বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

আমি একজন সাধারণ নাগরিক বলছি...

দুর্বৃত্তদের পুড়িয়ে দেওয়া গাড়ি পড়ে আছে রাস্তায়। গত ২২ জুলাই রাজধানীর উত্তরা থেকে তোলা। ছবি: দৈনিক বাংলা
আপডেটেড
৩১ জুলাই, ২০২৪ ১৫:৩২
নুসরাত জাহান
প্রকাশিত
নুসরাত জাহান
প্রকাশিত : ৩০ জুলাই, ২০২৪ ১৮:১৪

মনটা বেশ কিছুদিন থেকেই খুব ভারাক্রান্ত। মন ভারাক্রান্ত নিহত শিক্ষার্থীদের জন্য, ভারাক্রান্ত নিহত নিরীহ জনগণ ও সাংবাদিক ভাইদের জন্য। মন ভারাক্রান্ত সেই পুলিশ সদস্যের জন্য, হত্যার পর যার লাশটি উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। তারা সবাই তো কারও সন্তান, কারও স্বামী, কারও ভাই, কারও বন্ধু, কারও আত্মীয়-পরিজন। কিন্তু, আজ তারা কেউ বেঁচে নেই এ পৃথিবীতে। এ জগতের নির্মম নিষ্ঠুরতার বলি হতে হয়েছে সবাইকে। তাদের মধ্যে কার পেশা কী, কার এজেন্ডা কী, কে কোনো দল করে বা করে না— এসব কিছুর ঊর্ধ্বে তাদের পরিচয়, তারা সবাই মানুষ। এটাই কি এই পৃথিবীতে আমাদেরকে আর সবার থেকে আলাদা করেনি? দেয়নি অন্য সব জীবের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠের মর্যাদা? তাই, সেই ‘মানুষ’ হয়েও যদি তাদের এই করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়, তাহলে এর থেকে দুঃখজনক ব্যাপার আর কী হতে পারে!

এখানে কোনো দলের কথা বলছি না। হচ্ছে না কোনো ইস্যুর কথাও। এখানে শুধু একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের জন্য সহানুভূতির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু, সারা বিশ্বেই যেন আজ বড় অভাব দেখা দিয়েছে এই সহানুভূতির। মানবসভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে, উন্নতির আরও শিখরে নিয়ে যেতে মানুষে মানুষে যে সৌহার্দ্যের প্রয়োজন ছিল, সেটারই বড় অভাব আজ। উল্টো, মানুষে মানুষে হানাহানি, রেষারেষি আর কাদা ছোঁড়াছুড়ির রাজনীতির মধ্যে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সব মূল্যবোধ; হারিয়ে যাচ্ছে সহনশীলতা, আর ওষ্ঠাগত হচ্ছে সাধারণের প্রাণ।

আমার সন্তানের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা চলছিল এই জুলাই মাসে। বছরের ৭ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও সে এখনও অর্ধবার্ষিক পরীক্ষাই শেষ করতে পারেনি। দেশে বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরীক্ষার মধ্যেই স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে এখন ঘরবন্দি! মনে মনে শুধু ভাবছি— যে চাকরির জন্য কোটা যৌক্তিকভাবেই সংস্কার হলো, সেই চাকরির বাজার পর্যন্ত আদৌ সময়মতো সে যেতে পারবে?

যে দিনমজুর, রিকশাচালকের ধার-দেনা বেড়ে গেলো, খাওয়া জুটলো না কতোদিন; বরং, একটু উপার্জনের আশায় পথে বের হয়ে জীবনটাই যার খোয়াতে হলো; সারাজীবনের জন্য যে পঙ্গুত্বের শিকার হলো; যে মা-বাবা সন্তানহারা হলো; যার এইচএসসি পরীক্ষা আটকে গেলো; যে শিশুদের স্কুল আবারও বন্ধ হয়ে পড়াশোনায় নেমে এলো স্থবিরতা; পুরো দেশের অবকাঠামোগত এতো ক্ষতি হয়ে গেলো; পোশাক খাত থেকে শুরু করে সার্বিকভাবে রপ্তানি খাতে এতো ক্ষয়ক্ষতি; শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা; পর্যটন খাতে একপ্রকার ধস নামা; জরুরি রোগীদের সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়া; ব্যাংক-বীমা-শেয়ার বাজারে ক্ষতি— এসবের দায়ভার কার?

এর দায় যারই থাকুক, ভুক্তভোগী আসলে সাধারণ মানুষই। সেইসব মানুষ, যারা নিজের ছোট্ট একটি চাকরি বা ব্যবসা, নিজের একটি পরিবার নিয়ে নিজের ছোট্ট একটি পৃথিবীতে শুধু দু’বেলা একটু খাওয়া-পড়ার নিশ্চয়তা আর একটুখানি ‘সুখ’ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চায়।

কিন্তু, পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে সহনশীলতার অভাবে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ভুক্তভোগী হচ্ছি আমরা এই সাধারণ মানুষ। অনাকাঙ্ক্ষিত এসব পরিস্থিতির কারণে কারও দেখা দিচ্ছে জীবিকার একমাত্র অবলম্বন চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা, কারও বা কাজের সুযোগ হারিয়ে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, কারও বহু কষ্টের পুঁজিতে গড়ে তোলা ব্যবসা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া, শিক্ষার্থীদের ঘরবন্দি-পড়াশোনাহীন-বন্ধুহীন নিরানন্দ জীবন। আবার, কারও হয়তো জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হয়ে নিজের মূল্যবান জীবনটাই হারিয়ে ফেলা; আর, পেছনে পড়ে থাকে নিহত ওই সাধারণ মানুষটির ওপর আর্থিক ও মানসিকভাবে নির্ভরশীল অসহায় কয়েকটা নিরীহ মুখ।

কিন্তু, এ সঙ্কটকাল জিইয়ে রাখা যায় না। তাহলে এর যে ক্ষত সৃষ্টি হবে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের মনে, তা থেকে পরিত্রাণের হয়তো আর কোনো উপায় থাকবে না। হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে একটি রাষ্ট্র, সমাজ ও সমাজের মানুষ। তাই, এ ক্ষত সারিয়ে তোলার এখনই সময়। সব ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে সহমর্মিতা ও সহনশীলতার চর্চার মধ্য দিয়ে আবারও আমরা নির্মাণ করতে পারি সুন্দর, নির্মল একটি পরিবেশ; সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য আদতে যার কোনো বিকল্প নেই। আর, তাহলেই অকাতরে ঝরবে না কোনো প্রাণ; নিঃস্ব হতে হবে না কোনো মানুষের, বেঁচে থাকবে সাধারণের স্বপ্নগুলো।

লেখক: নুসরাত জাহান, সাংবাদিক।


বাঙালি পরিবারের বিয়েতে নাকফুল

সালমা বেগ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

নাকফুল—একটুকরো সোনা, তবু তার মূল্য কখনোই শুধু ধাতুর ওজনে মাপা যায় না। এর ভেতর লুকিয়ে থাকে বহু প্রজন্মের গল্প, এক কন্যার জীবন বদলে যাওয়ার নীরব মুহূর্ত, আর বাঙালি নারীর সৌন্দর্যের শাশ্বত চিহ্ন। বিয়ের দিন কনের নাকে নাকফুল তোলা যেন শুধু সাজগোজ নয়; এটি তার জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশের কোমল আচার, যা একই সঙ্গে অলঙ্কারও, আবার পরিচয় বদলের ঘোষণা।

বাঙালি পরিবারে কন্যা মানে আদরের আলো। বাবার হাত ধরে বড় হওয়া সেই মেয়ে যখন বিয়ের শাড়িতে সাজে, তার চোখে যেমন থাকে লাজুক স্বপ্নের কুয়াশা, তেমনি হৃদয়ে থাকে অচেনা ভবিষ্যতের ধুকপুকানি। আর ঠিক সেই সময়েই নাকে পরানো হয় নাকফুল। ক্ষুদ্র কিন্তু গভীর এক প্রতীক। বাবার ঘরের মেয়ে সেই মুহূর্তেই বধূ হয়ে ওঠে। কপালের টিপ, শাড়ির কুচি বা চুড়ির ঝনঝনানির মধ্যেও নাকফুল আলাদা করে বলে দেয়—

‘সে আর শুধু কন্যা নয়, সে এখন কারো বধূ, অন্য পরিবারের অংশিদার।’

আগে বনেদী পরিবারে মেয়ের দেনমোহর নির্ধারিত হতো তার ওজনের সমান সোনা দিয়ে। সেই সোনার ভাজে নাকফুল ছিল সবচেয়ে কোমল, সবচেয়ে আবেগী গয়না। অনেকে বড় গয়না কিনতে না পারলেও নাকফুল দেওয়াটা কখনো বাদ দিত না। কারণ নাকফুল ছিল বিবাহিত পরিচয়ের প্রথম মর্মস্পর্শী ছাপ—একটি ছোট অলঙ্কার, যার ভেতর লুকিয়ে থাকে স্বামীর ভালোবাসা, পরিবারের স্বীকৃতি এবং বধূর নতুন পরিচয়ের দৃঢ় অথচ নরম ঘোষণা।

আজকের দিনে গয়নার ঝলক কমে গেছে, সোনার দাম আকাশছোঁয়া, মেয়েরা জীবনযাপনের ব্যস্ততায় গয়নার ভার কমিয়েছে তবুও নাকফুল তার জায়গা ছাড়েনি। কারণ নাকফুল শুধু সাজ নয়—এ এক আবেগ, এক ইতিহাস। এটি পরতেই কনের মুখে ফুটে ওঠে এক অচেনা দীপ্তি, যেন লাজুক আলোয় ভরে যায় তার হাসি। মেয়ে থেকে বধূ হয়ে ওঠার যে রূপান্তর, তার সবচেয়ে স্নিগ্ধ অনুষঙ্গই হলো নাকফুল।

নাকফুল নারীর সৌন্দর্যকে শুধু বাড়ায় না—এ তাকে দেয় এক মর্যাদা, এক আত্মপরিচয়। শত বছর আগে যেমন ছিল, আজও তেমনই প্রাসঙ্গিক। সমাজের পরিবর্তন, রুচির বদল, সময়ের স্রোত—কিছুই নাকফুলের আবেগকে ছুঁতে পারেনি। তাই বাঙালি বিয়েতে এই ক্ষুদ্র অলঙ্কারটিই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় প্রতীক—ভালোবাসা, আস্থা ও নারীত্বের চিহ্ন।

এক কন্যা যখন নাকফুল পরে বধূ হয়ে ওঠে, তখন শুধু তার সাজই সম্পূর্ণ হয় না—সম্পূর্ণ হয় তার জীবনের এক অধ্যায়। সেই ছোট্ট সোনায় বাঁধা থাকে বাবার ঘর ছেড়ে নতুন ঘরে পা রাখার শিহরণ, নতুন জীবনের প্রতিশ্রুতি এবং অসংখ্য অদেখা আশার দীপ্তি।

নাকফুল তাই শুধু সৌন্দর্য নয়—এ বাঙালি নারীর জীবনে এক কোমল, অমর, এবং গভীর আবেগের প্রতীক।

লেখক: কবি।


OTP-এর অবসান: নিরাপত্তার নতুন সংজ্ঞা বায়োমেট্রিকে

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শাহজাহান মজিব
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

একটা সময় ছিল, অনলাইনে টাকা পাঠাতে গেলে আমরা অপেক্ষা করতাম একটা ছোট মেসেজের জন্য, সেই পরিচিত ছয় অঙ্কের OTP (One Time Password)। মোবাইলে কোড এলেই বুকের ভেতরটা হালকা হয়ে যেত, মনে হতো, এই সংখ্যাগুলোই আমাদের টাকা-পয়সা নিরাপদ রাখার একমাত্র চাবিকাঠি। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন সেই একসময়ের ‘নিরাপদ’ মনে হওয়া OTP-ই হয়ে উঠেছে প্রতারণার সবচেয়ে সহজ দরজা। OTP তাই ধীরে ধীরে ইতিহাসে পরিণত হচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ঘোষণা করেছে, ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে সব ব্যাংক থেকে SMS ও ইমেইল-ভিত্তিক OTP সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়া হবে। তার পরিবর্তে আসছে এমন এক সিস্টেম, যেখানে মানুষ নিজেই হবে নিজের পাসওয়ার্ড— বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশন, অর্থাৎ মুখ বা আঙুলের ছাপ দিয়ে হবে সব লেনদেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাত এই বাস্তবতা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছে। দেশটির ব্যাংকগুলো গত কয়েক বছর ধরে ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপ, ডিজিটাল পেমেন্ট সবখানেই ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে সাইবার প্রতারণা ও অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রে হ্যাকাররা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে ব্যবহারকারীর ফোনে প্রবেশ করে OTP সংগ্রহ করেছে। ফলে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়েছে এমন একটি সমাধান খুঁজতে, যা সম্পূর্ণভাবে ‘ইউজার আইডেন্টিটি'-এর ওপর ভিত্তি করে, বাহ্যিক কোড বা পাসওয়ার্ডের নয়।

সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) ঘোষণা করেছে, ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যেই তারা ব্যাংকিং সেবায় SMS ও ইমেইল ভিত্তিক OTP সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেবে। তার পরিবর্তে লেনদেনের প্রতিটি ধাপে গ্রাহকের মুখের ছবি বা আঙুলের ছাপের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ বাধ্যতামূলক হবে। এর মানে, আপনি নিজে উপস্থিত না থাকলে আর কেউ আপনার নামে লেনদেন করতে পারবে না। এই সিদ্ধান্তের পেছনে বড় কারণ প্রতারণা রোধ। UAE-এর সেন্ট্রাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২৩ সালেই অনলাইন ব্যাংকিং জালিয়াতিতে গ্রাহকরা প্রায় ৮৭ মিলিয়ন ডলার হারিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অপরাধীরা ফিশিং লিংক বা SIM swapping-এর মাধ্যমে গ্রাহকের OTP জেনে নিয়ে অ্যাকাউন্ট খালি করে ফেলেছে। অর্থাৎ, ব্যাংকের প্রযুক্তি যত উন্নতই হোক না কেন, যদি OTP ভুল হাতে পড়ে—নিরাপত্তা শূন্যে নেমে আসে।

বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশন তাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে যৌক্তিক ও নিরাপদ বিকল্প। ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফেস রিকগনিশন, আইরিস স্ক্যান বা ভয়েস অথেন্টিকেশন — এগুলোর মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় যে, লেনদেনটি সেই ব্যবহারকারীই করছেন, অন্য কেউ নয়। কোনো হ্যাকার বা প্রতারক যত উন্নত কৌশলই ব্যবহার করুক না কেন, কারও মুখ বা আঙুলের ছাপ নকল করা এত সহজ নয়। তাছাড়া বায়োমেট্রিক ডেটা সাধারণত এনক্রিপটেড আকারে সংরক্ষিত থাকে এবং কেবল ডিভাইসের ভেতরেই যাচাই হয় যায়।

ফলে সার্ভার-সাইডে লিক হওয়ার সম্ভাবনাও কমে

এখন যদি আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাবি, বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধরুন, মিরপুরে থাকেন মি. রাহিম, একজন সরকারি চাকরিজীবী। প্রতিদিন সকালে অফিসে যান, বিকেলে বাসায় ফেরেন, মাঝে মাঝে অনলাইন ব্যাংকিং করে বিল পরিশোধ করেন বা পরিবারের জন্য টাকা পাঠান। একদিন সকালে অফিসে বসে মোবাইলে ব্যাংকের নোটিফিকেশন পেলেন—‘আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে ২,০০,০০০ টাকা ট্রান্সফার হয়েছে।’ রাহিম চমকে উঠলেন! তিনি তো এমন কোনো লেনদেন করেননি! ব্যাংকে ফোন করলেন, কিন্তু দেখা গেল তার ফোনে ঠিকই OTP গেছে এবং সেটি ব্যবহারও হয়েছে। অথচ তিনি OTP দেননি। পরে জানা গেল, একজন প্রতারক আগেই একটি ফিশিং লিংক পাঠিয়ে রাহিমের ব্যাংক লগইন তথ্য জেনে নিয়েছিল, তারপর SIM swap করে সেই OTP নিজের হাতে নিয়ে টাকা ট্রান্সফার করেছে। এটাই বাস্তবতা—OTP থাকা সত্বেও গ্রাহক নিরাপদ নয়৷

ধরুন, একই ঘটনা যদি বায়োমেট্রিক সিস্টেমে ঘটত। রাহিমের ব্যাংক অ্যাপে লেনদেন করার আগে অ্যাপটি মুখ চিনে বা আঙুলের ছাপ যাচাই না করা পর্যন্ত টাকা পাঠানো সম্ভব হতো না। OTP চুরি করলেও কোনো লাভ হতো না, কারণ বায়োমেট্রিক তথ্য কারও পক্ষে নকল করা প্রায় অসম্ভব। এখানেই প্রযুক্তির আসল শক্তি। বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা মানে, আপনি নিজেই আপনার পাসওয়ার্ড—আপনার মুখ, আপনার আঙুল, আপনার কণ্ঠস্বরই হবে প্রমাণ যে আপনি আসল ব্যবহারকারী।

বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা চালু হলে গ্রাহকের জন্য সুবিধা অনেক। প্রথমত, তাকে আর কোড মনে রাখতে হবে না। দ্বিতীয়ত, প্রতারণার ঝুঁকি প্রায় শূন্যে নামবে। তৃতীয়ত, ব্যাংকও নিশ্চিত থাকবে যে লেনদেনটি আসল গ্রাহকই করেছেন। প্রথমে বায়োমেট্রিক সিস্টেম একটু ঝামেলাপূর্ণ মনে হতে পারে—নতুনভাবে অ্যাপ আপডেট করা, মুখ বা আঙুলের ছাপ নিবন্ধন করা ইত্যাদি। কিন্তু একবার সেটআপ হয়ে গেলে এটি অসাধারণ সুবিধাজনক। আর OTP-এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে না, পাসওয়ার্ড ভুলে যাওয়ার চিন্তা থাকবে না, কয়েক সেকেন্ডেই নিরাপদে লেনদেন সম্পন্ন হবে। এটা শুধু প্রযুক্তি নয়, মানসিক স্বস্তিও এনে দেবে।

এখানে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতিমধ্যেই ‘UAE PASS’ নামে একটি জাতীয় ডিজিটাল আইডেন্টিটি সিস্টেম চালু করেছে, যা নাগরিক ও প্রবাসী উভয়ের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য। এর মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি সব ডিজিটাল সেবায় একীভূত বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশন সম্ভব হচ্ছে। ব্যবহারকারী একবার নিবন্ধিত হলে, তার মুখ বা আঙুলের ছাপই যথেষ্ট সব লেনদেনের জন্য— হোক তা ব্যাংকে লগইন, ট্যাক্স প্রদান বা সরকারি নথি স্বাক্ষর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় হলেও নিরাপত্তা হুমকিও বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই অনলাইন প্রতারণা, ফিশিং বা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট হ্যাকের ঘটনা শোনা যায়। এখানে OTP অনেক সময়ই দুর্বল নিরাপত্তা প্রাচীর হিসেবে কাজ করছে— বিশেষ করে যখন ব্যবহারকারী অসচেতন বা হ্যাকার ফোনে ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে কোড পড়ে নিতে পারে। ফলে আমাদের জন্য এখনই বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সময়ের দাবি।

আমরা ইতোমধ্যেই জাতীয় পরিচয়পত্রে (NID) বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষণ করেছি। এই বিশাল ডেটাবেস যদি সুরক্ষিতভাবে ব্যাংকিং সেক্টরের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, তাহলে ডিজিটাল অথেন্টিকেশন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ব্যাংকগুলো চাইলে ধীরে ধীরে পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক লগইন ও লেনদেন চালু করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ ক্ষেত্রে একটি নীতিগত নির্দেশিকা দিতে পারে, যাতে গ্রাহকের ডেটা সুরক্ষা, এনক্রিপশন ও ব্যবহারকারীর সম্মতির বিষয়গুলো নিশ্চিত থাকে ।

তবে প্রযুক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি করাও জরুরি। অনেক গ্রাহকই এখনো বিশ্বাস করেন, OTP এলেই সেটি নিরাপদ; তারা বোঝেন না, এটি হ্যাক বা চুরি হওয়ার ঝুঁকিতেও থাকে। তাই ব্যাংকগুলোর উচিত গ্রাহকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও প্রচার চালানো। বিশেষ করে, নতুন প্রজন্মের পাশাপাশি গ্রামীণ বা প্রান্তিক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাই হবে আসল সফলতা।

আগামী দিনের ব্যাংকিং শুধু পাসওয়ার্ড বা OTP-এর ওপর নির্ভর করবে না। গ্রাহকের নিজের পরিচয়ই হবে প্রধান চাবিকাঠি। UAE-এর অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে, বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা শুধু সুবিধা নয়, এক জরুরি প্রয়োজন। বাংলাদেশেও যদি আমরা সময়মতো এই পদক্ষেপ নিই, তাহলে অনলাইন ব্যাংকিং নিরাপদ, সুবিধাজনক এবং বিশ্বস্ত হয়ে উঠবে। রাহিমের মতো গ্রাহকের জন্য এটি হবে শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।

একসময় আমরা পাসওয়ার্ড মুখস্থ করার দিনগুলোতে অভ্যস্ত ছিলাম, পরে এল ‘OTP যুগ’, আর এখন সেই যুগও ইতিহাস হতে যাচ্ছে। এখন থেকে আপনার মুখ, আপনার আঙুল, আপনার স্বরই হবে আপনার সুরক্ষার প্রহরী। এই পরিবর্তন শুধু প্রযুক্তিগত নয়— এটি এক নতুন বিশ্বাসের বিপ্লব। এমন এক ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্বপ্ন, যেখানে মানুষই তার নিজের নিরাপত্তার প্রতিচ্ছবি। সংযুক্ত আরব আমিরাত এই নতুন যাত্রার সূচনা করেছে, আর বাকিরা শিখবে, মানিয়ে নেবে, আর একসাথে তৈরি করবে নিরাপদ, আধুনিক ও সমন্বিত এক ডিজিটাল পৃথিবী। কারণ সাইবার নিরাপত্তা এখন আর বিলাসিতা নয়— এটি আজ একান্ত প্রয়োজন।

লেখক: হেড, ডিপার্টমেন্ট অব সিএসই, এমআইএসটি।


ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড নিয়ে সাবধান

মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করেছে। এ সূত্র ধরে কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম, মোবাইল ফোন, ক্যাবল টিভি, ডির্কোডার, এটিএম বুথ, ই-মেইল, ইত্যাদিতে পাসওয়ার্ড কথাটি একটি স্বাভাবিক ব্যবহার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এর ব্যবহারের এতটুকু হেরফেরের কারণে বিরম্বনা নেমে আসতে পারে। তাছাড়া এতে প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে সর্বশান্ত হয়ে পড়ে। ইদানীং এ ধরনের ভূড়ি ভূড়ি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পাসওয়ার্ড হলো শব্দ বা বিভিন্ন অক্ষরের সমষ্টি, যা ব্যবহার করা হয়। এদিকে ব্যবহারকারীর পরিচয় অথবা প্রবেশ অনুমোদন যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এর মাধ্যমে ব্যবহারকারী নির্দিষ্ট জায়গায় প্রবেশাধিকার পেয়ে থাকে। অবশ্য এই পাসওয়ার্ড হলো গোপনীয়। এবার আসুন প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড নিয়ে সাবধনতা’ এর কথায় আসা যাক। বর্তমানে ডিজিটাল ব্যাংকিং, মোবাইল ফাইন্যান্স, অনলাইন কেনাকাটা কিংবা সিম রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে ওটিপি একটি নিরাপত্তার প্রতীক। অথচ এই নিরাপত্তা বলয়ই এখন পরিণত হয়েছে প্রতারকদের সবচেয়ে নিজস্ব কার্যকরী হাতিয়ারে। কেননা ফোন বা এসএমএসে আসা একবার ব্যবহারযোগ্য এই কোড বর্তমানে মানুষের অর্থ, তথ্য ও গোপনীয়তা লুটের সহজ ও কার্যকরী পন্থা। অবশ্য দেশে এখন দিনে দিনে প্রতারণার ধরণ পরিবর্তিত হচ্ছে। কারণ পূর্বের ন্যায় ‘লটারিতে জিতেছেন’ বা ‘বিকাশ ভুল করে টাকা পাঠানো হয়েছে’ ইত্যাদি বলে ফাঁদগুলো এখন অনেকটা সেকেলে। এখন প্রযুক্তি-নির্ভর পরিকল্পিত ও মনস্তাত্ত্বিক কৌশল ব্যবহারে প্রতারকরা বিভিন্ন আঙ্গিকে কার্যসিদ্ধ করতে তৎপর। এক্ষেত্রে ওটিপি তাদের কার্যকরী অস্ত্র। মূলত ওটিপি তথা ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড হলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হওয়া ৪-৬ সংখ্যার একটি কোড, যা ব্যবহারকারীকে কোনো লেনদেন তথা লগইন নিশ্চিত করতে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে উদহারণ হিসেবে উল্লেখ্য যে, ‘আপনি বিকাশে টাকা পাঠাচ্ছেন’ বা ‘ব্যাংক ট্রান্সফার করছেন’ বা ‘ফেসবুক পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করছেন’, ইত্যাদি বলে সরল বিশ্বাসী গ্রাহকদের ভুলিয়ে ভালিয়ে কাজ সিদ্ধপূর্বক হাতের মুঠোই নিয়ে আসে ওটিপি। মজার ব্যাপার হলো যে, এই কোডটি যে কোনো ক্ষেত্রে একবার ব্যবহারের পর আর কোনো কাজে আসে না। অবশ্য নিরাপত্তার জন্যই এটি প্রবর্তন করা হয়েছিল। অথচ দুঃখের বিষয় হলো যে, সেই নিরাপত্তার অস্ত্রই হয়ে উঠেছে প্রতারণার বিশেষ হাতিয়ার। কেননা সাধারণত মানুষ ভাবে, কেউ কখনো যদি ‘অফিস থেকে ফোন করেছে’ বা ‘কাস্টমার কেয়ার বলছে’ এমন কথা শোনে তাহলে ওটিপি বলাটা তো নিরাপদ মনে করে। কিন্তু আসলে ব্যাপারটি উল্টো। আর বলতে গেলে এটি প্রতারণার খেলা। এক্ষেত্রে ওটিপি জালিয়াতি প্রতারকেরা মূলত দুইভাবে ওটিপি সংগ্রহ করে। সত্যিকারার্থে এটি এমন এক কৌশল, যেখানে প্রতারক ভুক্তভোগীকে ‘বিশ্বাস’ করাতে চায় যে সে একজন সরকারি কর্মকর্তা বা ব্যাংকের প্রতিনিধি বা মোবাইল অপারেটরের কর্মী বা ই-কমার্স সাইটের কোন এক কর্মকর্তা। তাছাড়া ফোনে বা মেসেঞ্জারে বলা হয় যে ‘স্যার, আপনার বিকাশ একাউন্ট ভেরিফিকেশন চলছে অথবা আপনার ফোনে একটা কোড গেছে, স্যার তা আপনার স্বার্থে বলুন তো প্লিজ।’ তখন মানুষ সরল বিশ্বাসে বা ভয়ে বা বিভ্রান্তিতে অবলীলাক্রমে ওটিপি বলে দেয়। তখন সেই মুহূর্তেই প্রতারক উক্ত একাউন্টের উপর পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এখনো সহজ সরল। যদিও প্রতিনিয়ত বিকাশ, নগদ, রকেট, শিওর ক্যাশ, ইত্যাদি সব মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে এই মর্মে সতর্কতা বার্তা দেয়া হয় যে, ‘কোনো অবস্থাতেই কাউকে ওটিপি বা পিন নম্বর জানাবেন না।’ তথাপিও প্রতিদিনই নতুন নতুন লোক এর শিকার হচ্ছেন। এক্ষেত্রে কোনো এক সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, ‘মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কিন্তু নিজের স্বার্থে এর নিরাপত্তা শিখছে না। আমাদের দেশে প্রযুক্তি শিক্ষার চেয়ে মোবাইল ব্যবহারের অভ্যাস দ্রুত রপ্ত করছে। তাই এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ শিক্ষার অভাবে অন্ধকারে থাকে বিধায় তারা সহজেই ভয় পায় বা বিশ্বাস করে বা বিভ্রান্ত হয়ে থাকে। ‘এদিকে ওটিপি প্রতারণার সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে আরেক ভয়ঙ্কর কৌশল; যা হলো- রিমোট অ্যাকসেস অ্যাপ’। এক্ষেত্রে প্রতারকেরা ব্যবহারকারীকে বলেন, ‘আপনার ফোনে একটা অ্যাপ ইনস্টল করুন, আমরা আপনার সমস্যা ঠিক করে দিচ্ছি।’ আর অ্যাপটির নাম হলো- ‘Quick Support, AnyDesk, SmartFix’

ইত্যাদি। এক্ষেত্রে এই অ্যাপটি একবার ইনস্টল করা হলে প্রতারক সরাসরি ভুক্তভোগীর মোবাইলের স্ক্রিন ও ইনপুট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। আর তখন ওটিপি না বললেও তারা নিজেরাই দেখে নেয়। যদিও গত জুনে এমন ১০টি অ্যাপভিত্তিক প্রতারণার দায়ে ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এতদ্ব্যতীত যে সমস্যা দেখা গিয়েছে, তা হলো ব্যাংক বা মোবাইল কোম্পানীর নামে বা পক্ষে প্রতারকরা যখন ওটিপি ফাঁদে ফেলে টাকা নিয়ে নেয়। তখন ভুক্তভোগীরা ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানীকে দায়ী করে থাকে। কিন্তু তারা জানে না যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেনদেন হয় ‘গ্রাহকের সম্মতিতে’। কারণ ওটিপি তো তাদের আওতায় থাকে। তাই সব কিছু বিবেচনায় এনে ব্যাংকগুলোরও উচিত বায়োমেট্রিক যাচাই ও ডুয়েল অথেটিফিকেশনে আরও শক্ত নিরাপত্তা স্তর তৈরি করা। অবশ্য এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ডিজিটাল ফ্রড মনিটরিং সেল’ গঠন করেছে, যেখানে প্রতিদিনের লেনদেন অ্যালগরিদমের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং সন্দেহজনক লেনদেন হলে তাৎক্ষণিকভাবে সেই অ্যাকাউন্ট আপাতত বন্ধ করে দেয়া হয়।

বর্তমানে প্রতারকেরা শুধু টাকা নয়, মানুষের নৈতিক সাহস ও আত্মবিশ্বাস কেড়ে নিচ্ছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়ে ‘নিজের ভুল’ বলে লজ্জায় মুখ খুলেন না বা অভিযোগ করতে চান না। ফলে চক্রগুলো আরও সাহসী ও তৎপর হয়ে উঠছে। কিন্তু অভিযোগ না এলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিভাবে চক্রের অবস্থান জানতে পারবে? তাই সব কিছু মিলে বলতে গেলে নিরাপত্তার বিষয়টি জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ব্যবহারকারীর সতর্কতা কতটা জরুরি তা সহজেই অনুমেয়। এক্ষেত্রে স্বভাবতই যে কথাটি উঠে আসে, তাহলো একটি কোড বলেই যদি কেউ সমস্ত তথ্য ও টাকা হাতে পেয়ে যায়। তাহলে সে দোষ প্রযুক্তির নয়? এক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর দূরদর্শিতা ও বিশ্বাসের প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট। তাই এই ডিজিটাল যুগে এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা থেকে বাঁচতে সবাইকে সচেতন ও সজাগ হতে হবে। এক্ষেত্রে গ্রাম বাংলায় সবার মুখে মুখে প্রচলিত দুটি বচনের কথা মনে পড়ে যায়। সেগুলো হলো, ‘ওই ছেঁড়ি, তোর বিয়ে’ এবং ‘চিলে কান নিয়েছে বলে, কানে হাত না দিয়ে ছুটতে শুরু করা’। এ ব্যাপারে উক্ত দুটি বচনের দর্শন এই কারণে স্মরণ করে দিলাম যে, কোন কিছু শোনা মাত্র সিদ্ধান্ত না নেয়া। আর এই আলোকে মোবাইলে মৌখিক বা লিখিত মেসেজে কোন তথ্য চাওয়া হলে, সে ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়া। এক্ষেত্রে এমনও দেখা গিয়েছে যে, প্রতারকরা এমন ভাবে একটির পর একটি মেসেজ দিয়ে বিশ্বাস অর্জনসহ ও ভয়ভীতি তৈরি করে যে, তখন তাদের চাহিদাকৃত তথ্যাদির ব্যাপারে বিভ্রান্ত না হয়ে এবং তাৎক্ষনিক তা না দিয়ে বুঝে-শুনে এবং অগ্র পশ্চাৎ ভেবে চিন্তে দেয়া সমীচীন। এতে প্রতারকদের খপ্পর থেকে হয়তো মুক্ত থাকা সম্ভব হতে পারে। আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে যে, অবস্থাভেদে প্রতারকদের কৌশল বা পন্থা বদলিয়ে থাকে, সে দিকেও চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।

বিশিষ্ট গবেষক, অথর্নীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।


হতাশা থেকে বের হয়ে আসুন, প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিন প্রতিদিন

মমতা মজুমদার 
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

হতাশা আমাদের জীবনকে গ্রাস করে বার বার। বিরহ-ব্যথা আর নিছক সুখের স্রোতে এগিয়ে চলছে তবুও সবার জীবন। একরকম যুদ্ধ করে। এই যুদ্ধে কেউ হয় বিজয়ী আর কেউ হয় পরাজিত। জীবন যুদ্ধে হার মানা আর এই যুদ্ধে লড়ে জয়ী হওয়া দুটোই কিন্তু এক নয়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কষ্টকর। হতাশাকে দূরে ছুঁড়ে কখনো কখনো এগিয়ে যাওয়া যায় না। থমকে যায় মনের গতি আর আমাদের পদযুগল। কষ্টকে জয় করতে হলে জীবনের অনেকগুলো সুখ বিসর্জন দিতে হয়। অনেক সময় জীবন থেকে হারিয়ে ফেলতে হয়। জয় আর পরাজয়ের খেলায় কাটছে আমাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত।

এই জীবন বড্ড ত্যাড়াবাঁকা কারো কারো ক্ষেত্রে। সুখের জন্য যদি কখনো দৌঁড়ান, দেখবেন জীবন থেকে অনেক হাসি আনন্দের সুন্দর কিছু মুহূর্ত বিলিন হয়ে গেছে নীরবে। যা হয় তো টেরও পাবেন না আপনি। আবার দুঃখদের ধুয়ে মুছে একবারে বাঁচাও কিন্তু পসিবল না। অর্থ্যাৎ আপনার চারপাশ ঘিরে থাকা দুঃখ-কষ্ট, বিরহবেদনা আর হতাশাদেরকে নিয়েই বাঁচতে হবে আপনাকে। যারা বিজয়ী তাদের সাফল্যের মূল্য এখানেই। আর যারা পরাজিত তারা মাঝ পথেই ক্লান্ত হয়ে আশা ছেড়ে দেন। সব মিলিয়ে তারা এগিয়ে যেতে চাইলেও তখন এগিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

জয়ের নেশায় তারা জীবন পর্যন্ত বাজি রাখতে দ্বিধা করেন না। অনেক বেশি সাহস নিয়ে এগিয়ে যান তারা। আমাদের জীবনের লক্ষ্য আমরা ঠিক করলেও সে লক্ষ্যে পৌঁছার মতো আমাদের সাহস কম। আমরা প্রতিটি মুহূর্তে নিজের সাথে যখন নিজে কথা বলি, তখন মনে করি আমিও পারবো। আমি আগামীকাল থেকে এই এই কাজগুলো করব। তখন আমাদের মেন্টালিটি একদম ফ্রেশ থাকে। মনে যা আসে, তা নিয়ে আমরা ভীষণ চিন্তা করি বলেই হয়তো এমনটা মনে হয় আমাদের। যেন মনে হয় আমি চেষ্টা করলেই কাজগুলো আমার জন্য সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু না, পরক্ষণেই দেখা যায় তার উল্টো। আমাদের আর কিছুই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

এক গবেষণায় ওঠে আসে, যারা জয়ী তারা কিন্তু কঠোর পরিশ্রম আর কৌশল অবলম্বন করে তাদের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় নিজ লক্ষ্যে জয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। হতাশাকে পায়ে ধলে সামনে এগিয়ে গেছেন। তাদের জন্য উপরওয়ালাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কাউকে উপলক্ষ করে। আসলে যারা সফল হোন, তাদের সে সফলতার পিছনে যাদের হাত থাকে, সেটা হয় তো সম্মুখে আর আসে না। সবাই তখন তার সফলতা টা-ই শুধু দেখে। আমাদের জীবনের সে কাঙ্ক্ষিত লক্ষে আমরা পৌঁছাতে গেলে, আমরা না পাই সাহায্যের সে বিশেষ কোনো হাত। ফলে নিজেদের মধ্যে নিজেরাই হতাশায় জর্জরিত হয়ে পড়ি। হতাশা তখন আমাদের আরো বেশি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।

আমি আমার নিজেকে দিয়েই তার প্রমাণ পাচ্ছি। যদিও এখনো সফল হতে পারিনি জীবনে। কিন্তু সবসময় ভেঙে পড়া কিছু মানুষের জীবন থেকে নেওয়া গল্পের পটভূমি লিখতে সচেষ্ট হয়েছি। সময় মানুষের উত্তম একজন শিক্ষক। আর সে শিক্ষক থেকে আমি রোজ শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ করে চলেছি। জীবনের পাতা থেকে যতটুকু শিখতে পেরেছি, তা হয়তো আমার একাডেমিক বই থেকেও পাইনি। মানুষ কখনো কখনো হার স্বীকার করে, অবশেষে হঠাৎ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় হতাশাকে সঙ্গী করে। জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে সাহসী মনোভাব রাখা কতটা জরুরি, তা সময় সাপেক্ষে বুঝতে পারবেন। হতাশা থেকে বের হয়ে আসুন। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিন প্রতিদিন। জীবন সুন্দর, কখনো আত্মহননের কল্পনাও করতে যাবেন না কিন্তু। মনে রাখবেন, আপনার জীবন আপনার কাছে ভীষণ মূল্যবান। ভালো থাকবেন সবসময়।

মমতা মজুমদার, কবি, লেখক ও গবেষক।


রাজনীতিতে গুমোট পরিস্থিতি কি কাটবে

ড. সুলতান মাহমুদ রানা
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে সংকট কাটছে না। দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাসের বাস্তবতার মধ্য দিয়েই দেশ আগাচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ, সরকারি সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক পরিস্থিতি গণতন্ত্রের কাঠামো নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠা সম্ভব হচ্ছে না। রাজনীতিতে একদিকে আশাবাদের সুর জাগালেও অন্যদিকে উদ্বেগেরও জন্ম দিয়েছে। সরকার সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এই গণভোটের লক্ষ্য হলো জুলাই সনদে ঘোষিত রাজনৈতিক সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে জনসমর্থনের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা করেছেন, ‘এই গণভোটের মাধ্যমে জনগণই নির্ধারণ করবেন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো।’ এই ঘোষণার পরই রাজনৈতিক অঙ্গন আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। একদিকে সরকার নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং আচরণবিধি ঘোষণা করছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো কোনোটি প্রশ্ন তুলছে এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্তিমূলকতা নিয়ে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মতপার্থক্য এখনো স্পষ্ট। কেউ চাইছে আগে গণভোট, পরে নির্বাচন; কেউ চাইছে উল্টোটা। ফলে একটি সুসংগঠিত বিরোধী রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠছে না।

ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন করা হয়। জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক ঐক্য বজায় রাখতে হবে। তা না হলে আমরা সবাই বিপদের মুখে পড়ব। এ সম্পর্কে আমি আগেও একাধিকবার আমার আশঙ্কা প্রকাশ করেছি।’ নানা কারণেই আগামী নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এবারের নির্বাচন নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলকে পুনরায় ফিরে পাওয়ার এক বড় পরীক্ষা। নির্বাচনকে ঘিরে যে উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা শুধুই ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই বা ভোটার উৎসাহের বিষয় নয়; এখানে রয়েছে ‘ভোট কি কার্যকর হবে?’, ‘সক্রিয় অংশগ্রহণ কি সম্ভব হবে?’ এবং ‘নির্বাচন পরবর্তী সময় কী রূপ ধারণ করবে?’- এসব বেশি গভীরে ভাবার বিষয় সামনে এসেছে।

বিগত কয়েকটি নির্বাচনে আমরা দেখেছি ভোটার অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল, গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি ছিল। বিরোধী দল বড় অংশ নির্বাচনে ছিল না। এই পরিপ্রেক্ষিতে খুব ন্যায্যভাবেই আলোচনা সামনে আসে যে শুধুই নির্বাচন আয়োজন বড় কথা নয়; সমস্যা হলো নির্বাচন-পরবর্তী সময়, তার স্বীকৃতি, অংশগ্রহণ ও জনআস্থার পরিবেশ। এবারের নির্বাচনকে তাই শুধু ‘আগামী নির্বাচন’ বলা যাবেনা; এটি হবে একটি রূপান্তরপ্রক্রিয়ার অংশ, যেখানে নির্বাচন নিজেই একটি উদ্দেশ্য নয়Ñ বরং একটি ‘মাধ্যম’ হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে বিষয়টি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে বেশ কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে।

প্রথমত: রাজনৈতিক প্রস্তুতির দিক থেকে দেখা যাচ্ছে যে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ইতিমধ্যে ২৩৭টি আসনের প্রার্থীতা ঘোষণা করেছে। জামায়াতও প্রায় সবগুলো আসনেই তাদের প্রার্থীতা ঘোষণা করেছে আরও আগেই। এটি একটি সক্রিয় পদক্ষেপ, যেখানে দল বিশ্বাসযোগ্যভাবে সামনে এগোচ্ছে। আবার সম্প্রতি আমরা রক্ষ করলাম বিএনপি থেকে যারা প্রার্থীতার গ্রিন সিগনাল পায়নি তারা বিদ্রোহ করে বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। আশা করছি এ সংকট তারা কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু মোটাদাগে যে বিষয়টি না বললেই নয় যে শুধু প্রার্থী ঘোষণা করলেই সব কিছু শেষ হয় নাÑপ্রত্যক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ, অংশগ্রহণ মনোবল, নিরাপত্তা ও তথ্যপ্রচারণার স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ এসব একসাথে কাজ করতে হবে। এছাড়াও বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নির্বাচনের সংবিধান-বিধি ও প্রতিষ্ঠানগত প্রেক্ষাপটের দিক থেকেও বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন- জবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ ড়ভ ঃযব চবড়ঢ়ষব ঙৎফবৎ, ১৯৭২ (জচঙ) সংশোধনের কারণে বড় দলের প্রতীকে অংম নেওয়ার বিষয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, গণভোট-পরিকল্পনা ও সংশোধিত সংবিধান প্রস্তাব এসব প্রশ্ন ঝুলে আছে। আর এগুলো ভোটের পরিবেশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে বলে মনে হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত: সাধারণ মানুষ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা মনে করছে নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুটি দিক সামনে রয়েছে। একদিকে রয়েছে ‘নির্বাচন ভালো হবে’-এমন আশাবাদ। অন্যদিকে রয়েছে ‘যদি অংশগ্রহণ না হয় বা প্রতিযোগিতা না হয়’-এর ভয় বা শঙ্কাও রয়েছে। অংশগ্রহণ মানে শুধু ভোট দেওয়াই নয়; অংশগ্রহণ মানে ভোটের পর ফলাফলকে গণভিত্তিক গ্রহণ, সিদ্ধান্তকে স্বীকার এবং অংশগ্রহণকারীর মনোবলকে সম্মান করা।

তৃতীয়ত, রাজনৈতিক মেরুকরণের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জ লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে ইসলামিক দলগুলোর রাজনৈতিক উত্তরণ ও পথচলা নতুন মাত্রা পাচ্ছে। এই শক্তিগুলো শুধুই নির্বাচনের লড়াই নিয়ে নয়; তারা নিজেদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকেও নতুনভাবে সাজাচ্ছে, যা আগামী দিনের সংসদীয় প্রতিযোগিতায় প্রভাব ফেলতে পারে।

এছাড়াও তথ্য ও মিডিয়া-পরিবেশও এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এবং এর পূবববর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া আন্দোলন ও তার ডিজিটাল পরিণতি দেখিয়ে দিয়েছে যে সোশ্যাল মিডিয়া-ভিত্তিক আন্দোলন ও তথ্যপ্রচারণা আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রকে দ্রুত পরিবর্তন করছে। এই পরিবর্তন শুধু নির্বাচনের দিনেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি নির্বাচনপ্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করবে- ভোটার সিদ্ধান্তে, প্রচারণায়, ফলাফল-গ্রহণে। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, এই সব প্রস্তুতি, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ মিলিয়ে আসন্ন নির্বাচনের ‘বড় অর্থ কী হতে পারে’?

প্রথমত, এটি হতে পারে একটি নতুন রাজনৈতিক যাত্রার সূচনা। যদি নির্বাচন হয় অংশগ্রহণমূলক, অংশগ্রহণমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে, তাহলে এমন একটি রূপ তৈরি হতে পারে যেখানে ভোট শুধু জেতার-লড়াই নয়; ভোট হবে নির্বাচিত প্রতিনিধির প্রতি দায়বদ্ধতা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতীক। সরকারের দায়িত্ব শুধু নির্বাচনের আয়োজন করে কোনো দলকে বিজয়ী করে দেওয়া নয়, বরং আগামী দিনে মানুষের জীবনে-পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক কৃষ্টি ও গতিতে পরিবর্তন আনার প্রসঙ্গ।

দ্বিতীয়ত, বিগত সময়ের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাঠামোগত সমস্যা ছিল। আজ সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ যেন মিলিত হয়ে একটা নতুন মানদণ্ড গড়তে পারে।

তৃতীয়ত, যদি দায়িত্বশীলভাবে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তাহলে এটি হবে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পরিচয়ের পুনর্গঠন। নির্বাচনের ফলাফল শুধু দেশীয় প্রতিফলন নয়; এটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিফলিত হবে নির্বাচন অবাধ, অংশগ্রহণ ও সার্বভৌমতার দৃষ্টিকোণ থেকে। আজ সময় এসেছে দেশকে দেখাতে যে, বাংলাদেশের ভোটব্যবস্থা শুধু ত্রুটিপূর্ণ নয় বরং আশাবাদীও হতে পারে।

তবে বিপরীতভাবে, যদি ভোট হয় উদ্বেগ-পরিপূর্ণ পরিবেশে; যদি অংশগ্রহণ কম হয়; যদি বড় অংশগ্রুপ (যেমন কোনো বৃহৎ বা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল) নির্বাচনে না থাকতে পারে বা নির্বাচনের আগে সিদ্ধান্তহীনতা হয়, তাহলে এই নির্বাচন হয়ে উঠতে পারে বিভাজনের উৎস, বিশ্বাসের সংকট এবং গণতান্ত্রিক ধারণার ক্ষয়ের কারণ। যেমন- ‘একতরফা ভোট’, ‘আংশিক প্রতিযোগিতা’- এসব ঘটনা জাতীয় ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রতিফলন ছুঁড়ে দিতে পারে।

নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এখন আর অপেক্ষা করার সুযোগ নেই; সময় এসেছে তাদের দায়িত্ব সচলভাবে নেওয়ার। বিচারিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক প্রস্তুতি যেন দ্রুত গতিতে এগিয়ে নেওয়া হয়। নাগরিক সমাজের পক্ষে এখন দায়িত্বের সময় এসেছে। ভোটাররা শুধু শেয়ার-লাইকে থাকলে চলবে না। নির্বাচনের সত্যিকারের শক্তি শুধু ভোট হয়েছে কিনা, কারা জয় পেয়েছে সেগুলোই নয়- এর সাথে আরও অনেক বিষয় জড়িত রয়েছে।

পরিশেষে বলতে পারি, এ নির্বাচন আমাদের সময়-সন্ধিক্ষণের একটা চিহ্ন হতে পারে। আমরা যদি আজ দায়িত্বশীলভাবে এগিয়ে যাই, যথাযথভাবে প্রস্তুত হই, তাহলে আসন্ন নির্বাচন শুধু একটি ভোটের আয়োজন হবে না, বরং সেটি হবে একটি ‘মুহূর্ত’, একটি ‘ধাপ’ এবং একটি ‘সম্ভাবনা’- যা আমাদের রাজনীতিতে বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধার পরিবশে তৈরি করতে পারে। রাজনীতির সম্ভাবনা শুধু নির্বাচনে জয়ের নয়; সম্ভাবনা ভবিষ্যতের বাংলাদেশের রূপায়ণ। এই বাস্তবতার নাম গণতন্ত্রের টেকসই টিকে থাকা। কাজেই বলা যায় যদি সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে না গিয়ে দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে চিন্তা করতে পারে, তাহলে হয়তো আগামী নির্বাচনই হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পুনর্জন্মের সূচনা।

লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


নির্বাচনের  আয়োজনটি টেকসই হতে হবে

মিজানুর রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

উৎসবমুখর নির্বাচন মানে এমন একটি নির্বাচন যেখানে ভোটার কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত হয় না। ভোট নিয়ে সবাই ভোট কেন্দ্রে নির্ভয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। প্রার্থীরা সমান সুযোগ পায় প্রচরণায়। প্রশাসন থাকে নিরপেক্ষ। আর গণমাধ্যম স্বাধীন ভাবে রিপোর্ট করতে পারে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয় সেখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি থাকলেও রাজনৈতিক পরিবেশের অস্থিরতা উৎসবের আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছিল। তাইত প্রকৃত গণতন্ত্র বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। অথচ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১ তে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়ত থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে ( এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগনের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।)’
তাই প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদের জন্য এবারের নির্বাচন হতে পারে নতুন পরীক্ষা---- ‘কীভাবে সেনাবাহিনী নিজেদের নিরপেক্ষতা ও উচ্চ মনোবল বজায় রেখে জাতির আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।’

আগামী ফেব্রুয়ারি/২৬ এ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সরকারের সক্ষমতা যাই হউক না কেন জনগণ নির্বাচনের ট্রেনে যাত্রা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে দেশের বড় বৃহত্তর দল বিএনপি ২৩৭ জনের প্রার্থীতা ঘোষণা করেছে। কিছু ক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থীরা বিক্ষোভ প্রকাশ করেছে। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে এক সময় সব ঠিক হয়ে যাবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। জামায়াত প্রায় এক বছর আগে প্রার্থীতা ঘোষণা করেছে। এনসিপি ও ঘোষণা করতে যাচ্ছে। সারাদেশে যখনই প্রচার প্রচারণা শুরু করেছে চট্টগ্রাম ৮ আসনে ঘোষিত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ নির্বাচনী জনসংযোগ করার সময় প্রার্থীসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তার মধ্যে একজন হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যুবরণ করে। একটি মহল দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে তা করছে। অগ্নিসন্ত্রাস ও শুরু হয়ে গেছে। বিষয়টি নির্বাচন ভণ্ডুল করার ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচিত। ভবিষ্যতে আরও এ ধরনের সমস্যা হতে পারে।

এরমধ্যে মাঠে আন্দোলনরত জামায়াত এর বক্তব্য হলো…গণভোট নভেম্বরে করতে হবে। গণভোটসহ ৫টি দাবি নিয়ে মাঠে আন্দোলনরত আছে। অবিলম্বে ৫ দফা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য শরিক আরও ৫টি দল জোট বেঁধে দাবি জানিয়ে আসছে। জনগণের চাহিদা এখন নির্বাচন। বিগত ১৫ বছর যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারিনি তা অংশগ্রহণ করতে উদগ্রীব হয়ে আছে। জনগণের মনোবল বুঝে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করা উচিত। পারম্পরিক দ্বন্দ্ব অথবা ঐক্যের ঘাটতিতে পতিত সরকার আবার যে পুন:র্বাসিত হবে না এর নিশ্চিয়তা কি?
জামায়াত তার আগে বলে আসছিল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে এরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এ দাবি জনমত সৃষ্টি করতে পারিনি বলে ঐ দাবিটা এখন আর উচ্চারিত হচ্ছে না। জামায়াত নভেম্বরে গনভোটের দাবি জানিয়ে বিএনপির সাথে আলোচনায় বসতে চাচ্ছে। বিএনপি আলোচনায় এখনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। এনসিপি বলছে জুলাই সনদকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় নির্বাচনে যাওয়াটা ভালো।

কিন্তু এখন কি সেই সময় আছে। এখন গণভোট করতে গেলে জুলাই সনদে যে সংবিধান

সংশোধনের ৪৮টি বিষয়ের গণভোট করতে চাচ্ছে তা জনগণকে জানাতে হবে। এখন তা প্রচরণা চালিয়ে গণভোট করাটা কি আদৌ সম্ভব?

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থীতা ঘোষণা করেছে। সম্ভাব্য প্রার্থী মঠে নেমে গেছে। ভোটারদের মাঝে একধরনের উৎসাহ উদ্দীপন সৃষ্টি হয়েছে। প্রচারণা নিয়ে উম্মাদনা শুরু হয়েছে।ভোটারদের অন্যকিছু এখন ভাববার সময় নেই। তাছাড়া আাগামী মাসে তফসিল ঘোষণা করা হলে মাঠ আরও সরগম হবে।গ্রামের হাট বাজার ও চা দোকানগুলোতে তুমুল আড্ডা চলছে আড্ডাবাজদের।উৎসবমূখর পরিবেশে নির্বাচন করতে এখন থেকেই নের্তৃবৃন্দের মাঝে সহনশীল মনোভাব থাকতে হবে। প্রচরণার সময় একে অপরের প্রতি কাদা ছুড়াছুড়ি বন্ধ করতে হবে। প্রার্থী নির্বাচন হওয়ার পর থেকে পোস্টার লাগানোর হিরিক পড়ে যায়। রাতের অন্ধকারে একে অপরের পোস্টার ছিড়ে পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না। এতে উভয় পক্ষের মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি হবে।আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সবাই চিন্তিত। পুলিশ এখনো শক্তি ও সাহস অর্জন করতে পারিনি। মাঠে তাদের সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনী আছে। নিজেদের স্বক্ষমতা অর্জন করার উপযুক্ত সময় ছিল। পুলিশ বাহিনী সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। যেহেতু সেনাবাহিনী নির্বাচনে সহায়তাকারী হিসেবে থাকবে সে হিসেবে কিছুটা ভরসা আমরা পাচ্ছি। সেনাকর্মকর্তারা দৃঢ়চিত্তে যে আশাবাদ ব্যাক্ত করেছে তাদের প্রতি আস্থা রাখা যেতে পারে। নিরাশ হচ্ছি না আমরা আশ্বস্ত হতে চাই তাই যেমনটি বলা হলো—

সেনাসদরে এক ব্রিফিয়ে সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনস অধিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান মোহাম্মদ মনজুর হোসেন বলেন, ‘১৫ মাস ধরে সেনাবাহিনী বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় নিয়োজিত রয়েছে। এর পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া অস্ত্র-গোলাবারদ উদ্ধারে এবং চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করছে। হারিয়ে যাওয়া অস্ত্রের ৮১ শতাংশ এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা গেছে। গোলাবারুদ (হারিয়ে যসওয়া) উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ৭৩ শতাংশ। এ ছাড়া ১৯ হাজারের বেশি অপরাধী গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে মতবিনিময় ও করছে। তিনি আরও বলেন একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আইনশৃঙ্খলা যাতে স্বাভাবিক থাকে সে লক্ষ্যে সেনাবাহিনী কাজ করতে বদ্ধপরিকর। নির্বাচনের সময় ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ সেনাসদস্য মাঠে মোতায়েন থাকবে। এটি এ এযাবতকালের সর্বোচ্চ। সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা রয়েছে জেলা উপজেলা এমনকি আসনভিত্তিক ক্যাম্প স্থাপন করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করার জন্য যা যা করার প্রয়োজন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তা করতে প্রস্তুত।
বেশকিছু দেশই সশস্ত্রবাহিনী নির্বাচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়-ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বা শ্রীলংকা এখানকার সেনারা নির্বাচনী নিরাপত্তায় অংশ নেয়। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দূরে থাকে। এই ভারসাম্য তাদের পেশাদারিত্বের মুল চাবিকাঠি। আমাদের সেনাবাহিনী যদি পেশাদার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে তবে তারা শুধু নিরাপত্তা নয় গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে জনগণের আস্থা অর্জন করবে।
সেনাবাহিনীর মনোবল ধরে রাখতে হলে প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে সেনাবাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে কোন রাজনৈতিক চাপ ছাড়াই।নির্বাচন কমিশনকে হতে হবে দৃঢ় ও স্বচ্ছ যাতে বাহিনীর ওপর অপ্রয়োজনীয় অভিযোগ না আসে।
অন্যদিকে গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো সেনাবাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশন করা। অযথা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে এমন শিরোনাম বা বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট না করা যা নির্বাচনকালীন পরিবেশকে অস্থির করে তুলতে পারে। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা যেমন জরুরি দায়িত্বশীল নীতি ও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

একজন সৈনিকের কাজ অনেক সময় নির্জন চাপমুক্ত ও ঝুকিপূর্ণ। এই সৈনিকরা গত ৫৪ বছরের অভিজ্ঞতায় বন্যার ত্রাণ থেকে অবকাঠামো উন্নয়ন পর্য়ন্ত নানান উদ্যোগের দায়িত্ব নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীগুলো সে-ই ধারাবাহিকতায় ক্রমাগত …জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে। তারা যে জনবিচ্ছিন্ন সেনাছাউনিতে আটকে থাকতে চায়নি তার ইঙ্গিত দিয়েছে বহুবার। নির্বাচনের সময় দিনরাত কাজ করতে হয় প্রায়ই বিরুপ পরিস্থিতিতে তাই বাহিনীর আভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ ও মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি ইউনিটে নেতৃত্বের ভুমিকা এখানে বড়। একজন অফিসার যদি তার দলের প্রতি আস্থা ও সাহস জোগাতে পারেন তবে তা মনোবলে প্রতিফলিত হয়। নির্বাচনকালীন সেনাসদস্যদের মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা বজায় রাখা দায়িত্বের প্রতি সম্মানবোধ জাগানো এসব বিষয়ই তাদের মনোবলকে টেকসই করে তোলে।
উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন করার লক্ষ্যে এখন থেকে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, যেমন সারাদেশে যৌথবাহিনীর মাধ্যমে চিরনি অভিযানের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে নিরপরাধ ব্যাক্তি যেন গ্রেপ্তার না হয়। প্রতিটি জনসভায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে হবে। প্রত্যেকটি জনসভায় নিজ নিজ দলের স্বেচ্ছাসেবক দল থাকতে হবে। নির্বাচনী প্রচারণায় কারও ব্যাক্তিগত চরিত্র হনন করা যাবে না। জনগণের দুর্ভোগ হয় অমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। কালো টাকার ছড়াছড়ি বন্ধ করতে হবে। ৪০০/৫০০ হোন্ডা নিয়ে মিছিল করাা-ওগুলো এখন জনগণ ভালোভাবে নিচ্ছে না। এতে পেশিশক্তির আবির্ভাব হয়। ২০ হোন্ডা ২০ গুন্ডা নির্বাচন ফিনিস এ মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। জনগণের ভাষা বুঝার জন্য তাদের দ্বোরগোরায় যেতে হবে। মানুষের ভালোবাসা নিতে হবে। হুমকি দুমকির রাজনীতি শেষ। প্রযুক্তির বদৌলতে ভোটাররা খুব সচেতন। এরা যোগ্য প্রার্থী দেখেই ভোট দেবে।
ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে তাদের ভোট যাতে ছিনিয়ে নিতে না পারে সে পাহারাদারের ভূমিকা যদি ভোটাররা পালন করতে পারে তখনই তারা বলবে আমার ভোট আমি দেব যাকে খুশি তাকে দেব। তখনই দেখা যাবে ভোট আয়োজনটি উৎসবমুখর হতে বাধ্য। মনে রাখতে হবে নির্বাচন কেবল প্রার্থী বা বাহিনীর নয় জনগণের ও দায়িত্ব। ভোটাররা যদি সচেতন না হন যদি নিজের ভোটাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হন তাহলে কোনো বাহিনীই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে পারবে

না। সেনাবাহিনীকে তখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
তাই নাগরিকদের বোঝা দরকার সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে কোনো ভয় নয় বরং নিরাপত্তার নিশ্চিয়তা তারা মাঠে নামে জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার্থে কার ও পক্ষ নিতে নয়। সেই বোঝাপড়াটা যত বেশি শক্ত হবে নির্বাচনের পরিবেশ তত বেশি শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর হবে।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এই নির্বাচন শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিবর্তনের নয়।বরং রাষ্ট্রের প্রতি জনগনের আস্থা পুনর্গঠনের সুযোগ। আর এই আস্থা রক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হলো আমাদের সশস্ত্র বাহিনী।
তাদের মনোবল যত দৃঢ় হবে ততই ভোটারদের আস্থা বাড়বে। সেনাবাহিনী যদি নিরপেক্ষতা শৃঙ্খলা ও উচ্চ পেশাদরিত্ব বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করে তবে দেশ পাবে একটি শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক ও সত্যিকারের উৎসবমুখর নির্বাচন।

আজ প্রয়োজন শুধু একটাই-

সবপক্ষের আন্তরিকতা ও সহযোগিতা। সেনাবাহিনী যেন তাদের ঐতিহ্য মর্যাদা ও জনগনের ভালবাসাকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নামে। তাহলে জনগণ বলতে পারবে…এই নির্বাচন আমাদের, ভোট আমার রক্ষিত সম্পদ, শস্য শ্যামল বাংলাদেশটা আমাদের, আর দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও আমাদের গর্বের।


লেখক: মিজানুর রহমান, কলামিস্ট ও সাবেক ব্যাংকার।


হাসিনার বিচার ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পরীক্ষা

তানিম জসিম
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও প্রাক্তন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ১৩ নভেম্বর এ মামলার রায়ের দিন নির্ধারণ করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। উল্লেখ্য, গত ২৩ অক্টোবর শেখ হাসিনার এ মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়। যুক্তিতর্ক শেষ হলে রায়ের দিন ধার্যের জন্য আগামী ১৩ নভেম্বর ঠিক করেন ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন– বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এই মুহূর্তটি কেবল একটি আইনি পর্ব নয়— এটি ক্ষমতা, জবাবদিহি ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আত্মার সঙ্গে এক গভীর হিসাব-নিকাশ। এ বিচার শুধু আদালতের ভেতরের লড়াই নয়; এটি পরীক্ষা করছে— একটি দেশ কি তার সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাদেরও ন্যায়বিচারের আওতায় আনতে পারে, নাকি আবারও রাজনীতির দোলাচলে পড়ে যাবে। আর এর মধ্য দিয়েই প্রমাণ হবে, ন্যায়বিচার কি গণতন্ত্রকে দৃঢ় করতে পারে, নাকি আরও ভেঙে দেয়।

অর্ধশতাব্দীর ক্ষমতা ও জবাবদিহি

পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি ব্যক্তিনির্ভর, দলনির্ভর— নীতিনির্ভর নয়। শেখ হাসিনার যুগ সেই দ্বৈত বাস্তবতার প্রতীক— একদিকে লোক দেখানো উন্নয়ন, অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী শাসন। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণবিক্ষোভ ও রক্তাক্ত দমন-পীড়নের পর তার পতন এমন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছিল, যা কেউ কল্পনাও করেনি। যে নেতা একসময় ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন, আজ তিনিই মানবতাবিরোধী অপরাধের আসামির কাঠগড়ায়। অভিযোগ অনুযায়ী, হাসিনা ও তার সহযোগীরা বিক্ষোভ দমনকালে নির্বিচারে শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেন বা তা প্রশ্রয় দেন, যাতে শত শত মানুষ নিহত হয়। অভিযোগ গুরুতর, তবে আরও গুরুতর হলো এর রাজনৈতিক তাৎপর্য— দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কি দলীয় আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবে?

যুক্তিতর্ক শেষে এখন মামলাটি রায়ের অপেক্ষায়। সেই দিনক্ষণ ঠিক হবে আগামী ১৩ নভেম্বর। এর সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে চূড়ান্ত ফলাফল। এ মামলায় হাসিনা-কামালের চরম দণ্ড বা সর্বোচ্চ সাজা চাইলেও, মামুনের শাস্তি নিয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছে প্রসিকিউশন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনভাবে কাজ করছে, কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নেই। তবুও হাসিনার সমর্থকরা তাকে ‘রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার’ হিসেবে তুলে ধরছে। পশ্চিমা তিনটি ও ভারতীয় চারটি পত্রিকাতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাসিনা বলেন, জুলাইয়ের রক্তপাতের জন্য তিনি দায়ী নন, যদিও স্বীকার করেন যে ‘কিছু ভুল’ হয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে। এমন বক্তব্য অস্পষ্ট ও আত্মরক্ষামূলক— তার উত্তরাধিকারকে আরও জটিল করে তুলছে।

সূত্র মতে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে দেশের ৪১ জেলার ৪৩৮ স্থানে হত্যাকাণ্ড ঘটে। ৫০-এরও বেশি জেলায় ব্যবহৃত হয় মারণাস্ত্র। গুলি ছোড়া হয়েছিল ৩ লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড। শুধু ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছিল ঢাকায়। মানুষের প্রাণ কাড়তে ব্যবহৃত হয়েছিল এলএমজি, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল, শটগান, রিভলভারসহ অন্যান্য অস্ত্র। এক দশকের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, গুম-খুন ও একদলীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পর, বাংলাদেশের জনগণ এখনো সেই সূক্ষ্ম সীমারেখা খুঁজছে— যেখানে আইন ও রাজনীতি একে অপরের হাত থেকে মুক্ত। এই বিচার সে সীমারেখা নতুন করে টানার এক বিরল সুযোগ।

ন্যায়বিচার নাকি রাজনীতি- সূক্ষ্ম সীমারেখা

১৩ নভেম্বর ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সতর্ক করছে, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ বিভিন্ন শহরে অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। সীমান্তের বাইরে অবস্থানরত দলীয় নেতারা গোপনে সমন্বয় করছে— এমন প্রমাণও মিলেছে। ভারতের কিছু সংবাদমাধ্যমে (যেমন আনন্দবাজার পত্রিকা) প্রকাশিত শিরোনাম ‘আওয়ামী লীগ রাস্তায় নামবে’— কেবল সংবাদ নয়, বরং একটি প্রচারণা-অভিযান। এর লক্ষ্য: বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল দেখানো, ট্রাইব্যুনালের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করা ও আন্তর্জাতিকভাবে হাসিনার প্রতি সহানুভূতি তৈরি করা। ভারতীয় গণমাধ্যমের এ ধরনের মনোভাব নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই তারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে ‘বন্ধু সরকার বনাম অস্থিরতা’ এই ছকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। তবে এখন সাধারণ মানুষ এসব বয়ানে ক্লান্ত— তারা আর আঞ্চলিক কূটনৈতিক খেলায় পুতুল হতে চায় না।

রাজনীতির বাইরে রয়েছে এক নির্মম মানবিক সত্য। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যানুযায়ী, ৩৬ দিনের গণঅভ্যুত্থানে ১,৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়। ছাত্র সমাবেশে গুলি চালানো, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কাছে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিশোধ নয়, বরং পরিসমাপ্তি। প্রশ্ন কেবল হাসিনার আদেশ নিয়ে নয়— বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের সেই অংশ নিয়ে, যা তার অধীনে নিষ্ঠুরতার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। যদি এই বিচার স্বচ্ছ ও প্রমাণনির্ভর হয়, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক নতুন দৃষ্টান্ত হতে পারে। কিন্তু যদি এটি রাজনৈতিক নাটকে পরিণত হয়, তবে তা জনগণের ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

জনমনের চাওয়া: প্রতিশোধ নয়, জবাবদিহি

জনগণের মধ্যে এখন একটাই স্পষ্ট চাওয়া— জবাবদিহি হোক; কিন্তু প্রতিশোধের মাধ্যমে নয়। অনেকে হাসিনার শাসনামলের ভয়াবহতা মনে রেখেছে, কিন্তু তারা একই সঙ্গে আরেকটি দমননীতি চায় না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এ সূক্ষ্ম ভারসাম্য সম্পর্কে সচেতন। ১৩ নভেম্বরকে উচ্চ-ঝুঁকির দিন ঘোষণা করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি যৌথভাবে টহল দেবে ঢাকা, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর ও শরীয়তপুরে। শান্তি রক্ষা জরুরি- তবে অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ আরও বিপজ্জনক হতে পারে।

এই বিচারের সময় প্রোপাগান্ডা আরও তীব্র হবে। হাসিনার পক্ষ নিজেদের গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করবে— যদিও তার প্রশাসনই সেই গণতন্ত্রকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম, কূটনীতি ও নাগরিক সমাজকে এখানে পাল্টা প্রচারণা নয়, বরং স্বচ্ছতা ও প্রমাণ দিয়ে উত্তর দিতে হবে।

  • গুম, নির্যাতন ও পুলিশি বর্বরতার তথ্য উন্মুক্ত করতে হবে।
  • একতরফা নির্বাচনগুলোর (২০১৪, ২০১৮, ২০২৪) রেকর্ড তুলে ধরতে হবে।
  • সাংবাদিক ও নাগরিক অধিকারকর্মীদের সাক্ষ্য প্রকাশ করতে হবে।

এটি কোনো সরকারের বৈধতা রক্ষার বিষয় নয়— এটি বাংলাদেশের নৈতিক বয়ান পুনরুদ্ধারের লড়াই। ১৩ নভেম্বরের পর যা ঘটবে, তা কেবল ট্রাইব্যুনালের নয়, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের নির্ধারক হবে। যদি বিচারপ্রক্রিয়া ন্যায়সঙ্গত, স্বচ্ছ ও মর্যাদাপূর্ণ হয়, তবে হারানো আস্থা ফিরে আসতে পারে। আর যদি তা প্রতিহিংসার আকার নেয়, তবে নতুন করে অবিশ্বাস জন্ম নেবে। বিশ্ব তাকিয়ে আছে — এক নারীর দোষ বা নির্দোষ নির্ধারণের জন্য নয়, বরং দেখার জন্য যে বাংলাদেশ কি তার ইতিহাসের এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

এই বিচার শুধু একটি মামলা নয়; এটি বাংলাদেশের সামনে ধরা এক আয়না। প্রশ্ন হচ্ছে— যে জাতি একদিন ন্যায়বিচারের জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়েছিল, তারা কি আজ নিজেদের নেতার ক্ষেত্রেও সেই একই ন্যায়বিচার দিতে পারে? যদি বাংলাদেশ শান্তি বজায় রাখতে পারে, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে ও বাহ্যিক প্রভাব প্রতিহত করতে পারে, তবে ১৩ নভেম্বরের ঘোষণা প্রতিশোধের নয়, বরং পরিপক্বতার প্রতীক হয়ে থাকবে। শেষ পর্যন্ত প্রকৃত রায় দেবে না ট্রাইব্যুনাল, দেবে ইতিহাস— আর একটি জাতির বিবেক, যে আবারও ন্যায়বিচারের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াতে শেখছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


মূল্যবান সময় সময় হারিয়ে নাকাল জনগণ

রোকেয়া ইসলাম
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

আমাদের প্রিয় এই ঢাকা একসময় ছিল সতেজ সজীব সবুজ শহর, প্রাণময় শহর পথ ছিল চলার আনন্দের।

আর আজ চলার পথ যেন এক দুর্বিষহ যন্ত্রণার নাম।

সকালের কর্মময় সূর্যটায় দিনের সফল সূচনা হয়, কর্মক্ষেত্রগামী মানুষ পূর্ণ প্রাণশক্তি চোখে মুখে তাড়াহুড়ো আর দুশ্চিন্তা নিয়ে বের হয়ে সন্ধ্যায় কর্মক্লান্তজন ঘরে ফেরে একরাশ বিরক্তি আফসোস অশান্তি ধুলোকালিঝুলি মেখে।

বর্তমানে এই শহরের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজিডি হলো অসহ্য অসহনীয় যানজট। এই যানজট এমন দানব যা মূল্যবান সময় অর্থনীতি মানসিক শান্তি সবকিছু গ্রাস করছে প্রতিদিন।

ভোরবেলায় প্রচন্ড গাড়ির হর্ণ কর্মব্যস্ত মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর রাস্তা একাংশ জুড়ে অসংখ্য গাড়ির স্থবির সারি, বাকি অংশ দখল করে নিত্যদিনের বাজার বসেছে, এই হলো রাজধানীর বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার চিত্র।

যানজটে আঁটকে থাকা মানুষগুলোর মুখে এক ধরনের অভ্যস্ততা। কেউ জানালা খুলে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে ধোয়াচ্ছন্ন আকাশে, কেউ সময় দেখে আর সময় গোণে আর কত মিনিট।

অপেক্ষায় মিনিটগুলো হারিয়ে যায় ঘন্টায়।

কোনো কর্মজীবীই সঠিক সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ কর্মগুলো পেছাতে পেছাতে গুরুত্বহীন হয়ে যায়। রোগীদের অবস্থা ততোধিক গুরুতর। এম্বুলেন্সে আঁটকে রোগীর মৃত্যু হয়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে রাজধানীর রাস্তায়। কোনো কোনো গর্ভবতী নারীর সন্তান হয়েছে রাস্তায় এটাও কখনো স্বাভাবিক ঘটনা মনে হয় যানজটের শহরে।

যানজট এখন কেবল নাগরিক দুর্ভোগ নয় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও বটে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ঢাকার যানজটে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হয়। বছরে এই অপচয় কতটা তা সহজেই অনুমেয়। ভয়াবহ অবস্থা।

এছাড়াও জ্বালানি অপচয় পণ্যের ক্ষতিসহ আরো অনেক প্রকার ক্ষতির মধ্যে বাংলাদেশ।

বানিজ্যিক প্রবাহ থমকে যায় অর্থনীতির শরীরে লেগে যায় যানজটের করাল গ্রাস।

যানজটে আঁটকে থাকা কেবল শারীরিক ক্লান্তি নয় এটি এ ধরনের মানসিক নির্যাতন। গাড়ির ভেতর তাপ শব্দ ধোঁয়া আর স্থবির সময় মিলিয়ে তৈরি করে এক দমবন্ধ অবস্থা। যা মেনে ও মনে নেয়া যায় না। মানুষ ক্রমশঃ হয়ে ওঠে অস্থির অসহিষ্ণু খিটখিটে মেজাজের অনেক সময় মেজাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

সামাজিক কর্মকাণ্ডে কখনো সুকুমার বৃত্তিতে সময় ও মনোযোগ দিতে পারে না। পরিবারকে সময় দিতে না পারার জন্য পরিবারের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়, দৈনন্দিন জীবনে এবং স্বাস্থ্যেরও বিপর্যয় ঘটে এটা এখন এই মহানগরীর বিষন্নতার নিত্যচিত্র।

বিশেষ করে ভোগান্তির শিকার হয় কর্মজীবী নারী ও শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে শিশু কিশোর। দীর্ঘ সময় পথে আঁটকে থেকে তারা নিরাপত্তাহীনতা ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকে নিজেরা ও পরিবার।

শিক্ষার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে অপচয় হয়। প্রতিযোগিতামূলক সময়ে কেবলই পিছিয়ে পড়ে।

যানজট মানেই স্থবিরতা, আর স্থবিরতা জন্ম দেয় বাযু ও শব্দের দূষণের মহামারী। রাজধানীর রাস্তায় প্রতিদিন লাখ লাখ গাড়ি দাঁড়িয়ে থেকে ফেলে অগণিত টন বিষাক্ত গ্যাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এই শহরের বাতাস ভয়াবহ দূষিত।

এই দূষণ ফুসফুসের রোগ হাঁপানি হৃদরোগ এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে।

রাস্তায় স্থির গাড়িগুলোর হর্ণ ও চিৎকার মানুষের মানসিক ভারসাম্য নাড়িয়ে কাঁপিয়ে দেয়।

নদীমাতৃক শ্বাসপ্রশ্বাসভরা বাংলাদেশ আজ রাজধানীতে দম নিতে ভয় পায়।

এই যানজটের শেকড়ের পেছনে লুকিয়ে আছে পরিকল্পনার অভাব আর অব্যবস্থার ভয়াবহ ছায়া।

অপরিকল্পিত নগরায়ন শহর বেড়েছে সে তুলনায় রাস্তা বাড়েনি পরিকল্পিতভাবে। দুর্বল গণপরিবহন বাসের সংখ্যা কম বেশিরভাগই নষ্টগুলো জোড়াতালি দিয়ে রঙ ও মেরামত করা তাও অনির্ভরতযোগ্য অকার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থা অদক্ষ ট্রাফিক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা।

অসচেতন নাগরিক দায়িত্ব পালন। উল্টোপথে গাড়ি চালনা, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা। মূল সমস্যা হলো রাস্তার বেশিরভাগ অবৈধ দখল রাখা ফুটপাতে হকার বসিয়ে চাঁদাবাজি করা।

আইন প্রয়োগে শৈথিল্য অপরাধের শাস্তি না পেলে অপরাধ অভ্যাসে পরিণত হয়, এটা রাজধানীতেও পূর্ণমাত্রায় ঘটেছে।

অসহ্য এই বাস্তবতা থেকে মুক্তি পেতে হলে চাই সাহসী সিদ্ধান্ত ও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি। গণপরিবহনের আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, আধুনিক নিরাপদ ও সময়নিষ্ঠ পরিবহন চালু করতে হবে। মেট্রোরেল প্রয়োজনে শহরে চক্রাকারে রেল ব্যবস্থা বিআরটিসি সম্প্রসারণ প্রয়োজনে পাতাল রেল দ্বিতল রাস্তা যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা কঠিন হাতে বন্ধ, অতি অবশ্য ফুটপাত দখল মুক্ত করা।

হকারদের অন্য কর্মস্থানের ব্যবস্থা করে পথ পথিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

স্মার্ট ট্রাফিক ব্যবস্থা ডিজিটাল সিগনাল ক্যামেরা জরিমানা এবং সময়সূচি মনিটরিং চালু করা যেতে পারে।

প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই ট্রাফিক শিক্ষার চর্চা প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলোচনা কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে।

নদীপথকে কাজে লাগানে যেতে পারে। সাইকেল ও বাইক ও রিকশার জন্য আলাদা লেন থাকা জরুরি।

প্রতিটি বহুতল ভবনে পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা প্রতিটি মার্কেট হোটেল রেস্তোরাঁয় পার্কিং সুব্যবস্থা আবশ্যক।

পার্কিং না থাকলে হোটেল রেস্তোরাঁকে কোনভাবেই অনুমতি না দেয়া।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন জনগণের মনোভাব পরিবর্তন।

জনগণ যদি নিজে ট্রাফিক আইন যথাযথ মেনে চলে এবং এটাকে সংস্কৃতির অংশ, আমার পথের আমি মানব গ্রহণ করব এবং অন্যেও যেন সেটা ভোগ করে তার ব্যবস্থা করা দরকার।

সমস্যা গভীর তার শেকড় কাটার দায়িত্ব সচেতন জনগণের।

চলাচলের সুশৃঙ্খল রাস্তা এক সভ্য জাতির প্রতিফলন।

যানজট শুধু রাস্তার সমস্যা নয় এটি আমাদের স্থবির জীবনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ।

আজ আমরা যে ক্লান্ত রাগান্বিত দমবন্ধ প্রায় স্থবির এক নগরে বাস করছি সেটি আসলে আমাদের পরিকল্পনা আর নৈতিকতার ব্যর্থতার ফল।

তবুও জনগণ আশা করে, নাগরিক ও রাষ্ট্র সবাই মিলে সঠিক পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে আসে তাহলে এই আবদ্ধ নগরীতে রাস্তায় জনগণ যানবাহনের সুশৃঙ্খল প্রবাহ হবে। ফুটপাত দখল মুক্ত হবে পথ হবে পথিকের চলার আনন্দ।

লেখক : চেয়ারম্যান, প্রশিকা।


হাসিনার মামলার রায়: ন্যায়বিচারের পথে নাকি প্রতিহিংসার পুনরাবৃত্তি?

এ কে এম মাজহারুল ইসলাম খান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। আগামী ১৩ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই–আগস্ট ২০২৪-এর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা ঘিরে সারাদেশে সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনা ও উদ্বেগের এক অস্বাভাবিক পরিবেশ। ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রক্তাক্ত অধ্যায় হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় থাকবে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষোভ, সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ নামে পরিচিত অভূতপূর্ব জনজাগরণ দেশজুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন দমন করতে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভয়াবহ দমননীতির অস্ত্রে পরিণত করে। সে সময় পুলিশ, র‌্যাব এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে ঢাকাসহ সারাদেশে নির্বিচারে গুলি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও গুমের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হিসেবে, দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হন এবং অগণিত মানুষ স্থায়ী অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ববরণ করেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে সে সময়ের সহিংসতার ভয়াবহতা স্পষ্টভাবে উঠে আসে। তাদের ভাষায়, ‘২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এক নজিরবিহীন মাত্রায় পৌঁছেছিল।’

দেশের অভ্যন্তরেও জনমতের চাপ দ্রুত বাড়তে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC)-এর সঙ্গে সমন্বয় করে ২০২৫ সালের শুরুতে শেখ হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে।এই মামলাটি কেবল একজন ব্যক্তির বিচার নয়; এটি এক যুগের রাজনীতির প্রতীকী হিসাবও বটে। অভিযোগপত্রে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, বিরোধীদের ওপর দমননীতি, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দীর্ঘ তালিকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আদালতে উপস্থাপিত হয়েছে প্রায় ২০ হাজার পৃষ্ঠার সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ ও সরকারি রেকর্ড। তদন্তে দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অধিকার, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফোরাম, এবং ল’ অ্যান্ড জাস্টিস সোসাইটি অব বাংলাদেশের মতো সংস্থাগুলো প্রমাণ সরবরাহ করেছে যে বহু ক্ষেত্রে সরকারি বাহিনী রাজনৈতিক নির্দেশে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ও তার সমর্থকরা এই মামলাকে শুরু থেকেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফসল বলে দাবি করে আসছেন। তাদের বক্তব্য, এটি ‘একটি সাজানো বিচার,’ যার উদ্দেশ্য রাজনৈতিকভাবে শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করা। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, মামলার প্রমাণের পরিমাণ ও সাক্ষ্যের বিশদতা ইঙ্গিত দেয়—এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং প্রকৃত মানবাধিকার লঙ্ঘনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিচালিত একটি বিচার প্রক্রিয়া।বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক চাপের অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আদালতের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক আস্থা কিছুটা ফিরে এসেছে। সে কারণেই আসন্ন রায়কে অনেকে মনে করছেন ‘বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার জন্য এক ঐতিহাসিক পরীক্ষা।’ রায়ের দিন ঘনিয়ে আসতেই রাজপথে শুরু হয়েছে উত্তাপ। নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঘোষিত ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীসহ সারাদেশে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

দলটির নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুব উল আলম হানিফসহ কয়েকজন প্রবাসী আওয়ামী নেতা বিভিন্ন ভার্চুয়াল বক্তব্য দিয়েছেন। গত ৫ নভেম্বর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘১৩ নভেম্বরকে সামনে রেখে আপনারা ঐক্যবদ্ধ হোন। ঢাকায় আমরা ১৩ নভেম্বর লকডাউন দিয়েছি—সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লকডাউন। ১০ থেকে ১২ নভেম্বর দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল, আর ১৩ নভেম্বর যেন রাজধানী ঢাকা শহর আমাদের দখলে থাকে, জয় বাংলার দখলে থাকে।’ এই বক্তব্যগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উস্কানিমূলক এবং আইনি সীমালঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আদালতের রায় ঘোষণার আগে রাজধানী অবরোধের ঘোষণা কার্যত বিচারপ্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার সমান। বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ জানে—রায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারে। তাই আগেভাগেই রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলে তারা আদালত ও প্রশাসনকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করার কৌশল নিচ্ছে। রায়কে কেন্দ্র করে সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। ঢাকায় সাত হাজারেরও বেশি পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সংবেদনশীল এলাকায় নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন ও ড্রোন টহল জোরদার করা হয়েছে। ‘লকডাউন’ প্রস্তুতির নামে কিছু গোষ্ঠী রাজধানীতে সহিংসতা ছড়ানোর চেষ্টা করায় ইতোমধ্যে ৩০ জনের বেশি সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, নাশকতা এড়াতে ১০ নভেম্বর থেকে ঢাকার প্রবেশপথ, আবাসিক হোটেল, মেস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলে তল্লাশি শুরু হবে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা জোরদার এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলবে। এ ছাড়া সারাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তালিকা ধরে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। অনেককে নজরদারিতে রাখা হয়েছে; তাদের গতিবিধি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। সূত্র বলছে, বিচ্ছিন্নভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পরিচয় গোপন রেখে অবস্থান করছেন এবং সুযোগ পেলেই সংগঠিত হয়ে ঝটিকা মিছিলের চেষ্টা করছেন। তবে বড় আকারে সংগঠিত হয়ে নাশকতা ঘটানোর সুযোগ তারা পাবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগ এক গভীর সংকটে পড়েছে। শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে দলের একচ্ছত্র নেতৃত্বে ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে দলে তৈরি হয়েছে বিভাজন ও বিভ্রান্তি। একদিকে দলের পুরনো নেতৃত্ব এখনো শেখ হাসিনার প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখাচ্ছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ চায় নতুন নেতৃত্ব ও নতুন রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা। রায়ের পর রাজনৈতিক পরিবেশ যেদিকে মোড় নেবে, তা সরাসরি প্রভাব ফেলবে দলটির অভ্যন্তরীণ কাঠামোর ওপর। যদি রায়ের পর দলে নেতৃত্ব পরিবর্তন বা পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তবে তরুণ নেতৃত্বের উত্থানের সুযোগ তৈরি হতে পারে। তবে সেটি তখনই সম্ভব, যখন দলীয় রাজনীতি হুমকি, মিথ্যাচার, উস্কানি বা সহিংসতার পরিবর্তে গণআস্থা পুনরুদ্ধারের পথে অগ্রসর হবে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিবেশী ভারতের প্রভাব নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে দিল্লি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অন্যতম কৌশলগত অংশীদার ছিল। কিন্তু বর্তমানে ভারতের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য না করলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দিল্লি এবার অপেক্ষাকৃত নীরব—সম্ভবত তারা বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করছে।যদি আওয়ামী লীগের কোনো অংশ ভারতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে সহিংসতা সৃষ্টি করে, তবে তা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও বিপদের মুখে ফেলবে। আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—রাষ্ট্র ও জনগণ কোন পথে যাবে? গণতন্ত্র তখনই টিকে থাকে, যখন নাগরিকরা আইনের শাসনে বিশ্বাস রাখে এবং দলীয় আনুগত্যের ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। রায়ের তারিখ ঘোষণার দিন যদি রাজপথে সহিংসতা দেখা দেয়, তবে তার ক্ষতি হবে জনগণেরই। একজন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের দায়িত্ব বিচার প্রক্রিয়াকে সম্মান করা, আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া এবং রাজনৈতিক মতবিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে প্রকাশ করা। ইতিহাস প্রমাণ করে, বাংলাদেশের সংকটের সময়ে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েই বিজয় অর্জন করেছে। ১৯৭১ সালে যেমন মুক্তিযুদ্ধের ঐক্য জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনও ছিল সেই ঐক্যেরই প্রতিফলন। আজও প্রয়োজন সেই জাতীয় চেতনার পুনর্জাগরণ। বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রধান প্রয়োজন হলো ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য। দলীয় পরিচয়, মতভেদ বা অতীতের সংঘাত ভুলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। বিচার ও ন্যায়বিচার যেন কোনো রাজনৈতিক প্রতিশোধে পরিণত না হয়—বরং তা যেন আইনের শাসনের প্রতীক হয়ে ওঠে, সে বিষয়ে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এই রায় কেবল শেখ হাসিনার বিচার নয়; এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। আদালতের রায় যদি নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে প্রদান করা হয়, তবে এটি ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করবে—যেখানে আর কোনো ক্ষমতাশালী ব্যক্তি রাষ্ট্রকে নিজের সম্পত্তি ভেবে আচরণ করতে সাহস পাবে না।

১৩ নভেম্বরের রায় তাই কেবল একটি আইনি সিদ্ধান্ত নয়; এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার প্রতীক। এটি প্রমাণ করবে, বাংলাদেশ কি সত্যিই ন্যায়বিচারের পথে অগ্রসর হচ্ছে, নাকি আবারও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও সহিংসতার চক্রে বন্দি হতে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা; নাগরিকদের দায়িত্ব সহিংসতা ও বিভাজন থেকে দূরে থাকা; আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব গণআস্থার পথে ফিরে আসা।যদি এই তিন পক্ষ তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারে, তবে বাংলাদেশ অস্থিরতার অন্ধকার পেরিয়ে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের এক নতুন ভোরে পৌঁছাবে।

লেখক : কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।


স্বায়ত্তশাসিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি অপরিহার্য?

ড. মিহির কুমার রায়
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

সাম্প্রতিককালে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রণীত বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ তে এটিকে একটি স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে দেশের সার্বিক আর্থিক উন্নয়নের স্বার্থে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বিগত চারদশকেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত নিয়ন্ত্রণ সংন্থা হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ কি এ কথাটি সুধী মহলে বহুল আলোচিত। প্রথাগতভাবে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক খাতের মুরুব্বি, ব্যাংকের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল, সরকারের আর্থিক সম্পদের রক্ষক , পরামর্শক এবং আর্থিক সম্পদ উন্নয়নের কাজে প্রথিকৃত । কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মতে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূলত দুটি কাজ (১) বছরে দুবার মুদ্রানীতি প্রণয়ন; (২) সংস্থা হিসাবে তফসিলী ব্যাংকের কাজের পরিদর্শন, তদারকি ও পরিবেশ মূল্যায়ন। প্রথমটির মুখ্য উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা যাতে সঠিক সময়ে সঠিক মুদ্রা সঠিক হাতে পৌঁছে দেয়া যায়। এর দুটি হাতিহার আছে যেমন (১) পরিমাণগত যার মধ্যে আছে ব্যাংক রেট পলিসি, খোলা বাজার অপারেশন, সি.আর,আর ও এস.এল.আর ইত্যাদি এবং অন্যটি হলো (২) গুনগত: যেমন রেশনিং, নৈতিকভাবে প্ররোচিত করা, প্রচারণা ও মিটিং করা।

দেশের প্রচলিত মিয়মানুসারে তফসিলী ব্যাংকগুলো তাদের আমানতের একটি অংশ সি.আর.আর হিসাবে ৬.৫ শতাংশ ও এস.এল.আর হিসাবে ১৩ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। সুত্র বাজাওে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ এই দুটি হার কম বেশি করা হয় অর্থনীতির সার্বিক বিবেচনায় এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত তাদের স্ব স্ব পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে তাদের সার্বিক সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করে সব দেশের একই নীতি। ২০১৮ সালে সি আর আর শতাংশ কমানো হয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস বিএবি এর দাবির মুখে অর্থমন্ত্রনালয় কাছে কোন প্রকার বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই আরও বলা হয়েছে আগে বাস্তবায়ন তারপর বিশ্লেষণ বিষয়টি এমনও হতে পারত বিএবি সদস্যবৃন্দ মন্ত্রণালয়ের আলাপ করতে পারত এবং এই আলাপের ফলাফল কেন্দ্রীয় বাংক অর্থমন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠাতে পারত ।

কিন্তু বিষয়টি উল্টো হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে বলে বিশ্লেষন গন মনে করেন। এইভাবে যদি ক্ষমতার বলয়ে মুদ্রা নীতির সবছেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদান্ত নেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংক উপেক্ষা করে তাহলে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাখার যৌক্তিকতা কি? আর্থিক খাতের গবেষকবৃন্দ বলছেন আমানতকারীদের স্বার্থেই সিআরআর/ এসএলআর ২০-২২ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হয় কারন ব্যাংকের মোট আমানতের ৯০ শতাংশই তাদের বাকি ১০ শতাংশ মালিক পক্ষ বিএবিএর সদ্যসদের। এই ঘটানাতিতে সংখ্যালঘু ব্যাংক মালিকদের স্বার্থ রক্ষা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ আমানতকারীদের নয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে বাজারে ১০ হাজার কোটি টাকা চলে এসেছিল যা ব্যাংকগুলোর বর্তমান মূলধন সংকটে বিমোচন ব্যবহৃত হবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে ব্যাংক মূলধন সংকটের কারণ কি? বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ১. খেলাপী ঋণ যা বর্তমানে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪ শতাংশ থাকে বলা হয় মহাবিপদ সংকেত। ২. এডভান্স ডিপোসিট রেসিও এডিআর অসামঞ্জস্য পূর্ন বিধায় সেখানে ব্যাংকগুলোর তাদের আমানতের ৮০-৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ অনুমোদন বিতরণ করতে পার সেখানে কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংক নিয়ম লঙ্ঘন করে এডিআর রেশিও ৯০ শতাংশে এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ৯২ শতাংশ উন্নতী করছে এ দুটি হলো তারল্য সংকটের মুল কারন। এল ফলশ্রুতিতে ব্যাংকগুলোর আর বিনিয়োগ করতে অপারগত প্রকাশ করছে উদ্যোক্তাদেরকে। এর জন্য দায়ী ভ্রান্ত রাজনীতি সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্যদ রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য লোক নিয়োগ ঋণখেলাপিরদের পৃষ্ঠপোষক করা অব্যহত রাখা এবং ব্যাংক জালিয়াতিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া।

বিগত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অলিগার্ক তৈরি হয়েছিল। সব অলিগার্কের একটি অভিন্ন চরিত্র ছিল, তারা ব্যাংক ঋণের অপব্যবহার করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান করা অপরিহার্য। এই স্বাধীনতা দিতে হবে আর্থিক, প্রশাসনিক ও কাঠামোগত। সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে হোটেল আমারিতে ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অপরিহার্যতা’ শীর্ষক এক আলোচনায় বিশিষ্টজন এসব কথা বলেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এ আলোচনার আয়োজন করে। পিআরআইর ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ এতে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এখানে সংস্কার, ওখানে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। তবে দেশের এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা অপরিহার্য। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসন দিলে হবে না, স্বাধীন প্রতিষ্ঠান করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা দিতে হলে সব দিক থেকেই দিতে হবে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় গভর্নর, ডেপুটি গভর্নরের নিয়োগ দিতে হবে। একই সঙ্গে আর্থিক, কাঠামোগত, আইনি, লোকবল নিয়োগ সবই স্বাধীনভাবে করতে হবে। আবার তাদের জবাবদিহি থাকতে হবে। আলোচনায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন বিগত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। নিয়ম না মেনে ঋণ, সুদহারে সীমা আরোপ, ডলারের দর ধরে রাখা ও টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এ থেকে উত্তরণে স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীন করার আইন প্রস্তাব করা হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যবসায়িক পরিবেশের জন্য আংশিক নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীন থাকলে কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ধরে রাখার পর একবারে ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধির ধাক্কা নিতে হতো না। বিশ্বের কোনো দেশে সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলে কিছু নেই। এটিকে অবশ্যই বিলুপ্ত করতে হবে। পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অলিগার্ক তৈরি হয়েছিল। সব অলিগার্কই ব্যাংক ঋণের অপব্যবহার করেছে। যে কারণে এখন দেশের খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশের মতো। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আর্থিক, প্রশাসনিক, ব্যক্তি ও কাঠামোগত স্বাধীনতা দিতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।

প্রায়শই বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এই বলে যে এই ব্যাংকটির গভর্নর তার কাজের জন্য কোনো সংস্থার কাছে দায়বদ্ধ অর্থমন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় রাষ্টপতির কার্যালয় নাকি জাতীয় সংসদ সচিবলায়। এই প্রশ্নটি কোনো একটি জাতীয় সেমিনারে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করেছিলাম কিন্তু উত্তর পাইনি। অথচ ভারতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর তাদের কাজের জন্য ভারতীয় লোকসভার কাছে দায়বদ্ধ বিধায় সেই দেশটি সরকার তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ব্যাংকের উপর চাপাতে সাহস পায় না। যেটি বাংলাদেশ ক্ষেত্রে অহরহ ঘটে চলছে। এখন এ থেকে পরিক্রমের উপায় নিয়ে ভাবতে হবে এখন আমাদেও প্রতিবেশি ভারত ও নেপাল কিভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কার্য্যক্রম চলছে তার কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে বি আই বি এম কর্তৃক আময়োজিত সেমিনারে এক আঞ্চলিক সেমিনার থেকে । নেপাল কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় বাংক দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাদের এস এল আর/সিএরআর বাংলাদেশ তুলনায় অনেক বেশি এবং তাদের পরিবেক্ষণ নজরদারি খুবি জুড়াল থাকায় ঋলাপী ঋণের পরিমাণ আমাদের তুলনায় কম। দেশটির রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সে দেশের ব্যাক্তি মালিকানায়/সরকারি মালিকানায় পরিচালিত সকল ব্যাংকের মালিক ও প্রধান নির্বহীদেও প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে তাদেরকে নিয়ে সেমিনার করে থাকে যা বাংলাদেশ অনেক চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়েছে। সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের কেলেঙ্কারি সম্পকে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক রির্জাভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া গর্ভনের একটি ব্যক্তব্য বলা হয়েছে দ্বৈত শাসন থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধার কমে যায় । এই ব্যক্তব্যটি বাংলাদেশ ব্যাংকিং খাতের জন্য শতভাগ প্রযোজ্য। কারণ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায়শই অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাংকি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এর সাথে মতানৈক্য জড়িত হয় যা কোনোভাবেই কাম্য নয় বিষয়টি এমন যে সে মন্ত্রণালয় কোনো কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংককে গণনাতেই আনে না । অথচ বিষটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ আবার কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাঠালেও তা তেমন গুরুত্ব পায় না। এতে করে অনেক সিদান্ত চলে আসছে যেমন নতুন ব্যাংক খোলার লাইসেন্স বড় বড় ঋন অবলোকন মওকুফ সঞ্চিত বাড়ানো কমানো যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে বাধ্য হয়েছে যদিও সেগুলো দেশের সার্বিক আর্থিক উন্নয়নের জন্য খুবি ক্ষতিকর। এতমাবস্তায় স্বায়ত্তশাসন কিংবা সুশাসন কিংবা শৃঙ্খলা উন্নয়ন খুবি জরুরি বলে প্রতীয়মান।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক জ্যাষ্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি।


বাংলাদেশের আর্থিক খাতে নতুন সম্ভাবনা: বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরো

মোহাম্মদ আব্দুল মুবিন গাজী
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

​বাংলাদেশ তার আর্থিক ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণের পথে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পাঁচটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ক্রেডিট ব্যুরো স্থাপনের জন্য লেটার অফ ইন্টেন্ট বা আগ্রহপত্র প্রদান করা হয়েছে, যা দেশের ঋণ ব্যবস্থাপনায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে। এই যুগান্তকারী উদ্যোগটি কেবল খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি মোকাবিলায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং একটি স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ ঋণদান ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় সিদ্ধান্তটি একটি শক্তিশালী আর্থিক বাস্তুতন্ত্র নির্মাণের পথে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

তথ্য বৈষম্যের প্রাচীর ভাঙার উদ্যোগ: যেকোনো দেশের আর্থিক খাতের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো ‘তথ্য বৈষম্য’ বা ‘Information Asymmetry’। সহজ ভাষায়, ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ঋণগ্রহীতার আর্থিক অবস্থা ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য রাখে না। এই তথ্যের ঘাটতির কারণে একদিকে যেমন ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ হয়, তেমনই অন্যদিকে ঝুঁকি মূল্যায়ন কঠিন হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় ‘Credit Rationing’ বা ঋণ সংকোচন নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, যেখানে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ঋণগ্রহীতারা ঋণ পাওয়ার জন্য বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং যোগ্য গ্রাহকরাও অনেক সময় ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।

​বর্তমানে বাংলাদেশে একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো এই তথ্যভান্ডার হিসেবে কাজ করে আসছে। তবে এর তথ্য শুধুমাত্র ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান ঋণগ্রহীতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে যারা মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করেন বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত, তারা এই আনুষ্ঠানিক ক্রেডিট তথ্য কাঠামোর বাইরে থেকে যান। বিকাশের চিফ কমার্শিয়াল অফিসার আলী আহমদের মতে, তাদের প্রায় ৮ কোটি গ্রাহকের বড় একটি অংশের কোনো আনুষ্ঠানিক ক্রেডিট ইতিহাস না থাকায় তারা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আশা করা যায় বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরো এই বিশাল শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে।

ারা পেলেন ই কাজের নুমোদন: দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে ২২টি আবেদনকারীর মধ্য থেকে ১৩টিকে সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করার পর অবশেষে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে।

প্রযুক্তি তথ্যের মেলবন্ধনে নতুন যুগে ঢুকতে যাচ্ছে দেশের আর্থিক এই খাত: এই বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরোগুলোর কার্যপদ্ধতির মূলে থাকবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং-এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। তারা কেবল ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেই নয়, বরং বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে গ্রাহকের একটি ক্রেডিট প্রোফাইল তৈরি করবে। এর মধ্যে যুক্ত থাকবে গ্রাহকের ইউটিলিটি বিল, মোবাইল ফোনের ব্যবহার, এমএফএস লেনদেনের ধরন, সরবরাহকারীদের সাথে লেনদেন এবং অন্যান্য ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট।

​আর এই ডেটা বিশ্লেষণ করে প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি ক্রেডিট স্কোর বা গ্রেড তৈরি করা হবে, যাখানে তাদের ঋণযোগ্যতার একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিচ্ছবি প্রকাশ পাবে। গ্রাহকের সম্মতি সাপেক্ষে ঋণদাতারা ডিজিটালভাবে এই তথ্য যাচাই করতে পারবেন, যা প্রচলিত সরেজমিনে পরিদর্শন বা নথিপত্র যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা বহুলাংশে কমিয়ে আনবে। এর ফলে ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া হবে দ্রুত, সাশ্রয়ী এবং বর্তমানের চেয়েও নির্ভুল।

অর্থনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব: সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের মনে করেন, এটি একটি অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ যা আর্থিক বাজারকে আরও স্বচ্ছ ও দক্ষ করে তুলবে। এটি যদি সফলভাবে পরিচালনা করা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব হবে বহুমাত্রিক, যেমন:

​১. খেলাপি ঋণ হ্রাস ও সুদের হার নির্ধারণ: বর্তমানে ব্যাংক কর্মকর্তারা ম্যানুয়ালি ঋণ মূল্যায়ন করেন, যেখানে যোগসাজশ বা ভুল মূল্যায়নের সুযোগ থেকে যায়। একটি নিরপেক্ষ ও ডেটা-নির্ভর স্কোরিং ব্যবস্থা এই ঝুঁকি কমাবে। শক্তিশালী ক্রেডিট রেটিং থাকা গ্রাহকরা কম সুদে ঋণ পাবেন, আর দুর্বল রেটিংয়ের ক্ষেত্রে সুদের হার কিছুটা বেশি হতে পারে। এই ঝুঁকি-ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিটি ঋণদাতাদের জন্য যেমন লাভজনক, তেমনই ভালো ঋণগ্রহীতাদের জন্য একটি পুরস্কারস্বরূপ।

​২. আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি: এতদিন যারা ব্যাংকিং খাতের বাইরে ছিলেন, যেমন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ফ্রিল্যান্সার বা এমএফএস ব্যবহারকারী, তারাও তাদের ডিজিটাল লেনদেনের ভিত্তিতে ক্রেডিট প্রোফাইল তৈরি করতে পারবেন। এটি তাদের জন্য আনুষ্ঠানিক ঋণের দরজা খুলে দেবে এবং দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতকে অর্থনীতির মূলধারায় আনতে সহায়তা করবে এবং সামগ্রিক অর্থব্যবস্থায় অর্থের যোগান ও ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে।

​৩. দায়িত্বশীল আর্থিক সংস্কৃতি নির্মাণ: যখন মানুষ জানবে যে তাদের প্রতিটি আর্থিক লেনদেন ও বিল পরিশোধের অভ্যাস তাদের ক্রেডিট স্কোরে প্রভাব ফেলছে, তখন তারা সময়মতো ঋণ ও বিল পরিশোধে আরও বেশি উৎসাহিত হবে। এটি একটি দায়িত্বশীল ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের সংস্কৃতি তৈরি করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে পুরো অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর।

​৪. প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিতকরণ: সব ঋণদাতার কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্য সহজলভ্য হলে বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। ছোট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমান তালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে। এর ফলে গ্রাহকদের জন্য আরও উন্নত ও উদ্ভাবনী ঋণ পণ্য বাজারে আসবে এবং সেবার মানও উন্নত হবে।

​৫. ডিজিটাল ঋণদান ও ব্যবসার প্রসার: নির্ভরযোগ্য ক্রেডিট ইতিহাস কেবল ব্যাংকঋণের জন্যই নয়, বরং কিস্তিতে পণ্য কেনা, বাড়ি ভাড়া নেওয়া বা অন্য যেকোনো বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে। একজন বিক্রেতা সহজেই একজন গ্রাহকের অর্থপ্রদানের সক্ষমতা মূল্যায়ন করে তাকে কিস্তিতে মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো পণ্য বিক্রির সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এটি ডিজিটাল ঋণদান এবং ই-কমার্সকে বহুলাংশে প্রসারিত করবে।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের করণীয়: ক্রেডিট ব্যুরো কোনো নতুন ধারণা নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো দেশগুলোতে এর সফল প্রয়োগ দেখা যায়। ভারতের সিবিআইএল সে দেশের ঋণপ্রাপ্তি সহজতর করা এবং ঋণঝুঁকি মূল্যায়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশ এই দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে একটি শক্তিশালী ও টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। তবে কেবল বৈশ্বিক মডেল অনুকরণ না করে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এর প্রয়োগ ঘটাতে হবে। বাংলাদেশের জন্য প্রধান শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

​১. দৃঢ় আইনি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো: গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এই উদ্যোগের সফলতার অন্যতম প্রধান শর্ত। ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। নির্দেশিকা অনুযায়ী, গ্রাহকের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্য কঠোরভাবে এর আওতার বাইরে থাকবে এবং শুধুমাত্র লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য ও ঋণ পরিশোধের অভ্যাসই শেয়ার করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এই সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

​২. তথ্যের যথার্থতা ও পূর্ণতা: তথ্যের নির্ভুলতা অপরিহার্য। তাই একাধিক উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ, কঠোর যাচাইকরণ প্রক্রিয়া এবং গ্রাহকদের জন্য ভুল তথ্য সংশোধনের সহজ সুযোগ রাখা অত্যন্ত জরুরি।

​৩. ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা: ক্রেডিট স্কোরিং অ্যালগরিদম এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তা লিঙ্গ, বর্ণ বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য না করে। প্রত্যেক গ্রাহকের নিজের ক্রেডিট রিপোর্ট দেখার এবং কোনো তথ্যের বিষয়ে আপত্তি জানানোর অধিকার থাকতে হবে।

৪. প্রযুক্তি ও বিকল্প তথ্যের ব্যবহার: বিদ্যুৎ, গ্যাস, ওয়াসা বিলের মতো নিয়মিত খরচের পাশাপাশি মোবাইল লেনদেন, বাড়িভাড়া ও সামাজিক মাধ্যমে লেনদেনের তথ্যও মূল্যায়নে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

৫. ভোক্তা শিক্ষা ও আর্থিক সাক্ষরতা: সাধারণ মানুষকে ক্রেডিট স্কোরের গুরুত্ব, তাদের অধিকার এবং ভালো ক্রেডিট ইতিহাস বজায় রাখার উপায় সম্পর্কে ব্যাপকভাবে শিক্ষিত করতে হবে। সরকারের এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এ বিষয়ে দেশব্যাপী প্রচারণা চালানো।

৬. সহযোগিতা, সমন্বয় ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ: ঋণদাতা, নিয়ন্ত্রক, ব্যুরো ও ভোক্তা সংগঠনের মধ্যে নিয়মিত সংলাপ সমস্যার চিহ্নিতকরণ ও কাজের মান উন্নয়নে সহযোগী হবে। তাছাড়া, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যুরোর কাজের মান উন্নয়নে দায়িত্বশীল হতে হবে ।

শেষ কথা: একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরো চালুর সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের আর্থিক খাতের জন্য একটি গেম-চেঞ্জার হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। এটি তথ্যের প্রাচীর ভেঙে দিয়ে ঋণদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি করবে। যদি আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ, শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো নিশ্চিতকরণ এবং তথ্যের সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এই ব্যবস্থাটি বাস্তবায়ন করা যায়, তবে এটি নিঃসন্দেহে খেলাপি ঋণ কমাবে, ঋণের বাজার প্রসারিত করবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে নতুন গতি দেবে। এই উদ্যোগের সফল প্রয়োগ দেশের অর্থনীতিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করবে। এটি অর্থপ্রবাহকে সুসংহত রেখে আর্থিক খাতকে আরও গতিশীল করবে। ফলে প্রতিটি নাগরিক ও ব্যবসায়ের জন্য তৈরি হবে অপার সম্ভাবনার দুয়ার।

লেখক: ঝুঁকি বিশ্লেষক, ব্যাংকার ও কলামিস্ট


পলাতক ফ্যাসিস্টদের ‘লকডাউন’: ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে রুখতে হবে

রেজাউল করিম খোকন
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরতে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ কখনোই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না। তারা অবৈধ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করে গদিতে থাকার জন্য যা ইচ্ছা তাই করেছে। তাই তাদের বিদায়টাও মোটেই সম্মানজনক হয়নি। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় এমন লজ্জাজনক বিদায় অতীতে কারোরই হয়নি। আর যারা এভাবে একবার বিদায় নিয়েছে তারা আর কখনোই দৃশ্যপটে ফিরে আসতে পারেনি বরং তাদেরকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশের পতিত স্বৈরাচার আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য নানাবিধ ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিচ্ছে। নানাভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা সেই নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই, কিন্তু সেখানেও অন্তরায়। জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ঐক্যের চেতনা ছিল, কোনো ষড়যন্ত্র কোনো লোভ নতুন করে এই অগ্রযাত্রাকে মাঝে মাঝে যেন বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এবং ঐক্যবদ্ধভাবে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ-বিভাজনের যে সব আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে স্বৈরাচারের দুর্নীতি ও গুম-খুনের বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনসহ গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট থেকে পুরোনো গতানুগতিক বন্দোবস্তে ফিরে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র, ভারতীয় হুমকি ও অপপ্রচার, নাশকতাসহ দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার ধারাবাহিক তৎপরতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ার বাস্তবতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও কর্মীরা ছাত্র-জনতাকে আবারো রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস, সংস্কার প্রশ্নে মতানৈক্য এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানাবিধ বিচ্যুতি ও ব্যর্থতার কারণে জুলাই অভ্যুত্থান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে। এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে, যেখানে রাষ্ট্রই প্রত্যেক নাগিরকের আয়-রোজগারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিরাপদ আশ্রয়স্থল হবে। রাষ্ট্রই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ সব মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করবে। সেই স্বপ্নের সমাজ প্রতিষ্ঠায় সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সব বিভেদ দ্বন্দ্ব সংঘাত ভুলে একসাথে পাশাপাশি থেকে কাজ করে যেতে হবে।জাতীয় নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেদিকেও মনোযোগ দিতে হবে সবার। জাতীয় নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সময়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে, জুলাই জাতীয় সনদ। যারা জুলাই চেতনার পরিপন্থি কাজের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে বাধা সৃষ্টি করবে তাদের জাতি ক্ষমা করবে না। জনগণের ভোটের মাধ্যমে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ ও জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম প্রধান কর্তব্য বলে মনে করি আমরা। অবশ্যই কারও দলীয় স্বার্থ বাস্তবায়ন করা এই সরকারের কাজ নয়। একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যথেষ্ট আন্তরিক এবং সিরিয়াস। তাদের বিগত কয়েক মাসের কর্ম তৎপরতা এটা প্রমাণ করে।

দেশ অস্থিতিশীল হলে পরাজিত, পলাতক ফ্যাসিবাদী অপশক্তির পুনর্বাসনের পথ সুগম হতে পারে। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘গুপ্ত রাজনীতি’ সম্পর্কে সজাগ থাকাতে হবে ।ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ফ্যাসিবাদের রোষানল থেকে বাঁচতে ফ্যাসিবাদবিরোধীদের কেউ কেউ ‘গুপ্ত কৌশল’ অবলম্বন করেছিল। একইভাবে পতিত–পরাজিত ফ্যাসিবাদী অপশক্তিও বর্তমানে ‘গুপ্ত কৌশল’ অবলম্বন করে দেশের গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করছ কি না, এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গী কারও কারও ভূমিকা দেশে ‘আপনার, আমার, আমাদের’ বহু মানুষের অধিকার ও সুযোগকে বিনষ্ট করার হয়তো একটি পরিস্থিতি তৈরি করছে । পতিত ও পলাতক অপশক্তিকে কোনো সুযোগ দেওয়া যাবেনা। গুপ্ত বাহিনীর সেই অপকৌশল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্যতম প্রধান কৌশল হচ্ছে, একটি ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য বজায় ও বহাল রাখা। সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকার এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গীদের সহযোগিতা ও সমঝোতার দৃষ্টিভঙ্গি সমুন্নত রাখতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শান্তিকামী, সহনশীল, গণমুখী ধারা চালু করতে না পারলে চব্বিশের ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানের অর্জন বিফলে যাবে। ভিন্ন দল ও মতের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে হবে সবাইকে, এটি একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। দেশের জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করার স্বার্থেই সবাইকে নতুন ধারার রাজনীতির প্রচলনের অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করতে হবে। স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট লুটেরা সন্ত্রাসী শক্তির কবল থেকে মুক্ত করে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাইকে মিলে আওয়ামী ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হবে। দেশের মানুষ সবাই যদি ঐক্যবদ্ধ না হয়, তবে ভয়াবহ পরিণতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের আকাশে যে কালো মেঘ ছিল, তা কিছুটা সরে গেছে; কিন্তু আবার ফিরে আসার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদি আবার সেই অন্ধকার ফিরে আসে, তবে আমরা ঐক্যবদ্ধ না থাকলে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। নিজেদের নিরাপত্তা ও দেশের স্বার্থে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত পতিত স্বৈরাচার নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে দেশে নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা আগামী ১৩ নভেম্বর দেশ অচল করে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে অপসারণের লক্ষ্যে লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে চরম স্পর্ধা দেখিয়েছে । বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করছেন নিষিদ্ধ ঘোষিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কতিপয় পলাতক নেতা। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রমাগতভাবে হুমকি দিয়ে চলছে দেশ অচল করে দেয়ার। হঠাৎ করে পতিত স্বৈরাচারের পলাতক নেতাদের হুমকিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে। সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে কি সেই দুঃসহ ভয়ঙ্কর আওয়ামী স্বৈরাচারী দুঃশাসন ফিরে আসছে দেশে? যখন দীর্ঘ সময়ব্যাপী আওয়ামী দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়ে দেশ একটি অবাধ সুষ্ঠু সুন্দর নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন সেই অপশক্তি দেশে অরাজকতা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা শুরু করেছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন ভন্ডুল করতে তারা মাঠে নেমেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল বের করে জনমনে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। যদিও বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর রেখেছে। এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে তেমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস নস্যাৎ করতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমে সাফল্য দেখিয়েছে।

চব্বিশের ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানের সময় এবং তার আগে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময়ে গুম খুন নিপীড়ন পৈশাচিকতার শিকার অসংখ্য মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন বর্তমানে। এতো এতো অপকর্মের জন্য দায়ী গোষ্ঠীটি প্রতিবেশী একটি দেশের প্রত্যক্ষ মদদে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠার হুমকি দিচ্ছে। বিদ্যমান শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্টের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামতে চাইছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ক্রান্তিকাল চলছে। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতবিরোধ, অনৈক্য, সংঘাত সৃষ্টির আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেই সুযোগে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসররা ষড়যন্ত্রের নতুন নতুন জাল বুনছে। এরই অংশ হিসেবে তারা আগামি ১৩ নভেম্বর লকডাউন ঘোষণা করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। তেমন প্রেক্ষাপটে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের সব ষড়যন্ত্র রুখে দিতে দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের বিকল্প নেই। নিজদের মধ্যে মতবিরোধ, পারস্পরিক বিভেদ, অনৈক্য ভুলে তাদের সকলকে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির পুনরুত্থান ঠেকাতে আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামার আহ্বান জানাচ্ছি। যেভাবে খুনি স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারি শেখ হাসিনার দুঃশাসন থেকে দেশকে রক্ষা করতে চব্বিশের জুলাই আগস্টে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিলেন আবারও সেই পরাজিত শক্তির ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করে দেশের মানুষকে নিরাপদে রাখতে সর্বশক্তি নিয়ে সবাই দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে মাঠে নামবেন , দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করছি। এখন চারদিকে ষড়যন্ত্রের আভাস দেখে ঘরে চুপচাপ নির্বিকার বসে থাকার সুযোগ নেই। আসুন, সবাই মিলে দেশবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রের কবল থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করি। কোনোভাবেই যেন সেই পতিত স্বৈরাচার ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্ট শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। তাদের পুনরুত্থান ঠেকাতে না পারলে অচিরেই দেশ আবার ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে, এটা উপলব্ধি করতে হবে সবাইকে। আমরা একটি রক্তক্ষয়ী গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারকে বিদায় করেছি। এত ত্যাগ, তিতিক্ষা, আত্মত্যাগ, বিসর্জন সব কিছুই বিফলে যাবে,যদি আমরা পরাজিত ফ্যাসিস্ট পতিত স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে না পারি।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট।


গণতন্ত্রের পথে বাঁধা গণভোট নিয়ে অনৈক্য

মিজানুর রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

দেশে গণভোট সবসময় হয় না। সংস্কারের উদ্যোগে জুলাই সনদকে আইনি বিধান দেওয়ার লক্ষ্যে সারাদেশে আলোচনার বিষয় হলো এখন গণভোট। এটি এমন একটি সিস্টেম যেখানে ভোটে সরাসরি জনগণ মতামত দেয়। গণভোট তখনই হয় যখন রাষ্টীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেমন সংবিধান সংশোধন, আইন তৈরি, রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে দেশে গণভোট হয়েছে। এই ভোট আয়োজনে দুটো বাক্সে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও গণভোট হয়েছে বা হচ্ছে। তবে অল্পকিছু দেশই এর প্রকৃত সফলতা পেয়েছে। সুইজারল্যান্ড থেকে শুরু করে নরওয়ে,ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য… দেশগুলোতে জনগণের রায় সত্যিই বদলে দিয়েছিল রাষ্টীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন। কিছু কিছু গণভোট রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় প্রভাব ফেলতে পারিনি।
…যেমন …রচিত নতুন সংবিধান অনুমোদন করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় ১৭৯৩ সালে ফ্রান্সে জনগণের মতামত নেওয়া হয় গণভোটের মাধ্যমে। সেখানে ও সংবিধান অনুমোদন বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ এর ব্যবস্থা ছিল। ভোটে প্রায় সব অংশগ্রহণকারী নাগরিক নতুন সংবিধানের পক্ষে রায় দেয়। এ রায়ে ফরাসি বিপ্লবের পর রাষ্ট্রের কাঠামো ও নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এটি এককালীন আয়োজন, যা স্থায়ী বা নিয়মিত প্রক্রিয়া হিসেবে গড়ে ওঠেনি। ফ্রান্সের এই ধরনের গণভোট বিশ্বের অন্যান্য দেশে জাতীয় ভোট ও সরাসরি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। পরে ১৯৫৮ সালে ফরাসী নেতা চালর্স দ্য গল নতুন সংবিধান অনুমোদনের জন্য গণভোটের আয়োজন করে। যার সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত হয় পঞ্চম প্রজাতন্ত্র--যা আজও কার্যকর। এই গণভোট ফরাসি রাজনীতিতে স্থিতিশীলতার নতুন অধ্যায় সূচনা করে। ইতিহাসে প্রথম গণভোটের অবদান অস্বীকার করা যাবে না।

…তবে বিশ্বের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ও নিয়মিত গণভোটের জন্মভুভূমি ফ্রান্স নয় সুইজারল্যান্ড। দেশটিতে নাগরিকদের সরাসরি ভোটের শুরু হয় ১৮০২ সালে। এরপর ১৮৪৮ সালে নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর গণভোটের মাধ্যমে স্থায়ীরূপ দেয়। ফ্রান্সে প্রথম গণভোট হলে ও সুইজারল্যান্ডই গণভোট কার্যকর করার ও নিয়মিত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাই বিশ্বের প্রাতিষ্ঠানিক গণভোটের জন্মভূমি হিসেবে সুইজারল্যান্ডের নাম স্বীকৃত। এখনো সুইজারল্যান্ডে বছরে একাধিক গণভোট হয় তাই ঐখানে দেশের স্বার্থে এ পর্যন্ত দ্বিধাহীনভাবে ৬০০ বার গণভোট হয়েছে এবং সরকার জনগণের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভোটের মাধ্যমে নীতিনির্ধারণ করেছে। তাদের গণভোটের আয়োজন নিয়ে কোনো সংকট সৃষ্টি হয়নি। সুইজারল্যান্ডকে বলা হয় গণতন্ত্রের জন্মভূমি।
…নরওয়ে কি সুইডেনের অধীনে থাকবে না বেরিয়ে আসবে এ নিয়ে গণভোট হয়। ভোটে বিপুল সমর্থনে নাগরিকরা স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়। এর ফলে নরওয়ে জন্ম নেয় স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে। ইউরোপের ইতিহাসে এটা সফল ও সার্থক গণভোট হিসেবে গণ্য করা হয়।
…২০১৬ সালের ‘ব্রেক্সিট’ গণভোটে যুক্তরাজ্যের জনগণ ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেন দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বের হবে। ভোটে ইইউ ত্যাগের পক্ষে বিপুল সমর্থন পায়। সরকার সেই রায় মেনে নেয় এবং ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউ থেকে বের হয়ে আসে। এই ভোটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
…তুরস্কে জাতীয় পরিসরে এখন পর্যন্ত সাতবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি ভোটই ছিল সংবিধান সংশোধন ও শাসনব্যবস্থার সংস্কার সম্পর্কিত। এই গনভোটগুলো দেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও সংবিধানিক প্রক্রিয়াকে নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে এক্ষেত্রে বিতর্ক ও আছে।
…চিলিতে মোট তিনবার গণভোট হয়েছে। যা দেশটির রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে ও সংবিধানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।এই গণভোটগুলোতে নাগরিকদের সরাসরি ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের শাসন ও সংবিধান নির্ধারণ করা হয়েছে। চিলিতে ১৯৮৮ সালে প্রাথম গনভোট অনুষ্ঠিত হয়। বিষয় ছিল আগুস্তো পিনোশের শাসন এক বছর বাড়ানো হবে কিনা। প্রায় ৫৬ শতাংশ ভোটার ‘না’ বলেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে পিনোশের একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি চিলির সাংবিধানিক ও নির্বাচনী সংস্কারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা দেশকে ধাপে ধাপে গণতান্ত্রিক পথে ফিরিয়ে আনে। ২০২০ সালে চিলিতে দ্বিতীয় গণভোট হয়। যেখানে নাগরিকদের জিজ্ঞাসা করা হয় নতুন সংবিধান প্রণয়নের অনুমোদন এবং সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া। ফলাফলে দেখা যায় প্রথম প্রশ্নে প্রায় ৭৮ শতাংশ এবং দ্বিতীয় প্রশ্নে ৭৯ শতাংশ ভোটার সমর্থন করেন। যা নাগরিকদের জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য স্পষ্ট মত প্রকাশ করেন।

চিলিতে ২০২২ সালে তৃতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে নাগরিকদের সামনে ছিল নতুন সংবিধান অনুমোদন প্রশ্ন। ফলাফলে ৬২ শতাংশ ভোটার ‘না’ বলেন। পক্ষে ভোট পড়েছে ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ নতুন সংবিধান প্রস্তাব বাতিল হয়। নাগরিকদের এই সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়েছে সংবিধান প্রস্তাবের জটিলতা ও রাজনৈতিক উদ্বেগ। ভোটাররা নতুন সংবিধান প্রণয়নের পরিবর্তে বর্তমান কাঠামোর স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। …উন্নত বিশ্বের গণভোটের বিষয়টি বিশ্লেষণ করার উদ্দেশ্য হলো…অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত, এরা গণভোটের মাধ্যমে ঐক্যমতে পৌঁছেছে। দেশের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে। এগুলো আমাদের জন্য অবশ্যই শিক্ষনীয়।
…স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নানা রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ছিল দুটি ছিল প্রশাসনিক গনভোট এবং আরেকটি সাংবিধানিক গনভোট। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৭ সালে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় গণভোট হয়েছিল রাষ্টপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনআমলে ১৯৮৫ সালে। সর্বশেষ গণভোট ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হয়েছিল।
প্রথম গণভোট হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩০ মে। উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনের বৈধতা যাচাই। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায় সারাদেশের ২১ হাজার ৬৮৫টি কেন্দ্রে ৩০ মে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিরতিহীন ভোট নেওয়া হয়।ঐ সময় দেশে মোট ভোটার ছিল ৩ কোটি ৮৪ লাখ। সেই গণভোটে ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিল। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৮দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে ‘না’ ভোট পড়েছিল ১ দশমিক ১ শতাংশ ।
…দ্বিতীয় গণভোট হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ। উদ্দেশ্য ছিল এরশাদের রাষ্টপতির দায়িত্বে জনসমর্থন যাচাই। জনগণের আস্থা থাকলে জেনারেল এরশাদের ছবিসহ ‘হ্যাঁ’ থাকে এবং আস্থা ‘না’ থাকলে না বাক্সে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী সেই গণভোটে ৭২ দশমিক ২ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি ছিল। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট ছিল ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ ‘না’ ভোট ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে উল্লেখিত দুটো নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাস্তবে একেবারে কম ছিল কিন্ত ভোটের ফলাফল বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল। তাই নির্বাচন দুটি নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।
…গণআন্দোলনে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ।এর ৩ মাসের মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। ১৬ বছরের রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সংসদীয় পদ্ধতির (পার্লামেন্টারী ডেমোক্র্যাসি) সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯১ সালের ৬ আগষ্ট মধ্যরাতে সর্বসম্মতিতে সংসদে বিল পাশ হয়।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলাকালে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী জাতীয় সংসদে গৃহীত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার পর সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে থাকা বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ সম্মতি দিবেন কিনা সে প্রশ্নে দেশব্যাপী গণভোটের আয়োজনের সর্বসম্মতিভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। দেশের ইতিহাসে অনুষ্ঠিত সেই তৃতীয় গণভোটে ভোট পড়ে ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। ‘হ্যাঁ’ ভোট দেন ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে ‘না’ ভোটের হার ছিল ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ।
…২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারায় সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়াকে জনসমর্থন দিতে নতুন করে গণভোট আয়োজনের পরিকল্পনা সামনে এসেছে। জতীয় ঐক্যমত্য কমিশন জানিয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই গনভোটের লক্ষ্য। তবে এটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হবে না পরে নাকি একসঙ্গে আয়োজন করা হবে… এই বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
…এই বিষয়ে প্রধান তিনটি দলের মতানৈক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে যেমনটি বলছে এন সি পি---‘গণভোট নির্বাচনের আগে না পরে হতে পারে এটি নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।’

…জামায়াত অবস্থান হলো:-‘জতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট না করলে সেই নির্বাচন অর্থহীন হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে লন্ডন যাত্রাবিরতীকালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জামায়াতের আমির ডা. শফিক বলেন বাংলাদেশে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে নির্বাচন কোনোভাবেই কার্যকর হবে না। আমাদের স্ট্যান্ড ভেরি ক্লিয়ার গণভোট আগে হতে হবে। না হলে এটা মূল্যহীন। এটার কোনো দুই পয়সার ও মূল্য নেই।
…বিএনপির মহাসচিব গত ১ নভেম্বর প্রেসক্লাবে মুক্তিযুদ্ধা সম্মেলনে বলেন, গণভোটের কোনো প্রয়োজন ছিল না তারপরও আমরা রাজি হয়েছি। আলাদাভাবে গণভোট করতে গেলে রাষ্ট্রের একহাজার কোটি টাকা খরচ হবে। তাই একইদিনে গণভোট চাই।
…সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণভোট নিয়ে ঐকত্যে পৌঁছতে এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়েছেন যদি রাজনৈতিক দলগুলো ঐ সময়ে ঐকমত্য পৌঁছাতে না পারে সরকার গণভোট আয়োজন নিয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে বাধ্য হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্নমত পোষণ করলে গণভোট করা দুরূহ ব্যাপার হবে। জনগণের মাঝে গণভোট নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। জুলাই সনদ ৮৪টির মধ্যে ৪৮টি বিষয়ে একমত হয়েছে। ৪০টি বিষয়ে নোট অফ ডিসেন্ট। জনগণকে ৪৮ বিষয়ে যে একমত হয়েছে তা অবহিত করার দায়িত্ব সরকারের । যদি জনগণ অবহিত না হয় কি উদ্দেশে নিয়ে গণভোট হচ্ছে জানবে কি করে? জনগণকে অন্ধকারে রেখে গণভোট করা হলে এই গণভোট অর্থহীন হবে। দেশে স্বচ্ছ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে অবশ্যই গণভোটের প্রয়োজন আছে। টালবাহানা নয়, সাংবিধানিক সংস্কারের নিমিত্তে ক্ষমতার প্রয়োগের জন্য গণভোট ও নির্বাচন সহজ পথ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ ঘোষিত সময় অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। দেশের স্বার্থে সকল রাজনৈতিক দল রেষারেষি বাদ দিয়ে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা উচিত।

লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক ব্যাংকার।


banner close