দুর্গা, যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করেন; অন্য মতে, ‘যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন’, তাকে সনাতন হিন্দুরা মহাশক্তির একটি উগ্র রূপ মনে করেন। তার অন্য নামগুলো হচ্ছে চণ্ডিকা, যোগমায়া, অম্বিকা, বৈষ্ণবী, মহিষাসুর সংহারিণী নারায়ণী, মহামায়া, কাত্যায়নী ইত্যাদি। দেবী দুর্গার অনেকগুলো হাত। তার অষ্টাদশভুজা, ষোড়শভুজা, দশভুজা, অষ্টভুজা ও চতুর্ভুজা মূর্তি দেখা যায়। তবে দশভুজা রূপটিই বেশি জনপ্রিয়। তার বাহন সিংহ (কোনো-কোনো মতে বাঘ)। মহিষাসুর মর্দিনী-মূর্তিতে তাকে মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধরতা অবস্থায় দেখা যায়।
হিন্দুধর্মে দেবী দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের জননী এবং কালীর অন্য রূপ। বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলোতে এবং আগমনী গানে দুর্গারূপে শিবজায়া হিমালয় দুহিতা পার্বতীর সপরিবারে পিতৃগৃহে অবস্থানের আনন্দময় দিনগুলোর (দুর্গাপূজা) এবং তার বিবাহিতা জীবনের অপূর্ব বর্ণনা পাওয়া যায়।
দুর্গার আরাধনা বাংলা, অসম, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড এবং বিহারের কোনো কোনো অঞ্চলে প্রচলিত। ভারতের অন্যত্র দুর্গাপূজা নবরাত্রি উৎসবরূপে উদ্যাপিত হয়। বছরে দুবার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে- আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজা। সম্ভবত খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় দুর্গোৎসব প্রবর্তিত হয়। জনশ্রুতি আছে, রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ প্রথম মহাড়ম্বরে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন।
নানারূপে দেবী
দুর্গা মূলত শক্তির দেবী। ঋগ্বেদে দুর্গার বর্ণনা নেই, তবে ঋগ্বেদোক্ত দেবী সূক্তকে দেবী দুর্গার সূক্ত হিসেবেই মান্যতা দেওয়া হয়। দুর্গার বিশেষ আলোচনা ও পূজা বিধি তন্ত্র ও পুরাণেই প্রচলিত। যেসব পুরাণ ও উপ-পুরাণে দুর্গা সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে: মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবী পুরাণ, কালিকা পুরাণ ও দেবী ভাগবত। তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও রূপে পূজিতা হন।
দেবী দুর্গা শাক্ত ধর্মে সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবী, বৈষ্ণব ধর্মে তাকে ভগবান বিষ্ণুর অনন্ত মায়া হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয় এবং শৈব ধর্মে দুর্গাকে শিবের অর্ধাঙ্গিনী পার্বতী হিসেবে অর্চনা করা হয়। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। কেনোপনিষদে বর্ণিত হৈমাবতীকে দুর্গা হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে; ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের যোগমায়াকে দুর্গা আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যিনি হরি সহায়িনী তথা হরিভক্তি প্রদায়িনী। এসব ছাড়াও দুর্গা দেবীর বর্ণনা মহাভারতের বিরাট পর্ব ও অন্যান্য পুরাণে পাওয়া যায়। দুর্গা দেবীর ভিন্ন-ভিন্ন অবতারগুলো হচ্ছে: কালিকা, নন্দা, ভ্রামরী, শাকম্ভরী, রক্তদণ্ডিকা, সতী, পার্বতী, কৌশিকী ইত্যাদি।
বিদেশে
জাপানি দুর্গা বা ‘জুনতেই ক্যানন (Juntei Kannon)Õ ১৮ হাতের দুর্গা রূপ। মহাযান পরিব্রাজকদের হাত ধরে দেবীর এই রূপ জাপানে পৌঁছায় ৭০০ শতাব্দীর কাছাকাছি। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে।
সিন্ধু সভ্যতায় তথা ব্যবিলনীয় সভ্যতায় উল্লেখ পাওয়া যায় এই মাতৃপূজার। মাতৃপূজাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির আদি পর্ব থেকে শুরু সিংহবাহিনী দেবীর পূজা। মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতায় খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী ইনান্নার। কুশান রাজা কনিষ্কের মুদ্রাতেও খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী নানার। তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রচলিত ছিল এই দেবীর মাহাত্ম্য। এখনো দেবী চণ্ডী ‘বিবি নানা’ হিসেবে এসব অঞ্চলে পূজিত হন।
শাক্ত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ হয় খ্রিষ্টীয় ৪০০-৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। খ্রিষ্টীয় ৪০০ অব্দে রচিত হয় শাক্ত মহাপুরাণের অন্যতম গ্রন্থ দেবীমাহাত্ম্য। এ সময়েই মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১-৯৩ অধ্যায়গুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় এই গ্রন্থ। দেবীমাহাত্ম্য গ্রন্থেই প্রথম বিভিন্ন নারী দেবতাসংক্রান্ত নানান পুরাণ-কথা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক উপাদানগুলো একত্রিত করা হয়। দেবীমাহাত্ম্য গ্রন্থে বৈদিক পুরুষতান্ত্রিক দেবমণ্ডলীর সঙ্গে সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব নবম সহস্রাব্দ থেকে বিদ্যমান নৃতাত্ত্বিক মাতৃপূজা কেন্দ্রিক সংস্কৃতির এক সম্মিলনের প্রয়াস লক্ষিত হয়। এর পরবর্তী হাজার বছর এই ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে।
বৌদ্ধ ধর্মের হাত ধরে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তিব্বত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও মঙ্গোলিয়ায়। কম্বোডিয়া আর ইন্দোনেশিয়ায় দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য পূজিত হতে শুরু করে হিন্দু ধর্মের প্রসারের সাথে সাথে। অ্যাংকর যুগের (১০১০ শতাব্দের) পূর্বে কম্বোডিয়ায় মহিষাসুর মর্দিনীর পূজার প্রচলন ছড়িয়ে পড়ে হিন্দু ধর্মের হাত ধরে। এ সময় যে দুর্গা মূর্তিগুলো কম্বোডিয়া থেকে উদ্ধার হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই চতুর্ভুজা এবং মহিষাসুর মর্দিনী। মূর্তিগুলোর বৈশিষ্ট্যাবলি হচ্ছে, এখানে মহিষাসুর মর্দিনী দুর্গা বিষ্ণুর ক্ষমতা ধারণ করেছেন, যা তার চতুর্ভুজের শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম থেকে প্রতিষ্ঠিত।
জাভা ও ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অংশ থেকে উদ্ধার হয়েছে অনেক মহিষাসুর মর্দিনী মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ। এই মূর্তিগুলোর মধ্যে প্রাচীনতমটির তারিখ আনুমানিক অষ্টম শতাব্দী।
ইন্দোনেশিয়ার সেন্ট্রাল জাভাতে রয়েছে নবম শতাব্দীর বিখ্যাত হিন্দু মন্দির প্রাম্বানান। এই মন্দিরে রয়েছে এক জগৎ বিখ্যাত মহিষাসুর মর্দিনী মূর্তি। এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান, ইন্দোনেশিয়ায় বৃহত্তম হিন্দু মন্দির এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বড় মন্দির প্রাঙ্গণ। ১৫০০ থেকে ১৬০০ শতাব্দীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় মহিষাসুর মর্দিনীর পূজা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইসলামের আগমনের পর দুর্গার আরাধনা পাড়ি জমায় আরও পূর্বদিকে হিন্দু বালিতে।
দুর্গা পূজা
দুর্গাপূজা হচ্ছে শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দুর্গা দেবীর উপাসনার উৎসব। দুর্গাপূজা শরৎ (আশ্বিন) এবং বসন্ত (চৈত্র) ঋতুর শুক্ল পক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। মার্কণ্ডেয় চণ্ডী অনুযায়ী, দুর্গাপূজার প্রথম প্রচলন হয়েছিল বসন্ত ঋতুতে, রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি কর্তৃক। দেবী ভাগবত ও কালিকা পুরাণে উল্লেখ আছে, শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্র দুর্গাপূজা করেছিলেন রাবণ বধের নিমিত্তে; এ জন্য একে, ‘অকালবোধন’ও বলা হয়ে থাকে।
পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ডে দুর্গাপূজা বহুলভাবে উদ্যাপন করা হয়; উত্তর ভারতে এটি নবরাত্রী হিসেবে পালন করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের একাধিক রাষ্ট্র দুর্গাপূজা পালন করে এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাও সবাই দুর্গাপূজা পালন করে। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ দিন তথা ষষ্ঠী থেকে আরম্ভ করে দশমী পর্যন্ত হয়ে থাকে এই দুর্গোৎসব। এই পাঁচ দিন যথাক্রমে দুর্গা ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। এই পক্ষটিকে দেবীপক্ষ নামেও জানা যায়। পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন এই দেবীপক্ষের সূচনা হয়, একে মহালয়াও বলা হয়ে থাকে; আর পূর্ণিমার দিনটিকে লক্ষ্মী পূজার দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।
নাম ব্যুৎপত্তি
হিন্দুশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে:
‘দৈত্যনাশার্থবচনো দকার: পরিকীর্তিত:।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত ।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচক:।
ভয়শত্রুঘ্নবনশ্চাকার: পরিকীর্তিত।।’
অর্থাৎ, ‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, ‘গ’ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম বলেছে, ‘দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা’। অর্থাৎ, যিনি দুর্গ নামে অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনি সব সময় দুর্গা নামে পরিচিত। শ্রীশ্রী চণ্ডী অনুসারে যে দেবী ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যা:’ (সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি), তিনিই দুর্গা।
লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
বিশ্বের নবম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ যা আবার দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর বৃহৎ অর্থনীতি। ২০২৪ সালের হিসাবের ভিত্তিতে দেশের মোট জিডিপির আকার ৪৫০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৫৪ বছর বয়সের বাংলাদেশ এখনো অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হতে পারেনি। দেশের উন্নয়ন প্রকল্প ও ঘাটতি বাজেট পূরনের জন্য ও দেশটিকে বৈদেশিক সাহায্যদাতা সংন্থার উপর নির্ভরশীল হতে হয় যা কোনোভাবেই সম্মানজনক নয়। সরকারের বাজেট ঘাটতি প্রায় উন্নয়ন বাজেটের সমান এবং অর্থ অভাবে এডিপি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে উঠেনা। কোনো বছরেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়না। যেমন ২০২৪-২৫ বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, অর্জন হয়েছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা ও ঘাটতি রয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। আরও উল্লেখ্য যে কর জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশ দক্ষিন এশিয়ার সকলের নিচে অবস্থান করছে। অর্থ মন্ত্রনালয়ের তথ্যমতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের দেশি বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঋণের পরিমান উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। সরকারের ঋণের উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক, বিমা, ট্রেজারি বন্ড, সেভিং বন্ড, প্রাইস বন্ড ইত্যাদি। প্রতি বছর সরকার রাজস্ব টার্গেট পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। করের ফাঁকির পরিমাণ বেড়েছে, কর এলাকার প্রসার সঙ্কুচিত হয়েছে, পরোক্ষ করের উপর নির্রশীলতা বাড়ছে ইত্যাদি।
সিপিডির এক গবেষণায় দেখা যায় যে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে কর ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২৩০ বিলিয়ন টাকা এবং বাংলাদেশ অনিবন্ধিত ৬ লাখ বিদেশি কর্মী কর ফাঁকি দিয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকার উপরে যা সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র দুর্বল কর কাঠামো ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে। বিগত কয়েক বছরে ব্যাংকের উপর ঋণ নির্ভরতা বেড়েছে। যেমন ২০২২ সালের শেষ থেকে ২০২৪ ডিসেম্বর পযর্ন্ত ব্যাংকের আমানত বেড়েছে ৩,০৯,৮৮৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে এই আমানতের ৮৭% সরকার ঋণ হিসাবে নিয়েছে এবং বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। এখন প্রশ্ন হলো সরকার কেন এত বেশি ঋণ নেয় এবং কেনই সুদে-আসলে তা পরিশোধ করতে হয়। একজন উপদেষ্টা বলেছেন সরকার ঋণ নেয় বকেয়া ঋণ পরিশোধের জন্য। ইআরডির তথ্য বলছে ২০২৪-২০২৫ বৈদেশিক ঋণের ৬৮% ব্যয় হয়েছে পূর্বের বকেয়া ঋণ পরিশোধের জন্য এবং পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেছেন ২০২৫-২৬ বছরের বাজেট হবে ঋণের দুষ্ঠু চক্র ভাঙার বাজেট। বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের বিষয়ে ২০২৪-২৫ সময়ে প্রথম ৮ মাসে ৪১টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং আই,এম,এফ/বিশ্বব্যাংক এর কাছে অতিরিক্ত ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়েছে যার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে যা দুঃখজনকও বটে। রিজার্ভ বাড়াতে হবে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর মাধ্যমে তাহলেই এটি টিকসই হবে। বিভিন্ন মাধ্যম বলছে বাংলাদেশে প্রকল্প ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে বেশি যার কারণ রাজনৈতিক বিশেষত: দ্বীপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে চীন ও রাশীয়ার কাছ থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়টি। এখন সরকারের সবচেয়ে বড় ঝুকি হলো এই সকল ঋণের পরিশোধ। ই,আর,ডি বলছে ২০২৩ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ যে পরিমাণ বৈদশিক ঋণ নিয়েছে তার জন্য ২০২৯ সাল থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ৩.৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি আসল পরিশোধ করতে হবে। বিগত সরকার যত ঋণ নিয়েছে সবই বিতর্কিত ঋণের মধ্যে পড়ে যায় একটা মৌকুফের সুযোগ থাকতে পারে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ঋণ নির্ভরতা বাড়ছে। ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির ৩.৬২ শতাংশ। এই ঘাটতি পূরণে সরকার দেশি ও বৈদেশিক উৎসের ঋণের ওপর অধিক নির্ভর করছে। বাজেট ঘাটতির বড় একটি অংশ, প্রায় ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে নেওয়া হবে। বাকি ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। চলতি অর্থবছরের ২১ মে পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা, যেখানে জানুয়ারি পর্যন্ত এই পরিমাণ ছিল মাত্র ১৩ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্য পূরণ না হওয়া, সঞ্চয়পত্র বিক্রির গতি কমে যাওয়া এবং বৈদেশিক ঋণ ছাড় কমে যাওয়াই এর পেছনে অন্যতম কারণ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা মূল বাজেট থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা হ্রাস করে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি ব্যয় ৫৩ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের কথা।
আবার রাজস্ব আদায়ে গতি বাড়াতে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এই অর্থ হাতে নেওয়া হচ্ছে ‘অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’ নামের একটি নতুন প্রকল্প। এটির মোট ব্যয় হবে এক হাজার ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৮ কোটি ৮০ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে এক হাজার কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। এই ঋণ পাওয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যেই নিশ্চিত করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এদিকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে তিন ধরনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি নিয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের আওতায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। চলতি বছর থেকে শুরু হয়ে ২০৩০ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের পাবলিক রিলেশন বিভাগের প্রধান জানান, ১২ জুন সরকারি খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষতা বাড়াতে ২৫ কোটি ডলারের একটি ঋণ অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংক বোর্ড। সেই ঋণের মধ্যে রাজস্ব বোর্ড সংস্কারসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে ঋণ রয়েছে। তবে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঋণ চুক্তি কবে নাগাদ হতে পারে সেটি ইআরডি বলতে পারবে। পরিকল্পনা কমিশন জানায়, বাংলাদেশের রাজস্ব সংগ্রহ অত্যন্ত কম, যা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত। দেশে রাজস্ব ও জিডিপির অনুপাত ২০১২ অর্থবছরে ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। যেটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে। এই সময়ের মধ্যে কর জিডিপির অনুপাত ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে স্থবির হয়ে পড়ে। সর্বশেষ গত বছরে ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসে। এটি বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং দক্ষিণ এশিয়ার সমকক্ষ দেশগুলোর অনুপাতের তুলনায় উল্লেখযোগ্য কম। এ পরিস্থিতিতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের চিহ্নিত করা তিনটি চ্যালেঞ্জ হলো- প্রথমত, বাণিজ্য সম্পর্কিত করের ওপর অত্যাধিক নির্ভরতা। দ্বিতীয়ত, একটি মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ব্যবস্থা থাকলেও সেটি অসংখ্য ছাড় এবং সংক্ষিপ্ত হার দিয়ে চিহ্নিত। যেটি দারিদ্র্যবান্ধব না হলেও রাজস্ব আদায় বাড়াতে কাজে আসছে না। তৃতীয়ত, আয়করের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ছাড়, কর্তন এবং অবকাশ সুবিধা দেওয়া। এসব চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হলেও রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং সুনির্দিষ্ট নীতি সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় রাজস্ব আদায় কাঙ্খিত পর্যায়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করতে রাজি হয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পে যেসব সংস্কার নিশ্চিত করা হবে সেগুলো হলো-জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট বিজনেস প্রসেস প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, পরিবর্তন এবং ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ। এছাড়া প্রশিক্ষণ, বিশ্লেষণী ও নীতি বিশ্লেষণ সক্ষমতা জোরদারকরণ, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃযোগাযোগ ব্যবস্থাপনা এবং একটি শক্তিশালী গবেষণা ও পরিসংখ্যান ইউনিট প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি সংস্থাটির সেবা প্রদান ব্যবস্থা আধুনিকায়নের জন্য তৈরি মাস্টার প্ল্যান বিশ্লেষণ, পরিবর্তন এবং সে অনুসারে স্বয়ংক্রিয় সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। আরও আছে, আয়কর প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে সহজ প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়করণ, বিদ্যমান ও নতুন সিস্টেমগুলোর মধ্যে কার্যকর আন্তঃসংযোগ স্থাপন এবং নতুন সিস্টেম প্রবর্তন। এনবিআর সংস্কারের কার্যক্রম হিসাবে আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর উভয় ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার তৈরি করা হবে। এছাড়া এনবিআরের বিদ্যমান ও প্রস্তাবিত সিস্টেম যেমন এ্যাসাইকোডা ওয়ার্ল্ড, আইভিএএস এবং আয়কর সংক্রান্ত অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে আইবিএ এসপ্লাস প্লাস ও অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ডেটা প্ল্যাটফর্মের সমন্বয় করা হবে। করদাতাদের জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় কল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা। রাজস্ব বোর্ডের জনবল, কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের জন্য একটি আধুনিক ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি। কর প্রশাসনের জনবলের দক্ষতা বাড়াতে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করা। একটি পূর্ণাঙ্গ আয়কর প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠার জন্য সমীক্ষা ও নকশা তৈরি করা হবে।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তান চেয়েও অনেক সূচকেই এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বিশ্বের খুব কম দেশই এ সাফল্য দেখাতে পেরেছে। ফলে বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অতি দারিদ্র পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। দেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। দশ বছরের ব্যবধানে প্রায় ১ কোটি হতদরিদ্র লোক অতি দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে অতি দারিদ্র্য হার কমেছে। এই প্রবণতাকে বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন হিসেবে মনে করা হয়। মূলত শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা ও সফল পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন এ দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ধরনের সহায়তা করেছে। কয়েক বছর ধরে সরকারের নেওয়া সমন্বিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে এ সাফল্য এসেছে। সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের আওতায় নেওয়া কর্মসূচি ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে সরকার। পাশাপাশি সারা দেশে সড়ক নেটওয়ার্কের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। গ্রাম-উপজেলা-জেলাসহ সব ক্ষেত্রে সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় এর সুফল পাচ্ছে সাধারণ জনগন। এখন গ্রামের সাধারণ কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য খুব সহজে শহরে আনতে পারছে। এসব কারনে বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্য অনেকটাই কমে আসছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও এসব কর্মসূচি ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমার প্রধান কারন, এদেশের মানুষের আয় সক্ষমতা বেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ একসময় দারিদ্রের করালগ্রাসে নিমজ্জিত ছিল, একথা সত্যি। তবে তখন নানা প্রতিবন্ধকতা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রশাসনিক দ্বিধাবিভক্তি, দায়সারা মনোভাব, নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার অভাব, ভুল সিদ্ধান্ত, জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ডের অশুভ তৎপরতা প্রভৃতি বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে এখন আগের সেই অবস্থা নেই। ৫ আগস্ট ২০২৪ ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিদ্যমান আর্থসামাজিক ও পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে দেশের শাসনকার্য পরিচালনায় নতুন নতুন অনেক কিছু উন্মোচিত হচ্ছে। স্বৈরাচারী দুঃশাসন দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের তরুণ প্রজন্ম দেশ নিয়ে একটি নতুন স্বপ্ন দেখেছে। যে স্বপ্ন একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। তারা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে দেশের আপামর মানুষ তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা তাদের জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। সরকার গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে। তারা এমন একটি সমাজ ও জাতি চায়, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। এই প্রজন্ম একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, যেখানে জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে। আমরা অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলাম, আমাদের জীবদ্দশায় দেশ দুঃশাসনমুক্ত হবে না। দেশ ১৬ বছরের দীর্ঘ স্বৈরাচার, অপশাসন ও নির্যাতন থেকে রাহুমুক্ত হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে নানান আন্দোলন-সংগ্রাম হলেও তা হালে পানি পায়নি। ছাত্রদের আন্দোলনের সাফল্যের প্রধান কারণ তিনটি। এক. আগের অন্য আন্দোলন-সংগ্রামগুলোর লক্ষ্য ছিল একটি স্থিতাবস্থার পরিবর্তে আরেকটি বিকল্প স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যাতে সবকিছুই আগের মতো থাকবে। কেবল নাটকের কুশীলব পরিবর্তন হবে, নতুন রাজা-রানি, যুবরাজ, পাইক-পেয়াদা দই-মাখন খাবে। শোষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, ঘুষ, দুর্নীতি ও অপশাসন যথারীতি অব্যাহত থাকবে। এর বিপরীতে ছাত্রদের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিলÑখোলনলচে বদলে ফেলা, শোষণ, নির্যাতনমুক্ত গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আন্দোলনে নেতৃত্বদান ও অংশগ্রহণকারী জেনারেশন জেড বলে অভিহিত ছাত্ররা ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২৪ সালের আন্দোলনে উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন এবং জনগণ তাতে সাড়া দিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের আন্দোলনগুলো ছিল গতানুগতিক। এই প্রজন্ম একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, যেখানে জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে। লুণ্ঠন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়াও গত ১৬ বছরের অপশাসনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো বিচার বিভাগ, সংসদীয় ব্যবস্থা, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, সাংবাদিকতাসহ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে, অবাধ দুর্নীতির সুযোগের বিনিময়ে এ গুলোয় পদলেহী ও আজ্ঞাবহ দুর্বৃত্তদের শীর্ষ পদে নিয়োগ প্রদান। তাই এখন একটি বড় কাজ হবে, এসব জঞ্জাল অপসারণ ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ।
জুলাই অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ যেসব কারণে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কাজেই এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশের সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রত্যাশা হলো নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস পার হলেও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন সফলতা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো চাল, ভোজ্যতেল, ডিম, মুরগি, চিনি ইত্যাদি পণ্যের মূল্য আরও বেড়েছে। যেকোনো রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ ও অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি গিয়ে পড়ে সমাজের প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপরে। গত বছরের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পর এসে বেসামাল অর্থনীতিকে অনেকটা লাইনে আনা গেলেও দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি। অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা থেকে বাদ পড়েছেন অনেক মানুষ। সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় কৃষকেরা একের পর এক ফসলে লোকসান গুনছেন। ঋণগ্রস্ত মানুষের আত্মহত্যার ঘটনা এই আর্থসামাজিক বাস্তবতার বাইরের কিছু নয়। গত এক সপ্তাহে রাজশাহীর পবায় স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার পর স্বামীর আত্মহত্যা এবং মোহনপুরে পানচাষির আত্মহত্যার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। কেননা এ দুটিকে আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে পারি না। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফসলে ন্যায্য দাম না পেয়ে ও ঋণগ্রস্ত কৃষকের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো নাগরিকের অপমৃত্যু ঠেকাতে সরকারের দিক থেকে যে ধরনের জোরালো উদ্যোগ থাকা দরকার, সেটা একেবারেই অনুপস্থিত। ১৬ আগস্ট পবা উপজেলার বামনশিখর গ্রামের কৃষক মিনারুল ইসলাম স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার পর নিজেও আত্মহত্যা করেছেন। ঘরে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, ‘ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে আমরা মরে গেলাম।’ অন্যদিকে মোহনপুর উপজেলার ধুরইল গ্রামে ১৮ আগস্ট আকবর হোসেন নামের এক কৃষক ঋণের চাপ ও পান চাষে লোকসানের কারণে আত্মহত্যা করেছেন। আমরা দেখছি যে দুটি ক্ষেত্রেই দারিদ্র্য আর ঋণের চাপ আত্মহত্যা ও স্বজন হত্যার মতো মর্মান্তিক পথ বেছে নেওয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, মিনারুল অভাব লুকিয়ে রাখতেন, কাউকে কিছু বলতেন না। সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দিতে না পারার যন্ত্রণা শেষ পর্যন্ত তাকে এমন ভয়াবহ পথে ঠেলে দেয়। অন্যদিকে আকবর প্রমাণ করলেন, আমাদের কৃষকদের এখনো কতটা অনিশ্চয়তা ও সুবিধাহীনতার মধ্যে বাস করতে হয়। একদিকে তিনি ১৩টি এনজিওর পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছিলেন, অন্যদিকে পান চাষ করে কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় লোকসান গুনছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কৃষকেরা কেন তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন না। কৃষকদের সুরক্ষা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা জরুরি। এ ভূমির কৃষক–প্রজাদের দীর্ঘ লড়াইয়ে কয়েক দশক আগে যে মহাজনি প্রথার উচ্ছেদ হয়েছিল, সে ব্যবস্থা কেন আবার নতুন করে ফিরে আসবে? কৃষকেরা যাতে সহজ শর্তে ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ পেতে পারেন, সে সংস্কার করাটাও জরুরি। সরকারকে অবশ্যই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে। সরকারকে অবশ্যই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে।
মূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া। মানুষের আয় বাড়ছে না, কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। বাজার সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকছে না। কখনো ডিম, কখনো পেঁয়াজ, আলু, সবজি কিংবা কখনো মাছ-মুরগির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ভোক্তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের বাজারের হাল দেখে এটিই স্পষ্ট হয় যে বাজারের ওপর কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি, কিন্তু বাজারে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে একেকটি নিত্যপণ্যের দাম। সব শ্রেণিপেশার মানুষই নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশাহারা। কোনো কোনো পণ্যের দাম মাসের ব্যবধানে ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা মোটেই সংগঠিত নয়। এর সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কোনো কোনো সময় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় এখন বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের জীবনে বেশ চাপ সৃষ্টি করছে। দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম না কমাকে দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবেই দেখতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত সরকারের যেসব বিভাগ ও সংস্থা রয়েছে, তাদের কার্যক্রম নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যেন বাজারকে অস্থির করতে না পারে সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। আমদানি ঠিক রেখে সরবরাহ চেইন সচল রাখার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তাদের সীমিত জনবল নিয়ে বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে, কিন্তু এই অভিযানেরও বাজারে কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে।
রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।
ঐকমত্য কমিশন জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়া ইতোমধ্যেই আমাদের সামনে এসেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। তবে বেশে কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়নি। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কার আনা হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্য হলেও সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। উল্লেখ্য, বিএনপি সনদ বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করার বিষয়ে একমত হলেও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল মনে করে, শুধু অঙ্গীকার করলেই হবে না। তারা মনে করে সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে হবে এবং সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) আছে, সেগুলো হলো: ১. রাষ্ট্রের মূলনীতি: এই প্রস্তাবে ভিন্ন আছে বাংলাদেশ জাসদ, সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), গণফোরামের; ২. রাষ্ট্রপতির নির্বাচনপদ্ধতি: ভিন্নমত আছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের; ৩. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব: কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ১২-দলীয় জোট, এলডিপির; ৪. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান: ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের; ৫. তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা: বিএনপি (গঠনপ্রক্রিয়া সংসদের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষে), কিছু অংশে ভিন্নমত আছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি, এনডিএম, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২-দলীয় জোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির; ৬. উচ্চকক্ষে পিআর: বিএনপি, এনডিএমের ভিন্নমত; ৭. উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ: বিএনপি, এনডিএমের ভিন্নমত; ৮. উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা: সিপিবি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, আম জনতার দলের ভিন্নমত; ৯. নারী আসনের বিধান: সিপিবি, বাসদ, আম জনতার দলের ভিন্নমত; ১০. ন্যায়পাল নিয়োগ, সরকারি কর্ম কমিশনে নিয়োগ, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগ: বিএনপি, এনডিএম, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ভিন্নমত; ১১. ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপের পক্ষভুক্ত হওয়া: জামায়াতে ইসলামী, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, জাকের পার্টি, জেএসডি ও বিএসপির ভিন্নমত আছে।
সার্বিক পরিস্থতি বিবেচনায় বলা যায়, এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংকটের মেঘ পুরোপুনি কেটে যায়নি। তবে পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনের টক শো, গোলটেবিল, সভা-সেমিনারÑসর্বত্রই এখন আলোচনার প্রধান বিষয় নির্বাচন। সম্প্রতি গণমাধ্যমসূত্রে জানতে পারলাম যে, নির্বাচন কমিশন সপ্তাহখানেকের মধ্যেই রোডম্যাপ ঘোষণা করা হতে পারে। এতে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, সামান্য যে অনিশ্চয়তা ছিল, তা-ও হয়তো কেটে যাচ্ছে। দু’একটি রাজনৈতিক দল এখনো কিছু শর্ত দিচ্ছে এবং শর্ত পূরণ না হলে নির্বাচন বর্জন করার হুমকি দিচ্ছে। এগুলোকে অবশ্য রাজনৈতিক সুবিধা আদায় বা দর-কষাকষির কৌশল হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী বাছাই ও অন্যান্য নির্বাচনী প্রস্তুতির পাশাপাশি রাজনৈতিক জোট গঠনে এখন অনেক বেশি তৎপর লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মূলত তিনটি জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলেছে। যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ১২ দল, সমমনা জোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ আরো কয়েকটি দলের সঙ্গে বিএনপির জোটবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত। যত দূর জানা যায়, এই জোটে আরো কয়েকটি দল অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদের নামও শোনা যাচ্ছে। তবে এটি প্রায় নিশ্চিত যে বিএনপি কোনোক্রমেই আগামী নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটে যাবে না।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও হেফাজতে ইসলামের মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন অংশ নিয়ে জোট বাঁধার বিষয়ে অনেকটাই ইতিবাচক বলে জানা গেছে। এর বাইরে এনসিপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ আরো কয়েকটি দল পৃথক জোট গঠনেরও চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত এই জোট বিএনপির সঙ্গে একীভূত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি মনে করা হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু আশার আলো দেখা গেলেও গত ১৫ আগস্ট বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘আমরা শুনি, বিশ্বাসও করতে চাই যে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া, ভোটগণনা, ফলাফলের আগমুহূর্ত পর্যন্ত জাতির কাছে একটা সংশয় আছে।’
রাজনীতিতে যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতি ঘটতে পারে এমন আলোচনা সর্বমহলে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। গত ৩১ জুলাই রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে বিএনপির মহাসচিব তাদের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকি, আমরা যদি সতর্ক না থাকি তাহলে এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়।’ তিনি বলেন, ‘খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমরা কিন্তু খুব একটা সূক্ষ্ম তারের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু চারদিকে আপনারা আমার চেয়ে ভালো জানেন, চারদিকে একটু চোখ-কান খোলা রাখেন। দেখবেন কতগুলো ঘটনা ঘটছে, যে ঘটনাগুলোর আলামত ভালো না। এদিকে একটু লক্ষ রাখতে হবে।’ তার এই বক্তব্য থেকেও মনে হয় যে বিদ্যমান পরিস্থতিতে রাজনীতিতে এক ধরনের সংকট রয়েছে। এমনকি রাজনীতিতে ঐক্য নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও একতা নেই।
৩১ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের দুপুর ১২টা ১১ মিনিটে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্ট নিয়েও বেশ আলোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা মো. আবু সাদিক কায়েমেরও সমালোচনা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘শিবির নেতা সাদিক কায়েম সম্প্রতি একটা টক শোতে বলেছেন, ছাত্রশক্তির গঠনপ্রক্রিয়ায় শিবির যুক্ত ছিল, শিবিরের ইনস্ট্রাকশনে আমরা কাজ করতাম। এটা মিথ্যাচার।’ নাহিদ তার ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ‘সাদিক কায়েম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক ছিলেন না।...’
অন্যদিকে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি বাতিলের অভিযোগ তুলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা বর্জন করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাসদ, বাংলাদেশ বাসদ, বাসদ মার্কসবাদী দল। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স) বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে এমন একটি প্রস্তাব পাস করানোর চেষ্টা থেকেই কমিশনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। আগে অনেকে বলেছিলেন, সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন করে লিখতে হবে, আজ তারই প্রতিচ্ছবি আমরা দেখলাম।’
আমরা জানি যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। অন্যদিকে গত ৩০ জুলাই জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের বিরুদ্ধে দলীয় সব ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। আদালত এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের বিরোধ নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন থাকা একটি রিট পিটিশনের (১৫০৫১) উল্লেখ করেন। আদালত বলেছেন, ‘মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের শুনানির জন্য প্রস্তুত অবস্থায় বিচারাধীন আছে। এ পর্যায়ে কারও পক্ষে দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সমীচীন নয় মর্মে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয়।’
এমন নানা ধরনের মত-ভিন্নমত এবং অনৈক্য পরিস্থিতি আমাদের ক্রমেই শঙ্কিত করে তুলছে। যেসব রাজনৈতিক দল বর্তমানে মাঠে নেই, তারা তো এমনিতেই বিদ্যমান মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে আছে। আর যেসব দল মাঠে সরব রয়েছে তারা যদি নিজেরা কোনো বিষয়ে একমত না হয়ে বিভেদ তৈরি করতে থাকে তাহলে রাজনীতির সংকট আরও বাড়তে পারে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আমরা চাই, দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু এ বিষয়ে নতুন করে কোনো প্রশ্ন তৈরি হোক- সেটি আমরা চাই না। নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাই চালাবে পাঁচ বছর। সেই পাঁচ বছরে যদি তারা ব্যর্থ হয়, না পারে, আবার নির্বাচন হবে। নির্বাচনে জনতা তাদের বাদ দিয়ে দেবে, অন্য দলকে দেবে। কাজেই এ বিষয়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক স্থায়ী হওয়া উচিত না।
আগামী নির্বাচনে যদি সত্যিই ফেব্রুয়ারিতে হয়, তাহলে সামনের সময়টা খুবই কম। এমনকি যে সময় আছে তা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, আর এক্ষেত্রে বহুমুখী সংকট থেকেই যাবে এ বিষয়ে কোনা সন্দেহ নেই। খালি চোখে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো চূড়ান্ত ঐকমত্য দেখতে পাচ্ছি না। এমনকি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপও দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্বের বহু দেশে নির্বাচনী সংস্কার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বারবার কমিটমেন্ট করছে- নির্বাচনকে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার বিষয়ে। এমনকি এমন কমিটমেন্টট বাংলাদেশেও ইতোপূর্বে কয়েকবার হয়েছে। তারপরও কোনো না কোনোভাবে নির্বাচন প্রভাবিত হচ্ছে এবং প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে। কাজেই এখানেও আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামেই চয়েস করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন, অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্যমানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন এবং নিজেদের উৎকৃষ্ট ভাবার প্রবণতা অধিকভাবে লক্ষণীয়।
মোটাদাগে বলতে গেলে বলা যায় রাজনৈতিক দলগুলোর বিদ্যমান টানাপোড়েনের পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের। উদার গণতন্ত্রের উপাদানগুলো সবসময়ই অনুপস্থিত। আর এই দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিত উপাদানগুলোর যথাযথ সংস্কার রাতারাতি সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের চলার পথ মসৃণ করতে হলে অতীতের ভুল চিহ্নিত করে শিক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইতোপূর্বে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় বিধি বিধানের অসমাঞ্জস্যতায় দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের পথ মসৃণ হয়নি। নানা প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চাই, তার জন্য দরকার আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রের বর্ণ ব্যবস্থা সমাজকে চারটি বর্ণে বিভক্ত করে যেমন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। যারা তাদের গুরুতর পাপের কারণে এই ব্যবস্থার বাইরে পড়ে তাদের বহিষ্কৃত বা অস্পৃশ্য হিসাবে বঞ্চিত করা হয় এবং বর্ণ ব্যবস্থার বাইরে বিবেচনা করা হয়। বর্বর এবং যারা অধার্মিক বা নীতিহীন তারাও বহিষ্কৃত বলে বিবেচিত হয়। আমাদের বর্তমান সমাজে কেউ বহিষ্কৃত ও নীতিহীন থাকুক তা আমরা কেউ ই চাই না । আমরা চাই সম্প্রীতি। আর এই শব্দের অর্থ হলো বন্ধুত্ব, সদ্ভাব, সৌহার্দ্য, শান্তি, বা মিলমিশ। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে মানুষে মানুষে প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক থাকে এবং সকলে মিলেমিশে থাকে। ধর্ম ও বর্ন নিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, ‘এই বাংলাদেশে শত শত বছর ধরে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পাহাড়ি, বাঙালি, উপজাতি—সবাই মিলে অত্যন্ত শান্তিতে, সম্প্রীতিতে আমরা বসবাস করে যাচ্ছি।
তার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরা বলতেই পারি ‘এই দেশ আমাদের সবার। সবাই একসঙ্গে এই দেশে সুন্দরভাবে ও শান্তিতে বসবাস করব। এখানে কোনো জাতি-ধর্মে, গোত্রের মধ্যে ভেদাভেদ থাকবে না। সবাই আমরা এ দেশের নাগরিক।
প্রতিটি ক্ষেত্রে সবার সমান অধিকার রয়েছে। সেভাবেই আমরা আমাদের সামনের সোনালি দিনগুলো দেখতে চাই।
রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি জন্মাষ্টমীর মিছিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ঐক্যের বার্তা নিয়ে এসব কথা বলেন। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘শ্রীকৃষ্ণের হাজার হাজার ভক্ত এখানে উপস্থিত আছেন। এখানে বাদ্য বাজছে। এই আনন্দে সামরিক বাহিনীকে সঙ্গে নেওয়ায় উনারা সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।’
তিন বাহিনী প্রধানদের এই যৌথ উপস্থিতি উৎসবকে আরো বর্ণাঢ্য এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি, ঐক্য ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তিনি আরো বলেন, ‘আজকের এই জন্মাষ্টমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যে আদর্শ, সেই আদর্শ এখান থেকে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ুক। এই আদর্শের ভিত্তিতে আমরা এই দেশে সুন্দরভাবে একসঙ্গে বাস করব। এই আনন্দ মিছিল ১৯ ও ২০ শতকে একসময় এক সঙ্গে হতো। একদিকে হিন্দুদের রথ যাত্রা উৎসব অন্যদিকে মুসলমানদের তাজিয়া মিছিল , চলতো ঘন্টার পর কোন অসুবিধা বা বিশৃংখল পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না তারপর ধীরে ধীরে এটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ইদানিং আবার শুরু হয়েছে।আশা করি, এই উৎসব ও মিছিল সব সময় জারি থাকবে। শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান আশ্বস্ত করেন সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে যত ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা চান, ইনশাআল্লাহ সেটা তারা দেবেন।
সেনাপ্রধানের মতে আজকের এই অনুষ্ঠানে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা উপস্থিত আছেন, তাদের মাধ্যমে আজকের এই সম্প্রীতির বার্তা সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে।
সবাই ভালো থাকবেন। তিনি বলেন আজকের অনুষ্ঠানের এই এলাকা আমার স্মৃতিবিজড়িত এলাকা। আজিমপুর, পলাশীতে আমি ছোট থেকে বড় হয়েছি। সবার মঙ্গল কামনা করছি।’
অনুষ্ঠানে সবাইকে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাসের আহবান জানিয়েছেন নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান বলেন, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ুক। এই আদর্শের ভিত্তিতে আমরা সুন্দরভাবে এ দেশে একসঙ্গে বসবাস করব। শ্রীকৃষ্ণ যেন সমাজে ন্যায় ও আলোর সত্য প্রজ্বালন করেন। আসুন, পারস্পরিক সহনশীলতার মাধ্যমে দেশকে আরো শক্তিশালী করি।’
বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন বলেন, ‘শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা শুধু অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসই জোগায় না, ন্যায়ের পথেও চলতে শেখায়। আমরা সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। কখনো ধর্মীয় ভেদাভেদ আমাদের মধ্যে কাজ করেনি। এই বাংলাদেশ আমাদের সবার। স্বাধীনতাকে রক্ষা করা আমাদের সবার পবিত্র দায়িত্ব।’ সবাই মিলে কাজ করলে বিশ্বের মানচিত্রে এই বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
উল্লেখ্য যথাযথ মর্যাদা ও হিন্দু ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি ‘শুভ জন্মাষ্টমী’ উৎসব উদযাপিত হয়েছে। গীতাযজ্ঞ, নামসংকীর্তন, কৃষ্ণপূজাসহ নানা আয়োজনে দেশ ও জাতির কল্যাণ ও মঙ্গল কামনার মধ্য দিয়ে রাজধানীর ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় এবং আনন্দঘন পরিবেশে হিন্দু সম্প্রদায় এ উৎসব উদযাপন করেছে।উদ্বোধনী বক্ত্যব্য শেষে প্রদীপ প্রজ্ব্বালনের মধ্য দিয়ে তিন বাহিনীর প্রধানরা জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রার শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশেই আজিমপুর দায়রা শরীফে প্রস্তুতি চলছিল মুসলমানদের ‘আখেরি চাহার সোম্বা’ উদযাপনের প্রস্তুতি।
আখেরি চাহর শোম্বা মূলত আরবি ও ফার্সি বাক্য। প্রথম শব্দ ‘আখেরি’ আরবি ও ফার্সিতে পাওয়া যায়। যার অর্থ হলো- শেষ। ফার্সি ‘চাহর’ শব্দের অর্থ হলো- সফর মাস এবং ফার্সি ‘শোম্বা’ শব্দের অর্থ হলো- বুধবার। অর্থাৎ ‘আখেরি চাহর সোম্বা’র অর্থ দাঁড়ায়- সফর মাসের শেষ বুধবার। দিনটিকে মুসলিম উম্মাহ খুশির দিন হিসেবে জানে এবং খুশির দিন হিসেবেই উদযাপন করে থাকে। কিন্তু কেন? জেনে রাখা দরকার :-
সফর মাসের শেষ বুধবার হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দীর্ঘ অসুস্থতার পর সাময়িক সুস্থ হয়ে ওঠার দিনকে স্মরণ করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে ইবাদত ও উৎসব প্রচলিত তাই ‘আখেরি চাহার সোম্বা’। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের মুসলিমরা রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি উদ্যোগে এ উৎসব-ইবাদত যথাযথ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যের মাধ্যমে পালন করে থাকেন।পারসিক প্রভাবিত অঞ্চলসহ ভারতীয় উপমহাদেশের দেশ ও অঞ্চলগুলোতে বহু যুগ ধরে ‘আখেরি চাহার সোম্বা’ ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতির অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
এ অঞ্চলের সুফি-সাধকসহ দিল্লি সালতানাতের শাসকবর্গ রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই আখেরি চাহার সোম্বা পালন করতেন।
আমরাও দেখতে পেয়েছি যথাযোগ্য মর্যাদায় তা উদযাপিত হয়েছে। এবং দুই ধর্মের দুইটি উৎসব মহা ধুমধামে যার যার সীমাবদ্ধতার মাঝে থেকে সম্পাদন করতে পেরেছেন আয়োজকেরা।
এবার আসি অন্য আলোচনায়,
সামনে নির্বাচন সমাগম, সেনাবাহিনীকে আইন শৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় আসন্ন নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির দায়িত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন সুশীল সমাজ। এ প্রসংঙ্গে
সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘এখন নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে দেশ। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য সেনাবাহিনী সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে সেনারা মাঠে দায়িত্ব পালন করছেন। আগে এত দীর্ঘ সময় মাঠে থাকতে হয়নি। তাই সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। দূরত্ব থাকলে তা দূর করতে হবে।’ সম্প্রতি ঢাকা সেনানিবাসে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ অনুষ্ঠানে সেনাসদস্যদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে দান কালে এ কথা বলেন সেনাপ্রধান।
উক্ত অনুষ্ঠানে পদস্থ কর্মকর্তারা সরাসরি উপস্থিত ছিলেন। এসময় সব সেনা স্থাপনার কর্মকর্তারা ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন।
তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষ এখন সেনাসদস্যদের দিকে তাকিয়ে আছে। তোমরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে এবং বাহিনীর চেইন অব কমান্ড অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।’
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইস্যুতে নানা কটূক্তির জবাবে তিনি বলেছেন, ‘এসব মন্তব্যে অখুশি হওয়ার কিছু নেই। যারা এসব করছে, তাদের বয়স কম। তারা আমাদের সন্তানের বয়সী। তারা বড় হলে নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। তখন নিজেরাই লজ্জিত হবে।’
সেনাপ্রধান আরো বলেন, ‘সেনাবাহিনী একটি পেশাদার সংগঠন। মাঠে দায়িত্ব পালনের সময় পেশাদারি দেখাতে হবে। প্রতিশোধমূলক কোনো কাজে জড়ানো যাবে না।’নাম উল্লেখ না করে সেনাপ্রধান বলেন, ‘একজন সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগ তদন্তাধীন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারবেন না।আরেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ নিয়েও তদন্ত চলছে। নৈতিক স্খলনের বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তবে মিডিয়া ট্রায়ালের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেওয়া হবে না, অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সেনাপ্রধান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সতর্ক করে বলেন, ‘একজন সেনা কর্মকর্তাকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করে। তাই কেউ যাতে অপরাধে জড়াতে না পারে, সে বিষয়ে আগেভাগেই খেয়াল রাখতে হবে। অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পর তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে সেটি রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।’
অতএব আমাদের সকল শ্রেনীপেশার জনগণকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে নির্দিষ্টহারে অংশগ্রহণ এর ভিত্তিতে এই দেশে আসন্ন নির্বাচনকে দ্রুত সুষ্ঠ এ সার্থক করে একটি সরকার গঠনে সক্রিয় থাকতে হতে হবে ।
প্রকৃতির ক্ষুদ্রতম এক সদস্য লাল পিঁপড়া ছোট অথচ পরিবেশে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। এই ক্ষুদ্র প্রাণী আমাদের জীববৈচিত্র্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা শুধুমাত্র এক পোকা নয়, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় নিঃশব্দ এক প্রহরী। কিন্তু আজ এই নীরব প্রহরীর অস্তিত্ব বিপন্ন। অসংযত ও অবাধ শিকারে তারা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। তাই তাদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি।
পিঁপড়া সামাজিক, পরিশ্রমী ও চতুর প্রাণী। আমাদের দেশে খুদে পিঁপড়া, ডেঁয়ো পিঁপড়া, সুড়সুড়ে পিঁপড়া, বিষ পিঁপড়া, লাল পিঁপড়া ছাড়াও বহু প্রজাতির পিঁপড়া রয়েছে। একটু কম বিষাক্ত বড়ো আকৃতির লাল পিঁপড়ারা বন্য এবং দলবেঁধে গাছের মাথায় বাসা বানিয়ে থাকে। ভাওয়াল ও মধুপুরের গজারী বনে গাছের মাথায় এদের বাসা বেশি দেখা যায়। এ এলাকায় স্থানীয় নাম ‘গজারী কুত্তা’। অনেকে ‘রামকুত্তা’ ‘কুড়িলের’ বলেও ডাকে। তাছাড়া সারা দেশে আম, লিচু, মেহগিনি গাছসহ অনেক গাছেই লাল পিঁপড়ার বাসা চোখে পড়ে। ওখানেই জীবনচক্রের ধাপগুলো সম্পূর্ণ করে।
বিচিত্র এদের জীবন। দলবদ্ধভাবে রানির অধীনে বাসা তৈরির কাজ করে ওরা। গাছের মগডালে প্রথমে অনেকগুলো পাতা জোড়া দিয়ে বল আকৃতির বানায়। লালার সাহায্যে এক রকম আঠা তৈরি করে পাতা জোড়া লাগায়। শক্ত চোয়াল দিয়ে পাতা মুড়িয়ে গোল করার আগে ভেতরে আলাদা আলাদা কুঠুরি বানায়। কর্মী পিঁপড়ারা ভবিষ্যতের খাবার সংগ্রহ করে রাখে। গোল আকৃতির বাসা এত মজবুত হয় যে বৃষ্টির পানি পর্যন্ত ভেতরে ঢোকে না। বসন্তকালে একটি কলোনিতে বেশ কিছু পুরুষ ও রানি পিঁপড়া জন্ম নেয়। এই সময় উভয়ের ডানা গজায়। এক সময় বাইরে এসে বংশ বৃদ্ধির জন্য ঝাঁক বেঁধে উড়াল দেয়। মিলনের পর নতুন রানি ডিম পেড়ে পৃথক কলোনির সৃষ্টি করে। ডিম দেখতে চিকন সাদা মুড়ি বা ভাতের মতো দেখায়। বেশি ডিম পাওয়া যায় শীতের শেষে। মাছ ধরার টোপের জন্য লাল পিঁপড়ার ডিমের চাহিদা বেশি। লাল পিঁপড়ার ডিমের টোপ বড়ো মাছেরা সহজেই গেলে। আশ্বিন ও কার্তিক মাসে এই ডিমের চাহিদা বেশি।
লাল পিঁপড়া শুধু একটি ক্ষুদ্র পোকা নয়; তারা বন্যপ্রাণী হিসেবে পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বনের গাছে, মাঠে, মাটির নিচে, এমনকি মানব আবাসের আশপাশেও তারা বাসা গড়ে দলবদ্ধভাবে জীবন যাপন করে। রানির নেতৃত্বে পিঁপড়ারা জটিল সামাজিক ব্যবস্থা মেনে কাজ করে; খাদ্য সংগ্রহ, বাসা নির্মাণ, বংশবৃদ্ধি সবকিছুই দলবদ্ধভাবে সংঘটিত হয়।
তাদের বাসা সাধারণত গাছের উপরের পাতাগুলো থেকে তৈরি হয়, যেখানে পাতা একত্র করে লালা দিয়ে শক্তিশালী বাসা বানানো হয়। বসন্তকালে ডানা গজিয়ে তারা উড়াল দিয়ে নতুন কলোনি গড়ে বংশ বিস্তার করে।
পরিবেশে লাল পিঁপড়ার গুরুত্ব এককথায় অপরিসীম ও বহুমাত্রিক। প্রকৃতির এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি তার অবিস্মরণীয় ভূমিকার মাধ্যমে জীবজগতে সমতা ও সুষমতা বজায় রাখে। প্রথমত, লাল পিঁপড়া কৃষিক্ষেত্রে এক ধরণের প্রাকৃতিক সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। তারা শুঁয়োপোকা, মশা, মাছি ও অন্যান্য ক্ষতিকর পোকামাকড়ের বিস্তার রোধ করে, যা আমাদের ফসলের উৎপাদনশীলতা ও গুণগতমান উন্নত করে। এই কারণে কৃষকরা রাসায়নিক কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পরিবেশ দূষণ ও মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থেকে মুক্তি পায়। পরিবেশে রাসায়নিকের অতিরিক্ত ব্যবহার অনেক সময় মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং জলবায়ুর ভারসাম্য বিঘ্নিত করে, তাই লাল পিঁপড়ার এই প্রাকৃতিক ভূমিকা পরিবেশ রক্ষার দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সার্বিকভাবে, লাল পিঁপড়া পরিবেশের এক নীরব কর্মী, যারা আমাদের কৃষি, বাস্তুসংস্থান, পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতিতে অনন্য অবদান রাখে। তাই তাদের সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন বিশেষ মনোযোগ ও আইনগত ব্যবস্থা, যাতে এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদটি আগামী প্রজন্মের জন্য অক্ষুণ্ণ থাকে।
অপরিকল্পিত শিকার ও রাসায়নিক ব্যবহার লাল পিঁপড়ার বিপন্নতার অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই এই ক্ষুদ্র প্রাণীকে ধ্বংস করতে অবাধ শিকার চালানো হয়, যা তাদের প্রজাতি সংকটের মুখে ফেলে। পাশাপাশি, কৃষিক্ষেত্রে ও পরিবেশে ব্যাপকভাবে রাসায়নিক কীটনাশক ও বিষ প্রয়োগ করা হয়, যা লাল পিঁপড়াসহ অন্যান্য গুণান্বিত জীবজন্তুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই অবৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে, ফসলের উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে। তাই, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই কৃষির জন্য লাল পিঁপড়াসহ প্রাকৃতিক জীবজগতের সুরক্ষা ও অবাধ শিকার রোধ করা অত্যন্ত জরুরি।
লাল পিঁপড়া সংরক্ষণের জন্য বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা
লাল পিঁপড়া বাংলাদেশের প্রকৃতির এক অতি মূল্যবান উপাদান হলেও বর্তমানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় নেই, যার ফলে তারা সঠিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও অবৈধ শিকার রোধে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। লাল পিঁপড়ার উপর সুনির্দিষ্ট আইনগত সুরক্ষা না থাকায় তাদের বাসস্থান বিনষ্ট হওয়া, অবৈধ শিকার ও পরিবেশ দূষণের ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আইনের আওতায় আনা হলে অবৈধ শিকার ও বাসস্থান ধ্বংস প্রতিরোধ সম্ভব হবে, যা লাল পিঁপড়ার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে লাল পিঁপড়ার গুরুত্ব সমাজে তুলে ধরা সম্ভব হবে এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো কার্যকর মনিটরিং ও সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। এর ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সাধারণ মানুষের দায়িত্ববোধও বৃদ্ধি পাবে, যা টেকসই উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। তাই লাল পিঁপড়াকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় আনা প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ।
লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে সফলতা অর্জনের জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে করণীয় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, যার মধ্যে অন্যতম হলো আইন প্রণয়ন ও কঠোর প্রয়োগ, যা লাল পিঁপড়াকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় নিয়ে আসবে। এতে বাসস্থান রক্ষা, অবৈধ শিকার নিয়ন্ত্রণ এবং জরিমানা বিধানসহ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে। একই সঙ্গে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় লাল পিঁপড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ প্রকৃতির এই অনন্য উপাদানের প্রতি দায়িত্বশীল হতে পারে। এছাড়াও, ডিম সংগ্রহকারীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান ও পরিবেশবান্ধব আয়সূত্র গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা তাদের জীবিকা ও পরিবেশের সুরক্ষা দুটোই নিশ্চিত করবে। বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য লাল পিঁপড়ার জীবনচক্র, বাসস্থান, প্রজনন ও বিপদ নির্ণয়ের ওপর নিয়মিত গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ জরুরি। সবশেষে, স্থানীয় কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে প্রকৃতির সুরক্ষায় তাদের দায়বদ্ধ করা হলে সংরক্ষণ কার্যক্রম অধিক কার্যকর ও টেকসই হবে। এই সমন্বিত উদ্যোগেই লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে বাস্তব পরিবর্তন আসবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে।
লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে কার্যকর ও টেকসই ফলাফল অর্জনের জন্য একটি সুশৃঙ্খল আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। এর আওতায় প্রথমত, লাল পিঁপড়ার ঘন ঘন আবাসস্থলগুলো সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে, যা সংরক্ষিত জোন হিসেবে পরিচিত হবে এবং সেখানে বিশেষ সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রযোজ্য হবে। দ্বিতীয়ত, ডিম আহরণ বা পিঁপড়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরকারি অনুমতি সাপেক্ষে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন, যাতে অবৈধ শিকার ও অতিরিক্ত আহরণ রোধ করা যায় এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় থাকে। তৃতীয়ত, অবৈধ শিকার, বাসা ভাঙা ও পরিবেশ বিনষ্টের জন্য কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নির্ধারণ করে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপের deterrent হিসেবে কাজ করবে। সর্বশেষ, সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে নিয়মিত পরিবেশ মনিটরিং ও প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে লাল পিঁপড়া সংরক্ষণের অগ্রগতি মূল্যায়ন ও জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি সম্ভব হবে। এইসব উপাদান নিয়ে গঠিত একটি সুশৃঙ্খল আইনি কাঠামো লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপন করবে এবং পরিবেশের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করবে।
সেলিম রানা,
গণমাধ্যম কর্মী ও কলামিস্ট
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস এবং পারস্পরিক সমঝোতার অভাব নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সব সময়ই সংকটময় করে তোলে। বর্তমানে তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক জটিল মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সেনাবাহিনীকে ঘিরে আলোচনা নতুন মাত্রা পায়। সেনাবাহিনী সব সময়ই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সংবেদনশীল নাম। কারণ জনগণের আস্থা, বাহিনীর শক্তি এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতায় তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই ঢাকা সেনানিবাসে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য শুধু সেনাসদস্যদের উদ্দেশে নয়, বরং জাতির উদ্দেশে একটি পরোক্ষ বার্তাও বটে। এই বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার সঙ্গে সেনাবাহিনীর অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সেনাপ্রধানের বক্তব্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল জাতীয় নির্বাচন, সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব ও শৃঙ্খলার ওপর জোর দেওয়া। তিনি সেনাসদস্যদের উদ্দেশে বলেছেন, দেশ এখন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা দেশের ভবিষ্যৎ। তাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই কথার মধ্যে শুধু একটি অনুপ্রেরণা নেই, বরং এর মাধ্যমে জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা রয়েছে যে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালনে কোনো অবস্থাতেই পক্ষপাতদুষ্ট হবে না। বাংলাদেশে অতীতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সব সময় একটি প্রত্যাশা কাজ করেছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিলো গৌরবান্বিত। এবার সেনাপ্রধান স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বাহিনী কেবল রাষ্ট্রের অঙ্গ হিসেবে কাজ করবে, কোনো দলের হয়ে নয়।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে সেনাবাহিনী একটি পেশাদার সংগঠন এবং দায়িত্ব পালনের সময় প্রতিশোধমূলক কোনো কাজে জড়ানো যাবে না। নির্বাচনের সময় মাঠপর্যায়ে সেনাদের উপস্থিতি জনগণের কাছে আস্থার প্রতীক হলেও, একই সঙ্গে এটি এক ধরনের অনেকেরই ভয়েরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করতে চায় তারা বিভিন্নভাবে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবং যে কোনো মূল্যে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত। তাই সেনাপ্রধানের এই বার্তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে বাহিনীকে অবশ্যই পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। এটি কেবল নির্বাচন নয়, সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেনাবাহিনীকে ঘিরে সমালোচনা নতুন কিছু নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই বাহিনী নিয়ে নানা মন্তব্য, সমালোচনা এমনকি অপপ্রচার চালানো হয়। সেনাপ্রধান এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপূর্ণ অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এসব মন্তব্যে বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। যারা করছে, তারা অনেকেই তরুণ এবং তাদের বয়স সেনা সদস্যদের সন্তানের বয়সি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। এই ধৈর্যশীল মনোভাব বাহিনীর মনোবল রক্ষা করার পাশাপাশি জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে। কারণ সেনাবাহিনী যদি সমালোচনার মুখে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাত, তবে তা গণমানুষের সঙ্গে অযাচিত দূরত্ব তৈরি করত। বরং সহনশীল মনোভাব দেখিয়ে সেনাপ্রধান এক ধরনের বার্তা দিয়েছেন—সেনাবাহিনী জনগণের বিপরীতে নয়, বরং জনগণের সঙ্গেই আছে।
বাহিনীর শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা রক্ষার বিষয়েও সেনাপ্রধান কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, এক সেনাসদস্যের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে এবং প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইভাবে এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগও তদন্তাধীন। তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে কোনো অভিযোগ প্রমাণ ছাড়া মিডিয়া ট্রায়ালের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেওয়া হবে না। এখানে দুই দিকের বার্তা রয়েছে, একদিকে সেনাবাহিনী কোনো অনৈতিকতা বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সহ্য করবে না, অন্যদিকে বাহিনীর সদস্যদের অধিকার ও ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করা হবে। এই ভারসাম্য সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বেরই প্রতিফলন।
বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা সব সময়ই আলোচনায় থাকে। জনগণ প্রায়শই আশা করে, সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে ভোট সুষ্ঠু হবে, জালিয়াতি বা অনিয়ম কম হবে। আবার রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে অভিযুক্ত করে থাকে যে সেনাবাহিনীকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে। সেনাপ্রধান এই প্রেক্ষাপটে ঘোষণা দিয়েছেন, সেনাবাহিনী নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। অর্থাৎ সেনাবাহিনী নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে দীর্ঘ সময় ধরে সেনারা মাঠে দায়িত্ব পালন করছেন, যা এর আগে হয়নি। তাই জনগণের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা এখন জরুরি।
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সেনাবাহিনীকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার নির্দেশ। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, নির্বাচনের সময় বাহিনী কেবল নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে না, বরং মানুষের আস্থা অর্জন করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যদি জনগণ সেনাদের উপস্থিতিকে আশ্বাস হিসেবে না দেখে, বরং ভয় হিসেবে দেখে, তাহলে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই সেনাপ্রধানের বার্তা ছিল আস্থা ফিরিয়ে আনার কৌশল।
বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এক অস্থির বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার রাজনৈতিক দলের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব এখনো মীমাংসিত হয়নি। জনগণের প্রত্যাশা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, রাজনৈতিক দলগুলো কোন পথে হাটবে এবং কাঙ্ক্ষিত সেই নির্বাচন হবে কি না। যদিও সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে বারবার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা হতে পারে আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। সেনাপ্রধানের বক্তব্য সেই আস্থার প্রতিশ্রুতি বহন করে। তিনি আগেই বলেছিলেন, নির্বাচনের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণ করবে একটি নির্বাচিত সরকার। অর্থাৎ সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সমাধানের অংশ নয়, বরং একটি নির্বাচিত সরকারের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কাজ করবে। কেবল নির্বাচনই নয় সেনা প্রধান তার বক্তব্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তা হলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও বিনিয়োগের প্রসঙ্গ। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, একজন সেনা কর্মকর্তাকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করে। তাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পর তাকে অব্যাহতি দেওয়ার পরিবর্তে আগেভাগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এর মাধ্যমে তিনি বাহিনীর ভেতরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি কেবল সেনাবাহিনীর জন্য নয়, দেশের সার্বিক প্রশাসন ও রাজনৈতিক কাঠামোর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা—অপরাধ দমনে প্রতিরোধই প্রধান সমাধান।
অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ও বিভ্রান্তিকর প্রচারের প্রসঙ্গও তিনি তুলেছেন। সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিভিন্ন ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, যা দেখে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। এই বার্তা শুধু সেনা সদস্যদের জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের জন্যও প্রযোজ্য। কারণ ডিজিটাল যুগে ভুয়া তথ্যই রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সেনাপ্রধানের সতর্কবার্তা বোঝাচ্ছে, বাহিনী এসব প্রোপাগান্ডার ফাঁদে পা দেবে না।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অফিসার্স অ্যাড্রেস ছিল বহুমাত্রিক। একদিকে সেনাসদস্যদের শৃঙ্খলা, নৈতিকতা, পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বের ওপর জোর দিয়েছেন; অন্যদিকে জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন যে সেনাবাহিনী নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও নির্বাচনকালীন অনিশ্চয়তার মধ্যে এই বক্তব্য এক ধরনের স্থিতিশীলতার বার্তা।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, কারণ নির্বাচনের সময় কেবল সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সহনশীল না হয়, তবে সেনাবাহিনী যতই পেশাদার হোক না কেন, নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হবেই। তাই সেনাপ্রধানের বার্তাটি আশ্বাসজনক হলেও, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের জটিলতা তা কতটা বাস্তবায়িত হতে দেবে, সেটিই বড় প্রশ্ন।
সব মিলে বলা যায়, সেনাপ্রধানের বক্তব্য শুধু বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দিকনির্দেশনা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক বার্তাও। তিনি পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও দেশপ্রেমের ওপর জোর দিয়ে জাতিকে এক ধরনের আস্থা দিতে চেয়েছেন। যখন রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা, বিভাজন ও অবিশ্বাস তীব্র আকার ধারণ করেছে, তখন সেনাপ্রধানের এই বার্তা জনগণকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে সেনাবাহিনী দেশের জন্য, কোনো দলের জন্য নয়। আর সেই কারণেই এই বক্তব্য বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাদা পাথরে কালো হাত পড়েছে। উল্লেখ্য যে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র ভোলাগঞ্জের ‘সাদাপাথর’। মনোমুগ্ধকর সেই ‘সাদাপাথর’ এলাকাটি এখন প্রায় বিবর্ণ, যেন এক বিরাণভূমী। এই নজিরবিহীন পাথর লুটের ঘটনায় দেশবাসী হতবাক। এক্ষেত্রে দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন যে, এই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের আরো সতর্ক থাকার প্রয়োজন ছিল। এদিকে পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, এক বছরে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট সাদা পাথর লুট হয়েছে, যার বাজারমূল্য আনুমানিক দুই শত কোটি টাকার উপরে। এটি সত্য যে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে পাথর লুট শুরু হলেও এতদিন নিস্ক্রিয় ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ এক বছর ধরে সাদা পাথর লুটপাট চলেছে। এখন বলতে গেলে, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। এটি সর্বজনবিদিত যে, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর বাংলাদেশের আলংকারিক সৌন্দর্যের একটি অনন্য প্রপঞ্চ।
যতদূর চোখ যায়, কেবল সাদা পাথর, মাঝখানে স্বচ্ছ পানি, ওপরে নীল আকাশ, আর সবুজ পাহাড়ে মেঘের আলিঙন। সেহেতু যে ভাবেই বলি না কেন, এটি প্রকৃতির এক অপরূপ স্বর্গরাজ্য। বস্তুত সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে প্রকৃতির এই রূপের আধার হলো উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। এখানের সাদা পাথর, রোপওয়ে, পাথর কোয়ারি, আর পাহাড়ি মনোলোভা দৃশ্য মুগ্ধ করার মতো। ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা ধলাই নদের বুকে স্বচ্ছ পানি, আর সাদা পাথরের মুগ্ধতায় মন ভরে যায় পর্যটক’সহ সবার। এটি লক্ষ্যনীয় যে যে, চারপাশে ছড়িয়ে আছে সাদা পাথর। মনে হয় যেন, প্রকৃতি শুভ্র বিছানা বিছিয়ে রেখেছে। মাঝখানে স্বচ্ছ ঢেউ খেলানো নীল পানি। চারদিকে ঘিরে আছে ছোট-বড় কয়েকটি পাহাড়; আর তার ওপর যেন আছড়ে পড়েছে মেঘ। এতদ্ব্যতীত চারপাশে আছে সবুজ প্রকৃতি। সব মিলিয়ে প্রকৃতির যেন অপরূপ এক স্বর্গরাজ্য। দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা এই অপূর্ব স্থানটি উপভোগের জন্য ছুটে আসেন এই সাদা পাথরের দেশে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ভোলাগঞ্জ সীমান্তে প্রাকৃতিক দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের উঁচু উঁচু পাহাড়। সেই পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনাধারা। একদিকে যোগানদাতা হিসেবে ধলাই নদের পানি। অন্যদিকে ঝরনার পানি প্রবাহ ভোলাগঞ্জকে রূপে রানী করে সাজিয়ে তুলেছে। তাছাড়া সবুজ পাহাড় ও সাদা-কাল মেঘের হাতছানি। বস্তুত বর্ষার পাহাড়ি ঢলের সাথে নেমে আসা সাদা পাথর ধলাই নদের বুকে মিলে মিশে ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুনে। বর্ষায় এই নদের বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাদা পাথরের বিছানা নদীর শোভা বাড়িয়ে তুলে। তাছাড়া সাদা পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ঝরনার পানির তীব্র স্রোতে নয়ন জুড়ায়।
২০২১ সালে আমার এখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ধলাই নদের উৎস মুখের পাথর পরিবেষ্টিত জায়গাটুকু ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট বা সাদা পাথর নামে পরিচিত। আসলে সাদাপাথর এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো। প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ধলাই নদের উৎসমুখে ভেসে আসা পাথরের বিশাল স্তূপের কারণে প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে তৈরি এ স্থানটি পর্যটন স্পট হিসেবে অভিহিত। মজার ব্যাপার হলো যে, ধলাই নদ বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দুভাগে বিভক্ত হয়ে চারপাশ ঘুরে আবার মিলিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ধলাই নদের পানির সঙ্গে ভারতের খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে প্রচুর সাদা পাথর নেমে আসে। আর এই পাথর উত্তোলনকে সহজ করতে ১৯৬৪-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে নির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে ভোলাগঞ্জ থেকে সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ এই রোপওয়ে চলে গেছে ছাতক পর্যন্ত, যা ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে রোপওয়ের টাওয়ারগুলো কেবল কালের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। রোপওয়ে বন্ধ হলেও থেমে নেই পাথর উত্তোলন। এখনো অনেক স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকার উৎস এই পাথর উত্তোলন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে, স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে সাদা পাথর তুলে নিয়ে সৌন্দর্যমন্ডিত সাদা পাথর কংকাল সার করে তুলেছে। এই পাথর লুট নিয়ে পাল্টাপাল্টি অনেক কথা বলা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে আইনগতভাবে নানা ধরনের ব্যবস্থা নাকি করা হয়েছে বলে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দাবী করছেন। তথ্যমতে জানা যায় যে, পাথর উত্তোলন ও সরানোয় জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরিপূর্বক ৬০ দিনের মধ্যে হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সিলেটের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ বিবাদীদের প্রতি এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে উত্তোলন করা ও সরানো সাদা পাথর সিভিল প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে ভোলাগঞ্জের ওই স্থলে সাত দিনের মধ্যে পূনস্থাপন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আবার প্রতিপাদ্য কথাই ফিরে আসি। সিলেটের অন্যতম পর্যটন স্পট সাদা পাথর এখন বিরাণভূমি। কোথাও আর পাথর নেই। উল্লেখ্য যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাদা পাথর এলাকার বর্তমান পরিস্থিতির ছবি ভাইরাল হয়। তারপর থেকেই দেশজুড়ে চলছে সমালোচনা। এ নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় সংবাদমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেই সমালোচনা ও প্রতিবেদনকে তোয়াক্কা না করেই দেখা গিয়েছে যে শত শত ট্রাকে সাদা পাথর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান একটি পত্রিকাকে বলেন, সাদা পাথর লুটের ঘটনায় ১৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে ১৯১ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর অজ্ঞাত আছে আরও ৩১০ জন। এরমধ্যে ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া শতাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। সাদা পাথর লুট হওয়া নিয়ে আমাদের জিরো টলারেন্স। আমরা চাই একটি পাথরও যেন লুট না হয়। এ বিষয়ে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। এর মধ্যে ১৭/০৮/২০২৫ তারিখের আর একটি পত্রিকায় দেখলাম ৩২টি মামলা হয়েছে এবং ঘুরে ফিরে ১৭ জনের নাম বার বার আসছে।
প্রকাশ থাকে যে, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে যত দূর চোখ যেতো, দেখা যেতো সাদা সাদা পাথর আর পাথর। কিন্তু এখন সেখানে ধু-ধু বালুচর। বাস্তবে দেখা গিয়েছে যে, গত ৫ আগস্টের পর থেকে বিরামহীনভাবে চলছে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথর লুট। অথচ সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে ভ্রমণপিপাসু মানুষের পছন্দের শীর্ষে থাকা এটি। বর্তমানে লুটে ক্ষতবিক্ষত স্পটে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, পাথরের সঙ্গে বালুও লুট করা হয়েছে। অথচ পর্যটনকেন্দ্রের চারদিকে বিজিবির চারটি ক্যাম্প ও পোস্ট রয়েছে।
পূর্বেও কিছুটা উল্লেখ করা হলেও আবারও বিশ্লেষনের জন্য আলোকপাত করতে হচ্ছে। বস্তুত সিলেট নগরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ। ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি ঝর্ণাগুলো থেকে যে নদীর উৎপত্তি হয়ে ভোলাগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সেই নদীর নাম ধলাই নদ। পাহাড় থেকে ঝর্ণার পানির স্রোতে এই নদী বেয়েই সাদা পাথর নেমে আসে। ধলাই নদের উৎসমুখের এই জায়গার নাম ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট। ঠিক এক বছর আগেও এই স্থানের সৌন্দর্যের সুবাদে হৃদয় আবেগময় হয়ে কবি মন হয়ে দাঁড়াতো। কেননা ‘যতদূর চোখ যায়, দুই দিকে কেবল সাদা পাথর, আর মাঝখানে স্বচ্ছ নীল জল আরেকদিকে পাহাড়ে মেঘের আলিঙ্গন। মনে হতো কাশ্মীরের মতো স্বর্গরাজ্য। সৌন্দর্যের যেন এক অনবদ্য ক্যানভাস।’ কিন্তু প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের ব্যবস্থা নেয়ার পরও আগের অবস্থায় ফিরে আসবে কি না, সে ব্যাপারে অনেকে সংশয় পোষন করে থাকেন।
সত্যি কথা বলতে কি, গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে মূলত সাদা পাথর লুট হওয়া শুরু হয়। প্রশাসনের স্থবিরতা বা ভীতিই এই পাথর লুট হওয়ার কারণ। আসলে প্রশাসনের কঠোর না হওয়ার কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। পরিবেশবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিবের মতে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এই স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা উক্ত স্বচ্ছ পানির আধার এই এলাকার বেশ কিছু স্থানের খাবার পানির চাহিদা মেটায়। এদিকে এই পাথরগুলো যেখান থেকে ন্যাচারালি আসে, ওইখান থেকে পানি প্রবাহের ভয়ংকর রকম তোড় তৈরি হয়। এর মানে পানি প্রবাহের তীব্রতা বেড়ে যায়। যেখানে তোড় বেশি, সেখানে পাথর জমে। পাথরের কাজ ওই তোড়ের পানিটাকে ভেঙে ভেঙে এদিক ওদিক প্রবাহপূর্বক টুকরো টুকরো করে তার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। এটা একটা প্রাকৃতিক ধাপ।’ শুধু তাই নয়, পানির মধ্যে অক্সিজেন সংশ্লেষ করাও এর কাজ, যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় ‘সোলার অ্যাকুয়াটিক ন্যাচারাল প্রসেস অব ট্রিটমেন্ট’ বলা হয়ে থাকে। প্রকৃতির এই পুরো সিস্টেমে যদি কোন ব্যাঘাত ঘটানো হয় অর্থাৎ পাথর তুলে ফেলা হলে, তখন সিস্টেম ভেঙে পড়ে। শুধু তাই নয়, এর ফলে দুপাশে প্লাবনের পরিমাণ বাড়ে, ভাঙনের সৃষ্টি হয় এবং পানিটাকে গোড়াতেই সাংঘাতিকভাবে পলিউটেড (দূষিত) করে ফেলে। এটি সত্য যে, ওই অঞ্চলের অনেক জায়গায় খাবার পানির স্বল্পতা মেটায় এই পানি। আর এসব ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের কারণে প্রকৃতিগতভাবে অন্যান্য ক্ষতি তৈরির অভিঘাত সৃষ্টির পথ সুগম করে। তাই সঙ্গতকারণেই যথেচ্ছার ভাবে পাথর লুট বা সরানো মোটেই কাম্য নয়।
ইতোমধ্যে সাদা পাথর লুট হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট সবাই তৎপর হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। ঠিক চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, এর ন্যায়। যাহোক, এই সাদা পাথর শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিয়ামক নয়। এর সুবাদে পরোক্ষভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা হয়ে থাকে। পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, ভবিষ্যতে যাতে এ রকম অনাহুত নেতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি না হয়, সে ক্ষেত্রে সবাই সজাগ থাকতে হবে। অপরাধীরা যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। আর এর পেছনে, বাইরের কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা, তাও তলিয়ে দেখতে হবে।
লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
সুরা লুকমান, পর্ব ১০
অনুবাদ
(৩৩) হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, আর সেদিনকে ভয় করো, যেদিন কোন পিতা তার পুত্রের কোন উপকারে আসবে না, এবং কোন পুত্রও তার পিতার কোন উপকারে আসবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং দুনিয়ার জীবন যেনো তোমাদের ধোঁকা না দেয় এবং মহাপ্রতারক (শয়তান) যেনো তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। (৩৪) নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটই রয়েছে কিয়ামতের জ্ঞান। তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনি জানেন মাতৃগর্ভে কি আছে। কেউ জানে না, আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে। আর কেউ জানে না, সে কোথায় মারা যাবে। আল্লাহই সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।
মর্ম ও শিক্ষা
আলোচ্য আয়াতগুচ্ছের মধ্য দিয়ে সূরা লুকমানের উপসংহার টানা হয়েছে। সূরাটিতে নানাভাবে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, কিয়ামত, আখিরাত ইত্যাদিসহ ঈমানের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সৃষ্টি জগতের প্রকৃতির বিভিন্ন প্রমাণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এগুলো আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদের নিদর্শন বহন করে। মানুষের সাধারণ বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদের অনুকূলে সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের আদর্শ আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, কিয়ামত ও আখিরাতের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে। মানুষের হৃদয়ের গভীরেও আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ ও প্রভূত্বের বীজ অঙ্কুরিত রয়েছে। এমনকি বাতিলপন্থীদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এ সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা কে, তখন তারাও স্বীকার করে যে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। এতসব দলীল প্রমাণের পর এখানে আলোচ্য আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, তাহলে মানুষের উচিত আল্লাহকে ভয় করা। কিয়ামতের দিন সম্পর্কে সতর্ক থাকা, যেদিন সবাই নিজকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে এবং কেউ কারো উপকারে আসতে পারবে না। সে কিয়ামতের দিন সত্য ও সঠিক। কিয়ামতের সেই ক্ষণ কবে আসবে, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। কাজেই প্রতিটি মানুষের উচিত মৃত্যু ও কিয়ামত সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহির ব্যাপারে সদা সতর্ক ও সচেতন থাকা।
তাকওয়া: আল্লাহভীতি
গোটা সূরায় এই সত্যটি যৌক্তিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে আল্লাহই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, তিনিই সবকিছু প্রতিপালন করেন। তিনি মানুষকে অগণিত এবং সীমাহীন নিয়ামত দান করেছেন। আসলে গোটা সৃষ্টিকেই আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এসব অনর্থক নয়, বরং এগুলোর একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। তা হলো এই যে মানুষ একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে, তার গোটা জীবনকে আল্লাহর সামনে সমর্পণ করে দেবে, আল্লাহর বিধি-নিষেধ ও জীবনাদর্শ অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করবে। তা না করলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। দুনিয়াতেও আল্লাহ তার নেয়ামত ছিনিয়ে নিতে পারেন, শাস্তি দিতে পারেন, এমনকি গোটা জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারেন। তারপর রয়েছে পরকালের জবাবদিহি এবং অনন্তকালের শাস্তি। সুতরাং প্রতিটি মানুষের উচিত আল্লাহকে ভয় করা। আলোচ্য আয়াত দুটির প্রথমেই আল্লাহর নির্দেশ দিয়েছেন, মানুষ যেনো আল্লাহকে ভয় করে, তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করে।
আখিরাতে বিশ্বাস
আল্লাহকে ভয় করা প্রসঙ্গে সেদিনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যেদিন আল্লাহ ছাড়া কেউ কাউকে কোন উপকার করতে পারবে না। বলাবাহুল্য, সে দিনটি হলো কিয়ামত, যা দিয়ে আখিরাতের অনন্তকালের জীবন শুরু হবে। এভাবে এখানে আখিরাতে বিশ্বাসের বিষয়টি বলিষ্ঠভাবে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ এ দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়, বরং মৃত্যুর পর থেকে আখিরাতের জীবনের যাত্রা শুরু, যে জীবনের শেষ নেই, যে জীবন অনন্তকালের। মানুষ তার দুনিয়ার কর্মজীবনের ফলাফল ভোগ করবে আখিরাতে। এ বিশ্বাস হলো ঈমানের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়নের প্রধান প্রেরণা হলো আখিরাতের সে জীবন।
আখেরাতের জীবনের অবস্থা নির্ভর করে কর্মের উপর
আখিরাতে মানুষ শান্তিতে বাস করবে নাকি শাস্তি ভোগ করবে, তা নির্ভর করে তার নিজের কর্ম ও আমলের উপর। প্রত্যেকের আমল অনুযায়ী কিয়ামতের দিন বিচার হবে, এবং সে বিচারের রায় অনুযায়ী অনন্তকালের জীবন যাপন করতে হবে। নিজ আমল দিয়ে যদি সেদিন মুক্তির ব্যবস্থা না হয়, তাহলে কেউ সেখানে কোন উপকারে আসবে না। আয়াতে বলা হয়েছে, পিতাও তার সন্তানের কোন উপকার করতে পারবে না, এবং সন্তানও তার পিতার কোনো উপকার করতে পারবে না। অর্থাৎ যত আপনজনই হোক, কেউ সেদিন কারো উপকার করতে পারবে না। শুধু তাই নয় বরং সেদিন মানুষ তার অতি প্রিয় প্রিয়জনের বিনিময়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হবে না। সুতরাং সে বিচারের প্রেক্ষাপটে আল্লাহকে ভয় করা উচিত।
দুনিয়ার জীবন হলো ধোঁকা: প্রতারিত হওয়া ঠিক নয়
এ দুনিয়ার ক্ষণিকের জীবন হলো ধোকা। মরীচিকার মতো। অনেক আকর্ষণীয় জিনিস মানুষকে আহবান করে এবং শান্তি দেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে। আসলে তা হলো মিথ্যা আশ্বাস ও প্রতারণা। সে আশ্বাস পেয়ে মানুষ দুনিয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, হন্যে হয়ে ঘুরে এবং ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা না করে সম্পদের পাহাড় গড়তে চেষ্টা করে। আলোচ্য আয়াতে এমন ধোকার আশ্বাসে প্রতারিত না হওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
শয়তানের প্রতারণা থেকে সাবধান
শুধু দুনিয়ার অবাঞ্ছিত ও আকর্ষণীয় জিনিসই নয়, বরং আরো আছে শয়তানের ধোকা ও প্রতারণা। জিন শয়তান মানুষের রন্ধ্রে রন্দ্রে ঘুরে মন্দ কাজের দিকে প্রতারিত করে। এছাড়া মানুষ শয়তান মানুষকে মন্দ কাজের দিকে উৎসাহিত করে এবং মন্দ কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। এ ধরনের সকল প্রকার শয়তানের প্রতারণা থেকে সাবধান করেছেন, যেনো আমরা শয়তানের প্ররোচনায় প্রতারিত না হই।
গায়েবের খবর আল্লাহর নিকট রয়েছে
আল্লাহ মানুষকে অত্যন্ত সীমিত জ্ঞান দিয়েছেন। এ সীমিত জ্ঞান দ্বারা মানুষ খুব কম বিষয়ই জানতে পারে। সেহেতু মানুষের উচিত সকল ব্যাপারে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা। এমনিতে সকল গায়েবের খবরই আল্লাহ নিকট রয়েছে, তবে এক সাহাবীর প্রশ্নের বরাতে আয়াতে পাঁচটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। প্রথম, কিয়ামতের জ্ঞান। কিয়ামত কখন হবে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। দ্বিতীয়, বৃষ্টিপাতের সময়। এ ব্যাপারে আবহাওয়া অফিস থেকে হয়তো কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। তবে তা নির্ভরযোগ্য হয় না। তৃতীয় বিষয় হলো মাতৃগর্ভে কি আছে, তার জ্ঞান। এ ব্যাপারে সঠিক খবর একমাত্র আল্লাহর নিকটই আছে। আজকাল আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে গর্ভে কি আছে, তা জানা যায়। কিন্তু তার মাধ্যমে গর্ভের শিশুটির গুণগত দিক সম্পর্কে জানা যায় না। সে কি জ্ঞানী হবে নাকি বোকা, তার আচার ব্যবহার কেমন হবে ইত্যাদি বিষয় কেউ জানে না। এসব বিষয় শুধু আল্লাহরই জানা আছে। আর কারো নেই। সুতরাং এ ব্যাপারে কারো কিছু করারও নেই। শুধু আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে দোয়া করা উচিত।
যে জিনিস সেবন করলে কিংবা বাহ্যিকভাবে শরীরে গ্রহণ করলে অস্বাভাবিক আচরণসহ অচেতন হয়ে নিজের ক্ষতি এবং অন্যের ক্ষতি করতে দ্বিধা করে না তাকেই নেশা বলে। নেশা অনেক প্রকারের হয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেশা হচ্ছে- মদ, গাঁজা, চরস, আফিম, ইয়াবা ও তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি। আচরণগত নেশা বলতে বোঝায়- জুয়া খেলা, তাস খেলা, আড্ডা মারা, মারামারি করা, বিনা স্বার্থে অন্যের ক্ষতি করা ইত্যাদি।
এছাড়া রয়েছে হেরোয়িন ও প্যাথিডিন শরীরে গ্রহণ করা। কোনো নেশাই নিজের পরিবারসহ অন্যের মঙ্গলদায়ক নয়। নেশা আসক্ত মানুষ কমবেশি চিরকালই ছিল। বর্তমানে এর ভয়াবহতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নেশাগ্রস্ত মানুষ কেন বাড়ছে এর কারণ খুঁজলে বের হয়ে আসবে, দেশে ব্যাপক বেকার সমস্যা। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত ছেলেরা নেশাগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। গ্রাম থেকে আসা নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব ঘরের সন্তানরা বাবা-মার জমিজমা, ভিটে-মাটি বিক্রি করে শহরে এসে উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে কোনো চাকরি পায় না। বর্তমানে অফিসার পদে চাকরি পেতে হলে ১০-২০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। কোনো কোনো চাকরির ক্ষেত্রে ৩০-৪০ লাখ পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। এত টাকা পাবে কোথায়? এছাড়া কেউ কেউ উল্লিখিত টাকা দেওয়ার পর চাকরি এবং টাকা দুটোই হাতছাড়া হয়ে যায়। মধ্যভোগী হিসেবে যারা এ ধরনের টাকা গ্রহণ করে তারা রাজনৈতিকভাবে কিংবা বিভিন্ন কারণে ওদের ক্ষমতার অবস্থান থাকে অনেক উঁচুতে। ইচ্ছে করলেই হুমকিধমকি দিয়ে সেই টাকা আদায় করতে পারে না। ফলে চাকরির প্রার্থীরা হতে হয় পথের ভিখারি। বাবা-মার জমিজমা বিক্রি করে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছে। সেই সঙ্গে হাওলাত-কর্জ করে লাখ লাখ টাকা প্রতারককে দিয়েছে। কী করবে? কোথায় যাবে? আত্মহত্যা করা মহাপাপ। বাধ্য হয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
ছাত্রজীবনে কত না স্বপ্ন দেখেছিল, ভবিষ্যতেই এই হবে, সেই হবে। কিন্তু উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার পর সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। পরিবারে ও সমাজে তারা হয়ে যায় অবহেলার পাত্র। এত বড় ডিগ্রি নিয়ে যেমন-তেমন চাকরি করতে বিবেকে বাধা দেয়। বেসকারি প্রতিষ্ঠানে মাসে যে টাকা বেতন পাবে, সেই টাকা শেষ হয়ে যায় মোবাইল ও ইন্টারনেট চালাতে গিয়ে। পুরো জীবনটা বৃথা। উন্নতমানের পোশাক-আশাক না পরতে পারলে সার্টিফিকেটের কোনো মূল্য থাকে না।
মা-বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে কতদিন চলা যায়? বেকার ছেলেকে হাত খরচের টাকা দেবে, সেই সামর্থ অনেক পরিবারের নেই। ফলে এসব ছেলেরা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দলবদ্ধ হয়ে নেশা না করলে কি চলে? অল্পদিনের মধ্যে নেশাগ্রস্ত অনেক বন্ধু জুটে যায়। নেশার টাকা জোগাতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে অবৈধ কর্মকাণ্ডে। তখন তাদের নীতি-আদর্শ বলতে কিছু থাকে না। দল ত্যাগ করে ক্ষমতাসীন দলে ভিড়তে দ্বিধা করে না। নিজে নেশা করে এবং নেশাখোর নেতার পেছনে ঘোরে। একে ধরে, তাকে মারে, এই হলো তাদের কর্মসূচি। সরকার দলীয় কর্মী হিসেবে একটু-আধটু সম্মানও পায়। নিরীহ জনগণ ভয়ে তাদের সালাম দেয়। যতদিন দল ক্ষমতায় থাকে ততদিন ভালোই কাটে তাদের দিনকাল। দল ক্ষমতা হারালে তাদের জেল-হাজত খাটতে হয়। তাদের প্রধান আয়ের উৎস থাকে বিচার সালিশ। বর্তমানে এটিকে বলা হয় ফিটিং ব্যবসা। নিরীহ মানুষকে ডেকে এনে বিনা কারণে অপরাধী বানিয়ে টাকা আদায় করাই এই ব্যবসার প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিচার-সালিশে যাওয়ার আগে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, এত টাকা দিতে হবে। বিচারের ন্যায়-অন্যায় কোনো বিষয় না। টাকা দিলেই জিতিয়ে দেয়। এসব সালিশিতে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কোনো মূল্যায়ন নেই। রাজ্য তাদের, রাজাও তারা। ইয়াবা ব্যবসা গ্রামগঞ্জে বেশ রমরমা। বিরক্ত না করার জন্য এলাকার ক্ষমতাশীল ব্যক্তি থেকে শুরু করে কোনো কোনো ইউপির চেয়ারম্যান এবং থানাতে ব্যবসার অংশ হিসেবে মাসিক ফি দিতে হয়। গ্রামের জ্ঞানী-গুণীরা বাধা দিলে অপমানিত হতে হয়। অতিরিক্ত নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে নেশা নিরাময় আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে ভর্তি হলে প্রতি মাসে প্রায় ৪০-৫০ হাজার করে টাকা দিতে হয়। নেশা করার আগে নিয়ন্ত্রণের চিন্তা না করে অতিমাত্রায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে নিরাময় আশ্রয় চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে এ দেশে।
এসব উচ্চ শিক্ষিত নেশাগ্রস্ত ছেলেদের কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়িদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। ভালোভাবে খোঁজ-খবর না নিয়ে উচ্চশিক্ষিত দেখে মেয়ে বিয়ে দিয়ে প্রথমে দম্ভ আর অহংকারের শেষ নেই। আত্মীয়-স্বজনসহ পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে শুধু একই কথা- জামাই বাংলাদেশের পড়ালেখা শেষ করে ফেলেছে। একাধিক ডিগ্রি নিলে দেশের বাইরে যেতে পারবে। শত হলেও উচ্চশিক্ষিত জামাই, লেবু ছাড়া ভাত খেতে পারে না। দামি ফার্নিচার না দিলে মান-সম্মান থাকে না। শিক্ষিত জামাই হিসেবে ঈদে দামি পোশাক-আশাক দিতেই হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই মেয়েকে পিটিয়ে পাঠায় বাপের বাড়িতে টাকা আনার জন্য। মেয়ে শুধু কান্দে আর চোখের পানি ফেলে। ক্রমান্বয়ে জানতে পারে জামাই বাবা নেশা করে। শ্বশুরবাড়ি, নিজের পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজনকে অশান্তিতে রাখার জন্য একজন নেশাখোরই যথেষ্ট।
নেশা থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এবং সংস্কৃতি চর্চার দিকে নিজেকে ধাবিত করা। সেই সঙ্গে ছোট হোক বড় যে কোনো কর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক
বক্তৃতা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ঢাকা।
চরাই-উৎরাই অতিক্রম করে গোটা জাতি আনন্দ-উদ্দেলে অতিক্রম করল একটি বছর। একই সময়ে দুটো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা এলো ৫ আগস্ট বর্ষপূর্তিতে। গণঅভ্যুত্থানের প্রারম্ভে যে গণআকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে প্রথমত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দল পেশাজীবীরা, সুশীল সমাজ এবং সর্বস্তরের জনসাধারণের পক্ষ থেকে যে পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষা প্রদর্শিত হয়েছে- তা এক কথায় অভূতপূর্ব। বিগত অর্ধ শতাব্দী যাবত রাজনৈতিক সরকারগুলো যে যথাযথভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গ্রাহ্য করেনি, এই অভ্যুত্থান এবং অভ্যুত্থান পরবর্তী দাবি-দাওয়ার বেশুমার প্রদর্শন- জমে থাকা হতাশারই প্রমাণ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমাবদ্ধতা সচেতন মানুষ জানেন। তার পরও অসচেতনভাবে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গন, সচিবালয় এমনকি প্রধান উপদেষ্টার আবাসস্থল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে জনগণের আবেদন ও আন্দোলন। এককভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই হিমালয়সম ক্ষোভ ও ক্রোধকে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অক্ষম। তাই সঙ্গতভাবেই জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত সরকারের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধানত তিনটি প্রত্যয় নিয়ে সরকার তার যাত্রা শুরু করে। প্রথমত এটি বৈষম্যের নিরসন। দ্বিতীয়ত এটি সংস্কার প্রস্তাবণা। তৃতীয়ত এটি গণহত্যাকারী পতিত সরকারের বিচার। বৈষম্যের নিরসন এমন একটি গণদাবি যার সঙ্গে জড়িত আছে কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘকাল ধরে বঞ্চনার ইতিহাস। আর সংস্কার প্রস্তাবণা এতই দীর্ঘ এবং অগণিত যে হিসেব-নিকেশ এক রকম অসম্ভব। সরকার এইসব সংস্কার বা মেরামতের সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করে। অবশেষে ৬টি কমিশনের মৌলিক বিষয়বস্তু নিয়ে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অসম্ভব ধৈর্য্য ও কুশলতার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য অর্জনের চেষ্টা করে। বাংলাদেশের জনচরিত্র বিভেদের-ঐক্যের নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঙন প্রক্রিয়া গভীরভাবে অবলোকন করলেই এই দ্বন্দ্ব, কলহ, কোন্দল ইত্যাদির প্রমাণ মেলবে। ৩০টিরও অধিক রাজনৈতিক দল এই সংলাপে অংশগ্রহণ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর শতভাগ একমত হওয়া অসম্ভব কল্পনা। তবে গরিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেশিরভাগ বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করলেই- কমিশনের স্বার্থকতা প্রমাণিত হবে। যদিও কতিপয় মৌলিক বিষয়ে একমত হয়নি রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তবে যা অর্জিত হয়েছে এই দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষের দেশে, তাও কম নয়।
সংস্কারের প্রধান প্রধান বিষয়গুলো ছিল সংবিধান, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রণয়ন, নির্বাচন ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ, গণপ্রতিনিধিদের সীমিত স্বাধীনতার গ্যারান্টি, আমলাতন্ত্রের জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা নির্ধারণ, শাসন ও বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনগুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর নিযুক্তির ন্যায্যকরণ। রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন কোনো দিক নেই যে সংস্কারের আবেদন উত্থাপিত হয়নি। রাষ্ট্রের মৌলিক ১৯ সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একমত হয়েছে। এসব বিষয়গুলো হচ্ছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নমনীয় করণ, কমিটির ভাগাভাগি, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমাসংক্রান্ত বিধান আইনানুগকরণ, বিচার বিভাগীয় বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা সীমিতকরণ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিটি গঠন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, সংসদের উচ্চ-কক্ষ গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিধান ইত্যাদি। এসব বিষয়ে সাধারণ ঐকমত্য অর্জন সরকারের একটি বড় সাফল্য। এদিকে সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের দাবি এবং ব্যবস্থাপনাও এগিয়ে চলেছে। সেই কারণে ৫ আগস্টের সুন্দর সময়ে সরকার একই সঙ্গে দুটো গুরুত্বপূর্ণ দায় এবং দায়িত্ব পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
যে ঘোষণাপত্রটি প্রকাশিত হতে পারত অভ্যুত্থানের পরপরই, সেটি অবশেষে প্রকাশিত হলো। জুলাই বিপ্লবের প্রতি রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির অঙ্গীকার রেখে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঘোষণাপত্রে ২৮টি দফা রয়েছে। এখানে ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের স্বীকৃতি রয়েছে। ঘোষণাপত্রের ২৪ নম্বর দফায় গণঅভুত্থানের শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে। ঘোষণাপত্রের শেষ কথা এ রকম, ‘৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হলো’। এই ঘোষণার মাধ্যমে বহুল প্রতিক্ষীত একটি বিষয়ের মীমাংসা হলো। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতারা বারবার এ ধরনের একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য দাবি জানিয়ে আসছিল। তারা নিজেরা ঘোষণাটি প্রদান করবে এ রকম তারিখও দু-একবার দিয়েছে। সর্বশেষ এনসিপি বলেছিল ৩ তারিখে জনসমুক্ষে ঘোষণাটি প্রকাশ করা হবে। সরকার তাদের আশ্বস্ত করায় তারা হয়তো সরকারকেই এই ঘোষণার আইনানুগ ঘোষণাকারী মনে করেছে। ঘোষণাটি অনেককে তুষ্ট করেছে। আবার রাজনৈতিক দলের কয়েকজন জুলাই ঘোষণায় সন্তুষ্ট হননি।
৫ আগস্ট ২০২৫ জাতীয় জীবনে গৌরবময় দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের পরপরই প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কাল ঘোষণা করেন। আগামী বছর, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই নির্বাচন আয়োজন করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকাররের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি পাঠানোর কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইতোমধ্যেই সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত চিঠি নির্বাচন কমিশন বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে কমিশন যেন রমজান মাস শুরুর আগে ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। জুলাই ঘোষণাপত্র, জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যার বিচার ও সংস্কারসহ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তার ভাষায়, ‘এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা, নির্বাচন অনুষ্ঠান। এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।’
নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন দূরত্ব ছিল। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন অনুষ্ঠানে বারবার ওয়াদা করছিলেন বটে, তবে সঠিকভাবে সুনির্দিষ্টভাবে তিনি কোনো কথা বলেননি। রাজনৈতিক দলগুলো স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনমুখী। যে দলটি যতটা প্রত্যয়ী তারা তত জোড়ে-সোরে নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছিলেন। এই অনিশ্চিত অবস্থাটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে বেশ দ্বন্দ্বিক অবস্থা তৈরি করে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডন বৈঠকে। রাজনৈতিক মহলে মোটামুটি স্বস্তি ফিরে আসে। তবে অন্য দলগুলো বিএনপির এই প্রাধান্যের বিরোধীতা করে। যাহোক ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সালে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হবে এরকম আশ্বাসের পর রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটে। সেই ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্টের এই ঘোষণা এসেছে। এই ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো যে সংশয় ও সন্দেহে ভুগছিলেন তার অবসান ঘটে। কিন্তু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দল জুলাই ঘোষণা এবং নির্বাচনের তারিখ নিয়ে অস্বস্তির কথা বলেছে। তবে কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচন নাকোচ করা বা প্রতিরোধের কথা বলেনি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে গুজব ছিল যে ঘোষিত সময়সীমার বিপক্ষে অবস্থান নেবে বিএনপির পরের ধারার ডান-বাম রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু অসম্পূর্ণতা, অগ্রহণযোগ্যতা ও অসহযোগিতার কথা উচ্চারিত হলেও প্রত্যাখ্যাত হয়নি ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্র ও নির্বাচনের দিন-ক্ষণ।
আগেই বলা হয়েছে বিএনপি স্বস্তির মধ্যে ছিল। এই ঘোষণা দুটোর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হবে এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচন ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে, বিএনপি তা স্বাগত জানায়। আমরা বিশ্বাস করি এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবিকতা, সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি নতুন, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি তৈরি হবে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণাকেও ইতিবাচকভাবে নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বৈঠকে এই সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে গণতন্ত্রের উত্তরণের পথ সুগম করবে। তিনি নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। একই সঙ্গে সব রাজনৈতিক দল ও জনগণকে নির্বাচনকে সফল করে গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। মির্জা ফখরুল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, আহতদের প্রতি সহানুভূতি ও সুস্থতার জন্য দোয়া করেন।
অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দাবি করেন জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন আমরা লক্ষ্য করছি, নির্বাচনের উপযুক্ত যে পরিবেশ থাকার কথা ছিল তা সরকার এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। এ জন্য প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত টাইমলাইন অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তার আইনি ভিত্তি দিতে হবে। অতীতে বিভিন্ন অভ্যুত্থান ও আন্দোলন হয়েছে- পরবর্তী সময়ে তার আইনি ভিত্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন- ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর লিগাল ফ্রেম ওয়ার্কের ভিত্তিতে ৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদে ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুমোদন হয়েছিল। জাতীয় ইতিহাসে এ ধরনের আরও ঘটনার উল্লেখ করে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিতে তিনি নির্বাচন সম্পন্ন করার দাবি জানান। বাংলাদেশের মতো শতধাবিভক্ত ও রাজনৈতিক ঝগড়ায় নিত্য নিয়োজিত নেতৃত্বকে একটি সমন্বিত ও সম্মিলিত ধারায় একত্রীকরণ একটি সুকঠিন কাজ। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ যে তারা যতটা সম্ভব ‘বিরোধের মাঝে ঐক্য’ নিশ্চিত করতে পেরেছেন। জুলাই ঘোষণাপত্র এবং নির্বাচন সম্পর্কে দোলাচলে ছিল দেশবাসী। ঘোষণার পরে গরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলো এক বাক্যে নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন যে প্রধান ধারার বিপরীতে অবস্থানকারী শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কিনা। এটি সন্তোষের বিষয় যে অবশেষে ওইসব রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিক্রিয়া সমালোচনা সত্ত্বেও নির্বাচনী দিন-ক্ষণকে মেনে নিয়েছে। জুলাই ঘোষণা সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রিয়া -প্রতিক্রিয়ায় অস্বস্তি লক্ষ্য করা গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি আগের মতো এসব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগেরমাধ্যমে মতামত জেনে নিতেন, তাহলে অদৃশ্যমান বিভেদটি দৃশ্যমান হতো না। তবে নাগরিক সাধারণ জুলাই ঘোষণার বাস্তবায়ন, জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে নির্ধারিত সংস্কারগুলো সর্বোপরি নির্বাচনের শতভাগ নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তিনটি উপায়ে নাগরিক সাধারণের এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান করা যায়। প্রথমত সকল রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বাক্ষরে জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা যায়। দ্বিতীয়ত অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানের স্বীকৃত সংশোধনীর প্রকাশ ঘটানো যায়। তৃতীয়ত রাষ্ট্রপতি তথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আইনানুগ ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সংস্কার কার্যক্রম এবং প্রশাসনিক দায়-দায়িত্বের ঘোষণা দেওয়া যায়।
লেখক: সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক ভিসি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের দেশের বহুল আলোচিত কিছু শব্দের মধ্যে ‘দুর্নীতি’ অন্যতম। কম বেশি সবাই এ নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করে থাকে। আলোচনার সময় মনে হয় সবাই দুর্নীতিকে অপছন্দ তো করেই; অনেকে তীব্র ঘৃণাও করে। যারা ক্ষমতায় থাকে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলে, যারা ক্ষমতায় থাকে না তারাও বলে, সাধারণ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলে, নাটক-সিনেমা, গল্প সবজায়গায় যে যেভাবে পারছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করছে। দৃশ্যত সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে থাকলেও এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দুর্নীতি আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যার মধ্যে একটা কেন? কোনোভাবেই কেন দুর্নীতির মোহ এবং গ্রাস থেকে আমাদের সমাজ মুক্ত হতে পারছে না?
আমাদের কাছে এই দুর্নীতি আসলে একটা দুর্বোধ্য বিষয়। অনেকে হয়তো ভাবছেন এটা আবার কেমন কথা? দুর্নীতি তো দুর্নীতিই। এটা দুর্বোধ্য হওয়ার কি আছে। কেন এটা দুর্বোধ্য সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমাদের বেশিরভাগ মানুষের চোখেই দুর্নীতির কথা বললে সরকারি অফিসে স্তূপ করে রাখা কিছু ফাইলের কথা মনে পড়ে যায়। অর্থাৎ দুর্নীতি হচ্ছে টাকার বিনিময়ে কিছু ফাইলের ফলপ্রসূ আদান প্রদান। টাকার বিনময়ে বিভন্ন সিদ্ধান্ত বা কাজ পাওয়া অবশ্যই দুর্নীতি তবে এটাই দুর্নীতির মূলকথা না। দুর্নীতি এরচেয়েও অনেক ব্যপক বিষয়। দুর্নীতির সহজ ও মিনিংফুল সংজ্ঞা হচ্ছে, অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাক্তিগত লাভের জন্যে অনৈতিক ও অবৈধ কাজ করা। এই সংজ্ঞায় একটা ছোট দুর্বলতা রয়ে গেছে। এখানে বলা হয়েছে কেউ যদি অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করে। অর্থাৎ, দুর্নীতি করতে হলে ক্ষমতা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি মানে অবৈধ এবং অনৈতিক কাজ করা। কেউ যদি অবৈধ এবং অনৈতিক কাজ করতে সহযোগিতা করে তাহলে সংজ্ঞা অনুযায়ী সরাসরি তাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাচ্ছে না। আর এই সুযোগটাই আমরা হর হামেশা নিয়ে যাচ্ছি।
আমি তখন সবে এইচ এস সি পাস করে একটা স্বনামধন্য কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে ক্লাস করা শুরু করেছি। ঢাকা ইউভার্সিটির পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতেও ভর্তি পরীক্ষা দেব বলে সিদ্ধান্ত নেই। তবে দুটো সাবজেক্ট ছাড়া আর কিছুতে ভর্তি হতে মন চাইছিল না। বিবিএ এবং ইংলিশ লিটেরেচার। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে নির্ধারিত দুই দিনে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। গাবতলি থেকে বাসের ছাদে করে যাতায়াতের সময় আমার এক সহপাঠীর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং বেশ সখ্যতার জন্ম নেয়। প্রথম দিন বিবিএ ভর্তি পরীক্ষা ছিল। পরের পরীক্ষা ইংলিশ। বেশ কঠিন প্রশ্ন এসেছিল। পরীক্ষা হলে প্রশ্ন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল যে ইংলিশ লিটেরেচারের প্রশ্ন যত কঠিন হবে আমার চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে। যাই হোক পরীক্ষা দিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে বের হলাম। আমার সেই নব্য বন্ধুর সঙ্গে দেখা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে পরীক্ষা কেমন হয়েছে। দেখলাম ও ‘ভালো’ বলে মিটিমিটি হাসছে। দুজনে আবার বাসের ছাদে উঠলাম। দুটো পরীক্ষাই আমার দারুণ হয়েছে। মনে মনে ভাবছিলাম আসন মাত্র আশিটা (যতদূর মনে পড়ে) তাতে কি আমার পজিশন দুটোতেই দশের মধ্যে থাকবে। হঠাৎ আমার সেই নব্য বন্ধু হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল ‘সব কমন পড়েছে না?’ আমি উত্তরে বললাম, ‘ভর্তি প্রশ্ন আবার কমন পড়ার কি আছে? আমার প্রিপারেশন ভালো ছিল। দারুণ পরীক্ষা দিয়েছি’। ও তখন বেশ সিরিয়াস হয়ে গেল। ‘মঙ্গলবারে যে প্রশ্ন আউট হয়েছিল সেটা তুমি পাউনি? ইংলিশ, বিবিএ দুইটার প্রশ্নই তো আউট হয়েছে।’ আমার মাথায় মনে হলো বাজ পড়ে গেছে। পরে জানলাম প্রতি প্রশ্ন পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল। হুবহু সেই প্রশ্নগুলোই এসেছে। রেজাল্ট বের হলে দেখলাম আমার সেই নব্য বন্ধু ভর্তি হচ্ছে আর আমার নাম ওয়েটিং লিস্টের বার নম্বরে। এখনো সেই অনুভূতি আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। আমার মেধা, আমার শ্রম কিভাবে অপমানিত হয়েছিল সেটা অগ্রহণযোগ্য। এভাবে আমাদের দেশে এ পর্যন্ত আমার ধারণা লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ হয় প্রশ্ন আউটের সুযোগ নিয়ে বা অন্য কোনো অবৈধ পন্থা বা সুপারিশের মাধ্যমে ভর্তি হয়েছে বা চাকরি পেয়েছে। তারা কি আসলেই মন থেকে দুর্নীতিকে ঘৃণা করে?
আমি এমন অনেক ক্ষমতাশালী সৎ মানুষ দেখেছি যারা ঘুষ খায় না। টাকা পয়সার বিষয়ে খুবই স্বচ্ছ; কিন্তু সুপারিশের মাধ্যমে নিজের কাছের মানুষদের আর্থিক বা অন্য কাজ পাইয়ে বড় ধরনের সুযোগ করে দিচ্ছে। অযোগ্য কাউকে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কোটিপতি করে দিচ্ছে। আর্থিক লেনদেন না করলেও সেই ক্ষমতাধর ব্যাক্তিকে আপনি কি দুর্নীতিগ্রস্ত না বলে থাকতে পারবেন? সুপারিশ খুব পরিচিত একটা শব্দ। চাকরির ক্ষেত্রে, সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে, কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে, কিছু সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মের বাইরে আমরা প্রতিনিয়ত অমুক নাহলে তমুকের কাছে ধরনা দিচ্ছি। আমি যখন নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো সুবিধা পাচ্ছি সেটাই কিন্তু অনিয়ম এবং দুর্নীতি। যেখানে আমাদের অনেকেই প্রতিনিয়তই ক্ষমতাধর কারো সুপারিশ নিয়ে হাজির হচ্ছি সেখানে দুর্নীতিকে আসলেই কি আমরা মন থেকে ঘৃণা করতে পারছি?
আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার সময় খুব সোচ্চার; কিন্তু অনেকে সুযোগ পেলেই দুর্নীতির মাধ্যমে সুবিধা নিতে প্রস্তুত। এই মানসিকতাই আমাদের সমাজে দুর্নীতির টিকে থাকার মূল গল্প। এছাড়াও আরও কিছু বিষয় আছে যেসব কারণে আমাদের ভেতরে দুর্নীতি শক্তিশালী অবস্থান গেঁড়ে আছে। মানুষ আপনার সফলতা দেখতে চায়। আপনি কিভাবে সফল হলেন সেটা মুখ্য না। সফলতা অর্জনে কোনো এক পর্যায়ে অসৎ হয়েছিলেন কিনা সেটা অনেকের কাছে কোনো বিষয়ই না। এর জন্যেই যেকোনোভাবে আমরা সফল হতে চাই। যে ব্যক্তি অনিয়মের মাধ্যমে সফল হচ্ছে সে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে দ্বিতীয়বার ভাববে না।
দুর্নীতিতে আকৃষ্ট হওয়ার জন্যে আমাদের দেশের সিস্টেম অনেকাংশে দায়ী। যেহেতু আমাদের দেশের অনেকেই দুর্নীতিতে আসক্ত তাই কর্মক্ষেত্রে সুযোগ পেলেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া কেউ যদি দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে চায় তাহলে সে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে যায়। একটা দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে অসৎ মানুষেরা যত সহজে সবাই এক হয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করে সৎ মানুষেরা কিন্তু তত সহজে এক হয়ে কাজ করতে পারে না। কারণ সৎ মানুষেরা একটু নন কম্প্রোমাইজিং হয়। এর কারণে কর্মক্ষেত্রে একজন অসৎ মানুষ তার অসৎ বসের কাছ থেকে চাকরিতে যে সুবিধা পেয়ে থাকে একজন সৎ মানুষ তার সৎ বসের কাছ থেকে ঠিক একই ধরণের চাকরি সংক্রান্ত সুবিধা পায় না। এ কারণেই অসৎ মানুষেরা কোনো একটা প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থায় অনেক সংগঠিত হয়ে অসৎ কাজ করে যেতে থাকে।
আমরা যতই বলি না কেন দুর্নীতি আমাদের দেশ থেকে সহজে যাবে না। আমাদের মন মানসিকতায় এক ভয়াবহ বিকৃতি ঘটেছে। আমরা ক্ষমতা চাই ক্ষমতা অপব্যবহার করার জন্যে, ক্ষমতা দিয়ে ভুলকে ঠিক করার জন্যে না।হয়তো কেউ কেউ ক্ষমতাকে অর্পিত দায়িত্ব হিসেবে মেনে নিয়ে ভালো কাজ করে যাচ্ছেন তবে সে সংখ্যাটা খুবই কম। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে না তুললে কোন ফল পাওয়া যাবে না। একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষকে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। সরকারিভাবেও কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতি বছর ভালো কাজের জন্যে সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত করা হয়। অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষকে কখনো তিরস্কার করতে দেখি নাই। প্রতি বছর দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের লিস্ট করে জনসম্মুখে আনতে হবে। তাহলে দেখবেন তারা সামাজিকভাবে লজ্জায় পড়বে। খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখবেন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এমন কিছুই করা হয় না। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বা পত্রিকায় সফল মানুষদের নিয়ে প্রতিবেদন করা হয়। অথচ সবচেয়ে বেশি প্রতিবেদন দরকার সৎ মানুষ এবং অসৎ মানুষদের নিয়ে। একজন সৎ মানুষকে শুধুমাত্র সততার ক্যাটাগরিতে অফিসিয়ালি কাউকে স্বীকৃতি দিতে দেখিনি। সৎ এবং অসৎ এই ধরনর মানুষকেই সমাজে পরিচিত করিয়ে দিতে হবে। সমস্যা হচ্ছে অসৎ মানুষদের কোরাম এত বেশি শক্তিশালী যে তাদের স্পর্শ করা সম্ভব না। তারচেয়ে বড় কথা আমরা রিয়েক্ট করি শুধু ভাইরাল হওয়া দুর্নীতিতে। অন্যসব দুর্নীতিতে চোখ বন্ধ করে না দেখার ভাণ করে থাকি। কারণ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা মনে প্রাণে দুর্নীতিকে ঘৃণা করি না বরং বুঝে না বুঝে দুর্নীতি করার সুযোগ খুঁজতে থাকি।
লেখক: কথাশিল্পী ও নাট্যকার
সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি ঘোষণা আসার পর থেকেই অনেক রাজনৈতিক মহলের ধারণা এই পুলিশ বাহিনী দিয়ে নির্বাচন? কিন্তু আমাদেরত একটি গর্বিত চৌকস সাহসী সেনাবাহিনী আছে। এদের দায়িত্ব, নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ন নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। দেশের ক্লান্তিলগ্নে সে দৃষ্টান্তত বহুবার দেখিয়েছে।
এদের নৈতিকতার জন্য জনগণ ও আস্থা রাখে। আমরা কেন এদেরকে কাজে লাগাতে পারব না? অবশ্যই তা সম্ভব। দরকার শুধু সুষ্ঠ পরিকল্পনা। আমরা কি ভুলতে বসেছি ছাত্র ও জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ও ক্ষমতার মসনদ ঠিক রাখার জন্য স্বৈরাচারী সরকার দমন-পীড়ন সমানতালে চালাচ্ছে। এরি মধ্যে অনেক লোকের জীবনহানি হল কিন্তু সরকারের টনক নড়ছে না। তারা জনগণের ভাষা না বুঝে চরম দাম্ভিকতার উচ্চ শিখরে আরোহন করছিল। যেখানে ক্ষমতাই মূখ্য। জনগণ বিবেচ্য বিষয় নয়। ঠিক তখনই দেবদূতের মত দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান ৩ আগষ্ট/২৪ স্বৈরাচারী সরকারকে ছাপ জানিয়ে দিলেন ---জনগণের ওপর সেনাবাহিনী গুলি চালাতে পারবে না। তখনই জনতার আন্দোলনের মোড় ঘুরে গেল । সেনাবাহিনীর এই ভূমিকার কারণে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।পৃথিবীর সব দেশেই গণঅভ্যুত্থানে অমনটি হয়ে থাকে। আমাদের সেনাবাহিনী যে কোন দুর্যোগমুহূর্তে জনগণের পাশে থেকে সাহায্যের হাত বাড়ায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ অগ্নি নির্বাপক, জঙ্গি দমনে অতীতে সেনাবাহিনী বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্তের প্রতীক আমাদের গর্বিত সেনাবাহিনী। এরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নির্বাচনে সহযোগিতা করে আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জন করে আসছে। বিশ্ববাসী এদের ওপর নির্ভর করতে পারে। শেখ হাসিনা তার স্বার্থ হাসিলের জন্য জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সময় এদেরকে কোনঠাসা করে রাখতেন। এখন সময় এসেছে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোর।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করার পর থেকে রাজনৈতিক দলসমূহ নড়েচড়ে বসেছে। বাংলাদেশের জনগণ প্রায় ১৫ বছর যাবত সুষ্ঠু নির্বাচন দেখেনি। সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কারণে ভোট কেন্দ্রে যাওয়াটা ও অনেকে ভুলতে বসেছে। গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই। সকল মতের সকল মানুষের অংশগ্রহণে যে নির্বাচন হয় সেই সংসদ হয় জনগণের। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসলে দেশের অর্থনীতি হয় ভঙ্গুর। যেখানে আমাদের পুলিশ সড়কের নিরাপত্তা দিতে পারে না সেখানে কিভাবে ভোট কেন্দ্রে নিরাপত্তা দেবে? পুলিশের দায়িত্ব হীনতার কারণে যে দেশে ঐকমত্যের ভিত্তিতে চোখের এক পলকে খনিজ মূল্যবান সম্পদ সাদা পাথর লুট হয়ে যায় সে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ভাবাটা দুরূহ ব্যাপার। অবশ্য সাদা পাথর ও সেনাবাহিনী কতৃক উদ্ধার হয়েছে। তাছাড়া দেশে একটি প্রচলিত কথা আছে ১০টা হোন্ডা ১০টা গুন্ডা থাকলেই নির্বাচনে জেতা কোনো ব্যাপার না। অমনটি হলে এত বিপ্লব মানুষের ত্যাগ বৃথা যাবে। মানুষ আশাভঙ্গ হবে। এদের দায়িত্ব কর্তব্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন আছে। দেশে এখন পুলিশের সাংগঠনিক ক্ষমতা ও মনোবল নিম্ন পর্যায়ে। এদের কারণে মব সন্ত্রাস দিন দিন বেড়েই চলছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়।এমন অবস্থায় ভালো নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবয়ব,আয়তন ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শান্তি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো রেখে নির্নাচন করতে হলে সেনাবাহিনীর বৃহত্তর ও কার্যকর অংশগ্রহণ দরকার। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লাগবে। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ এখন মাঠে আছে পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য। সেনাবাহিনী মাঠে থাকা স্বত্বেও
৫ আগস্টের পর পুলিশ এর মাঝে এখনো শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। তাইত বাস্তবতার নিরিখে ইসির নির্বাচন বিষয়ক প্রস্তাবনায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পরিবর্তন আসবেই। এই পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অনেক বেড়ে যাবে। বিদ্যমান আইনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সংজ্ঞায় বলা আছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অর্থ হলো: পুলিশ বাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, ব্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, আনসার বাহিনী ব্যাটালিয়ন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এবং কোস্ট গার্ড বাহিনী। সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্যে ২০০১ সালে আরপিওতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করা হয়েছিল। এই বিধানটি ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী সরকারের আমলে ২০০৯ তাদের অশুভ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই আইনটি বাদ দেওয়া হয়। আইনে সশস্ত্র বাহিনী সংজ্ঞাভুক্ত না থাকলে নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বাধ্যবাধকতা থাকে না। কিন্তু গত তিনটি নির্বাচনের আগে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপে অনেকই সশস্ত্র বাহিনীকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত দাবি জানিয়েছিল। আওয়ামী লীগ বিষয়টি আমলে নেয়নি। বিগত তিনটি নির্বাচনে সেনাবাহিনী টহলরত ছিল কিন্তু একটা আনসারের যে ক্ষমতা ছিল তাও ছিল না। এতে ভোট কারচুপি করে নির্বাচনের আয়োজনকে বিতর্কিত করেছেন।
বর্তমানে নির্বাচন সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায়’ সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর ‘যুক্ত করার প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আইনে এটি যুক্ত হলে তিন বাহিনীকে নির্বাচনী দায়িত্ব নিতে আলাদা কোন আদেশের প্রয়োজন হবে না। এই আইনের আওতায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ও পুলিশের মতো ভোট কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এবং বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবেন।
বর্তমান সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপারে আরপিও ৮৭ ধারায় আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর ক্ষমতার বিষয়ে বলা আছে। যেমন এই আইন অনুযায়ী পুলিশ কর্মকর্তা না হলে ও নির্বাচন সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনরত ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার’ কোনো সদস্য ভোটের দিন ভোট কেন্দ্রে বা ভোট কেন্দ্রের ৪০০ গজ ব্যাসার্ধের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্বাচনী অপরাধের জন্য যে কোনো ব্যাক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারেন। ইসি সেভাবে প্রস্তাবনা তৈরি করেছেন সেভাবে আইনে সংশোধনে এলে সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচনের সময় এ ক্ষমতাগুলো প্রয়োগ করতে পারবে।
আওয়ামী সরকারের আমলে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনে সংজ্ঞাভুক্ত না থাকলেও নির্বাচনগুলোতে সেনা মোতায়ন করা হয়েছিল। সেখানে দায়িত্ব ছিল --ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার- এর (বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার উদ্দেশ্য) আওতায়। এভাবে মোতায়ন করা হলে মূলত স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে দায়িত্ব হলো- স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নির্বাচনী এলাকায় নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় তারা অবস্থান নেয়, প্রয়োজনে টহল দেয়। রিটার্নিং কর্মকর্তা বা ম্যাজিষ্ট্রেটের নির্দেশে তারা কাজ করে।
ফাউন্ডেশন ফর ষ্ট্রেটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (এফ-এস ডিএস) মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর একটি সেমিনারে বলেন, ‘সেনাবাহিনীকে শুধু স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রাখার মানি হবে অরাজকতা তৈরির সুযোগ করে দেওয়া এবং বিপুল অর্থের অপচয়। আমি মনে করি সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞাভুক্ত করে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সযোগ)তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হোক। এতে জনগণ ভোট দিতে উৎসাহ পাবে।’
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করতে হলে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। আমি মনে করি সেনাবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত রাখতে হবে। ভোটের তিন মাস আগে তাদের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব দিতে হবে। ভোটের পরেও কমপক্ষে ১০ দিন সেনাবাহিনী মাঠে থাকতে হবে। একদম তৃণমূল পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সমন্বয় কমিটি হবে সেখানে সেনাবাহিনীকে রাখতে হবে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য ৮০ হাজার সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করবেন। নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবচেয়ে ইতিহাসের সেরা যে নির্বাচন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তা সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সরাসরি সংযুক্ত রাখতে হবে। ফোর্স স্বল্পতার কারণে ভারতের মত একাধিক দিবসে ----যেমন ৮টি বিভাগের জন্য ৪ দিনে সংসদ নির্বাচন করা যেতে পারে। তাহলে নিরাপত্তার বিষয়টি ১০০% নিশ্চিত হবে। বিশ্বের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো উত্তম সময় এসেছে । এরা যদি শান্তি মিশনে নিরাপত্তা দিতে পারে আমাদের দেশে পারবে না কেন? তবে জনগণকে ও সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করতে হবে তাহলেই দেশে একটি উৎসব মুখর নির্বাচন করা সম্ভব।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট
বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব কম নেতাই আছেন, যাঁরা দীর্ঘ নির্বাসনেও জনতার হৃদয়ে থেকেছেন সংগ্রামের প্রতীক হয়ে। তারেক রহমান- শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান। শুধু রাজনৈতিক উত্তরাধিকারেই নয়, নিজের যোগ্যতা ও দৃঢ়তায় আজ দেশের আপামর মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জাতীয় মর্যাদা রক্ষা ও ভবিষ্যতের নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় আশ্বাস । দীর্ঘ ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রবাসে থেকেও তিনি হার মানেননি- রাজপথে না থেকেও রাজপথের প্রতিটি আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হয়েছেন। তাঁর ডাকেই সংগঠিত হয়েছে লাখো কর্মী, জেগে উঠেছে ছাত্রসমাজ, তীব্র প্রতিবাদে কেঁপে উঠেছে স্বৈরাচারের ভিত।
অন্যদিকে গত দেড় দশক বাংলাদেশ ছিল ফ্যাসিবাদ, দুর্নীতি ও বিদেশি স্বার্থরক্ষার এক দীর্ঘ অন্ধকারে নিমজ্জিত- যেখানে শেখ হাসিনা ক্ষমতার লোভে জাতির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করেছেন। ঠিক এই অন্ধকারের মাঝেই তারেক রহমানের দৃঢ় বিশ্বাস, সুদূরদৃষ্টি ও অবিচল সংগ্রাম আজ জাতির জন্য হয়ে উঠেছে মুক্তির একমাত্র অপ্রতিরোধ্য আলোকবর্তিকা । বাংলাদেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে যখন দেশ নতুন পথের সন্ধানে, তখন জনমানসে একটি প্রত্যাশা ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে- তারেক রহমানের নেতৃত্বেই শুরু হবে স্বাধীন, সমৃদ্ধ ও মর্যাদাবান বাংলাদেশের নতুন অধ্যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিষ্ট শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনকাল ছিল এক গভীর অন্ধকারের সময়, যেখানে জনগণের অধিকারকে নির্মমভাবে পিষে দেওয়া হয়েছিল ক্ষমতার স্টিমরোলারের নিচে।
অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের বন্ধুত্ব। বিনিময়ে ভারতকে দিয়েছেন এমন সব সুবিধা, যা দেশের সার্বভৌমত্বকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। সীমান্তে বারবার বাংলাদেশি নাগরিকদের রক্ত ঝরলেও, তিনি নীরব থেকেছেন; বরং নানা চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে ভারতকে একতরফা সুবিধা দিয়েছেন- ট্রানজিট, সমুদ্রবন্দর ব্যবহার, জলসম্পদে প্রাধান্য, এমনকি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক নীতিতেও দিল্লির প্রভাব বিস্তারের সুযোগ। এ দেশের কৃষক যখন তিস্তা নদীর পানির জন্য হাহাকার করেছে, তখনো শেখ হাসিনা ভারতের মন জোগানোর রাজনীতিতে ব্যস্ত ছিলেন। দেশের শিল্প, বাণিজ্য ও জ্বালানি খাতকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করে তোলার মাধ্যমে তিনি শুধু অর্থনীতিকেই দুর্বল করেননি, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তা, কূটনীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রতিটি স্তরে ভারতীয় প্রভাব এমনভাবে প্রবেশ করেছে, যেন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নয়- বরং প্রতিবেশী পরাশক্তির একটি প্রভাবাধীন প্রদেশ। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পরপরই প্রতিবেশী দেশ ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। তখন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের মুখে মুখে শোনা যেত- ‘ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক কিংবা দুবাইয়ের মতো।'
কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা করে ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করে। ধাপে ধাপে ভারত শুধু সড়ক নয়, রেল ট্রানজিটও আদায় করে নেয়। এর ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যের পণ্য এখন বাংলাদেশের সড়ক, রেল এবং জলপথ ব্যবহার করে আখাউড়া-আশুগঞ্জ হয়ে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে পৌঁছাচ্ছে।
এখানেই শেষ নয়- ভারতকে বাংলাদেশের চারটি নদীপথ ব্যবহারেরও অনুমতি দেওয়া হয়। এতে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ সরাসরি বাংলাদেশের পূর্ব দিক হয়ে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়- এই ট্রানজিট দিয়ে কি বাংলাদেশ সত্যিই সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক বা দুবাইয়ের মতো সমৃদ্ধ হয়েছে? সোজা উত্তর- না, হয়নি। বরং, দৈনিক আজকালের খবর পত্রিকার (৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন- 'ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার ফলে ১৬ বছরে বাংলাদেশ আয় করেছে মাত্র ৩৭ লাখ টাকা, অথচ কেবল ট্রানজিটের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যয়েই খরচ হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।' অর্থাৎ যে ট্রানজিটকে উন্নয়নের সোনার হরিণ বলা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এক বিশাল আর্থিক ক্ষতির বোঝা এবং জাতীয় স্বার্থ বিসর্জনের প্রতীক।
শেখ হাসিনা যেভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় নিজ দেশের জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছেন, তা ইতিহাসে এক বিশ্বাসঘাতকতার উদাহরণ হয়ে থাকবে। ক্ষমতার লোভে আঞ্চলিক শক্তির কাছে দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়া এবং জনগণের ন্যায্য অধিকার উপেক্ষা করার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, তা থেকে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশের জন্য হবে দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রামের পথ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার আগমন ছিল এক প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ নারীর যাত্রা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর লন্ডনে প্রথম সফরেই বিবিসির খ্যাতিমান সাংবাদিক জন রেনারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন-রাজনীতি তার ভালো লাগে না, কিন্তু পিতা, মাতা ও ভাইদের হত্যার প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। সেই প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা পরবর্তীতে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি পদক্ষেপে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই ছিল শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য, আর সেই সঙ্গে তিনি শুরু করেন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা-যেখানে দেশের স্বার্থ সর্বদা ছিল শেষ প্রাধান্যে, আর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ ছিল সবার ওপর। ভবিষ্যতে যদি ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, তাহলে বিদেশে আশ্রয় নেওয়ার পথও তিনি আগেই সুসংহত করে রাখেন। পরিবারের সদস্যদের বিদেশি নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা ছিল সেই দূরদর্শী পরিকল্পনারই অংশ। আর বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য দেশের সম্পদ লুটপাটে তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা সব সময়ই ছিল সক্রিয়।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ থেকে পাচার করেছে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার- বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা (দৈনিক সমকাল, ২ ডিসেম্বর ২০২৪)। শুধু গত পাঁচ বছরের পাচারের অঙ্কই জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। এই অর্থ দিয়ে ৮৭টি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব ছিল। ২০০৯ সালে সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতনের সময় সেই ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ লাখ কোটি টাকায়।
মাথাপিছু ঋণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ টাকা। এই ঋণের বড় অংশই এসেছে বিদেশি ও দেশি উৎস থেকে, যার বিশাল অংশ লুটপাট হয়েছে মেগা প্রকল্পের নামে শেখ হাসিনার শাসনামলে মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতির চিত্র-
পদ্মা সেতু : উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, মাত্র ৬.১৫ কিমি দীর্ঘ পদ্মা সেতু নদীর ওপর নির্মিত, সিঙ্গেল রেললাইন, তৈরিতে সময় লেগেছে ৭ বছর ৬ মাস ২৬ দিন এবং খরচ ৩.৬ বিলিয়ন ডলার। সেখানে রাশিয়ার ক্রিমিয়া সেতুর দৈর্ঘ্য ১৮.১ কিলোমিটার, উত্তাল ব্লাক সির ওপর নির্মিত, ডাবল রেললাইন, তৈরিতে সময় লেগেছে মাত্র ৩ বছর এবং খরচ ৩.৭ বিলিয়ন ডলার। এই চিত্রে পদ্মা সেতুতে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে সেটা সহজেই অনুমেয়।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে শেখ হাসিনা একাই আত্মসাৎ করেছেন ৫৯ হাজার কোটি টাকা। (ঢাকা পোষ্ট, ১৮ আগস্ট ২০২৪)।
কর্ণফুলী টানেল : প্রতিদিন গড়ে ২৭ লাখ টাকার লোকসান, যার পেছনে অপরিকল্পিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত দায়ী। (ইত্তেফাক, ২৮ অক্টোবর ২০২৪)।
সড়ক ও অবকাঠামো খাত: বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তো বটেই, এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও বাংলাদেশে মহাসড়ক নির্মাণের ব্যয় কয়েক গুণ বেশি। ফলে মহাসড়ক নির্মাণ ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে। (প্রথম আলো, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫)। বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ ব্যয় ভারত ও চীনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি- প্রধান কারণ ছিল দুর্নীতি ও দরপত্রে প্রতিযোগিতার অভাব। ফ্লাইওভার নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি- বাংলাদেশের ব্যয় বিশ্বের শীর্ষে বিগত ৩১ মে, ২০১৬ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, “বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় ভয়াবহভাবে বেশি।
বাংলাদেশে কিলোমিটারপ্রতি ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় ঢাকা ফ্লাইওভার : ৩১৬ কোটি টাকা, মৌচাক মালিবাগ ফ্লাইওভার : ১৩৫ কোটি টাকা, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার : ১৮০ কোটি টাকা।
অন্যান্য দেশের তুলনা
মুম্বাইয়ের ইস্টার্ন ফ্রি হাইওয়ে ৮৮ কোটি টাকা, কলকাতার পরমা ফ্লাইওভার ৪৮ কোটি টাকা, চীন ও মালয়েশিয়া : ৮০-৯০ কোটি টাকা। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পগুলো শুধু ব্যয়বহুলই নয়, বরং সীমাহীন দুর্নীতি ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারি অর্থ লোপাটের একটি বড় উদাহরণ।
রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় ও জাতীয় সম্পদের ক্ষতিসাধনের গুরুতর অভিযোগে বারবার অভিযুক্ত হয়েছেন শেখ হাসিনা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্য অনুযায়ী, শুধু 'মুজিব শতবর্ষ' উদযাপনকে ঘিরেই শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল নির্মাণে অপচয় করা হয়েছে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা। সারাদেশে ১০ হাজারেরও বেশি ম্যুরাল ও মূর্তি নির্মাণে এই বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়, যা জনকল্যাণমূলক খাতে বিনিয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রচার ও ব্যক্তিপূজার উদ্দেশ্যে অপব্যবহৃত হয়েছে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, আহ্বায়ক, আমরা বিএনপি পরিবার ও সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল