মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪

পবিত্র ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য, শিক্ষা ও গুরুত্ব

 গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
প্রকাশিত
 গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
প্রকাশিত : ৯ এপ্রিল, ২০২৪ ১৭:০০

মুসলমানদের জীবনে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। এই দিনটির তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। প্রিয় পাঠক আমি অধম চেষ্টা করব ঈদুল ফিতরের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করার এবং একজন রোজাদার ব্যক্তির রোজা, ইবাদত-বন্দেগিগুলো পরিশুদ্ধভাবে আল্লাহতায়ালার দরবারে কবুল হওয়ার জন্য সঠিকভাবে তুলে ধরতে- ইনশাআল্লাহ।

ঈদুল ফিতর: ঈদুল ফিতর শব্দটি ‘আওদ’ শব্দমূল থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হলো ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, বারবার আসা। আর ফিতর শব্দের অর্থ হলো ফাটল, ভেঙে ফেলা, বিদীর্ণ করা। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়ালের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে রোজা ভেঙে ফেলা হয় বলে এ দিনটিকে ঈদুল ফিতর বলা হয়।

ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য ও করণীয়:

মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন: ‘আর যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্য তোমরা আল্লাহর মমত্ব-বড়ত্ব প্রকাশ কর এবং তার কৃতজ্ঞ হও।’ (বাকারা-১৮৫)।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ঈদুল ফিতরের দিন যখন আসে তখন আল্লাহতায়ালা রোজাদারদের পক্ষে গর্ব করে ফেরেশতাদেরকে বলেন, হে আমার ফেরেশতাগণ তোমরাই বলো রোজাদারদের রোজার বিনিময়ে আজকের এই দিন কি প্রতিদান দেওয়া যেতে পারে? সেই সমস্ত রোজাদার, যারা তাদের দায়িত্ব পুরোপুরি আদায় করেছে, তখন ফেরেশতারা আল্লাহকে বলেন, হে দয়াময় আল্লাহ উপযুক্ত উত্তম প্রতিদান তাদের দান করুন । কারণ তারা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা করেছেন, প্রাপ্য পারিশ্রমিক তাদেরকে দান করুন।

তখন আল্লাহতায়ালা রোজাদারদের বলতে থাকেন, ‘হে আমার বান্দা তোমরা যারা যথাযথভাবে রোজা পালন করেছ, তারাবিহর নামাজ পড়েছ, তোমরা তাড়াতাড়ি ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য যাও এবং তোমরা তোমাদের প্রতিদান গ্রহণ করো । ঈদের নামাজের শেষে আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, হে আমার প্রিয় বান্দারা আমি আজকের এ দিনে তোমাদের সব পাপ পুণ্যের দ্বারা পরিবর্তন করে দিলাম । অতএব তোমরা নিষ্পাপ হয়ে বাড়িতে ফিরে যাও’। (বায়হাকি ও মিশকাত)

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন: “আল্লাহ এই দুটি দিনের পরিবর্তে অন্য দুটি দিন তোমাদের উৎসব করার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার একটি হল ‘ঈদুল ফিতর’, অন্যটি ‘ঈদুল আজহা’। তোমরা পবিত্রতার সঙ্গে এ দুটি উৎসব পালন করবে।’’ (আবু দাউদ ও নাসায়ি)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: এদিনটিতে তোমরা রোজা রেখো না। এ দিন তোমাদের জন্য আনন্দ-উৎসবের দিন। খাওয়া, পান করা আর পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে আনন্দ-উৎসব করার দিন। আল্লাহকে স্মরণ করার দিন (মুসনাদ আহমাদ, ইবনু হিববান)।

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ঈদের আনন্দ শুধু তাদের জন্য যারা রমজানের রোজা তারাবিহর নামাজসহ আল্লাহতায়ালার যাবতীয় বিধিবিধান গুরুত্ব সহকারে আদায় করেছে । আর যারা রমজানের রোজা ও তারাবিহ আদায় করেনি তাদের জন্য ঈদের আনন্দ নেই, বরং তাদের জন্য ঈদ তথা আনন্দ অগ্নিশিখা সমতুল্য।’ (বুখারি)।

ঈদের রাতের ফজিলত: হজরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে আল্লাহর নিকট সাওয়াব প্রাপ্তির নিয়তে ইবাদত করবে তার হৃদয় সে দিনও জীবিত থাকবে, যেদিন সব হৃদয়ের মৃত্যু ঘটবে। (ইবন মাজাহ, হাদিস নম্বর ১৭৮২, আল মুজামুল আওসাত, হাদিস নম্বর-১৫৯)।

মহানবী সা. আরও ইরশাদ করেন ‘যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে পুণ্যের প্রত্যাশায় ইবাদত-বন্দেগি করে কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার, অর্থাৎ কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোকদের অন্তর মরে যাবে, কিন্তু কেবল সেই ব্যক্তির অন্তর জীবিত থাকবে, সে দিনও মরবে না’। (আততারগিব)।

রাসুল সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পুণ্যময় ৫টি রাতে ইবাদত-বন্দেগি করে সেই ব্যক্তির জন্য সু-সংবাদ রয়েছে, আর সেই সুসংবাদটি হচ্ছে ‘জান্নাত’ এবং পুণ্যময় ৫টি রাত হলো ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবেবরাত, জিলহজের রাত, আরাফাতের রাত । (বায়হাকি) ।

ঈদের নামাজের সময়সীমা: সূর্য আনুমানিক তিন গজ পরিমাণ ওপরে ওঠার পর অর্থাৎ সূর্যোদয়ের ২৩/২৪ মিনিট পর থেকে দ্বি-প্রহরের পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাজের ওয়াক্ত। সূর্য তিন গজ পরিমাণ ওপরে ওঠা পর্যন্ত সময়টুকুকে তার উদয়কাল বলে গণ্য করা হয়। এ সময়ে কোনো নামাজ পড়া জায়েজ নেই। ঈদুল ফিতরের নামাজ অপেক্ষাকৃত বিলম্বে এবং ঈদুল আজহার নামাজ আগে আদায় করা উত্তম।

বৃষ্টির কারণে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়া জায়েজ কি না। হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার ঈদের দিনে বৃষ্টি হলো, তখন রাসুল (স.) তাদেরকে নিয়ে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়লেন। (আবু দাউদ-১১৬২)। এতে বোঝা যায়, বৃষ্টি বা অন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণ থাকলে ঈদের নামাজ মসজিদে পড়া জায়েজ।

নামাজের জন্য ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হওয়ার আগে ৩টি, ৫টি এরকম বেজোড় সংখ্যক খেজুর খাওয়া সুন্নত। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, প্রিয়নবী (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন সকালে বেজোড়সংখ্যক খেজুর খেতেন। (আদ-দুরূসুর রামাদানিয়াহ, পৃ. ১৮৫।)

আসুন এক নজরে জেনে নেই ঈদের সুন্নতগুলো:

১। অন্য দিনের তুলনায় আগে আগে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া।

২। গোসল করা।

৩। শরিয়তসম্মত সাজসজ্জা গ্রহণ করা।

৪। সুগন্ধি ব্যবহার করা।

৫। ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে মিষ্টি জাতীয় আহার (যেমন খেজুর) গ্রহণ করা।

৬। সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া।

৭। ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার আগে সাদকাতুল ফিতরা আদায় করা।

৮। সম্ভব হলে এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ঈদগাহ থেকে ফিরে আসা।

৯। পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া।

১০। ঈদগাহে যাওয়ার সময় নিম্নোক্ত তাকবির পাঠ করা:

(আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।)

ঈদের দিনে শুভেচ্ছা বিনিময়: হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ‘যুবাইর ইবনে নফির থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত, রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময় সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, (তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম) অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। (ফাতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারি ৬/২৩৯, আসসুনানুল কুবরা লিলবাইহাকী, হাদীস-৬৫২১)।

সাদকায়ে ফিতর আদায়: রমজান মাসের রোজার ভুলত্রুটি দূর করার জন্য ঈদের দিন অভাবী বা দুস্থদের কাছে অর্থ প্রদান করা হয়, যেটিকে ফিতরা বলা হয়ে থাকে। এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী- ‘তুহরাতুল্লিস সায়িম’ অর্থাৎ এক মাস সিয়াম সাধনায় মুমিনের অনাকাঙ্ক্ষিত ত্রুটি-বিচ্যুতির কাফফারা হলো সাদকায়ে ফিতর।

ঈদের নামাজের পূর্বেই ফিতরা আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে ভুলক্রমে নামাজ আদায় হয়ে গেলেও ফিতরা আদায় করার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। সাদাকাতুল ফিতরবিষয়ক হাদিসগুলোতে পাঁচ ধরনের খাদ্যদ্রব্যের উল্লেখ রয়েছে : গম, যব, খেজুর, কিশমিশ, পনির। সাদকায়ে ফিতরের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে পরিশুদ্ধ হয় ৷’ (সুরা আলা : আয়াত ১৪)।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, গোলাম, স্বাধীন, পুরুষ, নারী, ছোট, বড় সব মুসলিমের ওপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ‘সা’ খেজুর, অথবা অর্ধ ‘সা’ গম জাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এবং (ঈদের) নামাজের আগে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন’ (বুখারি ও মুসলিম)। এবার রাষ্ট্রের পক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মাথাপিছু ফিতরা ধার্য করেছে সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯৭০ টাকা।

ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও শিক্ষা অপরিসীম। প্রত্যেক মুসলমানের জীবনে ধর্মীয় করণীয়গুলো পালনের মাধ্যমে নিজেকে একজন প্রকৃত মুমিন মুসলমান হিসেবে তৈরি করা জরুরি। পরিশেষে কামনা প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তির রোজা, সাহরি, ইফতার, তারাবি, ইবাদত- বন্দেগি, দান-সাদকা মহান আল্লাহতায়ালা কবুল করুন। আমিন। সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক।।

লেখক : ধর্ম ও সমাজ সচেতন লেখক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক ও চেয়ারম্যান, গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা।


বই আর খবরের কাগজের বিকল্প কিছু নেই

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
লিয়াকত হোসেন খোকন 

আর আসে না কিশোরবেলা- আগে আমরা ছোটবেলায় ভাইবোনেরা কাড়াকাড়ি করে, হুমড়ি খেয়ে পড়তাম রূপকথার বই। আরও ছিল বাটুল দি গ্রেট, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা ভোঁদা। জনপ্রিয় কমিকসের জনপ্রিয়তার কথা স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে আজও। একটু বড় হয়ে পড়েছি ঠাকুরমার ঝুলি, পাগলা দাশু, আবোল -তাবোল। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে চিত্রালী আর চিত্রাকাশের হয়েছিলাম প্রেমিক।

ছোটবেলায় ছিল পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি- সেখান থেকে বা অন্য বন্ধুকে ধরে গ্রন্থাগারে গিয়ে কিংবা ধার করে বই পড়ার অভ্যাস। অভ্যাস বলব না, সে যেন এক নেশা। দেবদাস, মেজদিদি, কপালকুণ্ডলা নিয়েছিল মন কেড়ে। হাতে হাতে ঘুরতে ঘুরতে জীর্ণ হয়ে যেত বই। এই ধারা অব্যাহত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় হোস্টেলেও। এখন এই রেওয়াজ কমে গেছে। আজকের বাচ্চারা পাঠ্যবইয়ের চাপেই বোধহয় হিমশিম।

বই পড়া একটি সংস্কৃতি- ছোটদের ভেতর তা চালিয়ে দেওয়া উচিত। বইমেলায় বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া উচিত অভিভাবকদের। আর দরকার বই কিনে উপহার দেওয়ার রেওয়াজটা বাঁচিয়ে রাখা। কেন জানি মনে হয়, দৈনিক কাগজগুলোতে সপ্তাহে অন্তত এক দিন ছোটদের পাতা থাকা উচিত। একবার সৈয়দ মুজতবা আলী কৌতুকের মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন, আমরা বই পড়াটাকে কীভাবে নেহাত সময় ও অর্থের অপচয় হিসেবে দেখি।

বিমল মিত্রের একটি গল্পে পড়েছিলাম, ভাইঝির বিয়ে ঠিক করতে এক পণ্ডিতমশাই গিয়েছিলেন জমিদার বাড়িতে। তার সব পছন্দ, তবু বিয়ে দিতে রাজি হলেন না। কারণ একটাই- এত বড় ঘর, এত বৈভব; কিন্তু কোথাও বইয়ের চিহ্ন নেই। ব্যক্তি, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে শিক্ষালাভ ও জ্ঞানার্জনের উৎস হলো বই। স্বাধীন চিন্তা, কল্পনাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেওয়া সাঁকো। বই অতীত থেকে ভবিষ্যৎ, নিকট থেকে দূরে, প্রান্ত থেকে অন্তে, যুগ থেকে যুগান্তরে আলো ছড়ায়।’ কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখকষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।’ কিন্তু ঘটনা হলো- বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস দিন দিন কমে যাচ্ছে।

অ্যাকাডেমিক লেখাপড়া শেষ হলে অনেকের জীবন থেকে বই চিরতরে হারিয়ে যায়। বর্তমানে ডিজিটাল যুগে সারাক্ষণ হাতে মোবাইল ভুলিয়ে দিয়েছে বইয়ের টান। কিন্তু পুরোনো বই আলমারি থেকে নামিয়ে তার পাতাগুলো স্পর্শ করা সুখ, আঘ্রাণ নেওয়ার তৃপ্তি সত্যিই কি ভোলা যায়? ডিজিটাল ডিভাইসে বই পড়ার বিকল্প হতে পারে না।

বইয়ের পাশাপাশি ছোট কাগজ বড় আশা- অন্যতম প্রধান লিটল ম্যাগাজিন মেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয় একাধিক পত্রপত্রিকা ও বই। বইমেলায় দেখতে পাওয়া যায় নামি-অনামি পত্রপত্রিকার বিপুল সমাবেশ। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের সঙ্গে একগুচ্ছ নতুনদেরও কখনো কখনো স্থান পাওয়ার সৌভাগ্য ঘটে।

বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি- এই কথা হজম করেই বলা যায়- বাংলা ভাষায় চার ও পাঁচের দশকে ছোট ছোট বই প্রকাশিত হতো। জ্ঞান-বিজ্ঞান চেতনা ও জীবনী গ্রন্থমালা। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন প্রখ্যাত দার্শনিক ছিলেন তার সম্পাদক। সেখানে ‘সে-যুগে মায়েরা বড়ো’, ‘ক্ষুদে শয়তানের রাজত্ব’, ‘শোনো বলি মনের কথা’, ‘পৃথিবীর ইতিহাস’ এমন সব বই বেরিয়েছিল; কিন্তু তা আজ কোথায়? বাঙালি বেমালুম ভুলে গেছে, বাংলা সাহিত্যে সাময়িক পত্রের ভূমিকার সূচনা যে হয়েছিল ১৯১৮ সাল থেকে। তারপর বঙ্গদর্শন হয়ে আজ পর্যন্ত অসংখ্য সাময়িক পত্র, প্রবন্ধ, সাহিত্য ও বাংলা উপন্যাস, গল্প, কবিতার এক বিশাল ক্ষেত্র নির্মাণ হয়েছিল। আর লিটল ম্যাগাজিনকে তো বলা হয় বাংলা সাহিত্যের বীজতলা।

আবার এ-ও দেখা গেছে, এক সময়ের জনপ্রিয় লেখক-লেখিকারা মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যান; কিন্তু কেন? যেমন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় প্রায় ২ দশক ধরে জনপ্রিয়তার চূড়ায় ছিলেন। আসল নাম তারাদাস মুখোপাধ্যায়। এই ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের লেখা- বহ্নিমান, হে মোর দুর্ভাগা দেশ, আকাশ বনানী জাগে, পথের ধুলো, আশার ছলনে ভুলি ইত্যাদি বই বেস্ট সেলার হয়েছিল এক সময়ে। ‘গুণধর ছেলে’ ও তার লেখা বিখ্যাত কিশোর উপন্যাস; কিন্তু আজ সেসব বইয়ের নাম জানা তো দূরের কথা, লেখকের নামই কেউ জানেন না।

নদীর প্রবল স্রোতেও কে যে থেকে যাবেন, তা কেউ জানেন না। তবে বছর ঘুরে ঘুরে একুশে ফেব্রুয়ারি আসবে- বইমেলা হবে। অনেকে বলেন, সবাই একটি করে বই কিনুন।

কিন্তু একটি কেন?

যা যা ভালো লাগবে, যে যে বই ভালো লাগবে তাই কিনুন। বইয়ের বিকল্প কিছুই হতে পারে না। বর্তমান ডিজিট্যাল বাংলাদেশের যুগে কিশোর ও কিশোরীদের হাতে হাতেও সহজভাবেই ধরা দিচ্ছে মোবাইল ফোন। কখনো তারা মোবাইলে গেম খেলায় মত্ত হয়ে থাকছে তো কখনো বা আবার ভালো-মন্দ ভিডিও দেখতেও তারা ব্যস্ত থাকছে। বাবা-মারাও যে যার নিজের নিজের ক্যারিয়ার গোছাতে ব্যস্ত, আর তাই ছেলেমেয়েদের বায়না মেটাতে গিয়ে হাতে দিয়ে দেয় ফোন। আর এই ফোনের নেশাতেই মত্ত হয়ে কিশোর ও কিশোরীরা আজ কোথাও বই পড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কথায় বলে, ‘বইয়ের থেকে ভালো বন্ধু আর কিছু নেই।’ আর তাই অভিভাবকদের এই বিষয়ে একটু সচেতন থাকা উচিত। মোবাইলের বদলে হাতে দেওয়া হোক বই। যাতে জ্ঞানের আলো পৌঁছাক কিশোর ও কিশোরদের মধ্যে। মোবাইল নয়, বই ও দৈনিক পত্রিকা হয়ে উঠুক কিশোর-কিশোরী থেকে সববয়সি মানুষের প্রকৃত বন্ধু।


বাজেটে কর্মসংস্থান ও চিকিৎসার বরাদ্দ সুনিশ্চিত করতে হবে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রেজাউল করিম খোকন

আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেট উপস্থাপন করা হবে। আগামী অর্থ বছরের বাজেট ছোটই রাখা হচ্ছে। এর আকার হতে পারে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থ বছরের মূল বাজেট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা থেকে ৩৫ হাজার ১১৫ কোটি টাকা অর্থাৎ ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। অন্য বছরগুলোতে এ বৃদ্ধি হয় ১০ থেকে ১৩ শতাংশের মতো। আগামী বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ছাড়া) ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হতে পারে। এ ছাড়া রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, চলতি অর্থ বছরে যা ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের আদায় লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থ বছরের মূল বাজেটে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি থাকলেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। আইএমএফের শর্ত অনুয়ায়ী আগামী অর্থ বছরে সরকারের ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার কর রাজস্ব আদায় করার কথা। চলতি অর্থ বছরের মতো আগামী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেটকেও ব্যয় সংকোচনমুখী করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী বাজেটেও বিলাসপণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে আগামী বাজেটের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। প্রধানমন্ত্রী দেখতে চেয়েছিলেন, বর্তমান মেয়াদের প্রথম বাজেটে নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিফলন থাকছে কি না। অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেটের যে কাঠামো দাঁড় করিয়েছে, তাতে সেই প্রতিফলন থাকছে বলে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জন্য ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেটে অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং গ্রামীণ অবকাঠামো খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সতর্কতার সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। তবে গোটা বিশ্বেই এখন সংকোচনমূলক ব্যবস্থা চলছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ইত্যাদি উন্নত দেশ নীতিসুদহার বাড়িয়েছে। মার্কিন ডলার আগের তুলনায় দামি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রাক্কলন করেছিল, গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি কমে যাবে। তবে কমেনি। এমন পরিস্থিতিও তৈরি করা যাবে না, যাতে আমদানি বেশি কমে যায়। আমদানি ব্যবস্থাপনা দক্ষতার সঙ্গে করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসের (ইএফডি) বহুল ব্যবহার আশা করছেন। বেশি মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আদায়ের ব্যাপারে তার পরামর্শ হচ্ছেÑএ কাজে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগকে কাজে লাগানো। তিনি চাইছেন, আইসিটি বিভাগ এমন অ্যাপ তৈরির উদ্যোগ নেবে, যাতে মূসকের চালান (ইনভয়েস) নিতে মানুষ আগ্রহী হন। নিজের নির্বাচনী এলাকার উদাহরণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার এলাকায় আয়কর দেওয়ার মতো সক্ষম ব্যক্তি অনেক আছেন; কিন্তু তারা করজালের বাইরে। আয়কর যারা দিচ্ছেন বা যারা করজালের মধ্যে আছেন, শুধু তাদের ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে করের আওতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে। আশা করা যায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাবে। আর বিনিময় হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে ডলারের দামও স্বাভাবিক হয়ে আসবে। বাজেট প্রণয়নে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তার অংশ হিসেবে কিছু ক্ষেত্রে করছাড় এবং অব্যাহতি কমানো হবে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার সঙ্গে আমরাও একমত। তবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি বাজেটে থাকছে কি না, তা-ও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ যে হারে দক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে প্রবাসী আয় অর্জন করছে, বাংলাদেশকেও সে ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে এবং বাজেটে তার প্রতিফলন থাকতে হবে। ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বৃদ্ধির মাধ্যমে টাকার বড় অবমূল্যায়ন হয়েছে। বাজেটের আকারের ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। ঢাকায় এসে আইএমএফের দল আগামী বাজেট ছোট রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। আগামী অর্থ বছরের বাজেট ছোটই রাখা হচ্ছে। চলতি অর্থ বছরের মূল বাজেটে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি থাকলেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। আইএমএফের শর্ত অনুয়ায়ী আগামী অর্থ বছরে সরকারের ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার কর রাজস্ব আদায় করার কথা। সে হিসাবে সরকারের লক্ষ্য ও আইএমএফের লক্ষ্যর কাছাকাছিই থাকছে। চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় আইএমএফের পরামর্শ ছিল করছাড় কমানো। ২০২৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে তিন ধাপে সব ধরনের করছাড় বাতিলের শর্ত রয়েছে আইএমএফের। প্রথম দফায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতি-সুবিধা বাতিল হতে পারে। দেশীয় শিল্পের বিকাশে বিভিন্ন শিল্প খাতে যেসব মূসক অব্যাহতি রয়েছে, সেগুলোও প্রত্যাহারের দিকনির্দেশনা থাকবে আগামী বাজেটে। তবে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বর্তমানে যে সাড়ে তিন লাখ টাকা রয়েছে, এবার তা না-ও বাড়তে পারে। নারী করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ টাকা, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের করদাতাদের ৪ লাখ ৭৫ হাজার এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা করদাতাদের করমুক্ত সীমা যে ৫ লাখ টাকা আছে, তাতেও কোনো পরিবর্তন আনা হবে না। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং ডলার-সংকট নিরসন করা- অর্থনীতির এই তিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ব্যয় সংকোচনের বাজেট করা ছাড়া উপায় নেই। বাজেট বড় করলে তা হয়ে যাবে বিষাক্ত জিনিস। করোনা মহামারির কারণে দেশের শিক্ষা খাতে বড় ক্ষতি হয়েছে। আবার ওই মহামারির সময়ই স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছিল; কিন্তু এরপরও বাজেটে এই দুটি খাত প্রত্যাশিত মনোযোগ পাচ্ছে না। টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়লেও বাজেট এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় এই দুই খাতে বরাদ্দ খুব একটা বাড়ছে না। কোভিডের আগের ধারাবাহিকতায় বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত অনেকটা অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। আগামী বাজেটেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার ইঙ্গিত নেই।

পৃথিবীর যে ১০টি দেশ অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, বাংলাদেশ তার একটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে একজন বাংলাদেশির বছরে ৮৮ ডলার খরচ করা প্রয়োজন; কিন্তু বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে মাথাপিছু খরচ হয় ৫৮ ডলার, যার বড় অংশই নাগরিকরা নিজেরা সংস্থান করেন। আগামী অর্থ বছরের শুধু শিক্ষা খাতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকবে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। এসব বরাদ্দ সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে। গত পাঁচ বছরের বাজেট বরাদ্দ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ সময় শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাজেটের ১২ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ৫ শতাংশের আশপাশে ছিল। অন্যদিকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতের শিক্ষা খাতের বরাদ্দ ২ শতাংশের মতো, আর স্বাস্থ্য খাতে তা ১ শতাংশের মতো। বাজেটের শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত একসঙ্গে দেখানো হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের শুধু শিক্ষা খাতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকবে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। এসব বরাদ্দ সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে। উন্নয়ন খাতের বরাদ্দে অবশ্য সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের চেয়ে রাস্তাঘাট, জ্বালানি খাতকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। আগামী অর্থ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) শীর্ষ তিনটি খাতের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত নেই। বরাদ্দ পাওয়ার বিবেচনায় শীর্ষ তিন খাত হলো স্থানীয় সরকার বিভাগ; সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং বিদ্যুৎ বিভাগ। এই তিন খাতই এডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ বরাদ্দ পাচ্ছে। যেখানে বিনিয়োগ করলে লাভের ভাগ বেশি হবে, সেখানেই বিনিয়োগ করা দরকার। তাই বাজেটে প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত। শিক্ষায় দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে না পারায় বিদেশ থেকে জনবল আনতে হয়। শিক্ষিতদের মধ্যে বেকার বেশি। দেশে অনেক এমবিএ ডিগ্রিধারী আছেন; কিন্তু ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে লোক আনতে হচ্ছে। তারা বছরে ৬০০ কোটি ডলার নিয়ে যাচ্ছেন, যা দেশের প্রবাসী আয়ের চার ভাগের এক ভাগের সমান। গত পাঁচ বছরের বাজেট বরাদ্দ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ টাকার অঙ্কে বাড়লেও বাজেটের অনুপাতে তা ১২ শতাংশের আশপাশে আছে। এর মানে হলো, সরকার এই খাতের বিষয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। শিক্ষা খাতের দুর্বলতা আমরা জানি; কিন্তু বাজেট ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার অজুহাতে শিক্ষা খাতকে পঙ্গু করে রাখতে পারি না। এ জন্য জিডিপির অনুপাতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এ ছাড়া সামাজিক দায়বদ্ধতাও দরকার। আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দেও বড় কোনো পরিবর্তন আসছে না। করোনার পর স্বাস্থ্য বাজেট বাড়ানোর বিষয়ে নানা আলোচনা হলেও বাস্তব অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাজেটের ৫ শতাংশ ও জিডিপির ১ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে স্বাস্থ্য বাজেটের আকার ছিল ২৯ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা, যা ছিল ওই বাজেটের ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। পরের কয়েক বছর কোভিডের ডামাডোল থাকলেও অগ্রাধিকারে তেমন পরিবর্তন আসেনি। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাজেটের ৫ শতাংশের আশপাশেই ছিল। সর্বশেষ চলতি অর্থ বছরে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী অর্থ বছরে তা বেড়ে ৪২ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রম সক্রিয় করার জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য জনবল বাড়াতে বিনিয়োগ করতে হবে। দিতে হবে শূন্য পদে লোকবল; কিন্তু সরকার অবকাঠামো নির্মাণে বেশি আগ্রহী। কারণ, এখানে স্বার্থ আছে। সেবায় বিনিয়োগ নেই। উদ্বোধন করা হয় ভবন, সেবা উদ্বোধন করা হয় না।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এগুলো রাজনৈতিক সংকটও। এ জন্য বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন জরুরি। আসন্ন বাজেটে খাদ্য, কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তার জন্য বরাদ্দ সুনিশ্চিত করতে হবে। ওই বরাদ্দ যাতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ছাড়াই খরচ হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার বাজেটের আগে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও বড়লোকদের সঙ্গে সংলাপ করে। যারা দেশের টাকা পাচার করছে, ব্যাংকের টাকা নিয়ে শোধ করে না, এসব সংলাপ তাদের সঙ্গেই হয়। অথচ দেশের অর্থনীতির চাকা যারা সচল রেখেছে, সেই শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সংলাপ হয় না। এবারের বাজেটে প্রধান দুটি সংকট হলো অস্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। ঋণখেলাপি ও টাকা পাচারকারীদের ক্ষমতা বর্তমানে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। পাচারের টাকা ফেরত আনার ক্ষেত্রে কোনো আইনগত বাধা নেই। সে জন্য বাজেটে এ ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। শীর্ষ খেলাপিদের নাম প্রকাশ ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। বাজেটের লক্ষ্য স্থির থাকছে না। তাতে আসল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এর মূল কারণ রাজনীতি ঠিক নেই। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও ডলার-সংকটের মতো সমস্যা এখন প্রকট। দেশে যথাযথভাবে ডলার আসে না। আবার দেশ থেকে ডলার চলে যায়। যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়া সম্পদের লুটপাট ঠেকানো যাবে না। বাজেটে গরিবের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীনতার পর যত ঋণ নেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে এই সরকার। সরকারের সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তারাই বলছে, জ্বালানি খাতে ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এর জন্য দায়ী কে? সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর নামে কয়েকটি খাতে বরাদ্দ দিয়ে দেশের মানুষের সংকট সমাধান করা যাবে না। সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূল কথা হবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব বিষয়ে মানুষের দায়িত্ব নেওয়া। করের টাকা লুটপাট নয়, জনস্বার্থে ব্যবহার করতে হবে। প্রকৃত কৃষক জমি চাষ করে না, বর্গাচাষিরাই কৃষি কাজ করেন। অথচ তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সরকারি কোনো প্রণোদনা পান না। ফসলের ন্যায্য দামও পান না। দিন দিন উৎপাদন খরচ বাড়ছে, ঠিকমতো বিদ্যুৎ নেই। সারের দাম বাড়তি, ভালো মানের কীটনাশক ও কৃষি বিভাগ থেকে ঠিকমতো পরামর্শ পাওয়া যায় না। বাজেটে এসব নিশ্চিত করতে হবে। পোশাকশ্রমিকদের নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। তারা নাকি দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছেন; কিন্তু তারা যে বেতন পান, তা দিয়ে ঠিকমতো ভালো খাবার খেতে পারেন না। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিচ্ছে অনেকে। অথচ গ্রামাঞ্চলে ঋণ করার পর অনেক মানুষকে রিকশা চালিয়ে কিস্তি পরিশোধের জন্য ঢাকায় আসতে হচ্ছে। তাদের এ দেশের মানুষ মনে করলে বাজেটে দরিদ্রদের জন্য আলাদা বরাদ্দ দিতে হবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট

বিষয়:

সঠিকতম ভাবনার বাস্তবায়নেই শিক্ষার সমৃদ্ধি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. মো. নাছিম আখতার

একজন ভদ্র মহিলা একজন পরামর্শকের কাছে গেলেন বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করতে। পরামর্শক বিচ্ছেদের কারণ জিজ্ঞাসা করলে ওই মহিলা বলেন, ‘আমি সারাদিন বাসার কাজ, রান্না, খাওয়া শেষ করে যখনই হারমোনিয়াম নিয়ে বসি তখনই আমার স্বামী এসে আমাকে মারধর করে এবং গরম গরম খাবার চায়। স্যার, আপনিই বলেন এরকম স্বামীর সঙ্গে কীভাবে সংসার করা যায়’? পরামর্শক উত্তর দিলেন, ‘আপনি ঠিক বলেছেন’। তখন মহিলাটির স্বামী পরামর্শককে বললেন, ‘সারাদিন কষ্ট করে কাজ শেষ করে ক্ষুধার্ত হয়ে বাসায় ফেরার পর সে আমাকে খাবার না দিয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। তাহলে তার সঙ্গে কীভাবে আমি সংসার করতে পারি’? পরামর্শক তাকেও উত্তর দিলেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন’। তখন সামনে বসা এক ব্যক্তি পরামর্শককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্যার আপনি দুজনকে একই উত্তর দিলেন। কীভাবে একই সময়ে দুজনই সঠিক হতে পারে? একজন তো ভুল হবেই’। তখন পরামর্শক উত্তর দিলেন, ‘ আপনিও সঠিক বলেছেন’। এতগুলো সঠিকতার সমারোহে সঠিকতম ভাবনাটি অনুধাবন করা ভীষণ কষ্টসাধ্য নয় কি?

স্কুল, কলেজের পরীক্ষায় পাস নম্বর একশতে তেত্রিশ। কিন্তু কেন এই তেত্রিশ নম্বরকে পাস নম্বর ধরা হয় তা অনেকেই হয়তো অবগত নন। এর মূল কারণ আমাদের মধ্যে এখনো ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রভাব থেকে যাওয়া। ১৮৫৮ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা চালু হয়; কিন্তু পাস নম্বর কত হবে তা নির্ধারণ নিয়ে বোর্ড কর্তৃপক্ষ দ্বিধাগ্রস্ত হন এবং ব্রিটেনে পরামর্শের জন্য চিঠি লেখেন। তখন ব্রিটেনে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের পাশের জন্য পঁয়ষট্টি শতাংশ নম্বর পেতে হতো। সেই সময় ইংরেজরা মনে করত বুদ্ধি এবং দক্ষতায় ভারতবর্ষের মানুষ তাদের অর্ধেক। তাই পঁয়ষট্টির অর্ধেক হিসেবে পাস নম্বর ৩২.৫ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এতে নম্বর হিসেব করতে বেশ বেগ পেতে হতো। তাই ১৮৬২ সালে গণনার সুবিধার্থে তা বৃদ্ধি করে তেত্রিশে উন্নীত করা হয়। সেই থেকে এই তেত্রিশ নম্বরই পাস নম্বর হিসেবে বিবেচিত হয়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারত এবং পাকিস্তানেও ব্রিটিশদের চালু করে দেওয়া এই সিস্টেমই চলছে।

আজ ১৬৬ বছর পর ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণ সম্পর্কে ব্রিটিশদের ধারণা কতটা কার্যকরী তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ২০২১ সালে ওয়াশিংটন বেইজড মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের (এমপিআই) গবেষণা মোতাবেক ‘দ্য ইকোনমিক টাইমস’ পত্রিকার প্রতিবেদনে ভারতীয় আমেরিকান অভিবাসীদের শিক্ষার মান এবং আয় আমেরিকার নেটিভ সিটিজেনদের তুলনায় অনেক বেশি। আমেরিকায় একজন ভারতীয় অভিবাসীর বাৎসরিক গড় আয় ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। যেখানে আমেরিকার নেটিভ সিটিজেনদের বাৎসরিক গড় আয় পঁচাত্তর হাজার ডলার দেখানো হয়েছে। শুধু আমেরিকা নয় কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলেও এমন চিত্রই পাওয়া যাবে। সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশের নাগরিকরা কর্মক্ষেত্রে সম্মানজনক অবস্থানে অধিষ্ঠিত রয়েছে। একটি পরিসংখ্যান মতে, আমেরিকায় ভারতীয় জনসংখ্যা তাদের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ। কিন্তু বিশ্বপ্রযুক্তির রাজধানীখ্যাত সিলিকন ভ্যালির তিন ভাগের এক ভাগ প্রকৌশলী ভারতীয়। গুগল, অ্যাডোবি, মাইক্রোসফট, আইবিএম, টুইটারের মতো স্বনামধন্য কোম্পানির সিইও ভারতীয়। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের শীর্ষ ১০ শতাংশ কোম্পানির সিইওর আসন অলঙ্কৃত করে রেখেছে ভারতীয়রা। প্রতি বছর ব্যবসাক্ষেত্রে চরম সফল ৫০০ কোম্পানির তালিকা তৈরি করে ফরচুন ম্যাগাজিন। ‘ফরচুন ফাইভ হানড্রেড’ কোম্পানির ৩০ শতাংশ সিইও হলো ভারতীয়। তথ্য সংবলিত এই বিশ্লেষণ বলছে মেধা, মনন ও দক্ষতার বিচারে বর্তমানে হিসেবটা ঠিক উল্টো।

আমরা যখন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়েছি তখন শিক্ষা পদ্ধতি ছিল একরকম। পাঠ্যবইয়েই অঙ্ক থাকত, তথ্য থাকত, সেখান থেকে প্রশ্ন হতো। ফলে আমরা বইগুলোকে খুব ভালোভাবে পড়ার চেষ্টা করতাম। এরপর শিক্ষা পদ্ধতিতে বহু নির্বাচনী প্রশ্ন এল এবং গ্রেডিং সিস্টেম চালু হলো। তারপর গ্রেডিং সিস্টেম চালু রেখেই সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি শুরু হলো। সৃজনশীল প্রশ্ন চালু থাকা অবস্থায় পাঠ্যবইগুলো গৌণ হয়ে গেল। চলল গাইড বইয়ের একচ্ছত্র রাজত্ব। আমার সন্তানদের বই পড়তে বললে বলত বই পড়ে প্রশ্ন কমন পাওয়া যায় না। তাই গাইড বই-ই আমাদের ভরসা। এখন যে শিক্ষাক্রম এসেছে সেটাও উন্নত দেশের আদলে নেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, বর্তমান শিক্ষাক্রম যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তি। এর মাধ্যমে ১০ ধরনের দক্ষতা শেখানোর উদ্যোগ বাস্তবায়িত হবে। দক্ষতার বিষয়বস্তুগুলো হলো- সূক্ষ্ম চিন্তা, সৃজনশীল চিন্তা, সমস্যার সমাধান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সহযোগিতা, যোগাযোগ, বিশ্ব নাগরিকত্ব, স্ব-ব্যবস্থাপনা, জীবিকায়ন, মৌলিক দক্ষতা। এই পাঠ্যক্রমেও ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, জীবন-জীবিকা বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে। এই শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত একমুখী শিক্ষার যে পরিকল্পনা তা প্রশংসনীয়। তবে গবেষণা বলছে, এই শিক্ষাক্রমে শিক্ষা উপকরণ কিনতে শিক্ষার্থীদের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তা ছাড়া স্মার্টফোন, কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের সহায়তায় অ্যাসাইনমেন্ট সমাধান করার যে অপরিহার্যতা তা প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। প্রত্যেক সিস্টেমেই কিছু দুর্বলতা থাকে। তবে আমার মতে, আমার জীবদ্দশায় দেখা তিনটি শিক্ষাক্রমের প্রত্যেকটিই সমসাময়িক কর্তৃপক্ষের ভাবনায় সঠিক ছিল। তাই তো আমাদের শিশু, কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের ওপর এই শিক্ষাক্রমগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে।

মানুষের জীবনে প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে অর্জিত ভিত্তিজ্ঞান নিয়েই মানুষ তার উচ্চতর জ্ঞানের পরিসরকে বৃদ্ধি করে। একটি ভাবনা আমার মনকে সর্বদা আন্দোলিত করে, পশ্চিমারা যারা তাদের মেধা, মনন ও দক্ষতায় আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ ভাবত, তাদের শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে আমরা কি খুব উপকৃত হবো! তা ছাড়া পশ্চিমা যে দেশগুলোর শিক্ষাপদ্ধতি আমরা হুবহু অনুসরণ করতে চাই তাদের শিক্ষা খাতে ব্যয়ও আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। ২০২০ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে ১৪৩২১ ও ১৬০১৮ ডলার, যুক্তরাজ্যে ১২৫১৩ ও ১৩৬৯৫ ডলার, কানাডায় ১১৫৩৩ ও ১৫৫২০ ডলার এবং অস্ট্রেলিয়ায় ১২৬৭৩ ও ১৫৪৩৭ ডলার। এই পরিসংখ্যানে আমি মোটেও আশাহত নই। কারণ স্বল্প বাজেটের পড়াশোনা হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান যুগের জ্ঞাননির্ভর প্রযুক্তির দক্ষ জনবলের সিংহভাগই ভারতীয় উপমহাদেশের।

বাস্তবিক অর্থে, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা, পরিবেশ, সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রেখে শিক্ষার উন্নয়নের পরিকল্পনা জাতির জন্য অধিক ফলপ্রসূ হবে। শুধু অর্থ দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। মানব জীবনের পাঁচটি গুণ বা বৈশিষ্ট্যে শিক্ষা পূর্ণতা পায়- জ্ঞান, প্রেম, ন্যায়, ধৈর্য ও সমর্পণ। কারণ ‘জ্ঞান’ বুদ্ধিকে স্থির রাখে, ‘প্রেম’ হৃদয়কে স্থির রাখে, ‘ন্যায়’ আত্মাকে স্থির রাখে, ‘ধৈর্য’ মনকে স্থির রাখে, আর ‘সমর্পণ’ শরীরের সব আবেগ শান্ত রাখে।

লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

সৌর বিদ্যুতের বিচিত্র প্রকল্প

আপডেটেড ২০ মে, ২০২৪ ১২:০২
প্রদীপ সাহা  

বিদ্যুৎ সমস্যা আমাদের দেশে প্রকট হলেও পশ্চিমা দেশগুলো সম্ভাব্য বিদ্যুৎ সংকট বা সমস্যা মোকাবিলায় বেশ তৎপর। তারা প্রকৃতির অপার উৎস সূর্যের আলোকে ব্যবহার করে ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি জার্মানির শতকরা ৮০ ভাগ জ্বালানিবিদ্যুৎ আসে বিদেশ থেকে। শুধু জার্মানিই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনেক দেশই তাদের জ্বালানিবিদ্যুতের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় জার্মানিতে বায়ুচালিত বিদ্যুৎ অত্যন্ত প্রচলিত। অন্যদিকে, স্পেন সৌরবিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প ‘আন্দাসোল’ স্পেনেই অবস্থিত; কিন্তু ইউরোপের উত্তরাঞ্চলের দেশগুলোতে বছরের বেশির ভাগ সময় সূর্যের আলো তেমন তীব্র না হওয়ায় তারা এই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারছে না। সে জন্য ইইউর বিভিন্ন দেশ উত্তর আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলে ‘ডেজারটেক’ নামে একটি বিশাল প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ডেজার্ট বা মরুভূমির প্রচণ্ড রোদকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করে সেই বিদ্যুৎ নিয়ে আসা হয় ইউরোপের নানা দেশে।

ডেজারটেক প্রকল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল জানান, এটি একটি ভিশন হলেও ভবিষ্যতে ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে এ প্রকল্প একটি চমৎকার বন্ধন হয়ে উঠতে পারে। ডেজারটেক প্রকল্পের উদ্যোক্তা জার্মানির গেরহার্ড কেনিস বলেন, এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো দিনের বেলায় সৌরবিদ্যুৎ জমিয়ে রাখার পাশাপাশি রাতেও উৎপাদিত তাপ থেকে বিদ্যুৎ শক্তি পাওয়া যাবে। আর এ প্রযুক্তির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎশক্তি উৎপন্ন করতে পারবে এবং প্রয়োজনের চেয়ে ১০০ ভাগ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। সৌর প্যানেলগুলোর অর্ধেকেরও বেশি স্থাপন করা হবে উত্তর আফ্রিকার মরক্কো, মিশর এবং তিউনিসিয়ায়। তবে ডেজারটেক প্রকল্প নিয়ে এখনো ইউরোপীয় দেশগুলো এবং আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বিতর্ক। ডেজারটেক প্রকল্পের প্রধান কর্মকর্তা থার্মো গ্রুপ বলেন, উৎপাদিত বিদ্যুৎ কোথায় জমা রাখা হবে এবং কীভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করা হবে সেসব নিয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কেবল ইউরোপই নয়, গোটা বিশ্বের কাছে এটি এক অভাবনীয় উদাহরণ হয়ে উঠবে।

ডেজারটেক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উত্তর আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিতে বসানো হয়েছে বিশাল আকারের বেশ কয়েকটি সৌর প্যানেল। আর এ প্যানেলগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে দূর থেকে কিংবা অনেক ওপর থেকে মনে হবে, মরুভূমির মধ্যে সারি সারি বিশাল আকারের আয়না ফেলে রাখা হয়েছে। আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে প্রচণ্ড রোদ এসে যেন ঝলসে দিচ্ছে গোটা এলাকাকে। সোলার প্যানেল বা আয়না বাড়ির ছাদে থাকা প্রচলিত প্যানেলের মতো নয়। বিশাল আকারের সোলার প্যানেল বা আয়নাগুলো থেকে আসা তাপ প্রকাণ্ড আকারের পানির ট্যাঙ্কে একীভূত করা হয়েছে। প্রচণ্ড তাপে এই ট্যাঙ্কের পানি গরম হয়ে বাষ্পে পরিণত হয়। সেই বাষ্প গিয়ে চাপ তৈরি করে টারবাইনে এবং বাষ্পের চাপে টারবাইন ঘোরে। ফলে সহজেই তৈরি হয় বিদ্যুৎ। অর্থাৎ শুধু সৌরশক্তিকেই নয়- এই ডেজারটেক প্রকল্পে বিদ্যুৎ তৈরির কাজে পানি এবং বাষ্পশক্তিকেও ব্যবহার করা হয়। আর উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভবিষ্যতে রপ্তানির জন্য জমিয়ে রাখা হয়।

মজার ব্যাপার হলো, এই প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনই নয়, সমুদ্রের পানিকে লবণমুক্তও করা যাবে। শুধু তাই নয়, এ লবণমুক্ত পানি খাবার পানি হিসেবে আবার অন্যান্য দেশে রপ্তানিও করা যাবে। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত গবেষকরা জানান, সৌর প্যানেল ব্যবহার করে প্রতি ঘণ্টায় চার মিলিয়ন লিটার সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা দূর করা সম্ভব। বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় ডেজারটেক প্রকল্পের সময়োপযোগী এবং বিচিত্র উদ্যোগ বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছে।

লেখক: বিজ্ঞানবিষয়ক প্রাবন্ধিক


মেডিটেশন করুন অর্জন করুন টোটাল ফিটনেস

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. মো. মাসুদুল হক সিদ্দিকী

যেকোনো কিছু জয় করার জন্য প্রয়োজন টোটাল ফিটনেস। প্রয়োজন শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক জীবনের প্রতিটি দিকের সুন্দর সমন্বয়। নিউরো সায়েন্টিস্টদের ২৫ বছরের গবেষণার সারকথা হচ্ছে, মেডিটেশন বা ধ্যান হলো ব্রেনের ব্যায়াম। ধ্যান ব্রেনের কর্মকাঠামোকে সুবিন্যস্ত, সুসংহত, গতিময় ও প্রাণবন্ত করে। ব্রেনকে বেশি পরিমাণে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করার সামর্থ্য বাড়ায়।

মেডিটেশন রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং মনকে প্রশান্ত করে, অস্থিরতা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও হতাশা থেকে মুক্ত করে। অসহিষ্ণুতা রূঢ়তা ও অমানবিকতার পরিবর্তে আচরণে আনে বিনয় এবং সমমর্মিতা। শুধু তা-ই নয়- ধ্যান মানুষকে জীবনের পরম সত্য উপলব্ধি করার স্তরে নিয়ে যায়। সত্যটা তখন আপন হয়। অন্তরে যে সুপ্ত শক্তির ভাণ্ডার রয়েছে সে ভাণ্ডারের দ্বার উন্মোচন করে দেয় ধ্যান। জীবনকে আশাবাদে ভরিয়ে দেয়। বিশুদ্ধ সম্ভাবনার বলয়ের সঙ্গে আপনার সত্তাকে সংযুক্ত করে। সব মিলিয়ে ধ্যান বা মেডিটেশন টোটাল ফিটনেস অর্থাৎ শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক ফিটনেসের পথ উন্মোচন করে।

ছন্দময় জীবনের জন্য শারীরিক ফিটনেস

নির্দিষ্ট মাপ ওজন বা আকার নয়, শারীরিক ফিটনেস নির্ভর করে একজন মানুষ ক্লান্তিহীনভাবে কতক্ষণ কাজ করতে পারেন, তার ওপর। তাই দেহের আকার-ওজনের ফ্যান্টাসি থেকে মুক্ত হয়ে গুরুত্ব দিন আপনার এনার্জি লেভেল ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার দিকে। শারীরিক ফিটনেসের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো আহার অর্থাৎ কী খাবেন, কতটুকু খাবেন কিংবা কখন খাবেন সে সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।

কী খাবেন?

টিনজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের পরিবর্তে প্রাকৃতিক খাবারে অভ্যস্ত হোন। খাবারে পর্যাপ্ত শাক-সবজি রাখুন। চিনির পরিবর্তে গুড় খান, খেজুর খান। মৌসুমি ফল খান। দুধ চায়ের পরিবর্তে বেছে নিন গ্রিন টি।

কতটুকু খাবেন?

পরিমিত খাবারই স্বাস্থ্যকর। নবীজীর (স.) সুন্নত অনুসারে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাবার, এক-তৃতীয়াংশ পানি এবং এক-তৃতীয়াংশ ফাঁকা রাখুন।

কখন খাবেন?

দিনের শুরুতে ভরপেট খাবার, দুপুরে তার চেয়ে কম আর রাতে আরও কম খান।

হাঁটা, দৌড়ানো ও যোগব্যায়াম

প্রতিদিন ৩০ মিনিট সময় রাখুন হাঁটা ও দৌড়ানোর জন্য। এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমবে। যোগব্যায়াম চর্চায় মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত প্রতিটি স্নায়ুপেশি শিথিল হয়। দেহে ভারসাম্য আসে। জন্স হপকি মেডিসিনের গবেষণা রিপোর্ট অনুসারে, যোগব্যায়াম ব্যাকপেইন ও আর্থ্রাইটিস নিরাময় ও প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা

দেহকে টক্সিনমুক্ত করতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো বিকল্প নেই। অগণিত ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাঁচারও উপায় এটি। তাই দাঁত, চুল, নখ, চোখ, নাক, মুখ পরিষ্কার করুন। পরিচ্ছন্ন থাকুন। প্রতিদিন স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে গোসল করুন। এ ছাড়া নিয়মিত দমচর্চা বা ব্রিদিং এক্সারসাইজ করুন। বাড়বে দেহ-মনের সুস্থতা।

মানসিক ফিটনেস

মানসিক ফিটনেসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- দৃষ্টিভঙ্গি বা ভাবনা। কারণ আমরা যা ভাবী আমরা তা-ই। ভাবনাকে যত বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল রাখা সম্ভব হবে, মানসিক ফিটনেস তত বাড়বে।

বারবার শুরু করার সামর্থ্য

যে মাটিতে মানুষ আছাড় খায়, সেই মাটি ধরেই আবার সে উঠে দাঁড়ায়। এই উঠে দাঁড়ানোর সামর্থ্যই মানসিক ফিটনেস। এ সামর্থ্য জন্মগত নয়, নিজের ভেতরে এর উন্মেষ ঘটানো সম্ভব। তাই ব্যর্থতাকে নিয়তি হিসেবে মেনে না নিয়ে বারবার চেষ্টা করুন। সব দ্বিধা ঝেড়ে আবার শুরু করুন। মনে রাখবেন, জীবন মানে বারবার শুরু করা।

ছোট ছোট বিষয় থেকে আনন্দ খুঁজে নেওয়া

মানসিক ফিটনেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি হলো সুখের অনুভূতি। সব অর্জনের পরও যদি মনে শূন্যতার অনুভূতি হয় তবে সে মানুষটি আপাতদৃষ্টিতে সফল হতে পারে; কিন্তু সুখী নয়। আর পাহাড়সম মানসিক সামর্থ্যকে নিঃশেষ করে দিতে এই শূন্যতাবোধই যথেষ্ট।

প্রধান দুই মানদণ্ড

প্রথমত, নিন্দা ও প্রশংসাÑদুটোকেই আপনি সহজভাবে নিতে পারেন কি না। হাততালি বা কটাক্ষ-কটুকথা তা যদি আপনার কাজে কোনো প্রভাব বিস্তার না করে, তাহলে আপনি মানসিকভাবে ফিট।

দ্বিতীয়ত, যেকোনো পরিস্থিতিতে আপনি ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কি না। প্রতিকূল সময়ে উত্তেজিত হয়ে রি-অ্যাক্ট করে ফেলেন নাকি সহজভাবে পরিস্থিতি সামলে নিতে পারেন?

বিরক্তিকে জয় করে করণীয় কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারাই মূলত মানসিক ফিটনেস। জীবনকে গভীরভাবে দেখতে শিখুন। যা আছে তার জন্য কৃতজ্ঞ হোন। ছোট ছোট বিষয় থেকে আনন্দ খুঁজে নিন। এই কৃতজ্ঞ ও পরিতৃপ্ত হৃদয়ই হবে ভবিষ্যৎ অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় শক্তি।

সামাজিক ফিটনেস

সোশ্যাল নিউরো সায়েন্সের প্রবক্তা ড. জন টি ক্যাসিওপ্পো। তিনি বলেন, দেহের পেশিগুলোর মতো প্রতিটি মানুষের অদৃশ্য একটি পেশি আছে। তা হলো- ‘সোশ্যাল মাসল’। এই মাসল আমরা যত কাজে লাগাব, আমাদের সুখের পরিমাণ তত বাড়বে। শুধু একতরফাভাবে নেওয়ার মধ্যে কারও বিকাশ ঘটে না। মানুষ সবচেয়ে সুন্দরভাবে বিকশিত হয় যখন একই সঙ্গে ভালোবাসা ও মমতা দেয় এবং নেয়। একাকিত্ব মানে শুধু পাওয়ার পথ বন্ধ হওয়া নয়, একাকী জীবনের অর্থ হলো অন্যকে দেওয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। আর এই বিচ্ছিন্নতা আমাদের সুখ ও সামগ্রিক ভালো থাকাকে ব্যাহত করে।

মানুষ আপনাকে দেখলে কতটা তটস্থ থাকে, সালাম দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ায়Ñ এটা আপনার সোশ্যাল ফিটনেস নয়। তারা আপনাকে কতটা আপন মনে করে, আপনার উপস্থিতি তাদের কতটা তৃপ্তি দেয় এটাই আপনার সোশ্যাল ফিটনেসের ব্যারোমিটার।

আত্মিক ফিটনেস

‘একটি প্রদীপ যেমন আগুন ছাড়া প্রজ্বলিত হতে পারে না, তেমনি আত্মিক শূন্যতা নিয়ে কোনো মানুষ বাঁচতে পারে না’-Ñকথাটি হাজার বছর আগে বলে গেছেন মহামতি বুদ্ধ। পণ্য পদমর্যাদা প্রাচুর্য প্রতিটি প্রত্যাশা পূরণের পরও যে শূন্যতা আর হাহাকার, সেটি দূর করতেই প্রয়োজন আত্মিক উন্নয়ন।

আত্মিক উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তিই হলো আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে সমাজকেন্দ্রিক হওয়া। শুধু নিজের জন্য নয়, চারপাশে সবার জন্য বাঁচা, সবার কথা ভাবা।

একজন ধার্মিকের জীবন এবং ধর্ম সম্পর্কে উদাসী ব্যক্তির তুলনা হতে পারে দুটি গাছের সঙ্গে। একটি গাছ শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত বলে তা সজীব, সতেজ ও অপার্থিব আনন্দের উৎস। অন্যটি শিকড় বিচ্ছিন্ন বলে শুষ্ক, রুক্ষ ও বেদনার্ত। তাই আত্মিকভাবে ফিট হতে শাশ্বত ধর্মের সত্যিকার জ্ঞানে জ্ঞানী হোন এবং তা অনুসরণ করুন।

যিনি সহজে অন্যকে ক্ষমা করতে পারেন, অন্যের ব্যথায় সমব্যথী, মানবতার কল্যাণে নিজের মেধাকে সেবায় রূপান্তরিত করেন, তিনিই আত্মিকভাবে ফিট। আসছে ২১ মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। সবাইকে অগ্রিম শুভেচ্ছা। ধ্যান করুন। অটুট রাখুন ভাবনার শক্তিকে। অর্জন করুন টোটাল ফিটনেস।

লেখক: অধ্যক্ষ, গোদাগাড়ী সরকারি কলেজ, রাজশাহী


উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে ভুল ধারণা ও করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ রক্তচাপ, যা প্রায়ই একটি স্থায়ী রোগ হিসেবে বিবেচিত। এর জন্য চিকিৎসা ও প্রতিরোধ খুবই জরুরি। তা না হলে বিভিন্ন জটিলতা, এমনকি হঠাৎ করে মৃত্যুরও ঝুঁকি থাকে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা। তাই এ সম্পর্কে সচেতন থাকার বিকল্প নেই। যদি কারও রক্তচাপ নরমাল মাত্রার চেয়ে বেশি হয় এবং অধিকাংশ সময় এমনকি বিশ্রামকালেও বেশি থাকে, তবে ধরে নিতে হবে তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী। প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো-

(১) কোনো এক সময় একবার উচ্চ রক্তচাপ হলেই কি রোগী হিসেবে বিবেচনা করা হবে?

উত্তর: না, কেউ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে তা বলার আগে বেশ কিছু বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। যেমন অন্তত তিন দিন ভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার রক্তচাপ মাপতে হবে। এরপর যদি দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে রক্তচাপ বেশি, তবেই বলা যাবে তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। অবশ্যই বসে রক্তচাপ মাপা উচিত, শরীর ও মন যেন শান্ত অবস্থায় থাকে, এমন সময় রক্তচাপ মাপতে হবে।

(২) কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ তো নেই, কেন চিকিৎসা নেব বা ওষুধ খেতে হবে?

উত্তর: অনেকেই মনে করেন, উচ্চ রক্তচাপ তার দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহে কোনো সমস্যা করছে না বা রোগের কোনো লক্ষণ নেই, তাই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে চান না বা প্রয়োজন মনে করেন না। তাদের ধারণা ভালোই তো আছি, ওষুধের কি দরকার। এই ধারণাগুলো সম্পূর্ণ ভুল। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কোনো প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায় না। এটাই উচ্চ রক্তচাপের সবচেয়ে খারাপ দিক। নিয়ন্ত্রণ করা না হলে উচ্চ রক্তচাপ ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। যদিও অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের রোগীর বেলায় কোনো লক্ষণ থাকে না, তবুও নীরবে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ জন্যই উচ্চ রক্তচাপকে বলা হয় ‘নীরব ঘাতক’। অনিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসাবিহীন উচ্চ রক্তচাপ থেকে মারাত্মক শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ ৪টি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন- হৎপিণ্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে পারে না এবং এই অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিওর। রক্তনালি সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি বিকল হয়ে কার্যকারিতা হারাতে পারে। এ ছাড়া মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক হয়ে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে এবং চোখের রেটিনায় রক্তক্ষরণ হয়ে অন্ধত্ব বরণ করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি এবং বড় ধরনের জটিলতা এড়াতেই ওষুধ দেওয়া হয়।’

(৩) উচ্চ রক্তচাপ হলে কি চিকিৎসা করাতেই হবে? ওষুধ সেবন কি খুবই জরুরি?

উত্তর: অনেকেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত জানার পরেও ওষুধ খেতে অনীহা প্রকাশ করেন বা খেতে চান না। কারও কারও ধারণা একবার ওষুধ শুরু করলে তা আর বন্ধ করা যাবে না। সারা জীবন খেতে হবে। তাই ওষুধ শুরু না করাই ভালো। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, এ চিন্তাও বিপজ্জনক। মনে রাখতে হবে, উচ্চ রক্তচাপ সারে না, একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর জন্য নিয়মিত ওষুধপত্র সেবন করতে হবে।

(৪) রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে ওষুধ কি বন্ধ করা যাবে?

উত্তর: অনেক রোগী কিছুদিন ওষুধ ব্যবহার করার পর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে ওষুধ বন্ধ করে দেন, মনে করেন রক্তচাপ ভালো হয়ে গেছে, কাজেই ওষুধ খাওয়ার দরকার কি? এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এই ধরনের রোগীরাই হঠাৎ করে হৃদরোগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, এমনকি মৃত্যুও হয়ে থাকে। কোনোক্রমেই ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত তাদের অবশ্যই ডাক্তারদের পরামর্শ নিতে হবে, নিয়মিত সারা জীবন ওষুধ সেবন করতে হবে এবং নিয়মিত চেক করাতে হবে।

(৫) উচ্চ রক্তচাপ কি শুধু বয়স্কদেরই হয়?

উত্তর: শুধু বয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপ হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। যেকোনো বয়সেই উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, বয়স হলে রক্তচাপ একটু বেশিই থাকে, এ জন্য চিন্তার কিছু নেই, এমন ধারণাও সঠিক নয়। উচ্চ রক্তচাপ যে বয়সেই ধরা পড়ুক, তাকে উচ্চ রক্তচাপ হিসেবেই গণ্য করা উচিত। উচ্চ রক্তচাপকে স্বাভাবিক না ভেবে নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা এবং চিকিৎসা নিলে জটিলতা এড়ানো সহজ হয়।

(৬) তরুণ বয়সে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে কি?

উত্তর: অনেকে ভাবেন, উচ্চ রক্তচাপ বয়স্কদের রোগ। আসলে তা নয়। অল্প বয়সেও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে তবে সন্তানেরও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি নিকটাত্মীয়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও অন্যদের রক্তচাপের ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া অন্যান্য কারণ হতে পারে, যেমন-
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার ইত্যাদি। অধিক ওজন এবং অলস জীবনযাত্রা, খেলাধুলা, ব্যায়াম বা কায়িক শ্রমের অভাবে অল্প বয়সিদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বাড়ছে।

কিছু কিছু অঙ্গে আক্রান্ত রোগের কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে একে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন। যেমন কিডনির রোগ, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার, ধমনির বংশগত রোগ,
গর্ভধারণ অবস্থায় অ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রি অ্যাকলাম্পসিয়া হলে, অনেক দিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির ব্যবহার, স্টেরয়েড গ্রহণ এবং ব্যথা নিরামক কিছু কিছু ওষুধ সেবন করলে।

(৭) উচ্চ রক্তচাপ হলে ঘাড় ব্যথা হয় কি?

উত্তর: ঘাড়ে ব্যথা হলে কেউ কেউ মনে করেন, নিশ্চয়ই রক্তচাপ বেড়েছে। এই ধারণা অমূলক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রক্তচাপ বৃদ্ধির কোনো উপসর্গ বোঝা যায় না।

(৮) লবণ ভেজে খাওয়া যাবে কি?

উত্তর: উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে খাবারে বাড়তি লবণের ব্যবহারে বারণ। শুধু তরকারিতে যতটুকু লবণ দেওয়া হয় তা খাওয়া যাবে। অনেকের ধারণা কাঁচা লবণ নিষেধ; কিন্তু লবণ ভেজে খাওয়া যাবে। এ ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল। কাঁচা বা ভেজে খাওয়া লবণে কোনো পার্থক্য হবে না।

(৯) মাংস, ডিম, দুধ খাওয়া নিষেধ কি?

উত্তর: অনেকের ধারণা, উচ্চ রক্তচাপ হলে মাংস, ডিম, দুধ খাওয়া নিষেধ। এসব খাবার খেলে রক্তচাপ বাড়ে। এটা ঠিক নয়। পরিমাণ মতো এগুলো খাওয়া যাবে, তবে গরু বা খাসির মাংসের চর্বি পরিহার করতে হবে।

(১০) তেঁতুল গুলে খেলে বা টক খেলে রক্তচাপ কমে কি?

উত্তর: অনেকে মনে করেন রক্তচাপ বাড়লে পানিতে তেঁতুল গুলে খেলে বা টক খেলে রক্তচাপ কমবে। আসলে মনে রাখতে হবে এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, তেঁতুল বা টক খাওয়ার সঙ্গে রক্তচাপ কমার কোনো সম্পর্ক নেই।

(১১) উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাই স্যালাইন খাওয়া যাবে না?

উত্তর: ডায়রিয়া, বমি, পানিশূন্যতা বা লবণশূন্যতা হলে খাওয়ার স্যালাইন খেতে হয়; কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের রোগী ভাবেন, তার স্যালাইন খাওয়া নিষেধ; কিন্তু এসব জরুরি পরিস্থিতিতে পানি ও লবণশূন্যতা পূরণ করা আগে জরুরি। তাই দরকারে স্যালাইন খেতে নিষেধ নেই।

উপসংহার: মনে রাখতে হবে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অতিরিক্ত ওজন, ধূমপান, মদ্যপান, তেল-চর্বিজাতীয় খাবার, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ ইত্যাদি উচ্চ রক্তচাপের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। জীবনাচরণ পরিবর্তন করে রক্তচাপ বাড়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। আর ওষুধ সেবনের বেলায় অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অনেকেই ফার্মেসিতে গিয়ে দোকানির কাছ থেকে অথবা নিজের ইচ্ছেমতো ওষুধ কিনে খেয়ে থাকেন। যেকোনো অসুখের ক্ষেত্রেই এটি বিপজ্জনক।’ মনে রাখতে হবে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য জীবনযাপন পদ্ধতির সঠিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিয়মিত ওষুধ সেবন অত্যন্ত জরুরি। যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত তাদের অবশ্যই ডাক্তারদের পরামর্শ নিতে হবে এবং নিয়মিত চেক করাতে হবে।

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক


বাজেট অগ্রাধিকারে থাকুক ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থান’

আপডেটেড ১৯ মে, ২০২৪ ১৪:৩৪
মোতাহার হোসেন

আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজস্ব বোর্ড পরামর্শের জন্য ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, নাগরিক সমাজসহ সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর অধিদপ্তর থেকেও তাদের চাহিদা, সম্ভাব্য পরামর্শ নিয়েছে; কিন্তু বিগত যেকোনো সময়ের তুলনায় এবারের বাজেট প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং দেশের মানুষের চাহিদাপূরণে সরকারকে বিরাট চ্যালেঞ্জে পড়তে হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে- করোনাপরবর্তী রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের সঙ্গে নতুন করে ইরানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন. ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের সম্ভাব্য সংকট মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখতে।

মূলত বাংলাদেশের মতো বিকাশমান বা উন্নয়নশীল দেশে দিনের শেষে বাজেট হচ্ছে সরকারের আয়-ব্যয়ের বার্ষিক হিসাব। এতে কিছুটা উন্নয়ন অর্থায়নের পরিকল্পনা, সাধারণ জনগণকে কিছুটা আশ্বস্ত আর কিছুটা সহায়তা করার পরিকল্পনাও থাকে। বাজেট প্রণয়ন, বিশেষ করে গুণগতমান বজায় রেখে বাজেট বাস্তবায়ন বেশ কঠিন হলেও উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টায় বাজেট বাস্তবায়ন করা হয়। তবে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় মাঠপর্যায়ে তহবিল বা বরাদ্দ ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট অগ্রগতি হচ্ছে।

প্রসঙ্গত বর্তমানে জাতীয় অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ালেও করোনাপরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব এবং চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মধ্যেও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নের গতিধারাকে এগিয়ে নিতে হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশকে আরও সুদৃঢ় ও জোরদার এবং চলমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, দেশের বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীল খাতকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট প্রণয়নের প্রত্যাশা করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। রাজস্ব বোর্ড এবং এফবিসিসিআইর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরামর্শক কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে এই প্রত্যাশার কথা জানান এফবিসিসিআই।

প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ পরিকল্পনা এবং আন্তরিক প্রয়াস দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সুদৃঢ় করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট উন্নত বাংলাদেশে উন্নীত পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে জনমুখী ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়নে প্রয়োজন করের বোঝা কমানো, আমদানিকৃত কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যসহ শিল্প উপকরণের ওপর আরোপিত এআইটি, আগাম কর প্রভৃতি প্রত্যাহার করা। ব্যাংক ঋণের সুদহার হ্রাসসহ আমদানি পণ্যের শুল্কায়নে ও পণ্য খালাসের জটিলতা দূর করার বিষয় গুরুত্বসহ দেখা দরকার। একই সঙ্গে কর কমিয়ে আয়কর ও মূসকের আওতা সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং সক্ষম ব্যক্তিদের করের আওতায় আনা দরকার। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিতকরণে ব্যাংকিং কমিশন গঠন, দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত না করার প্রস্তাবও আসে বৈঠকে। মানুষের প্রকৃত আয় বিবেচনায় রেখে- আগামী জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দেন তিনি।

বাজেট প্রণয়নে যুক্ত কর্মকর্তাদের মনে রাখা উচিত বিশ্ব পরিস্থিতি এখন টালমাটাল। এমনি অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বাজার মনিটরিং, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্সপ্রবাহ, রপ্তানি বৃদ্ধি, বহুমুখীকরণ, সম্প্রসারণ ও নতুন বাজার সন্ধান, মানব সম্পদ উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন কার্যক্রম জোরদার করা দরকার। বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় লক্ষ্যমাত্রাগুলোর আলোকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে দৃঢ় করতে ব্যবসায়িক খরচ কমিয়ে আনা, বিনিয়োগ সুরক্ষা, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিনিয়োগ সহায়ক মুদ্রা ও শুল্ক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, শিপিং খরচসহ সব ধরণের পরিবহন খরচ হ্রাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিশ্চয়তার পাশাপাশি কর আদায়ে হয়রানি ও জটিলতা নিরসন দরকার। কর্মসংস্থানের স্বার্থে বিনিয়োগ, দেশীয় শিল্প ও সেবাখাতে করের যৌক্তিক নির্ধারণ দরকার। পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নগদ সহায়তার বিকল্প সুবিধা নিশ্চিত করা এবং বিকল্প সহায়তা হিসেবে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও পরিবহন খাতে প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য- বিশেষ করে চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলা, বুট, ডাল, হলুদ, মরিচ, ভুট্টা, আটা, ময়দা, লবণ, ভোজ্য তেল, চিনিসহ সকল প্রকার কৃষিজাত নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যকে উৎসে কর কর্তনের আওতা বহির্ভূত রাখার বিষয়ে ভাবতে হবে।

ইতোপূর্বে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সবাই বলেছেন আমরা সঠিক পথে আছি। কী কী সমস্যা আছে, তা সবাই জানেন। তারপরও তারা তাদের মতো করে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো ঠিক আছে বলে মত দিয়েছেন।’ আগামী বাজেটে নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার যে সমস্যা চলমান আছে, সেটা দূর করতে হবে। অবশ্য সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর পাশাপাশি করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছি। অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধিকারগুলো যেন যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয়, সেটি বলেছি। খেলাপি ঋণ কমানো, বিদেশি ঋণ কম নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে বৈঠকে।’ তিনি ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশেরও পরামর্শ দিয়েছেন। তবে ‘বর্তমানে দেশে আয়বৈষম্য উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। আয়বৈষম্য কমাতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছি আমি। এ ক্ষেত্রে ধনীদের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক কর্মসূচিসহ যেসব খাত থেকে প্রান্তিক মানুষ উপকৃত হবে, সেসব খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং আগামী বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।’

আগামী অর্থবছরের বাজেটে বড় প্রকল্প কমিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, যে প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি সময় লাগে এবং ফল আসতে দেরি হয়, সে ধরনের প্রকল্প যেন কমিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর পরামর্শও দিয়েছেন। একবিংশ শতাব্দীতে দেশ ও মানুষের উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন। ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস, ক্লাউড কম্পিউটিং, মেশিন লার্নিং, ব্লকচেইন প্রযুক্তি, সেন্সর, অটোমেশন, থ্রিডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, জিন ও প্রকৌশল প্রযুক্তির সমন্বয়ে আজকের বিশ্বে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বিশ্বায়নের এই প্রশস্ত আঙিনায় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে করণীয়, ভবিষ্যৎ-সম্ভাবনা, পরিকল্পনা, দক্ষ জনবল তৈরির উপায়, সমস্যার সমাধান ইত্যাদি বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেটে এসব অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারের এসব পদক্ষেপের সঙ্গে সাধারণ জনগণকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা ও তাদের প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দক্ষ করে তোলার প্রয়াস সফল হলেই অর্থনীতিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-বিবেচনায় প্রাধান্যের ভিত্তিতে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে যেসব মানুষ পারদর্শী ও পেশাদার, তাদের কদর পৃথিবীব্যাপী বেড়েই চলেছে। তাই পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির বিষয়টি সামনে রেখে দেশে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের সমন্বয়ে স্মার্ট ইকোনমির ধারণা বর্তমানে একটি পরিজ্ঞাত বিষয়। বর্তমানে দেশে ৩ লাখ মানুষ সক্রিয়ভাবে আইসিটি খাতে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া ৫ লাখ রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সার আইসিটি বিষয়ে কাজ করছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে জনবহুল বাংলাদেশে বিপুল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে প্রযুক্তির মাধ্যমেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রয়োজন। মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং, অনলাইনে মানি ট্রান্সফার, মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন প্রভৃতি এখন বেশ জনপ্রিয়। জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণসহ এসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নই জনপ্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক

বিষয়:

নেটওয়ার্ক ও টেলিটক সিম

আপডেটেড ১৯ মে, ২০২৪ ১২:৩৪
আহমেদ কবির রিপন

বর্তমান দৈনন্দিন জীবন বা সময়ের সমষ্টি অতিবাহিত হচ্ছে মোবাইল বা সেলফোনের দ্বারা। ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে সেলফোনের যুগে টেলিটক বিশেষ অবদান রাখছে তাই কিছু কথা লেখার তাগিদ অনুভব করছি। এ যুগে এখন প্রতিটি পরিবারে একাধিক সংখ্যক মোবাইল বা সেলফোন রয়েছে যা তিন-চার দশক আগেও অকল্পনীয় ছিল। বর্তমানে লক্ষণীয় যে কোনো কোনো পরিবারে এক ব্যক্তির জন্য ২-৩টি মোবাইল ফোনও আছে।

স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের হাতেও মোবাইল থাকা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা এখন অনলাইনে মোবাইল ফোন বা সেলফোনের দ্বারা ক্লাস করে থাকেন। ব্যবসায়িক কাজে ও মোবাইল বা সেলফোনের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য, চাকরিজীবীদের সেলফোন ছাড়া চলেই না এ ছাড়া বিভিন্ন পেশাজীবীদেরও এখন মোবাইল লাগে, উচ্চশ্রেণি ছাড়াও এমনকি নিম্নশ্রেণি পেশার জনগণকে, রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা, গার্মেন্টশ্রমিকরাও সেলফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন তা ছাড়া বিশেষ করে প্রবাসীদের প্রতিটি পরিবারের কাছে মোবাইলের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রত্যেক পরিবারের সদস্যরা সুখ-দুঃখের খবরাখবর মোবাইল বা সেলফোনের মাধ্যমে নিয়ে থাকেন। একজন কৃষক খেত-খামারে থেকে মোবাইলের মাধ্যমে তার দূরবর্তী অবস্থানরত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে নিতে পারেন। এ দেশে মোবাইল বা সেলফোন নেই এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম।

যেসব এলাকায় নেটওয়ার্ক কম বা অস্পষ্ট ওইসব এলাকায় মোবাইল থেকেও ব্যবহারকারীদের খুব একটা লাভ হচ্ছে না। তাৎক্ষণিকভাবে কথাবার্তা, প্রয়োজনীয় খবরাখবর দ্রুত আদান-প্রদানে জনগণ খুবই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই বিটিসিএলের মাধ্যমে বা সরকারি ব্যবস্থাপনায় অধিক পরিমাণে সরকারি সিম বা টেলিটক কোম্পানির সিম, বাজারজাতকরণের জরুরি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

এই সিম ব্যবহারের ফলে দেশের একাংশের অবহেলিত দরিদ্র জনগণের সমস্যার কথা তারা একে অপরের কাছে ও বৃহৎ পরিষরে তুলে ধরতে পারবে।

শিক্ষার্থীরাও বাড়িতে বসেই অনলাইনে সহজে ক্লাস করতে পারবে এবং দেশ গড়ার ক্ষেত্রে দক্ষ সৈনিক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে।

ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশাজীবীদের কাজের গতি আরও বাড়বে। গ্রাম-গঞ্জের খবরাখবর আদান-প্রদানে অনেক সহায়ক হবে। বিশেষ করে হাওর ও পাহাড়িয়া দুর্গম অঞ্চলের জনগণ অনেক উপকৃত হবে, যেমন- ‘হাকালুকি’ হাওরতীরবর্তী বিশাল জনগোষ্ঠীর অসুবিধা লাঘবে প্রয়োজনীয় স্থানে অধিকসংখ্যক টাওয়ার স্থাপন করে মোবাইল যোগাযোগের সুবিধা বর্ধিতকরণ দরকার। তাহলে ওই এলাকার জনসাধারণের জীবনমানের সহজে উন্নতি ঘটবে এবং প্রধানমন্ত্রীর মহতী উদ্যোগ গ্রামের উন্নয়ন, কৃষকের উন্নয়ন সর্বোপরি দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং সরকারও সঠিক পদ্ধতিতে কর সংগ্রহে সফলতা অর্জন করবে। গ্রাহকদের অযাচিত ভোগান্তি দূর হবে।

আমরা লক্ষ্য করছি, বর্তমান প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডাকঘরগুলোতে বিভাগীয় সেবার পরিমাণ অনেকটা বেড়েছে তাও সম্প্রতি বর্তমান সরকারের উন্নয়নমূলক কিছু সিদ্ধান্ত ও প্রকল্প গ্রহণের ফলে, সেই সঙ্গে ডাক বিভাগের নিয়োজিত জনবলকে আরও উন্নত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে টেলিটক সিম বিপণন ও নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার উন্নয়ন আরও বৃদ্ধি করে গ্রাহকদের সহজে বেশি পরিমাণ উন্নত সেবা প্রদান করা সম্ভব। জরুরি এবং প্রতিযোগিতামূলক প্রকল্প গ্রহণ করার মাধ্যমে ডাক বিভাগের টেলিটক সিম বিপণন ও অন্যান্য সেবা প্রদান, ডাক জীবন বীমা সেবা, সঞ্চয়পত্র বিপণনসহ ডাক বিভাগের আওতাভুক্ত পার্সেল সেবা, বুকপোস্ট, রেজিস্টার্ড সংবাদপত্র, মানি ওর্ডার সেবা, এপ্রেস সেবা, জিইপি ও ইএমএস সেবা, ই-পোস্ট এবং ইন্টেল পোস্ট সেবাসহ সব পরিসেবাগুলো গ্রামগঞ্জের মানুষ যাতে সহজে ভোগ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে বর্তমান নীতি-নির্ধারকরা ও বাজেট প্রণয়নকারীরা এদিকে বিশেষ নজর ও বরাদ্দ বৃদ্ধি করে সারাদেশের গ্রাম-গঞ্জের মানুষের নেটওয়ার্ক সমস্যা লাঘবের জন্য টেলিটক কোম্পানির বিভিন্ন জায়গায় অধিক পরিমাণ টাওয়ার নির্মাণ ও দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করে এই সমস্যার সমাধান করা সহজ হবে, তাতে দেশের টাকা দেশে থাকবে, উন্নত সেবা নিশ্চিত হবে। জনস্বার্থে অতীব প্রয়োজনীয় সমস্যাগুলোর সমাধানে সম্মিলিতভাবে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে সরকারের সঙ্গে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে সবাইকেই যার যার জায়গায় আরও বেশি গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

লেখক: পরিবেশকর্মী


গণতন্ত্র ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র

আপডেটেড ১৯ মে, ২০২৪ ১২:৩৫
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সমর্থন নিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর স্বাধীন ও নিরেপক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রথম ধাপে দেশের ১৫২টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ৮ মে। পাশাপাশি দ্বিতীয় ধাপে দেশের ১৬১টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। সে ক্ষেত্রে আগামী ২১ মে এসব উপজেলায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে ভোট দিয়ে পুনরায় নির্বাচিত করেছে। ফলে পরাজিত হয়েছে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ঈর্ষান্বিত স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যরা। গণতন্ত্র ও জনগণের কাছে পরাজিত হলেও গণতন্ত্র ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত থামিয়ে দেয়নি। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংঘটিত বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি কমাতে এবং নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি কুচক্রীমহলের তৎপরতা এখনো বিদ্যমান। বাংলাদেশের আসন্ন উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচনকে ঘিরে তা বানচাল এবং তাতে ভোটার উপস্থিতি কমানোর লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থেমে নেই।

উল্লেখ্য, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বানচাল করে অবৈধভাবে সরকারের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনের পূর্ব থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেছে বিএনপি ও তাদের বিদেশি মিত্ররা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি কমাতে বিএনপি কঠিন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের পথ অবলম্বন করেও তাতে সফল হতে পারেনি। বিএনপির সব ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করে সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করেছে।

নির্বাচন বানচালে সব অপপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় এখন তাদের নতুন কৌশল হচ্ছে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত যেকোনো নির্বাচনকে যে করেই হোক প্রশ্নবিদ্ধ করা। দেশি-বিদেশি সব পর্যবেক্ষক যেখানে বলেছে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। সেখানে বিএনপি-জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিগুলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ আসন্ন উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচনেও ষড়যন্ত্র করে ভোটার উপস্থিতি কমিয়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নতুন করে অপপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অংশ হিসেবে বিএনপি প্রথমে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা তাই করেছিল। তারা ভেবেছিল যে যদি তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে বাতিল হবে; কিন্তু সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপি ছাড়া অন্যান্য যত গণতান্ত্রিক দল ছিল তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত হয়েছে এবং ষড়যন্ত্রকারী বিএনপির সব ধরনের ব্যর্থতায় রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছে। তারপর থেকে তারা বাংলাদেশবিরোধী আন্তর্জাতিক চক্রের প্ররোচনায় পড়ে মিথ্যাচার করেছে। বাংলাদেশবিরোধী বিদেশি অপশক্তিগুলোর সাথে আঁতাত করে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় আসন্ন উপজেলা নির্বাচনও বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে অপপ্রচার চালিয়ে সরকার ও দেশকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে। দেশের উন্নয়নে অংশীদার না হয়ে দেশ ও সরকারের অর্জনকে বিতর্কিত ও ম্লান করার জন্য ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সদ্য অতীত ইতিহাস বলছে শুধু নির্বাচন বর্জন করেই থেমে যায়নি বিএনপি। নির্বাচনের আগে থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনী ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কম রাখার লক্ষ্যে বাস, ট্রেন, ভ্যান, ট্রাক, রিকশা এবং মোটরসাইকেলে আগুনসন্ত্রাস তথা জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে জনমনে ভীতির সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচালের অপপ্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। নির্বাচনের দিন ভোটারদের উপস্থিতি কমানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুর চালিয়েছে। নির্বাচনের আগের দিন থেকে শুরু করে একটানা তিন দিন সহিংসতা চালিয়ে গিয়েছে; কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে- বিএনপির আগুনসন্ত্রাসকে এ দেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ একদমই তোয়াক্কা করেনি। বিএনপি কর্তৃক পরিচালিত সব ধরনের আগুন ও সহিংসতাকে উপেক্ষা করে এ দেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ ভোট দিয়ে বিপুল ভোটে পুনরায় নির্বাচিত করে জনগণের সমর্থন ও শক্তিতে বিশ্বাসী বাংলাদেশের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগকে। বিএনপির ভুলে গেলে চলবেনা যে বাঙালিরা বীরের জাতি। আগুনসন্ত্রাসী করে তাদের দমিয়ে রাখা যায় না। বিএনপি চেয়েছিল জ্বালাও-পোড়াও করে বাঙালি জনগণকে ভোটের দিন ঘরের ভিতর আটকে রেখে নির্বাচন বানচাল করতে; কিন্তু তা আর হলো কই, গণতন্ত্রমনা সাহসী বাঙালি জনগণ সব ধরনের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে উপেক্ষা করে গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি হরতাল-অবরোধের নামে দেশের অচলাবস্থা সৃষ্টির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। সেই লক্ষ্যেই মূলত ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে ৬ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। ৬ জানুয়ারি সকাল ৬টা থেকে বিএনপি কর্মসূচি দিয়েছিল। এভাবে হরতাল-অবরোধের নামে দলটি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে গিয়েছে। নির্বিঘ্নে কর্মসূচি পালনের সুযোগও নিতে চাচ্ছে না দলটি। দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন কর্মসূচি জনসম্পৃক্ত করে তুলতে না পারা এবং আন্দোলনের জন্য নতুন ইস্যু সৃষ্টির ব্যর্থতায় এমন সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে দলটি। এখন দলের কর্মসূচিও আসে অজ্ঞাত স্থান থেকে। মাঠেও দেখা যায় না দলীয় কোনো নেতা-কর্মীকে। রাজনৈতিকভাবে পরাজিত বিএনপির সন্ত্রাসী নেতা-কর্মীরা অজ্ঞাত স্থান থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনায় সব ধরনের সহিংস কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনকে বানচাল এবং প্রশ্নবিদ্ধ করতে।

অতীতের মতো এখন আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরেও বিএনপির প্রস্তুতি অপরিবর্তনীয়। তারা ইতোমধ্যে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এখন থেকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বাকি সময়টুকু তারা কীভাবে অতীতের মতো আগুনসন্ত্রাস করে বাঙালি জনগণের মনে ভীতির সৃষ্টি করে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কমিয়ে নির্বাচনকে বানচাল করা যায় সেই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের নীলনকশা আঁকছে বিদেশি অপশক্তিগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে। নির্বাচনকে কেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে তারা এ ধরনের গণতন্ত্রবিরোধী অপকর্ম করে সফল হতে না পারলেও নষ্ট করে দেশীয় অনেক সম্পদ এবং কেড়ে নেয় বাংলাদেশের সাধারণ এবং খেটে-খাওয়া মানুষের তাজা প্রাণ। নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি-জামায়াতের মতো গণতন্ত্রবিরোধী অপকর্ম অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল।

বিএনপির ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অপরাজনীতি শুধু ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কমানোর ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়- তাদের ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা পর্যন্ত বিস্তৃত। আর সেই লক্ষ্যেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে বিএনপি ষড়যন্ত্র করে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ইতিহাসের জঘন্যতম এবং ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা ঘটিয়েছিল। ১৯ বছরের আগের এ দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্যতম দিন। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নেতৃত্বশূন্য করার জঘন্য অপচেষ্টার দিন। দেশের মানুষ আজও কেঁপে ওঠেন শনিবার ওইদিনটির কথা ভেবে। কতশত মানুষ মনের অজান্তে কেঁদে ফেলেন। স্বজন হারানোরা খুঁজে ফেরেন প্রিয় মানুষের স্মৃতি। সেদিন যদি ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত ট্রাকে বিস্ফোরিত হতো- আজ হয়তো বঙ্গবন্ধুকন্যা বেঁচে থাকতেন না। মারা পড়তেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারাও। মূলত আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই এমন পৈশাচিক হামলা চালায় ঘাতকরা। এ ছাড়া ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার জনসমর্থন নিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসার পরপরই বিএনপি ষড়যন্ত্র করে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ ঘটায়, যেন আওয়ামী লীগের জয়কে বানচাল করে দিয়ে তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যায়। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় প্রাণ হারায় হাজার হাজার বাঙালি শ্রেষ্ঠ সন্তান বিডিআরের বিভিন্ন উচ্চ পদের কর্মকর্তারা।

সুতরাং, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মূলত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তনির্ভর একটি রাজনৈতিক দল। তাদের রাজনৈতিক আদর্শের মূলে রয়েছে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। তাদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বিস্তার শুধু নির্বাচন ঘিরেই নয় বরং আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা মানুষও তার আওতাভুক্ত। আওয়ামী লীগ যেখানে জনগণের সমর্থন ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিএনপি সেখানে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ সেখানে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে সংঘটিত করতে নির্বাচন কমিশনকে সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়ে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করতে যাচ্ছে। সেখানে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিএনপি ভোটারদের কম উপস্থিতি নিশ্চিত করতে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে ও চক্রান্তে লিপ্ত আছে। স্বাধীন ও নিরেপক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে সংঘটিত বিভিন্ন গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক বিজয় বিএনপির রাজনৈতিক পরাজয়কে নিশ্চিত করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্রই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বিজয়ের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারবে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ সব ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে।

লেখক: উপাচার্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়


শিশুশ্রম রোধে আমাদের করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সোমা মুৎসুদ্দী

শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজ যারা ছোট শিশু তারাই আগামী দিনের দেশ পরিচালনায় গুরুদায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু নানা কারণে আমাদের দেশের শিশুরা আজ উপযুক্ত পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত ও অবহেলিত। জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা বাধ্য হচ্ছে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে এবং তাদের বাধ্য করা হচ্ছে হাড়ভাঙা খাটুনিতে। তাই শ্রমজীবী শিশুদের নিয়ে জাতিসংঘ ও নানা সংস্থা আছে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে। নানা কারণে শিশুশ্রম সমাজ ও দেশে শিকড় গেড়ে বসেছে। এখনো আমাদের দেশে দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ। এরা অভাব-অনটন ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে ও জ্বালায় জর্জরিত হয়ে নিজেদের সন্তানদের শিশুশ্রমে বাধ্য করানো হচ্ছে। এ ছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম-আর্থিক বণ্টনের প্রতিক্রিয়ার ফলে শিশু শ্রমিকের সমস্যা জটিল আকার ধারণ করছে। আমাদের দেশে পিতৃমাতৃহীন শিশুরাই অধিক হারে শিশুশ্রমে জড়িত। বেঁচে থাকার জন্য নিরুপায় হয়ে তারা এপথে পা বাড়ায়। বিদ্যালয়ের প্রতি অনীহাও শিশুশ্রমের অন্যতম একটি কারণ। আন্তর্জাতিক, শ্রমসংস্থা এবং ইউনিসেফ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় বিভাগীয় শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০১, পুরাতন জেলা শহরে ২০১, নতুন জেলা শহরে ১৮৭, থানা সদরে ১৩৩, পার্বত্য এলাকাগুলোতে ২৩ এবং পল্লি এলাকায় ৯৪ ধরনের কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। এসব কাজের মধ্যে আছে- কুলি, হকার, রিকশা শ্রমিক, ফুল-বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, ইটপাথর ভাঙা, হোটেল শ্রমিক, বুনন কর্মী, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক, বেডিং স্টোরের শ্রমিক ও গৃহকর্মীর পেশা। তা ছাড়া ‘ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম’ শীর্ষক আরেক সমীক্ষায় দেখা যায়, কিছু বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও শিশুরা নিয়োজিত রয়েছে। যেমন- ইলেকট্রিশিয়ান, রাসায়নিকদ্রব্য তৈরির কারখানায় কাজ, মাদকদ্রব্য বিক্রি ও বহন। সমুদ্রবন্দর এলাকায় শিশুদের জোর করে মাফিয়া চক্রে যুক্ত করানো। এই উদ্দেশে অনেক শিশুকে অপহরণ করে পাশের দেশসহ নানা দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। চুরি, ছিনতাই, ভিক্ষাবৃত্তিসহ নানা কাজে এদের লাগিয়ে এক শ্রেণির দেশ ও সমাজবিরোধী লোক প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। তা ছাড়া পোশাকশিল্প কারখানাতেও হাড়ভাঙা খাটুনিতে শিশুদের নিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া শহরবাসী ভদ্রলোকদের বাসার কাজে শিশুরা প্রধান শ্রমিক হিসেবে কাজ পায়। শিশুদের শ্রমবৃত্তিতে নিয়োগ প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। বর্তমানে সভ্য দেশগুলোতে মানুষ যেখানে বিবেকশক্তি ও স্বাধীনতাবোধের বড়াই করে সেখানেও রয়েছে শিশুশ্রমের মতো ভয়ংকর পেশা। মানবতা আজ বড়ই বিপন্ন। বিশ্বের সব শিশুই, শিশু শ্রমিকরা মালিকের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়। অধিকার বঞ্চিত শিশুরা, তাদের শ্রমকর্তা কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই নির্যাতিত হয়ে থাকে। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও তারা দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না। অদক্ষ শ্রমিক বলে তাদের নেই নির্দিষ্ট মজুরি, অথচ আছে কথায়, কথায় জুলুম আর নিপীড়ন। সামান্যতম অমনোযোগিতার অভিযোগ এনে, গায়ে লাথি ও বেতের বারি সহ্য করতে হয় তাদের। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের শহরাঞ্চলে বড়লোকদের ঘরে শিশু নির্যাতনের হার বেড়ে গেছে। এদের ঘরে কাজের মেয়ে হিসেবে যারা কাজ করে তাদের সামান্য অপরাধের জন্য বাড়ির গৃহিণী অমানবিক শাস্তি দিয়ে থাকে। গায়ে আগুনের ছেঁকা দেওয়াসহ, খেতে না দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্রিকার পাতায় এসব নৃশংস ঘটনা খবরের কাগজে প্রকাশ পাচ্ছে। এ ছাড়া কল-কারখানায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন শিশু শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। শিশুশ্রম একটি মানবতাবিরোধী ও জঘন্য কাজ। শুধু বাংলাদেশেই নয় যেকোনো দেশের জন্য এর পরিণতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কারণ যে শিশুরা জাতির কর্ণধার ও ভবিষ্যৎ, শিশুশ্রমের কারণে তারা হয়ে উঠছে অযোগ্য ও অকর্মণ্য। শিক্ষা ও সুন্দর পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা হয়ে যাচ্ছে সামাজিকভাবে পঙ্গু। অতিরিক্ত শ্রমদানের ফলে শিশুদের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, তারা নানা অপুষ্টিতে রোগে ভোগে। পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘাটতি পূরণ হয় না ও জীবনীশক্তি ক্ষয় পেতে থাকে। তাদের ভাঙা স্বাস্থ্য আর উদ্ধার হয় না, ফলে শিশুরা অভিশপ্ত জীবন নিয়ে সমাজে বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশ শিশু ও নারী নির্যাতন আইন বলবৎ থাকলেও এর মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি। কেবল আইন দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য চাই জনসচেতনতা। উপযুক্ত শিক্ষার প্রসার ও দারিদ্র্য বিমোচন ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এর জন্য বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, যারা শিশু শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে, বিভিন্ন বিদেশি এনজিও ও সরকারকে নিতে হবে শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব। এক কথায় যেভাবেই হোক, আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিশুশ্রম রোধ করতে হবে। না হয় জাতির ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকার ও অভিশাপগ্রস্ত। তবে আশার কথা হলো এই কাজের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে ইতোমধ্যে অনেক দরিদ্র পিতামাতাই তাদের সন্তানদের কাজে দেওয়ার পরিবর্তে বিদ্যালয়ে পাঠাতে শুরু করেছে। মানবতার বিকাশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শিশুশ্রম রোধে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বস্তি এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে বিদ্যালয় খুলে তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্ব শিশু দিবসে শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও শিশুশ্রম বন্ধে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে ও শিশুশ্রমের প্রতি নিন্দা জানাতে হবে। এই সমস্যা সমাধানে প্রতিটি রাষ্ট্রের সরকার সচেতন হলেও কিছু মানুষের অসহযোগিতার কারণে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না ও সরকারি নানা উদ্যোগ অনেক সময় মুখ থুবড়ে পড়ছে। তবুও চাই আমরা সরকারের পাশাপাশি যে যার অবস্থান থেকে শিশুশ্রমকে না বলব ও শিশুশ্রম বন্ধে কাজ করে যাব জয় হোক মানবতার।

লেখক: বাচিকশিল্পী ও কবি

বিষয়:

এসএসসির ফল ও শিক্ষার মানোন্নয়ন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে, চারদিকে আনন্দের বন্যা বয়ে চলেছে, ফল প্রকাশের অনুভূতি প্রকাশকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ছেলের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কেন কমে যাচ্ছে, একটু ভেবে দেখা দরকার। এরা কি স্কুলে যাচ্ছে না? পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কেন কমে গেল? আমার মনে হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তা ভালোভাবে দেখা দরকার।’

আমরা সাধারণ জনগণ তার বক্তব্যকে সাধুবাদ ও অভিনন্দন জানিয়ে সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে আরও কিছু বিষয় নিয়ে দুটি কথা বলতে চাই।

ফল প্রকাশের আনন্দঘন মুহূর্তের জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করি, এই অপেক্ষার অবসান ঘটে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্যদিয়ে।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা বিনা মূল্যে পাঠ্যবই দিচ্ছি। করোনার সময়ও সঠিক সময়ে পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি এবং প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, ইউরোপ-আমেরিকায়ও একই অবস্থা। তার মধ্যেও আমরা বিনা মূল্যে শিক্ষার উপকরণ ও বই বিতরণ করেছি। এখানে আমরা কোনো কার্পণ্য করিনি। যেটা প্রয়োজন সেটা আমরা দিতে পেরেছি।’ ফলাফল প্রকাশের দিন সংবাদ সম্মেলনে পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমে যাওয়াকে স্বাভাবিক হিসেবেই তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি। করোনাভাইরাস মহামারির জন্য গত বছর সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে পরীক্ষা হলেও এবার হয়েছে পূর্ণ নম্বরে। এতে পাসের হার ও জিপিএ-৫ কিছুটা কমেছে বলে মনে করেন শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা।

হতাশাজনক খবর হলো এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি। কেন এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাস করতে পারেনি শিক্ষা-সংশ্লিষ্টদের সেই কারণ অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই শতভাগ শিক্ষার্থী পাস না করা কাম্য নয়। আরেকটি বিষয় লক্ষ রাখা দরকার, পাসের হার বাড়া-কমায় নজর না দিয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।

চলতি বছর এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা করোনার পর দুই বছর সময় পেয়েছিল, এই দুই বছর তারা কাজে লাগিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে। এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন ।এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন, এদের মধ্যে পাস করেছে ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৩ জন। গড় পাসের হার ৮৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থী। তবে গত বছরের চেয়ে এবার পাসের হার কিছুটা বেড়েছে ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও গত বছরের চেয়ে কমেছে। গত বছর সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থী। গত বছর এ হার ছিল ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

শুরু হয়ে যাবে কলেজে ভর্তির দৌড়ঝাপ, অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি।

এ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবারের এসএসসি ও সমমানের ফলে গণিত ও ইংরেজিতে তুলনামূলক কম পাস করেছে। এই দুই বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের দুর্বলতা রয়েই গেছে, করোনা মহামারিতে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে মৌলিক জ্ঞানের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে, কারণ শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা বছরের পুরোটা সময় ধরে অনলাইনে ক্লাস করার মাধ্যমে পড়াশুনা চালিয়েছে। করোনার সময় পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা না দেওয়ার প্রবণতা, না লেখার চর্চা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাডেমিক দুর্বলতা তৈরি করেছে, কিছুটা ভীতি কাজ করেছে। পরীক্ষায় ভালো ফল করার অনুষঙ্গ হচ্ছে লেখা, আগামীতে যারা ভালো পড়াশুনা করে খাতায় লিখে ভালো ফল করতে আগ্রহী তাদের সবারই উচিত বেশি বেশি করে লেখা।

দেশে শিক্ষার মান কতটুকু বাড়ল বা কমল তা বোঝা যায় পাসের হারের দিকে ভালোভাবে তাকালে, তবে পাসের হার যে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না তার প্রমাণ এইচএসসি পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সফলতার দিকে তাকালে প্রতীয়মান হয়, কারণ প্রতিবছর ৮০-৮৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী এসএসসি ও এইচএসসি পাস করার পরও ১০-১২ শতাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে থাকে। বাকিদের একটি বিশাল অংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো এবং বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন শিক্ষায় অংশ নিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।

প্রতিবছর এই শিক্ষার্থীদের একটি বিশাল অংশ আর পড়াশুনা চালাতে পারে না।

খুঁজে বের করতে হবে এই ঝরে পড়ার পিছনের কারণ, অভিভাবকদের সামর্থ্যের ব্যর্থতার পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের স্বল্পতা, উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ, খেলার মাঠ, শরীর চর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রের অপর্যাপ্ততা, মেধা বিকাশ ও মননশীল প্রতিভা অন্বেষণের অভাব, সচেতন শিক্ষকের স্বল্পতা ও সামাজিক অবস্থান ও তলিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সুধী সমাজের বোদ্ধারা। সবাই গুণগত শিক্ষার অনুসন্ধান করে থাকেন। নীতি ও নৈতিকতা ও আদর্শবান হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন সর্বত্র মানোন্নয়ন।

গুণগত শিক্ষা বা মানসম্মত শিক্ষা বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। এটি উন্নত বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল বিশ্বেও শিক্ষাবিদদের মনোযোগ আকর্ষণ করে চলেছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো টেকসই উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে গুণগত শিক্ষার ধারণা ও গুরুত্ব বিশেষভাবে তুলে ধরেছে।

শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর এই যোগ্যতা অর্জনের মান অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সর্বত্রই এর অবস্থা একই রকম। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়লেও মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে বাংলাদেশ ভীষণভাবে পিছিয়ে রয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দেশে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। বস্তুতপক্ষে সব স্তরের শিক্ষাতেই তাত্ত্বিক ধারা প্রাধান্য বিস্তার করছে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান উন্নয়ন দরকার। আরও অধিক পরিমাণে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও ল্যাব ব্যবহারের সুবিধা, শ্রেণিকক্ষে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকার নিরাপত্তা জোরদার করার প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি।

গুণগত শিক্ষার অনেক অপরিহার্য পূর্ব শর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে অধিক বিনিয়োগ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। এ কথাও অনস্বীকার্য, বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে খরচ করা হয় না, যা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। দেশে শিক্ষা খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ চাহিদার তুলনায় একেবারেই কম। শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ।

গুণগত শিক্ষা মূল্যায়নের সার্বজনীন কিছু নির্দেশক রয়েছে। এগুলোর ভিত্তিতে গুগণত শিক্ষা অর্জনে ও টেকসইকরণে কিছু সাধারণ পূর্বশর্ত পূরণ প্রয়োজন। এগুলো হচ্ছে- বৈষম্যহীন সমন্বিত শিক্ষা, আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাক্রম, মানসম্মত ও পেশার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ শিক্ষক সমাজ, প্রয়োজনীয় সুযোগ দিয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতায় এনে ধরে রাখা, সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, দুর্নীতি, মাদক নির্মূল ও অপচয়রোধ এবং শিক্ষায় অধিক বিনিয়োগ ইদানিং আরও একটি বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে, তা হচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহার বা অতিরিক্ত ডিভাইস-নির্ভরতা এবং মোবাইলের অপব্যবহার, তবে শিক্ষার মানোন্নয়নে কতগুলো বিশেষ পূর্বশর্ত বিবেচনা অপরিহার্য। শর্তগুলো হচ্ছে- শিক্ষক, প্রশিক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, তত্ত্বাবধান, নেতৃত্ব, শিক্ষাক্রম, শিক্ষণসামগ্রী, মূল্য যাচাই, শিক্ষানীতি ও পরিকল্পনা, বহিস্থ প্রশাসন, গবেষণা, পরিবেশ উন্নয়নে দ্রুত অর্থায়ন ইত্যাদি।

এসব পূর্বশর্ত পূরণের ওপর নির্ভর করে গুণগত শিক্ষার মাত্রা বৃদ্ধি সরকারের এই আসন্ন বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে অনুদান ও অর্থায়ন বৃদ্ধি, সেই সঙ্গে সঠিক মনিটরিং এজেন্ট দ্বারা সুষ্ঠু ও জবাবদিহিমূলক স্বচ্ছ পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

বিষয়:

ঘূর্ণিঝড় আইলার বিরুদ্ধে রিট

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

মে এবং নভেম্বর এ দুটি মাস বাংলাদেশের উপকূলে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের হানা দেওয়ার মৌসুম। ১৯৬০ সালের ১৪ মে, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর, ২০০৭ সালের ১৬ নভেম্বর সিডর, ২০০৯ সালের ১৫ মে আইলার আক্রমণ সবই এখনো দারুণ দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। সাম্প্রতিককালের সালতামামীতে সিডর ও আইলা বহুল উচ্চারিত। ২০০৯-এর ১৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার আক্রমণ নিয়ে সুন্দরবনে বসবাসকারী প্রাণী বৈচিত্র্যের পক্ষ থেকে যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে রসরচনায় তা তুলে ধরা হলো-

ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার বিরুদ্ধে রিট করার সিদ্ধান্ত নেয় সুন্দরবনের বাবাহকু (বাংলাদেশ বাঘ হরিণ ও কুমির) ফেডারেশনের আইন ও নিবর্তন নিরোধসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। আজ সুন্দরবনের কচিখালিতে বাবাহকুর কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার মন্ত্রকের মুখপত্র মলিশা মঞ্জিলা সাংবাদিকদের এ কথা জানান। মলিশার সংবাদ সম্মেলনের সূত্র ধরে বার্তাসংস্থা উবিসস (উড়ো বিভ্রান্তকর সংশয় সন্দেহ) প্রেরিত বাতাস বার্তায় জানা যায় গত বৃহস্পতিবার বাবাহকুর উচ্চ পরিষদ বনে-জঙ্গলে বিরোধীদলীয় সদস্যদের আনা এক মোশন প্রস্তাবের ওপর তীব্র ও প্রখর আলোচনার একপর্যায়ে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় সুন্দরবনের প্রাণী ও প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিতে এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গৃহীত না হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশে ফেটে পড়েন পক্ষের বিপক্ষের সবাই। সবার সম্মিলিত দাবির মুখে খোদ সিডর ও আইলার বিরুদ্ধেই সালিশী ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর সুবিদখালীর বর্ষীয়ান সদস্য, পাখ-পাখালি গোত্রের নেতা শঙ্খশালিয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি কণ্ঠভোটে গৃহীত হওয়ার পর উচ্চ পরিষদ অধ্যক্ষ শিয়ালেন্দু মামাইয়া তার রুলিংয়ে বলেন- সালিশ বিভাগ নিজের উদ্যোগে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে না গেলে বাবাহকুর পক্ষে কোনো কমিটি রিট পিটিশনটি দাখিল করতে পারে। ফেডারেশনের পরিচালনায় থাকায় বাবাহকুর নিজে এ জাতীয় মামলা দায়েরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেননা এর সঙ্গে ঘরে-বাইরের সম্পর্ক সংস্থাপনসংক্রান্ত স্পর্শকাতর বিষয়াদির যোগসূত্র রয়েছে।

সিডর ও আইলা এসেছে বাইরের থেকে, তাদের অভ্যন্তরীণ আইনের আওতায় সালিশে সোপর্দ করা যুক্তিযুক্ত হবে কি না এ ব্যাপারে সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করেন বাবাহকুর আইন ও সালিশ উপদেষ্টা বানরিয়া বাচাবন। অবশ্য বানরিয়া বাচাবনের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বিরোধী পক্ষের বিচার-সালিশ বিশেষজ্ঞ ময়নামন্দা। ময়নামন্দার মতে যেখান থেকেই আসুক না কেন বাতাস যেখানে যার ঘর ভেঙেছে সেখানেই তার হতে হবে বিচার। তিনি মেকং বনে বাঘ সম্প্রদায়ের সুখ্যাতির সর্বনাশ সাধনে দূর দ্বীপবাসী তক্ষক ও ভক্ষকদের বিরুদ্ধে দেওয়া একটি ঐতিহাসিক রায়ের কথা উল্লেখ করেন। উচ্চ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবটি আজ সকালে বাবাহকু প্রেসিডিয়ামের প্রেসিডেন্ট সুন্দরমিয়ার সানুগ্রহ সম্মতি লাভ করলে রিট দায়েরের জন্য বাবাহকুর আইন ও নিবর্তন নিরোধ কমিটিকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। আগামী কাল সালিশালয় বন্ধ থাকায় পরশু এটি দাখিল হতে পারে বলে মঞ্জিলা সংবাদ ব্রিফিংয়ে আভাস দেন।

এদিকে দুবলারচর থেকে সলিশালয় সূত্রে সাংবাদিকরা জানিয়েছেন সিডর ও আইলার বিরুদ্ধে সালিশালয় থেকে স্বউদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রাজ্ঞ পণ্ডিত প্রবরেরা। তবে তাদের ধারণা সব ব্যাপারে স্বউদ্যোগে অভিযোগ দায়েরে সংশ্লিষ্ট হতে গেলে সালিশে মনোযোগের সময় কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে এবং সালিশজীবীরাও এর মধ্যে তাদের মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করতে পারেন। পরশু সালিশজীবীদের পলিটব্যুরোতে এতদবিষয়ক এক আলোচনায় এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রাথমিক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে সংবাদসংস্থা বৈরী বাতাস ডট কম পরিবেশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়-

উপকূলীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রতিপক্ষ আইলার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের বিবরণীটি সিভিনিউজ ডট ৪৮ মিডিয়ার জন্য উন্মুক্ত করেছে। তাতে বলা হয়েছে ২০০৯ সালের মে মাসে আইলা ঘাপটি মেরে থাকা আপসহীন মনোভাব নিয়ে অতর্কিত আক্রমণে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় অবর্ণনীয় দুর্যোগ এবং দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগের কারণ সৃষ্টি করে। আইলা দুদেশের সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল কালিন্দীর মোহনা দিয়ে উঠে এসে ব্যাপক জলোচ্ছ্বাস ঘটায়, ফলে উভয় পাড়ের সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয় আর সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের নিম্নাঞ্চল হঠাৎ পাবনের পানিতে তলিয়ে যায়। পরে সেখানে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি হয় জনবসতিতে, কৃষিক্ষেতে, মৎস্য চাষে। মুহূর্তের মধ্যে সহায়-সম্বল ও গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। সুন্দরবনের মধ্যে সৃষ্ট বীভৎসকর পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বাবাহকুর তথ্য বিভাগের প্রধান হরিণা হাপানের সে সময়কার বিবৃতিটি এক্সিবিট আকারে আরজির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। হরিণা আইলায় সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের জন্য তাৎক্ষণিক বড় ক্ষতি সম্পর্কে সে সময় বলেছিলেন, এবারের বানে [আইলায়] আমরা বেশি সমস্যায় পড়েছি খাবার পানি নিয়ে। বাদার মধ্যে যে কয়টা পুকুর আছে আমরা দলবেঁধে সেখানকার পানি খেতাম। নোনা পানি আমরা তেমন খেতে পারি না। এসব পুকুরে আমাদের জন্য মিষ্টি পানির ব্যবস্থা ছিল কিন্তু এবারের বানে এসব পুকুর তলিয়ে গিয়ে নোনাপানিতে ভরে গেছে। এখনকার ছিটেফোঁটা বৃষ্টির পানি এই নোনা পানিকে মিষ্টি করতে পারছে না। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই। দুবলার চরে অনেক বন্দুকওয়ালা সেই লোকটা বড় পাড় বাঁধা পুকুর কেটে কি উপকারটা না করেছিলেন এবার সে পুকুর ডোবেনি। ওখানে আমাদের যারা আছে তারা সে পানি পাচ্ছে। আমাদের এখান থেকে তা অনেক দূর। ওরকম পাড়বাঁধা পুকুর কাটলে খুব কাজে লাগত। আর বর্তমানের এসব পুকুরের নোনা পানি ছেচে বের করে দিয়ে বৃষ্টির মিষ্টি পানি ধরার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হতো।’

আইলায় সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হরিণা হাপান তখন জানিয়েছিলেন, আমরা প্রকৃতির কোলেই আছি। এজাতীয় বান আমরা প্রায়ই মোকাবিলা করি- আমাদের নিজস্ব একটা নিয়ন্ত্রণ বা আত্মরক্ষার ব্যবস্থা আছে। তবে এবারের বানটা এসেছে হঠাৎ করে, আমরা বুঝে সারতে পারিনি। পানি এসেছে আচমকা ও অনেক পরিমাণে ফলে অনেকে সময়মতো উঁচু জায়গায় যাওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় আমাদের অনেকেই মারা পড়েছেন। জোয়ারের সময় জলোচ্ছ্বাস হওয়ায় এমনটি হয়েছে, সচরাচর ভাটার সময় বান আসে।’

আইলার বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ সে পূর্ণিমার ভরা জোয়ারের সময় আঘাত হানে এর ফলে পানির পরিমাণ ও স্রোতের তোড় বেশি হওয়ায় বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে সবকিছু ডুবে যায় হঠাৎ করেই।

আর্জিতে স্থানীয় জনগণের জীবনে নেমে আসা দুর্গতির বর্ণনায় বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আইলায় পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, শমসেরনগর আর বাংলাদেশের সাতক্ষীরার শ্যামনগর আশাশুনি আর খুলনার দাকোপ ও কয়রার বেশ কয়েকটা ইউনিয়নের মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে আজ দারুণ অসহায় অবস্থায় । শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের হরিচরণ মণ্ডল মোটামুটি অবস্থাপন্ন-তার দুদুটো দশ একরি মাছের ঘের, পঞ্চাশ বিঘে ভালো ধানী জমি, গোলাভরা ধান আর আটচালা ঘর উঠোন দহলিজ সবই এখন থৈ থৈ পানির নিচে। মেয়েটা শ্যামনগর কলেজে পড়ে, এবার আই এ পরীক্ষা দেবে, টুঙ্গীপুর শ্বশুরবাড়িতে পরিবার পাঠিয়ে দিয়ে সে আর তার বড় ছেলে নিবারণ বেড়িবাঁধের ওপর পলিথিনের চোঙায় থাকে। এ যেন সকালবেলার আমির ফকির সন্ধ্যাবেলা। তিনশ বিঘে জমির মালিক কয়রার নাংলার নাসের সরদার সেদিন লাইনে দাঁড়িয়ে রিলিফ নিতে গিয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল। টিভির বাক্সে সেই ছবি দেখে জায়গীরমহলে বাড়ি তার এক আত্মীয় ঢাকা থেকে ফোন করে তাকে আর কি সান্ত্বনা দেবে? মাসের পর মাস গেল পানি তো কমেইনি তাদের বুকের ভেতর এই পানি কালা পানির স্রোত হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তাদের আশাভরসা আর সব স্বপ্নকে। আজকাল সাগরে, নদীতে এমনিতে প্রায়ই জোয়ার বড় বাড়ন্ত। রাজধানী ঢাকায় বসে বিশেষজ্ঞরা বলা বলি করছে এই পানি নাকি সহজে সরবে না, সমুদ্রের তলা উঁচু হয়ে গেছে পানি টানবে কীভাবে? আইলার আক্রমণের প্রতি ইঙ্গিত করে আর্জিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নিচু এলাকাগুলো এ ধরনের আক্রমণে স্থায়ীভাবে তলিয়ে যেতে পারে, সুন্দরবন ডুবে যেতে পারে, মালদ্বীপের মতো দেশও হয়তো তলিয়ে গেলে আর জাগবে না। সমুদ্রের তলা উঁচু হচ্ছে কেন, কার কারসাজি কিংবা দোষে? যার জন্য হোক কিংবা যেভাবে হোক দেশের উপকূল অঞ্চলের জেলাগুলোর মানুষ আর সুন্দরবনের তাবৎ প্রাণিসম্পদ গাছ-গাছালি তার ভোগান্তির শিকার, কত অসহায় আজ তারা। আইলার সময় বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে কিংবা ছাপিয়ে নোনা পানি সেই যে ঢুকল বর্গীর মতো, মাছের ঘের ধানচালের খামার, বনের সব প্রাণী ও গরু-ছাগলের খাবার সবই তো পয়মাল। আইলার বিরুদ্ধে মানবতা, প্রাণিসম্পদ , প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগ এনে আর যাতে এ ধরনের বিপর্যয় না আসে তার প্রতিবিধান বা প্রতিরোধাত্মক নির্দেশনা কামনা করা হয়েছে।

লেখক: উপকূলীয় অর্থনীতির গবেষক ও বিশ্লেষক, সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


১৭ মে: বাংলাদেশের ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা দিন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোঃ শাহিনুর রহমান

বাংলাদেশের চলমান ইতিহাসে ১৯৮১’র ১৭ মে বঙ্গকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনাটি যে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা যত দিন যাচ্ছে ততই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতায় আসা প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক স্বৈরশাসকেরা স্বাধীন বাংলাদেশকে পুনরায় যেভাবে উল্টোরথে চড়িয়ে অধঃপাতে নিয়ে যাচ্ছিল, বঙ্গবন্ধুকন্যা সেদিন ফিরে না এলে আর কোনোদিন নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যের সোজা পথে ফিরে আসা বাংলাদেশের পক্ষে আদৌ সম্ভব হতো কি না সে-ব্যাপারে গভীর সন্দেহের অবকাশ আছে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর সামান্য আলোকপাত করা প্রয়োজন মনে করছি। কারণ এ ইতিহাস পুরোনো প্রজন্মের অনেকের জানা থাকলেও এ ব্যাপারে নতুন প্রজন্মের কোনো ধারণা নেই বললেই চলে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন তার ছোটবোন শেখ রেহানা এবং দুই সন্তানসহ স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন, যার ফলে তারা প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বাকি সদস্যরা এবং সম্প্রসারিত পরিবারের অনেক সদস্যও সেদিন শিকার হন শুধু বাংলার নয়, বিশ্বের এক নৃশংসতম রাজনৈতিক গণহত্যাকাণ্ডের।

এ হত্যাকাণ্ডের পর জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী এম.এ. ওয়াজেদ মিয়া ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং এ আবেদন অনুমোদিত হয় ২৪ আগস্ট। জার্মানির ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা জননেত্রী শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া, তাদের দুই শিশুসন্তান সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শেখ রেহানাকে ১৯৭৫-এর ২৫ আগস্ট সকালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে করে দিল্লি পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।

দিল্লিতে পৌঁছানোর কয়েকদিন পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে গিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার স্বামী বাংলাদেশের ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১—টানা প্রায় ছয় বছর দিল্লিতে তাদের নির্বাসিত জীবন কাটানোর সময় আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিভিন্ন সময়ে দিল্লিতে যান তাদের খোঁজখবর নিতে এবং দেশ ও দলের এক গভীরতম সঙ্কটলগ্নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিতে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে রাজি করানোর অভিপ্রায় নিয়ে। এদের মধ্যে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, জিল্লুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, তৎকালীন যুবনেতা আমির হোসেন আমু প্রমুখ।

এর পর ১৯৮১’র ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে জননেত্রী শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সম্মেলনের এক সপ্তাহ পরে ২৪ ফেব্রুয়ারি আবদুল মালেক উকিল, জিল্লুর রহমান, আবদুল মান্নান, আবদুস সামাদ, এম. কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, গোলাম আকবর চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আইভি রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ ঢাকা থেকে দিল্লিতে যান, এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে পর পর কয়েকটি বৈঠকে বসে নেত্রীকে দেশে ফিরতে রাজি করান এবং ফেরার পরবর্তী কর্মপন্থার খসড়া পরিকল্পনা করেন।

দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথ থেকে জোর করে বিচ্যুত করা জাতিকে আবার ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে বঙ্গবন্ধু-তনয়ার প্রয়োজনের গভীরতা তারা সেদিন নেত্রীকে বোঝাতে পেরেছিলেন। দেশ, জাতি আর দলের সেই ভয়াবহ সঙ্কটকালে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে জননেত্রী শেখ হাসিনা অবশেষে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দেশে ফিরতে সম্মত হন।

দিল্লিতে দুই শিশুসন্তান জয় আর পুতুলকে ছোটবোন শেখ রেহানার কাছে রেখে ১৯৮১’র ১৭ মে দেশে ফেরেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক আবহের মতো সেদিনকার আবহাওয়াও ছিল তীব্র ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। ঘণ্টায় ৬৫ মাইল বেগে বইছিল ঝোড়ো বাতাস, সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়বাদল অগ্রাহ্য করে সেদিন লক্ষ লক্ষ লোক জমা হয়েছিল তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে স্বাগত জানানোর জন্যে।

সেদিন বিকেল ৪টায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে জননেত্রী শেখ হাসিনা পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে চরাচর মুখরিত হয়ে ওঠে। লক্ষ লক্ষ মানুষের কণ্ঠে সমস্বরে ঘোষিত হয়-- ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’; ‘পিতৃহত্যার বদলা নিতে, লক্ষ ভাই বেঁচে আছে’; ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’...।

দেশের মাটিতে পা দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা সেদিন জনতার উদ্দেশ্যে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।... সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’

তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসি নি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’

দেশে ফিরে যেসব অঙ্গীকার নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেন তার মধ্যে ছিল: বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার স্বৈরতন্ত্রের চিরঅবসান ঘটিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠা। এসব অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কখনো পিছু হটেননি বঙ্গবন্ধুকন্যা।

দেশে ফেরার পর শুরু হয় সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জননেত্রী শেখ হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম, যা চলে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে। জেল-জুলম, অত্যাচার কোনোকিছুই তাকে তার পথ থেকে একতিলও টলাতে পারে নি। বাংলার মানুষের হৃত অধিকার পুনরুদ্ধার করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বার বার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। বাংলার জনগণ তার বৈপ্লবিক ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ভূষিত করেছে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ অভিধায়।

দেশে ফেরার পর জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার অপূর্ণ স্বপ্নকে সম্পূর্ণতা দেয়ার পথে সকল বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে পুরোপুরি প্রস্তুত বলে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হতে হয়।’ মহান নেত্রী তার জীবন দিয়ে তার এ উক্তিকে সত্য প্রমাণিত করেছেন। বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালে ঘাতকেরা তার ওপর একের পর এক প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে। বার বার তিনি সাক্ষাৎ মৃত্যুর মখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করেন নি। বঙ্গকন্যার অদম্য সাহস আমাদেরকে প্রাণিত ও প্রণোদিত করে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের সংগ্রামে আরো সাহসী হয়ে ওঠায়। মৃত্যুঞ্জয়ী জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ সত্যিই এক মহৎ প্রেরণার নাম।

১৯৮১ থেকে ২০২৪-- সুদীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর জননেত্রী শেখ হাসিনার সেদিনকার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আর অঙ্গীকারের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য ক্রমপরিস্ফূট হয়ে উঠছে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা যদি সেদিন ফিরে না আসতেন, কবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী, উগ্র সাম্প্রদায়িক, সামরিক স্বৈরাচারী অপশাসনের আগ্রাসন থেকে জাতি কোনোদিন মুক্তি পেতো কিনা সন্দেহ। জাতির পিতা আর তার স্বপ্নের হন্তারকেরা জাতিকে যে-উল্টোরথে চড়িয়ে এক কৃষ্ণবিবরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, জননেত্রী শেখ হাসিনাই তার চুয়াল্লিশ বছরব্যাপী সংগ্রাম আর সরকার পরিছালিনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বিনিময়ে সেই উল্টোরথকে উন্নয়ন ও প্রগতির আলোকাভিমুখী সোজা পথে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন।

১৯৮১’র ১৭ মে দেশে ফিরে জননেত্রী শেখ হাসিনা যেসব কথা বলেছিলেন, যেসব অঙ্গীকার করেছিলেন, সেগুলোকে সত্যে পরিণত করেছেন কঠোর নিষ্ঠা আর একাগ্র প্রচেষ্টায়। পঁচাত্তরপরবর্তী প্রবল প্রতিকূল সময়ে বিরুদ্ধস্রোতে কুটোর মতো ভাসমান ও ভগ্নপ্রায় আওয়ামী লীগ তার সময়োপযোগী বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই আজ একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে অনেক বেশি সুসংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পেরেছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আর ২০০৯ থেকে চলতি ২০২৪ পর্যন্ত মোট কুড়ি বছর প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব সর্বোচ্চ যোগ্যতার সঙ্গে পালন করে চলেছেন। ২০২৩-এ জনগণের নিরঙ্কুশ রায় নিয়ে টানা চতুর্থবার এবং সব মিলিয়ে পঞ্চমবার ক্ষমতায় আসার সূত্রে এ দফায় তাকে আমরা আরও চার বছর সরকার-প্রধান হিসেবে পাচ্ছি, এটা জাতির জন্যে এক বিরাট পাওয়া। আগামীতে আবারো আমরা তাকে নির্বাচিত করবো এবং আজীবন তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, এটাই আমাদের আশা।

এ ছাড়া ১১ বছরেরও বেশি সময় তিনি জাতীয় সংসদে একজন সংগ্রামী বিরোধী দলীয় নেতার ভূমিকাও পালন করেছেন। বঙ্গকন্যার হাত ধরে তার দল ও দেশ আজ প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক স্বৈরাচারী অপশাসনের দুঃসহ স্মৃতিকে পেছনে ফেলে পৌঁছে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। জননেত্রী শেখ হাসিনার সেদিনকার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে বিশ্বসভায় সমুন্নত শিরে দাঁড়াতে শিখিয়েছে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার গত ৪৪ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অর্জিত মাইল ফলকগুলো হলো: সামরিক স্বৈরশাসনের অবসান, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এবং জাতির ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশকে তিনিই আজ খাদ্যে সম্পূর্ণ স্বয়ম্ভর করে তুলতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার খুনিদের এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন তথা রায় কার্যকর করিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের এক নতুন পথের অভিযাত্রী। তারই দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের চোখে ‘উন্নয়নের আইকন’ হয়ে উঠেছে। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে কথিত বাংলাদেশ আজ পরিণত হয়েছে ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশ’-এ ।

প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রখর দূরদৃষ্টি, অক্লান্ত পরিশ্রম আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফলে দেশের এমজিডি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন, লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠা, কৃষি দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার মাধ্যমে পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া বাস্তবায়িত হয়েছে পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রো রেল, চট্টগ্রামের কর্ণফুলি টানেল প্রভৃতি মেগা-প্রকল্পগুলো এবং বাস্তবায়নের পথে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর প্রভৃতি আরও কিছু মেগা-প্রকল্প।

প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতক চক্রের হাতে পড়ে প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়া একটি দেশ ও জাতিকে আবার নিজের সুস্থ সবল দৃঢ় পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন অনাপোষ ও স্থিতপ্রতিজ্ঞ বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন একটি সম্মানজনক পরিচিতি। আজ বাংলাদেশ বিশ্বের সামনে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে তারই কারণে। তিনি আজ জাতীয় নেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রীর পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন।
বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ‘মানবতার জননী’, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে আজ অনেকটাই বাস্তবে পরিণত করেছে তার সুযোগ্য কন্যার গতিশীল নেতৃত্ব। আর এসব সম্ভব হচ্ছে শুধুমাত্র তিনি ১৯৮১’র ১৭ মে দেশে ফিরে আসার যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন বলেই। আর সেকারণেই ১৭ মে দিনটি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা হয়ে গেছে।

লেখক: গবেষক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ, ফোকলোরিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।


banner close