সব জাতি, দেশের কিছু ঘটনা, কাজ থাকে যা পরবর্তী প্রজন্মকে উৎসাহ দিয়ে থাকে। এমন একটি কাজ ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ আমাদের উপহার দিয়েছে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন, ১৯৯০ সালে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পাওয়ার সংগ্রামের পর যুক্ত হয়েছে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান আমাদের ইতিহাসে। ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে ঠিকই কিন্তু রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী একটি দেশের স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টার হিসাবের খাতায় বছরের সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের জনগণকে বারবার রক্ত দিতে হচ্ছে। ২০২৪ সালে যে সংখ্যায় বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে তা মনে হলে আমি মুক্তিযোদ্ধা হয়েও নিজকে অপরাধী ভাবতে হয়। যারা আহত, পঙ্গু হয়েছে তাদের কথা চিন্তা করতেও কষ্ট হয় তবে ভরসা এই আমাদের যুবসমাজ গণ-অভ্যুত্থানের পরে ঘরে ফিরে যায় নাই যেভাবে ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরে গিয়েছিল।
সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাপনার জগতে দেখা দিচ্ছে নানাবিধ বৈচিত্র্য। ব্যবসা, সংসার, সমাজ, দেশের ব্যবস্থাপনায় দিন দিন দেখা দিচ্ছে বৈচিত্র্যের সঙ্গে সমস্যাও। ছোট পরিসরে একক ব্যবস্থাপনায় যেমন সুবিধা আছে তেমনি সমস্যাও। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও প্রয়োজন হয় অন্যের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনার। আর তখন বড় পরিসরে ব্যবস্থাপনার জন্য নির্ভর করতে হয় নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের ওপর। এখানেই সমস্যা আমাদের দেশে বর্তমানে। বাংলাদেশের মতো শিক্ষা জগতে অনগ্রসর অবস্থায় দক্ষ জনবল পাওয়ার সমস্যায় ভুগছে পাবলিক, প্রাইভেট সেক্টর। শুধু তাই নয়- বিদেশেও যাচ্ছে অদক্ষ জনবল। ফলে শ্রমিকের চাকরি নিয়ে আমাদের যুবসমাজ এক মানবেতর জীবনযাপন করছে। দক্ষ জনবল পাওয়ার সময় যদি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের লোক নিয়োগ দিয়ে যায় তাহলে যা হওয়ার তাই হবে। যেমন হয়েছে সম্প্রতি বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশ গুলিই করে থেমে থাকেনি, লাশে আগুন দিয়েছে, সে এক অমানুষিক কাজ। আমি বলব জ্ঞানের স্বল্পতার সঙ্গে যোগ হয়েছিল রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। এখানে অবশ্যই মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসবেই। যদি কোনো দেশে সুস্থ রাজনীতি না থাকে তাহলে সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে এমন আচরণ অসম্ভব হয় না। এমন সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনেই দেখা দেয় সমাজে অনিয়ম, দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি। একটি দেশ যখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অধীনে চলে তখন যদি এমন অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি হয় তখন সমাজের গরিব, দুর্বল লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমাজে এমন অবস্থা বিরাজ দীর্ঘদিন করলে গণ-অভ্যুত্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যা আমরা দেখেছি ৫ আগস্ট ২০২৪-এ। এই গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণের যেমন অংশগ্রহণ ছিল তেমনি তার বিজয়ে সবাই আশাবাদী সামনের দিনে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে এই আশায়। এই প্রসঙ্গে চার মুক্তিযোদ্ধার বড় বোনের মন্তব্য উল্লেখ করার মতো। আমার বড়বোনের কথা বলছিলাম ভালোমন্দ নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, তোমরা দেশ স্বাধীন করেছিলে, এবার আদরের ছেলেরা যা অর্জন করেছে তাও তার চেয়ে কম নয়। আমিও একমত এই বিষয়ে।
ভালো কিছু পেতে হলে ক্ষতি বা কিছু ছাড় দিতে হয়। আমাদের ছাত্র-জনতা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এই আগস্টে তার একটি চিত্র সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে আমাদের সামনে এসেছে। সংবাদে শিরোনাম ‘মেরুদণ্ডে বুলেট, চোখের ভেতরে গুলি আর পা হারানো তামিমের গল্প’। এই ছিল সংবাদের ভিতরের অংশে প্রকাশ ‘শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মিরপুরে যে আনন্দ মিছিল হয়, সেটায় অংশ নিয়েছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তামিম হোসেন। একপর্যায়ে মিছিলে পুলিশ গুলি ছুড়লে একটি গুলি এসে পায়ে লাগে তামিমের।’ তার মানে আনন্দ মিছিলে অংশ নিয়ে তামিম একাধিক গুলির সম্মুখীন আমাদের সরকারি কর্মচারী ‘পুলিশের’ হাতে। এমন তামিমের সংখ্যা নিশ্চয়ই এক না। আমরা শুনে আসছি প্রায় প্রতিদিন কেউ না কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীদ হচ্ছেন। দেশের জন্য যারা মারা যান বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বেঁচে থাকবেন তাদের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা তারা বর্তমানে সরকার থেকে মাসিক আর্থিক সহায়তা পাচ্ছি। সরকারকে ধন্যবাদ তবে ১৯৭২ সালে যদি তা শুরু করা যেত তাহলে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো না। এক সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ‘নো ওয়ার্ক, নো পেমেন্ট’-এর আওতায় কাজ হারিয়েছিল, আর তখন সেই সন্তানের পিতা সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুর পর যেন রাষ্ট্রীয় সম্মানে দাফন করা না হয় তা বলেছিলেন (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫/১০/২০১৯)। তবে আশার কথা আমাদের যুবসমাজের প্রতিনিধিরা যাদের সম্পৃক্ততায় আজকের উপদেষ্টা পরিষদ, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেমন- ‘আমরা কখনোই শহিদদের স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না-প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের দায়িত্ব সরকারের-নাহিদ ইসলাম’। সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। উপদেষ্টা পরিষদ সামনের দিনে আরও সুন্দর এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত সময়ে নেবেন সে আস্থা আমার আছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যা দক্ষ জনবলে। দক্ষ জনবল সৃষ্টি করার প্রথম স্তর শিক্ষা জগতের প্রাথমিক শিক্ষা। আমাদের শিক্ষার উন্নতির যাত্রাপথেই বাধাগ্রস্ত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। আজকের অবস্থাও যেন এমন না হয়। আমাদের সন্তানদের যোগ্য এবং উপযুক্ত নাগরিক হয়ে সামনের দিনে প্রতিযোগিতায় সম্মুখীন হতে হবে। এই ক্ষেত্রে এক দিনও নষ্ট করা ঠিক হবে না। সংবাদে প্রকাশ ‘জবঃঁৎহ ঃড় পষধংংৎড়ড়স, পধসঢ়ঁংবং ঈযরবভ অফারংবৎ ঁৎমবং ংঃঁফবহঃং” (ঞযব ঋরহধহপরধষ ঊীঢ়ৎবংং, ৬ ঝবঢ়ঃবসনবৎ ২০২৪)।
বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ সেই বাংলাদেশের আদিকাল থেকে। সেই অনিয়মের বিরুদ্ধে সরকারের দুর্নীতি দমন দপ্তরের এক সেমিনারের কার্যপত্র উপস্থাপন করেছিলেন আজকের প্রধান উপদেষ্টা। আমি যদি ভুল না করে থাকি তাহলে তার কার্যপত্রের টাইটেল ছিল ‘আমি যদি দুদকের চেয়ারম্যান হতাম’। সেখানে উল্লেখ ছিল, ২০% কাজ করতে হবে অতীত নিয়ে, ২০% কাজ করতে হবে আজকের জন্য আর ৬০% সময় দিতে হবে আগামীর কজে। সেই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি আজ বাংলাদেশ পরিচালনের দায়িত্বে এক বিশেষ সমস্যা সংকুল সময়ে। প্রধান উপদেষ্টার ওপর আস্থা রেখে বলতে চাই বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে। সমাজের অনেক অনিয়মের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম দূর বা নিয়ন্ত্রণ করে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে হবে। দক্ষ জনবল যদি সৃষ্টি করা যায় এবং প্রশাসনে যদি যোগ্য লোক নিয়োগ করা যায় তাহলে সমাজের আসল এবং কার্যকর উন্নতি পরিলক্ষিত হবে। সরকারের কাজ হতে হবে দল নিরপেক্ষ ভাবে, দেশের মানুষের স্বার্থে। বর্তমানে দেশের মানুষ যা আশা করছে। বর্তমান সরকারের সামনে অনেক এজেন্ডা বা দাবি। অনেক সংস্কার করতে হবে। দেশ পরিচালনে যেহেতু রাজনৈতিক দল জড়িত তাই রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই দেশ পরিচালিত হতে হবে দীর্ঘমেয়াদে। বারবার আমাদের যে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে তা একমাত্র রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের জন্য। এ অবস্থার সম্মুখীন আমরা আর হতে চাই না। যা যা করণীয় বা দরকার তা যথসম্ভব দ্রুত করতে হবে। অনেকের মতো আমিও আশাবাদী। আজকে অনেকের সঙ্গে আমিও বলতে চাই ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়ে আমরা আমাদের ভাষার সম্মান দিতে পারি নাই, ১৯৭১ সালে রক্তের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করেও স্বাধীনতার স্বাদ পাই নাই, ১৯৯০ সালে গণতন্ত্রের জন্য রক্ত দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার পাই নাই। সম্প্রতি এক সংবাদে প্রকাশ ‘পটুয়াখালী, বাউফলে আর্থিক অনটনে উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে না গুলিবিদ্ধ সুমনের (প্রথমআলো, ৬/৯/২০৪)। আজ আমাদের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফসল যেন আমরা পাই। আমার জানা মতে আমাদের মতো বয়সের মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কম ছিল, আমি ছিলাম এসএসসি পরীক্ষার্থী। আমিই এখন ৭০ বছরের কাছাকাছি। আর বেশিদিন আমরা বাংলাদেশের আলো-বাতাস নিতে পারব সেই ভরসা নেই। আমাদের তরুণ সমাজ যারা আজকের গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক তাদের কাছে আমার মতো মুক্তিযোদ্ধার দাবি আমরা যা পারি নাই তা তোমরা করবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরের মাথায় আমরা যে অবস্থায় আছি তা ছিল না স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্দেশ্যে এবং লক্ষ্যে। সব শহীদদের রক্তের মূল্য দিতে হবে। শহীদরা জীবন দিয়েছে তাদের জন্য নয়। তারা দেখতে চায় বাংলাদেশের মানুষের শান্তি, উন্নতি।
লেখক: চেয়ারম্যান, এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (ইডিএ)
বিশ্ব শিক্ষক দিবস ৫ অক্টোবর। ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে শিক্ষকদের একটি সম্মেলন হয়।এ সম্মেলনে শিক্ষকদের অধিকার দায়িত্ব এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা হয়েছিল। সে দিন শিক্ষকদের কথা চিন্তা করে ইউনেস্কো এবং আইএলও কিছু পরামর্শে স্বাক্ষর করেন। তারপর ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হলে ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর শিক্ষকদের অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি দিতে শিক্ষকদের স্মরণে শিক্ষকদের অধিকার কল্যাণে সম্মানার্থে সারা বিশ্বব্যপী বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে। ইউনেস্কোর মতে বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসমান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পালন করা হয়।
বিশ্বের ১০০টি দেশে এ দিবস পালন করা হয়। এই দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১ সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারন করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকতা পেশার অবদানকে ও স্মরণ করিয়ে দেয়।
মানুষের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে, তা কিন্তু জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে তা বিকশিত হয়। শিক্ষা মানব জীবনের পরিবর্তন এনে দেয়। শিক্ষার মাধ্যমে জাতীর উন্নতি অবনতি সবই নির্ভর করে। তাই তো শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। বাবা মা জন্ম দেওয়ার পর সন্তানের বিকশিত বা শিক্ষার দীক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষকের। দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষকের ওপর বর্তায়। ছাত্রের দক্ষতা ও সততা নিষ্ঠাবান তা নির্ভর করে শিক্ষকের ওপর। মেধাবী ও দায়িত্বশীল শিক্ষকরাই মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা বিস্তারের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সংকট উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যারা শিক্ষা দেয় তাদের আর্থিক অবস্থা কেমন যদি জানতে চাওয়া হয়- চাকরি ক্ষেত্রে বিরাট বৈষম্য দেখা যাবে। শিক্ষক সমাজ কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সামাজিকভাবে বেশ অবহেলিত। পারিবারিক জীবনে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এদের শখ-আহ্লাদগুলো ডুবে ডুবে মরছে। এ দেশের ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই লাইব্রেরি গবেষণাগার ও খেলার মাঠ। যেখানে আছে- তা মানসম্মত নয়। নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষা উপকরণ ও আসবাবপত্র। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত নন। এদের অবস্থা আরও করুণ। যেসব শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়েছেন তাদের অধিকাংশের চাকরির শুরু থেকে এমপিওভুক্ত হয়নি। অথচ এমপিওভুক্তির তারিখ থেকে শিক্ষক ও কর্মচারীদের অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরা হয়। কেউ কেউ বছরের পর বছর শিক্ষা দিয়ে এমপিওভুক্তির খবর নেই অনেকে পেনশনে চলে যায় কিন্তু এমপিওভুক্ত হচ্ছে না। বেসরকারি কলেজের প্রভাষকদের পদোন্নতির বিষয়টি আরও জটিল ও অমানবিক। বর্তমানে বেসরকারি কলেজে শিক্ষকদের এমপিও নীতিমালা ২০১৮ অনুযায়ী উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের শিক্ষকরা পদোন্নতি পেয়ে হবেন জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। এই জটিল নিয়মের কারণে অনেককে প্রভাষকের পদ থেকেই অবসর নিতে হয়। অথচ সরকারি কলেজে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপকের পদোন্নতি আরও সহজতর করা হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান থেকে কর্মচারী পর্যন্ত বাড়িভাড়া ভাতা মাত্র ১০০০ টাকা। বিষয়টি একেবারে বেমানান। বোনাসের ক্ষেত্রে পান মূল বেতনের ২৫%। সবাই একতরফাভাবে চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা। আর্থিক শত প্রতিকূলতার মাঝে তার শিক্ষা কার্যক্রমে কোনো গাফিলতি নেই। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অনবরত শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষকতা সবার কাছে মহান পেশা হিসেবে বিবেচিত। সে জন্য সবচেয়ে সম্মানের জায়গাটা কিন্তু শিক্ষকই দখল করে আছে। যুগ যুগ ধরে শিক্ষককে গুরুজন হিসেবে মেনে আসছে। শিক্ষকের সঙ্গে বেয়াদবি করা যায় না ‘অভিশাপের ব্যাপার আছে তো’। এ কথাটি বহুল প্রচলিত। তা অস্বীকার করার কারণ নেই। রাস্তায় শিক্ষকের আচমকা দেখা মিললে তার ছাত্র/ছাত্রীরা শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। শিক্ষক আর্থিক দৈন্যতায় থেকে ও পরম তৃপ্তি পায়, ‘আমার ছাত্র অনেক বড় কর্মকর্তা হয়েছে তাকে গড়ার কারিগর তিনি ছিলেন বলে’। এটাই তার বড় সান্ত্বনা। দু-একটি ঘটনায় আমাদেরকে পীড়া দিচ্ছে। যেমন- বাংলাদেশের একটি জেলা নওগাঁর হাঁপানিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল ইসলামের পদত্যাগের দাবিতে তার কার্যালয়ে বিক্ষোভ করছিল শিক্ষার্থীরা। ২৮ আগস্ট সকাল থেকে অধ্যক্ষকে অবরোধ করে এই বিক্ষোভ শুরু হয়। অবরুদ্ধ অবস্থায় বেলা ৩টার দিকে অধ্যক্ষ অসুস্থ হয়ে এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর তাকে উদ্ধার করে প্রথমে নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে ও পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অধ্যক্ষের বড় ভাই আবু নাসের আহমেদ বলেন, বিক্ষুব্ধ জনতা একত্রিত হয়ে হিসাব-নিকাশ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন, তিনি হিসাব বুঝিয়ে দেওয়ার লগ্নে বিক্ষুব্ধ জনতা অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজে অশোভনীয় আচরণে অধ্যক্ষ হতবিহ্বল হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
ঘটনা দুই: ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে ঢুকে তাকে চেয়ার থেকে নামতে ও পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করতে জোরাজুরি করছেন একদল শিক্ষার্থী। এক পর্যায়ে শিক্ষিকা জোরাজুরি করা এক ছাত্রীকে চড় মারেন। তবুও শিক্ষার্থীরা তাকে চেয়ার থেকে নামানোর চেষ্টা চালিয়ে যান। এ নিয়ে শুরু হয় উত্তেজনা। ঘটনাটি ঘটেছে জামালপুর সরিষাবাড়ী উপজেলার সালেমা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে।
ঘটনা: তিন: শিক্ষকদের এই পদত্যাগ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে গত তিন বছর আগে ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের সময় মো. আমান উল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল তিনি বিএনপি-জামায়াতের অনুসারী। ধীরে ধীরে এ তকমা লেগে ও ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর ‘আওয়ামী লীগের লোক’ বলে একটি গ্রুপ অভিযোগ করছেন। সেখানে বিক্ষোভ হয়েছে। তার পদত্যাগের দাবিতে কলেজের একটি মহলের হাত রয়েছে বলে জানা যায়।
ঘটনা চার : প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ এনে তার পদত্যাগের দাবিতে ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ করছিল শিক্ষার্থীরা। সারাদিন নিজের কক্ষে অবরুদ্ধ থাকার পর বিকেলে প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যান প্রধান শিক্ষক। এর পরেই তার চেয়ারে বসে পরে দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। এ ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেরিয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঘটনাটি ঘটেছে গত বুধবার কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরদিন ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাজী আলমগীর হোসেনের চেয়ারে ছাত্র বসে থাকার ছবি। ছবিতে দেখা যায় টেবিলে কাজী আলমগীর হোসেনের নেমপ্লেটের ছবি। বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি জানিয়েছেন, ছাত্রটির বিরুদ্ধে দ্রুত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এগুলোর ব্যাপারে সরকারের কঠোর নজরদারি দরকার।
ঘটনা পাঁচ : নোয়াখালী জয়নাল আবেদীন মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাবু শিমুল চন্দ্র স্যারের দীর্ঘ ৩৬ বছর ১ মাস ১৯ দিনের শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিনটি অন্যরকম ছিল। তিনি নোয়াখালী অঞ্চলের দুইবারের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। বাড়িতে যাওয়ার গাড়ি ফুলদিয়ে সাজিয়েছে ছাত্র/ছাত্রীরা। দুই পাশে সারিবদ্ধ ভাবে ছাত্র/ছাত্রীরা দাঁড়িয়ে স্যারের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন এবং অনেককে কদমবুসি করতেও দেখা গেছে। মাইকে বাজছিল কবিগুরুর বিখ্যাত গান ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এ ঘাটে তখন বাইব আর খেয়াতরী এ ঘাটে।’ এ দৃশ্যপটে ছাত্র /ছাত্রী অভিভাবক এবং আমি নিজেও দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। সেরা শিক্ষকের বিদায় এমনই হয়। শিক্ষক হিসেবে তার বড় সান্ত্বনা। শিক্ষকদের অবহেলা না করে এ সম্মানটুকু আমরা কি দিতে পারি না?
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন কর এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শিখ এবং যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন কর তাকে সম্মান কর।’ ( হাদিস নং ৬১৮৪)
প্রিয় নবী আরও বলেন, ‘সর্বোত্তম দান হলো কোন মুসলমান নিজে কোনো বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে পরে তা অপর মুসলমান ভাইকে শিক্ষা দেয়।’
‘আমাদের মনে রাখতে হবে একটি বই একটি কলম একটি শিশু এবং একজন শিক্ষক বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারে’ (মালালা ইউসুফ জাই)।
বিগত সরকারের সময় তাদের জন্মদিন-মৃত্যুদিন পালন করতে করতে সবাই ক্লান্ত ছিল। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন, ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য কার্যালয়ে বিগত সরকারের নিজেদের ভাইবোনদের জন্মদিন-মৃত্যু দিবস পালন করতে হয়েছে। এটার জন্য প্রতিষ্ঠান দায়ী? জোর করে করানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সবার মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এ অপরাধের জন্য আমরা কেন শিক্ষককে দায়ী করব? সমাজের সকল স্তরেই এ ধারা অব্যাহত ছিল। ছাত্র/ছাত্রীরা শিক্ষকদের ওপর যদি চড়াও হয় তাহলে সবাই ভাববে সামাজিক অবক্ষয় হয়েছে। আমরা এটা বলতে নারাজ। কোনো অশুভ শক্তি হয়তো বিভ্রান্ত করছে তোমাদেরকে। জাতির স্বার্থে ছাত্ররা কেন বিভ্রান্ত হবে। শিক্ষক দোষ করলে কমিটি দেখবে- আমরা সেটার জন্য অপেক্ষা করতে ক্ষতি কী? শিক্ষককে সম্মান জানালে আমাদের সমাজ আরও সুন্দর ও মসৃণ হবে। আমরা কি এটা আশা করতে পারি না?
লেখক : সাবেক ব্যাংকার ও কলামিস্ট
ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) সাম্প্রতিক রিপোর্টে বিশ্বের বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ১৭৩টি শহরের মধ্যে বাংলাদেশের ঢাকা শহরের অবস্থান ১৬৮তম। ঢাকা শহরের যানজট, পরিবেশদূষণ, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা যে চরমভাবে প্রশ্নের দাবি রাখে, তা এই রিপোর্টই সাক্ষী দিচ্ছে। অবকাঠামোর মেট্রোরেলে মনোযোগ আছে, উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণে মনোযোগ আছে; কিন্তু ঢাকার মানুষের বসবাসের মানোন্নয়নের প্রতি মনোযোগ কিংবা দায়বদ্ধতা নেই কর্তৃপক্ষের। তাই ঢাকার এই করুণ অবস্থা। ঢাকায় কিছু বৃষ্টি হয়েছে, যা এ সময়ের পক্ষে স্বাভাবিক। টানা ছয় ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি। কিন্তু এর ফলেই বুড়িগঙ্গা আর আশপাশের জায়গাগুলো ত্রাসমূর্তি ধারণ করেছে। জলে ডুবে গিয়েছিল ঢাকার সিংহভাগ এলাকা, রাস্তা-অলিগলি। কোথাও হাঁটুজল, কোথাও কোমরসমান জল। অচল হয়ে পড়েছিল গোটা রাজধানী। রাস্তায় বাস আর অটোরিকশা নয়, নৌকা দিয়ে চলাচলের কথা ভাবছিল রাজধানীবাসী।
আধুনিক শহরে বৃষ্টি বরং কিছুটা অবাঞ্ছিত অতিথি। আমরা তার জন্য প্রস্তুত থাকি না কখনো। তারপরও দেখছি আকাশ থেকে ঝেঁপে বৃষ্টি পড়ছে এবং ঢালুর দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। নিচুর দিকে ক্রমাগত যাওয়াই জলের নিয়ম। সেই নিয়মের দরুণই স্থলভাগকে ঘিরে অতল মহাসাগর, সাগরের রক্ষাবন্ধন আর স্থলভাগে প্রাণরক্ষক জলাশয় তৈরি হয়। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ নানাভাবে আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টিকে ধরে রাখতে মাটিতে ছোট-বড় গর্ত খুঁড়েছে। কিন্তু তারপর? তার আর পর নেই। জলাশয় ভরে উঠেছে দালান-কোঠায়। খাল-বিল আর দেখা যায় না চোখের সীমানায়। নিয়মিত উদাসীনতার ফলে গত কয়েক দশক ধরে শহরে মোটামুটি দু-তিন ঘণ্টা স্বাভাবিক বৃষ্টি পড়লেও জল জমা শুরু হচ্ছে। প্রবল বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই! ঢাকাসহ কিছু শহরের নিচু অংশে জল আগেও জমত; কিন্তু পরে তা নেমেও যেত। এখন প্রায় পুরো শহরেই জল জমে এবং তা বেরোতে পারে না। জল বয়ে যাওয়ার জায়গা আর খালি নেই। তৈরি হয়েছে উঁচু রাস্তা এবং পাকা বাড়িঘর। মাটির নিচে জল গড়িয়ে পড়ার পথ বন্ধ। ফলে জল জমে থাকায় বিপদ বাড়ছে, নিয়মিত জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হচ্ছে। তবে থেমে থাকে না কর্তৃপক্ষের প্রজেক্ট। প্রজেক্ট হয়, বাজেট অনুমোদন হয়, বন্যায় উদ্ধারকাজ হয়; কিন্তু জল জমার কোনো সমাধান হয় না। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বসবাসের অভ্যস্ত নিয়মকে চূড়ান্ত অদূরদর্শিতায় যথেচ্ছ লঙ্ঘন করার উন্নয়নমূলক কাজে কেউই আর এখন পিছিয়ে থাকছে না।
ভারতের সুনীল গঙ্গোপধ্যায় হয়তো ভাগ্যবানই ছিলেন। এমন লেখার পরও তাকে জেলে যেতে হয়নি। তার কারণ সম্ভবত মানুষের ভাবাবেগ কিছুদিন আগেও আজকের মতো এত আঘাতপ্রবণ ছিল না। তিনি লিখেছিলেন, ‘এতগুলো শতাব্দী গড়িয়ে গেল, মানুষ তবু ছেলেমানুষ থেকে গেল/কিছুতেই বড় হতে চায় না/ এখনো বুঝল না, ঈশ্বর নামে কোনো বড়বাবু এই বিশ্বসংসার চালাচ্ছেন না/ ধর্মগুলো সব রূপকথা/ যারা সেই রূপকথায় বিভোর হয়ে থাকে/ তারা প্রতিবেশীর উঠোনের ধুলোমাখা শিশুটির কান্না শুনতে পায় না।’ সুনীল গঙ্গোপধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন ২০১২ সালে; তবে মানুষ এখনো ছেলেমানুষই থেকে গিয়েছে। আর ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে সেটা ভারী সুবিধার। ছেলেমানুষ বলেই দেশাত্মবোধের মোড়কে উগ্র মেরুকরণ, বিদ্বেষ, ভাষা ও সংস্কৃতিগত বহুত্বের প্রতি অনাস্থার ঝোঁক দিয়ে আমাদের কয়েদ করে রাখা যায় বোধশূন্যতার অন্ধকারে; সে আমরা সমাজের যে স্তরেই থাকি বা যত শিক্ষিতই হই না কেন। সবচেয়ে ভয়ানক বোধ হয় সমাজের শিক্ষিততম অংশ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর এই অন্ধকারে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাওয়া দেখে। বোধ বিলীন হবে না কেন? তারা সবসময় ভাবে, সব বেয়াড়া লোকজনকে প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দি থেকে দূর করতে পারলে করপোরেট প্রভুদের মনপছন্দ রোবট তৈরি করার কাজটি সহজ হয়। তাই তারা উপরমহলকে খুশি রাখতে ঠিক যেমনভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা উচিত, রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষবিন্দুতে আরোহণকারী ছেলেমানুষরা সেভাবেই চালিয়ে যাবেন। অন্যরাও তালে তাল দিয়ে চলবেন, অন্তত নিজের গায়ে আচ না-লাগা পর্যন্ত। তাই যা আমরা সহজেই প্রচুর পাই, সেই বৃষ্টিধারাকে অবহেলায় বয়ে যেতে বাধা দেওয়ার সংকটের কারণে পাশাপাশি তৈরি হয়েছে মাটির সঞ্চিত জলভাণ্ডার থেকে বেহিসাব জল তোলা। তুমুল বর্ষাকালের দেশের মানুষ তাই তীব্র জলসংকটের সম্মুখীন আজ।
কিন্তু পরিবেশ তো বসে নেই। আমরা ভুল করে তাকে যে বেপরোয়া করে দিয়েছিÑ তার গতিপথ এখন আটকাব কী করে? ইতোমধ্যেই দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সামনের দিনগুলো আরও ভয়াবহ হতে পারে। এই অস্বাভাবিকতা, প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনা একেবারেই ইদানীংকালের নিয়ম। এমন অবস্থা শুধু বাংলাদেশের নয়- এ অবস্থা চলছে সারা পৃথিবীতে। একাধারে চলছে তীব্র দাবদাহ, অসহনীয় গরম; অন্যদিকে চলছে ঝড়-বৃষ্টির তাণ্ডবতা। সাগর আছড়ে পড়ছে দুপারের মানুষের ওপর ঘূর্ণাবর্ত হয়ে। প্রকৃতির এ বিরূপ অবস্থার কারণ আমাদের সবারই জানা। জানা পরিত্রাণের উপায়ও। কিন্তু পরিত্রাণের পথে কারও কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। রাম দুষছে শ্যামকে, শ্যাম যদুকে, যদু তাকায় মধুর দিকে, আর মধু উদাসীন ও নির্বিকার।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ক্লাইমেট চেঞ্জ, বিশ্ব উষ্ণায়ন কিংবা জলবায়ু সংকট শব্দগুলো এখন শিশু থেকে বাড়ির রান্নাঘরেও ছড়িয়ে গিয়েছে। সব দেশের সব সরকার প্রতি বছরই এ নিয়ে সম্মেলনে বসে; কিন্তু পরিস্থিতি শোধরায় না, কেউ হাল ধরে না। সবাই শুধু পরামর্শ দেয়- এভাবে না ওভাবে। কিন্তু কাজটা কেউ করে না। আর প্রকৃতিও সেই সুযোগটাই নেয়। গরিব তো এমনিতেই আধামরা, তার ওপর এই গাফিলতি তার জন্য মৃত্যুসম হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মানুষ তাই একটু বেশিই অসহায়। কেননা, বাংলাদেশে পাল্লা দিয়ে চলে নদীগর্ভ থেকে অবাধে বালু-পাথর উত্তোলন, বনবাদাড় উজাড় করা। চলে অযথাই পানীয় জলের অপচয়, প্লাস্টিকের ব্যবহার। কত নদী যে ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে, আর সামনে যে আরও কত নদী হারিয়ে যাবে! এই সেদিনও এ দেশে কম-বেশি ৭০০টি নদী প্রবাহিত ছিল। এখন সরকারি হিসাবে বেঁচে আছে ৪০৫টি নদী। বাস্তবে হয়তো আরও অনেক কম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সচল নদীপথ ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার; আর আজ ২০২৪ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটার। বন-বাদাড়ের অবস্থা আরও ভয়াবহ। নদী হারালে, বন হারালে মানুষের জীবনে অসহায়ত্ব আসবে তা বুঝতে কোনো বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের হেঁসেলে বসা গৃহিণীও তা বুঝতে পারে; কিন্তু আমি-আপনি অসহায়। যাদের বুঝ এখানে কাজে দিত, তারা তো বেশ ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই দিন-রাত কাটাচ্ছেন; এখনো তাদের পালে বাতাস লাগছে না। আর লাগবেই-বা কী করে! আমরাও তো নিজেরা সচেতন নই। কাঠবিড়ালীর ভূমিকায় আমরাও নামতে পারছি না। গাছকাটা বন্ধ করতে পারছি না, জলের অপচয় রুখে দিতে পারছি না, প্লাস্টিক ব্যবহার না করে থাকতে পারছি না, জলাধার ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে পারছি না, নদীকে বাঁচাতে পারছি না, সচেতন জনপ্রতিনিধিকে বেছে নিতে পারছি না। তাই প্রকৃতি আমাদের ওপর চরমভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে।
লেখক: কলামিস্ট
যে কেউ যেকোনো সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত আমার এক বোনের অনুরোধে আজ ডেঙ্গু নিয়ে কিছু একটা লেখার তাগিদ অনুভব করছি। বোনটি সিলেটি, একজন ব্যাংকার সেখান থেকে অনুরোধ করল ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অনুভব করে এর প্রতিরোধের জন্য কিছু লিখতে, আমি বললাম আমি তো ডাক্তার নই আমি এই বিষয়ে তেমন ভালো কিছু জানি না, কীভাবে লিখব? আর আমার লেখা পাঠকরা পড়বেইবা কেন?
উত্তরে বোনটি জানাল, ‘তুমি চেষ্টা করলে তথ্য সংগ্রহ করে ভালো লিখতে পারবে আর তোমার লেখা অনেকেই পড়ে।’ সাহস পেলাম তাই চেষ্টা করছি, শুরুতেই জানিয়ে রাখি ডেঙ্গু কি এবং এর সূত্রপাত কোথায়?
সম্ভাব্য ডেঙ্গু জ্বরের ঘটনার প্রথম বিবরণ পাওয়া জিন বংশের, ২৬৫-৪২০ খ্রিষ্টাব্দে এক চীনা মেডিকেল এনসাইক্লোপিডিয়ায় বা বিশ্বকোষে যেখানে উড়ন্ত পতঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ‘জলীয় বিষ’-এর কথা বলা হয়েছে। সেখানে ১৭০০ শতাব্দীর এক মহামারির বিবরণও পাওয়া যায়; কিন্তু ডেঙ্গু মহামারির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় ১৭৭৯ ও ১৭৮০-তে, যখন এই মহামারির কবলে পড়েছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ।
তখন থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত মহামারি অনিয়মিত ছিল।
১৯০৬ সালে ‘এডিস ইজিপ্তাই’ নামক মশার পরিবাহিতা সম্পর্কে সবাই নিশ্চিত হয়, এবং ১৯০৭ সালে ভাইরাস ঘটিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু হয়ে ওঠে দ্বিতীয় ইয়েলো ফিভার।
এর কিছুদিন পরেই জন বার্টন ক্লেল্যান্ড এবং জোসেফ ফ্র্যাঙ্কলিন সিলার নামক দুই গবেষক আরও গবেষণা চালিয়ে ডেঙ্গু পরিবাহিতার মূল প্রতিপাদ্য সম্পূর্ণ করেন।
তাদের গবেষণায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও তারপর ডেঙ্গুর লক্ষণীয় বিস্তারের কারণ হিসাবে পরিবেশগত ধ্বংসের কথা বিশেষভাবে জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয়। একই প্রবণতা রোগের বিবিধ সেরোটাইপের নতুন নতুন এলাকা বিস্তারে এবং ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভারের উদ্ভবে দেখা যায়। রোগের এই চরম রূপের বিবরণ ১৯৫৩ সালে প্রথম ফিলিপাইন্সে পাওয়া যায়; ১৯৭০-এ এটি শিশু মৃত্যুর এক প্রধান কারণ হয়ে ওঠে এবং আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ১৯৮১ সালে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম প্রথম পরিলক্ষিত হয়, ডেঙ্গু জ্বরের সমার্থক ভিন্ন বানান হচ্ছে ডেঙ্গি, যা একটি ‘এডিস’ নামক মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমেই এই ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে সাধারণত শরীরে ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। এই রোগের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি।
সঠিক পরিচর্যন্তর ফলে দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে থাকে তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষরী জ্বর বা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়ে থাকে এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনোবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়।
মনে রাখা প্রয়োজন যে কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী বা স্ত্রী মশাই হলো ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধানতম। ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া যায়। ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে, কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। পরবর্তীতে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। কয়েক ধরনের টেস্টের মাধ্যমে, যেমন- ভাইরাসটি বা এর আরএনএ প্রতিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি দেখেও ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয় করা সহজ হয়।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধী টিকা কয়েকটি দেশে অনুমোদিত হয়েছে তবে এই টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর।
প্রধানত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায় বলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন তাই জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আঁধারে, যেমন- প্রতিটি বাড়িতে বিভিন্ন স্থানে আনাচে-কানাচে কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি দ্রুত অপসারণ করতে হবে। চলাফেরা ও জীবন যাত্রায় শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে এবং বেশি বেশি করে তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল দেওয়া হয়। তবে হাসপাতালে ভর্তি করলে দেখা যায় প্রায়শই রোগীর শিরায় স্যালাইন দিতে হতে পারে।
মারাত্মক রূপ ধারণ করলে রোগীকে রক্ত দিতে হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে কোনো ধরনের এন্টিবায়োটিক ও ননস্টেরয়েডাল প্রদাহপ্রশমী ওষুধ সেবন করা যাবে না, করলে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কালে ডেঙ্গু একটি বৈশ্বিক আপদে পরিণত হয়েছে। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, ভারত এবং বাংলাদেশসহ অন্যান্য মহাদেশের ১১০টির অধিক দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়। প্রতি বছর পাঁচ থেকে পঞ্চাশ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয় এবং তাদের মাঝে দশ থেকে বিশ হাজারের মতো মারা যায়। এ দেশে ১৭৭৯ সালে ডেঙ্গুর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। বিংশ শতকের প্রথমভাগে ডেঙ্গুর ভাইরাস উৎস ও সংক্রমণ বিশদভাবে জানা যায়। মশক নিধনই বর্তমানে ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। সরাসরি ডেঙ্গু ভাইরাসকে লক্ষ্য করে ওষুধ উদ্ভাবনের গবেষণা চলমান রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশটি অবহেলিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগের একটি হিসেবে ডেঙ্গু চিহ্নিত করেছে।
সাধারণভাবে, ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তরা হয় উপসর্গবিহীন শতকরা ৮০ ভাগ অথবা সাধারণ জ্বরের মতো সামান্য উপসর্গ। বাকিদের রোগ হয় আরও জটিল শতকরা ৫ ভাগ এবং স্বল্প অনুপাতে এটি প্রাণঘাতী হয়।
ইনকিউবিশন পিরিয়ড বা উপসর্গগুলোর সূত্রপাত থেকে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময় স্থায়ী হয় ৩-১৪ দিন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা হয় ৪-৭ দিন। অতএব, আক্রান্ত এলাকা-ফেরত পর্যটকদের ডেঙ্গু হয় না যদি ঘরে ফেরার ১৪ দিনের বেশি পরে জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ শুরু হয়।
বাচ্চাদের প্রায়ই এই উপসর্গগুলো হয় যা সাধারণ সর্দি এবং গ্যাস্ট্রোএন্টারাটাইটিস বা বমি এবং ডায়েরিয়ার সমান, আর সাধারণত ছোটদের ক্ষেত্রে বড়দের চেয়ে উপসর্গের তীব্রতা কম হয়; কিন্তু রোগের জটিলতার শিকার বেশি পরিমাণে হয়।
ডেঙ্গু উপসর্গের বৈশিষ্ট্য হলো হঠাৎ জ্বর হওয়া, মাথাব্যথা সাধারণত দু’চোখের মাঝে মাংসপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা এবং র্যাশ বেরোনো। ডেঙ্গুর আরেক নাম ‘হাড়-ভাঙা জ্বর’ যা এই মাংশপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা থেকে এসেছে। মেরুদণ্ড ও কোমরে ব্যথা হওয়া এ রোগের বিশেষ লক্ষণ। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর শরীরে ছোট ছোট লাল বিন্দু দেখা যায় যেগুলো ত্বকে চাপ দিলে অদৃশ্য হয় না, যেগুলোর আবির্ভাব হয় ত্বকে চাপ দিলে এবং এর কারণ হচ্ছে ভগ্ন রক্তবাহী নালি এই জায়গায় আবির্ভূত হতে পারে এবং কারোর মুখ ও নাকের মিউকাস মেমব্রেন থেকে অল্প রক্তপাতও হতে পারে।
কিছু লোকের ক্ষেত্রে অসুখটি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যার কারণে প্রবল জ্বর হয় এবং সাধারণত এক থেকে দুই দিন স্থায়ী হয়। এই পর্যায়ে প্রচুর পরিমাণে তরল বুক
এবং অ্যাবডোমিনাল ক্যাভিটিতে বর্ধিত ক্যাপিলারি শোষণ ও লিকেজের কারণে জমে। এর ফলে রক্তপ্রবাহে তরলের পরিমাণ কমে যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ হ্রাস পায়।
ডেঙ্গুর সাপেক্ষে অন্যান্য নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারের বিষয়ে জানা গেছে যেমন- ট্রান্সভার্স মায়েলিটিস এবং গুলেন-বারে সিনড্রোম, দুর্লভতর জটিলতার মধ্যে আছে হৃৎপিণ্ডে সংক্রমণ এবং অ্যাকিউট লিভার ফেইলিওর।
দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে কমপক্ষে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের যেকোনো মাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু এটি। এর মধ্যে রয়েছে আটটি শিশু। গত সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয় গত বছর তখন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। আর মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। গত বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ৩৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল সেপ্টেম্বরে। ওই সময় ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন।
অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩০ হাজার ৯৩৬ জন। আর এ বছর এডিস মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৬৩ জনের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮৮ ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন হাসপাতালে। এরপর ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন হাসপাতালে। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ নারী ও ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ।
এ বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছে ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সিরা। এই বয়সি ব্যক্তিদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ হাজার ৩৬৪। আর মারা যাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ১৯। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে ৬৩ শতাংশ পুরুষ ও ৩৭ শতাংশ নারী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে সর্বোচ্চ ২৬৭ রোগী ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ২২৮ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ২০৬, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮৩, খুলনা বিভাগে ১৩৪, বরিশাল বিভাগে ৭৪, রাজশাহী বিভাগে ৫৩, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৮ ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ২৮ জন ভর্তি হয়েছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয় গত বছর। তখন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। আর মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। গত বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ৩৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল সেপ্টেম্বরে। ওই সময় ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন।
সম্প্রতি আমার পরিচিতদের একজন ছিলেন আকলিমা আক্তার, যাকে পরিবারের সদস্যরা সুখী নামে ডাকতেন। তিনি হাসিখুশি সুখী সবাইকে সুখে রাখতে চাইতেন। সেই সুখী মাত্র সাত দিন আগে গত বুধবার সকালে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। বিকেলেই আকলিমার লাশ নিয়ে তার ব্যাংকার স্বামী সাইফুল ইসলাম ঢাকা থেকে ছুটে যান নোয়াখালীতে, এই দম্পতির দুই বছরও না হওয়া একমাত্র সন্তান সামিহা বিনতে ইসলামও জ্বর নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকা ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপে ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস পদে কর্মরত ছিলেন আকলিমা আক্তার।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের প্রত্যেককে তার নিজস্ব আঙিনায় এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকেই সম্মিলিত উদ্যোগে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে এবং আরও বেশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রতিরোধের জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রচারমাধ্যমে অধিক পরিমাণে ব্যাপক প্রচারণা ও আক্রান্ত রোগীদের সেবায় স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের সুস্থ করে তোলার উদ্যোগী হওয়া, রক্তদান কর্মসূচি সফল করা ইত্যাদি বেশি বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক
ছাত্রজীবনে আমাদের সবাইকে ‘মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য’ রচনাটি অনেকবার পড়তে হয়েছে। অনেক পরীক্ষায় রচনাটি লিখতে হয়েছে। এখনো ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ‘মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য’ রচনাটি। মানবজীবনে মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের অপরিসীম কর্তব্য রয়েছে। সংসারে মানুষকে অনেক রকম দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়। কারণ মানবজীবন কর্তব্যকর্মে বিধৃত। সেসব কর্তব্য পালনের মাধ্যমে মানুষকে তার চরিত্রের স্বরূপ প্রকাশ করতে হয়। যেসব কর্তব্যের বেড়াজালে মানুষ আবদ্ধ তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য বরং এ কর্তব্যকে অন্যকোনো কর্তব্যের সঙ্গে তুলনা করা সমীচীন নয়। কারণ এই কর্তব্যের সঙ্গে মানবজীবন এমনভাবে জড়িত যে এই কর্তব্যকে অবহেলা করলে মানুষের মনুষ্যত্ববোধ থাকে না তখন সে অমানুষ হয়ে যায়। জন্মলাভের পর একটি শিশু যাকে আপন করে পায় তিনি হলেন মা। যাকে একান্ত করে পায় তিনি বাবা। বিখ্যাত মনীষী, উইলিয়াম পেন বলেছেন, ‘পৃথিবীতে ঈশ্বরের পরবর্তী স্থানই হলো মাতা-পিতার। মাতা লালন করেন আর পালন করেন পিতা। তাদের ঋণ কোনোভাবেই শোধ করা যায় না।’ প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ এ প্রসঙ্গে সেই জনপ্রিয় গানের লাইন ‘মায়ের একধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম পাপোস বানাইয়া দিলে শোধ হবে না’ স্মরণ করতে হয়। পৃথিবীতে আমরা যখন জন্মগ্রহণ করেছিলাম তখন কত অসহায় ছিলাম। নিজের পায়ে দাঁড়াতে অনেক দিন সময় লেগেছে। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে একটা পর্যায়ে পৌঁছেছি। কিন্তু সেই পর্যায়ে পৌঁছতে অনেকটা সময় বড় অবলম্বন হয়ে সর্বদা পাশে থেকেছেন আমাদের মা-বাবা। নিজের সুখ ও আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে আমাদের তিল তিল করে বড় করে তুলেছেন তারা। সব সময়ই শিক্ষা-দীক্ষা, খাবার-দাবার, বিভিন্ন আবদার মেটানো বিষয়েসহ তারা সব সময়ই ভেবেছেন, সাধ্যমতো যা করা প্রয়োজন তাই করেছেন। বাবা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে উপার্জন করেছেন আমাদের সুখ এবং ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য। মা আমাদের বড় করে তুলতে কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। শিশু অবস্থায় আমাদের জন্য মা কত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। আমরা অসুস্থ হলে সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন হয়ে বিছানার পাশে বসে সেবা-যত্ন করেছেন। আরোগ্য লাভের জন্য যা করা প্রয়োজন তাই করেছেন সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। মা-বাবার এত ত্যাগ, মহান অবদান কোনো সন্তান অস্বীকার করতে পারবে না। মা-বাবা নিজে না খেয়ে সন্তানকে অমঙ্গল বাবা-মা কোনোভাবেই কামনা করতে পারেন না। এমনকি বিপথগামী ও অবাধ্য সন্তানের জন্যও মা-বাবার সহানুভূতি ও ভালোবাসার কমতি থাকে না। সন্তান প্রতিবন্ধী, পঙ্গু হলেও মা-বাবা তার প্রতি কম স্নেহ অনুভব করেন না, তাদের হৃদয়ে ভালোবাসা ও আদরের ঘাটতি থাকে না। মা-বাবার কষ্ট ধৈর্য, সাধনা ও শ্রমের ফল হিসেবে সন্তানের সুন্দর জীবন গড়ে ওঠে। সেই মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য কোনোভাবেই অবহেলা করা যায় না।
পরিবারের সার্বিক সুখ-শান্তি আর উচ্ছ্বাসকে মূল্য দিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করে মা ও সন্তানের মধ্যে। এই সম্পর্কটি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আত্মিক রক্তের বাধনে বাঁধা। স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক নানা ঝড়ে উড়ে যেতে পারে; কিন্তু সন্তানের সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক আমৃত্যু বজায় থাকে। কোনো কারণে যদি পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদ রচিত হয় তবুও সম্পর্কের অদৃশ্য সুতা ঠিকই রয়ে যায়। সত্যিকার অর্থেই একজন সন্তান; পুত্র কিংবা কন্যা তার জীবনে প্রথম নারী হচ্ছে মা। জন্মের পর পরই শালদুধ খাওয়ানোর সময় মায়ের মুখ শিশুসন্তানের দিকে কিছুটা ঝুঁকে থাকে। মায়ের এই মুখ সন্তানের মনে গেঁথে যায়। সুখী সমৃদ্ধ পরিবারে সন্তানের দুরন্তপনায় মা-ই সন্তানের শেষ আশ্রয়স্থল। তাই সন্তানের সব চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে সবার আগে অবগত হন মা। একজন মা-ই পারেন একটি সুখী পরিবারের জন্য যোগ্য সন্তান গড়ে তুলতে। এ ক্ষেত্রে মা ও ছেলের সম্পর্ক হয় মাতৃকেন্দ্রিক জগতের নানা মায়ায়। মা খুব সহজেই সন্তানকে নানা পরিস্থিতি বোঝাতে সক্ষম হন। ওদিকে যার ওরসে সন্তানের পৃথিবীতে আগমন সেই বাবা সন্তানের জন্য যেন এক নিবিড় ছায়া। যার কাজ দুঃখ-কষ্ট থেকে সরিয়ে সন্তানকে ভালোবাসার আর্দ্রতা উপহার দেওয়া। রক্তের বাধনে বাঁধা চমৎকার সম্পর্ক বাবা ও সন্তানের। সন্তান ও বাবার সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে শ্রদ্ধা। বেশির ভাগ সন্তানের কাছে বাবাই শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন। পুত্র জীবন পথে বাবাকে মূলত সেনাপতি হিসেবেই দেখে যার শাসনাধীনে চালিত হয় তার যাপিত জীবন। শৈশব-কৈশোরে পিতাই হন পুত্রের ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড অন্যদিকে পুত্রের মাঝে পিতা সাধারণত নিজের ছায়া দেখতে পান কিংবা দেখতে চান নিজের অনেক অপ্রাপ্তি, ব্যর্থ স্বপ্ন বা সাধ পূরণ করতে চান বাবা সন্তানের মাধ্যমেই। আর সন্তানও অনেক সময় প্রভাবিত হয় বাবার ব্যত্তিত্বের ছায়ায়।
আসলেই পরিবার একজন মানুষকে ধাপে ধাপে তৈরি করে। একটা মানুষকে ভালো কিংবা মন্দভাবে গড়ে উঠতে পরিবারই বড় ভূমিকা পালন করে। একজন মানুষ সেভাবেই বেড়ে উঠবে পরিবার তাকে যেভাবে গড়ে তুলবে। প্রকৃত পক্ষে শিশুর সঠিক মানসিক বিকাশের জন্য পরিবারের সান্নিধ্য খুবই প্রয়োজনীয়। স্নেহ, মায়া, যত্ন এবং প্রয়োজনে শাসন তো প্রথমে পরিবার থেকে আসে। মা-বাবার আদর, সোহাগ এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। একক পরিবারের আধিপত্য। আজ যৌথ পরিবারের ধারণা ভেঙে একক পরিবার তৈরি হচ্ছে। একক পরিবার গঠনের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে- যৌথ পরিবারে ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকে না, পরিবারের পারিবারিক সম্পর্কগুলো সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারে না। সম্পর্কে ভাঙন ধরে একক পরিবারে খুব সহজেই। আজকাল সামাজিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের অধঃপতনের জন্য একক পরিবারের নানা সংকটই দায়ী। এ জন্য প্রায়ই ঘটছে নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। মানসিক দ্বন্দ্বের কারণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হাতাশা তীব্র হচ্ছে। এর ফলে নিরাপত্তাহীনতা, ইমোশনাল ডিপ্রাইভেশন ও আইডেন্টি ক্রাইসিসও বাড়ছে। এ ধরনের বিপর্যয় ঠেকাতে পরিবারে বয়োবৃদ্ধ সদস্যরা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। কারণ এই একক পরিবারগুলোতে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ঠাঁই হচ্ছে না, তাদের গ্রামের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। অনাদরে, অযত্নে, অবহেলায় অনেকটা অসহায় মানবেতর জীবন-যাপন করতে হয়। কারও মা-বাবার স্থান হচ্ছে দূরে নিভৃত এলাকার বৃদ্ধাশ্রমে। ফলে নাতি-নাতনির, দাদা-দাদির স্নেহের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়ে ভেতরে ভেতরে কেঁদে মরছে। তারা জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কোনো ধরনের গভীর জ্ঞান লাভ করতে পারছে না অভিজ্ঞ হননের অনুপস্থিতিতে। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্ত্রীর আপত্তি কিংবা অনাগ্রহের কারণে বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিজের সংসারে ঠাঁই দিতে পারে না অনেক মানুষ। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের নানা টানাপড়েন ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এর কারণ কমিউনিকেশন গ্যাপ, আর্থিক ও পারিবারিক নানা বিষয়। আধুনিক ও সচেতন মানুষ হিসেবে সন্তানকেই এ ক্ষেত্রে পিতা-মাতার সঙ্গে সম্পর্ক সুন্দর ও স্বাভাবিক করতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মহাকাব্যে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের অবদান কম নয়, সম্পর্কের ব্যাখ্যায় তা যাই হোক না কেন। পরিবার মানেই ভালোবাসার অটুট বন্ধন। একক কিংবা একান্নবর্তী ধরনটা যাই হোক না কেন; সবাই চায় পরিবারটা হয় যেন সুখের সমুদ্র। যাতে ভাসবে আপন মানুষের সুখভরা প্রতিচ্ছবি। এ হবে এমন এক মরুদ্যান যাতে সবাই খুঁজে পাবে অপর সুখের সন্ধান। পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের যথাযথ দায়িত্ব পালন এবং বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের যত্নবান হওয়াটা মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হলেও তা পালনে আন্তরিক ও সচেষ্ট নন অনেক মানুষ। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খোঁজখবর রাখেন না অনেক ছেলেমেয়ে। নানা কষ্টে-দুর্ভোগে অসহায়ভাবে জীবন-যাপন করেন তারা, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। পিতা-মাতার প্রতি সন্তানদের দায়িত্ববান করতে সংসদে আইন পাস হয়েছে। পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলাকারীদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই আইন অনেককে দায়িত্ববান এবং সিরিয়াস করবে হয়তো বা। তবে এ ক্ষেত্রে আইনের চেয়ে হৃদয়ের একান্ত আবেগ অনুভূতিটাই বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। সন্তানের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত মাতা-পিতার সব রকম সুখের দিকে লক্ষ্য রাখা। পিতা-মাতার শারীরিক, মানসিক সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে সন্তানের দৃষ্টি দিতে হবে। মাতা-পিতার মনে আঘাত লাগে তেমন কর্মকাণ্ড থেকে সব সময় বিরত থাকতে হবে। মাতা-পিতার ভরণপোষণের দায়িত্বটাকে কোনোভাবেই বোঝা না ভেবে এটাকে জীবনের একটি প্রধান দায়িত্ব বিবেচনা করতে হবে। মা-বাবা যখন বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছেন তখন তারা কর্মজীবন থেকে অবসর জীবনে পৌঁছে যান। অনেকেই তখন সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হন। এই অবস্থায় তাদের সব রকমের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা সন্তানের কর্তব্য। নিজের জীবনে অভাব, অভিযোগ, সমস্যা, সংকট যতই থাকুক না কেন তার পরও পিতা-মাতার সুখ স্বাচ্ছন্দের বিষয়টাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কোনোভাবেই তাদের অবাধ্য হওয়া যাবে না। তাদের স্বাস্থ্যের দিকে দৃষ্টি রাখতে। অনেক বাবা-মা নিজে অশিক্ষিত হলেও সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করেন অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে। কর্মজীবনে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর অনেক সন্তান অশিক্ষিত বাবা-মাকে স্বীকার করতে লজ্জা পান, তাদের পরিচয় দিতে বিব্রতবোধ করেন। তাদের মতো নরাধম আর কেউ হতে পারে না। সেই সব নরাধমের জন্য করুণা হয়। আসুন, আমরা সবাই যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করি, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের সেবা-যত্নে নিজেদের সর্বোতভাবে উৎসর্গ করি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট
বাংলাদেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন লাগাতার বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে বছরে গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। তারপরও বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমরা আমদানি করছি প্রতি বছর। এর মধ্যে আছে চাল, গম ও ভুট্টাসহ অন্যান্য পণ্য। শুধু দানাদার খাদ্যশস্যের আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টন। এর সঙ্গে অন্যান্য কৃষিপণ্য যেমন- ডাল, তেলবীজ, চিনি, মসলা ও দুগ্ধজাত পণ্য যোগ করা হলে মোট আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯০ থেকে ১০০ লাখ টন। টাকার অঙ্কে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮০ থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকা। তারপরও দেশে খাদ্য নিরাপত্তার ঘাটতি আছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। বর্তমানে দেশের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এটি দূর করতে হলে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চায়তা বিধান করতে হলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন আরো দ্রুত বাড়াতে হবে। তার মাত্রা হতে হবে ন্যূনপক্ষে বছরে গড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। সেই সঙ্গে বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে হবে। কৃষিপণ্যের বাজারজাত উদ্বৃত্ত আরও বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ অনেক। উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে কৃষিজমি হ্রাস, আবাদযোগ্য জমি চাষের বাইরে ফেলে রাখা, জমির উর্বরতা হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, খাদ্য অপচয় এবং অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে চাষাধীন জমির পরিমাণ কম। মোট ১ কোটি ৮৬ লাখ একর বা ৭৫ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। জনপ্রতি প্রাপ্যতা মাত্র ১১ শতক। দ্রুত এর পরিমাণ কমছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯২০ লাখ হেক্টর। ১৯৯৬ সালে তা ৮২ লাখ, ২০০৮ সালে ৭৭ লাখ এবং ২০১৯ সালে তা ৭৫ লাখ হেক্টরে হ্রাস পায়। শতকরা হিসেবে আবাদি জমি হ্রাসের গড় হার ছিল ১৯৮৪ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ০.৯৭ শতাংশ, ১৯৯৬ থেকে ২০৮ সাল পর্যন্ত ০.৭৪ শতাংশ এবং ২০০৮ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ০.২১ শতাংশ। ১৯৮০ সালে কৃষি জমির পরিমাণ ছিল মোট জমির ৬৫.৬৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা ৫৯.২৮ শতাংশে হ্রাস পায়। এভাবে কৃষিজমি হ্রাসের প্রধান কারণ হলো- শিল্পায়ন, নগরায়ন, নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ, নতুন বসতবাড়ি স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, ইটভাটা স্থাপন, নদীভাঙন ইত্যাদি। সম্প্রতি জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের ফলে জমি হ্রাসের প্রবণতা কিছুটা কমে আসছে। কিন্তু তা এখনো উদ্বেগজনক ও বিপদাশঙ্কাপূর্ণ। আগামীতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কৃষিজমি অন্য খাতে ব্যবহারের সুযোগ সীমিত করতে হবে। বিশেষ করে তিন ও দোফসলি জমি কোনোক্রমেই অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করা যাবে না। এক ফসলি জমি অন্য খাতে ব্যবহার করতে হলেও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ বিষয়ে আইনপ্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা দরকার।
কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আর একটি বাধা হলো আবাদযোগ্য পতিত জমির আধিক্য। বর্তমানে এর পরিমাণ ৪ লাখ ৫২ হাজার ৪৩০ হেক্টর। মোট আবাদযোগ্য জমির ৫.১৩ শতাংশ হচ্ছে পতিত জমি। দেশের বিভিন্ন চিনিকল, পাটকল, বস্ত্রকল ও রেল বিভাগে চাষযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ বেশি। তা ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মচর্চা কেন্দ্র, সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনস্থল এবং ব্যক্তিগত ঘরবাড়ি ও শিল্প-কারখানার চারপাশেও অনেক আবাদযোগ্য জমি পতিত অবস্থায় পড়ে আছে। সরকারি বা বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য যে পরিমাণ জমি দখলে নেওয়া হয় তার বেশির ভাগই স্থাপনা নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হয় না। বাকি জমি ফেলে রাখা হয় খালি। ঢাকা মহানগরের চারপাশে আবাসন কোম্পানিগুলোর অসংখ্য সাইনবোর্ড দেখা যায়। তার চারপাশে পতিত ফেলে রাখা হয়েছে শত শত একর আবাদি জমি। ঢাকার বাইরেও চোখে পড়ে এমন অনেক দৃশ্য। অপেক্ষাকৃত উঁচু, নিচু ও সমস্যাসংকুল অঞ্চলে আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ বেশি। এরূপ জমি অপচয়ের শীর্ষে অবস্থানকারী জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে বান্দরবান, সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, সিলেট, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ। সম্প্রতি কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির কারণেও চাষের আওতাভুক্ত কিছু জমি পতিত ফেলে রেখেছেন অনেক কৃষক। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণেও অনেক সময় কৃষকরা চাষাবাদে অনীহা পোষণ করেন। তাতে ফসলের উৎপাদন হয় কম। এমতাবস্থায় সব পতিত জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে শস্য বহুধাকরণ, স্বল্প সময়ের শস্য আবাদ, শস্যক্রমের বিন্যাস পরিবর্তন। হাওরাঞ্চলের জন্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন ফল, কাজুবাদাম ও কফি চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। বছরের বিভিন্ন সময়ে মাঠের জমি যাতে অনাবাদি না থাকে সে বিষয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা দরকার। প্রয়োজনে কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জমি পতিত রাখার জন্য কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হয় (সেট এ সাইড পলিসি)। তাতে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ হ্রাস পায় এবং বিশ্ববাজারে কৃষি পণ্যের মূল্য পতন ঠেকানো যায়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো খাদ্য নিরাপত্তা সংকটে থাকা একটি দেশে পতিত জমি আবাদের জন্য কৃষকদের সহায়তা দেওয়া হবে খুবই যুক্তিসঙ্গত।
চাষযোগ্য মাটির গুনাগুন হ্রাস কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আর একটি বড় অন্তরায়। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার জমি অনুর্বর হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের মোট জমির শতকরা ৭৬.২ ভাগ এখন মোটামুটি অনুর্বর। এর পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০০ সালে ১.০৭ কোটি হেক্টর জমি উর্বরতা হারিয়েছে বলে ধারণা করা হতো। বর্তমানে তা ১.১২৪ কোটি হেক্টরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে হুমকি। এর কারণ বহুবিধ। তন্মধ্যে জমিতে অতিরিক্ত পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ, চিংড়ি চাষের জন্য মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বৃক্ষ নিধন ও বনভূমি উজাড় করা এবং জমিতে শিল্প ও ওষুধ বর্জ্য ফেলা অন্যতম। জমি গুণমান হারানোর ফলে শস্যের পুষ্টিমান হ্রাস পায় এবং বন্যা ও খরায় তা ফসল উৎপাদনের জন্য ঘাতোপযোগিতা হারায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিকার হিসেবে জমিতে ফসল চক্রের পরিবর্তন, জৈব সার প্রয়োগ, শিল্প বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকা, বনভূমির গাছ কাটা থেকে নিবৃত হওয়া এবং ফসলি জমিতে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণে নিরোৎসাহিত করা দরকার। তাছাড়া তামাক চাষ সম্প্রসারণ লাভজনক হলেও পরিবেশ ও মাটির গুনাগুন সংরক্ষণের জন্য তা পরিহার করা উচিত।
বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে খুবই সংবেদনশীল। এর প্রভাবে বন্যা ও খরার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বেড়ে যায়। উপকূল এলাকায় জলমগ্নতা ও লবণাক্ততার সম্প্রসারণ ঘটে। নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায় অনেক কৃষিজমি। সম্প্রতি বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা প্রায় দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। তাতে মরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে এবং পানির স্তর নিচে নেমে গিয়েছে। বিঘ্নিত হয়েছে পানি সেচ। উপযুক্ত অভিযোজন কর্মসূচি বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে লাগসই কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনে যত্নবান হওয়া দরকার। ইতোমধ্যেই বন্যা, খরা, জলমগ্নতা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু বেশ কিছু ফসলের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। এগুলোর ক্রমাগত উন্নয়ন সাধন ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়ানো আবশ্যক। তাছাড়া জমির ফসলক্রম পরিবর্তন এবং শস্য বহির্ভূত কৃষি খাতের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। কৃষি বিমা চালু করতে হবে।
আমাদের দেশে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্যের অপচয়। এটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বড় বাঁধা। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি বা ইউনেপের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গড়ে একজন ব্যক্তি বছরে ৮২ কেজি খাবার অপচয় করছেন। খাদ্য অপচয়ের এ পরিমাণ ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট-২০২৪ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি বছরে গড়ে ভারতে ৫৫ কেজি, যুক্তরাজ্যে ৭৬, যুক্তরাষ্ট্রে ৭৩ এবং রাশিয়ায় ৩৩ কেজি খাবার অপচয় করছেন। ২০১৯ সালের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ২০২১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী একজন বাংলাদেশি বছরে ৬৫ কেজি খাদ্য নষ্ট করেছিলেন। তাতে বাংলাদেশে খাদ্য অপচয়ের প্রবণতা বছরের পর বছর বেড়েছে বলে প্রতীয়মান। অনুরূপ খাদ্য অপচয় মাঠপর্যায়ে ফসল উৎপাদন থেকে বিপণন ও গ্রাহকপর্যায়ে পৌঁছা পর্যন্ত এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, পরিবেশন ও খাবার টেবিল পর্যন্ত বিস্তৃত। দানাদার শস্যের ক্ষেত্রে অপচয় কম। ফলমূলের ক্ষেত্রে অপচয়ের পরিমাণ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ এবং মাছের ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ। কারণ এগুলো দ্রুত পচনশীল। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে অপচয়ের পরিমাণ ৩০ শতাংশ এবং আলুতে ২০ শতাংশ। বাসা-বাড়িতে এবং হোটেল রেস্টুরেন্টে অপচয় হয় অনেক বেশি খাবার। কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে খাদ্যের অপচয়ের পরিমাণ ৫ থেকে ১৩ শতাংশ। রেস্টুরেন্টে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ অপচয় হয়। নিম্ন থেকে উচ্চ আয়ের মানুষের অপচয়ের মাত্রা বেশি। আগের রিপোর্ট অনুযায়ী ফসলের মাঠ থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত প্রতিবছর বাংলাদেশে ৩৭ লাখ টনের বেশি খাবার নষ্ট হয়। অন্যদিকে বাড়িতে এবং হোটেল রেস্টুরেন্টের টেবিলে খাবার অপচয়ের বার্ষিক পরিমাণ দাঁড়ায় ১.০৭ কোটি টন। সর্বসাকুল্যে বার্ষিক অপচয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৪৪ লাখ টন, যা দিয়ে বাংলাদেশের সব মানুষকে ৩ মাস খাওয়ানো সম্ভব। এ অপচয় রোধ করা সম্ভব হলে খাদ্যশস্য আমদানির কোনো প্রয়োজন হতো না। বাংলাদেশে উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে যখন গরিব ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে তখন অতিমাত্রায় খাদ্য অপচয় মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অতএব, এখনই তা রোধ করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার জনসচেতনতা সৃষ্টি, ফসল কর্তন ও সংরক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়ন, ইঁদুরের উপদ্রব হ্রাস, খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবেশনে ভালো প্রশিক্ষণ প্রদান। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর একটি হলো কৃষি উৎপাদনে টেকসই তা বাড়িয়ে ২০৩০-এর মধ্যে খাদ্য অপচয় অর্ধেক কমিয়ে আনা। এ লক্ষ্যে সরকার ও জনগণকে একযোগে কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত।
কৃষি উপকরণ যোগানে আমদানি নির্ভরতা আমাদের আর একটি বড় সমস্যা। এক সময় দেশের মোট প্রয়োজনের প্রায় ৭০ শতাংশ রাসায়নিক সারের চাহিদা দেশের উৎপাদন থেকেই মেটানো হতো। এখন তা নেমে এসেছে ২০ শতাংশেরও নিচে। দেশের ৫টি সার কারখানার মধ্যে মাত্র একটি এখন চালু আছে। বাকি ৪টি গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ সার মজুত আছে তাতে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে। এরপর শুরু হবে রবিশস্যের আবাদ ও বোরো ধানের চাষ। ইতোমধ্যে আমন ধানের উপরি প্রয়োগ করতে যত পরিমাণ সারের প্রয়োজন শেষকালে তারও কিছুটা ঘাটতি হতে পারে। রবি ও বোরো ফসলের জন্য লাগবে প্রায় ৪০ লাখ টন সার। এদিকে ডলার সংকটের কারণে সার আমদানির জন্য এলসি খোলা প্রায় বন্ধ রয়েছে। বকেয়া পরিশোধে অপারগতার কারণে বেসরকারি আমদানিকারকরা সার আনতে পারছে না বিদেশ থেকে। এমতাবস্থায় বিশেষ বিবেচনায় সার আমদানির ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার। তারও বেশি দরকার দেশের বন্ধ সার কারখানাগুলো চালু করা। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত প্রতি টন ইউরিয়া সারের খরচ দাঁড়ায় ৩২ থেকে ৩৩ হাজার টাকা। এর আমদানি খরচ দাঁড়ায় প্রতি টন ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। সুতরাং রাসায়নিক সার দেশে উৎপাদন করা অনেক বেশি লাভজনক। পানি সেচ ও মাটি কর্ষণের যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এসব যন্ত্রের উৎপাদন বাংলাদেশেই হতে পারে। প্রয়োজনে বিদেশের সঙ্গে সমঝোতা করে যন্ত্রপাতি উৎপাদনের কারখানা স্থাপনে তাদের সহযোগিতার নেওয়া যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।
আমাদের কৃষি পণ্যের বাজার অদক্ষ। এখানে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহযোগিতাই বেশি, প্রতিযোগিতা কম। সে কারণে বাজারে পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও মূল্য থাকে চড়া। ব্যবসায়ীদের অশুভ আঁতাত এর জন্য দায়ী। তাতে কম আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টভোগ করেন। তাদের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ঠকেন কৃষকরা। বাজার শৃঙ্খলের এই দুই প্রান্তে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য বাজার দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নিরন্তর কাজ করে যাওয়া উচিত।
লেখক: পরিচালক, ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকস এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ
বিংশ শতাব্দীর ২০ থেকে ৭০ দশক পর্যন্ত রাজনীতিতে ছিল দেশাত্মবোধের অনন্য জাগরণ। সাধারণ জনগণের সঙ্গে রাজনীতিকদের সম্পর্ক ছিল সমান্তরাল। ৪৭-এর দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে নানা ইস্যুতে দূরত্বের দানা বাঁধতে শুরু করে। তখন দুই পাকিস্তানের মধ্যে যে বিষয়টি নিয়ে বৈষম্যের বিষবাষ্প ছড়ায়, তার প্রধান এবং প্রথম কারণ ছিল ভাষার দূরত্ব। একে তো পশ্চিম পাকিস্তানিরা সরকারের সব প্রশাসনিক দপ্তর ছিল তাদের কবজায়; তার ওপর উর্দু ভাষাভাষি পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে বাংলা ভাষাভাষি পূর্ববঙ্গের জনগণ (বর্তমান বাংলাদেশ) সরকারি-বেসরকারি চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়। অতকিছুর পরেও উদার মানবিক সৃষ্টিশীল প্রজ্ঞাবান চেতনার অধিকারী বাঙালির গুটিকয়েক রাজনীতিকরা সুদূরপ্রসারী চিন্তার গুণে সৃষ্টি হয় ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যূত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার মুক্তিযুদ্ধ। তখন রাজনীতি ছিল অনেকটা স্বচ্ছ এবং রাজনীতিকরা ছিলেন একেকজন সম্মানের অধিকারী। জনগণের জন্য ছিল সেবার সর্বোচ্চ মানসিকতা। সেই রাজনীতির নীতি-আদর্শ এখন নির্বাসিত! রাজনীতিতে এখন সম্মানীদের চেয়ে অসম্মানীদের কদর ছিল বেশি। নীতিহীন ধূর্ত কপট মানুষরা হয়ে ওঠে রাজনীতির চালিকাশক্তি! যে যত বেশি অপকর্ম করতে পারে তার কদর হয় তোলা তোলা। অপরাজনীতির ছলাকলা দেখতে দেখতে দেশের মানুষের মতো আমি নিজেও ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি। রাজনীতি হয়ে ওঠেছে অনেকের কাছে খেতের ফসলের মতো; সেবার পরিবর্তে পকেট মোটাতাজা করার প্রধান ক্ষেত্র। পেশিশক্তি আর পুঁজিবাদীদের দৌরাত্ম্য। রাজনীতির গডফাদার খ্যাতদের নজরে কোনো রকমে একবার নিজেকে উন্মোচন করতে পারলে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না।
বিশ্বরাজনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতির কোনো মিল নেই। বিশ্বরাজনীতি এগিয়ে যায় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে আর আমাদের দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয় অস্ত্রবাজ, টেন্ডারবাজ, মাদক কারবারি, গুণ্ডা, ঘাড়-মোটাদের এবং যারা নেতাকে অর্থবিত্তসহ বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে তুষ্ট করতে পারা হোমরা-চোমরাদের নিয়ে। আমাদের দেশের রাজনীতি হয়ে উঠেছে পরিবার কেন্দ্রিক। এ ধারা বিস্তৃতি ঘটেছে কেন্দ্র থেকে মফস্বলে পর্যন্ত। যে ব্যক্তি এমপি, মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বার হয়, সে প্রতিবারই হতেই থাকে। পাঁচ বছর মেয়াদের সময়ে একেকজন ৮ বার পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হওয়ারও রেকর্ড আছে। একজন লোক যদি ৮ বার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় তার মেয়াদকাল দাঁড়ায় ৪০ বছর। এই ৪০ বছর একজন ব্যক্তি শাসন করার ফলে এলাকায় জারি হয় এক অঘোষিত একনায়কতন্ত্র। এতে করে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে পারে না। মেধাবী দেশপ্রেমিক জনগণ বঞ্চিত হয় অধিকার থেকে। এর ফলে অনেকের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ, অশ্রদ্ধা জন্ম নেয়। কোনো রকমে একবার সরকারি জনপ্রতিনিধির খাতায় নাম লেখাতে পারলে তাকে আর ঠেকানোর উপায় থাকে না। ভাব দেখায় এলাকাটা যেন তার লিজ নেওয়া। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের পর থেকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের এমন হাল অবস্থা দেখতে দেখতে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনে ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে। ছলে-বলে, কৌশলে কিংবা অপকৌশলে একবার ক্ষমতায় আরোহণ করতে পারলে জনগণ হয়ে যায় তাদের কাছে ছক্কার ঘুঁটি। শাসকরা মনে করতে থাকেন দেশের সব মানুষ তাদের হাতের পুতুল ‘যেমন করে নাচাবে, তেমনি নাচবে’। সোজাকথা কোনো সরকারই জনগণের স্বার্থের পক্ষে ছিলেন না। তাদের কর্মকাণ্ড ছিল সীমাহীন জনবিরোধী। সাধারণ জনগণকে শাসক ও তাদের সমর্থনপুষ্ট নেতা-কর্মীরা নানাভাবে শোষণ করে। এখন সময় এসেছে এ জাতীয় রাজনীতিক ও তাদের দোসরদের প্রত্যাখ্যাত করার।
রাজনীতিতে এখন নতুন উদ্যোম শুরু হয়েছে। দেশের মেধাবী ছাত্ররাই এর মূল উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে অনেকের মনে নতুন আশা সঞ্চারিত হয়েছে। বিশ্বরাজনীতির গতি-প্রকৃতির আদলে গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, উন্নত জীবনের ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি ব্যর্থ হয় তাহলে এই বাংলাদেশের অদূর ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন! শেখ হাসিনার সরকারকে পতন করার মধ্যে দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরাসরি দুজন তরুণ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হয়ে দেশের রাজনীতিক অঙ্গনে নবধারা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। এ ছাড়া ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে যুক্ত হয়েও বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এই ব্যাপারটি বাংলাদেশ শুধু নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বলা যায় একটি নতুন মডেল। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় গিয়ে ছাত্র, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়ের মধ্যে দিয়ে তৃণমূলের আশা-আকাঙ্ক্ষা জানা ও বুঝার চেষ্টা করছে। যা রাজনীতিক অঙ্গনে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হবে।
দেশে পরিশুদ্ধ রাজনীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এখন খুব জরুরি। রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে প্রথমে রাজনীতিক, রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংস্কার প্রয়োজন। মানুষকে শুদ্ধতার পাঠ নিতে হবে, রাজনীতিতে শুদ্ধতার চর্চা শুরু করতে হবে। পেশিশক্তি পরিহার করতে হবে। এ কথা সত্য যে, রাজনীতির মধ্যে দুর্বৃত্তায়নগোষ্ঠী বাসা বেঁধেছে। গুণী রাজনীতিকদের স্থলে চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের অনেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে দেশকে নষ্টদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। যেকোনো প্রকারে রাজনীতি থেকে দুর্বৃত্তায়ন ও পুঁজিবাদীগোষ্ঠীকে উৎখাত করে সুস্থ ধারার রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে।
ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেধাবী তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিকরা এমপি নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হওয়ার মতো গৌরব অর্জন করেছে। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের দেশের মেধাবী তরুণ প্রজন্মদের গড়ে তুলতে সেরকম কোনো পদ্ধতি বা পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। আমি মনে করি, আমাদের তরুণ প্রজন্মের সন্তানরা অন্যান্য দেশে যেহেতু তাদের কর্মদক্ষতা দেখাতে পারছে এখানেও পারবে। তরুণদের নতুন নতুন চিন্তাশক্তি কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
নিত্যদিনের সকালের কাজ হিসেবে প্রত্যহ প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে থাকি। আসলে এই ভ্রমণ আমার জীবনের সঙ্গে অপরিহার্য নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে যে কথাটি উঠে আসে, তা হলো চিকিৎসা বিজ্ঞানমতে প্রাতঃভ্রমণে দেহ মন সজীব পূর্বক কর্মক্ষম করে তোলে। আর এটাই স্বাভাবিক কথা। কিন্তু আমি মনে করি যে এর সঙ্গে আরও একটি বিশেষ দিক সংযোজিত আছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, ভ্রমণের প্রাক্কালে আশপাশের অনেক কিছু দেখি, যা এমনভাবে ঢেউ খেলে যায়, তাতে হৃদয় আঙিনা আলোড়িত করে তোলে বিধায় এগুলো না প্রকাশ করা পর্যন্ত ঘূর্ণিপাকের মতো মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। কোনো সময় কিছু ঘটনা দেখে দুঃখ লাগে। আবার কোনো সময় হাসির উদ্রেক করে থাকে এবং কোনো সময় শিক্ষণীয় অনেক কিছু চোখে পড়ে। এদিকে মনুষ্য চিরায়ত বৈশিষ্ট্য হলো, বুদ্ধিমান জীব হিসেবে ‘জানতেও চায় এবং জানাতেও চায়’। আর এ সারথি ধরে আমিও ব্যতিক্রম নই। যা হোক, সেই রকম একটি ঘটনার কথা বলছি। আমার বাসা ফার্মগেটের অনতিদূরে মোস্তফা রোডে, যেখানে রাস্তার দুপাশে বেশ কটি মহিলা হোস্টেলে শত শত ছাত্রীদের আনাগোনা। ভোরে বাসা থেকে বের হতেই যা প্রথমে চোখে পড়ে, তা হলো একটি কিংবা দুটি মিনি ট্রাক এবং এতে হোস্টেলের সব বাসি খাবার ভর্তি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদে জেনেছি যে এগুলো জিনজিরায় নিয়ে যাওয়া হবে এবং মাগুর মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। শুনে তো মাথায় হাত; এত খাবার নষ্ট হচ্ছে? এ দিয়ে তো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দুঃখী মানুষের রাতের খাবার দিব্যি হয়ে যেত। যা হোক, এরপর থেকে প্রত্যহ সকালে ট্রাকে বাসি খাবার বোঝাই করতে দেখি। তাই এখন কোনো প্রশ্ন করা নিষ্প্রয়োজন বলে মনে করি। অবশ্য একটি তথ্য আমার মাথায় ছিল, বাংলাদেশসহ এই বিশ্বে প্রতি বছর ১০০ কোটি টনেরও বেশি খাবার নষ্ট তথা অপচয় হয়। যা হোক, যেহেতু আমি একজন লেখক। সেহেতু ভাবলাম, এ নিয়ে লিখলে মন্দ হয় না। দেশের লোক জানুক, কীভাবে অপচয় হচ্ছে? তাই কাগজ-কলম হাতে তুলে নিই।
সাধারণত আমরা বাংলাদেশিরা তুলনামূলক অধিক অপব্যয় করে থাকি। তবে আরব বিশ্বেও কম নয়। জাপানি ও ইংরেজরাও বেশ মিতব্যয়ী। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কথা যদি বলি, তাতে মিতব্যয়িতার বেশ আভাস মেলে। যেমন- যদি একটি পরিবারে পাঁচজন লোক থাকে। তাহলে তারা বাজার থেকে ছয় টুকরা মাছ কেনে। পুরা মাছ কেনে না। এ ক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয় পুরা মাছ প্রয়োজনাতিরিক্ত হিসেবে অপচয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে তারা মনে করে থাকে। অবশ্য বাংলাদেশিরা এ বিষয়টি নিয়ে অনেক ঠাট্টা-তামাসা করে থাকে। এদিকে সঙ্গত কারণেই আমার চোখে দেখা বাংলাদেশের গ্রাম্য জনপদে দু-একটি ঘটনা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছি। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, কোনো ব্যক্তি মেয়েকে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছে বলে তার প্রতিবেশীর মর্যাদা সমুন্নত রাখতে তার মেয়েকেও জমি বিক্রি করে সেভাবে বিয়ে দিয়ে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে টাকা দিয়ে সেই জমি ফিরিয়ে নিতে বা অন্যত্র সে পরিমাণ জমি কিনতে সক্ষম হয়নি। একই ভাবে ছেলেকে জমি বিক্রি করে বিদেশে পাঠিয়েছে। অথচ ছেলে প্রবাসে পরিশ্রম করে টাকা কামিয়ে দেশে এসে অযথা খরচ করে বলে সেই জমি আর উদ্ধার করতে পারেনি। এ ধরনের ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। আসলে আমরা অধিকাংশ বাংলাদেশিরা অযথা খরচ করে আলগা ফুটানি দেখাই; যার কোনো বাস্তবসম্মত ভিত্তি নেই। আমি এ ব্যাপারে কিছু খণ্ড চিত্রের ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা জানি। সে পরিবারের একমাত্র ছেলেসন্তান। তাই তার আবদারের শেষ নেই। বিগত পবিত্র রমজানের ঈদে বন্ধু-বান্ধবের দেখাদেখি ছেলে জিদ ধরেছে, সে বসুন্ধরা মার্কেট থেকে পাঞ্জাবি কিনবে। বাবা-মা তাদের টানাটানি সংসারের আর্থিক অবস্থা নিয়ে কথা বললেও, তা সে কর্ণপাত করে না। দেখা গেল ছেলেটি যে পাঞ্জাবি বসুন্ধরা মার্কেট থেকে ১৮০০ টাকায় কিনেছে, তা খোলা মার্কেটে মাত্র ৬০০ টাকা। এ তো গেল একদিক। অন্যদিকে গত কোরবানি ঈদে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দেখেছি। তাদের কাছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ত্যাগের কোনো বালাই নেই। তারা লোক দেখানোর নামে আট/দশ লাখ টাকায় কোরবানি গরু কেনে, তা আবার ফেসবুকে নিজেদের নাম ফলাও করছেন। যেহেতু প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করাই অপচয়, সেহেতু সব ধরনের বিলাসিতাই অপচয়। এ ছাড়া শখও অপচয়ের কারণ হতে পারে।
আমি পূর্বেই বলেছি, বিভিন্ন ক্ষেত্র ধরে অপচয় নিয়ে যদি লিখি, তা হলে প্রবন্ধের কলেবর বই হয়ে দাঁড়াবে, যা এই আর্টিকেলে সঙ্গত কারণেই সম্ভব নয়। যা হোক, বাংলাদেশের খাদ্যের অপচয় নিয়ে একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় গত ৩১/০৩/২০২৪ তারিখে একটি প্রতিবেদন দেখেছিলাম, যার অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে বিশ্বে ২০২২ সালে বাসাবাড়ি, খাদ্য সেবা ও খুচরা পর্যায়ে ১০০ কোটি টনের বেশি খাবার অপচয় হয়েছে, যা মোট খাদ্যের প্রায় ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশে গড়ে এক ব্যক্তি বছরে ৮২ কেজি খাবার অপচয় করছেন। অপচয়ের এ প্রবণতা ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ৬০ শতাংশ খাদ্য অপচয় হয়েছে বাসাবাড়িতে। ওই বছর প্রতিদিন বিশ্বে ১০০ কোটি মানুষের একবারের খাবার নষ্ট করা হয়েছে, যেখানে ৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ খাদ্যাভাবে ছিলেন। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি বা ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট-২০২৪ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন সম্প্রতি ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে প্রকাশ হয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বাসাবাড়িতে বছরে গড়ে একজন ভারতীয় ৫৫ কেজি, ব্রিটিশ ৭৬ কেজি, মার্কিনি ৭৩ কেজি ও রুশ ৩৩ কেজি খাবার অপচয় করেন। তবে এ হিসাবে খাবারের সবচেয়ে বেশি অপচয় হয় মালদ্বীপে; সেখানে এক ব্যক্তি বছরে ২০৭ কেজি খাবার অপচয় করেন। আর সবচেয়ে কম হয় মঙ্গোলিয়ায়- ১৮ কেজি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান খাদ্য অপচয় নিয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং ঢাকায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে উচ্চ আয়ের পরিবারগুলোতে বেশি খাদ্য নষ্ট বা অপচয় হয়। এ ব্যাপারে গবেষকরা বলছেন, সাধারণভাবে খাবার সম্পূর্ণ না খেয়ে ফেলা দেওয়াটাই খাদ্য অপচয়। উৎপাদন বা আহরণের পর সে পরিমাণ খাদ্য গ্রাহক পর্যায়ে না পৌঁছানোটাও অপচয়ের আওতায় পড়ে। এ ছাড়া যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে খাবার নষ্ট হলে সেটাও অপচয় বলে ধরে নেওয়া হয়। এ প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, কমিউনিটি সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৫-১৩ শতাংশ খাবার নষ্ট বা অপচয় হয়। বাসাবাড়ি ও হোটেল-রেস্টুরেন্টে অনেক খাবার নষ্ট হয়। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ধনাঢ্যদের বাসায় একজন ব্যক্তি সপ্তাহে দুই কেজির বেশি খাবার অপচয় করেন। এ ছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্ডার দেওয়া ও সব খাবার একটু চেখে দেখার প্রবণতাই রেস্তোরাঁগুলোতে খাবার অপচয়ের বড় কারণ। মূলত এসব কারণেই যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে খাদ্য বেশি অপচয় হয় বলে ধারণা গবেষকদের। দুঃখের বিষয় হলো যে বাংলাদেশে খাদ্য অপচয়ের বিষয়টি দেখার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। আর এর পেছনে যে নেতিবাচক বিষয়াদি পরিলক্ষিত হয়, তা হলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত রান্না; প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত কিনে তা ব্যবহার না করতে পারা এবং যথাযথভাবে সংরক্ষণের অভাব। মূলত খাদ্য নষ্ট হয় খাদ্য চক্রের (ঋড়ড়ফ ঠধষঁব ঈযধরহ) প্রথম দিকে। আর এই চক্রের শেষের দিকেও কম নয়। এদিকে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মৌসুমী ফল-ফলাদি ও সবজি নষ্ট হয়, যার পরিমাণ প্রায় ১৭ থেকে ৩২ শতাংশ।
কথায় বলে, ‘আয় করা সহজ; কিন্তু সঠিকভাবে ব্যয় করা কঠিন’। কেননা এর পেছনে থাকে পরিস্থিতি ও ভাবাবেগ। বস্তুত জীবনধারণের জন্য অর্থ উপার্জন করা এবং সম্পদ ভোগ করার সুযোগ বা অনুমতি ও নির্দেশ প্রত্যেক ধর্ম ও ছোট-বড় ২৭টি সভ্যতায় মোটামুটিভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অন্যকোনো ধর্ম বা সভ্যতায় ইসলামের মতো আয়-ব্যয়কে নিয়ম-নীতির আদলে আবদ্ধ করা হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে ইসলামে একদিকে যেমন হালাল উপায়ে অর্থ উপার্জনের নির্দেশ রয়েছে; অন্যদিকে তেমনই উপার্জিত অর্থ-সম্পদ বৈধ পথে ব্যয় করারও জোরাল নির্দেশ দিয়েছে। মূলত ইসলাম মানুষকে বিভিন্নভাবে অপচয় ও অপব্যয় করতে নিষেধ করেছে। কেননা অপচয়ের কারণে দরিদ্র্যের কবলে পড়ে; হারাম উপার্জনে উদ্বুদ্ধ করে ও পাপের চর্চার পথ সৃষ্টি করে ইত্যাদি। উল্লেখ্য, মানবসমাজে অর্থ ও সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপচয় ও অপব্যয় বর্তমানে একটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অথচ ইসলাম এটিকে স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেছে। এদিকে পূর্বেই বলেছি, অপচয়ের প্রকারভেদের সীমা নেই। এই ধরুন, সবুজ তরুরাজি ধ্বংসের ফলে বহুমাত্রিক ক্ষতি হচ্ছে। গাছ কমে যাওয়ার ফলে বায়ুদূষণ বাড়ছে, বাড়ছে তাপমাত্রা। তা ছাড়া তরু-পল্লবের সঙ্গে বৃষ্টিপাতের সম্পর্ক রয়েছে। যেখানে সবুজ থাকে; সেখানে বায়োডারভারসি থাকে, অর্থাৎ গাছপালা থাকলে বিহঙ্গের আনাগোনা থাকে। আসলে সব মিলে সবুজ গাছ-পালা ধ্বংসের ফলে প্রকারান্তরে মনুষ্য জীবের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, তথাকথিত সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ঢাকা রাজধানীতে দেদার গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হিসেবে যেখানে গাছপালা ২৫% থাকার কথা, সেখানে আছে মাত্র ৮%। তথাপিও কাটা থেমে নেই।
পরিশেষে এই বলে সমাপ্তি টানছি, ব্যক্তি বা পরিবার বা সমাজ বা দেশ বা বিশ্বের সবার প্রতি এই মর্মে অনুরোধ করব, শুধু অর্থ বা খাদ্যদ্রব্য নয়, সর্বক্ষেত্রে অপচয় নামক ক্ষতিকর কার্যক্রম থেকে সর্বসময়ে শত হাত দূরে থাকব, তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের সবার জীবনে মঙ্গল বয়ে আসবে। অবস্থাভেদে অনেক সময় আমাদের আওতার মধ্যে না থাকলেও যতদূর সম্ভব, এই অনাহুত কার্যক্রমটির ব্যাপারে নিজেদের সংযত রাখব। আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, কোনো ব্যাপারে ব্যয় যেন স্বর্ণ বিন্দু ছেদ করে লাগাম ছাড়া হয়ে অপচয়ের রূপ না নেয়। এ ক্ষেত্রে আবেগ ও পরিস্থিতির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে নবী করিম (স.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে, সে কখনো দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত হয় না। এখন যে কথাটি বলব, তা অন্যভাবে নেবেন না। এটি ধ্রুবসত্য ও আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, মনুষ্য নিজ দেহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার বা অপচয় করা যাবে না। এখানে এই কথা দাঁড়ায় যে কাম্য ঘুম ও আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে দেহ-মনকে ক্ষতি করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদি প্রকৃতির দান এই মূল্যবান দেহ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন তথা অপচয় করেন, তাহলে তো বুঝতেই পারছেন, দুপুর না হতেই তিমিরাচ্ছন্ন সন্ধ্যা।
লেখক: বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
ব্রিটিশ কাউন্সিল শ্রীলঙ্কা এবং শ্রীলঙ্কান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ আয়োজনে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হলো শিক্ষা ও ইংরেজি ভাষা উন্নয়নবিষয়ক সেমিনার। তাদের আমন্ত্রণে সেই সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছি। এ নিয়ে শ্রীলঙ্কায় আমার দ্বিতীয় ভ্রমণ, দুবারের উদ্দেশ্য প্রায় একই। শ্রীলঙ্কা শিক্ষা-দীক্ষায় যেহেতু আমাদের চেয়ে এগিয়ে তাই সেখানকার শিক্ষা নিয়ে কিছু কথা এখানে তুলে ধরছি। শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার বয়স্ক সাক্ষরতার হার ২০২১ সালে ছিল ১০০%। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা দেশের কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক পরিষদ উভয়েরই নিয়ন্ত্রণাধীন। কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ কিছু দায়িত্ব বহন করে এবং প্রাদেশিক পরিষদ অন্যগুলোর জন্য স্বায়ত্তশাসনের অধীনে দায়িত্বপ্রাপ্ত। শ্রীলঙ্কায় প্রথম শ্রেণি থেকে একদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক। তবে, প্রাক-প্রাথমিকে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয় এবং প্রাক-প্রাথমিকের ৮০ শতাংশ বিদ্যালয় রাষ্ট্র পরিচালিত নয়। এগুলোর ৭১ শতাংশ ব্যক্তি পর্যায়ে বা সংস্থা পরিচালিত, ৭ শতাংশ ধর্মীয় সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে আর ৩ শতাংশ এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) পরিচালিত। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক অর্থাৎ একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ৯০ শতাংশ বিদ্যালয়ই রাষ্ট্র পরিচালিত।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে দেশের সব বিদ্যালয় রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়, সামান্য কিছু প্রতিষ্ঠান যারা নিজেরাই বেসরকারি থেকে যায়। যারা প্রাইভেট বিদ্যালয় নামে পরিচিত। আশির দশকের প্রথমদিকে আন্তর্জাতিক স্কুল নামে আর এক ধরনের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিকমানের পরীক্ষা পরিচালনা করে থাকে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত নয়। শ্রীলঙ্কার প্রাইভেট স্কুল হচ্ছে তিন ধরনের। সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত প্রাইভেট স্কুল, সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত নয় এবং আন্তর্জাতিক স্কুল।সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত স্কুলগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন। এসব স্কুলে শিক্ষকদের বেতন রাষ্ট্র প্রদান করে থাকে। স্কুলে শিক্ষার্থীদের নামমাত্র একটা ফি প্রদান করতে হয়। এজাতীয় অধিকাংশ স্কুলই বোর্ড অব ম্যানেজমেন্ট দ্বারা পরিচালিত। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পুরোপুরি সুপারভিশন করে থাকে বিধায় প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন খুবই কম। প্রাইভেট বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে দ্বিতীয় ক্যাটগরির হচ্ছে যেসব স্কুল সরকার থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা নেয় না। তারা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নিয়ে চলে। তারা ভর্তি ফি এবং টিউশন ফি দুটোই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করে। এসব বিদ্যালয়ও একটি বোর্ড অব ম্যানেজমেন্ট দ্বারা পরিচালিত। স্কুলগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধনকৃত আর তাই সরকারি সুপারভিশন তাদের মানতে হয়। তবে এসব বিদ্যালয়ের ম্যানজেমেন্ট কমিটি প্রচুর স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। ১৯৭৭ সালে শ্রীলঙ্কায় উদার অর্থনৈতিক পলিসির গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্কুলের ধারণাটি চলে আসে এবং ১৯৭৮ সালে বিদেশি বিজনেসের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় খোলার জন্য নিবন্ধন করার অনুমতি প্রদান করা হয়। ২০০৭ সাল থেকে দেশীয় কোম্পানিগুলোকেও আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় খোলার অনুমতি প্রদান করা হয়। আন্তর্জাতিক স্কুলগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধনকৃত নয় আর তাই সরকারি সুপারভিশনও এখানে নেই। এই স্কুলগুলোর ম্যানেজমেন্ট কমিটিগুলো সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত, সহায়তাপ্রাপ্ত নয় এমন সব স্কুলের কমিটির চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে।
শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সরাসরি ‘জাতীয় বিদ্যালয়গুলো অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারি বিদ্যালয়গুলো যার সংখ্যা মোট বিদ্যালয় তিন শতাংশ, এগুলো অত্যন্ত রিসোর্সফুল। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা এগুলোতে রয়েছে। এর কিছুটা তুলনা চলে আমাদের সরকারি বিদ্যালয়ের সঙ্গে। আমাদের সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যাও কিন্তু ৩%। রাষ্ট্র পরিচালিত বিদ্যালয়ের বিশাল অংশই নিয়ন্ত্রণ করে প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এখানে নয়টি প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় রয়েছে। এগুলোর শিক্ষকরা যদিও প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বেতন পান কিন্তু বিদ্যালয়গুলো জাতীয় বিদ্যালয়গুলোর চেয়ে কম রিসোর্সফুল, কম সুবিধাপ্রাপ্ত। প্রাইভেট বিদ্যালয়গুলোতে স্থানীয় কারিকুলাম সিংহলী কিংবা তামিল অনুসরণ করা হয়। অথবা ইংরেজি কারিকুলাম অনুসরণ করা হয়। বর্তমানে ইংরেজি কারিকুলামের দিকেই বেশি অভিভাবক ও শিক্ষার্থী ঝুঁকছে এবং সরকারও ইংরেজি কারিকুলামের বিদ্যালয় সম্প্রসারণের কাজ ত্বরান্বিত করছে। অটোনোমাস স্কুল, সরকারি স্কুল, বেসরকারি স্কুল সব বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূলে বই, পোশাকসহ আরও কিছু সুবিধা রাষ্ট্র থেকে সরবরাহ করা হয়। ইন্টরন্যাশনাল স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়েই চলছে তার কারণ হচ্ছে এখানকার কারিকুলাম আন্তর্জাতিক এবং শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। এখানকার শিক্ষার্থীরা দেশে কিংবা বিদেশে উচ্চ শিক্ষা ও চাকরির জন্য বেশি সুবিধা পেয়ে থাকে। তাই এলিট অভিভাবক, ধনী অভিভাবক ছাড়াও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া কিন্তু সচেতন অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের আশায় ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পাঠিয়ে থাকেন যদিও এখানকার পড়াশোনার খরচ অনেক বেশি। বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় মোট শিক্ষার্থীরা ৩২ শতাংশই ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়াশোনা করছে।
শ্রীলঙ্কায় সরকারি স্কুলের শিক্ষক হতে হলে ন্যাশনাল কলেজ অব এডুকেশন (বিদ্যাপীঠ) থেকে তিন বছরের প্রি-সার্ভিস টিচার এডুকেশন-এর প্রি-সার্ভিস কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। আর সেখানে ভর্তি হতে জিসিই ( অ্যাডভান্সড লেভেল) পরীক্ষা এবং জিসিই অর্ডিনারি লেভেলের বিষয়গুলোতে পাস করে ন্যাশনাল কলেজেস অব এডুকেশনে ভর্তি হতে হয়। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাদেশিক কাউন্সিল তাদের জন্য শিক্ষকতা পেশা অফার করে থাকে। আন্তর্জাতিক বিদ্যালয়গুলোও শিক্ষকতা করা যায় গ্র্যাজুয়েশনের পর। প্রাইভেট বিদ্যালয়েও শিক্ষকতা পেশা শুরু করা যায়। সেখানে গ্রেড-৫ শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি পরীক্ষার ক্লাস, ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেলের ক্লাস পরিচালনা করতে হয়। তবে পড়ানোর বিষয়সমূহ, প্রশ্নপত্রের ধরন এবং পেশাগতভাবে শিক্ষাদান করার সঙ্গে ভালো পরিচিতি প্রয়োজন হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা পাস করেন শিক্ষক হওয়ার জন্য তাদের শিক্ষায় ডিপ্লোমা কোর্স অবশ্যই সম্পন্ন করতে হয়। আর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে শিক্ষায় ডিপ্লোমা নিয়ে যারা পাস করেন তারা সরাসরি টিচিং-এ ঢুকতে পারেন। তবে ওইসব শিক্ষকরা শুধু গ্রেড ওয়ান থেকে অর্ডিনারি লেভেল পর্যন্ত পড়াতে পারেন, তার ওপরে তাদের ক্লাস দেওয়া হয় না। অর্থাৎ অ্যাডভান্সড লেভেলে পড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করতে হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কায় শিক্ষক হতে হলে টিচার্স এডুকেশন প্রোগ্রাম সম্পন্ন করতে হয় একটি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে। সেটি হতে পারে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে শিক্ষায় ডিগ্রি নেওয়া কিংবা টিচার ট্রেইনিং সম্পন্ন করা। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক কিছু শর্তাবলিও পূরণ করতে হয়। যেমন নির্দিষ্ট কয়েকটি পরীক্ষায় পাস করা, টিচিং সার্টিফিকেট অর্জন করা, নির্দিষ্ট বয়স থাকা ইত্যাদি। আমাদের দেশে এনটিআরসিএ- কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগের পূর্বে যেভাবে শিক্ষক নিয়োগ হতো তাতে যে কেউ শিক্ষক হতে পারতেন সেই বিষয়টি শ্রীলঙ্কায় নেই এবং ছিল না।
শ্রীলঙ্কায় শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬০ বছর, তবে ইচ্ছে করলে ৫৫ থেকে ৬০ এর মধ্যেও তারা অবসরে যেতে পারেন। অবসরে যাওয়ার পর প্রাইভেট স্কুলে তারা আবার শিক্ষকতা শুরু করতে পারেন। মানসম্পন্ন শিক্ষক ও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের চাহিদা শ্রীলঙ্কা প্রচুর। আর তাই এটি স্বীকৃত, অবসরের পর তারা পুনরায় যেকোনো বেসরাকরি বিদ্যালয়ে চাকরি করতে পারেন। ইংরেজি শিক্ষক, বিজ্ঞান শিক্ষক, গণিত শিক্ষক ও আইসিটি শিক্ষকদের প্রচুর চাহিদা ও মূল্য রয়েছে শ্রীলঙ্কায় যেমনটি আমাদের দেশেও দেখা যায়। একজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষককে একাধিক স্কুলে কাজ করতে হয় কারণ বিষয় বিশেষজ্ঞ শিক্ষক সব স্কুলে থাকে না। এটি একটি চমৎকার সিস্টেম। একজন বিষয় বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের সার্ভিস বহু শিক্ষার্থী পেয়ে থাকেন, ওই শিক্ষকেরও ভালো লাগে কারণ হচ্ছে তার কাজের, পরিচিতির পরিধি হয় তখন বৃহত্তর। রাষ্ট্রীয় রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট অনুযায়ী খরচ কম হয়।
কোন দেশের শিক্ষকরাই গ্রাম ও পিছিয়ে পড়া এলাকায় যেতে চান না। শ্রীলঙ্কায়ও একই অবস্থা। গ্রামীণ এলাকায়, অনুন্নত এলাকায় শিক্ষকদের পোস্টিং দিলে তারা যাতে সেখানে যান এবং চাকরি ছেড়ে না দিয়ে শিক্ষকতায় থাকেন তাই শ্রীলঙ্কান সরকার ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে একটি পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছে। পিছিয়ে পড়া ও অনুন্নত এলাকার বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট এমনিতেই লেগে থাকে। তাই যেসব শিক্ষকদের ওইসব এলাকায় পোস্টিং দেওয়া হয় তাদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা সহজে লোন দেওয়া ও বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি শিক্ষকদের বাসস্থানের ব্যবস্থাও করা হয়, পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। যেমন- তাইওয়ানের ডাক্তার যারা গ্রামে চাকরি করেন তাদের বেতন দ্বিগুণ। এটি একটি চমৎকার পদ্ধতি।
অনেকের প্রশ্ন যে, শ্রীলঙ্কায় আমাদের দেশের মতো প্রাইভেট টিউশন আছে কি না। প্রচুর আছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ১৯৪৩ সাল থেকেই সেখানে প্রাইভেট টিউশনি চলে এসেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই টিউশনির হার শহরের চেয়ে গ্রাম এলাকায় বেশি। তার একটি কারণ হচ্ছে গ্রামীণ এলাকায় মানসম্মত শিক্ষক পাওয়া যায় কম। তাই শিক্ষার্থীদের ঘাটতি মেটানোর জন্য তাদের প্রাইভেট পড়তে হয়। আমি দেখেছি গ্রামে সন্ধ্যার পরও শিক্ষার্থীরা নিজেরা কিংবা বাবা-মার সঙ্গে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে বাসায় ফিরছে। প্রাইভেটের আর একটি কারণ হচ্ছে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রচুর পড়তে হয়। আর আমাদের এসএসসি ও এইচএসসির মতো তাদের ‘ও’ লেভেল ও ‘এ’ লেভেল নামক পাবলিক পরীক্ষায় ভালো করার জন্যও প্রচুর প্রাইভেট পড়তে হয়। সবশেষ কারণটি হচ্ছে শিক্ষকরা বাড়তি ইনকামের জন্য প্রাইভেট পড়িয়ে থাকেন এবং এটি একটি ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে। এটি স্বীকৃত। রাষ্ট্র পরিচালিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তারা তাদের বেতনভাতা নিয়ে খুশি। তাদের অনেক বেশি (দ্বিগুণ এমনকি তিনগুণ বেতনে) বেসরকারি বিদ্যালযে নিতে চায় কিন্তু তারা সেখানে অনেকে যান না তার একটি কারণ হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালিত বিদ্যালয়ের পেনশন সুবিধা। আমাদের দেশের মতো এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) সিস্টেম সেখানে নেই। এটি আমাদের দেশের বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য একটি অস্থায়ী পদ্ধতি যেটি সামরিক শাসকরা করে গিয়েছিলেন কুইক সমাধানের জন্য। এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয় অথচ এটিকেই আমরা স্থায়ী ব্যবস্থা ধরে নিয়েছি। কোনো শিক্ষক সংগঠন কিংবা আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এই অস্থায়ী পদ্ধতিটি নিয়ে তেমন কিছু বলছে না যা রহস্যজনক মনে হয়। বিএনপি আমলে একজন শিক্ষামন্ত্রী গর্ব করে বলেছিলেন, বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য যে চমৎকার পদ্ধতি আমাদের দেশে বিদ্যমান পৃথিবীর কোনো দেশে তা নেই। অস্থায়ী পদ্ধতি অন্য দেশে থাকবে কেন?
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
ব্যাংকিং খাত অর্থনীতির প্রাণ। দেশের আর্থিক খাত খুব একটা বড় নয়, পুঁজিবাজার দুর্বল, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাতও শক্তিশালী নয়; সে কারণে অর্থের ৯০ শতাংশই ব্যাংক খাত থেকে আসে। স্বাধীনতার পর দেশের উদ্যোক্তাশ্রেণি তৈরি করেছে এই ব্যাংক খাত। কিন্তু এই খাত ধীরে ধীরে দুর্বল হয়েছে। অর্থনীতিতে নতুন সরকারের নানা চ্যালেঞ্জ আছে। এগুলোকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছে। সরকার শক্ত হাতে এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে, অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরানোর বিষয়টি তার ওপর নির্ভর করছে। দেশের মানুষের নৈতিক মানের অবক্ষয় হয়েছে, মূল্যবোধও কমে গেছে। ব্যাংকিং খাতের লোকজনদের মধ্যে এটি প্রকট। খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ব্যাংকিং খাতে চার ধরনের সমস্যা আছে। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা। সেটা হলো ব্যাংকিং খাতের যেসব নীতিমালা আছে, সেগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করা হয় না। ক্যামেলস রেটিং অনুসারে ব্যাংকের স্বাস্থ্য পরিমাপের যেসব সূচক, যেমন মূলধন পর্যাপ্ততা, তারল্য, খেলাপি ঋণ, সম্পদ, ব্যবস্থাপনা, এসব ক্ষেত্রে নীতিমালা পরিপালিত হয় না। যদিও আলোচনা কেবল খেলাপি ঋণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ২০০৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা; ২০২৪ সালের জুন মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকায়। মূলধনের পর্যাপ্ততা আরেকটি বড় সমস্যা। আন্তর্জাতিক নীতিমালা বা ব্যাসেল অনুযায়ী যে পরিমাণ মূলধন থাকার কথা, তা কিন্তু সবাই মানতে পারে না। বিশেষ করে ১০-১২টি ব্যাংকের এই মূলধন অপর্যাপ্ততা আছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা। আইনে যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে তা অতটা পরিপালিত হয় না। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সেই স্বাধীনতা প্রয়োগ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। গভর্নর নীতিপরায়ণ হলে তার আয়ত্তের মধ্যে যতটুকু স্বাধীনতা প্রয়োগ করা সম্ভব, তিনি ততটুকু করতে পারেন। কিন্তু সেটা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক আইনে বলা আছে, সরকারের কোনো কর্মকর্তা গভর্নর বা ডেপুটি গভর্নর হতে পারবেন না; কিন্তু পরপর দুজন গভর্নর আমলাতন্ত্র থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর জন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হোক। সেই সঙ্গে পরবর্তী কোনো রাজনৈতিক সরকার যেন এর পুনরাবৃত্তি করতে না পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন টাস্কফোর্স করেছে, তারা এ লক্ষ্যে কাজ করবে বলে আশা করি। এ ছাড়া গত মে মাসে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করাসহ সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি দুই ধরনের হয়, এক ধরনের কোম্পানি দুর্বল ব্যাংকগুলোর সম্পদ অধিগ্রহণ করে এবং দুর্বল ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে যায়। আরেকটি হলো, দুর্বল ব্যাংকের সম্পদ কিনে পরবর্তীকালে ফেরত দেওয়া হয়। তখন শঙ্কা থেকে যায়, আবারও সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সে জন্য এই কাজে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নেওয়া যেতে পারে। আরেকটি বিষয় আইনগত। অর্থঋণ আদালতে অনেক মামলা পড়ে আছে। প্রয়োজনীয় বিচারক নেই বলে মামলার কার্যক্রম চলে না। আদালতের বাইরে যে এই সমস্যার সমাধান করা হবে, তার উদ্যোগও নেই। চতুর্থত, তথ্য প্রকাশ। ব্যাংকগুলো তথ্য প্রকাশ করে না; আগে এ বিষয়ে নজরদারিও করা হতো না। মামলা ও বিশেষ হিসাবে যে অর্থ আটকে আছে, সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকা হতে পারে। যথাযথ তথ্য না থাকলে যথাযথ নীতি প্রণয়ন করা যাবে না। সামগ্রিকভাবে গড়পড়তা তথ্য পাওয়া যায়, কিন্তু ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। যেসব তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক, ব্যাংকগুলো তা দেয় না। সেই সঙ্গে ঋণ শ্রেণিকরণ, পুনঃতফসিল, অবলোপন এসব নিয়মকানুন বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২২ সালে এসব নিয়মকানুন শিথিল করা হয়েছে। এতে কী ফল হয়েছে, তা আমরা জানি না; কিন্তু যা হয়েছে, তা হলো সমস্যার স্তূপ তৈরি হওয়া। এসব খাতে আমাদের সংস্কার দরকার। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সেই ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর একসময় অর্থনীতিবিদ হিসেবে যেসব কথা বলেছেন, এখন সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে অনেক ধরনের উদারনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতেও বিশেষ কাজ হয়নি; বরং এক ধরনের দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। আমরা দুর্বৃত্তায়নমুক্ত, সচল ও টেকসই ব্যাংকিং খাত দেখতে চাই। কিন্তু সমস্যা হলো, এই খাতে দীর্ঘদিন ধরে যে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে এখন তা দূর করতে হচ্ছে। স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ দরকার। স্বল্প মেয়াদে বা তাৎক্ষণিকভাবে অনেকটা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যথাযথভাবেই তা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতকে অর্থনীতির মূল নিয়ামক হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে টেকসই ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই। সে জন্য কাঠামোগত দুর্বলতা আমলে নিতে হবে। অর্থনীতি খারাপ হয়ে পড়লে সরকারের পতন হয়। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ, দুর্নীতি ও ভোটাধিকার হরণের কারণে সরকারের পতন হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে কিছু ভালো ব্যাংক দুর্বল হয়েছে। এক পরিবারের কাছে ৮-৯টি ব্যাংক তুলে দেওয়া হয়েছে। ৪-৫টি পরিবার ব্যাংক থেকে ২ লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। বিস্ফোরণোন্মুখ এই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করে যাচ্ছে। টাকা ছাপানো বন্ধ, সঙ্গে বন্ধ রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রিও। এই নীতি স্থিতিশীল হলে মূল্যস্ফীতি কমতে বাধ্য। এতে সবাই স্বস্তিতে থাকবে। ব্যাংক খাত সংস্কারে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে রাজনীতি ঠিক না হলে ব্যাংক খাতের সংস্কারগুলো টেকসই হবে না। সুতরাং সংস্কার উদ্যোগ টেকসই করতে হলে রাজনীতিতেও সংস্কার আনতে হবে।
বর্তমানে যে খেলাপি ঋণের কথা বলা হচ্ছে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে। পৃথিবীর এমন কোনো ব্যাংক নেই, যেখানে খেলাপি ঋণ নেই। ইচ্ছাকৃত খেলাপি খারাপ। যারা অনিচ্ছাকৃত খেলাপি, তাদের সহায়তা করতে হবে, আর যারা ইচ্ছাকৃত তাদের শাস্তি দেওয়া, জেলে নিতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। খেলাপি ঋণ বেশি হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঋণ থেকে। কারণ, এ ধরনের বাণিজ্যের সব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক সংগ্রহ করে না। এর সূত্রপাত হয় ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র থেকে। এই বাণিজ্যেই ৭০-৮০ শতাংশ জালিয়াতি ও অর্থ পাচার হয়। বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বেশি। ব্যাংকিং নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের আশপাশের দেশ ও অঞ্চলের চর্চাগুলোকে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন খাতের ভালো ও সফল উদ্যোক্তারা ব্যাংকের পরিচালনায় এসে আর ভালো কিছু করতে পারেন না। এর বড় কারণ রাজনৈতিক চাপ। এ ছাড়া বৈরী পরিবেশ ও নীতিও বড় কারণ। এমন একটি ব্যবস্থা করা দরকার, শুধু টাকা থাকলেই যে কেউ যাতে ব্যাংকের মালিকানায় চলে আসতে না পারে।
বিদায়ী সরকারের আমলে বাংলাদেশে অনেক ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও পর্ষদ সদস্য রাজনৈতিক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে কেউ কেউ এমন সুবিধা পেতেন যে সবাই সেই প্রতিযোগিতায় সক্ষম থাকতেন না। রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাওয়া একটি পরিবার আট-নয়টি ব্যাংকের মালিকানা পেয়েছে। সেটি কীভাবে সম্ভব? অথচ বলা হচ্ছে, ব্যাংকে একটি পরিবারের শেয়ার ১০ শতাংশের বেশি হতে পারব না। রাজনৈতিক কারণে কিছু ভালো ব্যাংক দুর্বল হয়েছে। কিছু ব্যাংকের উদ্দেশ্য ভালো ছিল, কিন্তু নানা কারণে দুর্বল হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকের পূর্বাবস্থা যাচাই-বাছাই করে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। একটু সহায়তা দিলে কিছু ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবেই। তাই ব্যাংক খাত সংস্কারে সময়ক্ষেপণ করা উচিত হবে না।
ব্যাংক খাতের ক্ষতির প্রভাব পড়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে। ১৫ বছর আগে ব্যাংক খাত যে অবস্থায় ছিল, ১৫ বছর পর এসে সেই অবস্থায় নেই। ব্যাংক চলেছে মুদিদোকানের মতো। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই পর্যন্ত ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সাহসী সিদ্ধান্তগুলোয় আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। অর্থনীতি খারাপ হয়ে পড়লে সরকারের পতন হয়। বাংলাদেশেও তা-ই হয়েছে। অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ, দুর্নীতি ও ভোটাধিকার হরণের কারণে সরকার পতন হয়েছে। বিস্ফোরণোন্মুখ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে চেষ্টা চলছে। আমরা ভাগ্যবান, বৈশ্বিক আর্থিক সংকটে আমাদের সমস্যা হয়নি। ৪-৫টি পরিবার ব্যাংক থেকে ২ লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এতে অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসতে পারত, সেটা হয়নি। ব্যাংক খাত রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। আমাদের আরও কিছুদিন কষ্ট করতে হবে। মানুষের মনে এক ধরনের ভীতি আছে। অনেকেই জানতে চান, কোন ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ? নতুন সরকার আসার পর মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হলেও অনিশ্চয়তার বোধ এখনো আছে। সে জন্য বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। রুগ্ণ ব্যাংক টিকিয়ে রাখা হলে ভালো ব্যাংকেও তার প্রভাব পড়ে। এই খাত মানুষের আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। গত এক দশকে করপোরেট সুশাসনের কাঠামোয় অনেক ক্ষতি করা হয়েছে। এ সময়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনে কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এ পরিবর্তন হয়েছে স্বজনতোষী ও ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়ার জন্য। অন্তর্বর্তী সরকার এ ক্ষেত্রে কতটা কাজ করতে পারবে, তা দেখার বিষয়; তবে সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আর্থিক খাতে সমস্যা কী, সেটা আমরা জানি। এ জন্য কমিশন না করেই কাজ শুরু করে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে, ইতোমধ্যে একটা গঠন করা হয়েছে। ১০-১১ ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যাংককে নিবিড়ভাবে তদারকি করা হচ্ছে। স্বস্তির বিষয়, এত কিছুর পরও এসব ব্যাংকে ৮০০ কোটি টাকা আমানত বেড়েছে। মানুষ এখন এসব ব্যাংকে টাকা জমা করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এসব ব্যাংককে কীভাবে সহায়তা দেওয়া যায়, তা দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংকের আমানতকারীরা ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছেন। এক বছর সময় দিলে এসব ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে। গ্রাহকরা অপ্রয়োজনে টাকা উত্তোলন করতে গেলে সমস্যা বাড়বে। দুর্বল ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা দেখে কত টাকার গ্যারান্টি সুবিধা পাবে, তা নির্ধারণ করা হচ্ছে। গ্যারান্টি দিলেও পুরো টাকা একবারে দেওয়া হবে না।
ব্যাংক খাত রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। মানুষের মনে এক ধরনের ভীতি আছে। অনেকেই জানতে চান, কোন ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ? নতুন সরকার আসার পর মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হলেও অনিশ্চয়তার বোধ এখনো আছে। সে জন্য বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। এ ছাড়া কোনো ব্যাংককে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, সেরকম পরিকল্পনা নেই। যত রুগ্ণই হোক, কোনো ব্যাংককে মরতে দেওয়া হবে না। সেটা হলে পরিষ্কার বার্তা দেওয়া দরকার; তা না থাকলেও পরিষ্কার বলে দেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে শক্তিশালী ব্যাংক কোনগুলো, তা বলা উচিত। রুগ্ণ ব্যাংক টিকিয়ে রাখা হলে ভালো ব্যাংকেও এর প্রভাব পড়ে। এ খাত মানুষের আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা ঋণ তৈরি হয়, অর্থাৎ পুরো বিষয়টি বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ভালো ব্যাংকও যেকোনো সময় ধসে যেতে পারে। সে জন্য সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে পরিষ্কার বার্তা থাকা উচিত, কোন ব্যাংকগুলো কী অবস্থায় আছে। ব্যাংক তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও দক্ষতা দেখাতে হবে। আইনকানুন পরিপালনে কাউকে ছাড় দিয়ে টিকিয়ে রাখার প্রথা তুলে নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিবেচনায় সব ব্যাংকের পরিচালকদের এক কাতারে রাখতে হবে। যখন যা সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, তা নিতে হবে। তাহলে এর সুফল পাবে দেশের অর্থনীতি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট
আবারও মিয়ানমার থেকে এক শ্রেণির দালাল চক্রের মাধ্যমে রাতের আঁধারে হাজার হাজার রোহিঙ্গা চোরাইপথে কৌশলে এবং পথে পথে টাকা-পয়সা দিয়ে বাংলাদেশে আসা অব্যাহত রেখেছে যা দেখার কেউ নেই। যদিও সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের কড়া নজরদারি থাকার পরও এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজারের ওপরে রোহিঙ্গা নাফ নদী পার হয়ে ঢুকে পড়েছে। আরও ৫০ হাজারের বেশি বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার অপেক্ষায় রয়েছে। বিজিবি ও কোস্টগার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইতোমধ্যে প্রতি রাতে যে হারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, তা রীতিমতো উদ্বেগের বিষয়। পুনরায় গণহারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনায় স্থানীয়রা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ ব্যাপারে বর্ডারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথেষ্ট অবহেলা ও উদাসীনতা কাজ করছে। রাতের অন্ধকারে রোহিঙ্গারা নৌকা নিয়ে নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে আর বিজিবি কোস্টগার্ড এদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে একের পর ব্যর্থতায় পরিচয় দিয়ে আসছে। বিষয়গুলো শুধু তদন্ত নয়, গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়ানো উচিত। দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে সেনা-নৌবাহিনীর মোবাইল টহল অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর এ পর্যন্ত এক লাখের অধিক রোহিঙ্গা নাফ নদী অতিক্রম করে রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশে বিনা বাধায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। এই রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ এখন অনেক নিরাপওা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে দালালদের পাকরাও বা তাদের দমনের ব্যাপারে বিজিবির কোনো উদ্যোগ নেই। সীমান্তে রোহিঙ্গাদের আগমন প্রতিরোধ করার জন্য বিজিবি ও কোস্টগার্ডের নজরদারি না বাড়ালে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে বিপদের মধ্যে পড়তে পারে নইলে এক সময় সাড়া বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের বিচরণ রোধ করা কষ্টকর হয়ে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের আহ্বান জানিয়েছেন। এখন রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের পাশে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কার্যকর কোনো ভূমিকা নিতে পারছে না। অথচ যুক্তরাষ্ট্র হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে তাদের দেশে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে উদাসীনতা প্রদর্শন করছে। সীমিত অবকাঠামো এবং সংস্থাসহ রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে উপচেপড়া ভিড়, যা পর্যাপ্ত আশ্রয়, খাদ্য এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলছে। উদ্বাস্তুরা বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন এবং পরিষেবার অ্যাক্সেসসহ গুরুতর মানবিক প্রয়োজনের মুখোমুখি হচ্ছে। শিবিরগুলোতে প্রায়শই অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এবং বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া ক্যাম্পে নিরাপওা সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। সহিংসতা এবং মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনাও ঘটছে অহরহ, যা ইতোমধ্যেই কঠিন জীবনযাত্রাকে জটিল করে তুলছে। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানে সক্রিয়ভাবে জড়িত।
সাত বছর পূর্বে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার কর্তৃক গণহত্যা ও নির্যাতনের প্ররিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কোনো লক্ষ্যই দেখা যাচ্ছে না বা আদৌ দেখা যাবে কি না, তাও সন্দিহান। জাতিসংঘসহ বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর অনুরোধে তৎকালীন সরকার মানবিক দৃষ্টিতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাদের শুধু আশ্রয় নয়, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। যেসব রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে প্রবল ছিলেন তারা এক এক করে ইতোমধ্যে সরে পড়েছেন। মিয়ানমার বাংলাদেশের সীমানায় একের পর এক মর্টার, গোলাবারুদ ও গুলি ছুড়েছে যা চলমান। এই মানবিক কাজে সরকার চাহিদা মোতাবেক তেমন কোনো বৈদেশিক সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে না। বিপদে পড়েছে বাংলাদেশ, ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মাদক পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। এতে বাংলাদেশ হুমকির মধ্যে পড়েছে। মাদক, অস্ত্র, মদ, ইয়াবার ঘাঁটি হয়ে পড়ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। এরপর অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত ক্যাম্পগুলোর অভ্যন্তরে বগিরাগতদের আগমন বিপজ্জনক। মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো বর্তমানে নিরাপদ স্থান। এতে স্থানীয় প্রশাসন বিব্রত অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এরপর কিছু দেশি-বিদেশি এনজিওদের কর্মকাণ্ডে সরকার ক্ষুব্ধ। বিভিন্ন অপরাধে অনেক রোহিঙ্গা আটকও হয়েছে। চীন ও ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ আদৌ রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসন করতে পারবে কি? রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ এখন শুধু বিপদে নয়, নিরাপত্তার ঝুঁকির মধ্যেও রয়েছে। শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
ইতোমধ্যে ভারত থেকে শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়, এই অবস্থায় শুধু রোহিঙ্গা কেন ভারত থেকেও অনেক নাগরিক বাংলাদেশে চলে এসেছে। দীর্ঘদিন থেকে কয়েক লাখ ভারতীয় বাংলাদেশের বৈধ ও অবৈধভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি করছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের নিয়ে এমনিতে বাংলাদেশ বিড়ম্বনা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে, তারপর যদি ভারতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠানো হয়, এটা ঠিক নয়। বিহারি বা পাকিস্তানিদের এখন পর্যন্ত সে দেশে প্রত্যাবর্তন করা হয়ে ওঠেনি তদরূপ রোহিঙ্গাদেরও আর কোনোদিন মিয়ানমারে পাঠানো সম্ভব হবে কি না সন্দিহান। এটি বাংলাদেশের জন্য আরেকটি নতুন বোঝা, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই সংকট সমাধানে চীন ও ভারত এগিয়ে না আসাটাও বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্য। বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় দেশ এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সর্বত্র প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে। বাংলাদেশের কক্সবাজার পর্যটন জেলাটি আজ রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যুদস্ত। এ জেলার উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প। কক্সবাজার জেলার সমুদ্রসৈকত এখনো অবহেলিত ও উপেক্ষিত। জেলা প্রশাসন বা সরকার সমুদ্রসৈকতটি থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিকট লিজ দিতে পারে। অপরিকল্পিতভাবে যে হারে কক্সবাজারের কলাতলী এলাকায় হোটেল, রিসোর্ট ও বাড়িঘর নির্মাণ হয়েছে তার কোনো বৈধতা নেই। আশা করি, ড. ইউনূসের তত্ত্বাবধানে সরকার এবার রোহিঙ্গাদের নিশ্চয়ই মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হবে। জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) হাইকমিশনার আগামীতে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা বিপজ্জনক হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নতুন করে ইউক্রেন ও আফগানিস্তান সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের তহবিল পর্যাপ্ত নাও পেতে পারি। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও এডিপির সহযোগিতা রড়ই প্রয়োজন। ইউএনএইচসিআর মনে করে যে, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে আগামীতে ফেরত পাঠানোর বর্তমানে সেখানকার পরিস্থিতি কোনোভাবেই অনুকূলে নয়। তৎকালীন আওয়ামী সরকার বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এখন দেশটিকে মহাবিপদে ফেলে দিয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে চীন, ভারত ও জাপানের সহযোগিতার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো উপায় নেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইমেজকে কাজে লাগাতে হবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত নতুন স্বাধীনতার স্বপ্ন-স্বাদ জাতির ভাগ্যে জড়ানোর জন্য যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করছে, তখন অনেক অপরিণামদর্শীর মতো আমাদের ইসলাম ধর্মীয় কিছু গোষ্ঠীও তাদের মতবাদ বাস্তবায়নের জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় বিচারে ওরা যেই তরিকারই হোক কাজটা অপরাধমূলক এবং নিন্দনীয়ও। প্রসঙ্গটা সাম্প্রতিক দেশ জুড়ে ওলি-আওলিয়াদের মাজার ভাঙা। দুঃখজনক হলেও সত্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর (পুলিশ-আনসার) নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে এই অরাজকতার মাত্রাটা লাগামহীনভাবে ছড়াচ্ছে। এর ফলে পবিত্র মাজার ও সংযুক্ত উপাসনালয়গুলো যেমন ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি অসম্মানিত হচ্ছেন আমাদের ধর্ম প্রচারের জন্য আসা ওলিগণ। মহান আল্লাহ মনোনীত ধর্ম ইসলামও হচ্ছে বিতর্কিত।
ওরা কারা যারা মাজার ভাঙার কাজটি বেশ সাহসিকতার সাথে করছেন আর এর স্বপক্ষে কি যুক্তি বা কোরআন-হাদিসের সমর্থন তাদের আছে? প্রশ্নটি সবার। এই বিষয়ে বা এর পক্ষে-বিপক্ষে কিছু বলতে গেলে ইসলামের কিছু মতবাদ ও ধর্মীয় তত্ত্ব আমাদের জানা দরকার।
মাজারের ধারণা ও পরিবর্তিত প্রথা ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার একটি বৈচিত্র্যময় ও স্পর্শকাতর বিষয়। এটি কেবল ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা, সুফিবাদ এবং ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে জড়িত নয় বরং মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। আজকের আলোচনায় এই মাজারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, মর্যাদা এবং মাজার ভেঙে দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে কিছু আলোকপাত করব ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে। আশা করি যাদের এ বিষয়ে জানার অস্পষ্টতা রয়েছে, মহান আল্লাহ তাঁদের সত্যটা বোঝার তৈফিক দান করবেন।
ইসলামের সূচনালগ্নে অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনকালে মাজার প্রথা অর্থাৎ কবরের ওপর কাঠামো নির্মাণ বা এটাকে ধর্মীয় পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য করা হতো না। তবে ইসলামের প্রসার ও মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম প্রচারক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের স্মৃতিকে চিরস্থায়ী করার প্রবণতা থেকে মাজার প্রথার প্রচলন শুরু হয়। বিশেষত উমাইয়া ও আব্বাসিয়া খেলাফতের সময় ইসলামি স্থাপত্যের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পীর-আওলিয়াদের কবরের ওপর নান্দনিক মসজিদ ও আচ্ছাদন নির্মাণের রেওয়াজ শুরু হয়। এই সময় মসজিদের পাশে বা ভেতরে পীর-আওলিয়াদের কবর দেওয়া হতো এবং স্থানটিকে ধর্মীয় শ্রদ্ধার প্রতীকে পরিণত করা হতো।
ইরাকের কারবালায় হজরত ইমাম হোসেন (র.), বাগদাদের বড় পীর হজরত আব্দুল কাদির জিলানী (র.), ভারতের হজরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (র.), হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিস্তি (র.), বাংলাদেশের সিলেটের হজরত শাহজালাল (র.), হজরত শাহপরান (র.), হবিগঞ্জের মুরারবন্দে হজরত শাহ সৈয়দ নাসির উদ্দীন (র.), হজরত শাহ বোগদাদী (র.) এবং বাগেরহাটের হজরত খান জাহান আলী (র.), চট্টগ্রামের হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (র.)-এর মাজার সহ দেশ-বিদেশে অসংখ্য প্রসিদ্ধ মুসলিম ধর্মপ্রচারক, সুফী-সাধকদের কবর রয়েছে, যেগুলো ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুসলমানদের ধর্মীয় অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে শত শত বছর ধরে টিকে আছে। আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশে বাগদাদকেন্দ্রিক মুসলিম খেলাফত এবং পরবর্তীতে মোগল সাম্রাজ্যের যুগ থেকে সুফী মতবাদের বিকাশ ঘটে। যারা ধর্মকে আধ্যাত্মিক ভাবধারায় পরিচালনা এবং চর্চা করতেন। এই সুফিবাদীরাই মূলতঃ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও পিঠস্থানগুলোকে সম্মান করতেন এবং এগুলোকে কেন্দ্র করেই তাদের ধর্মচর্চা এবং প্রচার-প্রসারের কাজ পরিচালনা করতেন। সাধারণ মুসলমান উনাদের কথা, আচরণ ও মূল্যবোধকে গ্রহণ করতে লাগলেন। সম্মানিত হতে থাকল মাজার বা ধর্মীয় স্মৃতিস্থানগুলো।
কালক্রমে এগুলো ধর্মীয় সহনশীলতা, মর্যাদা ও আধ্যাত্মিকতার একটি প্রতীকে পরিণত হওয়ায় লক্ষ কোটি ভক্তকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো। ইরানে মাজার প্রথা ইসলামি বিপ্লবের পূর্বেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। বিশেষত শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ইমামদের মাজারগুলো আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে মাজারের বৈধতা: মাজার জিয়ারত এবং প্রার্থনা করার বৈধতা নিয়ে ইসলামে মতভেদের অভাব নেই। সুফিবাদীরা মাজার জিয়ারত ও ওলি আল্লাহদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকে আধ্যাত্মিক উন্নতির লক্ষণ মনে করে।
পক্ষান্তরে ওহাবী, সালাফী ও আরও কিছু মতাবলম্বী মাজার জিয়ারত ও পীরদের প্রতি আনুগত্য বা অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শনকে শিরক হিসেবে গণ্য করে। পবিত্র কোরআনের সুরা আন-নিসার (আয়াত ৪:৪৮) নির্দেশনা হলো মহান আল্লাহ বলছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ শিরককে ক্ষমা করেন না। তবে তিনি তার ইচ্ছা অনুযায়ী অন্য যেকোনো পাপ ক্ষমা করবেন।’ এই আয়াত অনুসারে সালাফী ও ওহাবীরা মনে করেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর কাছে প্রার্থনা করা বা কারোর কবরের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পরিপন্থি। সালাফী বা ওহাবীরা তাদের মতবাদের স্বপক্ষে যে হাদিসটি বর্ণনা করেন, তা হলো সহি বুখারী শরীফের ৪২৮ নং হাদিস। যেখানে রাসুল (সা.) মদিনায় এক উচ্চস্থানে উপনীত হয়ে নামাজের স্থান নির্বাচন করতে গিয়ে বনি নাজ্জার গোত্রের নেতাদের উপস্থিতিতে সাহাবাদে নির্দেশ দিয়েছেন সব উঁচু টিলা ও উঁচু কবর ভেঙে সমান করে দিতে। এই হাদিসের সূত্র ধরে মাজার প্রথার বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থান শত শত বছর ধরে। এই মতাবলম্বীরা এর পটভূমি বা প্রেক্ষাপটে না গিয়ে এর মধ্যে তারা অন্য কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে রাজি নন। তাঁদের এই বিরোধিতার পেছনে আরও যেসব কার্যকারণ কাজ করে, তাহলো মাজার বা পীরদের প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে গিয়ে ইসলামী সমাজে নানান রকম বিতর্ক ও সমালোচনা বিদ্যমান। যা পরস্পরের সম্পর্ক ও ইসলামি ঐক্যকে বিনষ্ট করছে। মাজারগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ব্যবসা, নেশা দ্রব্য বিক্রি, ব্যবহার, নাচ-গান ও অতিরিক্ত ভক্তি প্রসূত পীরদের পায়ে সেজদা/চুমু খাওয়ার মতো অসামাজিক ও বেদায়াতী কর্মকাণ্ড ঘটছে- যা ইসলামী শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। তাই এই প্রথাকে যদি উৎসাহিত করা হয়, তা হলে সমাজে শিরক ও পাপকর্ম বৃদ্ধি পাবে। সেজন্য এই প্রথার বিলোপ সাধনে তারা বদ্ধ পরিকর।
মাজার প্রথা বিরোধীদের কথায় ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, আনুগত্য ও যুক্তি যথেষ্ট জোরালো থাকলেও সাধারণ সব মুসলিম ও মাজারপন্থিরা মনে করেন মানুষের মাঝে আধ্যাত্মিকতা ও ধর্ম প্রচারক পীর-ওলিদের জীবনাদর্শ প্রচার এবং প্রতিষ্ঠার জন্য ওনাদের কবরস্থানগুলোকে বিশেষ আদব দেখানোর প্রয়োজন আছে। এই মতাবলম্বীরা আরও বিশ্বাস করেন যে, ইসলামের শেষ নবীর ইন্তেকালের পর ইসলামের প্রচার ও প্রসারের দায়িত্বটা উম্মতে মোহাম্মদীর স্কন্ধে বর্তায়। আর এই পবিত্র দায়িত্বটা অনেক ত্যাগ আর ধৈর্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী যারা প্রতিপালন করেছেন তারাই আল্লাহর প্রকৃত প্রিয় বান্দা বা ওলী। আজকের বিশ্ববিস্তৃত ইসলামী জগৎ তাদেরই ত্যাগ ও অবদানের ফসল। কাজেই উনাদের মাধ্যমে মহান আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করার মধ্যে বেদাত বা শিরক বলতে কিছু নেই। দ্বীনের খেদমতে উনারা ছিলেন পরীক্ষিত এবং পরহেজগার। অতএব ওলী-আল্লাহর উছিলায় আল্লাহ আমাদের হেদায়েত করবেন- এই বিশ্বাসটুকুই মাজারপন্থিদের সবচেয়ে বড় বুনিয়াদ। তাই এই পন্থিরা ওলী-আল্লাহদের কবর বা মাজারকে অসম্মান করতে চান না।
এই মতাবলম্বীরা মনে করেন যে, হাদিস বা দলিলের ভিত্তিতে মাজার বিরোধীরা তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছেন, সেখানে যথেষ্ট বোঝার ভুল রয়েছে। তারা সহি বুখারী শরীফের রাসুল (সা.)-এর উঁচু কবর ও টিলা ভাঙার নির্দেশনাটির পটভূমি ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনেননি। রাসুল (সা.) কোন পরিস্থিতিতে উক্ত নির্দেশনাটি সাহাবাদের দিয়েছিলেন তা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলে কোনো ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকবে না। সেজন্য সহি বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসটির বিষদ ব্যাখ্যা নিম্নে দেওয়া হলো :
হজরত আনাস বিন মালিক (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) মদিনায় এক উঁচু এলাকায় এলেন। যাকে ইবনুল আউফ গোত্রের মহল্লা বলা হয়। সেখানে তিনি ১৪ রাত্রি অবস্থান করলেন। তারপর তিনি নাজ্জার গোত্রের নেতাদে খবর পাঠালেন। তারা তরবারী ঝুলিয়ে উপস্থিত হলেন। নবী (সা.) আবু আয়ুবের গৃহ প্রাঙ্গণে অবস্থান করলেন। আনাস (র.) বলেন- রাসুল (সা.) যেখানে সালাতের ওয়াক্ত হতো, তিনি সেখানেই সালাত আদায় করতেন। হোক সেটা বকরি, ভেড়া বা উটের বসতঘর। তখন তিনি নাজ্জার গোত্রের প্রধানদের উপস্থিতিতে বললেন- হে নাজ্জার! তোমরা এই বাগানখানি আমার নিকট বিক্রি করো। তারা বললেন, আল্লাহর কসম আমরা এর মূল্য একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাই। আনাস (রা.) বললেন, এই বাগানটিতে কী ছিল, আমি বলছি: এখানে ছিল খেজুর গাছ, মুশরিকদের কবর আর পুরাতন ঘরদুয়ারের ভগ্নাবশেষ। তখন রাসুল (সা.) সেখানে মসজিদ নির্মাণের আদেশ দিলেন এবং তাঁর নির্দেশে খেজুর গাছ কেটে দেওয়া হলো। কবরগুলো খুঁড়ে ফেলা হলো এবং ধ্বংসাবশেষ সমান করে ফেলা হলো। আনাস (রা.) বললেন তারপর কিবলার দিকে খেজুর গাছের সারিবদ্ধ থাম দেওয়া হলো এবং দুই পাশে পাথর স্থাপন করা হলো (সহী বুখারী-৪১৬)। উল্লেখিত হাদিসের বরাতে সুফিবাদীদের মতামত হলো: কবর ভেঙে সমান করার হাদিস মুসলমানদের কবরের ক্ষেত্রে নয়। মুশরিকদের কবরের জন্য প্রযোজ্য।
অতএব এ বিষয়ে আর কোনো বিতর্ক বা আলোচনা না বাড়িয়ে আমরা সাধারণ মুসলমানগণ মনে করি যে, আমাদের বিশ্বাস আর আমলের ভিত্তি যদি হয় কোরআন-হাদিস, তাহলে এ বিষয়ে এসবের বাইরে কোনো মতামত বা যুক্তিকে অন্তরে ঠাঁই দেওয়া ঈমানের পরিপন্থি। মাজার সমাজে কোনো অশান্তি বা বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে না। মাজারকে পাপকর্মের কেন্দ্র বানিয়ে তুলছে কিছু ধর্ম বিষয়ে অজ্ঞ ও অতিভক্তির ব্যক্তিগণ। মাজার যদি ইসলাম প্রচার, মুসলিম ঐক্য সৃষ্টিতে সহায়ক হয়, তাহলে সেটির বিরুদ্ধে ঝান্ডা উড়ানো অনুচিত। তবে সেই মাজার বা কবর হতে হবে পরীক্ষিত ও সত্যিকার আল্লাহর ওলীদের। যেকোনো ব্যক্তির কবরকে আলিশান দালানে রেখে লালশালু বা বেলভেট কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দিলেই সেটি সম্মানের প্রতীক হতে পারে না। পক্ষান্তরে মাজারে যদি ধর্মকথা ও ধর্মীয় আচারের পরিবর্তে শুধু নাচ-গান, নেশাদ্রব্য সেবন-বিক্রি আর পীরবাবা বা কবরকে সেজদা করার জায়গা হয়, তাহলে সেগুলোর বিরুদ্ধে অবশ্যই জনমত তৈরি করে আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতিরোধ করতে হবে। বিশৃঙ্খলা ও ফেতনা তৈরি করে নয়।
ইসলাম শান্তি ও মর্যাদার ধর্ম। পারস্পরিক ঐক্য বিনষ্ট করে কোনো মতবাদ চাপিয়ে দিতে গেলে ক্ষতি হয় আমাদের প্রিয় ইসলাম ধর্মের। এই সুযোগে ইসলাম বিরোধীরা আমাদের নিয়ে বিতর্ক তৈরির সুযোগ পায়। তাই ইসলামকে সব সময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। মহান আল্লাহ আমাদের কোরআন ও হাদিসের আলোকে সব সংকট সমাধানের তৈফিক দিন। আমিন!
লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ
কথায় কথায় মারধর, গালমন্দ করা, আইন ভঙ্গ করে নিজের হাতে মনের ঝাল মিটিয়ে মানব হত্যা করা গুরুতর অপরাধ দেখতে দেখতে জাতির গা সহা হয়ে গেল নাকি। প্রবল প্রতিবাদের তাপে বুকফাটা আহাজারি করে প্রতিবাদের লেখনী মিছিল কোনো সুশীল সমাজ প্রতিক্রিয়া দেখাল না।
নির্মমতা চরম প্রকাশ নিরাপরাধ মানুষ গায়ের জোরে ধরে পিটিয়ে হত্যা করা। আজিব এক মগের মুল্লুকের প্রথা কৃষ্টি উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি। পৌরষের নিরীহ অসহায় মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জেলকে যারা হত্যা করেছে তারা জাতীর শত্রু। গোঁড়ামি গুণ্ডামি বৃক্ষের বেয়াড়া ডাল এখনি কেটে ফেলতে হবে। নিরীহ বেচারী চেয়ে খেত, টাকা ভিক্ষা করত। এই চাওয়াই তাকে ছাত্র নামের কলঙ্ক আজরাইলদের হাতে প্রাণ হারাতে হলো। এ নির্মমতা আস্ফালন মানা যায় না খুনিদের বিচার দাবি করি। এক মুঠো খাবারের জন্য অসহায় মানুষ তাদের কাছে গেছে আশাবাদী হয়ে। সে ভরসা রেখেছিল দেশের কাণ্ডারীরা এখানে বাস করে আর যাই হোক তারা তাদের মুখের অন্ন ত্যাগ করে আমাকে বুভুক্ষের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবে আরও অভয় দিয়ে বলবে ভবিষ্যতে কোনো দুর্দিনে এখানে ছুটে আসবা তুমি একা না তোমার পাশে আমরা সবাই আছি। হায়রে ভ্রান্ত ক্ষুধার্ত হৃদয় হত্যার কোনো পর্বে সে ভ্রান্তি কাটল না। ক্ষুধার্ত জলজ্যান্ত মানুষটাকে ছাত্ররা উল্লাস করে ধাপে ধাপে পিটিয়ে জল্লাদের মতো মেরে ফেলল। জাতির কপালে চরম দুর্ভোগ শুরুর বার্তা এই অশ্রু গড়ান হত্যাকাণ্ড।
একি সেই বাংলাদেশ দুদিন আগে যার যা ছিল টিএসসিতে এসে এই ছাত্রদের হাতে সমার্পণ করে গেল অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। কি লজ্জার সেখানেই এক মুঠো খাবারের জন্য অসহায় মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবকের জীবন গেল। সবেমাত্র ভাই হারিয়ে পিতা হারিয়ে একা হয়ে স্মৃতিশক্তি রহিত হয়ে যায়। আবছা আবছা যা মনে ভাসে চেনা পরিচিত সভ্যজনের কাছে হাত পেতে চলত। পরিচিতরা তাকে দেখলে পরম মমতায় তার পরিচর্যা করে মনের জোর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করত। কি গভীর দাবির আকুতি আপনাদের হলের খাবার মজা খেতে আইছি ভাই। এক বুক আশা নিয়ে খাবারের জন্য হলে গেল, মানবতার বাতিঘর আমার গর্বের বিশ্ববিদ্যলয়ে এক দিক হারা আপনজন হারা উদ্ভ্রান্ত যুবক। জাতির মেধাবী বিবেকবান দয়ালু ছাত্রদের কাছে সহানুভূতি পাওয়ার আশায়। সেখানেই স্বজনহারা সংসারত্যাগী এই উপেক্ষিত ছেলেটি উলঙ্গ চেহারা দেখল শিক্ষত ছেলেদের। সঙ্গে সঙ্গে জগতের সব অবজ্ঞা উপেক্ষা অনাদর দুঃখ-কষ্টের সংগ্রাম থেকে চিরতরে তার প্রভুর কাছে উড়াল দিল। সভ্যতা এ অসময়ের ব্যথিত আত্মার পরপারে যাত্রার কি কৈফিয়ত দেবে।
বিপ্লবের পর ভাঙা দেশ গড়া সহজ না। সময় লাগে, অর্থ লাগে, ধৈর্য লাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যমদুতেরা পড়া লেখা করে। কিছু মানুষ যমের মুল্লুকে কি ছিল না। কেউ তোফাজ্জেলকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে পারল না সবাই মজা দেখছে ভিডিও করছে কি করে মানুষ এমন পাষণ্ড হয়। জাতির পোড়া কপাল। ছাত্রদের আন্দোলনের সময় পরিপক্ক মনে হলো। এখন লক্ষ্যহীন উচ্ছৃঙ্খল কর্ম হতাশ করছে। বেমানান মনে হলো শাবির প্রো ভিসি ও কোষাধ্যক্ষকে শপথ বাক্য পাঠ করালেন ছাত্র নেতারা।
ঠুনকো অজুহাতে মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো অভিযোগ তুলে, আইন-কানুন নিজের হাতে তুলে মানুষকে হত্যা করছে তা দেখার ঠেকানোর কেউ নেই সবাই তামাশা দেখছে। সভ্যতার এই ভয়াবহ কলঙ্কজনক ব্যাপ্তি মানবসমাজে আমাদের দেশের সচেতন নাগরিকদের বিগত কয়েকদিন ধরে যেভাবে অসহায়ত্ব, নির্বাক আকীর্ণ করছে, তা একই সঙ্গে আতঙ্ক, পীড়ন এবং যন্ত্রণার একটা পরিমণ্ডল তৈরি করেছে সামাজিক জীবনে।
পথ ভোলা ভিক্ষুক নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনা আমরা দেখেছি। পদ্মা সেতু মুণ্ডু চায় এমন গুজবে অচেনা লোক এলাকায় পেলেই হত্যা করা কি মানসিক বৈকল্য।
বিদ্যা-বুদ্ধি-বিবেক-জ্ঞান-গবেষণা মানবতার প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুনিয়ায় বিশেষ মর্যাদায় স্থান অর্জনকারী একটি নিরাপদ জায়গা। সেখানেও আমরা দেখেছি আবেগে উত্তেজিত গণপিটুনি, গণধোলাই দিয়ে অপমান অপদস্ত করে পালাক্রমে কষ্ট দিয়ে দিয়ে চুরির আবরণে কি নারকীয় বীভৎসতা তৈরি করেছিল। এদের মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন আপন কেউ থাকলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাক। আরও বড় হিতাহিত জ্ঞানহীন কাণ্ড ঘটাবে।
উন্মাদনা আর রাজনীতিক কানেকশনের জোরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই নানা অছিলায় ধর্ম এবং সামাজিকতার দোহাই দিয়ে মানুষের দ্বারা মানুষকে খুন করার ঘটনা দর্শক হয়ে দেখেই চলেছি আমরা।
সেই ষাটের দশকে বর্নি গ্রামের সিদ্দিক আকুঞ্জি খুনের ঘটনার থানাজুড়ে শোক আর ভীতির অজানা শাস্তির আশঙ্কায় মানুষ খাওয়া-ঘুম ছেড়ে দিয়েছিল। পুলিশ বিষ আইন জারি করে। ছিঁচকে অপরাধীরা বছরের পর বছর গা ঢাকা দেয়। এমনকি আমাদের রাজনীতি ও ধর্মের দোহাই দিয়ে গণপিটুনিতে মানুষকে হত্যা করার অভিযোগ খুব কমই গোচরে আসে। নিষ্ঠুর আচরণ সামাজিক এবং রাজনৈতিক আবর্তকে ক্ষত করছে দীর্ণ করছে।
রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সংলগ্ন এলাকাগুলো এবং মফস্বলের বিভিন্ন শহর, গ্রামে যেভাবে গণপিটুনিতে মানুষের দ্বারা মানুষের হত্যাকাণ্ড ঘটছে, তা দেখে আমাদের শিউরে উঠতে হচ্ছে। মানুষের একটা বড় অংশের মধ্যে জিঘাংসা এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, অপছন্দের কোনো লোককে, নানা ধরনের অপবাদ দিয়ে, তাকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করা- এটা একটা সংক্রামক সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ব্যাধি যে আজ হঠাৎ করে নতুনভাবে গজিয়ে উঠেছে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এই ব্যাধি দেশের বুকে দীর্ঘদিন ধরে পরিব্যাপ্ত রয়েছে তা লালন করে রাজনৈতিক দল। অপরাধী হলে দল ছাড়িয়ে আনবে এই ক্ষমতার বলে ঘৃণিত জাহেলি কাজে উৎসাহ পায়। সাজার কোনো ডর নেই দল তো আছেই। একটা সময় ছিল, এ ধরনের ব্যক্তিগত ক্রোধ মানুষ ব্যবহার করত স্থানীয় সালিশ, মামলা মকদ্দমা করে ,অপছন্দের মানুষটিকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করার জন্য। ক্রমে ক্রমে সেই বিষয়টির সঙ্গে সংযুক্ত হতে শুরু করল রাজনীতির নাম করে এক ধরনের ব্যক্তিগত অসূয়ার পরিমণ্ডল। শাসনক্ষমতায় যখন যে রাজনীতিকরা থেকেছেন, সেই পরিমণ্ডলের মানুষ, চিরদিনই সামাজিকভাবে কিছু বেশি সুযোগ-সুবিধে আদায় করে নেন। আর এই সুযোগ-সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয়গুলো ক্রমশ ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার নিরিখে এসে থেমে যায়।
আমাদের সার্বিক নিচুমানের শিক্ষা আবার ছিটেফোঁটা যা আছে তা শিক্ষার অনগ্রসরতা এমন একটা জায়গায় আজ গোটা দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, যার দাপটে সাধারণ মানুষ, যার মধ্যে হয়তো কখনো হিংসার বিষয়টি জোরদার ছিল না, সেও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির চাপে পড়ে, নিজের মন, মানসিকতাকে, দৃষ্টিভঙ্গিকে কিছুতেই নিজের বশে রাখতে পারছে না। অর্থনৈতিক সংকট মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তকে এমন একটা জায়গায় ক্রমশ এনে ফেলছে, যার ফল হিসেবে মানুষ কিছুতেই নিজের মনুষ্যত্বের ধ্যান-ধারণার বিবেকের মধ্যে আটকে থাকতে পারছে না। তার আচার-আচরণ, তার জীবনযাপন, তার অঙ্গভঙ্গি সবকিছু যেন একটা ক্ষমতার বেসামাল ভাব।
বাঙালি খুব কোমল হৃদয়ের মানুষ। বাঙালি অহেতুক বিবাদ-বিসংবাদের মধ্যে যায় না। সাংস্কৃতিক রুচিতে বাঙালি কেবলমাত্র বাংলাদেশে না, দক্ষিণ এশিয়ায় বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ একটি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তবে সেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক হলো বাঙালি। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাংলাদেশের বাঙালির যে সার্বিক বৈশিষ্ট্য, সময়ের গতিতে সেই বৈশিষ্ট্য সাংস্কৃতিক, সামাজিক আদান-প্রদানের মধ্যদিয়ে এই পারের বাঙালির মধ্যেও অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করেছে।
অহেতুক হিংসাকে সমাজজীবনে প্রয়োগ ঘটাতে, বাঙালি কখনই সেভাবে উৎসাহী ছিল না। বরঞ্চ হিংসা নিরশনে বাঙালির ভূমিকা, জাতীয় আন্দোলনের সময়কালেই হোক বা বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক টানাপড়েনের মধ্যেই হোক, সর্ব বিবেচনায় অহিংসার একটা উঁচু স্থান অর্জন করতে পেরেছে।
সেই বাংলায় সেই বাঙালির মধ্যে যখন আমরা দেখি এই ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে, যে পরিস্থিতিতে ছেলেধরা থেকে শুরু করে, চুরি থেকে শুরু করে, নানা ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, আর সেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ফলশ্রুতি হিসেবে, একজন বা একাধিক মানুষ, অভিযুক্তকে মারধর করছে। এমনকি মেরে ফেলছে। তখন আমাদের শিউরে উঠতে হয়।
যদিও শিউরে ওঠার আরও অনেকটাই বাকি থাকে। আমরা যখন দেখি, এই গণধোলাই দেখছে একদল পশুরূপী মানুষ। নীরবভাবে হত্যাযজ্ঞ দেখছে এরা কি মানুষ! কোনো প্রতিবাদ করছে না। নৃশংসতা উপভোগ করছে। সেই গণধোলাইয়ের ভিডিও নিজের মোবাইলে তুলছে। সেটা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তখন এটাই কেবল মনে হয়, মানব মনস্তত্ত্বের কতখানি অবনমন হলে, মানুষের দ্বারা এ ধরনের একটা পরিস্থিতির বাস্তবায়ন ঘটানো সম্ভব হয়।
গণপিটুনি, খামখেয়ালি হত্যার ঘটনাগুলো ঘটছে তার মধ্যে যেমন রাজনীতির প্রভাব আছে, ঠিক তেমনিই রয়েছে ভয়াবহ দরিদ্রতা। অভিশপ্ত বেকার জীবন। একটা কথা খুব জোরের সঙ্গে বলতে হয়; সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা, বিশেষ করে শাসকবিরোধী শক্তি, যখন প্রতিবাদের সামিল হয়, তখন তাদের ওপরে রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্র প্রয়োগ করার প্রবণতা তীব্র হয়ে ওঠে। অপরাধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জাতিই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তি দিতে পারে। সব অন্যায়কে না বলতে হবে অমানবিকতাকে প্রতিবাদ করতে হবে। সম্মিলিত প্রতিবাদে এক দিন নির্মম চিত্তের মানুষ হয়ে উঠবে মানবিক মানুষ।
লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক
আমাদের বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধশালী একটি দেশ। যদিও আমরা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করতে না পারায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারছি না। যে কারণে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ চরম দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে। কিন্তু আমরা চাইলে দেশকে অনেক এগিয়ে নিতে পারি। এ জন্য প্রয়োজন সবার সম্মিলিত উদ্যোগ। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত অনেক সরকার এসেছে আবার চলে গেছে। বিগত সময়ে যারা এই দেশটাকে পরিচালনা করেছে তারা সবাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। সম্প্রতি ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ চালাচ্ছে। এই সরকার দেশকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। এসব উদ্যোগ সফল হলে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে বলে মনে করি। তবে দেশকে এগিয়ে নিতে গেলে বর্তমান সরকারকে যেসব বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে সে ব্যাপারে কিছু আলোকপাত করছি। সর্বপ্রথম আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ। আদিকাল থেকেই এ দেশের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস ছিল কৃষি। যা এখনো পর্যন্ত বিরাজমান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশের কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং উন্নত জাতের ফলন উৎপাদনের কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের কৃষি অনেক এগিয়ে গেছে। বর্তমানে আমাদের কৃষিতে সেই আগের ধ্যান-ধারণা নিয়ে কাজ করা হয় না। দেশের শিক্ষিত তরুণ যুবকরা কৃষি ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়োগ করছেন। যে কারণে কৃষিক্ষেত্র দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে শস্য, পোলট্রিশিল্প, মৎস্যশিল্প, ডেইরিশিল্প বিরাট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পোলট্রিশিল্পে উৎপাদিত মুরগি এবং ডিম দেশের ব্যাপক চাহিদা মেটাচ্ছে। আগে আমাদের শুধু দেশি মুরগির ওপর নির্ভর করতে হতো। বর্তমানে পোলট্রিশিল্পে বিভিন্নজাতের মুরগি উৎপন্ন হচ্ছে। যা নাকি দেশের চাহিদার বেশির ভাগ পূরণ করছে। পোলট্রিশিল্পে উৎপাদিত ডিমও দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ করছে। পোলট্রিশিল্পে বর্তমানে নানা সমস্যা বিরাজ করছে। এসব সমস্যা সমাধান করতে পারলে দেশের পোলট্রিশিল্প আরও এগিয়ে যাবে। দেশে উৎপাদিত পোলট্রিশিল্পের মুরগি এবং ডিম দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ হবে। এ ব্যাপারে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশের পোলট্রির পর দেশের মৎস্যশিল্প অনেক এগিয়ে গেছে। মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এটা আমাদের জন্য বিরাট গৌরবের ব্যাপার। সারা দেশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মৎস্য খামার। এসব খামারে সংযুক্ত রয়েছে দেশের শিক্ষিত তরুণ এবং যুবসমাজ। তারা মৎস্যশিল্পকে দিন দিন এগিয়ে নিয়ে যেতে তৎপর রয়েছেন। দেশে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় মৎস্য খামারে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের মাছ ক্রেতাদের ক্রয় সাধ্যের মধ্যে রয়েছে। বিদেশেও আমাদের দেশে উৎপাদিত মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বিদেশে মাছ রপ্তানি করতে রপ্তানিকারকদের নানা দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। দেশের মৎস্য সম্পদকে আরও সমৃদ্ধশালী করে তুলতে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। মৎস্য সম্পদের উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন। এ ব্যাপারে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া মৎস্যশিল্পে বিরাজমান সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে হবে। দেশের ডেইরিশিল্প আমাদের অর্থনীতিকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে। সারা দেশে হাজার হাজার ডেইরি ফার্ম গড়ে উঠেছে। ডেইরিশিল্প থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণ দুধ উৎপন্ন হচ্ছে তা দিয়ে দেশের দুধের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ হচ্ছে। আগে দেশে দুধের উৎপাদন তেমন ছিল না বলে বিদেশ থেকে গুঁড়োদুধ আমদানি করে দুধের চাহিদা পূরণ করতে হতো। বর্তমানে গুঁড়োদুধের আমদানি অনেক কমে গেছে। যে কারণে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমে গেছে। দেশের মিষ্টির দোকানগুলো ডেইরিশিল্পে উৎপাদিত দুধ দিয়ে তাদের চাহিদা পূরণ করছে। আগে প্রতি বছর কোরবানির ঈদের সময় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে গরু আমদানি করতে হতো। বর্তমানে দেশের ডেইরি ফার্মগুলোতে উৎপাদিত গরু দিয়ে দেশের মাংসের চাহিদা পূরণসহ কোরবানির সময় বিশালসংখ্যক গরু সরবরাহ করে থাকে। যে কারণে এখন কোরবানির ঈদের সময় দেশের বাইরে থেকে গরু আমদানি করতে হচ্ছে না। দেশের ডেইনিশিল্পের বিকাশে পদে পদে সমস্যা বিরাজমান। এসব সমস্যার মধ্যে গোখাদ্যের উচ্চমূল্য এবং বিভিন্ন ধরনের ওষুধের স্বল্পতা খামারিদের চরম দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে রেখেছে। গোখাদ্যের দাম কমানো গেলে গরুর লালনপালন ব্যয় অনেক কমে যাবে। যে কারণে গরুর দাম কমলে গরুর মাংসের দামও কমে যাবে। এতে সাধারণ মানুষ গরুর মাংসের স্বাদ অনায়াসে গ্রহণ করতে পারবে। গরুর মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে বিদেশে রপ্তানির সুযোগ হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ সুগম হবে। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সুদৃষ্টি দেবেন বলে আশা রাখি। দেশের কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন আগের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে উচ্চফলনশীল কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে কৃষক আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বর্তমানে দেশে উচ্চফলনশীল বিভিন্ন জাতের ধান উৎপন্ন হচ্ছে। বিভিন্নজাতের শাকসবজি উৎপন্ন হচ্ছে। গবেষণার মাধ্যমে উন্নতজাতের ফলের উৎপাদনে এগিয়ে গেছে আমাদের দেশ। বিভিন্ন ফলের মৌসুমে মৌসুমী ফলের সময় ফলের সরবরাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমের মৌসুমে আমের ফলন বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ করে উদ্ধৃত্ত থেকে যাচ্ছে। আমের মৌসুমে দেশের কিছু কিছু রপ্তানিকারক বিদেশে আম সীমিত পরিসরে রপ্তানি করছে। আগামী বছর আম রপ্তানি বৃদ্ধি করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে একটা পরিবর্তন আসবে বলে মনে করি। দেশের আমের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং তার সুষ্ঠু বিপণনে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমের ফলন আরও বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে আমচাষিদের উৎসাহিত করতে হবে। আম ছাড়াও দেশে আরও দেশি-বিদেশি ফলের উৎপাদন হচ্ছে। যা নাকি গত কয়েক দশক আগেও সম্ভব ছিল না। দেশের কৃষি খাত থেকে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগটাকে আমাদের কাজে লাগানো উচিত বলে মনে করি। বর্তমান দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। আমাদের দেশের কৃষি খাতকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সরকার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে আশা রাখি। আমাদের দেশের কুঠিরশিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প, দেশে-বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দেশের কুঠিরশিল্পের উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের কুঠিরশিল্পে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানির ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ব্যবস্থা হবে। ইদানীং আমাদের দেশে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তরা অনেক এগিয়ে গেছে। স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তরা বেশ সফল হচ্ছেন। এতে অনেক বেকার সমস্যার সমাধান হচ্ছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্ততাদের উৎসাহিত করলে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে। দেশে নিত্য-নতুন পণ্যের সমাহার ঘটবে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষাকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। যে কারণে সে সব দেশের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ যুবকদের বেশ চাহিদা থাকে। আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদি আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে দেশের তরুণ যুবসমাজকে গড়ে তোলা যায় তবে এসব তরুণ-যুবকরা দেশের সম্পদে পরিণত হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ব্যবস্থা হবে। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশের অদক্ষ শ্রমিকরা তেমন কোনো ভালো কাজ পায় না। আমাদের দেশের মতো জনবহুল দেশের মানুষকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিলে সুফল আসত। দেশের দক্ষ জনশক্তি রপ্তারির পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ব্যাপকভিত্তিতে রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিদেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু এর পরিমাণ বৃদ্ধি করা গেলে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও বেড়ে যেত। এ ব্যাপারে সরকারকে একটু সুনজর দিতে হবে। আমাদের দেশে বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন শিল্পোদ্যোক্তরা এসে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। দেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অবাধে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। নতুন নতুন শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। এতে দেশের বেকার সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে যাবে। দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অবসান ঘটাতে হবে। দেশের সম্ভাবনাময় গার্মেন্টস শিল্পকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশে উৎপাদিত পোশাকের চাহিদা বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে বেশ তৎপরতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের দেশে অনেক প্রতিভাবান তরুণ আছে যারা বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনীজ্ঞান রাখে। তারা বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। এসব সম্ভাবনাময়ী তরুণদের কাজে লাগাতে হবে। দেশে চীনের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারখানা স্থাপন করে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ উৎপাদনের ব্যবস্থা করলে বিদেশ থেকে আর ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হবে না। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। আমাদের দেশের কর্মস্থলে প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে শিল্পকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে শ্রম ঘণ্টা বাড়াতে হবে। দেশের রুগ্ণ শিল্পগুলোকে সংস্কার করে পুনরায় চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। এতে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। দেশের পাটকল, বস্ত্রকারখানাগুলোকে উন্নত করে আন্তর্জাতিক মানের পণ্য উৎপাদনে সক্রিয় করতে হবে। এতে বিদেশি কাপড়ের ওপর আর নির্ভর করতে হবে না। পাটের উৎপাদিত নিত্য-নতুনসামগ্রী বিদেশে রপ্তানির সুযোগ হবে। দেশের মধ্যে অনেক অপ্রচলিত পণ্য রয়েছে। যেগুলো দেশের চাইতে বিদেশে এর অনেক চাহিদা রয়েছে। সেগুলো বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের সফটওয়্যারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষিত যুবসমাজকে সফটওয়্যার শিল্পে ব্যাপক ভিত্তিতে সুযোগ দিয়ে সফটওয়্যার শিল্পকে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে প্রবাসীদের আয় বিরাট ভূমিকা রাখছে। এই প্রবাসীদের আয় আমাদের দেশে বৈধপথে এনে এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দেশের টাকা বিদেশে পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের প্রশাসনকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হতে হবে। সমস্ত প্রকার দুর্নীতি রোধে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। দেশকে রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে দূরে রাখতে হবে। এ ব্যাপারে আজকের সমৃদ্ধশালী দেশ সিঙ্গাপুর, হংকং-এর মতো দেশকে পরিচালিত করতে হবে। ৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর সিঙ্গাপুরের নাগরিকরা দেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ শুরু করে। তারা দীর্ঘ দশ বছরের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রের মধ্যে স্থান করে নেয়। হংকং ও একই পথে পরিচালিত হচ্ছে। যে কারণে এসব দেশ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতে রাজনীতি মুক্ত প্রশাসন চাই। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে দেশ পরিচালনা করছে। দেশে রাজনৈতিক প্রভাব অর্থনীতি, সমাজনীতি, সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। আমাদের দেশটাকেও এগিয়ে নিতে দিন। রাজনৈতিক তৎপরতা কমিয়ে দেশের কল্যাণে সবাই নিবেদিত হোন, দেখবেন দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। বাঙালি জাতি পারে না এমন কোনো কাজ নেই। শুধু দক্ষ পরিচালকের দরকার। সুদক্ষ পরিচালকের পথ ধরে চললে দেশ আর পিছিয়ে থাকবে না। দেশ অনেক এগিয়ে যাবে। দেশের মানুষ আর দারিদ্যসীমার নিচে থাকবে না। তখন বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে বিশ্বে মানচিত্রে স্থান করে নেবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক।