বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫
৬ ভাদ্র ১৪৩২

মিরাস বণ্টনে ইসলামের বিধান

মুফতি আলী হোসাইন
প্রকাশিত
মুফতি আলী হোসাইন
প্রকাশিত : ২৩ আগস্ট, ২০২৪ ১৫:২৫

মিরাস জীবনঘনিষ্ঠ একটি বিষয়। তাছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.) ফরায়েজ শাস্ত্র শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।

আমরা এখানে কোরআন-হাদিস, ইজমা-কিয়াসের ভিত্তিতে সংক্ষিপ্তভাবে ওয়ারিশ বণ্টন সম্পর্কে আলোচনা করব। উদ্দেশ্য হলো শুধু জানা থাকা। কারণ, একজন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে ওয়ারিশদের অংশ বের করা সহজ নয়, তাই ফরায়েজ বিদ্যা সম্পর্কে পারদর্শী আলেমদের শরণাপন্ন হতে হবে। এবং তাদের থেকেই সমাধান নিতে হবে।

পবিত্র কোরআনে ওয়ারিশ বণ্টনের বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,Ñআল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন, এক ছেলের জন্য দুই মেয়ের অংশের সমপরিমাণ। তবে যদি তারা দুইয়ের অধিক মেয়ে হয়, তাহলে তাদের জন্য হবে, যা সে রেখে গেছে তার তিন ভাগের দুই ভাগ; আর যদি একজন মেয়ে হয় তখন তার জন্য অর্ধেক। আর তার মাতা-পিতা উভয়ের জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ, সে যা রেখে গেছে তা থেকে, যদি তার সন্তান থাকে। আর যদি তার সন্তান না থাকে এবং তার ওয়ারিশ হয় নিজের মাতা-পিতা তখন তার মাতার জন্য তিন ভাগের এক ভাগ। আর যদি তার ভাই-বোন থাকে তবে তার মায়ের জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ। অসিয়ত পালনের পর, যা দ্বারা সে অসিয়ত করেছে অথবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের মাতা-পিতা ও তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্য থেকে তোমাদের উপকারে কে অধিক নিকটবর্তী তা তোমরা জান না। আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। [সুরা নিসা:১১]

ইসলাম-পূর্বকালে আরব ও অনারব জাতিসমূহের মধ্যে দুর্বল শ্রেণি, এতিম বালক-বালিকা ও অবলা নারী বরাবরই জুলুম-নির্যাতনের শিকার ছিল।

প্রথমত, তাদের কোনো অধিকারই স্বীকার করা হতো না। কোনো অধিকার স্বীকার করা হলেও পুরুষদের কাছ থেকে তা আদায়করে নেওয়ার সাধ্য কারও ছিল না। ইসলামই সর্বপ্রথম তাদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করে। এরপর সব অধিকার সংরক্ষণেরও চমৎকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। উত্তরাধিকার আইনের জগতের সাধারণ জাতিসমূহ সমাজের উভয় শ্রেণিকে তাদের স্বাভাবিক ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল। আরবদের নিয়মই ছিল এই যে, যারা অশ্বারোহন করতে পারে এবং শক্রদের মোকাবিলা করে তাদের অর্থ-সম্পদ লুট করার যোগ্যতা রাখে, তারাই শুধু উত্তরাধিকারের যোগ্য হতে পারে। [রুহুল মাআনী]

বলাবাহুল্য, বালক-বালিকা ও নারী উভয় প্রকার দুর্বল শ্রেণি এ নিয়মের আওতায় পড়ে না। তাই তাদের নিয়ম অনুযায়ী শুধু যুবক ও বয়প্রাপ্তপুত্ররা ওয়ারিশ হতে পারত। কন্যা কোনো অবস্থাতেই ওয়ারিশ বলে গণ্য হতো না, প্রাপ্ত বয়স্কা হোক কিংবা অপ্রাপ্ত বয়স্কা।

পুত্র সন্তানরাও অপ্রাপ্ত বয়স্ক হলে সে উত্তরাধিকারের যোগ্য বলে বিবেচিত হতো না। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আমলে একটি ঘটনা ঘটেছিল, সাদ ইবনে রবী [রাদিয়াল্লাহু আনহু]-এর স্ত্রী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! এরা দুজন সাদ ইবনে রবীর কন্যা। তাদের বাবা আপনার সঙ্গে উহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তারপর তাদের চাচা তাদের সব সম্পদ নিয়ে গেছে। তাদের জন্য কোনো সম্পদই অবশিষ্ট রাখেনি, অথচ সম্পদ ছাড়া তাদের বিয়েও হবে না। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহর হুকুম জানাবেন। ফলে উত্তরাধিকারীর আয়াত নাযিল হলো। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের চাচার কাছে লোক পাঠালেন এবং বললেন তুমি সাদের কন্যাদ্বয়কে দুই-তৃতীয়াংশ সম্পদ এবং তাদের মাকে এক অষ্টমাংশ দিয়ে দাও। আর যা অবশিষ্ট থাকবে তা তোমার। [আবু দাউদ:২৮৯১, ২৮৯২, তিরমিজি: ২০৯২, ইবনে মাজাহ: ২৭২০]

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ [রাদিয়াল্লাহু আনহুমা] বলেন, আমি অসুস্থ হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে দেখতে আসেন। আমি বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলাম, তিনি আমার ওপর তার অজুর পানি ছিটিয়ে দিলে আমি চেতনা ফিরে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! মিরাস কার জন্য? আমার তো কেবল কালালাই ওয়ারিশ হবে। অর্থাৎ আমার পিতৃকুলের কোনো সন্তান-সন্ততি নেই। তখন সুরা নিসার ১১ নম্বর আয়াত নাজিল হয়। [বুখারি: ৪৫৭৭, মুসলিম: ১৬১৬]

অন্য এক বর্ণনায় ইবনে আব্বাস [রাদিয়াল্লাহু আনহুমা] বলেন, তখনকার সময়ে শুধু ছেলেদেরই ওয়ারিশের সম্পদ দেওয়া হতো আর পিতা-মাতার জন্য ছিল ওসিয়ত করার নিয়ম। তারপর আল্লাহ তায়ালা তা পরিবর্তন করে, যা তিনি পছন্দ করেন তা নাজিল করেন এবং এক ছেলেকে দুই মেয়ের অংশ পরিমাণ দেন আর পিতা-মাতা প্রত্যেকের জন্য ছয়ভাগের এক ও তিন ভাগের এক ভাগ নির্ধারণ করেন। স্ত্রীর জন্য আট ভাগের এক ও চার ভাগের এক নির্দিষ্ট করেন। স্বামীকে অর্ধেক অথবা চার ভাগের এক অংশ দেন। [বুখারি: ৪৫৭৮]

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা নির্ধারিত ফরজ অংশসমূহ দেওয়ার পর সবচেয়ে কাছের পুরুষ লোককে প্রদান করবে [মুসলিম: ১৬১৫]

তাই পুত্রের তুলনায় পৌত্র অধিক অভাবগ্রস্ত হলেও নিকটতম আত্মীয়র আইনের দৃষ্টিতে সে ওয়ারিশ হতে পারে না। কেননা, পুত্রের উপস্থিতিতে সে নিকটতম আত্মীয় নয়। কোরআনে উল্লেখিত মূলনীতির ভিত্তিতে এতিম পৌত্রের উত্তরাধিকারিত্বের প্রশ্নটির অকাট্য সমাধান আপনা-আপনি বের হয়ে আসে। তার অভাব দূর করার জন্য অন্যান্য ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে। এমনি এক ব্যবস্থা পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হবে। এ প্রশ্নে প্রাশ্চাত্যভক্ত নবশিক্ষিতদের ছাড়া কেউ দ্বিমত করেনি। সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায় আজ পর্যন্ত কোরআন ও হাদিসের সুস্পষ্ট বর্ণনা থেকে এ কথাই বুঝে এসেছে যে, পুত্র বিদ্যমান থাকা অবস্থায় পৌত্র উত্তরাধিকার স্বত্ব পাবে না, তার পিতা বিদ্যমান থাকুক অথবা মারা যাক। এখন কোরআনি ব্যবস্থার সৌন্দর্য লক্ষ করুন। একদিকে স্বয়ং কোরআনেরই বর্ণিত সুবিচারভিত্তিক বিধান এই যে, নিকটবর্তী আত্মীয় বর্তমান থাকলে দূরবর্তী আত্মীয় বঞ্চিত হবে, অপরদিকে বঞ্চিত দূরবর্তী আত্মীয়ের মনোবেদনা ও নৈরাশ্যকেও উপেক্ষা করা হয়নি। এর জন্য একটি স্বতন্ত্র আয়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে- সম্পত্তি বণ্টনকালে উত্তরাধিকারী নয় এমন গরিব আত্মীয়, পিতৃহীন ও অভাবগ্রস্ত লোক উপস্থিত থাকলে তাদেরকে তা থেকে কিছু দিয়ে দাও এবং তাদের সঙ্গে সদালাপ কর। [সুরা নিসা: ৮]

তাছাড়া ইসলাম ওসিয়ত করার একটি দায়িত্ব মানুষকে দিয়েছে। দাদা যখনই তার নাতিকে বঞ্চিত হতে দেখবে, তখন তার উচিত হবে এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে তার জন্য ওসিয়ত করা। কারণ ওয়ারিশদের জন্য ওসিয়ত করার সুযোগ নেই সুতরাং ওসিয়তের সর্বোত্তম ক্ষেত্র হচ্ছে, নিকটাত্মীয় অথচ কোনো কারণে ওয়ারিশ হচ্ছে না, এমন লোকদের জন্য তা গুরুত্বের সঙ্গে সম্পাদন করা। এ রকম অবস্থায় ওসিয়ত করা কোনো কোনো আলেমের নিকট ওয়াজিব।

কোরআন কারিমে কন্যাদেরকে অংশ দেওয়ার প্রতি এতটুকু গুরুত্বারোপ করেছে যে, কন্যাদের অংশকে আসল ভিত্তি সাব্যস্ত করে সেই অনুপাতে পুত্রদের অংশ ব্যক্ত করেছে। অর্থাৎ ‘দুই কন্যার অংশ এক পুত্রের অংশের সমপরিমাণ’ বলার পরিবর্তে ‘এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমপরিমাণ’ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। অনেকেই বোনদেরকে অংশ দেয় না এবং বোনেরা এ কথা চিন্তা করে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চক্ষুলজ্জার খাতিরে ক্ষমা করে দেয় যে, সহজে যেহেতু পাওয়া যাবেই না, তখন ভাইদের সঙ্গে মন কষাকষির দরকার কি। আসলে এরূপ ক্ষমা শরিয়তের দৃষ্টিতে ক্ষমাই নয়; ভাইদের জিম্মায় তাদের হক পাওনা থেকে যায়। যারা এভাবে বোনদের ওয়ারিশের সম্পদ আত্মসাৎ করে, তারা মারাত্মক পাপিষ্ঠ। অনেকের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে আবার অপ্রাপ্ত বয়স্কা কন্যাও থাকে। তাদেরকে অংশ না দেওয়া দ্বিগুণ গোনাহ। প্রথমত শরিয়তসম্মত ওয়ারিশের অংশ আত্মসাৎ করার গোনাহ এবং দ্বিতীয় এতিমের সম্পত্তি হজম করে ফেলার গোনাহ। এরপর আরও ব্যাখ্যা সহকারে কন্যাদের অংশ বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, যদি পুত্র সন্তান না থাকে, শুধু একাধিক কন্যাই থাকে, তবে তারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগ পাবে। এতে সব কন্যাই সমান অংশীদার হবে। অবশিষ্ট তিন ভাগের একভাগ অন্য ওয়ারিশরা পাবে। যেমন মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা, স্ত্রী অথবা স্বামী প্রমুখ পাবে। কন্যাদের সংখ্যা দুই বা ততোধিক হলে দুই-তৃতীয়াংশের মধ্যে তারা সমান অংশীদার হবে।

কাতাদা বলেন, সন্তানরা মাকে এক-তৃতীয়াংশ থেকে কমিয়ে এক-ষষ্ঠাংশে নিয়ে এসেছে, অথচ তারা নিজেরা ওয়ারিশ হয়নি। যদি একজন মাত্র সন্তান থাকে তবে সে তার মায়ের অংশ কমাবে না। কেবল একের অধিক হলেই কমাবে। আলেমগণ বলেন, মায়ের অংশ কমানোর কারণ হচ্ছে, মায়ের ওপর তাদের বিয়ে বা খরচের দায়িত্ব পড়ে না। তাদের বিয়েশাদিও খরচাপাতির দায়িত্ব তাদের বাবার ওপর। তাই তাদের মায়ের অংশ কমানো যথার্থ হয়েছে। [ইবনে কাসির]

মৃত্যুর পর ওয়ারিশদের চারটি করণীয়

এখানে শরিয়াতের নীতি হচ্ছে এই যে, কেউ মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীদের ওপর সর্বপ্রথম চারটি করণীয়।

প্রথম. মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে শরিয়াত অনুযায়ী তার কাফন-দাফনের ব্যয়নির্বাহ করা হবে। এতে অপব্যয় ও কৃপণতা উভয়টি নিষিদ্ধ।

দ্বিতীয়. ঋণ পরিশোধ করা। তারপর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে তার ঋণ পরিশোধ করা হবে। যদি ঋণ সম্পত্তির সমপরিমাণ কিংবা তারও বেশি হয়, তবে কেউ ওয়ারিশের সম্পত্তি পাবে না এবং কোনো প্রকার ওসিয়ত কার্যকর হবে না।

তৃতীয়. শরিয়তসম্মত ওসিয়ত পূরণ করা। যদি ঋণ পরিশোধের পর সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকে কিংবা ঋণ একেবারেই না থাকে, তবে সে কোনো ওসিয়ত করে থাকলে এবং তা গোনাহের ওসিয়ত না হলে অবশিষ্ট সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ থেকে তা কার্যকর হবে। যদি সে তার সব সম্পত্তি ওসিয়ত করে যায় তবুও এক-তৃতীয়াংশের অধিক ওসিয়ত কার্যকর হবে না। মোটকথা ঋণ পরিশোধের পর এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তিতে ওসিয়ত কার্যকর করে অবশিষ্ট সম্পত্তি শরিয়তসম্মত ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।

চতুর্থ. পরিত্যক্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে শরিয়তসম্মতভাবে বণ্টন করে দেওয়া। ওসিয়ত না থাকলে ঋণ পরিশোধের পর সব সম্পত্তি ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।

বণ্টনের ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, মিকদাম ইবনে মাদীকারব [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তোমাদেরকে সবচেয়ে নিকটতমের ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছেন, তারপর পরের নিকটতম ব্যক্তি। [মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৩১]

মৃত ব্যক্তির কোনো উত্তরাধিকার না থাকলে এবং তা তিনি জীবিতকালে কাউকে না দেওয়ার ব্যবস্থা করে গেলে সরকার তার সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে। উত্তরাধিকার সম্পর্কে উপরোক্ত সাধারণ কয়েকটি বিষয় মনে রাখলে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের জটিলতা দূর হবে। ইনশাআল্লাহ।


নেশার ছোবলে তরুণ সমাজ

শাহজাহান আবদলী
আপডেটেড ২১ আগস্ট, ২০২৫ ০০:৩৭
সম্পাদকীয়

যে জিনিস সেবন করলে কিংবা বাহ্যিকভাবে শরীরে গ্রহণ করলে অস্বাভাবিক আচরণসহ অচেতন হয়ে নিজের ক্ষতি এবং অন্যের ক্ষতি করতে দ্বিধা করে না তাকেই নেশা বলে। নেশা অনেক প্রকারের হয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেশা হচ্ছে- মদ, গাঁজা, চরস, আফিম, ইয়াবা ও তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি। আচরণগত নেশা বলতে বোঝায়- জুয়া খেলা, তাস খেলা, আড্ডা মারা, মারামারি করা, বিনা স্বার্থে অন্যের ক্ষতি করা ইত্যাদি।

এছাড়া রয়েছে হেরোয়িন ও প্যাথিডিন শরীরে গ্রহণ করা। কোনো নেশাই নিজের পরিবারসহ অন্যের মঙ্গলদায়ক নয়। নেশা আসক্ত মানুষ কমবেশি চিরকালই ছিল। বর্তমানে এর ভয়াবহতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নেশাগ্রস্ত মানুষ কেন বাড়ছে এর কারণ খুঁজলে বের হয়ে আসবে, দেশে ব্যাপক বেকার সমস্যা। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত ছেলেরা নেশাগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। গ্রাম থেকে আসা নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব ঘরের সন্তানরা বাবা-মার জমিজমা, ভিটে-মাটি বিক্রি করে শহরে এসে উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে কোনো চাকরি পায় না। বর্তমানে অফিসার পদে চাকরি পেতে হলে ১০-২০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। কোনো কোনো চাকরির ক্ষেত্রে ৩০-৪০ লাখ পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। এত টাকা পাবে কোথায়? এছাড়া কেউ কেউ উল্লিখিত টাকা দেওয়ার পর চাকরি এবং টাকা দুটোই হাতছাড়া হয়ে যায়। মধ্যভোগী হিসেবে যারা এ ধরনের টাকা গ্রহণ করে তারা রাজনৈতিকভাবে কিংবা বিভিন্ন কারণে ওদের ক্ষমতার অবস্থান থাকে অনেক উঁচুতে। ইচ্ছে করলেই হুমকিধমকি দিয়ে সেই টাকা আদায় করতে পারে না। ফলে চাকরির প্রার্থীরা হতে হয় পথের ভিখারি। বাবা-মার জমিজমা বিক্রি করে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছে। সেই সঙ্গে হাওলাত-কর্জ করে লাখ লাখ টাকা প্রতারককে দিয়েছে। কী করবে? কোথায় যাবে? আত্মহত্যা করা মহাপাপ। বাধ্য হয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

ছাত্রজীবনে কত না স্বপ্ন দেখেছিল, ভবিষ্যতেই এই হবে, সেই হবে। কিন্তু উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার পর সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। পরিবারে ও সমাজে তারা হয়ে যায় অবহেলার পাত্র। এত বড় ডিগ্রি নিয়ে যেমন-তেমন চাকরি করতে বিবেকে বাধা দেয়। বেসকারি প্রতিষ্ঠানে মাসে যে টাকা বেতন পাবে, সেই টাকা শেষ হয়ে যায় মোবাইল ও ইন্টারনেট চালাতে গিয়ে। পুরো জীবনটা বৃথা। উন্নতমানের পোশাক-আশাক না পরতে পারলে সার্টিফিকেটের কোনো মূল্য থাকে না।

মা-বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে কতদিন চলা যায়? বেকার ছেলেকে হাত খরচের টাকা দেবে, সেই সামর্থ অনেক পরিবারের নেই। ফলে এসব ছেলেরা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দলবদ্ধ হয়ে নেশা না করলে কি চলে? অল্পদিনের মধ্যে নেশাগ্রস্ত অনেক বন্ধু জুটে যায়। নেশার টাকা জোগাতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে অবৈধ কর্মকাণ্ডে। তখন তাদের নীতি-আদর্শ বলতে কিছু থাকে না। দল ত্যাগ করে ক্ষমতাসীন দলে ভিড়তে দ্বিধা করে না। নিজে নেশা করে এবং নেশাখোর নেতার পেছনে ঘোরে। একে ধরে, তাকে মারে, এই হলো তাদের কর্মসূচি। সরকার দলীয় কর্মী হিসেবে একটু-আধটু সম্মানও পায়। নিরীহ জনগণ ভয়ে তাদের সালাম দেয়। যতদিন দল ক্ষমতায় থাকে ততদিন ভালোই কাটে তাদের দিনকাল। দল ক্ষমতা হারালে তাদের জেল-হাজত খাটতে হয়। তাদের প্রধান আয়ের উৎস থাকে বিচার সালিশ। বর্তমানে এটিকে বলা হয় ফিটিং ব্যবসা। নিরীহ মানুষকে ডেকে এনে বিনা কারণে অপরাধী বানিয়ে টাকা আদায় করাই এই ব্যবসার প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিচার-সালিশে যাওয়ার আগে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, এত টাকা দিতে হবে। বিচারের ন্যায়-অন্যায় কোনো বিষয় না। টাকা দিলেই জিতিয়ে দেয়। এসব সালিশিতে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কোনো মূল্যায়ন নেই। রাজ্য তাদের, রাজাও তারা। ইয়াবা ব্যবসা গ্রামগঞ্জে বেশ রমরমা। বিরক্ত না করার জন্য এলাকার ক্ষমতাশীল ব্যক্তি থেকে শুরু করে কোনো কোনো ইউপির চেয়ারম্যান এবং থানাতে ব্যবসার অংশ হিসেবে মাসিক ফি দিতে হয়। গ্রামের জ্ঞানী-গুণীরা বাধা দিলে অপমানিত হতে হয়। অতিরিক্ত নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে নেশা নিরাময় আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে ভর্তি হলে প্রতি মাসে প্রায় ৪০-৫০ হাজার করে টাকা দিতে হয়। নেশা করার আগে নিয়ন্ত্রণের চিন্তা না করে অতিমাত্রায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে নিরাময় আশ্রয় চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে এ দেশে।

এসব উচ্চ শিক্ষিত নেশাগ্রস্ত ছেলেদের কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়িদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। ভালোভাবে খোঁজ-খবর না নিয়ে উচ্চশিক্ষিত দেখে মেয়ে বিয়ে দিয়ে প্রথমে দম্ভ আর অহংকারের শেষ নেই। আত্মীয়-স্বজনসহ পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে শুধু একই কথা- জামাই বাংলাদেশের পড়ালেখা শেষ করে ফেলেছে। একাধিক ডিগ্রি নিলে দেশের বাইরে যেতে পারবে। শত হলেও উচ্চশিক্ষিত জামাই, লেবু ছাড়া ভাত খেতে পারে না। দামি ফার্নিচার না দিলে মান-সম্মান থাকে না। শিক্ষিত জামাই হিসেবে ঈদে দামি পোশাক-আশাক দিতেই হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই মেয়েকে পিটিয়ে পাঠায় বাপের বাড়িতে টাকা আনার জন্য। মেয়ে শুধু কান্দে আর চোখের পানি ফেলে। ক্রমান্বয়ে জানতে পারে জামাই বাবা নেশা করে। শ্বশুরবাড়ি, নিজের পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজনকে অশান্তিতে রাখার জন্য একজন নেশাখোরই যথেষ্ট।

নেশা থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এবং সংস্কৃতি চর্চার দিকে নিজেকে ধাবিত করা। সেই সঙ্গে ছোট হোক বড় যে কোনো কর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক

বক্তৃতা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ঢাকা।


জুলাই ঘোষণা ও নির্বাচন: স্বস্তি-অস্বস্তি

ড. আবদুল লতিফ মাসুম
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

চরাই-উৎরাই অতিক্রম করে গোটা জাতি আনন্দ-উদ্দেলে অতিক্রম করল একটি বছর। একই সময়ে দুটো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা এলো ৫ আগস্ট বর্ষপূর্তিতে। গণঅভ্যুত্থানের প্রারম্ভে যে গণআকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে প্রথমত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দল পেশাজীবীরা, সুশীল সমাজ এবং সর্বস্তরের জনসাধারণের পক্ষ থেকে যে পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষা প্রদর্শিত হয়েছে- তা এক কথায় অভূতপূর্ব। বিগত অর্ধ শতাব্দী যাবত রাজনৈতিক সরকারগুলো যে যথাযথভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গ্রাহ্য করেনি, এই অভ্যুত্থান এবং অভ্যুত্থান পরবর্তী দাবি-দাওয়ার বেশুমার প্রদর্শন- জমে থাকা হতাশারই প্রমাণ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমাবদ্ধতা সচেতন মানুষ জানেন। তার পরও অসচেতনভাবে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গন, সচিবালয় এমনকি প্রধান উপদেষ্টার আবাসস্থল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে জনগণের আবেদন ও আন্দোলন। এককভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই হিমালয়সম ক্ষোভ ও ক্রোধকে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অক্ষম। তাই সঙ্গতভাবেই জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত সরকারের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধানত তিনটি প্রত্যয় নিয়ে সরকার তার যাত্রা শুরু করে। প্রথমত এটি বৈষম্যের নিরসন। দ্বিতীয়ত এটি সংস্কার প্রস্তাবণা। তৃতীয়ত এটি গণহত্যাকারী পতিত সরকারের বিচার। বৈষম্যের নিরসন এমন একটি গণদাবি যার সঙ্গে জড়িত আছে কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘকাল ধরে বঞ্চনার ইতিহাস। আর সংস্কার প্রস্তাবণা এতই দীর্ঘ এবং অগণিত যে হিসেব-নিকেশ এক রকম অসম্ভব। সরকার এইসব সংস্কার বা মেরামতের সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করে। অবশেষে ৬টি কমিশনের মৌলিক বিষয়বস্তু নিয়ে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অসম্ভব ধৈর্য্য ও কুশলতার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য অর্জনের চেষ্টা করে। বাংলাদেশের জনচরিত্র বিভেদের-ঐক্যের নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঙন প্রক্রিয়া গভীরভাবে অবলোকন করলেই এই দ্বন্দ্ব, কলহ, কোন্দল ইত্যাদির প্রমাণ মেলবে। ৩০টিরও অধিক রাজনৈতিক দল এই সংলাপে অংশগ্রহণ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর শতভাগ একমত হওয়া অসম্ভব কল্পনা। তবে গরিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেশিরভাগ বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করলেই- কমিশনের স্বার্থকতা প্রমাণিত হবে। যদিও কতিপয় মৌলিক বিষয়ে একমত হয়নি রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তবে যা অর্জিত হয়েছে এই দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষের দেশে, তাও কম নয়।

সংস্কারের প্রধান প্রধান বিষয়গুলো ছিল সংবিধান, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রণয়ন, নির্বাচন ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ, গণপ্রতিনিধিদের সীমিত স্বাধীনতার গ্যারান্টি, আমলাতন্ত্রের জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা নির্ধারণ, শাসন ও বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনগুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর নিযুক্তির ন্যায্যকরণ। রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন কোনো দিক নেই যে সংস্কারের আবেদন উত্থাপিত হয়নি। রাষ্ট্রের মৌলিক ১৯ সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একমত হয়েছে। এসব বিষয়গুলো হচ্ছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নমনীয় করণ, কমিটির ভাগাভাগি, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমাসংক্রান্ত বিধান আইনানুগকরণ, বিচার বিভাগীয় বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা সীমিতকরণ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিটি গঠন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, সংসদের উচ্চ-কক্ষ গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিধান ইত্যাদি। এসব বিষয়ে সাধারণ ঐকমত্য অর্জন সরকারের একটি বড় সাফল্য। এদিকে সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের দাবি এবং ব্যবস্থাপনাও এগিয়ে চলেছে। সেই কারণে ৫ আগস্টের সুন্দর সময়ে সরকার একই সঙ্গে দুটো গুরুত্বপূর্ণ দায় এবং দায়িত্ব পালনের ঘোষণা দিয়েছে।

যে ঘোষণাপত্রটি প্রকাশিত হতে পারত অভ্যুত্থানের পরপরই, সেটি অবশেষে প্রকাশিত হলো। জুলাই বিপ্লবের প্রতি রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির অঙ্গীকার রেখে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঘোষণাপত্রে ২৮টি দফা রয়েছে। এখানে ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের স্বীকৃতি রয়েছে। ঘোষণাপত্রের ২৪ নম্বর দফায় গণঅভুত্থানের শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে। ঘোষণাপত্রের শেষ কথা এ রকম, ‘৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হলো’। এই ঘোষণার মাধ্যমে বহুল প্রতিক্ষীত একটি বিষয়ের মীমাংসা হলো। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতারা বারবার এ ধরনের একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য দাবি জানিয়ে আসছিল। তারা নিজেরা ঘোষণাটি প্রদান করবে এ রকম তারিখও দু-একবার দিয়েছে। সর্বশেষ এনসিপি বলেছিল ৩ তারিখে জনসমুক্ষে ঘোষণাটি প্রকাশ করা হবে। সরকার তাদের আশ্বস্ত করায় তারা হয়তো সরকারকেই এই ঘোষণার আইনানুগ ঘোষণাকারী মনে করেছে। ঘোষণাটি অনেককে তুষ্ট করেছে। আবার রাজনৈতিক দলের কয়েকজন জুলাই ঘোষণায় সন্তুষ্ট হননি।

৫ আগস্ট ২০২৫ জাতীয় জীবনে গৌরবময় দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের পরপরই প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কাল ঘোষণা করেন। আগামী বছর, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই নির্বাচন আয়োজন করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকাররের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি পাঠানোর কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইতোমধ্যেই সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত চিঠি নির্বাচন কমিশন বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে কমিশন যেন রমজান মাস শুরুর আগে ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। জুলাই ঘোষণাপত্র, জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যার বিচার ও সংস্কারসহ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তার ভাষায়, ‘এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা, নির্বাচন অনুষ্ঠান। এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।’

নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন দূরত্ব ছিল। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন অনুষ্ঠানে বারবার ওয়াদা করছিলেন বটে, তবে সঠিকভাবে সুনির্দিষ্টভাবে তিনি কোনো কথা বলেননি। রাজনৈতিক দলগুলো স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনমুখী। যে দলটি যতটা প্রত্যয়ী তারা তত জোড়ে-সোরে নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছিলেন। এই অনিশ্চিত অবস্থাটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে বেশ দ্বন্দ্বিক অবস্থা তৈরি করে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডন বৈঠকে। রাজনৈতিক মহলে মোটামুটি স্বস্তি ফিরে আসে। তবে অন্য দলগুলো বিএনপির এই প্রাধান্যের বিরোধীতা করে। যাহোক ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সালে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হবে এরকম আশ্বাসের পর রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটে। সেই ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্টের এই ঘোষণা এসেছে। এই ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো যে সংশয় ও সন্দেহে ভুগছিলেন তার অবসান ঘটে। কিন্তু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দল জুলাই ঘোষণা এবং নির্বাচনের তারিখ নিয়ে অস্বস্তির কথা বলেছে। তবে কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচন নাকোচ করা বা প্রতিরোধের কথা বলেনি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে গুজব ছিল যে ঘোষিত সময়সীমার বিপক্ষে অবস্থান নেবে বিএনপির পরের ধারার ডান-বাম রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু অসম্পূর্ণতা, অগ্রহণযোগ্যতা ও অসহযোগিতার কথা উচ্চারিত হলেও প্রত্যাখ্যাত হয়নি ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্র ও নির্বাচনের দিন-ক্ষণ।

আগেই বলা হয়েছে বিএনপি স্বস্তির মধ্যে ছিল। এই ঘোষণা দুটোর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হবে এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচন ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে, বিএনপি তা স্বাগত জানায়। আমরা বিশ্বাস করি এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবিকতা, সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি নতুন, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি তৈরি হবে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণাকেও ইতিবাচকভাবে নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বৈঠকে এই সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে গণতন্ত্রের উত্তরণের পথ সুগম করবে। তিনি নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। একই সঙ্গে সব রাজনৈতিক দল ও জনগণকে নির্বাচনকে সফল করে গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। মির্জা ফখরুল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, আহতদের প্রতি সহানুভূতি ও সুস্থতার জন্য দোয়া করেন।

অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দাবি করেন জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন আমরা লক্ষ্য করছি, নির্বাচনের উপযুক্ত যে পরিবেশ থাকার কথা ছিল তা সরকার এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। এ জন্য প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত টাইমলাইন অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তার আইনি ভিত্তি দিতে হবে। অতীতে বিভিন্ন অভ্যুত্থান ও আন্দোলন হয়েছে- পরবর্তী সময়ে তার আইনি ভিত্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন- ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর লিগাল ফ্রেম ওয়ার্কের ভিত্তিতে ৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদে ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুমোদন হয়েছিল। জাতীয় ইতিহাসে এ ধরনের আরও ঘটনার উল্লেখ করে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিতে তিনি নির্বাচন সম্পন্ন করার দাবি জানান। বাংলাদেশের মতো শতধাবিভক্ত ও রাজনৈতিক ঝগড়ায় নিত্য নিয়োজিত নেতৃত্বকে একটি সমন্বিত ও সম্মিলিত ধারায় একত্রীকরণ একটি সুকঠিন কাজ। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ যে তারা যতটা সম্ভব ‘বিরোধের মাঝে ঐক্য’ নিশ্চিত করতে পেরেছেন। জুলাই ঘোষণাপত্র এবং নির্বাচন সম্পর্কে দোলাচলে ছিল দেশবাসী। ঘোষণার পরে গরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলো এক বাক্যে নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন যে প্রধান ধারার বিপরীতে অবস্থানকারী শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কিনা। এটি সন্তোষের বিষয় যে অবশেষে ওইসব রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিক্রিয়া সমালোচনা সত্ত্বেও নির্বাচনী দিন-ক্ষণকে মেনে নিয়েছে। জুলাই ঘোষণা সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রিয়া -প্রতিক্রিয়ায় অস্বস্তি লক্ষ্য করা গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি আগের মতো এসব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগেরমাধ্যমে মতামত জেনে নিতেন, তাহলে অদৃশ্যমান বিভেদটি দৃশ্যমান হতো না। তবে নাগরিক সাধারণ জুলাই ঘোষণার বাস্তবায়ন, জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে নির্ধারিত সংস্কারগুলো সর্বোপরি নির্বাচনের শতভাগ নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তিনটি উপায়ে নাগরিক সাধারণের এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান করা যায়। প্রথমত সকল রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বাক্ষরে জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা যায়। দ্বিতীয়ত অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানের স্বীকৃত সংশোধনীর প্রকাশ ঘটানো যায়। তৃতীয়ত রাষ্ট্রপতি তথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আইনানুগ ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সংস্কার কার্যক্রম এবং প্রশাসনিক দায়-দায়িত্বের ঘোষণা দেওয়া যায়।

লেখক: সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক ভিসি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


দুর্বোধ্য দুর্নীতি

সাকিব রায়হান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

আমাদের দেশের বহুল আলোচিত কিছু শব্দের মধ্যে ‘দুর্নীতি’ অন্যতম। কম বেশি সবাই এ নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করে থাকে। আলোচনার সময় মনে হয় সবাই দুর্নীতিকে অপছন্দ তো করেই; অনেকে তীব্র ঘৃণাও করে। যারা ক্ষমতায় থাকে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলে, যারা ক্ষমতায় থাকে না তারাও বলে, সাধারণ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলে, নাটক-সিনেমা, গল্প সবজায়গায় যে যেভাবে পারছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করছে। দৃশ্যত সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে থাকলেও এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দুর্নীতি আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যার মধ্যে একটা কেন? কোনোভাবেই কেন দুর্নীতির মোহ এবং গ্রাস থেকে আমাদের সমাজ মুক্ত হতে পারছে না?

আমাদের কাছে এই দুর্নীতি আসলে একটা দুর্বোধ্য বিষয়। অনেকে হয়তো ভাবছেন এটা আবার কেমন কথা? দুর্নীতি তো দুর্নীতিই। এটা দুর্বোধ্য হওয়ার কি আছে। কেন এটা দুর্বোধ্য সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমাদের বেশিরভাগ মানুষের চোখেই দুর্নীতির কথা বললে সরকারি অফিসে স্তূপ করে রাখা কিছু ফাইলের কথা মনে পড়ে যায়। অর্থাৎ দুর্নীতি হচ্ছে টাকার বিনিময়ে কিছু ফাইলের ফলপ্রসূ আদান প্রদান। টাকার বিনময়ে বিভন্ন সিদ্ধান্ত বা কাজ পাওয়া অবশ্যই দুর্নীতি তবে এটাই দুর্নীতির মূলকথা না। দুর্নীতি এরচেয়েও অনেক ব্যপক বিষয়। দুর্নীতির সহজ ও মিনিংফুল সংজ্ঞা হচ্ছে, অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাক্তিগত লাভের জন্যে অনৈতিক ও অবৈধ কাজ করা। এই সংজ্ঞায় একটা ছোট দুর্বলতা রয়ে গেছে। এখানে বলা হয়েছে কেউ যদি অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করে। অর্থাৎ, দুর্নীতি করতে হলে ক্ষমতা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি মানে অবৈধ এবং অনৈতিক কাজ করা। কেউ যদি অবৈধ এবং অনৈতিক কাজ করতে সহযোগিতা করে তাহলে সংজ্ঞা অনুযায়ী সরাসরি তাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাচ্ছে না। আর এই সুযোগটাই আমরা হর হামেশা নিয়ে যাচ্ছি।

আমি তখন সবে এইচ এস সি পাস করে একটা স্বনামধন্য কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে ক্লাস করা শুরু করেছি। ঢাকা ইউভার্সিটির পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতেও ভর্তি পরীক্ষা দেব বলে সিদ্ধান্ত নেই। তবে দুটো সাবজেক্ট ছাড়া আর কিছুতে ভর্তি হতে মন চাইছিল না। বিবিএ এবং ইংলিশ লিটেরেচার। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে নির্ধারিত দুই দিনে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। গাবতলি থেকে বাসের ছাদে করে যাতায়াতের সময় আমার এক সহপাঠীর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং বেশ সখ্যতার জন্ম নেয়। প্রথম দিন বিবিএ ভর্তি পরীক্ষা ছিল। পরের পরীক্ষা ইংলিশ। বেশ কঠিন প্রশ্ন এসেছিল। পরীক্ষা হলে প্রশ্ন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল যে ইংলিশ লিটেরেচারের প্রশ্ন যত কঠিন হবে আমার চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে। যাই হোক পরীক্ষা দিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে বের হলাম। আমার সেই নব্য বন্ধুর সঙ্গে দেখা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে পরীক্ষা কেমন হয়েছে। দেখলাম ও ‘ভালো’ বলে মিটিমিটি হাসছে। দুজনে আবার বাসের ছাদে উঠলাম। দুটো পরীক্ষাই আমার দারুণ হয়েছে। মনে মনে ভাবছিলাম আসন মাত্র আশিটা (যতদূর মনে পড়ে) তাতে কি আমার পজিশন দুটোতেই দশের মধ্যে থাকবে। হঠাৎ আমার সেই নব্য বন্ধু হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল ‘সব কমন পড়েছে না?’ আমি উত্তরে বললাম, ‘ভর্তি প্রশ্ন আবার কমন পড়ার কি আছে? আমার প্রিপারেশন ভালো ছিল। দারুণ পরীক্ষা দিয়েছি’। ও তখন বেশ সিরিয়াস হয়ে গেল। ‘মঙ্গলবারে যে প্রশ্ন আউট হয়েছিল সেটা তুমি পাউনি? ইংলিশ, বিবিএ দুইটার প্রশ্নই তো আউট হয়েছে।’ আমার মাথায় মনে হলো বাজ পড়ে গেছে। পরে জানলাম প্রতি প্রশ্ন পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল। হুবহু সেই প্রশ্নগুলোই এসেছে। রেজাল্ট বের হলে দেখলাম আমার সেই নব্য বন্ধু ভর্তি হচ্ছে আর আমার নাম ওয়েটিং লিস্টের বার নম্বরে। এখনো সেই অনুভূতি আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। আমার মেধা, আমার শ্রম কিভাবে অপমানিত হয়েছিল সেটা অগ্রহণযোগ্য। এভাবে আমাদের দেশে এ পর্যন্ত আমার ধারণা লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ হয় প্রশ্ন আউটের সুযোগ নিয়ে বা অন্য কোনো অবৈধ পন্থা বা সুপারিশের মাধ্যমে ভর্তি হয়েছে বা চাকরি পেয়েছে। তারা কি আসলেই মন থেকে দুর্নীতিকে ঘৃণা করে?

আমি এমন অনেক ক্ষমতাশালী সৎ মানুষ দেখেছি যারা ঘুষ খায় না। টাকা পয়সার বিষয়ে খুবই স্বচ্ছ; কিন্তু সুপারিশের মাধ্যমে নিজের কাছের মানুষদের আর্থিক বা অন্য কাজ পাইয়ে বড় ধরনের সুযোগ করে দিচ্ছে। অযোগ্য কাউকে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কোটিপতি করে দিচ্ছে। আর্থিক লেনদেন না করলেও সেই ক্ষমতাধর ব্যাক্তিকে আপনি কি দুর্নীতিগ্রস্ত না বলে থাকতে পারবেন? সুপারিশ খুব পরিচিত একটা শব্দ। চাকরির ক্ষেত্রে, সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে, কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে, কিছু সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মের বাইরে আমরা প্রতিনিয়ত অমুক নাহলে তমুকের কাছে ধরনা দিচ্ছি। আমি যখন নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো সুবিধা পাচ্ছি সেটাই কিন্তু অনিয়ম এবং দুর্নীতি। যেখানে আমাদের অনেকেই প্রতিনিয়তই ক্ষমতাধর কারো সুপারিশ নিয়ে হাজির হচ্ছি সেখানে দুর্নীতিকে আসলেই কি আমরা মন থেকে ঘৃণা করতে পারছি?

আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার সময় খুব সোচ্চার; কিন্তু অনেকে সুযোগ পেলেই দুর্নীতির মাধ্যমে সুবিধা নিতে প্রস্তুত। এই মানসিকতাই আমাদের সমাজে দুর্নীতির টিকে থাকার মূল গল্প। এছাড়াও আরও কিছু বিষয় আছে যেসব কারণে আমাদের ভেতরে দুর্নীতি শক্তিশালী অবস্থান গেঁড়ে আছে। মানুষ আপনার সফলতা দেখতে চায়। আপনি কিভাবে সফল হলেন সেটা মুখ্য না। সফলতা অর্জনে কোনো এক পর্যায়ে অসৎ হয়েছিলেন কিনা সেটা অনেকের কাছে কোনো বিষয়ই না। এর জন্যেই যেকোনোভাবে আমরা সফল হতে চাই। যে ব্যক্তি অনিয়মের মাধ্যমে সফল হচ্ছে সে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে দ্বিতীয়বার ভাববে না।

দুর্নীতিতে আকৃষ্ট হওয়ার জন্যে আমাদের দেশের সিস্টেম অনেকাংশে দায়ী। যেহেতু আমাদের দেশের অনেকেই দুর্নীতিতে আসক্ত তাই কর্মক্ষেত্রে সুযোগ পেলেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া কেউ যদি দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে চায় তাহলে সে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে যায়। একটা দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে অসৎ মানুষেরা যত সহজে সবাই এক হয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করে সৎ মানুষেরা কিন্তু তত সহজে এক হয়ে কাজ করতে পারে না। কারণ সৎ মানুষেরা একটু নন কম্প্রোমাইজিং হয়। এর কারণে কর্মক্ষেত্রে একজন অসৎ মানুষ তার অসৎ বসের কাছ থেকে চাকরিতে যে সুবিধা পেয়ে থাকে একজন সৎ মানুষ তার সৎ বসের কাছ থেকে ঠিক একই ধরণের চাকরি সংক্রান্ত সুবিধা পায় না। এ কারণেই অসৎ মানুষেরা কোনো একটা প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থায় অনেক সংগঠিত হয়ে অসৎ কাজ করে যেতে থাকে।

আমরা যতই বলি না কেন দুর্নীতি আমাদের দেশ থেকে সহজে যাবে না। আমাদের মন মানসিকতায় এক ভয়াবহ বিকৃতি ঘটেছে। আমরা ক্ষমতা চাই ক্ষমতা অপব্যবহার করার জন্যে, ক্ষমতা দিয়ে ভুলকে ঠিক করার জন্যে না।হয়তো কেউ কেউ ক্ষমতাকে অর্পিত দায়িত্ব হিসেবে মেনে নিয়ে ভালো কাজ করে যাচ্ছেন তবে সে সংখ্যাটা খুবই কম। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে না তুললে কোন ফল পাওয়া যাবে না। একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষকে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। সরকারিভাবেও কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতি বছর ভালো কাজের জন্যে সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত করা হয়। অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষকে কখনো তিরস্কার করতে দেখি নাই। প্রতি বছর দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের লিস্ট করে জনসম্মুখে আনতে হবে। তাহলে দেখবেন তারা সামাজিকভাবে লজ্জায় পড়বে। খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখবেন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এমন কিছুই করা হয় না। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বা পত্রিকায় সফল মানুষদের নিয়ে প্রতিবেদন করা হয়। অথচ সবচেয়ে বেশি প্রতিবেদন দরকার সৎ মানুষ এবং অসৎ মানুষদের নিয়ে। একজন সৎ মানুষকে শুধুমাত্র সততার ক্যাটাগরিতে অফিসিয়ালি কাউকে স্বীকৃতি দিতে দেখিনি। সৎ এবং অসৎ এই ধরনর মানুষকেই সমাজে পরিচিত করিয়ে দিতে হবে। সমস্যা হচ্ছে অসৎ মানুষদের কোরাম এত বেশি শক্তিশালী যে তাদের স্পর্শ করা সম্ভব না। তারচেয়ে বড় কথা আমরা রিয়েক্ট করি শুধু ভাইরাল হওয়া দুর্নীতিতে। অন্যসব দুর্নীতিতে চোখ বন্ধ করে না দেখার ভাণ করে থাকি। কারণ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা মনে প্রাণে দুর্নীতিকে ঘৃণা করি না বরং বুঝে না বুঝে দুর্নীতি করার সুযোগ খুঁজতে থাকি।

লেখক: কথাশিল্পী ও নাট্যকার


সুষ্ঠু নির্বাচন: সেনাবাহিনী দ্বারাই সম্ভব

মিজানুর রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি ঘোষণা আসার পর থেকেই অনেক রাজনৈতিক মহলের ধারণা এই পুলিশ বাহিনী দিয়ে নির্বাচন? কিন্তু আমাদেরত একটি গর্বিত চৌকস সাহসী সেনাবাহিনী আছে। এদের দায়িত্ব, নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ন নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। দেশের ক্লান্তিলগ্নে সে দৃষ্টান্তত বহুবার দেখিয়েছে।

এদের নৈতিকতার জন্য জনগণ ও আস্থা রাখে। আমরা কেন এদেরকে কাজে লাগাতে পারব না? অবশ্যই তা সম্ভব। দরকার শুধু সুষ্ঠ পরিকল্পনা। আমরা কি ভুলতে বসেছি ছাত্র ও জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ও ক্ষমতার মসনদ ঠিক রাখার জন্য স্বৈরাচারী সরকার দমন-পীড়ন সমানতালে চালাচ্ছে। এরি মধ্যে অনেক লোকের জীবনহানি হল কিন্তু সরকারের টনক নড়ছে না। তারা জনগণের ভাষা না বুঝে চরম দাম্ভিকতার উচ্চ শিখরে আরোহন করছিল। যেখানে ক্ষমতাই মূখ্য। জনগণ বিবেচ্য বিষয় নয়। ঠিক তখনই দেবদূতের মত দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান ৩ আগষ্ট/২৪ স্বৈরাচারী সরকারকে ছাপ জানিয়ে দিলেন ---জনগণের ওপর সেনাবাহিনী গুলি চালাতে পারবে না। তখনই জনতার আন্দোলনের মোড় ঘুরে গেল । সেনাবাহিনীর এই ভূমিকার কারণে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।পৃথিবীর সব দেশেই গণঅভ্যুত্থানে অমনটি হয়ে থাকে। আমাদের সেনাবাহিনী যে কোন দুর্যোগমুহূর্তে জনগণের পাশে থেকে সাহায্যের হাত বাড়ায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ অগ্নি নির্বাপক, জঙ্গি দমনে অতীতে সেনাবাহিনী বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্তের প্রতীক আমাদের গর্বিত সেনাবাহিনী। এরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নির্বাচনে সহযোগিতা করে আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জন করে আসছে। বিশ্ববাসী এদের ওপর নির্ভর করতে পারে। শেখ হাসিনা তার স্বার্থ হাসিলের জন্য জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সময় এদেরকে কোনঠাসা করে রাখতেন। এখন সময় এসেছে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোর।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করার পর থেকে রাজনৈতিক দলসমূহ নড়েচড়ে বসেছে। বাংলাদেশের জনগণ প্রায় ১৫ বছর যাবত সুষ্ঠু নির্বাচন দেখেনি। সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কারণে ভোট কেন্দ্রে যাওয়াটা ও অনেকে ভুলতে বসেছে। গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই। সকল মতের সকল মানুষের অংশগ্রহণে যে নির্বাচন হয় সেই সংসদ হয় জনগণের। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসলে দেশের অর্থনীতি হয় ভঙ্গুর। যেখানে আমাদের পুলিশ সড়কের নিরাপত্তা দিতে পারে না সেখানে কিভাবে ভোট কেন্দ্রে নিরাপত্তা দেবে? পুলিশের দায়িত্ব হীনতার কারণে যে দেশে ঐকমত্যের ভিত্তিতে চোখের এক পলকে খনিজ মূল্যবান সম্পদ সাদা পাথর লুট হয়ে যায় সে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ভাবাটা দুরূহ ব্যাপার। অবশ্য সাদা পাথর ও সেনাবাহিনী কতৃক উদ্ধার হয়েছে। তাছাড়া দেশে একটি প্রচলিত কথা আছে ১০টা হোন্ডা ১০টা গুন্ডা থাকলেই নির্বাচনে জেতা কোনো ব্যাপার না। অমনটি হলে এত বিপ্লব মানুষের ত্যাগ বৃথা যাবে। মানুষ আশাভঙ্গ হবে। এদের দায়িত্ব কর্তব্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন আছে। দেশে এখন পুলিশের সাংগঠনিক ক্ষমতা ও মনোবল নিম্ন পর্যায়ে। এদের কারণে মব সন্ত্রাস দিন দিন বেড়েই চলছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়।এমন অবস্থায় ভালো নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবয়ব,আয়তন ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শান্তি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো রেখে নির্নাচন করতে হলে সেনাবাহিনীর বৃহত্তর ও কার্যকর অংশগ্রহণ দরকার। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লাগবে। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ এখন মাঠে আছে পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য। সেনাবাহিনী মাঠে থাকা স্বত্বেও

৫ আগস্টের পর পুলিশ এর মাঝে এখনো শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। তাইত বাস্তবতার নিরিখে ইসির নির্বাচন বিষয়ক প্রস্তাবনায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পরিবর্তন আসবেই। এই পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অনেক বেড়ে যাবে। বিদ্যমান আইনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সংজ্ঞায় বলা আছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অর্থ হলো: পুলিশ বাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, ব্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, আনসার বাহিনী ব্যাটালিয়ন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এবং কোস্ট গার্ড বাহিনী। সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্যে ২০০১ সালে আরপিওতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করা হয়েছিল। এই বিধানটি ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী সরকারের আমলে ২০০৯ তাদের অশুভ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই আইনটি বাদ দেওয়া হয়। আইনে সশস্ত্র বাহিনী সংজ্ঞাভুক্ত না থাকলে নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বাধ্যবাধকতা থাকে না। কিন্তু গত তিনটি নির্বাচনের আগে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপে অনেকই সশস্ত্র বাহিনীকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত দাবি জানিয়েছিল। আওয়ামী লীগ বিষয়টি আমলে নেয়নি। বিগত তিনটি নির্বাচনে সেনাবাহিনী টহলরত ছিল কিন্তু একটা আনসারের যে ক্ষমতা ছিল তাও ছিল না। এতে ভোট কারচুপি করে নির্বাচনের আয়োজনকে বিতর্কিত করেছেন।

বর্তমানে নির্বাচন সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায়’ সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর ‘যুক্ত করার প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আইনে এটি যুক্ত হলে তিন বাহিনীকে নির্বাচনী দায়িত্ব নিতে আলাদা কোন আদেশের প্রয়োজন হবে না। এই আইনের আওতায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ও পুলিশের মতো ভোট কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এবং বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবেন।

বর্তমান সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপারে আরপিও ৮৭ ধারায় আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর ক্ষমতার বিষয়ে বলা আছে। যেমন এই আইন অনুযায়ী পুলিশ কর্মকর্তা না হলে ও নির্বাচন সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনরত ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার’ কোনো সদস্য ভোটের দিন ভোট কেন্দ্রে বা ভোট কেন্দ্রের ৪০০ গজ ব্যাসার্ধের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্বাচনী অপরাধের জন্য যে কোনো ব্যাক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারেন। ইসি সেভাবে প্রস্তাবনা তৈরি করেছেন সেভাবে আইনে সংশোধনে এলে সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচনের সময় এ ক্ষমতাগুলো প্রয়োগ করতে পারবে।

আওয়ামী সরকারের আমলে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনে সংজ্ঞাভুক্ত না থাকলেও নির্বাচনগুলোতে সেনা মোতায়ন করা হয়েছিল। সেখানে দায়িত্ব ছিল --ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার- এর (বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার উদ্দেশ্য) আওতায়। এভাবে মোতায়ন করা হলে মূলত স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে দায়িত্ব হলো- স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নির্বাচনী এলাকায় নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় তারা অবস্থান নেয়, প্রয়োজনে টহল দেয়। রিটার্নিং কর্মকর্তা বা ম্যাজিষ্ট্রেটের নির্দেশে তারা কাজ করে।

ফাউন্ডেশন ফর ষ্ট্রেটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (এফ-এস ডিএস) মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর একটি সেমিনারে বলেন, ‘সেনাবাহিনীকে শুধু স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রাখার মানি হবে অরাজকতা তৈরির সুযোগ করে দেওয়া এবং বিপুল অর্থের অপচয়। আমি মনে করি সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞাভুক্ত করে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সযোগ)তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হোক। এতে জনগণ ভোট দিতে উৎসাহ পাবে।’

নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করতে হলে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। আমি মনে করি সেনাবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত রাখতে হবে। ভোটের তিন মাস আগে তাদের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব দিতে হবে। ভোটের পরেও কমপক্ষে ১০ দিন সেনাবাহিনী মাঠে থাকতে হবে। একদম তৃণমূল পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সমন্বয় কমিটি হবে সেখানে সেনাবাহিনীকে রাখতে হবে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য ৮০ হাজার সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করবেন। নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবচেয়ে ইতিহাসের সেরা যে নির্বাচন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তা সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সরাসরি সংযুক্ত রাখতে হবে। ফোর্স স্বল্পতার কারণে ভারতের মত একাধিক দিবসে ----যেমন ৮টি বিভাগের জন্য ৪ দিনে সংসদ নির্বাচন করা যেতে পারে। তাহলে নিরাপত্তার বিষয়টি ১০০% নিশ্চিত হবে। বিশ্বের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো উত্তম সময় এসেছে । এরা যদি শান্তি মিশনে নিরাপত্তা দিতে পারে আমাদের দেশে পারবে না কেন? তবে জনগণকে ও সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করতে হবে তাহলেই দেশে একটি উৎসব মুখর নির্বাচন করা সম্ভব।

লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট


তারেক রহমান: দীর্ঘ সংগ্রামের অপ্রতিরোধ্য আলোক বর্তিকা

আতিকুর রহমান রুমন
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব কম নেতাই আছেন, যাঁরা দীর্ঘ নির্বাসনেও জনতার হৃদয়ে থেকেছেন সংগ্রামের প্রতীক হয়ে। তারেক রহমান- শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান। শুধু রাজনৈতিক উত্তরাধিকারেই নয়, নিজের যোগ্যতা ও দৃঢ়তায় আজ দেশের আপামর মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জাতীয় মর্যাদা রক্ষা ও ভবিষ্যতের নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় আশ্বাস । দীর্ঘ ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রবাসে থেকেও তিনি হার মানেননি- রাজপথে না থেকেও রাজপথের প্রতিটি আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হয়েছেন। তাঁর ডাকেই সংগঠিত হয়েছে লাখো কর্মী, জেগে উঠেছে ছাত্রসমাজ, তীব্র প্রতিবাদে কেঁপে উঠেছে স্বৈরাচারের ভিত।

অন্যদিকে গত দেড় দশক বাংলাদেশ ছিল ফ্যাসিবাদ, দুর্নীতি ও বিদেশি স্বার্থরক্ষার এক দীর্ঘ অন্ধকারে নিমজ্জিত- যেখানে শেখ হাসিনা ক্ষমতার লোভে জাতির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করেছেন। ঠিক এই অন্ধকারের মাঝেই তারেক রহমানের দৃঢ় বিশ্বাস, সুদূরদৃষ্টি ও অবিচল সংগ্রাম আজ জাতির জন্য হয়ে উঠেছে মুক্তির একমাত্র অপ্রতিরোধ্য আলোকবর্তিকা । বাংলাদেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে যখন দেশ নতুন পথের সন্ধানে, তখন জনমানসে একটি প্রত্যাশা ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে- তারেক রহমানের নেতৃত্বেই শুরু হবে স্বাধীন, সমৃদ্ধ ও মর্যাদাবান বাংলাদেশের নতুন অধ্যায়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিষ্ট শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনকাল ছিল এক গভীর অন্ধকারের সময়, যেখানে জনগণের অধিকারকে নির্মমভাবে পিষে দেওয়া হয়েছিল ক্ষমতার স্টিমরোলারের নিচে।

অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের বন্ধুত্ব। বিনিময়ে ভারতকে দিয়েছেন এমন সব সুবিধা, যা দেশের সার্বভৌমত্বকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। সীমান্তে বারবার বাংলাদেশি নাগরিকদের রক্ত ঝরলেও, তিনি নীরব থেকেছেন; বরং নানা চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে ভারতকে একতরফা সুবিধা দিয়েছেন- ট্রানজিট, সমুদ্রবন্দর ব্যবহার, জলসম্পদে প্রাধান্য, এমনকি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক নীতিতেও দিল্লির প্রভাব বিস্তারের সুযোগ। এ দেশের কৃষক যখন তিস্তা নদীর পানির জন্য হাহাকার করেছে, তখনো শেখ হাসিনা ভারতের মন জোগানোর রাজনীতিতে ব্যস্ত ছিলেন। দেশের শিল্প, বাণিজ্য ও জ্বালানি খাতকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করে তোলার মাধ্যমে তিনি শুধু অর্থনীতিকেই দুর্বল করেননি, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তা, কূটনীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রতিটি স্তরে ভারতীয় প্রভাব এমনভাবে প্রবেশ করেছে, যেন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নয়- বরং প্রতিবেশী পরাশক্তির একটি প্রভাবাধীন প্রদেশ। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পরপরই প্রতিবেশী দেশ ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। তখন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের মুখে মুখে শোনা যেত- ‘ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক কিংবা দুবাইয়ের মতো।'

কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা করে ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করে। ধাপে ধাপে ভারত শুধু সড়ক নয়, রেল ট্রানজিটও আদায় করে নেয়। এর ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যের পণ্য এখন বাংলাদেশের সড়ক, রেল এবং জলপথ ব্যবহার করে আখাউড়া-আশুগঞ্জ হয়ে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে পৌঁছাচ্ছে।

এখানেই শেষ নয়- ভারতকে বাংলাদেশের চারটি নদীপথ ব্যবহারেরও অনুমতি দেওয়া হয়। এতে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ সরাসরি বাংলাদেশের পূর্ব দিক হয়ে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়- এই ট্রানজিট দিয়ে কি বাংলাদেশ সত্যিই সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক বা দুবাইয়ের মতো সমৃদ্ধ হয়েছে? সোজা উত্তর- না, হয়নি। বরং, দৈনিক আজকালের খবর পত্রিকার (৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন- 'ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার ফলে ১৬ বছরে বাংলাদেশ আয় করেছে মাত্র ৩৭ লাখ টাকা, অথচ কেবল ট্রানজিটের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যয়েই খরচ হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।' অর্থাৎ যে ট্রানজিটকে উন্নয়নের সোনার হরিণ বলা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এক বিশাল আর্থিক ক্ষতির বোঝা এবং জাতীয় স্বার্থ বিসর্জনের প্রতীক।

শেখ হাসিনা যেভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় নিজ দেশের জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছেন, তা ইতিহাসে এক বিশ্বাসঘাতকতার উদাহরণ হয়ে থাকবে। ক্ষমতার লোভে আঞ্চলিক শক্তির কাছে দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়া এবং জনগণের ন্যায্য অধিকার উপেক্ষা করার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, তা থেকে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশের জন্য হবে দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রামের পথ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার আগমন ছিল এক প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ নারীর যাত্রা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর লন্ডনে প্রথম সফরেই বিবিসির খ্যাতিমান সাংবাদিক জন রেনারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন-রাজনীতি তার ভালো লাগে না, কিন্তু পিতা, মাতা ও ভাইদের হত্যার প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। সেই প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা পরবর্তীতে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি পদক্ষেপে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই ছিল শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য, আর সেই সঙ্গে তিনি শুরু করেন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা-যেখানে দেশের স্বার্থ সর্বদা ছিল শেষ প্রাধান্যে, আর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ ছিল সবার ওপর। ভবিষ্যতে যদি ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, তাহলে বিদেশে আশ্রয় নেওয়ার পথও তিনি আগেই সুসংহত করে রাখেন। পরিবারের সদস্যদের বিদেশি নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা ছিল সেই দূরদর্শী পরিকল্পনারই অংশ। আর বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য দেশের সম্পদ লুটপাটে তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা সব সময়ই ছিল সক্রিয়।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ থেকে পাচার করেছে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার- বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা (দৈনিক সমকাল, ২ ডিসেম্বর ২০২৪)। শুধু গত পাঁচ বছরের পাচারের অঙ্কই জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। এই অর্থ দিয়ে ৮৭টি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব ছিল। ২০০৯ সালে সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতনের সময় সেই ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ লাখ কোটি টাকায়।

মাথাপিছু ঋণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ টাকা। এই ঋণের বড় অংশই এসেছে বিদেশি ও দেশি উৎস থেকে, যার বিশাল অংশ লুটপাট হয়েছে মেগা প্রকল্পের নামে শেখ হাসিনার শাসনামলে মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতির চিত্র-

পদ্মা সেতু : উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, মাত্র ৬.১৫ কিমি দীর্ঘ পদ্মা সেতু নদীর ওপর নির্মিত, সিঙ্গেল রেললাইন, তৈরিতে সময় লেগেছে ৭ বছর ৬ মাস ২৬ দিন এবং খরচ ৩.৬ বিলিয়ন ডলার। সেখানে রাশিয়ার ক্রিমিয়া সেতুর দৈর্ঘ্য ১৮.১ কিলোমিটার, উত্তাল ব্লাক সির ওপর নির্মিত, ডাবল রেললাইন, তৈরিতে সময় লেগেছে মাত্র ৩ বছর এবং খরচ ৩.৭ বিলিয়ন ডলার। এই চিত্রে পদ্মা সেতুতে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে সেটা সহজেই অনুমেয়।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে শেখ হাসিনা একাই আত্মসাৎ করেছেন ৫৯ হাজার কোটি টাকা। (ঢাকা পোষ্ট, ১৮ আগস্ট ২০২৪)।

কর্ণফুলী টানেল : প্রতিদিন গড়ে ২৭ লাখ টাকার লোকসান, যার পেছনে অপরিকল্পিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত দায়ী। (ইত্তেফাক, ২৮ অক্টোবর ২০২৪)।

সড়ক ও অবকাঠামো খাত: বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তো বটেই, এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও বাংলাদেশে মহাসড়ক নির্মাণের ব্যয় কয়েক গুণ বেশি। ফলে মহাসড়ক নির্মাণ ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে। (প্রথম আলো, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫)। বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ ব্যয় ভারত ও চীনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি- প্রধান কারণ ছিল দুর্নীতি ও দরপত্রে প্রতিযোগিতার অভাব। ফ্লাইওভার নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি- বাংলাদেশের ব্যয় বিশ্বের শীর্ষে বিগত ৩১ মে, ২০১৬ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, “বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় ভয়াবহভাবে বেশি।

বাংলাদেশে কিলোমিটারপ্রতি ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় ঢাকা ফ্লাইওভার : ৩১৬ কোটি টাকা, মৌচাক মালিবাগ ফ্লাইওভার : ১৩৫ কোটি টাকা, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার : ১৮০ কোটি টাকা।

অন্যান্য দেশের তুলনা

মুম্বাইয়ের ইস্টার্ন ফ্রি হাইওয়ে ৮৮ কোটি টাকা, কলকাতার পরমা ফ্লাইওভার ৪৮ কোটি টাকা, চীন ও মালয়েশিয়া : ৮০-৯০ কোটি টাকা। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পগুলো শুধু ব্যয়বহুলই নয়, বরং সীমাহীন দুর্নীতি ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারি অর্থ লোপাটের একটি বড় উদাহরণ।

রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় ও জাতীয় সম্পদের ক্ষতিসাধনের গুরুতর অভিযোগে বারবার অভিযুক্ত হয়েছেন শেখ হাসিনা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্য অনুযায়ী, শুধু 'মুজিব শতবর্ষ' উদযাপনকে ঘিরেই শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল নির্মাণে অপচয় করা হয়েছে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা। সারাদেশে ১০ হাজারেরও বেশি ম্যুরাল ও মূর্তি নির্মাণে এই বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়, যা জনকল্যাণমূলক খাতে বিনিয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রচার ও ব্যক্তিপূজার উদ্দেশ্যে অপব্যবহৃত হয়েছে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, আহ্বায়ক, আমরা বিএনপি পরিবার ও সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল


রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে একমত হতে সমস্যা কোথায়?

ড. সুলতান মাহমুদ রানা
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

ঐকমত্য কমিশন জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়া ইতোমধ্যেই আমাদের সামনে এসেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। তবে বেশে কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়নি। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কার আনা হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্য হলেও সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। উল্লেখ্য, বিএনপি সনদ বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করার বিষয়ে একমত হলেও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল মনে করে, শুধু অঙ্গীকার করলেই হবে না। তারা মনে করে সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে হবে এবং সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) আছে, সেগুলো হলো: ১. রাষ্ট্রের মূলনীতি: এই প্রস্তাবে ভিন্ন আছে বাংলাদেশ জাসদ, সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), গণফোরামের; ২. রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি: ভিন্নমত আছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের; ৩. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব: কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ১২-দলীয় জোট, এলডিপির; ৪. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান: ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের; ৫. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা: বিএনপি (গঠন প্রক্রিয়া সংসদের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষে), কিছু অংশে ভিন্নমত আছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি, এনডিএম, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২-দলীয় জোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির; ৬. উচ্চকক্ষে পিআর: বিএনপি, এনডিএমের ভিন্নমত; ৭. উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ: বিএনপি, এনডিএমের ভিন্নমত; ৮. উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা: সিপিবি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, আম জনতার দলের ভিন্নমত; ৯. নারী আসনের বিধান: সিপিবি, বাসদ, আম জনতার দলের ভিন্নমত ১০. ন্যায়পাল নিয়োগ, সরকারি কর্ম কমিশনে নিয়োগ, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগ: বিএনপি, এনডিএম, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ভিন্নমত; ১১. ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপের পক্ষভুক্ত হওয়া: জামায়াতে ইসলামী, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, জাকের পার্টি, জেএসডি ও বিএসপির ভিন্নমত আছে।

সার্বিক পরিস্থতি বিবেচনায় বলা যায়, এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংকটের মেঘ পুরোপুনি কেটে যায়নি। তবে পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনের টক শো, গোলটেবিল, সভা-সেমিনারÑসর্বত্রই এখন আলোচনার প্রধান বিষয় নির্বাচন। সম্প্রতি গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারলাম যে, নির্বাচন কমিশন সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই রোডম্যাপ ঘোষণা করা হতে পারে। এতে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, সামান্য যে অনিশ্চয়তা ছিল, তা-ও হয়তো কেটে যাচ্ছে। দুয়েকটি রাজনৈতিক দল এখনো কিছু শর্ত দিচ্ছে এবং শর্ত পূরণ না হলে নির্বাচন বর্জন করার হুমকি দিচ্ছে। এগুলোকে অবশ্য রাজনৈতিক সুবিধা আদায় বা দর-কষাকষির কৌশল হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী বাছাই ও অন্যান্য নির্বাচনী প্রস্তুতির পাশাপাশি রাজনৈতিক জোট গঠনে এখন অনেক বেশি তৎপর লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মূলত তিনটি জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলেছে। যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ১২ দল, সমমনা জোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ আরো কয়েকটি দলের সঙ্গে বিএনপির জোটবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত। যত দূর জানা যায়, এই জোটে আরো কয়েকটি দল অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদের নামও শোনা যাচ্ছে। তবে এটি প্রায় নিশ্চিত যে বিএনপি কোনোক্রমেই আগামী নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটে যাবে না।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও হেফাজতে ইসলামের মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন অংশ নিয়ে জোট বাঁধার বিষয়ে অনেকটাই ইতিবাচক বলে জানা গেছে। এর বাইরে এনসিপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ আরো কয়েকটি দল পৃথক জোট গঠনেরও চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত এই জোট বিএনপির সঙ্গে একীভূত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি মনে করা হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু আশার আলো দেখা গেলেও গত ১৫ আগস্ট বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘আমরা শুনি, বিশ্বাসও করতে চাই যে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া, ভোটগণনা, ফলাফলের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত জাতির কাছে একটা সংশয় আছে।’

রাজনীতিতে যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতি ঘটতে পারে এমন আলোচনা সর্ব মহলে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। গত ৩১ জুলাই রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে বিএনপির মহাসচিব তাদের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকি, আমরা যদি সতর্ক না থাকি তাহলে এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়।’ তিনি বলেন, ‘খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমরা কিন্তু খুব একটা সূক্ষ্ম তারের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু চারদিকে আপনারা আমার চেয়ে ভালো জানেন, চারদিকে একটু চোখ-কান খোলা রাখেন। দেখবেন কতগুলো ঘটনা ঘটছে, যে ঘটনাগুলোর আলামত ভালো না। এদিকে একটু লক্ষ রাখতে হবে।’ তার এই বক্তব্য থেকেও মনে হয় যে বিদ্যমান পরিস্থতিতে রাজনীতিতে এক ধরনের সংকট রয়েছে। এমনকি রাজনীতিতে ঐক্য নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও একতা নেই।

৩১ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের দুপুর ১২টা ১১ মিনিটে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্ট নিয়েও বেশ আলোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা মো. আবু সাদিক কায়েমেরও সমালোচনা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘শিবির নেতা সাদিক কায়েম সম্প্রতি একটা টক শোতে বলেছেন, ছাত্রশক্তির গঠন প্রক্রিয়ায় শিবির যুক্ত ছিল, শিবিরের ইনস্ট্রাকশনে আমরা কাজ করতাম। এটা মিথ্যাচার।’ নাহিদ তার ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ‘সাদিক কায়েম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক ছিলেন না।...’

অন্যদিকে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি বাতিলের অভিযোগ তুলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা বর্জন করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাসদ, বাংলাদেশ বাসদ, বাসদ মার্কসবাদী দল। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স) বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে এমন একটি প্রস্তাব পাস করানোর চেষ্টা থেকেই কমিশনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। আগে অনেকে বলেছিলেন, সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন করে লিখতে হবে, আজ তারই প্রতিচ্ছবি আমরা দেখলাম।’

আমরা জানি যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। অন্যদিকে গত ৩০ জুলাই জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের বিরুদ্ধে দলীয় সব ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। আদালত এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের বিরোধ নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন থাকা একটি রিট পিটিশনের (১৫০৫১) উল্লেখ করেন। আদালত বলেছেন, ‘মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের শুনানির জন্য প্রস্তুত অবস্থায় বিচারাধীন আছে। এ পর্যায়ে কারও পক্ষে দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সমীচীন নয় মর্মে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয়।’

এমন নানা ধরনের মত-ভিন্নমত এবং অনৈক্য পরিস্থিতি আমাদেরকে ক্রমেই শঙ্কিত করে তুলছে। যেসব রাজনৈতিক দল বর্তমানে মাঠে নেই, তারা তো এমনিতেই বিদ্যমান মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে আছে। আর যেসব দল মাঠে সরব রয়েছে তারা যদি নিজেরা কোনো বিষয়ে একমত না হয়ে বিভেদ তৈরি করতে থাকে তাহলে রাজনীতির সংকট আরও বাড়তে পারে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

আমরা চাই, দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু এ বিষয়ে নতুন করে কোনো প্রশ্ন তৈরি হোক- সেটি আমরা চাই না। নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাই চালাবে পাঁচ বছর। সেই পাঁচ বছরে যদি তারা ব্যর্থ হয়, না পারে, আবার নির্বাচন হবে। নির্বাচনে জনতা তাদের বাদ দিয়ে দেবে, অন্য দলকে দেবে। কাজেই এ বিষয়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক স্থায়ী হওয়া উচিত না।

আগামী নির্বাচনে যদি সত্যিই ফেব্রুয়ারিতে হয়, তাহলে সামনের সময়টা খুবই কম। এমনকি যে সময় আছে তা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, আর এক্ষেত্রে বহুমুখী সংকট থেকেই যাবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। খালি চোখে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো চূড়ান্ত ঐকমত্য দেখতে পাচ্ছি না। এমনকি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপও দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্বের বহু দেশে নির্বাচনী সংস্কার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বারবার কমিটমেন্ট করছে- নির্বাচনকে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার বিষয়ে। এমনকি এমন কমিটমেন্ট বাংলাদেশেও ইতোপূর্বে কয়েকবার হয়েছে। তারপরও কোনো না কোনোভাবে নির্বাচন প্রভাবিত হচ্ছে এবং প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে। কাজেই এখানেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামেই চয়েস করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন, অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্যমানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন এবং নিজেদের উৎকৃষ্ট ভাবার প্রবণতা অধিকভাবে লক্ষণীয়।

মোটা দাগে বলতে গেলে বলা যায় রাজনৈতিক দলগুলোর বিদ্যমান টানাপড়েনের পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের। উদার গণতন্ত্রের উপাদানগুলো সবসময়ই অনুপস্থিত। আর এই দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিত উপাদানগুলোর যথাযথ সংস্কার রাতারাতি সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের চলার পথ মসৃণ করতে হলে অতীতের ভুল চিহ্নিত করে শিক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইতোপূর্বে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় বিধি বিধানের অসমাঞ্জস্যতায় দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের পথ মসৃণ হয়নি। নানা প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চাই, তার জন্য দরকার আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি

রেজাউল করিম খোকন
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

দেশের মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি, সুরক্ষণ, উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবহারে জনসচেতনতা তৈরির জন্য মৎস্য সপ্তাহ পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ‘অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে এ বছর ১৮ আগস্ট থেকে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ -২০২৫ শুরু হচ্ছে। দেশের প্রাণিজ আমিষ ও পুষ্টি চাহিদার বড় অংশ আসে মাছ থেকে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে। দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। মাছের মাধ্যমে মানুষের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি উৎপাদিত মাছ নিরাপদ করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। ইতোমধ্যে মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে। সমুদ্রসীমাসহ অন্য জায়গায় যারা মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের প্রতিটি নৌযানে যান্ত্রিক পদ্ধতি সংযোজন করা হচ্ছে, যাতে তাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা যায়। পাশাপাশি মাছ ধরার কোনো নৌযান দুর্ঘটনায় পড়লে, সেটির অবস্থান জানার জন্যও এ পদ্ধতি কাজে লাগবে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের বহুমুখী ব্যবহারে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মাছ থেকে চিপস, কেকসহ অন্যান্য মৎস্যজাত পণ্য তৈরি করলে ভোক্তা বাড়বে। মাছের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে কাজ করলে সহজ শর্তে, স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ, প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ সরকার নানা রকম সহায়তা দিচ্ছে। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ।

এবারের জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ -২০২৫ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য শক্তিশালী মৎস্য খাত গড়ে তোলা। মৎস্য খাতে উৎপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়া জাতকরণ ও রপ্তানির প্রক্রিয়ায় সময় উপযোগী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে মৎস্য খাত থেকে সর্বোচ্চ অবদান রাখার লক্ষ্য নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাছ উৎপাদন এবং দেশে ও বিদেশে সরবরাহের জন্য সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার তৈরি করেছে। পরীক্ষাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে পৃথিবীর ৫২টি দেশে বাংলাদেশের মাছ রপ্তানি হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৪৭ দশমিক ৫৯ মেট্রিক লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত মাছ যাতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই খাতের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে পরিকল্পিত অর্থায়ন দরকার। সরকারের কৃষি ঋণ, সরকারি- বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণসহ বিভিন্ন আর্থিক খাতের বিনিয়োগে মৎস্য খাতকে গুরুত দিতে হবে। মৎস্য খাতে উৎপাদন বেড়ে যাওয়াসহ অনেক সাফল্য এলেও এই খাতে এখনো প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আসেনি। চাষিরা কীভাবে ঋণ পাবেন, তা নিয়েও ধারণার যথেষ্ট অভাব আছে। যে কারণে এখনো অনেক চাষি উচ্চ সুদে দাদন বা ঋণ নেন। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে তা সামগ্রিকভাবে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখবে। এই খাতে এতদিন যৌক্তিকভাবে বিনিয়োগ হয়নি। তবে বিদেশে রপ্তানির জন্য সরকার তিনটি মাছকে চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো পাঙাশ, তেলাপিয়া ও কই মাছ। এই মাছগুলোর রং, স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যাতে তা রপ্তানিযোগ্য করা যায়। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেভাবে ঋণ দিতে অভ্যস্ত এবং ঋণ আদায়ের যে সংস্কৃতি তা মৎস্য খাত বান্ধব নয়। তারা মনে করে, মৎস্য খাতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যাংক খাতের বাইরের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ওই খাতে ঋণ দিতে চায় না। তাই এই সংস্কৃতি থেকে আর্থিক খাতকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি ছাড়া অন্য মাছের রপ্তানির অভিজ্ঞতা কম। মাছের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি এর গুণগত মান বাড়াতে হবে। মিয়ানমারের মতো সমুদ্রে মাছ ধরার সব নৌযানকে নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে মৎস্য অধিদপ্তর করা উচিত। সামুদ্রিক জেলেদের জন্য ‘সামুদ্রিক মৎস্য পরামর্শ কেন্দ্র’ চালু করা যায়। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে জেলেরা প্রতিদিন ‘মাছের বসতি’ সম্পর্কে জানতে পারবে। এতে জেলেদের অর্থ ও সময় বাঁচবে। এ কাজে মৎস্য বিজ্ঞানীদের লাগানো যায়। আধুনিক ট্রলার বা ফ্রিজার ঘন্টায় এক টনেরও বেশি মাছ ধরতে ও প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ অনেক দেশই এ প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে প্রক্রিয়াজাত করে। উন্নত ট্রলারে থাকা-খাওয়ার সুবিধাও ভালো। এর চেয়ে বড় কথা, এগুলো অনেক নিরাপদ। ফলে এসব দেশের জেলেরা দীর্ঘদিন সমুদ্রে অবস্থান করে মাছ ধরতে পারে। মিয়ানমার ও ভারতের সমুদ্র সীমায় স্রোত ও ঢেউ বেশি থাকায় আমাদের জলসীমা থেকে তারা অনেক সময় মাছ ধরে নিয়ে যায়। সামুদ্রিক ঢেউ ও স্রোতের বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) আধুনিক জাহাজ আমদানি করে পিপিপির মাধ্যমে বা কিস্তিতে জেলেদের দিতে পারে। ডাটাবেইস করে সামুদ্রিক মাছ ধরার প্রতিটি নৌকা ও মালিককে সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে। এছাড়া মৎস্য আহরণ বাড়াতে সামুদ্রিক নৌযান, ট্রলারগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করে সমুদ্রের সর্বশেষ অবস্থা সব সময় জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের ব্যাপারে বিলম্ব করার কোনো অবকাশ নেই। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকেও এগিয়ে যেতে হবে।

এক সময় এদেশ মাছের জন্য সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন আর আগের সেই অবস্থা আর নেই। আগে যেখানে পুকুর, খাল, নদী-নালা, বিল-ঝিলে মাছের আবাসস্থল ছিল, এখন সময়ের বিবর্তনে সব পাল্টে গেছে। মাছের আবাস স্থলগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছ। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পুকুর, খাল, বিল ভরাট করে নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মাণের কারণে পুকুর, খাল, বিল হারিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে নদী, নালা, বিল ঝিলে কলকারখানার দুষিত বর্জ্য এসে এসব এলাকার পানি দুষিত করে ফেলছে। জমিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকরা বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করায় দেশীয় প্রজাতির আবাসস্থলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে আমাদের দেশে বিগত দুই দশক ধরে দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার ঘটছে না। ক্রমেই দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছ ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছের জায়গায় এখন স্থান দখল করে বসেছে বিদেশি প্রজাতির হাইব্রিড মাছগুলো। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে বিদশি মাছের ব্যাপক চাষ হয়ে আসছে। এসব বিদেশি মাছের মধ্যে রয়েছে তেলাপিয়া, নাইলেটিকা, পাঙাস, থাই কৈ, আফ্রিকান মাগুর পিরানহা, ঘ্রাসকার্প, সিলভারকার্পসহ আরো কিছু প্রজাতির মাছ। এসব হাইব্রিড মাছ চাষে অধিক লাভবান হওয়ার কারণে মাছ চাষিরা ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছের চাষ করছেন। যে কারনে দেশের মানুকে বাধ্য হয়ে এসব হাইব্রিড জাতীয় মাছ খেতে হচ্ছে। এসব হাইব্রিড জাতীয় মাছের স্বাদ, গন্ধ দেশি প্রজাতির মাছের মতো নয়। দেশি প্রজাতির মাছের স্বাদ, গন্ধ অতুলনীয়। এসব দেশি প্রজাতির মাছ সীমিত আকারে আবার অনেকে চাষ শুরু করেছেন। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় বিলুপ্ত প্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে দেশি পাবদা, টেংরা, পুঠি, কৈ, মাগুর, শিং, শোল, গজার, বোয়াল, আইড়, চাপিলা, খলিসা, তারাবাইন, গলদা চিংড়ি, চাঁদা, তপসে, তিন কাটা, চিতল, ফলইসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এক সময় আমাদের দেশে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে ৫৪ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বিপন্ন। এর মধ্যে ১৪০ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব রক্ষায় দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য মৎস্য বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশীয় মাছের অস্তিত্ব রক্ষার উদ্দেশে দেশীয় প্রজাতির মাছের ব্যাপক চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। মৎস্য হ্যাচারীগুলো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মাছের পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন চাষের ক্ষেত্র তৈরি করে দেশি প্রজাতির মাছের চাষের ব্যবস্থা করতে পারে দেশের মানুষকে মাছের প্রকৃত স্বাদ গ্রহণের লক্ষ্যে দেশি প্রজাতির মাছের চাষের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের তরফ থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলায় সরকারি উদ্যোগে দেশি প্রজাতির মাছের হ্যাচারী গড়ে তুলে সেখান থেকে মাছের পোনা মৎস্য চষিদের মাঝে বিতরণ করে দেশি মাছের চাষের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, দেশি প্রজাতির মাছের চাষের উদ্যোগ নেয়া হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশি প্রজাতির মাছ আবার তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে।

রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।


বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ: নিবন্ধন নয়, নিয়োগ পরীক্ষা হোক

মো. রহমত উল্লাহ্
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ষষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তিতে শূন্যপদ ছিল ১ লাখ ৮২২টি। এর বিপরীতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন জমা পড়েছে ৫৭ হাজারের কিছু বেশি। অর্থাৎ প্রায় ৪৩ হাজার পথ শূন্য থাকবে। চাহিদা দিয়েও শিক্ষক পাবে না অনেক প্রতিষ্ঠান। ক্লাস থেকে বঞ্চিত হবে শিক্ষার্থীরা! এ ব্যাপারে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন যে, আবেদনকালে প্রার্থীদের বয়স ৩৫ এর বেশি এবং নিবন্ধন সনদের মেয়াদ ৩ বছরের বেশি গ্রহণ না করার কারণে আবেদন কম পড়েছে। অর্থাৎ আরো কিছু ছাড় দেওয়া হলে আরো কিছু বেশি প্রার্থী আবেদন করতে পারত। বয়সে ও যোগ্যতায় বারবার ছাড় দিয়ে আবেদনের সুযোগ দিয়ে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ করা কোনো উত্তম সমাধান নয়। ছাড় দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ করা মানেই দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করা। একজন কম যোগ্য শিক্ষক তার শিক্ষকতা জীবনে তৈরি করেন অগণিত কম যোগ্য নাগরিক-কর্মী। তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে অধিক যোগ্য নাগরিক-কর্মী তৈরির প্রত্যাশা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অবাস্তব!

শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি এখন আর গ্রহণযোগ্য থাকা উচিত নয়। সরকারি এমনকি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বা কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও এখন আর তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণিধারী প্রার্থীদের আবেদন করার সুযোগ থাকে না। নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স সীমা ও বাছাই প্রক্রিয়া অন্যদের তুলনায় বেসরকারি শিক্ষকদের শিথিল করা হলে এর অর্থ এমন দাঁড়ায় না যে বেসরকারি শিক্ষক তুলনামূলক কম যোগ্য হলেও চলে? এতে কি তাদের মান ও মর্যাদা হ্রাস পায় না? দেশের ৯৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীদের পাঠদানকারী বেসরকারি শিক্ষকদের অধিক যোগ্য হওয়া কি অধিক গুরুত্বপূর্ণ নয়? তারা তো আমাদের সন্তানদেরই শিক্ষক হন। তারা অধিক যোগ্য হলেই তো আমাদের সন্তানরা অধিক যোগ্য হবার সম্ভাবনা অধিক থাকে। অর্থাৎ বয়সে, যোগ্যতায়, পরীক্ষায় ছাড় দিয়ে তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে নয়; বরং দ্রুত আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে অধিক যোগ্যদের আকৃষ্ট করে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়াই অধিক মঙ্গলজনক।

সার্বিক বিবেচনায় বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থাটিকে অতীতের ধারাবাহিকতায় আরও উন্নত করা আবশ্যক। সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে তা সহজেই সম্ভব। সে লক্ষ্যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগের অনুরূপ শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স সীমা ও বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া উচিত। অর্থাৎ শূন্য পদের বিপরীতে সরাসরি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উত্তম বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উত্তম প্রার্থী বাছাই করে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। নিবন্ধনধারী সবাইকেই যদি নিয়োগ দিতে হয় তাহলে এটিকে নিবন্ধন পরীক্ষা না বলে নিয়োগ পরীক্ষা বলা ও কার্যকর করা অধিক যুক্তিযুক্ত নয় কি? তুলনামূলক কম নম্বর প্রাপ্ত নিবন্ধন ধারীরাও নিয়োগের দাবিদার হয়, নিয়োগের জন্য সোচ্চার হয়, বয়সের শিথিলতা দাবি করে, অশান্তি তৈরি করে। এমনকি অকৃতকার্যরাও আন্দোলন করে! অথচ সরাসরি নিয়োগ পরীক্ষায়/ প্রক্রিয়ায় কম নম্বর পেয়ে বাদ পড়ে যাওয়ারা আর নিয়োগের দাবিদার হতে পারে না, বয়সের শিথিলতা দাবি করতে পারে না, অশান্তি তৈরি করতে পারে না। অপরদিকে একবার নিবন্ধন পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া, আবেদন নেওয়া, পরীক্ষা নেওয়া, তালিকা করা, সনদ দেওয়া এবং পরবর্তীতে আবার নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া, বাছাই করা, তালিকা করা, নিয়োগ করা ইত্যাদি নিয়োগ কর্তৃপক্ষ ও নিয়োগ প্রার্থী উভয়ের জন্যই দ্বিগুণ কষ্টসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ। তদুপরি নিয়োগ প্রার্থীর জন্য দ্বিগুণ ব্যয় সাপেক্ষ। অধিক সংখ্যক শূন্য পদে নিয়োগ প্রার্থীদের বাছাই কেন্দ্রীয়ভাবে দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব না হলে জেলা প্রশাসকগণের দায়িত্বে ঐ জেলার সরকারি স্কুল-কলেজের সুযোগ্য শিক্ষকগণের সহযোগিতা নিয়ে সারাদেশে একই প্রশ্নে ও প্রক্রিয়ায় বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের বাছাই দ্রুত সম্পাদন করা সম্ভব হয় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। যেমন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর করে থেকে।

অন্যান্য চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে নির্ধারিত বয়স ও যোগ্যতার চেয়ে অধিক বয়স্কদের ও কম যোগ্যদের শিক্ষকতায় প্রবেশের সুযোগ দেওয়া মোটেও উচিত নয়। কিছুদিন পরপর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করতে চাইলে বারবার অধিকতর যোগ্য ফ্রেশ ক্যান্ডিডেট পাওয়া যাবে। একজন ইয়ং এনার্জিটিক মেধাবী শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে তৈরি করতে ও পূর্ণ উদ্যমে দীর্ঘদিন পাঠদান করতে যতটা সক্ষম একজন বয়স্ক লোক ততটা সক্ষম না হওয়াই স্বাভাবিক। ব্যতিক্রম নগণ্য। একজন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকের প্রকৃত সফল শিক্ষক হয়ে উঠতে অনেক সময়, শ্রম, মেধা, চর্চা, উদ্যম, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা লাগে। কেউ শিক্ষক হয়ে উঠতেই যদি বৃদ্ধ হয়ে পড়েন তো সফল পাঠদানে নিরলস থাকবেন কীভাবে, কতদিন?

আলোচিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অধিক যুক্তিযুক্ত উন্নত নীতিমালা প্রণয়ন করে ঢেলে সাজানো উচিত সকল শিক্ষক নিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়া। মূল্যায়নে বিবেচনা করা উচিত প্রার্থীর শিক্ষা জীবনের কর্মকাণ্ড ও ডেমো ক্লাসের মান। দ্রুত দূর করা উচিত একই দায়িত্ব-কর্তব্যে নিয়োজিত সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স সীমা, বাছাই প্রক্রিয়া এবং আর্থিক সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত সকল বৈষম্য। অর্থাৎ বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য আর নিবন্ধন পরীক্ষা নয়, নিতে হবে সরাসরি নিয়োগ পরীক্ষা। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি করতে হবে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা। শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে সর্বাধিক যোগ্যদের।

লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট


বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত: কুইক রেন্টাল চক্রে এখনো আবদ্ধ বাংলাদেশ

রাজু আলীম
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

ডিম পাড়ে হাসে, খায় বাগডাসে। গত ১৬ বছরে কথাটির বাস্তব প্রমাণ যেন দিয়ে গিয়েছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। দেশের মানুষের শ্রম আর ঘামের পয়সা তুঘলকি উপায়ে লুটে নিয়ে অবিশ্বাস্য অংকে বিদেশে পাচার করার নতুন নজির গড়েছিল তারা। এই লুটপাটের অন্যতম একটি খাত ছিল বিদ্যুৎখাত আর কুইক রেন্টাল কেরামতি। যেখানে মাত্র ৬ থেকে ৭ টাকার বিদ্যুৎ রাতারাতি সরকার কেনা শুরু করে সর্বোচ্চ ২৬ টাকায়।

আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছর দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির অন্তরালে গড়ে ওঠা, দুর্নীতি এবং অপচয় বিদ্যুৎখাতকে ক্রমেই করে তুলেছে জনসাধারণের অর্থ লোপাটের কারখানা। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে কুইক রেন্টাল নামের বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক অস্বচ্ছ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আজো দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরের একটি বড় শুভাঙ্করের ফাঁকি হিসেবে থেকে গেছে।

২০০৯ থেকে শুরু করে গত দশকজুড়ে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে দ্রুততা আনতে ‘কুইক রেন্টাল’ ব্যবস্থা চালু হয়। তবে, এই ব্যবস্থার আওতায় তৈরি হওয়া কেন্দ্রগুলো প্রায়শই তাদের সক্ষমতার মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বাদবাকি সময় এসব পাওয়ার প্ল্যান্ট বসে থাকলেও সরকার চুক্তি অনুযায়ী তাদের পূর্ণ ক্ষমতার জন্য ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ বা স্থায়ী পেমেন্ট দিতে বাধ্য হয়। এর ফলে একদিকে অতিরিক্ত সক্ষমতা থাকলেও, তা পূর্ণ ব্যবহার হয় না, এবং সরকারকে বছরে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে এই কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টে মাত্র ৬ টাকা ইউনিটের বিদ্যুৎ কেনা হয় সর্বোচ্চ ২৬ টাকা মূল্যে। যার দায় মেটাতে হয় দেশের সাধারণ মানুষের।

বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩০,৭৮৭ মেগাওয়াট, যেখানে চাহিদা প্রায় ১৮,০০০ মেগাওয়াটের আশেপাশে। এর ফলে প্রায় ১২,৭৮৭ মেগাওয়াট অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকলেও, এ অতিরিক্ত ক্ষমতার জন্যও সরকারের পকেটে খরচ হয় কোটি কোটি টাকা। উপরন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাটের বিষয়টি ঘটে চলে ক্রমাগত। আর তাই প্রশ্ন ওঠে এত খরচ আর এত অর্থ পাচারের মচ্ছবে আমরা কি পুষছি সাদা হাতি? বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে, আওয়ামী লীগের আমলে এ খাতে হওয়া দুর্নীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা তো দূরের বিষয় বর্তমান সরকারের সময়ে কুইক রেন্টালের অর্থ কোথায় যাচ্ছে গণমাধ্যমে সে তথ্যও আসছে না।

দেশে কুইক রেন্টাল ব্যবস্থার এই উত্থান এবং অর্থ হরিলুটের পেছনে ছিলো ২০১০ সালে প্রণীত ‘দায়মুক্তি আইন’ (Quick Enhancement of Electricity and Energy Supply Act, 2010), যার মাধ্যমে দরপত্র ছাড়াই রাজনৈতিকভাবে সংযোগে থাকা ব্যবসায়ীদের হাতে দ্রুত কুইক রেন্টাল কেন্দ্র অনুমোদন দেওয়া হয়। এই আইনের আওতায় ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে সুবিধাভোগী হিসেবে গড়ে ওঠে। যদিও আইনটি বর্তমানে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, তবুও সংশ্লিষ্ট চুক্তিগুলো এখনো বহাল রয়েছে এবং দ্রুত বাস্তবায়নে আইনি জটিলতা ও ক্ষতিপূরণ ইস্যু রয়ে গেছে।

সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ হিসেবে কুইক রেন্টাল চুক্তি পুনর্বিবেচনা ও বাতিলের কথা বলা হলেও বাস্তবে অনেক কেন্দ্রে ক্যাপাসিটি চার্যের অতিরিক্ত অর্থ বাকি রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুধু ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাবদ সরকার প্রায় ২৬,৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা আগের পাঁচ বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি। সরকারের সামগ্রিক ভর্তুকি ও অতিরিক্ত খরচ মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতে অপচয়ের পরিমাণ বছরে ৬০,০০০ কোটি টাকারও বেশি হতে পারে। বিদ্যুৎ খাতে গত অর্থবছরেই ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। তারা নিয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা।

শ্বেতপত্র কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার (৬০ হাজার কোটি টাকা) দুর্নীতি ও অর্থপাচার হয়েছে, অথচ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বকেয়া বিল আদায়ে কিছু অগ্রগতি হলেও, বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে অনিয়ম ও অপচয় রোধে এখনো কাঙ্খিত পদক্ষেপগুলো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।

বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সাশ্রয়ী এবং টেকসই বিকল্প গড়ার ক্ষেত্রে এখনো যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। নবায়নযোগ্য শক্তি এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশ এই সংকট থেকে উত্তরণ পেতে পারত, তবে কুইক রেন্টালের বাইরে বিকল্প পথে যেতে সরকারের পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয়নি। প্রায়শই দেখা যায়, নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প বাতিল বা পেছনে পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

সরকারি রিপোর্ট ও সংবাদ বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে, কুইক রেন্টাল সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসতে হলে চুক্তির পুনর্বিবেচনা ও আইনি জটিলতা কাটিয়ে ওঠা জরুরি। তবেই বছরের পর বছর ধরে চলা অর্থনৈতিক অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ডিমান্ড সাইড ম্যানেজমেন্ট, এনার্জি এফিসিয়েন্সি বৃদ্ধি এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়নে দ্রুত কাজ করতে হবে।

বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘লোডশেডিং আছে এবং থাকবে, কারণ সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য ফেরানো সহজ নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্মক্ষমতা বাড়ানো এবং অপ্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান বন্ধ করাই এখন সময়ের দাবি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার দামের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে।’

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শুধু আইন পরিবর্তন বা চুক্তি বাতিল যথেষ্ট নয়। প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই প্রকৃত সমাধান। বিদ্যুৎ খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য তা জরুরি।

গণমানুষের দীর্ঘদিনের দাবি, বিদ্যুৎ খাতের এসব দুর্নীতি আর অর্থ লুট বন্ধ করার। দেশের মানুষের শ্রম, ঘাম, আর কষ্টের টাকায় প্রাসাদোপম অট্টালিকায় থাকার পর, আগের সরকার এর ফলাফল ঠিকই কড়ায় গণ্ডায় দেখেছে। তাই এ থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম হাতে নেয়াই ভালো। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ানো এই অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রয়োজন দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপের, যেখানে দুর্নীতি রোধ, স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা এবং উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ সংকট থেকে মুক্ত করা যাবে।

কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তি


কৃষিভিত্তিক শিল্পের অভাবে, বঞ্চিত কৃষক

সমীরণ বিশ্বাস
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং খাদ্য নিরাপত্তার বড় অংশই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও দেশে পর্যাপ্ত কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান, আধুনিক রাইস মিল, হিমাগার এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে ওঠেনি। এর ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং কৃষি খাতের সম্ভাবনা পূর্ণভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

কৃষি উৎপাদনের চিত্র: বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভর দেশ, যেখানে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয়ে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর মধ্যে ধান ও চাল প্রধানতম খাদ্যশস্য। বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৩৫০–৩৮০ লাখ মেট্রিক টন ধান ও চাল উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ করা হয়, যা দেশের জনগণের প্রধান খাদ্যচাহিদা মেটাতে সহায়তা করে। সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করেছে। বর্তমানে বছরে প্রায় ৬.৫ থেকে ১৯ মিলিয়ন টন সবজি উৎপাদিত হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয়-সর্বোচ্চ সবজি উৎপাদক দেশ হিসেবে স্বীকৃত। বিভিন্ন মৌসুমি সবজি দেশের বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানি হচ্ছে, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখে। ফল উৎপাদনের দিক থেকেও বাংলাদেশ সমৃদ্ধ। প্রতি বছর প্রায় ১৪.৮ মিলিয়ন টন ফল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে কলা, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা ও অনারস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মৌসুমি ফলের পাশাপাশি সারাবছর বিভিন্ন ফলের সরবরাহ কৃষকদের আয়ের উৎস এবং জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণে সহায়ক। মৎস্য খাতে বাংলাদেশ বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে আছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে মোট মাছ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৫০.১৮ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে শুধু ইলিশ উৎপাদন ছিল ৫.২৯ লাখ মেট্রিক টন, যা বাংলাদেশকে বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে শীর্ষস্থান অধিকারী করেছে। মাছ বাংলাদেশের জনগণের প্রোটিন চাহিদার প্রধান উৎস, একইসঙ্গে রপ্তানি আয়েরও গুরুত্বপূর্ণ খাত। সব মিলিয়ে, ধান, সবজি, ফল ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেশের অর্থনীতি ও খাদ্যনিরাপত্তাকে শক্তিশালী করেছে। এই উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তি, প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও কোল্ড চেইন অবকাঠামো উন্নয়ন আরও জরুরি। এতে কৃষক লাভবান হবে এবং টেকসই কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।

শিল্প প্রতিষ্ঠানের অভাব ও কৃষকের বঞ্চনা: বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভর দেশ। এদেশের উর্বর মাটি ও অনুকূল আবহাওয়া বছরে বিপুল পরিমাণ ধান, ফল, সবজি, মাছ ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদনে সহায়তা করে। কিন্তু এই বিপুল উৎপাদনের সঠিক ব্যবহার ও কৃষকের ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার মতো পর্যাপ্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান এখনো দেশে গড়ে ওঠেনি। এর ফলে কৃষকরা উৎপাদন করেও আর্থিকভাবে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। প্রথমত, দেশে আধুনিক রাইসমিল ও শস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রের অভাব প্রকট। অধিকাংশ কৃষক ধান বা গম কাঁচা অবস্থায় বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফলে তারা ধানের পূর্ণ মূল্য পান না। একইভাবে হিমাগার ও কোল্ড চেইন অবকাঠামোর ঘাটতির কারণে উৎপাদিত ফল ও সবজি দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায় না। ফলে মৌসুমে প্রচুর উৎপাদন হলেও তা দ্রুত বাজারজাত করতে গিয়ে কৃষকরা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। দ্বিতীয়ত, ফল ও সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের অভাব কৃষকদের সম্ভাবনা সীমিত করে রেখেছে। অনেক দেশে টমেটো, আম, লিচু, আনারস ইত্যাদি ফল থেকে রস, জুস, আচার বা ক্যানজাত পণ্য তৈরি হয়। বাংলাদেশেও এ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠিত হলে কৃষকরা শুধু মৌসুমেই নয়, সারা বছর ধরে ন্যায্য দামে পণ্য বিক্রি করতে পারতেন। একইভাবে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ভিত্তিক শিল্পের অভাবে মাছ, মাংস, দুধ ইত্যাদি পণ্য প্রক্রিয়াজাত হয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করার সুযোগ অনেকাংশে হাতছাড়া হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ না থাকায় অতিরিক্ত উৎপাদনের সময় বাজারে দাম পড়ে যায়। এতে কৃষকরা তাদের উৎপাদনের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন এবং আয় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অতএব, কৃষিকে টেকসই ও লাভজনক করতে হলে দেশে দ্রুত আধুনিক রাইসমিল, হিমাগার, কোল্ড চেইন, ফল-সবজি ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুলতে হবে। শিল্প ও কৃষির এই সমন্বয়ই কৃষকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব: কৃষকের আয় কমে যায়, ফলে তারা কৃষিকাজে আগ্রহ হারায়। বেকারত্ব বাড়ে, কারণ কৃষিভিত্তিক শিল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে না। রপ্তানি সম্ভাবনা নষ্ট হয়, কারণ আন্তর্জাতিক মানের প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি হয় না। কৃষিখাতে আয় হ্রাসের ফলে শ্রমশক্তির উৎসাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের হার কমিয়ে দেয়। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সংকট তীব্রতর হয়, কারণ কৃষিভিত্তিক শিল্পসমূহ পর্যাপ্ত স্কেল-আপ সক্ষমতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। পাশাপাশি, মূল্য সংযোজন ও গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে অন্তর্ভুক্তির অভাবে রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ক্ষুণ্ন হয়।

করণীয় ও সম্ভাবনা: বাংলাদেশের কৃষি খাতকে শিল্পায়নের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন, সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ কৃষিভিত্তিক শিল্পে উৎসাহিত করা। প্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন। কৃষক প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগ উন্নয়ন। রপ্তানিভিত্তিক কৃষি শিল্প গড়ে তোলা। বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন বিশ্বমানের হলেও, এর পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে কৃষি ভিত্তিক শিল্পায়ন অপরিহার্য। স্বাধীনতা পরবর্তী এপর্যন্ত তেমন কোনো রকম কৃষিভিত্তিক কলকারখানা, সবজি ও ফল সংরক্ষণে হিমাগার, কৃষি শিল্পভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন, এসব নিয়ে তেমন কিছু দৃশ্যমান কৃষক বান্ধব কার্যক্রম হাতে নেয় নাই বিগত দিনের সরকার গুলি। পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ , হিমাগার স্থাপন ও পণ্য পরিবহনের সুবিধা না থাকায় কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠে নাই বলে মত প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা। আন্ত:জেলার সড়ক ও ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা কৃষিবান্ধব করা না গেলে কৃষকের স্বার্থ রক্ষা হবে না বলে মনে করেন স্থানীয় কৃষকরা। কৃষি খাতে সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগ এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা না গেলে, টেকসই কৃষি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে উঠবে না এবং সেই সঙ্গে কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

কৃষিভিত্তিক শিল্পের অভাবে আমাদের কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হয় না, ফসলের যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের সুযোগ সীমিত থাকে, ফলে তারা মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এর ফলে কৃষকের পরিশ্রমের সঠিক মূল্য তারা পায় না এবং গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নতির সুযোগ হারায়। কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা হলে শুধু কৃষকের জীবনমান উন্নত হবে না, বরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও টেকসই হবে।

লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।


পর্যটনশিল্পের বিকাশই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ

ওসমান গনি
আপডেটেড ১৬ আগস্ট, ২০২৫ ২৩:০৪
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যময় জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য ভাগ সবুজের সমারোহ, অসংখ্য নদী, পাহাড়, সমুদ্রসৈকত, ম্যানগ্রোভ বন, প্রাচীন স্থাপত্য ও লোকজ ঐতিহ্য মিলিয়ে এ দেশ পর্যটনের জন্য এক স্বর্ণখনি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই অপরিসীম সম্পদকে এখনো পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। পৃথিবীর অনেক দেশ প্রাকৃতিক সম্পদ বা শিল্পের তুলনায় পর্যটনশিল্পকে প্রধান আয়ের উৎস হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ কিংবা নেপালের মতো দেশগুলো তাদের অর্থনীতিতে পর্যটনের অবদান দিয়ে বিশ্বে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। অথচ বাংলাদেশেও সেই সম্ভাবনা বিদ্যমান, তবে তা কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রচারণা।

পর্যটনশিল্প কেবল বিদেশি মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রই নয়, বরং স্থানীয় অর্থনীতি চাঙা করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং গ্রামীণ উন্নয়নের এক বড় মাধ্যম। এ শিল্পের প্রসার হলে হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, হস্তশিল্প ও স্থানীয় পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে, যা সরাসরি লাখো মানুষের জীবিকা গড়ে তুলবে। তাছাড়া পর্যটনের মাধ্যমে দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে, যা বিনিয়োগ আকর্ষণ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নেও সহায়ক হবে।

সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করতে হলে পর্যটনশিল্পকে অন্যতম কৌশলগত খাত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সঠিক বিনিয়োগ, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এটি দেশের উন্নয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে। এই প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পর্যটন মানচিত্রে শক্তিশালী অবস্থানে নেওয়াই এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সংস্কৃতির বৈচিত্র্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং অতিথিপরায়ণ মানুষের দেশ। আমাদের দেশের ভূপ্রকৃতি এমনভাবে বিন্যস্ত যে এখানে পর্যটনের অসীম সম্ভাবনা বিদ্যমান। সমুদ্র, পাহাড়, নদী, বনভূমি, দ্বীপ, চরাঞ্চল থেকে শুরু করে প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনা—সবই এখানে ছড়িয়ে আছে। এই সম্পদগুলো শুধু দেশের মানুষের জন্য নয়, বিদেশি পর্যটকদের জন্যও এক বিরল অভিজ্ঞতার উৎস হতে পারে। অথচ পর্যটনশিল্পকে আমরা এখনও অর্থনীতির প্রধান খাতে রূপ দিতে পারিনি। উন্নত বিশ্বে পর্যটন এখন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি গঠনের বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশও চাইলে এই খাতকে অর্থনীতির উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

আমাদের দেশে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, পাহাড়পুরের প্রাচীন বৌদ্ধবিহার, ষাটগম্বুজ মসজিদের অনন্য স্থাপত্য, মহাস্থানগড়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং সিলেটের চা বাগান—সবই পর্যটনের জন্য অসামান্য সম্পদ। এছাড়া বান্দরবান ও রাঙামাটির সবুজ পাহাড়, খাগড়াছড়ির জলপ্রপাত, কাপ্তাই হ্রদ, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও ইনানি সৈকত, ভোলা ও সেন্টমার্টিনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করতে পারে। নদীমাতৃক দেশের বৈশিষ্ট্য হিসেবে নদী ভ্রমণ, নৌকা বিহার, চরের জীবনযাপন এবং গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি পর্যটন সম্ভাবনায় নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে পর্যটনশিল্প একটি বহুমুখী প্রভাব বিস্তারকারী খাত। প্রথমত, এটি সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, ট্রাভেল এজেন্সি, পরিবহন ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে অসংখ্য মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হয়। দ্বিতীয়ত, এটি পরোক্ষভাবে কৃষি, মৎস্য, হস্তশিল্প, পরিবহন ও অন্যান্য সেবা খাতের চাহিদা বাড়ায়। তৃতীয়ত, বিদেশি পর্যটকদের আগমনে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি পায়, যা দেশের রিজার্ভকে শক্তিশালী করে। পর্যটনের মাধ্যমে একটি দেশের পরিচিতি বিশ্বমঞ্চে বিস্তৃত হয়, যা ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণেও সহায়ক হয়।

বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরারও এক দুর্দান্ত সুযোগ। এ খাতের উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি। পর্যটন উন্নয়ন পরিকল্পনায় স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ, অংশীদারিত্ব এবং উপকার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা পর্যটনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে লাভবান হয়।

পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। দীর্ঘসূত্রিতা ও অবহেলার কারণে এই খাত দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত থেকেছে। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এটি জাতীয় অর্থনীতির প্রধান আয় উৎসে পরিণত হতে পারে। পর্যটন আমাদের শুধু বৈদেশিক মুদ্রা ও কর্মসংস্থানই দেবে না, বরং দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। একবিংশ শতাব্দীতে উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য পর্যটনশিল্প হতে পারে সবচেয়ে বড় শক্তি। তাই আজই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—পর্যটনশিল্প হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি, যা দেশকে আরও সমৃদ্ধ, উন্নত ও বিশ্বে মর্যাদাবান করবে।

লেখক - সাংবাদিক ও কলামিস্ট


স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ছয় বছরের স্থগিতাদেশ: বাংলাদেশের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ এবং হুমকি

অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) উত্তরণের ছয় বছরের স্থগিতাদেশ বাস্তবায়নের প্রস্তাব অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক এবং উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে, আমি বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছয় বছরের বর্ধিতকরণকে সমর্থন করি না। পরিবর্তে, আমি যুক্তি দিচ্ছি যে দেশটির উচিত তার অবশিষ্ট রূপান্তর সময়কাল (২০২৬ সাল পর্যন্ত) ব্যবহার করে দ্রুত স্থগিতাদেশের চেষ্টা না করে জরুরি কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন করা। স্নাতক ডিগ্রি বিলম্বিত করার অন্যতম প্রধান সুবিধা হলো বাংলাদেশের জন্য টেকসই উন্নয়নের উপর মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ। বর্তমানে, বাংলাদেশ সহ অনেক স্বল্পোন্নত দেশ অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, উচ্চ দারিদ্র্যের হার এবং স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সীমিত সুযোগের সাথে লড়াই করছে। ছয় বছরের মেয়াদ বৃদ্ধি বাংলাদেশকে এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে সাহায্য করবে।

শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করলে কর্মশক্তি উদীয়মান শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে, অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা উন্নত করলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে সক্ষম একটি স্বাস্থ্যকর জনসংখ্যা নিশ্চিত করা যেতে পারে। টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন, বিশেষ করে পরিবহন এবং জ্বালানি, বাণিজ্যকে সহজতর করতে পারে এবং বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (FDI) আকর্ষণ করতে পারে। এই মৌলিক উপাদানগুলিকে অগ্রাধিকার দিয়ে, বাংলাদেশ একটি আরও শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করতে পারে যা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে উন্নতি করতে পারে। কেন ছয় বছরের স্থগিতাদেশ সমাধান নয়

কৃত্রিম বিলম্ব আত্মতুষ্টির জন্ম দিতে পারে

একটি সম্পূর্ণ সম্প্রসারণ নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে সংস্কারের তাগিদ কমাতে পারে: রপ্তানি বৈচিত্র্য, কর রাজস্ব সংগ্রহ, আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (যেমন, মালদ্বীপ, ভিয়েতনাম) দেখায় যে ধীরে ধীরে, পূর্ব-পরিকল্পিত রূপান্তর আকস্মিক পরিবর্তনের চেয়ে ভালো কাজ করে। জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (মাথাপিছু জিএনআই, মানব সম্পদ, অর্থনৈতিক দুর্বলতা) মানদণ্ড থেকে বোঝা যায় যে বাংলাদেশ প্রস্তুত।

দীর্ঘস্থায়ী স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা তাদের বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বাধাগ্রস্ত করতে পারে যারা ‘উদীয়মান অর্থনীতির’ পরিবর্তে ‘অল্পোন্নত’ দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত।

৩. বাণিজ্য সুবিধা ইতোমধ্যেই পর্যায়ক্রমে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ইইউর অস্ত্র বাদে সবকিছু (ইবিএ) প্রকল্প অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থায়ী হবে না।

ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার মতো প্রতিযোগীরা এলডিসি-পরবর্তী বাণিজ্য নিয়মের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে; বাংলাদেশকেও একই কাজ করতে হবে।

বিলম্বের পরিবর্তে কৌশলগত অগ্রাধিকার

রপ্তানি বৈচিত্র্য: আরএমজির বাইরে

ক্ষেত্রের বর্তমান শেয়ার বৃদ্ধির সম্ভাবনা মূল পদক্ষেপ:

আরএমজি ৮৪% রপ্তানি মাঝারি উচ্চমানের ফ্যাশন, কারিগরি টেক্সটাইলের দিকে অগ্রসর হওয়া।

ঔষধ শিল্প ২ বিলিয়ন ডলার উচ্চ এফডিএ অনুমোদন, এপিআই উৎপাদন।

আইটি/বিপিও ১.৫ বিলিয়ন ডলার অত্যন্ত উচ্চ দক্ষতা উন্নয়ন, স্টার্টআপ তহবিল।

চামড়া/পাদুকা $১.২ বিলিয়ন ডলার ইইউ ইকো-স্ট্যান্ডার্ডের সাথে উচ্চ সম্মতি।

হালকা প্রকৌশল।

কেস স্টাডি: ভিয়েতনাম ইলেকট্রনিক্স (স্যামসাং) এবং যন্ত্রপাতি বৃদ্ধি করে রপ্তানির উপর টেক্সটাইল নির্ভরতা ৬০% থেকে ৪০% এ কমিয়ে এনেছে।

এলডিসি-পরবর্তী বাজার অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা

ইইউর সঙ্গে জিএসপি+: ২৭টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুমোদন করা প্রয়োজন (বাংলাদেশ ১৫টি পূরণ করেছে)।

দ্বিপক্ষীয় এফটিএ: চীন এবং ভারতের সঙ্গে আলোচনা ত্বরান্বিত করতে হবে।

আঞ্চলিক একীকরণ: বিমসটেক বাণিজ্য সুবিধা ইবিএ ক্ষতি পূরণ করতে পারে।

প্রতিযোগিতামূলকতার জন্য অভ্যন্তরীণ সংস্কার

ব্যাংকিং খাত: কঠোর তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ (বর্তমানে ঋণের ৮.৫%) হ্রাস করা।

কর সংস্কার: ডিজিটাল সংগ্রহের মাধ্যমে কর/জিডিপি অনুপাত (৯% বনাম ভিয়েতনামের ১৮%) বৃদ্ধি করা।

ব্যবসা করার সহজতা: লাল ফিতা কাটা (বিশ্বব্যাংক সূচকে ১৬৮তম স্থানে)।

অপ্রস্তুত স্নাতকের ঝুঁকি

১. বাণিজ্য ধাক্কা পরিস্থিতি

যদি বাংলাদেশ জিএসপি+ ছাড়াই স্নাতক হয়:

ইইউতে আরএমজি শুল্ক: ০% থেকে ১২% এ উন্নীত করুন → $২.৬ বিলিয়ন রপ্তানি ক্ষতি (সিপিডি অনুমান)।

চাকরি হ্রাস: ১০ লক্ষ আরএমজি কর্মী ঝুঁকিতে।

২. এফডিআই মন্দা

এলডিসি কর সুবিধা ইপিজেডগুলোতে এফডিআই আকর্ষণ করে। স্নাতকোত্তর, বাংলাদেশকে অবকাঠামো/দক্ষতার উপর প্রতিযোগিতা করতে হবে।

৩. সামাজিক অস্থিরতা

ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যদি সুরক্ষা জাল (যেমন, আশ্রয়ণ আবাসন) দুর্বল হয়।

৬ বছরের কর্ম পরিকল্পনা (২০২৬-২০৩২)

বছর ১ (২০২৬)

অবশিষ্ট GSP+ কনভেনশনগুলো (শ্রম অধিকার, জলবায়ু) অনুমোদন করুন।

ফার্মা/আইটি স্টার্টআপগুলোর জন্য 500 মিলিয়ন ডলার দিয়ে ‘রপ্তানি বৈচিত্র্য তহবিল’ চালু করুন।

দ্বিতীয় বছর (২০২৭)

কৃষি-প্রক্রিয়াকরণের উপর জোর দিয়ে চীনের সাথে FTA স্বাক্ষর করুন।

রপ্তানি সময় কমাতে 90% শুল্ক প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করুন।

তৃতীয় বছর থেকে ষষ্ঠ বছর (২০২৮-২০৩২)

স্নাতক হওয়ার আগে GSP+ মর্যাদা অর্জন করুন।

WTO-সম্মত ভর্তুকি (নগদ প্রণোদনার পরিবর্তে গবেষণা ও উন্নয়ন অনুদান) বাস্তবায়ন করুন।

উপসংহার: বিলম্বকে না, সংস্কারকে হ্যাঁ

LDC থেকে স্নাতক হওয়ার ছয় বছরের স্থগিতাদেশ একটি অস্থায়ী সমাধান যা উন্নয়নের পরবর্তী পর্যায়ের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতিকে উপেক্ষা করে। পরিবর্তে, সরকারের উচিত:

2026-পরবর্তী বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য GSP+ এবং FTA দ্রুততর করা।

লক্ষ্যযুক্ত খাতভিত্তিক নীতিমালার মাধ্যমে রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ করুন।

LDC সুবিধার বাইরে FDI আকর্ষণ করার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করুন।

মনোযোগী সংস্কারের মাধ্যমে, বাংলাদেশ স্নাতকোত্তরকে এশিয়ার পরবর্তী উদীয়মান অর্থনীতিতে পরিণত করার জন্য হুমকি নয় বরং একটি সুযোগে রূপান্তর করতে পারে। সময় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে; কৌশলগত পদক্ষেপ এখনই শুরু করতে হবে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির অধ্যাপক,

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি)


ইলিশ মাছ কেবলই স্বপ্ন: ভোক্তারা স্বাদে বঞ্চিত

ড. মিহির কুমার রায়
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। ইলিশের টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধিতে ২০০৪ সালে ‘হিলশা ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয় এবং তদনুযায়ী সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ (প্রায় ১২%) এবং জিডিপিতে অবদান ১ শতাংশ। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের ৮০ শতাংশের বেশি আহরিত হয় এ দেশের নদ-নদী থেকে। শুধু তাই নয়; উপকূলীয় জেলে, মৎস্যজীবী সম্প্রদায় এবং উপকূলবাসীদের জীবন-জীবিকা নির্বাহে ইলিশের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রায় ৬ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০-২৫ লাখ মানুষ ইলিশ পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। বৈচিত্র্যময় জীবন ইলিশের। ইলিশ মূলত সামুদ্রিক মাছ হলেও প্রজননকালীন এ মাছ ডিম ছাড়ার জন্য বেছে নেয় স্বাদুপানির উজানকে। এ সময় ইলিশ দৈনিক প্রায় ৭১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। প্রজননের উদ্দেশে ইলিশ প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার উজানে পাড়ি দিতে সক্ষম। সাগর থেকে ইলিশ যত ভেতরের দিকে আসে, ততই শরীর থেকে লবণ কমে যায়। এতে স্বাদ বাড়ে ইলিশের।

ইলিশ মাছের প্রধান প্রজনন মৌসুমে নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ বছর প্রতি বছরের মতো এবারও বৈশাখের শুরু অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮দিন বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায়, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। নিষেধাজ্ঞা শেষে ১২ জুন থেকে সাগরে আবার মাছ আহরণ শুরু করেন জেলেরা, যে সময়টিকে ইলিশ আহরণের ভরা মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সর্বসাধারণ, বিশেষ করে জেলে, মৎস্যজীবী সম্প্রদায় ও ইলিশের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী, আড়তদার, বরফকল মালিক, দাদনদার, ভোক্তাসহ সবাইকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করাই উদ্দেশ্য। ২০২৫ সালে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে অভিযানে ৩৮টি জেলার ১৭৮টি উপজেলাকে নির্ধারণ করা হয়।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে কমে গিয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৫ লাখ ২৯ হাজার মেট্রিকটন। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার ৩৪২ টন। এর আগে, ২০২১-২২ সালে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৮৩ টন। ২০২০-২১ সালে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৮৩ টন, ২০১৯-২০ সালে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৪২৮ মেট্রিকটন, ২০১৮-১৯ সালে ৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৫ মেট্রিকটন, ২০১৭-১৮ সালে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ টন এবং ২০১৬-১৭ সালে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ মেট্রিকটন ইলিশ আহরণ হয়েছিল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিকটন। এক হিসেবে গত দেড় যুগে ইলিশের আহরণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে গত সাত বছরে ইলিশ আহরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে, শুধুমাত্র ২০২৩-২৪ অর্থবছর ছাড়া। কিন্তু এরপরও ইলিশের দাম ক্রেতা সাধারণের নাগালের মধ্যে থাকে না। গত আট বছরের রপ্তানির চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট আহরণের এক শতাংশেরও কম ইলিশ মাছ রপ্তানি হয়। বাকি ৯৯ শতাংশ ইলিশ মাছ দেশের বাজারেই বিক্রি হয়। এর পরও প্রতি বছর ইলিশের দাম ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ হারে বাড়ছে বলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যে জানা গেছে। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে ইলিশের দাম গড়ে কেজিতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেড়েছে। আর ১৮ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশের দাম বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১২ জুন থেকে প্রায় দেড়মাস চাহিদা অনুযায়ী সাগরে ইলিশ ধরা পড়েনি। আবহাওয়াজনিত কারণে সাগর উত্তাল থাকছে প্রায়ই। ফলে মাছ ধরার নৌযানগুলো গভীর সাগরে যেতে পারছে না। কিংবা গেলেও আহরণ কম ছিল। কিন্তু চলতি সপ্তাহে এসে এ চিত্র পাল্টে গেছে। সপ্তাহজুড়ে নৌকাপ্রতি ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়েছে। দেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ আহরণ হয় চট্টগ্রাম বিভাগের সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাগুলোয়। অবশ্য মাছ ধরার সমুদ্রগ্রামী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর হিসেব ওঠে চট্টগ্রামের তালিকায়। এর বাইরে পদ্মা-মেঘনার অববাহিকায় ভোলা, খুলনা, বরিশাল ও চাঁদপুর জেলায় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে।

এ বছরও ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম ক্রেতার নাগালের মধ্যে নেই। বর্তমানে

এক কেজি বা তার বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ মাছ বিক্রি হয়েছে ১৩৭৫ টাকায়, ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ১১০০ টাকা, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯০০ টাকা, ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আহরণকারীর নৌকা থেকে ইলিশ পৌঁছে আড়তে।, আড়তে বরফ দিয়ে সংরক্ষণের পর এক কেজি বা তার বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ মাছ ১৪০০-১৪৫০ টাকা, ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ১১৫০ টাকা, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯৫০-১০০০ টাকা, ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৮০০ থেকে ৯৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। আড়ত থেকে ইলিশ যায় বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। সেখানে এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ২ হাজার টাকা, দেড়-দুই কেজি ওজনের ইলিশ ৩ হাজার টাকা এবং ৫০০ গ্রাম বা তার কিছু কম-বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায়। ইলিশ মাছের জোগান ও সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু ইলিশের ব্যবসায় বিনিয়োগকারী, মৎস্যজীবী, আড়তদার এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের গড়ে তোলা ‘অদৃশ্য’ সিন্ডিকেটের কারণে দাম কমছে না। প্রতি বছর ইলিশের বাজার এই ‘চার হাতের চক্রের’ মধ্যে ঘুরতে থাকে।আবার কিছু কিছু অনলাইন ব্যবসায়ী ইলিশের বিক্রির নামে প্রতারনার ফাঁদ পেতেছে যা অত্যন্ত দুক্ষ্য জনক ।

একসময় মধ্যবিত্তের নিত্যবাজারে তালিকায় থাকলেও বর্তমানে উপলক্ষের মাছ হয়ে উঠেছে। সময়ের বিবর্তনে হয়ে উঠেছে উচ্চবিত্তের নিত্যখাদ্য অনুষঙ্গ। আর নিম্নবিত্তের কাছে ইলিশ দীর্ঘশ্বাসের অপর নাম, যাদের বছরে একটি উৎসবেও হয়তো খেয়ে দেখা হয় না এক টুকরো ইলিশ। রুপালি ইলিশের কেজিপ্রতি দাম যখন ২৮শ থেকে ৩২শ টাকা, তখন বাঙালি যেন চোখ মেলে প্রশ্ন করে, ইলিশ আসলে কার?, পাবনার তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের পরিচালক একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। শহরের কালাচাঁদপাড়ায় নিজ বাড়ির আঙিনায় তিনি আয়োজন করেন ‘গরিবের ইলিশ উৎসব’। এক দিনের এই উৎসবে শতাধিক দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষকে পরিবেশন করা হয় ইলিশ। এই আয়োজনে শুধু পেট ভরে না; ভরে ইলিশপ্রেমী নিম্নবিত্তের মন। বর্তমান বাস্তবতায় এমন আয়োজন নিছক উৎসব; অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বাজার নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ। এই উদ্যোগ দেখিয়ে দেয়– দায় শুধু রাষ্ট্র বা নীতিনির্ধারকদের নয়; সমাজের সচেতন নাগরিকদেরও।

সরকার প্রতি বছর মা ইলিশ রক্ষায় অভিযান চালায়; আইন করে জাটকা ধরা বন্ধ রাখে। শূন্য রেখায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে। এর ফলে কিছু বছর ভালো ফলও এসেছে। বিশেষ করে ২০২০ সালে রেকর্ড পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়েছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতা নেই। আইন আছে, প্রয়োগ নেই। সচেতনতা কম, বিকল্প ব্যবস্থা দুর্বল। দিনে দিনে কমছে ইলিশের উৎপাদন। অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে এই ইলিশকে ঢুকিয়ে রাখছে হিমাগারে। বাজারে হাহাকার ফেলে, সিন্ডিকেটের বেড়াজালে বাড়িয়ে ফেলা হচ্ছে ইলিশের দাম। নদীভিত্তিক জীবিকা চলে যাচ্ছে, আর মানুষ দোষ দিচ্ছে প্রকৃতিকে। এ অঞ্চলে মাছের অর্থনীতি, রাজনীতি এতটাই গভীর যে, একসময় ভারত সরকার যখন বাংলাদেশ থেকে ইলিশ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেটাকে কূটনৈতিক মাইলফলক বলে মনে করা হয়। আবার নির্বাচনের আগে বিশেষ রকম সুবিধা পেতে ইলিশ সরবরাহ নিয়েও গুঞ্জন ওঠে রাজনৈতিক মহলে। মাছ যদি রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে, তাহলে বুঝতে হবে, সে আর মাছ নেই। আর গরিবের ইলিশ কেবল স্বপ্নেই রয়ে গেল।

লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক


banner close