সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস

মিজানুর রহমান
প্রকাশিত
মিজানুর রহমান
প্রকাশিত : ৯ আগস্ট, ২০২৪ ১৬:১২

আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যার প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি আমাদের গ্রামীণ ব্যাংকের অহংকার এবং বাঙালি জাতিরও অহংকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একমাত্র নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বিদায়ী সরকার অনেক তীর্যক মন্তব্য করেছে। আমরা ব্যাংকে থেকেও প্রতিবাদ করতে পারিনি, আমাদের লেখনীতে অনেক বাধা ছিল। ওনার প্রশংসা করলেই শাস্তিমূলক বদলির আশঙ্কা ছিল। এ ভয়ে বিগত ১৫ বছর গ্রামীণ ব্যাংকের এই মহান ব্যক্তিটিকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেক সমস্যাও হয়েছে। অথচ এ মহান ব্যক্তিটির অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল কিন্তু প্রাণের গ্রামীণ ব্যাংক। এটা অমনি করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তার পেছনে স্যারের অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল। সদস্যদের স্বাক্ষরতা শিখিয়ে তাকে ঋণ দেওয়া, শিক্ষকের মতো ভূমিকা নিয়ে ঋণের মাধ্যমে কিভাবে স্বাবলম্বী করা যায় এবং তাকে কাজে লাগানো যায় সেটা কিভাবে করতে হয় পরম মমতা দিয়ে আমাদের শিখিয়েছেন।

শুরুর ইতিহাস থেকে জানা যায়, দারিদ্র্য বিমোচনের যুদ্ধে তার সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র যোগ দেন। তিনি তখন অর্থনীতির প্রফেসর ছিলেন। সে সময় ইউনিভার্সিটির পাশের দারিদ্র্যপীড়িত জোবরা গ্রামে গবেষণা প্রকল্প হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পটি হাতে নেন। ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকতেন ওই গ্রামে। সাহায্য নয় সহযোগিতা করা এই কর্মযজ্ঞের মন্ত্রে অনুপ্রাণিত করেছিলেন গ্রামবাসীকে। স্বল্প পুঁজিতে হরেক রকমের ব্যবসায় নামালেন গ্রামের ভূমিহীন ভিত্তিহীনদের। জোবরা গ্রামের অনাবাদি জমিগুলো তেভাগা কর্মসূচির মাধ্যমে চাষাবাদের জন্য আনা হলো। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনল এবং সফলতা পেল। প্রত্যেকের পারিবারিক অবস্থারও পরিবর্তন হলো। স্যানেটারি ল্যাট্রিন, গৃহনির্মাণ ঋণ, টিউবওয়েল বসানো ও রাস্তাঘাট তৈরির মাধ্যমে সব কিছুর আমূল পরিবর্তন হলো। প্রফেসর ইউনূস তাদের কাছে মহান ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হলেন।

জোবরা গ্রামের প্রকল্পটি সফলতা পাওয়ার পর টাঙ্গাইলের অজপাড়া গাঁয়ে এ কর্মসূচি স্থানান্তরিত হয়। সেখানেও প্রকল্পটি জনপ্রিয়তা পায়। সাফল্যের সঙ্গে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রকল্পের অবয়ব থেকে একটি পৃথক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তখন ব্যাংকের মালিকানা ৬০ শতাংশ সরকারের হাতে ছিল। আর ৪০ শতাংশ মালিকানা ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের হাতে। তখন অবশ্য এটা সরকারি ব্যাংক ছিল। পরবর্তীতে সময়ে মালিকানা পরিবর্তন হয় ২৫ শতাংশ সরকারের আর ৭৫ শতাংশ সদস্যদের। গ্রামীণ ব্যাংক সাধারণত ভূমিহীন ও বিত্তহীনদের ঋণ দেয়। যারা ঋণ নেয়, তারাই ১০০ টাকার শেয়ার কিনে মালিকানা পায়। ফলে এটাকে সদস্যদের মালিকানা ব্যাংকও বলা হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডের ১২ সদস্যের মধ্যে ৯ জন সদস্য গ্রামীণের সদস্যদের মাঝ থেকে, বাকি ৩ জন সরকার থেকে নিয়োগ পায়। ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাধারণত সরকার নিয়োগ দিয়ে থাকে। গ্রামীণ ব্যাংক কিন্তু কোনো এনজিও না, এটা একটি বিশেষায়িত ব্যাংক।

বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৫১টি ব্যাংক আছে। এরা শহর থেকে গ্রামে যেতে চায় না। শহরের চাকচিক্য থেকে ব্যাংকি কার্যক্রম চালায়। তাছাড়া সরকারি ব্যাংকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক পেশিশক্তির প্রভাবে সুশাসনের যথেষ্ট অভাব। দালিলিক কাগজপত্রের জটিলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত ঋণ থেকে বঞ্চিত হয়। সে জন্য গ্রামের জনগণ এদের কাছে যেতে পারে না। অন্যদিকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ভূমিহীন দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দেওয়া এবং আর্থসামাজিকতার সঙ্গে সঙ্গে তারা যাতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে, নিজেরা যাতে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে সেটাই গ্রামীণ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য। প্রফেসর ইউনূস স্যারের দর্শন হলো ব্যাংক যাবে ঋণ গ্রহীতার বাড়িতে। অর্থাৎ কর্মীরা ব্যাংকিং সুবিধা তার ঘরে পৌঁছে দেবে। এ কাজগুলো প্রফেসর ইউনূসের সৈনিকরা সততার সঙ্গে করে থাকে বিধায় গ্রামের মানুষের কাছে গ্রামীণ ব্যাংক খুবই জনপ্রিয় এবং আস্থার জায়গা। বর্তমানে সারা দেশব্যাপী এর কার্যক্রম আছে। শাখার সংখ্যা ২৫৬৮টি। আমানতে ব্যালেন্স ২৫ হাজার কোটি টাকা, আদায়যোগ্য ঋণের ব্যালেন্স ১৭ হাজার কোটি টাকা। আদায় হার ৯৭%। আদায়যোগ্য ঋণের তুলনায় আমানতের শতাংশ ১৫৩। গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে বিশ্বের ৯৭টি দেশে এর কার্যক্রম চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে গ্রামীণ আমেরিকা।

বিশ্বের বহু দেশের গুণীজন, সাংবাদিক, ছাত্রছাত্রী আসে এই গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর গবেষণা করতে, কিছু শিখতে এবং জানতে। এ গবেষণা কাজের জন্য গ্রামীণ ব্যাংককে নির্ধারিত ফি দিতে হয়। বর্তমানে দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের কাজের সফলতা দেখে অনেক সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এরাও ভালো সফলতা পাচ্ছে। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য সংখ্যা এক কোটি পাঁচ লাখ। অর্থাৎ ৪ কোটি ২০ লাখ জনগোষ্ঠী গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত।

ইতিহাসের পাতা থেকে আমরা এটাও জানি, এই উপমহাদেশের আরেক নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে কালীগ্রাম পরগনায় দরিদ্র গ্রামীণ মানুষদের মহাজনের পীড়ন থেকে রক্ষা করতে সমবায়ী কৃষি ব্যাংক (কালীগ্রাম কৃষি ব্যাংক) স্থাপন করেন। সেখানে সুদের হার ছিল ১২ শতাংশ। তিনি ৮ শতাংশ সুদে টাকা ধার করে ব্যাংকের প্রাথমিক পুঁজি সরবরাহ করতেন। ব্যাংক ভালোই চললে, গরিব মানুষ উপকৃত হলো। এর প্রভাবে মহাজনরা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হলো। রবিঠাকুরের কালীগ্রাম কৃষি ব্যাংক পরবর্তীতে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। রবিঠাকুর কৃষি ব্যাংক করে প্রচুর সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দমে যাননি। রবীন্দ্রনাথের কৃষি ব্যাংক ছিল বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গ্রামীণের পরিধি বিশ্বব্যাপী। দুই মহান ব্যক্তির মহান সৃষ্টিধারায় বাঙালি জাতি উপকৃত হলো। ১৯১৩ সালে সাহিত্যের জন্য রবিঠাকুর নোবেল পেলেন।

অন্যদিকে একেবারে নিম্নস্তর থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সাধনে এবং পৃথিবী থেকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৬ সালে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে যৌথভাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। নোবেল প্রাপ্তিতে হঠাৎ করে দেশ যেন জেগে উঠল। সারা বাংলাদেশের মিডিয়ায় খবরের শিরোনাম ছিল গ্রামীণ ব্যাংক। প্রিন্ট মিডিয়ায় কেউ কেউ নিউজ হেড লাইন করতে দেখা গিয়েছে ‘বাংলাদেশ নোবেল পুরস্কার পেয়েছে।’ সারা দেশে অসংখ্য ব্যানার পোস্টার ছেয়ে গেল- প্রফেসর ইউনূস স্যারকে অভিনন্দন জানানোর প্রতিযোগিতায়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্রছাত্রীরা এসেছিল স্যারকে অভিনন্দন জানাতে। সরকারদলীয়, বিরোধীদলীয় মন্ত্রী-এমপিরাও এসেছিল শুভেচ্ছা জানাতে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো ছিল খবর সংগ্রহে সরব। ধন্য বাংলাদেশ, ধন্য প্রফেসর ইউনূস, ধন্য গ্রামীণ ব্যাংক- সবার মুখে তাই ছিল।

সারা বিশ্ববাসী থেকে ক্রমান্বয়ে প্রশংসা আসতে শুরু করল। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে নরওয়ের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রচারের পর থেকে প্রফেসর ইউনূস স্যারকে দেশে না বুঝে হেনস্তা করা শুরু হলো। তখন অনেকেরই সন্দেহ হয় এ কাজটি স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করিয়েছে। পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারি পর্যায়ে লোকজন প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করা শুরু করে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এরকম বক্তব্যে পরিস্থিতি কেমন হয়? তখন আমাদের সদস্য পরিবারের হৃদয়ে যেন মারাত্মক রক্তক্ষরণ হয়েছিল। তখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল বলেই ফেললেন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল শেখ হাসিনা ও সন্তু লারমার। প্রফেসর ইউনূস পাওয়ার যোগ্য নয়। এদের কেউ কেউ নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দাবিও উঠাল। পরবর্তীতে মামলা-মোকদ্দমা হলো, প্রফেসর ইউনূসকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য আইনের আশ্রয় নিতে হলো। তাকে জোরপূর্বক ব্যাংক থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো।

সরকারের বোঝা উচিত- নোবেল পুরস্কার কোনো ব্যক্তির কৃপায় হয় না। যদি তা-ই হতো, বিশ্বে কি ধনাঢ্য ব্যক্তির অভাব ছিল? যদি সে সুযোগ থাকত, আমাদের দেশে কমপক্ষে ৫০টি নোবেল পুরস্কার আসত। কিন্তু বাস্তবতা স্বীকার করতে সমস্যা কোথায়? যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। দেশকে নতুন করে সম্মান এনে দিয়েছে। হাসিনা সরকার তা মানতে নারাজ। আমরা যে পুরস্কার প্রাপ্তির কারণে এক লাফে অনেক ওপরে উঠে গেছি, সেটাও তাদের অনুভূতিতে আঘাত করেনি, দুর্ভাগ্য আমাদের।

প্রফেসর ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার পাবে- আমরা তা শুনে আসছিলাম ১৯৯৪ সাল থেকে। এটা হঠাৎ করে হয়নি। প্রতিবছরই বিবেচনায় তার নাম আসত। এরই মধ্যে অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। পাশের দেশ ভারত থেকে প্রফেসর ইউনূস তিনটি সেরা পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার, মহাত্মা গান্ধী পুরস্কার, বিশ্বভারতী রবীন্দ্রনাথ পুরস্কার। সেটা কি অর্থের বিনিময়ে হয়েছে?আমেরিকার সেরা দুটি পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন- প্রেসিডেন্সিয়াল মেডাল অফ ফ্রিডম এবং কংগ্রেস গোল্ড মেডেল পুরস্কার। তাছাড়া জাপান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, সুইডেন, ইতালি, ফিলিাইন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তিনি পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশে তিনি পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পেয়েছেন।

বিশ্বের অনেক দেশেই স্যারের মূল্যবান বক্তব্য শোনার জন্য তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়। যারা নিমন্ত্রণ করে, তারা বিমানভাড়া থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ বহন করে। তিনি বাংলা ও ইংরেজির সুবক্তাও বটে। কিন্তু আওয়ামী সরকার তা মূল্যায়ন করেনি।

তিনি ভারতের লোকসভার যৌথ অধিবেশনে বক্তব্য রেখেছেন। বছর দুই আগেও আসামের রাজ্যসভায় বক্তব্য রেখেছেন। বার্লিন দেয়াল ধ্বংসের ২০তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে জার্মানিতে যখন বক্তব্য রাখেন, তখন ইউরোপের সব সরকারপ্রধান মাথা নিছু করে দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য টিকিট কেটে শুনছিলেন। তিনি সারা বিশ্বের সামাজিক ব্যবসার ও উদ্যোক্তা। সামাজিক ব্যবসা নিয়ে বিভিন্ন দেশে সম্মেলনও করে যাচ্ছেন।তিনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন পছন্দ করেন। যেহেতু গ্রামীণ ব্যাংক গরিবের ব্যাংক, অযথা আমাদেরকে খরচ করতে অনুমতি দেয়নি। তিনি যখন এমডি ছিলেন, কাঠের চেয়ারে বসতেন এ ধারা ম্যানেজার থেকে শুরু করে সবার ক্ষেত্রে অদ্যাবধি চালু আছে।

কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকেরা তাকে অর্থ পাচারকারী সুদখোর, ঘুষখোর আরও কত কি উপাধি দিলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রীও যাচ্ছেতাই মন্তব্য করলেন। এর প্রতিবাদে ফিল্ড পর্যায়ে আমরা মানববন্ধনও করি। সরকার কিছুই তোয়াক্কা না করে অনবরত মিথ্যাচার করে যাচ্ছিল। এমনকি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে যাচ্ছেতাই মন্তব্য করেছে। মনে হচ্ছে যেন শেখ হাসিনা নোবেল না পাওয়ায় এত যন্ত্রণা।

যে দেশে গুণীজনের সম্মান নেই, সে দেশে গুণীজন জন্মায় না। সেটা আমাদের বুঝতে সময় লাগল, সেটাই সবচেয়ে বড় আপসোস।

বিগত ১৫ বছর আমরা স্যারকে দেশের কাজে লাগাতে পারিনি। স্যার বলেছিলেন সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই, কিন্তু সহযোগিতা না নিয়ে মামলা দিয়ে ব্যস্ত রাখল। এতে ক্ষতি কার হলো, অবশ্যই বাংলাদেশের।

নরওয়েতে সম্প্রসারিত প্রামাণ্য চিত্র নিয়ে জোরালো তদন্ত করা হলো অধ্যাপক মনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে। গ্রামীণ ব্যাংকে কোনো আর্থিক অনিয়ম হয়নি, তা তিনি রিপোর্টে উল্লেখ করলেন এবং গ্রামীণ ব্যাংক সবচেয়ে কম সুদ নেয় এটাও রিপোর্টে উল্লেখ ছিল। তাই গ্রামীণ ব্যাংক হাজারো প্রতিষ্ঠানের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান।

এই উপমহাদেশে রবিঠাকুর, মাদার তেরেসা, অমর্ত্য সেন, প্রফেসর আব্দুস ছালাম, অং সান সু চি এবং আমাদের প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কারও চেয়ে কেউ কম নয়। তাই বলে নিজের দেশের নোবেল বিজয়ীকে বাদ দিয়ে অন্য দেশের নোবেল বিজয়ীকে দিয়ে একুশের বইমেলা উদ্বোধন করতে হবে? সেটাও আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের সময়। এভাবে পদে পদে আমাদের নোবেল বিজয়ীকে অপমানিত করে তিনি কি সম্মানিত হয়েছেন?

শেখ হাসিনা সরকারের সময় অধ্যাপক সাইফুল মজিদকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস স্যারের কি কি অনিয়ম আছে লাখ লাখ টাকা খরচ করে অডিট করালেন, কিন্তু কিছুই পননি। তিনি সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত ছিলেন। কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করতে দেখা যায়নি তাকে। তাকে নিয়ে ব্যাংকে বহু সমালোচনা আছে। তিনি ব্যাংকের অনেক ফান্ড তছরুপ করেছেন।

কেউ কেউ বলেন উনি আরেক আব্দুল হাই বাচ্চুর মতো ছিলেন। ওনার আমলেই গ্রামীণ ব্যাংক থেকে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ছবি অফিস অর্ডার করে নামিয়ে ফেলা হয়। স্বৈরচার সরকার পতনের পর পর স্যারের প্রিয় কর্মীরা গ্রামীণ ব্যাংকের সব কার্যালয়ে স্যারের ছবি এখন আবার টাঙ্গানো হয়েছে। এ ছবি আমাদের শক্তি দেয়, উৎসাহ-অনুপ্রেরণা জোগায়। সততা শেখায়। ছবি অপসারণের বিষয়টি সহজভাবে কেউ তখন মেনে নেয়নি। সবার মনে ভীষণ দাগ লেগেছিল। আমাদের ব্যর্থতা, প্রতিবাদ করে ব্যর্থ হয়েছি। এই সাইফুল মজিদ কি কি অনিয়ম গ্রামীণ ব্যাংকে করেছেন, তা সংবাদপত্রে আমার লেখার ইচ্ছা আছে। ব্যাংকের অর্থ ব্যয় করে তিনি হিরো সাজতে চেয়েছিলেন, আজ উনি ব্যাংকে অবাঞ্ছিত। গ্রামীণের প্রতিটি কর্মীর হৃদয়ে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস গেঁথে আছেন এবং তা থাকবে আজীবন। কেউ তার সম্মান কেড়ে নিতে পারবে না। স্যার আমাদের শিখিয়েছেন ‘ঋণ আমাদের মৌলিক অধিকার’, প্রযুক্তির পিঠে সওয়ার করে দেশ একদিন এগিয়ে যাবে, ভালো কাজ করতে হলে ক্রমাগত ভাবতে হবে। আমরা এগুলো ধারণ করে আছি এবং থাকব। আজ দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়ায় আমরা গর্বিত। ওনার হাতেই আমাদের দেশ সুরক্ষিত থাকবে, গতি হারাবে না প্রিয় মাতৃভূমি। আশা করি দেশবাসী সবাই মিলে স্যারকে সহযোগিতা করবে। আমরা স্যারের সহকর্মী হিসেবে তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

লেখক: প্রতিষ্ঠা সভাপতি, মিডিয়া সেল গ্রামীণ ব্যাংক।


অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা 

আপডেটেড ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১১:৪৮
রহিম আব্দুর রহিম

এক সময়কার প্রবল ক্ষমতাধর আওয়ামী লীগ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা তুমুল ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছে। ছাত্রদের সাধারণ একটা দাবিকে ঘিরে সৃষ্ট আন্দোলনকে গুরুত্ব দেয়নি পতিত সরকার ও তার দোসররা। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। পৃথিবী তথা এই উপমহাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস প্রমাণ করে কোনো কালেই ছাত্রদের রক্তদান বিফলে যায়নি। ২০২৪-এ যার ব্যত্যয় ঘটেনি। একজন রাষ্ট্রপ্রধান যখন মনে করেন তার দেশের সব দলমতের জনমানুষের তিনিই প্রভু, তখন তার পতন কেউ ঠেকাতে পারে না। আবার যে রাষ্ট্রপ্রধান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন তিনি জনমানুষের কর্তা নন, সেবকমাত্র। তার সুনাম, যশ ধ্বংস হওয়ার তেমন কোনো ক্ষেত্র সৃষ্টি হওয়ার সুযোগই থাকে না। ১৯৯০-এর গণআন্দোলনে ওই সময়ে প্রায় শতাধিক মানুষ প্রাণ বির্সজন দেয়। পতন হয় তৎকালীন স্বৈরাচার সরকারের। ইতিহাসের ঘূর্ণায়নে সরকারের পালাবদলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। টানা প্রায় ১৬ বছর তারা ক্ষমতায়। ২০২৪ জুলাই মাসে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ছাত্র আন্দোলন দমাতে রাষ্ট্রযন্ত্র শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। ১৫ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২২ জন। আহত হন ১৮ হাজার। বৃহৎ এই হত্যা তালিকায় ছাত্র-জনতার কাতারে পথচারী, রিকশা, ভ্যানচালক, ফল বিক্রেতা, শিশু-কিশোররাসহ সর্বস্তরের জনমানুষ রয়েছেন। ছাত্র আন্দোলন ঘিরে থানা পুলিশে আক্রমণ হয়েছে। লুটপাট হয়েছে অস্ত্র-গোলাবারুদ। প্রায় ৪০ জন পুলিশ নিহত হয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে যখন দেশ ছাড়েন ওইদিন থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগ (৮ আগস্ট) পর্যন্ত আরও প্রায় শতাধিক মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। একটি গোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে অন্য আরেকটি গোষ্ঠীর লোকজনদের বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেমন লুটপাট, ভাঙচুর হয়েছে তেমনি নিপীড়ন, নির্যাতন কিংবা মারধরের শিকার হতে হচ্ছে অনেকেরই। দেশের ১২ হাজার স্কুল শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করানো হয়েছে। ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট এই চার দিন দেশ মহাসাংবিধানিক সংকট অতিবাহিত করেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমানুষকে অবস্থান গ্রহণের যে ভদ্রোচিত আহ্বান বারবার জানাচ্ছেন, তাতে যথেষ্ট ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এ দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কালচারটা প্রতিষ্ঠিত মুদ্রার নেতিবাচক এপিট-ওপিট। তবে দেশের প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেই সৎ, দেশপ্রেমিক এবং নিবেদিত অনেক মানুষ রয়েছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার ভিন্ন আঙ্গিকে সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে জনমানুষের সেবক হিসেবে ইতিহাস গড়তেই পারেন। যা বিগত সরকারগুলো করতে পারেননি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার জন্য উদগ্রীব ছিলেন এমনটি ভাবার ফুরসত নেই। সাংবিধানিক সংকট এবং জাতির ক্রান্তিকালে এরা যে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন তাতে সর্বস্তরের জনমানুষের উচিত সরকারকে সমর্থন করা এবং সার্বিক সহযোগিতা প্রদান। একই সঙ্গে এই সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্রের উচিত দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করা। সব মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, লুটপাট হওয়া অস্ত্র গোলাবারুদের মধ্যে এখনো উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৮৮৫টি অস্ত্র এবং ৩ লাখ গোলাবারুদ। এটা ভয়ংকর আতঙ্কের সংবাদ। বিশ্বাস, অত্যাধুনিক যুগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে অভিযান চলছে, তাতে তারা সকল প্রকার ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করে অভিযানের সাফল্য ঘরে তুলবে। তবে অভিযান হতে হবে স্বচ্ছ এবং পরিচ্ছন্ন। কোনো বাহিনীর হেফাজত এবং অভিযান পরবর্তী কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হোক এটা কখনো সাধারণ বিবেক গ্রহণ করে না, করবেও না। মজার বিষয় হলো, মামলা মোকদ্দমার ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে ২০২৪-এর আন্দোলন পরবর্তী মামলা-মোকদ্দমায়। আসামির তালিকায় কে নেই, নেতা-নেত্রী, পুলিশ, বিচারক, সাংবাদিক সবাই রয়েছেন। তাও আবার প্রায় সবাই খুনের মামলার আসামি। এদিকে গণহারে মামলা, অন্যদিকে দাগী আসামিদের ছাড়া পাওয়ার সংবাদ মানুষের মধ্যে এক ধরনের বাড়তি আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। হাস্যকর বিষয় হলো- ছাত্ররা পরীক্ষায় বসবে না বলে আন্দোলন করতে গিয়ে হু হু করে ঢুকে গিয়েছিল সচিবালয়ে, আনসার বাহিনী দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে আন্দোলন করতে গিয়ে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসক নিয়োগ ক্ষেত্রে বঞ্চিতরা অভিযোগ করেছিল যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তারা নাকি আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী। জাতি দেখে আসছেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা দলবাজি করে যুগে যুগে লুটপাট করেছে ঠিকই; কিন্তু বরাবরই এরা পাড় পাওয়ায় এদের মধ্যে ‘বঞ্চিত’ বা ‘সুবিধাভোগী’ বিশেষণগুলো গেড়ে বসেছে। প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তা সংঘবদ্ধ আন্দোলন করতে পারেন না। এরপরও কেন এমনটা হচ্ছে! সম্প্রতি বিভিন্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে দাবি-দাওয়ার নামে যে জ্বালাও-পোড়াও চলছে এটা এক ধরনের অরাজকতা। এগুলোকে ছাড় দেওয়া উচিত নয়। মনে রাখতে হবে ‘সভ্যতাকে টিকাতে হলে অসভ্যকে ছাড়তে নেই।’ (শিক্ষক ও নাট্যকার)।

লেখক: শিক্ষক ও নাট্যকার


জনপ্রত্যাশা পূরণে নিরন্তর প্রচেষ্টার বিকল্প নেই

আপডেটেড ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১১:৪৮
মোতাহার হোসেন

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। গত ৫ আগস্ট একটি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে দেশের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন সরকার উৎখাতের এক দফা সংগ্রামে পর্যবসিত হয়েছিল ১৭ জুলাই। ধারণা করা হচ্ছে, ১৭ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাযজ্ঞে মৃতের সংখ্যা কয়েকশ ছাড়িয়ে গেছে। এমনি এক কঠিন সময়ে দায়িত্ব নেওয়া নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, বিগত ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান চলাকালে নরসিংদী, কাশিমপুর, শেরপুর, বগুড়াসহ কয়েকটি জেল ভেঙে আসামি পলাতক আসামি গ্রেপ্তার এবং জেলখানার লুট হওয়া অস্ত্র, বেশ কিছু থানার লুট হওয়া অস্ত্র দ্রুত সময়ে উদ্ধার করা, ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং রেমিট্যান্স বাড়ানো, উচ্চমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ. সর্বগ্রাসী দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা, খেলাপি ঋণ দ্রুত আদায় করা ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা ও পাচার হওয়া টাকা দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা, নাগরিক সেবায় নিয়োজিত সংস্থাসমূহের দুর্নীতি বন্ধ সেবা নিশ্চিত করা, সরকারি কেনাকাটি, টেন্ডারের কারসাজিতে সরকারি অর্থের হরিলুট, অপচয় বন্ধ করার পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবে ধুঁকতে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিংবা সামগ্রিক অর্থনীতির নানান সংকটকে উতরে নেওয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

তাছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ১১ দিনের মাথায় এরইমধ্যে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডবে প্রায় এক কোটি লাখ মানুষ আশ্রয়হীন, গৃহহীন হয়েছে। সম্পদের ক্ষতি আরও বিপুল বিশাল। তাই এ ক্ষতিটি স্বভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করাটাও সরকারের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যদিও এসব অঞ্চলের দুর্গত মানুষের সহায়তায়, আত্মমানবতার দুর্ভোগ লাগবে, ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই মর্মবাণী হৃদয়ে ধারণ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে প্রাচ্যের অক্সফোর্ট ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের টিএসসিতে স্থাপিত ত্রাণকেন্দ্রে শিশুশিক্ষার্থীসহ রাজধানী সর্বস্তরের মানুষের সামর্থ্য অনুযায়ী অংশগ্রহণ এক মানবিক উদাহরণের সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলসমূহ, সামাজিক সংগঠন, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠনও ত্রাণ, কাপড়, শিশুখাদ্য, ওষুধসহ বন্যাকবলিত মানুষকে উদ্ধার ও সর্বাত্মক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- বন্যাপরবর্তী এসব এলাকার মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি নির্মাণ, সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ‘প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিল’-এ ত্রাণ সহায়তায় একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ওই তহবিলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প গ্রুপ থেকে আশানুরূপ অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা জমা হচ্ছে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীমণ্ডলীর সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যরা বন্যাকবলিত বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণ ব্যাহত রেখেছে। আশা করছি বন্যা উপদ্রুত এলাকায় বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রমসহ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যবস্থা সচল ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল হয়ে উঠবে।

অন্যদিকে, ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার, বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার, আর্থিক খাতের সংস্কারের অঙ্গীকার রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের। সরকারের জন্য অগ্রাধিকারমূলক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক করা। ইতোমধ্যে বহু ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পর্যটন ব্যবসা, পরিবহন ব্যবসা, আইটিভিত্তিক ব্যবসা, হোটেল-মোটেল ব্যবসা থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসা পর্যন্ত বিপর্যস্ত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হবে ব্যবসা সচল করার জন্য ছোট, মাঝারি ও ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের স্বার্থ গুরুত্ব দেওয়া। কারণ এসব প্রতিষ্ঠান অর্থনীতির, বিশেষত গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ। দেশে প্রায় এ ধরনের ৭০-৮০ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্প সচল করতে হবে অবিলম্বে। তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে হবে। দেশের অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোয় জনবান্ধব এবং সেবা নিশ্চিত ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতির লাগাম টানা, পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ সব সরকারি অফিসকে ঢেলে সাজাতে হবে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি করা দরকার। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জনপ্রত্যাশা পূরণ করে সবকিছু সম্পন্ন করার জন্য তারা কতটুকু সময় পাবেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। প্রত্যাশা এবার বাংলাদেশে সত্যি সত্যিই একটি ‘সফল সামাজিক বিপ্লব’ সম্পন্ন হবে। ‘আর এই প্রত্যাশার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর দুজন সমন্বয়কও উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়।

বিগত ১৬ বছরে পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় জনআস্থা, জনগণের বিশ্বাসের জায়গায় প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে পুলিশ। পুলিশ রাষ্ট্র এবং জনগণের প্রতিপক্ষ তথা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে নির্বিচারে মানুষ হত্যায় লিপ্ত হয়েছে। এর ফলে জনরোষ সৃষ্টি হয় যা এক শিশু তার পিতার কোল থেকে নেমে এক পুলিশ সদস্যকে দেখে তার দিকে ছুটে গিয়ে কিল ঘুষি মারার দৃশ্যই মনে করিয়ে দেয় পুলিশের ওপর দেশের মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

অবশ্য অধ্যাপক ইউনূস দেশে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে কাজে নেমে পড়েছেন। আমরা দূঢ়ভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর সম্পূর্ণরূপে আস্থা এবং বিশ্বাস রাখতে চাই, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করতে মনোনিবেশ করবেন। তারপর অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত দুর্নীতি ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান। পুঁজি পাচারের মূল রয়ে গেছে দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের লাগামহীন সর্বগ্রাসী বিস্তার রোধ করে পাচার হওয়া অর্থ দ্রুত ফেরত আনা এবং ব্যাংকগুলোর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ উদ্ধার করার। মার্কিন ইতিহাসবিদ ব্রুক অ্যাডামস জানাচ্ছেন, ১৭৫৭ সালের পর বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে কাঠের জাহাজে পুঁজি পাচার এত বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছিল, ওই জাহাজগুলোকে লন্ডন বন্দরে মাল খালাস করার জন্য প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হতো। এই লুণ্ঠন-পর্বকে ইতিহাসবিদরা ‘দি বেঙ্গল লুট’ নামে অভিহিত করে থাকেন। বলা হচ্ছে, ওই লুণ্ঠিত পুঁজি ইংল্যান্ডের ‘প্রথম শিল্পবিপ্লবে’ তথা শিল্পায়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছিল। বর্তমানে এই ‘ঘৃণ্য জাতীয় দুশমন’ পুঁজি পাচারকারীরা প্রতি বছর গড়ে ১৫০০-১৬০০ কোটি ডলার পুঁজি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পাকিস্তানি পুঁজি পাচারকারীদের ভাবশিষ্য হচ্ছে বর্তমানে দেশের নব্য পুঁজি পাচারকারীরা।

প্রসঙ্গত, বিগত ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে পরিচালিত দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের আদলে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের আরেকটি ‘ঝাঁকুনি’ প্রয়োজন। অবশ্য একই রকম মন্তব্য দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের। অবশ্য পরবর্তীতে দুদকের ওই অভিযান এবং দুদক আইনের পুনঃসংশোধন করায় নানান মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয়। ২০০৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত দুদক অর্ডিন্যান্সটি সংসদে অনুসমর্থন (রেটিফাই) না করে দুদককে ‘নখদন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত করেছিলেন বলে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান মন্তব্য করেছিলেন।

‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্র আন্দোলনের অবস্থানও ‘রাষ্ট্রের সংস্কার’-যা একটি বড় ও সময় সাপেক্ষ। কিন্তু বিষয়টি বহুমুখী ও সময় সাপেক্ষ-দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। তাই এটি হবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এটা হবে একটা কঠিন কাজ। প্রথমত, তারা অনির্বাচিত। দ্বিতীয়ত, তাদের মেয়াদ কতদিনের, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিষয়টি গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা দরকার। দীর্ঘমেয়াদি কাজ অনেক, সেসব দেখতে হবে অবশ্যই। আর সেসব সমস্যা চিহ্নিত, বহুল আলোচিত। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে বহুদিন ধরে চলে আসা রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পাশাপাশি আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনও অত্যন্ত জরুরি। এসব করা না গেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিলিত রক্ত স্রোতে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানের ফসল আবার হারিয়ে যাবে কৃষ্ণগহ্বরের অতলে। একই সঙ্গে হারিয়ে যাবে কোটি কোটি কোটি মানুষের আশা ও সোনালি ভবিষ্যৎ। মনে রাখতে হবে পতিত শাসকদের মতো নতুন করে আয়নাঘর বানিয়ে তা অন্যকে দেখাতে না নিয়ে নিজের মুখ আয়নায় দেখতে হবে, যেন সেই চেহারায় বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের চেহারা ভেসে আসে, জনগণের চোখের ভাষা, মুখের ভাষা এবং অন্তরে জমে থাকা অব্যক্ত ভাষার প্রতিফলন ঘটে। প্রতিফলন ঘটে ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা, আস্থা এবং বিশ্বাসের। মনে রাখতে হবে, দেশ আর দেশের মানুষের কল্যাণ, অগ্রগতি, শান্তি, মঙ্গল, উন্নয়নও অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত।

লেখক: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।


বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ও অর্থনীতিতে প্রভাব

আপডেটেড ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১১:৪৯
ড. মিহির কুমার রায়

প্রতি বছরই বাংলাদেশে গ্রীষ্মের শেষার্ধ থেকে শরতের প্রথমার্ধে এক বা একাধিকবার বন্যা দেখা দিয়ে থাকে। বিশ্বের অন্যতম প্রধান বৃষ্টিবহুল অঞ্চল উত্তর-পূর্ব ভারতে বর্ষাকালে যে বৃষ্টিপাত হয়, তা নদীপথে গড়িয়ে এসে সমতলের বাংলাদেশে বন্যা ঘটায়। বার্ষিক এই প্লাবন বঙ্গীয় ব-দ্বীপের ফসলি জমির উর্বরতা যেমন রক্ষা করে, তেমনই অভ্যন্তরীণ ভূমির উচ্চতা বাড়ায় ও উপকূলীয় ভূমির সম্প্রসারণ ঘটায়। নদীর সঙ্গে জলাভূমির সম্পর্ক রক্ষা করে; মৎস্যসম্পদের আবাসন ও প্রজনন প্রক্রিয়াও সুরক্ষিত রাখে। কিন্তু এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা কীভাবে জীবন ও সম্পদ বিনাশী হয়ে উঠতে পারে তা প্রায় প্রতি বছরই কমবেশি সে চিত্র দেখা যায়। বিভিন্ন নদী অববাহিকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের যে ১১২টি পানিস্তর পরিমাপক স্টেশন রয়েছে; পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটের বন্যা মানচিত্রে চার রঙের সূচক থাকে যেমন সূচকের রং ‘সবুজ’ মানে নদীপ্রবাহ স্বাভাবিক; বন্যার ঝুঁকি নেই, নদীর প্রবাহ যদি বাড়তে শুরু করে এবং বিপৎসীমার নিচেই থাকে, তাহলে সূচকের রং হবে ‘হলুদ’, বিপৎসীমায় পৌঁছলে বা বন্যা দেখা দিলে সূচকগুলো ‘কমলা’ রং ধারণ করবে এবং প্রবল বন্যা দেখা দিলে ‘লাল’ হয়ে যাবে। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেঘনা অববাহিকা এবং উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানিস্তর পরিমাপক স্টেশনগুলোর সূচক ছিল লাল ও কমলা। মধ্যাঞ্চলের সূচকগুলো ছিল হলুদ। এখন যখন সব সূচকই সবুজ, তখন কি আমরা আশ্বস্থ হবো?

শনিবার (৩১ আগস্ট) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে সম্প্রতি বন্যায় দেশের ১২ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলায় এখনো পানিবন্দি রয়েছেন ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫৪ লাখ ৫৭ হাজার ৭০২ জন। সূত্রে জানা যায়, বন্যায় দেশের মোট ১২টি জেলার ৬৮টি উপজেলার ৫০৪টি ইউনিয়ন/পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলাগুলো হলো- ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ সিলেট, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। বন্যায় ৫৯ জন মারা গেছেন। এরমধ্যে পুরুষ ৪১ জন, মহিলা ৬ জন, শিশু- ১২ জন। মৃতদের মধ্যে কুমিল্লা ১৪ জন, ফেনী ২৩ জন, চট্টগ্রাম ৬ জন, খাগড়াছড়ি ১ জন, নোয়াখালী ৯ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ১, লক্ষ্মীপুর ১ ও কক্সবাজার ৩ জন, মৌলভী বাজার ১ জন। আর ১ জন নিখোঁজ রয়েছেন। পানিবন্দি/ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দিতে জন্য মোট ৩ হাজার ৯২৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩০৫ জন লোক এবং ৩৬ হাজার ১৩৯টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে মোট ৫১৯টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের এ পর্যন্ত ত্রাণ দেওয়া হয়েছে, ৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে নগদ, ২০ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন চাল, ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৩৫ লাখ টাকার শিশুখাদ্য এবং ৩৫ লাখ টাকার গো-খাদ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে।

কৃষি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতির ফলে অনেক পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস নষ্ট হয়ে গেছে, যা খাদ্যনিরাপত্তার ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়া, যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অনেক এলাকায় মোবাইল টাওয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। সেনাবাহিনী ত্রাণ প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে এবং খাদ্য ও অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করছে। তবে পরিস্থিতির তীব্রতার কারণে এই প্রচেষ্টা এখনো অপর্যাপ্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) মাধ্যমে ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এই ত্রাণ সংগ্রহ অভিযানটি বন্যার্তদের জন্য খাদ্য, পানি এবং অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতে সহায়ক হচ্ছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে, ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহের জন্য বুথ স্থাপন করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সহায়তা আহ্বান করছেন। তারা বিভিন্ন দাতা সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বন্যার্তদের কাছে পৌঁছানোর জন্য পরিকল্পনা করছেন।

দেশে বন্যার প্রকৃতি ও ক্ষয়ক্ষতি মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। প্রথমত, উজান থেকে কী পরিমাণে পানি আসছে। দ্বিতীয়ত, কত দ্রুত বা ধীরগতিতে পানি আসছে আর কতদিন ধরে সেই পানি বাংলাদেশে থাকছে। তৃতীয়ত, দেশের নদী-নালা-খাল-বিলে পানির ধারণক্ষমতা। উজানের ভারতীয় অঞ্চলে এবং দেশের ভেতরের প্রাকৃতিক স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ তিন ক্ষেত্রেই জটিলতা বেড়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে। বিশেষত উজান থেকে আসা পলির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে নদীর তলদেশের গভীরতা কমে নদীর পাড়ভাঙন বাড়ছে। আবার শুকনো মৌসুমে নদীগুলোর পানি পরিবহনক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে এ পলি নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদী ভরাট করে ফেলছে। আবার দেশের ভেতরের নদ-নদীর নাব্য কমে যাওয়া, চ্যানেলগুলো বন্ধ হওয়ার কারণেও দিন দিন বন্যা বাড়ছে। এসব সংকটের সমাধান করতে না পারলে বন্যার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলবে না। বন্যা মোকাবিলায় সব কর্তৃপক্ষকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন বন্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। এটি একটি আপদকালীন অবস্থা, যা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই আরও খারাপ হয়েছে। পুকুর, খাল ও হাওর যেগুলো এক সময় এ অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং বন্যার সময় অতিরিক্ত পানির জলাধার হিসেবে কাজ করত, গত কয়েক দশকে সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অবিবেচনাপ্রসূত উন্নয়ন, নগরায়ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ সরকারি নীতির কারণে এমনটা হয়েছে। ওই এলাকায় অনেক নদ-নদীও দখল করা হয়েছে। এতে গ্রীষ্মকালে এগুলো শুকিয়ে যায় এবং স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই উপচে পড়ে। দেশের প্রধান নদীগুলোকে দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা নিতে হবে। বছর বছর নদী খননের জন্য অর্থ বরাদ্দ হলেও সে অনুপাতে কাজ হয় না। দেশের নিম্ন এলাকার মানুষকে বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে হলে লোক দেখানো নদী খননের কাজ বন্ধ করতে হবে। টেকসই ও পরিকল্পিত উপায়ে নদী খননে পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্যার্তদের সহায়তায় বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিজেদের কাজের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এই সংকটের সময়ে সহায়তার জন্য তাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অর্থ, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ করছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মীরা নিজেরা কিছু পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করে তা বন্যার্তদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করছেন, যাদের সহায়তার ফলে অনেক বন্যার্তের খাবারের অভাব মেটানো সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া, অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছে। তারা বন্যার্তদের জন্য খাদ্য বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন প্রকার সহায়তা করছেন। কিছু সংস্থা স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য মেডিকেল টিম পাঠাচ্ছে এবং পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব রোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করছে।

সাম্প্রতিককালের বন্যাগুলোর ভয়াবহতা বৃদ্ধির বেশ কিছু মানবসৃষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। যার মধ্যে অন্যতম হলো পাহাড়ের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করায় ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করা এবং অতিবৃষ্টির সময় হঠাৎ বাঁধের সব পানি ছেড়ে দিয়ে বাঁধের ভাটির জনপদে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করা হচ্ছে যেমন পদ্মা নদীর উজানে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ ও তিস্তার নদীর উজানে ভারতের গজলডোবা বাঁধ থেকে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ বাঁধের সব দরজা খুলে দিয়ে পদ্মা ও তিস্তা নদীর উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যেমন- পররাষ্ট্র, পানি সম্পদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারে যা সময়ের দাবি বলে প্রতীয়মান হয়। মনে রাখতে হবে, দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ যার অবস্থান এখন সপ্তম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম যা ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে যা জার্মানিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচ থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছে। তাই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদান বাড়াতে হবে, আঞ্চলিক সমন্বয় বাড়াতে হবে। আগামীতে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে বন্যার কথা জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে এবং দায়ীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে: দীর্ঘমেয়াদিভাবে বন্যা প্রতিরোধে আন্তঃনদী পানিপ্রবাহ সংযোগসহ যেসব আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে তার সফল প্রয়োগ সময়ের দাবি বিশেষত ভারত ও চীনের সঙ্গে। এখন পর্যন্ত গঙ্গা চুক্তির সুফল আমরা তেমন কিছুই পাই নাই এবং যা হয়েছে তা হলো শুষ্ক মৌসুমে আমরা মৃত পদ্মা পেয়েছি যা রাজশাহী অঞ্চলের মরুকরণকে ত্বরান্বিত করছে। এখন বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে কূটনীতিতে বিশেষত ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সর্বশেষ বিষয়গুলোতে যে সফলতা দেখিয়েছে তা আরও জোরদার করতে হবে। সবশেষে বলা যায় এখন আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির যে অঞ্চলগুলো ফি-বছর বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে তা নিয়ে সরকারের নির্ভাবনা জোরধার করতে হবে এবং এখন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এবং বৃহৎ নদ-নদীগুলোর দ্বারা বন্যাকবলিত দুই তীরের জনপদের জীবন-জীবিকার স্বার্থে সরকার যদি এগিয়ে না আসে তবে আঞ্চলিক বৈষম্য কমবে, ভৌগোলিকভাবে মানুষ তার ভিটেবাড়ি কম হারাবে এবং দরিদ্র নিরশন কর্মসূচি আরও সফল হবে। সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বন্যা খরার বিষয় এবং এর ফলে গ্রামীণ জীবনের যে পরিণতি সেগুলো অগ্রাধিকার কাজের মধ্যে রাখছেন এবং এগুলোর বাস্তবায়নে সমন্বিত কর্মসূচির কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: গবেষক


কৃষিক্ষেত্র ও কৃষি যন্ত্রপাতির উন্নয়ন আবশ্যক

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

“ধনধান্যে পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা, ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, ও সে সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।”

গানটিতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই স্বপ্নিল দেশের বর্ণিল রুপের বর্ণনা দিয়ে দেশ প্রেমের অনুভূতিতে সবাইকে উদ্বেলিত করেছেন। দেশের জন্য এই গান গেয়ে বিদেশের মাটিতে সবচেয়ে বেশি শিহরিত হতে দেখি প্রবাসীদের। এই গানের কলি ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ নিয়ে কিছু কথা বলার তাগিদ অনুভব করেই আজকের এই লেখা।

আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল আমাদের দেশের গ্রামে গঞ্জে এখন অনেক ধানী জমি শহরের আদলে বদলে যাওয়ার দরুন বড় বড় মিল-কারখানা, দালানকোঠা, রিসোর্ট ইত্যাদি তৈরি ও নদী নালা, খাল বিল ভরাট ও দখলের ফলে ফসলি জমির স্বল্পতা ও কৃষি যন্ত্রপাতির অপর্যাপ্ততা লক্ষণীয়। এতে আগামী দিনে সহজে ধানী জমিতে ফসল উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যাপক বাধা ও ঝুঁকি রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

বিশ্বব্যাপী তৃতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী হিসেবে আমাদের দেশ বাংলাদেশের অবস্থান যা অবশ্যই দৃষ্টান্ত স্বরূপ, এত অল্প জমিতে এত ফসল তাও আবার অন্যতম খাদ্য- ধান।

উৎপাদন ২০২৩ সালে প্রায় ৩৯.১ মিলিয়ন টনে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে তিনটি মৌসুমে এই অর্থকরি ফসল ধান চাষ করা হয়, যেমন- আমন, আউশ ও বোরো। বোরো হলো অগ্রণী ধান উৎপাদনকারী ফসল, যা সেচ ও সারের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এরপর রয়েছে আমন ও আউশের অবস্থান। এই অবস্থান ও খাদ্য ঘাটতি লাঘবে আমাদের ধান উৎপাদনে আরও বেশি নজরদারি দরকার।

আমাদের দেশে প্রতি বছরের মতো এ বছর রংপুর জেলায় আমন ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শেষ হয়েছে গত ৩১ আগস্ট।

ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ৮ হাজার ৮৬২ মেট্রিক টন, কিন্তু গুদামজাত হয়েছে ৫ হাজার ৭৭৪ টন। সংগ্রহের ক্ষেত্রে পরিমাণগত ঘাটতির বিষয়টি অত্যন্ত চিন্তনীয়। আমাদের ভাবতে হবে কেন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলো না। কারণ উৎপাদনের ঘাটতি, যা পূরণ করতে হলে আমাদের দ্রুত বিকল্প পথে এগোতে হবে।

চাল আমদানি করে নিয়মিত ঘাটতি লাঘব করা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার, কারণ দেশে বর্তমানে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার ঘাটতি রয়েছে। নিজেদের উৎপাদিত ধানের দ্বারা আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

এবং আমাদের পক্ষে কৃষিতে বিপ্লব সম্ভব, যদি একটু নজর দিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতির মূল্য ও সহজলভ্যতা কৃষকের অনুকূলে থাকে, সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার পানিতে ডুবে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট সুনামগঞ্জসহ দেশের অনেক জেলার সোনালী ফসল পানিতে ডুবে যায়, যেখানে কয়দিন আগেও সবুজে ভরপুর ছিল ফসলের খেত, কৃষকরা আশায় প্রহর গুনছিলেন এবার ভালো ফলন হবে ঘরে বাম্পার ফসল তুলবেন, হঠাৎ রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈষম্যবাদী ছাত্র জনতার মেধাভিত্তিক কোটা বাতিলের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পরিবর্তন এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভারতীয় বাঁধভাঙা পানি ও অতি বৃষ্টির ফলে হঠাৎ ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষকের ফসলি জমি, বাড়িঘর, গৃহপালিত পশু, গরু-ছাগল হাঁস-মুরগি ইত্যাদি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অবর্ণনীয়। তার পরে যা হয়েছে, তা হলো পানি নেমে যাওয়ার পর ওইসব বন্যাপ্লাবিত এলাকার ফসলি উঁচু নিচু সব প্রকার জমিতে পড়ে থাকতে দেখা যায় বালুর স্তূপ। এই বালুর স্তূপ রেখে জমিতে চাষাবাদ কিছুতেই সম্ভব নয়। মহাবিপদে পড়েছেন বিশেষ করে ফেনী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও মৌলভীবাজার জেলার প্রান্তিক কৃষকরা, এখন তাদের মাথায় হাত, কারণ এই আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককুল অর্থনৈতিকভাবে চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছেন এই পরিস্থিতিতে তাদের মাঠের পর মাঠ কৃষি জমিকে আবাদযোগ্য করে গড়ে তুলতে এখনই দরকার আর্থিক সহযোগিতা ও কৃষি যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা, প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারিভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতা। উল্লেখ্য, ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৭০-এর দশকের প্রথমদিকে এদেশে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়। বস্তুত তখন কৃষিক্ষেত্রে রূপান্তরের মাধ্যমে ‘সবুজ বিপ্লব’ ঘটাতে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু করা হয়, যার লক্ষ্য ছিল উচ্চফলনশীল শস্যের জাত, উন্নত সেচব্যবস্থা ও যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যতা হ্রাস করা। ওই সময়ে তৎকালীন সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাদের সহায়তায় দেশে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার চালু করার জন্য কর্মসূচি শুরু করেছিল।

ওই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, কম্বাইন হারভেস্টার এবং অন্যান্য কৃষি সরঞ্জাম আমদানি ও বিতরণ। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক ছিল ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন সংক্ষেপে বিএডিসি প্রতিষ্ঠা। বিএডিসি যন্ত্রপাতি আমদানি, ভর্তুকি প্রদান এবং কৃষকের সুবিধার্থে ঋণ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

গত কয়েক বছরে দেশে, বিশেষ করে প্রধান প্রধান কৃষি অঞ্চলে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার, কৃষিপ্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি খাত বিভিন্ন কর্মসূচি, প্রশিক্ষণ, উদ্যোগ এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে। লক্ষণীয়, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং কৃষিব্যবস্থায় এর গ্রহণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে একধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ক্ষুদ্র কৃষক, যারা কৃষি কর্মশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, তারা প্রায়ই আধুনিক যন্ত্রপাতিতে প্রবেশাধিকার ও সামর্থ্যের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন।

আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার দেশের কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে- এ কথা সত্য যেমন ট্রাক্টর, কম্বাইন হার্ভেস্টার এবং সেচব্যবস্থা কৃষিকাজের কার্যকারিতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে। এই প্রকার মেশিনগুলো কৃষকের কাজকে দ্রুত ও কার্যকরভাবে সম্পন্ন করতে সহায়তা করে, যার ফলে ফলন বৃদ্ধি পায় এবং শ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায় এবং গবাদি পশুর ব্যবহার কমে আসে। ফলে কৃষকের ব্যয়ভার ও জনবল কম পরিলক্ষিত হয় এবং এর ফলে ব্যাপকভাবে খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে। এটি মানব শ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে। যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে চাষ দেওয়া, বীজ বপন, ফসল কাটা এবং সেচের মতো কাজগুলো স্বল্প সময়ে ও কম শ্রমিক দিয়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে। এটি কৃষকের আয় এবং সামগ্রিকভাবে জীবিকার সুযোগ বৃদ্ধি করে। মনে রাখা দরকার যে, কৃষি কাজে আমাদের দেশে ইদানীং লক্ষণীয়ভাবে কৃষি শ্রমিক অর্থাৎ কৃষকের অপ্রতুলতা লক্ষণীয়। আধুনিক তথা উন্নতমানের কৃষি যন্ত্রপাতি চাষাবাদকে অনেকাংশে নির্ভুল করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাক্টরে জিপিএসভিত্তিক নির্দেশিকা সিস্টেমগুলো থাকার ফলে সুনির্দিষ্ট রোপণ পদ্ধতি ও নিষিক্তকরণে সক্ষম করে, ইনপুট অপচয় হ্রাস করে এবং ফসলের গুণমান উন্নত করে। উপরন্তু, যন্ত্রপাতি, কীটনাশক ও ভেষজনাশক প্রয়োগে সহায়তা করে, পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে আরও কার্যকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে।

ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এবং কৃষিপণ্যের গুণগত মান রক্ষার জন্য ফসল-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক যন্ত্রপাতি, যেমন শস্য শুকানোর যন্ত্র এবং পর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধা ফসল কাটার পর অপচয় কমাতে সাহায্য করে। এটি কৃষককে সর্বোত্তম সময়ে তাদের পণ্য সংরক্ষণ ও বিক্রিতে সহায়তা দান করে। ফলে বেশি লাভ হয় এবং খাদ্যের অপচয় কম হয়। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির সঙ্গে উন্নত দক্ষতা, উচ্চ উৎপাদনশীলতা এবং খরচ সাশ্রয় কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখতে সাহায্য করে। তাৎক্ষণিকভাবে শ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস এবং সম্পদের সঠিক ব্যবহার করার মাধ্যমে কৃষক উচ্চফলন এবং কম উৎপাদন খরচ নিশ্চিত করতে পারে।

তাছাড়া আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির অধিক ব্যবহার কৃষি খাতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে, কৃষকের মনে আশার সঞ্চার হয় এবং সম্প্রতি এ দেশে ব্যাপক হারে কৃষি উন্নয়নে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। এর দ্বারা বিদ্যমান যন্ত্রপাতি উন্নত করতে, স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী নতুন যন্ত্রপাতি তৈরি করতে এবং টেকসই চাষাবাদের উপায় খুঁজে বের করার গবেষণা ও উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে উদ্দীপিত করে। কিছু কিছু কৃষি যন্ত্রপাতি বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব হয়েছে। এর সবকিছুই বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের কৃষি খাতের সামগ্রিক অগ্রগতি ও প্রতিযোগিতায় অবদান রাখতে পারে। ফসলের উন্নয়নে কীটনাশক ও সারের মতো রাসায়নিক ব্যবহারও সঠিকভাবে পরিচালনা করা প্রয়োজন। অন্যথায় পরিবেশ দূষণ আরও বেশি তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। উপরন্তু, যন্ত্রপাতি থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব রাখে।

আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার প্রচলিত হওয়ার ফলে কৃষকের মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভরতা তৈরির ঝুঁকিও রয়েছে। যদি কৃষকের যন্ত্রপাতি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব থাকে, তাহলে তারা বাইরের পরিষেবা প্রদানকারীদের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে। ফলে তাদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা হ্রাস পেতে পারে। উপরন্তু, প্রজন্মের মধ্যে একটি দক্ষতার ব্যবধান দেখা দিতে পারে। কারণ বেশি বয়সী কৃষকের তুলনায় অল্পবয়স্ক কৃষক আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও মেরামতে আরও পারদর্শী হতে পারে। যন্ত্রপাতির আকার ও নকশা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে এর ব্যবহারযোগ্যতা সীমিত করতে পারে, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় এর কার্যকারিতা ও গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যেমন, কিছু আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি বড় আকারের সমতল কৃষিব্যবস্থার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের ছোট ও পাহাড়ি খামারের জন্য কম উপযোগী।

কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাবগুলো মোকাবিলা করা এবং উপযুক্ত নীতি ও সহায়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রভাবগুলো হ্রাস করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে দ্রুত আর্থিক প্রণোদনা প্রদান, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতিতে প্রবেশাধিকার উন্নত করার জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি। উপরন্তু, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি সম্পর্কে প্রচার, সঠিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন দেশের সর্বস্তরের জনগণ। এ দেশের গ্রামোন্নয়নে- বিশেষ করে বানভাসি জনতার আশা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টাবৃন্দ এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন এবং বন্যা প্লাবিত এলাকাগুলোয় কৃষিবান্ধব পরিবেশ তৈরি ও ধানী জমি থেকে বালু অপসারণে কৃষকদের আর্থিক সহায়তাদানে সঠিক পদক্ষেপ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে কৃষিভূমিতে ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্যশস্য আমদানি-নির্ভরতা লাঘবে সচেষ্ট হবেন।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক


ইসলামে নারীর সম্মান

আপডেটেড ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৬:৩১
সৈয়দ জাহাংগীর সাদেক

মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিনের নিকট ইসলামই একমাত্র মনোনীত দ্বীন; সুরা আল ইমরানের ১৯নং আয়াতে স্পষ্ট করে বলা আছে আর এই দ্বীনে মহান আল্লাহ নারীর মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। নর-নারীর সমন্বয়েই মানবজাতি। নারী জাতি হলো মহান আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত। আল্লাহ তায়ালা নারীকে পুরুষের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে মানবজীবন পরিচালনার জন্য পারস্পরিক সহযোগী করেছেন। ইসলাম মর্যাদার দিক দিয়ে নারীকে পুরুষের থেকে ভিন্ন করে দেখেনি। বরং ইসলামের আগমনেই নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত নারীসমাজ পেয়েছে মুক্তির সন্ধান। সারা দুনিয়াতে যখন নারীরা নিদারুণ অবস্থায় কালাতিপাত করছিল তখন আরব, ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে তাদের জন্তু-জানোয়ার বলে মনে করা হতো এবং মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মর্যাদা ও অধিকার স্বীকার করা হতো না, তখন ইসলাম নারীর যথাযথ অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করে নারী জাতিকে সম্মানের সুউঁচু আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষরা মনে করেন, পুরুষরা যা করতে পারবে নারীরা তা পারবে না, তাই নারীদের অনেক বেশি অবজ্ঞার চোখে দেখে অথচ ইসলাম নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। কখনো মা হিসেবে, কখনো স্ত্রী হিসেবে, কখনো মেয়ে হিসেবে, আবার কখনো বোন হিসেবে। ইসলাম আগমনের আগে জাহিলিয়াতের অন্ধকার যুগে নারীরা ছিল চরম অবহেলিত ও ঘৃণিত। তখন তাদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু পর্যন্ত হরণ করা হতো।

নারীর সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষায় ইসলাম প্রয়োজনীয় সব বিধান দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে সুরা ‘নিসা’ (অর্থ: নারী) নামে একটি সুরাও আছে।

নিম্নে ইসলামে নারীর সম্মান বিষয়ে কিছু তথ্য সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করছি:

নারী যখন মা: মহান আল্লাহ নারীকে মায়ের মর্যাদা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন-হাদিসে মাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ জারি করেছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণ করো।’ (সুরা: বনি ইসরাঈল, আয়াত: ২৩)

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), মানুষের মধ্যে আমার সদ্ব্যবহারের সর্বাপেক্ষা অধিকারী ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, তোমার মা। সে বলল, এরপর কে? তিনি বলেন, এর পরও তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বলেন, তার পরও তোমার মা।

সে বলল, এরপর কে? তিনি বলেন, এরপর তোমার পিতা। (মুসলিম, হাদিস: ৬৩৯৪)

সুবহানাল্লাহ! এতে করে স্পষ্ট হয়ে যায়, ইসলাম সর্বোচ্চ নারীকে সম্মান দেয় বলেই আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের সম্মানের ব্যাপারে এতটা গুরুত্বারোপ করেছেন।

