৭ টাকা বাড়ানোর ফলে আমদানি ব্যয় বাড়বে, বাড়বে পণ্যের দাম। একই সঙ্গে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। ফলে চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এখন থেকে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলার কেনাবেচা হবে। এ পদ্ধতিতে সম্প্রতি ডলারের রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। মুদ্রানীতিতে একই সঙ্গে ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে। ক্রলিং পেগ হলো একটি আর্থিক ব্যবস্থা, যা জাতীয় মুদ্রা বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট পরিসরে (ব্যান্ড) ওঠানামা করতে দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যান্ডের বাইরে চলে যাওয়া থেকে বিনিময় হার রাখতে চেষ্টা করে।

চীন, ভিয়েতনাম, নিকারাগুয়া এবং বতসোয়ানা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এমন কয়েকটি দেশ। পেমেন্টের ভারসাম্যের স্থিতিশীলতা প্রচারের জন্য তারা এই সিস্টেমটি বেছে নেয়। এবং কখনও কখনও তারা রপ্তানি বাজারে দেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বাড়াতে পর্যায়ক্রমে বিনিময় হার সামঞ্জস্য করে। মূল্যস্ফীতি হলো স্বতন্ত্র পণ্য ও পরিষেবার দাম বৃদ্ধি। এটি বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। যেমন ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খরচ, বর্ধিত চাহিদা বা সরকারিনীতি। বাজারে যদি কোনো পণ্য ও সেবার চাহিদা বেড়ে যায় এবং সে অনুযায়ী সরবরাহ না থাকে, তখন দাম বেড়ে যায়। আবার কোনো জিনিস তৈরি করতে যে সামগ্রী প্রয়োজন তার দাম বাড়লেও মূল পণ্যের দাম বেড়ে যায়। অন্যদিকে একটি দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে পণ্য ও সেবা সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকলেও দামে এর প্রভাব পড়ে।

মুদ্রানীতিতে ২০২৪ সালের জুন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ ও সরকারি খাতে লক্ষ্যমাত্রা ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। সরকারি খাতে ছিল ১৮ শতাংশ। বেসরকারি উৎপাদনশীল খাতে ঋণ কমে গেলে উৎপাদন কার্য কমে যাবে; ফলে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সরকারি খাতে তো ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, 'ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দাম বাড়লেও এর জেরে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়ার সুযোগ নেই। কারণ প্রকৃত বিনিময় হার বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। তাদের মতে, ডলারের অফিসিয়াল দাম ১১০ টাকা হলেও খোলাখুলিভাবে ১১৮-১২০ টাকা বা তারও বেশি দামে বেচাকেনা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যবধান কমানোর পদক্ষেপ নিয়ে ডলারের গড় দাম ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এরচেয়ে ১ টাকা কম বা বেশি রাখা যাবে ডলারের দাম।

ক্রলিং পেগ চালুর ফলে আমদানি ব্যয় খুব বেশি বা বাড়বে না। বরং ডলারের দামের এই সমন্বয় বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখবে। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের রেটকে ঘিরে অনিশ্চয়তায় থাকা আমদানিকারকরা এই অনিশ্চয়তা দূর হওয়ায় স্বস্তি পাবেন। এছাড়াও আমদানিকৃত পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা সহজ হবে। উল্টো ডলারের ভালো দাম পাওয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক


উন্নয়নশীল দেশের বাজেট প্রণয়ন সব সময় চ্যালেঞ্জিং

আপডেটেড ১৫ মে, ২০২৪ ১১:১২
ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ

জাতীয় বাজেট আসছে। আগামী জুনের শুরুর দিকে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হবে। সে লক্ষ্যে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বাজেট প্রণয়ন সব সময়ই বেশ চ্যালেঞ্জিং। রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে তো বার্ষিক বাজেট তৈরি করতেই হয়। আমরা জানি ব্যক্তিপর্যায়ে এবং প্রাতিষ্ঠানিকপর্যায়ে বাজেটের প্রয়োজন রয়েছে। বাজেট হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট বছরের সম্ভাব্য আয়- ব্যয়ের খতিয়ান। তবে জাতীয় বাজেট এবং ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক বাজেটের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক বাজেটের ক্ষেত্রে আয় বুঝে খাতওয়ারি ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হয়। কারণ এসব ক্ষেত্রে চাইলেই আয় বাড়ানো যায় না। আর জাতীয় বাজেটের ক্ষেত্রে প্রয়োজন নির্ধারণ করে আয়ের পরিমাণ এবং খাত নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয়। তবে সরকারের আয় বাড়ানোর সম্ভাবনা থাকলেও সব সময় তা যৌক্তিকভাবে বাড়ানো সম্ভব হয় না। জনগণের ওপর বর্ধিতহারে করারোপ করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। অনেক সময় যাদের কর দেওয়ার তারা নানা ছুতোয় কর দেন না এবং আদায় করও যায় না। বর্তমান সরকার গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে।

আগামী অর্থ বছরের জন্য প্রণীত বাজেটে অতীতের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি অর্থ বছরের (২০০২৩-২০২৪) জন্য বাস্তবায়নাধীন জাতীয় বাজেটে যেসব অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা বলা হয়েছিল নানা কারণেই তা পরিপূর্ণভাবে অর্জন করা সম্ভব হবে বলে দেখা যাচ্ছে। প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়টি। চলতি অর্থ বছরের জন্য ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে তা ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলেছে, তা হবে সাড়ে পাঁচ বা ছয় শতাংশ। কেন এমন হচ্ছে? অর্থনীতিতে করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতের কারণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার কার্যকর পদক্ষেপ বাজেট থাকা জরুরি বলে আমি মনে করি। মূল্যস্ফীতি একটি জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী সমস্যা, যা নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। আর ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি।

আগামী অর্থ বছরে জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণের হার খুবই কম। বর্তমানে বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশ (২০২২-২৩)। অথচ প্রতিবেশী দেশগুলোতেই কর-জিডিপির অনুপাত অনেক বেশি। যেমন- নেপালে তা ১৮/১৯ শতাংশ এবং ভারতে ১১ দশমিক ২ শতাংশ (২০২২-২৩)। পৃথিবীতে যেসব দেশে কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। চেয়ে খারাপ হলেও কর-জিডিপির অনুপাত সেই দেশে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ (২০২১)। অন্যদিকে বাংলাদেশে ধনী হওয়ার হার উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কিন্তু সঠিক মাত্রায় কর প্রদান না করা। নানাভাবে তারা ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। এ রকমটি চলতে থাকলে সরকারকে বাধ্য হয়ে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস থেকে বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণ করতে হবে।

অতি মাত্রায় ঋণ নির্ভর হয়ে পড়া একটি দেশের জন্য কোনোক্রমেই লাভজনক নয়। এখনো আমরা ঋণের ক্ষেত্রে স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রয়েছি, কিন্তু এটা কত দিন থাকবে সেটাই বিবেচ্য বিষয়। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে বিদেশি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে মোট জিডিপির ২১ শতাংশের মতো। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গৃহীত ঋণের হার প্রায় সমপরিমাণ। অর্থাৎ বিদেশি এবং অভ্যন্তরীণ মিলিয়ে বাংলাদেশের মোট ঋণের হার হচ্ছে জিডিপির ৪২ শতাংশের মতো। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যাদের ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী জিডিপির ১২৯ শতাংশ (২০২২)। আর জাপানের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে ২৬৩ শতাংশ (২০২৩) এবং ভারতে ৮৬ শতাংশ (২০২২-২৩)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে যে ঋণ না। সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে আসে। সেই ঋণের অর্থ ব্যবহারের দায়িত্ব যাদের হাতে থাকে তারা অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে তা ব্যবহার করে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধান্ধাবাজির মাধ্যমে। আমাদের সমস্যা জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাতে নয়। সমস্যা হচ্ছে গৃহীত ঋণের সব অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পের সুফল যতটা পাওয়ার কথা ততটা পাওয়া যাচ্ছে না। বাজেটে বিভিন্ন খাতে ও প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে যথাসময়ে এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষা বাজেটের প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই। বাজেটে শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষা খাতে জিডিপির অনুপাত হিসেবে বাজেট বরাদ্দ ধীরে ধীরে কমছে। চলতি বছরে তা ২ শতাংশের কম। শিক্ষা অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজের জন্য ব্যয়িত হচ্ছে। ফলে খুবই কম। বলা হয়, যেহেতু বাজেটের আকার বাড়ছে তাই শিক্ষা বাজেটের প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই। বাজেটে থাতে যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে তাঁর বেশির ভাগই শিক্ষার মানোন্নয়ন ও গবেষণার কাজে অর্থ বরাদ্দ থাকছে খুবই কম। বলা হয় যেহেতু বাজেটের আকার বাড়ছে তাই অনুপাত কম হলেও টাকার অঙ্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে না। কিন্তু শিক্ষা খাত এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে সেখানে শুধু ব্যজের অঙ্ক কিছু বাড়লেই চলবে না, জিডিপির অনুপাতও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন; কিন্তু অনেক সময় বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয় না, শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোর এবং পাশাপাশি বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে বরাদ্দ ও সঠিক ব্যয় বাড়ানো প্রয়োজন।

আগামী জাতীয় বাজেটে কর্মসংস্থানের ওপর ব্যাপক মাত্রায় জোর দিতে হবে। করোনাকালিন অবস্থায় অনেকেই তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে। এ ছাড়া শ্রম বাজারে নতুন নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে। এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার অতীতের মতো আগামী বাজেটেও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বর্ধিত ব্যয় বরাদ্দ দেবে বলে আশা করা যায়। তবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অংশ হিসেবেও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে।

বর্তমান সময়ে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পরিবেশ সুরক্ষায় সরকার এখন জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ ব্যয় করছে। সরকার পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমরা ইতোমধ্যেই ব্যাপকভাবে ঘটতে দেখছি। জটিলতা সৃষ্টি করবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের আরও ব্যয় বাড়াতে হবে, যা অগ্রাধিকার নির্ধারণ এই খাতে ব্যয় ও কার্যক্রম বাড়ানো না হলে আগামীতে আগামী সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও করে প্রকল্প গ্রহণ ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে।

আগামী অর্থ বছবের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টার পাশাপাশি বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা প্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি যদি কমিয়ে এনে সহনীয় পর্যায়ে নামানো না যায় তাহলে জনগণের মনে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। এখানে বড় চ্যালেঞ্জ দুষ্টচক্র (সিন্ডিকেট)। অনেক সময় দেখা যায় সরকারের ভালো পদক্ষেপ বা উদ্যোগ গ্রহণ মাঠপর্যায়ে গিয়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহল বিশেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। উচ্চমূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি ব্রেট বাড়ানো হয়েছে এবং ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার বেড়েছে; কিন্তু দেশে মূল্যস্ফীতির ওপর কোনো প্রভাব পড়ছে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ রকম পদক্ষেপ কাজ করেছে; কিন্তু বাংলাদেশে এই উদ্যোগ সঠিকভাবে কাজ করছে না। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এমন উদ্যোগ কাজ করেছে এমনকি অর্থনৈতিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত শ্রীলঙ্কায় এমন পদক্ষেপের মাধ্যমে উচ্চমূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই উদ্যোগ কাজ করেনি। কেন কাজ করল না তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। বিভিন্ন খাতে বিদ্যমান দুষ্টচক্র এসব উদ্যোগকে কাজ করতে দিচ্ছে না বলে আমি মনে করি। এই দুষ্টচক্রগুলোর হোতাদের অনেকেই পরিচিত। কিন্তু তাদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা সব সময় তৎপর থাকছে, জবাবদিহি মুখোমুখি হতে হচ্ছে না।

মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর সম্পূর্ণ ছেড়ে দেওয়া উচিত কি না তা নিয়ে অনেকেই। প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন। এটি একটি জটিল প্রশ্ন বটে। আমি মনে করি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার এখনই বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে নানা জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। অনেকেই বলছেন, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারিত করে রাখার কারণে রেমিট্যান্স হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। যদি বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হতো তাহলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আরও বেশি আসত। আমি এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নই রেমিট্যান্স তো প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এখন প্রশ্ন হলো- যে সংখ্যক বাংলাদেশি বিদেশে যাচ্ছে কর্মসংস্থান উপলক্ষে রেমিট্যান্স সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, বাংলাদেশ থেকে উপার্জন করার জন্য বিদেশে যাচ্ছে কারা? গ্রামীণ দরিদ্র এবং অদক্ষ ব্যক্তিরাই মূলত 'বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যাচ্ছেন। তারা বিদেশে গিয়ে ভালো কাজ পাচ্ছেন না। কেউ কেউ বেকার থাকছেন। ফলে যে সংখ্যক মানুষ বিদেশে যাচ্ছেন সেই অনুপাতে রেমিট্যান্স আসছে কম। হয়তো হুন্ডি যারা করে তাদের মধ্যে থেকে কিছু মানুষ ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হতে পারে, কিন্তু কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে গেলে সেই প্রবণতা বাস্তবে রূপ লাভ নাও করতে পারে।

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে মূল্যস্ফীতি অনেক বৃদ্ধি পাবে। এতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাবে। আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। কিছু দিন আগেও বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার একাধিক বিনিময় হার চালু ছিল। এখন তা সঠিকভাবেই একক বিনিময় হারে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়িত হয় না। ফলে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এ জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। এটা বন্ধ করতে হবে। গৃহীত প্রকল্প যাতে নির্ধারিত সময়ে এবং ব্যয়ে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। এর বাতায় ঘটলে যারা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকস

বিষয়:

পরীক্ষার ফল, মিষ্টি ও মৃত্যুর অনুক্রম

আপডেটেড ১৪ মে, ২০২৪ ১৬:৫৬
সজীব সরকার

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত রোববার। মুদ্রিত, সম্প্রচার ও অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বরাবরের মতোই এবারও প্রাধান্য পেয়েছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের খবর। এর পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছে সর্বোচ্চ পাস, সবচেয়ে বেশি জিপিএ-৫ এবং সবচেয়ে বেশি ফেল করা বা খারাপ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর খবর।

এসব খবরের, মোটা দাগে, দুটি দিক থাকে:

এক. জিপিএ-৫ পেয়ে উল্লসিত কিছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের আনন্দের খবর; দুই. পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে অর্থাৎ ফেল করে কিছু শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর।

এবারও, একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের উল্লাসের খবর দেখা গেছে, তেমনি জানা গেছে পরীক্ষায় ফেল করে বা জিপিএ-৫ না পেয়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার খবর। সামনের দিনগুলোতে এমন খবর আরও পাওয়া যাবে হয়তো।

জিপিএ-৫ পাওয়া নিশ্চয়ই আনন্দের ব্যাপার; তবে, এ নিয়ে প্রতিবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে, তা কখনোই কাম্য নয়। গণমাধ্যমগুলোও যেভাবে এসব পাবলিক পরীক্ষার ফল সম্পর্কিত খবর প্রচার করে, তাতে এ প্রতিযোগিতা আরও গতি পায়। এমন সাংবাদিকতা মোটেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয় না।

জিপিএ-এর স্কোর তথা ‘ভালো রেজাল্ট’ সবসময় শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জনের নিশ্চয়তা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগবঞ্চিত কিন্তু স্বশিক্ষিত দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর বলেছিলেন, ‘বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রি আছে জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নেই, জ্ঞান ডিগ্রিবিহীন ও সীমাহীন’। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক - সবার মধ্যেই এ বোধোদয় ঘটা দরকার।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনটি ভালো বা মন্দ- তা নির্ণয় করা হয় পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার হার কতো - এ বিচারে। স্কুল-কলেজগুলোর বিজ্ঞাপনেও এসব তথ্যই গুরুত্ব পায়। কোচিং সেন্টারগুলোও জিপিএ-৫ পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন দেয়; অনেকের বিজ্ঞাপনে থাকে বিষয়ভিত্তিক ‘এ প্লাস’ বা জিপিএ-৫ পাইয়ে দেওয়ার ‘লিখিত গ্যারান্টি’ বা ‘বিফলে মূল্য ফেরত’-এর শর্ত। কিন্তু, পড়াশোনার প্রকৃত উদ্দেশ্য যে বিদ্যা অর্জন, জ্ঞান অর্জন- সে গ্যারান্টি কোথায়? বিদ্যাশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যে কুসংস্কারমুক্ত উদার মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কথা, সে নিশ্চয়তা কোথায়?

পরীক্ষার ফল ভালো হওয়া তথা জিপিএ-এর স্কোর বেশি থাকা মানেই ওই শিক্ষার্থীর প্রকৃত জ্ঞানার্জন হয়েছে- এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তেমনি, পরীক্ষার ফল খারাপ হলেই যে ওই শিক্ষার্থী নিরেট মূর্খ- সে কথাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা আরজ আলী মাতুব্বর কতো ক্লাস পড়েছেন আর তাদের পরীক্ষার ফল কেমন ছিলো - এমন প্রশ্ন অবান্তর নয় কি? বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে কার বা কতোজনের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফল ঘেঁটে তাদের মূল্যায়ন করা হয়?

তাহলে, এভাবে কেবল পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফলনির্ভর মূল্যায়ন একটি একমুখী, অবৈজ্ঞানিক, অপর্যাপ্ত ও অসার পদ্ধতি। বরং, শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যদি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞানার্জনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং সার্বিকভাবে যদি শিক্ষার্থীবান্ধব একটি কাঠামো গড়ে তোলা যায়, তাহলে পরীক্ষার তথাকথিত ‘ফল’ বা জিপিএ-এর স্কোর অনিবার্যভাবে ‘ভালো’ই হওয়ার কথা।

চাকরিদাতাদের একটি সাধারণ অভিযোগ হলো, দেশের নামকরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফল নিয়ে পাস করে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকেই ইন্টারভিউ বোর্ডে অত্যন্ত হতাশাজনক পারফর্ম করছে। তাহলে, মোটা স্কোর-অলা এসব সার্টিফিকেটের মূল্য কী? গণমাধ্যমগুলোও বিভিন্ন সময় প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, ‘নামকরা’ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, বিজয় দিবস, জাতীয় দিবস বা শহীদ দিবস - এমন ধারণাগুলোর সঙ্গে পরিচিত নয়; এসব বিষয়ে তারা তেমন কিছুই জানে না বা বলতে পারে না। তাহলে, প্রতিবছর গণমাধ্যমগুলোই বা কেন জিপিএ-নির্ভর এমন ফল বিশ্লেষণে গা ভাসাচ্ছে?

আমাদের মধ্যে অনেকেরই বিবেচনায় এটি নেই যে বুদ্ধিমত্তা, মেধা বা জ্ঞানের ধরন আলাদা। গান গাইতে না পারায় আইনস্টাইনকে যেমন 'মূর্খ' বলা অবিচার, তেমনি পদার্থবিদ্যার তাত্ত্বিক না হওয়ার দায়ে লতা মঙ্গেশকরকে 'অপদার্থ' বলাও অযৌক্তিক। আইনস্টাইন, বিটোফেন, শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ইলা মিত্র, লীলা নাগ, রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, মাইকেল ফেলপস, শচীন টেন্ডুলকার, সাকিব আল হাসান, রোনালদো বা লিওনেল মেসি - কে জ্ঞানী, আর কে মূর্খ? পরীক্ষার ফল দিয়ে তাদের বিচার করা সম্ভব কি?

জ্ঞান, মেধা বা যোগ্যতার অনেকগুলো দিক রয়েছে। প্রতিটি ব্যক্তির শারীরিক-মানসিক দক্ষতা ভিন্ন। আমাদের উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কার কোনদিকে সুপ্ত বা স্পষ্ট আগ্রহ ও যোগ্যতা বা দক্ষতা রয়েছে, তা বুঝে সে অনুযায়ীই শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা। নির্বিচারে সবাইকে জিপিএ-৫ পাওয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক চাপে ফেললে তা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যায় বৈ কিছু নয়। পৃথিবীর সবাইকে বিজ্ঞানী বানানো যেমন অসম্ভব ও অযৌক্তিক, তেমনি সবাইকে এসএম সুলতান বা লতা মঙ্গেশকর বানাতে চাওয়াটাও ভুল। কার মধ্যে কী ধরনের মেধা রয়েছে, তা নির্ণয় করে তার মধ্যে ওই বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক দক্ষতা তৈরি করে দেওয়াই হতে হবে শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত উদ্দেশ্য। তাহলেই শিক্ষার্থীরা একসময় নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হবে। সফলতাকে কেবল 'পরীক্ষায় ভালো ফলের' সীমায় সীমিত করে রাখলে তা ভুল হবে।

এবার ফল প্রকাশের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করেছেন; তিনি বলেছেন, যারা পরীক্ষায় খারাপ করেছে, তাদের মন এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে, তাই তাদের যেন বকা-ঝকা করা না হয়। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ; এ নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।

অভিভাবক ও শিক্ষকসহ সবার একমুখী অতি-প্রত্যাশার চাপ সামলাতে না পেরে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করলে এ দায় আসলে কার? নিজের সন্তান ভালো ফল করলে খুশি হতেও বাধা নেই, মিষ্টি বিতরণেও দোষ নেই; কিন্তু, যারা কোনো কারণে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারেনি, তাদের এমন মানসিক চাপে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা ঠিক নয় যে তারা আত্মহত্যার মাধ্যমে ওই চাপ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে বাধ্য হয়। তাদের তিরস্কার না করে বরং পাশে দাড়ানো উচিত যেন মনোবল না হারিয়ে বরং তারা নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার মতো ভরসা পায়। শিক্ষক ও অভিভাবকসহ গণমাধ্যমগুলোরও এ ব্যাপারে সতর্ক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা দরকার।

অবৈজ্ঞানিক প্রতিযোগিতার এমন পরিবেশে শিশুদের শৈশব আমরা কেড়ে নিয়েছি; সেই সাত-সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাত অবধি কেবল ক্লাস-কোচিং-টিউটর। ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে ‘ভালো রেজাল্ট’ করানোর জন্য অন্যদের চেয়ে বেশিসংখ্যক টিউটর বা কোচিং ক্লাসের চাপে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন পিষ্ট হতে হচ্ছে। এমন প্রতিযোগিতা শুরু হয় একেবারে প্রাথমিক স্তরেই। তাদের খেলাধুলা, শরীরচর্চা বা বিনোদন কোথায়? ধরে-বেঁধে সবাইকে জিপিএ-৫ পেতেই হবে? শিক্ষার্থীরা তো গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি নয় যে এক খোঁয়াড়ের সবগুলো একই চেহারার এবং একই বৈশিষ্ট্যের হতে হবে! এরা মানবসন্তান এবং প্রতিটি শিশু আলাদা; তাদেরকে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়াটাই বরং যৌক্তিক নয় কি?

শিক্ষাব্যবস্থার সঠিক সংস্কার দরকার, গতি দরকার- যেখানে চাকরির বাজারে যোগান দেওয়ার জন্য কেবল চাকুরে তৈরির দিকে মনোযোগ না দিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও সুপ্ত মেধা অন্বেষণে মনোযোগ থাকবে। এমন একটি ব্যবস্থা চাই, যেখানে পরীক্ষার ফলের ওপর অতিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত বিদ্যার্জনকে উৎসাহিত করা হবে। এতে সব ক্ষেত্রের জন্য দক্ষ কর্মী যেমন অনিবার্যভাবেই তৈরি হবে, তেমনি তাদের মধ্যেই পাওয়া যাবে সত্যিকার সুনাগরিক ও নৈতিক মানুষ; প্রকৃত-পূর্ণাঙ্গ মানুষ।

লেখক: সজীব সরকার : সহযোগী অধ্যাপক, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।

বিষয়:

বজ্রপাতে প্রাণহানি ও তালগাছ রোপণ

আপডেটেড ১৪ মে, ২০২৪ ১০:৫৬
ড. মো. হুমায়ুন কবীর

এখন প্রায়শই শোনা যায় সারা দেশের কোনো না কোনো স্থানে আকস্মিক বজ্রপাতে লোকজন মারা যাচ্ছে। এগুলো এখন আর কোনো মৌসুম কিংবা ফর্মুলা কিংবা নিয়মনীতি মানছে না। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এগুলো আর কিছুই না, তা আসলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আগে দেখা যেত বছরে বজ্রপাত হতে দু-চারজনের মৃত্যুর খবর কালেভদ্রে পাওয়া গেলেও এখন ফি-বছর বিষয়টি মহামারি আকার ধারণ করছে। বিগত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছরই সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর হিসাব রেকর্ড করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যাকে ইতোমধ্যে সরকারের তরফ থেকে দুর্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আমার এ অর্ধশতাধিক বয়সের অভিজ্ঞতায় এর আগে কখনো বজ্রপাতে এত মানুষের মৃত্যু হতে দেখিনি। বর্তমানে তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে উষ্ণতা বৃদ্ধি, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, গাছ কাটা, নতুন নতুন গাছ রোপণ না করা, জলাশয় ভরাট, দ্রুত নগরায়ণ- ইত্যাদি নানাবিধ কারণে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং জলবায়ু বায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলে প্রকৃতি এমন বিরূপ আচরণ করছে। আর সে জন্যই বজ্রপাতসহ প্রকৃতিতে নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই চলেছে। সেগুলোর একটিই হলো বজ্রপাতে মৃত্যু। সময়ের ব্যবধানে আজ তা মহামারি আকারে দেখা যাচ্ছে। বর্ষাকাল শুরু হলেই জনমনে এ নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়।

তারপর আসছে কীভাবে এসব আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। এটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও অভিমত হলো- খালি মাঠে কিংবা রাস্তার পাশে এমনকি বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড়, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, পাহাড়-বন, খাল-বিল, নদ-নদী, সাগর তীর প্রভৃতির পাড়ে কিংবা চারপাশে উন্মুক্ত স্থানে বেষ্টনী তৈরি করে উঁচু উঁচু গাছ লাগাতে হবে। সেসব গাছই থান্ডার অ্যারেস্টার (বজ্রপাত শোষক) হিসেবে কাজ করবে। তাতে গ্রামান্তরে বজ্রপাতের দরুন কৃষক কিংবা খেটে খাওয়া মানুষ মারা যাওয়া থেকে রেহাই পাবেন।

এ বিষয়টি মাথায় নিয়ে আমাদের দেশের পরিবেশবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনি তার একটি বক্তৃতায় বলেছেন, সারা দেশে প্রতি বছর কমপক্ষে তিন কোটি তাল, সুপারি, নারিকেল প্রভৃতি উঁচু গাছ রোপণ করতে হবে যাতে আমাদের দেশের কৃষক মাঠে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতের আঘাতে মৃত্যুবরণ না করেন। কারণ এ দুর্ঘটনাগুলো সাধারণত উন্মুক্ত স্থানেই বেশি ঘটতে দেখা যায়। তাছাড়া শহরের সচেতন মানুষ তারা তাদের বাড়ি-ঘর বানানোর সময় আগেই পরিকল্পিতভাবে থান্ডার অ্যারেস্টার লাগিয়ে কিছুটা হলেও নিরাপদে থাকে।

প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা শোনার পর দেশজুড়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংগঠন, সংস্থা তাল, সুপারি, নারিকেল প্রভৃতি গাছ লাগানো শুরু করে দিয়েছেন। এতে সম্পৃক্ত হয়েছে স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও। তবে সবচেয়ে অগ্রগামী হলো কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাদের সহযোগিতা দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট মাঠকর্মীসহ প্রশাসন ও দুর্যোগব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কর্মীরা। আমি এমন একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করব এখানে। ছড়া কবিতার কথায় আছে, ‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে সবগাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’। অর্থাৎ তালগাছ এক সময় সবগাছ থেকে উঁচুতে উঠে যায়।

তালগাছ সম্পর্কে গ্রামাঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। সেটি হচ্ছে- ‘যে ব্যক্তি তালগাছ রোপণ করে, সে ব্যক্তি সেই গাছের তাল খেয়ে মরতে পারে না’। তার মানে হলো তালগাছের বাড়-বাড়তি খুবই ধীরগতিতে ঘটে; কিন্তু কথাটি আসলে মোটেও ঠিক নয়। কারণ আমি নিজে আমার বাড়িতে ১৫ বছর বয়সে যে তালগাছ নিজের হাতে লাগিয়েছিলাম এখন আমার ৫৩ বছর বয়সে এসে আরও ১০ বছর আগে থেকেই সেই গাছের তাল খেয়ে চলেছি। তার থেকে বড় বাস্তব উদাহরণ আর কি হতে পারে! অর্থাৎ তালগাছ লাগানোর ২৫-৩০ বছরের মধ্যেই সেটা থেকে ফল খাওয়া যেতে পারে।

তালগাছ এখন আমরা যে শুধু বজ্রপাত থেকে রক্ষা করার জন্য লাগাব তাই নয়- এর রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার ও উচ্চ খাদ্যমান। যেমন তালের পাতা দিয়ে ঘরের মাদুর তৈরি করা হয়, তালের পিঠা, তালের রস থেকে নানারকম পিঠা, পায়েস তৈরি করা হয় যা আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য। হিন্দু শাস্ত্রের কৃষ্টিতে আছে তাল নবমী, তালের রস ক্যানসার প্রতিরোধী, তালগাছ দিয়ে তৈরি হয় তালের নৌকা। তালপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি, হাতপাখা, চাটাই, মাদুর, বিভিন্ন কুটির শিল্প, কাণ্ড দিয়ে বাড়িঘরের প্রয়োজনীয় কাঠ ও নৌকা তৈরি করা হয়। তালের কাণ্ড থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড়, পাটালি, মিছরি এবং একপ্রকার চোলাই মদ তৈরি করা হয় যাকে সবাই ‘তাড়ি’ বলে চেনেন।

তা ছাড়া তাল অ্যান্টি অক্সিডেন্ট গুণসমৃদ্ধ হওয়ায় ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। তালের রসে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। তাল ভিটামিন-বি এবং ভিটামিন-এ এর আধার। তালে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস আছে যা হাড় ও দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। কোষ্ঠকাঠিন্য ও অন্ত্রের রোগ ভালো রাখতেও তালের জুড়ি নেই। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে প্রতি ১০০ গ্রাম তালে ৮৭ কিলোক্যালোরি খাদ্যশক্তি বিদ্যমান। এতে আরও রয়েছে, জলীয় অংশ- ৭৭.৫০ গ্রাম, আমিষ-০.৮ গ্রাম, চর্বি-০.১ গ্রাম, শর্করা ১০.৯ গ্রাম, খাদ্য আঁশ- ১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম-২৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস-৩০ মিলিগ্রিাম, আয়রন-১ মিলিগ্রাম, থায়ামিন-০.০৪ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাবিন-০.০২ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন-০.৩ মিলিগ্রাম ও ভিটামিন নি-৫ মিলিগ্রাম ইত্যাদি।

বজ্রপাত নিরোধক হিসেবে তালের আঁটি রোপণ। এমনি একটি মহতি উদ্যোগের সঙ্গে বিগত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক আয়োজিত তালগাছ রোপণ কার্যক্রমে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। সেদিন তারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ দীপক কুমার পালের নেতৃত্বে উপজেলার সবপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এ তালের আঁটি রোপণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। আমি এ কার্যক্রমে একটু বেশি আগ্রহ বোধ করেছি, কারণ একে তো আমি নিজেও একজন কৃষিবিদ আর সেই তালের আঁটিগুলো লাগানো হচ্ছে আমাদের নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা সহযোগী ছাড়াও সেখানকার বেশ কজন সংবাদকর্মীও উপস্থিত ছিলেন। এভাবেই আশা করি সামনের কয়েক বছরেই তাল, সুপারি ও নারিকেলগাছ দিয়ে ভরে উঠবে সারা দেশের আনাচে-কানাচে, যাতে বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দূরীভূত করা সম্ভব হবে।

বজ্রপাতে মৃত্যুর বিষয়টি এখন রীতিমতো মহামারি আকারে দেখা দিচ্ছে। আগেই উল্লেখ করেছি এগুলো সবই জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটাও ঠিক যে প্রকৃতির বিরুদ্ধে বা বাইরে গিয়ে কোনো-কিছু করা সম্ভব নয়; কিন্তু সাময়িক ব্যবস্থাপনায় যদি সেগুলোকে কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হয় তবেই মঙ্গল। আর বজ্রপাতের মতো একটি নিয়ন্ত্রণহীন প্রাকৃতিক দুর্যোগকে যদি সামান্য কিছু তালগাছ রোপণের মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়- তবে তার থেকে ভালো কাজ আর কি হতে পারে! কাজেই আসুন প্রতি বছর আমাদের পারিপার্শে সবাই মিলে তালগাছ লাগাই এবং এর মাধ্যমে বজ্রপাতের দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার চেষ্টা করি।

লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়


তরুণ কর্মজীবী জনসংখ্যা কমছে ও বেকারত্ব বাড়ছে

আপডেটেড ১৪ মে, ২০২৪ ১১:১৪
ড. মিহির কুমার রায়

বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। এখানকার তরুণ জনশক্তিকে দেখা হয় অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হিসেবে। নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময় প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, এ যুব শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ আদায় করে নিতে সক্ষম হবে; কিন্তু দেশে এখন তরুণ কর্মজীবীর (১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি) সংখ্যা কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে দেশে তরুণ জনশক্তির সদস্যসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৯ লাখ ২০ হাজার। ২০২৩ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার। সে অনুযায়ী এক বছরের ব্যবধানে দেশে যুব শ্রমশক্তি সংকুচিত হয়েছে ৫ শতাংশের বেশি। শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত যুবকের সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৪ লাখ ৬০ হাজার। এ ক্ষেত্রে মূলত পুরুষ শ্রমশক্তিই কমেছে সবচেয়ে বেশি। বিবিএসের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের এ পরিসংখ্যান উদ্বিগ্ন করে তুলছে বিশেষজ্ঞদের। যুব শ্রমশক্তি সংকোচনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তারা বলছেন, এ ক্ষেত্রে জন্মহার কমার একটি বড় ভূমিকা থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে তা আগামীতেও অব্যাহত থাকতে দেখা যেতে পারে। তাছাড়া দেশে তরুণদের কাজের সুযোগও কম। অনেকে কাজ না পেয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আবার বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণেও এমনটি হয়ে থাকতে পারে। তবে প্রবৃদ্ধি কমায় শিল্প খাতে তরুণ জনশক্তি সংকোচনের প্রভাব সেভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে না।

বিবিএসের জরিপের তথ্যমতে, ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষের শেষ প্রান্তিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশের শ্রমশক্তিতে যুবকের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৬২ লাখ ৮০ হাজার। সে হিসাবে গত প্রান্তিকে তিন মাসের ব্যবধানে যুবশক্তি কমেছে ৩ লাখ ৬০ হাজার।ব্যুরোর প্রতিবেদনে উঠে আসা লিঙ্গভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশে পুরুষ যুব জনশক্তি ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার। এ বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজারে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে পুরুষ জনশক্তি কমেছে ৯ লাখ ৮০ হাজার। আর গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে নারী যুবশক্তি ছিল ১ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার, যা এবার কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২৮ লাখ ৭০ হাজারে। বহুমাত্রিক কারণে এমনটা হতে পারে বলে মনে করছেন জনসংখ্যাতাত্ত্বিকরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের শ্রমশক্তিতে নিযুক্ত লোকজনের অধিকাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। তাই মৌসুম পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় কাজ বেশি বা কম থাকে। তখন কাজে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যায় পার্থক্য দেখা দেয়। আবার যথাযথ কর্মসংস্থান না থাকায় অনেকে কাজের সন্ধানে বিদেশে চলে যান। কেউ কেউ উচ্চ শিক্ষার জন্যও বিদেশে যান। তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এমন স্থানান্তর বেশি দেখা যায়।জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন ১৩ লাখ ৫৪ হাজার বাংলাদেশি। এ বছর এখন পর্যন্ত বিদেশে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ২ লাখ ৩৬ হাজার ৮৩৭। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘সুযোগ না থাকায় কর্মে যুক্ত হতে পারছেন না তরুণরা। বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। তবে এত বেশিসংখ্যক যুবশক্তি কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। এটা তথ্য সংগ্রহের কোনো ত্রুটির কারণেও হতে পারে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক বরকত-ই-খুদা বলেন, ‘তরুণরা যদি মনে করেন কাজ পাওয়া কঠিন বা চাকরি পাওয়া যাবে না, তাহলে তারা নিরুৎসাহিত হয়ে কাজ নাও খুঁজতে পারেন। তখন ডিসকারেজড ওয়ার্কফোর্স হিসেবে তাদের শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। কারণ শ্রমশক্তিতে যুক্ত থাকতে হলে কাজ খোঁজার মধ্যে থাকতে হবে। এটাও তরুণ জনশক্তি হ্রাসের একটি কারণ হতে পারে। কর্মে যুক্ত তরুণদের বড় অংশই ঢাকায় কাজ করে। দেশের অন্য বিভাগে একইভাবে কাজের সুযোগ তৈরি হয়নি। ফলে তরুণদের বেকারত্বের কারণে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড নিতে পারছে না। দেশের আর্থিক ও জ্বালানি খাতের বর্তমান পরিস্থিতি যুব শ্রমশক্তি সংকুচিত হয়ে আসার পেছনে অনুঘটকের কাজ করেছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নেতারা। তবে উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি কমে আসার কারণে শিল্পখাত বিষয়টি এখনো সেভাবে অনুধাবন করতে পারছে না বলে মনে করছেন তারা। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘তরুণরা শিল্প খাতের প্রধান শক্তি। এটা কমে গেলে শিল্পে প্রভাব পড়ার কথা; কিন্তু শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। গত নয় মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশের কিছু বেশি। তাই শিল্প খাতে এখন শ্রমের চাহিদা নেই। বিবিএসের তথ্যে বেকার বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি না থাকায় এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। প্রবৃদ্ধি থাকলে হয়তো তরুণ শ্রমশক্তি কমে যাওয়ার ব্যথাটা অনুভব করত শিল্প খাত। আর সুদহার বৃদ্ধি ও গ্যাস সংকটের কারণে আগামীতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাবে কি না সে বিষয়ে সন্দিহান আমি।’ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘জন্মহার কমে যাওয়ায় দেশের তরুণ জনশক্তি কমে যাচ্ছে। এটা ক্রমাগত কমে আসবে। ২০৩৫-৩৬ সালের মধ্যে যুবকদের তুলনায় নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বেশি হবে। আর তরুণদের ৩০ শতাংশ আবার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মে নেই। নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও আমরা তাদের কোনো কিছুতে যুক্ত করতে পারিনি। ধীরে ধীরে যুবকের সংখ্যা কমে বেকারের চাপও কমে আসবে। বয়স্ক মানুষ বাড়বে। তাই কর্মক্ষম ও অভিজ্ঞদের কাজে লাগাতে অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯ থেকে বাড়িয়ে ৬২ বছর করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এটি যুক্ত করা যায়।’

বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তিতে এখন ৭ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার নারী-পুরুষ আছেন। এর মধ্যে ৭ কোটি ১১ লাখ ৬০ হাজার লোক কর্মে নিয়োজিত। বাকিরা বেকার। এ ছাড়া শ্রমশক্তির বাইরে বিশাল জনগোষ্ঠী আছে। তারা কর্মে নিয়োজিত নয়, আবার বেকার হিসেবেও বিবেচিত নয়। এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার। তারা মূলত শিক্ষার্থী, অসুস্থ, বয়স্ক, কাজে অক্ষম, অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মে অনিয়োজিত বা নিয়োজিত হতে অনিচ্ছুক ব্যক্তি।

এখন আসা যাক বেকারত্বের চিত্র যা এক ভয়াবহ বলে প্রতীয়মান হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়মানুসারে, যারা সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং গত এক মাস ধরে কাজপ্রত্যাশী ছিলেন, তারা বেকার হিসেবে গণ্য হবেন। বিবিএস এই নিয়মানুসারেই বেকারের হিসাব দিয়ে থাকে। সেই হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে যা বর্তমানে দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। গত বছরের তুলনায় এখন দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি। বর্তমানে বেকারের হার ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা ২০২৩ সালের গড় বেকারের হারের চেয়ে কিছুটা বেশি। ২০২৩ সালের গড় বেকারের হার ছিল ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এদিকে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে, নারী বেকার কমেছে। বিবিএস হিসাব অনুসারে, গত মার্চ মাস শেষে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৪০ হাজার। ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে (মার্চ-জানুয়ারি) সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ১০ হাজার। অন্যদিকে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ হাজার নারী বেকার কমেছে। এখন নারী বেকারের সংখ্যা ৮ লাখ ৫০ হাজার। বিবিএস বলছে, শ্রমশক্তিতে এখন ৭ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার নারী-পুরুষ আছেন। তাদের মধ্যে ৭ কোটি ১১ লাখ ৬০ হাজার লোক কর্মে নিয়োজিত। বাকিরা বেকার। এ ছাড়া শ্রমশক্তির বাইরে বিশাল জনগোষ্ঠী আছে। তারা কর্মে নিয়োজিত নয়, আবার বেকার হিসেবেও বিবেচিত নয়। এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার। তারা মূলত সাধারণ ছাত্র, অসুস্থ ব্যক্তি, বয়স্ক নারী-পুরুষ, কাজ করতে অক্ষম ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং কর্মে নিয়োজিত নন বা নিয়োজিত হতে অনিচ্ছুক গৃহিণী। সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী কর্মসংস্থান বেশি কৃষিতে। বিবিএসের হিসাবে, জানুয়ারি-মার্চ মাস শেষে কৃষি খাতে কাজ করেন ৩ কোটি ১৮ লাখ ৩০ হাজার। শিল্প খাতে এ সংখ্যা ১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার আর সেবা খাতে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৮০ হাজার। গত ডিসেম্বর শেষে কৃষি খাতে ছিল ৩ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার নারী-পুরুষ, শিল্পে ১ কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার আর সেবা খাতে ছিল ২ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার।

উচ্চশিক্ষিতরা মনমতো কাজ না পেলে নিজেদের বেকার হিসেবে পরিচয় দেন। যেমন স্নাতকোত্তর পাস করে ভালো চাকরির অপেক্ষা করছেন, এই সময় হয়তো টিউশনি করেন কিংবা অস্থায়ী চাকরি করছেন যেমন চিকিৎসকদের অনেকেই সম্মানীর বিনিময়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন অথচ জরিপের সময় তাদের অনেকেই নিজেদের বেকার হিসেবে গণ্য করেন। এ হিসাব নিয়ে প্রশ্ন আছে। সপ্তাহে এক ঘণ্টার মজুরি এই মূল্যস্ফীতির যুগে জীবনধারণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তবে নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠীও আছে। তারা শিক্ষায় নেই, প্রশিক্ষণে নেই, আবার কাজের মধ্যেও নেই। বেকারত্ব নিয়ে বিবিএস যে সংখ্যা উল্লেখ করেছে, তা বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ প্রতি বছর চার-পাঁচ লাখ তরুণ-তরুণী স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হন। তাদের ৫০-৬০ শতাংশকে গড়ে দু-তিন বছর বেকার থাকতে হয়। সে অনুযায়ী কর্মসংস্থান না হওয়ায় প্রতি বছর বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আরও উল্লেখ্য যে এক বছরের বেশি সময় ধরে অর্থনীতিতে এক ধরনের সংকট চলছে, ছোট-বড় সব ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকর্মী ছাঁটাই করছে এবং ছাঁটাই করা কর্মীদেরও বসে থাকতে হয় কিংবা আগের চেয়ে কম বেতনে চাকরি নিতে হয়। শিক্ষিত বেকারত্ব পরিস্থিতির শিগগিরই উন্নতি হবে এমন সম্ভাবনাও নেই। আবার কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ পরিবেশেও এক ধরনের স্থবিরতা আছে এবং বিনিয়োগ প্রস্তাবও ৩০ শতাংশের মতো কমে গেছে। এখন অর্থনীতিতে এক ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে, শোভন কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে এবং শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে হবে। বাসাবাড়িতে নারীরা সংসারের নানা কাজ করেন; কিন্তু মজুরি পান না, এমন অবৈতনিক পারিবারিক শ্রম কমে আসছে যেমন- ২০১০ সালে ৯১ লাখ নারী এমন মজুরহীন পারিবারিক কাজ করতেন। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, এই সংখ্যা ৩১ লাখে নেমে এসেছে। এক যুগের ব্যবধানে এই সংখ্যা ৬০ লাখ কমেছে, যা শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। ২০১০ সালে ১ কোটি ৭২ লাখ নারী শ্রমশক্তিতে ছিলেন যা এখন তা বেড়ে ২ কোটি ৫৮ লাখ হয়েছে। দেশে আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান হয় মাত্র ১৫ দশমিক ১ শতাংশ, বাকি প্রায় ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান হয়। যেখানে কোনো চাকরির নিশ্চয়তা নেই, কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না এবং যেকোনো সময় মালিকপক্ষ চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেয়। বিবিএস প্রণীত জরিপের ফলাফলগুলো আমাদের শ্রম বাজারের বিশ্লেষণের জন্য উপাদান যোগান দেবে। এর মাধ্যমে সরকারের নেওয়া কর্মসূচিগুলোর অগ্রগতিও পর্যবেক্ষণ করা যাবে। এই জরিপে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলো শ্রম বাজার উন্নয়নের চিত্রের প্রতিফলন ঘটায়। এসব তথ্য নীতি-নির্ধারক, পরিকল্পনাবিদ, গবেষক ও অন্যান্য ব্যবহারকারীরা ব্যবহার করতে পারবে। কার্যকর পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ জরিপের তথ্য।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি


তীব্র তাপপ্রবাহের স্মৃতি তালপাতার পাখা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
লিয়াকত হোসেন খোকন 

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে আর গরমের সময়ে সবার হাতে হাতে থাকত তালপাতার পাখা। সে তো ১৯৬০-এর দশকের কথা। তখন থাকতাম বলেশ্বর নদীতীরের ছোট্ট শহর পিরোজপুরে। সেই যুগে পিরোজপুরে ছিল না বিদ্যুৎ। তাহলে বৈদ্যুতিক পাখা আশা করা দুরাশা নয় কি!

তখন তো আমরা জানতাম না বিদ্যুৎ আর বৈদ্যুতিক পাখা দেখতে কেমন। বৈদ্যুতিক পাখা নিয়ে কারও মধ্যে কোনো ধরনের আলোচনা হতোই না। সবার মুখে মুখে ছিল তালপাতার পাখা। পড়ার সময়ে কিংবা ঘুমানোর সময় সবার হাতে হাতে ছিল তালপাতার পাখা। অতিরিক্ত গরম থেকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার জন্য তালপাতার পাখার বিকল্প ছিল না তখন।

আহারে আহারে কই গেল, কই গেল তালপাতার পাখা। প্রচণ্ড গরমে প্রাণ জুড়াতো তালপাতার পাখার হাওয়ায়। আবার ওই পাখা যাতে চটপট ভেঙে না যায় সে জন্য দাদি-নানি, মা-খালারা শাড়ির পাড় দিয়ে গোল করে ঢাকনা পরাতেন। পাখার গায়ে নানান কলকা ও ছবি আঁকা থাকত। মহিলা মহলে দুপুরের পান খাওয়ার সময় পাখার যেমন চাহিদা ছিল, তেমন আকাশবাণী কলকাতার অনুরোধের আসর শোনার সময়ে আমরা তালপাতার পাখা ব্যবহার করতাম বাতাস খাওয়ার আশায়। অনেক রমণীদের কাছে শোয়ার বিছানায় তালপাতার পাখা ছিল সতীনের মতো আরেক সঙ্গী। এই সতীনকে বড় সোহাগ করে স্বামীর হাতের পাশেই রাখতে হতো। গরমকালে তালপাতার পাখার চাহিদা ছিল অনেক বেশি। ধনী-গরিব সবার ঘরে ঘরে তালপাতার হাতপাখা দেখা যেত।

হাতপাখাকে কেন্দ্র করে গ্রাম-গঞ্জের প্রবাদবাক্য- রাতে পাখা করতে নেই। কারণ সে সময়ে গ্রামগঞ্জে বিদ্যুৎব্যবস্থা ছিল না, রেড়ির তেলে প্রদীপ জ্বলত। প্রদীপের আলোয় আমরা পড়াশোনা করতাম। পাখায় হাওয়া করলেই প্রদীপ নিভে যেত। রোদে চাষিরা যখন মাঠে কাজ করতেন, তার বউ মাঠে পান্তাভাত নিয়ে যেতেন, সঙ্গে নিতেন তালপাতার পাখার পাখা। মাঠে পাখা দিয়ে বাতাস করতেন। মাঠ-বিলে কৃষক অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে প্রচণ্ড গরম থেকে আরাম পেতে তালপাতার পাখার ফুরফুরে বাতাসে দেহ-মনে স্বস্তি পেতেন। তখন তালপাতার পাখার বিভিন্ন নাম ছিল, যেমন- শঙ্খলতা, কাঞ্চনমালা, পালংপোষ, মনসুন্দরী ইত্যাদি। স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে, কবে সেই গ্রামে দেখেছি ঘরের মেঝেতে বসে চাষি ভাত খাওয়ার সময় তার বউ হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন।

রাজা, বাদশাহ, জমিদার আমলে রাজসিংহাসনের দু’পাশে দুজন বড় বড় হাতপাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর ধীর লয়ে বাতাস করতেন। এ ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। বাড়িতে নতুন জামাই বা অতিথি এলে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করা হতো। তালপাতার হাতপাখা গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতীক; কিন্তু এখন আর দেখা যায় না হাতপাখা তৈরির কারিগর। বিজ্ঞানের উন্নতিতে বৈদ্যুতিক পাখার অহরহ ব্যবহারে তালপাতার পাখা বোনার চাহিদা প্রায় লুপ্ত হয়েছে। কালের স্রোতে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী তালপাতার হাতপাখা আজ বিলুপ্তপ্রায়। আর গ্রাম থেকে উবে গেছে সারি সারি তালগাছ।

আজও খুব করে মনে পড়ে, পিরোজপুর শহরের বলেশ্বর নদীর তীরে ছিল লাইন ধরে শত শত তালগাছ। সেই তালগাছগুলো আজ কোথায়? বাংলাদেশ থেকে তালগাছ বিলুপ্ত হলে তালপাতার পাখা আসবে কোথা থেকে? তালপাতার পাখার চল উঠে গেছে, অথচ এক সময়ে গ্রামবাংলার ছেলেমেয়েরা তালপাতার পাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। দেশে এমনিতেই বেকারের অভাব নেই। সেই অবস্থায় তালগাছ কেটে কেটে উজাড় করে দিয়ে বেকারের সংখ্যা বাড়াল কারা? তালগাছ ছিল, কিছু ছেলেমেয়েরা তালপাতার বিভিন্ন সামগ্রী বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। এই জীবিকাকর্মীদের পেটের ওপর কে লাথি মারল- যারা তালগাছ কেটে উজাড় করেছে, তারা নয় কী? ইন্ধনদাতাই বা কারা?

হাতপাখা শিল্পও আজ শেষ। বেকারদের সংখ্যাও তাই আজ দিন দিন ভারী হচ্ছে। বিশাল নগরী ঢাকার দুই দুইটি এলাকার নাম তালতলা। একটি খিলগাঁওয়ের দিকে আর অন্যটি হলো আগারগাঁওয়ের কাছে। শত বছর আগে এই দুই জায়গায় ছিল তালগাছ আর তালগাছ। হাজার হাজার তালগাছ শহীদ করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। কোথাও তালগাছের দেখা নেই- তবু জায়গার নাম থেকে কেউ মুছে দিতে পারেনি ‘তালতলা’।

আমাদের বাংলাদেশের সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তালগাছ লাগানোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে পারেন। তালগাছ লাগানোর পাশাপাশি তালরস সংগ্রহকারীদের জন্য এক বিমা-প্রকল্প ঘোষণা করতে পারেন। তাহলে অনেকেই তালগাছ লাগানো এবং এর চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। আমাদের দেশে তালগাছকে নিয়ে সেভাবে চিন্তাভাবনা হয়নি- হতে দেখা বা শোনাও যাচ্ছে না। কৃষি দপ্তর আছে বলে জানি। বিষয়টি তাদের ভেবে দেখা দরকার।

লেখক: চিঠিপত্র গবেষক ও পরিবেশবিদ


বাজেট ও মুদ্রানীতির সমন্বয় নিশ্চিতকরণ জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. আতিউর রহমান

আসছে জুনে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেট। এটি হবে সরকারের নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট। আগামী পাঁচ বছরের অর্থনৈতিক ভিত্তি বছর হিসেবে আসন্ন অর্থ বছরের বাজেট তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও দেশি উচ্চমূল্যস্ফীতির বাস্তবতায় পেশ হতে যাচ্ছে আগামী বাজেট। এ প্রেক্ষাপটে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নটি এবারে মুখ্য বলে বিবেচিত হওয়ার কথা। তাই বরাবর যে মাত্রায় প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বাড়ানো হয় এবার তা হচ্ছে না বলেই মনে হয়। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থেই এবার সংকোচনমুখী বাজেট হতে যাচ্ছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগপ্রবাহ অতটা বলশালী না হওয়ায় আমাদের প্রবৃদ্ধি মূলত নির্ভর করে সরকারি ব্যয়ের ওপর। কাজেই কাটছাঁটের বাজেট করলে প্রবৃদ্ধির চাকা তুলনামূলক কম গতিশীল থাকবে। এমনিতেই চলতি অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে এসেছে। ২০২৩-এর অক্টোবরে আইএমএফ চলতি অর্থ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবে বলে প্রক্ষেপণ করলেও এ বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি এসে তা কমিয়ে ৫.৭ শতাংশ করেছে। এ অবস্থায় কাটছাঁটের বাজেট করলে আসছে অর্থ বছরেও প্রবৃদ্ধি খুব গতিশীল হবে না, এ কথা বলাই যায়। ভোগ ও বিনিয়োগ সংকোচনের কারণেই যে এমনটি আশঙ্কা করা হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।

আসছে অর্থ বছরে যেহেতু তুলনামূলক সংকোচনমুখী বাজেট হতে যাচ্ছে, সেহেতু সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে বরাদ্দের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার সময়ও বাজেটপ্রণেতাদের বরাবরের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। তবে সম্পদ বরাদ্দের যথাযথ অগ্রাধিকার (বাজেটের ব্যয়ের দিক) নিশ্চিত করার পাশাপাশি সম্পদসমাবেশ অর্থাৎ বাজেটের আয়ের দিক নিয়েও একই রকম সংবেদনশীলতা কাম্য। বেশ কয়েক বছর ধরেই অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর দিকে নীতি-মনোযোগ আকর্ষণ করে আসছেন। জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরকারের আহরিত করের পরিমাণ ১০ শতাংশের নিচেই রয়ে যাচ্ছে। আসন্ন বাজেটে এ সংস্কারের প্রতিফলন ঘটার সম্ভাবনা যথেষ্ট।

ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আমাদের বহিঃঅর্থনীতি নিয়ে টানাপড়েনের কারণে আমদানি কমেছে। তাই রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি বহিঃঅর্থনীতির সংকটের কারণে মোটা দাগে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিই কমে এসেছে। এ কারণেও রাজস্ব আহরণ কঠিন হয়ে পড়েছে। চলতি অর্থ বছরে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ পরিমাণ তার আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। সাম্প্রতিক অর্থ বছরগুলোর কোনোটিতেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। রাজস্ব আহরণের দক্ষতা বাড়াতে এ প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাইজেশনের যে কোনো বিকল্প নেই সে কথাটি বারবার সামনে আনছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অংশীজনরা। এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছেন। তারা ইলেকট্রনিকস টেক্সট ডিটেকশন সোর্স (ইটিডিএস) অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। ডিজিটাইজেশনকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া আরও দক্ষ করতে নেওয়া এনবিআরের এসব উদ্যোগ যত দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে ততই মঙ্গল।

বাংলাদেশের ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২ থেকে ২০৪১ সময়ের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে আরোপিত কর ৩৩ শতাংশ কমানো গেলে ওই সময়ের ব্যবধানে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সরকারের রাজস্ব ৩৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২২৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে (যা জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশের সমান হবে)। শুধু তাই নয়- এর ফলে জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও ২.২ শতাংশে উন্নীত হবে (বর্তমানে ০.৩ শতাংশ)। দেখা যাচ্ছে, ঢালাওভাবে আরোপিত কর না বাড়িয়ে ক্ষেত্রবিশেষ করছাড় দিয়েও রাজস্ব আহরণ বাড়ানো সম্ভব। করছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন খাতগুলো অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত তা নিয়েও নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

কর আহরণবিষয়ক অনুশীলনগুলোয় কিছু পরিবর্তন করে বিদ্যমান উৎসগুলো থেকেও আরও বেশি বেশি কর আদায় সম্ভব। যেমন- সিগারেটের দাম প্রতি বছর বাজেটে অল্প অল্প করে বাড়ানো হয়; কিন্তু তামাকবিরোধী গবেষকদের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, এ ক্ষতিকারক পণ্যটির দাম এক ধাক্কায় অনেকখানি বাড়িয়ে তার থেকে কর আহরণ করলে একদিকে সিগারেটের ব্যবহার যেমন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমবে, অন্যদিকে সিগারেট বিক্রি থেকে আরও বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকা কর পাওয়া সম্ভব। বিদ্যমান ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আমাদের নিজস্ব সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর প্রেক্ষাপটে আসছে অর্থ বছরে বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীল একটি ব্যয় পরিকল্পনাই দরকার। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব এখানে তুলে ধরতে চাই।Ñ

০১) মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে জনগণ বিশেষত নিম্ন আয় শ্রেণির পরিবারগুলো সুরক্ষিত রাখাকেই প্রধানতম অগ্রাধিকার হিসেবে দেখতে হবে। ইতোমধ্যে ওএমএস কার্যক্রম এবং ১ কোটি পরিবারকে কার্ডের মাধ্যমে কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহের উদ্যোগগুলো বিশেষ কার্যকর হয়েছে। এসব কর্মসূচির পরিধি বাড়ানো এবং এমন নতুন নতুন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে (বিশেষত নগরাঞ্চলের জন্য) বেশি বেশি বরাদ্দ দিতে হবে।

০২) জ্বালানির দাম সমন্বয়ের উদ্যোগ ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর প্রভাব বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে পড়েছে। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় বলা যায় নিশ্চিতভাবেই আসছে অর্থ বছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামে অস্থিরতা থাকবে। জ্বালানির দাম খুব বেশি বেড়ে গেলে দরকারবোধে বাড়তি ভর্তুকি দেওয়ার জন্য কিছু সম্পদ বাজেটে আলাদা করে বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। জনগণকে স্বস্তি দিতে এলপি গ্যাসে কিছু রাজস্ব ছাড়ের কথাও বিবেচনা করা যায়।

০৩) জ্বালানি কেনাকাটার জন্য আমরা বেশি মাত্রায় ব্যক্তি খাতের ওপর নির্ভরশীল। সরকার এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের গ্যারান্টর হিসেবে ভূমিকা রাখে। সরকার নিজে সরাসরি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি কেনা শুরু করলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায় কি না ভেবে দেখা দরকার। নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের কার্যক্রমও শুরু হওয়ার পথে। দেরিতে হলেও এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। পাশাপাশি সবুজ জ্বালানির ক্ষেত্রগুলো আরও প্রসারিত করার জন্য বাজেটারি উদ্যোগ নিতে হবে।

০৪) যেহেতু কৃষিই আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির রক্ষাকবচ, তাই বিভিন্ন কৃষি ইনপুটসে যতটা সম্ভব করছাড় দেওয়ার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। পাশাপাশি কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভর্তুকি দেওয়ার ধারাবাহিকতাও বজায় রাখতে হবে। কেননা কৃষিতে দেওয়া এ ভর্তুকি মূলত এক ধরনের গণমুখী বিনিয়োগ। কৃষির সুরক্ষায় নেওয়া বাজেটারি উদ্যোগগুলো দেশের কর্মসংস্থান ও খাদ্যনিরাপত্তায়ও ভূমিকা রাখবে।

০৫) প্রবাসী আয়প্রবাহ বলশালী করার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের দক্ষতা একটি বড় প্রতিবন্ধক। এ লক্ষ্যে প্রবাসগামী শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাজেট বরাদ্দে বিশেষ মনোযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষাকে যথাযথ অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিখন ও প্রশিক্ষণে বাড়তি নীতি সমর্থন দিয়ে যেতে হবে।

০৬) অবকাঠামোগত উন্নয়নে বরাদ্দের ক্ষেত্রে সংযমী হতেই হবে। তবে যেসব প্রকল্প দেশের শিল্পায়ন গতিশীল করবে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে সেগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করে যথাযথ বরাদ্দ দিতে হবে।

০৭) অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানোর জন্য এবারের বাজেটে হয়তো করছাড় ও প্রণোদনার নানা দিক যৌক্তিক করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। নিঃসন্দেহে এমন সংস্কার কাম্য। তবে এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যেন এগুলোর ফলে দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত না হয়। বিশেষ করে ৭০০-র বেশি এমএফআই যে ছোটখাটো ঋণ দেয় তার এক-তৃতীয়াংশ যায় কৃষিতে। আরেকটি বড় অংশ যায় এমএসএমই খাতে। এর বেশির ভাগ সুবিধা পায় নারী ও প্রান্তিক উদ্যোক্তারাই। এমএফআইকেও তাই করারোপের প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখাই শ্রেয় হবে। এ খাতে করারোপ করলে গ্রামীণ ভোগ কমে যাবে। ভ্যাট আহরণও কমে যেতে পারে।

০৮) পুরো জলবায়ু অর্থায়নের বিষয়টিকেই বেশি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আগামী দিনের বাজেটগুলোয়। বাংলাদেশকে জলবায়ু তহবিলের ন্যায্য হিস্‌সা দিতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা বিশেষভাবে আগ্রহী। তাই জাতীয় বাজেটে জলবায়ুবান্ধব উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বেশি অগ্রাধিকার দিতে পারলে সে জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া সহজ হবে। বাজেটপ্রণেতাদের তাই প্রতিটি খাতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যতটা সম্ভব জলবায়ু-সংবেদনশীল করে সাজাতে হবে।

সর্বোপরি বাজেট এবং মুদ্রানীতির একটি কার্যকর ও সময়োচিত সমন্বয় নিশ্চিত করার বিষয়ে সর্বোচ্চ নীতি-মনোযোগ নিশ্চিত করতেই হবে। কেননা বহিঃঅর্থনীতির চ্যালেঞ্জ, রিজার্ভ ক্ষয়রোধ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ, বিনিময় হারে ভারসাম্য রক্ষার মতো বড় চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সরকারের বাজেট এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: অর্থনীতিবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর


বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি ও প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন প্রসঙ্গ 

আপডেটেড ১৩ মে, ২০২৪ ১৫:৫৫
মো. রহমত উল্লাহ্

‘গত ০৫ মে ২০২৪ তারিখ রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষক বদলি নীতিমালা ২০২৪’-এর খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। সভায় বদলি কার্যক্রম আপাতত বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ এতে অত্যন্ত আশাহত ও মর্মাহত হয়েছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা! এরূপ সিদ্ধান্তের প্রকাশিত কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের শূন্য পদে বদলির সুযোগ রাখলে আইনি জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে। কেননা, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়োগ দেয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি/ গভর্নিং বডি। তাই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মাধ্যমে বদলি শুরু করা আইনসম্মত নয়। এ কারণটির বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। সম্ভবত অন্যান্য জটিলতার পাশাপাশি আইনি এ জটিলতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেই এমপিও নীতিমালা ২০২১-তে (ধারা ১২.২) বলা হয়েছে, ‘এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক/ প্রদর্শক/ প্রভাষকদের কোনো প্রতিষ্ঠানে পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে সমপদে ও সমস্কেলে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয় নীতিমালা প্রণয়ন করে জনস্বার্থে আদেশ জারি করতে পারবে।’ লক্ষণীয়, এখানে ‘বদলি’ শব্দটির স্থলে ‘প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন’ লিখে এর জন্য পৃথক নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। বদলি নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়নি!

এতে প্রতীয়মান হয়, বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না, নেই। অর্থাৎ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকে যেভাবে শিক্ষক-কর্মচারীরা এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদের বিপরীতে বিধি মোতাবেক আবেদন করে যোগ্য বিবেচিত হলে নিয়োগ নিয়ে সে প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে আসছিলেন এবং পরবর্তীতে এমপিও ট্রান্সফার ও সিনিয়ারিটি সুবিধা ভোগ করে আসছিলেন এখনো সেরকম সুযোগ পাবেন। তদুপরি সুনির্দিষ্টভাবে শিক্ষক/প্রদর্শক/প্রভাষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ আরও সহজ ও সম্প্রসারিত করার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে এমপিও নীতিমালায়।

অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে- বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের নিমিত্তে প্রকাশিত চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষকদের ‘বদলির’ বিকল্প ‘প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন’-এর ন্যূনতম সুযোগটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতেও বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। অবাক ব্যাপার এই, একদিকে দেখা যাচ্ছে, এমপিও নীতিমালায় বলা হয়েছে এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য জনস্বার্থে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করার কথা। আর অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, উল্লিখিত নীতিমালা প্রণয়ন না করেই অর্থাৎ বিকল্প সুযোগ সৃষ্টি না করেই যুগ যুগ ধরে চলে আসা শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের প্রচলিত ন্যূনতম সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে! বর্তমানে সব বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর বদলির খসড়া নীতিমালা স্থগিত এবং এমপিওভুক্ত নিবন্ধনধারী বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ বন্ধ! বিদ্যমান শিক্ষকদের বদলির বা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের কোনো সুযোগ আর থাকল না! এমন অবস্থায় বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকরা অত্যন্ত আশাহত, মর্মাহত ও মনোকষ্টে নিমজ্জিত! শিক্ষকদের মন ভালো না থাকলে ভালো পাঠদানের কোনোই সম্ভাবনা থাকে না। শিক্ষকতা অত্যন্ত মননশীল কাজ।

বদলি নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত না করে স্থগিত করার পিছনে সম্ভাব্য আইনি জটিলতা ছাড়াও অন্য যে কারণটি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো- বদলি শুরু হলে গ্রামপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্য পদের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে যা পূর্ণ করা কঠিন হবে। অর্থাৎ গ্রামের শিক্ষকরা বদলি হয়ে শহরে চলে যাবেন এবং গ্রামে কেউ নতুন করে নিয়োগ নিতে চাইবেন না। এটি সর্বক্ষেত্রে সর্বাংশে সঠিক নয়। বিষয়টি বদলি নীতিমালার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাছাড়া স্বল্প বেতনে সব বিষয়ের শিক্ষক শহরে এসে টিকে থাকতে পারবেন না। শহরের সব প্রতিষ্ঠানই যে অধিক সচ্ছল তাও নয়। তবে অধিক যোগ্য-দক্ষরা অধিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ লাভের জন্য ও বদলি হওয়ার জন্য আবেদন করবেন নিয়োগ পাবেন ও বদলি হবেন এটাই স্বাভাবিক। তা না হলে অধিক যোগ্যরা আসবেন না ও থাকবেন না শিক্ষকতায়। মনে রাখতে হবে, বদলি সুবিধা হ্রাস করে বা যোগ্যতা শিথিল করে অথবা অন্য কোনো কৌশল করে তুলনামূলক কম যোগ্যদের শিক্ষকতায় এনে ও ধরে রেখে অধিক যোগ্য নেতা-কর্মী, শ্রমিক, আমলা, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি তৈরি করা সম্ভব নয়! কেননা, একজন কম যোগ্য শিক্ষক সারা জীবনে তৈরি করেন অগণিত কম যোগ্য বা অযোগ্য মানুষ। তাই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে শিক্ষকদের সব শূন্যপদ (গ্রামের ও শহরের) অধিক যোগ্যদের দ্বারা পূর্ণ করাই দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ও জাতির জন্য অধিক কল্যাণকর।

নিবন্ধনধারী এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করার সুযোগ বন্ধ করার পিছনে আলোচিত কারণগুলোর অন্যতম ছিল বিদ্যমান শিক্ষকদের আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হলে তাদের তুলনায় কম নম্বর প্রাপ্ত নিবন্ধনধারী বেকার প্রার্থীরা তাদের অধিক পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিলেকশন পান না অথবা তৎকালে আবেদনকৃত কোনো প্রতিষ্ঠানেই চাকরি পান না। আবার বিদ্যমান শিক্ষকরা তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানে চলে গেলে তাদের ছেড়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানে শূন্য পদ থেকে যায়। অর্থাৎ নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করার পরেও একদিকে শূন্য পদ থেকে যায়, অন্যদিকে আবেদন করেও চাকরিপ্রার্থী বেকার থেকে যান! এমন অবস্থা কিন্তু নিবন্ধন পরীক্ষা শুরুর আগেও বিরাজমান ছিল। যখন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করে পরীক্ষা নিয়ে বাছাই করে নিয়োগ দিত তখনো এক প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষকরা অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আবেদন করে বিধি মোতাবেক নিয়োগ নিয়ে যোগদান করলে পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠানের পদ শূন্য হতো। পুনরায় সেই প্রতিষ্ঠানের কমিটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিধি মোতাবেক নতুন লোক নিয়োগ করত। সেখানেও বিধি মোতাবেক অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষক এসে যোগদান করলে তার ছেড়ে আসা প্রতিষ্ঠানে পদ শূন্য হতো। কোনো ক্ষেত্রে নতুনরা নিয়োগ পেলে বিদ্যমান শিক্ষকদের আগের পদ শূন্য হতো না। অর্থাৎ বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের পদ শূন্য হওয়া, শূন্য পদ নতুন/ফ্রেশ প্রার্থীর দ্বারা পূর্ণ হওয়া বা বিদ্যমান শিক্ষকদের দ্বারা পূর্ণ হয়ে সে শিক্ষকের ছেড়ে আসা পদ শূন্য হওয়া এমন একটি বাস্তব প্রক্রিয়া সুদূর অতীত থেকেই সারা দেশে কার্যকর ছিল। সে প্রক্রিয়াটি বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে চলমান ছিল বলে সবার দৃষ্টিগোচর হতো না। এখন এনটিআরসিএর মাধ্যমে সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ একসঙ্গে হচ্ছে বলে বিষয়টি বড় আকারে সবার দৃষ্টিতে এসেছে। অবশ্যই এ সমস্যার একটা অনুকূল সমাধান প্রয়োজন ছিল। কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে এর সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন! যা বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকদের চরমভাবে মর্মাহত ও হতাশাগ্রস্ত করেছে। এটি কোনো দিক থেকেই সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত হয়নি।

অথচ নিম্নলিখিত উপায়ে সহজেই সমাধান হতে পারে এ সমস্যার। যাতে এমপিওভুক্ত নিবন্ধনধারী শিক্ষকদের অধিক হারে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়ার সম্ভব হবে, নিবন্ধনধারী নতুন প্রার্থীদের অধিক হারে নিয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত সব শূন্য পদ পূর্ণ করা সম্ভব হবে, সর্বোপরি বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের বদলির চাহিদা আংশিক পূর্ণ হবে। তা হচ্ছে, বর্তমান নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দুই ভাগে বিভক্ত করে প্রতিবছর বা প্রতিবার পৃথকভাবে সম্পন্ন করতে হবে দুটি নিয়োগ প্রক্রিয়া। প্রথমে প্রদান করতে হবে শুধুমাত্র নিবন্ধিত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য বিশেষ বিজ্ঞপ্তি। এ ক্ষেত্রে কোনো নতুন প্রার্থী আবেদন করতে পারবেন না। কেবল বিদ্যমান এমপিওভুক্ত নিবন্ধিত শিক্ষকরা আবেদন করতে পারবেন। এদের নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করে পুনর্নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন সম্পন্ন করার পরবর্তীতে চিহ্নিত করতে হবে শূন্য পদ। সেই শূন্য পদে নতুনদের নিয়োগের জন্য প্রকাশ করতে হবে গণবিজ্ঞপ্তি। সে ক্ষেত্রে কোনো এমপিওভুক্ত শিক্ষক আবেদন করতে পারবেন না। শুধু নিবন্ধিত প্রার্থীরা আবেদন করবেন। নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে তাদের নিয়োগের মাধ্যমে বিদ্যমান শূন্যপদগুলো পূর্ণ করা সম্ভব হবে। এভাবে প্রতি বছর বা প্রতিবার বিদ্যমান এমপিওভুক্ত নিবন্ধিত শিক্ষকদের পুনর্নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য একটি এবং শুধু নিবন্ধিত প্রার্থীদের নতুন নিয়োগের জন্য একটি অর্থাৎ মোট দুটি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হলে অবশ্যই অনেকাংশে পূর্ণ হবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বদলিপ্রত্যাশী লাখ লাখ শিক্ষকের দাবি। সেই সঙ্গে নিয়োগ পাবেন অধিক সংখ্যক নতুন প্রার্থী এবং পূর্ণ হবে অধিক শূন্য পদ। এমনি দুই ভাগে নিয়োগ সম্পন্ন করতে গিয়ে যদি অধিক জনবল ও অধিক অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন পড়ে তাহলে বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের আবেদনের ফি নতুন/বেকার প্রার্থীদের তুলনায় কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে। আমার এ প্রস্তাবটি তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরে যখন অনেক পদ শূন্য থেকে গিয়েছিল এবং অনেক বেকার চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছিল তখনো পরে একাধিক জাতীয় পত্রিকায় উপস্থাপন করেছিলাম। এর মধ্যে গত ১৪ আগস্ট ২০২১ তারিখে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখার শিরোনাম ছিল ‘দুই ভাগে হোক বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ’। সেটির পক্ষে ছিল ব্যাপক সমর্থন; কিন্তু কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের আবেদন করার সুযোগ বন্ধ করে দিল চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি থেকেই। পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতেও বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য দেওয়া হয়নি আবেদনের সুযোগ! তাই বিষয়টি আবারও আলোচনায় আনার তাগিদ অনুভব করলাম। তখন কেউ কেউ বলছিলেন, বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের পৃথক সুযোগ দেওয়া হলে তারা ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে চলে যাবেন। ফলে নতুনদের ভালো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ কমে যাবে। হ্যাঁ সেটি অবাস্তব নয়। তবে এটিও স্বীকার করতে হবে, পুরাতন বা বিদ্যমান শিক্ষকদের অভিজ্ঞতার ও প্রশিক্ষণের অবশ্যই একটা মূল্য আছে। সেটিকে যথাযথ মূল্যায়ন করাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। অধিক যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞরা অধিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ লাভের জন্য ও বদলি হওয়ার জন্য আবেদন করবেন নিয়োগ পাবেন ও বদলি হবেন এটাই স্বাভাবিক। এ প্রক্রিয়া সচল থাকলে এক সময় নবীনরাও অভিজ্ঞ হবেন এবং অনুরূপ সুযোগ পাবেন। এনটিআরসিএ যখন শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তখন তো এমন কোনো শর্ত থাকে না যে, এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যারা শিক্ষক হবেন তারা যেহেতু নিজের পছন্দমতো প্রতিষ্ঠানে আবেদন করে নিয়োগ নেবেন সেহেতু ভবিষ্যতে আর ওই প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য কিংবা বদলি হওয়ার জন্য কোনোরূপ দাবি উত্থাপন করতে পারবেন না। তাহলে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন বা বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকদের দাবিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে কেন, হবে কেন বারবার? উত্তম বিকল্প ব্যবস্থা না করে বন্ধ করা হলো কেন, হবে কেন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ? মানুষ গড়ার কারিগরদের সুবিধা বাড়ানোর পরিবর্তে কমিয়ে, দুঃখ-কষ্ট কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়ে কীভাবে সম্ভব হবে কাঙ্ক্ষিত মানুষ গড়া?

যেহেতু আইনি জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করা যাচ্ছে না বিধায় এখন সাধারণ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না সেহেতু সব এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পারস্পরিক বদলির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া এবং শুধু নিবন্ধিত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বিশেষ/পৃথক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্বেচ্ছায় প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া অধিক যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকদের দুঃখ-কষ্ট সামান্য লাঘব করে পাঠদানে তাদের মনোযোগ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার জন্য আবারও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।


লেখক: অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট


আসন্ন বাজেট ও করনীতি সংস্কার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রজত রায়

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট বিভিন্ন কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান কবে হবে তা অনিশ্চিত। ফলে আগামী বছরও উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করাটা বেশ জটিল এবং বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।

বহু ক্ষেত্রেই আমরা উন্নতি করছি। আয়, প্রত্যাশিত গড় আয়ু, সাক্ষরতার হার বেড়েছে, পরিবহন ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির বহু দিকের উন্নতি ঘটেছে। বেসরকারি ক্ষেত্রের কিছু অংশ টগবগ করছে, প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে, ডিজিটাল ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। অন্যান্য আর্থসামাজিক সূচকেরও উন্নতি হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমলেও আয়বৈষম্য বেড়েছে। বেড়েছে ভোগবৈষম্য। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এতে প্রমাণ হয় দেশের সম্পদের একটি বড় অংশ কিছু মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে। একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং করোনাভাইরাস মহামারির বৈরী প্রভাবের পরও দেশের দারিদ্র্যের হার গত ছয় বছরে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। তবে দারিদ্র্য কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের মাসিক গড় পারিবারিক আয় ২০২২ সালে বেড়ে ৩২,৪২২ টাকায় পৌঁছায়। ছয় বছর আগে ২০১৬ সালের সর্বশেষ জরিপের তুলনায় এটি প্রায় ১০২ শতাংশ বৃদ্ধি। ২০১৬ সালে মাসিক গড় আয় ছিল ১৫,৯৮৮ টাকা। আর ২০১০ সালে এ আয় ছিল আরও কম ১১,৪৭৯ টাকা। তবে আয়ের এ প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও তা হয়তো সর্বক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ দেশে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে। যারা আয়ের নিম্নসীমায় আছেন, তাদের সম্পদের পরিমাণ আগের চেয়ে আরও কমে গেছে। দেশে আয়বৈষম্য এবং ভোগবৈষম্য দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে।

সমাজে আয়বৈষম্য নিরূপণের জন্য ব্যবহৃত হয় জিনি সূচক। জিনি সূচকের মান হতে পারে শূন্য থেকে এক। কোনো সমাজের সব সম্পদের মালিক একজনই হলে অন্য কারও হাতে কোনো সম্পদ না থাকলে সে সমাজে হবে চূড়ান্ত বৈষম্য ও এর জিনি সূচক হবে ‘এক’। বিপরীত দিকে, যে সমাজের সব সম্পদ সবার মধ্যে শতভাগ সমভাবে বণ্টন হয়ে থাকে সে সমাজের জিনি সূচক হবে ‘শূন্য’। জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়ের মূল বিতর্কটি মূলত এর দ্বারা মানুষে মানুষে বৈষম্য বোঝাতে পারে না। ওইসিডি যথার্থই বলেছে, জিডিপি আয়ের পরিমাপ করে, তবে সমতা নয়, এটি সামাজিক সংহতি ও পরিবেশের মতো মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে।

জিডিপি হিসাব করা হয় তিনটি উপাদানের ভিত্তিতে। মানুষের ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয়, সরকারের ভোগ ব্যয় এবং স্থায়ী মূলধন নির্মাণ অর্থাৎ বিনিয়োগ। দেখা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় এই অর্থবর্ষে জিডিপিতে সরকারি ভোগ ব্যয়ের অনুপাতও বেড়েছে, স্থায়ী মূলধন নির্মাণের অনুপাতও বেড়েছে, কমে গিয়েছে ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয়ের অনুপাত। মানুষের খরচের মাত্রা এখনো কোভিড-পূর্ব স্তরে পৌঁছায়নি।

জিডিপি বাড়ছে, অথচ মানুষের ভোগ ব্যয় সেই অনুপাতে বাড়ছে না কেন? তাহলে যারা বেশি খরচ করেন তাদের বদলে রোজগার গিয়েছে যারা বেশি সঞ্চয় করেন তাদের হাতে? বিষয়টা তাহলে কি এমন লোকের হাতে টাকা বেড়েছে, অন্যদের তুলনায় যাদের রোজগারের অনুপাতে ভোগ ব্যয় কম। তাহলে এমন লোক কারা? গরিব মানুষের যেহেতু রোজগার কম তাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে যায় চাল, ডাল, জামা, কাপড়, ওষুধ, যাতায়াত, লেখাপড়ায়। অর্থব্যবস্থা যদিবা ঘুরে দাঁড়ায় তবে সুফল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের বদলে পৌঁছাচ্ছে মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে।

বাংলাদেশে গরিবদের আয় বৃদ্ধির হারের তুলনায় ধনীরা অনেক বেশি হারে আরও ধনী হয়েছেন। ২০২১ সালের তথ্যানুযায়ী মোট আয়ে দারিদ্র্যসীমার সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা ৪০ শতাংশ মানুষের অংশ ছিল ২১ শতাংশ আর সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অংশ ছিল ২৭ শতাংশ। আর ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল কেবল ১ শতাংশ লোকের হাতে। আর দারিদ্র্যসীমার নিচের অর্ধেকের হাতে ছিল ১৭ শতাংশ; কিন্তু বেশ কয়েকটি কাঠামোগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা রয়েছে। যেমন- দীর্ঘদিন ধরেই বাজেটের বড় ভাগ চলে ভর্তুকি আর পুরোনো ঋণ মেটাতে। রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর খাতায় ক্রমবর্ধমান অনাদায়ী ঋণের পাহাড়। জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় বাড়েনি। বাড়ছে সরকারের ঋণ। জিডিপির অনুপাতে সরকারের ঋণ ও রাজস্ব আয়ের এ অসামঞ্জস্যতা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করছে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসাবে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে চলতি মূল্যে জিডিপির মোট দেশজ উৎপাদনের আকার দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে কর আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কর-জিডিপি অনুপাত ছিল ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী অধিকাংশ দেশের কর-জিডিপির হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। যেমন নেপালের কর-জিডিপির হার হচ্ছে ২৩ শতাংশ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতিযোগী ১০ দেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ওই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার পেছনে। অন্য দেশগুলো হচ্ছে শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, ভারত, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। উল্লিখিত দেশগুলোতে এই হার ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশ।

কর-জিডিপির অনুপাত দিয়ে সাধারণত বিভিন্ন দেশে কর আহরণ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা পরিমাপ করা হয়। কোনো দেশের কর-জিডিপি অনুপাত বেশি হলে সম্পদ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বেশি বলে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত বেশ কয়েক বছর থেকে ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনেক অর্জন থাকলেও কর-জিডিপির অনুপাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আশাব্যঞ্জক নয়। তাহলে এর কারণ কি? এর প্রধান কারণ হলো দেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় ব্যাপক হারে অব্যাহতি দেওয়া।

আমরা দেখতে পাচ্ছি কৃষি, পশু সম্পদ, মৎস্য, স্বাস্থ্য জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে পুরোপুরি ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে। তৈরি পোশাক ছাড়াও বিদেশি পণ্যে নির্ভরতা কমিয়ে আনতে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক পণ্যে দেওয়া হয়েছে ভ্যাট ছাড়। এ ছাড়া ভ্যাট অব্যাহতির আওতায় রয়েছে ওষুধের কাঁচামালসহ বিভিন্ন প্রসাধনী পণ্য। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে স্থানীয় পর্যায়ে আহরিত ভ্যাটের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা যা গত অর্থ বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। সরকারের প্রতি ১০০ টাকার রাজস্ব আদায়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের খরচ সবচেয়ে কম। বাংলাদেশের খরচ হয় ২১ পয়সা। এ খরচ ভারতে ৬০ পয়সা, থাইল্যান্ডে ৭১ পয়সা, সিঙ্গাপুরে ৭৯ পয়সা, মালয়েশিয়ায় ১ টাকা, জার্মানিতে ১ টাকা ৫০ পয়সা এবং জাপানে ১ টাকা ৭০ পয়সা। তবে এটা ঠিক রাজস্ব খাতে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য কমাতে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। ইআরএফ তথ্য মোতাবেক, যদি সব কর যোগ্য ব্যক্তিরা আয়কর স্লাব অনুযায়ী কর প্রদান করে তাহলে জিডিপির অনুপাতে বর্তমানে ১ শতাংশ ব্যক্তি আয়কর বাড়িয়ে ৩ দশমিক ১ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হবে। এ জন্য নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। বর্তমানে পরোক্ষ কর ৬৫ শতাংশ এবং প্রত্যক্ষ কর ৩৫ শতাংশ।

আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও উন্নত দেশে যেতে হলে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ২১ শতাংশ করতে হবে। আর এর উল্লেখযোগ্য অংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে আসতে হবে। আবার করপোরেট কর জিডিপির অনুপাতে মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে ২ লাখ ৭০ হাজার নিবন্ধিত কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ বা ৩০ হাজারের মতো কোম্পানি কর দেয়। এ ক্ষেত্রেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। যাদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে তারা কম কর দেন। সরকার অনেক খাত থেকে কর পাচ্ছে না। অপ্রচলিত খাতে প্রায় ৮০ ভাগ জনশক্তি কাজ করে। আর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা করের আওতার বাইরে আছে। এসব খাত থেকে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে পারলে বৈষম্য দূর হবে। আবার আবাসন খাত এবং ফেসবুক, আমাজন ও ফুডপান্ডার মতো নতুন ব্যবসার প্রসার হচ্ছে সেখান থেকে সরকার কাঙ্ক্ষিত কর পায় না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মোতাবেক, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সব বিভাগ মোট ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। বাংলাদেশে কর আদায়ে তুলনামূলক খরচ কম হলেও কর দিতে গিয়ে কর দাতাদের অনেক সময়ই নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ আছে। তাই করদাতারা যেন সহজে ও নির্বিঘ্নে কর দিতে পারে সেদিকে এনবিআরের নজর দিতে হবে। বেশি সম্পদের মালিকদের বেশি সম্পদ থাকার কারণে অতিরিক্ত কর হিসেবে সারচার্জ আরও বাড়াতে হবে। গাড়ির মালিকদের ওপর বেশি পরিমাণে কর বহাল রাখতে হবে।

সকল পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি না দিয়ে অতি প্রয়োজনীয় পণ্যে শুধু ভ্যাট অব্যাহতি রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে কৃষি যন্ত্রপাতি উপকরণে পুরোপুরি ভ্যাট মুক্ত রাখতে হবে এবং শুধু কৃষিখাতে ভর্তুকি রাখা সমীচীন হবে। তাই করনীতি সংস্কার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

বিষয়:

ডোনাল্ড লু আসছেন, রাজনীতিতে লুর হাওয়া ভাসছে

আপডেটেড ১২ মে, ২০২৪ ১৪:২৬
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আগামী মঙ্গলবার ঢাকায় আসছেন, বুধবার সফর শেষে দেশের উদ্দেশ্য যাত্রা করবেন। ১০ মে শুক্রবার তিনি ভারতে এসেছেন। ভারতের সফর শেষে শ্রীলঙ্কা যাবেন, শ্রীলঙ্কা থেকে ঢাকায় আসবেন। ভারতে তার সফর নিয়ে গণমাধ্যম কিংবা সরকারি কোনো মহলে তেমন কোনো আলোচনা নেই। তিনি চেন্নাই সফর করছেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে কনসুলেট কর্মীদের সঙ্গে দেখা করবেন। ভারতীয় সরকারি কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে তার দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার সংবাদ কোনো ভারতীয় গণমাধ্যমে নেই। ভারতে এই মুহূর্তে লোকসভা নির্বাচন চলছে। নির্বাচন চলাকালে ভারতে কোনো দেশের কে আসে, কে যায় তা নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। এই সময় তেমন উচ্চপর্যায়ের কোনো সরকারি বা রাষ্ট্রীয় নেতা ভারতে আমন্ত্রিতও হন না। ডোনাল্ড লু ভারতের দৃষ্টিতে কোন পর্যায়ের মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা-তার অবস্থান দেখেই বোঝা যায়। ডোনাল্ড লু এখনো বাংলাদেশে এসে পৌঁছাননি এরই মধ্যে বাংলাদেশের গণমাধ্যম, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ অনেক ক্ষেত্রেই লু (উত্তপ্ত) হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিরোধীদের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস, স্বস্তি এবং মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কানাঘুষোও প্রচার করতে শোনা যাচ্ছে, তথাকথিত নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরও কারও কারও সাজগোজের প্রস্তুতি নেওয়ার আয়োজন ভেতরে ভেতরে চলছে। ডোনাল্ড লু শ্রীলঙ্কাতে বেশ সমাদর পাবেন- তেমনটি গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে বোঝা যাচ্ছে। সেখানে অর্থনৈতিক সংকট থাকায় সরকার এবং বিভিন্ন মহলের সঙ্গে তার নানা ধরনের বৈঠক হবে বলেও জানা গেছে। সে দেশের নাগরিক সমাজের সঙ্গেও তার কথাবার্তা হবে। অবশ্য ভারতের নাগরিক সমাজ ডোনাল্ড লুর সঙ্গে বৈঠকে বসেনি- তেমন খবর সে দেশের গণমাধ্যমে কেন দিতে পারছে না সেটি বোঝা গেল না!

ডোনাল্ড লু ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ঢাকায় তিনবার সফর করে গেছেন। যদিও তখন বলা হয়েছিল তিনি রোহিঙ্গা বিষয়ে উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে ঢাকা সফর করেছিলেন। তবে সেই সময়ে তিনি বা অন্য মার্কিন প্রতিনিধিদের ঢাকা সফরের উদ্দেশ্য সবারই জানার বিষয় ছিল। মূলত যুক্তরাষ্ট্র যে একটি মুক্ত, অবাধ ও সমৃদ্ধ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল দেখতে চায়, তাতে বাংলাদেশকে যুক্ত করাই এবং এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য সেটি সবারই জানার বিষয়। এতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলে বলয় বৃদ্ধি পায় এটি সহজেই অনুমেয়; কিন্তু বাংলাদেশ ‘কারও সঙ্গে বৈরিতা নয় সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’ এমন পররাষ্ট্রনীতিতে অটল রয়েছে। বাংলাদেশের এই নীতি খুবই পরীক্ষিত। এ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না যে শেখ হাসিনা সরকার বঙ্গবন্ধুর বিঘোষিত নীতির কোনো ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। সে কারণেই কোনো দেশ এখনো পর্যন্ত প্রশ্ন তুলতে পারেনি যে শেখ হাসিনা শাসনামলে বাংলাদেশ বড় কোনো শক্তির বলয়ের ভেতরে এক ইঞ্চিও প্রবেশ করেছে। আবার কোনো বড় রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী কোনো আচরণেও লিপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক সবার সঙ্গে বজায় রেখে চলার যে দক্ষতা দেখাতে পেরেছে সেটি একমাত্র সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার সাহস, দৃঢ়তা এবং দক্ষতার প্রমাণ বহন করে। বৃহৎ কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মাখামাখি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার অর্থ হচ্ছে অন্যদের সঙ্গে শত্রুতা বাড়ানো। বাংলাদেশের সেটি একেবারেই প্রয়োজন নেই বরং সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থ বৃদ্ধি করা বাংলাদেশের জন্য এই পর্বে সবচেয়ে জরুরি বিষয়। বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ, পৃথিবীর সবচেয়ে জনঘনবসতির দেশ। আমাদের বিপুল এই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার কোনো বিকল্প নেই; কিন্তু সেটি এক কঠিন চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছাড়া মানুষকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অন্ন, বস্ত্র এবং বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করা মোটেও সম্ভব নয়। সে জন্যই আমাদের প্রয়োজন সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে টাল-মাটাল বিশ্ব ব্যবস্থায় নিজেদের রক্ষা করার স্বার্থে এগিয়ে চলা। শেখ হাসিনার সরকারই এই নীতি দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করে চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার নীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে নানাভাবে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সব বাস্তবতাই তুলে ধরেছে; কিন্তু তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা ছাড়ছে না, বাংলাদশও তার নীতি ও অবস্থানের পরিবর্তন করছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে- সেটি তাদের হিসাব-নিকাশের ব্যাপার; কিন্তু বাংলাদেশে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন কেন, ছোট কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গেও বৃহৎ রাষ্ট্রের কোনো বলয়ে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আমলে নিতে চায় না। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে চীনের টানাপড়েন সম্পর্কে অবহিত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ চীন এবং ভারতের সঙ্গে চমৎকার ভারসাম্যমূলক অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে। সে কারণে ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো ধরনের চাপ কখনো দিচ্ছে না, উভয় দেশের মধ্যে এ ব্যাপারে চমৎকার আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবকিছু জেনে-শুনেও বারবার বাংলাদেশকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কাছে টানতে চাইছে। সেই চাওয়ার অবস্থান থেকেই মার্কিনীরা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরোধীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে। গত নির্বাচনের আগে বিষয়টি তারা মোটেও গোপন রাখতে পারেনি। তাদের একপক্ষীয় অবস্থান ও আচরণ দেশে-বিদেশে বড় বড় শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল-সেটি প্রকাশ্যেই সবাই দেখেছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বড় বড় দেশগুলোর এভাবে বাগ-বিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়ার বিষয়টি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যেই বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণ করেছে এবং এর বিরোধিতা করেছে। তবে যেহেতু দেশে কোনো বিষয় নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐকমত্য নেই, তাই সরকার খুব কঠোরভাবে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে না। বিরোধীদল সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে খুব এগিয়ে থাকে তা তাদের আচরণ, কথাবার্তা, সরকারবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদির মধ্যেই প্রকাশ পেয়ে থাকে, সেটি গত বছর কে না দেখেছে? ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডে হাসের ভূমিকা তখন কতটা কূটনৈতিক নরমস বহির্ভূত ছিল তা সবার কাছেই স্পষ্ট হয়েছিল; কিন্তু আমাদের সমাজে আন্তর্জাতিক নরমস মেনে চলার বিষয়টি অনেকের মধ্যেই যথেস্ট দুর্বলভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, ভোজ সভায় মিলিত হতে অথবা দেশের সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অথবা পক্ষে কথা বলতে কতটা যে মুখিয়ে থাকেন সেটি গত বছর দেখা গেছে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বলে যারা নিজেদের পরিচয় দিতে ভালোবাসেন তারা কিসের ভিত্তিতে এই অধিকার চর্চা করেন তা মোটেও বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই দুর্বলতার সুযোগ কোনো কোনো দেশ নিচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। ভারতে কোনো রাজনৈতিক দলই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলেন না, অভিযোগও করেন না। সে দেশের নাগরিক সমাজও একই নীতি অনুসরণ করেন। শ্রীলঙ্কায় আগে বিদেশিদের সঙ্গে নাগরিক সমাজের বিশেষ কোনো সম্পর্ক ছিল কি না জানিনা, তবে এখন অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের সঙ্গে নাগরিক সমাজের ওঠাবসার বিষয়টি ঘটেছে কি না বলা মুশকিল। আমাদের এখানে স্বাধীনতার পর থেকেই গোপনে অনেকেই যে বিদেশি দূতাবাসে যাতায়াত করতেন, ষড়যন্ত্রও করতেন এ সম্পর্কে বেশ কিছু বই-পুস্তকে বিস্তর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। এখন তো দেখা যাচ্ছে প্রকাশ্যেই বিষয়টি ঘটছে। তবে তাদের আলোচনার সব বিষয়বস্তুই জানা যায় না। সেখানেই সমস্যার রহস্য আবৃত থাকছে!

ঢাকায় ডোলান্ড লু মঙ্গলবার আসার পর সরকারি কর্মকর্তা এবং নাগরিক সমাজের নেতারাসহ অন্যান্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীরকরণসহ মার্কিন-বাংলাদেশ সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করবেন বলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। বিএনপি ডোলান্ড লুর এই সফরকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে। যদিও বিএনপির কোনো নেতার সঙ্গে লুর বৈঠক হবে কি না তা উচ্চপর্যায়ের কোনো নেতাই বলতে পারেননি। তবে বিএনপি নেতাদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রধানমন্ত্রীর কিছু বক্তব্যকে নিয়ে নানা ধরনের সন্দেহের জাল বিস্তার করছে বলে প্রচার করছে। তাদের ধারণা লু মধ্যবর্তী নির্বাচন প্রসঙ্গে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন- যার কোনো তথ্য ভিত্তি নেই। তা ছাড়া এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছে নির্বাচনী ঝড় এবং ছাত্র আন্দোলনের ঘূর্ণিঝড়। ইসরায়েলের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে সারা বিশ্বেই যখন বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিস্তৃত হচ্ছে তখন সে দেশের একজন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদমর্যাদার কেউ বাংলাদেশে এসে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে এমন চাপ সৃষ্টির কথা কল্পনা করতে পারার কথা নয়। তা ছাড়া ২৮ অক্টোবর বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারীদের ঢাকায় মহাসমাবেশের শেষ দিকে আকস্মিকভাবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়দানকারী মিয়া আরেফীর সংবাদ সম্মেলনের নাটক যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল। ভুয়া এই উপদেষ্টা কোনো না কোনো মহলের বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই সেদিন রাজনীতির মঞ্চে বক্তৃতা দিতে প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন। মিয়া সাহেব তখন আটক হয়ে জেলে গেছেন, তিনি এখন কোথায় আছেন তা গণমাধ্যমেও জানা যাচ্ছে না। তবে এসব যে বাংলাদেশে তখন বড় ধরনের সংঘর্ষ তৈরিতে কাজে লাগানো হতো এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং ২৮ অক্টোবর পরবর্তী বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন, অগ্নিসংযোগ ও প্রতিহত করা নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে আদর্শিক, গণতান্ত্রিক নির্বাচন করার প্রত্যাশা যুক্তরাষ্ট্রেরও দেখার আশা করা সম্ভব নয়। তারপরও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন এড়িয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশন যেতে পেরেছে তা মোটেও হালকা করে দেখার বিষয় নয়। বিরোধীরা নির্বাচনকে কলঙ্কিত এবং প্রশ্নবোধক করার লক্ষ্যেই অবস্থান করছে; কিন্তু এটি বিএনপির জন্য এখন মোটেও সুখের হচ্ছে না তা বুঝতে পেরেই তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের স্বপ্ন দেখতে চাইছে। সেই চাপ সরকারের ওপর প্রয়োগ করতে তারা আবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সওয়ার হতে চাচ্ছে। তবে সেই আশায় বোধ হয় না ডোলান্ড লু কোনো হাওয়া দিয়ে যেতে চাইবেন।

লেখক: ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক


banner close