বর্তমান পৃথিবীতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম হাতিয়ার পর্যটন। পর্যটন শিল্প বহুদেশেরই অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে দিয়েছে, এমনকি বিভিন্ন দেশের মূল অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিই এই পর্যটন। বহিঃবিশ্বের মতো বাংলাদেশও তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পর্যটনকে ঘিরে বহু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র ও একক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হওয়ায় পর্যটন বিকাশে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। যার মধ্যে আশার হাতছানি দিচ্ছে কক্সবাজার। কক্সবাজার, বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিন-পূর্বাঞ্চলের একটি অপার সম্ভাবনাময়ী জেলা। চট্টগ্রাম বিভাগের এই জেলাকে দেশের একটি মৎস ও অন্যতম পর্যটন শহরও বলা হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্র সৈকত এই কক্সবাজারে অবস্থিত, যা ১২০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। সৈকতের পাশাপাশি বন-উপবন, খাল-নদী, ঝিরি-ঝরনা, বন্য প্রাণী ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এ জেলা একসময় পালঙ্কি বা প্যানোয়া নামে পরিচিত ছিল। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এই কক্সবাজারে রয়েছে সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশনও। সৈকতের তীরে বেসরকারী হোটেল-মোটেল ছাড়াও রয়েছে পর্যটন মোটেল, সম্প্রতি গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি পাঁচ তারকা মানের হোটেলও। এক কথায় বলা চলে দেশের সবচেয়ে আকর্ষিক পর্যটন স্পট এখন এই কক্সবাজারে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ছোঁয়া পেতে তাই সময় পেলেই দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ছুটে আসেন কক্সবাজারে। বিশ্ব যখন ভ্রমণকে আলিঙ্গন করতে শুরু করেছে, তখন কক্সবাজার পর্যটকদের জন্য একটি উপযুক্ত স্পট হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
কক্সবাজার সৈকতে গেলে দেখা যায় এক অপরুপ মনোরম দৃশ্য। আনন্দ উল্লাসে মুখরিত সাগর তীর। ইনানি পাথরের সৈকত, মহেশখালী আদিনাথ মন্দির, হিমছড়ি ঝরনা, ডুলহাজারা সাফারিপার্কসহ জেলার পর্যটন স্পটগুলোতে বছরজুড়ে লেগেই থাকে পর্যটকদের ভিড়। এই কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে ‘মেরিন ড্রাইভ সড়ক’ প্রকল্প, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার কাজ, মহেশখালী টু্রিজম পার্ক প্রকল্প, টেকনাফের সাবরাং এলাকায় ১২০০ একর জমিতে বিশেষ পর্যটন অঞ্চল প্রকল্প, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণ, এবিসি সড়ক সম্প্রসারণ, কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাটে ব্রীজ প্রকল্প, দোহাজারী-ঘুমধুম-কক্সবাজার রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প, কক্সবাজারে পর্যটনের উন্নয়নে পর্যটন কর্পোরেশনের মালিকাধীন মোটেল শৈবালের ১২৫ একর জমিতে আর্ন্তজাতিক মানের পর্যটন জোন বাস্তবায়ন, একই সঙ্গে মোটেল প্রবালের ৬ একর জমিতে পর্যটন বিষয়ক একটি ইনষ্টিটিউট তৈরী করার পরিকল্পনা। সবগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কক্সবাজার হবে একটি আদর্শ পর্যটন শহর এবং যা দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে। আর এ লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে ‘কক্সবাজার উন্নয়ন কতৃপক্ষ’। পর্যটকদের সার্বিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করারা জন্য বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। পর্যটনকে বিকশিত করার সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখন সময়মাত্র। দ্রুত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে এবং প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এই কক্সবাজারে। যা বেকারত্ব হ্রাসে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
কক্সবাজার হলো অবিরাম প্রবাল সমুদ্র সৈকতের অনন্য সৃষ্টি, বঙ্গোপসাগর দ্বারা আচ্ছন্ন সোনালী বালির অবিরাম প্রসারিত এই সৈকত স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় পর্যটকদের আকৃষ্ট করে, শহুরে জীবনের তাড়াহুড়ো থেকে প্রশান্তি দেয়। যেখানে মন্ত্রমুগ্ধ সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দৃশ্যগুলি যাদুকরের যাদুর চেয়ে থেকে কম নয়। সৈকতটি সার্ফিং, জেট-স্কিইং এবং প্যারাসেইলিং সহ বিভিন্ন জল ক্রীড়ার জন্য উপযুক্ত স্থান।
কক্সবাজারের দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে ঐতিহাসিক বদর মোকাম মসজিদ, ঝাউবীথি, প্যারাবন, বার্মিজ মার্কেট, শুঁটকির আড়ৎ নাজিরারটেক, রাডার স্টেশন, হিলটপ সার্কিট হাউস, লাইট হাউস, অমেধা ক্যাং, জাদি, রাখাইন পল্লী, মোঘল আমলের প্রাচীন মসজিদ, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, রাবার ড্যাম, ইন্টারন্যাশনাল এমিউজমেন্ট পার্ক, শিশু পার্ক (চলমান), আন্তর্জাতিক ফুটবল কমপ্লেক্স (চলমান), বাগদা চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারী, দরিয়ানগর পর্যটন কেন্দ্র, হিমছড়ি, ঝর্ণা, ইনানী, গাজীর টেক, পাটোয়ার টেক, বাহারছড়া, পাহাড় ও সমুদ্র, কক্সবাজার-টেকনাফ দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ, শাহপরীর গার্ডেন, ঘুমধুম কুমীর চাষ প্রকল্প, টেকনাফ গেম রিজার্ভ বা ন্যাচার পার্ক, খুরুস্কুল স্মার্ট সিটি, থিম পার্ক, ইকো রিসোর্ট, চৌফলদন্ডী রিভাররেইন ট্যুরিজম, কউকের দৃষ্টি নন্দন পুকুর, দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, লামারপাড়া ক্যাং, রামু রামকোর্ট বৌদ্ধ মন্দির, তীর্থ ধাম, আইসোলেটেড নারিকেল বাগান, বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনাকেন্দ্র, রামু রাবার বাগান, রামু চা-বাগান, দেশের একমাত্র পাহাড় বিশিষ্ট দ্বীপ মহেশখালী আদিনাথ শিব মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির, মহেশখালীতে দেশের বিখ্যাত পানের বরজ, দেশে ৯০ ভাগ রপ্তানিকারক লবণের ফ্যাক্টরি, চিংড়ি চাষ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, খুটাখালী মেদাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্ক, মগনামা ঘাট, দেশের একমাত্র বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাতি ঘর, মালেক শাহের দরবার শরীফ, সোনাদিয়া দ্বীপ, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হেলিকপ্টারে জয় রাইড, প্যারাসাইলিং রাইড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ইতোমধ্যে কক্সবাজারের পর্যটন বিকাশ এবং গভীর সমুদ্র বন্দরভিত্তিক বাণিজ্যের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগও গড়ে তোলা হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনে এসেছে রেল যোগাযোগের মাধ্যমে। এতে পর্যটন শিল্পে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি কক্সবাজারকে সিঙ্গাপুর, হংকংসহ দ্বীপভিত্তিক অর্থনৈতিক হাবের আদলে গড়ে তোলার জন্য সরকার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
শুধু যোগাযোগ অবকাঠামো নয়, দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর- কক্সবাজার জেলার মাতারবাড়ী-মহেশখালীতে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। জাপানের অর্থনীতি ও সৌন্দর্যে ব্যাপক ভূমিকা রাখা কাশিমা বন্দরের আদলে নির্মিত মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরটি বাংলাদেশের প্রধান আমদানি কারক চীনসহ বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যের নতুন নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই সমুদ্র নগরীতে প্রতি বছর ৬০-৭০ লাখ পর্যটক কক্সবাজারে বেড়াতে গেলেও বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম। এদেশে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ইতিমধ্যে সাবরাং, নাফ ও সোনাদিয়ায় ইকো ট্যুরিজম করা হচ্ছে। টেকনাফের সাবরাং, নাফ ও মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ সাজানো হচ্ছে। ১৯৬২ সালে যখন কাশিমা বন্দর নির্মাণ শুরু হয়, তখন এলাকাটি ছিল ধানক্ষেত। বন্দর নির্মাণের পর এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরও এ ধরনের বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে থাকবে পাঁচ তারকা হোটেল, ইকো-ট্যুরিজম, মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম ও সি-ক্রুজ, বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিশেষ সংরক্ষিত এলাকা, সেন্ট মার্টিনে যাতায়াতের বিশেষ ব্যবস্থা, ভাসমান জেটি, শিশু পার্ক, ইকো-কটেজ, সাগরমণ্ডল, পানির নিচে। রেস্তোরাঁ, ভাসমান রেস্তোরাঁ, ইত্যাদি বিনোদনের বিভিন্ন সুবিধা। এছাড়া টেকনাফ শহরের কাছে নাফ নদীর মোহনায় জালিয়ার দ্বীপকে ঘিরে নাফ ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের কাজ চলছে। মূলত বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে এই পার্কে ইকো কটেজ, লাইফ এন্টারটেইনমেন্ট থিয়েটার, মেগা শপিং মল, সিনেমা হল, গলফ ক্লাব, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ডের মতো ওয়াটার স্পোর্টস বিচসহ নানা আয়োজন থাকবে।
কক্সবাজারে মেরিন ড্রাইভ সড়কের কাজ শেষ হয়েছে, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও রেললাইন প্রকল্পের কাজ শেষ। গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ তিন লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের কাজ চলছে। এই প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে আগামী ৫-৬ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হবে।
সারাদেশে যোগাযোগব্যবস্থা ও অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি সরকার দেশের আভ্যন্তরীন পর্যটন বিকাশে যেসব মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তার অনন্য উদাহরণ কক্সবাজার। কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পে নতুন করে যে কটি প্রকল্প আশার প্রদীপ হিসেবে ধরা হয় এর মধ্যে অন্যতম ‘সাবরাং ট্যুরিজম অর্থনৈতিক অঞ্চল’। ২০১৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেকনাফ সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক উন্নয়নকাজ উদ্বোধন করেন। টেকনাফের অর্থনৈতিক অঞ্চল সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক জোনে ১ হাজার ১৬৫ একর জমি রয়েছে। সুদীর্ঘ বালুকাময় সৈকত আর সাগর-পাহাড়ের অপূর্ব মিলন আর বৈচিত্র্যময় দৃশ্য এ স্থানকে পরিণত করেছে সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা সাবরাং ট্যুরিজম পার্কটি বিনোদনপ্রেমীদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের পর্যটন খাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৭০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করছে বাস্তবায়ন সংস্থা বেজা কর্তৃপক্ষ। সাবরাং ট্যুরিজম পার্কটিতে পাঁচতারকা হোটেল, ইকো ট্যুরিজম, মেরিন অ্যাকুয়ারিয়াম, বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিশেষ সংরক্ষিত এলাকা, সেন্টমার্টিনে ভ্রমণের বিশেষ ব্যবস্থা, ভাসমান জেটি, শিশুপার্ক, ইকো কটেজ, ওশানেরিয়াম, আন্ডার ওয়াটার রেস্টুরেন্ট, ভাসমান রেস্টুরেন্টসহ নানা বিনোদনের সুবিধা রাখা হবে। এছাড়া টেকনাফে নাফ ট্যুরিজম পার্ক ও মহেশখালী উপজেলায় সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
এর অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক দৃশ্যের বাইরে, কক্সবাজার একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আবাসস্থল। এলাকাটিতে বিভিন্ন জাতিগত সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করে এবং এরা এ অঞ্চলের অনন্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও অবদান রাখে। ইকো টুরিজমের ফলে পর্যটকদের স্থানীয় গ্রামগুলি অন্বেষণ করার, বন্ধুত্বপূর্ণ স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ করার এবং ঐতিহ্যগত রীতিনীতি এবং আচার-অনুষ্ঠানগুলি অনুভব করার সুযোগ রয়েছে। প্রাণবন্ত বাজার এবং রঙিন উৎসব কক্সবাজারের মানুষের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্য বহন করে।
কক্সবাজার শুধু রোদ আর বালি নয়; এটি পরিবেশ-সচেতন ভ্রমণকারীদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল। হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান, কক্সবাজারের কাছে অবস্থিত, লীলাভূমি, বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণী এবং হাইকিং ট্রেইলগুলি অন্বেষণ করার সুযোগ রয়েছে ভ্রমনপিপাসুদের জন্য। পার্কগুলো হাতি, চিতাবাঘ এবং অসংখ্য প্রজাতির পাখি সহ বিভিন্ন প্রজাতির জন্য একটি অভয়ারণ্য। ইকোট্যুরিজম জড়িত হওয়ায় এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণকে আরো উৎসাহিত করে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যত নিশ্চিত করে।
কক্সবাজারে ইকোট্যুরিজমের ব্যাপক প্রসারে পরিবেশবান্ধব আবাসন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, পর্যটনভিত্তিক স্থানীয় বিভিন্ন ব্যবসায়ী উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পর্যটকদের কাছে স্থানীয় সংস্কৃতি তুলে ধরতে সেখানকার হোটলেগুলোতে বৈচিত্রপূর্ন খাবারের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। সেখানকার অধিবাসীদের হাতে উৎপাদিত ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, গহনার প্রদর্শনীর আয়োজন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, আয়ের উৎস তৈরি হবে। কমিউনিটি হোম স্টে’র উদ্যোগ স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে, যা ইকোট্যুরিজমের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারলে টেকসই পর্যটন উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব।
কক্সবাজারকে একটি সুপরিকল্পিত পর্যটন শহর হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। কক্সবাজারের অন্তর্গত সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রতিবেশগতভাবে সংবেদনশীল ও সংকটপূর্ণ এলাকা হওয়ায় ২০২৩ সালের মে মাসে সরকার এ দ্বীপ রক্ষার্থে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর আওতায় দ্বীপের জমি, ভূমি উন্নয়ন ও অবকাঠামো (যেমন: রেস্টহাউজ, ডরমিটরি, হোস্টেল) নির্মাণ, পরিচ্ছন্নতা, বর্জ্য, পর্যটনসংক্রান্ত বিষয় এবং পরিবহণ ব্যবস্থাপনায় মুখ্য ও সহযোগী বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিনির্দেশপূর্বক একটি নির্দেশিকা জারি করেছে। তবে ইকোট্যুরিজম বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রচার-প্রচারণা না থাকায় এখনো যথেষ্ট জনসচেতনতা গড়ে ওঠেনি। ইকোট্যুরিজমের উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
তবে, সমুদ্র ও পাহাড়বেষ্টিত কক্সবাজারকে একটি টেকসই ও আধুনিক পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ইতিমধ্যে সরকারের অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারে পৌঁছে গেছে রেল। যার ফলে কক্সবাজারের সাথে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। এ শেষ গন্তব্যস্থল কক্সবাজার রেলস্টেশনে আবাসনসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত লকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর ফলে সেখানে বেড়াতে যাওয়া রেল যাত্রীরা তাদের লাগেজ নিরাপদে রাখতে পারবেন এবং কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, হিমছড়ি সমুদ্রসৈকত ও বন্যপ্রাণী পার্ক, ইনানী সমুদ্রসৈকত, মহেশখালী এবং সোনাদিয়া দ্বীপে নির্বিঘ্নে সময় কাটাতে পারবেন। রেল লাইন সম্প্রসারনের ফলে ভ্রমণ তুলনামূলক আরামপ্রদ, ব্যয়সাশ্রয়ী, নিরাপদ হওয়ায় এ নগরীতে পর্যটকদের পদচারণা বৃদ্ধি পাবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
পর্যটন খাত ছাড়াও কক্সবাজারের নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে রেল যোগাযোগব্যবস্থার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যেমন: লবণ, কৃষিপণ্য, মৎস্য ও শুঁটকি, স্থানীয় পরিবহণ, নির্মাণ ও আবাসন খাতে ব্যাপক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
রেলওয়ে জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের আন্তঃনগর ট্রেন চট্টলা এক্সপ্রেসের অবমুক্ত করা রেক দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চালানো হচ্ছে ট্রেন। আর ঢাকা-কক্সবাজারে চলাচলকারী ট্রেনগুলোতে যুক্ত করা হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আনা নতুন কোচ।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমানে পর্যটন খাত পৃথিবীর জিডিপিতে প্রায় ১১ শতাংশ অবদান রাখে। বিশ্বব্যাপী ২০১৯ সালে পর্যটকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১.৫ বিলিয়ন। ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম ওরগানাইজেশন ধারণা করেছিল পরবর্তী প্রত্যেক বছর আরো ৪ থেকে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন যা ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪৩৫ মিলিয়নে।
ধারণা করা হচ্ছে, বিগত ৭০ বছরে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে। পর্যটনের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়ে বর্তমানে পৃথিবীর চারটি কর্মসংস্থানের মধ্যে একটি কর্মসংস্থান তৈরি হয় পর্যটন খাতে। বর্তমানে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে আয় প্রায় ৭৬ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার। ভারত আয় করেছে ১০ হাজার ৭২৯ মিলিয়ন ডলার, মালদ্বীপ ৮০২ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কায় ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার এবং নেপালে ১৯৮ মিলিয়ন ডলার, যা সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের তুলনায় অপ্রতুল।
বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২২ সাল নাগাদ পর্যটনশিল্প থেকে প্রতিবছর ২ ট্রিলিয়ন ডলার আয় হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫১টি দেশের পর্যটকেরা বাংলাদেশে ভ্রমণ করবেন, যা মোট জিডিপির ১০ শতাংশ অবদান রাখবে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৯ শতাংশ হবে পর্যটনশিল্পের অবদান। পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল।
ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) তথ্যানুযায়ী, বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের অবদান ৮ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে পর্যটন শিল্প বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার অবদান রাখে, যা বিশ্ব জিডিপির ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে ১৫৬ কোটি পর্যটক, অর্থাৎ প্রতি সাতজনের একজন পর্যটক। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ফলে সাধারণ মানুষের কাছে ভ্রমণ পিপাসা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে বিধায় আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অনন্য অবদান রাখছে। বাংলাদেশে পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত আছেন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ।
এ ছাড়া পরোক্ষভাবে ২৩ লাখ। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১১০ কোটি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর বিপুল সংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৫ শতাংশ ভ্রমণ করবে এশিয়ার দেশগুলোতে। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজারে টিকে থাকতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির রূপরেখা। বাংলাদেশের গ্রামগুলো হতে পারে পর্যটন আকর্ষণের অপার সম্ভাবনা।
সারাবিশ্বের হিসেব করতে গেলে বাংলাদেশ এখনো পর্যটন শিল্পে অনেক পিছিয়ে আছে। ধারণা করা হয়, বছরে প্রায় ৪ কোটি দেশীয় পর্যটক সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ান। সে হিসেবে বাংলাদেশেও ভবিষ্যতে পর্যটকের সংখ্যা ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে কক্সবাজরের পর্যটন খাতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, সেন্টমার্টিন দ্বীপ এবং সোনাদিয়া দ্বীপের বাস্তুতন্ত্রের ওপর পর্যটকদের কর্মকাণ্ডের বিরূপ প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে সরকার এসব এলাকাকে প্রতিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছিল। এর প্রেক্ষিতে আমরা যেন নির্বিঘ্নে এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন ও উপভোগ করতে পারি, তার জন্য আমাদের অবশ্যই উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র রক্ষার্থে পর্যটন স্থানগুলোর প্রতিবেশগত ধারণক্ষমতা বিবেচনার দাবি রাখে। বর্তমান ভঙ্গুর উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র দীর্ঘস্থায়ীভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন কর্মকাণ্ড থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পর্যটকদের ঘোড়ায় চড়া, সৈকতে খেলাধুলা, অপরিকল্পিত ভ্রমণ, মোটরবাইক চালানো, অসতর্ক ও এলোমেলো গতিতে বোটিং, ডাইভিংয়ের মতো বিনোদনমূলক কার্যকলাপের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় মাটি, সমুদ্রসৈকত এবং প্রবাল প্রাচীরের প্রাণীদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। এছাড়া অনেক পর্যটক প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাবে তাদের খাবারের উচ্ছিষ্ট এবং পলিথিনের খালি প্যাক যেন-তেনভাবে এদিক-সেদিক নিক্ষেপ করে থাকেন। অসচেতন রেস্টহাউজ, কটেজ, রিসোর্টগুলোও তাদের উৎপাদিত বর্জ্য সরাসরি উপকূলীয় জলাশয়ে ফেলে দেয়।
বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আগমনে খাবারের সংস্থানের প্রয়োজনে স্থানীয় সামুদ্রিক মাছের চাহিদা বাড়ে, স্যুভেনির হিসাবে বিক্রির জন্য অতিরিক্ত প্রবাল সংগ্রহীত হয়। বিভিন্ন পর্যটনসংশ্লিষ্ট কার্যাদি স্বাদু পানির চাহিদা সৃষ্টি করে, যা পূরণ করতে ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন বাড়ে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়, যা মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি এবং লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশে সাহায্য করতে পারে। এসব পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড উপকূলীয় উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের জীবনের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে, যা এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য এবং সূক্ষ্ম বাস্তুতন্ত্রকে বিপন্ন করতে পারে। এটা সত্য যে, গণপর্যটন ব্যবস্থায় বর্তমান প্রজন্ম উপকূলীয় কক্সবাজার জেলার অকৃত্রিম প্রকৃতির অপরূপ রূপের আস্বাদন নিতে সক্ষম হলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তা থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
কক্সবাজারে দেশের পর্যটন বিকাশে ব্যাপক সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনই সমসাময়িক ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রচুর সমস্যাও রয়েছে। কক্সবাজারের অপার সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে পর্যটনের বিকাশের সুযোগের পাশাপাশি এখানকার অন্যতম সমস্যা হলো অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও রোহিঙ্গাসহ আরও বেশ কয়েকটি সমস্যা। যেখানে-সেখানে গড়ে উঠছে ইট-পাথরের স্থাপনা, সরকারী দপ্তর কর্তৃক বাঁধা দিয়ে কিংবা আইন প্রয়োগ করেও দমানো যাচ্ছে না এসব পরিকল্পনাবিহীন কাযৃক্রম। যত্রতত্র পাহাড় কেটে প্রকৃতির ক্ষতি করে এসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। নদী ভরাট আর ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট নিধন করে চলছে দখলের মহোৎসব। সেন্টমার্টিনেও চলছে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের কাজ, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করছে। পরিবেশবাদীরা এসব অনিয়ম বন্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যে কক্সবাজারকে কেন্দ্র সরকারের এত এত পরিকল্পনা সেই কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার সৈকতের মধ্যে বর্তমানে বিক্ষিপ্তভাবে এখানে-ওখানে মাত্র তিন কিলোমিটার এলাকা পর্যটন এলাকা হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মানবসৃষ্ট নানা সমস্যার কারণে ওই তিন কিলোমিটার সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে সম্প্রতি ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। এ ভাঙনের কবলে পড়ে মাত্র কয়েক মাসে প্রায় কয়েক হাজার ঝাউগাছ বিলীন হয়ে গেছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা এখানে আরেকটি বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৭ সালের পরে কিংবা এরও আগে দফায় দফায় সব মিলয়ে এদেশে প্রায় ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলাও চরম হুমকির মুখে রয়েছে বর্তমানে। তাদের জন্য নির্মিত ক্যাম্প থেকে পালিয়ে প্রতিদিন কক্সবাজারসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। দেশে ইয়াবা ও অস্ত্র ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছে তারা। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে নিয়মিত। ব্যবহৃত হচ্ছে একাধিক গ্রুপের ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসাবে। জেলার শ্রমবাজারও অনেকটা তাদের দখলে বললেই চলে।
আরেকটি বিষয় হলো, কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসায় সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়া একটি অঘোষিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্তহীন এসব সমস্যা ছাড়াও রয়েছে আরেকটি গুরুতর অপরাধ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এলাকায় প্রতিনিয়ত সরকারি মূল্যবান জমি দখল হচ্ছে। কোটি কোটি টাকার জমি দখল করে পর্যটন এলাকার একাধিক পয়েন্টে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। সরকারি খাসজমি দখলের প্রতিযোগিতা চলছে ইনানী, হিমছড়ি ও শহরের সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট, সি-ইন পয়েন্ট, বালিকা মাদ্রাসা পয়েন্ট ও ডায়াবেটিক পয়েন্টে। অভিযোগ রয়েছে, এসব বেপরোয়া ভূমি দখল ও স্থাপন নির্মান কাজে সহযোগিতা করছেন প্রশাসনের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা।
উপর্যুক্ত সমস্যাগুলো নিরসন করতে পারলে কক্সবাজারের টেকসই উন্নয়ন-অভিযাত্রায় ইকোট্যুরিজম হতে পারে সবচেয়ে সুন্দর সমাধান। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি উন্নত জীবিকা উপার্জনেও ইকোট্যুরিজম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পাহাড়, বন-বনানী, বেলাভূমি, সমুদ্রসৈকতের ভূ-প্রকৃতিগত আকর্ষণ, প্রশান্তিদায়ক উপক্রান্তীয় জলবায়ু, উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের বৈচিত্র্য, সহজগম্যতা এবং স্থানীয় জনমানুষের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনাচরণ ও সংস্কৃতির কারণে এখানে ইকোট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। একই স্থানে বন্যপ্রাণী, প্রবাল প্রাচীর ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের মতো অমূল্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাবেশ অত্যন্ত বিরল, যার ফলে কক্সবাজারকে দেশের প্রধান ইকোট্যুরিজম হটস্পট হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
কক্সবাজার, এর আদিম সৈকত, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং টেকসই পর্যটনের প্রতিশ্রুতি সহ একটি বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ গন্তব্যে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভ্রমণকারীরা অর্থপূর্ণ এবং প্রামাণিক অভিজ্ঞতার সন্ধান করার কারণে, কক্সবাজার একটি গন্তব্য হিসাবে দাঁড়িয়েছে যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক নিমগ্নতার একটি নিখুঁত মিশ্রণ সরবরাহ করে। সতর্ক পরিকল্পনা এবং দায়িত্বশীল পর্যটন অনুশীলনের মাধ্যমে, কক্সবাজার তার পর্যটন সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করতে পারে, যা সারা বিশ্বের অভিযাত্রী এবং প্রকৃতিপ্রেমীদের হৃদয়কে মোহিত করে।
কক্সবাজারে পর্যটন শিল্প দ্রুত বিকাশমান খাত হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারবে। এ শিল্পের বিকাশে আমাদের রয়েছে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সুপ্রাচীন নিদর্শন। সরকার কক্সবাজারের অফুরন্ত সম্ভাবনাময় পর্যটনকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। সারাবিশ্বের মধ্যে কক্সবাজার অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে পরিচিত হয়েছে। দেশের মানুষের আয় বৃদ্ধির কারণে বিগত কয়েক বছরে অভ্যন্তরীণ পর্যটনের উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটেছে। একই সাথে এ খাতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের ব্যাপক চাহিদা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক মানের হোটেল, মোটেল, কটেজ ও রিসোর্টের সংখ্যাবৃদ্ধির সাথে সাথে পর্যটন ও আতিথেয়তা-ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট দক্ষ ও প্রশিক্ষিত পেশাজীবীর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কক্সবাজার আয়তনে ছোট হলেও এর ভৌগোলিক অবস্থান, নৈসর্গিক সৌন্দর্য, সংস্কৃতি, মানুষের অতিথিপরায়ণতা ইত্যাদি বিবেচনায় এখানে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
কক্সবাজারের পর্যটন খাতে অপার সম্ভাবনা থাকা সত্বেও পরিকল্পনা ও তদারকির অভাবে আমরা কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে আছি। সমন্বিত পরিকল্পনা ব্যতিত এ শিল্পের বিকাশ পুরোপুরি সম্ভব নয়। পর্যটনকে অর্থনীতিতে রুপ দিতে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব পক্ষকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। এ শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বিদেশের মতো পর্যটন শিল্প বিকাশের সুযোগ ও সম্ভাবনা কক্সবাজারে রয়েছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হবে। বেসরকারি উদ্যোগকে উদ্বুদ্ধ করে সমুদ্র বেষ্টিত সেন্টমার্টিন দ্বীপ, ইনানী, ছেঁড়াদ্বীপ, টেকনাফকে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে রূপায়িত করা যেতে পারে। স্থানীয়ভাবেও জায়গাগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ সড়ক সম্প্রতি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পর্যটন নগরীর আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক ও সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্কের কাজ সম্পন্ন হলে প্রতি বছর এতে বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
লেখক: সেনা কর্মকর্তা
নদী বলতে বুঝায় বহমান স্বচ্ছ পানির ধারা যা গিয়ে শেষ হয়েছে কোন সাগর বা মহাসাগরে। যদিও নদীর মধ্যে কখনো রং বেরঙের পানিও প্রবাহিত হয় যেমন কলোম্বিয়ার ‘রেইনবো রিভার’। যেখানে একসাথে রংধনুর সাতটি রং এর পানি প্রবাহিত হয়। তাই অনেকে একে রংধনু নদী নামেও অভিহিত করে থাকে। কিন্তু এখন যে নদীটির কথা বলতে যাচ্ছি সেটা রঙিন বা স্বচ্ছ কোনরকম পানির নদীই নয়। সেটা হচ্ছে ‘ফুলের নদী’! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। বিচিত্র এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে যা দেখলে স্রষ্টার সৃষ্টি নিয়ে মন ভাবনায় পড়তে বাধ্য। তবে এ সবই একমাত্র মহান রবের কুদরতের নিশানা। আজ পরিচয় করিয়ে দেব এরকমই এক নদীর সাথে যেখানে কোন পানি নেই। আছে শুধু ফুল আল ফুল। এতে আছে চেরি, নীল অপরাজিতা, টিউলিপ ও নদীর মতো বেয়ে আসা ছোট ছোট নীল ফুলের সারি। চমৎকার এই নীলাভ ফুলটি এক ধরনের ঘাসফুল যা হাঁটার সময় পায়ের তলায় চুরচুর করে ভেঙে পড়তে চায়। এই পুষ্পদ্বয়ের দোলায়িত দীর্ঘ ও প্রশস্ত বাগান দেখলে যে কেউ ই ভাববে এটা কোন ফুলের নদীই হবে, যা বয়ে চলেছে কোন পুষ্পসাগরে মিলিত হবার জন্য।
অবস্থান: অপূর্ব, অসাধারণ, অপরূপা সুন্দর এই ফুলের বাগানটি অবস্থিত ইউরোপ মহাদেশের নেদারল্যান্ডস এর ‘কেউকেনহফ’ শহরে। এ জায়গাটি পুষ্পসম্ভারে এতোই মনোরম ও মনোমুগ্ধকর যে, তা যে কারো স্বপ্নকেও হার মানায়। এখানে আছে নানা প্রজাতির রঙ-বেরঙের হাজার নয় লক্ষ লক্ষ টিউলিপ ফুলের বাগান।এ ফুলগুলো সাদা, লাল, গোলাপী, নীল, হলুদ, দুধে-আলতা প্রভৃতি হরেক রং এর হয়ে থাকে। এই এলাকা থেকে প্রতি বছর এসব টিউলিপ ফুল আমেরিকা ও জাপানে রপ্তানি করা হয়। এছাড়াও আরো অনেক ফুলপ্রেমি দেশ ও রাজ্য নেদারল্যান্ডস এর এই ‘কেউকেনহফ’ থেকে টিউলিপ আমদানি করে নিয়ে যায়। একে ফুলপ্রেমিদের জন্য একটি ফুলের স্বর্গই বলা যায়। যেদিকে চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। অনেকে এই ফুলের সমাহারের সৌন্দর্য্য পুরোপুরি উপভোগ করার জন্য এই কেউকেনহফ শহরে এসে অনেকদিন থেকেও যায়।
বসন্তে এর রূপ: একে তো এই অঞ্চলটি ফুলের জন্য বিখ্যাত, তারউপর বসন্ত এলে এখানে যেন ফুলপরীরা অসংখ্য ডানামেলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বসন্তে এর রূপ অনন্যা হয়ে চোখে ধরা দেয়। সাথে মন-মাতানো সৌরভে চারদিকের বাতাস ভরভর করে। আর তাই এসময় এখানে পর্যটকের সংখ্যাও স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেকটা বেড়ে যায়। যেদিকে চোখ যায় শুধু রঙ-বেরঙের আর নানা প্রজাতির ফুল যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তখন দূর থেকে ‘কেউকেনহফ’ এর ঘরবাড়িগুলো কে দেখলে মনে হবে ফুলের এক মহাসাগরের মাঝখানে ছোট ছোট কয়েকটি মাত্র দ্বীপ গড়ে উঠেছে। বাকি পুরোটাই ভর্তি শুধু চোখ ধাঁধানো রঙ-বেরঙের ফুল আর ফুলের সমাহারে।
নদীতে ভ্রমণ: ‘কেউকেনহফ’ এ এলে শুধু ফুল দেখেই যে চোখ জুড়াবে তা নয়, এখানে ফুলের স্বর্গীয় নদীর পাশাপাশি আছে ছোট ছোট সত্যিকারের নদী যেগুলোর দুই তীর শুধু বাহারী রঙের ফুলে ফুলে সজ্জিত। এ নদীতে নৌকায় করে ভ্রমণ করলে আশেপাশের প্রকৃতি দেখে মনে হবে এটা হয়তো পৃথিবীর বাইরের অন্য কোন জগতে চলে এসেছি।
ফুলের চাষ: প্রতি বছর এ অঞ্চলে প্রায় সত্তর লক্ষের মতো ফুলের বীজ ও চারাগাছ রোপণ করা হয়। স্বভাবতো সেজন্যই এটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাগান হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এখানে ফুলের আকর্ষণে আগত পর্যটকদের জন্য উপযুক্ত সময়টা হলো মার্চ মাস থেকে শুরু করে মধ্য মে পর্যন্ত। মার্চের শেষের দিক থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্ত সময়টা।লো টিউলিপ ফুটার উপযুক্ত সময়। এসময় ‘কেউকেনহফে’র প্রধান বাগান যেটা প্রায় আড়াইশ বিঘা জমির উপরিভাগ জুড়ে রয়েছে, তার উপরিভাগ পুরোটাই জুড়ে থাকে শুধু এই হরেক রঙের টিউলিপ ফুলের সমাহার। এর সাথে নদীর তীরে, পার্কে, বা মাঠে রয়েছে অজস্র অপরাজিতা, চেরি বা নীলাভ রঙের ঘাসফুলের বাহার। সবকিছু মিলিয়ে এ ‘কেউকেনহফ’ কে শুধু ‘ফুলের নদী’ নয় পুরো একটি ফুলের সাগরও বলা যায়।
সুবর্ণ ভূমির কোমল পলির মতো বাঙালির মনোভূমি। আমাদের অর্থনীতি চিরকাল কৃষিভিত্তিক। জীবন ও জীবিকা একসময় ছিলো নদীকেন্দ্রিক। গভীর রাতে কিংবা অলস দুপুরে উদাও কন্ঠে বাউল ভাটিয়ালি গানের সুর আমাদের জনজীবনকে মুখরিত করে তুলত। যাত্রাপালার দর্শক হয়ে নিপীড়িতের উপর নির্যাতন দেখে বাঙালি অঝোর ধারায় কাঁদত একসময়। যাত্রার বিবেক বাঙালির বিবেক হয়ে নৈতিক কথা বলতো। শ্যাক্সপিয়রের কিংবা এলিয্যবেথান যুগের নাটকে ‘কোরাস’ যে ভূমিকা পালন করত আমাদের যাত্রাগানের বিবেকও সে ভূমিকা পালন করে গেছে। আমাদের অকৃত্রিম সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য শাখা ছিল যাত্রা পালা।
এক সময় ‘পঞ্চায়েত’ গ্রামের সুখ দুঃখের সকল অনুষ্ঠান, বিচার ব্যবস্থা, সমাজের কল্যাণ মূলক কাজের দায়িত্ব স্বতঃপ্রণোদিত গ্রহণ করত। আধুনিক উন্নয়ন বিজ্ঞান যাকে বলে জননেতৃত্বে সামাজিক কর্মকাণ্ড।
বাঙালির ধৈর্য, স্থৈর্য সীমাহীন। পরার্থে জীবন দানের অগণন নজির আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে। আবার এই ভীতু, কোমল বাঙালি বুক পেতে দাঁড়িয়ে যায় মাতৃভূমির মুক্তির যুদ্ধে। আমেরিকা থেকে সপ্তম নৌবহর আসার খবর বিচলিত করেনা লাঠি হাতে প্রতিরোধ করা বাঙালিকে।
কী হলো কোমল স্বভাবের বাঙালির। হঠাৎ করে এত অস্থিরতা, চিত্তে এত চাঞ্চল্য। বাঙালির অনুভুতিও কী কিছুটা ভোঁতা হয়ে গেল। মিরপুরের গার্মেন্টস ও ক্যামিকেল কারখানার অগ্নিকান্ডে তরতাজা ষোলটা মানুষ প্রাণ হারালো এ নিয়ে মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক বেদনাবোধ লক্ষ্য করা গেল না। সামজিক মাধ্যমে এ নিয়ে উল্লেখ করার মতো আবেগ প্রকাশিত হতেও দেখা গেলো না।
সামাজিক অস্থিরতা, মানবিকতাহীনতা ও অসহিষ্ণুতা যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। পারিবারিক
সংঘাত, সংঘর্ষ, গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ, স্থানীয় আধিপত্য, রাস্তাঘাটে মারামারি ইত্যাদি নানা ঘটনা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। মানুষ এমনিতেই নানা কারণে বিষাদগ্রস্ত। এসব ঘটনা মানুষকে আরও বিষাদগ্রস্ত করে তুলছে। সামাজিক এসব অনাচার ও বিশৃঙ্খলার ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। এ কারণেই বোধ হয় সুযোগ পেলেই মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশও ঘটাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণাবাচক মন্তব্য, রাজনৈতিক মতভেদে শত্রুতা, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ে বৈষম্য–এসবই প্রশ্ন তোলে, আমরা কি জাতিগতভাবে অমানবিক ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি?
সহিষ্ণুতা আসলে কী। সহিষ্ণুতা কী শুধু নৈতিক গুণ। সভ্য, সমঅধিকারের সমাজে সহিষ্ণুতা হলো টিকে থাকার সবচেয়ে বড় শর্ত। সমতা, সমদৃষ্টির, বহুত্ববাদী সমাজ গড়ার সব চেয়ে বড় হাতিয়ার হলো সহিষ্ণুতা। সহিষ্ণুতার কী কোন সূচক আছে জাতিসংঘে, আমার জানা নেই। সূচক থেকে থাকলে আমাদের চিন্তার কোন কারণ নেই। সাম্প্রতিককালে আমাদের যে সহিষ্ণুতার মান, সেই মান নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামলে নিচের সারিতে আমাদের অবস্থান ঠেকায় কে। ব্যক্তি, পরিবার কিংবা সমাজকে বিবেচনা করলে আমাদের অবস্থা তপ্ত কড়াইয়ের মতো। পানি কিংবা তৈল যা কিছু ঢালা হোক না কেনো আমরা ধুম্র সহ জ্বলে উঠব। সেই জ্বলা এতই তীব্র কখনো কখনো বড় অট্টালিকাও জ্বালিয়ে দিতে পারি আমরা নির্ভয়ে। জাতি হিসেবেও আমরা অগ্নিশর্মা। সহিষ্ণুতার অভাবে যে অগ্নি সংযোগ ঘটে, সেটিই হলো প্রকৃত মবদন্ড বা মব জাস্টিস।
জাতিগতভাবে আমরা যে অসহিষ্ণু ছিলাম না তা ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপকে বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যাবে। আমাদের স্বদেশপ্রেম, স্বাধিকারের দাবির জন্য আক্রমন আসলে আমরা প্রতিহত করেছি। এসব ক্ষেত্রে আমরা সতত আপসহীন ছিলাম। আমাদের মানসজগত মূলত লালন, হাসন, রাধারমণ, আরকুম শাহ সহ সকল মরমী কবিদের চেতনায় সমৃদ্ধ। বৈচিত্র্য, বহুত্ববাদের দর্শন আমরা প্রকৃতিগত ভাবে ধারণ করি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের আগমনের পূর্বে বাঙালি মানসে সামান্য পরিমাণও সাম্প্রদায়কতার প্রকাশ দেখা যায়নি। সমাজকে বিভাজিত করার যে কূটকৌশল গ্রহণ করেছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক এর প্রভাবে পাকিস্তানের স্বাধীনয়াত্র অব্যবহিত পূর্বে এবং পাকিস্তানত্তোর সময়ে কিছুটা সাম্প্রদায়িক মনোমালিন্য, দাঙ্গার নজির সৃষ্টি হয়েছিলো। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন উদার, বহুত্বভাদ, প্রগতিবাদী এক সমাজের ধারণা সফল ভাবে বাঙালি হৃদয়ে প্রোথিত করতে সমর্থ হয়। বায়ান্নের আন্দোলনের মালিকানা ছিল বাংলাদেশের জনগণের। তাই এই মহান আন্দলনের স্বরূপ আন্বেষন করলে বাঙালি মননের প্রকৃত রূপ দর্শন করা যায়।
ফিরে আসি সহিষ্ণুতার আলোচনায়। সহিষ্ণুতার প্রতিফলন দেখা যায় সব চেয়ে বেশি শাসক এবং রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম, আচার আচারণে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, চর্চার ভেতরে মুক্তোর মতো ঝিনুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকে সহিষ্ণুতা। কিছুটা কাব্যিক শুনাতে পারে, তবে সহিষ্ণুতার ভেতরেই সমতা, সমদৃষ্টি, সমঅধিকারের বীজ লুক্কায়িত থাকে। উদার, সহিষ্ণু একটি রাজনৈতিক দল সব সময় সমাজের প্রান্তিক, বিপন্ন, অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য লড়াই করে যায় সেটি নির্ভর করে দলটির দর্শনে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আমরা যেমন সমাজের প্রতিটি সদস্যের দিকে ‘সমদৃষ্টি’ দিতে সক্ষম হইনি একইভাবে রাজনৈতিক দলের ভেতরে নিবেদিত, নেতৃত্বগুণে সমৃদ্ধ সকল শ্রেণিপেশার মানুষের প্রতি দৃষ্টির নীতিকেও অনুসরণ করতে পারিনি। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে যেমন পদ পদবী ক্ষমতার চর্চা হয়েছে, একইভাবে শাসক দলগুলোর ভেতরে ক্ষমতার লড়াই বহমান ছিলো। ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতা শাসকদলের ভেতরে এমনভাবে রোপণ করা হয়েছে যে বীজ থেকে ক্রমান্বয়য়ে ক্ষমতার লড়াই আকারে বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতা অর্জনের লড়াই যখন প্রবল হয়ে যায় তখন সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে নির্বাসিত হতে থাকে।
আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই, দেখতে পাব-সহিষ্ণুতা রাতারাতি জন্মায়নি, বরং এটি দীর্ঘ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার ফল। সমাজের আচরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের আচরণকে প্রভাবিত করে। ক্ষমতা যখন রাজনৈতিক দলের একমাত্র আরাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন সমাজেও এর প্রবল চর্চা হতে থাকে। সমাজের আচরণ এবং রাজনৈতিক দলের আচরণকে বিভক্ত করা কঠিন। সমাজের আচরণ রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সমাজের চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। মূলত রাজনৈতিক দলের আচরণের সংস্কৃতি গণমুখী, কল্যাণকামী, সমদৃষ্টি সম্পন্ন না হলে সমাজের সকল স্তরে অস্থিরতা এবং বিভাজন চলতে থাকে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মানসিক পরিশুদ্ধতা, উন্নত রুচি ও সংস্কৃতি বারবার প্রত্যাশা করেছে মানুষ। প্রত্যাশা করেছে, দেশ ও জাতি গঠনে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে এদের মাধ্যমে বড় ধরনের জাগরণ ঘটবে। দেশের উন্নয়নসহ হতদরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা শুধুই হতাশায় রূপ নিচ্ছে। দেশটা কিছুতেই সামনের দিকে এগোতে পারছে না। জনগণ শুধু অসহায়ের মতো লক্ষ্য করছে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ একে অন্যের প্রতি আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ লিপ্ত হয়ে রয়েছে। আক্রোশ আক্রোশ আক্রমণের মধ্যে দলীয় ব্যর্থতার চেয়ে ব্যক্তি বিদ্বেষ, ব্যক্তি কুৎসা অতিমাত্রায় দৃশ্যমান বলে মনে হয়। পারস্পরিক এই যে দ্বন্ধ এ দ্বন্দ্বের পেছনে প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া মানুষকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার যে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা তা’ কাজ না করে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার প্রবল কামনাই প্রধান হয়ে ওঠে।
সমাজ, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের সহিষ্ণুতা একই সূত্রে গাঁথা। সামজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয় সহিষ্ণুতাকে প্রভাবিত করে। আবার রাষ্ট্রীয় সহিষ্ণুতা সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার চাহিদাকে অনুসরন করে। স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থা আবার কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করেনা। একমাত্র নিরবিচ্ছিন্ন গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমেই যেমন সকল মানুষের প্রতি সমদৃষ্টি প্রদানের সংস্কৃতি জাগ্রত করা যায় একই সাথে মানুষের সহিষ্ণুতার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে সহিষ্ণুতা মূলত একটি নৈতিক গুণ যা সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে কোন ভাবেই আরোপ করা যায়না। ক্ষমতার রাজনীতি থেকে যদি সকল মানুষের প্রতি মমতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায় তাহলে ধীরে ধীরে আমরা সহিষ্ণুতার মতো নৈতিক গুণ অর্জন করতে সক্ষম হব। সহিষ্ণু সমাজ গণতন্ত্রকে খুব দ্রুত সংস্কৃতির অংশ হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। আর প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় জন অংশগ্রহণ স্থিতিশীল সমাজ, স্থিতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম বলে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন। আমরা কি সে পথে এগোতে পারবো। এই পারা না পারার উপর জাতি হিসেবে টিকে থাকার উপাদান গুলো নিহিত আছে বলে মনে করি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে মতানৈক্য ছিল। এ নিয়ে মিটিং মিছিল বেশ হয়েছে। মাঠ ও উত্তপ্ত হয়েছে। বিএনপি দাবি ছিল সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হতে হবে। আর জামায়াতের বক্তব্য হলো নভেম্বরে গণভোট হতে হবে অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে গণভোট চাই। জুলাই অভ্যুত্থানে প্রথম সারির সৈনিক এনসিপি বলছে জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে জুলাই সনদের জন্য অধ্যাদেশ জারি করতে হবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো মতৈক্য পৌঁছাতে না পারায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। ১৩ নভেম্বরে উপদেষ্টা পরিষদে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন অধ্যাদেশ, ২০২৫ অনুমোদন করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করেন। সকল জল্পনা ও কল্পনার অবসান ঘটিয়ে উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তগুলো ঘোষণা করেন।
সরকার জুলাই সনদ যেভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য পরিকল্পনা নিয়েছেন যেমন:-সনদ বাস্তবায়নে জুলাই জাতীয় সনদ(সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারি। আদেশে গণভোট ও গণভোটের প্রশ্ন এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন সংক্রান্ত বিধান আছে। গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য আইন (অধ্যাদেশ) করা হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করা হবে।গনভোটে হ্যাঁ জয়ী হলে আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। সংবিধান সংস্কার হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চ কক্ষ গঠন করবে। নিম্ন কক্ষ বা সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চ কক্ষে আসন বণ্টন। উচ্চ কক্ষের মেয়াদ নিম্ন কক্ষের মেয়াদের সাথে শেষ হবে।
কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে গণভোটের প্রশ্নমালার ও রূপরেখা দিয়েছেন যেমন
প্রথম প্রশ্ন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্নিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন আাগামী সংসদ হবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চ-কক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চ কক্ষের সংখ্যা গরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
তৃতীয় প্রশ্ন সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন প্রধান মন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরন রাষ্টপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
চতুর্থ প্রশ্ন জুলাই সনদে বর্নিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
বাংলাদেশের ২২% লোক নিরক্ষর। তাদের কাছে এই ৪টি প্রশ্ন সহজবোধ্য হবে কি? যারা কম লেখাপড়া জানে তাদের কাছে বিষয়টি এতটা সহজতর নয়।যাদের সক্ষমতা আছে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে ৪টি বিষয় পড়ে ভোট কার্যসম্পাদন করতে কমপক্ষে ৫/৬ মিনিট সময় ব্যয় হবে। তাহলে ভোটদান প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। জাতীয় পর্যায়ে ভোট কাস্টিং কম হবে। সুতারাং প্রশ্নগুলো সহজ করতে না পারলে ভোটাররা অন্ধকারে
থেকে যাবে। যেহেতু জুলাই সনদে ইতোপূর্বেই রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছে সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি অঙ্গীকারনামা রয়েছে। জুলাই সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে জাতির কাছে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হলো। আমরা অবগত ৯০ এ এরশাদ বিরোধী আন্দোলন এর সময় তিন জোট একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে ছিলেন। অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার পতনের পর তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী গনভোট হয়েছিল। তখনকার আন্দোলনকারী ও বিশ্লেষকদের মতে এটি ছিল ‘ক্ষমতা হস্তান্তর ও রাজনীতি রাষ্ট্র পরিচালনার দলিল যা পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি।’
রাজনৈতি বিশ্লষকদের মতে ওই রূপরেখার সাফল্য হলো এরশাদের পতন ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হওয়া কিন্তু পরে দুই প্রধান দল নিজেদের রূপরেখা থেকে শুধুই উপেক্ষা করেননি বরং অনেক ক্ষেত্রে উল্টো কাজ করেছে। বিশ্লেষকরা আরও বলেন,তিন জোটের রূপরেখা অঙ্গীকার ১৯৯১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত দলগুলো মেনে চললেও পরে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন ছাড়া আর কিছুই হয়নি বরং উল্টোপথে গেছে দলগুলো, যার পরিনতি হলো ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে।
শংকা থেকেই যাচ্ছে এবার ও যদি অমনটি হয়?এমনটি হওয়ার কি সুযোগ আছে?কিন্ত ২৫টি রাজনৈতিক দল ১৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অঙ্গীকার নামায় যে স্বাক্ষর কার্য সম্পাদন করেছেন যে কর্মটি দেশের জনগণ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে তা থেকে সরে আসাটা কঠিন। তাই অঙ্গীকারনামা বাস্তবায়ন না করে উপায় নেই। সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ
বলেছেন ‘অঙ্গীকার নামায় যা আছে তা বাস্তবায়ন করতে বিএনপি বদ্ধপরিকর’ তাহলে জাতীর সামনে কি অঙ্গীকার করা হয়েছিল? যদি ফিরে তাকাই :-- (:ক) জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই - আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ- তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জন- আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রণীত ও ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব।
(খ) যেহেতু জনগণ এই রাষ্ট্রের মালিক তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সেহেতু রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আলাপ-আলোচনা ভিত্তিতে জনগনের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ গ্রহন করেছি বিধায় এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করব।
(গ)জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করবো না উপরোক্ত উক্ত সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করব। (ঘ) গণতন্ত্র মানবাধিকার ও আইনের শাষণ প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করব।
(ঙ)গণঅভ্যুত্থান পূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই আগষ্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংগঠিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনবার্সনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।
(চ) জুলাই সনদ ২০২৫ এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা তথা সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান এবং বিদ্যমান আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমামার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করব।
(ছ) জুলাই জাতীয় সনদ২০২৫ এর ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যে সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো কোন প্রকার কালক্ষেপন না করেই দ্রুততম সময়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।
দলগুলো যদি একসাথে বসে অঙ্গীকারনামা করে থাকে ক্ষমতায় এসে ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন করা না হলে জাতির সাথে প্রতারণা হবে। তাহলেত আমরা আবার পুরানো ধারায় চলে গেলাম। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত গনভোট বা জুলাই সনদ নিয়ে দলাদলি না করে তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সবাই সোচ্চার থেকে আগামী সংসদ সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে গণতন্ত্রের ধারায় দেশ ফিরে আসুক ধীরে ধীরে জুলাই জাতীয় সনদ ও বাস্তবায়ন হউক সেটাই জাতির প্রত্যাশা।
লেখক: কলামিস্ট ও ব্যাংকার।
আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অস্বস্তিকর সত্যের চেয়ে স্বস্তিকর মিথ্যাকেই বেছে নেই। এই কথাটা অনেক ব্যাপক এবং আমরা মেনে নিতে চাই না। অথচ বাস্তবতা এটাই। নিজের বাসা, কর্মস্থল, আড্ডার জায়গা সবখানেই একই চিত্র। চারিদিকে মিথ্যার জয়জয়কার এবং সত্য কোণঠাসা। এটা কিন্তু ঘটনাক্রমে হচ্ছে না, বরং আমি, আপনি, আমরা সবাই মিলে এই পরিস্থিতি তৈরি করে রাখছি। এটা একটা সম্মিলিত স্বার্থ যাকে আমরা উপরে উপরে অস্বীকার করলেও মনে মনে প্রমোট করে চলেছি। এটুকু পড়েই অনেকে বিরক্ত হয়ে গেছেন হয়তো। এটা আসলে বিরক্তি না বরং অস্বস্তি। সত্যকে মোকাবিলা করতে হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা অস্বস্তিতে পড়ে যাই। আজকে আমি চেষ্টা করব সেই অস্বস্তিকর বিষয়েই আলোচনা করতে যাকে আমরা সম্মিলিতভাবে ভয় পাই এবং প্রতিহত করি। এর ফলে, মিথ্যা এবং অন্যায়ের জয় হলেও আমরা আনন্দ চিত্তে মেনে নেই। কারণ আমরা সত্য খুঁজি না, আমরা আমাদের কম্ফোর্টকে নিশ্চিত করার জন্যে ভুল বা মিথ্যাকে ভ্যালিডেটেড করতে চাই।
আমার অবসর সময়ের অনেকটাই কাটে পড়া লেখা করে, টেলিভিশনে খেলা এবং নাটক সিনেমা দেখে। সময় পেলে হলে গিয়ে সিনেমাও দেখি। নাটক-সিনেমা বা এজাতীয় কিছু যখন অন্য কারো সাথে দেখি বা পরবর্তীতে এসব নিয়ে অন্য কারো সাথে আলোচনা করি তখন একটা বিষয়ে প্রায় সবাই একমত থাকে। সেটা হচ্ছে, ‘নাটক- সিনেমা দেখি বিনোদনের জন্যে, এখানে ভারী বা গভীর কিছু ভালো লাগে না’। এটা নিয়ে আমিও ভেবেছি; এবং একমতও হয়েছি। সেটা হচ্ছে আমাদের বিনোদন দরকার। তবে যে বিষয়ে একমত হতে পারিনি সেটা হচ্ছে আমাদেরকে হালকা বা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় বিনোদন দিতে সক্ষম হবে কেন?
আমাদের দেশের বাংলা সিনেমা মূলত এখন ঈদ নির্ভর। ঈদ আসলে কিছু সিনেমা রিলিজ পায় আর বছরের বাকী সময় ধরে নামমাত্র কয়েকটা সিনেমা রিলিজ পায় যার অনেকগুলোই একদমই মান সম্মত না। যাই হোক, গত ঈদে আমি বেশ কয়েকটি সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছি। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে হাতে গোণা দারুণ হিট মুভিগুলো একটা বাদে বাকিগুলো অপ্রাসঙ্গিক, আজগুবি এবং আমাদের জীবনের কথা বলে না। ঠিক একইভাবে টেলিভিশনে কয়েকটি মিলিয়ন্স ভিউপ্রাপ্ত নাটক দেখেছি যেগুলো এতটাই মানহীন যে পাঁচ মিনিটের বেশী দেখতে ইচ্ছা হয় নি। আবার এমন কিছু দারুণ সিনেমা দেখেছি যেটা হিট হয়নি বা কিছু ভালো নাটক দেখেছি যেগুলো তেমন ভিউ পায়নি।এই অদ্ভুত অবস্থার জন্যে আসলে কারা দায়ী? অনেকেই অনেক মতবাদ দিবেন। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে কিছু শিক্ষিত মানুষের মুখে বলতে শুনেছি, ‘নাটক, সিনেমা দেখি এন্টারটেইন্ড হতে। দেশ সমাজ নিয়ে ভাবার জন্যে না’। আমাদের এই চিন্তাই আমাদেরকে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই চিন্তাই ভালো কিছুকে খারাপ কিছুর কাছে হারিয়ে দিচ্ছে। আগেকার দিনে কমেডির মাধ্যমে সমাজের নিদারুণ বাস্তবতাকে তুলে ধরা হতো আর এখন কমেডি নাটকের নামে সমাজকে তামাশায় ফেলে দিচ্ছে। আগে থ্রিলার মুভি-নাটকে সাসপেন্সের মাধ্যমে টুইস্ট থাকতো আর এখন টুইস্টের নামে অযৌক্তিক ঘটনার অবতারণা করা হচ্ছে। আর এসব অযৌক্তিক জিনিষে আমরা এন্টারটেইন্ড হয়ে ভালো কিছুকে উঠে আসতে দিচ্ছি না।
এটা শুধু নাটক সিনেমাতেই আবর্তিত না। সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখেন। এন্টারটেইনার, গুরু, ইনফ্লুয়েন্সার, মোটিভেটর, সবজান্তায় চারিদিক আচ্ছন্ন। এদের ক’জনা আমাদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করছে? কারা আমাদেরকে মিথ্যা থেকে দূরে রেখে সত্যের দিকে ধাবিত করছে? এটা নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই আবার সেই একই সমস্যা। সমাজের অনেকেই বলবেন, ‘আরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটু মজা নিতে আসি। এখানে এত গভীর কথাবাত্রা শুনে কি লাভ হবে?’ সোশ্যাল মিডিয়ায় যাদের অনেক ফলোয়ার তাদের দিকে একটু গভিরভাবে খেয়াল করেন। তাদের আলোচনার টপিক এবং দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই করার চেষ্টা করেন। একটা জায়গায় দারুণ মিল পাবেন। সবাই প্রতিটা বিষয়ে একটা নির্দিষ্ট মতবাদ দিচ্ছে। সেই মতবাদ একটা টাইপের। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট গ্রুপ অফ পিপলের জন্যে। সেই নির্দিষ্ট গ্রুপ অফ পিপল তাদের মতাদর্শের ভ্যালিডেশন খুঁজছে সেসব ফেমাস ইনফ্লুয়েন্সারদের কাছ থেকে। গুরু বা ইনফ্লুয়েন্সাররা সত্যকে প্রমোট করছে না বরং একটা নির্দিষ্ট মতবাদকে প্রমোট করে একটা নির্দিষ্ট গ্রুপ অফ পিপলকে ফলোয়ার বানিয়ে দেদারসে কামাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, সেসব ইনফ্লুয়েন্সাররা প্রকৃতপক্ষে নিজের জ্ঞান দিয়ে কাউকে ইনফ্লুয়েন্স করতে পারে না বরং একটা নির্দিষ্ট আদর্শের মানুষ তাদের মতাদর্শের ভ্যালিডেশনের জন্যে তাদের কাছে আসে। এ কারণেই ডিপ থট বা গভীর চিন্তার উদ্রেগ যারা ঘটাতে পারে তাদের চেয়ে নির্দিষ্ট মতাদর্শকে সুন্দরভাবে ভ্যালিডেটেড করতে পারে তাদের ফলোয়ার বেশি। আরেকটু ভিন্নভাবে বললে, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ফলোয়ার পেতে হলে বেশি
রভাগ ক্ষেত্রেই যে গুনটার প্রয়োজন হয় সেটা হচ্ছে গুছিয়ে অন্যের মনের কথা বা আবেগকে বলতে পারা, নিজের মতাদর্শ বা জ্ঞানকে প্রচার করার ক্ষমতা না।
শুধু সোশ্যাল মিডিয়াতেই বা কেন। এবার কর্মক্ষেত্রে খেয়াল করে দেখেন বিশেষ করে আপনি যদি করপোরেট জব করে থাকেন। আপনার কতটা মেধা আছে বা আপনি কত ক্লিয়ারলি চিন্তা করতে পারেন সেটার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনি কতটা গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। আর ইংরেজিতে দক্ষ হলে তো কথাই নেই। কি বলছেন সেটা নিয়ে কেউ ভাববে না, কিভাবে গুছিয়ে কথা বলছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। তেলবাজ এবং চাপাবাজদের কর্মক্ষেত্রে জয়জয়কার। কর্মক্ষেত্রের চাপাবাজেরা খুব কম জ্ঞানের অধিকারী হয়। তাদের সবচেয়ে যে ক্ষমতা থাকে সেটা হচ্ছে বসের মন বুঝে কথা বলার ক্ষমতা এবং অন্যের কাছ থেকে আইডিয়া নিয়ে হালকা জ্ঞানকে দারুণভাবে উপস্থাপন করা যেটাতে মনে হবে সে দারুণ কিছু বলছে। মেধা দিয়ে না, তারা বসকে ইমপ্রেস করে গুছিয়ে কথা বলে।
আমি মনে করি, সমাজে দুই শ্রেণির মানুষ বসবাস করে। এক শ্রেণির মানুষ হচ্ছে আম-জনতা এবং আরেক শ্রেণির মানুষ হচ্ছে আম জনতাকে বেঁচে বড়লোক হওয়া। এই আম জনতাকে বেঁচে দেওয়া কিন্তু বিভিন্ন ফরমেটে হয়। তার মধ্যে একটা হচ্ছে সরাসরি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। ছোটবেলায় দেখতাম বিজ্ঞাপন গুলো খুব ডাইরেক্ট হতো। যেমন অমুক দেশের অমুক প্রোডাক্ট সেরা, কিনে ফেলেন। এরপর দেখলাম বিজ্ঞাপনে ভিন্নতা আসছে। আমাদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করতে দিচ্ছে না। কারণ, আপনি যখন কোন প্রোডাক্ট নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবেন তখন সেই প্রোডাক্ট দারুণ একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে। তাই তারা হালকাভাবে বিজ্ঞাপন করা শুরু করলো। যার কোনো যুক্তি নেই, বাস্তবতা নেই। আছে শুধু চটুলতা আর মজা। এতেই আমরা আম-জনতা প্রোডাক্টের প্রেমে পড়ে হুমড়ি খেয়ে দোকানে হাজির। এরপর বিজ্ঞাপন আরেক মাত্রায় গেলো। বর্তমান সময়ে আমরা ড্যাটা এবং পরিসংখ্যানের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল। তার ওরা বলা শুরু করলো ৮০%, ৯৯.৯৯% , সাধারণের চেয়ে দশ গুণ বেশি ইত্যাদি। এসব তথ্য উপাত্ত নিয়ে আমরা কিন্তু কেউ কিছু ভাবছি না। বিজ্ঞাপনের মোহাচ্ছন্নতায় প্রোডাক্ট কেনা শুরু করে দেই। একটা প্রোডাক্ট গুনগতভাবে কতটা ভালো তারচেয়েও আমরা বেশি গুরুত্ব দেই সেই প্রোডাক্টটার বিজ্ঞাপন কত সুন্দর হয়েছে এবং সেই বিজ্ঞাপনে আমাদের কোন গুরু বা ইনফ্লুয়েন্সার অংশ নিয়েছে।
আমার ছেলের বয়স যখন তের চৌদ্দ বছর তখন একদিন আমার ফেইস বুকের কয়েকটা স্ট্যাটাস পড়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘বাবা, এসব লিখে ফেমাস হতে পারবা না। তোমার এত জটিল কথা পড়ার মানুষের সময় নেই। মজার কিছু হালকা করে লিখ, অনেক ফলোয়ার পাবা’। পরে অনেকক্ষণ ভেবেছিলাম ছেলের কথাটা। উপলব্ধি করেছিলাম যে এটাই বাস্তবতা। এই বাবলের মধ্যে থাকা সমাজের এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা যে একটা কিশোর ছেলেকেও বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে তথাকথিত সাফল্যের জন্যে বেশি গভীর কিছু ভাবা যাবে না। এটাকে আমরা হালকাভাবে নিলে বড় রকমের ভুল করে ফেলবো। আমাদের এই সমাজের নাটের গুরুরা কিন্তু এটাই চায়। তারা চায় আমি, আপনি সবকিছুকে হালকাভাবে ভাবতে শুরু করি। তাহলেই তারা আমাদেরকে অনেক কিছু গিলিয়ে ইনকাম করতে পারবে। আমাদের চিন্তা শক্তি যত প্রখর হবে, আমরা যত রিজনিং খুঁজব তত অন্যায়কে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের উচিৎ হবে পরবর্তী প্রজন্মকে গভীর চিন্তা করার ক্ষমতা অর্জন করতে সহায়তা করা। আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে তরুনরা যেন ইনফ্লুয়েন্সারের দুষ্টু ইনফ্লুয়েন্সে না পড়ে তারা যা বলছে সেটা ঠিক বলছে কি না সেটা যাচাই করার ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করা। তা না হলে পরবর্তী প্রজন্ম এক ইলিউশনে পড়ে যাবে যেখান থেকে আর মুক্তি মিলবে না।
লেখক: কথাশিল্পী ও নাট্যকার।
সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সারা বিশ্বে প্রায় ৪৬ কোটি শিশু সঙ্ঘাতপূর্ণ এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রে বাস করে। যা কিনা সেই সকল শিশুর নিরাপত্তাহীনতার এবং ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও সারা বিশ্বে অপুষ্টি, অকাল জন্ম এবং সংক্রামক রোগ শিশুদের বড় হয়ে ওঠার পথে বাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মনে হয়, একটু দৃষ্টি নিয়ে এদিকে সেদিকে তাকালে এরকম দৃশ্য চোখে পড়বেই।
শিশুদের বলা হয়, ফিউচার অফ দ্য নেশন। শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে যেকোনও দেশের ক্রীড়া, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতির অঙ্গনে তাঁদের প্রাধান্য বিস্তার করে আজকের শিশুরা। সুতরাং সকল দেশ এবং জাতির কর্তব্য, আজকে যারা শিশু, তাদের মানসিক এবং শারীরিক উন্নতির জন্য চিন্তা - ভাবনা করা, তাদের আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত করে তোলা। কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করে যাচ্ছি যে, গোটা বিশ্বেই বর্তমান সময়ে শৈশব বিধ্বস্ত। বিশেষ করে, যুদ্ধে যে সকল দেশ জড়িয়ে পড়েছে, সেই সকল দেশের শৈশব আজ প্রচণ্ড ভাবে বিপর্যস্ত। ইজরায়েল, প্যালেষ্টাইন, রাশিয়া, ইউক্রেন, সুদান, সিরিয়া, ইরান, ইরাক ইত্যাদি দেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি যুদ্ধাস্ত্রের আঘাতে প্রচুর শিশু নিহত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। আহতের সংখ্যা নিহতের থেকেও বেশি। মা - বাবাকে জনমের তরে হারিয়ে বহু শিশু হয়ে পড়েছে অনাথ, অসহায়। তাদের পড়াশোনা, মানসিক বিকাশ সম্পূর্ণ ভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া অনেক দেশে অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক শিশু তাদের স্কুল জীবন অসমাপ্ত রেখেই নিয়োজিত হচ্ছে বিভিন্ন কাজে। তারা কাজ করছে বিভিন্ন যানবাহনের গ্যারেজে, হোটেলে, দোকানে, রেস্তোরাঁয় বা চায়ের দোকানে। তাদের অর্থাৎ শিশুদেরকে নানা রকম কাজে নিয়োজিত করা হয় সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। কখনও কখনও তাদের ওপর শারীরিক অত্যাচার পর্যন্ত করা হয়। এই ধরনের কর্মকাণ্ড কখনওই শৈশবের ভবিষ্যৎ চিত্র খুব একটা উজ্জ্বল করে না।
শৈশবে দেখেছি,পাঠশালায় ‘বাংলা এবং ইংরেজি’ অক্ষর চেনা, জানা ও হাতে ধরে লেখার জন্য পণ্ডিতদের কাছে পাঠাতেন। তারা হাতে হাত রেখে বা ধরে ইংরেজি এবং বাংলা অক্ষর লেখা শিখাতেন। পাঠশালাতে প্রায় ১ বছর ধরে অক্ষর সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান হওয়ার পর প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হত। শিশু বয়সে পণ্ডিতদের কাছ থেকে অক্ষর চেনা, জানা ও লিখতে পারার জ্ঞান অর্জন করা শুধু নয়, পাশাপাশি তারা প্রতিটি শিশুকে আদর্শিক হিসাবে গড়ে ওঠার শিক্ষা দিতেন। বাংলাদেশে আদিকাল থেকে গুরুভিত্তিক পাঠশালার অস্তিত্ব ছিল, যা আমরাও শিশু বয়সে পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে সরকার নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তনের ফলে পাঠশালা শিক্ষা ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, আমাদের পিরোজপুর শহরে আদর্শ হিন্দু স্কুলের একটি শাখা ছিল, সেটি আদর্শ কালিবাড়ী পাঠশালা হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই পাঠশালাটি ১৯৭১ সালে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
তাছাড়া আদর্শ হিন্দু স্কুলের অস্তিত্বও আর নেই। সত্যি বলতে কি, এ যুগে পাঠশালা না থাকার কারণে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করার ব্যবস্থা চিরতরে বন্ধ হওয়া মানেই বর্তমান প্রজন্ম যে আদর্শিক হতে গড়ে উঠবে, সে সুযোগ আজ কোথায়! যেজন্য পাঠশালার পণ্ডিতদের অস্তিত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পণ্ডিতও নেই তাই বোধহয় মানুষ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না এ প্রজন্মের একাংশ। আজকাল প্রায়শই পত্রিকার পাতায় দেখা যায়, ছাত্র কর্তৃক শিক্ষক
লাঞ্ছিত - অপমানিত। কারণ, ঐ যে শিশু বয়সে তারা পণ্ডিত মশাই পাননি। কেননা, পণ্ডিতরাই সত্যিকার অর্থে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতেন সেই সময়ের শিশুদেরকে। যে জন্য শিশুরা বড় হয়ে শিক্ষকসহ সর্বস্তরের গুরুজনদেরকে সন্মান করতেন, শ্রদ্ধা জানাতেন।
লেখক: চিঠিপত্র বিশারদ
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দিয়েছে সরকার।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে একটা চিঠি পাঠানো হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, গণভোটের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। আর এই গণভোট এবং জাতীয় সংসদের নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। আর এই ইস্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক বিশেষ মুহূর্ত অতিক্রম করছে। রাজনীতির এটই সময়টি এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্ত শুধু রাজনৈতিক নয়- রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো, গণতন্ত্রের রূপ নির্ধারণ এবং জনগণের ক্ষমতার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে। গত কয়েক সপ্তাহে নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনের সম্ভাবনা উত্থাপিত হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, তা স্বাভাবিক উত্তেজনার অনেক বাইরে। এটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সীমা অতিক্রম করে এখন হয়ে উঠেছে এক বৃহদাকার রাজনৈতিক বিতর্ক। আর এই বিতর্কে রাজনৈতিক দল, সাধারণ জনগণ, গণমাধ্যম, রাজনীতি বিশ্লেষক এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও গভীর নজর রাখছে।
এছাড়াও বিভিন্ন সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, নির্বাচন কমিশনও এক অভূতপূর্ব চাপের মুখে রয়েছে। তারা এটিকে ‘দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট, গণভোটের ব্যালট, আলাদা গণনা, পর্যবেক্ষণ, নিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণÑ সব মিলিয়ে এমন দ্বৈত আয়োজন বাংলাদেশের মতো দেশে এই প্রথম। কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি, কর্মী প্রশিক্ষণ, ব্যালটপেপার মুদ্রণ, নিরাপত্তা সমন্বয়- সবকিছুই এখন এক প্রকার যুদ্ধ।
সরকার ও নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কাঠামো গঠনের অন্যতম রোডম্যাপ। নতুন রাষ্ট্র কাঠামো, বিশেষ করে Upper House-এর মতো একটি প্রস্তাব বাস্তবায়নের আগে জনগণের মতামত নেওয়া জরুরি। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক শূন্যতা দীর্ঘায়িত হলে রাষ্ট্র আরও অস্থিতিশীল হবে- তাই দ্রুত প্রক্রিয়া শুরু করা ছাড়া উপায় নেই। বিএনপি বলছে, গণভোটকে অজুহাত করে নির্বাচনের প্রস্তুতির সময় সংকুচিত করা হচ্ছে, যাতে তারা সংগঠিত কৌশল নিতে না পারে। অন্যদিকে যারা গণভোটের পক্ষে, তারা বলছে, নতুন রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাপারটি এতদিন ধরে ঝুলে ছিল। দেশের অবস্থা ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিবেচনায় এখনই জনগণের সামনে প্রশ্নটি উপস্থাপন করার সময়। এই দুই বিপরীত অবস্থান মাঠে এক ধরনের দ্বৈত উত্তাপ তৈরি করেছে। একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়তে পারে অথবা কমতেও পারে। তবে প্রশাসনিকভাবে ভুলের ঝুঁকি বহু গুণ বাড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, দেশের আমলাতন্ত্র, নিরাপত্তা বাহিনী, নির্বাচন পরিচালনা কাঠামো- সবকিছুই সীমিত সম্পদে পরিচালিত হয়। একটি বিশাল জাতীয় নির্বাচনই যেখানে বিশৃঙ্খলা বা জটিলতার আশঙ্কা তৈরি করে, সেখানে একই দিনে দ্বৈত ভোট আয়োজন করলে ভুল হওয়ার সুযোগও দ্বিগুণ হবে। সেই ভুল যদি ফলাফল, ব্যালট গণনা বা কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় ঘটে- তাহলে তা রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দেবে, যার প্রভাব বহুদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। তবে যদি নির্বাচন ও গণভোট আলাদা দিনে করা হয়, তাহলেও রাজনৈতিক উত্তেজনা দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ঢা যায় না। বাংলাদেশে নির্বাচনী আবহ যখনই সৃষ্টি হয়, তখনই অনিশ্চয়তা, গুজব, দলীয় ইস্যু এবং সহিংসতা বেড়ে যায়। সে প্রেক্ষাপটে আলাদা দিনে ভোট দুটি আয়োজন করলে দেশের ওপর চাপও দ্বিগুণ হবে। সুতরাং একটি দিনের সিদ্ধান্তই অনেকের কাছে ‘রাজনৈতিকভাবে ন্যূনতম ঝুঁকির পথ’ মনে হচ্ছে।
নতুন রাষ্ট্র কাঠামো তৈরির যে আলোচনাটি চলছেÑতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে Upper House বা উচ্চ কক্ষ গঠনের প্রস্তাব। গণমাধ্যমের এক একটি প্রতিবেদন সূত্রে জানতে পারলাম যে, উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্ব কীভাবে নির্ধারণ হবে- এটি এখন রাজনৈতিক বিরোধের সবচেয়ে বড় ইস্যু। কেউ চান এটি সরাসরি নির্বাচিত হোক, কেউ চান পেশাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব, আবার কেউ চান অংশভিত্তিক মনোনয়ন ব্যবস্থা। রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ মনে করছে যে, এটি ক্ষমতা ভাগাভাগির নামে ক্ষমতার পুনঃবিন্যাসের নতুন কৌশল। আবার অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, উচ্চকক্ষ গঠিত হলে টেকসই আইন প্রণয়ন, সংবিধান সংশোধন এবং রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি নীতি নির্ধারণ আরও শক্তিশালী হবে।
গত এক দশকে নানান রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন-সংঘর্ষ, আদালতের নানা সিদ্ধান্ত, নির্বাচন নিয়ে বিতর্কÑসব মিলিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক অবসাদও জমেছে। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দেওয়া হলেও তা এই নির্বাচনে প্রযোজ্য নয়। এমন একটি সিদ্ধান্তও নাগরিকদের মনে নতুন বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। অনেকে বলছেন, আদালতের এই রায় ভবিষ্যতে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামো গঠনের পথ তৈরি করবে। আবার কেউ বলছেন, এটি রাজনৈতিক সংকট আরও জটিল করবে। বিএনপি দাবি করছেÑগণভোটের ফলে নির্বাচনের আসল ইস্যুগুলো আড়ালে পড়ে যাবে এবং সরকার প্রক্রিয়াটি নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করবে। তাদের বক্তব্যÑ‘এক দিনে নির্বাচন ও গণভোট মানে দুইটি বিশাল রাজনৈতিক চাপকে একসঙ্গে বেঁধে দেওয়া।’এতে ভোটারের মনোযোগ বিভক্ত হবে। অন্যদিকে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন যে, যারা গণভোটকে বিলম্বের কৌশল বলছেন, তারা নিজেরাই রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে ব্যর্থ। তারা মনে করেন, গণভোটের প্রশ্ন জনগণের ওপর আস্থা রাখার একটি সুযোগ।
গণভোটের বাস্তব চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণ কি গণভোটের জন্য প্রস্তুত? একটি দেশের গণভোট তখনই সার্থক হয় যখন জনগণ বিষয়টি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ও তথ্যসমৃদ্ধ থাকে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন রাষ্ট্রগঠনের যে প্রস্তাব নিয়ে এত আলোচনা- তা আদৌ কয়জন গভীরভাবে বুঝেছে? এই কাঠামো কীভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দেবে? এতে প্রশাসনের ওপর কী প্রভাব পড়বে? জনগণের ক্ষমতায়ন কি বাড়বে, নাকি এটি ক্ষমতাবৃত্তির আরেকটি স্তর তৈরি করবে?
গণমাধ্যমের ভূমিকাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রচলিত মিডিয়ার পাশাপাশি অনলাইন মিডিয়া, ইউটিউব চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন রাজনৈতিক বয়ান তৈরির মূল ক্ষেত্র। কিন্তু এখানেও এক ধরনের ‘বিভক্ত গণমাধ্যম বাস্তবতা’ দেখা যাচ্ছে। কেউ শক্তভাবে নির্বাচন-গণভোট একইদিনে করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছে, আবার কেউ এটিকে রাজনৈতিক কৌশল বলে আখ্যা দিচ্ছে। এই ভিন্নমুখী কাঠামো জনগণের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বেও প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে উপেক্ষা করা যায় না। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের নির্বাচন এখন আন্তর্জাতিক নজরদারির অন্যতম বিষয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ ও ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ প্রসঙ্গে। একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের ধরনও বদলে যাবে। অনেক প্রতিষ্ঠান হয়তো দুটি ইভেন্টেই পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারবে না। ফলে পর্যবেক্ষণের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
সব মিলিয়ে এখন স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক পর্যায়ে ঢুকেছে, যেখানে নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজন করা হবে কিনা- এ প্রশ্নটাই রাজনৈতিক রূপরেখা নির্ধারণ করবে। এই আয়োজন সফল হলে এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রে কাঠামোগত পরিবর্তনের ঐতিহাসিক সূচনা হতে পারে। বিশেষ করে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতা বিভাজন, আইনি সংস্কার- সবই এক নতুন রাজনৈতিক দিগন্তের সূচনা করবে। কিন্তু যদি আয়োজন ব্যর্থ হয়, গণনা ভুল হয়, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় বা রাজনৈতিক দলগুলো ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে- তাহলে তা দেশে নতুন অস্থিতিশীলতা, নতুন অসন্তোষ এবং নতুন ধরনের সংকটের জন্ম দিতে পারে। যা নিয়ন্ত্রণ করা নতুন সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে এখন লড়াই শুধু দলগত নয়Ñএটি আদর্শিক লড়াইয়েও রূপ রিয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোন পথে যাবে- এটি এখনো অনিশ্চিত। কিন্তু একটি বিষয়ে দেশ ইতোমধ্যে নিশ্চিত যে, বাংলাদেশের রাজনীতি আর আগের জায়গায় থাকবে না। নির্বাচন ও গণভোটের এই সিদ্ধান্তই হয়তো আগামী রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করবে অথবা নতুন অস্থিরতার দরজা খুলে দেবে।
লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিটি শিশু কিছু অধিকার ও দ্বায়িত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। জন্মের পর থেকেই সে অধিকারগুলো ভোগ করতে শুরু করলেও দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়। দায়িত্ব ও কর্তব্য শুরু হয় আরও কিছু দিন পর থেকে। যেমন জন্মের শুরু থেকেই শিশু আহার, নিদ্রা, চিকিৎসা, মায়ামমতা ও নিরাপত্তার অধিকার ভোগ করতে থাকে। কিন্তু দায়িত্ব ও কর্তব্য দেখা যায় আরও কিছু দিন পর থেকে। যেমন- একটি শিশুকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য বাবা মা তাকে স্কুলে পাঠাবেন এটা ঐ শিশুর অধিকার। কিন্তু ভালোভাবে লেখাপড়া করা ঐ শিশুর কর্তব্য। এমনি করে অধিকার ভোগের পাশাপাশি শিশুর কর্তব্য ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। যেমন নিয়মিত স্কুলে যাওয়া। পড়ার টেবিল গুছিয়ে রাখা। সময় মত পড়তে বসা। লেখাপড়ার সময় লেখা পড়া করা, খেলাধুলার সময় খেলাধুলা করা। বাবা মায়ের কথামত চলা। বড়দের সম্মান করা ইত্যাদি। আর একটু বড় হলেই তার উপর দায়িত্ব ভর করতে শুরু করে। যেমন-ছোট ভাই বোনদের প্রতি খেয়াল রাখা ও তাদের প্রতি যত্নবান হওয়া। ছোটদেরকে স্নেহ করা। বড়দের সম্মান করতে শেখানো, সংসারের কাজে বাবা মাকে সাহায্য করা ইত্যাদি।
জীবনের প্রতিটি ধাপে মানুষের দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। আগেই বলা হয়েছে শিক্ষা মানুষের অধিকার। কিন্তু যথাযথভাবে শিক্ষা লাভ করে সেই শিক্ষাকে নিজের ও দেশের কল্যাণে কাজে লাগানো তার দায়িত্ব। একজন মানুষ কর্মজীবনে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত দেশের সর্বশ্রেণিপেশার মানুষের কাছে ঋণী হতে থাকে। একজন নাগরিককে সুশিক্ষিত করে তুলতে সরকারকে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করতে হয়। আমাদের সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধার জন্য সরকার যে অর্থ ব্যয় করে সেই অর্থ দেশের প্রতিটি মানুষের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। কাজেই সহজেই অনুমান করা যায় যে, আমরা মানুষের কাছে কতভাবে ঋণী। কর্মজীবনে প্রবেশের পরও মানুষের কাছে ঋণী হওয়া বন্ধ হয় না। মানুষ চাকরি যে বেতন পায় তাতেও থাকে সর্ব শ্রেণিপেশার মানুষে ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের টাকা। অর্থাৎ মানুষ যত বড়লোকই হোক, যত বড় চাকুরেই হোক, যত বড় ব্যবসাই হোক, যে পেশারই হোক না কেন সর্বশ্রেণিপেশার অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক, কুলী, মজুর, রিকসাওয়ালা, ঝাড়ুদার, এমন কি একজন ভিক্ষুকের কাছেও সে ঋণী। এটাই আমাদের দায়। এই দায় থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি ভাবে এই ঋণী পরিশোধ করে নিজেকে দায়মুক্ত করব? প্রশ্নের যখন উদয় হয়েছে, উত্তরও অবশ্যই মিলবে। উত্তর হলো এই ঋণ পুরোপুরি পরিশাধ যোগ্য নয়। তবে প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে এই ঋণের ভার বেশ খানিকটা হালকা করতে পারি। যেমন-প্রতিটি পেশাজীবি মানুষের স্তর অনুযায়ী সমাজে অবস্থান থাকে।
প্রতিটি মানুষ যদি তার অবস্থান থেকে সঠিক ভাবে তার দায়িত্ব পালন করে তবেই সে দায় থেকে মুক্তি পেতে পারে। নিজেকে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ‘নৈতিক শিক্ষা’। কিন্তু নৈতিক শিক্ষা কিভাবে লাভ করা যায়? পরিবার হচ্ছে নৈতিক শিক্ষার আতুর ঘর। অর্থাৎ শৈশবে পরিবার থেকেই শুরু হয় মানুষের নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষা হচ্ছে সেই শিক্ষা যা মানুষকে উচিৎ-অনুচিৎ, ন্যায় অন্যায় বুঝতে শেখায়। মানুষকে শিষ্টাচারী, মানবতাবাদী হিসেবে গড়ে তোলে। মানুষের মধ্যে আত্মতৃপ্তি এবং আত্ম বিশ্বাস তৈরি করে। নৈতিক শিক্ষা মানুষকে ভালো কাজে উৎসাহ যোগায় এবং মন্দ কাজে নিরুৎসাহিত করে। তাই সমাজের সর্বস্তরে নৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে।
অ্যাড. আব্দুর রাজ্জাক খান রানা: সমাজ সেবক, আয়কর আইনজীবী।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের মাটিতে হঠাৎ কম্পনের অনুভূতি জনসাধারণের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। প্রথমে ছোটখাটো দমকা বা কম্পন মনে হলেও, পরপর কম্পনের ঘটনা মানুষকে নিশ্চিন্ত হতে দিচ্ছে না। ছোট-বড় সকল শ্রেণির মানুষ দোকানদার, অফিসকর্মী, শিক্ষার্থী, দিনমজুর একই প্রশ্ন নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন: ‘পরবর্তী ধাক্কা কি আরও বড়ো হতে পারে?’ এই অনিশ্চয়তা এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গেছে।
সাধারণ মানুষের আতঙ্কের পেছনে শুধু প্রকৃত ভূমিকম্পই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে প্রতিনিয়ত অ্যানিমেশন, ভিডিও, চিত্র এবং তথ্যচিত্র ছড়ানো হচ্ছে। অনেক সময় এগুলো আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে নাটকীয় রূপ পায়, যা জনমনে অতিরিক্ত ভয় সৃষ্টি করে। ভিডিওতে অগ্নিকাণ্ডের চিত্র, ভেঙে পড়া ভবন, মানুষের দৌঁড়াদৌঁড়ি সবই অতিমাত্রায় আতঙ্ক সৃষ্টিকারী। ফলে, সাধারণ মানুষ বাস্তব ও কল্পনার পার্থক্য করতে পারছেন না।
এটি শুধু মানসিক উদ্বেগই নয়, সামাজিক জীবনেও প্রভাব ফেলছে। দৈনন্দিন জীবনের রুটিন দোকান খোলা রাখা, স্কুল-কলেজে পড়াশোনা, অফিসে যাতায়াত সবকিছুই স্থবির হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানপাট খোলার বিষয়ে দ্বিধায় পড়েছেন, পরিবারগুলো রাতে ঘুমাতে পারছেন না, শিশুরা আতঙ্কিত। বিশেষ করে যেসব এলাকা পুরনো ভবন এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ, সেসব স্থানে আতঙ্ক আরও তীব্র। অনেকেই ইতোমধ্যেই নিজের বাড়ি বা অফিসে নিরাপদ স্থানের খোঁজ শুরু করেছেন।
বিগত কয়েক বছরের নগরায়ন অভ্যাসও এই আতঙ্কের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। নগরায়ন পরিকল্পিত না হওয়ায় আমাদের শহরে রাস্তা সংকীর্ণ, বহুতল ভবন অনিয়মিতভাবে নির্মিত এবং অনেক পুরাতন ভবন এখনো ব্যবহার হচ্ছে। একদিকে শহরের জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, অন্যদিকে নিরাপদ নির্মাণের মান কমছে। এই পরিবেশে ভূমিকম্পের প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই বেশি। শহরের আকাশচুম্বী ভবন, জনবহুল মার্কেট, রাস্তার সংকীর্ণতা এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করছে, যা সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ককে প্রজ্বলিত করছে।
সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও পরিস্থিতিকে জটিল করছে। দেশের রাজনৈতিক মাঠে উত্তাপ, ভোটের প্রস্তুতি এবং শীতের আগমন সবকিছু একসঙ্গে মানুষের মনকে উদ্বিগ্ন করছে। এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিরিক্ত আতঙ্ক ছড়ানো হলে সাধারণ মানুষের মানসিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয়। একে অযথা আতঙ্ক বলা যায় না, কারণ এটি বাস্তব জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, কিন্তু অতিরিক্ত তথ্য এবং নাটকীয় চিত্র জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
সরকারের করণীয় এখানে স্পষ্ট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিক ও দ্রুত তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছানো। বিভ্রান্তিকর বা অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণে আতঙ্ক আরও বাড়তে পারে। প্রতিটি জেলায় স্থানীয় প্রশাসনকে সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে হবে। নিরাপদ স্থানের তথ্য, ভূমিকম্প মোকাবিলার নিয়মাবলি, জরুরি সেবা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থানীয় ক্লাব ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় শুধু আতঙ্কই তৈরি করে না, বরং আমাদের প্রস্তুতির সক্ষমতাকেও পরীক্ষার মুখে ফেলে। এই প্রস্তুতিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ঘটনা ঘটার মুহূর্তে তারা তৎপরভাবে উদ্ধার, চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হলে সাধারণ মানুষ দ্রুত নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র পেশাদার সংস্থার উপর নির্ভর করলেই চলবে না।
এক্ষেত্রে স্কাউট, যুবসংগঠন এবং স্থানীয় কমিউনিটি দলের মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর প্রশিক্ষণ ও অংশগ্রহণও অত্যন্ত জরুরি। তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বয়স্ক মানুষ ও শিশুদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর দিকনির্দেশনা দিতে পারে। তাছাড়া, সাধারণ বাসিন্দাদেরও প্রাথমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক ভূমিকম্পের সময় কিভাবে আশ্রয় নেবেন, জরুরি সাপ্লাই সংরক্ষণ কোথায় থাকবে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে যোগাযোগের সঠিক পথ কী।
এই প্রস্তুতির কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে। প্রত্যেক জেলা ও উপজেলায় ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি নীতি প্রণয়ন, নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র চিহ্নিতকরণ, জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং স্থানীয় জনগণকে প্রশিক্ষিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি।
শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত জনসচেতনত সামজিক যোগাযো মধ্যম ভিডিও ও লিখিত তথ্যের মাধ্যমে শিক্ষামূলক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। এভাবে নাগরিকরা শুধু আতঙ্কিত হবে না, বরং বিপদের মুহূর্তে স্বশক্তিতে নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জন করবে।
ফলশ্রুতিতে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পেশাদার প্রস্তুতি, স্কাউট ও যুব সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী সহায়তা এবং সাধারণ বাসিন্দাদের সচেতনতা একসাথে মিলিত হলে, ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক বিপদকে যথাযথভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে এই সব ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
নাগরিকদেরও তাদের ভূমিকা বোঝা জরুরি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর বা আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কন্টেন্ট ছড়ানো বা সেয়ার থেকে বিরত থাকতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে সরকারি সূত্র এবং নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যম থেকে তথ্য গ্রহণ করা উচিত। পরিবার, প্রতিবেশী ও স্থানীয় কমিউনিটির সঙ্গে সক্রিয় সংযোগ রক্ষা করলে মানুষ মানসিকভাবে আরও প্রস্তুত হতে পারে।
এছাড়াও, বাস্তব জীবনের উদাহরণও আমাদের শেখায় যে সচেতনতা এবং প্রস্তুতি ভয়কে মোকাবিলার শক্তি বৃদ্ধি করে। জাপান, চিলি, তুরস্কের মতো দেশগুলোতে, যেখানে ভূমিকম্প স্বাভাবিক ঘটনা, জনগণ এবং প্রশাসন আগে থেকেই প্রস্তুত থাকে। সেখানে শিক্ষামূলক সিমুলেশন, জরুরি ব্যবস্থা এবং জনসচেতনতা কার্যক্রমের ফলে আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমাদের দেশেও একই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা সম্ভব। প্রতিটি শহর, উপজেলা ও গ্রামে এই ধরনের প্রস্তুতি নিলে মানুষের জীবন এবং মানসিক শান্তি দুইই রক্ষা করা সম্ভব।
বিভিন্ন গবেষণাও প্রমাণ করে, আতঙ্কিত মানুষ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, যা বিপদের সময় আরও ক্ষতি সৃষ্টি করে। তাই মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি। স্কুল-কলেজে ভূমিকম্প সচেতনতামূলক ক্লাস নেওয়া, অফিস ও কারখানায় জরুরি পরিকল্পনা তৈরি করা, পরিবারকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার শিক্ষাদান এগুলো সবই জনগণকে আতঙ্কমুক্ত রাখতে সহায়ক।
বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রভাবও এই আতঙ্কের সঙ্গে যুক্ত। ব্যবসায়ীরা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে দ্বিধায় পড়ছেন, শেয়ার বাজার বা অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। এমন অবস্থায় সরকারি পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতা জরুরি। শুধু আতঙ্ক দূর করা নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বোপরি, ভূমিকম্প যেমন একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, তেমনি আমাদের সচেতনতা ও প্রস্তুতি সেটিকে মোকাবেলার সক্ষমতা নির্ধারণ করে। আতঙ্ককে দূরে সরিয়ে সঠিক তথ্য, শিক্ষিত নাগরিক এবং কার্যকর প্রশাসন একত্রিত হলে আমরা নিরাপত্তা এবং মানসিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারি। সমাজ এবং সরকার একযোগে কাজ করলে আতঙ্ক কমানো সম্ভব, এবং জনগণ নিরাপদভাবে দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।
আজকের এই মুহূর্ত আমাদের জন্য একটি হুঁশিয়ারি: আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনভাবে এবং সুপরিকল্পিত প্রস্তুতির মাধ্যমে আমরা ভূমিকম্পের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এটি শুধু সরকারের কাজ নয় সাধারণ জনগণও সচেতনতা, দায়িত্বশীল আচরণ এবং সহমর্মিতার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে হবে। একমাত্র সঠিক তথ্য, প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি মিলিত হলে আতঙ্ককে আমরা সামলাতে পারব, জীবন রক্ষা করতে পারব এবং মানসিক শান্তি বজায় রাখতে পারব।
ভূমিকম্প একটি প্রকৃতির পরীক্ষা, এবং আমাদের প্রতিক্রিয়া এই পরীক্ষার প্রকৃত মান নির্ধারণ করে। আতঙ্ক নয়, প্রস্তুতি এটাই আমাদের একমাত্র নিরাপত্তা। আজকের জনগণ সচেতন হলে আগামী দিনের বাংলাদেশ আরও নিরাপদ, আরও স্থিতিশীল এবং আরও সুসংগঠিত হবে।
আ.ন.ম খলিলুর রহমান (ভিপি ইব্রাহীম): লেখক ও টকশো বিশ্লেষক।
সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দল
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্রের নানা সমীকরণ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে-এমন ঘোষণার পর অপশক্তিগুলো নির্বাচন বানচাল করতে চতুর্মুখী অপতৎপরতা শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী এবং পতিত আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা নাশকতা সৃষ্টিসহ পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মতো ক্ষেত্র তৈরির অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে ছদ্মবেশে থাকা পতিত আওয়ামী লীগের দোসররা সক্রিয় রয়েছে। এ অবস্থায় এসব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হলে সবার আগে দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এটি হলো অন্যতম পূর্বশর্ত। আর দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে এ মুহূর্তে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য নির্বাচন পর্যন্ত আগামী কয়েকটি মাস ভালোভাবে পার করতে সরকারের পাশে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের সব শক্তিকে শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে। সরকার নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়া জানতে আন্তরিক সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এই মুহূর্তে সৃষ্ট সংকট নিরসনে সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। নির্বাচন বানচাল করতে ইতোমধ্যেই একটি মহল এখন প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ শুরু করেছে। এটি হলো তাদের বড় শক্তি। এটা তাদের একধরনের ষড়যন্ত্রমূলক মিশন। এজন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তারা প্রতিনিয়ত গুজব ছড়াতে ব্যস্ত রয়েছে। ফলে সৃষ্ট সংকট ও বহুমুখী ষড়যন্ত্র কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে হলে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য গণঅভ্যুত্থানের সব শক্তিকে সত্যিকারার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ক্ষমতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে নিজেরা বিভেদে জড়িয়ে পড়লে বিপদ অনিবার্য।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান ঘিরে শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে দেড় বছর না পেরোতেই সেই ঐক্যে ফাটল ধরেছে। যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। অপরদিকে নির্বাচনের সময় নিয়ে কারও অপত্তি না থাকলেও কয়েকটি দল বিতর্কিত কিছু দাবি তুলছে। এমনকি কোনো কোনো নেতা তাদের দাবি পূরণ না হলে নির্বাচন হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন। এতে করে নির্বাচন নিয়ে জনমনে নানা সন্দেহ ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হচ্ছে। জটিল হয়ে উঠছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিষয়টি নিয়ে দুই ধরনের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। একটি হচ্ছে-এটি তাদের ‘রাজনৈতিক কৌশল’ হতে পারে। কারণ, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আসন ভাগাভাগি নিয়ে পর্দার আড়ালে হয়তো কিছু দেনদরবার করতে চাইছে ওই সব দল। দ্বিতীয়ত, হতে পারে যারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বেশি সুবিধা করতে পারবে না, তারা নির্বাচন ছাড়া ভিন্ন পথে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। এর ফলে প্রকারান্তরে লাভবান হচ্ছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। তাদের ষড়যন্ত্রের পথকে এভাবে মসৃণ করে দেওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনার দুঃশাসনের সময় তিনটি নির্বাচন হয়েছিল। সেসব নির্বাচনে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কাজেই নির্বাচনহীন অবস্থা থেকে মুক্তির সমাধান হচ্ছে-একটি সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও নির্ভরযোগ্য নির্বাচন। তাই ৫ আগস্টের পর দেশে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, আবারও সেই ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য সব দলের উচিত হবে নির্বাচনমুখী হওয়া এবং ঐক্যবদ্ধভাবে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেওয়া।
দেশ যাতে গণতান্ত্রিক অবস্থায় ফিরে আসতে না পারে, সেজন্য বিভিন্ন জায়গায় ষড়যন্ত্র চলছে। ষড়যন্ত্র চলছে আগামী জাতীয় নির্বাচন যাতে না হয়, সেজন্যও। সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা যাতে বাস্তবায়ন না হয়, ভন্ডুল হয়ে যায়-সেজন্য ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা। সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থেকে এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনও ভোটের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের বড় দল বিএনপি তাদের মিত্র দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে। আসন নিয়ে দর কষাকষি চলছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচন বর্জন করা আরও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। এই প্রক্রিয়াকে সাধুবাদ জানাতে হয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকা যায়-সে বিষয়ে এখন সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার কৃত অপরাধের বিচার শেষে কয়েকটি অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে তার ফাঁসির রায় হয়েছে। সেই রায়কে কেন্দ্র করে পতিত আওয়ামী লীগ এখন দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত করছে। এ ব্যাপারে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন থাকতে হবে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ করতে হলে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। ঐক্যের মধ্যে কোনো বিভাজন সৃষ্টি হলে তা দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। চব্বিশের ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানের পর জাতীয় ঐক্যমতের সরকার গঠনের যে সম্ভাবনা রয়েছে, সেটিকে কাজে লাগিয়ে জনগণের অধিকার ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথকে সুদৃঢ় করতে হবে। দেশের জনগণ এখন পরিবর্তন চায়। নতুন ধারার রাজনীতির চর্চা দেখতে চায়। নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ চায়। আজকের নতুন প্রজন্ম গণতন্ত্র ও সুশাসনের বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমাদের সবাইকে সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, যেন কেউ বিভেদ সৃষ্টি করে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পথে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। গত ১৬ বছরেরও বেশি সময় পছন্দের মানুষকে ভোট দিতে না পারার কারণে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর যারা ভোটার হয়েছেন তারা আজ পর্যন্ত ভোট দিতে পারেননি। নিজের পছন্দের ভিত্তিতে সরকার পরিবর্তনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই তাদের। এমন অবস্থায় আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশা ও আগ্রহ তৈরি করেছে, সেটি সাধারণ জরিপে আসবে না। কারণ, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অনেক সময় জরিপের বিশ্বাসযোগ্যতা নিম্নমানের। এটা মূলত একটি সামাজিক প্রত্যাশা তৈরি করেছে এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ ও জবাবদিহিমূলক শাসন তৈরির প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে নিরাপত্তা জোরদার, কালো টাকার প্রভাব রোধকল্পে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য বদ্ধপরিকর। তবে এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং আন্তরিক সহযোগিতা অপরিহার্য। নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন ও পরে এই তিনটি পর্যায়েই রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা লাগবে। সবার লক্ষ্য একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। এজন্য কালো টাকার প্রভাব, পেশিশক্তির ব্যবহার, ধর্মের অপব্যবহার এবং প্রশাসনিক কারসাজি বন্ধ করা জরুরি। ভোটগ্রহণ যাতে আরও নিরপেক্ষ হয়, সেজন্য একই উপজেলার শিক্ষকদের নিজ উপজেলায় দায়িত্ব না দিয়ে অন্য উপজেলায় দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এতে নির্বাচন আরও সুষ্ঠু ও ন্যায্য হবে বলে আমরা মনে করি। এই নির্বাচন কমিশনের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না করে নতুন ইতিহাস তৈরি করতে হবে তাদের। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, নির্বাচন কমিশনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা। একে পুনরুদ্ধার করার জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। আমরা চাই,রাজনৈতিক অনৈক্য এবং বিভেদ দূর হোক। সাধারণ মানুষের চাওয়া হচ্ছে সর্বজনগ্রাহ্য, শান্তিপূর্ণ, সুসংগঠিত নির্বাচন। আমরা বিশ্বাস করি, আসন্ন নির্বাচন হবে ঐতিহাসিক এবং দৃষ্টান্তমূলক- যেখানে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের নয়, সাধারণ জনগণের স্বপ্ন পূরণ হবে। জাতীয় নিরাপত্তা কেবল সামরিক সক্ষমতার বিষয় নয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজনীতির বিকাশ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ। জনগণের ক্ষমতায়ন ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে পারলে জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এর মানে এই নয় যে সবার মধ্যে ঐক্য নেই। জাতীয় স্বার্থে সবাই আমরা ঐক্যবদ্ধ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে দ্রুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া জরুরি। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে পারলেই জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। ১৫-২০ বছর ধরে যে যুদ্ধ চলছে, তা বাংলাদেশের মানুষের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। এ মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার পথ একটাই—জনগণের হাতে ব্যালট পেপার তুলে দেওয়া, যাতে তারা স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন। ঐক্যের একমাত্র পথ হচ্ছে গণতন্ত্র। এটি নিশ্চিত হলে ঐক্য নিশ্চিত হবে। এ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি ‘ন্যাশনাল আর্মি’ গঠন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এর উদাহারণ চীনে আছে, সুইজারল্যান্ডে আছে, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তারা দায়িত্বে থাকেন এবং তারা সেনাবাহিনীর ট্রেনিং করে। সবার মধ্যে দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার করে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে। ইতোমধ্যেই আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠা হয়েছে। তবে তা কার্যকর হবে চতুর্দশ জাতীয় নির্বাচনের সময়। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন যেনতেন একটি নির্বাচন যেন হয়ে না ওঠে সেদিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু জাতীয় সংহতি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে সবাইকে।
রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হলেও, ঢাকার রাজধানী গুলশান, সেটা সবাই স্বীকার করে।
কারণ গুলশানে এখন বড় বড় সব জায়ান্ট কর্পোরেট হাউজগুলোর হেড অফিস। যেমন, বহুজাতিক টেলিকম কোম্পানি রবি, এয়ারটেল, বাংলালিংক, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো সহ
সবগুলো ব্যাংকের স্থায়ী প্রধান কার্যালয় এখানে অবস্থিত। তাছাড়া রয়েছে অনেকগুলো বিলাস বহুল পাঁচ তারকা হোটেল ও ৫০ টির বেশি গেস্ট হাউস।
গুলশান - বারিধারা আবাসিক এলাকায় পৃথিবীর প্রায় ৬০ টির ও বেশি দেশের দূতাবাস রয়েছে।
গুলশানে বাংলাদেশের সবচেয়ে এলিট শ্রেণীর লোক বাস করে।
গুলশানে এখন ক্লাব ও বারের ব্যবসা খুবই জমজমাট। রাত হলেই জমে ওঠে ক্লাবগুলো।
যেখানে বিলাস বহুল গাড়িগুলো ক্লাবের আঙ্গিনা পেরিয়ে বাইরের রাস্তাগুলিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
এখন আসি "গুলশান সাউথ ক্লাব " কেন একটি সেরা ক্লাব হবে।
গুলশান সাউথ এরিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্পোরেট হাউস এবং ব্যাংক গুলোর স্থায়ী প্রধান কার্যালয় অবস্থিত।
বর্তমানে সিটি ব্যাংক, শাহজাহান ইসলামী ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক , এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক , যমুনা ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক,উরি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এন,এ, ইউসিবি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এইচ এস বি সি, ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক,পদ্মা ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক সহ প্রায় ২০টির ও বেশি ব্যাংকের স্থায়ী হেড অফিস গুলশান সাউথে অবস্থিত।
এছাড়া রবি ও বাংলালিংক এর প্রধান কার্যালয় গুলশান সাউথেই অবস্থিত। কর্পোরেট হাউজ গুলির মধ্যে ডিবিএল গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, রানার গ্রুপ, ইফাদ গ্রুপ, সুপারস্টার গ্রুপ, এনার্জিপ্যাক গ্রুপ,
ইস্ট কোস্ট গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এসিআই গ্রুপ, আকিজগ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ সহ কমপক্ষে পঞ্চাশটির বেশি কর্পোরেট হাউস গুলশান সাউথে অবস্থিত। তাছাড়াও ফ্যাশন হাউস গুলোর মধ্য রয়েছে, ভাসাবি
জারা, প্রেমস কালেকশন,
জুয়েলারি হাউজ গুলোর মধ্য ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, আপন জুয়েলার্স, নিউ জড়ুয়া গুলশান সাউথে অবস্থিত । গুলশান সাউথই রয়েছে সুইচ টেল ও হায়াত রিজেন্সি নামে বিলাস বহুল ২টি পাঁচ তারকা হোটেল। শপিং মল গুলির মধ্য রয়েছে, গুলশান সার্কেল - ১, এ নির্মিত হচ্ছে ৩৫ তলা ডি,এন,সি,সি শপিং মল, রয়েছে নাভানা সেন্টার শপিং মল ও পুলিশ প্লাজা কনকর্ড।
সাউথে রয়েছে, দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল ও ডাঃ ফজলে রাব্বি সাউথ পার্ক।
বাংলাদেশের সাংহাই ও নিউইয়র্ক হিসেবে খ্যাত গুলশান - তেজগাঁও লিং রোডে বর্তমানে ৪১ তলা
কমার্শিয়াল স্পেস নির্মাণ করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে ১০০ তলা পর্যন্ত সু উচ্চ ভবন নির্মাণ করা হবে।
গুলশান সাউথতেই রয়েছে, চোখ ধাঁধানো লাক্সারি সব গাড়ির শোরুম যেখানে সাজানো রয়েছে
BMW, RANS ROVER এবং AUDI মতো নিত্য নতুন সব মডেলের গাড়িগুলো, যা প্রমাণ করে দেয় যে, গুলশান সাউথ এরিয়া বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে
দামি এরিয়া হতে চলেছে।
সুতরাং "গুলশান সাউথ ক্লাব " নিঃসন্দেহে হতে চলছে বাংলাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ ক্লাব।
এবং আমরা বিশ্বাস করি ২০৩০ সালের দিকে "গুলশান সাউথ ক্লাবের মেম্বারগন একসময় গর্ব করে বলবেন, ভাগ্যিস সাউথ ক্লাবের মেম্বারশিপ নিয়েছিলাম,
না হলে তো এখন এক কোটি টাকা
লাগতো।
লেখক: মোহাম্মদ খুরশিদ আলম; ফাউন্ডার ও সাধারণ সম্পাদক; গুলশান সাউথ ক্লাব লিমিটেড
একবিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অবকাঠামো (ICT Infrastructure) এখন একটি দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। ডিজিটাল রূপান্তরে বাংলাদেশ যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে, তা বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে প্রশংসিত হলেও বিদেশী ক্লাউড পরিষেবা, ডেটা স্টোরেজ ও আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ের ওপর কৌশলগত নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে দেশের ডেটা সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। বিশেষ করে ক্লাউড অ্যাক্টের মতো আন্তর্জাতিক আইন বিদেশে সংরক্ষিত ডেটাকে বিদেশী বিচারিক কর্তৃপক্ষের আওতায় এনে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ তৈরি করতে পারে।
এ প্রেক্ষাপটে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ডেটা—যেমন ব্যাংকিং লেনদেন, নাগরিক তথ্য, সরকারি গোপন নথি, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য এবং স্বাস্থ্যসেবার সংবেদনশীল ডেটা—দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেই সুরক্ষিত রাখা এখন আর কেবল প্রযুক্তিগত চাহিদা নয়; এটি একটি জাতীয় নিরাপত্তা অগ্রাধিকার। এজন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী ও স্বনির্ভর ডেটা কৌশল বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ক্লাউড অবকাঠামো শক্তিশালী করতে নীতিগত ও কাঠামোগত বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ‘ক্লাউড কম্পিউটিং নীতিমালা ২০২৩’ প্রণয়ন এবং সরকারি ডেটা দেশীয় ক্লাউডে সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ ভবিষ্যৎ ডেটা সুরক্ষার ভিত্তি তৈরি করেছে। এছাড়া টিআইআর-৪ মানের ডেটা সেন্টার নির্মাণ এবং BDCCL–ওরাকল সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত ‘সার্বভৌম ক্লাউড’ (Sovereign Cloud) দেশের ডেটা যাতে দেশের বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিশেষত ফিনটেক, ব্যাংকিং, স্বাস্থ্যসেবা ও ই-গভর্ন্যান্সের মতো সংবেদনশীল খাতে এই অবকাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ডেটা গোপনীয়তা এবং নিয়ন্ত্রক সম্মতি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়।
ডেটা স্টোরেজ ও ক্লাউড সক্ষমতায় স্বনির্ভর হয়ে উঠলে অর্থনৈতিকভাবেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে লাভবান হবে। বিদেশী ক্লাউড পরিষেবায় বাংলাদেশ প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে, যদি স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় তাহলে দেশের অভ্যন্তরেই প্রযুক্তি শিল্প আরও সম্প্রসারিত হবে। পাশাপাশি স্থানীয় উদ্ভাবক, স্টার্টআপ এবং গবেষকদের জন্যও এর নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে।
বাংলাদেশের স্মার্ট নেশন গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) হবে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। AI ও মেশিন লার্নিং মডেল প্রশিক্ষণে উচ্চ-পারফরম্যান্স কম্পিউটিং (HPC) অপরিহার্য, যা বিদেশী ক্লাউডে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। সার্বভৌম ক্লাউডের মাধ্যমে দেশের গবেষক, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, কৃষি প্রযুক্তিবিদ ও উদ্ভাবকরা নিজের দেশের মাটিতেই নিরাপদ, দ্রুততর এবং সাশ্রয়ী HPC সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন। এর ফলে স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ ও জলবায়ু অভিযোজনের মতো খাতে স্থানীয় ডেটা ব্যবহার করে বিশেষায়িত AI ড্রিভেন সমাধান তৈরি করা আরও সহজ হবে।
একইভাবে আন্তর্জাতিক সংযোগে নির্ভরতা কমানোও প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বাংলাদেশ বর্তমানে সাবমেরিন কেবল এবং সীমিত স্থলপথের আন্তর্জাতিক গেটওয়ের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরতা দূর করতে তৃতীয় ও চতুর্থ সাবমেরিন কেবল সংযোগের কাজ চলছে, যা দেশের নেটওয়ার্ক রিডান্ডেন্সি ও স্থিতিস্থাপকতা বাড়াবে। পাশাপাশি ITC সংযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশের সাথে স্থলভিত্তিক ইন্টারনেট রুট আরও শক্তিশালী হচ্ছে, যা জাতীয় নেটওয়ার্ককে আরও নিরাপদ, দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য করবে।
বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত অগ্রযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবার সংযুক্তি। দূরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল, উপকূলীয় চরাঞ্চল, নদীবিধৌত বিচ্ছিন্ন গ্রাম—যেসব স্থানে প্রচলিত ব্রডব্যান্ড বা মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছায় না বা স্থিতিশীল থাকে না, সেখানে স্টারলিংক উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। স্যাটেলাইটভিত্তিক এই সংযোগ দেশের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিকে আরও গতিশীল করবে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি প্রযুক্তি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সরকারি সেবার মতো ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক ব্যবধান কমিয়ে নিয়ে আসবে। বিশেষ করে গ্রামীণ উদ্যোক্তা, টেলিমেডিসিন, অনলাইন লার্নিং ও রিমোট মনিটরিং সেবাগুলো স্টারলিংকের স্থিতিশীল ও দ্রুত গতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত হবে।
তাই আমি মনেকরি এই মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য খুবই স্পষ্ট—ডেটাকে দেশের ভেতরেই নিরাপদ রাখা, প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জন করা এবং ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা। তবে অবকাঠামো নির্মাণই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা, ক্লাউড আর্কিটেকচার ও ডেটা সায়েন্সে বিশেষজ্ঞ তৈরি করা এবং দেশীয় উদ্ভাবকদের আরও উৎসাহিত করা। এই ভিত্তি আরও মজবুত করতে পারলে ‘দেশের ডেটা দেশে থাকুক’—এই নীতির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ স্মার্ট জাতির ভিশন বাস্তবায়নে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে এবং একই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি খাতে স্থায়ী অগ্রগতি অর্জন করবে।
সাকিফ শামীম, অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, ল্যাবএইড গ্রুপ
বাংলার বার ভূঁইয়াদের প্রধান মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁ ছিলেন বাংলার বার ভূঁইয়াদর প্রধান। তিনি তার দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেছিলেন কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি। কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে ৬.৫ কিলোমিটার পূর্বে করিমগঞ্জ উপজেলাধীন কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নে নরসুন্দা নদীর তীরে ইতিহাসখ্যাত জঙ্গবাড়ির অবস্থান।
একাদশ শতাব্দীতে জোঙ্গাল বলাহুর নামক একজন রাজা স্বাধীন ভাটিরাজ্য কায়েম করে এর রাজধানী জঙ্গলবাড়িতে স্থাপন করেছিলেন বলে জানা যায়। ঈশা খাঁ জঙ্গলবাড়ি দুর্গ দখলের পূর্বে সেখানে কুচ রাজাগণ শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। ঈশা খাঁ সোনারগাঁওয়ের সিংহাসনে আরহনের পরে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে জঙ্গবাড়ি দুর্গ যুদ্ধ করে নিজ অধিকারে নেন। তখন তিনি এর সংস্কার সাধন এবং নিরাপত্তার জন্য তিনদিকে পরিখা খনন করেন। পরবর্তীতে ১৫৮৬ সালে জঙ্গবাড়িতে স্থাপন করেন ভাটিরাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী।
ঈশা খাঁ’র হাজারো স্মৃতি বিজড়িত আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এবং ইতিহাসখ্যাত জঙ্গলবাড়ির স্থাপনাসমূহ। এসব দেখতে ও বীরত্বগাথার কথা জানতে এখনো প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে বহু দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে। কিন্তু, তাদের ফিরে যেতে হয়ে অনেকটা হতাশ হয়ে। কারণ এখানকার ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নগুলো চরম অযত্ন ও অবহেলায় আজ প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অন্যদিকে ঈশা খাঁর বীরত্বগাথা এবং এখনো অবশিষ্ট থাকা নিদর্শনগুলো জানতে ও দেখতে আসা দর্শনার্থীগনের সাথে কথা বলার জন্যও এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ নেই।
বর্তমানে দরজা ও জানালা বিহীন ঈশা খাঁর দরবার হল, অন্দরমহল এবং দুর্গপ্রাচীরসহ কোনভাবে টিকে থাকা অন্যান্য স্থাপনগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে। প্রাচীন মসজিদ এবং পরিখা আজও পুরনো দিনের গৌরবময় দিনগুলোর কথা মানুষজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বেশ কিছুদিন পূর্বে যাওয়া হয়েছিল ঈশা খাঁর হাজারো স্মৃতি বিজড়িত জঙ্গলবাড়ি কেমন আছে তা দেখার জন্য। আমাদের কৈশোরে জঙ্গলবাড়িকে বহুবার দেখেছি। কিন্তু পূর্বেকার চেয়ে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন বা ভালো অবস্থা দেখতে পাইনি। যেমনটি দেখেছি তাতে বলা যায়, মোটেও ভালো নেই জঙ্গলবাড়ি। ঐতিহাসিক নিদর্শন দরবার হলের অভ্যন্তরে ‘ঈশা খাঁ স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার’ লেখা একটি সাইনবোর্ড দেখা গেছে। তার পাশেই রয়েছে পাথরে খোদাই করা স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাগণের নাম ও পদবী সম্বলিত একটি স্মৃতিফলক। কিন্তু জাদুঘর ও পাঠাগারে নেই কোন বই-পুস্তক, চেয়ার টেবিল এবং স্মৃতির কোন নিদর্শন। সর্বত্রই যেন আনাদর আর দারুন অবহেলার ছাপ সুস্পষ্ট। কিছু সময় অবস্থান করে মনে হলো প্রতিনিয়ত যেন জঙ্গলবাড়ি কাঁদছে। এখাকার অতি মূল্যবান স্মৃতিচিহ্নগুলো কাঁদছে। আগন্তুকদের করুণ সুরে কানে কানে বলছে; আমি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, আমি নিশ্চিহ্ন হতে চলেছি! তোমাদের শক্ত হাত দিয়ে আমাকে ধরো, আমাকে বাঁচাও। আমি তোমাদের মাঝে স্বগৌরবে বেঁচে থাকতে চাই।
জঙ্গলবাড়ি অবস্থানকালে সৌভাগ্যক্রমে সাক্ষাৎ হয় ঈশা খাঁর ১৫তম বংশধর দেওয়ান জামাল দাদ খাঁ’র সাথে। তিনি নিজ হাতে আমাদেরকে ঈশা খাঁ’র বংশ পরিচিতি দেখান। দেওয়ান ঈশা খাঁ এবং মোঘল সম্রাট আকবরের দরবারের ছবি তাদেরই সংগ্রহ থেকে নেয়া। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, ঈশা খাঁর স্মৃতি বহনকারী অন্দরমহলে চল্লিশটি কক্ষ ছিল। ধ্বংসের পরে এখন আছে মাত্র চারটি। এগুলো কোনভাবে সংস্কার করে এখন সেখানে তাদের পরিবার বসবাস করছেন। তিনি জানান যে, সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সম্প্রতি ঈশা খাঁ’র স্মৃতি রক্ষার্থে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। উক্ত প্রকল্পের আওতায় এখানে জাদুঘর, ডাক বাংলো, পুকুর ঘাট তৈরি এবং জরাজীর্ণ স্থাপনাসমূহের সংস্কার কাজ শিগগিরই শুরু হবে সেসময় তিনি জানিয়েছিলেন।
ঈশা খাঁর বীরত্বেগাথা ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অংশ জঙ্গলবাড়ি। এই ইতিহাস আমাদের আজকের ও আগামী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াও আমাদেরই দায়িত্ব। তাছাড়া দেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও ইতিহাসখ্যাত জঙ্গবাড়িতে ঈশা খাঁর স্মৃতি বহনকারী স্থাপনাগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় করে তোলা একান্ত প্রয়োজন। তাই ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী জঙ্গলবাড়ির প্রতিটি স্থাপনার প্রয়োজনীয় সংস্কার ও প্রয়োজনে নতুন স্থাপনা তৈরির কাজ সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা দ্রুত বাস্তবায়িত করবেন এটাই একান্ত চাওয়া।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো স্থিতিশীলতা ও স্থায়ী গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর দাঁড়াতে পারেনি। দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে অস্থিরতা যেন এক অনিবার্য শব্দ- যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন, দলীয় দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার পালাবদল, প্রশাসনিক অদক্ষতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি এবং অসহিষ্ণুতা, এসবই বারবার জাতিকে পিছিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যেই জনগণ প্রত্যাশা করেছে এমন একটি নেতৃত্ব, যা ক্ষমতার প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠে দেশকে একটি সুসংগঠিত ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করবে। সেই প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে তারেক রহমান নামটি আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে ক্রমশ সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক যাত্রা কেবল একটি পরিবারের উত্তরাধিকার নয়; এটি সময়, অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং জাতীয় সংকট উপলব্ধির মাধ্যমে গড়ে ওঠা নেতৃত্বের প্রকৃত রূপ। তিনি জন্মসূত্রে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেছেন নিজস্ব বিশ্লেষণ, মনন ও নেতৃত্বগুণের ওপর। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নীতি এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব তাকে রাজনৈতিকভাবে সম্যক ধারণা দিয়েছে ঠিকই; কিন্তু সময়ের বাস্তবতা তাকে বাধ্য করেছে নিজের রাজনৈতিক চিন্তার স্বাতন্ত্র্য তৈরি করতে। সেই স্বাতন্ত্র্য আজ তাকে দেশের প্রেক্ষাপটে এক ভিন্ন চরিত্রে দাঁড় করিয়েছে যেখানে রাজনীতি কেবল ভোটের সমীকরণ নয়, বরং রাষ্ট্রের কাঠামো পুনর্গঠনের দায়িত্ব।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বহুবার রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এমন এক পরিস্থিতিতে তারেক রহমান যে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন, তা হলো সংলাপ ও সহিষ্ণুতার রাজনীতি। তার দৃষ্টিতে রাষ্ট্র পরিচালনা কোনো একক দলের কর্তৃত্ব নয়; বরং এটি একটি সম্মিলিত দায়িত্ব যেখানে বিভিন্ন মত, স্বার্থ এবং সামাজিক স্তরের মানুষ একসাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন, কারণ দেশে রাজনৈতিক মতপার্থক্য মানেই বিরোধ, আর বিরোধ মানেই সংঘাত। তারেক রহমান এই দীর্ঘস্থায়ী ধারা থেকে বের হয়ে সমঝোতা, পারস্পরিক সম্মান এবং ধীরস্থির রাজনৈতিক আলাপচারিতাকে সামনে এনেছেন।
বিএনপি তার নেতৃত্বে কেবল দলীয় শক্তি হিসেবে নয়, বরং একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে। দলকে তিনি সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠন করেছেন, যেখানে তৃণমূলের কর্মীদের মতামত গুরুত্ব পেয়েছে, দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও গণতান্ত্রিক হয়েছে এবং রাজনৈতিক কৌশল আরও সুসংহত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বিএনপিকে দীর্ঘমেয়াদে একটি সুসংগঠিত ও স্বচ্ছ দলীয় কাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করবে, যা দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তারেক রহমানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি হলো যুবসমাজকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আনা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ, এবং তাদের রাজনৈতিক উদ্বেগ, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর চিন্তা এবং স্বপ্নগুলোকে জাতীয় উন্নয়নের সাথে যুক্ত না করলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সংকটে পড়বে এই সত্য তিনি ভালোভাবেই উপলব্ধি করেন। তাই তিনি এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে আগ্রহী, যেখানে তরুণরা কেবল নির্বাচনী প্রচারণার অংশ নয়, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণেও ভূমিকা রাখবে। এই অংশগ্রহণধর্মী রাজনীতি ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্বকে যে পরিপক্বতা দেবে, তা স্পষ্টভাবেই অনুমেয়।
দেশের রাজনৈতিক সংকটের গভীরে রয়েছে দুর্নীতি, যা একটি কাঠামোগত, দীর্ঘস্থায়ী ও প্রশাসনিকভাবে প্রোথিত সমস্যা। তারেক রহমান বারবার বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেবল আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব নয়; বরং রাজনৈতিক সততা, সুশাসন এবং স্বচ্ছতার প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা না হলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যায় এটি আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বিএনপির অভ্যন্তরেও তিনি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপিত হয়। এই উদ্যোগগুলো তাকে রাজনৈতিকভাবে দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ইতিহাস প্রমাণ করে, অস্থিরতা অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, বিদেশি বিনিয়োগ কমায়, শিক্ষা–স্বাস্থ্য–উন্নয়ন প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জনগণের আস্থা কমে যায়। তারেক রহমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার এই আন্তঃসম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, উন্নয়ন কোনো দলের একক অর্জন নয়; এটি একটি রাষ্ট্রীয় প্রকল্প যা সকল বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে পরিচালিত হতে হবে। সেই কারণে তিনি অর্থনীতি পুনর্গঠনের পরিকল্পনায় জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
তার অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে—
এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে যে তিনি কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্বই নন; বরং রাষ্ট্র পরিচালনার আধুনিক কাঠামো ও বৈশ্বিক অর্থনীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন।
তারেক রহমানের নেতৃত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সমাজে সংহতি ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক বিভাজন, সামাজিক বৈষম্য এবং মতভেদকে তিনি উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে দেখেন। তার মতে, শক্তিশালী সমাজব্যবস্থা তখনই গড়ে ওঠে যখন বিভিন্ন মত, চিন্তা এবং সামাজিক শ্রেণির মানুষ একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে নিজেদের নিরাপদ ও স্বীকৃত মনে করে। তাই তিনি সামাজিক সংলাপ, সাংস্কৃতিক সমন্বয় এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমান যে রাজনৈতিক পথ দেখাচ্ছেন, তা কেবল কোনো দলকে ক্ষমতায় নেওয়ার কৌশল নয়; বরং দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণের একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। তার রাজনৈতিক দর্শনে রয়েছে দৃঢ়তা, বাস্তবতা, সমঝোতা ও আধুনিক রাষ্ট্র-চিন্তার সমন্বয়। সে কারণে তার নেতৃত্বকে অনেকেই ‘ভবিষ্যতের রাজনীতি’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ এমন একটি সময় অতিক্রম করছে, যখন জনগণ চায় একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ। তারা চায় এমন এক নেতৃত্ব, যা ক্ষমতার অহমিকায় নয়, বরং জনগণের স্বার্থে কাজ করবে; সংঘাত নয়, বরং সংলাপকে এগিয়ে নেবে; দল নয়, বরং রাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দেবে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে সেই আশার আলো বহু মানুষের মনে জাগ্রত হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন পরিবর্তন সম্ভব, তবে তার জন্য প্রয়োজন জনগণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, আধুনিক রাষ্ট্র-চিন্তা এবং রাজনৈতিক সাহস।
তারেক রহমান আজ আর শুধু বিএনপির নেতা নন; তিনি এমন এক নেতৃত্বের প্রতীক, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ধারণা সঞ্চার করেছে—ন্যায়, গণতন্ত্র, সমতা ও উন্নয়নের ধারণা। এই ধারণার ভিত্তিতে আগামী দিনের বাংলাদেশ আরও সংহত, সুশাসিত এবং সমৃদ্ধ হতে পারে এই শঙ্কাহীন আস্থা অনেকেই রাখেন।
সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তারেক রহমান এমন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছেন যা সম্ভাবনায় ভরপুর। তিনি জাতিকে একটি আধুনিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন যেখানে ব্যক্তি বা দল নয়, বরং দেশ ও জনগণ প্রথম। রাজনৈতিক অস্থিরতার বহু দশক পর এ ধরনের নেতৃত্ব নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক বার্তা।
তারেক রহমানের নেতৃত্বের মধ্যে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে গড়ে তোলার মানসিকতা স্পষ্ট। তার রাজনৈতিক দর্শন বলে গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন নয়, বরং মানুষের অধিকার, ন্যায়বিচার, উন্নয়ন ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি। এ কারণেই তিনি আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্ভাবনার অম্লান প্রতীক।
লেখক: ডা. এ কে এম মাজহারুল ইসলাম খান কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।