আমাদের বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের অর্থনীতি অনেকটা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আদিকাল থেকেই এ দেশের মানুষ কৃষির ওপর জীবিকা নির্বাহ করত। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের চাহিদাও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করায় খাদ্যের উৎপাদন অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। চাষাবাদে আগের ধ্যান-ধারণা অনেক পাল্টে গেছে। বর্তমানে শিক্ষিত তরুণ-যুবকরা চাষাবাদে নিজেদের নিয়োজিত করে কৃষিকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। দেশের ধানচাষ হতে শুরু করে সবজিচাষে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
তাছাড়া মৎস্য, পোলট্রি, ডেইরিশিল্পেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। দেশের কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে পর্যন্ত রপ্তারি হচ্ছে। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শাক-সবজি, মাছ রপ্তানি হচ্ছে। দেশের বাইরে আমাদের দেশের কৃষিজাত পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। আমরা যদি এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারি তবে দেশের জন্য অনেক মঙ্গল হবে। আয় হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। দেশের তরুণ যুবকরা এখন আর গতানুগতিক চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেরা স্বনির্ভর হওয়ার লক্ষ্যে কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়োজিত করছে। ইতোমধ্যে অনেকেই বেশ সফলতার সঙ্গে এগিয়ে গেছে। সৃষ্টি করেছে অনন্য দৃষ্টান্ত। আমাদের সমাজে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ব্যবস্যায় নিয়োজিত হয়ে স্বনির্ভর হয়ে অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন।
অতীতের তরুণসমাজ আর বর্তমান তরুণসমাজের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বর্তমান সময়ের তরুণরা পড়ালেখার পাশাপাশি আত্মনির্ভর হওয়ার উপায় খোঁজে। যে কারণে আমাদের দেশ এবং জাতি তরুণরা আত্মনির্ভর হতে গিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা করছে, পোলট্রিশিল্প, ডেইরিশিল্প, মৎস্যশিল্পের মতো শিল্পে জড়িত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের অনেক তরুণ জনপ্রিয় মাশরুমচাষে নিয়োজিত হচ্ছে। স্বল্পপুঁজিতে অধিক লাভ হওয়া মাশরুমচাষে দেশের তরুণ সমাজের একটা অংশ নিয়োজিত আছে। মাশরুমচাষ সহজ হওয়ায় নারীরাও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসছেন। মাশরুম চাষ এখন একটা শিল্পে পরিণত হয়েছে। দেশে-বিদেশে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের মধ্যে মাশরুম এখন একটি জনপ্রিয় খাবার। যা আমাদের নানা রকমের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে।
মাশরুমের বিশেষ গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও মাশরুম আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত সহজলভ্য হয়নি। কিন্তু একটু সচেতন হলেই আমরা নিজেরাই আমাদের দৈনন্দিন চাহিদা নিজেরাই পূরণ করতে পারি। আমাদের দেশে সাধারণত খাবারের উপযোগী তিন জাতের মাশরুম চাষ হয়। ক) স্ট্র মাশরুম: ধানের খড়, শিমুল তুলা, ছোলার বেসন ও চাউলের কুড়া ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহার করে স্ট্র মাশরুমের চাষ করা হয়। আমাদের দেশে সাধারণত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এর চাষ করা যায়। খ) ইয়ার মাশরুম: সাধারণত বর্ষাকালে প্রাকৃতিকভাবে আমগাছে ইয়ার মাশরুম পাওয়া যায়। ইয়ার মাশরুম দেখতে কালচে রঙের হয়ে থাকে। ইয়ার মাশরুম সারাবছর চাষ করা গেলেও সাধারণত বর্ষাকালে এর ফলন ভালো হয়। গ) অয়েস্টার মাশরুম: আমাদের দেশে এই জাতের মাশরুমের চাষ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে।
সারা বছরই এই মাশরুম চাষ করা যায় তবে শীত এবং বর্ষাকালে এর ফলন ভালো হয়। অয়েস্টার মাশরুম খুব সহজে চাষ করা যায় এবং এর জন্য খুব অল্পজায়গার প্রয়োজন হয়। মাশরুম উৎপাদন কৌশল এবং চাষের উপযোগী স্থান সম্পর্কে জানা যায় মাশরুম খোলা জায়গায় চাষ করা যায় না আর তার জন্য আবাদি জমির প্রয়োজন পড়ে না। মাশরুম চাষ করার জন্য ছায়াযুক্ত জায়গায় ছন বা বাঁশের চালা দিয়ে ঘর তৈরি করতে হয়। মাটির দেয়াল দিয়েও ঘর তৈরি করা যায়। আবার বাঁশের বেড়াও দেওয়া যায়। ঘরের ভেতরে যাতে আলো প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বাঁশের বেড়ায় মাটি লেপে দিতে হয়। অয়েস্টার মাশরুম চাষ পদ্ধতি: ওয়েস্টার মাশরুম বীজ বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড় করে মাশরুম চাষ করা যাবে। ধাপে ধাপে মাশরুম চাষ করতে হয়। প্রাপ্ত তথ্য থেকে আরও জানা যায় পৃথিবীতে প্রায় ৩ লাখ প্রজাতির মাশরুম রয়েছে।
এগুলোর মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার প্রজাতি খাওয়ার অযোগ্য। আনুমানিক ১০ হাজার মাশরুমের ওপর গবেষণা চলছে। এদের ভেতর ১০ প্রজাতির মাশরুম খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে। মাশরুমচাষে বেশি লাভ হওয়ার কারণে আমাদের দেশে অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক এবং গৃহিণীরা মাশরুমচাষে এগিয়ে আসছেন। মাশরুম চাষ একটি লাভজনক ব্যবসা, ক্ষুদ্র বা ব্যাপক পরিসরে মাশরুম চাষ করা যায়। স্পন থেকে মাশরুম চাষ করা হয়। এই স্পনগুলো ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়। মাশরুম চাষ করতে গেলে সর্বপ্রথম সঠিক কর্মপরিকল্পনা করা প্রয়োজন। সঠিকভাবে কাজ পরিচালনা করার জন্য হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেওয়া জরুরি। কিছু লোক একত্রে মিলেমিশে মাশরুম চাষ করলে দ্রুত লাভবান হওয়া যায়। ঘরে বসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করা যায়।
গ্রাম কিংবা শহরের যুবকরা এই মাশরুম চাষ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন। পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও ঘরে বসে অল্প মূলধন দিয়ে মাশরুম চাষ শুরু করতে পারেন। মাশরুম চাষের জন্য আলোহীন স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ প্রয়োজন। তবে খেয়াল রাখতে হবে ঘরে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে। শহর কিংবা গ্রামে সব জায়গায় মাশরুম চাষ করা সম্ভব। স্পনগুলোকে রাখার জন্য ছোট ছোট মাচা ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো হতে পারে লোহা, বাঁশ কিংবা কাঠের। অতিরিক্ত গরম মাশরুম চাষের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এ জন্য প্রয়োজন হলে ফ্যান ব্যবহার করা যেতে পারে।
পাশাপাশি মাশরুম চাষের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির প্রয়োজন হয়। হ্যান্ড স্প্রে মেশিনের সাহায্যে স্পনগুলোতে নিয়মিত পানি দিয়ে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা করে রাখতে হবে। মাশরুমের উৎপাদন সম্পর্কে জানা যায় সাধারণ ভালো মানের স্পন থেকে গ্রীষ্মকালে প্রতি আড়াই মাসে ৯০ থেকে ১০০ গ্রাম মাশরুম পাওয়া যায়। শীত এবং বর্ষাকালে মাশরুম উৎপাদন অধিক পরিমাণে হয়ে থাকে। এ সময় একটি ভালো মানের স্পন থেকে প্রতি আড়াই মাসে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম মাশরুম উৎপাদন করা সম্ভব। ১০-১২ টাকা মূল্যের এই স্পনগুলো প্রতি আড়াই মাস পরপর পরিবর্তন করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মাশরুমের চাষ করা হচ্ছে। মাশরুম চাষের পাশাপাশি মাশরুম বিপণন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সঠিকভাবে বিপণন করতে না পারলে মাশরুম থেকে অধিক পরিমাণে লাভ করা সম্ভব নয়।
এ জন্য চাষের পাশাপাশি বিপণন বা মার্কেটিং পদ্ধতি ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন বড় বড় হোটেলগুলোতে এবং চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে মাশরুমের ভালো চাহিদা রয়েছে। তা ছাড়া দেশের বড় বড় সুপার শপ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে এবং বাজারে মাশরুম বিক্রি হয়ে থাকে। সাধারণত বাজারে প্রতি কেজি মাশরুম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি করা সম্ভব না হলে তা শুকিয়ে রাখা সম্ভব। এটাকে ড্রাই মাশরুম বলা হয়। বাজারে ড্রাই মাশরুমের দাম প্রতি কেজি ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। ড্রাই মাশরুম পানিতে ভেজালে আবার কাঁচা মাশরুমের মতো হয়ে যায়। বিক্রির অসুবিধা হলে মাশরুম সংরক্ষণ করা সম্ভব বলে এটা একটি লাভজনক ব্যবসা। মাশরুম চাষ এবং প্রশিক্ষণের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সাভারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ‘মাশরুম চাষ সেন্টার’ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে।
এখানে প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণার্থীকে আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এই প্রশিক্ষণের মেয়াদ তিন দিন পর্যন্ত। এখানে প্রশিক্ষণার্থীদের সরকারিভাবে সার্টিফিকেট প্রদানের মাধ্যমে কীভাবে মাশরুম চাষ করা যায়, কীভাবে বিপণন করা যায়, মাশরুম চাষের সমস্যা সুবিধা ইত্যাদি বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করা ছাড়াও বেসরকারি বেশ কিছু এনজিও সংস্থা মাশরুমচাষিদের প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। এ ছাড়া মাশরুম চাষ সম্পর্কে বাজারে অনেক বই পাওয়া যায়। মাশরুম একটি মূল্যবান সবজি। উন্নত বিশ্বে মাশরুম বেশ চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশেও মাশরুমের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। মাশরুম চাষের মাধ্যমে আমাদের দেশের কৃষি বিভাগে নতুন ধারার সৃষ্টি হবে এবং অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি আসবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক
বাংলার বার ভূঁইয়াদের প্রধান মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁ ছিলেন বাংলার বার ভূঁইয়াদর প্রধান। তিনি তার দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেছিলেন কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি। কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে ৬.৫ কিলোমিটার পূর্বে করিমগঞ্জ উপজেলাধীন কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নে নরসুন্দা নদীর তীরে ইতিহাসখ্যাত জঙ্গবাড়ির অবস্থান।
একাদশ শতাব্দীতে জোঙ্গাল বলাহুর নামক একজন রাজা স্বাধীন ভাটিরাজ্য কায়েম করে এর রাজধানী জঙ্গলবাড়িতে স্থাপন করেছিলেন বলে জানা যায়। ঈশা খাঁ জঙ্গলবাড়ি দুর্গ দখলের পূর্বে সেখানে কুচ রাজাগণ শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। ঈশা খাঁ সোনারগাঁওয়ের সিংহাসনে আরহনের পরে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে জঙ্গবাড়ি দুর্গ যুদ্ধ করে নিজ অধিকারে নেন। তখন তিনি এর সংস্কার সাধন এবং নিরাপত্তার জন্য তিনদিকে পরিখা খনন করেন। পরবর্তীতে ১৫৮৬ সালে জঙ্গবাড়িতে স্থাপন করেন ভাটিরাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী।
ঈশা খাঁ’র হাজারো স্মৃতি বিজড়িত আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এবং ইতিহাসখ্যাত জঙ্গলবাড়ির স্থাপনাসমূহ। এসব দেখতে ও বীরত্বগাথার কথা জানতে এখনো প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে বহু দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে। কিন্তু, তাদের ফিরে যেতে হয়ে অনেকটা হতাশ হয়ে। কারণ এখানকার ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নগুলো চরম অযত্ন ও অবহেলায় আজ প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অন্যদিকে ঈশা খাঁর বীরত্বগাথা এবং এখনো অবশিষ্ট থাকা নিদর্শনগুলো জানতে ও দেখতে আসা দর্শনার্থীগনের সাথে কথা বলার জন্যও এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ নেই।
বর্তমানে দরজা ও জানালা বিহীন ঈশা খাঁর দরবার হল, অন্দরমহল এবং দুর্গপ্রাচীরসহ কোনভাবে টিকে থাকা অন্যান্য স্থাপনগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে। প্রাচীন মসজিদ এবং পরিখা আজও পুরনো দিনের গৌরবময় দিনগুলোর কথা মানুষজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বেশ কিছুদিন পূর্বে যাওয়া হয়েছিল ঈশা খাঁর হাজারো স্মৃতি বিজড়িত জঙ্গলবাড়ি কেমন আছে তা দেখার জন্য। আমাদের কৈশোরে জঙ্গলবাড়িকে বহুবার দেখেছি। কিন্তু পূর্বেকার চেয়ে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন বা ভালো অবস্থা দেখতে পাইনি। যেমনটি দেখেছি তাতে বলা যায়, মোটেও ভালো নেই জঙ্গলবাড়ি। ঐতিহাসিক নিদর্শন দরবার হলের অভ্যন্তরে ‘ঈশা খাঁ স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার’ লেখা একটি সাইনবোর্ড দেখা গেছে। তার পাশেই রয়েছে পাথরে খোদাই করা স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাগণের নাম ও পদবী সম্বলিত একটি স্মৃতিফলক। কিন্তু জাদুঘর ও পাঠাগারে নেই কোন বই-পুস্তক, চেয়ার টেবিল এবং স্মৃতির কোন নিদর্শন। সর্বত্রই যেন আনাদর আর দারুন অবহেলার ছাপ সুস্পষ্ট। কিছু সময় অবস্থান করে মনে হলো প্রতিনিয়ত যেন জঙ্গলবাড়ি কাঁদছে। এখাকার অতি মূল্যবান স্মৃতিচিহ্নগুলো কাঁদছে। আগন্তুকদের করুণ সুরে কানে কানে বলছে; আমি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, আমি নিশ্চিহ্ন হতে চলেছি! তোমাদের শক্ত হাত দিয়ে আমাকে ধরো, আমাকে বাঁচাও। আমি তোমাদের মাঝে স্বগৌরবে বেঁচে থাকতে চাই।
জঙ্গলবাড়ি অবস্থানকালে সৌভাগ্যক্রমে সাক্ষাৎ হয় ঈশা খাঁর ১৫তম বংশধর দেওয়ান জামাল দাদ খাঁ’র সাথে। তিনি নিজ হাতে আমাদেরকে ঈশা খাঁ’র বংশ পরিচিতি দেখান। দেওয়ান ঈশা খাঁ এবং মোঘল সম্রাট আকবরের দরবারের ছবি তাদেরই সংগ্রহ থেকে নেয়া। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, ঈশা খাঁর স্মৃতি বহনকারী অন্দরমহলে চল্লিশটি কক্ষ ছিল। ধ্বংসের পরে এখন আছে মাত্র চারটি। এগুলো কোনভাবে সংস্কার করে এখন সেখানে তাদের পরিবার বসবাস করছেন। তিনি জানান যে, সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সম্প্রতি ঈশা খাঁ’র স্মৃতি রক্ষার্থে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। উক্ত প্রকল্পের আওতায় এখানে জাদুঘর, ডাক বাংলো, পুকুর ঘাট তৈরি এবং জরাজীর্ণ স্থাপনাসমূহের সংস্কার কাজ শিগগিরই শুরু হবে সেসময় তিনি জানিয়েছিলেন।
ঈশা খাঁর বীরত্বেগাথা ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অংশ জঙ্গলবাড়ি। এই ইতিহাস আমাদের আজকের ও আগামী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াও আমাদেরই দায়িত্ব। তাছাড়া দেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও ইতিহাসখ্যাত জঙ্গবাড়িতে ঈশা খাঁর স্মৃতি বহনকারী স্থাপনাগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় করে তোলা একান্ত প্রয়োজন। তাই ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী জঙ্গলবাড়ির প্রতিটি স্থাপনার প্রয়োজনীয় সংস্কার ও প্রয়োজনে নতুন স্থাপনা তৈরির কাজ সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা দ্রুত বাস্তবায়িত করবেন এটাই একান্ত চাওয়া।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো স্থিতিশীলতা ও স্থায়ী গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর দাঁড়াতে পারেনি। দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে অস্থিরতা যেন এক অনিবার্য শব্দ- যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন, দলীয় দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার পালাবদল, প্রশাসনিক অদক্ষতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি এবং অসহিষ্ণুতা, এসবই বারবার জাতিকে পিছিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যেই জনগণ প্রত্যাশা করেছে এমন একটি নেতৃত্ব, যা ক্ষমতার প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠে দেশকে একটি সুসংগঠিত ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করবে। সেই প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে তারেক রহমান নামটি আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে ক্রমশ সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক যাত্রা কেবল একটি পরিবারের উত্তরাধিকার নয়; এটি সময়, অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং জাতীয় সংকট উপলব্ধির মাধ্যমে গড়ে ওঠা নেতৃত্বের প্রকৃত রূপ। তিনি জন্মসূত্রে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেছেন নিজস্ব বিশ্লেষণ, মনন ও নেতৃত্বগুণের ওপর। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নীতি এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব তাকে রাজনৈতিকভাবে সম্যক ধারণা দিয়েছে ঠিকই; কিন্তু সময়ের বাস্তবতা তাকে বাধ্য করেছে নিজের রাজনৈতিক চিন্তার স্বাতন্ত্র্য তৈরি করতে। সেই স্বাতন্ত্র্য আজ তাকে দেশের প্রেক্ষাপটে এক ভিন্ন চরিত্রে দাঁড় করিয়েছে যেখানে রাজনীতি কেবল ভোটের সমীকরণ নয়, বরং রাষ্ট্রের কাঠামো পুনর্গঠনের দায়িত্ব।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বহুবার রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এমন এক পরিস্থিতিতে তারেক রহমান যে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন, তা হলো সংলাপ ও সহিষ্ণুতার রাজনীতি। তার দৃষ্টিতে রাষ্ট্র পরিচালনা কোনো একক দলের কর্তৃত্ব নয়; বরং এটি একটি সম্মিলিত দায়িত্ব যেখানে বিভিন্ন মত, স্বার্থ এবং সামাজিক স্তরের মানুষ একসাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন, কারণ দেশে রাজনৈতিক মতপার্থক্য মানেই বিরোধ, আর বিরোধ মানেই সংঘাত। তারেক রহমান এই দীর্ঘস্থায়ী ধারা থেকে বের হয়ে সমঝোতা, পারস্পরিক সম্মান এবং ধীরস্থির রাজনৈতিক আলাপচারিতাকে সামনে এনেছেন।
বিএনপি তার নেতৃত্বে কেবল দলীয় শক্তি হিসেবে নয়, বরং একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে। দলকে তিনি সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠন করেছেন, যেখানে তৃণমূলের কর্মীদের মতামত গুরুত্ব পেয়েছে, দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও গণতান্ত্রিক হয়েছে এবং রাজনৈতিক কৌশল আরও সুসংহত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বিএনপিকে দীর্ঘমেয়াদে একটি সুসংগঠিত ও স্বচ্ছ দলীয় কাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করবে, যা দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তারেক রহমানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি হলো যুবসমাজকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আনা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ, এবং তাদের রাজনৈতিক উদ্বেগ, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর চিন্তা এবং স্বপ্নগুলোকে জাতীয় উন্নয়নের সাথে যুক্ত না করলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সংকটে পড়বে এই সত্য তিনি ভালোভাবেই উপলব্ধি করেন। তাই তিনি এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে আগ্রহী, যেখানে তরুণরা কেবল নির্বাচনী প্রচারণার অংশ নয়, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণেও ভূমিকা রাখবে। এই অংশগ্রহণধর্মী রাজনীতি ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্বকে যে পরিপক্বতা দেবে, তা স্পষ্টভাবেই অনুমেয়।
দেশের রাজনৈতিক সংকটের গভীরে রয়েছে দুর্নীতি, যা একটি কাঠামোগত, দীর্ঘস্থায়ী ও প্রশাসনিকভাবে প্রোথিত সমস্যা। তারেক রহমান বারবার বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেবল আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব নয়; বরং রাজনৈতিক সততা, সুশাসন এবং স্বচ্ছতার প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা না হলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যায় এটি আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বিএনপির অভ্যন্তরেও তিনি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপিত হয়। এই উদ্যোগগুলো তাকে রাজনৈতিকভাবে দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ইতিহাস প্রমাণ করে, অস্থিরতা অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, বিদেশি বিনিয়োগ কমায়, শিক্ষা–স্বাস্থ্য–উন্নয়ন প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জনগণের আস্থা কমে যায়। তারেক রহমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার এই আন্তঃসম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, উন্নয়ন কোনো দলের একক অর্জন নয়; এটি একটি রাষ্ট্রীয় প্রকল্প যা সকল বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে পরিচালিত হতে হবে। সেই কারণে তিনি অর্থনীতি পুনর্গঠনের পরিকল্পনায় জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
তার অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে—
এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে যে তিনি কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্বই নন; বরং রাষ্ট্র পরিচালনার আধুনিক কাঠামো ও বৈশ্বিক অর্থনীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন।
তারেক রহমানের নেতৃত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সমাজে সংহতি ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক বিভাজন, সামাজিক বৈষম্য এবং মতভেদকে তিনি উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে দেখেন। তার মতে, শক্তিশালী সমাজব্যবস্থা তখনই গড়ে ওঠে যখন বিভিন্ন মত, চিন্তা এবং সামাজিক শ্রেণির মানুষ একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে নিজেদের নিরাপদ ও স্বীকৃত মনে করে। তাই তিনি সামাজিক সংলাপ, সাংস্কৃতিক সমন্বয় এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমান যে রাজনৈতিক পথ দেখাচ্ছেন, তা কেবল কোনো দলকে ক্ষমতায় নেওয়ার কৌশল নয়; বরং দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণের একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। তার রাজনৈতিক দর্শনে রয়েছে দৃঢ়তা, বাস্তবতা, সমঝোতা ও আধুনিক রাষ্ট্র-চিন্তার সমন্বয়। সে কারণে তার নেতৃত্বকে অনেকেই ‘ভবিষ্যতের রাজনীতি’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ এমন একটি সময় অতিক্রম করছে, যখন জনগণ চায় একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ। তারা চায় এমন এক নেতৃত্ব, যা ক্ষমতার অহমিকায় নয়, বরং জনগণের স্বার্থে কাজ করবে; সংঘাত নয়, বরং সংলাপকে এগিয়ে নেবে; দল নয়, বরং রাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দেবে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে সেই আশার আলো বহু মানুষের মনে জাগ্রত হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন পরিবর্তন সম্ভব, তবে তার জন্য প্রয়োজন জনগণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, আধুনিক রাষ্ট্র-চিন্তা এবং রাজনৈতিক সাহস।
তারেক রহমান আজ আর শুধু বিএনপির নেতা নন; তিনি এমন এক নেতৃত্বের প্রতীক, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ধারণা সঞ্চার করেছে—ন্যায়, গণতন্ত্র, সমতা ও উন্নয়নের ধারণা। এই ধারণার ভিত্তিতে আগামী দিনের বাংলাদেশ আরও সংহত, সুশাসিত এবং সমৃদ্ধ হতে পারে এই শঙ্কাহীন আস্থা অনেকেই রাখেন।
সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তারেক রহমান এমন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছেন যা সম্ভাবনায় ভরপুর। তিনি জাতিকে একটি আধুনিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন যেখানে ব্যক্তি বা দল নয়, বরং দেশ ও জনগণ প্রথম। রাজনৈতিক অস্থিরতার বহু দশক পর এ ধরনের নেতৃত্ব নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক বার্তা।
তারেক রহমানের নেতৃত্বের মধ্যে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে গড়ে তোলার মানসিকতা স্পষ্ট। তার রাজনৈতিক দর্শন বলে গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন নয়, বরং মানুষের অধিকার, ন্যায়বিচার, উন্নয়ন ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি। এ কারণেই তিনি আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্ভাবনার অম্লান প্রতীক।
লেখক: ডা. এ কে এম মাজহারুল ইসলাম খান কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
ইতিহাসে বহু প্রমাণ রয়েছে, স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষ বিশ্বের অন্যতম প্রশিক্ষিত; কিন্তু বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ জনতার শক্তি আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল উপজীব্য ছিল সমাজ থেকে সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে একটি মানবিক এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
আর এ জন্য সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। বিগত সরকারের আমলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে যে তিনটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আগের সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর বিভাজনকে পুঁজি করে পুরো জাতিকে অনৈক্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। জাতি ছিল দ্বিধাবিভক্ত।
এই বিভক্তির সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বিগত সাড়ে ১৫ বছর (২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত) জনগণের ওপর নির্মম নির্যাতন ও স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেছিল। দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যাপক মাত্রায় দলীয়করণ ও আত্মীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। কিন্তু একসময় দেশের মানুষ আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে।
কথায় বলে, ‘united we stand, divided we fall’, একটি জাতি যদি তাদের বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকে, তাহলে কোনো জাগতিক শক্তি তাদের পরাজিত করতে পারে না। কিন্তু বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে ফাটল দেখা দিলে একটি সম্ভাবনাময় জাতিও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তাই আমাদের সর্বাবস্থায় জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ এবং অটল থাকতে হবে। বিশেষ করে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কোনো কারণে আমরা যদি জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে না পারি, ক্ষুদ্র স্বার্থে পরস্পর বিচ্ছিন্ন বা বিভক্ত হয়ে পড়ি, তাহলে পরাজিত শক্তি সেই সুযোগে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কাজেই এই মুহূর্তে আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
প্রাচীনকালে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উর্বর জনপদ। বিদেশি বণিক ও ব্যবসায়ীরা এখানে এসে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থবিত্ত অর্জন করতেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসি পরিব্রাজক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য এবং সম্পদের প্রাচুর্য দেখে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে তিনি মন্তব্য করেন, ‘there are hundred gates open to enter bengal, but there is not a single gate to come out of it.’ ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার কোনো সাধারণ পর্যটক ছিলেন না, তাকে বলা হয় দার্শনিক পর্যটক। তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তৎকালীন ভারতীয় সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে অবলোকন করে সত্যনির্ভর তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। বাংলাদেশ বারবার বিদেশি শক্তির পদানত হয়েছে মূলত অনৈক্যের কারণে।
ইংরেজরা বাংলার মানুষের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল। তাই তারা সব সময়ই চেষ্টা করেছে এ দেশের মানুষ যেন একতাবদ্ধ হতে না পারে। তারা জাতিতে জাতিতে, অঞ্চলে অঞ্চলে এবং ধর্মে ধর্মে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করে। ইংরেজদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘divide and rule’, অর্থাৎ ‘ভাগ করও এবং শাসন করও।’ যত দিন তারা এই নীতির সফল বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে, তত দিন ইংরেজদের বাংলাসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চল শাসন করার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয়নি। ইংরেজরা মনে করত, বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত দূরদর্শী এবং রাজনীতিসচেতন। ‘what bengal thinks today, india thinks tomorrow’ গোখলের এই মহান চিন্তাকে মনে রেখে ইংরেজরা বাংলাকে ভাগ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলা ভাগের অন্যতম উদ্দেশ্য এই অঞ্চলের মানুষ যাতে একতাবদ্ধ হতে না পারে, তা নিশ্চিত করা।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। প্রথমেই আমাদের মাতৃভাষার ওপর আঘাত হানা হয়। বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সেদিন বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল। একুশ আমাদের শিখিয়েছে ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে কোনো কিছুই অর্জন করা অসম্ভব নয়। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে এক রক্তপাতহীন সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে অবৈধভাবে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেন। দেশের মানুষ দল-মত-নির্বিশেষে ঐকমত্যে উপনীত হতে পেরেছিল বলেই ১৯৯০ সালে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন।
জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য বিভিন্ন সময় নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো ম্যাকিয়াভেলির কৌশল। ম্যাকিয়াভেলি তার ‘The Prince’ গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘the prince should be as mighty as a lion and as clever as a fox.’ অর্থাৎ একজন শাসককে হতে হবে সিংহের মতো শক্তিশালী এবং শৃগালের মতো ধূর্ত। তাকে ক্ষমতায় যেতে হবে এবং যেকোনো মূল্যে তা ধরে রাখতে হবে। তার কাছে নীতি-নৈতিকতা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তাকে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে। এ জন্য যেকোনো পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। তাই তার মতে, end will justify the means; অর্থাৎ চূড়ান্ত পরিণতিই গৃহীত পদক্ষেপের যৌক্তিকতা নির্ধারণ করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ম্যাকিয়াভেলির তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ লক্ষ করা গেছে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ম্যাকিয়াভেলির দীক্ষা গ্রহণ করেন। তবে ইতিহাসের সেই বহু কথিত আপ্তবাক্য: ‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।’ ইতিহাসের শিক্ষা কেন ক্ষমতার কষ্টকল্পিত প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না, সে এক আশ্চর্য রহস্যময় জিজ্ঞাসা, যার উত্তর কোনো দিন কোনোকালেই কোনো স্বৈরাচার দিতে পারেনি। তবে নিষ্ঠুরভাবে ভোগ করেছে ইতিহাসের অমোঘ পরিণতি।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের আদেশ খারিজ করে দিলেও এখনো আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়নি। তাই জরুরি ভিত্তিতে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব উপদেষ্টার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা প্রশাসনিক অদক্ষতার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তাদের অব্যাহতি দেওয়া বাঞ্ছনীয়। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি ছোট আকারের নির্বাচনকালীন সরকার গঠনপূর্বক আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে সমঝোতায় উপনীত হতে পারলে ভবিষ্যতে কোনো মহল থেকেই প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি মাস। এই মাসেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় প্রকাশ শুরু হবে এবং নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার জন্য পরাজিত স্বৈরাচারের দোসররা তৎপর রয়েছে। তারা বিভিন্ন বাসে অগ্নিকাণ্ড ঘটাচ্ছে, বোমাবাজি করছে। কাজেই তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো দৃঢ় ঐক্য প্রদর্শন করতে পারলে কোনো ষড়যন্ত্রই হালে পানি পাবে না। বিগত সরকারের আমলে যারা নানা ধরনের অনৈতিক সুবিধা ভোগ করেছে, তারা আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষায় আছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখতে না পারে, তাহলে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে। সেই সুযোগে পরাজিত শত্রুরা ছোবল মারতে পারে। যেকোনো মূল্যেই হোক, ভবিষ্যতে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সুযোগ বারবার আসে না। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জন্য যে সুযোগ সৃষ্টি এবং ঐক্যের ভিত রচনা করে দিয়েছে, তাকে কোনোভাবেই নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে- ঐক্যেই উত্থান, অনৈক্যে পতন।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বাহরাইনে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত।
নাকফুল—একটুকরো সোনা, তবু তার মূল্য কখনোই শুধু ধাতুর ওজনে মাপা যায় না। এর ভেতর লুকিয়ে থাকে বহু প্রজন্মের গল্প, এক কন্যার জীবন বদলে যাওয়ার নীরব মুহূর্ত, আর বাঙালি নারীর সৌন্দর্যের শাশ্বত চিহ্ন। বিয়ের দিন কনের নাকে নাকফুল তোলা যেন শুধু সাজগোজ নয়; এটি তার জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশের কোমল আচার, যা একই সঙ্গে অলঙ্কারও, আবার পরিচয় বদলের ঘোষণা।
বাঙালি পরিবারে কন্যা মানে আদরের আলো। বাবার হাত ধরে বড় হওয়া সেই মেয়ে যখন বিয়ের শাড়িতে সাজে, তার চোখে যেমন থাকে লাজুক স্বপ্নের কুয়াশা, তেমনি হৃদয়ে থাকে অচেনা ভবিষ্যতের ধুকপুকানি। আর ঠিক সেই সময়েই নাকে পরানো হয় নাকফুল। ক্ষুদ্র কিন্তু গভীর এক প্রতীক। বাবার ঘরের মেয়ে সেই মুহূর্তেই বধূ হয়ে ওঠে। কপালের টিপ, শাড়ির কুচি বা চুড়ির ঝনঝনানির মধ্যেও নাকফুল আলাদা করে বলে দেয়—
‘সে আর শুধু কন্যা নয়, সে এখন কারো বধূ, অন্য পরিবারের অংশিদার।’
আগে বনেদী পরিবারে মেয়ের দেনমোহর নির্ধারিত হতো তার ওজনের সমান সোনা দিয়ে। সেই সোনার ভাজে নাকফুল ছিল সবচেয়ে কোমল, সবচেয়ে আবেগী গয়না। অনেকে বড় গয়না কিনতে না পারলেও নাকফুল দেওয়াটা কখনো বাদ দিত না। কারণ নাকফুল ছিল বিবাহিত পরিচয়ের প্রথম মর্মস্পর্শী ছাপ—একটি ছোট অলঙ্কার, যার ভেতর লুকিয়ে থাকে স্বামীর ভালোবাসা, পরিবারের স্বীকৃতি এবং বধূর নতুন পরিচয়ের দৃঢ় অথচ নরম ঘোষণা।
আজকের দিনে গয়নার ঝলক কমে গেছে, সোনার দাম আকাশছোঁয়া, মেয়েরা জীবনযাপনের ব্যস্ততায় গয়নার ভার কমিয়েছে তবুও নাকফুল তার জায়গা ছাড়েনি। কারণ নাকফুল শুধু সাজ নয়—এ এক আবেগ, এক ইতিহাস। এটি পরতেই কনের মুখে ফুটে ওঠে এক অচেনা দীপ্তি, যেন লাজুক আলোয় ভরে যায় তার হাসি। মেয়ে থেকে বধূ হয়ে ওঠার যে রূপান্তর, তার সবচেয়ে স্নিগ্ধ অনুষঙ্গই হলো নাকফুল।
নাকফুল নারীর সৌন্দর্যকে শুধু বাড়ায় না—এ তাকে দেয় এক মর্যাদা, এক আত্মপরিচয়। শত বছর আগে যেমন ছিল, আজও তেমনই প্রাসঙ্গিক। সমাজের পরিবর্তন, রুচির বদল, সময়ের স্রোত—কিছুই নাকফুলের আবেগকে ছুঁতে পারেনি। তাই বাঙালি বিয়েতে এই ক্ষুদ্র অলঙ্কারটিই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় প্রতীক—ভালোবাসা, আস্থা ও নারীত্বের চিহ্ন।
এক কন্যা যখন নাকফুল পরে বধূ হয়ে ওঠে, তখন শুধু তার সাজই সম্পূর্ণ হয় না—সম্পূর্ণ হয় তার জীবনের এক অধ্যায়। সেই ছোট্ট সোনায় বাঁধা থাকে বাবার ঘর ছেড়ে নতুন ঘরে পা রাখার শিহরণ, নতুন জীবনের প্রতিশ্রুতি এবং অসংখ্য অদেখা আশার দীপ্তি।
নাকফুল তাই শুধু সৌন্দর্য নয়—এ বাঙালি নারীর জীবনে এক কোমল, অমর, এবং গভীর আবেগের প্রতীক।
লেখক: কবি।
একটা সময় ছিল, অনলাইনে টাকা পাঠাতে গেলে আমরা অপেক্ষা করতাম একটা ছোট মেসেজের জন্য, সেই পরিচিত ছয় অঙ্কের OTP (One Time Password)। মোবাইলে কোড এলেই বুকের ভেতরটা হালকা হয়ে যেত, মনে হতো, এই সংখ্যাগুলোই আমাদের টাকা-পয়সা নিরাপদ রাখার একমাত্র চাবিকাঠি। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন সেই একসময়ের ‘নিরাপদ’ মনে হওয়া OTP-ই হয়ে উঠেছে প্রতারণার সবচেয়ে সহজ দরজা। OTP তাই ধীরে ধীরে ইতিহাসে পরিণত হচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ঘোষণা করেছে, ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে সব ব্যাংক থেকে SMS ও ইমেইল-ভিত্তিক OTP সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়া হবে। তার পরিবর্তে আসছে এমন এক সিস্টেম, যেখানে মানুষ নিজেই হবে নিজের পাসওয়ার্ড— বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশন, অর্থাৎ মুখ বা আঙুলের ছাপ দিয়ে হবে সব লেনদেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাত এই বাস্তবতা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছে। দেশটির ব্যাংকগুলো গত কয়েক বছর ধরে ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপ, ডিজিটাল পেমেন্ট সবখানেই ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে সাইবার প্রতারণা ও অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রে হ্যাকাররা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে ব্যবহারকারীর ফোনে প্রবেশ করে OTP সংগ্রহ করেছে। ফলে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়েছে এমন একটি সমাধান খুঁজতে, যা সম্পূর্ণভাবে ‘ইউজার আইডেন্টিটি'-এর ওপর ভিত্তি করে, বাহ্যিক কোড বা পাসওয়ার্ডের নয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) ঘোষণা করেছে, ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যেই তারা ব্যাংকিং সেবায় SMS ও ইমেইল ভিত্তিক OTP সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেবে। তার পরিবর্তে লেনদেনের প্রতিটি ধাপে গ্রাহকের মুখের ছবি বা আঙুলের ছাপের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ বাধ্যতামূলক হবে। এর মানে, আপনি নিজে উপস্থিত না থাকলে আর কেউ আপনার নামে লেনদেন করতে পারবে না। এই সিদ্ধান্তের পেছনে বড় কারণ প্রতারণা রোধ। UAE-এর সেন্ট্রাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২৩ সালেই অনলাইন ব্যাংকিং জালিয়াতিতে গ্রাহকরা প্রায় ৮৭ মিলিয়ন ডলার হারিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অপরাধীরা ফিশিং লিংক বা SIM swapping-এর মাধ্যমে গ্রাহকের OTP জেনে নিয়ে অ্যাকাউন্ট খালি করে ফেলেছে। অর্থাৎ, ব্যাংকের প্রযুক্তি যত উন্নতই হোক না কেন, যদি OTP ভুল হাতে পড়ে—নিরাপত্তা শূন্যে নেমে আসে।
বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশন তাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে যৌক্তিক ও নিরাপদ বিকল্প। ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফেস রিকগনিশন, আইরিস স্ক্যান বা ভয়েস অথেন্টিকেশন — এগুলোর মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় যে, লেনদেনটি সেই ব্যবহারকারীই করছেন, অন্য কেউ নয়। কোনো হ্যাকার বা প্রতারক যত উন্নত কৌশলই ব্যবহার করুক না কেন, কারও মুখ বা আঙুলের ছাপ নকল করা এত সহজ নয়। তাছাড়া বায়োমেট্রিক ডেটা সাধারণত এনক্রিপটেড আকারে সংরক্ষিত থাকে এবং কেবল ডিভাইসের ভেতরেই যাচাই হয় যায়।
ফলে সার্ভার-সাইডে লিক হওয়ার সম্ভাবনাও কমে
এখন যদি আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাবি, বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধরুন, মিরপুরে থাকেন মি. রাহিম, একজন সরকারি চাকরিজীবী। প্রতিদিন সকালে অফিসে যান, বিকেলে বাসায় ফেরেন, মাঝে মাঝে অনলাইন ব্যাংকিং করে বিল পরিশোধ করেন বা পরিবারের জন্য টাকা পাঠান। একদিন সকালে অফিসে বসে মোবাইলে ব্যাংকের নোটিফিকেশন পেলেন—‘আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে ২,০০,০০০ টাকা ট্রান্সফার হয়েছে।’ রাহিম চমকে উঠলেন! তিনি তো এমন কোনো লেনদেন করেননি! ব্যাংকে ফোন করলেন, কিন্তু দেখা গেল তার ফোনে ঠিকই OTP গেছে এবং সেটি ব্যবহারও হয়েছে। অথচ তিনি OTP দেননি। পরে জানা গেল, একজন প্রতারক আগেই একটি ফিশিং লিংক পাঠিয়ে রাহিমের ব্যাংক লগইন তথ্য জেনে নিয়েছিল, তারপর SIM swap করে সেই OTP নিজের হাতে নিয়ে টাকা ট্রান্সফার করেছে। এটাই বাস্তবতা—OTP থাকা সত্বেও গ্রাহক নিরাপদ নয়৷
ধরুন, একই ঘটনা যদি বায়োমেট্রিক সিস্টেমে ঘটত। রাহিমের ব্যাংক অ্যাপে লেনদেন করার আগে অ্যাপটি মুখ চিনে বা আঙুলের ছাপ যাচাই না করা পর্যন্ত টাকা পাঠানো সম্ভব হতো না। OTP চুরি করলেও কোনো লাভ হতো না, কারণ বায়োমেট্রিক তথ্য কারও পক্ষে নকল করা প্রায় অসম্ভব। এখানেই প্রযুক্তির আসল শক্তি। বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা মানে, আপনি নিজেই আপনার পাসওয়ার্ড—আপনার মুখ, আপনার আঙুল, আপনার কণ্ঠস্বরই হবে প্রমাণ যে আপনি আসল ব্যবহারকারী।
বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা চালু হলে গ্রাহকের জন্য সুবিধা অনেক। প্রথমত, তাকে আর কোড মনে রাখতে হবে না। দ্বিতীয়ত, প্রতারণার ঝুঁকি প্রায় শূন্যে নামবে। তৃতীয়ত, ব্যাংকও নিশ্চিত থাকবে যে লেনদেনটি আসল গ্রাহকই করেছেন। প্রথমে বায়োমেট্রিক সিস্টেম একটু ঝামেলাপূর্ণ মনে হতে পারে—নতুনভাবে অ্যাপ আপডেট করা, মুখ বা আঙুলের ছাপ নিবন্ধন করা ইত্যাদি। কিন্তু একবার সেটআপ হয়ে গেলে এটি অসাধারণ সুবিধাজনক। আর OTP-এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে না, পাসওয়ার্ড ভুলে যাওয়ার চিন্তা থাকবে না, কয়েক সেকেন্ডেই নিরাপদে লেনদেন সম্পন্ন হবে। এটা শুধু প্রযুক্তি নয়, মানসিক স্বস্তিও এনে দেবে।
এখানে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতিমধ্যেই ‘UAE PASS’ নামে একটি জাতীয় ডিজিটাল আইডেন্টিটি সিস্টেম চালু করেছে, যা নাগরিক ও প্রবাসী উভয়ের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য। এর মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি সব ডিজিটাল সেবায় একীভূত বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশন সম্ভব হচ্ছে। ব্যবহারকারী একবার নিবন্ধিত হলে, তার মুখ বা আঙুলের ছাপই যথেষ্ট সব লেনদেনের জন্য— হোক তা ব্যাংকে লগইন, ট্যাক্স প্রদান বা সরকারি নথি স্বাক্ষর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় হলেও নিরাপত্তা হুমকিও বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই অনলাইন প্রতারণা, ফিশিং বা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট হ্যাকের ঘটনা শোনা যায়। এখানে OTP অনেক সময়ই দুর্বল নিরাপত্তা প্রাচীর হিসেবে কাজ করছে— বিশেষ করে যখন ব্যবহারকারী অসচেতন বা হ্যাকার ফোনে ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে কোড পড়ে নিতে পারে। ফলে আমাদের জন্য এখনই বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সময়ের দাবি।
আমরা ইতোমধ্যেই জাতীয় পরিচয়পত্রে (NID) বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষণ করেছি। এই বিশাল ডেটাবেস যদি সুরক্ষিতভাবে ব্যাংকিং সেক্টরের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, তাহলে ডিজিটাল অথেন্টিকেশন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ব্যাংকগুলো চাইলে ধীরে ধীরে পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক লগইন ও লেনদেন চালু করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ ক্ষেত্রে একটি নীতিগত নির্দেশিকা দিতে পারে, যাতে গ্রাহকের ডেটা সুরক্ষা, এনক্রিপশন ও ব্যবহারকারীর সম্মতির বিষয়গুলো নিশ্চিত থাকে ।
তবে প্রযুক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি করাও জরুরি। অনেক গ্রাহকই এখনো বিশ্বাস করেন, OTP এলেই সেটি নিরাপদ; তারা বোঝেন না, এটি হ্যাক বা চুরি হওয়ার ঝুঁকিতেও থাকে। তাই ব্যাংকগুলোর উচিত গ্রাহকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও প্রচার চালানো। বিশেষ করে, নতুন প্রজন্মের পাশাপাশি গ্রামীণ বা প্রান্তিক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাই হবে আসল সফলতা।
আগামী দিনের ব্যাংকিং শুধু পাসওয়ার্ড বা OTP-এর ওপর নির্ভর করবে না। গ্রাহকের নিজের পরিচয়ই হবে প্রধান চাবিকাঠি। UAE-এর অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে, বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা শুধু সুবিধা নয়, এক জরুরি প্রয়োজন। বাংলাদেশেও যদি আমরা সময়মতো এই পদক্ষেপ নিই, তাহলে অনলাইন ব্যাংকিং নিরাপদ, সুবিধাজনক এবং বিশ্বস্ত হয়ে উঠবে। রাহিমের মতো গ্রাহকের জন্য এটি হবে শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
একসময় আমরা পাসওয়ার্ড মুখস্থ করার দিনগুলোতে অভ্যস্ত ছিলাম, পরে এল ‘OTP যুগ’, আর এখন সেই যুগও ইতিহাস হতে যাচ্ছে। এখন থেকে আপনার মুখ, আপনার আঙুল, আপনার স্বরই হবে আপনার সুরক্ষার প্রহরী। এই পরিবর্তন শুধু প্রযুক্তিগত নয়— এটি এক নতুন বিশ্বাসের বিপ্লব। এমন এক ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্বপ্ন, যেখানে মানুষই তার নিজের নিরাপত্তার প্রতিচ্ছবি। সংযুক্ত আরব আমিরাত এই নতুন যাত্রার সূচনা করেছে, আর বাকিরা শিখবে, মানিয়ে নেবে, আর একসাথে তৈরি করবে নিরাপদ, আধুনিক ও সমন্বিত এক ডিজিটাল পৃথিবী। কারণ সাইবার নিরাপত্তা এখন আর বিলাসিতা নয়— এটি আজ একান্ত প্রয়োজন।
লেখক: হেড, ডিপার্টমেন্ট অব সিএসই, এমআইএসটি।
বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করেছে। এ সূত্র ধরে কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম, মোবাইল ফোন, ক্যাবল টিভি, ডির্কোডার, এটিএম বুথ, ই-মেইল, ইত্যাদিতে পাসওয়ার্ড কথাটি একটি স্বাভাবিক ব্যবহার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এর ব্যবহারের এতটুকু হেরফেরের কারণে বিরম্বনা নেমে আসতে পারে। তাছাড়া এতে প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে সর্বশান্ত হয়ে পড়ে। ইদানীং এ ধরনের ভূড়ি ভূড়ি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পাসওয়ার্ড হলো শব্দ বা বিভিন্ন অক্ষরের সমষ্টি, যা ব্যবহার করা হয়। এদিকে ব্যবহারকারীর পরিচয় অথবা প্রবেশ অনুমোদন যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এর মাধ্যমে ব্যবহারকারী নির্দিষ্ট জায়গায় প্রবেশাধিকার পেয়ে থাকে। অবশ্য এই পাসওয়ার্ড হলো গোপনীয়। এবার আসুন প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড নিয়ে সাবধনতা’ এর কথায় আসা যাক। বর্তমানে ডিজিটাল ব্যাংকিং, মোবাইল ফাইন্যান্স, অনলাইন কেনাকাটা কিংবা সিম রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে ওটিপি একটি নিরাপত্তার প্রতীক। অথচ এই নিরাপত্তা বলয়ই এখন পরিণত হয়েছে প্রতারকদের সবচেয়ে নিজস্ব কার্যকরী হাতিয়ারে। কেননা ফোন বা এসএমএসে আসা একবার ব্যবহারযোগ্য এই কোড বর্তমানে মানুষের অর্থ, তথ্য ও গোপনীয়তা লুটের সহজ ও কার্যকরী পন্থা। অবশ্য দেশে এখন দিনে দিনে প্রতারণার ধরণ পরিবর্তিত হচ্ছে। কারণ পূর্বের ন্যায় ‘লটারিতে জিতেছেন’ বা ‘বিকাশ ভুল করে টাকা পাঠানো হয়েছে’ ইত্যাদি বলে ফাঁদগুলো এখন অনেকটা সেকেলে। এখন প্রযুক্তি-নির্ভর পরিকল্পিত ও মনস্তাত্ত্বিক কৌশল ব্যবহারে প্রতারকরা বিভিন্ন আঙ্গিকে কার্যসিদ্ধ করতে তৎপর। এক্ষেত্রে ওটিপি তাদের কার্যকরী অস্ত্র। মূলত ওটিপি তথা ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড হলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হওয়া ৪-৬ সংখ্যার একটি কোড, যা ব্যবহারকারীকে কোনো লেনদেন তথা লগইন নিশ্চিত করতে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে উদহারণ হিসেবে উল্লেখ্য যে, ‘আপনি বিকাশে টাকা পাঠাচ্ছেন’ বা ‘ব্যাংক ট্রান্সফার করছেন’ বা ‘ফেসবুক পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করছেন’, ইত্যাদি বলে সরল বিশ্বাসী গ্রাহকদের ভুলিয়ে ভালিয়ে কাজ সিদ্ধপূর্বক হাতের মুঠোই নিয়ে আসে ওটিপি। মজার ব্যাপার হলো যে, এই কোডটি যে কোনো ক্ষেত্রে একবার ব্যবহারের পর আর কোনো কাজে আসে না। অবশ্য নিরাপত্তার জন্যই এটি প্রবর্তন করা হয়েছিল। অথচ দুঃখের বিষয় হলো যে, সেই নিরাপত্তার অস্ত্রই হয়ে উঠেছে প্রতারণার বিশেষ হাতিয়ার। কেননা সাধারণত মানুষ ভাবে, কেউ কখনো যদি ‘অফিস থেকে ফোন করেছে’ বা ‘কাস্টমার কেয়ার বলছে’ এমন কথা শোনে তাহলে ওটিপি বলাটা তো নিরাপদ মনে করে। কিন্তু আসলে ব্যাপারটি উল্টো। আর বলতে গেলে এটি প্রতারণার খেলা। এক্ষেত্রে ওটিপি জালিয়াতি প্রতারকেরা মূলত দুইভাবে ওটিপি সংগ্রহ করে। সত্যিকারার্থে এটি এমন এক কৌশল, যেখানে প্রতারক ভুক্তভোগীকে ‘বিশ্বাস’ করাতে চায় যে সে একজন সরকারি কর্মকর্তা বা ব্যাংকের প্রতিনিধি বা মোবাইল অপারেটরের কর্মী বা ই-কমার্স সাইটের কোন এক কর্মকর্তা। তাছাড়া ফোনে বা মেসেঞ্জারে বলা হয় যে ‘স্যার, আপনার বিকাশ একাউন্ট ভেরিফিকেশন চলছে অথবা আপনার ফোনে একটা কোড গেছে, স্যার তা আপনার স্বার্থে বলুন তো প্লিজ।’ তখন মানুষ সরল বিশ্বাসে বা ভয়ে বা বিভ্রান্তিতে অবলীলাক্রমে ওটিপি বলে দেয়। তখন সেই মুহূর্তেই প্রতারক উক্ত একাউন্টের উপর পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এখনো সহজ সরল। যদিও প্রতিনিয়ত বিকাশ, নগদ, রকেট, শিওর ক্যাশ, ইত্যাদি সব মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে এই মর্মে সতর্কতা বার্তা দেয়া হয় যে, ‘কোনো অবস্থাতেই কাউকে ওটিপি বা পিন নম্বর জানাবেন না।’ তথাপিও প্রতিদিনই নতুন নতুন লোক এর শিকার হচ্ছেন। এক্ষেত্রে কোনো এক সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, ‘মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কিন্তু নিজের স্বার্থে এর নিরাপত্তা শিখছে না। আমাদের দেশে প্রযুক্তি শিক্ষার চেয়ে মোবাইল ব্যবহারের অভ্যাস দ্রুত রপ্ত করছে। তাই এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ শিক্ষার অভাবে অন্ধকারে থাকে বিধায় তারা সহজেই ভয় পায় বা বিশ্বাস করে বা বিভ্রান্ত হয়ে থাকে। ‘এদিকে ওটিপি প্রতারণার সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে আরেক ভয়ঙ্কর কৌশল; যা হলো- রিমোট অ্যাকসেস অ্যাপ’। এক্ষেত্রে প্রতারকেরা ব্যবহারকারীকে বলেন, ‘আপনার ফোনে একটা অ্যাপ ইনস্টল করুন, আমরা আপনার সমস্যা ঠিক করে দিচ্ছি।’ আর অ্যাপটির নাম হলো- ‘Quick Support, AnyDesk, SmartFix’
ইত্যাদি। এক্ষেত্রে এই অ্যাপটি একবার ইনস্টল করা হলে প্রতারক সরাসরি ভুক্তভোগীর মোবাইলের স্ক্রিন ও ইনপুট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। আর তখন ওটিপি না বললেও তারা নিজেরাই দেখে নেয়। যদিও গত জুনে এমন ১০টি অ্যাপভিত্তিক প্রতারণার দায়ে ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এতদ্ব্যতীত যে সমস্যা দেখা গিয়েছে, তা হলো ব্যাংক বা মোবাইল কোম্পানীর নামে বা পক্ষে প্রতারকরা যখন ওটিপি ফাঁদে ফেলে টাকা নিয়ে নেয়। তখন ভুক্তভোগীরা ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানীকে দায়ী করে থাকে। কিন্তু তারা জানে না যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেনদেন হয় ‘গ্রাহকের সম্মতিতে’। কারণ ওটিপি তো তাদের আওতায় থাকে। তাই সব কিছু বিবেচনায় এনে ব্যাংকগুলোরও উচিত বায়োমেট্রিক যাচাই ও ডুয়েল অথেটিফিকেশনে আরও শক্ত নিরাপত্তা স্তর তৈরি করা। অবশ্য এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ডিজিটাল ফ্রড মনিটরিং সেল’ গঠন করেছে, যেখানে প্রতিদিনের লেনদেন অ্যালগরিদমের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং সন্দেহজনক লেনদেন হলে তাৎক্ষণিকভাবে সেই অ্যাকাউন্ট আপাতত বন্ধ করে দেয়া হয়।
বর্তমানে প্রতারকেরা শুধু টাকা নয়, মানুষের নৈতিক সাহস ও আত্মবিশ্বাস কেড়ে নিচ্ছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়ে ‘নিজের ভুল’ বলে লজ্জায় মুখ খুলেন না বা অভিযোগ করতে চান না। ফলে চক্রগুলো আরও সাহসী ও তৎপর হয়ে উঠছে। কিন্তু অভিযোগ না এলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিভাবে চক্রের অবস্থান জানতে পারবে? তাই সব কিছু মিলে বলতে গেলে নিরাপত্তার বিষয়টি জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ব্যবহারকারীর সতর্কতা কতটা জরুরি তা সহজেই অনুমেয়। এক্ষেত্রে স্বভাবতই যে কথাটি উঠে আসে, তাহলো একটি কোড বলেই যদি কেউ সমস্ত তথ্য ও টাকা হাতে পেয়ে যায়। তাহলে সে দোষ প্রযুক্তির নয়? এক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর দূরদর্শিতা ও বিশ্বাসের প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট। তাই এই ডিজিটাল যুগে এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা থেকে বাঁচতে সবাইকে সচেতন ও সজাগ হতে হবে। এক্ষেত্রে গ্রাম বাংলায় সবার মুখে মুখে প্রচলিত দুটি বচনের কথা মনে পড়ে যায়। সেগুলো হলো, ‘ওই ছেঁড়ি, তোর বিয়ে’ এবং ‘চিলে কান নিয়েছে বলে, কানে হাত না দিয়ে ছুটতে শুরু করা’। এ ব্যাপারে উক্ত দুটি বচনের দর্শন এই কারণে স্মরণ করে দিলাম যে, কোন কিছু শোনা মাত্র সিদ্ধান্ত না নেয়া। আর এই আলোকে মোবাইলে মৌখিক বা লিখিত মেসেজে কোন তথ্য চাওয়া হলে, সে ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়া। এক্ষেত্রে এমনও দেখা গিয়েছে যে, প্রতারকরা এমন ভাবে একটির পর একটি মেসেজ দিয়ে বিশ্বাস অর্জনসহ ও ভয়ভীতি তৈরি করে যে, তখন তাদের চাহিদাকৃত তথ্যাদির ব্যাপারে বিভ্রান্ত না হয়ে এবং তাৎক্ষনিক তা না দিয়ে বুঝে-শুনে এবং অগ্র পশ্চাৎ ভেবে চিন্তে দেয়া সমীচীন। এতে প্রতারকদের খপ্পর থেকে হয়তো মুক্ত থাকা সম্ভব হতে পারে। আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে যে, অবস্থাভেদে প্রতারকদের কৌশল বা পন্থা বদলিয়ে থাকে, সে দিকেও চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।
বিশিষ্ট গবেষক, অথর্নীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
হতাশা আমাদের জীবনকে গ্রাস করে বার বার। বিরহ-ব্যথা আর নিছক সুখের স্রোতে এগিয়ে চলছে তবুও সবার জীবন। একরকম যুদ্ধ করে। এই যুদ্ধে কেউ হয় বিজয়ী আর কেউ হয় পরাজিত। জীবন যুদ্ধে হার মানা আর এই যুদ্ধে লড়ে জয়ী হওয়া দুটোই কিন্তু এক নয়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কষ্টকর। হতাশাকে দূরে ছুঁড়ে কখনো কখনো এগিয়ে যাওয়া যায় না। থমকে যায় মনের গতি আর আমাদের পদযুগল। কষ্টকে জয় করতে হলে জীবনের অনেকগুলো সুখ বিসর্জন দিতে হয়। অনেক সময় জীবন থেকে হারিয়ে ফেলতে হয়। জয় আর পরাজয়ের খেলায় কাটছে আমাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত।
এই জীবন বড্ড ত্যাড়াবাঁকা কারো কারো ক্ষেত্রে। সুখের জন্য যদি কখনো দৌঁড়ান, দেখবেন জীবন থেকে অনেক হাসি আনন্দের সুন্দর কিছু মুহূর্ত বিলিন হয়ে গেছে নীরবে। যা হয় তো টেরও পাবেন না আপনি। আবার দুঃখদের ধুয়ে মুছে একবারে বাঁচাও কিন্তু পসিবল না। অর্থ্যাৎ আপনার চারপাশ ঘিরে থাকা দুঃখ-কষ্ট, বিরহবেদনা আর হতাশাদেরকে নিয়েই বাঁচতে হবে আপনাকে। যারা বিজয়ী তাদের সাফল্যের মূল্য এখানেই। আর যারা পরাজিত তারা মাঝ পথেই ক্লান্ত হয়ে আশা ছেড়ে দেন। সব মিলিয়ে তারা এগিয়ে যেতে চাইলেও তখন এগিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
জয়ের নেশায় তারা জীবন পর্যন্ত বাজি রাখতে দ্বিধা করেন না। অনেক বেশি সাহস নিয়ে এগিয়ে যান তারা। আমাদের জীবনের লক্ষ্য আমরা ঠিক করলেও সে লক্ষ্যে পৌঁছার মতো আমাদের সাহস কম। আমরা প্রতিটি মুহূর্তে নিজের সাথে যখন নিজে কথা বলি, তখন মনে করি আমিও পারবো। আমি আগামীকাল থেকে এই এই কাজগুলো করব। তখন আমাদের মেন্টালিটি একদম ফ্রেশ থাকে। মনে যা আসে, তা নিয়ে আমরা ভীষণ চিন্তা করি বলেই হয়তো এমনটা মনে হয় আমাদের। যেন মনে হয় আমি চেষ্টা করলেই কাজগুলো আমার জন্য সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু না, পরক্ষণেই দেখা যায় তার উল্টো। আমাদের আর কিছুই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এক গবেষণায় ওঠে আসে, যারা জয়ী তারা কিন্তু কঠোর পরিশ্রম আর কৌশল অবলম্বন করে তাদের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় নিজ লক্ষ্যে জয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। হতাশাকে পায়ে ধলে সামনে এগিয়ে গেছেন। তাদের জন্য উপরওয়ালাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কাউকে উপলক্ষ করে। আসলে যারা সফল হোন, তাদের সে সফলতার পিছনে যাদের হাত থাকে, সেটা হয় তো সম্মুখে আর আসে না। সবাই তখন তার সফলতা টা-ই শুধু দেখে। আমাদের জীবনের সে কাঙ্ক্ষিত লক্ষে আমরা পৌঁছাতে গেলে, আমরা না পাই সাহায্যের সে বিশেষ কোনো হাত। ফলে নিজেদের মধ্যে নিজেরাই হতাশায় জর্জরিত হয়ে পড়ি। হতাশা তখন আমাদের আরো বেশি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।
আমি আমার নিজেকে দিয়েই তার প্রমাণ পাচ্ছি। যদিও এখনো সফল হতে পারিনি জীবনে। কিন্তু সবসময় ভেঙে পড়া কিছু মানুষের জীবন থেকে নেওয়া গল্পের পটভূমি লিখতে সচেষ্ট হয়েছি। সময় মানুষের উত্তম একজন শিক্ষক। আর সে শিক্ষক থেকে আমি রোজ শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ করে চলেছি। জীবনের পাতা থেকে যতটুকু শিখতে পেরেছি, তা হয়তো আমার একাডেমিক বই থেকেও পাইনি। মানুষ কখনো কখনো হার স্বীকার করে, অবশেষে হঠাৎ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় হতাশাকে সঙ্গী করে। জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে সাহসী মনোভাব রাখা কতটা জরুরি, তা সময় সাপেক্ষে বুঝতে পারবেন। হতাশা থেকে বের হয়ে আসুন। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিন প্রতিদিন। জীবন সুন্দর, কখনো আত্মহননের কল্পনাও করতে যাবেন না কিন্তু। মনে রাখবেন, আপনার জীবন আপনার কাছে ভীষণ মূল্যবান। ভালো থাকবেন সবসময়।
মমতা মজুমদার, কবি, লেখক ও গবেষক।
বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে সংকট কাটছে না। দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাসের বাস্তবতার মধ্য দিয়েই দেশ আগাচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ, সরকারি সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক পরিস্থিতি গণতন্ত্রের কাঠামো নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠা সম্ভব হচ্ছে না। রাজনীতিতে একদিকে আশাবাদের সুর জাগালেও অন্যদিকে উদ্বেগেরও জন্ম দিয়েছে। সরকার সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এই গণভোটের লক্ষ্য হলো জুলাই সনদে ঘোষিত রাজনৈতিক সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে জনসমর্থনের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা করেছেন, ‘এই গণভোটের মাধ্যমে জনগণই নির্ধারণ করবেন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো।’ এই ঘোষণার পরই রাজনৈতিক অঙ্গন আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। একদিকে সরকার নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং আচরণবিধি ঘোষণা করছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো কোনোটি প্রশ্ন তুলছে এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্তিমূলকতা নিয়ে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মতপার্থক্য এখনো স্পষ্ট। কেউ চাইছে আগে গণভোট, পরে নির্বাচন; কেউ চাইছে উল্টোটা। ফলে একটি সুসংগঠিত বিরোধী রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠছে না।
ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন করা হয়। জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক ঐক্য বজায় রাখতে হবে। তা না হলে আমরা সবাই বিপদের মুখে পড়ব। এ সম্পর্কে আমি আগেও একাধিকবার আমার আশঙ্কা প্রকাশ করেছি।’ নানা কারণেই আগামী নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এবারের নির্বাচন নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলকে পুনরায় ফিরে পাওয়ার এক বড় পরীক্ষা। নির্বাচনকে ঘিরে যে উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা শুধুই ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই বা ভোটার উৎসাহের বিষয় নয়; এখানে রয়েছে ‘ভোট কি কার্যকর হবে?’, ‘সক্রিয় অংশগ্রহণ কি সম্ভব হবে?’ এবং ‘নির্বাচন পরবর্তী সময় কী রূপ ধারণ করবে?’- এসব বেশি গভীরে ভাবার বিষয় সামনে এসেছে।
বিগত কয়েকটি নির্বাচনে আমরা দেখেছি ভোটার অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল, গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি ছিল। বিরোধী দল বড় অংশ নির্বাচনে ছিল না। এই পরিপ্রেক্ষিতে খুব ন্যায্যভাবেই আলোচনা সামনে আসে যে শুধুই নির্বাচন আয়োজন বড় কথা নয়; সমস্যা হলো নির্বাচন-পরবর্তী সময়, তার স্বীকৃতি, অংশগ্রহণ ও জনআস্থার পরিবেশ। এবারের নির্বাচনকে তাই শুধু ‘আগামী নির্বাচন’ বলা যাবেনা; এটি হবে একটি রূপান্তরপ্রক্রিয়ার অংশ, যেখানে নির্বাচন নিজেই একটি উদ্দেশ্য নয়Ñ বরং একটি ‘মাধ্যম’ হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে বিষয়টি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে বেশ কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে।
প্রথমত: রাজনৈতিক প্রস্তুতির দিক থেকে দেখা যাচ্ছে যে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ইতিমধ্যে ২৩৭টি আসনের প্রার্থীতা ঘোষণা করেছে। জামায়াতও প্রায় সবগুলো আসনেই তাদের প্রার্থীতা ঘোষণা করেছে আরও আগেই। এটি একটি সক্রিয় পদক্ষেপ, যেখানে দল বিশ্বাসযোগ্যভাবে সামনে এগোচ্ছে। আবার সম্প্রতি আমরা রক্ষ করলাম বিএনপি থেকে যারা প্রার্থীতার গ্রিন সিগনাল পায়নি তারা বিদ্রোহ করে বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। আশা করছি এ সংকট তারা কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু মোটাদাগে যে বিষয়টি না বললেই নয় যে শুধু প্রার্থী ঘোষণা করলেই সব কিছু শেষ হয় নাÑপ্রত্যক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ, অংশগ্রহণ মনোবল, নিরাপত্তা ও তথ্যপ্রচারণার স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ এসব একসাথে কাজ করতে হবে। এছাড়াও বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নির্বাচনের সংবিধান-বিধি ও প্রতিষ্ঠানগত প্রেক্ষাপটের দিক থেকেও বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন- জবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ ড়ভ ঃযব চবড়ঢ়ষব ঙৎফবৎ, ১৯৭২ (জচঙ) সংশোধনের কারণে বড় দলের প্রতীকে অংম নেওয়ার বিষয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, গণভোট-পরিকল্পনা ও সংশোধিত সংবিধান প্রস্তাব এসব প্রশ্ন ঝুলে আছে। আর এগুলো ভোটের পরিবেশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে বলে মনে হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত: সাধারণ মানুষ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা মনে করছে নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুটি দিক সামনে রয়েছে। একদিকে রয়েছে ‘নির্বাচন ভালো হবে’-এমন আশাবাদ। অন্যদিকে রয়েছে ‘যদি অংশগ্রহণ না হয় বা প্রতিযোগিতা না হয়’-এর ভয় বা শঙ্কাও রয়েছে। অংশগ্রহণ মানে শুধু ভোট দেওয়াই নয়; অংশগ্রহণ মানে ভোটের পর ফলাফলকে গণভিত্তিক গ্রহণ, সিদ্ধান্তকে স্বীকার এবং অংশগ্রহণকারীর মনোবলকে সম্মান করা।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক মেরুকরণের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জ লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে ইসলামিক দলগুলোর রাজনৈতিক উত্তরণ ও পথচলা নতুন মাত্রা পাচ্ছে। এই শক্তিগুলো শুধুই নির্বাচনের লড়াই নিয়ে নয়; তারা নিজেদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকেও নতুনভাবে সাজাচ্ছে, যা আগামী দিনের সংসদীয় প্রতিযোগিতায় প্রভাব ফেলতে পারে।
এছাড়াও তথ্য ও মিডিয়া-পরিবেশও এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এবং এর পূবববর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া আন্দোলন ও তার ডিজিটাল পরিণতি দেখিয়ে দিয়েছে যে সোশ্যাল মিডিয়া-ভিত্তিক আন্দোলন ও তথ্যপ্রচারণা আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রকে দ্রুত পরিবর্তন করছে। এই পরিবর্তন শুধু নির্বাচনের দিনেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি নির্বাচনপ্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করবে- ভোটার সিদ্ধান্তে, প্রচারণায়, ফলাফল-গ্রহণে। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, এই সব প্রস্তুতি, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ মিলিয়ে আসন্ন নির্বাচনের ‘বড় অর্থ কী হতে পারে’?
প্রথমত, এটি হতে পারে একটি নতুন রাজনৈতিক যাত্রার সূচনা। যদি নির্বাচন হয় অংশগ্রহণমূলক, অংশগ্রহণমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে, তাহলে এমন একটি রূপ তৈরি হতে পারে যেখানে ভোট শুধু জেতার-লড়াই নয়; ভোট হবে নির্বাচিত প্রতিনিধির প্রতি দায়বদ্ধতা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতীক। সরকারের দায়িত্ব শুধু নির্বাচনের আয়োজন করে কোনো দলকে বিজয়ী করে দেওয়া নয়, বরং আগামী দিনে মানুষের জীবনে-পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক কৃষ্টি ও গতিতে পরিবর্তন আনার প্রসঙ্গ।
দ্বিতীয়ত, বিগত সময়ের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাঠামোগত সমস্যা ছিল। আজ সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ যেন মিলিত হয়ে একটা নতুন মানদণ্ড গড়তে পারে।
তৃতীয়ত, যদি দায়িত্বশীলভাবে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তাহলে এটি হবে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পরিচয়ের পুনর্গঠন। নির্বাচনের ফলাফল শুধু দেশীয় প্রতিফলন নয়; এটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিফলিত হবে নির্বাচন অবাধ, অংশগ্রহণ ও সার্বভৌমতার দৃষ্টিকোণ থেকে। আজ সময় এসেছে দেশকে দেখাতে যে, বাংলাদেশের ভোটব্যবস্থা শুধু ত্রুটিপূর্ণ নয় বরং আশাবাদীও হতে পারে।
তবে বিপরীতভাবে, যদি ভোট হয় উদ্বেগ-পরিপূর্ণ পরিবেশে; যদি অংশগ্রহণ কম হয়; যদি বড় অংশগ্রুপ (যেমন কোনো বৃহৎ বা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল) নির্বাচনে না থাকতে পারে বা নির্বাচনের আগে সিদ্ধান্তহীনতা হয়, তাহলে এই নির্বাচন হয়ে উঠতে পারে বিভাজনের উৎস, বিশ্বাসের সংকট এবং গণতান্ত্রিক ধারণার ক্ষয়ের কারণ। যেমন- ‘একতরফা ভোট’, ‘আংশিক প্রতিযোগিতা’- এসব ঘটনা জাতীয় ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রতিফলন ছুঁড়ে দিতে পারে।
নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এখন আর অপেক্ষা করার সুযোগ নেই; সময় এসেছে তাদের দায়িত্ব সচলভাবে নেওয়ার। বিচারিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক প্রস্তুতি যেন দ্রুত গতিতে এগিয়ে নেওয়া হয়। নাগরিক সমাজের পক্ষে এখন দায়িত্বের সময় এসেছে। ভোটাররা শুধু শেয়ার-লাইকে থাকলে চলবে না। নির্বাচনের সত্যিকারের শক্তি শুধু ভোট হয়েছে কিনা, কারা জয় পেয়েছে সেগুলোই নয়- এর সাথে আরও অনেক বিষয় জড়িত রয়েছে।
পরিশেষে বলতে পারি, এ নির্বাচন আমাদের সময়-সন্ধিক্ষণের একটা চিহ্ন হতে পারে। আমরা যদি আজ দায়িত্বশীলভাবে এগিয়ে যাই, যথাযথভাবে প্রস্তুত হই, তাহলে আসন্ন নির্বাচন শুধু একটি ভোটের আয়োজন হবে না, বরং সেটি হবে একটি ‘মুহূর্ত’, একটি ‘ধাপ’ এবং একটি ‘সম্ভাবনা’- যা আমাদের রাজনীতিতে বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধার পরিবশে তৈরি করতে পারে। রাজনীতির সম্ভাবনা শুধু নির্বাচনে জয়ের নয়; সম্ভাবনা ভবিষ্যতের বাংলাদেশের রূপায়ণ। এই বাস্তবতার নাম গণতন্ত্রের টেকসই টিকে থাকা। কাজেই বলা যায় যদি সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে না গিয়ে দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে চিন্তা করতে পারে, তাহলে হয়তো আগামী নির্বাচনই হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পুনর্জন্মের সূচনা।
লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎসবমুখর নির্বাচন মানে এমন একটি নির্বাচন যেখানে ভোটার কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত হয় না। ভোট নিয়ে সবাই ভোট কেন্দ্রে নির্ভয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। প্রার্থীরা সমান সুযোগ পায় প্রচরণায়। প্রশাসন থাকে নিরপেক্ষ। আর গণমাধ্যম স্বাধীন ভাবে রিপোর্ট করতে পারে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয় সেখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি থাকলেও রাজনৈতিক পরিবেশের অস্থিরতা উৎসবের আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছিল। তাইত প্রকৃত গণতন্ত্র বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। অথচ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১ তে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়ত থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে ( এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগনের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।)’
তাই প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদের জন্য এবারের নির্বাচন হতে পারে নতুন পরীক্ষা---- ‘কীভাবে সেনাবাহিনী নিজেদের নিরপেক্ষতা ও উচ্চ মনোবল বজায় রেখে জাতির আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।’
আগামী ফেব্রুয়ারি/২৬ এ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সরকারের সক্ষমতা যাই হউক না কেন জনগণ নির্বাচনের ট্রেনে যাত্রা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে দেশের বড় বৃহত্তর দল বিএনপি ২৩৭ জনের প্রার্থীতা ঘোষণা করেছে। কিছু ক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থীরা বিক্ষোভ প্রকাশ করেছে। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে এক সময় সব ঠিক হয়ে যাবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। জামায়াত প্রায় এক বছর আগে প্রার্থীতা ঘোষণা করেছে। এনসিপি ও ঘোষণা করতে যাচ্ছে। সারাদেশে যখনই প্রচার প্রচারণা শুরু করেছে চট্টগ্রাম ৮ আসনে ঘোষিত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ নির্বাচনী জনসংযোগ করার সময় প্রার্থীসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তার মধ্যে একজন হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যুবরণ করে। একটি মহল দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে তা করছে। অগ্নিসন্ত্রাস ও শুরু হয়ে গেছে। বিষয়টি নির্বাচন ভণ্ডুল করার ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচিত। ভবিষ্যতে আরও এ ধরনের সমস্যা হতে পারে।
এরমধ্যে মাঠে আন্দোলনরত জামায়াত এর বক্তব্য হলো…গণভোট নভেম্বরে করতে হবে। গণভোটসহ ৫টি দাবি নিয়ে মাঠে আন্দোলনরত আছে। অবিলম্বে ৫ দফা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য শরিক আরও ৫টি দল জোট বেঁধে দাবি জানিয়ে আসছে। জনগণের চাহিদা এখন নির্বাচন। বিগত ১৫ বছর যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারিনি তা অংশগ্রহণ করতে উদগ্রীব হয়ে আছে। জনগণের মনোবল বুঝে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করা উচিত। পারম্পরিক দ্বন্দ্ব অথবা ঐক্যের ঘাটতিতে পতিত সরকার আবার যে পুন:র্বাসিত হবে না এর নিশ্চিয়তা কি?
জামায়াত তার আগে বলে আসছিল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে এরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এ দাবি জনমত সৃষ্টি করতে পারিনি বলে ঐ দাবিটা এখন আর উচ্চারিত হচ্ছে না। জামায়াত নভেম্বরে গনভোটের দাবি জানিয়ে বিএনপির সাথে আলোচনায় বসতে চাচ্ছে। বিএনপি আলোচনায় এখনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। এনসিপি বলছে জুলাই সনদকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় নির্বাচনে যাওয়াটা ভালো।
কিন্তু এখন কি সেই সময় আছে। এখন গণভোট করতে গেলে জুলাই সনদে যে সংবিধান
সংশোধনের ৪৮টি বিষয়ের গণভোট করতে চাচ্ছে তা জনগণকে জানাতে হবে। এখন তা প্রচরণা চালিয়ে গণভোট করাটা কি আদৌ সম্ভব?
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থীতা ঘোষণা করেছে। সম্ভাব্য প্রার্থী মঠে নেমে গেছে। ভোটারদের মাঝে একধরনের উৎসাহ উদ্দীপন সৃষ্টি হয়েছে। প্রচারণা নিয়ে উম্মাদনা শুরু হয়েছে।ভোটারদের অন্যকিছু এখন ভাববার সময় নেই। তাছাড়া আাগামী মাসে তফসিল ঘোষণা করা হলে মাঠ আরও সরগম হবে।গ্রামের হাট বাজার ও চা দোকানগুলোতে তুমুল আড্ডা চলছে আড্ডাবাজদের।উৎসবমূখর পরিবেশে নির্বাচন করতে এখন থেকেই নের্তৃবৃন্দের মাঝে সহনশীল মনোভাব থাকতে হবে। প্রচরণার সময় একে অপরের প্রতি কাদা ছুড়াছুড়ি বন্ধ করতে হবে। প্রার্থী নির্বাচন হওয়ার পর থেকে পোস্টার লাগানোর হিরিক পড়ে যায়। রাতের অন্ধকারে একে অপরের পোস্টার ছিড়ে পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না। এতে উভয় পক্ষের মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি হবে।আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সবাই চিন্তিত। পুলিশ এখনো শক্তি ও সাহস অর্জন করতে পারিনি। মাঠে তাদের সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনী আছে। নিজেদের স্বক্ষমতা অর্জন করার উপযুক্ত সময় ছিল। পুলিশ বাহিনী সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। যেহেতু সেনাবাহিনী নির্বাচনে সহায়তাকারী হিসেবে থাকবে সে হিসেবে কিছুটা ভরসা আমরা পাচ্ছি। সেনাকর্মকর্তারা দৃঢ়চিত্তে যে আশাবাদ ব্যাক্ত করেছে তাদের প্রতি আস্থা রাখা যেতে পারে। নিরাশ হচ্ছি না আমরা আশ্বস্ত হতে চাই তাই যেমনটি বলা হলো—
সেনাসদরে এক ব্রিফিয়ে সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনস অধিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান মোহাম্মদ মনজুর হোসেন বলেন, ‘১৫ মাস ধরে সেনাবাহিনী বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় নিয়োজিত রয়েছে। এর পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া অস্ত্র-গোলাবারদ উদ্ধারে এবং চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করছে। হারিয়ে যাওয়া অস্ত্রের ৮১ শতাংশ এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা গেছে। গোলাবারুদ (হারিয়ে যসওয়া) উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ৭৩ শতাংশ। এ ছাড়া ১৯ হাজারের বেশি অপরাধী গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে মতবিনিময় ও করছে। তিনি আরও বলেন একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আইনশৃঙ্খলা যাতে স্বাভাবিক থাকে সে লক্ষ্যে সেনাবাহিনী কাজ করতে বদ্ধপরিকর। নির্বাচনের সময় ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ সেনাসদস্য মাঠে মোতায়েন থাকবে। এটি এ এযাবতকালের সর্বোচ্চ। সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা রয়েছে জেলা উপজেলা এমনকি আসনভিত্তিক ক্যাম্প স্থাপন করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করার জন্য যা যা করার প্রয়োজন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তা করতে প্রস্তুত।
বেশকিছু দেশই সশস্ত্রবাহিনী নির্বাচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়-ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বা শ্রীলংকা এখানকার সেনারা নির্বাচনী নিরাপত্তায় অংশ নেয়। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দূরে থাকে। এই ভারসাম্য তাদের পেশাদারিত্বের মুল চাবিকাঠি। আমাদের সেনাবাহিনী যদি পেশাদার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে তবে তারা শুধু নিরাপত্তা নয় গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে জনগণের আস্থা অর্জন করবে।
সেনাবাহিনীর মনোবল ধরে রাখতে হলে প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে সেনাবাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে কোন রাজনৈতিক চাপ ছাড়াই।নির্বাচন কমিশনকে হতে হবে দৃঢ় ও স্বচ্ছ যাতে বাহিনীর ওপর অপ্রয়োজনীয় অভিযোগ না আসে।
অন্যদিকে গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো সেনাবাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশন করা। অযথা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে এমন শিরোনাম বা বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট না করা যা নির্বাচনকালীন পরিবেশকে অস্থির করে তুলতে পারে। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা যেমন জরুরি দায়িত্বশীল নীতি ও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
একজন সৈনিকের কাজ অনেক সময় নির্জন চাপমুক্ত ও ঝুকিপূর্ণ। এই সৈনিকরা গত ৫৪ বছরের অভিজ্ঞতায় বন্যার ত্রাণ থেকে অবকাঠামো উন্নয়ন পর্য়ন্ত নানান উদ্যোগের দায়িত্ব নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীগুলো সে-ই ধারাবাহিকতায় ক্রমাগত …জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে। তারা যে জনবিচ্ছিন্ন সেনাছাউনিতে আটকে থাকতে চায়নি তার ইঙ্গিত দিয়েছে বহুবার। নির্বাচনের সময় দিনরাত কাজ করতে হয় প্রায়ই বিরুপ পরিস্থিতিতে তাই বাহিনীর আভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ ও মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি ইউনিটে নেতৃত্বের ভুমিকা এখানে বড়। একজন অফিসার যদি তার দলের প্রতি আস্থা ও সাহস জোগাতে পারেন তবে তা মনোবলে প্রতিফলিত হয়। নির্বাচনকালীন সেনাসদস্যদের মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা বজায় রাখা দায়িত্বের প্রতি সম্মানবোধ জাগানো এসব বিষয়ই তাদের মনোবলকে টেকসই করে তোলে।
উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন করার লক্ষ্যে এখন থেকে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, যেমন সারাদেশে যৌথবাহিনীর মাধ্যমে চিরনি অভিযানের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে নিরপরাধ ব্যাক্তি যেন গ্রেপ্তার না হয়। প্রতিটি জনসভায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে হবে। প্রত্যেকটি জনসভায় নিজ নিজ দলের স্বেচ্ছাসেবক দল থাকতে হবে। নির্বাচনী প্রচারণায় কারও ব্যাক্তিগত চরিত্র হনন করা যাবে না। জনগণের দুর্ভোগ হয় অমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। কালো টাকার ছড়াছড়ি বন্ধ করতে হবে। ৪০০/৫০০ হোন্ডা নিয়ে মিছিল করাা-ওগুলো এখন জনগণ ভালোভাবে নিচ্ছে না। এতে পেশিশক্তির আবির্ভাব হয়। ২০ হোন্ডা ২০ গুন্ডা নির্বাচন ফিনিস এ মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। জনগণের ভাষা বুঝার জন্য তাদের দ্বোরগোরায় যেতে হবে। মানুষের ভালোবাসা নিতে হবে। হুমকি দুমকির রাজনীতি শেষ। প্রযুক্তির বদৌলতে ভোটাররা খুব সচেতন। এরা যোগ্য প্রার্থী দেখেই ভোট দেবে।
ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে তাদের ভোট যাতে ছিনিয়ে নিতে না পারে সে পাহারাদারের ভূমিকা যদি ভোটাররা পালন করতে পারে তখনই তারা বলবে আমার ভোট আমি দেব যাকে খুশি তাকে দেব। তখনই দেখা যাবে ভোট আয়োজনটি উৎসবমুখর হতে বাধ্য। মনে রাখতে হবে নির্বাচন কেবল প্রার্থী বা বাহিনীর নয় জনগণের ও দায়িত্ব। ভোটাররা যদি সচেতন না হন যদি নিজের ভোটাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হন তাহলে কোনো বাহিনীই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে পারবে
না। সেনাবাহিনীকে তখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
তাই নাগরিকদের বোঝা দরকার সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে কোনো ভয় নয় বরং নিরাপত্তার নিশ্চিয়তা তারা মাঠে নামে জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার্থে কার ও পক্ষ নিতে নয়। সেই বোঝাপড়াটা যত বেশি শক্ত হবে নির্বাচনের পরিবেশ তত বেশি শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর হবে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এই নির্বাচন শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিবর্তনের নয়।বরং রাষ্ট্রের প্রতি জনগনের আস্থা পুনর্গঠনের সুযোগ। আর এই আস্থা রক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হলো আমাদের সশস্ত্র বাহিনী।
তাদের মনোবল যত দৃঢ় হবে ততই ভোটারদের আস্থা বাড়বে। সেনাবাহিনী যদি নিরপেক্ষতা শৃঙ্খলা ও উচ্চ পেশাদরিত্ব বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করে তবে দেশ পাবে একটি শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক ও সত্যিকারের উৎসবমুখর নির্বাচন।
আজ প্রয়োজন শুধু একটাই-
সবপক্ষের আন্তরিকতা ও সহযোগিতা। সেনাবাহিনী যেন তাদের ঐতিহ্য মর্যাদা ও জনগনের ভালবাসাকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নামে। তাহলে জনগণ বলতে পারবে…এই নির্বাচন আমাদের, ভোট আমার রক্ষিত সম্পদ, শস্য শ্যামল বাংলাদেশটা আমাদের, আর দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও আমাদের গর্বের।
লেখক: মিজানুর রহমান, কলামিস্ট ও সাবেক ব্যাংকার।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও প্রাক্তন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ১৩ নভেম্বর এ মামলার রায়ের দিন নির্ধারণ করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। উল্লেখ্য, গত ২৩ অক্টোবর শেখ হাসিনার এ মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়। যুক্তিতর্ক শেষ হলে রায়ের দিন ধার্যের জন্য আগামী ১৩ নভেম্বর ঠিক করেন ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন– বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এই মুহূর্তটি কেবল একটি আইনি পর্ব নয়— এটি ক্ষমতা, জবাবদিহি ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আত্মার সঙ্গে এক গভীর হিসাব-নিকাশ। এ বিচার শুধু আদালতের ভেতরের লড়াই নয়; এটি পরীক্ষা করছে— একটি দেশ কি তার সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাদেরও ন্যায়বিচারের আওতায় আনতে পারে, নাকি আবারও রাজনীতির দোলাচলে পড়ে যাবে। আর এর মধ্য দিয়েই প্রমাণ হবে, ন্যায়বিচার কি গণতন্ত্রকে দৃঢ় করতে পারে, নাকি আরও ভেঙে দেয়।
অর্ধশতাব্দীর ক্ষমতা ও জবাবদিহি
পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি ব্যক্তিনির্ভর, দলনির্ভর— নীতিনির্ভর নয়। শেখ হাসিনার যুগ সেই দ্বৈত বাস্তবতার প্রতীক— একদিকে লোক দেখানো উন্নয়ন, অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী শাসন। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণবিক্ষোভ ও রক্তাক্ত দমন-পীড়নের পর তার পতন এমন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছিল, যা কেউ কল্পনাও করেনি। যে নেতা একসময় ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন, আজ তিনিই মানবতাবিরোধী অপরাধের আসামির কাঠগড়ায়। অভিযোগ অনুযায়ী, হাসিনা ও তার সহযোগীরা বিক্ষোভ দমনকালে নির্বিচারে শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেন বা তা প্রশ্রয় দেন, যাতে শত শত মানুষ নিহত হয়। অভিযোগ গুরুতর, তবে আরও গুরুতর হলো এর রাজনৈতিক তাৎপর্য— দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কি দলীয় আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবে?
যুক্তিতর্ক শেষে এখন মামলাটি রায়ের অপেক্ষায়। সেই দিনক্ষণ ঠিক হবে আগামী ১৩ নভেম্বর। এর সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে চূড়ান্ত ফলাফল। এ মামলায় হাসিনা-কামালের চরম দণ্ড বা সর্বোচ্চ সাজা চাইলেও, মামুনের শাস্তি নিয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছে প্রসিকিউশন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনভাবে কাজ করছে, কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নেই। তবুও হাসিনার সমর্থকরা তাকে ‘রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার’ হিসেবে তুলে ধরছে। পশ্চিমা তিনটি ও ভারতীয় চারটি পত্রিকাতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাসিনা বলেন, জুলাইয়ের রক্তপাতের জন্য তিনি দায়ী নন, যদিও স্বীকার করেন যে ‘কিছু ভুল’ হয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে। এমন বক্তব্য অস্পষ্ট ও আত্মরক্ষামূলক— তার উত্তরাধিকারকে আরও জটিল করে তুলছে।
সূত্র মতে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে দেশের ৪১ জেলার ৪৩৮ স্থানে হত্যাকাণ্ড ঘটে। ৫০-এরও বেশি জেলায় ব্যবহৃত হয় মারণাস্ত্র। গুলি ছোড়া হয়েছিল ৩ লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড। শুধু ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছিল ঢাকায়। মানুষের প্রাণ কাড়তে ব্যবহৃত হয়েছিল এলএমজি, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল, শটগান, রিভলভারসহ অন্যান্য অস্ত্র। এক দশকের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, গুম-খুন ও একদলীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পর, বাংলাদেশের জনগণ এখনো সেই সূক্ষ্ম সীমারেখা খুঁজছে— যেখানে আইন ও রাজনীতি একে অপরের হাত থেকে মুক্ত। এই বিচার সে সীমারেখা নতুন করে টানার এক বিরল সুযোগ।
ন্যায়বিচার নাকি রাজনীতি- সূক্ষ্ম সীমারেখা
১৩ নভেম্বর ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সতর্ক করছে, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ বিভিন্ন শহরে অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। সীমান্তের বাইরে অবস্থানরত দলীয় নেতারা গোপনে সমন্বয় করছে— এমন প্রমাণও মিলেছে। ভারতের কিছু সংবাদমাধ্যমে (যেমন আনন্দবাজার পত্রিকা) প্রকাশিত শিরোনাম ‘আওয়ামী লীগ রাস্তায় নামবে’— কেবল সংবাদ নয়, বরং একটি প্রচারণা-অভিযান। এর লক্ষ্য: বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল দেখানো, ট্রাইব্যুনালের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করা ও আন্তর্জাতিকভাবে হাসিনার প্রতি সহানুভূতি তৈরি করা। ভারতীয় গণমাধ্যমের এ ধরনের মনোভাব নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই তারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে ‘বন্ধু সরকার বনাম অস্থিরতা’ এই ছকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। তবে এখন সাধারণ মানুষ এসব বয়ানে ক্লান্ত— তারা আর আঞ্চলিক কূটনৈতিক খেলায় পুতুল হতে চায় না।
রাজনীতির বাইরে রয়েছে এক নির্মম মানবিক সত্য। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যানুযায়ী, ৩৬ দিনের গণঅভ্যুত্থানে ১,৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়। ছাত্র সমাবেশে গুলি চালানো, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কাছে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিশোধ নয়, বরং পরিসমাপ্তি। প্রশ্ন কেবল হাসিনার আদেশ নিয়ে নয়— বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের সেই অংশ নিয়ে, যা তার অধীনে নিষ্ঠুরতার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। যদি এই বিচার স্বচ্ছ ও প্রমাণনির্ভর হয়, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক নতুন দৃষ্টান্ত হতে পারে। কিন্তু যদি এটি রাজনৈতিক নাটকে পরিণত হয়, তবে তা জনগণের ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
জনমনের চাওয়া: প্রতিশোধ নয়, জবাবদিহি
জনগণের মধ্যে এখন একটাই স্পষ্ট চাওয়া— জবাবদিহি হোক; কিন্তু প্রতিশোধের মাধ্যমে নয়। অনেকে হাসিনার শাসনামলের ভয়াবহতা মনে রেখেছে, কিন্তু তারা একই সঙ্গে আরেকটি দমননীতি চায় না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এ সূক্ষ্ম ভারসাম্য সম্পর্কে সচেতন। ১৩ নভেম্বরকে উচ্চ-ঝুঁকির দিন ঘোষণা করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি যৌথভাবে টহল দেবে ঢাকা, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর ও শরীয়তপুরে। শান্তি রক্ষা জরুরি- তবে অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ আরও বিপজ্জনক হতে পারে।
এই বিচারের সময় প্রোপাগান্ডা আরও তীব্র হবে। হাসিনার পক্ষ নিজেদের গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করবে— যদিও তার প্রশাসনই সেই গণতন্ত্রকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম, কূটনীতি ও নাগরিক সমাজকে এখানে পাল্টা প্রচারণা নয়, বরং স্বচ্ছতা ও প্রমাণ দিয়ে উত্তর দিতে হবে।
এটি কোনো সরকারের বৈধতা রক্ষার বিষয় নয়— এটি বাংলাদেশের নৈতিক বয়ান পুনরুদ্ধারের লড়াই। ১৩ নভেম্বরের পর যা ঘটবে, তা কেবল ট্রাইব্যুনালের নয়, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের নির্ধারক হবে। যদি বিচারপ্রক্রিয়া ন্যায়সঙ্গত, স্বচ্ছ ও মর্যাদাপূর্ণ হয়, তবে হারানো আস্থা ফিরে আসতে পারে। আর যদি তা প্রতিহিংসার আকার নেয়, তবে নতুন করে অবিশ্বাস জন্ম নেবে। বিশ্ব তাকিয়ে আছে — এক নারীর দোষ বা নির্দোষ নির্ধারণের জন্য নয়, বরং দেখার জন্য যে বাংলাদেশ কি তার ইতিহাসের এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
এই বিচার শুধু একটি মামলা নয়; এটি বাংলাদেশের সামনে ধরা এক আয়না। প্রশ্ন হচ্ছে— যে জাতি একদিন ন্যায়বিচারের জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়েছিল, তারা কি আজ নিজেদের নেতার ক্ষেত্রেও সেই একই ন্যায়বিচার দিতে পারে? যদি বাংলাদেশ শান্তি বজায় রাখতে পারে, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে ও বাহ্যিক প্রভাব প্রতিহত করতে পারে, তবে ১৩ নভেম্বরের ঘোষণা প্রতিশোধের নয়, বরং পরিপক্বতার প্রতীক হয়ে থাকবে। শেষ পর্যন্ত প্রকৃত রায় দেবে না ট্রাইব্যুনাল, দেবে ইতিহাস— আর একটি জাতির বিবেক, যে আবারও ন্যায়বিচারের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াতে শেখছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের প্রিয় এই ঢাকা একসময় ছিল সতেজ সজীব সবুজ শহর, প্রাণময় শহর পথ ছিল চলার আনন্দের।
আর আজ চলার পথ যেন এক দুর্বিষহ যন্ত্রণার নাম।
সকালের কর্মময় সূর্যটায় দিনের সফল সূচনা হয়, কর্মক্ষেত্রগামী মানুষ পূর্ণ প্রাণশক্তি চোখে মুখে তাড়াহুড়ো আর দুশ্চিন্তা নিয়ে বের হয়ে সন্ধ্যায় কর্মক্লান্তজন ঘরে ফেরে একরাশ বিরক্তি আফসোস অশান্তি ধুলোকালিঝুলি মেখে।
বর্তমানে এই শহরের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজিডি হলো অসহ্য অসহনীয় যানজট। এই যানজট এমন দানব যা মূল্যবান সময় অর্থনীতি মানসিক শান্তি সবকিছু গ্রাস করছে প্রতিদিন।
ভোরবেলায় প্রচন্ড গাড়ির হর্ণ কর্মব্যস্ত মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর রাস্তা একাংশ জুড়ে অসংখ্য গাড়ির স্থবির সারি, বাকি অংশ দখল করে নিত্যদিনের বাজার বসেছে, এই হলো রাজধানীর বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার চিত্র।
যানজটে আঁটকে থাকা মানুষগুলোর মুখে এক ধরনের অভ্যস্ততা। কেউ জানালা খুলে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে ধোয়াচ্ছন্ন আকাশে, কেউ সময় দেখে আর সময় গোণে আর কত মিনিট।
অপেক্ষায় মিনিটগুলো হারিয়ে যায় ঘন্টায়।
কোনো কর্মজীবীই সঠিক সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ কর্মগুলো পেছাতে পেছাতে গুরুত্বহীন হয়ে যায়। রোগীদের অবস্থা ততোধিক গুরুতর। এম্বুলেন্সে আঁটকে রোগীর মৃত্যু হয়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে রাজধানীর রাস্তায়। কোনো কোনো গর্ভবতী নারীর সন্তান হয়েছে রাস্তায় এটাও কখনো স্বাভাবিক ঘটনা মনে হয় যানজটের শহরে।
যানজট এখন কেবল নাগরিক দুর্ভোগ নয় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও বটে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ঢাকার যানজটে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হয়। বছরে এই অপচয় কতটা তা সহজেই অনুমেয়। ভয়াবহ অবস্থা।
এছাড়াও জ্বালানি অপচয় পণ্যের ক্ষতিসহ আরো অনেক প্রকার ক্ষতির মধ্যে বাংলাদেশ।
বানিজ্যিক প্রবাহ থমকে যায় অর্থনীতির শরীরে লেগে যায় যানজটের করাল গ্রাস।
যানজটে আঁটকে থাকা কেবল শারীরিক ক্লান্তি নয় এটি এ ধরনের মানসিক নির্যাতন। গাড়ির ভেতর তাপ শব্দ ধোঁয়া আর স্থবির সময় মিলিয়ে তৈরি করে এক দমবন্ধ অবস্থা। যা মেনে ও মনে নেয়া যায় না। মানুষ ক্রমশঃ হয়ে ওঠে অস্থির অসহিষ্ণু খিটখিটে মেজাজের অনেক সময় মেজাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
সামাজিক কর্মকাণ্ডে কখনো সুকুমার বৃত্তিতে সময় ও মনোযোগ দিতে পারে না। পরিবারকে সময় দিতে না পারার জন্য পরিবারের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়, দৈনন্দিন জীবনে এবং স্বাস্থ্যেরও বিপর্যয় ঘটে এটা এখন এই মহানগরীর বিষন্নতার নিত্যচিত্র।
বিশেষ করে ভোগান্তির শিকার হয় কর্মজীবী নারী ও শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে শিশু কিশোর। দীর্ঘ সময় পথে আঁটকে থেকে তারা নিরাপত্তাহীনতা ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকে নিজেরা ও পরিবার।
শিক্ষার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে অপচয় হয়। প্রতিযোগিতামূলক সময়ে কেবলই পিছিয়ে পড়ে।
যানজট মানেই স্থবিরতা, আর স্থবিরতা জন্ম দেয় বাযু ও শব্দের দূষণের মহামারী। রাজধানীর রাস্তায় প্রতিদিন লাখ লাখ গাড়ি দাঁড়িয়ে থেকে ফেলে অগণিত টন বিষাক্ত গ্যাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এই শহরের বাতাস ভয়াবহ দূষিত।
এই দূষণ ফুসফুসের রোগ হাঁপানি হৃদরোগ এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে।
রাস্তায় স্থির গাড়িগুলোর হর্ণ ও চিৎকার মানুষের মানসিক ভারসাম্য নাড়িয়ে কাঁপিয়ে দেয়।
নদীমাতৃক শ্বাসপ্রশ্বাসভরা বাংলাদেশ আজ রাজধানীতে দম নিতে ভয় পায়।
এই যানজটের শেকড়ের পেছনে লুকিয়ে আছে পরিকল্পনার অভাব আর অব্যবস্থার ভয়াবহ ছায়া।
অপরিকল্পিত নগরায়ন শহর বেড়েছে সে তুলনায় রাস্তা বাড়েনি পরিকল্পিতভাবে। দুর্বল গণপরিবহন বাসের সংখ্যা কম বেশিরভাগই নষ্টগুলো জোড়াতালি দিয়ে রঙ ও মেরামত করা তাও অনির্ভরতযোগ্য অকার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থা অদক্ষ ট্রাফিক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
অসচেতন নাগরিক দায়িত্ব পালন। উল্টোপথে গাড়ি চালনা, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা। মূল সমস্যা হলো রাস্তার বেশিরভাগ অবৈধ দখল রাখা ফুটপাতে হকার বসিয়ে চাঁদাবাজি করা।
আইন প্রয়োগে শৈথিল্য অপরাধের শাস্তি না পেলে অপরাধ অভ্যাসে পরিণত হয়, এটা রাজধানীতেও পূর্ণমাত্রায় ঘটেছে।
অসহ্য এই বাস্তবতা থেকে মুক্তি পেতে হলে চাই সাহসী সিদ্ধান্ত ও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি। গণপরিবহনের আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, আধুনিক নিরাপদ ও সময়নিষ্ঠ পরিবহন চালু করতে হবে। মেট্রোরেল প্রয়োজনে শহরে চক্রাকারে রেল ব্যবস্থা বিআরটিসি সম্প্রসারণ প্রয়োজনে পাতাল রেল দ্বিতল রাস্তা যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা কঠিন হাতে বন্ধ, অতি অবশ্য ফুটপাত দখল মুক্ত করা।
হকারদের অন্য কর্মস্থানের ব্যবস্থা করে পথ পথিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
স্মার্ট ট্রাফিক ব্যবস্থা ডিজিটাল সিগনাল ক্যামেরা জরিমানা এবং সময়সূচি মনিটরিং চালু করা যেতে পারে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই ট্রাফিক শিক্ষার চর্চা প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলোচনা কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে।
নদীপথকে কাজে লাগানে যেতে পারে। সাইকেল ও বাইক ও রিকশার জন্য আলাদা লেন থাকা জরুরি।
প্রতিটি বহুতল ভবনে পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা প্রতিটি মার্কেট হোটেল রেস্তোরাঁয় পার্কিং সুব্যবস্থা আবশ্যক।
পার্কিং না থাকলে হোটেল রেস্তোরাঁকে কোনভাবেই অনুমতি না দেয়া।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন জনগণের মনোভাব পরিবর্তন।
জনগণ যদি নিজে ট্রাফিক আইন যথাযথ মেনে চলে এবং এটাকে সংস্কৃতির অংশ, আমার পথের আমি মানব গ্রহণ করব এবং অন্যেও যেন সেটা ভোগ করে তার ব্যবস্থা করা দরকার।
সমস্যা গভীর তার শেকড় কাটার দায়িত্ব সচেতন জনগণের।
চলাচলের সুশৃঙ্খল রাস্তা এক সভ্য জাতির প্রতিফলন।
যানজট শুধু রাস্তার সমস্যা নয় এটি আমাদের স্থবির জীবনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ।
আজ আমরা যে ক্লান্ত রাগান্বিত দমবন্ধ প্রায় স্থবির এক নগরে বাস করছি সেটি আসলে আমাদের পরিকল্পনা আর নৈতিকতার ব্যর্থতার ফল।
তবুও জনগণ আশা করে, নাগরিক ও রাষ্ট্র সবাই মিলে সঠিক পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে আসে তাহলে এই আবদ্ধ নগরীতে রাস্তায় জনগণ যানবাহনের সুশৃঙ্খল প্রবাহ হবে। ফুটপাত দখল মুক্ত হবে পথ হবে পথিকের চলার আনন্দ।
লেখক : চেয়ারম্যান, প্রশিকা।
বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। আগামী ১৩ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই–আগস্ট ২০২৪-এর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা ঘিরে সারাদেশে সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনা ও উদ্বেগের এক অস্বাভাবিক পরিবেশ। ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রক্তাক্ত অধ্যায় হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় থাকবে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষোভ, সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ নামে পরিচিত অভূতপূর্ব জনজাগরণ দেশজুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন দমন করতে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভয়াবহ দমননীতির অস্ত্রে পরিণত করে। সে সময় পুলিশ, র্যাব এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে ঢাকাসহ সারাদেশে নির্বিচারে গুলি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও গুমের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হিসেবে, দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হন এবং অগণিত মানুষ স্থায়ী অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ববরণ করেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে সে সময়ের সহিংসতার ভয়াবহতা স্পষ্টভাবে উঠে আসে। তাদের ভাষায়, ‘২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এক নজিরবিহীন মাত্রায় পৌঁছেছিল।’
দেশের অভ্যন্তরেও জনমতের চাপ দ্রুত বাড়তে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC)-এর সঙ্গে সমন্বয় করে ২০২৫ সালের শুরুতে শেখ হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে।এই মামলাটি কেবল একজন ব্যক্তির বিচার নয়; এটি এক যুগের রাজনীতির প্রতীকী হিসাবও বটে। অভিযোগপত্রে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, বিরোধীদের ওপর দমননীতি, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দীর্ঘ তালিকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আদালতে উপস্থাপিত হয়েছে প্রায় ২০ হাজার পৃষ্ঠার সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ ও সরকারি রেকর্ড। তদন্তে দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অধিকার, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফোরাম, এবং ল’ অ্যান্ড জাস্টিস সোসাইটি অব বাংলাদেশের মতো সংস্থাগুলো প্রমাণ সরবরাহ করেছে যে বহু ক্ষেত্রে সরকারি বাহিনী রাজনৈতিক নির্দেশে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ও তার সমর্থকরা এই মামলাকে শুরু থেকেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফসল বলে দাবি করে আসছেন। তাদের বক্তব্য, এটি ‘একটি সাজানো বিচার,’ যার উদ্দেশ্য রাজনৈতিকভাবে শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করা। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, মামলার প্রমাণের পরিমাণ ও সাক্ষ্যের বিশদতা ইঙ্গিত দেয়—এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং প্রকৃত মানবাধিকার লঙ্ঘনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিচালিত একটি বিচার প্রক্রিয়া।বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক চাপের অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আদালতের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক আস্থা কিছুটা ফিরে এসেছে। সে কারণেই আসন্ন রায়কে অনেকে মনে করছেন ‘বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার জন্য এক ঐতিহাসিক পরীক্ষা।’ রায়ের দিন ঘনিয়ে আসতেই রাজপথে শুরু হয়েছে উত্তাপ। নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঘোষিত ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীসহ সারাদেশে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
দলটির নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুব উল আলম হানিফসহ কয়েকজন প্রবাসী আওয়ামী নেতা বিভিন্ন ভার্চুয়াল বক্তব্য দিয়েছেন। গত ৫ নভেম্বর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘১৩ নভেম্বরকে সামনে রেখে আপনারা ঐক্যবদ্ধ হোন। ঢাকায় আমরা ১৩ নভেম্বর লকডাউন দিয়েছি—সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লকডাউন। ১০ থেকে ১২ নভেম্বর দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল, আর ১৩ নভেম্বর যেন রাজধানী ঢাকা শহর আমাদের দখলে থাকে, জয় বাংলার দখলে থাকে।’ এই বক্তব্যগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উস্কানিমূলক এবং আইনি সীমালঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আদালতের রায় ঘোষণার আগে রাজধানী অবরোধের ঘোষণা কার্যত বিচারপ্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার সমান। বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ জানে—রায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারে। তাই আগেভাগেই রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলে তারা আদালত ও প্রশাসনকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করার কৌশল নিচ্ছে। রায়কে কেন্দ্র করে সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। ঢাকায় সাত হাজারেরও বেশি পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সংবেদনশীল এলাকায় নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন ও ড্রোন টহল জোরদার করা হয়েছে। ‘লকডাউন’ প্রস্তুতির নামে কিছু গোষ্ঠী রাজধানীতে সহিংসতা ছড়ানোর চেষ্টা করায় ইতোমধ্যে ৩০ জনের বেশি সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, নাশকতা এড়াতে ১০ নভেম্বর থেকে ঢাকার প্রবেশপথ, আবাসিক হোটেল, মেস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলে তল্লাশি শুরু হবে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা জোরদার এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলবে। এ ছাড়া সারাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তালিকা ধরে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। অনেককে নজরদারিতে রাখা হয়েছে; তাদের গতিবিধি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। সূত্র বলছে, বিচ্ছিন্নভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পরিচয় গোপন রেখে অবস্থান করছেন এবং সুযোগ পেলেই সংগঠিত হয়ে ঝটিকা মিছিলের চেষ্টা করছেন। তবে বড় আকারে সংগঠিত হয়ে নাশকতা ঘটানোর সুযোগ তারা পাবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগ এক গভীর সংকটে পড়েছে। শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে দলের একচ্ছত্র নেতৃত্বে ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে দলে তৈরি হয়েছে বিভাজন ও বিভ্রান্তি। একদিকে দলের পুরনো নেতৃত্ব এখনো শেখ হাসিনার প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখাচ্ছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ চায় নতুন নেতৃত্ব ও নতুন রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা। রায়ের পর রাজনৈতিক পরিবেশ যেদিকে মোড় নেবে, তা সরাসরি প্রভাব ফেলবে দলটির অভ্যন্তরীণ কাঠামোর ওপর। যদি রায়ের পর দলে নেতৃত্ব পরিবর্তন বা পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তবে তরুণ নেতৃত্বের উত্থানের সুযোগ তৈরি হতে পারে। তবে সেটি তখনই সম্ভব, যখন দলীয় রাজনীতি হুমকি, মিথ্যাচার, উস্কানি বা সহিংসতার পরিবর্তে গণআস্থা পুনরুদ্ধারের পথে অগ্রসর হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিবেশী ভারতের প্রভাব নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে দিল্লি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অন্যতম কৌশলগত অংশীদার ছিল। কিন্তু বর্তমানে ভারতের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য না করলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দিল্লি এবার অপেক্ষাকৃত নীরব—সম্ভবত তারা বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করছে।যদি আওয়ামী লীগের কোনো অংশ ভারতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে সহিংসতা সৃষ্টি করে, তবে তা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও বিপদের মুখে ফেলবে। আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—রাষ্ট্র ও জনগণ কোন পথে যাবে? গণতন্ত্র তখনই টিকে থাকে, যখন নাগরিকরা আইনের শাসনে বিশ্বাস রাখে এবং দলীয় আনুগত্যের ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। রায়ের তারিখ ঘোষণার দিন যদি রাজপথে সহিংসতা দেখা দেয়, তবে তার ক্ষতি হবে জনগণেরই। একজন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের দায়িত্ব বিচার প্রক্রিয়াকে সম্মান করা, আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া এবং রাজনৈতিক মতবিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে প্রকাশ করা। ইতিহাস প্রমাণ করে, বাংলাদেশের সংকটের সময়ে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েই বিজয় অর্জন করেছে। ১৯৭১ সালে যেমন মুক্তিযুদ্ধের ঐক্য জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনও ছিল সেই ঐক্যেরই প্রতিফলন। আজও প্রয়োজন সেই জাতীয় চেতনার পুনর্জাগরণ। বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রধান প্রয়োজন হলো ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য। দলীয় পরিচয়, মতভেদ বা অতীতের সংঘাত ভুলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। বিচার ও ন্যায়বিচার যেন কোনো রাজনৈতিক প্রতিশোধে পরিণত না হয়—বরং তা যেন আইনের শাসনের প্রতীক হয়ে ওঠে, সে বিষয়ে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এই রায় কেবল শেখ হাসিনার বিচার নয়; এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। আদালতের রায় যদি নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে প্রদান করা হয়, তবে এটি ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করবে—যেখানে আর কোনো ক্ষমতাশালী ব্যক্তি রাষ্ট্রকে নিজের সম্পত্তি ভেবে আচরণ করতে সাহস পাবে না।
১৩ নভেম্বরের রায় তাই কেবল একটি আইনি সিদ্ধান্ত নয়; এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার প্রতীক। এটি প্রমাণ করবে, বাংলাদেশ কি সত্যিই ন্যায়বিচারের পথে অগ্রসর হচ্ছে, নাকি আবারও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও সহিংসতার চক্রে বন্দি হতে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা; নাগরিকদের দায়িত্ব সহিংসতা ও বিভাজন থেকে দূরে থাকা; আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব গণআস্থার পথে ফিরে আসা।যদি এই তিন পক্ষ তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারে, তবে বাংলাদেশ অস্থিরতার অন্ধকার পেরিয়ে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের এক নতুন ভোরে পৌঁছাবে।
লেখক : কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
সাম্প্রতিককালে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রণীত বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ তে এটিকে একটি স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে দেশের সার্বিক আর্থিক উন্নয়নের স্বার্থে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বিগত চারদশকেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত নিয়ন্ত্রণ সংন্থা হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ কি এ কথাটি সুধী মহলে বহুল আলোচিত। প্রথাগতভাবে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক খাতের মুরুব্বি, ব্যাংকের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল, সরকারের আর্থিক সম্পদের রক্ষক , পরামর্শক এবং আর্থিক সম্পদ উন্নয়নের কাজে প্রথিকৃত । কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মতে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূলত দুটি কাজ (১) বছরে দুবার মুদ্রানীতি প্রণয়ন; (২) সংস্থা হিসাবে তফসিলী ব্যাংকের কাজের পরিদর্শন, তদারকি ও পরিবেশ মূল্যায়ন। প্রথমটির মুখ্য উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা যাতে সঠিক সময়ে সঠিক মুদ্রা সঠিক হাতে পৌঁছে দেয়া যায়। এর দুটি হাতিহার আছে যেমন (১) পরিমাণগত যার মধ্যে আছে ব্যাংক রেট পলিসি, খোলা বাজার অপারেশন, সি.আর,আর ও এস.এল.আর ইত্যাদি এবং অন্যটি হলো (২) গুনগত: যেমন রেশনিং, নৈতিকভাবে প্ররোচিত করা, প্রচারণা ও মিটিং করা।
দেশের প্রচলিত মিয়মানুসারে তফসিলী ব্যাংকগুলো তাদের আমানতের একটি অংশ সি.আর.আর হিসাবে ৬.৫ শতাংশ ও এস.এল.আর হিসাবে ১৩ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। সুত্র বাজাওে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ এই দুটি হার কম বেশি করা হয় অর্থনীতির সার্বিক বিবেচনায় এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত তাদের স্ব স্ব পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে তাদের সার্বিক সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করে সব দেশের একই নীতি। ২০১৮ সালে সি আর আর শতাংশ কমানো হয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস বিএবি এর দাবির মুখে অর্থমন্ত্রনালয় কাছে কোন প্রকার বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই আরও বলা হয়েছে আগে বাস্তবায়ন তারপর বিশ্লেষণ বিষয়টি এমনও হতে পারত বিএবি সদস্যবৃন্দ মন্ত্রণালয়ের আলাপ করতে পারত এবং এই আলাপের ফলাফল কেন্দ্রীয় বাংক অর্থমন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠাতে পারত ।
কিন্তু বিষয়টি উল্টো হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে বলে বিশ্লেষন গন মনে করেন। এইভাবে যদি ক্ষমতার বলয়ে মুদ্রা নীতির সবছেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদান্ত নেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংক উপেক্ষা করে তাহলে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাখার যৌক্তিকতা কি? আর্থিক খাতের গবেষকবৃন্দ বলছেন আমানতকারীদের স্বার্থেই সিআরআর/ এসএলআর ২০-২২ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হয় কারন ব্যাংকের মোট আমানতের ৯০ শতাংশই তাদের বাকি ১০ শতাংশ মালিক পক্ষ বিএবিএর সদ্যসদের। এই ঘটানাতিতে সংখ্যালঘু ব্যাংক মালিকদের স্বার্থ রক্ষা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ আমানতকারীদের নয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে বাজারে ১০ হাজার কোটি টাকা চলে এসেছিল যা ব্যাংকগুলোর বর্তমান মূলধন সংকটে বিমোচন ব্যবহৃত হবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে ব্যাংক মূলধন সংকটের কারণ কি? বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ১. খেলাপী ঋণ যা বর্তমানে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪ শতাংশ থাকে বলা হয় মহাবিপদ সংকেত। ২. এডভান্স ডিপোসিট রেসিও এডিআর অসামঞ্জস্য পূর্ন বিধায় সেখানে ব্যাংকগুলোর তাদের আমানতের ৮০-৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ অনুমোদন বিতরণ করতে পার সেখানে কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংক নিয়ম লঙ্ঘন করে এডিআর রেশিও ৯০ শতাংশে এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ৯২ শতাংশ উন্নতী করছে এ দুটি হলো তারল্য সংকটের মুল কারন। এল ফলশ্রুতিতে ব্যাংকগুলোর আর বিনিয়োগ করতে অপারগত প্রকাশ করছে উদ্যোক্তাদেরকে। এর জন্য দায়ী ভ্রান্ত রাজনীতি সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্যদ রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য লোক নিয়োগ ঋণখেলাপিরদের পৃষ্ঠপোষক করা অব্যহত রাখা এবং ব্যাংক জালিয়াতিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া।
বিগত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অলিগার্ক তৈরি হয়েছিল। সব অলিগার্কের একটি অভিন্ন চরিত্র ছিল, তারা ব্যাংক ঋণের অপব্যবহার করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান করা অপরিহার্য। এই স্বাধীনতা দিতে হবে আর্থিক, প্রশাসনিক ও কাঠামোগত। সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে হোটেল আমারিতে ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অপরিহার্যতা’ শীর্ষক এক আলোচনায় বিশিষ্টজন এসব কথা বলেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এ আলোচনার আয়োজন করে। পিআরআইর ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ এতে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এখানে সংস্কার, ওখানে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। তবে দেশের এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা অপরিহার্য। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসন দিলে হবে না, স্বাধীন প্রতিষ্ঠান করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা দিতে হলে সব দিক থেকেই দিতে হবে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় গভর্নর, ডেপুটি গভর্নরের নিয়োগ দিতে হবে। একই সঙ্গে আর্থিক, কাঠামোগত, আইনি, লোকবল নিয়োগ সবই স্বাধীনভাবে করতে হবে। আবার তাদের জবাবদিহি থাকতে হবে। আলোচনায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন বিগত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। নিয়ম না মেনে ঋণ, সুদহারে সীমা আরোপ, ডলারের দর ধরে রাখা ও টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এ থেকে উত্তরণে স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীন করার আইন প্রস্তাব করা হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যবসায়িক পরিবেশের জন্য আংশিক নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীন থাকলে কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ধরে রাখার পর একবারে ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধির ধাক্কা নিতে হতো না। বিশ্বের কোনো দেশে সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলে কিছু নেই। এটিকে অবশ্যই বিলুপ্ত করতে হবে। পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অলিগার্ক তৈরি হয়েছিল। সব অলিগার্কই ব্যাংক ঋণের অপব্যবহার করেছে। যে কারণে এখন দেশের খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশের মতো। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আর্থিক, প্রশাসনিক, ব্যক্তি ও কাঠামোগত স্বাধীনতা দিতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।
প্রায়শই বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এই বলে যে এই ব্যাংকটির গভর্নর তার কাজের জন্য কোনো সংস্থার কাছে দায়বদ্ধ অর্থমন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় রাষ্টপতির কার্যালয় নাকি জাতীয় সংসদ সচিবলায়। এই প্রশ্নটি কোনো একটি জাতীয় সেমিনারে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করেছিলাম কিন্তু উত্তর পাইনি। অথচ ভারতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর তাদের কাজের জন্য ভারতীয় লোকসভার কাছে দায়বদ্ধ বিধায় সেই দেশটি সরকার তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ব্যাংকের উপর চাপাতে সাহস পায় না। যেটি বাংলাদেশ ক্ষেত্রে অহরহ ঘটে চলছে। এখন এ থেকে পরিক্রমের উপায় নিয়ে ভাবতে হবে এখন আমাদেও প্রতিবেশি ভারত ও নেপাল কিভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কার্য্যক্রম চলছে তার কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে বি আই বি এম কর্তৃক আময়োজিত সেমিনারে এক আঞ্চলিক সেমিনার থেকে । নেপাল কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় বাংক দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাদের এস এল আর/সিএরআর বাংলাদেশ তুলনায় অনেক বেশি এবং তাদের পরিবেক্ষণ নজরদারি খুবি জুড়াল থাকায় ঋলাপী ঋণের পরিমাণ আমাদের তুলনায় কম। দেশটির রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সে দেশের ব্যাক্তি মালিকানায়/সরকারি মালিকানায় পরিচালিত সকল ব্যাংকের মালিক ও প্রধান নির্বহীদেও প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে তাদেরকে নিয়ে সেমিনার করে থাকে যা বাংলাদেশ অনেক চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়েছে। সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের কেলেঙ্কারি সম্পকে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক রির্জাভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া গর্ভনের একটি ব্যক্তব্য বলা হয়েছে দ্বৈত শাসন থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধার কমে যায় । এই ব্যক্তব্যটি বাংলাদেশ ব্যাংকিং খাতের জন্য শতভাগ প্রযোজ্য। কারণ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায়শই অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাংকি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এর সাথে মতানৈক্য জড়িত হয় যা কোনোভাবেই কাম্য নয় বিষয়টি এমন যে সে মন্ত্রণালয় কোনো কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংককে গণনাতেই আনে না । অথচ বিষটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ আবার কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাঠালেও তা তেমন গুরুত্ব পায় না। এতে করে অনেক সিদান্ত চলে আসছে যেমন নতুন ব্যাংক খোলার লাইসেন্স বড় বড় ঋন অবলোকন মওকুফ সঞ্চিত বাড়ানো কমানো যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে বাধ্য হয়েছে যদিও সেগুলো দেশের সার্বিক আর্থিক উন্নয়নের জন্য খুবি ক্ষতিকর। এতমাবস্তায় স্বায়ত্তশাসন কিংবা সুশাসন কিংবা শৃঙ্খলা উন্নয়ন খুবি জরুরি বলে প্রতীয়মান।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক জ্যাষ্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি।