ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দারুণ এক অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিশ্বে আলোচিত উদীয়মান অর্থনীতির দেশ চীন ও ভারত এবং দক্ষিণে বিশাল জলরাশি বঙ্গোপসাগরের মতো অবস্থানিক প্রপঞ্চকের মধ্যে অবস্থিত, যা তাকে আঞ্চলিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। আর এই সুবিধাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে সিঙ্গাপুরের মতো উন্নয়নের দারুণ এক দ্বার উন্মোচন করা সম্ভব।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা আমরা অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করতে পারি। মানচিত্রে খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম, অর্থাৎ তিনদিকেই ভারতের অবস্থান। আর দক্ষিণে সুবিশাল সমুদ্র। ভারতকে নিজের রাজ্যগুলোর সঙ্গে যেমন- পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ত্রিপুরার যোগাযোগ করতে গেলে বাংলাদেশের সাহায্য নিতে হবে। বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহারের আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিলিগুঁড়ি করিডোর হয়ে ত্রিপুরায় যেতে একটি পরিবহনকে অতিক্রম করতে হতো প্রায় ১৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা এবং সময় লাগতে অন্তত দুই দিন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট নিয়ে পদ্মা সেতু হয়ে কলকাতা-ঢাকা-ত্রিপুরা রুটে অতিক্রম করতে হচ্ছে মাত্র ৪৭০ কিলোমিটার এবং সময় লাগছে ৮-৯ ঘণ্টা।
সুতরাং অর্থ ও সময়- দুটোরই সাশ্রয়ী ট্রানজিটের জন্য বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের কাছে এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ট্রানজিট বা করিডোর বাণিজ্যের মাধ্যমে আর্থিকভাবে পরিপূর্ণ লাভ ঘরে তোলার রূপরেখা তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। এটি বাংলাদেশের অবকাঠামো ও পণ্য উৎপাদন খাতে বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ টানার সুযোগ করে দেবে। বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের বাজার পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকে উন্মুক্ত থাকায় প্রচুর কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য অর্থাৎ আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা, যেগুলো সমষ্টিগতভাবে সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত। এই সেভেন সিস্টার্স অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। কেননা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেকোনো পণ্য পরিবহনের চেয়ে বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করা তাদের জন্য সহজসাপেক্ষ। ২ লাখ ৬২ হাজার ২৩০ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত এই সেভেন সিস্টার্সে প্রায় ৫ কোটি মানুষের বসবাস। এই বিশাল বাজার ধরার সম্যক সুযোগ বাংলাদেশের সামনে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক অনবদ্য আশীর্বাদ বঙ্গোপসাগর। ইউরোপের অনেক দেশ আছে, যারা তাদের ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সমুদ্রপথে সরাসরি প্রবেশের সুবিধা থেকে বঞ্চিত, যাকে বলা হয় ল্যান্ড লকড কান্ট্রি। এই দেশগুলো বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে নেদারল্যান্ডসের সমুদ্রবন্দরের ওপর নির্ভরশীল। আর সেজন্যই নেদারল্যান্ডস অন্তত ৩৭টি সমুদ্রবন্দর গড়ে তুলেছে, যেগুলো অন্য দেশগুলোকে ব্যবহার করতে দিয়ে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশ, যারা এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত ছিল, তাদের পোর্ট বন্দর আব্বাস ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে ইরান। এই দেশগুলোকে ট্রানজিট প্রদানের মাধ্যমে এবং তার পোর্ট ব্যবহার করতে দেওয়ার বিনিময়ে ইরানও বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে।
একই সুযোগের হাতছানি বাংলাদেশের সামনেও। বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত নেপাল ও ভুটান এবং ভারতের সেভেন সিস্টার্সের ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরও বেগবান করার জন্য চট্টগ্রাম, মোংলা কিংবা পায়রা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে দিয়ে ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।
অন্যদিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন মালাক্কা প্রণালি দিয়ে পরিবহন করা জ্বালানি সম্পদের ওপর খুবই নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনের জ্বালানি আমদানির প্রায় ৮০ ভাগ আসে এই মালাক্কা প্রণালি দিয়ে, যেটা ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। খুবই সংকীর্ণ এ প্রণালিটি চীনকে আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানির জন্য চীনের চাহিদাও বেড়ে চলেছে। আর জ্বালানি পরিবহনের জন্য চীনের কাছে সমুদ্র অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্ব বাড়ছে। দেশটি ধীরে ধীরে মালাক্কা প্রণালির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা থেকে সরে আসতে চায়। আর এ জন্য ভারতের মহাসাগরের আশপাশের তীরবর্তী যেসব দেশ আছে সেগুলোতে চীন প্রভাব বাড়াচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মালাক্কা প্রণালির বিকল্প নৌপথ হিসেবে বাংলাদেশ চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের আলোচিত স্ট্র্যাটেজিক পজিশন ‘স্ট্রিং অব পালস’ বা মুক্তামালার তত্ত্বে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। এই তত্ত্বে বোঝানো হয় চীন কীভাবে মালাক্কা প্রণালি ও ভারত মহাসাগরের আশপাশের দেশগুলোতে নিজের প্রভাব অক্ষুণ্ন রেখে ও তা বাড়ানোর জন্য উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগের মাধ্যমে আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠতে চায়। বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের পেছনে এটা অন্যতম একটি প্রধান কারণ। চীনের এই বিনিয়োগকে নিজের সুবিধায় লাগানোর জন্য বাংলাদেশের সুদূরপ্রসারী ও কার্যকর রোডম্যাপ প্রস্তুত এখন সময়ের দাবি।
দেশের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত বিশাল বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস প্রাপ্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনা বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে, বিশেষ করে ক্ষমতাধর দেশগুলোর কাছে গুরুত্ব বৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। একই সঙ্গে রয়েছে খনিজ সম্পদের বিপুল আধার, মাৎস্যসম্পদের প্রাচুর্য, শৈবাল উৎপাদন ও বাজার তৈরির সম্ভাবনা, উপকূলীয় অঞ্চলে জাহাজভাঙা শিল্পের বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা এবং সমুদ্র ঘিরে গড়ে ওঠা অর্থনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ আগামীতে অন্যতম অর্থনীতিসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিদেশি পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র হিসেবে সুপরিচিত করে তোলার দারুণ সুযোগ রয়েছে। বিশ্বে অনেক দেশ রয়েছে, যাদের অর্থনীতির ভিত দাঁড়িয়ে আছে পর্যটনশিল্পকে কেন্দ্র করে। আমাদের খুব কাছেই অবস্থিত মালদ্বীপের অর্থনীতি দাঁড়িয়েই আছে পর্যটনশিল্পের ওপর। শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের অর্থনীতিও বহুলাংশে পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। ওরা পারলে আমরা কেন নয়?
আমাদের দেশেও পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা স্বীকৃত। আমাদের রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। একপাশে সুবিশাল সমুদ্রের জলরাশি, আরেকপাশে পাহাড় নিয়ে বয়ে চলা মেরিনড্রাইভের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য হয়ে উঠতে পারে যেকোনো বিদেশি পর্যটকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন হতে পারে প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের প্রধান গন্তব্য। আমাদের আছে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, শৈবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, নয়নাভিরাম সবুজে ঘেরা পাহাড়ি পার্বত্য অঞ্চল। দেশের উত্তরাঞ্চলে আছে মহাস্থানগড় থেকে শুরু করে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা। আকর্ষণীয় অঞ্চলগুলোয় ইকো-ট্যুরিজম পার্ক তৈরি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
আঞ্চলিক যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। আর যে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা যত মসৃণ, তার উন্নয়নও তত সহজ। এশিয়ার তিনটি প্রধান অঞ্চল-দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়া মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ায় এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে- আন্তঃসীমান্ত দ্রব্য, সেবা এবং বিনিয়োগ প্রবাহ থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ট্রান্সপোর্টেশনের জন্য গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন; ভুটান, নেপাল, ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে এনার্জির ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং আরও বেশি অর্থনৈতিক বা শিল্প জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ সার্ক ও আসিয়ান অঞ্চলের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
এছাড়া এশিয়ান হাইওয়ে, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে, BBIN, BCIM এবং BIMSTEC-এর অর্থনৈতিক করিডোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের মধ্যে সংযুক্ত হয়ে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক লেনদেন বাড়াতে পারে, যার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নামে একটি উন্নয়ন কৌশল ও কাঠামো উপস্থাপন করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে বিশ্বের ৬০টি দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা। এই পরিকল্পনায় সড়ক পথে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সংযোগ স্থাপন, সড়ক পথের সঙ্গে রেলপথ ও তেলের পাইপলাইনও রয়েছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রপথেও, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন। বলা হয়ে থাকে প্রাচীন সিল্ক রুটের আধুনিক সংস্করণ এটি। এই পরিকল্পনার বেশ সুবিধাজনক অবস্থানেই আছে বাংলাদেশ। পরিকল্পনার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়ার দারুণ একটা সুযোগ থাকবে বাংলাদেশের কাছে। প্রকল্পের আওতায় চীনের কুনমিং প্রদেশ ভারতের কলকাতা, মিয়ানমারের মান্দালয় এবং বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, অর্থনৈতিক করিডোরের ফলে উন্নত সংযোগ হবে, বাণিজ্য সহজতর হবে এবং দেশগুলোর বাজারে প্রবেশের বিস্তৃতি ঘটবে ও এই চার প্রতিবেশী দেশ লাভবান হবে। বাংলাদেশ যেহেতু ‘আসিয়ান’ এবং দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর প্রবেশদ্বার এবং একই সঙ্গে কুনমিং হয়ে চীনের প্রতিবেশী এবং চীন ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অংশকে যুক্ত করেছে, তাই বাংলাদেশ এবং চীন যৌথভাবে ভৌগোলিক এ অবস্থানের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
প্রকৃতির ক্ষুদ্রতম এক সদস্য লাল পিঁপড়া ছোট অথচ পরিবেশে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। এই ক্ষুদ্র প্রাণী আমাদের জীববৈচিত্র্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা শুধুমাত্র এক পোকা নয়, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় নিঃশব্দ এক প্রহরী। কিন্তু আজ এই নীরব প্রহরীর অস্তিত্ব বিপন্ন। অসংযত ও অবাধ শিকারে তারা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। তাই তাদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি।
পিঁপড়া সামাজিক, পরিশ্রমী ও চতুর প্রাণী। আমাদের দেশে খুদে পিঁপড়া, ডেঁয়ো পিঁপড়া, সুড়সুড়ে পিঁপড়া, বিষ পিঁপড়া, লাল পিঁপড়া ছাড়াও বহু প্রজাতির পিঁপড়া রয়েছে। একটু কম বিষাক্ত বড়ো আকৃতির লাল পিঁপড়ারা বন্য এবং দলবেঁধে গাছের মাথায় বাসা বানিয়ে থাকে। ভাওয়াল ও মধুপুরের গজারী বনে গাছের মাথায় এদের বাসা বেশি দেখা যায়। এ এলাকায় স্থানীয় নাম ‘গজারী কুত্তা’। অনেকে ‘রামকুত্তা’ ‘কুড়িলের’ বলেও ডাকে। তাছাড়া সারা দেশে আম, লিচু, মেহগিনি গাছসহ অনেক গাছেই লাল পিঁপড়ার বাসা চোখে পড়ে। ওখানেই জীবনচক্রের ধাপগুলো সম্পূর্ণ করে।
বিচিত্র এদের জীবন। দলবদ্ধভাবে রানির অধীনে বাসা তৈরির কাজ করে ওরা। গাছের মগডালে প্রথমে অনেকগুলো পাতা জোড়া দিয়ে বল আকৃতির বানায়। লালার সাহায্যে এক রকম আঠা তৈরি করে পাতা জোড়া লাগায়। শক্ত চোয়াল দিয়ে পাতা মুড়িয়ে গোল করার আগে ভেতরে আলাদা আলাদা কুঠুরি বানায়। কর্মী পিঁপড়ারা ভবিষ্যতের খাবার সংগ্রহ করে রাখে। গোল আকৃতির বাসা এত মজবুত হয় যে বৃষ্টির পানি পর্যন্ত ভেতরে ঢোকে না। বসন্তকালে একটি কলোনিতে বেশ কিছু পুরুষ ও রানি পিঁপড়া জন্ম নেয়। এই সময় উভয়ের ডানা গজায়। এক সময় বাইরে এসে বংশ বৃদ্ধির জন্য ঝাঁক বেঁধে উড়াল দেয়। মিলনের পর নতুন রানি ডিম পেড়ে পৃথক কলোনির সৃষ্টি করে। ডিম দেখতে চিকন সাদা মুড়ি বা ভাতের মতো দেখায়। বেশি ডিম পাওয়া যায় শীতের শেষে। মাছ ধরার টোপের জন্য লাল পিঁপড়ার ডিমের চাহিদা বেশি। লাল পিঁপড়ার ডিমের টোপ বড়ো মাছেরা সহজেই গেলে। আশ্বিন ও কার্তিক মাসে এই ডিমের চাহিদা বেশি।
লাল পিঁপড়া শুধু একটি ক্ষুদ্র পোকা নয়; তারা বন্যপ্রাণী হিসেবে পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বনের গাছে, মাঠে, মাটির নিচে, এমনকি মানব আবাসের আশপাশেও তারা বাসা গড়ে দলবদ্ধভাবে জীবন যাপন করে। রানির নেতৃত্বে পিঁপড়ারা জটিল সামাজিক ব্যবস্থা মেনে কাজ করে; খাদ্য সংগ্রহ, বাসা নির্মাণ, বংশবৃদ্ধি সবকিছুই দলবদ্ধভাবে সংঘটিত হয়।
তাদের বাসা সাধারণত গাছের উপরের পাতাগুলো থেকে তৈরি হয়, যেখানে পাতা একত্র করে লালা দিয়ে শক্তিশালী বাসা বানানো হয়। বসন্তকালে ডানা গজিয়ে তারা উড়াল দিয়ে নতুন কলোনি গড়ে বংশ বিস্তার করে।
পরিবেশে লাল পিঁপড়ার গুরুত্ব এককথায় অপরিসীম ও বহুমাত্রিক। প্রকৃতির এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি তার অবিস্মরণীয় ভূমিকার মাধ্যমে জীবজগতে সমতা ও সুষমতা বজায় রাখে। প্রথমত, লাল পিঁপড়া কৃষিক্ষেত্রে এক ধরণের প্রাকৃতিক সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। তারা শুঁয়োপোকা, মশা, মাছি ও অন্যান্য ক্ষতিকর পোকামাকড়ের বিস্তার রোধ করে, যা আমাদের ফসলের উৎপাদনশীলতা ও গুণগতমান উন্নত করে। এই কারণে কৃষকরা রাসায়নিক কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পরিবেশ দূষণ ও মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থেকে মুক্তি পায়। পরিবেশে রাসায়নিকের অতিরিক্ত ব্যবহার অনেক সময় মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং জলবায়ুর ভারসাম্য বিঘ্নিত করে, তাই লাল পিঁপড়ার এই প্রাকৃতিক ভূমিকা পরিবেশ রক্ষার দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সার্বিকভাবে, লাল পিঁপড়া পরিবেশের এক নীরব কর্মী, যারা আমাদের কৃষি, বাস্তুসংস্থান, পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতিতে অনন্য অবদান রাখে। তাই তাদের সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন বিশেষ মনোযোগ ও আইনগত ব্যবস্থা, যাতে এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদটি আগামী প্রজন্মের জন্য অক্ষুণ্ণ থাকে।
অপরিকল্পিত শিকার ও রাসায়নিক ব্যবহার লাল পিঁপড়ার বিপন্নতার অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই এই ক্ষুদ্র প্রাণীকে ধ্বংস করতে অবাধ শিকার চালানো হয়, যা তাদের প্রজাতি সংকটের মুখে ফেলে। পাশাপাশি, কৃষিক্ষেত্রে ও পরিবেশে ব্যাপকভাবে রাসায়নিক কীটনাশক ও বিষ প্রয়োগ করা হয়, যা লাল পিঁপড়াসহ অন্যান্য গুণান্বিত জীবজন্তুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই অবৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে, ফসলের উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে। তাই, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই কৃষির জন্য লাল পিঁপড়াসহ প্রাকৃতিক জীবজগতের সুরক্ষা ও অবাধ শিকার রোধ করা অত্যন্ত জরুরি।
লাল পিঁপড়া সংরক্ষণের জন্য বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা
লাল পিঁপড়া বাংলাদেশের প্রকৃতির এক অতি মূল্যবান উপাদান হলেও বর্তমানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় নেই, যার ফলে তারা সঠিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও অবৈধ শিকার রোধে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। লাল পিঁপড়ার উপর সুনির্দিষ্ট আইনগত সুরক্ষা না থাকায় তাদের বাসস্থান বিনষ্ট হওয়া, অবৈধ শিকার ও পরিবেশ দূষণের ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আইনের আওতায় আনা হলে অবৈধ শিকার ও বাসস্থান ধ্বংস প্রতিরোধ সম্ভব হবে, যা লাল পিঁপড়ার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে লাল পিঁপড়ার গুরুত্ব সমাজে তুলে ধরা সম্ভব হবে এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো কার্যকর মনিটরিং ও সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। এর ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সাধারণ মানুষের দায়িত্ববোধও বৃদ্ধি পাবে, যা টেকসই উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। তাই লাল পিঁপড়াকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় আনা প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ।
লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে সফলতা অর্জনের জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে করণীয় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, যার মধ্যে অন্যতম হলো আইন প্রণয়ন ও কঠোর প্রয়োগ, যা লাল পিঁপড়াকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় নিয়ে আসবে। এতে বাসস্থান রক্ষা, অবৈধ শিকার নিয়ন্ত্রণ এবং জরিমানা বিধানসহ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে। একই সঙ্গে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় লাল পিঁপড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ প্রকৃতির এই অনন্য উপাদানের প্রতি দায়িত্বশীল হতে পারে। এছাড়াও, ডিম সংগ্রহকারীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান ও পরিবেশবান্ধব আয়সূত্র গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা তাদের জীবিকা ও পরিবেশের সুরক্ষা দুটোই নিশ্চিত করবে। বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য লাল পিঁপড়ার জীবনচক্র, বাসস্থান, প্রজনন ও বিপদ নির্ণয়ের ওপর নিয়মিত গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ জরুরি। সবশেষে, স্থানীয় কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে প্রকৃতির সুরক্ষায় তাদের দায়বদ্ধ করা হলে সংরক্ষণ কার্যক্রম অধিক কার্যকর ও টেকসই হবে। এই সমন্বিত উদ্যোগেই লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে বাস্তব পরিবর্তন আসবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে।
লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে কার্যকর ও টেকসই ফলাফল অর্জনের জন্য একটি সুশৃঙ্খল আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। এর আওতায় প্রথমত, লাল পিঁপড়ার ঘন ঘন আবাসস্থলগুলো সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে, যা সংরক্ষিত জোন হিসেবে পরিচিত হবে এবং সেখানে বিশেষ সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রযোজ্য হবে। দ্বিতীয়ত, ডিম আহরণ বা পিঁপড়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরকারি অনুমতি সাপেক্ষে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন, যাতে অবৈধ শিকার ও অতিরিক্ত আহরণ রোধ করা যায় এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় থাকে। তৃতীয়ত, অবৈধ শিকার, বাসা ভাঙা ও পরিবেশ বিনষ্টের জন্য কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নির্ধারণ করে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপের deterrent হিসেবে কাজ করবে। সর্বশেষ, সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে নিয়মিত পরিবেশ মনিটরিং ও প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে লাল পিঁপড়া সংরক্ষণের অগ্রগতি মূল্যায়ন ও জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি সম্ভব হবে। এইসব উপাদান নিয়ে গঠিত একটি সুশৃঙ্খল আইনি কাঠামো লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপন করবে এবং পরিবেশের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করবে।
সেলিম রানা,
গণমাধ্যম কর্মী ও কলামিস্ট
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস এবং পারস্পরিক সমঝোতার অভাব নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সব সময়ই সংকটময় করে তোলে। বর্তমানে তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক জটিল মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সেনাবাহিনীকে ঘিরে আলোচনা নতুন মাত্রা পায়। সেনাবাহিনী সব সময়ই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সংবেদনশীল নাম। কারণ জনগণের আস্থা, বাহিনীর শক্তি এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতায় তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই ঢাকা সেনানিবাসে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য শুধু সেনাসদস্যদের উদ্দেশে নয়, বরং জাতির উদ্দেশে একটি পরোক্ষ বার্তাও বটে। এই বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার সঙ্গে সেনাবাহিনীর অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সেনাপ্রধানের বক্তব্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল জাতীয় নির্বাচন, সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব ও শৃঙ্খলার ওপর জোর দেওয়া। তিনি সেনাসদস্যদের উদ্দেশে বলেছেন, দেশ এখন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা দেশের ভবিষ্যৎ। তাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই কথার মধ্যে শুধু একটি অনুপ্রেরণা নেই, বরং এর মাধ্যমে জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা রয়েছে যে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালনে কোনো অবস্থাতেই পক্ষপাতদুষ্ট হবে না। বাংলাদেশে অতীতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সব সময় একটি প্রত্যাশা কাজ করেছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিলো গৌরবান্বিত। এবার সেনাপ্রধান স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বাহিনী কেবল রাষ্ট্রের অঙ্গ হিসেবে কাজ করবে, কোনো দলের হয়ে নয়।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে সেনাবাহিনী একটি পেশাদার সংগঠন এবং দায়িত্ব পালনের সময় প্রতিশোধমূলক কোনো কাজে জড়ানো যাবে না। নির্বাচনের সময় মাঠপর্যায়ে সেনাদের উপস্থিতি জনগণের কাছে আস্থার প্রতীক হলেও, একই সঙ্গে এটি এক ধরনের অনেকেরই ভয়েরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করতে চায় তারা বিভিন্নভাবে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবং যে কোনো মূল্যে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত। তাই সেনাপ্রধানের এই বার্তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে বাহিনীকে অবশ্যই পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। এটি কেবল নির্বাচন নয়, সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেনাবাহিনীকে ঘিরে সমালোচনা নতুন কিছু নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই বাহিনী নিয়ে নানা মন্তব্য, সমালোচনা এমনকি অপপ্রচার চালানো হয়। সেনাপ্রধান এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপূর্ণ অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এসব মন্তব্যে বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। যারা করছে, তারা অনেকেই তরুণ এবং তাদের বয়স সেনা সদস্যদের সন্তানের বয়সি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। এই ধৈর্যশীল মনোভাব বাহিনীর মনোবল রক্ষা করার পাশাপাশি জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে। কারণ সেনাবাহিনী যদি সমালোচনার মুখে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাত, তবে তা গণমানুষের সঙ্গে অযাচিত দূরত্ব তৈরি করত। বরং সহনশীল মনোভাব দেখিয়ে সেনাপ্রধান এক ধরনের বার্তা দিয়েছেন—সেনাবাহিনী জনগণের বিপরীতে নয়, বরং জনগণের সঙ্গেই আছে।
বাহিনীর শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা রক্ষার বিষয়েও সেনাপ্রধান কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, এক সেনাসদস্যের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে এবং প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইভাবে এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগও তদন্তাধীন। তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে কোনো অভিযোগ প্রমাণ ছাড়া মিডিয়া ট্রায়ালের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেওয়া হবে না। এখানে দুই দিকের বার্তা রয়েছে, একদিকে সেনাবাহিনী কোনো অনৈতিকতা বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সহ্য করবে না, অন্যদিকে বাহিনীর সদস্যদের অধিকার ও ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করা হবে। এই ভারসাম্য সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বেরই প্রতিফলন।
বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা সব সময়ই আলোচনায় থাকে। জনগণ প্রায়শই আশা করে, সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে ভোট সুষ্ঠু হবে, জালিয়াতি বা অনিয়ম কম হবে। আবার রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে অভিযুক্ত করে থাকে যে সেনাবাহিনীকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে। সেনাপ্রধান এই প্রেক্ষাপটে ঘোষণা দিয়েছেন, সেনাবাহিনী নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। অর্থাৎ সেনাবাহিনী নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে দীর্ঘ সময় ধরে সেনারা মাঠে দায়িত্ব পালন করছেন, যা এর আগে হয়নি। তাই জনগণের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা এখন জরুরি।
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সেনাবাহিনীকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার নির্দেশ। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, নির্বাচনের সময় বাহিনী কেবল নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে না, বরং মানুষের আস্থা অর্জন করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যদি জনগণ সেনাদের উপস্থিতিকে আশ্বাস হিসেবে না দেখে, বরং ভয় হিসেবে দেখে, তাহলে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই সেনাপ্রধানের বার্তা ছিল আস্থা ফিরিয়ে আনার কৌশল।
বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এক অস্থির বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার রাজনৈতিক দলের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব এখনো মীমাংসিত হয়নি। জনগণের প্রত্যাশা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, রাজনৈতিক দলগুলো কোন পথে হাটবে এবং কাঙ্ক্ষিত সেই নির্বাচন হবে কি না। যদিও সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে বারবার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা হতে পারে আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। সেনাপ্রধানের বক্তব্য সেই আস্থার প্রতিশ্রুতি বহন করে। তিনি আগেই বলেছিলেন, নির্বাচনের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণ করবে একটি নির্বাচিত সরকার। অর্থাৎ সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সমাধানের অংশ নয়, বরং একটি নির্বাচিত সরকারের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কাজ করবে। কেবল নির্বাচনই নয় সেনা প্রধান তার বক্তব্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তা হলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও বিনিয়োগের প্রসঙ্গ। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, একজন সেনা কর্মকর্তাকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করে। তাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পর তাকে অব্যাহতি দেওয়ার পরিবর্তে আগেভাগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এর মাধ্যমে তিনি বাহিনীর ভেতরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি কেবল সেনাবাহিনীর জন্য নয়, দেশের সার্বিক প্রশাসন ও রাজনৈতিক কাঠামোর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা—অপরাধ দমনে প্রতিরোধই প্রধান সমাধান।
অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ও বিভ্রান্তিকর প্রচারের প্রসঙ্গও তিনি তুলেছেন। সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিভিন্ন ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, যা দেখে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। এই বার্তা শুধু সেনা সদস্যদের জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের জন্যও প্রযোজ্য। কারণ ডিজিটাল যুগে ভুয়া তথ্যই রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সেনাপ্রধানের সতর্কবার্তা বোঝাচ্ছে, বাহিনী এসব প্রোপাগান্ডার ফাঁদে পা দেবে না।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অফিসার্স অ্যাড্রেস ছিল বহুমাত্রিক। একদিকে সেনাসদস্যদের শৃঙ্খলা, নৈতিকতা, পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বের ওপর জোর দিয়েছেন; অন্যদিকে জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন যে সেনাবাহিনী নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও নির্বাচনকালীন অনিশ্চয়তার মধ্যে এই বক্তব্য এক ধরনের স্থিতিশীলতার বার্তা।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, কারণ নির্বাচনের সময় কেবল সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সহনশীল না হয়, তবে সেনাবাহিনী যতই পেশাদার হোক না কেন, নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হবেই। তাই সেনাপ্রধানের বার্তাটি আশ্বাসজনক হলেও, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের জটিলতা তা কতটা বাস্তবায়িত হতে দেবে, সেটিই বড় প্রশ্ন।
সব মিলে বলা যায়, সেনাপ্রধানের বক্তব্য শুধু বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দিকনির্দেশনা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক বার্তাও। তিনি পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও দেশপ্রেমের ওপর জোর দিয়ে জাতিকে এক ধরনের আস্থা দিতে চেয়েছেন। যখন রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা, বিভাজন ও অবিশ্বাস তীব্র আকার ধারণ করেছে, তখন সেনাপ্রধানের এই বার্তা জনগণকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে সেনাবাহিনী দেশের জন্য, কোনো দলের জন্য নয়। আর সেই কারণেই এই বক্তব্য বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাদা পাথরে কালো হাত পড়েছে। উল্লেখ্য যে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র ভোলাগঞ্জের ‘সাদাপাথর’। মনোমুগ্ধকর সেই ‘সাদাপাথর’ এলাকাটি এখন প্রায় বিবর্ণ, যেন এক বিরাণভূমী। এই নজিরবিহীন পাথর লুটের ঘটনায় দেশবাসী হতবাক। এক্ষেত্রে দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন যে, এই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের আরো সতর্ক থাকার প্রয়োজন ছিল। এদিকে পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, এক বছরে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট সাদা পাথর লুট হয়েছে, যার বাজারমূল্য আনুমানিক দুই শত কোটি টাকার উপরে। এটি সত্য যে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে পাথর লুট শুরু হলেও এতদিন নিস্ক্রিয় ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ এক বছর ধরে সাদা পাথর লুটপাট চলেছে। এখন বলতে গেলে, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। এটি সর্বজনবিদিত যে, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর বাংলাদেশের আলংকারিক সৌন্দর্যের একটি অনন্য প্রপঞ্চ।
যতদূর চোখ যায়, কেবল সাদা পাথর, মাঝখানে স্বচ্ছ পানি, ওপরে নীল আকাশ, আর সবুজ পাহাড়ে মেঘের আলিঙন। সেহেতু যে ভাবেই বলি না কেন, এটি প্রকৃতির এক অপরূপ স্বর্গরাজ্য। বস্তুত সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে প্রকৃতির এই রূপের আধার হলো উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। এখানের সাদা পাথর, রোপওয়ে, পাথর কোয়ারি, আর পাহাড়ি মনোলোভা দৃশ্য মুগ্ধ করার মতো। ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা ধলাই নদের বুকে স্বচ্ছ পানি, আর সাদা পাথরের মুগ্ধতায় মন ভরে যায় পর্যটক’সহ সবার। এটি লক্ষ্যনীয় যে যে, চারপাশে ছড়িয়ে আছে সাদা পাথর। মনে হয় যেন, প্রকৃতি শুভ্র বিছানা বিছিয়ে রেখেছে। মাঝখানে স্বচ্ছ ঢেউ খেলানো নীল পানি। চারদিকে ঘিরে আছে ছোট-বড় কয়েকটি পাহাড়; আর তার ওপর যেন আছড়ে পড়েছে মেঘ। এতদ্ব্যতীত চারপাশে আছে সবুজ প্রকৃতি। সব মিলিয়ে প্রকৃতির যেন অপরূপ এক স্বর্গরাজ্য। দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা এই অপূর্ব স্থানটি উপভোগের জন্য ছুটে আসেন এই সাদা পাথরের দেশে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ভোলাগঞ্জ সীমান্তে প্রাকৃতিক দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের উঁচু উঁচু পাহাড়। সেই পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনাধারা। একদিকে যোগানদাতা হিসেবে ধলাই নদের পানি। অন্যদিকে ঝরনার পানি প্রবাহ ভোলাগঞ্জকে রূপে রানী করে সাজিয়ে তুলেছে। তাছাড়া সবুজ পাহাড় ও সাদা-কাল মেঘের হাতছানি। বস্তুত বর্ষার পাহাড়ি ঢলের সাথে নেমে আসা সাদা পাথর ধলাই নদের বুকে মিলে মিশে ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুনে। বর্ষায় এই নদের বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাদা পাথরের বিছানা নদীর শোভা বাড়িয়ে তুলে। তাছাড়া সাদা পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ঝরনার পানির তীব্র স্রোতে নয়ন জুড়ায়।
২০২১ সালে আমার এখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ধলাই নদের উৎস মুখের পাথর পরিবেষ্টিত জায়গাটুকু ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট বা সাদা পাথর নামে পরিচিত। আসলে সাদাপাথর এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো। প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ধলাই নদের উৎসমুখে ভেসে আসা পাথরের বিশাল স্তূপের কারণে প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে তৈরি এ স্থানটি পর্যটন স্পট হিসেবে অভিহিত। মজার ব্যাপার হলো যে, ধলাই নদ বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দুভাগে বিভক্ত হয়ে চারপাশ ঘুরে আবার মিলিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ধলাই নদের পানির সঙ্গে ভারতের খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে প্রচুর সাদা পাথর নেমে আসে। আর এই পাথর উত্তোলনকে সহজ করতে ১৯৬৪-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে নির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে ভোলাগঞ্জ থেকে সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ এই রোপওয়ে চলে গেছে ছাতক পর্যন্ত, যা ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে রোপওয়ের টাওয়ারগুলো কেবল কালের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। রোপওয়ে বন্ধ হলেও থেমে নেই পাথর উত্তোলন। এখনো অনেক স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকার উৎস এই পাথর উত্তোলন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে, স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে সাদা পাথর তুলে নিয়ে সৌন্দর্যমন্ডিত সাদা পাথর কংকাল সার করে তুলেছে। এই পাথর লুট নিয়ে পাল্টাপাল্টি অনেক কথা বলা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে আইনগতভাবে নানা ধরনের ব্যবস্থা নাকি করা হয়েছে বলে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দাবী করছেন। তথ্যমতে জানা যায় যে, পাথর উত্তোলন ও সরানোয় জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরিপূর্বক ৬০ দিনের মধ্যে হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সিলেটের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ বিবাদীদের প্রতি এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে উত্তোলন করা ও সরানো সাদা পাথর সিভিল প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে ভোলাগঞ্জের ওই স্থলে সাত দিনের মধ্যে পূনস্থাপন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আবার প্রতিপাদ্য কথাই ফিরে আসি। সিলেটের অন্যতম পর্যটন স্পট সাদা পাথর এখন বিরাণভূমি। কোথাও আর পাথর নেই। উল্লেখ্য যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাদা পাথর এলাকার বর্তমান পরিস্থিতির ছবি ভাইরাল হয়। তারপর থেকেই দেশজুড়ে চলছে সমালোচনা। এ নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় সংবাদমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেই সমালোচনা ও প্রতিবেদনকে তোয়াক্কা না করেই দেখা গিয়েছে যে শত শত ট্রাকে সাদা পাথর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান একটি পত্রিকাকে বলেন, সাদা পাথর লুটের ঘটনায় ১৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে ১৯১ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর অজ্ঞাত আছে আরও ৩১০ জন। এরমধ্যে ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া শতাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। সাদা পাথর লুট হওয়া নিয়ে আমাদের জিরো টলারেন্স। আমরা চাই একটি পাথরও যেন লুট না হয়। এ বিষয়ে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। এর মধ্যে ১৭/০৮/২০২৫ তারিখের আর একটি পত্রিকায় দেখলাম ৩২টি মামলা হয়েছে এবং ঘুরে ফিরে ১৭ জনের নাম বার বার আসছে।
প্রকাশ থাকে যে, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে যত দূর চোখ যেতো, দেখা যেতো সাদা সাদা পাথর আর পাথর। কিন্তু এখন সেখানে ধু-ধু বালুচর। বাস্তবে দেখা গিয়েছে যে, গত ৫ আগস্টের পর থেকে বিরামহীনভাবে চলছে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথর লুট। অথচ সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে ভ্রমণপিপাসু মানুষের পছন্দের শীর্ষে থাকা এটি। বর্তমানে লুটে ক্ষতবিক্ষত স্পটে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, পাথরের সঙ্গে বালুও লুট করা হয়েছে। অথচ পর্যটনকেন্দ্রের চারদিকে বিজিবির চারটি ক্যাম্প ও পোস্ট রয়েছে।
পূর্বেও কিছুটা উল্লেখ করা হলেও আবারও বিশ্লেষনের জন্য আলোকপাত করতে হচ্ছে। বস্তুত সিলেট নগরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ। ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি ঝর্ণাগুলো থেকে যে নদীর উৎপত্তি হয়ে ভোলাগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সেই নদীর নাম ধলাই নদ। পাহাড় থেকে ঝর্ণার পানির স্রোতে এই নদী বেয়েই সাদা পাথর নেমে আসে। ধলাই নদের উৎসমুখের এই জায়গার নাম ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট। ঠিক এক বছর আগেও এই স্থানের সৌন্দর্যের সুবাদে হৃদয় আবেগময় হয়ে কবি মন হয়ে দাঁড়াতো। কেননা ‘যতদূর চোখ যায়, দুই দিকে কেবল সাদা পাথর, আর মাঝখানে স্বচ্ছ নীল জল আরেকদিকে পাহাড়ে মেঘের আলিঙ্গন। মনে হতো কাশ্মীরের মতো স্বর্গরাজ্য। সৌন্দর্যের যেন এক অনবদ্য ক্যানভাস।’ কিন্তু প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের ব্যবস্থা নেয়ার পরও আগের অবস্থায় ফিরে আসবে কি না, সে ব্যাপারে অনেকে সংশয় পোষন করে থাকেন।
সত্যি কথা বলতে কি, গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে মূলত সাদা পাথর লুট হওয়া শুরু হয়। প্রশাসনের স্থবিরতা বা ভীতিই এই পাথর লুট হওয়ার কারণ। আসলে প্রশাসনের কঠোর না হওয়ার কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। পরিবেশবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিবের মতে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এই স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা উক্ত স্বচ্ছ পানির আধার এই এলাকার বেশ কিছু স্থানের খাবার পানির চাহিদা মেটায়। এদিকে এই পাথরগুলো যেখান থেকে ন্যাচারালি আসে, ওইখান থেকে পানি প্রবাহের ভয়ংকর রকম তোড় তৈরি হয়। এর মানে পানি প্রবাহের তীব্রতা বেড়ে যায়। যেখানে তোড় বেশি, সেখানে পাথর জমে। পাথরের কাজ ওই তোড়ের পানিটাকে ভেঙে ভেঙে এদিক ওদিক প্রবাহপূর্বক টুকরো টুকরো করে তার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। এটা একটা প্রাকৃতিক ধাপ।’ শুধু তাই নয়, পানির মধ্যে অক্সিজেন সংশ্লেষ করাও এর কাজ, যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় ‘সোলার অ্যাকুয়াটিক ন্যাচারাল প্রসেস অব ট্রিটমেন্ট’ বলা হয়ে থাকে। প্রকৃতির এই পুরো সিস্টেমে যদি কোন ব্যাঘাত ঘটানো হয় অর্থাৎ পাথর তুলে ফেলা হলে, তখন সিস্টেম ভেঙে পড়ে। শুধু তাই নয়, এর ফলে দুপাশে প্লাবনের পরিমাণ বাড়ে, ভাঙনের সৃষ্টি হয় এবং পানিটাকে গোড়াতেই সাংঘাতিকভাবে পলিউটেড (দূষিত) করে ফেলে। এটি সত্য যে, ওই অঞ্চলের অনেক জায়গায় খাবার পানির স্বল্পতা মেটায় এই পানি। আর এসব ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের কারণে প্রকৃতিগতভাবে অন্যান্য ক্ষতি তৈরির অভিঘাত সৃষ্টির পথ সুগম করে। তাই সঙ্গতকারণেই যথেচ্ছার ভাবে পাথর লুট বা সরানো মোটেই কাম্য নয়।
ইতোমধ্যে সাদা পাথর লুট হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট সবাই তৎপর হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। ঠিক চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, এর ন্যায়। যাহোক, এই সাদা পাথর শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিয়ামক নয়। এর সুবাদে পরোক্ষভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা হয়ে থাকে। পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, ভবিষ্যতে যাতে এ রকম অনাহুত নেতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি না হয়, সে ক্ষেত্রে সবাই সজাগ থাকতে হবে। অপরাধীরা যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। আর এর পেছনে, বাইরের কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা, তাও তলিয়ে দেখতে হবে।
লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
সুরা লুকমান, পর্ব ১০
অনুবাদ
(৩৩) হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, আর সেদিনকে ভয় করো, যেদিন কোন পিতা তার পুত্রের কোন উপকারে আসবে না, এবং কোন পুত্রও তার পিতার কোন উপকারে আসবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং দুনিয়ার জীবন যেনো তোমাদের ধোঁকা না দেয় এবং মহাপ্রতারক (শয়তান) যেনো তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। (৩৪) নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটই রয়েছে কিয়ামতের জ্ঞান। তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনি জানেন মাতৃগর্ভে কি আছে। কেউ জানে না, আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে। আর কেউ জানে না, সে কোথায় মারা যাবে। আল্লাহই সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।
মর্ম ও শিক্ষা
আলোচ্য আয়াতগুচ্ছের মধ্য দিয়ে সূরা লুকমানের উপসংহার টানা হয়েছে। সূরাটিতে নানাভাবে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, কিয়ামত, আখিরাত ইত্যাদিসহ ঈমানের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সৃষ্টি জগতের প্রকৃতির বিভিন্ন প্রমাণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এগুলো আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদের নিদর্শন বহন করে। মানুষের সাধারণ বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদের অনুকূলে সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের আদর্শ আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, কিয়ামত ও আখিরাতের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে। মানুষের হৃদয়ের গভীরেও আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ ও প্রভূত্বের বীজ অঙ্কুরিত রয়েছে। এমনকি বাতিলপন্থীদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এ সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা কে, তখন তারাও স্বীকার করে যে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। এতসব দলীল প্রমাণের পর এখানে আলোচ্য আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, তাহলে মানুষের উচিত আল্লাহকে ভয় করা। কিয়ামতের দিন সম্পর্কে সতর্ক থাকা, যেদিন সবাই নিজকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে এবং কেউ কারো উপকারে আসতে পারবে না। সে কিয়ামতের দিন সত্য ও সঠিক। কিয়ামতের সেই ক্ষণ কবে আসবে, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। কাজেই প্রতিটি মানুষের উচিত মৃত্যু ও কিয়ামত সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহির ব্যাপারে সদা সতর্ক ও সচেতন থাকা।
তাকওয়া: আল্লাহভীতি
গোটা সূরায় এই সত্যটি যৌক্তিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে আল্লাহই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, তিনিই সবকিছু প্রতিপালন করেন। তিনি মানুষকে অগণিত এবং সীমাহীন নিয়ামত দান করেছেন। আসলে গোটা সৃষ্টিকেই আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এসব অনর্থক নয়, বরং এগুলোর একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। তা হলো এই যে মানুষ একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে, তার গোটা জীবনকে আল্লাহর সামনে সমর্পণ করে দেবে, আল্লাহর বিধি-নিষেধ ও জীবনাদর্শ অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করবে। তা না করলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। দুনিয়াতেও আল্লাহ তার নেয়ামত ছিনিয়ে নিতে পারেন, শাস্তি দিতে পারেন, এমনকি গোটা জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারেন। তারপর রয়েছে পরকালের জবাবদিহি এবং অনন্তকালের শাস্তি। সুতরাং প্রতিটি মানুষের উচিত আল্লাহকে ভয় করা। আলোচ্য আয়াত দুটির প্রথমেই আল্লাহর নির্দেশ দিয়েছেন, মানুষ যেনো আল্লাহকে ভয় করে, তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করে।
আখিরাতে বিশ্বাস
আল্লাহকে ভয় করা প্রসঙ্গে সেদিনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যেদিন আল্লাহ ছাড়া কেউ কাউকে কোন উপকার করতে পারবে না। বলাবাহুল্য, সে দিনটি হলো কিয়ামত, যা দিয়ে আখিরাতের অনন্তকালের জীবন শুরু হবে। এভাবে এখানে আখিরাতে বিশ্বাসের বিষয়টি বলিষ্ঠভাবে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ এ দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়, বরং মৃত্যুর পর থেকে আখিরাতের জীবনের যাত্রা শুরু, যে জীবনের শেষ নেই, যে জীবন অনন্তকালের। মানুষ তার দুনিয়ার কর্মজীবনের ফলাফল ভোগ করবে আখিরাতে। এ বিশ্বাস হলো ঈমানের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়নের প্রধান প্রেরণা হলো আখিরাতের সে জীবন।
আখেরাতের জীবনের অবস্থা নির্ভর করে কর্মের উপর
আখিরাতে মানুষ শান্তিতে বাস করবে নাকি শাস্তি ভোগ করবে, তা নির্ভর করে তার নিজের কর্ম ও আমলের উপর। প্রত্যেকের আমল অনুযায়ী কিয়ামতের দিন বিচার হবে, এবং সে বিচারের রায় অনুযায়ী অনন্তকালের জীবন যাপন করতে হবে। নিজ আমল দিয়ে যদি সেদিন মুক্তির ব্যবস্থা না হয়, তাহলে কেউ সেখানে কোন উপকারে আসবে না। আয়াতে বলা হয়েছে, পিতাও তার সন্তানের কোন উপকার করতে পারবে না, এবং সন্তানও তার পিতার কোনো উপকার করতে পারবে না। অর্থাৎ যত আপনজনই হোক, কেউ সেদিন কারো উপকার করতে পারবে না। শুধু তাই নয় বরং সেদিন মানুষ তার অতি প্রিয় প্রিয়জনের বিনিময়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হবে না। সুতরাং সে বিচারের প্রেক্ষাপটে আল্লাহকে ভয় করা উচিত।
দুনিয়ার জীবন হলো ধোঁকা: প্রতারিত হওয়া ঠিক নয়
এ দুনিয়ার ক্ষণিকের জীবন হলো ধোকা। মরীচিকার মতো। অনেক আকর্ষণীয় জিনিস মানুষকে আহবান করে এবং শান্তি দেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে। আসলে তা হলো মিথ্যা আশ্বাস ও প্রতারণা। সে আশ্বাস পেয়ে মানুষ দুনিয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, হন্যে হয়ে ঘুরে এবং ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা না করে সম্পদের পাহাড় গড়তে চেষ্টা করে। আলোচ্য আয়াতে এমন ধোকার আশ্বাসে প্রতারিত না হওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
শয়তানের প্রতারণা থেকে সাবধান
শুধু দুনিয়ার অবাঞ্ছিত ও আকর্ষণীয় জিনিসই নয়, বরং আরো আছে শয়তানের ধোকা ও প্রতারণা। জিন শয়তান মানুষের রন্ধ্রে রন্দ্রে ঘুরে মন্দ কাজের দিকে প্রতারিত করে। এছাড়া মানুষ শয়তান মানুষকে মন্দ কাজের দিকে উৎসাহিত করে এবং মন্দ কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। এ ধরনের সকল প্রকার শয়তানের প্রতারণা থেকে সাবধান করেছেন, যেনো আমরা শয়তানের প্ররোচনায় প্রতারিত না হই।
গায়েবের খবর আল্লাহর নিকট রয়েছে
আল্লাহ মানুষকে অত্যন্ত সীমিত জ্ঞান দিয়েছেন। এ সীমিত জ্ঞান দ্বারা মানুষ খুব কম বিষয়ই জানতে পারে। সেহেতু মানুষের উচিত সকল ব্যাপারে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা। এমনিতে সকল গায়েবের খবরই আল্লাহ নিকট রয়েছে, তবে এক সাহাবীর প্রশ্নের বরাতে আয়াতে পাঁচটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। প্রথম, কিয়ামতের জ্ঞান। কিয়ামত কখন হবে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। দ্বিতীয়, বৃষ্টিপাতের সময়। এ ব্যাপারে আবহাওয়া অফিস থেকে হয়তো কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। তবে তা নির্ভরযোগ্য হয় না। তৃতীয় বিষয় হলো মাতৃগর্ভে কি আছে, তার জ্ঞান। এ ব্যাপারে সঠিক খবর একমাত্র আল্লাহর নিকটই আছে। আজকাল আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে গর্ভে কি আছে, তা জানা যায়। কিন্তু তার মাধ্যমে গর্ভের শিশুটির গুণগত দিক সম্পর্কে জানা যায় না। সে কি জ্ঞানী হবে নাকি বোকা, তার আচার ব্যবহার কেমন হবে ইত্যাদি বিষয় কেউ জানে না। এসব বিষয় শুধু আল্লাহরই জানা আছে। আর কারো নেই। সুতরাং এ ব্যাপারে কারো কিছু করারও নেই। শুধু আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে দোয়া করা উচিত।
যে জিনিস সেবন করলে কিংবা বাহ্যিকভাবে শরীরে গ্রহণ করলে অস্বাভাবিক আচরণসহ অচেতন হয়ে নিজের ক্ষতি এবং অন্যের ক্ষতি করতে দ্বিধা করে না তাকেই নেশা বলে। নেশা অনেক প্রকারের হয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেশা হচ্ছে- মদ, গাঁজা, চরস, আফিম, ইয়াবা ও তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি। আচরণগত নেশা বলতে বোঝায়- জুয়া খেলা, তাস খেলা, আড্ডা মারা, মারামারি করা, বিনা স্বার্থে অন্যের ক্ষতি করা ইত্যাদি।
এছাড়া রয়েছে হেরোয়িন ও প্যাথিডিন শরীরে গ্রহণ করা। কোনো নেশাই নিজের পরিবারসহ অন্যের মঙ্গলদায়ক নয়। নেশা আসক্ত মানুষ কমবেশি চিরকালই ছিল। বর্তমানে এর ভয়াবহতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নেশাগ্রস্ত মানুষ কেন বাড়ছে এর কারণ খুঁজলে বের হয়ে আসবে, দেশে ব্যাপক বেকার সমস্যা। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত ছেলেরা নেশাগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। গ্রাম থেকে আসা নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব ঘরের সন্তানরা বাবা-মার জমিজমা, ভিটে-মাটি বিক্রি করে শহরে এসে উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে কোনো চাকরি পায় না। বর্তমানে অফিসার পদে চাকরি পেতে হলে ১০-২০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। কোনো কোনো চাকরির ক্ষেত্রে ৩০-৪০ লাখ পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। এত টাকা পাবে কোথায়? এছাড়া কেউ কেউ উল্লিখিত টাকা দেওয়ার পর চাকরি এবং টাকা দুটোই হাতছাড়া হয়ে যায়। মধ্যভোগী হিসেবে যারা এ ধরনের টাকা গ্রহণ করে তারা রাজনৈতিকভাবে কিংবা বিভিন্ন কারণে ওদের ক্ষমতার অবস্থান থাকে অনেক উঁচুতে। ইচ্ছে করলেই হুমকিধমকি দিয়ে সেই টাকা আদায় করতে পারে না। ফলে চাকরির প্রার্থীরা হতে হয় পথের ভিখারি। বাবা-মার জমিজমা বিক্রি করে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছে। সেই সঙ্গে হাওলাত-কর্জ করে লাখ লাখ টাকা প্রতারককে দিয়েছে। কী করবে? কোথায় যাবে? আত্মহত্যা করা মহাপাপ। বাধ্য হয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
ছাত্রজীবনে কত না স্বপ্ন দেখেছিল, ভবিষ্যতেই এই হবে, সেই হবে। কিন্তু উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার পর সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। পরিবারে ও সমাজে তারা হয়ে যায় অবহেলার পাত্র। এত বড় ডিগ্রি নিয়ে যেমন-তেমন চাকরি করতে বিবেকে বাধা দেয়। বেসকারি প্রতিষ্ঠানে মাসে যে টাকা বেতন পাবে, সেই টাকা শেষ হয়ে যায় মোবাইল ও ইন্টারনেট চালাতে গিয়ে। পুরো জীবনটা বৃথা। উন্নতমানের পোশাক-আশাক না পরতে পারলে সার্টিফিকেটের কোনো মূল্য থাকে না।
মা-বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে কতদিন চলা যায়? বেকার ছেলেকে হাত খরচের টাকা দেবে, সেই সামর্থ অনেক পরিবারের নেই। ফলে এসব ছেলেরা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দলবদ্ধ হয়ে নেশা না করলে কি চলে? অল্পদিনের মধ্যে নেশাগ্রস্ত অনেক বন্ধু জুটে যায়। নেশার টাকা জোগাতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে অবৈধ কর্মকাণ্ডে। তখন তাদের নীতি-আদর্শ বলতে কিছু থাকে না। দল ত্যাগ করে ক্ষমতাসীন দলে ভিড়তে দ্বিধা করে না। নিজে নেশা করে এবং নেশাখোর নেতার পেছনে ঘোরে। একে ধরে, তাকে মারে, এই হলো তাদের কর্মসূচি। সরকার দলীয় কর্মী হিসেবে একটু-আধটু সম্মানও পায়। নিরীহ জনগণ ভয়ে তাদের সালাম দেয়। যতদিন দল ক্ষমতায় থাকে ততদিন ভালোই কাটে তাদের দিনকাল। দল ক্ষমতা হারালে তাদের জেল-হাজত খাটতে হয়। তাদের প্রধান আয়ের উৎস থাকে বিচার সালিশ। বর্তমানে এটিকে বলা হয় ফিটিং ব্যবসা। নিরীহ মানুষকে ডেকে এনে বিনা কারণে অপরাধী বানিয়ে টাকা আদায় করাই এই ব্যবসার প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিচার-সালিশে যাওয়ার আগে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, এত টাকা দিতে হবে। বিচারের ন্যায়-অন্যায় কোনো বিষয় না। টাকা দিলেই জিতিয়ে দেয়। এসব সালিশিতে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কোনো মূল্যায়ন নেই। রাজ্য তাদের, রাজাও তারা। ইয়াবা ব্যবসা গ্রামগঞ্জে বেশ রমরমা। বিরক্ত না করার জন্য এলাকার ক্ষমতাশীল ব্যক্তি থেকে শুরু করে কোনো কোনো ইউপির চেয়ারম্যান এবং থানাতে ব্যবসার অংশ হিসেবে মাসিক ফি দিতে হয়। গ্রামের জ্ঞানী-গুণীরা বাধা দিলে অপমানিত হতে হয়। অতিরিক্ত নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে নেশা নিরাময় আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে ভর্তি হলে প্রতি মাসে প্রায় ৪০-৫০ হাজার করে টাকা দিতে হয়। নেশা করার আগে নিয়ন্ত্রণের চিন্তা না করে অতিমাত্রায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে নিরাময় আশ্রয় চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে এ দেশে।
এসব উচ্চ শিক্ষিত নেশাগ্রস্ত ছেলেদের কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়িদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। ভালোভাবে খোঁজ-খবর না নিয়ে উচ্চশিক্ষিত দেখে মেয়ে বিয়ে দিয়ে প্রথমে দম্ভ আর অহংকারের শেষ নেই। আত্মীয়-স্বজনসহ পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে শুধু একই কথা- জামাই বাংলাদেশের পড়ালেখা শেষ করে ফেলেছে। একাধিক ডিগ্রি নিলে দেশের বাইরে যেতে পারবে। শত হলেও উচ্চশিক্ষিত জামাই, লেবু ছাড়া ভাত খেতে পারে না। দামি ফার্নিচার না দিলে মান-সম্মান থাকে না। শিক্ষিত জামাই হিসেবে ঈদে দামি পোশাক-আশাক দিতেই হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই মেয়েকে পিটিয়ে পাঠায় বাপের বাড়িতে টাকা আনার জন্য। মেয়ে শুধু কান্দে আর চোখের পানি ফেলে। ক্রমান্বয়ে জানতে পারে জামাই বাবা নেশা করে। শ্বশুরবাড়ি, নিজের পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজনকে অশান্তিতে রাখার জন্য একজন নেশাখোরই যথেষ্ট।
নেশা থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এবং সংস্কৃতি চর্চার দিকে নিজেকে ধাবিত করা। সেই সঙ্গে ছোট হোক বড় যে কোনো কর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক
বক্তৃতা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ঢাকা।
চরাই-উৎরাই অতিক্রম করে গোটা জাতি আনন্দ-উদ্দেলে অতিক্রম করল একটি বছর। একই সময়ে দুটো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা এলো ৫ আগস্ট বর্ষপূর্তিতে। গণঅভ্যুত্থানের প্রারম্ভে যে গণআকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে প্রথমত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দল পেশাজীবীরা, সুশীল সমাজ এবং সর্বস্তরের জনসাধারণের পক্ষ থেকে যে পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষা প্রদর্শিত হয়েছে- তা এক কথায় অভূতপূর্ব। বিগত অর্ধ শতাব্দী যাবত রাজনৈতিক সরকারগুলো যে যথাযথভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গ্রাহ্য করেনি, এই অভ্যুত্থান এবং অভ্যুত্থান পরবর্তী দাবি-দাওয়ার বেশুমার প্রদর্শন- জমে থাকা হতাশারই প্রমাণ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমাবদ্ধতা সচেতন মানুষ জানেন। তার পরও অসচেতনভাবে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গন, সচিবালয় এমনকি প্রধান উপদেষ্টার আবাসস্থল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে জনগণের আবেদন ও আন্দোলন। এককভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই হিমালয়সম ক্ষোভ ও ক্রোধকে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অক্ষম। তাই সঙ্গতভাবেই জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত সরকারের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধানত তিনটি প্রত্যয় নিয়ে সরকার তার যাত্রা শুরু করে। প্রথমত এটি বৈষম্যের নিরসন। দ্বিতীয়ত এটি সংস্কার প্রস্তাবণা। তৃতীয়ত এটি গণহত্যাকারী পতিত সরকারের বিচার। বৈষম্যের নিরসন এমন একটি গণদাবি যার সঙ্গে জড়িত আছে কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘকাল ধরে বঞ্চনার ইতিহাস। আর সংস্কার প্রস্তাবণা এতই দীর্ঘ এবং অগণিত যে হিসেব-নিকেশ এক রকম অসম্ভব। সরকার এইসব সংস্কার বা মেরামতের সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করে। অবশেষে ৬টি কমিশনের মৌলিক বিষয়বস্তু নিয়ে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অসম্ভব ধৈর্য্য ও কুশলতার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য অর্জনের চেষ্টা করে। বাংলাদেশের জনচরিত্র বিভেদের-ঐক্যের নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঙন প্রক্রিয়া গভীরভাবে অবলোকন করলেই এই দ্বন্দ্ব, কলহ, কোন্দল ইত্যাদির প্রমাণ মেলবে। ৩০টিরও অধিক রাজনৈতিক দল এই সংলাপে অংশগ্রহণ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর শতভাগ একমত হওয়া অসম্ভব কল্পনা। তবে গরিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেশিরভাগ বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করলেই- কমিশনের স্বার্থকতা প্রমাণিত হবে। যদিও কতিপয় মৌলিক বিষয়ে একমত হয়নি রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তবে যা অর্জিত হয়েছে এই দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষের দেশে, তাও কম নয়।
সংস্কারের প্রধান প্রধান বিষয়গুলো ছিল সংবিধান, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রণয়ন, নির্বাচন ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ, গণপ্রতিনিধিদের সীমিত স্বাধীনতার গ্যারান্টি, আমলাতন্ত্রের জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা নির্ধারণ, শাসন ও বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনগুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর নিযুক্তির ন্যায্যকরণ। রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন কোনো দিক নেই যে সংস্কারের আবেদন উত্থাপিত হয়নি। রাষ্ট্রের মৌলিক ১৯ সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একমত হয়েছে। এসব বিষয়গুলো হচ্ছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নমনীয় করণ, কমিটির ভাগাভাগি, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমাসংক্রান্ত বিধান আইনানুগকরণ, বিচার বিভাগীয় বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা সীমিতকরণ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিটি গঠন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, সংসদের উচ্চ-কক্ষ গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিধান ইত্যাদি। এসব বিষয়ে সাধারণ ঐকমত্য অর্জন সরকারের একটি বড় সাফল্য। এদিকে সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের দাবি এবং ব্যবস্থাপনাও এগিয়ে চলেছে। সেই কারণে ৫ আগস্টের সুন্দর সময়ে সরকার একই সঙ্গে দুটো গুরুত্বপূর্ণ দায় এবং দায়িত্ব পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
যে ঘোষণাপত্রটি প্রকাশিত হতে পারত অভ্যুত্থানের পরপরই, সেটি অবশেষে প্রকাশিত হলো। জুলাই বিপ্লবের প্রতি রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির অঙ্গীকার রেখে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঘোষণাপত্রে ২৮টি দফা রয়েছে। এখানে ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের স্বীকৃতি রয়েছে। ঘোষণাপত্রের ২৪ নম্বর দফায় গণঅভুত্থানের শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে। ঘোষণাপত্রের শেষ কথা এ রকম, ‘৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হলো’। এই ঘোষণার মাধ্যমে বহুল প্রতিক্ষীত একটি বিষয়ের মীমাংসা হলো। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতারা বারবার এ ধরনের একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য দাবি জানিয়ে আসছিল। তারা নিজেরা ঘোষণাটি প্রদান করবে এ রকম তারিখও দু-একবার দিয়েছে। সর্বশেষ এনসিপি বলেছিল ৩ তারিখে জনসমুক্ষে ঘোষণাটি প্রকাশ করা হবে। সরকার তাদের আশ্বস্ত করায় তারা হয়তো সরকারকেই এই ঘোষণার আইনানুগ ঘোষণাকারী মনে করেছে। ঘোষণাটি অনেককে তুষ্ট করেছে। আবার রাজনৈতিক দলের কয়েকজন জুলাই ঘোষণায় সন্তুষ্ট হননি।
৫ আগস্ট ২০২৫ জাতীয় জীবনে গৌরবময় দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের পরপরই প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কাল ঘোষণা করেন। আগামী বছর, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই নির্বাচন আয়োজন করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকাররের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি পাঠানোর কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইতোমধ্যেই সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত চিঠি নির্বাচন কমিশন বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে কমিশন যেন রমজান মাস শুরুর আগে ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। জুলাই ঘোষণাপত্র, জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যার বিচার ও সংস্কারসহ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তার ভাষায়, ‘এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা, নির্বাচন অনুষ্ঠান। এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।’
নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন দূরত্ব ছিল। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন অনুষ্ঠানে বারবার ওয়াদা করছিলেন বটে, তবে সঠিকভাবে সুনির্দিষ্টভাবে তিনি কোনো কথা বলেননি। রাজনৈতিক দলগুলো স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনমুখী। যে দলটি যতটা প্রত্যয়ী তারা তত জোড়ে-সোরে নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছিলেন। এই অনিশ্চিত অবস্থাটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে বেশ দ্বন্দ্বিক অবস্থা তৈরি করে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডন বৈঠকে। রাজনৈতিক মহলে মোটামুটি স্বস্তি ফিরে আসে। তবে অন্য দলগুলো বিএনপির এই প্রাধান্যের বিরোধীতা করে। যাহোক ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সালে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হবে এরকম আশ্বাসের পর রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটে। সেই ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্টের এই ঘোষণা এসেছে। এই ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো যে সংশয় ও সন্দেহে ভুগছিলেন তার অবসান ঘটে। কিন্তু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দল জুলাই ঘোষণা এবং নির্বাচনের তারিখ নিয়ে অস্বস্তির কথা বলেছে। তবে কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচন নাকোচ করা বা প্রতিরোধের কথা বলেনি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে গুজব ছিল যে ঘোষিত সময়সীমার বিপক্ষে অবস্থান নেবে বিএনপির পরের ধারার ডান-বাম রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু অসম্পূর্ণতা, অগ্রহণযোগ্যতা ও অসহযোগিতার কথা উচ্চারিত হলেও প্রত্যাখ্যাত হয়নি ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্র ও নির্বাচনের দিন-ক্ষণ।
আগেই বলা হয়েছে বিএনপি স্বস্তির মধ্যে ছিল। এই ঘোষণা দুটোর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হবে এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচন ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে, বিএনপি তা স্বাগত জানায়। আমরা বিশ্বাস করি এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবিকতা, সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি নতুন, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি তৈরি হবে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণাকেও ইতিবাচকভাবে নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বৈঠকে এই সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে গণতন্ত্রের উত্তরণের পথ সুগম করবে। তিনি নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। একই সঙ্গে সব রাজনৈতিক দল ও জনগণকে নির্বাচনকে সফল করে গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। মির্জা ফখরুল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, আহতদের প্রতি সহানুভূতি ও সুস্থতার জন্য দোয়া করেন।
অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দাবি করেন জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন আমরা লক্ষ্য করছি, নির্বাচনের উপযুক্ত যে পরিবেশ থাকার কথা ছিল তা সরকার এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। এ জন্য প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত টাইমলাইন অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তার আইনি ভিত্তি দিতে হবে। অতীতে বিভিন্ন অভ্যুত্থান ও আন্দোলন হয়েছে- পরবর্তী সময়ে তার আইনি ভিত্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন- ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর লিগাল ফ্রেম ওয়ার্কের ভিত্তিতে ৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদে ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুমোদন হয়েছিল। জাতীয় ইতিহাসে এ ধরনের আরও ঘটনার উল্লেখ করে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিতে তিনি নির্বাচন সম্পন্ন করার দাবি জানান। বাংলাদেশের মতো শতধাবিভক্ত ও রাজনৈতিক ঝগড়ায় নিত্য নিয়োজিত নেতৃত্বকে একটি সমন্বিত ও সম্মিলিত ধারায় একত্রীকরণ একটি সুকঠিন কাজ। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ যে তারা যতটা সম্ভব ‘বিরোধের মাঝে ঐক্য’ নিশ্চিত করতে পেরেছেন। জুলাই ঘোষণাপত্র এবং নির্বাচন সম্পর্কে দোলাচলে ছিল দেশবাসী। ঘোষণার পরে গরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলো এক বাক্যে নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন যে প্রধান ধারার বিপরীতে অবস্থানকারী শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কিনা। এটি সন্তোষের বিষয় যে অবশেষে ওইসব রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিক্রিয়া সমালোচনা সত্ত্বেও নির্বাচনী দিন-ক্ষণকে মেনে নিয়েছে। জুলাই ঘোষণা সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রিয়া -প্রতিক্রিয়ায় অস্বস্তি লক্ষ্য করা গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি আগের মতো এসব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগেরমাধ্যমে মতামত জেনে নিতেন, তাহলে অদৃশ্যমান বিভেদটি দৃশ্যমান হতো না। তবে নাগরিক সাধারণ জুলাই ঘোষণার বাস্তবায়ন, জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে নির্ধারিত সংস্কারগুলো সর্বোপরি নির্বাচনের শতভাগ নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তিনটি উপায়ে নাগরিক সাধারণের এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান করা যায়। প্রথমত সকল রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বাক্ষরে জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা যায়। দ্বিতীয়ত অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানের স্বীকৃত সংশোধনীর প্রকাশ ঘটানো যায়। তৃতীয়ত রাষ্ট্রপতি তথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আইনানুগ ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সংস্কার কার্যক্রম এবং প্রশাসনিক দায়-দায়িত্বের ঘোষণা দেওয়া যায়।
লেখক: সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক ভিসি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের দেশের বহুল আলোচিত কিছু শব্দের মধ্যে ‘দুর্নীতি’ অন্যতম। কম বেশি সবাই এ নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করে থাকে। আলোচনার সময় মনে হয় সবাই দুর্নীতিকে অপছন্দ তো করেই; অনেকে তীব্র ঘৃণাও করে। যারা ক্ষমতায় থাকে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলে, যারা ক্ষমতায় থাকে না তারাও বলে, সাধারণ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলে, নাটক-সিনেমা, গল্প সবজায়গায় যে যেভাবে পারছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করছে। দৃশ্যত সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে থাকলেও এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দুর্নীতি আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যার মধ্যে একটা কেন? কোনোভাবেই কেন দুর্নীতির মোহ এবং গ্রাস থেকে আমাদের সমাজ মুক্ত হতে পারছে না?
আমাদের কাছে এই দুর্নীতি আসলে একটা দুর্বোধ্য বিষয়। অনেকে হয়তো ভাবছেন এটা আবার কেমন কথা? দুর্নীতি তো দুর্নীতিই। এটা দুর্বোধ্য হওয়ার কি আছে। কেন এটা দুর্বোধ্য সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমাদের বেশিরভাগ মানুষের চোখেই দুর্নীতির কথা বললে সরকারি অফিসে স্তূপ করে রাখা কিছু ফাইলের কথা মনে পড়ে যায়। অর্থাৎ দুর্নীতি হচ্ছে টাকার বিনিময়ে কিছু ফাইলের ফলপ্রসূ আদান প্রদান। টাকার বিনময়ে বিভন্ন সিদ্ধান্ত বা কাজ পাওয়া অবশ্যই দুর্নীতি তবে এটাই দুর্নীতির মূলকথা না। দুর্নীতি এরচেয়েও অনেক ব্যপক বিষয়। দুর্নীতির সহজ ও মিনিংফুল সংজ্ঞা হচ্ছে, অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাক্তিগত লাভের জন্যে অনৈতিক ও অবৈধ কাজ করা। এই সংজ্ঞায় একটা ছোট দুর্বলতা রয়ে গেছে। এখানে বলা হয়েছে কেউ যদি অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করে। অর্থাৎ, দুর্নীতি করতে হলে ক্ষমতা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি মানে অবৈধ এবং অনৈতিক কাজ করা। কেউ যদি অবৈধ এবং অনৈতিক কাজ করতে সহযোগিতা করে তাহলে সংজ্ঞা অনুযায়ী সরাসরি তাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাচ্ছে না। আর এই সুযোগটাই আমরা হর হামেশা নিয়ে যাচ্ছি।
আমি তখন সবে এইচ এস সি পাস করে একটা স্বনামধন্য কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে ক্লাস করা শুরু করেছি। ঢাকা ইউভার্সিটির পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতেও ভর্তি পরীক্ষা দেব বলে সিদ্ধান্ত নেই। তবে দুটো সাবজেক্ট ছাড়া আর কিছুতে ভর্তি হতে মন চাইছিল না। বিবিএ এবং ইংলিশ লিটেরেচার। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে নির্ধারিত দুই দিনে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। গাবতলি থেকে বাসের ছাদে করে যাতায়াতের সময় আমার এক সহপাঠীর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং বেশ সখ্যতার জন্ম নেয়। প্রথম দিন বিবিএ ভর্তি পরীক্ষা ছিল। পরের পরীক্ষা ইংলিশ। বেশ কঠিন প্রশ্ন এসেছিল। পরীক্ষা হলে প্রশ্ন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল যে ইংলিশ লিটেরেচারের প্রশ্ন যত কঠিন হবে আমার চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে। যাই হোক পরীক্ষা দিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে বের হলাম। আমার সেই নব্য বন্ধুর সঙ্গে দেখা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে পরীক্ষা কেমন হয়েছে। দেখলাম ও ‘ভালো’ বলে মিটিমিটি হাসছে। দুজনে আবার বাসের ছাদে উঠলাম। দুটো পরীক্ষাই আমার দারুণ হয়েছে। মনে মনে ভাবছিলাম আসন মাত্র আশিটা (যতদূর মনে পড়ে) তাতে কি আমার পজিশন দুটোতেই দশের মধ্যে থাকবে। হঠাৎ আমার সেই নব্য বন্ধু হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল ‘সব কমন পড়েছে না?’ আমি উত্তরে বললাম, ‘ভর্তি প্রশ্ন আবার কমন পড়ার কি আছে? আমার প্রিপারেশন ভালো ছিল। দারুণ পরীক্ষা দিয়েছি’। ও তখন বেশ সিরিয়াস হয়ে গেল। ‘মঙ্গলবারে যে প্রশ্ন আউট হয়েছিল সেটা তুমি পাউনি? ইংলিশ, বিবিএ দুইটার প্রশ্নই তো আউট হয়েছে।’ আমার মাথায় মনে হলো বাজ পড়ে গেছে। পরে জানলাম প্রতি প্রশ্ন পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল। হুবহু সেই প্রশ্নগুলোই এসেছে। রেজাল্ট বের হলে দেখলাম আমার সেই নব্য বন্ধু ভর্তি হচ্ছে আর আমার নাম ওয়েটিং লিস্টের বার নম্বরে। এখনো সেই অনুভূতি আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। আমার মেধা, আমার শ্রম কিভাবে অপমানিত হয়েছিল সেটা অগ্রহণযোগ্য। এভাবে আমাদের দেশে এ পর্যন্ত আমার ধারণা লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ হয় প্রশ্ন আউটের সুযোগ নিয়ে বা অন্য কোনো অবৈধ পন্থা বা সুপারিশের মাধ্যমে ভর্তি হয়েছে বা চাকরি পেয়েছে। তারা কি আসলেই মন থেকে দুর্নীতিকে ঘৃণা করে?
আমি এমন অনেক ক্ষমতাশালী সৎ মানুষ দেখেছি যারা ঘুষ খায় না। টাকা পয়সার বিষয়ে খুবই স্বচ্ছ; কিন্তু সুপারিশের মাধ্যমে নিজের কাছের মানুষদের আর্থিক বা অন্য কাজ পাইয়ে বড় ধরনের সুযোগ করে দিচ্ছে। অযোগ্য কাউকে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কোটিপতি করে দিচ্ছে। আর্থিক লেনদেন না করলেও সেই ক্ষমতাধর ব্যাক্তিকে আপনি কি দুর্নীতিগ্রস্ত না বলে থাকতে পারবেন? সুপারিশ খুব পরিচিত একটা শব্দ। চাকরির ক্ষেত্রে, সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে, কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে, কিছু সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মের বাইরে আমরা প্রতিনিয়ত অমুক নাহলে তমুকের কাছে ধরনা দিচ্ছি। আমি যখন নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো সুবিধা পাচ্ছি সেটাই কিন্তু অনিয়ম এবং দুর্নীতি। যেখানে আমাদের অনেকেই প্রতিনিয়তই ক্ষমতাধর কারো সুপারিশ নিয়ে হাজির হচ্ছি সেখানে দুর্নীতিকে আসলেই কি আমরা মন থেকে ঘৃণা করতে পারছি?
আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার সময় খুব সোচ্চার; কিন্তু অনেকে সুযোগ পেলেই দুর্নীতির মাধ্যমে সুবিধা নিতে প্রস্তুত। এই মানসিকতাই আমাদের সমাজে দুর্নীতির টিকে থাকার মূল গল্প। এছাড়াও আরও কিছু বিষয় আছে যেসব কারণে আমাদের ভেতরে দুর্নীতি শক্তিশালী অবস্থান গেঁড়ে আছে। মানুষ আপনার সফলতা দেখতে চায়। আপনি কিভাবে সফল হলেন সেটা মুখ্য না। সফলতা অর্জনে কোনো এক পর্যায়ে অসৎ হয়েছিলেন কিনা সেটা অনেকের কাছে কোনো বিষয়ই না। এর জন্যেই যেকোনোভাবে আমরা সফল হতে চাই। যে ব্যক্তি অনিয়মের মাধ্যমে সফল হচ্ছে সে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে দ্বিতীয়বার ভাববে না।
দুর্নীতিতে আকৃষ্ট হওয়ার জন্যে আমাদের দেশের সিস্টেম অনেকাংশে দায়ী। যেহেতু আমাদের দেশের অনেকেই দুর্নীতিতে আসক্ত তাই কর্মক্ষেত্রে সুযোগ পেলেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া কেউ যদি দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে চায় তাহলে সে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে যায়। একটা দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে অসৎ মানুষেরা যত সহজে সবাই এক হয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করে সৎ মানুষেরা কিন্তু তত সহজে এক হয়ে কাজ করতে পারে না। কারণ সৎ মানুষেরা একটু নন কম্প্রোমাইজিং হয়। এর কারণে কর্মক্ষেত্রে একজন অসৎ মানুষ তার অসৎ বসের কাছ থেকে চাকরিতে যে সুবিধা পেয়ে থাকে একজন সৎ মানুষ তার সৎ বসের কাছ থেকে ঠিক একই ধরণের চাকরি সংক্রান্ত সুবিধা পায় না। এ কারণেই অসৎ মানুষেরা কোনো একটা প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থায় অনেক সংগঠিত হয়ে অসৎ কাজ করে যেতে থাকে।
আমরা যতই বলি না কেন দুর্নীতি আমাদের দেশ থেকে সহজে যাবে না। আমাদের মন মানসিকতায় এক ভয়াবহ বিকৃতি ঘটেছে। আমরা ক্ষমতা চাই ক্ষমতা অপব্যবহার করার জন্যে, ক্ষমতা দিয়ে ভুলকে ঠিক করার জন্যে না।হয়তো কেউ কেউ ক্ষমতাকে অর্পিত দায়িত্ব হিসেবে মেনে নিয়ে ভালো কাজ করে যাচ্ছেন তবে সে সংখ্যাটা খুবই কম। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে না তুললে কোন ফল পাওয়া যাবে না। একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষকে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। সরকারিভাবেও কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতি বছর ভালো কাজের জন্যে সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত করা হয়। অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষকে কখনো তিরস্কার করতে দেখি নাই। প্রতি বছর দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের লিস্ট করে জনসম্মুখে আনতে হবে। তাহলে দেখবেন তারা সামাজিকভাবে লজ্জায় পড়বে। খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখবেন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এমন কিছুই করা হয় না। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বা পত্রিকায় সফল মানুষদের নিয়ে প্রতিবেদন করা হয়। অথচ সবচেয়ে বেশি প্রতিবেদন দরকার সৎ মানুষ এবং অসৎ মানুষদের নিয়ে। একজন সৎ মানুষকে শুধুমাত্র সততার ক্যাটাগরিতে অফিসিয়ালি কাউকে স্বীকৃতি দিতে দেখিনি। সৎ এবং অসৎ এই ধরনর মানুষকেই সমাজে পরিচিত করিয়ে দিতে হবে। সমস্যা হচ্ছে অসৎ মানুষদের কোরাম এত বেশি শক্তিশালী যে তাদের স্পর্শ করা সম্ভব না। তারচেয়ে বড় কথা আমরা রিয়েক্ট করি শুধু ভাইরাল হওয়া দুর্নীতিতে। অন্যসব দুর্নীতিতে চোখ বন্ধ করে না দেখার ভাণ করে থাকি। কারণ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা মনে প্রাণে দুর্নীতিকে ঘৃণা করি না বরং বুঝে না বুঝে দুর্নীতি করার সুযোগ খুঁজতে থাকি।
লেখক: কথাশিল্পী ও নাট্যকার
সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি ঘোষণা আসার পর থেকেই অনেক রাজনৈতিক মহলের ধারণা এই পুলিশ বাহিনী দিয়ে নির্বাচন? কিন্তু আমাদেরত একটি গর্বিত চৌকস সাহসী সেনাবাহিনী আছে। এদের দায়িত্ব, নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ন নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। দেশের ক্লান্তিলগ্নে সে দৃষ্টান্তত বহুবার দেখিয়েছে।
এদের নৈতিকতার জন্য জনগণ ও আস্থা রাখে। আমরা কেন এদেরকে কাজে লাগাতে পারব না? অবশ্যই তা সম্ভব। দরকার শুধু সুষ্ঠ পরিকল্পনা। আমরা কি ভুলতে বসেছি ছাত্র ও জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ও ক্ষমতার মসনদ ঠিক রাখার জন্য স্বৈরাচারী সরকার দমন-পীড়ন সমানতালে চালাচ্ছে। এরি মধ্যে অনেক লোকের জীবনহানি হল কিন্তু সরকারের টনক নড়ছে না। তারা জনগণের ভাষা না বুঝে চরম দাম্ভিকতার উচ্চ শিখরে আরোহন করছিল। যেখানে ক্ষমতাই মূখ্য। জনগণ বিবেচ্য বিষয় নয়। ঠিক তখনই দেবদূতের মত দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান ৩ আগষ্ট/২৪ স্বৈরাচারী সরকারকে ছাপ জানিয়ে দিলেন ---জনগণের ওপর সেনাবাহিনী গুলি চালাতে পারবে না। তখনই জনতার আন্দোলনের মোড় ঘুরে গেল । সেনাবাহিনীর এই ভূমিকার কারণে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।পৃথিবীর সব দেশেই গণঅভ্যুত্থানে অমনটি হয়ে থাকে। আমাদের সেনাবাহিনী যে কোন দুর্যোগমুহূর্তে জনগণের পাশে থেকে সাহায্যের হাত বাড়ায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ অগ্নি নির্বাপক, জঙ্গি দমনে অতীতে সেনাবাহিনী বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্তের প্রতীক আমাদের গর্বিত সেনাবাহিনী। এরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নির্বাচনে সহযোগিতা করে আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জন করে আসছে। বিশ্ববাসী এদের ওপর নির্ভর করতে পারে। শেখ হাসিনা তার স্বার্থ হাসিলের জন্য জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সময় এদেরকে কোনঠাসা করে রাখতেন। এখন সময় এসেছে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোর।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করার পর থেকে রাজনৈতিক দলসমূহ নড়েচড়ে বসেছে। বাংলাদেশের জনগণ প্রায় ১৫ বছর যাবত সুষ্ঠু নির্বাচন দেখেনি। সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কারণে ভোট কেন্দ্রে যাওয়াটা ও অনেকে ভুলতে বসেছে। গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই। সকল মতের সকল মানুষের অংশগ্রহণে যে নির্বাচন হয় সেই সংসদ হয় জনগণের। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসলে দেশের অর্থনীতি হয় ভঙ্গুর। যেখানে আমাদের পুলিশ সড়কের নিরাপত্তা দিতে পারে না সেখানে কিভাবে ভোট কেন্দ্রে নিরাপত্তা দেবে? পুলিশের দায়িত্ব হীনতার কারণে যে দেশে ঐকমত্যের ভিত্তিতে চোখের এক পলকে খনিজ মূল্যবান সম্পদ সাদা পাথর লুট হয়ে যায় সে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ভাবাটা দুরূহ ব্যাপার। অবশ্য সাদা পাথর ও সেনাবাহিনী কতৃক উদ্ধার হয়েছে। তাছাড়া দেশে একটি প্রচলিত কথা আছে ১০টা হোন্ডা ১০টা গুন্ডা থাকলেই নির্বাচনে জেতা কোনো ব্যাপার না। অমনটি হলে এত বিপ্লব মানুষের ত্যাগ বৃথা যাবে। মানুষ আশাভঙ্গ হবে। এদের দায়িত্ব কর্তব্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন আছে। দেশে এখন পুলিশের সাংগঠনিক ক্ষমতা ও মনোবল নিম্ন পর্যায়ে। এদের কারণে মব সন্ত্রাস দিন দিন বেড়েই চলছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়।এমন অবস্থায় ভালো নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবয়ব,আয়তন ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শান্তি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো রেখে নির্নাচন করতে হলে সেনাবাহিনীর বৃহত্তর ও কার্যকর অংশগ্রহণ দরকার। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লাগবে। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ এখন মাঠে আছে পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য। সেনাবাহিনী মাঠে থাকা স্বত্বেও
৫ আগস্টের পর পুলিশ এর মাঝে এখনো শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। তাইত বাস্তবতার নিরিখে ইসির নির্বাচন বিষয়ক প্রস্তাবনায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পরিবর্তন আসবেই। এই পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অনেক বেড়ে যাবে। বিদ্যমান আইনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সংজ্ঞায় বলা আছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অর্থ হলো: পুলিশ বাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, ব্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, আনসার বাহিনী ব্যাটালিয়ন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এবং কোস্ট গার্ড বাহিনী। সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্যে ২০০১ সালে আরপিওতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করা হয়েছিল। এই বিধানটি ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী সরকারের আমলে ২০০৯ তাদের অশুভ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই আইনটি বাদ দেওয়া হয়। আইনে সশস্ত্র বাহিনী সংজ্ঞাভুক্ত না থাকলে নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বাধ্যবাধকতা থাকে না। কিন্তু গত তিনটি নির্বাচনের আগে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপে অনেকই সশস্ত্র বাহিনীকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত দাবি জানিয়েছিল। আওয়ামী লীগ বিষয়টি আমলে নেয়নি। বিগত তিনটি নির্বাচনে সেনাবাহিনী টহলরত ছিল কিন্তু একটা আনসারের যে ক্ষমতা ছিল তাও ছিল না। এতে ভোট কারচুপি করে নির্বাচনের আয়োজনকে বিতর্কিত করেছেন।
বর্তমানে নির্বাচন সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায়’ সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর ‘যুক্ত করার প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আইনে এটি যুক্ত হলে তিন বাহিনীকে নির্বাচনী দায়িত্ব নিতে আলাদা কোন আদেশের প্রয়োজন হবে না। এই আইনের আওতায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ও পুলিশের মতো ভোট কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এবং বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবেন।
বর্তমান সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপারে আরপিও ৮৭ ধারায় আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর ক্ষমতার বিষয়ে বলা আছে। যেমন এই আইন অনুযায়ী পুলিশ কর্মকর্তা না হলে ও নির্বাচন সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনরত ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার’ কোনো সদস্য ভোটের দিন ভোট কেন্দ্রে বা ভোট কেন্দ্রের ৪০০ গজ ব্যাসার্ধের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্বাচনী অপরাধের জন্য যে কোনো ব্যাক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারেন। ইসি সেভাবে প্রস্তাবনা তৈরি করেছেন সেভাবে আইনে সংশোধনে এলে সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচনের সময় এ ক্ষমতাগুলো প্রয়োগ করতে পারবে।
আওয়ামী সরকারের আমলে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনে সংজ্ঞাভুক্ত না থাকলেও নির্বাচনগুলোতে সেনা মোতায়ন করা হয়েছিল। সেখানে দায়িত্ব ছিল --ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার- এর (বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার উদ্দেশ্য) আওতায়। এভাবে মোতায়ন করা হলে মূলত স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে দায়িত্ব হলো- স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নির্বাচনী এলাকায় নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় তারা অবস্থান নেয়, প্রয়োজনে টহল দেয়। রিটার্নিং কর্মকর্তা বা ম্যাজিষ্ট্রেটের নির্দেশে তারা কাজ করে।
ফাউন্ডেশন ফর ষ্ট্রেটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (এফ-এস ডিএস) মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর একটি সেমিনারে বলেন, ‘সেনাবাহিনীকে শুধু স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রাখার মানি হবে অরাজকতা তৈরির সুযোগ করে দেওয়া এবং বিপুল অর্থের অপচয়। আমি মনে করি সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞাভুক্ত করে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সযোগ)তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হোক। এতে জনগণ ভোট দিতে উৎসাহ পাবে।’
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করতে হলে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। আমি মনে করি সেনাবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত রাখতে হবে। ভোটের তিন মাস আগে তাদের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব দিতে হবে। ভোটের পরেও কমপক্ষে ১০ দিন সেনাবাহিনী মাঠে থাকতে হবে। একদম তৃণমূল পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সমন্বয় কমিটি হবে সেখানে সেনাবাহিনীকে রাখতে হবে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য ৮০ হাজার সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করবেন। নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবচেয়ে ইতিহাসের সেরা যে নির্বাচন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তা সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সরাসরি সংযুক্ত রাখতে হবে। ফোর্স স্বল্পতার কারণে ভারতের মত একাধিক দিবসে ----যেমন ৮টি বিভাগের জন্য ৪ দিনে সংসদ নির্বাচন করা যেতে পারে। তাহলে নিরাপত্তার বিষয়টি ১০০% নিশ্চিত হবে। বিশ্বের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো উত্তম সময় এসেছে । এরা যদি শান্তি মিশনে নিরাপত্তা দিতে পারে আমাদের দেশে পারবে না কেন? তবে জনগণকে ও সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করতে হবে তাহলেই দেশে একটি উৎসব মুখর নির্বাচন করা সম্ভব।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট
বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব কম নেতাই আছেন, যাঁরা দীর্ঘ নির্বাসনেও জনতার হৃদয়ে থেকেছেন সংগ্রামের প্রতীক হয়ে। তারেক রহমান- শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান। শুধু রাজনৈতিক উত্তরাধিকারেই নয়, নিজের যোগ্যতা ও দৃঢ়তায় আজ দেশের আপামর মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জাতীয় মর্যাদা রক্ষা ও ভবিষ্যতের নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় আশ্বাস । দীর্ঘ ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রবাসে থেকেও তিনি হার মানেননি- রাজপথে না থেকেও রাজপথের প্রতিটি আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হয়েছেন। তাঁর ডাকেই সংগঠিত হয়েছে লাখো কর্মী, জেগে উঠেছে ছাত্রসমাজ, তীব্র প্রতিবাদে কেঁপে উঠেছে স্বৈরাচারের ভিত।
অন্যদিকে গত দেড় দশক বাংলাদেশ ছিল ফ্যাসিবাদ, দুর্নীতি ও বিদেশি স্বার্থরক্ষার এক দীর্ঘ অন্ধকারে নিমজ্জিত- যেখানে শেখ হাসিনা ক্ষমতার লোভে জাতির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করেছেন। ঠিক এই অন্ধকারের মাঝেই তারেক রহমানের দৃঢ় বিশ্বাস, সুদূরদৃষ্টি ও অবিচল সংগ্রাম আজ জাতির জন্য হয়ে উঠেছে মুক্তির একমাত্র অপ্রতিরোধ্য আলোকবর্তিকা । বাংলাদেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে যখন দেশ নতুন পথের সন্ধানে, তখন জনমানসে একটি প্রত্যাশা ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে- তারেক রহমানের নেতৃত্বেই শুরু হবে স্বাধীন, সমৃদ্ধ ও মর্যাদাবান বাংলাদেশের নতুন অধ্যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিষ্ট শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনকাল ছিল এক গভীর অন্ধকারের সময়, যেখানে জনগণের অধিকারকে নির্মমভাবে পিষে দেওয়া হয়েছিল ক্ষমতার স্টিমরোলারের নিচে।
অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের বন্ধুত্ব। বিনিময়ে ভারতকে দিয়েছেন এমন সব সুবিধা, যা দেশের সার্বভৌমত্বকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। সীমান্তে বারবার বাংলাদেশি নাগরিকদের রক্ত ঝরলেও, তিনি নীরব থেকেছেন; বরং নানা চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে ভারতকে একতরফা সুবিধা দিয়েছেন- ট্রানজিট, সমুদ্রবন্দর ব্যবহার, জলসম্পদে প্রাধান্য, এমনকি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক নীতিতেও দিল্লির প্রভাব বিস্তারের সুযোগ। এ দেশের কৃষক যখন তিস্তা নদীর পানির জন্য হাহাকার করেছে, তখনো শেখ হাসিনা ভারতের মন জোগানোর রাজনীতিতে ব্যস্ত ছিলেন। দেশের শিল্প, বাণিজ্য ও জ্বালানি খাতকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করে তোলার মাধ্যমে তিনি শুধু অর্থনীতিকেই দুর্বল করেননি, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তা, কূটনীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রতিটি স্তরে ভারতীয় প্রভাব এমনভাবে প্রবেশ করেছে, যেন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নয়- বরং প্রতিবেশী পরাশক্তির একটি প্রভাবাধীন প্রদেশ। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পরপরই প্রতিবেশী দেশ ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। তখন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের মুখে মুখে শোনা যেত- ‘ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক কিংবা দুবাইয়ের মতো।'
কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা করে ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করে। ধাপে ধাপে ভারত শুধু সড়ক নয়, রেল ট্রানজিটও আদায় করে নেয়। এর ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যের পণ্য এখন বাংলাদেশের সড়ক, রেল এবং জলপথ ব্যবহার করে আখাউড়া-আশুগঞ্জ হয়ে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে পৌঁছাচ্ছে।
এখানেই শেষ নয়- ভারতকে বাংলাদেশের চারটি নদীপথ ব্যবহারেরও অনুমতি দেওয়া হয়। এতে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ সরাসরি বাংলাদেশের পূর্ব দিক হয়ে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়- এই ট্রানজিট দিয়ে কি বাংলাদেশ সত্যিই সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক বা দুবাইয়ের মতো সমৃদ্ধ হয়েছে? সোজা উত্তর- না, হয়নি। বরং, দৈনিক আজকালের খবর পত্রিকার (৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন- 'ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার ফলে ১৬ বছরে বাংলাদেশ আয় করেছে মাত্র ৩৭ লাখ টাকা, অথচ কেবল ট্রানজিটের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যয়েই খরচ হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।' অর্থাৎ যে ট্রানজিটকে উন্নয়নের সোনার হরিণ বলা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এক বিশাল আর্থিক ক্ষতির বোঝা এবং জাতীয় স্বার্থ বিসর্জনের প্রতীক।
শেখ হাসিনা যেভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় নিজ দেশের জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছেন, তা ইতিহাসে এক বিশ্বাসঘাতকতার উদাহরণ হয়ে থাকবে। ক্ষমতার লোভে আঞ্চলিক শক্তির কাছে দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়া এবং জনগণের ন্যায্য অধিকার উপেক্ষা করার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, তা থেকে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশের জন্য হবে দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রামের পথ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার আগমন ছিল এক প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ নারীর যাত্রা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর লন্ডনে প্রথম সফরেই বিবিসির খ্যাতিমান সাংবাদিক জন রেনারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন-রাজনীতি তার ভালো লাগে না, কিন্তু পিতা, মাতা ও ভাইদের হত্যার প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। সেই প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা পরবর্তীতে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি পদক্ষেপে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই ছিল শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য, আর সেই সঙ্গে তিনি শুরু করেন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা-যেখানে দেশের স্বার্থ সর্বদা ছিল শেষ প্রাধান্যে, আর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ ছিল সবার ওপর। ভবিষ্যতে যদি ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, তাহলে বিদেশে আশ্রয় নেওয়ার পথও তিনি আগেই সুসংহত করে রাখেন। পরিবারের সদস্যদের বিদেশি নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা ছিল সেই দূরদর্শী পরিকল্পনারই অংশ। আর বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য দেশের সম্পদ লুটপাটে তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা সব সময়ই ছিল সক্রিয়।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ থেকে পাচার করেছে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার- বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা (দৈনিক সমকাল, ২ ডিসেম্বর ২০২৪)। শুধু গত পাঁচ বছরের পাচারের অঙ্কই জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। এই অর্থ দিয়ে ৮৭টি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব ছিল। ২০০৯ সালে সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতনের সময় সেই ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ লাখ কোটি টাকায়।
মাথাপিছু ঋণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ টাকা। এই ঋণের বড় অংশই এসেছে বিদেশি ও দেশি উৎস থেকে, যার বিশাল অংশ লুটপাট হয়েছে মেগা প্রকল্পের নামে শেখ হাসিনার শাসনামলে মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতির চিত্র-
পদ্মা সেতু : উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, মাত্র ৬.১৫ কিমি দীর্ঘ পদ্মা সেতু নদীর ওপর নির্মিত, সিঙ্গেল রেললাইন, তৈরিতে সময় লেগেছে ৭ বছর ৬ মাস ২৬ দিন এবং খরচ ৩.৬ বিলিয়ন ডলার। সেখানে রাশিয়ার ক্রিমিয়া সেতুর দৈর্ঘ্য ১৮.১ কিলোমিটার, উত্তাল ব্লাক সির ওপর নির্মিত, ডাবল রেললাইন, তৈরিতে সময় লেগেছে মাত্র ৩ বছর এবং খরচ ৩.৭ বিলিয়ন ডলার। এই চিত্রে পদ্মা সেতুতে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে সেটা সহজেই অনুমেয়।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে শেখ হাসিনা একাই আত্মসাৎ করেছেন ৫৯ হাজার কোটি টাকা। (ঢাকা পোষ্ট, ১৮ আগস্ট ২০২৪)।
কর্ণফুলী টানেল : প্রতিদিন গড়ে ২৭ লাখ টাকার লোকসান, যার পেছনে অপরিকল্পিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত দায়ী। (ইত্তেফাক, ২৮ অক্টোবর ২০২৪)।
সড়ক ও অবকাঠামো খাত: বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তো বটেই, এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও বাংলাদেশে মহাসড়ক নির্মাণের ব্যয় কয়েক গুণ বেশি। ফলে মহাসড়ক নির্মাণ ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে। (প্রথম আলো, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫)। বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ ব্যয় ভারত ও চীনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি- প্রধান কারণ ছিল দুর্নীতি ও দরপত্রে প্রতিযোগিতার অভাব। ফ্লাইওভার নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি- বাংলাদেশের ব্যয় বিশ্বের শীর্ষে বিগত ৩১ মে, ২০১৬ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, “বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় ভয়াবহভাবে বেশি।
বাংলাদেশে কিলোমিটারপ্রতি ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় ঢাকা ফ্লাইওভার : ৩১৬ কোটি টাকা, মৌচাক মালিবাগ ফ্লাইওভার : ১৩৫ কোটি টাকা, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার : ১৮০ কোটি টাকা।
অন্যান্য দেশের তুলনা
মুম্বাইয়ের ইস্টার্ন ফ্রি হাইওয়ে ৮৮ কোটি টাকা, কলকাতার পরমা ফ্লাইওভার ৪৮ কোটি টাকা, চীন ও মালয়েশিয়া : ৮০-৯০ কোটি টাকা। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পগুলো শুধু ব্যয়বহুলই নয়, বরং সীমাহীন দুর্নীতি ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারি অর্থ লোপাটের একটি বড় উদাহরণ।
রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় ও জাতীয় সম্পদের ক্ষতিসাধনের গুরুতর অভিযোগে বারবার অভিযুক্ত হয়েছেন শেখ হাসিনা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্য অনুযায়ী, শুধু 'মুজিব শতবর্ষ' উদযাপনকে ঘিরেই শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল নির্মাণে অপচয় করা হয়েছে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা। সারাদেশে ১০ হাজারেরও বেশি ম্যুরাল ও মূর্তি নির্মাণে এই বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়, যা জনকল্যাণমূলক খাতে বিনিয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রচার ও ব্যক্তিপূজার উদ্দেশ্যে অপব্যবহৃত হয়েছে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, আহ্বায়ক, আমরা বিএনপি পরিবার ও সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল
ঐকমত্য কমিশন জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়া ইতোমধ্যেই আমাদের সামনে এসেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। তবে বেশে কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়নি। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কার আনা হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্য হলেও সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। উল্লেখ্য, বিএনপি সনদ বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করার বিষয়ে একমত হলেও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল মনে করে, শুধু অঙ্গীকার করলেই হবে না। তারা মনে করে সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে হবে এবং সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) আছে, সেগুলো হলো: ১. রাষ্ট্রের মূলনীতি: এই প্রস্তাবে ভিন্ন আছে বাংলাদেশ জাসদ, সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), গণফোরামের; ২. রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি: ভিন্নমত আছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের; ৩. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব: কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ১২-দলীয় জোট, এলডিপির; ৪. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান: ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের; ৫. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা: বিএনপি (গঠন প্রক্রিয়া সংসদের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষে), কিছু অংশে ভিন্নমত আছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি, এনডিএম, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২-দলীয় জোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির; ৬. উচ্চকক্ষে পিআর: বিএনপি, এনডিএমের ভিন্নমত; ৭. উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ: বিএনপি, এনডিএমের ভিন্নমত; ৮. উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা: সিপিবি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, আম জনতার দলের ভিন্নমত; ৯. নারী আসনের বিধান: সিপিবি, বাসদ, আম জনতার দলের ভিন্নমত ১০. ন্যায়পাল নিয়োগ, সরকারি কর্ম কমিশনে নিয়োগ, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগ: বিএনপি, এনডিএম, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ভিন্নমত; ১১. ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপের পক্ষভুক্ত হওয়া: জামায়াতে ইসলামী, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, জাকের পার্টি, জেএসডি ও বিএসপির ভিন্নমত আছে।
সার্বিক পরিস্থতি বিবেচনায় বলা যায়, এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংকটের মেঘ পুরোপুনি কেটে যায়নি। তবে পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনের টক শো, গোলটেবিল, সভা-সেমিনারÑসর্বত্রই এখন আলোচনার প্রধান বিষয় নির্বাচন। সম্প্রতি গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারলাম যে, নির্বাচন কমিশন সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই রোডম্যাপ ঘোষণা করা হতে পারে। এতে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, সামান্য যে অনিশ্চয়তা ছিল, তা-ও হয়তো কেটে যাচ্ছে। দুয়েকটি রাজনৈতিক দল এখনো কিছু শর্ত দিচ্ছে এবং শর্ত পূরণ না হলে নির্বাচন বর্জন করার হুমকি দিচ্ছে। এগুলোকে অবশ্য রাজনৈতিক সুবিধা আদায় বা দর-কষাকষির কৌশল হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী বাছাই ও অন্যান্য নির্বাচনী প্রস্তুতির পাশাপাশি রাজনৈতিক জোট গঠনে এখন অনেক বেশি তৎপর লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মূলত তিনটি জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলেছে। যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ১২ দল, সমমনা জোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ আরো কয়েকটি দলের সঙ্গে বিএনপির জোটবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত। যত দূর জানা যায়, এই জোটে আরো কয়েকটি দল অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদের নামও শোনা যাচ্ছে। তবে এটি প্রায় নিশ্চিত যে বিএনপি কোনোক্রমেই আগামী নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটে যাবে না।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও হেফাজতে ইসলামের মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন অংশ নিয়ে জোট বাঁধার বিষয়ে অনেকটাই ইতিবাচক বলে জানা গেছে। এর বাইরে এনসিপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ আরো কয়েকটি দল পৃথক জোট গঠনেরও চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত এই জোট বিএনপির সঙ্গে একীভূত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি মনে করা হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু আশার আলো দেখা গেলেও গত ১৫ আগস্ট বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘আমরা শুনি, বিশ্বাসও করতে চাই যে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া, ভোটগণনা, ফলাফলের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত জাতির কাছে একটা সংশয় আছে।’
রাজনীতিতে যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতি ঘটতে পারে এমন আলোচনা সর্ব মহলে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। গত ৩১ জুলাই রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে বিএনপির মহাসচিব তাদের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকি, আমরা যদি সতর্ক না থাকি তাহলে এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়।’ তিনি বলেন, ‘খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমরা কিন্তু খুব একটা সূক্ষ্ম তারের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু চারদিকে আপনারা আমার চেয়ে ভালো জানেন, চারদিকে একটু চোখ-কান খোলা রাখেন। দেখবেন কতগুলো ঘটনা ঘটছে, যে ঘটনাগুলোর আলামত ভালো না। এদিকে একটু লক্ষ রাখতে হবে।’ তার এই বক্তব্য থেকেও মনে হয় যে বিদ্যমান পরিস্থতিতে রাজনীতিতে এক ধরনের সংকট রয়েছে। এমনকি রাজনীতিতে ঐক্য নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও একতা নেই।
৩১ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের দুপুর ১২টা ১১ মিনিটে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্ট নিয়েও বেশ আলোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা মো. আবু সাদিক কায়েমেরও সমালোচনা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘শিবির নেতা সাদিক কায়েম সম্প্রতি একটা টক শোতে বলেছেন, ছাত্রশক্তির গঠন প্রক্রিয়ায় শিবির যুক্ত ছিল, শিবিরের ইনস্ট্রাকশনে আমরা কাজ করতাম। এটা মিথ্যাচার।’ নাহিদ তার ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ‘সাদিক কায়েম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক ছিলেন না।...’
অন্যদিকে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি বাতিলের অভিযোগ তুলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা বর্জন করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাসদ, বাংলাদেশ বাসদ, বাসদ মার্কসবাদী দল। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স) বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে এমন একটি প্রস্তাব পাস করানোর চেষ্টা থেকেই কমিশনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। আগে অনেকে বলেছিলেন, সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন করে লিখতে হবে, আজ তারই প্রতিচ্ছবি আমরা দেখলাম।’
আমরা জানি যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। অন্যদিকে গত ৩০ জুলাই জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের বিরুদ্ধে দলীয় সব ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। আদালত এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের বিরোধ নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন থাকা একটি রিট পিটিশনের (১৫০৫১) উল্লেখ করেন। আদালত বলেছেন, ‘মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের শুনানির জন্য প্রস্তুত অবস্থায় বিচারাধীন আছে। এ পর্যায়ে কারও পক্ষে দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সমীচীন নয় মর্মে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয়।’
এমন নানা ধরনের মত-ভিন্নমত এবং অনৈক্য পরিস্থিতি আমাদেরকে ক্রমেই শঙ্কিত করে তুলছে। যেসব রাজনৈতিক দল বর্তমানে মাঠে নেই, তারা তো এমনিতেই বিদ্যমান মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে আছে। আর যেসব দল মাঠে সরব রয়েছে তারা যদি নিজেরা কোনো বিষয়ে একমত না হয়ে বিভেদ তৈরি করতে থাকে তাহলে রাজনীতির সংকট আরও বাড়তে পারে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আমরা চাই, দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু এ বিষয়ে নতুন করে কোনো প্রশ্ন তৈরি হোক- সেটি আমরা চাই না। নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাই চালাবে পাঁচ বছর। সেই পাঁচ বছরে যদি তারা ব্যর্থ হয়, না পারে, আবার নির্বাচন হবে। নির্বাচনে জনতা তাদের বাদ দিয়ে দেবে, অন্য দলকে দেবে। কাজেই এ বিষয়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক স্থায়ী হওয়া উচিত না।
আগামী নির্বাচনে যদি সত্যিই ফেব্রুয়ারিতে হয়, তাহলে সামনের সময়টা খুবই কম। এমনকি যে সময় আছে তা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, আর এক্ষেত্রে বহুমুখী সংকট থেকেই যাবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। খালি চোখে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো চূড়ান্ত ঐকমত্য দেখতে পাচ্ছি না। এমনকি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপও দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্বের বহু দেশে নির্বাচনী সংস্কার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বারবার কমিটমেন্ট করছে- নির্বাচনকে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার বিষয়ে। এমনকি এমন কমিটমেন্ট বাংলাদেশেও ইতোপূর্বে কয়েকবার হয়েছে। তারপরও কোনো না কোনোভাবে নির্বাচন প্রভাবিত হচ্ছে এবং প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে। কাজেই এখানেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামেই চয়েস করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন, অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্যমানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন এবং নিজেদের উৎকৃষ্ট ভাবার প্রবণতা অধিকভাবে লক্ষণীয়।
মোটা দাগে বলতে গেলে বলা যায় রাজনৈতিক দলগুলোর বিদ্যমান টানাপড়েনের পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের। উদার গণতন্ত্রের উপাদানগুলো সবসময়ই অনুপস্থিত। আর এই দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিত উপাদানগুলোর যথাযথ সংস্কার রাতারাতি সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের চলার পথ মসৃণ করতে হলে অতীতের ভুল চিহ্নিত করে শিক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইতোপূর্বে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় বিধি বিধানের অসমাঞ্জস্যতায় দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের পথ মসৃণ হয়নি। নানা প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চাই, তার জন্য দরকার আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
দেশের মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি, সুরক্ষণ, উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবহারে জনসচেতনতা তৈরির জন্য মৎস্য সপ্তাহ পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ‘অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে এ বছর ১৮ আগস্ট থেকে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ -২০২৫ শুরু হচ্ছে। দেশের প্রাণিজ আমিষ ও পুষ্টি চাহিদার বড় অংশ আসে মাছ থেকে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে। দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। মাছের মাধ্যমে মানুষের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি উৎপাদিত মাছ নিরাপদ করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। ইতোমধ্যে মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে। সমুদ্রসীমাসহ অন্য জায়গায় যারা মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের প্রতিটি নৌযানে যান্ত্রিক পদ্ধতি সংযোজন করা হচ্ছে, যাতে তাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা যায়। পাশাপাশি মাছ ধরার কোনো নৌযান দুর্ঘটনায় পড়লে, সেটির অবস্থান জানার জন্যও এ পদ্ধতি কাজে লাগবে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের বহুমুখী ব্যবহারে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মাছ থেকে চিপস, কেকসহ অন্যান্য মৎস্যজাত পণ্য তৈরি করলে ভোক্তা বাড়বে। মাছের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে কাজ করলে সহজ শর্তে, স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ, প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ সরকার নানা রকম সহায়তা দিচ্ছে। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ।
এবারের জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ -২০২৫ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য শক্তিশালী মৎস্য খাত গড়ে তোলা। মৎস্য খাতে উৎপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়া জাতকরণ ও রপ্তানির প্রক্রিয়ায় সময় উপযোগী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে মৎস্য খাত থেকে সর্বোচ্চ অবদান রাখার লক্ষ্য নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাছ উৎপাদন এবং দেশে ও বিদেশে সরবরাহের জন্য সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার তৈরি করেছে। পরীক্ষাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে পৃথিবীর ৫২টি দেশে বাংলাদেশের মাছ রপ্তানি হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৪৭ দশমিক ৫৯ মেট্রিক লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত মাছ যাতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই খাতের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে পরিকল্পিত অর্থায়ন দরকার। সরকারের কৃষি ঋণ, সরকারি- বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণসহ বিভিন্ন আর্থিক খাতের বিনিয়োগে মৎস্য খাতকে গুরুত দিতে হবে। মৎস্য খাতে উৎপাদন বেড়ে যাওয়াসহ অনেক সাফল্য এলেও এই খাতে এখনো প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আসেনি। চাষিরা কীভাবে ঋণ পাবেন, তা নিয়েও ধারণার যথেষ্ট অভাব আছে। যে কারণে এখনো অনেক চাষি উচ্চ সুদে দাদন বা ঋণ নেন। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে তা সামগ্রিকভাবে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখবে। এই খাতে এতদিন যৌক্তিকভাবে বিনিয়োগ হয়নি। তবে বিদেশে রপ্তানির জন্য সরকার তিনটি মাছকে চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো পাঙাশ, তেলাপিয়া ও কই মাছ। এই মাছগুলোর রং, স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যাতে তা রপ্তানিযোগ্য করা যায়। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেভাবে ঋণ দিতে অভ্যস্ত এবং ঋণ আদায়ের যে সংস্কৃতি তা মৎস্য খাত বান্ধব নয়। তারা মনে করে, মৎস্য খাতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যাংক খাতের বাইরের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ওই খাতে ঋণ দিতে চায় না। তাই এই সংস্কৃতি থেকে আর্থিক খাতকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি ছাড়া অন্য মাছের রপ্তানির অভিজ্ঞতা কম। মাছের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি এর গুণগত মান বাড়াতে হবে। মিয়ানমারের মতো সমুদ্রে মাছ ধরার সব নৌযানকে নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে মৎস্য অধিদপ্তর করা উচিত। সামুদ্রিক জেলেদের জন্য ‘সামুদ্রিক মৎস্য পরামর্শ কেন্দ্র’ চালু করা যায়। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে জেলেরা প্রতিদিন ‘মাছের বসতি’ সম্পর্কে জানতে পারবে। এতে জেলেদের অর্থ ও সময় বাঁচবে। এ কাজে মৎস্য বিজ্ঞানীদের লাগানো যায়। আধুনিক ট্রলার বা ফ্রিজার ঘন্টায় এক টনেরও বেশি মাছ ধরতে ও প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ অনেক দেশই এ প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে প্রক্রিয়াজাত করে। উন্নত ট্রলারে থাকা-খাওয়ার সুবিধাও ভালো। এর চেয়ে বড় কথা, এগুলো অনেক নিরাপদ। ফলে এসব দেশের জেলেরা দীর্ঘদিন সমুদ্রে অবস্থান করে মাছ ধরতে পারে। মিয়ানমার ও ভারতের সমুদ্র সীমায় স্রোত ও ঢেউ বেশি থাকায় আমাদের জলসীমা থেকে তারা অনেক সময় মাছ ধরে নিয়ে যায়। সামুদ্রিক ঢেউ ও স্রোতের বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) আধুনিক জাহাজ আমদানি করে পিপিপির মাধ্যমে বা কিস্তিতে জেলেদের দিতে পারে। ডাটাবেইস করে সামুদ্রিক মাছ ধরার প্রতিটি নৌকা ও মালিককে সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে। এছাড়া মৎস্য আহরণ বাড়াতে সামুদ্রিক নৌযান, ট্রলারগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করে সমুদ্রের সর্বশেষ অবস্থা সব সময় জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের ব্যাপারে বিলম্ব করার কোনো অবকাশ নেই। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকেও এগিয়ে যেতে হবে।
এক সময় এদেশ মাছের জন্য সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন আর আগের সেই অবস্থা আর নেই। আগে যেখানে পুকুর, খাল, নদী-নালা, বিল-ঝিলে মাছের আবাসস্থল ছিল, এখন সময়ের বিবর্তনে সব পাল্টে গেছে। মাছের আবাস স্থলগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছ। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পুকুর, খাল, বিল ভরাট করে নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মাণের কারণে পুকুর, খাল, বিল হারিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে নদী, নালা, বিল ঝিলে কলকারখানার দুষিত বর্জ্য এসে এসব এলাকার পানি দুষিত করে ফেলছে। জমিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকরা বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করায় দেশীয় প্রজাতির আবাসস্থলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে আমাদের দেশে বিগত দুই দশক ধরে দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার ঘটছে না। ক্রমেই দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছ ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছের জায়গায় এখন স্থান দখল করে বসেছে বিদেশি প্রজাতির হাইব্রিড মাছগুলো। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে বিদশি মাছের ব্যাপক চাষ হয়ে আসছে। এসব বিদেশি মাছের মধ্যে রয়েছে তেলাপিয়া, নাইলেটিকা, পাঙাস, থাই কৈ, আফ্রিকান মাগুর পিরানহা, ঘ্রাসকার্প, সিলভারকার্পসহ আরো কিছু প্রজাতির মাছ। এসব হাইব্রিড মাছ চাষে অধিক লাভবান হওয়ার কারণে মাছ চাষিরা ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছের চাষ করছেন। যে কারনে দেশের মানুকে বাধ্য হয়ে এসব হাইব্রিড জাতীয় মাছ খেতে হচ্ছে। এসব হাইব্রিড জাতীয় মাছের স্বাদ, গন্ধ দেশি প্রজাতির মাছের মতো নয়। দেশি প্রজাতির মাছের স্বাদ, গন্ধ অতুলনীয়। এসব দেশি প্রজাতির মাছ সীমিত আকারে আবার অনেকে চাষ শুরু করেছেন। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় বিলুপ্ত প্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে দেশি পাবদা, টেংরা, পুঠি, কৈ, মাগুর, শিং, শোল, গজার, বোয়াল, আইড়, চাপিলা, খলিসা, তারাবাইন, গলদা চিংড়ি, চাঁদা, তপসে, তিন কাটা, চিতল, ফলইসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এক সময় আমাদের দেশে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে ৫৪ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বিপন্ন। এর মধ্যে ১৪০ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব রক্ষায় দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য মৎস্য বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশীয় মাছের অস্তিত্ব রক্ষার উদ্দেশে দেশীয় প্রজাতির মাছের ব্যাপক চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। মৎস্য হ্যাচারীগুলো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মাছের পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন চাষের ক্ষেত্র তৈরি করে দেশি প্রজাতির মাছের চাষের ব্যবস্থা করতে পারে দেশের মানুষকে মাছের প্রকৃত স্বাদ গ্রহণের লক্ষ্যে দেশি প্রজাতির মাছের চাষের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের তরফ থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলায় সরকারি উদ্যোগে দেশি প্রজাতির মাছের হ্যাচারী গড়ে তুলে সেখান থেকে মাছের পোনা মৎস্য চষিদের মাঝে বিতরণ করে দেশি মাছের চাষের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, দেশি প্রজাতির মাছের চাষের উদ্যোগ নেয়া হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশি প্রজাতির মাছ আবার তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে।
রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।
বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ষষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তিতে শূন্যপদ ছিল ১ লাখ ৮২২টি। এর বিপরীতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন জমা পড়েছে ৫৭ হাজারের কিছু বেশি। অর্থাৎ প্রায় ৪৩ হাজার পথ শূন্য থাকবে। চাহিদা দিয়েও শিক্ষক পাবে না অনেক প্রতিষ্ঠান। ক্লাস থেকে বঞ্চিত হবে শিক্ষার্থীরা! এ ব্যাপারে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন যে, আবেদনকালে প্রার্থীদের বয়স ৩৫ এর বেশি এবং নিবন্ধন সনদের মেয়াদ ৩ বছরের বেশি গ্রহণ না করার কারণে আবেদন কম পড়েছে। অর্থাৎ আরো কিছু ছাড় দেওয়া হলে আরো কিছু বেশি প্রার্থী আবেদন করতে পারত। বয়সে ও যোগ্যতায় বারবার ছাড় দিয়ে আবেদনের সুযোগ দিয়ে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ করা কোনো উত্তম সমাধান নয়। ছাড় দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ করা মানেই দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করা। একজন কম যোগ্য শিক্ষক তার শিক্ষকতা জীবনে তৈরি করেন অগণিত কম যোগ্য নাগরিক-কর্মী। তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে অধিক যোগ্য নাগরিক-কর্মী তৈরির প্রত্যাশা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অবাস্তব!
শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি এখন আর গ্রহণযোগ্য থাকা উচিত নয়। সরকারি এমনকি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বা কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও এখন আর তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণিধারী প্রার্থীদের আবেদন করার সুযোগ থাকে না। নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স সীমা ও বাছাই প্রক্রিয়া অন্যদের তুলনায় বেসরকারি শিক্ষকদের শিথিল করা হলে এর অর্থ এমন দাঁড়ায় না যে বেসরকারি শিক্ষক তুলনামূলক কম যোগ্য হলেও চলে? এতে কি তাদের মান ও মর্যাদা হ্রাস পায় না? দেশের ৯৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীদের পাঠদানকারী বেসরকারি শিক্ষকদের অধিক যোগ্য হওয়া কি অধিক গুরুত্বপূর্ণ নয়? তারা তো আমাদের সন্তানদেরই শিক্ষক হন। তারা অধিক যোগ্য হলেই তো আমাদের সন্তানরা অধিক যোগ্য হবার সম্ভাবনা অধিক থাকে। অর্থাৎ বয়সে, যোগ্যতায়, পরীক্ষায় ছাড় দিয়ে তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে নয়; বরং দ্রুত আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে অধিক যোগ্যদের আকৃষ্ট করে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়াই অধিক মঙ্গলজনক।
সার্বিক বিবেচনায় বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থাটিকে অতীতের ধারাবাহিকতায় আরও উন্নত করা আবশ্যক। সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে তা সহজেই সম্ভব। সে লক্ষ্যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগের অনুরূপ শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স সীমা ও বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া উচিত। অর্থাৎ শূন্য পদের বিপরীতে সরাসরি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উত্তম বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উত্তম প্রার্থী বাছাই করে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। নিবন্ধনধারী সবাইকেই যদি নিয়োগ দিতে হয় তাহলে এটিকে নিবন্ধন পরীক্ষা না বলে নিয়োগ পরীক্ষা বলা ও কার্যকর করা অধিক যুক্তিযুক্ত নয় কি? তুলনামূলক কম নম্বর প্রাপ্ত নিবন্ধন ধারীরাও নিয়োগের দাবিদার হয়, নিয়োগের জন্য সোচ্চার হয়, বয়সের শিথিলতা দাবি করে, অশান্তি তৈরি করে। এমনকি অকৃতকার্যরাও আন্দোলন করে! অথচ সরাসরি নিয়োগ পরীক্ষায়/ প্রক্রিয়ায় কম নম্বর পেয়ে বাদ পড়ে যাওয়ারা আর নিয়োগের দাবিদার হতে পারে না, বয়সের শিথিলতা দাবি করতে পারে না, অশান্তি তৈরি করতে পারে না। অপরদিকে একবার নিবন্ধন পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া, আবেদন নেওয়া, পরীক্ষা নেওয়া, তালিকা করা, সনদ দেওয়া এবং পরবর্তীতে আবার নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া, বাছাই করা, তালিকা করা, নিয়োগ করা ইত্যাদি নিয়োগ কর্তৃপক্ষ ও নিয়োগ প্রার্থী উভয়ের জন্যই দ্বিগুণ কষ্টসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ। তদুপরি নিয়োগ প্রার্থীর জন্য দ্বিগুণ ব্যয় সাপেক্ষ। অধিক সংখ্যক শূন্য পদে নিয়োগ প্রার্থীদের বাছাই কেন্দ্রীয়ভাবে দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব না হলে জেলা প্রশাসকগণের দায়িত্বে ঐ জেলার সরকারি স্কুল-কলেজের সুযোগ্য শিক্ষকগণের সহযোগিতা নিয়ে সারাদেশে একই প্রশ্নে ও প্রক্রিয়ায় বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের বাছাই দ্রুত সম্পাদন করা সম্ভব হয় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। যেমন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর করে থেকে।
অন্যান্য চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে নির্ধারিত বয়স ও যোগ্যতার চেয়ে অধিক বয়স্কদের ও কম যোগ্যদের শিক্ষকতায় প্রবেশের সুযোগ দেওয়া মোটেও উচিত নয়। কিছুদিন পরপর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করতে চাইলে বারবার অধিকতর যোগ্য ফ্রেশ ক্যান্ডিডেট পাওয়া যাবে। একজন ইয়ং এনার্জিটিক মেধাবী শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে তৈরি করতে ও পূর্ণ উদ্যমে দীর্ঘদিন পাঠদান করতে যতটা সক্ষম একজন বয়স্ক লোক ততটা সক্ষম না হওয়াই স্বাভাবিক। ব্যতিক্রম নগণ্য। একজন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকের প্রকৃত সফল শিক্ষক হয়ে উঠতে অনেক সময়, শ্রম, মেধা, চর্চা, উদ্যম, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা লাগে। কেউ শিক্ষক হয়ে উঠতেই যদি বৃদ্ধ হয়ে পড়েন তো সফল পাঠদানে নিরলস থাকবেন কীভাবে, কতদিন?
আলোচিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অধিক যুক্তিযুক্ত উন্নত নীতিমালা প্রণয়ন করে ঢেলে সাজানো উচিত সকল শিক্ষক নিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়া। মূল্যায়নে বিবেচনা করা উচিত প্রার্থীর শিক্ষা জীবনের কর্মকাণ্ড ও ডেমো ক্লাসের মান। দ্রুত দূর করা উচিত একই দায়িত্ব-কর্তব্যে নিয়োজিত সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স সীমা, বাছাই প্রক্রিয়া এবং আর্থিক সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত সকল বৈষম্য। অর্থাৎ বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য আর নিবন্ধন পরীক্ষা নয়, নিতে হবে সরাসরি নিয়োগ পরীক্ষা। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি করতে হবে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা। শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে সর্বাধিক যোগ্যদের।
লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
ডিম পাড়ে হাসে, খায় বাগডাসে। গত ১৬ বছরে কথাটির বাস্তব প্রমাণ যেন দিয়ে গিয়েছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। দেশের মানুষের শ্রম আর ঘামের পয়সা তুঘলকি উপায়ে লুটে নিয়ে অবিশ্বাস্য অংকে বিদেশে পাচার করার নতুন নজির গড়েছিল তারা। এই লুটপাটের অন্যতম একটি খাত ছিল বিদ্যুৎখাত আর কুইক রেন্টাল কেরামতি। যেখানে মাত্র ৬ থেকে ৭ টাকার বিদ্যুৎ রাতারাতি সরকার কেনা শুরু করে সর্বোচ্চ ২৬ টাকায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছর দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির অন্তরালে গড়ে ওঠা, দুর্নীতি এবং অপচয় বিদ্যুৎখাতকে ক্রমেই করে তুলেছে জনসাধারণের অর্থ লোপাটের কারখানা। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে কুইক রেন্টাল নামের বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক অস্বচ্ছ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আজো দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরের একটি বড় শুভাঙ্করের ফাঁকি হিসেবে থেকে গেছে।
২০০৯ থেকে শুরু করে গত দশকজুড়ে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে দ্রুততা আনতে ‘কুইক রেন্টাল’ ব্যবস্থা চালু হয়। তবে, এই ব্যবস্থার আওতায় তৈরি হওয়া কেন্দ্রগুলো প্রায়শই তাদের সক্ষমতার মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বাদবাকি সময় এসব পাওয়ার প্ল্যান্ট বসে থাকলেও সরকার চুক্তি অনুযায়ী তাদের পূর্ণ ক্ষমতার জন্য ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ বা স্থায়ী পেমেন্ট দিতে বাধ্য হয়। এর ফলে একদিকে অতিরিক্ত সক্ষমতা থাকলেও, তা পূর্ণ ব্যবহার হয় না, এবং সরকারকে বছরে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে এই কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টে মাত্র ৬ টাকা ইউনিটের বিদ্যুৎ কেনা হয় সর্বোচ্চ ২৬ টাকা মূল্যে। যার দায় মেটাতে হয় দেশের সাধারণ মানুষের।
বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩০,৭৮৭ মেগাওয়াট, যেখানে চাহিদা প্রায় ১৮,০০০ মেগাওয়াটের আশেপাশে। এর ফলে প্রায় ১২,৭৮৭ মেগাওয়াট অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকলেও, এ অতিরিক্ত ক্ষমতার জন্যও সরকারের পকেটে খরচ হয় কোটি কোটি টাকা। উপরন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাটের বিষয়টি ঘটে চলে ক্রমাগত। আর তাই প্রশ্ন ওঠে এত খরচ আর এত অর্থ পাচারের মচ্ছবে আমরা কি পুষছি সাদা হাতি? বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে, আওয়ামী লীগের আমলে এ খাতে হওয়া দুর্নীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা তো দূরের বিষয় বর্তমান সরকারের সময়ে কুইক রেন্টালের অর্থ কোথায় যাচ্ছে গণমাধ্যমে সে তথ্যও আসছে না।
দেশে কুইক রেন্টাল ব্যবস্থার এই উত্থান এবং অর্থ হরিলুটের পেছনে ছিলো ২০১০ সালে প্রণীত ‘দায়মুক্তি আইন’ (Quick Enhancement of Electricity and Energy Supply Act, 2010), যার মাধ্যমে দরপত্র ছাড়াই রাজনৈতিকভাবে সংযোগে থাকা ব্যবসায়ীদের হাতে দ্রুত কুইক রেন্টাল কেন্দ্র অনুমোদন দেওয়া হয়। এই আইনের আওতায় ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে সুবিধাভোগী হিসেবে গড়ে ওঠে। যদিও আইনটি বর্তমানে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, তবুও সংশ্লিষ্ট চুক্তিগুলো এখনো বহাল রয়েছে এবং দ্রুত বাস্তবায়নে আইনি জটিলতা ও ক্ষতিপূরণ ইস্যু রয়ে গেছে।
সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ হিসেবে কুইক রেন্টাল চুক্তি পুনর্বিবেচনা ও বাতিলের কথা বলা হলেও বাস্তবে অনেক কেন্দ্রে ক্যাপাসিটি চার্যের অতিরিক্ত অর্থ বাকি রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুধু ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাবদ সরকার প্রায় ২৬,৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা আগের পাঁচ বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি। সরকারের সামগ্রিক ভর্তুকি ও অতিরিক্ত খরচ মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতে অপচয়ের পরিমাণ বছরে ৬০,০০০ কোটি টাকারও বেশি হতে পারে। বিদ্যুৎ খাতে গত অর্থবছরেই ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। তারা নিয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা।
শ্বেতপত্র কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার (৬০ হাজার কোটি টাকা) দুর্নীতি ও অর্থপাচার হয়েছে, অথচ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বকেয়া বিল আদায়ে কিছু অগ্রগতি হলেও, বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে অনিয়ম ও অপচয় রোধে এখনো কাঙ্খিত পদক্ষেপগুলো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সাশ্রয়ী এবং টেকসই বিকল্প গড়ার ক্ষেত্রে এখনো যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। নবায়নযোগ্য শক্তি এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশ এই সংকট থেকে উত্তরণ পেতে পারত, তবে কুইক রেন্টালের বাইরে বিকল্প পথে যেতে সরকারের পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয়নি। প্রায়শই দেখা যায়, নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প বাতিল বা পেছনে পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
সরকারি রিপোর্ট ও সংবাদ বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে, কুইক রেন্টাল সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসতে হলে চুক্তির পুনর্বিবেচনা ও আইনি জটিলতা কাটিয়ে ওঠা জরুরি। তবেই বছরের পর বছর ধরে চলা অর্থনৈতিক অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ডিমান্ড সাইড ম্যানেজমেন্ট, এনার্জি এফিসিয়েন্সি বৃদ্ধি এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়নে দ্রুত কাজ করতে হবে।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘লোডশেডিং আছে এবং থাকবে, কারণ সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য ফেরানো সহজ নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্মক্ষমতা বাড়ানো এবং অপ্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান বন্ধ করাই এখন সময়ের দাবি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার দামের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে।’
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শুধু আইন পরিবর্তন বা চুক্তি বাতিল যথেষ্ট নয়। প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই প্রকৃত সমাধান। বিদ্যুৎ খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য তা জরুরি।
গণমানুষের দীর্ঘদিনের দাবি, বিদ্যুৎ খাতের এসব দুর্নীতি আর অর্থ লুট বন্ধ করার। দেশের মানুষের শ্রম, ঘাম, আর কষ্টের টাকায় প্রাসাদোপম অট্টালিকায় থাকার পর, আগের সরকার এর ফলাফল ঠিকই কড়ায় গণ্ডায় দেখেছে। তাই এ থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম হাতে নেয়াই ভালো। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ানো এই অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রয়োজন দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপের, যেখানে দুর্নীতি রোধ, স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা এবং উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ সংকট থেকে মুক্ত করা যাবে।
কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তি