শনিবার, ১ নভেম্বর ২০২৫
১৬ কার্তিক ১৪৩২

মুজিবনগর দিবসের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা

ঐতিহাসিক মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা এলাকায় তোলা। ছবি: সংগৃহীত
আপডেটেড
১৬ এপ্রিল, ২০২৪ ২২:০২
ড. মো. শাহিনুর রহমান
প্রকাশিত
ড. মো. শাহিনুর রহমান
প্রকাশিত : ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ ১৯:০২

ভৌগোলিকভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার পলাশী আম্রকানন আর বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা বা মুজিবনগর আম্রকাননের দূরত্ব সরাসরি ধরলে বড় জোর তিরিশ কিলোমিটার আর পাকা সড়কের ঘুরপথে ৮২ কিলোমিটারের বেশি হবে না। বাংলার ইতিহাসে এ দুই আম্রকাননের গুরুত্ব বাড়িয়ে বলার অবকাশ নেই। এ দুই কাননের প্রথমটিতে প্রায় পৌনে তিনশ’ বছর আগে, ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যদের কাছে শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার পরাজয় ও মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। অপর আম্রকাননটিতে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য পুনরুদিত হয়, ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী ইংরেজি সময় গণনার ভিত্তিতে ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রটি আসে পরবর্তী ১০ এপ্রিল তারিখে। এ ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন এবং অনুমোদন করা হয়। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর, ১৭ এপ্রিল তারিখে একটি যুদ্ধকালীন বিপ্লবী সরকার বা স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম সরকার গঠনের মাধ্যমে সদ্যোজাত দেশটিকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হয়। এদিন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকুঞ্জে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং যুদ্ধকালীন সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ শপথ গ্রহণ করে। তারপর থেকে বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ হয় ‘মুজিবনগর’ আর ১৭ এপ্রিল দিনটি উদযাপন করা হয় ‘মুজিবনগর দিবস’ হিসেবে।

নবগঠিত মুজিবনগর সরকার শপথ নেয়ার পরপরই একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জগৎ সভায় বাংলাদেশের আত্মপ্রতিষ্ঠার উচ্চাকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সাংবিধানিকভাবে অনুমোদিত, যুক্তিসঙ্গত ও সম্ভবপর সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার জন্যে একটা কায়েমি স্বার্থবাদী মহল যে-অবিরাম অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে তা প্রতিহত করে এ ইতিহাসকে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করার জন্য মুজিবনগর সরকার বা দিবসের যথোপযুক্ত গুরুত্ব নির্ণয় ও স্মরণ করা একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ আর অধ্যবসায় নিয়ে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের উচিত বঙ্গবন্ধুসহ সকল স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক সংগঠকদের সর্বক্ষণ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণে রাখা।

স্মর্তব্য, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এক ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে, কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরাচারী সরকার বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রিত্ব দিতে অস্বীকার করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করে। অবশেষে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে কিন্তু তার নাম আর দিকনিদের্শনাকে সামনে রেখেই বাঙলাদেশের সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক সরকার- মুজিবনগর সরকার- ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল শপথ নিয়ে কার্যভার গ্রহণ করে। গণপরিষদের সকল সদস্য এদিন বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পূর্ণ করার মধ্য দিয়ে জাতিকে পূর্ণ স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। এজন্য বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি আর তার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস এক অভূতপূর্ব স্থান অধিকার করে আছে। কারণ অতীত হাজার বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে এই প্রথম বাংলাদেশে তার ভূমিপুত্রদের একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

একাত্তরের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রকাশের সাত দিন পর, ১৭ এপ্রিল বৃহত্তর কুষ্টিয়ার মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলা নামের একটি ছোট গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নেয়ার পর জায়গাটির নতুন নাম রাখা হয় মুজিবনগর এবং এটিই হয়ে ওঠে এ সরকারের সদরদপ্তর। একটি নতুন জাতির জন্ম আর তাদের প্রথম স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের মাহেন্দ্রক্ষণটির প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার জন্যে সেদিন ভারতসহ বিভিন্ন দেশের শয়ে শয়ে সাংবাদিক মুজিবনগরে এসে জড়ো হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু সেদিন সশরীরে সেখানে উপস্থিত ছিলেন না বটে, কিন্তু তার দিয়ে যাওয়া দিকনির্দেশনা অনুযায়ীই সমস্ত কার্যক্রম চলছিল। প্রতিটি মুহূর্তেই তিনি ছিলেন প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধুর নামই ঘোষণা করা হল সদ্যোজাত রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে। কিন্তু তিনি তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মনোনীত করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী তাজউদ্দিন আহমদকে। এ ছাড়া এম. মনসুর আলী বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী, এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান প্রথম স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, এবং পরবর্তী কালে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রমাণিত খোন্দকার মোশতাক পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী, এবং আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী (তৎকালীন কর্নেল) বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। শপথ গ্রহণের পরপরই এ সরকার বেসামরিক প্রশাসন চালানোর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা এবং তাদের জন্যে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করা, জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে আন্তর্জাতিক সমর্থন নিশ্চিত করা, এবং যুদ্ধের নির্মম, ক্লান্তিকর, কালো দিনগুলো থেকে দ্রুত মুক্তিলাভ নিশ্চিত করার জন্যে সর্বতোমুখী প্রয়াস চালাতে থাকে। অসীম দেশাত্মবোধ আর নজিরবিহীন বিচক্ষণতাই ছিল এই বিপুল কর্মযজ্ঞের পেছনকার মূল চালিকাশক্তি।

মুজিবনগর সরকার একটি নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা আর কুশলী সমম্বয়ের মাধ্যমে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার অবচেতনে তাদের মনোবল চাঙা করে তুলেছিল এবং পুরো যুদ্ধকালে তদ্রুপ রেখেছিল। আমাদের শ্রেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার সহযোগী নেতৃবৃন্দ, যারা মুজিবনগর সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তারা এই ঐতিহাসিক ক্রান্তিকালে জাতিকে তথা জাতির চলমান স্বাধীনতা যুদ্ধকে পরিচালনার গুরুদায়িত্ব নিজেদের কাঁধে শুধু তুলেই নেননি, সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সঙ্গে সে-দায়িত্ব পালন করে জাতিকে পৌঁছে দিয়েছেন স্বাধীনতার অভীষ্ট লক্ষ্যে। একাত্তরের এপ্রিলে শপথ গ্রহণের পর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আট মাস ধরে এ সরকার দেশের সশস্ত্র যুদ্ধকে ক্রমবর্ধমানভাবে অব্যাহত রেখেছে। অনড়-অটলভাবে তারা তাদের প্রয়াস চালিয়ে গেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ভিত্তিস্বরূপ আমাদের জাতীয় ঐক্যকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য। ঘরে-বাইরে সব শত্রুর বিরুদ্ধে তারা অক্লান্ত যুদ্ধ করেছেন সর্বোচ্চ বীরত্বের সঙ্গে, তবে তার চেয়েও বড় কথা, যুদ্ধ চলাকালে পুরোটা সময় ধরে তারা আমাদের অবিকল্প মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা অবিচলভাবে অনুসরণ করেছেন, এবং গণমানসে তার ভাবমূর্তি অম্লান রেখেছেন। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল গঠিত হওয়ার পর মুজিবনগর সরকার জাতির যুদ্ধপ্রয়াসে এক নতুন গুরুত্ব আর তাগিদের সঞ্চার করে। এর ফলে এমনকি সেই ধ্বংস ও মৃত্যুর মুহূর্তেও বাংলাদেশের জনগণের মনে যুদ্ধজয়ের ব্যাপারে একটা দৃঢ় আস্থার সৃষ্টি হয় এবং তারা আন্তর্জাতিক সমাজে তাদের দেশের অবস্থান হৃদয়ঙ্গম করতে শুরু করে।

মুজিবনগর সরকার গঠনের যুগান্তকারী পদক্ষেপটিকে বিজ্ঞজনেরা বিবেচনা করেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পূর্ণ বাস্তবায়নের পথে একটি যথোপযুক্ত সাংবিধানিক, যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হিসেবে। মুজিবনগর দিবস আমাদের জাতীয় ইতিহাসে একটি মাইলফলক সংগঠন। দিনটির সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যের কয়েকটি দিক এখানে তুলে ধরা হলো।

প্রথমত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো আন্দোলন নয়, বরং একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনিবার্য সম্প্রসারণ, সেটা আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরা। সেইসঙ্গে এটাও সারা বিশ্বের কাছে নিশ্চিত করা যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্বদানের ব্যাপারে মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত মানুষের এবং স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এসব লক্ষ্য বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করাটা মুজিবনগর সরকার জন্য যেমন অপরিহার্য ছিল, তেমনি ছিল ভারত সরকারের জন্যও।

তখন বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের গভীর সংকটে জর্জরিত। বহু দেশ আমাদের সংগ্রামের সাথে একাত্মতা প্রকাশের পাশাপাশি সাহায্যের হাত বাড়ালেও, বিশ্বের দুটি বৃহৎ শক্তি যথা যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এমন একটি প্রতিকুল পরিস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের যেকোন একটি ভুল সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ লড়াই হিসেবে চিহ্নিত করার সম্ভাবনা জাগাতে পারতো।

দ্বিতীয়ত, মুজিবনগর সরকার গঠনে আরও দেরি হলে বা আদৌ গঠন করা না গেলে নিশ্চিতভাবে কোনো ধরনের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তো বিশৃঙ্খলভাবে। চলমান জনযুদ্ধকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার জন্যে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল। মুজিবনগর সরকার দক্ষভাবে দায়িত্বটি পালন করে, যার ফলে আওয়ামীপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা মূলধারার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। মুজিবনগর সরকার গঠিত না হলে, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ের আভাবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্বের চোখে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা ছিল।

তৃতীয়ত, যুদ্ধের শুরুতে সাধারণ জনগণ, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক, পুলিস, আনসার, ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যগণ ইত্যাদি সবাই স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশ নিলেও, তাদের সে-প্রয়াসের পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। এদের সবাইকে সঙ্ঘবদ্ধ করে একটি একক আদেশানুক্রমের মধ্যে নিয়ে আসা এবং তাদের নিজ নিজ রণাঙ্গণ নির্দিষ্ট করে দেয়া সম্ভব হয়েছে মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার ফলেই।

মুজিবনগরে শপথ নেয়া স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার তার অসাধারণ কর্মতৎপরতার গুণে অচিরেই সাফল্যের তুঙ্গে পৌঁছে যায়। মাত্র নয় মাসের মধ্যে এ সরকার এক অসাধারণ কার্যকর ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলে। এ সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী এইচ. টি. ইমাম লিখেছেন, “১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সরকার আকারে বিশাল ছিল না, কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর এবং দক্ষ ছিল। মন্ত্রিসভার প্রাত্যহিক বৈঠক ছাড়াও যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো প্রয়োজন ও সময়ের তাগিদে। যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থায় যেভাবে সরকার পরিচালনা করতে হয়, ঠিক সেভাবে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা এবং আমরা সবাই কাজ করেছি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি ছিল দ্রুত এবং দৃঢ়। বাস্তবায়নও হতো ক্ষিপ্র গতিতে।” (এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, পৃ. ৬৫)

যুদ্ধ চলাকালে অনেক দেশেই প্রবাসী সরকার গঠিত হওয়ার বহু নজির আছে। তবে এগুলোর মধ্যে কিন্তু মুজিবনগর সরকার ছিল অনন্য। এ সরকার শুধুমাত্র প্রবাসী ছিল না, এর নিজস্ব ভূখণ্ডও ছিল। ভারত সীমান্ত সংলগ্ন নিজস্ব ভূমিতেই এ সরকার শপথ নিয়েছে এবং সদরদপ্তর স্থাপন করেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেসব এলাকা পাক হানাদারমুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল বা যেসব এলাকা হানাদার বাহিনী দখল করতে পারেনি, সেসব মুক্তাঞ্চলে সরকার সবরকমের সামরিক এবং বেসামরিক প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। এসব মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়মিত পরিদর্শনে আসতেন বিদেশি সাংবাদিকরা। একথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে মুজিবনগর সরকার নামে বিভিন্ন সময়ে অভিহিত এই সরকারই প্রথম পূর্ণাঙ্গ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি মাইলফলক যা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে ‘জীবন ও বৈধতা’ দিয়েছে। জাতির পিতার কারাবন্দি অবস্থায় তারই দিকনির্দেশনা অনুযায়ী যে মহান নেতারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদেরকে জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে।

সামরিক স্বৈরসরকার ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ১৯৭১-এ যে-সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়, তাতে প্রাথমিক সাফল্য আসে দলের সুপ্রিমো বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেও তাকে রাষ্ট্রপ্রধান করে জননির্বাচিত সরকার গঠনের মধ্যে দিয়ে। এসময় নবগঠিত সরকারকে যুদ্ধকালীন নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধুর চার ঘনিষ্টতম ছায়াসহচর-অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, অর্থমন্ত্রী এম. মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান। ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু নিজেই সরকারপ্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তারপর ১৯৭৫-এ আবার লোহার বাসরে কালসাপ এসে ঢোকে। পাকিস্তানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা নিহত হওয়ার পর আবার ফিরে আসে সেই সামরিক প্রেতচ্ছায়া। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা কন্যা, বর্তমান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম, আত্মদান-আত্মত্যাগের পর অবশেষে গণতন্ত্র এদেশে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। দেশে অনতিদীর্ঘ কাল ধরে একটা জননির্বাাচিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত থাকায় অর্থনীতিতে একটা বর্ধিষ্ণু স্থিতিশীলতা এসেছে। দেশ এখন অপ্রতিহতভাবে এগিয়ে চলেছে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে।

এই গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস আমাদের প্রেরণা, আমাদের দিকপ্রদর্শক বাতিঘর। প্রত্যেক বাঙালির কর্ম ও চিন্তায় মুজিবনগর দিবসের তাৎপর্যকে ধারণ করতে হবে। দিনটি বাংলাদেশিদের কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ, সে-ব্যাপারে জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে বিদেশিদেরকেও অবগত করতে হবে। মুজিবনগর দিবসের গৌরবোজ্জ্বল গুরুত্ব আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই।

লেখক: অধ্যাপক; ইংরেজি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

বিষয়:

আবার রক্তাক্ত ডুরান্ড লাইন: শান্তি চুক্তির বিকল্প নেই

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

দুটি প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘর্ষ দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে এক নতুন সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে। উভয় পক্ষের মধ্যেই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে এবং উত্তেজনা এখনো চরমে। ইতোমধ্যে এই উত্তাপ নিরসনের জন্য বার কয়েক আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা হলেও বারবার তা ভেঙে গেছে। যা এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। এই সংঘাত শুধু সীমান্ত পারাপার বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় নয়, এটি দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস, আস্থার অভাব, দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক টানাপড়েন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং বহির্বিশ্বের অন্যান্য দেশের ষড়যন্ত্রের শিকার।

পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘাতের একটি বিস্তীর্ণ পটভূমি রয়েছে। যার ভিত্তি মূলত ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক। ডুরান্ড লাইন ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ ভারতের তরফে স্যার হেনরি মর্টিমার ডুরান্ড ও আফগানিস্তানের এমীর আব্দুর রহমান খান এর মধ্যে চুক্তি চিহ্নিত হয়েছিল মূলত ব্রিটিশ ভারতের প্রতিযোগী হিসাবে রাশিয়া-অধিষ্ঠিত ‘গ্রেট গেম’ পরিচালনায়। স্বাধীন পাকিস্তান (১৯৪৭) ওই সীমান্ত লাইন উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু আফগানিস্তান আরও পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের সময় থেকে এটিকে আন্তর্জাতিক বৈধ সীমান্ত হিসেবে স্বীকার করেনি। এই সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বহুয়ান পশতুন জনগোষ্ঠীর বসবাস; যারা ঐতিহ্যগতভাবে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান দুই দেশভুক্ত। এই সমাজে ঐতিহ্য, জনসংখ্যা ও ভাষাগত বন্ধন রয়েছে; যে কারণে সীমান্ত সমস্যা আজও জিইয়ে আছে।

পাকিস্তান-আফগানিস্থান সীমান্ত বরাবর বিশেষত পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া ও বালুচিস্তান অঞ্চলে তেহরিক- ই- তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর পাকিস্তানভিত্তিক কার্যক্রমের জন্য আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার হয়; যেটি পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হিসেবে গণ্য।

পাকিস্তান এসব গ্রুপের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে। সীমান্ত রক্ষা, বেআইনি চাপা প্রবেশ প্রতিরোধ এবং ২০১৭ সাল থেকে সীমান্তরোধ বাঁধ নির্মাণ শুরু করে।

সম্প্রতি পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, তা বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক। সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় আফগানিস্তানে পাকিস্তানের বিমান হামলাকে কেন্দ্র করে। ইসলামাবাদ অভিযোগ করে যে, আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে তেহরিক- ই- তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) জঙ্গিরা পাকিস্তানের ভেতরে হামলা চালাচ্ছে, বিশেষত খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে। জঙ্গিদের সেই হামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন জওয়ান শহীদ হয়েছে। সেই জঙ্গি আস্তানা লক্ষ্য করেই পাকিস্তান তাদের বিমান হামলা চালায়।

পাল্টা হিসেবে আফগান তালেবান বাহিনী সীমান্তে পাকিস্তানের সামরিক চৌকি লক্ষ্য করে হামলা চালায়, যার ফলে উভয় পক্ষেই সেনা হতাহত হয়। আফগানিস্তান এই হামলাকে তাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করে। এই সংঘর্ষের তীব্রতা এতটাই ছিল যে চামান ও স্পিন বলদাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ক্রসিংগুলো বন্ধ করে দিতে হয়, যার ফলে সাধারণ মানুষের যাতায়াত ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এমনকি আফগানিস্তান পাকিস্তানের সাথে অনুষ্ঠিতব্য ক্রিকেট সিরিজও বাতিল করে।

এত সবকিছুর মূল কারণ পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং আন্তর্জাতিক ইন্দন। এই সংঘাতের মূলে রয়েছে পাকিস্তানের অভিযোগ আফগানিস্তানের তালেবান সরকার টিটিপি-কে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। টিটিপি, যা পাকিস্তানি তালেবান নামেও পরিচিত, পাকিস্তানের জন্য এরা বড় নিরাপত্তা হুমকি। ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জঙ্গি হামলা বহুগুণে বেড়ে গেছে। পাকিস্তান মনে করে, আফগান তালেবান তাদের মিত্র হওয়া সত্ত্বেও টিটিপি-র বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, বরং তাদেরকে পাকিস্তানবিরোধী কার্যক্রমে উৎসাহ দিচ্ছে। অতিসম্প্রতি আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর এবং বিবৃতি প্রদান এই অবিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

অন্যদিকে, আফগান তালেবান সরকার পাকিস্তানের এই অভিযোগ অস্বীকার করে। তাদের দাবি, তারা কারো বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আফগান ভূমি ব্যবহার করতে দেয় না। তারা উল্টো পাকিস্তানকে বিমান হামলা চালিয়ে নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিক হত্যার জন্য দায়ী করে। এই পাল্টা-অভিযোগ এবং পরস্পরকে দোষারোপ করার প্রবণতা দুই দেশের মধ্যে আস্থার সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

এছাড়াও দুই দেশের মধ্যে ডুরান্ড লাইনকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে আফগানিস্তানের স্বীকৃতি না দেওয়াও একটি দীর্ঘদিনের বিবাদের কারণ। যদিও পাকিস্তান এটিকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত মনে করে, আফগানিস্তানের তালেবান সরকারসহ পূর্বের সরকারগুলোও এটিকে মানতে নারাজ। এই অচিহ্নিত ও বিতর্কিত সীমান্ত বরাবরই সংঘাতের জন্ম দিয়েছে।

প্রাথমিকভাবে সংঘর্ষ মারাত্মক আকার ধারণ করার পর কাতার এবং সৌদি আরবের মতো মধ্যস্থতাকারীদের উদ্যোগে দুই দেশ ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এই যুদ্ধবিরতির উদ্দেশ্য ছিল উত্তেজনা প্রশমিত করা এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজা। তবে এই যুদ্ধবিরতির মধ্যেই উত্তর ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে টিটিপি-র আত্মঘাতী হামলা এবং এরপর আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের নতুন করে বিমান হামলা চালানো এই সবই যুদ্ধবিরতিকে ভঙ্গুর করে তুলেছে।

এসব ঘটনা স্পষ্ট করে যে, সীমান্ত সংঘর্ষ শুধুমাত্র সামরিক উত্তেজনা নয়, এটি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং জঙ্গিগোষ্ঠীর কৌশলের সাথেও গভীরভাবে সম্পর্কিত। টিটিপি যেন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতে চায়।

সংলাপের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই সংকটই হতে পারে শান্তি প্রক্রিয়ার নতুন ট্রিগার: আগের তুলনায় বিশ্বের আনুগত্য ও মধ্যস্থতার আগ্রহ রয়েছে। তবে যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে এটি আবার বৃহত্তর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সঙ্কটে রূপ নিতে পারে — যেমন জঙ্গি পুনরুজ্জীবন, বিএসএম প্রবাহ বৃদ্ধি, মানুষের দুর্দশা বৃদ্ধি ইত্যাদি।

পাকিস্তান-আফগানিস্তানের এই সংঘাত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ। এই অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশেষত চীন, ইরান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো গভীরভাবে আগ্রহী। তারা প্রত্যেকেই এই সংঘাতের অবসানের জন্য সংলাপের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রধান মিত্র চীন, যারা আফগানিস্তানের সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী, তারা উভয় পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে। আবার, আমেরিকার মতো পশ্চিমা শক্তি যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে আগ্রহী, তারাও পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে। তবে, এই সংঘাতের ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলো থেকে শত শত পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালাতে হচ্ছে।

এই জটিল পরিস্থিতিতে সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। দুই দেশের মধ্যে একমাত্র পথ হলো অর্থপূর্ণ ও টেকসই সংলাপ। আর এই সংলাপের ভিত্তি হবে পারস্পরিক আস্থা এবং বিশ্বাস। টিটিপির মতো জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে উভয়কে একমত হতে হবে। আফগানিস্তানকে নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের ভূমি থেকে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে না। ডুরান্ড লাইন ইস্যুতে একটি বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি। সীমান্তকে সুরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত করার জন্য যৌথ নজরদারি ব্যবস্থা বা সমন্বিত সীমান্ত টহল চালু করা। তদুপরি সংঘাতের কারণে যে সমস্ত বেসামরিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের সুরক্ষা ও মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে এই সংকট নিরসনের জন্য কূটনৈতিক পর্যায়ে দোহা-র মতো স্থানে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠক অত্যন্ত জরুরি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা-র মাধ্যমেই এই সংঘাতের স্থায়ী সমাধান সম্ভব। অন্যথায়, এই সীমান্ত সংঘাত শুধু দুই দেশের মধ্যেই নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলবে। তাছাড়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে দুই দেশের সাধারণ মানুষ। কেননা সীমান্ত চেকপয়েন্ট বন্ধ হলে সাধারণ বাণিজ্য, মানুষের চলাচল ও সামুদ্রিক সরবরাহ লাইন ব্যাহত হয়। এতে স্থানীয় অর্থনীতি একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়।

সর্বোপরি আমি মনে করি, দুই দেশের সীমান্তের উত্তেজনা শুধুই দুদেশের মধ্যকার বিষয় নয়—এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে রয়েছে বড় জঙ্গি সংগঠন, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক এবং শক্তির সমীকরণ। যেমন: পাকিস্তান-চিন-ইরান-মধ্য এশিয়ার দেশগুলো এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতার স্বার্থ রাখে; অপর দিকে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রেরও নেটওয়ার্ক ভিত্তিক যোগাযোগ রয়েছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত অনেক দেশই নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় এই সংঘর্ষের আগুনকে আরো প্রজ্জ্বলিত করার জন্য ঘি ঢালতে প্রস্তুত। তাছাড়া পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান উভয়েই মুসলিম দেশ হওয়ার তাদের মধ্যে অনৈক্য এবং বিভেদ সৃষ্টির সুযোগ অনেকেই হাতছাড়া করতে চাইবে না। মুসলিম বিশ্ব এমনিতেই সমগ্র বিশ্ব জুড়ে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। তাই আমি মনে করি, কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর কল্যাণে এই সংঘাত যত দ্রুত সম্ভব মিটিয়ে ফেলা উচিত। অন্যথায় এই আগুনে কেবল পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান পুড়বে না; জাতি হিসাবে মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য এবং বিভেদ চূড়ান্ত মাত্রায় ছড়িয়ে পড়বে। মুসলিম বিশ্বের জন্য যার পরিণতি হবে অত্যন্ত মারাত্মক।

লেখক; জসীম উদ্দীন মুহম্মদ, কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট এবং সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ।


জাতিসংঘের সংকট ও বিশ্বশক্তির রাজনীতি

ড. আজিজুল আম্বিয়া
আপডেটেড ৩১ অক্টোবর, ২০২৫ ০১:৪৮
সম্পাদকীয়

António Guterres ২০২৬ সালের শেষ দিন (৩১ ডিসেম্বর ২০২৬) তার দ্বিতীয় পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করবেন।

জেনারেল অ্যাসেম্বলি ও নিরাপত্তা পরিষদে নতুন রুল-বিধি গৃহীত হয়েছে মহাসচিব নির্বাচন প্রক্রিয়ায় — উদাহরণস্বরূপ, প্রার্থীদের অবশ্যই তাদের ফান্ডিং উৎস প্রকাশ করতে হবে, নির্বাচনী সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে, এবং “নারীর সম্ভাব্যতা” উদ্দিষ্ট করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে কয়েকজন প্রার্থী নাম ঘোষণা করেছে:

  • Michelle Bachelet (চিলি) – দেশটি ঘোষণা করেছে তাকে মহাসচিবের জন্য মনোনয়ন দেবে।
  • Rebeca Grynspan (কোস্টা রিকা) – দেশ ঘোষণা করেছে তাকে মনোনীত করার জন্য।
  • Rafael Mariano Grossi (আর্জেন্টিনা) – তিনি নিজে ঘোষণা করেছেন এই পদের জন্য প্রার্থী হিসেবে।

Latin America অঞ্চলের দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে যে এবার এই জায়গাটি তাদের পালা, কারণ গত কয়েকবার হয় অন্যান্য অঞ্চলের নাগরিকই হয়েছে মহাসচিব।

যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে তারা ‘বিশ্বব্যাপী’ প্রার্থীর খোঁজে, শুধুই নির্দিষ্ট অঞ্চলের নয় — তবে এই বক্তব্যকে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো ‘আমাদের পালা’ দাবি হিসেবে দেখছে। সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করার চেস্টা করছি,

  • নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে — আগের তুলনায় বেশ কিছু নতুন রুল বাতলে দেওয়া হয়েছে।
  • নারী নেতার সম্ভাবনার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে কারণ এই পদে এখনো কোনো নারী অধিষ্ঠিত হননি।
  • যেহেতু ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো মনোনয়ন ঘোষণা করছে, ভবিষ্যতে এই অঞ্চল থেকে মহাসচিব হওয়া সম্ভাবনা বেড়ে গেছে।
  • বড় শক্তিধর দেশ ও নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের (ভেটোধারী দেশগুলো) অনুমোদন না পেলেই পদ কখনও নিশ্চিত হবেনা — তাই প্রার্থীর জন্য বিশ্বরাজনীতি এবং শক্তিধর

দেশগুলোর বিন্যাস বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের জন্য এর অর্থ

  • বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বড় সুযোগ রয়েছে এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও কণ্ঠস্বর বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার। যদি নতুন মহাসচিব নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ‘উন্নয়নশীল দেশ’ এবং ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সংহতি বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সুযোগ বাড়তে পারে।
  • বাংলাদেশ যেহেতু বিশ্ব শান্তি, উন্নয়ন ও মানবাধিকার ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে, তাই নির্বাচিত মহাসচিবের মনোনীত নীতির সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে নিজস্ব নেতৃত্ব বাড়াতে পারে।
  • তবে বিশ্ব রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন সাধারণত সময় সাপেক্ষ — তাই সংস্থাভিত্তিক কাঠামো, শক্তি বাণিজ্য ও রাজনৈতিক ভারসাম্য সবকিছুর প্রভাব থাকবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পর মানবসভ্যতা যখন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল, তখনই ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ— মানবতার শান্তি ও ন্যায়ের পতাকা হাতে। উদ্দেশ্য ছিল, ভবিষ্যতে যেন আর কোনো বিশ্বযুদ্ধ না ঘটে, যেন আলোচনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো পার্থক্য মিটিয়ে নিতে পারে। কিন্তু আট দশক পার হয়ে আজ বিশ্ববাসীর মুখে একটাই প্রশ্ন— জাতিসংঘ আসলেই কি সেই নিরপেক্ষ ন্যায়বিচারের মঞ্চ, নাকি এটি পরিণত হয়েছে বিশ্বশক্তির স্বার্থরক্ষার একটি কূটনৈতিক পর্দায়?

🔹 নিরাপত্তা পরিষদ: ভেটোর ফাঁদে ন্যায়বিচার

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (UNSC) হলো সংস্থাটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর অঙ্গ। এখানে পাঁচ স্থায়ী সদস্য— যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্স— এককভাবে প্রস্তাব ভেটো করতে পারে। এই এক ‘ভেটো’ শব্দটাই আজ জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় সংকটের প্রতীক।

কোনো যুদ্ধবিরতি, মানবাধিকার তদন্ত, কিংবা অস্ত্রবিরোধী প্রস্তাব— এসব কিছুই প্রায়ই আটকে যায় এই পাঁচ দেশের রাজনৈতিক স্বার্থে।

সিরিয়া যুদ্ধ, ইউক্রেন সংঘাত কিংবা গাজা উপত্যকার গণহত্যা— প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব শক্তিধরদের ভেটোতে থমকে গেছে। রাশিয়া যেমন ইউক্রেন প্রসঙ্গে নিজের অবস্থান রক্ষায় ভেটো দিয়েছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ইস্যুতে বহুবার ভেটো ব্যবহার করেছে।

ফলাফল— নিরীহ মানুষের মৃত্যু, ধ্বংস আর নির্বিকার জাতিসংঘ।

🔹 সাধারণ পরিষদের সীমাবদ্ধতা

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সমান ভোটাধিকার থাকলেও, এখানকার সিদ্ধান্তগুলো বাধ্যতামূলক নয়। তাই বাস্তব প্রভাব খুব সীমিত।

উদাহরণস্বরূপ, গাজা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব সাধারণ পরিষদে পাস হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি, কারণ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় না।

এভাবে ছোট দেশগুলোর কণ্ঠস্বর প্রায়ই হারিয়ে যায় বড় শক্তির স্বার্থের কাছে।

জাতিসংঘের মূল মঞ্চে ‘সবার সমান অধিকার’ থাকলেও বাস্তবে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত থাকে কিছু রাষ্ট্রের হাতে।

🔹 মহাসচিব নির্বাচন: নেপথ্যের কূটনীতি

জাতিসংঘের মহাসচিবকে বলা হয় ‘বিশ্বের নৈতিক নেতা’। কিন্তু এই পদটিও রাজনীতির জটিল হিসাবের বাইরে নয়। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের অনুমোদন ছাড়া কেউ মহাসচিব হতে পারেন না।

অতএব, প্রার্থীকে হতে হয় কূটনৈতিকভাবে ‘নিরাপদ’— এমনভাবে কথা বলতে হয় যেন কোনো বড় শক্তি ক্ষুব্ধ না হয়।

আগামী মহাসচিব নির্বাচনের আলোচনাতেই এটি স্পষ্ট। চিলির মিশেল ব্যাচেলেট, আর্জেন্টিনার রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসি, বুলগেরিয়ার ইরিনা বোকোভা, এবং লাইবেরিয়ার এলেন জনসন স্যারলিফ— এদের প্রত্যেকেই আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য, কিন্তু কাউকেই ‘অতি নিরপেক্ষ’ বলা যায় না।

কারণ, একেকজনের পেছনে একেকটি ব্লকের সমর্থন রয়েছে। ফলে যিনি নির্বাচিত হবেন, তাকেও সেই ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে— মানবতার জন্য নয়, বরং রাজনীতির ভারসাম্যের জন্য।

🔹 উন্নয়ন ও অনুদানের রাজনীতি

জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যেমন UNDP, WHO, UNESCO, UNICEF— এসবই মানবিক উন্নয়নের প্রতীক। কিন্তু বাস্তবে এসব তহবিলের বড় অংশ আসে ধনী দেশগুলোর অনুদান থেকে। ফলে অনুদানদাতা দেশের রাজনৈতিক অগ্রাধিকারই অনেক সময় নির্ধারণ করে কোন অঞ্চলে প্রকল্প হবে, কোথায় হবে না।

আফ্রিকার দারিদ্র্য, ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষ, কিংবা রোহিঙ্গা সংকট— অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সাহায্যের প্রতিশ্রুতি থাকলেও কার্যকর সহায়তা আসে না।

এভাবেই মানবিকতার চেয়ে রাজনীতি বড় হয়ে দাঁড়ায়, এবং জাতিসংঘের নৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

🔹 যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের ভূমিকা: আশার চেয়ে হতাশা বেশি

বর্তমানে ইউক্রেন ও গাজা— এই দুই যুদ্ধই জাতিসংঘের সক্ষমতার কঠিন পরীক্ষা।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর একাধিক প্রস্তাব আনা হলেও রাশিয়ার ভেটো ব্যবহারে সব থেমে যায়। অপরদিকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের বোমা হামলায় হাজারো বেসামরিক নিহত হলেও নিরাপত্তা পরিষদ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

সাধারণ পরিষদের বিবৃতিতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান এসেছে, কিন্তু তা বাস্তবে প্রভাব ফেলেনি।

বিশ্ববাসী তাই এখন প্রশ্ন করছে— জাতিসংঘ কি কেবল বিবৃতি দেয়ার সংস্থা?

যদি যুদ্ধ থামাতে না পারে, যদি মানবতা রক্ষা করতে না পারে, তবে এই সংস্থার প্রয়োজনীয়তা কোথায়?

এক জরিপে দেখা গেছে, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার মাত্র ৪৫ শতাংশ মানুষ জাতিসংঘের প্রতি ‘পূর্ণ আস্থা’ রাখে। আফ্রিকায় এই হার কিছুটা বেশি, প্রায় ৬০ শতাংশ। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় আস্থার হার নেমে এসেছে ৩০ শতাংশে। অর্থাৎ, জাতিসংঘের নৈতিক অবস্থান ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে।

🔹 বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে জাতিসংঘ

বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হয় ১৯৭৪ সালে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শান্তি, উন্নয়ন ও মানবতার পক্ষে জাতিসংঘে সক্রিয় ভূমিকা রেখে আসছে।

বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অন্যতম শীর্ষ অবদানকারী দেশ। বর্তমানে প্রায় ৭,০০০ বাংলাদেশি সেনা ও পুলিশ সদস্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত।

এটি শুধু বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়ায়নি, বরং জাতিসংঘে দেশের কণ্ঠস্বরকে জোরালো করেছে।

তবে বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘের ভূমিকা অনেক সময় হতাশাজনকও হয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা, জলবায়ু অর্থায়নের বিলম্ব, কিংবা গাজা যুদ্ধের নীরবতা— এসবই জাতিসংঘের সীমাবদ্ধতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।

বাংলাদেশ চায়, জাতিসংঘ যেন উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রকৃত কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে, শুধুমাত্র বড় শক্তির মঞ্চ না থাকে।

🔹 সংস্কারের দাবি ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

বিশ্ব এখন বহুমেরুকেন্দ্রিক— শুধু পশ্চিমা দুনিয়া নয়, চীন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশও বৈশ্বিক প্রভাবশালী শক্তি।

তাই জাতিসংঘের কাঠামোতে পরিবর্তন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে বলছে— নিরাপত্তা পরিষদে নতুন স্থায়ী সদস্য যুক্ত করতে হবে, ভেটো ক্ষমতা সীমিত করতে হবে, এবং সংস্থার নেতৃত্বে বৈচিত্র্য আনতে হবে।

এই সংস্কার ছাড়া জাতিসংঘ আর বিশ্ববাসীর আস্থা ফেরাতে পারবে না।

🔹 জাতিসংঘের সামনে পথচলা

জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনটি বিষয়ের ওপর—

  1. মানবিক সংকটে দ্রুত পদক্ষেপ,
  2. বড় শক্তির প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ নেতৃত্ব,
  3. সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ন্যায়ভিত্তিক সহযোগিতা।

যদি এই তিনটি ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কার্যকর হতে না পারে, তাহলে সংস্থাটির অস্তিত্ব শুধু নামমাত্র হয়ে যাবে। বিশ্বকে তখন নতুন কোনো সমন্বিত কাঠামোর প্রয়োজন পড়বে, যেমনটা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার আগের যুগে দেখা গিয়েছিল।

জাতিসংঘের রাজনীতি আজ ন্যায়বিচার ও বাস্তবতার সংঘাতে দাঁড়িয়ে। একদিকে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, শরণার্থী সংকট, জলবায়ু বিপর্যয়; অন্যদিকে ভেটো আর কূটনীতির দেয়াল।

তবুও জাতিসংঘ ছাড়া মানবজাতির বিকল্প কোনো বৈশ্বিক কাঠামো এখনো নেই।

বিশ্ববাসী তাই আশা ছাড়তে চায় না— একদিন হয়তো জাতিসংঘ সত্যিই তার মূল প্রতিশ্রুতির জায়গায় ফিরে যাবে।

যুদ্ধ নয়, আলোচনাই সমাধান— এই মূলমন্ত্র যদি আবার সক্রিয়ভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে জাতিসংঘ আবার হতে পারে ন্যায় ও মানবতার প্রকৃত আশ্রয়স্থল।

আর যদি তা না হয়, তবে শান্তির প্রতীক এই সংস্থাই একদিন হয়ে উঠবে শক্তির প্রতীক— ইতিহাস তখন সেটাকেই কঠিনভাবে বিচার করবে।

লেখক: ড. আজিজুল আম্বিয়া, কলাম লেখক ও গবেষক।


দাবি আদায়ের জন‍্য আন্দোলনের নামে রাজপথে আর কতদিন?

সৈয়দ শাকিল আহাদ
আপডেটেড ২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ২৩:৪৫
সম্পাদকীয়

বর্তমানে দেশের প্রধান ইস্যু নিয়ে নীরব কেন? আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে নানান প্রপাগান্ডা, ইসকনের উগ্রবাদী উত্থান এবং ভারতের অস্বাভাবিক বাংলাদেশ বিরোধিতা এসব বিষয় যেন জাতীর কাছে নগণ্য! নির্বাচনকে প্রধান করে দেশের রাজনীতির অঙ্গন থেকে জনজীবন পর্যন্ত অস্থির করে রেখেছে এক শ্রেণির অসুস্থ মস্তিষ্কের কিছু লোক, উস্কে দিচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণির অবাধ‍্য জনতাকে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চলমান পরিস্থিতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ভারসাম‍্য। অনেকেই দেশের জন্য নয় বরং নিজ স্বার্থে রাজনীতির আধিপত্য করতে চান, ধ্বংস করতে চান গণতন্ত্র! এরা এদেশের জন্য অযোগ্য!
দেশে আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা, সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক দাবি-দাওয়া সম্পর্কিত কার্যকলাপ চলছে সারা দেশে। উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যেমন বিদেশি কোম্পানির বন্দর ইজারা বাতিল না করা হলে গণআন্দোলনের হুঁশিয়ারি এবং অবৈধ অর্থ পাচার রোধে আইন প্রণয়নের দাবি ইত‍্যাদি, এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং তাদের দাবি-দাওয়াও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসছে।
বাড়ি ভাড়াসহ বিভিন্ন ভাতা বাড়ানোর দাবিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলন করতে দেখেছি আমরা।
শহীদ মিনারে শিক্ষক-কর্মচারীরা অবস্থান নিয়ে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ইত‍্যাদি বাড়ানোর দাবি ছিল একইসঙ্গে এমপিওভুক্ত কর্মচারীদের উৎসব ভাতা মূল বেতনের ৭৫ শতাংশ করারও দাবি তুলেছেন তারা। অবস্থান কর্মসূচির পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মচারীদের একাংশের অংশগ্রহণে ‘আমরণ অনশন’ কর্মসূচি চলাকালে অনশনরত ৪ জন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আন্দোলনরত শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রধান নেতা অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজী নিজেও অসুস্থ হয়ে জ্বর ও পেটের পীড়ায় ভুগেছেন। এক পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের আংশিক দাবি গ্রহণ করা হয়েছে, বেড়েছে বেতন ভাতা যা অপ্রতুল।
এই মুহূর্তে ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রম জাতীয়করণের দাবিতে দীর্ঘ ১৫ দিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর অভিমুখে লং মার্চ করেন আন্দোলনরত মাদ্রাসা শিক্ষকেরা।

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক ঐক্যজোট আন্দোলন বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে এই লং মার্চের আয়োজন করা হয়। লং মার্চে অংশ নেন শতশত শিক্ষক। এ সময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দেন— ‘ইবতেদায়ী শিক্ষক, হয়েছে কেন ভিক্ষুক?’, ‘অবহেলার ৪০ বছর, মানুষ বাঁচে কত বছর’, ‘চাকরি আছে বেতন নাই, এমন কোনো দেশ নাই’, ‘বৈষম্য নিপাত যাক, জাতীয়করণ মুক্ত পাক’, ‘এক দফা এক দাবি, জাতীয়করণ করতে হবে’ ইত্যাদি।
দেশে এখন এমন অবস্থা চলমান আছে
যে, চাইলেই যে কেউ যে কোনো সময়ে তাদের প্রয়োজনীয় কিছু ‘দাবি’ করতে পারেন এবং সেই মোতাবেক দাবি জানিয়েও থাকেন ।
তবে বলে রাখা ভালো , ‘দাবি করা’ এবং ‘দাবি জানানো’ দুটি অভিব্যক্তি হলেও তাদের মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে।
দাবি করা মানে হলো ‘যখন কেউ কিছু দাবি করে, তখন তারা সরাসরি কিছু দাবি করছে বা বলছে যে এটি তাদের অধিকার বা দাবি অনুযায়ী। এটি অনেকটা নিশ্চিতভাবে কিছু পাওয়ার অধিকারকে বোঝায়। উদাহরণ: ‘তিনি জমিটি তার নিজের বলে দাবি করলেন।’
আর দাবি জানানো বলতে আমরা কি বুঝি ‘দাবি জানানো বলতে বোঝায় কিছু দাবি করার বা দাবিটি প্রকাশ করার প্রক্রিয়া। এটি কিছু প্রাপ্তির জন্য প্রস্তাব বা আবেদন করার একটি উপায়। উদাহরণ: ‘শ্রমিকরা তাদের বেতনের বৃদ্ধি দাবি জানিয়েছে।’
সুতরাং, ‘দাবি করা’ বলতে কোনো কিছু নিজের হিসেবে ঘোষণা করা বোঝায়, আর ‘দাবি জানানো’ বলতে কোনো দাবির বিষয়ে অবহিত করা বা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো বোঝায়।-
আমাদের দেশের সর্বস্তরের সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রতি নিয়ত জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে এই দাবি আদায় ও আন্দোলন সম্পর্কে, আমরা কোথায় যাচ্ছি তা যদি কেই উপলব্ধি করতে পারতো তা হলে হয়তো ভৈরবের জনতাকে উস্কে দিয়ে ট্রেনে ইট-পাটকেল ছুড়ে জেলার করার দাবি আদায় কতটুকু সমীচিন তা বোধ হয় সেই দাবির পক্ষের কোমলমতি ছাত্র জনতা বুঝতে পারত। কিছু মারমুখী জনতা উপলব্ধি করে না বলেই আমাদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ‍্যমের কল‍্যানে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় তা সহজেই বিশ্ববাসীর কাছে অনেক লজ্জাকর ও মান সম্মানহানিসহ মারাত্মক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পরতে হচ্ছে।
গণঅভ‍্যুত্থানে বিগত সরকারের পতনের পর থেকে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে ঢাকার রাজপথে আন্দোলন ও সড়কে অবস্থান এখন নিত্যদিনের চিত্র। ন্যায্য-অন্যায্য, যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি আদায়ে অনেক পেশাজীবী সংগঠন, শিক্ষার্থী, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ আন্দোলন করছেন। আন্দোলনকারীরা যে যেভাবে পারছেন সেখানেই বসে পড়ছেন দাবি আদায়ের উদ্দেশ‍্যে কথায় কথায় চলছে সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, অনশন ইত‍্যাদি।
কিছু আন্দোলনের উত্তাপ দেশজুড়েও ছড়িয়ে পড়েছে। আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণ ও নির্বিঘ্নে যান চলাচল নিশ্চিতে পুলিশও ও প্রশাসনকে অসহায় অবস্থায় পড়তে দেখা গেছে সড়কে মহাসড়কে। সম্প্রতি সিলেটে রেলপথ আটকে ট্রেনের সামনে শুয়ে থেকে বিক্ষোভ-আন্দোলন করায় চলাচলের গতি স্থিমিত ও বিশৃঙ্খলাকারীদের প্রতি যাত্রীসাধারণের ক্ষোভ তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হয়েছে। আন্দোলনের নামে অস্তিত্বিশীল পরিস্থিতিতে ফেলার ফলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা, কোমলমতি শিশু-কিশোরদের শিক্ষা, স্বাস্থ‍্য, চিকিৎসায় ভোগান্তি ও কষ্ট বেড়েছে কয়েকগুণ। মানুষকে জিম্মি করে পথঘাট বন্ধ করা হলেও তাতে মোটেও কর্ণপাত করছেন না আন্দোলনকারীরা। এই সমস্থ বিষয় নিয়ে অতিষ্ঠ ও ক্ষুব্ধ অধিকাংশ পথচারী ও সাধারণ ঢাকাবাসী।

কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই দাবি আদায় বা আন্দোলনের অজুহাতে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করার নামে রাজপথ, রেলপথ অবরোধ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে জনঅসন্তোষ ও সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন এবং অর্থনীতি ও নিরাপত্তা ব‍্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করে প্রশাসন ও সাধারণ জনগণকে বিপর্যস্ত করে তুলে ক্রমাগত দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া দ্রুত বন্ধ করতে হবে। আন্দোলনের নামে রাজপথ বন্ধ করে দেওয়া এবং সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে কষ্ট দেওয়া সম্পূর্ণ অনুচিত।


কর্মক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি বনাম পুরোনো মনোভাব—বাংলাদেশ সংস্করণ

প্রফেসর ড. ইকবাল আহমেদ
আপডেটেড ২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ২৩:৪৮
সম্পাদকীয়

কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি বলতে এখন শুধু যন্ত্র নয়, এক ধরনের মানসিক অবস্থাও বুঝায়। আমাদের দেশে কেউ কেউ একে ভবিষ্যতের চাবিকাঠি বলে, কেউ ভয় পায় ‘মানুষ খাওয়া, চাকরি খাওয়া’ রোবট ভেবে। কেউ আবার মনে করে, প্রযুক্তি মানেই ‘ফেসবুকে বেশি সময় দেওয়া যায়’—কারণ অফিসের ইন্টারনেটই এখন সভ্যতার মাপকাঠি! তবে যেভাবেই দেখা হোক না কেন, উন্নত প্রযুক্তি এখন ঢুকে পড়েছে আমাদের সর্বত্র কাজের মাঝে, অনেকটা নিঃশব্দে, অনেকটা চায়ের কাপের ফেনার মতো। প্রশ্ন হলো—আমরা কি সত্যিই প্রস্তুত?
প্রযুক্তির আগমন—চায়ের টেবিল থেকে ক্লাউডে
একসময় অফিসে প্রযুক্তির মানে ছিল মোবাইল ইন্টারনেট কিংবা একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার, যেটা চালু হতে সময় নিতো এক কাপ চা ঠাণ্ডা হওয়ার সমান। এখন সেই যুগ পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গেছি ক্লাউড, অটোমেশন, আইওটি আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে। অনেক প্রতিষ্ঠান ভিডিও কনফারেন্স করছে হরদম, ক্লাউড সার্ভারে ফাইল রাখছে, AI কিংবা Copilot দিয়ে রিপোর্ট তৈরি করছে।
তবে বাস্তবতা কিছুটা অন্যরকম। ভিডিও কলে, জুম মিটিং-এ কেউ কথা বলছে, বাকিরা বলছে—‘ভাই, আওয়াজ যাচ্ছে না!’ বা ‘আপনার নেটওয়ার্ক ফ্রিজ!’। অফিসে ক্লাউড ব্যবহার মানে এখনো অনেকের কাছে ‘গুগল ড্রাইভে জায়গা ফুরিয়ে গেছে’ বোঝানো। AI রিপোর্ট তৈরি করছে ঠিকই, কিন্তু কখনো কখনো সেই AI এবং IoT বসের মুখ চিনতে না পেরে গেটের দারোয়ানকেই ‘চিফ অফিসার’ ঘোষণা করে বসছে।
চ্যালেঞ্জ—যন্ত্র উন্নত, মনোভাব আগের জায়গায়
সত্যি বলতে কি-প্রযুক্তি যত উন্নত হোক, আমাদের মানসিক প্রস্তুতি রয়ে গেছে এখনো পুরোনো দিনের ফাইল-নির্ভর কাঠামোয়। বিশেষ করে সরকারি অফিস–আদালতের দিকে তাকালে বোঝা যায়, প্রযুক্তি সেখানে এখনো অতিথি, বাসিন্দা নয়। অনেক জায়গায় ‘ডিজিটাল ফাইল ম্যানেজমেন্ট’ মানে হলো স্ক্যান কপি প্রিন্ট করে আবার ফাইলে রেখে দেওয়া। ই-মেইলে চিঠি পাঠানোর চেয়ে ডাকযোগে পাঠানো এখনো বেশি ‘নির্ভরযোগ্য’ মনে হয়, সফটকপি আপলোড করলেও হার্ডকপি ডাকযোগে পাঠাতে হয়।
এই অনীহার মূল কারণ মানসিক ও প্রাতিষ্ঠানিক জড়তা। দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে শুরু হয় ‘সেমিনার’, তারপর ‘কমিটি’, এরপর ‘উদ্বোধন অনুষ্ঠান’—কিন্তু বাস্তব ব্যবহার শুরু হতে হতে সফটওয়্যারটির হয়ত মেয়াদই প্রায় শেষ। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রযুক্তিকে বোঝেন অতিরিক্ত ঝামেলা হিসেবে—যেন কম্পিউটার চালালেই কাজের চাপ বেড়ে যাবে। ফলে ‘ডিজিটাল অফিস’ এখনো অনেক ক্ষেত্রে শুধু ফেস্টুনে ঝুলে আছে, ফাইলে নয়।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বল ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার—দেশের অনেক স্থানে ইন্টারনেটের গতি এমন যে অনলাইনে ফাইল খোলার আগেই এক কাপ চা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সার্ভার রুম আছে, কিন্তু সার্ভার নেই; আছে কেবল তালা আর ধুলাবালি। বিদ্যুৎ গেলে অফিসের নেটওয়ার্কও ঘুমিয়ে পড়ে, সার্ভার ডাউন হয়—আবার চালু হতে যত সময় লাগে, ততক্ষণে মিটিংয়ের আগ্রহ, কাজের আগ্রহও শেষ হয়ে যায়।
সবশেষে, আছে ডেটা সিকিউরিটি নিয়ে ভয়। অনেক সরকারি অফিস কর্মকর্তা মনে করেন, ‘ডেটা ক্লাউডে রাখলে বিদেশীরা দেখে ফেলবে।’ ফলে ফাইল পেনড্রাইভে ঘুরে বেড়ায়, কেউ কেউ নিজের জিমেইলে সরকারি নথি পাঠান—‘ব্যাকআপ’ নামে। কিন্তু এই ভয় একদিক থেকে বাস্তবও, কারণ আমাদের দেশের সাইবার নিরাপত্তা এখনো দুর্বল, তথ্য চুরির আশঙ্কা অমূলক নয়। তাই দেখা যায়—যন্ত্র উন্নত, কিন্তু মনোভাব আগের জায়গাতেই আটকে আছে।
প্রশিক্ষণহীন প্রযুক্তি ব্যবহার—বিপদে অফিস
আধুনিক সফটওয়্যার আনা হয়েছে, কিন্তু চালাতে জানে না কেউ—এমন দৃশ্য এখনও খুব পরিচিত। কোনো প্রতিষ্ঠানে ERP সিস্টেম বসানো হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত Excel-ই চালু, কারণ পাসওয়ার্ড ভুলে গেছে সবাই! HR সফটওয়্যার কেনা হয়েছে, কিন্তু তথ্য আপলোড করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এমন কাউকে, যিনি এখনো মনে করেন ‘কম্পিউটার ভাইরাস’ মানে ‘কম্পিউটার ঠাণ্ডা লেগেছে’।
সবচেয়ে বড় কথা, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তি আনে ‘দেখানোর’ জন্য। কেউ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নাম দেয়, কিন্তু কাজ চলে সাধারণ ফর্মুলা দিয়েই; কেউ বলে IoT আছে, আসলে শুধু Wi-Fi লাইট বাল্বই বসানো হয়েছে।
প্রযুক্তির মানবিক দিক—যন্ত্র কাজ করে, মানুষ হাসে
তবুও প্রযুক্তি কোনো অভিশাপ নয়। বরং সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এটি আমাদের কাজকে সহজ, দ্রুত ও স্বচ্ছ করে তুলতে পারে। অটোমেশন এখন অনেক অফিসে রুটিন কাজ কমিয়ে দিয়েছে—যেমন উপস্থিতি রেকর্ড করা, রিপোর্ট তৈরি, ডকুমেন্ট ট্র্যাক করা। এতে কর্মীরা এখন কফির কাপে ফেনা দেখেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করার সময় পান।
AI ব্যবহার করে ডেটা বিশ্লেষণ, ক্লাউড দিয়ে দূরবর্তী সহযোগিতা, ডিজিটাল ফাইল ব্যবস্থাপনা—সবই উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করছে। সরকারও বিভিন্ন সময়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার পরিকল্পনা নিচ্ছে, যেখানে অফিসের কাজ হবে দ্রুত, দক্ষ ও স্বচ্ছভাবে। শুনতে দারুণ, তবে বাস্তবায়নে প্রয়োজন বাস্তব প্রস্তুতি—যতক্ষণ না ‘লগইন পাসওয়ার্ড ভুলে গেছি’ জাতীয় সমস্যার সমাধান হয়।
প্রযুক্তি বনাম অফিস রাজনীতি
বাংলাদেশি অফিস সংস্কৃতিতে প্রযুক্তি যত উন্নতই হোক, অফিস রাজনীতি কিন্তু চিরন্তন। কেউ বলবে, ‘AI রিপোর্টে আমার নাম নেই কেন?’ আবার কেউ সন্দেহ করবে, ‘সফটওয়্যার আমার মেধা বুঝতে পারেনি।’ ফলে প্রযুক্তি যত স্বচ্ছ, ততই অভিযোগের খোরাক বাড়ে। অনেক সময় রোবটেরই ইউনিয়ন লাগবে মনে হয়—যে বলবে, ‘আমার ওপর দোষ চাপাবেন না, আমি কেবল নির্দেশ মানি।’
Excel কিংবা Word ফাইলের নাম দেওয়ার দিকেও দেখা যায় এক ধরনের সাংস্কৃতিক শিল্প—Final.xlsx, Final_Approved, Final_Approved_This_Time, Final_Last_Use_This_One। তাই মনে হয়, প্রযুক্তির সাথে আমাদের সৃজনশীলতা এখনো অটুট, যদিও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
সম্ভাবনা—যদি ইচ্ছা থাকে, পথ মিলবেই
সব মজার আড়ালে সত্য হলো—উন্নত প্রযুক্তি বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রের জন্য বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। সময় বাঁচানো, উৎপাদন বাড়ানো, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা—সবকিছুতেই এটি ভূমিকা রাখতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অটোমেশন যদি সঠিক প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো এবং মানসিক প্রস্তুতির সাথে ব্যবহৃত হয়, তবে অফিসগুলো হবে আরও দক্ষ ও আধুনিক।
বিগত বেশ কিছুকাল ধরে দেশের নীতি নির্ধারকরা ঘোষণা দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে হাঁটছে। কর্মক্ষেত্রে এই উদ্যোগের প্রতিফলন ঘটলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমবে, কাজের গতি বাড়বে, এবং অফিসে কাগজের পাহাড় ছোট হবে। তখন হয়তো একদিন কেউ বলবে না, ‘ভাই, প্রিন্ট হইতাছে না, আইটির লোক কই!’—বরং বলবে, ‘এ্যলেক্সা/সিরি, ফাইলটা ইমেইল করে দে।’
শেষকথা—যন্ত্র নয়, মানুষই আসল শক্তি
প্রযুক্তি যত উন্নতই হোক, মানুষের বুদ্ধি, সৃজনশীলতা আর মানবিক বোধই সবচেয়ে বড় সম্পদ। যন্ত্র আমাদের সময় বাঁচাতে পারে, কিন্তু সম্পর্ক গড়তে পারে না। তাই প্রযুক্তিকে প্রতিপক্ষ নয়, সহযাত্রী ভাবতে শিখতে হবে।
হয়তো ভবিষ্যতে রোবট বস এসে বলবে, ‘আপনার পারফরম্যান্স ভালো, কিন্তু আপনি অনেক কফি খান, ব্রেক নেন।’ তখন আমরা হেসে বলব, ‘এই তো, প্রযুক্তি সত্যিই মানুষ হয়ে যাচ্ছে।’

প্রফেসর ড. ইকবাল আহমেদ : কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


বৈশ্বিক কালোবাজার ও চোরাচালানের ভয়ংকর অর্থনীতি

সোমা ঘোষ মণিকা
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বিশ্ব অর্থনীতির দৃশ্যমান জগৎ যত শক্তিশালী, তার পেছনের অন্ধকার দিকটিও তত গভীর। এই অন্ধকার দিকের নাম হলো- কালোবাজার ও চোরাচালান ভিত্তিক অর্থনীতি। এখানে মুদ্রার রঙ বদলে যায়, কিন্তু অর্থের প্রবাহ থামে না।

জাতিসংঘের অনুমান অনুযায়ী, বৈশ্বিক অবৈধ অর্থনীতির বার্ষিক পরিমাণ প্রায় ২.১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের মোট জিডিপির প্রায় ২.৫%। এই অর্থের উৎস মাদক, অস্ত্র, দেহব্যবসা, মানবপাচার, স্বর্ণ ও হীরা চোরাচালান এবং প্রত্নবস্তু বাণিজ্য। এই গোপন অর্থনীতি একদিকে দারিদ্র্য, দুর্নীতি, সহিংসতা ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে, অন্যদিকে কিছু ক্ষেত্রে অর্থপ্রবাহ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদন চক্রে ক্ষণস্থায়ী ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই, ‘কালোবাজার’ কেবল অপরাধের গল্প নয়। এটি বিশ্ব অর্থনীতির এক জটিল ছায়া বাস্তবতা।

কালোবাজার (Black Market) হলো সেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্র যেখানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ, কর, বা আইনি অনুমোদন ছাড়াই পণ্য ও সেবা লেনদেন হয়। অন্যদিকে, স্মাগলিং (Smuggling) হলো রাষ্ট্রের সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে পণ্য আমদানি বা রপ্তানি করা। দুইয়ের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে কালোবাজার হলো ভোগের জায়গা, আর স্মাগলিং হলো সরবরাহের পথ।গোপন লেনদেন ও নগদ অর্থ ব্যবহার, আইনি শাস্তির ঝুঁকি, মাফিয়া, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর অংশগ্রহণ, ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ডার্কনেটের ব্যবহার, বিশ্বব্যাপী এই গোপন অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী খাত পাঁচটি: (১) মাদক ব্যবসা, (২) মানবপাচার ও দেহব্যবসা, (৩) অস্ত্র বাণিজ্য, (৪) মূল্যবান ধাতু ও রত্ন চোরাচালান, (৫) প্রত্নবস্তু পাচার।

জাতিসংঘের UNODC World Drug Report 2024 জানায়, বিশ্বের অবৈধ মাদক ব্যবসার বার্ষিক বাজারমূল্য প্রায় ৩৫০-৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

এই বিশাল অর্থনৈতিক প্রবাহ আফগানিস্তান, মায়ানমার, কলম্বিয়া, মেক্সিকো, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান ও ইরানের মতো দেশগুলোকে ঘিরে গড়ে উঠেছে।

মূল মাদক চোরাচালানের পথ গুলো হলো: গোল্ডেন ক্রিসেন্ট: আফগানিস্তান-ইরান-পাকিস্তান।

গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল: মায়ানমার-থাইল্যান্ড-লাওস।

লাতিন আমেরিকা: কলম্বিয়া-পেরু-বলিভিয়া। (কোকেইন উৎপাদক দেশ)। মাদক চোরাচালান থেকে আসা অর্থ প্রায়শই মানিলন্ডারিং হয়ে ব্যাংক, রিয়েল এস্টেট, এমনকি রাজনীতিতেও ঢুকে পড়ে।

উৎপাদনশীল জনশক্তির পতন,স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতা বৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে কর ফাঁকি ও দুর্নীতি। ইতিবাচক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ খুবই সীমিত যেখানে মাদক উৎপাদনকারী দেশগুলোর গ্রামীণ অর্থনীতিতে আংশিক কর্মসংস্থান ও পণ্যবিনিময় প্রবাহ দেখা যায়, যা অর্থনৈতিক কার্যক্রমের একটি অদ্ভুত ভারসাম্য তৈরি করে।

Global Slavery Index 2023 অনুযায়ী, পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ আধুনিক দাসত্বে রয়েছে। যার মধ্যে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ নারী ও শিশু।

এই পাচারের মূল উদ্দেশ্য যৌন ব্যবসা, জোরপূর্বক শ্রম, ও অঙ্গ পাচার।

বিশ্বব্যাপী বাজারমূল্য: আনুমানিক ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রধান দেশসমূহ: ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়া, ইউক্রেন ও রোমানিয়া।

নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক বিভাজন, জনস্বাস্থ্য সংকট (HIV, STD), নারী ও শিশুদের শিক্ষাবঞ্চনা, পরিবার কাঠামো ধ্বংস। ইতিবাচক দিক (অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে, নৈতিকভাবে নয়): যেসব দেশে দেহব্যবসা বৈধ (যেমন নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড), সেসব দেশে যৌনশিল্প থেকে কর আদায়ের মাধ্যমে সরকারি আয় বৃদ্ধি ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। তবে উন্নয়নশীল দেশে এটি নীতিহীন অর্থনীতির মাধ্যমে সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি করছে।

Small Arms Survey 2024 (Geneva) অনুযায়ী, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার বার্ষিক আয় ৯০-১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অস্ত্র পাচার সাধারণত যুদ্ধ ও সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত , আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও আফগানিস্তান।

প্রধান উৎস দেশ: যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, উত্তর কোরিয়া। প্রধান বাজার: নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, সিরিয়া, লিবিয়া, কঙ্গো।

সংঘাতের অর্থায়ন বৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যয় বৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগে ভয়, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা।

তবে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো দেশে অস্ত্র শিল্প বৈধভাবে জিডিপিতে অবদান রাখে, যা এই খাতের দ্বৈত চরিত্রকে স্পষ্ট করে। বিশ্বব্যাপী স্বর্ণ চোরাচালানের বার্ষিক পরিমাণ ৩০-৪০ বিলিয়ন ডলার, আর হীরা পাচারের বাজার প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। আফ্রিকার সিয়েরা লিওন, কঙ্গো ও অ্যাঙ্গোলা অঞ্চলের ‘Blood Diamond’ যুদ্ধগুলির অর্থায়নে ব্যবহার হয়েছে।

আফ্রিকা- দুবাই- ভারত- সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আমেরিকা - ইউরোপ, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তেও স্বর্ণ চোরাচালানের প্রচুর নজির রয়েছে।

বৈধ ব্যবসার ক্ষতি, রাষ্ট্রীয় রাজস্ব ক্ষয়,‌ আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারে ভারসাম্যহীনতা। যদিও কিছু দেশে এই পাচারের মাধ্যমে অল্প সময়ের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ দেখা যায়, দীর্ঘমেয়াদে তা অর্থনীতিকে ধ্বংস করে। UNESCO (2022) জানিয়েছে, প্রতি বছর ৮-১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের প্রত্নবস্তু অবৈধভাবে পাচার হয়। প্রধান উৎস অঞ্চল - ইরাক, সিরিয়া, মিশর, ভারত, বাংলাদেশ, গ্রিস, ইতালি; এগুলির বড় অংশ পরে ইউরোপ ও আমেরিকার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা বা জাদুঘরে দেখা যায়।

সাংস্কৃতিক পর্যটনের ক্ষতি,জাতীয় ইতিহাস বিকৃতি, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও পরিচয়হানি, প্রত্নবস্তু পাচার কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক অপরাধ, যা একটি জাতির স্মৃতি চুরি করে। অর্থনীতি কর আদায় হ্রাস, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা আফ্রিকায় হীরা পাচার ও জিডিপি পতন; রাজনীতি দুর্নীতি, মাফিয়া রাজনীতি লাতিন আমেরিকায় ড্রাগ কার্টেল, সমাজ বেকারত্ব, নৈতিক অবক্ষয় দক্ষিণ এশিয়ায় মানবপাচার। নিরাপত্তা সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধি মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র বাণিজ্য। এছাড়াও, অর্থ পাচার ও কর ফাঁকি রাষ্ট্রীয় রাজস্বের ১০-১৫% ক্ষতি করে, যার ফলে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থসংকট দেখা দেয়।

যদিও এই প্রভাব নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, তবুও অর্থনীতিবিদদের মতে অবৈধ অর্থপ্রবাহের কিছু ‘প্যারাডক্সিকাল’ সুবিধা আছে। যেমন:

১, অর্থপ্রবাহের ধারাবাহিকতা: কালোবাজারের লেনদেন অর্থনীতিতে নগদ অর্থের গতি বাড়ায়।

২, গোপন কর্মসংস্থান: উন্নয়নশীল দেশে কিছু মানুষ এই খাতে অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে জড়িত থাকে।

৩. বিনিয়োগ প্রবাহ: অবৈধ অর্থ প্রায়শই রিয়েল এস্টেট, ব্যাংকিং ও অবকাঠামো খাতে প্রবেশ করে-যা সাময়িক অর্থনৈতিক স্থিতি আনে।

তবে এই ‘ইতিবাচকতা’ আসলে অস্থায়ী এবং ভুয়া স্থিতিশীলতা, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দুর্নীতি বাড়ায়।

অঞ্চল প্রধান দেশ মূল অবৈধ খাতসমূহ গুলো হলো: দক্ষিণ এশিয়া ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল মাদক, মানবপাচার, স্বর্ণ চোরাচালান। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থাইল্যান্ড, মায়ানমার, লাওস মাদক ও যৌনশিল্প। মধ্যপ্রাচ্য ইরান, আফগানিস্তান, সিরিয়া অস্ত্র ও আফিম। আফ্রিকা নাইজেরিয়া, কঙ্গো, সিয়েরা লিওন হীরা ও অস্ত্র।ইউরোপ রাশিয়া, ইউক্রেন, আলবেনিয়া মানবপাচার ও অস্ত্র। লাতিন আমেরিকা কলম্বিয়া, মেক্সিকো, পেরু কোকেইন। ওশেনিয়া অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড বৈধ যৌনশিল্প (আংশিক)।

বাংলাদেশ এখানে মাদক ও মানবপাচার রুট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে - মায়ানমার থেকে ইয়াবা আসে, আর নারীরা পাচার হয় ভারতে ও মধ্যপ্রাচ্যে।

প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে যেমন:

UNODC ও Interpol এর যৌথ অভিযান বাড়ানো।

.FATF-এর সন্ত্রাস অর্থায়ন নজরদারি শক্তিশালী করা।

Arms Trade Treaty (ATT) বাস্তবায়ন। Blockchain Technology দ্বারা স্বর্ণ ও রত্নের উৎস ট্র্যাকিং। UNESCO Heritage Protection Act কার্যকর করা।

সীমান্তে উন্নত স্ক্যানার ও ড্রোন নজরদারি। মানিলন্ডারিং রোধে ব্যাংক তদারকি বৃদ্ধি। শিক্ষা ও সচেতনতা কর্মসূচি। দেহব্যবসা ও মানবপাচারবিরোধী আইনের কঠোর বাস্তবায়ন। বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি। প্রযুক্তি-নির্ভর উদ্যোগ, AI-ভিত্তিক আর্থিক ট্র্যাকিং, ডার্কনেট মনিটরিং সিস্টেম, সাইবার ফরেনসিক টিম গঠন। কালোবাজার যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তবে যে ক্ষতি সমূহে সম্মুখীন হতে হবে: ডার্কনেট ও ক্রিপ্টোকারেন্সি আগামী দিনে অবৈধ বাণিজ্যের প্রধান মুদ্রা হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা অবৈধ লেনদেন ধরতে আরও কার্যকর হবে। মানবপাচার ও অঙ্গব্যবসা জনসংখ্যা সংকট ও দারিদ্র্য যুক্ত দেশগুলোতে বাড়বে। উন্নত দেশগুলিতে অবৈধ অর্থের ‘রেগুলেটেড লিগালাইজেশন’ হতে পারে, যেমন: মারিজুয়ানার বৈধকরণ। যদি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দৃঢ় হয়, তবে ২০৭৫ সালের মধ্যে অবৈধ বাণিজ্যের পরিমাণ ২৫-৩০% পর্যন্ত কমতে পারে।

বিশ্ব অর্থনীতির এই ছায়া অংশটি মানব সভ্যতার জন্য এক দ্বিমুখী বাস্তবতা। একদিকে এটি ধ্বংস, দুর্নীতি ও দাসত্বের জন্ম দেয়, অন্যদিকে আমাদের মনে করিয়ে দেয়। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও নৈতিক পতন রোধ না করলে অবৈধ অর্থনীতি আবার ফিরে আসবে। অতএব, আইন, প্রযুক্তি, শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক সংহতি এই চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে হতে হবে প্রতিরোধের কাঠামো।

শুধু শাস্তি নয়, বিকল্প সুযোগ সৃষ্টি করলেই কালোবাজারের অর্থনীতি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে।

একটি ন্যায্য, স্বচ্ছ ও মানবিক বিশ্ব গড়ার পথে সেটিই হবে প্রকৃত অগ্রগতি।

লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট।


হায়রে তালাকনামা কার দোষে তুই এলি?

মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

কয়েকদিন আগে ইউটিউবে দেখলাম ষাট/সত্তর দশকের সিনেমার অন্যতম কোনো এক জনপ্রিয় নায়িকা অকালেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। মৃত্যুর অব্যবহিত পর তার বাক্সে একটি তালাকনামা পাওয়া যায়, যা তিনি সযতনে রেখে দিয়েছিলেন। এতে কি প্রতীয়মান হয় না যে কতখানি হৃদয়ভাঙ্গা কষ্ট করে রেখে দিয়েছিলেন এই অনাকাঙ্ক্ষিত কাগজটি? একদিকে তার কাছে ঘৃণিত; আবার অন্যদিকে মহামূল্যবান। কেননা শুধু এর কারণে তার জীবনের মোড় সম্পূর্ণরূপে ঘুরে গিয়েছে। বস্তুত বাংলার পারিবারিক সংস্কৃতির আওতায় স্বামী কি স্ত্রী, যেই হোক না কেন, সহজে কেউ তালাক দিতে চায় না। একান্ত অবস্থার শিকার হয়ে এই ঘৃণিত কাজ করে থাকে। যে ভাবেই বলি না কেন, মানব জীবনে বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এক্ষেত্রে আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেছেন যে তোমাদেরকে আমি সৃষ্টি করেছি (স্বামী-স্ত্রী রূপে) জোড়ায় জোড়ায় (সূরা নাবা, আয়াত-৮)। বাল্যকালে এই রকম আরেকটি দুঃখজনক ঘটনা দেখেছিলাম, যা না হয় পরে তুলে ধরা হবে। যাহোক, প্রথমে তালাকের কিছু মৌলিক বিষয়কে ঘিরে সঙ্গতকারনেই নিম্নে আলোকপাত করার প্রয়াসী হয়েছি।

আজকের আধুনিক সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ বৈধ এবং আইন দ্বারা সমর্থিত হলেও সমাজে তার স্বীকৃতি পায় সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই। তাই তালাক তথা বিবাহবিচ্ছেদের প্রথা এখনকার নয়। এটি যিশুখৃষ্টের জন্মের অনেক আগ থেকেই চলে আসছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ১৯৭০ খৃষ্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবির রাজত্বকালে এই প্রথা প্রচলিত ছিল। এর নজির হিসেবে উল্লেখ্য যে তখনকার পাথরের গায়ে ২৮২টি আইন খোদাই করা ছিল, যার মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের আইনটি বলা তবিয়তে অন্তর্ভুক্ত ছিল। যতদূর জানা যায়, তাতে প্রতীয়মান হয় যে, আদিতে বিয়ে প্রথা প্রচলিত ছিল না। তখন স্বেচ্ছাচারিতা প্রকট ছিল। যে বেশি শিকার করতে পারতো বা ফসল ফলাতে পারতো তার সঙ্গী বা সঙ্গীনির অভাব হতো না। যাহোক, আদিম যুগে যখন মানুষ টোটেম গ্রুপের আওতায় সমাজবদ্ধ হতে থাকে, তখনই বিবাহ শুরু। আবার এইভাবে ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্য সম্বলিত দুটি পৃথক সত্ত্বা এক সূত্রে গাঁথা হলে ছন্দপতন হওয়া স্বাভাবিক বলে বিচ্ছেদও শুরু হয়। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, তালাকের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ডিভোর্স। এই ‘ডিভোর্স’ এসেছে ল্যাটিন শব্দ থেকে, যার অর্থ বিচ্ছেদ। আর এটি ‘ডিভোর্টের’ শব্দের সমতুল্য। এক্ষেত্রে ‘উর’ এর মানে আলাদা এবং এর অর্থ বিভিন্ন পন্থায় ঘুরে আসা। মজার ব্যাপার হলো যে, এই ডিভোর্স শব্দটি ১৪ শতকের পরবর্তী সময়ে ফরাসি শব্দভান্ডারে অর্ন্তুভুক্ত থাকলেও ১৩৫০-১৪০০ সালের দিকে ইংরেজিতে জায়গা করে নেয়। বর্তমানে, যদিও বিবাহবিচ্ছেদ বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ বা সংজ্ঞায়িত করা হয়। তবে তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের সর্বাধিক জনপ্রিয় সংজ্ঞাগুলির মধ্যে তিনটি উল্লেখ করা হলো। প্রথমত বিবাহের আওতায় সম্পূর্ণভাবে স্বামী এবং স্ত্রীকে একসাথে বসবাসের বৈবাহিক বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দেওয়ার একটি বিচারিক ঘোষণা; দ্বিতীয়ত প্রতিষ্ঠিত প্রথা অনুযায়ী স্বামী ও স্ত্রীর যে কোনো একজনের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ এবং শেষত সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ বা বিচ্ছিন্নতা, যা বৈবাহিক মিলনকে বিচ্ছিন্ন করা বুঝায়। মূলত তালাক শব্দটির উৎস আরবী ভাষা থেকে, যার অর্থ হলো কোনো কিছু ভেঙ্গে ফেলা বা ছিন্ন করা। মুসলিম আইনের বিধান মতে তালাক স্বামী-স্ত্রীর একটি বৈধ ও স্বীকৃত অধিকার। যখন স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এমন এক চরম নেতিবাচক পর্যায়ে পৌঁছায় যে দুইজনের পক্ষে একত্রে বসবাস করা সম্ভব হয় না। তখনই যে কোন এক পক্ষ থেকে বা উভয়েই কিছু নির্দিষ্ট উপায়ে তালাকের মাধ্যমে তাদের এই সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেন। উল্লেখ্য যে, মুসলিম আইনের বিধানমতে তালাক দেবার ক্ষমতা বা অধিকার স্বামী ও স্ত্রীর সমান নয়। স্বামীর এক্ষেত্রে প্রায় একচ্ছত্র ক্ষমতা রয়েছে। তথাপিও স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো এক জনের ইচ্ছেতে (কিছু আইনগত শর্ত পূরণের মাধ্যমে) তালাক হতে পারে। মুসলিম আইন অনুযায়ী নিম্নলিখিত ভাবে তালাক দেওয়া যায়:

স্বামীর পক্ষ থেকে তালাকের ব্যাপারে উল্লেখ্য যে আমাদের দেশে প্রচলিত মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন পূর্ণ বয়স্ক ও সুস্থ মস্তিস্কের মুসলিম ব্যক্তি যে কোনো সময় কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। এতে আইনের কাছে তাকে কোন জবাবদিহি করতে হয়না। আশ্চর্যর বিষয় হলো যে তাকে কেন তালাক দেওয়া হলো স্ত্রী তা জানতে চাইতে পারেনা। তবে এক্ষেত্রে এখনও অনেকে মনে করেন ‘এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক’ বা বায়েন তালাক উচ্চারণ করা মাত্র তালাক হয়ে যায়। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। স্বামী যে কোনো সময় তালাক দিতে পারলেও তাকে আইনগতভাবে সব নিয়ম মেনেই তালাক দিতে হয়।

এদিকে স্ত্রী তিন উপায়ে তালাক দিতে পারেন যেমন (ক) তালাক-ই-তৌফিজের মাধ্যমে (নিকাহনামার ১৮ নং ঘর বা অনুচ্ছেদ স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাকা প্রদানের ক্ষমতা অর্পন করে থাকে, সে ক্ষমতার বলে স্ত্রী যদি স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ চায়, তাহলে সে বিচ্ছেদ, তালাক-ই তৌফিজ বলে) (খ) খুলার মাধ্যমে (স্বামী এবং স্ত্রীর আলোচনার সাপেক্ষে নিজেদের সমঝোতার মাধ্যমে যে বিচ্ছেদ হয়, তাকে খুলা বলে। তবে স্বামীকে খুলা বিচ্ছেদে রাজি করানোর দায়িত্ব হচ্ছে স্ত্রীর। অবশ্য এক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীকে ইদ্দতকালীন সময়ে ও গর্ভস্থ সন্তানের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য)। (গ) এখন আদালতের মাধ্যমে তালাক অহরহ দেখা যায়। এ সূত্র ধরে স্বামী-স্ত্রী দুই জনই নিজেদের ইচ্ছাতে নিজেদের সম্মতিক্রমে সমঝতার মাধ্যমে তালাকের ব্যবস্থা করতে পারেন। যদিও বর্তমানে তালাক রেজিস্ট্রেশন করা এখন আইনের মাধ্যমে বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। তালাক প্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রী কি পুনরায় বিয়ে করতে পারবে? হাঁ পারে। সেক্ষেত্রে নতুন করে বিয়ে করতে হবে। আর তালাকের পর সন্তান কার কাছে থাকবে? এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে তালাকের পর সন্তান মায়ের কাছে থাকবে। ছেলে সন্তান ৭ বছর পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তান বয়ঃসদ্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে। তবে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব বাবা বহন করবে। যদি বাবা দায়িত্ব পালন না করে সেক্ষেত্রে চেয়ারম্যান সালিসীর মাধ্যমে আলাপ আলোচনা করে বিষয়টি মীমাংসা করতে পারেন। আর তালাক কখন প্রত্যাহার করা যায়? সেক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে ৯০ দিন অতিক্রান্ত হবার আগেই তালাক প্রত্যাহার করা যায়। মূলত কোন ব্যক্তি স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে তাকে যে কোনো পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথা শিগগিরই সম্ভব স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ/পৌর/সিটি চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে এবং স্ত্রীকে উক্ত নোটিসের নকল প্রদান করতে হবে। এ ব্যাপারে বিশদ আইন ও বিধিমালা রয়েছে, যা প্রবন্ধের কলেবরের সংক্ষিপ্ততার স্বার্থে বর্ণনা করা সম্ভব হলো না। তবে কিছুটা উল্লেখ না করা হলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই যৎকিঞ্চিত তুলে ধরা হলো।

শুধু দেশে নয় সারা বিশ্বেই তালাক জ্যামিতিক গতিতে বেড়ে চলেছে। আর তালাকের দিক দিয়ে আমেরিকা রেকর্ড করে ফেলেছে। তালাক এখন স্বাভাবিক ব্যাপার, যেন ভাত-মাছ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাহোক দেশে তালাক বাড়ছে। গ্রামে যেমন, তেমনই শহরে। শহরের চেয়ে গ্রামে তালাকের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক ২০২৩-এর ফলাফলে দেখা যায় যে, গ্রামে প্রতি ১০ হাজারে তালাকের সংখ্যা ১১, আর শহরে ৯। তালাক বৃদ্ধি বিশেষত গ্রামে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে এটি অধিক পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। গ্রামে বাল্যবিবাহের সংখ্যাও বেশি। যখন কম বয়সি একটি মেয়ের দুয়েকটি সন্তান নিয়ে তালাক হয়ে যায়, তখন তার দুর্ভোগ, বিড়ম্বনা ও অনিশ্চয়তার শেষ থাকে না। দ্বিতীয় বিবাহ যেমন তার জন্য কঠিন হয়ে ওঠে, তেমনি বাবা-মার কাছেও অনেক সময় আশ্রয় জোটে না কিংবা তাদের আশ্রয় দেয়ার মতো অবস্থা থাকে না। এহেন পরিস্থিতিতে তালাকপ্রাপ্তা ও তার সন্তান-সন্ততির কী দুঃসহ অবস্থা দাঁড়ায়, সেটা সহজেই আন্দাজ করা যায়। আসলে তালাকের কারণ প্রধানত দারিদ্র্য বা পারিবারিক ব্যয়বহনের অক্ষমতা। তাছাড়া পারিবারিক চাপ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন অক্ষমতা ইত্যাদিও তালাকের জন্য দায়ী। মূলত অভাব-দারিদ্র্য পারিবারিক অশান্তির প্রধান কারণ। আর পারিবারিক অশান্তি তালাকের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। পারিবারিক অশান্তি বা কলহ-বিবাদ স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর শারীরিক নির্যাতনের মূলে। দেখা গেছে যে, দেশের যে সব এলাকায় অভাব-দারিদ্র্য বেশি, সে সব এলাকায় তালাকের হার বেশি। এছাড়া বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণেও তালাক হতে দেখা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নৈতিক অবক্ষয় বেড়ে যাওয়ায় বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক সময় বেশি বয়সি বর ও বিপত্মীকের কাছেও বিয়ে দিতে বাধ্য হয়। কেননা মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। মেয়েদের জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, জবরদস্তি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। ইজ্জত-সম্মান রক্ষার স্বার্থে তারা কিছুমাত্র সুযোগ পেলেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে স্বস্তি লাভ করে। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত জুন মাসে প্রকাশ করা জরিপের ফল অনুযায়ী দেখা যায় যে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে তালাকের সংখ্যা বেড়েছে ১.৪ শতাংশ, যা আগে ছিল ০.৭ শতাংশ। আশ্চার্যর বিষয় হলো যে ঢাকায় গড়ে ৪০ মিনিটের ব্যবধানে একটি করে তালাকের ঘটনা ঘটছে। আর তালাকের দিক দিয়ে পুরুষকে পেছনে ফেলে মেয়েরা ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলছে। দুঃখের বিষয় হলো যে, এখন কোনো ঠুনকো বিষয় নিয়েও তালাক হয়। যাহোক বর্তমানে তালাক হওয়ার পেছনে উল্লেখ্যযোগ্য পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারন হলো পরকীয়া; মাদকাশক্ত; মোবাইল (ফেসবুক; ইউটিউব; টিকটক) প্রতিবেশি দেশের নেতিবাচক টিভি সিরিয়াল; বিদেশে অধিক সময় স্বামীর প্রবাসী জীবন; একে অন্যের সময় না দেয়া; চাকরি বা অন্য কাজে জড়িত; নির্যাতন; যৌতুক; মানসিক পীড়ন; বেপরোয়া জীবন; বদমেজাজ; সংসারের প্রতি উদাসিনতা; পুরুষত্বহীনতা; অবাধ্য হওয়া; শারীরিক চাহিদায় অপূর্ণতা; সন্তান না হওয়া, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তাছাড়া আধুনিকতার নামে ইদানীং পাশ্চাত্ত সংস্কৃতির আওতায় ডেটিং ও লিভ টুগেদার অনুপ্রবেশ করে পারিবারিক জীবন কাঁপিয়ে তুলছে।

পরিশেষে এই বলে শেষ করছি যে, তালাকের পক্ষে যতই যুক্তিতর্ক দেখাই না কেন। তালাক কোন সময় গ্রহণযোগ্য ও শুভ নয়, যা ফরিদা জীবন দিয়ে দেখিয়ে চির বিদায় নিয়েছে।

লেখক: মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব: বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।


রাজনীতি কি ব্যবসার জন্য কাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্র তৈরি করতে পারবে

ড. সুলতান মাহমুদ রানা
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক অদ্ভুত সময় পার করছে। সময়টা দৃশ্যত স্থিতিশীল, কিন্তু গভীরে অনিশ্চয়তাতেও ভরা। দেশের ব্যবসায়ীরা গত এক বছরে যতটা রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন, ততটা আর কোনো সময় ছিল কিনা- সেটি গবেষণাযোগ্য বিষয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে: ব্যবসায়ীরা এখন কেবল অর্থনীতির নয়, রাজনীতিরও ‘স্টেকহোল্ডার’। তারা শুধু লাভের হিসাব করছে না, বরং ভাবছে নির্বাচনের পর দেশের ক্ষমতার কাঠামো কী হবে, এবং সেই কাঠামো তাদের ব্যবসার ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে কিনা। গত ২৫ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদনে ব্যবসায়ীদের প্রতীক্ষার চিত্রটি বিশেষভাবে উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, নির্বাচিত সরকারের আগমনের প্রত্যাশায় ব্যবসায়ীরা এখন যেন এক প্রকার স্থবিরতার মধ্যে রয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বড় কোনো নীতিগত পরিবর্তন বা প্রণোদনা দেখা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, নির্বাচিত সরকারই তাদের জন্য নীতির ধারাবাহিকতা আনবে। কিন্তু কখন সেই সরকার আসবে, কে আসবে, এবং কীভাবে নীতি পরিচালনা করবেÑএই অনিশ্চয়তা এখন তাদের মূল ভয় বা শঙ্কা।
অন্যদিকে আরও একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নির্বাচন ঘিরে ব্যবসায়ীদের মানসিক দ্বিধা এখন বিনিয়োগের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। অনেক উদ্যোক্তা ইতোমধ্যে বিনিয়োগের প্রস্তুতি নিয়েছেন, কিছু প্রকল্প হাতে রেখেছেন, কিন্তু তারা বলছেনÑনির্বাচনের আগে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা ঝুঁকিপূর্ণ। নির্বাচনের পর যদি সরকারের রূপরেখা বদলে যায়, নীতিগত অগ্রাধিকার পাল্টে যায়, তাহলে সেই বিনিয়োগ হয়তো ডুববে। তাই তারা কৌশলে আছেন। এই ‘অপেক্ষা’র অর্থ আসলে অর্থনৈতিক স্থবিরতা। বিনিয়োগ না হলে উৎপাদন কমে, কর্মসংস্থান কমে, এবং পুরো অর্থনৈতিক প্রবাহ ধীরে যায়। ব্যাংক ঋণ বিতরণও কমে গেছে, শিল্প ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে, এবং বেসরকারি খাতে আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। আর এই আস্থা সংকটের মূল কারণÑরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। অর্থনীতির মৌলিক সূত্র হলো, বাংলাদেশ আজ সেই সূত্রের বাস্তব উদাহরণ।
আরও একটি দৈনিকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকারিতা ও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার চিত্র। সরকার গঠনের ১৪ মাস পেরিয়ে গেলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে। বাজেটের বাস্তবায়ন, প্রকল্প অনুমোদন, কিংবা বাণিজ্যনীতিÑসব ক্ষেত্রেই বিলম্ব ও অস্বচ্ছতা স্পষ্ট। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই ধরনের অচলাবস্থা সবচেয়ে ক্ষতিকর। কারণ তারা জানেন নাÑনীতির দিক কোনদিকে যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা না আসায় তারা পরিকল্পনা করতে পারছেন না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের প্রতিক্রিয়া। একটি সংবাদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের বাজারকে বলে বর্ণনা করছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশের শ্রমশক্তি ও বাজার সম্ভাবনা চমৎকার, কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে সেটি বিনিয়োগের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক আন্তর্জাতিক কোম্পানি ইতোমধ্যে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছে। এর ফলে, বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রবাহও মন্থর হয়েছে।
এখানে প্রশ্ন ওঠেÑ কেন বাংলাদেশের ব্যবসা রাজনীতির উপর এত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে? এর উত্তর খুঁজলে দেখা যায়, রাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এখানে সবসময়ই দুর্বল ছিল। একটি সরকার যে নীতি নেয়, পরের সরকার সেটি বদলে দেয় বা নতুন রূপ দেয়। ফলে, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে আস্থা গড়ে ওঠে না। উদ্যোক্তারা জানেন না, পরের সরকার এলে তাদের নেওয়া সিদ্ধান্ত টিকে থাকবে কিনা। অনেক সময় এমনও হয়েছেÑ এক সরকারের সময় যেসব ব্যবসায়ী সুবিধাভোগী ছিলেন, অন্য সরকারের সময় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই চক্রাকার রাজনীতি ব্যবসার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সমাজ এখন একটি ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে তারা আশাবাদীÑদেশের অর্থনীতি বিশাল ভোক্তা বাজার, অবকাঠামো উন্নত হচ্ছে, রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আসছে। অন্যদিকে তারা ভয় পাচ্ছেনÑরাজনৈতিক ঝড় এলে সেই অগ্রগতি থেমে যেতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, নির্বাচনের পর সরকার যদি দ্রুত আস্থা পুনর্গঠন করতে না পারে, তাহলে অর্থনীতি ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদে’ আটকে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে সরকারেরও দায়িত্ব কম নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত ক্ষমতা থাকলেও, তারা অন্ততপক্ষে কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে পারতÑ যেমন ব্যবসা নীতিতে ধারাবাহিকতা ঘোষণা, বিনিয়োগ প্রণোদনা বজায় রাখা, কিংবা ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। কিন্তু এর পরিবর্তে দেখা গেছে নীতিগত অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক জটিলতা, এবং তথ্যের স্বচ্ছতার অভাব। এর ফলে ব্যবসায়ীরা সরকারের উপর আস্থা হারাচ্ছেন।
রাজনীতির বড় সমস্যা হলোÑ ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতা অর্থনীতির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো নানা প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু ক্ষমতায় এসে অনেক কিছুই বদলে ফেলে। অথচ উন্নত গণতন্ত্রে দেখা যায়, অর্থনৈতিক নীতি সাধারণত দলের পরিবর্তনে নাটকীয়ভাবে বদলায় না। যেমনÑভারত, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় সরকার পাল্টালেও শিল্পনীতি বা বিনিয়োগ নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন হয় না। এই ধারাবাহিকতাই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা দেয়। বাংলাদেশের জন্যও এই স্থিতিশীল নীতি সংস্কৃতি এখন সবচেয়ে জরুরি। অন্যদিকে, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও এখন রাজনৈতিক ভারসাম্যের খেলায় যুক্ত হয়ে পড়েছে। তারা একদিকে সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিতে চায়, অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার জন্য। এর ফলে তারা প্রকৃত নীতিগত চাপ প্রয়োগ করতে পারছে না। চেম্বার, ফেডারেশন বা বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনগুলো নীতিনির্ধারণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারত, কিন্তু তারা এখন অনেকটা প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থায় আছেÑঅর্থাৎ সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
এই অপেক্ষা দীর্ঘ হলে অর্থনীতি যে দিকেই তাকাক না কেন, দুর্বল হয়ে পড়বে। গত বছর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৬.২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আগের বছরের তুলনায় অনেক কম। দেশের তৈরি পোশাক খাত, যা রপ্তানির ৮৪ শতাংশ জোগায়, তার অর্ডারও কমছে। স্থানীয় শিল্পে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ঘাটতি নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
অর্থনীতির এই সংকট সমাধানে মূল পথ হলো রাজনৈতিক ঐক্য। ব্যবসায়ীরা চাইছেন, যে সরকারই আসুক, অন্তত পাঁচ বছর অর্থনৈতিক নীতি অপরিবর্তিত থাকুক। তারা চান না, প্রতিবার নতুন সরকারের সঙ্গে নতুন করে ‘রিসেট’ করতে। কিন্তু এই দাবির বাস্তবায়ন নির্ভর করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতার উপর। যদি রাজনৈতিক দলগুলো বুঝতে পারে, যে অর্থনীতি তাদের ক্ষমতার ভিত্তি, তাহলে তারা হয়তো দায়িত্বশীল হবে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্যÑবাংলাদেশের জনগণ এখন আগের চেয়ে বেশি অর্থনৈতিকভাবে সচেতন। তারা জানে, রাজনৈতিক অস্থিরতা মানেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান হ্রাস, ও জীবনের কষ্ট বাড়া। তাই জনগণের মধ্যেও এক ধরনের ‘অর্থনৈতিক শান্তির দাবি’ তৈরি হচ্ছে। এই দাবি যদি রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক নীতি স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

সবশেষে, বিষয়টি কেবল ব্যবসা বা রাজনীতি নয়- এটি রাষ্ট্রচিন্তার প্রশ্ন। বাংলাদেশ এখন এমন এক পর্যায়ে এসেছে, যেখানে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন হোক প্রতিযোগিতামূলক, কিন্তু তার ফল যেন অর্থনীতিকে পঙ্গু না করে। সরকার, বিরোধী দল, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজÑসবাইকে বুঝতে হবে, এই দেশটি কেবল ক্ষমতার নয়, টেকসই আস্থারও।
অতএব, এখন প্রয়োজন ‘নীতির রাজনীতি’র চেয়ে ‘রাজনীতির নীতি’Ñ যেখানে ক্ষমতার হিসাব নয়, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনাই হবে কেন্দ্রবিন্দু। ব্যবসায়ীরা যে অপেক্ষায় আছেন, সেটি কেবল নির্বাচনের ফল দেখার নয়; তারা অপেক্ষা করছেন এমন একটি রাষ্ট্রের জন্য, যেখানে নীতি বদলায় না, আস্থা ভাঙে না, আর উন্নয়ন থেমে থাকে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি তার ইতিহাসে বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এবারও পারবেÑযদি রাজনীতি তার হাত ধরে, তার পা না টানে। ব্যবসার আশা, নির্বাচনের পর রাজনীতি হয়তো এই শিক্ষা নেবেÑ দেশের উন্নয়ন কোনো দলের নয়, এটি সবার যৌথ বিনিয়োগ। রাজনীতি ও অর্থনীতিÑদুই চাকার মতো; একটির ভারসাম্য হারালে অন্যটি চলতে পারে না। তাই ব্যবসার উন্নতি চাইলে, প্রথমে দরকার স্থিতিশীল রাজনীতি। নির্বাচনের এই সময়টায় দেশের রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, যার উপর দাঁড়িয়ে একটি টেকসই অর্থনীতি গড়ে ওঠে। ব্যবসায়ীরা আজ সেই বিশ্বাসেরই অপেক্ষায় আছেন।

লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


পলিথিন তৈরিতে অসচেতনতাই দায়ী

প্রসপারিনা সরকার
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ এমনিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ তার ওপর অসচেতন মানুষের পরিবেশ বিমুখ কার্যকলাপে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর পরিবেশ বিপর্যয়ে কারণগুলির মধ্যে পলিথিন তৈরি ও ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।

বর্তমানে জনগণের অসচেতনতায় সর্বত্র পলিথিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে ভয়াবহ মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে সারা বাংলাদেশে। সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে একটু বৃষ্টিতেই ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটের অচল অবস্থা হয়। প্রবল বন্যার পানির মতো থৈ থৈ করে । বৃষ্টি হলে প্রথমে রাস্তায় ভেসে ওঠে ছোট-বড় অসংখ্য অসংখ্য শত সহস্র পলিথিন। যেন পলিথিনের প্রতিযোগিতা চলছে শহরের প্রতিটি রাস্তা রাস্তায়। বৃষ্টির পর প্রতিটি ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে দিলেও পানি দ্রুত অপসারণ, নিষ্কাষণ হয় না। ফলে চাকচিক্য শহরে বৃষ্টি হলেই রাস্তা ডুবে যায় মুহূর্তে । ঢাকা শহরসহ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরের চিত্র।

কিন্তু বর্তমানে কেউ আর হাট বাজারে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটার জন্য কাপড়ের ব্যাগ পাটের তৈরি ব্যাগ বা বাসের তৈরি ঝুড়ি ব্যবহার করে না। হাট বাজার, বড় বড় শপিংমল দোকান কাঁচা বাজারসহ যেখানেই যাবেন কিছু কিনতে গেলেই পলিথিনের ব্যাগ ধরিয়ে দিচ্ছে। একটি ডিম কিনলেও পলিথিন, পাঁচ টাকার কাঁচামরিচ কিনলেও পলিথিন, এমনকি রাস্তায় বিভিন্ন ফেরিওয়ালার কাছে দুই টাকার আচার কিনলেও সে ধরিয়ে দিচ্ছে অতি সস্তার পলিথিন। এই পলিথিন ব্যাগ অতি সস্তা বলে কেউ সংরক্ষণ এবং পরবর্তীতে আর ব্যবহার করছে না। কেননা তিনি যতবার দোকানে, মার্কেটে কাঁচাবাজারে যাবে এমন পলিথিন বিনামূল্যে আবার পাবেন। তাই নিত্যদিন পাওয়া ভালো মন্দ পলিথিন বজ্র হিসাবে ময়লা আবর্জনায় ফেলে দিচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- একচেটিয়া এতো শত শত ব্যবহৃত অব্যবহৃত অপচনযোগ্য পলিথিন কোথায়।

আগের দিনে মানুষ হাট বাজার করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করার জন্য পাটের ব্যাগ কাপড়ের ব্যাগ বা বাঁশের তৈরি ঝুড়ি খালোই ব্যবহার করতে এবং এবং ব্যবহার শেষে তা সংরক্ষণ করে বার সেই ব্যাগ এবং বাঁশের ঝুড়ি ব্যবহার করত যা ছিল মাটিতে পচনযোগ্য কিন্তু বর্তমানে কেউ আর হাট বাজার করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটার জন্য কাপড়ের ব্যাগ পাটের তৈরি ব্যাগ বা বাসের তৈরি ঝুড়ি ব্যবহার করে না হাট বাজার বড় বড় শপিংমল, দোকান, কাঁচাবাজারসহ যেখানেই যাবেন কিছু কিনতে গেলেই পলিথিনের ব্যাগ ধরিয়ে দিচ্ছে। একটি ডিম কিনলেও পলিথিন, ৫ টাকার কাঁচামরিচ কিনলেও পলিথিন, এমনকি রাস্তায় বিভিন্ন ফেরিওয়ালার কাছে দুই টাকার আচার কিনলেও সেও ধরিয়ে দিচ্ছে অতি সস্তার পলিথিন। এই পলিথিন ব্যাগ অতি সস্তা বলে কেউ সংরক্ষণ করছে না এবং পরবর্তীতে এই পলিথিন আর ব্যবহার করছে না। কেননা তিনি যতবার দোকানে যাবেন মার্কেটে যাবেন কাঁচাবাজারে যাবে -এমন পলিথিন বিনামূল্যে আবার পাবে। ফলে লক্ষ্য লক্ষ্য সহস্র পলিথিন বজ্র হিসাবে ময়লা আবর্জনায় ফেলে দিচ্ছে। অর্থাৎ ফেরিওয়ালা কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে মাছ মাংস, ফলের দোকান, ছোট বড় মার্কেট, শপিংমল সকল ক্ষেত্রে একচেটিয়া পলিথিনের ব্যবহার হচ্ছে যা সহজে পচনযোগ্য নয় ।

এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে পলিথিন উৎপাদনের কল কারখানা, প্রতিষ্ঠান, পলিথিন তৈরি উপর পূর্বের ন্যায় প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ম জারির প্রতি দৃষ্টিপাত এবং পলিথিন ব্যবহার কমানোর বিকল্প পাট, কাগজ ও কাপড়ের ব্যাগ তৈরি ও ব্যবহারে নিয়ম জারি করতে হবে। পক্ষান্তরে প্রশাসন সরকারের পাশাপাশি প্রচুর জনসচেতনতা কার্যক্রম, সভা-সেমিনার, মানববন্ধন ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনে সকল শ্রেণির জনগণকে অংশগ্রহণ করতে হবে।

সর্বোপরি জনগণ যদি সচেতন হয় একান্ত প্রয়োজন ছাড়া পলিথিন ব্যবহার না করে, অন্যকেও যদি যত্রতত্র পলিথিন ব্যবহারে অনুৎসাহিত ও বিকল্প ব্যাগ ব্যবহার উদ্বুদ্ধ করে তাহলে পলিথিন এর ব্যবহার আশানুরূপভাবে কমবে। আর ব্যবহার কমলে উৎপাদনও কমে যাবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপই পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার কমানোর অধিক ফলপ্রসূ হবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

লেখক: কবি ও উদ্যোক্তা।


বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় কার্যকর অংশগ্রহণের জন্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ

রেজাউল করিম খোকন
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

খেলনা রপ্তানি আগামী পাঁচ বছরে আট গুণের বেশি বাড়তে পারে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে বিশ্বের ৮৮টি দেশে খেলনা রপ্তানি হয়েছে সাড়ে সাত কোটি ডলারের বেশি। ২০৩০ সালে এই রপ্তানির আকার বেড়ে দাঁড়াতে পারে প্রায় ৪৭ কোটি ডলার। ফলে বৈশ্বিক খেলনা রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ২৮তম। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ২৭ কোটি ডলারের বেশি প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিকে এই খাতে প্রচ্ছন্ন রপ্তানি হয়েছে ১২০ কোটি ডলার। প্লাস্টিক শিল্পের দেশীয় বাজারের আকার এখন ৪০ হাজার কোটি টাকা। খাতটি সরকারকে বছরে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব দিয়েছে। দেশে প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার, যার অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই)। এর মধ্যে খেলনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ২৫০। বাংলাদেশের খেলনাশিল্পে সম্ভাবনা থাকলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মান নিয়ন্ত্রণের সমস্যা, দুর্বল অবকাঠামো ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগের ঘাটতি আছে। এর সঙ্গে খেলনাশিল্পে ছাঁচ ও নকশা উন্নয়নের অভাব আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশকে কঠিন করছে। এর আগে রপ্তানিশিল্পে বৈচিত্র্য আনতে হবে। ২০৩২ সালের মধ্যে বিশ্বের খেলনা বাজারের আকার দাঁড়াবে ১৫০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বিশ্বের খেলনা বাজারের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে চীন। তবে মজুরি বেড়ে যাওয়ায় তারা ধীরে ধীরে নিম্নমানের খেলনা উৎপাদন থেকে সরে আসছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন সুযোগ। বর্তমানে দেশে এই খাতে বিনিয়োগ ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০৩০ সালের মধ্যে এই বিনিয়োগ দ্বিগুণ হতে পারে। খেলনা রপ্তানির জন্য আমাদের আলাদা বাজার চিহ্নিত করতে হবে। দেশে তৈরি কিছু পণ্য কম মানের হলেও বিক্রি করা যায়। তবে বিশ্ববাজারে পণ্যের মান সর্বোচ্চ রাখতে হবে। খেলনা রপ্তানিতে ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করতে হবে। ছাঁচ ও নকশার প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হবে । স্থানীয় ছাঁচ যেভাবে তৈরি হচ্ছে, তা মানসম্পন্ন করছে না। স্বত্ব ও মেধাস্বত্বের বিষয়ে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ বেশি দেখা যায়। স্বত্ব ও ট্রেডমার্ক ব্যবস্থা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য নিরাপত্তার বলয় তৈরি করবে। এর ফলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক নতুন বাজারে দেশের প্রতিষ্ঠান সুযোগ পাবে। সরকার কিছু নীতিগত সহায়তা দেবে। তবে মান, প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়ন শিল্পোদ্যোক্তাদের নিজেদের করতে হবে। চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে আমাদের আরও শক্তিশালী হতে হবে। সরকার জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করছে। রপ্তানিমুখী খেলনাশিল্পকে এসব বাজারে রপ্তানির সুযোগ তৈরি করতে হবে। এই শিল্পে রপ্তানি শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর প্রয়োজন।এই একটি সম্ভবনাময় খেলনা শিল্প খাতের দ্রুত বিকাশ এবং উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের রপ্তানি বাজার বিস্তৃত করা যায় অনেকটাই। এরকম আরও অনেক অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে এত দিন ধরে অবহেলিত থাকা শিল্প ও কৃষি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া জরুরি হয়ে উঠেছে। কারণ, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রপ্তানি বহুমুখীকরণের বিকল্প নেই এই মুহূর্তে।

বাংলাদেশ। রপ্তানি বাণিজ্যের হাত ধরেই এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটতে পারে। রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে হয়তো নানা প্রতিকূলতা আছে, যা অতিক্রম করে সমৃদ্ধির ধারা বজায় রাখাটা নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের প্রত্যাশা, সব প্রতিকূলতা, বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে। রপ্তানি আয় বাড়াতে নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের মধ্যে রপ্তানি-বাণিজ্যকে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পৃথিবীর কোন দেশে কোন ধরনের পণ্যের চাহিদা রয়েছে তা জানতে হবে। এজন্য বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এদিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণে বাংলাদেশি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে খাদ্য ও কৃষিজাত শিল্প পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশের বেশ কটি ব্র্যান্ডের পণ্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ায় এর বাজার বিস্তৃতির উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এজন্য সময়োপযোগী, কার্যকর, বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।

বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় কার্যকর অংশগ্রহণের জন্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেশের রপ্তানি খাত এখনো গুটিকয়েক পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই আসে পোশাকশিল্প থেকে। এরপর রয়েছে চামড়া, পাটজাত পণ্য ও ওষুধপণ্য। স্বল্পপণ্যের ওপর এই অতিনির্ভরতা রপ্তানি নৈপুণ্য এবং অর্থনৈতিক স্থায়িত্বশীলতা উভয় দিক থেকে দুশ্চিন্তার। কাজেই রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের বিকল্প নেই। বাস্তবতা হলো, রপ্তানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। সেগুলোর মধ্যে আছে বর্তমান বাণিজ্য কাঠামোয় সমস্যা, বাণিজ্যনীতি ও প্রণোদনা ব্যবস্থা সম্পর্কিত সমস্যা, শুল্কায়ন পদ্ধতির জটিলতা, বিরাজমান বাণিজ্যনীতি ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা এবং অবকাঠামো ব্যবহার (বন্দর, পরিবহন প্রভৃতি) সেবায় মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়। রপ্তানি বৈচিত্র্য বেগবান করতে এগুলোর সমাধান এখন সময়ের দাবি। উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করলে এবং বিদ্যমান সুবিধাগুলো সংকুচিত হলে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য বছরে ৪-৫ বিলিয়ন ডলার কমে যাবে। তেমনটি হলে পুরো অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ পড়বে বৈকি। সুতরাং এটি বিবেচনা করে এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রচলিত পণ্যের বাইরে আরো কিছু পণ্যের রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আছে গ্লাস, ইলেকট্রনিক পণ্য, সিরামিকস, হালকা প্রকৌশল পণ্য, সিমেন্ট, আইটি পণ্য, কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, ছোট জাহাজ প্রভৃতি। শুধু পণ্য নয়, রপ্তানি গন্তব্যেও বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন। দেশের রপ্তানি বাজার প্রধানত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক। মূলত বিভিন্ন ধরনের অগ্রাধিকারমূলক ও শুল্ক সুবিধার কারণে বাজার প্রবেশাধিকারে তুলনামূলক ভালো করেছে বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সেখানে বাজার ধরে রাখা কঠিন। তাই নতুন রপ্তানি গন্তব্যের অন্বেষণ দরকার। জাপান, রাশিয়া, ব্রাজিল, চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় রপ্তানি গন্তব্য হতে পারে। রপ্তানি বাড়াতে ওইসব দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদারের পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করা বেশ সহায়ক হবে।পণ্য রপ্তানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে বাজার বহুমুখীকরণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের তৈরি-পোশাকবহির্ভূত পণ্যের বড় বাজার অপ্রচলিত বাজারগুলোতে বিদ্যমান। এসব বাজার মূলত ভারত, শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশকেন্দ্রিক। পাশাপাশি বাংলাদেশি অধ্যুষিত বা বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর অবস্থানরত দেশগুলোতে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী পণ্যের বাজার রয়েছে। অবশ্য এসব পণ্যের বাজার খুব বড় নয়। উপরোক্ত সব পণ্যের বাজারে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা খুব সীমিত আকারেই রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পারছেন ভিন্ন ভিন্ন কারণে। প্রথমত, অপ্রচলিত প্রায় প্রতিটি বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এসব দেশ উন্নয়নশীল হওয়ায় পণ্য রপ্তানিতে উচ্চ শুল্ক এক বড় বাধা। যেমন : রাশিয়া, ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বড় বাজারে ৩০-৪০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রপ্তানি সম্ভব নয়। রাশিয়ার মতো বাজারে সরাসরি এলসি খুলে রপ্তানির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ, যেমন চীন বা ভারত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিলেও বাংলাদেশ তা পর্যাপ্ত আকারে ব্যবহার করতে পারেনি। একটি নির্দিষ্ট খাত রপ্তানি বাজারে তখনই এগোতে পারে, যখন পণ্য ক্রেতারা পণ্যের অর্ডার দেওয়ার জন্য অনেক বিক্রেতার খোঁজ পান। দুর্ভাগ্যজনক হলো বাংলাদেশের বেশির ভাগ উদীয়মান খাতই মাত্র এক বা একাধিক স্বল্পসংখ্যক বিক্রেতা উদ্যোক্তার ওপর নির্ভরশীল। একটি নির্দিষ্ট খাতের ন্যূনতম সংখ্যক বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার উপস্থিতি না থাকলে ক্রেতা অর্ডার দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত থাকে। বেশির ভাগ খাত কিছু বৃহৎ উদ্যোক্তা বা গ্রুপ অব কোম্পানিজ নির্ভরশীল হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এসব খাতের বিকাশ শ্লথগতিতে হচ্ছে। এসব খাতে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ উদ্যোক্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক মানের পণ্য ও সেবা উৎপাদন ও প্রদানের ক্ষমতা থাকা জরুরি। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের গুরুত্ব রয়েছে। একক পণ্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা ঝুঁকি তৈরি করে। পণ্যের বহুমুখীকরণ এই ঝুঁকি কমিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনে। বাজার সম্প্রসারণ হলে, রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র্যময় হলে নতুন বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হয়, যা রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। উচ্চ মূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদনে সহায়তা করে রপ্তানির পরিমাণ ও আয় বাড়ানো সম্ভব হয়। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের জন্য রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ একটি জরুরি পদক্ষেপ। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জসমূহগুলো হলো, তৈরি পোশাকের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে, যা অন্যান্য খাতের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বহুমুখীকরণের কথা বলা হলেও এর অগ্রগতি খুবই ধীর। তৈরি পোশাকের বাইরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত পণ্য ও হালকা প্রকৌশল পণ্যসহ অন্যান্য খাতের রপ্তানি আয় এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। শুধুমাত্র তৈরি পোশাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য এবং হালকা প্রকৌশল পণ্যসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে উচ্চ মূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদনে সহায়তা করতে হবে। বাংলাদেশি পণ্যের ব্র্যান্ডিং এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচার বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এখনো অনেক দূর। যদিও দেশের রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার প্রয়োজনীয়তা দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচিত হচ্ছে তবুও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে খুবই কম। বাস্তবে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের কোনো পরিষ্কার চিত্র দেখা যাচ্ছে না। তৈরি পোশাক এখনো আধিপত্য বজায় রেখেছে।

রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।


গাজায় আপাতত স্বস্তি 

হাসান জাবির
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

গাজায় গণহত্যা বন্ধের লক্ষ্যে মিসরের শার্ম আল শেখে মার্কিন শান্তি প্রস্তাবে বিবদমান পক্ষগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে গত ১০ অক্টোবর ২০২৫ থেকে কার্যকর হয়েছে যুদ্ধ বিরতি। কয়েক ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য ওই শান্তিচুক্তির আলোকে হামলা বন্ধ করে ১০ অক্টোবরের মধ্যে গাজার একটি নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে ইয়েলো লাইন নামক কৌশলগত সীমারেখার মধ্যে স্থবির হয়ে পরেছে দখলদার সেনাদের কর্মকান্ড। যা মূলত গাজা থেকে স্থায়ী ও সম্পুর্ণ ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের পূর্বাবস্থা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। শান্তিচুক্তির প্রথম ধাপের শর্তের আলোকে আক্রান্ত না হলে ইসরায়েলি সেনারা আপাতত গাজায় যত্রতত্র ও নির্বিচার গুলি চালাতে পারবে না। পক্ষান্তরে দ্রুত দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়ে গাজার বিভিন্ন অংশে অবস্থান নিয়েছে হামাসের নিরাপত্তা বাহিনী। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের শুরুতেই নতুন করে সাত হাজার যোদ্ধাকে রণাঙ্গনে নিয়ে এসে গাজার সামগ্রিক নিরাপত্তা তদারকিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে হামাস। সেই সঙ্গে গাজার জনজীবনে স্বাভাবিকতা ফেরাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টাগুলোকে ফলপ্রসূ করতে অব্যাহত রয়েছে হামাসের তৎপরতা। বিশেষত ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে দ্রুত খাদ্য পৌঁছে দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোড় প্রচেষ্টায় কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে হামাসের বিভিন্ন বাহিনী। শান্তিচুক্তির শর্ত মোতাবেক ইতোমধ্যেই মুক্ত হয়েছে সব জীবিত ইসরায়েলি জিম্মি। মৃত জিম্মিদের কয়েকজনের মৃতদেহ ইসরায়েলে পাঠানো হয়েছে। যদিও এখনো কয়েকটি মৃতদেহ ফেরত দিতে পারেনী হামাস। এজন্য তারা কিছু সময় চেয়েছেন। বিপরীতে ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছে প্রায় তিন হাজার ফিলিস্তিনি। যার মধ্যে রয়েছে হামাসের গুরুত্বপূর্ণ চার সদস্য। ধারণা করা হচ্ছে বিভিন্ন মেয়াদে ইসরায়েলে কারাভোগ করা এই চার নেতা হামাসের নেতৃত্ব শুন্যতা দূর করতে সক্ষম হবে। গাজা যুদ্ধে বিবদমান দুই পক্ষ হামাস ও ইসরায়েলের মৌখিক সম্মতিতে যেসব দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে তারা সবাই মধ্যস্থতাকারী। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছারাও রয়েছে তুরস্ক, মিসর ও কাতার। এই দেশগুলো মূলত চুক্তির গ্যারেন্টর হিসেবে কাজ করবে। এই অবস্থায় ১০ অক্টোবরের পর গাজায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধ থাকলেও হামাসের অভিযোগ কমপক্ষে পঞ্চাশ বার যুদ্ধ বিরতির শর্ত লংঘন করেছে আইডিএফ। বিপরীতে যুদ্ধ বিরতি কার্যকর থাকার মধ্যেই ভিন্ন ধরনের একটি আক্রমণে গাজায় প্রাণ হারিয়েছে দুইজন ইসরায়েলী সেনা। ওই ঘটনায় আহত হয়েছে আরও কয়েক জন। সঙ্গতকারনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে গাজায় বিদ্যমান শান্তি কতদিন টিকে থাকবে? এই অনিশ্চয়তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইসরায়েলি দুর্বৃত্তায়নের সুদীর্ঘ ইতিহাস। পেছনের দিকে তাকালে আমরা দেখব যে কখনোই এ ধরনের চুক্তি কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সিদ্ধান্তকে পরোয়া করেনি ইসরায়েল। তাই মার্কিন প্রস্থাবিত তুরস্ক, কাতার, সৌদি আরব, মিসরের মধ্যস্থতায় কয়েক ধাপের গাজা শান্তিচুক্তির প্রতি ইসরায়েল কতটা সম্মান প্রদর্শন করবে সেটি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উৎকন্ঠা খুবই স্বাভাবিক। সর্বশেষ মার্কিন শান্তি প্রস্থাব বাস্তবায়নের এই প্রক্রিয়ায় -ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হামাসের পরোক্ষ আলোচনার খবর সম্পর্কে সবাই অবগত আছেন। হামাসকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে তাদের সঙ্গে যেকোনো ধরনের আলোচনায় অংশ নিতে বরাবর অনীহা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের। এমনকি ৭ অক্টোবরের পরেও হামাসের আলোচনায় প্রস্থাব প্রত্যাখ্যান করে ইসরায়েল। এ পর্যায়ে যুদ্ধের মাধ্যমে জিম্মি উদ্ধারের ইসরায়েলি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই বাস্তবতায় মিসরে হামাস- ইসরায়েল, হামাস- যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষ আলোচনা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটির বড়ো ধরনের রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবেই দেখা হচ্ছে। হামাসের রাজনৈতিক শাখার গুরুত্বপূর্ণ নেতা খলিল আল হায়ার নেতৃত্বে ওই আলোচনায় অগ্রাধিকার পেয়েছিল জিম্মি মুক্তি ও মানবিক সহায়তার বিষয়গুলো। গণমাধ্যমে চাউর হলেও হামাসের নিরস্ত্রীকরণ, গাজার সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রশাসন প্রতিষ্টার মার্কিন ধারনা নিয়ে যেকোনো আলোচনার খবর প্রত্যাখ্যান করেছে প্রতিরোধ সংগঠনটি। এ পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও কয়েকটি আরব দেশ এই চুক্তিকে স্বাগত জানালেও সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে রাশিয়া, ইরান ও চীন। ইতোমধ্যে যুদ্ধ বিরতি পর্যবেক্ষণের উদ্দেশে ইসরায়েলে মোতায়েন করা হয়েছে মার্কিন সেনা। সেইসঙ্গে গাজায় আরও কিছু দেশের সৈন্য পাঠানো হতে পারে বলে কানাঘুষা চলছে। ফলে ওই শান্তিচুক্তির আলোকে গাজার ভবিশ্যত নিয়ে চলছে বহুমাত্রিক আলোচনা। এক্ষেত্রে হামাসকে বাদ দিয়ে গাজায় একটি অন্তর্বতী প্রশাসন গড়ে তোলার ব্যপারে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, তুরস্ক, সৌদি আরব, আরব আমিরাতের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য গণমাধ্যমে এসেছে সেগুলো বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। যদিও কিছুদিন থেকে ট্রাম্প ব্লেয়ারের নেতৃত্বে একটি বিকল্প অন্তর্বতী প্রশাসনের কথা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এখনো এ ধরনের কোনো প্রাশাসনিক কাঠামো গাজায় দৃশ্যমান হয়নি। অন্যদিকে অঞ্চলটির প্রশাসনিক কাঠামো ইতোমধ্যেই ৭ অক্টোবর ২০২৩ এর পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সঙ্গত কারনেই এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে শান্তিচুক্তিতে লাভ ক্ষতির খতিয়ান কি? চুক্তিতে হামাস নাকি ইসরায়েল কে এগিয়ে রইলো? সেইসঙ্গে চুক্তির পরবর্তী ধাপগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে গাজায় প্রকৃত শান্তি ফেরানোর সম্ভাবনা কতোটুকু?

মিসরের শার্ম আল শেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কতিপয় আরব দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সম্পাদিত গাজা শান্তিচুক্তিকে অপেক্ষাকৃত দূর্বল একটি পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের সুস্পষ্ট রূপরেখা না থাকায় এই শান্তিচুক্তি একটি অসাড় প্রবণতা ব্যতিত আর কিছুই নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সময় ইসরায়েলি স্বার্থ সুরক্ষার পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিরই আরেকটি মঞ্চায়ন হচ্ছে সর্বশেষ গাজা শান্তিচুক্তি। যেখানে সংকটের মূল উপাদান উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনি জনগণকে আরেকবার বোকা বানানোর চেষ্টা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রকৃত শান্তি সেইসঙ্গে দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের ঐতিহাসিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে পশ্চিমা দেশগুলোর সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই এই প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভুতিশীল পক্ষগুলোকে সঙ্গে নিয়েই চুক্তিতে উপনীত হলে সেটি সব পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হতো। ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য পক্ষগুলোর অনুপস্থিতির বিপরীতে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রতিটি দেশই ইসরায়েলের ভূমি দস্যুতা,দখলদারিত্বকে বৈধতা দিতে বরাবর তৎপর ছিল বা এখনো আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় দেশগুলোর একপেশে পক্ষপাতদুষ্ট ফিলিস্তিন নীতির কথা সবারই জানা। দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক ভূমি বন্টনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সমাধান প্রক্রিয়া অবজ্ঞা করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোই ফিলিস্তিনিদের দূর্ভোগ বাড়িয়ে তুলেছে। ফিলিস্তিনের রাষ্ট স্বপ্নকে দু:স্বপ্নে পরিণত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়রাই। এই দেশগুলোর সঙ্গে কয়েকটি আরব দেশও একইভাবে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ বৃদ্ধির জন্য বহুলভাবে দায়ী। যে কারণে এসব দেশের সিদ্ধান্তের আলোকে গৃহীত শান্তিচুক্তিকে মন্দের ভালো হিসেবে গ্রহণ করে হামাস কার্যত ফিলিস্তিনি জনগণের উপর নির্মম ইসরায়েলি বর্বরতা থেকে সাময়িক মুক্তি খোঁজেছে। সাধারণ বিচারে এটা স্থায়ী, ন্যায্য সমাধানের কোনো গ্রহণযোগ্য চুক্তি নয়। তাহলে কি হতে পারে? পৃথিবীর পরিবর্তন হয়েছে। তাই নতুন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সুবিধা নিয়ে উজ্জিবিত হয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম। ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালের আল আকসা তুফান অভিযান ছিল পরিবর্তিত বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সমিকরণের ফলাফল। যে ঘটনায় কেঁপে উঠেছে ইসরায়েলের রাষ্টিয় অস্তিত্ব। বলা চলে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সামরিক সমিকরণের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের সবটুকু সুবিধা কাজে লাগিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিজয়ের কাছাকাছি পৌছে গেছে প্রতিরোধ যুদ্ধ। আর ফিলিস্তিনিদের এই ন্যায়সঙ্গত লড়াইয়ে এবার শক্তি যুগাচ্ছে পুরো বিশ্বই। ব্যতিক্রম শুধু যুক্তরাষ্ট্র সেইসঙ্গে কয়েকটি ইউরোপিয় ও আরব সরকার। অন্যদিকে সমগ্র বিশ্বের প্রায় সব মানুষের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিরা ঘনিষ্টভাবে পাশে পেয়েছে ইরান, রাশিয়া, চীনসহ অনেক দেশকে। সমিকরণের এই বাস্তবতার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত হচ্ছে গাজার পরিস্থিতি ঘিরে ইসরায়েলবিরোধী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কৌশলি অবস্থান। যেখানে হামাসসহ সকল ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামীরা একটি কৌশল অবলম্বন করে সামগ্রিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছে। সেইসঙ্গে ইসরায়েলের যেকোন দূরভিসন্ধিমূলক তৎপরতার জবাবে নিজেদের যুদ্ধ প্তস্তুতির প্রতিও সজাগ রয়েছে হামাস। এই অবস্থায় গত কয়েক দিনের গাজা পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত থাকলেও যেকোন মুহুর্তেই যুদ্ধ বিরতি ভেঙে পরার শঙ্কা রয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক অঙ্গণ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ইসরায়েলের পক্ষে পূর্বের মতো বেপরোয়া আচরণ করা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে এই শান্তিচুক্তি ভেঙ্গে গেলে বড়ো ধরনের প্রশ্নের মুখে পরবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাশক্তি মূলক ভূমিকা। তাই এই স্থিতাবস্থা যা হামাসসহ অন্যান্য ফিলিস্তিনি শক্তিগুলোকে বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে। সব মিলিয়ে গাজা শান্তিচুক্তির পরিণতি সম্পর্কে অনিশ্চয়তা থাকলেও আপাতত স্বস্তিতে রয়েছে গাজার জনগণ।

লেখক: হাসান জাবির: বিশ্লেষক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা।


শিক্ষা বিস্তারে ও সমাজ সংস্কারে শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক

ড. দেওয়ান আযাদ রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক, স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা, মুসলিম জাগরণের অগ্রনায়ক, লাহোর প্রস্তাবের উপস্থাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার রূপকার ও লাঞ্চিত বঞ্চিত ও শোষিত কৃষক প্রজার মুক্তিদাতা হিসেবে এ উপমহাদেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। ব্রিটিশ শাসকদের দুঃশাসনে এ উপমহাদেশের মুসলমানরা যখন ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছিল, ইংরেজদের প্রতি ঘৃণায় ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে বিরত ছিল ঠিক সে সময়ে ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর মধ্যরাতে বরিশালের রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৮৮৭ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। শিক্ষা জীবনে তিনি অত্যন্ত তীক্ষ্ম, প্রতিভাধর ও মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি গণিত, পদার্থ ও রসায়ন মোট তিনটি বিষয়ে অনার্স পাস করেন। বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম তিনটি বিষয় নিয়ে অনার্স করেন। পরবর্তীতে ১৮৯৫ সালে গণিতে এম.এ পাস করেন এবং ১৮৯৭ সালে ইউনিভার্সিটি ল কলেজ থেকে বিএল ডিগ্রী লাভের মধ্য দিয়ে পাঠ পর্ব শেষ করেন। ১৮৯৭ সালে স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষানবিস হিসেবে কলকাতা হাইকোর্ট কর্মজীবন শুরু করেন। আইন ব্যবসা ছেড়ে ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের চাকরি গ্রহণ করেন। পরে সরকারি চাকরি ত্যাগ করে পুনরায় আইন ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। এ.কে ফজলুল হক নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ মানসপত্র ছিলেন। তার সযত্ন তত্ত্বাবধানেই পরবর্তীতে শেরে বাংলা সারা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অঙ্গনে মহীরূপে অবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় দলের নেতা ছিলেন। তিনি ১৯১৪ সালে কৃষক প্রজা সমিতি গঠন করেন। পরবর্তীতে তার গঠিত কৃষক প্রজা পার্টি ১৯৩৭ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করলে তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করলে পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯১৩ সাল হতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত আইন সভার সদস্য, ১৯২৪ সালে শিক্ষামন্ত্রী ১৯৫৬-৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ছিলেন। তিনি শিক্ষা বিস্তারে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেন। বাংলার মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার প্রধান উদ্যোক্তা। তিনি মাদ্রাসা শিক্ষার প্রধান উদ্যোক্তা। তিনি মাদ্রাসা শিক্ষায় সারকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করেন এবং মুসলমানদের শিক্ষায় অগ্রসরতা বৃদ্ধির জন্য স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও মেডিক্যাল কলেজ আসন নির্দিষ্ট করে দেন। নারী শিক্ষার প্রসারতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৩৯ সালে লেডি ব্রার্বোন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সকল বালিকা বিদ্যালয়ে আর্থিক বরাদ্ধ বৃদ্দি করেন। এছাড়াও ঐতিহাসিক চাখার ফজলুল হক কলেজ, সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ, ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজে ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এ.কে. ফজলুল হক হলসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তার সদিচ্ছার ফসল। তিনি কৃষি শিক্ষা বিস্তারে বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট, পশু চিকিৎসা কেন্দ্র ও তেজগাঁও কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রত্যেক জেলায় স্কুল বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য তিনি প্রাথমিক বয়স্ক শিক্ষা কমিশন এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক করার জন্য মাওলাবক্স কমিটি গঠন করেন। কমিটির সুপারিশে জুনিয়র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। শেরে বাংলা কৃষক ও প্রজা সাধারণের প্রাণের বন্ধু ছিলেন। কংগ্রেস, মুসলিমলীগ ও অন্যান্য দলের জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ, ভূমি ও কৃষি সংস্কারের সদিচ্ছার অভাব উপলদ্ধি করেই কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করেছিলেন এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঋণ সালিশী বোর্ড গঠন করে কৃষকদের মহাজনদের শোষণমুক্ত করেছিলেন। তিনি ফ্লাউড কমিশন নিয়োগ করে জমিদারদের শোষণ মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তার সময়ে সে সমবায় আইনি ও বিধি প্রণীত হয়েছিল, এরই ফলশ্রুতিতে হাজার হাজার সমবায় সমিতি গঠিহ হয় যা কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে। পল্লী উন্নয়য়নের জন্য পল্লী মঙ্গল সমিতি ও কুটির শিল্পের ব্যবস্থার পাশাপাশি সুচিকিৎসার ব্যবস্থা, পানীয়জলের ব্যবস্থা, পয়:প্রণালী ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। তিনি মুসলিম জাগরণের অগ্রপথিক ছিলেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভের পর অনগ্রসর মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতার লক্ষ্যে চাকরির ক্ষেত্রে ৫০% আসন সংরক্ষিত রাখার নির্দেশ দেন। অপরদিকে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তিনি হিন্দু মুসলমানদের সম্প্রীতি রক্ষার জন্য ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্ট ও ১৯১৬ সালে লাখনৌ প্যাক্ট প্রণয়নে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৪০ সালে ২৩ মার্চ ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তিনি আসাম-বাংলা নিয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৩৭ সালে ১৫ অক্টোবর লাখনৌ শহরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে অপূর্ব ভাষণ শ্রবণ করে লাখনৌবাসী তাকে শেরে বাংলা উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নববর্ষকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তারই উদ্যোগে পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্রে বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা করা হয়।
এ.কে. ফজলুল হক কঠিন করোনারী থ্রোমসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়েন। ১৯৬২ সালে ২৭ এপ্রিল সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ৮৯ বছর ৬ মাস বয়সে একজন শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক, সেরা সমাজ সংস্কারক সর্বোপরি একজন শ্রেষ্ঠ মানুষের দেহাবসান ঘটে। ২০০৪ সালের মার্চ এপ্রিলে বিবিসি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ জন বাঙালির নাম ঘোষণা করেছির। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন- ‘ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বাঙালি’। সেই সংঙ্গে তার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সাচ্চা মুসলমান। খাটি বাঙালি আর সাচ্চা মুসলমানের এমন সমন্বয় আমি আর দেখিনি।
ড. দেওয়ান আযাদ রহমান

লেখক: গবেষক ও প্রবন্ধকার।


বিচারের নামে সেনাবাহিনী নিয়ে যেন প্রহসন না হয়

মিজানুর রহমান
আপডেটেড ২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ২৩:২০
সম্পাদকীয়

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে গুম সংক্রান্ত ‘মানবতা বিরোধী অপরাধের’ মামলায় একযোগে ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি-- এমন ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রায় নজিরবিহীন। বিশেষ করে তাদের মধ্যে ১৫ জন বর্তমানে কর্মরত হওয়ায় বিষয়টি শুধু সেনা সদর নয় পুরো দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

এ বিষয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য স্পষ্ট করে জানান। ‘আমরা সব সময় ন্যয়ের পক্ষে। ইনসাফের সঙ্গে কোন আপস নেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল।’ আদালতের আদেশ পাওয়ার পরই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দেখিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত ১৬ কর্মকর্তাকে স্বেচ্ছায় হেফাজতে আত্মসমর্পণের নির্দশ দেয়।তাদের মধ্যে ১৫ জন ইতোমধ্যে সেনা হেফাজতে এসেছেন একজন অনুপস্থিত রয়েছেন।

-তবে একই সঙ্গে সেনা সদর স্বীকার করে হঠাৎ এ ধরনের ঘটনা সেনা সদস্যদের মনোবলে সাময়িক প্রভাব ফেলেছে এবং তাদের দিয়েই ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের ভাষ্য মোতাবেক ইতিহাসের সেরা নির্বাচন করার পরিকল্পনা ও রয়েছে।

সেনা সদর মনে করে বিচার প্রক্রিয়া যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তা অনেক সময় একটি প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

এ বিষয়ে সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের অভিমত হলো কেউ অপরাধ করে থাকলে আইন অনুসারে তার বিচার হবে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তি হবে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যেভাবে বিঢয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে বিচারের আগেই শাস্তির ঘটনা ঘটছে। সেনাবাহিনীকে মিডিয়া ট্রায়ালের স্বীকার করা হচ্ছে।

অথচ অভিযুক্তরা ঘটনার সময় কেউ কেউ ডিজিএফআই ও সরকারী অন্যান্য সংস্থায় কর্মরত ছিলেন এসব সংস্থায় পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে।

‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাহেদুর রহমান বলেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের --সেটি সশস্ত্র বাহিনী হোক, বিচার বিভাগ হোক, বা প্রশাসন বিভাগ হোক সবার নিজস্ব মর্যাদা আছে, দেশের জন্য দশের জন্য ভূমিকা আছে। আমরা যখন সেই প্রতিষ্ঠানের কোনো সদস্যের কৃতকর্মের জন্য ঢালাওভাবে সেই প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করি অথবা তার ইমেজকে সংকটে ফেলে দিই তখন সেই প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।সেই প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের কর্মস্পৃহা উদ্দীপনা হ্রাস পায়। আমরা বর্তমানে যে ঘটনা যে দেখছি সশস্ত্র বাহিনীর যেসব সদস্য গুম বা এ সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি মামলায় এসেছেন। মামলা হওয়াটা স্বাভাবিক। আসতেই হবে। কেউ তার কৃতকর্মের জন্য দায়মুক্তি পেতে পারেন না। সেটি আইনের বরখেলাপ হবে।দেশের মানুষের প্রতি অন্যায় করা হবে। অবশ্যই অপরাধ করে থাকলে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়াকে আমি স্বাগত জানাই। সশস্ত্র বাহিনী ও এটাকে স্বাগত জানিয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী ও একটি নিয়মের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে, যাতে সুষ্ঠুভাবে তাদের বিচারের সামনে দাঁড় করানো যায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি আমরা সশস্ত্র বাহিনীকেই কালিমা লিপ্ত করি তাহলে দেশের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর যে অবদান সেটিকে প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আমার পর্যবেক্ষণ ---ব্যক্তিকে দোষারোপ করব প্রতিষ্ঠানকে নয়। কিছু গণমাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনকের বক্তব্য শুনেছি। এতে দুঃখজনক ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। আমি ৩৪ বছর সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ করেছি। কেউ অপরাধ করে থাকলে তাকে দায় নিতে হবে। আমি অপরাধ করলে আমি কি বলব--- প্রতিষ্ঠান এটা আমাকে শিখিয়েছে। অবশ্যই শিখায়নি। লোভে হউক রাজনৈতিক চাপে হউক আমি লেজুড়বৃত্তি করে থাকলে আমার বিচার হবে। আমার প্রশিক্ষণ প্রণোদনায় ভুল ছিল না। বাহিনী আমাকে অপরাধ করতে শিখিয়ে দেয়নি। আমি আমার প্রতিষ্ঠানের শেখানো মন্ত্রের বাহিরে গিয়ে কাজ করে থাকলে তার দায় আমাকেই নিতে হবে। আমরা যেন চেষ্টা করি শুধু সশস্ত্র বাহিনী নয় যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে ---যারা দেশের কাজে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত সেই প্রতিষ্ঠানকে যেন দোষারোপ না করি।’

অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিচার কোন আইনে হবে--সেনা আইন নাকি আইসিটি আইনে-এ নিয়ে কোন সাংঘর্ষিক অবস্থান আছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেছেন ‘আইসিটি আইন বনাম সেনা আইন- এটা না বলাই ভালো মুখোমুখি বিষয়টি না বলাই ভালো।

তিনি আরও বলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-আইসিটি আইনে বলা আছে যে ---অভিযোগ পত্রে নাম উঠলে চাকরি চলে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো অভিযুক্ত কি আসলে সাজাপ্রাপ্ত? সাজা হওয়ার পরও কিন্তু আপিলের সুযোগ থাকে। আপিল নিষ্পত্তির পর যদি সাজা বহাল থাকে তখনই তাকে সাজাপ্রাপ্ত বলা যাবে। আবার দেখা যাবে কেউ খালাস পেয়ে গেলেন----তাহলে আইন অনুযায়ী তিনি আবার সার্ভিসে ফিরে যেতে পারবেন।

মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন অনেকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে।কেউ মানসিকচাপে অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন, কেউ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন---- এসব মানবাধিকার লঙ্গন নয়, এই প্রশ্ন ও আছে।

সেনাবাহিনীতে চলমান নিয়মের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন,’ কোন কর্মকর্তার বিচার চলাকালীন সময়ে তার বয়স শেষ হয়ে গেলে তিনি অবসরে যাবেন। তখন খালাস পেলেও তাকে চাকরিতে ফেরানো যাবে না। তাই ট্রাইব্যুনাল আইনের বিষয়ে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চাইব। চার্জসিটে নাম থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সেনা আাইনে কোন পদক্ষেপ নেওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন গুম সংক্রান্ত একটি জাতীয় কমিশন আছে যাদের আমরা সর্বত্মক সহযোগিতা করে আসছি। সেনাবাহিনী আলাদা করে কোন কমিশন করিনি। বাংলাদেশ আর্মি ন্যায়বিচারের প্রতি অটল----যা ন্যায়সঙ্গত হবে আর্মি তার পক্ষেই থাকবে।

তিনি আরও বলেন গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। আমাদের কিছু কর্মকর্তা হয়তো ব্যাব বা ডিজিএফআইয় এ ছিলেন, কিন্তু তখন তারা আর্মিতে সক্রিয় দায়িত্বে ছিলেন না।ব্যাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজিএফআই প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে। বর্তমানে এটি উপদেষ্টা পরিষদের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।’

অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার সামরিক আইনে করা যেতে পারে কিনা--- সে প্রশ্ন রয়েছে। এ বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ সাজ্জাদ সিদ্দিক (সেনাবাহিনীর সাবেক জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল) বলেন সেনা আইনের ৫৭(২)ধারা অনুসারে গুমের সঙ্গে যেহেতু খুনের বিষয়টি ও জড়িত সে কারণে অভিযুক্তদের বিচার সামরিক আদালতে করা যাবে না। মুহাম্মদ সাজ্জাদ সিদ্দিক তার পেজবুক পেজে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।

সেনাকর্মকর্তাদের বিচারের ব্যাপারে এরি মধ্যে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মতবাদ ব্যক্ত করেছেন যেমনটি বিএনপির বক্তব্যে এসেছে --বিএনপি যুগ্ন মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বিষয়টি নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরা হয়।উল্লেখ করেন বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল –‘বিএনপি বিশ্বাস করে, দেশের গণতন্ত্র মানবাধিকার ও সেনাবাহিনীর পেশাদারি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট অপরাধের সুষ্ঠু ও নির্মোহ বিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায়বিচার শুধু অতীতের ঘটনাগুলোর শাস্তির নিশ্চয়তা দেয় না বরং ভবিষ্যতে যেন কেউ এমন অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি না ঘটায় সেই নিশ্চয়তা দেয়।আইন ও মানবাধিকারের প্রতি পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধা রেখেই হতে পারে একটি শান্তিপূর্ণ জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তি।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কিছু চিহ্নিত ব্যক্তির দায় যেমন কোন প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপানো উচিত নয়, তেমনি তাদের অপকর্মের কারণে সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ও অনুচিত। একজন মানুষের কাজের ভালো মন্দের দায় বিশেষত গুরুতর অপরাধের শাস্তি একান্তই তার নিজের।’

জামায়াত যা বলেছে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে পেজে লিখেছেন, ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে নিয়ে বাংলাদেশের জনগন গর্বিত থাকতে চান। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাহিনীর কিছু সদস্য দেশের বিদ্যমান আইন ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছেন। ফ্যাসিষ্ট সরকারের প্ররোচনায় প্রতিপক্ষ নিধনের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা অন্ধ সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। ফলে গুম ও খুনের একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সুনির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির অপরাধের কারণে পুরো প্রতিষ্ঠানকে কলংকিত হতে দেওয়া যায় না। অপরাধের দায় কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপরই বর্তাবে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী এই বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা করার ঘোষণা দিয়েছে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হেফাজতে নিয়েছে। আমরা সেনাবাহিনীর এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।’

দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষা করা ও দেশের ক্লান্তি লগ্নে সবার আগে এগিয়ে আসা, জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে অবদান রাখা আমরা কোনটাই তাদের অবদানকে খাটো করে দেখতে চাই না। বিচারের নামে মিডিয়া ট্রায়াল যা কিছু বলি না কেন সেনাবাহিনী আমাদের গর্বের।ফ্যাসিবাদী সরকারের অবসানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কম নয় বরং অগ্রনী ভূমিকা ছিল বলেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এসেছে। বর্তমানে আমাদের সেনাবাহিনী দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে মাঠে অতন্দ্র প্রহরীর মত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে যারা অপরাধী তাদের বিচার হবে এটা স্বাভাবিক কিন্তু বিচারের নামে যেন প্রহসন না হয় সেইদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।দেশে আইনের শাষন প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে নিরপেক্ষভাবে বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদন করা লক্ষ্যে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে যেন অযথা মন্তব্য বা বিতর্কে আমরা না জড়াই এটাই হবে নাগরিক হিসেবে সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক : কলামিস্ট ও ব্যাংকার।


ভেজাল-নকলের বিষচক্র: যেখানে জীবন ও জীবিকা উভয়ই নিঃস্ব

ওসমান গনি
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

নকল আর ভেজালের সর্বগ্রাসী থাবা আজ আমাদের সমাজদেহের প্রতিটি পরতে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, মানুষের জীবন ও জীবিকা উভয়ই আজ এক গভীর সংকটের মুখে। একুশ শতকের এই তথাকথিত আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়েও যখন খাদ্য থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী, এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজালের রমরমা কারবার চলে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, জাতিগতভাবে আমরা এক ভয়াবহ নৈতিক স্খলনের মধ্য দিয়ে চলেছি। এই ভেজাল সংস্কৃতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন করে না, বরং মানুষের স্বাস্থ্য, বিশ্বাস এবং সামাজিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়ে একটি জাতিকে নিঃস্বতার দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।

মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হলো নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা। কিন্তু বাজারে আজ যে খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায়, তার কতটুকুই বা নির্ভেজাল? কৃষিপণ্যে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ব্যবহার থেকে শুরু করে ফল পাকাতে কার্বাইড, মাছ তাজা রাখতে ফরমালিন, দুধে সাবান বা স্টার্চের মিশ্রণ, মসলায় ইটের গুঁড়ো, এই তালিকা যেন অন্তহীন। মুনাফা লাভের এক অন্ধ প্রতিযোগিতায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মানুষের জীবন নিয়ে নির্দ্বিধায় ছিনিমিনি খেলছে। এই ভেজাল খাবার খেয়ে মানুষ আপাতদৃষ্টিতে হয়তো পেট ভরাচ্ছে, কিন্তু বিনিময়ে তাদের শরীরকে ঠেলে দিচ্ছে দুরারোগ্য ব্যাধির দিকে। ক্যান্সার, কিডনি ফেইলিওর, লিভারের মারাত্মক সমস্যা এবং অন্যান্য জটিল রোগ আজ ঘরে ঘরে। আর এসব রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সাধারণ মানুষ তাদের সঞ্চয়, সম্পত্তি এমনকি ভিটেমাটিও হারাচ্ছে। একসময় যারা সচ্ছল ছিল, তারাও চিকিৎসার বিপুল ব্যয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। রোগভোগের শারীরিক কষ্টের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের যন্ত্রণা।

দীর্ঘমেয়াদে এই ভেজাল সংস্কৃতি একটি জাতিকে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত উভয় দিক থেকেই পঙ্গু করে দেয়। স্বাস্থ্যখাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে রোগ প্রতিরোধের পরিবর্তে রোগ নিরাময়ের দিকে। অথচ এই অর্থ যদি শিক্ষা, গবেষণা বা অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করা যেত, তবে দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধি আরও দ্রুত হতো। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা জাতির ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত। শিশুরা সঠিক পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাদের মেধা ও কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে দেশের মানবসম্পদকে দুর্বল করে দেবে। অর্থাৎ, ভেজাল চক্র কেবল বর্তমান প্রজন্মকে নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও নিঃস্ব করে দিচ্ছে।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি বহুমুখী এবং সমন্বিত উদ্যোগ। প্রথমেই দরকার কঠোর আইনের প্রয়োগ এবং নিয়মিত মনিটরিং। ভেজালকারীদের জন্য দ্রুত বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অন্যরা এমন জঘন্য কাজ করার সাহস না পায়। আদালত এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোকে এক্ষেত্রে শূন্য সহনশীলতা নীতি অবলম্বন করতে হবে। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং বড় বড় ভেজাল কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের জনসম্মুখে নিয়ে আসতে হবে। শুধু জরিমানা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের মতো কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা সবাই যদি একযোগে এই ভেজালের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই, তবেই কেবল সম্ভব একটি সুস্থ ও নিরাপদ সমাজ গঠন করা। অন্যথায়, এই নকল ও ভেজালের সর্পিল চক্রের জালে আবদ্ধ হয়ে মানুষ তার অর্থ, স্বাস্থ্য এবং সর্বোপরি জীবনের শান্তি হারিয়ে কেবলই নিঃস্ব হতে থাকবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আর দেরি করা নয়, এখনই প্রয়োজন জাতীয় চেতনার উন্মেষ এবং সম্মিলিত প্রতিরোধের মাধ্যমে এই ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিকে চিরতরে নির্মূল করা। এই সংগ্রাম কেবল অর্থনৈতিক বা আইনি নয়, এটি মূলত মানবতা ও নৈতিকতার পক্ষে এক ঐতিহাসিক লড়াই। এই লড়াইয়ে জয়ী না হলে আমাদের আগামী প্রজন্ম এক অসুস্থ, প্রতারণাপূর্ণ এবং নিঃস্ব সমাজে বড় হবে, যা কারও কাম্য হতে পারে না। এই ভয়াবহ জাল থেকে মুক্তিই এনে দিতে পারে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক মর্যাদা।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


banner close