ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। গত ৫ আগস্ট একটি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে দেশের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন সরকার উৎখাতের এক দফা সংগ্রামে পর্যবসিত হয়েছিল ১৭ জুলাই। ধারণা করা হচ্ছে, ১৭ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাযজ্ঞে মৃতের সংখ্যা কয়েকশ ছাড়িয়ে গেছে। এমনি এক কঠিন সময়ে দায়িত্ব নেওয়া নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, বিগত ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান চলাকালে নরসিংদী, কাশিমপুর, শেরপুর, বগুড়াসহ কয়েকটি জেল ভেঙে আসামি পলাতক আসামি গ্রেপ্তার এবং জেলখানার লুট হওয়া অস্ত্র, বেশ কিছু থানার লুট হওয়া অস্ত্র দ্রুত সময়ে উদ্ধার করা, ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং রেমিট্যান্স বাড়ানো, উচ্চমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ. সর্বগ্রাসী দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা, খেলাপি ঋণ দ্রুত আদায় করা ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা ও পাচার হওয়া টাকা দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা, নাগরিক সেবায় নিয়োজিত সংস্থাসমূহের দুর্নীতি বন্ধ সেবা নিশ্চিত করা, সরকারি কেনাকাটি, টেন্ডারের কারসাজিতে সরকারি অর্থের হরিলুট, অপচয় বন্ধ করার পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবে ধুঁকতে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিংবা সামগ্রিক অর্থনীতির নানান সংকটকে উতরে নেওয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
তাছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ১১ দিনের মাথায় এরইমধ্যে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডবে প্রায় এক কোটি লাখ মানুষ আশ্রয়হীন, গৃহহীন হয়েছে। সম্পদের ক্ষতি আরও বিপুল বিশাল। তাই এ ক্ষতিটি স্বভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করাটাও সরকারের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যদিও এসব অঞ্চলের দুর্গত মানুষের সহায়তায়, আত্মমানবতার দুর্ভোগ লাগবে, ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই মর্মবাণী হৃদয়ে ধারণ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে প্রাচ্যের অক্সফোর্ট ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের টিএসসিতে স্থাপিত ত্রাণকেন্দ্রে শিশুশিক্ষার্থীসহ রাজধানী সর্বস্তরের মানুষের সামর্থ্য অনুযায়ী অংশগ্রহণ এক মানবিক উদাহরণের সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলসমূহ, সামাজিক সংগঠন, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠনও ত্রাণ, কাপড়, শিশুখাদ্য, ওষুধসহ বন্যাকবলিত মানুষকে উদ্ধার ও সর্বাত্মক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- বন্যাপরবর্তী এসব এলাকার মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি নির্মাণ, সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ‘প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিল’-এ ত্রাণ সহায়তায় একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ওই তহবিলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প গ্রুপ থেকে আশানুরূপ অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা জমা হচ্ছে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীমণ্ডলীর সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যরা বন্যাকবলিত বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণ ব্যাহত রেখেছে। আশা করছি বন্যা উপদ্রুত এলাকায় বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রমসহ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যবস্থা সচল ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে, ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার, বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার, আর্থিক খাতের সংস্কারের অঙ্গীকার রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের। সরকারের জন্য অগ্রাধিকারমূলক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক করা। ইতোমধ্যে বহু ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পর্যটন ব্যবসা, পরিবহন ব্যবসা, আইটিভিত্তিক ব্যবসা, হোটেল-মোটেল ব্যবসা থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসা পর্যন্ত বিপর্যস্ত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হবে ব্যবসা সচল করার জন্য ছোট, মাঝারি ও ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের স্বার্থ গুরুত্ব দেওয়া। কারণ এসব প্রতিষ্ঠান অর্থনীতির, বিশেষত গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ। দেশে প্রায় এ ধরনের ৭০-৮০ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্প সচল করতে হবে অবিলম্বে। তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে হবে। দেশের অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোয় জনবান্ধব এবং সেবা নিশ্চিত ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতির লাগাম টানা, পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ সব সরকারি অফিসকে ঢেলে সাজাতে হবে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি করা দরকার। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জনপ্রত্যাশা পূরণ করে সবকিছু সম্পন্ন করার জন্য তারা কতটুকু সময় পাবেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। প্রত্যাশা এবার বাংলাদেশে সত্যি সত্যিই একটি ‘সফল সামাজিক বিপ্লব’ সম্পন্ন হবে। ‘আর এই প্রত্যাশার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর দুজন সমন্বয়কও উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়।
বিগত ১৬ বছরে পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় জনআস্থা, জনগণের বিশ্বাসের জায়গায় প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে পুলিশ। পুলিশ রাষ্ট্র এবং জনগণের প্রতিপক্ষ তথা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে নির্বিচারে মানুষ হত্যায় লিপ্ত হয়েছে। এর ফলে জনরোষ সৃষ্টি হয় যা এক শিশু তার পিতার কোল থেকে নেমে এক পুলিশ সদস্যকে দেখে তার দিকে ছুটে গিয়ে কিল ঘুষি মারার দৃশ্যই মনে করিয়ে দেয় পুলিশের ওপর দেশের মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
অবশ্য অধ্যাপক ইউনূস দেশে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে কাজে নেমে পড়েছেন। আমরা দূঢ়ভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর সম্পূর্ণরূপে আস্থা এবং বিশ্বাস রাখতে চাই, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করতে মনোনিবেশ করবেন। তারপর অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত দুর্নীতি ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান। পুঁজি পাচারের মূল রয়ে গেছে দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের লাগামহীন সর্বগ্রাসী বিস্তার রোধ করে পাচার হওয়া অর্থ দ্রুত ফেরত আনা এবং ব্যাংকগুলোর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ উদ্ধার করার। মার্কিন ইতিহাসবিদ ব্রুক অ্যাডামস জানাচ্ছেন, ১৭৫৭ সালের পর বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে কাঠের জাহাজে পুঁজি পাচার এত বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছিল, ওই জাহাজগুলোকে লন্ডন বন্দরে মাল খালাস করার জন্য প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হতো। এই লুণ্ঠন-পর্বকে ইতিহাসবিদরা ‘দি বেঙ্গল লুট’ নামে অভিহিত করে থাকেন। বলা হচ্ছে, ওই লুণ্ঠিত পুঁজি ইংল্যান্ডের ‘প্রথম শিল্পবিপ্লবে’ তথা শিল্পায়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছিল। বর্তমানে এই ‘ঘৃণ্য জাতীয় দুশমন’ পুঁজি পাচারকারীরা প্রতি বছর গড়ে ১৫০০-১৬০০ কোটি ডলার পুঁজি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পাকিস্তানি পুঁজি পাচারকারীদের ভাবশিষ্য হচ্ছে বর্তমানে দেশের নব্য পুঁজি পাচারকারীরা।
প্রসঙ্গত, বিগত ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে পরিচালিত দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের আদলে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের আরেকটি ‘ঝাঁকুনি’ প্রয়োজন। অবশ্য একই রকম মন্তব্য দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের। অবশ্য পরবর্তীতে দুদকের ওই অভিযান এবং দুদক আইনের পুনঃসংশোধন করায় নানান মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয়। ২০০৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত দুদক অর্ডিন্যান্সটি সংসদে অনুসমর্থন (রেটিফাই) না করে দুদককে ‘নখদন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত করেছিলেন বলে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান মন্তব্য করেছিলেন।
‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্র আন্দোলনের অবস্থানও ‘রাষ্ট্রের সংস্কার’-যা একটি বড় ও সময় সাপেক্ষ। কিন্তু বিষয়টি বহুমুখী ও সময় সাপেক্ষ-দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। তাই এটি হবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এটা হবে একটা কঠিন কাজ। প্রথমত, তারা অনির্বাচিত। দ্বিতীয়ত, তাদের মেয়াদ কতদিনের, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিষয়টি গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা দরকার। দীর্ঘমেয়াদি কাজ অনেক, সেসব দেখতে হবে অবশ্যই। আর সেসব সমস্যা চিহ্নিত, বহুল আলোচিত। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে বহুদিন ধরে চলে আসা রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পাশাপাশি আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনও অত্যন্ত জরুরি। এসব করা না গেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিলিত রক্ত স্রোতে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানের ফসল আবার হারিয়ে যাবে কৃষ্ণগহ্বরের অতলে। একই সঙ্গে হারিয়ে যাবে কোটি কোটি কোটি মানুষের আশা ও সোনালি ভবিষ্যৎ। মনে রাখতে হবে পতিত শাসকদের মতো নতুন করে আয়নাঘর বানিয়ে তা অন্যকে দেখাতে না নিয়ে নিজের মুখ আয়নায় দেখতে হবে, যেন সেই চেহারায় বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের চেহারা ভেসে আসে, জনগণের চোখের ভাষা, মুখের ভাষা এবং অন্তরে জমে থাকা অব্যক্ত ভাষার প্রতিফলন ঘটে। প্রতিফলন ঘটে ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা, আস্থা এবং বিশ্বাসের। মনে রাখতে হবে, দেশ আর দেশের মানুষের কল্যাণ, অগ্রগতি, শান্তি, মঙ্গল, উন্নয়নও অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত।
লেখক: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।
১৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস’। দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় এক সহজ কিন্তু জীবনরক্ষাকারী অভ্যাসের কথা—সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা বলেন, “সাবান দিয়ে হাত ধোয়া হলো সবচেয়ে সাশ্রয়ী প্রতিরোধমূলক টিকা।” কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এখনো অনেক মানুষ এই সহজ অভ্যাসটিকে অবহেলা করেন, যার ফলেই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা কিংবা ভাইরাসজনিত অন্যান্য সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, সঠিকভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে এসব রোগের সংক্রমণ ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। তবুও বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের বহু মানুষের কাছে এখনো নিরাপদ পানি ও সাবান—এই মৌলিক জিনিস দুটি সহজলভ্য নয়। বিশেষ করে গ্রামীণ ও বস্তি এলাকায় এই অভাব প্রকট। তাই হাত ধোয়ার বার্তা কেবল সচেতনতায় সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, এটিকে বাস্তব কর্মসূচিতে রূপ দিতে হবে।
খাবার গ্রহণের আগে ও পরে, শৌচাগার ব্যবহারের পর, বাইরে থেকে বাসায় ফেরার পর কিংবা রোগীর সেবা করার আগে-পরে—প্রতিটি ক্ষেত্রেই হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। এই অভ্যাস কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটি সামাজিক দায়িত্বও বটে। বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের হাত ধোয়ার অভ্যাস শেখানো গেলে তারা পরিবার ও সমাজে এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে।
সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার, এনজিও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। বিভিন্ন প্রচারাভিযান, স্কুলভিত্তিক কর্মসূচি ও জনসচেতনতা কার্যক্রমের মাধ্যমে হাত ধোয়ার গুরুত্ব বোঝাতে হবে। এটি কেবল স্বাস্থ্য সুরক্ষাই নয়, অর্থনৈতিকভাবেও একটি বড় বিনিয়োগ—কারণ প্রতিরোধ চিকিৎসার চেয়ে অনেক কম ব্যয়বহুল।
আমরা প্রায়ই উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি, কিন্তু ভুলে যাই—সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ লুকিয়ে আছে আমাদের নিজের হাতে। হাত ধোয়ার মতো ছোট্ট একটি কাজই হতে পারে সংক্রমণ প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় ঢাল।
এই হাত ধোয়া দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক—নিজে হাত ধোব, অন্যকেও শেখাবো। কারণ সুস্থ সমাজ গড়ার শুরুটা সেখান থেকেই।
মোঃ সাজ্জাদুল ইসলাম
লেখক ও কলামিস্ট
কবিতা, কাব্য লেখনী সর্বোচ্চ বোধশক্তি বিশিষ্ট উত্তম চিন্তা ধারণার উৎকৃষ্ট মানের শিল্প সাহিত্যের উপাদান। কাব্যে লেখনীতে কবির প্রাণ উৎসারিত নিবেদন, ভাবনার উৎসর্গের নৈবেদ্য উন্মোচিত প্রকাশিত, উদঘাটিত হয়। তার আত্মবিশ্বাস, আবেগ -অনুভূতি, মূল্যবোধ- দৃষ্টিভঙ্গি। যে মূল্যবোধ, নীতিনৈতিকতা শিষ্টাচার, জ্ঞান তার পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বই-পুস্তকসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অর্জিত। সেই বিশ্বাস, চিন্তা চেতনা, মূল্যবোধেরই পরিস্ফূটন, প্রতিফলন দেখা যায় তার কাব্যে, লেখনীতে।
কবির কাব্য, লেখনী হচ্ছে তার চিন্তা চেতনা, মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, দেশাত্ববোধ ও রাজনৈতিক ভাবনাসহ মানবিক মূল্যবোধের স্বচ্ছ দর্পণ। যেখানে সমাজ জাতির সত্য মিথ্যা, ন্যায়- অন্যায়, সততা- আদর্শ, অসম অনাচার, কুসংস্কার, দুঃশাসন, ধর্মীয় বিশ্বাস, বিপ্লবী চেতনা, দেশ ও মানব প্রেম, রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ সমাজের সার্বিক বিষয় সম্পৃক্ত। অবশ্য দ্বৈত চরিত্রের মূল্যবোধহীন ভয়াবহ বতিক্রম আছে যা এখানে আলোচ্য নয়।
কাব্যিক মূল্যবোধ একটি ইতিবাচক ধারাবাহিক জীবনমুখী পরিবর্তনের মূল্যবোধ। কবি যদি তার আত্বার বিশ্বাস, কবির উপলব্ধিতে কাব্য রচনা করেন সমাজ, সংসার, দেশ জাতি, মানবকল্যাণে, মঙ্গলের উদ্দেশ্যে। প্রকৃত কবি নিমগ্ন চাষির মতো মনের মাধুরী মিশিয়ে যতনে শব্দের চাষ কর্ষনে, বাক্য, চরণে, স্তবকে কাব্য নামক মাঠে প্রেম- মানবতা, বিপ্লবী চেতনা ও দেশাত্ববোধ তৈরি করে। সমাজ সংসার দেশ জাতি ও মানবকল্যাণ মানুষের কর্তব্য, দায়বদ্ধতা, সকল অন্যায়, অশুভ অপশক্তি, বঞ্চনা-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অকপটে নির্মম সত্য প্রকাশের দুর্বার দুঃসাহসী প্রতিবাদের বীজ রোপণ করে ।
কবির কাব্যে বাস্তব আলোয় মুক্ত উদার মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ বিশ্বাসের প্রকাশ থাকে যা অন্ধকারে সমাজ সংসারে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে উন্নয়নের গতিপথ পরিবর্তন করে। সকল নেতিবাচক, জীবনবিমূখ মূল্যবোধকে প্রতিহত করে দেশ ও মানবপ্রেমে উজ্জীবিত, ঐক্যবদ্ধ ও অন্যায় দুঃশাসন রোধে বিপ্লবী চেতনায় জাগ্রত করে। ঘুমন্ত অন্ধবিশ্বাসী মানুষকে জাগরণের মাধ্যমে সুন্দর মানবিক সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সঠিক পথ দেখায়। যা সমাজ হবে জাত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষের জন্য মঙ্গলময়।
পক্ষান্তরে যে কাব্যের বিষয় বস্তুতে শুধু কবির নিজস্ব অন্ধ বিশ্বাস, অলীক চিন্তা- চেতনা, অযৌক্তিক ভাবনা-যুক্তিহীনবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, আবেদন, আত্ম-প্রশংসার প্রকাশ হয়। যে কাব্য পাঠে মানুষের চৈতন্য না ফিরে, বোধ সম্বিত না জাগে, আর সেই কাব্যে যদি সমাজের সংসারের সর্বজনীন, শিল্প -সাহিত্য সংস্কৃতি, সভ্যতা, জগৎ সংসারের কল্যাণের বিষয় সম্পৃক্ত না হয়, তাহলে সেই কবিতা কাব্য লেখনী বৃথা চিরকুট কেবল। অর্থাৎ যে লেখনীতে সমাজ পরিবর্তনে মানব কল্যাণে ইতিবাচক বার্তা মূল্যবোধ না থাকে তবে সেই কাব্য লেখনী আবর্জনা মাত্র।
সবশেষে কাব্যে কবিকে শুধু প্রকৃতি প্রাণীকুল জৈবিক , ব্যক্তি স্বার্থে জীবনের প্রেম ভালোবাসার স্তুতিবাক্য সংমিশ্রণ করলে হবে না। কাব্যে সংযোজন করতে হবে জীবনমুখী ইতিবাচক মূল্যবোধ, দেশ ও মানব কল্যাণে প্রকৃত মানব ধর্ম, মানবতার জয়বার্তা- মন্ত্রবানী।
যে কাব্যে অন্ধকার, ভেদাভেদ, বৈষম্য ও অপশক্তি, অপশাসন অনিয়ম অনাচার মোচনে জাগরণী শব্দ বাক্যে, চরণ, স্তবকের ঝংকারে কাব্যিক সৌন্দর্য গুণে মানুষের চেতনাবোধকে জাগ্রত করবে, সেই কাব্য লেখনীই যুগ যুগ ধরে কালজয়ী হবে। সহজবোধ্য, প্রাঞ্জল ইতিবাচক মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ বাস্তব প্রকৃত মানসম্মত কাব্য লেখনীই পরিবার, সমাজ, গোষ্ঠী জাতি তথা সমগ্র পৃথিবীর সকল বিভীষিকা, পাপ পঙ্কিলতা, গ্লানি আধার ঘোচাবে এবং মানুষকে আলোকিত করবে।
দেশে বর্তমান জনসংখ্যা:
বর্তমান জনসংখ্যা (২০২৫ বা সাম্প্রতিক) ২০২৫ সালে, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন সূত্রে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭৫.৭ মিলিয়ন (১৭৫,৭০০,০০০) ধরা হয়েছে। একটি ডেইলি স্টার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭৫.৭ মিলিয়ন ছুঁয়ে গেছে। অন্য কিছু উৎস ২০২৪–২০২৫ সময়ের জনসংখ্যা ১৭৪–১৭৬ মিলিয়নের সীমায় দেখায়। সুতরাং, বর্তমানের বেশি সম্ভাব্য এবং গ্রহণযোগ্য গণনা ১৭৫.৭ মিলিয়ন–১৭৬ মিলিয়ন (প্লাস-মাইনাস কিছু শতাংশ) বলা যায়।
চ্যালেঞ্জ আগামীর জনসংখ্যা:
২০৫০ সালের জনসংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন, কারণ তা নির্ভর করে জন্মহার, মৃত্যুহার, অভিবাসন, জনসংখ্যা গতি ও সামাজিক পরিবর্তনগুলোর ওপর। নিচে কিছু অনুমান ও সূত্র বিশ্লেষণ দেওয়া হলো: একটি জনপ্রিয় পূর্বাভাস অনুসারে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২১৪.৭ মিলিয়ন হবে। আরও একটি সূত্র World Economics অনুযায়ী, ২০৫০ সালের দিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২১৪ মিলিয়নের দিকে যেতে পারে। জনসংখ্যা বিকাশের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের অনুমানগুলি সাধারণত অপেক্ষাকৃত সংযত হয়; UNFPA বলেছে যে, যদি বর্তমান প্রবণতা বজায় থাকে, তাহলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০৫৩ সালে শীর্ষে পৌঁছতে পারে।
জনসংখ্যার বৃদ্ধি বা হ্রাসের কারণ:
জন্মহার (Fertility Rate): বাংলাদেশে জন্মহার গত কয়েক দশকে ক্রমহ্রাস পাচ্ছে।
মৃত্যুহার ও স্বাস্থ্যসেবা: স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, শিশুমৃত্যু হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
অভিবাসন (Migration): অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর (গ্রাম থেকে শহরে), দেশান্তরী অভিবাসন, সব মিলিয়ে জনসংখ্যার বণ্টনে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। জনসংখ্যার গতি (Population Momentum): একটি দেশে যদি একটি বড় যুব‐সমষ্টি থাকে যারা সন্তান উৎপাদনের বয়সে উপনীত হবে, তাহলে ভবিষ্যতের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে ‘মোমেন্টাম’ কাজ করে।
শিক্ষা, বিশেষ করে নারী শিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনা: শিক্ষার প্রসারণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে পরিবার পরিকল্পনার ব্যবহার বাড়বে, ফলে জন্মহার আরও নিয়ন্ত্রিত হবে।
পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রভাব: বন্যা, রূপান্তরিত কৃষিজমি, মেঘলা আবহাওয়া, উপকূলীয় ক্ষয়, জমি অভিগম্যতা হ্রাস ইত্যাদি কারণে কিছু অঞ্চলের জনসংখ্যা বাসযোগ্য পরিবেশ কম পাবে।
নগরায়ন (Urbanization): গ্রামের মানুষের শহরে আগমন বৃদ্ধি পাবে বলে আশা। শহুরে সুযোগ-সুবিধা, যাতায়াত, কাজের সুযোগ বেশি হওয়ায় মানুষ শহরে যেতে আগ্রহী হবে।
নীতি ও পরিকল্পনা প্রভাব: সরকার ও নীতিনির্ধারকরা জনসংখ্যা চাহিদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নগর পরিকল্পনায় যদি সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করে, জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রিত রাখার সুযোগ থাকবে।
চ্যালেঞ্জ: অবকাঠামোর চাপ বাড়বে (বাসস্থান, পানি, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ)। খাদ্য নিরাপত্তা , খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির চাহিদা, কৃষিজমি হ্রাস, পরিবেশ পরিবর্তন। পরিবেশ ও পরিবর্তন , বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা। স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবার চাহিদা, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, পরিবহন সরঞ্জাম, কর্মসংস্থান। বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বৃদ্ধদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্যবৃদ্ধি।
কৃষি জমি হ্রাস: ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS)–র একটি প্রকল্প (ECDS) অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কৃষি জমি প্রায় ১.৯৮ শতাংশ কমেছে। এর অর্থ, কৃষি জমির আয়তন প্রায় ৭৪,৩৮৮ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে ৭২,৯১৬ বর্গকিলোমিটার এ এসেছে। প্রতি বছর প্রায় ২,৫০০–৩,০০০ হেক্টর (হেক্টর = ১০,০০০ বর্গমিটার) চাষযোগ্য জমি নন-কৃষি কাজে ব্যবহার হচ্ছে। কৃষি জমি হ্রাসে নগরায়ন, শিল্পায়ন, ভবন ও অবকাঠামো সম্প্রসারণ ইত্যাদি প্রধান কারণ।
সুযোগ: যদি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী (১৫–৬৪ বছর) সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানো যায়, অর্থনীতি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ উৎপাদন, সেবা, প্রযুক্তি খাতে বৃহত বাজার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বড় বাজার, দেশজ উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি। উন্নত মানবসম্পদ বিনিয়োগ, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করলে দীর্ঘমেয়াদে যে সুদ পাওয়া যাবে, তা ব্যাপক হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা (Food Security): খাদ্য নিরাপত্তা বলতে বোঝায়, প্রত্যেক মানুষের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে, নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্যে সব সময় শারীরিক ও অর্থনৈতিক প্রবেশাধিকার থাকা, যা একজন সক্রিয় ও সুস্থ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন। মূল উপাদান চারটি: উপলব্ধতা (Availability): পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ। প্রবেশযোগ্যতা (Access): মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বা খাদ্য পেতে সক্ষমতা। ব্যবহার (Utilization): খাদ্য গ্রহণ, সংরক্ষণ ও পুষ্টি ব্যবহারের সক্ষমতা। স্থিতিশীলতা (Stability): দীর্ঘমেয়াদে এসব উপাদানের নিরবচ্ছিন্নতা। খাদ্য নিরাপত্তা শুধু খাদ্যের পরিমাণ বা সরবরাহ নয়, বরং মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, বাজারব্যবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ বা বৈশ্বিক সংকট (যেমন, কোভিড-১৯) খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
পুষ্টি নিরাপত্তা (Nutrition Security): পুষ্টি নিরাপত্তা বলতে বোঝায়, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পুষ্টিকর খাদ্য ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য হওয়া, যাতে তারা সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে ও জীবনযাপন করতে পারে। শুধু যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য খাওয়াই যথেষ্ট নয়, সুষম খাদ্য খেতে হবে। খাদ্যে প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ উপাদান, ক্যালরি ইত্যাদির সঠিক ভারসাম্য থাকা চাই। পুষ্টি নিরাপত্তা খাদ্য নিরাপত্তার একটি উন্নত ধাপ। খাদ্য আছে মানেই পুষ্টি নিশ্চিত নয়। দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, খাদ্যাভ্যাস, মাতৃশিক্ষা – এসব পুষ্টি নিরাপত্তার বড় প্রভাবক। অপুষ্টি শিশুমৃত্যু, খর্বতা (stunting), দুর্বল এবং কর্মক্ষমতা হ্রাসের অন্যতম কারণ।
নিরাপদ খাদ্য (Safe Food): নিরাপদ খাদ্য হলো এমন খাদ্য যা কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক, জীবাণু, কীটনাশক বা ভেজাল পদার্থ মুক্ত এবং মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। নিরাপদ খাদ্য না হলে, তা পুষ্টি বা খাদ্য নিরাপত্তা দিয়েও ক্ষতিপূরণ হয় না। খাদ্যে বিষক্রিয়া, খাদ্যবাহিত রোগ, দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি (যেমন ক্যান্সার) দেখা দিতে পারে। অনেক সময় খাদ্য আছে, পুষ্টিও আছে, কিন্তু তা নিরাপদ নয়, যা পুরো ব্যবস্থা ব্যর্থ করে দিতে পারে। উন্নয়নশীল দেশে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার, খাদ্যে ভেজাল, সংরক্ষণের ত্রুটি, বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা, সবই খাদ্যকে অনিরাপদ করে। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে, এই তিনটি স্তম্ভ, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা, এবং নিরাপদ খাদ্য, একসাথে নিশ্চিত করতে হবে। শুধু খাদ্য সরবরাহ নয়, বরং মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভিগম্যতা প্রয়োজন। সরকার, সমাজ এবং ব্যক্তি, সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
LDC (Least Developed Country): LDC বা ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ হলো এমন একটি দেশ যেখানকার অর্থনীতি, মানবসম্পদ, অবকাঠামো প্রভৃতিতে উন্নয়ন উচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়নি। জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা (যেমন UN, WTO) বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচক (আয়, মানব উন্নয়ন সূচক, অবকাঠামো ইত্যাদি) বিবেচনায় রেখে একটি দেশকে LDC ঘোষণা করে। LDC মর্যাদা পাওয়া দেশের জন্য বিশেষ সুবিধাদি দেওয়া হয়: জিডিপি সীমিত আয় থেকে রপ্তানি ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বা শুল্কহ্রাস সুবিধা, আন্তর্জাতিক সহায়তা, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও কারিগরি সহায়তা ইত্যাদি। LDC থেকে উত্তরণের মুহূর্ত থেকে পরবর্তী ৩ বছর একটি ‘সক্ষমতা রূপান্তর সুবিধা দেওয়া হবে, যাতে উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করা যায়।
‘স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের জন্য যেমন কিছু ইতিবাচক সুযোগ সৃষ্টি হবে, তেমনি কৃষি খাতসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য তা বড় চ্যালেঞ্জও বয়ে আনবে। বিশেষ করে কৃষি খাতে উপকরণ, যেমন বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদির ওপর আমদানি কর ৬ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে সরকারের প্রদত্ত কৃষি ভর্তুকি হ্রাস পেলে কৃষকদের সেচ, বীজ, সার, এবং যন্ত্রপাতির জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হবে, যা তাদের উৎপাদন সক্ষমতাকে হ্রাস করতে পারে।
বর্তমান বৈশ্বিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে কৃষি খাতে সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ হ্রাস এবং আমদানি কর বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। অপরদিকে, আমদানি কর বৃদ্ধি দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, যা সাধারণ ভোক্তাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে। এই পরিবর্তনগুলো শুধু মানব খাদ্য নয়, নন-হিউম্যান যেমন প্রাণিখাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে, সামগ্রিকভাবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
এছাড়া, ডিজেল ও বিদ্যুৎ খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় সেচ কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা সরাসরি ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ সকল চ্যালেঞ্জ খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্যদিকে, প্রতিবছর কৃষি জমি কমে যাওয়া এবং ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের জনসংখ্যা ২০ কোটির বেশি ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশে খাদ্যের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়বে, যা বর্তমানে যে কৃষি উৎপাদন অবকাঠামো রয়েছে, তা দিয়ে সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
এই প্রেক্ষাপটে, এখনই সময় একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের। নীতি নির্ধারকদের উচিত, কৃষি উপকরণের কর হ্রাস, প্রযুক্তিনির্ভর টেকসই কৃষির প্রসার, কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কৃষকদের জন্য সরাসরি সহায়তা নিশ্চিত করা। তবেই ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি টেকসই করা সম্ভব হবে।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।
জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত এবং কলঙ্কিত নির্বাচন। এই তিনটি নির্বাচনে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি।
ফলে সরকার গঠনে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পেছনে অন্যতম উপলক্ষ হিসেবে এসব বিতর্কিত নির্বাচন বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আজ যাদের বয়স ৩৪ বছর, তারা ১৮ বছর বয়স হওয়ার পর জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য যোগ্যতা অর্জন করেন, কিন্তু তাদের ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে।
তারা অধীর আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য। তবে সে নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা রয়েছে, যেগুলো সমাধানের জন্য দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
একটি মহল নির্বাচন বানচাল করার জন্য সচেষ্ট রয়েছে। নিদেনপক্ষে তারা নির্বাচনকে বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইবে—এটি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে।
বিদ্যমান অবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কতটা তৈরি করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা থাকা। ভোটার তালিকায় কোনো ত্রুটি থাকলে নির্বাচন কোনো অবস্থায়ই সুষ্ঠু হতে পারে না। প্রতিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরেজমিনে যাচাইপূর্বক বিদ্যমান ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়। এবারও ভোটার তালিকা যাচাই করার জন্য নির্বাচন কমিশন থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
ভোটার তালিকা যাচাইকারী দলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা যাচাই করার কথা। অভিযোগ আছে, ভোটার তালিকা যাচাইকারীরা অনেক ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি না গিয়েই ভোটার তালিকা হালনাগাদ করেছেন। এই গাফিলতির কারণে ভোটার হওয়ার যোগ্য অনেকেই তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। আবার ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার যোগ্য অনেকেই তালিকায় রয়ে গেছেন। নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, যারা ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তারা নির্বাচন কমিশন অফিসে গিয়ে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করাতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটা কতটা বাস্তবসম্মত, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। আমাদের দেশের মানুষ কি এতটা সচেতন হয়েছেন যে তারা নির্বাচন কমিশন অফিসে গিয়ে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করাবেন? এতে যে সময় ব্যয় ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব হয় না। এখনো সময় আছে পরিদর্শকদল বাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার। ভোটার তালিকা ত্রুটিপূর্ণ রেখে কোনোভাবেই সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায় না।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, সেই প্রশ্নটির এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সাংবিধানিক এবং নিয়মিত সরকার নয়। অতীতে কখনোই এমন সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। পরাজয়ের ভয় থেকে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আদালতকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাতিল করে দেয়। সম্প্রতি আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাতিল করার রায় অবৈধ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে সাধারণভাবে মনে করা যেতে পারে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা খুবই কম। অথচ দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই চায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হোক।
অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। তাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালনের কোনো সুযোগ নেই। এই প্রশ্নের সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে।
এক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতি হতে পারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বহাল রেখে এই সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা এবং বাইরে থেকে উপযুক্ত ও জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য কয়েকজন ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তর করা। পুরো বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের মতামতের জন্য প্রেরণ করা যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের অনুকূল মতামত পাওয়া গেলে নবগঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার কার্যক্রম শুরু করতে পারে। নবগঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কাজ হবে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা।
বিগত জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সংখ্যা ছিল দুই-তৃতীয়াংশের বেশি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়া ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা অনেকাংশে দায়ী। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে দলীয় মনোনয়নদানের অভিযোগ উঠেছে। এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যেকোনো মূল্যেই হোক, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে।
নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণার জন্য প্রার্থীরা বিপুল অর্থ ব্যয় করে থাকেন। এতে প্রার্থীদের মধ্যে সুষম অবস্থান বিঘ্নিত হয়। যারা তুলনামূলক কম অর্থের মালিক, সেসব প্রার্থী প্রচারণায় পিছিয়ে পড়ে একসময় নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। এ জন্য সরকারিভাবে নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকারি খরচে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে মঞ্চ তৈরি করা যেতে পারে। সেই মঞ্চে প্রার্থীরা সমবেত হয়ে জনতার সামনে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করবেন। তারা তাদের কর্মসূচি এবং জনগণের জন্য কী করতে চান, তা ব্যাখ্যা করবেন। নির্বাচনে প্রার্থীরা যে পোস্টার বা ব্যানার স্থাপন করেন, তা সরকারি উদ্যোগে করে দেওয়া হবে। যারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন, তারা অবসরগ্রহণের পরই যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। অবসরগ্রহণের পর অন্তত পাঁচ বছর বিরতি দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। আমলাতন্ত্রের কর্মকর্তা বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন এমন কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে তার পেনশন বেনিফিট রাষ্ট্রের অনুকূলে সারেন্ডার করার বিধান করা যেতে পারে।
জনগণ হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিক, কিন্তু তাদের সব সময়ই ক্ষমতাহীন করে রাখা হয়। পাঁচ বছরে মাত্র এক দিন অর্থাৎ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন জনগণ ক্ষমতায়িত হয়। তারা ভোট দিয়ে তাদের ইচ্ছামতো যে কাউকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাতে পারে। ক্ষমতা শুধু থাকলেই হয় না, সেই ক্ষমতা ব্যবহারের মতো যোগ্যতাও থাকতে হয়। জনগণকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে সতর্ক থাকতে হবে। একমাত্র তাদের সচেতনতাই পারে উপযুক্ত ব্যক্তি বা দলের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা অর্পণ করতে। যারা ভোট দেবেন, তাদের মনে রাখতে হবে, তারা যদি ভোট দিয়ে একজন ভালো মানুষকে সংসদে পাঠান, তাহলে সেই ব্যক্তির ভালো কাজের অংশীদার তারাও হবেন। আর যদি কোনো অসৎ, দুর্নীতিবাজ লোককে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠান, তাহলে তার কৃত অপকর্মের দায়ভার ভোটারকেও বহন করতে হবে।
বর্তমানে একজন তিনটি আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রধান শর্ত হচ্ছে প্রার্থীকে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার হতে হয়। এক ব্যক্তি নিশ্চয়ই তিনটি সংসদীয় আসনের ভোটার নন। তাহলে তিনি কিভাবে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন? যার জনপ্রিয়তা আছে, তিনি তো একটি আসনে দাঁড়ালেই জয়লাভ করতে পারবেন। কোনো ব্যক্তি যদি তিনটি আসনে প্রতিযোগিতা করে তিনটিতেই বিজয়ী হন, তাহলে পরবর্তী সময়ে তাকে দুটি আসন ছেড়ে দিতে হয়। ছেড়ে দেওয়া আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রশ্ন হলো, জয়ী হলেও যে আসন ছেড়ে দিতে হয়, সেই আসনে নির্বাচন করতে হবে কেন? ছেড়ে দেওয়া আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। এই অপচয়ের দায়ভার কে নেবে?
নির্বাচনে ভোটারদের বিশাল দায়িত্ব রয়েছে। দল অথবা মার্কা না দেখে ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে ভোট দিতে হবে। আমরা যদি দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে সঠিক ব্যক্তিকে ভোট দিতে পারি, তাহলেই কেবল জাতীয় সংসদ আমাদের মনের মতো হতে পারে। ভোটারদের সমর্থন না পেলে একজন ব্যক্তির পক্ষে সংসদ সদস্য হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, জাতীয় সংসদ হচ্ছে একটি পবিত্র স্থান, সেখানে যোগ্যদেরই যাওয়া উচিত। নির্বাচনের আগে যেকোনো মূল্যেই হোক, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো বিতর্কিত কর্মকর্তা অথবা কর্মচারীকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। যারা বিতর্কিত, তাদের নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত রাখতে হবে।তাছাড়া আর একটি কথা না বললেই নয়, আমাদের সেনাবাহিনী দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনী। তার বড় প্রমাণ নিকট সময়ে তাদের ভূমিকায় সবাই আশান্নিত। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যার জন্ম। তাদের মাধ্যমে নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব। জাতির ক্লান্তলগ্নে নির্বাচন চলাকালে সেনাবাহিনীকে মেজিড্রেসি পাওয়ার দেওয়া অপরিতার্য। একমাত্র তাদের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে বলে আমি বিশ্বাস করে। তা নাহলে নির্বাচনে কোনো ধরনের কারচুপি হলে জাতিকে সে জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্রের এই যাত্রা শুভ হোক-এই প্রার্থনাই করি।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশে গবেষণার গল্প শুনতে গেলে অনেকটা নদীর মতো মনে হয়। কখনো তা প্রলয়ংকরী বন্যার মতো ভেসে আসে বড় কোনো আবিষ্কারের খবর দিয়ে, আবার কখনো শুষ্ক মরুর মতো স্থবির হয়ে পড়ে—চলমান গবেষণাগুলো মাঝপথেই থেমে যায়, টেকসই হওয়ার আগেই ম্লান হয়ে যায়। আমাদের ইতিহাস প্রমাণ করে, আমরা চাইলে পারি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার যাত্রা মূলত কৃষি গবেষণার ফল। লবণাক্ত সহনশীল কিংবা খরাপ্রতিরোধী ধানের জাত শুধু কৃষকদের জীবনই বদলায়নি, বদলে দিয়েছে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎও। একইভাবে স্বাস্থ্য খাতে স্থানীয় গবেষকদের উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা--রোগ প্রতিরোধে টিকা তৈরি, খাবার স্যালাইন- আশা জাগিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও তরুণ গবেষকরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার সিকিউরিটি কিংবা ইন্টারনেট অব থিংস নিয়ে যে উদ্যোগ নিচ্ছেন, তা সীমিত হলেও আশাব্যঞ্জক। এসব অর্জন বলে দেয়—আমাদের মেধা কম নয়, তবে বড় সমস্যা হলো এই মেধাকে কাজে লাগানোর সিস্টেম দুর্বল।
উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ দেখলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হয়। দক্ষিণ কোরিয়া একসময় যুদ্ধবিধ্বস্ত, অর্থহীন একটি দেশ ছিল। আজ তারা বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তি শক্তি। কারণ তারা বুঝেছিল, গবেষণা কেবল বই বা ল্যাবরেটরির মধ্যে বন্দি রাখলে হবে না; গবেষণাকে শিল্পে, সমাজে ও রাষ্ট্রীয় নীতিতে রূপান্তর করতে হবে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান একসাথে কাজ করে, সরকারের পরিকল্পনা তাদের সহযোগিতা করে, আর গবেষণার প্রতিটি সাফল্য বাজারে পণ্য হয়ে মানুষের জীবনে প্রবেশ করে। আবার জাপান দেখিয়েছে, গবেষণাকে ব্যবহার করে কীভাবে একটি সুপার-এজড সমাজেও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়। সেখানে রোবটিক্স ও এআইভিত্তিক গবেষণাকে স্বাস্থ্যসেবা, প্রবীণ সহায়তা এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজে লাগানো হচ্ছে। জার্মানি নবায়নযোগ্য জ্বালানির গবেষণায় রাষ্ট্রীয় কৌশল নিয়েছে, আর ফিনল্যান্ড শিক্ষা খাতে গবেষণার ফল প্রয়োগ করে গোটা জাতির ভবিষ্যৎ বদলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিও বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার ল্যাব থেকে উঠে আসা এক বিশাল গল্প, যা আজ গোটা বিশ্বের প্রযুক্তির ধারা নির্ধারণ করছে।
কিন্তু বাংলাদেশে গবেষণার পথ অনেকটাই খণ্ডিত। এখানে গবেষণা হয়, তবে বেশিরভাগ সময় তা কাগজে কিংবা প্রোফাইলেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। শিল্প খাত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দূরত্ব কমে না। গার্মেন্টস শিল্প, যা দেশের অর্থনীতির প্রাণ, এখনো গবেষণার ফসল ব্যবহার করে নিজেদের উন্নয়ন ঘটাতে পারছে না! টেক্সটাইল বা পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের মতো ক্ষেত্রে যৌথ গবেষণা থাকলে হয়তো আমাদের গার্মেন্টস খাত আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠত। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবগুলো অনেক সময় ভালো কাজ করে, কিন্তু রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের পরিবর্তনে বা বাজেটের ঘাটতিতে গবেষণাগুলো অকালেই থেমে যায়।
সমস্যার আরেকটি জায়গা অর্থায়ন। উন্নত দেশগুলোতে গবেষণার জন্য স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি তহবিল থাকে। একটি গবেষণা শুরু হলে তা শেষ হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে, এবং সেই ফল ব্যবহারযোগ্য করার সুযোগও থাকে। আমাদের দেশে বরাদ্দ সীমিত, অনেক সময় অনিয়মিত। কোনো প্রকল্প শুরু হলো, দুই বছর পর বাজেট বন্ধ হয়ে গেল, তারপর গবেষণা ফাইলের ধুলোয় হারিয়ে গেল—এটাই আমাদের বাস্তবতা।
এছাড়া গবেষণাকে প্রমোশন বা পদোন্নতির শর্তে পরিণত করাও আরেকটি সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছে। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে গবেষণার মান নির্ধারণ হয় সংখ্যার ভিত্তিতে, গুণের নয়। ফলে অনেক সময় প্রবন্ধ প্রকাশ পায়, কিন্তু তা সমাজে কোনো বাস্তব প্রয়োগ খুঁজে পায় না। অথচ যদি মানদণ্ডে বাস্তব প্রয়োগ, উদ্ভাবনের মাত্রা এবং সামাজিক প্রভাবকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তবে গবেষকরা সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে আগ্রহী হবেন। আরেকটি দিক হলো গবেষকদের মর্যাদা। উন্নত দেশে গবেষক মানে জাতির সম্পদ। তাদের কাজকে সম্মান, মর্যাদা ও প্রণোদনা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে গবেষকরা প্রাপ্য সম্মান অনেক সময় পান না। ফলে তরুণ প্রজন্মের মেধাবীরা গবেষণায় আগ্রহ হারায়, কিংবা যারা আগ্রহী, তারা সুযোগ না পেয়ে বিদেশে চলে যায়। দেশে গবেষণার অবকাঠামো থাকলে, সামাজিক স্বীকৃতি ও আর্থিক প্রণোদনা থাকলে, হয়তো অনেকেই দেশের জন্য থেকে যেতেন।
তবু আশা হারানোর কারণ নেই। কৃষি গবেষণা আমাদের দেখিয়েছে কীভাবে গবেষণার ফল সরাসরি মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। তথ্যপ্রযুক্তিতে তরুণদের স্টার্টআপ, স্বাস্থ্য খাতে স্থানীয় টিকা উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা, কিংবা নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষুদ্র গবেষণা—সবই আমাদের পথ দেখাচ্ছে। এখন দরকার এগুলোকে ছিটেফোঁটা সাফল্য থেকে একটি সুসংগঠিত কাঠামোয় রূপান্তর করা। তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই দেখুন—এআই দিয়ে কৃষিতে উৎপাদন বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে, ইন্টারনেট অব থিংস দিয়ে স্মার্ট সিটি গড়ে তোলা সম্ভব, সাইবার নিরাপত্তা গবেষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো রক্ষা করা যায়। আমাদের তরুণ গবেষকরা এই ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করছেন, কিন্তু তারা যদি সরকারের দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা ও শিল্পখাতের অংশীদারিত্ব পান, তবে বাংলাদেশের গবেষণাও বিশ্বমঞ্চে স্থান করে নিতে পারবে।
এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। গবেষণায় অর্থায়নকে ব্যয়ের খাত নয়, বিনিয়োগের খাত হিসেবে দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা ল্যাব শিল্প খাতের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। গবেষণা মূল্যায়নের মানদণ্ডে কেবল সংখ্যা নয়, বরং সামাজিক প্রভাবকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর গবেষকদের মর্যাদা বাড়াতে হবে—তাদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, পাশাপাশি নীতি নির্ধারণে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশে গবেষণার গল্প তাই সম্পূর্ণ ব্যর্থতার নয়। আমাদের রয়েছে আলোর রেখা, রয়েছে ছায়াও। আলোর দিক হলো মানুষের মেধা, সৃজনশীলতা ও সম্ভাবনা। ছায়ার দিক হলো সিস্টেমের দুর্বলতা, নীতি নির্ধারণের সীমাবদ্ধতা ও অর্থায়নের অভাব। যদি আমরা সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারি, তবে গবেষণা হবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার মূল চালিকাশক্তি।
গবেষণা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের হাতিয়ার। যে জাতি গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেয়, তারাই ইতিহাস বদলায়। আমাদেরও সময় এসেছে গবেষণাকে আনুষ্ঠানিকতা থেকে মুক্ত করে জীবনের অংশ করে তোলার। বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটি ল্যাব, প্রতিটি গবেষকের স্বপ্ন যদি রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে মিলে যায়, তবে একদিন আমরা গর্ব করে বলতে পারব—আমাদের গবেষণা শুধু কাগজে নয়, মানুষের জীবনে পরিবর্তন এনেছে।
লেখক: প্রফেসর ড. ইকবাল আহমেদ : কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু তাদের ভবিষ্যতের পথ হয়ে উঠছে দুর্গম। শিশুরা শ্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ায় সমাজে তাদের অবস্থান, অশিক্ষিত, দরিদ্র ও মাদকাসক্ত, বখাটে এমনকি নানান অপরাধী মানুষের জীবনে প্রবেশ করছে। আন্তর্জাতিক তথ্যমতে, শিশুশ্রমের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এটি কোনোভাবেই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক বার্তা নয়। তাই একজন শিশুর জীবনে শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা দেশ ও সমাজের জন্য জরুরি। কারণ একটি দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অংশকে অবহেলায় অযত্নে রেখে সে দেশের উন্নতি আশা করা আকাশ কুসুম কল্পনা।
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশে শিশুশ্রম একটি গভীর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারতের মতো দেশে, যেখানে দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক চাপ প্রকট, সেখানে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। বাংলাদেশ সরকার শিশুশ্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে নানাবিধ আইন প্রণয়ন করছে। বাংলাদেশের শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী কিশোর শ্রমিকদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ থেকে ১৮ বছর। এছাড়াও আইনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকেই শ্রমে নিয়োগ করা যাবে না। শ্রমজীবী শিশুদের বাবা মা কোনো মালিকের সাথে কোনো ধরনের চুক্তি করতে পারবেন না। এবং কোনো কিশোর শ্রমিককে যদি কাজে নিয়োগ করতে হয়, সেক্ষেত্রে রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তারের কাছে মালিকের খরচে ফিটনেস সনদ সংগ্রহ করে তারপর তাকে কাজে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এদের কাজের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে দৈনিক সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা। আর সেই সময় হতে হবে সন্ধ্যা সাতটা থেকে ভোর সাতটার বাহিরের সময়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আইনগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাগুজের দেয়ালে বন্ধী। বাস্তব চিত্র পুরোটাই মুদ্রার অন্য পিঠ। সরকারি একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৯ লক্ষ।এর মধ্যে শহরাঞ্চলের সংখ্যা ১৫ লক্ষ ও গ্রামাঞ্চলে ৬৪ লক্ষ। এই জরিপে থেকে আরও জানা যায় আমাদের দেশের শিশুরা যে ধরনের কাজের সাথে জড়িত তার মধ্যে প্রায় ৪৫টি কাজই ঝুঁকিপূর্ণ। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শিশুর অধিকার রক্ষা করবে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম অর্থাৎ স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর অথবা শিশুর ব্যাঘাত ঘটায় অথবা বিপদ আশঙ্কা করে, এমন কাজ যেন না হয়, তার ব্যবস্থা নেবে’। এজন্য বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ শিশু সনদের এই ধারা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পেশার তালিকা চূড়ান্ত করে নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি এই শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য বহু পূর্বেই সরকার সারাদেশে ৯৯ শতাংশের বেশি শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। ইটভাটা, গ্যারেজ, ওয়ার্ক শপ, হোটেল, দোকান, বিভিন্ন মিল কারখানায় দেখা যাবে বড়দের মতো শিশুরাও দিনরাত সব ধরনের স্বাভাবিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত। এতে করে তাদের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন দাড়ায় শিশুশ্রম কেন হয়? এর প্রধান কারণ দারিদ্র্য। গরিব পরিবারে বাবা-মা যখন নিজেরাই সংসার চালাতে পারে না, তখন তারা সন্তানের হাতে বই না দিয়ে কাজে পাঠায়। কেউ ভাবেন, এখন যদি কাজ করে টাকা আনে, তাহলে অন্তত খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু এতে তারা ভুল করে, কারণ পড়াশোনা না করলে সেই শিশু সারাজীবন দারিদ্র্যর শৃঙ্খলেই আটকে থাকবে। আরেকটি কারণ হলো অশিক্ষা। বাবা-মা যদি নিজেরাই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, তারা বোঝে না যে শিক্ষা ছাড়া জীবনে উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তারা ভাবে- কাজ করলেই টাকা আসবে, পড়াশোনায় সময় নষ্ট কেন! এর ফল হলো- প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়। কিছু মালিকও দোষী। তারা জানে শিশুদের দিয়ে কাজ করালে কম টাকায় কাজ করানো যায়। তাই তারা শিশুশ্রমিক খোঁজে। এভাবে শিশুশ্রম চলতে থাকে। অথচ আমাদের আইন আছে, শিশুদের দিয়ে কঠিন কাজ করানো নিষিদ্ধ। কিন্তু আইন মানা হয় না, নজরদারি কম। ফলে শিশুদের শৈশব কেড়ে নেওয়া হয়।
শিশুশ্রমের সমাজতত্ব বিশ্লেষনের প্রয়োজন । যেমন ১. শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, তাই তারা অশিক্ষিত থেকে যায়; ২. তাদের কোমল শরীর কষ্টে ভেঙে পড়ে। ভারী ইট বহন করতে গিয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে যায়, হোটেলে ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে ফুসফুস নষ্ট হয়; ৩. তাদের মানসিক অবস্থাও খারাপ হয়। খেলা না করতে পারায় তারা দুঃখী হয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস হারায়; ৪. সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো- তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়; ৫. শিশু শ্রমের বেড়াজালে আটকে পড়া এসব শিশুরা হারিয়ে ফেলে তাদের শৈশব, কল্পনা, আনন্দ সবকিছুই। তারা হয় কাজের খাতিরে, নয়তো পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে কঠিন পরিশ্রমে নিযুক্ত থাকে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর; ৬. শিশুশ্রমিকের জীবন কেমন হতে পারে, তার প্রকৃত চিত্র আমরা খুঁজে পাই আমাদের আশপাশের বহু বাস্তবতায়। শিশুদের শৈশব তো হলো খেলার মাঠে হাসিখুশি সময় কাটানো, বন্ধুর সঙ্গে গল্প করা এবং নতুন কিছু শিখে নিজেদের বিকাশের সুযোগ পাওয়া। কিন্তু যখন শিশুরা শ্রমের বেড়াজালে আটকে যায়, তখন তার জীবন হয়ে ওঠে শুধুই কাজের; ৭. শ্রমের কারণে তাদের পড়াশোনার সুযোগ একদম কমে যায়। এ কারণে শিশুশ্রমিকরা অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে না, যার ফলে তাদের ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতার জন্য একেবারেই অযোগ্য হয়ে পড়ে; ৮. শিশুশ্রমিকদের ওপর কাজের চাপ, নিগ্রহ এবং অভাবের তাড়না তাদের মানসিকভাবে হতাশ ও বিপথগামী করে তোলে। তারা শৈশবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।
শিশু শ্রমের অনেক কারণ রয়েছে; যেমন এক: অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের কাজের জন্য পাঠায়। কারণ তারা চায় তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি। পরিবারের অভাব-অনটন শিশুদের শ্রমের দিকে ঠেলে দেয়; দুই: পারিবারিক অশান্তি, বাবা-মায়ের অশিক্ষা অথবা একাধিক সন্তান থাকার কারণে অনেক সময় শিশুদের কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ে, কারণ তারা মনে করে যে কাজের মাধ্যমে পরিবারকে সহায়তা করা যাবে; তিন: কিছু সমাজে বিশেষ করে গ্রাম-অঞ্চলে, শিশুদের কাজে লাগানোর একটি প্রচলিত অভ্যাস রয়েছে। এখানে শিশুকে স্কুলে পাঠানো অপেক্ষা কাজে পাঠানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়; চার : শিশুশ্রমে শুধু শারীরিক ক্ষতি নয়, এটি তাদের মানসিক ও সামাজিক জীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে; পাঁচ: শিশুরা যখন ছোটবেলায় কঠোর কাজ করতে শুরু করে, তাদের শরীর আরও উন্নতি করতে পারে না। এতে তারা দীর্ঘদিন শারীরিক অসুস্থতায় ভোগে। যেমন- পিঠ, হাড়ের সমস্যার পাশাপাশি দুর্বল শরীরের কারণে রোগবালাইয়ের শিকার হয়; ছয় : শিশুশ্রম শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তারা হতাশাগ্রস্ত, অস্থির ও বিপথগামী হয়ে পড়ে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে তারা মানসিক নির্যাতন ও শোষণের শিকার হয়; সাত: শিশুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো- তার শৈশব, যেখানে সে কল্পনা, খেলা এবং নতুন কিছু শিখে বেড়ে ওঠে। কিন্তু যখন সে শ্রমের মধ্যে আটকে যায়, তখন তার শৈশব হারিয়ে যায় এবং তা কখনও ফিরে আসে না; আট: আমাদের সমাজে হাজার হাজার শিশু আছে যারা বই হাতে নিতে পারে না। তাদের কাঁধে থাকে ভারী বোঝা, হাতে থাকে কাজের সরঞ্জাম, চোখে থাকে অবসাদের ছাপ। স্কুলে যাওয়ার বদলে তারা কাজ করতে যায়। কেউ হোটেলে থালা ধোয়, কেউ রাস্তায় বাদাম বিক্রি করে, কেউ ইটভাটায় কাজ করে, কেউ বাসাবাড়িতে ঝাড়– দেয়। অথচ এই বয়সে তাদের বই পড়া, খেলা আর স্বপ্ন দেখার কথা ছিল। তাই আমরা বলতে চাই- শিশুশ্রম চাই না, পড়তে চাই; নয়: শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য সরকার, সমাজ এবং পরিবারকেই একযোগে কাজ করতে হবে।
এখন শিশুশ্রম বন্ধের এজন্য সরকারের বড় দায়িত্ব আছে; যেমন আইন ও নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন: শিক্ষা সুযোগ নিশ্চিতকরণ; পরিবারের সদস্যদের আয়ের উৎস বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করা; শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি; ধনী পরিবারগুলো গরিব শিশুদের পড়াশোনার খরচ বহন করতে পারে; শিক্ষকরা চেষ্টা করবে, যাতে সব শিশু স্কুলে আসে, আর যারা ছাত্র, তারাও তাদেরকে স্কুলে টানব, যদি সে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। সর্বশেষে বলা যায় শিশুশ্রম সমাজের জন্য একটি মারাত্মক সমস্যা। এটি শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নষ্ট করে এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা দেয়। শিশু শ্রমের ফলে তারা অল্প মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়, যা দারিদ্র্য চিরস্থায়ী করে। অনেক সময় শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ ও অমানবিক পরিবেশে কাজ করতে হয়, যা তাদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। এটি শুধু শিশুদের অধিকার লঙ্ঘন করে না, বরং জাতির ভবিষ্যৎকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই শিশুদের সুরক্ষা, শিক্ষা এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে শিশু শ্রম রোধ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। দেশটা আমাদের সবার। তাই দেশের সকল ভালোমন্দের ফলও ভোগ করতে হবে আমাদেরই। তাই আজকে আমরা শিশুশ্রমকে প্রশ্রয় দিলে ভবিষ্যতে নিরক্ষরতার বোঝা মাথায় করে বয়ে বেড়াতে হবে আমাদের। তাই নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার দায়িত্ব সরকারসহ আমাদের সবার।
লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রয়োগ এখন রমরমা সারা বিশ্বে। কিন্তু সব ছাপিয়ে গিয়ে একজন এআই মানবীকে মন্ত্রী করে ফেলল আলবেনিয়া। রক্ত-মাংসের মানুষ নন, এআই মন্ত্রী পৃথিবীতে এটাই প্রথম। বিশ্বের এই প্রথম এআই মন্ত্রীর নাম ‘ডায়েলা’। দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ এবং সাধারণ মানুষের জন্য সরাসরি ব্যয়ে স্বচ্ছতা রক্ষা করা তার প্রধান দায়িত্ব। আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এদি রামা এমন একটি নিয়োগে উদ্যোগ নিয়েছেন। এআই মানবী ‘ডায়েলা’ তৈরি করে মন্ত্রিসভায় জায়গা করে দিয়েছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। এআই মানবীর কাজে একেবারে মুগ্ধ আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী। তার বিশ্বাস, ডায়েলার নজরদারিতে প্রতিটি সরকারি দরপত্র ১০০ ভাগ স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত হবে।
২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর মানুষের উন্নতির যাত্রাপথে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক দিবস। সেদিন ‘চ্যাটজিপিটি’ নামে একটি শক্তিশালী চ্যাটবট-এর আবির্ভাব ঘটেছিল। চ্যাটজিপিটিতে ‘ডিপ লার্নিং’ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়, যা শুধু টেক্সট বা ভাষা নয়Ñ বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, এমনকি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যেকোনো কাজে ব্যবহার করা যায়। চ্যাটজিপিটির জয়যাত্রা অব্যাহত আছে। সম্প্রতি ‘ভার্সন ৪.৫’ টিউরিং টেস্টেও পাস করেছে। এর অর্থ, মানুষের কাছ থেকে তাদের আলাদা করা কঠিন হচ্ছে। ‘ডিপ লার্নিং’ কাজ করে মানুষের মস্তিষ্কের অনুকরণে তৈরি নিউরাল নেটওয়ার্কের সাহায্যে। এরপর তারা বিষয়গুলো শিখে নেয় অনেকটা মানুষের মতোই। শুধু মানুষের সঙ্গে পার্থক্যÑ এআই-এর বুদ্ধিমত্তা ও অসীম ক্ষমতা। প্রায় মানুষের মতো সহজাত বুদ্ধি; কিন্তু সেইসঙ্গে বিপুল তথ্যভাণ্ডার। ফলশ্রুতিতে এআই সৃষ্টি করেন যে স্রষ্টারা, এআই-এর সিদ্ধান্ত সেই স্রষ্টারাও বুঝতে সক্ষম হন না। অদূর ভবিষ্যতে অতি শক্তিশালী কোনো কম্পিউটারকে বিশেষ কোনো নির্দেশ দেওয়া হলে সে চাইবে, যেকোনো মূল্যে নির্দেশটি পালন করতে; সেজন্য সমাজ-পৃথিবী-পরিবেশ ইত্যাদি ধ্বংস হয়ে গেলেও তার কিছু যাবে-আসবে না। স্রষ্টার ইচ্ছেপূরণ তাতে হয়তো হবে, তবে বড় কঠিন মূল্যে। ‘কম্পিউটেশনাল থিওরি অব মাইন্ড’-এর তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের মন ও চেতনাকে সম্পূর্ণভাবে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামে পুরোপুরি ধরা সম্ভব। তবে আজ সিলিকনের মস্তিষ্কে চেতনার সঞ্চার সম্ভব না হলেও, কে জানে আগামীকাল তা-ও হয়তো সম্ভব হয়ে যাবে! আমরা চাই বা না-চাই, এই নতুন প্রযুক্তিকে নিয়েই আগামী দিনে চলতে হবে আমাদের। সারা বিশ্বের দুরারোগ্য রোগ সারানো, নতুন শক্তির উৎস সন্ধান, শিল্পক্ষেত্রে বিপুল উৎপাদন বৃদ্ধি, শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ পাঠ্যক্রম ও শিক্ষা পদ্ধতি, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন এবং পরিবহণসহ হাজারও মানব কল্যানের দিকগুলো খুলে যাবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ক্ষমতার হাত ধরেÑ এমনটা আজ আশাবাদ নয়, বাস্তবতার দিক নিদর্শন।
এআই সক্ষমতার শত্রু এআই নিজেই। এর অগ্রগতি যেমন বৈপ্লবিক, আবার ক্ষতিকারক সম্ভাবনাও বৈপ্লবিক। এআই অগ্রগতির দূত হলেও নৈতিক দায়িত্ব পালনে কি সমর্থ? এ প্রশ্নের উত্তরটি আরও জটিল হয়েছে, যখন আধুনিক এআই-এর গডফাদার জেফ্রি হিন্টন নিজেই নৈতিক দায়িত্বের কথা বলে গুগল থেকে পদত্যাগ করেছেন। এই প্রযুক্তির ক্ষমতা ও স¤পদ মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী বা একনায়কদের হাতে কেন্দ্রীভূত করে আর্থ-সামাজিক অসাম্য বাড়িয়ে বিপুল কর্মহানি ঘটাতে সক্ষম। ফাইন্যান্স এবং ব্যাংকিং, ই-কমার্স, হেলথকেয়ার, টেলিযোগাযোগ, পরিবহন, ভ্রমণ থেকে সমাজমাধ্যম, বিনোদন, শিল্পকলা, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান গবেষণাÑ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআই-এর বৈপ্লবিক অগ্রগতি হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত চার বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআই-এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭০ শতাংশ। কিন্তু তারপরও এআই নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এআই কি মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে? এক কথায় এর উত্তর ‘না’। অন্তত মানুষ যেভাবে চিন্তা করতে পারে, সেভাবে কখনোই নয়। মানুষের ‘কমন সেন্স’ একটি স্বভাবসিদ্ধ ক্ষমতা; কিন্তু এআই-এর ‘কমন সেন্স’ অর্জন অসম্ভব। এআই-এর না-থাকার তালিকায় আরও অনেক কিছুই আছে। যেমন নান্দনিক বোধ, প্রেরণা, দরদ বা অনুভূতি।
প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান অভিজাত গবেষণাগার থেকে ধীরে ধীরে পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের দোরগোড়ায়, শহরে-গ্রামে-পাড়ায়। সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, একটি বেসরকারি সংস্থা ভারত এবং তানজানিয়ায় প্রায় আট হাজার মানুষের ওপর ইইজি পরীক্ষার মাধ্যমে মস্তিষ্কের তরঙ্গ সংগ্রহ করেছে। এ পরীক্ষায় তারা ওই মানুষদের মনস্তাত্বিক অবস্থা, ঘুম, মনোযোগ, স্মৃতি বা মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়া বুঝতে পেরেছে। এ পরীক্ষা তারা ব্যয়বহুল প্রযুক্তি, প্রশিক্ষিত কর্মী কিংবা নির্দিষ্ট গবেষণাগার ইত্যাদি ছাড়াই একটি সাশ্রয়ী যন্ত্র দিয়ে এবং স্বল্প প্রশিক্ষণের পরেই মস্তিষ্কের তথ্য সংগ্রহে পারদর্শী হয়েছে। এই গবেষণা গর্বের সঙ্গে প্রমাণ করেছে, প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান এখন সবার জন্য, সবার মধ্যে এবং সবার দ্বারা পরিচালিত হতে পারে। বিজ্ঞান আজ শুধু মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গ বিশ্লেষণই করে না, মানুষের অভ্যন্তরের স্বরকেও শুনতে চায়। এত কম খরচে এবং এত বৃহৎ পরিসরে এমন নিউরোসায়েন্স প্রকল্প চালিয়ে ভারতের বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান নিঃসন্দেহে বিশাল মাইলফলকের দাবিদার।
প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান আজ যেখানে পৌঁছেছে, তা একবাক্যে বৈপ্লবিক। তাকে স্বাগত না জানিয়ে অন্য কোনো উপায় নেই। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। কথা থেকে যায়, কারণ এআই-এর গড ফাদার জেফ্রি হিন্টন নৈতিক দায়িত্বের কথা বলে পদত্যাগ করেছেন। কথা থেকে যায় ডিপ লার্নিং নিয়েও। ডিপ লার্নিং কাজ করে মানুষের মস্তিষ্কের অনুকরণে নিউরাল নেটওয়ার্কের সাহায্যে। মডেলগুলোকে বিভিন্ন বিষয়ে বিপুল তথ্য দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়। তারপর আর স্রষ্টার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তথ্যগুলো বিচার করে নিজস্ব নকশা খুঁজে বের করে মডেলরাইÑ ঠিক মানুষের মতোই। ডিপ লার্নিং-এর সিদ্ধান্তের ওপর আর স্রষ্টার কোনো নিয়ন্ত্রণ কাজ করে না। এই মডেলগুলোর বুদ্ধিমত্তা ও অসীম ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের আর কোনো সুযোগ থাকে না; এআই হয়ে দাঁড়ায় নিয়ন্ত্রণহীন শক্তিময় তথ্যভাণ্ডার, যা তারপর তার পথেই চলতে থাকে। এর পাশাপাশি এটাও বলার সুযোগ রয়েছে যে, প্রযুক্তির ক্ষমতা ও সম্পদ মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী বা একনায়কদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে আর্থ-সামাজিক অসাম্য বাড়িয়ে দিতে পারে। এ কারণেই নতুন প্রযুক্তি বিস্ময়ের সঙ্গে বিতর্কের পথেও হেঁটেছে। বিতর্ক এজন্য যে, ডিপ লার্নিং কাজ করে মানুষের মস্তিষ্কের অনুকরণে; কিন্তু সেই মানুষ কোনো না-কোনোভাবে, কারো না-কারো দ্বারা প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রিত হতে পারেÑ এমন সম্ভাবনা থাকলেও এআই-এর ডিপ লার্নিংকে প্রভাবিত কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো সুযোগ নেই। প্রশিক্ষিত করা পর্যন্ত তাকে নিয়ন্ত্রিত করা গেলেও প্রশিক্ষার পর তাকে আর কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সৃষ্টি তখন স্রষ্টার থেকেও অধিক শক্তিশালী হয়ে পড়ে।
সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ক্রমশ আরও সহজ, স্বচ্ছ ও গতিশীল করে তুলেছে। তবু, নাগরিক জীবনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক আজও জটিলতার কাছে পরাস্ত পরিচয় প্রমাণের ক্ষেত্রে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নাগরিককে বারবার একই ধরনের কাগজপত্র, ফর্ম ও তথ্য জমা দিতে হয়। জন্ম নিবন্ধনের জন্য আলাদা ফর্ম, জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য ভিন্ন, শিক্ষাব্যবস্থা ও চাকরির জন্য আলাদা আলাদা তথ্য, ভোটার তালিকায় নাম উঠাতে ও জমি রেজিস্ট্রি করতে আরেকটি, পাসপোর্ট কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্সে আরও আলাদা কিছু। সরকারি-বেসরকারি, প্রতিষ্ঠান-সংগঠন প্রতিটি জায়গায় বারবার নিজের পরিচয় প্রমাণের কঠিন ঝামেলা।
এই বিশৃঙ্খল তথ্য ব্যবস্থায় সত্য ও গোপনীয়তা হীন তথ্য, ভুল তথ্য এবং ভুয়া তথ্যের প্রবেশ বাধা দিতে পারে না কেউ। ফলে নাগরিকের পরিচয় হয় অস্পষ্ট, তথ্য হয় বিচ্ছিন্ন, এবং প্রশাসনের দক্ষতা ও ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক সময় ব্যক্তি নিজেও তার বংশ, ঐতিহ্য, জীবনী সঠিকভাবে বহন করতে পারেন না।
তাই প্রশ্ন হলো সব তথ্য যদি একটি মাত্র একক, সার্বজনীন, আজীবন ব্যবহারযোগ্য নাগরিক পরিচয় নম্বর (একক পরিচয় নম্বর) এর সঙ্গে যুক্ত করা যেত, যা জন্ম থেকে মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকত, তবে কি নাগরিক জীবনের এই বহুবিধ জটিলতা দূর হয়ে যেত; কীভাবে এটি আমাদের পরিচয় ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর, নির্ভুল করে তুলতে পারত?
এই প্রশ্নের উত্তরে, একক পরিচয় নম্বর -ই এক যুগান্তকারী ধারণা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি শুধু নাগরিকের জীবনকে সহজ করবে না, রাষ্ট্রের সেবা প্রক্রিয়াকেও করবে দ্রুত, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হতে পারে কীভাবেএকক পরিচয় নম্বর আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হতে পারে।
জীবনচক্র, ধরা যাক রাজধানীর একটি হাসপাতালে এক নারী সন্তান প্রসব করতে এলেন। তিনি যদি পূর্বেই একটি ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন নম্বর পান, এবং সেটি রাষ্ট্রীয় তথ্যকেন্দ্রে সংরক্ষিত থাকে, তাহলে সেই নম্বর ব্যবহার করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সহজেই জানতে পারবে তার স্বাস্থ্য ইতিহাস, রক্তের গ্রুপ, অ্যালার্জি, অপারেশনের বিবরণ, এমনকি গর্ভকালীন চিকিৎসা সম্পর্কেও। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে এবং জীবনরক্ষাকারী সিদ্ধান্ত নিতে তাদের আর দ্বিধা করতে হবে না।
শিশুটি যখন জন্ম নেবে, তখনই তার জন্য একটি একক পরিচয় নম্বর স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেনারেট হবে। এই নম্বরে থাকবে - তার জন্মের স্থান ও সময়, পিতামাতার নাম ও পরিচয় নম্বর, জন্মের সময় তার শারীরিক চিহ্ন বা বায়োমেট্রিক তথ্য, প্রসবসংক্রান্ত মেডিকেল ইতিহাস (জন্ম পরিচয়)
এখানেই শেষ নয় এই নম্বরের মাধ্যমেই শিশুটির টিকা কার্যক্রম শুরু হবে। যতবারই সে টিকা নেবে, সেই রেকর্ড তার একক পরিচয় নম্বরের সাথে যুক্ত হবে। এতে চিকিৎসকরা ভবিষ্যতে সহজেই জানতে পারবেন, সে কোন কোন ভ্যাকসিন নিয়েছে, আদৌ সময়মতো নিয়েছে কিনা, তার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল ইত্যাদি।
শিক্ষাক্ষেত্রে, শিশুটি যখন প্রথম বা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি হবে, তখন আর বাবা-মাকে আলাদা করে জন্মসনদ, মেডিকেল সার্টিফিকেট, ঠিকানা প্রমাণ ইত্যাদি জমা দিতে হবে না। শুধুমাত্র তার একক শিক্ষা-নম্বর প্রদান করলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জানতে পারবে শিশুটি কে, তার পিতা-মাতা কারা, তার কোনো স্বাস্থ্যগত বা মানসিক বিশেষ চাহিদা রয়েছে কিনা, সে পূর্বে কোনো শিশু বিকাশ কেন্দ্রে পড়েছে কিনা এবং তার শেখার অগ্রগতি কেমন।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক, তারপর উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি স্তরেই এই একক নম্বর শিক্ষার্থীর জীবনপঞ্জির মতো কাজ করবে। তার ফলাফল, উপস্থিতি, সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, আচরণ মূল্যায়ন এমনকি পছন্দের বিষয়সমূহও এই নম্বরের সাথে যুক্ত থাকবে।
এই তথ্য সর্বক্ষেত্রে থাকার অর্থ হলো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কমিটি আগেই জানতে পারবে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা ও মনোভাব। তার মেধা মূল্যায়ন করা যাবে সামগ্রিকভাবে। কোনো ভুয়া সনদ তৈরি বা জমা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, দেশে কিংবা বিদেশে ভর্তি প্রক্রিয়া সহজ হবে এবং শিক্ষার্থী প্রতারণার শিকার হবে না।
মেধাবী কিন্তু আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বাছাই করাও সহজ হবে। সরকার, শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা বেসরকারি কোনো সংগঠন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশের যে কোনো প্রান্তের প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীকে খুঁজে বের করতে পারবে এবং তাকে যথাযথভাবে প্রণোদনা বা বৃত্তি দিতে পারবে। এর জন্য আর আলাদাভাবে কোনো সুপারিশ বা মধ্যস্থতার প্রয়োজন হবে না।
একজন শিক্ষার্থী তার পূর্ববর্তী সকল শিক্ষা জীবনের তথ্য অনায়াসে জানাতে পারবে। কারণ তার অতীতের শিক্ষা-ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করেই ভবিষ্যতের সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ ও অর্জন সম্ভব হবে।
কর্মক্ষেত্রে , কর্মজীবনে প্রবেশ করতে গেলে একজন চাকরিপ্রার্থীকে নানা ধরনের জটিলতা ও বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আলাদাভাবে সিভি জমা দেওয়া, একই তথ্য বারবার সরবরাহ করা, পরীক্ষা ও সাক্ষাৎকারের প্রতিটি ধাপে নিজের পরিচয় ও যোগ্যতা নতুন করে প্রমাণ করা এ যেন একটি দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, নিয়োগদাতাদের ক্ষেত্রেও সঠিক প্রার্থী বাছাই করা, তার অতীত অভিজ্ঞতা যাচাই, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বোঝা কিংবা তার আগের বেতন ও দক্ষতার ভিত্তিতে ন্যায্য মূল্যায়ন করা প্রায়ই সম্ভব হয় না। ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেক সময়ই স্বচ্ছ ও কার্যকর হয় না, যা প্রার্থী ও নিয়োগকর্তা উভয়ের জন্যই সময়, শ্রম ও অর্থের অপচয় ঘটায়।
এই প্রেক্ষাপটে একটি একক পরিচয় নম্বর চালু করা হলে দেশের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একই নম্বর ব্যবহার করে একজন নাগরিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ, পূর্ব অভিজ্ঞতা, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা, বেতন কাঠামো, দক্ষতা ও সাফল্যের সঠিক রেকর্ড সংরক্ষণ করা গেলে নিয়োগের ক্ষেত্রে আর কোনো জটিলতা থাকবে না। নিয়োগকর্তারা সহজেই একক পরিচয় নম্বরের মাধ্যমে প্রার্থীর প্রোফাইল যাচাই করতে পারবেন এবং পছন্দের প্রার্থীকে স্বল্প সময়ে খুদেবার্তা বা অন্য যে কোনো মাধ্যমে নিয়োগের প্রস্তাব দিতে পারবেন। প্রার্থীরও আর বারবার দরজায় দরজায় ঘুরতে হবে না।
অন্যদিকে, জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে আজও নানা ধরনের জালিয়াতি ও অসচ্ছতার ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের যদি নির্দিষ্ট একক পরিচয় নম্বর থাকে, তাহলে জমির মালিকানা নিশ্চিত করা, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচয় যাচাই, মামলার অবস্থান জানা এবং কোর্টের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সহজ হবে। এছাড়াও, দুরগত এলাকায় বসবাসরত মানুষের সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি করা সম্ভব হবে, যা সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
এই আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় তথ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে একদিকে নাগরিকের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষা এবং অন্যদিকে পরিবার ও সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই একক পরিচয় নম্বর ভিত্তিক এই ব্যবস্থা কার্যকর করলে দেশের উত্তরাধিকার প্রক্রিয়া হবে আরও সুশৃঙ্খল, স্বচ্ছ ও দ্রুততর।
পরিকল্পনায় , বর্তমান তথ্যভিত্তিক যুগে উন্নয়ন এবং নীতিনির্ধারণের সফলতা মূলত নির্ভর করে সঠিক, সময়োপযোগী ও ব্যাপক তথ্যের উপস্থিতির ওপর। বাংলাদেশে নানা ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষা সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য নির্ভরযোগ্য ডেটার অভাব এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একক পরিচয় নম্বর চালু হলে সরকারের জন্য দেশের জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন দিক যেমন শিক্ষার্থী সংখ্যা, কর্মক্ষম জনগণ, স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা, নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি, মৃত্যুহার এবং শিক্ষার হার সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ অত্যন্ত সহজ ও কার্যকর হবে।
এই তথ্যসমূহের মাধ্যমে নীতিনির্ধারণীরা বাস্তবসম্মত ও তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যা দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে গতিশীল করবে। ফলে সুনির্দিষ্ট ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন এবং সমাজের বিভিন্ন দুর্বল ক্ষেত্রে কার্যকর হস্তক্ষেপ সম্ভবপর হবে। তাই একক পরিচয় নম্বর বাস্তবায়ন আমাদের দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে, যা তথ্যের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে সামগ্রিক উন্নয়নের পথ সুগম করবে।
নিরাপত্তা , রাষ্ট্র বা সরকারের সামনে আজকের ডিজিটাল যুগে নিরাপত্তা, গোপনীয়তা ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলো অন্যতম জটিল ও সংবেদনশীল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা, তথ্যের অবৈধ ব্যবহার রোধ, এবং প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাইবার হামলা প্রতিরোধ করাই এখন সরকারের প্রধান দায়িত্বের মধ্যে পড়েছে। সফল ও নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল সেবা প্রদানের জন্য রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যে, তথ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা যেমন ডেটা এনক্রিপশন এবং গোপনীয়তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ সম্পূর্ণ কার্যকর, নাগরিকের সম্মতি ছাড়া তাদের তথ্য ব্যবহার সংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধ বজায় রয়েছে, এবং হ্যাকিং কিংবা ডেটা চুরির মতো সাইবার ঝুঁকিগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। পাশাপাশি, এই ব্যবস্থাগুলোর জন্য যথাযথ ও আধুনিক প্রযুক্তি অবকাঠামো গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। নাগরিকদের আস্থা অর্জন ও তাদের তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, যাতে ডিজিটাল পরিবর্তনের সুফল সমগ্র সমাজে নিরাপদে পৌঁছাতে পারে।
রাষ্ট্রের উচিত নাগরিকদের আস্থা অর্জন করা এবং প্রয়োজনীয় সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
আমাদের আহ্বান ,সরকার যেন দ্রুত নীতিমালা প্রণয়ন করে, পাইলট প্রকল্প চালু করে এবং নাগরিকদের জন্য এই একক, সার্বজনীন ও আজীবন নাগরিক পরিচয় নম্বর বাস্তবায়ন শুরু করে।
সেলিম রানা : গণমাধ্যমকর্মী ও কলাম লেখক।
বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে প্রথমবারের মতো সরাসরি রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। এই সাক্ষাৎকার শুধু তার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিকনির্দেশনা হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে। তার কণ্ঠে শোনা গেছে আত্মবিশ্বাস, সহিষ্ণুতা ও পরিবর্তনের অঙ্গীকার, যা অনেকের কাছে নতুন বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক রূপরেখা হয়ে উঠেছে।
সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান প্রথমেই বলেন, তিনি খুব শিগগিরই দেশে ফিরবেন। তবে দেশে ফেরার পথে কিছু ‘সংগত কারণ’ রয়েছে, যা তিনি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেননি। দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে অবস্থানরত এই নেতা জানান, সময় এসেছে বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার। তার ভাষায়, ‘আমি দেশে ফিরতে চাই এমন এক সময়ে, যখন মানুষ রাজনীতিতে বিশ্বাস করতে পারবে, যখন ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা ফিরে আসবে।’ এই বক্তব্যের মধ্যেই ফুটে ওঠে এক ধরনের রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাস, যা বিগত দেড় দশকের মধ্যে বিএনপির নেতৃত্বে তেমনভাবে দেখা যায়নি।
তারেক রহমানের ভাষায়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু প্রতিহিংসা ও দমননীতি রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘যারা অন্যায় করেছে, তাদের বিচার হবে আইন অনুযায়ী, কিন্তু প্রতিশোধের রাজনীতি আমরা করব না।’ এই বক্তব্যে তার রাজনৈতিক পরিণতিবোধের পরিচয় মেলে। একসময়ের তরুণ রাজনৈতিক উত্তরসূরি এখন নিজেকে এক ধীরস্থির, প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি হিসেবে তুলে ধরছেন।
সাক্ষাৎকারে তিনি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য অবস্থান নিয়েছেন। বলেছেন, ‘যে দেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীন, সে দেশই প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক। আমরা সংবাদমাধ্যমকে ভয় পাই না, বরং তার স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করি।’ এক সময় বিএনপির শাসনামলে সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। এবার তিনি সেই ইতিহাস থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, স্বাধীন মতপ্রকাশ ও তথ্যপ্রবাহে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করবেন। তার এই বক্তব্য গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে, যদিও অনেকে বলছেন—কথায় নয়, কার্যকর পদক্ষেপেই দেখা যাবে এর বাস্তব রূপ।
বিচারব্যবস্থা নিয়েও তিনি পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। বলেছেন, ‘আমরা কাউকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দিতে চাই না, কিন্তু অপরাধ করলে বিচার হবেই। আইন সবার জন্য সমান হতে হবে।’ এই বক্তব্য বিএনপির অতীত রাজনীতি থেকে এক ধরণের নীতিগত বিচ্ছিন্নতা নির্দেশ করে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তারেক রহমান যদি ভবিষ্যতে এ দিকটি প্রাধান্য দেন, তবে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
রাজনীতিতে তার এই নতুন ভাষা, সংলাপ, সহনশীলতা ও পুনর্গঠন, একটি ইতিবাচক সুর তৈরি করেছে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তার এই বক্তব্য নতুন আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক তরুণ লিখেছেন, ‘এটাই সেই ভাষা যা রাজনীতি থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।’ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমালোচনা না করে তিনি বরং সহযোগিতার ডাক দিয়েছেন। বলেছেন, ‘বিরোধিতা থাকতেই পারে, কিন্তু আমরা চাই সব দলই রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিক। যে সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে, সেটিই হবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার।’
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি আসন্ন নির্বাচনের জন্য একটি নরম রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করেছেন। এমন এক সময়ে যখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত, তখন তার সংযত ভাষা এবং আক্রমণাত্মক না হয়ে সমঝোতামূলক অবস্থান বিএনপির ভাবমূর্তি বদলাতে সাহায্য করতে পারে।
তবে এই সাক্ষাৎকারে কিছু বিষয় রয়ে গেছে। তিনি এখনো দেশে ফেরা প্রসঙ্গে বলেছেন ‘সংগত কারণ’। যার পেছনে রয়েছে বেশ কিছু সংগত কারণ রয়েছে। সেই কারণগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে নানা বক্তব্য রয়েছে। অনেকের মতে, এটি নিরাপত্তাজনিত বা আইনি জটিলতার ইঙ্গিত। আবার অনেকে বলছেন, এটি একটি কৌশলগত অপেক্ষা, যাতে বিএনপির সংগঠন আরও দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারে তার প্রত্যাবর্তনের আগে।
তবে এই প্রশ্নের বাইরেও যে বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত, তা হলো তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর। ২০০৬–০৭ সালের তরুণ তারেক রহমানের সঙ্গে আজকের সাক্ষাৎকার দেওয়া তারেক রহমানের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য। তখন তিনি ছিলেন সংগঠনমুখী। এখন তিনি জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। তিনি স্পষ্ট করে বলছেন, ‘রাজনীতি মানে সেবা, শাসন নয়। আমি চাই জনগণই রাষ্ট্রের মালিক হোক।’ এই কথার মধ্যেই নতুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দর্শন নিহিত আছে। তারেক রহমানের ভাষায় এটি এমন একটি একটি অংশগ্রহণমূলক, দায়বদ্ধ ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক কাঠামো, যেখানে নাগরিকই হবে নীতিনির্ধারণের কেন্দ্র।
অর্থনৈতিক বিষয়েও তার বক্তব্যে এসেছে সুগভীর চিন্তার ছাপ। তিনি বলেছেন, ‘আমরা শুধু প্রবৃদ্ধির কথা বলব না, বলব ন্যায্যতার কথা। ধনী আরও ধনী হবে, আর গরিব আরও গরিব—এই চক্র ভাঙতে হবে।’ বাংলাদেশের বর্তমান বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রেক্ষাপটে এটি এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উচ্চারণ। তার এই বক্তব্য ইঙ্গিত করে, বিএনপি আগামীর অর্থনৈতিক নীতিতে সামাজিক ন্যায্যতা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দিতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সাক্ষাৎকারের পর বিএনপির অভ্যন্তরে একধরনের নীতি–পুনর্বিন্যাস ঘটছে। অনেকেই মনে করছেন, তারেক রহমান আসন্ন নির্বাচনের আগেই দেশে ফিরতে পারেন এবং ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের যে স্বপ্ন তিনি ব্যক্ত করেছেন, সেটির রূপরেখা ধীরে ধীরে সামনে আনবেন। তার লক্ষ্য কেবল ক্ষমতায় ফেরা নয়, বরং রাষ্ট্রের কাঠামোগত পুনর্গঠন।
তবে সামনে বাধাও কম নয়। আইনি জটিলতা, সংগঠনের দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা। সব কিছুই তার পথে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তার প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে দরকার হবে সুসংগঠিত কর্মপরিকল্পনা ও নেতৃত্বের দৃঢ়তা।
এই সাক্ষাৎকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন আশার সঞ্চার করেছে। অনেকেই একে ‘পরিবর্তনের শুরু’ বলে অভিহিত করছেন। রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে যে সহিংসতা, প্রতিহিংসা ও বিভাজনের সংস্কৃতি চলেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যে সংলাপ, সহমর্মিতা ও সংস্কারের পথে হাঁটতে পারে। তারেক রহমান সেই সম্ভাবনা জাগিয়েছেন।
তারেক রহমানের এই সাক্ষাৎকারের পর রাজনৈতিক বোদ্ধা, বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ, সমাজ বিশ্লেষকেরা তার এই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে নতুন এবং ইতিবাচক ধারার প্রবর্তনের ইঙ্গিত পেয়েছেন। রাজনৈতিক মহলে এটি একটি মিডিয়া ইন্টারভিউ হিসেবে দেখা হচ্ছে না, বরং একজন সম্ভাব্য রাষ্ট্রনায়কের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রজ্ঞার পরিচয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সাক্ষাৎকার ভবিষ্যতের জাতীয় রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত হবে, যার প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি।
আন্তর্জাতিক ও প্রভাবশালী মিডিয়া হিসেবে বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেওয়াটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করা হয়; বিশেষ করে, যখন প্রতিটি শব্দ দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণকে প্রভাবিত করে। বিষয়টি নিশ্চয় তারেক রহমানের অজানা নয়।
তিনি সাক্ষাৎকারের সময় অত্যন্ত স্থির, আত্মবিশ্বাসী এবং পরিমিতভাবে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তার প্রতিটি উত্তর হিসেবি ও কৌশলগত; তাতে আবেগপ্রবণতা বা হঠকারিতা নেই। একজন জাতীয় নেতা হিসেবে এই স্থিরতা, আত্মবিশ্বাস ও পরিমিত প্রকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয় তারেক রহমানকে এই প্রজন্মের কাছে নতুন ও আলাদা করে উপস্থাপন করেছে।
এ বিষয়ে এক কলামে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফাইজুস সালেহীন এক কলামে লিখেছেন, ‘বিবিসির সঙ্গে তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার বাস্তবিক অর্থেই অনন্যতার দাবি করতে পারে। সাক্ষাৎকারের প্রায় পুরোটাই শুনেছি এবং টেক্সটও পড়েছি। প্রতিটি প্রশ্নের জবাবের মধ্যে পরিমিতিবোধ, সংযম ও দূরদর্শিতার অপূর্ব মেলবন্ধন ছিল মুগ্ধ হওয়ার মতো। একজন পরিণত নেতার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটেছে এই সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে। বিবিসি সাংবাদিকের প্রশ্নগুলোও ছিল বাংলাদেশের জনগণের ভাবনার সমান্তরাল। অর্থাৎ মানুষের মনে যেসব প্রশ্ন রয়েছে, মোটামুটি সেগুলোই জিজ্ঞাসিত হয়েছেন তারেক রহমান। তার উত্তরের মধ্যে না ছিল আমিত্বের বড়াই, না ছিল অন্য কোনো পক্ষকে ছোট করার প্রবণতা।’
মওদুদ আলমগীরের এক কলামে লেখেন, ‘পুরোটা দেখে মনে হয়েছে, উত্তর দেওয়ার সময় তার মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। তিনি অন্তর দিয়ে যেটা বিশ্বাস করেন, সেটাই বলেছেন নির্দ্বিধায়। কথা বলার সময় তিনি যতটা না দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অবস্থান থেকে কথা বলেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সচেষ্ট ছিলেন তার কথোপকথনে জাতীয় ঐক্যের সুরটা যেন আরও বেশি বলিষ্ঠ শোনা যায়।
তাঁর বক্তব্যের এ ধারা দেশের রাজনৈতিক সুস্থতার জন্য অনেক প্রয়োজন। প্রতিপক্ষকে অনাবশ্যক আক্রমণের সুযোগ যেমন নেননি, তেমনি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে এক সাধারণ মানুষের মতো ভদ্রোচিত অস্বস্তিতে ছিলেন, যেন তার কোনো কথাতেই আত্মম্ভরিতা বা অহংকার প্রকাশিত না হয়। শ্রোতা–দর্শকের কাছে তার এ অভিব্যক্তি নিশ্চয়ই নজর এড়াবে না।’
গণমাধ্যমে তারেক রহমানের এই ভাষা, ইতিবাচক চিন্তা ও জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়িত হবে কি না—তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। তবে এটুকু স্পষ্ট, এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি বিএনপির রাজনীতিকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস নিয়েছেন। তার বক্তব্যে যে ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন ফুটে উঠেছে, সেটি কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, বরং একটি ন্যায্য, স্বাধীন ও সুশাসিত রাষ্ট্র গড়ার আহ্বান। এই আহ্বান যদি বাস্তবে রূপ পায়, তবে হয়তো বহুদিন পর বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও নতুন আশার আলো দেখতে পাবে।
রাজু আলীম : কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
খেলনা রপ্তানি আগামী পাঁচ বছরে আট গুণের বেশি বাড়তে পারে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে বিশ্বের ৮৮টি দেশে খেলনা রপ্তানি হয়েছে সাড়ে সাত কোটি ডলারের বেশি। ২০৩০ সালে এই রপ্তানির আকার বেড়ে দাঁড়াতে পারে প্রায় ৪৭ কোটি ডলার। ফলে বৈশ্বিক খেলনা রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ২৮তম। ২০২৩–২৪ র্অথবছরে ২৭ কোটি ডলারের প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিকে এই খাতে প্রচ্ছন্ন রপ্তানি হয়েছে ১২০ কোটি ডলার। প্লাস্টিক শিল্পের দেশীয় বাজারের আকার এখন ৪০ হাজার কোটি টাকা। খাতটি সরকারকে বছরে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব দিয়েছে। দেশে প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার, যার অদিকাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই)। এর মধ্য খেলনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ২৫০। বাংলাদশেরে খেলনাশিল্পে সম্ভাবনা থাকলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মান নিয়ন্ত্রণের সমস্যা, দুর্বল অবকাঠামো ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া গবষেণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগের ঘাটতি আছে। এর সঙ্গে
খেলনাশিল্পে ছাঁচ ও নকশা উন্নয়নের অভাব আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশকে কঠিন করছে। এর আগে রপ্তানিশিল্পে বৈচিত্র্য আনতে হবে। ২০৩২ সালের মধ্যে বিশ্বের খেলনা বাজারের আকার দাঁড়াবে ১৫০ বলিয়িন ডলার। র্বতমানে বিশ্বের খেলনা বাজারের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে চীন। তবে মজুরি বেড়ে যাওয়ায় তারা ধীরে ধীরে নিম্নমানের খেলনা উৎপাদন থেকেও সরে আসছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন সুযোগ। র্বতমানে দেশে এই খাতে বিনিয়োগ ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০৩০ সালের মধ্যে এই বিনিয়োগ দ্বিগুণ হতে পারে। খেলনা রপ্তানরি জন্য আমাদের আলাদা বাজার চহ্নিতি করতে হবে। দেশে তৈরি কিছু পণ্য কম মানের হলেও বিক্রি করা যায়। তবে বিশ্ববাজারে পণ্যের মান র্সবোচ্চ রাখতে হব। খেলনা রপ্তানিতে ব্র্যান্ড ইমিজ তৈরি করতে হবে। ছাঁচ ও নকশার প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হবে । স্থানীয় ছাঁচ যেভাবে তৈরি হচ্ছে, তা মানসম্পন্ন করছে না। স্বত্ব ও মধ্যস্বত্বের বিষয়ে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ বেশি দেখা যায়। স্বত্ব ও ট্রেডমার্ক ব্যবস্থা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য নিরাপত্তার বলয় তৈরি করবে। এর ফলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক নতুন বাজারে দেশের প্রতিষ্ঠানের সুযোগ পাবে। সরকার কিছু নীতিগত সহায়তা দেবে। তবে মান, প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়ন শিল্পউদ্যোক্তাদের নিজেদের করতে হবে। চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে আমাদের আরও শক্তিশালী হতে হবে। সরকার জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশেগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য নিয়েও আলোচনা করছে। রপ্তানিমুখী খেলনাশিল্পকে এসব বাজারে রপ্তানির সুযোগ তৈরি করতে হবে। এই শিল্প রপ্তানি শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর প্রয়োজন।
রপ্তানিমুখী খাত হলেও প্লাস্টিক শিল্পকে উচ্চহারে করপোরেট কর দিতে হয়। এটা কমানো প্রয়োজন। সম্ভাবনাময় এ খাত আরও একটু সহযোগিতা পেলে দ্রুত এগিয়ে যাবে। প্লাস্টিক খাতের উপখাত খেলনায়ও বাংলাদেশ বেশ ভালো করছে। দেশে খেলনার ব্যবহার বেড়েছে। এখন প্রায় আমদানি করতে হয় না। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে, এমন পণ্য বানাতে হবে। খেলনাশিল্পের কোয়ালিটি বাড়ানোর পাশাপাশি দামও কমাতে হবে। উদ্যোক্তারা প্রতিটি খেলনায় ভিন্নতা ও নতুনত্ব নিয়ে আসায় অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি বিদেশের বাজারে আমাদের পণ্যের চাহিদা বেশ ভালো। খেলনা শিল্প উন্নয়নে বিকাশের জন্য সরকারের সব রকমের সহযোগিতা লাগবে। যেহেতু প্লাস্টিক খাত একটি শ্রম নির্ভর এবং প্রচুর পরিমাণে মহিলা শ্রমিকের কাজের সুযোগ আছে তাই এই সেক্টর একদিন গার্মেন্টস এর মতো রপ্তানিতে বড় ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা আছে। আজ থেকে ১ দশক আগেও ৯০% খেলনা আমদানি নির্ভর ছিল। বর্তমানে ১০% আমদানি হয়, ৯০% দেশে তৈরি হয়। দেশের রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ ঝুড়িতে নতুন করে আশা দেখাচ্ছে প্লাস্টিকের খেলনা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের রপ্তানি আয়ে বড় ভূমিকা রাখবে প্লাস্টিকের খেলনাসামগ্রী। সে জন্য এই খাতের ওপর থেকে করপোরেট ট্যাক্স তথা কর কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন রপ্তানিমুখী প্লাস্টিক ব্যবসায়ীরা। আমাদের এখানে কয়েক বছর আগেও কম মূল্যের প্লাস্টিকের খেলনার প্রায় পুরোটাই ছিল আমদানি নির্ভর। কিন্ত গত কয়েক বছরে অবস্থা অনেকটা বদলেছে। বর্তমানে এসব খেলনার বিরাট একটি অংশই তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। আরও আগে থেকেই পুরান ঢাকা এবং আশেপাশের কিছু এলাকায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প হিসেবে খেলনা তৈরির বিভিন্ন কারখানা গড়ে উঠছে । মূলত: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং ব্যস্ততম খেলনার বাজার পুরান ঢাকার চকবাজারে। বেশ কয়েক বছর আগেও প্লাস্টিকের খেলনার প্রায় পুরোটাই আসত চীন ও তাইওয়ান থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে ভালো একটি জায়গা দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশে তৈরি খেলনা সামগ্রী। দেশে বিভিন্ন ধরনের খেলনার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে এ শিল্পে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমান। বাংলাদেশে ছোটদের জন্য খেলনা তৈরির মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির জন্য বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। খেলনা প্রস্তুতকারী দেশীয় বিভিন্ন কারখানা এবং প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে এই শিল্প দ্রুত বিকশিত হয়ে বিরাট অবদান রাখতে পারে দেশীয় অর্থনীতিতে। একসময়ে বাংলাদেশে খেলনা সামগ্রী হিসেবে অনেক নিম্নমানের পন্য তৈরি হতো। যা ক্রেতাদের তেমনভাবে আকৃষ্ট করতো না। ফলে বিদেশ থেকে খেলনা আমদানি করা হতো, যার বেশিরভাগই আমদানি হতো চীন থেকে। তবে বর্তমানে চীন থেকে আমদানিকৃত খেলনার সমমানের অনেক খেলনা আমাদের দেশেই তৈরি হচ্ছে। দেশে উন্নত কারিগরী প্রযুক্তির অভাব থাকায় খেলনা শিল্প তেমন এগিয়ে যেতে পারছেনা, বার বার হোঁচট খাচ্ছে। দেশীয় লেদ কারখানা থেকে ম্যানুয়ালি মোল্ড তৈরি করতে হচ্ছে। অথচ বিদেশে কম্পিউটারাইজড মেশিনে এ ধরনের মোল্ড তৈরি করা হয় অত্যন্ত নিখুঁত এবং সুন্দরভাবে। আজকাল অনেক ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা চীন ও তাইওয়ান থেকে মোল্ড বা ডাইস করে নিয়ে আসছেন। ডাইস তৈরির কম্পিউটারাইজড মেশিন দেশে থাকলে বাংলাদেশেই অনেক সুন্দর, উন্নত এবং আধুনিক মানের খেলনা তৈরি সম্ভব। এতে করে অপেক্ষাকৃত কম খরচে ভালো ভালো খেলনা সামগ্রী তৈরি করে বাজারে ছাড়া সম্ভব হবে। সুলভে ডাইস তৈরি করা গেলে চীনা বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে তৈরি খেলনা আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজন ভালো ডাইস ডিজাইনার। দক্ষ, আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন ডিজাইনারেরও অভাব রয়েছে এখানে। শুধুমাত্র ডাইস দিয়ে খেলনা তৈরী করলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না, এর সঙ্গে আরো অনেক কিছুর প্রয়োজন রয়েছে। এই শিল্প যদি দিনে দিনে উন্নতি লাভ করে তাহলে আরো অনেকেই আগ্রহী হবেন এ ব্যাপারে। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রয়োজনীয় কারিগরী সহযোগিতা পেলে আন্তর্জাতিক মানের খেলনা সামগ্রী এদেশেই তৈরি সম্ভব। তখন খেলনা বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা যাবে। খেলনা শিল্পটিকে এসএমই খাতের আওতায় এনে প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকার দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করতে নানমুখী পদক্ষেপ গ্রহন করছেন। এ জন্য প্রনোদনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। আমদানিকৃত খেলনার সঙ্গে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই দেশীয় খেলনা শিল্পের প্রসার এবং সুরক্ষার জন্য খেলনা তৈরিতে ব্যবহার্য অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ আমদানিতে একটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক এবং সমুদয় মূল্য সংযোজন কর থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় খেলনা শিল্পের উন্নয়নে প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতা। আমাদের প্রত্যাশা, খেলনা শিল্পের উদ্যোক্তা, প্রস্তুতকারীদের প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলামিস্ট।
একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সুসমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য, যেমন অপরিহার্য একটি সার্থক সংগীত নির্মাণে গীতিকার, সুরকার, কন্ঠশিল্পী ও বাদক যন্ত্রীদের সমন্বিত ও আন্তরিক প্রয়াস। অর্থ বিভাগ জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করে ঠিকই কিন্তু সেই বাজেটের আয় ব্যয়ের চাহিদা প্রাক্কলন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকেই আসে এবং বাজেট বরাদ্দের পর তা ব্যয়ন, বাস্তবায়ন ওই সব মন্ত্রণালয়গুলোই করে থাকে। সুতরাং বাজেট ব্যবস্থাপনায় অর্থ বিভাগের দায়িত্ব একক নয় এবং এর সাফল্য ব্যর্থতার দায়ভার অবশ্যই সকলের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশের আমদানি রপ্তানির নীতি নির্ধারণ করে মাত্র। কিন্তু আমদানি রপ্তানির সার্বিক পারঙ্গমতা বেসরকারি খাতের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষি খাতের উপায় উপকরণ থেকে শুরু করে চাষাবাদসহ যাবতীয় বিষয় আশয়ের নীতি নিয়মকানুন ভালমন্দ তদারকি করে থাকলেও কৃষি কাজে নিয়োজিত দেশের শতকরা ৭০ ভাগ জনগোষ্ঠীই কৃষি উৎপাদন বিপনন এর সফলতা ব্যর্থতার ভাগিদার।
পুজিবাজারের উন্নয়নের প্রশ্নেও একই কথা খাটে। সাধারণ অসাধারণ বিনিয়োগকারী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, সরকার, সিকিউরিটিজ এন্ড একচেঞ্জ কমিশন, এক্সচেঞ্জসমূহ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সিকিউরিটিজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংকার্সবৃন্দ সকলের সক্রিয় ও দায়িত্বশীল আচার আচরণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পুঁজি বাজারের মতো স্পর্শকাতর অথচ অতীব গুরুত্বপূর্ণ খাতে কাঙ্ক্ষিত ও বাঞ্ছিত উন্নয়ন সাধন সম্ভব হতে পারে। আমাদের জাতীয় বাজেটের সর্বমোট ব্যয়ের গড়ে ৭০ ভাগ অর্থায়ন হয় অভ্যন্তরীণ সম্পদ দ্বারা যার আহরণের প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। কিন্তু রাজস্ব বোর্ড নিজে ব্যবসা বাণিজ্য, বিনিয়োগ করে না, সম্পদ সৃষ্টিতে এর সরাসরি কোনো ভূমিকা থাকে না। সুতরাং যারা আয় করেন, যাদের উপর আয়কর আরোপিত হওয়ার বিষয়, যারা ভোগ করেন, যাদের উপর ভ্যাট প্রযোজ্য এবং যারা আমদানি করেন, যাদের উপর আমদানি শুল্ক প্রযোজ্য তাদের কৃত কর্মের উপর কর আহরনের গতি প্রকৃতি নির্ভরশীল। আবার ব্যক্তি বা কোম্পানীর আয় শুধু ব্যক্তি বা কোম্পানীর দক্ষতা অদক্ষতার উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল নয়। যে পরিবেশে বা যে ব্যবসায় বা যে কর্মকাণ্ডের মধ্য থেকে ব্যক্তি বা কোম্পানী আয় উপার্জন করে সে পরিবেশ, সে লোকবল, সে ব্যবসা বা সে কর্মকাণ্ড নিরাপদ সঞ্চালনের ওপর নির্ভরশীল। একই অবস্থা ভোক্তা ও আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের বেলায়ও প্রযোজ্য। সুতরাং সামষ্টিক অর্থনীতির সামষ্টিকতা সর্বত্র পরিব্যপ্ত।
দেখা যাচ্ছে কার্যকারণ এর সাথে ফলাফলের আন্ত:যোগাযোগ বা আন্ত:সম্পর্ক পরস্পর প্রযুক্ত ও নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল। যে কোনো পর্যায়কে তাই বিছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই, দীর্ঘমেয়াদে অর্জিত সাফল্যকে একটি সীমাবদ্ধ সময়ের অবয়বে শুধু নিজেদের সাফল্য হিসেবে দেখার, প্রচারের ও প্রগলভতা প্রকাশের সুযোগ নেই। সামষ্টিকতার সামষ্টিকতাই থাকেনা যদি কজ আর ইফেক্টের মধ্যেকার পরস্পর প্রযুক্ততার বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে নৈবক্তিক বিশ্লেষনে যাওয়া না হয় , যদি শুধু খণ্ডিত দৃষ্টিতে দেখা হয় একটি সম্পূর্ণ বিষয়কে। অর্থনীতির ক্ষতিকর যে কোনো অপপ্রয়াস এর সামনের ও নেপথ্যের উভয় কারণ এর প্রতি দৃষ্টিদান সমাধান প্রত্যাশা ও প্রয়াসকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে পারে। কার্যকারণ ছাড়া কোনো কিছু উদ্ভব হয় না। শুধমাত্র উদ্ভূত পরিস্থিতি কিংবা উপস্থাপিত ফলাফলকে সমালোচনার কাঠগড়ায় না এনে একই সাথে কি কারণে এই পরিস্থিতির উদ্ভব কিংবা এই ফলাফলের উপলক্ষকেও বিচার বিশ্লেষণের আর্জিতে আনার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। দৃষ্টিভঙ্গি সীমাবদ্ধ হলেই যে কোনো ফলাফলকে নানান অবয়বে উপস্থাপন ও সমালোচনা চলে। তার দাবি, প্রয়োজন ও চাহিদামত পুষ্টিকর খাবার না পেলে কোন শিশু ক্ষুধায় কাঁদলে, হাত পা ছুড়ে একাকার করতে থাকলে তাকে ‘কাঁদুনে শিশু’ বলে অপবাদ দেয়ার অপপ্রয়াস নিশ্চয়ই সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যেমন এককভাবে কোনো মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষের বা কর্তৃত্বের হতে পারে না, তেমনি পুঁজি বাজারও। আর পুঁজিবাজার এর সাথে সরকারি -বেসরকারি খাত বা ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ততা বা সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেহেতু পুজিবাজারের রেগুলেটর ( এস ই সি) এককভাবে এর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ বা কবজাকরণের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট অন্য সবাই দায়িত্বশলিতার সাথে দায়িত্ব পালন করছে কিনা, কোনো অনিয়মের দ্বারা পুঁজিবাজারের বস্তগত স্বার্থহানি ঘটাচ্ছে কিনা, ঘটাতে পারে কিনা, তার ওয়াচ ডগ হিসেবে, হুইসেল ব্লোয়ার হিসেবে, মার্কেট মেকার ও প্লেয়ারকে রেগুলেট করবে, ভালো কোম্পানি যাতে পুঁজিবাজারেও আসতে পারে তার নিয়ামক তৈরি করবে এবং জবাবদিহি পরিবেশ নিশ্চিত করবে। ঠুনকো কারণে কে বড় কারণ এবং বড় কারণে ঠুনকো সাব্যস্ত করবে না। নিজেকে সর্বোতভাবে নিরপেক্ষ না রাখতে পারলে, পরিপোষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের অকার্যকারিতাই প্রতিপন্ন হবে।’ বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ, এক্সচেঞ্জসমূহের কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সিকিউরিটিজ ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং এতদসংক্রান্ত বিষয়াবলি নিশ্চিত করিবার জন্য’ ২০১৩ সালে এক্সচেঞ্জ ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইন ( ২০১৩ সালের ১৫ নং আইন) পাস করা হয় এবং তার আলোকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচ্যুয়লাইজড হয়। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের জন্য এটি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক রূপি ঘটনা বা পরিবর্তন। এর সুত্র ধরে ডিরাইভেটিভস, এফ টি এ প্রভূতি সংস্কার সংস্থা গঠনের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল। সেগুলোর অগ্রগতির সালতামামী বা মূল্যায়ন হলে সে সবের প্রভাবক ভূমিকা যেমন জানা যাবে তেমনি পুঁজিবাজারের উন্নয়নের হাল হকিকত আরো উপলব্ধির আওতায় আসতে পারে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের সংঘবদ্ধ অথচ স্ব স্ব দায়িত্ব কর্তব্য পালনের উপর নির্ভরশীলতাকে মানতেই হবে সুতরাং সামগ্রিক অবয়বে দেখেই বিচার করতে হবে সব ফলাফলকে। সামষ্টিক অর্থনীতির সামষ্টিকতায় প্রধান সীমাবদ্ধতা এখানে যে প্রত্যেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে অবস্থান করেই দ্বীপপুঞ্জের সাফল্য ও কল্যাণ কামনা করা হয়। সকলের সাফল্য শুধু নিজের বলে জাহির আবার নিজের ব্যর্থতাকে অন্যের ওপর চাপানোর মানসিকতা সকল সমন্বয় ও সাযুজ্যকরনকে বাধাগ্র¯ত করে। পরস্পরের দোষারোপের দ্বারা ঐক্যবদ্ধ চেতনা বিকাশ লাভ করে না, সকলের প্রয়াস এক সুরে বাধা যায় না, হয় না। উন্নয়নের তানপুরায় বার বার ধুলি জমে আর সেখানে ঐকমত্যের সুর সাধা বেসুরো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে সঞ্চয় বিনিয়োগের প্রধানতম পূর্বশর্ত। জনগণের মাথাপিছু আয়ের মৌল স্তর বৃদ্ধি ব্যতিরেকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৃদ্ধির চিন্তাচেতনা বাস্তবসম্মত নয়। সামাজিক কল্যাণ খাতে উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়ে সঞ্চয় বাড়ানোর পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। ক্যালোরি ইনটেক বাড়িয়ে, বিশুদ্ধ পানি ও মৌল স্বাস্থ্য সেবার আওতায় (জনস্বাস্থ্য) সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে মৃত্যুর হার কমিয়ে জন্মহারকে সুষম নিয়ন্ত্রণ, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান সংক্রান্ত মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং কাজ সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের মৌলিক আয়ের স্তর বাড়ানো সম্ভব হতে পারে। শিক্ষা চিকিৎসা খাতে ব্যক্তিগত ব্যয়ের মাত্রা কমিয়েও সঞ্চয়ের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। সঞ্চয়কে উৎসাহিত করতে ব্যাংকিং সৃবিধা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। বিদেশি সাহায্য ও ঋণনির্ভর অর্থনীতিতে সঞ্চয় প্রত্যাশা করা বাতুলতা মাত্র বিধায় জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় দেশজ সম্পদ উন্নয়নে গৃহীত পরিকল্পনা নিজস্ব উপায়ে বাস্তবায়ন সক্ষমতার সমাহার আবশ্যক। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের সরকারী ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হার এখনো নিম্নে। বিনিয়োগ হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকরী ও সহনশীল পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক। দেখা গেছে বেসরকারি খাতের উন্নয়নে ১৯৭৩ সালে শিল্পনীতিতে ঘোষিত সংরক্ষণবাদী বিধানাবলি ১৯৮২ সালে অপসারিত হলেও ১৯৯১ এর আগে বেসরকারি খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ হয়নি। আবার, ১৯৭৬, ১৯৮২, ১৯৮৬’র শিল্পনীতিতে গার্মেন্টস শিল্প খাতে উন্নয়নবিষয়ক কোনো পরিকল্পনার আভাস-ইঙ্গিত ততটা না থাকলেও এখাতে বিনিয়োগ হয়েছে অভাবিতপূর্ব। শিল্পনীতিতে আবকাঠামো, খাদ্য কৃষি ও ক্ষদ্র শিল্প খাতে উন্নয়নের কথা বেশি বেশি করে বলা হলেও এসব খাতের উন্নয়নে যথাযথ সহায়তা ও প্রযত্ন প্রদানের পর্যাপ্ত ক্ষক্ষমতা রাখা হয়নি পোষক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। প্রদত্ত সীমিত ক্ষক্ষমতা প্রয়োগের উদ্যোগও লক্ষণীয় হয়ে উঠেনি। দপ্তর সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় হয়ে রয়ে গেছে।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব, এন বি আরের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ডিমিউচ্যুয়ালাইজড চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রথম চেয়ারম্যান।
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষির ভূমিকা অপরিসীম। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে কৃষিতে অধিক হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি, মাটির অবক্ষয়, জলাশয়ের দূষণসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি কৃষকরা প্রায়শই তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। এ প্রেক্ষাপটে কৃষিতে সংস্কারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা আজ সময়ের দাবি। এজন্য অযাচিত কীটনাশকের ব্যবহার কমানো, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, জৈব প্রযুক্তি ও বায়ো-পেস্টিসাইড ব্যবহারের প্রসার, কৃষিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির সংযোজন, নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাই হতে পারে একটি কার্যকর রূপরেখা। নিম্নে সরকারের কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো :
কৃষিতে অযাচিত বালাইনাশক ব্যবহার কমানো : বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনে কীটনাশকের ভূমিকা থাকলেও অযাচিত ও অতিরিক্ত ব্যবহার বর্তমানে এক বড় সংকটে পরিণত হয়েছে। অনেক কৃষক পরামর্শ ছাড়াই কীটনাশক প্রয়োগ করেন, যার ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়, পানিদূষণ ঘটে এবং মানুষের খাদ্যে বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ থেকে যায়। এটি কেবল স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, বরং পরিবেশের জন্যও হুমকি। তাই কৃষিতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) গ্রহণ করা জরুরি। কৃষকদের সচেতনতা বাড়াতে মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, যাতে তারা সঠিক সময়ে ও পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করতে শিখেন। এছাড়া সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগে বিকল্প পদ্ধতি যেমন জৈব কীটনাশক, ফেরোমন ফাঁদ বা জৈব সার ব্যবহারের প্রচলন বাড়াতে হবে। এই উদ্যোগগুলো কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাবে, খাদ্য নিরাপদ রাখবে এবং পরিবেশ রক্ষা করবে।
মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা: মাটি কৃষির প্রাণ। বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন দীর্ঘদিন ধরে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় মাটির জৈব উপাদান ও উর্বরতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। মাটির এই অবক্ষয়ের কারণে ফসলের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে এবং কৃষকরা আগের মতো ফলন পাচ্ছেন না। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য জৈব সার, সবুজ সার ও কম্পোস্ট ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে। মাটির পরীক্ষা করে প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক পরিমাণে সার প্রয়োগ করা জরুরি। সরকার ইতিমধ্যে ‘মাটি পরীক্ষা কার্ড’ বিতরণ শুরু করেছে, যা আরও সম্প্রসারণ করতে হবে। কৃষকরা যদি মাটির স্বাস্থ্য বুঝে চাষাবাদ করেন, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ফসলের উৎপাদন বাড়বে, জমি উর্বর থাকবে এবং পরিবেশও সুরক্ষিত হবে। টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে হলে মাটির প্রতি যত্নশীল হওয়াই হবে সর্বপ্রথম শর্ত।
অর্গানিক বা জৈব (বায়ো পেস্টিসাইড) বালাইনাশক ব্যবহার বাড়ানো: অতিরিক্ত রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এ কারণে এখন জৈব বা বায়ো পেস্টিসাইড ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব বাড়ছে। বায়ো পেস্টিসাইড প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি হয়, যেমন নিমের নির্যাস, ট্রাইকোডার্মা, ব্যাসিলাস বা অন্যান্য অণুজীবভিত্তিক সমাধান। এগুলো পরিবেশের জন্য নিরাপদ, মাটির উর্বরতা রক্ষা করে এবং খাদ্যে বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ রাখে না। বাংলাদেশের কৃষিতে জৈব পদ্ধতির ব্যবহার ক্রমে জনপ্রিয় হচ্ছে, তবে এখনও এটি পর্যাপ্ত নয়। এজন্য সরকারকে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে হবে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেখাতে হবে যে বায়ো পেস্টিসাইড শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, বরং খরচও তুলনামূলক কম। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, রপ্তানি বাজারে সুনাম এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বাস্থ্যকর জীবন দিতে হলে জৈব কীটনাশকের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।
রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকে কৃষকের ভর্তুকি কমানো: বাংলাদেশে কৃষি খাতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকে সরকারের ভর্তুকি কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমিয়েছে, তবে এর নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। সস্তায় পাওয়া যাওয়ায় কৃষকরা অনেক সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন, যা মাটি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দীর্ঘমেয়াদে এটি কৃষির জন্য বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। তাই ধীরে ধীরে ভর্তুকি কমিয়ে কৃষকদের টেকসই বিকল্পে উৎসাহিত করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, জৈব সার উৎপাদনে প্রণোদনা দেওয়া, কম্পোস্টিং প্রযুক্তি সহজলভ্য করা এবং বায়ো পেস্টিসাইড ব্যবহারে সহায়তা প্রদান। পাশাপাশি কৃষকদের ডিজিটাল কৃষি পরামর্শ সেবা দিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ সার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ভর্তুকি নীতি সংস্কার করলে শুধু পরিবেশই রক্ষা হবে না, বরং কৃষির উৎপাদন ব্যবস্থাও দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল হবে।
কৃষিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি: ডিজিটাল প্রযুক্তি বাংলাদেশের কৃষিকে আধুনিক ও টেকসই পথে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রাখছে। ড্রোন, সেন্সর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), আইওটি (IoT), ও মোবাইল অ্যাপস এখন কৃষিতে নতুন দিগন্ত খুলেছে। ড্রোনের মাধ্যমে ফসলের রোগ-পোকার অবস্থা শনাক্ত করা যায়, সেন্সর দিয়ে মাটির আদ্র্যতা ও পুষ্টি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব, আর কৃষকরা মোবাইল অ্যাপে আবহাওয়া পূর্বাভাস ও বাজারদর জানতে পারেন। এসব প্রযুক্তি কৃষকদের খরচ কমায়, উৎপাদন বাড়ায় এবং ফসলের গুণগতমান উন্নত করে। সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে কৃষি ডিজিটালাইজেশনের গতি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ছোট কৃষকদের কাছে এসব প্রযুক্তি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে তুলতে হবে। স্মার্ট কৃষি কেবল উৎপাদনশীলতাই বাড়াবে না, বরং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাংলাদেশকে কৃষিতে বিশ্বমানের পর্যায়ে পৌঁছে দেবে।
‘খামারী’ মোবাইল অ্যাপ: মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয় এর তত্ত্বাবধানে একটি যুগান্তকারী ডিজিটাল সিস্টেম ‘খামারী’ মোবাইল অ্যাপ উদ্ভাবন করেছেন। এই অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকরা জমিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার থেকে মুক্তি পাবে এবং তাদের ব্যয় সাশ্রয় হবে! পাশাপাশি পরিবেশ ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা পাবে। এই প্রযুক্তিটি বাংলাদেশের কৃষিতে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই খামারী এই অ্যাপস এর মাধ্যমে ফসল অনুযায়ী কৃষকরা তাদের জমির লোকেশন এবং ক্রোপজনিং বেইজ সার ব্যবহার করতে পারেন।
কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা: বাংলাদেশের কৃষকরা বছরের পর বছর কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করেন, কিন্তু অনেক সময় ন্যায্যমূল্য পান না। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকেরা উৎপাদন খরচও তুলতে পারেন না। এর ফলে তারা কৃষিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। কৃষকের অধিকার রক্ষায় ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য সরকারকে কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। কৃষিপণ্য সরাসরি ক্রয়ের ব্যবস্থা, ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও কৃষি গুদামজাতকরণ উন্নয়ন করতে হবে। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হলে কৃষকরা আর্থিকভাবে সুরক্ষিত হবেন, উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত হবেন এবং দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকবে। কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য শুধু কৃষকের প্রাপ্যই নয়, বরং গ্রামীণ অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
কৃষিতে নতুন নতুন জাত এবং প্রযুক্তি সম্প্রসারণ: বাংলাদেশের কৃষিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এজন্য উচ্চফলনশীল, জলবায়ু সহনশীল ও রোগবালাই প্রতিরোধী নতুন জাত আবিষ্কার এবং এর সম্প্রসারণ অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ধান, গম, ভুট্টা ও ডাল জাতীয় ফসলে নতুন জাত উদ্ভাবন করছে। এসব জাত কম পানি, কম সার ব্যবহার করেও ভালো ফলন দিতে সক্ষম। একইসাথে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন হাইড্রোপনিকস, ভার্টিক্যাল ফার্মিং, স্মার্ট সেচ ও যান্ত্রিক কৃষিকাজকে মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। কৃষকদের এসব নতুন জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকার ও কৃষক, তিন পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগেই কৃষি খাতকে আধুনিক ও উৎপাদনশীল করা সম্ভব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষি সংস্কার শুধু কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত জরুরি। মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ, এবং কৃষকদের সঠিক মূল্যের নিশ্চয়তা প্রদান করলে কৃষি হবে টেকসই ও লাভজনক। বাংলাদেশ যদি পরিকল্পিতভাবে কৃষি সংস্কারের এই ধাপগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে একদিকে কৃষক হবে স্বাবলম্বী, অন্যদিকে দেশও অগ্রসর হবে একটি নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার দিকে।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র অর্ধেক নয়, পূর্ণ হতে হবে। সংসদে নারীর কণ্ঠ অলঙ্কার নয়, হতে হবে শক্তির প্রতীক। স্বাধীনতার ইতিহাসে নারী শুধু সহযাত্রী নয়, বরং নেতৃত্বের সারিতে থেকেও আজও পিছিয়ে আছে রাজনৈতিক বাস্তবতায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে ২০২৪ সালের সংসদ পর্যন্ত- নারীর সংগ্রাম অব্যাহত, কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্র এখনো তাদের নাগালের বাইরে। আজ তাই ১৫টি বিস্তৃত দিক থেকে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশের ইতিহাসে নারী কখনোই নিস্তব্ধ দর্শক ছিলেন না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তারা শুধু যোদ্ধা নন, ছিলেন চিকিৎসক, গুপ্তসংযোগ রক্ষাকারী, আশ্রয়দাত্রী, ও সর্বোপরি মনোবল জোগানো প্রতীক। বিপ্লবের প্রতিটি ধাপে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সকল আন্দোলনে নারীরা রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এই নারীরা সংসদে সংখ্যায় সীমিত। গণতন্ত্রের প্রতিটি ধাপে যেখানে নারীরা জীবন দিয়েছেন, সেখানে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান আজও প্রান্তিক। এই বৈপরীত্য প্রমাণ করে যে, ইতিহাস নারীর ত্যাগকে সম্মান দিয়েছে, কিন্তু রাজনীতি তাকে ক্ষমতায় আসীন করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনীতির অন্দরমহলে এখনো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবশালী। নারীকে ক্ষমতার প্রতীক নয়, বরং পারিবারিক ঐতিহ্যের ‘সহচরী’ হিসেবে দেখা হয়। অতএব, বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীর ভূমিকা যত গৌরবময়, বর্তমান রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ ততই অসম্পূর্ণ। ইতিহাস তাদের দিয়েছে মর্যাদা; রাজনীতি দিয়েছে প্রতীক, নেতৃত্ব নয়।
২. সংরক্ষিত আসনের সীমাবদ্ধতা: ১৯৭২ সালে সংবিধানে নারী প্রতিনিধিত্বের উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত আসনের ধারণা যুক্ত হয়। প্রথমে এর মেয়াদ ছিল ১০ বছর, পরে তা বারবার বাড়ানো হয়, আজ তা দাঁড়িয়েছে ৫০টি আসনে। কিন্তু সমস্যা একটাই, এই আসনগুলো জনগণের ভোটে নির্ধারিত নয়। রাজনৈতিক দলগুলোই নির্ধারণ করে কে সংসদে যাবে। ফলে এসব নারী এমপি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন না, বরং দলীয় নেতার প্রতি অনুগত থাকেন।
এই প্রক্রিয়া নারী রাজনীতিকদের ক্ষমতাহীন করে তোলে। অনেক সময় তারা বলেন, ‘আমরা সংসদে বসি, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেই না।’ প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বহীন এই প্রথা নারীর কণ্ঠকে করুণায় পরিণত করেছে। সংরক্ষিত আসন তাই নারীর ক্ষমতায়ন নয়, বরং রাজনৈতিক দলের প্রতীকী অনুগ্রহের প্রকাশ। যখন নেতৃত্ব করুণায় নির্ধারিত হয়, তখন তার মধ্যে স্বতন্ত্রতা থাকে না। এ কারণেই নারীর অনেকেই সংসদে থেকেও প্রভাবশালী ভূমিকা রাখতে পারেন না। কোটার সংস্কার নয়, প্রয়োজন সরাসরি প্রতিযোগিতার সুযোগ, যেখানে নারী নিজের যোগ্যতা দিয়ে নেতৃত্ব প্রমাণ করবেন।
৩. সরাসরি ভোটের প্রয়োজনীয়তা: গণতন্ত্রের মূল শক্তি হলো ‘ভোট’। ভোট ছাড়া কোনো প্রতিনিধিত্বের মূল্য নেই। সংরক্ষিত আসনে বসা নারী এমপিরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন; তাই তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল। সত্যিকারের নেতৃত্ব তখনই গড়ে ওঠে, যখন জনগণ নিজ হাতে কাউকে বেছে নেয়। যে নারী সরাসরি ভোটে জয়ী হন, তার আত্মবিশ্বাস, জনসংযোগ ও নেতৃত্বের পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়। তিনি জানেন, তার অবস্থান করুণায় নয়, নির্বাচনের বৈধতায় প্রতিষ্ঠিত। এই গণতান্ত্রিক স্বীকৃতি তাকে নীতিনির্ধারণের টেবিলে স্বাধীন কণ্ঠ দেয়। অন্যদিকে, সংরক্ষিত আসনের নারীরা অনেক সময় দলীয় নির্দেশেই ভোট দেন, নিজস্ব মতপ্রকাশের সুযোগ কম পান। তাই নারী নেতৃত্বকে প্রকৃত শক্তিতে রূপ দিতে হলে তাঁদেরও পুরুষদের মতো সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হবে। নারী প্রার্থীদের ভোটের ময়দানে নামার মানেই হবে নারীর আত্মমর্যাদার জয়যাত্রা।
৪. রাজনৈতিক দলগুলোর দায়:
রাজনৈতিক দলগুলো নারী নেতৃত্বের প্রশংসা করলেও বাস্তবে তারা নারীদের সুযোগ দিতে কুণ্ঠিত। মনোনয়ন বণ্টনে নারীদের প্রাপ্য অংশ প্রায় শূন্য। অনেক সময় দলগুলো নারীদের মনোনয়ন দেয় কেবল পরিবারিক পরিচয় বা প্রভাবশালী নেতার স্ত্রীর ‘কৃতিত্বে’। এই সংস্কৃতি নারীদের যোগ্যতাকে অবমূল্যায়ন করে। একজন নারী যিনি নিজের রাজনৈতিক জীবনে মাঠে কাজ করেছেন, ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তুলেছেন, তার জায়গা অনেক সময় দখল করে নেন এমন কেউ যিনি কেবল কোনো নেতার আত্মীয়। ফলে নারীরা নিজের প্রতিভায় নয়, পুরুষতন্ত্রের ছায়ায় রাজনীতি করেন।দলগুলো যদি সত্যিই নারী নেতৃত্ব চায়, তবে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও স্বচ্ছ মনোনয়ন প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। দলের প্রতিটি পর্যায়ে নারীর নেতৃত্ব নিশ্চিত না করলে নারী নেতৃত্ব কাগজে থাকবে, বাস্তবে নয়।
৫. নেতৃত্ব বনাম অলঙ্কার:
আজকের প্রশ্ন, সংসদে নারীরা আছেন, কিন্তু তারা কি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, নাকি কেবল অলঙ্কার? সংসদে ৫০ জন নারী সদস্য থাকলেও তাদের মধ্যে কয়জন গুরুত্বপূর্ণ কমিটি বা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন? খুব কম। কারণ তাদের আসন দলীয় কোটায় নির্ধারিত, ভোটের মাঠে নয়।ফলে নারী এমপিরা সংসদে থেকেও জনআস্থার নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেন না। জনগণ তাদের ভোট দেয়নি, তাই তাদের মনে রাখেও না। তাদের বক্তব্য সংসদের প্রটোকলে থাকে, কিন্তু সমাজে তার প্রতিধ্বনি শোনা যায় না।নেতৃত্ব মানে সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা, নীতি নির্ধারণে প্রভাব, ও জনগণের সঙ্গে জবাবদিহিতা। সংরক্ষিত আসনের নারীরা এই তিনটি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। তাই নারী নেতৃত্বকে অলঙ্কার নয়, নীতিনির্ধারণের চালিকাশক্তিতে পরিণত করতে হলে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে বৈধতা দিতে হবে।
৬. নারীর নিরাপত্তা ও অংশগ্রহণ: ভোটের মাঠে নারীরা এখনো ভয় ও অনিরাপত্তার মুখোমুখি। নির্বাচনী সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, হুমকি, এসব পুরুষ প্রার্থীদের মতো সামলানো তাদের পক্ষে সবসময় সম্ভব নয়। অনেক সময় রাজনৈতিক সহিংসতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, নারীরা প্রার্থী হওয়াতেই আগ্রহ হারান। এই বাস্তবতা বদলাতে হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষভাবে দায়িত্ব নিতে হবে।
৭. সমান সুযোগের দাবি:
রাজনীতিতে নারীরা প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার। মনোনয়ন থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের কাভারেজ পর্যন্ত, সবখানেই তাদের ব্যক্তিত্ব নয়, পোশাক বা চেহারা নিয়ে মন্তব্য হয়। পুরুষ প্রার্থীরা এসব সমালোচনা থেকে মুক্ত থাকেন। এই সংস্কৃতি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ন করে। প্রকৃত যোগ্যতা আড়ালে পড়ে যায়, দৃশ্যমান হয় ‘লিঙ্গ’। তাই রাষ্ট্র, গণমাধ্যম ও দলীয় কাঠামো, সবখানেই নারী প্রার্থীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সমতার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
৮. আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট:
বিশ্বজুড়ে নারী নেতৃত্ব আজ এক নতুন বাস্তবতা। ভারত নারী সংরক্ষণ বিল পাস করে সংসদে ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে, তাও সরাসরি ভোটের মাধ্যমে। নেপাল সংবিধানে নারীদের জন্য ৩৩% অংশ বাধ্যতামূলক করেছে, পাকিস্তানে নারীরা নির্বাচনে জিতে সংসদে প্রবেশ করছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সংসদে নারীরা এখনো কোটার সীমায় বন্দি।
৯. ৩৩ শতাংশ বাধ্যবাধকতা:
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বলছে, প্রতিটি সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব কমপক্ষে ৩৩% হতে হবে। বাংলাদেশে এ নিয়ে কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো নারী প্রার্থীদের প্রায় উপেক্ষা করতে পারে। প্রয়োজন আইনি সংস্কার, যাতে রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য হয় অন্তত এক-তৃতীয়াংশ মনোনয়ন নারীদের দিতে। এটি কেবল ন্যায্যতা নয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতারও শর্ত। যখন দলগুলো নারীদের মনোনয়ন দেবে বাধ্যতামূলকভাবে, তখন রাজনীতির মাঠে নতুন প্রজন্মের নারী নেতৃত্ব বিকশিত হবে।
১০. সংসদ আসন সংখ্যা দ্বিগুণের প্রস্তাব: নারী নেত্রীরা প্রস্তাব করেছেন, সংসদ আসন ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ করা হোক; ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কেবল নারীরা। প্রথমে এটি অদ্ভুত শোনাতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এটি গণতন্ত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। যদি ৩০০ নারী সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদে প্রবেশ করেন, তবে নারীর নেতৃত্ব কাগজে নয়, বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে সংসদে ভারসাম্য, নীতিনির্ধারণে বৈচিত্র্য ও প্রতিনিধিত্বের ন্যায্যতা নিশ্চিত হবে।
১১. উন্নয়ন ও নারীর অংশগ্রহণ: গবেষণা প্রমাণ করে, যেসব দেশে সংসদে নারীর উপস্থিতি বেশি, সেখানে মানব উন্নয়ন সূচক দ্রুত বৃদ্ধি পায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশু কল্যাণ, সব খাতে নারীর দৃষ্টিভঙ্গি নতুন মাত্রা আনে।
নারী নেত্রীরা সাধারণত জনগণের কল্যাণকেন্দ্রিক নীতি প্রণয়ন করেন, যা উন্নয়নকে টেকসই করে। বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন বিশ্বে উদাহরণ হতে পারে, যদি এই উন্নয়নের অর্ধেক ভাগীদার নারীও সমানভাবে সিদ্ধান্তে অংশ নেন।
১২. শান্তি প্রতিষ্ঠায় নারীর ভূমিকা:
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলে, যেখানে শান্তি আলোচনায় নারী অংশ নেন, সেখানে যুদ্ধবিরতি ও সমঝোতা টেকসই হয়। নারীরা আপসহীন নয়, কিন্তু তারা আপসহীনতার পরিবর্তে স্থিতিশীলতার সন্ধান করে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন ও সহিংসতার যে বাস্তবতা, সেখানে নারী নেতৃত্ব হতে পারে সমঝোতার নতুন সেতু। সংসদে ও দলীয় সিদ্ধান্তে যদি নারীরা সক্রিয়ভাবে থাকেন, তবে বিরোধিতাও মানবিক রূপ পাবে।
১৩. তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা:
আজকের তরুণ সমাজ নারী-পুরুষ সমতা চায়। তারা চায় নেতৃত্বে বৈচিত্র্য ও যোগ্যতার স্বীকৃতি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায়, তরুণরা নারী প্রার্থীদের সফলতা উদযাপন করে।
যদি রাজনৈতিক দলগুলো নারীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না আনে, তরুণ ভোটাররা ক্রমে হতাশ হবে। ভবিষ্যতের রাজনীতি তরুণদের, আর তারা আর ‘পুরুষতন্ত্রের ছায়া রাজনীতি’ মেনে নেবে না।
১৪. নাগরিক সমাজের আহ্বান:
নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরাম, মানবাধিকার সংগঠন, ও এনজিওগুলো একসুরে বলছে, সংরক্ষিত আসনের যুগ শেষ। এখন সময় সরাসরি নির্বাচনের। নাগরিক সমাজের এই দাবি আসলে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইঙ্গিত, যেখানে নারীরা কোটার অনুগ্রহ নয়, জনগণের আস্থায় প্রতিষ্ঠিত হবেন।
১৫. নারীর ক্ষমতায়ন মানে দেশের ক্ষমতায়ন:
নারীকে ক্ষমতার বাইরে রেখে কোনো জাতি টেকসই উন্নয়নের পথে যেতে পারে না। সংরক্ষণ ব্যবস্থা একটি অস্থায়ী সোপান হতে পারে, কিন্তু স্থায়ী সমাধান নয়। প্রকৃত সমাধান হলো সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নারী নেতৃত্ব। নারীর ক্ষমতায়ন মানে দেশের ক্ষমতায়ন, কারণ যখন নারী নেতৃত্বে থাকে, তখন সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। তবেই গণতন্ত্র পূর্ণতা পায়, তবেই দেশ শক্তিশালী হয়।
উপসংহার: বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনো অসম্পূর্ণ, কারণ সংসদে নারীর কণ্ঠ আছে, কিন্তু নেতৃত্ব নেই। সংরক্ষিত আসনের প্রথা নারীদের কণ্ঠস্বরকে প্রতীকী করেছে, কার্যকর নয়। এখন সময় এসেছে নারীদের প্রকৃত প্রতিযোগিতার ময়দানে আনার সরাসরি ভোট, নিরাপত্তা, সমান সুযোগ ও বাধ্যতামূলক মনোনয়ন, এই চার স্তম্ভেই গড়ে উঠবে নারী নেতৃত্বের নতুন দিগন্ত। গণতন্ত্রের অর্ধেক বাদ দিলে কোনো রাষ্ট্র টেকসই হয় না।
দেশ এগোয়, যদি নারী এগোয়। সংসদ শক্তিশালী হয়, যদি নারীর কণ্ঠ শোনা যায়।
সংরক্ষিত আসন যথেষ্ট নয়, সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতে হবে নারী প্রার্থীদের। এটাই হোক টেকসই গণতন্ত্রের শর্ত।
লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক। মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।