বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫
২৯ শ্রাবণ ১৪৩২

বিদায় হজের ভাষণ

আপডেটেড
১০ মে, ২০২৪ ১৬:৪৯
আতিকুল ইসলাম খান
প্রকাশিত
আতিকুল ইসলাম খান
প্রকাশিত : ১০ মে, ২০২৪ ১৬:৪৫

এই ভাষণই ইসলাম ধর্মের শেষ খুতবা বলে আখ্যায়িত। দশম হিজরিতে আরাফার ময়দানে জুমার দিন সংগঠিত, আখেরি নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই ভাষণে সমাজ ও রাষ্ট্রে অরাজকতা, বিদ্রোহ এবং কুপরামর্শ প্রদানকারী শয়তানের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে বলেছেন। এই ভাষণে বিভিন্ন সুদ প্রথা রোহিত করে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা, সম্মান ও অধিকারকে নিশ্চিত করার দায়িত্ব শুধু মুসলিম উম্মাহর জন্য নয় বরং সমগ্র বিশ্বমানবতার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সুরাতুল আরাফে আল্লাহ বলেন; ও নবী আপনার উম্মতকে জানিয়ে দিন, আজকের দিনে ইসলামকে আমি জীবন বিধান হিসাবে তোমাদের জন্য কবুল করলাম। এই আয়াত শুনে একজন ইহুদি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ.)কে বলেছিল এমন একটা দিন পেলে আমরা ইহুদিরা ঈদের দিন বানিয়ে নিতাম। এ কথা শুনে হজরত ওমর (রা.) আল্লাহর কসম করে বললেন, নিশ্চয়ই আজকের এই দিন মুসলমানদের ঈদের দিন এবং এই জুমাবারে সাপ্তাহিক ঈদ পালন করার দিন। এই ভাষণ হচ্ছে তেইশ বছরের নবুওয়তি জীবনের কর্মপন্থা ও প্রজ্ঞার নির্যাস।

বিদায় হজের ভাষণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা-

১) হে মানব মণ্ডলী---

তোমরা হৃদয়ের কর্ণে ও মনোযোগ সহকারে আমার বক্তব্য শ্রবণ করো, আমি জানি না আগামী বছর এ সময়ে এ স্থানে এ নগরীতে সম্ভবত

তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ হবে কি না।

২) হে মানব সকল ---

সাবধান! সব প্রকার জাহিলিয়াতকে আমার দুই পায়ের নিচে পিষ্ট করে যাচ্ছি। নিরপরাধ মানুষের রক্তপাত চিরতরে হারাম ঘোষিত হলো।

প্রথমে আমি আমার বংশ থেকে রবিয়া বিন হারেস বিন আব্দুল মুত্তালিবের রক্তের দাবি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সে বনি লাইস গোত্রের দুধ পান করেছে। হুযাইল তাকে হত্যা করেছে।

৩) হে মানুষ সকল ---

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে ‘সুদ’কে চিরদিনের জন্য হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। আমি আজ আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের যাবতীয় সুদের দাবি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।

৪) হে লোক সকল ---

বলো আজ কোন দিন? সবাই বলল, আজ মহান আরাফার দিন। আজ হজের দিন। সাবধান! আজকের এই দিন জুমার দিন। এই মাস জিলহজ মাস। এই শহর (মক্কা) যেমন পবিত্র, তোমাদের জান মাল ইজ্জত মান-সম্মান আবরু কিয়ামত পর্যন্ত পবিত্র। তোমাদের একের জন্য অপরের রক্ত, তার মাল, সম্পদ, তার ইজ্জত-সম্মান, আজকের দিনের মতোই পবিত্র। এই হারাম মাসের মতো হারাম অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম। তোমাদের কাছে একজনের গচ্ছিত সম্পদ এ সম্মানিত নগরীর মতো পবিত্র আমানত। সাবধান! মানুষের আমানত, প্রকৃত মালিকের নিকট পৌঁছে দেবে।

৫) হে মানুষ সকল ---

ঋণ অবশ্যই তোমাদের ফেরত দিতে হবে। বিশ্বস্ততার সাথে প্রত্যেকের আমানত রক্ষা করতে হবে। তোমরা কেউ দুর্বলের ওপর অবিচার করবে না। কারও সম্পত্তি সে যদি স্বেচ্ছায় না দেয়, তবে তা অপর কারও জন্য হালাল নয়।

৬) হে মানব সকল ---

নিশ্চয়ই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ একজন। তোমাদের পিতাও একজন। তোমরা সবাই আদম (আ.) থেকে আর আদম (আ.) মাটি থেকে সৃষ্টি। তোমাদের সবার পিতা আদম (আ.)। হে মানবজাতি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে সমাজ ও গোত্রে ভাগ করে দিয়েছি, যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পারো। অতএব শুনে রাখ, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। অন্ধকার যুগের কৌশিল্য বিলুপ্ত করা হলো। শুধু কাবা ঘরের তত্ত্বাবধান ও হাজীদের পানি পান করানো ছাড়া। আরবের ওপর অনারবের এবং অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার ওপর কালোর আর কালোর ওপর সাদার কোনো মর্যাদা নেই।

তাকওয়াই শুধু পার্থক্য নির্ণয় করবে। তোমাদের মাঝে যারা মুত্তাকি, আল্লাহভীরু, কেবল তারাই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান।

৭) হে লোক সকল ---

পুরুষদের নারী জাতির ওপর নেতৃত্বের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তবে, নারীদের বিষয়ে তোমরা আল্লাহ তা’য়ালাকে স্মরণ করো। নারীদের ওপর যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে, তেমনি পুরুষদের ওপরও রয়েছে নারীদের অধিকার। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর জামিনে আল্লাহর আমানত হিসেবে আল্লাহর কালিমার মাধ্যমে হালাল করে গ্রহণ করেছ। স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে তারা যেন নিজ স্বামী ছাড়া পর পুরুষের সঙ্গে ভোগে লিপ্ত না হয়। যদি তারা তা করে তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তাদের প্রতি কঠোরতার অনুমতি দিয়েছেন। এমতাবস্থায় তোমরা তাদের শয্যা পৃথক করে দেবে এবং মৃদু প্রহার করবে। তাতে তারা বিরত হলে নিয়মাফিক তাদের ভরণ পোষণের প্রতি লক্ষ রাখবে। স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে, কেননা তারা তোমাদের সহযোগী ও সাহায্যকারিনী।

৮) হে উপস্থিত সকল ---

মুমিনরা পরস্পর ভাই আর তারা সকলে মিলে এক অখণ্ড ভ্রাতৃসমাজ। এই ভাইয়ের ধন-সম্পদ তার অনুমতি ব্যতিরেকে ভক্ষণ করবে না।

তবে যদি কেউ স্বেচ্ছায় কাউকে কিছু দেয়, তাহলে সেটা স্বতন্ত্র ব্যাপার। আমার পর তোমরা কুফরিতে ফিরে যেও না। পরস্পর খুনাখুনি করো না এবং তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।

৯) হে মানুষেরা ---

তোমরা শুনে রাখ, শয়তান আজ নিরাশ হয়ে পড়েছে। বড় বড় বিষয়ে সে তোমাদের পথভ্রষ্ট করতে সামর্থ্য হবে না। তবে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমরা সতর্ক থাকবে এবং তার অনুসারী হবে না।

১০) হে আল্লাহর বান্দা ---

তোমরা আল্লাহর বন্দেগি করবে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত প্রতিষ্ঠা করবে। রমজান মাসে সিয়াম পালন করবে এবং জাকাত আদায় করবে। তবেই তোমরা জান্নাত লাভ করতে পারবে।

১১) হে মানুষ সাবধান ---

তোমরা তোমাদের গোলাম ও অধীনস্থদের বিষয়ে আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় করো। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরবে, তাদেরকেও সেভাবে পরতে দেবে। শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করবে।

১২) হে মানুষ ---

বিশ্বাসী তো সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অন্যের সম্মান ধন প্রাণ নিরাপদ। সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, অন্যের জন্যও তাই পছন্দ করে।

১৩) হে মানুষ ---

তোমরা ঈর্ষা ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকবে, ঈর্ষা ও হিংসা মানুষের সব সৎ গুণকে ধ্বংস করে দেয়। শুনে রাখো, আজ হতে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বা কৌলিন্য প্রথা বিলুপ্ত করা হলো। কৌলিন্য বা শ্রেষ্ঠ সেই- যে বিশ্বাসী ও মানুষের উপকার করে।

১৪) হে লোক সকল ---

আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহ তা’য়ালার পয়গাম পৌঁছে দেইনি? তখন লোকেরা বলল, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন; আমার বিষয়ে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে- সেদিন তোমরা কি সাক্ষ্য দেবে? সকলে এক বাক্যে বলে উঠল, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আমাদের নিকট রিসালাতের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন। উম্মতকে সব বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন এবং সব গোমরাহির আবরণ ছিন্ন করে ওহির আমানত পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ শাহাদাৎ অঙ্গুলি আকাশের দিকে তুলে তিনবার বললেন, হে আল্লাহ তা’য়ালা! আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন।

১৫) হে মানুষেরা ---

আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার থেকে কম বেশি করবে না। উত্তরাধিকারীর জন্য কোনো অসিয়ত প্রযোজ্য নয়। সাবধান! অন্যদের জন্য এক-তৃতীয়াংশের অধিক ওসিয়ত করা বৈধ নয়।

১৬) হে মানব মণ্ডলী---

সন্তান যার বিছানায় জন্মগ্রহণ করবে সে তারই হবে। ব্যভিচারের শাস্তি হচ্ছে প্রস্তরাঘাত, অর্থাৎ সন্তানের জন্য শর্ত হলো তা, বিবাহিত দম্পতি হতে হবে। ব্যভিচারীর সন্তানের অধিকার নেই।

যে সন্তান আপন পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা এবং যে দাস নিজের মালিক ব্যতীত অন্য কাউকে মালিক বলে স্বীকার করে, তাদের ওপর আল্লাহতা’য়ালা ফেরেস্তাকুল এবং সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ। তার ফরজ নফল কোনো ইবাদতই কবুল হবে না।

১৭) হে কুরাইশ সম্প্রদায়---

তোমরা দুনিয়ার মানুষের বোঝা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে যেন কিয়ামতে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করো, কেননা, আমি আল্লাহর আজাবের মোকাবেলায় তোমাদের কোনো উপকার করতে পারব না। তোমাদেরকে দেখেই লোকেরা আমল করবে। মনে রেখ সকলকে একদিন আল্লাহ তা’য়ালার নিকট হাজির হতে হবে। সেদিন তিনি প্রতিটি কর্মের হিসাব গ্রহণ করবেন।

১৮) হে মানুষ সকল ---

তোমরা আমার পরে গোমরাহিতে লিপ্ত হবে না। পরস্পর মারামারি হানাহানিতে মেতে উঠবে না। আমিই আখেরি নবী। আমার পরে আর কোনো নবী আসবে না। আমার সাথেই ওহির পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে।

১৯) হে মানুষেরা ---

তোমরা জেনে রাখ, আমি নিঃসন্দেহে একজন মানুষ। সুতরাং আমাকেও আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে। (সুরা ইসরাইলের প্রথম আয়াতের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)কে আবদ্ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। আবদ্ অর্থ বান্দা। আল্লাহই ভালো জানেন, তবে মাটি আর নূর নিয়ে তর্ক বিতর্ক করার আগে প্রাধান্য দিতে হবে তিনি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানব সমাজে মনুষ্য আচরণ প্রদর্শনের জন্য তিনি মাটির সৃষ্টি হলেও সে মাটি ছিল অসাধারণ, নূরের থেকেও শ্রেষ্ঠ।

২০) হে মানুষ সকল ---

শুনে রাখ আমার পরে আর কোনো নবী নেই। হে মানুষ আমি তোমাদের কাছে দুটি আলোকবর্তিকা রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এই দুটি অনুসরণ করবে, ততদিন তোমরা নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হবে না। এর একটি হলো ‘আল্লাহর কিতাব আর অপরটি আমার জীবন দৃষ্টান্ত।’

২১) হে মানব মণ্ডলী---

তোমরা নেতার আনুগত্য করবে এবং তার কথা শ্রবণ করবে। যদিও তিনি হন হাবশী ক্রীতদাস। যতদিন পর্যন্ত তিনি আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করেন, ততদিন অবশ্যই তার কথা শুনবে এবং তার নির্দেশ মানবে ও তার প্রতি আনুগত্য করবে। আর যখন তিনি আল্লাহর কিতাবের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করবেন, তখন থেকে তার কোনো কথা শুনবে না এবং তার আনুগত্যও করা যাবে না।

২২) হে মানুষ সাবধান ---

তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাকবে। জেনে রেখো, তোমাদের পরবর্তীরা এই বাড়াবাড়ির করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। এই নির্দেশটি হচ্ছে অমুসলিমদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ কোনো বিধর্মীকে বাড়াবাড়ি বা জোর জবরদস্তি করে ইসলামের দীক্ষা দেওয়া যাবে না। তবে, একজন মুসলমানকে অবশ্যই পরিপূর্ণ ইসলামী জিন্দেগী অবলম্বন করে জীবন যাপন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সুবিধাবাদের কোন সুযোগ নেই।

২৩) হে মানুষ ---

প্রত্যেককে শেষ বিচারের দিনে নিজেদের কাজের হিসাব দিতে হবে, অতএব তোমরা তোমাদের কর্মের ব্যাপারে সাবধান হও।

২৪) হে মানুষ ---

শুনে রাখ, অপরাধের দায়িত্ব কেবল অপরাধীর ওপরেই বার্তায়, অর্থাৎ পিতা তার পুত্রের জন্য আর পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্য দায়ী হবে না। যার যার কর্মফল তাকেই ভোগ করতে হবে।

২৫) হে মানুষ ---

তোমরা ইসলামি জ্ঞান অর্জন করবে, কেননা, ইসলামি জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক নর-নারীর জন্য অপরিহার্য, কারণ জ্ঞান মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। জ্ঞানবিহীন মানুষ অন্ধ। মূলত, ইসলামি জ্ঞান ছাড়া একজন মানুষ মূর্খ ছাড়া কিছুই নয়।

২৬) মনে রেখ মানুষ ---

আমি তোমাদের সকলের আগেই হাওজে কাওসারে পৌঁছে যাব এবং তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। আর অন্য সকল উম্মতের মধ্যে তোমাদের আধিক্য নিয়ে আমি গর্ব করব। অতএব হে আমার উম্মতেরা, তোমরা বিদায়াত সৃষ্টি করে আমার চেহারায় কালিমা লিপ্ত করো না।

২৭) তোমরা শুনে রাখ ---

আমি সেদিন অনেককে মুক্ত করব, যারা কোরআন সুন্নার ওপর অটল থেকে দুনিয়া হতে বিদায় হবে এবং অনেকে সেদিন আমার থেকে মুক্ত হয়ে যাবে তারা হলো, যারা ইসলামের মধ্যে বিদায়াত সৃষ্টি করেছে এবং যারা আমার পরে আমার সুন্নত অর্থাৎ দ্বীনকে পরিবর্তন করেছে।

২৮) অতঃপর তিনি বলেন---

আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দ্বীন পৌঁছে দিয়েছি? সকলেই বলল ‘নিশ্চয়ই’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) শাহাদাত আঙ্গুলি আকাশের দিকে তুলে আবার বলবেন; হে আল্লাহ তা’য়ালা! আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন।

২৯) হে উপস্থিতগণ--

তোমরা অনুপস্থিতদের নিকট আমার এই পয়গাম পৌঁছে দেবে। হয়তো বা তাদের মধ্যে কেউ এ নসিহতের ওপর তোমাদের চেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে আমল করবে। তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।

পৃথিবীর মহামনীষিদের বাণী কখনো সত্য কখনো মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা মুহূর্তের জন্য মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে না। একটি সুন্দর বাণীর কারণে মানুষ হয় বিশ্ববিখ্যাত আবার একটি অসুন্দর বাণীর কারণেই মানুষ হয় বিশ্বকুখ্যাত। তাইতো আমাদের জাতীয় কবি ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ বলেছিলেন, আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান?

আয় আল্লাহ! আমাদেরকে প্রিয় নবীজির আদর্শের সেই মুসলমান হওয়ার সঠিক জ্ঞান দান করুন। ‘আমীন’

লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক।


চারদিকে গভীর ষড়যন্ত্রের জাল: কান্ডারী হুঁশিয়ার

রেজাউল করিম খোকন
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

চব্বিশের জুলাই থেকে পঁচিশের জুলাই-আগস্ট। ঐতিহাসিক গত অভ্যুত্থানের একটি বছর পূর্ণ না হতেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের ঘটনাপ্রবাহ দেখে ব্যথিত ও হতাশ হতে হচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবন বাজি রেখে লড়াই করা সৈনিকদের মধ্যে এখন নানা মতবিরোধ, সন্দেহ , অবিশ্বাস, মতানৈক্য, পরস্পরের প্রতি বিষেদগার করা, অপরের চরিত্র হননের হীন চেষ্টা এমনকি এক পক্ষের ওপর আরেক পক্ষের সরাসরি আক্রমণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি গত কিছুদিন ধরে। একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বিভেদ প্রকারন্তরে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের জুলাই অভ্যুত্থানের বিজয় নস্যাৎয়ের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে দুঃসাহসী করে তুলেছে। বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ন্যায়বিচারভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন শিক্ষার্থী নেতাদের কেউ কেউ নিজেরাই চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়েছে। অথচ তারাই সেদিন দেশকে চাঁদাবাজ মুক্ত, দখলদার মুক্ত, দুর্নীতি মুক্ত করার দীপ্ত শপথ নিয়েছিল। তাদের ওপর ভরসা করতে শুরু করেছিলাম আমরা। ভেবেছিলাম তাদের মাধ্যমে দেশে রাজনীতিতে পচা-গলা নষ্ট সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে সম্পূর্ণ নতুন বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠিত হবে। নতুন সুস্থ সুন্দর রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চা শুরু হবে। কিন্তু ১ বছর না যেতেই তাদের চরিত্র এমনভাবে কলঙ্কিত হয়েছে, যা আমাদের হতাশ, ব্যথিত এবং লজ্জিত করেছে।

পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসররা এখন অনায়াসেই চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে কটাক্ষ করে কথা বলার সাহস পেয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কারও কাছে কাম্য নয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে আমাদের আকুল আবেদন, আমরা যেন কোনোভাবেই দিকভ্রান্ত পথিক না হই। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আগে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছি, এখনো তেমন ঐক্যবদ্ধ থেকে অর্জিত বিজয়কে সুসংহত করতে হবে। অনৈতিক আচরণ, বিশৃঙ্খলা, পারস্পরিক বিভেদ, অবিশ্বাস, ঈর্ষাকাতরতা, লোভ-লালসা ত্যাগ করে সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকে পরাজিত শত্রুর নানা ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আরও সতর্ক ও সক্রিয় হতে হবে দেশের সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে। বিভেদ, সংঘাত, পারস্পরিক অশ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটিয়ে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটাতে হবে। সব রাজনৈতিক দলেরই অধিকার রয়েছে সারাদেশে সর্বত্র সভা সমাবেশ অনুষ্ঠানের। কাউকে বাধা দেওয়া কিংবা ঘোষণা দিয়ে তাদের প্রতিরোধের অধিকারও নেই কারও। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে গোপালগঞ্জে যা ঘটেছে তা নিজের চোখে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত লাইভ টেলিকাস্টে সরাসরি দেখেছি আমরা। যেখানে এডিট কিংবা বানোয়াট কিছু প্রচারের সুযোগ ছিল না। যেখানে একটি রাজনৈতিক দলের নেতারা সভায় কোনো উসকানিমূলক বক্তব্য দিলেন না, অথচ পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তাদের ওপর জঙ্গি হামলা চালাল দুর্বৃত্তের দল। পতিত স্বৈরাচারের দোসর, সমর্থকরা। তাদের ফ্যাসিস্ট স্বভাব রক্তমজ্জায় এমনভাবে মিশে আছে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার পরও তারা সেই আগের মতো আচরণ করছে। বিরোধী দলের উপস্থিতি সহ্য করতে পারছে না। তারা কেন উপলব্ধি করতে পারছে না, গোপালগঞ্জটাই বাংলাদেশ নয়। সারাদেশের মানুষ কী ভাবছেন, কী চাইছেন, তাদের আকাঙ্ক্ষা কী? গোপালগঞ্জ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে এক ধরনের আত্মতুষ্টিতে ভোগা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ মনে হয় ওদের। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের স্মৃতি আমরা ভুলে যাইনি। শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিম, নাফিসারা আমাদের স্মৃতিতে হানা দেয় বারবার।

আজকাল একশ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তীতে দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার উপদেষ্টামণ্ডলীর নানা সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা, ব্যর্থতা, অক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন, প্রায় সময়ই দেখছি। এটা এক ধরনের অসুস্থ মন মানসিকতার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এক ধরনের হীনমন্যতাবোধ, পতিত স্বৈরাচারের আমলে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা ভোগের স্মৃতি ভুলতে না পারাসহ নিজেদের অনেক সুপ্ত বাসনা কামনা পূরণ না হওয়ার বেদনা থেকে এমন আবলতাবোল বকছেন তারা। অনায়াসেই অন্যের সমালোচনা করা যায়। কিন্তু নিজের ঘাড়ে সেই দায়িত্ব অর্পিত হলে বোঝা যায় ওটা পরিপূর্ণভাবে পরিপালন করা কতটা কঠিন। আমরা দেশের বেশির ভাগ মানুষই তো জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আস্থা রেখে এসেছি। এখনো তা বিদ্যমান। আমরা তো সুবিধাভোগী কোনো গোষ্ঠী বা পরিবারের লোক নই। পিওর আমজনতা বলতে যা বোঝায়, আমরা তাই। এখন যারা মজা লুটতে পারছে না,প তিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের সময়ের মতো হালুয়া রুটির ভাগ পাচ্ছে না। কোনো পদ-পদবি পাচ্ছে না, হয়তো মনে বড় আশা ছিল কিছু একটা না একটা পদ বাগিয়ে নেব এই আমলেও। সেই সব লোভী তথাকথিত বিশিষ্টজনদের মনে নানা প্রশ্ন, নানা জ্বালা যন্ত্রণার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। মোদ্দা কথা, আমরা এখন আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময় থেকে অনেক অনেক ভালো আছি। হয়তো সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহেবের পক্ষে। এটা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কারও পক্ষে হান্ড্রেট পার্সেন্ট সুখী করা যাবে না, কখনো কোনো মানুষকে। যিনি এইসব লম্বা চওড়া কথা বলেন, তাকে বসিয়ে দেওয়া হোক কোনো চেয়ারে, তখন তিনি বোঝতে- পারবেন কত ধানে কত চাল। আমি নিজে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলাম। চেয়ারে বসে টের পেয়েছি, কী যে মহা ঝামেলা সবকিছু সামাল দেওয়া ও দায়িত্ব পালন করার যন্ত্রণা। কেবলই মনে হতো এই চেয়ার-টেয়ার ফেলে একদিকে ছুটে পালিয়ে যাই। দূরে কোনো পাহাড় কিংবা জঙ্গলে গিয়ে শান্তিতে বসবাস করি। অতএব, কথা বলতে একটু হুঁশ করে বলা উচিত। মুখে বা মনে যা এলো তা বলে ফেলা একটা ছাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়।

পতিত স্বৈরাচারের কান্ডারী শেখ হাসিনা নিজেকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে জাহির করে পুলকিত হতেন। বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় তার নামের আগে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ বলাটা নাকি সব নেতাদের জন্য ছিল বাধ্যতামুলক। এটা তার নির্দেশ। ২০১৪, ২০১৮ আর ২০২৪ এর জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে গায়ের জোরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা মানুষটাই গণতন্ত্রের মানসকন্যা। এখন সেই গণতন্ত্রের মানসকন্যার স্বরূপ বেরিয়ে আসছে একে একে। এখনতো সব তথ্যই বেরিয়ে আসছে আস্তে আস্তে। সাবেক সিইসি স্বীকার করেছেন, আগের রাতেই ভোটের বাক্স ভরে রাখার নির্দেশ তিনিই দিয়েছিলেন। সাবেক পুলিশ প্রধানও স্বীকার করেছেন, হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার নির্দেশ তিনিই দিয়েছিলেন। বালুভর্তি ট্রাক আর গোপালী পুলিশ দিয়ে খালেদা জিয়ার বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথ যিনি আটকে রেখেছিলেন তিনিই। তিনি নাকি গণতন্ত্রের মানসকন্যা। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় প্রায়শই ২০৪৯ সালের কথা বলতেন। হয়তো তার স্বপ্ন ছিল যে প্রকারেই হোক ২০৪৯ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। তখন তার বয়স হতো ১০০ বছর। তিনি হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন যে তিনি ওই পর্যন্ত বাঁচবেন এবং সাধারণ ‘পাবলিক’ নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই সর্গে প্রবেশ করবেন। আচ্ছা, তিনি কি আজরাইল (আঃ) কেও ম্যানেজ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন? প্রশ্ন জাগে। কিন্তু বিধি বাম। পৃথিবীতে অন্যায় অবিচার অনিয়ম বর্বরতা নৃশংসতা চালিয়ে আজীবন টিকে থাকা যায় না। তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন, মহান সৃষ্টিকর্তা বলে একজন আছেন সবার ওপরে। তার ইশারায়ই পৃথিবীর সবকিছু পরিচালিত হয়ে আসছে। তিনি মাঝে মধ্যে কাউকে কিছুটা ছাড় দেন হয়তো, কিন্তু একেবারে ছেড়ে দেন না। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা এখনো চারদিকে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছে। সুযোগ পেলেই বিষধর সাপের মতো- ছোবল মারতে নানা কলাকৌশল প্রয়োগ করছে। এখন ছাত্র-জনতার দৌড় খেয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়ে আবারও এই গণতন্ত্রের মানসকন্যা নানা গণতান্ত্রিক- উপায় খুঁজে বের করছেন ক্ষমতায় ফেরার জন্য। প্রথমে তিনি আশা করেছিলেন, প্রতিবেশী দেশের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে আবার যেকোনোভাবেই হোক ক্ষমতা ফিরে পাবেন। ভিন দেশের সরকার তাকে ঘাড়ে করে বাংলাদেশে নিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে যাবেন। সেটাতে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি ফন্দি করছিলেন, বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সবাইকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিয়ে আবার তাকেই প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসিয়ে দেবেন। সম্প্রতি পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যেখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত গণতন্ত্রের শত্রু আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণসহ সেনাবাহিনীর কারও সহযোগিতা নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, আতঙ্ক, ভয়ংকর সব ঘটনা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিস্থিতি অশান্ত করে তোলার ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ পেয়েছে। দেশের আপামর জনসাধারণের বিরুদ্ধে গিয়ে আবার ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্নে বিভোর পতিত স্বৈরাচারের নেত্রী শেখ হাসিনার উচ্চাভিলাসী ভাবনা দেখে অবাক হয়ে গেছি আমরা। তার স্মরণ রাখা উচিত, যে যায় সে আর ফিরে না এত সহজে। আফগান বাদশাহ ফিরেনি, ইরানের শাহ ফিরেনি, ফিলিপাইনের মার্কোস ফিরেনি, তিনিও ফিরবেন না। তার প্রতি অনুরোধ, অনুসারীদের সুপরামর্শ দিন, বলুন পজিটিভ হতে, দেশ-সেবা করতে চাইলে ভালো বিকল্প বেছে নিতে।

এই সময়ে চারদিকে নানা ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে গণতন্ত্রের শত্রুরা। তারা একেরপর এক ঘটনার জন্ম দিয়ে নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। এ ব্যাপারে সরকারকে যেমন সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। তেমনিভাবে সকল ফ্যাসিস্টবিরোধী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সাধারণ জনগণের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার নেই কারও। আমরা সবাই একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ সুন্দর নির্বাচনের জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছি। অতীতে পতিত স্বৈরাচার পরপর তিনটি কলঙ্কজনক নির্বাচন করে দেশে-বিদেশে নিন্দিত হয়েছেন। আমরা সেই নষ্ট , কলঙ্কিত নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। সে জন্য দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সুন্দর ও নিরাপদ রাখতে হবে। অতএব, কান্ডারী হুঁশিয়ার। কোনোভাবেই ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী দুঃশাসন আর ফিরে আসতে না পারে সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার , কলাম লেখক।


ভারতে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস, ক্ষমতায় ফিরে আসার চাতুর্যপূর্ণ প্রয়াস

রাজু আলীম
আপডেটেড ১৪ আগস্ট, ২০২৫ ০০:০৯
সম্পাদকীয়

২০০৮ এর ২৯ ডিসেম্বর থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪। সুদীর্ঘ এই সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি, অপশাসনের নতুন রাজত্ব সৃষ্টি করা আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় এখন কার্যত অবাঞ্ছিত, নিষিদ্ধ। বিশেষ করে ৫ আগস্ট বাংলাদেশের মাটিতে হাজারও ছাত্র জনতার বুকের রক্ত ঝরানো আওয়ামী লীগকে দেশের সাধারণ মানুষ সম্মিলিত গণঅভ্যুত্থানে ছুড়ে ফেলেছে ঘৃণার সাগরে। ছুড়ে ফেলেছে শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদে থাকা অপরাজনীতির দোসরদের। দেশের মাটিতে তাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখন অপ্রাসঙ্গিকই নয় বরং জনধিকৃতও বটে। তবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিনের এই ফ্যাসিস্ট দলটিকে সমর্থন না জানালেও শেখ হাসিনা ও তার প্রভাবশালী নেতাদের আশ্রয় দেওয়া ভারত নিজেদের রক্ষায় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগকে। বাংলাদেশে বসে ভারতের ছত্রছায়ায়, ভারতীয় নীতি করা আওয়ামী লীগ এখনো রাজনীতি করছে ভারতেরই প্রত্যক্ষ সহায়তা এবং মদদে।

দেশের মাটিতে ঘৃণার প্রতীক হয়ে উঠলেও, শেখ হাসিনা এবং তার ঘনিষ্ঠ নেতৃত্ব ভারতীয় আশ্রয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই রাজনৈতিক আশ্রয়গ্রহণ একদিকে যেমন প্রশ্ন তোলে ভারতের নৈতিক অবস্থান নিয়ে, অন্যদিকে তা বাংলাদেশের জাতীয় সার্বভৌমত্বকেও করে প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ শেখ হাসিনা এবং তার দল যে কৌশলে ভারতের ছায়াতলে থেকে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে, সেটি কেবল আশ্রয়ের গল্প নয়, বরং একটি পরিপূর্ণ ভূরাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ।

সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, কলকাতার উপনগরীর এক বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি ‘পার্টি অফিস’ খুলে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অফিসটির আকার ছোট মাত্র ৫০০-৬০০ স্কয়ার ফুট। কোনো সাইনবোর্ড নেই, বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার কোনো ছবি নেই, এমনকি দলীয় দপ্তরের ফাইলপত্রও নেই। সবকিছুই অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যেন দলটির অস্তিত্ব সেখানে দৃশ্যমান না হয়। এ যেন এক ধরনের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড অপারেশন’, যার মাধ্যমে ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী নেতারা দলকে সংগঠিত করার কাজ করছেন।

ভারতে আওয়ামী লীগের এই ‘পার্টি অফিস’ শুধু ভবিষ্যতের প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা নয়, বরং এটি ভারতের একটি কৌশলগত দাবার চাল, যার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে নিজেদের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ খুঁজছে। স্বাধীন দেশের একটি রাজনৈতিক দল যদি অন্য দেশের মাটিতে গিয়ে কর্মকাণ্ড চালায়, তবে সেটি কি কেবল আত্মরক্ষার কৌশল, নাকি একটি বৃহৎ আগ্রাসী রাজনীতির অংশ? এই প্রশ্ন এখন বাংলাদেশি জনগণের মনে গভীরভাবে দাগ কাটছে। যারা ১৯৭১ সালে ভারতের সহযোগিতাকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করেছিলেন, তারাই আজ প্রশ্ন তুলছেন, ভারত কি সত্যিই বাংলাদেশের বন্ধু, না কি এক বিকাশমান শাসক?

আওয়ামী লীগের কলকাতা অফিস কার্যত একটি ‘পলিটিক্যাল এক্সাইলের দৃষ্টান্ত। এটি ইঙ্গিত দেয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত একটি সরাসরি পক্ষ হয়ে উঠেছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের কিছু অংশ এ ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে প্রচার করছে। তাদের যুক্তি, ‘আওয়ামী লীগ হচ্ছে ভারত-বান্ধব দল, আর কলকাতা হচ্ছে বাঙালির রাজধানী। তাই এখানে তাদের পার্টি অফিস থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।’ কিন্তু এই ব্যাখ্যা রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। এটি কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের নামান্তর। কোনো স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক দল অন্য দেশের ভেতরে সংগঠিতভাবে কার্যক্রম চালাতে পারে না। এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির মৌলিক নীতি। ভারত যদি সত্যিই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হয়, তবে তাদের উচিত ছিল এই ধরনের অফিস চালানোর অনুমতি না দেওয়া।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ভারতে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগের নেতারা মূলত কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, মেয়র, জেলা পর্যায়ের নেতা, এমনকি অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তারাও। কেউ কেউ সপরিবারে, কেউ বা কয়েকজন মিলে একটি ফ্ল্যাটে বাস করছেন। আনুমানিক ৮০ জন সাবেক সংসদ সদস্যসহ প্রায় ২০০ জন আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তি এখন কলকাতায় রয়েছেন। এই সংখ্যা সময়ের সঙ্গে হয়তো আরও বাড়বে।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং ভারতনির্ভর পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে জনগণের জাগরণ। এই আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল ভারতের প্রভাবমুক্ত, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। অথচ সেই প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, পরাজিত সরকারদল বিদেশে গিয়ে ‘শরণার্থী রাজনীতি’ করছে, তখন জনগণের আশঙ্কা আরও দৃঢ় হয় এই দলটি শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নয়, সার্বভৌমত্বকেও বিকিয়ে দিতে প্রস্তুত।

ভারতের আগ্রাসনের রাজনীতি নতুন কিছু নয়। দেশের জলসীমায় আগ্রাসন, সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না দেওয়া, বাজার দখল, ট্রানজিট, এমনকি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ এসবই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ভারত যেন একটি ‘ডিপ্লোম্যাটিক প্রক্সি’ তৈরি করেছিল। তারা জানত, এই দল ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণ ভারতের পক্ষে থাকবে। তাই আওয়ামী লীগের পতনের পর ভারত সরকার উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। আর সেই উৎকণ্ঠা থেকেই এই ‘কলকাতা অফিস’ যা এক অর্থে ভারতীয় ভূরাজনীতির নিরাপত্তা বলয়ের অংশ।

বাংলাদেশের জনগণ আজ সচেতন। তারা ১৯৭১ সালে ভারতের ভূমিকার মূল্যায়ন করতে জানে, আবার দীর্ঘ ৫০ বছর দেশের অভ্যন্তরে ভারতের হস্তক্ষেপকেও অনুধাবন করতে শিখেছে। আর কলকাতায় আওয়ামী লীগের ‘পার্টি অফিস’ জনগণের কাছে এক ভয়ংকর বার্তা বহন করছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো এক বিদেশি শক্তি সক্রিয় থাকতে চায়, যেটি গণতন্ত্র নয়, বরং তাদের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে।

বছরের পর বছর ধরে ভারত নিজেদের বাংলাদেশের ‘বড় ভাই’ হিসেবে জাহির করে আসছে। অথচ সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যা, বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার অস্বীকার, এবং রাজনৈতিকভাবে অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা এই ‘বড় ভাই’-এর মুখোশ খুলে দিয়েছে। কলকাতায় ‘পার্টি অফিস’ খোলা এই আগ্রাসনেরই নতুন রূপ একটি সফট কূটনৈতিক অভিযান, যার মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটি অনুগত রাজনৈতিক শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

ভারত সরকারের স্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া এই ধরনের রাজনৈতিক দপ্তর পরিচালনা অসম্ভব। অর্থাৎ ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ ও গোয়েন্দা তদারকির মধ্য দিয়েই কলকাতার মাটিতে বাংলাদেশের একটি বিতাড়িত রাজনৈতিক শক্তি টিকে রয়েছে। এটি ভারতের ভূরাজনৈতিক কৌশলেরই অংশ যেখানে বাংলাদেশে তাদের একক অনুগত শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই উদ্দেশ্য। ভারত অতীতে সীমান্ত হত্যা, পানিবণ্টনে বৈষম্য, ট্রানজিট ও অর্থনৈতিক নির্ভরতার মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। এবার তাদের নতুন কৌশল হচ্ছে সরাসরি রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে নিজেদের অনুগত শক্তিকে টিকিয়ে রাখা।

আওয়ামী লীগ ভারতে বসে রাজনৈতিক বৈঠক করছে, ভার্চুয়ালি নেতা-কর্মীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে, হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামে দল পরিচালিত হচ্ছে। শেখ হাসিনা দিল্লির উপকণ্ঠে থাকলেও মাঝে মধ্যে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। সর্বশেষ বৈঠকটি হয়েছিল ৩১ জুলাই। এইসব আয়োজন প্রমাণ করে, দলটির মূল নেতৃত্ব এখন দেশের বাইরে, কিন্তু রাজনৈতিক অভিসন্ধি থেকে সরে আসেনি।

আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও আওয়ামী লীগের এই অবস্থান অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সাধারণ কর্মীরা দেশে দমন-পীড়নের শিকার হলেও শীর্ষ নেতারা ভারতে নিরাপদে অবস্থান করছেন এটি সাংগঠনিক নৈতিকতার দিক থেকেও প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও পঙ্কজ দেবনাথের মতো নেতারা বলছেন, ‘জেলে গেলে বা মারা পড়লে সংগঠন গড়া যেত না।’ এই অবস্থান নিঃসন্দেহে বিতর্কিত। কারণ এটি দেশপ্রেম নয়, বরং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার এক চাতুর্যপূর্ণ প্রয়াস।

অর্থনৈতিকভাবে এই সংগঠনের ভার বহন করা হচ্ছে তথাকথিত ‘শুভাকাঙ্ক্ষীদের’ সহায়তায়। এই অর্থায়ন কতটা স্বচ্ছ তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

কলকাতায় আওয়ামী লীগের এই ‘পার্টি অফিস’ শুধু একটি রাজনৈতিক দপ্তর নয়, এটি ভারতের ভূরাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকির জীবন্ত প্রতীক। ভারতের সরকারি অনুমোদনে এই অফিসের মাধ্যমে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ ও পুনর্গঠন চলছে। বিদেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা কোনো সার্বভৌম দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি দেশের স্বাধিকার ও নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।

কবি, লেখক মিডিয়া ব্যক্তি


ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর: অপূর্ব ঐশ্বর্যের মর্মান্তিক ধ্বংস

সেলিম রানা
আপডেটেড ১৩ আগস্ট, ২০২৫ ২০:৪২
সম্পাদকীয়

সাদা পাথর এলাকা আজ মরুভূমি। আমরা নতুন প্রজন্ম প্রাকৃতিক এই মহামূল্যবান সম্পদ ধরে রাখতে পারলাম না। কিছু রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতার কারণে সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এলাকা আজ মরুভূমিতে রূপ নিয়েছে। গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে এই অপার সৌন্দর্যের প্রাকৃতিক সম্পদকে। তথাকথিত সভ্য সমাজ প্রকৃতির সঙ্গে এমন আচরণ করেছে, যেন প্রকৃতি কেবল ভোগের বস্তু।

নিজ দেশের সৌন্দর্য রক্ষা ও উন্নয়নে নাগরিকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে তবেই আমরা আমাদের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যকে আগামীর জন্য বাঁচিয়ে রাখতে পারব।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্ত সিলেট একটি ভূখণ্ড, যা প্রকৃতির উদার দান, পাহাড়-নদী-ঝর্ণার অপার মেলবন্ধন, চা-বাগানের সবুজ সমারোহ, সীমান্তের পাহাড়ি বাতাস আর মানুষের আন্তরিক আতিথেয়তা মিলিয়ে একটি অনন্য সৌন্দর্যের আঁধার। এই সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ ছিল এমনই এক প্রাকৃতিক রত্নভাণ্ডার, যেখানে ধলাই নদীর স্বচ্ছ জল, সাদা পাথরের স্তূপ আর মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণাধারার মিলনে সৃষ্টি হয়েছে অপরূপ দৃশ্যপট। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য এটি ছিল যেন এক ভূ-স্বর্গীয় গন্তব্য।

কিন্তু আজ, সেই ভোলাগঞ্জ সাদা পাথরের চিত্র দেখে শিউরে উঠতে হয়। একসময়ের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখন ধূলিধূসর মরুভূমির মতো। নদীর বুক ফাঁকা, পাথরের স্তূপ নেই, স্বচ্ছ জল ঘোলা, তলদেশে সৃষ্টি হয়েছে গভীর গর্ত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া আগের ও বর্তমান ছবির তুলনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমরা নিজেরাই প্রকৃতির গলা টিপে হত্যা করছি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অসংখ্য ভিডিও যেন প্রমাণ দিচ্ছে সিলেটের ভোলাগঞ্জে সাদা পাথর এখন আর প্রকৃতির অলঙ্কার নয়, লুটেরাদের লোভের শিকার। ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, জিরো পয়েন্টে খোঁড়াখুঁড়ি করে পাথর তোলা হচ্ছে নির্বিচারে। ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে লুটেরাদের মধ্যে হাতাহাতি এমনকি মারামারির ঘটনাও ঘটছে প্রকাশ্যে।

ধলাই নদীতে দিনের আলো কিংবা গভীর রাত সময় যেন কোনো বাধা নয়। প্রভাবশালী একটি চক্র শত শত বারকি নৌকা ভরে তুলছে পাথর। এমন প্রভাব যে, স্থানীয় মানুষ মুখ খুলতে ভয় পান; প্রশাসনের নীরবতা ও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় এই বেপরোয়া কর্মকাণ্ডকে আরও বেগবান করে তুলেছে। মাসের পর মাস ধরে চলা এই অবৈধ উত্তোলনে নদীর তলদেশে সৃষ্টি হয়েছে গভীর গর্ত, ব্যাহত হয়েছে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ, আর পাথরশূন্য তীরে ভোলাগঞ্জ হারাচ্ছে তার প্রাকৃতিক রূপ।

গত বছরের ৫ আগস্ট থেকেই সাদা পাথরে লুটপাটের সূত্রপাত, তবে গত দুই সপ্তাহে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে চলছে এই লুটপাট; তবে অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরাও নেপথ্যে রয়েছে। সরকার পতনের পর চিত্রটি হয়েছে আরও ভয়াবহ। পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে ভেসে আসা পাথর লুটে চলছে প্রতিযোগিতা, বাদ যাচ্ছে না ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বাঙ্কার এলাকাও। লুটেরাদের তালিকায় রাজনৈতিক রঙের ভেদাভেদ নেই চাঁদাবাজির ধরন বদলে গিয়ে সব পক্ষ মিলে ভাগ বসাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদে।

গত দুই-তিন মাসে দিন-রাত মিলিয়ে অন্তত হাজারের বেশি বারকি নৌকা ব্যবহার করে পাথর লুট হয়েছে। পুলিশের ভূমিকাও ছিল প্রায় নিষ্ক্রিয় যেন তারা শুধু দর্শকের আসনে।

শ্রমিকদের কার্যক্রমও ভয়াবহ চিত্র আঁকে। দিনরাত সমানতালে হাজার হাজার শ্রমিক কোদাল, বেলচা, শাবল ও টুকরি নিয়ে কোয়ারি ও আশপাশের এলাকা থেকে মাটি খুঁড়ে পাথর তুলছেন। পরে বারকি নৌকায় করে সেই পাথর মিল মালিকদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মেশিনে পাথর ভেঙে ছোট করা হয় এবং ট্রাক-পিকআপে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয় যেন এই ধ্বংসযজ্ঞের কোনো শেষ নেই।

ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর ধ্বংসের এই লুটযজ্ঞ কেবল সৌন্দর্যের ক্ষতি নয়; এটি এক গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত সংকটের জন্ম দিচ্ছে। নদী, পাহাড়, জলজ প্রাণী এবং মানুষের জীবন সবই এই বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে।

প্রথমত, নদীর তলদেশে গভীর গর্ত তৈরি হওয়ায় ধলাই নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পানির গতি ও দিক পরিবর্তনের ফলে বন্যা ও ভাঙনের ঝুঁকি আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বর্ষাকালে অতিরিক্ত স্রোতে তীর ভাঙন ও বসতভিটা হারানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়, যা স্থানীয় মানুষের নিরাপত্তা ও বসবাসের স্থায়িত্বকে হুমকির মুখে ফেলে।

দ্বিতীয়ত, জলজ প্রাণীর স্বাভাবিক বাসস্থান ধ্বংস হচ্ছে। নদীর পাথরশয্যা মাছ ও অন্যান্য জলজ জীবের প্রজনন ও আশ্রয়ের জন্য অপরিহার্য। পাথর হারিয়ে যাওয়ায় তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল বিলীন হচ্ছে, ফলে জীববৈচিত্র্য দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব নদীর সম্পূর্ণ খাদ্যচক্রে পড়ছে যা শেষ পর্যন্ত মানুষের খাদ্য ও অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করছে।

তৃতীয়ত, ধলাই নদীর স্বচ্ছতা হারিয়ে জলদূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাথর উত্তোলনের সময় নদীর তলদেশ থেকে মাটি, বালি ও কাদা উঠে এসে পানিকে ঘোলা করে তোলে। এর ফলে পানির মান নষ্ট হয়, নদী ব্যবস্থার প্রাকৃতিক স্বচ্ছতা ও সৌন্দর্য হারিয়ে যায়, আর পানি ব্যবহারের যোগ্যতা কমে যায়।

চতুর্থত, পর্যটনশিল্পের উপর বিরূপ প্রভাব মারাত্মক আকার ধারণ করছে। একসময় যেখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় থাকত, এখন সেখানে হতাশা ও বিমুখতা। পর্যটক না আসায় হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ, নৌকা ভাড়া, স্থানীয় গাইড, হস্তশিল্প বিক্রেতা সবাই অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছে। শতাধিক পরিবার, যারা পুরোপুরি এই পর্যটন নির্ভর জীবিকার সঙ্গে জড়িত, তারা এখন বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

সব মিলিয়ে, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরের এই ধ্বংসযজ্ঞ একটি পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমাজ সবক্ষেত্রের সমন্বিত বিপর্যয়। প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানকে ধ্বংস করে যে উন্নয়ন সম্ভব নয়, তা এই উদাহরণ আমাদের স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও এই অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়নি। প্রশ্ন ওঠে প্রশাসন কি অসহায়, নাকি প্রভাবশালীদের চাপে নীরব?

ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর কেবল একটি পর্যটন স্পট নয়; এটি একটি জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদ ধ্বংস করা মানে জাতীয় ঐতিহ্যের অপচয়। টেকসই সমাধানের প্রয়োজন

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার - ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয় এটি সিলেটের জীববৈচিত্র্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। অথচ অবৈধ উত্তোলন ও পরিবেশ ধ্বংসের কারণে এই অনন্য সম্পদ মারাত্মক হুমকির মুখে। এখনই কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে, অদূর ভবিষ্যতে এই অঞ্চল হারিয়ে যাবে আমাদের চোখের সামনে।

ভোলাগঞ্জ ও এর আশপাশের অঞ্চলকে ‘সংরক্ষিত প্রাকৃতিক অঞ্চল’ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। এতে করে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনুমতি ছাড়া পাথর উত্তোলন, ভূমি খনন বা পরিবেশ বিনষ্টমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে না।

প্রভাবশালী চক্রের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ শুধু অভিযান চালানো নয়, বরং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ একই অপরাধ করার সাহস না পায়।

পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত হাজারো শ্রমজীবী মানুষ হঠাৎ বেকার হয়ে পড়লে সামাজিক সংকট সৃষ্টি হবে। তাই তাদের জন্য বিকল্প আয়ের পথ, যেমন ইকো-ট্যুরিজম, হস্তশিল্প, বা কৃষিভিত্তিক প্রকল্প চালু করতে হবে।

ভোলাগঞ্জকে একটি পরিবেশবান্ধব পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে নিয়ন্ত্রিত পর্যটন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ অবকাঠামো এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের মাধ্যমে।

প্রকৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষকেই অভিভাবক হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি। তারা যদি সরাসরি পর্যটন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত হয়, তাহলে নিজেদের স্বার্থেই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় এগিয়ে আসবে।

পর্যটন কেবল বিনোদনের একটি মাধ্যম নয়; এটি একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ইঞ্জিন। সিলেটের পর্যটন খাত বছরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করতে সক্ষম, যদি প্রাকৃতিক সম্পদগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করা হয়। ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর শুধু স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক পর্যটন মানচিত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ।

বিদেশি পর্যটকরা কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেই আসেন না তারা নিরাপত্তা, অবকাঠামো, পরিবেশের স্থায়িত্ব, এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণকেও মূল্যায়ন করেন। যদি এই অনন্য প্রাকৃতিক দৃশ্য হারিয়ে যায়, তবে সিলেটের পর্যটন আয় ও কর্মসংস্থান উভয় ক্ষেত্রেই বড় ধাক্কা লাগবে। প্রায় হাজার হাজার মানুষ, যারা পর্যটন নির্ভর হোটেল, রেস্টুরেন্ট, নৌকা সেবা, গাইডিং এবং হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

ভোলাগঞ্জ হারিয়ে গেলে শুধু সিলেট নয়, সমগ্র বাংলাদেশের পর্যটন মানচিত্রে একটি বড় শূন্যতা তৈরি হবে, যা দেশের অর্থনীতিতেও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

প্রকৃতি আমাদের শত্রু নয় সে আমাদের জীবনদাতা, আশ্রয়দাতা, এবং সংস্কৃতির ধারক। আমরা যদি প্রকৃতিকে রক্ষা না করি, তবে একদিন প্রকৃতিও আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর ধ্বংস হওয়া মানে কেবল একটি মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক স্থান হারানো নয় এটি আমাদের পরিবেশ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি এক অমার্জনীয় অপরাধ।

এখনই সময় কঠোর আইন প্রয়োগ, স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং টেকসই পর্যটন নীতি বাস্তবায়নের। নয়তো অদূর ভবিষ্যতে ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর শুধু পুরনো ছবিতে, গল্পে, আর আক্ষেপে বেঁচে থাকবে যেখানে আমরা গর্বের পরিবর্তে অপরাধবোধ অনুভব করব।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট


সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি ও পূর্বপুরুষ: ইতিহাস, বিভ্রান্তি ও রাষ্ট্রীয় অবস্থান

তানিম জসিম
আপডেটেড ১৩ আগস্ট, ২০২৫ ২০:৪১
সম্পাদকীয়

সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি পুরনো স্থাপনা ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়েছে। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা পুরনো স্থাপনাটি ময়মনসিংহ শহরের হরি কিশোর রায় রোডের একটি বাড়ি- যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাপিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও দাবি করা হয়েছে এটি কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের বসতভিটা। যা ভেঙ্গে ফেলার খবরটি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। যেখানে আশ্রয় নেয়া হয়েছে শ্রুতিকথা, আবেগ, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। যার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে আমাদের ইতিহাসচর্চার করুণ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক; যাচাই-বাছাইহীন ঐতিহাসিক দাবি, সামাজিক আবেগের সংঘর্ষ, তর্ক পাল্টা তর্ক আর অপতথ্যের ছড়াছড়ি। যা নিয়ে তৈরি হয়েছে দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়া। বাস্তবতার ভিত্তিতে এই নিবন্ধে বিষয়টির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বিভ্রান্তির উৎস, সরকারের অবস্থান এবং বৃহত্তর সাংস্কৃতিক শিক্ষা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি।

ঐতিহাসিক বাস্তবতা

ইতিহাস থেকে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলায় অবস্থিত মসূয়া জমিদার বাড়ি হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটা। এটি হরিকিশোর রায় চৌধুরীর জমিদার বাড়ি ছিল। তার আদি বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ জেলায়। তৎকালীন সময়ে জমিদারিতে অনেক প্রভাব থাকলেও মনে তার শান্তি ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। পরবর্তীতে বড় ভাই কালীনাথ দেব ওরফে শ্যামসুন্দর দেব ও জয়তারা দেবীর পুত্র কামদারঞ্জনকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন জমিদার হরিকিশোর রায়। জমিদারি প্রথা টিকিয়ে রাখতে দত্তক পুত্র কামদা রঞ্জনের নাম পরিবর্তন করে নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখেন উপেন্দ্র কিশোর রায়। পরবর্তীকালে জমিদার হরি কিশোর রায়ের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। যার নাম রাখা হয় নরেন্দ্র কিশোর রায়। লেখাপড়ায় মনোযোগী উপেন্দ্র কিশোর রায়কে পড়ালেখায় স্বাবলম্বী করতে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ভর্তি করানো হয়। সেখানে হরিকিশোর রায়ের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। এখনো তার নিজ নামের একটি রাস্তা সে ইতিহাস বহন করে চলছে।

দ্বারকানাথ ও কাদম্বিনীর একমাত্র কন্যা সন্তান বিধুমুখীকে ১৮৮৩ সালে বিয়ে করেন উপেন্দ্রকিশোর রায়। তাদের বৈবাহিক জীবনে ১৮৮৭ সালে ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন দ্বিতীয় সন্তান সুকুমার রায়। জন্মের পর থেকেই পিতার সকল গুণাবলিই বিদ্যমান ছিল তার মধ্যে। ১৯১৩ সালের গোড়ার দিকে সুকুমার রায় ঢাকার খ্যাতনামা সমাজসেবক কালী নারায়ণ গুপ্তের কন্যা সুপ্রভাকে বিয়ে করেন। বৈবাহিক জীবনের আট বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯২১ সালে ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তিনি একবারই বাংলাদেশের ঢাকায় এসেছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত মুখ্য সচিব এবং রায় পরিবারেরই সন্তান প্রসাদরঞ্জন রায় ‘ময়মনসিংহ ও উপেন্দ্র কিশোর’ শিরোনামে কালি ও কলম পত্রিকায় ২০১৪ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেন ‘উপেন্দ্র কিশোর ১৮৯৮ সালে ভূমিকম্প ও প্লেগের মহামারির পর একবার, ১৯০৫-০৬ সালে সম্পত্তি ভাগাভাগি করতে একবার, ১৯১১ সালের শেষে একবার আর সম্ভবত সুকুমারের বিবাহের পর একবার দেশে গিয়েছিলেন। দেশের সঙ্গে তার যোগসূত্র ক্ষীণ হয়ে আসছিল।’ শুধু উপেন্দ্রকিশোরের নয়, তার পরিবারের আর কারও সঙ্গেই মসূয়ার সম্পর্ক আর বহাল থাকেনি। তিনি আরও লিখেছেন: ‘১৯২৬ সালেই গড়পারের বাড়ির সঙ্গে এবং মসূয়ার জমিদারির সঙ্গে সম্পর্কের শেষ। যদিও হরি কিশোরের বংশ ধরদের কেউ কেউ বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছেন মসূয়ায়। তবে উপেন্দ্র কিশোর-সুকুমারের বংশ ধরদের সঙ্গে মসূয়ার সম্পর্ক সেই শেষ।’ উপেন্দ্র কিশোরের মূল যে ভিটা, সেই মসূয়ার জমিদারবাড়ি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় বর্তমানে সংরক্ষিত আছে। যদিও সেই জমিদারবাড়ির সংস্কার ও সংরক্ষণেও যথাযথ উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে।

ময়মনসিংহের প্রত্নতত্ত্ব গবেষক স্বপন ধর সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ভবনটি সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের বাড়ি নয়। এই ভবনটি বাংলাদেশের বিশিষ্ট সমাজসেবক, জমিদার ও দানবীর ব্যক্তিত্ব রণদা প্রসাদ সাহা (যিনি আর.পি সাহা নামে অধিক পরিচিত) এর একটি অস্থায়ী বাসভবন ছিল; ‍যিনি কুমুদিনী হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস, কমুদিনী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। ভবনটি মূলত উনিশ শতকের শেষভাগ বা বিশ শতকের প্রথম দিকে নির্মিত হয়। এটি পূর্বে স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র (Old DC Power Station বা ‘বিদ্যুৎ কল’) হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যা ১৯২০-এর দশকে শুরু হয়ে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রণদা প্রসাদ সাহার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রণদা প্রসাদ সাহার মৃত্যু হয় এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সংশ্লিষ্ট ভবন সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৮৭ সালে সরকার এটি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির জন্য লিজ প্রদান করে। লিজ নেয়ার পর ভবনটি শিশু একাডেমির কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যবহার করা হলেও দীর্ঘ সময় ব্যবহৃত হওয়ার ফলে কাঠামোগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ২০০৭ সালে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ও অনুপযোগী হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।

বিতর্কের সূচনা

২০২৪ সালের শেষ দিকে ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়ায় একটি পুরনো ভবন ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয় স্থানীয় প্রশাসন। ভবনটি আগে শিশু একাডেমি ব্যবহার করত (১৯৮৭-২০০৭)। ভবনটি পরিত্যক্ত এবং দীর্ঘদিন অব্যবহৃত ছিল। ভাঙার আগে একজন স্থানীয় লেখক ও ইতিহাসপ্রেমী সামাজিক মাধ্যমে দাবি করেন, এটি উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর পূর্বপুরুষদের বাড়ি এবং ঐতিহাসিকভাবে সংরক্ষণযোগ্য। এই দাবিটি বিভিন্ন মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কিছু সংবাদমাধ্যম যাচাই না করেই ‘সত্যজিৎ রায়ের দাদার ভিটা ভেঙে ফেলা হচ্ছে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ফলাফল— সামাজিক মাধ্যমে জনরোষ, ইতিহাস সংরক্ষণের দাবিতে প্রতিবাদ এবং সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা ছড়াতে থাকে। যা বাংলাদেশে খুব সহজসাধ্য কাজ; তবে সত্য যাচাই করে প্রকৃত ঘটনা জানতে আমাদের বড় অনাগ্রহ! বাস্তবতা হচ্ছে ময়মনসিংহ শহরের এক সময়কার ধনাঢ্য ব্যক্তি হরি কিশোর রায় এর নামানুসারে হরি কিশোর রায় রোড নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়। যার ৩য় লেনের একটি বাড়ি তিনি দত্তক পুত্র উপেন্দ্র কিশোর রায় এবং নরেন্দ্র কিশোর রায়ের নামে বণ্টন করে দেন। উপেন্দ্রকিশোর স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে গেলে বাড়িটি পরবর্তীতে নরেন্দ্রকিশোর বিক্রি করে দেন।

প্রকৃত তথ্য

ময়মনসিংহের বাংলাদেশ শিশু একাডেমির বাড়িটি হরি কিশোর রায় রোডের প্রথম লেনসংলগ্ন; যার প্রকৃত মালিক জমিদার শশিকান্ত বা মহারাজা শশিকান্ত আচার্য্য- যা তিনি রণদা প্রসাদ সাহাকে ব্যবহারের জন্য দান করেন। রণদা প্রসাদ সাহা ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাড়িটি ব্যবহার করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মৃত্যুবরণ করলে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকার তা অধিগ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে সরকার কর্তৃক শিশু একাডেমিকে লিজ হিসেবে দেয়া হয়। অপরদিকে হরি কিশোর রায় রোডের ৩য় লেনের অপর একটি বাড়ি- যা হরিকিশোর রায়ের বাড়ি বা পূর্ন্যলক্ষ্মী ভবন নামে পরিচিত; এই বাড়িটিই সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ উপেন্দ্রকিশোর রায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।

রাষ্ট্রীয় অবস্থান

ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং দেশি বিদেশি প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্রের ভাষ্যমতে, বিভিন্ন সূত্র, আর্কাইভ, এবং ভূমি রেকর্ড বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে— ময়মনসিংহের উক্ত ভবনের সঙ্গে সত্যজিৎ রায় বা তার পূর্বপুরুষদের কোনো সংযোগ নেই। সরকারি ভূমি রেকর্ড এবং জমির মালিকানা দলিলপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ওই বাড়ির সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বাড়িটি স্থানীয় জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে নির্মিত হয়েছিল এবং পরে সরকারের নামে রেজিস্ট্রেশন হয়। যাতে স্পষ্ট হয় গণমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমে ছড়ানো খবরটি ছিল ভুল ও বিভ্রান্তিকর।

পরিশেষে বলা যায়, ময়মনসিংহের বাড়িটি সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের নয়—এটি নিশ্চিতভাবে সরকারি রেকর্ড ও প্রশাসনিক পর্যবেক্ষণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে। তবে এই ঘটনার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, শুধুমাত্র বিশ্বাস বা শ্রুতিকথা নয়—ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে দরকার দলিল, গবেষণা ও দায়বদ্ধতা। একইসঙ্গে প্রশাসনের উচিত, এমন বিতর্কিত ক্ষেত্রে প্রথমেই স্বচ্ছতা ও তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে জনমতকে আস্থায় আনা।

*প্রাবন্ধিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক। সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


আগামী নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটুক

আপডেটেড ১১ আগস্ট, ২০২৫ ২০:০২

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিষয় হলো নির্বাচন। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এমনকি এ তথ্য নিশ্চত হওয়া গেছে যে স্থানীয় সরকার নয়, বরং সংসদ নির্বাচন ঘিরে পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছে সাংবিধানিক এই সংস্থা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এবং সরকারের ভেতর নির্বাচন নিয়ে টানাপড়েন কাটছে না। এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে- সেটিও অনুমান করা যাচ্ছে না।
নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান কেমন হবে এবং নতুন রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে নির্বাচনে যাবে সে বিষয়ে কোনো পরিষ্কার ধারণা করা যাচ্ছে না। তরুণ এবং ছাত্রদের নেতৃত্বে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা শেষ করেছে। তারা কীভাবে মনোয়ন দিবে সে বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত কোনো কিছু না জানালেও কোনো কোনো গণমাধ্যম সূত্রে আমর জেনেছি যে এনসিপি ৩০০ আসনেই প্রার্থীতা দিতে পারে। অবশ্য ইতিমধ্যেই বেশ কিছু আসনে অনানুষ্ঠঅনিকভাবে তাদের প্রার্থীতা ঘোষণা করতে দেখো গেছে। আর বিএনপি এবং জামায়াত আলাদাভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে- সে বিষয়ে স্পষ্ট মনে হচ্ছে।
সাধারণ জনগণ চায় দেশে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। দীর্ঘদিন জনগণ তাদেও অধস্থা নিয়ে নির্বাচনের মাঠে থাকতে পারেনি। এই মুহূর্তে জনগণের আকাঙ্ক্ষাই হলো একটি গ্রহণযোগ্য এবং অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইতিবাচক থাকলে জনগণের আস্থার মাত্রাও অধিক ইতিবাচক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে জনগণের আস্থা অনেকাংশে বেড়ে যায়। এবারের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় একটি বিষয় পরিষ্কার যে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা না থাকলে নির্বাচনে কোনোভাবেই বিজয়ী হতে পারবে না। কোনো প্রতীক বা দলের মনোয়ন কোনোভাবেই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মূল কার্ড হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ দেশে একটি বিরাট জনগোষ্ঠী তরুণ এবং সচেতন। তাদের বেশিরভাগ অংশই এবারই প্রথম ভোট দিতে যাবে।
নির্বাচনের আগেই কোনো রাজনৈতিক দলকে হারিয়ে দেয়ার মানসিকতা থেকেও সকল রাজনৈতিক দলকে বের হয়ে আসতে হবে। একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, বেশ কিছু রাজনৈতিক দল মোটামুটি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনমুখী জনসংযোগের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। কাজেই নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের রোডম্যাপ এমন হওয়া উচিত যাতে দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির মধ্য দিয়ে সকল সংকটের সুষ্ঠু সমাধান হয়।
ইতোমধ্যেই আমরা লক্ষ্য করেছি যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক প্রার্থী তাদের প্রচারণায় তৎপর হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় সকল পর্যায়ের নেতারা প্রচারণায় মনোযোগ দিয়েছে। আবার জোট গঠনের বিষয়েও যথেষ্ট তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরিস্থিতি এখন এমন হয়েছে যে, দেশের জনগণ সংস্কার প্রশ্নে নির্বাচন আটকে থাকুক এমনটি আর চায় না। নির্বাচন আগে নাকি সংস্কার আগে- এই প্রশ্নে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটি এখন আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশের মানুষের যে প্রাণের আকাক্সক্ষা, ভোট কেন্দ্রে গিয়ে একটি ভোট দেওয়া, সেটা সত্যিকার অর্থে পূরণ হওয়ার চ্যালেঞ্জটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা সত্য যে, নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, তাদের কাছে যে শক্তি, সাহস ও দক্ষতা থাকবে তা দিয়ে দেশের বিদ্যমান কাঠামোগত সমস্যার স্থায়ী সমাধান করার মানসিকতা থাকতে হবে। যেগুলো এ সরকারের (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, সেগুলো নির্বাচিত সরকার করবে- এমন প্রত্যাশা অনেকেই গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এখন আমরা দেখতে চাই যে, যেসব দল এবং প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেবে তারা সাধারণ জনগণের জন্য এবং দেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গে কী ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিতে যাচ্ছে। এমনকি কীভাবে দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা যায়, কীভাবে দেশের জনগণের চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করা যায়- সেসব বিষয়েও পরিষ্কার রোডম্যাপ আসলে ভোটারদের চিন্তা করতে সহজ হবে।
তাছাড়া দেশের মানুষ বিভিন্ন অনলাইন জরিপ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রকাশিত জনগণের মন্তব্যের মধ্য দিয়ে রাজনীতির বাস্তব চিত্র যাচাই করতে পারে। আর এসব চিত্র বাস্তবতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা যায়। এখন মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর বক্তব্যে কিংবা তথ্যে রাজনীতিতে লাভবান হওয়া কঠিন। এক কথায় বলা যায়, ধোঁকাবাজির রাজনীতি এখন আর নেই। একথা আমরা সবাই জানি, রাজনীতিতে আস্থা-অনাস্থা এবং বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটি অনেক বেশি। পাশাপাশি সন্দেহ-সংশয় তো আছেই। সাম্প্রতিককালে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য শুনলে মনে হয় রাজনীতিতে আস্থা এবং বিশ্বাস বলতে কিছু নেই। সকালে এক ধরনের বক্তব্য বিকেলে আবার আরেক ধরনের বক্তব্য দেখা যায়। দিন না ঘুরতেই যদি বক্তব্য এবং মতামত পরিবর্তন ঘটে, তাহলে মাস এবং বছর গেলে তাদের অবস্থান কেমন হবে বা হতে পারে - সেটি অনুমান করা কঠিন কিছু না।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সংকট ও অনাস্থার পরিবেশ নতুন নয়। অনাস্থার বেড়াজাল থেকে রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই বের হতে পারেনি। গণতন্ত্রের নামে এবং গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকারে রাজনৈতিক দলগুলো বারবারই রাজনৈতিক অনিশ্চিয়তার মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে এমনই এক অনিশ্চিয়তার দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছে বিদ্যমান রাজনীতি।
ধারণা করা যাচ্ছে যে, দেশে আসন্ন নির্বাচনকেন্দ্রিক সুনির্দিষ্ট নিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি না হলে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি ব্যাপকতর হতে পারে। এ জন্য একটি সুশৃঙ্খল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বর্তমানে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হলো নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া। আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সকল রাজনৈতিক দলই নিজস্ব কৌশল প্রয়োগে ব্যস্ত থাকবে- সেটি স্বাভাবিক। কৌশল প্রয়োগের দিক সকল দলই নিজ নিজ জায়গা থেকে সামনে এগিয়ে যাবে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেরুকরণ ঘটবে- এটি অস্বাভাবিক কিছু না। মূলত নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য রাজনৈতিক মেরুকরণে পরিবর্তন হতে পারে। তবে কোনো দল যদি রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজ নির্বাচনী আয়োজনের পক্ষে কাজে লাগানোর সুযোগ পায় অথবা কাজে লাগায় তাহলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সেটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সামনে আসবে। আর নির্বাচন কমিশনও প্রভাবিত না হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করলে নির্বাচন ও রাজনীতি দুটিই গ্রহণযোগ্য মাত্রা পাবে। আর এ কারণেই সকল পক্ষকে সমান সুযোগের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীদের প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’ কাজেই নির্বাচন কমিশনই প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। মূলত নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের ভূমিকার ওপরই সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্পর্ক রয়েছে। আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনটির তিনটি চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান হতে পারে। প্রথমত: নির্বাচনে বেশিরভাগ জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; দ্বিতীয়ত: সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান, তৃতীয়ত: ভবিষ্যতে সাধারণ জনগণের ভোটে অংশ নেয়ার বিষয়ে আগ্রহ এবং আস্থা সৃষ্টি করা। কারণ নির্বাচন যদি ভালো হয়, তাহলে নির্বাচনী রাজনীতিতে জনগণের আস্থা তৈরি হবে, আর ভালো না হলে তৈরি হবে স্থায়ী অনাস্থা।
তবে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই নিজেদের পথের কাঁটা হওয়া থেকে দূরে সরে আসতে হবে। দেশ ও জাতির উন্নয়ন করতে হলে রাষ্ট্রক্ষমতার চাবি হাতে থাকা যেহেতু জরুরি সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় যেতে অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে রাজনৈতিক দলগুলো এখন মরিয়া হয়ে উঠবে- এমনটাই স্বাভাবিক। তবে শিষ্টাচারসম্মত রাজনীতির জন্য জনপ্রতিনিধিদের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি। আমাদের নিজেদের বিবেক এবং চিন্তা যদি পরিশীলিত বা মার্জিত না হয় তাহলে কোনোভাবেই ইতিবাচক প্রত্যাশা সফল হবে না। আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামেই চয়েস করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন, অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্যমানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। দেশের সাধারণ জনগণ দেশের রাজনীতির একটি গুণগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করে। আর এ কারণে নতুন রাজনৈতিক দলসহ দেশে বিদ্যমান সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে বলব আপনারা যদি দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চান, তাহলে মনে রাখবেন, রাজনীতি মানে উগ্রতা, প্রতিহিংসা নয়, রাজনীতি মানে শালীনতা, ভদ্রতা এবং সহনশীলতা। আর এসব গুণাবলির মধ্য দিয়ে জনগণের মনে স্থান করে নিতে হবে। রাগ, হিংস্রতা কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ দিয়ে রাজনীতি করলে কখনোই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে না। আমরা সাধারণ জনগণ ভালো এবং নতুন কিছু প্রত্যাশা করি। আর এ জন্য পরিবর্তন শুধু মুখে নয় আচরণে এবং কার্যক্রমে প্রমাণ করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


যার দক্ষতা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও কর্মযজ্ঞে প্রাণ ফিরে পেয়েছে এলজিইডি

আপডেটেড ১০ আগস্ট, ২০২৫ ১৭:৫১
নিজস্ব প্রতিবেদক

সাবেক প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিন, প্রধান প্রকৌশলী আলি আখতার হোসেন এবং প্রধান প্রকৌশলী গোপাল চন্দ্র দেবনাথ (রুটিন ওয়ার্ক) অবসরে যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি একজন কর্মদক্ষ প্রধান প্রকৌশলীর শূণ্যতায় ভুগছিল। সে সময়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে প্রকৌশলী আব্দুর রশীদ মিয়ার নাম প্রস্তাবিত হয়। যিনি বিগত সময়ে এলজিইডির প্রশাসন এবং মানব সম্পদ বিভাগে সফলতার সাথে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্বপালনকালে তার কর্মদক্ষতা প্রশংসিত হয়। এলজিইডি একটি বিকেন্দ্রীকৃত সংস্থা, যার মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম বেশি। গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলে রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট, পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্প এবং অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন করে থাকে। এলজিইডি বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এবং এক্ষেত্রে প্রকৌশলী আব্দুর রশীদ মিয়া তার পুরো কর্মজীবনে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখেন। যার স্বীকৃতিস্বরুপ চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আব্দুর রশীদ মিয়াকে (মানবসম্পদ উন্নয়ন, মাননিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ) এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে আব্দুর রশীদ মিয়া দায়িত্ব নেওয়ার পর, তিনি এলজিইডির স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন, গতিশীলতা বৃদ্ধিতে নিরলস ভাবে কাজ করছেন। তিনি যোগদানের পর এলজিইডির বিভিন্ন কার্যক্রম তদারকি করেছেন এবং কর্মকর্তাদের সাথে নিয়মিত বৈঠক করে বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করেছেন। এতে করে প্রানস্পন্দন ফিরতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটিতে। আব্দুর রশীদ মিয়া এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে যোগদানের পর, তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে মূলত উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপদেষ্ঠার এবং সচিবের পরামর্শে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সাথে আস্থাবৃদ্ধিতে সফলতার সাথে কাজ করে চলছেন । তিনি ইতোমধ্যে তার অভিজ্ঞতার আলোকে কর্মদক্ষতায় দীর্ঘ সময় পর কর্মমুখর করে তুলেছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। বিগত সময়ে তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন)-এ দীর্ঘসময় দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে মানবসম্পদ, পরিবেশ ও জেন্ডার ইউনিটেও কর্মরত ছিলেন। আব্দুর রশীদ মিয়া ২০২৩ সালে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পান।

তিনি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (মানবসম্পদ উন্নয়ন, মাননিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ ইউনিট) হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প (পিইডিপি-৪)-এর দায়িত্ব পালন করেন। আব্দুর রশীদ মিয়া মেধাবী, কর্মঠ, দক্ষ ও সৎ প্রকৌশলী হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন। পেশাদারি উৎকর্ষ সাধনে তিনি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন কারিগরি, ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ নেন। তিনি মানব সম্পদ বিভাগে দায়িত্বপালনকালে প্রতিষ্ঠানের জনবল ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন, এবং কর্মপরিবেশ উন্নয়নে কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে জনবল নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ প্রদান, কর্মীর দক্ষতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি, এবং একটি স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ তৈরি করেন। এছাড়াও, মানব সম্পদ বিভাগ কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা দেখাশোনা করে এবং তাদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত উন্নয়ন সহায়তায় দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) প্রশাসনে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন)- হিসেবে আব্দুর রশীদ মিয়া দায়িত্বপালকালে গ্রামীণ এবং শহরাঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।

এলজিইডি গ্রামীণ অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে, গ্রামীণ রাস্তা, বাজার, এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন করা। সে সবে তার কর্মদক্ষতা নানান ভাবে প্রশংসিত হয়। নারীর ক্ষমতায়নে ব্যাপক ভুমিকা রাখেন। আব্দুর রশীদ মিয়া জাপানের বহুজাতিক কোম্পানি মিতসুবিসিতে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৯-এ বাংলাদেশ কর্মকমিশন (পিএসসি)-এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল ব্যুরো (এলজিইবি)-তে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ২০০৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে এলজিইডি কুষ্টিয়া জেলায় যোগাদান করেন এবং সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। পরে সিরাজগঞ্জ জেলায় নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে আব্দুর রশীদ মিয়া সহকারী প্রকৌশলী, উপজেলা প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি “ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীনিবাস নির্মাণ শীর্ষক” প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে সফল্যের স্বাক্ষর রাখেন। এটি ছিল পরিচ্ছন্নকর্মীদের জন্য ঢাকায় নির্মিত প্রথম আবাসন প্রকল্প। আব্দুর রশিদ মিয়া রাজশাহী বিভাগ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে রাজশাহী বিভাগের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আব্দুর রশীদ মিয়া ২০১৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পান। একজন পেশাদার প্রকৌশলী হিসেবে তিনি এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে চলতি দায়িত্ব গ্রহনের পর অনেকটা ঘুড়ে দাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। দায়িত্বশীল সংশ্লিস্টরা বলছেন প্রতিষ্ঠানটির বৃহৎ স্বার্থে ধারাবাহিকতা ধরে রাখা জরুরী।


‘প্রিয় শিক্ষালয়’ অ্যাপ আশা জাগাচ্ছে বেকার ও চাকরি খুঁজছেন এমন হাজারো মানুষের

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মো: মেরাজ উদ্দিন, শেরপুর জেলা প্রতিনিধি

কাজের ফাঁঁকে চাকরীর প্রস্তুতি নিচ্ছে অনেক বেকার ও চাকরি প্রত্যাশীরা। তাদের অনেকেরই এখন নির্ভর করতে হচ্ছে প্রিয় শিক্ষালয়’ অ্যাপ এর ওপর। এর মধ্যে মনিরা ইয়াসমিন মুক্তা নামে এক গৃহীনী একজন। তিনি পড়াশোনা শেষ করেছেন প্রায় দুই বছর আগে। কিন্তু ছোট সন্তান থাকার কারণে কোথাও গিয়ে কোচিং করে চাকরির প্রস্তুতি নেয়া তার জন্য ছিল প্রায় অসম্ভব। যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রস্তুতির অভাবে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছিলেন না তিনি। ধীরে ধীরে হতাশা আর আত্মবিশ্বাসহীনতা গ্রাস করছিল মনিরাকে।

ঠিক তখনই একদিন এক পরিচিতের কাছ থেকে জানতে পারেন ‘প্রিয় শিক্ষালয়’ অ্যাপ সম্পর্কে। তার কথাতেই গুগল প্লে-স্টোর থেকে priyoshikkhaloy লিখে সার্চ দিয়ে ইনস্টল করে নেয় অ্যাপটি। অ্যাপটি মোবাইলে ডাউনলোড করে প্রথমে কিছুটা দ্বিধায় থাকলেও ধীরে ধীরে সেটাই হয়ে উঠেছে এখন তার সবচেয়ে বড় ভরসার স্থল। এখন আর বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, সন্তানকে সময় দিয়েও নিয়মিত চালিয়ে যাচ্ছেন নিয়োগ প্রস্তুতি। আশা করছেন খুব শ্রীঘ্রই আসবে সফলতা, জানালেন মনিরা ইয়াসমিন মুক্তা।

মনিরার মতো অভিজিৎ চক্রবর্তীর গল্পটাও প্রায় একই। আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি পারিবারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কোচিং করার সময় হয়ে উঠছিল না। ফেসবুকে ‘প্রিয় শিক্ষালয়’ অ্যাপের বিজ্ঞাপন দেখে সেটি ডাউনলোড করে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এর মাধ্যমেই তিনি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাশ করেন এবং শিক্ষক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন।

এই অ্যাপটি বর্তমানে চাকরি খুঁজছেন এমন হাজারো মানুষের জন্য নতুন আশার আলো হয়ে উঠেছে। যাদের অর্থ বা সময়ের সমস্যা আছে, তারা এখন ঘরে বসেই চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে পারছেন। ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চালু হওয়া অ্যাপটি অল্প সময়েই এক লাখের বেশি ডাউনলোড ছাড়িয়ে গেছে।

এই অ্যাপ থেকে উপকৃত হচ্ছেন না শুধু চাকরি প্রত্যাশীরা, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাওয়া শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবকরাও। অ্যাপটিতে রয়েছে বিসিএস, ব্যাংক, শিক্ষক নিবন্ধন, প্রাথমিক শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, নার্সিং ভর্তি, আইনজীবী এনরোলমেন্টসহ নানা পরীক্ষার প্রস্তুতির কনটেন্ট।

গুগল প্লে-স্টোরে অ্যাপটির রেটিং ৪.৮, আর হাজারো মানুষ ইতোমধ্যে প্রশংসা করে রিভিউ দিয়েছেন। অনেকে বলেছেন, এই অ্যাপের মাধ্যমেই তারা চাকরি পেয়েছেন এবং তাদের জীবন বদলে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়োপযোগী প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন উদ্যোগগুলো ভবিষ্যতে দেশের বেকার সমস্যা মোকাবেলায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে। প্রিয় শিক্ষালয়ের প্রধান নির্বাহী মহিউদ্দিন সোহেল জানান, অ্যাপটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন শিক্ষার্থীরা নিজের দুর্বল দিক চিহ্নিত করে ঠিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেন। প্রতিটি মডেল টেস্টের শেষে ফলাফল বিশ্লেষণ করে ব্যবহারকারীদের উন্নতি কোথায় দরকার তা জানিয়ে দেয় অ্যাপটি। ভবিষ্যতে অ্যাপে ভিডিও লেসন, লাইভ ক্লাস এবং আরও উন্নত লার্নিং সিস্টেম যোগ করা হবে।


“অবসরপ্রাপ্তদের জন্য বিআরটিসি’র দরজা সবসময় খোলা”

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০

অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিআরটিসির দরজা সবসময় খোলা। কর্পোরেশনের ডিপো বা প্রধান কার্যালয় এ কোনো কাজে আসলে তাদেরকে বিনা কারণে হয়রানি করা যাবে না। তাদের যে কোনো কাজ আগে করে দিতে হবে, তাদের খোঁজ-খবর নিতে হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি)’র চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল লতিফ মোল্লা।

বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) সকালে বিআরটিসি’র প্রধান কার্যালয় “পরিবহন ভবন” এর সভাকক্ষে আয়োজিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিপিএফ, গ্র্যাচুইটি এবং ছুটি নগদায়নের অর্থ প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

বিআরটিসি চেয়ারম্যান বলেন, অবসরপ্রাপ্তদের যে কোনো প্রয়োজনে আমরা পাশে আছি। আপনাদের সুযোগ-সুবিধা দেখার দায়িত্ব বিআরটিসি পরিবারের।

অনুষ্ঠানে ৩২২ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সিপিএফ, গ্র্যাচুইটি এবং ছুটি নগদায়ন বাবদ মোট ২ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার ২৩২ টাকা অনলাইন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে সুবিধা ভোগীদের নিজস্ব একাউন্টে প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬১ জন কর্মচারী (সম্পুর্ণ ১৮ জন ও আংশিক ৪৩ জন) সিপিএফ বাবদ প্রায় ১ কোটি ৫৯ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা, ১৬ জন কর্মচারী (সম্পুর্ণ ০১ জন ও আংশিক ১৫ জন) ছুটি নগদায়ন বাবদ ৭ লক্ষ ৯৭ হাজার টাকা এবং ২৪৫ জন কর্মচারী গ্র্যাচুইটি বাবদ ১ কোটি ২২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা পেয়েছে।

বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ মোল্লা’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক ড. অনুপম সাহা, প্রশাসন ও অপারেশন বিভাগের পরিচালক মোঃ রাহেনুল ইসলাম, কারিগরী বিভাগের পরিচালক কর্নেল কাজী আইয়ুব আলী, কর্পোরেশনের বিভিন্ন বিভাগের জিএমগণ, ঢাকাস্থ ডিপো ম্যানেজারগণ এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা।


যদি আমরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম তাহলে জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশ হতো একেবারে ভিন্ন দেশ : হান্নান মাসুদ

আপডেটেড ২ জুলাই, ২০২৫ ২২:৫৬
বাসস

আব্দুল হান্নান মাসউদ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। পুরো জুলাই মাস তিনি পালিয়ে বেড়িয়েছেন। আর আন্দোলনকে একটি সামগ্রিক রূপ দিতে কখনো ফেসবুক লাইভ, কখনো বা সাংবাদিকদের কাছে বার্তা পাঠিয়ে কর্মসূচি চালিয়ে গেছেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে আন্দোলনের সময়কার বিভিন্ন ইস্যুতে স্মৃতিচারণ করেন তিনি। তার কথার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে সে সময়ের অনেক অজানা কথা। হান্নান মাসউদ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিলেন এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। যার ফলে দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন তাকে হল ছাড়তে বাধ্য করে তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তার রাজনীতির শুরুটা হয় ছাত্র অধিকার পরিষদ দিয়ে। ন্যায় ও নীতির ব্যাপারে আপস না করে পরিষদের রাজনীতি থেকেও সরে আসেন তিনি। হান্নান মাসউদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী।

আপনার রাজনীতির যাত্রাটা কবে থেকে শুরু হয়েছে, কী চিন্তা থেকে রাজনীতিতে আসেন আপনি?

হান্নান মাসউদ: আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস কেবল জুন থেকে শুরু হয়নি। আমার রাজনীতির শুরুটা ২০২২ সাল থেকে। তখন হল ছেড়ে দিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের রাজনীতিতে যোগ দেই। উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়ভাবে যে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যে অত্যাচার চলছিল সেগুলোর প্রতিবাদ করা। আমার চিন্তা ছিল, অন্যায়ের প্রতিবাদ কাউকে না কাউকে করতে হবে। একটি অংশকে অবশ্যই জেগে উঠতে হবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। যারা সত্য তুলে ধরবে তারা সংখ্যায় যত কমই হোক এক সময় মানুষ এসে তাদের পাশে দাঁড়াবে। এমন চিন্তা থেকে আমার রাজনীতিতে আসা।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে আপনি কোন প্রেক্ষাপটে যুক্ত হয়েছেন?

হান্নান মাসউদ: আমি তখন মোহাম্মদপুরে থাকি। টিউশন থেকে আসার পর আমরা যারা একসাথে রাজনীতি করতাম তাদের মধ্যে অনলাইনে একটি মিটিং হয়। মিটিং এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫ জুন সন্ধ্যায় আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করি। আমরা ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে যুক্ত করার চেষ্টা করি। শিক্ষার্থীদের ভালো সাড়াও আমরা পাই। সেদিনের প্রোগ্রাম থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, ক্রাউড ফান্ডিং করে আমরা আন্দোলন পরিচালনা করবো। ওইভাবেই আমরা আন্দোলনের সকল খরচ বহন করতাম শুরুর দিকে। জুনের ১২ তারিখ পর্যন্ত আমরা বিক্ষোভ মিছিল চালু রাখি।

১২ জুন আমাদের একদল প্রতিনিধি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে স্মারকলিপি দিতে হাইকোর্টে যায়। তিনি সেদিন আমাদের সাথে দেখা না করলেও আমরা তার অফিসে তা জমা দিয়ে আসি। সেখানে আমরা এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশের মুখোমুখি হই। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাদের জেরা করেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামটি কীভাবে আসে?

হান্নান মাসউদ: ১২ জুন অ্যাটর্নি জেনারেলকে স্মারকলিপি দেওয়ার পর আমরা ৩০ জুন পর্যন্ত আল্টিমেটাম দেই। ১ জুলাই থেকে আবারও বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করি। ৪ জুলাই কোটা নিয়ে হাইকোর্টের শুনানি ছিল। আমাদের চিন্তা ছিল, সেদিন যদি রায় স্থগিত না করা হয় তবে আমরা এই আন্দোলনের একটি সাংগঠনিক ভিত্তি দাঁড় করাবো। এরপর আমাদের মধ্যে আলোচনায় আমি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামটি প্রস্তাব করি। সেখান থেকে সর্বসম্মতিক্রমে এই নামটি উঠে আসে।

১৪ জুলাই রাতে শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে রাজাকার বলার প্রতিবাদে তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার স্লোগান দিয়ে হল থেকে বের শিক্ষার্থীরা। ওই দিনের রাতের ঘটনা নিয়ে কিছু বলেন।

হান্নান মাসউদ: শেখ হাসিনা চীন সফর শেষে দেশে ফেরার পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের সাথে কথা বলেন। তারা জানায়, মন্ত্রী পর্যায়ের কয়েকজন আমাদের সাথে বসতে চায়। আমি সেখানে খুব জোরালোভাবে বলি যে, দেখেন আমাদের দাবিগুলো খুব পরিষ্কার। আমাদের দাবিগুলো মেনে নেয়ার নিশ্চয়তা দিলে আমরা তাদের সাথে আলোচনায় বসার কথা বিবেচনা করতে পারি। একই সাথে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এমন নিশ্চয়তা যদি দেয় তবে আমরা বসবো। আমরা সেখানে সিদ্ধান্ত শুনতে যেতে পারি। বড় কোনো আলোচনা করার জন্য আমরা যাব না। এই আলোচনার মধ্যেই আমরা সেখান থেকে চলে আসি। এরপর সেদিন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার সংবাদ সম্মেলন করে হুমকি দেয় যে, আন্দোলনের কারণে জনভোগান্তি হলে ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা ভাবছিলাম যে, হয়তো এসব হুমকির কারণে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম হবে। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল। ১৪ তারিখ বিকেলে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে সম্বোধন করেন। সেদিন রাতেই শিক্ষার্থীরা সকল হল থেকে একযোগে মিছিল নিয়ে বের হয়ে শেখ হাসিনার এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করে। এর আগে ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের সময় মতিয়া চৌধুরী কোটা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বলে সম্বোধন করে। এর প্রতিবাদে তখন মিছিল করা হয়। ২০১৮ সালের ঘটনা আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করে। সেদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আমাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। সকল ভয়, রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নারী শিক্ষার্থীরা সেদিন গভীর রাতে হল থেকে থালা, বাটি বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে পড়ে। সেদিন রাতের ঘটনার মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ সারাদেশের সকল ক্যাম্পাস থেকে অস্তিত্ব হারানো শুরু করে। সেদিনের ঘটনায় ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। অনেক ছাত্রলীগ নেতা সেদিন পদত্যাগ করে।

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার সূত্রপাত হয় কীভাবে? পরবর্তী অন্যান্য ছাত্রসংগঠন আপনাদের কীভাবে সহযোগিতা করেছিল তখন?

হান্নান মাসউদ : ১৫ জুলাই রাজু ভাস্কর্যে আমাদের অবস্থান কর্মসূচি ছিল। রিফাত, হাসিবসহ কয়েকজন ক্যাম্পাসে মাইকিং করতে হলপাড়ায় যায়। সেখানে একাত্তর হল ছাত্রলীগের কয়েকজন তাদের হামলা করে। এ খবর পেয়ে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্য থেকে হল পাড়ার দিকে এগিয়ে যায়। তখন মধুর ক্যান্টিনে সাদ্দাম, ইনান, সৈকত ও শয়নের অনুসারীরা লাঠি, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত ছিল। শিক্ষার্থীদের ওইদিকে গেলেই তারা সেখানে হামলা শুরু করে। এসময় তাদের সাথে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও উপস্থিত ছিল। নারী শিক্ষার্থীরাও তাদের এই হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। হামলার পর আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, বিক্ষোভ মিছিল করবো। ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, শিবিরের কাছে বিক্ষোভ মিছিল করার ব্যাপারে সহযোগিতা চাই। তাদের তেমন কোন সাড়া না পেয়ে আমরা ১৫-২০ জন মিলে মিছিল করার জন্য হাঁটা দেই। পুলিশ আমাদের দোয়েল চত্বর আটকায়। সেখান থেকে আমাদের আর সামনে যেতে দেওয়া হয়নি। সেখান থেকেই আমরা পরদিন রাজু ভাস্কর্যে বিক্ষোভের ঘোষণা দেই।

১৬ জুলাই রাতে ছাত্রলীগকে হলছাড়া করার প্রক্রিয়ায় ছাত্রদল, শিবির অন্যান্য সংগঠনের সাথে কোনো যোগাযোগ হয়েছে আপনাদের?

হান্নান মাসউদ : ১৫ তারিখ সন্ধ্যার পর আমরা আর সেভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখিনি। পরদিন আমরা ক্যাম্পাসে গায়েবানা জানাজার আয়োজন করি। সেখানেও পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। আমার দুই পায়ে রাবার বুলেট লাগে। আমি তখন পায়ে ব্যথা নিয়ে বসে পড়ি। সূর্যসেন হলের দিকে ছিল পুলিশ আর বঙ্গবন্ধু হলের দিকে ছিল ছাত্রলীগ। তখন সাংবাদিকরা আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। সেদিন সন্ধ্যার পরে আসিফ ভাই কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা দেন।

আন্দোলনের এই পর্যায়ে সংকটপূর্ণ একটা সময় অতিবাহিত হচ্ছিল। ১৭ জুলাই সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে কিছু বলেন।

হান্নান মাসউদ : আন্দোলনের এই সময়টাতে আমাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিল আমার টিউশনের ফ্যামিলি। স্টুডেন্টের বাবা-মা আমাকে খুব যত্ন করতেন। ওই সময়ে আমাকে তারা নিজেদের বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন। পুরো আন্দোলনে আমার জন্য অনেক করেছেন তারা। আন্দোলনের সময় আন্টি নিজের হাতে রান্না করে শিক্ষার্থীদের খাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন রাস্তায় নিয়ে যেতেন । ১৭ তারিখ ক্যাম্পাস থেকে চলে যাওয়ার পর ওনার বাসায় আমি ১৯ তারিখ পর্যন্ত ছিলাম। ১৮ তারিখ দুপুরের দিকে আংকেল আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললেন, শেখ হাসিনা তো পালাবে মনে হয়। শিক্ষার্থীরা সবকিছু ঘেরাও করে রেখেছে। টিভি স্ক্রিনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ যখন দেখছিলাম, আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমরা মনে হয় সফল হতে যাচ্ছি।

১৯ তারিখ রাতে দফা ঘোষণা করা হয়। আর সেদিন রাতেই নাহিদ ইসলামকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই রাতেই তিন সমন্বয়ক মন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করেন। সেদিন আপনার সাথে কী হয়েছিল?

হান্নান মাসউদ: সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে ডিবি থেকে ফোন দেয়। সেখানে থাকা তিন সমন্বয়কের একজন আমাকে খুব জোরাজুরি করেন ডিবি কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য। আমাকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। আমাকে ওই সমন্বয়ক বলেছিলেন, নাহিদ ও আসিফ জামাত-শিবিরের টাকা খেয়ে আন্দোলন করছে। নানাভাবে প্রলোভন দেখাচ্ছিলেন তখন। আমি একবারে স্পষ্ট করে বলেছি আমি যাব না। এক পর্যায়ে আমাকে বলেছিলেন, এই যে এত এত লাশ পড়ছে এটার শেষ কোথায়? আমি বলেছি, হয় শেখ হাসিনার পতন ঘটবে না হয় আমাকে মেরে ফেলবে। তবেই এটার শেষ হবে। সেই একই ফোনে ডিবির সাথেও আমার কথা হয়। তারাও নানাভাবে হুমকি দিয়েছে আমাকে। এই ঘটনার পর আংকেলের বাইকে করে আমি মোহাম্মদপুর গিয়ে আমার আরেক স্টুডেন্টের বাসায় গিয়ে উঠি। সেখানে একদিন থাকি। পরদিন আমার এক মামার বাসায় চলে যাই।

নাহিদ ইসলাম যেদিন গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে যায় সেদিন আপনারা সেখানে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেদিন আপনাদের সাথে কী কথা হয়েছিল সেখানে?

হান্নান মাসউদ: সেদিন মামার বাসা থেকে আমি গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে আসি। হাসপাতালে আসার আগে আমাদের দুইজন সমন্বয়কের সাথে আমার যোগাযোগ হয়। তাদের মধ্যে একজন বলছিলেন, তার কাছে কারফিউ পাস আছে, গাড়ি আছে। সে আমাকে তার সাথে দেখা করার প্রস্তাব দেয়। আমি সরাসরি না করি। এর আগে কয়েকবার গাড়ি নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন তিনি। আমি সরাসরি না করে দিয়েছি। আমি নিজেই সিএনজি করে গণস্বাস্থ্যে যাই। সেখানে যাওয়ার আধাঘণ্টার মধ্যে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারো সাথেই আমাদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। সেখান থেকে আবার প্রথমদিন যে স্টুডেন্টের বাসায় ছিলাম, তাদের কাছে ফিরে যাই। সে বাসায় যাওয়ার পর জানতে পারি আমার এলাকার এক বড় ভাই আমাকে খুঁজতে এসেছিলেন।

ওই সময়ে আপনারা যে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন, সে ব্যাপারে কিছু বলুন।

হান্নান মাসউদ: সেদিন গণস্বাস্থ্যের সামনে আমরা একটা সংবাদ সম্মেলন করি। সংবাদ সম্মেলন শেষে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের ঘিরে ফেলে। আমার এলাকার ওই বড় ভাই (গাফফার) সেদিন গণস্বাস্থ্যে ছিলেন। সাংবাদিকদের সহযোগিতায় তিনি সেদিন অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাকে কলাবাগানের একটা বাসায় নিয়ে রাখেন। সেদিন রাতেই সেখান থেকে বোরকা পরিয়ে তিনি রামপুরায় একটা বাসায় নিয়ে যান আমাকে। সেখান থেকে ২৩ তারিখ মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন ভাইয়ের চেম্বারে আসি। উনি যাত্রাবাড়ীতে উনার ভাইয়ের কাছে আমাকে রাখেন। সেখান থেকে ২৫ তারিখ বের হয়ে মোহাম্মদপুর আসি। এর মাঝে নাহিদ ভাই ফোন দিয়ে আহতদের খোঁজ খবর নিতে বলেন। পাশাপাশি আইনজীবীদের নিয়ে একটি লিগ্যাল সেল তৈরি করার পরামর্শ দেন। তিনি একটা মেডিকেল টিম তৈরি করার কথাও বলেন। হাসপাতালে গিয়ে আহতদের খোঁজ নেয়ার পরামর্শ দেন। আমরা সেদিন আহতদের সাথে দেখা করতে উত্তরায় বাংলাদেশ হাসপাতালে যাই । সেখানে গিয়ে দেখতে পাই, পুরো হাসপাতালে আহতদের কোন রেকর্ড নেই। তারা আমাদের কোনোভাবে সহযোগিতা করছিলেন না। তারপরও আমরা একজন আহতের খোঁজ পেয়ে জোর করে তার সাথে দেখা করতে যাই।

সেদিন মাঠপর্যায়ে আর কোনো কার্যক্রম ছিল আপনাদের?

হান্নান মাসউদ: সেখান থেকে বের হয়ে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা আটকা পড়ি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের হাতে। তখন গাফফার ভাইকে কল করে একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করি। মাহিন ভাইকে অসুস্থ বানিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে আমরা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাই গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনকে ফাঁকি দিয়ে। বের হওয়ার সাথে সাথে কয়েকটা বাইক, মাইক্রো আমাদের ফলো করতে থাকে। ড্রাইভার একরকম রেইস করে মার্কিন দূতাবাসের সামনে নিয়ে যান। দূতাবাসের কর্মকর্তারা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকলেও তারা আমাদের সেখানে আশ্রয় দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু তারা অন্য একটা ইন্টারন্যাশনাল সংস্থার সাথে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়। সেখানে একরাতের জন্য আমরা ছিলাম।

ওই সময়ে ভিডিও বার্তা কর্মসূচি দিতেন কোথা থেকে?

হান্নান মাসউদ: সেখান থেকে বের হয়ে শহীদুল আলম ভাইয়ের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়। উনি গুলশানের একটা স্কুলে থাকার ব্যবস্থা করে দেন আমাদের। সেখান থেকে আমরা কর্মসূচিগুলো দিচ্ছিলাম। সেখানে আমরা তিনদিন ছিলাম। গাফফার ভাইও আমাদের সাথে ছিলেন তখন। উনি আমাদের সেখানে রান্না করে খাওয়াতেন। আমাদের দেখাশুনা উনিই করেছিলেন। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে আরেকটি মাধ্যমে আমরা বিহারি ক্যাম্পে চলে আসি। সেখানেও খুব একটা সুবিধাজনক মনে হয়নি। সাথে সাথে বের হয়ে এক ব্যবসায়ীর অফিসে গিয়ে উঠি। সেখানে একদিন থাকার পর সদরঘাট এলাকায় চলে যাই। সেখানেও সেইফ ফিল না হওয়ায় সাথে সাথে বের হয়ে যাই। সেদিন জুলকারনাইন সায়ের ভাইয়ের সাথে আমাদের কথা হয়। তিনি মিরপুরে ওনার এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন। উনার অফিসে গিয়ে আমরা উঠি। সেখানে ২ তারিখ পর্যন্ত আমরা ছিলাম।

তারিখ আপনি একটি লাইভ করেছিলেন, সে ব্যাপারে কিছু বলুন।

হান্নান মাসউদ: সেদিন প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে আমাকে কল করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে কল করে স্বপরিবারে সাক্ষাৎ করার জন্য অফার করা হয়। আমাদের ভবিষ্যতে কোন কিছুর অভাব হবে না। দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দেয়ার লোভ দেখানো হয়। আমি বলি, আপনার প্রধানমন্ত্রীর হাতে আমার ভাইদের রক্ত লেগে আছে। উনাকে বলেন, আমার ভাইদের রক্ত পরিষ্কার করতে। ওই দিনই মিডিয়ায় দেখি ৩০-৪০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এটা দেখার পর আমি ফেসবুকে লাইভ করি। সেখানে বলি, প্রধানমন্ত্রী আপনার দরজা খোলা রাখার দরকার নেই। আপনি বের হয়ে আসেন। জনগণের টাকা খরচ করে গণভবনে থাকার অধিকার আপনার নেই। আপনার অবশ্যই গণভবন ছাড়তে হবে। সেখানে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেই আমি। সেদিন এক মহিলা সাংবাদিক এক দফার ঘোষণা দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। এক পর্যায়ে উনি আমাকে বললেন, এক মিনিটের মধ্যে সিদ্ধান্ত নাও। আর যদি সিদ্ধান্ত না নিতে পারো তবে আমরা তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারবো না। আমি তখন বলি, আপনি যা ইচ্ছে করেন। মেরে ফেললে মেরে ফেলেন। আমরা এটা দিতে পারবো না। কালকে মাঠ থেকে নাহিদ ভাই এক দফার ঘোষণা দিবেন। তখন নাহিদ ভাইয়ের পরামর্শ ছিল, তোমরা সর্বোচ্চটা ধরে রাখ। না পারলে ঘোষণা দিয়ে দিও। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা বনানী চলে যাই। সেখানে একদিন থাকার পর ৩ ও ৪ তারিখ থাকি বারিধারায়।

মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি কেন একদিন এগিয়ে তারিখ করেছিলেন?

হান্নান মাসউদ: সেদিন আসিফ ভাইকে আমি ফোন দিয়ে মার্চ টু ঢাকা একদিন এগিয়ে আনার পরামর্শ দেই। নাহিদ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে একদিন এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেই। জুলাইয়ের ৩০ তারিখ থেকে শিবিরের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়। ছাত্রদলের রাকিব ভাইয়ের সাথেও আমাদের যোগাযোগ হয়। ভিডিও করার জন্য তিনি আমাদের ফোন কিনে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা নেই নি। এক্ষেত্রে আমরা ৫০ হাজার টাকার ব্যবস্থা করি এবং শিবিরের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আমরা এই টাকা দিয়ে দুইটা ফোন ক্রয় করি। আমরা সংগঠন হিসেবে শিবিরের সাথে যোগাযোগ করি। কোন ব্যক্তির সাথে নয়।

তারিখ হাসিনার পতন হয়। সময় আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?

হান্নান মাসউদ: সেদিন খুব আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। হেঁটে হেঁটে সংসদ ভবন, গণভবনে আসি। কিন্তু সংসদ ভবনে ঢুকিনি। আমার চিন্তা ছিল, যদি কখনো ঢুকি সংসদ সদস্য হয়েই এখানে যাবো। তখন চারদিকে এত এত শুভাকাঙ্ক্ষী.. একেকজন একেক দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদেরকে আমাদের মত করে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া হয় নাই। চ্যানেল ২৪-এ আমাদের সেদিন যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু নিয়ে যাওয়া হইছে। তখন আমাদের মত করে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম তাহলে এই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ অন্যরকম হত।


আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিই, ‘রক্ত মাড়িয়ে সংলাপ নয়’: হাসনাত আবদুল্লাহ

আপডেটেড ৩ জুলাই, ২০২৫ ০০:০৪
বাসস

হাসনাত আবদুল্লাহ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক। এই তরুণ সংগঠক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। ছাত্রজীবন থেকেই শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া আদায় এবং যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে লড়াকু হয়ে আন্দোলনে-সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলেনে একাধিকবার নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সবসময় ছিলেন অগ্রগামী।

২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গড়ে ওঠা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে তিনি জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করেন। সেই আন্দোলন থেকেই তিনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের দাবিতে রাজপথ কাঁপিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্রে পরিণত হন তিনি। এই সময় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের শিকার হয়ে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। পুলিশের হাতে বন্দি থেকে ট্রমার মধ্য দিয়েও দিনযাপন করতে হয়। দেশের জন্য শহীদি মৃত্যু বরণ করতেও রাজি ছিলেন এই দুঃসাহসী তরুণ। তবুও স্বৈরাচারের কাছে মাথানত করেননি।

ছাত্রজীবনে একজন চৌকস বিতার্কিক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন হাসনাত। যে কোনো বিতর্কে তিনি খুরধার যুক্তি ও চুলচেরা বিশ্লেষণ দিয়ে শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান তুলে ধরতেন। কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার গোপালনগর গ্রামে জন্ম নেওয়া এই তরুণ নেতার স্বপ্ন একটি ন্যায্য, গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

সম্প্রতি বাসস'কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার নেতৃত্ব ও অভিজ্ঞতার নানা দিক তুলে ধরেন হাসনাত আবদুল্লাহ।

তিনি বলেন, ‘আমরা ৯ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে একটা কর্মসূচি দেই, যেটি ঢাকাসহ সারাদেশের ছাত্র জনতা ও সাধারণ মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়েছে এ কর্মসূচি। পরবর্তী দুই দিন আমাদের ব্লকেড কার্যক্রম চলে। ‘বাংলা ব্লকেড’ কার্যক্রমের পরে আমরা একদিন বিরতি দেই। সেদিন আমরা আমাদের সমন্বয়ক টিমকে ভাগ করে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই, যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা ভালো মতো সমন্বয় করতে পারি। সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবে আমি কুমিল্লাতে যাই।’

হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে গিয়ে ছাত্রদের সাথে কথা বলি। সেখানে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যেখানে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়েছে সেই স্থানগুলো পরিদর্শন করি এবং ছাত্রদের নির্দেশনা দেই। একই সাথে আমরা সমন্বয়করা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। ওই সময় আমাদের সমন্বয়করা ছাত্রলীগ ও পুলিশের তাণ্ডবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। তারাও আন্দোলনকে সমন্বয় করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে থাকে। পরবর্তীতে যেটি হয়, আন্দোলন দৃঢ় ও ইস্পাত-কঠিন হতে থাকে। সারা দেশের সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে থাকা শিক্ষার্থীরা সুসংগঠিত হতে থাকে। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সমন্বয়ক নির্বাচিত করি, যাতে করে বিগত দিনের মতো অন্য শিক্ষার্থীদের ওপরেও দায় চাপিয়ে আন্দোলন বেহাত হওয়ার যে ঘটনা ঘটে, তার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। পরবর্তীতে আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।’

তিনি বলেন, ‘১৪ জুলাই আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচিবালয়ের পাশের রাস্তা দিয়ে জিরো পয়েন্ট হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য যাই। ১৪ জুলাই আমরা স্মারকলিপি দিয়ে হলে ফিরি, ওইদিন গণভবনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার একটা প্রেস কনফারেন্স ছিলো। আমরা দেখি যে সেই প্রেস কনফারেন্সে তিনি (শেখ হাসিনা) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতি-পুতি বলে সম্বোধন করে বক্তব্য রাখেন। শেখ হাসিনার এমন আপত্তিকর বক্তব্যের পর ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ জানাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদী স্লোগান নিয়ে রাজপথে নেমে আসে।’

হাসনাত বলেন, ‘১৪ জুলাই রাতে সবাই যখন যার যার হল থেকে রাস্তায় নেমে আসে, ঠিক তখন আমি একটি টিভি টকশোতে ছিলাম। টকশো শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে রওনা হই। এর মধ্যে দেখতে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের বিস্ফোরণে রাতের ঢাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। তখন আমরা অমর একুশে হল ও সায়েন্স ফ্যাকাল্টির প্রত্যেকটা হল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যে আসি। খেয়াল করলে দেখবেন যে, সেদিন রাতে একটা আইকনিক মিছিল ঢাকাসহ সারাদেশ প্রকম্পিত করেছিল একটি শ্লোগান দিয়ে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!!’ আমরা মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসি। সে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের হল থেকে মেয়েরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, কুয়েত মৈত্রী হল থেকেও শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!!’ স্লোগান দিয়ে নেমে আসে।’

হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘১৫ জুলাই দুপুর বারোটায় আমরা রাজু ভাস্কর্যে একটি কর্মসূচি দেই। ছাত্রলীগ পাল্টা কর্মসূচি দেয়। তবুও আমরা আমাদের কর্মসূচি পরিবর্তন করিনি। রাজু ভাস্কর্য থেকে আমরা যখন হলের দিকে প্রতিদিনকার মতো মিছিল নিয়ে আসতে থাকি, তখনই বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগ নৃশংসভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। এটি দীর্ঘ সময় ধরে চলে। এই সময়ে আমরা দেখি যে তৎকালীন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এই আন্দোলন দমন করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট।’ ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখেছি ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর বেপরোয়াভাবে আক্রমণ করে। তারা নারী শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে আহত করে। আমিও এই আক্রমণের শিকার হই। ওরা আমাকেও বেধড়ক পিটায়। রেজিস্টার বিল্ডিংয়ের সামনে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের শাকিরুল ইসলাম শাকিল আমাকে বাজেভাবে পিটিয়ে আহত করে। আমার বাঁ পায়ে জখম হয়। সেদিন আমাদের নারী শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা করা হয়। নারী শিক্ষার্থীদের আহত হওয়ার এই ফুটেজ সারা দেশের প্রত্যেকটি বিবেকবান মানুষকে ব্যথিত করেছে।’

তিনি বলেন, এখানে বলে রাখি, ৯ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির আগে সর্বপ্রথম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। আমরা তখন শাহবাগে ছিলাম। শাহবাগে আন্দোলন চলাকালীন আমাদের ডেকে নিয়ে যায়। আমাদের সাথে নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ছিলো। তখন টিএসসিতে ওই কর্মকর্তা আমাদের সাথে কথা বলেন। শাহবাগ থানার পুলিশসহ অন্যান্য জোনের পুলিশও ছিলো সেখানে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, আমাদের মোটিভ কী? আমরা বারবার বলেছি, রাষ্ট্রের মধ্যে যে বৈষম্য আছে তা নিরসনের জন্য আমরা আন্দোলন করছি। পুলিশ থেকে আমাদের ওপর প্রেশার দিতে থাকে আমরা যেন আন্দোলন তুলে নিই। কিন্তু আমরা বলেছি, শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট ছাড়া আমাদের পক্ষে আন্দোলন বন্ধ করা সম্ভব নয়।’

হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘ছাত্রলীগ মনে করেছিল ১৫ জুলাইয়ে হামলা করেই আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু ১৬ জুলাই আরও বেশি শিক্ষার্থী শহীদ মিনারে জড়ো হয়। সবাই একত্রিত হওয়ার পর আমরা একটা বিক্ষোভ মিছিল করি।’

১৬ জুলাই দুপুরে আমরা একটি অনলাইন মিটিং করছিলাম। মিটিংয়ে আমি, নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ, বাকের, হাসিব থেকে শুরু করে অন্যরাও উপস্থিত ছিল। এসময় খবর পাই যে রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। তখন আমরা ওই মিটিংয়েই সিদ্ধান্ত নিই আর কোনো সংলাপ হবে না। ‘রক্ত মাড়িয়ে কোনো সংলাপ নয়’।

তিনি বলেন, ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভিসি চত্বরে একটি গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় শিক্ষার্থী এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলের সবাই উপস্থিত হন। হাসনাত বলেন, ‘আমার মনে আছে, গায়েবানা জানাজা চলাকালীন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদেরকে কনস্ট্যান্টলি ফোর্স করতে থাকে যেন আমরা গায়েবানা জানাজা না করি। কিন্তু সকল প্রেশার উপেক্ষা করে আমরা গায়েবানা জানাজা আদায় করার সিদ্ধান্ত নিই। গায়েবানা জানাজা শেষ করে আমরা যখন কফিন কাঁধে মিছিল নিয়ে ভিসির বাসভবনের সামনে দিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যেতে চাই, তখনই আমাদেরকে দুই দিক থেকে মুহুর্মুহু টিয়ার শেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়তে থাকে। আমাদের ওপর টিয়ারশেল সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়া হলেও আমরা সেটি প্রতিহত করি।’

তিনি বলেন, ‘সেদিন আপনারা দেখেছেন যে পুলিশকে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয় এবং বিকাল পাঁচটার মধ্যে হলগুলো খালি করার ক্ষেত্রে প্রভোস্টরা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে সবচেয়ে ঘৃণ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তৎকালীন ভিসি মাকসুদ কামালকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তিনি গণভবনের প্রেসক্রিপশনে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ করে দেন। বিশেষ করে ভিসি এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য চেষ্টা করেন। তিনি আমাদেরকে বারবার ফোর্স করেন আমরা যেন আন্দোলনকে প্রত্যাহার করে নিই। আন্দোলন প্রত্যাহার করার ক্ষেত্রে আমরা বারবার বলি যে এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট লাগবে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতন-নিপীড়নের বিচার করতে হবে। আমরা বলি যে, এখন আর এই আন্দোলন থেকে ফেরার পথ নেই। আমরা ভিসির কাছে দাবি জানাই, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া চলবে না। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।’

‘হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা কীভাবে কী করব তা নিয়ে সন্দিহান অবস্থায় থাকি। তখন আমি সায়েন্স ল্যাবে আমার মামার বাসায় চলে যাই। তখন আমরা সবাই বিক্ষিপ্ত হয়ে যাই। তখন আন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সারজিস আলমও আমার মামার বাসায় চলে আসে। তখন নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের সঙ্গে আমরা ফোনে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। এরমধ্যে আমাদেরকে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী (নওফেল) সংলাপের প্রস্তাব দেন।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন সাইন্সল্যাবে আমাদের বাসার নিচে আসে এবং আমাদেরকে বলে, মিটিং করার জন্য একটা জায়গায় আমাদেরকে যেতে হবে। তখন আমরা অনীহা প্রকাশ করে বলি, কোনোভাবেই আমরা এই মিটিংয়ে উপস্থিত হতে পারব না। যতক্ষণ পর্যন্ত না, আমাদের সবার সমন্বিত সিদ্ধান্ত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দ্বারা কোনো মিটিং করা সম্ভব না। তখন তারা আমাদেরকে বলে, হয় মিটিংয়ে যাবেন, না হয় বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন তারা আমাদেরকে নিয়ে পদ্মাতে যায়।’

‘আমাদেরকে পদ্মাতে নিয়ে যাওয়ার পরপরই সেখানে তিন মন্ত্রী প্রবেশ করেন। তারা হলেন, তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তারা প্রবেশ করার পরেই আমাদেরকে বলেন, আমরা যেন তাদের সাথে মিটিং করি। তখন আমরা প্রত্যাখ্যান করি যে, ওনাদের সাথে আমাদের মিটিং করা সম্ভব না। বারবার আমাদেরকে পুশ করা হয় আমরা যেন ওনাদের সাথে বসি। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই ওনাদের সাথে মিটিং করতে রাজি হইনি। চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর তিন মন্ত্রী আমাদের সামনেই বের হয়ে চলে যান। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্ষুব্ধ হয়ে আমাদেরকে সাইন্সল্যাবে না নিয়ে একটি সেইফ হোমে নিয়ে রাখে।’

হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘ওই দিন ছিল বৃহস্পতিবার, রাত। পরের দিন শুক্রবার। আমাদেরকে জুমার নামাজ পড়তে দেওয়া হয় নাই। তিন মন্ত্রীর সাথে দেখা না করায় আমাদেরকে সারারাত ইন্ডিভিজুয়ালি (পৃথকভাবে) জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আমাকে একবার, সারজিসকে একবার, এভাবে পালাক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। তারা আমাকে বলে, সারজিস রাজি হয়ে গেছে। সারজিসকে বলে, আমি রাজি হয়ে গিয়েছি। আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে বলা হয়, যেহেতু আমার বাবা একসময় বিদেশে থাকতেন। নানানভাবে পারিবারিক বিষয়গুলো টেনে এনে আমাকে ভয়-ভীতি দেখানোর চেষ্টা করা হতে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে আমাকে কিচেন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন বুঝতে পারি আমি কাকরাইল মসজিদ থেকে বেশি দূরে না। কারণ ওইদিন জুমার নামাজের পরপরই কাকরাইল মসজিদ থেকে একটা বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। তখন এই মিছিলটাকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। এই মিছিলটা সম্ভবত বায়তুল মোকাররমের দিকে যাওয়ার কথা ছিল। জুমার নামাজের পরে আরেকটা টিম আমাদের কাছে আসে এবং তারা আরও বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়। আন্দোলনের সময়ে তখন সর্বপ্রথম আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রথম লাঞ্ছনার শিকার হই। আমাকে কিচেনে একপর্যায়ে থাপ্পড় দেওয়া হয়। আমাকে বলে যে আমার পরিবার তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। যেন নাহিদসহ আরও যারা আন্দোলনকারী আছে তাদেরকে নিয়ে আমরা যেন মিটিং করি।

হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে প্রেস কনফারেন্সের দিনও প্রেশার দেওয়া হয় এটা বলার জন্য যে, আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। তখন আমরা দেখতে পাই, আমাদের সামনে সাংবাদিকের চেয়েও বেশি আছে এজেন্সির লোকজন। তারা সবাই মোবাইল ও ক্যামেরা হাতে ছিল। আরেকটা খুব ইন্টারেস্টিং বিষয় ছিল যে ক্যাম্পাসের শ্যাডোতে, মল চত্বরে, কলা ভবনের সামনে, লাইব্রেরির সামনে আমরা যাদেরকে দেখে ভাবতাম হলের কর্মচারী বা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করে, আমাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর আমরা খেয়াল করি যে, ওরা সবাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থার (ল’ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির) ফিল্ড স্টাফ।’

তিনি বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন আমাদেরকে প্রেশার দেয়, আমরা যেন মিটিং করি। তারপর থেকে আমি আমার স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধ করে দেই। একটা বাটন ফোন ব্যবহার করা শুরু করি। ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির প্রেস কনফারেন্সের পরে আমি মামার বাসায় না গিয়ে কাঁটাবনে আমার বন্ধুর সাথে থাকি। ওইদিন রাতেই আমি আবার মামার বাসায় চলে আসি। সারজিসকেও সেখানে আসতে বলি। নাহিদ ইসলামকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে নিরাপত্তা বাহিনী সদস্যরা এসে সাইন্সল্যাবের বাসা থেকে আমাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। উঠিয়ে নিয়ে যাবার পর তারা আমাদেরকে গাড়িতে সারা ঢাকা ঘোরায়। তারপর আমাদেরকে তাদের অফিসে নিয়ে যায়।’

হাসনাত বলেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনীর অফিসের প্যাটার্ন ছিল এই টাইপের একটা জায়গায় ত্রিশ জনের মতো অফিস করে। বাথরুম হচ্ছে একটা। সারাদিন আমাদেরকে বাথরুমের সামনে বসিয়ে রাখত। বসার জায়গা নাই, শোয়ার জায়গা নাই, কমপ্লিটলি ওই অফিসে পেপার-পত্রিকা সব বন্ধ, মোবাইল বন্ধ, টিভি বন্ধ। সে সময় নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য আমার সাথে খুবই রূঢ় আচরণ করে। সে খাবারে সমস্যা করেছে এবং সারারাত বাথরুমের সামনে বসিয়ে রাখত। নিরাপত্তা হেফাজত থেকে একদিন আমাদের গার্ডিয়ানদের আসতে বলা হয়। আমার এক ভগ্নিপতি আসেন আমাকে নেওয়ার জন্য। ওনাকে রাত এগারোটা পর্যন্ত বসিয়ে রেখে বলেন, আপনি চলে যান। কোনো ডিসিশন হয় নাই।’

হাসনাত জানান, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে নিয়োজিত ক্যাম্পাসের এক বড় ভাই আমাকে কল দিয়ে বলেন, ‘কালকে তোরা সামনে থাকিস না। দুইটা শার্ট নিয়ে বের হইস। কারণ আমাদের কাছে নির্দেশ আছে আমাদেরকে গুলি চালাতে হবে’। উনি এই কথাটা বলে অঝোরে কান্না করা শুরু করেন। আমি তখন খুব ইমোশনাল হয়ে যাই। তাকে বলি, ভাই আমরা আসলে পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে আছি। ৫ আগস্ট ফজরের সময় আমাকে তিনি বলছিলেন, আমরা যেন ফার্স্ট লাইনে না থাকি।

হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ৫ আগস্ট সকালে বৃষ্টি হয়। সারজিস আলমকে মহাখালী থেকে পিক করার কথা ছিল আমার। আসিফ মাহমুদ পুরান ঢাকার ওইদিকে থাকেন। আমি সারজিসকে বলেছিলাম যদি বৃষ্টি হয় তাহলে হয়তো শেখ হাসিনা বেঁচে যাবে। কারণ এটা সংশয় ছিল যে, বৃষ্টি হলে রাস্তায় মানুষ নামবে না। এটা ভেবে আমার খুব খারাপ লাগে এবং পুরো আন্দোলন চলাকালীন এই সময়টায় আমি খুব ডিসহার্টেনড (হতাশ) হই। তখন আমি সাকিবকে ফোন দেই। ওরা একেবারে ছোট ছোট। থার্ড ইয়ারে পড়ে মাত্র। ওরা ২ আগস্ট থেকেই ক্যাম্পাসে এসে শেখ হাসিনার পতনের স্লোগান দেয়। তখন সাকিব আমাকে বলে, ভাই আপনি আসেন। আমরা বের হবো। বৃষ্টি হোক আর যাই হোক, আমরা বের হবো। তখন সাকিব, রিয়াদ, জামিল আসে। আমিও বের হই। আমি আর আগাতে পারি না। গাড়ি নিয়ে আমরা অনেক ঘুরে বিজয় সরণির ওদিকে যাই। ঢাকায় একদম সুনসান নীরবতা। ওই এলাকায় একটা মানুষও ছিল না। মহাখালী ব্রিজটার ওদিকে এসে আবার আমরা টার্ন নেই। কারণ আমরা সাহস পাচ্ছিলাম না যে পেছনে যাব। কারণ কেউই নাই। তখন আমরা এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়া শুরু করি। মহাখালী থেকে তিতুমীরের দিকে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ ছিল। তখন গাড়ি টার্ন নিতে পারে নাই। আমরা সোজা গিয়ে বনানী থেকে টার্ন নেওয়ার চেষ্টা করলাম। সেটিও বন্ধ ছিল। তখন নেভির ওদিকে একটা রাস্তা আছে সেটি দিয়ে মহাখালীর দিকে আসতে আসতে ওখানে দাঁড়াই অনেকক্ষণ।’

তিনি বলেন, ‘তখন দুই ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। তখন আমি ভাবি যে ‘উই আর ডান’। কিন্তু একটু পর আবার যখন ইন্টারনেট কাজ করা শুরু করে তখন আমরা নিউজ পেলাম সেনাপ্রধান বক্তব্য দিবেন। তখন সাড়ে দশটা-এগারোটার দিকে মানুষ বের হওয়া শুরু করল। এয়ারপোর্ট থেকে মহাখালী পর্যন্ত জনস্রোতটা মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়েছে। সব দিক থেকে মানুষ আসা শুরু করছে। তখন আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। আর তখন তো মানুষ আর মানুষ। এরপর আমরা গণভবনের দিকে আসলাম। খবর ছড়িয়ে পড়ল স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। সারা বাংলায় বিজয়ের মিছিল শুরু হলো। দেশ মুক্ত হলো দেড় দশকের নিপীড়ন নির্যাতন গণতন্ত্র হত্যাকারী স্বৈরাচারের হাত থেকে। এভাবেই সৃষ্টি হলো নতুন এক বাংলাদেশের, ছাত্র-জনতার বিজয়ের গৌরবগাথা...’


নগরায়নের চাপে সবুজ হারাচ্ছে ঢাকা

আপডেটেড ২৭ জুন, ২০২৫ ১৯:১৩
ইউএনবি

বিশ্বের অন্যতম পরিচিত মেগাসিটি আমাদের রাজধানী ঢাকা। এক সময় সবুজ গাছপালা আর খোলামেলা পরিবেশের জন্য নাম ছিল এই ঢাকার। তবে আধুনিক হয়ে উঠতে গিয়ে শহরটি হারিয়েছে সেই প্রাকৃতিক জৌলুস।

আজ ঢাকার যেদিকেই তাকানো হবে, দেখা যাবে সুউচ্চ সব ভবন, কতশত কারখানা; সবমিলিয়ে একদম আধুনিকতায় মোড়ানো ব্যস্ততম এক মহানগরী। তবে বিনিময়ে হারিয়েছে সেই সবুজ পরিবেশ, বাসযোগ্যতা ও বায়ুমান নিয়ে তৈরি হয়েছে গুরুতর উদ্বেগ।

একদিকে গাছপালার প্রাকৃতিক বাতাসের পরিবর্তে ঢাকার ঘরবাড়ি ও অফিসগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি)। অন্যদিকে, আশঙ্কাজনকহারে কমে আসছে সবুজ বনভূমির পরিমাণ।

মহানগরী ঢাকা একসময় পরিচিত ছিল ‘বাগানের শহর’ নামে। তবে ১৯৮১ সাল থেকে ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে শহরটি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নগর সম্প্রসারণ হয়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে রাজধানীর সবুজের পরিমাণ, বিশেষত গাছপালা আশঙ্কাজনকভাবে বিলীন হয়েছে।

অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে হাজার হাজার গাছ কাটা পড়েছে। ফলে বর্তমান সময়ে এসে অতিরিক্ত গরম, বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে পড়েছে ঢাকা।

১৯৮১ সালের নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের (ইউডিডি) এক জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার প্রায় ১৯ শতাংশ ভূমি সবুজে আচ্ছাদিত ছিল।

আশির দশকের উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায়, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, এমনকি ধানমণ্ডি, মিরপুর ও উত্তরার মতো আবাসিক এলাকাগুলোর সড়কের পাশে ও বাড়ির আঙিনায় প্রচুর গাছ ছিল।

সংখ্যায় বলতে গেলে সে সময় ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকায় (তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশন অঞ্চলে) আনুমানিক ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ পূর্ণবয়স্ক গাছ ছিল।

ঢাকায় গাছ কাটার হার আধুনিকায়নের গতিকে ছাড়িয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন ভবন, রাস্তা ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের জন্য পার্ক ও খোলামেলা জায়গা নিশ্চিহ্ন হচ্ছে, ফলে নগর উন্নয়ন ও পরিবেশগত স্থায়িত্বের ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়েছে বলে সতর্ক করেছেন তারা।

পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. রেহানা করিম বলেন, ‘ঢাকায় অবকাঠামো বাড়ছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হচ্ছে পরিবেশের বিনিময়ে। উচ্চ ভবন ও বাণিজ্যিক এলাকার জন্য গাছ কাটা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখছে শুরু করেছে এই সবুজের অভাব।’

শুধু বিশেষজ্ঞরা নন, ঢাকার গাছপালা আশঙ্কাজনভাবে কমার কারণে শহরটির বসবাসকারীরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

মিরপুরের বাসিন্দা তারেক রহমান বলেন, ‘এখন সব জায়গায় এসি লাগানো হচ্ছে, কিন্তু প্রাকৃতিক ছায়ার যে আরাম ও স্বাস্থ্য উপকারিতা তা এসিতে নেই। যেসব উপাদান এই শহরটিকে বাসযোগ্য করে তুলেছিল, আমরা সেগুলোই হারিয়ে ফেলছি।’

অতিরিক্ত উত্তপ্ত শহর ঢাকা

১৯৮১ সালের হিসাব তো আগেই দেখানো হয়েছে, এবার আসা যাক বর্তমান সময়ে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ বিভাগ জানিয়েছে, তাদের হিসাবে ২০২৫ সালে ঢাকা শহরের রাস্তার পাশে থাকা পূর্ণবয়স্ক গাছের সংখ্যা ৫০ হাজারেরও কম। আশির দশকের ১৯ শতাংশ বনভূমি এসে এখন ঠেকেছে ৬ শতাংশেরও নিচে।

বর্তমান হিসাব অনুযায়ী, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সবুজ জায়গা মাত্র ০ দশমিক ৪২ বর্গমিটার, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী যেটি হওয়া উচিত ৯ বর্গমিটার।

এতে শহরের তাপমাত্রায় এক লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা গেছে। ১৯৮১ সালের পর থেকে গ্রীষ্মের গড় তাপমাত্রা ২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া, ধুলাবালি কণার (পিএম ২.৫) মাত্রায় বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে দূষিত পাঁচটি শহরের তালিকায় নিয়মিত থাকতে দেখা যায় ঢাকাকে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে গাছের বিশুদ্ধ বাতাসের অভাব।

অনেকদির ধরেই সরকারের কাছে নগর পরিকল্পনায় বাধ্যতামূলক সবুজ এলাকা ও বৃক্ষরোপণের কড়া নীতি গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নিলে ঢাকা তীব্র তাপপ্রবাহ, বায়ুদূষণ বৃ্দ্ধি ও জনস্বাস্থ্যের অবনতির মতো মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলেও সতর্ক করেছে তারা।

দশকের পর দশক ধরে বন উজাড়ে

আধুনিকতার পথে অগ্রগতির সঙ্গে টেকসই পরিবেশ বজায় রাখতে গিয়ে ঢাকা আজ একটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে—প্রাকৃতিক পরিবেশের বলি না দিয়ে আধুনিক হতে পারবে ঢাকা?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ঢাকার ক্রমবর্ধমাণ জনসংখ্যা সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। সরকারি হিসাব বলছে, ১৯৮১ সালে যেখানে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ, ২০২৫ সালের মধ্যে তা বেড়ে ২ কোটি ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

এতে ১৯৮১-১৯৯১ পর্যন্ত এই দশ বছরে দ্রুত নগরায়নের প্রাথমিক লক্ষণস্বরূপ সড়ক সম্প্রসারণ ও প্লট উন্নয়নের কারণে ১০ থেকে ১৫ হাজার গাছ কাটা পড়েছে। পরের ১০ বছরে অর্থনৈতিক মুক্ত বাজার নীতির পর নির্মাণ প্রবৃদ্ধির সময় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ গাছ নিধন করা হয়েছে।

এর পরের দশকে মহাখালী ও খিলগাঁও উড়ালসড়কসহ বড় রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের কারণে কাটা হয়েছে আরও অন্তত ৪০ হাজার গাছ।

তবে সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে বিভিন্ন এলাকায় বিশেষত উত্তরা, ফার্মগেট ও শাহবাগ এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার গাছ কাটা হয়েছে।

এরপর ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই চার বছরে ৫ থেকে ৮ হাজার গাছ কমেছে ঢাকার। বনায়ন নীতি থাকলেও নির্মাণ চলমান থাকায় গাছের পরিমাণ কমেই চলেছে।

এসিতে কেউ পাচ্ছেন ঠান্ডা হাওয়া, কেউ পুড়ছেন গরমে

একসময় কেবল ধনী মানুষের বিলাসের সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হত এসি। কিন্তু এখন ঢাকার তীব্র গরমে এটি একপ্রকার প্রয়োজনীয়তায় পরিণত হয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যে এসির ব্যবহার বাড়ছে, এতে যে শুধু তাপমাত্রাই বাড়ছে না, এটি বিদ্যুৎতের চাপ, বায়ুদূষণ ও সামাজিক বৈষম্যকেও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ টেকসই জ্বালানি কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ঢাকায় এসির সংখ্যা গত ১৫ বছরে চারগুণ বেড়েছে। ২০১০ সালের দেড় লাখ ইউনিট থেকে এটি ২০২৪ সালে সাড়ে ৭ লাখে পৌঁছেছে।

আরও পরিষ্কারভাবে বলা হলে, রাজধানীর প্রায় তিনটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে একটি এখন এসির মালিক। তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা জানান, ঢাকায় গ্রীষ্মকালে আবাসিক বিদ্যুতের প্রায় ৪০ শতাংশ এসি ব্যবহারেই ব্যয় হয়। ফলে জাতীয় গ্রিডের ওপর চাপ বাড়ে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়।

নগর অধিকারকর্মী ফারুক হোসেন বলেন, ‘ধনীরা এসি চালিয়ে স্বস্তিতে থাকেন, অথচ দরিদ্ররা লোডশেডিং আর অসহনীয় গরমে কষ্ট করে।’ বিশেষ করে বস্তিবাসী ও নিম্নআয়ের শ্রমজীবীরা এতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে জানান তিনি।

বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, পুরনো মডেলের এসিগুলো হাইড্রোফ্লোরোকার্বন গ্যাস ছাড়ে, যা অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস। যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ঢাকার এই শীতলকরণ প্রবণতা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিগুলো (কিগালি সংশোধনী ও প্যারিস চুক্তি) ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন তারা।

পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যবিদ শিরিন কবির বলেন, ‘ঢাকা যদি তার গাছ, পার্ক ও প্রাকৃতিক বাতাস চলাচলের পথ সংরক্ষণ করত, তাহলে এত বেশি কৃত্রিম শীতলকরণের প্রয়োজন হতো না। আমরা এমন শহর তৈরি করছি, যেটিকে বাসযোগ্য রাখতে যন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।’

বেঁচে থাকার জন্য বনায়ন

ঢাকার পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে বনায়নের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

মিশন গ্রিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান রনি ইউএনবিকে বলেন, ‘তীব্র গরম, বায়ুদূষণ ও দ্রুত সবুজ হারানো প্রতিরোধে ঢাকার জন্য পুনরায় বনায়ন অপরিহার্য। ঢাকায় বনায়ন এখন শুধু পরিবেশগত চাহিদা নয়, এটি টিকে থাকার কৌশল। শহরটি দ্রুত তার সবুজ আচ্ছাদন হারাচ্ছে, আর সঙ্গে হারাচ্ছে পরিষ্কার বাতাস, ছায়া ও জীববৈচিত্র্য।’

এ কারণে তিনি মিশন গ্রিন বাংলাদেশের মাধ্যমে গ্রিন ভলান্টিয়ার প্রোগ্রাম শুরু করেছেন বলে জানান। সেখানে তরুণদের সরাসরি শহরকে সবুজ করায় যুক্ত করার আশাও প্রকাশ করেন তিনি।

এই তরুণ পরিবেশকর্মী আরও জানান, তারা গাছ লাগানোর অনুষ্ঠান আয়োজন করেন, সচেতনতা কার্যক্রম চালান এবং ছোট শহুরে বনও তৈরি করে থাকেন। যেমন: ৫৫টি কদমগাছ নিয়ে গড়া ‘কদমতলা ইনিশিয়েটিভ’।

তিনি বলেন, ‘আমার লক্ষ্য পরিবেশগত কাজকে সহজলভ্য, হাতে-কলমে ও সমাজভিত্তিক করে তোলা। আমি বিশ্বাস করি, আজ আমরা যে গাছ লাগাচ্ছি, তা আগামী দিনের জন্য একটি সুস্থ ও বাসযোগ্য ঢাকার প্রতিশ্রুতি।’

সরকার ও বিভিন্ন এনজিওর সৌজন্যেও একাধিক বৃক্ষরোপণ অভিযান চালানো হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে এক লাখের বেশি চারা রোপণ করা হয়েছে এই শহরে। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, ভাঙচুর, অবহেলা বা অনুপযুক্ত (বিদেশি বা দুর্বল মূলবিশিষ্ট) প্রজাতির গাছের চারা ব্যবহারের কারণে এগুলোর অন্তত ৩০ শতাংশ প্রথম বছরেই মারা গেছে।


নীরব সমুদ্রের আহ্বান: মালদ্বীপের যুব সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের প্রতিনিধির পরিবেশ রক্ষার বার্তা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০

ভূমিকা: সমুদ্র বলছে – আমরা কি শুনছি?

ভারতের মহাসাগরের নীল জলরাশির নিচে চলছে এমন এক সংকট যা কোনো একটি দেশের একার নয়—এটি বৈশ্বিক। প্রবাল প্রাচীরগুলো বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে, দুর্লভ সামুদ্রিক প্রজাতিগুলো বিলুপ্তির পথে, কিন্তু এই সমুদ্রের আর্তনাদ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মানুষের শোরগোলে। এমন এক সংকটময় সময়েই আমি সুযোগ পেয়েছি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার, তাও সম্পূর্ণভাবে অর্থায়িত প্রতিনিধি হিসেবে, মালদ্বীপের মাফুশি দ্বীপে অনুষ্ঠিত ইউনিভার্সাল ইয়ুথ লিডারশিপ সামিট (UYLS) ২০২৫-এ।

এই সামিটের আয়োজন করে ইউনিভার্সাল ইয়ুথ মুভমেন্ট (UYM), যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে তরুণ নেতৃত্ব একত্রিত হয়েছিল—উদ্দেশ্য ছিল আমাদের গ্রহের প্রধান সংকটগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর সমাধান বের করা। আমাদের দলের প্রেজেন্টেশন ছিল:

‘আমাদের সাগর বাঁচান: বিপন্ন সামুদ্রিক প্রাণী’।

এটি কেবল একটি সম্মেলন ছিল না—এটি ছিল এক জাগরণ, একটি বার্তা, যেখানে পরিবেশ রক্ষায় তরুণদের নেতৃত্বকে তুলে ধরা হয়েছে। আমার জন্য, এটি ছিল জীবনের অন্যতম গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা।

সংকট: বিপন্নতার মুখে সাগরের অভিভাবক–সামুদ্রিক কচ্ছপ: সাগরের অতল গহ্বরে, প্রাগৈতিহাসিক এক প্রাণী—সামুদ্রিক কচ্ছপ, যেটি গত দশ লক্ষ বছর ধরে টিকে রয়েছে, আজ মানুষের লোভ ও দায়িত্বহীনতার কারণে বিলুপ্তির পথে। আমাদের কল্পিত দেশের প্রকৃত অবস্থা বর্তমান পৃথিবীর বাস্তব প্রতিচ্ছবি। আমরা দেখেছি কীভাবে পাচার ও বেআইনি শিকারের ফলে কচ্ছপের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, নির্মাণ কাজ ও পর্যটনের চাপে ধ্বংস হচ্ছে কচ্ছপের ডিম পাড়ার উপকূল ,প্লাস্টিক দূষণ ও সামুদ্রিক বর্জ্যতে মৃত্যু ঘটছে প্রজাতিগুলোর, বাণিজ্যিক জাল ব্যবহারে কচ্ছপেরা হয়ে যাচ্ছে অনিচ্ছাকৃত শিকার। আমরা বুঝে গিয়েছিলাম—এটি কেবল একটি দলীয় অ্যাসাইনমেন্ট নয়, বরং বাস্তব জীবনের সংকট যার সমাধান আজ জরুরি।

আমাদের ভূমিকা: একটি জাতিসংঘ ভিত্তিক প্রেস কনফারেন্সের রূপে উপস্থাপনা: আমাদের দল একটি জাতিসংঘভিত্তিক সংবাদ সম্মেলনের আদলে উপস্থাপন করেছিল। আমি অভিনয় করেছিলাম সরকারের পরিবেশ সংক্রান্ত আইন উপদেষ্টা হিসেবে। আমাদের দলে ছিল: সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী, পরিবেশ NGO-র প্রতিনিধি, মিডিয়া সাংবাদিক, পরিবেশমন্ত্রী, স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি । আমরা কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম এবং তুলে ধরেছিলাম বহুমাত্রিক সমাধান।

স্বল্পমেয়াদি সমাধান: প্লাস্টিক বর্জ্য নিষিদ্ধকরণ, সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা চিহ্নিতকরণ, উপকূলীয় উন্নয়ন স্থগিত রাখা ডিম পাড়ার মৌসুমে, কচ্ছপ উদ্ধার হেল্পলাইন চালু করা, জেলেদের সচেতনতা বাড়ানো ও বিকল্প টেকনোলজি দেওয়া।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন, পাঠ্যসূচিতে সমুদ্র শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কচ্ছপ পর্যবেক্ষণ, ইকো-ট্যুরিজম প্রচার, আন্তঃদেশীয় চুক্তি ও সমুদ্র সংরক্ষণ সহযোগিতা।

আমার আইনজীবী পরিচয় আমাকে সাহায্য করেছিল বাস্তব সম্মত ও কার্যকর নীতিমালা উপস্থাপন করতে। আমরা বুঝাতে পেরেছিলাম—পরিবেশ সংরক্ষণ কোনো স্বপ্ন নয়, এটি বাস্তবায়নযোগ্য একটি নৈতিক দায়িত্ব।

মালদ্বীপের শিক্ষা: স্বর্গপৃথিবীও ঝুঁকিতে: সামিটের ভেন্যু মালদ্বীপ ছিল এক জীবন্ত শিক্ষা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে দেশটি ইতোমধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। প্রবাল প্রাচীরের ধ্বংস, সমুদ্রদূষণ, এবং অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন—সব মিলিয়ে এখানকার সামুদ্রিক প্রাণীরা আজ বিপন্ন।সাগরপাড়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিল—এই দ্বীপ কি একদিন কেবল মানচিত্রে বেঁচে থাকবে?

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: আমাদের সাগরের গল্পও কি আলাদা?

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও বঙ্গোপসাগরও একই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আমরা যেমন ভোগ করছি প্লাস্টিক দূষণ, তেল নিঃসরণ, বর্জ্য ব্যবস্থার অভাব, তেমনি ভোগ করছি অজ্ঞতা ও দায়িত্বহীনতার খেসারত। সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী মানুষরাও জানে না তারা কী হারাতে বসেছে। আমার লক্ষ্য এখন এই শিখন কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় সচেতনতামূলক প্রকল্প শুরু করা, যেখানে স্থানীয় স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে সমুদ্র সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করব।

ভবিষ্যতের রূপরেখা: আইন, শিক্ষা এবং সচেতনতার মিলনস্থল

একজন আইনজীবী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি যে শক্তিশালী আইন এবং স্থানীয় জনসম্পৃক্ততা মিলেই হতে পারে স্থায়ী সমাধানের চাবিকাঠি। আমি একটি প্রকল্প চালু করতে চাই—‘কমিউনিটি ওশান স্কুল’, যেখানে মোবাইল ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শেখানো হবে: সামুদ্রিক প্রাণী রক্ষা, প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা, মাছ ধরার নিরাপদ পদ্ধতি, পরিবেশ-সম্পর্কিত আইনি অধিকার । এই স্কুল হবে সচেতনতা তৈরির কেন্দ্র, আইনগত সহায়তার সেতুবন্ধন, এবং সমাজের একটি জাগরণ কেন্দ্র।

সমাপ্তি: আমরা না বাঁচালে, কে বাঁচাবে?

আজকের তরুণদের প্রতি আমার আহ্বান—আমাদের কণ্ঠই হোক প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষাকবচ। সমুদ্রের গভীরতা যতই গভীর হোক না কেন, আমাদের দায়বদ্ধতা যেন হয় ততটাই অটল। আমরা যেন সেই প্রজন্ম না হই যারা কেবল বিবৃতি দিয়েছে—কিন্তু কিছু করেনি। আমরা যেন হই সেই প্রজন্ম যারা গর্জে উঠেছে, দাঁড়িয়েছে, এবং প্রভাব ফেলেছে।

লেখক: যুব নেতৃত্ব প্রশিক্ষক ও অ্যাডভোকেট


ঢাকার বায়ুদূষণে অদৃশ্য বাধা

ড. ফারজানা ফাতিমা লিজা
আপডেটেড ২০ মে, ২০২৫ ২০:৫৮
দৈনিক বাংলা ডেস্ক

ঢাকার বায়ুদূষণ, কার্বন নিঃসরণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি: টেকসই উন্নয়নের পথে অদৃশ্য বাধা

ঢাকার একটি ব্যস্ত সকাল। হাজারো মানুষ জীবিকার তাগিদে ছুটছে, বাস-রিকশা-প্রাইভেটকার-ট্রাক- সব চলছে নিজের ছন্দে। কিন্তু সেই ছন্দের মাঝেই বাতাসে মিশছে এক ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর ভার। রাস্তায় দাঁড়ানো মাত্র চোখে জ্বালা, গলায় খুসখুসে কাশি, আর মনে হয় যেন ফুসফুসে ধোঁয়া ঢুকে যাচ্ছে। আমরা যত উন্নয়নের গল্প শুনি, ঢাকার বাতাস ঠিক ততটাই নীরবে বিষাক্ত হয়ে উঠছে। এই শহরের রাস্তার কালো ধোঁয়া, ধুলাবালি, অতিরিক্ত কার্বন ইমিশন এখন কেবল পরিবেশগত ইস্যু নয়—এটি স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়নের অন্যতম বড় বাধা।

Bangladesh Air Quality Index(AQI) ২০২৪-এর তথ্য বলছে, ঢাকার বাতাসে PM2.5 এর গড় মাত্রা ৭৮ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার—যা WHO গাইডলাইনের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ৫ µg/m³ কে নিরাপদ বললেও ঢাকার বাস্তবতা এর বহু গুণ বেশি। যানবাহনের ইঞ্জিন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় থাকে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো গ্যাস। এগুলো শুধু বায়ু দূষণই নয়, বরং মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দূষিত বাতাস এখন সারা বিশ্বের মানুষের জন্য চতুর্থ প্রধান মৃত্যুঝুঁকির কারণ। আর ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে এ ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। শিশুদের মধ্যে হাঁপানি, বয়স্কদের হৃদরোগ এবং কর্মজীবী মানুষের প্রোডাক্টিভিটি হ্রাস—সবকিছু এই দূষণের ফল।

Air Quality Life Index অনুযায়ী, শুধু বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে গড় আয়ু ৬.৮ বছর পর্যন্ত কমে যেতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের রিপোর্ট বলছে, বায়ুদূষণ ও স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে বাংলাদেশের GDP প্রতিবছর ৩.৯–৪.৪% পর্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হয়।এই তথ্যগুলো কেবল সংখ্যাই নয়—এর মানে হলো, দূষণের কারণে আমাদের অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে, মানুষের আয়ু কমে যাচ্ছে, চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে, এবং স্বাস্থ্যসেবার ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বায়ুদূষণের মূল উৎস হলো: পুরনো ডিজেলচালিত যানবাহন, ট্রাফিক জ্যাম, নির্মাণসাইটের খোলা ধুলাবালি এবং দুর্বল নগর ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ১৫% হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিলেও, রাজধানী প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ কার্বন ইমিশন করছে।

আমাদের সমাধান অবশ্যই সম্ভব। প্রথমত, পরিবহন খাতে সংস্কার আনতে হবে। পুরনো ডিজেলচালিত গাড়ি নিষিদ্ধ করতে হবে। সিএনজি ও ইলেকট্রিক যানবাহনের ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং গণপরিবহনকে জনবান্ধব করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নির্মাণ কার্যক্রমে পরিবেশগত নিয়ম মানা নিশ্চিত করতে হবে। খোলা বালি ও সিমেন্ট ঢেকে রাখা, ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানো, এবং নির্মাণসাইট বেষ্টনীর ব্যবস্থা থাকা জরুরি। তৃতীয়ত, নাগরিকদের সচেতন হতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে গাড়ি ব্যবহারে সংযম, মাস্ক পরা এবং গাছ লাগানোর মতো ছোট ছোট অভ্যাসগুলো পরিবেশ রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে। সরকারের পক্ষ থেকে Air Pollution Control Rules 2022 কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন এবং ফিটনেস পরীক্ষার কঠোরতা নিশ্চিত করাও সময়ের দাবি।

এই শহরের বাতাস আমাদের সন্তানদের ফুসফুসে যাচ্ছে—এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হবে, যখন সেই উন্নয়নের ভেতরেই থাকবে মানুষ, স্বাস্থ্য, এবং পরিবেশের ভারসাম্য। আর শুদ্ধ বাতাসের চেয়ে বড় কোনো মৌলিক অধিকার হতে পারে না। ঢাকার রাস্তায় গাড়ির কালো ধোঁয়া, ধুলাবালি আর কার্বন ইমিশনের ছায়া থেকে শহরকে বাঁচাতে হলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই । ঢাকা বাঁচলে আমরা বাঁচব। বাতাস বিশুদ্ধ হলে, ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল।

লেখক: পরিবেশ অর্থনীতিবিদ ও গবেষক


banner close