শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

জনসংখ্যা বেড়েছে কিন্তু ‘মানুষ’ বাড়েনি

আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন
প্রকাশিত
আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন
প্রকাশিত : ২৬ মে, ২০২৪ ১৮:০৬

লার্নিং ইজ অ্যা নেভার-এন্ডিং প্রসেস। শেখার যেমন কোনো বয়স নেই, তেমনি শেখার কোনো শেষও নেই। যে কোনো বয়সে, যেকোনো অবস্থাতেই শেখার সুযোগ রয়েছে। আমরা প্রতিনিয়তই শিখছিÑহোক তা প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক। আবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই যে আমাদের শিক্ষিত করে তোলেÑসবক্ষেত্রেই এমনটাও নয়! আবার সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করলেই যে শিক্ষিত হওয়া যায়Ñএমনটাও নয়! তাই তো সুশিক্ষিত আর স্বশিক্ষিত শব্দ দুটির সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়ত পরিচিত হতে হয়।

দেশের মধ্যে সরকারি চাকরিতে আবেদন করার যোগ্যতাটুকু অর্জন করামাত্রই প্রচেষ্টারত থেকেছি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে জনগণের সেবক হওয়ার। মহান সৃষ্টিকর্তা প্রথমবারের চাকরিযুদ্ধেই সফল হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল এমনটাই। আজ চাকরির বয়স প্রায় আঠারো বছর। নির্ধারিত মৌলিক প্রশিক্ষণ, মাঠপর্যায়ে বাস্তব প্রশিক্ষণ, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের বাইরেও পেশাগত বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অনেক প্রশিক্ষণ নিয়েছি। বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিচিত্র পরিবেশ-পরিস্থিতিতে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়েছি। প্রতিনিয়তই শিখছি, নিজেকে শাণিত করছি।

সরকারি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য আমাদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। সকল শ্রেণি-পেশার ছোট-বড় মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। ধর্মীয় উৎসবে সব ধর্মাবলম্বী মানুষের মাঝে যেতে হয়। রাষ্ট্রাচার আর দেশীয় উৎসব-ঐতিহ্যে নিবেদিতপ্রাণ হতে হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ’। আবার সংবিধানের ২১(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।’ ২১(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’

পুলিশ আইন, ১৮৬১ (১৮৬১ সালের ৫ নংআইন) এর ২২ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক পুলিশ কর্মচারী সর্বদা কার্যে রত বলিয়া বিবেচিত হইবে এবং যেকোনো সময় জেলার যেকোনো স্থানে তাহাকে পুলিশ অফিসার হিসাবে নিযুক্ত করা যাইবে।’ শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, প্রগতির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত বাংলাদেশ পুলিশের সেবাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ যোদ্ধা এবং করোনাকালীন সম্মুখ যোদ্ধা বাংলাদেশ পুলিশের অকুতোভয় সদস্যদের চব্বিশ ঘণ্টার সতর্ক দৃষ্টি আর আন্তরিক প্রচেষ্টাতেই জনসাধারণের স্বাভাবিক এবং নিরাপদ জীবনযাপন অনেকটাই নিশ্চিত হয়।

এমনই একদিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। পাশের মসজিদে মাগরিবের আজান পড়ে। নামাজের সময়ে মসজিদে গিয়ে পোশাক পরিহিত অবস্থায় জামাতে নামাজ আদায় করি। অবশ্য আমি একা নই, সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের বেশ কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা এবং আমার পেশার কয়েকজন কনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। গল্পের মূল অংশের আলোচনায় তাদের পরিচয় আর নাই দিলাম। নামাজ শেষ হতে না হতেই হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে এবং ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। বের হতে না পেরে অগত্যা মসজিদেই বসে রইলাম। মসজিদের বেশ কয়েকজন মুসল্লি নামাজ শেষ করে বৃষ্টির কারণে বাইরে যেতে না পেরে আমাদের সঙ্গে বসে রইলেন। আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম এবং সঙ্গে বসা মুসল্লিদের খোঁজ-খবর নিচ্ছিলাম। এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন, রাতে কোনো চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই হয় কি-না, মানুষ রাতে নিরাপদে চলাচল করতে পারে কি-না, তাদের জীবন-জীবিকা ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিরাপদ কি-না, সন্তান-মা-বোন রাস্তাঘাটে নিরাপদ কি-না, স্থানীয়ভাবে কোনো দ্বন্দ্ব আছে কি-না, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে কোনো ঘাটতি আছে কি-না, ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারছে কি-না ইত্যাদি, ইত্যাদি।

আমার বাম পাশে বসা একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের কৃষক, পড়নে তার লুঙ্গি আর গায়ে পুরোনো ফুলহাতা জামা, মুখমণ্ডলে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। লক্ষ্য করলাম আমাদের আলোচনা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আমাদের আলোচনার মধ্যেই প্রসঙ্গক্রমে বলে বসলেন, ‘স্যার, জনসংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু মানুষ বাড়েনি তো।’ প্রথমদিকে বুঝতে পারলাম না, কিছুটা অবাকই হলাম। প্রাথমিকভাবে তাকে অস্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিলাম; কিন্তু দ্বিতীয়বার একইভাবে দৃঢ়চিত্তে বললেন, ‘স্যার, জনসংখ্যা, বেড়েছে কিন্তু মানুষ বাড়েনি।’ ততক্ষণে আমার সম্বিত ফিরে পাওয়ার মতোই। মনে হলো শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগলো, গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। যেহেতু আমার বামপাশে শরীর ঘেঁষেই বসেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গেই আমি তার হাতটা ধরলাম। আমার উপলব্ধি হলো যে, ইনিই তো প্রকৃত মানুষ। ‘জনসংখ্যা’ এবং ‘মানুষ’ নিয়ে এমন ভিন্ন ভাবনা কখনোই মাথায় আমার আসেনি। সর্বশেষ আদমশুমারি ২০২২ অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লক্ষ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন; যেখানে ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ছিল ১৪ কোটি ৯৭ লক্ষ ৭২ হাজার ৩৬৪ জন। সত্যিই তো জনসংখ্যা বেড়েছে! কেবল বাংলাদেশেই নয়, সময়ের ব্যবধানে সারা বিশ্বের জনসংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু প্রকৃত ‘মানুষ’ তো বাড়েনি?

মানুষ বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী জীব। আধুনিক মানুষ বা হোমো স্যাপিয়েন্স হলো হোমিনিনা উপজাতির একমাত্র বিদ্যমান সদস্য। কিন্তু কেবল জন্মগ্রহণ করলেই কি মানুষ হওয়া যায়? মানুষের রয়েছে মন, মনুষ্যত্ব ও মানবিক গুণাবলি। মনুষ্যত্ব হলো মানুষের চিরাচরিত বা শাশ্বত স্বভাব বা গুণ। যেমনÑদয়া-মায়া, ভালোবাসা, পরোপকারিতা, সহানুভ‚তি, সম্প্রীতি, ঐক্য ইত্যাদি। কিন্তু আমরা মানুষ হিসেবে নিজেদের কতটা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? তাছাড়া মনুষ্যত্বহীন কাউকে কখনোই ‘মানুষ’ বলে সমর্থন দেওয়া যায় না।

সেই কৃষক ভাইটি সেদিন মূলত জনসংখ্যার পরিমানগত নয়, বরং গুণগত মান অর্থাৎ মনুষ্যত্ব ও মানবিক গুণাবলিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তার মতে মানুষ হতে হলে যে মনুষ্যত্ববোধ থাকা প্রয়োজন, মানবিক গুণাবলি অর্জন করা আবশ্যকÑবর্তমান সময়ে তার বড্ড ঘাটতি রয়েছে। নিঃসন্দেহে পরিসংখ্যানগতভাবে জনসংখ্যা পূর্বের তুলনায় বেড়েছে, কাঠামোবদ্ধ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদের উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত ‘মানুষ’ বাড়েনি। মানুষে মানুষে আজ ভ্রাতৃত্ববোধ হ্রাস পেয়েছে, একে অপরের সঙ্গে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, লড়াই, রক্তপাত, মৃত্যু, ধ্বংস আর অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। সেই ছোটবেলার মান্যতার কালচার এখন আর বুঝি নেই! পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান, আদর, ভালোবাসা যেনো অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে।

সেদিনের মতো দায়িত্ব পালন করে বাসভবনে ফিরে আসি। আজ বদলি সূত্রে কর্মস্থল পরিবর্তিত হয়ে অন্যত্র চলে এসেছি। কিন্তু আজও সেই কৃষক ভাইয়ের কথাটা মনের ভেতর গেঁথে আছে। মাঝেমধ্যেই কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হয় সেই কথাটা। এখনো মনে হলে উপলব্ধি হয় যে, আসলেই আমরা যেকোনো পরিস্থিতিতে যে কারো কাছেই শিখতে পারি। শেখার জন্য কেবলই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রয়োজন হয় না। জন্মের পর থেকে প্রতিটি মানবশিশুই তার পরিবার ও পরিবেশ থেকে শিক্ষালাভ করে। কেউ কেউ স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি না পেরোলেও পরবর্তী সময়ে সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে সনদপত্র অর্জনকারীকেও ছাপিয়ে যায় জ্ঞান-গরিমায়।

অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যে আমাদের জীবনে পরিবর্তন ঘটাতে পারে, আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ সেই কৃষক ভাইটি। তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বললেই চলে, কিন্তু মানুষ ও জীবন সম্পর্কে রয়েছে গভীর দর্শন। তাই তো, সে একজন শিক্ষক আমার কাছে, আমাদের কাছে। একজন প্রকৃত ‘মানুষ’ও বটে!

লেখক: পুলিশ সুপার, নৌ-পুলিশ, সিলেট অঞ্চল


শিরা-উপশিরায় মিশে গেছে ইন্টারনেট

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ফাতেমা তুজ জোহরা মাইসা

বর্তমানে পড়াশোনা থেকে শুরু করে অফিস-আদালতের কোনো কাজই ইন্টারনেট ছাড়া কল্পনা করা যায় না। একটা দিন যদি ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকে তো দুনিয়া যেন অচল হয়ে পড়ে! তবে এই কল্পনাতীত ব্যাপারটি এবার সত্যিই ঘটে গেল আমাদের দেশে! ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কেটে গেল ৫টি দিন।

বাংলাদেশের ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গেল। কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। দেশের ভয়ংকর অরাজকতায় চারদিকে দম বন্ধ পরিবেশ সৃষ্টি হলো। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাইকে যেন শূন্যতা গ্রাস করে ফেলেছিল। ‘কীভাবে সময় কাটবে’- এই ভেবেই প্রায় সবার কপালে পড়েছিল চিন্তার ভাঁজ। সেই সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবস্থা কখন ঠিক হবে- এই উদ্বিগ্নতায় বারবার ফোনের নেটওয়ার্ক অন করে দেখার অস্থিরতাও তৈরি হলো। সর্বোপরি সবকিছু যেন একেবারে থমকে গিয়েছিল।

ইন্টারনেটের যেমন অসংখ্য উপকারী দিক রয়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে কিছু ভয়ংকর ক্ষতিকর দিক । বর্তমানে মানুষের অবসরের সবচেয়ে বড় বন্ধু ইন্টারনেট। ইন্টারনেটে আসক্ত মানুষের সংখ্যা রয়েছে অগণিত। আসক্তির পরিমাণ এতটাই বেশি যে, দিন-রাত মিলিয়ে প্রায় ১২/১৪ ঘণ্টায় অনেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে। সারারাত চোখ আটকে থাকে ফোনের স্ক্রিনে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের রিলস, বিভিন্ন অনলাইন গেমস মাদকের মতো আসক্তিদায়ক হয়ে উঠেছে। ফলে মাদকাসক্ত মানুষ যেমন মাদকের অভাবে অস্থির হয়ে পড়ে, ইন্টারনেট আসক্ত মানুষের অবস্থাও ঠিক তেমনই হয়ে পড়েছিল এই কয়টা দিনে ।

ইন্টারনেট সংযোগবিহীন এই দিনগুলোর পর আমার রিয়েলাইজেশন হলো ইন্টারনেটের অনুপস্থিতিতে মানুষ যে কতটা অসহায় তা অবর্ণনীয়। এখন ইন্টারনেট শুধু নেটওয়ার্কের জাল নয় বরং এটা এখন রূপকথার মায়াজালে পরিণত হয়েছে, যা আমাদেরকে প্রতিনিয়ত বশীভূত করে রাখছে। শিরা-উপশিরায় মিশে গেছে ইন্টারনেট ।

এমতাবস্থায় আমি মনে করি সময় কাটানোর উপায় হিসেবে আমরা নিজেদের মধ্যকার সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করতে পারি । যেমন অনেকেই আছেন দারুণ ছবি আঁকতে, গান গাইতে বা নাচতে পারেন । কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততায় এসব চর্চা করার সময় আর হয়ে ওঠে না। তারা চাইলেই তাদের অবসরে ইন্টারনেটের পরিবর্তে এসব চর্চা করে সময় কাটাতে পারেন। বিভিন্ন শিক্ষণীয় বই পড়তে পারেন সঙ্গে ডায়েরিতে লেখালেখি করেও সময় কাটাতে পারেন।

এ ক্ষেত্রে মাথায় আসে অ্যারিস্টটলের একটা বিখ্যাত উক্তি –‘Know Thyself অর্থাৎ নিজেকে জানো ।’ ইন্টারনেট সংযোগবিচ্ছিন্ন এই দিনগুলোতে আর কিছু করার না থাকলেও নিজেকে জানার একটা দারুণ সুযোগ কিন্তু অবশ্যই ছিল। শুধু এমন দুর্যোগের দিন বলেই নয় আমাদের উচিত সবসময়ই ব্যস্ততা কাটিয়ে উঠে নিজেকে জানার চেষ্টা করা। এতে লাভ ছাড়া কোনো ক্ষতি অন্তত হবে না। অন্যথায় এমন অতিরিক্ত ইন্টারনেটনির্ভর অবস্থা থেকে নিজেদের পরিত্রাণ করতে না পারলে ক্রমশই অন্ধকারের অতল গভীরে ডুবে যাব আমরা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ।

লেখক : শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়


সালামে শান্তি সালামে ঐক্য

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মুফতি আলী হুসাইন

নিঃসন্দেহে সালাম ইসলামের উত্তম শিষ্টাচার, উৎকৃষ্ট সভ্যতার প্রতীক। সালাম মুমিনদের জন্য এক বরকতময় তোহফা, একত্ববাদে বিশ্বাসীদের নিদর্শন, মুসলমানদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব, সু-সম্পর্ক, হৃদ্যতা সৃষ্টির মাধ্যম। সালামে শান্তি, ঐক্য এবং আসমানি কল্যাণ নিহিত রয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, যখন তোমরা ঘরে প্রবেশ করবে তখন একে অপরকে সালাম কর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বরকতময় পবিত্র অভিবাদন স্বরূপ। [সুরা নূর: ৬১]

জান্নাতবাসীদের জন্যও অভিবাদন হবে এই সালাম। যখন জান্নাতের অধিবাসীগণ দলে দলে জান্নাতের দিকে যাবে তখন জান্নাতের আটটি দরজা তাদের সম্মানার্থে খুলে দেওয়া হবে। অতঃপর জান্নাতের দারোয়ান তাদেরকে এভাবে সালামের মাধ্যমে সম্বোধন করবেন- তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, তোমরা পবিত্র, সুতরাং তোমরা চিরকালের জন্য তাতে প্রবেশ কর। [সুরা আজ-জুমার:৭৩]

আর জান্নাতবাসীরাও একে অপরকে সম্বোধন ও অভিবাদন করবে সালামের মাধ্যমে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তাদের পরস্পরের সম্বোধন হবে সালাম। [সুরা ইবরাহিম :২৩]

আবু হুরাইরা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা আদম (আ.)কে তাঁর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। তার দৈর্ঘ্য ৬০ গজ ছিল। তাকে সৃষ্টি করার সময় আল্লাহ বলেছিলেন, যাও, ওই জামায়াতকে সালাম কর। (আর তারা ছিল ফেরেশতাদের এক উপবিষ্ট জামাত)। অতঃপর তারা তোমাকে সালামের যে জবাব দেয়, তা মনোযোগের সঙ্গে শ্রবণ করবে। ওটাই তোমার এবং তোমার সন্তানাদির সালাম। আদম (আ.) গিয়ে বললেন, আসসালামু আলাইকুম। ফেরেশতারা তার জবাবে বললেন- আসসালামু আলাইকা ওয়া রাহমাতুল্লাহ এবং তারা ওয়া রাহমাতুল্লাহ শব্দটি বৃদ্ধি করলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, প্রত্যেক ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করবে আদম (আ.)-এর আকৃতিতে। তার দৈর্ঘ্য ৬০ গজ হবে। আদম (আ.)-এর পর থেকে এখন পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে মানুষের আকৃতি ছোট হয়ে গেছে। [সহিহ বুখারি: ৬২২৭, সহিহ মুসলিম: ২৮৪১]

সালামের ফজিলত

সালামের ফজিলত প্রসঙ্গে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সেগুলোর মধ্য হতে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হাদিস ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলÑ

 আবদুল্লাহ ইবনে ওমর [রাদিয়াল্লাহু আনহুমা] থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন,Ñ ইসলামের মধ্যে সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি উত্তর দিলেন- তুমি খাবার খাওয়াবে এবং পরিচিত-অপরিচিত; সবাইকে সালাম দিবে। [সহিহ বুখারি:২৮, সহিহ মুসলিম:৩৯]

 একজন মুসলিম ব্যক্তির ওপর অপর মুসলিম ব্যক্তির যে কয়েকটি হক রয়েছে, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো, সালাম বিনিময় করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেনÑ

এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে, তার মধ্য থেকে তিনি একটি উল্লেখ করে বলেন- যখন তুমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে তাকে সালাম দিবে।

 সালাম মুসলমানদের পরস্পরের মাঝে ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সুসম্পর্ক সৃষ্টির সবচেয়ে বড় মাধ্যম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ না তোমরা মুমিন হবে এবং তোমরা মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরে ভালোবাসা রাখবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন কাজের কথা বলে দেবনা যা করলে তোমরা পরস্পর একে অপরকে ভালোবাসবে? তা হলো, তোমরা পরস্পরের মাঝে সালামের ব্যাপক প্রচার কর। [সহিহ মুসলিম:৫৪]

এই হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ‘সালাম বিনিময়’ পরস্পরের মাঝে ভালোবাসা সৃষ্টির অনন্য উপায়। এটি একটি দোয়া। যার মাধ্যমে একে অপরের সাক্ষাতের সময় শান্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণের দোয়া করা হয়। বারবার সালাম দেওয়ার অর্থ হলো, বারবার তার জন্য কল্যাণের দোয়া করা। সবাই যখন সবাইকে সালাম দেবে তখন এটা হবে সালামময় পরিবেশ। তাছাড়া হাদিসের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.) সালামের যে ব্যাপক প্রচারের কথা বলেছেন, তা তখনই সম্ভব হবে যখন ছোট বড়কে আর বড় ছোটকে সালাম দেবে; পরিচিত-অপরিচিত সুযোগ পেলেই সবাইকে সালাম দেবে। এভাবে ব্যাপকহারে সালাম বিনিময় করলে প্রত্যেকের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণ বয়ে আসবে। নবী কারিম (সা.) থেকে বর্ণিত তিনি এরশাদ করেছেন, তোমরা সালামের ব্যাপক প্রচার কর তাহলে তোমরা শান্তি ও নিরাপদে থাকবে। [আল আদাবুল মুফরাদ:৭৮৭]

সালামের বিধিবিধান ও আদবসমূহ

 সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। যে ব্যক্তিকে সালাম দেওয়া হয় তার উচিত সালামদাতার থেকে উত্তম অথবা অনুরূপ শব্দ দ্বারা জবাব দেওয়া। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর যখন তোমাদেরকে সসম্মানে সালাম প্রদান করা হয়, তখন তারচেয়ে উত্তমরূপে জওয়াবি সালাম দাও কিংবা অনুরূপভাবে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ের হিসাব গ্রহণকারী। [সুরা নিসা: ৮৬]

 দুই ব্যক্তির মধ্যে সর্বোত্তম হলো যে আগে সালাম দেয়।

আবু উমামা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালার নিকট মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি, যে আগে সালাম দেয়। [সুনানে আবু দাউদ:৫১৯৭]

 যে ব্যক্তির আগে সালাম করা উচিত ছিল, সে যদি সালাম না দেয়, তাহলে অপর ব্যক্তির উচিত সালাম দিয়ে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সুন্নত হলো ছোট বড়কে সালাম দিবে। অল্প সংখ্যক লোক বেশি সংখ্যক লোককে, আরোহী ব্যক্তি পদব্রজে গমনকারীকে এবং চলমান ব্যক্তি উপবিষ্ট ব্যক্তিকে সালাম দিবে।

আবু হুরাইরা [রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু] থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ছোট বড়কে সালাম দিবে। চলমান ব্যক্তি উপবিষ্টকে, অল্প সংখ্যক লোক বেশি সংখ্যক লোককে সালাম দিবে [সহিহ বুখারি:৬২৩২, সহিহ মুসলিম: ২১৬০]

নবী কারিম (সা.) ছোটদেরকে সালাম দিতেন এবং সালামের ক্ষেত্রে তিনি সবাইকে আগে সালাম দিতেন। এটা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিপূর্ণ বিনয় ও নম্রতার বহিঃপ্রকাশ। আমাদের পূর্বসূরিদের প্রত্যেকেই এমন অনুপম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। ইয়াসার [রাহিমাহুল্লাহু] বর্ণনা করেন, আমি সাবেত বুনানী (রাহিমাহুল্লাহু)-এর সঙ্গে যাচ্ছিলাম, যখন তিনি ছোট বাচ্চাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন তখন তিনি তাদেরকে সালাম দিলেন। সাবেত [রাহিমাহুল্লাহু] বর্ণনা করেন, তিনি আনাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর সঙ্গে যাচ্ছিলেন, তখন তিনিও ছোট বাচ্চাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাদেরকে সালাম দিয়েছেন। আনাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে যাচ্ছিলাম। তিনি ছোট বাচ্চাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাদেরকে সালাম দিয়েছেন। [সহিহ মুসলিম:২১৬৮]

 আগে সালাম দেওয়া সুন্নত। তাই আগে সালাম দেবে তারপর কথা বলবে। সালামের পূর্বে কথা বলা ঠিক নয়।

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তাদের দুজনের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি হলো, যে আগে সালাম দেয়। [সহিহ বুখারি]

অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি সালাম দেওয়ার পূর্বে কথা বলবে তার জবাব দিবে না। [আমালুল আওমি ওয়াল লাইলাতি:২১০]

আর যাদেরকে সালাম দেওয়া হবে, তারা যদি দুই বা ততোধিক হন, তাহলে একজন জবাব দিলেই যথেষ্ট। তবে সবাই জবাব দিলে তা অধিক উত্তম। যিনি সালাম দিবেন তার উচিত হলো উচ্চ আওয়াজে সালাম দেওয়া যেন সবাই ভালোভাবে শুনতে পারে। কেননা হাদিসে সালামের ব্যাপক প্রচলনের কথা বলা হয়েছে। আর যদি কয়েকজন জাগ্রত আর কয়েকজন ঘুমন্ত থাকে, সে ক্ষেত্রে আস্তে আওয়াজে সালাম দিবে যেন জাগ্রতরাই শুধু শুনতে পারে এবং ঘুমন্তদের ঘুমে কোনো সমস্যা না হয়। এটা ছালামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আদব। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন রাতে ঘরে আসতেন, তখন এমনভাবে সালাম দিতেন যেন ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম না ভাঙে এবং কেবল জাগ্রত ব্যক্তি তা শুনতে পারে। [সহিহ মুসলিম: ২০৫৫]

 সালামের মধ্যে মাসনুন ও মাসুর অর্থাৎ হাদিসে বর্ণিত শব্দ বাড়ানোর দ্বারা সওয়াবও বৃদ্ধি পাবে এবং প্রত্যেক শব্দের বিনিময়ে দশটি করে নেকি বৃদ্ধি পাবে।

ইমরান ইবনে হুসাইন [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এসে আসসালামু আলাইকুম বলল, রাসুলুল্লাহ (সা.) তার জবাব দিলেন এবং বললেন দশ নেকি। অতঃপর অপর ব্যক্তি এসে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বলল, তিনি তার জবাব দিলেন আর ওই ব্যক্তি বসে যাওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন বিশ নেকি। এরপর আরেক ব্যক্তি এসে বলল, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ্। তিনি তাঁর জবাব দিলেন। ওই ব্যক্তি বসে যাওয়ার পর বললেন ত্রিশ নেকি। [সুনানে আবু দাউদ: ৫১৯৫]

তবে হাদিসে বর্ণিত হয়নি এমন কোনো শব্দ সালামের মধ্যে বৃদ্ধি করা উচিত নয়। যেমন ওয়ামাগফিরাতুহু ও ওয়া জান্নাতুহু ইত্যদি ইত্যাদি। কেননা মাসনুন সালাম ‘ওয়াবারাকাতুহু’ পর্যন্ত আর এর চেয়ে বেশি শব্দে যদি সওয়াব ও কল্যাণ নিহিত থাকত, তাহলে অবশ্যই রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে তা অবহিত করতেন।

মুহাম্মদ ইবনে আমর ইবনে আত্বা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। তখন ইয়েমেন থেকে এক ব্যক্তি তাঁর নিকট এসে বলল, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ। অতঃপর এই ধরনের আরও কিছু শব্দ বাড়িয়ে বলল। ইবনে আব্বাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] সেই সময় চোখে দেখতে পেতেন না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন এই ব্যক্তি কে? তখন সবাই বলল, এই ব্যক্তি ইয়ামানের অধিবাসী। সে আপনার নিকট আসা-যাওয়া করে। অতঃপর সবাই ওই ব্যক্তিকে ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তখন ইবনে আব্বাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বললেন, ‘সালাম’ ওয়া বারাকাতুহু পর্যন্ত শেষ হয়ে যায়। [মুয়াত্তা মালেক:২৭৫৮]

 চেনা-অচেনা সবাইকে সালাম দেওয়া

এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদিস পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে। তাছাড়া শুধু পরিচিতদেরকে সালাম দেওয়া কিয়ামতের একটি আলামত। আসওয়াদ ইবনে ইয়াজিদ [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, কেয়ামতের নিদর্শনসমূহের মধ্য হতে একটি নিদর্শন হলো, শুধু পরিচিতদেরকেই সালাম দেওয়া। [মুসনাদে আহমাদ-১/৩৮৭]

 কোনো অমুসলিম কিংবা ইহুদি-খ্রিস্টানকে আগে সালাম না করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ইহুদি-খ্রিস্টানদেরকে আগে সালাম কোরো না। [সহিহ মুসলিম:২১৬৮]

তবে যদি তারা কখনো সালাম দেয়, তাহলে শুধু ‘ওয়ালাইকুম’ বলবে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আহলে কিতাবগণ যখন তোমাদের সালাম দেয়, তখন তারা ‘আসসামু আলাইকুমْ’ (তোমার মৃত্যু হোক) বলে, সুতরাং তোমরা শুধু ‘ওয়ালাইকুম’ বলবে। [সহিহ বুখারি: ৬২৫৮, সহিহ মুসলিম: ২১৬৪]

 বিদআতি ও বিভ্রান্ত ব্যক্তিকে সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রে করণীয়

বিদআত ও বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ব্যক্তিদের সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রে শরিয়তের দলিল ও সালাফে সালেহীনের আমল দ্বারা যা বোঝা যায়, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো বিদআতপন্থি যদি তার বিদআতের কারণে কাফের হয়ে যায় এবং উলামাগণ তার ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়ার হুকুম দেন, সে ক্ষেত্রে তাকে সালাম দেওয়া যাবে না। কেননা, তখন তাকে সালাম দেওয়ার বিধান অন্য কাফেরদেরকে সালাম দেওয়ার মতোই। আর যদি সে তার বিদআতের কারণে কুফরির সীমানায় না পৌঁছায়, তাহলে তাকে সালাম দেওয়া এবং সালামের জবাব দেওয়া জায়েজ আছে। কেননা মুসলমান হওয়াটাই সালামের হকদার হওয়াকে আবশ্যক করে। আর অনুরূপ হুকুম ফাসেক ও গুনাহগার মুসলমানদের ক্ষেত্রেও।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদআতিকে সালাম করা যাবে না। যেসব ক্ষেত্রে তাকে সালাম না করার মাঝেই কোনো দ্বীনি কল্যাণ রয়েছে অথবা তাকে সালাম করার ক্ষেত্রে যদি কোনো ফিতনা-ফাসাদ বা দ্বীনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেসব ক্ষেত্রে তাকে সালাম করা থেকে বিরত থাকবে। যেমন তাকে সালাম না করার দ্বারা যদি তাকে সংশোধন বা তার বিদআতি কর্মকাণ্ডের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন উদ্দেশ্য হয় অথবা তাকে সালাম করার দ্বারা যদি মানুষ তার বিদআতি কর্মকাণ্ডকে বৈধ মনে করার আশঙ্কা হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাকে সালাম দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। আর যদি তাকে সালাম না করার ক্ষেত্রে কোনো অনিষ্ট বা ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাকে সালাম দেওয়া যাবে।

 চিঠি বা অন্যের মাধ্যমে কারও কাছে সালাম পৌঁছানো সুন্নত। যার কাছে সালাম পৌঁছানো হবে, তার জন্য তার উত্তর দেওয়া ওয়াজিব। দূত বা কারও মাধ্যমে কেউ সালাম পৌঁছালে মুস্তাহাব হলো ওই দূতকে এভাবে জবাব দেওয়া ওয়ালাইকা ওয়ালাইহিস সালাম।

আনাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) খাদিজার [রাদিয়াল্লাহু আনহা] নিকট জিবরিল (আ.) সালাম পৌঁছালে খাদিজা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] বললেন, ওয়ালাইকা ওয়াআলা জিবরিল (আ.)।

[সুনানে নাসাঈ:৮৩৫৯]

রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে এক ব্যক্তি এসে বললেন, আমার পিতা আপনাকে সালাম দিয়েছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) তার জবাবে বললেন, আলাইকা ওয়ালা আবিকাস সালাম। অর্থাৎ তোমার ওপর এবং তোমার পিতার ওপর সালাম।

[মুসনাদে আহমাদ: ২৩১০৪, সুনানে আবু দাউদ: ৫২৩১]

 সশব্দে ও শুদ্ধ উচ্চারণে সালাম দিতে হবে। ‘আসসালাম’-এর হামজা, লাম ও মিমের পেশকে স্পষ্ট করে উচ্চারণ করতে হবে। হাত বা মাথার ইশারায় সালাম দেওয়া যাবে না। তবে যদি কেউ দূরে থাকে সে ক্ষেত্রে হাত দ্বারা ইশারা করা যেতে পারে। তবে সালাম মুখে উচ্চারণের সময় হাত ওঠানো সুন্নতের খেলাফ।

 চিঠি বা মেসেজ ইত্যাদির শুরুতে সালাম দেওয়া সুন্নত আর এর মৌখিক বা লিখিত উত্তর দেওয়া ওয়াজিব।

 বিশেষ কিছু অবস্থায় সালাম দেওয়া মাকরুহ এবং তার উত্তর দেওয়া জরুরি নয়। যে ব্যক্তি সালামের উত্তর দিতে সক্ষম নয়, তাকে সালাম দেওয়া মাকরুহ। যেমন সালাত আদায়রত ব্যক্তি, আজান, ইকামত, জিকির, তিলাওয়াতে মগ্ন ব্যক্তি, খুতবা দানকারী ও শ্রবণকারী, দ্বীনি শিক্ষায় নিয়োজিত, পানাহার ও পেশাব-পায়খানায় লিপ্ত ব্যক্তি, কোনো গুনাহের কাজে লিপ্ত ব্যক্তি- এদেরকে এসব কাজে লিপ্ত থাকা অবস্থায় সালাম দেওয়া মাকরুহ।

লেখক: ইমাম ও খতিব, বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, কাশিমপুর, গাজীপুর


কেন বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পেল 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মিজানুর রহমান

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট সব সেবার তথ্য একটি ইন্টার-অপারেবল প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রদানের সার্ভিস পোর্টালের কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এতে সহসা সেবা পেতে সহায়ক হবে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখার জন্যই বিডা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিডা বিনিয়োগসংক্রান্ত বিষয়াদি নিবিড় মনিটরিং করা তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যেক দেশই বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে দেশের বিনিয়োগকারীদের ওপর যে রকম সেবা দেওয়া দরকার তার চেয়ে বেশি সেবা দিতে হয় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। অবশ্যই এ সেবার ওপরই দেশের ভাবমূর্তি নির্ভর করে। সেই সেবাটা কতটুকু পাচ্ছে দেশে তা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার চিত্র থেকেই অনুমান করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ২০২৩ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের বছরের চেয়ে ১৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ব বিনিয়োগ রিপোর্ট অনুযায়ী (যা ২০ জুন ২০২৪ প্রকাশিত) বিগত বছরগুলোতে প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে- সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ২০১৯ সালে ২৮৭ কোটি ডলার, ২০২০ সালে ২৫৬ কোটি ডলার, ২০২১ সালে ২৯০ কোটি ডলার, ২০২২ সালে ৩৪৮ কোটি ডলার এবং ২০২৩ সালে ৩০০ কোটি ডলার। অন্যদিকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ স্থিতি ও হ্রাস পেয়েছে বছরওয়ারি তথ্য অনুযায়ী- ২০১৯ সালে ১৭৭৮ কোটি ডলার, ২০২০ সালে ১৯৩৯ কোটি ডলার, ২০২১ সালে ২১৫৮ কোটি ডলার, ২০২২ সালে ২০৭৫ কোটি ডলার, ২০২৩ সালে ২০৫৫ কোটি ডলার।

২০২৩ সালে এফডিআই এসেছে ৩০০ কোটি ডলার স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। গত বছরের চেয়ে এ বছর ৪৮ কোটি ডলার কম সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কম হয়েছে। আমরা যদি পিছনের দিকে তাকাই দেখা যাচ্ছে যে করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে এর প্রভাবে এফডিআই প্রায় দেশেই হ্রাস পেয়েছিল। বাংলাদেশে ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সময়ে বিনিয়োগে ভাটা পড়েছিল। মহামারি কাটিয়ে বিশ্বজুড়ে যখন স্বস্তি ফিরে আসে সব দেশেই বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে যায়। বাংলাদেশ ও এফডিআই বেড়েছিল।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আংকটাডের ২০২৪-এর ২০ জুন প্রকাশিত বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে (WIR) আরও যেসব তথ্য উঠে এসেছে তা বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে।

২০২৩ অনেক দেশের অর্থনৈতিক গতি হ্রাস পাওয়া ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিশ্বজুড়ে মোট এফডিআই কমেছে সার্বিকভাবে ২ শতাংশ। এফডিআই পরিমাণগত দিক হলো ১.৩০ ট্রিলিয়ন ডলার। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ও ১৪% কমেছে। প্রতিবেদনে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিগত তিন বছর (২০২০ থেকে ২০২২) পর্যন্ত এফডিআই ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে উল্টোটা হলো।

বিনিয়োগের হ্রাসের কারণে এফডিআই বিনিয়োগ স্টক ব্যালেন্স ও (বিনিয়োগ স্থিতি) হ্রাস পেয়েছে। ২০২২ সালে বিনিয়োগের স্থিতি ছিল ২ হাজার ৭৫ কোটি ডলার ২০২৩ সালে স্থিতি ছিল ২ হাজার ৫৫ কোটি ডলার। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে (এলডিসি) এফডিআই প্রাপ্তিতে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশ। যদিও সামগ্রিকভাবে গত বছর এলডিসিভুক্ত দেশগুলোয় এফডিআই ১৭ শতাংশ বেড়েছিল সেখানে বাংলাদেশ উল্টো হ্রাস পেয়েছে।

২০২৩ সালে তারপর ও যেসব দেশ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে আমাদের দেশে ভূমিকা রেখেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো (যা বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে প্রকাশিত)- নেদারল্যান্ডস থেকে এসেছে বিনিয়োগ ৩৬৬ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩১৪ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার, চীন থেকে ২৫৯ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১৮১ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার নরওয়ে থেকে ১৭৬ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন ডলার।

অবশ্য ৪৫টি এলডিসিভুক্ত দেশে পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে- ৫০ শতাংশ বিনিয়োগ পেয়েছে ৫টি দেশ। এর মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছে আমাদের বাংলাদেশ। গত বছর ও একই অবস্থান ছিল। শীর্ষ দুই দেশ হলো ইথোপিয়া ও কম্বোডিয়া আর ৪র্থ ও ৫ম স্থানে আছে সেনেগাল ও মোজাম্বিক।

গত বছরে এফডিআই কমে যাওয়ার বিষয়টির কারণ অবশ্যই খুঁজতে হবে। এখন থেকে বিষয়টির ওপর পর্যবেক্ষণ করা না হলে ভবিষ্যতে দেশের জন্য অর্থনীতির ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা বয়ে আনতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে দেশে অনেক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হওয়া সত্ত্বেও এবং তাদের বিশেষ অঞ্চলে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার নিশ্চিয়তা পরেও বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে উদ্বেগজনক মনে করা হচ্ছে।

ফরেন ইনভেস্টমেন্ট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক এম নূরুল কবিরের অভিমত, বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাসের ক্ষেত্রটি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে সরকারের কিছু রেগুলেশনে বিনিয়োগে অনিশ্চিয়তা তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রথা চালু ছিল। প্রণোদনা প্রাপ্তিতে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হয়েছিল। কোনো কারণ ছাড়াই এক বছর পরই সেই প্রণোদনা তুলে নেওয়া হয়। তারপর বিনিয়োগকারীদের ওপর আবার এসডি ভ্যাট চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে এদের ব্যবসা খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বিদেশিরা কিন্তু এক বছরের জন্য বিনিয়োগ করেন না। তারা দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনা নিয়ে দেশে বিনিয়োগ করতে আসে। অনেক সময় তারা বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ও বিনিয়োগের হালচাল নিয়ে ধারণা নিয়ে থাকে। সেখানে যদি দেখেন পলিসিতে অনিশ্চিয়তা আছে তাহলে তো তারা এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন কি করে?

অবশ্য নীতিনির্ধারকরা মনে করে থাকেন সস্তা শ্রমের বড় একটি উৎস বাংলাদেশে বিদ্যমান আছে বলে বিনিয়োগকারীরা এ দেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেই। তাদের জন্য বিশেষ অঞ্চল তৈরি করতে পারলে দেশে ভালো এফডিআই আসবে বলে তাদের ধারণা। বিশেষ অঞ্চলে বরাদ্দ দেওয়া হলো তারপরও বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার কারণ কি? সস্তা শ্রমের ধারণাটি কাজের ক্ষেত্রে কতটা যুক্তিসংগত? কিংবা বিদেশি বিনিয়োগ টানতে সস্তা শ্রমই কি যথেষ্ট? আমাদের বুঝতে হবে সস্তা শ্রম দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার দিন এখন শেষ। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পূর্ণ শ্রমিক প্রয়োজন- সেটা চাহিদার তুলনায় আমরা কি দিতে পারছি?

অন্যান্য দেশে জমির প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক জমি পেয়ে যায়। ভূমি আইন এর বিভিন্ন জটিলতার কারণে দেশে জমি প্রাপ্তিতে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে বিনিয়োগ কার্যাদি সম্পাদনে অনেক দেরি হয়।

টেকসই জ্বালানি সরবরাহ আরেকটি উদ্বেগের কারণ। শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের নিশ্চিয়তা নেই। এতে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায়। কাঙ্ক্ষিত আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আমাদের দেশে ভ্যাট ট্যাক্স অন্যান্য নীতিমালাগুলো দ্রুত পরিবর্তন হয় এদের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিরক্তবোধ করে।

দুর্নীতিবাজ ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম আছেই। এটির কারণে দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। তা ছাড়া ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না। ঘুষের জন্য জনপ্রতিনিধিরাও হাত বাড়ায়। তাহলে সহযোগিতা কার থেকে নেবে? সুশাসনের বড্ড অভাব এর কারণে বিনিয়োগ সম্প্রসারণে অন্তরায় হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিক করনীতি ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে আসছে। তার কোনো গুরুত্বই দেওয়া হচ্ছে না। বরং প্রতিবছর করনীতি পরিবর্তন করা হচ্ছে। এর সঙ্গে এদের সমন্বয়টা হচ্ছে না। তাছাড়া গত বছরটি বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের বছর ছিল। সরকারি ও বিরোধী দলগুলো পুরো বছরই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে অতিবাহিত করেছে। রাজনৈতিক সহিংসতা উত্তেজনাও বেশ বেড়ে ছিল। এটার কারণে বিদেশিরা বিনিয়োগে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার কারণও থাকতে পারে।

সর্বোপরি বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা এখনো আশানুরূপ নয়। তাই বাংলাদেশ যদি আরও বেশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয় তাহলে বন্দরের ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। তার উন্নয়ন করতে হবে তাহলেই এফডিআই দেশে আসবে। যেসব জায়গায় আমাদের দুর্বলতা আছে তা দ্রুত সমাধান করতে না পারলে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে যাব। তা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হতে পারে না।

লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট


চলমান বাস্তবতা ও রাজনীতি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
শেখর দত্ত

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর বেশ কিছুটা স্বস্তির মধ্যে থেকে কলামটা লিখছি। সম্পূর্ণ স্বস্তি পাওয়া যাবে পরিস্থিতি পরিপূর্ণ স্বাভাবিক হওয়ার পর। প্রজ্ঞাপন জারি এবং কোটা আন্দোলনকারী ছাত্রদের ৮ দফা দাবিনামা সরকার সাধারণভাবে মেনে নিলেও সুনির্দিষ্টভাবে দাবি বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারী ও ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া কি হয় এবং ঘটনা নানা ঘাতপ্রতিঘাতে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় তা এখনো সুস্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। কোটা আন্দোলকারীদের এক গ্রুপ এখনো আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। সর্বোপরি কোটাবিরোধী আন্দোলন একপর্যায়ে জ্বালাও-পোড়াও তথা আগুনসন্ত্রাসের দিকে মোড় নেয়। সমন্বয়কারীরা ‘দেশজুড়ে সংঘটিত ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমাদের আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই’ কথাটা বললে আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। এই তৃতীয় পক্ষ যে বিএনপি-জামায়াত ও উগ্রসন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী তা আজ সুস্পষ্ট।

অতীতে ২০১৪ সালে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ গোষ্ঠী সর্বাত্মকভাবে আগুনসন্ত্রাসে নেমেছিল। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেও এ গোষ্ঠী আগুনসন্ত্রাসে নামে; কিন্তু এবারে এ গোষ্ঠী এমন নীল নক্শা প্রণয়ন করে, যার ব্যাপ্তি ও গভীরতা ভয়াবহ। বেছে বেছে জনস্বার্থে ব্যবহৃত ও জাতির গৌরবের স্থাপনা ও অবকাঠামোতে আঘাত করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সামান্য দেশপ্রেম থাকলেও কেউ এ ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারে না। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ঘাপটি মেরে থাকা মরণ কামড় দিতে নামা তৃতীয় পক্ষ ঘটনাপ্রবাহে কখন কি অবস্থান নেয় এবং কোন সুযোগ নিয়ে আবারও অগ্নিসন্ত্রাস করতে নামে তা নিয়েও চলমান দিনগুলোতে অনিশ্চয়তা থেকে যাবে।

২১ জুলাই বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল বলেছেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতাকে আটক করে তাদের দিয়ে জোর করে সাজানো বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।’ কথাটা সম্পূর্ণ অসত্য। বাস্তবে একথা বলে তিনি একদিকে ‘কয়েকজন নেতা’কে অপমানিত করেছেন এবং অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে পরিস্থিতি ঘোলাটে রাখতে চাইছেন। তিনি আন্দোলন তথা আগুনসন্ত্রাসকে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ বলে দায় এড়াতে চাইছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় পক্ষ যেখানে ধ্বংসাত্মক কাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, সেখানে ‘ধ্বংসাত্মক’ শব্দটি তিনি উচ্চারণও করেননি। এ ব্যাপারে নীরবতাই প্রমাণ করে দেশের জন্য চরম স্বার্থহানীকর কোনো কাজ করতে আগামী দিনগুলোতেও তারা পিছপা হবে না।

তিনি বিবৃতিতে তার দলের কেউ নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেননি। কোটা আন্দোলনকারী এবং পুলিশসহ সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় পক্ষসহ নিরীহ মানুষ নিহত হলো ঠিকই, কিন্তু আগুনসন্ত্রাসের হোতাদের কিছুই হলো না। জামায়াত রয়েছে চুপটি করে। নাশকতামূলক কাজে এরা ওস্তাদ। এদিকে দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে বিদেশে এ অপশক্তি মিথ্যা প্রচার করে দেশের ভাবমূর্তি নষ্টের খেলায় মেতে উঠেছে। তাদের লক্ষ্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে সরকারের প্রতি আস্থা বিনষ্ট করা। কোটা আন্দোলনের সুযোগে আগুনসন্ত্রাসের উসকানির খেলাটা বিএনপি ও জামায়াত আসলে ভালোই খেলেছে। এ গোষ্ঠী আসলে ভুলে গেছে আগুন নিয়ে খেলার পরিণাম হয় ফ্যাককেনস্টাইনের মতোই ভয়াবহ।

নির্বাচন ও নতুন সরকার কার্যকাল শুরু করার ৬ মাসের মাথায় এ ধরনের মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের দুর্ভাগ্যজনক ও অনভিপ্রেত ঘটনা একেবারেই কাম্য ছিল না। এখন প্রধান কাজ হচ্ছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে জনজীবনে স্বস্তি, শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, তা সুনিশ্চিত করা এবং ধ্বংসাত্মক কাজে যুক্ত দোষীদের বিচার ও শাস্তি দেওয়া। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলতেই হয়, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করা এবং রাজনীতি ও আন্দোলনের নামে ধ্বংস ও নাশকতা সচেতন দেশবাসী কারোরই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ঘুরে-ফিরে তেমনটাই হচ্ছে। ফলে সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে দেশ অগ্রসর হতে পারছে না।

এবারের জুলাই মাসটা শুরুই হয় সর্বজনীন পেনশন প্রত্যয় কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন প্রত্যহারের দাবিতে ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাগাতার ধর্মঘট দিয়ে। প্রসঙ্গত, বিগত ৫ জুন হাইকোর্টে সরকারের ‘কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে’। তারপর থেকেই ‘কোটা বাতিলের সরকারি পরিপত্র পুনর্বহালের’ দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত আন্দোলন শুরু করে। একই দিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। অর্থাৎ জুলাইয়ের প্রথম দিনই এক আন্দোলন অন্য আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

কোটা আন্দোলনের সমস্যার মধ্যেই প্রত্যয় স্কিম চালু হয়। শিক্ষক নেতৃত্বের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনো আলোচনা করেছিল কি! ভালো বা বড় কিছু করতে গেলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের মানুষের সম্পৃক্ত করা একান্ত জরুরি। এটা ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ছাত্রদের আন্দোলনের উৎস হাইকোর্টের রায় আর শিক্ষকদের আন্দোলনের উৎস সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। ২ জুলাই অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মোহাম্মদ আলী বললেন, শিক্ষক আন্দোলনের ‘যৌক্তিকতা’ নেই। ওইদিন এবং এর পরেও দিনের পর দিন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের সঙ্গে শিক্ষকদের আলোচনা হলো না। এমন খবরও দেশবাসীর পড়তে হলো, শিক্ষকদের বিষয়ে সরকার ‘চিন্তিত নয়’, তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে ‘সতর্ক’। এই সংবাদ যদি সত্য হয় তবে প্রশ্ন জাগে, ওই পরিস্থিতিতে দুই আন্দোলনকে কি পৃথক করে দেখার সুযোগ ছিল?

মহামান্য হাইকোর্ট থেকে সৃষ্ট কোটাবিরোধী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি আলোচনায় ৪ জুলাইয়ের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধন করা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত বিগত ৫ জুন হাইকোর্ট কোটা বাতিলের পরিপত্র বাতিল করে রায় দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে, যা ৯ জুন চেম্বার আদালতে ওঠে। সেদিন চেম্বার আদালত আবেদনটি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ৪ জুলাই নির্ধারণ করে। সাধারণ বিবেচনা থেকে বলা যায়, সরকার ও আদালত বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। তাই প্রচার রয়েছে যে, সরকারই হাইকোর্টকে প্রভাবিত করে পরিপত্র বাতিলের রায় বের করেছে কিংবা আন্দোলনের চাপে সরকার রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করেছে, তা সম্পূর্ণ ভুয়া। ইতোমধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং ছাত্ররা ২ জুলাই হাইকোর্টের কাছে নয়, সরকারের কাছে ‘সরকারের পরিপত্র পূর্ণবহালের’ দাবি করে।

৪ জুলাই বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আটর্নি জেনারেল আমিনউদ্দিন ‘হাইকোর্টের রায় স্থগিতের’ আবেদন জানান, যা ছিল সম্পূর্ণরূপে ছাত্রদের দাবির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তখন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘নট টু ডে’। তিনি ‘সিপি (লিভ টু আপিল) ফাইল’ করতে বলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হাইকোর্টের রায় এখনো পাইনি। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘পাবেন’। সরকারের ইচ্ছা ও ছাত্রসমাজের চাওয়া স্থগিতাদেশ আইনি প্রক্রিয়ায় এ পর্যায়ে আটকে যায়। ওইদিনই একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এত আন্দোলন কিসের, রাস্তায় শুরু হয়েছে? আন্দোলনের চাপ দিয়ে কি হাইকোর্টের রায়, সুপ্রিম কোর্টের রায় পরিবর্তন করবেন?’ অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলেন, আন্দোলনের কারণে নয়, সরকারের ‘পলিসি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট রায় দেওয়ায়’ এবং ‘আইনের প্রশ্ন জড়িত থাকায়’ আবেদন করেছি।

৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত’ মন্তব্য করে বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এভাবে আন্দোলন করা সাবজুডিস। আমরা সরকারে থেকে কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে পারি না।’ ওইদিনই কোর্টের অবস্থান বিবেচনায় না এনে ছাত্রসমাজ ‘কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ‘বাংলা ব্লকেড’ ও ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছাত্র ধর্মঘটে চলে যায়। ৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী যখন চীন সফরে, সেদিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন।

সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আদালতের প্রক্রিয়া ‘দ্রুত করার সুযোগ থাকলে, সে উদ্যোগও নেবে সরকার।’ এ প্রেক্ষাপটে ১০ জুলাই দুই ছাত্রের হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ কোটা বিষয়ে ৪ সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা দেন এবং ৭ আগস্ট শুনানির দিন ধার্য করেন। পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এক. ‘সব প্রতিবাদী কোমলমতি ছাত্রদের’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে; দুই. সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রক্টর এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের ‘নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের ফিরিয়ে নিয়ে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে; তিন. শিক্ষার্থীরা আইনজীবীর মাধ্যমে ‘তাদের বক্তব্য আদালতে তুলে’ ধরা এবং ‘বিষয়টি নিষ্পত্তির সময় তাদের বক্তব্য বিবেচনা করা হবে’ বলে মতামত দেন।

কিন্তু আদালতের কথা না শুনে ছাত্ররা মহাসড়ক, রেলপথ অবরোধে যায়। আশ্চর্য, কোটা যখন স্থগিত তখন অবরোধ! ওইদিনই পত্রিকা পাঠে জানা যায় ‘প্রয়োজনে সরকার কঠোর’ হওয়ার কথা ভাবছে। ১৩ জুলাই রাজধানীর শাহবাগে পুলিশকে মারধর ও গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত করা এ নিয়ে মামলা প্রদানের খবর জনগণ জানতে পারে। ১৪ জুলাই ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেয়। এদিকে সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলার পর শিক্ষকরা ওইদিনই সিদ্ধান্ত নেন, দাবি পূরণ হয়নি, কর্মবিরতি চলবে।’ একই দিন চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যকে বিকৃত করে গভীর রাতে ছাত্ররা হলের তালা ভেঙে রাস্তায় নামে এবং ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দেয়। সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি যায় সম্পূর্ণ পাল্টে। এর পরের ঘটনা সবার জানা।

এখন প্রশ্ন হলো- ছাত্ররা আইনি বিষয় ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশ না মেনে বিশেষত সরকারের পরিপত্রবিষয়ক রায় যখন স্থগিত তখন এতটা অনড়-অধৈর্য অবস্থানে গেল কেন? সরকারের নির্বাহী বিভাগের আদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলন হতেই পারে; কিন্তু সরকার দাবির পক্ষে থাকলেও আদালতের অবস্থানের বিপরীতে আন্দোলনে গেল কেন? পাকিস্তানি আমলে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলি তখন কোর্টে কোনো বিষয় গেলে সঙ্গত কারণেই ছাত্ররা কোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করত। তখন তো আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ ছিল দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। আর এখন নিজেদের চাকরির জন্য। নিজেদের জন্য বলেই কি এতটা অস্থির? বর্তমানে ব্যতিক্রম বাদে সাধারণ ছাত্রদের কিংবা চাকরি পাওয়ার পর কাউকে কি বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে বা অবস্থান নিতে আদৌ আমরা দেখি?

উল্টোদিকে প্রশ্ন হলো- উল্লিখিত ঘটনাপ্রবাহ থেকে সুস্পষ্ট, সরকার ১৫ জুলাই অর্থাৎ প্রথম পর্যায় পর্যন্ত পদ্ধতিগতভাবে সঠিক ছিল। আন্দোলনকারীরা ছিল অস্থিরতার মধ্যে। তবে সরকার হচ্ছে আওয়ামী লীগের, যে দলের চেয়ে বেশি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আর কোনো দলের নেই। অতীতের কোটা আন্দোলন ও সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক সরকার রাজনৈতিকভাবে বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়েছিল কি? প্রকাশ্যভাবে ছাত্রদের আলোচনার আহ্বান জানাল না কেন? যদি ভেতরে ভেতরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয় এবং আন্দোলনকারীরা বসতে অস্বীকার করে, তবুও বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয়, স্মারকলিপি দেওয়ার সময় রাষ্ট্রপতি দেশের অভিভাবক হিসেবে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বললেন না কেন?

আরও একটি প্রশ্ন হলো- বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও ছাত্র- এ দুটো আন্দোলন একসঙ্গে চলতে দেওয়ার কি কোনো দরকার ছিল। সংশ্লিষ্ট বিষয় সমাধানের জন্য পাঁচ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী যখন বসলেন তখন তারা কি করলেন? সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, যিনি হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সুরক্ষা ও দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির একমাত্র ভরসা, তাকে যখন-তখন এমনকি চীন সফর শেষ করে আসা এবং আরও দুটো দেশে যাওয়ার প্রস্তুতির প্রাক্কালে সব ব্যস্ততার মধ্যে সব বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে কেন? দেশ ও জনবিরোধী শক্তির সুপরিকল্পিত সহিংসতার মাধ্যমে দেশের যে ক্ষতি হলো সেদিকটির প্রতি লক্ষ্য রেখে মন্ত্রীসহ সব পদাধিকারী, দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সবার যার যার অবস্থানে থেকে একান্ত কর্তব্য প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করা। বিশেষত মন্ত্রীদেরই তো সামনে থেকে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে যার যার মন্ত্রণালয় বিষয়ে রাজনীতি বিবেচনায় নিয়ে কথা বলা এবং সমাধানের পথ বের করা প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মের কথা ভেবে চরম দুঃখ ও চিন্তা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে অনেক কথা বুকে রেখে আজ এখানেই কলামটা শেষ করলাম।

লেখক: রাজনীতিক ও কলামিস্ট


দূর করতে হবে দুর্নীতি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মো. রহমত উল্লাহ্

বাংলাদেশ বেতারের একজন সহকারী প্রকৌশলী আদনান ফেরদৌস চাকরি ছেড়ে সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করেছেন বলে অনেক আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে। ক্যাডার পদ ছেড়ে নন-ক্যাডার পদে যাওয়াটাকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না, দেখার কথাও নয়। কেউ কেউ বলছেন তথ্য বিভাগে পদোন্নতি অত্যন্ত সীমিত, তাই এখানে কর্মকর্তারা থাকতে চান না। এটি যৌক্তিক বলে মনে হয় না। কেননা, আমার জানা-দেখা অনেক সাব-রেজিস্ট্রার সারাজীবন একই পদে চাকরি করে অবসরে গিয়েছেন। অবশ্য তারা প্রায় সবাই অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তা সবাই জানেন। হয়তো এ কারণেই আদনান ফেরদৌসের চাকরি পরিবর্তনের উদ্দেশ্য অসৎ বলে অগণিত মন্তব্য দেখা যায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রায় সবাই তার চিন্তা-চেতনাকে বিভিন্নভাবে অসৎ আখ্যায়িত করেছেন। এটি অযৌক্তিক নয়। সবাই জানেন সাব-রেজিস্ট্রারের অবৈধ আয় লাগামহীন। (গত ৯ জুন ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে, ‘কুমিল্লার আদর্শ সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস: দুই বছরে ২৫ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার।’) কেউ কেউ বলেছেন, যেহেতু আদনান ফেরদৌসের অসৎ উদ্দেশের বিষয়টি প্রায় প্রমাণিত, সেহেতু তাকে সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করতে দেওয়া উচিত হয়নি। বাস্তবে আইনগতভাবে তা সম্ভব নয়। এসব সমালোচনা শুনে সম্পদের পাহাড়ে বসা অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সাব-রেজিস্ট্রাররা হয়তো একটুও লজ্জা পাচ্ছেন না, বরং আমাদের বোকা ভেবে মুচকি হাসছেন!

আদনান ফেরদৌস যদি সাব-রেজিস্ট্রার পদ ছেড়ে বাংলাদেশ বেতারের সহকারী প্রকৌশলী পদে যেতেন তো নিশ্চয়ই এমন সমালোচনা হতো না। তাহলে এখন তাকে নিয়ে এত সমালোচনা কেন? তার সঙ্গে অন্যান্য যারা সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করেছেন, তাদের নিয়ে কিন্তু কোনো সমালোচনা আমরা শুনছি না। যদিও তাই হওয়া উচিত ছিল। তাদের উদ্দেশ্যও কিন্তু আদনান ফেরদৌস থেকে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। তারাও তো অন্য চাকরি থেকে সাব-রেজিস্ট্রার পদকে লোভনীয় মনে করে অগ্রাধিকার দিয়ে অনেক চেষ্টা করে নিয়োগপত্র হাত করে যোগদান করেছেন। কেউ তাদের ঘৃণা করে বয়কট করবেন বা আত্মীয়তা করতে চাইবেন না, এমনটি হবে বলে মনে হয় না। বরং আগে যারা পাত্তা দিতেন না, এখন তারা প্রায় সবাই অধিক গুরুত্ব দেবেন। দেখতে যেমনই হোক উত্তম পাত্র-পাত্রী পাওয়ার ও সফল স্বামী-স্ত্রী হওয়ার প্রতিযোগিতায় তারা অন্য অনেক চাকরির তুলনায় বহুগুণ এগিয়ে গেছেন। খোঁজ নিলে জানা যাবে তারা এলাকায় ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে আদৃত হচ্ছেন, বাহবা পাচ্ছেন!

আমাদের দেশে কর্ম পছন্দ-সংক্রান্ত সমালোচনার বিষয় কিন্তু আরও অনেক আছে। যখন প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ ইত্যাদি বিশেষ ডিগ্রিধারীরা এসে কাস্টম অফিসার, পুলিশ অফিসার, অ্যাডমিন ক্যাডার ইত্যাদি পদে নিয়োগ নিচ্ছেন ও যোগদান করছেন তখন কিন্তু এত সমালোচনা শোনা যাচ্ছে না। তাদের উদ্দেশ্য কি প্রশ্নবিদ্ধ নয়? যখন শিক্ষকতার মতো সম্মানজনক কাজ তথা শিক্ষা ক্যাডার বাদ দিয়ে অনেকেই অন্য ক্যাডারে বা চেয়ারে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন ও যাচ্ছেন তখন কিন্তু এত সমালোচনা হচ্ছে না। অ্যাডমিন ক্যাডারে কেউ সুযোগ পেলে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি করা হয়, তাকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য অনেক কিছুই করা হয়! তার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না! অথচ শিক্ষার্থীদের ক্যাডারের যোগ্য করে তোলার জন্য যারা নিয়োজিত থাকেন, বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করেন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন, সেই শিক্ষা ক্যাডারে কেউ সুযোগ পেলে তাকে কিন্তু সংবর্ধনা দেওয়া হয় না! বিসিএস পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় প্রায় সব প্রার্থীর সর্বশেষ পছন্দ থাকে শিক্ষা ক্যাডার! সর্বশেষ সুযোগ কাজে লাগিয়েও অন্য পেশায় চলে যেতে চান, চলে যান শিক্ষক। এসব কি দুঃখজনক নয়? সর্বাধিক যোগ্যরা শিক্ষক হবেন, অন্য পেশা ছেড়ে শিক্ষকতায় আসবেন, শিক্ষকরা সর্বাধিক সচ্ছল ও সম্মানিত হবেন, তবেই তো শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে জাতি। অথচ এ জন্য আমরা কিন্তু তেমন কিছুই করছি না! যখন উচ্চশিক্ষিতরা অনেক চেষ্টা-তদবির করে অবৈধ আয়ে ভরপুর বিভিন্ন বিভাগের ছোট ছোট পদ হাত করছেন ও যোগদান করছেন তখন কিন্তু আমরা তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে খুব বেশি সমালোচনা করছি না। বরং প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে গেলে, পরিশ্রম করে বৈধ উপার্জন করতে গেলে, সৎভাবে সাধারণ জীবনযাপন করতে গেলে, আমরা অনেকেই বলছি- সে লেখাপড়া করে কী করেছে? একটা সরকারি চাকরি ম্যানেজ করতে পারে নাই! আবার সরকারি চাকরি সৎভাবে করে, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে, দেশকে বা মানুষকে সেবা দিয়ে সাধারণ জীবনযাপন করে, কেউ অবসরে এলে আমরাই কেউ কেউ বলছি- সে সারাজীবন সরকারি চাকরি করে কিছুই করতে পারল না! অথচ সব চাকরির ক্ষেত্র যদি সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত হতো, সব চাকরির বৈধ সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে যদি ন্যায্যতা নিশ্চিত হতো, পদ-পদবি-পরিচিতি নির্বিশেষে সব অপরাধীর যথাযথ শাস্তি যদি নিশ্চিত হতো, সর্বক্ষেত্রে সবার ন্যায্য অধিকার ও প্রাপ্য মর্যাদা যদি নিশ্চিত থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই আলোচিত পরিস্থিতির চিত্রটি অন্যরকম হতো।

দুর্নীতিবাজদের মোটা অঙ্কের অনুদান নিয়ে অনেক মসজিদ-মাদ্রাসায় কমিটির নেতা-কর্মী বানানো হচ্ছে! সেসব দুর্নীতিবাজদের তোয়াজ করে বেড়াচ্ছেন কতিপয় হুজুর ও তাদের অনুসারীরা! অধিক চতুর দুর্নীতিবাজরা সুদ খেয়ে, ঘুষ খেয়ে, চাঁদাবাজি করে, দখলদারি করে এসে স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা বানিয়ে সেখানকার নেতা বনে যাচ্ছেন। এসব করে অবৈধ ও কালো টাকা ধর্মীয়ভাবে সাদা হয় ও অবৈধ উপার্জনের পাপ মাফ হয় বলে আমার জানা নেই! পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, টাকা হলে সবই হয়! যার টাকা নেই তার কিছুই নেই! এই অশুভ পরিস্থিতি কিন্তু অনেক মানুষের দুর্নীতির আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে!

বেশির ভাগ ভোটারের মানসিকতা এমন হয়েছে যে, টাকা না দিলে, খাবার না দিলে, সুযোগ-সুবিধা না দিলে, ভোট দিবে না; প্রার্থী যতই সৎ ও যোগ্য হোক! অবৈধ সুযোগ-সুবিধা না দিলে সঙ্গে বা পাশে থাকবে না কর্মী, দায়িত্ব পালন করবে না কর্মচারী। রোদ-বৃষ্টি-ঈদ-পূজা ইত্যাদি উসিলা পেলেই জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিবে ব্যবসায়ীরা, ভাড়া বাড়িয়ে দিবে রিকশাওয়ালা ও গাড়িওয়ালা! সুযোগ পেলেই সামান্য পানি মিশিয়ে দিবে দুধে। অর্থাৎ যার যতটুকু সুযোগ বা ক্ষমতা আছে, সে ততটুকুই দুর্নীতি করতে উদগ্রীব! এতে মনে হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছি! মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের চিন্তা-চেতনা সর্বত্রই দুর্নীতির পক্ষে যুক্তি খুঁজে! তাদের কেউ এক টাকার দুর্নীতিবাজ, কেউ লাখ টাকার দুর্নীতিবাজ, কেউ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিবাজ। নীতিকথা আজ মূল্যহীন, নীতিবানরা আজ অবহেলিত, বিজ্ঞরা মূর্খের অধীন, সততা মানেই দরিদ্রতা। সবকিছুই যেন গ্রাস করেছে দুর্নীতির দুষ্টচক্র! দুর্নীতি করা, দুর্নীতিকে সমর্থন করা, দুর্নীতিবাজকে সম্মানিত করা, যখন সামাজিকভাবে স্বাভাবিক হয়ে যায় তখন সমাজের মানুষের মানসিকতা কতটা অস্বাভাবিক হয়ে গেছে, তা কিঞ্চিৎ অনুমান করা যায়! এমন অস্বাভাবিক মানসিকতার ধারকই আদনান ফেরদৌস ও অন্যরা। এমন অস্বাভাবিক দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতা এক দিনে কিংবা এক যুগে তৈরি হয় না, আমাদেরও হয়নি। এটি কত যে ভয়াবহ, তা আমরা অনেকেই অনুমান করতে পারছি না এখনো। মনে পচন ধরে গেলে মানুষের আর অবশিষ্ট থাকে না কিছুই!

আমাদের সবারই যে দুর্নীতি পরায়ণ মানসিকতা তৈরি হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় না, দিতে পারে না, এমন অগণিত ভালো মানুষ এখনো আমাদের সমাজের আনাচে-কানাচে বিদ্যমান। তবে সামাজিকভাবে স্বেচ্ছায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সক্রিয় মানুষের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা, তেমনটি করতে গেলে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। কেউ ন্যায়ের পক্ষে ও অন্যায়ের বিপক্ষে সামান্য এগিয়ে এলেই আঘাত করা হয়, ফেলে দেওয়া হয়! এর বিচার চাইতে গেলেও বিপদ হয়! আমরা স্বীকার করি বা না করি বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভালোরা ঐক্যহীন, শক্তিহীন ও দুর্বল আর মন্দরা ঐক্যবদ্ধ, শক্তিধর ও সবল! এমতাবস্থায় আমাদের নতুন প্রজন্মের ভালোরা, যোগ্যরা ও দক্ষরা বাধ্য হয়েই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দেশ থেকে, পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। এতে মাঠ খালি পেয়ে খুশি হয়ে তবল বাজাচ্ছে অযোগ্য আর দুষ্টুরা! আমাদের অনেকেই বিশ্বসেরা হচ্ছে বিদেশে গিয়ে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে। অথচ তারা দেশে থাকলে দেশটাই বিশ্বসেরা হতে পারত তাদের দ্বারা। যারা বিদেশ যেতে পারছে না বা চাচ্ছে না; অথচ সৎভাবে পরিশ্রম করে সচ্ছল জীবনযাপন করতে চাচ্ছে, তারা চাকরি নিচ্ছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, ব্যাংক ও আইটি সেক্টরসহ বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে আমাদের অনেক যোগ্য সন্তান। দুর্নীতিকে ঘৃণা করার মতো, দুর্নীতিমুক্ত থাকার মতো, সৎ জীবনযাপন করার মতো, পরিশ্রম করে অধিক অর্থ উপার্জন করার মতো, দেশ-জাতিকে ভালোবাসার মতো অনেক মানুষ এখনো অবশিষ্ট আছে এবং আরও অনেক মানুষ তৈরি হচ্ছে। এটি অবশ্যই আমাদের শুদ্ধ সমাজ ফিরে পাওয়ার সম্ভাব্য আশার বিষয়। তাই যেকোনো মূল্যে ওদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে অনুকূল পরিবেশ। শক্তিশালী ও বাস্তবমুখী করতে হবে শুদ্ধতার সংগ্রাম। পরাস্ত করতে হবে দুর্নীতির দুষ্টচক্র। যার জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন ও নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি অপরাধের শাস্তি নিশ্চিতকরণ ব্যতীত কোনো দেশের মানুষই দুর্নীতিমুক্ত হয়নি, হবে না। মহান সৃষ্টিকর্তাও তাই মানুষের জন্য উপদেশ দেওয়ার পাশাপাশি শাস্তির বিধান দিয়েছেন। যেখানে শাসন থাকে না, শাস্তির ভয় থাকে না, বিবেকের দংশন থাকে না সেখানেই মানুষ অবাধ্য হয় বেশি। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। ক্যান্টনমেন্টের ভিতর ঢুকলেই সব ট্রাফিক আইন মেনে চলে সব ড্রাইভার। যে দেশে নৈতিক শিক্ষা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা যত বেশি সে দেশে দুর্নীতি তত কম। সেসব দেশের কৌশল আমাদের জন্য হতে পারে অনুসরণীয়। একটি দেশ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হতে যেমন দীর্ঘ সময় লাগে তেমনি দুর্নীতি থেকে উত্তরণের জন্য আরও বেশি সময় প্রয়োজন হয় এবং সেটি ধরে রাখার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। দেশ ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই শুদ্ধতার সে সংগ্রাম আরও শুদ্ধ করা, সুসংগঠিত করা ও শক্তিশালী করা অত্যাবশ্যক।

লেখক: সাহিত্যিক, শিক্ষক ও কলামিস্ট

বিষয়:

পরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মো. আব্দুস সোবহান পিপিএম

বাংলাদেশ সুজলা-সুফলা এক শান্তিময় দেশ। এ দেশের মৃত্তিকায় জন্ম নিয়েছে অনেক মহীয়সী নর-নারী, অনেক বীর ও বীরাঙ্গনা। আবার এ দেশের সম্পদের লোভে বিশেষ করে সেই গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, সমুদ্র, নদ-নদী, বিল, হাওর, বাঁওড়, পুকুর ও অন্যান্য জলাশয়ভরা মাছ ও সম্পদের কারণে বিদেশিরা বিভিন্ন সময় এ দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে এবং এ দেশ শাসন করেছে। তবে এ প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি আমাদের অবহেলা, অযত্ন, অত্যাচার ও নিপীড়নের কারণে পৃথিবীর সব সম্পদের বহুলাংশ অবনয়ন ও ক্ষতি হয়েছে। সেই সঙ্গে আমাদের সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের অভাবে আমরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। প্রথমে আমাদের মৃত্তিকার স্বাস্থ্য সম্পর্কে আলোচনা করা যাক- একটা কথা বহুল প্রচলিত ও প্রচারিত আছে, এ দেশের মৃত্তিকা খুবই উর্বর এবং এ মৃত্তিকায় যেকোনো সবজি বা ফসলের বীজ বপন করলেই তা কোনো পরিচর্যা ছাড়াই দ্রুত বর্ধিত হয় এবং ফলন দেয়; কিন্তু এ মিথ বা প্রচলিত কথা এখন আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

বাংলাদেশের মৃত্তিকার এক বড় অংশে জৈব পদার্থের সংকট রয়েছে। এক গবেষণা থেকে জানা যায় বাংলাদেশের প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ জমির জৈব পদার্থের পরিমাণ ১ শতাংশের নিচে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জমিতে শতকরা ৩% থেকে ৬% জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। এর কারণ হিসেবে বলা যায় আমাদের রাসায়নিক সারের ওপর অতিশয় নির্ভরতা এবং জৈব সারের প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে বা বাদ দেওয়া বা আমলে না নেওয়া। রাসায়নিক সারের অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এবং উত্তরবঙ্গের অনেক ফসলি জমিতে এখন ফসল উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের ২০২২ সালের এক জরিপ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ বিশ্বে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সর্বোচ্চপর্যায়ে আছে। আমার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার সময় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) ভ্রাম্যমাণ পরীক্ষাগারের কাজের নিমিত্তে বছরে ২ বার দেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন থানায় মৃত্তিকা পরীক্ষা ও ফার্টিলাইজার রিকমন্ডেশন দেওয়ার সময় দেখা গেছে কৃষকরা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহার করে থাকে। যা জলাশয়ের পানি, মৃত্তিকা, প্রাণী, মৎস্য ও অনুজীবের ক্ষতির কারণ। আমার এরূপ একজন কৃষকের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। এটা ১৯৯৯ সালের ঘটনা ওই সময়ে আমি মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে রাজশাহী পরীক্ষাগারে নিয়োজিত ছিলাম। তো এক দিন একদল কৃষক আসবে জেনে আমার অফিসপ্রধান আমাকে বললেন, আপনি কৃষকদের একটা ক্লাস নেবেন। সে মোতাবেক যথারীতি আমি ক্লাস নিতে শুরু করলাম। ক্লাসের শেষ পর্বটা ছিল কৃষকদের জমি ও জমির ফসলের অবস্থা জানা। এরূপ মতবিনিময়ের সময় একজন কৃষক ভাই অশ্রুজল চোখে আমার কাছে এসে বললেন, আমার জমিতে এখন বেগুন চাষ করতে চাই; কিন্তু বেগুনগাছ আর বড় হচ্ছে না এবং বেগুনের ফুল ও ফল হচ্ছে না। তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম জমিতে কি কি সার ব্যবহার করেন? তিনি জবাবে জানান কেবল রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন। তখন আমি তাকেসহ সব কৃষক ভাইদের বোঝালাম আপনাদের জমিতে জৈব সারের পরিমাণ অধিক মাত্রায় বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে গোবর সার, কম্পোস্ট, কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট), ছাই, বাড়ির গৃহস্থালির আবর্জনা, ধানের খড়, গাছের পাতা ইত্যাদি দ্বারা সার তৈরি করে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। একই ফসল বারবার চাষ করা যাবে না। বরং শস্যবর্তন করতে হবে। অর্থাৎ একাধারে সবজি চাষ না করে ধান, পাট, গম, ভুট্টা, ডালজাতীয় ফসল ও ধৈঞ্চার মাধ্যমে সবুজ সার তৈরি করা যেতে পারে।

আমাদের দেশে সম্পদ নেই এ কথা সত্য নয়; আমাদের দেশে জৈব সার আছে, জৈব সার তৈরির উপাদানও রয়েছে; কিন্তু আমাদের সচেতনতা ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ লক্ষ্যে দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় প্রকাশিত ড. মো. আবুল কাসেম ভাইয়ের লেখার একটু উদ্ধৃতি টানছি। চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা খালের তীরে ৫০০ ডেইরি ফার্ম আছে। ওইসব ডেইরি ফার্মের মহামূল্যবান জৈব পদার্থ গোবর ও অন্যান্য বর্জ্যগুলো সঠিক অব্যবস্থাপনার অভাবে এবং কর্ণফুলী খালের পানিতে ফেলার কারণে পানি দূষিত হচ্ছে এবং খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ওইসব ডেইরি ফার্মের মালিকরা ও কৃষকরা অনুনয়-বিনয় করেছেন, তারাও চান না এসব ডেইরি বর্জ্য খালে ফেলতে এবং এর একটা সুরাহা চান। যাহোক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ কর্ণফুলীর শিকলবাহা খালের পাড়ের ডেইরি ফার্মগুলোর বর্জ্যগুলো সারে রূপান্তরিত করতে প্রভৃতি সহায়তা করতে পারেন। তা ছাড়া কেঁচো কম্পোস্ট (ভার্মি কম্পোস্ট) তৈরি করলে তা জৈব সারের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে সদয় দৃষ্টি দেবেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসতে পারে।

পানি দূষণ

বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে মিষ্টি পানির তীব্র অভাব রয়েছে। এ সংকট দিন দিন আরও তীব্রতর হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে ভূ-পৃষ্ঠের পানির দূষণ, অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক মাত্রায় উচ্চফলনশীল ফসল আবাদে প্রচুর পরিমাণ ভূ-পৃষ্ঠের পানি ও ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার ও পানির স্তর নেমে যাওয়া এবং ভারী ধাতু পানির সঙ্গে মিশে যাওয়া উল্লেখযোগ্য। সে জন্য আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে। বাসাবাড়িতে রান্না, গোসল ও টয়লেটে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হওয়া, গৃহস্থালির আবর্জনা মিউনিসিপ্যালটির বর্জ্য ও কলকারখানার বর্জ্যগুলো সঠিকভাবে শোধন (ট্রিটমেন্ট) করে পানিতে ফেলার ওপর জোর দিতে হবে। ফসলের ক্ষেত্রে পোকা-মাকড় নিধনে কীটনাশক অতিমাত্রার ব্যবহার করা এবং সেগুলো বৃষ্টির পানি, সেচের পানি ও বন্যার পানির সঙ্গে মিশে পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী জলাশয়ের পানিতে মিশে এবং পানির দূষণ ঘটায়। পানি দূষণের ফলে পানিতে প্রয়োজনীয় দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যায় যা জলজ প্রাণীর জন্য অপরিহার্য। তাছাড়া BOD (Biochemical oxygen demand), COD (Chiemi oxygen demand) বেড়ে যায়। ঢাকার চারপাশের বিশেষ করে সাভারের ট্যানারির পার্শ্বস্থ নদীর পানিতে এরূপ প্যারামিটারগুলোর মাত্রা অনুমোদিত মাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় মর্মে সূত্র থেকে জানা যায়। আবার সমুদ্রে ও নদীতে বিভিন্ন জলযান থেকে তেল নিঃসরণ ও বিভিন্ন বর্জ্য ডাম্পিং করার মাধ্যমেও পানিদূষণ হয়ে থাকে। ঋতুভিত্তিক ফসল চাষ এবং অপেক্ষাকৃত কম পানি গ্রহণকারী জাত উদ্ভাবন করতে হবে এবং সবাইকে অতিমাত্রায় সচেতন হতে হবে।

বায়ুদূষণ

বায়ুদূষণের কারণেই বর্তমান বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। বায়ুদূষণ হয়ে থাকে জীবশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, ইটের ভাটা, ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ (যেখানে না ঢেকেই সিমেন্ট, বালু, মাটি ব্যবহার করা হয়), গাড়ি ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া, গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন, পানিতে নিমজ্জিত ধান চাষ করা (Submerged rice cultivation), সিগারেটের ধোঁয়া, যুদ্ধের কারণে ব্যবহৃত বিস্ফোরক এবং বিস্ফোরণ ও বোমা, বন-বনানী ও বৃক্ষরাজিতে অগ্নিসংযোগ এবং উজাড় ও সামুদ্রিক শৈবালের বৃদ্ধি-ব্যাহত হওয়ার কারণে। প্রকৃতির প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতা, বিশেষ করে বৃক্ষ নিধন দিন দিন সারা পৃথিবীব্যাপী বাড়ছে। এসব বিষয় দেখার জন্য যেন কেউ নেই। অথচ এ বিশ্বের সব মানুষকে অচিরেই এ জন্য অনেক মূল্য দিতে হবে। একটি সূত্র থেকে জানায়, ঢাকা নগরীর বাতাস দূষকের মাত্রা অনুমোদিত মাত্রার থেকে পাঁচগুণ বেশি। ঢাকা নগরী পৃথিবীর দূষিত নগরীগুলোর অন্যতম। বায়ুদূষণ ফুসফুস শ্বাসপ্রশ্বাস, স্নায়ুতন্ত্রের রোগ, শিশুদের মানসিক রোগ এবং তাদের ব্যবহারে ও আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে। ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা ধারণারও অতিরিক্ত বেড়েছে। যা থেকে জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। এগুলো দ্রুত থামাতে হবে। এক গবেষণার পরিসংখ্যানের তথ্য থেকে জানা যায়, ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর ২০০ শত মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হচ্ছে এবং ১৫০০০ মানুষ মারা যাচ্ছে।

শব্দদূষণ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে শব্দ যদি ৬৫ ডেসিবলসের ওপরে থাকে তাহলেই তা শব্দ দূষণ হিসেবে পরিগণিত। গাড়ি, বিমান, কলকারখানার মেশিন, লাউডস্পিকার, রেডিও, টিভি, বোমাবাজি, হোটেল-রেস্তোরাঁর মিউজিক, ইঞ্জিন, নির্মাণ কাজ ইত্যাদি থেকে উদ্ভূত শব্দের মাধ্যমে শব্দদূষণ হয়ে থাকে। শব্দদূষণ নগরবাসীর জীবনে বিরূপ-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং এর সঙ্গে জীবের স্বাস্থ্য-সমস্যা সরাসরি জড়িত। শব্দদূষণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, উত্তেজনা, যোগাযোগের সমস্যা, ঘুমের সমস্যা, হৃদরোগ, শিক্ষণে ব্যাঘাত, শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়া, উৎপাদনশীলতা হারানো প্রভৃতি জাতির ক্ষতি হয়। আমরা শব্দদূষণ থেকে পরিত্রাণ পেতে যানবাহন ও মেশিনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, রেডিও, টেলিভিশন, মাইক, মিউজিক লো ভলিউমে শোনা, যন্ত্রপাতি যখন ব্যবহার হয় না, তখন সেগুলোকে বন্ধ করে রাখা, ইয়ার প্লাগ ব্যবহার, বেশি বেশি গাছ লাগানো ও সর্বোপরি সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারি। শব্দদূষণ কমানো ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শব্দের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মানুষসহ অন্য প্রাণিকুল সুরক্ষা পেতে পারে।

পাখি, মৎস্য ও প্রাণীর সুরক্ষা

আইইউসিএনের সর্বশেষ লাল তালিকা মোতাবেক আজ বাংলাদেশের অনেক প্রজাতি ভয়াবহ জেনেটিক ক্ষতির মুখে পৌঁছেছে। এ ধরনের প্রজাতির বিস্তারিত তথ্য অনেক সময় পাওয়া যায় না। তবে বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে সমস্যাগুলোর মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশের ৩০৫টি প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৯ প্রজাতির পাখি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ছিল ১৯৭৫ সালে ৩৫০টি (হেনরিচ, ১৯৭৫), ১৯৯৮ সালে ছিল ৩৬২টি (জলিল, ১৯৯৮), ২০০৪ সালে ৪৪০টি (ইউএনডিপি, ২০০৪); কিন্তু সর্বশেষ আইইউসিএনের ক্যামেরা ট্রাপ জরিপ থেকে এ সংখ্যা পাওয়া গেছে ১০৫টি (আইইউসিএন, ২০১৫)। এ ছাড়া সুন্দরবনের চিত্রা হরিণের সংখ্যা ছিল ১৯৭৫ সালে ৮০,০০০টি (হেনরিচ, ১৯৭৫), ২০০৭ সালে ৮৩,০০০টি (দে, ২০০৭) এবং বর্তমানে সুন্দরবনের হরিণের সংখ্যা বেড়েছে মর্মে জানা যায়। অন্যদিকে, নিঝুম দ্বীপে ২০০৬ সালে হরিণ ছিল ১৪,০০০টি, যা ২০১৫ সালে ২০০০-এর কমে চলে আসে (ফিরোজ এবং উদ্দিন, ২০১৫)। সাইক্লোন রেমালের আঘাতে সুন্দরবনে ৩০টি হরিণের মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া বনরক্ষীরা আরও ১৫টি আহত হরিণ উদ্ধার করেছে। পূর্বে সুন্দরবনে বানরের সংখ্যা ছিল ১,৫২,৪৪৪টি যা কমে হয়েছে ১,২৬,২২০টি। উপরন্তু, ২০১৯ সালের মৎস্য সপ্তাহের বুলেটিন থেকে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশ থেকে ৩০ প্রজাতির সাধু-পানির মৎস্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং ৯টি প্রজাতির মৎস্য বিলুপ্তির পথে। তা ছাড়া এশিয়ার দেশগুলোতে বন্যপ্রাণী হত্যা, নির্যাতন ও পাচার হয়ে থাকে। এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। পাখি, মৎস্য, প্রাণী ও উদ্ভিদ রক্ষার্থে অভয়াশ্রম গড়ে তোলা, সামাজিক সচেতন বৃদ্ধি, সামাজিক আন্দোলন ও প্রয়োজনে আইনানুগ শক্তি প্রয়োগের নিমিত্তে পরিবেশ পুলিশ গঠন করা যেতে পারে।

বন-বনানী ও বৃক্ষরাজির সুরক্ষা

সূত্র থেকে জানা যায় বিগত ১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জাতি সংঘ ও FAO-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে শতকরা ১১.১ ভাগ বন-বনানী রয়েছে। সে জন্য আমাদের নতুন করে বনায়ন শুরু করতে হবে। পারিবারিক বনায়ন, সামাজিক বনায়ন, সরকারি উদ্যোগে বনায়ন, সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে নতুন চারা গাছ লাগানো কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। পাশাপাশি ব্যাপকভাবে বৃক্ষ নিধন এবং বৃক্ষে অগ্নিসংযোগ বন্ধকরণে র‌্যালি, লিফলেট, পথসভা, নাটক, আলোচনা সভা ও বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করতে হবে। মানুষের অবিবেচনা এবং অপরিণামদর্শী কার্যক্রমের কারণে বিশ্বের প্রাণিকুল, উদ্ভিদ রাজি, অনুজীবগুলো এবং জীববৈচিত্র্য প্রতিনিয়ত বিলুপ্ত হচ্ছে এবং মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে এবং সাইক্লোন রেমাল, মোখা, সিডর, আইলা ইত্যাদি তাপপ্রবাহ, ভূমিধস, বন্যা, ক্ষরা, অতিমাত্রার শীত ও শৈত্যপ্রবাহ বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া এবং পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের দূষণের পেছনে মানুষই মূলত দায়ী। আমাদের পরিবেশদূষণ বন্ধ থামাতে হবে এবং সব কাজের ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও পরিবেশকে প্রাধিকার দিতে হবে। আর পরিবেশের উপাদানগুলোর যথাযথ পরিচর্যা, সুরক্ষা ও উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমেই পরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। তাহলেই বাংলাদেশ এবং বিশ্বমানবতা ও আধুনিক সভ্যতা বড় আকারের বিপদ থেকে মুক্তি পাবে।

লেখক: কমান্ড্যান্ট (এডিশনাল ডিআইজি) পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল (পিএসটিএস), বেতবুনিয়া, রাঙামাটি


দুর্জন সর্বদাই পরিত্যাজ্য!

আপডেটেড ১৭ জুলাই, ২০২৪ ১০:৫৩
মোতাহার হোসেন

ছাত্রাবস্থায় ভাবসম্প্রসারণ পড়েছি, ‘দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।’ কারণ বিদ্যা এবং চরিত্র এ দুটি মানবজীবনে মূল্যবান সম্পদ। তাই বিদ্বানের সঙ্গ কল্যাণকর কিন্তু বিদ্বান অথচ চরিত্রহীন এমন ব্যক্তির সঙ্গ কখনো সমাজের জন্য, দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়, এদের সঙ্গ সর্বদাই পরিত্যাজ্য। এ ধরনের বিদ্বান ব্যক্তিরা তাদের অসৎ চরিত্রের মাধ্যমে সজ্ঞানে দেশ, জাতি ও সমাজের ভয়ানক ক্ষতি করেন। অন্যদিকে, বিদ্বান ব্যক্তি সর্বত্র সম্মানিত। কিন্তু দুর্জন অর্থাৎ খারাপ প্রকৃতির লোক বিদ্বান হলেও সে সমাজের দুশমন। সবাই তাকে ঘৃণা করে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হতে পারে, ‘দুর্জন আর দুর্নীতিবাজ’ বিদ্বান হলেও তাদের পরিত্যাজ্য করা উচিত। কারণ দুর্নীতির দুষ্ট ক্ষত সমাজের অগ্রগতি, মানুষের প্র্যত্যাশা, স্বপ্নকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত করে। তা ছাড়া বাস্তবে দেশের অধিকাংশ মানুষই সৎ। কেবল কিছু কিছু সরকারি, আধা-সরকারি সংস্থা, সেবাধর্মী সংস্থার কতিপয় কর্মকর্তা কর্মচারীর দুর্নীতির কারণে আজকে সরকারে যারা আছেন, বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের প্রতিও তির্যক দৃষ্টি পড়ছে, অভিযোগের আঙুল তুলছেন।

মূলত সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের বেনজির, চট্টগ্রামে পুলিশের এডিসি কামরুল, এনবিআরের মতিউর, মতিউরের দুই স্ত্রী, চার সন্তান, ক্যাশিয়ার, বান্ধবী, ফয়সাল, এনামুল, ইসলাম, পলিটেকনিক শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট বাণিজ্যে জড়িত চেয়ারম্যান আলী আকবর খান, সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামান, নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ জালকারী প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান, তার স্ত্রী নুরুন্নাহার মিতু, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিন আলী ও দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির ডিরেক্টর বুলবুল আহমেদ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অতিরিক্ত প্রধান মালেক, মিঠু, প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে আলোচিত পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক ড্রাইভার আবেদ আলী জীবন, তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামসহ ১৭ জনকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আটককৃতদের ছয়জনই সরকারি কর্ম-কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে আলোচনা, নিউজ প্রকাশ এবং এ নিয়ে সরকারের দৃঢ় অবস্থান সম্পর্কে আলোকপাত করাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস রহস্য উন্মোচিত হলো সম্প্রতি। প্রশ্ন ফাঁস অব্যাহত থাকায় জাতির বহু মেধাবির মেধার অবমূল্যায়ন হচ্ছে আবার যারা কম মেধাবী অথচ ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে নিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে। সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত খোদ বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাই। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির তিন কর্মকর্তা, তিন কর্মচারীসহ ১৭ জনকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। এই চক্র অন্তত একযুগ ধরে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার চাকরির ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। আর এ কাজ করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন প্রত্যেকেই। পিএসসির প্রশ্নফাঁস চক্রের ১৪ জনের ব্যাংক হিসাবে মোটা অঙ্কের লেনদেনের তথ্য পেয়েছে তদন্তকারী দল। তাদের প্রত্যেকের নামে অন্তত ৫টি থেকে সর্বোচ্চ ২০টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর, সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী, অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান ও ডেসপাস রাইডার সাজেদুল ইসলামের হিসাবে।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির, সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবন ও তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম, ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা-প্রহরী শাহাদাত হোসেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেকনিশিয়ান নিয়ামুন হাসান, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, নোমান সিদ্দিকী, আবু সোলায়মান মো. সোহেল, জাহিদুল ইসলাম, মামুনুর রশীদ, সাখাওয়াত হোসেন, সায়েম হোসেন ও লিটন সরকার। জাতির জন্য সর্বনাশা প্রশ্ন ফাঁস চিরতরে বন্ধের উপায় খুঁজে বের করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।

জনগণের সেবার জন্য এবং সরকারের উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নসহ প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা, নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নই হচ্ছে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর একমাত্রা দায়িত্ব ও কর্তব্য। একইভাবে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলায় অন্যান্য বাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রশাসন, রাজস্ব প্রশাসন ও পুলিশের কিছু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন না করে সেবাপ্রার্থীদের ঠেকিয়ে-ঠকিয়ে, ফাইল আটকিয়ে অবৈধ, অনৈতিক পথে কামাই করছে কোটি কোটি টাকা। আর ওই টাকায় গড়ে তুলছে সুরম্য অট্টালিকা, রিসোর্ট, দামি গাড়ি, ফ্ল্যাট, থাকছে কোটি কোটি টাকার এফডিআর, শেয়ার ব্যবসা আরও কত কি। অর্থাৎ ‘টাকাই ক্ষমতা’ যেন এসব দুর্নীতিবাজদের একমাত্র লক্ষ্য। এই বক্র প্রক্রিয়া রাষ্ট্র কর্তৃক সর্বসাধারণের জন্য কোনো গৃহীত পদক্ষেপ নয়। বরং ব্যক্তিবিশেষের সুবিধা নেওয়ার জন্য ক্ষমতাশালীদের সুবিধাদানের মাধ্যমে প্ররোচনা করা, যা একই পজিশনে চাকরিরত ব্যক্তিদের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে। পাশাপাশি দেশ, সরকার ও জনগণের প্রত্যাশিত অর্জনকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। একই সঙ্গে তখন দেশের পুরো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল।

পাকিস্তান আমলও প্রশাসনে দুর্নীতি ছিল। এখন ক্রমাগতভাবে তা বাড়ছে। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল দুর্নীতি থেকে মুক্তি এবং সৎ পরিশ্রমী ও বিবেকবান আমলাতন্ত্র এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা। নয় মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন করা একটি দেশের কাছে জনগণের এ দাবি খুব একটা অযৌক্তিক ছিল না। অধিকাংশই সেই মহান লক্ষ্য থেকে প্রশাসন সরে গেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রেই তারা তাদের ভোগের ভাগ নিশ্চিত করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে, প্রশাসনকে দুর্নীতির যূপ কাষ্ঠের দিকে ঠেলে দেয়। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময়ই দেশে রাজনীতিকে, রাজনীতিককে মূলত দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছিল। ঠিক একইভাবে দুর্নীতির স্বর্ণযুগ ছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়। তখন দুর্নীতিতে রাষ্ট্রকে পর পর ৫ বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের তকমা লাগাতে হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীর দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ হয়েছে তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। বিশেষ করে তাদের স্বামীর হাতে যখন আলাদিনের চেরাগ থাকে তখন স্ত্রীরাও সেই আলোয় আলোকিত হয়। আবার কখনো দুর্নীতিগ্রস্ত স্ত্রীর বদৌলতে স্বামী আলোকিত হয়। আবার উল্টো চিত্রও লক্ষণীয় স্বামীর অপরাধ, অপকর্ম, দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করায় স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ার স্বামী আশরাফুজ্জামান।

পুলিশের কিছু সদস্যের কর্মকাণ্ড, দুর্নীতির কারণে সাধারণ এবং ভুক্তভোগী মানুষ আস্থাহীন। এ ধরনের একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে দুর্নীতির কারণেই। দুর্নীতির সঙ্গে পুলিশ বিভাগের সংশ্লিষ্টতা ঘোচাতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এ অবস্থার অবসান চান সবাই। তাই উপযুক্ত প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে জনগণের কাছে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। ঘুষ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ‘আলোচিত’ ঘটনা। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে মসনদহারা করানোর জন্য সেনাপতি মীর জাফরকে ঘুষ দিয়েছিলেন লর্ড ক্লাইভ। শুধু ঘুষ নয়, সিরাজের সিংহাসনও তাকে দেওয়া হবে বলে চুক্তি করা হয়। তার ফল শুধু বাংলা কেন ভারতবাসীও ভোগ করেছে। মীর জাফর ও ক্লাইভও ভোগ করেছেন। মীর জাফর গদিহারা-ইজ্জতহারা হয়ে মরেছেন। আর রবার্ট ক্লাইভকে করতে হয়েছে আত্মহত্যা; কিন্তু ব্যক্তির দুর্নীতির খেসারত ব্যক্তির শাস্তিতে শেষ হয় না, তার দায় ভোগ করে দেশ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এমনকি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বও চলে যেতে পারে।

ব্যক্তির দুর্নীতি তাই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিপর্যয় ঘটিয়ে ফেলে। নীতি নয়, দুর্নীতিই যেহেতু সংক্রামক, সেহেতু দুর্নীতিবাজরা পুরো সমাজকেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলে। ঝুড়ির একটা পচা আম বাকি আমগুলো পচিয়ে দিতে যথেষ্ট। এ জন্যই দুর্নীতিবাজদের পরিবারে, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুমহলে খুব কম লোককেই পাওয়া যায়, যারা বলতে পারে- তুমি ভালো না, তুমি দুর্নীতিবাজ। দুই-দশ ডজন দুর্নীতিবাজ দমন করা খুবই সম্ভব। কিন্তু দুর্নীতিবান্ধব এ সংস্কৃতি এ সমাজকে পাল্টাতে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস ও কার্যকর উদ্যোগ। নুতবা দুর্নীতিই যদি নীতি হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি মুখথুবড়ে পড়তে পারে। এ জন্য প্রয়োজন দুর্নীতির বিরুদ্ধে চির টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন।

আজকে গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদের নাটকীয় আবির্ভাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এরা তো দুর্নীতির সিস্টেমের অংশ বিশেষ মাত্র। তাই জনপ্রত্যাশা ও জনগণের মনের আশ পূরণে এদের কয়েকজনকে ঝেড়ে ফেলে দিলে সিস্টেমের বরং লাভ। তৎস্থলে ফ্রেশ ব্লাডের কর্মকর্তা নিয়ে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো বা নবায়ন করে নিতে পারে। বিশেষ তবে মতিউর-আবেদ আলীদের প্রতি স্থাপন হিসেবে নতুন লোকেদের নিয়োগ দিতে পারে, যাকে বলে ফ্রেশ বøাড। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে ‘অ্যাপেনডিক্স’ ফেলে দিলে শরীর আরও সচল, সবল হয় এবং সক্রিয় ও স্বচ্ছ হবে। এসব দুর্নীতিবাজদের দৌড়ানি দিলে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে দুর্নীতির দুষ্ট ক্ষত থেকে দেশ, রাষ্ট্র, সরকার, মানুষ মুক্তি পাবে। তাই আসুন আমরা সমস্বরে, দৃঢ় কণ্ঠে দুর্নীতিকে না বলি। দুর্নীতিকে শক্ত হাতে দমন এবং মোকাবিলা করে আমাদের ভবিষ্যৎ পথ চলাকে সুগম করি। জীবন হোক কুসুমাস্তীর্ণ। সমাজ হোক দুর্নীতি মুক্ত। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখি। এ দৃঢ় অঙ্গীকার হোক আমাদের সবার পথ চলার পাথেয়।

লেখক: সাংবাদিক


প্রসঙ্গ ঘুষ-দুর্নীতি ও লুটপাট

আপডেটেড ১৭ জুলাই, ২০২৪ ১০:৫১
শেখর দত্ত

সাম্প্রতিক সময়ে ঘুষ-দুর্নীতি ও লুটপাটের যেসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তা কল্পনাকেও যেন হার মানাচ্ছে। এসব অপকর্ম রাষ্ট্র ও সরকারের উচ্চপর্যায় যেমন- এমপি, সেনাপ্রধান, পুলিশ প্রধান, রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা, ব্যাংকের পরিচালকরা যেমন রয়েছেন তেমনি ড্রাইভার, পিয়ন ও কেরানিও কম যায় নাই। এদের মধ্যে কেউ কেউ সাবেক আবার কেউ কেউ বর্তমানের।

এসব ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আবারও দিচ্ছে যে, রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে ওপর থেকে নিম্নপর্যায় পর্যন্ত নৈতিকতার অধঃপতনে ভালোভাবেই পচন ধরেছে। এই পচন প্রক্রিয়ার শেষ নিয়ে ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। তবে ন্যূনপক্ষে নিয়ন্ত্রিত কিংবা পদানত আদৌ কখনো হবে কি না, তা নিয়ে জনকল্যাণকামী ও দেশপ্রেমী মানুষদের ক্রমেই বেশি বেশি করে ভাবিয়ে তুলছে।

এটা তো কারওই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যতটুকু প্রকাশিত হয়েছে কিংবা হবে ততটুকুই জনগণ জানবে। জানবে ক্ষুদ্র খণ্ডাংশ, জানার বাইরেই বোধকরি থেকে যাবে বেশির ভাগ। কারণ দুর্নীতি হচ্ছে সমাজদেহের ক্যানসার, মর্মমূলে থাকে শক্ত অবস্থান নিয়ে গভীরে, চেইন ছাড়া তা অগ্রসর হতে পারে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হচ্ছে মর্মমূলকে দুর্বল ও কোণঠাসা করা। প্রসঙ্গত, এমনটাও মনে করা হয়ে থাকে, কখনো যদি কোনো চেইনে ফাটল (মনোমালিন্য) ধরে কিংবা চেইনের কেউ ভুল করে তবেই তা প্রকাশিত হয়। সরকারের সদিচ্ছার সঙ্গে জনগণের চাপের ওপর নির্ভর করবে, ক্যানসার কতটুকু জনগণের কাছে উন্মোচিত হবে, তস্কর ও দস্যুরা কতটুকু সাজা পাবে। সর্ষে থেকে ভূত কতটুকু নামবে। সর্ব অঙ্গের ব্যথার কতটুকু ব্যথা সারাবে।

তবে অভিজ্ঞতা থেকে নির্দ্বিধায় বলা যায়, কিছুদিন এ নিয়ে হইচই চলবে, যেমন চলেছিল ২০১৯ সালের ক্যাসিনো কাণ্ডকে নিয়ে। কিছু মামলা-গ্রেপ্তার ও শাস্তি হবে, শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন নিয়েও হয়তো তৎপরতা চলবে। তারপর যদিও বলতে কষ্ট হচ্ছে, যা চলছে সেভাবেই চলবে। এমনটাই তো হয়ে এসেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে দুর্নীতিকে প্রধান ইস্যু করে প্রচারে নেমেছিল। ক্ষমতা প্যারালাল কেন্দ্র হাওয়া ভবন ও ১১১ জন গডফাদারের অপকর্মকে যথার্থ ও সফলভাবে সামনে আনতে সক্ষম হয়েছিল। ওই নির্বাচনে ‘দিনবদলের সনদ’-এ পাঁচটি অগ্রাধিকারের বিষয়ে দুর্নীতিকেও রাখা হয়েছিল। কিছু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করায় যে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল, তা অবস্থা পর্যবেক্ষণে সুস্পষ্ট।

প্রসঙ্গত, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি বিষয় রিপোর্ট নিয়ে জনগণের মধ্যে বিতর্ক ও অবিশ্বাস রয়েছে, নানাদিক বিচারের যথার্থতা আছে। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিএনপি-জামায়াত আমলে ‘পরপর পাঁচবার’ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে ওই সংগঠনের মূল্যায়ন নির্বাচনী প্রচারে আওয়ামী লীগ বেশ ভালোভাবেই ব্যবহার করেছিল। এ দিকটি বিবেচনায় নিয়ে একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টান্যাশনালের স্বীকৃতি আছে। ওই সংগঠনের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থান যে ধাপে ছিল, তা থেকে ২০২৩ সালে দুই ধাপ অবনমন হয়েছে। ২০২৪ সাল বা তারপর কী হবে এ বিষয়ে অবশ্যই সরকারি দল আওয়ামী লীগকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ এই সংগঠনের মূল্যায়ন রিপোর্ট দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। সর্বোপরি কোন পরিবার কীভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে জনগণ লক্ষ-কোটি চোখ দিয়ে যেমন দেখছে, তেমনি সমান সংখ্যক কান দিয়ে শুনছে। ফলে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।

এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনভিপ্রেত ও দুর্ভাগ্যজনক হত্যা-ক্যু-সামরিক শাসনের যত ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে ঘুষ-দুর্নীতি ও লুটপাট ইস্যু জড়িয়ে রয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাদ্য ও অর্থ ঘাটতি, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত এবং বন্যা-দুর্ভিক্ষের মধ্যে দেশ যখন গভীর সংকটে তখন বঙ্গবন্ধু ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ে কী বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর অভিযানসহ কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তা কম-বেশি সবারই জানা। শত চেষ্টা করেও তিনি তা দমন করতে পারেননি। সরকার ও দলের অভ্যন্তরের এ গণশত্রুদের তিনি ঘৃণাভরে ‘চাটার দল’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে ‘চাটার দল’ ও ‘রাতের বাহিনী’ বাড়াবাড়ি করছে বিধায় তিনি তা বাতিল করে একদল বাকশাল পর্যন্ত গঠন করেছিলেন।

একটু খেয়াল করলে এটাও স্মরণে আসবে যে, ১৫ আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর প্রথমে মোশতাকসহ স্বঘোষিত খুনিরা এবং পরে সেনাশাসক জিয়া বঙ্গবন্ধু আমলের ঘুষ-দুর্নীতিকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রচারের ইস্যু হিসেবে ব্যাপকভাবে সামনে আনে। বিশেষভাবে রাষ্ট্রপতি জিয়া যখন ক্যান্টনমেন্টে বসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সুযোগসন্ধানী-সুবিধাবাদীদের নিয়ে দল গঠন করেন, তখন ঘুষ-দুর্নীতিই হয় প্রধান ইস্যু। তবে ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ ও ‘রাজনীতি রাজনীতিকদের জন্য ডিফিক্যান্ট’ করার নীতি-কৌশল নিয়ে নিজেই পড়েন দুর্নীতি ও দলাদলির ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে। গ্রাম সরকার ও যুব কমপ্লেক্স হয় গ্রামাঞ্চলে দুর্নীতির ক্যানসার ছড়িয়ে দেওয়ার বাহন। কোরআন শরিফ ছুঁয়ে মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ এবং নৈতিকতা উন্নয়নে ক্লাস করার হাস্যকর ও ব্যর্থ প্রচেষ্টাও জনগণ ভুলতে পারেনি।

ঘুষ-দুর্নীতি এবং তা থেকে উত্থিত সন্ত্রাস ও দলাদলিকে অন্যতম প্রধান ইস্যু করে জেনারেল জিয়া ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী করতে তৎপর হন। কিন্তু এটাই হয় তার জন্য ব্রহ্মশূল। অর্থ ও অস্ত্রশক্তির দলাদলি ঠেকাতে চট্টগ্রাম গিয়ে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। দুর্বল রাষ্ট্রপতি সাত্তারও ঘুষ-দুর্নীতি ও লুটপাট ইস্যুতে কোণঠাসা হন এবং শাসনকাজে সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণের বিষয়টি সামনে এনে বঙ্গভবন থেকে বিতাড়ন করেন সেনাশাসক এরশাদ। এরশাদের আমলে ঘুষ-দুর্নীতি চরমে ওঠে এবং গ্রাম-গঞ্জ টাউটবাজদের দখলে চলে যায়। রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে অর্থ ও অস্ত্রের কাছে বন্দি হয়ে পড়ে। প্রশাসনে ঘুষ-দুর্নীতি ও লুটপাট সর্বোতোভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। বঙ্গবন্ধুর আমলের ‘কম্বল চোর’, ‘চাটার দল’ থেকে ক্রমে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ওঠে দুর্নীতি-লুটপাট, যা থেকে সৃষ্টি হয় গডফাদার ও সন্ত্রাসী চক্র।

সার্বিক বিচারে আশির দশক হচ্ছে অর্থ ও অস্ত্রশক্তির বাড়বাড়ন্ত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়ার সময়কাল। মৎস্যজীবী ‘নিকারি’ বলে পরিচিত পরিবার থেকে উঠে আসে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিহত কুষ্টিয়ার এমপি আনোয়ারুল আজিম। যে ব্যক্তি সীমান্তে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও আছে। শুরুতে খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি পেয়ে জাতীয় পার্টির মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৯২ সালে বিএনপি থেকে পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ইন্টারপোলের তালিকায় থাকা এই ব্যক্তি ২০০৭ সালের আগে-পরে অন্তত চার বছর আত্মগোপনে ছিলেন বলেও জানা যায়। এরপর আওয়ামী লীগে এসে পরপর তিনবার এমপি। এলাকা ও দলের ভেতরে-বাইরে সবাই তা জানত। অনেক নেতা-কর্মী নাকি তার হামলার স্বীকারও হয়েছেন। প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থা তা জানত না, এমনটিও কোনোক্রমেই বলা যায় না। সাংবাদিকরাও নিশ্চয়ই জানত।

গাজীপুরের রানা, নারায়ণগঞ্জের নূরু পার পায়নি। কিন্তু এমপি আনার পার পেয়েছিল। কিন্তু তার আগুন নিয়ে খেলার পরিণাম হয় ভয়াবহ, লাশও পাওয়া যায়নি। এদিকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অভিযুক্ত হয়ে দুর্নীতিবাজ হিসেবে ধরা খেয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ। বসুন্ধরা গ্রুপের পত্রিকা ‘কালের কণ্ঠ’ যদি তথ্য প্রকাশ না করত, তবে বেনজীর সম্পর্কে জানাই যেত না। বেনজীর- বসুন্ধরা প্রশ্রয়-দ্বন্দ্ব নিয়ে যে কত গল্প বাজারে।

ছাগলকাণ্ড না হলে রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা ও সোনালী ব্যাংকের পরিচালক মতিউর সম্পর্কে জনগণ জানতই না। এই কাণ্ড না হলে কি কেউ জানত মতিউরের স্ত্রী উপজেলা চেয়ারম্যান হয়ে গেছেন। মানে এমপি হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। আর ভাগ্যিস, বারবার পিএসপির প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছিল। নতুবা ড্রাইভার আবেদ আলীর ভাগ্য কোথায় গিয়ে ফুল ফোটাত কে জানে! প্রধানমন্ত্রীর ‘পিয়ন’ ৪০০ কোটি টাকার মালিক! এমপি নির্বাচনেও নামতে চেয়েছিলেন। যাই হোক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়েছে। দেখা যাক, কোন পর্যন্ত গড়ায়।

তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, বহাল তবিয়তে থাকলে পৌষ মাস আর নানা কার্যকারণে ধরা পড়লে সর্বনাশ কিংবা ক্ষণে ক্ষণে আকাশে বিজলির মতো দুর্নীতিবিরোধী অভিযান কিংবা এক ধাক্কায় সব নির্মূল প্রভৃতি নীতি কৌশল যদি থাকে, তবে দুর্নীতিমুক্ত হওয়া দূরে থাকুক দুর্নীতিকে পদানত বা নিয়ন্ত্রণেও রাখা যাবে না। কারণ এ সম্পর্কিত চেইনের খুঁটি নিঃসন্দেহে শক্ত। প্রসঙ্গত, ঘুষ-দুর্নীতি ও লুটপাট নিয়ে কলামটি লিখতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিষয়ে কী লেখা আছে, তা নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, ২০১৮ সালের ইশতেহারে ‘বিশেষ অঙ্গ; কিন্তু ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ‘বিশেষ অঙ্গীকারে’ দুর্নীতি নিয়ে কিছু নেই।

কিন্তু বাস্তবের কশাঘাতে নির্বাচনের ৬ মাস যেতে না যেতেই ঘুষ-দুর্নীতি ও লুটপাট এখন জ্বলন্ত ইস্যু। ক্যানসার রোগী যদি কখনো ভুলে যায় তার রোগ, চিকিৎসা না করায়; তবে সেই রোগী তো নির্ঘাত পড়বে স্বখাত সলিলে। আসলেই ঘুষ-দুর্নীতি ও লুটপাট নিয়ে জাতি রয়েছে মহাবিপদে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মন্দা ও জাতীয় অর্থনীতি যখন সংকটে রয়েছে, জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় যখন বাড়ছে; তখন এই মহাবিপদ থেকে উত্তরণের ধারাবাহিক ও কার্যকর কোনো পন্থা বের করার ভিন্ন বিকল্প নেই।

সর্বোপরি এটা তো ঠিক, কেবল রাজনৈতিক অঙ্গীকার, আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়, এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। সবদিক থেকেই জাতি হিসেবে আমরা রয়েছি পিছিয়ে। দুর্নীতিবাজরা ঘৃণার পাত্র- এমন মনোভাব খুব বেশি নয়। টাকা থাকলে তোষামদ ঘরে এসে দেখা দেয়। অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, ঘুষ-দুর্নীতি ও লুটপাট হয় ত্রয়োস্পর্শযোগে অর্থাৎ অশুভ তিনের মিলনে। দুর্নীতিবাজ আমলা-ব্যবসায়ী-রাজনীতিকরা চেইনে যুক্ত থাকার কারণেই দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত হয়। ‘চাটার দল’ এ তিন নিয়েই শক্ত অবস্থান নিয়েছিল স্বাধীনতার পর। অবস্থাদৃষ্টে এখনো তেমনটাই চলছে বলে ধারণা করা যায়।

এ তিন গণশত্রুর অশুভ ঐক্য থেকে জাতিকে কীভাবে বের করে আনা যাবে, তাই এখন মুক্তিযুদ্ধে এবং বর্তমানে উন্নয়নের গতিধারায় স্থাপন করেছে যে আওয়ামী লীগ, সেই দলের সরকারকেই ভাবতে হবে। অবস্থা অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে অগ্রসর হতে হবে।

লেখক: রাজনীতিক ও কলামিস্ট

বিষয়:

অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ধস: মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মো. হুমায়ুন কবীর

আমি সরকারিভাবে একটি সফরে ২০০৫ সালে ফিলিপাইনে গিয়েছিলাম। আমরা জানি ভৌগোলিকভাবে ফিলিপাইন দেশটি পাহাড় ও সমুদ্রে ভরা। সেখানে গিয়ে আমি শুনেছি তার ঠিক আগের বছর অর্থাৎ ২০০৪ সালে ফিলিপাইনজুড়ে পাহাড়ধস হয়েছিল। সেই ভয়াবহ পাহাড়ধসে তখন হাজার মানুষের ঘরবাড়ি মাটির নিচে চাপা পড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। শুধু তাই নয়- সেখানে অনেক মানুষের জীবনও গিয়েছিল এবং রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ জরুরি সেবাসমূহে ব্যাপক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। আমরা যখন বাংলাদেশি ভ্রমণকারী দলটি সাগরের পাড়ঘেঁষে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকা পরিদর্শন করছিলাম; এক বছর গত হয়ে যাওয়ার পরও সেখানে সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতটি চোখে পড়ার মতোই ছিল।

বিশ্বের বিভিন্ন পাহাড়ি দেশেই পাহাড়ধসের এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। কিছুদিন বিরতিতে এমন ঘটনা অনেকটা স্বাভাবিক হিসেবেই ধরা হয়ে থাকে। আমাদের বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি উপকূলীয় জেলায় অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ধস এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর্যায়ভুক্ত। তবে প্রায় প্রতি বছরই পাহাড়ধসের বিষয়টি আরও এক ডিগ্রি করে বেশি ভয়াবহতা লাভ করছে। কারণ রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি এবং মানুষের হতাহত হওয়ার সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করছে। বিভিন্ন সময়ে এসব দুর্যোগে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অনেক সময় পাহাড়ধসের দেড়-দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও মাটিচাপা পড়া ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে একটি-দুটি করে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। সেই হিসেবে ক্ষণে ক্ষণে মৃতের সংখ্যা শুধু বেড়েই চলে। এমনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন সাংবাৎসরিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্মরণাতীতকালে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি ছিল গত ১১ জুন ২০১৭ থেকে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে উপকূলবর্তী পাঁচটি জেলা তথা- চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি ইত্যাদিতে ব্যাপক পাহাড়ধস দেখা দেয়। এ সম্পর্কিত অতীতের নিরীক্ষাগুলো বলছে- ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের সাতটি স্থানে পাহাড়ধসে মাটিচাপায় ১২৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকার পাহাড়ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকায় বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে ২৬-২৭ জুন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও সিলেটে ৯৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৫ সালের ২৬-২৭ জুন টানা বর্ষণ, পাহাড়ধসে এবং পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে ১৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল।

তার মানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, প্রতি বছরই যখন পাহাড়ধস ঘটছে তখন তা ঘটছে আসলে বেশির ভাগই জুন-জুলাই মাসে। আবহাওয়া কিংবা ভূতাত্ত্বিকভাবে পূর্বাভাস থেকে যতদূর জানা যায়, সেখানে দেখা গেছে প্রতি বছরের জুন থেকে আগস্টে তিন মাস পাহাড়ধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে পারে; কিন্তু তিন মাসের মধ্যে জুন মাসেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি পাহাড়ধস হতে দেখা যায়; কিন্তু আগেই বলেছি বিগত ১১ জুন ২০১৭ তারিখের পাঁচটি জেলায় পাহাড়ধস সবকিছু গুলিয়ে দিয়েছিল। সেবারের এ দুর্যোগের অন্যতম একটি ভয়াবহ দিক ছিল দীর্ঘ সময়জুড়ে পাহাড়ধস হওয়া এবং এর কারণে পুরো এলাকার জনদুর্ভোগ চরমে ওঠা। শুধু তাই নয়- সেখানে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা প্রান্তিকপর্যায়ের মানুষ তো প্রাণ হারিয়েছেই সেই সঙ্গে তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর পাঁচ সদস্যের উদ্ধারকারী একটি চৌকস দল। যেখানে একজন মেজর এবং একজন ক্যাপ্টেন পদবির কর্মকর্তাও ছিলেন।

এখন আমরা আসি কেন এরকম পাহাড়ধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। এটা কি শুধু আমাদের বাংলাদেশেই ঘটে থাকে নাকি বিশ্বের সবখানেই ঘটে। এসব বিষয় বিস্তারিত আলাপ করতে হলে কিছু উদাহরণ সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। ওপরে আমি যে বর্ণনাক্রমিক উপাত্ত পেশ করলাম তাতে দেখা যায় ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশে এ দুর্ঘটনা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। কাজেই এগুলো দুর্যোগ সম্পর্কে শুধু আলোকপাত করলেই চলবে না, এর প্রতিরোধ কিংবা প্রতিকারসহ অন্যান্য বিষয়ে আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আর এটি করতে হলে তার জন্য এক বছর দুই বছর কিংবা পাঁচ বছরের কোনো পরিকল্পনা তেমন কাজে আসবে না। সে জন্য প্রয়োজন হবে দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা।

যেসব কারণে পাহাড় ধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয়, তার অনেক কারণ থাকলেও মূল কারণ আসলে জলবায়ু পরিবর্তন। ইতোপূর্বে যেসব পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে তার একটির চেয়ে আরেকটির তীব্রতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া পাহাড়ের মাটির রকমফের অর্থাৎ সেখানকার সয়েল প্রোফাইল, সয়েল টেকচার, সয়েল স্ট্রাকচার ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে কোন পাহাড় কতটা শক্ত বা নরম। বাংলাদেশের ভূমিরূপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাহাড়গুলোর বেশির ভাগই বালিমাটির স্তর দ্বারা সৃষ্ট। আমরা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য পাহাড়ি দেশের যে পাহাড় পর্বতগুলো দেখতে পাবো সেগুলোর বেশির ভাগই শক্ত পাথরের মতো মাটি দ্বারা সৃষ্ট। সে জন্য সেখানকার পাহাড়ধস কোনো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা নয়। কালে-ভদ্রে যদিওবা কখনো-সখনো পাহাড়ধস হয়, তবু তা এত ভয়াবহ আকার ধারণ করে না।

বাংলাদেশের পাহাড়গুলোর উচ্চতা এত বেশি নয়। কেওক্রাডাং নামের পাহাড়টিই সবচেয়ে বেশি উচ্চতাসম্পন্ন। কাজেই এসব পাহাড় একদিকে যেমন বেশি উচ্চতাসম্পন্ন নয়, অন্যদিকে পাহাড়ের মাটিগুলো আলগা ও বেলে প্রকৃতির। পাহাড় কেটে মাটি সরিয়ে নেওয়া, পাহাড় কেটে নতুন নতুন রাস্তা তৈরি করা, পাহাড়ের ঢালে অপরিকল্পিতভাবে বসতি স্থাপন করা, পাহাড়ের প্রাকৃতিক গাছ-গাছালির বাগান সৃজন না করে শুধু গাছপালা কেটে উজাড় করে নেওয়া ইত্যাদি আরও নানাবিধ কারণে পাহাড়ধসের মতো ঘটনা অহরহ হচ্ছে। পাহাড়ের মাটি সরানোর কয়েকটি ধাপ রয়েছে। পাহাড় কেটে কেটে মাটি দিয়ে ইট পোড়ানো, অন্যত্র রাস্তা তৈরির জন্য মাটি স্থানান্তর, দ্রুত নগরায়ণের কারণে মাটি নিয়ে নতুন নতুন নিচু জায়গা ভরাট করার কাজে ব্যবহার ইত্যাদি ইত্যাদি। তা ছাড়া স্বাভাবিক কারণেই ইদানীং পর্যটনশিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে রাস্তা তৈরির জন্যও পাহাড়ের মাটি কাটা হচ্ছে।

বর্ষাকালে একটি নির্দিষ্ট সময় ও তাল অনুযায়ীই প্রতি বছর বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়ে থাকে যা অনেকটা রীতিসিদ্ধ। কিন্তু যেসব বছরগুলোতে পাহাড়ধস হয়েছে সেসব বছরগুলোতে আগাম বৃষ্টি কিংবা অতিবৃষ্টি, দীর্ঘ সময়ের বৃষ্টি ইত্যাদিও বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এমনিতে বেলে মাটি, তার ওপর অধিক এবং দীর্ঘসময় বৃষ্টি, তা ছাড়া গাছ-গাছালি কাটা তো রয়েছেই, পাশে আরও যোগ হয় বেলে ও আলগা ধরনের মাটি। ইদানীং প্রকৃতিতে আরেকটি অভিশাপের কথা আমরা সবাই লক্ষ্য করছি। সেটি হলো ভূমিকম্প এবং বজ্রপাত। দুটিই একটি আরেকটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। কারণ ভূকম্পনের ফলে যেমন ভূপৃষ্ঠ কেঁপে ওঠে এবং মাটির ভিতর বাহির আন্দোলিত হয়, ঠিক তেমনি বজ্রপাতের সময়ও মৃদু হলেও ভূপৃষ্ঠ কেঁপে ওঠে। তখনও মাটির উপরিভাগ আন্দোলিত হয়ে পাহাড়ের ওপরের বেলে ধরনের মাটি আলগা হয়ে পড়ে। আর বালুকাময় মাটি বলে এর প্রভাব একটু বেশি পরিলক্ষিত হয়। আমরা এও জানি, ওই অঞ্চলে এ দুর্যোগের মাত্র সপ্তাহখানেক আগেই ‘মোরা’ নামক একটি সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় সেসব এলকাকে আন্দোলিত করে গেছে।

এসব পাহাড়ধসে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশি প্রাণহানির অন্যতম কারণ অপরিকল্পিত আবাসন। দেখা গেছে একশ্রেণির লোভী প্রভাশালীরা পাহাড় দখল করে তাতে আবার টাকার বিনিময়ে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে পাহাড়ের ঢালে কোনো রকম নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে ছোট ছোট বাড়িঘর তৈরি করে দিয়ে বিরাট অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়। আর পাহাড়ের পাদদেশে বসতবাড়ি তৈরি করার ক্ষেত্রে কোনো রকম বাছ-বিছার না করে ঢালাওভাবে যেখানে-সেখানে মানুষকে থাকতে বাধ্য করে। সেখানে কোন পাহাড়ের মাটি কেমন, কোন পাহাড়ে থাকা নিরাপদ, কোনটি নিরাপদ নয় সেরকম কোনো ভাবনার সুযোগ থাকে না। এবারেও যে পাহাড়ধস হয়েছে তার মধ্যে এসব কারণেই জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবুও বিভিন্ন সময় কথায় আছে, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’। প্রতিবারেই দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার অনেক হাঁকডাক শোনা যায়। কিন্তু যখনই বিপদ কোনো রকমে কেটে যায় তখন আর ঠেকায় কে? আবার সব পর্যায় থেকেই বেমালুম ভুলে যায় সবাই। কি ভুক্তভোগী, কি সংশ্লিষ্ট এলাকা, কি সংশ্লিষ্ট বিভাগ কিংবা দপ্তর। সর্বশেষ ২০০৭ সালে পাহাড়ধসের পর এ বিষয়টি প্রতিরোধে একটি সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ৩১ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি তখন ২৮টি কারণ চিহ্নিত করেছিল এবং ৩৬ দফা সুপারিশও প্রণয়ন করেছিল; কিন্তু বিগত দশ বছরেও এসব সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি বলে জানা গেছে। কারণ একটাই আর তা হলো বিপদ কেটে গেছে!

পাহাড়ধসের সঙ্গে পরিবেশের একটি বিরাট সম্পর্ক রয়েছে। পাহাড়ধস মানেই পরিবেশের বিপর্যয়। কাজেই পরিবেশের উন্নয়ন করতে হলে মহাপরিকল্পনার বিকল্প নেই। সেই মহাপরিকল্পনা নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। বাড়িঘর পরিকল্পিতভাবে বানাতে হবে। প্রতিটি বাসযোগ্য পাহাড়ের চারদিকে শক্তিশালী বাউন্ডারি ওয়াল তৈরি করতে হবে। বর্তমানে যারা পাহাড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন তাদের সরকারিভাবেই একটি নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটি করার জন্য সরকার সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় সরকারকে আর্থিক বরাদ্দসহ দায়িত্ব প্রদান করতে পারে। পাহাড়ে বাড়িঘর বানানোর একটি অবশ্য পালনীয় এবং সবার গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

যে বছর বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা বেশি ঘটবে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাবে সে বছর আগে থেকেই পাহাড়ে বসবাসকারী জনগণকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে। এসব কাজ করার জন্য অত্যাধিক বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। পাহাড়ে সমতল ভূমির সঙ্গে ২৬ দশমিক ৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি কোণে ঢাল থাকাটা আদর্শ। কিন্তু বাংলাদেশের পাহাড়ে তা কাটতে কাটতে ৬০, ৭০ কিংবা ৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঢাল তৈরি করা হয়েছে। সেগুলো আদর্শ করতে হবে নতুবা নির্দিষ্ট দূরত্ব ঠিক রেখে নিরাপত্তা দেয়াল তৈরি করে দিতে হবে। পাহাড় থেকে কমপক্ষে ৩০০ থেকে ৫০০ মিটার দূরে বাড়িঘর তৈরি করতে হবে। এসব বিষয়ে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সরকারি নির্দেশে তৎপর রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে; কিন্তু এ তৎপরতা কোনো অজুহাতেই বন্ধ না করে সামনে চালিয়ে নিতে হবে। তাহলেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়


নতুন অর্থবছর শুরু হলেও বাস্তবায়ন নিয়ে ভাবনা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মিহির কুমার রায়

বিগত ৬ জুন সংসদের অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব সংসদ উপস্থাপন করেন। এর আগে বাজেটে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ব্যয় সম্পর্কিত ৫৯টি দাবির ওপর ভোট গ্রহণ করা হয়। এসব মঞ্জুরি দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে বিরোধী দলের ছয়জন সংসদ সদস্য মোট ২৫১টি ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এসব দাবির বিপরীতে যে ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো আসে তার মধ্যে তিনটির ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বিভাগগুলো হলো- আইন ও বিচার বিভাগ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় খাত। আলোচনার পর তা কণ্ঠভোটে নিষ্পত্তি করা হয়। বাজেটটি প্রস্তাবের পর এর ওপর প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, অর্থমন্ত্রীসহ ২৩৬ জন সংসদ সদস্য সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন। গত রোববার ৩০ জুন পাস হওয়া এ বাজেট ১ জুলাই থেকে কার্যকর হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, এ বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।

সংসদে বাজেট অধিবেশন

গত ১১ জুন থেকে সংসদে বাজেট অধিবেশনে আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র এমপিরা, যা ৩০ জুন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বড় কোনো সংশোধনী ছাড়াই জাতীয় সংসদে অর্থ বিল উত্থাপন হয়েছে এবং পাসও হয়েছে। এবারের বাজেটে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল: এক. ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি। এ নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে নানা মহলে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হলেও এটি বহাল রয়েছে; দ্বিতীয়ত. বাজেটে ব্যক্তির সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ প্রস্তাব করা হলেও সংসদ তা গ্রহণ করেনি। এর পরিবর্তে সর্বোচ্চ কর বিদ্যমান ২৫ শতাংশই বহাল থাকছে; তৃতীয়ত. বাজেট প্রস্তাব পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের ওপর ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স বসানোর কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। এতে বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন আপত্তি থাকলেও তা আমলে নেওয়া হয় নাই। সংশোধনী বাজেটে আগের মতোই ৫০ লাখ টাকা লাভের ওপর কর আরোপের সিদ্ধান্ত অব্যাহত থাকছে। এর ফলে পতনের মধ্যে থাকা বাজার আরও খারাপের দিকে যাবে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ এ কর বাতিলের দাবিতে বিবৃতিও দিয়েছে। যদিও এনবিআর এ কর প্রত্যাহার করবে না বলে জানা গেছে; চতুর্থত. নতুন অর্থ বিলে আয়কর ও কাস্টমস-সংক্রান্ত সামান্য কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের চাপে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাই-টেক পার্কগুলোর কর অবকাশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থাৎ এসব অঞ্চল ও পার্কের কর অবকাশ সুবিধা আগের মতোই বহাল থাকছে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি শুল্কও আগের মতো শূন্য শতাংশ রাখা হয়েছে; পঞ্চমত. প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ বা উন্নয়নের জন্য ডেভেলপারদের আমদানি করা যন্ত্রপাতির শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয। শিল্প স্থাপনের মূলধনি যন্ত্রপাতিতেও ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা বাতিল করা হয়; ষষ্ঠত. সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে শুল্ক আরোপের প্রস্তাবটি শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়; অষ্টমত. কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিতে রিটার্ন জমার বিরূপ প্রদর্শনের শর্তে পরিবর্তন আসছে। সেক্ষেত্রে পৌর এলাকা বা গ্রামাঞ্চলে এ বিরূপ প্রদর্শনের প্রয়োজন পড়বে না। তবে সিটি করপোরেশন এলাকায় তা প্রদর্শন করতে হবে। সর্বশেষে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতারা বলেন, ‘এটি একটা গতানুগতিক বাজেট। উচিত ছিল উন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে রাখা, পরিচালন ব্যয় আরও কমানো। ঋণ যাতে কম নিতে হয়, সেই ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। প্রত্যক্ষ করের দিকে নজর দেওয়া উচিত ছিল। আমাদের দেশে যারা আয় করে, তারা ট্যাক্স দেয় না। ঋণখেলাপ যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে আমাদের অর্থনীতি হুমকিতে পড়বে। আমাদের বর্তমান সমস্যাগুলো অর্থনৈতিক কারণে তৈরি হয়নি। এটা হয়েছে জবাবদিহিতার অভাবে এবং সুশাসন না থাকায়। দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রসার ঘটেছে, যা টেনে ধরার কোনো উপায় রাখা হয়নি।’

বাজেট বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ কি হতে পারে

সংসদে বিরোধী দলের সদস্যরা প্রস্তাবিত বাজেটকে গতানুগতিক হিসেবেই দেখছেন। তাদের ভাষ্যমতে, অর্থনীতির চলমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় এতে কোনো নতুনত্ব আনা হয়নি। তবে প্রস্তাবিত বাজেট পাসের মাধ্যমে সরকার নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাবে বলে মনে করছেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা। এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের সরকারদলীয় চিফ হুইপ বলেন, ‘সব সময়ই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের বিষয়টি আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাজেট পরিকল্পনায় থাকে। তিনি ধাপে ধাপে ওই লক্ষ্যটায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। সব সময়ই বাজেট করার আগেই তিনি এটা খেয়াল রাখেন। তিনি জনগণকে যে ওয়াদা করেছেন, সেটা প্রতিফলন থাকবে বলে আমি মনে করি। যে বাজেট প্রস্তবটা এসেছে তার অধিকাংশই পাস হয়েছে।’ এখন নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের মতামতটা ভিন্ন যেমন ১. বাংলাদেশের মতো একদিকে সীমিত সম্পদ, অন্যদিকে দ্রুত উন্নতির আকাঙ্ক্ষা পোষণকারী একটি দেশের বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। তবে এবার এমন কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে, যেগুলো অন্তত দেখা যায়নি। সম্প্রতি খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশেরও ওপরে উঠে গেছে। এ হারে মূল্যস্ফীতি থাকলে বিশেষত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়। দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত মানুষের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। তখন সরকারকে বাধ্য হয়ে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বেশি বরাদ্দ দিতে হয়। ফলে অন্যান্য প্রয়োজনীয় উন্নয়নমূলক খাতে বরাদ্দ কমে যায়; ২. ইতোমধ্যে রিজার্ভ উদ্বেগজনক পরিমাণে কমে গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। কারণ তখন বিনিয়োগকারীরা ভেবে নেয়, এ দেশ থেকে বিনিয়োগের ফল হিসেবে প্রাপ্য মুনাফা তারা নিতে পারবে না; ৩. মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ একটা সময় পর্যন্ত বেশ সাফল্য দেখালেও সাম্প্রতিক সময়ে তা দেখা যাচ্ছে না। বিশেষত অর্থনীতিতে যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সেই হারে দারিদ্র্য কমছে না। শহর-গ্রামের উদ্বেগজনক ব্যবধানের পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রামের তুলনায় বরিশাল ও খুলনার মতো এলাকার পিছিয়ে থাকা বা আঞ্চলিক বৈষম্যও চিন্তার বিষয়; ৪. এ পরিস্তিতি সামাল দিতে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। তবে একটি আমদানিনির্ভর দেশে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক কমানো যেত। তাতে বিভিন্ন আমদানি পণ্যের দাম কমানোর সম্ভাবনা ছিল। আমাদের আমদানিকৃত পণ্যের বেশির ভাগ হলো কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য ও শিল্পের যন্ত্রপাতি; শুল্ক হ্রাসের সুবিধা নিয়ে এগুলোর আমদানি বাড়লে দেশে উৎপাদন বাড়ত। এতে সরবরাহ বেড়ে পণ্যমূল্য কমে যেত। তবে ব্যষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় সব সময়ই কিছু ট্রেড অফ থাকে। এক্ষেত্রে ট্রেড অফ হলো এক্সচেঞ্জ রেট বা বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর বেশি আমদানির নেতিবাচক প্রভাব। এমনিতেই আমাদের বিনিময় হার বেশ কিছু দিন ধরে ঊর্ধ্বমুখী। অর্থাৎ টাকার দাম নিম্নমুখী। বেশি আমদানি হলে টাকার মান আরও কমে যায়। এর ফলে পণ্যমূল্য বেড়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ ইতোমধ্যে ডলার এক লাফে ১১৭ টাকায় উঠেছে। ফলে সরকারকে আমদানিতে শুল্কহার হ্রাসের পাশাপাশি ট্রেড অফ মোকাবিলারও সমন্বিত কার্যক্রম নিতে হবে; ৫. এখনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরকারের প্রায় নিয়মিত সভা হয়। নিছক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভা করে, তাদের পরামর্শ দিয়ে বা তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়ে তো এ সমস্যার সমাধান হবে না। পণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে যারা কারসাজি করে, তাদের বিরদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ না নিলে কোনো কাজ হবে না। এখন তো মাঝে মাঝেই দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নানা কর্তৃপক্ষের অভিযান দেখি। কিন্তু অভিযানের নামে বাস্তবে কী ঘটে, কেউ জানে না; ৬. মূল্যস্ফীতি কমাতে গিয়ে ব্যাংক ঋণে সুদের হার বৃদ্ধি নিয়ে ব্যবসায়ী সমাজ উদ্বিগ্ন। এর পরে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিষয়টি এ রকম যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে আমদানিনির্ভর দেশে মূল্যস্ফীতি কমানো যায় না। আমাদের এখানে পুঁজিবাজার ঠিকমতো কাজ না করায় শিল্পে পুঁজি সরবরাহ করতে পারছে না। শিল্প বা ব্যবসায়ের পুঁজি আসে প্রধানত ব্যাংক ঋণ থেকে। ফলে সুদের হার বৃদ্ধি তহবিল ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। ইতোমধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেশ কমে গেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব সরাসরি পড়ছে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের ওপর। কর্মসংস্থান কম হলে দারিদ্র্যসীমার নিচের লোক বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের জন্য জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়বে; ৭. দেশের ব্যাংক খাতের অবস্থা করুণ- এটা তো বলাই যায়। খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান নিয়েও প্রশ্ন আছে। কারণ পুনর্তফশিলিকৃত ঋণ, আদালতে আটকে থাকা ঋণ এবং অবলোপনকৃত ঋণকে খেলাপি ঋণের হিসাবে আনা হয় না। এর ফলে ব্যাংকগুলো তাদের মধ্যবর্তী দায়িত্ব পালন করতে পারছে না; আমানত সংগ্রহের ওপরেও এর প্রভাব পড়ে। সুশাসনের অভাব, যোগসাজশের ভিত্তিতে ঋণদান ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুদিন ধরে চেষ্টা করছে, তবে সাফল্য আসছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কিছু পদক্ষেপ, বিশেষত ব্যাংক একীভূতকরণ কর্মসূচি তো ইতোমধ্যে বেশ সমালোচনার মধ্যে পড়েছে। বিশ্বের বহু দেশে ব্যাংক একীভূতকরণ হয়েছে। সেসব অভিজ্ঞতা আমাদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তা ছাড়া যেসব ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত, তাদের একীভূতকরণে সংশ্লিষ্ট সংস্থা শুধু নয়, সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের মতো নেওয়া উচিত। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আমানতকারীরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে তাদের টাকা ফেরত নিতে চাইলে কোনো বাধা দেওয়া যাবে না; ৮. এবার বাজেটের অর্থায়ন নিয়েও আলোচনা আছে। একদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছেও যেতে পারছে না; আবার পাইপলাইনে থাকা বিদেশি অর্থেরও ব্যবহার প্রত্যাশিত মাত্রায় ঘটছে না। আমাদের জিডিপি ও রাজস্বের অনুপাত বিশ্বে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। এনবিআরকে তো রাজস্ব বাড়াতেই হবে। রাজস্ব না বাড়ায় সম্প্রতি দেখা গেছে, সরকার ব্যাংক খাত থেকে বেশি ঋণ নিয়েছে। এ কারণে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক দিন ধরেই আমরা এ কথা বলে আসছি, করের হার না বাড়িয়ে এখানে করের আওতা বাড়ানো দরকার। গ্রামাঞ্চলে বহু দোকান আছে, যারা নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট দিতে পারে। তাদের অনেকে আয়করের আওতায়ও আসতে পারে। যারা ট্যাক্স শনাক্তকরণ নম্বর থাকা সত্ত্বেও রিটার্ন দাখিল করেন না, তাদের শনাক্ত করা জরুরি; ৯. এডিপি নিয়ে একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চলছে বহু বছর ধরে। দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম সাত-আট মাসে বড়জোর ৪০ শতাংশ বাস্তবায়িত হলো, বাকিটা স্বল্প সময়ে তাড়াহুড়োর মাধ্যমে কাজ করে ৮০-৮৫ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়। এটা করতে গিয়ে কাজের মান খারাপ হয়। কখনো কাজ না করেই বিল তুলে নেওয়া হয়। এখানে ভালো কাজের জন্য পুরস্কার; ব্যর্থতার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকলে এডিপি বাস্তবায়নের প্রচলিত ধারায় পরিবর্তন সম্ভব; ১০. এডিপিতে বিদেশি অর্থায়নের সহজ উৎস ব্যবহারে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কথাও বেশ আলোচিত। এতে বর্তমানে পাইপলাইনে থাকা বিদেশি অর্থের পরিমাণ এ উৎস থেকে আসা গত ১০ বছরের মোট অর্থের সমান হয়ে গেছে। তাই বহুপক্ষীয় উৎস থেকে আসা ঋণ ব্যবহারে মনোযোগ বেশি দেওয়া উচিত। কারণ এ ধরনের ঋণে শর্ত কিছু থাকলেও সুদের হার ও পরিশোধের সময় দ্বিপক্ষীয় উৎসের চেয়ে আমাদের দেশের জন্য অনেক ভালো। তাই সরকার সার্বিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে এই প্রত্যাশা রইল।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা)


আপনি আমি সচেতন হলেই জলাবদ্ধতা দূর হবে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম

টানা বৃষ্টি হলেই মহানগরীগুলোতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পথঘাটগুলো কূল-কিনারাহীন নদী হয়ে যায়। যারা বাড়ি-ঘর, মার্কেট নির্মাণ করেন তারা কি রাজউকে নির্দেশ শতভাগ মানেন? জলাবদ্ধতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে এভাবেই লেখেন চন্দ্রশিলা। জলাবদ্ধ এলাকার ছবি জুড়ে দিয়ে তিনি আরও লেখেন, ‘দেশের মানুষ কি যত্রতত্র পলিথিন, পানির বোতল, ময়লা ফেলা বন্ধ করেছেন? দায় কিন্তু সব রাষ্ট্রের একার হয় না, প্রতিটি মানুষের দায়-দায়িত্ব থাকতে হয়। কারণ সমস্যা হলে ভোগ করতে হয় প্রতিটি মানুষকেই।

হাসিব বাবু ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, জলাবদ্ধতা নিয়ে গত দুই দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ স্ট্যাটাস দেখলাম! আচ্ছা ঢাকায় যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা তাহলে ফেলে কারা? এ পোস্টে ২ ঘণ্টার মধ্যে নিচে মন্তব্য পড়েছে ৩৬টি এবং দুজন শেয়ার করেছেন। নাজমুস শাহাদাত নামের এক ব্যক্তি মন্তব্য করেন, রাস্তার পাশে যতগুলো দোকান সব দোকানের ময়লা ঝাড়ু দিয়ে রাস্তায় ফেলে, মনে হয় রাস্তাটা একটা ডাস্টবিন! আর অলিগলিতে তো মূর্খ ভাড়াটিয়ারা প্যাকেটভর্তি ময়লা-আবর্জনা ছুড়ে ফেলে, পরে সেগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কি যে অবস্থা হয়। বলে বোঝানো সম্ভব না।

আসলে, রাজধানী ঢাকায় জলাবদ্ধতা নতুন কোনো বিষয় নয়। মাত্র ঘণ্টা খানেকের ভারী বৃষ্টিতেই পরিণত হয় পানির নগরীতে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ঢাকায় বৃষ্টি হয়েছে ৬০ মিলিমিটার। এরপরও অবশ্য হয়েছে, তবে তা ভারী বৃষ্টি ছিল না; কিন্তু সকালের বৃষ্টিতেই ধানমন্ডি, গ্রিন রোড, নিউ মার্কেট, মতিঝিল, আরামবাগ, কাজীপাড়া, রোকেয়া সরণি, দক্ষিণ খান, কল্যাণপুর, বিজয় সরণি, মালিবাগ, মৌচাকসহ রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকার সড়ক ডুবে যায়। অনেক বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। কোথাও পানি ছিল হাঁটুসমান, কোথাও প্রায় কোমরসমান।

রাস্তায় গাড়িগুলোকে দেখা যায় রীতিমতো সাঁতরাতে।

আর এ জলাবদ্ধতার জন্য আমরা সরকার, মেয়র তথা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সবচেয়ে বেশি দায়ী করে থাকি। ফেসবুক থেকে শুরু করে এ দুর্ভোগ নিয়ে মিডিয়া নানা আলোচনা-সমালোচনা করি, লেখালেখি করি। এত এখন ফেসবুক কিংবা মিডিয়া আলোচনা হচ্ছে- গত চার বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে কমপক্ষে ৭৩০ কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু এর সুফল কতটা পাওয়া গেছে, তা শুক্রবার সকালের তিন ঘণ্টার বৃষ্টি দেখিয়ে দিয়েছে। গত ২৬ জুন ঢাকায় ৩ ঘণ্টায় ৬১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। সেদিনের বৃষ্টিতে ঢাকার অনেক এলাকার সড়কে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।

আমি মনে করি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যতই দায়ী করি না কেন- এটা মানবসৃষ্ট বেশি। কারণ আমাদের প্রতিদিন ব্যবহৃত ময়লা, প্লাস্টিক, পলিথিন ডাস্টবিনে না ফেলে ফেলছি রাস্তার। এ ময়লা, প্লাস্টিক, পলিথিন বৃষ্টির পানি সঙ্গে ড্রেনে পড়ে আবর্জনায় পূর্ণ হচ্ছে। গত কয়েক দিনে যেই পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে এর পানি যদি যথাযথভাবে ড্রেন দিয়ে না সরতে পারে তাহলে তো রাস্তাগুলো নদী হবেই। আমি স্বীকার করি ঢাকার মেয়রদের আরও বেশি সচেতন হওয়ার দরকার ছিল।

এবার আসি আমাদের কথায়- এ জলাবদ্ধতার জন্য আমরা কতটা দায়ী? আমাদের করণীয় কী? শুধু সরকার আর মেয়রকে দোষ দিয়ে যাচ্ছি, আমরা কি সরকার বা মেয়রদের কথা মানছি? আমরা কি আইন মানি? আমাদের ওপর কি আইনের প্রয়োগ করা হয়? দায়িত্বরত কর্মকর্তারা কি দায়িত্ব পালন করছে? নাহ! কেউ কিছুই মানছি না। শুধু একে ওপরের ওপর দোষ দিয়ে যাচ্ছি।

আপনি স্টুডেন্ট, অথচ আপনি ক্লাসে শিখছেন একটা ক্লাসের বাইরে এসে করছেন আরেকটা! তেমনি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের সঙ্গে জড়িত ডেপুটি রেজিস্ট্রার ইব্রাহিম খলিল তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমরা কবে সভ্য হব?

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত পরিমাণ ময়লার বিন স্থাপন এবং পরিচ্ছন্নকর্মীদের দ্বারা নিয়মিত পরিষ্কার করার পরেও ক্যাম্পাসকে ময়লা-আবর্জনা থেকে মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। ‘আপনি নিজেই আপনার ক্যাম্পাসকে সুন্দর রাখতে পারেন না। ময়লা-আবর্জনায় সব সিঁড়ি থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের ফুলের গাছের টবে পর্যন্ত ফেলে রাখেন। কেউ কিছু বললে, বলেন মামা (ক্লিনার) আছে পরিষ্কার করার জন্য! হুম বলতে পারে তার সঙ্গে ঢাকার জলাবদ্ধতার সম্পর্ক কোথায়? এ লেখাটা ছোট হলেও গভীরতা অনেক বেশি। শুধু সেবা সংস্থাগুলোই নয়- নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানুষের কিছু দায়িত্ববোধ রয়েছে। আমরা ময়লা-আবর্জনাগুলো নিজ দায়িত্বে নির্দিষ্ট জায়গা ফেলতে পারি। কিন্তু সেটা না করে রাস্তার এখানে সেখানে কিংবা ড্রেনের মধ্যে ফেলে দিই। ড্রেন ছাড়া তো এলাকার পানি নিষ্কাশনের বিকল্প কিছু নেই।

নগর-পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয়-জলাধার থাকার কথা। কিন্তু বিআইপির গবেষণার দেখা গেছে, ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরে সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৫২ বর্গকিলোমিটারের বেশি। এখন সেটি প্রায় ৪৩ শতাংশ কমে ৩০ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরের মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি ছিল জলাভূমি। এখন তা মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। গত তিন দশকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট জলাভূমির প্রায় ৮৬ শতাংশ ভরাট করা হয়েছে। বিআইপি গবেষণাটি করেছে গত বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালে। এই গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ঢাকা শহরে একদিকে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা ও জলাশয় কমেছে, অন্যদিকে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ বেড়েছে। গত তিন দশকে (১৯৯৫ সালের পর থেকে) ঢাকায় কংক্রিটের আচ্ছাদন প্রায় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।

এ তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের জলাভূমি অধিকাংশ ভরাট হয়ে আছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই বিভিন্ন সড়কে পানি জমে যায় হাঁটু সমান। ওয়াসা থেকে সিটি করপোরেশন খালগুলো বুঝে পাওয়ার পর কিছু এলাকায় সমস্যার সমাধান হলেও এখনো জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পায়নি মানুষ। দুই সিটি করপোরেশন বলছে, কিছু কিছু এলাকায় এখন বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ চলমান। যার কারণে ড্রেনগুলো দিয়ে পানি সরতে না পারায় পানি জমে থাকছে। অন্যদিকে, স্থায়ীভাবে কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে পরিকল্পিত সড়ক ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকার কারণে। তবে এসব এলাকায় কুইক রেসপন্স টিম কাজ করে যাচ্ছে বলে সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়।

ভাবতে কষ্ট লাগে, যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’-এর জরিপে বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে বিশ্বের ১৭৩টি শহরের মধ্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান ১৬৮। এ দায় কার? একবার ভেবে দেখুন, পলিথিন, খাবারের প্যাকেট ও প্লাস্টিকের বোতলগুলো আমরা কোথায় ফেলছি? গৃহস্থালি বর্জ্য আমরা কোথায় ফেলছি? এ ব্যাপারে আমাদের ভাবতে হবে।

আপনি আমি যখন ঘুরতে বেড়াতে যাই তখন পানিটা খেয়ে বোতলটা রাস্তায় ফেলতে দ্বিধাবোধ করি না। আবার চিপস খেয়ে খালি প্যাকেটটা কোথায় ফেলতে হবে তা জানি না। সত্যি কথা, আমরা এখন উন্নত দেশে পরিণত হতে পারিনি। কিন্তু আপনি কিন্তু প্রতিনিয়ত উন্নত দেশের কার্যকলাপ ফলো করেন। তবে কেন তা আপনার দেশের বা আপনার শহরের বেলায় নয়? ঢাকার ড্রেনগুলো কি আপনার ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল এবং প্যাকেটে ব্লক হয়ে যায় না? অনেকেই বলে সবাই ফেলে আমি একা এতটা সচেতন হয়ে কি হবে! কিছু হবে? আমার জবাব অবশ্যই হবে, পরিবর্তন এবং অব্যাশটা একজন একজন করেই করতে হয়।

ঢাকায় নদী রয়েছে, এটা আমাদের ভাগ্যের ব্যাপার। বিশ্বের অনেক দেশের রাজধানী ঘিরে কোনো নদীই নেই। কিন্তু আমরা ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে নষ্ট করে ফেলেছি। ঢাকা শহরের মাঝেও অতীতে খাল, বিল-ঝিল, দিঘি, পুকুর ও জলাভূমি ছিল। বৃষ্টির পানি ওই সব খাল দিয়ে নিষ্কাশিত হয়ে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশে নদী ও অন্যান্য জলাভূমিতে জমা হতো। মানুষ অপরিকল্পিত দালানকোঠা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করে সেগুলোর নামনিশানা মুছে গেছে আজ।

আমাদের হিসাব করে দেখা দরকার জলাবদ্ধতার কারণে সরকারি বা ব্যক্তিপর্যায়ে যে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তা কি কোনোভাবেই জলাভূমি ভরাট করে নগরায়ণকে সমর্থন করে? তাহলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কেন রক্ষা করতে পারছে না খাল আর জলাধার। এখানেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় আমাদের আইন ব্যবস্থা এবং আইন প্রয়োগে সদিচ্ছা। সভা-সেমিনারে সহজেই দায়ী করা যায় কিছু ব্যক্তিকে। অবশ্যই জলাবদ্ধতায় নাকাল নগরবাসীর কাছে তাদের দায়বদ্ধতা আছে। তবে নগরবাসী বুঝতে পারে সমস্যার মূল, শাখা-প্রশাখা অনেক গভীরে। যতদিন পর্যন্ত নগরায়ণে অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট প্রাধান্য পাবে, কতিপয় গোষ্ঠীর অর্থলিপ্সার কাছে উপেক্ষিত হবে মানুষ, সামাজিক মূল্যবোধ ও পরিবেশ, ততদিন প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে আমরা বারবার বিপর্যস্ত হব।

প্রতিদিন সকাল হওয়ার আগে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ক্লিনাররা ঢাকাকে চকচকে করে রাখে। বিশ্বাস না হলে এক দিন ভোরে এই প্রাণের শহরটাকে একটু ঘুরে দেখেন। অথচ আমরা ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাই রাস্তায় ময়লা ফেলতে ফেলতে, স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে বিদ্যা অর্জন করতে যাই রাস্তায় ময়লা ফেলতে ফেলতে। পরিবেশবাদী মিটিং করতে যাই রাস্তায় ময়লা ফেলতে ফেলতে! আমরা তো সবাই জমিদার! সবকিছুই দুই মেয়র করবে! আমার ভাষায় আমরা হচ্ছি এক টাইপের অভদ্র জমিদার।

ঢাকায় প্রতিদিন হাজার হাজার নতুন মানুষ প্রবেশ করে, তারা বেশির ভাগই মফস্বল থেকে আসে। তাদের মধ্যে এখনো ওই অভ্যাসটা নেই। কিন্তু তারা যদি ঢাকায় প্রবেশ করে দেখে সবাই নির্দিষ্ট স্থানে (ডাস্টবিন) ময়লা ফেলে, যেখানে-সেখানে ময়লা ফেললে পুলিশ জরিমানা করে। অথবা কেউ একজন ময়লা ফেললেই আরেকজন পাশ থেকে বলছে, প্লিজ ময়লাটা কষ্ট করে একটু ডাস্টবিনে ফেলুন, না হয় পুলিশ আপনাকে জরিমানা করবে। এটাও বলতে পারেন আমরা সবাই নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলি প্লিজ আপনিও ফেলুন। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি মানুষ কখনোই বেখুশি হবে না। আমাদের দেশের একজন শ্রমিক উন্নত দেশে গিয়ে কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সেই দেশের আইন-কানুন এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। শুধু উন্নত দেশে কেন? আমরা যখন ক্যান্টনমেন্টের ভিতর প্রবেশ করি তখন সব আইন-কানুন এবং পরিবেশের সঙ্গেও মেনে চলি।

একটু গভীরভাবে জলাবদ্ধতার কারণ যদি আমার খুঁজতে যাই তবে কয়েকটি বিষয় উঠে আসে। যেমন- জলাশয়, খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট, পানি নিষ্কাশন তথা বৃষ্টির পানি বেরিয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে নগরীর খালি জায়গা কমে গেছে। অত্যন্ত ঘনবসতি হওয়ায় পয়ঃনিষ্কাশন ক্ষমতা অকার্যকর হয়ে গেছে, ডাস্টবিন ছাড়া যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা হয়। ফলে পাড়া-মহল্লার পানি নিষ্কাশনের ড্রেন বন্ধ হয়ে যায়। বর্ষায় অতিরিক্ত খোঁড়াখুঁড়ি, ফলে একটু বৃষ্টি হলেই পুরো রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়।

এক সময় পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যার কারণে কাঁচাবাজার, হাটবাজার এবং দোকানপাটে এর ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। পলিথিনগুলো ড্রেন, খাল এমনকি নদ-নদীর তলদেশের গভীরতা কমিয়ে দিচ্ছে। ড্রেন পরিষ্কার করে ময়লা ড্রেনের পাশেই ফেলে রাখা হয়। সামান্য বৃষ্টিতে সে ময়লা আবার ড্রেনে গিয়েই পড়ে। সময়মতো বর্জ্য পরিষ্কার করা হয় না। নগরীতে ছোট-বড় অনেক ডাস্টবিন দেওয়া হলেও সেগুলোর ব্যবহার নেই বললেই চলে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পেছনে আরেক অভিশাপ বলা যেতে পারে নির্মাণাধীন ভবনগুলো থেকে তৈরি উপজাতগুলোকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভবন তৈরির কাঁচামাল এনে জড়ো করা হয় রাস্তার ওপর। তার পর সেখান থেকে নিয়ে তৈরি করা হয় স্থাপনা।

ঢাকা জলাবদ্ধতা সমস্যা-সমাধানে গণসচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। এ সমস্যা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। তাই রাতারাতি নিরসন করাও যাবে না। তবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেগুলো স্বচ্ছতার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিদ্যমান খালগুলো দখলমুক্ত ও খনন করে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। খাল, ড্রেন পরিষ্কার রাখতে হবে। কোথায়ও যেন পলিথিন, প্লাস্টিক বা আবর্জনা আটকে না থাকে সেদিকে
নাগরিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। যেখানে-সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং তা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী বাড়ি-ঘর, অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথম পর্যায়ে সরকারি স্থাপনার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা মাথায় নিয়ে এখন পরিকল্পনা করতে হবে। কেননা এখন ঘন ঘন বৃষ্টি হচ্ছে, অসময়েও। এ ছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী অনতিবিলম্বে ঢাকার নদীগুলোর সীমানা নির্ধারণ করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। সংসদ সদস্য এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলররা তার এলাকার জলাভূমি রক্ষার দায়িত্বে থাকবে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর কাছে তারা দায়বদ্ধ থাকবে।

আপনি আমি সচেতন হলেই ঢাকা বাঁচবে। অবশ্যই এ জলাবদ্ধতা দূর হবে। যানজট দূর হয়ে। আলো আসবেই। আশাবাদী।

লেখক: উপপরিচালক শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়


শিক্ষাবিদের সামাজিক ভূমিকা 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত ও প্রাচ্যের অন্যতম ভাষাবিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (জন্ম ১০ জুলাই ১৮৮৫, মৃত্যু ১৩ জুলাই ১৯৬৯) ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তিনি ধর্মীয় অনুভূতি অপেক্ষা জাতীয় অনুভূতিকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করেন। জাতীয় ও ধর্মীয় চেতনা সম্পর্কে তার বক্তব্য: ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বেও এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকার জো-টি নেই’। মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এ দুঃসাহসিক উক্তি বাঙালির জাতীয় চেতনা শাণিতকরণে মাইলফলকের ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার (১৯৪৭) পরপরই দেশের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে, না বাংলা হবে এ বিতর্ক সৃষ্টি হলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোরাল বক্তব্য উপস্থাপন করেন তিনি। তার এ ভূমিকার ফলে পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হয়। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে শহীদুল্লাহ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনের সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে লেখনীর মাধ্যমে ও সভা-সমিতির বক্তৃতায় জোরাল বক্তব্য উপস্থাপন করে আন্দোলনের পথ প্রশস্ত ও গতি বৃদ্ধি করেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ড. জিয়াউদ্দীন উর্দু ভাষার পক্ষে ওকালতি করলে ড. শহীদুল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এর প্রতিবাদ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দি ভাষা গ্রহণ করা হইলে, ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহন রূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার পক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবল বৈজ্ঞানিক শিক্ষনীতির বিরোধীই নহে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতিবিগর্হিতও বটে।’ (পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা, দৈনিক আজাদ, ১২ শ্রাবণ ১৩৫৪)।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বিশাল জ্ঞান তিনি অর্জন করেছিলেন তা তাকে গোঁড়ামি অথবা অহংকারী করে তোলেনি। বরং এই বিশাল জ্ঞানরাজি তাকে দান করেছিল এক সুমহান ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধু নিজধর্ম ইসলাম চর্চা করেননি অথবা আপন ধর্মে নিজেকে সঁপে দিয়ে অন্ধত্ববরণ করেননি। অন্যের ধর্মীয় পুস্তকাবলি পাঠ ও চর্চা করে তিনি দেখিয়ে গেছেন ধর্ম মানুষকে বেঁধে রাখতে পারে না। বরং ধর্ম মানুষকে দিয়েছে মহত্তম মুক্তি।

‘যে সমস্ত অবিবাহিত লোক সন্ন্যাসী হয়ে তাদের নামের সংগে ‘স্বামী’ এই বিশেষণ যোগ করে দেয়, ভূমিকা যেমন দয়ানন্দ স্বামী, সদানন্দ স্বামী ইত্যাদি, আমি তাদের মতো স্বামী নই। আমার স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও আমি তাদের মতোই স্বামী। আমার নাম জ্ঞানানন্দ স্বামী, জ্ঞান চর্চায়ই আমার আনন্দ।’ কথা কয়টি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয়বার অবসর গ্রহণকালে সংবর্ধনা সভায় বলেছিলেন। রসিকতা করে কথা কয়টি বলা হলেও ওর ভিতর নিহিত আছে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পর্কে চিরন্তন সত্য কথা। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন এমন একজন জ্ঞানসাধক যিনি আজীবন উক্ত সাধনায় একনিষ্ঠভাবে নিয়োজিত ছিলেন। প্রায় পৌনে এক শতাব্দীকাল ধরে অক্লান্তভাবে তিনি জ্ঞানচর্চা করে গেছেন। তিনি জ্ঞান সাধনায় এই যে অসাধারণত্ব অর্জন করেছিলেন তার জন্য তিনি কোনোদিন অহমিকা দেখাননি। তিনি ছিলেন শিশুর মতো সরল। হিংসা, ঈর্ষা, অহংকার কোনোদিন তার চরিত্রে ঠাঁই পায়নি। তিনি প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল শিক্ষকতা করে কাটান। তার এই উজ্জ্বল মানবছায়ায় জ্ঞানের সুশীতল বারিধারা পান করে কতজন যে ধন্য হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সব সময় অসাধারণ হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতেন। অসাধারণ কিছু শেখার এ স্পৃহাই যে তাকে এতগুলো ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভের স্পৃহায়তা করেছিল সে বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। ভাবতে আশ্চর্য লাগে তিনি ১৮টি ভাষার ওপর পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। ভাষাগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, সংস্কৃত, প্রাকৃত, আরবি, পারসি, বৈদিক, আবেস্তান, তিব্বতী, উর্দু, হিন্দি, সিংহলী, মৈথিলি, উড়িয়া, আসামী এবং সিন্ধি। স্কুলজীবনেই তিনি বেশ কয়েকটি ভাষা আয়ত্তে এনেছিলেন। পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষার্থে শেখেন উর্দু এবং পারসি। বিদ্যালয় সূত্রে শেখেন ইংরেজি, বাংলা এবং সংস্কৃত। আর হওড়াস্ব বাসার প্রতিবেশীর নিকট থেকে উড়িয়া ও হিন্দি ভাষা শিখেছিলেন। তার জীবনের দুটি ঘটনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ দুটি ঘটনাকে তার বিস্তৃত জ্ঞান-সাধনার দিগদর্শন বলা যেতে পারে।

আরবি ছিল তার পরিবারের প্রিয় ভাষা। অথচ এ আরবি ত্যাগ করে তিনি সংস্কৃতে এন্ট্রানস পরীক্ষা দেন। এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলতেন, শিক্ষকের মারের ভয়ে। হুগলি জেলা স্কুলের তখনকার আরবি শিক্ষক নাকি কারণে-অকারণে ছাত্রদের বেদম প্রহার করতেন। শহীদুল্লাহ সাহেবের এটা পছন্দ হতো না। তাই তিনি আরবির পরিবর্তে সংস্কৃত পণ্ডিতের কাছে এসে ধরা দিলেন সংস্কৃতের শিক্ষার্থী হিসেবে। এমনিভাবে তিনি সংস্কৃত শিক্ষার উৎসাহ পেলেন। ১৯০৪ ইং সালে তিনি সংস্কৃতকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে নিয়ে এন্ট্রানস পাস করেন। ১৯০৬ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ পাস করার পর তিনি হুগলি কলেজে ভর্তি হন সংস্কৃতে অনার্স পড়ার জন্য। এ সময় তিনি বেশ কিছুকাল ম্যালেরিয়া রোগে ভোগেন। বছর দুয়েক পড়াশোনা করতে পারেননি। কিন্তু তাতে হতোদ্যম হয়ে তিনি পড়েননি। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে ১৯১০ সালে তিনি সংস্কৃতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। তার আমলে একজন মুসলমান ছাত্রের পক্ষে সংস্কৃতে অনার্স পাস করাটা আশ্চর্যজনক ছিল বৈকি।

আর একটি ঘটনা তিনি তখন বিএ (অনার্স) পাস করে সংস্কৃতে এমএ করার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন কিন্তু সংস্কৃত বিভাগের কতিপয় শিক্ষক শ্মশ্রুবদন মুসলমান মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে পড়াতে অস্বীকার করলেন। সত্যব্রত শ্যামাশ্রয়ী এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এই মর্মে আপত্তি তুললেন, বেদ বেদাভগ ব্রাহ্মণদের ছাড়া আর কারও পড়ার অধিকার নেই। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বেশ গোলযোগের সৃষ্টি হলো। সংবাদটি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বেড়া পেরিয়ে বাইরে এল। তৎকালীন চিন্তানায়কদের তুমুলভাবে আলোড়িত করল। মওলানা মুহম্মদ আলী কমরেড পত্রিকার দি লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা অব ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখলেন-

‘সংস্কৃত ও আরবিতে রচিত সাহিত্য ও দর্শনের অফুরন্ত খনি শ্রেষ্ঠ প্রত্ন সাহিত্যের শিক্ষর্থীকে যে আকৃষ্ট করত তাতে সন্দেহ নেই এবং বর্তমানের চেয়ে অধিক সংখ্যায় মুসলিম বিদ্যার্থীরা সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করুক-এই আশা পোষণ করে, আমরা বিশ্বাস করি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পণ্ডিত জনৈক মুসলমান ছাত্রকে সংস্কৃত পড়াতে অস্বীকার করে শহীদুল্লাহ ঘচিত ব্যাপারের মতো যে ঘটনার সৃষ্টি করে, আর তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।’

বেঙ্গলি পত্রিকার সম্পাদক সুরেন ব্যানার্জীর মতো লোকও লিখলেন ‘টু ডে দিস অর্থডক্স পন্ডিটস শুড বিথ্রোন ইন টু দ্য গাঙ্গেজ’।

তবে সেবার অর্থডক্সির (গোঁড়ামি)ই জয় হয়েছিল। বাকবিতণ্ডার ফলে সৃষ্ট চাপে বাধ্য হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্যই তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগটি খুলতে হয়েছিল। এ বিভাগের প্রথম এবং একক ছাত্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯১২ সালে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এমএ পাস করেন। যদিও তিনি সংস্কৃতে এমএ পড়া থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন তবুও তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন সংস্কৃতে উচ্চ শিক্ষালাভ করবেন। সম্ভবত তিনি এই উপমহাদেশের সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের একজন ছিলেন। সংস্কৃতে এমএ পড়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে নতুন নতুন ভাষা শিক্ষার এক সম্ভাবনার দ্বার সবার সামনে খুলে গিয়েছিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সুপারিশক্রমে ও বগুড়ার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী বাহাদুরের বদান্যতায় তিনি জার্মানিতে সংস্কৃতে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য একটি রাষ্ট্রীয় বৃত্তি পান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি ভালো মেডিকেল সার্টিফিকেট পাননি, তাই তার আর জার্মানি যাওয়া হয়নি; কিন্তু এতেও তিনি হতোদ্যম হয়ে পড়েননি। প্রাচ্যের জ্ঞানভাণ্ডার তাকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। সে ডাকে তিনি সাড়া দিলেন ১৯২৬ সালে। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনা করছিলেন। দুই বছরের ছুটি নিয়ে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন নিজের খরচে। সেখানে তিনি বৈদিক, বৌদ্ধ, সংস্কৃত, তিব্বতী এবং প্রাচীন পারসি ভাষা সম্পর্কে গবেষণা শুরু করলেন। এর ফাঁকে ফাঁকে তিনি প্যারিসের ‘আর্কিভ ডি লা প্যারোল’ নাম ধ্বনিতত্ত্ব শিক্ষায়তনে ধ্বনিতত্ত্ব বিষয়ে শিক্ষালাভ করতে লাগলেন। সেখানে তিনি ‘লেস সনস ডু বেঙ্গলি’ নামে একটি গবেষণাপত্রের জন্য উক্ত শিক্ষায়তনের মানপত্র লাভ করেছিলেন। এদিকে সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ‘লেশাঁ মিস্ত্রিক’ নামক তার গবেষণা কর্মটি জমা দিয়ে জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় আসেন বৈদিক সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য। কিন্তু ছুটি ফুরিয়ে এল। সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণির ডক্টরেট অব লেটারেচার ডিগ্রি নিয়ে ১৯২৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন।

অনুকূল স্বাস্থ্যবিষয়ক সার্টিফিকেট না পাওয়ায় ১৯১৩ সালে তার জার্মানিতে যাওয়া না হলে তিনি আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এলএলবি পাস করেন। ১৯১৫ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত তিনি বশিরহাটে ওকালতিও করেছিলেন। তুলনামূলক ভাষা তত্ত্বে যিনি এমএ পাস তিনি হঠাৎ করে কেন আইন শিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়েন তা বলা মুষ্কিল। তবে এর পিছনে সম্ভবত এটাই প্রধান কারণ ছিল, ‘তিনি চাইতেন জ্ঞানারাজ্যের সর্বত্র ভ্রমণ করতে।’ ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের ভাষায় ‘হি ইজ এ ওয়াকিং ইনসাইক্লোপেডিয়া অব ওরিয়েন্টাল লোর’।

লেখক: সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআর-এর সাবেক চেয়ারম্যান


এক মুক্তিযোদ্ধার কথা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
হায়দার আহমদ খান এফসিএ

১৯৭১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে চলে গিয়েছিলাম যুদ্ধে দেশকে স্বাধীন করতে। যুদ্ধের আসল উদ্দেশ্যই ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমস্যার সঙ্গে একপর্যায়ে ছাত্রদের সমস্যাও যোগ হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম আগে জাতীয় সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার সুতরাং যুদ্ধে যাওয়া। যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করে অনিয়ম, দুর্নীতি দূর করে মানুষের জীবনকে করতে হবে আরামদায়ক। সমাজে আনতে হবে সুশাসন। সেই স্বপ্ন নিয়ে আমার মতো বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন কমছে। জানিনা প্রায় ৭০ বছর বয়সের মুক্তিযোদ্ধারা সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়া চিত্র দেখে যেতে পারব কি না।

গত কয়েক দিন ধরে দুর্নীতি, পেনশন স্কিম এবং সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা নিয়ে আলোচিত হচ্ছে। হঠাৎ এমন সব একাধিক বিষয়ের সংবাদ একসঙ্গে আমাদের সামনে কেন? সরকারের কাজ সফলতার সঙ্গে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। পরিকল্পনার শতভাগ সফল বাস্তবায়নেই সফলতা। তখনই জনগণের মঙ্গল সাধন হয়েছে দাবি করতে পারবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকার। সরকারকে যদি বিচার করার কাজে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় তাহলে উন্নয়নের কাজ করবে কখন? অতীতের দিনের চেয়ে আগামীকাল বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

অনিয়ম, দুর্নীতির নতুন নতুন খবর প্রকাশের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বলা চলে। আজকের নতুন খবর পিএসসির প্রশ্নপত্র নিয়ে। সংবাদটি পড়ে নিজেকে বড় অসহায় বোধ করছি। দেশের মানুষের মঙ্গলজনক কাজের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে থাকেন সেই দেশের কর্মকর্তরা। সেই কর্মকর্তাদের নিয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিয়োগ পেতে বা নিয়োগ নিতে যদি অনিয়ম হয় তাহলে তার ফসলের ফলন চলতে থাকে অবসরে যাওয়ার দিন পর্যন্ত। সরকারের সব কর্মকর্তা সৎ এবং নিষ্ঠাবান হবেন তা যেমন সম্ভব না আবার দুর্নীতিবান কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে একটি দেশের সরকারের কাজ তাও মানা যায় না। একটি সফল সরকারের কাজ হবে দেশের জনগণের মঙ্গলজনক কাজটি আদায় করে নেওয়া।

গত কয়েক দিন ধরে সরকারের পেনশন স্কিম এবং সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা নিয়ে আলোচিত হচ্ছে, চলছে আন্দোলন। বাংলাদেশ সরকারের নিয়োগে কোটাপ্রথা বর্তমান, যা নিয়ে আন্দোলন। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে বলতে চাই মুক্তিযোদ্ধারা রিলিপ চায় না। তারা চায় দেশের সব মানুষের উন্নতির জন্য মঙ্গলজনক পরিকল্পনা এবং কাজ। যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে তার শতভাগ বাস্তবায়ন মানে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। একজন অবিবাহিত মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করতে করতে যদি মারা যেতেন তাহলে কি তার সন্তানের লেখাপড়া, চাকরির বিষয় নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন হতো? আজকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের চাকরির জন্য কোটাপ্রথার প্রয়োজন অবশ্যই হতো না। যে মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন তার সন্তানের কথা আলাদাভাবে চিন্তা করতেও আমি বলব না। দেশের সব মানুষ যদি সুখে-শান্তিতে থাকে তাহলেই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরাও ভালো থাকবে। এমনটাই মুক্তিযোদ্ধার চাওয়া। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের কথা আলাদাভাবে চিন্তা করতে গিয়েই দেখা দিয়েছে এ সমস্যা। আসল সমস্যা অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধারা সুখে-শান্তিতেই। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা দেশের পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে। পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান যদি বজায় রাখা যায় তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কোটা পদ্ধতির প্রশাসনও লাগবে না। যোগ্যতার আসল ভিত্তি মেধা। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগকৃত কর্মকর্তারা যদি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে না যান তাহলে দেশের উন্নয়ন কেউ আটকিয়ে রাখতে পারবে না। পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়-দায়িত্ব সরকারের হতে। শিক্ষার উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং সব দায়-দায়িত্ব সরকারের। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যে দেশ রক্ত দিয়ে স্বাধীন হয়েছে সে দেশের উন্নয়নের সময় এত দীর্ঘ আশা করা যায় না বা মানা যায় না। বাংলাদেশের সংবিধান এবং অর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় সাময়িকভাবে কোটাপ্রথা থাকতে পারে। সরকারের কাজ দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন। আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের প্রধান এবং টেকসই পথ শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করা। দেশের মানুষ মানসম্মত শিক্ষা পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। আর তা যদি করতে পারা না যায় এবং যে শিক্ষাব্যবস্থা চলছে তার ফলে আমাদের সন্তানদের যোগ্যতা যদি এমন হয়: (১). বাংলায় শতকরা ৫৪ শতাংশ, (২). ইংরেজিতে শতকরা ১৯ শতাংশ এবং (৩). গণিতে শতকরা ২২ শতাংশ তাহলে সমাজে নানা অস্থিরতা দূর করা অনেক সময় কঠিন হবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার অধিকাংশ ছাত্ররা থাকে টেনশনে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্জনের আসল দাবিদার আমাদের ছাত্রসমাজ। বর্তমান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় কোটাপ্রথা সংশোধিত করার দাবি রাখে। ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেনশন নিয়ে আন্দোলন। মনে রাখতে হবে একজন চাকরিজীবীর আর্থিক সুবিধা কোনো অবস্থায় কমানো যায় না। সেই লক্ষ্য বিবেচনায় নিয়ে পেনশন স্কিম চালু করলে আন্দোলন করার সুযোগ থাকবে না বা প্রয়োজন হবে না।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ছাত্র এবং শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন, ক্লাস হচ্ছে না, লেখাপড়া হচ্ছে না। প্রধানত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে তার প্রভাব পরিলক্ষিত দেশের শুধু শিক্ষাব্যবস্থায়ই নয় ব্যবসা বাণিজ্যেও। সুতরাং সময়কে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত সব সমস্যার সমাধান করা।

লেখক: চেয়ারম্যান, এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (ইডিএ)


banner close