বিংশ শতাব্দীর ২০ থেকে ৭০ দশক পর্যন্ত রাজনীতিতে ছিল দেশাত্মবোধের অনন্য জাগরণ। সাধারণ জনগণের সঙ্গে রাজনীতিকদের সম্পর্ক ছিল সমান্তরাল। ৪৭-এর দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে নানা ইস্যুতে দূরত্বের দানা বাঁধতে শুরু করে। তখন দুই পাকিস্তানের মধ্যে যে বিষয়টি নিয়ে বৈষম্যের বিষবাষ্প ছড়ায়, তার প্রধান এবং প্রথম কারণ ছিল ভাষার দূরত্ব। একে তো পশ্চিম পাকিস্তানিরা সরকারের সব প্রশাসনিক দপ্তর ছিল তাদের কবজায়; তার ওপর উর্দু ভাষাভাষি পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে বাংলা ভাষাভাষি পূর্ববঙ্গের জনগণ (বর্তমান বাংলাদেশ) সরকারি-বেসরকারি চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়। অতকিছুর পরেও উদার মানবিক সৃষ্টিশীল প্রজ্ঞাবান চেতনার অধিকারী বাঙালির গুটিকয়েক রাজনীতিকরা সুদূরপ্রসারী চিন্তার গুণে সৃষ্টি হয় ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যূত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার মুক্তিযুদ্ধ। তখন রাজনীতি ছিল অনেকটা স্বচ্ছ এবং রাজনীতিকরা ছিলেন একেকজন সম্মানের অধিকারী। জনগণের জন্য ছিল সেবার সর্বোচ্চ মানসিকতা। সেই রাজনীতির নীতি-আদর্শ এখন নির্বাসিত! রাজনীতিতে এখন সম্মানীদের চেয়ে অসম্মানীদের কদর ছিল বেশি। নীতিহীন ধূর্ত কপট মানুষরা হয়ে ওঠে রাজনীতির চালিকাশক্তি! যে যত বেশি অপকর্ম করতে পারে তার কদর হয় তোলা তোলা। অপরাজনীতির ছলাকলা দেখতে দেখতে দেশের মানুষের মতো আমি নিজেও ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি। রাজনীতি হয়ে ওঠেছে অনেকের কাছে খেতের ফসলের মতো; সেবার পরিবর্তে পকেট মোটাতাজা করার প্রধান ক্ষেত্র। পেশিশক্তি আর পুঁজিবাদীদের দৌরাত্ম্য। রাজনীতির গডফাদার খ্যাতদের নজরে কোনো রকমে একবার নিজেকে উন্মোচন করতে পারলে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না।
বিশ্বরাজনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতির কোনো মিল নেই। বিশ্বরাজনীতি এগিয়ে যায় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে আর আমাদের দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয় অস্ত্রবাজ, টেন্ডারবাজ, মাদক কারবারি, গুণ্ডা, ঘাড়-মোটাদের এবং যারা নেতাকে অর্থবিত্তসহ বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে তুষ্ট করতে পারা হোমরা-চোমরাদের নিয়ে। আমাদের দেশের রাজনীতি হয়ে উঠেছে পরিবার কেন্দ্রিক। এ ধারা বিস্তৃতি ঘটেছে কেন্দ্র থেকে মফস্বলে পর্যন্ত। যে ব্যক্তি এমপি, মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বার হয়, সে প্রতিবারই হতেই থাকে। পাঁচ বছর মেয়াদের সময়ে একেকজন ৮ বার পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হওয়ারও রেকর্ড আছে। একজন লোক যদি ৮ বার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় তার মেয়াদকাল দাঁড়ায় ৪০ বছর। এই ৪০ বছর একজন ব্যক্তি শাসন করার ফলে এলাকায় জারি হয় এক অঘোষিত একনায়কতন্ত্র। এতে করে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে পারে না। মেধাবী দেশপ্রেমিক জনগণ বঞ্চিত হয় অধিকার থেকে। এর ফলে অনেকের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ, অশ্রদ্ধা জন্ম নেয়। কোনো রকমে একবার সরকারি জনপ্রতিনিধির খাতায় নাম লেখাতে পারলে তাকে আর ঠেকানোর উপায় থাকে না। ভাব দেখায় এলাকাটা যেন তার লিজ নেওয়া। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের পর থেকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের এমন হাল অবস্থা দেখতে দেখতে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনে ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে। ছলে-বলে, কৌশলে কিংবা অপকৌশলে একবার ক্ষমতায় আরোহণ করতে পারলে জনগণ হয়ে যায় তাদের কাছে ছক্কার ঘুঁটি। শাসকরা মনে করতে থাকেন দেশের সব মানুষ তাদের হাতের পুতুল ‘যেমন করে নাচাবে, তেমনি নাচবে’। সোজাকথা কোনো সরকারই জনগণের স্বার্থের পক্ষে ছিলেন না। তাদের কর্মকাণ্ড ছিল সীমাহীন জনবিরোধী। সাধারণ জনগণকে শাসক ও তাদের সমর্থনপুষ্ট নেতা-কর্মীরা নানাভাবে শোষণ করে। এখন সময় এসেছে এ জাতীয় রাজনীতিক ও তাদের দোসরদের প্রত্যাখ্যাত করার।
রাজনীতিতে এখন নতুন উদ্যোম শুরু হয়েছে। দেশের মেধাবী ছাত্ররাই এর মূল উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে অনেকের মনে নতুন আশা সঞ্চারিত হয়েছে। বিশ্বরাজনীতির গতি-প্রকৃতির আদলে গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, উন্নত জীবনের ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি ব্যর্থ হয় তাহলে এই বাংলাদেশের অদূর ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন! শেখ হাসিনার সরকারকে পতন করার মধ্যে দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরাসরি দুজন তরুণ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হয়ে দেশের রাজনীতিক অঙ্গনে নবধারা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। এ ছাড়া ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে যুক্ত হয়েও বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এই ব্যাপারটি বাংলাদেশ শুধু নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বলা যায় একটি নতুন মডেল। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় গিয়ে ছাত্র, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়ের মধ্যে দিয়ে তৃণমূলের আশা-আকাঙ্ক্ষা জানা ও বুঝার চেষ্টা করছে। যা রাজনীতিক অঙ্গনে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হবে।
দেশে পরিশুদ্ধ রাজনীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এখন খুব জরুরি। রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে প্রথমে রাজনীতিক, রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংস্কার প্রয়োজন। মানুষকে শুদ্ধতার পাঠ নিতে হবে, রাজনীতিতে শুদ্ধতার চর্চা শুরু করতে হবে। পেশিশক্তি পরিহার করতে হবে। এ কথা সত্য যে, রাজনীতির মধ্যে দুর্বৃত্তায়নগোষ্ঠী বাসা বেঁধেছে। গুণী রাজনীতিকদের স্থলে চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের অনেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে দেশকে নষ্টদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। যেকোনো প্রকারে রাজনীতি থেকে দুর্বৃত্তায়ন ও পুঁজিবাদীগোষ্ঠীকে উৎখাত করে সুস্থ ধারার রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে।
ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেধাবী তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিকরা এমপি নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হওয়ার মতো গৌরব অর্জন করেছে। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের দেশের মেধাবী তরুণ প্রজন্মদের গড়ে তুলতে সেরকম কোনো পদ্ধতি বা পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। আমি মনে করি, আমাদের তরুণ প্রজন্মের সন্তানরা অন্যান্য দেশে যেহেতু তাদের কর্মদক্ষতা দেখাতে পারছে এখানেও পারবে। তরুণদের নতুন নতুন চিন্তাশক্তি কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশের ফুড (Food) কালচারে শাকসবজি বিশেষ জায়গাজুড়ে আছে। কেননা, আমিষ তথা মাছ-মাংসের অধিক মূল্যের কারণে সাধারণ জনগোষ্ঠীর ওগুলো কেনা ততটা সামর্থ্য নেই বলে অনেক ক্ষেত্রে শাকসবজির ওপর ভর করে জীবন নির্বাহ করে থাকে। তা ছাড়া অতিরিক্ত আমিষ খাওয়ার কারণে অধিক বয়সে শরীরে যে নেতিবাচক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হয়, সেটাও তিবেহিত হয়। একই সঙ্গে ব্যালেন্সড খাবার হিসেবে পাইভোটাল রোল প্লে করে থাকে।
কিন্তু সেই শাকসবজির দাম যখন বেড়ে যায়। তখন যে কী রকম বেহাল অবস্থা হয়, তা হয়তো আপনাদের বুঝিয়ে বলতে হবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে, গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে শাকসবজির দাম দুই-তিন গুণ এবং এমনকি পণ্য বিশেষে তার বেশিও বেড়ে গেছে। তাই সবার মুখে মুখে রাস্তাঘাট, চায়ের দোকান এবং এমনকি অফিস-আদালতেও গ্যালোপিং (Galloping) হারে শাকসবজির দাম যে বেড়েছে সেটাই শোনা যাচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, বিগত ৫ আগস্ট (২০২৪) বিপ্লবোত্তর সময়ে জরাজীর্ণ ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যস্ত।
এই সরকার যেদিকে তাকাচ্ছেন, সেদিকেই দাবি-দাওয়ার আড়ালে দুর্নীতিতে ভরা। তা ছাড়া কোনো ব্যাপারে সংস্কারে হাত দিলে সমালোচনার শেষ নেই। এমনো দেখা গেছে যে, দেশের ভেতরে ও বাইরে ষড়যন্ত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অব্যাহত আছে। এমনই অবস্থায় শাকসবজির দাম বেড়ে গেছে বলে বর্তমান সরকারের দায়ী করে নানা অসংলগ্ন কথা বলা হচ্ছে। তাই শাকসবজির দাম কেন বাড়ল? সেটাই খুঁজে বেড় করার জন্য কয়েক দিন ধরে ঢাকা শহরের বড় বড় কাঁচা বাজারে গিয়ে সশরীরে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে যে তথ্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে, সেটাই তুলে ধরা হলো।
আসলে প্রাকৃতিক কারণের আওতায় বন্যা ও থেমে থেমে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত প্রাধান্য পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। একদিকে প্রতিবেশী দেশের থেকে আসা আচমকা বন্যা, যা আগে কখনো পরিলক্ষিত হয়নি এবং একই সঙ্গে বৃষ্টিপাতের ধরন, পূর্বের ন্যায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নয়। এই রোদ হঠাৎ লাগাতার দুই-তিন দিন বৃষ্টি। কোনো সময় অল্প, আবার কোনো সময় মুষলধারে বৃষ্টি। তাই খেতে থাকা শাকসবজির প্রায় দুই-তৃতীংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
সাধারণত সারা দেশ থেকে ঢাকা রাজধানীতে শাকসবজি এসে থাকে। কিন্তু অনেক জেলার শাকসবজি খেতেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আরেকটি কথা, সামনে শীত; তাই স্বাভাবিকভাবে আশ্বিন ও কার্তিক মাস হলো শাকসবজির জন্মানোর প্রকৃত সময়। আর সেই সময় যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে কী অবস্থা হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। সত্যি কথা বলতে কী, সারা দেশের মধ্যে কেবল ঠাকুরগাঁ, বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, যশোর ইত্যাদি জেলায় যে শাকসবজি আছে, সেখানে পাইকার ও তাদের প্রতিনিধিদের ভিড়। এতে দর-কষাকষির সূত্র ধরে অধিক চাহিদার জন্য কৃষক বেশি দাম দাবি করায় পাইকাররা কিনতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, কাওরান বাজারের জনৈক পাইকারের সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রাক্কালে, তিনি বলেন, চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম। তাই দাম বেশি হওয়া স্বাভাবিক। অথচ তাদের লাভ না হয়ে উল্টো ক্ষতির টাকা গুনতে হচ্ছে। কেননা একটি ট্রাকে ১০-১২ টন মাল পরিবহন করে থাকে। অথচ সে পরিমাণ মাল না পেয়ে কৃষকের কাছ থেকে সংগৃহীত ৬-৭ টন মাল নিয়ে অর্ধেক খালি অবস্থায় রাজধানীতে আসছে। তা ছাড়া লেবার খরচ আগের মতোই আছে। তাই সব মিলে পরিবহন খরচের কারণে লাভ তো দূরে থাক, তাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আরেকটি কথা, বিষয়টি অনৈতিক হলেও সত্যতা তুলে ধরতে বলতে বাধ্য হচ্ছি। আগে বর্ডার দিয়ে প্রতিবেশী দেশ থেকে চোরাইপথে কাঁচা শাকসবজি আসত। কিন্তু তা বলতে গেলে পুরাপুরি বন্ধ।
শুধু এলসির মাধ্যমে কাঁচা মরিচসহ কিছু নির্ধারিত শাকসবজি আসছে। এখানে একটি কথা বলা শ্রেয় যে, নবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন বলেছিলেন যে দেশের এক জায়গায় যদি মালামালের প্রাচুর্যতা থাকে, সেক্ষেত্রে সমানভাবে বিপণন হলে, অনেক ক্ষেত্রে দাম কমে আসে। কিন্তু এখানে সে তত্ত্ব ততটা প্রযোজ্য নয়। কেননা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আসলেই শাকসবজির সরবরাহ কম। এদিকে গণমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যমে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, এ বিষয়টি নিয়ে প্রচারে তুলকালাম করে তুলছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশের মার্কেটিং দর্শন এবং নরম বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় ব্যতিক্রম। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, অর্থনীতির মেকানিজম অনুযায়ী যে দ্রব্যের সরবরাহ কম, সেক্ষেত্রে চাহিদা ও সরবরাহের কার্ভের একটি বিন্দুতে দাম নির্ধারিত হয়ে থাকে। অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে শাকসবজির সরবরাহ অপ্রতুল বিধায় দাম বেশি হওয়া স্বাভাবিক।
কিন্তু যেসব ফুড গ্রেইনের সরবরাহ ঠিক আছে এবং বৃষ্টি বা বন্যায় ক্ষতি হয়নি। অথচ যেসব পণের দাম অযথা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি বিক্রেতা সুযোগ বুঝে অতিলাভের আশায় এই কাজ করছেন, যা অনভিপ্রেত। তবে শাকসবজির অ্যালাইড প্রোডাক্ট হিসেবে ডিম, ডাল, মুরগি, ইত্যাদির দাম বাড়া স্বাভাবিক। সম্মানিত পাঠকরা আপনারা কীভাবে নেবেন, তা জানি না। তবে প্রবন্ধের স্বার্থে বলতে হচ্ছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, বিগত সরকারের আমলে যে সিন্ডিকেটের প্ল্যাটফর্ম ছিল, তা তুলনামূলকভাবে কম হলেও এখন কিছুটা বহাল তবিয়তে বিদ্যমান।
তাই সিন্ডিকেটের হাত আছে বা নেই, তা বলা দুস্কর। তবে একটি ইতিবাচক দিক হলো বর্তমানে আগের মতো ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি নেই বলে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সাক্ষাৎকারের প্রাক্কালে অবহিত হয়েছি। এদিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কাঁচা শাকসবজি গুদামজাত করা সম্ভব নয়। তবে কতগুলো শাকসবজি ২-৩ দিন সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব; যেমন- পটোল, আলু, চিচিঙ্গা, কচুর লতি, মুখী কচু ইত্যাদি। অবশ্য এগুলো কাওরান বাজারের আরতে আমি প্রত্যক্ষ করেছি। তা ছাড়া অব্যবহৃত পচা কাঁচামালও পড়ে থাকতে দেখেছি। আরেকটি বিষয় হলো- পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে দামের দিক দিয়ে বেশ পার্থক্য। শুধু তাই নয়, ঢাকা রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে একই পণ্যের দাম বিভিন্ন রকম পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা মার্কেটিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে বিধেয় নয়।
পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি, এই অতিরিক্ত দামের পেছনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা বন্যা ও অস্বাভাবিক বৃষ্টি দায়ী। তবে আগামী তিন সপ্তাহ পর অর্থাৎ কার্তিকের শেষের দিকে শাকসবজির দাম সাধারণ ক্রেতার ক্রয়-ক্ষমতার নাগালে আসবে বলে তথ্যমতে অবহিত হয়েছি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
আমরা হুজুগে বাঙাল। গুজবে ভাসি। কান চিলে নিয়েছে কেউ বলছে তো, তার পিছু ছুটি। হালসময়ে দেশে ‘ফেসবুক’ গুজবের আগুন লেগেছে। কেউ একজন কিছু একটা লেখেছে তো দেশ সুদ্ধ হইচই শুরু হয়ে যায়। বিজ্ঞানের উন্নতির কল্যাণে মুঠোফোন ও ইন্টারনেট এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। যোগাযোগ ক্ষেত্রে জীবনযাপনে ইতিবাচক প্রভাব থাকলেও ক্ষতির পরিমাণও নেহায়েত কম নয়। সাইবার জগতে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর গুজব বড় বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অসচেতন, অজ্ঞমানুষকে গুজবে ভাসিয়ে ফায়দা লুটছে সাইবার অপরাধীরা। গুজবে দেশের ক্ষতি যা হবার হচ্ছে; রোধ হচ্ছে না।
গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। তাদের জনগণকে বোঝানোর দায়িত্বেও মাঠে নামতে হবে। গুজব মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। গুজবের প্রতিকার সচেতনতা ও কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই সম্ভব। তাতে পরিস্থিতি পুরোটা সামাল দেওয়া না গেলেও যথেষ্ট উন্নতি হবে।
গুজবে বহু প্রাণও ঝড়েছে এ দেশে। গুজবের শিকার হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তি জানে না, কোন অপরাধে তাকে মারা হলো। আর যারা মারছে তারাও জানে না, কেন তাকে মারছে। এভাবেই গুজবে ভর করে কোনো ঘটনার সত্য-মিথ্যার তোয়াক্কা না করে নিরপরাধ মানুষকে কখনো পিটিয়ে, কখনো আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে। সাইবার জগতে গুজব, হুজুগ, অলীকতা, বিবেকহীনতা, মূর্খতা, নির্বুদ্ধিতা, অন্যায় হত্যা, বিচারহীনতা ও সত্য-মিথ্যা ইত্যাদি রোধ করা না গেলে দেশ এবং ব্যক্তির ক্ষতি অনিবার্য।
চারদিকে গুজব। ব্যক্তিস্বার্থ, রাজনৈতিক স্বার্থসহ নানা স্বার্থে যে যার মতো ছড়িয়ে দিচ্ছেন গুজবের ডালপালা। যা আতঙ্কিত করছে দেশের মানুষকে। আমাদের প্রিয় কবি শামসুর রাহমানের ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায় কবি লিখেছেন- ‘এই নিয়াছে ঐ নিল যা! কান নিয়েছে চিলে,/ চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে’। বাংলাদেশের মানুষের দশাও তাই হয়েছে। বিশ্বে কোনো দেশে এভাবে গুজব ছড়ানোর রেওয়াজ বোধ করি নেই।
ফেসবুক, ইউটিউবসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবেশ করলেই গুজবের ছড়াছড়ি লক্ষ করা যায়। সাইবার বিশ্লেষকরা বলছেন, গুজব সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। ১. বিনা স্বার্থে, যা কিনা অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে থাকে। এসব গুজব না বুঝে ছড়ানো হয়। যা কোনো অপরাধ বা অরাজকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয় না। ২. অরাজকতা, অপরাধ ও অরাজকতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই এসব গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে। আমরা দেখছি মানুষ তিলকে তালে পরিণত করছে। এ প্রবণতার কারণে দেশে অশান্তি সৃষ্টি হয়।
দেশকে তো বটেই, গুজব মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। গুজব যে কোনো মুহূর্তে সমাজের পরিস্থিতি আরও সংকটের দিকে টেনে নিয়ে যায়। হুজুগে বাঙ্গাল খবি প্রচলিত শব্দ। গুজব ছড়ানোর ইতিহাস বাংলাদেশে নতুন নয়। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত গুজব হলো ৮ অক্টোবর খবর বেরিয়েছে, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস মধ্যরাতে পদত্যাগ করেছেন। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনী নাকি তার বাসভবন ‘যমুনা’ ঘেরাও করে রেখেছিল। সেনাবাহিনী এবং বিক্ষুব্ধ সেনা সদস্যরা বিভিন্ন বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন। এমন কি সেনাপ্রধানের সঙ্গে তার তর্কবিতর্ক-হাতাহাতিও নাকি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে যে গুজবটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে সে বিষয়ে বেশকিছু পোস্ট করতে দেখা গেছে মুফাসসিল ইসলাম নামক একটি অ্যাকাউন্ট থেকে।
সেখানে দাবি করা হয়েছে- যে প্রধান উপদেষ্টা সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে পরিবর্তন করার একটি পরিকল্পনা করেছিলেন এবং পরবর্তীতে সেনাপ্রধান তা জেনে যান। এ নিয়েই নাকি সেনাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন পোস্টে দাবি করা হয়, এটা নিয়ে নাকি সেনাপ্রধান ও ইউনূসের মধ্যে ভালোমন্দ অনেক কথাবার্তা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ড. ইউনূসকে ঘিরে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রূদ্ধশ্বাস বৈঠক চলছে। বিক্ষুব্ধ আর্মি অফিসাররা ইউনূসকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
কিন্তু এমন দাবির কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর সবটাই ছিল গুজব। অতীত নিকটের যোগাযোগমাধ্যমে আরেকটি ‘গুজব’ হলো- বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে নয়, এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে অবস্থান করছেন। আলোচিত-সমালোচিত এমপি শামীম ওসমানের বাসায় নাকি তিনি উঠেছেন। দেশবাসী তা বিশ্বাসও করে নিয়েছে। কিন্তু এটিরও কোনো সত্যতা মেলেনি। বরং ভারতের একাধিক সরকারি কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন এমন তথ্য ভিত্তিহীন। দিল্লির বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারা যায়, শেখ হাসিনা এখানে গত সপ্তাহে যেভাবে ছিলেন, এই সপ্তাহেও ঠিক একইভাবে আছেন। ভারতের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এমন তথ্য দিয়েছে। এছাড়া, দুর্গাপূজা ঘিরেও মন্দির ও প্রতিমা ভাঙা-বিষয়ক কিছু গুজবও বিভিন্ন সময় সামনে এসেছে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডির পর হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বাতাসে মিশে অ্যাসিড বৃষ্টি তৈরি ইত্যাদি গুজবের কথা এখনো আমাদের কানে বাজে। পাঠক, নিশ্চয় মনে আছে পদ্মা সেতুতে নাকি রক্ত আর কল্লা (মাথা) লাগবে। এ থেকে আতঙ্ক; ছেলেধরা আর গণপিটুনি। একি অবস্থা দেশে! চোখের সামনে নিরীহ মানুষ মরছে। বড় লজ্জা লাগে। এ আতঙ্ক দূর করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিংয়ের জন্য গিয়েছি। প্রতি জায়গাতেই আমি শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করেছিলাম- ‘তোমাদের কোনো বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে কি কোনো ছেলেধরা নিয়ে গেছে? কারও মাথা কেটে নিয়ে গেছে?’ কেউই হ্যাঁ সূচক উত্তর দিতে পারেনি। বলেছিলাম- ‘তোমরা আধুনিক যুগে বাস করছ। গুজবে কান দিচ্ছ কেন?’ আরও বলছিলাম- সেতু বানাতে কি মাথা ও রক্ত লাগে? উত্তরটা আমি নিজেই দিচ্ছিলাম, শিক্ষার্থীদের বলছিলাম- ‘সেতুতে ভালোমানের রড লাগে, সিমেন্ট, বালু, কংক্রিট লাগে।
আর লাগে মানুষের মাথার ব্রেইন অর্থাৎ বুদ্ধি। আর কত মানুষের ঘামঝরা শ্রম লাগে। সেখানে রক্ত আর মানুষের মাথার কেন প্রয়োজন হবে? শিক্ষার্থীদের বলেছি- এমন বাজে আতঙ্কে, গুজবে তোমাদের শিক্ষা থমকে যাবে। তোমরা পড়াশোনায় পিছিয়ে যাবে। আর এটাই হয়তো চায় গুজব রটনাকারীরা। বলেছি তোমরা সর্বাধুনিক জমানায় বাস করে এটা বিশ্বাস করবা কি না? সবাই এক বাক্যে বলেছে ‘না’। যখন বুঝালাম তখন সবাই বুঝল। আমরা বাঙালিরা যেমন সহজ সরল, সহসাই নেগেটিভ আবার পজেটিভও বটে! শুধু বুঝাতে হয়। আমরা যারা সচেতন মানুষ তাদের এই শিক্ষকতা কিংবা কাউন্সিলিংয়ের কাজটা করতে হবে সব সময়। তাহলে গুজবের গজব ছড়াতে পারবে না দুষ্ট চক্র।
গুজব মানেই কিন্তু মিথ্যা রটানো। সমাজে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে এ গুজব। সেখানে সত্য অসহায় হয়ে পড়ে। বর্তমানে নানা গুজবের ভয়াবহতায় সারা দেশের মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। দীর্ঘ হয়েছে নিরীহ মানুষের মৃত্যুর মিছিল আর গণপিটুনি। বাড্ডায় মেয়ের জন্য চিপস আনতে গিয়ে গণপিটুনিতে খুন হন রেনু নামে এক গৃহবধূ। নিহত রেনুর ছোট্ট মেয়ে তবা এখনো অপেক্ষা করে মায়ের জন্য। তার মমতাময়ী মা নাকি তার জন্য চিপস আনবে। সে আশায় এ ছোট্ট খুকুমণিটির অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। গণপিটুনিতে নির্মমভাবে নিহত তবার মা আর কখনোই ফিরে আসবে না। তবাকে কী জবাব দেব আমরা? জবাব দেওয়ার ভাষা আমাদের নেই। এ জন্য আমরা বড়ই লজ্জিত।
নারায়ণগঞ্জে বাকপ্রতিবন্ধী যুবক সিরাজকেও ওরা গণপিটুনি দিয়ে মেরেই ফেলল। প্রতিবন্ধী বলে সিরাজের বউ তার বড় আদুরে মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে বেশ কমাস আগে। প্রাণপ্রিয় মেয়েকে সিরাজ অনেক খুঁজেছে। মেয়েকে পায়নি। শেষতক খোঁজ পেল তার কলিজার টুকরো মেয়েটা নাকি নারায়ণগঞ্জে আছে। জানতে পেরেই সিরাজ আকুল হয়ে চিপস, পুতুলসহ তার মেয়েকে দেখতে নারায়ণগঞ্জে আসে। পরের ঘটনাটা ঘটে খুবই ভয়ঙ্করভাবে। এই সিরাজকেও গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলল কটা অসভ্য খুনি মানুষ।
গুজব ছড়িয়ে ওরা এক দিন হয়তো আমাকেও মেরে ফেলতে পারে। এমনই গণপিটুনিতে হয়তো আমার প্রাণবায়ুটা আর্তনাদ করতে করতে নীল আকাশে হারিয়ে যাবে। প্রতিবন্ধী সিরাজের মতো প্রমাণ হবে আমি ছেলেধরা নই। আমি পদ্মা সেতুর জন্য কারও কল্লা কাটতে আসিনি। তত দিনে আমার কবর রচিত হবে পারিবারিক কবরস্থানে। ছিঃছিঃ লজ্জায় মরে যাই আমরা। বড় বেশি লজ্জা পাই আমরা। প্রতিবন্ধী সিরাজেরও নিরাপত্তা নেই এ দেশে। আমরা গুম ও খুনের জন্য মাঝে মধ্যে সরকারকে দুষি। আমরা জনগণও কম কোথায়? সারা দেশে কত না হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। মানুষ মানুষকে খুন করছে। জমির জন্য, অর্থের জন্য ও নানা কারণে কথায় কথায় মানুষ খুন হচ্ছে। লজ্জা, বড় লজ্জা লাগে আমার ওসব ভেবে।
হুজুগের গজব বাংলাদেশে সব সময়ই দেখেছি। হুজুগের দাপটে হাল সময়ে শেয়ারবাজারের ২৭ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে গেছে শেয়ার লুটেরারা। স্বয়ং দরবেশ বাবার পক্ষ থেকেই এমন রটনা রটানো হয়। এ দেশে এটা নতুন নয়। বরাবরই ঘটছে। নিরীহ মানুষগুলো সর্বস্ব হারাচ্ছে। তবুও তারা হুজুগে আর লোভে শেয়ারবাজারে ছুটে যায় বারবার। ওদের বলতে গেলে লজ্জা নেই। এখানেই আমার বড় লজ্জা লাগে।
শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সর্বত্রই গুজবের বিষয়ে জানি আমরা। ছড়াইতে দেখা যায়। আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, এশিয়ায়- কোথায় নাই গুজব? মৃত মাইকেল জ্যাকসনকে নিয়ে কী গুজবই না ছড়ানো হয়। তিনি বেঁচে আছেন, আর প্যারিসের রাস্তায় তাকে নাকি ঘুরতে দেখা গেছে। এমন গুজব সম্প্রতি খোদ উন্নত দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। করোনা ভাইরাস নিয়ে কী কাণ্ডটাই না ঘটে গেছে বিশ্বে। সংক্রমণের সময় সবচাইতে বড় গুজব ছিল, চীনের লোকজন বাদুড়ের স্যুপ খায়, সে কারণেই এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। পূর্বে সোশ্যাল মিডিয়ায় নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মৃত্যুর গুজব ছড়ানো হলে অনেকে শোক প্রকাশ করতে শুরু করেন।
গুজব দেশে-বিদেশে সব জায়গাতেই আছে। তবে বাংলাদেশে এ প্রবণতা অনেক বেশি। তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা বলছেন, গত দু-মাসে বাংলাদেশে গুজবের পরিমাণ বেড়েছে। গুজব বৃদ্ধির একটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন তারা। তাদের মতে, দীর্ঘসময় বাংলাদেশের মানুষ বাকস্বাধীনতা পায়নি এবং গণমাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। তখন সাধারণ মানুষ নিয়মিত গণমাধ্যমের ওপর আস্থা হারিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে তথ্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে। সে কারণেই মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা দেখছে, সেটিকেই বিশ্বাস করতে চাইছে।
আগেও গুজবের গজব ছিল। তখন তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত না। আঞ্চলিক সীমানার মধ্যে থাকত। আধুনিক এ জমানায় গুজবের ডালপালা মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। গুজব ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই। অস্বীকার করা যাবে না যে, গুজব সব সমাজেই রয়েছে। বাংলাদেশেও এর শিকড় অনেক গভীরে বলেই 'চিলে কান নেয়া' প্রবাদের জন্ম হয়েছে বাংলা ভাষায়। রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক ক্ষেত্রে গুজব কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, তার ভয়াবহ নজির সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি। আর ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ২০১৭ সালে রংপুরে গুজব ছড়িয়ে হামলা চালানো হয়েছিল সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে। আমরা দেখেছি, এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
স্বীকার করতে হবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক অনেক অবদানও রয়েছে। পাশাপাশি অনেক ক্ষতিকর সাইডও আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের। এটি ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচিয়ে মানুষকে যেমন কাছে এনে দিচ্ছে, তেমনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা ইস্যুতে গড়ে তুলছে নেতিবাচক উদ্যোগ। যা কিনা খুনখারাবির দিকেও গাড়াচ্ছে। গুজব এমন একটা বিষয় যা সহজেই রচনা ও রটনা করা যায়। একবার গুজব রটে গেলে তা সামাল দেওয়া বড় কঠিন হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই। দেশের সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। জনগণকে রটনার বিরুদ্ধে বাস্তবটা বোঝাতে হবে। বড় কথা, কোনো খবর শোনামাত্রই যাচাই-বাছাই ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়া কোনো সুবিবেচনার পরিচয় হতে পারে না।
গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। নয়া আইন তৈরি করতে হবে। ওদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আমরা আশা করি, এ ব্যাপারে আরও কঠোর হবে সরকার। এ ছাড়া জনগণও এসব দেখে ভবিষ্যতে গুজবের পথে না হেঁটে অধিক সাবধান ও সচেতন হবে। গুজবের পিছু ছুটে মানুষ যাতে তার মূল্যবান সময়, অর্থ ও সম্মান না হারান, এই জন্য গুজব প্রতিরোধে আমাদের সচেতন ও সচেষ্ট হতে হবে।
লেখক: মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব- কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা নিম্নমুখী। বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কর্মমুখী শিক্ষার অভাব আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়। শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট আছে তবে দক্ষতা নেই, পাশের হার অনেক বেশি তবে সজ্ঞানের অভাব অসীম। জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে আমাদের শিক্ষার্থীরা বড়ই উদাসীন।অন্যদিকে আমাদের দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারিভাবে ছাত্ররাজনীতিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। ফলে ছাত্ররাজনীতির নেতারা লেখাপড়া বাদ দিয়ে বছরের পর বছর কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুঁটি গেড়ে বসে থাকে এবং সাধারণ ছাত্রের মাঝে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার সরকারের বিভিন্ন সমাবেশে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক নিয়ে যায় এবং বাধ্যতামূলক যেতে হয়। সরকারিভাবে লেখাপড়ার চেয়ে ছাত্ররাজনীতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে।যার ফলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার চেয়ে অসৎ পথে টাকা উপার্জন করতে পছন্দ করে এর ফলে ফলস্বরূপ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুণি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী তৈরি হয় না।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা যে সময় মহাকাশ বা বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা বা চিন্তা করে থাকে তখন আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা চিন্তা করে কীভাবে মিছিল করা যায়, মিটিং করা যায়। কীভাবে নেতা হওয়া যায়। কীভাবে দুর্নীতি করা যায় বা কীভাবে টাকা ছাড়া গরিব হোটেলের খাবার বা বাস ভাড়া না দেওয়া যায়, যার ফলে বিশ্ব রেংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম তো দূরের কথা এশিয়ার রাঙ্কিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে নাম নাই।
শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে জাহেলিয়াত যুগের বর্বরতা হয়েছিল শিক্ষার অভাবে, অসভ্য জাতি কে সভ্যজাতিতে পরিবর্তন করার মাধ্যম হলো শিক্ষা। আধুনিক যুগের যত আবিষ্কার ও পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে তা শিক্ষার দ্বারা।যে শিক্ষা সমাজ কে পরিবর্তন করতে পারে না, যে শিক্ষা আচরণকে পরিবর্তন করতে পারে না ও শিষ্টাচার থেকে দূরে থাকে আমি তাকে শিক্ষা বলতে পারিনা। আমাদের দেশে যতো দুর্নীতি, অন্যায়, টাকা পাচার হয়ে থাকে তার সব প্রাই কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের দাঁড়াই হয়ে থাকে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভাত খাইয়ে মানুষ মারা হয়ে থাকে। তাহলে এই শিক্ষাকে আমি কি শিক্ষা বলব নাকি কুশিক্ষা বলবো?।
আমি বিশ্বের প্রায় চল্লিশটা দেশে গিয়েছি। প্রায় ৬০ থেকে ৭০ টা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছি কনফারেন্স বা লেকচার দেয়ার জন্য। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এইভাবে ছাত্ররাজনীতি নাই। তাই বলে কি ওদেশের ছাত্ররা সমাজের কাজে বা দেশ রক্ষার কাজে কোন ভূমিকা পালন করে থাকে না বা যুদ্ধের সময় দেশকে সহযোগিতা করে থাকে না। দেশ রক্ষার জন্য বা রাজনীতি করার জন্য কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্ররাজনীতি করতে হবে এ ধারণা পুরোপুরি ভুল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মনে সংশয় তারা আবাসিক হলে সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারবে কিনা?। পড়ার সময় লেখাপড়া বাদ দিয়ে মিছিলে যেতে হয এবং টিশনের সময় টিশনি বাদ দিয়ে মিছিল বা মিটিং না করলে বড় ভাইদের চড় থাপ্পর মার খেতে হবে এটা কি রাজনীতি নাকি অপরাধনীতি। কোন দলের মত পোষণ করা বা না করা এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর নির্ভর করে থাকে কারোর ওপর জোর করে চাপায় দেওয়ার অধিকার কারো নাই। তবে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিশেষভাবে জোরপূর্বক অপরের উপর চাপায় দেয়া হয়ে থাকে। যার ফলে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে অনেক হতাশা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নাই বেকার জীবন যেমন পরিবারের কাছে বোঝা অন্যদিকে হতাশা স্বরূপ দেশের বড় একটা অংশ যা দেশে বসবাস করতে চায় না সুন্দর জীবন গড়ার জন্য তারা বিদেশে আসতে চায়।
যেটা আমি করেছিলাম আরও ১৫ বছর আগে। আমি যে জায়গায় এখন আছি এটার জন্য শুধু মেধাকেই ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো নেতাদের পা টেপা বা রাজনীতি করা বা ঘুষ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন হয়নি শুধু মেধার প্রয়োজন হয়েছে। আমি যদি বাংলাদেশের সঙ্গে আমার অবস্থান তুলনা করতে চাই তাহলে এই জায়গায় আসতে বা ইউনিভার্সিটি প্রফেসর হতে বা পুরোপুরি একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে আমাকে হাজার নেতার পা ধরা বা কোটি কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া নাগতো বা কত দুশ্চিন্তা নিয়ে জীবন যেতো যেটা কল্পনার বাইরে।
বিগত সময়ে ঘুষ ছাড়া বা ছাত্ররাজনীতি ছাড়া শিক্ষার্থীদের কোন চাকরি হয় নাই। চাকরির সময় জিজ্ঞাসা করা হয়েছে সে কোন দলের তার পরিবার কোন দল করে সে কি ছাত্ররাজনীতি করেছে কিনা। তাহলে কী দরকার আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের, কী দরকার আছে শিক্ষার, কী দরকার আছে বইয়ের? এককথায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের জীবন ছিল আমাবস্যার অন্ধকারের মতো।
নেতা তাকে বলা যেতে পারে যেখানে নেতার আচরণ, শিষ্টাচার, নম্রতা, ভদ্রতা এবং শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আনে। অন্যদিকে তার শিষ্টাচার দ্বারা সাধারণ মানুষের মাঝে ভালোবাসার সঞ্চয় হয়ে থাকে। এই সংজ্ঞার ভিত্তিতে আমি যদি দেশের নেতা বা শিক্ষার্থীদের নেতার দিকে তাকাই তাহলে ছাত্ররাজনীতি সংজ্ঞা বড়ই বেমানান। গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিক সরকার আসার পর থেকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজ গুলোতে যে বিশৃঙ্খলা আমরা দেখেছি তা রাজনীতির সংজ্ঞাকে পরিবর্তন করে দিয়েছে।
আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং গ্রাম ও জেলা শহর হতে শিক্ষার্থীরা আসে লেখাপড়া করার জন্য। একটা পরিবারের হাজারো স্বপ্ন থাকে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেই স্বপ্ন যখন চোখের সামনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে ঝরে যায় সেই পরিবার জীবিত লাশ হয়ে বেঁচে থাকে। বিগত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতাদের দ্বারা কত শিক্ষার্থী যে নির্যাতনের শিকার হয়েছে তা আমাদের সবারই জানা।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের দিন কাটে আতঙ্কের মাধ্যমে যে কখন কোন দল এসে হামলা করে প্রতিটা মিনিট শিক্ষার্থীদের জীবন থাকে বড় ভাইয়ের নজরদারি উপর। অন্যদিকে আর এক সমস্যা হলো আবাসিক হলগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ আসন সংখ্যা না থাকা এবং বহিরাগত শিক্ষার্থী এবং পুরাতন শিক্ষার্থী দ্বারা আবাসিক হল দখল করে রাখা। যে সব শিক্ষার্থীর জীবন আতঙ্কের মধ্য দিয়ে কাটে তাদের দিয়ে ভালো গবেষণা কী করে হবে। ভালো গবেষণার জন্য দরকার সুন্দর পরিবেশ ও গবেষণার উপকরণ।
আমি অনেক দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখেছি যেখানে কোন প্রকার মিছিল হয় না এবং কোন প্রকার দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়না তবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ইউনিয়ন রয়েছে,ছাত্র ইউনিয়ন শুধু ওই দেশের ইউনিয়ন নয় বিভিন্ন দেশের ছাত্র সংগঠন এবং তাদের ইউনিট রয়েছে। আমাদের দেশের একজন ছাত্র যত পরিমাণ সময় মিছিল-মিটিং ও অন্যান্য রাজনৈতিক কাজে ব্যয় করে থাকে তা আর পৃথিবীর অন্য কোন দেশের শিক্ষার্থী করে থাকে না। উদাহরণস্বরূপ লন্ডন ও ইউরোপের ইউনিভার্সিটির ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলে থাকে সমস্যা সমাধানের ছাত্ররা একত্রিত হয়ে কাজ করে থাকে,তাহলে আমাদের দেশে ভিন্ন কেন। আমাদের দেশে নতুনদেরকে বরণ করতে মিছিল নিয়ে বের হতে হয়। আবার বড় বড় ব্যানার নিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে হয় । বাংলাদেশের যত টাকা শুধুমাত্র ব্যানার ও মার্কার জন্য খরচ করা হয়ে থাকে তা দিয়ে অনেক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। আমি লন্ডনের ২টা জাতীয় নির্বাচন দেখেছি এবং পোল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচন দেখেছি এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নির্বাচন দেখেছি, কিন্তু কোথাও কোনো প্রকার মিছিল ও ব্যানার ও মার্কা দেখি নাই। ব্যানার ও মার্কা শুধুমাত্র টাকা নষ্ট করে না পাশাপাশি পরিবেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের সৌন্দর্য কে নষ্ট করে থাকে।একটু পিছন দিকে দেখা যাক ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার যুদ্ধের অন্যতম ভূমিকা ছিল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এবং শিক্ষার্থীদের।যেখানে সবাই এক হয়ে পাকহানাদার বাহিনীদেরকে হারাতে আমরা পেরেছিলাম।তাহলে নিজের দেশ ও নিজের মানুষের সঙ্গে এক হয়ে আমরা কেন স্বপ্নময় দেশ গড়তে পারব না।
পত্রিকার পাতায় আর দেখতে চায় না কোনো শিক্ষার্থীর অপমৃত্যু ও বিশৃঙ্খলা। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মেধা আছে শক্তি আছে সামর্থ্য আছে তবে মেধা কে সঠিকভাবে সঠিক কাজে লাগানোর সুযোগ কম।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর বন্ধুসুলভ আচরণের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে ।আমি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের কর্মকান্ড দেখেছি যারা প্রথম সারির দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের কে পিছনে ফেলে প্রথম স্থান দখল করে আছে। আমরা যদি অন্য দেশে এসে অন্য দেশের ভাষা,পরিবেশ ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করতে পারি তাহলে নিজের দেশ নিজের মানুষ নিজের দেশের ভাষা ব্যবহার করে কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বিশ্ব রেংকিং এর পাশে এগিয়ে নিতে পারব না। কেনই বা আমাদের ছাত্ররাজনীতির নামে অপরাজনীতি সৃষ্টি হবে। ছাত্ররাজনীতি হওয়া উচিত আদর্শের, ছাত্র নেতাদের আদর্শ দেখে সাধারণ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ আকৃষ্ট হয়ে তাদের দিকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিবে সহযোগিতা করার জন্য।
আমি বিশ্ববিদ্যালয় ওই রাজনীতি চাই না যে রাজনীতি ছাত্রদেরকে পিটাই মারে।আমি বিশ্ববিদ্যালয় ওই রাজনীতি চাই না যেখানে দুর্নীতি, অন্যায়, অপরাধকে সাবলীল ভাবে ব্যবহার করে। যেখানে শিক্ষক পড়ানোর চেয়ে দলীয় রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার চেয়ে মিছিল, মিটিং এবং দলীয় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমি এ নীতিভ্রষ্ট ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে।
লেখক: ফাউন্ডার এবং ডিরেক্টর, ব্রিটিশ গ্র্যাজুয়েট কলেজ
দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় বাড়ছে না রাজস্ব আহরণ। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত এখনও ১০ শতাংশের ঘরে। সরকারের রাজস্বের ৭০ শতাংশই আসে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও শুল্কের মতো পরোক্ষ খাত থেকে। প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে বাকি ৩০ শতাংশ। আবার প্রত্যক্ষ করের ৮৫ শতাংশই আসে উৎসে কর কর্তন ও অগ্রিম কর থেকে। মূলত দেশের মানুষের বড় একটা অংশ করজালের বাইরে থাকায় তাদের কাছ থেকে রিটার্নের ভিত্তিতে আয়কর আহরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া আয়কর আহরণ ও আদায় পদ্ধতি ঝামেলাপূর্ণ হওয়ায় করদাতারাও আয়কর প্রদানে খুব একটা আগ্রহী নন। ফলে ব্যয় মেটাতে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভর করতে হয় সরকারকে।
আর প্রত্যক্ষ কর যেটুকু আহরণ হয়, তা-ও অনেকাংশে উৎসে কর্তননির্ভর। উৎসে কর কর্তন বা টিডিএস হচ্ছে দেশের জনগণের কাছ থেকে আয়ের বিভিন্ন উৎস ও সেবা প্রদান পর্যায়ে কর আদায় করার পরোক্ষ উপায়। বেতন ছাড়াও কমিশন, ব্রোকারেজ, রয়্যালটি পেমেন্ট, চুক্তির ভিত্তিতে পরিশোধ, একাধিক আর্থিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আয়কৃত সুদ বা মুনাফা, পেশাগত ফি ইত্যাদির ক্ষেত্রে এ কর কর্তন প্রযোজ্য হয়। রাজস্ব আয় প্রত্যাশার চেয়ে কম হচ্ছে। তাই সরকারি বিভিন্ন সেবার ফি ও মূল্য বাড়িয়ে কর বহির্ভূত উৎস থেকে আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে গত তিন বছরে পরিবর্তন হয়নি, এমন সেবার মাশুল বাড়িয়ে নতুন করে নির্ধারণ করতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে- আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও শুল্ক। এ উৎসগুলো থেকে আয় সংগ্রহের দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)।
এর বাইরেও অন্যতম একটি খাত রয়েছে সরকারের রাজস্ব আয় সংগ্রহের, যেটাকে সরকার বলে কর বহির্ভূ প্রাপ্তি (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ)। সংক্ষেপে তা এনটিআর নামে পরিচিত। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে ইতোমধ্যে ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি আরও কাটছাঁটের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে সরকারি ব্যয় নির্বাহে যতটা সম্ভব কম ঋণ নেওয়া হবে। নিজস্ব প্রয়োজন তো আছেই, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দিক থেকেও রাজস্ব আয় বাড়ানোর চাপ রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্ব সংগ্রহের হার ৮ শতাংশের কম। আইএমএফ বলে দিয়েছে, বাংলাদেশকে রাজস্ব-জিডিপির হার বছরে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সরকার ঋণ দিলেও তার বিপরীতে সুদ পাওয়া যায় না।
তাই গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাত থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আয় হয়েছে মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা। সরকারি বিভিন্ন পরিষেবায় ৮ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ভাড়া ও ইজারায় ২ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১ হাজার ৮০০, টোলে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিপরীতে ১ হাজার ২০০ কোটি এবং অবাণিজ্যিক বিক্রয় কার্যক্রম বাবদ ৪ হাজার কোটির বিপরীতে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। তবে লভ্যাংশ, জরিমানা ও অন্যান্য রাজস্ব খাতে আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছু বেশি হয়েছে। এনটিআর আদায় বাড়াতে ইতোমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো আন্তমন্ত্রণালয় সভায় আলোচনা করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে– এক বছরে ৩১টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর অংশগ্রহণে ৯টি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে কর বহির্ভূত আয় সরকারি আয়ের একটি প্রধান উৎস। চীনের মোট রাজস্বের ৪০ শতাংশ হচ্ছে কর বহির্ভূত আয়। মালয়েশিয়ায় যা ২৭ শতাংশ। এমনকি ছোট অর্থনীতির দেশ ভুটানে তা ২৮ শতাংশ।
অথচ বাংলাদেশে এটি ১১ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। অবশ্য বাংলাদেশেও কোনো কোনো সময় কর বহির্ভূত রাজস্ব বেড়েছে। যেমন ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়েছিল মোবাইল অপারেটরদের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার স্পেকট্রাম বিক্রি এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে জমে থাকা বাড়তি তহবিল ফেরত নেওয়ায়। ওই দুই অর্থবছরে এনটিআর থেকে রাজস্ব আসে প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ওই দুই ধরনের আয় সব বছরেই হয় না। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয় অন্য সব মন্ত্রণালয়কে ফি ও সেবামূল্য থেকে আয় বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করার অনুরোধ করেছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। আবার দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে মানুষের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবা গ্রহণের হার বেড়েছে। ফলে এনটিআর সংগ্রহ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সক্ষমতা এবং সেবা প্রদানে উন্নতি না করতে পারলে শুধু দাম বাড়িয়ে কর ব্যতীত আয় তেমন বাড়বে না। বিভিন্ন টোল ও মাশুল বৃদ্ধির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করেছে অর্থ বিভাগ।
মাশুল বাড়াতে অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরগুলোকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে জানানো হয়েছে, তারা যেন এনটিআর বাড়ানোর প্রস্তুতি নেয়। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে- বাণিজ্য, ভূমি, প্রাণিসম্পদ, রেলপথ, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ইত্যাদি। কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও দপ্তর এরই মধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কোনো কোনো দপ্তরের মাশুল বাড়ানোর প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এনটিআরের মধ্যে বড় ১০টি উৎস রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম লভ্যাংশ ও মুনাফা। ব্যাংক, বিমাসহ বিভিন্ন আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের বিপরীতে সরকার লভ্যাংশ ও মুনাফা পায়। আইন ও নিয়মনীতির পরিপন্থি বিভিন্ন কাজের জন্য সরকার জরিমানা, দণ্ড ও বাজেয়াপ্তকরণ করে প্রতিবছর কিছু অর্থ আয় করে। সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণকে দেওয়া সেবার বিপরীতে আয় করে। যেমন, আমদানি-রপ্তানি সনদের মাশুল, কোম্পানি নিবন্ধন মাশুল, বিমা প্রিমিয়াম, সমবায় সমিতিগুলোর নিরীক্ষা মাশুল, নিবন্ধন ও নবায়ন মাশুল ইত্যাদি। সঙ্গে আছে মূলধন রাজস্ব। পুরোনো গাড়ি বা আসবাব নিলামে বিক্রির অর্থ মূলধন রাজস্ব হিসেবে বিবেচিত হয়।
রাজস্ব আয়ে প্রত্যাশার চেয়ে হচ্ছে কম প্রবৃদ্ধি। এর মধ্যেই সরকারি বিভিন্ন সেবার ফি ও মূল্য প্রদান বাড়িয়ে কর বহির্ভূত উৎস থেকে আয় বাড়ানোর উপায় খুঁজছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আগামী অর্থবছরে সরকারের আয় ও ব্যয়ের ব্যবধান কমিয়ে আনতেই এমন পরিকল্পনা। যেসব সেবার ফি গত তিন বছরে পরিবর্তন হয়নি, সেগুলো বাড়িয়ে নতুন করে নির্ধারণ করতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুসারে, ইতোমধ্যে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ জনগণকে দেওয়া তাদের সেবার ফি ও চার্জ পুনর্নির্ধারণে কমিটিও গঠন করেছে সম্ভাবনার চেয়ে অনেক কমই রয়ে গেছে কর বহির্ভূত উৎস থেকে রাজস্ব আয়। জাতীয় বাজেটে কর বহির্ভূত এবং নন-এনবিআর উৎস থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও, আরও বেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর রাজস্ব অর্জনের জন্য মূলত এনবিআরের ওপরই সমস্ত মনোযোগ দেওয়া হয়। কর বহির্ভূত আয়ের অংশ- সরকারি প্রতিষ্ঠানের ডিভিডেন্ট, আমানতের সুদ, সেবামূল্য থেকে আয়– বাংলাদেশে ১১ শতাংশের মধ্যে আটকে থাকছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে ফি ও সেবামূল্য থেকে আয় বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করার অনুরোধ করেছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ তাদের সেবামূল্য বাড়ায়, এতে সরকারি সেবা পেতে জনগণের ব্যয় বাড়লেও কর বহির্ভূত আয় বাড়াতে সামান্যই ভূমিকা রাখে।
একারণে প্রতি অর্থবছরেই কর বহির্ভূত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস করা হয়। গত বছরও সরকারের বিভিন্ন পার্কে প্রবেশ ফি, হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার টিকিটের ফি, বিভিন্ন যানবাহনের জন্য সেতুগুলোর টোলের পরিমাণ বাড়ানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরপরও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ খাতের রাজস্ব সংগ্রহ হবে না। সেবার মান উন্নত করার পাশাপাশি দুর্নীতি বা অনিয়ম রোধ করা গেলে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সেবা থেকে আয় বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। সরকারি ফি ও সেবামূল্য দেখতে কম মনে হলেও সেবা গ্রহীতাদের তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি খরচ করতে হয়। কর বহির্ভূত আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো- যাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, ক্রমাগত লোকসানের ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে এসে ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
আবার দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে মানুষের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবা গ্রহণের হার বেড়েছে। ফলে নন ট্যাক্স রেভিনিউ সংগ্রহ বাড়বে বলে আশা করা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেবামূল্য বাড়ানো ও নতুন ফি বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থার সেবার মান উন্নত না হওয়া, নতুন উৎস চিহ্নিত না হওয়া এবং অনিয়মের কারণে কর বহির্ভূত উৎস থেকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ছে না। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্যের মতো দেশ উন্নত সেবা নিশ্চিত করে এই খাত থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করছে। কর বহির্ভূত রাজস্বে সর্বোচ্চ অবদান রাখে সুদ আয়, তারপরেই আছে প্রশাসনিক বিভিন্ন ফি, ডিভিডেন্ট ও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর আমানতের সুদ আয় এবং সরকারি সম্পত্তি ভাড়া বা ইজারার মাধ্যমে পাওয়া আয়।
সরকারি সম্পত্তি লিজ (ইজারা) দেওয়ার পদ্ধতি আরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ করতে হবে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিযোগিতার অভাবে সরকার ন্যায্য মূল্য পায় না। একই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে হবে, যা ব্যয় কমিয়ে এনে এসব প্রতিষ্ঠান আরও বেশি আয় করতে পারে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সেবা দেওয়ার দক্ষতা আরও বাড়াতে হবে, যাতে মানুষ বেশি সেবা গ্রহণ ও ফি আদায় স্বচ্ছ হয়। রাজস্ব আহরণে হিস্যার দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও প্রত্যক্ষ কর আহরণেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে সরকারের। দেশের রাজস্ব ব্যবস্থায় নানা অসামঞ্জস্য রয়েছে। তা দূর করতে হবে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছি। হাতে সময় নেই তেমন। এর মধ্যে রেভিনিউ রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক, ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক- সবই স্ট্রিমলাইন করতে হবে। রাজস্বের রেগুলেটরি কাঠামো যত দ্রুত সম্ভব হালনাগাদ করা প্রয়োজন।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক
‘এই অন্তর্বর্তী সরকার কি সেই ধাত্রী’ শিরোনামে বেশ কিছুদিন আগে একটি কলাম পড়েছিলাম। সেখানে মূলত দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে এবং আমাদের প্রত্যাশা কী সে বিষয়ে একটি সুন্দর আলোচনা ছিল। বাংলাদেশের মানুষ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের রাষ্ট্রকে দেখতে চায়। এমনকি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষ্যে বারবার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু স্বপ্ন বারবারই ভঙ্গ হয়। রাষ্ট্রের মেরামত নিয়ে নানা উদ্যোগ আমরা ইতোপূর্বে খেয়াল করেছি। কিন্তু সেগুলো যথাযথ রাস্তায় উঠতে গিয়েও উঠতে পারেনি।
ভালো-মন্দ এবং চাওয়া-পাওয়ার হিসাব সঙ্গে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সাধারণ জনগণের নিজস্ব কী উন্নয়ন হচ্ছে সেই সমীকরণটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। জনসাধারণের যে ধরনের প্রত্যাশা থাকে সেগুলোর শতভাগ বাস্তবায়ন কোনোভাবেই কোনো সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে দীর্ঘ সময় একটি সরকার ক্ষমতায় থাকার পর বিদায় নেওয়ায় সাধারণ জনগণের মনে চাওয়া-পাওয়া কিংবা প্রত্যাশার কোনো সীমা নেই। আমরা জানি কোনোভাবেই একজন ব্যক্তির চাওয়ার-পাওয়ার হিসাবটি যথাযথভাবে পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের অনেকের মনেই সরকারবিরোধী একটি মানসিকতা গড়ে উঠতে শুরু করে।
ছাত্র-জনতা জীবন বাজি রেখে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে বিগত সরকারকে অভ্যুত্থান করে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। ফলে তাদের দাবি-দাওয়া কিংবা চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি পূরণ না হলে তাদের মনের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যেকোনো সমস্যা কিংবা আপদে-বিপদে কোনো ব্যক্তি যদি সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের নিকট সরাসরি পৌঁছাতে না পারে কিংবা দেখা না পান তাহলেও তার মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভের সঞ্চার হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়শই যে সমস্যাটি লক্ষ করা যায়; সেটি হলো- ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সরকারের আচরণ এবং ভূমিকা কিছুটা পরিবর্তন হয়। সরকারে আসার আগে যে ধরনের প্রতিশ্রুতি থাকে জনগণের সামনে, ঠিক সে ধরনের আচরণ এবং প্রতিশ্রুতির ব্যত্যয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে।
আমরা জানি, অনেক সরকারি দপ্তরে কাজ করতে গেলে সাধারণের হয়রানি হতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক অন্য কোনো বিদ্যালয়ে শূন্যপদে বদলির ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের আদেশ থাকা সত্ত্বেও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পেছনে বারবার ধরনা না দেওয়া পর্যন্ত ওই বদলির কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন হওয়া কঠিন। দেশে বিভিন্ন ধরনের অফিশিয়াল কাজ আছে, যেগুলো এক ধরনের ফাইল ওয়ার্ক। এসব ফাইল ওয়ার্ক যথাসময়ে হওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অফিশিয়ালদের পেছনে ধরনা দিতে হয়। কিন্তু এ ধরনের প্র্যাকটিসের ফলে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অজান্তেই তাদের আশপাশের অধীনস্তরা অথবা ব্যক্তিগত সহকারীগণ অর্থনৈতিক উৎকোচ বিনিময় করেন। সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে যেসব অফিস-আদালত রয়েছে সেসব জায়গায় যথার্থ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়ে। স্বজনপ্রীতি, তদবির বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়, যা কোনোভাবেই সুশাসনের জন্য ইতিবাচক নয়।
রাষ্ট্রের সংস্কার আমরা সবাই চাই। ৫৩ বছরের একটি রাষ্ট্রে দীর্ঘদিন থেকে গড়ে ওঠা একটি সিস্টেমকে ভাঙতে দেশের সরকার এবং জনগণ উভয়েরই বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন। শুধু সরকার নয়, বাংলাদেশে ১৮ কোটি মানুষের মন-মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন না আনতে পারলে কখনোই পরিপূর্ণ সফলতা সম্ভব নয়। দেশের প্রতিটি প্রশাসনিক স্তরের দায়িত্বশীলদের যেমন সংস্কার প্রয়োজন, তেমনি যারা সেবা গ্রহণ করবে তাদের মনেও ১০০ শতাংশ ইতিবাচক প্রবণতা থাকতে হবে। আমাদের দেশে বেশ কিছু অফিস-আদালত রয়েছে যেখানে ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না। আবার সেবা গ্রহীতারা যাতে তাদের কাজ সাধন হওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে ঘুষ অ্যাপ্রোচ করেন সেজন্য সংশ্লিষ্ট অনেক অফিশিয়াল তাদের সেবা কার্যক্রমকে কিছুটা জটিল থেকে জটিলতর করেন। এমন অসংখ্য সেক্টর কিংবা অফিস রয়েছে, যেখানে তদবির ছাড়া একজন সাধারণ/নগণ্য মানুষ তার ন্যায্য কাজটি পান না। বারবার তাদের সংশ্লিষ্ট অফিশিয়ালদের টেবিলে টেবিলে ঘুরতে হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা রাজনৈতিক/গণতান্ত্রিক/সামরিক সরকার যা বিগত ৫৩ বছরেও করতে পারেনি তা যেন তারা করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আসলে কি সম্ভব?
গত বছর ১৫ ডিসেম্বর ‘সংসদ সদস্য: দেশের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা?’ শিরোনামে একটি কলাম পড়েছিলাম। সেখানে বেশ কিছু তথ্য আমাকে অবাক করেছিল। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব দেখে এবং শুনে আমাদের মনে দেশের রাজনীতি সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এমনকি এ বছরের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর দেশের বেশ কিছু সাবেক এমপি (সংসদ সদস্য) মন্ত্রীর সম্পদের হিসাব দেখে সেই নেতিবাচক ধারণাটি আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। এসব পরিস্থিতির ফলে বর্তমান সময়ের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার প্রশ্নে সারা দেশে একটি দাবি উঠেছে সংসদ সদস্য এবং সরকারের উচ্চপদস্থদের জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রসঙ্গে।
যেকোনো দেশের জনপ্রতিনিধিদের কার্যক্রম ও আচরণ সাধারণত নাগরিকদের প্রভাবিত করে থাকে। যেসব প্রতিনিধি আইন প্রণয়ন করেন, জনগণের সমস্যা সমাধানের দিক নির্দেশনা প্রণয়ন করেন, তাদের কার্যক্রম এবং আচরণ যদি স্বাভাবিক ও উন্নতমানের না হয়, তবে বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে এমনটি খুব স্বাভাবিক। জনপ্রতিনিধিদের কার্যক্রম ও আচরণ স্বাভাবিক এবং ন্যায্য না হলে গণতান্ত্রিক-প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর থেকে এমন প্রবণতাই আমরা অবলোকন করেছি। বিশেষ করে এমপি-মন্ত্রীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা খুব বেশি থাকায় দুর্নীতির প্রবণতা বেশি হয়ে উঠেছে। একজন সংসদ সদস্য কী কাজ করতে পারবেন, কত টাকা আয় করেতে পারবেন, সেটি আমাদের সাধারণ জনগণের কাছে পরিষ্কার থাকবে- এমনটি স্বাভাবিক হওয়ার কথা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে গড়ে না ওঠায় এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংসদ সদস্যদের দেওয়া হলফনামা মনিটরিং না হওয়ায় তাদের (এমপি-মন্ত্রীদের) কার্যক্রম বেপোরোয়া হওয়ার বিষয়টি প্রচলিত হয়ে উঠেছিল।
বাংলাদেশে একজন সংসদ সদস্য হওয়া মানেই যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়া। একজন সংসদ সদস্য যখন প্রথমবার হলফলামা জমা দেন তখন তার মাসিক কিংবা বাৎসরিক যে আয়ের কথা উল্লেখ থাকে সেটি পাঁচ বছর পর কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়া সাধারণ প্রবণতা ভয়াবহ ধরনের। শুধু তাই নয়, এমপিদের ব্যক্তিগত সহকারীরা যেভাবে টাকার পাহাড় গড়ে তোলেন তখন অবাক হই যে এগুলো দেখার কি কেউ নেই? এমনকি এসব পরিস্থিতি সবার সামনে ঘটলেও এসবের প্রতিবাদ করার সাহস কারও থাকে না। অথচ দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নামে একটা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাহলে কেন দুদক স্বপ্রণোদিতভাবে এসব অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় না?
আমাদের দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক। দ্রব্যমূল্যের কারণে দেশের মানুষের মাথায় হাত। বাজারে গেলে সাধারণ জনগণের দৃষ্টি সরকারের দিকেই থাকে। সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে কি না, সেটির ওপরেই সাধারণদের মতামত প্রকাশিত হয়। সাধারণ মানুষ অবশ্যই তাদের নিজেদের কল্যাণ যেভাবে হবে সেটি নিয়েই বেশি ভাবে।
দেশের সর্বস্তরে এবং সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির ব্যাপকতা এখন সবার জানা। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠনের বড় চ্যালেঞ্জ বর্তমান সরকারের। আজ যারা দুর্নীতিবাজ ধরা পড়ছে আগামী দিন তারা যে ছাড়া পেয়ে যাবে না এর কোনো গ্যারান্টি নেই। বিগত সময়ে যারা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল তারা কি আজ কারাগারে আছে। তারা কারাগারে নেই। বর্তমানে যারা ধরা পড়ছে, তারাও ভবিষ্যতে কারাগারে হয়তো থাকবে না। আমরা সবাই ভুলে যাবে যে তারা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ছিল। আইনের জাল ছিঁড়ে বড় মাছগুলো বেরিয়ে যায়। কেবল ছোট কিছু মাছ থেকে যায়। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের বিচার করা বড়ই কঠিন। আমরা ইতোপূর্বে খেয়াল করেছি যে অভিযুক্ত ব্যক্তি সরকারি দলের লোক হলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ধীরগতিতে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে।
আজকাল প্রায়ই টেকসই উন্নতির কথা শুনতে পাওয়া যায়। টেকসই উন্নতির উদ্দেশ্য কেবল উৎপাদন, ভোগ এবং কাঁচামালের সরবরাহের নিশ্চয়তা বিধান নয়, এর সঙ্গে সামাজিক ন্যায় বিচার বা ন্যায়ের যে সম্পর্ক রয়েছে- তার সমাধান বিবেচ্য একটি বিষয়। আমাদের শাসকদের দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু আমরা দেখি শাসক আসে এবং যায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতির ন্যায্য বাস্তবায়ন হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শাসক মহলের একটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। যারা দেশকে পকেটে রেখে চালাতে চায়। সুশাসনের প্রসঙ্গ কাগজে-কলমে থাকে। বিগত ৩৩ বছর ধরে সবচেয়ে দামি স্লোগান ছিল সুশাসন। এমনকি এখনো এই সুশানের স্বপ্নই আমাদের নাড়া দিচ্ছে।
দার্শনিক প্লেটোর পর থেকে আধুনিক যুগের দার্শনিকরাও সুশাসনের বিষয়ে ভেবেছেন। জন লকের ভাষায়, উত্তম রাষ্ট্র হবে সেই রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র জনগণের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দেয়। কার্ল মার্কস মনে করেন শ্রমজীবী মানুষের সরকারই উত্তম সরকার। বৃহত্তর অর্থে নাগরিকদের কল্যাণের উদ্দেশ্য ভালোভাবে শাসন পরিচালনার নামই সুশাসন। জনগণকে দেওয়া সরকারের প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তবায়নকেই সুশাসনের আওতায় ভাবা যায়। তবে একটি দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় সেই দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্তর এবং সামাজিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুশাসনের অন্তঃসার হচ্ছে সুষ্ঠু, বাস্তবায়নযোগ্য নীতি এবং নীতি বাস্তবায়নের জন্য একটি পেশাদারি আমলাতন্ত্র এবং শাসন বিভাগ, যা এর কর্মকাণ্ডের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক হবে। এখন আমাদের শুধু চাওয়া একটি জবাবদিহিমূলক সরকার ব্যবস্থা। আমরা এমন কোনো ব্যবস্থা চাই না যেটি কোনো গোষ্ঠীতন্ত্রে রূপ নেয়।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
দুর্গা নামের ব্যাখ্যা হলো-‘দ’অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ-কার’বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়- শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। যে দেবী অগম্যা বা যাকে সহজে পাওয়া যায় না, তিনিই মা দুর্গা। চণ্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গ বিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগৎকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি মা দুর্গা।
দেবী দুর্গা হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। অন্য দেব-দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তার বিভিন্ন রূপের প্রকাশ মাত্র। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গা ‘দুর্গতিনাশিনী’ বা সকল দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারিণী। পুরাকালে দেবতারা মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের শরীর থেকে আগুনের মতো তেজরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল এক আলোক পুঞ্জে পরিণত হয়। ওই আলোক পুঞ্জ থেকে আবির্ভূত এক দেবী মূর্তি। এই দেবীই হলেন দুর্গা। দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত আদ্যশক্তি মহামায়া অসুর কুলকে একে একে বিনাশ করে স্বর্গ তথা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে শান্তি স্থাপন করেন।
সরকারি বা জাতীয়ভাবে এই উৎসবকে দুর্গাপূজা বা দুর্গা উৎসব হিসেবে অভিহিত করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এটাকে শরৎ কালের বার্ষিক মহাউৎসব হিসেবে ধরা হয় বলে একে শারদীয় উৎসবও বলা হয়। কার্তিক মাসের দ্বিতীয় দিন থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত এই উৎসবকে মহালয়া, ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহা অষ্টমী, মহানবমী ও দশমী নামে পালন করা হয়। অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন বা জাগরণ তাই বসন্তকালের এই উৎসবকে বাসন্তী পূজা বা অকালবোধনও বলা হয়।
মা দুর্গার দশ হাত রয়েছে বলেই তাকে দশভূজা বলা হয়। তিনটি চোখ এ জন্য তাকে ত্রিনয়নী বলা হয়। মা দুর্গা দেবীর ডান দিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলো যথাক্রমে ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, বান ও শক্তি নামক অস্ত্র। বাম দিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলো যথাক্রমে শঙ্খ, ঢাল, ঘণ্টা, অঙ্কুশ ও পাখা। এ সব কিছুই দুর্গা দেবীর অসীম শক্তি ও গুণের প্রতীক। দশদিক থেকে মহিষাসুরকে বধ করার জন্য পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত ঊর্ধ্ব, অধঃ- এই দশদিক থেকে মা দুর্গার দশটি হাত, যাকে বলা হয় দশপ্রহরণী। দেবী দুর্গা এই দশপ্রহর দিয়ে মহিষাসুরকে বধ করেন। অন্যদিকে মানবজাতির অশুভ শক্তি বিনাশের জন্য দেবীকে দশ প্রহরনধারিনী বলা হয়ে থাকে।
রামায়ণে রামচন্দ্র ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে মা দুর্গাদেবীর পূজার আয়োজন করেছিলেন, অন্যদিকে মহাভারতের ভীষ্ম পর্বে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধারম্ভের আগে জয় নিশ্চিত করার জন্য দুর্গা পূজার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মহামায়া দুর্গারূপে দুর্ধর্ষ অশুররাজ মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। তার ফলে অসুরবধের অত্যাচার থেকে দেবগণ মুক্ত হয়েছিলেন, ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর স্বর্গরাজ্য।
শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধ করার জন্য দেবীর আরাধনায় বসেছিলেন। তখন ছিল শরৎকাল। দেবতাদের নিদ্রার সময় নিদ্রাভঙ্গ করতে রামচন্দ্র অকাল বোধন করলেন। আর সে জন্যই এই পূজাকে তখন অনেকেই অকালবোধন হিসেবে উল্লেখ করেন। এই বোধন হচ্ছে জাগরণ। ষষ্ঠী পূজার সময় সন্ধ্যায় বিল্ববৃক্ষমূলে দেবীবন্দনার উদ্দেশ্যে যে বিশেষ ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় সেটাকেই বলা হয় বোধন। দুর্গাপূজায় বোধন ছাড়া দেবীপূজা পরিপূর্ণ হয় না। চৈত্রমাসের বসন্তকালে অকাল বোধনের আগে বসন্তকালে দেবীর পূজা হতো, এ কারণেই দেবী বাসন্তীরূপে পরিচিত।
অসুরবিনাশিনী মাকে হিমালয় থেকে মর্ত্যে বরণ করে নেওয়া হয়- ‘হে দেবী, তুমি জাগো, তুমি জাগো, তুমি জাগো’। তোমার আগমনে এই পৃথিবীকে ধন্য করো। কলুষতা মুক্ত কর। মাতৃরূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে আশীর্বাদ করো পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে। বিনাশ করো আমাদের অসুর প্রবৃত্তিকে। মা দুর্গা দেবী কোথাও দ্বিভুজা, কোথাও চতুর্ভুজা, কোথাও অষ্টভুজা আবার কোথাও দশভুজা বা অষ্টাদশভুজা রূপে বর্ণিত, পূজিতা এবং বন্দিতা। চণ্ডীতে দুর্গার সহস্রভুজা মূর্তির উল্লেখও করা আছে। দুর্গা কখনো লগ্না, কখনো বা রাজরাজেশ্বরীরূপে অধিষ্ঠত হন। মহাকালী দেবীর তামসী মূর্তি, মহাসরস্বতী দেবীর সাত্বিকী মূর্তি, মহালক্ষ্মী দেবীর রাজসী মূর্তি, সবই মা দুর্গা। অন্নপূর্ণ, মনসা, ষষ্ঠী, শীতলা, সুবচনী, গন্ধেশ্বরী এ সবই একই মহাপ্রকৃতির। শ্রীরামচন্দ্র যখন পূজা দিতে গিয়ে দেখলেন আরেকটা নীলপদ্ম না পেলে পূজা থেকে যাবে অসম্পন্ন। সীতা উদ্ধারও হবে না।
তাই তো নিরুপায় রামচন্দ্র নিজের চোখ দিয়ে পূজা সম্পন্ন করতে উদ্যত হন, কেননা রামচন্দ্রের চোখ পদ্মের মতো ছিল বলে তার আরেক নাম ছিল পদ্মলোচন। মা দুর্গা রামচন্দ্রের ভক্তিতে খুশি হয়ে চোখ তুলতে বাধা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। দেবী দুর্গার আশীর্বাদে রামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন। পরাশক্তির অধিকারী অসুরকে বধ করার জন্য মা দুর্গা ১০ হাতে ১০ অস্ত্রে সুসজ্জিত, তার ১০ হাত ১০ দিক রক্ষার প্রতীক। মূলে তিনি এক পরমবিদ্যা স্বরূপিনী, যিনি সর্বভূতের প্রাণরূপী মহা দিব্য মূর্তি মা ও জগৎ মঙ্গলময়ী দুর্গা।
দুর্গাপূজা উৎসবে বহুকাল থেকেই মহিলারা মায়ের চরণে বসে পূজার পরে সিদুঁর খেলার অনুষ্ঠান শুরু করে। এই সিঁদুর খেলা দুর্গাদেবীর আশীর্বাদ পেতে আয়োজন করা হয়। অনেকে বলেন, এর মাধ্যমে বিবাহিত মহিলাদের শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতি আলাদাভাবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অংশ মাত্র। এর ইতিহাস অনেক আগের প্রায় ৪৫০ বছরের পুরোনো। অর্থাৎ দেবী দুর্গাকে তাঁর বাবার বাড়ি থেকে বিদায় জানানোর সময় সিঁদুর পরিয়ে দেন। সেই থেকেই সিঁদুর দানের জন্ম।
অষ্টমীতে কুমারী পূজা। সনাতন ধর্ম মতে কুমারী পূজা হলো ষোলো বছরের কম বয়সী অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। শারদীয় দুর্গাপূজার অংশ হিসেবে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশে সুপ্রাচীনকাল থেকেই কুমারী পূজার প্রচলন চলে আসছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, সিলেট হবিগঞ্জ ও দিনাজপুর জেলা শহরের প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে।
প্রতি বছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে নবমী পূজার দিনও এ পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে। পূরাণ মতে দেবগণের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়। এ দিন নির্বাচিত কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয়। হাতে দেওয়া হয় ফুল, কপালে সিঁন্দুরের তিলক ও পায়ে আলতা। ঠিক সময়ে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে ষোড়শোপচারে পূজা করা হয়। চারদিক মুখরিত হয় শঙ্খ, উলুধ্বনি আর মায়ের স্তব-স্তুতিতে।
দুর্গা যেন সমস্ত জগতের প্রতীক। তিনি জগৎরূপে আমাদের আহার্যের সংস্থান করে আমাদের রক্ষণ ও প্রতিপালিত করছেন। শ্রী শ্রী চণ্ডীতে মহামায়ার স্বরূপ সম্পর্কে বলা হয়েছে- তিনি আমাদের বুদ্ধিরূপে, নিদ্রারূপে, ক্ষুধারূপে, তৃষ্ণারূপে, ক্ষন্তিরূপে ইত্যাদি জীবন প্রকাশের যাবতীয় শক্তির উৎস। তাঁর অস্তিত্বেই আমরা চেতনাবান, তাঁর শক্তিতেই আমরা শক্তিমান। ‘মা’নাম করলেই আমরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ভাব অনুভব করি। পূজা ও উপাসনার মাধ্যমে আমরা তাঁরই শক্তিতে শক্তিমান হয়ে তাঁকেই লাভ করার চেষ্টা করি।
দুর্গাপূজা সমাজের সকল বর্ণ, শ্রেণি ও পেশার, সকল স্তরের মানুষের মিলনমেলা ও উৎসব; সকলের কল্যাণভাবনা ও প্রেরণার উৎস। মায়ের ডান পাশে রয়েছেন লক্ষ্মী ও গণেশ, বাঁ পাশে সরস্বতী ও কার্তিক। লক্ষ্মী ঐশ্বর্য ও সম্পদের, গণেশ সিদ্ধিদাতা ও গণঐক্যের, সরস্বতী জ্ঞানের, কার্তিক শৌর্য-বীর্যের প্রতীক।
হিন্দু শাস্ত্র মতে, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়- শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। দুর্গার শাস্ত্রীয় স্বরূপ হলো: তিনি শাশ্বত, মহাকাল ও সনাতনী, তিনিই নিয়তি ও নিয়ন্তা। দুর্গার এই গুণ ও বৈশিষ্ট্য থেকে বোঝা যায় তিনি শুধু দেবী মাত্র নন, তিনি ঈশ্বর।
মায়ের পদতলে মহিষাসুর অশুভ এবং অহংকারের প্রতীক- যা জগতের অমঙ্গলের হেতু। ত্রিনয়নী মহাদেবী দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনে আবির্ভূতা, এ পূজার মূর্তি কল্পনায় ফুটে উঠে শৌর্য, বীর্য (কার্তিক), জ্ঞানভক্তি (সরস্বতী), সিদ্ধি (গণেশ), সম্পদ (লক্ষ্মী) এবং মানবজীবনের ইহকালের বস্তুলাভ ও অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির আশ্রয়। পুরোনো শাস্ত্রমতে দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। পূজার ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, অন্যদিকে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে, সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা, কদলী বৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল একসাথে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে বধূর আকৃতির মতো তৈরি করে দেবীর পাশে বসানো হয়, একেই বলে কলাবউ। পূজার অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে দেবীর বিশেষ পূজা হয়, যার নাম ‘সন্ধিপূজা’।
পূজা ও উপাসনার মাধ্যমে আমরা ইন্দ্রিয় ও মনকে একাগ্র করার ও শুদ্ধ করার প্রয়াস পাই। আমাদের চিত্ত শুদ্ধ হলে মা আমাদের হৃদয়ে প্রকাশিত হন, আমরা আমাদের আনন্দময় স্বরূপ উপলব্ধি করি। মা স্মরণাগত সন্তানকে দশ হাতে সতত সর্বপ্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করে অভয় দিচ্ছেন, সন্তানকে কল্যাণ কাজের শক্তি ও প্রেরণা দিচ্ছেন এবং পরম লক্ষ্যে পৌঁছে দিচ্ছেন। মা দুর্গা জগৎ জুড়িয়া আছেন। তিনিই সমস্ত শক্তি ও গুণের আধার, স্বরূপিনী, তিনি শরণাগত পালিনী, যে তার শরণ সকালে লয়, তিনি তাহার দুঃখ দূর করেন। মা প্রসন্ন হইলে সব বিপদ কাটিয়া যায়, আর মা রাগ করিলে বিপদ ঘটে, মনের সকল বাসনা বিফল হয়।
আমরা আজ সবাই আমাদের দুর্গা মাকে বরণ করব, তার পূজা করে শরণ করব আর কামনা করব মা যেন আমাদের বিপদ থেকে সব সময় রক্ষা করেন। আমরা সবাই যেন সবার জন্য সুখে দুঃখে এগিয়ে আসতে পারি, সকলে দুঃখ কষ্ট ভাগ করে নিতে পারি। দুর্গা পূজার আনন্দ যেন সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি। আমাদের মধ্যে হিংসা, হানাহানি সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে আমরা সবাই যেন একে অপরের বন্ধু হতে পারি। তবেই দেবী দুর্গতিনাশিনী আমাদের মাঝে আসবেন, অসুরকে নাশ করবেন, আমরা সবাই শান্তি ফিরে পাব। মাতৃরূপিনী মহাশক্তির শরণাপন্ন হলে, মা সন্তানের জন্য কল্যাণকর সকল কিছুই পরিপূর্ণ করেন।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস-মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা।
শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। এই মানুষ গড়ার কারিগর যত বেশি যোগ্য হবেন, সুদক্ষ হবেন ততবেশি, যোগ্য নাগরিক পাব আমরা। তাই তো জীবনের সব পরীক্ষায় অতিউত্তম ফলাফল অর্জনের পাশাপাশি একজন শিক্ষককে চলায়, বলায়, সাজে, পোশাকে, চিন্তায়, চেতনায়, জ্ঞানে, দক্ষতায়, মেধায়, নীতিতে, আদর্শে, দেশপ্রেমে, জাতীয়তাবোধে, আধুনিকতায় হতে হয় উত্তম।
এসব বিবেচনায় যার উত্তম হওয়ার ইচ্ছা আছে, যোগ্যতা আছে, শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নেওয়ার মানসিকতা আছে তাকে বাছাই করার কাজটি আসলেই কঠিন। আমাদের দেশে শিক্ষক বাছাইয়ের প্রচলিত-প্রক্রিয়া কতটা মানসম্মত তা ভেবে দেখা উচিত। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বাছাই ক্ষমতা এনটিআরসিএর হাতে নেওয়ার ফলে আগের তুলনায় কিছুটা অধিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছেন সারা দেশে। তথাপি সেই মান প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছেনি।
এখনো কিছু কিছু বিষয়ে এমন শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া যাচ্ছে, যাদের সাধারণ জ্ঞান ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের গভীরতা ও প্রায়োগিক ক্ষমতা অত্যন্ত কম এবং তারা জানেন না ও পারেন না অনেক শব্দের সঠিক বানান ও উচ্চারণ! শ্রেণিকক্ষেও পরিহার করতে পারেন না আঞ্চলিক ভাষা! প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য অবশ্যই আরও উন্নত করতে হবে শিক্ষক বাছাই-প্রক্রিয়া।
সর্বস্তরেই বৃদ্ধি করতে হবে শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বাছাইয়ে মূল্যায়ন করতে হবে আরও অনেক বিষয়। তদুপরি শিক্ষক বাছাইকালে অবশ্যই প্রার্থীদের অংশগ্রহণ করাতে হবে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ও প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে। যেন মূল্যায়ন করা যায় তাদের কথা বলার ও পাঠদানের তথা কোনো কিছু উপস্থাপনের দক্ষতা এবং চিহ্নিত করা যায় অযোগ্যতা বা দুর্বলতা।
একজন ভালো শিক্ষক আজীবন লালন করবেন জানার এবং জানানোর ঐকান্তিক ইচ্ছা। শিক্ষককে জ্ঞানার্জনে হতে হবে নিরলস। অত্যন্ত সমৃদ্ধ হতে হবে নির্ধারিত বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে। শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি অত্যন্ত ভালোভাবে জানা থাকতে হবে শিক্ষার সংজ্ঞা, শিক্ষার উদ্দেশ্য ও শিক্ষাদানের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি।
আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষককে থাকতে হয় সমৃদ্ধ। জানতে হয় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার, সুফল-কুফল এবং সে আলোকে শিক্ষার্থীকে দিতে হয় সঠিক দিকনির্দেশনা। শিক্ষালাভে শিক্ষককে সদা সর্বদা থাকতে হয় সক্রিয়। হতে হয় বই ও প্রকৃতির একনিষ্ঠ পাঠক এবং সেভাবেই গড়ে তুলতে হয় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষক নিজে হতে হয় সবচেয়ে বড় শিক্ষার্থী। যিনি নিজে শিক্ষার্থী নন, তিনি অন্যের শিক্ষক হবেন কী করে? শিক্ষাদান শিক্ষকের একান্ত কর্তব্য। আর শিক্ষাগ্রহণ শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব। শিক্ষাদানের পূর্বশর্তই শিক্ষাগ্রহণ।
প্রতিনিয়ত শিক্ষাদান কার্যের পূর্বপ্রস্তুতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত শিক্ষাগ্রহণ। অবশ্যই থাকতে হবে বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ। যে শিক্ষক ভাববেন, আমি কেবল পড়াব, পড়ব না; সে শিক্ষক কখনো ভালো শিক্ষক হবেন না। শিক্ষক নিজের মধ্যে শিক্ষার সঠিক চর্চা করেই সঠিক পরিচর্যা করবেন শিক্ষার্থীর। ভালো শিক্ষক নিজের মধ্যে জ্ঞানের চর্চা করবেন প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, আজীবন। নিরলসভাবে অর্জন ও বিতরণ করবেন নতুন নতুন জ্ঞান। শিক্ষার্থী ও সমাজের সব মানুষকে করবেন জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ। আলোকিত করবেন দেশ ও জাতি।
একজন ভালো শিক্ষক হবেন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তার থাকবে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মতো মন-মানসিকতা। ভোগের চেয়ে ত্যাগের ইচ্ছাই থাকবে বেশি। তিনি কী পেলেন, তার চেয়ে বেশি ভাববেন কী দিলেন এবং কী দিতে পারলেন না। ভোগের চেয়ে ত্যাগেই বেশি আনন্দিত হবেন তিনি। বস্তু প্রাপ্তির নয়, জ্ঞানপ্রাপ্তি ও প্রদানের সংগ্রামে অবতীর্ণ থাকবেন শিক্ষক। কেবল বস্তুগত প্রাপ্তির আশায় যিনি শিক্ষক হবেন ও শিক্ষকতা করবেন তিনি কখনো
প্রকৃত শিক্ষক হয়ে উঠবেন না। কেননা, প্রকৃত শিক্ষাদানের অন্তর্নিহিত অনাবিল আনন্দ ও শিক্ষাদানের অফুরান পুণ্য থেকে তিনি বঞ্চিতই থেকে যাবেন। শিক্ষকতার প্রকৃত পরিতৃপ্তি লাভের অতল সাগরে কোনো দিন যাওয়া হবে না তার। শিক্ষার্থীর জন্য যিনি নিবেদিতপ্রাণ তিনিই পরম শ্রদ্ধেয়। তাকেই শ্রদ্ধাভরে আজীবন মনে রাখে শিক্ষার্থী।
অত্যন্ত দূর-দৃষ্টিসম্পন্ন হবেন শিক্ষক। তিনি হবেন সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল ও বাস্তববাদী। তার আয়ত্তে থাকবে শিক্ষাদানের মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান ও আধুনিক কলাকৌশল। একজন ভালো শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর মন-মানসিকতা, যোগ্যতা-অযোগ্যতা, আগ্রহ-অনাগ্রহ বোঝার অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। নিজের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সব দিক থেকে প্রতিনিয়ত মূল্যায়ন করবেন শিক্ষক। সেই মূল্যায়নের আলোকেই দেখাবেন শিক্ষার্থীর সামনে এগিয়ে যাওয়ার সঠিক পথ।
দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধে পরিপূর্ণ হবেন শিক্ষক। ভালোভাবে জানবেন দেশ-জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। নিজের মধ্যে গভীরভাবে লালন ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সচেতনভাবে সঞ্চালন করবেন দেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনা। দেশপ্রেমে ও জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করবেন শিক্ষার্থীদের।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষকের থাকতে হবে প্রাকৃতিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির একনিষ্ঠ ছাত্র হবেন শিক্ষক। থাকতে হবে প্রতিনিয়ত প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের ঐকান্তিক ইচ্ছা। নিজে শিখবেন এবং নিজের শিক্ষার্থীদের শিখাবেন প্রকৃতির পাঠ। সেই সঙ্গে শিখিয়ে দেবেন প্রকৃতির পাঠ রপ্ত করার কৌশল। শিক্ষার্থী যেন প্রকৃতিকে বানাতে পারে তার জীবনের নিত্য শিক্ষক।
যতই আধুনিক শিক্ষা উপকরণ যুক্ত করা হোক, উন্নত সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বহুতল ভবন নির্মাণ করা হোক; শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা খুবই কঠিন কাজ বিশেষ করে আমাদের দেশে যেখানে সর্বোচ্চ মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসেননি, আসছেন না যুগ যুগ ধরে। টাকা হলে রাতারাতি শিক্ষা উপকরণ বদল করা যায়, পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা যায়; কিন্তু শিক্ষকদের বদল বা মান বৃদ্ধি করা যায় না। শিক্ষকের মান বৃদ্ধি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। শিক্ষকের বেতন সর্বোচ্চ নির্ধারণ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সব শিক্ষকের মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে যাবে এমনটি অবাস্তব। কেননা, এই আমি যতদিন আছি ততদিন দিয়েই যাব ফাঁকি, রেখেই যাব কম দক্ষতার স্বাক্ষর। তথাপি বৃদ্ধি করতে হবে আমার তথা শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা। প্রশিক্ষিতদের দিতে হবে আরও বর্ধিত বেতন। শিক্ষকতায় আনতে হবে সর্বোচ্চ মেধাবী ও যোগ্যদের।
কোনো রকম কোটা সংরক্ষণ করে তুলনামূলক কম যোগ্যদের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ দেওয়া মোটেও উচিত নয়। কেননা, শিক্ষক অযোগ্য হলে জাতি অযোগ্য হয়। আমাদের সর্বাধিক মেধাবী ও যোগ্য সন্তানরা যেদিন সাগ্রহে এসে দখল করবে আমাদের স্থান সেদিনই উন্নীত হবে আমাদের শিক্ষকদের কাঙ্ক্ষিত মান। সেটি যতই সময়সাপেক্ষ হোক এখন হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না কোনো অজুহাতেই। ব্যাপক প্রশিক্ষণ দিয়ে যথাসম্ভব বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে আমার মতো বিদ্যমান শিক্ষকদের মান। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে শিক্ষক হওয়ার জন্য টিচিং ডিগ্রি বাধ্যতামূলক।
তিনি যে পর্যায়ের, যে বিষয়ের শিক্ষকই হতে চান না কেন তার নিজস্ব বিষয়ে ডিগ্রির পাশাপাশি টিচিংয়ের ওপর আলাদা ডিগ্রি থাকতেই হবে। অর্থাৎ পাঠদানের বৈজ্ঞানিক কৌশল না জেনে কেউ শিক্ষক হতে পারেন না। অথচ আমাদের দেশে যে কেউ যেকোনো সময় শিক্ষক বা হুজুর হয়ে যাচ্ছেন! শিক্ষক হওয়ার জন্য শিক্ষকতা শিক্ষা করার অর্থাৎ শিক্ষা মনোবিজ্ঞান ও পাঠদানের আধুনিক কলাকৌশল আয়ত্ত করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই আমাদের বিদ্যমান শিক্ষক বা ওস্তাদদের যতটুকু সম্ভব প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদানে। এর কোনো বিকল্প নেই বর্তমান বাস্তবতায়।
দীর্ঘদিনের এই দুরবস্থা থেকে শিক্ষার উত্তরণ ঘটাতে চাইলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও বাড়াতে হবে শিক্ষকদের প্রকৃত আর্থিক সুবিধা এবং সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে তাদের বাস্তবিক কর্মঘণ্টা। আর সেটি আন্তরিকভাবে মেনে নিতে হবে শিক্ষকদের। উন্নত বিশ্বের শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত ক্লাসেই দিয়ে থাকেন পরিপূর্ণ শিক্ষা। স্কুলের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় না ক্লাসের পড়া।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমত নিশ্চিত করতে হবে মানসম্মত শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয়ত শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা প্রদানের মাধ্যমে আরও বেশি সময় প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। যেন শিক্ষকদের না থাকে বেতন-ভাতার অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের ধান্দা এবং শিক্ষার্থীদের না থাকে ক্লাসরুমের বাইরে ক্লাসের বিষয় পড়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ- কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।
আমাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে রিজিক দরকার। আর রিজিকের মালিক তো মহান রাব্বুল আল আমিন। তিনি সকল প্রাণীকুলকে যেমন সৃষ্টি করেছেন তেমনি নানানভাবে, নানান উপায়ে তাদের রিজিকের ব্যাবস্থাও তিনি করে রেখেছেন। তবে মহান খোদার কুদরতী হাতে সেই রিজিক প্রাণীকুলের মুখে আসে না। সেই রিজিককে আমাদের দুই হাত, দুই পা আর মেধা দিয়ে খুঁজে নিতে হয় ।
মানুষ ছাড়া সকল প্রাণীই তার পরিবেশ ও প্রতিবেশের মধ্যে থেকে তাদের প্রয়োজনীয় রিজিক বা আহার আহরণ করে । কখনো কোথায় সেই আহারের কমতি রাখেননি আল্লাহ । তাহলে বিনা আহারে প্রাণীকুল ধ্বংস হয়ে যেত। আলহামদুলিল্লাহ! সে রকমটি কখনো ঘটেনি আর ভবিষ্যতেও কখনো ঘটবে না।
আর মানুষের রিজিকের ব্যবস্থাও তেমনিভাবে মহান আল্লাহ বিরাজিত রেখেছেন সমগ্র বিশ্বজুড়ে। এই রিজিক বা আহারের আয়োজন মানুষ তার শরীর ও বুদ্ধি দিয়ে নানানভাবে সম্পাদন করে। রিজিক আহরণের জন্য তাই মানুষের কর্ম বা প্রচেষ্টা পৃথিবীর বুকে মানব সৃষ্টির সূচনা থেকেই। জন্ম থেকেই মানুষ ক্ষুধার সম্মুখীন এবং এই জঠর জ্বালা নিবারণের জন্য তারা মাঠে-ঘাটে-পাহাড়ে-জঙ্গলে খাদ্য অন্বেষণ করত। তখন আগুন ও হাতিয়ারের আবিষ্কার না হওয়ায় তারা প্রাণী ধরত এবং কাঁচা ভক্ষণ করত । বৃষ্টি-নদী-সরোবর-সমুদ্র মেটাত পানির তৃষ্ণা। আগুন, হাতিয়ার ও চাকা আবিষ্কারের মাধ্যমে সভ্যতার যখন সুচনা হলো সেই থেকে আজ অবধি মানুষ তার রিজিক বা আহার সংস্থানের জন্য নানা রকম পেশা বেছে নিল।
কেউ হলো শিকারি, কেউ হলো কাঠুরিয়া, কেউ হলো কামার, কুমার, জেলে, চাষি। যাদের অর্থকড়ি ছিল তারা হলো ব্যবসায়ী, সওদাগর, মহাজন। বিদ্যা বা বুদ্ধির জোরে অনেকেই চাকরি করতেন রাজা বাদশাহ বা জমিদারের অধীনে। ক্রমান্বয়ে সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক পেশার জন্ম হলো। তৈরি হলো হেকিম, কবিরাজ, পণ্ডিত, পুরোহিত, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকতার পেশা, যা আজও প্রচলিত। জীবন পরিচালনার ব্যয় নির্বাহের জন্য এসবের সঙ্গে দিন দিন আরও অনেক পেশা যুক্ত হচ্ছে এবং মানুষ তার পছন্দমতো পেশা বেছে নিয়ে সংসার সীমান্ত ও জীবন পাড়ি দিচ্ছেন ।
আজ আমরা এমন একটি পেশা নিয়ে আলাচনা করব যা আল্লাহর পছন্দের, ইসলামের শেষ নবী রাসুলাল্লাহ (সা.) নিজেও পছন্দ করতেন এবং সবাইকে সেই পেশায় বিযুক্ত হওয়ার জন্য নসিহত করে গেছেন। সেই পেশাটি হচ্ছে ব্যবসা। আজ আমরা ইসলামের আলোকে ব্যবসার মূলনীতি ও গুরুত্ব বিষয়ে কিছু আলোচনা করব।
পবিত্র আল কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম (সুরা বাক্কারাহ-২৭৫)। এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, মহান আল্লাহ আয় উপার্জনের পেশা হিসেবে ব্যবসাকে যেমন হালাল করেছেন, তেমনি অবৈধ পথে বা মানুষকে ঠকিয়ে অর্থ কামানো বা ব্যবসা-বাণিজ্য করাকেও নিষেধ করেছেন। আমরা বর্তমান সময়ে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, মুসলিম/অমুসলিম সবাই ব্যবসাকে হালাল উপার্জনের পথ হিসেবে বেছে নিয়ে কোনো সততা বা নীতিবোধের তোয়াক্কা না করে ব্যবসা পরিচালনায় লাভবান হচ্ছেন। ব্যবসার মাধ্যমে অসাধুতা করে, মানুষকে ঠকিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন, যা আল্লাহ পছন্দ করেন না।
মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে, মানুষকে ঠকিয়ে সাময়িকভাবে লাভবান হলেও এর শেষ পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। হাশরের ময়দানে এর জন্য সমস্ত ভালো আমলগুলোও কোনো সাহায্যে আসবে না। হাজি সাহেবের খেতাব যতই পোক্ত হোক বা প্রভাব-প্রতিপত্তি যাই থাকুক, কিয়ামত দিবসে কোনো কাজে আসবে না যদি ব্যবসায় অমরা সৎ না থাকি। তাই ইসলামে অন্যায়, জুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, কালোবাজারি, মজুদদারি ইত্যাদি অবৈধ ও ইসলামবিরোধী কার্যাবলি পরিহার করে সততা ও ইসলামী মূলনীতি প্রতিপালন করে ব্যবসা-বাণিজ্য করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে ।
আসুন এবার আমরা সৎ পথে ব্যবসা পরিচালনার লাভ-ক্ষতি ও গুরুত্ব বিষয়ে কোরআন ও হাদিস কী বলে আলাচনা করি ।
পবিত্র কোরআনে হালাল পথে ব্যবসা করার গুরুত্ব : পবিত্র কোরআনে শুআইব (আ.) তার ধর্ম ও ব্যবসায়িক নীতি সম্পর্কে বলেন- ‘হে আমার কওম! আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নাই। আর মাপ ও ওজন ইনসাফের সঙ্গে পূর্ণ করো। লোকদেরকে তাদের প্রাপ্য কম দিও না। পরিমাপে ও ওজনে কম দিও না আর জমিনে ফ্যাসাদ তৈরি করো না’ ( সুরা হুদ : আয়াত-৮৪-৮৫ ) ।
পবিত্র কোরআনে আরো ইরশাদ হচ্ছে :
‘মেপে দেওয়ার সময় পূর্ণমাপে দেবে। সঠিক পাল্লায় ওজন করবে। এটি উত্তম, এর পরিণাম শুভ। ( সুরা বনী ঈসরাইল : আয়াত-৩৫ )
সততা ও ন্যায়নিষ্ঠতার সঙ্গে ব্যবসা করার বিষয়ে হাদিসে আছে : নবী ( সা.) বলেন– ‘কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহাঅপরাধী হিসেবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করবে, নেকভাবে, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করবে তারা ব্যতিত’ (তিরমিজি-হা/১২১০, ইবনে মাজাহ-হা/২১৪৬)।
ব্যবসা-উপার্জন ও জীবিকার প্রধান ও আল্লাহর নির্দেশিত পেশা হওয়ায় আমরা যারা খোদার সন্তুষ্টি ও হালাল উপার্জনের জন্য এটাকে গ্রহণ করি তাদের মনে রাখা উচিত এর মাধ্যমে কাউকে ঠকানোর চিন্তা করা যাবে না । একমণ দুধের ভেতর একফোঁটা দই মিশ্রিত হলে যেমন দুধের স্বাদ আর থাকে না তেমনি ব্যবসায়িক কাজে বিন্দু পরিমাণ অসৎ চিন্তা বা চেষ্টা তেমনি খোদার কাছে এই আমলের ফজিলত নষ্ট করে দেয় আর দুনিয়াতেও বরকত উঠে যায়।
সাময়িকভাবে এর লাভ বা সমৃদ্ধি দেখে ব্যবসায়ী ব্যক্তির আত্মতৃপ্তি আসতে পারে কিন্তু যেকোনো সময় বিশাল আর্থিক ক্ষতি বা সমাজে সম্মান বিনষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা খোদার ইচ্ছাতেই ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। যার ফলে ব্যবসায়ী হয়েও ইহকাল ও পরকালের সকল শান্তি থেকেই সে বঞ্চিত হয়। আর তাই খোদার পছন্দের ব্যবসা করে দুনিয়া ও আখিরাতে লাভবান হতে চাইলে নিম্নোক্ত মূলনীতিগুলো অনুসরণ করা উচিত।
১. ব্যবসায়িক পণ্য, কায়-কারবার ও শেয়ারগুলো হতে হবে হালাল। যেমন : অবৈধ পণ্য, নিষিদ্ধ মালামাল , ইসলামে নিষিদ্ধ দ্রব্য যেমন- মদ , জুয়া , সুদ, ঘুষ ইত্যাদি ব্যবসায় জড়িত হওয়া যাবে না। কারণ এসব বিষয়কে ইসলামে হারাম করা হয়েছে। সুতরাং ব্যবসার সাথে এসবের মিশ্রণ পেশাটাকে কলুষিত করতে পারে ।
২. ব্যবসা-বাণিজ্যে সকল অবস্থায় বৈধ পন্থা অবলম্বন করতে হবে। মানুষকে ঠকানো, ধোঁকাবাজি-ভেজাল এবং অন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করা যাবে না । এ বিষয়ে নবী (সা.) বলেন– ‘নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া আর অন্যের ক্ষতি করা কোনোটিই উচিত নয়।’
৩. সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করা। ব্যবসা করে আমরা শুধু লাভ করছি না বরং আমরা জিনিসের মাধ্যমে সেবা প্রদান করছি। এখানে আমরা যদি যৌক্তিক লাভ করি তা ব্যক্তি বা সমাজের জন্য একটা বড় সহায়তা। ভালো মানের ও ন্যায্য দামে পণ্য গ্রাহকের হাতে পৌঁছাতে পারলে সমাজের মানুষ সন্তুষ্ট হবে। সেই সঙ্গে আল্লাহও ব্যবসায়ীর ওপর রহমত প্রদান করবেন ।
৪. ধোঁকাবাজি, প্রতারণ ও ফাঁকিবাজি না করা। এ ধরনের অপকর্ম ইসলামের মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত। মন্দ জিনিস ভালো বলে চালিয়ে দেওয়া, ভালোর সঙ্গে মন্দ জিনিস মিশিয়ে দেওয়া জঘন্য প্রতারণা ও হারাম । নবী (সা.) বলেন- ‘যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয়।’ ( সহি মুসলিম-হা/১০২)
৫. পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যা শপথ না করা। মিথ্যা সকল আমল ও কাজের বরকত নষ্ট করে দেয়। মানুষের নৈতিক চরিত্রের অবসান ঘটায়। মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রির পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এ ব্যাপারে নবী (সা.) বলেন– ‘কিয়মত দিবসে আল্লাহ তিন ধরনের ব্যক্তির সাথে কথা বলবেন না । তাদের প্রতি তাকাবেন না, তাদের পবিত্র করবে না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন হচ্ছে যে তার ব্যবসায়িক পণ্যকে মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে।’ (আবু দাউদ-হা/৩৪৭৪)
৬. ব্যবসার সাথে সুদকে মেশানো যাবে না। ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ একটি মারাত্মক অপরাধ। ব্যবসার সাথে সুদকে বা সুদের ব্যবসা কঠোরভাবে হারাম করা হয়েছে । সুদের পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন– ‘যারা সুদ খায় কিয়ামতের দিন তারা দণ্ডায়মান হবে শয়তানের সাথে । কারণ তারা বলে-ক্রয়/বিক্রয় ( ব্যবসা ) তো সুদের মতো। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম। ( সুরা বাকারাহ/আয়াত-২৭৫ )
৭. অন্যায়ভাবে কারোর সম্পদ গ্রাস না করা : হালার ব্যবসার চরিত্রটাই এমন হওয়া উচিত যে, নিজের বৈধ টাকায় সততা ও ঈমানদারিত্বের সাথে ব্যবসা করা। অন্যের সম্পদ দখল করে লাভবান হওয়া যাবে না। এতে বরকত নেই আছে কঠিন আজাবের নিশ্চয়তা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন– ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না । কেবল মাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মাতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ ।’ (সুরা আন নিসা /আয়াত-২৯)।
আমরা যদি ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে উল্লেখিত নীতিমালা ও কোরআন-হাদিসের বিধানগুলো সহি-শুদ্ধভাবে অনুসরণ করি তাহলেই কেবল আমাদের রিজিক ও রোজগারগুলো হালাল হবে । সেই সাথে বরকত আসবে আমাদের উপার্জনে। খোদার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে নাজাত পাব কবর ও কিয়ামতের কঠিন আজাব থেকে । সুদকে পরিহার করে, অন্যকে না ঠকিয়ে এবং মানুষের সাথে প্রতারণা না করে যিনি ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন- ব্যবসায়ী অঙ্গনে তার সুনাম ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে নিশ্চিত। আর এর ব্যতিক্রমের জন্য রয়েছে দুই জগতেই জাহান্নামের মতো শাস্তি আর লানত। আমাদের ব্যবসায়ীদের জীবনে ও সমাজের আজকের বাস্তবতা সেই রূঢ় সত্যেরই প্রতিফলন। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সততার সাথে ব্যবসা করে নিজের এবং জনগণের সমৃদ্ধি ঘটানোর তওফিক দিন। আমিন!
লেখক : ইসলামী কলামিস্ট
দুর্গা, যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করেন; অন্য মতে, ‘যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন’, তাকে সনাতন হিন্দুরা মহাশক্তির একটি উগ্র রূপ মনে করেন। তার অন্য নামগুলো হচ্ছে চণ্ডিকা, যোগমায়া, অম্বিকা, বৈষ্ণবী, মহিষাসুর সংহারিণী নারায়ণী, মহামায়া, কাত্যায়নী ইত্যাদি। দেবী দুর্গার অনেকগুলো হাত। তার অষ্টাদশভুজা, ষোড়শভুজা, দশভুজা, অষ্টভুজা ও চতুর্ভুজা মূর্তি দেখা যায়। তবে দশভুজা রূপটিই বেশি জনপ্রিয়। তার বাহন সিংহ (কোনো-কোনো মতে বাঘ)। মহিষাসুর মর্দিনী-মূর্তিতে তাকে মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধরতা অবস্থায় দেখা যায়।
হিন্দুধর্মে দেবী দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের জননী এবং কালীর অন্য রূপ। বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলোতে এবং আগমনী গানে দুর্গারূপে শিবজায়া হিমালয় দুহিতা পার্বতীর সপরিবারে পিতৃগৃহে অবস্থানের আনন্দময় দিনগুলোর (দুর্গাপূজা) এবং তার বিবাহিতা জীবনের অপূর্ব বর্ণনা পাওয়া যায়।
দুর্গার আরাধনা বাংলা, অসম, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড এবং বিহারের কোনো কোনো অঞ্চলে প্রচলিত। ভারতের অন্যত্র দুর্গাপূজা নবরাত্রি উৎসবরূপে উদ্যাপিত হয়। বছরে দুবার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে- আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজা। সম্ভবত খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় দুর্গোৎসব প্রবর্তিত হয়। জনশ্রুতি আছে, রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ প্রথম মহাড়ম্বরে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন।
নানারূপে দেবী
দুর্গা মূলত শক্তির দেবী। ঋগ্বেদে দুর্গার বর্ণনা নেই, তবে ঋগ্বেদোক্ত দেবী সূক্তকে দেবী দুর্গার সূক্ত হিসেবেই মান্যতা দেওয়া হয়। দুর্গার বিশেষ আলোচনা ও পূজা বিধি তন্ত্র ও পুরাণেই প্রচলিত। যেসব পুরাণ ও উপ-পুরাণে দুর্গা সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে: মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবী পুরাণ, কালিকা পুরাণ ও দেবী ভাগবত। তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও রূপে পূজিতা হন।
দেবী দুর্গা শাক্ত ধর্মে সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবী, বৈষ্ণব ধর্মে তাকে ভগবান বিষ্ণুর অনন্ত মায়া হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয় এবং শৈব ধর্মে দুর্গাকে শিবের অর্ধাঙ্গিনী পার্বতী হিসেবে অর্চনা করা হয়। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। কেনোপনিষদে বর্ণিত হৈমাবতীকে দুর্গা হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে; ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের যোগমায়াকে দুর্গা আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যিনি হরি সহায়িনী তথা হরিভক্তি প্রদায়িনী। এসব ছাড়াও দুর্গা দেবীর বর্ণনা মহাভারতের বিরাট পর্ব ও অন্যান্য পুরাণে পাওয়া যায়। দুর্গা দেবীর ভিন্ন-ভিন্ন অবতারগুলো হচ্ছে: কালিকা, নন্দা, ভ্রামরী, শাকম্ভরী, রক্তদণ্ডিকা, সতী, পার্বতী, কৌশিকী ইত্যাদি।
বিদেশে
জাপানি দুর্গা বা ‘জুনতেই ক্যানন (Juntei Kannon)Õ ১৮ হাতের দুর্গা রূপ। মহাযান পরিব্রাজকদের হাত ধরে দেবীর এই রূপ জাপানে পৌঁছায় ৭০০ শতাব্দীর কাছাকাছি। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে।
সিন্ধু সভ্যতায় তথা ব্যবিলনীয় সভ্যতায় উল্লেখ পাওয়া যায় এই মাতৃপূজার। মাতৃপূজাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির আদি পর্ব থেকে শুরু সিংহবাহিনী দেবীর পূজা। মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতায় খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী ইনান্নার। কুশান রাজা কনিষ্কের মুদ্রাতেও খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী নানার। তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রচলিত ছিল এই দেবীর মাহাত্ম্য। এখনো দেবী চণ্ডী ‘বিবি নানা’ হিসেবে এসব অঞ্চলে পূজিত হন।
শাক্ত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ হয় খ্রিষ্টীয় ৪০০-৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। খ্রিষ্টীয় ৪০০ অব্দে রচিত হয় শাক্ত মহাপুরাণের অন্যতম গ্রন্থ দেবীমাহাত্ম্য। এ সময়েই মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১-৯৩ অধ্যায়গুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় এই গ্রন্থ। দেবীমাহাত্ম্য গ্রন্থেই প্রথম বিভিন্ন নারী দেবতাসংক্রান্ত নানান পুরাণ-কথা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক উপাদানগুলো একত্রিত করা হয়। দেবীমাহাত্ম্য গ্রন্থে বৈদিক পুরুষতান্ত্রিক দেবমণ্ডলীর সঙ্গে সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব নবম সহস্রাব্দ থেকে বিদ্যমান নৃতাত্ত্বিক মাতৃপূজা কেন্দ্রিক সংস্কৃতির এক সম্মিলনের প্রয়াস লক্ষিত হয়। এর পরবর্তী হাজার বছর এই ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে।
বৌদ্ধ ধর্মের হাত ধরে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তিব্বত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও মঙ্গোলিয়ায়। কম্বোডিয়া আর ইন্দোনেশিয়ায় দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য পূজিত হতে শুরু করে হিন্দু ধর্মের প্রসারের সাথে সাথে। অ্যাংকর যুগের (১০১০ শতাব্দের) পূর্বে কম্বোডিয়ায় মহিষাসুর মর্দিনীর পূজার প্রচলন ছড়িয়ে পড়ে হিন্দু ধর্মের হাত ধরে। এ সময় যে দুর্গা মূর্তিগুলো কম্বোডিয়া থেকে উদ্ধার হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই চতুর্ভুজা এবং মহিষাসুর মর্দিনী। মূর্তিগুলোর বৈশিষ্ট্যাবলি হচ্ছে, এখানে মহিষাসুর মর্দিনী দুর্গা বিষ্ণুর ক্ষমতা ধারণ করেছেন, যা তার চতুর্ভুজের শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম থেকে প্রতিষ্ঠিত।
জাভা ও ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অংশ থেকে উদ্ধার হয়েছে অনেক মহিষাসুর মর্দিনী মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ। এই মূর্তিগুলোর মধ্যে প্রাচীনতমটির তারিখ আনুমানিক অষ্টম শতাব্দী।
ইন্দোনেশিয়ার সেন্ট্রাল জাভাতে রয়েছে নবম শতাব্দীর বিখ্যাত হিন্দু মন্দির প্রাম্বানান। এই মন্দিরে রয়েছে এক জগৎ বিখ্যাত মহিষাসুর মর্দিনী মূর্তি। এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান, ইন্দোনেশিয়ায় বৃহত্তম হিন্দু মন্দির এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বড় মন্দির প্রাঙ্গণ। ১৫০০ থেকে ১৬০০ শতাব্দীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় মহিষাসুর মর্দিনীর পূজা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইসলামের আগমনের পর দুর্গার আরাধনা পাড়ি জমায় আরও পূর্বদিকে হিন্দু বালিতে।
দুর্গা পূজা
দুর্গাপূজা হচ্ছে শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দুর্গা দেবীর উপাসনার উৎসব। দুর্গাপূজা শরৎ (আশ্বিন) এবং বসন্ত (চৈত্র) ঋতুর শুক্ল পক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। মার্কণ্ডেয় চণ্ডী অনুযায়ী, দুর্গাপূজার প্রথম প্রচলন হয়েছিল বসন্ত ঋতুতে, রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি কর্তৃক। দেবী ভাগবত ও কালিকা পুরাণে উল্লেখ আছে, শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্র দুর্গাপূজা করেছিলেন রাবণ বধের নিমিত্তে; এ জন্য একে, ‘অকালবোধন’ও বলা হয়ে থাকে।
পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ডে দুর্গাপূজা বহুলভাবে উদ্যাপন করা হয়; উত্তর ভারতে এটি নবরাত্রী হিসেবে পালন করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের একাধিক রাষ্ট্র দুর্গাপূজা পালন করে এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাও সবাই দুর্গাপূজা পালন করে। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ দিন তথা ষষ্ঠী থেকে আরম্ভ করে দশমী পর্যন্ত হয়ে থাকে এই দুর্গোৎসব। এই পাঁচ দিন যথাক্রমে দুর্গা ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। এই পক্ষটিকে দেবীপক্ষ নামেও জানা যায়। পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন এই দেবীপক্ষের সূচনা হয়, একে মহালয়াও বলা হয়ে থাকে; আর পূর্ণিমার দিনটিকে লক্ষ্মী পূজার দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।
নাম ব্যুৎপত্তি
হিন্দুশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে:
‘দৈত্যনাশার্থবচনো দকার: পরিকীর্তিত:।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত ।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচক:।
ভয়শত্রুঘ্নবনশ্চাকার: পরিকীর্তিত।।’
অর্থাৎ, ‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, ‘গ’ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম বলেছে, ‘দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা’। অর্থাৎ, যিনি দুর্গ নামে অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনি সব সময় দুর্গা নামে পরিচিত। শ্রীশ্রী চণ্ডী অনুসারে যে দেবী ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যা:’ (সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি), তিনিই দুর্গা।
লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
তিস্তা নদী এখন বাংলাদেশের জন্য বিরাট সমস্যা। তিস্তাকে ভারত বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের নামে ভারত আমাদের থেকে সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। এ বাংলায় তারা কানেকটিভিটিও স্থাপন করেছে। বিনিময়ে আমরা কি পেলাম। তাদের সঙ্গে এখনো আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েই গেল। তিস্তা আমাদের জন্য মহাবিপর্যয়। আমাদের কি হলো না হলো তা তোয়াক্কা না করে প্রতি বছর ইচ্ছেমতো পানি ছেড়ে দিচ্ছে আবার আটকে দিচ্ছে কিছুই কি বলার থাকছে না? অমন পরিস্থিতি আমরা বারবার দেখতে পাচ্ছি।
শুষ্ক সিজনে খরায় মরুকরণ করে কৃষি কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে আমার কৃষক ভাইকে দিন দিন নিষ্ফসলায় ফেলে দিচ্ছে। তিস্তা সুবিধাভোগী দুই কোটির বেশি লোক বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাস করে। তিস্তার ওপর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল রংপুর বিভাগের মধ্য দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা তিস্তা বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। তিস্তার প্লাবনভূমি ২ হাজার ৭৫০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তীর্ণ। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফসল বোরো ধান চাষের জন্য পানির প্রাথমিক উৎস এবং মোট ফসলী জমির প্রায় ১৫ শতাংশ সেচ প্রদান করে।
তিস্তা ব্যারাজ প্রজেক্ট বাংলাদেশের বড় সেচ প্রকল্প। এটাও তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। এ প্রকল্পটির অন্তর্ভুক্ত উত্তরবঙ্গের ৬টি জেলা যথা নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা ও জয়পুরহাটের আওতাভুক্ত ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি বিস্তৃত। তিস্তা উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবন জীবিকা ও অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
অধিকার আদায়ে প্রতিবাদ করে কোনো প্রতিকার হয়নি। বন্ধুভাবাপণ্য হৃদয় দিয়ে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। অস্বীকার করার কারণ নেই এরা আমাদের পরম প্রতিবেশী বন্ধু দেশ। ভারত যদি বড় রাষ্ট্রের বড়াই নিয়ে মুরুব্বিয়ানা ভাব দেখায় তাহলে কি সমস্যার সমাধান হবে?
তিস্তার অতীত ইতিহাস তিক্ততায় ভরা ছিল। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য বিরোধ চলে আসছে। ১৯৭২ সালে যখন নদী কমিশন গঠন করা হয়, তখনও স্পর্শকাতর ও জনগণের প্রত্যাশা বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে গঙ্গা ও তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুর মীমাংসা করার সিদ্ধান্ত হয়। দুর্ভাগ্য শেখ মুজিবুর রহমানের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে কোনো ইস্যুরই মীমাংসা হয়নি। অন্যদিকে ভারতকে একতরফাভাবে ফারাক্কা চালুর অনুমতি দেওয়ায় আমাদের জাতীয় স্বার্থের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বিশাল লংমার্চ করে ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেটা ছিল প্রতিবাদী ঐতিহাসিক লংমার্চ। পাকিস্তান থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরও তিস্তা সমস্যা-সমাধানে ভারতের আগ্রহের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
উপকূলের পথে তিস্তার দীর্ঘ ৪০০ কিলোমিটারজুড়ে ভারত মর্জিমাফিক বাঁধ নির্মাণ করে চলেছে। এর মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবার তিস্তার বাঁধ নির্মাণ। গজলডোবায় বাঁধ স্থাপিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে। তিস্তা নদীর বাংলাদেশ সীমান্তের ৬০ কিলোমিটার উজানে ভারত সরকার এই বাঁধ নির্মাণ করে। এই বাঁধে ৫৪টি গেট রয়েছে। যা বন্ধ করে তিস্তার মূলপ্রবাহ থেকে পানি বিভিন্ন খাতে পুনর্বাহিত করা হয়। প্রধানত তিস্তার পানি তিস্তা ও মহানন্দা খালে পুনর্বাহিত করার উদ্দেশ্যে নিয়েই এই বাঁধ স্থাপন করা হয়েছে। ২ হাজার ৯১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা মহানন্দ খালের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ও মালদহ জেলায় কৃষি কাজের জন্য সেচের পানি সরবরাহ করা হয়। কার্যত তিস্তা নদীর পানি গজলডোবার বাঁধের মাধ্যমে বিহারের মেচী নদীর দিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে।
সেখানে ফারাক্কার উজানে এই পানি ফুলহার নদের মাধ্যমে পুনর্সরবরাহ করা হবে। মেচী নদীতে একটি বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে যার ফলে উত্তর বঙ্গ ও বিহারে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। তা ছাড়া সিকিমে দুটি জলবিদ্যুৎ বাঁধ তো আছেই- একটি কুলেসানিতে ও অন্যটি উজানের দিকে। ভারত সরকার তিস্তায় আরও নতুন বাঁধ নির্মাণ করার পরিকল্পনা করছে। একের পর এক বাঁধ নির্মাণের কারণে পানিপ্রবাহ মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। এর ফলে নদীতে পলি জমছে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে। ভাঙন তীব্রতর হয়েছে এবং পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। উজানে বাঁধ দিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তিস্তা মহানন্দার প্রায় সব পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এক সময়ের প্রমত্তা তিস্তা ক্রমশ কার্যত একটি মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। শুকনো মৌসুমে এখন গজলডোবা পয়েন্ট দিয়ে ৫০০ কিউসেকেরও কম পানি আসছে।
তিস্তা নিয়ে তৎকালীন সরকার ভারতের সঙ্গে ১৯৮৩ সালে অন্তর্বর্তীকালীন একটি চুক্তি হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ৩৬% ভারত ৩৯% আর বাকি অংশ ২৫%শতাংশ পানি নদীর নাব্য বজায় রাখার জন্য। ১৯৮৫ সালে এ অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিটি শেষ হয়। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আরও দুই বছর চুক্তি বাড়ানো হয়। ভারতের অসহযোগিতার কারণে তারপর আর কোনো চুক্তি হয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের সময় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপধ্যায় একই সঙ্গে বাংলাদেশে আসার কথা ছিল হঠাৎ করেই বাংলাদেশ সফরের আগ মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপধ্যায় আর এলেন না।
মনমোহন সিং বললেন তিনি মমতা বন্দ্যোপধ্যায়কে ছাড়া তিনি তিস্তার পানিচুক্তি করবেন না। সেই সময় তিস্তা চুক্তিটি চূড়ান্ত করা হয়েছিল। সেই চুক্তির সময়কাল ধরা হয়েছিল ১৫ বছর। ওই চুক্তি অনুসারে তিস্তা নদীর পানির ওপর ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ ভারতের এবং ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাংলাদেশর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতো। শেখ হাসিনা সরকার যখনই তিস্তার চুক্তি চূড়ান্ত করতে গেছেন তখনই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেওয়া মমতার চিঠির মাধ্যমে বাধা সৃষ্টি হয়। মমতার চিঠির বক্তব্য ছিল এ রকম, ‘ফারাক্কা চুক্তির কারণে আমরা ১৯৯৬ সাল থেকে কষ্ট ভোগ করছি। বাংলার পানি বিক্রি দেওয়ার অর্থ হলো আগামী দিনে গঙ্গার ভাঙন বাড়বে মানুষের ঘরবাড়ি তলিয়ে যাবে। ফারাক্কায় ড্রেজিং না করার ফলে কলকাতা বন্দরের নাব্য কমে গেছে। টান পড়েছে লাখ লাখ মানুষের জীবিকায়। তিস্তায় পানি নেই। সেখান থেকে পানি দিলে খাবার পানি পাবে না। বিশাল অংশের মানুষের কৃষি কাজে সমস্যা হবে। অর্থাৎ রাজ্যের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে কোনোভাবেই পানি দেওয়া সম্ভব নয়।’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চুক্তি বিরোধিতামূলক এই পত্রের পানি চুক্তিটি চূড়ান্ত লাভ করেনি।
তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া যাচ্ছে না বিধায় কৃষি কাজে সেচ ব্যবহার করার লক্ষ্যে লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা উপজেলার গাডীমারী ইউনিয়নের দোসানি গ্রামে ১৯৭৯ সালে তিস্তা ব্যারাজের কাজ শুরু করা হয়। ১৯৯০ সালে মূল বাঁধ নির্মাণ কার্যক্রম শেষ হয়। অন্যান্য কাজ বাকি থাকে। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ অংশে পূর্ণাঙ্গ তিস্তা ব্যারাজের বাঁধের কাজ সম্পূর্ণ হয়। ৬১৫ দশমিক ২৪ মিটার দীর্ঘ এই বাঁধের উদ্দেশ্য ছিল ৬ লাখ কিউসেক পরিমাণ পানি শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা। ৭টি জেলার ৩৫টি উপজেলার ১৩ লাখ ৩৫ হাজার একর জমি সেচের আওতায় এনে ফসল ফলানোর লক্ষ্যে ১৯৫৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বৃহৎ তিস্তা প্রকল্পের আওতায় তিস্তা বাঁধ নির্মাণের সূত্রপাত করে। এতে বোঝা যাচ্ছে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই তিস্তা নিয়ে দুই দেশের মাঝে দেনদরবার চলে আসছে। তিস্তা ব্যারাজ করে পানি সংকট নিরসনে কাঙ্ক্ষিত ফল আসছে না। কিন্তু পানির বিষয়টির সুরাহা তো হলো না। সমস্যা রয়েই গেল।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআইর দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিস্তার প্রসঙ্গ নিয়ে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে মতপার্থক্য দূর করার উপায় ভারতের সঙ্গে আলোচনা করবে অন্তর্বর্তী সরকার। বিষয়টি দীর্ঘদিন ঝুলে আছে এতে কোনো দেশেরই লাভ হচ্ছে না।
ঢাকায় নিজ বাসভবনে পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টনের বিষয়টি অবশ্যই হতে হবে। তিনি বলেন বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশগুলোর অধিকার সমুন্নত রাখার সুনির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে। তিনি আরও বলেন বিষয়টি নিয়ে বসে থাকার ফলে এটা কোনো কাজে আসছে না। আমি যদি জানি যে কতটুকু পানি পাব তাহলে এটি ভালো হতো। এমনকি পানির পরিমাণ প্রাপ্তিতে যদি খুশি না হই তাতে সমস্যা নেই। বিষয়টি সমাধান দরকার। তিনি আরও বলেন, ২০১১ সালে ঢাকায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর অনেকটা চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই চুক্তিকে অনুমোদন দিতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে আর চুক্তি হয়নি। মমতার বক্তব্য ছিল তার রাজ্যের পানির সংকট রয়েছে।
এটা নতুন কোনো বিষয় নয় বরং খুবই পুরোনো বিষয়। আমরা বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে কথা বলেছি। পাকিস্তান শাসনামল থেকেই এ নিয়ে আলোচনা শুরু। আমরা সবাই যখন এই চুক্তি চূড়ান্ত করতে চেয়েছি এমনকি ভারত সরকারও প্রস্তুত ছিল তখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার এর জন্য তৈরি ছিল না। আমাদের এটির সমাধান করতে হবে।
বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশগুলোর নির্দিষ্ট অধিকার সমুন্নত রাখতে চাওয়ার অধিকার থাকার বিষয়টি পুনঃব্যক্ত করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি আরও বলেন আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মেনে এ বিষয়ে সমাধান করতে হবে। ভাটির দেশগুলোর নির্দিষ্ট কিছু অধিকার রয়েছে এবং আমরা সেই অধিকার চাই।
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা অধিকার আদায়ে সোচ্চার মনোভাব, নতজানু পরারাষ্ট্রনীতির ঊর্ধ্বে থেকে
তিস্তার ন্যায্য পানির হিস্যার একটা সমাধান আসতে পারে বলে- বাংলাদেশের জনগণ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের অপেক্ষায় থেকে আমরা ধৈর্যধারণ করি।
লেখক: সাবেক ব্যাংকার ও কলামিস্ট
মনে করেছিলাম সরকার পরিবর্তনের পর দেশে ভোগ্যপণ্য দ্রব্যের মূল্য কমে আসবে। কই বাজারে গেলে জিনিসপত্রের দাম বিশেষ করে তরিতরকারি, চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, বেগুন, মাছ ইত্যাদি আকাশছোঁয়া মূল্য বেড়েছে যা গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য কষ্টকর। ইলিশ মাছ কেন, যেকোনো মাছের দাম এত ব্যাপকভাবে বেড়েছে তা কল্পনাতীত। এখন বাজার মনিটরিং থেকে ভোক্তা অধিকার উধাও। সরকারের সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের কোনো নজরদারি চোখে পড়ে না।
এদিকে বাজারে চড়া হারে মূল্যবৃদ্ধিতেই মাথাপিছু খরচ অনেক বেড়েছে। আয় কম থাকায় খাবারের থালা বা প্লেটে কোপ। খাদ্য সুরক্ষা নিয়ে বঞ্চনার প্রশ্ন আজও পুরো মাত্রায় বহাল রয়ে গেছে। দ্রব্যমূল্য বা ভোগ্যপণ্য বৃদ্ধি জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ কারার জন্য দেশের কৃষিশিল্প এবং আমদানি-রপ্তানির উন্নতির যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। মজুতদার কালোবাজারিদের কঠোর হস্তে দমন করতে পারলে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা সম্ভব। তারপরও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে সমাজের দারিদ্র্য পীড়িত মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না।
মানুষকে প্রতিদিনই নানাবিধ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে হয়। আর এরূপ কেনাকাটা যদি তার আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তবে তার বা তাদের দুরবস্থার সীমা থাকে না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে যে আর্থিক সংকটের সৃষ্টি হয় তাতে শিক্ষার্থীদের জীবনেও প্রভাব পড়ে যেমন- খাদ্য, পোশাক, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদির অভাব প্রকট হয়ে দেখা দেয়। প্রান্তিক মানুষের কথা বাদই দিলাম। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেও আজ নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। শুধু সোয়াবিন নয়, সরিষার তেলের দামও যেভাবে বেড়েই চলছে তাতে সাধারণ মানুষের বাসায় তেল মেখে আলু সিদ্ধ ভাত খাওয়াও যেন আজ বিলাসিতা মনে হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য আকাশছোঁয়া, দরিদ্র মধ্যবিত্তের বেঁচে থাকা এখন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি আর নতুন কথা নয়। প্রায় সারা বছর মূল্যবৃদ্ধির আঁচে সাধারণ মানুষের হাত পুড়েই চলছে। দফায় দফায় রান্না করার সিলিন্ডারের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে দুর্বিসহ করে তুলছে।
তারপর দেশে অনেক প্রবীণ ও বয়স্ক মানুষ রয়েছেন, যারা পেনশন বা বেকার ভাতাও পান না। তাদের দুরবস্থার কথা কেউ কি ভেবে দেখেন। কেউ হয়তো বা এক হাজার টাকা ভাতা পেলে পেতেও পারেন আবার অনেকে তাও পান না। কারও অবসরের সময় প্রাপ্ত টাকা ব্যাংকে রেখে সুদের টাকায় সংসার চালান। দিন দিন সুদও ক্রমহ্রাসমান। ওষুধের খরচ আছে। মূল্য বৃদ্ধির মুখে এদের সাহায্যে কেউ তো এগিয়ে আসে না। বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন ভাতা বণ্টনে ছিল ব্যাপক অনিয়ম। সরকারের রাজস্ব প্রয়োজনে হতে পারে কিন্তু সঙ্গে নাগরিক সমাজ যাতে মূল্যবৃদ্ধি এবং করের বোঝায় জর্জরিত না হয়ে পড়ে, সেটা দেখাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আশা করি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গরিব-দুঃখীদের কথা মাথায় রেখে বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখতে চেষ্টা করবেন পাশাপাশি প্রবীণদের চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা ভাতা প্রদানে সচেষ্ট হবেন এ আশাই করছি।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে কলঙ্কের ছাপ যেন ঘোচানোই যাচ্ছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী হচ্ছে এসব? মাঝে মাঝে এমন সব ঘটনা মিডিয়ায় চলে আসে যা গোটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদাসীনতা ও বিরাট ক্ষতচিহ্নের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে এবং জাতির সামনে এমন উদাহরণ সৃষ্টি করবে যা অনেক প্রতিষ্ঠানে অহেতুক সরকারি হস্তক্ষেপকে বাদ দিয়ে সেসব জায়গাতেও যাতে স্বায়ত্তশাসন চালু করা হয়। কিন্তু প্রশাসনের কাজ দেখে সবাইকে স্তম্ভিত হতে হয় এবং স্বায়ত্তশাসন এবং সরকারি কিংবা বাইরের হস্তক্ষেপকে যেন আরও উৎসাহ জোগায়।
দৈনিক আমাদের বার্তা ও দৈনিক শিক্ষা ডটকম একটি চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে গত ২৭ সেপ্টেম্বর। সেখানে বলা হয়েছে যে, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে চাকরি পাওয়া তো দূরের কথা, আবেদন করার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই তার! প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য হওয়ায় সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিয়োগ-প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিয়ে ঠেকানো যায়নি তাকে। নানা কৌশল কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক পদে ঠিকই নিয়োগ বাগিয়ে নেন তিনি। পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন সহকারী অধ্যাপকও। আলোচিত এই শিক্ষকের নাম মো. ইউসুফ।
তার নিয়োগ-প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে উঠেছে প্রশ্ন। নিয়োগের ক্ষেত্রে তাকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৎকালীন বাছাই ও নিয়োগ বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। তবে অভিযুক্ত শিক্ষকের দাবি, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া যোগ্যতা অনুযায়ী তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। এক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটে থাকলে সেজন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রস্তুতকারীরা দায়ী বলে উল্টো অভিযোগ তুলেছেন তিনি।
অধ্যাপক মো. ইউসুফের নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মো. গোলাম রব্বানী। গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রারসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগও জমা দিয়েছেন তিনি। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপকের (স্থায়ী) একটি পদের জন্য যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়; তাতে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়- এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার যেকোনো একটি ন্যূনতম ‘এ’ (৫.০০ পয়েন্টভিত্তিক গ্রেড সিস্টেমে সিজিপিএ বা জিপিএ ন্যূনতম ৪.০) থাকতে হবে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অভিযুক্ত ইউসুফ এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ‘বি’ গ্রেড পেয়েছেন।
এর মধ্যে এসএসসির গণিতে ‘সি’ এবং এইচএসসির ইংরেজিতে ‘ডি’ গ্রেড পেয়ে পাস করেছেন টেনেটুনে। স্নাতকে উত্তীর্ণ হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। এসএসসি ও এইচএসসির কোনোটিতেই জিপিএ ৪ পাননি ইউসুফ। এই দুই পরীক্ষায় তার জিপিএ যথাক্রমে ৩.৫০ এবং ৩.০১। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী, ওই পদে আবেদনের যোগ্যতাই ছিল না মো. ইউসুফের। দুটো বেসিক বিষয়ে তার যে গ্রেড, তা পুরো জাতিকে স্তম্ভিত করে! কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া ‘ছেলের হাতের মোয়া নয়।’ শিক্ষকতায় তো যাকে তাকে ঢোকানো আর জাতি ধ্বংস করা এক কথা। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের কম্প্রোমাউজ করতে হয়, কারণ কঠিন বিষয়ের শিক্ষক পাওয়া যায় না, মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসতে চায় না, শিক্ষকতার প্যাকেজও আকর্ষণীয় নয় এসব কারণে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেবারেই অনুপযুক্ত শিক্ষক কেন নিয়োগ দেওয়া হবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, যোগ্যতা না থাকলেও সবাইকে ম্যানেজ করে পরীক্ষার জন্য আবেদন এবং ভাইভা পরীক্ষায় অংশ নেন ইউসুফ। নিয়োগও বাগিয়ে নেন। এক্ষেত্রে আদালকেও ব্যবহার করেছেন তিনি। ইউসুফকে নিয়োগ দিতে কেবল শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রেই নয়, পুরো নিয়োগ-প্রক্রিয়ার পদে পদে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, আইন অনুযায়ী বিভাগের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষকের সমন্বয়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্ল্যানিং কমিটির গঠনের কথা থাকলেও তা না করেই ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া বাছাই বোর্ডের সদস্যরাও যোগ্যতাবিহীন ইউসুফকেই নিয়োগের সুপারিশ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, একটি পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও নিয়োগ-সংক্রান্ত বাছাই কমিটি ইউসুফ ছাড়া আরও দুজনকে নিয়োগের সুপারিশ করে।
কিন্তু ২০১৩ সালের ৪ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬তম সিন্ডিকেট সভায় বাছাই বোর্ডের সুপারিশ পর্যালোচনা করা হয়। সিন্ডিকেট সদস্যরা বাছাই বোর্ডের সুপারিশে বেশ কিছু অসংগতি খুঁজে পান। প্রথমত, ইতিহাস ও প্রত্মতত্ত্ব বিভাগীয় অধ্যাপক পদের কোনো অস্তিত্ব নেই। অথচ বাছাই বোর্ড তৃতীয় মনোনীত প্রার্থীকে অধ্যাপক পদের বিপরীতে নিয়োগ প্রদানের সুপারিশ করেছে।
দ্বিতীয়ত, একটি প্রভাষকের পদ বিজ্ঞপ্তি করে দুজন প্রার্থীকে নিয়োগ প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বাছাই বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী তিনজন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দ্বিতীয় প্রার্থী মো. ইউসুফের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ‘বি’ গ্রেড, স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি থাকায় নিয়োগের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারে না। সিন্ডিকেট সভায় উপস্থিত সব সদস্যের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে পদ পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জন্য সৃষ্ট দুটি প্রভাষকের স্থায়ী পদে বাছাই বোর্ডের সুপারিশকৃত প্রথম ও তৃতীয় প্রার্থী যথাক্রমে মো. মনিরুজ্জামান ও মো. আকতারুল ইসলামকে নিয়োগ প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সিন্ডিকেট অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পরও কৌশল খুঁজতে থাকেন ইউসুফ। সহযোগিতা নেন তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ইকবাল শাহ রুমি ও তৎকালীন ভিসি প্রফেসর এ কে এম নুর-উন নবীর। তাদের সহযোগিতা নিয়ে ইউসুফ অবৈধ উপায়ে বাছাই বোর্ডের সুপারিশসহ তার নিয়োগ-সংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালযের সিদ্ধান্তের গোপন সব নথি সংগ্রহ করে ২০১৪ সালে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন। তবে কী কারণে সিন্ডিকেট তাকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে সে বিষয়টি চেপে যান। ২০১৯ সালে আদালত ইউসুফের পক্ষে রায় দেন। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ ওই রায়ের বিপক্ষে আপিল না করায় ওই বছরই প্রভাসক হিসেবে নিয়োগ পান ইউসুফ।
এ বিষয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. গোলাম রব্বানী বলেন, ইউসুফ রিট পিটিশন করলেও কেন তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তা তিনি আদালতকে অবগত করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এ বিষয়ে আদালতকে অবগত না করায় এক তরফা রায় পান ইউসুফ। যারা এই নিয়োগের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই আইন অমান্য করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে রংপুর বারের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম বুলেট বলেন, ইউসুফের নিয়োগ সুপারিশ সিন্ডিকেট বাতিল করার বিষয়টি চ্যান্সেলরকে না জানিয়ে কৌশলে তৎকালীন ভিসি তাকে (ইউসুফকে) আইনি সুবিধা পেতে সহযোগিতা করেছেন। আবার রায়ের পর আপিল না করার বিষয়টিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের পরিপন্থি। বিষয়টি পুকুর চুরি। শিক্ষাব্যবস্থাকে এভাবে মেধাহীন ও ধ্বংস করেছে বিগত সরকার।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক ইউসুফ সাংবাদিকদের বলেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি শর্তাবলির ‘ঘ’ তে বল হয়েছে কোনো পরীক্ষায় ‘বি’ গ্রেডের নিচে অথবা তৃতীয় বিভাগ/শ্রেণি গ্রহণযোগ্য হবে না। সে অনুযায়ী আমি আবেদনের যোগ্য। সেজন্যই আমাকে বাছাই বোর্ড সুপারিশ করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে শর্তাবলি (গ) নয় শর্তে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় যেকোনো একটিতে ন্যূনতম ‘এ’ এবং জিপিএ ন্যূনতম ৪.০ থাকতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা সার্কুলারের দুর্বলতা। এর দায় আমার নয়।’ তিনি আরও বলেন, বাছাই বোর্ডের সুপারিশ সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেট বাতিল করতে পারে না। সে কারণে আমি উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হই। আদালতের আদেশে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছি। আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত ভিসি ড. শওকত আলী সাংবাদিকদের জানান অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কমিটি করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি নিয়ে রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথ বলার কথাও জানান তিনি।
বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে সেটি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন উঠছে। একজন পাওয়ারফুল শিক্ষকের পছন্দের একজন শিক্ষার্থীকে তার বিভাগের শিক্ষক বানানো, ভিসি যে প্যানেলের লোক সেই প্যানেলকে ভারি করার জন্য যেনতেন প্রকারের যোগ্যতার লোকদের শিক্ষক বানানো, কে কোন পার্টি করে সেটি দেখে শিক্ষক নিয়োগ। আবার একাডেমিক রেজাল্ট খুব ভালো কিন্তু উপস্থাপন দক্ষতা, সামাজিকতা, বাইরের জ্ঞান সীমিত ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে শুধু ভিসির ইচ্ছায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ-প্রক্রিয়া বাদ দিতে হবে। কারণ ভিসিরা সেরকম সততার পরিচয় দিতে পারেননি। শিক্ষক নিয়োগ হতে হবে কেন্দ্রীয়ভাবে যেখানে ফলসহ সবকিছুই নিরপেক্ষভাবে দেখে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। যে শিক্ষকের কথা আমরা এখানে জানলাম উনি পড়াবেন, কেন পড়াবেন, কীভাবে পড়াবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের? জাতি ধ্বংসের এই প্রক্রিয়ায় যুক্তদের আইনের আওতায় আনতে হবে, নতুবা এই অনিয়ম থেকে উচ্চশিক্ষাকে বাঁচানো যাবে না।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক (সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজের শিক্ষক, চিফ অব পার্টি ব্র্যাক এডুকেশন এবং কান্ট্রি ডিরেক্টর-ভাব বাংলাদেশ।
ব্যাংকিং খাত অর্থনীতির প্রাণ। দেশের আর্থিক খাত খুব একটা বড় নয়, পুঁজিবাজার দুর্বল, ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক খাতও শক্তিশালী নয়; সে কারণে অর্থের ৯০ শতাংশই ব্যাংক খাত থেকে আসে। স্বাধীনতার পর দেশের উদ্যোক্তাশ্রেণি তৈরি করেছে এই ব্যাংক খাত। কিন্তু এই খাত ধীরে ধীরে দুর্বল হয়েছে। অর্থনীতিতে নতুন সরকারের নানা চ্যালেঞ্জ আছে। সরকার শক্ত হাতে এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে, অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরানোর বিষয়টি তার ওপর নির্ভর করছে। দেশের মানুষের নৈতিক মানের অবক্ষয় হয়েছে, মূল্যবোধও কমে গেছে। ব্যাংকিং খাতের লোকজনদের মধ্যে এটি প্রকট।
খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ব্যাংকিং খাতে অনেক ধরনের সমস্যা আছে। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা। সেটা হলো ব্যাংকিং খাতের যেসব নীতিমালা আছে, সেগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করা হয় না। ক্যামেলস রেটিং অনুসারে ব্যাংকের স্বাস্থ্য পরিমাপের যেসব সূচক, যেমন মূলধন পর্যাপ্ততা, তারল্য, খেলাপি ঋণ, সম্পদ, ব্যবস্থাপনা, এসব ক্ষেত্রে নীতিমালা পরিপালিত হয় না। যদিও আলোচনা কেবল খেলাপি ঋণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মূলধনের পর্যাপ্ততা আরেকটি বড় সমস্যা। আন্তর্জাতিক নীতিমালা বা ব্যাসেল অনুযায়ী যে পরিমাণ মূলধন থাকার কথা, তা কিন্তু সবাই মানতে পারে না। বিশেষ করে ১০-১২টি ব্যাংকের এই মূলধন অপর্যাপ্ততা আছে।
সংকটে পড়া সাত ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার তারল্য-সহায়তা চেয়েছিল। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক ৫ হাজার কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২ হাজার কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৭ হাজার ৯০০ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংক ১ হাজার ৫০০ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক সাড়ে ৩ হাজার কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ৫ হাজার কোটি ও এক্সিম ব্যাংক ৪ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জর্জরিত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ ছাড়া মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান নগদেও প্রশাসক বসানো হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ইতোমধ্যে পরিবর্তন করা হয়েছে। এর সবকটি ব্যাংক এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ও নিয়ন্ত্রণে ছিল। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার আত্মগোপনে চলে যান। এরপর গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি যোগ দিয়েই ব্যাংক খাতের সংস্কারে মনোযোগ দেন।
গত ২০ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ১১টি ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এর মধ্যে আটটি ব্যাংক তারল্য-সংকটে ভুগছে। তবে ছয়টি ব্যাংকের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাদের অনেক শাখায় নগদ টাকার লেনদেন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আমানতকারীদের চাপে শাখা ব্যবস্থাপকসহ ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা প্রতিদিনই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। গ্রাহকরা প্রয়োজনে দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গেলে সমস্যা বাড়ছে। অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে, এমন ১০টি ব্যাংক আর্থিক অনিয়মে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। তাদের এই ঋণে গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা ঋণের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন দিনের মধ্যে টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি ও বাজারভিত্তিক সুদ চেয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেওয়া ঋণের টাকা ফেরত চাইলে সবল ব্যাংকগুলোকে তিন দিনের মধ্যেই তা ফেরত দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংক ঋণ দেওয়ার জন্য কোনো টাকা নিতে পারবে না। কোন ব্যাংককে কত টাকার তারল্য-সহায়তা দেওয়া হবে, সেটি নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ ছাড়া দুই ব্যাংকের সমঝোতার ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত তারল্য থাকা যে ১০ ব্যাংক ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ব্র্যাক, ইস্টার্ন, দি সিটি, শাহ্জালাল ইসলামী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, সোনালী, পূবালী, ঢাকা, ডাচ্-বাংলা ও ব্যাংক এশিয়া। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে যেসব ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে, সেগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ব্যবস্থায় তারল্য-সহায়তা দিয়েছে। প্রথম ধাপে ৯৪৫ কোটি টাকা ধার পেয়েছে চার ব্যাংক। এতে সুদের হার ধরা হয়েছে সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ। ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির (নিশ্চয়তা) বিপরীতে ইস্টার্ন ব্যাংক (ইবিএল), দ্য সিটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি), ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক এই ধার দিয়েছে। এর মধ্যে সিটি ব্যাংক একাই দিয়েছে ৭০০ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৩০০ কোটি টাকা ধার পেয়েছে। এর মধ্যে সিটি ব্যাংক ২০০ কোটি টাকা এবং এমটিবি ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৫০ কোটি টাকা করে দিয়েছে। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংককে সিটি ব্যাংক ৩০০ কোটি টাকা ও এমটিবি ৫০ কোটি টাকা দিয়েছে। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংককে ২৫ কোটি টাকা দিয়েছে ইস্টার্ন ব্যাংক। ন্যাশনাল ব্যাংক পেয়েছে ২৭০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে সিটি ব্যাংক ২০০ কোটি টাকা, এমটিবি ৫০ কোটি টাকা ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক ২০ কোটি টাকা দিয়েছে। এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ফলে তারল্য-সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে গ্যারান্টির বিপরীতে যে টাকা ধার নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে তার ২৫ শতাংশ তারা প্রথম ধাপে পেয়েছে। এতে ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে আর টাকা ধার দেওয়া হবে না। তখন কৌশল পরিবর্তন করা হবে। ধার নেওয়া দুর্বল ব্যাংকগুলোকে লিখিত ও মৌখিক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ব্যক্তি আমানতকারীরা টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবেন। এই টাকা দিয়ে অন্য ব্যাংকের ধারের টাকা শোধ করা যাবে না। ব্যাংকের আগের বা বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের কেউ জমানো টাকা তুলতে পারবেন না। নতুন করে কোনো ঋণ দেওয়া যাবে না। ডলার কেনার কাজেও এই টাকা খরচ করা যাবে না।
সারা বিশ্বে সম্পদমূল্যের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকগুলো বিশেষ তারল্য-সহায়তা পায়। বাংলাদেশে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোর সম্পদমূল্য ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। ফলে নতুন উপায়ে এসব ব্যাংককে তারল্য-সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের পর ক্ষুদ্র ও বড়, সব ধরনের আমানতকারী টাকা তোলার জন্য ব্যাংকগুলোতে ভিড় করছেন। এতে বেশির ভাগ ব্যাংকে তারল্য-সংকট আরও প্রকট হয়ে ওঠে এবং সবাই টাকা পাচ্ছেন না। ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া চলতি হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি থাকায় কয়েকটি ব্যাংকের চেক ক্লিয়ারিং সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে।
এসব ব্যাংকের গ্রাহকেরা এটিএম বুথ থেকেও টাকা তুলতে পারছেন না। এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক খাত রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। মানুষের মনে এক ধরনের ভীতি আছে। অনেকেই জানতে চান, কোন ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ? নতুন সরকার আসার পর মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হলেও অনিশ্চয়তার বোধ এখনো আছে। সে জন্য বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। এ ছাড়া কোনো ব্যাংককে কি ব্যর্থ হতে দেওয়া হবে না। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, সে রকম পরিকল্পনা নেই। যত রুগ্ণই হোক, কোনো ব্যাংককে মরতে দেওয়া হবে না। সেটা হলে পরিষ্কার বার্তা দেওয়া দরকার।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এসব ব্যাংককে কীভাবে সহায়তা দেওয়া যায়, তা দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের সহায়তা প্রয়োজন হবে না। ফলে সহায়তার আকার অর্ধেক কমে গেছে। এসব ব্যাংকের আমানতকারীরা ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছেন। এক বছর সময় দিলে এই ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াবে। তবে গ্রাহকেরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে টাকা উত্তোলন করতে গেলে সমস্যা বাড়বে। ব্যাংক খাতের সংস্কারে আগে কমিশন করার দরকার ছিল। কিন্তু এখনই কমিশন করলে ছয় মাস সময় লেগে যাবে। এর মধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করে কাজ শুরু করলে তা অনেকটা এগিয়ে যাবে। আর্থিক খাতে সমস্যা কী সেটা জানা থাকায় কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে, ইতোমধ্যে একটি গঠন করা হয়েছে। ব্যাংক আইন সংস্কার এখনই হবে তা নয়। তিন টাস্কফোর্সের সুপারিশের পর আইন পরিবর্তনের জন্য সরকার ব্যবস্থা নেবে। দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কমে আসুক, এটা আমরা সবাই চাই। বিশ্ববাজারে এসব ব্যাংকের কোনো দাম নেই। অনেক দেশে ৬০টি ব্যাংক ছিল, তা ১৫টিতে নামিয়ে এনেছে। কিন্তু দেশে এমন কিছু করতে হলে স্থানীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় আছে। ব্যাংক একীভূত বা অধিগ্রহণ স্বেচ্ছায় হলে ভালো। না হলে সরকারি পর্যায়ে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশে পুনর্গঠন হয়ে ইস্টার্ন ব্যাংক গঠন একটি ভালো উদাহরণ। এ জন্য সময় প্রয়োজন হবে। এক-দুই মাসে এসব বাস্তবায়িত হবে না। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য একধরনের নীতি গ্রহণ হবে। তাদের ব্যবসার ওপর নির্ভর করে নীতি সংশোধন করা হবে। যারা ভালো ব্যাংক, তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে টাকা দেয়।
দুর্বল ব্যাংককে কী পরিমাণ টাকা দেওয়া হবে, শর্ত কী, এসব নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। দুর্বল ব্যাংকের স্বাস্থ্য অনুসারে কত টাকা দেওয়া হবে, কী শর্তে দেওয়া হবে, বাংলাদেশ ব্যাংক তা ঠিক করবে। কিন্তু ব্যাংকগুলোতে যখন নিরীক্ষা হবে, তখন যদি দেখে, কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই দুর্বল ব্যাংককে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তাহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কোনো ব্যাংক অর্থ ফেরত দিতে না পারলে গ্যারান্টার হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যাবে। এটা খুবই বিব্রতকর হবে যে, অর্থ ফেরত চাইতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। এটি কোনোভাবেই সুখকর পরিবেশ তৈরি করবে না। এখন প্রশ্ন, এভাবে তারল্য-সহায়তা দিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব?
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট