যে ব্যক্তি মানুষের জীবনের যুদ্ধ-সংঘাত আর আনন্দ-বেদনায় নিখুঁত চিত্র ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন চলচ্চিত্রের বৃহৎ ক্যানভাসে তিনি হলেন বাঙালির হদয়ের মানিক সত্যজিৎ রায়। দেশ-মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে চলচ্চিত্রের রুপালি ফিতায় নিজের অনুভূতিকে তুলে ধরে সত্যজিৎ রায় পৌঁছে গিয়েছিলেন বিশ্ব দরবারে। একবার কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের এক অধ্যাপক যখন ক্লাসে ঢোকেন, ছাত্ররা তখন উঠে দাঁড়িয়েছিল তটস্থ হয়ে। সেই সময় অধ্যাপক একজনকে বললেন, তুমি বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়েছ কেন? ছাত্রটি তখন তটস্থ হয়ে জবাব দিয়েছিল, না স্যার, আমি বেঞ্চে না মেঝেতেই দাঁড়িয়েছি। তখন অধ্যাপক ভালোভাবে তাকিয়ে সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতার সত্যজিৎ রায়কে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। ক্লাসের সবচেয়ে লম্বা ছেলেটি তার শারীরিক উচ্চতা ছাপিয়ে কর্ম আর মেধায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল বিশ্ব দরবারে। নিজের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা আর বাঙালিকে যিনি নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়, তিনি হলেন সত্যজিৎ রায়। ছোটবেলায় তার ডাকনাম ছিল মানিক। এই মানিক একদিন হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির হৃদয়ের মানিক। যার নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পথের পাঁচালী, অপুর সংসার, আগন্তুক কিংবা ফেলুদার নাম তিনি হলেন সব দেশের সেরা চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও শিল্পী। যাদের নিয়ে বিশ্বসভায় বাঙালি জাতি গর্ব অনুভব করে তাদের মধ্যে অন্যতম সত্যজিৎ রায়। ২ মে তার জন্ম শতবর্ষ।
১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়। বাবার নাম সুকুমার রায় এবং মায়ের নাম সুপ্রভা দেবী। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন তার পিতামহ। তার পূর্ব-পুরুষের বাড়ি ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে। জন্মের পর তাকে ডাকা হয়েছিল প্রসাদ নামে। মা ডাকতেন মানিক। ছোটকাকা নাম রেখেছিলেন নুলমুলি। মানিক নামটাই তার সঙ্গে যেন মানান সিং। যেখানে হাত দিয়েছেন, সেটাই হয়ে উঠেছিল মূল্যবান মানিক।
ছেলেবেলায় হারান বাবা বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়কে। বাবা সুকুমার রায়কে তিনি চিনেছেন তার লেখা ও আঁকার মধ্য দিয়ে। তার দাদা বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে চিনেছেন তার কর্মের মাধ্যমে।
তার প্রাথমিক শিক্ষা হয়েছিল মায়ের হাতে। ১৯২৯ সালে বালিগঞ্জ সরকারি স্কুলে শুরু হয়েছিল তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। ১৯৪০ সালে বিএ অনার্স পাস করেন। ১৯৪০ সালে মায়ের আগ্রহে শান্তি নিকৈ কলাভবনে ভর্তি হন সত্যজিৎ। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ডি জে কেমার নামক বিজ্ঞাপন সংস্থায় জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার পদে চাকরি পান ৮০ টাকা বেতনে।এ সময় সত্যজিৎ নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখা শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ রায় ও বংশী চন্দ্র গুপ্ত কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একটি প্রকাশনা সংস্থা সিগনেটের জন্য বাণিজ্যিক ইলাস্ট্রেটর হিসেবেও কাজ করছেন। সত্যজিৎ যখন নিজের প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন নতুন বলে প্রযোজক পাননি। ১৯৫২ সালের শেষের দিকে নিজের টাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে ভারতের তৃতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে এটি শ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং সেরা বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনীত হন। পরে কান চলচ্চিত্র উৎসবে বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট এবং ওসিআইসি পুরস্কার জিতে নেন। ২০০৫ সালে টাইম ম্যাগাজিনের সর্বকালের সেরা ১০০ চলচ্চিত্রে স্থান পায়। ১৯৬৭ সালে ফিলিপাইনের রামন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান। ১৯৬৯ সালে সবচেয়ে বাণিজ্যিকভাবে সফল চলচ্চিত্র মিউজিক্যাল ফ্যান্টাসি গুপি গাইন বাঘা বাইন। ১৯৭৪ সালে লন্ডনের রয়েল আর্ট কলেজ তাকে চলচ্চিত্রের জন্য সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৭৮ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজক কমিটি তাকে সর্বকালের সেরা তিনজন পরিচালকের মধ্যে তাকে স্থান দেন। ১১তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তার অশনি সংকেত সিনেমার জন্য বিশেষ সম্মান সূচক পুরস্কার দেওয়া হয়। বিদেশের মতো নিজ দেশ ভারতে পেয়েছেন পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ ও ভারতরত্ন পুরস্কার। এ ছাড়া সত্যজিৎ রায় ছিলেন সুরকার এবং একজন লেখক। বিশ্ববিখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্র নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়া বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে বাস করে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা না দেখা মানে পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র-সূর্য না দেখা’। কেউ কেউ বলেন, বাংলা ভাষায় কথা বলেও তারা ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কুকে চেনে না তারা নির্ভেজাল আনন্দ থেকে বঞ্চিত। সত্যজিৎ রায়ের ছবি আঁকা দেখে তার ড্রয়িং টিচার আশু বাবু বলতেন সত্যজিৎ নামেও সত্যজিৎ, কামেও সত্যজিৎ। ছোটবেলার মানিক সে তো সত্যিকারের মানিক হয়েই থাকবে বাঙালিদের তথা বিশ্ববাসীর হৃদয়ে। মৃত্যুবরণ করেন ২৩ এপ্রিল ১৯৯২ সালে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। ইলিশের টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধিতে ২০০৪ সালে ‘হিলশা ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয় এবং তদনুযায়ী সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ (প্রায় ১২%) এবং জিডিপিতে অবদান ১ শতাংশ। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের ৮০ শতাংশের বেশি আহরিত হয় এ দেশের নদ-নদী থেকে। শুধু তাই নয়; উপকূলীয় জেলে, মৎস্যজীবী সম্প্রদায় এবং উপকূলবাসীদের জীবন-জীবিকা নির্বাহে ইলিশের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রায় ৬ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০-২৫ লাখ মানুষ ইলিশ পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। বৈচিত্র্যময় জীবন ইলিশের। ইলিশ মূলত সামুদ্রিক মাছ হলেও প্রজননকালীন এ মাছ ডিম ছাড়ার জন্য বেছে নেয় স্বাদুপানির উজানকে। এ সময় ইলিশ দৈনিক প্রায় ৭১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। প্রজননের উদ্দেশে ইলিশ প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার উজানে পাড়ি দিতে সক্ষম। সাগর থেকে ইলিশ যত ভেতরের দিকে আসে, ততই শরীর থেকে লবণ কমে যায়। এতে স্বাদ বাড়ে ইলিশের।
ইলিশ মাছের প্রধান প্রজনন মৌসুমে নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ বছর প্রতি বছরের মতো এবারও বৈশাখের শুরু অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮দিন বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায়, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। নিষেধাজ্ঞা শেষে ১২ জুন থেকে সাগরে আবার মাছ আহরণ শুরু করেন জেলেরা, যে সময়টিকে ইলিশ আহরণের ভরা মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সর্বসাধারণ, বিশেষ করে জেলে, মৎস্যজীবী সম্প্রদায় ও ইলিশের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী, আড়তদার, বরফকল মালিক, দাদনদার, ভোক্তাসহ সবাইকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করাই উদ্দেশ্য। ২০২৫ সালে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে অভিযানে ৩৮টি জেলার ১৭৮টি উপজেলাকে নির্ধারণ করা হয়।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে কমে গিয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৫ লাখ ২৯ হাজার মেট্রিকটন। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার ৩৪২ টন। এর আগে, ২০২১-২২ সালে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৮৩ টন। ২০২০-২১ সালে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৮৩ টন, ২০১৯-২০ সালে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৪২৮ মেট্রিকটন, ২০১৮-১৯ সালে ৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৫ মেট্রিকটন, ২০১৭-১৮ সালে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ টন এবং ২০১৬-১৭ সালে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ মেট্রিকটন ইলিশ আহরণ হয়েছিল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিকটন। এক হিসেবে গত দেড় যুগে ইলিশের আহরণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে গত সাত বছরে ইলিশ আহরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে, শুধুমাত্র ২০২৩-২৪ অর্থবছর ছাড়া। কিন্তু এরপরও ইলিশের দাম ক্রেতা সাধারণের নাগালের মধ্যে থাকে না। গত আট বছরের রপ্তানির চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট আহরণের এক শতাংশেরও কম ইলিশ মাছ রপ্তানি হয়। বাকি ৯৯ শতাংশ ইলিশ মাছ দেশের বাজারেই বিক্রি হয়। এর পরও প্রতি বছর ইলিশের দাম ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ হারে বাড়ছে বলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যে জানা গেছে। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে ইলিশের দাম গড়ে কেজিতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেড়েছে। আর ১৮ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশের দাম বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১২ জুন থেকে প্রায় দেড়মাস চাহিদা অনুযায়ী সাগরে ইলিশ ধরা পড়েনি। আবহাওয়াজনিত কারণে সাগর উত্তাল থাকছে প্রায়ই। ফলে মাছ ধরার নৌযানগুলো গভীর সাগরে যেতে পারছে না। কিংবা গেলেও আহরণ কম ছিল। কিন্তু চলতি সপ্তাহে এসে এ চিত্র পাল্টে গেছে। সপ্তাহজুড়ে নৌকাপ্রতি ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়েছে। দেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ আহরণ হয় চট্টগ্রাম বিভাগের সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাগুলোয়। অবশ্য মাছ ধরার সমুদ্রগ্রামী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর হিসেব ওঠে চট্টগ্রামের তালিকায়। এর বাইরে পদ্মা-মেঘনার অববাহিকায় ভোলা, খুলনা, বরিশাল ও চাঁদপুর জেলায় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে।
এ বছরও ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম ক্রেতার নাগালের মধ্যে নেই। বর্তমানে
এক কেজি বা তার বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ মাছ বিক্রি হয়েছে ১৩৭৫ টাকায়, ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ১১০০ টাকা, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯০০ টাকা, ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আহরণকারীর নৌকা থেকে ইলিশ পৌঁছে আড়তে।, আড়তে বরফ দিয়ে সংরক্ষণের পর এক কেজি বা তার বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ মাছ ১৪০০-১৪৫০ টাকা, ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ১১৫০ টাকা, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯৫০-১০০০ টাকা, ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৮০০ থেকে ৯৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। আড়ত থেকে ইলিশ যায় বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। সেখানে এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ২ হাজার টাকা, দেড়-দুই কেজি ওজনের ইলিশ ৩ হাজার টাকা এবং ৫০০ গ্রাম বা তার কিছু কম-বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায়। ইলিশ মাছের জোগান ও সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু ইলিশের ব্যবসায় বিনিয়োগকারী, মৎস্যজীবী, আড়তদার এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের গড়ে তোলা ‘অদৃশ্য’ সিন্ডিকেটের কারণে দাম কমছে না। প্রতি বছর ইলিশের বাজার এই ‘চার হাতের চক্রের’ মধ্যে ঘুরতে থাকে।আবার কিছু কিছু অনলাইন ব্যবসায়ী ইলিশের বিক্রির নামে প্রতারনার ফাঁদ পেতেছে যা অত্যন্ত দুক্ষ্য জনক ।
একসময় মধ্যবিত্তের নিত্যবাজারে তালিকায় থাকলেও বর্তমানে উপলক্ষের মাছ হয়ে উঠেছে। সময়ের বিবর্তনে হয়ে উঠেছে উচ্চবিত্তের নিত্যখাদ্য অনুষঙ্গ। আর নিম্নবিত্তের কাছে ইলিশ দীর্ঘশ্বাসের অপর নাম, যাদের বছরে একটি উৎসবেও হয়তো খেয়ে দেখা হয় না এক টুকরো ইলিশ। রুপালি ইলিশের কেজিপ্রতি দাম যখন ২৮শ থেকে ৩২শ টাকা, তখন বাঙালি যেন চোখ মেলে প্রশ্ন করে, ইলিশ আসলে কার?, পাবনার তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের পরিচালক একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। শহরের কালাচাঁদপাড়ায় নিজ বাড়ির আঙিনায় তিনি আয়োজন করেন ‘গরিবের ইলিশ উৎসব’। এক দিনের এই উৎসবে শতাধিক দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষকে পরিবেশন করা হয় ইলিশ। এই আয়োজনে শুধু পেট ভরে না; ভরে ইলিশপ্রেমী নিম্নবিত্তের মন। বর্তমান বাস্তবতায় এমন আয়োজন নিছক উৎসব; অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বাজার নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ। এই উদ্যোগ দেখিয়ে দেয়– দায় শুধু রাষ্ট্র বা নীতিনির্ধারকদের নয়; সমাজের সচেতন নাগরিকদেরও।
সরকার প্রতি বছর মা ইলিশ রক্ষায় অভিযান চালায়; আইন করে জাটকা ধরা বন্ধ রাখে। শূন্য রেখায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে। এর ফলে কিছু বছর ভালো ফলও এসেছে। বিশেষ করে ২০২০ সালে রেকর্ড পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়েছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতা নেই। আইন আছে, প্রয়োগ নেই। সচেতনতা কম, বিকল্প ব্যবস্থা দুর্বল। দিনে দিনে কমছে ইলিশের উৎপাদন। অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে এই ইলিশকে ঢুকিয়ে রাখছে হিমাগারে। বাজারে হাহাকার ফেলে, সিন্ডিকেটের বেড়াজালে বাড়িয়ে ফেলা হচ্ছে ইলিশের দাম। নদীভিত্তিক জীবিকা চলে যাচ্ছে, আর মানুষ দোষ দিচ্ছে প্রকৃতিকে। এ অঞ্চলে মাছের অর্থনীতি, রাজনীতি এতটাই গভীর যে, একসময় ভারত সরকার যখন বাংলাদেশ থেকে ইলিশ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেটাকে কূটনৈতিক মাইলফলক বলে মনে করা হয়। আবার নির্বাচনের আগে বিশেষ রকম সুবিধা পেতে ইলিশ সরবরাহ নিয়েও গুঞ্জন ওঠে রাজনৈতিক মহলে। মাছ যদি রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে, তাহলে বুঝতে হবে, সে আর মাছ নেই। আর গরিবের ইলিশ কেবল স্বপ্নেই রয়ে গেল।
লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক
সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমকে সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছিল। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে উপস্থাপক ঘোষণা দিলেন, এখন বাউল শাহ আবদুল করিমের হাতে সোয়া ৩ লাখ টাকার চেক তুলে দেয়া হবে। অনুষ্ঠানের এক পাশে শাহ আবদুল করিম বসে আছেন। ঘোষণা শুনতেই তিনি তার পাশে থাকা ছেলে শাহ নূর জালাল বাবুলকে বললেন- ‘সোয়া ৩ হাজার টাকা! এত টাকা দিয়া আমি কি করমু! এত টাকা আমার লাগবে না।’ পাশ থেকে বলা হলো সোয়া ৩ হাজার টাকা না, সোয়া ৩ লাখ টাকা। শাহ আবদুল করিম এবার টাকার অংক শুনে বলেই ফেললেন, ‘এত টাকা দিয়া আমার কাজ কী? মানুষ আমারে ভালোবাসে এটাই বড়। এই টাকা আমার লাগবো না। এই বাবুল চল, বাড়িত যাই।’ এই নির্লোভ বাউলকে কোনো একদিন দোহারের শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য জিজ্ঞেস করেছিলেন-‘মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়। আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলেন না। এসবে আপনার খারাপ লাগে না? ‘শাহ্ আবদুল করিম জবাবে বললেন- ‘কথা বোঝা গেলেই হইল, আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই।’ কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য ভীষণ অবাক হলেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘আপনার সৃষ্টি, আপনার গান। মানুষ আপনার সামনে বিকৃত করে গাইবে। আপনি কিছুই মনে করবেন না!এটা কোন কথা, এটার কোন অর্থ আছে!’ শাহ আবদুল করিম বললেন- ‘তুমি তো গান গাও, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। ধরো, তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো। হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে কিন্তু গান শুনতে কোন মানুষ আসে নাই। শুধু সামনের সারিতে একজন মানুষ বসে আছে। তুমি কি গান গাইতে পারবে?’ কালীপ্রসাদ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলেন- ‘না, তা আমি পারব না।’ শাহ আবদুল করীম হেসে বললেন- ‘আমি পারব, কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়ে আমি একটা আদর্শকে প্রচার করতে চাই। সেটা একজন মানুষের কাছে হলেও। সুর না থাকুক, নাম না থাকুক। কিন্তু সেই আদর্শটা থাকলেই হলো। আর কিছু দরকার নাই, সেজন্যই বললাম শুধু গানের কথা বোঝা গেলেই আমি খুশি! ‘কালীপ্রসাদ ভট্টাচার্য কৌতুহল বেড়ে গেলো,তিনি জানতে চাইলেন, ‘সেই আদর্শটা কি? বাউল বললেন’ একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে, এই পৃথিবী একদিন বাউলের পৃথিবী হয়ে যাবে।’ এই বিখ্যাত মানুষটি যে কতটা নির্লোভী ছিলেন তা এই বাক্যের মধ্য দিয়েই প্রকাশ হয়েছে। ছিলেন কৃষকের সন্তান, মাঠে ঘাটে রাখাল হিসেব গরু চরাতেন, সেই রাখাল বালক থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাউল সম্রাট। অথচ এত খ্যাতির পরও আজীবন তিনি ছিলেন মাটির মানুষ। তার মন-ধ্যান, চিন্তা-চেতনায় আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। এমনও হয়েছে তার ঘরে খাবার নেই, কিন্তু দূর দূরান্ত থেকে এসেছেন মেহমান। নিজে না খেয়ে তিনি অতিথি অ্যাপায়নে শান্তি খুঁজে পেয়েছেন। শাহ আব্দুল করিমই বাংলার বাউল সংগীতকে এক অনন্য উচ্চাতায় নিয়ে গেছেন। তার গানে ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসার পাশাপাশি উঠে এসেছে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিশুদ্ধতার সুর। এই শিল্পী গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ এর দর্শন থেকে। তিনি বাউল গানের দীক্ষা নিয়েছিলেন সাধক রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকশ এর মতো গুণিদের কাছ থেকে। কেবল বাউল গান না; শরীয়তী, মারফতি, দেহতত্ত্ব, গণসংগীতসহ সংগীতের বহুরূপ সৃষ্টি হয়েছে তার হাত ধরেই। তার রচিত প্রায় ৫শতাধিক গানের সম্ভারের ২০টির মতো গান ইংরেজি ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। এই গুণি মানুষটি হতে পারে আমাদের অহংকারী সমাজের দৃষ্টান্তের প্রতীক, আদর্শের মিনার।
বাংলাদেশের অতি সাম্প্রতিককালের একটি বহুল আলোচিত ও ব্যাপক বিস্তৃত অনুষঙ্গ হচ্ছে মব (mob) বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। মানুষ সারাক্ষণই এ মবের ভয়ে এই ভেবে আতঙ্কে থাকে যে, কখন না কার উপর এটি ভর করে বসে। আর এ ভীতির মাত্রা ইদানীংকালে আরো বিস্তার লাভ করেছে এ কারণে যে, মবের পেছনে আগে কোনো সাংগঠনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও এখন তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও সৃষ্টি করা হচ্ছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘চাপ’। তো এই মবের মতো সমান গতিতে বা তারচেয়েও অধিক শক্তিতে চারদিকে এখন দ্রুত বিস্তার লাভ করছে ধর্ষণ। এবং সে ধর্ষণের ঘটনা ইদানীং এতটাই বেড়ে গেছে যে, বিষয়টি এখন আর কেবল উদ্বেগের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই-- উদ্বেগের মাত্রা ছাড়িয়ে তা এরইমধ্যে এক ধরনের আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বাসগৃহ থেকে শুরু করে বাস, ট্রেন, লঞ্চ, জনপথ, পর্যটন কেন্দ্র সর্বত্রই এটি সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে উল্লিখিত ধর্ষণের যত সংখ্যক ঘটনার কথা সাধারণ মানুষ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে জানতে পারছে, এক্ষেত্রে প্রকৃত ঘটনা তারচেয়েও অনেক বেশি। অর্থাৎ এ ভয়াবহতার প্রকৃত মাত্রা দৃশ্যমান বাহ্যিক অবস্থার চেয়েও অনেক বেশি নিষ্ঠুর। বর্তমান অবস্থায় ধর্ষণের যেসব ঘটনার কথা গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে জনসমক্ষে প্রকাশ পাচ্ছে, বস্তুত সেগুলোর ধরন, বৈশিষ্ট্য ও সংখ্যা দেখেই মানুষ এর ভয়াবহতা সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা তৈরি করে নিচ্ছে। কিন্তু তারাই জানলে আরো বিস্মিত হবেন যে, এ উভয় মাধ্যমের বিস্তার ও পরিধির বাইরে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত ও প্রান্তিক জনপদগুলোতে এ জাতীয় বা এরচেয়েও জঘন্য ধর্ষণের ঘটনা প্রতিদিনই আরো অনেক বেশি সংখ্যায় ঘটে চলছে। কিন্তু লোকলজ্জা, ধর্ষকের সামাজিক প্রভাব, যোগাযোগ অবকাঠামোর পশ্চাৎপদতা ও অন্য নানাবিধ কারণে সেসব জনসমক্ষে প্রকাশ পাচ্ছে না।
উল্লিখিত পরিস্থিতিতে জনসমক্ষে প্রকাশ পাওয়া ও লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা অর্থাৎ জনসমক্ষে প্রকাশ না পাওয়া-- এ উভয়বিধ ধর্ষণের বিস্তার, এসবের প্রকৃতি ও সম্ভাব্য কারণ নিয়ে এখানে অতি সংক্ষেপে খানিকটা আলোচনা করা হলো। আশা করব, সমস্যাটির ভয়াবহতা বিবেচনায় এবং এর বিস্তার রোধ ও প্রতিহতকরণের উদ্দেশে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে অন্যেরাও এ ধরনের আলোচনায় যুক্ত হবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে হঠাৎ করেই ধর্ষণের ঘটনা এভাবে এতোটা বেড়ে গেল কেন? এর কারণ একাধিক। তবে মূল কারণ অবশ্যই সমাজ ও রাষ্ট্রে বিচার, ন্যায়ের শাসন, রাজনৈতিক স্থিরতা এবং সামাজিক ঐক্য ও সংহতি না থাকা। তদুপরি রয়েছে অর্থনীতির নানা নেতিবাচক অনুষঙ্গ যার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বেকারত্ব, প্রয়োজনের তুলনায় আয়ের ঘাটতি, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমূল্য ইত্যাদি। আর উল্লিখিত এই উভয় শ্রেণির সমস্যা সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার এবং সব বয়নি ও লিঙ্গের মানুষকে স্পর্শ করলেও তা সর্বাধিক সংখ্যায় করছে তরুণদেরকে। আর এই তরুণদের মধ্যে অভাব, বেকারত্ব ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতির সমস্যা এতটাই প্রকট যে, সেসব থেকে তাদের ভেতরে যেসব কষ্ট, ক্ষোভ ও হতাশা পুঞ্জিভূত আকারে জমা হয়েছে, সেটাই ক্রমান্বয়ে নানা হিংস্রতাপূর্ণ পাশবিক প্রবণতার দিকে ধাবিত হতে হতে বর্তমানের ধর্ষণ বা গণধর্ষণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আর তারই এক ধরনের আদিম বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে অতিদ্রুত হারে বেড়ে চলা ধর্ষণের ঘটনাগুলো।
এসব ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে ধর্ষকের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাও একটি বড় কারণ। এক্ষেত্রে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্ষক বা ধর্ষণকারীরা কোনো না রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এরূপ জড়িত থাকার উদাহরণ হচ্ছে: মুরাদনগরে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকা, টাংগাইলে বাসে শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে, নোয়াখালীর গ্রামে স্থানীয় সমিতির সঙ্গে ইত্যাদি। মোটকথা ধর্ষক ধরেই নিচ্ছে যে, তাকে রক্ষা করার জন্য তার পেছনে সাংগঠনিক শক্তির সমর্থন যথেষ্টই রয়েছে। অন্যদিকে ধর্ষকের সামাজিক অবস্থানও তার একটি বড় রক্ষাকবচ। সমাজের বিত্তবান বা প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যরা এসব ঘটনায় জড়িত হয়েও চারপাশের প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। আর তাদেরকে ধর্ষণের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ থেকে মুক্তিদানের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্বচ্ছ আচরণ, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের উদ্যমহীন দায়িত্বহীনতা, বিচারব্যবস্থার নির্লিপ্ততা ও গাফিলতি ইত্যাদি এতোটাই দায়ী যে, এটিকে শুধু রাষ্ট্রব্যবস্থার ত্রুটি ও দুর্বলতা বললে খুবই সামান্য বলা হয়। আসলে এগুলো হচ্ছে অসহায় ধর্ষিতাদের প্রতি রাষ্ট্রের একধরনের শোষণ ও উপেক্ষামূলক বর্বর দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ।
তবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটা ও ঘটার পর ধর্ষককে সে অভিযোগ থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্রের রাজনীতি। দেশে যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকছে, তখন সে দলের অনুসারীরা পুরো দেশ ও দেশের সমুদয় সম্পদকেই তাদের নিজেদের জন্য ‘মালে গণিমত’ ভাবতে শুরু করে, যে গণিমতের আওতায় তারা হয়তো ওই অসহায় ধর্ষিতা নারীকেও গণ্য করে বৈকি! কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, যে রাজনৈতিক নেতারা এসব অপকর্মকে প্রশ্রয় দেন, তারা যখন জনগণের কাছে ভোট চাইতে যান, তখন সে ভোটারদের কেউই তাকে প্রশ্ন করেন না যে, বিভিন্ন সময়ে ধর্ষকের পক্ষে দাঁড়ানোর কারণে ইতোমধ্যে তিনি তার ভোট চাওয়ার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে ফেলেছেন কিনা। আশা করা হচ্ছে, সামনেই নির্বাচন। ধর্ষণের ক্ষত শুকিয়ে যাওয়ার আগেই ওই নির্বাচনের ভোটপ্রার্থীদের কাছে ভোটাররা কি দয়া করে এর কারণ জানতে চাইবেন? আর তাদের কাছে এটাও জানতে চাওয়া যেতে পারে যে: তুলনামূলকভাবে দরিদ্র, সংখ্যালঘু এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে পিছিয়েপড়া নারীরাই কেন অধিক হারে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন? রাজনীতিকদের কাছে এ প্রশ্নও রাখছি যে, ধর্ষককে প্রশ্রয় দিয়ে ও তাকে নিজ দলের কর্মী-কাম-লাঠিয়াল বানিয়ে এ দেশের জন্য কোন রাষ্ট্রব্যবস্থা তার গড়ে তুলবেন?
ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে উপরোক্ত কারণসমূহ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে আরো কিছু নতুন কারণ সমাজে সৃষ্টি হয়েছে, যেসবের বেশিরভাগই আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এর একটি হচ্ছে: উপার্জনের প্রয়োজনে বাংলাদেশের গ্রামগুলোর এক বিরাট সংখ্যক মানুষ বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছে, যে ক্ষেত্রে তার পরিবারের নারী সদস্যদেরকে অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই দেশে বসবাস করতে হচ্ছে। কিছু বছর আগ পর্যন্তও বাংলাদেশের গ্রামগুলোর দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যিক সংহতির কারণে এ নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এসব পরিবারের জন্য যৌন হয়রানিসহ নানাবিধ সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেছে। দেশে একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বহাল থাকলে এ দেখভালের কাজটি খুব সহজেই তারা করতে পারত। একইভাবে যেসব গ্রামীণ পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বর্তমানে পরিবার-পরিজনকে গ্রামের বাড়িতে রেখে শহরে যেয়ে কাজ করছেন, সেসব পরিবারের নারী সদস্যদের জন্যও নিরাপত্তাহীনতার অনুরূপ ঝুঁকি দিন দিনই বেড়ে চলেছে। আর পোশাক শিল্পের দরিদ্র অসহায় দুঃখী মেয়েরাতো এখন ধর্ষণের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য (target)। তথ্য পর্যালোনা করলে দেখা যাবে যে, সারাদেশে গত পাঁচ বা দশ বছরের মধ্যে যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে এই পোশাককর্মীর সংখ্যাই সর্বাধিক।
ধর্ষণের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ নিয়ে উপরে যে আলোচনা করা হলো, তার বাইরে যেয়ে এসবের মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে, এসব ঘটনায় ধর্ষকের মধ্যে যৌন আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার চেয়েও অধিক হারে কাজ করে এক ধরনের রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ ও হতাশা, যার কিছুটা নিজের প্রতি হলেও বেশির ভাগটাই চলমান রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি। ওই যে দেশের তরুণেরা এখন বন্যার স্রোতের মতো বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে, সেটি যেমন বহুলাংশে রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ ও হতাশা থেকে, এই ধর্ষকদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি মোটামটি একই। ধর্ষণের মতো পাশবিক অমানবিকতা প্রকাশের মাধ্যমে সে বস্তুত রাষ্ট্রের প্রতিই এক ধরনের ঘৃণা প্রকাশ করতে চায়, যদিচ সে ঘৃণা প্রকাশের জন্য এটি কোনো গ্রহণযোগ্য পথ নয়। এমতাবস্থায় ধর্ষণ প্রতিরোধে আশু ও জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় গ্রহণের পাশাপাশি রাষ্ট্রকে ঐসব ব্যবস্থাদিও গ্রহণ করতে হবে, যার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের প্রতি ধর্ষকের ঘৃণা, ক্ষোভ ও হতাশাগুলোও দূরীভূত হশ।
শিরীন আমজাদ: সাবেক অধ্যক্ষ, মির্জা আব্বাস মহিলা কলেজ, ঢাকা।
ষড়যন্ত্র হলো কিছু মানুষের গোপন পরিকল্পনা, যা সাধারণত অনৈতিক বা ক্ষতিকর উদ্দেশে করা হয়। এটি একটি গোপন চুক্তি, যা কোনো অন্যায় বা ক্ষতি করার জন্য করা হয়। ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বলতে বোঝায় কোনো ঘটনার পেছনে কিছু মানুষের তৈরি করা জটিল ও গোপন পরিকল্পনা, যা অস্পষ্ট ও বিতর্কিত হয়ে থাকে। ষড়যন্ত্র বহু ধরনের। সাধারণত নিম্নোক্ত ধরনের আওতাভুক্ত হতে পারে, যেমন: (১) পারিবারিক ষড়যন্ত্র; (২) সামাজিক ষড়যন্ত্র; (৩) সংগঠনগত ষড়যন্ত্র; (৪) অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্র; (৫) রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র; (৬) প্রাসাদ ষড়যন্ত্র; (৭) ইত্যাদি। ষড়যন্ত্রের মূল বিষয় ইতিবাচক নয়; সবই নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্বক। উল্লেখ্য যে, ইসলামে অন্যের ক্ষতি করার জন্য বা অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে যারা অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তাদের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করলে আখিরাতে তার কঠিন প্রতিফল ভোগ করতে হবে। মূলত প্রতিহিংসাপরায়ন কতিপয় হীন মনের মানুষ কর্তৃক কর্তৃত্ব, লোভ, লালসা, জিঘাংসা, জিদ, আধিপত্য ইত্যাদির জন্য সংঘটিত হয়ে থাকে। এরা এতটাই জঘন্য মনের মানুষ যে শুধু ব্যক্তি বিশেষ নয়, সমাজ ও দেশের ক্ষতি হলেও তাদের কিছু আসে যায় না। ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে ইংরেজিতে সুন্দর একটি কথা আছে, যা হলো ‘Dirty man with dirty mind in negative phenomena’।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে এই বিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা থেকে ষড়যন্ত্র চলে আসছে। অবশ্য এ সব ষড়যন্ত্রের প্রকারভেদ আছে। দুঃখের বিষয় হলো যে, নবী-রাসূল (সা.) এর বিরুদ্ধে কম ষড়যন্ত্র হয়নি? এর স্বপক্ষে একটি জলন্ত উদহারণ হলো আমাদের প্রানপ্রিয় নবীজি (সা.) এর বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান একটি ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরছি। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, মক্কার মুশরিকরা যখন কোনোভাবেই সাহাবিদের দেশত্যাগ ঠেকাতে পারল না এবং বুঝতে পারল নবীজি (সা.) মদিনায় গিয়ে পৌঁছালে কোনোভাবেই ইসলামের উত্থান তারা ঠেকাতে পারবে না, তখন তারা নবীজি (সা.)-কে প্রতিহত করতে মক্কার ‘পরামর্শ কেন্দ্রে’ একত্র হলো। বৈঠকে উমাইয়া বিন খালফ, আবু জাহাল, নদর বিন হারিসসহ মক্কার শীর্ষ স্থানীয় সাত ব্যক্তি ছিল। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় শয়তানও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। বৈঠকে আবু জাহাল নবীজি (সা.)-কে হত্যার পরামর্শ দেয়। নাউজুবিল্লাহ! সে বলে প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন যুবক হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে। সিদ্ধান্ত হয় রাতের আঁধারে তারা একযোগে নবীজির ওপর হামলা করবে। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ১/৩৮৫; আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১৬৭-১৬৮)। এদিকে পবিত্র কোরআনে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, কাফিররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বন্দি করার জন্য, হত্যা করার জন্য অথবা নির্বাসিত করার জন্য এবং তারা ষড়যন্ত্র করে এবং এক্ষেত্রে আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেন। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৩০)। রাতের বেলা নীলনকশা বাস্তবায়নে আবু জাহাল, হাকাম ইবনে আস, উকবা ইবনে আবি মুয়িত, নদর ইবনে হারিস, উমাইয়া ইবনে খালফসহ ১১ ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর বাড়ি ঘেরাও করে। অন্যদিকে মহানবী (সা.) নিজের বিছানায় আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-কে শুইয়ে দেন। এরপর তিনি হাতে এক মুঠ মাটি নিয়ে কাফিরদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করেন এবং সুরা ইয়াসিনের প্রথম থেকে ৯ আয়াত তিলাওয়াত করেন। নিক্ষিপ্ত ধুলা প্রত্যেক দুর্বৃত্তের মাথায় গিয়ে পড়ল এবং তারা কার্যত অন্ধ হয়ে গেল। নবীজি (সা.) তাদের সামনে দিয়ে নিরাপদে বের হয়ে গেলেন। তিনি বের হয়ে যাওয়ার পর একজন আগন্তুক তাদের বলল, তোমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। আল্লাহর কসম, মুহাম্মদ ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। কিন্তু তারা যখন ঘরে উঁকি দিয়ে মহানবী (সা.)-এর বিছানায় অন্য কাউকে শোয়া দেখল, তখন তারা আগন্তুককে তিরস্কার করল। অথচ সকালে যখন আলী (রা.)-কে শয্যা ত্যাগ করতে দেখলেন তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। (সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা ৪৭; আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, পৃষ্ঠা ৪৫৬। এদিকে আবু সিরমা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্য কারো ক্ষতিসাধন করে, আল্লাহ তাআলা তা দিয়েই তার ক্ষতিসাধন করেন। যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাআলা তাকে কষ্টের মধ্যে ফেলেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ ধরনের লোক কিয়ামতের দিন দেউলিয়া হয়ে যাবে।
বাংলাদেশে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, যা পূর্ব থেকেই অনেকেই কম বেশি অবহিত ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, একজন সৎ ও দক্ষ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে চট্টগ্রামে নির্মমভাবে হত্যা করা, যা কেউ এতটুকু বিশ্বাস করতে পারেনি। সত্যি কথা বলতে কি, প্রেসিডেন্ট জিয়া নিষ্ঠাবান ও সৎ ছিলেন। তিনি দেশের জন্য কাজের মাধ্যমে এমনভাবে বাংলাদেশীদের মনে স্থান করে নিয়েছিলেন যে তার জানাজায় লাখ লাখ লোক শরিক হয়েছিল, স্মরণকালে এমন নাকি হয়নি। যাহোক, এই রকম অনেক ষড়যন্ত্র পৃথিবী ব্যাপী সংঘটিত হয়েছে, যা প্রবন্ধের কলেবরের স্বার্থে সন্নিবেশন করা সম্ভব হলো না। এদিকে বর্তমান বাধা বিঘ্নের মধ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কার্যকাল ইতিমধ্যে এক বছর শেষ হয়ে গেছে। এই সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। শুধু দেশে নয়। দেশের বাইরে থেকেও ষড়যন্ত্র চলছে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এই সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে।তাই সবাইকে সজাগ থাকতে হব।
যে কারণে ষড়যন্ত্রের উপর লিখতে হাতে কাগজ কলম তুলে নিয়েছি। তা হলো একটি বয়সি ও অবসরপ্রাপ্ত মানুষের সমবায় সমিতির মধ্যে ষড়যন্ত্র। ওই সমবায় সমিতির সঙ্গে প্রথম থেকেই সংশ্লিষ্ট ছিলাম। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, ২০১০ সাল থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উদ্যোগী কার্যক্রমের সুবাদে ২০১৫ সালে এটি সমবায় অধিদপ্তরে নিবন্ধিত হয়। আর এর ৪ বছরের মাথার অর্থাৎ ২০১৯ সালে সফলতার মুখ দেখে এবং ৫ বছর ধরে সফলতার সঙ্গে চলে ২০২৫ সালে সমিতির মধ্যে কিছু নেতিবাচক সদস্য মাথা চারা দিয়ে উঠে। তৎপর থেকে বলতে গেলে, সমিতির মধ্যে অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা চলছে। শুধু তাই নয়, তারা নানা বাহানার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। আর সমিতিকে ধ্বংস করার জন্যে ভেতর বাইরে গুজব ছড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত আক্রমন করে কথা বলছে। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, ইতিমধ্যে সমবায় অধিদপ্তরসহ সাধারণ সদস্যগণের মধ্যে অনেকেই আশংকাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। শেয়ার মূলধন হিসেবে এককালীন টাকা উঠিয়ে নেয়ার জন্য অনেকেই প্রায়ই সমিতির অফিসে ধর্ণা দিচ্ছেন। আর এটি সমিতির জন্য মোটেই ভাল লক্ষন নয়। এদিকে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, মূল ষড়যন্ত্রকারীরা সংখায় খুব একটা বেশি নয়। বড় জোর ৩/৪ জন হবে। এরাই রাত দিন ষড়যন্ত্র করে চলছে। আমার এই মর্মে বাস্তবভিত্তিক ধারণা যে, এইভাবে ষড়যন্ত্র চললে, হয়তো এই সমিতি বেশি দিন টিকবে না।
পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে ষড়যন্ত্র আছে, ছিল এবং আগামীতে বিভিন্ন আঙ্গিকে আসবে। তাই জীবন চলার পথে ষড়যন্ত্রকারী থেকে সাবধান থাকতে হবে এবং সদা চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। কেননা অনেক ক্ষেত্রে ইবলিসও এদের কাছে হার মানে। এটি চিরন্তন সত্য যে ষড়যন্ত্রকারী বা আপাতত ভাল অবস্থানে থাকলেও, শেষ পর্যন্ত টিকে না এবং জনরোষে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। হয়তো আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, বাস্তব জীবন থেকে নিংড়ানো তিন ঘন্টার সব সিনেমায় ভিলেন দোর্দন্ড প্রতাপে প্রথম দিকে ভাল অবস্থান থাকলেও শেষ পর্যন্ত হয় করুণ পরিনতি। এক্ষেত্রে ‘যার শেষ ভালো তার সব ভালো’ দর্শনের আওতায় নায়ক মাথা উঁচু করে থাকে। আর এই ভিলেন তথা ষড়যন্ত্রকারীদের কি অবস্থা হয়, তা কম বেশি সবারই জানা। এদিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, এই ষড়যন্ত্রকারীরা নায়কের বিরুদ্ধে নেতিবাচক কথা বলে তাকে যেমন প্রকারান্তরে উপরে উঠায়। তেমন ষড়যন্ত্রকারীরা নিচের দিকে যেয়ে নিজেরাই নিজেদের কবর রচনা করে থাকে।
বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
আল্লাহপাক মানুষকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন (সুরা আর রাহমান, আয়াত-২)। কোরআন গবেষণার জন্য আমাদের তাগিদ দিয়েছেন । সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করত: আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী সঠিকভাবে জীবন যাপন করতে মানবসমাজকে নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন-…‘পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং অনুধাবন কর কিভাবে তিনি সৃষ্টি শুরু করেছেন? অতঃপর আল্লাহ পুনর্বার সৃষ্টি করবেন পরবর্তী সৃষ্টি। আল্লাহতো সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান’। (আন কাবুত, আয়াত ২০)। ‘এতে আমি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য এক সুস্পষ্ট নিদর্শন রেখে দিয়েছি’ (আন কাবুত, আয়াত-৩৫)। ‘আর এটাই আপনার রব নির্দেশিত সরল পথ। যারা উপদেশ গ্রহণ করে আমরা তাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি’ (সুরা আনআম, আয়াত-১২৬)। ‘তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সব কিছু নিজ অনুগ্রহে। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন’ (সুরা যাসিয়া আয়াত-১৩)’। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় সম্পূর্ণ কোরআনের বিভিন্ন অংশে অসংখ্যার উল্লেখ করা হয়েছে যে, এতে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে। অর্থাৎ কোরআন নিয়ে গবেষণার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। বিজ্ঞানের গবেষণায় এমন কিছু অজানা তথ্য আমরা জানতে পেরেছি যা প্রায় পনরশত বছর আগে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে, আমাদের মুসলিম চিন্তাবিদ কতটুকু গবেষণা করেছেন সে বিষয় নিয়ে উদাহরণসহ কয়েকটা আলোচনা করতে চাই :
১) বিগব্যাং থিওরি: ১৯২৭ সালে প্রথম বিগব্যাং থিওরি ধারণা দেয়া হয় যা ১৯৬৫ সালে বিজ্ঞান গবেষণা করে প্রমাণ পায় যে প্রথমে আকাশ ও পৃথিবী একত্রে ছিল, পরে একটা বিস্ফোরণ এর ফলে তারা পৃথক হয়ে গেছে। এই বক্তব্য পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে-‘যারা কুফরী করে তারা কি ভেবে দেখেনা যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে; অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলাম পানি হতে; তবুও কি তারা বিশ্বাস করবেনা?’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৩০।
২) পানি চক্র: ১৮৬১ সালে বিজ্ঞান আবিষ্কার করে পানি চক্র। কোরআনে বর্নিত আছে- ‘তুমি কি দেখনা যে, আল্লাহ আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন; অতঃপর ভূমিতে নির্ঝররূপে প্রবাহিত করেন এবং তদ্বারা বিবিধ বর্ণের ফসল উৎপন্ন করেন, অতঃপর ওটা শুকিয়ে যায় এবং তোমরা ওটা পীত বর্ণ দেখতে পাও, অবশেষে তিনি ওটা খড়কুটায় পরিণত করেন? এতে অবশ্যই উপদেশ রয়েছে বোধশক্তি সম্পন্নদের জন্য’। (যুমার, আয়াত-২১।
৩) ভ্রুণতত্ব: ১৯৫০ সালে আল্ট্রাসাউন্ড আবিষ্কার এর পর বিজ্ঞান জানতে পারে। অথচ কোরআন পনরশত বছর আগেই উল্লেখ করেছে যে, ‘সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট-বাঁধা রক্তপিণ্ড হতে’। (সুরা আলাক, আয়াত-২)।’ পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি রক্তপিণ্ডে, অতঃপর রক্তপিণ্ডকে পরিণত করি মাংসপিণ্ডে এবং মাংসপিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিপিঞ্জিরে; অতঃপর অস্থিপিঞ্জিরকে ঢেকে দিই মাংস দ্বারা; অবশেষে ওকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টি রূপে; অতএব নিপুণতম স্রষ্টা আল্লাহ কত কল্যাণময়’। (সুরা মুমিনুন, আয়াত-১৪।
৪) সম্প্রসারণবাদ: এডউইন হাবল ১৯২৪ সালে প্রমাণ করেন বিশ্বজগৎ ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই তথ্য পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে- ‘আমি আকাশ নির্মাণ করেছি আমার ক্ষমতা বলে এবং আমি অবশ্যই মহাসম্প্রসারণকারী’ (সুরা যারিয়াত, আয়াত-৪৭)।
৫) রোজার বাধ্যবাধকতা : প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য রোজাকে ফরজ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআন এর সুরা বাকারা ১৮৩ নম্বর আয়াত-’ হে মুমিনরা, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।’ এই আয়াতে প্রধান দুটি বিষয় আছে, রোজা মুসলিমদের উপর ফরজ, এবং রোজার পালনের মাধ্যমে মুত্তাকি হতে পারি। এর মধ্যে স্বাস্থ্যের উপকারিতার কথা সরাসরি না থাক্লেও আমরা সবাই জানি রোজা পালন শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু কোন মুসলিম কি কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছেন কিভাবে শরীরের জন্য উপকারী, বা পবিত্র কোরআনের এই বক্তব্যের বৈজ্ঞানিক প্রমাণের জন্য কোন থিয়োরি প্রদান করেছেন? কেননা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত যদি না হয় তো কোন অমুসলিম কেন ওই তথ্যের উপর সরল বিশ্বাস করবে?
৬) একটি নোবেল প্রাইজ : ২০১৬ সালে YOSHINORI OHSUMI, একজন জাপানি বিজ্ঞানীকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় ফিজিওলজি ও মেডিসিন ক্যাটেগরিতে। তিনি আবিষ্কার করেন ‘AUTOPHAGY’ নামের ফর্মুলা। অর্থ্যাৎ তিনি দেখতে পান মানব দেহে যদি ১২ ঘণ্টার অধিক কোন খাদ্য বা পানীয় পাকস্থলীতে না যায় তবে দেহের সুস্থ ও কার্যকরী কোষগুলো অসুস্থ মরা কোষগুলোকে খেয়ে ফেলে। এভাবে শরীর দূষণমুক্ত হয়। এই পদ্ধতির নাম অটোফেজি। ওই ঘটনার পর আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে বিশেষ করে যে সব মৌলভি ওয়াজ করেন, তারা জোরে সোরে বলতে শুরু করেন যে ১৫০০ বছর আগে পবিত্র কোরআনের বাণী বিজ্ঞানের আবিষ্কারে প্রমাণিত। আমার কাছে তাদের আত্মতৃপ্তিটা হাস্যকর মনে হয়েছে। আমি প্রশ্ন করেছিলাম কুরআনের বাণী সত্য। কিন্তু কোনো মুসলিম কেন আবিষ্কার করে নোবেল প্রাইজ নিতে পারলেন না । আর যে বিজ্ঞানী আবিষ্কার করে নোবেল প্রাইজ পেলেন তিনি তো পরীক্ষা করার জন্য গবেষণা করে চলেছেন। তিনি কোরআনের বাণী সত্য প্রমাণ করেছেন। তার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন ছিল মানব দেহের কোষগুলো কিভাবে কাজ করে সেটা জানতে চেষ্টা করেছেন। আমরা মুসলিম হিসেবে নন মুসলিমের সার্টিফিকেটের উপরে কেন নির্ভর করব কোরআনের নির্দেশনা প্রমাণ করতে? আমরা কেন ওই তথ্য আবিষ্কার করতে পারি না?
৭) সত্যমিথ্যা : আজকাল ন্যায় বিচার কায়েম করার জন্য কতই না প্রচেষ্টা করতে হয়। গত ৫৪ বছরে দেখলাম শুধুই আন্দোলন, সরকারের বিরুদ্ধে দাবী আদায়ের আন্দোলন। ৯৫% মুসলিমের দেশ, চিন্তা করতেই অবাক হই যে, ইমানদার অথচ অন্যায়ের বিপক্ষে বেশিরভাগই নেই। অথচ পবিত্র কোরআনে নির্দেশ করেছেন- ‘তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন তুলাদণ্ড। যাতে তোমরা সিমালংঘন না কর তুলাদণ্ডে। তোমরা ন্যায্য ওজন কায়েম কর এবং ওজনে কম দিয়ো না’। (সুরা রহমান, আয়াত : ৭-৯)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ করে দাও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে। আমরা কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কষ্ট দিই না’। (সুরা আনআম, আয়াত : ১৫২)। পরিমাপে ও ওজনে কম দেওয়ার ফলে আল্লাহ তাআলা ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দেন ও দুর্ভিক্ষ দেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়, যারা মানুষের কাছ থেকে ওজন করে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে, আর যখন মানুষকে মেপে কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়’। (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ১-৩)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে-‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করো না এবং জেনেশুনে সত্য গোপন কর না’। (সুরা বাকারা, আয়াত-৪২)।
৮) সর্বশেষ: আমার মূল বক্তব্য কোরআনে বর্ণিত জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা, অর্থাৎ চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য প্রদত্ত পরামর্শ আমরা যারা সিভিল সার্ভিসে কর্মরত বিশেষ করে মুসলিম অফিসার, তাদের জন্যই প্রযোজ্য। তাদের কাছেই প্রশ্ন, আমরা সবকিছু জেনেশুনে কিভাবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারি। আমাদের মধ্যে যেমন রাজনৈতিক বিশ্বাস ও বিভক্তি আছে, তেমনি আছে ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিভক্তি। সাধারণ মানুষ সহজেই একটা দলভুক্ত হতে পারে। তাদের মধ্যে গোঁড়ামি অত্যন্ত কাজ করে। কিন্তু সিভিল সার্ভেন্ট অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ, দক্ষ, অভিজ্ঞ, শিক্ষিত ও বিবেকবান কর্মকর্তা, কোরআনের বর্ননা মতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে যেমন প্রফেশনালিজম থাকবে, তেমনি থাকবে ন্যায় পরায়নতা। তাতে থাকবে যুক্তি, এবং অপরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা। ওজনে কম দিয়ো না অর্থ ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা কর, বিচারে পক্ষপাতিত্ব কর না। অন্য আয়াতে আছে-‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ কর না। এবং জনগণের সম্পদের কিয়দংশ জেনেশুনে পাপ পন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশে শাসন কতৃপক্ষের হাতেও তুলে দিও না’। (সুরা বাকারা:১৮৮)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে-‘যে দানের পর কষ্ট দেয়া হয় তার চেয়ে ভালো কথা ও ক্ষমা উত্তম। আর আল্লাহ অভাবমুক্ত, পরম সহনশীল’। (সুরা বাকারা ২:২৬৩)। ‘যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার মীমাংসা করতে আরম্ভ কর, তখন মীমাংসা কর ন্যায়ভিত্তিক। আল্লাহ তোমাদিগকে সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী’। (সুরা নিসা ৪:৫৮)। ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও ভয়ানক’। (সুরা বাকারা-১৯১)। ‘তোমরা আল্লার রুজ্জুকে শক্তভাবে সবাই আঁকড়ে ধর দলাদলি করো না’। (সুরা ইমরান -১০৩)। ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে’। (সুরা নিসা-৫৮)। আমরা যারা মুসলিম, আমাদের সাধারণ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে স্বীকার করতেই হবে। আর কোরআনের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তো আছেই। কিন্তু একজন মুসলিম, বিশেষ করে আলেমদের মধ্যে এই সীমাবদ্ধতা কতটুকু রয়েছে সে প্রশ্ন করাই যায়। প্রায় পনরশত বছর আগে পবিত্র কোরআনে অনুরূপ অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা এসেছে যা এখন বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে, কোরআন একদিকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক নির্দেশনা প্রদান করে অন্যদিকে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোর প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করত: যুক্তি ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে একটা সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। জ্ঞান অন্বেষণের তাগিদ প্রদান করেছে যা মহান সৃস্টিকর্তার প্রকৃতিতে বিরাজমান বিভিন্ন নমুনা ও তার অস্তিত্ব খুঁজে বের করতে উৎসাহ যোগায়। সুতরাং কোরআনের সব অজানা তথ্য যে সঠিক তা মহান আল্লাহ পাকের কৃপায় আমরা সময়মতো আবিষ্কার করতে পারবো ইনশাআল্লাহ্। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, কোরআনের কথা বিজ্ঞানের প্রমাণের উপর নির্ভরশীল। সিভিল সার্ভিসের একটা অন্যতম কাজ জনসেবা নিশ্চিত করা। জনগণের কাজকে সহজ করে তোলা। পার্লামেন্টে আইন পাস হয় কিন্তু তারপর প্রয়োগ হয় সিভিল সার্ভেন্টের মাধ্যমে। সেজন্য একজন সিভিল সার্ভেন্টের মনোভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই জানি আইনের ভাষা, শর্ত, শাস্তি বা পুরস্কার, আইন অমান্যের কারণ, অপরাধী সনাক্তকরণ এইসব যাবতীয় বিষয় একই আইনের বইয়ে লেখা থাকে। কিন্তু নির্ম আদালত যে রায় দেয় উচ্চ আদালতে যেয়ে দেখা যায় আদেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখানে যুক্ত হিসেবে দেখা যায় উচ্চ আদালতের বিচারকের মনোভাব। তিনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করছেন তার উপর নির্ভর করে একজন অপরাধী অপরাধের মাত্রা, অথবা তার নিরপরাধের যৌক্তিকতা, ইত্যাদি নির্ণয় করা।
মো. জহিরুল হক, সরকারি কর্মকর্তা
চব্বিশের জুলাই থেকে পঁচিশের জুলাই-আগস্ট। ঐতিহাসিক গত অভ্যুত্থানের একটি বছর পূর্ণ না হতেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের ঘটনাপ্রবাহ দেখে ব্যথিত ও হতাশ হতে হচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবন বাজি রেখে লড়াই করা সৈনিকদের মধ্যে এখন নানা মতবিরোধ, সন্দেহ , অবিশ্বাস, মতানৈক্য, পরস্পরের প্রতি বিষেদগার করা, অপরের চরিত্র হননের হীন চেষ্টা এমনকি এক পক্ষের ওপর আরেক পক্ষের সরাসরি আক্রমণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি গত কিছুদিন ধরে। একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বিভেদ প্রকারন্তরে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের জুলাই অভ্যুত্থানের বিজয় নস্যাৎয়ের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে দুঃসাহসী করে তুলেছে। বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ন্যায়বিচারভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন শিক্ষার্থী নেতাদের কেউ কেউ নিজেরাই চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়েছে। অথচ তারাই সেদিন দেশকে চাঁদাবাজ মুক্ত, দখলদার মুক্ত, দুর্নীতি মুক্ত করার দীপ্ত শপথ নিয়েছিল। তাদের ওপর ভরসা করতে শুরু করেছিলাম আমরা। ভেবেছিলাম তাদের মাধ্যমে দেশে রাজনীতিতে পচা-গলা নষ্ট সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে সম্পূর্ণ নতুন বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠিত হবে। নতুন সুস্থ সুন্দর রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চা শুরু হবে। কিন্তু ১ বছর না যেতেই তাদের চরিত্র এমনভাবে কলঙ্কিত হয়েছে, যা আমাদের হতাশ, ব্যথিত এবং লজ্জিত করেছে।
পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসররা এখন অনায়াসেই চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে কটাক্ষ করে কথা বলার সাহস পেয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কারও কাছে কাম্য নয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে আমাদের আকুল আবেদন, আমরা যেন কোনোভাবেই দিকভ্রান্ত পথিক না হই। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আগে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছি, এখনো তেমন ঐক্যবদ্ধ থেকে অর্জিত বিজয়কে সুসংহত করতে হবে। অনৈতিক আচরণ, বিশৃঙ্খলা, পারস্পরিক বিভেদ, অবিশ্বাস, ঈর্ষাকাতরতা, লোভ-লালসা ত্যাগ করে সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকে পরাজিত শত্রুর নানা ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আরও সতর্ক ও সক্রিয় হতে হবে দেশের সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে। বিভেদ, সংঘাত, পারস্পরিক অশ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটিয়ে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটাতে হবে। সব রাজনৈতিক দলেরই অধিকার রয়েছে সারাদেশে সর্বত্র সভা সমাবেশ অনুষ্ঠানের। কাউকে বাধা দেওয়া কিংবা ঘোষণা দিয়ে তাদের প্রতিরোধের অধিকারও নেই কারও। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে গোপালগঞ্জে যা ঘটেছে তা নিজের চোখে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত লাইভ টেলিকাস্টে সরাসরি দেখেছি আমরা। যেখানে এডিট কিংবা বানোয়াট কিছু প্রচারের সুযোগ ছিল না। যেখানে একটি রাজনৈতিক দলের নেতারা সভায় কোনো উসকানিমূলক বক্তব্য দিলেন না, অথচ পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তাদের ওপর জঙ্গি হামলা চালাল দুর্বৃত্তের দল। পতিত স্বৈরাচারের দোসর, সমর্থকরা। তাদের ফ্যাসিস্ট স্বভাব রক্তমজ্জায় এমনভাবে মিশে আছে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার পরও তারা সেই আগের মতো আচরণ করছে। বিরোধী দলের উপস্থিতি সহ্য করতে পারছে না। তারা কেন উপলব্ধি করতে পারছে না, গোপালগঞ্জটাই বাংলাদেশ নয়। সারাদেশের মানুষ কী ভাবছেন, কী চাইছেন, তাদের আকাঙ্ক্ষা কী? গোপালগঞ্জ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে এক ধরনের আত্মতুষ্টিতে ভোগা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ মনে হয় ওদের। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের স্মৃতি আমরা ভুলে যাইনি। শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিম, নাফিসারা আমাদের স্মৃতিতে হানা দেয় বারবার।
আজকাল একশ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তীতে দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার উপদেষ্টামণ্ডলীর নানা সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা, ব্যর্থতা, অক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন, প্রায় সময়ই দেখছি। এটা এক ধরনের অসুস্থ মন মানসিকতার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এক ধরনের হীনমন্যতাবোধ, পতিত স্বৈরাচারের আমলে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা ভোগের স্মৃতি ভুলতে না পারাসহ নিজেদের অনেক সুপ্ত বাসনা কামনা পূরণ না হওয়ার বেদনা থেকে এমন আবলতাবোল বকছেন তারা। অনায়াসেই অন্যের সমালোচনা করা যায়। কিন্তু নিজের ঘাড়ে সেই দায়িত্ব অর্পিত হলে বোঝা যায় ওটা পরিপূর্ণভাবে পরিপালন করা কতটা কঠিন। আমরা দেশের বেশির ভাগ মানুষই তো জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আস্থা রেখে এসেছি। এখনো তা বিদ্যমান। আমরা তো সুবিধাভোগী কোনো গোষ্ঠী বা পরিবারের লোক নই। পিওর আমজনতা বলতে যা বোঝায়, আমরা তাই। এখন যারা মজা লুটতে পারছে না,প তিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের সময়ের মতো হালুয়া রুটির ভাগ পাচ্ছে না। কোনো পদ-পদবি পাচ্ছে না, হয়তো মনে বড় আশা ছিল কিছু একটা না একটা পদ বাগিয়ে নেব এই আমলেও। সেই সব লোভী তথাকথিত বিশিষ্টজনদের মনে নানা প্রশ্ন, নানা জ্বালা যন্ত্রণার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। মোদ্দা কথা, আমরা এখন আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময় থেকে অনেক অনেক ভালো আছি। হয়তো সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহেবের পক্ষে। এটা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কারও পক্ষে হান্ড্রেট পার্সেন্ট সুখী করা যাবে না, কখনো কোনো মানুষকে। যিনি এইসব লম্বা চওড়া কথা বলেন, তাকে বসিয়ে দেওয়া হোক কোনো চেয়ারে, তখন তিনি বোঝতে- পারবেন কত ধানে কত চাল। আমি নিজে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলাম। চেয়ারে বসে টের পেয়েছি, কী যে মহা ঝামেলা সবকিছু সামাল দেওয়া ও দায়িত্ব পালন করার যন্ত্রণা। কেবলই মনে হতো এই চেয়ার-টেয়ার ফেলে একদিকে ছুটে পালিয়ে যাই। দূরে কোনো পাহাড় কিংবা জঙ্গলে গিয়ে শান্তিতে বসবাস করি। অতএব, কথা বলতে একটু হুঁশ করে বলা উচিত। মুখে বা মনে যা এলো তা বলে ফেলা একটা ছাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়।
পতিত স্বৈরাচারের কান্ডারী শেখ হাসিনা নিজেকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে জাহির করে পুলকিত হতেন। বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় তার নামের আগে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ বলাটা নাকি সব নেতাদের জন্য ছিল বাধ্যতামুলক। এটা তার নির্দেশ। ২০১৪, ২০১৮ আর ২০২৪ এর জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে গায়ের জোরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা মানুষটাই গণতন্ত্রের মানসকন্যা। এখন সেই গণতন্ত্রের মানসকন্যার স্বরূপ বেরিয়ে আসছে একে একে। এখনতো সব তথ্যই বেরিয়ে আসছে আস্তে আস্তে। সাবেক সিইসি স্বীকার করেছেন, আগের রাতেই ভোটের বাক্স ভরে রাখার নির্দেশ তিনিই দিয়েছিলেন। সাবেক পুলিশ প্রধানও স্বীকার করেছেন, হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার নির্দেশ তিনিই দিয়েছিলেন। বালুভর্তি ট্রাক আর গোপালী পুলিশ দিয়ে খালেদা জিয়ার বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথ যিনি আটকে রেখেছিলেন তিনিই। তিনি নাকি গণতন্ত্রের মানসকন্যা। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় প্রায়শই ২০৪৯ সালের কথা বলতেন। হয়তো তার স্বপ্ন ছিল যে প্রকারেই হোক ২০৪৯ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। তখন তার বয়স হতো ১০০ বছর। তিনি হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন যে তিনি ওই পর্যন্ত বাঁচবেন এবং সাধারণ ‘পাবলিক’ নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই সর্গে প্রবেশ করবেন। আচ্ছা, তিনি কি আজরাইল (আঃ) কেও ম্যানেজ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন? প্রশ্ন জাগে। কিন্তু বিধি বাম। পৃথিবীতে অন্যায় অবিচার অনিয়ম বর্বরতা নৃশংসতা চালিয়ে আজীবন টিকে থাকা যায় না। তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন, মহান সৃষ্টিকর্তা বলে একজন আছেন সবার ওপরে। তার ইশারায়ই পৃথিবীর সবকিছু পরিচালিত হয়ে আসছে। তিনি মাঝে মধ্যে কাউকে কিছুটা ছাড় দেন হয়তো, কিন্তু একেবারে ছেড়ে দেন না। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা এখনো চারদিকে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছে। সুযোগ পেলেই বিষধর সাপের মতো- ছোবল মারতে নানা কলাকৌশল প্রয়োগ করছে। এখন ছাত্র-জনতার দৌড় খেয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়ে আবারও এই গণতন্ত্রের মানসকন্যা নানা গণতান্ত্রিক- উপায় খুঁজে বের করছেন ক্ষমতায় ফেরার জন্য। প্রথমে তিনি আশা করেছিলেন, প্রতিবেশী দেশের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে আবার যেকোনোভাবেই হোক ক্ষমতা ফিরে পাবেন। ভিন দেশের সরকার তাকে ঘাড়ে করে বাংলাদেশে নিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে যাবেন। সেটাতে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি ফন্দি করছিলেন, বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সবাইকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিয়ে আবার তাকেই প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসিয়ে দেবেন। সম্প্রতি পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যেখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত গণতন্ত্রের শত্রু আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণসহ সেনাবাহিনীর কারও সহযোগিতা নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, আতঙ্ক, ভয়ংকর সব ঘটনা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিস্থিতি অশান্ত করে তোলার ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ পেয়েছে। দেশের আপামর জনসাধারণের বিরুদ্ধে গিয়ে আবার ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্নে বিভোর পতিত স্বৈরাচারের নেত্রী শেখ হাসিনার উচ্চাভিলাসী ভাবনা দেখে অবাক হয়ে গেছি আমরা। তার স্মরণ রাখা উচিত, যে যায় সে আর ফিরে না এত সহজে। আফগান বাদশাহ ফিরেনি, ইরানের শাহ ফিরেনি, ফিলিপাইনের মার্কোস ফিরেনি, তিনিও ফিরবেন না। তার প্রতি অনুরোধ, অনুসারীদের সুপরামর্শ দিন, বলুন পজিটিভ হতে, দেশ-সেবা করতে চাইলে ভালো বিকল্প বেছে নিতে।
এই সময়ে চারদিকে নানা ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে গণতন্ত্রের শত্রুরা। তারা একেরপর এক ঘটনার জন্ম দিয়ে নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। এ ব্যাপারে সরকারকে যেমন সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। তেমনিভাবে সকল ফ্যাসিস্টবিরোধী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সাধারণ জনগণের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার নেই কারও। আমরা সবাই একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ সুন্দর নির্বাচনের জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছি। অতীতে পতিত স্বৈরাচার পরপর তিনটি কলঙ্কজনক নির্বাচন করে দেশে-বিদেশে নিন্দিত হয়েছেন। আমরা সেই নষ্ট , কলঙ্কিত নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। সে জন্য দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সুন্দর ও নিরাপদ রাখতে হবে। অতএব, কান্ডারী হুঁশিয়ার। কোনোভাবেই ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী দুঃশাসন আর ফিরে আসতে না পারে সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার , কলাম লেখক।
২০০৮ এর ২৯ ডিসেম্বর থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪। সুদীর্ঘ এই সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি, অপশাসনের নতুন রাজত্ব সৃষ্টি করা আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় এখন কার্যত অবাঞ্ছিত, নিষিদ্ধ। বিশেষ করে ৫ আগস্ট বাংলাদেশের মাটিতে হাজারও ছাত্র জনতার বুকের রক্ত ঝরানো আওয়ামী লীগকে দেশের সাধারণ মানুষ সম্মিলিত গণঅভ্যুত্থানে ছুড়ে ফেলেছে ঘৃণার সাগরে। ছুড়ে ফেলেছে শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদে থাকা অপরাজনীতির দোসরদের। দেশের মাটিতে তাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখন অপ্রাসঙ্গিকই নয় বরং জনধিকৃতও বটে। তবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিনের এই ফ্যাসিস্ট দলটিকে সমর্থন না জানালেও শেখ হাসিনা ও তার প্রভাবশালী নেতাদের আশ্রয় দেওয়া ভারত নিজেদের রক্ষায় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগকে। বাংলাদেশে বসে ভারতের ছত্রছায়ায়, ভারতীয় নীতি করা আওয়ামী লীগ এখনো রাজনীতি করছে ভারতেরই প্রত্যক্ষ সহায়তা এবং মদদে।
দেশের মাটিতে ঘৃণার প্রতীক হয়ে উঠলেও, শেখ হাসিনা এবং তার ঘনিষ্ঠ নেতৃত্ব ভারতীয় আশ্রয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই রাজনৈতিক আশ্রয়গ্রহণ একদিকে যেমন প্রশ্ন তোলে ভারতের নৈতিক অবস্থান নিয়ে, অন্যদিকে তা বাংলাদেশের জাতীয় সার্বভৌমত্বকেও করে প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ শেখ হাসিনা এবং তার দল যে কৌশলে ভারতের ছায়াতলে থেকে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে, সেটি কেবল আশ্রয়ের গল্প নয়, বরং একটি পরিপূর্ণ ভূরাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ।
সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, কলকাতার উপনগরীর এক বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি ‘পার্টি অফিস’ খুলে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অফিসটির আকার ছোট মাত্র ৫০০-৬০০ স্কয়ার ফুট। কোনো সাইনবোর্ড নেই, বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার কোনো ছবি নেই, এমনকি দলীয় দপ্তরের ফাইলপত্রও নেই। সবকিছুই অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যেন দলটির অস্তিত্ব সেখানে দৃশ্যমান না হয়। এ যেন এক ধরনের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড অপারেশন’, যার মাধ্যমে ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী নেতারা দলকে সংগঠিত করার কাজ করছেন।
ভারতে আওয়ামী লীগের এই ‘পার্টি অফিস’ শুধু ভবিষ্যতের প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা নয়, বরং এটি ভারতের একটি কৌশলগত দাবার চাল, যার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে নিজেদের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ খুঁজছে। স্বাধীন দেশের একটি রাজনৈতিক দল যদি অন্য দেশের মাটিতে গিয়ে কর্মকাণ্ড চালায়, তবে সেটি কি কেবল আত্মরক্ষার কৌশল, নাকি একটি বৃহৎ আগ্রাসী রাজনীতির অংশ? এই প্রশ্ন এখন বাংলাদেশি জনগণের মনে গভীরভাবে দাগ কাটছে। যারা ১৯৭১ সালে ভারতের সহযোগিতাকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করেছিলেন, তারাই আজ প্রশ্ন তুলছেন, ভারত কি সত্যিই বাংলাদেশের বন্ধু, না কি এক বিকাশমান শাসক?
আওয়ামী লীগের কলকাতা অফিস কার্যত একটি ‘পলিটিক্যাল এক্সাইলের দৃষ্টান্ত। এটি ইঙ্গিত দেয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত একটি সরাসরি পক্ষ হয়ে উঠেছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের কিছু অংশ এ ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে প্রচার করছে। তাদের যুক্তি, ‘আওয়ামী লীগ হচ্ছে ভারত-বান্ধব দল, আর কলকাতা হচ্ছে বাঙালির রাজধানী। তাই এখানে তাদের পার্টি অফিস থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।’ কিন্তু এই ব্যাখ্যা রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। এটি কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের নামান্তর। কোনো স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক দল অন্য দেশের ভেতরে সংগঠিতভাবে কার্যক্রম চালাতে পারে না। এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির মৌলিক নীতি। ভারত যদি সত্যিই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হয়, তবে তাদের উচিত ছিল এই ধরনের অফিস চালানোর অনুমতি না দেওয়া।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ভারতে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগের নেতারা মূলত কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, মেয়র, জেলা পর্যায়ের নেতা, এমনকি অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তারাও। কেউ কেউ সপরিবারে, কেউ বা কয়েকজন মিলে একটি ফ্ল্যাটে বাস করছেন। আনুমানিক ৮০ জন সাবেক সংসদ সদস্যসহ প্রায় ২০০ জন আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তি এখন কলকাতায় রয়েছেন। এই সংখ্যা সময়ের সঙ্গে হয়তো আরও বাড়বে।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং ভারতনির্ভর পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে জনগণের জাগরণ। এই আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল ভারতের প্রভাবমুক্ত, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। অথচ সেই প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, পরাজিত সরকারদল বিদেশে গিয়ে ‘শরণার্থী রাজনীতি’ করছে, তখন জনগণের আশঙ্কা আরও দৃঢ় হয় এই দলটি শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নয়, সার্বভৌমত্বকেও বিকিয়ে দিতে প্রস্তুত।
ভারতের আগ্রাসনের রাজনীতি নতুন কিছু নয়। দেশের জলসীমায় আগ্রাসন, সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না দেওয়া, বাজার দখল, ট্রানজিট, এমনকি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ এসবই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ভারত যেন একটি ‘ডিপ্লোম্যাটিক প্রক্সি’ তৈরি করেছিল। তারা জানত, এই দল ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণ ভারতের পক্ষে থাকবে। তাই আওয়ামী লীগের পতনের পর ভারত সরকার উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। আর সেই উৎকণ্ঠা থেকেই এই ‘কলকাতা অফিস’ যা এক অর্থে ভারতীয় ভূরাজনীতির নিরাপত্তা বলয়ের অংশ।
বাংলাদেশের জনগণ আজ সচেতন। তারা ১৯৭১ সালে ভারতের ভূমিকার মূল্যায়ন করতে জানে, আবার দীর্ঘ ৫০ বছর দেশের অভ্যন্তরে ভারতের হস্তক্ষেপকেও অনুধাবন করতে শিখেছে। আর কলকাতায় আওয়ামী লীগের ‘পার্টি অফিস’ জনগণের কাছে এক ভয়ংকর বার্তা বহন করছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো এক বিদেশি শক্তি সক্রিয় থাকতে চায়, যেটি গণতন্ত্র নয়, বরং তাদের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে।
বছরের পর বছর ধরে ভারত নিজেদের বাংলাদেশের ‘বড় ভাই’ হিসেবে জাহির করে আসছে। অথচ সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যা, বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার অস্বীকার, এবং রাজনৈতিকভাবে অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা এই ‘বড় ভাই’-এর মুখোশ খুলে দিয়েছে। কলকাতায় ‘পার্টি অফিস’ খোলা এই আগ্রাসনেরই নতুন রূপ একটি সফট কূটনৈতিক অভিযান, যার মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটি অনুগত রাজনৈতিক শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
ভারত সরকারের স্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া এই ধরনের রাজনৈতিক দপ্তর পরিচালনা অসম্ভব। অর্থাৎ ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ ও গোয়েন্দা তদারকির মধ্য দিয়েই কলকাতার মাটিতে বাংলাদেশের একটি বিতাড়িত রাজনৈতিক শক্তি টিকে রয়েছে। এটি ভারতের ভূরাজনৈতিক কৌশলেরই অংশ যেখানে বাংলাদেশে তাদের একক অনুগত শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই উদ্দেশ্য। ভারত অতীতে সীমান্ত হত্যা, পানিবণ্টনে বৈষম্য, ট্রানজিট ও অর্থনৈতিক নির্ভরতার মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। এবার তাদের নতুন কৌশল হচ্ছে সরাসরি রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে নিজেদের অনুগত শক্তিকে টিকিয়ে রাখা।
আওয়ামী লীগ ভারতে বসে রাজনৈতিক বৈঠক করছে, ভার্চুয়ালি নেতা-কর্মীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে, হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামে দল পরিচালিত হচ্ছে। শেখ হাসিনা দিল্লির উপকণ্ঠে থাকলেও মাঝে মধ্যে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। সর্বশেষ বৈঠকটি হয়েছিল ৩১ জুলাই। এইসব আয়োজন প্রমাণ করে, দলটির মূল নেতৃত্ব এখন দেশের বাইরে, কিন্তু রাজনৈতিক অভিসন্ধি থেকে সরে আসেনি।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও আওয়ামী লীগের এই অবস্থান অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সাধারণ কর্মীরা দেশে দমন-পীড়নের শিকার হলেও শীর্ষ নেতারা ভারতে নিরাপদে অবস্থান করছেন এটি সাংগঠনিক নৈতিকতার দিক থেকেও প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও পঙ্কজ দেবনাথের মতো নেতারা বলছেন, ‘জেলে গেলে বা মারা পড়লে সংগঠন গড়া যেত না।’ এই অবস্থান নিঃসন্দেহে বিতর্কিত। কারণ এটি দেশপ্রেম নয়, বরং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার এক চাতুর্যপূর্ণ প্রয়াস।
অর্থনৈতিকভাবে এই সংগঠনের ভার বহন করা হচ্ছে তথাকথিত ‘শুভাকাঙ্ক্ষীদের’ সহায়তায়। এই অর্থায়ন কতটা স্বচ্ছ তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
কলকাতায় আওয়ামী লীগের এই ‘পার্টি অফিস’ শুধু একটি রাজনৈতিক দপ্তর নয়, এটি ভারতের ভূরাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকির জীবন্ত প্রতীক। ভারতের সরকারি অনুমোদনে এই অফিসের মাধ্যমে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ ও পুনর্গঠন চলছে। বিদেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা কোনো সার্বভৌম দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি দেশের স্বাধিকার ও নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
কবি, লেখক মিডিয়া ব্যক্তি
সাদা পাথর এলাকা আজ মরুভূমি। আমরা নতুন প্রজন্ম প্রাকৃতিক এই মহামূল্যবান সম্পদ ধরে রাখতে পারলাম না। কিছু রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতার কারণে সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এলাকা আজ মরুভূমিতে রূপ নিয়েছে। গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে এই অপার সৌন্দর্যের প্রাকৃতিক সম্পদকে। তথাকথিত সভ্য সমাজ প্রকৃতির সঙ্গে এমন আচরণ করেছে, যেন প্রকৃতি কেবল ভোগের বস্তু।
নিজ দেশের সৌন্দর্য রক্ষা ও উন্নয়নে নাগরিকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে তবেই আমরা আমাদের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যকে আগামীর জন্য বাঁচিয়ে রাখতে পারব।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্ত সিলেট একটি ভূখণ্ড, যা প্রকৃতির উদার দান, পাহাড়-নদী-ঝর্ণার অপার মেলবন্ধন, চা-বাগানের সবুজ সমারোহ, সীমান্তের পাহাড়ি বাতাস আর মানুষের আন্তরিক আতিথেয়তা মিলিয়ে একটি অনন্য সৌন্দর্যের আঁধার। এই সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ ছিল এমনই এক প্রাকৃতিক রত্নভাণ্ডার, যেখানে ধলাই নদীর স্বচ্ছ জল, সাদা পাথরের স্তূপ আর মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণাধারার মিলনে সৃষ্টি হয়েছে অপরূপ দৃশ্যপট। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য এটি ছিল যেন এক ভূ-স্বর্গীয় গন্তব্য।
কিন্তু আজ, সেই ভোলাগঞ্জ সাদা পাথরের চিত্র দেখে শিউরে উঠতে হয়। একসময়ের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখন ধূলিধূসর মরুভূমির মতো। নদীর বুক ফাঁকা, পাথরের স্তূপ নেই, স্বচ্ছ জল ঘোলা, তলদেশে সৃষ্টি হয়েছে গভীর গর্ত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া আগের ও বর্তমান ছবির তুলনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমরা নিজেরাই প্রকৃতির গলা টিপে হত্যা করছি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অসংখ্য ভিডিও যেন প্রমাণ দিচ্ছে সিলেটের ভোলাগঞ্জে সাদা পাথর এখন আর প্রকৃতির অলঙ্কার নয়, লুটেরাদের লোভের শিকার। ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, জিরো পয়েন্টে খোঁড়াখুঁড়ি করে পাথর তোলা হচ্ছে নির্বিচারে। ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে লুটেরাদের মধ্যে হাতাহাতি এমনকি মারামারির ঘটনাও ঘটছে প্রকাশ্যে।
ধলাই নদীতে দিনের আলো কিংবা গভীর রাত সময় যেন কোনো বাধা নয়। প্রভাবশালী একটি চক্র শত শত বারকি নৌকা ভরে তুলছে পাথর। এমন প্রভাব যে, স্থানীয় মানুষ মুখ খুলতে ভয় পান; প্রশাসনের নীরবতা ও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় এই বেপরোয়া কর্মকাণ্ডকে আরও বেগবান করে তুলেছে। মাসের পর মাস ধরে চলা এই অবৈধ উত্তোলনে নদীর তলদেশে সৃষ্টি হয়েছে গভীর গর্ত, ব্যাহত হয়েছে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ, আর পাথরশূন্য তীরে ভোলাগঞ্জ হারাচ্ছে তার প্রাকৃতিক রূপ।
গত বছরের ৫ আগস্ট থেকেই সাদা পাথরে লুটপাটের সূত্রপাত, তবে গত দুই সপ্তাহে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে চলছে এই লুটপাট; তবে অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরাও নেপথ্যে রয়েছে। সরকার পতনের পর চিত্রটি হয়েছে আরও ভয়াবহ। পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে ভেসে আসা পাথর লুটে চলছে প্রতিযোগিতা, বাদ যাচ্ছে না ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বাঙ্কার এলাকাও। লুটেরাদের তালিকায় রাজনৈতিক রঙের ভেদাভেদ নেই চাঁদাবাজির ধরন বদলে গিয়ে সব পক্ষ মিলে ভাগ বসাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদে।
গত দুই-তিন মাসে দিন-রাত মিলিয়ে অন্তত হাজারের বেশি বারকি নৌকা ব্যবহার করে পাথর লুট হয়েছে। পুলিশের ভূমিকাও ছিল প্রায় নিষ্ক্রিয় যেন তারা শুধু দর্শকের আসনে।
শ্রমিকদের কার্যক্রমও ভয়াবহ চিত্র আঁকে। দিনরাত সমানতালে হাজার হাজার শ্রমিক কোদাল, বেলচা, শাবল ও টুকরি নিয়ে কোয়ারি ও আশপাশের এলাকা থেকে মাটি খুঁড়ে পাথর তুলছেন। পরে বারকি নৌকায় করে সেই পাথর মিল মালিকদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মেশিনে পাথর ভেঙে ছোট করা হয় এবং ট্রাক-পিকআপে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয় যেন এই ধ্বংসযজ্ঞের কোনো শেষ নেই।
ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর ধ্বংসের এই লুটযজ্ঞ কেবল সৌন্দর্যের ক্ষতি নয়; এটি এক গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত সংকটের জন্ম দিচ্ছে। নদী, পাহাড়, জলজ প্রাণী এবং মানুষের জীবন সবই এই বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে।
প্রথমত, নদীর তলদেশে গভীর গর্ত তৈরি হওয়ায় ধলাই নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পানির গতি ও দিক পরিবর্তনের ফলে বন্যা ও ভাঙনের ঝুঁকি আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বর্ষাকালে অতিরিক্ত স্রোতে তীর ভাঙন ও বসতভিটা হারানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়, যা স্থানীয় মানুষের নিরাপত্তা ও বসবাসের স্থায়িত্বকে হুমকির মুখে ফেলে।
দ্বিতীয়ত, জলজ প্রাণীর স্বাভাবিক বাসস্থান ধ্বংস হচ্ছে। নদীর পাথরশয্যা মাছ ও অন্যান্য জলজ জীবের প্রজনন ও আশ্রয়ের জন্য অপরিহার্য। পাথর হারিয়ে যাওয়ায় তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল বিলীন হচ্ছে, ফলে জীববৈচিত্র্য দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব নদীর সম্পূর্ণ খাদ্যচক্রে পড়ছে যা শেষ পর্যন্ত মানুষের খাদ্য ও অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করছে।
তৃতীয়ত, ধলাই নদীর স্বচ্ছতা হারিয়ে জলদূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাথর উত্তোলনের সময় নদীর তলদেশ থেকে মাটি, বালি ও কাদা উঠে এসে পানিকে ঘোলা করে তোলে। এর ফলে পানির মান নষ্ট হয়, নদী ব্যবস্থার প্রাকৃতিক স্বচ্ছতা ও সৌন্দর্য হারিয়ে যায়, আর পানি ব্যবহারের যোগ্যতা কমে যায়।
চতুর্থত, পর্যটনশিল্পের উপর বিরূপ প্রভাব মারাত্মক আকার ধারণ করছে। একসময় যেখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় থাকত, এখন সেখানে হতাশা ও বিমুখতা। পর্যটক না আসায় হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ, নৌকা ভাড়া, স্থানীয় গাইড, হস্তশিল্প বিক্রেতা সবাই অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছে। শতাধিক পরিবার, যারা পুরোপুরি এই পর্যটন নির্ভর জীবিকার সঙ্গে জড়িত, তারা এখন বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
সব মিলিয়ে, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরের এই ধ্বংসযজ্ঞ একটি পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমাজ সবক্ষেত্রের সমন্বিত বিপর্যয়। প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানকে ধ্বংস করে যে উন্নয়ন সম্ভব নয়, তা এই উদাহরণ আমাদের স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও এই অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়নি। প্রশ্ন ওঠে প্রশাসন কি অসহায়, নাকি প্রভাবশালীদের চাপে নীরব?
ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর কেবল একটি পর্যটন স্পট নয়; এটি একটি জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদ ধ্বংস করা মানে জাতীয় ঐতিহ্যের অপচয়। টেকসই সমাধানের প্রয়োজন
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার - ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয় এটি সিলেটের জীববৈচিত্র্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। অথচ অবৈধ উত্তোলন ও পরিবেশ ধ্বংসের কারণে এই অনন্য সম্পদ মারাত্মক হুমকির মুখে। এখনই কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে, অদূর ভবিষ্যতে এই অঞ্চল হারিয়ে যাবে আমাদের চোখের সামনে।
ভোলাগঞ্জ ও এর আশপাশের অঞ্চলকে ‘সংরক্ষিত প্রাকৃতিক অঞ্চল’ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। এতে করে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনুমতি ছাড়া পাথর উত্তোলন, ভূমি খনন বা পরিবেশ বিনষ্টমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে না।
প্রভাবশালী চক্রের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ শুধু অভিযান চালানো নয়, বরং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ একই অপরাধ করার সাহস না পায়।
পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত হাজারো শ্রমজীবী মানুষ হঠাৎ বেকার হয়ে পড়লে সামাজিক সংকট সৃষ্টি হবে। তাই তাদের জন্য বিকল্প আয়ের পথ, যেমন ইকো-ট্যুরিজম, হস্তশিল্প, বা কৃষিভিত্তিক প্রকল্প চালু করতে হবে।
ভোলাগঞ্জকে একটি পরিবেশবান্ধব পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে নিয়ন্ত্রিত পর্যটন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ অবকাঠামো এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের মাধ্যমে।
প্রকৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষকেই অভিভাবক হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি। তারা যদি সরাসরি পর্যটন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত হয়, তাহলে নিজেদের স্বার্থেই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় এগিয়ে আসবে।
পর্যটন কেবল বিনোদনের একটি মাধ্যম নয়; এটি একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ইঞ্জিন। সিলেটের পর্যটন খাত বছরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করতে সক্ষম, যদি প্রাকৃতিক সম্পদগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করা হয়। ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর শুধু স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক পর্যটন মানচিত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ।
বিদেশি পর্যটকরা কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেই আসেন না তারা নিরাপত্তা, অবকাঠামো, পরিবেশের স্থায়িত্ব, এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণকেও মূল্যায়ন করেন। যদি এই অনন্য প্রাকৃতিক দৃশ্য হারিয়ে যায়, তবে সিলেটের পর্যটন আয় ও কর্মসংস্থান উভয় ক্ষেত্রেই বড় ধাক্কা লাগবে। প্রায় হাজার হাজার মানুষ, যারা পর্যটন নির্ভর হোটেল, রেস্টুরেন্ট, নৌকা সেবা, গাইডিং এবং হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ভোলাগঞ্জ হারিয়ে গেলে শুধু সিলেট নয়, সমগ্র বাংলাদেশের পর্যটন মানচিত্রে একটি বড় শূন্যতা তৈরি হবে, যা দেশের অর্থনীতিতেও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রকৃতি আমাদের শত্রু নয় সে আমাদের জীবনদাতা, আশ্রয়দাতা, এবং সংস্কৃতির ধারক। আমরা যদি প্রকৃতিকে রক্ষা না করি, তবে একদিন প্রকৃতিও আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর ধ্বংস হওয়া মানে কেবল একটি মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক স্থান হারানো নয় এটি আমাদের পরিবেশ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি এক অমার্জনীয় অপরাধ।
এখনই সময় কঠোর আইন প্রয়োগ, স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং টেকসই পর্যটন নীতি বাস্তবায়নের। নয়তো অদূর ভবিষ্যতে ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর শুধু পুরনো ছবিতে, গল্পে, আর আক্ষেপে বেঁচে থাকবে যেখানে আমরা গর্বের পরিবর্তে অপরাধবোধ অনুভব করব।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট
সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি পুরনো স্থাপনা ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়েছে। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা পুরনো স্থাপনাটি ময়মনসিংহ শহরের হরি কিশোর রায় রোডের একটি বাড়ি- যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাপিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও দাবি করা হয়েছে এটি কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের বসতভিটা। যা ভেঙ্গে ফেলার খবরটি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। যেখানে আশ্রয় নেয়া হয়েছে শ্রুতিকথা, আবেগ, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। যার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে আমাদের ইতিহাসচর্চার করুণ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক; যাচাই-বাছাইহীন ঐতিহাসিক দাবি, সামাজিক আবেগের সংঘর্ষ, তর্ক পাল্টা তর্ক আর অপতথ্যের ছড়াছড়ি। যা নিয়ে তৈরি হয়েছে দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়া। বাস্তবতার ভিত্তিতে এই নিবন্ধে বিষয়টির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বিভ্রান্তির উৎস, সরকারের অবস্থান এবং বৃহত্তর সাংস্কৃতিক শিক্ষা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি।
ঐতিহাসিক বাস্তবতা
ইতিহাস থেকে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলায় অবস্থিত মসূয়া জমিদার বাড়ি হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটা। এটি হরিকিশোর রায় চৌধুরীর জমিদার বাড়ি ছিল। তার আদি বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ জেলায়। তৎকালীন সময়ে জমিদারিতে অনেক প্রভাব থাকলেও মনে তার শান্তি ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। পরবর্তীতে বড় ভাই কালীনাথ দেব ওরফে শ্যামসুন্দর দেব ও জয়তারা দেবীর পুত্র কামদারঞ্জনকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন জমিদার হরিকিশোর রায়। জমিদারি প্রথা টিকিয়ে রাখতে দত্তক পুত্র কামদা রঞ্জনের নাম পরিবর্তন করে নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখেন উপেন্দ্র কিশোর রায়। পরবর্তীকালে জমিদার হরি কিশোর রায়ের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। যার নাম রাখা হয় নরেন্দ্র কিশোর রায়। লেখাপড়ায় মনোযোগী উপেন্দ্র কিশোর রায়কে পড়ালেখায় স্বাবলম্বী করতে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ভর্তি করানো হয়। সেখানে হরিকিশোর রায়ের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। এখনো তার নিজ নামের একটি রাস্তা সে ইতিহাস বহন করে চলছে।
দ্বারকানাথ ও কাদম্বিনীর একমাত্র কন্যা সন্তান বিধুমুখীকে ১৮৮৩ সালে বিয়ে করেন উপেন্দ্রকিশোর রায়। তাদের বৈবাহিক জীবনে ১৮৮৭ সালে ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন দ্বিতীয় সন্তান সুকুমার রায়। জন্মের পর থেকেই পিতার সকল গুণাবলিই বিদ্যমান ছিল তার মধ্যে। ১৯১৩ সালের গোড়ার দিকে সুকুমার রায় ঢাকার খ্যাতনামা সমাজসেবক কালী নারায়ণ গুপ্তের কন্যা সুপ্রভাকে বিয়ে করেন। বৈবাহিক জীবনের আট বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯২১ সালে ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তিনি একবারই বাংলাদেশের ঢাকায় এসেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত মুখ্য সচিব এবং রায় পরিবারেরই সন্তান প্রসাদরঞ্জন রায় ‘ময়মনসিংহ ও উপেন্দ্র কিশোর’ শিরোনামে কালি ও কলম পত্রিকায় ২০১৪ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেন ‘উপেন্দ্র কিশোর ১৮৯৮ সালে ভূমিকম্প ও প্লেগের মহামারির পর একবার, ১৯০৫-০৬ সালে সম্পত্তি ভাগাভাগি করতে একবার, ১৯১১ সালের শেষে একবার আর সম্ভবত সুকুমারের বিবাহের পর একবার দেশে গিয়েছিলেন। দেশের সঙ্গে তার যোগসূত্র ক্ষীণ হয়ে আসছিল।’ শুধু উপেন্দ্রকিশোরের নয়, তার পরিবারের আর কারও সঙ্গেই মসূয়ার সম্পর্ক আর বহাল থাকেনি। তিনি আরও লিখেছেন: ‘১৯২৬ সালেই গড়পারের বাড়ির সঙ্গে এবং মসূয়ার জমিদারির সঙ্গে সম্পর্কের শেষ। যদিও হরি কিশোরের বংশ ধরদের কেউ কেউ বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছেন মসূয়ায়। তবে উপেন্দ্র কিশোর-সুকুমারের বংশ ধরদের সঙ্গে মসূয়ার সম্পর্ক সেই শেষ।’ উপেন্দ্র কিশোরের মূল যে ভিটা, সেই মসূয়ার জমিদারবাড়ি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় বর্তমানে সংরক্ষিত আছে। যদিও সেই জমিদারবাড়ির সংস্কার ও সংরক্ষণেও যথাযথ উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে।
ময়মনসিংহের প্রত্নতত্ত্ব গবেষক স্বপন ধর সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ভবনটি সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের বাড়ি নয়। এই ভবনটি বাংলাদেশের বিশিষ্ট সমাজসেবক, জমিদার ও দানবীর ব্যক্তিত্ব রণদা প্রসাদ সাহা (যিনি আর.পি সাহা নামে অধিক পরিচিত) এর একটি অস্থায়ী বাসভবন ছিল; যিনি কুমুদিনী হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস, কমুদিনী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। ভবনটি মূলত উনিশ শতকের শেষভাগ বা বিশ শতকের প্রথম দিকে নির্মিত হয়। এটি পূর্বে স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র (Old DC Power Station বা ‘বিদ্যুৎ কল’) হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যা ১৯২০-এর দশকে শুরু হয়ে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রণদা প্রসাদ সাহার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রণদা প্রসাদ সাহার মৃত্যু হয় এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সংশ্লিষ্ট ভবন সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৮৭ সালে সরকার এটি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির জন্য লিজ প্রদান করে। লিজ নেয়ার পর ভবনটি শিশু একাডেমির কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যবহার করা হলেও দীর্ঘ সময় ব্যবহৃত হওয়ার ফলে কাঠামোগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ২০০৭ সালে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ও অনুপযোগী হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
বিতর্কের সূচনা
২০২৪ সালের শেষ দিকে ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়ায় একটি পুরনো ভবন ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয় স্থানীয় প্রশাসন। ভবনটি আগে শিশু একাডেমি ব্যবহার করত (১৯৮৭-২০০৭)। ভবনটি পরিত্যক্ত এবং দীর্ঘদিন অব্যবহৃত ছিল। ভাঙার আগে একজন স্থানীয় লেখক ও ইতিহাসপ্রেমী সামাজিক মাধ্যমে দাবি করেন, এটি উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর পূর্বপুরুষদের বাড়ি এবং ঐতিহাসিকভাবে সংরক্ষণযোগ্য। এই দাবিটি বিভিন্ন মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কিছু সংবাদমাধ্যম যাচাই না করেই ‘সত্যজিৎ রায়ের দাদার ভিটা ভেঙে ফেলা হচ্ছে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ফলাফল— সামাজিক মাধ্যমে জনরোষ, ইতিহাস সংরক্ষণের দাবিতে প্রতিবাদ এবং সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা ছড়াতে থাকে। যা বাংলাদেশে খুব সহজসাধ্য কাজ; তবে সত্য যাচাই করে প্রকৃত ঘটনা জানতে আমাদের বড় অনাগ্রহ! বাস্তবতা হচ্ছে ময়মনসিংহ শহরের এক সময়কার ধনাঢ্য ব্যক্তি হরি কিশোর রায় এর নামানুসারে হরি কিশোর রায় রোড নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়। যার ৩য় লেনের একটি বাড়ি তিনি দত্তক পুত্র উপেন্দ্র কিশোর রায় এবং নরেন্দ্র কিশোর রায়ের নামে বণ্টন করে দেন। উপেন্দ্রকিশোর স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে গেলে বাড়িটি পরবর্তীতে নরেন্দ্রকিশোর বিক্রি করে দেন।
প্রকৃত তথ্য
ময়মনসিংহের বাংলাদেশ শিশু একাডেমির বাড়িটি হরি কিশোর রায় রোডের প্রথম লেনসংলগ্ন; যার প্রকৃত মালিক জমিদার শশিকান্ত বা মহারাজা শশিকান্ত আচার্য্য- যা তিনি রণদা প্রসাদ সাহাকে ব্যবহারের জন্য দান করেন। রণদা প্রসাদ সাহা ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাড়িটি ব্যবহার করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মৃত্যুবরণ করলে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকার তা অধিগ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে সরকার কর্তৃক শিশু একাডেমিকে লিজ হিসেবে দেয়া হয়। অপরদিকে হরি কিশোর রায় রোডের ৩য় লেনের অপর একটি বাড়ি- যা হরিকিশোর রায়ের বাড়ি বা পূর্ন্যলক্ষ্মী ভবন নামে পরিচিত; এই বাড়িটিই সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ উপেন্দ্রকিশোর রায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।
রাষ্ট্রীয় অবস্থান
ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং দেশি বিদেশি প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্রের ভাষ্যমতে, বিভিন্ন সূত্র, আর্কাইভ, এবং ভূমি রেকর্ড বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে— ময়মনসিংহের উক্ত ভবনের সঙ্গে সত্যজিৎ রায় বা তার পূর্বপুরুষদের কোনো সংযোগ নেই। সরকারি ভূমি রেকর্ড এবং জমির মালিকানা দলিলপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ওই বাড়ির সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বাড়িটি স্থানীয় জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে নির্মিত হয়েছিল এবং পরে সরকারের নামে রেজিস্ট্রেশন হয়। যাতে স্পষ্ট হয় গণমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমে ছড়ানো খবরটি ছিল ভুল ও বিভ্রান্তিকর।
পরিশেষে বলা যায়, ময়মনসিংহের বাড়িটি সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের নয়—এটি নিশ্চিতভাবে সরকারি রেকর্ড ও প্রশাসনিক পর্যবেক্ষণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে। তবে এই ঘটনার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, শুধুমাত্র বিশ্বাস বা শ্রুতিকথা নয়—ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে দরকার দলিল, গবেষণা ও দায়বদ্ধতা। একইসঙ্গে প্রশাসনের উচিত, এমন বিতর্কিত ক্ষেত্রে প্রথমেই স্বচ্ছতা ও তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে জনমতকে আস্থায় আনা।
*প্রাবন্ধিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক। সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিষয় হলো নির্বাচন। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এমনকি এ তথ্য নিশ্চত হওয়া গেছে যে স্থানীয় সরকার নয়, বরং সংসদ নির্বাচন ঘিরে পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছে সাংবিধানিক এই সংস্থা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এবং সরকারের ভেতর নির্বাচন নিয়ে টানাপড়েন কাটছে না। এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে- সেটিও অনুমান করা যাচ্ছে না।
নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান কেমন হবে এবং নতুন রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে নির্বাচনে যাবে সে বিষয়ে কোনো পরিষ্কার ধারণা করা যাচ্ছে না। তরুণ এবং ছাত্রদের নেতৃত্বে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা শেষ করেছে। তারা কীভাবে মনোয়ন দিবে সে বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত কোনো কিছু না জানালেও কোনো কোনো গণমাধ্যম সূত্রে আমর জেনেছি যে এনসিপি ৩০০ আসনেই প্রার্থীতা দিতে পারে। অবশ্য ইতিমধ্যেই বেশ কিছু আসনে অনানুষ্ঠঅনিকভাবে তাদের প্রার্থীতা ঘোষণা করতে দেখো গেছে। আর বিএনপি এবং জামায়াত আলাদাভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে- সে বিষয়ে স্পষ্ট মনে হচ্ছে।
সাধারণ জনগণ চায় দেশে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। দীর্ঘদিন জনগণ তাদেও অধস্থা নিয়ে নির্বাচনের মাঠে থাকতে পারেনি। এই মুহূর্তে জনগণের আকাঙ্ক্ষাই হলো একটি গ্রহণযোগ্য এবং অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইতিবাচক থাকলে জনগণের আস্থার মাত্রাও অধিক ইতিবাচক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে জনগণের আস্থা অনেকাংশে বেড়ে যায়। এবারের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় একটি বিষয় পরিষ্কার যে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা না থাকলে নির্বাচনে কোনোভাবেই বিজয়ী হতে পারবে না। কোনো প্রতীক বা দলের মনোয়ন কোনোভাবেই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মূল কার্ড হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ দেশে একটি বিরাট জনগোষ্ঠী তরুণ এবং সচেতন। তাদের বেশিরভাগ অংশই এবারই প্রথম ভোট দিতে যাবে।
নির্বাচনের আগেই কোনো রাজনৈতিক দলকে হারিয়ে দেয়ার মানসিকতা থেকেও সকল রাজনৈতিক দলকে বের হয়ে আসতে হবে। একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, বেশ কিছু রাজনৈতিক দল মোটামুটি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনমুখী জনসংযোগের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। কাজেই নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের রোডম্যাপ এমন হওয়া উচিত যাতে দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির মধ্য দিয়ে সকল সংকটের সুষ্ঠু সমাধান হয়।
ইতোমধ্যেই আমরা লক্ষ্য করেছি যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক প্রার্থী তাদের প্রচারণায় তৎপর হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় সকল পর্যায়ের নেতারা প্রচারণায় মনোযোগ দিয়েছে। আবার জোট গঠনের বিষয়েও যথেষ্ট তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরিস্থিতি এখন এমন হয়েছে যে, দেশের জনগণ সংস্কার প্রশ্নে নির্বাচন আটকে থাকুক এমনটি আর চায় না। নির্বাচন আগে নাকি সংস্কার আগে- এই প্রশ্নে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটি এখন আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশের মানুষের যে প্রাণের আকাক্সক্ষা, ভোট কেন্দ্রে গিয়ে একটি ভোট দেওয়া, সেটা সত্যিকার অর্থে পূরণ হওয়ার চ্যালেঞ্জটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা সত্য যে, নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, তাদের কাছে যে শক্তি, সাহস ও দক্ষতা থাকবে তা দিয়ে দেশের বিদ্যমান কাঠামোগত সমস্যার স্থায়ী সমাধান করার মানসিকতা থাকতে হবে। যেগুলো এ সরকারের (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, সেগুলো নির্বাচিত সরকার করবে- এমন প্রত্যাশা অনেকেই গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এখন আমরা দেখতে চাই যে, যেসব দল এবং প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেবে তারা সাধারণ জনগণের জন্য এবং দেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গে কী ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিতে যাচ্ছে। এমনকি কীভাবে দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা যায়, কীভাবে দেশের জনগণের চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করা যায়- সেসব বিষয়েও পরিষ্কার রোডম্যাপ আসলে ভোটারদের চিন্তা করতে সহজ হবে।
তাছাড়া দেশের মানুষ বিভিন্ন অনলাইন জরিপ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রকাশিত জনগণের মন্তব্যের মধ্য দিয়ে রাজনীতির বাস্তব চিত্র যাচাই করতে পারে। আর এসব চিত্র বাস্তবতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা যায়। এখন মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর বক্তব্যে কিংবা তথ্যে রাজনীতিতে লাভবান হওয়া কঠিন। এক কথায় বলা যায়, ধোঁকাবাজির রাজনীতি এখন আর নেই। একথা আমরা সবাই জানি, রাজনীতিতে আস্থা-অনাস্থা এবং বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটি অনেক বেশি। পাশাপাশি সন্দেহ-সংশয় তো আছেই। সাম্প্রতিককালে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য শুনলে মনে হয় রাজনীতিতে আস্থা এবং বিশ্বাস বলতে কিছু নেই। সকালে এক ধরনের বক্তব্য বিকেলে আবার আরেক ধরনের বক্তব্য দেখা যায়। দিন না ঘুরতেই যদি বক্তব্য এবং মতামত পরিবর্তন ঘটে, তাহলে মাস এবং বছর গেলে তাদের অবস্থান কেমন হবে বা হতে পারে - সেটি অনুমান করা কঠিন কিছু না।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সংকট ও অনাস্থার পরিবেশ নতুন নয়। অনাস্থার বেড়াজাল থেকে রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই বের হতে পারেনি। গণতন্ত্রের নামে এবং গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকারে রাজনৈতিক দলগুলো বারবারই রাজনৈতিক অনিশ্চিয়তার মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে এমনই এক অনিশ্চিয়তার দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছে বিদ্যমান রাজনীতি।
ধারণা করা যাচ্ছে যে, দেশে আসন্ন নির্বাচনকেন্দ্রিক সুনির্দিষ্ট নিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি না হলে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি ব্যাপকতর হতে পারে। এ জন্য একটি সুশৃঙ্খল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বর্তমানে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হলো নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া। আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সকল রাজনৈতিক দলই নিজস্ব কৌশল প্রয়োগে ব্যস্ত থাকবে- সেটি স্বাভাবিক। কৌশল প্রয়োগের দিক সকল দলই নিজ নিজ জায়গা থেকে সামনে এগিয়ে যাবে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেরুকরণ ঘটবে- এটি অস্বাভাবিক কিছু না। মূলত নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য রাজনৈতিক মেরুকরণে পরিবর্তন হতে পারে। তবে কোনো দল যদি রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজ নির্বাচনী আয়োজনের পক্ষে কাজে লাগানোর সুযোগ পায় অথবা কাজে লাগায় তাহলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সেটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সামনে আসবে। আর নির্বাচন কমিশনও প্রভাবিত না হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করলে নির্বাচন ও রাজনীতি দুটিই গ্রহণযোগ্য মাত্রা পাবে। আর এ কারণেই সকল পক্ষকে সমান সুযোগের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীদের প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’ কাজেই নির্বাচন কমিশনই প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। মূলত নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের ভূমিকার ওপরই সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্পর্ক রয়েছে। আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনটির তিনটি চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান হতে পারে। প্রথমত: নির্বাচনে বেশিরভাগ জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; দ্বিতীয়ত: সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান, তৃতীয়ত: ভবিষ্যতে সাধারণ জনগণের ভোটে অংশ নেয়ার বিষয়ে আগ্রহ এবং আস্থা সৃষ্টি করা। কারণ নির্বাচন যদি ভালো হয়, তাহলে নির্বাচনী রাজনীতিতে জনগণের আস্থা তৈরি হবে, আর ভালো না হলে তৈরি হবে স্থায়ী অনাস্থা।
তবে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই নিজেদের পথের কাঁটা হওয়া থেকে দূরে সরে আসতে হবে। দেশ ও জাতির উন্নয়ন করতে হলে রাষ্ট্রক্ষমতার চাবি হাতে থাকা যেহেতু জরুরি সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় যেতে অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে রাজনৈতিক দলগুলো এখন মরিয়া হয়ে উঠবে- এমনটাই স্বাভাবিক। তবে শিষ্টাচারসম্মত রাজনীতির জন্য জনপ্রতিনিধিদের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি। আমাদের নিজেদের বিবেক এবং চিন্তা যদি পরিশীলিত বা মার্জিত না হয় তাহলে কোনোভাবেই ইতিবাচক প্রত্যাশা সফল হবে না। আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামেই চয়েস করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন, অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্যমানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। দেশের সাধারণ জনগণ দেশের রাজনীতির একটি গুণগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করে। আর এ কারণে নতুন রাজনৈতিক দলসহ দেশে বিদ্যমান সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে বলব আপনারা যদি দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চান, তাহলে মনে রাখবেন, রাজনীতি মানে উগ্রতা, প্রতিহিংসা নয়, রাজনীতি মানে শালীনতা, ভদ্রতা এবং সহনশীলতা। আর এসব গুণাবলির মধ্য দিয়ে জনগণের মনে স্থান করে নিতে হবে। রাগ, হিংস্রতা কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ দিয়ে রাজনীতি করলে কখনোই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে না। আমরা সাধারণ জনগণ ভালো এবং নতুন কিছু প্রত্যাশা করি। আর এ জন্য পরিবর্তন শুধু মুখে নয় আচরণে এবং কার্যক্রমে প্রমাণ করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিন, প্রধান প্রকৌশলী আলি আখতার হোসেন এবং প্রধান প্রকৌশলী গোপাল চন্দ্র দেবনাথ (রুটিন ওয়ার্ক) অবসরে যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি একজন কর্মদক্ষ প্রধান প্রকৌশলীর শূণ্যতায় ভুগছিল। সে সময়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে প্রকৌশলী আব্দুর রশীদ মিয়ার নাম প্রস্তাবিত হয়। যিনি বিগত সময়ে এলজিইডির প্রশাসন এবং মানব সম্পদ বিভাগে সফলতার সাথে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্বপালনকালে তার কর্মদক্ষতা প্রশংসিত হয়। এলজিইডি একটি বিকেন্দ্রীকৃত সংস্থা, যার মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম বেশি। গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলে রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট, পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্প এবং অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন করে থাকে। এলজিইডি বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এবং এক্ষেত্রে প্রকৌশলী আব্দুর রশীদ মিয়া তার পুরো কর্মজীবনে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখেন। যার স্বীকৃতিস্বরুপ চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আব্দুর রশীদ মিয়াকে (মানবসম্পদ উন্নয়ন, মাননিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ) এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে আব্দুর রশীদ মিয়া দায়িত্ব নেওয়ার পর, তিনি এলজিইডির স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন, গতিশীলতা বৃদ্ধিতে নিরলস ভাবে কাজ করছেন। তিনি যোগদানের পর এলজিইডির বিভিন্ন কার্যক্রম তদারকি করেছেন এবং কর্মকর্তাদের সাথে নিয়মিত বৈঠক করে বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করেছেন। এতে করে প্রানস্পন্দন ফিরতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটিতে। আব্দুর রশীদ মিয়া এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে যোগদানের পর, তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে মূলত উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপদেষ্ঠার এবং সচিবের পরামর্শে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সাথে আস্থাবৃদ্ধিতে সফলতার সাথে কাজ করে চলছেন । তিনি ইতোমধ্যে তার অভিজ্ঞতার আলোকে কর্মদক্ষতায় দীর্ঘ সময় পর কর্মমুখর করে তুলেছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। বিগত সময়ে তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন)-এ দীর্ঘসময় দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে মানবসম্পদ, পরিবেশ ও জেন্ডার ইউনিটেও কর্মরত ছিলেন। আব্দুর রশীদ মিয়া ২০২৩ সালে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পান।
তিনি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (মানবসম্পদ উন্নয়ন, মাননিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ ইউনিট) হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প (পিইডিপি-৪)-এর দায়িত্ব পালন করেন। আব্দুর রশীদ মিয়া মেধাবী, কর্মঠ, দক্ষ ও সৎ প্রকৌশলী হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন। পেশাদারি উৎকর্ষ সাধনে তিনি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন কারিগরি, ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ নেন। তিনি মানব সম্পদ বিভাগে দায়িত্বপালনকালে প্রতিষ্ঠানের জনবল ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন, এবং কর্মপরিবেশ উন্নয়নে কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে জনবল নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ প্রদান, কর্মীর দক্ষতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি, এবং একটি স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ তৈরি করেন। এছাড়াও, মানব সম্পদ বিভাগ কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা দেখাশোনা করে এবং তাদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত উন্নয়ন সহায়তায় দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) প্রশাসনে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন)- হিসেবে আব্দুর রশীদ মিয়া দায়িত্বপালকালে গ্রামীণ এবং শহরাঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
এলজিইডি গ্রামীণ অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে, গ্রামীণ রাস্তা, বাজার, এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন করা। সে সবে তার কর্মদক্ষতা নানান ভাবে প্রশংসিত হয়। নারীর ক্ষমতায়নে ব্যাপক ভুমিকা রাখেন। আব্দুর রশীদ মিয়া জাপানের বহুজাতিক কোম্পানি মিতসুবিসিতে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৯-এ বাংলাদেশ কর্মকমিশন (পিএসসি)-এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল ব্যুরো (এলজিইবি)-তে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ২০০৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে এলজিইডি কুষ্টিয়া জেলায় যোগাদান করেন এবং সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। পরে সিরাজগঞ্জ জেলায় নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে আব্দুর রশীদ মিয়া সহকারী প্রকৌশলী, উপজেলা প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি “ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীনিবাস নির্মাণ শীর্ষক” প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে সফল্যের স্বাক্ষর রাখেন। এটি ছিল পরিচ্ছন্নকর্মীদের জন্য ঢাকায় নির্মিত প্রথম আবাসন প্রকল্প। আব্দুর রশিদ মিয়া রাজশাহী বিভাগ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে রাজশাহী বিভাগের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আব্দুর রশীদ মিয়া ২০১৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পান। একজন পেশাদার প্রকৌশলী হিসেবে তিনি এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে চলতি দায়িত্ব গ্রহনের পর অনেকটা ঘুড়ে দাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। দায়িত্বশীল সংশ্লিস্টরা বলছেন প্রতিষ্ঠানটির বৃহৎ স্বার্থে ধারাবাহিকতা ধরে রাখা জরুরী।
কাজের ফাঁঁকে চাকরীর প্রস্তুতি নিচ্ছে অনেক বেকার ও চাকরি প্রত্যাশীরা। তাদের অনেকেরই এখন নির্ভর করতে হচ্ছে প্রিয় শিক্ষালয়’ অ্যাপ এর ওপর। এর মধ্যে মনিরা ইয়াসমিন মুক্তা নামে এক গৃহীনী একজন। তিনি পড়াশোনা শেষ করেছেন প্রায় দুই বছর আগে। কিন্তু ছোট সন্তান থাকার কারণে কোথাও গিয়ে কোচিং করে চাকরির প্রস্তুতি নেয়া তার জন্য ছিল প্রায় অসম্ভব। যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রস্তুতির অভাবে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছিলেন না তিনি। ধীরে ধীরে হতাশা আর আত্মবিশ্বাসহীনতা গ্রাস করছিল মনিরাকে।
ঠিক তখনই একদিন এক পরিচিতের কাছ থেকে জানতে পারেন ‘প্রিয় শিক্ষালয়’ অ্যাপ সম্পর্কে। তার কথাতেই গুগল প্লে-স্টোর থেকে priyoshikkhaloy লিখে সার্চ দিয়ে ইনস্টল করে নেয় অ্যাপটি। অ্যাপটি মোবাইলে ডাউনলোড করে প্রথমে কিছুটা দ্বিধায় থাকলেও ধীরে ধীরে সেটাই হয়ে উঠেছে এখন তার সবচেয়ে বড় ভরসার স্থল। এখন আর বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, সন্তানকে সময় দিয়েও নিয়মিত চালিয়ে যাচ্ছেন নিয়োগ প্রস্তুতি। আশা করছেন খুব শ্রীঘ্রই আসবে সফলতা, জানালেন মনিরা ইয়াসমিন মুক্তা।
মনিরার মতো অভিজিৎ চক্রবর্তীর গল্পটাও প্রায় একই। আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি পারিবারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কোচিং করার সময় হয়ে উঠছিল না। ফেসবুকে ‘প্রিয় শিক্ষালয়’ অ্যাপের বিজ্ঞাপন দেখে সেটি ডাউনলোড করে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এর মাধ্যমেই তিনি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাশ করেন এবং শিক্ষক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন।
এই অ্যাপটি বর্তমানে চাকরি খুঁজছেন এমন হাজারো মানুষের জন্য নতুন আশার আলো হয়ে উঠেছে। যাদের অর্থ বা সময়ের সমস্যা আছে, তারা এখন ঘরে বসেই চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে পারছেন। ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চালু হওয়া অ্যাপটি অল্প সময়েই এক লাখের বেশি ডাউনলোড ছাড়িয়ে গেছে।
এই অ্যাপ থেকে উপকৃত হচ্ছেন না শুধু চাকরি প্রত্যাশীরা, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাওয়া শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবকরাও। অ্যাপটিতে রয়েছে বিসিএস, ব্যাংক, শিক্ষক নিবন্ধন, প্রাথমিক শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, নার্সিং ভর্তি, আইনজীবী এনরোলমেন্টসহ নানা পরীক্ষার প্রস্তুতির কনটেন্ট।
গুগল প্লে-স্টোরে অ্যাপটির রেটিং ৪.৮, আর হাজারো মানুষ ইতোমধ্যে প্রশংসা করে রিভিউ দিয়েছেন। অনেকে বলেছেন, এই অ্যাপের মাধ্যমেই তারা চাকরি পেয়েছেন এবং তাদের জীবন বদলে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়োপযোগী প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন উদ্যোগগুলো ভবিষ্যতে দেশের বেকার সমস্যা মোকাবেলায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে। প্রিয় শিক্ষালয়ের প্রধান নির্বাহী মহিউদ্দিন সোহেল জানান, অ্যাপটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন শিক্ষার্থীরা নিজের দুর্বল দিক চিহ্নিত করে ঠিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেন। প্রতিটি মডেল টেস্টের শেষে ফলাফল বিশ্লেষণ করে ব্যবহারকারীদের উন্নতি কোথায় দরকার তা জানিয়ে দেয় অ্যাপটি। ভবিষ্যতে অ্যাপে ভিডিও লেসন, লাইভ ক্লাস এবং আরও উন্নত লার্নিং সিস্টেম যোগ করা হবে।
অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিআরটিসির দরজা সবসময় খোলা। কর্পোরেশনের ডিপো বা প্রধান কার্যালয় এ কোনো কাজে আসলে তাদেরকে বিনা কারণে হয়রানি করা যাবে না। তাদের যে কোনো কাজ আগে করে দিতে হবে, তাদের খোঁজ-খবর নিতে হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি)’র চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল লতিফ মোল্লা।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) সকালে বিআরটিসি’র প্রধান কার্যালয় “পরিবহন ভবন” এর সভাকক্ষে আয়োজিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিপিএফ, গ্র্যাচুইটি এবং ছুটি নগদায়নের অর্থ প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
বিআরটিসি চেয়ারম্যান বলেন, অবসরপ্রাপ্তদের যে কোনো প্রয়োজনে আমরা পাশে আছি। আপনাদের সুযোগ-সুবিধা দেখার দায়িত্ব বিআরটিসি পরিবারের।
অনুষ্ঠানে ৩২২ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সিপিএফ, গ্র্যাচুইটি এবং ছুটি নগদায়ন বাবদ মোট ২ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার ২৩২ টাকা অনলাইন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে সুবিধা ভোগীদের নিজস্ব একাউন্টে প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬১ জন কর্মচারী (সম্পুর্ণ ১৮ জন ও আংশিক ৪৩ জন) সিপিএফ বাবদ প্রায় ১ কোটি ৫৯ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা, ১৬ জন কর্মচারী (সম্পুর্ণ ০১ জন ও আংশিক ১৫ জন) ছুটি নগদায়ন বাবদ ৭ লক্ষ ৯৭ হাজার টাকা এবং ২৪৫ জন কর্মচারী গ্র্যাচুইটি বাবদ ১ কোটি ২২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা পেয়েছে।
বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ মোল্লা’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক ড. অনুপম সাহা, প্রশাসন ও অপারেশন বিভাগের পরিচালক মোঃ রাহেনুল ইসলাম, কারিগরী বিভাগের পরিচালক কর্নেল কাজী আইয়ুব আলী, কর্পোরেশনের বিভিন্ন বিভাগের জিএমগণ, ঢাকাস্থ ডিপো ম্যানেজারগণ এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা।