ইমেজ বা ভাবমূর্তি গঠন (Image & Image Building)
সাধারণভাবে বলতে গেলে ইমেজ বা ভাবমূর্তি হলো সেই উপলব্ধি যা মানুষ কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সম্পর্কে ব্যক্ত করে থাকে। ব্যাপকভাবে বলতে গেলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিনের পথচলা বা তার কার্যকলাপের ইতিবাচক বা নেতিবাচক দিক সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় তাকেই ইমেজ বা ভাবমূর্তি বলে। ইমেজ হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যা কোনো লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। কোনো প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিনের সেবাদান বা ব্যক্তিপর্যায়ের কাজের গুণগত মান, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে কোনো প্রতিষ্ঠানের ইমেজ বা ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে।
ইমেজ বা ভাবমূর্তি গঠনের উপায়
যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য ইমেজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি পুলিশ ইমেজ পুলিশের কাজের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজন পড়ে। নিম্নোক্ত উপায়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ইমেজ বা ভাবমূর্তি গঠন করা যেতে পারে।
কাজের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখা
স্বচ্ছতা নেতা, অনুসারী এবং কর্মীদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করে। তা কর্মসংশ্লিষ্ট চাপ কমায়। পক্ষান্তরে স্বচ্ছতা কর্মীদের বা অধস্তনদের মনে প্রশান্তি আনে এবং কর্মক্ষমতা বাড়ায়। নেতা বা কোনো প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব হলো স্বচ্ছতার একটি সংস্কৃতি তৈরি করা যা তার অধস্তনদের জন্য অনেক সুবিধা বয়ে আনবে। তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনোবল উন্নত করে। যখন অধস্তন ও সতীর্থরা দেখে যে কোনো ব্যক্তি এবং তাদের কাজের স্বচ্ছতা আছে বা সে খোলামেলা হতে পছন্দ করে, তাহলে তাদের ওই ব্যক্তির প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা বেড়ে যাবে। এভাবে কাজকর্মে স্বচ্ছতা থাকলে তা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি গঠনে সহায়ক হয়।
জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা
জবাবদিহিতা নাগরিকের ভোগান্তি কমিয়ে দেয়। জবাবদিহিতা কোনো দলের সদস্যদের দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। জবাবদিহিতা অনুশীলনের ফলে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়, কাজের প্রতি সন্তুষ্টি ও প্রতিশ্রুতি বৃদ্ধি পায়। কাজের পরিমাণ ও গুণাগুণ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং কোনো কাজের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি গঠনে সহায়ক হয়।
বিপদের সময়ে মানুষের পাশে থাকা
সংকটকালে ভুক্তভোগীরা অসহায় থাকে। সে সময় সাধারণ মানুষ পুলিশ বা রাজনৈতিক নেতা বা সমাজের নেতাদের সাহায্য ও সমর্থন প্রত্যাশা করে। সে জন্য বিপদকালীন সময়ে পুলিশ বা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি বা নেতাদের উচিত ভুক্তভোগীর পাশে থাকা। তাই ভিকটিম বা ভুক্তভোগীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ইমেজ বা ভাবমূর্তি বৃদ্ধি হয়।
বিভিন্ন জাতি বর্ণ, ধর্ম ও প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে সব স্তরের মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া জোরদার করা
বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া বাড়ানোর মাধ্যমে ওই জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমে যায় এবং তাদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। যখন অনুগামী, অধস্তন ও কর্মীরা ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে দূরত্ব কম দেখতে পায়, তখন তারা কাজে অধিক মনোযোগ দিয়ে থাকে। যা প্রকারন্তরে ইমেজ বা ভাবমূর্তি গঠনে সহায়ক হয়।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সততা ও সাধুতা অনুশীলন করা
কোনো একজন নেতা বা প্রতিষ্ঠানের সততা অনুশীলন কর্মক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ বয়ে আনে এবং অনুসারীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বাড়ায়। যখন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাজে সততা ও সাধুতা থাকে না তখন ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কেউ বিশ্বাস করে না। কোনো প্রতিষ্ঠানের বা তার প্রধানের মধ্যে সততা ও সাধুতার চর্চা ওই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ইমেজ বহুলাংশে বৃদ্ধি করে।
ভালো ব্যবহার করা
ভালো ব্যবহার করার মাধ্যমে ভালো সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং ভালো আচরণের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় জয় করা যায়। যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির উপকার করতে নাও পারে, তবে শুধু ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে। ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তি অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয় এবং তার ইতিবাচক ইমেজ বা ভাবমূর্তি গঠিত হয়।
সংকটের সময়ে শান্ত থাকা
কোনো কাজে বা পরিস্থিতিতে শান্ত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যখন কোনো ব্যক্তি সংকটের সময়ে শান্ত থাকে, তখন সাধারণত সে আরও যুক্তিযুক্তভাবে চিন্তা করতে পারে এবং যৌক্তিক ও সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে। কোনো সংকটে অস্থিরতা বা অশান্ত আচরণ সংকট না থামিয়ে বরং সংকটকে আরও জটিল করে তোলে। তাই তো দেখা যায়, সংকটকালীন সময়ে শান্ত থাকার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে।
মাঝেমধ্যে কৌশলী হওয়া
একজন নেতাকে বা কোনো ব্যক্তিকে বুদ্ধিমান হতে হয় এবং তাকে মাঝেমধ্যে কৌশলী হতে হয়। কারণ পরিস্থিতি সামলাতে বা সিদ্ধান্ত নিতে নেতাকে কিছু কৌশলী খেলা বা চাল দিতে হয়। তাই নেতার কৌশল ও সুচারুভাবে কাজ সম্পন্ন করার মাধ্যমে নেতার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে এবং তার ইমেজ বা ভাবমূর্তি গঠিত হবে।
যুক্তিবাদী হওয়া বা যৌক্তিকভাবে কাজ করা
যৌক্তিক সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং যৌক্তিক মূল্যায়ন যৌক্তিকতার ওপর নির্ভর করে। তাই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, সমস্যা সমাধান করা এবং রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী হওয়া খুবই জরুরি। যা ব্যক্তির ইমেজ গঠনে ভূমিকা রাখে।
অংশীজনের মন ও মনোভাব জানা
একজন নেতাকে মনোবিজ্ঞানী হতে হয়, তাকে তার অধস্তনদের সম্পর্কে জানা উচিত এবং পাশাপাশি তাকে তার অংশীজনদের সম্পর্কেও অবগত থাকা উচিত। অংশীজনদের মন-মানসিকতা যাচাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া যুক্তিসঙ্গত। তাই একজন সফল নেতা অংশীজনদের মনের কথা জানেন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। ফলে ওই ব্যক্তির ইমেজ বৃদ্ধি পায়।
ভালো কাজ বা ইতিবাচকতা প্রচার করা
কোন ভালো কাজের তথ্য বা সংবাদ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে প্রচার করার মাধ্যমে বিষয়টির ব্যাখ্যা ও সমস্যা সবাই স্পষ্টভাবে জানতে পারে। একটি ঘটনার তথ্যপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রচার করার মাধ্যমে জনসাধারণের সঙ্গে ধারণা শেয়ার করা, তাদের বোঝাপড়া বৃদ্ধি করা, তাদের উপলব্ধি পরিবর্তন করা এবং তাদের নতুন দক্ষতা অর্জনে সহায়ক হয়ে থাকে। তাই ভালো কাজ অংশীজনদের মধ্যে প্রচার করলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়েরই ইমেজ বৃদ্ধি পাবে।
সরল জীবনযাপন এবং সেইসঙ্গে উচ্চ চিন্তাভাবনা
সরলতা সব সময় সাধারণ মানুষের কাছে প্রশংসিত। সরল জীবনযাপন ও উচ্চ চিন্তাভাবনা অন্য মানুষকে উৎসাহিত করে এবং প্রভাবিত করে। সাধারণত অনুসারীরা বা অধস্তনরা নেতাকে বা প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তাকে দেখে থাকে, তাকে অনুসরণ করে এবং তার জীবনধারা নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে। তাই সরল জীবনযাপন ও উচ্চচিন্তা ইমেজ গঠনে সহায়ক হয়।
নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতা অনুসরণ করা
শৃঙ্খলা ভালো অনুসারী তৈরি করে। শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতা চর্চা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গলস্বরূপ। কেননা তা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে একটি সুন্দর বা সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করে। সুতরাং এটা বলা যেতে পারে শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা অনুসরণ করা ইমেজ তৈরির সহজ উপায়। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতা মেনে চললে তাদের সম্পর্কে আরও অধিক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হয়ে থাকে এবং ইতিবাচক ভাবমূর্তি গঠিত হয়। কথা রাখা বা সময় রক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি এক কথার মানুষে পরিণত হয়। কোনো নেতার নিয়মানুবর্তিতা পালন নেতাকে তার কর্মীদের মধ্যে নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত হিসেবে পরিগণিত করে।
ভদ্রতা ও সৌজন্যতা অনুশীলন করা
যখন কোনো ব্যক্তি ভদ্রতা ও সৌজন্যতা প্রদর্শন করে তখন তার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ এবং সম্মান সৃষ্টি হয়। ভদ্রতা ও সৌজন্যতা কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য অত্যাবশ্যক। তাই তো ভদ্রতা ও সৌজন্যতা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ইমেজ বা ভাবমূর্তি গঠনে সহায়ক হয়।
পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শন করা ও সহনশীল হওয়া
পারস্পারিক শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে বিশ্বাস, সম্মান ও অর্থপূর্ণ যোগাযোগের ভিত্তি রচিত হয়। কোনো ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে ওই ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ ও সুস্থতার অনুভূতি তৈরি হয় এবং তার মেধা, মনন ও প্রতিভা বিকশিত হতে সহায়ক হয়। একজন সহনশীল ব্যক্তি ধৈর্যর সঙ্গে অন্যের মতামত শোনেন এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করেন। সহনশীল ব্যক্তি পরমতসহিষ্ণু হন এবং সবার মতামতকে শ্রদ্ধা করেন। তাই পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সহনশীলতা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পারে।
ভালো যোগাযোগ রক্ষা করা
যোগাযোগ দক্ষতা সামাজিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাগুলোকে সক্রিয় করে। এ ছাড়া যোগাযোগ মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি করে এবং সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। কার্যকর যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট সবার পক্ষকে সন্তুষ্ট করে। দ্বন্দ্বময় পরিস্থিতিতে কার্যকর যোগাযোগেরমাধ্যমে একটি সম্মানজনক ও সুষ্ঠু সমাধান করা যায়। ভালো যোগাযোগ সুস্থ সম্পর্ক তৈরি এবং সুষ্ঠু বিকাশে সহায়ক বিধায় ব্যক্তিগত ইমেজ গঠনে ভূমিকা রাখে।
মার্জিত পোশাক পরিধান করা
শেক্সপিয়ার তার ম্যাকবেথ নাটকে বলেছেন, পোশাকে মানুষ চেনা যায়। সত্যই পোশাকের মাধ্যমে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। ব্যক্তিত্বের বিকাশের মাধ্যমে মানুষ সফল মানুষে পরিণত হয়। একজন ব্যক্তির পোশাক এবং পোশাক পরিধানের ধরন তার ব্যক্তিত্ব বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই বলা যায় পোশাক ব্যক্তি ইমেজ গঠনে ভূমিকা রাখে।
বিনয়ী ও শিষ্টাচার বজায় রাখা
শিষ্টাচার মানুষকে শেখায় কীভাবে বিভিন্ন পরিবেশে অন্যের সঙ্গে সুআচরণ করতে হয়। শিষ্টাচার চর্চার মাধ্যমে এক সহজাত ও কর্মময় পরিবেশ তৈরি হয়। তা সবার জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও আরামপ্রদ করে তোলে। শিষ্টাচার দয়া, নম্রতা ও সুবিচেনা উপহার দেয়। শিষ্টাচার জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আত্মবিশ্বাস দেয়। এটি আমাদের অন্যের অনুভূতি এবং অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে। আর বিনয়ী হওয়া এবং কোনো কাজে বিনয়ীভাব প্রদর্শন করা ব্যক্তি সম্পর্কে একটা ইতিবাচক বার্তা দেয়। সুতরাং সবাই কাজে বিনয়ী হওয়া ও শিষ্টাচার প্রদর্শন ব্যক্তির ইমেজ গঠনে বড় ভূমিকা রাখে।
পাঠ্যক্রম বহির্ভূত সৃষ্টিশীল কার্যক্রম অনুশীলন করা
পাঠ্যক্রম বহির্ভূত সৃষ্টিশীল কার্যকলাপগুলো ব্যক্তির প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। এ ছাড়া ব্যক্তি কীভাবে একটা টিমে কাজ করে সম্মিলিতভাবে লক্ষ্য অর্জন করবে তা শেখায়। এসব কাজগুলো মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, নেতৃত্বের দক্ষতা সৃষ্টি করে এবং নিজের মানোন্নয়ন করে যা প্রকারান্তরে ইমেজ বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে অন্যকে আকৃষ্ট করা যায়, অন্যের কাছাকাছি যাওয়া যায় এবং অন্যকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করা যায়। যা ব্যক্তির ইমেজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হওয়া
ব্যক্তিত্ব মানুষকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। ব্যক্তিত্বের বিকাশ মানুষকে আকর্ষণীয় করে তোলে। ব্যক্তিত্বের বিকাশের মাধ্যমে ব্যক্তির যোগাযোগ দক্ষতার উন্নতি হয়। ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে ব্যক্তির চিন্তাভাবনা ও অনুভূতিগুলো পছন্দসই উপায়ে প্রকাশ পায়। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি বিবেকবান, যৌক্তিক ও খোলামেলা মনের হয়। ফলে তার দ্বারা অনেকে সুবিচার ও উপকার পেয়ে থাকে। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তির ইতিবাচক ইমেজ গঠিত হয়।
পুলিশ ইমেজ
অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় ধরে পুলিশ বাহিনী বা এর সদস্যদের কার্যকলাপ, আচরণ, ব্যবহার, স্বচ্ছতা, সততা, পেশাদারিত্ব ও আইনি পদক্ষেপ সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে দেশের অধিকাংশ জনগণ বদ্ধমূল, স্থায়ী বা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘমেয়াদি যে বিশ্বাস বা ধারণা পোষণ করে তাকে পুলিশ ইমেজ বলে।
পুলিশের কাজে ইমেজ গঠনের গুরুত্ব (Importance of Image Building in Police Functioning)
কোনো প্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক ইমেজ জনগণের মধ্যে ওই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আস্থা, বিশ্বাসযোগ্যতা, সততা ও সাধুতার ইঙ্গিত দেয়। পুলিশ বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত। তাকে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও জনসাধারণের সঙ্গে কাজ করতে হয়। সে জন্য পুলিশ ইমেজ বা ভাবমূর্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে পুলিশের কাজে ইমেজের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো-
অপরাধ নিবারণে
অপরাধ নিবারণ পুলিশের কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এর মাধ্যমে মানুষকে অপরাধ ঘটনের কারণে শারীরিক, অর্থনৈতিক ও মননে ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে রক্ষা করে। আর অপরাধ নিবারণে প্রযুক্তির পাশাপাশি জনসাধারণের সহায়তা অত্যন্ত প্রয়োজন পড়ে। পুলিশের বা অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইমেজ ভালো থাকলে জনগণ তাদের তথ্য দিয়ে, সরাসরি গ্রেপ্তারে ও অপরাধস্থলে পৌঁছে দিয়ে অপরাধ নিবারণে সহায়তা করে।
ঘটনা উদ্ঘাটনে
কোনো ঘটনা উদ্ঘাটন মামলা তদন্তে বড় ভূমিকা রাখে। ঘটনা উদ্ঘাটনে অনেক ভদ্রবেশি অপরাধী যারা অপরাধ প্রক্রিয়ার পেছনে বা অন্তরালে থেকে অঘটন ঘটায় তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়। সর্বোপরি তা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে। কোনো ঘটনা দ্রুত উদ্ঘাটন ভিকটিম বা ভুক্তভোগীকে আরও সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, পুনরায় আরও অপরাধ ঘটন থেকে নিষ্কৃতি দেয়। কোনো সমাজে বা সম্প্রদায়ের মধ্যে পুলিশের ইতিবাচক ইমেজ থাকলে সেসব গোষ্ঠীর মানুষ পুলিশকে ঘটনা উদ্ঘাটনে সহায়তা করবে।
তদন্ত কাজে সহায়তা
মামলার তদন্তে বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তের গুরুত্ব অপরিসীম; কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তে জনসাধারণের সহায়তা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তের পাশাপাশি অন্যান্য তদন্তে জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। পুলিশ ইমেজ উন্নত হলে জনসাধারণ স্বেচ্ছায় সাক্ষ্য দিয়ে, তথ্য দিয়ে, ডকুমেন্টস দিয়ে পুলিশকে সহায়তা করবে এবং পুলিশের কাছে সর্বপ্রকার সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসবে। তাই তো সুষ্ঠুভাবে ও সুচারুভাবে তদন্ত কাজ সম্পন্ন করতে হলে জনগণের সহযোগিতা অপরিহার্য।
সাজা বা শাস্তি প্রদানে
পুলিশের ভালো ইমেজ গঠিত হলে জনসাধারণ পুলিশের ডাকে সাড়া দিয়ে আদালতে নিজে সাক্ষী দেবে, অন্যকে সাক্ষী দিতে উদ্ভূত করবে, তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে পুলিশকে তদন্তে সহায়তা করবে। যা প্রকারন্তরে অপরাধীর সাজা প্রদানে সহায়তা করবে।
অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কে তথ্য পেতে
অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কে তথ্য পেতে পুলিশকে সমাজের সব স্তরের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও মিথস্ক্রিয়া করতে হয়। ইমেজ বা ভাবমূর্তি গঠনের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যরা সহজে জনগণের কাছে যেতে পারে এবং জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয় ও জনবান্ধবতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। তাই পুলিশের ইমেজ গঠনের মাধ্যমে জনগণ অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কে তথ্য পাবে এবং অপরাধ প্রতিরোধ করে টেকসই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারবে। পুলিশের ইমেজ উন্নত হলে মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহায়তা করবে।
অপরাধী গ্রেপ্তারে
বর্তমান যুগকে বলা হয় ডিজিটাল যুগ। প্রায় সব মানুষই এখন সেল ফোন ব্যবহার করে। সব ধরনের অপরাধীরাও এখন সেল ফোন ব্যবহার করে থাকে। এ ছাড়া অপরাধী গ্রেপ্তারে পিন পয়েন্ট ইনফরমেশন বা তথ্যের প্রয়োজন হয়। আর জনগণ সহায়তা না করলে অপরাধী গ্রেপ্তারে সফলতা পাওয়া কষ্টকর। পুলিশের ইতিবাচক ইমেজ গঠিত হলে জনগণ পুলিশকে অপরাধী গ্রেপ্তারে প্রভূত সহায়তা করবে। পুলিশের ইমেজ বৃদ্ধি পেলে জনগণ অপরাধীর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিয়ে, অপরাধীকে ধৃত করে এবং অপরাধী গ্রেপ্তারে সরাসরি ও আর্থিকভাবে সহায়তা করবে।
সমাজ থেকে অপরাধভীতি দূর করতে
কোনো অপরাধ একবার ঘটার পর পুনরায় সে অপরাধ সংগঠিত হতে পারে। অপরাধ ভয়ের কারণে ভুক্তভোগী বা ভিকটিম বিভিন্ন রকম রোগে আক্রান্ত হতে পারে যেমন- হৃদরোগ, প্রেসার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি। আবার অপরাধ ভয়ের কারণে ভুক্তভোগী শারীরিক বৈকল্যের স্বীকার হতে পারে। এ ছাড়া অপরাধ ভয়ের কারণে ভুক্তভোগী মানসিক আঘাত পেয়ে থাকে। সমাজ থেকে অপরাধভীতি দূর করতে ভয়ের উৎস জানা, ভয়ের মাত্রা জানা, সঠিক তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থা করা, ভিকটিমকে যথাযথ সাপোর্ট দেওয়া, পুলিশকে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছানো ও সহায়তা প্রদান, সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রেষণা, কাউন্সেলিং, জনগণ ও পুলিশের আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়ন প্রয়োজন। এসব কাজ পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয় এবং সব ক্ষেত্রে জনগণের সহায়তা একান্ত প্রয়োজন পড়ে। আর পুলিশ ইমেজ বৃদ্ধি ঘটলে জনগণ পুলিশকে সব ক্ষেত্রে সহায়তা করবে এবং সমাজ থেকে অপরাধভীতি দূর হবে।
জঙ্গি দমনে
জঙ্গিবাদ, জঙ্গিদের সংগঠিত হওয়া এবং জঙ্গি হামলা এখন বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের এক বড় সমস্যা। জঙ্গি তৎপরতা চালু রাখতে জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রধানরা নিত্যনতুন সদস্য সংগ্রহ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে তারা কম শিক্ষিত ও সহজ-সরল মানুষের দিকে দৃষ্টি দিয়ে থাকে। জঙ্গি দমনে প্রচলিত ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার পাশাপাশি প্রো-অ্যাকটিভ পুলিশিং ও জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা প্রয়োজন। পুলিশ ইমেজ গঠনের মাধ্যমে জনগণ পুলিশকে জঙ্গি দমনে সহায়তা করতে পারে।
সন্ত্রাস দমনে
সন্ত্রাস বাংলাদেশের অন্যতম এক সমস্যা। একটা ছেলে বা মানুষ কেন সন্ত্রাসী হয়, সেটা আগে খুঁজে বের করা প্রয়োজন। একজন মানুষ কিন্তু এক দিনে সন্ত্রাসী হয় না। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অসম্মান, ক্ষুধা, দরিদ্রতা, মাদকাসক্তি ইত্যাদি এর পেছনে রয়েছে। তাই সন্ত্রাস দমনে সমাজের সব স্তরের মানুষ যেমন- পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, ধর্মীয় নেতা, উন্নয়নকর্মী ও সমাজ সেবক সবাইকে কাজ করতে হবে। আর পুলিশ এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সংগঠিত করতে পারে। পুলিশের ইতিবাচক ইমেজ গঠনের মাধ্যমে সমাজের সব স্তরের মানুষকে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে সমাজ থেকে সন্ত্রাস দূর করতে পারে।
চুরি ও ডাকাতি নিয়ন্ত্রণে
চুরি ও ডাকাতিসংক্রান্ত অপরাধগুলোকে সম্পত্তিসংক্রান্ত অপরাধ বলে। এসব অপরাধে সাধারণত মানুষ শারীরিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এসব অপরাধে ভুক্তভোগীর অনেক সময় মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে। এসব অপরাধ দমনে পুলিশের কার্যক্রমের পাশাপাশি জনগণের অংশগ্রহণ প্রয়োজন হয়। যেমন- ভিলেজ ডিভেন্স পার্টি গঠন, কমিউনিটি পুলিশিং ও বিট পুলিশিং কার্যক্রম চালুকরণের মাধ্যমে এ জাতীয় অপরাধ নির্মূল করা যায়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশের ইতিবাচক ইমেজ একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে
পুলিশের কাজের মূল কথা হলো মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা। কোনো সমাজের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে জনসাধারণের স্বেচ্ছায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অংশগ্রহণ এবং স্বেচ্ছায় পুলিশকে সহায়তা করতে হয়। আর যদি পুলিশ সদস্যদের জনসাধারণের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকে তাহলে তারা পুলিশকে যেকোনো অপরাধ সম্পর্কে অবগত করবে এবং সে মোতাবেক পুলিশ কাজ করবে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কমিউনিটি মিটিং, উঠান বৈঠক ও অপরাধ নিরোধ সভা অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখে। এসব সভা ও বৈঠক থেকে সমাজের অপরাধের ও আইনশৃঙ্খলার সঠিক চিত্র পাওয়া যায় এবং তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করা যায়। এসব উপায়ে সমস্যা সমাধানকল্পে পুলিশ ইমেজ গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনায়
জনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনায় সংলাপ এবং সমঝোতায় পৌঁছানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেখা যায় দীর্ঘ বঞ্চনার কারণে মানুষ জনতাবদ্ধ হয়ে যায়, আন্দোলন করে, প্রতিবাদ করে ও ভাঙচুর করে। পুলিশকে তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে নেয়। পুলিশের একারপক্ষে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় না। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবেগপ্রবণ জনতাকে বোঝায়ে আলোচনার টেবিলে বসানো যায়। সে জন্য বলা হয়ে থাকে ওইসব ক্ষেত্রে পুলিশের ইমেজ গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মাদক ও মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণে
আমাদের সমাজে বিরাজমান সমস্যাগুলোর মধ্যে মাদকাসক্তি অন্যতম। বর্তমানে আমাদের যুবসমাজের বড় একটা অংশ মাদকাসক্ত। এক সমীক্ষা থেকে জানা যায় বড় শহরগুলোতে যত অপরাধ ঘটে থাকে তার শতকরা ৮০ ভাগ মাদকাসক্তরা করে থাকে। মাদক ও মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিনটি উপায়ে কাজ করা যায়। প্রথমত, চাহিদা কমিয়ে, দ্বিতীয়ত, ক্ষতি কমিয়ে এবং সর্বশেষটি হলো সরবরাহ কমিয়ে। এ তিনটি ক্ষেত্রেই জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। আর পুলিশকেই এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। সর্বোপরি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সে জন্য পুলিশ ইমেজ গঠন অত্যন্ত গুরুত্ববহ। কারণ পুলিশের ইমেজ বৃদ্ধি ঘটলেই জনসাধারণ পুলিশকে সহায়তা করবে এবং এ দেশ থেকে মাদক ও মাদকাসক্তি নির্মূল হবে। সুতরাং ইতিবাচক ইমেজ গঠন ও ইমেজ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে পুলিশিং ফলপ্রসূ হবে এবং এক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা পাবে।
লেখক: অতি: ডিআইজি, কমান্ড্যান্ট, পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল (পিএসটিএস), বেতবুনিয়া, রাঙামাটি
আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অস্বস্তিকর সত্যের চেয়ে স্বস্তিকর মিথ্যাকেই বেছে নেই। এই কথাটা অনেক ব্যাপক এবং আমরা মেনে নিতে চাই না। অথচ বাস্তবতা এটাই। নিজের বাসা, কর্মস্থল, আড্ডার জায়গা সবখানেই একই চিত্র। চারিদিকে মিথ্যার জয়জয়কার এবং সত্য কোণঠাসা। এটা কিন্তু ঘটনাক্রমে হচ্ছে না, বরং আমি, আপনি, আমরা সবাই মিলে এই পরিস্থিতি তৈরি করে রাখছি। এটা একটা সম্মিলিত স্বার্থ যাকে আমরা উপরে উপরে অস্বীকার করলেও মনে মনে প্রমোট করে চলেছি। এটুকু পড়েই অনেকে বিরক্ত হয়ে গেছেন হয়তো। এটা আসলে বিরক্তি না বরং অস্বস্তি। সত্যকে মোকাবিলা করতে হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা অস্বস্তিতে পড়ে যাই। আজকে আমি চেষ্টা করব সেই অস্বস্তিকর বিষয়েই আলোচনা করতে যাকে আমরা সম্মিলিতভাবে ভয় পাই এবং প্রতিহত করি। এর ফলে, মিথ্যা এবং অন্যায়ের জয় হলেও আমরা আনন্দ চিত্তে মেনে নেই। কারণ আমরা সত্য খুঁজি না, আমরা আমাদের কম্ফোর্টকে নিশ্চিত করার জন্যে ভুল বা মিথ্যাকে ভ্যালিডেটেড করতে চাই।
আমার অবসর সময়ের অনেকটাই কাটে পড়া লেখা করে, টেলিভিশনে খেলা এবং নাটক সিনেমা দেখে। সময় পেলে হলে গিয়ে সিনেমাও দেখি। নাটক-সিনেমা বা এজাতীয় কিছু যখন অন্য কারো সাথে দেখি বা পরবর্তীতে এসব নিয়ে অন্য কারো সাথে আলোচনা করি তখন একটা বিষয়ে প্রায় সবাই একমত থাকে। সেটা হচ্ছে, ‘নাটক- সিনেমা দেখি বিনোদনের জন্যে, এখানে ভারী বা গভীর কিছু ভালো লাগে না’। এটা নিয়ে আমিও ভেবেছি; এবং একমতও হয়েছি। সেটা হচ্ছে আমাদের বিনোদন দরকার। তবে যে বিষয়ে একমত হতে পারিনি সেটা হচ্ছে আমাদেরকে হালকা বা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় বিনোদন দিতে সক্ষম হবে কেন?
আমাদের দেশের বাংলা সিনেমা মূলত এখন ঈদ নির্ভর। ঈদ আসলে কিছু সিনেমা রিলিজ পায় আর বছরের বাকী সময় ধরে নামমাত্র কয়েকটা সিনেমা রিলিজ পায় যার অনেকগুলোই একদমই মান সম্মত না। যাই হোক, গত ঈদে আমি বেশ কয়েকটি সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছি। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে হাতে গোণা দারুণ হিট মুভিগুলো একটা বাদে বাকিগুলো অপ্রাসঙ্গিক, আজগুবি এবং আমাদের জীবনের কথা বলে না। ঠিক একইভাবে টেলিভিশনে কয়েকটি মিলিয়ন্স ভিউপ্রাপ্ত নাটক দেখেছি যেগুলো এতটাই মানহীন যে পাঁচ মিনিটের বেশী দেখতে ইচ্ছা হয় নি। আবার এমন কিছু দারুণ সিনেমা দেখেছি যেটা হিট হয়নি বা কিছু ভালো নাটক দেখেছি যেগুলো তেমন ভিউ পায়নি।এই অদ্ভুত অবস্থার জন্যে আসলে কারা দায়ী? অনেকেই অনেক মতবাদ দিবেন। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে কিছু শিক্ষিত মানুষের মুখে বলতে শুনেছি, ‘নাটক, সিনেমা দেখি এন্টারটেইন্ড হতে। দেশ সমাজ নিয়ে ভাবার জন্যে না’। আমাদের এই চিন্তাই আমাদেরকে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই চিন্তাই ভালো কিছুকে খারাপ কিছুর কাছে হারিয়ে দিচ্ছে। আগেকার দিনে কমেডির মাধ্যমে সমাজের নিদারুণ বাস্তবতাকে তুলে ধরা হতো আর এখন কমেডি নাটকের নামে সমাজকে তামাশায় ফেলে দিচ্ছে। আগে থ্রিলার মুভি-নাটকে সাসপেন্সের মাধ্যমে টুইস্ট থাকতো আর এখন টুইস্টের নামে অযৌক্তিক ঘটনার অবতারণা করা হচ্ছে। আর এসব অযৌক্তিক জিনিষে আমরা এন্টারটেইন্ড হয়ে ভালো কিছুকে উঠে আসতে দিচ্ছি না।
এটা শুধু নাটক সিনেমাতেই আবর্তিত না। সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখেন। এন্টারটেইনার, গুরু, ইনফ্লুয়েন্সার, মোটিভেটর, সবজান্তায় চারিদিক আচ্ছন্ন। এদের ক’জনা আমাদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করছে? কারা আমাদেরকে মিথ্যা থেকে দূরে রেখে সত্যের দিকে ধাবিত করছে? এটা নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই আবার সেই একই সমস্যা। সমাজের অনেকেই বলবেন, ‘আরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটু মজা নিতে আসি। এখানে এত গভীর কথাবাত্রা শুনে কি লাভ হবে?’ সোশ্যাল মিডিয়ায় যাদের অনেক ফলোয়ার তাদের দিকে একটু গভিরভাবে খেয়াল করেন। তাদের আলোচনার টপিক এবং দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই করার চেষ্টা করেন। একটা জায়গায় দারুণ মিল পাবেন। সবাই প্রতিটা বিষয়ে একটা নির্দিষ্ট মতবাদ দিচ্ছে। সেই মতবাদ একটা টাইপের। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট গ্রুপ অফ পিপলের জন্যে। সেই নির্দিষ্ট গ্রুপ অফ পিপল তাদের মতাদর্শের ভ্যালিডেশন খুঁজছে সেসব ফেমাস ইনফ্লুয়েন্সারদের কাছ থেকে। গুরু বা ইনফ্লুয়েন্সাররা সত্যকে প্রমোট করছে না বরং একটা নির্দিষ্ট মতবাদকে প্রমোট করে একটা নির্দিষ্ট গ্রুপ অফ পিপলকে ফলোয়ার বানিয়ে দেদারসে কামাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, সেসব ইনফ্লুয়েন্সাররা প্রকৃতপক্ষে নিজের জ্ঞান দিয়ে কাউকে ইনফ্লুয়েন্স করতে পারে না বরং একটা নির্দিষ্ট আদর্শের মানুষ তাদের মতাদর্শের ভ্যালিডেশনের জন্যে তাদের কাছে আসে। এ কারণেই ডিপ থট বা গভীর চিন্তার উদ্রেগ যারা ঘটাতে পারে তাদের চেয়ে নির্দিষ্ট মতাদর্শকে সুন্দরভাবে ভ্যালিডেটেড করতে পারে তাদের ফলোয়ার বেশি। আরেকটু ভিন্নভাবে বললে, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ফলোয়ার পেতে হলে বেশি
রভাগ ক্ষেত্রেই যে গুনটার প্রয়োজন হয় সেটা হচ্ছে গুছিয়ে অন্যের মনের কথা বা আবেগকে বলতে পারা, নিজের মতাদর্শ বা জ্ঞানকে প্রচার করার ক্ষমতা না।
শুধু সোশ্যাল মিডিয়াতেই বা কেন। এবার কর্মক্ষেত্রে খেয়াল করে দেখেন বিশেষ করে আপনি যদি করপোরেট জব করে থাকেন। আপনার কতটা মেধা আছে বা আপনি কত ক্লিয়ারলি চিন্তা করতে পারেন সেটার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনি কতটা গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। আর ইংরেজিতে দক্ষ হলে তো কথাই নেই। কি বলছেন সেটা নিয়ে কেউ ভাববে না, কিভাবে গুছিয়ে কথা বলছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। তেলবাজ এবং চাপাবাজদের কর্মক্ষেত্রে জয়জয়কার। কর্মক্ষেত্রের চাপাবাজেরা খুব কম জ্ঞানের অধিকারী হয়। তাদের সবচেয়ে যে ক্ষমতা থাকে সেটা হচ্ছে বসের মন বুঝে কথা বলার ক্ষমতা এবং অন্যের কাছ থেকে আইডিয়া নিয়ে হালকা জ্ঞানকে দারুণভাবে উপস্থাপন করা যেটাতে মনে হবে সে দারুণ কিছু বলছে। মেধা দিয়ে না, তারা বসকে ইমপ্রেস করে গুছিয়ে কথা বলে।
আমি মনে করি, সমাজে দুই শ্রেণির মানুষ বসবাস করে। এক শ্রেণির মানুষ হচ্ছে আম-জনতা এবং আরেক শ্রেণির মানুষ হচ্ছে আম জনতাকে বেঁচে বড়লোক হওয়া। এই আম জনতাকে বেঁচে দেওয়া কিন্তু বিভিন্ন ফরমেটে হয়। তার মধ্যে একটা হচ্ছে সরাসরি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। ছোটবেলায় দেখতাম বিজ্ঞাপন গুলো খুব ডাইরেক্ট হতো। যেমন অমুক দেশের অমুক প্রোডাক্ট সেরা, কিনে ফেলেন। এরপর দেখলাম বিজ্ঞাপনে ভিন্নতা আসছে। আমাদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করতে দিচ্ছে না। কারণ, আপনি যখন কোন প্রোডাক্ট নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবেন তখন সেই প্রোডাক্ট দারুণ একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে। তাই তারা হালকাভাবে বিজ্ঞাপন করা শুরু করলো। যার কোনো যুক্তি নেই, বাস্তবতা নেই। আছে শুধু চটুলতা আর মজা। এতেই আমরা আম-জনতা প্রোডাক্টের প্রেমে পড়ে হুমড়ি খেয়ে দোকানে হাজির। এরপর বিজ্ঞাপন আরেক মাত্রায় গেলো। বর্তমান সময়ে আমরা ড্যাটা এবং পরিসংখ্যানের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল। তার ওরা বলা শুরু করলো ৮০%, ৯৯.৯৯% , সাধারণের চেয়ে দশ গুণ বেশি ইত্যাদি। এসব তথ্য উপাত্ত নিয়ে আমরা কিন্তু কেউ কিছু ভাবছি না। বিজ্ঞাপনের মোহাচ্ছন্নতায় প্রোডাক্ট কেনা শুরু করে দেই। একটা প্রোডাক্ট গুনগতভাবে কতটা ভালো তারচেয়েও আমরা বেশি গুরুত্ব দেই সেই প্রোডাক্টটার বিজ্ঞাপন কত সুন্দর হয়েছে এবং সেই বিজ্ঞাপনে আমাদের কোন গুরু বা ইনফ্লুয়েন্সার অংশ নিয়েছে।
আমার ছেলের বয়স যখন তের চৌদ্দ বছর তখন একদিন আমার ফেইস বুকের কয়েকটা স্ট্যাটাস পড়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘বাবা, এসব লিখে ফেমাস হতে পারবা না। তোমার এত জটিল কথা পড়ার মানুষের সময় নেই। মজার কিছু হালকা করে লিখ, অনেক ফলোয়ার পাবা’। পরে অনেকক্ষণ ভেবেছিলাম ছেলের কথাটা। উপলব্ধি করেছিলাম যে এটাই বাস্তবতা। এই বাবলের মধ্যে থাকা সমাজের এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা যে একটা কিশোর ছেলেকেও বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে তথাকথিত সাফল্যের জন্যে বেশি গভীর কিছু ভাবা যাবে না। এটাকে আমরা হালকাভাবে নিলে বড় রকমের ভুল করে ফেলবো। আমাদের এই সমাজের নাটের গুরুরা কিন্তু এটাই চায়। তারা চায় আমি, আপনি সবকিছুকে হালকাভাবে ভাবতে শুরু করি। তাহলেই তারা আমাদেরকে অনেক কিছু গিলিয়ে ইনকাম করতে পারবে। আমাদের চিন্তা শক্তি যত প্রখর হবে, আমরা যত রিজনিং খুঁজব তত অন্যায়কে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের উচিৎ হবে পরবর্তী প্রজন্মকে গভীর চিন্তা করার ক্ষমতা অর্জন করতে সহায়তা করা। আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে তরুনরা যেন ইনফ্লুয়েন্সারের দুষ্টু ইনফ্লুয়েন্সে না পড়ে তারা যা বলছে সেটা ঠিক বলছে কি না সেটা যাচাই করার ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করা। তা না হলে পরবর্তী প্রজন্ম এক ইলিউশনে পড়ে যাবে যেখান থেকে আর মুক্তি মিলবে না।
লেখক: কথাশিল্পী ও নাট্যকার।
সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সারা বিশ্বে প্রায় ৪৬ কোটি শিশু সঙ্ঘাতপূর্ণ এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রে বাস করে। যা কিনা সেই সকল শিশুর নিরাপত্তাহীনতার এবং ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও সারা বিশ্বে অপুষ্টি, অকাল জন্ম এবং সংক্রামক রোগ শিশুদের বড় হয়ে ওঠার পথে বাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মনে হয়, একটু দৃষ্টি নিয়ে এদিকে সেদিকে তাকালে এরকম দৃশ্য চোখে পড়বেই।
শিশুদের বলা হয়, ফিউচার অফ দ্য নেশন। শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে যেকোনও দেশের ক্রীড়া, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতির অঙ্গনে তাঁদের প্রাধান্য বিস্তার করে আজকের শিশুরা। সুতরাং সকল দেশ এবং জাতির কর্তব্য, আজকে যারা শিশু, তাদের মানসিক এবং শারীরিক উন্নতির জন্য চিন্তা - ভাবনা করা, তাদের আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত করে তোলা। কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করে যাচ্ছি যে, গোটা বিশ্বেই বর্তমান সময়ে শৈশব বিধ্বস্ত। বিশেষ করে, যুদ্ধে যে সকল দেশ জড়িয়ে পড়েছে, সেই সকল দেশের শৈশব আজ প্রচণ্ড ভাবে বিপর্যস্ত। ইজরায়েল, প্যালেষ্টাইন, রাশিয়া, ইউক্রেন, সুদান, সিরিয়া, ইরান, ইরাক ইত্যাদি দেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি যুদ্ধাস্ত্রের আঘাতে প্রচুর শিশু নিহত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। আহতের সংখ্যা নিহতের থেকেও বেশি। মা - বাবাকে জনমের তরে হারিয়ে বহু শিশু হয়ে পড়েছে অনাথ, অসহায়। তাদের পড়াশোনা, মানসিক বিকাশ সম্পূর্ণ ভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া অনেক দেশে অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক শিশু তাদের স্কুল জীবন অসমাপ্ত রেখেই নিয়োজিত হচ্ছে বিভিন্ন কাজে। তারা কাজ করছে বিভিন্ন যানবাহনের গ্যারেজে, হোটেলে, দোকানে, রেস্তোরাঁয় বা চায়ের দোকানে। তাদের অর্থাৎ শিশুদেরকে নানা রকম কাজে নিয়োজিত করা হয় সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। কখনও কখনও তাদের ওপর শারীরিক অত্যাচার পর্যন্ত করা হয়। এই ধরনের কর্মকাণ্ড কখনওই শৈশবের ভবিষ্যৎ চিত্র খুব একটা উজ্জ্বল করে না।
শৈশবে দেখেছি,পাঠশালায় ‘বাংলা এবং ইংরেজি’ অক্ষর চেনা, জানা ও হাতে ধরে লেখার জন্য পণ্ডিতদের কাছে পাঠাতেন। তারা হাতে হাত রেখে বা ধরে ইংরেজি এবং বাংলা অক্ষর লেখা শিখাতেন। পাঠশালাতে প্রায় ১ বছর ধরে অক্ষর সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান হওয়ার পর প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হত। শিশু বয়সে পণ্ডিতদের কাছ থেকে অক্ষর চেনা, জানা ও লিখতে পারার জ্ঞান অর্জন করা শুধু নয়, পাশাপাশি তারা প্রতিটি শিশুকে আদর্শিক হিসাবে গড়ে ওঠার শিক্ষা দিতেন। বাংলাদেশে আদিকাল থেকে গুরুভিত্তিক পাঠশালার অস্তিত্ব ছিল, যা আমরাও শিশু বয়সে পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে সরকার নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তনের ফলে পাঠশালা শিক্ষা ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, আমাদের পিরোজপুর শহরে আদর্শ হিন্দু স্কুলের একটি শাখা ছিল, সেটি আদর্শ কালিবাড়ী পাঠশালা হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই পাঠশালাটি ১৯৭১ সালে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
তাছাড়া আদর্শ হিন্দু স্কুলের অস্তিত্বও আর নেই। সত্যি বলতে কি, এ যুগে পাঠশালা না থাকার কারণে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করার ব্যবস্থা চিরতরে বন্ধ হওয়া মানেই বর্তমান প্রজন্ম যে আদর্শিক হতে গড়ে উঠবে, সে সুযোগ আজ কোথায়! যেজন্য পাঠশালার পণ্ডিতদের অস্তিত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পণ্ডিতও নেই তাই বোধহয় মানুষ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না এ প্রজন্মের একাংশ। আজকাল প্রায়শই পত্রিকার পাতায় দেখা যায়, ছাত্র কর্তৃক শিক্ষক
লাঞ্ছিত - অপমানিত। কারণ, ঐ যে শিশু বয়সে তারা পণ্ডিত মশাই পাননি। কেননা, পণ্ডিতরাই সত্যিকার অর্থে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতেন সেই সময়ের শিশুদেরকে। যে জন্য শিশুরা বড় হয়ে শিক্ষকসহ সর্বস্তরের গুরুজনদেরকে সন্মান করতেন, শ্রদ্ধা জানাতেন।
লেখক: চিঠিপত্র বিশারদ
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দিয়েছে সরকার।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে একটা চিঠি পাঠানো হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, গণভোটের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। আর এই গণভোট এবং জাতীয় সংসদের নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। আর এই ইস্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক বিশেষ মুহূর্ত অতিক্রম করছে। রাজনীতির এটই সময়টি এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্ত শুধু রাজনৈতিক নয়- রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো, গণতন্ত্রের রূপ নির্ধারণ এবং জনগণের ক্ষমতার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে। গত কয়েক সপ্তাহে নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনের সম্ভাবনা উত্থাপিত হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, তা স্বাভাবিক উত্তেজনার অনেক বাইরে। এটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সীমা অতিক্রম করে এখন হয়ে উঠেছে এক বৃহদাকার রাজনৈতিক বিতর্ক। আর এই বিতর্কে রাজনৈতিক দল, সাধারণ জনগণ, গণমাধ্যম, রাজনীতি বিশ্লেষক এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও গভীর নজর রাখছে।
এছাড়াও বিভিন্ন সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, নির্বাচন কমিশনও এক অভূতপূর্ব চাপের মুখে রয়েছে। তারা এটিকে ‘দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট, গণভোটের ব্যালট, আলাদা গণনা, পর্যবেক্ষণ, নিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণÑ সব মিলিয়ে এমন দ্বৈত আয়োজন বাংলাদেশের মতো দেশে এই প্রথম। কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি, কর্মী প্রশিক্ষণ, ব্যালটপেপার মুদ্রণ, নিরাপত্তা সমন্বয়- সবকিছুই এখন এক প্রকার যুদ্ধ।
সরকার ও নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কাঠামো গঠনের অন্যতম রোডম্যাপ। নতুন রাষ্ট্র কাঠামো, বিশেষ করে Upper House-এর মতো একটি প্রস্তাব বাস্তবায়নের আগে জনগণের মতামত নেওয়া জরুরি। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক শূন্যতা দীর্ঘায়িত হলে রাষ্ট্র আরও অস্থিতিশীল হবে- তাই দ্রুত প্রক্রিয়া শুরু করা ছাড়া উপায় নেই। বিএনপি বলছে, গণভোটকে অজুহাত করে নির্বাচনের প্রস্তুতির সময় সংকুচিত করা হচ্ছে, যাতে তারা সংগঠিত কৌশল নিতে না পারে। অন্যদিকে যারা গণভোটের পক্ষে, তারা বলছে, নতুন রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাপারটি এতদিন ধরে ঝুলে ছিল। দেশের অবস্থা ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিবেচনায় এখনই জনগণের সামনে প্রশ্নটি উপস্থাপন করার সময়। এই দুই বিপরীত অবস্থান মাঠে এক ধরনের দ্বৈত উত্তাপ তৈরি করেছে। একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়তে পারে অথবা কমতেও পারে। তবে প্রশাসনিকভাবে ভুলের ঝুঁকি বহু গুণ বাড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, দেশের আমলাতন্ত্র, নিরাপত্তা বাহিনী, নির্বাচন পরিচালনা কাঠামো- সবকিছুই সীমিত সম্পদে পরিচালিত হয়। একটি বিশাল জাতীয় নির্বাচনই যেখানে বিশৃঙ্খলা বা জটিলতার আশঙ্কা তৈরি করে, সেখানে একই দিনে দ্বৈত ভোট আয়োজন করলে ভুল হওয়ার সুযোগও দ্বিগুণ হবে। সেই ভুল যদি ফলাফল, ব্যালট গণনা বা কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় ঘটে- তাহলে তা রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দেবে, যার প্রভাব বহুদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। তবে যদি নির্বাচন ও গণভোট আলাদা দিনে করা হয়, তাহলেও রাজনৈতিক উত্তেজনা দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ঢা যায় না। বাংলাদেশে নির্বাচনী আবহ যখনই সৃষ্টি হয়, তখনই অনিশ্চয়তা, গুজব, দলীয় ইস্যু এবং সহিংসতা বেড়ে যায়। সে প্রেক্ষাপটে আলাদা দিনে ভোট দুটি আয়োজন করলে দেশের ওপর চাপও দ্বিগুণ হবে। সুতরাং একটি দিনের সিদ্ধান্তই অনেকের কাছে ‘রাজনৈতিকভাবে ন্যূনতম ঝুঁকির পথ’ মনে হচ্ছে।
নতুন রাষ্ট্র কাঠামো তৈরির যে আলোচনাটি চলছেÑতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে Upper House বা উচ্চ কক্ষ গঠনের প্রস্তাব। গণমাধ্যমের এক একটি প্রতিবেদন সূত্রে জানতে পারলাম যে, উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্ব কীভাবে নির্ধারণ হবে- এটি এখন রাজনৈতিক বিরোধের সবচেয়ে বড় ইস্যু। কেউ চান এটি সরাসরি নির্বাচিত হোক, কেউ চান পেশাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব, আবার কেউ চান অংশভিত্তিক মনোনয়ন ব্যবস্থা। রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ মনে করছে যে, এটি ক্ষমতা ভাগাভাগির নামে ক্ষমতার পুনঃবিন্যাসের নতুন কৌশল। আবার অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, উচ্চকক্ষ গঠিত হলে টেকসই আইন প্রণয়ন, সংবিধান সংশোধন এবং রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি নীতি নির্ধারণ আরও শক্তিশালী হবে।
গত এক দশকে নানান রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন-সংঘর্ষ, আদালতের নানা সিদ্ধান্ত, নির্বাচন নিয়ে বিতর্কÑসব মিলিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক অবসাদও জমেছে। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দেওয়া হলেও তা এই নির্বাচনে প্রযোজ্য নয়। এমন একটি সিদ্ধান্তও নাগরিকদের মনে নতুন বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। অনেকে বলছেন, আদালতের এই রায় ভবিষ্যতে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামো গঠনের পথ তৈরি করবে। আবার কেউ বলছেন, এটি রাজনৈতিক সংকট আরও জটিল করবে। বিএনপি দাবি করছেÑগণভোটের ফলে নির্বাচনের আসল ইস্যুগুলো আড়ালে পড়ে যাবে এবং সরকার প্রক্রিয়াটি নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করবে। তাদের বক্তব্যÑ‘এক দিনে নির্বাচন ও গণভোট মানে দুইটি বিশাল রাজনৈতিক চাপকে একসঙ্গে বেঁধে দেওয়া।’এতে ভোটারের মনোযোগ বিভক্ত হবে। অন্যদিকে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন যে, যারা গণভোটকে বিলম্বের কৌশল বলছেন, তারা নিজেরাই রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে ব্যর্থ। তারা মনে করেন, গণভোটের প্রশ্ন জনগণের ওপর আস্থা রাখার একটি সুযোগ।
গণভোটের বাস্তব চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণ কি গণভোটের জন্য প্রস্তুত? একটি দেশের গণভোট তখনই সার্থক হয় যখন জনগণ বিষয়টি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ও তথ্যসমৃদ্ধ থাকে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন রাষ্ট্রগঠনের যে প্রস্তাব নিয়ে এত আলোচনা- তা আদৌ কয়জন গভীরভাবে বুঝেছে? এই কাঠামো কীভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দেবে? এতে প্রশাসনের ওপর কী প্রভাব পড়বে? জনগণের ক্ষমতায়ন কি বাড়বে, নাকি এটি ক্ষমতাবৃত্তির আরেকটি স্তর তৈরি করবে?
গণমাধ্যমের ভূমিকাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রচলিত মিডিয়ার পাশাপাশি অনলাইন মিডিয়া, ইউটিউব চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন রাজনৈতিক বয়ান তৈরির মূল ক্ষেত্র। কিন্তু এখানেও এক ধরনের ‘বিভক্ত গণমাধ্যম বাস্তবতা’ দেখা যাচ্ছে। কেউ শক্তভাবে নির্বাচন-গণভোট একইদিনে করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছে, আবার কেউ এটিকে রাজনৈতিক কৌশল বলে আখ্যা দিচ্ছে। এই ভিন্নমুখী কাঠামো জনগণের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বেও প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে উপেক্ষা করা যায় না। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের নির্বাচন এখন আন্তর্জাতিক নজরদারির অন্যতম বিষয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ ও ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ প্রসঙ্গে। একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের ধরনও বদলে যাবে। অনেক প্রতিষ্ঠান হয়তো দুটি ইভেন্টেই পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারবে না। ফলে পর্যবেক্ষণের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
সব মিলিয়ে এখন স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক পর্যায়ে ঢুকেছে, যেখানে নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজন করা হবে কিনা- এ প্রশ্নটাই রাজনৈতিক রূপরেখা নির্ধারণ করবে। এই আয়োজন সফল হলে এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রে কাঠামোগত পরিবর্তনের ঐতিহাসিক সূচনা হতে পারে। বিশেষ করে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতা বিভাজন, আইনি সংস্কার- সবই এক নতুন রাজনৈতিক দিগন্তের সূচনা করবে। কিন্তু যদি আয়োজন ব্যর্থ হয়, গণনা ভুল হয়, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় বা রাজনৈতিক দলগুলো ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে- তাহলে তা দেশে নতুন অস্থিতিশীলতা, নতুন অসন্তোষ এবং নতুন ধরনের সংকটের জন্ম দিতে পারে। যা নিয়ন্ত্রণ করা নতুন সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে এখন লড়াই শুধু দলগত নয়Ñএটি আদর্শিক লড়াইয়েও রূপ রিয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোন পথে যাবে- এটি এখনো অনিশ্চিত। কিন্তু একটি বিষয়ে দেশ ইতোমধ্যে নিশ্চিত যে, বাংলাদেশের রাজনীতি আর আগের জায়গায় থাকবে না। নির্বাচন ও গণভোটের এই সিদ্ধান্তই হয়তো আগামী রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করবে অথবা নতুন অস্থিরতার দরজা খুলে দেবে।
লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিটি শিশু কিছু অধিকার ও দ্বায়িত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। জন্মের পর থেকেই সে অধিকারগুলো ভোগ করতে শুরু করলেও দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়। দায়িত্ব ও কর্তব্য শুরু হয় আরও কিছু দিন পর থেকে। যেমন জন্মের শুরু থেকেই শিশু আহার, নিদ্রা, চিকিৎসা, মায়ামমতা ও নিরাপত্তার অধিকার ভোগ করতে থাকে। কিন্তু দায়িত্ব ও কর্তব্য দেখা যায় আরও কিছু দিন পর থেকে। যেমন- একটি শিশুকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য বাবা মা তাকে স্কুলে পাঠাবেন এটা ঐ শিশুর অধিকার। কিন্তু ভালোভাবে লেখাপড়া করা ঐ শিশুর কর্তব্য। এমনি করে অধিকার ভোগের পাশাপাশি শিশুর কর্তব্য ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। যেমন নিয়মিত স্কুলে যাওয়া। পড়ার টেবিল গুছিয়ে রাখা। সময় মত পড়তে বসা। লেখাপড়ার সময় লেখা পড়া করা, খেলাধুলার সময় খেলাধুলা করা। বাবা মায়ের কথামত চলা। বড়দের সম্মান করা ইত্যাদি। আর একটু বড় হলেই তার উপর দায়িত্ব ভর করতে শুরু করে। যেমন-ছোট ভাই বোনদের প্রতি খেয়াল রাখা ও তাদের প্রতি যত্নবান হওয়া। ছোটদেরকে স্নেহ করা। বড়দের সম্মান করতে শেখানো, সংসারের কাজে বাবা মাকে সাহায্য করা ইত্যাদি।
জীবনের প্রতিটি ধাপে মানুষের দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। আগেই বলা হয়েছে শিক্ষা মানুষের অধিকার। কিন্তু যথাযথভাবে শিক্ষা লাভ করে সেই শিক্ষাকে নিজের ও দেশের কল্যাণে কাজে লাগানো তার দায়িত্ব। একজন মানুষ কর্মজীবনে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত দেশের সর্বশ্রেণিপেশার মানুষের কাছে ঋণী হতে থাকে। একজন নাগরিককে সুশিক্ষিত করে তুলতে সরকারকে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করতে হয়। আমাদের সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধার জন্য সরকার যে অর্থ ব্যয় করে সেই অর্থ দেশের প্রতিটি মানুষের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। কাজেই সহজেই অনুমান করা যায় যে, আমরা মানুষের কাছে কতভাবে ঋণী। কর্মজীবনে প্রবেশের পরও মানুষের কাছে ঋণী হওয়া বন্ধ হয় না। মানুষ চাকরি যে বেতন পায় তাতেও থাকে সর্ব শ্রেণিপেশার মানুষে ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের টাকা। অর্থাৎ মানুষ যত বড়লোকই হোক, যত বড় চাকুরেই হোক, যত বড় ব্যবসাই হোক, যে পেশারই হোক না কেন সর্বশ্রেণিপেশার অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক, কুলী, মজুর, রিকসাওয়ালা, ঝাড়ুদার, এমন কি একজন ভিক্ষুকের কাছেও সে ঋণী। এটাই আমাদের দায়। এই দায় থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি ভাবে এই ঋণী পরিশোধ করে নিজেকে দায়মুক্ত করব? প্রশ্নের যখন উদয় হয়েছে, উত্তরও অবশ্যই মিলবে। উত্তর হলো এই ঋণ পুরোপুরি পরিশাধ যোগ্য নয়। তবে প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে এই ঋণের ভার বেশ খানিকটা হালকা করতে পারি। যেমন-প্রতিটি পেশাজীবি মানুষের স্তর অনুযায়ী সমাজে অবস্থান থাকে।
প্রতিটি মানুষ যদি তার অবস্থান থেকে সঠিক ভাবে তার দায়িত্ব পালন করে তবেই সে দায় থেকে মুক্তি পেতে পারে। নিজেকে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ‘নৈতিক শিক্ষা’। কিন্তু নৈতিক শিক্ষা কিভাবে লাভ করা যায়? পরিবার হচ্ছে নৈতিক শিক্ষার আতুর ঘর। অর্থাৎ শৈশবে পরিবার থেকেই শুরু হয় মানুষের নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষা হচ্ছে সেই শিক্ষা যা মানুষকে উচিৎ-অনুচিৎ, ন্যায় অন্যায় বুঝতে শেখায়। মানুষকে শিষ্টাচারী, মানবতাবাদী হিসেবে গড়ে তোলে। মানুষের মধ্যে আত্মতৃপ্তি এবং আত্ম বিশ্বাস তৈরি করে। নৈতিক শিক্ষা মানুষকে ভালো কাজে উৎসাহ যোগায় এবং মন্দ কাজে নিরুৎসাহিত করে। তাই সমাজের সর্বস্তরে নৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে।
অ্যাড. আব্দুর রাজ্জাক খান রানা: সমাজ সেবক, আয়কর আইনজীবী।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের মাটিতে হঠাৎ কম্পনের অনুভূতি জনসাধারণের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। প্রথমে ছোটখাটো দমকা বা কম্পন মনে হলেও, পরপর কম্পনের ঘটনা মানুষকে নিশ্চিন্ত হতে দিচ্ছে না। ছোট-বড় সকল শ্রেণির মানুষ দোকানদার, অফিসকর্মী, শিক্ষার্থী, দিনমজুর একই প্রশ্ন নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন: ‘পরবর্তী ধাক্কা কি আরও বড়ো হতে পারে?’ এই অনিশ্চয়তা এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গেছে।
সাধারণ মানুষের আতঙ্কের পেছনে শুধু প্রকৃত ভূমিকম্পই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে প্রতিনিয়ত অ্যানিমেশন, ভিডিও, চিত্র এবং তথ্যচিত্র ছড়ানো হচ্ছে। অনেক সময় এগুলো আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে নাটকীয় রূপ পায়, যা জনমনে অতিরিক্ত ভয় সৃষ্টি করে। ভিডিওতে অগ্নিকাণ্ডের চিত্র, ভেঙে পড়া ভবন, মানুষের দৌঁড়াদৌঁড়ি সবই অতিমাত্রায় আতঙ্ক সৃষ্টিকারী। ফলে, সাধারণ মানুষ বাস্তব ও কল্পনার পার্থক্য করতে পারছেন না।
এটি শুধু মানসিক উদ্বেগই নয়, সামাজিক জীবনেও প্রভাব ফেলছে। দৈনন্দিন জীবনের রুটিন দোকান খোলা রাখা, স্কুল-কলেজে পড়াশোনা, অফিসে যাতায়াত সবকিছুই স্থবির হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানপাট খোলার বিষয়ে দ্বিধায় পড়েছেন, পরিবারগুলো রাতে ঘুমাতে পারছেন না, শিশুরা আতঙ্কিত। বিশেষ করে যেসব এলাকা পুরনো ভবন এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ, সেসব স্থানে আতঙ্ক আরও তীব্র। অনেকেই ইতোমধ্যেই নিজের বাড়ি বা অফিসে নিরাপদ স্থানের খোঁজ শুরু করেছেন।
বিগত কয়েক বছরের নগরায়ন অভ্যাসও এই আতঙ্কের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। নগরায়ন পরিকল্পিত না হওয়ায় আমাদের শহরে রাস্তা সংকীর্ণ, বহুতল ভবন অনিয়মিতভাবে নির্মিত এবং অনেক পুরাতন ভবন এখনো ব্যবহার হচ্ছে। একদিকে শহরের জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, অন্যদিকে নিরাপদ নির্মাণের মান কমছে। এই পরিবেশে ভূমিকম্পের প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই বেশি। শহরের আকাশচুম্বী ভবন, জনবহুল মার্কেট, রাস্তার সংকীর্ণতা এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করছে, যা সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ককে প্রজ্বলিত করছে।
সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও পরিস্থিতিকে জটিল করছে। দেশের রাজনৈতিক মাঠে উত্তাপ, ভোটের প্রস্তুতি এবং শীতের আগমন সবকিছু একসঙ্গে মানুষের মনকে উদ্বিগ্ন করছে। এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিরিক্ত আতঙ্ক ছড়ানো হলে সাধারণ মানুষের মানসিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয়। একে অযথা আতঙ্ক বলা যায় না, কারণ এটি বাস্তব জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, কিন্তু অতিরিক্ত তথ্য এবং নাটকীয় চিত্র জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
সরকারের করণীয় এখানে স্পষ্ট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিক ও দ্রুত তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছানো। বিভ্রান্তিকর বা অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণে আতঙ্ক আরও বাড়তে পারে। প্রতিটি জেলায় স্থানীয় প্রশাসনকে সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে হবে। নিরাপদ স্থানের তথ্য, ভূমিকম্প মোকাবিলার নিয়মাবলি, জরুরি সেবা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থানীয় ক্লাব ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় শুধু আতঙ্কই তৈরি করে না, বরং আমাদের প্রস্তুতির সক্ষমতাকেও পরীক্ষার মুখে ফেলে। এই প্রস্তুতিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ঘটনা ঘটার মুহূর্তে তারা তৎপরভাবে উদ্ধার, চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হলে সাধারণ মানুষ দ্রুত নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র পেশাদার সংস্থার উপর নির্ভর করলেই চলবে না।
এক্ষেত্রে স্কাউট, যুবসংগঠন এবং স্থানীয় কমিউনিটি দলের মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর প্রশিক্ষণ ও অংশগ্রহণও অত্যন্ত জরুরি। তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বয়স্ক মানুষ ও শিশুদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর দিকনির্দেশনা দিতে পারে। তাছাড়া, সাধারণ বাসিন্দাদেরও প্রাথমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক ভূমিকম্পের সময় কিভাবে আশ্রয় নেবেন, জরুরি সাপ্লাই সংরক্ষণ কোথায় থাকবে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে যোগাযোগের সঠিক পথ কী।
এই প্রস্তুতির কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে। প্রত্যেক জেলা ও উপজেলায় ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি নীতি প্রণয়ন, নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র চিহ্নিতকরণ, জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং স্থানীয় জনগণকে প্রশিক্ষিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি।
শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত জনসচেতনত সামজিক যোগাযো মধ্যম ভিডিও ও লিখিত তথ্যের মাধ্যমে শিক্ষামূলক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। এভাবে নাগরিকরা শুধু আতঙ্কিত হবে না, বরং বিপদের মুহূর্তে স্বশক্তিতে নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জন করবে।
ফলশ্রুতিতে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পেশাদার প্রস্তুতি, স্কাউট ও যুব সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী সহায়তা এবং সাধারণ বাসিন্দাদের সচেতনতা একসাথে মিলিত হলে, ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক বিপদকে যথাযথভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে এই সব ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
নাগরিকদেরও তাদের ভূমিকা বোঝা জরুরি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর বা আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কন্টেন্ট ছড়ানো বা সেয়ার থেকে বিরত থাকতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে সরকারি সূত্র এবং নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যম থেকে তথ্য গ্রহণ করা উচিত। পরিবার, প্রতিবেশী ও স্থানীয় কমিউনিটির সঙ্গে সক্রিয় সংযোগ রক্ষা করলে মানুষ মানসিকভাবে আরও প্রস্তুত হতে পারে।
এছাড়াও, বাস্তব জীবনের উদাহরণও আমাদের শেখায় যে সচেতনতা এবং প্রস্তুতি ভয়কে মোকাবিলার শক্তি বৃদ্ধি করে। জাপান, চিলি, তুরস্কের মতো দেশগুলোতে, যেখানে ভূমিকম্প স্বাভাবিক ঘটনা, জনগণ এবং প্রশাসন আগে থেকেই প্রস্তুত থাকে। সেখানে শিক্ষামূলক সিমুলেশন, জরুরি ব্যবস্থা এবং জনসচেতনতা কার্যক্রমের ফলে আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমাদের দেশেও একই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা সম্ভব। প্রতিটি শহর, উপজেলা ও গ্রামে এই ধরনের প্রস্তুতি নিলে মানুষের জীবন এবং মানসিক শান্তি দুইই রক্ষা করা সম্ভব।
বিভিন্ন গবেষণাও প্রমাণ করে, আতঙ্কিত মানুষ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, যা বিপদের সময় আরও ক্ষতি সৃষ্টি করে। তাই মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি। স্কুল-কলেজে ভূমিকম্প সচেতনতামূলক ক্লাস নেওয়া, অফিস ও কারখানায় জরুরি পরিকল্পনা তৈরি করা, পরিবারকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার শিক্ষাদান এগুলো সবই জনগণকে আতঙ্কমুক্ত রাখতে সহায়ক।
বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রভাবও এই আতঙ্কের সঙ্গে যুক্ত। ব্যবসায়ীরা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে দ্বিধায় পড়ছেন, শেয়ার বাজার বা অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। এমন অবস্থায় সরকারি পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতা জরুরি। শুধু আতঙ্ক দূর করা নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বোপরি, ভূমিকম্প যেমন একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, তেমনি আমাদের সচেতনতা ও প্রস্তুতি সেটিকে মোকাবেলার সক্ষমতা নির্ধারণ করে। আতঙ্ককে দূরে সরিয়ে সঠিক তথ্য, শিক্ষিত নাগরিক এবং কার্যকর প্রশাসন একত্রিত হলে আমরা নিরাপত্তা এবং মানসিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারি। সমাজ এবং সরকার একযোগে কাজ করলে আতঙ্ক কমানো সম্ভব, এবং জনগণ নিরাপদভাবে দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।
আজকের এই মুহূর্ত আমাদের জন্য একটি হুঁশিয়ারি: আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনভাবে এবং সুপরিকল্পিত প্রস্তুতির মাধ্যমে আমরা ভূমিকম্পের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এটি শুধু সরকারের কাজ নয় সাধারণ জনগণও সচেতনতা, দায়িত্বশীল আচরণ এবং সহমর্মিতার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে হবে। একমাত্র সঠিক তথ্য, প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি মিলিত হলে আতঙ্ককে আমরা সামলাতে পারব, জীবন রক্ষা করতে পারব এবং মানসিক শান্তি বজায় রাখতে পারব।
ভূমিকম্প একটি প্রকৃতির পরীক্ষা, এবং আমাদের প্রতিক্রিয়া এই পরীক্ষার প্রকৃত মান নির্ধারণ করে। আতঙ্ক নয়, প্রস্তুতি এটাই আমাদের একমাত্র নিরাপত্তা। আজকের জনগণ সচেতন হলে আগামী দিনের বাংলাদেশ আরও নিরাপদ, আরও স্থিতিশীল এবং আরও সুসংগঠিত হবে।
আ.ন.ম খলিলুর রহমান (ভিপি ইব্রাহীম): লেখক ও টকশো বিশ্লেষক।
সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দল
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্রের নানা সমীকরণ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে-এমন ঘোষণার পর অপশক্তিগুলো নির্বাচন বানচাল করতে চতুর্মুখী অপতৎপরতা শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী এবং পতিত আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা নাশকতা সৃষ্টিসহ পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মতো ক্ষেত্র তৈরির অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে ছদ্মবেশে থাকা পতিত আওয়ামী লীগের দোসররা সক্রিয় রয়েছে। এ অবস্থায় এসব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হলে সবার আগে দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এটি হলো অন্যতম পূর্বশর্ত। আর দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে এ মুহূর্তে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য নির্বাচন পর্যন্ত আগামী কয়েকটি মাস ভালোভাবে পার করতে সরকারের পাশে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের সব শক্তিকে শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে। সরকার নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়া জানতে আন্তরিক সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এই মুহূর্তে সৃষ্ট সংকট নিরসনে সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। নির্বাচন বানচাল করতে ইতোমধ্যেই একটি মহল এখন প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ শুরু করেছে। এটি হলো তাদের বড় শক্তি। এটা তাদের একধরনের ষড়যন্ত্রমূলক মিশন। এজন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তারা প্রতিনিয়ত গুজব ছড়াতে ব্যস্ত রয়েছে। ফলে সৃষ্ট সংকট ও বহুমুখী ষড়যন্ত্র কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে হলে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য গণঅভ্যুত্থানের সব শক্তিকে সত্যিকারার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ক্ষমতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে নিজেরা বিভেদে জড়িয়ে পড়লে বিপদ অনিবার্য।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান ঘিরে শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে দেড় বছর না পেরোতেই সেই ঐক্যে ফাটল ধরেছে। যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। অপরদিকে নির্বাচনের সময় নিয়ে কারও অপত্তি না থাকলেও কয়েকটি দল বিতর্কিত কিছু দাবি তুলছে। এমনকি কোনো কোনো নেতা তাদের দাবি পূরণ না হলে নির্বাচন হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন। এতে করে নির্বাচন নিয়ে জনমনে নানা সন্দেহ ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হচ্ছে। জটিল হয়ে উঠছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিষয়টি নিয়ে দুই ধরনের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। একটি হচ্ছে-এটি তাদের ‘রাজনৈতিক কৌশল’ হতে পারে। কারণ, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আসন ভাগাভাগি নিয়ে পর্দার আড়ালে হয়তো কিছু দেনদরবার করতে চাইছে ওই সব দল। দ্বিতীয়ত, হতে পারে যারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বেশি সুবিধা করতে পারবে না, তারা নির্বাচন ছাড়া ভিন্ন পথে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। এর ফলে প্রকারান্তরে লাভবান হচ্ছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। তাদের ষড়যন্ত্রের পথকে এভাবে মসৃণ করে দেওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনার দুঃশাসনের সময় তিনটি নির্বাচন হয়েছিল। সেসব নির্বাচনে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কাজেই নির্বাচনহীন অবস্থা থেকে মুক্তির সমাধান হচ্ছে-একটি সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও নির্ভরযোগ্য নির্বাচন। তাই ৫ আগস্টের পর দেশে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, আবারও সেই ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য সব দলের উচিত হবে নির্বাচনমুখী হওয়া এবং ঐক্যবদ্ধভাবে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেওয়া।
দেশ যাতে গণতান্ত্রিক অবস্থায় ফিরে আসতে না পারে, সেজন্য বিভিন্ন জায়গায় ষড়যন্ত্র চলছে। ষড়যন্ত্র চলছে আগামী জাতীয় নির্বাচন যাতে না হয়, সেজন্যও। সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা যাতে বাস্তবায়ন না হয়, ভন্ডুল হয়ে যায়-সেজন্য ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা। সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থেকে এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনও ভোটের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের বড় দল বিএনপি তাদের মিত্র দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে। আসন নিয়ে দর কষাকষি চলছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচন বর্জন করা আরও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। এই প্রক্রিয়াকে সাধুবাদ জানাতে হয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকা যায়-সে বিষয়ে এখন সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার কৃত অপরাধের বিচার শেষে কয়েকটি অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে তার ফাঁসির রায় হয়েছে। সেই রায়কে কেন্দ্র করে পতিত আওয়ামী লীগ এখন দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত করছে। এ ব্যাপারে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন থাকতে হবে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ করতে হলে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। ঐক্যের মধ্যে কোনো বিভাজন সৃষ্টি হলে তা দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। চব্বিশের ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানের পর জাতীয় ঐক্যমতের সরকার গঠনের যে সম্ভাবনা রয়েছে, সেটিকে কাজে লাগিয়ে জনগণের অধিকার ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথকে সুদৃঢ় করতে হবে। দেশের জনগণ এখন পরিবর্তন চায়। নতুন ধারার রাজনীতির চর্চা দেখতে চায়। নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ চায়। আজকের নতুন প্রজন্ম গণতন্ত্র ও সুশাসনের বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমাদের সবাইকে সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, যেন কেউ বিভেদ সৃষ্টি করে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পথে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। গত ১৬ বছরেরও বেশি সময় পছন্দের মানুষকে ভোট দিতে না পারার কারণে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর যারা ভোটার হয়েছেন তারা আজ পর্যন্ত ভোট দিতে পারেননি। নিজের পছন্দের ভিত্তিতে সরকার পরিবর্তনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই তাদের। এমন অবস্থায় আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশা ও আগ্রহ তৈরি করেছে, সেটি সাধারণ জরিপে আসবে না। কারণ, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অনেক সময় জরিপের বিশ্বাসযোগ্যতা নিম্নমানের। এটা মূলত একটি সামাজিক প্রত্যাশা তৈরি করেছে এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ ও জবাবদিহিমূলক শাসন তৈরির প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে নিরাপত্তা জোরদার, কালো টাকার প্রভাব রোধকল্পে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য বদ্ধপরিকর। তবে এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং আন্তরিক সহযোগিতা অপরিহার্য। নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন ও পরে এই তিনটি পর্যায়েই রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা লাগবে। সবার লক্ষ্য একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। এজন্য কালো টাকার প্রভাব, পেশিশক্তির ব্যবহার, ধর্মের অপব্যবহার এবং প্রশাসনিক কারসাজি বন্ধ করা জরুরি। ভোটগ্রহণ যাতে আরও নিরপেক্ষ হয়, সেজন্য একই উপজেলার শিক্ষকদের নিজ উপজেলায় দায়িত্ব না দিয়ে অন্য উপজেলায় দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এতে নির্বাচন আরও সুষ্ঠু ও ন্যায্য হবে বলে আমরা মনে করি। এই নির্বাচন কমিশনের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না করে নতুন ইতিহাস তৈরি করতে হবে তাদের। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, নির্বাচন কমিশনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা। একে পুনরুদ্ধার করার জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। আমরা চাই,রাজনৈতিক অনৈক্য এবং বিভেদ দূর হোক। সাধারণ মানুষের চাওয়া হচ্ছে সর্বজনগ্রাহ্য, শান্তিপূর্ণ, সুসংগঠিত নির্বাচন। আমরা বিশ্বাস করি, আসন্ন নির্বাচন হবে ঐতিহাসিক এবং দৃষ্টান্তমূলক- যেখানে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের নয়, সাধারণ জনগণের স্বপ্ন পূরণ হবে। জাতীয় নিরাপত্তা কেবল সামরিক সক্ষমতার বিষয় নয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজনীতির বিকাশ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ। জনগণের ক্ষমতায়ন ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে পারলে জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এর মানে এই নয় যে সবার মধ্যে ঐক্য নেই। জাতীয় স্বার্থে সবাই আমরা ঐক্যবদ্ধ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে দ্রুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া জরুরি। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে পারলেই জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। ১৫-২০ বছর ধরে যে যুদ্ধ চলছে, তা বাংলাদেশের মানুষের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। এ মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার পথ একটাই—জনগণের হাতে ব্যালট পেপার তুলে দেওয়া, যাতে তারা স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন। ঐক্যের একমাত্র পথ হচ্ছে গণতন্ত্র। এটি নিশ্চিত হলে ঐক্য নিশ্চিত হবে। এ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি ‘ন্যাশনাল আর্মি’ গঠন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এর উদাহারণ চীনে আছে, সুইজারল্যান্ডে আছে, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তারা দায়িত্বে থাকেন এবং তারা সেনাবাহিনীর ট্রেনিং করে। সবার মধ্যে দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার করে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে। ইতোমধ্যেই আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠা হয়েছে। তবে তা কার্যকর হবে চতুর্দশ জাতীয় নির্বাচনের সময়। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন যেনতেন একটি নির্বাচন যেন হয়ে না ওঠে সেদিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু জাতীয় সংহতি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে সবাইকে।
রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হলেও, ঢাকার রাজধানী গুলশান, সেটা সবাই স্বীকার করে।
কারণ গুলশানে এখন বড় বড় সব জায়ান্ট কর্পোরেট হাউজগুলোর হেড অফিস। যেমন, বহুজাতিক টেলিকম কোম্পানি রবি, এয়ারটেল, বাংলালিংক, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো সহ
সবগুলো ব্যাংকের স্থায়ী প্রধান কার্যালয় এখানে অবস্থিত। তাছাড়া রয়েছে অনেকগুলো বিলাস বহুল পাঁচ তারকা হোটেল ও ৫০ টির বেশি গেস্ট হাউস।
গুলশান - বারিধারা আবাসিক এলাকায় পৃথিবীর প্রায় ৬০ টির ও বেশি দেশের দূতাবাস রয়েছে।
গুলশানে বাংলাদেশের সবচেয়ে এলিট শ্রেণীর লোক বাস করে।
গুলশানে এখন ক্লাব ও বারের ব্যবসা খুবই জমজমাট। রাত হলেই জমে ওঠে ক্লাবগুলো।
যেখানে বিলাস বহুল গাড়িগুলো ক্লাবের আঙ্গিনা পেরিয়ে বাইরের রাস্তাগুলিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
এখন আসি "গুলশান সাউথ ক্লাব " কেন একটি সেরা ক্লাব হবে।
গুলশান সাউথ এরিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্পোরেট হাউস এবং ব্যাংক গুলোর স্থায়ী প্রধান কার্যালয় অবস্থিত।
বর্তমানে সিটি ব্যাংক, শাহজাহান ইসলামী ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক , এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক , যমুনা ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক,উরি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এন,এ, ইউসিবি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এইচ এস বি সি, ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক,পদ্মা ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক সহ প্রায় ২০টির ও বেশি ব্যাংকের স্থায়ী হেড অফিস গুলশান সাউথে অবস্থিত।
এছাড়া রবি ও বাংলালিংক এর প্রধান কার্যালয় গুলশান সাউথেই অবস্থিত। কর্পোরেট হাউজ গুলির মধ্যে ডিবিএল গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, রানার গ্রুপ, ইফাদ গ্রুপ, সুপারস্টার গ্রুপ, এনার্জিপ্যাক গ্রুপ,
ইস্ট কোস্ট গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এসিআই গ্রুপ, আকিজগ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ সহ কমপক্ষে পঞ্চাশটির বেশি কর্পোরেট হাউস গুলশান সাউথে অবস্থিত। তাছাড়াও ফ্যাশন হাউস গুলোর মধ্য রয়েছে, ভাসাবি
জারা, প্রেমস কালেকশন,
জুয়েলারি হাউজ গুলোর মধ্য ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, আপন জুয়েলার্স, নিউ জড়ুয়া গুলশান সাউথে অবস্থিত । গুলশান সাউথই রয়েছে সুইচ টেল ও হায়াত রিজেন্সি নামে বিলাস বহুল ২টি পাঁচ তারকা হোটেল। শপিং মল গুলির মধ্য রয়েছে, গুলশান সার্কেল - ১, এ নির্মিত হচ্ছে ৩৫ তলা ডি,এন,সি,সি শপিং মল, রয়েছে নাভানা সেন্টার শপিং মল ও পুলিশ প্লাজা কনকর্ড।
সাউথে রয়েছে, দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল ও ডাঃ ফজলে রাব্বি সাউথ পার্ক।
বাংলাদেশের সাংহাই ও নিউইয়র্ক হিসেবে খ্যাত গুলশান - তেজগাঁও লিং রোডে বর্তমানে ৪১ তলা
কমার্শিয়াল স্পেস নির্মাণ করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে ১০০ তলা পর্যন্ত সু উচ্চ ভবন নির্মাণ করা হবে।
গুলশান সাউথতেই রয়েছে, চোখ ধাঁধানো লাক্সারি সব গাড়ির শোরুম যেখানে সাজানো রয়েছে
BMW, RANS ROVER এবং AUDI মতো নিত্য নতুন সব মডেলের গাড়িগুলো, যা প্রমাণ করে দেয় যে, গুলশান সাউথ এরিয়া বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে
দামি এরিয়া হতে চলেছে।
সুতরাং "গুলশান সাউথ ক্লাব " নিঃসন্দেহে হতে চলছে বাংলাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ ক্লাব।
এবং আমরা বিশ্বাস করি ২০৩০ সালের দিকে "গুলশান সাউথ ক্লাবের মেম্বারগন একসময় গর্ব করে বলবেন, ভাগ্যিস সাউথ ক্লাবের মেম্বারশিপ নিয়েছিলাম,
না হলে তো এখন এক কোটি টাকা
লাগতো।
লেখক: মোহাম্মদ খুরশিদ আলম; ফাউন্ডার ও সাধারণ সম্পাদক; গুলশান সাউথ ক্লাব লিমিটেড
একবিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অবকাঠামো (ICT Infrastructure) এখন একটি দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। ডিজিটাল রূপান্তরে বাংলাদেশ যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে, তা বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে প্রশংসিত হলেও বিদেশী ক্লাউড পরিষেবা, ডেটা স্টোরেজ ও আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ের ওপর কৌশলগত নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে দেশের ডেটা সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। বিশেষ করে ক্লাউড অ্যাক্টের মতো আন্তর্জাতিক আইন বিদেশে সংরক্ষিত ডেটাকে বিদেশী বিচারিক কর্তৃপক্ষের আওতায় এনে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ তৈরি করতে পারে।
এ প্রেক্ষাপটে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ডেটা—যেমন ব্যাংকিং লেনদেন, নাগরিক তথ্য, সরকারি গোপন নথি, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য এবং স্বাস্থ্যসেবার সংবেদনশীল ডেটা—দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেই সুরক্ষিত রাখা এখন আর কেবল প্রযুক্তিগত চাহিদা নয়; এটি একটি জাতীয় নিরাপত্তা অগ্রাধিকার। এজন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী ও স্বনির্ভর ডেটা কৌশল বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ক্লাউড অবকাঠামো শক্তিশালী করতে নীতিগত ও কাঠামোগত বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ‘ক্লাউড কম্পিউটিং নীতিমালা ২০২৩’ প্রণয়ন এবং সরকারি ডেটা দেশীয় ক্লাউডে সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ ভবিষ্যৎ ডেটা সুরক্ষার ভিত্তি তৈরি করেছে। এছাড়া টিআইআর-৪ মানের ডেটা সেন্টার নির্মাণ এবং BDCCL–ওরাকল সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত ‘সার্বভৌম ক্লাউড’ (Sovereign Cloud) দেশের ডেটা যাতে দেশের বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিশেষত ফিনটেক, ব্যাংকিং, স্বাস্থ্যসেবা ও ই-গভর্ন্যান্সের মতো সংবেদনশীল খাতে এই অবকাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ডেটা গোপনীয়তা এবং নিয়ন্ত্রক সম্মতি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়।
ডেটা স্টোরেজ ও ক্লাউড সক্ষমতায় স্বনির্ভর হয়ে উঠলে অর্থনৈতিকভাবেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে লাভবান হবে। বিদেশী ক্লাউড পরিষেবায় বাংলাদেশ প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে, যদি স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় তাহলে দেশের অভ্যন্তরেই প্রযুক্তি শিল্প আরও সম্প্রসারিত হবে। পাশাপাশি স্থানীয় উদ্ভাবক, স্টার্টআপ এবং গবেষকদের জন্যও এর নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে।
বাংলাদেশের স্মার্ট নেশন গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) হবে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। AI ও মেশিন লার্নিং মডেল প্রশিক্ষণে উচ্চ-পারফরম্যান্স কম্পিউটিং (HPC) অপরিহার্য, যা বিদেশী ক্লাউডে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। সার্বভৌম ক্লাউডের মাধ্যমে দেশের গবেষক, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, কৃষি প্রযুক্তিবিদ ও উদ্ভাবকরা নিজের দেশের মাটিতেই নিরাপদ, দ্রুততর এবং সাশ্রয়ী HPC সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন। এর ফলে স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ ও জলবায়ু অভিযোজনের মতো খাতে স্থানীয় ডেটা ব্যবহার করে বিশেষায়িত AI ড্রিভেন সমাধান তৈরি করা আরও সহজ হবে।
একইভাবে আন্তর্জাতিক সংযোগে নির্ভরতা কমানোও প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বাংলাদেশ বর্তমানে সাবমেরিন কেবল এবং সীমিত স্থলপথের আন্তর্জাতিক গেটওয়ের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরতা দূর করতে তৃতীয় ও চতুর্থ সাবমেরিন কেবল সংযোগের কাজ চলছে, যা দেশের নেটওয়ার্ক রিডান্ডেন্সি ও স্থিতিস্থাপকতা বাড়াবে। পাশাপাশি ITC সংযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশের সাথে স্থলভিত্তিক ইন্টারনেট রুট আরও শক্তিশালী হচ্ছে, যা জাতীয় নেটওয়ার্ককে আরও নিরাপদ, দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য করবে।
বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত অগ্রযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবার সংযুক্তি। দূরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল, উপকূলীয় চরাঞ্চল, নদীবিধৌত বিচ্ছিন্ন গ্রাম—যেসব স্থানে প্রচলিত ব্রডব্যান্ড বা মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছায় না বা স্থিতিশীল থাকে না, সেখানে স্টারলিংক উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। স্যাটেলাইটভিত্তিক এই সংযোগ দেশের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিকে আরও গতিশীল করবে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি প্রযুক্তি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সরকারি সেবার মতো ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক ব্যবধান কমিয়ে নিয়ে আসবে। বিশেষ করে গ্রামীণ উদ্যোক্তা, টেলিমেডিসিন, অনলাইন লার্নিং ও রিমোট মনিটরিং সেবাগুলো স্টারলিংকের স্থিতিশীল ও দ্রুত গতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত হবে।
তাই আমি মনেকরি এই মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য খুবই স্পষ্ট—ডেটাকে দেশের ভেতরেই নিরাপদ রাখা, প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জন করা এবং ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা। তবে অবকাঠামো নির্মাণই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা, ক্লাউড আর্কিটেকচার ও ডেটা সায়েন্সে বিশেষজ্ঞ তৈরি করা এবং দেশীয় উদ্ভাবকদের আরও উৎসাহিত করা। এই ভিত্তি আরও মজবুত করতে পারলে ‘দেশের ডেটা দেশে থাকুক’—এই নীতির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ স্মার্ট জাতির ভিশন বাস্তবায়নে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে এবং একই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি খাতে স্থায়ী অগ্রগতি অর্জন করবে।
সাকিফ শামীম, অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, ল্যাবএইড গ্রুপ
বাংলার বার ভূঁইয়াদের প্রধান মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁ ছিলেন বাংলার বার ভূঁইয়াদর প্রধান। তিনি তার দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেছিলেন কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি। কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে ৬.৫ কিলোমিটার পূর্বে করিমগঞ্জ উপজেলাধীন কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নে নরসুন্দা নদীর তীরে ইতিহাসখ্যাত জঙ্গবাড়ির অবস্থান।
একাদশ শতাব্দীতে জোঙ্গাল বলাহুর নামক একজন রাজা স্বাধীন ভাটিরাজ্য কায়েম করে এর রাজধানী জঙ্গলবাড়িতে স্থাপন করেছিলেন বলে জানা যায়। ঈশা খাঁ জঙ্গলবাড়ি দুর্গ দখলের পূর্বে সেখানে কুচ রাজাগণ শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। ঈশা খাঁ সোনারগাঁওয়ের সিংহাসনে আরহনের পরে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে জঙ্গবাড়ি দুর্গ যুদ্ধ করে নিজ অধিকারে নেন। তখন তিনি এর সংস্কার সাধন এবং নিরাপত্তার জন্য তিনদিকে পরিখা খনন করেন। পরবর্তীতে ১৫৮৬ সালে জঙ্গবাড়িতে স্থাপন করেন ভাটিরাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী।
ঈশা খাঁ’র হাজারো স্মৃতি বিজড়িত আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এবং ইতিহাসখ্যাত জঙ্গলবাড়ির স্থাপনাসমূহ। এসব দেখতে ও বীরত্বগাথার কথা জানতে এখনো প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে বহু দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে। কিন্তু, তাদের ফিরে যেতে হয়ে অনেকটা হতাশ হয়ে। কারণ এখানকার ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নগুলো চরম অযত্ন ও অবহেলায় আজ প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অন্যদিকে ঈশা খাঁর বীরত্বগাথা এবং এখনো অবশিষ্ট থাকা নিদর্শনগুলো জানতে ও দেখতে আসা দর্শনার্থীগনের সাথে কথা বলার জন্যও এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ নেই।
বর্তমানে দরজা ও জানালা বিহীন ঈশা খাঁর দরবার হল, অন্দরমহল এবং দুর্গপ্রাচীরসহ কোনভাবে টিকে থাকা অন্যান্য স্থাপনগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে। প্রাচীন মসজিদ এবং পরিখা আজও পুরনো দিনের গৌরবময় দিনগুলোর কথা মানুষজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বেশ কিছুদিন পূর্বে যাওয়া হয়েছিল ঈশা খাঁর হাজারো স্মৃতি বিজড়িত জঙ্গলবাড়ি কেমন আছে তা দেখার জন্য। আমাদের কৈশোরে জঙ্গলবাড়িকে বহুবার দেখেছি। কিন্তু পূর্বেকার চেয়ে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন বা ভালো অবস্থা দেখতে পাইনি। যেমনটি দেখেছি তাতে বলা যায়, মোটেও ভালো নেই জঙ্গলবাড়ি। ঐতিহাসিক নিদর্শন দরবার হলের অভ্যন্তরে ‘ঈশা খাঁ স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার’ লেখা একটি সাইনবোর্ড দেখা গেছে। তার পাশেই রয়েছে পাথরে খোদাই করা স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাগণের নাম ও পদবী সম্বলিত একটি স্মৃতিফলক। কিন্তু জাদুঘর ও পাঠাগারে নেই কোন বই-পুস্তক, চেয়ার টেবিল এবং স্মৃতির কোন নিদর্শন। সর্বত্রই যেন আনাদর আর দারুন অবহেলার ছাপ সুস্পষ্ট। কিছু সময় অবস্থান করে মনে হলো প্রতিনিয়ত যেন জঙ্গলবাড়ি কাঁদছে। এখাকার অতি মূল্যবান স্মৃতিচিহ্নগুলো কাঁদছে। আগন্তুকদের করুণ সুরে কানে কানে বলছে; আমি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, আমি নিশ্চিহ্ন হতে চলেছি! তোমাদের শক্ত হাত দিয়ে আমাকে ধরো, আমাকে বাঁচাও। আমি তোমাদের মাঝে স্বগৌরবে বেঁচে থাকতে চাই।
জঙ্গলবাড়ি অবস্থানকালে সৌভাগ্যক্রমে সাক্ষাৎ হয় ঈশা খাঁর ১৫তম বংশধর দেওয়ান জামাল দাদ খাঁ’র সাথে। তিনি নিজ হাতে আমাদেরকে ঈশা খাঁ’র বংশ পরিচিতি দেখান। দেওয়ান ঈশা খাঁ এবং মোঘল সম্রাট আকবরের দরবারের ছবি তাদেরই সংগ্রহ থেকে নেয়া। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, ঈশা খাঁর স্মৃতি বহনকারী অন্দরমহলে চল্লিশটি কক্ষ ছিল। ধ্বংসের পরে এখন আছে মাত্র চারটি। এগুলো কোনভাবে সংস্কার করে এখন সেখানে তাদের পরিবার বসবাস করছেন। তিনি জানান যে, সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সম্প্রতি ঈশা খাঁ’র স্মৃতি রক্ষার্থে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। উক্ত প্রকল্পের আওতায় এখানে জাদুঘর, ডাক বাংলো, পুকুর ঘাট তৈরি এবং জরাজীর্ণ স্থাপনাসমূহের সংস্কার কাজ শিগগিরই শুরু হবে সেসময় তিনি জানিয়েছিলেন।
ঈশা খাঁর বীরত্বেগাথা ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অংশ জঙ্গলবাড়ি। এই ইতিহাস আমাদের আজকের ও আগামী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াও আমাদেরই দায়িত্ব। তাছাড়া দেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও ইতিহাসখ্যাত জঙ্গবাড়িতে ঈশা খাঁর স্মৃতি বহনকারী স্থাপনাগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় করে তোলা একান্ত প্রয়োজন। তাই ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী জঙ্গলবাড়ির প্রতিটি স্থাপনার প্রয়োজনীয় সংস্কার ও প্রয়োজনে নতুন স্থাপনা তৈরির কাজ সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা দ্রুত বাস্তবায়িত করবেন এটাই একান্ত চাওয়া।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো স্থিতিশীলতা ও স্থায়ী গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর দাঁড়াতে পারেনি। দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে অস্থিরতা যেন এক অনিবার্য শব্দ- যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন, দলীয় দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার পালাবদল, প্রশাসনিক অদক্ষতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি এবং অসহিষ্ণুতা, এসবই বারবার জাতিকে পিছিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যেই জনগণ প্রত্যাশা করেছে এমন একটি নেতৃত্ব, যা ক্ষমতার প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠে দেশকে একটি সুসংগঠিত ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করবে। সেই প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে তারেক রহমান নামটি আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে ক্রমশ সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক যাত্রা কেবল একটি পরিবারের উত্তরাধিকার নয়; এটি সময়, অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং জাতীয় সংকট উপলব্ধির মাধ্যমে গড়ে ওঠা নেতৃত্বের প্রকৃত রূপ। তিনি জন্মসূত্রে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেছেন নিজস্ব বিশ্লেষণ, মনন ও নেতৃত্বগুণের ওপর। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নীতি এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব তাকে রাজনৈতিকভাবে সম্যক ধারণা দিয়েছে ঠিকই; কিন্তু সময়ের বাস্তবতা তাকে বাধ্য করেছে নিজের রাজনৈতিক চিন্তার স্বাতন্ত্র্য তৈরি করতে। সেই স্বাতন্ত্র্য আজ তাকে দেশের প্রেক্ষাপটে এক ভিন্ন চরিত্রে দাঁড় করিয়েছে যেখানে রাজনীতি কেবল ভোটের সমীকরণ নয়, বরং রাষ্ট্রের কাঠামো পুনর্গঠনের দায়িত্ব।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বহুবার রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এমন এক পরিস্থিতিতে তারেক রহমান যে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন, তা হলো সংলাপ ও সহিষ্ণুতার রাজনীতি। তার দৃষ্টিতে রাষ্ট্র পরিচালনা কোনো একক দলের কর্তৃত্ব নয়; বরং এটি একটি সম্মিলিত দায়িত্ব যেখানে বিভিন্ন মত, স্বার্থ এবং সামাজিক স্তরের মানুষ একসাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন, কারণ দেশে রাজনৈতিক মতপার্থক্য মানেই বিরোধ, আর বিরোধ মানেই সংঘাত। তারেক রহমান এই দীর্ঘস্থায়ী ধারা থেকে বের হয়ে সমঝোতা, পারস্পরিক সম্মান এবং ধীরস্থির রাজনৈতিক আলাপচারিতাকে সামনে এনেছেন।
বিএনপি তার নেতৃত্বে কেবল দলীয় শক্তি হিসেবে নয়, বরং একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে। দলকে তিনি সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠন করেছেন, যেখানে তৃণমূলের কর্মীদের মতামত গুরুত্ব পেয়েছে, দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও গণতান্ত্রিক হয়েছে এবং রাজনৈতিক কৌশল আরও সুসংহত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বিএনপিকে দীর্ঘমেয়াদে একটি সুসংগঠিত ও স্বচ্ছ দলীয় কাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করবে, যা দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তারেক রহমানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি হলো যুবসমাজকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আনা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ, এবং তাদের রাজনৈতিক উদ্বেগ, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর চিন্তা এবং স্বপ্নগুলোকে জাতীয় উন্নয়নের সাথে যুক্ত না করলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সংকটে পড়বে এই সত্য তিনি ভালোভাবেই উপলব্ধি করেন। তাই তিনি এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে আগ্রহী, যেখানে তরুণরা কেবল নির্বাচনী প্রচারণার অংশ নয়, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণেও ভূমিকা রাখবে। এই অংশগ্রহণধর্মী রাজনীতি ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্বকে যে পরিপক্বতা দেবে, তা স্পষ্টভাবেই অনুমেয়।
দেশের রাজনৈতিক সংকটের গভীরে রয়েছে দুর্নীতি, যা একটি কাঠামোগত, দীর্ঘস্থায়ী ও প্রশাসনিকভাবে প্রোথিত সমস্যা। তারেক রহমান বারবার বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেবল আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব নয়; বরং রাজনৈতিক সততা, সুশাসন এবং স্বচ্ছতার প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা না হলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যায় এটি আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বিএনপির অভ্যন্তরেও তিনি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপিত হয়। এই উদ্যোগগুলো তাকে রাজনৈতিকভাবে দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ইতিহাস প্রমাণ করে, অস্থিরতা অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, বিদেশি বিনিয়োগ কমায়, শিক্ষা–স্বাস্থ্য–উন্নয়ন প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জনগণের আস্থা কমে যায়। তারেক রহমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার এই আন্তঃসম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, উন্নয়ন কোনো দলের একক অর্জন নয়; এটি একটি রাষ্ট্রীয় প্রকল্প যা সকল বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে পরিচালিত হতে হবে। সেই কারণে তিনি অর্থনীতি পুনর্গঠনের পরিকল্পনায় জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
তার অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে—
এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে যে তিনি কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্বই নন; বরং রাষ্ট্র পরিচালনার আধুনিক কাঠামো ও বৈশ্বিক অর্থনীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন।
তারেক রহমানের নেতৃত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সমাজে সংহতি ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক বিভাজন, সামাজিক বৈষম্য এবং মতভেদকে তিনি উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে দেখেন। তার মতে, শক্তিশালী সমাজব্যবস্থা তখনই গড়ে ওঠে যখন বিভিন্ন মত, চিন্তা এবং সামাজিক শ্রেণির মানুষ একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে নিজেদের নিরাপদ ও স্বীকৃত মনে করে। তাই তিনি সামাজিক সংলাপ, সাংস্কৃতিক সমন্বয় এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমান যে রাজনৈতিক পথ দেখাচ্ছেন, তা কেবল কোনো দলকে ক্ষমতায় নেওয়ার কৌশল নয়; বরং দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণের একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। তার রাজনৈতিক দর্শনে রয়েছে দৃঢ়তা, বাস্তবতা, সমঝোতা ও আধুনিক রাষ্ট্র-চিন্তার সমন্বয়। সে কারণে তার নেতৃত্বকে অনেকেই ‘ভবিষ্যতের রাজনীতি’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ এমন একটি সময় অতিক্রম করছে, যখন জনগণ চায় একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ। তারা চায় এমন এক নেতৃত্ব, যা ক্ষমতার অহমিকায় নয়, বরং জনগণের স্বার্থে কাজ করবে; সংঘাত নয়, বরং সংলাপকে এগিয়ে নেবে; দল নয়, বরং রাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দেবে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে সেই আশার আলো বহু মানুষের মনে জাগ্রত হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন পরিবর্তন সম্ভব, তবে তার জন্য প্রয়োজন জনগণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, আধুনিক রাষ্ট্র-চিন্তা এবং রাজনৈতিক সাহস।
তারেক রহমান আজ আর শুধু বিএনপির নেতা নন; তিনি এমন এক নেতৃত্বের প্রতীক, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ধারণা সঞ্চার করেছে—ন্যায়, গণতন্ত্র, সমতা ও উন্নয়নের ধারণা। এই ধারণার ভিত্তিতে আগামী দিনের বাংলাদেশ আরও সংহত, সুশাসিত এবং সমৃদ্ধ হতে পারে এই শঙ্কাহীন আস্থা অনেকেই রাখেন।
সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তারেক রহমান এমন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছেন যা সম্ভাবনায় ভরপুর। তিনি জাতিকে একটি আধুনিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন যেখানে ব্যক্তি বা দল নয়, বরং দেশ ও জনগণ প্রথম। রাজনৈতিক অস্থিরতার বহু দশক পর এ ধরনের নেতৃত্ব নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক বার্তা।
তারেক রহমানের নেতৃত্বের মধ্যে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে গড়ে তোলার মানসিকতা স্পষ্ট। তার রাজনৈতিক দর্শন বলে গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন নয়, বরং মানুষের অধিকার, ন্যায়বিচার, উন্নয়ন ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি। এ কারণেই তিনি আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্ভাবনার অম্লান প্রতীক।
লেখক: ডা. এ কে এম মাজহারুল ইসলাম খান কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
ইতিহাসে বহু প্রমাণ রয়েছে, স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষ বিশ্বের অন্যতম প্রশিক্ষিত; কিন্তু বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ জনতার শক্তি আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল উপজীব্য ছিল সমাজ থেকে সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে একটি মানবিক এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
আর এ জন্য সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। বিগত সরকারের আমলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে যে তিনটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আগের সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর বিভাজনকে পুঁজি করে পুরো জাতিকে অনৈক্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। জাতি ছিল দ্বিধাবিভক্ত।
এই বিভক্তির সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বিগত সাড়ে ১৫ বছর (২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত) জনগণের ওপর নির্মম নির্যাতন ও স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেছিল। দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যাপক মাত্রায় দলীয়করণ ও আত্মীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। কিন্তু একসময় দেশের মানুষ আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে।
কথায় বলে, ‘united we stand, divided we fall’, একটি জাতি যদি তাদের বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকে, তাহলে কোনো জাগতিক শক্তি তাদের পরাজিত করতে পারে না। কিন্তু বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে ফাটল দেখা দিলে একটি সম্ভাবনাময় জাতিও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তাই আমাদের সর্বাবস্থায় জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ এবং অটল থাকতে হবে। বিশেষ করে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কোনো কারণে আমরা যদি জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে না পারি, ক্ষুদ্র স্বার্থে পরস্পর বিচ্ছিন্ন বা বিভক্ত হয়ে পড়ি, তাহলে পরাজিত শক্তি সেই সুযোগে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কাজেই এই মুহূর্তে আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
প্রাচীনকালে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উর্বর জনপদ। বিদেশি বণিক ও ব্যবসায়ীরা এখানে এসে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থবিত্ত অর্জন করতেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসি পরিব্রাজক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য এবং সম্পদের প্রাচুর্য দেখে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে তিনি মন্তব্য করেন, ‘there are hundred gates open to enter bengal, but there is not a single gate to come out of it.’ ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার কোনো সাধারণ পর্যটক ছিলেন না, তাকে বলা হয় দার্শনিক পর্যটক। তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তৎকালীন ভারতীয় সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে অবলোকন করে সত্যনির্ভর তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। বাংলাদেশ বারবার বিদেশি শক্তির পদানত হয়েছে মূলত অনৈক্যের কারণে।
ইংরেজরা বাংলার মানুষের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল। তাই তারা সব সময়ই চেষ্টা করেছে এ দেশের মানুষ যেন একতাবদ্ধ হতে না পারে। তারা জাতিতে জাতিতে, অঞ্চলে অঞ্চলে এবং ধর্মে ধর্মে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করে। ইংরেজদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘divide and rule’, অর্থাৎ ‘ভাগ করও এবং শাসন করও।’ যত দিন তারা এই নীতির সফল বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে, তত দিন ইংরেজদের বাংলাসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চল শাসন করার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয়নি। ইংরেজরা মনে করত, বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত দূরদর্শী এবং রাজনীতিসচেতন। ‘what bengal thinks today, india thinks tomorrow’ গোখলের এই মহান চিন্তাকে মনে রেখে ইংরেজরা বাংলাকে ভাগ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলা ভাগের অন্যতম উদ্দেশ্য এই অঞ্চলের মানুষ যাতে একতাবদ্ধ হতে না পারে, তা নিশ্চিত করা।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। প্রথমেই আমাদের মাতৃভাষার ওপর আঘাত হানা হয়। বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সেদিন বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল। একুশ আমাদের শিখিয়েছে ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে কোনো কিছুই অর্জন করা অসম্ভব নয়। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে এক রক্তপাতহীন সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে অবৈধভাবে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেন। দেশের মানুষ দল-মত-নির্বিশেষে ঐকমত্যে উপনীত হতে পেরেছিল বলেই ১৯৯০ সালে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন।
জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য বিভিন্ন সময় নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো ম্যাকিয়াভেলির কৌশল। ম্যাকিয়াভেলি তার ‘The Prince’ গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘the prince should be as mighty as a lion and as clever as a fox.’ অর্থাৎ একজন শাসককে হতে হবে সিংহের মতো শক্তিশালী এবং শৃগালের মতো ধূর্ত। তাকে ক্ষমতায় যেতে হবে এবং যেকোনো মূল্যে তা ধরে রাখতে হবে। তার কাছে নীতি-নৈতিকতা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তাকে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে। এ জন্য যেকোনো পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। তাই তার মতে, end will justify the means; অর্থাৎ চূড়ান্ত পরিণতিই গৃহীত পদক্ষেপের যৌক্তিকতা নির্ধারণ করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ম্যাকিয়াভেলির তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ লক্ষ করা গেছে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ম্যাকিয়াভেলির দীক্ষা গ্রহণ করেন। তবে ইতিহাসের সেই বহু কথিত আপ্তবাক্য: ‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।’ ইতিহাসের শিক্ষা কেন ক্ষমতার কষ্টকল্পিত প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না, সে এক আশ্চর্য রহস্যময় জিজ্ঞাসা, যার উত্তর কোনো দিন কোনোকালেই কোনো স্বৈরাচার দিতে পারেনি। তবে নিষ্ঠুরভাবে ভোগ করেছে ইতিহাসের অমোঘ পরিণতি।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের আদেশ খারিজ করে দিলেও এখনো আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়নি। তাই জরুরি ভিত্তিতে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব উপদেষ্টার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা প্রশাসনিক অদক্ষতার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তাদের অব্যাহতি দেওয়া বাঞ্ছনীয়। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি ছোট আকারের নির্বাচনকালীন সরকার গঠনপূর্বক আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে সমঝোতায় উপনীত হতে পারলে ভবিষ্যতে কোনো মহল থেকেই প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি মাস। এই মাসেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় প্রকাশ শুরু হবে এবং নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার জন্য পরাজিত স্বৈরাচারের দোসররা তৎপর রয়েছে। তারা বিভিন্ন বাসে অগ্নিকাণ্ড ঘটাচ্ছে, বোমাবাজি করছে। কাজেই তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো দৃঢ় ঐক্য প্রদর্শন করতে পারলে কোনো ষড়যন্ত্রই হালে পানি পাবে না। বিগত সরকারের আমলে যারা নানা ধরনের অনৈতিক সুবিধা ভোগ করেছে, তারা আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষায় আছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখতে না পারে, তাহলে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে। সেই সুযোগে পরাজিত শত্রুরা ছোবল মারতে পারে। যেকোনো মূল্যেই হোক, ভবিষ্যতে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সুযোগ বারবার আসে না। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জন্য যে সুযোগ সৃষ্টি এবং ঐক্যের ভিত রচনা করে দিয়েছে, তাকে কোনোভাবেই নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে- ঐক্যেই উত্থান, অনৈক্যে পতন।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বাহরাইনে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত।
নাকফুল—একটুকরো সোনা, তবু তার মূল্য কখনোই শুধু ধাতুর ওজনে মাপা যায় না। এর ভেতর লুকিয়ে থাকে বহু প্রজন্মের গল্প, এক কন্যার জীবন বদলে যাওয়ার নীরব মুহূর্ত, আর বাঙালি নারীর সৌন্দর্যের শাশ্বত চিহ্ন। বিয়ের দিন কনের নাকে নাকফুল তোলা যেন শুধু সাজগোজ নয়; এটি তার জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশের কোমল আচার, যা একই সঙ্গে অলঙ্কারও, আবার পরিচয় বদলের ঘোষণা।
বাঙালি পরিবারে কন্যা মানে আদরের আলো। বাবার হাত ধরে বড় হওয়া সেই মেয়ে যখন বিয়ের শাড়িতে সাজে, তার চোখে যেমন থাকে লাজুক স্বপ্নের কুয়াশা, তেমনি হৃদয়ে থাকে অচেনা ভবিষ্যতের ধুকপুকানি। আর ঠিক সেই সময়েই নাকে পরানো হয় নাকফুল। ক্ষুদ্র কিন্তু গভীর এক প্রতীক। বাবার ঘরের মেয়ে সেই মুহূর্তেই বধূ হয়ে ওঠে। কপালের টিপ, শাড়ির কুচি বা চুড়ির ঝনঝনানির মধ্যেও নাকফুল আলাদা করে বলে দেয়—
‘সে আর শুধু কন্যা নয়, সে এখন কারো বধূ, অন্য পরিবারের অংশিদার।’
আগে বনেদী পরিবারে মেয়ের দেনমোহর নির্ধারিত হতো তার ওজনের সমান সোনা দিয়ে। সেই সোনার ভাজে নাকফুল ছিল সবচেয়ে কোমল, সবচেয়ে আবেগী গয়না। অনেকে বড় গয়না কিনতে না পারলেও নাকফুল দেওয়াটা কখনো বাদ দিত না। কারণ নাকফুল ছিল বিবাহিত পরিচয়ের প্রথম মর্মস্পর্শী ছাপ—একটি ছোট অলঙ্কার, যার ভেতর লুকিয়ে থাকে স্বামীর ভালোবাসা, পরিবারের স্বীকৃতি এবং বধূর নতুন পরিচয়ের দৃঢ় অথচ নরম ঘোষণা।
আজকের দিনে গয়নার ঝলক কমে গেছে, সোনার দাম আকাশছোঁয়া, মেয়েরা জীবনযাপনের ব্যস্ততায় গয়নার ভার কমিয়েছে তবুও নাকফুল তার জায়গা ছাড়েনি। কারণ নাকফুল শুধু সাজ নয়—এ এক আবেগ, এক ইতিহাস। এটি পরতেই কনের মুখে ফুটে ওঠে এক অচেনা দীপ্তি, যেন লাজুক আলোয় ভরে যায় তার হাসি। মেয়ে থেকে বধূ হয়ে ওঠার যে রূপান্তর, তার সবচেয়ে স্নিগ্ধ অনুষঙ্গই হলো নাকফুল।
নাকফুল নারীর সৌন্দর্যকে শুধু বাড়ায় না—এ তাকে দেয় এক মর্যাদা, এক আত্মপরিচয়। শত বছর আগে যেমন ছিল, আজও তেমনই প্রাসঙ্গিক। সমাজের পরিবর্তন, রুচির বদল, সময়ের স্রোত—কিছুই নাকফুলের আবেগকে ছুঁতে পারেনি। তাই বাঙালি বিয়েতে এই ক্ষুদ্র অলঙ্কারটিই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় প্রতীক—ভালোবাসা, আস্থা ও নারীত্বের চিহ্ন।
এক কন্যা যখন নাকফুল পরে বধূ হয়ে ওঠে, তখন শুধু তার সাজই সম্পূর্ণ হয় না—সম্পূর্ণ হয় তার জীবনের এক অধ্যায়। সেই ছোট্ট সোনায় বাঁধা থাকে বাবার ঘর ছেড়ে নতুন ঘরে পা রাখার শিহরণ, নতুন জীবনের প্রতিশ্রুতি এবং অসংখ্য অদেখা আশার দীপ্তি।
নাকফুল তাই শুধু সৌন্দর্য নয়—এ বাঙালি নারীর জীবনে এক কোমল, অমর, এবং গভীর আবেগের প্রতীক।
লেখক: কবি।
একটা সময় ছিল, অনলাইনে টাকা পাঠাতে গেলে আমরা অপেক্ষা করতাম একটা ছোট মেসেজের জন্য, সেই পরিচিত ছয় অঙ্কের OTP (One Time Password)। মোবাইলে কোড এলেই বুকের ভেতরটা হালকা হয়ে যেত, মনে হতো, এই সংখ্যাগুলোই আমাদের টাকা-পয়সা নিরাপদ রাখার একমাত্র চাবিকাঠি। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন সেই একসময়ের ‘নিরাপদ’ মনে হওয়া OTP-ই হয়ে উঠেছে প্রতারণার সবচেয়ে সহজ দরজা। OTP তাই ধীরে ধীরে ইতিহাসে পরিণত হচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ঘোষণা করেছে, ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে সব ব্যাংক থেকে SMS ও ইমেইল-ভিত্তিক OTP সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়া হবে। তার পরিবর্তে আসছে এমন এক সিস্টেম, যেখানে মানুষ নিজেই হবে নিজের পাসওয়ার্ড— বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশন, অর্থাৎ মুখ বা আঙুলের ছাপ দিয়ে হবে সব লেনদেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাত এই বাস্তবতা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছে। দেশটির ব্যাংকগুলো গত কয়েক বছর ধরে ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপ, ডিজিটাল পেমেন্ট সবখানেই ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে সাইবার প্রতারণা ও অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রে হ্যাকাররা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে ব্যবহারকারীর ফোনে প্রবেশ করে OTP সংগ্রহ করেছে। ফলে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়েছে এমন একটি সমাধান খুঁজতে, যা সম্পূর্ণভাবে ‘ইউজার আইডেন্টিটি'-এর ওপর ভিত্তি করে, বাহ্যিক কোড বা পাসওয়ার্ডের নয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) ঘোষণা করেছে, ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যেই তারা ব্যাংকিং সেবায় SMS ও ইমেইল ভিত্তিক OTP সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেবে। তার পরিবর্তে লেনদেনের প্রতিটি ধাপে গ্রাহকের মুখের ছবি বা আঙুলের ছাপের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ বাধ্যতামূলক হবে। এর মানে, আপনি নিজে উপস্থিত না থাকলে আর কেউ আপনার নামে লেনদেন করতে পারবে না। এই সিদ্ধান্তের পেছনে বড় কারণ প্রতারণা রোধ। UAE-এর সেন্ট্রাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২৩ সালেই অনলাইন ব্যাংকিং জালিয়াতিতে গ্রাহকরা প্রায় ৮৭ মিলিয়ন ডলার হারিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অপরাধীরা ফিশিং লিংক বা SIM swapping-এর মাধ্যমে গ্রাহকের OTP জেনে নিয়ে অ্যাকাউন্ট খালি করে ফেলেছে। অর্থাৎ, ব্যাংকের প্রযুক্তি যত উন্নতই হোক না কেন, যদি OTP ভুল হাতে পড়ে—নিরাপত্তা শূন্যে নেমে আসে।
বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশন তাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে যৌক্তিক ও নিরাপদ বিকল্প। ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফেস রিকগনিশন, আইরিস স্ক্যান বা ভয়েস অথেন্টিকেশন — এগুলোর মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় যে, লেনদেনটি সেই ব্যবহারকারীই করছেন, অন্য কেউ নয়। কোনো হ্যাকার বা প্রতারক যত উন্নত কৌশলই ব্যবহার করুক না কেন, কারও মুখ বা আঙুলের ছাপ নকল করা এত সহজ নয়। তাছাড়া বায়োমেট্রিক ডেটা সাধারণত এনক্রিপটেড আকারে সংরক্ষিত থাকে এবং কেবল ডিভাইসের ভেতরেই যাচাই হয় যায়।
ফলে সার্ভার-সাইডে লিক হওয়ার সম্ভাবনাও কমে
এখন যদি আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাবি, বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধরুন, মিরপুরে থাকেন মি. রাহিম, একজন সরকারি চাকরিজীবী। প্রতিদিন সকালে অফিসে যান, বিকেলে বাসায় ফেরেন, মাঝে মাঝে অনলাইন ব্যাংকিং করে বিল পরিশোধ করেন বা পরিবারের জন্য টাকা পাঠান। একদিন সকালে অফিসে বসে মোবাইলে ব্যাংকের নোটিফিকেশন পেলেন—‘আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে ২,০০,০০০ টাকা ট্রান্সফার হয়েছে।’ রাহিম চমকে উঠলেন! তিনি তো এমন কোনো লেনদেন করেননি! ব্যাংকে ফোন করলেন, কিন্তু দেখা গেল তার ফোনে ঠিকই OTP গেছে এবং সেটি ব্যবহারও হয়েছে। অথচ তিনি OTP দেননি। পরে জানা গেল, একজন প্রতারক আগেই একটি ফিশিং লিংক পাঠিয়ে রাহিমের ব্যাংক লগইন তথ্য জেনে নিয়েছিল, তারপর SIM swap করে সেই OTP নিজের হাতে নিয়ে টাকা ট্রান্সফার করেছে। এটাই বাস্তবতা—OTP থাকা সত্বেও গ্রাহক নিরাপদ নয়৷
ধরুন, একই ঘটনা যদি বায়োমেট্রিক সিস্টেমে ঘটত। রাহিমের ব্যাংক অ্যাপে লেনদেন করার আগে অ্যাপটি মুখ চিনে বা আঙুলের ছাপ যাচাই না করা পর্যন্ত টাকা পাঠানো সম্ভব হতো না। OTP চুরি করলেও কোনো লাভ হতো না, কারণ বায়োমেট্রিক তথ্য কারও পক্ষে নকল করা প্রায় অসম্ভব। এখানেই প্রযুক্তির আসল শক্তি। বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা মানে, আপনি নিজেই আপনার পাসওয়ার্ড—আপনার মুখ, আপনার আঙুল, আপনার কণ্ঠস্বরই হবে প্রমাণ যে আপনি আসল ব্যবহারকারী।
বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা চালু হলে গ্রাহকের জন্য সুবিধা অনেক। প্রথমত, তাকে আর কোড মনে রাখতে হবে না। দ্বিতীয়ত, প্রতারণার ঝুঁকি প্রায় শূন্যে নামবে। তৃতীয়ত, ব্যাংকও নিশ্চিত থাকবে যে লেনদেনটি আসল গ্রাহকই করেছেন। প্রথমে বায়োমেট্রিক সিস্টেম একটু ঝামেলাপূর্ণ মনে হতে পারে—নতুনভাবে অ্যাপ আপডেট করা, মুখ বা আঙুলের ছাপ নিবন্ধন করা ইত্যাদি। কিন্তু একবার সেটআপ হয়ে গেলে এটি অসাধারণ সুবিধাজনক। আর OTP-এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে না, পাসওয়ার্ড ভুলে যাওয়ার চিন্তা থাকবে না, কয়েক সেকেন্ডেই নিরাপদে লেনদেন সম্পন্ন হবে। এটা শুধু প্রযুক্তি নয়, মানসিক স্বস্তিও এনে দেবে।
এখানে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতিমধ্যেই ‘UAE PASS’ নামে একটি জাতীয় ডিজিটাল আইডেন্টিটি সিস্টেম চালু করেছে, যা নাগরিক ও প্রবাসী উভয়ের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য। এর মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি সব ডিজিটাল সেবায় একীভূত বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশন সম্ভব হচ্ছে। ব্যবহারকারী একবার নিবন্ধিত হলে, তার মুখ বা আঙুলের ছাপই যথেষ্ট সব লেনদেনের জন্য— হোক তা ব্যাংকে লগইন, ট্যাক্স প্রদান বা সরকারি নথি স্বাক্ষর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় হলেও নিরাপত্তা হুমকিও বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই অনলাইন প্রতারণা, ফিশিং বা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট হ্যাকের ঘটনা শোনা যায়। এখানে OTP অনেক সময়ই দুর্বল নিরাপত্তা প্রাচীর হিসেবে কাজ করছে— বিশেষ করে যখন ব্যবহারকারী অসচেতন বা হ্যাকার ফোনে ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে কোড পড়ে নিতে পারে। ফলে আমাদের জন্য এখনই বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সময়ের দাবি।
আমরা ইতোমধ্যেই জাতীয় পরিচয়পত্রে (NID) বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষণ করেছি। এই বিশাল ডেটাবেস যদি সুরক্ষিতভাবে ব্যাংকিং সেক্টরের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, তাহলে ডিজিটাল অথেন্টিকেশন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ব্যাংকগুলো চাইলে ধীরে ধীরে পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক লগইন ও লেনদেন চালু করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ ক্ষেত্রে একটি নীতিগত নির্দেশিকা দিতে পারে, যাতে গ্রাহকের ডেটা সুরক্ষা, এনক্রিপশন ও ব্যবহারকারীর সম্মতির বিষয়গুলো নিশ্চিত থাকে ।
তবে প্রযুক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি করাও জরুরি। অনেক গ্রাহকই এখনো বিশ্বাস করেন, OTP এলেই সেটি নিরাপদ; তারা বোঝেন না, এটি হ্যাক বা চুরি হওয়ার ঝুঁকিতেও থাকে। তাই ব্যাংকগুলোর উচিত গ্রাহকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও প্রচার চালানো। বিশেষ করে, নতুন প্রজন্মের পাশাপাশি গ্রামীণ বা প্রান্তিক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাই হবে আসল সফলতা।
আগামী দিনের ব্যাংকিং শুধু পাসওয়ার্ড বা OTP-এর ওপর নির্ভর করবে না। গ্রাহকের নিজের পরিচয়ই হবে প্রধান চাবিকাঠি। UAE-এর অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে, বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা শুধু সুবিধা নয়, এক জরুরি প্রয়োজন। বাংলাদেশেও যদি আমরা সময়মতো এই পদক্ষেপ নিই, তাহলে অনলাইন ব্যাংকিং নিরাপদ, সুবিধাজনক এবং বিশ্বস্ত হয়ে উঠবে। রাহিমের মতো গ্রাহকের জন্য এটি হবে শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
একসময় আমরা পাসওয়ার্ড মুখস্থ করার দিনগুলোতে অভ্যস্ত ছিলাম, পরে এল ‘OTP যুগ’, আর এখন সেই যুগও ইতিহাস হতে যাচ্ছে। এখন থেকে আপনার মুখ, আপনার আঙুল, আপনার স্বরই হবে আপনার সুরক্ষার প্রহরী। এই পরিবর্তন শুধু প্রযুক্তিগত নয়— এটি এক নতুন বিশ্বাসের বিপ্লব। এমন এক ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্বপ্ন, যেখানে মানুষই তার নিজের নিরাপত্তার প্রতিচ্ছবি। সংযুক্ত আরব আমিরাত এই নতুন যাত্রার সূচনা করেছে, আর বাকিরা শিখবে, মানিয়ে নেবে, আর একসাথে তৈরি করবে নিরাপদ, আধুনিক ও সমন্বিত এক ডিজিটাল পৃথিবী। কারণ সাইবার নিরাপত্তা এখন আর বিলাসিতা নয়— এটি আজ একান্ত প্রয়োজন।
লেখক: হেড, ডিপার্টমেন্ট অব সিএসই, এমআইএসটি।