রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তিক ইতিহাস: প্রেক্ষাপট পাগলা থানা

সোহেল মাজহার 
প্রকাশিত
সোহেল মাজহার 
প্রকাশিত : ২৮ মার্চ, ২০২৪ ১২:৩১

’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সব থেকে গৌরবময় অধ্যায়। ৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্বপ্ন এখনো অধরা রয়ে গেছে। জাতি হিসাবে বাংলাদেশকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের পথে হাঁটছে।

এই সময়ের ভিতর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এসব গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের অজানা ঘটনা ও অনালোকিত অধ্যায় পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছে। তারপরেও অনেক ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধের বহু গৌরবদীপ্ত স্মৃতি ও বীরগাঁথা আজও স্বীকৃতি পায়নি। অনেক অর্জন ও স্বীকৃতি বেহাত অথবা বেহাত হয়ে যাওয়ার পথে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ময়মনসিংহের পাগলা থানার গৌরব। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাগলা থানা স্বতন্ত্র কোনো পরিচয় ছিল না। পাগলা ছিল গফরগাঁও থানা অন্তর্গত দত্তের বাজার ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম্য বাজার। তদুপরি অঞ্চলটি গফরগাঁও উপজেলার দক্ষিণের ৮টি ইউনিয়নের প্রায় মধ্যবিন্দু হওয়ার সব সময় এর একটি রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল। ২০১২ সালে পাগলা একটি নতুন থানা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

শুধু ময়মনসিংহের মধ্যে নয়- বাংলাদেশের ভিতর পাগলা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গৌরবজনক ঘটনা ঘটে; কিন্তু প্রশাসনিক পরিচয়ের কারণে পাগলা অঞ্চলে সংগঠিত সকল যুদ্ধ ও যুদ্ধ সম্পর্কিত সকল ঘটনা- গৌরবময় বীরগাঁথা গফরগাঁও-এর নামে প্রচারিত হয়েছে। এই অঞ্চলের সিংহভাগ মুক্তিযুদ্ধ পাগলা থানার ৮টি ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলে সংগঠিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার ঐতিহাসিক ভাষণে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মূলত এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করেন। তিনি আরও ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ এই ঘোষণার পর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হয়ে যায়। একইভাবে তৎকালীন ঢাকা জেলা বর্তমান গাজীপুর জেলার কাওরাইদ কে এন উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং শুরু হয়। অঞ্চলটি গাজীপুর জেলার আওতাভুক্ত হলেও ময়মনসিংহ পাগলা থানার সীমান্তবর্তী অঞ্চল। এই ট্রেনিং সেন্টারের মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনজন নেতা। তন্মধ্যে সাইদুর রহমান সিরাজ তৎকালীন গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মো. মফিজুল হক চেয়ারম্যান তৎকালীন গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগের ও ময়মনসিংহ সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাদের দুজনের বাড়ি বর্তমান পাগলা থানার পাইথল ও নিগুয়ারী ইউনিয়নে। অপরজন কাওরাইদ ইউনিয়নের মনির উদ্দিন ফকির ছিলেন শ্রীপুর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। একইভাবে মশাখালী রেলস্টেশন সংলগ্ন চাইড়বাড়িয়া মাদ্রাসা মাঠে আরফান আলী চেয়ারম্যান, সাইদুর রহমান কামাল ও শাহাদাত হোসেন মাস্টার।

২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধু মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ২৫ মার্চের রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পাগলা থানার বিভিন্ন অঞ্চল যেমন- গয়েশপুর মাদ্রাসা মাঠে, মশাখালী চাইড়বাড়িয়া মাদ্রাসা, মাইজবাড়ি স্কুল মাঠ, দক্ষিণ হাড়িনা পার্বতীর মাঠ, দাওয়াদাইর প্রাইমারি স্কুল মাঠ, ছাপিলা মান্দারগড় প্রাইমারি স্কুল মাঠ, কুরচাই, তললী প্রাইমারি স্কুল মাঠ, অললী প্রাইমারি স্কুল মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং সেন্টার স্থাপিত হয়। এসব ট্রেনিং সেন্টারের নেতৃত্ব ও সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি সাইদুর রহমান সিরাজ, গফরগাঁও থানা ও ময়মনসিংহ সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মফিজুল হক চেয়ারম্যান, অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ, আরফান আলী চেয়ারম্যান, সাইদুর রহমান কামাল, শাহাদাত হোসেন মাস্টার, ইকবাল ই আলম কামাল এ কে এম নিজাম উদ্দিন মাস্টার প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মে-জুন মাসের দিকে সাইদুর রহমান সিরাজ, মফিজুল হক চেয়ারম্যান, অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ প্রমুখ কসবা সি অ্যান্ড বি ব্রিজ পার হয়ে আগরতলা হাঁপানিয়া যুব শিবিরে যান। সেখানে সাইদুর রহমান সিরাজ যমুনা যুব শিবিরে উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আবার সোনার বাংলা যুব শিবিরের চিফ ও ডেপুটি চিফ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে- অধ্যাপক শামসুল হুদা এম এন এ ও অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ। মফিজুল হক ও গিয়াস উদ্দিন মাস্টার পলিটিকাল মটিভেটর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ট্রেনিং কার্যক্রম শেষ হলে ৩নং সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান মফিজুল হককে গফরগাঁও থানা মুক্তিবাহিনীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেন। তার ওপর ফজলুল হক কোম্পানি, হাবিবুল হক মন্টু কোম্পানি ও এম এ কাদির কোম্পানির দায়িত্ব ন্যস্ত করে গফরগাঁও ও ভালুকা অঞ্চলে পাঠিয়ে দেন। শুধু মফিজুল হক নয় তার সহোদর দুই ভাই বজলুল হক ও জহিরুল হক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে জহিরুল হক নভেম্বর মাসের ২০ তারিখ ভালুকা অঞ্চলের ৯নং বাঁধ এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে শহীদ হন। গফরগাঁও অঞ্চলের তিনজন কোম্পানি কমান্ডারের মতো চতুর্থ কোম্পানি কমান্ডার ইকবাল ই আলম কামালের বাড়িও পাগলা থানায়।

গফরগাঁও উপজেলার তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগ মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান পাগলা থানার ৮ ইউনিয়নের বাসিন্দা। গফরগাঁও-এর অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে বর্তমান পাগলা থানার বিভিন্ন অঞ্চলে।

পাগলা থানা এলাকায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। ১ সেপ্টেম্বর ইকবাল ই আলম কামালের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী রাজাকার ক্যাম্প দখল করে। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, বিস্ফোরক ও রসদ দখল করে। যুদ্ধে মাইজউদ্দীন ফকির নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সেপ্টেম্বর মাসের ১১-১২ তারিখ ইকবাল ই আলম কামালের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী বাগেরগাঁও- বাকশীতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এই যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তান বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। এই যুদ্ধে আবদুল মজিদ, আবদুর রশিদ, আবদুস সাহিদ, মহর চাঁদ, মনিন্দ্র মোদক, আবদুল হাই, আফাজ, মফিজসহ ১১ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হন। ১৭ সেপ্টেম্বর ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানি দক্ষিণ পাড়ায় একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে মোবারক ও আলাউদ্দীন নামে দুজন শহীদ হন। ২৪-২৫ সেপ্টেম্বর সীমাখালীর দ্বিতীয় যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর মাহতাব ও মান্নান শহীদ হোন। উস্থি- নয়াবাড়ির যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তান বাহিনীর কয়েকজন সদস্য নিহত হন। পরবর্তীতে ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানি পাকিস্তান বাহিনীর বারইগাঁও ক্যাম্পে আকাশ করে সাফল্য পায়। ৯ ডিসেম্বর মুক্ত গফরগাঁওয়ে ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানির নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা উত্তোলন করেন।

অন্যদিকে গফরগাঁও থানা মুক্তিবাহিনীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা মফিজুল হক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ফজলুল হক কোম্পানি ও হাবিবুল হক মন্টু কোম্পানি অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ভারত থেকে ট্রেনিং গ্রহণ করে মফিজুল হক, ফজলুল হক ও মো. সেলিমের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি নিয়ে গফরগাঁও-পাগলা ও ভালুকায় পদার্পণ করেন। তন্মধ্যে দুটি সেকশন ভালুকার মেজর আফসার উদ্দিনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মফিজুল হক চেয়ারম্যান, ফজলুল হক ও এম এ সেলিম মূল বাহিনী নিয়ে প্রসাদপুর ওমর মেম্বারের বাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করেন। এই ঘাঁটি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ফরচুঙ্গি - শিলার রেলব্রিজে ও মশাখালী স্টেশনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক সাফল্য পায়। মশাখালী রেলস্টেশনের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কাছে ৬৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করেন। কিছুদিন পর অতর্কিতে পাকিস্তান বাহিনী ওমর মেম্বারের বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুললেও আক্রমণের তীব্রতায় একপর্যায়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে হেলাল নামে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

ইব্রাহিম খান একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তান বাহিনী কাওরাইদ থেকে রওনা হয়ে নিগুয়ারী গৈয়ারপাড়ের রয়ান বিল পর্যন্ত অগ্রসর হলে শিলানদীর তীরে গৈয়ারপাড়ে অবস্থান নিয়ে স্টেনগান দিয়ে গুলি করে পাকিস্তান বাহিনী অগ্রগতিকে রোধ করেন। ১৯ নভেম্বর পাকিস্তান বাহিনী কাওরাইদ থেকে রওনা হয়ে নান্দিয়াসাঙ্গন- নিগুয়ারী খান বাড়ি হয়ে ত্রিমোহনীতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী তললী চৌকিদার বাড়ির ঘাট হয়ে সুতারচাপরে আশ্রয় নেয়। সেখানেও পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এই যুদ্ধে আ. রাজ্জাক, সালাহউদ্দিন, সুলতান ও মান্নানসহ অন্তত ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষ শহীদ এবং নিহত হন। একই দিন পাকিস্তান বাহিনী নিগুয়ারীতে অপারেশন শেষ করে কাওরাইদ ফিরে যাওয়ার পথে হাবিবুল হক মন্টু কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধারা কেল্লারপাড়ে পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থানের ওপর একটি সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত ও আহত হয়।

নভেম্বর মাসে মোশাররফ হোসেন রতনের নেতৃত্বে শিলার বাজার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। একপর্যায়ে পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় মুক্তিবাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। মোশারফ হোসেন রতন একটি পুরাতন কবরে আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচায়। যুদ্ধে আবদুল আওয়াল ঝানু, সিদ্দিকুর রহমান চানুসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২০ নভেম্বর ফটুয়ার টেকে পাকিস্তান বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে ফজলুল হক কোম্পানি, হাবিবুল হক মন্টু ও ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানির যৌথ নেতৃত্বে গয়েশপুর বাজারে পাকিস্তান বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় হলেও মহর আলী, আবদুস সাত্তার, আ. কাদের ও নিজাম উদ্দিনসহ মোট ১১ জন শহীদ হন।

স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের চারণভূমি পাগলা থানায় কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি- উন্নয়ন সাধিত হয়নি। পাগলা থানার সমন্বিত উন্নয়নে নিম্নোক্ত সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করছি-

(১) সর্বাগ্রে পাগলা থানাকে উপজেলায় উন্নীত করতে হবে। (২) কিশোরগঞ্জ হতে হোসেনপুর, পাকুন্দিয়া, পাগলা ও কাওরাইদ হয়ে টাঙ্গাইল পর্যন্ত নতুন রেললাইন স্থাপন করতে হবে। (৩) পাগলা বাজারে একটি সরকারি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (৪) দত্তের বাজার ও পাকুন্দিয়ার মধ্যে সংযোগ সৃষ্টির জন্য পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর সড়ক সেতু নির্মাণ করতে হবে। (৫) পাগলা এলাকায় গ্যাস সংযোগসহ একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (৬) পাগলা থানায় আইটি পার্ক নির্মাণ করতে হবে। (৭) পাগলা থানার অভ্যন্তরীণ নদী-খাল ও সড়কপথ সংস্কার করতে হবে।

উপরোক্ত দাবিসমূহ বাস্তবায়নের মধ্যে পাগলা থানার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নিহিত। অন্যথায় এ অঞ্চলের গণমানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল পৌঁছাবে না। সব অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে নিহত গণমানুষ, নিপীড়িত মা-বোন প্রত্যেকের অতৃপ্ত আত্মা গুমরে গুমরে কেঁদে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন তাদের কাছে অর্থবহ না হয়ে ব্যর্থ বলে পরিগণিত হবে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্বপ্নের মধ্যে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নিশ্চিত করা, উন্নয়ন বৈষম্য নিরসন করা ও সবার জন্য সমান সুযোগ অধিকার নিশ্চিত করা। পাগলায় এসব সূচকের কোনোটি পূরণ হয়নি। বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট সব মহলকে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, পাগলা উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক


পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আবুল কাসেম ভূঁইয়া

বাংলাদেশের এক বিশাল অংশ নিয়ে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলো গঠিত। পুরো বাংলাদেশের দশ ভাগের এক ভাগ এলাকা এখানে অবস্থিত। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলো এখন এক সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে রামগড়, খাগড়াছড়ি, কাপ্তাই, বান্দরবান, চন্দ্রঘোনা, লামাসহ বিভিন্ন এলাকা রয়েছে। এসব এলাকাগুলোর অবস্থা এখন আর আগের মতো নেই। গত কয়েক দশক আগেও এসব এলাকার পাহাড়গুলো অনাবাদি অবস্থায় ছিল। ৮০-র দশকের পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলগুলোকে আবাদের আওতায় আনা হয়। পাহাড়গুলো আবাদ করে প্রথমে রাবার চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। রাবার চাষে সফল হওয়ায় অনেকেই রাবার চাষে এগিয়ে আসে। সরকার পাহাড়গুলো লিজের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করলে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে রাবার একটি শিল্পে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে কয়েক লাখ একর জমিতে রাবার চাষ করা হচ্ছে। প্রতি বছর এখানে ছয় হাজার মেট্রিক টন রাবার উৎপন্ন হচ্ছে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত প্রাকৃতিক রাবার দেশের রাবারের চাহিদা অনেকখানি মেটাচ্ছে। বর্তমানে রাবারের উৎপাদন যে হারে বাড়ছে তাতে বিদেশ থেকে রাবার আমদানির প্রয়োজন হবে না। বরং আমাদের দেশে উৎপাদিত রাবার বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত রাবারকে সাদা স্বর্ণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। কারণ এই রাবার আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখছে। ৮০-র দশকের পর থেকে এ পর্যন্ত চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে যেভাবে পাহাড়ে আবাদ শুরু হয় তাতে পার্বত্যাঞ্চল অনেক এগিয়ে গেছে। এখানে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল বাগান। পাহাড়ের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে ফলজ, বনজ বাগান গড়ে তোলা হচ্ছে। রাবার বাগানগুলোতে উন্নতজাতের আমের বাগান গড়ে তোলা হচ্ছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ছোট-বড় প্রায় পাঁচ হাজার আমের বাগান রয়েছে। আমের মৌসুমে এখানে উন্নতজাতের আম্রপালি উৎপন্ন হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় প্রতি বছর এখানে পাঁচ হাজার মেট্রিক টন আম্রপালি আম উৎপন্ন হয়। এই আম আমাদের আমের চাহিদার অনেকাংশ পূরণ করছে। এখানকার আমচাষিরা জানান আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলো আম্রপালি আম উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে। বিদেশি আমের ওপর আর নির্ভর করতে হবে না। এখানে আমের বাগানের সম্প্রসারণের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলে আম চাষের পাশাপাশি কাঁঠাল, লিচু, মালটা, কমলা, সফেদা কাজুবাদাম ড্রাগন ফলসহ আদা, হলুদের চাষ করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যান্য ফলনের মধ্যে অত্যন্ত সুস্বাদু ফল কাজুবাদাম চাষের জন্য আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলগুলো সম্ভাবনাময় স্থান হিসেবে ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। বিদেশি ফল কাজুবাদাম চাষের ব্যাপারে আমাদের দেশের কৃষিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। এ ব্যাপারে তারা সফলও হয়েছেন। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে রামগড়, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবান, লামাসহ বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে অনেক বাগানের মালিক সীমিত পর্যায়ে কাজুবাদামের চাষ করে ভালো ফলন পাচ্ছেন। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় ৮০-র দশকের দিকে সর্বপ্রথম রামগড় এলাকায় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কাজুবাদাম চাষের উদ্যোগ নেয়। সেই উদ্যোগ সফল হওয়ার পর অনেকেই কাজুবাদাম চাষে এগিয়ে আসে। কৃষি কর্মকর্তারা জানান চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের মাটি, আবহাওয়া এবং পারিপার্শিক অবস্থা কাজুবাদাম চাষের জন্য উপযুক্ত। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদিত কাজুবাদাম বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। পার্বত্যাঞ্চলে উৎপাদিত কাজুবাদামগুলো বিদেশি কাজুবাদামের মতো উন্নত। তবে এখানে উন্নত প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকায় কাজুবাদামগুলো ক্রেতাদের সহজে আকৃষ্ট করছে না। সম্পূর্ণ হাতে বাদামের খোসা ছাড়ানোর কারণে এমনটি হচ্ছে। মেশিনে বাদামের খোসা ছাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া গেলে এসব কাজুবাদামও বিদেশি কাজুবাদামের সমতুল্য হতো। এ ব্যাপারে কাজুবাদাম চাষিরা উদ্যোগ নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত কাজুবাদাম ঢাকা, চট্টগ্রামের বিভিন্ন ফলের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে। বিদেশি কাজুবাদাম প্রতি কেজি ১১০০-১২০০ টাকায় বিক্রি হয় আর সেখানে আমাদের দেশে উৎপাদিত কাজুবাদাম বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৬০০-৭০০ টাকায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কাজুবাদাম চাষের ব্যাপারে বিভিন্ন শিল্পোদ্যোক্ততা, এনজিও সংস্থা, কৃষিবিভাগ এবং সরকার বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় কাজুবাদাম চাষে উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকায় এবং দামি ফল হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন বাগানে ইতোমধ্যে ব্যাপক ভিত্তিতে কাজুবাদাম চাষের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলগুলোতে অনেক পরিত্যক্ত খালি জায়গা পড়ে আছে। এসব জায়গায় কাজুবাদাম চাষের ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলে অনেক উদ্যোক্ততা এগিয়ে আসবেন। দামি ফল কাজুবাদাম উৎপাদন করে দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করার উদ্যোগ নেওয়া যাবে। এতে অনেক কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হবে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে কাজুবাদামের পাশাপাশি দামি মসলা গোলমরিচ চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় গোলমরিচের চাষ শুরুর ব্যাপারে সরকারিভাবে সাহায্য-সহযোগিতা এবং উৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় ষাটের দশকের দিকে বাংলাদেশে গোলমরিচের চাষ শুরু হয়। তখন সিলেট অঞ্চলে বসতবাড়িতে কিছু কিছু গোলমরিচের গাছ ছিল। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক জৈন্তিয়া গোলমরিচ জাতটি ১৯৮৭ সালে উদ্ভাবিত হয়। যা বারিগোল মরিচ-১ নামে পরিচিত। এ ছাড়া কারিমুন্ডা, বালনকাট্টা আরকুলপাম মুন্ডা প্রভৃতি জাতের গোলমরিচ রয়েছে। সাধারণত গোলমরিচের চারা ডালের কলম থেকে তৈরি করা হয়। কৃষিবিজ্ঞানীরা জানান বাংলাদেশের মাটি এবং জলবায়ু গোলমরিচের চাষের জন্য উপযোগী। আর্দ্রতাযুক্ত স্থানে গোলমরিচের চাষ ভালো হয়। গোলমরিচের চারা এমন স্থানে রোপণ করতে হবে যেখানে পানি জমতে না পারে। এ জন্য পাহাড়ি এলাকায় গোলমরিচের চাষ ভালো হয়। গাছের কাটিং কলমের চারা রোপণ করতে হয়। বড় বড় গাছ যেমন- আম, কাঁঠাল, বাঁদি গাছের গোড়ায় গোড়ায় গোলমরিচের চারা রোপণ করা হয়। উচ্চমূল্যের মসলা গোলমরিচের চাষের ব্যাপারে আমাদের দেশে যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তাতে যদি সফল হওয়া যায় তবে বিদেশ থেকে আর গোলমরিচ আমদানি করতে হবে না। এ ব্যাপারে সরকারিভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করা হচ্ছে। গোলমরিচ চাষে আমরা যদি সফল হই তবে দেশের গোলমরিচের চাহিদা অনেকটা মিটে যাবে। বিদেশ থেকে আর গোলমরিচ আমদানি করতে হবে না। পার্বত্য এলাকায় গোলমরিচ চাষের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে। আমরা আশা করি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের উদ্যোগ সফল হবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভিত্তিতে গোলমরিচ চাষের ব্যাপারে সরকারকে আরও তৎপর হতে হবে। তবেই দেশে গোলমরিচের উদ্যোগ সফল হবে। আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে জনপ্রিয় পানীয় কফি চাষের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কৃষি বিভাগ জানায় খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি তিন পার্বত্য জেলাসহ দেশের ২২টি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে কফি এবং কাজুবাদাম চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কফি এবং কাজুবাদামের উৎপাদন ভালো হলেও চাষিরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করে প্রাপ্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা কাজুবাদাম এবং কফি চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বর্তমানে কফি এবং কাজুবাদামের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কৃষকদের কফি এবং কাজুবাদামের চাষের ব্যাপারে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ঋণের ব্যবস্থা করেছে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে কফি চাষের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ বিদ্যমান। পাহাড়ের অনাবাদি এক লাখ হেক্টর জমিতে কফি চাষ করতে পারলে ২ লাখ টন কফি উৎপাদন সম্ভব। যার বাজারমূল্য দাঁড়াবে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। জানা যায় চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ৫ লাখ হেক্টর পতিত জমি রয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ হেক্টর জমিতে কফির চাষ করতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। সরকারের গৃহীত প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে ১৬ উপজেলায় গবেষণা কার্যক্রম চলছে। কফি এবং কাজুবাদামের সম্ভাব্যতা যাচাই কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া খাগড়াছড়িতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, হিমাগার, গুদাম স্থাপন, বান্দরবানে কার্যালয়, রাঙামাটির রায়খালীতে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র বীজ উদ্ভাবন, সংরক্ষণসহ প্রকল্পের কাজ চলছে। সরকার বিশ্ববাজারের চাহিদার কথা বিবেচনা করেই কফি এবং কাজুবাদাম উৎপাদন বৃদ্ধি করতে ২১১ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে যারা ইতোমধ্যেই কফিচাষের উদ্যোগ নিয়েছেন তারা জানান আমরা গত কয়েক বছর ধরে এখানে কফিচাষের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এতে আমরা সফলও হয়েছি। কারণ এখানকার জলবায়ু এবং মাটি কফিচাষের জন্য খুবই উপযুক্ত। উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় কফি উৎপাদন ভালো হয়। কফি বীজ এবং কফির গুঁড়া (পাউডার) উচ্চমূল্যে হওয়ার কারণে কফিচাষিরা কফিচাষে এগিয়ে আসছেন। ব্যাপকভিত্তিতে কফিচাষ হলে আমাদের দেশে কফির উৎপাদন বেড়ে যাবে এবং দেশের কফির চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। বিদেশ থেকে উচ্চমূল্য দিয়ে আর কফি আমদানি করতে হবে না। কফিচাষিরা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির আশা করছেন। কফিচাষে এতদিন কৃষক বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভুগছিলেন। মূলধন সমস্যা, প্রশিক্ষণের অভাব, ভালো চারার অভাবসহ বিভিন্ন সমস্যা। বর্তমানে সরকার কফিচাষিদের এসব সমস্যা সমাধান করে অধিক পরিমাণে জমিতে কফিচাষের জন্য উৎসাহিত করছেন। সরকার এবং দেশের কফিচাষিরা আশা করছেন দেশে কফিচাষের ব্যাপারে বর্তমানে যে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা অবশ্যই সুফল আসবে। আশা করা যায় সবকিছু অনুকূলে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ কফি উৎপাদনে উল্লেখ করার মতো দেশ হিসেবে চিহ্নিত হবে। আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় থাকলাম। শুধু তাই নয়- পাহাড়ে উৎপাদিত সবজি আমাদের সবজির চাহিদা অনেকখানি মেটাচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলগুলোর লেকগুলোতে মাছের চাষ করে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। লেকে উৎপাদিত মাছগুলো মাছের চাহিদা অনেকখানি মেটাচ্ছে। পাহাড়ি অঞ্চলে অনেকেই আবার গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি বাণিজ্যিকভাবে লালন-পালন করে অনেকেই লাভবান হচ্ছেন। মোট কথা চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলো এখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। পরিত্যক্ত পাহাড়গুলোতে এখন সোনা ফলছে। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশাল এলাকা রয়েছে। সরকার যদি এসব এলাকাগুলোকে উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় লিজের মাধ্যমে জমি বিতরণের মাধ্যমে পাহাড়ে আবাদ করা হয় তবে আগামী দশ বছরের মধ্যে এই অঞ্চল দেশের সেরা অর্থনৈতিক জোন হিসেবে গড়ে উঠবে। বর্তমানে যেসব এলাকা এখনো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সেগুলো আবাদের উদ্যোগ নিয়ে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুতের ব্যবস্থা, পানির ব্যবস্থা করতে পারলে অনেক সুফল পাওয়া যাবে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোর ব্যাপারে সরকার পৃথকভাবে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে এখানকার কৃষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ, স্বল্পসুদে অথবা বিনা সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা, জায়গা লিজের ব্যাপারে সহজীকরণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির সমৃদ্ধির পথ সুগম হবে। এ জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। পাহাড়ে যেভাবে আবাদ হচ্ছে তা অব্যাহত রাখা জরুরি। এখানে নতুন অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠলে অনেক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।

লেখক: অর্থনৈতিক বিষয়ক প্রাবন্ধিক


পর্যটন সম্ভাবনা ও বাংলাদেশ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আবদুস সামাদ ফারুক

কবিগুরুর অনন্য পঙ্তিমালা আমাদের জীবন পরিক্রমায় পরম সত্য। আমাদের আশি বছর কিংবা বড়জোর এক শ বছরের জীবন চলে যায় কিন্তু দেখা হয় না স্বদেশ, বিশ্ব তো বহু দূরের পথ।

ষড়ঋতুর রূপ-বৈচিত্র্যমাখা বাংলাদেশে দেখার রয়েছে অনেক নিরুপম সৌন্দর্য ও সুযোগ। নদীমাতৃক দেশে শত নদীর মিলন বিরহ গাঁথা আমাদের জীবন-জীবিকা, সাহিত্য, সংগীত, সিনেমায় অপরূপ আলোকোজ্জ্বল প্রভা ফেলেছে।

পাহাড়, নদী, ঝর্ণা, বন-উপবন, সমুদ্র, দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ, একেক ঋতুতে একেক ধরনের ফসল, উজ্জ্বল সূর্যের নিচে মানুষের জীবনসংগ্রাম, নীল আকাশের নিচে জীবন-আনন্দ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রত্নতত্ত্ব, সংগীত, নৃত্যকলা, নাটক কত বিচিত্র-বৈচিত্র্যে ভরা বাংলাদেশ। বরফ পতন, তুষার ঝড় আর আপেল বাগান ছাড়া পর্যটনের সব উপাদান রয়েছে এই পলল ভূমিতে।

বিশ্বে ৫টি খাত ব্যাপকভাবে এবং বহুমাত্রিকতা নিয়ে আবির্ভূত হয়ে অর্থনীতি ও সমাজজীবনে গতির সঞ্চার করছে। উল্লিখিত ৫টি খাতের একটি হচ্ছে ট্যুরিজম। বিশেষত ডোমেস্টিক ট্যুরিজম বা অভ্যন্তরীণ পর্যটন। চলমান প্রেক্ষাপটে ‘ট্যুরিজম বাবল’ শব্দটি খুবই প্রচলিত এবং জনপ্রিয় যা আন্তদেশীয়-উপমহাদেশীয় বা মহাদেশ বিবেচনায় জোট বা আঞ্চলিক পর্যটনকে নির্দেশ করে।

প্রায় ১৭০ মিলিয়নের বিশাল জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশে ৮টি বিভাগকে কেন্দ্র করে এই ‘ট্যুরিজম বাবল’ বা আঞ্চলিক পর্যটনের নতুন মাত্রা ও বিস্তার ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটাতে হবে। পর্যটনের মাধ্যমে সাফল্য লাভের সম্ভাবনাময় সফল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম হওয়ার কারণ বহুবিধ। পর্যটন সম্ভাবনা বিবেচনায় বাংলাদেশকে বলা হয় ‘ইউনিক ডেল্টা অফ সেভেন টিএ (7TA or Seven Tourist Attractions)। এই সেভেন টিএ হচ্ছে নদী, সমুদ্র, পাহাড়, বন-উপবন, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, ঋতু বৈচিত্র্য এবং আতিথেয়তা।

অর্থাৎ কোনো স্থানে বা কোনো দেশে এই সেভেন টিএ-এর একটি যদি উপস্থিত থাকে পর্যটনের জন্য তাকে বলা হয় GOOD, যদি দুটি থাকে তাকে বলা হয় BETTER, আর যদি দুইয়ের অধিক থাকে তবে বলা হয় BEST। সেই বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে BEST++++। ২০২১ সালে বাংলাদেশে ডোমেস্টিক টুরিস্ট ট্রিপস ছিল প্রায় আড়াই কোটি। বিভিন্ন সূত্রের তথ্যানুযায়ী এই পর্যটকদের গড় খরচের পরিমাণ ছিল ৭-১২ হাজার টাকা। একই সময়ে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যক পর্যটক নানা কারণে বিদেশ ভ্রমণ করেন। যার মধ্যে ভারতে যান প্রায় ২৯ লাখ বাংলাদেশি পর্যটক, থাইল্যান্ডে যান ৫ লাখ, মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেন প্রায় ৩ লাখ, সিঙ্গাপুর যান ২ লাখ, নেপাল-ভুটান-শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন প্রায় ১ লাখ মানুষ। প্রতি বছর শুধু যুক্তরাজ্য থেকে সিলেটে আসেন ১.৫ লাখ বাংলাদেশি ব্রিটিশ নাগরিক, পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে বিয়ে, উৎসব, পারিবারিক ছুটি কাটাতে দেশে ফেরেন আরও ২০ লাখেরও বেশি প্রবাসী, বাংলাদেশের পর্যটন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব, দুর্বল প্রচারের কারণে উল্লিখিত প্রবাসীদের একটি বড় অংশ পারিবারিক ভ্রমণে বোনাস হিসেবে মেডিকেল চেকআপ, বিয়ে পরবর্তী হানিমুন উদ্‌যাপন কিংবা অবসর উপভোগ করতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় ভ্রমণে চলে যান। এরা সেখানে মোটাদাগে খরচ করেন, প্লেনে ওঠেন, স্টার হোটেলে থাকেন, ভালো খাবার খান, উপহার কেনেন।

ঈদ, পূজা বা নানারকম ছুটির সময় আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যারা বেড়াতে যেতেন, আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই সংস্কৃতি বদলে গিয়ে এখন তিন দিনের ছুটি পেলেও মানুষ দেশের কোনো পর্যটনস্থান বা নিকটতম দেশগুলোতে পরিবার নিয়ে বেড়াতে যান। অর্থাৎ সামগ্রিক বিচারে একটি পর্যটন বিপ্লব চলমান রয়েছে। জাতিসংঘের পর্যটনবিষয়ক অঙ্গসংগঠন ইউএনডব্লিউটিও ইতোমধ্যে আভাস দিয়েছে বিশ্বে অচিরেই ‘ডোমেস্টিক পর্যটন ট্র্যাফিক’ সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির সেরা পেনাল্টি শুট পর্যটন:

আজকের পৃথিবীতে একক বৃহত্তম এবং দ্রুত বর্ধনশীল শিল্প হিসেবে ট্যুরিজম স্বীকৃত। পৃথিবীর পরীক্ষিত, প্রমাণিত এবং প্রতিষ্ঠিত পরিসংখ্যান বলছে পর্যটন ১০৯টি শিল্পকে সরাসরি প্রভাবিত করে, চালিত করে, প্রসারিত করে। সঙ্গে রয়েছে আরও ১১০০ উপখাত। একজন পর্যটক বা ট্যুরিস্ট যখন কোথাও যান তিনি যাতায়াতের জন্য যানবাহন ব্যবহার করেন, প্লেনে ওঠেন, হোটেলে থাকেন, চাল-ডাল-রুটি-চিকেন-এগ-মিল্কসহ নানাকিছু আহার করেন, স্থানীয় পণ্য কেনাকাটা করেন। অর্থাৎ একজন ট্যুরিস্টের আগমনের ফলে অনেক ভোগ, উপভোগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন হয়। পরিবহনে তিনি অর্থ ব্যয় করেন। হোটেলে সাবান-শ্যাম্পু-টাওয়েল-বেডশিট, চিরুনি, কটন বাডস, কাপ-পিরিচ, গ্লাস, টিস্যু, বাস্কেট, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহার করেন। নানা রকম খাদ্য উপভোগ করেন। ফিরে যাওয়ার আগে বিভিন্ন প্রকার উপহার সামগ্রী ক্রয় করেন। এ সব কার্যক্রমের ফলে যাতায়াতের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানি, হোটেল, স্থানীয় ব্যবসায় ও সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরিভাবে ব্যবসা করতে পারছে। আবার সাবান-শ্যাম্পু-টুথপেস্ট ফ্যাক্টরি বা টাওয়েল-বেডশিট ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত উৎপাদক, কর্মী, সরবরাহকারীসহ সংশ্লিষ্টরাও পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছেন। অর্থাৎ একজন ট্যুরিস্টের আগমন ও উপস্থিতি কৃষি, পোলট্রিসহ নানাবিধ শিল্প উৎপাদনে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা রাখে।

একই সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে দেশের উন্নতি ও মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে গতির সঞ্চার হয়। অর্থাৎ একজন ট্যুরিস্টের আগমনের ফলে অনেক ভোগ, উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন হয়। পৃথিবীতে চলমান নানা দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক বিপত্তির কারণে বহু মানুষ কর্মহীন হওয়ার পরেও পর্যটনক্ষেত্রে প্রতি আড়াই সেকেন্ডে একটি করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। একজন পর্যটকের আগমনে সেবাখাতে ১১ জন মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়। পরোক্ষভাবে কাজ পান আরও ৩৩ জন। অর্থাৎ ১ লাখ পর্যটকের আগমনের সঙ্গে ১১লাখ কর্মসংস্থান যুক্ত। কোনো স্থানে যদি ১০ লাখ নিয়মিত অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক পর্যটক থাকে সেখানে স্থায়ী কর্মসংস্থান হয় ১ কোটি ১০ লাখ লোকের। ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে এটি আরও ব্যাপকভাবে হচ্ছে, কারণ এই জনগোষ্ঠীর ৬০ ভাগ হচ্ছে তরুণ।

সুতরাং আসন্ন দিনগুলোতে পর্যটনের এই অপার সম্ভাবনা হচ্ছে সত্যিকারভাবেই বাংলাদেশের আর্থিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক দারুন ‘পেনাল্টি শুট’। ফুটবল খেলায় ‘পেনাল্টি শুট’ পাওয়া জয়লাভের জন্য যেমন বড় সুযোগ, বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে চলমান বিশ্বক্রাইসিস ‘পেনাল্টি শুট’ অপরচুনিটি হিসেবে আমাদের দুয়ারে অপেক্ষমাণ। এই অমূল্য পেনাল্টি শুটে গোল করার নেতৃত্বদানকারী শুটার হচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দেশভেদে পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ১১ থেকে ১৩টি, বাংলাদেশে এই সংখ্যা ২৩টি, বিভাগ রয়েছে ৫৫টি।

ফলে এ ধরনের শুটে গোল করার জন্য কুশলী খেলোয়াড় হওয়াই যথেষ্ট নয়, কৌশলী খেলা উপহার দেওয়ার মতো সাহস ও সৃজনশীল পারদর্শিতা থাকাও অপরিহার্য। পরিস্থিতি এবং স্থান-কাল-পাত্রভেদে নিত্যনতুন ট্যাকটিস এবং প্রাকটিস প্রয়োগ করার মতো ওনারশিপ, নেতৃত্বদক্ষতা ও উদ্যোগ থাকতে হবে তাহলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হবে। ২০২০ সালে বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন তাদের এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যেখানে উল্লেখ রয়েছে পর্যটন খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পৃথিবীর সব দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। যদিও আমাদের দেশে এই চমৎকার সংবাদটি উৎকৃষ্টরূপে প্রকাশ ও প্রচার হয়নি।

বাংলাদেশে দেখার কী আছে?:

বাংলাদেশে রূপ-রস-গন্ধে ভরা যে বহু বৈচিত্র্যময় পর্যটন আকর্ষণ বা গন্তব্য, সংস্কৃতি, উৎসব, আয়োজন ইত্যাদি রয়েছে তার সংখ্যা ২৩৪৬টি। লালন উৎসব, পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্রজয়ন্তী, গঙ্গা স্নান, বিশ্ব ইজতেমা, ঈদ উৎসব, বড়দিন, দুর্গা উৎসব দেখা বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে গভীরভাবে। শুধু ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিবিষয়ক পর্যটন আকর্ষণ সংখ্যা ৫০০টির বেশি। দেশব্যাপী রয়েছে শতাধিক জাদুঘর বা মিউজিয়াম। ভিন্ন বৈশিষ্ট্যময় সমুদ্রসৈকত বা সি বিচ রয়েছে ১৯টি।

জলকেন্দ্রিক পর্যটন আকর্ষণ যার মধ্যে পৃথিবীর অদ্বিতীয় হাওরও রয়েছে, এমন সংখ্যা ২১৯টি। রিলিজিয়াস অ্যান্ড স্পিরিচুয়াল পর্যটন আকর্ষণ ৪৭৬টি। ৫৫টিরও বেশি বিশেষায়িত গ্রাম রয়েছে দেশজুড়ে। (আলজাক্স) বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, ষাটগম্বুজ মসজিদ, পাহাড়পুর, ওয়ারী বটেশ্বর, মহাস্থানগড়সহ রয়েছে বেশ কয়েকটি স্থাপনা যা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। সোনারগাঁয়ে রয়েছে হাজার বছরের প্রাচীন শহর পানাম নগর। এ ছাড়া মনকে ছুঁয়ে যাওয়া অকৃত্রিম আতিথেয়তাসহ অদেখা বহু স্থাপনা এবং রিসোর্ট রয়েছে অপরূপ এই বাংলাদেশে। নদীমাতৃক দেশে নৌপর্যটন এক বড় সম্ভাবনা। তা ছাড়া বঙ্গোপসাগরে দেশের দক্ষিণের দ্বীপগুলোতে পরিকল্পিতভাবে পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। সমুদ্রকেন্দ্রিক পর্যটনও একটি অসীম সম্ভাবনা। তা ছাড়া নৌপথে ঢাকা-কলকাতা কিংবা চেন্নাই-গুয়াহাটি পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

বর্ণিত পর্যটন আকর্ষণগুলোর আন্তর্জাতিক মান কেমন?

কক্সবাজার, পতেঙ্গা এবং কুয়াকাটা ছাড়া আমাদের অন্য ১৬টি সমুদ্র সৈকত সত্যিকারভাবে এখনো অনাঘ্রাত রয়ে গেছে। এগুলো ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যময়। পৃথিবীতে কোনো একটি স্থানে তা বিরল। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত কিয়ামা বিচে অনেকেই গেছেন। প্রশ্ন হতে পারে বিশ্বপর্যটন গন্তব্যের বিচারে বাংলাদেশের পর্যটন আকর্ষণ বা গন্তব্যগুলোর মান বা অবস্থান কী বা কী হতে পারে?

পৃথিবীময় সমুদ্র সৈকতে সাধারণত ঢেউয়ের মিছিল গর্জন করতে করতে তীরে আছড়ে এসে পড়ে। মানুষ সেই ঢেউয়ের সঙ্গে জলকেলি করে। ঝাপাঝাপিসহ সমুদ্রস্নানে মগ্ন করে। কিন্তু কিয়ামা বিচের ঢেউ আছড়েও আসে না, গর্জনও করে না। সেখানে সমুদ্রের জল নাচতে নাচতে তীরে আসে, তীরে এসে চুমু খায়, চুমু খেয়ে আবার চলে যায়। দিনভর মানুষ সমুদ্রতীরে বসে ফিশ অ্যান্ড চিপস খায় এবং নৃত্যরত সমুদ্রজলের তীরে আসা এবং চুমু খাওয়া উপভোগ করে।

বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কাট্টলি সমুদ্র সৈকতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার কিয়ামা বিচের মতো। একইভাবে গুলিয়াখালির সবুজগুচ্ছের ভেতর দিয়ে নেমে যাওয়া সমুদ্রের আরেক রূপ যে কোনো পর্যটককে বিস্মিত করবে। পারকি বা সাতক্ষীরার মান্দারবাড়িয়া বা বরগুনার লালদিয়া সমুদ্র সৈকতের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। যারা স্পেনের বিলবাও ভ্রমণ করেছেন তারা অনায়াসে বুঝবেন বাংলাদেশের সাজেক ভ্যালি হচ্ছে স্প্যানিশ বিলবাও ইন বাংলাদেশ। একইভাবে কাপ্তাইয়ের পলওয়েল পার্কের তুলনা চলে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ পার্কের সঙ্গে। ভরা বর্ষায় সীতাকুণ্ডের সপ্তসুর ঝর্ণার রূপ যারা দেখেছেন চোখ বুজে তারা বলবেন এটি বাংলাদেশের নায়াগ্রা জলপ্রপাত। স্বচ্ছ জলেঘেরা সুনামগঞ্জকে বলা হয় বাংলাদেশের কাশ্মীর।

গ্রীষ্মের বান্দরবান সামারের অনিন্দ্যসুন্দর সুইজারল্যান্ড হয়ে আবির্ভূত হয়। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির আটঘর কুরিয়ানা বা ভিমরুলিয়ার ভাসমান বাজার হার মানায় থাইল্যান্ড বা কেরালার ফ্লোটিং মার্কেটকে। এই উপজেলার ত্রিশটি গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা জলপথ ভ্রমণকারীকে বিখ্যাত ভেনিস বা আমস্টারডামের বোট ট্রিপের কথা মনে করিয়ে দেবে নিঃসন্দেহে।

চট্টগ্রামে ভাটিয়ারির একাংশ, ঢাকার অদূরে অবস্থিত পানাম নগরীকে আখ্যায়িত করা হয় বাংলার ব্যাবিলন বলে। অলওয়েদার সড়ক নির্মাণের পরে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম, নিকলি আর মিঠামইনের অপরূপ সৌন্দর্য এক কথায় জাদুময় স্পর্শে উদ্ভাসিত।

এলিফ্যান্ট থিওরি অ্যান্ড উইন্ডো ড্রেসিং মেথড ট্যুরিজম:

বাংলাদেশসহ সাফল্য সম্ভাবনায় থাকা দেশগুলোকে পর্যটনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা পেতে ‘এলিফ্যান্ট থিওরি অ্যান্ড উইন্ডো ড্রেসিং মেথড ট্যুরিজমকে বিবেচনায় নিতে হবে। যেকোনো দেশের পর্যটনকে বলা হয় হাতি; হাতির যেমন শুঁড় থাকে, মাথা থাকে, বিশাল শরীর, পা, লেজ থাকে, পর্যটনেরও তাই।

Destination, Service, Aviation, Entertainment, Relaxation-সহ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পর্যটনের বহুমাত্রিক বিভাজন সংখ্যা ২৫টিরও বেশি। এই সবগুলোকে বিবেচনায় নিয়েই এলিফ্যান্ট থিওরি পর্যটন’ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। উইন্ডো ড্রেসিং মেথড হচ্ছে যেগুলো যে অবস্থায় আছে সেগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী ঠিকঠাক করা, কিছু সংস্কার করা (যেমনটা ঘরে অতিথি এলে আমরা করি, ঘরের পর্দাগুলো ধুয়ে দিই, দেয়ালে ময়লা থাকলে রং করি, পাপোশটা পুরোনো হলে বদল করি, বিছানায় ধোয়া পরিষ্কার চাদর বিছাই, ভাত না করে পোলাও রান্না করি, অতিথির পছন্দ অনুযায়ী কিছু আয়োজন করি ইত্যাদি), এবং অবশ্যই এখানে অনুসরণীয় অগ্রাধিকার কনসেপ্ট বিবেচ্য হবে: গ্লোবাল সাসটেইনেবল ট্যুরিজম কাউন্সিল (জিএসটিসি) প্রণীত রীতি ও পদ্ধতি।

প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব:

সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থা, মিশন, সংগঠন, মিডিয়া ও সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখা ও প্রয়োজনীয় কুশলী ও কৌশলী উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব এবং কমপক্ষে তিন বছরের ধারাবাহিক যোগ্য নেতৃত্বই বাংলাদেশের পর্যটনকে সত্যিকারের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে নেওয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করবে। সরকারের সদিচ্ছা কাজে লাগিয়ে যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে পর্যটনে অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে যাবে এটাই প্রত্যাশা।

পর্যটনের অগ্রগামী করতে যারা যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন:

পৃথিবীর এক নম্বর পর্যটন দেশ ফ্রান্স কিংবা মুসলিম পর্যটনে শীর্ষে থাকা মালয়েশিয়ার পর্যটন সাফল্য নির্মাণে দুজন ব্যক্তি, বুরোক্র্যাট বা আমলা নেতৃত্ব দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

প্যারিস ইউরোপের অন্য দেশগুলোর মতোই ছিল। নেপোলিয়নের নির্দেশে ফরাসি পর্যটনকে বদলে দিয়েছেন একজন ফরাসি আমলা তার নাম জ্যজ ব্যারো ওসমান, তিনি প্যারিসকে এমনভাবে সাজিয়েছেন এবং নির্মাণ করেছিলেন যেন গোটা ইউরোপবাসী ফ্রান্সকে দেখতে আসে এবং তার সুফল আজ ফ্রান্স পাচ্ছে যেটা ২০১৯ এবং ২১ থেকে অজ পর্যন্ত প্রতি বছর প্যারিস ভ্রমণ করছেন প্রতি বছর ৯ কোটিরও বেশি বিদেশি পর্যটক। একইভাবে আমরা যদি মালয়েশিয়ার দিকে তাকাই মালয়েশিয়ার পর্যটনকে যিনি বদলে দিয়েছেন তিনি দাইম জয়নুদ্দিন। আমরা যদি নেপালের দিকে দেখি যে নেপাল আমাদের চেয়েও দরিদ্র দেশ সেই দেশে পর্যটনকে একটি উচ্চ জায়গায় নিয়ে গেছেন মিস্টার জোশী বা ভুটানে দর্জি কিংবা হালের শ্রীলঙ্কা, যারা অর্থনৈতিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে প্রায় ধ্বংসস্তূপে চলে গিয়েছিল সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে পর্যটনের মাধ্যমে দেশটিকে তুলে আনতে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি নন্দলাল বিক্রম সিংহ। সম্প্রতি ধনী দেশ সৌদি আরব তেলনির্ভরতা বাদ দিয়ে পর্যটনকেন্দ্রিক অর্থনীতির দেশ হতে চলেছে যেখানে আহমেদ আল খাতিবের নেতৃত্বে ২ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি পর্যটককে আতিথ্য দিয়েছে দেশটি হজ ছাড়া এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি বিদেশি পর্যটককে স্বাগত জানানোর মাধ্যমে পৃথিবীর নাম্বার ওয়ান পর্যটন কান্ট্রি হওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি তারা গ্রহণ করেছেন আহমদ আল খাতিব।

সৃজনশীল বহুমাত্রিক প্রচারণা, অল ইন ওয়ান:

এ বিবেচনায় ডেস্টিনেশন, নদী, হাওর, সমুদ্র, পাহাড়, বন, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, ঋতুবৈচিত্র্য, কুলিনারি, শপিং, লেইজার, স্পিরিচুয়াল, আন্তজেলা হেলথ, জাদুঘর, জমিদারবাড়ি, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, উৎসব ইত্যাদি বিষয়াদির সৃজনশীল বহুমাত্রিক প্রচার চালাতে হবে, তবে অবশ্যই সেটি ব্রুশয়ার জাতীয় ‘রুহআফজা’র মতো নিছক মিষ্টি প্রচারণা নয়, এটি হবে কোকাকোলার মতো ত্রিমাত্রিক প্রচার, যেখানে মিষ্টির সঙ্গে ঝাঁজ থাকবে এবং তৃপ্তির ঢেঁকুর উঠবে। এই লক্ষ্যে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সহজভাবে প্রচারণা সম্ভব। Youtube, Tik Tok-সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে Beautiful Bangladesh-কে বেশি বেশি করে উপস্থাপন ও প্রচার করতে হবে।

রিসার্চ, ট্রেনিং, এডুকেশন, ইনোভেশন এবং সংস্কার:

রিসার্চ, ট্রেনিং, এডুকেশন, ইনোভেশন, সেমিনার, অনুষ্ঠান ইত্যাদি কাজে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট ইউএনও এবং জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। নাগরিক সমাজকে সঙ্গে রাখতে হবে। পরে সময়ভেদে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে ওয়েবিনার, এক্সপো ইত্যাদি বিষয়ে একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কিছুক্ষেত্রে নীতি ও পদ্ধতির সংস্কার করা গেলে গোটা পর্যটন কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী ও গতিদান করবে। ইতোমধ্যে পর্যটন মন্ত্রণালয় যে মাস্টার প্ল্যান করেছেন তার বাস্তবায়ন আবশ্যক।

এসডিজি বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে পর্যটন সফলতা অত্যাবশ্যক:

বাংলাদেশ উচ্চমধ্যম আয়ের রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জনের পথে রয়েছে। একই সঙ্গে যে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করতে হবে তার মধ্যে ইউএনডব্লিউটিও-এর নির্ধারিত ৩টি এসডিডিজি সরাসরিভাবে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত। পরোক্ষভাবে সংযুক্ত আরও ১৪টি অর্থাৎ ১৬৯টি টার্গেটের প্রায় সবই যুক্ত। সুতরাং আগামী দিনে পর্যটনে ব্যর্থতার অর্থ দাঁড়াবে এসডিজি বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে ব্যর্থতা। সবকিছু মিলিয়ে আসন্ন সময়গুলোতে বাংলাদেশের জন্য পর্যটনক্ষেত্রে সামনে তাকানো, সফলতার পথে ছুটে চলা ও তা অর্জন করার উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ:

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কাজ অচিরেই সমাপ্ত হবে যা বছরে ১.২ কোটি যাত্রী পরিবহন করবে। কার্গো ও কোল্ড স্টোরেজ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। ১১৫টি চেক-ইন কাউন্টার, ৬৬টি অবতরণ ইমিগ্রেশন ডেস্ক, ৫৯টি আরোহণ ডেস্ক এবং ৩টি ভিআইপি কাউন্টার থাকবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সাহসী উদ্যোগ পর্যটন সেক্টরে নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটাবে।

তাছাড়া শৈল শহর কক্সবাজারে একটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর স্থাপন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আশা করা যায় বিভিন্ন দেশ থেকে সরাসরি ফ্লাইটে বিদেশি পর্যটকরা কক্সবাজারে আসবেন। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলওয়ে পথ নির্মাণ করা হয়েছে এবং কক্সবাজারে দৃষ্টিনন্দন ঝিনুক রেলস্টেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের জন্য এটি একটি বড় সুখবর। পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পর কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র অনেক বেশি জমজমাট হচ্ছে। তা ছাড়া সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলে নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্র সৃষ্টি হচ্ছে।

সর্বশেষ একথা বলা যায়, পর্যটকবান্ধব মানসিকতা সৃষ্টি এবং পর্যটনের যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা পরিবেশ সম্মতভাবে সংরক্ষণ করা আবশ্যক। বাংলাদেশের অপরূপ নৈসর্গকে পৃথিবীর কাছে উপস্থাপন করা দরকার। আমরা অবশ্য আশা করব বাংলাদেশের পর্যটনে রাঙা প্রভাতের উদয় হবে।

লেখক: সিনিয়র সচিব (অব.) নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং চেয়ারম্যান, গ্লোবাল সাসটেইনেবল ট্যুরিজম নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ


দেশীয় জাতের গাছ লাগান, সব জীবের প্রাণ বাঁচান

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আহমদ কবির রিপন

বাংলাদেশ সরকার এবং পরিবেশ ও জলবায়ু সংরক্ষণ বিভাগ কর্তৃক ১৯৯৯ সালে, হাকালুকি হাওরসহ কয়েকটি হাওর এলাকা, কক্সবাজার ও টেকনাফ সমুদ্রবন্দর এলাকাকে Ecologicaly Critical Area (ECA) ঘোষণা করেন। তারপর এসব এলাকার পরিবেশ সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে পরিবেশ অধিদপ্তর ও জলবায়ু সংরক্ষণ বিভাগ Costal Weatland Management Project (CWMP)-এর মাধ্যমে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষকে সংঘবদ্ধ করে গ্রাম সংরক্ষণ দল বা Village Conservation Group (VCG)-এর মাধ্যমে হাওর তীরবর্তী জলাভূমি, রাস্তার পার্শ্বের খালি জায়গা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনাতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। এই প্রজেক্টের ফলজ ও বনজ গাছ লাগানো হয়েছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় খালি জায়গা ও খাসজমিতে দেশীয় জাতের ফলজ ও বনজ গাছ লাগানো হলে, সেই সুফল আমরা ভোগ করতাম। খাদ্যের জন্য বন্য প্রাণী আজ লোকালয়ে আসত না। এখন বসবাসের জন্য অধিকাংশ প্রাণী লোকালয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। তা ছাড়া আরও কয়েকটি কুফলের বিষয় নিম্নে তুলে ধরছি:

(১) প্রথমে বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে ধ্বংস করে ইউক্যালিপ্টাস, মেহগনি, একাশিয়ামের মতো বিদেশি গাছের মনোকালচার করে মূলত বন বিভাগ ধ্বংস হয়েছে। বন বিভাগে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের অনবিজ্ঞ চিন্তাধারাতে বন উজাড় হয়েছে, পাশাপাশি বন্য প্রাণী, পশু-পাখির অভয়ারণ্যে নষ্ট হয়েছে। এখন প্রাণীগুলো খাদ্যের জন্য এদিগ-সেদিগ ঘোরাফেরা করছে। মোট কথা বন্য প্রাণী সংরক্ষণে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। এ ধরনের ভুল পরিকল্পনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বনাঞ্চল উজাড় হয়েছে। উল্লেখ্য, চীনের গোবি মরুভূমিতে চায়না বিশাল বাজেট করে কয়েক লাখের বেশি ম্যাপল/পাইনগাছ লাগিয়েছিল। সে গাছগুলো মরুভূমিতে সাহায্যকারী কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি, বরং বৃক্ষরোপণে টেকসই কাজে স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। এ কাজে দুটি ভুল স্পষ্ট হয়েছে যেমন-

(১) বর্ণিত এলাকায় দেশীয় জাতের গাছ না লাগানোর ফলে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়েছে, বন্য প্রাণীর খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে এবং প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

(২) ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে, জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে। পশুপাখিগুলো চাহিদামতো খাদ্য না পেয়ে এদিগ-সেদিগ ঘোরাফেরা করে, খাদ্যের অভাবে পশু-পাখির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। ফলজ গাছ না থাকাতে পশু-পাখি বাহিরে চলে আসে এবং গাছে ফুল ও ফল না ধরলে বংশবৃদ্ধি পায় না। বিদ্যমান প্রতিকূল আবহাওয়া পরিবর্তন ঘটাতে অঞ্চলভেদে মাটি পরীক্ষা সাপেক্ষে গাছ লাগাতে হবে। যেসব এলাকায় গাছ কম, ওই এলাকার ইকোসিস্টেম, বায়োটিক এবং এবায়োটিক এলিমেন্টের সঙ্গে পজিটিভলি ইন্টারেক্ট করবে।

আমাদের দেশের মাটির উর্বরাশক্তি এক সমান নহে। তাই সব জায়গাতে সব জাতের গাছপালা, ফলমূল ভালো হয় না। যেকোনো গাছ লাগানোর আগে মাটি পরীক্ষা করা উচিত। তখন এই মাটিতে কোন জাতীয় গাছ লাগালে টেকসই হবে, সহজে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। নতুবা সব প্রচেষ্টা বিফলে যাবে। আমাদের দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা না বুজে বিদেশি গাছ লাগাতে মানুষকে উৎসাহিত করেন। মানুষ আরেকজনের দেখে গাছ লাগাতে প্রতিযোগিতা করে। পরিশেষে ফলাফল শূন্য থাকে। Invasive আচরণে ইকোসিস্টেম স্থায়ীভাবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে রূপান্তর হয়। আমাদের দেশে Suckermouth fish যা করছে, রুই ও কাতলা (Carps) জাতীয় মাছে আমেরিকার নদ-নদীগুলোতে একইভাবে ধ্বংসযজ্ঞ করছে।

মেরু অঞ্চল ও সমতল তৃণভূমিতে যদি গাছ লাগানো হয়, তাতে সেখানে উষ্ণতা বাড়াবে। মেরু অঞ্চলের বরফ মূলত আয়নার মতো আলো প্রতিফলন করে। সেখানে যদি গাছ লাগানো হয়, তবে গাছের গায়ে অপ্রতিফলি রং তাপ শোষণ করে। অন্যদিকে তৃণভূমিতে তৃণভোজীদের বিচরণে ও খাদ্য গ্রহণে ক্রমাগত তৃণকে মাটির সারে রূপান্তর করে উক্ত তৃণমালাকে পুনরায় গ্রোথ স্টেজ শুরু করে, গাছ লাগালে তা একসময় তুলনামূলকভাবে ধীর হয়ে যায়। যে মাটিতে যে গাছ জন্মাবে, সেই মাটিতে সেই গাছ লাগানো উচিত। জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে মানুষ সতর্ক হবে, ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে মানুষ রক্ষা পাবে।

লেখক: পরিবেশকর্মী


বাতাস দূষণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মো. হুমায়ুন কবীর

সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় বাতাস দূষণ সম্পর্কে একটি ভয়াবহ সংবাদ বিবেকবান সব মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। খবরে প্রকাশ বিশ্বের বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৫৫ লাখ মানুষের মুত্যু ঘটে। এ সংখ্যা আমাদের নিকটবর্তী প্রতিবেশী চীন ও ভারতে সবচেয়ে বেশি। এ প্রসঙ্গে একটি পরিসংখ্যানে প্রকাশ, ২০১৩ সালে চীনে বায়ুদূষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ, আবার একই বছরে ভারতে এ সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ।

বাতাস হলো জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। বাতাস না থাকলে আমরা এক মুহূর্তের জন্যও বাঁচতে পারি না। আমাদের নিশ্বাসে ও প্রশ্বাসে শুধু প্রয়োজন বাতাস আর বাতাস। তবে সে বাতাস হওয়া চাই নির্মূল। না হলে দূষণের কারণে এভাবেই পাওয়া যাবে বাতাসে লাশের গন্ধ। ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরের দিকে যে গ্যাসীয় আবরণ সমগ্র পৃথিবীকে বেষ্টন করে রেখেছে তাকে বায়ুমণ্ডল বলে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যতই ওপরে ওঠা যায় বায়ুমণ্ডল ততই হালকা হতে থাকে।

বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উপাদানের ৯৭ শতাংশ পদার্থ ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২৯ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করলেও বিজ্ঞানীদের মতে, বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্বসীমা ভূপৃষ্ট থেকে ১০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের প্রধানত বিশুদ্ধ ও শুষ্ক উপাদান হলো দুটি; আর তা হলো- অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন। বায়ুমণ্ডলের চারটি স্তর রযেছে, সেগুলো হলো- ১. ট্রপোমণ্ডল বা ট্রপোস্ফেয়ার, ২. স্ট্রেটোমণ্ডল বা স্ট্রেটোস্ফেয়ার, ৩. মেসোমণ্ডল বা মেসোস্ফেয়ার ও ৪. তাপমণ্ডল বা থার্মোস্ফেয়ার। বায়ু ছাড়া পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং স্বল্প পরিমাণ নিষ্ক্রিয় গ্যাস যথা- আর্গন, হিলিয়াম, জেনন, ক্রিপ্টন ইত্যাদিকে বায়ু বলা হয়। এ উপাদানগুলো বাতাসের মধ্যে শতকরা হারের নির্দিষ্ট পরিমাণে থাকলে সেই বায়ুকে আদর্শ বায়ু বলা হয়।

আদর্শ বায়ুতে শতকরা হারে আয়ন হিসেবে নাইট্রোজেন-৭৮.০২ শতাংশ, অক্সিজেন-২০.৭১ শতাংশ, নিষ্ক্রিয় গ্যাস-০.৮০ শতাংশ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড-০.০৩ শতাংশ ও বাকি অন্যান্য গ্যাস রয়েছে। জীবের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য আদর্শমাত্রার এ বিশুদ্ধ বায়ু অত্যাবশ্যক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিভিন্ন কারণে প্রতিনিয়তই আমাদের নিত্যব্যবহার্য বায়ুদূষণ ঘটছে। আর বায়ুদূষণ বলতে বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন ধরনের ডাস্ট, ফিউম, গ্যাস, ঘনকুয়াশা, গন্ধ, ধোঁয়া, বাষ্প ইত্যাদি বায়ুদূষকের উপস্থিতিকে বুঝায়।

যে উপাদানগুলো বায়ুতে মিশ্রিত হলে বায়ুদূষণ হয় তাদের দূষক বলে। বায়বীয় দূষক যেমন- কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি। কণাজাতীয় দূষক যেমন- ধোঁয়া, ফিউম, ধুলাবালি, মিস্ট, কুয়াশা, ধোঁয়াশা ও এরোসল ইত্যাদি। রাসায়নিক জৈবদূষক যেমন- হাইড্রোকার্বন, অ্যালডিহাইড, কিটোন, অ্যামিন ও অ্যালকোহল ইত্যাদি। রাসায়নিক অজৈব দূষক যেমন- কার্বনেট, ক্লোরাইড ইত্যাদি।

অজৈব কণার মধ্যে রয়েছে- উড়ন্ত ছাই, বালি, এসবেস্টস, যানবাহনের ধুলাবালি, খনি ও অন্যান্য শিল্পকারখানার ধুলাবালি ইত্যাদি। আরও রয়েছে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও পরাগরেণুর মতো সজীব বায়ুদূষকও। আবার তেজস্ক্রিয় বায়ুদূষক যেমন- তেজস্ক্রিয় গ্যাস ও আলোক রাসায়নিক জারক ইত্যাদিই প্রধান। মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাবগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইসিমা, ফুসফুসে ক্যানসার, বন্ধ্যাত্ব ও জন্মত্রুটি ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব।

২০১৫ সালে প্যারিসে কপ-২১ সম্মেলন চলাকালেই আমাদের পার্শ্ববর্তী দুটি প্রতিবেশী দেশ চীন ও ভারতে বায়ুদূষণের জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হচ্ছিল। সেখানে বায়ুদূষণের বিষয়টি এমন বেগতিক হয়ে উঠেছে যে ঘন কুয়াশা, কলকারখানার কালো ধোঁয়া ও ধূলিকণার প্রভাবে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকায় এক নম্বরে হলো আমাদের এক প্রতিবেশী চীনের নাম, আর সেই তালিকায় দুই নম্বরেই রয়েছে আরেক প্রতিবেশী ভারতের নাম। তারপর তিন নম্বরে যুক্তরাষ্ট্র, চার বা তদোর্ধ্ব হলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশ।

মোট কার্বন নিঃসরণকারী দেশের মধ্যে চীন এককভাবে যোগ করে ২৪ শতাংশ আর ভারত করে থাকে কমপক্ষে ৭ শতাংশ। কিন্তু সে হিসাবে যদিও আমাদের রাজধানী ঢাকার বাতাসে দিল্লি কিংবা চীনের মতো দূষণ নেই, তার পরও একেবারে হাত গুটিয়ে বসে থাকার পরিস্থিতিতেও নেই। জানা যায়, বিগত ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকে ঘন কুয়াশা ও ধোঁয়ায় চীনের আরও ১০টি শহরে সতর্কতা জারির আরেকটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। চীনে ব্যবহৃত চারস্তরের সতর্কতার মধ্যে ‘রেড এলার্ট’ হলো সবচেয়ে গুরুতর ধরনের সতর্কতা।

পরামর্শমূলক সেই সতর্ক বার্তায় বলা হয়েছে, স্কুল বন্ধ এবং গাড়ি চলাচল, কারখানার উৎপাদন, নির্মাণকাজ সীমিত করার কথা। একই সপ্তাহে চীনে দ্বিতীয়বারের মতো এ ধরনের সতর্কতা জারি করা হলো। আগের সপ্তাহের ধারাবাহিকতায় চীনের পরিবেশ মন্ত্রণালযের তরফে মারাত্মক দূষণের কারণে তিয়ান জিন, পুইয়াং, জিনজিয়াং, ডেঝাউ, হান্দান, জিনতাই, লাংফাং, হেংসুই, জিনজি এবং অ্যানইয়াং শহরে এ লাল সতর্কতা জারি করা হলো। সম্প্রতি আরেকটি রিপোর্টে প্রকাশ, চীনের বায়ুদূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেখানে এখন জনস্বাস্থ্য ও টেকসই উন্নয়ন হুমকির সম্মুখীন। সেখানে বেইজিং শহরের পার্শ্ববর্তী প্রায় ১০ কোটি মানুষ অধ্যুষিত হেবি ও তিয়ানজিন শহর এলাকায় কয়লার ব্যবহার কমাতে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) চলতি বছরই বায়ুদূষণ কমাতে ৩০ কোটি ডলার ঋণ দেবে বলে জানিয়েছে। একইভাবে ভারতের রাজধানী দিল্লিসহ আরও কয়েকটি শহরে বায়ুদূষণের ভয়াবহতার কারণে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

সে কারণেই দেখা গেছে এ বছরের গরমকালে ভারতের রাজধানী দিল্লি শহরকে বিশ্বের উষ্ণতম স্থান হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। সেজন্য এবার সেখানে অত্যাধিক গরমে প্রায় সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর আমরা সবাই জানি। বাতাসে যখন দূষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তখন অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রায়ও সমানতালে বাড়তে থাকে। সেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশ, জলবায়ু ইত্যাদির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়। মানুষসহ সব জীবজগৎই এর দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশের ঢাকা শহর হলো বিশ্বের অন্যতম একটি মেগাসিটি। সে কারণে এর বায়ুমণ্ডলের ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনের ওপরই নির্ভর করে এ শহর আসলে নাগরিকদের বসবাসের জন্য কতটুকু নিরাপদ। সম্প্রতি ঢাকা শহরের বাতাসের নমুনা পরীক্ষা করে এতে মারাত্মক ক্ষতিকর কিছু দূষকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা সচেতন নাগরিকদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। শুষ্ক মৌসুম হওয়ার কারণে এখানকার বাতাসে প্রচুর পরিমাণ ধুলাবালি, ঢাকা শহরের কিছু শিল্পাঞ্চল থেকে নির্গত ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া, চামড়াশিল্পের ট্যানারি থেকে ক্ষতিকর দুর্গন্ধ, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী সাভার, আশুলিয়া, মাওয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টঙ্গী ইত্যাদি স্থানগুলো হতে ইটভাটার কালো ধোঁয়া বাতাসে সংযুক্ত হচ্ছে।

ঢাকায় চলাচলকারী মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন পরিবহনের কালো ধোঁয়া, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রী হতে প্রতিনিয়তই ঢাকা শহরের কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, সিসাসহ আরও অনেক ভারী ধাতু (হেভি মেটাল), রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশন হতে সিএফসি, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হয়ে দূষণের মাত্রা বেড়ে গিয়ে পরিবেশ নষ্ট করে চলেছে। তা ছাড়া পরিবেশ নির্দিষ্ট কোনো দেশের একক কোনো সমস্যা নয়। কাজেই যেহেতু আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে চীন ও ভারতে অত্যাধিক পরিমাণ বায়ুদূষণ রয়েছে, তার সামান্য প্রভাব হলেও আমাদের দেশে পড়ছে বা আগামীতে আরও পড়বে।

দেখা গেছে, যদি কোনো কারণে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উৎস থেকে ভারসাম্য বিনষ্টকারী কোনো কঠিন, তরল বা বায়বীয় অবাঞ্ছিত বহিস্থ পদার্থ বায়ুতে প্রচুর পরিমাণে অনুপ্রবেশ করে তাহলে স্বনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে বহিস্থ পদার্থ বা উপাদান নিজ উপাদানের অতিরিক্ত পরিমাণ বায়ু থেকে অপসারিত হয়। ফলে বায়ুর স্বাভাবিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণকারী বায়ুর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটি চরম সীমা রয়েছে। এ সীমার বাইরে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কাজ করে না। ফলে বায়ুতে বহিস্থ ও নিজ উপাদানের মাত্রাধিক সঞ্চয় ঘটে।

বায়ুতে বহিস্থ উপাদানের উপস্থিত ও সঞ্চয় এবং নিজ উপাদানের অতিরিক্ত সঞ্চয় জীবজগৎ ও সম্পত্তির ওপর মন্দ প্রভাব বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে ক্রমবৃদ্ধি অরণ্য ধ্বংস, দ্রুতগতিতে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, কৃষিপদ্ধতির পরিবর্তন এবং নিজ উপাদানের মাত্রাধিক সঞ্চয়ে বায়ু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ক্রিয়াশক্তি বিনষ্টের পথে। মানুষের এ অদূরদর্শী ক্রিয়াকলাপে পৃথিবীর সার্বজনীন বায়ুসম্পদ আজ বিপন্ন এবং মানুষ তথা সমগ্র জীবজগৎ সম্ভাব্য বিপদে আতঙ্কিত। এসব সমস্যা হতে বাঁচতে হলে আমাদের পৃথিবীকে সবুজ করে ফেলতে হবে।

পরিকল্পিত নগরায়ণ সেখানে একটি বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। আর পরিকল্পিত নগরায়ণ হলো কোনো স্থানের মোট আয়তনের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ রাস্তাঘাট থাকা এবং সেই রাস্তাঘাটকে সবুজ বনায়নের আওতায় নিয়ে এসে নগরের ২৫ শতাংশ বনায়ন করা। বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই এ পরমর্শটিই দিয়ে থাকেন নগসবাসীর জন্য। কাজেই ভারত কিংবা চীনের পর্যায়ে যাওয়ার আগেই আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়


যুদ্ধে নয় বরং পৃথিবী রক্ষায় অর্থ ব্যয় করা দরকার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

বর্তমানে পৃথিবীর আলোচিত এবং সংকটময় বিষয়গুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম প্রধান একটি বিষয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন ঘটছে। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমগ্র বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা প্রকারের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, নদীভাঙন, ভূমি ধস, শিলাবৃষ্টি ইত্যাদি। বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও ভূমিকম্প। টঘঋঈঈঈ’র দেওয়া তথ্য বলছে, বিংশ শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ১০-২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং আগামীতে আরও ১৮-৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর এতে মালদ্বীপসহ তলিয়ে যাবে উপকূলবর্তী আমাদের বাংলাদেশ। মালদ্বীপ এবং বাংলাদেশের পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি দেশই জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের ফলে কমবেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বন্ধে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে আমরা ব্যর্থ হলে আজকের পৃথিবী অচিরেই অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক ধারা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী মানুষসহ অন্য প্রাণীদের বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়বে। আগামী প্রজন্মকে সমৃদ্ধ, নিরাপদ এবং বসবাসযোগ্য এক পৃথিবীর নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষ্যে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে যুদ্ধে অর্থ ব্যয়ের পরিবর্তে জলবায়ু প্রভাব মোকাবিলায় তা ব্যয়ের আহ্বান জানিয়েছেন। সোমবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপশন প্ল্যান (ন্যাপ) এক্সপো-২০২৪’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যুদ্ধে অস্ত্র এবং অর্থ ব্যয় না করে সেই টাকাগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে যদি ব্যয় করা হত তো বিশ্বটা রক্ষা পেত।’

বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন যেখানে একটা আতঙ্কের বিষয় সেখানে এই ব্যাপারে উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা হতাশ করার মতো। এই ব্যাপারে তাদের আগ্রহ বলতে শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সম্মেলন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের বিষয়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশ যেখানে চিন্তিত সেখানে উন্নত রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত। যুদ্ধের পিছনে প্রতি বছর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ তারা খরচ করলেও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় অর্থ ব্যয়ে তাদের কোনো ধরনের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, চলমান যুদ্ধ ও নতুন করে সংঘাতের ভয় থেকে বিশ্বে সামরিক ব্যয়ে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। গত বছর তথা ২০২৩ সালে বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় ছিল ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন তথা ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার। যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। সুইডেনের প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সোমবার (২২ এপ্রিল, ২০২৪) এসআইপিআরআই বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এবারের প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বজুড়ে গত বছর সামরিক ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। শুধু তাই নয়- ২০০৯ সালের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বের সব ভৌগোলিক অঞ্চলে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে বিশ্ব যেখানে হুমকির মুখে সেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহের পিছনে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর ক্রমবর্ধমান সামরিক ব্যয়ের চিত্র সত্যিই আমাদের অনেক হতাশ করে। যুদ্ধ-বিগ্রহ পিছনের প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তা যদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ব্যয় করা হতো তাহলে বিশ্ব তার অস্তিত্ব সংকট থেকে রক্ষা পেত।

যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের মাত্রা নিয়ে অবিরাম কথামালা চলতে থাকলেও তা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। তাদের পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের খেসারত টানতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে। বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব নেতৃত্ব আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনানুযায়ী বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে ২০১০ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। এর ট্রাস্টের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- সরকারের উন্নয়ন বা অনুন্নয়ন বাজেটের বাইরে বিশেষ ক্ষেত্র হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় এই ট্রাস্টের তহবিল ব্যবহার করা; জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা; জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তৃণমূলপর্যায়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানবসম্পদ উন্নয়নসংক্রান্ত প্রকল্প বা কর্মসূচি গ্রহণ করা; জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজন, প্রশমন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং অর্থ ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক গবেষণা করা এবং গবেষণালব্ধ ফলাফলের আলোকে উপযুক্ত বিস্তারসহ বা পাইলট কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা; জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং ক্ষতিগ্রস্ততা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এর ভিত্তিতে কর্মসূচি বা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা; পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে স্থাপিত জলবায়ু পরিবর্তন ইউনিটসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এবং পরিবেশ অধিদপ্তরে গঠিত জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত জলবায়ু পরিবর্তন সেল বা ফোকাল পয়েন্টকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সহায়তা করা; জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সম্ভাব্য পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক বা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে উপযুক্ত কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সহায়তা করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী জরুরি কার্যক্রমে সহায়তা করা ইত্যাদি।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিভিন্ন ধরনের কৌশল গ্রহণের পাশাপাশি বাংলাদেশ সব সময়ই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ-বিসিডিপি’ গঠন করা হয়েছে। এতে সব পক্ষ ঐকমত্য হয়েছে। আমরা আশা করি, মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান, ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান, ন্যাশনাল ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন ও বাংলাদেশের রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে বিসিডিপি তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (এনএপি) ২০২২-২০৫০ প্রণয়ন করেছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এটি এইএনএফসিসিসি-তে দাখিল করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ১১টি জলবায়ু ঝুঁকিযুক্ত এলাকাতে ৮টি খাতে ১১৩টি অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম চিহ্নিত করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ আগামী ২৭ বছরে ন্যাপে গৃহীত কর্মপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন। এ জন্য সুনির্দিষ্ট তহবিল ও অতিরিক্ত আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ধনী দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশ্বে জলবায়ুর এই নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার রয়েছে জোরাল অবদান। তিনি জলবায়ুবিষয়ক সর্বোচ্চ বিশ্ব ফোরাম, জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি)-র কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (সিওপি)-এ ২০১৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার এই সম্মাননা ছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর বিশ্ব ফোরামে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মুখপাত্র হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়ার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় অবদান রাখার পাশাপাশি বিশ্বজনীন আলোচনায় স্বীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সদা সচেষ্ট রয়েছে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশন’র (জিসিএ) ঢাকা বৈঠকে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অভিযোজন ও সামলে নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের কিছু ধারণা ও অভিজ্ঞতা আছে বিনিময় করার মতো। আমি শুধু নিজের দেশ নিয়ে ভাবী না। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে অনেক ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ হারিয়ে যাবে। তখন সেখানকার মানুষ কোথায় যাবে, সে কথাও আমাদের ভাবতে হবে।’ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রতিকূলতা ও প্রাকৃতিক দুরে‌্যাগ ব্যবস্থাপনায় অনন্য দক্ষতা ও সাফল্য প্রদর্শনের সুবাদে সমগ্র বিশ্বের কাছে আজ একটি রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে বাংলাদেশ এবং প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। এই ব্যাপারে জাতিসংঘের মহাসচিব জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনের জন্য বাংলাদেশকে একটি মডেল হিসেবে বর্ণনা করে জানিয়েছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনে বাংলাদেশ সেরা শিক্ষক।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে তিনি জানিয়েছেন, ‘শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতাদের মধ্যে অন্যতম যিনি জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি নিয়ে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’

তবে আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে বিশ্বের সব নেতৃত্বকে সমানভাবে এবং সমানতালে এগিয়ে আসা দরকার। কারণ বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্র এবং তাদের নেতাদের সহযোগিতা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে একা এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না। এমতাবস্থায় বিশ্বের সব দেশ ও নেতাদের উচিত যুদ্ধ-বিগ্রহের পিছনে না ছুটে জলবায়ু পরিবর্তনের এই নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় এগিয়ে আসা। যুদ্ধ-বিগ্রহের পিছনে অর্থ ব্যয় না করে জলবায়ু পরিবর্তনের এই নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায়ি ওইসব অর্থ ব্যয় করা। তাহলে জলবায়ুর পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্তির পাশাপাশি যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে সৃষ্ট সমস্যা থেকে বেঁচে যাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত মানুষ। আর পৃথিবী বেঁচে যাবে অস্তিত্ব সংকটের হাত থেকে। বর্তমান বিশ্বে এই মুহূর্তে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলার চেয়ে আর গুরুত্বপূর্ণ কোনো সমস্যা থাকতে পারে না। সুতরাং, আমাদের আগত প্রজন্মকে একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ এবং নিরাপদ পৃথিবী উপহার দিতে হলে বিশ্বের উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোকে যুদ্ধে নয় বরং পৃথিবী রক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অর্থ ব্যয় করা দরকার।

লেখক: উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়


ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

মুসলিম ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জনপদের কিশোরগঞ্জকে ঘিরে রয়েছে অনেক ইতিহাস। প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপত্যের বিখ্যাত নানা দর্শনীয় স্থান রয়েছে এখানে।

আড়াইশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ তারই একটি নিদর্শন। পাগলা মসজিদটি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার হারুয়া নামক স্থানে বর্তমানে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত, যা একসময় নদীর মাঝে ছিল একপাড় থেকে সরু রাস্তা ও অন্য পাড় থেকে বাঁশের সাঁকো দিয়ে মুসল্লিরা চলাচল করত। জনশ্রুতি অনুসারে, ঈশা খানের পরবর্তী আমলে তারই এক বংশধর দেওয়ান জিল কদর খান ওরফে ‘জিল কদর পাগলা’ নামক এই বংশের একজন ব্যক্তি নদীর তীরে বসে নামাজ পড়তেন। তিনি অত্যন্ত মুজ্জফ ছিলেন তিনি দেওয়ান হয়বত খাঁর নাতি দেওয়ান মোহাম্মদ খাঁর ছেলে পরবর্তীতে ওই স্থানটিতে একটি মসজিদ নির্মিত হয়।

জিল কদর পাগলার নামানুসারে মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এই দেওয়ান জিল কদর দাদ খান পাগলা সাহেবের কবর হয়বতনগর বড় গোরস্তানে রয়েছে । অপর জনশ্রুতি অনুসারে, তৎকালীন কিশোরগঞ্জের হয়বতনগর জমিদার পরিবারের ‘পাগলা বিবি’র নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয়।

কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিমে নরসুন্দা নদীর তীরে এই তিনতলা বিশিষ্ট মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটি একসময় নরসুন্দা নদীর প্রায় মাঝেই ছিল, একদিকে বাশের সাঁকো অন্যদিকে সরু রাস্তা দিয়ে লোকজন যাতায়াত করত। নদীর নাব্য কমে যাওয়ায় এখন নদীর হারুয়া পাড়েই মসজিদটি এবং আশপাশে অনেক সুরম্য দালানকোঠায় আবৃত।

যদিও আশির দশকেও এই মসজিদটি ছিল আধাপাকা এবং টিনের ঘর এবং এর মোতোয়ালি ছিলেন হয়বতনগরের সর্বশেষ জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খানের বড় ছেলে, কিশোরগঞ্জ মিউনিসিপ্যালটির (বর্তমান পৌরসভা) চেয়ারম্যান দেওয়ান সাত্তার দাদ খান (সাইয়ারা মিয়া)। সাইয়ারা মিয়াকে সবাই চেয়ারম্যন সাহেব বলেই জানত, তিনি টানা ১৪ বছর চেয়ারম্যন ছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে দেওয়ান ফাত্তাহ দাদ খান ওই মসজিদের মোতোয়ালি নিযুক্ত হন, এ ছাড়াও তিনি তার দাদা কিশোরগঞ্জের অন্যতম জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খানের দানকৃত মাঠ যা বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত সম্পন্ন ঈদগাহ ময়দান, শোলাকিয়া ঈদগাহেরও মোতোয়ালি। মসজিদটি মোগল স্থাপত্যশৈলীর কারুকার্যময় গঠন কাঠামোতে তৈরি করা হয়।

নামাজির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৮২ সালে সংস্করণ ও কলেবর বৃদ্ধির জন্যে পুরোনো কাঠামো ভেঙে সামনের অংশ পুনর্নির্মাণ করা হয়। ’৯০-এর দশকে ১১ তলা সুউচ্চ মিনারসহ বর্তমান কাঠামোয় রূপান্তর করা হয়। মসজিদ-সংলগ্ন ১৩২ কেভি বিদ্যুৎ লাইনের কারণে কলেবর বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বিদ্যুৎ লাইন মসজিদের খরচে স্থানান্তরিত করে এর আরও উন্নয়ন করা হবে। মসজিদের আয়তন বহুগুণে বাড়িয়ে জানাজা- ঈদগাহ-কবরস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।

এর পাঁচতলা সুউচ্চ মিনারটি বহুদূর থেকে সহজেই দৃষ্টি কাড়ে। পাগলা মসজিদের ইমরাত খুবই সুন্দর এবং নির্মাণশৈলীও বেশ চমৎকার। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত পাগলা মসজিদটি নানা ধরনের ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থাপনা হিসেবে খ্যাত।

অন্য একটি মহলে জনশ্রুতি আছে যে, পাগলবেশী এক আধ্যাত্মিক পুরুষ, হয়বতনগর বাড়ির এক বংশধর জিল কদর পাগলা একদিন খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর মধ্যস্থলে মাদুর পেতে ভেসে এসে বর্তমান মসজিদের কাছে স্থিতু হন এবং তাকে ঘিরে আশপাশে অনেক ভক্তকুল সমবেত হন। ওই পাগলের মৃত্যুর পর তার সমাধির পাশে পরবর্তীতে এই মসজিদটি গড়ে ওঠে। ফলে কালক্রমে মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ’ নামে পরিচিত পায়।

অত্র অঞ্চলের সহজ সরল মানুষের বদ্ধমূল ধারণা কোনো বিপদে পড়লেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে এই মসজিদে নামাজ পড়া ও শিরনি দেওয়ার নিয়ত করলেই আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন তা কবুল করবেন এবং সেই বিশ্বাসের মূলেই এই মসজিদে সবধর্মের জনগণেরই পবিত্রতা প্রকাশে

ব্যাকুলভাবে সাড়া দিয়ে আসছেন ।

ফলে সাধারণ মানুষ এমন বিশ্বাসের আলোকে পাগলা মসজিদে প্রচুর দান-খয়রাত করে থাকেন এবং ক্রমেই তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ মসজিদের আয় দিয়ে কমপ্লেক্সের বিশাল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মসজিদের আয় থেকে বিভিন্ন সেবামূলক খাতে অর্থ সাহায্য করা হয়।

মসজিদটি কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিমে হয়বতনগর সংলগ্ন হারুয়া নামক এলাকায় অবস্থিত। শহরের যেকোনো স্থান থেকে রিকশাযোগে বা পায়ে হেঁটে বা অন্য যে কোনো পরিবহনযোগে সহজেই এই মসজিদে যাওয়া যায়।


গরমের বিপদ হিটস্ট্রোক: ঝুঁকি এড়াতে করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ

সারা দেশে প্রচণ্ড দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে, গরম বেড়ে চলছে। দেশের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। সারা দেশেই গরমে হাঁসফাঁস এবং নাভিশ্বাস অবস্থা, আর গরমের উৎপাতে দিশেহারা মানুষ এবং প্রাণীকুল। এ ছাড়া নানা রকম অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই। তবে কয়েক দিনে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

হিটস্ট্রোক কী : গরমের সময়ের একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যগত সমস্যার নাম হিটস্ট্রোক। চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী, প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, তাকে হিটস্ট্রোক বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় রক্ত দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। কোনো কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ত্বকের রক্তনালি প্রসারিত হয় এবং অতিরিক্ত তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। গরম বাড়লে শরীরও ঘামতে শুরু করে, ঘাম বাষ্পীভূত হলে শরীর ঠাণ্ডা হয় এবং ঘামের মাধ্যমেও শরীরের তাপ কমে যায়। কিন্তু প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র পরিবেশে বেশি সময় অবস্থান বা পরিশ্রম করলে তাপ নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভব হয় না। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপদসীমা ছাড়িয়ে যায়, খাম বন্ধ হয়ে যায় এবং হিট

স্ট্রোক দেখা দেয়।

হিট স্ট্রোক কাদের বেশি হয় : প্রচণ্ড গরমে ও আর্দ্রতায় যে কারও হিটস্ট্রোক হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যেমন-
১. শিশু ও বৃদ্ধদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিরা যেহেতু প্রায়ই বিভিন্ন রোগে ভোগেন যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার বা হার্টের রোগী, স্ট্রোক বা ক্যানসারজনিত রোগে যারা ভোগেন, এমনকি যেকোনো কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা নানা ওষুধ সেবন করেন, যা হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

২. যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। যেমন কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক।

৩. শরীরে পানিস্বল্পতা হলে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।

৪. কিছু কিছু ওষুধ হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষ করে প্রস্রাব বাড়ানোর ওষুধ, বিষণ্নতার ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ ইত্যাদি।

হিটস্ট্রোকের লক্ষণগুলো কী : তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে হিটস্ট্রোকের আগে অপেক্ষাকৃত কম মারাত্মক হিট ক্র্যাম্প অথবা হিট এক্সহসশন হতে পারে। হিট ক্র্যাম্পে শরীরের মাংসপেশিতে ব্যথা হয়, শরীর দুর্বল লাগে এবং প্রচণ্ড পিপাসা পায়। এর পরের ধাপে হিট এক্সহসশনে দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস, মাথাব্যথা, ঝিমঝিম করা, বমিভাব, অসংলগ্ন আচরণ ইত্যাদি দেখা দেয়। এই দুই ক্ষেত্রেই শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ঠিক থাকে এবং শরীর অত্যন্ত ঘামতে থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এর লক্ষণ গুলো হলো-
১. শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়।

২. ঘাম বন্ধ হয়ে যায়।

৩. ত্বক শুষ্ক ও লালচে হয়ে যায়।

৪. নিশ্বাস দ্রুত হয়।

৫. নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়।

৬. রক্তচাপ কমে যায়।

৭. খিঁচুনি, মাথা ঝিমঝিম করা, অস্বাভাবিক আচরণ, হ্যালুসিনেশন, অসংলগ্নতা ইত্যাদি।

৮. প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়।

৯. রোগী শকেও চলে যায়। এমনকি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

প্রতিরোধের উপায় কী : গরমের দিনে কিছু সতর্কতা মেনে চললে হিটস্ট্রোকের বিপদ থেকে বেঁচে থাকা যায়। এগুলো হলো-
১. হালকা, ঢিলেঢালা পোশাক পরুন। কাপড় সাদা বা হালকা রঙের হতে হবে। সুতি কাপড় হলে ভালো।

২. যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকুন।

৩. বাইরে যেতে হলে মাথার জন্য চওড়া কিনারাযুক্ত টুপি, ক্যাপ বা ছাতা ব্যবহার করুন।

৪. বাইরে যারা কাজকর্মে নিয়োজিত থাকেন, তারা মাথায় ছাতা বা মাথা ঢাকার জন্য কাপড়জাতীয় কিছু ব্যবহার করতে পারেন।

৫. প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল পান করুন। মনে রাখবেন, গরমে ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ দুই-ই বের হয়ে যায়। তাই পানির সঙ্গে সঙ্গে লবণযুক্ত পানীয় যেমন-খাবার স্যালাইন, ফলের রস, লাচ্ছি ইত্যাদিও পান করতে হবে। পানি অবশ্যই বিশুদ্ধ হতে হবে।

৬. তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী পানীয় যেমন- চা ও কফি যথাসম্ভব কম পান করা উচিত।

৭. রোদের মধ্যে শ্রমসাধ্য কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। এসব কাজ সম্ভব হলে রাতে বা খুব সকালে করুন। যদি দিনে করতেই হয়, তবে কিছুক্ষণ পরপর রোদ থেকে সরে গিয়ে ছায়াযুক্ত স্থানে বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর লবণযুক্ত পানি ও স্যালাইন পান করতে হবে।

আক্রান্ত হলে কী করণীয় : প্রাথমিকভাবে হিটস্ট্রোকের আগে যখন হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সহসশন দেখা দেয়, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হিটস্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই যা করতে পারেন তা হলো-
১. দ্রুত শীতল কোনো স্থানে চলে যান। যদি সম্ভব হয়, ফ্যান বা এসি ছেড়ে দিন।

২. ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে ফেলুন। সম্ভব হলে গোসল করুন।

৩. প্রচুর পানি ও খাবার স্যালাইন পান করুন। চা বা কফি পান করবেন না।

কিন্তু যদি হিটস্ট্রোক হয়েই যায়, তবে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে, ঘরে চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে রোগীর আশপাশে যারা থাকবেন তাদের করণীয় হলো-

৪. রোগীকে দ্রুত শীতল স্থানে নিয়ে যান।

৫. তার কাপড় খুলে দিন।

৬. শরীর পানিতে ভিজিয়ে দিয়ে বাতাস করুন। এভাবে তাপমাত্রা কমাতে থাকুন।

৭. সম্ভব হলে কাঁধে, বগলে ও কুঁচকিতে বরফ দিন।

৮. রোগীর জ্ঞান থাকলে তাকে খাবার স্যালাইন দিন।

৯. দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

১০. সব সময় খেয়াল রাখবেন হিটস্ট্রোকে অজ্ঞান রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস এবং নাড়ি চলছে কি না। প্রয়োজন হলে কৃত্রিমভাবে নিশ্বাস ও নাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হতে পারে। হিটস্ট্রোকে জীবন বিপদাপন্ন হতে পারে। এমনকি রোগী মারাও যেতে পারেন। গরমের এই সময়টায় সবাইকে সাবধানে থাকতে হবে। দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও হাসপাতালে ভর্তি করে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া গেলে বেশির ভাগ রোগীই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।

১১. গরমে শিশুদের জন্য ঝুঁকিটা বেশি। বাচ্চাদের বেশি বেশি পানি খাওয়াতে হবে। তারা যেন রোদের মধ্যে অনেক বেশি দৌড়ঝাঁপ না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সবাইকে মনে রাখতে হবে, এই গরমে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে এর থেকে বেঁচে থাকা উচিত।

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক


প্রতিদিনের সাত হজ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মুফতি আলী হুসাইন

আপনি কি হজ না করেও হজের নেকি অর্জন করতে চান? আপনার সামর্থ্য নেই মক্কা যাওয়ার, নেই আর্থিক সংগতি তারপরও কি আপনি একজন হাজির মর্যাদা অর্জন করতে আগ্রহী? যারা অর্থ ও শ্রম দিয়ে কাবা শরিফ পৌঁছেছেন; অশেষ নেকি অর্জনে সক্ষম হয়েছেন; মহান রবের নৈকট্য লাভ করেছেন; কাবা চত্বরে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি তুলেছেন আর আপনি দেশের সীমানা অতিক্রম করেননি কিন্তু সাধ্য না থাকলেও মনে বড় স্বাদ আছেÑ তাদের মতো বিপুল নেকি অর্জন করবেন বলে। তা হলে এবার আপনাকে জানতে হবে এমন কি আমল যার দ্বারা আপনি হজ না করেও হজের নেকি লাভ করবেন। বাইতুল্লাহ শরিফে না গিয়েও হাজিদের মর্যাদা অর্জন করবেন।

আপনার বিশ্বাস হোক আর না-হোক

* মাত্র তিন মিনিট সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজের সাওয়াব লেখা হবে।

* মাত্র ছয় মিনিট সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পরিপূর্ণ একটি ওমরার সাওয়াব লিখা হবে।

* মাত্র ১৫ মিনিট সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজের সাওয়াব লেখা হবে।

* মাত্র এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজের সাওয়াব লেখা হবে।

* মাত্র দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজ ও ওমরার সাওয়াব লেখা হবে।

এখন নিশ্চয়ই আপনার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, এটা জানার জন্য যে, কি সেই আমল? যে আমল করলে এতগুলো হজ ও ওমরার সাওয়াব লেখা হবে। তাহলে এখনই জেনে নিন, সেসব আমল সম্পর্কে, যেগুলোর মাধ্যমে হজ না করেও হজের নেকি পাওয়া যায়; মক্কায় না গিয়েও হাজিদের সমান মর্যাদা ও নেকি অর্জন করা যায়।

এক. জামাতের সঙ্গে ফরজ নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে বের হলে পরিপূর্ণ একটি হজের সাওয়াব হাসিল হয়।

হাদিসে এসেছে, আবু উমামা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ফরজ নামাজ জামাতের সঙ্গে আদয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়, তার এক হজের সমান নেকি লাভ হয়। আর যে ব্যক্তি কোনো নফল নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে বের হয়, তার জন্য একটি পরিপূর্ণ ওমরার সাওয়াব লেখা হয়। [মুসনাদে আহমাদ: ২২৩০৪]

এক ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করলে পরিপূর্ণ একটি হজের সাওয়াব অর্জন হয়, তাহলে যে ব্যক্তি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে, নিঃসন্দেহে তার পাঁচটি পরিপূর্ণ হজের সাওয়াব অর্জন হবে। তারপরও মানুষ কি করে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা থেকে দূরে থাকে! অথচ মাত্র ১৫ মিনিটের ব্যাপার!

দুই. যে ব্যক্তি ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে জায়নামাজে বসে থেকে যিকির-আযকার, দোয়া-দরুদ বা কোরআন তিলাওয়াতে লিপ্ত থাকে, তারপর সূর্য একটু ওপরে ওঠে গেলে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নেয়, তাহলে তার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজ ও পূর্ণ একটি ওমরার সাওয়াব লিখে দেওয়া হয়।

হাদিসে এসেছে, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে। অতঃপর সূর্য ওঠা পর্যন্ত জায়নামাজে বসে যিকির-আযকার করতে থাকে, তারপর (সূর্য একটু ওপরে ওঠে গেলে বা ইশরাকের সময়) দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নেয়, তার জন্য পরিপূর্ণ একটি হজ ও ওমরার সওয়াব অর্জন হয়। রাসুলুল্লাহ শেষোক্ত শব্দটি তিনবার বলেন- পরিপূর্ণ হজ ও ওমরা, পরিপূর্ণ হজ ও ওমরা, পরিপূর্ণ হজ ও ওমরা। [তিরমিযি: ৫৮৬]

মানুষ ও জিন জাতির জন্য কি সুবর্ণ সুযোগ! মাত্র দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করেই হজ ও ওমরার সাওয়াব অর্জন করতে পারে।

তিন. যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ৩৩ বার আল্লাহু আকবার, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ পাঠ করবে, তার আমলনামায় একটি হজ, একটি ওমরা এবং আল্লাহর রাস্তায় দান করার নেকি লাভ করবে।

আবু হুরাইরা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনÑ

একদল দরিদ্র মুহাজির সাহাবিগণ রাসুলুল্লাহর নিকট এসে অনুযোগ করল, ধনী ব্যক্তিরা উচ্চমর্যাদাও নায-নেয়ামতে আমাদের থেকে অগ্রগামী। তিনি বললেন এটা কীভাবে? তারা বলল, আমরা যেভাবে সালাত আদায় করি তারাও সেভাবে সালাত আদায় করে, আমরা যেভাবে সওম পালন করি তারাও সেভাবে সওম পালন করে। তারা দান-সাদাকাহ করে, আমরা দান-সাদাকা করি না, তারা গোলাম আজাদ করে আমরা করি না। রাসুলুল্লাহ বললেন, আমি তোমাদেরকে এমন কিছু শিখিয়ে দেব কি? যার দ্বারা তোমরা তোমাদের অগ্রগামীদের মর্যাদায় পৌঁছতে পারবে এবং তোমাদের পশ্চাৎগামীদের আগে যেতে পারবে। কেউ তোমাদের অগ্রগামী হতে পারবে না। তবে তোমাদের মতো কেউ আমল করলে ভিন্ন কথা। তারা বলল, আপনি বলুন ইয়া রাসুলাল্লাহ!। রাসুলুল্লাহ তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা প্রত্যেক সালাতের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল-হামদুলিল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। বর্ণনাকারী আবু সালেহ বলেন, অতঃপর দরিদ্র মুহাজিরগণ আবার রাসুলুল্লাহর নিকট এসে অবহিত করলেন যে, আমাদের সম্পদশালীরা তো আমাদের আমলের কথা শুনে তারাও তদ্রূপ আমল শুরু করেছে। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বললেনÑ

এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছে তা দান করেন। [বুখারি: ৮৪৩, মুসলিম: ৫৯৫]

এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, আবু হুরাইরা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন,Ñ

যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ এবং ৩৩ বা র আলহামদুলিল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবার, মোট ৯৯ বার পাঠ করবে এবং ১০০ বার নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করবেÑ

‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লাশারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহুয়া আলা কুল্লিশাইন কাদির’

তাহলে তার সমস্ত গোনাহ মিটিয়ে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনারাশির সমপরিমাণ হয়। [মুসলিম:৫৯৭ ]

মাত্র তিন মিনিট সময় ব্যয় করে কি বিপুল পরিমাণ নেকি অর্জন করা যায়!

চার. যে ব্যক্তি দীন শিক্ষা করা বা শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করে, তার আমলনামায় একটি পরিপূর্ণ হজের সাওয়াব দান করেন।

হাদিসে এসেছে, আবু উমামা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি শুধু কল্যাণ শিক্ষা লাভ কিংবা কল্যাণ শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করবে, তাকে পরিপূর্ণরূপে হজ পালনকারীর ন্যায় প্রতিদান দেওয়া হবে। [তাবরানি কাবির: ৭৪৭৩]

সৌভাগ্যবান ওই ব্যক্তি, যে মসজিদে গমন করে কোরআন হিফজ করার জন্য কিংবা করানোর জন্য, ধর্মীয় জ্ঞানার্জন বা শিক্ষা প্রদান অথবা জুমআর খোৎবা শ্রবণের উদ্দেশ্যে। অতঃপর পরিপূর্ণ হজের সাওয়াব নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। মাত্র এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেই এই মহৎ নেকি অর্জন সম্ভব। তারপরও কি এব্যা পারে অলসতা করা উচিত?

পাঁচ. রমাদানের এক ওমরা এক হজের সমান।

হাদিসে এসেছে, ইবনে আব্বাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন,Ñ নিশ্চয়ই রমাদান মাসের ওমরা পালনে হজের সমান নেকি হাসিল হয়। [বুখারি ও মুসলিম]

হে দীনি ভাই ও বন্ধুগণ! নেক কাজে আর বিলম্ব নয়। এখনই ছুটে আসুন, রমাদান মাসে ওমরা পালনের জন্য, আপনি একটি পরিপূর্ণ একটি কবুল হজের সমান নেকি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন। সেই সঙ্গে আছে পাপমুক্তির পরোয়ানা। ইনশাআল্লাহ!।

ছয়. হাজিদের সাহায্য করলে হজের সওয়াব পাওয়া যায়।

যায়েদ বিন খালিদ আল-জুহানি [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো যোদ্ধাকে যুদ্ধের সরঞ্জামের জোগান দেবে বা যোদ্ধার পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করবে কিংবা কোনো হাজির আসবাপত্রের জোগান দেবে অথবা কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার-ও অনুরূপ নেকি অর্জন হবে কিন্তু উদ্যোক্তার সামান্য পরিমাণ নেকিও কমবে না। [নাসাঈ: ৩১৮০]

সুতরাং হাজিদের হজ পালনের প্রস্তুতিতে সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। এই নেকি অর্জনের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহী হওয়া উচিত। বিশেষত আমরা যারা হজ করতে সামর্থ্য রাখি না।

এখন তিনটি উপঢৌকন সম্পর্কে কথা বলে আলোচনা শেষ করব।

এক. যে ব্যক্তি নিজ বাড়ি বা কর্মস্থলে অজু করে মসজিদে কোবায় আগমন করব, অতঃপর সেখানে নামাজ আদায় করবে, তার আমলনামায় একটি ওমরা করার নেকি অর্জন হবে।

সাহল ইবনে হুনাইফ [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নিজ ঘরে অজু করে মসজিদের কোবায় গিয়ে নামাজ পড়ে, তার একটি ওমরার সাওয়াব হাসিল হয়। [নাসাঈ: ৬৯৯]

আমরা যা জানতে পারলাম

* প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ আলহামদুল্লিাহ, ৩৩ আল্লাহু আকবার পাঠ করতে সর্বোচ্চ তিন মিনিট সময় ব্যয় হবে, বিনিময়ে আপনি পাবেন একটি হজ ও একটি ওমরার সাওয়াব।

* মাত্র ছয় মিনিট সময় ব্যয় করে আপনি মসজিদে কোবায় দুই রাকাত নামাজ আদায় করুন, বিনিময়ে পাবেন পূর্ণ একটি ওমরা পালনের নেকি।

* ১৫ মিনিট সময় ব্যয় করে আপনি জামাতের সঙ্গে ফরজ নামাজ আদায় করুন, বিনিময়ে পাবেন একটি কবুল হজের সওয়াব।

* এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে আপনি মসজিদে গিয়ে কিছু ধর্মীয় জ্ঞান বা কল্যাণকর কিছু শিখুন কিংবা জুমার খুতবা শ্রবণ করুন, বিনিময়ে আপনি পাবেন একটি কমপ্লিট একটি কবুল হজের সাওয়াব।

* ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে, জায়নামাজে বসে থেকে যিকির-আযকার করতে থাকুন, তারপর সূর্য উঠে গেলে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নিন, বিনিময়ে পাবেন একটি পরিপূর্ণ হজ ও পরিপূর্ণ ওমরার সাওয়াব।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই জানতে পেরেছেন যে, কীভাবে একজন মুসলিম প্রতিদিন সাতটি হজ পালনের নেকি লাভ করবে?

* ঘরে অজু করে মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে পাঁচটি কবুল হজের নেকি লাভ হয়।

* ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে, জায়নামাজে বসে থেকে যিকির-আযকার করতে থাকুন, তারপর সূর্য ওঠে গেলে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নিন, বিনিময়ে পাবেন একটি পরিপূর্ণ হজ ও পরিপূর্ণ ওমরার সাওয়াব।

* এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে আপনি মসজিদে গিয়ে কিছু ধর্মীয় জ্ঞান বা কল্যাণকর কিছু শিখুন কিংবা জুমার খুতবা শ্রবণ করুন, বিনিময়ে আপনি পাবেন একটি কমপ্লিট কবুল হজের সাওয়াব।

আপনার প্রাত্যহিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক কবুল হজের ছক

প্রতিদিন ৭ হজ

প্রতি সপ্তাহে ৭ˣ৭= ৪৯

প্রতি মাসে ৭ ˣ ১০=২১০

প্রতিবছর ৩৬৫ ˣ ১২=২৫৫৫

প্রতিদানের দিক দিয়ে ওহুদ পাহাড়ের চেয়ে বৃহৎ। কোনো বিবেকবান মুসলিম ব্যক্তির জন্য অবহেলা করা উচিত নয়।


গ্রামের জিয়াফত বা মেমানি  

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আলমগীর খোরশেদ 

ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে দেখতাম অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে মুরুব্বি কেউ মারা গেলে চল্লিশ দিন পর মৃত্যুবার্ষিকী পালনে কিংবা কারোর বিয়ে, মেয়ের কান ফুটা, খৎনা, এলাকার কোনো খেলায় জয় ইত্যাদি উপলক্ষে গ্রামোময় ভোজ বা খাওয়ার যে আয়োজন করত সেটাকেই মেমানি বা মেজবানি বলা হতো। মেমানি বা মেজবানি বলতে আতিথিয়েতা বা গণভোজকে বোঝায়। যা সবার জন্য উন্মুক্ত। ধনী-গরিব সবাই একসঙ্গে বসে মেমানির খাবার খেতো।

বাংলাদেশে মেজবানি বলতে যদিও চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি ঐতিহ্য ভাবা হয়; কিন্তু এটা বৃহত্তর ময়মনসিংহের সব জেলাসহ সিলেট, খুলনা এমনকি দেশের বাইরে ইউরোপ, আমেরিকায়ও মেমানি বা মেজবানি প্রচলিত আছে। গৃহস্থদের ধান মাড়াই শেষ হলে গ্রামের বাড়িতে কাছারি ঘরের সামনে নামা খালি জমিসহ মেমানি বা মেজবানির আয়োজন করা হতো। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে এটাকে ‘জিয়াফত’ বলা হয়ে থাকে। জিয়াফত হলো ফার্সি শব্দ, যার অর্থ হলো ভোজ বা ভোজসভা। তা একটি ঐতিহ্যগত আঞ্চলিক উৎসব। প্রতিবেশী, পাড়া তথা সামর্থ্য অনুযায়ী পুরো গ্রামের লোকজনদের মেমানিতে দাওয়াত দেওয়া হতো। মেমানির যিনি আয়োজক তিনি বা তার লোকজন পাড়াময় হেঁটে হেঁটে বাড়ির মুরুব্বিদের দাওয়াত দিতেন। দাওয়াত দিতে পরিবারের সবাইকেসহ বলতে হতো, না হলে রাগ করে আসত না কেউ।

মেমানির খাবার: মেমানিতে সাদা ভাত, মরিচ ও মসলাসহ গরুর মাংস সঙ্গে ছোট আলুর ঝোল, মাছভাঙ্গা সঙ্গে আলুর ঝোল, মাষকলাইয়ের ডাল আর থাকত মজার জিনিস ‘মিডুরি’। মিডুরি হলো চালের গুঁড়া, আখের গুড়, নারকেল গুঁড়া গরম মসলা সহযোগে তৈরি তরল মিষ্টিজাতীয় খাবার। মিডুরিটা খাবারের শেষে পরিবেশন করা হতো। বাবুর্চির সুনাম নির্ভর করত মিডুরি ও গরুর মাংস রান্নার ওপর। সবশেষে দেওয়া হতো পান সঙ্গে চিকন করে কাটা সুপারি, খয়ের, চুন ও পাতা এবং জর্দা।

মেমানির ডেকোরেশন: তখনকার দিনে এখনকার সময়ের মতো ডেকোরেটর ছিল না। বিয়ে, ওয়াজ মাহফিলে কাপড়ের তৈরি বড় সামিয়ানা টানানো হতো, যাতে কোনো সমিতি বা প্রতিষ্ঠানের নাম, সন তারিখ, সাকিন এসব লাল, নীল সুতো দিয়ে লেখা থাকত। রান্নার জন্য বিভিন্ন পাড়া বা গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি থেকে পিতলের তৈরি বড় ডেকচি যাকে ‘মেমানির ডেক’ বলত, তা আনা হতো। ডেকচির গায়ে ওপরের দিকে ডেকচির মালিকের নাম, সন তারিখ, সাকিন ইত্যাদি পিতল খোদাই করে লেখা থাকত। পাড়া থেকে চেয়ার, প্লেট বা বাসন, সানকি আনা হতো। গ্রামের লোকেরা চাটাই বিছিয়ে তাতে কলাপাতায় মেমানির খাবার খেতো।

মেমানির গরু কেনা: দাওয়াত দেওয়ার পর কর্তাব্যক্তি মেমানির জন্য গরু কেনায় অভিজ্ঞ বা মিডিয়া যে, তাকেসহ পাড়ার ও বাড়ির লোকজন নিয়ে গরু কিনতে বাজারে যেতেন। গরুর দালাল দেখলেই বোঝা যেত, নারিকেল তেল দিয়ে আঁচড়ানো মাথা চকচক করত। লুঙ্গিটা নিচ থেকে উল্টায়ে কোমরে বাঁধা, ছাতাটার বাঁট পিছনে ঘাড়ের কাছে শার্টে ঢুকানো। কখনোই তার চোখ দুটো স্থির নয়। গরুর মালিকের সঙ্গে ও ক্রেতার সঙ্গে এমনভাবে চোখের ভ্রু নামিয়ে উঠিয়ে কথা বলত যে সাধারণ মানুষ ওই চোখের ভাষা বোঝা কঠিন।

মেমানির কাজ ও ব্যস্ততা: অনুষ্ঠানের আগের রাত যেন কর্মযজ্ঞ। এ রাতে বাড়িতে কারোর ঘুম নেই। বিকেল থেকেই বাবুর্চি তার সহযোগী লোকজন, চামচাসহ অন্যান্য উপাদান, চার-পাঁচটা গরু জবাইয়ের কসাই ও তার লোকজন সবাই এসে হাজির হতো। গরু জবাই করে একটার পর একটা টুকরা করে বাবুর্চি মাংস বুঝে নিতো। পুকুর থেকে মাছ ধরার জন্য জেলেকে খবর দেওয়া হলে জেলে এসে পুকুরে জাল ফেলত। পুকুরের এপার থেকে ওপারে জাল টেনে নিলে ওদিকে মাছের লাফালাফি শুরু হতো। বড় বড় কাতল, রুই, মৃগেল, ঘাসকার্প মাছ উঠিয়ে আনা হতো। বাবুর্চি বলে দিত কত কেজি মাছ লাগবে। পেঁয়াজ, মসলা, আদা, রসুন বাটার জন্য মহিলারা শীল-পাটা নিয়ে বসে যেত। গাঁইল চেঁহাইট দিয়ে পেঁয়াজ, রসুন, পেষার কাজ করা হতো। এত লোক রাতে খাবারের জন্য খিচুড়ি পাক করত বাবুর্চি।

উঠানের কোণে লম্বা পরিখা বা মাটি কেটে গর্ত করে লম্বা চুলা বানানো হতো। ধান সিদ্ধ দেওয়ার বড় কড়াইয়ে ভাত রান্না হতো। চাল সিদ্ধ হতেই কড়াই উঠিয়ে নিয়ে গরম ভাত বড় বাঁশের তৈরি খাঁচায় ঢেলে দেওয়া হতো পানি ঝরে যাওয়ার জন্য। পানি ঝরে গেলে ভাত বিছিয়ে রাখা নতুন চাটাইয়ে স্তূপ করে রাখা হতো। চুলা ধরানোর জন্য পাটশোলার আঁটি, কেরোসিন তৈল রাখা হতো, লাকড়ির পাশে। বাড়ির মুরুব্বি যিনি, তাকে দিয়ে চুলা ধরানোর উদ্বোধন করা হতো।

মেমানি খাওয়ানোতে বিভিন্ন গ্রুপ: এত লোকের আয়োজনে নিয়মানুবর্তিতা জরুরি বিধায় লোকজনদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দায়িত্ব দেওয়া হতো। মাটির পেয়ালায় রান্না করা গরুর মাংস, মাছ, ডাল, মিডুরি দেওয়া হতো। এক গ্রুপ মাংস, অন্য গ্রুপ মাছ, অন্যরা ডাল, মিডুরি ও পানি দেবে, এভাবে। বাবুর্চিকে বলা থাকত নির্দিষ্ট লোক বা গ্রুপ ছাড়া তরকারি বা খাবার দেবে না।

শেষকথা: গ্রামে এখন আর মেমানি, মেজবানি বা জিয়াফতের আয়োজন করে না কেউ। একান্নবর্তী পরিবারগুলো হারিয়ে গেছে। সবাই হয়ে গেছে আত্মকেন্দ্রিক। একান্ত নিজের মানুষ ছাড়া কেউ কাউকে এক বেলা খাওয়ায় না এখন। মেমানি, জিয়াফত বা মেজবানি তো অনেক খরচের ব্যাপার। এখনকার বাবা-মা মারা গেলে মেমানি করার মন-মানসিকতা থাকে না সন্তানের। পরিবর্তনের হাওয়ায় সব বদলে গেছে। আজকের প্রজন্ম বুঝবেই না মাটিতে চাটাইয়ে বসে কলাপাতায় ভাত খাওয়ায় কি মজা আর কি আনন্দ। আধুনিকতায় গা ভাসানো ও সংসারের আয়োনিক বন্ধন ভেঙে যাওয়ায় হারিয়ে গেছে মেমানি, মেজবানি বা জিয়াফতের মতো গ্রামীণ ঐতিহ্য। যা কেবল স্মৃতিময় হয়ে আছে মধ্য বয়সি প্রজন্মের।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক


সড়কে মৃত্যুর মিছিল: দায়ী কে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এম এ মান্নান

কথায় আছে যেখানে ঠেকবে সেখানেই শিখবে; কিন্তু আমি এই কথার কোনো সত্যাসত্য খুঁজে পাচ্ছি না। তবে দিব্যজ্ঞানে যেটা ঠাওর করতে পারছি সেটা হলো উল্টো বুদ্ধির লোপ পায় বা হতবুদ্ধি হয় বা বুদ্ধির বৈকল্য ধরা পড়ে। যদি তাই না হতো তাহলে প্রতি বছর এবং বারবার এত এত সড়ক দুর্ঘটনা এবং এত এত অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটবে কেন? এত এত লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটবে কেন? এত এত মানুষ মারা যাবে কেন? কই এর তো কোনো স্থায়ী সুরাহা দেখতে পাচ্ছি না। নাকি এখানে শেখার কিছু নেই। শুধু ঠেকেই যাবে?

দেশে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই কেবল প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসে। ব্যাপারটা এমন যে কাজ নেই তো খই ভাজ। একটি তদন্ত কমিটি হয়। কমিটি আদা-জল খেয়ে কয়েক দিন দৌড়ায়। ওই পর্যন্তই। শুধু শুধু ব্যস্ত হওয়া। ফল যে লাউ সেই কদু। আমরা আশায় থাকি শুধু শুধু।

দেশে কী পরিমাণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি আছে চট্টগ্রাম-১১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২০২১ সালে সংসদের প্রশ্নোত্তর-পর্বে বলেছিলেন, দেশে ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি ফিটনেসবিহীন গাড়ি আছে। এরপরও কি বোঝার বাকি থাকে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ কী? কারা দায়ী? নিশ্চয় এই তিন বছরে ওই ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো ফিটলেস হয়ে গেছে। নতুন করে আরও শত শত গাড়ি ফিটনেস হারাচ্ছে। যেগুলোকে আমরা বলি লক্কর-ঝক্কর, ধাক্কা না দেওয়া পর্যন্ত খাড়াইয়া পড়।

আমরা প্রায়ই দেখতে পাই রাস্তায় গাড়ি বিকল হয়ে যেতে। গাড়ির যাত্রীদের গাড়ি থেকে নেমে ধাক্কা দিতে, নিদেনপক্ষে আরেক গাড়ি এসে তাকে ধাক্কা দিতে। ফাঁকে দেখি গাড়ির মাদকাসক্ত চালককে আরাম-আয়েশ করে মাদক ফুঁকতে। এমনতর ধুঁকে ধুঁকে চলা গাড়ি আর মাদক ফুঁকে চলা চালকের কাছে যাত্রীরা কী নিরাপত্তা পাবে? যেখানে গাড়ির চালক বসেন তার মাথার ওপরে প্রায়ই একটা লেখা চোখে পড়ে। দোয়া কুনুত। লা-ইলাহা...। এখন বুঝতে পারছি এ দোয়ার শানেনজুল কী। গাড়ি এবং চালকের কারও প্রতি যাত্রীদের ভরসা নেই। একমাত্র ভরসা আল্লাহ মালেকশাই।

গোড়ায় গলদ একটা কথা আছে। এটার শানেনজুল আবার একটু তাড়াতাড়ি বুঝতে পারছি। গাড়ির যিনি চালক হবেন তাকে দক্ষ এবং যোগ্য হতে হবে। এবং গাড়ির শতভাগ ফিটনেস থাকতে হবে। এটার ঘাটতি থাকলেই গোড়ায় গলদ। এখানে দুটোরই চরম সংকট। আর বড় গোড়ায় গলদ হলো যারা এসবের অনুমোদন দেন তারা। এর থেকে বড় গলদ আর নেই।

বেশ কয়েক বছর আগে সম্ভবত ২০১৯ সালের ঘটনা। তখন সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু নিয়ে রাজধানী প্রায় অচল করে দিয়েছিল ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা। তাদের উত্তেজনা প্রশমন করতে প্রশাসনকে অসীম বেগ পেতে হয়েছিল। তারা নিজেরাই রাজধানীর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছিল। আর সরকারি চাকুরে ট্রাফিক পুলিশরা অন্দরমহলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অতিশয় আশ্চার ব্যাপার হলো যারা কোনোদিন জানত না ট্রাফিক পুলিশ কী জিনিস, সিগন্যাল কী জিনিস সেই তারাই দায়িত্ব নিয়ে নিল সারা রাজধানীর ট্রাফিকের নিয়ন্ত্রণ। গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না, গাড়ির ফিটসেন আছে কি না। কাগজ ঠিক আছে কি না- এসব তল্লাশি করতে বেশুমার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছিল। অবাক করা কাণ্ড হলো তাদের তল্লাশি থেকে বাদ পড়েনি মন্ত্রী-এমপিদের গাড়ি পর্যন্ত। অনেকে তল্লাশির ভয়ে বিকল্প পথ ধরে পগারপার হয়েছেন। এখানেই বলা যায় যেখানে ঠেকবে সেখানেই শিখবে। তারা ঠেকেছে, তারা শিখেছে, তারা কাজ করে দেখিয়েছে এবং তারা সফল হয়েছে।

কারা ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারেন তাদের পক্ষে কোনো এক মন্ত্রীর সরল উক্তি ছিল, গাছের ছবি দেখে যে বলতে পারবে এটা গাছ, মাছের ছবি দেখে যে বলতে পারবে এটা মাছ সে-ই গাড়ির চালক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবে। অর্থাৎ প্রতীক চিনতে পারলেই তিনি যোগ্য হবেন। অবশ্য কী কারণে যেন ওই মন্ত্রী পরে অনেক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুয়ায়ী গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৩ হাজার ৫৬২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এসব দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৩১৭ জন লোক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫ হাজার ১৭২ জন। গত বছরের তুলনায় এবার সড়ক দুর্ঘনা এবং মৃত্যু দুটোই বেশি। চলতি বছর তিন মাসে প্রায় দেড় হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং নিহত হয়েছে ১৩৬৭ জন।

আমরা সবাই জানি যে প্রতি ঈদের সময় বিপুলসংখ্যক লোক বাড়ি ফেরেন। আবার ঈদপরবর্তী সময়ে বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরেন। ফলে যাওয়া এবং আসার সময় সড়কে যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পায়। এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এটাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামানো- এটা কিন্তু স্বাভাবিক নয়। আরও স্বাভাবিক নয় অদক্ষ-অযোগ্য গাড়ির চালক দিয়ে গাড়ি চালানো; কিন্তু আমরা বাস্তবে তাই দেখতে পাচ্ছি। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের নিত্যসঙ্গী হচ্ছে, রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল ভারী হচ্ছে। যা কখনো কাম্য নয়।

অতি সম্প্রতি দেশে ঘটে গেল ভয়াবহ দুটি সড়ক দুর্ঘটনা। যা গা শিউরে ওঠার মতো। ভয়াবহ ওই সড়ক দুর্ঘটনার একটি ঘটে ফরিদপুরে। ওই ঘটনায় বাস এবং পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে নারী ও শিশুসহ ১৪ জন নিহত হয়েছেন। আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে ঝালকাঠিতে। এতে ট্রাক-প্রাইভেটকার ও ইজিবাইকের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষে ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। এই দুটি ঘটনাই কি দিবালোকের মতো পরিষ্কার নয়, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা কোথায়।

সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা হামেশাই যে কথাটি শুনতে পাই বা দেখতে পাই তা হলো বাসের সঙ্গে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ বা ধাক্কা, বাসের সঙ্গে ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ বা ধাক্কা, নইলে গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কা ইত্যাদি। আর এসবের মূলে যা শুনতে পাই তা হলো গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানো। ফলে বাস বা ট্রাককে প্রায়ই দেখা যায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে বা নদীতে পড়ে থাকতে।

কথায় আছে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? এই যে যত্রতত্র ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে এর জন্য দায়ী কিন্তু অদক্ষ গাড়ির চালক এবং ফিটনেসবিহীন বা মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি। তাই এর দায় কিন্তু প্রশাসন এড়াতে পারবে না। রাস্তায় যেসব গাড়ির চালক গাড়ি চালাচ্ছেন তাদের নিয়ে শঙ্কার শেষ নেই। এসব চালকের বেশির ভাগের গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। আবার যাদের আছে তাদের অনেকের লাইসেন্স জাল। এ ছাড়া আছে অপ্রাপ্ত বয়স্ক গাড়ির চালকও। আবার অনেক চালক আছেন যারা নেশাগ্রস্ত। তারা নেশা করেই গাড়ি চালিয়ে থাকেন। একজন গাড়ির চালক যদি নানা দোষে দুষ্ট থাকেন এবং তিনি যে গাড়িটি চালান সেটি যদি ফিটনেসবিহীন গাড়ি হয়ে থাকে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে থাকে তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে এটাই তো বাস্তবতা, এটাই স্বাভাবিক। অথচ মোটরগাড়ি চালনা আইনের ধারা ৪ এবং ৫-এ উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে। অন্যথায় তিনি আইন লঙ্ঘনের দায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অথবা অনধিক ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন; কিন্তু আমরা কি এসবের বাস্তবতা দেখতে পাই। পাই না।

কাজির গরু নাকি কেতাবে থাকে গোয়ালে থাকে না। আমাদের সড়কে যানবাহন আইনের ক্ষেত্রেও তাই। আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। যদি সড়কে যানবাহন আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হতো এবং দক্ষ ও যোগ্য গাড়ির চালক গাড়ি চালাতেন এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির নিবন্ধন বাতিল করা হতো তাহলে সড়কে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিল রোধ করা যেত; কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে। কিন্তু গত দুই দিনে দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় যে ২৮ জন লোক প্রাণ হারাল এর দায়ভার কে নেবে?

সব শেষে যে কথা বলব তা হলো আইনের সঠিক প্রয়োগ। দেশে লাখ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে। সবার আগে এসব গাড়ির নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। আর যিনি রাস্তায় গাড়ি চালাবেন তাকে অবশ্যই দক্ষ এবং যোগ্য চালক হতে হবে এবং গাড়ি চালানোর বৈধ সনদ থাকতে হবে। আর যে গাড়িটি সড়কে চলবে সেটিও হতে হবে শতভাগ চলাচলের উপযোগী। কোনোভাবেই মেয়াদোত্তীর্ণ নয়।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক


খন্দকার আসাদুজ্জামান: অবিস্মরণীয় একটি নাম

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
খন্দকার হাসানুজ্জামান

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে গঠিত মুজিবনগর সরকারের অর্থসচিব, ভাষাসৈনিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যার অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে, যিনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের লোভনীয় সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধা উপেক্ষা করে মাতৃভূমির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে সর্বদা কাজ করে গেছেন, আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি কেবল ভূমিকাই রাখেননি পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশের উপযোগী প্রশাসন গড়ে তোলার সব পরিকল্পনা ও নীতি-নির্ধারণে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ভাষা আন্দোলনেরও একজন বলিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।

রাজনীতি ও দেশের বৃহত্তর কল্যাণে অগ্রাধিকার বিবেচনায় তিনি তার কর্মপরিকল্পনা সাজিয়ে ছিলেন। শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী হিসেবে তিনি তার এলাকার বাইরেও বৃহত্তর পরিসরে কাজ করে গেছেন। চাকরি জীবনের শুরু থেকেই সৎ এবং কর্মনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে তার সুখ্যাতি রয়েছে। রাজনীতিতেও তিনি যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। তিনি সরকারি চাকরি শেষে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন।

মরহুম খন্দকার আসাদুজ্জামান টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের নারুচী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৫ সালের ২২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তাদের ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি ওই এলাকায় ‘মিয়া বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত। পিতা মরহুম খন্দকার আব্দুস সামাদ এম এ (এলএলবি) ছিলেন বহুমুখী প্রজ্ঞার অধিকারী একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। খ্যাতনামা উকিল হিসেবে তার অবদান ছিল সুদৃঢ়। এলাকায় তো বটেই এমনকি টাঙ্গাইল বারেও তিনি ‘সামাদ উকিল’ হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। খন্দকার আব্দুস সামাদ স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তার মা ছালেমা খাতুন। বর্তমান গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বেরুয়া গ্রামের তৎকালিন ঢাকা জেলার প্রথম মুসলিম ডাক্তার শামসুদ্দিন খান সাহেবের একমাত্র কন্যা। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, ধর্ম পরায়ণ দানশীলতার খ্যাতি ছিল চারদিকে।

মরহুম খন্দকার আসাদুজ্জামানের কর্মজীবন ছিল বেশ বর্ণাঢ্য ও ঘটনা বহুল। ১৯৬০ সালে প্রতিযোগিতামূলক পাকিস্তান সুপ্রিয়র সার্ভিস (সিএসপি) কেডারে যোগদান করেন। প্রায় ৩০ বছর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সর্বত্র তিনি সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৫৮ সালে রাজশাহীতে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের যুগ্ম অর্থ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গঠিত প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অর্থ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। এই কর্মবীর মানুষটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO), এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকে (ADB) বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন একাধিকবার। এমনকি অবসর গ্রহণের পরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে তার মধ্যে WORLD BANK, UNDP অন্যতম।

১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত শিল্প সচিব ১৯৭২-১৯৭৩ পাট সচিব ১৯৭৪-১৯৭৫ এবং ১৯৮৭-১৯৮৯ ভূমি সচিব ১৯৮৬-১৯৮৬ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সচিব ১৯৯০-১৯৯১: পরিকল্পনা সচিব ১৯৯১-১৯৯৩। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে খন্দকার আসাদুজ্জামান একটি অবিস্মরণীয় নাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা জাতি চিরকাল তাকে স্মরণ করবে। সরকারি উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকেও মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। মুজিবনগর সরকারের অর্থ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালান।

মাত্র ৬০০০ টাকা নগদ তহবিল নিয়ে মুজিবনগর সরকারের অর্থবিভাগের দায়িত্ব নেন এবং সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেওয়ার পর তার মনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হয়, তিনি বুঝতে পারেন দেশের অবস্থা খুবই খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে দেওয়ায় তিনি তখন নিশ্চিত হন, রাজনৈতিক দুর্যোগ অতি নিকটে। এই সময়, দেশে চলছে অসহযোগ আন্দোলনে বাঙালি জাতি যে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা লাভের আশায় তাতে তিনি একজন সচেতন নাগরিক ও একজন রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে কীভাবে ভূমিকা পালন করা যায় ভাবছিলেন তখন পরিস্থিতি ক্রমেই জটিলতার দিকে ধাবিত হতে দেখে তিনি আরও কিছু সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন। এই বৈঠক হয় সালাউদ্দিন সাহেবের বাসায়। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সালাউদ্দিন, মুজিবুল হকসহ আরও বেশ কয়েকজন সিএসপি অফিসার। বৈঠকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।

১ মার্চ সংসদ অধিবেশন বন্ধ করে দেয় যা ৩ মার্চ হওয়ার কথা ছিল, বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ হতে ৬ মার্চ সারা দেশে হরতালের কর্মসূচি দেন। ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণে স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, যার কাছে যা আছে তাই নিয়েই প্রস্তুত থাকো, শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। শেষে বললেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’

ঢাকা, জয়দেবপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে এবং এমভি সোয়াতে অস্ত্র আনাতে পাকিস্তানি সরকারের কুমতলব সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ খন্দকার আসাদুজ্জামান তার নিজ জেলা শহর টাঙ্গাইলে চলে আসেন। সেখানে গিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ২৪ মার্চ তার এক আত্মীয় ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে আসেন তার মাধ্যমে ঢাকা একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে জানতে পারেন। ২৫ মার্চ আলোচনা ভেঙে যায়।

টাঙ্গাইলে বসেই তিনি ঢাকার সব ঘটনার তথ্য পান। ২৬ মার্চ সকালেই তিনি টাঙ্গাইলের সব রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে আলোচনায় বসেন এবং আগামী দিনের কর্মসূচি সম্পর্কে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ওই দিনই টাঙ্গাইল জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আর এই সংগ্রাম পরিষদের পরামর্শ দাতা হিসেবে খন্দকার আসাদুজ্জামানকে উপদেষ্টা নির্বাচিত করা হয়। তিনি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে ওই দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আরও শক্তিশালী করে তোলার জন্য ঝড়ের বেগে বিভিন্ন স্থানে চষে বেড়ান, অস্ত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের জন্য ময়মনসিংহ যান। সেখানে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা রফিকউদ্দিন ভূইয়া, সৈয়দ আব্দুস সুলতান সহনবেশ কয়েকজন নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেন জেলা প্রশাসকের বাসায়।

তিনি সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার চেষ্টা বেশ প্রশংসনীয়। তারপর তিনি জয়পুরহাট ও হিলি হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছে তিনি মালদা জেলার ডিসির সঙ্গে দেখা করেন এবং সংবাদ পান আরও কিছু নেতৃত্ব স্থানীয় নেতারা ভারতে আসছেন। তিনি কলকাতা গিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামরুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন। সরকার গঠনের বিষয়েও আলাপ-আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে নেতারা খন্দকার আসাদুজ্জামান ও নুরুল কাদের খানকে একটি সরকারের কাঠামো তৈরি করার দায়িত্ব দেন।

মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের অপরাধে সরকার খন্দকার আসাদুজ্জামানকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং তাকে ধরার জন্য ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। তার সঙ্গে আরও ১২ জন সিএসপি অফিসারের ও বিচার করে একই মেয়াদের কারাদণ্ড প্রদান করে। সঙ্গে সঙ্গে দণ্ডিত অফিসারদের সম্পত্তির ৫০ ভাগ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে খন্দকার আসাদুজ্জামানের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে চিরদিনের জন্য লেখা থাকবে।

রাজনীতি: ১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর বৃহত্তর গণমানুষের কল্যাণে কাজ করার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এ ক্ষেত্রে তিনি হয়ে ওঠেন গণমানুষের মধ্যমণি, বিশেষ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটি আশার আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখা দেন। সেই ১৯৭৩-এর পর থেকে ১৯৯১-এর জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত এই আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া ছিল।

স্বীয় যোগ্যতা ও বাবার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তিনি চলে আসেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে টাঙ্গাইল ২ গোপালপুর -ভূয়াপুর আসন থেকে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘদিন পর আসনটি পুনরুদ্ধার করেন।

কারাবরণ : দেশের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকায় খন্দকার আসাদুজ্জামান তার বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হন একাধিকবার। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ৯২-এর ক ধারা বলে গভর্নর শাসন ও জরুরি ঘোষণার পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে কারাবরণ করতে হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর পাকিস্তানিদের দোসর তৎকালিন খুনি সরকার তার ওপরও নির্মম খড়গ চালায়। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় চার নেতার সঙ্গে তাকেও কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।

অবদান: নিজ এলাকা দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার নানাবিধ অবদান আজ স্বীকৃত। মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সুবিদিত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও দেশের হয়ে কাজ করেছেন সুনাম ও সাফল্যের সঙ্গে। এলাকার উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা তার চাকরি জীবনের শুরু থেকেই। তিনি টাঙ্গাইলে বিশেষ করে গোপালপুর ভূঞাপুরের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা।

সন্তান : তার জ্যেষ্ঠপুত্র খন্দকার মাহবুব উজ্জামান ২০০৮ সালের ৭ মে তারিখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তিনি কম্পিউটার সায়েন্সের একজন উচ্চতর ডিগ্রিধারী ছিলেন। তিনি জেম নিট ওয়ারের এমডি ছিলেন। ছোট ছেলে খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল বিকম (অনার্স) এমকম করেন। তিনি বেশ কয়েকবার বিজিএমইএ-এর সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। বহুবার FBCCI প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী ঢাকা ক্লাবের দুইবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।

বড় মেয়ে অপরাজিতা হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ এমএ করেছেন। তিনি সংরক্ষিত মহিলা আসনের টাঙ্গাইলের এমপি। বড় মেয়ে অপরাজিতা হকের স্বামী বিশিষ্ট সাংবাদিক, একাত্তর টিভির সিইও মোজাম্মেল হক বাবু। ছোট মেয়ে তামান্না জামানের স্বামী কমিউনিটি ব্যাংকের এমডি ও সিইও মাশিহুল হক চৌধুরী। ছোট মেয়ে তামান্না জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে বিএসসি অনার্সসহ এমএসসি(ফার্স্ট ক্লাস) তিনি ১৯৯৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তিনি তখন মুজিবনগর সরকারি কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন।

তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার মিন্টু রোডের বাসায় এবং তার নির্দেশ মোতাবেক ১৯৯৬-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শুধু টাঙ্গাইল ২ গোপালপুর-ভূঞাপুরে নয়- সারা বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে, সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন, স্বাধীনতার চেতনার কথা বলেন, কি কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, কি কারণে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, জাতির জনকের কি স্বপ্ন ছিল,

অনেক সময় বক্তব্য দিতে গিয়ে এতটা আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন যে তার মনের অজান্তেই দুচোখ ছলছলে করে উঠত এবং এটা দেখে ওই সভারও অনেকেরই দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত বিশেষ করে জাতির জনকের পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা যখন বলতেন। দেশের স্বার্থে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানান। পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল ২ গোপালপুর-ভূঞাপুর থেকে দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ১৯৭৩-এর পর থেকে আওয়ামী লীগের এই আসনটি হাতছাড়া হয়েছিল, সেই আসনটি ১৯৯৬-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে আসনটি পুনরুদ্ধার করেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

পরবর্তীতে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। সাফল্যের সঙ্গে তিনি এই অর্পিত দায়িত্ব পালন করে প্রশংসিত হন। সাফল্যেরই নন্দিত নাম যেন মরহুম খন্দকার আসাদুজ্জামান। তিনি ২৫ এপ্রিল ২০২০ সালে ইন্তেকাল করেন। আমরা তার বিদেহি আত্মার শান্তি ও জান্নাত কামনা করি। আমিন।

লেখক: পরিবেশবিদ ও কলামিস্ট


তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সমীরণ বিশ্বাস

সূর্যের জ্বলন্ত রশ্মিতে যেন টগবগে আগুন ঝরছে। নিজের উত্তাপ শক্তিমত্তা জানান দিতে বিন্দুমাত্র ছাড় দিচ্ছে না শহর, গ্রাম, পথ-ঘাট, সড়ক-মহাসড়ক সবখানেই সূর্যের খরতা! পিচঢালা পথ যেন জ্বলন্ত উনন! জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা এ জীবন যেন ওষ্ঠাগত! গত কয়েক দিন, দেশজুড়ে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহে তেতে উঠেছে প্রাণিকুলও। বাতাসেও আগুনের ছটা। মৌসুমের প্রথম তাপপ্রবাহই চলতি মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। টানা কয়েক দিন ধরেই তাপমাত্রার পারদ চড়াই হয়ে উঠেছে চুয়াডাঙ্গায়। এখন থেকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড সীমান্তবর্তী এ জেলায়। তাপমাত্রার উত্তাপ ছড়িয়েছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে- যা অতি তীব্র দাবদাহ! এরই প্রভাবে কোথাও কোথাও গলে যাচ্ছে রাস্তার পিচ! দেশের অন্য জেলাগুলোও পুড়ছে খরতাপে। পশ্চিম-দক্ষিণ অঞ্চলে বয়ে যাচ্ছে ৪১ ডিগ্রি তীব্র দাবদাহ। দেশের অন্য জেলাগুলোও পুড়ছে অতি তাপপ্রবাহে। এদিকে প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে না পেরে অনেকেই অচেতন হয়ে পড়ছেন। দেখা দিচ্ছেন নানাবিধ রোগব্যাধি ও স্বাস্থ্য সমস্যা। তীব্র গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। প্রয়োজন ছাড়া কেউই বের হচ্ছে না ঘর থেকে। অনেকেই বের হচ্ছেন ছাতা নিয়ে। গরমে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন কর্মজীবীরা। আবহাওয়া অফিসের মতে দেশজুড়ে গরমের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে।

আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটাকে মৃদু দাবদাহ বলে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে গেলে ধরা হয় মাঝারি দাবদাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে ধরা হয় তীব্র দাবদাহ চলছে। ঢাকায়, চুয়াডাঙ্গা ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে তীব্র দাবদাহ চলছে।

আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরসহ সারা দেশই আজ শ্যামল সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তরের অত্যন্ত অভাব; কিন্তু বিদেশে এমনটি হয় না। সেখানে নগর পরিকল্পনার সময়ে উদ্যান ও প্রান্তরের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়। সুতরাং মানুষকে বাঁচতে হলে তার আদিম জীবনের প্রতিবেশী গাছ-তরুলতাকেও বাঁচাতে হবে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে তাই বিজ্ঞানীরা রব তুলেছেন, পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে গাছ-তরুরাজির শ্যামল ছায়ায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে তাই বৃক্ষ রোপণের প্রয়োজনীয়তা আছে।

ঐতিহ্যের শহর ঢাকা। চার শ বছরের পুরাতন ঢাকাকে বলা হয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের নগরী। ১৩৪ বর্গ মাইলের এ শহরে বাস করে ১ কোটি ৪১ লাখ মানুষ। বর্তমানে জনসংখ্যা আরও অনেক বেশি। ধারণা করা হয় প্রায় ২ কোটির কাছাকাছি। প্রতি বর্গ মাইলে ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষের বসবাস বলা চলে এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। বিশ্ব ব্যাংক বলছে ২০৩৫ সাল নাগাদ জনসংখ্যা ৩ কোটি ৫০ লাখ হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাল, নদী, ডোবা, বৃক্ষ নিধন করে ঘর-বাড়ি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে ফলে পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। কমে যাচ্ছে সবুজের পরিমাণ।

জাপানের কিয়োটো ও হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন গবেষক ঢাকা শহরের সবুজ নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের মতে ১৯৯৫ সালে ঢাকার সবুজ অঞ্চল ছিল ১২ %, ২০১৫ সালে ৮% এবং বর্তমানে ৬-৭%-এর বেশি না। ঢাকায় যত পরিমাণে গাছ কাটা হয় তার অল্প পরিমাণই রোপণ করা হয়। বৃক্ষ নিধনের ফলে ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বত্রই এই একই চিত্র বিরাজমান।

প্রকৃতির এই আগুনঝরা তীব্র দাবদাহ বাড়িয়ে দিয়েছে; দেশজুড়ে বৈধ-অবৈধ ইটের ভাটা, শহর ও নগর অঞ্চলে মিল-কারখানা, শপিংমল, দোকান, মার্কেট, হোটেল-মোটেল, বাসাবাড়ি, সর্বক্ষেত্রে এসির ব্যবহার প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গিয়েছে। তারই সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অপরিকল্পিত বৈধ-অবৈধ ব্যাটারি, সিএনজি, ডিজেল, পেট্রোলচালিত গাড়ি, রিকশা, অটোরিকশা বিভিন্ন যানবাহন, যার প্রতিটি কর্মকাণ্ড তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কার্যকর প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন রকমের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহারের ফলেও প্রতিনিয়ত উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। দেশজুড়ে নদী-নালা,খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, ভরাটের যেন একটি মহোৎসব চলছে! এসব কর্মকাণ্ডই আজকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত তীব্র তাপপ্রবাহের জন্য দায়ী। আমাদের দৈনিক কৃতকর্ম সংবরণ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা কষ্টসাধ্য এবং চ্যালেঞ্জিং হবে। শুধু বৃক্ষ রোপণ করেই এই সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন করা কঠিন হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটগুলো ফসলের উপকারী পোকামাকড়ের অস্তিত্বকেও এখন হুমকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে কৃষিতে নির্বিচারে রাসায়নিক ও কীটনাশক প্রয়োগ। যার ফলে এই অযাচিত কীটনাশক ফসলের মাটিতে মিশে মাটির কার্বন নিঃসরণকে বাড়িয়ে তুলছে; যার কারণে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে।

দাবদাহে কৃষি খাতে বিপর্যয়ের শঙ্কা ও করণীয়

তীব্র দাবদাহে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের কৃষি খাত। দিন দিন দেশব্যাপী তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। ৩৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা ধানের জন্য অসহনীয়, দেশে চলছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা! যা সার্বিক ধান উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় অন্তরায়! এই অতি দাবদাহে ধান ছাড়াও আম, কাঁঠাল, লিচু ও তুলাসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। ভুট্টা ও সোয়াবিন উৎপাদনেও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তীব্র দাবদাহে ফল-ফসলের ব্যবস্থাপনা

বোরো ধানে হিটশক ( তাপজনিত ক্ষতি) বা গরম বাতাস (৩৫ ডিগ্রি C+) প্রবাহ হলে ধান চিঁটা হতে পারে। তাই জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি, কাইচথোড় (Panicle stage of rice) হতে ফুল ফোটা পর্যায় পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে। আম, কাঁঠাল এবং লিচুগাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত (৭ থেকে ১০ দিন অন্তর) সেচ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে গাছের শাখা-প্রশাখায় পানি স্প্রে করে দিতে হবে। প্রয়োজনে প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া যেতে পারে। এতে ফল ঝরে পড়া কমবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া মাটিতে রস ধরে রাখার জন্য সেচের পর গাছের গোড়ায় মালচিং দেওয়া যেতে পারে।

তীব্র দাবদাহে সবজি ফসলের ব্যবস্থাপনা

ফল এবং পাতাজাতীয় সবজির জমিতে আগামী এক সপ্তাহে মাটির ধরন বুঝে প্রয়োজনীয় দুই থেকে তিনটি সেচ ব্যবস্থা করতে হবে। জৈব সারের পানি ধারণক্ষমতা বেশি, সে জন্য জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। ফল এবং সবজির চারাকে তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য মালচিং ও সেচ নিশ্চিত করতে হবে। চলমান তাপপ্রবাহের কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিতে হবে।

তীব্র দাবদাহে প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনা

প্রাণিসম্পদের তাপপ্রবাহজনিত পীড়ন (স্ট্রেস) সহনশীল করতে, গবাদিপশু, পোলট্রির ঘর শীতল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। গবাদিপশুকে দিনে একাধিকবার গোসল করিয়ে দিতে হবে অথবা পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। গবাদিপশুকে পানির সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ, ভিটামিন সি এবং গ্লোকোজ ইত্যাদি মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। দাবদাহের এই সময় গবাদিপশুকে ঘরে আবদ্ধ না রেখে গাছের বা প্রাকৃতিক ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। গবাদিপশুকে এই সময় শুকনো খড় না দিয়ে কচি সবুজ ঘাস খেতে দিতে হবে। অতি দাবদাহে খাবার কমিয়ে দিতে হবে। প্রচণ্ড গরমের সময় গবাদিপশুকে কৃমিনাশক, টিকা কিংবা প্রাণীর পরিবহন পরিহার করতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি হলে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

তীব্র দাবদাহে মৎস্য সম্পদ বাঁচাতে ব্যবস্থাপনা

তুলনামূলক কম গভীরতার পুকুরে নতুন পানি যোগ করে গভীরতা কমপক্ষে ৫ ফুট করতে হবে যাতে নিচের পানি কিছু ঠাণ্ডা থাকে এবং মাছ সেখানে থাকতে পারে। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে পানির মধ্যে মাচা করে লাউজাতীয় গাছ লাগিয়ে পুকুরে ছায়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পুকুরের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ জায়গায় চারদিকে বাঁশের ঘেরাও দিয়ে কচুরিপনা/ নারকেলগাছের পাতা রাখা যেতে পারে। দিনের বেলায় রোদের সময় অর্থাৎ দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গভীর নলকূপ থেকে পানির সরবরাহ করে কমপক্ষে ৫ ফুট বা তার বেশি পানির উচ্চতা বজায় রাখতে হবে। সকালবেলায় শতকে ২০০-২৫০ গ্রাম লবণ বা ১০০ গ্রাম ভেট স্যালাইন গুলে পুকুরে ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। রাতের বেলায় এরেটর/ব্লোয়ার/মেশিন (পুকুরের পানিকে ফোয়ারা বা ঘুরনি তৈরি করে বাতাসের অক্সিজেনকে পানিতে দ্রুত মেশাতে সহায়তা করে) চালিয়ে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে অন্যথায় শতকে ১০ গ্রাম হারে অক্সিজেন ট্যাবলেট পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরের পানি স্বাভাবিক ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত পুকুরে খাবার সরবরাহ কমিয়ে দিতে হবে বা প্রয়োজনে সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে। সকালে এবং সন্ধ্যার পর খাবার অল্প করে দিতে হবে। ভিটামিন-সি মিশিয়ে (৭-৮ গ্রাম/কেজি খাদ্যে) খাদ্যের সঙ্গে খাওয়াতে হবে তাপমাত্রা স্বভাবিক না হওয়া পর্যন্ত। এ সময় দিনের বেলায় মাছ/পোনা স্থানান্তর বন্ধ রাখতে হবে বা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। গত কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মারাত্মক দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। তাই আসুন আমরা সবাই সতর্ক হই এবং অন্যকে সতর্ক করি।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ


সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তোয়াব খান

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এম নজরুল ইসলাম

ইতিহাসের সাক্ষী তিনি। সেই কবে থেকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখছেন সময়ের বয়ে চলা ও পরিবর্তন। জন্ম ব্রিটিশ ভারতে। এরপর পাকিস্তানি শাসন পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ। সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেছেন। দেখেছেন একাত্তর। ধারণ করে চলেছেন একাত্তরের চেতনা। অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে, একজন বিপ্লবী কলম সৈনিক হিসেবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত হতো তার ‘পিণ্ডির প্রলাপ’। তার জীবনকে কোনো মামুলি জীবন বলা চলে না। ইতিহাসের সাক্ষী হতে হতে তিনি আজ নিজেই তো এক ইতিহাস। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে নানা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এক মানুষ তিনি। তার জীবনখাতার পাতাগুলোও তো কম বর্ণিল নয়। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে তিনি এক উজ্জ্বল তারকা। সাংবাদিকদের সাংবাদিক তিনি এতে কোনো সন্দেহ নেই। পেশাগত জীবনে ছয় দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসে আজ তিনি নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। সব সময়ে সমসময়ের প্রতিনিধি। তাই যথার্থ আধুনিক। সেই আধুনিকতার প্রতিফলন তার পেশা ও ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পরতে।

একালের গায়ক নচিকেতার গানে আছে, ‘অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন/ শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন’। ৮৫ বছরের মুখর জীবনে মিডিয়ার মহীরুহপ্রতিম এই মানুষটির পথচলাও যেন অন্তবিহীন। ব্যক্তি জীবনে যেমন স্মার্ট আর স্টাইলিশ তিনি; তার লেখনীও তেমন নির্মেদ আর তীক্ষ্ণ। যদিও পাঠক হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, তিনি লিখেছেন কম, লিখিয়েছেনই বেশি। আপাত গম্ভীর এই মানুষটিকে আবিষ্কারই করতে হয়। এই আবিষ্কারের আরেকটি গূঢ় কারণ হচ্ছে, তার জীবন তো কোনো মামুলি জীবন নয়। চলমান এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনকালে শুরু যে পথের, তা আজও বহমান। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে নিজেকে সঠিক খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এ জন্যই তিনি সমসাময়িক। আধুনিক।

তিনি এক অসাধারণ গল্পকথক। অনুপুঙ্খ বলে যান আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। দীর্ঘ সময়ের প্রতিটি ঘটনা তার নখদর্পণে। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগই নেই। তার চেতনায় একাত্তর, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। সাংবাদিক হিসেবে তিনি পরিবর্তনগুলো যেমন দেখেছেন, তেমনি সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবেও দেখেছেন খুব কাছ থেকে। খুব কাছে থেকে স্বাধীনতার মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছেন। ১৯৭৩-৭৫-এ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুই বেছে নিয়েছিলেন তাকে। ছিলেন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের প্রেস সচিব। ১৯৮০-৮৭-তে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। পালন করেছেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্বও।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার সাতক্ষীরার রসুলপুরে। পড়েছেন সাতক্ষীরার সার্ধশত বছরেরও বেশি পুরোনো পিএন (প্রাণনাথ) স্কুলে। স্কুলের পাট চুকিয়ে ঢাকায় কলেজে পড়তে আসা। বছর না ঘুরতেই ভাষা আন্দোলনে উত্তাল দেশ। ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় হলেন। এর পর থেকেই ভেতরে ভেতরে একটা পরিবর্তনের হাওয়া। অজান্তে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দীক্ষা। বদলে যায় জীবনের গতিপথও। ক্রমেই শিকেয় উঠছে পড়াশোনা। পেয়ে বসে বিপ্লবের নেশা। ১৯৫৩ সালে কেজি মুস্তফার সঙ্গে বের করেন সাপ্তাহিক জনতা। এর মধ্য দিয়েই হাতেখড়িও হয়ে যায় তার সাংবাদিকতা জীবনের। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন সংবাদে। ১৯৬১ সালে সংবাদের বার্তা সম্পাদক। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে। বার্তা সম্পাদক হিসেবেই। ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। সত্যবাক নামে দৈনিক বাংলায় শুরু করেন ‘সত্যমিথ্যা, মিথ্যাসত্য’ শিরোনামে বিশেষ কলাম। এ কলামে উঠে আসে একটি স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক চিত্র। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একেকটি মাইলফলক রচিত হয়েছে তারই নেতৃত্বে। প্রথম চাররঙা সংবাদপত্র এর মধ্যে একটি। ‘সবসময়েই পাঠকরাই আমার প্রাইমারি কনসার্ন’, এ কথা সব সময় বলেন তিনি। তার একমাত্র বই ‘আজ এবং ফিরে দেখা কাল’।

বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ‘সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান’ বলতে যা বোঝায়, তার শেষ সলতে তিনি। না, নিজেকে মানিক মিয়া কিংবা জহুর হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তুলনা করেন না কখনো। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ওরা যে-সাংবাদিকতা করেছেন, তার ধারে-কাছেও আমরা নেই।’ কিন্তু আমরা জানি, সাংবাদিক হিসেবে সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য কর্মজীবন তার। সম্পাদকদের সম্পাদক তিনি। দেশের সংবাদপত্র জগতের প্রিয়মুখ। ২০১৬ সালে একুশে পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে তাকে। একই বছর ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমি সম্মানিত ফেলো হিসেবে নির্বাচিত করেছে। অগ্রজপ্রতিম সাংবাদিক হিসেবে দেশের সব সংবাদকর্মীর মনে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনটিও তো জাতীয় প্রেস ক্লাবের এই আজীবন সদস্যের দখলে।

এই নির্মোহ-নির্লোভ মানুষটির নাম তোয়াব খান। নামটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র যে মানুষটির চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তাকে একবার দেখে ভেতরের মানুষটিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। আপাতগাম্ভীর্যের আড়ালে যে সংবেদনশীল মানুষটির বাস, তাকে আবিষ্কার করা সহজ নয়। এর জন্য সময় ও শ্রম দিতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তোয়াব খান নিজে কয়জনের কাছে উন্মোচিত করেছেন নিজেকে? গুরুগম্ভীর তোয়াব খানের আড়ালে যে স্নেহময় মানুষটি লুকিয়ে, তাকে কি তিনি প্রকাশ করেছেন সবার সামনে? তবে, আপাতগম্ভীর এই মানুষটির সাহচর্য যারা পেয়েছেন, তারা জানেন, ওই গাম্ভীর্যের খোলস খসে পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না। আর সে কারণেই বলা যেতে পারে একজন তোয়াব খানকে আবিষ্কারই করতে হয়। এই আবিষ্কারের আরেকটি গূঢ় কারণ হচ্ছে, তার জীবন তো কোনো মামুলি জীবন নয়। চলমান এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনকালে শুরু যে পথের, তা আজও বহমান। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এ জন্যই তিনি সমসাময়িক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে ‘তোয়াব খান’ নামটি উচ্চারিত হয় পরম শ্রদ্ধায়।

অগ্রসর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সাংবাদিকতাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন তিনি। বহুদর্শী মানুষটি নামের পেছনে ছোটেননি কখনো। অদ্ভুত আড়ালচারিতা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে লড়াই এখনো চলছে, সে লড়াইয়ে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তোয়াব খান।

আজ তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন তোয়াব ভাই। আপনার স্নেহছায়ায় আরও অনেকটা পথ হাঁটতে চাই আমরা।

লেখক: সভাপতি সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ


banner close