১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ প্রণীত হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট বলে বিবেচিত হয়। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত গণপরিষদের ৪০৪ জন সদস্যকর্তৃক স্বাক্ষরিত ও অনুমোদিত, যা ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে পূর্ণাঙ্গরূপে উপস্থাপিত হয় এবং সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য আইনি দলিল হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা শুরু করে।
১৭ ডিসেম্বর, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৮৮ আসন পায়। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার এবং প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় এম মনসুর আলীকে পূর্ব পাকিস্তান পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার নির্বাচিত করা হয়। ’৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং এম মনসুর আলী পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ বিজয় মেনে না নিয়ে ষড়যন্ত্রের নীল-নকশা বুনতে থাকেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সমঝোতার নাটক ব্যর্থ হওয়ার পর ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৮ মার্চ, জিওসির অফিসে জেনারেল রাও ফরমান আলী ও জেনারেল খাদিম রাজা বৈঠকে বসেন। ‘বৈঠকে জেনারেল ফরমান অফিসিয়াল প্যাডের ওপর নতুন পরিকল্পনাটি লিপিবদ্ধ করেন। যার দ্বিতীয় অংশটি লেখেন জেনারেল খাদিম। পরিকল্পনাটি সংশোধনপূর্বক চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল আব্দুল হামিদ খান অনুমোদন করেন’- (সূত্র: উইটনেস অব স্যারেন্ডার, লেখক: সিদ্দিক সালিক, যুদ্ধকালীন সময়ে আইএসপিআরের পিআরও)। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে জেনারেল ফরমানের নেতৃত্বে ঢাকায় এবং জেনারেল খাদিমের নেতৃত্বে অন্যান্য ১০টি গুরুত্বপূর্ণ শহরে অপারেশনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সামরিক অভিযানের কোড নেম ছিল ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১১টা ৩০ মিনিটে ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর নামে শুরু হয় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। সায়মন ড্রিংই প্রথম ২৫ মার্চের পরিকল্পিত গণহত্যার খবরটি ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে অবহিত করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি তার বর্ণনায় বলেন, ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি দখলপূর্বক, পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল লক্ষ্য করে কামান ও মর্টার হামলা চালায়। হলের পার্শ্ববর্তী পুকুরে শতশত লাশ ভাসছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের অগণিত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রতিবেদনে বলেন, ‘আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং সন্ত্রস্ত এক নগরী’।
অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ‘দ্যা রেপ অব বাংলাদেশ’ বইয়ের মুখবন্ধে বলেন, হিটলারের নাৎসি বাহিনীর অমানবিক কার্যকলাপে পড়েছি; কিন্তু ইস্ট বেঙ্গলে যা দেখলাম, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং যন্ত্রণাদায়ক।
’৭১-এর ২৬ মার্চ ০০:২০ প্রথম প্রহরে পাকিস্তান পার্লামেন্টের মেজরিটি পার্টির লিডার আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন- ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন..........সকল শক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ কর.......(অনূদিত: শেখ মুজিবুর রহমান)’। অতঃপর রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর নিজ বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তাটি তাৎক্ষণিকভাবে মগবাজার ওয়্যারলেস স্টেশনে পাঠানো হয়। স্বাধীনতার বার্তাটি ডিএইচএফ চ্যানেলে মগবাজার থেকে সলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত জাতিসংঘের জাহাজ মিনি-লা-ট্রিয়া, গ্রিক জাহাজ সালভিস্তার ভিএইচএফ চ্যানেলে সমগ্র বিশ্বে প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে, বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে লয়ালপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। লয়ালপুর মার্শাল ‘ল’ কোর্টে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইন্টিলিজেন্স স্পট রিপোর্ট ৪৩-এর ১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়, পাকিস্তানের পূর্ব অংশকে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাবিষয়ক আর্কাইভ তাদের অবমুক্তকৃত দলিল প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
১ এপ্রিল ভোরে তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, বিএসএফের ডিজি কেএফ রুস্তমজী ও গোলক মজুমদার একটি সামরিক কার্গো বিমানে দিল্লির উদ্দেশে কলকাতা বিমান বন্দর ত্যাগ করেন। ৩ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব? ইজ হি অল রাইট? জবাবে তাজউদ্দীন আহমেদ বলেন বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তার স্থান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন’ (সূত্র: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, লেখক: ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম)। উভয়ে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল এক বিশেষ অধিবেশনে ১৯৭০ সালের নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। উক্ত গণপরিষদের অধিবেশনেই অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান প্রণীত হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণকর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ’৭১-এর ২৬ মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রক্রিয়ায় আইনি দলিল হিসেবে স্বীকৃত।
১০ এপ্রিল গণপরিষদের বিশেষ অধিবেশনে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়। এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব অপর্ণ করা হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে উল্লিখিত সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় যাহা ‘মুজিব নগর’ সরকার হিসেবে পরিচিতি পায়। ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত জনপ্রতিরোধ শুরু হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়, উক্ত যুদ্ধে সহায়তাকারী বন্ধুপ্রতিম ভারত সরকারের ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে উক্ত সরকারের ভূমিকা ছিল অনন্য। উক্ত সরকার কর্তৃক কর্নেল এমএজি ওসমানীকে সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়ক এবং এমএ রবকে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় এবং ১১ জন সেক্টর কমান্ডার নিয়োজিত হন যথাক্রমে- জিয়াউর রহমান, কেএম সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের, রফিকুল ইসলাম, মীর শওকত আলী, সিআর দত্ত, আবু ওসমান চৌধুরী (আগস্ট পর্যন্ত), এমএ মঞ্জুর, এমএ জলিল, এএনএম নূরুজ্জামান, এমএ বাশার।
প্রধানমন্ত্রী কেবিনেটের সঙ্গে পরামর্শ পূর্বক উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন এবং বর্ষীয়ান জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণি সিং ও অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদকে সদস্য হিসেবে অর্ন্তভুক্ত করা হয়। মুজিবনগর সরকারের মেয়াদকাল ছিল ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত।
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল কলকাতা পাকিস্তান মিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীর নেতৃত্বে ৫০ জন কর্মকর্তা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ৬ এপ্রিল দিল্লি পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব কেএম শেহাবুদ্দিন আহমেদ ও আমজাদুল হক পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট দিল্লিতে ২০ বছরমেয়াদি ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের পক্ষে দলিলে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরন সিং এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো। হিমালয়ের তুষার ও সোভিয়েটের বন্ধুত্ব এই দুটি ছিল চীনের বিরুদ্ধে ভারতের রক্ষাকবচ। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজির নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সেনা অস্ত্রশস্ত্রসহ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিত সিং আরোরা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারের উপস্থিতিতে বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে অত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন যার শিরোনাম হলো ‘ইন্সট্রুমেন্ট অব স্যারেন্ডার’।
৩০ লাখ শহীদের তাজা তপ্ত রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা অভ্যুদয়ের পশ্চাতে রয়েছে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী নেতৃত্ব ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞা। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি নতুন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে।
লেখক: প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় চার নেতা পরিষদ ও কলামিস্ট।
এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার এখনও বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি- ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ভুটানের মূল্যস্ফীতি হবে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারতের ৪ শতাংশ, মালদ্বীপের ২ দশমিক ৫ শতাংশ, নেপালের ৪ দশমিক ২ শতাংশ। শ্রীলংকায় গত অর্থবছর মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১ দশমিক ২ শতাংশ, চলতি বছরে দেশটিতে কোনো মূল্যস্ফীতি নাও হতে পারে। মালদ্বীপ ও নেপাল মূল্যস্ফীতির লাগাম টানায় এগিয়ে রয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনামের মূল্যস্ফীতি হবে ৩ দশমিক ২ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়ার ২ দশমিক ৯ শতাংশ যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। অপরদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। করোনা মহামারির আঘাত ও বৈশ্বিক মন্দার ছোবল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারেনি। দেশকে এখনো নিম্ন জিডিপির প্রবৃদ্ধির গতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ভুটানের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারতের ৬ দশমিক ২ শতাংশ, নেপালের ৫ দশমিক ২ শতাংশ। রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ যা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের সমান প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার জন্য। দেশটির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অতছ বাংলাদেশ এখনো ৪ শতাংশের রয়েছে। আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখনও প্রাইমারি ব্যালেন্সের স্থিতি চলতি অর্থবছরেও নেতিবাচক থাকবে। বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতিতেও চাপে থাকতে হবে।
অপরদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শেষে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ হবে। যা আগামী ২০২৬ সালে অর্থবছর শেষে ৫ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। যদিও পোশাক রপ্তানি স্থিতিশীল রয়েছে, তবুও ধীর প্রবৃদ্ধির অনুমান চলমান মূলত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে। অন্যদিকে বারবার বন্যা, শিল্প শ্রমিক বিরোধ এবং ক্রমাগত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে দেশীয় চাহিদা হ্রাস পেয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। এডিবি জানায়, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার ওপর এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধি নির্ভর করবে। বাংলাদেশের বাণিজ্যের ওপর মার্কিন শুল্কের প্রভাব এখনো দেখা যায়নি এবং ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা রয়ে গেছে। উচ্চতর অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা অর্জনের জন্য এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা অপরিহার্য। ২০২৬ অর্থবছরের দৃষ্টিভঙ্গির কিছু নেতিবাচক ঝুঁকি রয়ে গেছে। বাণিজ্য অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং সম্ভাব্য নীতিগত স্থিতিস্থাপকতা অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বিচক্ষণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বজায় রাখা এবং কাঠামোগত সংস্কার ত্বরান্বিত করা জরুরি। মূলত টেকসই উন্নয়নে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এডিবি আরও জানায়, পাইকারি বাজারে সীমিত প্রতিযোগিতা, অপর্যাপ্ত বাজার তথ্য, সরবরাহ শৃঙ্খলের সীমাবদ্ধতা এবং টাকার দুর্বলতার কারণে মুদ্রাস্ফীতি ২০২৪ অর্থবছরের ৯ দশমিক ৭ ৭ শতাংশ থেকে ২০২৫ অর্থবছরে ১০ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি হিসাবে ২০২৫ অর্থবছরে জিডিপির ০ দশমিক ০৩ শতাংশের সামান্য উদ্বৃত্ত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা ২০২৪ অর্থবছরে জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশ ঘাটতি থেকে বেশি, যা বাণিজ্য ব্যবধান সংকুচিত এবং শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ দ্বারা সমর্থিত।
সরকারি হিসাবে প্রায় এক দশক ধরে দেশের প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৭ শতাংশের ওপরে, যা ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চীন ও ভারতসহ উন্নয়নশীল প্রায় সব দেশের প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যায়। এর সুবাদে বাংলাদেশকে ‘এশিয়ান টাইগার’ খেতাবও দেয়া হয়। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকলেও সে অনুপাতে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়েনি। শিল্পের প্রসারও সেভাবে চোখে পড়েনি। আবার বিশ্বব্যাংক ও এডিবিরি মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা সময়ে প্রশ্ন তুলেছিল। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যেই গড়ে সাড়ে ৩ শতাংশীয় পয়েন্টের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ যখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতার মুখ দেখছে, তখন বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) বৃদ্ধির পরিকল্পনা বর্তমান পরিস্থিতিতে কতটা যৌক্তিক তা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন। কারণ, এমন উদ্যোগ মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দিতে পারে, ফলে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় না হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণের সুদহার এবং নীতি সুদহার প্রায় দ্বিগুণ করেছে। এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী হলেও, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সেভাবে কার্যকর হয়নি। বরং মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। তদুপরি, আইএমএফের শর্ত পূরণে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। একই সঙ্গে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য নয়, বরং রাজস্ব বাড়ানোর স্বার্থেই ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে ৪৩টি পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে নিত্যপণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১৩.৮০ শতাংশ। যদিও জুলাইয়ে এটি ছিল ১৪.১০ শতাংশ, সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ১১.৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ, গত বছরের নভেম্বরে ১০০ টাকায় যে পণ্য পাওয়া যেত, এ বছরের নভেম্বরে সেটি কিনতে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা প্রয়োজন। অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভারতের মতো দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতির হার ৭০ শতাংশে পৌঁছালেও এখন তা ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এক বছর আগে ২৭ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতি এখন কমে ৯.৬৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম মূল্যস্ফীতি বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় (০.৫ শতাংশ)। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন মালদ্বীপে (১.৪ শতাংশ)। এরপর ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তান রয়েছে। ভারতের মূল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশে স্থিতিশীল। বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকট কাটাতে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও বৈদেশিক মুদ্রাবাজার কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারকদের আরও সতর্কভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা, যাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দাম কমাতে বেশ কিছু পণ্যের শুল্ক ছাড়সহ আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, পাশাপাশি বাজার অভিযান জোরদার করেছে। একসঙ্গে মাঠে নামানো হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তিন উপসচিবের নেতৃত্বে তিনটি টিম। জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের টিমও ঢাকাসহ সারাদেশে নিয়মিত বাজার তদারকি করছে। এছাড়া প্রতিযোগিতা কমিশন, বিএসটিআই, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও নড়েচড়ে বসেছে। একই সঙ্গে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কম দামে বেশ কিছু নিত্যপণ্য বিক্রি শুরু করেছে এবং খাদ্য অধিদপ্তর ভর্তুকি মূল্যে চাল-আটা বিক্রি শুরু করেছে। আবার সরকার প্রতিবেশী দেশ থেকে ডিম, আলু, পেঁয়াজ, চাল এবং কাঁচামরিচের আমদানিও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তবুও সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আসছে না পেঁয়াজ ও আলুর দাম। এরই মধ্যে আমদানি করা পেঁয়াজে কাস্টমস শুল্ক ও রেগুলেটরি শুল্ক অব্যাহতি এবং আলুর আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার পাশাপাশি ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক তুলে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরপরও খুচরা বাজারে চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ দুই পণ্য।এখানে উল্লেখ্য যে সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপড়েন ভারত থেকে খাদ্যপণ্য আমদানিতে বাধা সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিঢয়ছে যা বাজার পরিস্থিতিকে আরও সমস্যায় ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে । বাজারে আমনের নতুন ধান উঠেছে। উৎপাদনও আশানুরূপ। ১০ দিনের মধ্যে ধানের দাম মণপ্রতি কমেছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা। এরপরও চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে ক্ষোভ বাড়ছে ভোক্তাদের। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ বাড়ানো জরুরি। শুল্ক কমানো হলো; কিন্তু আমদানি বাড়ল না- তাতে সুফল পাওয়া যাবে না। চাল, পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের বাজারে শুল্ক কমানোর পরও আশানুরূপ আমদানি না আসায় বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না বলে মনে করেন তারা। এ ব্যাপারে (ক্যাব) সাবেক সভাপতি বলেন, কর কমানো একটি উপায় হলেও বেশির ভাগ সময় তা সুফল দেয় না। আমি মনে করি, নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা ও এ ব্যাপারে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনাটা জরুরি। চাঁদাবাজিও বন্ধ করতে হবে। একদল চাঁদাবাজি করে চলে গেছে, আরেক দল চাঁদাবাজি করার দায়িত্বে এসেছে- এটাকে যদি সরকার স্বাভাবিকভাবে নেয়, তাহলে আমার বলার কিছু নেই। সরকারের পরিবর্তন হলেও খেলোয়ারের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে মহান মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের সদস্য অসামান্য অবদান রেখে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের সবাই সেনাবাহিনীরই সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই থেকে শুরু করে জাতির বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে জাতির ভরসা এই সেনাবাহিনী এগিয়ে এসেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সবার আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছে। এখন কোথাও কোনো সমস্যা সংকট সৃষ্টি হলে সবাই সেখানে সেনবাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সেই সংকট নিরসনে সেই সংকট থেকে উত্তরণে তাদের শক্তিশালী ভূমিকা পালন প্রত্যাশা করে একান্তভাবে। ঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় , নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অপরাধী, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে সেনাবাহিনী সবসময় প্রশংসনীয় অবদান রেখে দেশের সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে এক গৌরবময় আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। প্রশংসা ও সুনাম বয়ে এনেছে দেশের জন্য। চব্বিশের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারী ছাত্র জনতাকে জোর করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমনের জন্য স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারি দুঃশাসনের প্রধান হোতা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার অন্যায়মূলক নির্দেশ উপেক্ষা করে ছাত্র জনতার আন্দোলনকে সফল করতে ঐতিহাসিক গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশ ও জাতির স্বার্থে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন।
আজকাল সেই সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে নানা ধরনের গুজব, অপপ্রচার, ষড়যন্ত্রমূলক খবর প্রচার চালানো হচ্ছে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। যা দুঃখজনক। আমাদের সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে এমন সব খবর ছড়ানো হচ্ছে যার কোনো সত্যতা নেই। ভিত্তিহীন, বানোয়াট খবর প্রচার করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। জনমনে সেনাবাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে একটি মহল। এটা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, শান্তি, শৃঙ্খলা, সংহতি, স্থিতিশীলতা বিনষ্টের লক্ষ্যে সুগভীর চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।
পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম সরকারের তাবেদারি করায় গণমাধ্যমের খবরের প্রতি মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতায় ভাটা পড়ে। মত প্রকাশ, কথা বলা এবং ভাবের আদান-প্রদানে সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ অনেকগুলো আন্দোলন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণায় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণায় দলমত নির্বিশেষে রাস্তায় নেমেছিল। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সমাজ জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে এই প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহারও কম হচ্ছে না। যা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। এক শ্রেণির মানুষ সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে অপপ্রচার, কুৎসা রটানো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার, সহিংসতার ভুল তথ্য প্রচারে গুজব ছড়াচ্ছে। এতে সমাজে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর পর থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় অসংখ্য ‘গুজব বাহিনী’ গড়ে তোলা হয়েছে। তারা কখনো পতিত স্বৈরাচার হাসিনার হয়ে কখনো দিল্লির হয়ে কখনো দেশের একাধিক রাজনৈতিক দলের হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একের পর এক গুজব ছড়াচ্ছে। খুবই পরিকল্পিত এবং সুচিন্তিতভাবেই কখনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের গুজব, কখনো অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে গুজব, কখনো প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের মধ্যে বিরোধের গুজব, কখনো ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে গুজব, কখনো মহামান্য প্রেসিডেন্টকে নিয়ে গুজব, বিভিন্ন সময় নানা ঢংয়ে ছড়ানো হয়। গুজববাজরা অনেকটা কবি শামসুর রাহমানের ‘কান নিয়েছে চিলে’ কবিতার মতোই গুজব ছড়াচ্ছে এবং এক শ্রেণির মানুষ সেটাকে ইস্যু করে প্রচার প্রচারণায় শরিক হয়ে লাইক, শেয়ার ও মন্তব্যজুড়ে দিচ্ছেন। এই ঘৃণ্য গুজব বাহিনীর সর্বশেষ টার্গেট হয়ে উঠেছে আমাদের গৌরব বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সেনাবাহিনীর সাবেক ১০ জন এবং বর্তমানে কর্মরত ১৫ জন মোট ২৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। চিহ্নিত কিছু গুজববাজ কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ইউটিউবার, বিদেশে অবস্থানরত কয়েকজন সাংবাদিক, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও দেশের একাধিক রাজনৈতিক দলের বট বাহিনী ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার, ইউটিউবার প্রচারণা চালায় অন্তর্বর্তী সরকার আর সেনাবাহিনী মুখোমুখি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কয়েকজন সেনা সদস্যকে আসামি করায় সেনাবাহিনী ক্ষেপে গেছে। যে কোনো সময় দেশে অঘটন ঘটে যেতে পারে। ইত্যাদি, ইত্যাদি। বিদেশি আধিপত্যবাদী শক্তির এজেন্ডায় ছড়ানো এ গুজব প্রচার করে শেষ পর্যন্ত গুজববাজরা ধরা খেয়েছে। তাদের মুখে ছাই দিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। খোলাখুলি কথা বলে তারা সেনাবাহিনীর অবস্থান সুস্পষ্ট করেছেন। এক আদেশের মাধ্যমে চাকরিরত ১৫ জন এবং এলপিআর ভোগরত ১ জনসহ মোট ১৬ কর্মকর্তাকে ৯ অক্টোবরের মধ্যে সেনা হেফাজতে আসতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এলপিআর ভোগরত কর্মকর্তাসহ ১৫ জনকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেনা হেফাজতে নিয়ে আসা হয়েছেও। সেনাবাহিনীর এই স্মার্ট সিদ্ধান্তের ফলে তথাকথিত গুজববাজদের দেশে বিশৃংখলা সৃষ্টির স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে।
সেনাবাহিনী একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ। দেশের প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে বারবার সেনাবাহিনী এগিয়ে এসেছে। বিশাল সংখ্যার সেনাবাহিনীতে কয়েকজন কর্মকর্তার অপরাধের দায় কখনো সেনাবাহিনী নেয়নি। এবারও নিচ্ছে না। সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেছেন, সংবিধান স্বীকৃত বাংলাদেশের সব আইনের প্রতি সেনাবাহিনী শ্রদ্ধাশীল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ও সেনা আইন মুখোমুখি নয়। একটা বনাম আরেকটা এই দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা দেখা উচিত হবে না। সেনাবাহিনী দ্ব্যর্থহীনভাবে বিচারের পক্ষে অবস্থান করে। সেনাবাহিনী ন্যায়বিচারের পক্ষে। আমরা বিশ্বাস করি, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। গুমের শিকার পরিবারগুলোর প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।
আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী দেশ ভারতের অ্যাজেন্ডা বস্তবায়নে ভার্চুয়াল এ মিডিয়াগুলো এখন যেন গুজবের কারখানায় পরিণত হয়েছে। পতিত স্বৈরাশাসক শেখ হাসিনা যেমন ১৪০০ ছাত্রজনতাকে হত্যা করে পালিয়ে দিল্লি যাওয়ার পর থেকে তার এবং দোসরদের পাচার করা অর্থ ব্যয়ে বট বাহিনী গঠন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে; তেমনি ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কন্টেন্ট ক্রিয়েটর অন্তর্বর্তী সরকার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যেতে পারবে না দেশের এমন রাজনৈতিক দল। তারা কখনো আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে দিল্লির এজেন্ডা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, গণভোট ইত্যাদির ইস্যুতে মাঠ গরম করছে। পাশাপাশি তারাও দেশ-বিদেশে বিশাল বট বাহিনী তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের পক্ষে এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। এটা করতে গিয়ে তারা কার্যত আইনের শাসন, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে।
এই মুহূর্তে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে নিরাপদে থেকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, তার দোসর এবং দেশের কিছু জনসমর্থনহীন রাজনৈতিক শক্তি আসন্ন নির্বাচনে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধার সৃষ্টি, সেনাবাহিনী, অন্তর্বর্তী সরকার এমনকি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে বিশেষ কিছু গোষ্ঠীকে মাঠে নামিয়েছে। তারা পরিকল্পিতভাবে একের পর এক গুজব ছড়াচ্ছে। আসন্ন নির্বাচন বিলম্বিত করতে নতুন নতুন ইস্যু সৃষ্টি করছে এবং সেটা নিয়ে দেশি-বিদেশে অবস্থানরত ষড়যন্ত্রকারী বাহিনীকে গুজব ছড়ানোর প্রচারণায় নামাচ্ছেন। আবার পাশাপাশি এই গুজব বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রচারণা চালাচ্ছে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখানে চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে একাধিক নেটিজেন লিখেছেন, পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি মাঠে মারা যাওয়ায় অনেকেই নির্বাচন পেছাতে আইন-শৃংখলার অবনতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টায় উদ্দেশ্যমূলক ভাবে গুজব ছড়াতে পারে। কেউ লিখেছেন, নির্বাচন যখন দরজায় কড়া নাড়ছে এবং মানবতা বিরোধী শত শত মামলার কার্যক্রম শুরু হয়নি তখন ভোটের আগে সেনাবাহিনী বিক্ষুব্ধ হতে পারে এমন মামলাকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার রহস্য কি? কেউ লিখেছেন, কুড়িগ্রামের বড়াই বাড়ির ঘটনার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ভারত ভালো চোখে দেখে না। ২০০৯ সালে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে সেনা হত্যা তার প্রমাণ। তাছাড়া আরাকান আর্মিকে করিডোর দেয়ার বিরোধিতা করেছে সেনাবাহিনী; এটা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত পছন্দ করেনি। অন্যদিকে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে প্রকাশ্য ও গোপনে একের পর এক বৈঠক করছেন। আবার অন্যদিকে রিফাইন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে। এ সবই কি আসন্ন নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করার চেষ্টা? নেটিজেনদের কেউ কেউ এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলামের মামলার আসামি সেনাসদস্যদের গ্রেপ্তারের দাবি, বিএনপির বিবৃতি এবং একদিন পর জামায়াতের বিবৃতি নিয়েও মন্তব্য করেন। ১১ জুলাই বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বিএনপি বিশ্বাস করে, দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব রক্ষায় সংশ্লিষ্ট অপরাধের সুষ্ঠু ও নির্মোহ বিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ন্যায়বিচার শুধু অতীতের ঘটনাগুলোর শাস্তির নিশ্চয়তা দেয় না, বরং ভবিষ্যতে যেন কেউ এমন অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি না ঘটায়, সেই নিশ্চয়তাও দেয়। আইন ও মানবাধিকারের প্রতি পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধাই হতে পারে একটি শান্তিপূর্ণ, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তি। একটি দেশের চলা উচিত ‘ল অফ দ্যা ল্যান্ড’ অনুযায়ী। কিছু চিহ্নিত ব্যক্তির দায় যেমন কোনো প্রতিষ্ঠানের উপর চাপানো উচিত নয়, তেমনি তাদের অপকর্মের কারণে সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করাও অনুচিত। আজকাল কেউ কেউ সারাক্ষণ বলে চলেছেন, তারা বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান চায় না। এরাই মূলত জনগণকে উস্কানি দিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে সামরিক অভ্যুত্থান তৈরির বা অতীতের মতো ১/১১ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। তেমন পটভূমি সৃষ্টি করতে চাইছে। এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার পেছনে কাজ করছে পার্শ্ববর্তী দেশের একটি সুসংগঠিত চক্র। তারা এমনভাবে খেলছে যে, খালি চোখে মনে হতে পারে, এরা দেশের মঙ্গলের পক্ষে কথা বলছে। কিন্তু এরা বাস্তবে সাধারণ মানুষকে উস্কে দিয়ে আত্মঘাতী কাজ করিয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে চায়। এটাই তাদের মাস্টারপ্ল্যান। সুতরাং কারও পাতানো ফাঁদে পা না দিয়ে, নিজেই সত্যমিথ্য যাচাই-বাছাই করতে হবে আমাদের সবাইকে। আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো, অপরাধ যেই করুক তার বিচার হওয়া উচিত। বিগত দিনে সেনাবাহিনীর অভিযুক্ত সদস্যের বিচার সিভিল আদালতে হয়েছে। এবারও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত সাবেক ও বর্তমান সেনা সদস্যদের বিচার হবে। নানা গুজবের মধ্যেও সেনাবাহিনী অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি নেয়ায় সহায়তা করছে। এতে সেনাবাহিনীর সম্মান বাড়বে এবং সেনাপ্রধান হিসেবে অবশ্যই জেনারেল ওয়াকার উজ জামান প্রশংসিত হবেন। সেনাবাহিনীর উজ্জ্বল ইমেজ অক্ষুন্ন রাখতে ষড়যন্ত্রকারীদের সব অশুভ তৎপরতা বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। ধ্বংস করে দিতে হবে তাদের সব নেটওয়ার্ক। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবময় ঐতিহ্য মর্যাদা ও সন্মান অটুট রাখতে আমাদের মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী সচেতন হবেন, সতর্ক থাকবেন, এটা আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের আকাশপথের প্রাণকেন্দ্র। এই বিমানবন্দর শুধু যাত্রী চলাচলের মাধ্যম নয়, বাংলাদেশের রপ্তানি-আমদানির অর্থনীতিরও মূল প্রবেশদ্বার। গত শনিবার বিকেলে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ এলাকায় হঠাৎ লাগা ভয়াবহ আগুন সেই কেন্দ্রটিকেই এক মুহূর্তে স্তব্ধ করে দেয়। ধোঁয়ার কালো স্তম্ভ আকাশে উঠে দৃশ্যমান হয় শহরের বহু স্থান থেকে। একে একে স্থগিত হয় সব ফ্লাইট, বন্ধ হয়ে যায় টার্মিনাল কার্যক্রম, দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় দমকল, নিরাপত্তা ও বিমান কর্তৃপক্ষের। এই দৃশ্য কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি, নিরাপত্তা-পরিকল্পনা ও দায়বদ্ধতার এক নির্মম পরীক্ষা।
বিমানের কার্গো টার্মিনালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা শাখাও ঘটনাস্থলে যুক্ত হয়। একটি জাতীয় কৌশলগত স্থাপনায় একাধিক বাহিনীর দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। উন্নত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ‘ইন্টার-এজেন্সি কো-অর্ডিনেশন’ বা সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রতিক্রিয়া যেভাবে অনুশীলিত হয়, সেদিকে বাংলাদেশের এই প্রতিক্রিয়া একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত রাখে। তবে ঘটনাটির প্রকৃত কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কার্গো ভিলেজের কোনো ইলেকট্রিক্যাল প্যানেল বা স্টোরেজ ইউনিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। যে এলাকায় আগুন লাগে, সেখানে বিপুল পরিমাণ রপ্তানিযোগ্য পণ্য, প্যাকেজিং সামগ্রী ও কাঠের বাক্স রাখা ছিল। এসব দাহ্য বস্তু দ্রুত আগুন ছড়িয়ে দেয়, ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগেছে দীর্ঘ। এখানেই প্রথম বড় প্রশ্ন- কার্গো টার্মিনালের মতো উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় আগুন নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধের ব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত ছিল? আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর ‘ফায়ার রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট’ প্রতিবছর হালনাগাদ করা হয়। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নিয়মিতভাবে এই মূল্যায়ন করা হয় এবং প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ জোনে থাকে স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংকলার, সেন্সরভিত্তিক অ্যালার্ম সিস্টেম ও আগুনের বিস্তার রোধক দেয়াল। শাহজালাল বিমানবন্দরের এই ঘটনায় দেখা গেছে, আগুনের খবর পাওয়া এবং প্রথম ফায়ার ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সময় লেগেছে প্রায় ১৫ মিনিট। এই সময়ই আগুন ছড়িয়ে পড়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
দুর্ঘটনার পরপরই বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ একটি ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। এই কমিটির মধ্যে রয়েছেন বিমানের ফ্লাইট সেফটি বিভাগের প্রধান, সিএএবি প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন কারিগরি বিশেষজ্ঞ। এটি প্রশাসনিকভাবে সঠিক পদক্ষেপ হলেও প্রশ্ন রয়ে যায়- এই রিপোর্ট কেবল অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনায় সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি জনসমক্ষে প্রকাশিত হবে? উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে যেমন যুক্তরাজ্য, জাপান বা কানাডায় এ ধরনের দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ্যে দেওয়া হয়। তাতে দায় নির্ধারণ, ক্ষতি নিরূপণ ও ভবিষ্যৎ প্রতিরোধের সুপারিশ তুলে ধরা হয়। জনজবাবদিহিতার সেই সংস্কৃতি এখনো আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় অনুপস্থিত।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘রয়টার্স’ ও ‘ইকোনমিক টাইমস’-এর খবরে দেখা যায়, আগুনের পর অন্তত আটটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল ও চারটি বিকল্পভাবে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে স্থানান্তর করা হয়। কয়েক ঘণ্টা স্থগিত থাকে সমগ্র বিমান চলাচল। এতে শুধু যাত্রীই নয়, বিপুল পরিমাণ রপ্তানি পণ্যÑবিশেষ করে তৈরি পোশাক ও ঔষধ সামগ্রীÑঅবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অর্থনীতির এই প্রভাব হয়তো এখনো পরিসংখ্যান দিয়ে মাপা যায়নি, কিন্তু ক্ষতিটা বাস্তবে গুরুতর। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে, যার অধিকাংশ পণ্য বিমানযোগে পাঠানো হয়। একটি বিমানবন্দর ঘন্টার পর ঘন্টা অচল থাকলে এর অভিঘাত পড়ে সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, ক্রেতা আস্থা এবং সরবরাহ-চেইন ব্যবস্থায়।
এই দিক থেকে দেখলে, একটি আগুনের ঘটনা আসলে আমাদের প্রশাসনিক পরিকল্পনার গভীর প্রশ্ন তুলে ধরে। বিমানবন্দর কেবল যাত্রীবাহী নয়, এটি অর্থনৈতিক প্রবাহের কেন্দ্রবিন্দু। অথচ তার কার্গো বিভাগে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার যথাযথ প্রস্তুতি না থাকা, নিরাপত্তা তদারকি যথাসময়ে না করা- এসবই আমাদের দীর্ঘদিনের ‘রিঅ্যাকটিভ’ প্রশাসনের প্রতিফলন। উন্নত রাষ্ট্রগুলো “প্রোঅ্যাকটিভ” ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে, অর্থাৎ দুর্ঘটনা ঘটার আগেই সম্ভাব্য ঝুঁকি শনাক্ত, প্রশিক্ষণ ও মহড়া সম্পন্ন, জরুরি বাজেট বরাদ্দ এবং বিকল্প পরিকল্পনা নির্ধারণ করে রাখে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে, হঠাৎ ফ্লাইট বাতিল ও দেরিতে তথ্যপ্রদান নিয়ে যাত্রীদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়। কেউ কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরে আটকে ছিলেন, অনেকে জানতেন না কখন ফ্লাইট ছাড়বে। আমরা দেশ হিসেবে ডিজিটালি এখনো কেন পিছিয়ে আছি, কেন রিয়েল-টাইম তথ্য ব্যবস্থার অভাব এই ঘটনার মধ্যেও চোখে পড়ে? উন্নত দেশগুলোতে বিমানবন্দরের যেকোনো সংকট মুহূর্তে যাত্রীদের মোবাইল বার্তা, অ্যাপ ও অনলাইন নোটিফিকেশনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক আপডেট দেওয়া হয়। আমাদের এখনো সে রকম নাগরিক সহায়ক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
তবে সব দিকই হতাশার নয়। এই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের শতাধিক সদস্য, বিমানবাহিনীর বিশেষ ইউনিট ও সিভিল এভিয়েশন কর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। কোনো প্রাণহানি হয়নি- এটিই সবচেয়ে বড় স্বস্তির বিষয়। দ্রুত বিমান চলাচল পুনরায় চালু করার যে প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে, তা বাংলাদেশের সক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়; উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে এমন প্রতিক্রিয়াকে নিয়মিত রূপ দিতে হবে, কেবল একবারের জন্য ঘটনাপ্রতিক্রিয়া হিসেবে নয়।
প্রসঙ্গত বলা যায়, বিমানবন্দর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় সিঙ্গাপুর, কাতার ও জাপান আদর্শ উদাহরণ। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে বছরে অন্তত ছয়বার অগ্নিনির্বাপণ মহড়া হয়, যেখানে দমকল, পুলিশ, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, এমনকি বেসরকারি এয়ারলাইনসমূহও অংশ নেয়। তাদের প্রতিটি টার্মিনালে তিন স্তরের সেফটি জোন, স্বয়ংক্রিয় সেন্সর-ভিত্তিক ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম এবং ‘ইনস্ট্যান্ট রেসপন্স প্রোটোকল’ সক্রিয় থাকে। আমাদের শাহজালাল বিমানবন্দরে যদি এমন ব্যবস্থাপনা থাকত, তাহলে হয়তো আগুনের ক্ষতি অনেকটাই কমানো যেত।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার প্রশ্নও নতুনভাবে সামনে এসেছে। যেহেতু বিমানবন্দর একটি কৌশলগত স্থাপনা, তাই এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল সিএএবি বা বিমানের দায়িত্ব নয়; বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তার অংশ। রাষ্ট্র যদি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়- বিদ্যুৎকেন্দ্র, বন্দর, শিল্পাঞ্চল-সমন্বিত নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, তাহলে যেকোনো দুর্ঘটনা মোকাবিলা সহজতর হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ‘ক্রিটিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোটেকশন ফ্রেমওয়ার্ক’ নামে এমনই একটি নীতি অনুসরণ করে, যেখানে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তাদের ঝুঁকি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা বার্ষিকভাবে সরকারের কাছে জমা দেয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমন কাঠামো এখন অত্যাবশ্যক।
অগ্নিকাণ্ডের আরেকটি মাত্রা হলো, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিমা ব্যবস্থার কার্যকারিতা। বিমানের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কার্গোতে থাকা পণ্যের একটি অংশ বীমাকৃত ছিল, তবে পুরো ক্ষতি কাভার করা সম্ভব হবে না। উন্নত রাষ্ট্রে শিল্প-বাণিজ্যিক বিমা কার্যক্রম অনেক বেশি সক্রিয় থাকে; এমনকি দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় যাতে তাদের উৎপাদন ও রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমাদের দেশে বিমা ব্যবস্থার সেই গতিশীলতা এখনো গড়ে ওঠেনি।
পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, এই ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া। উন্নত রাষ্ট্র মানে নিখুঁত রাষ্ট্র নয়, বরং ভুল থেকে দ্রুত শেখার রাষ্ট্র। জাপানের তোহোকু ভূমিকম্পের পর দেশটি তার পুরো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১-এর পর বিমান নিরাপত্তা নীতিতে বিপ্লব এসেছে। বাংলাদেশকেও এখন সেই শিক্ষা নিতে হবে- শুধু বিমানবন্দর নয়, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর জন্য ঝুঁকি মূল্যায়ন ও প্রস্তুতি প্রোটোকল তৈরি করতে হবে।
এই আগুনের ঘটনায় প্রাণহানি না ঘটায় আমরা আপাতত স্বস্তি পেতে পারি, কিন্তু এই স্বস্তিই যেন আত্মতুষ্টিতে পরিণত না হয়। আমাদের প্রশাসনকে আরও দ্রুত, সমন্বিত ও স্বচ্ছ হতে হবে। তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে, দায় নির্ধারণ করতে হবে, এবং দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তা সংস্কারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। জনগণের জানার অধিকার ও নিরাপত্তা দুটোই রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির অংশ। আজকের আগুন আমাদের জন্য কেবল আতঙ্ক নয়, বরং এক বাস্তব আয়না, যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আমরা কতটা প্রস্তুত, আর কতটা পিছিয়ে। সেই আয়নায় নিজেদের সৎভাবে দেখার সাহসটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। কারণ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া শুধু বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে নয়, বরং এমন সংকট মুহূর্তে দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা ও সময়মতো প্রতিক্রিয়া দেখানোর মাধ্যমেই সম্ভব।
লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
আমি তখন কলেজে পড়ি। স্যারের বাসায় যত সিনসিয়ারলি যাই তত সিনসিয়ারলি পড়ালেখা করি না। পুরা শহর ঘুরে বেড়ানোয় যত মনোযোগ ততটা মনোযোগ কলেজে যাওয়ায় না। তবে নিঃসন্দেহে দারুণ সময় পার করছিলাম। একদিন আমি কোনো এক কাজে রিকশায় করে ফরেস্ট ঘাটের দিকে যাচ্ছিলাম। যথারীতি রিকশা চালকের সাথে নানবিধ গল্প করছি। রাজনীতি, শহর, দেশসহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই আমাদের আলোচনায় স্থান পাচ্ছিল। রিকশা চালকের চিন্তা এবং জ্ঞান দেখে আমি বেশ মুগ্ধই হয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম যে আমাদের সমাজে আসলেই অনেক সুচিন্তাশীল মানুষ আছে যারা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটলো যেটা আমার চিন্তাশক্তিকে কিছুক্ষণের জন্যে অবশ করে দিলেও পরবর্তীতে একটা কঠিন সত্যকে জানতে সাহায্য করেছিল। ফরেস্ট ঘাটের কাছাকাছি একটা জায়গায় পৌঁছেতেই কিছু দূরে একটা জটলা মত পেলাম এবং একজন পথচারীর কাছ থেকে জানতে পারলাম তিনি আর কেউ না, শহরের সবচেয়ে কুখ্যাত টেরর (যার নাম বললে আপনারা সবাই চিনবেন)। আমি কেন যেন আর অগ্রসর হতে চাইলাম না। রিকশা চালককে ওখানেই আমাকে নামিয়ে দিতে বললাম। ঘৃণা থেকেই হোক বা অজানা শঙ্কায় হোক সে মুহূর্তে ওই মানুষটার কাছাকাছি যেতে আমার ইচ্ছা হচ্ছিল না। আমি রিকশা থেকে নেমে যখন ভাড়া মিটাচ্ছিলাম তখন দেখি আমার সেই রিকশাচালক বেশ রাগান্বিত হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক রিকশা চালককে তার হাতের বিড়িটা ফেলে দিতে বলছে। প্রায় ধমকের স্বরেই বলেছিল, ‘বিড়ি ফ্যাল ব্যাটা। সামনে একজন সম্মানিত মানুষ দেখা যায় সেটার খেয়াল নেই?’ আমি বেশ ভালো রকমের ধাক্কা খেলাম। অনেকটা বিড়বিড় করে বললাম, ‘সামনে কোনো সম্মানিত লোক আছে যে এখানে দাঁড়িয়ে এই রিকশাচালক বিড়ি খেতে পারবে না?’ তখন আমার সেই রিকশাচালক আমার উপর বিরক্ত হয়েই বলেছিল, ‘ভাইরে চিনেন না?’ আমি আর কোন কথা না বলে যতটা সম্ভব দ্রুত হেঁটে বিপরীত দিকে চলে গিয়েছিলাম। মজার বিষয় হচ্ছে আমাদের রিকশা থেকে সেই সম্মানিত(!) লোক এতটুকু দুরুত্বে ছিল যে আরেকজন রিকশাচালক বিড়ি খেলে সেটা দেখতে পাবে না। তার মানে সে ভয় থেকে কথাটা বলে নি। বরং তার চোখে মুখে এক ধরনের মুগ্ধতা দেখেছিলাম। কিছুক্ষণ আগেও যে রিকশাচালককে আমি বুদ্ধিমান, বিবেকবান মনে করেছিলাম তার প্রতি আমার দৃষ্টি ভঙ্গিটাই মুহূর্তে পালটে গিয়েছিল।
এটুকু পড়ে হয়তো অনেকেই ভাবছেন এটাতে কি আর এমন ঘটনা আছে যে এত বছর পরে এসে আমাকে লিখতে হবে? আসলে এটা আমার একটা ভিন্ন চিন্তা শক্তিকে উন্মুক্ত করেছিল। এরপর থেকে একটা বিষয় আমি খুব ভালোভাবে বুঝার চেষ্টা করি। আমরা কম বেশি সবাই নীতি কথা বলি, বিবেকের কথা বলি; কিন্তু অসৎ এবং খারাপ মানুষদের কেন এক গোপন সমর্থন দিয়ে যাই? কেন অনেক ক্ষেত্রেই সমাজের সবচেয়ে খারাপ মানুষদের একজনকে ভোট দিয়ে আমরা নির্বাচিত করি? কোনো এক ব্যাক্তি যদি অশ্লীল কথা বলে তারপরেও কেন আমরা তাকে পছন্দ করি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে ফলো করে যাই? তারচেয়েও যেটা আমাকে বেশি ভাবতে সাহায্য করেছিল যে আমাদের চোখের সামনে পরিষ্কার অনিয়ম, অন্যায় দেখতে পেলেও কেন আমরা তার প্রতিবাদ তো করিই না বরং কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা তার নীরব সমর্থনও দিয়ে যাই? আর এই অনিয়মের অংশ কিন্তু মূর্খ, জ্ঞানহীন বা অবুঝ মানুষজনই শুধু না বরং শিক্ষিত, মার্জিত, বুদ্ধিমানেরাও। কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কেন আমরা সম্মিলিতভাবে অন্যায়কে মেনে নেই?
আমরা সবসময় আমাদের স্বার্থ নিয়েই ভাবি। আমাদের কম্ফোর্ট নষ্ট হয় এমন কিছুকে ইচ্ছা করেই এড়িয়ে চলি। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে আমরা সত্য খুঁজি না, আমাদের কম্ফোর্ট খুঁজি। অর্থাৎ, যে ঘটনা বা তথ্য আমাদেরকে ডিসকম্ফোর্ট দিবে সেটাকে আমরা দেখেও না দেখার ভাণ করি। মনে করেন আপনি একটা গাড়িতে বসে আছেন। সেই গাড়িটা যদি ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করে বা কাউকে বোকা বানিয়ে আপনাকে বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে দেয় তখন কিন্তু আপনি মনে মনে খুশী হবেন। আবার ঠিক বিপরীতভাবে, আপনার পাশ দিয়ে আপনাকে বোকা বানিয়ে যদি আরেকটা গাড়ি নিয়ম ভঙ্গ করে কোন ব্যানিফিট নেয় তাহলে তার উদ্দেশে নৈতিক কথা বলবেন এবং সে যে অন্যায় করেছে সেটার জন্যে আপনি কথা শুনিয়ে দিবেন। তার মানে ন্যায় এবং সত্য আপনার স্বার্থের সাথে সমন্বয় করে চলে। কোনো অসৎ এবং খারাপ মানুষের কাছ থেকে আপনি যদি সুবিধা পেয়ে থাকেন তাহলে তার সেই অসততা আপনি মনে মনে মেনে নেবেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে তাহলে কি সবাই অন্যায়ের সাথেইে আপস করে চলে? না, সবাই আপস করে না। সংখ্যায় খুব অল্প হলেও অনেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মতামত প্রদান করে। তবে এর ফলে তাকে অনেকটাই সমাজচ্যুত হতে হয়। এখন হয়তো ভাবছেন কয়টা বিষয়ে কজনা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে? এই প্রতিবাদ শুধুমাত্র আন্দোলনে না। এর অনেক রূপ আছে। মজার বিষয় হচ্ছে সেসব প্রতিবাদীরা আইসোলোটেড হয়ে যায়, কারণ আমি আপনিই নিয়মের জালে তাদের একলা করে দেই। সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্টিং মিডিয়া সব জায়গায় দেখবেন চটুল লোকদের জয়জয়কার। যারা ন্যায়ের কথা বলছে, সমাজ ও দেশের কথা বলছে তাদের অস্তিত্ব থাকছে না। সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে ন্যায়ের কথা বলা লোকজনেরা শুধুমাত্র কোণঠাসাই হয় না, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রমণের স্বীকারও হয়।
ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে সবচেয়ে ভালো ও জনপ্রিয় ছাত্রটিই সাধারনত সবচেয়ে ভালো মিথ্যাবাদী। অন্যভাবে বললে যে যত সুন্দরভাবে গুছিয়ে এবং কনভিন্সিংলি মিথ্যা বলতে পারে সে তত জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এমনকি গবেষকরা বলেছেন যে বর্তমান সমাজে বুঝিয়ে মিথ্যা বলতে পারাটা দারুণ একটা স্কিল হিসাবে গন্য হতে পারে। যারা এই মতবাদে বিশ্বাসী না তাদের অনুরোধ করব একটু ভালো করে আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। অনেক ক্ষেত্রেই ডিসিভাররা দারুণভাবে জনপ্রিয়। তারা সুন্দরভাবে গুছিয়ে মিথ্যা বলে আমাদেরকে মিথ্যা গিলিয়ে দিচ্ছে। তাদের মিথ্যা ধরার মতো ক্ষমতা বেশিরভাগ মানুষেরই নেই। যারা মিথ্যাকে ধরতে পারছে তারা প্রতিবাদ করছে না কারণ এতে করে তারা আক্রমণের স্বীকার হবে। এটাই আমাদের সমাজের অদ্ভুত নিষ্ঠুরতা। সত্য যখন আমাদেরকে ডিসকম্ফোর্ট দেয় কিংবা আনসেটেল্ড করে দেয় তখন আমরা সত্যবাদীকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আক্রমণ করে বসি।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে কেন সত্যের চেয়ে মিথ্যা বেশি প্রসারিত এবং জনপ্রিয়। এর সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা হচ্ছে, সত্য উপলব্ধি করার জন্যে জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, সত্যকে যাচাই করে নিতে হয়। সত্য কখনো কখনো রূঢ় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্য আমাদের ডিস্কম্ফোর্ট দেয়, আমাদের স্বার্থে আঘাত হানে। অন্যদিকে মিথ্যা হচ্ছে সহজ এবং চটুল। মিথ্যাকে যাচাই করতে হয় না, মিথ্যাকে ধারণ করার জন্যে কোন জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। মিথ্যার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে মিথ্যা আপনাকে কম্ফোর্ট দিবে, কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করে দিবে না। সত্য র্যাশিওনাল আর্গুমেন্টকে উৎসাহিত করে আর মিথ্যা আবেগকে ম্যানিপুলেট করে। যেটা আবেগকে ম্যানিপুলেট করতে পারে তার জয় তো হবেই, তাই না?
কগনিটিভ ডিসোন্যান্স নামে সাইকলোজিতে একটা পরিস্থিতি আছে। এটা হচ্ছে নিজের ভেতরে নিজের আরেকটা ভিন্নমত। আমার মনে হয় কম বেশি আমরা সবাই এই সমস্যাতে ভুগি। এটার মাত্রা বেড়ে গেলে তখন হয়তো রোগাক্রান্ত হিসাবে বিবেচিত হয়। অনেক সত্যই আমরা জানি কিন্তু সেই সত্যকে আরেকটা যুক্তি দিয়ে আমরা নিজের কাছে নিজেই আশ্বস্ত হতে চাই। একটা উদাহরণ দেই যেটা আমাদের আগে আলোচনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একজন অসৎ এবং খারাপ মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই আমরা নেতা হিসাবে মেনে নেই। একজন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজকে দেখবেন পিএইচডি করা এক ব্যাক্তি ভোট দিচ্ছে। এসবই হচ্ছে কম্ফোর্ট দেয়া মিথ্যার আশ্রয় নেয়া। একজন খারাপ মানুষকে যখন আমরা সমর্থন করি তখন নিজের কাছে নিজেই যুক্তি দেই যে, অমুক তো এর চেয়েও বেশি খারাপ কাজ করেছে। তমুক তো, এই ভালো কাজটা করেনি। অতএব, আমি যে খারাপ মানুষটাকে সমর্থন করছি সেটা করাই যায়। আমাদের সমাজ নৈতিক অবক্ষয়ের এক চূড়ান্ত জায়গায় এসে উপনীত হয়েছে। আমরা নিজ স্বার্থে মিথ্যাকে আকড়ে ধরে পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে বসবাস অনুপযোগী এক সমাজ ব্যবস্থা রেখে যাচ্ছি। আমরা সম্মিলিতভাবে মিথ্যাকে মেনে নিয়েছি। আমরা সবাই কগনিটিভ ডিসোন্যান্সে সংক্রমিত।
লেখক: কথাশিল্পী ও নাট্যকার।
বর্তমানে আমাদের এই বাংলাদেশে জনসংখ্যার দিক দিয়ে পুরুষেরা এগিয়ে থাকলেও ভোটার হিসেবে পিছিয়ে আছে নারী ভোটাররা।
নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তালিকানুসারে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৬৩ লাখ ৭ হাজার ৫০৪ জন। এর মধ্যে নারী ৬ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার ৮১৯ জন আর পুরুষ ৬ কোটি ৪১ লাখ ৪৫৫ জন।
অর্থাৎ নারী ভোটারের চেয়ে পুরুষ ভোটার সংখ্যা বেশি , মাত্র ১৯ লাখ ৪ হাজার ৬৩৬ জন।
নির্বাচন কমিশন আরো বলছেন, ভোটার করার কার্যক্রম এখনো চলমান আছে। উনদের পক্ষ থেকে সর্বস্তরের জনগণকে ভোটার হতে উৎসাহিত করতে ব্যপক প্রচারণাও চালানো হয়েছে। অন্যদিকে নারী নেতৃবৃন্দরা মনে করেন, নারীরা ভোটার হলে রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণে আগ্রহ বাড়বে।তবে ভোটার বাড়লেই ক্ষমতায়ন বাড়বে এই কথা কতটুকু সত্য তা অনুমেয়। এখন শুরু হয়েছে সারাদেশে সর্বত্র নির্বাচনী প্রচারণা এবং এই প্রচারণার সর্বস্তরেই পুরুষ ভোটার দের আকৃষ্ট করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার সম্ভাব্য নমিনেশন এর আশায় দৌড়ঝাঁপ রত নেতারা, জনসভা, পথসভা, মিছিল, মিটিং ও কর্মীদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালাতে দল বদ্ধ ভাবে দাওয়াত এ অংশগ্রহণ ইত্যাদি চলছে হর হামেশা বিশেষ করে একটি দলের নেতাদের সালাম দোওয়া ও শুভেচ্ছায় ছবি সম্বলিত পোস্টারে, ব্যানারে ছেয়ে গেছে পথ ঘাট, ওলি, গলি, সমগ্র দেশের আনাচে কানাচের দেওয়াল ও পিলার এমন কি গাছ গাছালী পর্যন্ত। সেখানে নারী ভোটার দের আকৃষ্ট করার জন্য তেমন কোনো নজর কারা উদ্যোগ খুব একটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী এখনো অনেক পেছনে। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে পরিলক্ষিত হয়েছে একজন প্রধানমন্ত্রী একজন বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিয়ে নারীর সামগ্রিক রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে তা বলা যায় না। কারণ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী দলে প্রতি কমিটিতে নারীর অংশগ্রহণ ৩৩ শতাংশের এখনো পূরণে তেমন কোনো অগ্রগতি চক্ষুগোচর হয়নি।
৭১ সাল থেকে সংরক্ষিত আসনে নারীর সংখ্যা বেড়েছে তুলনামূলকভাবে তা অনেক কম। নারীকে মনোনয়ন দিতে নারীর ভোটার বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন নারী নেতৃবৃন্দ।
নারীরা ভোটার হলে এবং ভোট দিলে রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহ বাড়বে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। তার মতে সাধারণ আসনে নারীকে মনোনয়ন দিতে চায়না পুরুষতন্ত্র। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন হয় না। তাই ভোটারদের সংখ্যা বাড়ালেও পুরো রাজনৈতিক কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি নারী সংস্কার কমিশনের সদস্য কল্পনা আক্তার বলেন, রাতের ভোট, ভোট চুরি, ডাকাতি এসব নানা কারণে ভোটার হওয়া ওপর আগ্রহ নেই একশ্রেণির মানুষের। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করা নারীদের নিবন্ধনজনিত কার্যক্রমের জন্য পুরুষের ওপর নির্ভরশীল করে রেখেছে সমাজ।
ফলে তারা নিজেরা নিবন্ধন করে ভোটার হতে পারে না। আবার এক-দুই দিনে ছুটি নিয়ে বেতন কেটে গ্রামের বাড়ি গিয়ে ভোটার হওয়া তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। ফলে এই শ্রেণির অর্থাৎ
গার্মেন্টস শ্রমিক নারীরা ভোটার হন কম।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ গত আগষ্ট মাসে এক সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন নির্বাচনে ভোটার করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। ভোটার হতে উৎসাহিত করতে প্রচারণাও চালিয়েছে নির্বাচন কমিশন। বস্তি এলাকাসহ ভাসমান ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করতে বেদে, যাযাবর গোষ্ঠীকেও ভোটার করার কার্যক্রমও নির্বাচন কমিশনের আছে। তবে কাউকে জোর করে নির্বাচন কমিশন ভোটার বানাতে পারে না। এখনো সময় আছে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যে নাগরিকের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে সে ভোটার হতে পারবে।
জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে নারী আসন বাড়িয়ে সরাসরি ভোট, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও নির্বাচনী ব্যয় কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের অধিকাংশ প্রতিনিধিরা। সম্প্রতি গাইবান্ধায় জেলা পর্যায়ের সংলাপে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতকরণে নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তারা এ আহ্বান জানান।
ভোটের ইতিহাস খুঁজে জানা যায়, বাংলাদেশের নারীরা ১৯৪৬ সালে সীমিত ভোটাধিকার লাভ করে, কিন্তু ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তারা প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন যদিও অবিভক্ত বাংলায় ১৯২১ সাল থেকে সীমিত ভোটাধিকার ছিল, পাকিস্তান সৃষ্টির পর এবং পরবর্তীকালে স্বাধীনতার পর প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভোটাধিকারের সুযোগ আসে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিধানে একটি অতি আধুনিক সংযোজন এবং এমন একটি ধারণা যা বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বা অবদানকে স্বীকৃতি দেয়। উন্নয়নে নারী বলতে বুঝায় যে নারীরা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত এবং উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণের পরিবেশ অনুকূল করা অত্যাবশ্যক।
বাংলাদেশের নারীরা বরাবরই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার সনাতনী ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ এবং লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি ও সুশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক বহু সুযোগ সুবিধা থেকে প্রায়শ তারা বঞ্চিত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যোগ্য নারী নেতৃত্ব তৈরি হয়নি, সমাজে প্রচলিত আছে নারীরা সন্তান ধারণ করে, সন্তান জন্ম দেয়, তাদের প্রতিপালন করে এবং সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম করে, কিন্তু কখনো তারা নিজেদের কাজের জন্য যথোপযুক্ত মজুরি ও স্বীকৃতি পায় না।
চাকরির ক্ষেত্রে কোনো প্রকার আইনি বা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা নারীরা পায় না। গ্রামীণ পর্যায়ে ৮৪% এবং শহরে ৫৯% নারী অবৈতনিক গৃহ পরিচালিকা হিসেবে কর্মরত থাকে এবং প্রকৃত দায়িত্ব পালন করে থাকে।
বাংলাদেশের নারীরা পুরুষের তুলনায় সপ্তাহে গড়ে ২১ ঘণ্টা বেশি সময় কাজ করে। যদিও ঘর গৃহস্থালীর কাজে যুক্ত নারীশ্রমকে অর্থনৈতিক মানদণ্ডে কর্মকাণ্ড হিসেবে ধরা হয়েছে, কিন্তু এর অর্থমূল্য এখন পর্যন্ত জাতীয় আয় গণনায় হিসাব করা হয় না।
নারীর শ্রেণি পরিচিতি সবসময় নির্ধারিত হয় পরিবারের পুরুষ সদস্যের পেশা ও সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে।
এমন কি পরিবারের মধ্যে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় নারীরা কম খাদ্য গ্রহণ করে, স্বাস্থ্যসেবা এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ, সন্তান গ্রহণ, বৈবাহিক সিদ্ধান্ত ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের সুযোগ তাদের জন্য কম। সাংবিধানিকভাবে নারী ও পুরুষ উভয়েরই সমানাধিকার স্বীকৃত থাকলেও পারিবারিক ও ধর্মীয় আইন নারীর সার্বভৌম সত্ত্বা ও অধিকারকে খর্ব করে রেখেছে। বাংলাদেশের নারী অধিকার আন্দোলন, অসংখ্য নারী অধিকার দল বাংলাদেশের সকল মানুষের জন্য এক ও অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের দাবিতে সোচ্চার রয়েছে।
এদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল তাদের বিগত নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছে। অনেক সেমিনার ও কর্মশালা শেষে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সর্বপ্রথম ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোডের একটি ড্রাফট মডেল তৈরি করে এবং অন্যান্য নারী সংগঠনের সহায়তায় মডেলটির উৎকর্ষ সাধন করে।
বর্তমান আইনি প্রক্রিয়াতে জটিলতা থাকা সত্ত্বেও নারীর জন্য কিছু আইন প্রণীত হয়েছে। মিডিয়েশন কোর্ট প্রতিষ্ঠা, এসিড নিক্ষেপ আইন প্রণয়ন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশ সরকারের একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে ক্ষমতা প্রদান যেকোন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি মৌলিক বিষয়। এক্ষেত্রে প্রশাসনের সর্বনিম্ন স্তর ইউনিয়ন পরিষদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে নারীদের প্রতিনিধিত্বও অস্থায়ী ও অকার্যকর। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪৬ সালে নির্বাচিত এবং মনোনীত উভয় ধরনের সদস্য নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয়। কিন্তু সেখানে নারীদের মনোনয়নের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান ছিল না। বস্তুত ১৯৫৬ সালে প্রথম বারের মতো নারীরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটাধিকার লাভ করে। তখন প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন থেকে সম্পত্তির মালিকানা, খাজনা প্রদান ও শিক্ষাগত যোগ্যতা স্থানীয় সরকার কাঠামোতে ভোট দানের যোগ্যতা হিসেবে গণ্য করা হয়নি। স্বাধীনতার পরই এদেশের ইতিহাসে প্রথম স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তরে নারীরা প্রতিনিধিত্ব করার মর্যাদা লাভ করে।
সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, দেশের নারী জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত করতে এবং তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। নারী সংগঠনগুলি নারী নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ সংস্থা হিসেবে কাজ করে, বিশেষ করে নারীদের দাবি দাওয়ার সঠিক চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যায়। বিভিন্ন সেমিনার, কর্মশালা এবং লেখালেখির মধ্য দিয়ে তারা তুলে ধরেন সরকারি নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা বা দুর্বল দিক যা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রভাব ফেলে। তবে ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব এবং নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তাদের দাবিগুলি পুরুষ নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ধীর ধীরে নাড়া দিচ্ছে। নারীদের বিভিন্ন বিষয় জাতীয় এজেন্ডা হিসেবে তুলে ধরার জন্য এখনও কোনো জাতীয় মোর্চা গড়ে উঠেনি। কোনো সংগঠন বা সংগঠনগুলির এমন কোনো সংঘবদ্ধ রূপ বা ঐক্য গড়ে উঠেনি যা জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সম্ভাবনাময় নারী প্রার্থীদের নির্বাচনে সহযোগিতা দিতে সত্যিকারভাবে এগিয়ে আসবে। নারী সংগঠনগুলির রাজনীতিকীকরণ এধরনের ঐক্য মোর্চা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে নারী সমাজের কণ্ঠকে জোরালো করার ক্ষেত্রে তাদের অবদানকে অতিরঞ্জিত করার অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মূলধারায় নারী সমাজকে যুক্ত করার গতি ধীর, জটিল এবং প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ। ক্ল্যাসিক্যাল গণতন্ত্র, সামাজিকভাবে পিতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব ও সহজে অপরিবর্তনীয় রাষ্ট্রীয় বিধান রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণকে কঠিন করে তুলেছে। ফলে দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত নারীরা এই ব্যবস্থায় এগিয়ে আসতে পারছে না। তবে রাষ্ট্রের সম্প্রতি গৃহীত কিছু উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। অতএব সকলের উচিত আসন্ন নির্বাচনে নারী ভোটারদের নিরাপদে ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করা। পরিশেষে কবি কাজী নজরুল ইসলামের নারী কবিতার শেষ দুই লাইন স্বরণ করছি
‘সেদিন সুদূর নয় যেদিন ধরনী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয় ।’
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক কৌশলগত গুরুত্ব এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধনের ভূমিকা দেশটিকে উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া আয়োজনের মাধ্যমে তার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা জোরদার করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথ মহড়া অপারেশন ‘প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল’ ২৫-৩ আন্তর্জাতিক মহলে যথেষ্ট আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ইন্ডিয়া টুডে সহ কিছু ভারতীয় সংবাদমাধ্যম পরামর্শ দিয়েছে যে এই ধরনের মহড়া ভারতের পূর্ব সীমান্তে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। বাস্তবে এই ধরনের উদ্বেগ ভিত্তিহীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিমান বাহিনী নিয়মিতভাবে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত প্রশিক্ষণ মহড়া পরিচালনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই ধরনের যৌথ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অভূতপূর্ব নয়। বছরের পর বছর ধরে উভয় দেশই তাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর সাথে যৌথ মহড়ায় অংশগ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী তাদের পঞ্চম যৌথ মহড়ায় অংশগ্রহণ করেছে যার লক্ষ্য ছিল সামুদ্রিক কৌশলগত সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। সম্প্রতি ২০২২ সালেও একই ধরনের মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, সর্বশেষ মহড়াটি ১৪-১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে চট্টগ্রামের বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হক-এ অনুষ্ঠিত হয়। এই ধরনের সম্পৃক্ততা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি, প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব জোরদার এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে গঠনমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটায় এবং এই উদ্যোগগুলি তার প্রতিবেশীদের জন্য হুমকিস্বরূপ নয়, তা নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশ - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যৌথ সামরিক মহড়ার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি মেনে চলে আসছে। দেশটি কোনও সামরিক জোটের সদস্য নয় এবং দীর্ঘদিন ধরে ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈষম্য নয়’ এই বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করে আসছে। এই নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়মিত অবদান রেখে আসছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও জোরদার করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের প্রথম প্রধান যৌথ সামরিক মহড়া ১৯৯০-এর দশকে শুরু হয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে বেশ কয়েকটি মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কোঅপারেশন অ্যাফ্লোট রেডিনেস অ্যান্ড ট্রেনিং (CARAT), টাইগার শার্ক, প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এবং সাম্প্রতিকতম এক্সারসাইজ ডিজাস্টার রেসপন্স অ্যান্ড হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স। এই মহড়াগুলি সাধারণত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ, নৌ ও বিমান প্রতিরক্ষা কৌশল, মানবিক ও চিকিৎসা সহায়তা, সেইসাথে সন্ত্রাসবাদ দমন এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা মহড়ার মতো বিস্তৃত ক্ষেত্রগুলিতে মনোনিবেশ করেছে। অতি সম্প্রতি ২০২৫ সালে অনুষ্ঠিত অপারেশন প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল ২৫-৩-এ কেবল বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, অংশগ্রহণকারী দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি এই সত্যকে প্রতিফলিত করে যে, এই ধরনের উদ্যোগগুলি আর কেবল দ্বিপাক্ষিক নয় বরং বৃহত্তর আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কাজ করে।
উল্লেখযোগ্য যৌথ মহড়া
টাইগার শার্ক: ২০০৯ সাল থেকে ফ্ল্যাশ বেঙ্গল সিরিজের অংশ হিসেবে পরিচালিত একটি যৌথ বিশেষ বাহিনীর প্রশিক্ষণ মহড়া। এই কর্মসূচিতে টহল নৌকা পরিচালনা এবং স্বল্পপাল্লার অস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে দক্ষতা বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
টাইগার লাইটনিং: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্যাসিফিকের সাথে জড়িত একটি বাস্তবসম্মত মাঠ প্রশিক্ষণ মহড়া। এটি এখন টানা চার বছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা স্থল যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং কৌশলগত সমন্বয়ের ক্ষেত্রে টেকসই অংশীদারিত্বের উপর জোর দেয়।
প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল: প্রাথমিকভাবে একটি মানবিক সহায়তা এবং দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া মহড়া, অনুসন্ধান ও উদ্ধার (SAR) অভিযান এবং বিমান চিকিৎসা স্থানান্তরের উপর জোর দেওয়া হয়। এই উদ্যোগটি বাংলাদেশের দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং সংকট প্রতিক্রিয়া ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করে।
কো অপারেশন অ্যাফ্লোট রেডিনেস অ্যান্ড ট্রেনিং (CARAT): ২০১০ সাল থেকে এই বার্ষিক বহুজাতিক মহড়াটি বঙ্গোপসাগরে পরিচালিত হয়ে আসছে। এর লক্ষ্য সামুদ্রিক ক্ষেত্র সচেতনতা উন্নত করা এবং শক্তিশালী নৌ সহযোগিতা গড়ে তোলা।
স্টেট পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম (এসপিপি): ২০০৮ সাল থেকে অনুষ্ঠিত এই প্রোগ্রামটি বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন ন্যাশনাল গার্ডের মধ্যে স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলে, দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং জ্ঞান ভাগাভাগি সহজতর করে।
যৌথ মহড়ায় বাংলাদেশের আগ্রহ এবং উদ্দেশ্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিমান বাহিনী প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত প্রশিক্ষণ মহড়া পরিচালনা করে। বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা এবং সংকটের সময় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার এবং পরিবহন বিমান প্রায়শই মোতায়েন করা হয়। অপারেশন প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল ২৫-৩ প্রতিকূল এবং জরুরি পরিস্থিতিতে এই সম্পদের অপারেশনাল প্রস্তুতি বৃদ্ধির উপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছিল। এই মহড়ার সময় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একটি C-130J পরিবহন বিমান এবং একটি MI-17 হেলিকপ্টার মোতায়েন করে- যেখানে মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিমান বাহিনীর দুটি C-130J পরিবহন বিমান অবদান রাখে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মোট ১৫০ জন কর্মী এবং মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিমান বাহিনীর ৯২ জন কর্মী অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীর সদস্যরাও অংশগ্রহণ করেন, যা মহড়ার বহুমাত্রিক প্রকৃতির উপর জোর দেয়। এই ধরনের মহড়ায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সামরিক দক্ষতা বৃদ্ধি, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা সক্ষমতা জোরদার, দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া এবং মানবিক সহায়তা, সামুদ্রিক নিরাপত্তা রক্ষা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য কাজ করে।
ভারতের উদ্বেগের অন্তর্নিহিত কারণ
যদিও ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রধান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে রয়ে গেছে, তবুও সম্প্রতি বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশের সাথে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিক পরিবর্তন, পাকিস্তানের সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা এবং পাকিস্তানের সাথে অপারেশন সিন্দুরের মতো যৌথ উদ্যোগ নয়াদিল্লিতে অস্বস্তি তৈরি করেছে। বাংলাদেশের উপর ভারতের নিজস্ব বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং শিলিগুড়ি করিডোর নিয়ে উদ্বেগ দ্বিপাক্ষিক গতিশীলতাকে আরও জটিল করে তুলেছে। অভ্যন্তরীণভাবে মণিপুর এবং লাদাখে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন ভারতের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাগুলিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বাহ্যিকভাবে তিস্তা নদী প্রকল্পে চীনের জড়িত থাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে মার্কিন আগ্রহ ভারতের আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। নয়াদিল্লির জন্য ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন কৌশলগত অগ্রাধিকারগুলিকে- বিশেষ করে যখন বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করা হয় তখন তা ভূ-রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল হিসাবে দেখা হয়। ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করে যে, যৌথ সামরিক মহড়ার আড়ালে বাংলাদেশ হয়তো আঞ্চলিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করতে পারে, পাশাপাশি বৈশ্বিক শক্তির সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গভীরতর করতে পারে।
অধিকন্তু ভারত দক্ষিণ এশিয়াকে তার ঐতিহ্যবাহী প্রভাব বলয় হিসেবে দেখে। তাই এই অঞ্চলে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলির তাদের পদচিহ্ন সম্প্রসারণের সম্ভাবনাকে তাদের কৌশলগত অবস্থানের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই পটভূমিতে ভারতীয় গণমাধ্যমের কিছু অংশ বাংলাদেশ-মার্কিন মহড়াকে ভারতের সামরিক ঘেরাওয়ের অংশ হিসেবে অতিরঞ্জিত করে তুলেছে। এই বর্ণনার সাথে যুক্ত হয়েয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ভুল তথ্য এবং গুজব; যা প্রায়শই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলিতে সমালোচনামূলকভাবে পুনরুৎপাদন করা হয়েছে- যা বাস্তবতা থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন একটি চিত্র তৈরি করেছে।
ভারতের উদ্বেগ কেন ভিত্তিহীন?
বাস্তবসম্মতভাবে মূল্যায়ন করলে দেখা যায় যে, এই ধরনের মহড়া ভারতের জন্য কোনও হুমকি নয়। বাংলাদেশ কখনও অন্য দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনও সামরিক জোটে যোগ দেয়নি এবং যৌথ মহড়ায় তাদের অংশগ্রহণ কেবল পেশাদার দক্ষতা বৃদ্ধির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। ২০২৫ সালের মহড়ায় আক্রমণাত্মক সামরিক পদক্ষেপের পরিবর্তে দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া, চিকিৎসা সহায়তা এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রশিক্ষণের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। তদুপরি মহড়াগুলি কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না- দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলিও অংশগ্রহণ করেছিল; যা কোনও একক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নকশার পরিবর্তে সহযোগিতামূলক এবং আঞ্চলিক উদ্যোগের প্রকৃতি তুলে ধরে। এটিও লক্ষণীয় যে, ভারত নিজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নিয়মিত যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করে। এই পটভূমিতে ওয়াশিংটনের সাথে বাংলাদেশের অনুরূপ মহড়ায় ক্ষেত্রে ভারতের উদ্বেগ অযৌক্তিক বলে মনে হয়। তদুপরি বাংলাদেশ এবং ভারতের সশস্ত্র বাহিনী নিয়মিত দ্বিপাক্ষিক যৌথ মহড়া পরিচালনা করে, চলমান প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বজায় রাখে। এটি এই সত্যকে তুলে ধরে যে, বাংলাদেশ ভারতের জন্য হুমকি নয় বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রচারে অংশীদার।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এবং ভারতের অর্থনীতি পরস্পর নির্ভরশীল। যদিও ২০২৫ সালে ভারতের একতরফা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আঘাত হানে, তবুও এর প্রভাব উভয় পক্ষের উপরই পড়ে। বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতি প্রায় ৭.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারতীয় রপ্তানিও প্রায় ৬.২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এটি এই বাস্তবতাকে তুলে ধরে যে, যদি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে অবিশ্বাস অব্যাহত থাকে, তাহলে উভয় দেশই তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। অতএব পারস্পরিক বিশ্বাস ভাগাভাগি করা সমৃদ্ধি রক্ষার একমাত্র কার্যকর পথ।
আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি এবং বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান একে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগরের সংযোগস্থলে স্থাপন করেছে। দেশটি তিনটি প্রধান শক্তির মধ্যে কৌশলগত প্রতিযোগিতার একটি অঞ্চলে অবস্থিত: ভারত তার আঞ্চলিক নেতৃত্ব বজায় রাখতে চায়; চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে; এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসাবে দেশের জন্য আরও বেশি কৌশলগত তাৎপর্যপূর্ণ। এই প্রতিযোগিতার মধ্যে বাংলাদেশ ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়- কোনও একক শক্তির সাথে একচেটিয়াভাবে জোটবদ্ধ না হয়ে বরং ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’ এই নির্দেশক নীতি মেনে চলতে চায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। বাংলাদেশ-মার্কিন সামরিক মহড়াকে হুমকি হিসেবে দেখার পরিবর্তে, একে সহযোগিতার সুযোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে ভারতই উপকৃত হবে।
উপসংহার
বাংলাদেশ-মার্কিন কৌশলগত সামরিক মহড়া বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধির বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ। এই উদ্যোগগুলি কোনোভাবেই ভারতের বিরুদ্ধে নয়। বরং তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হল দুর্যোগ মোকাবিলা, মানবিক সহায়তা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার করা। ভারত যদি এই ধরনের মহড়াকে হুমকি হিসেবে নয় বরং সহযোগিতার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখতে চায়, তাহলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার হতে পারে। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য পারস্পরিক বিশ্বাসের চেতনায় বাংলাদেশের অনন্য ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে কাজে লাগানো অপরিহার্য হবে।
*তানিম জসিম: প্রাবন্ধিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক। সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ১০০০।
আজ ঐতিহাসিক বঙ্গভঙ্গ দিবস। এদেশের ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়, যা আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের গতিপথে গভীর প্রভাব ফেলেছে। বঙ্গভঙ্গের ঘটনাপ্রবাহই ছিল এক দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা, যার পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম।
১৮৭০ থেকে ১৮৮০-এর দশকে বাংলা প্রেসিডেন্সি ছিল প্রশাসনিকভাবে একটি বিশাল প্রদেশ, যার কেন্দ্র ছিল কলকাতা। সমগ্র প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পশ্চিমবঙ্গনির্ভর ছিল। পূর্ববঙ্গ ছিল যোগাযোগ, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ। ব্রিটিশ শাসকরা দাবি করতেন— প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক বিভাগ অপরিহার্য।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৪ সালের ১১ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার এক নতুন প্রশাসনিক পরিকল্পনা ঘোষণা করে, যাতে ঢাকা ও ময়মনসিংহকে আসাম ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু এ প্রস্তাবকে পূর্ববঙ্গের নেতৃবৃন্দ জনগণের কল্যাণবিরোধী বলে মনে করেন। তারা বিকল্প প্রস্তাবে আসাম, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং যশোর-খুলনা অঞ্চলকে একত্র করে নতুন প্রদেশ গঠনের দাবি জানান, যার রাজধানী হবে ঢাকা।
১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরে এসে আহসান মঞ্জিলে অবস্থানকালে বঙ্গ বিভাগের প্রস্তাব নিয়ে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তাদের পরামর্শে পরিকল্পনার কিছু পরিবর্তন আসে, যাতে নতুন প্রদেশটি পূর্ববঙ্গের মানুষের স্বার্থের অনুকূলে হয়।
অবশেষে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের চূড়ান্ত ঘোষণা দেন। বাংলা প্রদেশকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়— ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ এবং ‘পশ্চিমবঙ্গ’। প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাত থাকলেও প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের ‘Divide and Rule’— বিভাজন ও শাসনের নীতি। পূর্বাঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, পশ্চিমে হিন্দুরা— এই ধর্মভিত্তিক বিভাজনই ভবিষ্যৎ ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে।
বঙ্গভঙ্গের ফলে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সমাজে প্রবল উদ্বেগ দেখা দেয়। তারা আশঙ্কা করেছিল— বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ঐক্য বিনষ্ট হবে এবং কলকাতাকেন্দ্রিক প্রভাব হ্রাস পাবে। অন্যদিকে, পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা মনে করেছিল— শিক্ষা, প্রশাসন ও বাণিজ্যে তারা নতুন সুযোগ পাবে। এই দ্বিমুখী প্রতিক্রিয়াই হিন্দু-মুসলমান বিভেদের ভিত্তি রচনা করে।
পশ্চিমবঙ্গের নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গকে ‘বঙ্গমাতার দ্বিখণ্ডন’ বলে আখ্যায়িত করে গণআন্দোলনে নেমে পড়েন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বাল গঙ্গাধর তিলক ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতা বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। প্রতিবাদে সংগঠিত হয় বয়কট, স্বদেশী ও স্বরাজ আন্দোলন। অপরদিকে, উপমহাদেশের মুসলমানরা উপলব্ধি করেন— তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন গঠন প্রয়োজন। এই ভাবনা থেকেই ১৯০৬ সালে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জন্ম হয়।
বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার পর নবগঠিত প্রদেশটির আয়তন ছিল ১,০৬,৫৪০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি দশ লক্ষ। রাজধানী ঢাকা দ্রুত নতুন প্রশাসনিক, শিক্ষা ও বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। কার্জন হল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পুরনো হাইকোর্ট ভবন, বাংলা একাডেমি— এসব স্থাপনা বঙ্গ বিভাগের ফলশ্রুতিই ছিল। পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা উচ্চশিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে নতুন সুযোগ পায়, ফলে এ অঞ্চলে নবজাগরণের সূচনা ঘটে।
তবে রাজনৈতিক দিক থেকে বঙ্গভঙ্গ ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে দৃঢ় করে। অনেকে মনে করেন, ব্রিটিশ সরকার ১৯০৫ সালের এই বিভাজন এবং ১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কারের মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী চালু করে কংগ্রেসে তাদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা নষ্ট করতে চেয়েছিল। এভাবেই তারা হিন্দু-মুসলমান বিরোধ স্থায়ী করে নিজেদের শাসন টিকিয়ে রাখার কৌশল গ্রহণ করে।
জনমতের চাপে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত বাতিল করে। দিল্লির রাজসভায় সম্রাট জর্জ পঞ্চম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন— পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ পুনরায় একত্রিত হবে এবং ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে নয়া দিল্লিতে স্থানান্তরিত হবে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় আপাতদৃষ্টিতে ঐক্য ফিরলেও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মানসিক বিভাজন তখনও গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে।
বঙ্গভঙ্গ ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এর ফলে বাঙালি সমাজে রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ ঘটে। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের ভেতর থেকেই সন্ত্রাসবাদী ও স্বদেশী আন্দোলনের উত্থান হয়। একইসঙ্গে মুসলমান সমাজেও জন্ম নেয় স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয়ের বোধ, যা পরবর্তীকালে পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত রচনা করে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় বাংলা পুনরায় বিভক্ত হয়— এবার ধর্মভিত্তিকভাবে। পশ্চিমবঙ্গ ভারত অংশে অন্তর্ভুক্ত হয়, আর পূর্ববঙ্গ হয় পাকিস্তানের পূর্বাংশ, ‘ইস্ট পাকিস্তান’। এই বিভাজনে অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত ও নিপীড়িত হয়; ধর্মীয় সংঘাত ও সহিংসতা সমাজকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা ও সংস্কৃতির অবমূল্যায়ন নতুন অসন্তোষ সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রীয়ভাবে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার চেষ্টা বাঙালি জাতিসত্তাকে আঘাত করে। এরই প্রতিক্রিয়ায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন জন্ম নেয়, যা বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার ভিত্তি গড়ে দেয়।
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে জাতীয় চেতনার বীজ রোপিত হয়, তা পরবর্তী দুই দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণের তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, পশ্চিম পাকিস্তানের অস্বীকৃতি এবং সামরিক দমন-পীড়ন শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটায়।
অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে— যা বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস থেকে শুরু হওয়া জাতীয় আত্মপরিচয়ের চূড়ান্ত প্রকাশ।
বঙ্গভঙ্গ শুধু বিভাজনের ইতিহাস নয়; এটি বাঙালির আত্মসচেতনতা, প্রতিরোধ ও পুনর্জাগরণের ইতিহাসও বটে। ১৯০৫ সালের সেই বিভাজন যেমন জাতিকে বিভক্ত করেছিল, তেমনি সেটিই দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের একত্রীকরণের প্রেরণাও হয়ে উঠেছিল। আজকের বাংলাদেশ সেই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতারই ফল— একটি জাতি, যার ভিত্তি ভাষা, চেতনা ও সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য ঐক্যে দৃঢ়ভাবে বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ।
লেখক: গবেষক ও প্রবন্ধকার।
১৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস’। দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় এক সহজ কিন্তু জীবনরক্ষাকারী অভ্যাসের কথা—সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা বলেন, “সাবান দিয়ে হাত ধোয়া হলো সবচেয়ে সাশ্রয়ী প্রতিরোধমূলক টিকা।” কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এখনো অনেক মানুষ এই সহজ অভ্যাসটিকে অবহেলা করেন, যার ফলেই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা কিংবা ভাইরাসজনিত অন্যান্য সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, সঠিকভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে এসব রোগের সংক্রমণ ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। তবুও বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের বহু মানুষের কাছে এখনো নিরাপদ পানি ও সাবান—এই মৌলিক জিনিস দুটি সহজলভ্য নয়। বিশেষ করে গ্রামীণ ও বস্তি এলাকায় এই অভাব প্রকট। তাই হাত ধোয়ার বার্তা কেবল সচেতনতায় সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, এটিকে বাস্তব কর্মসূচিতে রূপ দিতে হবে।
খাবার গ্রহণের আগে ও পরে, শৌচাগার ব্যবহারের পর, বাইরে থেকে বাসায় ফেরার পর কিংবা রোগীর সেবা করার আগে-পরে—প্রতিটি ক্ষেত্রেই হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। এই অভ্যাস কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটি সামাজিক দায়িত্বও বটে। বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের হাত ধোয়ার অভ্যাস শেখানো গেলে তারা পরিবার ও সমাজে এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে।
সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার, এনজিও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। বিভিন্ন প্রচারাভিযান, স্কুলভিত্তিক কর্মসূচি ও জনসচেতনতা কার্যক্রমের মাধ্যমে হাত ধোয়ার গুরুত্ব বোঝাতে হবে। এটি কেবল স্বাস্থ্য সুরক্ষাই নয়, অর্থনৈতিকভাবেও একটি বড় বিনিয়োগ—কারণ প্রতিরোধ চিকিৎসার চেয়ে অনেক কম ব্যয়বহুল।
আমরা প্রায়ই উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি, কিন্তু ভুলে যাই—সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ লুকিয়ে আছে আমাদের নিজের হাতে। হাত ধোয়ার মতো ছোট্ট একটি কাজই হতে পারে সংক্রমণ প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় ঢাল।
এই হাত ধোয়া দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক—নিজে হাত ধোব, অন্যকেও শেখাবো। কারণ সুস্থ সমাজ গড়ার শুরুটা সেখান থেকেই।
মোঃ সাজ্জাদুল ইসলাম
লেখক ও কলামিস্ট
কবিতা, কাব্য লেখনী সর্বোচ্চ বোধশক্তি বিশিষ্ট উত্তম চিন্তা ধারণার উৎকৃষ্ট মানের শিল্প সাহিত্যের উপাদান। কাব্যে লেখনীতে কবির প্রাণ উৎসারিত নিবেদন, ভাবনার উৎসর্গের নৈবেদ্য উন্মোচিত প্রকাশিত, উদঘাটিত হয়। তার আত্মবিশ্বাস, আবেগ -অনুভূতি, মূল্যবোধ- দৃষ্টিভঙ্গি। যে মূল্যবোধ, নীতিনৈতিকতা শিষ্টাচার, জ্ঞান তার পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বই-পুস্তকসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অর্জিত। সেই বিশ্বাস, চিন্তা চেতনা, মূল্যবোধেরই পরিস্ফূটন, প্রতিফলন দেখা যায় তার কাব্যে, লেখনীতে।
কবির কাব্য, লেখনী হচ্ছে তার চিন্তা চেতনা, মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, দেশাত্ববোধ ও রাজনৈতিক ভাবনাসহ মানবিক মূল্যবোধের স্বচ্ছ দর্পণ। যেখানে সমাজ জাতির সত্য মিথ্যা, ন্যায়- অন্যায়, সততা- আদর্শ, অসম অনাচার, কুসংস্কার, দুঃশাসন, ধর্মীয় বিশ্বাস, বিপ্লবী চেতনা, দেশ ও মানব প্রেম, রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ সমাজের সার্বিক বিষয় সম্পৃক্ত। অবশ্য দ্বৈত চরিত্রের মূল্যবোধহীন ভয়াবহ বতিক্রম আছে যা এখানে আলোচ্য নয়।
কাব্যিক মূল্যবোধ একটি ইতিবাচক ধারাবাহিক জীবনমুখী পরিবর্তনের মূল্যবোধ। কবি যদি তার আত্বার বিশ্বাস, কবির উপলব্ধিতে কাব্য রচনা করেন সমাজ, সংসার, দেশ জাতি, মানবকল্যাণে, মঙ্গলের উদ্দেশ্যে। প্রকৃত কবি নিমগ্ন চাষির মতো মনের মাধুরী মিশিয়ে যতনে শব্দের চাষ কর্ষনে, বাক্য, চরণে, স্তবকে কাব্য নামক মাঠে প্রেম- মানবতা, বিপ্লবী চেতনা ও দেশাত্ববোধ তৈরি করে। সমাজ সংসার দেশ জাতি ও মানবকল্যাণ মানুষের কর্তব্য, দায়বদ্ধতা, সকল অন্যায়, অশুভ অপশক্তি, বঞ্চনা-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অকপটে নির্মম সত্য প্রকাশের দুর্বার দুঃসাহসী প্রতিবাদের বীজ রোপণ করে ।
কবির কাব্যে বাস্তব আলোয় মুক্ত উদার মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ বিশ্বাসের প্রকাশ থাকে যা অন্ধকারে সমাজ সংসারে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে উন্নয়নের গতিপথ পরিবর্তন করে। সকল নেতিবাচক, জীবনবিমূখ মূল্যবোধকে প্রতিহত করে দেশ ও মানবপ্রেমে উজ্জীবিত, ঐক্যবদ্ধ ও অন্যায় দুঃশাসন রোধে বিপ্লবী চেতনায় জাগ্রত করে। ঘুমন্ত অন্ধবিশ্বাসী মানুষকে জাগরণের মাধ্যমে সুন্দর মানবিক সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সঠিক পথ দেখায়। যা সমাজ হবে জাত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষের জন্য মঙ্গলময়।
পক্ষান্তরে যে কাব্যের বিষয় বস্তুতে শুধু কবির নিজস্ব অন্ধ বিশ্বাস, অলীক চিন্তা- চেতনা, অযৌক্তিক ভাবনা-যুক্তিহীনবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, আবেদন, আত্ম-প্রশংসার প্রকাশ হয়। যে কাব্য পাঠে মানুষের চৈতন্য না ফিরে, বোধ সম্বিত না জাগে, আর সেই কাব্যে যদি সমাজের সংসারের সর্বজনীন, শিল্প -সাহিত্য সংস্কৃতি, সভ্যতা, জগৎ সংসারের কল্যাণের বিষয় সম্পৃক্ত না হয়, তাহলে সেই কবিতা কাব্য লেখনী বৃথা চিরকুট কেবল। অর্থাৎ যে লেখনীতে সমাজ পরিবর্তনে মানব কল্যাণে ইতিবাচক বার্তা মূল্যবোধ না থাকে তবে সেই কাব্য লেখনী আবর্জনা মাত্র।
সবশেষে কাব্যে কবিকে শুধু প্রকৃতি প্রাণীকুল জৈবিক , ব্যক্তি স্বার্থে জীবনের প্রেম ভালোবাসার স্তুতিবাক্য সংমিশ্রণ করলে হবে না। কাব্যে সংযোজন করতে হবে জীবনমুখী ইতিবাচক মূল্যবোধ, দেশ ও মানব কল্যাণে প্রকৃত মানব ধর্ম, মানবতার জয়বার্তা- মন্ত্রবানী।
যে কাব্যে অন্ধকার, ভেদাভেদ, বৈষম্য ও অপশক্তি, অপশাসন অনিয়ম অনাচার মোচনে জাগরণী শব্দ বাক্যে, চরণ, স্তবকের ঝংকারে কাব্যিক সৌন্দর্য গুণে মানুষের চেতনাবোধকে জাগ্রত করবে, সেই কাব্য লেখনীই যুগ যুগ ধরে কালজয়ী হবে। সহজবোধ্য, প্রাঞ্জল ইতিবাচক মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ বাস্তব প্রকৃত মানসম্মত কাব্য লেখনীই পরিবার, সমাজ, গোষ্ঠী জাতি তথা সমগ্র পৃথিবীর সকল বিভীষিকা, পাপ পঙ্কিলতা, গ্লানি আধার ঘোচাবে এবং মানুষকে আলোকিত করবে।
দেশে বর্তমান জনসংখ্যা:
বর্তমান জনসংখ্যা (২০২৫ বা সাম্প্রতিক) ২০২৫ সালে, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন সূত্রে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭৫.৭ মিলিয়ন (১৭৫,৭০০,০০০) ধরা হয়েছে। একটি ডেইলি স্টার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭৫.৭ মিলিয়ন ছুঁয়ে গেছে। অন্য কিছু উৎস ২০২৪–২০২৫ সময়ের জনসংখ্যা ১৭৪–১৭৬ মিলিয়নের সীমায় দেখায়। সুতরাং, বর্তমানের বেশি সম্ভাব্য এবং গ্রহণযোগ্য গণনা ১৭৫.৭ মিলিয়ন–১৭৬ মিলিয়ন (প্লাস-মাইনাস কিছু শতাংশ) বলা যায়।
চ্যালেঞ্জ আগামীর জনসংখ্যা:
২০৫০ সালের জনসংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন, কারণ তা নির্ভর করে জন্মহার, মৃত্যুহার, অভিবাসন, জনসংখ্যা গতি ও সামাজিক পরিবর্তনগুলোর ওপর। নিচে কিছু অনুমান ও সূত্র বিশ্লেষণ দেওয়া হলো: একটি জনপ্রিয় পূর্বাভাস অনুসারে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২১৪.৭ মিলিয়ন হবে। আরও একটি সূত্র World Economics অনুযায়ী, ২০৫০ সালের দিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২১৪ মিলিয়নের দিকে যেতে পারে। জনসংখ্যা বিকাশের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের অনুমানগুলি সাধারণত অপেক্ষাকৃত সংযত হয়; UNFPA বলেছে যে, যদি বর্তমান প্রবণতা বজায় থাকে, তাহলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০৫৩ সালে শীর্ষে পৌঁছতে পারে।
জনসংখ্যার বৃদ্ধি বা হ্রাসের কারণ:
জন্মহার (Fertility Rate): বাংলাদেশে জন্মহার গত কয়েক দশকে ক্রমহ্রাস পাচ্ছে।
মৃত্যুহার ও স্বাস্থ্যসেবা: স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, শিশুমৃত্যু হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
অভিবাসন (Migration): অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর (গ্রাম থেকে শহরে), দেশান্তরী অভিবাসন, সব মিলিয়ে জনসংখ্যার বণ্টনে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। জনসংখ্যার গতি (Population Momentum): একটি দেশে যদি একটি বড় যুব‐সমষ্টি থাকে যারা সন্তান উৎপাদনের বয়সে উপনীত হবে, তাহলে ভবিষ্যতের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে ‘মোমেন্টাম’ কাজ করে।
শিক্ষা, বিশেষ করে নারী শিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনা: শিক্ষার প্রসারণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে পরিবার পরিকল্পনার ব্যবহার বাড়বে, ফলে জন্মহার আরও নিয়ন্ত্রিত হবে।
পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রভাব: বন্যা, রূপান্তরিত কৃষিজমি, মেঘলা আবহাওয়া, উপকূলীয় ক্ষয়, জমি অভিগম্যতা হ্রাস ইত্যাদি কারণে কিছু অঞ্চলের জনসংখ্যা বাসযোগ্য পরিবেশ কম পাবে।
নগরায়ন (Urbanization): গ্রামের মানুষের শহরে আগমন বৃদ্ধি পাবে বলে আশা। শহুরে সুযোগ-সুবিধা, যাতায়াত, কাজের সুযোগ বেশি হওয়ায় মানুষ শহরে যেতে আগ্রহী হবে।
নীতি ও পরিকল্পনা প্রভাব: সরকার ও নীতিনির্ধারকরা জনসংখ্যা চাহিদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নগর পরিকল্পনায় যদি সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করে, জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রিত রাখার সুযোগ থাকবে।
চ্যালেঞ্জ: অবকাঠামোর চাপ বাড়বে (বাসস্থান, পানি, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ)। খাদ্য নিরাপত্তা , খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির চাহিদা, কৃষিজমি হ্রাস, পরিবেশ পরিবর্তন। পরিবেশ ও পরিবর্তন , বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা। স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবার চাহিদা, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, পরিবহন সরঞ্জাম, কর্মসংস্থান। বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বৃদ্ধদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্যবৃদ্ধি।
কৃষি জমি হ্রাস: ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS)–র একটি প্রকল্প (ECDS) অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কৃষি জমি প্রায় ১.৯৮ শতাংশ কমেছে। এর অর্থ, কৃষি জমির আয়তন প্রায় ৭৪,৩৮৮ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে ৭২,৯১৬ বর্গকিলোমিটার এ এসেছে। প্রতি বছর প্রায় ২,৫০০–৩,০০০ হেক্টর (হেক্টর = ১০,০০০ বর্গমিটার) চাষযোগ্য জমি নন-কৃষি কাজে ব্যবহার হচ্ছে। কৃষি জমি হ্রাসে নগরায়ন, শিল্পায়ন, ভবন ও অবকাঠামো সম্প্রসারণ ইত্যাদি প্রধান কারণ।
সুযোগ: যদি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী (১৫–৬৪ বছর) সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানো যায়, অর্থনীতি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ উৎপাদন, সেবা, প্রযুক্তি খাতে বৃহত বাজার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বড় বাজার, দেশজ উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি। উন্নত মানবসম্পদ বিনিয়োগ, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করলে দীর্ঘমেয়াদে যে সুদ পাওয়া যাবে, তা ব্যাপক হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা (Food Security): খাদ্য নিরাপত্তা বলতে বোঝায়, প্রত্যেক মানুষের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে, নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্যে সব সময় শারীরিক ও অর্থনৈতিক প্রবেশাধিকার থাকা, যা একজন সক্রিয় ও সুস্থ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন। মূল উপাদান চারটি: উপলব্ধতা (Availability): পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ। প্রবেশযোগ্যতা (Access): মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বা খাদ্য পেতে সক্ষমতা। ব্যবহার (Utilization): খাদ্য গ্রহণ, সংরক্ষণ ও পুষ্টি ব্যবহারের সক্ষমতা। স্থিতিশীলতা (Stability): দীর্ঘমেয়াদে এসব উপাদানের নিরবচ্ছিন্নতা। খাদ্য নিরাপত্তা শুধু খাদ্যের পরিমাণ বা সরবরাহ নয়, বরং মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, বাজারব্যবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ বা বৈশ্বিক সংকট (যেমন, কোভিড-১৯) খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
পুষ্টি নিরাপত্তা (Nutrition Security): পুষ্টি নিরাপত্তা বলতে বোঝায়, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পুষ্টিকর খাদ্য ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য হওয়া, যাতে তারা সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে ও জীবনযাপন করতে পারে। শুধু যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য খাওয়াই যথেষ্ট নয়, সুষম খাদ্য খেতে হবে। খাদ্যে প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ উপাদান, ক্যালরি ইত্যাদির সঠিক ভারসাম্য থাকা চাই। পুষ্টি নিরাপত্তা খাদ্য নিরাপত্তার একটি উন্নত ধাপ। খাদ্য আছে মানেই পুষ্টি নিশ্চিত নয়। দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, খাদ্যাভ্যাস, মাতৃশিক্ষা – এসব পুষ্টি নিরাপত্তার বড় প্রভাবক। অপুষ্টি শিশুমৃত্যু, খর্বতা (stunting), দুর্বল এবং কর্মক্ষমতা হ্রাসের অন্যতম কারণ।
নিরাপদ খাদ্য (Safe Food): নিরাপদ খাদ্য হলো এমন খাদ্য যা কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক, জীবাণু, কীটনাশক বা ভেজাল পদার্থ মুক্ত এবং মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। নিরাপদ খাদ্য না হলে, তা পুষ্টি বা খাদ্য নিরাপত্তা দিয়েও ক্ষতিপূরণ হয় না। খাদ্যে বিষক্রিয়া, খাদ্যবাহিত রোগ, দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি (যেমন ক্যান্সার) দেখা দিতে পারে। অনেক সময় খাদ্য আছে, পুষ্টিও আছে, কিন্তু তা নিরাপদ নয়, যা পুরো ব্যবস্থা ব্যর্থ করে দিতে পারে। উন্নয়নশীল দেশে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার, খাদ্যে ভেজাল, সংরক্ষণের ত্রুটি, বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা, সবই খাদ্যকে অনিরাপদ করে। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে, এই তিনটি স্তম্ভ, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা, এবং নিরাপদ খাদ্য, একসাথে নিশ্চিত করতে হবে। শুধু খাদ্য সরবরাহ নয়, বরং মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভিগম্যতা প্রয়োজন। সরকার, সমাজ এবং ব্যক্তি, সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
LDC (Least Developed Country): LDC বা ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ হলো এমন একটি দেশ যেখানকার অর্থনীতি, মানবসম্পদ, অবকাঠামো প্রভৃতিতে উন্নয়ন উচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়নি। জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা (যেমন UN, WTO) বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচক (আয়, মানব উন্নয়ন সূচক, অবকাঠামো ইত্যাদি) বিবেচনায় রেখে একটি দেশকে LDC ঘোষণা করে। LDC মর্যাদা পাওয়া দেশের জন্য বিশেষ সুবিধাদি দেওয়া হয়: জিডিপি সীমিত আয় থেকে রপ্তানি ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বা শুল্কহ্রাস সুবিধা, আন্তর্জাতিক সহায়তা, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও কারিগরি সহায়তা ইত্যাদি। LDC থেকে উত্তরণের মুহূর্ত থেকে পরবর্তী ৩ বছর একটি ‘সক্ষমতা রূপান্তর সুবিধা দেওয়া হবে, যাতে উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করা যায়।
‘স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের জন্য যেমন কিছু ইতিবাচক সুযোগ সৃষ্টি হবে, তেমনি কৃষি খাতসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য তা বড় চ্যালেঞ্জও বয়ে আনবে। বিশেষ করে কৃষি খাতে উপকরণ, যেমন বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদির ওপর আমদানি কর ৬ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে সরকারের প্রদত্ত কৃষি ভর্তুকি হ্রাস পেলে কৃষকদের সেচ, বীজ, সার, এবং যন্ত্রপাতির জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হবে, যা তাদের উৎপাদন সক্ষমতাকে হ্রাস করতে পারে।
বর্তমান বৈশ্বিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে কৃষি খাতে সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ হ্রাস এবং আমদানি কর বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। অপরদিকে, আমদানি কর বৃদ্ধি দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, যা সাধারণ ভোক্তাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে। এই পরিবর্তনগুলো শুধু মানব খাদ্য নয়, নন-হিউম্যান যেমন প্রাণিখাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে, সামগ্রিকভাবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
এছাড়া, ডিজেল ও বিদ্যুৎ খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় সেচ কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা সরাসরি ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ সকল চ্যালেঞ্জ খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্যদিকে, প্রতিবছর কৃষি জমি কমে যাওয়া এবং ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের জনসংখ্যা ২০ কোটির বেশি ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশে খাদ্যের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়বে, যা বর্তমানে যে কৃষি উৎপাদন অবকাঠামো রয়েছে, তা দিয়ে সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
এই প্রেক্ষাপটে, এখনই সময় একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের। নীতি নির্ধারকদের উচিত, কৃষি উপকরণের কর হ্রাস, প্রযুক্তিনির্ভর টেকসই কৃষির প্রসার, কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কৃষকদের জন্য সরাসরি সহায়তা নিশ্চিত করা। তবেই ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি টেকসই করা সম্ভব হবে।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।
জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত এবং কলঙ্কিত নির্বাচন। এই তিনটি নির্বাচনে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি।
ফলে সরকার গঠনে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পেছনে অন্যতম উপলক্ষ হিসেবে এসব বিতর্কিত নির্বাচন বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আজ যাদের বয়স ৩৪ বছর, তারা ১৮ বছর বয়স হওয়ার পর জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য যোগ্যতা অর্জন করেন, কিন্তু তাদের ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে।
তারা অধীর আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য। তবে সে নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা রয়েছে, যেগুলো সমাধানের জন্য দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
একটি মহল নির্বাচন বানচাল করার জন্য সচেষ্ট রয়েছে। নিদেনপক্ষে তারা নির্বাচনকে বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইবে—এটি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে।
বিদ্যমান অবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কতটা তৈরি করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা থাকা। ভোটার তালিকায় কোনো ত্রুটি থাকলে নির্বাচন কোনো অবস্থায়ই সুষ্ঠু হতে পারে না। প্রতিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরেজমিনে যাচাইপূর্বক বিদ্যমান ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়। এবারও ভোটার তালিকা যাচাই করার জন্য নির্বাচন কমিশন থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
ভোটার তালিকা যাচাইকারী দলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা যাচাই করার কথা। অভিযোগ আছে, ভোটার তালিকা যাচাইকারীরা অনেক ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি না গিয়েই ভোটার তালিকা হালনাগাদ করেছেন। এই গাফিলতির কারণে ভোটার হওয়ার যোগ্য অনেকেই তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। আবার ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার যোগ্য অনেকেই তালিকায় রয়ে গেছেন। নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, যারা ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তারা নির্বাচন কমিশন অফিসে গিয়ে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করাতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটা কতটা বাস্তবসম্মত, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। আমাদের দেশের মানুষ কি এতটা সচেতন হয়েছেন যে তারা নির্বাচন কমিশন অফিসে গিয়ে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করাবেন? এতে যে সময় ব্যয় ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব হয় না। এখনো সময় আছে পরিদর্শকদল বাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার। ভোটার তালিকা ত্রুটিপূর্ণ রেখে কোনোভাবেই সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায় না।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, সেই প্রশ্নটির এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সাংবিধানিক এবং নিয়মিত সরকার নয়। অতীতে কখনোই এমন সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। পরাজয়ের ভয় থেকে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আদালতকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাতিল করে দেয়। সম্প্রতি আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাতিল করার রায় অবৈধ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে সাধারণভাবে মনে করা যেতে পারে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা খুবই কম। অথচ দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই চায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হোক।
অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। তাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালনের কোনো সুযোগ নেই। এই প্রশ্নের সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে।
এক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতি হতে পারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বহাল রেখে এই সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা এবং বাইরে থেকে উপযুক্ত ও জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য কয়েকজন ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তর করা। পুরো বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের মতামতের জন্য প্রেরণ করা যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের অনুকূল মতামত পাওয়া গেলে নবগঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার কার্যক্রম শুরু করতে পারে। নবগঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কাজ হবে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা।
বিগত জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সংখ্যা ছিল দুই-তৃতীয়াংশের বেশি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়া ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা অনেকাংশে দায়ী। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে দলীয় মনোনয়নদানের অভিযোগ উঠেছে। এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যেকোনো মূল্যেই হোক, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে।
নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণার জন্য প্রার্থীরা বিপুল অর্থ ব্যয় করে থাকেন। এতে প্রার্থীদের মধ্যে সুষম অবস্থান বিঘ্নিত হয়। যারা তুলনামূলক কম অর্থের মালিক, সেসব প্রার্থী প্রচারণায় পিছিয়ে পড়ে একসময় নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। এ জন্য সরকারিভাবে নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকারি খরচে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে মঞ্চ তৈরি করা যেতে পারে। সেই মঞ্চে প্রার্থীরা সমবেত হয়ে জনতার সামনে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করবেন। তারা তাদের কর্মসূচি এবং জনগণের জন্য কী করতে চান, তা ব্যাখ্যা করবেন। নির্বাচনে প্রার্থীরা যে পোস্টার বা ব্যানার স্থাপন করেন, তা সরকারি উদ্যোগে করে দেওয়া হবে। যারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন, তারা অবসরগ্রহণের পরই যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। অবসরগ্রহণের পর অন্তত পাঁচ বছর বিরতি দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। আমলাতন্ত্রের কর্মকর্তা বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন এমন কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে তার পেনশন বেনিফিট রাষ্ট্রের অনুকূলে সারেন্ডার করার বিধান করা যেতে পারে।
জনগণ হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিক, কিন্তু তাদের সব সময়ই ক্ষমতাহীন করে রাখা হয়। পাঁচ বছরে মাত্র এক দিন অর্থাৎ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন জনগণ ক্ষমতায়িত হয়। তারা ভোট দিয়ে তাদের ইচ্ছামতো যে কাউকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাতে পারে। ক্ষমতা শুধু থাকলেই হয় না, সেই ক্ষমতা ব্যবহারের মতো যোগ্যতাও থাকতে হয়। জনগণকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে সতর্ক থাকতে হবে। একমাত্র তাদের সচেতনতাই পারে উপযুক্ত ব্যক্তি বা দলের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা অর্পণ করতে। যারা ভোট দেবেন, তাদের মনে রাখতে হবে, তারা যদি ভোট দিয়ে একজন ভালো মানুষকে সংসদে পাঠান, তাহলে সেই ব্যক্তির ভালো কাজের অংশীদার তারাও হবেন। আর যদি কোনো অসৎ, দুর্নীতিবাজ লোককে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠান, তাহলে তার কৃত অপকর্মের দায়ভার ভোটারকেও বহন করতে হবে।
বর্তমানে একজন তিনটি আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রধান শর্ত হচ্ছে প্রার্থীকে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার হতে হয়। এক ব্যক্তি নিশ্চয়ই তিনটি সংসদীয় আসনের ভোটার নন। তাহলে তিনি কিভাবে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন? যার জনপ্রিয়তা আছে, তিনি তো একটি আসনে দাঁড়ালেই জয়লাভ করতে পারবেন। কোনো ব্যক্তি যদি তিনটি আসনে প্রতিযোগিতা করে তিনটিতেই বিজয়ী হন, তাহলে পরবর্তী সময়ে তাকে দুটি আসন ছেড়ে দিতে হয়। ছেড়ে দেওয়া আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রশ্ন হলো, জয়ী হলেও যে আসন ছেড়ে দিতে হয়, সেই আসনে নির্বাচন করতে হবে কেন? ছেড়ে দেওয়া আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। এই অপচয়ের দায়ভার কে নেবে?
নির্বাচনে ভোটারদের বিশাল দায়িত্ব রয়েছে। দল অথবা মার্কা না দেখে ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে ভোট দিতে হবে। আমরা যদি দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে সঠিক ব্যক্তিকে ভোট দিতে পারি, তাহলেই কেবল জাতীয় সংসদ আমাদের মনের মতো হতে পারে। ভোটারদের সমর্থন না পেলে একজন ব্যক্তির পক্ষে সংসদ সদস্য হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, জাতীয় সংসদ হচ্ছে একটি পবিত্র স্থান, সেখানে যোগ্যদেরই যাওয়া উচিত। নির্বাচনের আগে যেকোনো মূল্যেই হোক, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো বিতর্কিত কর্মকর্তা অথবা কর্মচারীকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। যারা বিতর্কিত, তাদের নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত রাখতে হবে।তাছাড়া আর একটি কথা না বললেই নয়, আমাদের সেনাবাহিনী দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনী। তার বড় প্রমাণ নিকট সময়ে তাদের ভূমিকায় সবাই আশান্নিত। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যার জন্ম। তাদের মাধ্যমে নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব। জাতির ক্লান্তলগ্নে নির্বাচন চলাকালে সেনাবাহিনীকে মেজিড্রেসি পাওয়ার দেওয়া অপরিতার্য। একমাত্র তাদের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে বলে আমি বিশ্বাস করে। তা নাহলে নির্বাচনে কোনো ধরনের কারচুপি হলে জাতিকে সে জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্রের এই যাত্রা শুভ হোক-এই প্রার্থনাই করি।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশে গবেষণার গল্প শুনতে গেলে অনেকটা নদীর মতো মনে হয়। কখনো তা প্রলয়ংকরী বন্যার মতো ভেসে আসে বড় কোনো আবিষ্কারের খবর দিয়ে, আবার কখনো শুষ্ক মরুর মতো স্থবির হয়ে পড়ে—চলমান গবেষণাগুলো মাঝপথেই থেমে যায়, টেকসই হওয়ার আগেই ম্লান হয়ে যায়। আমাদের ইতিহাস প্রমাণ করে, আমরা চাইলে পারি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার যাত্রা মূলত কৃষি গবেষণার ফল। লবণাক্ত সহনশীল কিংবা খরাপ্রতিরোধী ধানের জাত শুধু কৃষকদের জীবনই বদলায়নি, বদলে দিয়েছে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎও। একইভাবে স্বাস্থ্য খাতে স্থানীয় গবেষকদের উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা--রোগ প্রতিরোধে টিকা তৈরি, খাবার স্যালাইন- আশা জাগিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও তরুণ গবেষকরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার সিকিউরিটি কিংবা ইন্টারনেট অব থিংস নিয়ে যে উদ্যোগ নিচ্ছেন, তা সীমিত হলেও আশাব্যঞ্জক। এসব অর্জন বলে দেয়—আমাদের মেধা কম নয়, তবে বড় সমস্যা হলো এই মেধাকে কাজে লাগানোর সিস্টেম দুর্বল।
উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ দেখলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হয়। দক্ষিণ কোরিয়া একসময় যুদ্ধবিধ্বস্ত, অর্থহীন একটি দেশ ছিল। আজ তারা বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তি শক্তি। কারণ তারা বুঝেছিল, গবেষণা কেবল বই বা ল্যাবরেটরির মধ্যে বন্দি রাখলে হবে না; গবেষণাকে শিল্পে, সমাজে ও রাষ্ট্রীয় নীতিতে রূপান্তর করতে হবে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান একসাথে কাজ করে, সরকারের পরিকল্পনা তাদের সহযোগিতা করে, আর গবেষণার প্রতিটি সাফল্য বাজারে পণ্য হয়ে মানুষের জীবনে প্রবেশ করে। আবার জাপান দেখিয়েছে, গবেষণাকে ব্যবহার করে কীভাবে একটি সুপার-এজড সমাজেও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়। সেখানে রোবটিক্স ও এআইভিত্তিক গবেষণাকে স্বাস্থ্যসেবা, প্রবীণ সহায়তা এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজে লাগানো হচ্ছে। জার্মানি নবায়নযোগ্য জ্বালানির গবেষণায় রাষ্ট্রীয় কৌশল নিয়েছে, আর ফিনল্যান্ড শিক্ষা খাতে গবেষণার ফল প্রয়োগ করে গোটা জাতির ভবিষ্যৎ বদলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিও বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার ল্যাব থেকে উঠে আসা এক বিশাল গল্প, যা আজ গোটা বিশ্বের প্রযুক্তির ধারা নির্ধারণ করছে।
কিন্তু বাংলাদেশে গবেষণার পথ অনেকটাই খণ্ডিত। এখানে গবেষণা হয়, তবে বেশিরভাগ সময় তা কাগজে কিংবা প্রোফাইলেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। শিল্প খাত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দূরত্ব কমে না। গার্মেন্টস শিল্প, যা দেশের অর্থনীতির প্রাণ, এখনো গবেষণার ফসল ব্যবহার করে নিজেদের উন্নয়ন ঘটাতে পারছে না! টেক্সটাইল বা পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের মতো ক্ষেত্রে যৌথ গবেষণা থাকলে হয়তো আমাদের গার্মেন্টস খাত আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠত। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবগুলো অনেক সময় ভালো কাজ করে, কিন্তু রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের পরিবর্তনে বা বাজেটের ঘাটতিতে গবেষণাগুলো অকালেই থেমে যায়।
সমস্যার আরেকটি জায়গা অর্থায়ন। উন্নত দেশগুলোতে গবেষণার জন্য স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি তহবিল থাকে। একটি গবেষণা শুরু হলে তা শেষ হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে, এবং সেই ফল ব্যবহারযোগ্য করার সুযোগও থাকে। আমাদের দেশে বরাদ্দ সীমিত, অনেক সময় অনিয়মিত। কোনো প্রকল্প শুরু হলো, দুই বছর পর বাজেট বন্ধ হয়ে গেল, তারপর গবেষণা ফাইলের ধুলোয় হারিয়ে গেল—এটাই আমাদের বাস্তবতা।
এছাড়া গবেষণাকে প্রমোশন বা পদোন্নতির শর্তে পরিণত করাও আরেকটি সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছে। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে গবেষণার মান নির্ধারণ হয় সংখ্যার ভিত্তিতে, গুণের নয়। ফলে অনেক সময় প্রবন্ধ প্রকাশ পায়, কিন্তু তা সমাজে কোনো বাস্তব প্রয়োগ খুঁজে পায় না। অথচ যদি মানদণ্ডে বাস্তব প্রয়োগ, উদ্ভাবনের মাত্রা এবং সামাজিক প্রভাবকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তবে গবেষকরা সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে আগ্রহী হবেন। আরেকটি দিক হলো গবেষকদের মর্যাদা। উন্নত দেশে গবেষক মানে জাতির সম্পদ। তাদের কাজকে সম্মান, মর্যাদা ও প্রণোদনা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে গবেষকরা প্রাপ্য সম্মান অনেক সময় পান না। ফলে তরুণ প্রজন্মের মেধাবীরা গবেষণায় আগ্রহ হারায়, কিংবা যারা আগ্রহী, তারা সুযোগ না পেয়ে বিদেশে চলে যায়। দেশে গবেষণার অবকাঠামো থাকলে, সামাজিক স্বীকৃতি ও আর্থিক প্রণোদনা থাকলে, হয়তো অনেকেই দেশের জন্য থেকে যেতেন।
তবু আশা হারানোর কারণ নেই। কৃষি গবেষণা আমাদের দেখিয়েছে কীভাবে গবেষণার ফল সরাসরি মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। তথ্যপ্রযুক্তিতে তরুণদের স্টার্টআপ, স্বাস্থ্য খাতে স্থানীয় টিকা উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা, কিংবা নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষুদ্র গবেষণা—সবই আমাদের পথ দেখাচ্ছে। এখন দরকার এগুলোকে ছিটেফোঁটা সাফল্য থেকে একটি সুসংগঠিত কাঠামোয় রূপান্তর করা। তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই দেখুন—এআই দিয়ে কৃষিতে উৎপাদন বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে, ইন্টারনেট অব থিংস দিয়ে স্মার্ট সিটি গড়ে তোলা সম্ভব, সাইবার নিরাপত্তা গবেষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো রক্ষা করা যায়। আমাদের তরুণ গবেষকরা এই ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করছেন, কিন্তু তারা যদি সরকারের দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা ও শিল্পখাতের অংশীদারিত্ব পান, তবে বাংলাদেশের গবেষণাও বিশ্বমঞ্চে স্থান করে নিতে পারবে।
এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। গবেষণায় অর্থায়নকে ব্যয়ের খাত নয়, বিনিয়োগের খাত হিসেবে দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা ল্যাব শিল্প খাতের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। গবেষণা মূল্যায়নের মানদণ্ডে কেবল সংখ্যা নয়, বরং সামাজিক প্রভাবকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর গবেষকদের মর্যাদা বাড়াতে হবে—তাদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, পাশাপাশি নীতি নির্ধারণে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশে গবেষণার গল্প তাই সম্পূর্ণ ব্যর্থতার নয়। আমাদের রয়েছে আলোর রেখা, রয়েছে ছায়াও। আলোর দিক হলো মানুষের মেধা, সৃজনশীলতা ও সম্ভাবনা। ছায়ার দিক হলো সিস্টেমের দুর্বলতা, নীতি নির্ধারণের সীমাবদ্ধতা ও অর্থায়নের অভাব। যদি আমরা সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারি, তবে গবেষণা হবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার মূল চালিকাশক্তি।
গবেষণা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের হাতিয়ার। যে জাতি গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেয়, তারাই ইতিহাস বদলায়। আমাদেরও সময় এসেছে গবেষণাকে আনুষ্ঠানিকতা থেকে মুক্ত করে জীবনের অংশ করে তোলার। বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটি ল্যাব, প্রতিটি গবেষকের স্বপ্ন যদি রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে মিলে যায়, তবে একদিন আমরা গর্ব করে বলতে পারব—আমাদের গবেষণা শুধু কাগজে নয়, মানুষের জীবনে পরিবর্তন এনেছে।
লেখক: প্রফেসর ড. ইকবাল আহমেদ : কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু তাদের ভবিষ্যতের পথ হয়ে উঠছে দুর্গম। শিশুরা শ্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ায় সমাজে তাদের অবস্থান, অশিক্ষিত, দরিদ্র ও মাদকাসক্ত, বখাটে এমনকি নানান অপরাধী মানুষের জীবনে প্রবেশ করছে। আন্তর্জাতিক তথ্যমতে, শিশুশ্রমের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এটি কোনোভাবেই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক বার্তা নয়। তাই একজন শিশুর জীবনে শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা দেশ ও সমাজের জন্য জরুরি। কারণ একটি দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অংশকে অবহেলায় অযত্নে রেখে সে দেশের উন্নতি আশা করা আকাশ কুসুম কল্পনা।
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশে শিশুশ্রম একটি গভীর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারতের মতো দেশে, যেখানে দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক চাপ প্রকট, সেখানে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। বাংলাদেশ সরকার শিশুশ্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে নানাবিধ আইন প্রণয়ন করছে। বাংলাদেশের শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী কিশোর শ্রমিকদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ থেকে ১৮ বছর। এছাড়াও আইনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকেই শ্রমে নিয়োগ করা যাবে না। শ্রমজীবী শিশুদের বাবা মা কোনো মালিকের সাথে কোনো ধরনের চুক্তি করতে পারবেন না। এবং কোনো কিশোর শ্রমিককে যদি কাজে নিয়োগ করতে হয়, সেক্ষেত্রে রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তারের কাছে মালিকের খরচে ফিটনেস সনদ সংগ্রহ করে তারপর তাকে কাজে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এদের কাজের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে দৈনিক সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা। আর সেই সময় হতে হবে সন্ধ্যা সাতটা থেকে ভোর সাতটার বাহিরের সময়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আইনগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাগুজের দেয়ালে বন্ধী। বাস্তব চিত্র পুরোটাই মুদ্রার অন্য পিঠ। সরকারি একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৯ লক্ষ।এর মধ্যে শহরাঞ্চলের সংখ্যা ১৫ লক্ষ ও গ্রামাঞ্চলে ৬৪ লক্ষ। এই জরিপে থেকে আরও জানা যায় আমাদের দেশের শিশুরা যে ধরনের কাজের সাথে জড়িত তার মধ্যে প্রায় ৪৫টি কাজই ঝুঁকিপূর্ণ। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শিশুর অধিকার রক্ষা করবে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম অর্থাৎ স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর অথবা শিশুর ব্যাঘাত ঘটায় অথবা বিপদ আশঙ্কা করে, এমন কাজ যেন না হয়, তার ব্যবস্থা নেবে’। এজন্য বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ শিশু সনদের এই ধারা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পেশার তালিকা চূড়ান্ত করে নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি এই শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য বহু পূর্বেই সরকার সারাদেশে ৯৯ শতাংশের বেশি শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। ইটভাটা, গ্যারেজ, ওয়ার্ক শপ, হোটেল, দোকান, বিভিন্ন মিল কারখানায় দেখা যাবে বড়দের মতো শিশুরাও দিনরাত সব ধরনের স্বাভাবিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত। এতে করে তাদের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন দাড়ায় শিশুশ্রম কেন হয়? এর প্রধান কারণ দারিদ্র্য। গরিব পরিবারে বাবা-মা যখন নিজেরাই সংসার চালাতে পারে না, তখন তারা সন্তানের হাতে বই না দিয়ে কাজে পাঠায়। কেউ ভাবেন, এখন যদি কাজ করে টাকা আনে, তাহলে অন্তত খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু এতে তারা ভুল করে, কারণ পড়াশোনা না করলে সেই শিশু সারাজীবন দারিদ্র্যর শৃঙ্খলেই আটকে থাকবে। আরেকটি কারণ হলো অশিক্ষা। বাবা-মা যদি নিজেরাই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, তারা বোঝে না যে শিক্ষা ছাড়া জীবনে উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তারা ভাবে- কাজ করলেই টাকা আসবে, পড়াশোনায় সময় নষ্ট কেন! এর ফল হলো- প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়। কিছু মালিকও দোষী। তারা জানে শিশুদের দিয়ে কাজ করালে কম টাকায় কাজ করানো যায়। তাই তারা শিশুশ্রমিক খোঁজে। এভাবে শিশুশ্রম চলতে থাকে। অথচ আমাদের আইন আছে, শিশুদের দিয়ে কঠিন কাজ করানো নিষিদ্ধ। কিন্তু আইন মানা হয় না, নজরদারি কম। ফলে শিশুদের শৈশব কেড়ে নেওয়া হয়।
শিশুশ্রমের সমাজতত্ব বিশ্লেষনের প্রয়োজন । যেমন ১. শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, তাই তারা অশিক্ষিত থেকে যায়; ২. তাদের কোমল শরীর কষ্টে ভেঙে পড়ে। ভারী ইট বহন করতে গিয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে যায়, হোটেলে ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে ফুসফুস নষ্ট হয়; ৩. তাদের মানসিক অবস্থাও খারাপ হয়। খেলা না করতে পারায় তারা দুঃখী হয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস হারায়; ৪. সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো- তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়; ৫. শিশু শ্রমের বেড়াজালে আটকে পড়া এসব শিশুরা হারিয়ে ফেলে তাদের শৈশব, কল্পনা, আনন্দ সবকিছুই। তারা হয় কাজের খাতিরে, নয়তো পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে কঠিন পরিশ্রমে নিযুক্ত থাকে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর; ৬. শিশুশ্রমিকের জীবন কেমন হতে পারে, তার প্রকৃত চিত্র আমরা খুঁজে পাই আমাদের আশপাশের বহু বাস্তবতায়। শিশুদের শৈশব তো হলো খেলার মাঠে হাসিখুশি সময় কাটানো, বন্ধুর সঙ্গে গল্প করা এবং নতুন কিছু শিখে নিজেদের বিকাশের সুযোগ পাওয়া। কিন্তু যখন শিশুরা শ্রমের বেড়াজালে আটকে যায়, তখন তার জীবন হয়ে ওঠে শুধুই কাজের; ৭. শ্রমের কারণে তাদের পড়াশোনার সুযোগ একদম কমে যায়। এ কারণে শিশুশ্রমিকরা অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে না, যার ফলে তাদের ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতার জন্য একেবারেই অযোগ্য হয়ে পড়ে; ৮. শিশুশ্রমিকদের ওপর কাজের চাপ, নিগ্রহ এবং অভাবের তাড়না তাদের মানসিকভাবে হতাশ ও বিপথগামী করে তোলে। তারা শৈশবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।
শিশু শ্রমের অনেক কারণ রয়েছে; যেমন এক: অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের কাজের জন্য পাঠায়। কারণ তারা চায় তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি। পরিবারের অভাব-অনটন শিশুদের শ্রমের দিকে ঠেলে দেয়; দুই: পারিবারিক অশান্তি, বাবা-মায়ের অশিক্ষা অথবা একাধিক সন্তান থাকার কারণে অনেক সময় শিশুদের কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ে, কারণ তারা মনে করে যে কাজের মাধ্যমে পরিবারকে সহায়তা করা যাবে; তিন: কিছু সমাজে বিশেষ করে গ্রাম-অঞ্চলে, শিশুদের কাজে লাগানোর একটি প্রচলিত অভ্যাস রয়েছে। এখানে শিশুকে স্কুলে পাঠানো অপেক্ষা কাজে পাঠানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়; চার : শিশুশ্রমে শুধু শারীরিক ক্ষতি নয়, এটি তাদের মানসিক ও সামাজিক জীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে; পাঁচ: শিশুরা যখন ছোটবেলায় কঠোর কাজ করতে শুরু করে, তাদের শরীর আরও উন্নতি করতে পারে না। এতে তারা দীর্ঘদিন শারীরিক অসুস্থতায় ভোগে। যেমন- পিঠ, হাড়ের সমস্যার পাশাপাশি দুর্বল শরীরের কারণে রোগবালাইয়ের শিকার হয়; ছয় : শিশুশ্রম শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তারা হতাশাগ্রস্ত, অস্থির ও বিপথগামী হয়ে পড়ে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে তারা মানসিক নির্যাতন ও শোষণের শিকার হয়; সাত: শিশুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো- তার শৈশব, যেখানে সে কল্পনা, খেলা এবং নতুন কিছু শিখে বেড়ে ওঠে। কিন্তু যখন সে শ্রমের মধ্যে আটকে যায়, তখন তার শৈশব হারিয়ে যায় এবং তা কখনও ফিরে আসে না; আট: আমাদের সমাজে হাজার হাজার শিশু আছে যারা বই হাতে নিতে পারে না। তাদের কাঁধে থাকে ভারী বোঝা, হাতে থাকে কাজের সরঞ্জাম, চোখে থাকে অবসাদের ছাপ। স্কুলে যাওয়ার বদলে তারা কাজ করতে যায়। কেউ হোটেলে থালা ধোয়, কেউ রাস্তায় বাদাম বিক্রি করে, কেউ ইটভাটায় কাজ করে, কেউ বাসাবাড়িতে ঝাড়– দেয়। অথচ এই বয়সে তাদের বই পড়া, খেলা আর স্বপ্ন দেখার কথা ছিল। তাই আমরা বলতে চাই- শিশুশ্রম চাই না, পড়তে চাই; নয়: শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য সরকার, সমাজ এবং পরিবারকেই একযোগে কাজ করতে হবে।
এখন শিশুশ্রম বন্ধের এজন্য সরকারের বড় দায়িত্ব আছে; যেমন আইন ও নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন: শিক্ষা সুযোগ নিশ্চিতকরণ; পরিবারের সদস্যদের আয়ের উৎস বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করা; শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি; ধনী পরিবারগুলো গরিব শিশুদের পড়াশোনার খরচ বহন করতে পারে; শিক্ষকরা চেষ্টা করবে, যাতে সব শিশু স্কুলে আসে, আর যারা ছাত্র, তারাও তাদেরকে স্কুলে টানব, যদি সে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। সর্বশেষে বলা যায় শিশুশ্রম সমাজের জন্য একটি মারাত্মক সমস্যা। এটি শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নষ্ট করে এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা দেয়। শিশু শ্রমের ফলে তারা অল্প মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়, যা দারিদ্র্য চিরস্থায়ী করে। অনেক সময় শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ ও অমানবিক পরিবেশে কাজ করতে হয়, যা তাদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। এটি শুধু শিশুদের অধিকার লঙ্ঘন করে না, বরং জাতির ভবিষ্যৎকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই শিশুদের সুরক্ষা, শিক্ষা এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে শিশু শ্রম রোধ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। দেশটা আমাদের সবার। তাই দেশের সকল ভালোমন্দের ফলও ভোগ করতে হবে আমাদেরই। তাই আজকে আমরা শিশুশ্রমকে প্রশ্রয় দিলে ভবিষ্যতে নিরক্ষরতার বোঝা মাথায় করে বয়ে বেড়াতে হবে আমাদের। তাই নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার দায়িত্ব সরকারসহ আমাদের সবার।
লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক।