বাংলাদেশ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে ইতোপূর্বে ঘটে যাওয়া বহু তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট, পরিণতি ও অর্জনের ঘটনাগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, যেকোনো ন্যায়ভিত্তিক যৌক্তিক রাজনৈতিক আন্দোলন সাফল্য অর্জন করেছে, কখনো ব্যর্থ হয়নি। এসব আন্দোলন-সংগ্রামের প্রকৃতি ও আদর্শগত অবস্থানের মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও অবৈধ দখলদারী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এগুলো সর্বদাই বিজয়লাভ করেছে। বিশ্বের প্রাচীন ইতিহাসেও স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে। কোথাও বিদ্রোহ সফল হয়েছে, কোথাও আবার ব্যর্থ হয়েছে। সাফল্য ও ব্যর্থতার ধারাবাহিকতায় আমরা দেখেছি আধুনিককালে কোনো স্বৈরশাসকই গণ-অভ্যুথানের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তার মসনদ রক্ষা করতে পারেনি।
সাম্প্রতিককালের প্রসঙ্গ বাদ দিলেও গত ১০০ বছরে আমরা অতিশয় কদর্যভাবে বিদায় নিতে দেখেছি বেশ কয়েকজন মহাপরাক্রমশালী স্বৈরশাসকের। এসব বহুনিন্দিত স্বৈরাচার আত্মমহিমায় এতই মগ্ন ছিলেন যে, কখন তারা জনতার রুদ্ররোষে উপলক্ষ্যের মতো ভেসে গেছেন তারা নিজেরাও বুঝতে পারেননি। হিটলার শেষ মুহূর্তে ভেবেছিলেন, জার্মান আর্যজাতির নীলরক্ত কখনো পরাভূত হবে না। কুখ্যাত এই ফুয়েরারকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল। তারই এক সহোদরসম স্বৈরমিত্র মুসোলিনীর পরিণতি আমরা সবাই জানি। মার্কোজ পলায়ন করেন তার ‘প্রিয় দেশবাসীর’ হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। রক্ষা পাননি ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কো।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার অনুকম্পা পেলেও স্বৈরতন্ত্রের অনিবার্য পরিণতি ডেকে এনেছে হত্যার মহামিছিল, দুর্ভিক্ষ এবং বিচ্ছিন্নতার মতো বিপর্যয়। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা অখণ্ড রাখতে ব্যর্থ হয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে, খণ্ডিত হয়েছে সুদান, বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি আমাদের প্রতিবেশী বার্মা। এ রকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে রয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত।
তবে ইতিহাসের সেই বহুকথিত বহুচর্চিত আপ্তবাক্য: ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ইতিহাসের শিক্ষা কেন ক্ষমতার কষ্টকল্পিত প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। সে এক আশ্চর্য রহস্যময় জিজ্ঞাসা; যার উত্তর কোনোদিন কোনোকালেই কোনো স্বৈরাচার দিতে পারেননি। তবে নিষ্ঠুরভাবে ভোগ করেছেন ইতিহাসের অমোঘ পরিণতি।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনাও তার ব্যতিক্রম নন। তার অলিন্দ উপচে পড়েছিল স্বৈরাচারের সর্বপ্রকার উপাদানে কী অর্থনীতি, কী রাজনীতি, কী সমাজ, সংস্কৃতি সর্বত্র হাসিনার আগ্রাসী স্বৈরতন্ত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো। বিশ্বের বহু স্বৈরাচারীর অসংখ্য ‘কীর্তি’ বিবর্ণ হয়ে গেছে হাসিনার ‘মহাকীর্তির’ কাছে। আলাদীনের দৈত্য ফ্যাসিবাদের সব চেরাগ ধরিয়ে দেয় হাসিনার হাতে এবং ইতিহাস আতঙ্কে হেসে উঠেছে তার অবধারিত বিনাশের গতিপথের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে।
আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, আপনারা সবাই গত ১৫ বছরে হাসিনা সরকারের ‘অবদান’ সম্পর্কে জানেন। ‘জানেন’ এই শব্দটি ব্যবহার করার চেয়ে আমার মনে হয় ‘মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন’ বলা অধিকতর যুক্তিসংগত। শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের ন্যূনতম অস্তিত্বের বিনাশ সাধন করেছেন, অবারিত লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছেন, ঋণের ভারে বিধ্বস্ত করেছেন সমগ্র জাতিকে (বৈদেশিক ঋণ উনিশ লক্ষ কোটি টাকা), নিষ্ঠুর পৈশাচিকতায় নির্মম হাতে গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করেছেন, অগণিত গণতন্ত্রকার্মী মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করেই তিনি তৃপ্ত হননি। স্বৈরাচারের নির্বিঘ্ন রাজপ্রাসাদ গড়ে তোলার কুবাসনায় হাজার হাজার দেশপ্রেমিককে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন, জীবনযাপনের ন্যূনতম চালিকা চাহিদাগুলো দুর্লভ করে ১৮ কোটি মানুষের জীবনকে করে তুলেছেন অবর্ণনীয় কষ্টের কারাগার। আমি আমার বিভিন্ন প্রবন্ধ নিবন্ধে এবং সভা সমিতিতে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। পাশাপাশি গভীরভাবে এই আশাবাদও ব্যক্ত করেছি যে, স্বৈরতন্ত্রের পতাকাবাহী হাসিনা তন্ত্রের পতন অনিবার্য। কেননা, ইতিহাসের অপ্রতিরোধ্য সত্য এবং সেই সত্যের পথে ইতিহাসের অভিযাত্রা কেউ রুখতে পারে না।
২০২৪ সালের জুলাই মাস এবং আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহজুড়ে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব ও অভূতশ্রুত গণ-আন্দোলন আমার পূর্বঘোষিত প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপদান করেছে। গণ-আন্দোলনেই যে হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের ঐতিহাসিক পতন হবে এ বিষয়ে আমি পূর্বেই সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করি। একই সঙ্গে আমি এ কথাও গভীরভাবে বিশ্বাস করেছিলাম যে, উদীয়মান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিকশিত নবজাগরণের বা রেনেসাঁর উন্মেষ থেকেই নবপর্যায়ের একটি গণ-আন্দোলনের সূচনা হবে।
স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র-জনতার এই ঐতিহাসিক বিজয়লগ্নে দাঁড়িয়ে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি যে, এবারের গণ-আন্দোলন বৈশিষ্ট্যগত ও গুণগতভাবে ছিল বহুলাংশে ভিন্নতর মৌলিকতার দিক থেকে এবং এর প্রকৃতির দিক থেকে। আমি বালক বয়সেই ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি- এ আন্দোলনের তাৎপর্য বুঝতে না পারলেও। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে আমি কেবল একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারীই ছিলাম না, একজন সংগঠকের ভূমিকাও পালন করি।
১৯৭১ সালে আমি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই। আমার জীবনে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তির সব আন্দোলনে আমি সক্রিয় থেকেছি।
একটি অনুশীলনশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকলে রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে নেমে আসে কালাপাহাড়ের অত্যাচার। এ ধরনের অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয় অর্থনীতি। হাসিনার অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদের হাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। তার অনিবার্য ফল ভোগ করতে হয়েছে সমগ্র দেশবাসীর। বিভিন্ন তথ্যে আপনারা লীগ দস্যুদের মহাডাকাতির বিস্তারিত বিবরণ জানেন, আমি সেগুলো পুনরায় উল্লেখ করতে চাই না।
২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের সব দিগন্তে এক নতুন সূর্য উঠেছে, এসেছে এক আশ্চর্য নতুন প্রভাত উদ্ভাসিত এ সূর্যের প্রতিটি আলোকবিন্দুতে আমি দেখতে পাচ্ছি রেনেসাঁর দ্যুতি।
কেননা, একমাত্র রেনেসাঁ মুক্তির পথ দেখাতে পারে। সর্বকালে সব দেশে রেনেসাঁর মতো উন্মেষ নাও ঘটতে পারে। নিজের দেশের বাস্তবতায় সে দেশের জনগণ মুক্তির পথ খুঁজে নিবে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বিন্যাস ও পটভূমির আলোকেই আজ এক নতুন রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে। আমার বহু প্রত্যাশিত এ রেনেসাঁ ইউরোপের মতো নয়; চরিত্রগতভাবে এ রেনেসাঁ শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার ক্ষুরধার দিয়ে ইহলৌকিকতার জয়গান নয়, এ রেনেসাঁ জাতীয় মুক্তির চেতনায় আলোকিত একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রেনেসাঁ। এ নবউন্মেষ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের এক সম্মিলিত অঙ্গীকার। এ নবজাগরণ একটি জাতিকে নব উদ্বোধনের চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমার বহুলালিত এ রেনেসাঁ বাংলাদেশের সামগ্রিক জাতীয় চেতনা, আবেগ ও প্রত্যাশার এক উজ্জ্বল অগ্রদূত।
এ দেশের ছাত্রসমাজ এ রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে। তারা সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছেন রেনেসাঁর চিরাচরিত ধারণা। তারা ভাবমানসের অতীন্দ্রিয় কুহক থেকে রেনেসাঁকে সরিয়ে এনেছেন স্বৈরতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের মুক্তি। তারা মহামতি কাল মার্কসের সেই অমর বাক্যের মূর্তরূপ দিয়েছেন বাংলাদেশে। Philosophers have hitherto interpreted history, now the task is to change it. বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ মার্কসের গভীর প্রত্যাশাকে আজ পূর্ণ করেছে। তারা আবদ্ধ কক্ষের গ্রন্থঠাসা আলো-আঁধারিতে বসে বাংলাদেশকে তথ্য ও তত্ত্বের সারণী ও সিদ্ধান্ত নিয়ে মস্তিষ্ক উত্তপ্ত করেননি; তারা গণমানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামে সেনানায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। মার্কস ‘পরিবর্তনের’ যে আশার কথা শুনতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ সমগ্র দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে সেই আশা পূর্ণ করেছেন। ছাত্র-জনতা পরিণত হয়েছে সংগ্রামরত গণদার্শনিকে।
ছাত্র-জনতার এ আন্দোলনে অসংখ্য সম্ভাবনাময় নবীন প্রাণ ঝরে গেছে হাসিনা স্বৈরাচারের নির্বিচার সশস্ত্র আক্রমণে। নিহত হয়েছে সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষ। দুগ্ধপোষ্য শিশুও রেহাই পায়নি ফ্যাসিবাদের হত্যা উৎসব থেকে। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। আজও বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত্যুর দুঃসহ প্রহর কাটাচ্ছেন অনেক মানুষ। চিরতরে পঙ্গুত্বের শঙ্কায় শত শত আহত মানুষ। নিহত ও আহতদের প্রতি রইল আমার গভীর সমবেদনা।
আমাদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবী কোনো বিপ্লবই রক্তপাতহীন নয়; কোনো বিপ্লবই পুষ্পসজ্জিত সড়কপথের আনন্দদায়ক শোভাযাত্রা নয়। বিপ্লব মানেই আত্মত্যাগ, বিপ্লবের অন্য নাম আত্মোৎসর্গ। আমাদের ছাত্র-জনতা বিপ্লবের ধ্রুপদী পথই অনুসরণ করেছেন। তাদের প্রতি রইল আমার আন্তরিক অভিনন্দন। বিশেষ করে স্বৈরতন্ত্রের সর্বপ্রকার ভয়ভীতি, রক্তচক্ষু, রক্ত-পিপাসা ও গুলিকে উপেক্ষা করে, আত্মবলিদানে উদ্বুদ্ধ ছাত্রনেতাদের আমি কুর্নিশ করি। তাদের বিজয় আজ জাতির অমর বিজয়কাব্য।
ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে এবং সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। গভীর আনন্দের কথা যে, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আমি মনে করি, বিপ্লব বিজয়ী ছাত্র-জনতার এ নির্বাচন যথাযথ এবং ন্যায়সংগত। ড. মোহাম্মদ ইউনূস আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। দেশ ও জাতির এই মহাক্রান্তিলগ্নে তিনি জাতিকে নেতৃত্ব দেবেন যথাযোগ্য ভূমিকায়, বর্তমান সংকট উত্তরণে তার সুচিন্তিত ও বাস্তবমুখী উদ্যোগ জাতিকে এক নতুন অভিজ্ঞতায় অভিষিক্ত করবে, এ বিষয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। দারিদ্র্য দূরীকরণের মধ্য দিয়ে মানবতার সার্বিক মুক্তির যে সুশৃঙ্খল পদ্ধতিগত সামষ্টিক আন্দোলনের তিনি সূচনা করেছেন, তা কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। অবিচল মহীরুহের ন্যায় ড. ইউনূস তার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারের প্রতি দৃঢ় অবস্থান অব্যাহত রেখেছেন। জাতির এই ক্রান্তিকালে তিনি একই অবস্থান বজায় রেখে জাতিকে সঠিকপথে নেতৃত্ব দেবেন বলে আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অর্থনীতির পুনরুদ্ধার, রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় তিনি সংশপ্তকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।
সন্দেহাতীতভাবে তিনি অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। পরাজিত স্বৈরাচারের চর-অনুচররা দেশের ভেতরে ও বাইরে চুপ করে বসে নেই। তারা আবার সিংহাসনে বসার স্বপ্নে বিভোর হবে, এটাই স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েও ফ্যাসিবাদের দোসরদের অভাব নেই। সুতরাং সরকারকে অতি সতর্কতার সঙ্গে সব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবেগের আকস্মিকতা এবং বিজয়ের বিকুলতায় কোনো ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। পরাজিত শক্তিকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। আমি গভীরভাবে আস্থাশীল যে, ড. ইউনূস বর্ণিত বিষয়গুলো সম্পূর্ণ সম্পর্কে সচেতন রয়েছেন।
একটি স্থিতিশীল শৃঙ্খলাপূর্ণ সরকার ব্যবস্থা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিলুপ্ত গণতান্ত্রিক কাঠামো ফিরিয়ে আনা সময়সাপেক্ষ হলেও অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলাকে এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। স্বৈরাচার পতনের অব্যবহিত পরই এমন কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা দেখেছি, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি এত বড় একটি ঐতিহাসিক অর্জনের গুরুত্বকে ম্লান করে দিতে পারে। সরকারের স্বাভাবিক প্রশাসনিক তৎপরতা নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার তেমন প্রয়োজন নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কয়েকটি আশু দায়িত্ব নির্ধারণ করতে হবে। যেমন-
১. অনতিবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় জীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
২. জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে।
৩. সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া হত্যা, লুটপাটসহ সব ধরনের অপরাধের তদন্ত ও বিচার করতে হবে। বিচারহীনতার ও জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি জাতিকে সর্বদিক থেকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়ে একে সম্পূর্ণরূপে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে। সুতরাং সরকারকে এ বিষয়ে গভীর মনোযোগ দিতে হবে।
৪. বিদ্যমান প্রশাসন কাঠামোতে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যতীত এ মুহূর্তে হস্তক্ষেপ করলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত করা বা পুরস্কৃত করা উভয় বিষয়েই বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে।
৫. যেকোনো প্রকার বা যেকোনো ক্ষেত্রেই হোক দুর্নীতির মূল উৎপাটন করতে হবে। বিগত পনের বছরের সীমাহীন দুর্নীতিই আজ বাংলাদেশকে নিঃস্ব রিক্ত করছে।
৬. গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। গণতন্ত্রহীনতার অবাধ ও উলঙ্গ চর্চার প্রতিফলন ঘটেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সুস্থ বিকাশ না ঘটলে এই গণবিপ্লবের সাফল্য অর্জিত হবে না।
৭. শিক্ষাব্যবস্থা বলতে বাংলাদেশে আজ কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিগত ফ্যাসিস্টরা শিক্ষা নামক বিষয়টাকে হত্যা করেছে। সুতরাং এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি একটি সর্বজনীন গণমুখী শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
বর্ণিত দায়িত্বগুলো সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন সময়, সদিচ্ছা, পরিকল্পনা ও আন্তরিকতা। আমি জানি, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার এগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারবেন। জনমানুষের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
কামনা করি, গণতন্ত্রের এই যাত্রাপথ শুভ হোক।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত।
ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দারুণ এক অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিশ্বে আলোচিত উদীয়মান অর্থনীতির দেশ চীন ও ভারত এবং দক্ষিণে বিশাল জলরাশি বঙ্গোপসাগরের মতো অবস্থানিক প্রপঞ্চকের মধ্যে অবস্থিত, যা তাকে আঞ্চলিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। আর এই সুবিধাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে সিঙ্গাপুরের মতো উন্নয়নের দারুণ এক দ্বার উন্মোচন করা সম্ভব।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা আমরা অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করতে পারি। মানচিত্রে খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম, অর্থাৎ তিনদিকেই ভারতের অবস্থান। আর দক্ষিণে সুবিশাল সমুদ্র। ভারতকে নিজের রাজ্যগুলোর সঙ্গে যেমন- পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ত্রিপুরার যোগাযোগ করতে গেলে বাংলাদেশের সাহায্য নিতে হবে। বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহারের আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিলিগুঁড়ি করিডোর হয়ে ত্রিপুরায় যেতে একটি পরিবহনকে অতিক্রম করতে হতো প্রায় ১৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা এবং সময় লাগতে অন্তত দুই দিন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট নিয়ে পদ্মা সেতু হয়ে কলকাতা-ঢাকা-ত্রিপুরা রুটে অতিক্রম করতে হচ্ছে মাত্র ৪৭০ কিলোমিটার এবং সময় লাগছে ৮-৯ ঘণ্টা।
সুতরাং অর্থ ও সময়- দুটোরই সাশ্রয়ী ট্রানজিটের জন্য বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের কাছে এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ট্রানজিট বা করিডোর বাণিজ্যের মাধ্যমে আর্থিকভাবে পরিপূর্ণ লাভ ঘরে তোলার রূপরেখা তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। এটি বাংলাদেশের অবকাঠামো ও পণ্য উৎপাদন খাতে বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ টানার সুযোগ করে দেবে। বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের বাজার পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকে উন্মুক্ত থাকায় প্রচুর কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য অর্থাৎ আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা, যেগুলো সমষ্টিগতভাবে সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত। এই সেভেন সিস্টার্স অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। কেননা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেকোনো পণ্য পরিবহনের চেয়ে বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করা তাদের জন্য সহজসাপেক্ষ। ২ লাখ ৬২ হাজার ২৩০ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত এই সেভেন সিস্টার্সে প্রায় ৫ কোটি মানুষের বসবাস। এই বিশাল বাজার ধরার সম্যক সুযোগ বাংলাদেশের সামনে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক অনবদ্য আশীর্বাদ বঙ্গোপসাগর। ইউরোপের অনেক দেশ আছে, যারা তাদের ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সমুদ্রপথে সরাসরি প্রবেশের সুবিধা থেকে বঞ্চিত, যাকে বলা হয় ল্যান্ড লকড কান্ট্রি। এই দেশগুলো বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে নেদারল্যান্ডসের সমুদ্রবন্দরের ওপর নির্ভরশীল। আর সেজন্যই নেদারল্যান্ডস অন্তত ৩৭টি সমুদ্রবন্দর গড়ে তুলেছে, যেগুলো অন্য দেশগুলোকে ব্যবহার করতে দিয়ে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশ, যারা এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত ছিল, তাদের পোর্ট বন্দর আব্বাস ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে ইরান। এই দেশগুলোকে ট্রানজিট প্রদানের মাধ্যমে এবং তার পোর্ট ব্যবহার করতে দেওয়ার বিনিময়ে ইরানও বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে।
একই সুযোগের হাতছানি বাংলাদেশের সামনেও। বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত নেপাল ও ভুটান এবং ভারতের সেভেন সিস্টার্সের ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরও বেগবান করার জন্য চট্টগ্রাম, মোংলা কিংবা পায়রা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে দিয়ে ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।
অন্যদিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন মালাক্কা প্রণালি দিয়ে পরিবহন করা জ্বালানি সম্পদের ওপর খুবই নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনের জ্বালানি আমদানির প্রায় ৮০ ভাগ আসে এই মালাক্কা প্রণালি দিয়ে, যেটা ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। খুবই সংকীর্ণ এ প্রণালিটি চীনকে আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানির জন্য চীনের চাহিদাও বেড়ে চলেছে। আর জ্বালানি পরিবহনের জন্য চীনের কাছে সমুদ্র অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্ব বাড়ছে। দেশটি ধীরে ধীরে মালাক্কা প্রণালির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা থেকে সরে আসতে চায়। আর এ জন্য ভারতের মহাসাগরের আশপাশের তীরবর্তী যেসব দেশ আছে সেগুলোতে চীন প্রভাব বাড়াচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মালাক্কা প্রণালির বিকল্প নৌপথ হিসেবে বাংলাদেশ চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের আলোচিত স্ট্র্যাটেজিক পজিশন ‘স্ট্রিং অব পালস’ বা মুক্তামালার তত্ত্বে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। এই তত্ত্বে বোঝানো হয় চীন কীভাবে মালাক্কা প্রণালি ও ভারত মহাসাগরের আশপাশের দেশগুলোতে নিজের প্রভাব অক্ষুণ্ন রেখে ও তা বাড়ানোর জন্য উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগের মাধ্যমে আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠতে চায়। বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের পেছনে এটা অন্যতম একটি প্রধান কারণ। চীনের এই বিনিয়োগকে নিজের সুবিধায় লাগানোর জন্য বাংলাদেশের সুদূরপ্রসারী ও কার্যকর রোডম্যাপ প্রস্তুত এখন সময়ের দাবি।
দেশের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত বিশাল বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস প্রাপ্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনা বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে, বিশেষ করে ক্ষমতাধর দেশগুলোর কাছে গুরুত্ব বৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। একই সঙ্গে রয়েছে খনিজ সম্পদের বিপুল আধার, মাৎস্যসম্পদের প্রাচুর্য, শৈবাল উৎপাদন ও বাজার তৈরির সম্ভাবনা, উপকূলীয় অঞ্চলে জাহাজভাঙা শিল্পের বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা এবং সমুদ্র ঘিরে গড়ে ওঠা অর্থনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ আগামীতে অন্যতম অর্থনীতিসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিদেশি পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র হিসেবে সুপরিচিত করে তোলার দারুণ সুযোগ রয়েছে। বিশ্বে অনেক দেশ রয়েছে, যাদের অর্থনীতির ভিত দাঁড়িয়ে আছে পর্যটনশিল্পকে কেন্দ্র করে। আমাদের খুব কাছেই অবস্থিত মালদ্বীপের অর্থনীতি দাঁড়িয়েই আছে পর্যটনশিল্পের ওপর। শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের অর্থনীতিও বহুলাংশে পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। ওরা পারলে আমরা কেন নয়?
আমাদের দেশেও পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা স্বীকৃত। আমাদের রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। একপাশে সুবিশাল সমুদ্রের জলরাশি, আরেকপাশে পাহাড় নিয়ে বয়ে চলা মেরিনড্রাইভের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য হয়ে উঠতে পারে যেকোনো বিদেশি পর্যটকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন হতে পারে প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের প্রধান গন্তব্য। আমাদের আছে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, শৈবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, নয়নাভিরাম সবুজে ঘেরা পাহাড়ি পার্বত্য অঞ্চল। দেশের উত্তরাঞ্চলে আছে মহাস্থানগড় থেকে শুরু করে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা। আকর্ষণীয় অঞ্চলগুলোয় ইকো-ট্যুরিজম পার্ক তৈরি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
আঞ্চলিক যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। আর যে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা যত মসৃণ, তার উন্নয়নও তত সহজ। এশিয়ার তিনটি প্রধান অঞ্চল-দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়া মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ায় এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে- আন্তঃসীমান্ত দ্রব্য, সেবা এবং বিনিয়োগ প্রবাহ থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ট্রান্সপোর্টেশনের জন্য গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন; ভুটান, নেপাল, ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে এনার্জির ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং আরও বেশি অর্থনৈতিক বা শিল্প জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ সার্ক ও আসিয়ান অঞ্চলের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
এছাড়া এশিয়ান হাইওয়ে, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে, BBIN, BCIM এবং BIMSTEC-এর অর্থনৈতিক করিডোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের মধ্যে সংযুক্ত হয়ে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক লেনদেন বাড়াতে পারে, যার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নামে একটি উন্নয়ন কৌশল ও কাঠামো উপস্থাপন করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে বিশ্বের ৬০টি দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা। এই পরিকল্পনায় সড়ক পথে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সংযোগ স্থাপন, সড়ক পথের সঙ্গে রেলপথ ও তেলের পাইপলাইনও রয়েছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রপথেও, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন। বলা হয়ে থাকে প্রাচীন সিল্ক রুটের আধুনিক সংস্করণ এটি। এই পরিকল্পনার বেশ সুবিধাজনক অবস্থানেই আছে বাংলাদেশ। পরিকল্পনার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়ার দারুণ একটা সুযোগ থাকবে বাংলাদেশের কাছে। প্রকল্পের আওতায় চীনের কুনমিং প্রদেশ ভারতের কলকাতা, মিয়ানমারের মান্দালয় এবং বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, অর্থনৈতিক করিডোরের ফলে উন্নত সংযোগ হবে, বাণিজ্য সহজতর হবে এবং দেশগুলোর বাজারে প্রবেশের বিস্তৃতি ঘটবে ও এই চার প্রতিবেশী দেশ লাভবান হবে। বাংলাদেশ যেহেতু ‘আসিয়ান’ এবং দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর প্রবেশদ্বার এবং একই সঙ্গে কুনমিং হয়ে চীনের প্রতিবেশী এবং চীন ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অংশকে যুক্ত করেছে, তাই বাংলাদেশ এবং চীন যৌথভাবে ভৌগোলিক এ অবস্থানের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
এখন থেকে ৫০ বছর আগে আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। তখন সহপাঠীরাসহ অনেকেই আমার দেশের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে বাংলাদেশ বললে চিনত না, বলতে হতো ÒSome where in IndiaÓ কিন্তু সারা বিশ্বের লোক এখন চেনে ইউনূসের বাংলাদেশ হিসেবে। এ ক্ষেত্রে ক্রিকেটের বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য। যাহোক, এই তো চলতি মাসের ৫ আগস্ট (২০২৪) সারা দেশে গণতন্ত্রকামী ছাত্রসহ জনসাধারণ কর্তৃক বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেল এবং জান বাঁচাতে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা এক কাপড়ে ভারতে পালিয়ে যান। আর এই লেডি হিটলার শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও গণনিধন কম হয়নি। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ন্যূনতম ৬৫০ জন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তার নৃশংস হত্যাকাণ্ড অনেকাংশে হিটলারকে ছেড়ে গিয়েছে। তার টর্চার সেল হিসেবে আয়নাঘর এবং হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প সমজাতীয় হিসেবে অনেক সুধীজন অভিহিত করে থাকেন। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে হাসিনা সরকারের লাগাতার দুঃশাসন ও অপশাসনে মানুষ দুঃখ ও ক্ষোভে হাফিয়ে উঠেছিল। কেউ প্রতিবাদ করলে হত্যা বা গুম বা জেল ভাগ্যে জুটত। এদিকে অনেকে বলে থাকেন যে বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার নিয়ে এই গণঅভ্যুত্থান। আসলে তা নয়। আসলে দেশের মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের মুখে কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রজ্বলিত একটি ম্যাচের কাঠি বই কিছু নয়। এর মধ্যে দেশ পরিচালনায় বিশাল শূন্যতার কারণে ছাত্র-জনতার একান্ত অনুরোধে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস হাল ধরেছেন। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, দেশবাসী সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। কেননা অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে এই ক্রান্তিলগ্নে তিনি যদি এগিয়ে না আসতেন; তাহলে প্রতি বিপ্লবের খপ্পরে পড়ে আমাদের ভাগ্যে এমন কিছু ভর করত, তাতে দুঃখের আর সীমা থাকত না। অথচ এই মহান মানুষটিকে আমরা অর্বাচিনরা নানাভাবে নাজেহাল করেছি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে প্রতিহিংসাবশত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ১০০ জনের বেশি নোবেল বিজয়ীসহ ১৭০ জন বিশ্ব ব্যক্তিত্ব শেখ হাসিনার কাছে পত্র দিয়েছিলেন। অথচ শেখ হাসিনা তার মূল্যায়ন না করে উল্টো কথা বলেন; কিন্তু আমরা হয়তো জানি না, তিনি কত বড় মহান ব্যক্তিত্ব যে এ বিশ্বের অনেক দেশের পাঠ্যপুস্তকে তার জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর বিশ্বের প্রথম দশজন মানুষের মধ্যে তিনি একজন। অথচ বাংলাদেশের কৃতিসন্তান হিসেবে গর্ব না করে আমরা প্রতিহিংসাবশত কত কিছু না বলেছি এবং বিভিন্নভাবে তাকে নিগৃহীত করেছি।
উল্লেখ্য, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন ব্রিটিশ ভারতের চট্টগ্রামের হাটহাজারির কাপ্তাই সড়কের বাথুয়া গ্রামে একটি সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার পিতা হাজী দুলা মিয়া সওদাগর ছিলেন একজন জহুরি এবং তার মাতা সুফিয়া খাতুন। তার শৈশব কাটে গ্রাম-বাংলায়। ১৯৪৪ সালে তার পরিবার চট্টগ্রাম শহরে চলে আসে। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ৩৯ হাজার ছাত্রের মধ্যে ১৬তম স্থান অধিকার করেন। স্কুলজীবনে তিনি একজন সক্রিয় বয় স্কাউট ছিলেন এবং ১৯৫২ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত এবং ১৯৫৫ সালে কানাডায় জাম্বোরিতে অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করার প্রাক্কালে তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন এবং নাটকে অভূতপূর্ব অভিনয়ের জন্য পুরস্কারও পান। ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৬১ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। মজার ব্যাপার হলো- ছাত্রজীবনেই তার অনেক শিক্ষক এই মর্মে উক্তি করেছেন, এই ছেলে যেনতেন নয়। আগামীতে বড় কিছু হয়ে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবে। কেননা ‘সকালবেলায় বোঝা যায়, দিন ভরে কি হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে তিনি নুরুল ইসলাম এবং রেহমান সোবহানের অর্থনৈতিক গবেষণায় গবেষণা সহকারী হিসেবে অর্থনীতি ব্যুরোতে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। একই সময়ে তিনি পাশাপাশি একটি লাভজনক প্যাকেজিং কারখানা স্থাপন করেন। ১৯৬৫ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য ফুলব্রাইট স্কলারশিপ লাভ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তৎপর ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি মার্ফ্রিসবোরোতে মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সেখানে থেকেই মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে তিনি একটি নাগরিক কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং অন্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সমর্থনসহ অর্থ সংগ্রহ করতে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার পরিচালনা করেন। শুধু তাই নয়, ‘বাংলাদেশের পক্ষে নিউজলেটারও’ প্রকাশ করেন। আর এই কারণে বাংলাদেশ থেকে তখন অনেক প্রশংসা পেয়েছেন। যুদ্ধ শেষ হলে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে নিযুক্ত হন। তবে তার কাছে কাজটি একঘেয়েমি লাগায় তিনি সেখানে ইস্তফা দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং কিছুদিন পর বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি পুরোপুরি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে আসীন ছিলেন।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের সময় সাধারণ মানুষের দুরবস্থা দেখে তার মন কেঁদে ওঠে এবং চিন্তা করতে থাকেন, কীভাবে এ থেকে গণমানুষের মুক্তি দেওয়া যায়। তিনি এই মর্মে বাস্তবভিত্তিক চিন্তা করেন যে স্বল্প পরিমাণে প্রদত্ত ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। সেই সময়ে তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন, যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে। প্রকল্পটিকে আরও কার্যকর করতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সহযোগীরা ‘গ্রাম সরকার’ কর্মসূচি প্রস্তাব করেন। যেটি সত্তর দশকের শেষের দিকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রবর্তন করেন। এই কর্মসূচির অধীনে ২০০৩ সালে ৪০,৩৯২টি গ্রাম সরকার গঠিত হয়, যা চতুর্থ স্তরের সরকার হিসেবে কাজ করত। যদিও ২০০৫ সালের ২ আগস্ট বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট কর্তৃক দায়ের করা একটি পিটিশনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গ্রাম সরকারকে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। এর মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। এর মধ্যে তিনি ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষুদ্রবিত্ত ধারণা বাস্তবায়ন করতে বিভিন্ন আঙ্গিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। যেভাবেই বলি না কেন, তিনি একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ এবং সফল ব্যাংকার।
সৃষ্টিধর্মী ও সফল উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলাদেশের হতদরিদ্র ও গরিব মানুষের ঋণ দেওয়ার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ৫.৩ মিলিয়ন ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৫.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করেন। আর ঋণের টাকা ফেরতের ব্যাপারে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গ্রামীণ ব্যাংক ‘সংহতি দল’ পদ্ধতি প্রবর্তন করে। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, একটি অনানুষ্ঠানিক ছোট দল একত্রে ঋণের জন্য আবেদন করে। অবশ্য এর সদস্যরা একে অন্যের জামিনদার হিসেবে থাকে এবং একে অন্যের উন্নয়নে সাহায্যের ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে ব্যাংকের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুঃখী মানুষকে রক্ষা ও উন্নতিকল্পে ব্যাংক অন্যান্য পদ্ধতিরও আশ্রয় নেয়। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের যুগপৎ নতুনভাবে যোগ হয় গৃহঋণ, মৎস্য খামার এবং সেচ ঋণ প্রকল্পসহ অন্যান্য সমজাতীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এর মধ্যে গরিব জনগোষ্ঠীর উত্তরোত্তর অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যে উন্নত বিশ্ব এমনকি স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বসহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশসমূহ গ্রামীণের এই মডেল ব্যবহার করতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারাও এই পদ্ধতির আশ্রয় নিতে সক্রিয় হয়। এই ক্ষুদ্র ঋণের সারথি ধরে ভেসে থাকা দরিদ্র জনগোষ্ঠী বলতে গেলে কুল পেয়ে যায়। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে এর দর্শন ছড়িয়ে পড়ে। আর এই সৃষ্টিধর্মী মহৎ কাজের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করে। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই বিরল সম্মান পেলেও শেখ হাসিনা সরকারের গাত্র দহনের কারণ হয়ে ওঠে; যা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি। অথচ নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি বলেছিল, ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তি অর্জন করা সম্ভব নয়, যদি বড় জনগোষ্ঠী দরিদ্রতা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় না খুঁজে পায় এবং সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার বিভিন্নতার মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, এমনকি সবচেয়ে দরিদ্র মানুষও তাদের নিজস্ব উন্নয়নের জন্য কাজ করতে পারে’। যাহোক, তার এই ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রায়োগিক মহৎ কর্মের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা নানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬২টি সম্মানসূচক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রায় দেড় শত পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এবং এ বিশ্বে শীর্ষ ১০০ জন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় স্থান পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। আর গরিব মানুষকে ঘিরে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ তার কর্তৃক প্রণীত ৭টি বই বিশ্বে সাড়া জাগিয়ে তুলেছে। এদিকে দরিদ্র দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ বা সামাজিক ব্যবসার এই মডেল পৃথিবীর ৪০টির বেশি দেশে ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ধারণ করেছে। তাছাড়া বিশ্বের ৮০টির বেশি প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে তার নামে ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; যেখানে তার চিন্তা, কাজ, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও জীবনাদর্শ নিয়ে গবেষণা হয়। সত্যি কথা বলতে কি, তার প্রাপ্তি যদি লিখতে যাই, তাহলে একটি বড় বই হয়ে দাঁড়াবে। তাই অত্র প্রবন্ধের কলেবরের স্বার্থে তা পুরোপুরি তুলে ধরা সম্ভব হলো না। অথচ এই বিশাল মানুষটিকে আমরা প্রতিহিংসাবশত কটূক্তিসহ নানাভাবে নাজেহাল করে তুলেছি। তা ছাড়া তাকে বিনা অপরাধে আদালতের কাঠগড়ায় পর্যন্ত দাঁড় করেছি; কিন্তু দাদা ইতিহাস ঠিকই ফলাফল অনুযায়ী ০৮/০৮/২০২৪ তারিখে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দিয়েছে বাংলাদেশের মসনদের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সিংহাসন। অথচ সেই সব পরচর্চাকারী এবং হীনমনের মানুষের আর বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আসলে বিধির বিধান এতটুকু নড়চড় হয় না।
সাধারণত গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবের অব্যবহিত পর, যে সরকার দেশ চালনার জন্য কর্মভার গ্রহণ করেন, সে সরকারকে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। এ ক্ষেত্রে একটি কথা না বলে পারছি না; তা হলো গণঅভ্যুত্থানের পর বিপ্লবের কাউন্টার হিসেবে ছোট আকারে প্রতি বিপ্লব সংঘটিত হয়ে থাকে; যা মূল বিপ্লবের লক্ষ্য নস্যাৎ করে দেয়। তা ছাড়া সুবিধাবাদী গোষ্ঠী পুঞ্জীভূত দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হয়ে থাকে এবং একই সঙ্গে দেশের চলমান প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ে। কেউ কারও কথা শুনতে চায় না। তা ছাড়া অর্থনীতির চলমান প্রক্রিয়া তলানিতে পৌঁছে। যাহোক, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষায় এটি দ্বিতীয় স্বাধীনতা। আসলে তিনি যথার্থ কথাই বলেছেন। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, এর মধ্যে বিগত সরকারের মনোনীত সবাই একেক করে তাদের দুষ্কর্মের জন্য পদত্যাগ করছেন। সত্যি কথা বলতে কি, খুনি সরকার এমনভাবে তাদের লোককে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে গিয়েছে যে তারা ভেতরে ভেতরে এখনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ ক্ষেত্রে পাশের প্রতিবেশী দেশও নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছে বলে প্রতীয়মান হয়। তাছাড়া বর্তমান মধ্যবর্তী সরকারের মধ্যে সবাই যে ভালো, তা কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না। কেউ কেউ বলছেন, এখন সংখ্যালঘু সনাতনী মানুষের দাবার ঘুঁটি হিসেবে চাল দিচ্ছেন বিগত সরকারের পোষা লোকেরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভেতরেই অনেক ষড়যন্ত্রকারী লোক আছে। তাছাড়া বাইরেও নানাভাবে অবস্থান নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অকার্যকর করার জন্য বদ্ধপরিকর। আর এমন অবস্থায় অন্য কেউ প্রধান উপদেষ্টা হলে এই অবস্থা সামাল দিতে পারত কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিশ্বনন্দিত সর্বজন স্বীকৃত নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভাব হয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে বিশ্বের সামাজিক মাধ্যম এবং চ্যানেলগুলো ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সক্ষমতার ব্যাপারে ইতিবাচক অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এ সূত্র ধরে প্রখ্যাত প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত রায় চৌধুরী উল্লেখ করেন যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি আরও বলেন, ড. ইউনূস বর্তমান পরিস্থিতিতে সেরা বিকল্প; তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং দেশের ভেতরে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এবং ভারতের কাছেও তিনি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তাছাড়া রাজনীতি সরাসরি না করলেও তার স্ট্রাটেজিক সুদূরপ্রসারী বুদ্ধি আছে বিধায় উদ্ভুত নেতিবাচক পরিস্থিতি সামাল দিতে তেমন বেগ পেতে হবে না। বাংলাদেশের এই নড়বড়ে অস্থির পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ব্যাপারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস মহোদয় সম্পর্কে আমার কিছু কথা আছে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, একটি ইস্যু নিয়ে এই মহান মানুষটির সরাসরি সংস্পর্শে দুবার (১১/০১/২০০৯ইং এবং ১৭/০৮/২০১৬ইং) আসার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই সময়ে লক্ষ্য করি, তার লৌহসম কঠিন মনোবল এবং জ্ঞানের গভীরতা। কথা বলার প্রাক্কালে প্রতীয়মান হয় যে তার নির্ভরশীলতা অপছন্দনীয় এবং ঝুঁকি নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানের ব্যাপারে জোর দেন। আরও প্রত্যক্ষ করেছি, কোনো প্রতিকূল পরিবেশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্ট্রাটেজিক কৌশল ও বুদ্ধি রাখেন। তাই বর্তমানে বাংলাদেশের নাজুক ও উদ্ভূত নেতিবাচক পরিস্থিতি তিনি অনায়াসে অতিক্রম করতে পারবেন বলে কায়মনে বাক্যে শতভাগ বিশ্বাস করি।
লেখক: বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের কারণে দেশের জনসাধারণ বহু আগেই রাজনৈতিক নেতারা তথা রাজনৈতিক সরকারের কাছে প্রকৃত মঙ্গলজনক কিছু আশা করা ছেড়ে দিয়েছে বহু আগেই। তাই, দেশের মানুষ এমন সব ব্যক্তিদের রাষ্ট্র পরিচালনায় দেখতে চান যারা নিজেদের আখের গোছানো, অর্থবৃত্তের পাহাড় গড়া আর বিদেশের ব্যাংকে কাড়ি কাড়ি টাকা রাখার চিন্তা করবে না। জনসাধারণের সেই ধরনের ব্যক্তিরা দ্বারা বর্তমানে দেশ পরিচালিত হচ্ছে কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে যারা কর্মরত, যারা সরাসরি জনগণকে সেবা প্রদান করবেন তারা তো অধিকাংশই সেই রাজনৈতিক নেতাদের ধ্বাজাধারী, তাদেরই সৃষ্ট এবং দেশের সব প্রতিষ্ঠান দুর্বৃত্তায়ন আর দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে রূপান্তর করে রেখেছেন। তাদের নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে বর্তমানকালের জনগণের বহুল প্রতীক্ষিত সরকারকে। তারপরও জনগণ আশায় বুক বেঁধে আছেন। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমাবদ্ধতা ও বাঁধার পাহাড় সম্পর্কে তারা জানেন তারপরেও একটু বেশি বেশি আশা করে আছেন। দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সংস্কার করতে হবে, ঢেলে সাজাতে হবে যা চাট্টিখানি কথা নয়। অনেক বন্ধুর, অনেক চ্যালেঞ্জিং এই পথ! তারপরেও মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বর্তমান সরকার সেসব সংস্কারে হাত দিয়েছে।
আমরা দেখলাম, সরকার ইতোমধ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এসব কমিশন পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে এই কমিশনগুলো পরিচালনা করার দায়িত্ব দিয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার ও জনগণের মালিকানায় বিশ্বাসী এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়নে এখানকার সংস্কারকে গুরুত্ব দিয়েছে যা প্রশংসার দাবিদার। নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এই চারটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য। এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার জনমালিকানাভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন সরফরাজ চৌধুরী, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে ড. শাহদীন মালিক দায়িত্ব পালন করবেন। আমরা মনেপ্রাণে এবং পূর্ণাঙ্গভাবে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি এবং যেসব ব্যস্তিত্বকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা সবাই জনসাধারণের কাছে নন্দিত; কিন্তু আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করি আমাদের একটি আশা ছিল, প্রাথমিকভাবে বর্তমান সরকার শিক্ষা কমিশনও গঠন করবে। সেটি না দেখে আমরা কিছুটা হতাশ হয়েছি। আমরা তারপরেও বিশ্বাস করি আমাদের জাতির গর্ব এবং বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যার নিশ্চয়ই শিক্ষার জন্য এমন কিছু করবেন যা আমরা হয়তো চিন্তাও করিনি। শিক্ষা তার কাছে অগ্রাধিকার পাবে, এটি আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চ প্রশাসনিক পদগুলো পূরণ করে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা বোর্ডে দখলদারিত্বের রাজনীতি বন্ধ করার ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। অতীতে শুধু আওয়ামী মতাদর্শী না হওয়ার কারণে ২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত বিপিএসসি কর্তৃক সুপারিশকৃত অনেক প্রার্থী নিয়োগ বঞ্চিত ছিলেন, ৮ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে ২৫৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বর্তমানের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা হয়েছে। বই সংশোধন এবং পরিমার্জনের কাজ শেষ পর্যায়ে আছে। এ সংস্কারের কাজ অব্যাহত থাকবে। বর্তমান সরকারের প্রথম মাসে দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য মহোদয়গণ পদত্যাগ করেছেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এটা বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। ক্রমাগতভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এমন উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। এর ফলে সব সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ যেন উজ্জ্বল হয় সেটি নিশ্চিত করতে শিক্ষাব্যবস্থার দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পূর্ণ নজর রয়েছে বলে প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা সংস্কার চাই। আমাদের একান্ত অনুরোধ আমাদের ওপর যে সংস্কারের গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব দিয়ে আপনারা দর্শকের গ্যালারিতে চলে যাবেন না। আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকুন। আমরা একসঙ্গে সংস্কার করব। এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। আপনারা নিজ নিজ জগতে সংস্কার আনুন। একটা জাতির সংস্কার শুধু সরকারের সংস্কার বলে হয় না। আপনি যেখানে আছেন সেখানে সংস্কার নিয়ে আসুন।’ চমৎকার কথা বলেছেন। অনেকের শুধু অন্যের ওপর নির্ভর করে নিজের দায়িত্ব এড়াতে চান। সবকিছু যেন এমনিতেই হয়ে যাবে, সবই যেন সরকারকে করতে হবে এবং এই সরকারকে, এটি ভুল ধারণা। সবাই মিলে একই লক্ষ্যে আমরা অগ্রসর হতে চাই। আমাদের মধ্যে বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে আছে সেটা যেন বিনা বাধায় রাষ্ট্রের এবং সমাজের সহযোগিতায় প্রকাশ করা যায় সেই সুযোগের কাঠামো তৈরি করার প্রচেষ্টা সরকার চালিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র, শ্রমিক, জনতার এই বিপ্লবের লক্ষ্যকে আমরা দ্রুত বাস্তবায়ন করার উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে। সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে এবং জনগণকে মন খুলে সরকারের সমালোচনা করার আহ্বনা জানানো হয়েছে যা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। অথচ তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলো জনগণের কোনো সমালোচনাই শুনতে রাজি ছিল না। বর্তমান সরকার ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন করার কথাও চিন্তা করছে। আরও যেসব কমিশন সরকারসহ অন্য সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়, সেগুলোর পুনর্গঠন ও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে বর্তমান সরকার জানিয়েছে।
যে ছয়টি কমিশন ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হওয়ার পর কমিশন আনষ্ঠানিকভাবে আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করতে পারবে বলে প্রধান উপদেষ্টা আশাপ্রকাশ করেন। পরবর্তী তিনমাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে ধারণা করছেন তিনি। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শসভার আয়োজন করবে। চূড়ান্তপর্যায়ে ছাত্রসমাজ, নাগরিকসমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক তিন থেকে সাত দিনব্যাপী একটি পরামর্শসভার ভিত্তিতে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। এতে এই রূপরেখা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার একটি ধারণাও দেওয়া হবে। আরও বিভিন্ন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার কথাও প্রধান উপদেষ্টা পুনর্ব্যক্ত করেন। আমরা আশা করছি’ শিক্ষা কমিশনের’ কথা শিগগিরই ঘোষণা করা হবে কারণ শিক্ষার সংস্কারের সঙ্গে দেশের প্রতিটি বিভাগের উন্নয়ন, সততা ও প্রকৃত পেশাদারিত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পূর্ববর্তী সরকারগুলো শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটাই ‘লিপ সার্ভিস’ দিয়ে রাষ্ট্রের বাকি বিভাগগুলোতে অবৈধ সুযোগ-সুবিধার বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। ফলে, জনগণের কোনো উপকার হয়নি, সরকারগুলো নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি ধ্বংস করেছে আর শিক্ষাকে সবসময়ই অবজ্ঞা করেছে। কাজেই জনগণের পাহাড়সম আশা বর্তমান সরকার শিক্ষাকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাবে যেটি হবে বিশ্বমানের আর সেটি করার জন্য ‘শিক্ষা কমিশন’ গঠন একটি অপরিহার্য শর্ত।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক (সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজের শিক্ষক, চিফ অব পার্টি ব্র্যাক এডুকেশন এবং কান্ট্রি ডিরেক্টর-ভাব বাংলাদেশ)
বাংলাদেশকে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে অনেকগুলো সংস্কারের প্রয়োজন। ইতোমধ্যেই ৬টি কমিশনের বিষয়ে আমরা জানতে পেরেছি। আগামী ১ অক্টোবর থেকে পূর্ণাঙ্গ কমিশনগুলো কাজ শুরু করবে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে রাষ্ট্রীয় সংস্কার একটি কঠিন ও জটিল কাজ। সরকারের সদিচ্ছা সত্ত্বেও সব সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত সময় এবং সাধ্যের মধ্যে সম্ভব হবে কি না সেটি নিয়ে সংশয় রয়েছে। তারপরও আমাদের প্রত্যাশা ইতিবাচক। এ কথা সত্য, রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য একটি যৌক্তিক সময় প্রয়োজন। সেই সময় এবং ধৈর্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং দেশের জনগণের আছে কি না সেটি বলা মুশকিল। কারণ আমরা লক্ষ্য করেছি যে দুই একটি রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যেই বারবার নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত সংস্কার শুধু ছাত্র-জনতার সমর্থন নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর স্পষ্ট সহযোগিতা ও সমর্থনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নেওয়া ছাড়া সম্ভব নয়। স্বল্প সময়ে কোনোভাবেই জনগণের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার আসবে না। তবে সীমিত সময় বিবেচনায় নিয়েই সরকারকে সংস্কারের জন্য একটি অগ্রাধিকার নির্ণয় করতে হবে। যেসব অগ্রাধিকার বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি সেই দলগুলো নিয়ে আজকের এই লেখা।
প্রথম প্রয়োজন একটি নির্ভরযোগ্য এবং জনআস্থাসম্পন্ন নির্বাচনী কাঠামো। পরিস্থিতিটি যেন এমন হয়, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, সেই দলের অধীনে নির্বাচন হলেও তাদের পরাজিত হওয়ার শঙ্কা থাকবে। তারা নিশ্চিত থাকবে না, তারাই আবার ক্ষমতায় আসবে। এমন কোনো পরিস্থিতি কিংবা শঙ্কা থাকা যাবে না যে সরকারি দলের অধীনে বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিতে ভয় পাবে। যেকোনো পরিস্থিতিতেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী কাঠামো বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি। সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম ফাউন্ডেশন হিসেবে এই প্রক্রিয়াকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। কারণ আমরা জানি বাংলাদেশের ইতিহাসে যারা সরকারে থেকে নির্বাচন করেছে তাদের কেউ ভোটে হারাতে পারেনি। এ কারণে এমন একটি নির্বাচন কমিশন আমরা চাই যেখানে সব রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ জনগণের আস্থা থাকবে শতভাগ।
দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি খুবই গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে সেটি হলো সুশাসনের পথ নিশ্চিত করা। ভালো একটি নির্বাচনী কাঠামোর মধ্যদিয়ে যেই সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা যেন যথাযথ এবং ন্যায্য প্রক্রিয়ায় শাসন কাঠামো পরিচালনা করে- সে বিষয়ের একটি জবাবদিহিমূলক কাঠামো প্রস্তুত রাখা। এ জন্য আমাদের প্রত্যাশা একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে প্রয়োজনীয় কাঠামো তৈরি করা। সংসদ এবং সংসদের বাইরে নির্বাচনী প্রতিনিধিরা যেন একটি জবাবদিহিতার মধ্যে থাকে- তেমন একটি কাঠামো তৈরি করা জরুরি। সংসদ সদস্যদের সব আয়-ব্যয়ের হিসাব ওপেন-এক্সেস ইনফরমেশন ডেটাবেইজের ভিত্তিতে হতে পারে। একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে এবং পরে কী অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা কিংবা আয়-ব্যয়ের কাঠামোতে থাকে তার একটি সুনির্দিষ্ট ডেটাবেইজ থাকবে- যেখানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের সেটি পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ থাকবে।
দেশের মানুষ আর এমন কোনো কাঠামো দেখতে চায় না যেখানে বৈষম্যহীন ও ন্যায়ভিত্তিক পরিবেশ থাকবে না। কোনো রাজনৈতিক দল নীতিগতভাবে বৈষম্য হ্রাসের বিরোধিতা করতে পারে না। এ কারণে ঘুষ-দুর্নীতি, লুণ্ঠন, অর্থ পাচার, চাঁদাবাজি, ব্যাংকের অর্থ লুট বন্ধ করতে একটি স্বচ্ছ কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) এমন একটি অবস্থায় নিয়ে যাওয়া দরকার যাতে সরকারি দল কিংবা যেকোনো ব্যক্তিপর্যায়ে দুর্নীতিবাজ ভয়ে তটস্থ থাকে। দুদক চেয়ারম্যান এবং কমিশনার কে হবেন, তার ওপর অনেকটা নির্ভর করে দুদক কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে এমন ব্যবস্থা তৈরি হওয়া দরকার যে সরকারি দলের পছন্দে নয় বরং বিরোধী দলের পছন্দে দুদকের চেয়ারম্যান এবং কমিশনার নিয়োগের ব্যবস্থা রাখা। তাছাড়া সরকারি দল যতই নিরপেক্ষ ব্যক্তি পছন্দ করে দুদকের চেয়ারম্যান এবং কমিশনার নিয়োগ দেন না কেন, তাদের সফট কর্নার থাকতে পারে সরকারি দলের ব্যক্তিদের ওপর। এ জন্য দুদকের এমন একটি সংস্কার কাঠামো দেওয়া দরকার যাতে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার পর দুদক চেয়ারম্যান এবং কমিশনার একমাত্র তাদের মন মতোই যেন না হয়।
তৃতীয়ত, যে বিষয়টি অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন সেটি হলো- বিচারব্যবস্থায় একটি গ্রহণযোগ্য কাঠামো প্রস্তুত করা। বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়াবহ জিনিস হচ্ছে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের বেলায় কোনো ধরনের যোগ্যতার মানদণ্ড ঠিক করা নেই। কেবল সরকারি দল যে নিয়োগ করবে এবং ওই লোকটা যে আইনজীবী হিসেবে দশ বছর অথবা কোনো একটা অধস্তন আদালতে দশ বছর চাকরি করেছে এটুকু শর্ত পূরণ করলেই আদালত তাকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেবেন। এক্ষেত্রে ওইসব বিচারকের দলীয় চরিত্র দেখে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি সামনে আসতে পারে। এ জন্য এমন একটি কাঠামো প্রস্তুত রাখা দরকার যাতে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ থাকার পরই একটি সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার মানদণ্ড প্রতিযোগিতামূলক হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশে অনেক ধরনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় না। বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা এবং স্বাধীনতার ওপর দেশের সুশাসনের অন্যান্য ইন্ডিকেটর যথাযথভাবে কাজ করতে পারে।
আমরা সবাই জানি- আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতি এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে সমাজে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং কোনো সংস্কারের কাজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। কাজেই আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতি এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেকোনো সংস্কারের অগ্রাধিকার নির্ণয়ে মৌলিক নীতি ও মানদণ্ড হওয়া উচিত। যে সংস্কারগুলো আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সহায়ক, সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, অন্যদিকে যে সংস্কারগুলো আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে অবনতি বা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়, তা সংস্কারের বাইরে রাখা উচিত।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাষ্ট্র যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে তার জন্য মূলত দায়ী সমাজের নেতৃত্ব রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, আমলা, পেশাজীবী, গণমাধ্যম ও ব্যবসায়ী শ্রেণি। সাধারণ মানুষ সহজ ও সরল প্রকৃতির। তাই দেশের দুরবস্থার জন্য তারা মোটেও দায়ী নয়- এমন একটি ধারণা সমাজে রয়েছে। তবে একটি কথা প্রচলিত আছে, যার মর্মার্থ হলো, ‘যে দেশের জনগণ যেমন, রাষ্ট্র ঠিক তেমনই হয়ে থাকে।’ দেশের সম্পদ লুটের জন্য একজন দুর্বৃত্ত নেতা যেমন দায়ী, অজ্ঞতাবশত অথবা সামান্য টাকার লোভে ওই মানুষটিকে যে ভোট দিয়েছে সেও দায়ী।
রাজনীতির অন্যতম প্রধান কাজ মানুষকে সক্রিয় নাগরিকে রূপান্তর করা। তাদের রাজনীতি সচেতন এবং নাগরিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করা। একজন দুর্বৃত্তও যখন সমাজ সচেতন হয়ে ওঠে, তখন সে বুঝতে পারে যে ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে সমাজের স্বার্থ রক্ষাই দীর্ঘমেয়াদে তার ও তার সন্তানদের অধিক লাভবান করবে। তখন সে-ও সমাজের পক্ষে কাজ করে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল দায়িত্বই হলো জনগণের মাঝে সেরকম চিন্তার বিকাশ ঘটানো। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে আগ্রহী হয়- সেদিকটা পরিষ্কারভাবে কাঠামোগত অবস্থায় নিতে হবে। আমরা জানি, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো দেশ ও সমাজ গঠনের কোনো আদর্শভিত্তিক পরিকল্পনা কিংবা বক্তব্য দেয় না। ক্ষমতায় যাওয়াই হলো দলগুলোর সর্বশ্রেষ্ট লক্ষ্য। রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় সন্ত্রাস ও দুর্নীতি এবং আপত্তিকর বক্তব্যের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের প্রবণতা রাজনীতির বড় নিয়ামক। এমনকি আশ্চর্যের বিষয় হলো, নির্বাচন ও নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা নির্বাচন-উত্তরকালে খুবই সীমিত, প্রায় নেই বললেই চলে। কেননা একবার নির্বাচিত হওয়ার পর প্রার্থীরা নগ্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কের আরোপিত বাধা-নিষেধ ছাড়া আর কিছুই তোয়াক্কা করে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করার জন্য দেশের রাজনীতিবিদরা অতীতে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিন্তু সেগুলো তারা রক্ষা করতে পারেননি কিংবা রক্ষা করার চেষ্টা করেননি। সব সরকারই নাগরিক অধিকার সীমিত করতে আইনি ও আইনবহির্ভূত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাছাড়া জবাবদিহির বিষয়টি এখনো ‘সোনার হরিণ’ই থেকে গেছে। জবাবদিহিতার প্রশ্নটি যেহেতু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় এ কারণে জনপ্রতিনিধিরা নির্দ্বিধায় কটূক্তি কিংবা আপত্তিকর বক্তব্যে বিন্দুমাত্র পিছপা হয় না।
সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে- ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের এমন চেতনার হাত ধরে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও দেশে উদ্ভূত বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশের দুর্বলতার সুযোগে রাজনীতিতে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে বারবার। সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেই রাজনীতিবিদ তথা জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক স্থিতিশীল শিষ্টাচারসম্মত পরিবেশ গঠন করা সম্ভব হতে পারে। গণতন্ত্রের অপমৃত্যুর দিকে দেশ ধাবিত হোক এটা দেশের কোনো নাগরিক কিংবা রাজনৈতিক দলের জন্য কাম্য নয়।
লেখক:অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল কী এবং বন্যা কী ভয়ংকর হতে পারে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে এবার বাংলাদেশের মানুষ। বিশেষ করে নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামের মানুষ। কারণ এবার স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হলো এসব এলাকা। উপকূলবর্তী বাংলাদেশের মানুষদের এমনিতেই ঝড়-জলোচ্ছ্বাস তেমন একটা নাকাল করতে পারে না। অনেকটা সহিষ্ণু বিষয় তাদের কাছে এসব প্রাকৃতিক দুযোগ। কিন্তু এবার যেন অনেকটা বেশামাল করে দিয়েছে এসব এলাকার মানুষকে। কারণ এমন আকস্মিক বন্যা এসব এলাকার মানুষ এর আগে কখনো দেখেনি। হঠাৎ এই বন্যার ঢলে মানুষ যেন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। তাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই এসব এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। ডুবে যায় ঘরবাড়ি, ভেসে যায় হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলসহ নানা কিছু। প্রাণ বাঁচাতে মানুষ হন্যে হয়ে ছুটেছে দিগবিদিক। কোথাও যেন ঠাঁই মিলছে না এসব বানভাসি মানুষের। ঘরের চালে আশ্রয় আর গাছের ডাল আকড়ে ধরে স্রোত থেকে মানুষের বাঁচার যে আকুতি তা অসহায়ের মতো দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না অনেকের। ওই দৃশ্য যে কত ভয়ংকর তা কখনো ভুলবে না আক্রান্ত ওই সব এলাকার মানুষ। জীবন যে কত দুর্বিষহ হতে পারে তার কালের সাক্ষী স্মরণাতীত এই বন্যা।
কথায় আছে বিপদে বন্ধুর পরিচয়। কিন্তু বিপদে না পড়লে বোঝা যায় না বন্ধু কারে কয়। তাই বিপদে বন্ধুও নিষ্ঠুর হয়। অস্বীকার করব না ভারত আমাদের আজীবনের বন্ধু। অবিচ্ছেদ্য আত্মা। যাকে বলে হরিহর আত্মা। যদিও ইদানীং হরি এবং হর অনেকটাই পর, এক বন্ধু রাখে না আরেক বন্ধুর খবর। বাঙালিরা বরাবরই একটু বন্ধুবৎসল, দিলখোলা। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা সুগম করে। উপকারী বন্ধুর উপকার স্বীকার করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারত যে বন্ধুর পরিচয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সহযোগিতা করে যে ঋণাবদ্ধ করে রেখেছে সেই ঋণ শোধ করতেই এখন ত্রাহি মধুসূন অবস্থা। কাল কিয়ামতের আগে এই ঋণ শোধ হবে কি না কে জানে। তাই তো তাদের খুশি রাখতে আমাদের ডুবতে হয় ক্ষণে ক্ষণে। তবুও কষ্টও রাখি না মনে।
গত কিছু দিন আগে ভারী বৃষ্টি আর ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আমাদের দেশের আটটি জেলা প্লাবিত হয়ে গেল। এরই মধ্যে ভারত তাদের ফারাক্কার যে কয়টি বাঁধ ছিল তার সব কয়টি খুলে দিয়েছিল। ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ছিল, ভারত তাদের বন্যার চাপ মোকাবিলা করতে না পারায় তারা সীমান্তবর্তী এলাকার সবগুলো বাঁধ খুলে দিয়েছে। ফলে দ্রুত বেগে পানি ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে। এক দিনের ব্যবধানে প্লাবিত হয়েছে দেশের বৃহৎ অঞ্চল। বাংলাদেশ যখন অভিমানে মুখ টিপাটিপি করছিল তখন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে বুঝিতে দিল, ভুল বুঝিও না বন্ধু, আমরা তোমাদের শত্রু নই। আমরা কোনো বাঁধ খুলে দিইনি। পানির চাপে বাঁধ আপনাআপনি খুলে গেছে। এক মুখে দুই কথা। তাতে সমস্যা নাই, বন্ধু বলে কথা। আমরা বন্ধুর ওই কথা ঐশী বাণী বলে বুকে ধারণ করলাম। প্রবল বন্যায় ডুবিলাম। ডুবিয়া মরিলাম, মরিয়া ভাসিলাম।
আমরা বরাবরই যে বৈষম্য লক্ষ করে আসছি সেটা হলো ফারাক্কার বাঁধ। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। এর স্থায়ী কোনো সমাধান হয়নি আজও। বরং সময় সময় সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। যেমন এবারকার বন্যা পরিস্থিতি। ভারত যতই বলুক না কেন তারা বাঁধের মুখ খুলে দেয়নি আপনাআপনি খুলে গেছে। এ কথা তারা যত সহজভাবে বলতে পারে আমরা তত সহজভাবে মেনে নিতে পারি না।এর আগে তো এ রকম কোনো বাঁধ নিজ থেকে খুলে যায়নি।এখন কেন খুলে গেল? অর্থাৎ আগেও তাদের ইচ্ছাতেই বাঁধ বন্ধ রাখা হয়েছে, এখন আবার তাদের ইচ্ছাতেই খুলে দেওয়া হয়েছে।
আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ফারাক্কার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পানি বণ্টন বিষয়ে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল, উভয় দেশ একটি চুক্তিতে আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না। পরে কাজীর গরু গোয়ালে আছে কেতাবে নেই-এর মতো অবস্থা। দুই দেশের পানি বণ্টন চুক্তি হলো কিন্তু মানা হলো না।
শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর যেমন পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি হয়েছিল ঠিক তেমনই একটি চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। চুক্তিটি ছিল ৩০ বছর মেয়াদি। ওই চুক্তিতে উল্লেখ ছিল ভারত কখন ফারাক্কার বাঁধ খুলবে আবার কখন বন্ধ রাখবে। এ কথা সত্যি ভারতের সঙ্গে পানিবণ্টন চুক্তিতে বাংলাদেশের জনগণ খুশির জোয়ারে ভাসছিল। অবশ্য পরে বারবার ফারাক্কার পানিতে ডুবছিল। এখনো বাংলাদেশ পানিতে ডুবছে। তাই এ চুক্তি শুভঙ্করের ফাঁকি ছাড়া আর কিছুই না।
ফারাক্কার বাঁধ যে মরণফাঁদ এটা ভালোভাবেই আঁচ করতে পেরেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তাই তিনি ১৯৭৬ সালে ফারাক্কা লং মার্চের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন ভারত যদি বাংলাদেশকে পানির হিস্যা না দেয় তাহলে পানি আদায়ের আন্দোলন চলবে। এ-সংক্রান্ত একটি চিঠিও লিখেছিলেন ইন্দিরা গান্ধিকে। তখন তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছরের বেশি। ওই সময় তিনি অসুস্থও ছিলেন। তারপরও আন্দোলন থেকে দমে যাননি ভাসানী। দেশবাসীকে অবাক করে দিয়ে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে রাজশাহী থেকে লং মার্চ শুরু করেন। আরও অবাক করার বিষয়, এই লংমার্চ ছিল ৬৪ কিলোমিটার লম্বা একটি যাত্রা। যা পৃথিবীতে ছিল নজিরবিহীন এক ঘটনা। আক্ষেপ, তারপর আমরা পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। বন্যায় ডুবছি, খরায় মরছি।
ফারাক্কার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে যেটা করে আসছে সেটা ইঁদুর-বিড়াল খেলা ছাড়া কিছুই নয়। সে জন্যই তো শুকনা মৌসুমে পানির অভাবে বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গ মরু ভূমিতে পরিণত হয়। যেখানে অথই পানি থাকার কথা, সেখানে খা খা বালুর চর। যেখানে নৌকা-স্টিমার চলার কথা, সেখানে গরুর গাড়ি চলে। ভারতের কাছে তখন পানির জন্য ধরনা দিয়েও আমরা কোনো পানি পাই না। আর যদি কখনো কিছু পাই সেটা হলো বানরের রুটি বণ্টন। যা ভারতেরই উদরপূর্তি, আমাদের চরম দুর্গতি। আমরা সহজ কথায় যেটা বুঝি সেটা হলো, ভারতের যখন পানির প্রয়োজন হয় তখন তারা বাঁধ আটকে রাখবে, আর যখন তারা বন্যায় আক্রান্ত হবে তখন বাঁধ খুলে দেবে। এখানে পানি বণ্টনের হিস্যা কোনো মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয় হলো প্রয়োজন হলে বাঁধ আটকে রাখা এবং প্রয়োজন না হলে বাঁধ খুলে দেওয়া। এই সমস্যা দূরীকরণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী চুক্তিতে উপনীত হওয়া দরকার। কিন্তু সেটা কোনো কালে সম্ভব হবে কি না জানি না।
শেখ মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি গেল নিষ্ফলে, শেখ হাসিনা-দেবগৌড়ার চুক্তিও গেল বিফলে। এখন দেখার বিষয় ড. মোহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের সঙ্গে ফারাক্কার চুক্তি নিয়ে কোন পথে চলে।
রবীন্দ্রনাথের গানে আছে ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই’। ফারাক্কার পানির হলো সোনার হরিণ। সেটা আমরা পাব না। সেটা পাবে ভারত। আর যদি আমরা পানির জন্য বিচার চাই তাহলে বলবে বিচার মানি কিন্তু তালগাছ আমার। সুতরাং আমরা যে উজান থেকে নেমে আসা বন্যা থেকে রেহাই পাব না তা সহজেই অনুমেয়। তাহলে উপায়? উপায় একটাই আছে, তা হলো ভারতের সঙ্গে আমাদের যে পানি বণ্টন চুক্তি রয়েছে তার সঠিক বাস্তবায়ন। আর তা না হলে বিকল্প পথের সন্ধান।
লেখক: কবি ও সাহিত্যিক
এক সময়কার প্রবল ক্ষমতাধর আওয়ামী লীগ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা তুমুল ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছে। ছাত্রদের সাধারণ একটা দাবিকে ঘিরে সৃষ্ট আন্দোলনকে গুরুত্ব দেয়নি পতিত সরকার ও তার দোসররা। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। পৃথিবী তথা এই উপমহাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস প্রমাণ করে কোনো কালেই ছাত্রদের রক্তদান বিফলে যায়নি। ২০২৪-এ যার ব্যত্যয় ঘটেনি। একজন রাষ্ট্রপ্রধান যখন মনে করেন তার দেশের সব দলমতের জনমানুষের তিনিই প্রভু, তখন তার পতন কেউ ঠেকাতে পারে না। আবার যে রাষ্ট্রপ্রধান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন তিনি জনমানুষের কর্তা নন, সেবকমাত্র। তার সুনাম, যশ ধ্বংস হওয়ার তেমন কোনো ক্ষেত্র সৃষ্টি হওয়ার সুযোগই থাকে না। ১৯৯০-এর গণআন্দোলনে ওই সময়ে প্রায় শতাধিক মানুষ প্রাণ বির্সজন দেয়। পতন হয় তৎকালীন স্বৈরাচার সরকারের। ইতিহাসের ঘূর্ণায়নে সরকারের পালাবদলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। টানা প্রায় ১৬ বছর তারা ক্ষমতায়। ২০২৪ জুলাই মাসে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ছাত্র আন্দোলন দমাতে রাষ্ট্রযন্ত্র শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। ১৫ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২২ জন। আহত হন ১৮ হাজার। বৃহৎ এই হত্যা তালিকায় ছাত্র-জনতার কাতারে পথচারী, রিকশা, ভ্যানচালক, ফল বিক্রেতা, শিশু-কিশোররাসহ সর্বস্তরের জনমানুষ রয়েছেন। ছাত্র আন্দোলন ঘিরে থানা পুলিশে আক্রমণ হয়েছে। লুটপাট হয়েছে অস্ত্র-গোলাবারুদ। প্রায় ৪০ জন পুলিশ নিহত হয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে যখন দেশ ছাড়েন ওইদিন থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগ (৮ আগস্ট) পর্যন্ত আরও প্রায় শতাধিক মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। একটি গোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে অন্য আরেকটি গোষ্ঠীর লোকজনদের বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেমন লুটপাট, ভাঙচুর হয়েছে তেমনি নিপীড়ন, নির্যাতন কিংবা মারধরের শিকার হতে হচ্ছে অনেকেরই। দেশের ১২ হাজার স্কুল শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করানো হয়েছে। ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট এই চার দিন দেশ মহাসাংবিধানিক সংকট অতিবাহিত করেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমানুষকে অবস্থান গ্রহণের যে ভদ্রোচিত আহ্বান বারবার জানাচ্ছেন, তাতে যথেষ্ট ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এ দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কালচারটা প্রতিষ্ঠিত মুদ্রার নেতিবাচক এপিট-ওপিট। তবে দেশের প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেই সৎ, দেশপ্রেমিক এবং নিবেদিত অনেক মানুষ রয়েছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার ভিন্ন আঙ্গিকে সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে জনমানুষের সেবক হিসেবে ইতিহাস গড়তেই পারেন। যা বিগত সরকারগুলো করতে পারেননি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার জন্য উদগ্রীব ছিলেন এমনটি ভাবার ফুরসত নেই। সাংবিধানিক সংকট এবং জাতির ক্রান্তিকালে এরা যে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন তাতে সর্বস্তরের জনমানুষের উচিত সরকারকে সমর্থন করা এবং সার্বিক সহযোগিতা প্রদান। একই সঙ্গে এই সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্রের উচিত দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করা। সব মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, লুটপাট হওয়া অস্ত্র গোলাবারুদের মধ্যে এখনো উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৮৮৫টি অস্ত্র এবং ৩ লাখ গোলাবারুদ। এটা ভয়ংকর আতঙ্কের সংবাদ। বিশ্বাস, অত্যাধুনিক যুগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে অভিযান চলছে, তাতে তারা সকল প্রকার ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করে অভিযানের সাফল্য ঘরে তুলবে। তবে অভিযান হতে হবে স্বচ্ছ এবং পরিচ্ছন্ন। কোনো বাহিনীর হেফাজত এবং অভিযান পরবর্তী কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হোক এটা কখনো সাধারণ বিবেক গ্রহণ করে না, করবেও না। মজার বিষয় হলো, মামলা মোকদ্দমার ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে ২০২৪-এর আন্দোলন পরবর্তী মামলা-মোকদ্দমায়। আসামির তালিকায় কে নেই, নেতা-নেত্রী, পুলিশ, বিচারক, সাংবাদিক সবাই রয়েছেন। তাও আবার প্রায় সবাই খুনের মামলার আসামি। এদিকে গণহারে মামলা, অন্যদিকে দাগী আসামিদের ছাড়া পাওয়ার সংবাদ মানুষের মধ্যে এক ধরনের বাড়তি আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। হাস্যকর বিষয় হলো- ছাত্ররা পরীক্ষায় বসবে না বলে আন্দোলন করতে গিয়ে হু হু করে ঢুকে গিয়েছিল সচিবালয়ে, আনসার বাহিনী দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে আন্দোলন করতে গিয়ে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসক নিয়োগ ক্ষেত্রে বঞ্চিতরা অভিযোগ করেছিল যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তারা নাকি আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী। জাতি দেখে আসছেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা দলবাজি করে যুগে যুগে লুটপাট করেছে ঠিকই; কিন্তু বরাবরই এরা পাড় পাওয়ায় এদের মধ্যে ‘বঞ্চিত’ বা ‘সুবিধাভোগী’ বিশেষণগুলো গেড়ে বসেছে। প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তা সংঘবদ্ধ আন্দোলন করতে পারেন না। এরপরও কেন এমনটা হচ্ছে! সম্প্রতি বিভিন্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে দাবি-দাওয়ার নামে যে জ্বালাও-পোড়াও চলছে এটা এক ধরনের অরাজকতা। এগুলোকে ছাড় দেওয়া উচিত নয়। মনে রাখতে হবে ‘সভ্যতাকে টিকাতে হলে অসভ্যকে ছাড়তে নেই।’ (শিক্ষক ও নাট্যকার)।
লেখক: শিক্ষক ও নাট্যকার
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। গত ৫ আগস্ট একটি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে দেশের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন সরকার উৎখাতের এক দফা সংগ্রামে পর্যবসিত হয়েছিল ১৭ জুলাই। ধারণা করা হচ্ছে, ১৭ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাযজ্ঞে মৃতের সংখ্যা কয়েকশ ছাড়িয়ে গেছে। এমনি এক কঠিন সময়ে দায়িত্ব নেওয়া নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, বিগত ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান চলাকালে নরসিংদী, কাশিমপুর, শেরপুর, বগুড়াসহ কয়েকটি জেল ভেঙে আসামি পলাতক আসামি গ্রেপ্তার এবং জেলখানার লুট হওয়া অস্ত্র, বেশ কিছু থানার লুট হওয়া অস্ত্র দ্রুত সময়ে উদ্ধার করা, ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং রেমিট্যান্স বাড়ানো, উচ্চমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ. সর্বগ্রাসী দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা, খেলাপি ঋণ দ্রুত আদায় করা ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা ও পাচার হওয়া টাকা দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা, নাগরিক সেবায় নিয়োজিত সংস্থাসমূহের দুর্নীতি বন্ধ সেবা নিশ্চিত করা, সরকারি কেনাকাটি, টেন্ডারের কারসাজিতে সরকারি অর্থের হরিলুট, অপচয় বন্ধ করার পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবে ধুঁকতে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিংবা সামগ্রিক অর্থনীতির নানান সংকটকে উতরে নেওয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
তাছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ১১ দিনের মাথায় এরইমধ্যে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডবে প্রায় এক কোটি লাখ মানুষ আশ্রয়হীন, গৃহহীন হয়েছে। সম্পদের ক্ষতি আরও বিপুল বিশাল। তাই এ ক্ষতিটি স্বভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করাটাও সরকারের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যদিও এসব অঞ্চলের দুর্গত মানুষের সহায়তায়, আত্মমানবতার দুর্ভোগ লাগবে, ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই মর্মবাণী হৃদয়ে ধারণ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে প্রাচ্যের অক্সফোর্ট ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের টিএসসিতে স্থাপিত ত্রাণকেন্দ্রে শিশুশিক্ষার্থীসহ রাজধানী সর্বস্তরের মানুষের সামর্থ্য অনুযায়ী অংশগ্রহণ এক মানবিক উদাহরণের সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলসমূহ, সামাজিক সংগঠন, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠনও ত্রাণ, কাপড়, শিশুখাদ্য, ওষুধসহ বন্যাকবলিত মানুষকে উদ্ধার ও সর্বাত্মক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- বন্যাপরবর্তী এসব এলাকার মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি নির্মাণ, সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ‘প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিল’-এ ত্রাণ সহায়তায় একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ওই তহবিলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প গ্রুপ থেকে আশানুরূপ অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা জমা হচ্ছে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীমণ্ডলীর সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যরা বন্যাকবলিত বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণ ব্যাহত রেখেছে। আশা করছি বন্যা উপদ্রুত এলাকায় বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রমসহ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যবস্থা সচল ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে, ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার, বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার, আর্থিক খাতের সংস্কারের অঙ্গীকার রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের। সরকারের জন্য অগ্রাধিকারমূলক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক করা। ইতোমধ্যে বহু ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পর্যটন ব্যবসা, পরিবহন ব্যবসা, আইটিভিত্তিক ব্যবসা, হোটেল-মোটেল ব্যবসা থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসা পর্যন্ত বিপর্যস্ত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হবে ব্যবসা সচল করার জন্য ছোট, মাঝারি ও ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের স্বার্থ গুরুত্ব দেওয়া। কারণ এসব প্রতিষ্ঠান অর্থনীতির, বিশেষত গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ। দেশে প্রায় এ ধরনের ৭০-৮০ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্প সচল করতে হবে অবিলম্বে। তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে হবে। দেশের অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোয় জনবান্ধব এবং সেবা নিশ্চিত ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতির লাগাম টানা, পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ সব সরকারি অফিসকে ঢেলে সাজাতে হবে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি করা দরকার। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জনপ্রত্যাশা পূরণ করে সবকিছু সম্পন্ন করার জন্য তারা কতটুকু সময় পাবেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। প্রত্যাশা এবার বাংলাদেশে সত্যি সত্যিই একটি ‘সফল সামাজিক বিপ্লব’ সম্পন্ন হবে। ‘আর এই প্রত্যাশার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর দুজন সমন্বয়কও উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়।
বিগত ১৬ বছরে পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় জনআস্থা, জনগণের বিশ্বাসের জায়গায় প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে পুলিশ। পুলিশ রাষ্ট্র এবং জনগণের প্রতিপক্ষ তথা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে নির্বিচারে মানুষ হত্যায় লিপ্ত হয়েছে। এর ফলে জনরোষ সৃষ্টি হয় যা এক শিশু তার পিতার কোল থেকে নেমে এক পুলিশ সদস্যকে দেখে তার দিকে ছুটে গিয়ে কিল ঘুষি মারার দৃশ্যই মনে করিয়ে দেয় পুলিশের ওপর দেশের মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
অবশ্য অধ্যাপক ইউনূস দেশে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে কাজে নেমে পড়েছেন। আমরা দূঢ়ভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর সম্পূর্ণরূপে আস্থা এবং বিশ্বাস রাখতে চাই, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করতে মনোনিবেশ করবেন। তারপর অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত দুর্নীতি ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান। পুঁজি পাচারের মূল রয়ে গেছে দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের লাগামহীন সর্বগ্রাসী বিস্তার রোধ করে পাচার হওয়া অর্থ দ্রুত ফেরত আনা এবং ব্যাংকগুলোর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ উদ্ধার করার। মার্কিন ইতিহাসবিদ ব্রুক অ্যাডামস জানাচ্ছেন, ১৭৫৭ সালের পর বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে কাঠের জাহাজে পুঁজি পাচার এত বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছিল, ওই জাহাজগুলোকে লন্ডন বন্দরে মাল খালাস করার জন্য প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হতো। এই লুণ্ঠন-পর্বকে ইতিহাসবিদরা ‘দি বেঙ্গল লুট’ নামে অভিহিত করে থাকেন। বলা হচ্ছে, ওই লুণ্ঠিত পুঁজি ইংল্যান্ডের ‘প্রথম শিল্পবিপ্লবে’ তথা শিল্পায়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছিল। বর্তমানে এই ‘ঘৃণ্য জাতীয় দুশমন’ পুঁজি পাচারকারীরা প্রতি বছর গড়ে ১৫০০-১৬০০ কোটি ডলার পুঁজি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পাকিস্তানি পুঁজি পাচারকারীদের ভাবশিষ্য হচ্ছে বর্তমানে দেশের নব্য পুঁজি পাচারকারীরা।
প্রসঙ্গত, বিগত ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে পরিচালিত দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের আদলে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের আরেকটি ‘ঝাঁকুনি’ প্রয়োজন। অবশ্য একই রকম মন্তব্য দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের। অবশ্য পরবর্তীতে দুদকের ওই অভিযান এবং দুদক আইনের পুনঃসংশোধন করায় নানান মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয়। ২০০৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত দুদক অর্ডিন্যান্সটি সংসদে অনুসমর্থন (রেটিফাই) না করে দুদককে ‘নখদন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত করেছিলেন বলে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান মন্তব্য করেছিলেন।
‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্র আন্দোলনের অবস্থানও ‘রাষ্ট্রের সংস্কার’-যা একটি বড় ও সময় সাপেক্ষ। কিন্তু বিষয়টি বহুমুখী ও সময় সাপেক্ষ-দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। তাই এটি হবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এটা হবে একটা কঠিন কাজ। প্রথমত, তারা অনির্বাচিত। দ্বিতীয়ত, তাদের মেয়াদ কতদিনের, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিষয়টি গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা দরকার। দীর্ঘমেয়াদি কাজ অনেক, সেসব দেখতে হবে অবশ্যই। আর সেসব সমস্যা চিহ্নিত, বহুল আলোচিত। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে বহুদিন ধরে চলে আসা রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পাশাপাশি আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনও অত্যন্ত জরুরি। এসব করা না গেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিলিত রক্ত স্রোতে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানের ফসল আবার হারিয়ে যাবে কৃষ্ণগহ্বরের অতলে। একই সঙ্গে হারিয়ে যাবে কোটি কোটি কোটি মানুষের আশা ও সোনালি ভবিষ্যৎ। মনে রাখতে হবে পতিত শাসকদের মতো নতুন করে আয়নাঘর বানিয়ে তা অন্যকে দেখাতে না নিয়ে নিজের মুখ আয়নায় দেখতে হবে, যেন সেই চেহারায় বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের চেহারা ভেসে আসে, জনগণের চোখের ভাষা, মুখের ভাষা এবং অন্তরে জমে থাকা অব্যক্ত ভাষার প্রতিফলন ঘটে। প্রতিফলন ঘটে ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা, আস্থা এবং বিশ্বাসের। মনে রাখতে হবে, দেশ আর দেশের মানুষের কল্যাণ, অগ্রগতি, শান্তি, মঙ্গল, উন্নয়নও অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত।
লেখক: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।
প্রতি বছরই বাংলাদেশে গ্রীষ্মের শেষার্ধ থেকে শরতের প্রথমার্ধে এক বা একাধিকবার বন্যা দেখা দিয়ে থাকে। বিশ্বের অন্যতম প্রধান বৃষ্টিবহুল অঞ্চল উত্তর-পূর্ব ভারতে বর্ষাকালে যে বৃষ্টিপাত হয়, তা নদীপথে গড়িয়ে এসে সমতলের বাংলাদেশে বন্যা ঘটায়। বার্ষিক এই প্লাবন বঙ্গীয় ব-দ্বীপের ফসলি জমির উর্বরতা যেমন রক্ষা করে, তেমনই অভ্যন্তরীণ ভূমির উচ্চতা বাড়ায় ও উপকূলীয় ভূমির সম্প্রসারণ ঘটায়। নদীর সঙ্গে জলাভূমির সম্পর্ক রক্ষা করে; মৎস্যসম্পদের আবাসন ও প্রজনন প্রক্রিয়াও সুরক্ষিত রাখে। কিন্তু এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা কীভাবে জীবন ও সম্পদ বিনাশী হয়ে উঠতে পারে তা প্রায় প্রতি বছরই কমবেশি সে চিত্র দেখা যায়। বিভিন্ন নদী অববাহিকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের যে ১১২টি পানিস্তর পরিমাপক স্টেশন রয়েছে; পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটের বন্যা মানচিত্রে চার রঙের সূচক থাকে যেমন সূচকের রং ‘সবুজ’ মানে নদীপ্রবাহ স্বাভাবিক; বন্যার ঝুঁকি নেই, নদীর প্রবাহ যদি বাড়তে শুরু করে এবং বিপৎসীমার নিচেই থাকে, তাহলে সূচকের রং হবে ‘হলুদ’, বিপৎসীমায় পৌঁছলে বা বন্যা দেখা দিলে সূচকগুলো ‘কমলা’ রং ধারণ করবে এবং প্রবল বন্যা দেখা দিলে ‘লাল’ হয়ে যাবে। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেঘনা অববাহিকা এবং উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানিস্তর পরিমাপক স্টেশনগুলোর সূচক ছিল লাল ও কমলা। মধ্যাঞ্চলের সূচকগুলো ছিল হলুদ। এখন যখন সব সূচকই সবুজ, তখন কি আমরা আশ্বস্থ হবো?
শনিবার (৩১ আগস্ট) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে সম্প্রতি বন্যায় দেশের ১২ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলায় এখনো পানিবন্দি রয়েছেন ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫৪ লাখ ৫৭ হাজার ৭০২ জন। সূত্রে জানা যায়, বন্যায় দেশের মোট ১২টি জেলার ৬৮টি উপজেলার ৫০৪টি ইউনিয়ন/পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলাগুলো হলো- ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ সিলেট, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। বন্যায় ৫৯ জন মারা গেছেন। এরমধ্যে পুরুষ ৪১ জন, মহিলা ৬ জন, শিশু- ১২ জন। মৃতদের মধ্যে কুমিল্লা ১৪ জন, ফেনী ২৩ জন, চট্টগ্রাম ৬ জন, খাগড়াছড়ি ১ জন, নোয়াখালী ৯ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ১, লক্ষ্মীপুর ১ ও কক্সবাজার ৩ জন, মৌলভী বাজার ১ জন। আর ১ জন নিখোঁজ রয়েছেন। পানিবন্দি/ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দিতে জন্য মোট ৩ হাজার ৯২৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩০৫ জন লোক এবং ৩৬ হাজার ১৩৯টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে মোট ৫১৯টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের এ পর্যন্ত ত্রাণ দেওয়া হয়েছে, ৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে নগদ, ২০ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন চাল, ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৩৫ লাখ টাকার শিশুখাদ্য এবং ৩৫ লাখ টাকার গো-খাদ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে।
কৃষি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতির ফলে অনেক পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস নষ্ট হয়ে গেছে, যা খাদ্যনিরাপত্তার ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়া, যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অনেক এলাকায় মোবাইল টাওয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। সেনাবাহিনী ত্রাণ প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে এবং খাদ্য ও অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করছে। তবে পরিস্থিতির তীব্রতার কারণে এই প্রচেষ্টা এখনো অপর্যাপ্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) মাধ্যমে ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এই ত্রাণ সংগ্রহ অভিযানটি বন্যার্তদের জন্য খাদ্য, পানি এবং অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতে সহায়ক হচ্ছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে, ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহের জন্য বুথ স্থাপন করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সহায়তা আহ্বান করছেন। তারা বিভিন্ন দাতা সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বন্যার্তদের কাছে পৌঁছানোর জন্য পরিকল্পনা করছেন।
দেশে বন্যার প্রকৃতি ও ক্ষয়ক্ষতি মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। প্রথমত, উজান থেকে কী পরিমাণে পানি আসছে। দ্বিতীয়ত, কত দ্রুত বা ধীরগতিতে পানি আসছে আর কতদিন ধরে সেই পানি বাংলাদেশে থাকছে। তৃতীয়ত, দেশের নদী-নালা-খাল-বিলে পানির ধারণক্ষমতা। উজানের ভারতীয় অঞ্চলে এবং দেশের ভেতরের প্রাকৃতিক স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ তিন ক্ষেত্রেই জটিলতা বেড়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে। বিশেষত উজান থেকে আসা পলির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে নদীর তলদেশের গভীরতা কমে নদীর পাড়ভাঙন বাড়ছে। আবার শুকনো মৌসুমে নদীগুলোর পানি পরিবহনক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে এ পলি নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদী ভরাট করে ফেলছে। আবার দেশের ভেতরের নদ-নদীর নাব্য কমে যাওয়া, চ্যানেলগুলো বন্ধ হওয়ার কারণেও দিন দিন বন্যা বাড়ছে। এসব সংকটের সমাধান করতে না পারলে বন্যার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলবে না। বন্যা মোকাবিলায় সব কর্তৃপক্ষকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন বন্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। এটি একটি আপদকালীন অবস্থা, যা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই আরও খারাপ হয়েছে। পুকুর, খাল ও হাওর যেগুলো এক সময় এ অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং বন্যার সময় অতিরিক্ত পানির জলাধার হিসেবে কাজ করত, গত কয়েক দশকে সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অবিবেচনাপ্রসূত উন্নয়ন, নগরায়ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ সরকারি নীতির কারণে এমনটা হয়েছে। ওই এলাকায় অনেক নদ-নদীও দখল করা হয়েছে। এতে গ্রীষ্মকালে এগুলো শুকিয়ে যায় এবং স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই উপচে পড়ে। দেশের প্রধান নদীগুলোকে দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা নিতে হবে। বছর বছর নদী খননের জন্য অর্থ বরাদ্দ হলেও সে অনুপাতে কাজ হয় না। দেশের নিম্ন এলাকার মানুষকে বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে হলে লোক দেখানো নদী খননের কাজ বন্ধ করতে হবে। টেকসই ও পরিকল্পিত উপায়ে নদী খননে পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্যার্তদের সহায়তায় বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিজেদের কাজের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এই সংকটের সময়ে সহায়তার জন্য তাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অর্থ, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ করছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মীরা নিজেরা কিছু পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করে তা বন্যার্তদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করছেন, যাদের সহায়তার ফলে অনেক বন্যার্তের খাবারের অভাব মেটানো সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া, অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছে। তারা বন্যার্তদের জন্য খাদ্য বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন প্রকার সহায়তা করছেন। কিছু সংস্থা স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য মেডিকেল টিম পাঠাচ্ছে এবং পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব রোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করছে।
সাম্প্রতিককালের বন্যাগুলোর ভয়াবহতা বৃদ্ধির বেশ কিছু মানবসৃষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। যার মধ্যে অন্যতম হলো পাহাড়ের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করায় ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করা এবং অতিবৃষ্টির সময় হঠাৎ বাঁধের সব পানি ছেড়ে দিয়ে বাঁধের ভাটির জনপদে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করা হচ্ছে যেমন পদ্মা নদীর উজানে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ ও তিস্তার নদীর উজানে ভারতের গজলডোবা বাঁধ থেকে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ বাঁধের সব দরজা খুলে দিয়ে পদ্মা ও তিস্তা নদীর উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যেমন- পররাষ্ট্র, পানি সম্পদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারে যা সময়ের দাবি বলে প্রতীয়মান হয়। মনে রাখতে হবে, দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ যার অবস্থান এখন সপ্তম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম যা ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে যা জার্মানিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচ থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছে। তাই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদান বাড়াতে হবে, আঞ্চলিক সমন্বয় বাড়াতে হবে। আগামীতে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে বন্যার কথা জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে এবং দায়ীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে: দীর্ঘমেয়াদিভাবে বন্যা প্রতিরোধে আন্তঃনদী পানিপ্রবাহ সংযোগসহ যেসব আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে তার সফল প্রয়োগ সময়ের দাবি বিশেষত ভারত ও চীনের সঙ্গে। এখন পর্যন্ত গঙ্গা চুক্তির সুফল আমরা তেমন কিছুই পাই নাই এবং যা হয়েছে তা হলো শুষ্ক মৌসুমে আমরা মৃত পদ্মা পেয়েছি যা রাজশাহী অঞ্চলের মরুকরণকে ত্বরান্বিত করছে। এখন বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে কূটনীতিতে বিশেষত ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সর্বশেষ বিষয়গুলোতে যে সফলতা দেখিয়েছে তা আরও জোরদার করতে হবে। সবশেষে বলা যায় এখন আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির যে অঞ্চলগুলো ফি-বছর বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে তা নিয়ে সরকারের নির্ভাবনা জোরধার করতে হবে এবং এখন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এবং বৃহৎ নদ-নদীগুলোর দ্বারা বন্যাকবলিত দুই তীরের জনপদের জীবন-জীবিকার স্বার্থে সরকার যদি এগিয়ে না আসে তবে আঞ্চলিক বৈষম্য কমবে, ভৌগোলিকভাবে মানুষ তার ভিটেবাড়ি কম হারাবে এবং দরিদ্র নিরশন কর্মসূচি আরও সফল হবে। সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বন্যা খরার বিষয় এবং এর ফলে গ্রামীণ জীবনের যে পরিণতি সেগুলো অগ্রাধিকার কাজের মধ্যে রাখছেন এবং এগুলোর বাস্তবায়নে সমন্বিত কর্মসূচির কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: গবেষক
“ধনধান্যে পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা, ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, ও সে সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।”
গানটিতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই স্বপ্নিল দেশের বর্ণিল রুপের বর্ণনা দিয়ে দেশ প্রেমের অনুভূতিতে সবাইকে উদ্বেলিত করেছেন। দেশের জন্য এই গান গেয়ে বিদেশের মাটিতে সবচেয়ে বেশি শিহরিত হতে দেখি প্রবাসীদের। এই গানের কলি ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ নিয়ে কিছু কথা বলার তাগিদ অনুভব করেই আজকের এই লেখা।
আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল আমাদের দেশের গ্রামে গঞ্জে এখন অনেক ধানী জমি শহরের আদলে বদলে যাওয়ার দরুন বড় বড় মিল-কারখানা, দালানকোঠা, রিসোর্ট ইত্যাদি তৈরি ও নদী নালা, খাল বিল ভরাট ও দখলের ফলে ফসলি জমির স্বল্পতা ও কৃষি যন্ত্রপাতির অপর্যাপ্ততা লক্ষণীয়। এতে আগামী দিনে সহজে ধানী জমিতে ফসল উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যাপক বাধা ও ঝুঁকি রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
বিশ্বব্যাপী তৃতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী হিসেবে আমাদের দেশ বাংলাদেশের অবস্থান যা অবশ্যই দৃষ্টান্ত স্বরূপ, এত অল্প জমিতে এত ফসল তাও আবার অন্যতম খাদ্য- ধান।
উৎপাদন ২০২৩ সালে প্রায় ৩৯.১ মিলিয়ন টনে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে তিনটি মৌসুমে এই অর্থকরি ফসল ধান চাষ করা হয়, যেমন- আমন, আউশ ও বোরো। বোরো হলো অগ্রণী ধান উৎপাদনকারী ফসল, যা সেচ ও সারের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এরপর রয়েছে আমন ও আউশের অবস্থান। এই অবস্থান ও খাদ্য ঘাটতি লাঘবে আমাদের ধান উৎপাদনে আরও বেশি নজরদারি দরকার।
আমাদের দেশে প্রতি বছরের মতো এ বছর রংপুর জেলায় আমন ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শেষ হয়েছে গত ৩১ আগস্ট।
ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ৮ হাজার ৮৬২ মেট্রিক টন, কিন্তু গুদামজাত হয়েছে ৫ হাজার ৭৭৪ টন। সংগ্রহের ক্ষেত্রে পরিমাণগত ঘাটতির বিষয়টি অত্যন্ত চিন্তনীয়। আমাদের ভাবতে হবে কেন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলো না। কারণ উৎপাদনের ঘাটতি, যা পূরণ করতে হলে আমাদের দ্রুত বিকল্প পথে এগোতে হবে।
চাল আমদানি করে নিয়মিত ঘাটতি লাঘব করা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার, কারণ দেশে বর্তমানে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার ঘাটতি রয়েছে। নিজেদের উৎপাদিত ধানের দ্বারা আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
এবং আমাদের পক্ষে কৃষিতে বিপ্লব সম্ভব, যদি একটু নজর দিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতির মূল্য ও সহজলভ্যতা কৃষকের অনুকূলে থাকে, সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার পানিতে ডুবে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট সুনামগঞ্জসহ দেশের অনেক জেলার সোনালী ফসল পানিতে ডুবে যায়, যেখানে কয়দিন আগেও সবুজে ভরপুর ছিল ফসলের খেত, কৃষকরা আশায় প্রহর গুনছিলেন এবার ভালো ফলন হবে ঘরে বাম্পার ফসল তুলবেন, হঠাৎ রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈষম্যবাদী ছাত্র জনতার মেধাভিত্তিক কোটা বাতিলের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পরিবর্তন এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভারতীয় বাঁধভাঙা পানি ও অতি বৃষ্টির ফলে হঠাৎ ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষকের ফসলি জমি, বাড়িঘর, গৃহপালিত পশু, গরু-ছাগল হাঁস-মুরগি ইত্যাদি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অবর্ণনীয়। তার পরে যা হয়েছে, তা হলো পানি নেমে যাওয়ার পর ওইসব বন্যাপ্লাবিত এলাকার ফসলি উঁচু নিচু সব প্রকার জমিতে পড়ে থাকতে দেখা যায় বালুর স্তূপ। এই বালুর স্তূপ রেখে জমিতে চাষাবাদ কিছুতেই সম্ভব নয়। মহাবিপদে পড়েছেন বিশেষ করে ফেনী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও মৌলভীবাজার জেলার প্রান্তিক কৃষকরা, এখন তাদের মাথায় হাত, কারণ এই আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককুল অর্থনৈতিকভাবে চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছেন এই পরিস্থিতিতে তাদের মাঠের পর মাঠ কৃষি জমিকে আবাদযোগ্য করে গড়ে তুলতে এখনই দরকার আর্থিক সহযোগিতা ও কৃষি যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা, প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারিভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতা। উল্লেখ্য, ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৭০-এর দশকের প্রথমদিকে এদেশে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়। বস্তুত তখন কৃষিক্ষেত্রে রূপান্তরের মাধ্যমে ‘সবুজ বিপ্লব’ ঘটাতে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু করা হয়, যার লক্ষ্য ছিল উচ্চফলনশীল শস্যের জাত, উন্নত সেচব্যবস্থা ও যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যতা হ্রাস করা। ওই সময়ে তৎকালীন সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাদের সহায়তায় দেশে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার চালু করার জন্য কর্মসূচি শুরু করেছিল।
ওই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, কম্বাইন হারভেস্টার এবং অন্যান্য কৃষি সরঞ্জাম আমদানি ও বিতরণ। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক ছিল ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন সংক্ষেপে বিএডিসি প্রতিষ্ঠা। বিএডিসি যন্ত্রপাতি আমদানি, ভর্তুকি প্রদান এবং কৃষকের সুবিধার্থে ঋণ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গত কয়েক বছরে দেশে, বিশেষ করে প্রধান প্রধান কৃষি অঞ্চলে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার, কৃষিপ্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি খাত বিভিন্ন কর্মসূচি, প্রশিক্ষণ, উদ্যোগ এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে। লক্ষণীয়, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং কৃষিব্যবস্থায় এর গ্রহণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে একধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ক্ষুদ্র কৃষক, যারা কৃষি কর্মশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, তারা প্রায়ই আধুনিক যন্ত্রপাতিতে প্রবেশাধিকার ও সামর্থ্যের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন।
আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার দেশের কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে- এ কথা সত্য যেমন ট্রাক্টর, কম্বাইন হার্ভেস্টার এবং সেচব্যবস্থা কৃষিকাজের কার্যকারিতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে। এই প্রকার মেশিনগুলো কৃষকের কাজকে দ্রুত ও কার্যকরভাবে সম্পন্ন করতে সহায়তা করে, যার ফলে ফলন বৃদ্ধি পায় এবং শ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায় এবং গবাদি পশুর ব্যবহার কমে আসে। ফলে কৃষকের ব্যয়ভার ও জনবল কম পরিলক্ষিত হয় এবং এর ফলে ব্যাপকভাবে খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে। এটি মানব শ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে। যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে চাষ দেওয়া, বীজ বপন, ফসল কাটা এবং সেচের মতো কাজগুলো স্বল্প সময়ে ও কম শ্রমিক দিয়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে। এটি কৃষকের আয় এবং সামগ্রিকভাবে জীবিকার সুযোগ বৃদ্ধি করে। মনে রাখা দরকার যে, কৃষি কাজে আমাদের দেশে ইদানীং লক্ষণীয়ভাবে কৃষি শ্রমিক অর্থাৎ কৃষকের অপ্রতুলতা লক্ষণীয়। আধুনিক তথা উন্নতমানের কৃষি যন্ত্রপাতি চাষাবাদকে অনেকাংশে নির্ভুল করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাক্টরে জিপিএসভিত্তিক নির্দেশিকা সিস্টেমগুলো থাকার ফলে সুনির্দিষ্ট রোপণ পদ্ধতি ও নিষিক্তকরণে সক্ষম করে, ইনপুট অপচয় হ্রাস করে এবং ফসলের গুণমান উন্নত করে। উপরন্তু, যন্ত্রপাতি, কীটনাশক ও ভেষজনাশক প্রয়োগে সহায়তা করে, পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে আরও কার্যকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে।
ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এবং কৃষিপণ্যের গুণগত মান রক্ষার জন্য ফসল-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক যন্ত্রপাতি, যেমন শস্য শুকানোর যন্ত্র এবং পর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধা ফসল কাটার পর অপচয় কমাতে সাহায্য করে। এটি কৃষককে সর্বোত্তম সময়ে তাদের পণ্য সংরক্ষণ ও বিক্রিতে সহায়তা দান করে। ফলে বেশি লাভ হয় এবং খাদ্যের অপচয় কম হয়। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির সঙ্গে উন্নত দক্ষতা, উচ্চ উৎপাদনশীলতা এবং খরচ সাশ্রয় কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখতে সাহায্য করে। তাৎক্ষণিকভাবে শ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস এবং সম্পদের সঠিক ব্যবহার করার মাধ্যমে কৃষক উচ্চফলন এবং কম উৎপাদন খরচ নিশ্চিত করতে পারে।
তাছাড়া আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির অধিক ব্যবহার কৃষি খাতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে, কৃষকের মনে আশার সঞ্চার হয় এবং সম্প্রতি এ দেশে ব্যাপক হারে কৃষি উন্নয়নে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। এর দ্বারা বিদ্যমান যন্ত্রপাতি উন্নত করতে, স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী নতুন যন্ত্রপাতি তৈরি করতে এবং টেকসই চাষাবাদের উপায় খুঁজে বের করার গবেষণা ও উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে উদ্দীপিত করে। কিছু কিছু কৃষি যন্ত্রপাতি বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব হয়েছে। এর সবকিছুই বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের কৃষি খাতের সামগ্রিক অগ্রগতি ও প্রতিযোগিতায় অবদান রাখতে পারে। ফসলের উন্নয়নে কীটনাশক ও সারের মতো রাসায়নিক ব্যবহারও সঠিকভাবে পরিচালনা করা প্রয়োজন। অন্যথায় পরিবেশ দূষণ আরও বেশি তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। উপরন্তু, যন্ত্রপাতি থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব রাখে।
আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার প্রচলিত হওয়ার ফলে কৃষকের মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভরতা তৈরির ঝুঁকিও রয়েছে। যদি কৃষকের যন্ত্রপাতি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব থাকে, তাহলে তারা বাইরের পরিষেবা প্রদানকারীদের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে। ফলে তাদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা হ্রাস পেতে পারে। উপরন্তু, প্রজন্মের মধ্যে একটি দক্ষতার ব্যবধান দেখা দিতে পারে। কারণ বেশি বয়সী কৃষকের তুলনায় অল্পবয়স্ক কৃষক আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও মেরামতে আরও পারদর্শী হতে পারে। যন্ত্রপাতির আকার ও নকশা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে এর ব্যবহারযোগ্যতা সীমিত করতে পারে, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় এর কার্যকারিতা ও গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যেমন, কিছু আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি বড় আকারের সমতল কৃষিব্যবস্থার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের ছোট ও পাহাড়ি খামারের জন্য কম উপযোগী।
কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাবগুলো মোকাবিলা করা এবং উপযুক্ত নীতি ও সহায়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রভাবগুলো হ্রাস করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে দ্রুত আর্থিক প্রণোদনা প্রদান, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতিতে প্রবেশাধিকার উন্নত করার জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি। উপরন্তু, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি সম্পর্কে প্রচার, সঠিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন দেশের সর্বস্তরের জনগণ। এ দেশের গ্রামোন্নয়নে- বিশেষ করে বানভাসি জনতার আশা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টাবৃন্দ এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন এবং বন্যা প্লাবিত এলাকাগুলোয় কৃষিবান্ধব পরিবেশ তৈরি ও ধানী জমি থেকে বালু অপসারণে কৃষকদের আর্থিক সহায়তাদানে সঠিক পদক্ষেপ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে কৃষিভূমিতে ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্যশস্য আমদানি-নির্ভরতা লাঘবে সচেষ্ট হবেন।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক
মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিনের নিকট ইসলামই একমাত্র মনোনীত দ্বীন; সুরা আল ইমরানের ১৯নং আয়াতে স্পষ্ট করে বলা আছে আর এই দ্বীনে মহান আল্লাহ নারীর মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। নর-নারীর সমন্বয়েই মানবজাতি। নারী জাতি হলো মহান আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত। আল্লাহ তায়ালা নারীকে পুরুষের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে মানবজীবন পরিচালনার জন্য পারস্পরিক সহযোগী করেছেন। ইসলাম মর্যাদার দিক দিয়ে নারীকে পুরুষের থেকে ভিন্ন করে দেখেনি। বরং ইসলামের আগমনেই নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত নারীসমাজ পেয়েছে মুক্তির সন্ধান। সারা দুনিয়াতে যখন নারীরা নিদারুণ অবস্থায় কালাতিপাত করছিল তখন আরব, ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে তাদের জন্তু-জানোয়ার বলে মনে করা হতো এবং মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মর্যাদা ও অধিকার স্বীকার করা হতো না, তখন ইসলাম নারীর যথাযথ অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করে নারী জাতিকে সম্মানের সুউঁচু আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষরা মনে করেন, পুরুষরা যা করতে পারবে নারীরা তা পারবে না, তাই নারীদের অনেক বেশি অবজ্ঞার চোখে দেখে অথচ ইসলাম নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। কখনো মা হিসেবে, কখনো স্ত্রী হিসেবে, কখনো মেয়ে হিসেবে, আবার কখনো বোন হিসেবে। ইসলাম আগমনের আগে জাহিলিয়াতের অন্ধকার যুগে নারীরা ছিল চরম অবহেলিত ও ঘৃণিত। তখন তাদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু পর্যন্ত হরণ করা হতো।
নারীর সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষায় ইসলাম প্রয়োজনীয় সব বিধান দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে সুরা ‘নিসা’ (অর্থ: নারী) নামে একটি সুরাও আছে।
নিম্নে ইসলামে নারীর সম্মান বিষয়ে কিছু তথ্য সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করছি:
নারী যখন মা: মহান আল্লাহ নারীকে মায়ের মর্যাদা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন-হাদিসে মাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ জারি করেছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণ করো।’ (সুরা: বনি ইসরাঈল, আয়াত: ২৩)
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), মানুষের মধ্যে আমার সদ্ব্যবহারের সর্বাপেক্ষা অধিকারী ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, তোমার মা। সে বলল, এরপর কে? তিনি বলেন, এর পরও তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বলেন, তার পরও তোমার মা।
সে বলল, এরপর কে? তিনি বলেন, এরপর তোমার পিতা। (মুসলিম, হাদিস: ৬৩৯৪)
সুবহানাল্লাহ! এতে করে স্পষ্ট হয়ে যায়, ইসলাম সর্বোচ্চ নারীকে সম্মান দেয় বলেই আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের সম্মানের ব্যাপারে এতটা গুরুত্বারোপ করেছেন।
নারী যখন স্ত্রী: নারী যখন স্ত্রী, তখনো তাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ নারীদের তার বিশেষ নিদর্শন বলে আখ্যা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে আছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে সে সম্প্রদায়ের জন্য, যারা চিন্তা করে।’ (সুরা: রুম, আয়াত: ২১)
ইসলাম নারীকে রানীর মর্যাদা দিয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে। একজন শাসক সে তার অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন পুরুষ তার পরিবারের রক্ষক, সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন স্ত্রী তার স্বামীর গৃহের রক্ষক, সে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন গোলাম তার মনিবের সম্পদের রক্ষক, সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব সাবধান, তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি, হাদিস: ৫১৮৮)
নারী যখন মেয়ে: ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, সন্তানরা আল্লাহর নিয়ামত। আর মেয়ে-সন্তানরা পুণ্য। মহান আল্লাহ নিয়ামতের হিসাব নেন, আর পুণ্যের প্রতিদান দেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তিকে কন্যাসন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সে ধৈর্যের সঙ্গে তা সম্পাদন করেছে, সেই কন্যাসন্তান তার জন্য জাহান্নাম থেকে আড় (প্রতিবন্ধক) হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১৯১৩)
নারী যখন বোন: ইসলামে মেয়ে এবং বোনের সঙ্গেও সদাচরণ করার তাগিদ দিয়েছে। আবু সাঈদ আল-খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারই তিনটি মেয়ে অথবা তিনটি বোন আছে, সে তাদের সঙ্গে স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করলে জান্নাতে যাবে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১৯১২)
নারী যখন অনাত্মীয়: নারী অনাত্মীয় হলেও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ইসলামের সৌন্দর্য। তার নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন থাকা সবার দায়িত্ব। ইসলামের ইতিহাসে নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় বনু কাইনুকা গোত্রের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এক সাহাবি তার মুসলিম বোনের সম্ভ্রম রক্ষায় জীবন দিয়ে দিয়েছেন।
আবু আওন থেকে ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন, এক দিন জনৈকা মুসলিম নারী বনু কাইনুকা গোত্রের বাজারে দুধ বিক্রি করে বিশেষ কোনো প্রয়োজনে এক ইহুদি স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে বসে পড়েন। কয়েকজন দুর্বৃত্ত ইহুদি তার মুখের নেকাব খোলানোর অপচেষ্টা করে, তাতে ওই নারী অস্বীকৃতি জানান। ওই স্বর্ণকার গোপনে মুসলিম নারীটির (অগোচরে) পরিহিত বস্ত্রের এক প্রান্ত তার পিঠের ওপরে গিঁট দিয়ে দেয়, তিনি তা বুঝতেই পারলেন না। ফলে তিনি উঠতে গিয়ে বিবস্ত্র হয়ে পড়েন। এই ভদ্র মহিলাকে বিবস্ত্র অবস্থায় প্রত্যক্ষ করে নরপিশাচের দল হো হো করে হাততালি দিতে থাকল। মহিলাটি ক্ষোভে ও লজ্জায় মৃতপ্রায় হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন। তা শুনে জনৈক (প্রতিবাদী) মুসলিম ওই স্বর্ণকারকে আক্রমণ করে হত্যা করেন। প্রত্যুত্তরে ইহুদিরা মুসলিম লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে। এরপর নিহত মুসলিমটির পরিবারবর্গ চিৎকার করে ইহুদিদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের কাছে ফরিয়াদ করেন। এর ফলে মুসলিম ও বনু কাইনুকার ইহুদিদের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত বাধে। প্রায় ১৫ দিন সে গোত্রের দুর্গ অবরোধ করে রাখার পর তাদের সবাইকে বন্দি করা হয়। (ইবনে হিশাম: ২/৪৭, আর রাহিকুল মাখতুম [বাংলা]: ২৪০/২৪২)
পবিত্র কোরআন মজিদের সুরা বাক্বারাহর ১৮৭নং আয়াতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, হে মানব সকল! তোমরা তোমাদের স্বীয় প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদের একই আত্মা (আদম) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং ওই আত্মা থেকে তার জোড়া (হাওয়া)-কে সৃষ্টি করেছেন এবং এতদুভয় থেকে বহু নর ও নারী বিস্তার করেছেন। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা পরস্পরের নিকট (স্বীয় হকের) দাবি করে থাক এবং আত্মীয়তা (এর হক বিনষ্ট করা) থেকেও ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সবার খবর রাখেন’ (নিসা ১)।
বিবাহের মাধ্যমে নারীকে অধিকার ও মর্যাদা দান:
জাহিলী যুগে বৈবাহিক ক্ষেত্রে নারীদের কোনোরূপ অধিকার ছিল না। তারা শুধু পুরুষের ভোগের সামগ্রী ছিল। ইসলাম এহেন ঘৃণিত প্রথার মূলোৎপাটন করত: নারী ও পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে। এই মর্মে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, তবে যেসব নারী তোমাদের পছন্দ হয়, তাদের মধ্য থেকে দুই দুই, তিন তিন, চার চারজনকে বিবাহ কর। কিন্তু তোমাদের মনে যদি আশঙ্কা জাগে যে, তোমরা তাদের সঙ্গে ইনসাফ করতে পারবে না। তাহলে একজন স্ত্রী গ্রহণ কর অথবা তোমাদের দাসিদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ কর। অবিচার থেকে বাঁচার জন্য এটাই অধিক সঠিক কাজ’ (নিসা ৩)
স্বামী নির্বাচনের স্বাধীনতায় ক্ষেত্রে নারীকে অধিকার ও মর্যাদা দান:
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীদের পছন্দমতো স্বামী গ্রহণের কোনো অধিকার ছিল না। যখন-তখন তাদের পাত্রস্থ করা হতো। কিন্তু ইসলাম নারীকে স্বামী নির্বাচনের স্বাধীনতা দিয়েছে। যে কেউ ইচ্ছা করলে বলপূর্বক কোনো নারীর স্বামী হতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে পুরুষরা! তোমরা মহিলাদের (স্বীয় স্বামী নির্বাচন করে) বিয়ে করাতে বাধা প্রদান করো না’ (বাক্বারাহ: ২৩২)।
এই আলোচনা থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, ইসলাম নারীদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার প্রতি কতটা গুরুত্ব দিয়েছে।
লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ
বর্তমানে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নানা প্যারামিটার বিবেচনায় এনে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা উঠে এসেছে। সেহেতু সম্যক ধারণার জন্য জাতীয় সংগীতের ইতিবৃত্তসহ শানে নুযুল নিয়ে কিছু জানা-অজানা কথা তুলে ধরার প্রয়াসী হয়েছি। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, জাতীয় সংগীত হলো একটি দেশের দর্শনের আওতায় প্রতিফলিত রাগ-রাগিনীর সুরের মূর্চ্ছনার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কেননা একটি দেশের জাতীয় সংগীত শুনলেও বোঝা যাবে জাতিগত দিক দিয়ে শিল্প-সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণা, প্রকৃতি ও ঐহিত্যগত নির্যাসের প্রাণবন্ত গঠনমূলক মিষ্টি আমেজ। উল্লেখ্য, জাতীয় সংগীতের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো National Anthem; আর এ Anthem; শব্দটি অপভ্রংশ হয়ে এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে। এর বাংলায় অর্থ দাঁড়ায়- ভজনগান, স্তর, স্তোত্র ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় সংগীত সেই গান, যাতে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের প্রতিভ‚ হিসেবে সামগ্রিক প্রকৃতি ও সত্তা ফুটে ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি...’। এ গানটি নেওয়া হয়েছে রবিঠাকুরের স্বরবিতান গীতি কাব্যগ্রন্থ থেকে। গানটি রচিত হয় ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে পূর্ব-পশ্চিম উভয়বঙ্গের একই সূত্রে গাঁথার উদ্দেশ্যে। বাস্তবে কতটুকু পেরেছে, তা সম্মানিত পাঠকরা আপনারা সবাই অবহিত আছেন। যাহোক, এটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায়। এ গানের সুর দিয়েছেন কবি গুরু নিজেই। আর সুর নাকি নেওয়া হয়েছিল গীতিকবি গগন হরকারার কাছ থেকে। এদিকে আমার সোনার বাংলার গানের ২৫টি চরণ সংবলিত প্রথম ১০ লাইন, যা ১৯৭১ সালে ৩ মার্চ স্বাধীনতা ইস্তেহারে পল্টন ময়দানে গৃহীত হয়। এটি বাংলাদেশ সংবিধানের ৪নং অনুচ্ছেদ উল্লেখ আছে। ইংরেজিতে অনুবাদ করেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান।
মূলত জাতীয় সংগীত দেশের গণমানুষের মধ্যে জাতীয় চেতনা ও দেশাত্মবোধকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সাধারণত বিভিন্ন দেশে এই মহান গান জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে গাওয়া হয়ে থাকে। এই গানের মেলোডির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে হৃদয় কাড়া নানা যন্ত্রের সুরের মূর্চ্ছনার আবেশ, যা শুনে প্রতিটি নাগরিকের তনু মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। আর আনুষ্ঠানিক হলে তো কথাই নেই, দাঁড়িয়ে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতে হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, স্পেনে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সঙ্গে কোনো শব্দ ব্যবহার করা হয় না।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, প্রথমে এই সাধের জাতীয় সংগীত সৃষ্টি ও পরিবেশনার কার্যক্রমটি প্রথম কখন থেকে শুরু হয়েছে? এ প্রেক্ষিতে উল্লেখ্য, যতদূর জানা যায় নবম শতাব্দীতে জাপানে ‘কিম গাও নামে এ ধরনের একটি গানের প্রচলন ছিল। আর এটাই বিশ্বের প্রথম জাতীয় সংগীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যাহোক, এর মধ্যে শত শত বছর পার হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশে সংগীত থাকলেও জাতীয় সংগীত হিসেবে তেমন কিছু পরিলক্ষিত বা বিশেষায়িত হয়নি। সময়ের পরিক্রমায় সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় নানা দেশে পরিবর্তন আসতে থাকলে ১৬০০ দশক থেকে ব্রিটিশরা সারাবিশ্বের উপনিবেশগুলোতে বিশেষ অবস্থান নিতে থাকে এবং একই সঙ্গে তাদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বিভিন্নভাবে বিকাশ হতে থাকে। আর সেই আমেজে ১৭৪৫ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে জাতীয় সংগীত প্রবর্তিত হয়। আর এই ক্ষেত্রে গানটি ছিল রাজাকে ঘিরে ÒGod save the kingÓ অবশ্য এ গানটি রচয়িতা নিয়ে মতভেদ থাকলেও, যার কথা সর্বজন স্বীকৃতি, তিনি হলেন- মি. হেনরী বেরী। তিনি ১৭৪৩ সালের দিকে ডেটিংগেন নামক যুদ্ধে ইংরেজদের বিজয় উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতে এই গানটি প্রথম রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধশত বছর কেটে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তখন ওপরের দিকে ওঠার পালা, যা অর্থনীতির ভাষায় টেক অব স্টেজ বলে অভিহিত। সেই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নানা দিকে উন্নতি সাধিত হতে থাকে এবং এই আবর্তে জাতীয় সংগীত প্রবর্তিত হয়। এই জাতীয় সংগীতের নাম ÒThe star spangled bannerÓ, এর বাংলা মানে হলো এ দেশের অন্তর্গত সকল রাজ্যের প্রতিভূ হিসেবে তারকার চুমকি বসানো পতাকা। গানটি রচনা করেন ১৮১৪ সালে একজন সাধারণ সৈনিক, যার নাম মি. ফ্রান্সিস স্কট কী। এদিকে ফ্রান্সের জাতীয় সংগীত রচিত ও প্রবর্তিত হয় ১৭৯২ সালে, যার নাম ‘লা মার্সেলেজ’। অবশ্য এর রচনার পেছনে একটি মজার কাহিনী শোনা যায়। সেই সময়ে নাকি ফ্রান্সের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ চলছিল। তখন একটি কথা জনমনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগে যে ফরাসিদের জন্য ভালো কোনো রণসংগীত বা জাতীয় সংগীত নেই। এ প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর রুজেট দ্য নীল নামে জনৈক ক্যাপ্টেন ঝোঁকের মাথায় এক ঘণ্টার মধ্যে এই অনবদ্য গান রচনা করেন। এই গানটির কথা ছিল ÒAllons enfants de la partie Le jour de glorie est. aribeÓ, এর বাংলা অর্থ হলো ‘পিতৃভূমির হে সব সন্তানেরা কোথায় রে তোরা, দেখ না চেয়ে কীর্তিলাভের সময় দুয়ারে উপস্থিত’। গানটির সুরও তিনি নিজেই দিয়েছিলেন এবং নাম রেখেছিলেন ‘রাইন বাহিনীর রণসংগীত।’ এদিকে ফরাসি বিপ্লব শুরু হলে অগণিত বিপ্লবীরা মার্সেলজে শহর হতে যখন সদলবলে রাজপ্রাসাদ আক্রমণের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল। তখন তাদের মুখে মুখে ছিল এ গানটি। পরবর্তীতে এটির ফ্রান্সের জাতীয় সংগীতরূপে স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তৎপর যে দেশের কথা উঠে আসে, সেটা হলো চেকোস্লোভিয়া। এ দেশের দুটো জাতি-চেক এবং স্লোভাক। চেকদের প্রিয় গান ছিল Kde domor i meej, যার অর্থ ‘কোথায় মোর সাধের দেশ’। অন্যদিকে স্লোভাকদের প্রিয় গান হলো Nad tatrou se Bilyska, এর বাংলা অর্থ হলো ‘শৈল মাথায় শিরে বিজলী জ্বলে’। যাহোক, পরবর্তীতে এই দুটো গানই এ দেশের দুটো জাতির জন্য জাতীয় সংগীতরূপে স্বীকৃতি লাভ করে। তৎপর যে দেশটির কথা আসে, সেটা হলো সুইজারল্যান্ড। এর জাতীয় সংগীত হলো তিনটি। উল্লেখ্য, এ তিনটি গান বসবাসরত জার্মান ও ফরাসি জনগণের ভাষাকে ঘিরে। কেননা এ দেশে দুটো ভাষা প্রচলিত বিধায় জার্মানভাষীদের রয়েছে একটি প্রিয় গান এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ফরাসিদের জন্য দুটি গান। এছাড়া রাশিয়ার জাতীয় সংগীতের নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল’। এদিকে সুইডেনের জাতীয় সংগীতের কথা হলো ‘সুইডেনের এ হৃদয় হতে’। তাছাড়া বেলজিয়ামের জাতীয় সংগীতের নাম হলো ‘এথনিকস ইন্সস’। এ গানটি জাতীয় গাথা থেকে প্রণীত হয়েছে। এছাড়া জার্মানদের জাতীয় সংগীতের নাম হলো- ÒDeutschuberalles, Uberalles in der welt,Ó -এর অর্থ হলো ‘পিতৃভূমিই জগতের সকলের সেরা’। যাহোক, এই সময়ে ইউরোপের প্রায় দেশে জাতীয় সংগীতের ক্ষেত্রে সাড়া পড়ে যায় এবং সেই সূত্র ধরে বিশ্বের সব দেশে একের পর এক জাতীয় সংগীত প্রবর্তিত হতে থাকে। বর্তমানে বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই, যার জাতীয় সংগীত নেই। অনেক দেশে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে যুগপৎ রণসংগীতও আছে। বাংলাদেশের রণসংগীত হলো চল্-চল্-চল্ .., যা নেওয়া হয়েছে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সন্ধ্যা’ নামক কাব্য গ্রন্থ থেকে। এই রণসংগীতটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে শিখা নামক একটি পত্রিকায়। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- প্রায় জাতীয় সংগীত রচয়িতার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট উদ্যোগী ব্যক্তিত্ব, অধিব্যক্তিত্ব, কবি ও লেখকদের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের আদি প্রেক্ষাপটে ছিল ভিন্ন মাত্রার।
বিগত ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে এটিএন নিউজের ডেক্স রিপোর্ট থেকে এই মর্মে শুনিলাম, অধুনা জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা বলেন; গুম থেকে মুক্তি পাওয়া সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা সাবেক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহ হিল আমান আজমি। তিনি উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের নেপথ্যে আছে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আওতায় দুই বাংলা এক করার গান। এই গানে সামগ্রিক জাতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় সংগীতের জন্য এই গান লেখেননি। লিখেছেন দুই বাংলা এক করার মানসে। তাই তাকে অযথা নেতিবাচকভাবে টানাহেঁচড়া না করাই শ্রেয়। যাহোক, জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা উঠে আসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোস্তাক আহমেদের সময়ে। তখন একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ‘চল্ চল্ ...’ এবং ফারুক আহমেদের ‘পাঞ্জেরি’ কবিতা, জাতীয় সংগীত হিসেবে সুপারিশ করেন। এদিকে দ্বিতীয় উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৭৯ সালে। সেই সময়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ; আমার শেষ বাংলাদেশ...’ এর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তৎপর তৃতীয় উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০১-২০০৬ সালে। কিন্তু পরিবর্তিত কোনো গানই আলো বাতাসের মুখ দেখেনি।
জাতীয় সংগীত পরিবর্তন নিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক কথাই হচ্ছে। বস্তুত কোনো প্রপঞ্চে অপরিবর্তনীয় বলে কিছু নেই। সময়, অবস্থা ও উপযোগিতার আড়ালে পরিবর্তনশীল। যা জনগণ চাই, সেটাই হওয়া সমীচীন। তবে জাতীয় সংগীত যেহেতু সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সেহেতু সহজে পরিবর্তন করা হয় না বা যায় না। কেননা এটি পরিবর্তন করতে হলে আইনগত দিক দিয়ে দেশের পার্লামেন্ট তথা গণভোটের আবশ্যকতা অপরিহার্য। কিন্তু জনগণের দাবির মুখে পরিবর্তনশীল। যতদূর জানা যায়, তাতে প্রতিভাত হয় যে নেপাল, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরাক, আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, রুয়ান্ডা, লিবিয়া, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, জিম্বাবুয়ে, কঙ্গো, ঘানা ও নামিবিয়ায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তিত হয়েছে।
পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা.....’-র মতো খণ্ড চিত্র নয়। জাতীয় সংগীত এমন হওয়া বাঞ্ছনীয়, তাতে দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সামগ্রিক প্রকৃতি ও সত্তা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। তখন পাবলিক লাইব্রেরিতে চাহিদা অনুযায়ী বই খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ জাতীয় সংগীত নিয়ে লেখা একটি বই চোখে পড়ে। সেই সময়ে ওই বইটি নিয়ে পড়ি। পড়ার পর মনে হয় আমাদের জাতীয় সংগীত গান হিসেবে হৃদয় স্পর্শ করলেও জাতীয় সংগীতের বৈশিষ্ট্য দিক দিয়ে সঠিক নয় বলে প্রতীয়মান হয়; কিন্তু স্পর্শকাতরের আদলে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে এ কথা লিখতে সাহসী হইনি। তবে অনেক ফোরামে মৌখিকভাবে বলতে গিয়ে নাজুক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি। তথাপিও শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অর্থাৎ ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে (২১ ফেব্রুয়ারি) ‘প্রবন্ধ ভাই-বোন কবিতা’ শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করি। আর দেশ মাতৃকার টানে বিবেকের তাড়নায় এ বইয়ের ৩৯ পৃষ্ঠা থেকে ৪৬ পৃষ্ঠায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে সাহসী ভূমিকা পালন করি। শুধু তাই নয়, এই বইয়ের কয়েকটি কপি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্তও পাঠাই। অবশ্য অনেকেই বলেছিলেন, এই দুঃসাহসিক কাজ করার জন্য আমার নাকি বড় বিপদ হতে পারে; কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। কেননা সত্য সর্ব সময়ে সত্যই থাকে। আর সত্য হলো মহাপরাক্রমশালী।
লেখক: বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত
রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সময় যে আমলাতন্ত্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল তা-ই কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে চালু রয়েছে। আমাদের ছাত্রাবস্থায় এবং গত শতাব্দীর আশির দশকের গোড়ার দিকে সরকারি চাকরিতে যোগদান করে সরকারের আমলাতন্ত্রের উচ্চপদে সিএসপিদের পেয়েছি। আমলাদের অবশ্য পালনীয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- সততা ও নিষ্ঠা, বিধি-বিধানের যথাযথ পরিপালন, নিরপেক্ষতা ও যখন যে রাজনৈতিক সরকার দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে তাদের নীতি বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনে বস্তুনিষ্ঠ পরামর্শ প্রদান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন সত্ত্বেও আমলাতন্ত্রের রূপ ও কর্মপদ্ধতি নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত খুব একটা বদলায়নি।
বলতে গেলে আমলাতন্ত্রে অবক্ষয় শুরু হয় সিএসপি যুগের অবসানের পর বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে। আমরা দেখেছি, যে আমলারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কাজ করেছেন, তারাই খন্দকার মোশতাক ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এবং পরবর্তীতে স্বৈরশাসক এরশাদের সময়ও কাজ করেছেন। রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ওই একই আমলারা তৎকালীন বিএনপি সরকারের শাসন কার্যে সহায়তা করেছেন। তবে আমলাতন্ত্রকে রাজনীতিকীকরণ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে সাবেক সিএসপি সচিব মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ‘জনতার মঞ্চে’ যোগদানের মাধ্যমে।
২০০১-২০০৫ সালে বিএনপি শাসনামলে রাজনৈতিক সরকারের ধারণা হয়েছে ১৯৭৩ সালে যোগদানকৃত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারা যেহেতু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদের দ্বারা রিক্রুট, সেহেতু তাদের পূর্ণ আনুগত্য আওয়ামী লীগের ওপর। সে জন্য বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা (১৯৭৩ ব্যাচ) সিনিয়র কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। তৎকালীন সরকার বিএনপি সমর্থিত একটি অনুগত আমলা শ্রেণি বেছে নেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ইতোপূর্বে বিএনপি শাসনামলে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদেরকে পেছনের তারিখ থেকে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী পদোন্নতি দিয়ে বকেয়া বেতন-ভাতাসহ আর্থিক সুবিধা প্রদান করে। এ সরকার ধারাবাহিকভাবে তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পর ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে জয়লাভ করে চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, এ সরকারের সময় অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচন দেশে বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সরকারের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নিয়োজিত কতিপয় দলকানা আমলা, পুলিশ বাহিনী, নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগে নিয়োজিত প্রভাবশালী আমলারা ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনে সরকারকে সহায়তা করে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রেখেছে। স্বাধীনতার পর যোগদানকৃত সিভিল সার্ভিসের প্রতিটি ব্যাচে বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী- দুই ঘরানার কর্মকর্তা সৃষ্টি হয়। অনেক নিরপেক্ষ কর্মকর্তা শুধু বিএনপি আমলে জেলা প্রশাসক কিংবা মন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করার কারণে বিএনপি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আওয়ামী লীগ শাসনামলে আর পদোন্নতি পাননি। মেধা ও যোগ্যতা বাদ দিয়ে দলীয় আনুগত্যই পদোন্নতি পাওয়ার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। অনুরূপভাবে ১৯৯৬-২০০১ সালে জেলা প্রশাসক, মন্ত্রীদের একান্ত সচিব বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়োজিত কতিপয় কর্মকর্তা ২০০১- ২০০৫ সালের শাসনে পদোন্নতি বঞ্চিত হন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সমর্থিত কর্মকর্তারা ২০০৯-এর পর দ্রুত পদোন্নতি নিয়ে বিপরীত ঘরানার কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করেন। যত দিন যায় বিভেদ ততই বাড়তে থাকে। ব্যাচের সিনিয়রদের বঞ্চিত করে জুনিয়র কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেতে থাকেন। আমলাতন্ত্রের সততা, নিরপেক্ষতা এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা ক্ষয় হতে থাকে। তবে এর মধ্যেও আমলাতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা সততা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়-নীতি বজায় রাখেন।
এ প্রসঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে চাই। কিছুটা বিলম্বে হলেও ২০১০ এর ফেব্রুয়ারিতে আমি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে নিয়োজিত হই। সম্ভবত এপ্রিল অথবা মে মাসে অনুষ্ঠিত একটি সচিব সভায় কেবিনেট সচিব এম এ আজিজ কয়েকজন সচিবের সঙ্গে আমাকেও কিছু বলতে অনুরোধ করেন। বক্তব্য প্রদানকারী অন্য সচিবগণ স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। আমার বক্তব্যে আমি সরকার ও সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য গুরুত্বপূর্ণ ৩টি বিষয়ে আলোকপাত করি। প্রথমত আমি বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকাসহ বহুজাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশের কাছ থেকে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরি। সচিব হওয়ার আগে আমি ইআরডির অতিরিক্ত সচিব হিসেবে আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি। এ বিষয়টি অবতারণার কারণ, তখন কতিপয় মন্ত্রী বিশ্বব্যাংকসহ কতিপয় সংস্থার ঋণ গ্রহণের বিরোধিতা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিষয় হিসেবে আমি যুক্তিসহকারে সরকারি কর্মচারীদের অবসরের বয়স ৫৭ থেকে ৬০ বছর করার ইস্যুটি উল্লেখ করি। তৃতীয় ও সর্বশেষ যে বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম তা ছিল ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিভেদ ও অনৈক্য। পদোন্নতি, বদলি সব ক্ষেত্রেই মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন না করে দলীয় আনুগত্য ও ব্যক্তিগত পরিচিতি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে দলাদলি, অনৈক্য ও পারস্পরিক প্রতিযোগিতা হচ্ছে। যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন ও পদোন্নতি হচ্ছে না। এ অবস্থার অবসান প্রয়োজন। সিভিল সার্ভিসে বৈষম্যের অবসান করে ঐক্য ফিরিয়ে আনতে হবে মর্মে আমি মতামত তুলে ধরি।
শেষের বিষয়টি বলার সময় প্রধানমন্ত্রী সজাগ দৃষ্টিতে কিছুটা মুচকি হাসছিলেন, আমার ব্যাচমেট প্রধানমন্ত্রীর সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব পাশাপাশি বসা অবস্থায় বিরক্ত হয়ে পরস্পর কিছু একটা বলাবলি করছিলেন। সবশেষে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় তিনি বলেন, ‘সেতু বিভাগের সচিব কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করেছে। আশা করি এসব বিষয়ে জনপ্রশাসন উপদেষ্টা কিছু বলবেন।’ এইচ টি ইমাম বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বয়স বাড়ানোর ব্যাপারে এ মুহূর্তে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। ক্যাডার সার্ভিস বিষয়ে মোশাররফ যা বলেছে এ বিষয়ে তাকে ডেকে আমি বিস্তারিত আলাপ করব।’ সভার শেষে অনেক সচিব আমার কাছে এসে আমার সাহসী বক্তব্যের প্রশংসা করলেন। আমার ব্যাচের এক সহকর্মী বললেন, ‘তুমি এসব বলে নিজেকে বিপদে ফেলছ না তো? তুমি কিন্তু এখনো সচিব পদে রেগুলার হওনি।’ যাক, আমি দলবাজি, একদল আরেক দলকে বঞ্চিত করে পদোন্নতি নেওয়া, তুচ্ছ বা বিনা কারণে বছরের পর বছর কতিপয় কর্মকর্তাকে পদোন্নতি না দেওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেছি। শিল্প মন্ত্রণালয়ে সচিব থাকাকালে আমার ৪/৫ জন জুনিয়র সহকর্মীর অন্যায়ভাবে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে কেবিনেট সচিব ও জনপ্রশাসন সচিবকে আলাদা আলাদা চিঠি লিখেছি। একবার তৎকালীন কেবিনেট সচিব আমাকে বলেন, ‘স্যার, আমি চেষ্টা করেছি। ওরা (এসএসবির অন্য কয়জন প্রভাবশালী সদস্য) রাজি হয় না। ওরা দারুণ জেহাদি।'
ক্রমান্বয়ে দলবাজি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগ করলে পদোন্নতি আটকায় না। আমার অধীন এক কর্মকর্তার গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়- ‘অফিসার কোন দল করে না, কোন অভিযোগ নাই, তবে তার চাচা বিপক্ষ দলের সদস্য বা সাপোর্টার।’ তার পদোন্নতি আটকে গেল। আমি সিনিয়র কর্মকর্তাদের বেশ কিছু সমাবেশে বলেছি, এ অবস্থা চলতে থাকলে সিভিল সার্ভিসে ভবিষ্যতে মেধাবি ছেলেমেয়েরা আসবে না। দেখা গেছে, অতিরিক্ত সচিব থেকে সচিব পর্যায়ে পদোন্নতিতে প্রায় শতভাগ পছন্দের দলীয় অনুগত কর্মকর্তাদের নিয়োগ করার নিয়ম চালু হয়। ফলে ক্ষমতাসীন সরকারকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এসব সিনিয়র কর্মকর্তার সহযোগিতা ও সমর্থনও শতভাগ নিশ্চিত হয়।
আমার নিজের ক্ষেত্রে দীর্ঘ চাকরি জীবনে ১৯৮১ সাল থেকে সকল দলীয় এবং ২০০৭-২০০৮ দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চাকরিকালে সর্বদা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দেশপ্রেম ও সততার সাথে কাজ করেছি এবং মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশংসা কুড়িয়েছি। দলমত নির্বিশেষে যারা আমাকে চেনেন ও জানেন তারা এর সাক্ষী। আমার জানামতে আমলাতন্ত্রে বা সরকারি চাকরিতে এ ধরনের কর্মকর্তা অনেকেই আছেন। অসৎ ও ধান্দাবাজ কর্মকর্তার সংখ্যা কম হলেও তাদের দ্বারা যে ক্ষতি সাধিত হয় তা অনেক বড় হয়ে ধরা দেয়। দীর্ঘদিনের একদলীয় শাসনে আমলাতন্ত্রে যে কোটারি শ্রেণীর জন্ম হয়েছিল এরা সার্বিকভাবে দেশের আমলাতন্ত্রকে দুর্বল করেছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে জনগণের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে এ সরকার দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন, রাষ্ট্র সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ইত্যাদির কথা বলছেন। তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। এরা আমলাতন্ত্রে নিরপেক্ষতা, সততা ও যোগ্যতার অনুশীলন চালু করে ভবিষ্যতের জন্য একটি স্থায়ী কাঠামো তৈরি করবেন যাতে করে আমলাতন্ত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় কোনো বাধা না হয়ে বরং গণতন্ত্র চর্চায় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
রিক্রুটমেন্ট থেকে শুরু করে পদোন্নতি, বদলি- সব ক্ষেত্র থেকে দলীয় বিবেচনা আইন করে নিষিদ্ধ করা হলে পূর্বের ন্যায় আমলাতন্ত্র একটা সুদৃঢ় কাঠামোর ওপর দাঁড়াতে পারবে বলে আশা করা যায়। এতদুদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন:
১. কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
২. যারা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য বা সমর্থক হতে পারবে না, এ ব্যাপারে মুচলেকা গ্রহণসহ পুলিশ ভেরিফিকেশনে নিশ্চিত হতে হবে।
৩. বর্তমানে ডাক্তার, কৃষিবিদ বা অন্য কোনো পেশাজীবী ক্যাডারে যেসব সরকার সমর্থিত বা বিপক্ষ দলের সংগঠন রয়েছে (যেমন ড্যাব, স্বাচিপ) সেসব বিলুপ্ত ও বেআইনি ঘোষণা করতে হবে।
৪. আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণের বিধিমালা এমন ভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে তারা ঘুষ, দুর্নীতি মুক্ত থেকে জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করে। তাদেরকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।
৫. সিভিল সার্ভিস প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালা এমনভাবে প্রণীত হবে যাতে আমলাতন্ত্রে সততা, দেশপ্রেম ও জনসেবার মত মানবিক গুণাবলি বিকশিত হয়।
ওপরের আলোচিত বিষয়গুলো ছাড়াও আমলাতন্ত্র সংস্কারে আরও অনেক কর্মপন্থা থাকতে পারে যা নীতিনির্ধারণী মহল বিবেচনায় নেবেন। মোট কথা, আমলাতন্ত্র হবে সম্পূর্ণ মেধা ও যোগ্যতাভিত্তিক পেশাদারি শ্রেণি যা সরকারের একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হবে।
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্টদূত
বিগত সরকারের দেওয়া তথ্য, বক্তব্য ও পরিসংখ্যানে বক্তব্যে দেশের অর্থনীতির সঠিক চিত্র দেখা যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিগত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছে। এর মাধ্যমে বর্তমান সরকার উপলব্ধি করবে, কী ধরনের উত্তরাধিকারের অর্থনীতিতে তাদের কাজ করতে হবে। সেই ভিত্তিভূমি নিরূপণ করাই কমিটির কাজ। নব্বই দিনের মধ্যে এটি সরকারকে জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। শ্বেতপত্রে দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র থাকার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ, জাতিসংঘের টেকসই অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন ও বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে করণীয় বিষয়ের প্রতিফলন থাকবে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করবে।
শ্বেতপত্রের ধারণাটি এসেছে যুক্তরাজ্যের সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে। সরকারের দ্বারা প্রকাশিত কোনো নীতিগত নথি যেখানে সংসদীয় প্রস্তাবনা থাকে, সেগুলোই শ্বেতপত্র, যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে এভাবেই শ্বেতপত্রের বর্ণনা দেওয়া আছে। এর ফলে, অধিকতর আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়। উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটেনে পার্লামেন্ট রিপোর্টের প্রচ্ছদ থাকত নীল রঙের। যদি রিপোর্টের বিষয়বস্তু সরকারের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ হতো নীল প্রচ্ছদ বাদ দিয়ে সাদা প্রচ্ছদেই সেগুলো প্রকাশ করা হতো। সেই রিপোর্টগুলোকে বলা হতো হোয়াইট পেপারস। এ প্রথা কোনো প্রস্তাবিত নীতি বা জনস্বার্থ সম্পর্কিত সমস্যার সঙ্গে যুক্ত নয়। বরং কোনো রাজনৈতিক দলের সরকার পরিচালনার পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক শাসক দলের কুকীর্তির দলিল হিসাবে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দায় নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার ঋণ রেখে গেছে ১৮ লাখ কোটি টাকা। বিগত বছরগুলোতে মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অবস্থাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতি সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে কেমন অর্থনৈতিক অবস্থা পেল সেটি বুঝতে অর্থনীতির একটা ‘হেলথ চেক আপ’। শ্বেতপত্র প্রণয়ন বর্তমানে অর্থনীতি কোন অবস্থায় আছে, উত্তরাধিকারসূত্রে কী পাওয়া গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলছে সেগুলোকে চিত্রায়িত করার কাজটাই করবে। এটা স্বাস্থ্য পরীক্ষার মতো। এ ছাড়া ‘মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাও করা হবে। পলিসি বা নীতিগত দিকটা কীভাবে চলছে, সেই পর্যালোচনাও থাকবে শ্বেতপত্রে। তারা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করবেন না। তারল্যসংকট, নামে-বেনামের ঋণ, সঞ্চিতি ঘাটতি এসব বিষয়ে পর্যালোচনা করা হবে। আর যেন টাকা পাচার না হয়, টাকা পাচার করলে শাস্তি পেতে হবে, এমন কথা বলা থাকবে শ্বেতপত্রে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে আকৃতি ও প্রভাব বিবেচনায় বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্পও রয়েছে। কোনো কোনো মেগাপ্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, কোনোটির কাজ চলমান। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অর্জন হিসেবে এসব মেগা প্রকল্পের কথা বেশ জোরেসোরেই প্রচার করে আসছিল। তবে পদ্মা সেতুসহ মেগাপ্রকল্পগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি অভিযোগ করে আসছে সরকার বিরোধীরা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার স্বার্থে প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। সময় স্বল্পতার কারণে সব প্রকল্প বিশ্লেষণ করবে না। তবে তারা মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করবে। মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যদি কোনো একটি বিশেষ প্রজেক্টের ওপর মনোযোগ দিতে হয় তারা সেটা করবেন।
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে আকৃতি ও প্রভাব বিবেচনায় বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্পও রয়েছে। কোনো কোনো মেগাপ্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, কোনোটির কাজ চলমান। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অর্জন হিসেবে এসব মেগাপ্রকল্পের কথা বেশ জোরেসোরেই প্রচার করে আসছিল। তবে, পদ্মা সেতুসহ মেগাপ্রকল্পগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি অভিযোগ করে আসছে সরকার বিরোধীরা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার স্বার্থে প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। সময় স্বল্পতার কারণে সব প্রকল্প বিশ্লেষণ করবে না। তবে তারা মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করবে। মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যদি কোনো একটি বিশেষ প্রজেক্টের ওপর মনোযোগ দিতে হয় তারা সেটা করবেন। কয়েক মাস আগে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রথম দশ মাসের রপ্তানি আয়ের হিসেবে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য ধরা পড়ে। রপ্তানির বাৎসরিক হিসেবে প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি দেখানোর ঘটনা বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। সরকারি সংস্থাগুলো পরিসংখ্যান নিয়ে অর্থনীতিবিদদের বিভিন্ন সময় সংশয় প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। ফলে তাদের দেওয়া তথ্য-উপাত্তের ওপর ভর করে পাওয়া চিত্র কতটা সঠিক হবে তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। যা তথ্য পাওয়া গেছে অর্থাৎ, বিবিএস (পরিসংখ্যান ব্যুরো), ইপিবি এবং অন্য সংস্থাগুলোর কাছে যা আছে তার ভিত্তিতে অর্থনীতির একটা বস্তুনিষ্ঠ চিত্রায়ণ এখানে আশা করা যেতে পারে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিতে অর্থনীতিবিদ ছাড়াও জ্বালানি, অভিবাসন, উন্নয়ন ও সুশাসনের মতো বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। নীতি বিশ্লেষক বা বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে কমিটির সদস্যরা তাদের মতামত দেবেন। আগামী দুই মাসের মধ্যেই কার্যক্রম গুছিয়ে আনা হবে। খাতওয়ারি যেমন- জ্বালানি, প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যাংক, রাজস্ব খাত, অর্থ পাচার, বৈষম্য ও দারিদ্র্য বিমোচনসহ বিভিন্ন বিষয় সদস্যদের মধ্যে ভাগ করা হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি জ্বালানি খাতসহ বিগত বছরগুলোতে হওয়া বৈদেশিক ঋণ চুক্তিগুলো খতিয়ে দেখা হবে। বিগত বছরগুলোতে বিদেশি ঋণসংক্রান্ত চুক্তিগুলো যদি পাওয়া যায় তাহলে তা খতিয়ে দেখে অবশ্যই তারা মূল্যায়ন করবেন। কোন সদস্য কী বিষয়ে দায়িত্ব পালন করবেন, ঠিক করা হয়েছে। ইস্যুগুলো নিয়ে তারা ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে ও বিদেশেও যারা বিশেষজ্ঞ আছেন তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। দেশের উন্নয়নে ১০ খাতে শ্বেতপত্র কমিটি কাজ করবে। শ্বেতপত্র কমিটি কোন কোন বিষয়ে মনোযোগ দেবে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো- সাধারণ অর্থনীতি, সামষ্টিক অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাত, মেগাপ্রকল্প, কর আহরণ, পাচার হওয়া অর্থ, বৈষম্য, দারিদ্র্য বিমোচনসহ শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কাজ করবে শ্বেতপত্র কমিটি। তথ্যগুলো আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তুলনা করে যাচাই করা হবে। ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র কমিটি যাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে, তাদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ বিগত সরকারের রেখে যাওয়া সামগ্রিক অর্থনীতির শ্বেতপত্র তৈরির কাজকর্ম শুরু করেছে। কমিটির কাজের পরিধি হবে নির্দেশনামূলক; বাধ্যতামূলক নয়। সময়ে সময়ে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তথ্যের সঠিকতা যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এবং সবার মতামত ও পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে গঠিত কমিটি কাজ করবে। দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ, জাতিসংঘের টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন ও স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে করণীয় বিষয়ের প্রতিফলন তুলে ধরা হবে এই শ্বেতপত্রে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটা শ্বেতপত্র তৈরি করা দরকার। শ্বেতপত্র তৈরি করলে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে। এই মুহূর্তে অর্থনীতিতে যে জটিল পরিস্থিতি রয়েছে, তা জানার জন্য এবং পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যা হবে একটি নির্দেশিকা। শ্বেতপত্রের অনেক সুবিধা আছে। নতুন সরকার কোন অবস্থায় অর্থনীতিকে পেল, তার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন তাদের যেমন দরকার, ইতিহাসের জন্যও দরকার। শ্বেতপত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি মূল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আলোচনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সৃষ্টি হবে। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যা এক ধরনের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দেবে। কোনো কারণে সরকার যদি না করে তাহলে পেশাজীবী নাগরিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসতে হবে। তাই শ্বেতপত্র তৈরি করা জরুরি।
শ্বেতপত্রের অনেক সুবিধা আছে। নতুন সরকার কোন অবস্থায় অর্থনীতিকে পেল, তার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন তাদের যেমন দরকার, ইতিহাসের জন্যও দরকার। শ্বেতপত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি মূল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আলোচনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সৃষ্টি হবে। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যা এক ধরনের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দেবে। কোনো কারণে সরকার যদি না করে তাহলে পেশাজীবী নাগরিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসতে হবে। তাই শ্বেতপত্র তৈরি করা জরুরি। শ্বেতপত্র তৈরি করতে হলে অবশ্যই সরকারকে একটি কাঠামো দিতে হবে। কাঠামোর সঙ্গে সরকারের আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান অবস্থানপত্র তৈরি করবে। যেমন- ইতোমধ্যে দায়দেনা পরিস্থিতি নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্র রয়েছে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার অবস্থানপত্র লাগবে। পাশাপাশি অংশীজনের মতামত নিতে হবে। এখানে বেসরকারি খাত, বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং উন্নয়ন সহযোগীদের আনতে হবে। ব্যক্তি খাতের বড় ও মাঝারিদের পাশাপাশি ছোট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মতামত নিতে হবে। শ্বেতপত্র তৈরিতে এক মাসের বেশি সময় নেওয়া উচিত হবে না। অনেক কিছুই নির্ভর করবে সরকারের মেয়াদকালের ওপর। মেয়াদকাল যাই হোক না কেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি ডেটা কমিশন করতে পারে। তথ্য-উপাত্তের ক্ষেত্রে যেসব ব্যত্যয় হয়েছে এবং ঘাটতি আছে বা যে ক্ষেত্রে নতুন প্রয়োজন দেখা দিয়েছেÑ সেই জায়গাটা পরিষ্কার করবে। তথ্যের উৎপাদক, ব্যবহারকারী এবং মূল্যায়নকারী এই তিন পক্ষকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সরকারি তথ্য-উপাত্ত সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। পাশাপাশি সাংবিধানিক সুরক্ষা দিতে হবে। ব্যাংকিং এবং জ্বালানি- এ দুটি খাত অর্থনীতির ফুসফুসের মতো কাজ করে। ব্যাংকিং কমিশন তৈরি করা দরকার। কিন্তু এর পরিধি কী হবে- তা সরকারের সময়কাল ও সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করবে। যে সময় পর্যন্ত সরকার থাকবে, তার মধ্যে ব্যাংকিং খাতের রোগ নির্ণয় করার সময় পাবে নাকি পথ্য দেওয়া ও চিকিৎসা করার সময় পাবে এবং ফলাফল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারবে- তা আমরা জানি না; কিন্তু একটি কমিশন হওয়া উচিত। ব্যাংকিং খাতে তথ্য-উপাত্তের সঠিকতা যাচাই করা হবে এর প্রথম কাজ। খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে বড় কাজ। প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন পর্যাপ্ততার মতো বিষয়গুলোকে স্বচ্ছতার সঙ্গে যাচাই করতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে মালিকদের প্রতিনিধিত্ব এবং সময়কাল পর্যালোচনা করে বর্তমানের শিথিল অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আমানতকারীদের স্বার্থ বিঘ্নিত না করে একটি বাস্তবসম্মত ‘এক্সিট পলিসি’ করতে হবে। ঋণ অবলোপনের নিয়ম পর্যালোচনা করতে হবে। ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ হতে হবে স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে। যেসব শক্তিশালী শিল্পগোষ্ঠী বা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী ব্যাংকের মালিকানায় রয়েছে, তাদের মালিকানার প্রশ্নটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সুরাহা করতে হবে। এটি খুবই জটিল রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়। করপোরেট সুশাসনে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে, যার সঙ্গে মালিকানা ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত। সরকারি ব্যাংক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে দিতে হবে। অভিজ্ঞ, বিজ্ঞ ও পেশাদারদের সমন্বয়ে একটা ‘ব্লুরিবন’ কমিটি করা যেতে পারে, যারা ব্যাংকে পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী নিয়োগের সুপারিশ অনুমোদন দেবে। ব্যাংকের পাশাপাশি এ ধরনের কমিটি দুদক, নির্বাচন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে হতে পারে। এতে রাজনৈতিক অনুগ্রহে নিয়োগের চর্চা বন্ধ হবে। জ্বালানি খাতের জন্য একটা টাস্কফোর্স করতে হবে। ২৩ থেকে ২৪ হাজার মেগাওয়াটের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট কেন উৎপাদন করতে হচ্ছে এবং একই সঙ্গে আমদানি করতে হচ্ছে টাস্কফোর্স তার ওপর প্রাথমিক একটা প্রতিবেদন দিতে পারে। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও দায়মুক্তির বিষয়গুলোও সেখানে আসবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট