সোমবার, ২০ মে ২০২৪

বাতাস দূষণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন

ড. মো. হুমায়ুন কবীর
প্রকাশিত
ড. মো. হুমায়ুন কবীর
প্রকাশিত : ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ ১১:৩৯

সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় বাতাস দূষণ সম্পর্কে একটি ভয়াবহ সংবাদ বিবেকবান সব মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। খবরে প্রকাশ বিশ্বের বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৫৫ লাখ মানুষের মুত্যু ঘটে। এ সংখ্যা আমাদের নিকটবর্তী প্রতিবেশী চীন ও ভারতে সবচেয়ে বেশি। এ প্রসঙ্গে একটি পরিসংখ্যানে প্রকাশ, ২০১৩ সালে চীনে বায়ুদূষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ, আবার একই বছরে ভারতে এ সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ।

বাতাস হলো জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। বাতাস না থাকলে আমরা এক মুহূর্তের জন্যও বাঁচতে পারি না। আমাদের নিশ্বাসে ও প্রশ্বাসে শুধু প্রয়োজন বাতাস আর বাতাস। তবে সে বাতাস হওয়া চাই নির্মূল। না হলে দূষণের কারণে এভাবেই পাওয়া যাবে বাতাসে লাশের গন্ধ। ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরের দিকে যে গ্যাসীয় আবরণ সমগ্র পৃথিবীকে বেষ্টন করে রেখেছে তাকে বায়ুমণ্ডল বলে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যতই ওপরে ওঠা যায় বায়ুমণ্ডল ততই হালকা হতে থাকে।

বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উপাদানের ৯৭ শতাংশ পদার্থ ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২৯ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করলেও বিজ্ঞানীদের মতে, বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্বসীমা ভূপৃষ্ট থেকে ১০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের প্রধানত বিশুদ্ধ ও শুষ্ক উপাদান হলো দুটি; আর তা হলো- অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন। বায়ুমণ্ডলের চারটি স্তর রযেছে, সেগুলো হলো- ১. ট্রপোমণ্ডল বা ট্রপোস্ফেয়ার, ২. স্ট্রেটোমণ্ডল বা স্ট্রেটোস্ফেয়ার, ৩. মেসোমণ্ডল বা মেসোস্ফেয়ার ও ৪. তাপমণ্ডল বা থার্মোস্ফেয়ার। বায়ু ছাড়া পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং স্বল্প পরিমাণ নিষ্ক্রিয় গ্যাস যথা- আর্গন, হিলিয়াম, জেনন, ক্রিপ্টন ইত্যাদিকে বায়ু বলা হয়। এ উপাদানগুলো বাতাসের মধ্যে শতকরা হারের নির্দিষ্ট পরিমাণে থাকলে সেই বায়ুকে আদর্শ বায়ু বলা হয়।

আদর্শ বায়ুতে শতকরা হারে আয়ন হিসেবে নাইট্রোজেন-৭৮.০২ শতাংশ, অক্সিজেন-২০.৭১ শতাংশ, নিষ্ক্রিয় গ্যাস-০.৮০ শতাংশ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড-০.০৩ শতাংশ ও বাকি অন্যান্য গ্যাস রয়েছে। জীবের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য আদর্শমাত্রার এ বিশুদ্ধ বায়ু অত্যাবশ্যক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিভিন্ন কারণে প্রতিনিয়তই আমাদের নিত্যব্যবহার্য বায়ুদূষণ ঘটছে। আর বায়ুদূষণ বলতে বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন ধরনের ডাস্ট, ফিউম, গ্যাস, ঘনকুয়াশা, গন্ধ, ধোঁয়া, বাষ্প ইত্যাদি বায়ুদূষকের উপস্থিতিকে বুঝায়।

যে উপাদানগুলো বায়ুতে মিশ্রিত হলে বায়ুদূষণ হয় তাদের দূষক বলে। বায়বীয় দূষক যেমন- কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি। কণাজাতীয় দূষক যেমন- ধোঁয়া, ফিউম, ধুলাবালি, মিস্ট, কুয়াশা, ধোঁয়াশা ও এরোসল ইত্যাদি। রাসায়নিক জৈবদূষক যেমন- হাইড্রোকার্বন, অ্যালডিহাইড, কিটোন, অ্যামিন ও অ্যালকোহল ইত্যাদি। রাসায়নিক অজৈব দূষক যেমন- কার্বনেট, ক্লোরাইড ইত্যাদি।

অজৈব কণার মধ্যে রয়েছে- উড়ন্ত ছাই, বালি, এসবেস্টস, যানবাহনের ধুলাবালি, খনি ও অন্যান্য শিল্পকারখানার ধুলাবালি ইত্যাদি। আরও রয়েছে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও পরাগরেণুর মতো সজীব বায়ুদূষকও। আবার তেজস্ক্রিয় বায়ুদূষক যেমন- তেজস্ক্রিয় গ্যাস ও আলোক রাসায়নিক জারক ইত্যাদিই প্রধান। মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাবগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইসিমা, ফুসফুসে ক্যানসার, বন্ধ্যাত্ব ও জন্মত্রুটি ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব।

২০১৫ সালে প্যারিসে কপ-২১ সম্মেলন চলাকালেই আমাদের পার্শ্ববর্তী দুটি প্রতিবেশী দেশ চীন ও ভারতে বায়ুদূষণের জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হচ্ছিল। সেখানে বায়ুদূষণের বিষয়টি এমন বেগতিক হয়ে উঠেছে যে ঘন কুয়াশা, কলকারখানার কালো ধোঁয়া ও ধূলিকণার প্রভাবে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকায় এক নম্বরে হলো আমাদের এক প্রতিবেশী চীনের নাম, আর সেই তালিকায় দুই নম্বরেই রয়েছে আরেক প্রতিবেশী ভারতের নাম। তারপর তিন নম্বরে যুক্তরাষ্ট্র, চার বা তদোর্ধ্ব হলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশ।

মোট কার্বন নিঃসরণকারী দেশের মধ্যে চীন এককভাবে যোগ করে ২৪ শতাংশ আর ভারত করে থাকে কমপক্ষে ৭ শতাংশ। কিন্তু সে হিসাবে যদিও আমাদের রাজধানী ঢাকার বাতাসে দিল্লি কিংবা চীনের মতো দূষণ নেই, তার পরও একেবারে হাত গুটিয়ে বসে থাকার পরিস্থিতিতেও নেই। জানা যায়, বিগত ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকে ঘন কুয়াশা ও ধোঁয়ায় চীনের আরও ১০টি শহরে সতর্কতা জারির আরেকটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। চীনে ব্যবহৃত চারস্তরের সতর্কতার মধ্যে ‘রেড এলার্ট’ হলো সবচেয়ে গুরুতর ধরনের সতর্কতা।

পরামর্শমূলক সেই সতর্ক বার্তায় বলা হয়েছে, স্কুল বন্ধ এবং গাড়ি চলাচল, কারখানার উৎপাদন, নির্মাণকাজ সীমিত করার কথা। একই সপ্তাহে চীনে দ্বিতীয়বারের মতো এ ধরনের সতর্কতা জারি করা হলো। আগের সপ্তাহের ধারাবাহিকতায় চীনের পরিবেশ মন্ত্রণালযের তরফে মারাত্মক দূষণের কারণে তিয়ান জিন, পুইয়াং, জিনজিয়াং, ডেঝাউ, হান্দান, জিনতাই, লাংফাং, হেংসুই, জিনজি এবং অ্যানইয়াং শহরে এ লাল সতর্কতা জারি করা হলো। সম্প্রতি আরেকটি রিপোর্টে প্রকাশ, চীনের বায়ুদূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেখানে এখন জনস্বাস্থ্য ও টেকসই উন্নয়ন হুমকির সম্মুখীন। সেখানে বেইজিং শহরের পার্শ্ববর্তী প্রায় ১০ কোটি মানুষ অধ্যুষিত হেবি ও তিয়ানজিন শহর এলাকায় কয়লার ব্যবহার কমাতে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) চলতি বছরই বায়ুদূষণ কমাতে ৩০ কোটি ডলার ঋণ দেবে বলে জানিয়েছে। একইভাবে ভারতের রাজধানী দিল্লিসহ আরও কয়েকটি শহরে বায়ুদূষণের ভয়াবহতার কারণে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

সে কারণেই দেখা গেছে এ বছরের গরমকালে ভারতের রাজধানী দিল্লি শহরকে বিশ্বের উষ্ণতম স্থান হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। সেজন্য এবার সেখানে অত্যাধিক গরমে প্রায় সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর আমরা সবাই জানি। বাতাসে যখন দূষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তখন অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রায়ও সমানতালে বাড়তে থাকে। সেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশ, জলবায়ু ইত্যাদির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়। মানুষসহ সব জীবজগৎই এর দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশের ঢাকা শহর হলো বিশ্বের অন্যতম একটি মেগাসিটি। সে কারণে এর বায়ুমণ্ডলের ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনের ওপরই নির্ভর করে এ শহর আসলে নাগরিকদের বসবাসের জন্য কতটুকু নিরাপদ। সম্প্রতি ঢাকা শহরের বাতাসের নমুনা পরীক্ষা করে এতে মারাত্মক ক্ষতিকর কিছু দূষকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা সচেতন নাগরিকদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। শুষ্ক মৌসুম হওয়ার কারণে এখানকার বাতাসে প্রচুর পরিমাণ ধুলাবালি, ঢাকা শহরের কিছু শিল্পাঞ্চল থেকে নির্গত ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া, চামড়াশিল্পের ট্যানারি থেকে ক্ষতিকর দুর্গন্ধ, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী সাভার, আশুলিয়া, মাওয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টঙ্গী ইত্যাদি স্থানগুলো হতে ইটভাটার কালো ধোঁয়া বাতাসে সংযুক্ত হচ্ছে।

ঢাকায় চলাচলকারী মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন পরিবহনের কালো ধোঁয়া, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রী হতে প্রতিনিয়তই ঢাকা শহরের কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, সিসাসহ আরও অনেক ভারী ধাতু (হেভি মেটাল), রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশন হতে সিএফসি, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হয়ে দূষণের মাত্রা বেড়ে গিয়ে পরিবেশ নষ্ট করে চলেছে। তা ছাড়া পরিবেশ নির্দিষ্ট কোনো দেশের একক কোনো সমস্যা নয়। কাজেই যেহেতু আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে চীন ও ভারতে অত্যাধিক পরিমাণ বায়ুদূষণ রয়েছে, তার সামান্য প্রভাব হলেও আমাদের দেশে পড়ছে বা আগামীতে আরও পড়বে।

দেখা গেছে, যদি কোনো কারণে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উৎস থেকে ভারসাম্য বিনষ্টকারী কোনো কঠিন, তরল বা বায়বীয় অবাঞ্ছিত বহিস্থ পদার্থ বায়ুতে প্রচুর পরিমাণে অনুপ্রবেশ করে তাহলে স্বনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে বহিস্থ পদার্থ বা উপাদান নিজ উপাদানের অতিরিক্ত পরিমাণ বায়ু থেকে অপসারিত হয়। ফলে বায়ুর স্বাভাবিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণকারী বায়ুর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটি চরম সীমা রয়েছে। এ সীমার বাইরে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কাজ করে না। ফলে বায়ুতে বহিস্থ ও নিজ উপাদানের মাত্রাধিক সঞ্চয় ঘটে।

বায়ুতে বহিস্থ উপাদানের উপস্থিত ও সঞ্চয় এবং নিজ উপাদানের অতিরিক্ত সঞ্চয় জীবজগৎ ও সম্পত্তির ওপর মন্দ প্রভাব বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে ক্রমবৃদ্ধি অরণ্য ধ্বংস, দ্রুতগতিতে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, কৃষিপদ্ধতির পরিবর্তন এবং নিজ উপাদানের মাত্রাধিক সঞ্চয়ে বায়ু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ক্রিয়াশক্তি বিনষ্টের পথে। মানুষের এ অদূরদর্শী ক্রিয়াকলাপে পৃথিবীর সার্বজনীন বায়ুসম্পদ আজ বিপন্ন এবং মানুষ তথা সমগ্র জীবজগৎ সম্ভাব্য বিপদে আতঙ্কিত। এসব সমস্যা হতে বাঁচতে হলে আমাদের পৃথিবীকে সবুজ করে ফেলতে হবে।

পরিকল্পিত নগরায়ণ সেখানে একটি বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। আর পরিকল্পিত নগরায়ণ হলো কোনো স্থানের মোট আয়তনের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ রাস্তাঘাট থাকা এবং সেই রাস্তাঘাটকে সবুজ বনায়নের আওতায় নিয়ে এসে নগরের ২৫ শতাংশ বনায়ন করা। বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই এ পরমর্শটিই দিয়ে থাকেন নগসবাসীর জন্য। কাজেই ভারত কিংবা চীনের পর্যায়ে যাওয়ার আগেই আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়


বাজেট অগ্রাধিকারে থাকুক ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থান’

আপডেটেড ১৯ মে, ২০২৪ ১৪:৩৪
মোতাহার হোসেন

আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজস্ব বোর্ড পরামর্শের জন্য ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, নাগরিক সমাজসহ সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর অধিদপ্তর থেকেও তাদের চাহিদা, সম্ভাব্য পরামর্শ নিয়েছে; কিন্তু বিগত যেকোনো সময়ের তুলনায় এবারের বাজেট প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং দেশের মানুষের চাহিদাপূরণে সরকারকে বিরাট চ্যালেঞ্জে পড়তে হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে- করোনাপরবর্তী রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের সঙ্গে নতুন করে ইরানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন. ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের সম্ভাব্য সংকট মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখতে।

মূলত বাংলাদেশের মতো বিকাশমান বা উন্নয়নশীল দেশে দিনের শেষে বাজেট হচ্ছে সরকারের আয়-ব্যয়ের বার্ষিক হিসাব। এতে কিছুটা উন্নয়ন অর্থায়নের পরিকল্পনা, সাধারণ জনগণকে কিছুটা আশ্বস্ত আর কিছুটা সহায়তা করার পরিকল্পনাও থাকে। বাজেট প্রণয়ন, বিশেষ করে গুণগতমান বজায় রেখে বাজেট বাস্তবায়ন বেশ কঠিন হলেও উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টায় বাজেট বাস্তবায়ন করা হয়। তবে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় মাঠপর্যায়ে তহবিল বা বরাদ্দ ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট অগ্রগতি হচ্ছে।

প্রসঙ্গত বর্তমানে জাতীয় অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ালেও করোনাপরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব এবং চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মধ্যেও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নের গতিধারাকে এগিয়ে নিতে হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশকে আরও সুদৃঢ় ও জোরদার এবং চলমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, দেশের বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীল খাতকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট প্রণয়নের প্রত্যাশা করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। রাজস্ব বোর্ড এবং এফবিসিসিআইর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরামর্শক কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে এই প্রত্যাশার কথা জানান এফবিসিসিআই।

প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ পরিকল্পনা এবং আন্তরিক প্রয়াস দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সুদৃঢ় করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট উন্নত বাংলাদেশে উন্নীত পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে জনমুখী ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়নে প্রয়োজন করের বোঝা কমানো, আমদানিকৃত কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যসহ শিল্প উপকরণের ওপর আরোপিত এআইটি, আগাম কর প্রভৃতি প্রত্যাহার করা। ব্যাংক ঋণের সুদহার হ্রাসসহ আমদানি পণ্যের শুল্কায়নে ও পণ্য খালাসের জটিলতা দূর করার বিষয় গুরুত্বসহ দেখা দরকার। একই সঙ্গে কর কমিয়ে আয়কর ও মূসকের আওতা সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং সক্ষম ব্যক্তিদের করের আওতায় আনা দরকার। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিতকরণে ব্যাংকিং কমিশন গঠন, দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত না করার প্রস্তাবও আসে বৈঠকে। মানুষের প্রকৃত আয় বিবেচনায় রেখে- আগামী জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দেন তিনি।

বাজেট প্রণয়নে যুক্ত কর্মকর্তাদের মনে রাখা উচিত বিশ্ব পরিস্থিতি এখন টালমাটাল। এমনি অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বাজার মনিটরিং, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্সপ্রবাহ, রপ্তানি বৃদ্ধি, বহুমুখীকরণ, সম্প্রসারণ ও নতুন বাজার সন্ধান, মানব সম্পদ উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন কার্যক্রম জোরদার করা দরকার। বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় লক্ষ্যমাত্রাগুলোর আলোকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে দৃঢ় করতে ব্যবসায়িক খরচ কমিয়ে আনা, বিনিয়োগ সুরক্ষা, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিনিয়োগ সহায়ক মুদ্রা ও শুল্ক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, শিপিং খরচসহ সব ধরণের পরিবহন খরচ হ্রাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিশ্চয়তার পাশাপাশি কর আদায়ে হয়রানি ও জটিলতা নিরসন দরকার। কর্মসংস্থানের স্বার্থে বিনিয়োগ, দেশীয় শিল্প ও সেবাখাতে করের যৌক্তিক নির্ধারণ দরকার। পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নগদ সহায়তার বিকল্প সুবিধা নিশ্চিত করা এবং বিকল্প সহায়তা হিসেবে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও পরিবহন খাতে প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য- বিশেষ করে চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলা, বুট, ডাল, হলুদ, মরিচ, ভুট্টা, আটা, ময়দা, লবণ, ভোজ্য তেল, চিনিসহ সকল প্রকার কৃষিজাত নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যকে উৎসে কর কর্তনের আওতা বহির্ভূত রাখার বিষয়ে ভাবতে হবে।

ইতোপূর্বে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সবাই বলেছেন আমরা সঠিক পথে আছি। কী কী সমস্যা আছে, তা সবাই জানেন। তারপরও তারা তাদের মতো করে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো ঠিক আছে বলে মত দিয়েছেন।’ আগামী বাজেটে নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার যে সমস্যা চলমান আছে, সেটা দূর করতে হবে। অবশ্য সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর পাশাপাশি করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছি। অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধিকারগুলো যেন যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয়, সেটি বলেছি। খেলাপি ঋণ কমানো, বিদেশি ঋণ কম নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে বৈঠকে।’ তিনি ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশেরও পরামর্শ দিয়েছেন। তবে ‘বর্তমানে দেশে আয়বৈষম্য উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। আয়বৈষম্য কমাতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছি আমি। এ ক্ষেত্রে ধনীদের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক কর্মসূচিসহ যেসব খাত থেকে প্রান্তিক মানুষ উপকৃত হবে, সেসব খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং আগামী বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।’

আগামী অর্থবছরের বাজেটে বড় প্রকল্প কমিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, যে প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি সময় লাগে এবং ফল আসতে দেরি হয়, সে ধরনের প্রকল্প যেন কমিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর পরামর্শও দিয়েছেন। একবিংশ শতাব্দীতে দেশ ও মানুষের উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন। ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস, ক্লাউড কম্পিউটিং, মেশিন লার্নিং, ব্লকচেইন প্রযুক্তি, সেন্সর, অটোমেশন, থ্রিডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, জিন ও প্রকৌশল প্রযুক্তির সমন্বয়ে আজকের বিশ্বে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বিশ্বায়নের এই প্রশস্ত আঙিনায় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে করণীয়, ভবিষ্যৎ-সম্ভাবনা, পরিকল্পনা, দক্ষ জনবল তৈরির উপায়, সমস্যার সমাধান ইত্যাদি বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেটে এসব অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারের এসব পদক্ষেপের সঙ্গে সাধারণ জনগণকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা ও তাদের প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দক্ষ করে তোলার প্রয়াস সফল হলেই অর্থনীতিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-বিবেচনায় প্রাধান্যের ভিত্তিতে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে যেসব মানুষ পারদর্শী ও পেশাদার, তাদের কদর পৃথিবীব্যাপী বেড়েই চলেছে। তাই পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির বিষয়টি সামনে রেখে দেশে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের সমন্বয়ে স্মার্ট ইকোনমির ধারণা বর্তমানে একটি পরিজ্ঞাত বিষয়। বর্তমানে দেশে ৩ লাখ মানুষ সক্রিয়ভাবে আইসিটি খাতে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া ৫ লাখ রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সার আইসিটি বিষয়ে কাজ করছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে জনবহুল বাংলাদেশে বিপুল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে প্রযুক্তির মাধ্যমেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রয়োজন। মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং, অনলাইনে মানি ট্রান্সফার, মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন প্রভৃতি এখন বেশ জনপ্রিয়। জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণসহ এসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নই জনপ্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক

বিষয়:

নেটওয়ার্ক ও টেলিটক সিম

আপডেটেড ১৯ মে, ২০২৪ ১২:৩৪
আহমেদ কবির রিপন

বর্তমান দৈনন্দিন জীবন বা সময়ের সমষ্টি অতিবাহিত হচ্ছে মোবাইল বা সেলফোনের দ্বারা। ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে সেলফোনের যুগে টেলিটক বিশেষ অবদান রাখছে তাই কিছু কথা লেখার তাগিদ অনুভব করছি। এ যুগে এখন প্রতিটি পরিবারে একাধিক সংখ্যক মোবাইল বা সেলফোন রয়েছে যা তিন-চার দশক আগেও অকল্পনীয় ছিল। বর্তমানে লক্ষণীয় যে কোনো কোনো পরিবারে এক ব্যক্তির জন্য ২-৩টি মোবাইল ফোনও আছে।

স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের হাতেও মোবাইল থাকা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা এখন অনলাইনে মোবাইল ফোন বা সেলফোনের দ্বারা ক্লাস করে থাকেন। ব্যবসায়িক কাজে ও মোবাইল বা সেলফোনের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য, চাকরিজীবীদের সেলফোন ছাড়া চলেই না এ ছাড়া বিভিন্ন পেশাজীবীদেরও এখন মোবাইল লাগে, উচ্চশ্রেণি ছাড়াও এমনকি নিম্নশ্রেণি পেশার জনগণকে, রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা, গার্মেন্টশ্রমিকরাও সেলফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন তা ছাড়া বিশেষ করে প্রবাসীদের প্রতিটি পরিবারের কাছে মোবাইলের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রত্যেক পরিবারের সদস্যরা সুখ-দুঃখের খবরাখবর মোবাইল বা সেলফোনের মাধ্যমে নিয়ে থাকেন। একজন কৃষক খেত-খামারে থেকে মোবাইলের মাধ্যমে তার দূরবর্তী অবস্থানরত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে নিতে পারেন। এ দেশে মোবাইল বা সেলফোন নেই এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম।

যেসব এলাকায় নেটওয়ার্ক কম বা অস্পষ্ট ওইসব এলাকায় মোবাইল থেকেও ব্যবহারকারীদের খুব একটা লাভ হচ্ছে না। তাৎক্ষণিকভাবে কথাবার্তা, প্রয়োজনীয় খবরাখবর দ্রুত আদান-প্রদানে জনগণ খুবই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই বিটিসিএলের মাধ্যমে বা সরকারি ব্যবস্থাপনায় অধিক পরিমাণে সরকারি সিম বা টেলিটক কোম্পানির সিম, বাজারজাতকরণের জরুরি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

এই সিম ব্যবহারের ফলে দেশের একাংশের অবহেলিত দরিদ্র জনগণের সমস্যার কথা তারা একে অপরের কাছে ও বৃহৎ পরিষরে তুলে ধরতে পারবে।

শিক্ষার্থীরাও বাড়িতে বসেই অনলাইনে সহজে ক্লাস করতে পারবে এবং দেশ গড়ার ক্ষেত্রে দক্ষ সৈনিক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে।

ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশাজীবীদের কাজের গতি আরও বাড়বে। গ্রাম-গঞ্জের খবরাখবর আদান-প্রদানে অনেক সহায়ক হবে। বিশেষ করে হাওর ও পাহাড়িয়া দুর্গম অঞ্চলের জনগণ অনেক উপকৃত হবে, যেমন- ‘হাকালুকি’ হাওরতীরবর্তী বিশাল জনগোষ্ঠীর অসুবিধা লাঘবে প্রয়োজনীয় স্থানে অধিকসংখ্যক টাওয়ার স্থাপন করে মোবাইল যোগাযোগের সুবিধা বর্ধিতকরণ দরকার। তাহলে ওই এলাকার জনসাধারণের জীবনমানের সহজে উন্নতি ঘটবে এবং প্রধানমন্ত্রীর মহতী উদ্যোগ গ্রামের উন্নয়ন, কৃষকের উন্নয়ন সর্বোপরি দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং সরকারও সঠিক পদ্ধতিতে কর সংগ্রহে সফলতা অর্জন করবে। গ্রাহকদের অযাচিত ভোগান্তি দূর হবে।

আমরা লক্ষ্য করছি, বর্তমান প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডাকঘরগুলোতে বিভাগীয় সেবার পরিমাণ অনেকটা বেড়েছে তাও সম্প্রতি বর্তমান সরকারের উন্নয়নমূলক কিছু সিদ্ধান্ত ও প্রকল্প গ্রহণের ফলে, সেই সঙ্গে ডাক বিভাগের নিয়োজিত জনবলকে আরও উন্নত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে টেলিটক সিম বিপণন ও নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার উন্নয়ন আরও বৃদ্ধি করে গ্রাহকদের সহজে বেশি পরিমাণ উন্নত সেবা প্রদান করা সম্ভব। জরুরি এবং প্রতিযোগিতামূলক প্রকল্প গ্রহণ করার মাধ্যমে ডাক বিভাগের টেলিটক সিম বিপণন ও অন্যান্য সেবা প্রদান, ডাক জীবন বীমা সেবা, সঞ্চয়পত্র বিপণনসহ ডাক বিভাগের আওতাভুক্ত পার্সেল সেবা, বুকপোস্ট, রেজিস্টার্ড সংবাদপত্র, মানি ওর্ডার সেবা, এপ্রেস সেবা, জিইপি ও ইএমএস সেবা, ই-পোস্ট এবং ইন্টেল পোস্ট সেবাসহ সব পরিসেবাগুলো গ্রামগঞ্জের মানুষ যাতে সহজে ভোগ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে বর্তমান নীতি-নির্ধারকরা ও বাজেট প্রণয়নকারীরা এদিকে বিশেষ নজর ও বরাদ্দ বৃদ্ধি করে সারাদেশের গ্রাম-গঞ্জের মানুষের নেটওয়ার্ক সমস্যা লাঘবের জন্য টেলিটক কোম্পানির বিভিন্ন জায়গায় অধিক পরিমাণ টাওয়ার নির্মাণ ও দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করে এই সমস্যার সমাধান করা সহজ হবে, তাতে দেশের টাকা দেশে থাকবে, উন্নত সেবা নিশ্চিত হবে। জনস্বার্থে অতীব প্রয়োজনীয় সমস্যাগুলোর সমাধানে সম্মিলিতভাবে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে সরকারের সঙ্গে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে সবাইকেই যার যার জায়গায় আরও বেশি গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

লেখক: পরিবেশকর্মী


গণতন্ত্র ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র

আপডেটেড ১৯ মে, ২০২৪ ১২:৩৫
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সমর্থন নিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর স্বাধীন ও নিরেপক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রথম ধাপে দেশের ১৫২টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ৮ মে। পাশাপাশি দ্বিতীয় ধাপে দেশের ১৬১টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। সে ক্ষেত্রে আগামী ২১ মে এসব উপজেলায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে ভোট দিয়ে পুনরায় নির্বাচিত করেছে। ফলে পরাজিত হয়েছে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ঈর্ষান্বিত স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যরা। গণতন্ত্র ও জনগণের কাছে পরাজিত হলেও গণতন্ত্র ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত থামিয়ে দেয়নি। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংঘটিত বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি কমাতে এবং নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি কুচক্রীমহলের তৎপরতা এখনো বিদ্যমান। বাংলাদেশের আসন্ন উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচনকে ঘিরে তা বানচাল এবং তাতে ভোটার উপস্থিতি কমানোর লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থেমে নেই।

উল্লেখ্য, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বানচাল করে অবৈধভাবে সরকারের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনের পূর্ব থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেছে বিএনপি ও তাদের বিদেশি মিত্ররা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি কমাতে বিএনপি কঠিন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের পথ অবলম্বন করেও তাতে সফল হতে পারেনি। বিএনপির সব ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করে সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করেছে।

নির্বাচন বানচালে সব অপপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় এখন তাদের নতুন কৌশল হচ্ছে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত যেকোনো নির্বাচনকে যে করেই হোক প্রশ্নবিদ্ধ করা। দেশি-বিদেশি সব পর্যবেক্ষক যেখানে বলেছে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। সেখানে বিএনপি-জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিগুলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ আসন্ন উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচনেও ষড়যন্ত্র করে ভোটার উপস্থিতি কমিয়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নতুন করে অপপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অংশ হিসেবে বিএনপি প্রথমে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা তাই করেছিল। তারা ভেবেছিল যে যদি তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে বাতিল হবে; কিন্তু সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপি ছাড়া অন্যান্য যত গণতান্ত্রিক দল ছিল তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত হয়েছে এবং ষড়যন্ত্রকারী বিএনপির সব ধরনের ব্যর্থতায় রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছে। তারপর থেকে তারা বাংলাদেশবিরোধী আন্তর্জাতিক চক্রের প্ররোচনায় পড়ে মিথ্যাচার করেছে। বাংলাদেশবিরোধী বিদেশি অপশক্তিগুলোর সাথে আঁতাত করে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় আসন্ন উপজেলা নির্বাচনও বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে অপপ্রচার চালিয়ে সরকার ও দেশকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে। দেশের উন্নয়নে অংশীদার না হয়ে দেশ ও সরকারের অর্জনকে বিতর্কিত ও ম্লান করার জন্য ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সদ্য অতীত ইতিহাস বলছে শুধু নির্বাচন বর্জন করেই থেমে যায়নি বিএনপি। নির্বাচনের আগে থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনী ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কম রাখার লক্ষ্যে বাস, ট্রেন, ভ্যান, ট্রাক, রিকশা এবং মোটরসাইকেলে আগুনসন্ত্রাস তথা জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে জনমনে ভীতির সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচালের অপপ্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। নির্বাচনের দিন ভোটারদের উপস্থিতি কমানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুর চালিয়েছে। নির্বাচনের আগের দিন থেকে শুরু করে একটানা তিন দিন সহিংসতা চালিয়ে গিয়েছে; কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে- বিএনপির আগুনসন্ত্রাসকে এ দেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ একদমই তোয়াক্কা করেনি। বিএনপি কর্তৃক পরিচালিত সব ধরনের আগুন ও সহিংসতাকে উপেক্ষা করে এ দেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ ভোট দিয়ে বিপুল ভোটে পুনরায় নির্বাচিত করে জনগণের সমর্থন ও শক্তিতে বিশ্বাসী বাংলাদেশের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগকে। বিএনপির ভুলে গেলে চলবেনা যে বাঙালিরা বীরের জাতি। আগুনসন্ত্রাসী করে তাদের দমিয়ে রাখা যায় না। বিএনপি চেয়েছিল জ্বালাও-পোড়াও করে বাঙালি জনগণকে ভোটের দিন ঘরের ভিতর আটকে রেখে নির্বাচন বানচাল করতে; কিন্তু তা আর হলো কই, গণতন্ত্রমনা সাহসী বাঙালি জনগণ সব ধরনের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে উপেক্ষা করে গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি হরতাল-অবরোধের নামে দেশের অচলাবস্থা সৃষ্টির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। সেই লক্ষ্যেই মূলত ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে ৬ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। ৬ জানুয়ারি সকাল ৬টা থেকে বিএনপি কর্মসূচি দিয়েছিল। এভাবে হরতাল-অবরোধের নামে দলটি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে গিয়েছে। নির্বিঘ্নে কর্মসূচি পালনের সুযোগও নিতে চাচ্ছে না দলটি। দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন কর্মসূচি জনসম্পৃক্ত করে তুলতে না পারা এবং আন্দোলনের জন্য নতুন ইস্যু সৃষ্টির ব্যর্থতায় এমন সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে দলটি। এখন দলের কর্মসূচিও আসে অজ্ঞাত স্থান থেকে। মাঠেও দেখা যায় না দলীয় কোনো নেতা-কর্মীকে। রাজনৈতিকভাবে পরাজিত বিএনপির সন্ত্রাসী নেতা-কর্মীরা অজ্ঞাত স্থান থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনায় সব ধরনের সহিংস কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনকে বানচাল এবং প্রশ্নবিদ্ধ করতে।

অতীতের মতো এখন আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরেও বিএনপির প্রস্তুতি অপরিবর্তনীয়। তারা ইতোমধ্যে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এখন থেকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বাকি সময়টুকু তারা কীভাবে অতীতের মতো আগুনসন্ত্রাস করে বাঙালি জনগণের মনে ভীতির সৃষ্টি করে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কমিয়ে নির্বাচনকে বানচাল করা যায় সেই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের নীলনকশা আঁকছে বিদেশি অপশক্তিগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে। নির্বাচনকে কেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে তারা এ ধরনের গণতন্ত্রবিরোধী অপকর্ম করে সফল হতে না পারলেও নষ্ট করে দেশীয় অনেক সম্পদ এবং কেড়ে নেয় বাংলাদেশের সাধারণ এবং খেটে-খাওয়া মানুষের তাজা প্রাণ। নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি-জামায়াতের মতো গণতন্ত্রবিরোধী অপকর্ম অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল।

বিএনপির ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অপরাজনীতি শুধু ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কমানোর ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়- তাদের ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা পর্যন্ত বিস্তৃত। আর সেই লক্ষ্যেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে বিএনপি ষড়যন্ত্র করে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ইতিহাসের জঘন্যতম এবং ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা ঘটিয়েছিল। ১৯ বছরের আগের এ দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্যতম দিন। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নেতৃত্বশূন্য করার জঘন্য অপচেষ্টার দিন। দেশের মানুষ আজও কেঁপে ওঠেন শনিবার ওইদিনটির কথা ভেবে। কতশত মানুষ মনের অজান্তে কেঁদে ফেলেন। স্বজন হারানোরা খুঁজে ফেরেন প্রিয় মানুষের স্মৃতি। সেদিন যদি ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত ট্রাকে বিস্ফোরিত হতো- আজ হয়তো বঙ্গবন্ধুকন্যা বেঁচে থাকতেন না। মারা পড়তেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারাও। মূলত আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই এমন পৈশাচিক হামলা চালায় ঘাতকরা। এ ছাড়া ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার জনসমর্থন নিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসার পরপরই বিএনপি ষড়যন্ত্র করে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ ঘটায়, যেন আওয়ামী লীগের জয়কে বানচাল করে দিয়ে তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যায়। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় প্রাণ হারায় হাজার হাজার বাঙালি শ্রেষ্ঠ সন্তান বিডিআরের বিভিন্ন উচ্চ পদের কর্মকর্তারা।

সুতরাং, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মূলত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তনির্ভর একটি রাজনৈতিক দল। তাদের রাজনৈতিক আদর্শের মূলে রয়েছে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। তাদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বিস্তার শুধু নির্বাচন ঘিরেই নয় বরং আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা মানুষও তার আওতাভুক্ত। আওয়ামী লীগ যেখানে জনগণের সমর্থন ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিএনপি সেখানে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ সেখানে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে সংঘটিত করতে নির্বাচন কমিশনকে সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়ে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করতে যাচ্ছে। সেখানে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিএনপি ভোটারদের কম উপস্থিতি নিশ্চিত করতে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে ও চক্রান্তে লিপ্ত আছে। স্বাধীন ও নিরেপক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে সংঘটিত বিভিন্ন গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক বিজয় বিএনপির রাজনৈতিক পরাজয়কে নিশ্চিত করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্রই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বিজয়ের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারবে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ সব ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে।

লেখক: উপাচার্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়


শিশুশ্রম রোধে আমাদের করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সোমা মুৎসুদ্দী

শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজ যারা ছোট শিশু তারাই আগামী দিনের দেশ পরিচালনায় গুরুদায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু নানা কারণে আমাদের দেশের শিশুরা আজ উপযুক্ত পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত ও অবহেলিত। জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা বাধ্য হচ্ছে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে এবং তাদের বাধ্য করা হচ্ছে হাড়ভাঙা খাটুনিতে। তাই শ্রমজীবী শিশুদের নিয়ে জাতিসংঘ ও নানা সংস্থা আছে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে। নানা কারণে শিশুশ্রম সমাজ ও দেশে শিকড় গেড়ে বসেছে। এখনো আমাদের দেশে দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ। এরা অভাব-অনটন ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে ও জ্বালায় জর্জরিত হয়ে নিজেদের সন্তানদের শিশুশ্রমে বাধ্য করানো হচ্ছে। এ ছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম-আর্থিক বণ্টনের প্রতিক্রিয়ার ফলে শিশু শ্রমিকের সমস্যা জটিল আকার ধারণ করছে। আমাদের দেশে পিতৃমাতৃহীন শিশুরাই অধিক হারে শিশুশ্রমে জড়িত। বেঁচে থাকার জন্য নিরুপায় হয়ে তারা এপথে পা বাড়ায়। বিদ্যালয়ের প্রতি অনীহাও শিশুশ্রমের অন্যতম একটি কারণ। আন্তর্জাতিক, শ্রমসংস্থা এবং ইউনিসেফ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় বিভাগীয় শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০১, পুরাতন জেলা শহরে ২০১, নতুন জেলা শহরে ১৮৭, থানা সদরে ১৩৩, পার্বত্য এলাকাগুলোতে ২৩ এবং পল্লি এলাকায় ৯৪ ধরনের কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। এসব কাজের মধ্যে আছে- কুলি, হকার, রিকশা শ্রমিক, ফুল-বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, ইটপাথর ভাঙা, হোটেল শ্রমিক, বুনন কর্মী, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক, বেডিং স্টোরের শ্রমিক ও গৃহকর্মীর পেশা। তা ছাড়া ‘ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম’ শীর্ষক আরেক সমীক্ষায় দেখা যায়, কিছু বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও শিশুরা নিয়োজিত রয়েছে। যেমন- ইলেকট্রিশিয়ান, রাসায়নিকদ্রব্য তৈরির কারখানায় কাজ, মাদকদ্রব্য বিক্রি ও বহন। সমুদ্রবন্দর এলাকায় শিশুদের জোর করে মাফিয়া চক্রে যুক্ত করানো। এই উদ্দেশে অনেক শিশুকে অপহরণ করে পাশের দেশসহ নানা দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। চুরি, ছিনতাই, ভিক্ষাবৃত্তিসহ নানা কাজে এদের লাগিয়ে এক শ্রেণির দেশ ও সমাজবিরোধী লোক প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। তা ছাড়া পোশাকশিল্প কারখানাতেও হাড়ভাঙা খাটুনিতে শিশুদের নিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া শহরবাসী ভদ্রলোকদের বাসার কাজে শিশুরা প্রধান শ্রমিক হিসেবে কাজ পায়। শিশুদের শ্রমবৃত্তিতে নিয়োগ প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। বর্তমানে সভ্য দেশগুলোতে মানুষ যেখানে বিবেকশক্তি ও স্বাধীনতাবোধের বড়াই করে সেখানেও রয়েছে শিশুশ্রমের মতো ভয়ংকর পেশা। মানবতা আজ বড়ই বিপন্ন। বিশ্বের সব শিশুই, শিশু শ্রমিকরা মালিকের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়। অধিকার বঞ্চিত শিশুরা, তাদের শ্রমকর্তা কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই নির্যাতিত হয়ে থাকে। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও তারা দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না। অদক্ষ শ্রমিক বলে তাদের নেই নির্দিষ্ট মজুরি, অথচ আছে কথায়, কথায় জুলুম আর নিপীড়ন। সামান্যতম অমনোযোগিতার অভিযোগ এনে, গায়ে লাথি ও বেতের বারি সহ্য করতে হয় তাদের। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের শহরাঞ্চলে বড়লোকদের ঘরে শিশু নির্যাতনের হার বেড়ে গেছে। এদের ঘরে কাজের মেয়ে হিসেবে যারা কাজ করে তাদের সামান্য অপরাধের জন্য বাড়ির গৃহিণী অমানবিক শাস্তি দিয়ে থাকে। গায়ে আগুনের ছেঁকা দেওয়াসহ, খেতে না দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্রিকার পাতায় এসব নৃশংস ঘটনা খবরের কাগজে প্রকাশ পাচ্ছে। এ ছাড়া কল-কারখানায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন শিশু শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। শিশুশ্রম একটি মানবতাবিরোধী ও জঘন্য কাজ। শুধু বাংলাদেশেই নয় যেকোনো দেশের জন্য এর পরিণতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কারণ যে শিশুরা জাতির কর্ণধার ও ভবিষ্যৎ, শিশুশ্রমের কারণে তারা হয়ে উঠছে অযোগ্য ও অকর্মণ্য। শিক্ষা ও সুন্দর পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা হয়ে যাচ্ছে সামাজিকভাবে পঙ্গু। অতিরিক্ত শ্রমদানের ফলে শিশুদের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, তারা নানা অপুষ্টিতে রোগে ভোগে। পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘাটতি পূরণ হয় না ও জীবনীশক্তি ক্ষয় পেতে থাকে। তাদের ভাঙা স্বাস্থ্য আর উদ্ধার হয় না, ফলে শিশুরা অভিশপ্ত জীবন নিয়ে সমাজে বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশ শিশু ও নারী নির্যাতন আইন বলবৎ থাকলেও এর মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি। কেবল আইন দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য চাই জনসচেতনতা। উপযুক্ত শিক্ষার প্রসার ও দারিদ্র্য বিমোচন ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এর জন্য বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, যারা শিশু শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে, বিভিন্ন বিদেশি এনজিও ও সরকারকে নিতে হবে শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব। এক কথায় যেভাবেই হোক, আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিশুশ্রম রোধ করতে হবে। না হয় জাতির ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকার ও অভিশাপগ্রস্ত। তবে আশার কথা হলো এই কাজের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে ইতোমধ্যে অনেক দরিদ্র পিতামাতাই তাদের সন্তানদের কাজে দেওয়ার পরিবর্তে বিদ্যালয়ে পাঠাতে শুরু করেছে। মানবতার বিকাশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শিশুশ্রম রোধে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বস্তি এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে বিদ্যালয় খুলে তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্ব শিশু দিবসে শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও শিশুশ্রম বন্ধে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে ও শিশুশ্রমের প্রতি নিন্দা জানাতে হবে। এই সমস্যা সমাধানে প্রতিটি রাষ্ট্রের সরকার সচেতন হলেও কিছু মানুষের অসহযোগিতার কারণে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না ও সরকারি নানা উদ্যোগ অনেক সময় মুখ থুবড়ে পড়ছে। তবুও চাই আমরা সরকারের পাশাপাশি যে যার অবস্থান থেকে শিশুশ্রমকে না বলব ও শিশুশ্রম বন্ধে কাজ করে যাব জয় হোক মানবতার।

লেখক: বাচিকশিল্পী ও কবি

বিষয়:

এসএসসির ফল ও শিক্ষার মানোন্নয়ন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে, চারদিকে আনন্দের বন্যা বয়ে চলেছে, ফল প্রকাশের অনুভূতি প্রকাশকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ছেলের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কেন কমে যাচ্ছে, একটু ভেবে দেখা দরকার। এরা কি স্কুলে যাচ্ছে না? পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কেন কমে গেল? আমার মনে হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তা ভালোভাবে দেখা দরকার।’

আমরা সাধারণ জনগণ তার বক্তব্যকে সাধুবাদ ও অভিনন্দন জানিয়ে সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে আরও কিছু বিষয় নিয়ে দুটি কথা বলতে চাই।

ফল প্রকাশের আনন্দঘন মুহূর্তের জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করি, এই অপেক্ষার অবসান ঘটে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্যদিয়ে।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা বিনা মূল্যে পাঠ্যবই দিচ্ছি। করোনার সময়ও সঠিক সময়ে পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি এবং প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, ইউরোপ-আমেরিকায়ও একই অবস্থা। তার মধ্যেও আমরা বিনা মূল্যে শিক্ষার উপকরণ ও বই বিতরণ করেছি। এখানে আমরা কোনো কার্পণ্য করিনি। যেটা প্রয়োজন সেটা আমরা দিতে পেরেছি।’ ফলাফল প্রকাশের দিন সংবাদ সম্মেলনে পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমে যাওয়াকে স্বাভাবিক হিসেবেই তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি। করোনাভাইরাস মহামারির জন্য গত বছর সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে পরীক্ষা হলেও এবার হয়েছে পূর্ণ নম্বরে। এতে পাসের হার ও জিপিএ-৫ কিছুটা কমেছে বলে মনে করেন শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা।

হতাশাজনক খবর হলো এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি। কেন এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাস করতে পারেনি শিক্ষা-সংশ্লিষ্টদের সেই কারণ অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই শতভাগ শিক্ষার্থী পাস না করা কাম্য নয়। আরেকটি বিষয় লক্ষ রাখা দরকার, পাসের হার বাড়া-কমায় নজর না দিয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।

চলতি বছর এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা করোনার পর দুই বছর সময় পেয়েছিল, এই দুই বছর তারা কাজে লাগিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে। এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন ।এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন, এদের মধ্যে পাস করেছে ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৩ জন। গড় পাসের হার ৮৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থী। তবে গত বছরের চেয়ে এবার পাসের হার কিছুটা বেড়েছে ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও গত বছরের চেয়ে কমেছে। গত বছর সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থী। গত বছর এ হার ছিল ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

শুরু হয়ে যাবে কলেজে ভর্তির দৌড়ঝাপ, অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি।

এ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবারের এসএসসি ও সমমানের ফলে গণিত ও ইংরেজিতে তুলনামূলক কম পাস করেছে। এই দুই বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের দুর্বলতা রয়েই গেছে, করোনা মহামারিতে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে মৌলিক জ্ঞানের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে, কারণ শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা বছরের পুরোটা সময় ধরে অনলাইনে ক্লাস করার মাধ্যমে পড়াশুনা চালিয়েছে। করোনার সময় পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা না দেওয়ার প্রবণতা, না লেখার চর্চা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাডেমিক দুর্বলতা তৈরি করেছে, কিছুটা ভীতি কাজ করেছে। পরীক্ষায় ভালো ফল করার অনুষঙ্গ হচ্ছে লেখা, আগামীতে যারা ভালো পড়াশুনা করে খাতায় লিখে ভালো ফল করতে আগ্রহী তাদের সবারই উচিত বেশি বেশি করে লেখা।

দেশে শিক্ষার মান কতটুকু বাড়ল বা কমল তা বোঝা যায় পাসের হারের দিকে ভালোভাবে তাকালে, তবে পাসের হার যে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না তার প্রমাণ এইচএসসি পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সফলতার দিকে তাকালে প্রতীয়মান হয়, কারণ প্রতিবছর ৮০-৮৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী এসএসসি ও এইচএসসি পাস করার পরও ১০-১২ শতাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে থাকে। বাকিদের একটি বিশাল অংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো এবং বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন শিক্ষায় অংশ নিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।

প্রতিবছর এই শিক্ষার্থীদের একটি বিশাল অংশ আর পড়াশুনা চালাতে পারে না।

খুঁজে বের করতে হবে এই ঝরে পড়ার পিছনের কারণ, অভিভাবকদের সামর্থ্যের ব্যর্থতার পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের স্বল্পতা, উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ, খেলার মাঠ, শরীর চর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রের অপর্যাপ্ততা, মেধা বিকাশ ও মননশীল প্রতিভা অন্বেষণের অভাব, সচেতন শিক্ষকের স্বল্পতা ও সামাজিক অবস্থান ও তলিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সুধী সমাজের বোদ্ধারা। সবাই গুণগত শিক্ষার অনুসন্ধান করে থাকেন। নীতি ও নৈতিকতা ও আদর্শবান হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন সর্বত্র মানোন্নয়ন।

গুণগত শিক্ষা বা মানসম্মত শিক্ষা বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। এটি উন্নত বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল বিশ্বেও শিক্ষাবিদদের মনোযোগ আকর্ষণ করে চলেছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো টেকসই উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে গুণগত শিক্ষার ধারণা ও গুরুত্ব বিশেষভাবে তুলে ধরেছে।

শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর এই যোগ্যতা অর্জনের মান অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সর্বত্রই এর অবস্থা একই রকম। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়লেও মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে বাংলাদেশ ভীষণভাবে পিছিয়ে রয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দেশে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। বস্তুতপক্ষে সব স্তরের শিক্ষাতেই তাত্ত্বিক ধারা প্রাধান্য বিস্তার করছে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান উন্নয়ন দরকার। আরও অধিক পরিমাণে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও ল্যাব ব্যবহারের সুবিধা, শ্রেণিকক্ষে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকার নিরাপত্তা জোরদার করার প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি।

গুণগত শিক্ষার অনেক অপরিহার্য পূর্ব শর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে অধিক বিনিয়োগ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। এ কথাও অনস্বীকার্য, বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে খরচ করা হয় না, যা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। দেশে শিক্ষা খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ চাহিদার তুলনায় একেবারেই কম। শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ।

গুণগত শিক্ষা মূল্যায়নের সার্বজনীন কিছু নির্দেশক রয়েছে। এগুলোর ভিত্তিতে গুগণত শিক্ষা অর্জনে ও টেকসইকরণে কিছু সাধারণ পূর্বশর্ত পূরণ প্রয়োজন। এগুলো হচ্ছে- বৈষম্যহীন সমন্বিত শিক্ষা, আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাক্রম, মানসম্মত ও পেশার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ শিক্ষক সমাজ, প্রয়োজনীয় সুযোগ দিয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতায় এনে ধরে রাখা, সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, দুর্নীতি, মাদক নির্মূল ও অপচয়রোধ এবং শিক্ষায় অধিক বিনিয়োগ ইদানিং আরও একটি বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে, তা হচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহার বা অতিরিক্ত ডিভাইস-নির্ভরতা এবং মোবাইলের অপব্যবহার, তবে শিক্ষার মানোন্নয়নে কতগুলো বিশেষ পূর্বশর্ত বিবেচনা অপরিহার্য। শর্তগুলো হচ্ছে- শিক্ষক, প্রশিক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, তত্ত্বাবধান, নেতৃত্ব, শিক্ষাক্রম, শিক্ষণসামগ্রী, মূল্য যাচাই, শিক্ষানীতি ও পরিকল্পনা, বহিস্থ প্রশাসন, গবেষণা, পরিবেশ উন্নয়নে দ্রুত অর্থায়ন ইত্যাদি।

এসব পূর্বশর্ত পূরণের ওপর নির্ভর করে গুণগত শিক্ষার মাত্রা বৃদ্ধি সরকারের এই আসন্ন বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে অনুদান ও অর্থায়ন বৃদ্ধি, সেই সঙ্গে সঠিক মনিটরিং এজেন্ট দ্বারা সুষ্ঠু ও জবাবদিহিমূলক স্বচ্ছ পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

বিষয়:

ঘূর্ণিঝড় আইলার বিরুদ্ধে রিট

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

মে এবং নভেম্বর এ দুটি মাস বাংলাদেশের উপকূলে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের হানা দেওয়ার মৌসুম। ১৯৬০ সালের ১৪ মে, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর, ২০০৭ সালের ১৬ নভেম্বর সিডর, ২০০৯ সালের ১৫ মে আইলার আক্রমণ সবই এখনো দারুণ দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। সাম্প্রতিককালের সালতামামীতে সিডর ও আইলা বহুল উচ্চারিত। ২০০৯-এর ১৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার আক্রমণ নিয়ে সুন্দরবনে বসবাসকারী প্রাণী বৈচিত্র্যের পক্ষ থেকে যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে রসরচনায় তা তুলে ধরা হলো-

ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার বিরুদ্ধে রিট করার সিদ্ধান্ত নেয় সুন্দরবনের বাবাহকু (বাংলাদেশ বাঘ হরিণ ও কুমির) ফেডারেশনের আইন ও নিবর্তন নিরোধসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। আজ সুন্দরবনের কচিখালিতে বাবাহকুর কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার মন্ত্রকের মুখপত্র মলিশা মঞ্জিলা সাংবাদিকদের এ কথা জানান। মলিশার সংবাদ সম্মেলনের সূত্র ধরে বার্তাসংস্থা উবিসস (উড়ো বিভ্রান্তকর সংশয় সন্দেহ) প্রেরিত বাতাস বার্তায় জানা যায় গত বৃহস্পতিবার বাবাহকুর উচ্চ পরিষদ বনে-জঙ্গলে বিরোধীদলীয় সদস্যদের আনা এক মোশন প্রস্তাবের ওপর তীব্র ও প্রখর আলোচনার একপর্যায়ে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় সুন্দরবনের প্রাণী ও প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিতে এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গৃহীত না হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশে ফেটে পড়েন পক্ষের বিপক্ষের সবাই। সবার সম্মিলিত দাবির মুখে খোদ সিডর ও আইলার বিরুদ্ধেই সালিশী ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর সুবিদখালীর বর্ষীয়ান সদস্য, পাখ-পাখালি গোত্রের নেতা শঙ্খশালিয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি কণ্ঠভোটে গৃহীত হওয়ার পর উচ্চ পরিষদ অধ্যক্ষ শিয়ালেন্দু মামাইয়া তার রুলিংয়ে বলেন- সালিশ বিভাগ নিজের উদ্যোগে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে না গেলে বাবাহকুর পক্ষে কোনো কমিটি রিট পিটিশনটি দাখিল করতে পারে। ফেডারেশনের পরিচালনায় থাকায় বাবাহকুর নিজে এ জাতীয় মামলা দায়েরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেননা এর সঙ্গে ঘরে-বাইরের সম্পর্ক সংস্থাপনসংক্রান্ত স্পর্শকাতর বিষয়াদির যোগসূত্র রয়েছে।

সিডর ও আইলা এসেছে বাইরের থেকে, তাদের অভ্যন্তরীণ আইনের আওতায় সালিশে সোপর্দ করা যুক্তিযুক্ত হবে কি না এ ব্যাপারে সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করেন বাবাহকুর আইন ও সালিশ উপদেষ্টা বানরিয়া বাচাবন। অবশ্য বানরিয়া বাচাবনের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বিরোধী পক্ষের বিচার-সালিশ বিশেষজ্ঞ ময়নামন্দা। ময়নামন্দার মতে যেখান থেকেই আসুক না কেন বাতাস যেখানে যার ঘর ভেঙেছে সেখানেই তার হতে হবে বিচার। তিনি মেকং বনে বাঘ সম্প্রদায়ের সুখ্যাতির সর্বনাশ সাধনে দূর দ্বীপবাসী তক্ষক ও ভক্ষকদের বিরুদ্ধে দেওয়া একটি ঐতিহাসিক রায়ের কথা উল্লেখ করেন। উচ্চ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবটি আজ সকালে বাবাহকু প্রেসিডিয়ামের প্রেসিডেন্ট সুন্দরমিয়ার সানুগ্রহ সম্মতি লাভ করলে রিট দায়েরের জন্য বাবাহকুর আইন ও নিবর্তন নিরোধ কমিটিকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। আগামী কাল সালিশালয় বন্ধ থাকায় পরশু এটি দাখিল হতে পারে বলে মঞ্জিলা সংবাদ ব্রিফিংয়ে আভাস দেন।

এদিকে দুবলারচর থেকে সলিশালয় সূত্রে সাংবাদিকরা জানিয়েছেন সিডর ও আইলার বিরুদ্ধে সালিশালয় থেকে স্বউদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রাজ্ঞ পণ্ডিত প্রবরেরা। তবে তাদের ধারণা সব ব্যাপারে স্বউদ্যোগে অভিযোগ দায়েরে সংশ্লিষ্ট হতে গেলে সালিশে মনোযোগের সময় কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে এবং সালিশজীবীরাও এর মধ্যে তাদের মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করতে পারেন। পরশু সালিশজীবীদের পলিটব্যুরোতে এতদবিষয়ক এক আলোচনায় এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রাথমিক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে সংবাদসংস্থা বৈরী বাতাস ডট কম পরিবেশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়-

উপকূলীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রতিপক্ষ আইলার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের বিবরণীটি সিভিনিউজ ডট ৪৮ মিডিয়ার জন্য উন্মুক্ত করেছে। তাতে বলা হয়েছে ২০০৯ সালের মে মাসে আইলা ঘাপটি মেরে থাকা আপসহীন মনোভাব নিয়ে অতর্কিত আক্রমণে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় অবর্ণনীয় দুর্যোগ এবং দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগের কারণ সৃষ্টি করে। আইলা দুদেশের সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল কালিন্দীর মোহনা দিয়ে উঠে এসে ব্যাপক জলোচ্ছ্বাস ঘটায়, ফলে উভয় পাড়ের সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয় আর সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের নিম্নাঞ্চল হঠাৎ পাবনের পানিতে তলিয়ে যায়। পরে সেখানে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি হয় জনবসতিতে, কৃষিক্ষেতে, মৎস্য চাষে। মুহূর্তের মধ্যে সহায়-সম্বল ও গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। সুন্দরবনের মধ্যে সৃষ্ট বীভৎসকর পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বাবাহকুর তথ্য বিভাগের প্রধান হরিণা হাপানের সে সময়কার বিবৃতিটি এক্সিবিট আকারে আরজির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। হরিণা আইলায় সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের জন্য তাৎক্ষণিক বড় ক্ষতি সম্পর্কে সে সময় বলেছিলেন, এবারের বানে [আইলায়] আমরা বেশি সমস্যায় পড়েছি খাবার পানি নিয়ে। বাদার মধ্যে যে কয়টা পুকুর আছে আমরা দলবেঁধে সেখানকার পানি খেতাম। নোনা পানি আমরা তেমন খেতে পারি না। এসব পুকুরে আমাদের জন্য মিষ্টি পানির ব্যবস্থা ছিল কিন্তু এবারের বানে এসব পুকুর তলিয়ে গিয়ে নোনাপানিতে ভরে গেছে। এখনকার ছিটেফোঁটা বৃষ্টির পানি এই নোনা পানিকে মিষ্টি করতে পারছে না। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই। দুবলার চরে অনেক বন্দুকওয়ালা সেই লোকটা বড় পাড় বাঁধা পুকুর কেটে কি উপকারটা না করেছিলেন এবার সে পুকুর ডোবেনি। ওখানে আমাদের যারা আছে তারা সে পানি পাচ্ছে। আমাদের এখান থেকে তা অনেক দূর। ওরকম পাড়বাঁধা পুকুর কাটলে খুব কাজে লাগত। আর বর্তমানের এসব পুকুরের নোনা পানি ছেচে বের করে দিয়ে বৃষ্টির মিষ্টি পানি ধরার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হতো।’

আইলায় সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হরিণা হাপান তখন জানিয়েছিলেন, আমরা প্রকৃতির কোলেই আছি। এজাতীয় বান আমরা প্রায়ই মোকাবিলা করি- আমাদের নিজস্ব একটা নিয়ন্ত্রণ বা আত্মরক্ষার ব্যবস্থা আছে। তবে এবারের বানটা এসেছে হঠাৎ করে, আমরা বুঝে সারতে পারিনি। পানি এসেছে আচমকা ও অনেক পরিমাণে ফলে অনেকে সময়মতো উঁচু জায়গায় যাওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় আমাদের অনেকেই মারা পড়েছেন। জোয়ারের সময় জলোচ্ছ্বাস হওয়ায় এমনটি হয়েছে, সচরাচর ভাটার সময় বান আসে।’

আইলার বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ সে পূর্ণিমার ভরা জোয়ারের সময় আঘাত হানে এর ফলে পানির পরিমাণ ও স্রোতের তোড় বেশি হওয়ায় বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে সবকিছু ডুবে যায় হঠাৎ করেই।

আর্জিতে স্থানীয় জনগণের জীবনে নেমে আসা দুর্গতির বর্ণনায় বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আইলায় পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, শমসেরনগর আর বাংলাদেশের সাতক্ষীরার শ্যামনগর আশাশুনি আর খুলনার দাকোপ ও কয়রার বেশ কয়েকটা ইউনিয়নের মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে আজ দারুণ অসহায় অবস্থায় । শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের হরিচরণ মণ্ডল মোটামুটি অবস্থাপন্ন-তার দুদুটো দশ একরি মাছের ঘের, পঞ্চাশ বিঘে ভালো ধানী জমি, গোলাভরা ধান আর আটচালা ঘর উঠোন দহলিজ সবই এখন থৈ থৈ পানির নিচে। মেয়েটা শ্যামনগর কলেজে পড়ে, এবার আই এ পরীক্ষা দেবে, টুঙ্গীপুর শ্বশুরবাড়িতে পরিবার পাঠিয়ে দিয়ে সে আর তার বড় ছেলে নিবারণ বেড়িবাঁধের ওপর পলিথিনের চোঙায় থাকে। এ যেন সকালবেলার আমির ফকির সন্ধ্যাবেলা। তিনশ বিঘে জমির মালিক কয়রার নাংলার নাসের সরদার সেদিন লাইনে দাঁড়িয়ে রিলিফ নিতে গিয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল। টিভির বাক্সে সেই ছবি দেখে জায়গীরমহলে বাড়ি তার এক আত্মীয় ঢাকা থেকে ফোন করে তাকে আর কি সান্ত্বনা দেবে? মাসের পর মাস গেল পানি তো কমেইনি তাদের বুকের ভেতর এই পানি কালা পানির স্রোত হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তাদের আশাভরসা আর সব স্বপ্নকে। আজকাল সাগরে, নদীতে এমনিতে প্রায়ই জোয়ার বড় বাড়ন্ত। রাজধানী ঢাকায় বসে বিশেষজ্ঞরা বলা বলি করছে এই পানি নাকি সহজে সরবে না, সমুদ্রের তলা উঁচু হয়ে গেছে পানি টানবে কীভাবে? আইলার আক্রমণের প্রতি ইঙ্গিত করে আর্জিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নিচু এলাকাগুলো এ ধরনের আক্রমণে স্থায়ীভাবে তলিয়ে যেতে পারে, সুন্দরবন ডুবে যেতে পারে, মালদ্বীপের মতো দেশও হয়তো তলিয়ে গেলে আর জাগবে না। সমুদ্রের তলা উঁচু হচ্ছে কেন, কার কারসাজি কিংবা দোষে? যার জন্য হোক কিংবা যেভাবে হোক দেশের উপকূল অঞ্চলের জেলাগুলোর মানুষ আর সুন্দরবনের তাবৎ প্রাণিসম্পদ গাছ-গাছালি তার ভোগান্তির শিকার, কত অসহায় আজ তারা। আইলার সময় বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে কিংবা ছাপিয়ে নোনা পানি সেই যে ঢুকল বর্গীর মতো, মাছের ঘের ধানচালের খামার, বনের সব প্রাণী ও গরু-ছাগলের খাবার সবই তো পয়মাল। আইলার বিরুদ্ধে মানবতা, প্রাণিসম্পদ , প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগ এনে আর যাতে এ ধরনের বিপর্যয় না আসে তার প্রতিবিধান বা প্রতিরোধাত্মক নির্দেশনা কামনা করা হয়েছে।

লেখক: উপকূলীয় অর্থনীতির গবেষক ও বিশ্লেষক, সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


১৭ মে: বাংলাদেশের ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা দিন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোঃ শাহিনুর রহমান

বাংলাদেশের চলমান ইতিহাসে ১৯৮১’র ১৭ মে বঙ্গকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনাটি যে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা যত দিন যাচ্ছে ততই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতায় আসা প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক স্বৈরশাসকেরা স্বাধীন বাংলাদেশকে পুনরায় যেভাবে উল্টোরথে চড়িয়ে অধঃপাতে নিয়ে যাচ্ছিল, বঙ্গবন্ধুকন্যা সেদিন ফিরে না এলে আর কোনোদিন নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যের সোজা পথে ফিরে আসা বাংলাদেশের পক্ষে আদৌ সম্ভব হতো কি না সে-ব্যাপারে গভীর সন্দেহের অবকাশ আছে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর সামান্য আলোকপাত করা প্রয়োজন মনে করছি। কারণ এ ইতিহাস পুরোনো প্রজন্মের অনেকের জানা থাকলেও এ ব্যাপারে নতুন প্রজন্মের কোনো ধারণা নেই বললেই চলে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন তার ছোটবোন শেখ রেহানা এবং দুই সন্তানসহ স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন, যার ফলে তারা প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বাকি সদস্যরা এবং সম্প্রসারিত পরিবারের অনেক সদস্যও সেদিন শিকার হন শুধু বাংলার নয়, বিশ্বের এক নৃশংসতম রাজনৈতিক গণহত্যাকাণ্ডের।

এ হত্যাকাণ্ডের পর জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী এম.এ. ওয়াজেদ মিয়া ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং এ আবেদন অনুমোদিত হয় ২৪ আগস্ট। জার্মানির ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা জননেত্রী শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া, তাদের দুই শিশুসন্তান সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শেখ রেহানাকে ১৯৭৫-এর ২৫ আগস্ট সকালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে করে দিল্লি পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।

দিল্লিতে পৌঁছানোর কয়েকদিন পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে গিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার স্বামী বাংলাদেশের ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১—টানা প্রায় ছয় বছর দিল্লিতে তাদের নির্বাসিত জীবন কাটানোর সময় আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিভিন্ন সময়ে দিল্লিতে যান তাদের খোঁজখবর নিতে এবং দেশ ও দলের এক গভীরতম সঙ্কটলগ্নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিতে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে রাজি করানোর অভিপ্রায় নিয়ে। এদের মধ্যে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, জিল্লুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, তৎকালীন যুবনেতা আমির হোসেন আমু প্রমুখ।

এর পর ১৯৮১’র ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে জননেত্রী শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সম্মেলনের এক সপ্তাহ পরে ২৪ ফেব্রুয়ারি আবদুল মালেক উকিল, জিল্লুর রহমান, আবদুল মান্নান, আবদুস সামাদ, এম. কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, গোলাম আকবর চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আইভি রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ ঢাকা থেকে দিল্লিতে যান, এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে পর পর কয়েকটি বৈঠকে বসে নেত্রীকে দেশে ফিরতে রাজি করান এবং ফেরার পরবর্তী কর্মপন্থার খসড়া পরিকল্পনা করেন।

দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথ থেকে জোর করে বিচ্যুত করা জাতিকে আবার ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে বঙ্গবন্ধু-তনয়ার প্রয়োজনের গভীরতা তারা সেদিন নেত্রীকে বোঝাতে পেরেছিলেন। দেশ, জাতি আর দলের সেই ভয়াবহ সঙ্কটকালে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে জননেত্রী শেখ হাসিনা অবশেষে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দেশে ফিরতে সম্মত হন।

দিল্লিতে দুই শিশুসন্তান জয় আর পুতুলকে ছোটবোন শেখ রেহানার কাছে রেখে ১৯৮১’র ১৭ মে দেশে ফেরেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক আবহের মতো সেদিনকার আবহাওয়াও ছিল তীব্র ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। ঘণ্টায় ৬৫ মাইল বেগে বইছিল ঝোড়ো বাতাস, সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়বাদল অগ্রাহ্য করে সেদিন লক্ষ লক্ষ লোক জমা হয়েছিল তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে স্বাগত জানানোর জন্যে।

সেদিন বিকেল ৪টায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে জননেত্রী শেখ হাসিনা পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে চরাচর মুখরিত হয়ে ওঠে। লক্ষ লক্ষ মানুষের কণ্ঠে সমস্বরে ঘোষিত হয়-- ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’; ‘পিতৃহত্যার বদলা নিতে, লক্ষ ভাই বেঁচে আছে’; ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’...।

দেশের মাটিতে পা দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা সেদিন জনতার উদ্দেশ্যে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।... সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’

তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসি নি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’

দেশে ফিরে যেসব অঙ্গীকার নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেন তার মধ্যে ছিল: বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার স্বৈরতন্ত্রের চিরঅবসান ঘটিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠা। এসব অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কখনো পিছু হটেননি বঙ্গবন্ধুকন্যা।

দেশে ফেরার পর শুরু হয় সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জননেত্রী শেখ হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম, যা চলে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে। জেল-জুলম, অত্যাচার কোনোকিছুই তাকে তার পথ থেকে একতিলও টলাতে পারে নি। বাংলার মানুষের হৃত অধিকার পুনরুদ্ধার করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বার বার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। বাংলার জনগণ তার বৈপ্লবিক ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ভূষিত করেছে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ অভিধায়।

দেশে ফেরার পর জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার অপূর্ণ স্বপ্নকে সম্পূর্ণতা দেয়ার পথে সকল বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে পুরোপুরি প্রস্তুত বলে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হতে হয়।’ মহান নেত্রী তার জীবন দিয়ে তার এ উক্তিকে সত্য প্রমাণিত করেছেন। বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালে ঘাতকেরা তার ওপর একের পর এক প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে। বার বার তিনি সাক্ষাৎ মৃত্যুর মখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করেন নি। বঙ্গকন্যার অদম্য সাহস আমাদেরকে প্রাণিত ও প্রণোদিত করে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের সংগ্রামে আরো সাহসী হয়ে ওঠায়। মৃত্যুঞ্জয়ী জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ সত্যিই এক মহৎ প্রেরণার নাম।

১৯৮১ থেকে ২০২৪-- সুদীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর জননেত্রী শেখ হাসিনার সেদিনকার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আর অঙ্গীকারের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য ক্রমপরিস্ফূট হয়ে উঠছে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা যদি সেদিন ফিরে না আসতেন, কবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী, উগ্র সাম্প্রদায়িক, সামরিক স্বৈরাচারী অপশাসনের আগ্রাসন থেকে জাতি কোনোদিন মুক্তি পেতো কিনা সন্দেহ। জাতির পিতা আর তার স্বপ্নের হন্তারকেরা জাতিকে যে-উল্টোরথে চড়িয়ে এক কৃষ্ণবিবরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, জননেত্রী শেখ হাসিনাই তার চুয়াল্লিশ বছরব্যাপী সংগ্রাম আর সরকার পরিছালিনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বিনিময়ে সেই উল্টোরথকে উন্নয়ন ও প্রগতির আলোকাভিমুখী সোজা পথে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন।

১৯৮১’র ১৭ মে দেশে ফিরে জননেত্রী শেখ হাসিনা যেসব কথা বলেছিলেন, যেসব অঙ্গীকার করেছিলেন, সেগুলোকে সত্যে পরিণত করেছেন কঠোর নিষ্ঠা আর একাগ্র প্রচেষ্টায়। পঁচাত্তরপরবর্তী প্রবল প্রতিকূল সময়ে বিরুদ্ধস্রোতে কুটোর মতো ভাসমান ও ভগ্নপ্রায় আওয়ামী লীগ তার সময়োপযোগী বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই আজ একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে অনেক বেশি সুসংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পেরেছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আর ২০০৯ থেকে চলতি ২০২৪ পর্যন্ত মোট কুড়ি বছর প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব সর্বোচ্চ যোগ্যতার সঙ্গে পালন করে চলেছেন। ২০২৩-এ জনগণের নিরঙ্কুশ রায় নিয়ে টানা চতুর্থবার এবং সব মিলিয়ে পঞ্চমবার ক্ষমতায় আসার সূত্রে এ দফায় তাকে আমরা আরও চার বছর সরকার-প্রধান হিসেবে পাচ্ছি, এটা জাতির জন্যে এক বিরাট পাওয়া। আগামীতে আবারো আমরা তাকে নির্বাচিত করবো এবং আজীবন তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, এটাই আমাদের আশা।

এ ছাড়া ১১ বছরেরও বেশি সময় তিনি জাতীয় সংসদে একজন সংগ্রামী বিরোধী দলীয় নেতার ভূমিকাও পালন করেছেন। বঙ্গকন্যার হাত ধরে তার দল ও দেশ আজ প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক স্বৈরাচারী অপশাসনের দুঃসহ স্মৃতিকে পেছনে ফেলে পৌঁছে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। জননেত্রী শেখ হাসিনার সেদিনকার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে বিশ্বসভায় সমুন্নত শিরে দাঁড়াতে শিখিয়েছে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার গত ৪৪ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অর্জিত মাইল ফলকগুলো হলো: সামরিক স্বৈরশাসনের অবসান, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এবং জাতির ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশকে তিনিই আজ খাদ্যে সম্পূর্ণ স্বয়ম্ভর করে তুলতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার খুনিদের এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন তথা রায় কার্যকর করিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের এক নতুন পথের অভিযাত্রী। তারই দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের চোখে ‘উন্নয়নের আইকন’ হয়ে উঠেছে। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে কথিত বাংলাদেশ আজ পরিণত হয়েছে ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশ’-এ ।

প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রখর দূরদৃষ্টি, অক্লান্ত পরিশ্রম আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফলে দেশের এমজিডি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন, লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠা, কৃষি দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার মাধ্যমে পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া বাস্তবায়িত হয়েছে পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রো রেল, চট্টগ্রামের কর্ণফুলি টানেল প্রভৃতি মেগা-প্রকল্পগুলো এবং বাস্তবায়নের পথে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর প্রভৃতি আরও কিছু মেগা-প্রকল্প।

প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতক চক্রের হাতে পড়ে প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়া একটি দেশ ও জাতিকে আবার নিজের সুস্থ সবল দৃঢ় পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন অনাপোষ ও স্থিতপ্রতিজ্ঞ বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন একটি সম্মানজনক পরিচিতি। আজ বাংলাদেশ বিশ্বের সামনে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে তারই কারণে। তিনি আজ জাতীয় নেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রীর পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন।
বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ‘মানবতার জননী’, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে আজ অনেকটাই বাস্তবে পরিণত করেছে তার সুযোগ্য কন্যার গতিশীল নেতৃত্ব। আর এসব সম্ভব হচ্ছে শুধুমাত্র তিনি ১৯৮১’র ১৭ মে দেশে ফিরে আসার যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন বলেই। আর সেকারণেই ১৭ মে দিনটি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা হয়ে গেছে।

লেখক: গবেষক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ, ফোকলোরিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।


হিজড়া সম্প্রদায়ের পুনর্বাসন জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
খন্দকার হাসানুজ্জামান

বাংলাদেশের বহুল আলোচিত এক জনগোষ্ঠীর নাম ‘হিজড়া’। হিজড়া বলতে সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তলিঙ্গ, উভয়লিঙ্গ, তৃতীয় লিঙ্গ বা রূপান্তরিত নারী-পুরুষদের বোঝানো হয়। তারা পূর্ণাঙ্গ পুরুষ নয়, আবার পূর্ণাঙ্গ মহিলাও নয়। দৈহিক বা জিনগত পুরুষ ও নারীর মধ্যবর্তী জন্মগতভাবে কোনো অবস্থানের ব্যক্তিরাই হিজড়া। হিজড়া শব্দের ইংরেজি পরিভাষা হচ্ছে ‘ট্রান্সজেন্ডার’। আরবিতে হিজড়াদের বলা হয় ‘খুনছা’। চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুসারে, ক্রোমোজমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌনপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি যাদের দৈহিক বা জেনেটিক কারণে নারী বা পুরুষ কোনো শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সমাজে তারা হিজড়া হিসেবে পরিচিত। হিন্দু পুরাণে বর্ণিত কৃতবীর্যের পুত্র অর্জুনও ছিলেন হিজড়া, যার অপর নাম বৃহন্নলা। যেকোনো দেশে যেকোনো পরিবারে হিজড়া সন্তানের জন্ম হতে পারে। অনাদর ও অবহেলায় বড় হলে তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে হিজড়াদের দলে ভিড়ে যায়। বিশ্বের ট্রান্সজেন্ডারদের ৪০ শতাংশ বিষণ্নতায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে। অথচ তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলার কেউ নেই।

পথচারীদের বেশিরভাগ সময় উত্ত্যক্ত করে জোরপূর্বক টাকা আদায় করে বিশেষ করে ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি রুটে চলাচলকারী বাস সমুহে দুইজন করে হিজড়া উঠে এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে চাঁদাবাজি করে থাকে যা এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে, এদের আচরণে কোমলমতি শিশুদের এ মহিলা যাত্রীদের সামনে পুরুষ সদস্যদের বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়।

দীর্ঘকাল ধরে তারা এরা অবহেলিত, অনাদৃত ও ভাগ্যবিড়ম্বিত। সমাজের সদস্যদের মনের অন্ধকার ও ব্যাধিগ্রস্ত মানসিকতার কারণে এ জনগোষ্ঠী নিজেদের বিচ্ছিন্নভাবে। তাচ্ছিল্য, উপহাস ও সামাজিক বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য তারা যৌনব্যবসা, ভিক্ষাবৃত্তি, চাঁদাবাজিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এসব মানুষ পরিণত বয়সে অসহায় হয়ে পড়েন। তাদের চিকিৎসা ও দেখভালের জন্য কোনো আপনজন বা নিকট আত্মীয় থাকে না। এদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে এনে সম্মানজনক জীবিকার ব্যবস্থা করা আশু প্রয়োজন।

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রথম উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সাদিয়া আখতার পিংকি। তিনি মনে করেন, ‘হিজড়ারাও মানুষ। তাদের হেয় চোখে দেখার কিছু নেই।’ তিনি নিজে তাই সব মানুষের জন্য কাজ করতে চাচ্ছেন। আর এলাকার মানুষ চাইলে আরো বড় দায়িত্ব নিতে চান ভবিষ্যতে। নানা সামাজিক প্রতিকূলতা তাকে পার হতে হয়েছে। এমনকি নির্বাচনে দাঁড়ানোর পরও তাকে কটূক্তি শুনতে হয়েছে। পিংকি বলেন, ‘যারা আমাকে কটূক্তি করেছেন তাদের আমি এড়িয়ে চলিনি। তাদের কাছে গিয়ে বলেছি, আমিও তো তোমাদের মতো মানুষ।’ তারা আমার কথা তখন শুনেছেন। আমাকে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পিংকি বলেন, সবার সঙ্গে মিশে তাদের মন জয় করেছি।

বাংলাদেশে হিজড়াদের পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ পেতে বিড়ম্বনা ও জটিলতা রয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো আইনেই স্পষ্ট কিছু বলা নেই। হিজড়া জনগোষ্ঠী যেন মা-বাবার সম্পত্তির সমান ভাগ পান, সে জন্য আইন মন্ত্রণালয় মুসলিম শরিয়াহ আইন এবং সংবিধানের আলোকে একটা উপায় বের করার চেষ্টা করছে। হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন। শরিয়াহ আইনে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীও মানুষ। তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক মানবিক আচরণ করতে হবে। লৈঙ্গিক বৈকল্যের কারণে কাউকে দূরে ঠেলে দেওয়া কোনোক্রমে উচিত হবে না। সমাজের একটি অংশকে অন্ধকারে রেখে আমরা আলোর সন্ধান করতে পারি না। তাদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, উপযুক্ত ও কর্মমুখী শিক্ষা ও সম্মানজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে তারাও অবদান রাখতে পারবে এবং মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এখন সহজ হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান , গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি এনজিও এবং সেবা সংস্থাগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে এগিয়ে আসতে পারে।

লেখক: গবেষক, পরিবেশকর্মী


প্রত্যাবর্তন শেখ হাসিনার: পূর্ণতা স্বদেশের

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোস্তফা কামাল

১৯৮১ সালের ১৭ মের আগ পর্যন্ত আরেকটি তারিখ ছিল স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের। সেটি ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে এ তারিখটিতে স্বাধীন দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর মা-বাবাসহ স্বজনহারা মুজিবকন্যার একাশির ১৭ মে স্বদেশ ফেরার আরেক প্রেক্ষিত। তবে ভিন্ন ভিন্ন স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাঝেই দেশের ও ইতিহাসের পরিপূর্ণতা, ছিল অনেক বেদনা। সঙ্গে আবেগ-আনন্দাশ্রু। পঁচাত্তরের আগস্ট ট্র্যাজেডির সময় বিদেশ থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। দুই বোনের আর্থিক সম্বল বলতে ছিল কেবল ২৫ ডলার। স্বামীর জার্মান ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে ২৫ আগস্ট স্বামী, বোন ও দুই সন্তানসহ দিল্লিতে পৌঁছান শেখ হাসিনা। ভারতে তখন জরুরি অবস্থা, দুই সপ্তাহ দিল্লির ডিফেন্স কলোনিতে থাকার পর ইন্দিরা গান্ধীর স্বাক্ষাৎ পান তারা। ইন্দিরা গান্ধীর আদেশে দুজন নিরাপত্তাকর্মীসহ তাদের থাকার নতুন ঠিকানা হয় ইন্ডিয়া গেট সংলগ্ন পান্ডারা পার্ক, সি-ব্লক ফ্ল্যাটে। ১ অক্টোবর ’৭৫ সালে এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে পরমাণু শক্তি বিভাগে স্বল্প বেতনে ফেলোশিপ দেয় ভারত সরকার। লন্ডনপ্রবাসী শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে বিয়ের পর ১৯৭৬ সালের ২৪ জুলাই শেখ রেহানা লন্ডন চলে যান।

দেশের রাজনীতিতে তখন ভিন্ন পরিস্থিতি। মুশতাক-সায়েম ইত্যাদি পর্ব শেষে রাষ্ট্রক্ষমতায় জিয়াউর রহমান। আর আওয়ামী লীগ অনেকটা নেতৃত্বহীন, কয়েকভাগে ব্যাকেট বন্ধী। নৌকা কাণ্ডারিহীন। অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে দলের শীর্ষ কয়েক নেতার উপলব্ধিতে আসে দল রক্ষা করতে গেলে দরকার বঙ্গবন্ধুর রক্তের অধিকার। তাদের ওই সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের পর ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ওই সম্মেলনে শেখ হাসিনা শুধু দলটির সভানেত্রীই হলেন না, ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলটিকে। এরপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১৬ মে পুতুলকে নিয়ে রওনা দিয়ে কলকাতা হয়ে ১৭ মে ফেরেন নিজ মাতৃভূমিতে। তথ্য-সাবুদে দেখা যায়, তাকে বহন করা ইন্ডিয়া বোয়িং এয়ারলাইন্সের কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে নামে বিকাল সাড়ে ৪টায়। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সেদিন বাতাস ছিল বেশ গতিময়। সঙ্গে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। তাকে বরণ করতে সেই বিরূপ আবহাওয়ার মাঝেই প্রায় ১৫ লাখ মানুষ জড় হয় শেরেবাংলা নগর হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত।

শেরেবাংলা নগরের বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকন্যার ভাষণের কয়েকটি লাইন ছিল এমন- ‘সব হারিয়ে আজ আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’ ... ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসেবে জনগণের সামনে আসিনি। আমি আপনাদের বোন, মেয়ে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে সেদিন শেখ হাসিনার আরও উচ্চারণ ছিল, ‘সব হারিয়ে আজ আমি এসেছি বাংলায়। এ দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিতে। আমার আজ হারানোর কিছুই নেই।’ আজকের জনসভায় লাখো চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। শেখ হাসিনা বলেন, ভাই রাসেল আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। বড় আবেগময় শেখ হাসিনার সেই ভাষণ। আর প্রত্যাবর্তন ছিল দেশ- দলের জন্য সময়ের দাবি। তা অনেকটা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘যাত্রী আমি ওরে। পারবে না কেউ রাখতে আমায় ধরে’-র মতো। শেখ হাসিনাকে কেউ ধরে রাখতে পারেনি। পারছেও না। একাশিতে দেশে ফেরার পর অবিরাম কেবল এগোচ্ছেন তিনি। বিভক্ত দলকে একই করেননি। দীর্ঘ একুশ বছরের লড়াই-সংগ্রাম শেষে ছিয়াশিতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছেন। এরপর ২০০৯ থেকে আছেন টানা চারবার। যা কারো কাছে বিস্ময়ের । কারো কাছে ঈর্ষার। জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হওয়ার। মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে সাহস- প্রজ্ঞায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে তিনি কেবলই আগোয়ান-ধাবমান। তা কোনো ম্যাজিক বা মন্ত্র পাঠে নয়। তা সম্ভব হয়েছে সাহস আর চেতনায়।

বিমানবন্দর থেকে শেখ হাসিনা সরাসরি গিয়েছিলেন তাদের বাড়ি ৩২ নম্বর ধানমন্ডি যেখানে ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে ৬ বছর আগে বাবা-মাসহ পরিবারের সব আপনজনকে হারিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না। তখন ৩২ নম্বরের সামনের রাস্তাতে বসেই বুকফাটা আর্তনাদে সবার জন্য দোয়া করেছিলেন, আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছিলেন। ওই সময়টায় গণমাধ্যম আজকের মতো বিস্তৃত ছিল না। আর গণমাধ্যম মানে পত্রিকা। এর মাঝেও শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। তখনকার আলোচিত সাপ্তাহিক ‘ইত্তেহাদ’ এ লেখা হয়, ‘ইন্দিরার নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে এবং বাংলাকে সিকিম বানাবার জন্যই শেখ হাসিনাকে দেশে পাঠানো হচ্ছে।’ সরকারি পত্রিকা ‘দৈনিক বাংলা’ এ ঘটনায় ভারতীয় পত্রিকায় ‘খুশির জোয়ার’ দেখেছে। ‘হলিডে’ তে লেখা হয়, ‘তার দেশে ফেরার ব্যাপারটি ঢাকা ও দিল্লি কর্তৃপক্ষের মধ্যকার এক চুক্তি অনুসারে বহু আগেই স্থির করা হয়।’ শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে পরদিন ১৯৮১ সালের ১৮ মে দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকায় লেখা হয় ‘লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয় তাদের নেত্রীকে’ শিরোনামে লিখে- রাজধানী ঢাকা ১৭ মে মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিও মিছিলের গতিরোধ করতে পারেনি। শ্লোগানেও ভাটা পড়েনি। লাখো কণ্ঠের স্লোগান নগরীকে প্রকম্পিত করেছে।

দলকে এবং দেশকে এ অভিযাত্রায় আনতে অনেক লড়াই-সংগ্রাম, চড়াই-উৎরাই, হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার আগের ছয়টা বছর তার দুঃসহ যন্ত্রণা এখনো অনেকের ধারণা-কল্পনার বাইরে। রওনা হওয়ার কয়েকদিন আগে মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজউইকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে শেখ হাসিনা একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ১১ মে ৮১ প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, তিনি নিহত হওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত নন; এমন কী যে সরকারের মোকাবিলা করবেন তার শক্তিকে তিনি বাধা বলে গণ্য করবেন না। ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’ ভারত থেকে ফেরার সময় দিল্লি বিমানবন্দরে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ছ-বছরের প্রবাস জীবনে আমার প্রতি যে মমতা ও ভালোবাসা দেখানো হয়েছে, তার জন্য আমি ভারতের জনগণকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।’ সেই ঝুঁকির মাঝেই যে তার দেশে ফেরা, ফেরার পর বেঁচে থাকা, দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে ক্ষমতা, সেই ক্ষমতায় টিকে থাকা- সে কথা তিনি নিজ মুখেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন। সে সময়ে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে শেখ রেহানার এক স্মৃতিচারণে রয়েছে- ‘কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছিলাম। ঘাতকরা যদি আবার সক্রিয় হয়ে তাদের আরাধ্য কাজ শেষ করতে তৎপর হয়ে ওঠে? আমি ঠিক করলাম জয় আর পুতুলকে আমি সেই মৃত্যুপুরীতে যেতে দেব না। ওদের লন্ডনে নিয়ে আসব। ঠিক তখনই পুতুলের পক্স হলো। এদিকে দিল্লিতে আমার তিন সপ্তাহ থাকার কথা। কিন্তু বিশ্রীভাবে হাত পুড়ে যাওয়ায় প্রায় দু’মাস তখন চলে গেছে। আমার অফিসের ছুটি ও আর বাড়ানো যাচ্ছিল না। তাই কেবল জয়কে নিয়ে আমি লন্ডন ফিরলাম।’

আজকের বাস্তবতায় ভাবা যায় দুই বোনসহ পরিবারটির দুঃসহ সেই কষ্টের দিনাতিপাতের কথা? বাস্তব ও কঠিন এ পথে দেশে ফিরে বারবার মৃত্যুর মুখে পড়ছেন শেখ হাসিনা। এ পর্যন্ত তিনি ২০-২১ বার শত্রুপক্ষের হত্যা চেষ্টার সম্মুখীন হয়েছেন। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিনটি তাই কেবল একটি তারিখ নয়, ইতিহাসের বাঁক ঘুরানো ঘটনা। এর মাঝে শুধু তার দল নয়, রাজনীতির মাঠের আরও অনেকের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় আছে। কথা দেওয়া, কথা রাখার পথে ডানবাম না তাকানোর চর্চা বঙ্গবন্ধুর ছিল। সেই শিক্ষা শেখ হাসিনাও নিয়েছেন। ওয়াদা বা অঙ্গীকার অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে কুখ্যাত ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বিচার শুরু করেন তিনি। ওই আমলেই ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের আদালত কর্তৃক ঘোষিত বিচারের রায়ে প্রকাশ্য ফায়ারিং স্কোয়াডে ১৫ জন ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুলভোটে জিতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেন। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। কারও কাছে হার না মানার এ বৈশিষ্ট্যেই এগিয়ে চলছেন তিনি। যা কেবল স্থানিক বা জাতীয় রাজনীতিতে নয়, বিশ্ব দরবারেও আলোচিত অভিযাত্রায় শামিল করেছে। বিশ্ব নেতৃত্বে এখন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা শেখ হাসিনার। আর সেখানে শেখ হাসিনা মানেই বাংলাদেশ।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন


বঙ্গবন্ধুকন্যা না ফিরলে কেমন হতো বাংলাদেশ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
প্রফেসর ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন

১৯৮১ সালের ১৭ মে। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে ফিরবেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানুষের কাছে এটা যেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ৯ বছর আগে তারা যেমন প্রতিক্ষায় ছিলেন, তেমনি ৯ বছর পরও তারা প্রতিক্ষায়। তবে এবারের প্রতিক্ষা অনেক ভয়ের। ভয়টাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু নাম এ দেশে নিতে দেওয়া হয় না। তার ছবি কোথাও টাঙ্গাতে দেওয়া হয় না। তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীদের বিচার আইন (ইনডেমনিটি) করে বন্ধ করা হয়েছে। খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে পুরস্কার স্বরূপ চাকরি দিয়ে পাঠানো হয়েছে। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর চলছে দমন-পীড়ন। প্রায় ৬২ হাজার আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে। ১৯৭৭ সালের অক্টোবরের ২ তারিখে অনুষ্ঠিত এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগে ১১৪৩ জনকে বিভিন্ন কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। বিচারবহির্ভূতভাবে অন্তত ৩০০০ সেনাসদস্য, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা হত্যা ও গুম করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ’৭২-এর ঘাতক দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে ৭৫২ জন দণ্ডপ্রাপ্ত ছিল। জামায়াতে ইসলাম জিয়ার সমর্থনে চলছে। দেশে গণতন্ত্র উধাও। গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। সেনা শাসন চলছে।

সেই সময়ে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আলোকবর্তিকা নিয়ে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে প্রিয় জন্মভূমির পবিত্র মাটিতে ফিরে আসেন আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা; দীর্ঘ ৬ বছরের নির্বাসন শেষে, নিজের ছেলে জয় (সজিব ওয়াজেদ জয়) ও মেয়ে পুতুলকে (সায়মা ওয়াজেদ পুতুল) বোন রেহানার (শেখ রেহানা) কাছে রেখে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে। এ দিন ঢাকায় বয়ে যাচ্ছিল কালবৈশাখী, ঝড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ঘণ্টায় ৬৫ মাইল। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি আর বৈরী আবহাওয়া। তাতে কী! শেখ হাসিনা আসবেন তাই কুর্মিটোলা থেকে শেরেবাংলা নগর লক্ষপ্রাণ মুজিবপ্রেমীর ভিড়। বিকাল সাড়ে ৪টায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমানে তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে তৎকালীন ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে। সেদিন রাজধানী ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকা শহর মিছিল আর স্লোগানে প্রকম্পিত হয়। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর পরিণত হয় জনসমুদ্রে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখতে সেদিন সারা দেশের মানুষের গন্তব্য ছিল রাজধানী ঢাকা। বেলা ৪টা ৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ট্রাকে নেমে আসেন। এই সময় লাখো জনতার কণ্ঠে ছিল গগণবিদারী স্লোগান; স্বাধীনতার অমর স্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম পিতৃ হত্যার বদলা নেব’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে আমরা আছি তোমার সঙ্গে’। ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’। এ সময় অনেকের চোখে ছিল অশ্রুধারা। প্রয়াত জননেতা আবদুর রাজ্জাক যখন মালা পরিয়ে দেন তাকে, তখন শেখ হাসিনাও অঝোর ধারায় কান্না করছিলেন। এ সময় শেখ হাসিনার পরনে ছিল সাদা রঙের ওপর কালো ডোরাকাটা তাঁতের মোটা শাড়ি।

কুর্মিটোলা থেকে শেখ হাসিনার শেরেবাংলা নগরে এসে পৌঁছাতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সেদিনের গগণবিদারী মেঘ গর্জন, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার বদলা নেওয়ার লক্ষ্যে গর্জে উঠেছিল। আর বৃষ্টির পানি মিশে গিয়েছিল বাঙালির চোখের আনন্দঅশ্রুতে। শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানানোর জন্য উপস্থিত প্রায় ১৫ লাখ মানুষের হৃদয়ছোঁয়া ভালোবাসার জবাবে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ একবার ভেবে দেখুন: ১৯৭৫ সালের আগস্টের সেই ভয়াল রাতের কথা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। বঙ্গমাতা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল কেউ বাদ গেল না। যদি সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানিতে না থাকতেন? যদি সেদিন তারা ৩২ নম্বরে থাকতেন তাহলে কী হতো? নিশ্চিতভাবেই ওই ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে তাদের জীবনের চরম নিষ্পত্তি ঘটতে পারত; বেঁচে গেলে সেটি অলৌকিকই হতো। অথবা শেখ হাসিনা যদি কোনোদিন বাংলাদেশে ফিরে না আসতেন। যদি অভিমানে থেকে যেতেন নিরাপদ দূরত্বে। তাহলে আমরা বর্তমান যে বাংলাদেশকে দেখি সেই বাংলাদেশ কেমন হতো? আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থা আজ কোথায় থাকত? বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ যেভাবে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে তারইবা উত্তরণ ঘটত কী? এমন অজস্র প্রশ্নের উত্তর একটাই- শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার কারণেই আজ গণতন্ত্রের মুক্তি মিলেছে, উন্নয়ন আর অগ্রযাত্রার পথে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।

সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ২০২২ সালে বলেন, ‘১৯৮১ সালে ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ত্রয়োদশ জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এ ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতাদের এক দূরদর্শী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই থেকে দলের এবং দেশের হাল ধরে আছেন। ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতায় না থেকেও মানুষের মুক্তির জন্য তিনি তার জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি বারবার বলেন, তার আর হারানোর কিছু নেই। তিনি যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন বাংলাদেশ পথ হারাবে না।

শেখ হাসিনা দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন হয়, বিজয় হয় গণতন্ত্রের। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। এ সময় পাহাড়ি-বাঙালি দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধে পার্বত্য শান্তিচুক্তি এবং প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি সই হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসে এবং জনগণের কল্যাণে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করা হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমে তার সাহসিকতা, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, দারিদ্র্যবিমোচন, বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর, রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় দিয়ে বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে মানবিক নেত্রী হিসেবে স্বীকৃতি এমন অসংখ্য দৃশ্যমান কার্যক্রম আজ মহিমান্বিত করেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলের স্বীকৃতি পেয়েছে। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা চার দশকের বেশি সময় আওয়ামী লীগের সভাপতি। নানা চড়াই-উৎড়াই, কারাবরণ, মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়াসহ অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে আজকের অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন। শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের ফলেই আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ রেখে পাঁচ বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়েছে এবং বর্তমানে টানা চতুর্থবার ক্ষমতাসীন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের এই সময়ের শাসন আমলেই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নতুন মাত্রা সূচিত হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলেই বাংলাদেশ স্বল্পন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ ডিজিটাল দেশে পরিণত হয়েছে। এখন বাংলাদেশ উন্নত বাংলাদেশ হবার পথে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে বদ্ধপরিকর। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে পিতার মতোই অবিচল, দৃঢ় ও সাহসী শেখ হাসিনা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের কল্যাণে যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছেন। ‘রূপকল্প ২০২১’ এর মধ্যম আয়ের বাংলাদেশকে ‘রূপকল্প ২০৪১’ এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি উন্নত, আধুনিক, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধু-কন্যা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দেশের উন্নয়নে এরই মধ্যে ঘোষণা করেছেন শতবর্ষব্যাপী কর্মসূচি ডেল্টা প্ল্যান-২১০০।

জাতির পতিা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাজারো প্রচেষ্টা, ত্যাগ তিতিক্ষার পর দেশের রাজনীতিতে একজন সফল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে রোল মডেল হিসেবে বিশ্বে নেতৃত্বে দিচ্ছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু দেশের রত্ন নয়, তিনি বিশ্বরত্ন। তিনি বাঙালি জাতির চেতনার প্রতীক। আমাদের অহংকার। যার অপ্রতিরোধ্য পথ চলায় বাংলাদেশ আজ ছুটে চলছে উন্নয়নের মহাসড়কে। শেখ হাসিনা মানেই উন্নয়নের জয়জয়কার। বাংলাদেশের আস্থার প্রতীক। আমাদের সবার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিরোধী দলে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন ও নেতৃত্বশূন্য করতে বেশ কয়েকবার মরণ আঘাত চালায় ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শুধু তাকে নয় আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। এরপর ২০০৮ সালে আবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর একুশ শতকে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো শপথ নেন। ডিজিটাল বিপ্লব ঘটানোই এই সরকারের লক্ষ্য ছিল না, এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিই ছিল মূল লক্ষ্য। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের করে। এরপর ১১ জানুয়ারি (নির্বাচন হয় ৭ জানুয়ারি) ২০২৪ শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের (মোট ৫ বার) মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

শেখ হাসিনা যদি না ফিরতেন তাহলে কেমন হতো বাংলাদেশ? বাংলাদেশে কী আজও সেনাশাসন থাকত? গণতন্ত্রের কী মুক্তি মিলত? বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের কখনো বিচার হতো? জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের বিচার হতো? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতো? দেশে যে এত উন্নয়ন তা কী হতো? এই যে বাংলাদেশে এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে, এই যে ঢাকার চারপাশের বৃত্তাকার রাস্তা, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, ডিজিটাল ও স্মার্ট শব্দ, ২৪ ঘণ্টা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎÑএসব ঘটনা কী ঘটত? তবে একটি জিনিস নিশ্চিতই ঘটত। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা ক্ষমতায় থাকত। ২০০১ সালে জিয়া প্রতিষ্ঠিত দলের মাধ্যমে তাদের গাড়িতে আমরা জাতীয় পতাকা দেখেছি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে কিছু থাকত না। সংবিধানের চারটি মূলনীতি থাকত না। অসাম্প্রদায়িক দেশ থাকত না। হয়তো বদলে যেত জাতীয় সঙ্গীত। বদলে যেত মানুষের গায়ের পোশাক। উৎসবের রকম। মোড়ে মোড়ে হয়তো সেনাবহিনী থাকত। বাংলাদেশ এসব দেখার জন্য স্বাধীন হয়নি। আজ (মে ১৭) প্রধানমন্ত্রী-জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। আমরা বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই এ জন্য যে, বাংলাদেশের আজ যা কিছু অর্জন সেই অর্জন তার হাত ধরেই। আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।

লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)

বিষয়:

মশামাছির মুখপোড়া 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আলমগীর খোরশেদ 

আবহমান গ্রামবাংলা হাজারো ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক হয়ে আজও টিকে আছে স্মৃতি জাগানিয়া হয়ে। নানা ধরনের পূজা, পার্বণ, আচার, পালন করত ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে। সংস্কার, আচার, লোকাচার যাই বলিনা কেন, তখনকার লোকজন তা মানত। সংস্কৃতি মানেই একটি জাতি বা গোষ্ঠীর যাপিতজীবন চারণ। দুর্গা পুজোতে পাড়ার হিন্দু লোকজন চাঁদা ধরে প্রতিমা গড়তেন। কোনো জাতির আয়না হয়ে সমুজ্জ্বল থাকে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। কার্তিকের শেষে ভোলা সংক্রান্তি যা ভোলাভুলি উৎসব বা মশামাছির মুখ পোড়া নামে পূজা ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পালন করা হতো। হিন্দু মুসলমান সবাই পালন করত এটা। বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ধরে রাখার বয়স প্রায় দুই হাজার বছরের মূলে প্রোথিত। বঙ্গ বা বাংলা ছিল সম্পদে প্রাচুর্যে ভরপুর এক জনপদ। ফলে বারবার আঘাত এসেছে, যুদ্ধ হয়েছে, শত বছর ধরে বাঙালি সংস্কৃতিকে শুকুনের মতো খামছে ধরেছে ঔপনিবেশিক শাসন। আঘাত করেছে বর্গীরা। বিভিন্ন জাতির বসবাস হয়ে শংকর জাতির বারোয়ারি উপদ্রব সইতে হয়েছে চোখ বুঁজে। বারো মাসে তেরো পার্বণে একটি হলো মশামাছির মুখপোড়া বা ভোলাভুলি পূজা। খড়-বাঁশ দিয়ে তৈরি ভোলার প্রতিকৃতি বানিয়ে তাতে মশামাছি রেখে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর কেউ সেটা উঁচু করে ধরে দৌড়ে যেত আর চিৎকার করে বলত,

‘ভালা আইয়ে বুড়া যা, মশা-মাছির মুখ পোড়া যা।’

বাড়িতে ঠাট্টা সম্পর্কীয় ভাবী, বেয়াই, দাদা, দাদি, বেয়াইনরা কলাগাছের ডাগ্গোয়া কেটে পিছন থেকে পিঠে বারি দিয়ে বলত,

‘ভোলা ছাড় ভুলি ছাড়, বার মাইয়া পিছা ছাড়’। কেউ কেউ বাঁশের নতুন কুলা পিঠে পিটাইয়া দৌড়ানো দিত। বলত,

‘মশা মাছি বাইর অ, টাকা-পয়সা ঘর ল, জঞ্জাল সব দূর হ’।

সবাই মিলে কাঁচা তেঁতুল পেড়ে এই আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া হতো। খড়, দড়ি, শোলা, কাপড়, কলাগাছের ডাগ্গোয়া, প্রয়োজন পড়ত এই কাজে। জনমনে ধারণা ছিল, খড়ের আগুনে এবং কলাগাছের ও কুলা দিয়া পিটিয়ে ঘর বা সংসারের যাবতীয় বদ বা খারাপি দূর হয়ে যাবে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মাসব্যাপী পূজা করত। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের লোকজন কার্তিক মাসে প্রতিদিন সকালে স্নান করে দেবতাকে ভোগ দিত। বাড়িতে মাইক বাজিয়ে গান হতো, লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি, কাগজ, ত্রিকোণাকৃতি করে কেটে পাটের সুতলীতে আঁটা দিয়ে লাগিয়ে বাড়ি-ঘর সাজাত মানুষ। কার্তিক পূজা করা হতো এ মাসেই। মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে। পুজোতে প্রসাদ দেয়, আতপ চাল ভিজিয়ে তাতে কলা মাখিয়ে। সাথে আখ টুকরা করে কেটে দেওয়া হতো। ঢোল, খঞ্জনি, কাঁসা বাজিয়ে কীর্তন গাইত পূজারী ও তার লোকজন। অন্যরা সাথে কোরাস গাইত। মেহমান, মেয়ে নাইওর আসত বাবার বাড়িতে। আজকের প্রজন্ম ইন্টারনেট মোবাইলে বুঁদ হয়ে সামাজিকতা ভুলে গেছে। গুছিয়ে কথাই বলতে জানে না। সংস্কৃতি ঐতিহ্য নিয়ে তাদের জ্ঞান খুব নগণ্য। বিভিন্ন সামাজিক আচার, মশামাছির মুখপোড়া কিংবা ভোলাভুলির পূজা কি তা জানেই না। দল বেঁধে খড়ের মূর্তি বানিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে হৈ-হুল্লোড় করার মানুষ নেই আর। সেই মন-মানসিকতা হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। বাঙালির গ্রামীণ ঐতিহ্যের ইতিহাস হাজার বছরের লালিত স্বপ্নমোড়ানো ইতিহাস। যা যুগ যুগ ধরে, কাল থেকে মহাকাল রচনা করে যাবে নীরবে নিভৃতে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক

বিষয়:

গোলাপি শার্ট পরা ওই লোকটা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সুধীর সাহা

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। কলেজে পড়ার সময় যা ছিল মুখে মুখে এবং বিশ্বাসে, আজ তা-ই হয়ে দাঁড়িয়েছে ম্যাজিক স্লেটের লেখা। আপনি ইচ্ছেমতো লিখবেন, মুছবেন, আঁকবেন, মুছবেন আর সুর করে বলবেন ‘কুমির, তোমার জলে নেমেছি; পারলে আমায় ধরে দেখাও।’ অথবা গম্ভীর গলার হুঙ্কারÑ ‘ক্যাচ মি, ইফ ইউ ক্যান’। এটি আজকের দিনে হয়ে দাঁড়িয়েছে ম্যাজিক স্লেটের গল্প। এখন মনে হয় প্রজা যে তন্ত্র নির্মাণ করেছে, সেই তন্ত্রের চালিকাশক্তি কি প্রকৃতই প্রজার হাতে থাকে? নাকি এ তন্ত্রে প্রজার প্রেরিত প্রতিনিধি আর শাসক দল এক দুরূহ অন্তরালে নিজেদের ঢেকে রাখে যাকে সবাই দেখতে পায় না; শুধু কোনো অজ্ঞাত নির্দেশ বা কোনো অলীক সম্মোহনে রথের চাকাগুলো অবিরাম ঘুরতে থাকে, যার সামনে হুজুর মাই-বাপ বলে হাঁটু মুড়ে বসা ছাড়া প্রজার আর কোনো গতি নেই।

ধরুন, আপনার পাড়ায় একজন কুঁড়েঘরে থাকে। হঠাৎ এক দিন দেখলেন, বাড়িটা প্রাসাদ হয়ে গেল। তার আগে থেকেই আপনি দেখছিলেন, লোকটি শাসক দলের সঙ্গে ওঠাবসা করছে, নেতার পিছনে হাত কচলাচ্ছে, তার মোটরবাইক হচ্ছেÑ এক দিন সে জনপ্রশাসক হলো কিংবা জনপ্রতিনিধি হলো। আপনার ফুটপাত বাঁধানো হলো, কলে পানি এল, রাস্তায় বাতি জ্বলল, আর তার বাড়িটা হঠাৎ প্রাসাদ হয়ে গেল। আপনি খোঁজ নিলেন। জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারের কর্তাব্যক্তিটির বেতন, পরিবারের আয়, খরচ সবকিছু মিলিয়েও আপনি হিসাব মেলাতে পারলেন না; কিন্তু এ অবস্থায় আপনি কী করবেন? আপনার কী মনে হবে মাস্টারমশাই তো বটেই, কারও কিছু করার নেই। আপনি বড়জোর, সবকিছু ম্যাজিক স্লেটে লিখে রাখতে পারেন; কিন্তু ম্যাজিক স্লেটের ওই লেখা দেখে আপনার পোষা বিড়ালটাও কিন্তু ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে হেসে উঠবে। বাকি সবাই বলবে, মাস্টার মশাই এবং আপনি দুজনেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন। আপনি বলতে থাকবেন, স্লেটে সব লেখা আছে; কিন্তু সময়মতো দেখলেন, সেই ম্যাজিক স্লেটটিও ফাঁকা। শয়তান বেড়ালটা থাবা দিয়ে ম্যাজিক বাটনটা টিপে দিয়ে স্লেটটি ফাঁকা করে দিয়েছে ততক্ষণে। আপনার রাগ হলে কোনো লাভ নেই; কেননা এমন ঘটনা এখন থেকে আপনার জীবনে ঘটতেই থাকবে, আর ঘটতেই থাকবে। যেমন কিছু লোক জেলে যাবে, কিছু লোক জেলে যাবে না বিদেশে যাবে। যেমন কিছু লোক বিদেশেই থাকবে, জেলে যাবে না। আরও শুনতে চান? ঠিক আছে, না-হয় আরও একটু বলি। আপনি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দেখলেন, একটা লোককে অনেকে মাটিতে ফেলে পেটাচ্ছে। আপনি দৌড়ে গেলেন সেখানে; কিন্তু গায়ের জোরে পারবেন না ওদের সঙ্গে। পরে যখন পুলিশ আপনাকে ডাকবে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে, আপনি চিনতে পারবেন কারা মেরেছিল লোকটিকে; কিন্তু পুলিশসহ কেউ আপনাকে মানবে না। গোলাপি শার্ট পরা ওই লোকটাই যে রাস্তার প্রধান গুণ্ডা ছিল, সে আপনি বললেই হলো? প্রমাণ কোথায়? গোলাপি শার্ট তো কত মানুষই পরে। যতসব ভুল-ভাল কথাবার্তা। আপনি মাথা নিচু করে থানা থেকে বেরিয়ে আসবেন। আপনি ওই মাস্টার মশাইয়ের মতো কিছুই দেখেননি অথবা যা দেখেছেন, তা আপনি আসলে দেখছেন না। অতএব হে পাঠক, হে মহামান্য পাঠকÑআপনারা এতক্ষণ যা পড়লেন, এই এতগুলো শব্দ আসলে আপনারা পড়েননি; একটা সাদা পাতা দেখেছেন শুধু। আর ভেবেছেন, এগুলো আপনি পড়েছেন। পাড়ার লোকটার প্রাসাদোপম বাড়ির জন্য, ওই গোলাপি শার্ট পরা লোকটার বিরুদ্ধে লেখার জন্য যদি কখনো আমার দিকে কেউ আঙুল তোলে, আমি কিন্তু বলব যে লেখে, সে আমি নই। সে ম্যাজিক স্লেটের ম্যাজিক লেখক- অন্য কেউ।

লজ্জার মতো অপরাধবোধ এবং কলঙ্কের মতো ভয়ও সমাজে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমার যদি মনে হয়, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে অপরাধবোধে ভুগব কিংবা কলঙ্কের ভয়ে সারাক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকব, তাহলে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার আগে আমি বহুবার ভাবব। অন্যদিকে, সমাজে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত আমাদের অপরাধবোধ এবং কলঙ্কের ভয় কমায়। সমাজের অধিকাংশ লোক দুর্নীতিতে যুক্ত না থাকলে দুর্নীতিতে না জড়ানোটাই তখন সমাজের আদর্শ হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে কেউ সামান্য দুর্নীতিতে যুক্ত হলেই সে অপরাধবোধে ভোগে, কলঙ্কের ভয়ে থাকে। কিন্তু সমাজে যদি সবাই দুর্নীতিতে যুক্ত হয়, তাহলে দুর্নীতিটাই ‘আদর্শ আচরণ’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে যায়। সেই দুর্নীতিতে আর অপরাধবোধ থাকে না, কলঙ্কের ভয় থাকে না। তখন দুর্নীতিতে এমনিতেই জড়িয়ে পড়ার মানসিক জরিমানার অঙ্কটা কমতে থাকে। এক সময় দুর্নীতি হয়ে পড়ে ‘স্বাভাবিক’। এমন সমাজব্যবস্থায় বেঁচে থাকার জন্য দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়াটাই মানুষের পক্ষে হয়ে ওঠে যুক্তিযুক্ত। অন্তত এমন যুক্তিই দাঁড় করিয়ে ফেলে দুর্নীতিগ্রস্তরা। খুব প্রণিধানযোগ্য প্রশ্ন হলো- এমন সমাজ হয়ে গেলে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? উত্তরটা কারও জানা থাকে না সেই বাস্তবতায়। তবে এর মাঝখানে যেটা সবার জানা আছে তা হলো, সরকার বা রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্দরে যে ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে সেটা ক্রমাগত অস্বীকার করলে কিংবা সমাজের স্বাভাবিক আচরণ বলে মেনে নিলে সেই দুর্নীতি থেকে বেরোনো যাবে না কোনোদিনই।

মাস্টার মশাই, এত কথাই বা কেন বলতে যাবেন? আমাকেও তেমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। কী দায় এত আমার কিংবা মাস্টার মশাইয়ের? যখন অন্যরা চোখ বুঁজে আছে, তখন বাপু তোমার এত বাড়বাড়ন্ত কেন? তুমি কী দেখছ না- চারদিকে কী ঘটছে? পাঁচ বছর পর পর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে সরকারের সরে আসার উদ্যোগ ইতোমধ্যেই গোচরীভূত হয়েছে। নতুন আইন হয়ে যাওয়ার পথে সরকার হাঁটছে, যেখানে পাঁচ বছর পর

পর আর ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী দিতে হবে না। সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জবাবদিহি থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার রাস্তা নিশ্চিত হয়ে যাবে। দুর্নীতিকে সুরক্ষিত ও উৎসাহিত করার এর চেয়ে ভালো পন্থা আর কি-বা হতে পারে। আপনি যা-ই ভাবেন, যেভাবেই ভাবেন ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবীদের পাঁচ বছর পর পর সম্পত্তি বিবরণের বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে সংশোধন সংসদে আসছে শিগগিরই। সংশোধনী আনার পক্ষের যুক্তি তো অকাট্য। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তার সম্পদের হিসাব রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দেওয়া বার্ষিক আয়কর রিটার্ন থেকে নেওয়া যাবে। সরাসরি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কেন এ বিপদের মধ্যে ফেলা! আপনি যতই বলবেন, এ সংশোধনী আনা হলে এতে অসাধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উৎসাহিত হবে দুর্নীতি করতে। যারা এখনো সাধু হওয়ার স্বপ্নে আছে, তারাও অচিরেই ভুল পাল্টে অধিক সংখ্যার মানুষের কাতারে যোগ দেবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান নেই। বাঃ! দারুণ ব্যাপার। নির্ভয়ে দুর্নীতি করুন, নির্ভয়ে অবৈধ সম্পদ বাড়িয়ে চলুন- ভয়ের চিহ্ন নেই, কেউ আর পিছুটানে আটকে যাবেন না। স্বদম্ভে এগিয়ে যাও তুমি দুর্নীতি। ম্যাজিক স্লেটে যা লেখা হচ্ছে, মুছে দিয়ে এগিয়ে যাও স্বদর্পে। গোলাপি শার্ট পরে ধুলো দেওয়া মানুষটির মতো এগিয়ে চলো হে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কেউ দেখছে না তোমাদের। দেখলেও ওদের দেখায় বিশ্বাস করে কে? বিবরণী দিয়ে আটকে যেও না। সংশোধনী পাস করিয়ে নাও জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে। তারপর মাণিকজোড় হয়ে চলো একসঙ্গে, একপথে।

লেখক: কলামিস্ট


সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের জন্য তরুণদের দক্ষ করে তোলা জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন থেকে তরুণ যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু তরুণদের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার কারণে এ বিষয়ে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই তরুণদের পড়াশোনার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখে নিজেকে প্রস্তুত করতে আহ্বান জানান। কোনোমতে সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য পড়াশোনা না করে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলার আহ্বানও প্রধানমন্ত্রী অসংখ্যবার জানিয়েছেন; কিন্তু আমাদের দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী সেদিকে মোটেও মনোযোগ দিচ্ছে না। এমনকি অসংখ্য তরুণ যারা পড়াশোনা এবং কর্মসংস্থান নিয়ে হতাশ এবং উদাসীন রয়েছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস, ২০২৩ জরিপে উঠে এসেছে যে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই আছেন নিষ্ক্রিয় অবস্থায়। অর্থাৎ তারা পড়াশোনা, কর্মসংস্থান কিংবা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণে নেই। বাংলাদেশের ছেলেদের চেয়ে এই নিষ্ক্রিয়তার হার আবার তিনগুণেরও বেশি মেয়েদের ক্ষেত্রে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি মেয়েদের নিষ্ক্রিয়তার হার শতকার ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বিপরীতে ছেলেদের এই হার ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছেলে। মেয়েদের বাল্যবিয়ে, দক্ষতার অভাব, শিক্ষার মানের ঘাটতি, জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা কিংবা মূল্যস্ফীতির কারণেই তরুণদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তা বাড়ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ পাওয়া যায়।

গত ১১ মে দেশে প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রত্যয় নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নাটোরে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বাংলাদেশের কোনো তরুণ-তরুণী আর কর্মহীন ও বেকার থাকবে না। যদি আমরা তাদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।’ যৌক্তিকভাবেই এখন যোগ্যতা এবং দক্ষতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তরুণদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের দেশ একধাপ এগিয়ে যাবে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নানাভাবে দক্ষ করে তুলতে উদ্যোগ এবং উৎসাহ থাকলেও তারা নিজেদের দক্ষ করে তুলতে একধাপ পিছিয়ে রয়েছে। তারা শুধুই চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় নেমেছে; কিন্তু নিজেদের কীভাবে দক্ষ করে দেশের উন্নয়নের ধারক হওয়া যায়- সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা তারা গ্রহণ করে না বললেই চলে।

গত ১৪ মে গণমাধ্যমসূত্রে জানতে পারলাম, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের অর্থায়নে বাংলাদেশসহ চার দেশের তরুণ উদ্যোক্তা ও উদ্যোক্তা উন্নয়নে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রতি বছর প্রো-ফেলোস কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের জন্য আবেদনপত্র গ্রহণ চলছে। ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সি ক্ষুদ্র বা মাঝারি ব্যবসার প্রতিষ্ঠাতা, ব্যবসার উদ্যোক্তা, স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তারা এ ফেলোশিপের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এ ধরনের ফেলোশিপের মাধ্যমে বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে। বাংলাদেশে বসে যারা কাজ করছেন, তাদের অনেক সম্ভাবনা আছে। যারা বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছেন, তাদের জন্য এই ফেলোশিপ ভীষণ কার্যকর হতে পারে; কিন্তু এর জন্য নিজের দক্ষতা এবং যোগ্যতাকে প্রমাণ করতে হবে।

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-বিবেচনায় প্রাধান্যের ভিত্তিতে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে যেসব মানুষ পারদর্শী ও পেশাদার, তাদের কদর পৃথিবীব্যাপী বেড়েই চলেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ৩ লাখ মানুষ সক্রিয়ভাবে আইসিটি খাতে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া ৫ লাখ রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সার আইসিটি বিষয়ে কাজ করছেন। আমরা জানি, বিদেশের শ্রমবাজারেও রয়েছে দক্ষ জনশক্তির বিরাট চাহিদা। দেশের অভ্যন্তরেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তির বৃদ্ধির চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।

আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের স্লোগান ছিল ‘দিন বদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’, ২০১৮ সালের ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ স্লোগানে নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলাসহ মোট ১১টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক কৃষি, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং রোবোটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ন্যানো টেকনোলজিসহ গ্রামীণ অকৃষিজ খাতের উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন মোকাবিলায় উপযুক্ত কর্মকৌশল গ্রহণ করার বিষয়ে সুস্পষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষি গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপের বিষয়টিও ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ কর্মরত রয়েছেন। যাদের ৮৮ শতাংশই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া অর্থাৎ প্রায় ৭৬ লাখ প্রবাসীর কাজের প্রশিক্ষণ নেই। আমাদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে হলে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, ফিজিক্যাল ইন্টেলিজেন্স, সোশ্যাল ইন্টেলিজেন্স, কনটেস্ট ইন্টেলিজেন্সের মতো বিষয়গুলো মাথায় প্রবেশ করাতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবিলায় বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরে জাতিসংঘের ই-গভর্ন্যান্স উন্নয়ন সূচকে সেরা ৫০টি দেশের তালিকায় থাকার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশে অনেক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু করা, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প। বাংলাদেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণ, উন্নয়ন ও মুক্তির পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার।

তরুণ-যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে কী করণীয়, সে বিষয়ে সবাই সজাগ থাকলেও ফলপ্রসূভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষতা এবং উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা সম্ভব না হলে দেশের জন্য আশানুরূপ উন্নয়ন সফলতা পাওয়া কঠিন হবে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগই এখন তরুণ যুবগোষ্ঠী। বাংলাদেশে তরুণরা সংখ্যায় বিশাল হলেও তাদের কতটা ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। বিগত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে যুবশক্তিকে যথাযথভাবে জনশক্তি হিসেবে কাজে লাগানো যায়নি। এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রমবাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য এবং বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত যুবক প্রতি বছর শ্রমবাজারে যুক্ত হলেও সে অনুপাতে সরকারি-বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়া।

আমরা সবাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যাশা করি; কিন্তু কীভাবে সেই উন্নয়ন হবে তা নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন হওয়া না হওয়া নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। দেশের তরুণ-যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে, দেশকে কোনোভাবেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ এই তরুণগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল এবং কর্মক্ষম। তাদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দ্রুততর এবং টেকসই করা সম্ভব। আর এ জন্য শুধু রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ নয়, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু আমরা ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দেশে বিনিয়োগের কার্যকর অনুকূল পরিবেশ নেই। অন্যদিকে সরকারি খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে, এটি ঠিক; কিন্তু সরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অর্থই হচ্ছে দুর্নীতির হার বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ যদি আগামী দিনের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায়, তাহলে অবশ্যই যুব সম্প্রদায়কে যথাযথ এবং দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি আন্তরিক দৃষ্টি স্থাপন করতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


banner close