নারী যখন স্ত্রী: নারী যখন স্ত্রী, তখনো তাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ নারীদের তার বিশেষ নিদর্শন বলে আখ্যা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে আছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে সে সম্প্রদায়ের জন্য, যারা চিন্তা করে।’ (সুরা: রুম, আয়াত: ২১)

ইসলাম নারীকে রানীর মর্যাদা দিয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে। একজন শাসক সে তার অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন পুরুষ তার পরিবারের রক্ষক, সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন স্ত্রী তার স্বামীর গৃহের রক্ষক, সে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন গোলাম তার মনিবের সম্পদের রক্ষক, সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব সাবধান, তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি, হাদিস: ৫১৮৮)

নারী যখন মেয়ে: ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, সন্তানরা আল্লাহর নিয়ামত। আর মেয়ে-সন্তানরা পুণ্য। মহান আল্লাহ নিয়ামতের হিসাব নেন, আর পুণ্যের প্রতিদান দেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তিকে কন্যাসন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সে ধৈর্যের সঙ্গে তা সম্পাদন করেছে, সেই কন্যাসন্তান তার জন্য জাহান্নাম থেকে আড় (প্রতিবন্ধক) হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১৯১৩)

নারী যখন বোন: ইসলামে মেয়ে এবং বোনের সঙ্গেও সদাচরণ করার তাগিদ দিয়েছে। আবু সাঈদ আল-খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারই তিনটি মেয়ে অথবা তিনটি বোন আছে, সে তাদের সঙ্গে স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করলে জান্নাতে যাবে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১৯১২)

নারী যখন অনাত্মীয়: নারী অনাত্মীয় হলেও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ইসলামের সৌন্দর্য। তার নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন থাকা সবার দায়িত্ব। ইসলামের ইতিহাসে নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় বনু কাইনুকা গোত্রের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এক সাহাবি তার মুসলিম বোনের সম্ভ্রম রক্ষায় জীবন দিয়ে দিয়েছেন।

আবু আওন থেকে ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন, এক দিন জনৈকা মুসলিম নারী বনু কাইনুকা গোত্রের বাজারে দুধ বিক্রি করে বিশেষ কোনো প্রয়োজনে এক ইহুদি স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে বসে পড়েন। কয়েকজন দুর্বৃত্ত ইহুদি তার মুখের নেকাব খোলানোর অপচেষ্টা করে, তাতে ওই নারী অস্বীকৃতি জানান। ওই স্বর্ণকার গোপনে মুসলিম নারীটির (অগোচরে) পরিহিত বস্ত্রের এক প্রান্ত তার পিঠের ওপরে গিঁট দিয়ে দেয়, তিনি তা বুঝতেই পারলেন না। ফলে তিনি উঠতে গিয়ে বিবস্ত্র হয়ে পড়েন। এই ভদ্র মহিলাকে বিবস্ত্র অবস্থায় প্রত্যক্ষ করে নরপিশাচের দল হো হো করে হাততালি দিতে থাকল। মহিলাটি ক্ষোভে ও লজ্জায় মৃতপ্রায় হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন। তা শুনে জনৈক (প্রতিবাদী) মুসলিম ওই স্বর্ণকারকে আক্রমণ করে হত্যা করেন। প্রত্যুত্তরে ইহুদিরা মুসলিম লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে। এরপর নিহত মুসলিমটির পরিবারবর্গ চিৎকার করে ইহুদিদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের কাছে ফরিয়াদ করেন। এর ফলে মুসলিম ও বনু কাইনুকার ইহুদিদের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত বাধে। প্রায় ১৫ দিন সে গোত্রের দুর্গ অবরোধ করে রাখার পর তাদের সবাইকে বন্দি করা হয়। (ইবনে হিশাম: ২/৪৭, আর রাহিকুল মাখতুম [বাংলা]: ২৪০/২৪২)

পবিত্র কোরআন মজিদের সুরা বাক্বারাহর ১৮৭নং আয়াতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, হে মানব সকল! তোমরা তোমাদের স্বীয় প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদের একই আত্মা (আদম) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং ওই আত্মা থেকে তার জোড়া (হাওয়া)-কে সৃষ্টি করেছেন এবং এতদুভয় থেকে বহু নর ও নারী বিস্তার করেছেন। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা পরস্পরের নিকট (স্বীয় হকের) দাবি করে থাক এবং আত্মীয়তা (এর হক বিনষ্ট করা) থেকেও ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সবার খবর রাখেন’ (নিসা ১)।

বিবাহের মাধ্যমে নারীকে অধিকার ও মর্যাদা দান:

জাহিলী যুগে বৈবাহিক ক্ষেত্রে নারীদের কোনোরূপ অধিকার ছিল না। তারা শুধু পুরুষের ভোগের সামগ্রী ছিল। ইসলাম এহেন ঘৃণিত প্রথার মূলোৎপাটন করত: নারী ও পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে। এই মর্মে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, তবে যেসব নারী তোমাদের পছন্দ হয়, তাদের মধ্য থেকে দুই দুই, তিন তিন, চার চারজনকে বিবাহ কর। কিন্তু তোমাদের মনে যদি আশঙ্কা জাগে যে, তোমরা তাদের সঙ্গে ইনসাফ করতে পারবে না। তাহলে একজন স্ত্রী গ্রহণ কর অথবা তোমাদের দাসিদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ কর। অবিচার থেকে বাঁচার জন্য এটাই অধিক সঠিক কাজ’ (নিসা ৩)

স্বামী নির্বাচনের স্বাধীনতায় ক্ষেত্রে নারীকে অধিকার ও মর্যাদা দান:

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীদের পছন্দমতো স্বামী গ্রহণের কোনো অধিকার ছিল না। যখন-তখন তাদের পাত্রস্থ করা হতো। কিন্তু ইসলাম নারীকে স্বামী নির্বাচনের স্বাধীনতা দিয়েছে। যে কেউ ইচ্ছা করলে বলপূর্বক কোনো নারীর স্বামী হতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে পুরুষরা! তোমরা মহিলাদের (স্বীয় স্বামী নির্বাচন করে) বিয়ে করাতে বাধা প্রদান করো না’ (বাক্বারাহ: ২৩২)।

এই আলোচনা থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, ইসলাম নারীদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার প্রতি কতটা গুরুত্ব দিয়েছে।

লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ


জাতীয় সংগীত নিয়ে কিছু কথা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব 

বর্তমানে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নানা প্যারামিটার বিবেচনায় এনে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা উঠে এসেছে। সেহেতু সম্যক ধারণার জন্য জাতীয় সংগীতের ইতিবৃত্তসহ শানে নুযুল নিয়ে কিছু জানা-অজানা কথা তুলে ধরার প্রয়াসী হয়েছি। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, জাতীয় সংগীত হলো একটি দেশের দর্শনের আওতায় প্রতিফলিত রাগ-রাগিনীর সুরের মূর্চ্ছনার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কেননা একটি দেশের জাতীয় সংগীত শুনলেও বোঝা যাবে জাতিগত দিক দিয়ে শিল্প-সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণা, প্রকৃতি ও ঐহিত্যগত নির্যাসের প্রাণবন্ত গঠনমূলক মিষ্টি আমেজ। উল্লেখ্য, জাতীয় সংগীতের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো National Anthem; আর এ Anthem; শব্দটি অপভ্রংশ হয়ে এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে। এর বাংলায় অর্থ দাঁড়ায়- ভজনগান, স্তর, স্তোত্র ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় সংগীত সেই গান, যাতে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের প্রতিভ‚ হিসেবে সামগ্রিক প্রকৃতি ও সত্তা ফুটে ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি...’। এ গানটি নেওয়া হয়েছে রবিঠাকুরের স্বরবিতান গীতি কাব্যগ্রন্থ থেকে। গানটি রচিত হয় ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে পূর্ব-পশ্চিম উভয়বঙ্গের একই সূত্রে গাঁথার উদ্দেশ্যে। বাস্তবে কতটুকু পেরেছে, তা সম্মানিত পাঠকরা আপনারা সবাই অবহিত আছেন। যাহোক, এটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায়। এ গানের সুর দিয়েছেন কবি গুরু নিজেই। আর সুর নাকি নেওয়া হয়েছিল গীতিকবি গগন হরকারার কাছ থেকে। এদিকে আমার সোনার বাংলার গানের ২৫টি চরণ সংবলিত প্রথম ১০ লাইন, যা ১৯৭১ সালে ৩ মার্চ স্বাধীনতা ইস্তেহারে পল্টন ময়দানে গৃহীত হয়। এটি বাংলাদেশ সংবিধানের ৪নং অনুচ্ছেদ উল্লেখ আছে। ইংরেজিতে অনুবাদ করেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান।

মূলত জাতীয় সংগীত দেশের গণমানুষের মধ্যে জাতীয় চেতনা ও দেশাত্মবোধকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সাধারণত বিভিন্ন দেশে এই মহান গান জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে গাওয়া হয়ে থাকে। এই গানের মেলোডির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে হৃদয় কাড়া নানা যন্ত্রের সুরের মূর্চ্ছনার আবেশ, যা শুনে প্রতিটি নাগরিকের তনু মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। আর আনুষ্ঠানিক হলে তো কথাই নেই, দাঁড়িয়ে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতে হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, স্পেনে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সঙ্গে কোনো শব্দ ব্যবহার করা হয় না।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, প্রথমে এই সাধের জাতীয় সংগীত সৃষ্টি ও পরিবেশনার কার্যক্রমটি প্রথম কখন থেকে শুরু হয়েছে? এ প্রেক্ষিতে উল্লেখ্য, যতদূর জানা যায় নবম শতাব্দীতে জাপানে ‘কিম গাও নামে এ ধরনের একটি গানের প্রচলন ছিল। আর এটাই বিশ্বের প্রথম জাতীয় সংগীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যাহোক, এর মধ্যে শত শত বছর পার হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশে সংগীত থাকলেও জাতীয় সংগীত হিসেবে তেমন কিছু পরিলক্ষিত বা বিশেষায়িত হয়নি। সময়ের পরিক্রমায় সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় নানা দেশে পরিবর্তন আসতে থাকলে ১৬০০ দশক থেকে ব্রিটিশরা সারাবিশ্বের উপনিবেশগুলোতে বিশেষ অবস্থান নিতে থাকে এবং একই সঙ্গে তাদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বিভিন্নভাবে বিকাশ হতে থাকে। আর সেই আমেজে ১৭৪৫ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে জাতীয় সংগীত প্রবর্তিত হয়। আর এই ক্ষেত্রে গানটি ছিল রাজাকে ঘিরে ÒGod save the kingÓ অবশ্য এ গানটি রচয়িতা নিয়ে মতভেদ থাকলেও, যার কথা সর্বজন স্বীকৃতি, তিনি হলেন- মি. হেনরী বেরী। তিনি ১৭৪৩ সালের দিকে ডেটিংগেন নামক যুদ্ধে ইংরেজদের বিজয় উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতে এই গানটি প্রথম রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধশত বছর কেটে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তখন ওপরের দিকে ওঠার পালা, যা অর্থনীতির ভাষায় টেক অব স্টেজ বলে অভিহিত। সেই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নানা দিকে উন্নতি সাধিত হতে থাকে এবং এই আবর্তে জাতীয় সংগীত প্রবর্তিত হয়। এই জাতীয় সংগীতের নাম ÒThe star spangled bannerÓ, এর বাংলা মানে হলো এ দেশের অন্তর্গত সকল রাজ্যের প্রতিভূ হিসেবে তারকার চুমকি বসানো পতাকা। গানটি রচনা করেন ১৮১৪ সালে একজন সাধারণ সৈনিক, যার নাম মি. ফ্রান্সিস স্কট কী। এদিকে ফ্রান্সের জাতীয় সংগীত রচিত ও প্রবর্তিত হয় ১৭৯২ সালে, যার নাম ‘লা মার্সেলেজ’। অবশ্য এর রচনার পেছনে একটি মজার কাহিনী শোনা যায়। সেই সময়ে নাকি ফ্রান্সের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ চলছিল। তখন একটি কথা জনমনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগে যে ফরাসিদের জন্য ভালো কোনো রণসংগীত বা জাতীয় সংগীত নেই। এ প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর রুজেট দ্য নীল নামে জনৈক ক্যাপ্টেন ঝোঁকের মাথায় এক ঘণ্টার মধ্যে এই অনবদ্য গান রচনা করেন। এই গানটির কথা ছিল ÒAllons enfants de la partie Le jour de glorie est. aribeÓ, এর বাংলা অর্থ হলো ‘পিতৃভূমির হে সব সন্তানেরা কোথায় রে তোরা, দেখ না চেয়ে কীর্তিলাভের সময় দুয়ারে উপস্থিত’। গানটির সুরও তিনি নিজেই দিয়েছিলেন এবং নাম রেখেছিলেন ‘রাইন বাহিনীর রণসংগীত।’ এদিকে ফরাসি বিপ্লব শুরু হলে অগণিত বিপ্লবীরা মার্সেলজে শহর হতে যখন সদলবলে রাজপ্রাসাদ আক্রমণের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল। তখন তাদের মুখে মুখে ছিল এ গানটি। পরবর্তীতে এটির ফ্রান্সের জাতীয় সংগীতরূপে স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তৎপর যে দেশের কথা উঠে আসে, সেটা হলো চেকোস্লোভিয়া। এ দেশের দুটো জাতি-চেক এবং স্লোভাক। চেকদের প্রিয় গান ছিল Kde domor i meej, যার অর্থ ‘কোথায় মোর সাধের দেশ’। অন্যদিকে স্লোভাকদের প্রিয় গান হলো Nad tatrou se Bilyska, এর বাংলা অর্থ হলো ‘শৈল মাথায় শিরে বিজলী জ্বলে’। যাহোক, পরবর্তীতে এই দুটো গানই এ দেশের দুটো জাতির জন্য জাতীয় সংগীতরূপে স্বীকৃতি লাভ করে। তৎপর যে দেশটির কথা আসে, সেটা হলো সুইজারল্যান্ড। এর জাতীয় সংগীত হলো তিনটি। উল্লেখ্য, এ তিনটি গান বসবাসরত জার্মান ও ফরাসি জনগণের ভাষাকে ঘিরে। কেননা এ দেশে দুটো ভাষা প্রচলিত বিধায় জার্মানভাষীদের রয়েছে একটি প্রিয় গান এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ফরাসিদের জন্য দুটি গান। এছাড়া রাশিয়ার জাতীয় সংগীতের নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল’। এদিকে সুইডেনের জাতীয় সংগীতের কথা হলো ‘সুইডেনের এ হৃদয় হতে’। তাছাড়া বেলজিয়ামের জাতীয় সংগীতের নাম হলো ‘এথনিকস ইন্সস’। এ গানটি জাতীয় গাথা থেকে প্রণীত হয়েছে। এছাড়া জার্মানদের জাতীয় সংগীতের নাম হলো- ÒDeutschuberalles, Uberalles in der welt,Ó -এর অর্থ হলো ‘পিতৃভূমিই জগতের সকলের সেরা’। যাহোক, এই সময়ে ইউরোপের প্রায় দেশে জাতীয় সংগীতের ক্ষেত্রে সাড়া পড়ে যায় এবং সেই সূত্র ধরে বিশ্বের সব দেশে একের পর এক জাতীয় সংগীত প্রবর্তিত হতে থাকে। বর্তমানে বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই, যার জাতীয় সংগীত নেই। অনেক দেশে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে যুগপৎ রণসংগীতও আছে। বাংলাদেশের রণসংগীত হলো চল্-চল্-চল্ .., যা নেওয়া হয়েছে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সন্ধ্যা’ নামক কাব্য গ্রন্থ থেকে। এই রণসংগীতটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে শিখা নামক একটি পত্রিকায়। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- প্রায় জাতীয় সংগীত রচয়িতার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট উদ্যোগী ব্যক্তিত্ব, অধিব্যক্তিত্ব, কবি ও লেখকদের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের আদি প্রেক্ষাপটে ছিল ভিন্ন মাত্রার।

বিগত ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে এটিএন নিউজের ডেক্স রিপোর্ট থেকে এই মর্মে শুনিলাম, অধুনা জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা বলেন; গুম থেকে মুক্তি পাওয়া সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা সাবেক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহ হিল আমান আজমি। তিনি উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের নেপথ্যে আছে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আওতায় দুই বাংলা এক করার গান। এই গানে সামগ্রিক জাতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় সংগীতের জন্য এই গান লেখেননি। লিখেছেন দুই বাংলা এক করার মানসে। তাই তাকে অযথা নেতিবাচকভাবে টানাহেঁচড়া না করাই শ্রেয়। যাহোক, জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা উঠে আসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোস্তাক আহমেদের সময়ে। তখন একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ‘চল্ চল্ ...’ এবং ফারুক আহমেদের ‘পাঞ্জেরি’ কবিতা, জাতীয় সংগীত হিসেবে সুপারিশ করেন। এদিকে দ্বিতীয় উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৭৯ সালে। সেই সময়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ; আমার শেষ বাংলাদেশ...’ এর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তৎপর তৃতীয় উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০১-২০০৬ সালে। কিন্তু পরিবর্তিত কোনো গানই আলো বাতাসের মুখ দেখেনি।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তন নিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক কথাই হচ্ছে। বস্তুত কোনো প্রপঞ্চে অপরিবর্তনীয় বলে কিছু নেই। সময়, অবস্থা ও উপযোগিতার আড়ালে পরিবর্তনশীল। যা জনগণ চাই, সেটাই হওয়া সমীচীন। তবে জাতীয় সংগীত যেহেতু সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সেহেতু সহজে পরিবর্তন করা হয় না বা যায় না। কেননা এটি পরিবর্তন করতে হলে আইনগত দিক দিয়ে দেশের পার্লামেন্ট তথা গণভোটের আবশ্যকতা অপরিহার্য। কিন্তু জনগণের দাবির মুখে পরিবর্তনশীল। যতদূর জানা যায়, তাতে প্রতিভাত হয় যে নেপাল, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরাক, আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, রুয়ান্ডা, লিবিয়া, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, জিম্বাবুয়ে, কঙ্গো, ঘানা ও নামিবিয়ায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তিত হয়েছে।

পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা.....’-র মতো খণ্ড চিত্র নয়। জাতীয় সংগীত এমন হওয়া বাঞ্ছনীয়, তাতে দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সামগ্রিক প্রকৃতি ও সত্তা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। তখন পাবলিক লাইব্রেরিতে চাহিদা অনুযায়ী বই খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ জাতীয় সংগীত নিয়ে লেখা একটি বই চোখে পড়ে। সেই সময়ে ওই বইটি নিয়ে পড়ি। পড়ার পর মনে হয় আমাদের জাতীয় সংগীত গান হিসেবে হৃদয় স্পর্শ করলেও জাতীয় সংগীতের বৈশিষ্ট্য দিক দিয়ে সঠিক নয় বলে প্রতীয়মান হয়; কিন্তু স্পর্শকাতরের আদলে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে এ কথা লিখতে সাহসী হইনি। তবে অনেক ফোরামে মৌখিকভাবে বলতে গিয়ে নাজুক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি। তথাপিও শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অর্থাৎ ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে (২১ ফেব্রুয়ারি) ‘প্রবন্ধ ভাই-বোন কবিতা’ শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করি। আর দেশ মাতৃকার টানে বিবেকের তাড়নায় এ বইয়ের ৩৯ পৃষ্ঠা থেকে ৪৬ পৃষ্ঠায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে সাহসী ভূমিকা পালন করি। শুধু তাই নয়, এই বইয়ের কয়েকটি কপি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্তও পাঠাই। অবশ্য অনেকেই বলেছিলেন, এই দুঃসাহসিক কাজ করার জন্য আমার নাকি বড় বিপদ হতে পারে; কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। কেননা সত্য সর্ব সময়ে সত্যই থাকে। আর সত্য হলো মহাপরাক্রমশালী।

লেখক: বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত


অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্বারাই আমলাতন্ত্রের সংস্কার সম্ভব

আপডেটেড ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৫:২০
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সময় যে আমলাতন্ত্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল তা-ই কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে চালু রয়েছে। আমাদের ছাত্রাবস্থায় এবং গত শতাব্দীর আশির দশকের গোড়ার দিকে সরকারি চাকরিতে যোগদান করে সরকারের আমলাতন্ত্রের উচ্চপদে সিএসপিদের পেয়েছি। আমলাদের অবশ্য পালনীয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- সততা ও নিষ্ঠা, বিধি-বিধানের যথাযথ পরিপালন, নিরপেক্ষতা ও যখন যে রাজনৈতিক সরকার দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে তাদের নীতি বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনে বস্তুনিষ্ঠ পরামর্শ প্রদান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন সত্ত্বেও আমলাতন্ত্রের রূপ ও কর্মপদ্ধতি নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত খুব একটা বদলায়নি।

বলতে গেলে আমলাতন্ত্রে অবক্ষয় শুরু হয় সিএসপি যুগের অবসানের পর বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে। আমরা দেখেছি, যে আমলারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কাজ করেছেন, তারাই খন্দকার মোশতাক ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এবং পরবর্তীতে স্বৈরশাসক এরশাদের সময়ও কাজ করেছেন। রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ওই একই আমলারা তৎকালীন বিএনপি সরকারের শাসন কার্যে সহায়তা করেছেন। তবে আমলাতন্ত্রকে রাজনীতিকীকরণ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে সাবেক সিএসপি সচিব মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ‘জনতার মঞ্চে’ যোগদানের মাধ্যমে।

২০০১-২০০৫ সালে বিএনপি শাসনামলে রাজনৈতিক সরকারের ধারণা হয়েছে ১৯৭৩ সালে যোগদানকৃত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারা যেহেতু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদের দ্বারা রিক্রুট, সেহেতু তাদের পূর্ণ আনুগত্য আওয়ামী লীগের ওপর। সে জন্য বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা (১৯৭৩ ব্যাচ) সিনিয়র কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। তৎকালীন সরকার বিএনপি সমর্থিত একটি অনুগত আমলা শ্রেণি বেছে নেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ইতোপূর্বে বিএনপি শাসনামলে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদেরকে পেছনের তারিখ থেকে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী পদোন্নতি দিয়ে বকেয়া বেতন-ভাতাসহ আর্থিক সুবিধা প্রদান করে। এ সরকার ধারাবাহিকভাবে তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পর ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে জয়লাভ করে চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, এ সরকারের সময় অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচন দেশে বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সরকারের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নিয়োজিত কতিপয় দলকানা আমলা, পুলিশ বাহিনী, নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগে নিয়োজিত প্রভাবশালী আমলারা ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনে সরকারকে সহায়তা করে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রেখেছে। স্বাধীনতার পর যোগদানকৃত সিভিল সার্ভিসের প্রতিটি ব্যাচে বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী- দুই ঘরানার কর্মকর্তা সৃষ্টি হয়। অনেক নিরপেক্ষ কর্মকর্তা শুধু বিএনপি আমলে জেলা প্রশাসক কিংবা মন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করার কারণে বিএনপি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আওয়ামী লীগ শাসনামলে আর পদোন্নতি পাননি। মেধা ও যোগ্যতা বাদ দিয়ে দলীয় আনুগত্যই পদোন্নতি পাওয়ার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। অনুরূপভাবে ১৯৯৬-২০০১ সালে জেলা প্রশাসক, মন্ত্রীদের একান্ত সচিব বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়োজিত কতিপয় কর্মকর্তা ২০০১- ২০০৫ সালের শাসনে পদোন্নতি বঞ্চিত হন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সমর্থিত কর্মকর্তারা ২০০৯-এর পর দ্রুত পদোন্নতি নিয়ে বিপরীত ঘরানার কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করেন। যত দিন যায় বিভেদ ততই বাড়তে থাকে। ব্যাচের সিনিয়রদের বঞ্চিত করে জুনিয়র কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেতে থাকেন। আমলাতন্ত্রের সততা, নিরপেক্ষতা এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা ক্ষয় হতে থাকে। তবে এর মধ্যেও আমলাতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা সততা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়-নীতি বজায় রাখেন।

এ প্রসঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে চাই। কিছুটা বিলম্বে হলেও ২০১০ এর ফেব্রুয়ারিতে আমি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে নিয়োজিত হই। সম্ভবত এপ্রিল অথবা মে মাসে অনুষ্ঠিত একটি সচিব সভায় কেবিনেট সচিব এম এ আজিজ কয়েকজন সচিবের সঙ্গে আমাকেও কিছু বলতে অনুরোধ করেন। বক্তব্য প্রদানকারী অন্য সচিবগণ স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। আমার বক্তব্যে আমি সরকার ও সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য গুরুত্বপূর্ণ ৩টি বিষয়ে আলোকপাত করি। প্রথমত আমি বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকাসহ বহুজাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশের কাছ থেকে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরি। সচিব হওয়ার আগে আমি ইআরডির অতিরিক্ত সচিব হিসেবে আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি। এ বিষয়টি অবতারণার কারণ, তখন কতিপয় মন্ত্রী বিশ্বব্যাংকসহ কতিপয় সংস্থার ঋণ গ্রহণের বিরোধিতা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিষয় হিসেবে আমি যুক্তিসহকারে সরকারি কর্মচারীদের অবসরের বয়স ৫৭ থেকে ৬০ বছর করার ইস্যুটি উল্লেখ করি। তৃতীয় ও সর্বশেষ যে বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম তা ছিল ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিভেদ ও অনৈক্য। পদোন্নতি, বদলি সব ক্ষেত্রেই মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন না করে দলীয় আনুগত্য ও ব্যক্তিগত পরিচিতি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে দলাদলি, অনৈক্য ও পারস্পরিক প্রতিযোগিতা হচ্ছে। যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন ও পদোন্নতি হচ্ছে না। এ অবস্থার অবসান প্রয়োজন। সিভিল সার্ভিসে বৈষম্যের অবসান করে ঐক্য ফিরিয়ে আনতে হবে মর্মে আমি মতামত তুলে ধরি।

শেষের বিষয়টি বলার সময় প্রধানমন্ত্রী সজাগ দৃষ্টিতে কিছুটা মুচকি হাসছিলেন, আমার ব্যাচমেট প্রধানমন্ত্রীর সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব পাশাপাশি বসা অবস্থায় বিরক্ত হয়ে পরস্পর কিছু একটা বলাবলি করছিলেন। সবশেষে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় তিনি বলেন, ‘সেতু বিভাগের সচিব কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করেছে। আশা করি এসব বিষয়ে জনপ্রশাসন উপদেষ্টা কিছু বলবেন।’ এইচ টি ইমাম বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বয়স বাড়ানোর ব্যাপারে এ মুহূর্তে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। ক্যাডার সার্ভিস বিষয়ে মোশাররফ যা বলেছে এ বিষয়ে তাকে ডেকে আমি বিস্তারিত আলাপ করব।’ সভার শেষে অনেক সচিব আমার কাছে এসে আমার সাহসী বক্তব্যের প্রশংসা করলেন। আমার ব্যাচের এক সহকর্মী বললেন, ‘তুমি এসব বলে নিজেকে বিপদে ফেলছ না তো? তুমি কিন্তু এখনো সচিব পদে রেগুলার হওনি।’ যাক, আমি দলবাজি, একদল আরেক দলকে বঞ্চিত করে পদোন্নতি নেওয়া, তুচ্ছ বা বিনা কারণে বছরের পর বছর কতিপয় কর্মকর্তাকে পদোন্নতি না দেওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেছি। শিল্প মন্ত্রণালয়ে সচিব থাকাকালে আমার ৪/৫ জন জুনিয়র সহকর্মীর অন্যায়ভাবে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে কেবিনেট সচিব ও জনপ্রশাসন সচিবকে আলাদা আলাদা চিঠি লিখেছি। একবার তৎকালীন কেবিনেট সচিব আমাকে বলেন, ‘স্যার, আমি চেষ্টা করেছি। ওরা (এসএসবির অন্য কয়জন প্রভাবশালী সদস্য) রাজি হয় না। ওরা দারুণ জেহাদি।'

ক্রমান্বয়ে দলবাজি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগ করলে পদোন্নতি আটকায় না। আমার অধীন এক কর্মকর্তার গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়- ‘অফিসার কোন দল করে না, কোন অভিযোগ নাই, তবে তার চাচা বিপক্ষ দলের সদস্য বা সাপোর্টার।’ তার পদোন্নতি আটকে গেল। আমি সিনিয়র কর্মকর্তাদের বেশ কিছু সমাবেশে বলেছি, এ অবস্থা চলতে থাকলে সিভিল সার্ভিসে ভবিষ্যতে মেধাবি ছেলেমেয়েরা আসবে না। দেখা গেছে, অতিরিক্ত সচিব থেকে সচিব পর্যায়ে পদোন্নতিতে প্রায় শতভাগ পছন্দের দলীয় অনুগত কর্মকর্তাদের নিয়োগ করার নিয়ম চালু হয়। ফলে ক্ষমতাসীন সরকারকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এসব সিনিয়র কর্মকর্তার সহযোগিতা ও সমর্থনও শতভাগ নিশ্চিত হয়।

আমার নিজের ক্ষেত্রে দীর্ঘ চাকরি জীবনে ১৯৮১ সাল থেকে সকল দলীয় এবং ২০০৭-২০০৮ দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চাকরিকালে সর্বদা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দেশপ্রেম ও সততার সাথে কাজ করেছি এবং মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশংসা কুড়িয়েছি। দলমত নির্বিশেষে যারা আমাকে চেনেন ও জানেন তারা এর সাক্ষী। আমার জানামতে আমলাতন্ত্রে বা সরকারি চাকরিতে এ ধরনের কর্মকর্তা অনেকেই আছেন। অসৎ ও ধান্দাবাজ কর্মকর্তার সংখ্যা কম হলেও তাদের দ্বারা যে ক্ষতি সাধিত হয় তা অনেক বড় হয়ে ধরা দেয়। দীর্ঘদিনের একদলীয় শাসনে আমলাতন্ত্রে যে কোটারি শ্রেণীর জন্ম হয়েছিল এরা সার্বিকভাবে দেশের আমলাতন্ত্রকে দুর্বল করেছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে জনগণের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে এ সরকার দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন, রাষ্ট্র সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ইত্যাদির কথা বলছেন। তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। এরা আমলাতন্ত্রে নিরপেক্ষতা, সততা ও যোগ্যতার অনুশীলন চালু করে ভবিষ্যতের জন্য একটি স্থায়ী কাঠামো তৈরি করবেন যাতে করে আমলাতন্ত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় কোনো বাধা না হয়ে বরং গণতন্ত্র চর্চায় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

রিক্রুটমেন্ট থেকে শুরু করে পদোন্নতি, বদলি- সব ক্ষেত্র থেকে দলীয় বিবেচনা আইন করে নিষিদ্ধ করা হলে পূর্বের ন্যায় আমলাতন্ত্র একটা সুদৃঢ় কাঠামোর ওপর দাঁড়াতে পারবে বলে আশা করা যায়। এতদুদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন:

১. কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।

২. যারা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য বা সমর্থক হতে পারবে না, এ ব্যাপারে মুচলেকা গ্রহণসহ পুলিশ ভেরিফিকেশনে নিশ্চিত হতে হবে।

৩. বর্তমানে ডাক্তার, কৃষিবিদ বা অন্য কোনো পেশাজীবী ক্যাডারে যেসব সরকার সমর্থিত বা বিপক্ষ দলের সংগঠন রয়েছে (যেমন ড্যাব, স্বাচিপ) সেসব বিলুপ্ত ও বেআইনি ঘোষণা করতে হবে।

৪. আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণের বিধিমালা এমন ভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে তারা ঘুষ, দুর্নীতি মুক্ত থেকে জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করে। তাদেরকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।

৫. সিভিল সার্ভিস প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালা এমনভাবে প্রণীত হবে যাতে আমলাতন্ত্রে সততা, দেশপ্রেম ও জনসেবার মত মানবিক গুণাবলি বিকশিত হয়।

ওপরের আলোচিত বিষয়গুলো ছাড়াও আমলাতন্ত্র সংস্কারে আরও অনেক কর্মপন্থা থাকতে পারে যা নীতিনির্ধারণী মহল বিবেচনায় নেবেন। মোট কথা, আমলাতন্ত্র হবে সম্পূর্ণ মেধা ও যোগ্যতাভিত্তিক পেশাদারি শ্রেণি যা সরকারের একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হবে।

লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্টদূত


অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে শ্বেতপত্র প্রণয়ন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রেজাউল করিম খোকন

বিগত সরকারের দেওয়া তথ্য, বক্তব্য ও পরিসংখ্যানে বক্তব্যে দেশের অর্থনীতির সঠিক চিত্র দেখা যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিগত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছে। এর মাধ্যমে বর্তমান সরকার উপলব্ধি করবে, কী ধরনের উত্তরাধিকারের অর্থনীতিতে তাদের কাজ করতে হবে। সেই ভিত্তিভূমি নিরূপণ করাই কমিটির কাজ। নব্বই দিনের মধ্যে এটি সরকারকে জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। শ্বেতপত্রে দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র থাকার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ, জাতিসংঘের টেকসই অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন ও বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে করণীয় বিষয়ের প্রতিফলন থাকবে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করবে।

শ্বেতপত্রের ধারণাটি এসেছে যুক্তরাজ্যের সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে। সরকারের দ্বারা প্রকাশিত কোনো নীতিগত নথি যেখানে সংসদীয় প্রস্তাবনা থাকে, সেগুলোই শ্বেতপত্র, যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে এভাবেই শ্বেতপত্রের বর্ণনা দেওয়া আছে। এর ফলে, অধিকতর আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়। উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটেনে পার্লামেন্ট রিপোর্টের প্রচ্ছদ থাকত নীল রঙের। যদি রিপোর্টের বিষয়বস্তু সরকারের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ হতো নীল প্রচ্ছদ বাদ দিয়ে সাদা প্রচ্ছদেই সেগুলো প্রকাশ করা হতো। সেই রিপোর্টগুলোকে বলা হতো হোয়াইট পেপারস। এ প্রথা কোনো প্রস্তাবিত নীতি বা জনস্বার্থ সম্পর্কিত সমস্যার সঙ্গে যুক্ত নয়। বরং কোনো রাজনৈতিক দলের সরকার পরিচালনার পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক শাসক দলের কুকীর্তির দলিল হিসাবে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দায় নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার ঋণ রেখে গেছে ১৮ লাখ কোটি টাকা। বিগত বছরগুলোতে মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অবস্থাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতি সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে কেমন অর্থনৈতিক অবস্থা পেল সেটি বুঝতে অর্থনীতির একটা ‘হেলথ চেক আপ’। শ্বেতপত্র প্রণয়ন বর্তমানে অর্থনীতি কোন অবস্থায় আছে, উত্তরাধিকারসূত্রে কী পাওয়া গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলছে সেগুলোকে চিত্রায়িত করার কাজটাই করবে। এটা স্বাস্থ্য পরীক্ষার মতো। এ ছাড়া ‘মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাও করা হবে। পলিসি বা নীতিগত দিকটা কীভাবে চলছে, সেই পর্যালোচনাও থাকবে শ্বেতপত্রে। তারা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করবেন না। তারল্যসংকট, নামে-বেনামের ঋণ, সঞ্চিতি ঘাটতি এসব বিষয়ে পর্যালোচনা করা হবে। আর যেন টাকা পাচার না হয়, টাকা পাচার করলে শাস্তি পেতে হবে, এমন কথা বলা থাকবে শ্বেতপত্রে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে আকৃতি ও প্রভাব বিবেচনায় বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্পও রয়েছে। কোনো কোনো মেগাপ্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, কোনোটির কাজ চলমান। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অর্জন হিসেবে এসব মেগা প্রকল্পের কথা বেশ জোরেসোরেই প্রচার করে আসছিল। তবে পদ্মা সেতুসহ মেগাপ্রকল্পগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি অভিযোগ করে আসছে সরকার বিরোধীরা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার স্বার্থে প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। সময় স্বল্পতার কারণে সব প্রকল্প বিশ্লেষণ করবে না। তবে তারা মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করবে। মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যদি কোনো একটি বিশেষ প্রজেক্টের ওপর মনোযোগ দিতে হয় তারা সেটা করবেন।

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে আকৃতি ও প্রভাব বিবেচনায় বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্পও রয়েছে। কোনো কোনো মেগাপ্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, কোনোটির কাজ চলমান। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অর্জন হিসেবে এসব মেগাপ্রকল্পের কথা বেশ জোরেসোরেই প্রচার করে আসছিল। তবে, পদ্মা সেতুসহ মেগাপ্রকল্পগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি অভিযোগ করে আসছে সরকার বিরোধীরা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার স্বার্থে প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। সময় স্বল্পতার কারণে সব প্রকল্প বিশ্লেষণ করবে না। তবে তারা মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করবে। মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যদি কোনো একটি বিশেষ প্রজেক্টের ওপর মনোযোগ দিতে হয় তারা সেটা করবেন। কয়েক মাস আগে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রথম দশ মাসের রপ্তানি আয়ের হিসেবে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য ধরা পড়ে। রপ্তানির বাৎসরিক হিসেবে প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি দেখানোর ঘটনা বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। সরকারি সংস্থাগুলো পরিসংখ্যান নিয়ে অর্থনীতিবিদদের বিভিন্ন সময় সংশয় প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। ফলে তাদের দেওয়া তথ্য-উপাত্তের ওপর ভর করে পাওয়া চিত্র কতটা সঠিক হবে তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। যা তথ্য পাওয়া গেছে অর্থাৎ, বিবিএস (পরিসংখ্যান ব্যুরো), ইপিবি এবং অন্য সংস্থাগুলোর কাছে যা আছে তার ভিত্তিতে অর্থনীতির একটা বস্তুনিষ্ঠ চিত্রায়ণ এখানে আশা করা যেতে পারে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিতে অর্থনীতিবিদ ছাড়াও জ্বালানি, অভিবাসন, উন্নয়ন ও সুশাসনের মতো বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। নীতি বিশ্লেষক বা বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে কমিটির সদস্যরা তাদের মতামত দেবেন। আগামী দুই মাসের মধ্যেই কার্যক্রম গুছিয়ে আনা হবে। খাতওয়ারি যেমন- জ্বালানি, প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যাংক, রাজস্ব খাত, অর্থ পাচার, বৈষম্য ও দারিদ্র্য বিমোচনসহ বিভিন্ন বিষয় সদস্যদের মধ্যে ভাগ করা হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি জ্বালানি খাতসহ বিগত বছরগুলোতে হওয়া বৈদেশিক ঋণ চুক্তিগুলো খতিয়ে দেখা হবে। বিগত বছরগুলোতে বিদেশি ঋণসংক্রান্ত চুক্তিগুলো যদি পাওয়া যায় তাহলে তা খতিয়ে দেখে অবশ্যই তারা মূল্যায়ন করবেন। কোন সদস্য কী বিষয়ে দায়িত্ব পালন করবেন, ঠিক করা হয়েছে। ইস্যুগুলো নিয়ে তারা ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে ও বিদেশেও যারা বিশেষজ্ঞ আছেন তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। দেশের উন্নয়নে ১০ খাতে শ্বেতপত্র কমিটি কাজ করবে। শ্বেতপত্র কমিটি কোন কোন বিষয়ে মনোযোগ দেবে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো- সাধারণ অর্থনীতি, সামষ্টিক অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাত, মেগাপ্রকল্প, কর আহরণ, পাচার হওয়া অর্থ, বৈষম্য, দারিদ্র্য বিমোচনসহ শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কাজ করবে শ্বেতপত্র কমিটি। তথ্যগুলো আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তুলনা করে যাচাই করা হবে। ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র কমিটি যাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে, তাদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ বিগত সরকারের রেখে যাওয়া সামগ্রিক অর্থনীতির শ্বেতপত্র তৈরির কাজকর্ম শুরু করেছে। কমিটির কাজের পরিধি হবে নির্দেশনামূলক; বাধ্যতামূলক নয়। সময়ে সময়ে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তথ্যের সঠিকতা যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এবং সবার মতামত ও পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে গঠিত কমিটি কাজ করবে। দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ, জাতিসংঘের টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন ও স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে করণীয় বিষয়ের প্রতিফলন তুলে ধরা হবে এই শ্বেতপত্রে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটা শ্বেতপত্র তৈরি করা দরকার। শ্বেতপত্র তৈরি করলে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে। এই মুহূর্তে অর্থনীতিতে যে জটিল পরিস্থিতি রয়েছে, তা জানার জন্য এবং পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যা হবে একটি নির্দেশিকা। শ্বেতপত্রের অনেক সুবিধা আছে। নতুন সরকার কোন অবস্থায় অর্থনীতিকে পেল, তার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন তাদের যেমন দরকার, ইতিহাসের জন্যও দরকার। শ্বেতপত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি মূল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আলোচনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সৃষ্টি হবে। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যা এক ধরনের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দেবে। কোনো কারণে সরকার যদি না করে তাহলে পেশাজীবী নাগরিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসতে হবে। তাই শ্বেতপত্র তৈরি করা জরুরি।

শ্বেতপত্রের অনেক সুবিধা আছে। নতুন সরকার কোন অবস্থায় অর্থনীতিকে পেল, তার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন তাদের যেমন দরকার, ইতিহাসের জন্যও দরকার। শ্বেতপত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি মূল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আলোচনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সৃষ্টি হবে। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যা এক ধরনের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দেবে। কোনো কারণে সরকার যদি না করে তাহলে পেশাজীবী নাগরিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসতে হবে। তাই শ্বেতপত্র তৈরি করা জরুরি। শ্বেতপত্র তৈরি করতে হলে অবশ্যই সরকারকে একটি কাঠামো দিতে হবে। কাঠামোর সঙ্গে সরকারের আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান অবস্থানপত্র তৈরি করবে। যেমন- ইতোমধ্যে দায়দেনা পরিস্থিতি নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্র রয়েছে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার অবস্থানপত্র লাগবে। পাশাপাশি অংশীজনের মতামত নিতে হবে। এখানে বেসরকারি খাত, বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং উন্নয়ন সহযোগীদের আনতে হবে। ব্যক্তি খাতের বড় ও মাঝারিদের পাশাপাশি ছোট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মতামত নিতে হবে। শ্বেতপত্র তৈরিতে এক মাসের বেশি সময় নেওয়া উচিত হবে না। অনেক কিছুই নির্ভর করবে সরকারের মেয়াদকালের ওপর। মেয়াদকাল যাই হোক না কেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি ডেটা কমিশন করতে পারে। তথ্য-উপাত্তের ক্ষেত্রে যেসব ব্যত্যয় হয়েছে এবং ঘাটতি আছে বা যে ক্ষেত্রে নতুন প্রয়োজন দেখা দিয়েছেÑ সেই জায়গাটা পরিষ্কার করবে। তথ্যের উৎপাদক, ব্যবহারকারী এবং মূল্যায়নকারী এই তিন পক্ষকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সরকারি তথ্য-উপাত্ত সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। পাশাপাশি সাংবিধানিক সুরক্ষা দিতে হবে। ব্যাংকিং এবং জ্বালানি- এ দুটি খাত অর্থনীতির ফুসফুসের মতো কাজ করে। ব্যাংকিং কমিশন তৈরি করা দরকার। কিন্তু এর পরিধি কী হবে- তা সরকারের সময়কাল ও সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করবে। যে সময় পর্যন্ত সরকার থাকবে, তার মধ্যে ব্যাংকিং খাতের রোগ নির্ণয় করার সময় পাবে নাকি পথ্য দেওয়া ও চিকিৎসা করার সময় পাবে এবং ফলাফল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারবে- তা আমরা জানি না; কিন্তু একটি কমিশন হওয়া উচিত। ব্যাংকিং খাতে তথ্য-উপাত্তের সঠিকতা যাচাই করা হবে এর প্রথম কাজ। খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে বড় কাজ। প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন পর্যাপ্ততার মতো বিষয়গুলোকে স্বচ্ছতার সঙ্গে যাচাই করতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে মালিকদের প্রতিনিধিত্ব এবং সময়কাল পর্যালোচনা করে বর্তমানের শিথিল অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আমানতকারীদের স্বার্থ বিঘ্নিত না করে একটি বাস্তবসম্মত ‘এক্সিট পলিসি’ করতে হবে। ঋণ অবলোপনের নিয়ম পর্যালোচনা করতে হবে। ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ হতে হবে স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে। যেসব শক্তিশালী শিল্পগোষ্ঠী বা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী ব্যাংকের মালিকানায় রয়েছে, তাদের মালিকানার প্রশ্নটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সুরাহা করতে হবে। এটি খুবই জটিল রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়। করপোরেট সুশাসনে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে, যার সঙ্গে মালিকানা ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত। সরকারি ব্যাংক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে দিতে হবে। অভিজ্ঞ, বিজ্ঞ ও পেশাদারদের সমন্বয়ে একটা ‘ব্লুরিবন’ কমিটি করা যেতে পারে, যারা ব্যাংকে পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী নিয়োগের সুপারিশ অনুমোদন দেবে। ব্যাংকের পাশাপাশি এ ধরনের কমিটি দুদক, নির্বাচন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে হতে পারে। এতে রাজনৈতিক অনুগ্রহে নিয়োগের চর্চা বন্ধ হবে। জ্বালানি খাতের জন্য একটা টাস্কফোর্স করতে হবে। ২৩ থেকে ২৪ হাজার মেগাওয়াটের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট কেন উৎপাদন করতে হচ্ছে এবং একই সঙ্গে আমদানি করতে হচ্ছে টাস্কফোর্স তার ওপর প্রাথমিক একটা প্রতিবেদন দিতে পারে। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও দায়মুক্তির বিষয়গুলোও সেখানে আসবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট


নিজের ভাবনা নিজের কাছে 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধ অছিমদ্দীন ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল আর হালের বাংলাদেশ আমলে ৫৩ বছর পার করেছেন। পরকালের পথে পা দিয়ে রেখেছেন তিনি। অছিমদ্দীন দেখেছেন কীভাবে তার সামনে ব্রিটিশরা তল্পিতল্পাসহ চলে গেছে এ দেশ ছেড়ে, দেখেছেন কীভাবে সংসার ভেঙেছে পাকিস্তানিদের। নিজে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশ স্বাধীন করতে মহান মুক্তিযুদ্ধে। অতীত তার কাছে এখন ধূসর, স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে আনন্দ-বেদনার সুখ সর্বনাশের মুহূর্তগুলো গুটিয়ে গেছে। অফুরন্ত অবসরের আয়নায় অছিমদ্দীন দেখেন তার ছেটোবেলা, কৈশোরকাল, ক্যাম্পাস জীবন, যুদ্ধের রণাঙ্গন, মনুষ্য কারসাজিতে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির বেসাতি, নীতি-নৈতিকতার নানান বেশভূষা। নব্বই বছরে কত কিছিমের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে তার। জমিদার বরকন্দাজের পর একবিংশ শতাব্দীর সূচনাপ্রহরে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ এই সময়ও সমাজে বয়স, বর্ণ, পর্যায় ও প্রকারভেদে নানান কিছিমের মানুষ এখনো রীতি পদ্ধতি, নীতি ও নিয়মে ঔপনিবেশিত। শ্রমজীবী কর্মক্লান্ত মানুষের পাশাপাশি অতিচালাক ফিটফাট ট্রেড ইউনিয়ন নেতা-কর্মী, শিক্ষাবিহীন শিক্ষিতের সমারোহের পাশে প্রযুক্তিপ্রখর মেধাবী মুখ, মুক্তবুদ্ধি শান্ত সমাহিত চিন্তা-চেতনার সারিতে সহসা মৌলবাদী চেহারার মানুষ, উন্নয়নকর্মীর পাশাপাশি নিজের আখের গোছাতে তৎপর এনজিও কর্ণধার, সন্ত্রাসীর ভয়ে আতঙ্কিত মানুষ, চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী আত্মোৎসর্গীকৃত সেই পুলিশ সার্জেন্ট, ষড়যন্ত্রের শিকার গৃহহীন মানুষ, আশ্রয়ণ প্রকল্পে হাসিমুখের মানুষ, বানভাসি মানুষ, নিঃস্বার্থ ত্রাণকর্মীর পাশে সুযোগ-সন্ধানী অসৎ উদ্দেশ্য অভিলাষী চোখের মানুষ, কোণঠাসা সৎ ও নিষ্ঠাবান চাকুরে, ধান্দাবাজ আর আত্মস্বার্থের শর্করাসমৃদ্ধ জনস্বার্থসেবী আমলা, অবিবেচক বাসের হেলপার, ট্রাকের মাতাল ড্রাইভার, নীল সাদা অধ্যাপক, একচোখা আঁতেল, রাজনৈতিক শিল্পী, ঋণখেলাপি, ব্রিফকেসবাহী নতুন শিল্পপতি, নকল সরবরাহকারী, উদ্ধত ছাত্রনেতার সামনে অসহায় অধ্যক্ষ, জামিনপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী, কুকুরের মাংস বিক্রেতা আর এসিডে দগ্ধ তরুণীর দেশে সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটার। সময় সমাজ ও সংসারে এত পরিবর্তন দেখার জন্য প্রভু নিরঞ্জন তাকে যে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছেন এটাই আশ্চর্য লাগে। বড় কৃতজ্ঞতা তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি।

চোখে মোটা চশমা পরেন তিনি। ইতোমধ্যে তিনবার চোখের ছানি কাটাতে হয়েছে, দুবার বড় অপারেশন, ৪৩-এর মন্বন্তরে, ৭১-এর রণাঙ্গনে, অতিমারী করোনাকালে মরণপথ থেকে ফিরে এসেছেন। চৌকষ ক্রিকেটারের মতো সাফল্যের ছক্কা মেরেছেন কয়েকবার, আবার বোল্ড আউট হয়েও সাজঘরে ফিরেছেন কখনো-সখনো। শ্রান্তি ও ক্লান্তির কোলে মাথা রেখে তন্দ্রায় গিয়েছেন আবার নতুন উদ্যমে জেগে উঠেছেন। অছিমদ্দীন তালপাতায় হাত মকশ করেছে, শ্লেটে পেনসিল ভেঙেছেন, কাগজে মুখে কালির আলপনা এঁকেছেন। এখন তিনি দেখেন তার নাতি-পুতিরা কম্পিউটারে লেখাপড়া করে। ক্যালকুলেটরে অঙ্ক কষে, নামতা মুখস্ত তারা করে না, বানান শেখা লাগে না তাদের, ব্রেনে অঙ্ক কষার কাজটা নিয়েছে কত রং-বেরঙের জীবন জলন্ত জীবন তরঙ্গ।

ব্রিটিশ আমলে অছিমদ্দীন দেখেছেন গোরা পুলিশ, খাকি হাফপ্যান্ট বেল্টপরা চৌকিদার-দফাদার, নায়েব কানুনগো, মোটা পেট পঞ্চায়েত, শৌখিন ধুতিপরা জমিদার বাবু, রুমি টুপিপরা মৌলবী, পৈতা লাগানো ব্রাহ্মণ আর বাংলার বার বধূ। কলের গানে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ কিংবা ‘নিমাই দাঁড়াবে’ জাতীয় গান শুনতে শুনতে রাতে ঘুমুতে যেত বালক অছিমদ্দীন। কলের গান থেকে টেপ, টেপ থেকে চিপসে এখন গান শোনা যায়, ইউটিউবে পুরো সিনেমা দেখা যায়। স্কুলে যাওয়ার তাড়া ছিল না, তবে কুটে পণ্ডিতের হাতের বেতের ভয় তো ছিলই। বিনা মূল্যে পাওয়া পাঠ্যবই, দামি গাইড বইয়ের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে লেখাপড়ার মান। অকাতরে বিদ্যাদানে ধণ্য গুরুমশাইরা এখন কোচিংয়ের কসাই।

সেই অছিমদ্দীন কি দেখছে তার ৫২ বছর বয়সি বাংলাদেশে? জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নীতি-নৈতিকতাবিহীন দলীয় কর্মীর প্রবেশের প্রথা কেন চালু হলো এই সৌহার্দ-সম্প্রীতির পারিবারিক, সামাজিক সংসারে? এখন সামান্য একটা চারিত্রিক সনদ আনতে গেলে ইউপি সদস্য পর্যন্ত পক্ষ বিপক্ষভেদে আচরণ করে। গ্রামের ভেতর দিয়ে এলজিইডি রাস্তা বানাবে সেখানে ভাগ বসাবে ক্ষমতাসীন দলীয় কর্মী, সেই রাস্তা ওজন সর্বস্ব ভারী যানবাহন চলাচল করে রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত করবে ইউপি চেয়ারম্যান, স্থানীয় ঠিকাদার এমনকি উপজেলা প্রশাসনের নাকের ডগায়, চোরে চোরে মাসতুতো ভাইয়ের মতো আচার-আচরণে স্থানীয় শান্তি নিয়ম-শৃঙ্খলার মাঠ হচ্ছে বেদখল। বড় রাস্তার শরীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য বড় বড় উপদেশমূলক (গতিসীমা, ওভারলোডেড গাড়ি, একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না) বিলবোর্ডের খরচটাও অকার্যকর অপচয় মনে হয় প্রতিদিন গড়ে ৭০-৮০ জনের পথে দুর্ঘটনায় মৃত্যুও সংবাদে। বড় শহরে ট্রাফিক সিগনাল ও জলে আবার হাততোলা ট্রাফিকের বিচার বিবেচনাহীন ব্যবসাও চলে। অছিমদ্দীনের গ্রামের বসতবাড়ির গা ঘেঁষে চলে গেছে পাকা রাস্তা। সে রাস্তায় নসিমন মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতিতে চলাচলে সেই রাস্তায় হাঁটতে ভয় পায় সবাই। অকাল মৃত্যুর ফাঁদ পেতে মানুষকে গৃহবন্দি করে তুলছে। ফিটনেসবিহীন, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চলছেই কেউ দেখার নেই। গরিবের দিন এনে দিন খাওয়ার উপার্জন আনে যে ভ্যানগাড়ি তা চুরি হলে থানায় কিংবা পরিষদে নালিশ বা উদ্ধার প্রার্থনাতেও পয়সা লাগে, পাছে প্রশাসন ও বাহিনী তার চৌদ্দগোষ্ঠী যাচাইয়ে নেমে বিব্রত করতে শুরু করবে। অছিমদ্দীন ভাবে পদে পদে এসব ঠেকা-বেঠোকায় পড়ার জন্য কি তারা স্বাধীন হয়েছে। দিন দিন ভালো মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে, পালিয়ে বেড়াচ্ছে। রাতের চাইতে ভোরবেলায় ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য বেড়ে যাচ্ছে। কে কাকে দেখবে? বিপুল উন্নয়ন দৈনন্দিন সুশাসন কেড়ে নিচ্ছে কি না, শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন নতুন সংস্কার এর নামে পঙ্গু করে দিচ্ছে না তো জাতিকে, দেশের অদক্ষ শ্রমিক যাচ্ছে বিদেশে আর প্রতিবেশী দেশের শিক্ষিত ও দক্ষরা এসে এদেশ থেকে রেমিট্যান্স নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে স্মার্ট বাংলাদেশে। সাগর-রুনির চার্জশিট দিতে বিলম্বের কারণ খোঁজা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে সহযোদ্ধা সহকর্মীরা। সবখানে সংশয়, সন্দেহ, অধৈর্য, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং কেনাবেচা চলছে তো চলছে।

জাপানের এক মন্দিরে ৩ বানরের মূর্তি আছে- একটি বানর মুখে আঙ্গুল দিয়ে, এক বানর কানে আঙ্গুল দিয়ে এবং অপর বানর চোখে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। বানর তিনটির একান্ত প্রতিজ্ঞা যে, তারা খারাপ কিছু শুনবে না, খারাপ কিছু বলবে না এবং খারাপ কিছু দেখবে না। অছিমুদ্দীন কোরআন শরিফের সুরা বাকারার ৭ম আয়াতে পড়েছে (যারা গাফিল তারা ফিরবে না) আল্লাহ তাদের অন্তকরণ এবং তাদের কানগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন আর তাদের চোখগুলো পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন। আবার গাফিল বা কাফিরদের বলা হয়েছে ‘তারা বধির, ম্ক ও অন্ধ সুতরাং তারা ফিরে আসবে না’। (বাকারা, আয়াত-১৮)। অছিমুদ্দীন ভাবে সত্যিই তো মুখের কথা কানে শোনা এবং চোখের দেখায় তারতম্য ঘটলে বিপদ নিজের জন্য, পরিবারের জন্য ও দেশের জন্য। অছিমুদ্দীন প্রায়ই দেখেন নানান বিষয় আশ্রয়ে আচার-আচরণে চলনে বলনে সবাই কেমন যেন খাপছাড়া ও সমন্বয়হীনতার উদাহরণ সৃষ্টি করেই চলেছেন। অছিমুদ্দীন শুনেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নাকি বলা আছে কোনো বন্ধুদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিনষ্ট হতে পারে এমন কোনো মন্তব্য বা বক্তব্য দেওয়া যাবে না। অছিমুদ্দীন ভাবেন নিজেদের দূর্বলতা অন্যেরা জানুক এটা অন্যায়কারীরা কথা বলুক তা মোকাবিলা করতে পরস্পরের দোষারোপে ও দুর্বৃত্তপনাতে ও কম যান না অনেকে। কারও মাজা ভেঙে দিয়ে তারপর বলা তার মাজা ভেঙে গিয়েছে। অছিমুদ্দীনের ছেলেবেলায় পড়া, মনে হয় বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় বা বনফুলের একটা গল্প -পড়েছিলেন দুই গ্রামের পণ্ডিত কে কেমন বুদ্ধিমান তার পরীক্ষা প্রতিযোগিতা হচ্ছে দুই গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে। দিনক্ষণ ঠিক করে সবাই দুই গ্রামের মাঝখানে বটতলায় দুই পণ্ডিতের পাণ্ডিত্বের পরীক্ষা/বির্তক সভার আয়োজন করেছে। এক পণ্ডিত প্রশ্ন করলে অন্য পণ্ডিত জবাব দিতে পারলে সবাই ঢাকঢোল পিটিয়ে আনন্দ হৈ চৈ করে। বিষয়টি অনেকটা টাই ব্রেকারে গোল দেওয়া বা ঠেকানোর কসরতের মতো। তো একপর্যায়ে এক পণ্ডি -এর বাংলা কি হবে জানতে চাইল অন্য পণ্ডিত সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল ‘আমি জানি না’। আর যায় কোথায় মূর্খ গ্রামবাসী হৈ চৈ করে উঠল পণ্ডিত মহাশয় এটা জানে না, তিনি নিজেই স্বীকার করলেন। কি আর বলা, সঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য পণ্ডিত মহাশয়ের পরাজয় ঘোষিত হলো। কেউ আসল কথার ধারেকাছে গেল না, গলাবাজির সরগরমে সবার যুক্তি ও বুদ্ধি লোপ পেল। আপন আচরি ধর্মে আস্থাবান অছিমুদ্দীন ইদানীং দেখেন তার চারপাশে এভাবে এখনো বোকা বানানোর চেষ্টা চলছে।

লেখক: সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআর-এর সাবেক চেয়ারম্যান


সৎচিন্তায় সৎকর্ম

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন

সততা মানব চরিত্রের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ। মানব জীবনে সততার প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা সীমাহীন। মানবসমাজের নিরাপত্তা, সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির ভিত্তি হলো সততা। যারা এ গুণ অর্জন করতে সক্ষম হন, মহান স্রষ্টা দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। সত্যিকার মুমিন সততাকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকেও ঊর্ধ্বে মনে করেন। কেননা তারা জানেন, সততা ইমান ও ইসলামকে পরিপূর্ণতা দান করে। সততা ও বিশ্বস্ততার প্রতি আহ্বান জানিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক’ (সূরা আত তওবা-১১৯)।

মহান স্রষ্টা মানবসমাজকে যে সীমারেখায় চলার নির্দেশ দিয়েছেন, এগুলোর মধ্যে সততা অন্যতম। সততা শুধু মুসলমান নয়, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই প্রয়োজন; সে ইসলামের অনুসারী হোক কিংবা অন্য ধর্মের, চাকরিজীবী কিংবা ব্যবসায়ী, পদস্থ কর্মকর্মা কিংবা সহকর্মী, শিক্ষক বা ছাত্র, ধনী হোক বা গরিব, পিতা-মাতা হোক বা সন্তান। মানবসন্তানের চলার পথে প্রতিটা বিভাগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হল সততা। এই গুণ মানুষকে উন্নত, আদর্শ ও নৈতিকতায় ভূষিত করে এবং এর মাধ্যমেই মানবজীবনের সম্পূর্ণতা অর্জিত হয়।

সততা ব্যক্তি চরিত্রে আরোপিত একটি বিশেষ গুণ। গুণটি যখন কোনো ব্যক্তির চরিত্রে ওপর আরোপিত হয় তখন তাকে বলা হয় সৎ। সততার অস্তিত্ব চিন্তায় ও মননে; ধ্যানে, জ্ঞানে ও কর্মে। সততার ব্যবহারিক অভিব্যক্তি চরিত্রের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। একজন ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র ভালো হলে তিনি সচ্চরিত্রের অধিকারী হন; সবাই তাকে গ্রহণ করেন। অন্যদিকে নৈতিক চরিত্র খারাপ হলে তিনি দুশ্চরিত্রের অধিকারী হন; সবাই তাকে বর্জন করেন। আর এ জন্যই বলা হয়, ‘দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য’।

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন কোরআনুল কারিমের বহু স্থানে সততা ও স্বচ্ছতা অবলম্বনকারী নারী-পুরুষের ফজিলত, আখিরাতে তাদের পুরস্কার, তাদের মর্যাদার ব্যাপারে বলেছেন। সততা কেবল সত্য কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সত্য কথা বলার সঙ্গে কাজ-কর্ম, আকিদা-বিশ্বাস সবগুলোতেই সততা অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর কেউ আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করলে সে নবী, সিদ্দীক (সত্যনিষ্ঠ), শহীদ ও সৎকর্মপরায়ন-যাদের প্রতি আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন-তাদের সঙ্গী হবে এবং তারা কত উত্তম সঙ্গী’। (সূরা নিসা আয়াত-৬৯)।

কিয়ামতের দিন শেষ বিচারে সততার কারণে জান্নাত মিলবে সত্যবাদীদের। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ বলবেন, এ সেদিন যেদিন সত্যবাদীগণ তাদের সত্যের জন্য উপকৃত হবে, তাদের জন্য আছে জান্নাত যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে; আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তার প্রতি সন্তুষ্ট; এটা মহাসফলতা’। (সূরা মায়িদা আয়াত-১১৯) আল্লাহ সত্যবাদীদের পুরস্কৃত করেন তাদের সত্যবাদিতার জন্য এবং তার ইচ্ছা হলে মুনাফিকদের শাস্তি দেন অথবা তাদের ক্ষমা করেন। সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গ লাভ করার প্রতি আহ্বান জানিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর সঙ্গে তাদের করা অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন, তাদের কেউ কেউ (অঙ্গীকার পূর্ণ করে) মারা গেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা তাদের অঙ্গীকারে কোন পরিবর্তন করেনি; যাতে আল্লাহ পুরস্কৃত করেন সত্যবাদীদের তাদের সত্যবাদিতার জন্য এবং শাস্তি দেন মুনাফিকদের যদি তিনি চান অথবা তাদের ক্ষমা করেন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’। (সূরা আহজাব আয়াত-২৩-২৪)

অনেক সৎ গুণের সমষ্টি হলো সততা। অসংখ্য হাদিসেও সততার গভীরতার বিষয়টি ফুটে উঠেছে। এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়তের বিশুদ্ধতা ও সততার সঙ্গে আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের প্রার্থনা করেন, আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদায় পৌঁছাবে, যদিও সে বিছানায় মৃত্যুবরণ করে’। (সহিহ মুসলিম)। অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি সততা আন্তরিকতার সঙ্গে শাহাদত লাভ করতে চায়, শহীদ না হলেও শহীদের মর্যাদা ও সওয়াব দেওয়া হবে’। (সহিহ মুসলিম)।

রাসূল্লাহ (সাঃ) আরও বলেন ‘তোমাদের উচিত সততা ও সত্যতা অবলম্বন করা। কেননা সততা ও সত্যতা মানুষকে পুণ্যের পথে পরিচালিত করে আর পুণ্য জান্নাতের দিকে পরিচালিত করে। কোনো ব্যক্তি যখন সত্য কথা বলে এবং সততা ও সত্যতার গুণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, তখন আল্লাহর কাছে সত্যবাদী সিদ্দিক হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে বিরত থাক। নিঃসন্দেহে মিথ্যা পাপের দিকে চালিত করে। পাপ জাহান্নামে নিয়ে যায়। ব্যক্তি যখন মিথ্যা বলে এবং মিথ্যায় মনোনিবেশ করে তখন তার নাম আল্লাহর কাছে মিথ্যাবদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়’। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যাবতীয় লেনদেনে সততার পরিচয় দিলে তাতে বরকত হয়। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যদি ক্রেতা-বিক্রেতা সত্য বলে এবং ভালো-মন্দ প্রকাশ করে দেয় তাহলে তাদের লেনদেন বরকতময় হবে। আর যদি উভয়ে মিথ্যা বলে এবং দোষত্রুটি গোপন করে তাহলে এ লেনদেন থেকে বরকত উঠিয়ে নেওয়া হবে, (মুসলিম, হাদিস: ১৫৩২)।

সততা অবলম্বনকারীদের জন্য মহানবী (সা.) সুপারিশ করবেন। সততার প্রশংসা করে মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমার সুপারিশ তার জন্য যে সাক্ষ্য দেবে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। এমন নিষ্ঠার সঙ্গে যে তার অন্তর তার মুখকে সত্যায়ন করবে এবং মুখ অন্তরকে সত্যায়ন করবে, (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৮০৭০)।

মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সৎ ও সত্যবাদী হবে এবং কখনোই মিথ্যাবাদী হবে না, এমনটা নয়। সততা চর্চার বিষয়। সততার বিপরীত মিথ্যাÑযা পাপ, অন্যায় ও অপরাধের মূল উৎস। মিথ্যার চর্চা ও প্রচলনের ফলে মুসলিম সমাজে নেফাক, খেয়ানত ও প্রতারণার মতো নৈতিক অধঃপতন ও বিকৃতি দেখা দেয়। পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দার মধ্যে সিদ্দিকীন বা সাদেকীনদের কথা নবীদের পর পর উল্লেখ করা হয়েছে। সাদেকিন (সত্যবাদী) পক্ষে উন্নতি হওয়ার লক্ষ্যে প্রত্যেক মুমিনেরই চেষ্টা-সাধনায় ব্রতি হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন সর্বোত্তম আদর্শ ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নবুয়ত লাভের অনেক আগেই তার সততা ও বিশ্বস্ততার সুনাম সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সব মানুষ তাকে আল-আমিন বা মুহাম্মাদুল আমিন অর্থাৎ পরম বিশ্বস্ত সত্যবাদী উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তিনি প্রতিটি কাজে সততা, সত্যতা ও বিশ্বস্ততা রক্ষা করতেন।

একটি দেশের সব শ্রেশি-পেশা নির্বিশেষে-রাজনীতিবিদ, বিচারক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকতা, ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী, পেশাজীবী, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী সবার জন্য সৎ হওয়া অপরিহার্য। নীতির সঙ্গে নৈতিকতা সম্পর্কিত। নীতির কাজ মূল্যবোধ নির্ধারণ করা, আদর্শের মানদণ্ড নির্ণয় করা। আর নৈতিকতা হলো নীতির বাহ্যিক রূপ। নৈতিকতা নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করে। নীতির স্থান কেবল ব্যক্তির চিন্তা-চেতনায়, বিবেক, মগজে। আর নৈতিকতা শোভা পায় ব্যক্তির আচার-আচরণে, কাজকর্মে। মূলত আমরা যা বলি, যে কাজ করি কিংবা যে ভাবাদর্শ মানি, তা আমাদের ভেতরকার লালনকৃত নীতি-নৈতিকতারই প্রতিচ্ছবি।

তাই প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য জীবনে সততা ও বিশ্বস্ততার ফসল আহরণে যত্নবান হওয়ার। কেননা সততা ও সত্যবাদিতা আখলাকে হাসানের অন্যরকম বৈশিষ্ট্য। যার মধ্যে এ গুণের সমাহার থাকবে সমাজের সব ধরনের লোক তাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করবে। সর্বোপরি আখিরাতে আল্লাহর কাছে এর বিনিময় লাভ করবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে।

লেখক: পুলিশ সুপার, নৌ-পুলিশ


স্মৃতি জাদুঘর ভাবনা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন

ছাত্র-জনতার বিপ্লবে দীর্ঘদিনের ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর যেসব অভাবনীয়, আনন্দের ঘটনা ঘটেছে এবং মুক্তির স্বাদ মিলেছে তন্মধ্যে অন্যতম ঘটনা হলো ৫ আগস্ট গণভবন জনতার দখলে যাওয়া। মানুষের কষ্ট আর ক্ষোভ এত বেশি ছিল, সেনাবাহিনী প্রথম দিকে গণভবনে ঢুকতে বাঁধা দিলেও পরবর্তীতে তারা সরে যায়। লাখো জনতা হুমড়ি খেয়ে পড়ে সাবেক স্বৈরাচার প্রধানের বাসভনের আনাচ-কানাচ দখলে। ভবনে প্রথম দিকে প্রবেশকারী অনেকে বলেছেন, নিয়মমাফিক দুপুরের রান্নাও হয়েছিল, ভাত ও তরকারি থেকে গরম ভাঁপ বের হচ্ছিল কিন্তু অপরাধীদের খেয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। রাষ্ট্রের ও জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বিলাসী জীবনের প্রতিচ্ছবি জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। জনগণের ক্ষোভের এ পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু লুটপাটের বিষয়টি প্রত্যাশিত ছিল না। শ্রীলঙ্কাতেও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনবিপ্লবের পর জনগণ রাষ্ট্রপতির বাড়ি দখল করে সুইমিং-এ গোছল করেছে, রাষ্ট্রপতির ব্যবহারের খাটে, চেয়ারে বসেছে; কিন্তু এগুলো নিজের মনে করে বাসায় নিয়ে যায়নি। ৫ আগস্টের বিপ্লবের বিজয়ের এ ঐতিহাসিক ঘটনা সারা বিশ্বের মানুষ লাইভ প্রত্যক্ষ করেছে। আমার অনেক বন্ধু যারা এ বিপ্লবে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে, তারা বিদেশ থেকে বলেছে, সবই ঠিক ছিল তবে লুঠতরাজের বিষয়টি বিশ্বদরবারে আমাদের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করেছে। তবে এ লুটতরাজের ফুটেজ ভালোভাবে দেখলে তা যে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা করেনি তা সহজেই বোঝা যাবে। শুনেছি পাশের জেনেভা ক্যাম্পের অনেক টোকাই বা ছেচকা চোরেরা এসব করেছে। কেউ কাউকে সেখানে বাঁধা দেওয়ার ছিল না। অধিকাংশ ছাত্র-জনতা এসব জিনিসে হাতই দেয়নি। তারপরও ভুলে যারা এ কাজ করেছে তারা ভুল বুঝতে পেরে গণভবনের ফটকে অনেক লুটের জিনিস ফেরত দিয়ে এসেছে। এগুলো এখনো সেভাবেই পড়ে আছে। আরেকটি ব্যাখ্যাও আমলে আনার মতো, মূল লুটপাট করেছে গণভবনের ভেতরে থাকা সাধারণ কর্মচারী ও শ্রমিকরা। তারা আসলে জানত কোথায় কি আছে। প্যাসিবাদের দুস্কৃতকারীরাও এরমধ্যে ছিল ইতোমধ্যে এর অনেক প্রমাণ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে।

যাই হোক বিপ্লবের পরবর্তী এক মাস এ ভবনে কোনো সংস্কার হয়নি। যেভাবে নিরাপত্তা দেয়ালসহ ভিতরে ভাঙচুর হয়েছে সেভাবেই রেখে দেওয়া হয়েছে। এক মাসপর উপদেষ্টা পরিষদ এখানে বিপ্লবোত্তর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে তথ্য ও আইসিটি উপদেষ্টা জানিয়েছেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্রুততম সময়ে গণভবনকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর করা হবে। সেখানে তুলে ধরা হবে বিগত ১৬ বছরের গুম, খুন, নির্যাতনের সামগ্রিক চিত্র। তার ভাষায়, অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা পাঁচ আগস্ট নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। জনগণের বিজয়কে ধারণ করে রাখার উদ্দেশ্যেই গণভবনের বর্তমান ভগ্নাবশেষ অক্ষত রেখেই জাদুঘরে রূপান্তর করা হবে যা জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। উপদেষ্টা বলেন, যেকোনো ফ্যাসিস্ট, স্বৈরচারী ও খুনি রাষ্ট্রনায়কদের কী পরিণতি হয়, তা পৃথিবীর বুকে একটা নির্দশন হিসেবে রাখার জন্য এই ভবনকে জাদুঘর করা হচ্ছে। আর জনগণই যে রাষ্ট্র ক্ষমতার আসল মালিক সেই বিষয়টিকে গুরুত দিয়ে গণভবনকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি জাদুঘরে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য একটি কমিটি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এ কাজ সম্পন্ন করা হবে। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও যারা জাদুঘর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি জাদুঘর করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের পরামর্শ নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়া বলেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি এবং বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের জনগণের ওপর অত্যাচার, গুম, খুনের স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখার জন্য গণভবনকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হবে। পরে জনসাধারণের জন্য তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। শিল্পী এবং জাদুঘর বিশেষজ্ঞ আর্কিটেক্টদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। পরিদর্শনকালে শিল্প উপদেষ্টা আজিজুর রহমান খান উপস্থিত ছিলেন।

উপদেষ্টার লক্ষ্য উদ্দেশ্য অবশ্যই মহৎ। তাছাড়া তিনি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কদের অন্যতম ছিলেন। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে তারা আন্দোলন চালিয়ে সব মত ও পথের মানুষকে একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। বিপ্লবের একমাস পর জাদুঘর করে এ স্মৃতি রক্ষার চিন্তা অবশ্যই ধন্যবাদ পাবে, তবে গণভবনইে স্মৃতিজাদুঘর করতে হবে বিষয়টি এমন নয়। বিপ্লবের নেতাদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে, বিপ্লবের স্মৃতি জাদুঘর কারও কাছে ইতিহাস রোমন্থন অন্যদিকে কারও কাছে ঘৃণা আর জিঘাংসা উদ্রেকের স্থান হিসেবে পরিগণিত হবে। আমার আশঙ্কা এভাবে জাদুঘর করলে যেমনটি উপদেষ্টা বলেছেন সাময়িকভাবে সবাইকে আন্দোলিত করলেও সময়ের বিচারে পরিস্থিতি উল্টে যেতে পারে। বরং এমনভাবে এর পরিকল্পনা করতে হবে যেন ফ্যাসিবাদের সমর্থকরা তা দেখে লজ্জিত হয় এবং তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে। মিসরের তাহরির স্কয়ারের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। যে তাহরির স্কয়ারের বিপ্লব মিসরে গণতন্ত্র এনেছিল এবং মুরসি সরকারকে ক্ষমতায় এনেছিল মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ঠিক তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবেই মুরসির পতন হয়েছিল এবং বিপ্লবের অনেক স্মৃতি ও গ্রাফিতি মুছে দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য আমার মনে হয় গণভবনে কারও বিজয়ের উচ্ছ্বাস আবার বিপরীতে ফ্যাসিবাদের সমর্থকদের কষ্টের কারণ হবে এবং সময়ের অপেক্ষায় থাকবে এটাকে নষ্ট করার। এ জন্য আমি মনে করি গণভবনে পাবলিক সংশ্লিস্ট কোনো স্থাপনা করে জনগণের প্রত্যহিক সেবার ব্যবস্থা করলে ভবিষ্যতে কোনো পরিবর্তন হলেও জনসেবার স্থানটি আর পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। এমন উদাহরণ আমাদের দেশে অনেক আছে। এ জন্য অনেকের সঙ্গে কথা বলে আমার যে ধারণা জন্মেছে তা হলো দ্রুত আবেগী সিদ্ধান্ত না নিয়ে উপদেষ্টার কথা অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করুণ এবং তারা দেশে-বিদেশের অভিজ্ঞতা দিয়ে একটি সুপারিশ করুক। এ সুপারিশ জাতির কাছে উন্মুক্ত করে তবেই আপনারা এ স্মৃতি জাদুঘর প্রকল্পে হাত দিন। প্রয়োজনে অনলাইনে সবার মতামত চাওয়া যেতে পারে। আমার মনে হয়, প্রস্তাবিত বিশেষজ্ঞ কমিটি শ্রীলঙ্কার ইন্ডিপেনডেন্ট স্কয়ার, ওয়াশিংটনের ‘সেকেন্ড ওয়াল্ডওয়ার ভ্যাটার্নস মেমোরিয়াল এবং ভিয়েতনাম ভেটার্নস মেমোরিয়ালকে তাদের কাজের স্যাম্পল হিসেবে নিতে পারে। এসব উদাহরণের মধ্যে আমার কাছে ভিয়েতনাম ভেটার্নসদের মেমোরিয়ালকে খুব যৌক্তিক ও আবেগ সৃষ্টিকারী মনে হয়েছে। সত্যিকারভাবে ফ্যাসিবাদের কালো অধ্যায় এবং বিপ্লবের স্বর্ণালী ইতিহাস ও শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে হলে প্রত্যেক শহীদের ইতিহাস ঐতিহ্য, তাদের জীবন বৃত্তান্ত, বিপ্লবে সংযুক্তির ইতিহাস সংযুক্ত করতে হবে যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত এখান থেকে ফ্যাসিবাদের শেষ করুণ পরিণতির শিক্ষা পায়। আরও যেসব বিষয় এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার চিন্তায় সংযুক্ত করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি: (১) ত্যাগ ও সংগ্রামের স্মরণ: মেমোরিয়াল বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাত্রদের সাহস, নিষ্ঠা এবং ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। এটি শহীদ ছাত্র-জনতাকে সম্মান জানাবে যারা এ ঐতিহাসিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের অবদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় থাকবে। (২) সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার প্রতীক: বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিজয় সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিজয়কে প্রতিনিধিত্ব করে। মেমোরিয়ালটি এ মূল্যবোধগুলোর প্রতীক হিসেবে থাকবে এবং বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রামের গুরুত্বের একটি স্থায়ী স্মারক হিসেবে কাজ করবে। (৩) ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা: মেমোরিয়ালটি একটি শক্তিশালী শিক্ষামূলক উপকরণ হিসেবে কাজ করবে, যা ইতিহাসের সঙ্গে একটি বাস্তব সংযোগ তৈরি করবে। এটি এমন একটি স্থান হবে কেবল বাংলাদেশের নয় বরং সারা পৃথিবীর শিক্ষার্থী, গবেষক এবং সাধারণ মানুষ আন্দোলন, এর কারণ এবং সমতাপুর্ণ সমাজ গঠনে এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারবে। (৪) সামাজিক অংশগ্রণের অনুপ্রেরণা: ছাত্রজোটের সফলতা তুলে ধরে মেমোরিয়ালটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সামাজিক কার্যক্রম, সামাজিক আন্দোলন এবং মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারে। (৫) সমষ্টিগত স্মৃতি সংরক্ষণ: একটি জাতির সমষ্টিগত স্মৃতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মেমোরিয়াল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে অতীতের সংগ্রাম ও বিজয়কে প্রতিফলিত করে এমন একটি পাবলিক স্পেস রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে অর্জিত শিক্ষা প্রাসঙ্গিক থাকে। (৬) জাতীয় গৌরব ও ঐক্য বৃদ্ধি: বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রদর্শন করে একটি মেমোরিয়াল জাতীয় গৌরব ও ঐক্যের অনুভূতি তৈরি করতে পারে। এটি নাগরিকদের মনে করিয়ে দেবে যে সংকল্প ও ঐক্যের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। (৭) গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করা: বৈষম্যমূলক প্রথার বিরুদ্ধে বিজয়কে স্মরণ করে মেমোরিয়াল গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ইনক্লোসিভ সোসাইটি এবং প্রতিবাদের অধিকারের মতো মূল্যবোধগুলোকে পুনঃমূলানের সুযোগ করে দেয় যা একটি সুস্থ, প্রাণবন্ত সমাজের ভিত্তি। একটি নিরপেক্ষ স্থানে একটি সার্বজনীন স্মৃতি জাদুঘর বা স্মৃতি মেমোরিয়াল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতিকে সর্বদা সজাগ রাখার এ মহতী উদ্যোগে উল্লিখিত পরামর্শগুলোকে আমলে নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেখক: সমাজচিন্তক, ইন্টারফেইথ বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়


পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় সবার সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মিজানুর রহমান

এ বছর গোমতীতে প্রচুর পানি বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন অযত্নে থাকার কারণে বাঁধের অবস্থা খুবই দুর্বল ছিল। পানি বৃদ্ধি পেতে পেতে বাঁধে যখন পানি উপচে পড়ার উপক্রম, তখন নদী দুপাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে চরম উৎকণ্ঠা বেড়ে যাচ্ছিল। স্থানীয়রা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে বাঁধ মেরামতে শরিক হতে দেখা যায়। এ কাজটি যখন এরা করছিল প্রতিনিয়ত নদী ভাঙন নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছিল। অবশেষে ২২ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টায় কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া গ্রামে হঠাৎ করে নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। বাঁধের পরিধি বিস্তৃত হতে হতে প্রচণ্ড বেগে লোকালয়ে পানি ঢুকে গ্রামকে গ্রাম ভাসিয়ে দেয়। মানুষের স্বপ্ন নিমিষে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। গোমতীর সঙ্গে সঙ্গে ঘুংঘুর নদী ও সালদা নদীর বাঁধও ভেঙে বিস্তৃর্ণ এলাকা প্লাবিত করে।

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয়েছে কুমিল্লার ১৪টি উপজেলা। পানিবন্দি অবস্থায় ১৩দিন এলাকাটি থাকার পর ধীরে ধীরে পানি কমতে শুরু করে। দৃশ্যমান হতে দেখা যাচ্ছে রাস্তার ক্ষত। এরই মধ্যে রাস্তাঘাট বাড়ির উঠান থেকে পানি সরে যাওয়ার পর অনেকেই ফিরতে শুরু করেছেন নিজ বসতবাড়িতে। ঘরের উনুনটা তলিয়ে গেছে। রান্না ঘরটার অবস্থা যাচ্ছে তাই। প্রতিটা বসতবাড়ি দুরগন্ধময় পরিবেশ। পচা আবর্জনা কর্দমাক্ত হয়ে একাকার। এর প্রভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। থাকার ঘরের ধ্বংসের পাশাপাশি গ্রামবাসীর কৃষি খাত ও মাছের ঘের প্রাণিসম্পদ, রাস্তাঘাট ও ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মিলিয়ে কুমিল্লা জেলাজুড়ে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে সবার ধারণা। জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, এবারের বন্যায় জেলার মোট ২৩ হাজার ৪২টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মৎস্য জমির আয়তনে এর পরিমাণ ৫ হাজার ৮৩৫ দশমিক ৬১ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত এসব খামারে ২৫ হাজার ৫৩৮ দশমিক ৫০টন ফিন ফিশ ১০দশমিক ২৮ টন চিংড়ি মাছ, ১০কোটি ১৭ লাখ সংখ্যক পোনা মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে আরও করুণ অবস্থা। বুড়বুড়িয়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী মিথিলাপুর গ্রামের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির এমএসসি পাশ। ঢাকার একটি নামীদামি কোম্পানিতে চাকরি করা অবস্থায় স্টোকে প্যারালইসড হয়ে ডান সাইডটা তার একদম অবশ হয়ে যায়। ধার-কর্য করে বাড়িতে হাঁস-মুরগি খামার, গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প ছাড়া ও তিনটি পুকুরে মৎস্য চাষ করে। এগুলো আয়ের নির্ভরতাই ছিল তার সংসার । বন্যায় তার তিনটি পুকুরই তলিয়ে যায়। প্রায় ৫ লাখ টাকার মাছ বন্যার পানিতে ভেসে যায়। এ ক্ষতিতে লোকটি এখন পাগলপ্রায়। ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা তার জন্য খুবই কষ্টকর। এ রকম শত শত হুমায়ুন কবিরের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ এবারের বন্যায় ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এদের পাশে সরকার না দাঁড়ালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। মোট জাতীয় উৎপাদনেও ঘাটতি দেখা দেবে।

পুরো জেলায় ৫০০ কোটি টাকার মৎস্যসম্পদ বাবদ ক্ষতি হয়েছে। খামারিরা নিঃস্ব হয়ে গেল। কুমিল্লাতে মৎস্য উৎপাদনের জন্য পানি ও আবহাওয়ার দিক দিয়ে অত্যন্ত উপযোগী । তাই তো কৃষকরা ধান চাষে লাভবান হতে না পেরে মৎস্য চাষে বেশি উৎসাহিত হচ্ছেন। দিন দিন মৎস্য খামারির সংখ্যা বেড়েই চলছে। তাছাড়া মিঠা পানিতে মাছ উৎপাদনে সারাদেশে কুমিল্লার অবস্থান দ্বিতীয়। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে শুধু দাউদকান্দি উপজেলায় প্লাবন পানিতে উৎপাদিত মৎস্য দেশের এক দিনের মৎস্যের যোগানে সক্ষম । এই খাতে লাভবান হওয়ার কারণে সেখানে ধান চাষের চেয়ে মৎস্য চাষে অধিক পরিমাণে উৎসাহিত হচ্ছে ।কুমিল্লা জেলায় ২০২১- ২২ অর্থবছরে মাছের চাহিদা ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৫৭ মেট্রিক টন।উৎপাদন হয় দুই লাখ ৮৪ হাজার ৪১ মেট্রিক টন। উদ্ধৃত্ত ছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ১৯৪ মেট্রিক টন। ঢাকার বাজারে কুমিল্লার মাছেই বেশি সরবরাহ হয়। মৎস্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ও কুমিল্লা ভালো ভূমিকা রাখছে।আশে পাশের জেলার চাহিদা মিটিয়ে গত অর্থ বছরে কুমিল্লা থেকে ৫০ মেট্রিক টন মাছ রপ্তানি হয় যার মূল্য ১ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। মৎস্য চাষে অনেক পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন ও হয়েছে। রোপা আমনের বীজতলা, রোপা আমন ধান, আখের চাষ, শাকসবজি চাষাবাদে ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছে। কুমিল্লা জেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ১লাখ ৩৫ হাজার ২৩৮ হেক্টর। যার মধ্যে ৬৩ হাজার ৯৭৪ হেক্টর জমি ক্ষতি হয়। যা টাকায় মূল্য হলো ৮০০ কোটি টাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বলেন এবারের বন্যায় জেলায় কৃষক প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।।আমরা এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষি প্রণোদনা, বিনামূল্যে সার ও বীজ বিতরণ ক্ষুদ্র ঋণ নেয়ার সহায়তা বিনামূল্যে কৃষি সেবা ও সার্বিক সহযোগিতা করবে। এবারের বন্যায় জেলায় গবাদি পশুর চার হাজার খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২ লাখ ৯ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির গবাদি পশুর ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত গরুর সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার ১৬ টি মহিষ,৩০ হাজার ছাগল, ৭০০ ভেড়া। ক্ষতিগ্রস্ত পশু থেকে গরু মারা গেছে ৩৫টি,০৩টি মহিষ, ১৭১টি ছাগল,৭টি ভেড়া। এ ছাড়া পোল্ট্রি ও হাঁস মুরগির খামার আছে ১৩ লাখ ৬৬ হাজার, সবগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মারা গেছে ১০ লাখ ২২ হাজার মুরগি ২ হাজার হাঁস। বন্যার সময় প্রচুর ত্রাণ বিতরণ হয়েছে। কোন কোন আশ্রয় কেন্দ্রে তিন বেলাই খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বুড়িচং উপজেলার সোনার বাংলা কলেজে আশ্রয় কেন্দ্রে বানভাসি ৬০০ জন আশ্রয় নিয়েছিল, এদের সঙ্গে ১৮০টি গরু ছাগল অবস্থান নিয়েছিল। সবাইকে তিন বেলা আহার ২৩ শে আগষ্ট থেকে ০১/০৯/২৪ তারিখ পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করা হয়েছে। বিষয়টি ওই কলেজের প্রিন্সিপাল সেলিম রেজা সৌরভ তার দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে করতে সক্ষম হয়েছে। এই আশ্রয় কেন্দ্রে সেনাবাহিনীর প্রধান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পরিদর্শনে এসে ত্রান বিতরণে সন্তোষ প্রকাশ করেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যেভাবে ত্রান কাজের পূর্ণতা পেয়েছে তেমনিভাবে পূর্ণবাসন ক্ষেত্রে ও হওয়া দরকার। ইতোমধ্যে সে নমুনা ও আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং আশাবাদী ।

পুনর্বাসনে নিজ উদ্যোগে যারা এগিয়ে এসেছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সর্ব প্রথম নিতে হয়। ছাত্ররা আমনের চারা উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। এরি মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ একর নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ একর, চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ৪ একর লক্ষীপুরে ২ একরসহ মোট ১২ একর জমিতে চারা উৎপাদন করা হচ্ছে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করার জন্য। তাদের দেখাদেখি দিনাজপুরের হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ লাখ সবজির চারার পাশাপাশি ৫ একর জমিতে ধানের চারা রোপন করছে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করার জন্য। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এর মৎস্য বিজ্ঞান ও একুয়াকালচার ও মেরিন সায়েন্সের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে মাছের পোনা উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে নিজেরা। ইতোমধ্যে তারা কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করেছেন।এদের মাঝে তেলাপিয়া ও কার্প মাছের পোনা বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। শুধু ছাত্ররা উদ্যোগ নিলে হবে না স্কুল কলেজ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিষ্ঠানে বীজতলা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে তৈরি করে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ বিতরণ করার সুযোগত এখনই। সরজমিনে দেখা কিছু কিছু এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে যেমন কুমিল্লা সদর উপজেলার বানাসূয়া গ্রামের বন্যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তাগুলো প্রবাসীদের আর্থিক সাহায্য নিয়ে মেরামতের কাজে হাত দিয়েছে। সেটা অন্যান্য গ্রামের ক্ষেত্রেও হতে পারে। সরকারের জন্য অপেক্ষা না থেকে মেরামতের কাজটা ও এভাবে করা হয় তাহলে সরকারের ওপর চাপ কমবে।

সরকারের পক্ষ থেকে মৎস্যজীবীদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।অনেকের গৃহ নেই তা মেরামতের জন্য সহায়তা করতে হবে।আবার যেন শস্য উৎপাদন করতে পারে প্রয়োজনীয় সার্বিক সহযোগিতা করা না হলে কৃষকরা দাঁড়াতে পারবে না। বন্যা শেষ হলে ও জমির পানি অত্যন্ত ধীরগতিতে নামছে। কারণ খালগুলো ভরাট ও দখল হয়ে গেছে সেজন্য পানি নামছে না। পানি না নামলে আমন রোপন করা সমস্যা হবে বলে কৃষকরা জানান। অতি দ্রুত বেদখলকৃত খাল উদ্ধার করে সরকারকে খাল খননের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রবল বর্ষণে পানি ধারণ ক্ষমতার জন্য খালগুলো গভীর হলে জমির পানি অনায়াসে খালে নেমে আসবে। নতুবা পানি নিয়ে আবার কৃষকদের সমস্যায় পড়তে হবে। বন্যার্তের মধ্যে ত্রাণ নিয়ে দেশের সবাই মিলে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও এমনটি হলে কৃষকরা আবার প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পাবেন।

লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট

বিষয়:

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড.আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী

দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নগ্ন দলীয়করণ, অনিয়ম ও সীমাহীন দুর্নীতির কারণে শিক্ষাকার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। এই সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে এদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। তাই একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের মাধ্যমে এদেরকে চিহ্নিত করে আইনের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আরেকটি কথা না বললেই নয়, আমরা জানি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয় খোলা-বন্ধের কোনো এখতিয়ার নেই। গত ১৬ জুলাই আবু সাঈদকে হত্যার পর শেখ হাসিনার নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ জন্য ইউজিসি প্রজ্ঞাপন দেয়। গত ৫২ বছরে ইউজিসি এ কাজ করে নাই। এ ঘটনার বিচার হওয়া প্রয়োজন। আমার ধারণা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নির্দেশ ফ্যাসিবাদীদের দোসরদের নির্দেশে হয়েছে। যে করেছে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। এটা যদি ফ্যাসিবাদের নির্দেশে হয়ে থাকে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এটা স্বৈরশাসকের নির্দেশে করে থাকলে সেটা জাতিকে জানাতে হবে এবং যিনি বা যারা নিয়মবহির্ভূতভাবে এ কাজটি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

শাস্তি লঘু বা গুরু হোক দিতে হবে। ইউজিসিতে যেসব অনিয়ম হয়েছে এগুলোর তদন্ত করতে হবে এবং দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব অনিয়ম হয়েছে সেগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তদন্ত বা সরকার উচ্চপদস্থ তদন্ত করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে পারে।

ইউজিসির বড় কাজ বাজেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বরাদ্দ দেওয়া। কিন্তু তাদের প্রধান কাজ কারিকুলাম দেখা। এটা যুগোপযোগী, কার্যকরী, গণমুখী কি না। যে জ্ঞান কাজে আসে না সে জ্ঞান দিয়ে আমি কী করব? গবেষণার জন্য টাকা দেওয়া আরেকটা কাজ। এই প্রতিষ্ঠানের দেখতে হবে এ গবেষণার মূল্যায়ন কী? এটা সমাজের কী কাজে লাগল? ইউজিসিকে আরও সক্রিয় হতে হবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন যেন আর না দেয়। ডিগ্রি বেচাকেনা করা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বন্ধ করতে হবে।

এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। এই ১৬ বছরে নোংরা দলীয়করণ করে লেখাপড়া একরকম শেষ করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ জ্ঞানচর্চা। এটা আর হয় না। এখন হয় দলচর্চা। বিগত ১৬ বছরে যারা হাসিনার শাসক দলে ছিল তাদের উন্নতি হয়েছে। তারা লেখাপড়া না করে ডিগ্রি পেয়েছে। শিক্ষকদের নিয়োগ-পদোন্নতি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ হয় নেই। এখন কঠোরভাবে যোগ্যতাকে মাপকাঠি হিসেবে ধরতে হবে। আর ছাত্ররা যেন হলে সহাবস্থান করতে পারে। যারা অপরাধী তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, জেলে পুরতে হবে। এই পরিবেশ ফেরাতে হলে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা জরুরি। ছাত্রদের প্রতি অনুরোধ তোমরা এখন ক্লাসে ফিরে যাও। তোমরা একটা মহৎ অর্জন করেছো। তোমরা দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন করেছো। তোমাদের জ্ঞানচর্চা করতে হবে। তোমাদের এই অর্জন যেন বৃথা না হয়। আবার যদি প্রয়োজন হয় আবারও আন্দোলন করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও ক্লাস কিন্তু বন্ধ হয় নাই। যেখানে বোমা পড়েছে সেখান থেকে স্কুল-কলেজ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। একটা-দুইটা করলে তো হবে না। হয়তো অনেকে বলবে শিক্ষা কমিশন করে শিক্ষানীতি করতে হবে। এটা একটা দুরূহ কাজ। এটা না করে সরকার যেটা করতে পারে যে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টগুলো আছে এগুলো পর্যালোচনা করে কয়েকটা সুপারিশ করতে পারে। যেগুলোর কয়েকটি এক্ষুণি ইমপ্লিমেন্ট করতে পারে। একটা সুপারিশ আছে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা। এটি বাস্তবায়ন করতে পারে। কারিগরি ও গণমুখী যে সুপারিশ আছে এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে। এগুলো করতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

পাবলিক সার্ভিস কমিশনতো (পিএসসি) দুর্নীতির কারখানা। প্রত্যেকটা পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে। এটা বিলুপ্ত করে নতুন করে গঠন করা উচিত। এটা পুরোটা দুর্নীতিগ্রস্ত। এটার সংস্কার শুধু নয়, এটার মূলোৎপাটন করা উচিত। শুধু তাই নয়, টিক মার্ক দিয়ে মেধার যাচাই করা যায় না। ভাষা জ্ঞানের ওপর জোর দেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

গত ১৬ বা ১৮ বছরে একটা দেশের সব প্রতিষ্ঠান একে একে ধ্বংস করা হয়েছে। মানুষের বাক-স্বাধীনতা হরণ ও নির্বাচন চুরি করা হয়। যার ফলে গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়। আরবের ‘আইয়্যামে জাহেলিয়াত’ যুগের মতো অবস্থা ছিল। হত্যা, গুম, খুন, ডাকাতি, চুরি, ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার লুট এগুলো করে দেশকে সর্বস্বান্ত করে ফেলা হয়। এরা ছিল লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণি। পরিকল্পিতভাবে দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে নিয়ে যায়। সম্পদ বিদেশে পাচার করায় দেশের মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হয়। ভারতের কথা যদি বলি আদানি, টাটা, ডাল মিয়া এরাও লাভ করে, এরাও শ্রমিকদের বঞ্চিত করে কিন্তু তারা তাদের পুঁজি দেশে বিনিয়োগ করে। হাসিনার লোকদের এদের কোনো জাতীয় চরিত্র নেই। এর ফলে মানুষ বাজারে গিয়ে হাঁসফাঁস করে। এই কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবেই কমাতে পারে নাই। এ জন্য মানুষ মুক্তির প্রতীক্ষা করেছে। এ কারণেই মানুষ ছাত্রদের আন্দোলনে যুক্ত হয়, মুক্তি চায়। ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই বলেছিল, আমিই রাষ্ট্র, আমি যা বলি তাই আইন। হাসিনার শাসনও আইন ছিল। হিটলার পতনের তিন বছরের আগে বলেছিল, আমরা (জার্মানরা) বিশ্বকে এক হাজার বছর শাসন করব। হাসিনা যখন বলে, হাসিনা পালায় না। এই কথা বলার তিন সপ্তাহ পরে পালিয়ে গেল।

সমাজে বিশৃঙ্খলা দূর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এই কাজ শুরু করেছে; কিন্তু পুলিশ প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। দ্বিতীয় পরামর্শ, যে গণহত্যা হয়েছে যত ছাত্র আত্মাহুতি দিয়েছে স্বৈরাচার থেকে মুক্তির জন্য তাদের হত্যার বিচার করতে হবে। এটাকে প্রায়রিটি দিতে হবে। হাসিনাসহ সব হত্যাকারী ও লুটেরাদের বিচার করতে হবে। তৃতীয়ত, পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কারণ ড. ইউনূস বিশ্বনন্দিত মানুষ। তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আছে। আমি আশাবাদী কারণ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান। সব সম্ভব নয় কিন্তু একটা অংশ তো ফিরে আসবে।

সরকার তো আহত-নিহতদের সাহায্য করছে। আমরা যারা শিক্ষক তারা মিলে একটা ফান্ড সৃষ্টি করতে পারি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা যদি আসে তাহলে আমরা এই ফান্ড গঠন করতে চাই। এই ফান্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, সচিব বা ইউজিসি চেয়ারম্যান তাদের কাছে থাকবে। ছাত্ররা যদি চায় আমি দায়িত্ব নিয়ে একটা ফান্ড করতে চাই।

লেখক: সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক রাষ্ট্রদূত


banner close