যুগে যুগে যেকোনো আন্দোলনে পুরুষের পাশে ছিল নারীরা, আমরা ভাষা আন্দোলনে দেখেছি নারীদের অংশগ্রহণ আর ৭১ সালের তো কথাই আলাদা আর এবারও ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নারীদের বিপুল অংশগ্রহণ নারীর রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা যায়।
গণ-অভ্যুত্থানের পর নারীর প্রতি বিরাজমান সব বৈষম্য দূর করার বিষয়টি রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডায় কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, তা নিয়ে ভাবছেন অনেকেই, তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সৃষ্ট ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ অল্প সময়ের মধ্যে বৈষম্য আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিকৃতি হয়ে উঠেছিল।
পরিণত হয়েছিল সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বিভিন্ন জাতি-ধর্ম পরিচয়ের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এই আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে নারীদের ব্যাপক সাহসী উপস্থিতি এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য সবচেয়ে জরুরি যে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, তা হলো ‘সংস্কার’। পাশাপাশি আরও একটি বিষয় খুব আলোচনা হচ্ছে, তা হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা।
তবে আমরা দেখছি, বেশির ভাগ উদ্যোগ ও আলোচনা থেকে নারী এবং আন্দোলনের নারী সমন্বয়করা যেন ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছেন। তাদের ডাকা হচ্ছে না, কেন এমন হচ্ছে তা জানিনা তাহলে প্রশ্ন জাগে, রাষ্ট্র সংস্কারের আলাপ পারবে কি রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্ত ও সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নারীর হিস্যা ও অংশীদারত্বের বিষয়টি উত্থাপন করতে, পারবে কি নারীর অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে অমীমাংসিত বিষয়গুলোকে সংস্কারের দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে?
রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে সংবিধান সংস্কার নিয়ে। ইতোমধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনও গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে- যেমন ১৯ (১), ১৯ (৩), ২৮ (১) ও ২৮ (২)-এ সর্বজনীন নীতির অধীনে নারীর সমতা এবং সব ক্ষেত্রে সমান অংশগ্রহণের বিষয়টি বিস্তৃত এবং সুরক্ষিত।
উদ্যোগটি থেমে যায়।
সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র সব নাগরিকের সমান গণতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। সংবিধান সংস্কারের এজেন্ডাতে নারীর সমানাধিকার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে পারিবারিক আইনে বৈষম্য সৃষ্টি করে এমন সব বিধান বাতিলের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। এ ছাড়া সিডও সনদ থেকে সব সংরক্ষণ তুলে নেওয়ার বিষয়টিও কাম্য।
সম্প্রতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, সেখানে অবশ্যই সংস্কারের ক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রয়োজনীয় আইনি, প্রশাসনিক ও সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে নারী উন্নয়নের এক উদাহরণ হয়ে উঠেছিল। করোনাপরবর্তী সময়ে নারীর অংশগ্রহণ সেখানে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে; কিন্তু কেন এমনটা হলো, তার কারণ এখনো অস্পষ্ট। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের মাত্রা আসলে বর্তমানে ঠিক কত ভাগ, তা জানার জন্য একটি শ্রম জরিপ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।
সমান কাজে সমান মজুরি নিশ্চিত করা, নারীর জন্য প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও চাকরিতে সমান সুযোগ করে দেওয়া, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রাখা, শ্রম আইন সংস্কার এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী সব অধিকার সুরক্ষা করে নারীর প্রকৃত অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করা এখন অত্যন্ত জরুরি। সংবিধান যেখানে নারীকে রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার দিয়েছে, তার পূর্ণ বাস্তবায়ন কেবল আইন প্রণয়ন নয়, সামাজিক পরিবর্তনের এজেন্ডায় আনার চ্যালেঞ্জটি বর্তমান সরকার নেবে কি?
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশকে বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে সমুন্নত এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। সংস্কার আলোচনাগুলোতে গণপ্রতিনিধিত্ব সংশোধন আদেশ আইন (২০০৯) বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের পরিকল্পনা কী, এটা জানা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়াটা খুব জরুরি। সংস্কারব্যবস্থায় শিগগিরই একটি ‘নারী অধিকার কমিশন’ গঠন করা উচিত। এর মাধ্যমে দেশের সর্বস্তরের নারীদের কাছ থেকে দেশ গঠনে তাদের মতামত নেবে এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করবে। নারীরা যোগ্যতা ও মেধা প্রমাণে নিজেদের মেলে ধরতে পারবেন
মাত্র তিন মাস আগেই, জুলাই অভ্যুত্থানে আমরা দেখেছি মেয়েরা কীভাবে রাজপথগুলোর দখল নিয়েছিল। পথে নেমে এসেছিল নানা বয়সি হাজারো হাজারো মেয়ে। স্লোগানে, স্লোগানে আর গ্রাফিতিতে কাঁপিয়ে দিয়েছিল চারদিক। ৭ জুলাই বাংলা ব্লকেডে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় চোখে পড়ার মতো এর পর তা থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলে আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ।
তখন মিছিলের সামনে থেকেও পুলিশের গুলি ও লাঠির আঘাত থেকে রেহাই পায়নি নারীরা, এতে কয়েকজন নারী নিহতও হয়েছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে দুই তরুণীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া হেলমেট বাহিনীর লাঠির ছবি। আর এক তরুণী কী অসমসাহসে একা দাঁড়িয়ে পড়েছে পুলিশের প্রিজন ভ্যানের সামনে, যেন দুহাত দিয়ে আটকে দেবে সব আগ্রাসন। এই সব ছবি ভাইরাল হয়েছিল দেশে-বিদেশে, প্রেরণা আর সাহস জোগাচ্ছিল সবাইকে।
আমরা দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা তার ছাত্রকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দুহাত দিয়ে আগলে রেখেছেন, পিঠ পেতে দিচ্ছেন পুলিশের লাঠির নিচে। দেখেছি পুলিশের ভ্যানে ওঠানোর সময় টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া সন্তানকে পিঠে চাপড় মেরে সাহস দিচ্ছেন মা। দেশের অন্য অঞ্চলেও প্রতিবাদে বিক্ষোভে মুখর ছিল আমাদের মেয়েরা। স্কুলের বালিকা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণী, পোশাককর্মী, গৃহবধূ, মায়েরা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, চাকরিজীবী, ডাক্তার , আইনজীবী, অভিনেত্রী, শিল্পী, গায়িকা কে ছিল না এই আন্দোলনে?
অথচ কয়েক মাস যেতে না যেতেই এই অভ্যুত্থানের ইতিহাস থেকে যেন মেয়েরা হারিয়ে যেতে শুরু করল। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জুলাই-আগস্টে নিহতদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে। সেখানে ছয়জন বিভিন্ন বয়সি নারীর নাম রয়েছে। অথচ ১৪ আগস্টে প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মায়া ইসলাম (৬০) ও নাছিমা আক্তারের (২৪) নিহত হওয়ার ঘটনা ছবিসহ উল্লেখ থাকলেও তারা বাদ পড়েছেন এই তালিকা থেকে। বাদ পড়েছেন ফেসবুকে দেখা ১৭ বছরের তানহা বা নাফিসা মারওয়া। হয়তো এভাবে বাদ পড়ে গেছেন আরও অনেকে, যারা আহত হয়েছেন বা অঙ্গ হারিয়েছেন। এই বাদ পড়া তালিকাকে পূর্বাবস্তায় পুনঃপ্রকাশ করা জরুরি বলে মনে করেন মৃতের স্বজনরা।
আন্দোলনে অন্য নিহত ছাত্রদের মতো হিরো হয়ে উঠতে পারেনি মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী নাইমা সুলতানা। নাইমার জন্য হওয়া উচিত ছিল কোনো চত্বর বা কোনো সড়ক বা দেয়ালের নাম। মুগ্ধ বা ফারহানকে প্রতিনিয়ত মনে রাখলেও সবাই নাইমারের কথা ভুলে গেছি। অন্য সমন্বয়কদের সঙ্গে ডিবি কার্যালয়ে আটক ছিলেন সমন্বয়ক নুসরাতও, তিনিও যেন কোথায় গায়েব হয়ে গেছেন, কেন এমনটা হলো?
যে মেয়েরা স্লোগানে-বিক্ষোভে-প্রতিবাদে রাজপথ মুখর করে রেখেছিল, যাদের ছাড়া এই আন্দোলন কখনোই সফল হতো না বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা, এখন সেই মেয়েদেরই কেউ খুঁজে পাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, ১৯৩০-৩১ সালে ভারতে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে ৮০ হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৭ হাজার ছিলেন নারী। অথচ ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে কোথাও তাদের নাম বা স্থান মেলেনি। বাংলা ভাষা আন্দোলনে ভাষার দাবিতে ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস স্কুলে কালো পতাকা তুলে রাষ্ট্রিকেট ও শিক্ষা জীবন থেকে বহিষ্কৃত হন ছালেহা বেগম অদ্যাবধি তার সেই বহিষ্কারাদেশ বাতিল করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ এভাবে মেয়েরা পরিসংখ্যান আর তথ্য-উপাত্ত থেকে হারিয়ে যায়। তখন গোটা বিষয়টা শুধু পুরুষদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমাদের সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের পরও আমরা যেন এমনটা ঘটতে দেখছি।
৩ অক্টোবর প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘এই আন্দোলনে মেয়েদের সম্পৃক্ততা ছিল বিরাট। এখন অনেকে ভুলে গেলেও এ কথাটা সত্য যে মেয়েরা না থাকলে এই আন্দোলন কোনোভাবেই সফল হতো না।’
নারীর অবস্থান পরিবর্তনের কোনো সংস্কার পরিকল্পনা চোখে পড়েনি। দেখা যাচ্ছে আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়ার পরও অধিকার আদায়ের বেলায় মেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে ক্রমাগত। ক্রমাগত যেন চলে যাচ্ছে দৃশ্যের বাইরে।
এবারই সব আশঙ্কা, সব দ্বিধা পায়ে মাড়িয়ে বিপুলসংখ্যক সাধারণ নারী পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিজমে জড়িয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে পড়ছেন তারা। সাধারণ নারীরা তো বটেই, যারা আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন, তারাও। অথচ বাস্তবতা হলো এই যে আমাদের দেশে আরও বেশিসংখ্যক নারীর রাজনীতিতে আসা উচিত, সব স্তরে নারীর কণ্ঠ শোনার মতো পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য এটা খুব দরকার। রাষ্ট্র সংস্কারের পর জনসংখ্যার অর্ধেক জুড়ে থাকা এই অদৃশ্য নারীরা হয়তো ভবিষ্যতে দৃশ্যমান হবেন। আমরা অনুরোধ করব সবাইকে প্লিজ পুরুষদের পাশাপাশি যেকোনো আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণকে মূল্যায়ন করুন।
লেখক: স্কুল শিক্ষিকা ও শিক্ষানবিশ আইনজীবী
রাজনীতি যে শুধু আদর্শের লড়াই নয়, বরং এক জটিল অর্থনৈতিক কাঠামো, তা আজ আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। রাজনীতিকে কার্যকর রাখতে দল চালানোর খরচ, নির্বাচনী প্রচারণা, কর্মী পরিচালনা এবং প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যয় ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপুল অর্থ আসে কোথা থেকে? এবং এর ওপর জনগণের ও রাষ্ট্রযন্ত্রের কতটা নজরদারি রয়েছে?
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাস মূলত সংগ্রাম, প্রতিরোধ ও পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতার নাম। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে সামরিক শাসন, একদলীয় শাসন ও গণআন্দোলনের উত্তাল সময় পেরিয়ে দেশে যে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের কাঠামো গড়ে উঠেছে, তা ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে চরম মূল্য পরিশোধের ফল। কিন্তু এই কাঠামোর ভিত মজবুত হওয়ার পরিবর্তে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েছে অর্থনৈতিক এবং নৈতিক দিক থেকে। রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থনৈতিক নকশা, অনুদান আহরণের পদ্ধতি ও নেতৃত্বের আচরণগত চরিত্র। রাজনীতি আজ আর জনসেবার ব্রত নয় বরং তা এক ধরনের উচ্চ ব্যয়ের ‘পেশায়’ পরিণত হয়েছে, যেখানে ক্ষমতা দখলই মুখ্য লক্ষ্য, আর আদর্শ, নৈতিকতা কিংবা জনস্বার্থ প্রায়শই পেছনের সারিতে ঠাঁই পায়। ফলে দল চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে নানা অনিয়ন্ত্রিত উৎস, যার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, ব্যবসায়িক প্রভাব ও অপরাধমূলক জোট। এই বাস্তবতায় রাজনীতি এখন এমন এক প্রতিযোগিতার মঞ্চ, যেখানে নীতির চেয়ে পুঁজি, আদর্শের চেয়ে পৃষ্ঠপোষকতা, আর গণমানুষের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ক্ষমতা অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
রাজনৈতিক অর্থায়নের বাস্তবতা-
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক অর্থায়ন নিছক একটি প্রশাসনিক প্রয়োজন নয়; বরং এটি রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নৈতিক মানদণ্ডের প্রতিফলন। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই অর্থায়ন একটি সুসংহত নীতিমালার অধীনে পরিচালিত হয়, যার মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষমতার রাজনীতি যেন আর্থিক স্বেচ্ছাচার কিংবা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর করায়ত্ত না হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার, আর ভারতে ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার - যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচনী ব্যয় ছিল প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। এই পরিসংখ্যান কেবল নির্বাচনী প্রচারণার নয়, বরং রাজনৈতিক অর্থনীতির জটিলতা ও বিস্তৃত কাঠামোর দিকেও ইঙ্গিত করে। এই বিপুল ব্যয়ের মধ্যেও একটি মৌলিক পার্থক্য রয়ে গেছে। যেখানে উন্নত বিশ্ব অর্থায়নের প্রতি তৈরি করেছে জবাবদিহিমূলক কাঠামো, দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ রাষ্ট্র সেখানে দাঁড়িয়ে আছে নিয়ন্ত্রণহীনতা ও স্বচ্ছতার অভাবে। যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল ইলেকশন কমিশন (FEC), যুক্তরাজ্যে ইলেকটোরাল কমিশন এমনকি ভারতের নির্বাচন কমিশনও তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর আয়-ব্যয়ের ওপর কঠোর নজরদারি আরোপ করে, অনুদান গ্রহণে নির্দিষ্ট বিধিমালা নির্ধারণ করে দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুদান ও তার উৎস জনসমক্ষে প্রকাশ বাধ্যতামূলক করে। যদিও ভারতে এ সংক্রান্ত কাঠামো থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ে ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’-এর মতো ব্যবস্থার মাধ্যমে অনুদানদাতার পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যা এই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে আবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির মডেল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের হার ও সদস্যসংখ্যার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় অনুদান পায়। শর্ত হিসেবে দলগুলোকে বছরের শেষে পূর্ণাঙ্গ অডিট রিপোর্ট জমা দিতে হয় এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হয়। এই নীতিগত কাঠামো রাজনৈতিক অর্থায়নে একটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। এই তুলনায় বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রাজনৈতিক অর্থের উৎস ও ব্যয়ের কাঠামোতে ব্যাপক অস্বচ্ছতা, করপোরেট প্রভাব ও পক্ষপাতমূলক সুবিধা প্রদানের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থায়ন কাঠামো একদিকে যেমন অস্বচ্ছ, তেমনি ভয়াবহভাবে অনিয়ন্ত্রিত। নির্বাচনী ব্যয়ে নির্ধারিত সীমা থাকলেও বাস্তবতায় তা কেবল কাগুজে নিয়মেই সীমাবদ্ধ। একাধিক পরিসংখ্যান বলছে, অনেক ক্ষেত্রেই ঘোষিত ব্যয়ের তুলনায় প্রকৃত ব্যয় পাঁচ থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বেশি হয়ে থাকে। ফলে একটি মৌলিক প্রশ্ন দাঁড়ায়- এই অতিরিক্ত অর্থের উৎস কী? এবং কারা এর মূল সুবিধাভোগী? এই ধরনের প্রশ্নের গভীরে আমরা যে ধরনের উৎস ও সুবিধাভোগী শ্রেণি দেখি-
প্রথমত, দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী শ্রেণি এ সব রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রধান অর্থদাতা। তাদের দেওয়া অনুদান কোনো নিছক দাতব্য কাজ নয়, বরং এটি এক ধরনের বিনিয়োগ, যার বিপরীতে তারা প্রত্যাশা করে রাজনৈতিক সুবিধা। সরকারি নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার, প্রকল্প বরাদ্দ, কর রেয়াত, আমদানি-রপ্তানিতে ছাড়, এমনকি নৈতিক জবাবদিহিতাহীন বাণিজ্যিক পরিবেশ, সবই এর আওতায় পড়ে।
দ্বিতীয়ত, সরকারি প্রকল্প ও উন্নয়ন বরাদ্দের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করা। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম করে যে অতিরিক্ত অর্থ আত্মসাৎ করে, তার একটি অংশ সরাসরি রাজনৈতিক তহবিলে চলে যায়। ফলে দুর্নীতিকে শুধু ব্যক্তি নয়, বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও দলীয় কাঠামোর মধ্যেই যুক্ত করে ফেলা হয়।
সম্ভাব্য সমাধান-
রাজনৈতিক অর্থায়নের অস্বচ্ছতা ও অনিয়ন্ত্রিত প্রবণতা যদি গণতন্ত্রের এক মারাত্মক অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তবে এর উত্তরণও হতে হবে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে। একক কোনো সমাধান নয়, বরং একটি সমন্বিত ও বহুমাত্রিক উদ্যোগই পারে রাজনৈতিক অর্থনীতিকে জবাবদিহিমূলক ও জনবান্ধব করতে।
১. রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য বৈধ বেতন কাঠামো প্রবর্তন: প্রতিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে তাদের তৃণমূল কর্মী ও সাংগঠনিক নেতাদের জন্য নির্দিষ্ট হারে সম্মানী বা বেতন প্রদান বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হবে এবং চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব বা সহিংসতায় জড়ানোর প্রলোভন থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। এই উদ্দেশে দলীয় আয়-ব্যয়ের পূর্ণ স্বচ্ছতা ও বার্ষিক নিরীক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।
২. অনুদানের বাধ্যতামূলক প্রকাশ ও নথিভুক্তি: যেকোনো ব্যক্তি বা করপোরেট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ৫,০০০ টাকার অধিক অনুদান নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। এতে অনুদানের উৎস ও প্রভাব উন্মুক্ত থাকবে, এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গোপন লেনদেনের অবকাশ কমবে।
৩. নির্বাচনী ব্যয়ের ডিজিটাল ট্র্যাকিং ও নিরীক্ষা: নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের প্রতিটি খরচের ডিজিটাল রসিদ সংরক্ষণ ও নির্বাচন কমিশনের আওতায় তা অডিটের আওতায় আনা আবশ্যক। মোবাইল অ্যাপ, ব্লকচেইনভিত্তিক ট্র্যাকিং ব্যবস্থা বা অনলাইন রিপোর্টিং সিস্টেম চালু করে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
৪. সরকার-নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক অনুদান তহবিল (State Funding): উন্নত বিশ্বের অনুকরণে যদি সম্ভব হয় বাংলাদেশেও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি সরকার-নিয়ন্ত্রিত তহবিল চালু করা। ভোটের হার, সাংগঠনিক কার্যক্রম ও সদস্যসংখ্যার ভিত্তিতে দলগুলো নির্ধারিত অনুদান পাবে। এর বিনিময়ে দলগুলোকে বছরে একাধিকবার আয়-ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ হিসাব কমিশনে দাখিল করতে হবে এবং জনসমক্ষে তা প্রকাশ করতে হবে। এতে বেসরকারি অনুদানের নির্ভরতা কমে যাবে এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অবৈধ অর্থের প্রবাহ হ্রাস পাবে।
৫. নির্বাচন কমিশনের কাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি: এই সকল পদক্ষেপ কার্যকর করতে হলে, প্রথমেই প্রয়োজন একটি স্বাধীন, দক্ষ ও আধুনিকায়নপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশন। বর্তমানে দলীয় আর্থিক অডিট, অনুদান পর্যবেক্ষণ বা নিয়মভাঙায় শাস্তি প্রদানে কমিশনের ভূমিকা অত্যন্ত দুর্বল। কমিশনকে প্রযুক্তি-নির্ভর, আইনগত ক্ষমতাসম্পন্ন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে একটি স্বতন্ত্র ‘রাজনৈতিক অর্থায়ন পর্যবেক্ষণ সেল’ গঠন করা যেতে পারে, যারা নিরবচ্ছিন্নভাবে দলগুলোর আয়-ব্যয়ের ওপর নজরদারি রাখবে।
এই সমাধানগুলো কেবল কল্পনাপ্রসূত ধারণা নয়; অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশেও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এ ধরনের কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। বরং সময়ের দাবি হচ্ছে-রাজনীতি ও দুর্নীতির মধ্যে যে আর্থিক জোট, তা ভেঙে দিয়ে গণতন্ত্রকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।
শেষ কথা-
গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি হলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনঅংশগ্রহণ। কিন্তু রাজনৈতিক অর্থনীতির যখন নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অদৃশ্য, অনিয়ন্ত্রিত এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক উৎসের হাতে; তখন গণতন্ত্র রূপ নেয় নির্বাচনের মোড়কে মোড়ানো এক বিত্তবানদের খেলায়। যতদিন রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থনীতি গোপন, অনিয়ন্ত্রিত ও ক্ষমতানির্ভর থাকবে, ততদিন গণতন্ত্র জনগণের নয়, বরং অর্থবানের নিয়ন্ত্রণেই আবদ্ধ থাকবে।রাজনৈতিক অর্থায়নের সংস্কার ছাড়া দুর্নীতি দূর করা যাবে না। একটি ন্যায্য ও কার্যকর গণতন্ত্র গঠনের জন্য দলীয় অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং নিয়মতান্ত্রিকতা আনা জরুরি। রাজনীতি যদি একটি ‘পেশা’ হয়, তবে এর জন্য বৈধ ‘বেতন’ ও ‘অর্থের উৎস’ থাকা আবশ্যক। না হলে রাজনীতি একটি দুর্নীতির পাইপলাইনে পরিণত হবে, যার খেসারত দেবে গোটা জাতি।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট।
বাজারে সবজির সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। অথচ আলু-পেঁপে আর মিষ্টিকুমড়ো ছাড়া ১০০ টাকার নিচে ভালো সবজি মিলছে না। সামুদ্রিক মাছের ভরা মৌসুম, অথচ মাছের দাম চড়া। ডিম-মাংস, শুকনো নিত্যপণ্যের দামও ঘুরছে বাড়া-কমার চক্রে। বাজারের এমন অস্থির পরিস্থিতিতে ক্রেতার ত্রাহি অবস্থা। নিত্যপণ্যের বাজারে এমন ঊর্ধ্বগতির কারণে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারা বলছেন, বাজারে অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ‘বাজার করতে হবে শুনলেই চোখে অন্ধকার আসে। একটা পণ্যের দাম কমলে পাঁচটার দাম বাড়ে। মাসের পর মাস ধরে এমন অবস্থা চলছে। যদি মাছ-মাংসের দাম বেশি হয়ে সবজির দাম কম থাকতো কিংবা সবজির দাম বেশি হলেও অন্য পণ্যের দাম কম থাকত, তা-ও কোনোমতে মানিয়ে নেয়া যেত। এখন যে অবস্থা, সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। বাজারের ওপর কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চলছে। আমরা মধ্য আয়ের মানুষ কেমন আছি, কীভাবে চলছি, কেউ জানতেও চায় না, কেউ ভাবেও না। সবকিছুর দাম বাড়ছে, কিন্তু আয় তো বাড়েনি।’
কাঁচাবাজারে সবজির মধ্যে কাঁকরোল, ঝিঙা, পটল, ঢ্যাঁড়স, শসা, করলা প্রতিকেজি ৯০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। বরবটি ১২০ টাকা, বেগুন ৮০ থেকে ১০০ টাকা, টমেটো ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কচুরমুখী, লাউ, মূলা কেজিপ্রতি ৬০ থেকে ৮০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। কচুর লতি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। গাজর ১৬০ টাকা, হাইব্রিড শসা ৬০ টাকা, কাঁচা কলার হালি ৪০ টাকা, শালগম ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফুলকপি ও বাঁধাকপি ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি আলু মানভেদে ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। আর মিষ্টি কুমড়োর দাম ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। কাঁচামরিচ ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, ধনেপাতা প্রতি কেজি ১৫০ টাকা আর শাকের মধ্যে কচুশাক ৪০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া শাক ৫০ টাকা, পুঁইশাক ৪০ টাকা ও লালশাক ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছের মধ্যে লইট্যা ও ফাইস্যা ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, আবার মানভেদে ২২০ টাকা, পোয়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, শাপলা পাতা মাছ ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, কোরাল ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা, রূপচাঁদা ৩৫০ থেকে ৭০০ টাকা, আইড় ৪০০ থেকে ৬৫০ টাকা, চিংড়ি (বাগদা ও গলদা) আকারভেদে ৬৫০ থেকে ১২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। খুচরা বাজারে এক-দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ২০০০ থেকে ২৪০০ টাকা, ৫০০-৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১৫০০ টাকা, এক কেজির কিছু কম ওজনের ইলিশ ১৮০০-২০০০ টাকা এবং জাটকা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায়। দুই-আড়াই কেজি ওজনের বড় ইলিশ মাছ প্রতি কেজি তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া খাল-নদী ও চাষের মাছের মধ্যে রুই ও কাতলা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, পাবদা ছোট আকারের ৪০০ টাকা, মাঝারি সাইজের ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, শিং ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, টেংরা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, পুঁটি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, সরপুঁটি ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা, তেলাপিয়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, নাইলোটিকা ২২০ থেকে ২৮০ টাকা, কৈ ২০০ থেকে ২২০ টাকা এবং পাঙাস, সিলভার কার্প মিলছে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায়। ছোট চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা দরে। বিক্রেতারা জানালেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে সামুদ্রিক ও খাল-নদীর কয়েকটি মাছের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা।
বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম আবার বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা দরে, যা গত সপ্তাহের চেয়ে ১০ টাকা বেশি। সোনালি মুরগির দাম কিছুটা কমে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা, পাকিস্তানি কক ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা, দেশি মোরগ ৬৫০ টাকা এবং জাতভেদে প্রতি পিস হাঁস বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়। অন্যান্য মাংসের মধ্যে গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৯৫০ টাকা, খাসি ও পাঁঠা ছাগলের মাংস ১২০০ থেকে ১২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ডজন প্রতি ১০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। দেশি মুরগির ডিম ১৮০ টাকা ও হাঁসের ডিম ২৩০ টাকা ডজন প্রতি বিক্রি হচ্ছে।
এমতাবস্তায় এখন নীতি সহায়তায় বাজারে সাপ্লাই ঠিক রাখতে হলে ডিলার ও বাজারে সবসময় পর্যাপ্ত পণ্য মজুদ রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে বিভিন্ন কারণে সক্ষম ডিলার ও বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য মজুদ রাখা সম্ভব হয় না। ফলে মিল থেকে পাঁচ-সাত দিন সরবরাহ কিছু কম হলেই বাজারে তার প্রভাব পড়ে। ভোগ্যপণ্যগুলো মূলত কৃষিপণ্য, এগুলোর উৎপাদন অনেকটাই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। কোনো বছর উৎপাদন বেশি হয় আবার কোনো বছর উৎপাদন কম হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যের অস্তিরতা তৈরি হয়। বর্তমান বিশ্বে ভোগ্যপণ্যের বাজারে প্রায়ই অস্থিরতা বিরাজ করে। এ অস্থিরতা থেকে ঝুঁকিমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে কমোডিটি মার্কেট চালু হয়েছে, যা কার্যকর করা জরুরি। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য উৎপাদনের পূর্বাভাসের ওপর ভিত্তি করে সময়ভিত্তিক নীতিসহায়তা দরকার। তাছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতি বাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করবে। পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ না করে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া অতীব জরুরি। খাদ্যনিরাপত্তায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিক মান বজায় রেখে সরবরাহ নিশ্চিত রাখা। আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় বাধা হলো আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা। যেমন বলা যেতে পারে বিএসটিআই নীতির সঙ্গে পিউর ফুডের অনেক নীতির মিল নেই। আবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়মনীতির সঙ্গেও সমন্বয়হীনতা আছে, যা উৎপাদন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সমন্বয়হীনতা দূর করা জরুরি। এই মুহূর্তে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা দূর করা প্রথম ও প্রধান কাজ। যেমন ভোক্তা অধিদপ্তর, বিএসটিআই, সিটি করপোরেশন, পিউর ফুড, ফুড সেইফটি অথরিটিসহ সবার উচিত একক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক একক নীতির মাধ্যমে ব্যবসাকে পরিচালিত করা। দুগ্ধজাত দ্রব্য ও প্রাণিজ আমিষের (মাছ, মাংস, ডিম) দাম কমানোর সুযোগ সীমিত। এখানে দুটি মূল বিষয় হলো—প্রথমত, বাজার অর্থনীতিতে চাহিদা-জোগানের ওঠাপড়ার ওপর দাম নির্ভর করে। আর মৌসুমভেদে নানা রকম কারণে দামের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। তাছাড়া সারাটা বছর তো আর এক রকম যায় না। বন্যা, খরাসহ নানা রকম দুর্যোগের শিকারও হতে হয়। সেজন্য আমরা ‘সারা বছরের জন্য এক পরিকল্পনা’ করতে পারি না । কেন আমরা পোলট্রির দাম নির্ধারণের জন্য সারা বছরের পরিকল্পনা করতে পারি না? শুধু এ হিসাবে না গিয়ে আমরা যদি উৎপাদনকারীদের জন্য বাজার ও মূল্যসহায়তা (মার্কেট ও প্রাইস সাপোর্ট) নিয়ে কাজ করি সেটাও বাজারে ভারসাম্য আনতে সাহায্য করবে। উৎপাদনকারীদের ন্যূনতমভাবে বেঁচে থাকার মতো সক্ষমতার ব্যবস্থা করা উচিত। কেননা, অনেক সময় দাম এতটা পড়ে যায় যে তার সঙ্গে মিল রেখে উৎপাদন খরচ একদমই কমেনি। বিদ্যুতের রেট কমেনি, খাদ্য-ওষুধ ও শ্রমের মজুরিও আগের মতোই আছে; তাহলে উৎপাদন খরচ না কমে বরং আগের মতো বা তার চেয়ে বেশিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু অন্যদিকে দাম কমানোর ফলে উৎপাদনকারীদের, ব্যবসায়ীদের আয় কমে যাচ্ছে। এ আয়ে তাদের খরচই উঠছে না। এছাড়া ভর্তুকি দেয়ারও একটা বিষয় আছে। ধরা যাক, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত যখন বাজারে চাহিদা বেশি থাকে, ব্যবসায়ীরা অনেক আয় করেন। কিন্তু আবার বছরের যে সময়টাতে ওদের এ আয়-ইনকাম থাকবে না তখন সাবসিডি দেয়া যায় কিনা। এতে ক্রেতারাও ভালো থাকবেন আবার আমাদের ব্যবসায়ীরাও ভালো থাকবেন। কিন্তু ব্যবসায়ীকে মেরে ফেলে ক্রেতাকে সুবিধা দেয়ার যে সামগ্রিক ক্ষতি; সেটা নিয়ে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। একই কথা কৃষি ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন বাম্পার ফলন হলে কৃষককে অতি অল্প দামে—২ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করতে হয়, সেই আলু আবার ৪০ টাকা কেজিতে ঢাকায় বিক্রি হয়। পণ্যমূল্যের ওপর কোনো নীতি প্রণয়ন করা অথবা পণ্যমূল্য নির্ধারণ করা যায় কিনা সেটা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কৃষিদ্রব্য যেহেতু দ্রুত পচনশীল তাই দাম নির্ধারণীতে সেটা শিল্পপণ্যের মতো কাজ করবে না। সেজন্য আমার মূল চেষ্টার জায়গাটি হলো, উৎপাদন খরচের জায়গায় কিছু কাজ করা। কেননা, এটা কমাতে পারলে কৃষিপণ্যে আর মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির দরকার হবে না। কৃষিতে যন্ত্রপাতির দাম কমানো, বাজার সুরক্ষা, ফিডসহ গবাদিপশু খাদ্যের দাম কমানো, সরকারিভাবে চারা, পোনা সরবরাহ—এগুলো করা প্রয়োজন । সিন্ডিকেট করে ফিডের দাম বাড়ানো, এমনকি দেখা যায় অনেক সময় বাজার কোম্পানি দ্বারা নয়, ডিলারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এ জায়গাগুলোয় শক্তিশালী রেগুলেটরি ম্যাকানিজম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ভাবে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রন সম্ভব হতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
আমরা প্রতিদিন অসংখ্য প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করি। মিনারেল ওয়াটার, কোল্ড ড্রিংক, জুস কিংবা বিভিন্ন বেভারেজের জন্য এই বোতলগুলো আমাদের কাছে স্বাচ্ছন্দ্য ও আধুনিক জীবনের প্রতীক। কিন্তু এই ক্ষণিকের সুবিধার পিছনে যে ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী মূল্য আমরা দিতে চলেছি তা অনেকেই গভীরভাবে ভেবে দেখি না। প্লাস্টিকের বোতল কেবল মাত্রাবিহীন বর্জ্য নয়; এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ভয়ংকর বিষদাঁতের মতো যা পরিবেশ, অর্থনীতি এবং মানব স্বাস্থ্যকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। একটি বিপজ্জনক চক্র প্লাস্টিক বোতলের জীবনচক্রটি শুরু হয় জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল ও গ্যাস) থেকে। এর উৎপাদন প্রক্রিয়াই অত্যন্ত সম্পদ-নিঃশেষকারী এবং দূষণকারী।
একটি একলিটার প্লাস্টিকের বোতল তৈরি করতে প্রায় ২৫০ মিলিলিটার তেল, ৩ লিটার পানি এবং প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। এই প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস (কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন) নিঃসরণ হয় যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করে। আশ্চর্যজনকভাবে একটি প্লাস্টিকের বোতল তৈরি করতে যতটা পানি খরচ হয় অনেক সময় তার চেয়ে বেশি পানি বোতলটি প্যাকেজিং এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ায় ব্যয় হয়। এটি পানির একটি চরম অপচয়। ল্যান্ডফিল, নদী ও সমুদ্রের দূষণ প্লাস্টিক বোতলের সবচেয়ে বড় এবং দৃশ্যমান সমস্যা হলো এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
অবিশ্বাস্য পরিমাণ বর্জ্য- বিশ্বজুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি প্লাস্টিকের বোতল বিক্রি হয়। এর মধ্যে মাত্র ৯%-এর মতো রিসাইকেল হয়। বাকি ৯১% বোতল যায় ল্যান্ডফিলে পোড়ানো হয় বা সরাসরি প্রকৃতিতে (নদী-নালা, খাল-বিল, সমুদ্র) পড়ে থাকে। প্লাস্টিকের বোতল প্রকৃতিতে কখনও সম্পূর্ণভাবে পচে না। এটি শত শত বছর হাজার বছর পর্যন্ত টিকে থাকে এবং ধীরে ধীরে ছোট ছোট টুকরোয় ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক-এ পরিণত হয়। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক মাটি, পানির উৎস এবং সমুদ্রে মিশে যায় যা পুরো ইকোসিস্টেমকে বিষিয়ে তোলে।
সমুদ্রের জীবন ধ্বংস: প্রতি বছর ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে পতিত হয়। সামুদ্রিক প্রাণীরা (কচ্ছপ, তিমি, ডলফিন, সামুদ্রিক পাখি) এগুলোকে খাদ্য ভেবে খেয়ে ফেলে যা তাদের পেটে আটকে থেকে ধীরে ধীরে তাদের মৃত্যুর কারণ হয় অথবা তারা দূষিত হয়।
মানব স্বাস্থ্যের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে এই নীরব ঘাতক প্লাস্টিক বোতল, শুধু পরিবেশের জন্যই নয় আমাদের নিজেদের স্বাস্থ্যের জন্যও একটি বড় হুমকি। রাসায়নিক মাইগ্রেশন করে বেশিরভাগ প্লাস্টিকের বোতল PET (Polyethylene Terephthalate) বা অন্যান্য প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি, যাতে শিল্প রাসয়নিক বিসফেনল BPA (Bisphenol-A) এবং Phthalates (থ্যালেটস)-এর মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে। এই রাসায়নিকগুলো বোতলে রাখা পানিতে এবং অবশেষে আমাদের দেহে মিশে যায় বিশেষ করে যদি বোতলটি গরম পরিবেশে থাকে বা পুনরায় ব্যবহার করা হয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে BPA এবং Phthalates (থ্যালেটস) মানবদেহের জন্য এন্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টর (হরমোনের ভারসাম্য নষ্টকারী)। এগুলো ক্যান্সার (বিশেষ করে ব্রেস্ট ও প্রোস্টেট ক্যান্সার), বন্ধ্যাত্ব, শিশুদের বিকাশগত সমস্যা, ডায়াবেটিস, এবং অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে জড়িত। আমরা মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষিত পানি ও খাদ্য (বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, লবণ) এর মাধ্যমে সরাসরি আমাদের দেহে গ্রহণ করছি। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো আমাদের রক্তস্রোত, ফুসফুস প্লাসেন্টাতেও পাওয়া গেছে, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ। অর্থনৈতিক বোঝা- অদৃশ্য খরচ-প্লাস্টিকের বোতলের সস্তা দামটি একটি বিভ্রম। এর আসল খরচ আমরা অন্য খাতে গুনি। নদী, ড্রেন, সৈকত, এবং রাস্তাঘাট থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার করতে সরকার এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। প্লাস্টিক দূষণ ও রাসায়নিক এক্সপোজার থেকে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটে একটি বিশাল চাপ তৈরি হয়। দূষিত সৈকত ও নদী পর্যটকদের আকর্ষণ হারায়, যা স্থানীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতির কারণ। একইভাবে প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাছের মজুত কমে যাওয়া মৎস্য খাতকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
প্লাস্টিক বোতলের অদৃশ্য বিষ- আরও গভীরে যে ক্ষতিগুলো জানা হয়নি-প্লাস্টিক বোতলের ক্ষতি শুধু যে দৃশ্যমান দূষণ সেখানেই সীমাবদ্ধ নয় এর প্রভাব আরও গভীর, সূক্ষ্ম ও সুদূরপ্রসারী। আগের আলোচনায় যেসব দিক আসেনি, সেগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করা হলো:
বায়ু দূষণ ও বিষাক্ত নিঃসরণ: শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যেই ঝুঁকি
* পোড়ানোর সময় বিষাক্ত গ্যাস: যখন প্লাস্টিকের বোতলগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে পুড়িয়ে ফেলা হয় (যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণ ঘটনা), তখন তা ডাইঅক্সিন (Dioxin), ফুরান (Furan) এবং অন্যান্য মারাত্মক কার্সিনোজেনিক (ক্যান্সার সৃষ্টিকারী) যৌগ নির্গত করে। এই বিষাক্ত গ্যাসগুলি বায়ুতে মিশে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে এবং ফুসফুসের রোগ, হরমোনের ব্যাঘাত ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
* উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দূষণ: প্লাস্টিক বোতল তৈরির কারখানা থেকে নিয়মিত ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড (VOCs) এবং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক বাতাসে মিশে। এর ফলে কারখানার আশেপাশের জনবসতিতে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগের ব্যাপকতা বেড়ে যায়।
* মাটির গঠন ও উর্বরতা হ্রাস: ল্যান্ডফিলে বা প্রকৃতিতে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বোতল ধীরে ধীরে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক-এ পরিণত হয়। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মাটির ভৌত গঠন পরিবর্তন করে, এর জল ধারণক্ষমতা এবং বায়ু চলাচলের সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এটি মাটির স্বাস্থ্য ও উর্বরতার উপর গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মাটি দূষণ ও কৃষির উপর প্রভাব ফেলে মাটির উর্বরতা নষ্ট করে দেয়।
* কীটপতঙ্গ ও রোগের আবাস: পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতলে বৃষ্টির পানি জমে থাকে, যা মশা (如 ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া) এবং অন্যান্য রোগের বাহক পোকামাকড়-এর প্রজননক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি।
* রাসায়নিক মাটির গভীরে প্রবেশ: প্লাস্টিক থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর রাসায়নিক (BPA, Phthalates (থ্যালেটস) মাটিতে শোষিত হয়ে ভূগর্ভস্থ পানির উৎসকে দূষিত করে এমনকি ফসল তাদের শিকড় মাধ্যমে-এ প্রবেশ করে, যা অবশেষে আমাদের খাদ্য চেইনে -এ পৌঁছায়।
সামাজিক ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন: দূষণের অসম বোঝা
* পরিবেশগত বর্ণবাদ (Environmental Racism): প্লাস্টিক বোতলের ল্যান্ডফিল, পুনর্ব্যবহারকারী কারখানা এবং বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্লান্ট-গুলি সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষ যেখানে বসবাস করে সেখানে হয়। এর ফলে এই কমিউনিটির মানুষ অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেশি বায়ু দূষণ, পানি দূষণ এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।
* অনানুষ্ঠানিক বর্জ্য বাছাইকারী এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি: অনেক উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ এবং প্রাথমিক প্রক্রিয়াকরণ কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক বর্জ্য বাছাইকারীগণ। তারা প্রায়ই কোনো সঠিক নিরাপত্তা গিয়ার, গ্লাভস, মাস্ক) ছাড়াই কাজ করেন। এর ফলে তারা সরাসরি ক্ষতিকর রাসায়নিক এবং প্যাথোজেন-এর সংস্পর্শে আসেন, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি।
অর্থনীতির উপর অদৃশ্য খরচ: উত্পাদনশীলতার ক্ষতি
* কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন হ্রাস: মাটি ও পানি দূষণের ফলে কৃষি ও মৎস্য খাত-এর উত্পাদনশীলতা কমে যায়। পান। এটি সরাসরি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা এবং এই সেক্টরের উপর নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ মানুষদের জীবনযাত্রা হুমকিতে ফেলে দেয়।
* স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধি: প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কিত রোগ (শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সার, হরমোনজনিত ব্যাধি)-এর চিকিৎসা করতে সরকার এবং ব্যক্তিকে -কে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। এটি একটি বিশাল অর্থনৈতিক বোঝা যা প্রায়শই অচেনা থেকে যায়।
* জৈব বৈচিত্র্যের উপর Cascade (ক্যাসকেড প্রভাব) খাদ্য শৃঙ্খলে বিঘ্ন যখন ছোট প্রাণী বা প্লাঙ্কটন-মাইক্রোপ্লাস্টিক খায়, তখন এটি পুরো খাদ্য শৃঙ্খল অভ্যাসে পরিনথ হয়। বড় প্রাণরা যখন এই দূষিত ছোট প্রাণীগুলো খায়, তখন তাদের শরীরেও টক্সিন জমা হয়। এটি সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করতে পারে এবং বিপন্ন প্রজাতিদের বিলুপ্তির ঝুঁকি বাড়ায়।
আমাদের করণীয় –
আমরা যদি আজই সচেতন না হই, তাহলে আমাদের সন্তান-সন্ততিদের একটি বিষাক্ত, দূষিত ও দুর্বিষহ পৃথিবী উপহার দেবো। তাদেরকে বিশুদ্ধ পানি ও বায়ুর জন্য সংগ্রাম করতে হবে, দূষণজনিত নানা রোগে ভুগতে হবে, এবং একটি বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করতে হবে। এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব যে আমরা তাদের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাই। এই সুদূরপ্রসারী ক্ষতি রোধ করতে আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। সরকার, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি প্রত্যেককেই ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে পুনঃব্যবহারযোগ্য বোতল (স্টিল, কাচ, বিপিএ মুক্ত) ব্যবহার করা এটি সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর সমাধান।
একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বোতল এড়িয়ে চলুন।
বাড়িতে ও বাইরে ওয়াটার পিউরিফাই বা ফিল্টার ব্যবহার করুন।
যদি প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে সঠিকভাবে রিসাইক্লিং এর ব্যবস্থা করুন।
সচেতনতা তৈরি করুন, পরিবার ও বন্ধুদের উদ্ধুদ্ধ করুন।
শিল্প ও সরকারি পর্যায়ে বর্ধিত উৎপাদক দায়িত্ব (ইপিআর) চালু করা অর্থাৎ উৎপাদকদেরকে তাদের পণ্যের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা।
একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা বা উচ্চ কর আরোপ করা।
রিসাইক্লিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার আরও শক্তিশালী ও ব্যাপকভাবে উন্নয়ন করা।
বিকল্প প্যাকেজিং বায়ো-ডিগ্রেডেবল উপাদানের গবেষণা ও ব্যবহারকে উৎসাহিত করা।
একদমশেষে বলা যায়, প্লাস্টিকের বোতল আমাদের আধুনিক জীবনের একটি বিভ্রমমাত্র। এটি আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের নামে আমাদের পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং ভবিষৎতকে গিলে খাচ্ছে। এই সুদূরপ্রসারী ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে আমাদের আজই -এই মুহূর্তেই সচেতন হতে হবে এবং পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের ছোট ছোট পদক্ষেপই আমাদের এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে।
লেখক: মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট, ক্রিলিক-এলজিইডি।
ছায়া ভালোবাসা অর্থনীতি এমন একটি অর্থনীতি, যাকে ঘিরে আমরা তেমন চিন্তা করি না। অথচ এই অর্থনীতির আওতায় পরিবার, সমাজ তথা দেশ বলতে গেলে টিকে আছে। এই অর্থনীতির কথা মুখে বললেও চিন্তাও করি না এবং সে রকম গুরুত্বও দেই না। অনেকে অবশ্য বলে থাকেন যে, এই হিসাব এমন যে খাতায় আছে। অথচ গোয়ালে গরু নেই। কিন্তু এ কথাটি মোটেই ঠিক নয়। কেননা এর আলটিমেট সুবিধা আমরা কড়ায় গণ্ডায় পেয়ে থাকি। অবশ্য জিডিপিতে সরাসরি যোগ না হলেও, বাস্তবতার নিরীক্ষে বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। আর এ বিষয়টি নিয়ে অর্থনীবিদরা বিভিন্ন আঙ্গিকে কম কথা বলেন না? মূলত এই অর্থনীতি হলো সহজাত প্রবৃত্তির আড়ালে বাবা অথবা মা কর্তৃক সন্তান-সন্ততি ও পরিবার আগলিয়ে রাখার প্রপঞ্চ। আর এটিকে ভিত্তি করে প্রকৃতিগত অমোঘ টানে প্রেম, প্রীতি, স্নেহ ও ভালোবাসাসহ উদ্ভুত নিয়ামকের সূত্র ধরে নানা রকম কাজ পজিটিভ মিথস্ক্রিয়ায় করা হয়ে থাকে এবং এর আওতায় সন্তানের যত্ন বা পরিচর্যা ও হাউজহোল্ডসহ বিবিধ কাজ স্বতস্ফূর্তভাবে আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন হয়। মজার ব্যাপার হলো যে, এই সামগ্রিক কাজকর্ম মানি ভ্যালুর কভারে চিন্তা করি না। ভাবি, এগুলো তাদের একান্ত নিজস্ব অপরিহার্য কাজ। এর আবার মানি ভ্যালু কি? কিন্তু অবশ্যই এর মানি ভ্যালু আছে এবং জিডিপিতে পরোক্ষভাবে যোগ হয়। কিন্তু খাতা কলমে হিসাবের বাইরে থাকে। আসলে এটি ছায়ার মতো স্বকীয়তা নিয়ে অবস্থান করে থাকে।
পরিবারের ক্ষেত্রে যতই কাজ করা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য নির্ভর করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। আদিতে যে রক্ত সম্পর্ক ধর্মীয় বন্ধন বা সংঘবদ্ধ জীবন এবং নেতৃত্বের সৃষ্টি করেছিল, সে বিষয়ে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এ ব্যাপারে ভালোবাসার আদলে স্বীকৃত স্নেহ, প্রেম, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, যোগাযোগ রক্ষা বা সংঘ গঠন ছাড়া মানুষের বসবাস করা সম্ভব নয়।
এ বিশ্বে উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত মিলে প্রায় ২০৬টি রাষ্ট্র আছে এবং এ বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় আট শত কোটি, যার অর্ধেক হলো নারী। উন্নত বিশ্বে নারী অনেকাংশে মর্যাদা নিয়ে থাকলেও, আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীকূল তেমন একটা প্রাধান্য পায় না। আর জিডিপিতে অবদানের ক্ষেত্রে পুরুষকূল যা দাবী করে, আসলে তা নয়। এদিকে সংবিধানে সমধিকারের কথা থাকলেও বাস্তবে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ লোক গ্রামে বাস করেন। তবে শহরে যারা বাস করেন, সে ক্ষেত্রে মেয়েরা তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও গ্রামের বেচারী মেয়েদের কি যে হাল? তা বলে শেষ করা যাবে না। সেই যে ভোর-রাত্রি থেকে কাজ শুরু করে, যেমন- সন্তানদের পরিচর্যা, ধান সিদ্ধকরণ, উঠান ঝাড় দেয়া, পানি আনা, নাস্তা তৈরি করা, দুধ দোহন করা, গরুর ঘাস দেয়া, ধান শুকানো, ধান ভানা. শ্বশুর-শাশুড়ীর দেখাশোনা, ক্ষেতে কার্যরত স্বামীকে খাবার পাঠানো, মুরগি, গরু বা ছাগল পালন, উঠানের পাশে শাক-সবজিতে পানি দেয়া, ইত্যাদি আরও কত কি, যা লিখে শেষ করা যাবে না। আর এ সব কাজ করে মধ্য রাতের আগে ঘুমানোর ফুরসৎ পায় না। অথচ বাংলাদেশের কালচারে এটি চিরাচরিত হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এ ধরনের গৃহস্থালীর কাজ করার জন্যই নারীর জন্ম এবং যদিও তারা একান্ত নিরবে ভালোবাসার টানে তা করে থাকেন। অবশ্য অর্থনীতিবিদরা এটি ছায়া ভালোবাসার অর্থনীতি হিসেবে অভিহিত করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তারা যে এতে অবদান রাখে, তদনুযায়ী মর্যাদা পায় না। সেহেতু জনৈক বিট্রিশ বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, They beset with so many household affairs without raising any question. Thus for fostering these phenomena put forth the voice of love of these voiceless women.
এতদ্ব্যতীত গৃহকর্তা হিসেবে সংসারকে ঘিরে বাবা যে বিভিন্ন আঙ্গিকে কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে থাকেন, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বজনীনভাবে ‘মা’ ও ‘বাবা’ কে উচ্চ আসনে বসানো হয়েছে। এই দুব্যক্তির নিঃস্বার্থ, চিরন্তন ও স্বভাবজ অবদানের কথা; সব পর্যায়ে স্বীকার্য। যাহোক, অর্থনীতির দর্শন ও নরম অনুযায়ী বলা হয় যে, তাদের এ লাগাতার পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ড নাকি অর্থনীতির আওতায় নয় বিধায় অর্থের মূল্যে নিরূপণ করা হয় না। তবে আমি জোর গলায় বলতে পারি, এ কৃষি নির্ভরশীল অর্থনীতিতে তাদের এ ভালোবাসাসুলভ কাজ যদি না হতো, তাহলে মনে হয় অর্থনীতি দুমড়ে পড়তো। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এটিকে অর্থনীতির আওতায় আনতে সচেষ্ট হয়ে উল্লেখ করেছিলেন যে, দেশের ১০ বছর বয়সী বা তদোর্ধ নারীগণের গৃহস্থালী কর্মকাণ্ডের ‘সময়’ বছরে ১৬,৬৪১ কোটি শ্রম ঘন্টা, যা অর্থের হিসেবে মূল্যায়ন করলে দাঁড়ায় আনুমানিক ২৪৯,৬১৫.০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রাম ও শহুরে নারীর শ্রমের অংশ যথাক্রমে ৭৯% এবং ২১%, তাই মনে করি, তাদের এই ভালবাসাসুলভ গৃহস্থালীর কর্মকাণ্ড প্রসূত অবদান জিডিপিতে অবশ্যই বিবেচনায় আনা সমীচীন। নতুবা বৃক্ষের গোড়াতে অন্ধকার থাকলে কোনোভাবেই গাছের পুরোপুরি চেহারা যেমন দেখা যায় না। তেমনি আর্থ-সামাজিক দিক-দিয়ে যে কোনো পরিকল্পনা নেয়া হোক না কেন, সত্যিকার অর্থে শ্রম বিন্যাস ও বিশেষায়িত উৎপাদন নির্ণয় করা কখনো সম্ভব হবে না, সব জগাখিচুরী হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রাক্কালে জিডিপিতে নারী ও পুরুষের কার কত অংশ, তা কোনক্রমেই নিশ্চিত হওয়া যাবে না। এ প্রেক্ষাপটে সামষ্টিক অর্থনীতির কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা থাকবে না। এদিকে অধুনা বিট্রিশ এক জরীপে দেখা গিয়েছে যে, মেয়েরা কাজের প্রতি অধিকতর আন্তরিক এবং এ সূত্র ধরে সংসার বা সমাজের মঙ্গল কামনায় তুলনামূলক তারা অবদান বেশি রাখে। মূলত মেয়েরা হিসেবী এবং নীতিনিষ্ঠ এবং সাধারণত মেয়েরা সিদ্ধান্ত নেয় অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে। কিন্তু পুরুষরা ততটা না ভেবে পৌরুষোচিত আবেগে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে বিধায় মাঝে-মধ্যে ছন্দপতন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেই আঙ্গিকে আনুপাতিক হারে মেয়েদের এ ভালোবাসাপ্রসূত কর্মকাণ্ড খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
বিগত ১০/০৯/২০২৫ইং তারিখে পত্র-পত্রিকায় দেখলাম, দেশের অর্থনীতিতে নারীর অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যত্নশীল কাজের অবদান প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে হিসাব করা হয়েছে। এ সূত্র ধরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিসিএস) জানায় যে, রান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর গোছানো, শিশু ও বৃদ্ধের যত্ন নেওয়া; কিংবা অসুস্থের সেবা, ইত্যাদি হিসাবের মধ্যে আনা হয়েছে। এসব অদৃশ্য শ্রমের বার্ষিক অর্থনৈতিক মূল্য দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন বা ৬ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। আর এই অঙ্ক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১৮ দশমিক ৯ শতাংশের সমান। এর মধ্যে নারীর অবদান প্রায় ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ ৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অবশিষ্ট ১৫ শতাংশ অবদান পুরুষের, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ১ লাখ কোটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীরা পুরুষদের চেয়ে গড়ে সাত গুণ সময় দেন অবৈতনিক কাজে। একজন নারী বছরে প্রায় ২১শ ঘন্টা সময় দেন রান্না, ঘর সামলানো এবং শিশু ও প্রবীণদের সেবা যত্নে। অন্যদিকে, একজন পুরুষ এ কাজে ব্যয় করেন গড়ে ৩০০ ঘন্টা। অর্থাৎ মূল্য নির্ধারণের বাইরের কাজে ৮৮ শতাংশই করে থাকেন নারী। এ ব্যাপারে গত মঙ্গলবার (০৯/০৯/২০২৫ইং) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিসিএস অডিটরিয়ামের প্রকাশিত হাউসহোল্ড প্রোডাকশন স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টে (এইচপিএসএ) এ তথ্য জানানো হয়। অবশ্য ২০২১ সালের ‘সময়’ ব্যবহার জরিপ এবং যুগপৎ ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ হিসাব করা হয়েছে। সাধারণত অবৈতিক কাজের আর্থিক মূল্য হিসাব নির্ধারণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দুটি পদ্ধতি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে র) প্রতিস্থাপন খরচ পদ্ধতি ও রর) সুযোগের খরচ পদ্ধতি। এর পর কাজের ধরন বিবেচনা করে সাধারণ পদ্ধতি, বিশেষ পদ্ধতি ও হাইব্রিড পদ্ধতির সমন্বয়ে অবৈতিক কাজের আর্থিক মূল্যায়ণ করা হয়। মূলত হাইব্রিড পদ্ধতিকে বিশ্বজুড়ে অবৈতিক কাজের আর্থিক মূল্য নির্ধারণে সুপারিশ করা হয়। আর এ পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক বিবিএসের পক্ষ থেকে অবৈতিক কাজের আর্থিক মূল্য নির্ণয় করা হয়েছে।
উপর্যুক্ত হিসাব অবশ্যই যুগান্তকারী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো যে দেশের জিডিপিতে প্রায়োগিকভাবে কিভাবে প্রতিফলিত করা হবে। এটিকে কি সামগ্রিকভাবে দেখানো হবে? নাকি শুধু হিসাবের জন্যই খাতা কলমে থাকবে। অবশ্য এ হিসাব যদি সামগ্রিকভাবে টানা হয়। তাহলে জিডিপির কলেবরে কি রকম চেহারা হয়ে উঠবে, তা সহজেই অনুমেয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে শিক্ষা জীবন থেকেই দেখতাম; অর্থনীতি নরম হিসেবে গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর অবদান হিসাবে আনা হয় না। অথচ সেই কাজ যদি চাকর বা চাকরানী করে, তাহলে সসম্মানে বিবেচনায় আনা হয়। তাই আমি অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবো যে, এর সামগ্রিক প্যারামিটার বিশ্লেষণপূর্বক একটি প্রতিবেদন যেন দেশবাসীর গোচরে আনা হয়। তাহলে সংশ্লিষ্ট সবার সম্যক ধারণা হবে এবং হিতকরও কম হবে না?
লেখক: বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence বা এআই) হলো বর্তমান বিশ্বের এক অনন্য প্রযুক্তিগত বিপ্লব। এটি মানুষের চিন্তা, বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সৃজনশীলতার অনুকরণ করার ক্ষমতা রাখে। এর ব্যাপ্তি এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যে, শিল্প, স্বাস্থ্য, ব্যবসা থেকে শুরু করে শিক্ষা ও গবেষণার মতো সংবেদনশীল ক্ষেত্রেও এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় এআই টুলস যেমন ChatGPT, Gemini, Claude, GitHub Copilot, Grammarly, MidJourney কিংবা DALL•E ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য প্রতিদিনের অপরিহার্য সহায়ক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। একদিকে এগুলো জ্ঞান আহরণ, তথ্য বিশ্লেষণ, গবেষণা ও সৃজনশীলতাকে সহজতর করছে; অন্যদিকে একাডেমিক সততা, মৌলিকতা এবং গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্নও তুলছে। তাই এআই ব্যবহারের জন্য একটি সুস্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি।
শিক্ষা ও গবেষণায় এআই টুলসের বিস্তার:
বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এআই ব্যবহার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীরা সহজেই এআই টুলস ব্যবহার করে লেকচার নোট তৈরি, প্রবন্ধ রচনা, অ্যাসাইনমেন্ট সমাধান কিংবা থিসিসের প্রাথমিক খসড়া তৈরি করছে। গবেষণায় তারা লিটারেচার রিভিউ, ডেটা অ্যানালাইসিস, পরিসংখ্যান মডেল তৈরি এমনকি জটিল গ্রাফ বা ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরিতেও এআই-এর সাহায্য নিচ্ছে। শিক্ষকরাও এআই ব্যবহার করছেন পাঠ পরিকল্পনা, গবেষণার প্রাথমিক ধারণা বা নতুন লেকচার সামগ্রী তৈরি করতে। যেমন একজন কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র যখন কোড লেখায় সমস্যায় পড়ে, তখন GitHub Copilot তাকে নির্দিষ্ট সমাধান বা বিকল্প পদ্ধতি প্রস্তাব করতে পারে। একজন গবেষক যখন শতাধিক প্রবন্ধের রিভিউ করতে চান, তখন ChatGPT বা Elicit দ্রুত সেই কাজকে সারসংক্ষেপ আকারে উপস্থাপন করতে পারে। অন্যদিকে একজন শিক্ষক জটিল কোনো অ্যালগরিদম শেখানোর আগে MidJourney বা DALL•E ব্যবহার করে চিত্র তৈরি করতে পারেন, যা শিক্ষার্থীদের বোঝা সহজ করবে।
তবে এই সুযোগের পাশাপাশি সমস্যা হলো—শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে নিজেরা চিন্তা না করে সরাসরি এআই-সৃষ্ট কন্টেন্ট জমা দিচ্ছে। ফলাফল হলো, তাদের সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষণার ক্ষেত্রে এআই-সৃষ্ট লেখা ব্যবহার করলে তা নকল বা একাডেমিক অসততার মধ্যে পড়ে। এই দ্বৈত বাস্তবতাই নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তাকে অত্যন্ত জরুরি করে তুলেছে।
উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা ও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট:
বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যেই এআই ব্যবহারের নীতি নির্ধারণে পদক্ষেপ নিয়েছে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, পরীক্ষায় এআই ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও অ্যাসাইনমেন্ট বা গবেষণার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমায় অনুমোদিত। এমআইটি গবেষণাপত্র বা প্রকল্পে এআই ব্যবহার করলে তা স্পষ্টভাবে ডিক্লেয়ার করার বিধান চালু করেছে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক সততা বজায় রাখতে ঘোষণা দিয়েছে যে, এআই ব্যবহারের তথ্য গোপন করা এক ধরনের প্রতারণা হিসেবে গণ্য হবে। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এআই-কে শিক্ষার সহায়ক টুল (Assistive Tool) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তবে প্লেজারিজম ও একাডেমিক অসততার ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছে। এই উদাহরণগুলো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। প্রথমত, এআই-কে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়, কারণ এটি বিশ্বব্যাপী শিক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে। দ্বিতীয়ত, স্পষ্ট নিয়ম ছাড়া এআই ব্যবহার করলে একাডেমিক মান ভেঙে পড়বে। তৃতীয়ত, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষক—তিন পক্ষকেই সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করে নীতি প্রণয়ন করাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় এআই ব্যবহারের ধারা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও এর বিস্তার দ্রুত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যেই এআই ব্যবহার করে নোট তৈরি, অ্যাসাইনমেন্ট বা থিসিস লিখছে। গবেষকরা ডেটা প্রসেসিং বা লিটারেচার রিভিউতে এর সহায়তা নিচ্ছেন। তবে এই ব্যবহার এখনো নিয়ন্ত্রিত নয়, যার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মৌলিক চিন্তার প্রতি অনীহা এবং নকলের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো ডিজিটাল বিভাজন। সব শিক্ষার্থী সমানভাবে প্রযুক্তিতে দক্ষ নয়। যেসব শিক্ষার্থী ইংরেজি ও প্রযুক্তিতে পারদর্শী, তারা সহজেই এআই ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে গ্রামীণ বা প্রযুক্তি-অপরিচিত শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বাড়তে পারে। এই বাস্তবতায় এআই নীতিমালা শুধু একাডেমিক সততা রক্ষার জন্য নয়, বরং সমতা নিশ্চিত করার জন্যও জরুরি হয়ে উঠেছে।
এআই নীতিমালা কেন জরুরি:
নীতিমালা ছাড়া এআই ব্যবহার একাধিক সমস্যা তৈরি করবে। প্রথমত, একাডেমিক সততা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি শিক্ষার্থীরা পুরো অ্যাসাইনমেন্ট বা থিসিস এআই দিয়ে লিখে জমা দেয়, তবে তাদের নিজস্ব বিশ্লেষণী ক্ষমতা বিকাশের কোনো সুযোগ থাকবে না। দ্বিতীয়ত, গবেষণার মান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এআই ভুল তথ্য বা কল্পিত রেফারেন্স দিতে পারে (hallucinations), যা যাচাই ছাড়া ব্যবহার করলে গবেষণা আনরিল্যাইবেল হয়ে পড়বে। তৃতীয়ত, শিক্ষকরা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বিভ্রান্ত হবেন, কারণ কোনটা শিক্ষার্থীর নিজের অবদান আর কোনটা এআই-এর তৈরি—তা আলাদা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে নীতিমালা ছাড়া এআই ব্যবহারে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে বিশ্বাসের সংকট তৈরি হবে। শিক্ষকেরা ভাববেন শিক্ষার্থীর কাজ আসলে তার নিজের নয়, আবার শিক্ষার্থীরা মনে করতে পারে শিক্ষক অযথা সন্দেহ করছেন। এভাবে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই এক ধরনের অনাস্থা ও বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যাবে।
আমাদের দেশের জন্য প্রস্তাবিত নীতি:
আমি মনে করি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এখনই একটি সুসংগঠিত ও জাতীয় পর্যায়ের নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এই নীতিমালায় প্রথমত স্বচ্ছতা বাধ্যতামূলক করতে হবে। যে কোনো কাজেই এআই ব্যবহার করলে তা উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, থিসিস বা গবেষণাপত্রে আলাদা সেকশনে ‘এআই ব্যবহারের ধরন’ (Usages Type) স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ‘ব্যবহারের সীমারেখা’ (limit) নির্ধারণ করতে হবে। যেকোনো পরীক্ষায় এআই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে, পরীক্ষার হলে যেকোনো ডিজিটাল ডিভাইস নিষিদ্ধ করতে হবে, কারণ এটি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত দক্ষতা যাচাইয়ের ক্ষেত্র। অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রজেক্টে সীমিত ব্যবহার অনুমোদিত হতে পারে, তবে ব্যবহারের ধরন ও প্রক্রিয়া বিস্তারিতভাবে জমা দিতে হবে। গবেষণায় এআই ডেটা বিশ্লেষণ, লিটারেচার সারসংক্ষেপ বা ভিজ্যুয়ালাইজেশনে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে মৌলিক গবেষণার যুক্তি বা ফলাফল তৈরিতে এর ওপর নির্ভর করা যাবে না।
তৃতীয়ত, শিক্ষকদের জন্য পাশাপাশি গাইডলাইন থাকতে হবে। প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হবে এমনভাবে যাতে সরাসরি এআই দিয়ে সমাধান করা সম্ভব না হয়। এজন্য হাইয়ার থিঙ্কিং ও বিশ্লেষণভিত্তিক প্রশ্ন করার উপর জোর দিতে হবে। অ্যাসাইনমেন্ট প্রক্রিয়াভিত্তিক (Process based) করতে হবে—চূড়ান্ত ফলাফলের পাশাপাশি কাজের ধাপগুলো জমা দিতে হবে। পাঠদানে শিক্ষকরা এআই-কে সহায়ক টুল হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, যেমন জটিল বিষয় ব্যাখ্যায় ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট তৈরি করা।
চতুর্থত, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মশালা আয়োজন করতে হবে। এতে তারা এআই-এর সীমাবদ্ধতা, নৈতিকতা ও কার্যকর ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা পাবেন।
সবশেষে, বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের বদলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি জাতীয় নীতি প্রণয়ন করা অপরিহার্য। এতে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিতভাবে এআই ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হবে এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় সামঞ্জস্য বজায় থাকবে।
এটা সত্য যে,- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজ আর ভবিষ্যতের বিষয় নয়, এটি বর্তমানের বাস্তবতা। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় এর ব্যবহার একদিকে যেমন সম্ভাবনা তৈরি করছে, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিচ্ছে। সঠিক নীতিমালা ছাড়া এই প্রযুক্তি একাডেমিক সততা ও মৌলিকতাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে, আবার সঠিকভাবে ব্যবহার করলে শিক্ষার মান, গবেষণার গতি এবং সৃজনশীলতা বহুগুণে বাড়াতে পারে। তাই বাংলাদেশের জন্য এখনই জরুরি একটি সুস্পষ্ট, ভারসাম্যপূর্ণ এবং বাস্তবসম্মত নীতি প্রণয়ন করা, যেখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং গবেষক—সবার দায়িত্ব, অধিকার ও সীমারেখা নির্ধারিত থাকবে।
লেখক: প্রফেসর ড. ইকবাল আহমেদ, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা শুধু পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর সাথে জড়িত রয়েছে খাদ্যের মান, পুষ্টিগুণ এবং নিরাপত্তা। বাংলাদেশসহ অনেক কৃষিনির্ভর দেশে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন একটি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে এবং ফসলকে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে কৃষকরা অতিরিক্তভাবে রাসায়নিক কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এই অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার একদিকে মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে, অন্যদিকে পানির উৎস দূষিত করছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্যে, দীর্ঘমেয়াদে এসব রাসায়নিক খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের রোগ, স্নায়ুবিক সমস্যা এমনকি প্রজনন জটিলতা তৈরি করছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারার অন্যতম কারণও হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য মান বজায় রাখতে ব্যর্থতা। যদিও সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ‘বাংলাদেশ-GAP’ বা উত্তম কৃষি চর্চা নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে জৈব সার ও বায়োপেস্টিসাইড ব্যবহারের দিকে জোর দিচ্ছে, তবে বাস্তব প্রয়োগে এখনও বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের পথে কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা এখন জরুরি প্রয়োজন।
কীটনাশকের ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশে কীটনাশকের ব্যবহার, ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন দীর্ঘদিন ধরে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিশেষ করে পোকামাকড় ও রোগবালাই ফসল উৎপাদনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্যা মোকাবিলায় দেশে কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৫৩ সালে। সে সময় ‘বোকার ফসল পোকায় খায়’ স্লোগানকে সামনে রেখে রাষ্ট্রীয় কর্তা ব্যক্তিরা কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল কৃষি উৎপাদন বাড়ানো এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রথমদিকে সীমিত আকারে কীটনাশক ব্যবহার করা হলেও, ধীরে ধীরে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে মোট কীটনাশক ব্যবহার ছিল মাত্র ৪ হাজার মেট্রিক টন। কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকার কৃষকদের ভর্তুকি, প্রশিক্ষণ এবং বাজারে সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে। এর ফলে ফসল উৎপাদনে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেলেও, অযাচিত ব্যবহার বাড়তে থাকে। এরপর থেকে কীটনাশকের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। গত ৫০ বছরের মধ্যে ব্যবহার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ভয়াবহ মাত্রায়। তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে (২০২২ সালে) দেশে কীটনাশকের ব্যবহার প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ ১৯৭২ সালের তুলনায় এটি দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি কেবল উৎপাদনের চাহিদা পূরণের কারণে নয়, বরং কৃষকদের সচেতনতার অভাব, বিকল্প প্রযুক্তির স্বল্পতা এবং কোম্পানির প্রচারণার ফলেও ঘটেছে।
অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের প্রভাব এখন ভয়াবহ আকারে দেখা যাচ্ছে। একদিকে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। একই সঙ্গে নদী-খাল-জলাশয়ে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ মিশে পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। মাছ, পাখি ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এসব কীটনাশক মানুষের খাদ্যে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি খাত এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে খাদ্য উৎপাদনের চাহিদা বাড়ছে, অন্যদিকে কীটনাশকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা বড় বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন জৈব বা বায়োপেস্টিসাইডের ব্যবহার বৃদ্ধি, সমন্বিত বালাই দমন (IPM) পদ্ধতির প্রসার এবং কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি। একই সঙ্গে সরকারের নীতিগত সহায়তা ও গবেষণা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে হবে। সার্বিকভাবে বলা যায়, ১৯৫৩ সালে শুরু হওয়া কীটনাশক ব্যবহারের যাত্রা আজ আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। খাদ্য নিরাপত্তার সাথে সাথে এখন সময় এসেছে নিরাপদ খাদ্য ও পরিবেশ সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার।
কীটনাশকে পোকা নিয়ন্ত্রণ ও মানব ঝুকি:
কীটনাশক আধুনিক কৃষিতে পোকামাকড় দমন এবং ফসল রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এর অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কীটনাশকের সক্রিয় রাসায়নিক উপাদান শ্বাসনালী, চামড়া এবং খাদ্যের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সার, স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, লিভার ও কিডনি বিকলসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত কৃষকদের প্রায় ৬৪% নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করার কারণে আক্রান্ত হচ্ছেন। খোলা মাঠে কীটনাশক ব্যবহারের সময় কৃষকরা প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী যেমন মাস্ক, গ্লাভস বা বিশেষ পোশাক ব্যবহার করেন না। ফলে বিষাক্ত রাসায়নিক সরাসরি তাদের শরীরে প্রবেশ করে। একইসঙ্গে কীটনাশক অবশিষ্টাংশ খাদ্যে থেকে গিয়ে ভোক্তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। শিশু ও গর্ভবতী নারীরা এসব ঝুঁকিতে বেশি ভোগেন। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে আজ ঘরে ঘরে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ দেখা দিচ্ছে। কৃষকরা ফসল রক্ষার জন্য অযাচিতভাবে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করেন, কিন্তু এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যের ওপর। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ক্যান্সার আক্রান্তদের একটি বড় অংশ দীর্ঘদিন কীটনাশকের সংস্পর্শে থাকার ফলেই আক্রান্ত হচ্ছেন। বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে কীটনাশকের বাজার পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা এ খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার একটি স্পষ্ট প্রমাণ। তবে আশার কথা হলো, পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতির দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে দেশ। ইতোমধ্যে দেশে ১১০টি নিবন্ধিত বায়ো পেস্টিসাইড বা জৈব কীটনাশক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যা মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ। পাশাপাশি সরকার সচেতন পদক্ষেপ হিসেবে ৪০টি ক্ষতিকর কীটনাশক নিষিদ্ধ করেছে। এসব উদ্যোগ টেকসই কৃষি ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে এখনো সামনে বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি, বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহার ও বাজারে জৈব কীটনাশকের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। রাসায়নিকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমিয়ে বায়ো পেস্টিসাইড ও সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা (IPM) বাড়ানো গেলে কৃষি হবে নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং টেকসই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কীটনাশক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে প্রায় ২ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। তাই নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের স্বার্থে জৈব ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ এবং কৃষকদের সচেতনতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান CABI এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. সালেহ আহমেদ বলেন; কীটনাশকের ব্যবহার সীমিত করার জন্য কাজ করা হচ্ছে। কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব কমানোর জন্য নতুন নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
সাংবাদিকদের ভূমিকা:
কীটনাশক ব্যবহার কমানো এবং সতর্কতায় সাংবাদিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ হিসেবে কাজ করেন। কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে তারা সঠিক তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেন। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব যেমন ক্যান্সার, পরিবেশ দূষণ ও মাটির উর্বরতা হ্রাস, এসব বিষয় সংবাদ প্রতিবেদন, টক শো কিংবা ফিচার আকারে প্রচার করলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া সাংবাদিকরা কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতামত, জৈব ও বায়ো কীটনাশকের সুবিধা এবং কীভাবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন সম্ভব সে বিষয়ে আলোকপাত করতে পারেন। এভাবে গণমাধ্যম কৃষকদের বিকল্প পদ্ধতি সম্পর্কে জানার সুযোগ সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে কীটনাশক বিক্রেতা ও কোম্পানিগুলোর অনিয়ম বা অবৈধ ব্যবসা উন্মোচন করাও সাংবাদিকদের দায়িত্বের অংশ। এতে সরকার নীতিনির্ধারণে আরও সতর্ক হতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সাংবাদিকদের ইতিবাচক ভূমিকা সমাজে আস্থা তৈরি করে। তারা শুধু সমস্যার চিত্র নয়, সমাধানের পথও দেখাতে পারেন। সঠিক তথ্য প্রচার এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরলে কৃষকরা সচেতন হবে, জনগণ নিরাপদ খাদ্যের দাবি তুলবে এবং সরকার নীতি সংস্কারে উদ্যোগী হবে। ফলে কীটনাশক ব্যবহারের ঝুঁকি কমে যাবে এবং একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে উঠবে।
কীটনাশকের ভয়াবহতা আজ দেশের কৃষি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এক গুরুতর হুমকি। মাত্রাতিরিক্ত ও অযাচিত কীটনাশক ব্যবহার মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে, পানির উৎসকে দূষিত করছে এবং মানুষের শরীরে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগের কারণ হয়ে উঠছে। এই ভয়াবহ বাস্তবতা জনগণের কাছে তুলে ধরতে সাংবাদিকদের ভূমিকা অত্যন্ত ইতিবাচক। তারা সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে কৃষক ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করছেন। সাংবাদিকরা শুধু সমস্যার দিকটি তুলে ধরেননি, পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে জৈব বা বায়ো-পেস্টিসাইড ব্যবহারের উপকারিতাও প্রচার করেছেন। এছাড়া সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ কীটনাশকের তথ্য, ভেজাল ব্যবসায়ীদের অনিয়ম এবং কৃষকদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তারা নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ফলে অনেক কৃষক এখন সচেতন হচ্ছেন এবং কীটনাশক ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করছেন। বলা যায়, সাংবাদিকদের ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই কীটনাশকের ভয়াবহতা নিয়ে সামাজিক আলোচনা এবং সচেতনতা কার্যকরভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের মূল বাধা হলো কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। যতদিন না পর্যন্ত কৃষকরা বিকল্প পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকবেন, ততদিন পর্যন্ত খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হবে। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন কৃষকদের সচেতন করা, যাতে তারা বুঝতে পারেন কীটনাশক কেবল ফসলের ক্ষতি ঠেকায় না, বরং মানুষের জীবন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও হুমকি সৃষ্টি করে। সমাধান হিসেবে জৈব সার, জৈব কীটনাশক এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি, কৃষি খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। সরকারকে কঠোরভাবে কীটনাশকের বাজার নিয়ন্ত্রণ, মান যাচাই এবং ভর্তুকির ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। একই সঙ্গে কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে নিরাপদ খাদ্য শংসাপত্রের ব্যবস্থা বাড়ানো অপরিহার্য। অবশেষে বলা যায়, কৃষি শুধু খাদ্য উৎপাদনের জন্য নয়, এটি স্বাস্থ্য ও জীবন রক্ষার সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই ‘বেশি উৎপাদন নয়, নিরাপদ উৎপাদন’ এটাই হওয়া উচিত কৃষির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা। কীটনাশক কমিয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিলে কৃষক, ভোক্তা এবং দেশের অর্থনীতি সবাই উপকৃত হবে।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের এ সময় ঘোষণা করেছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার, নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি ইতোমধ্যে জনসমক্ষে এসেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচন কেবল জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের একটি প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি জনগণের মতামত প্রকাশ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্রিয় অংশগ্রহণের একটি মৌলিক অধিকার। তাই নির্বাচন যতটা স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে, দেশের গণতন্ত্র ততটাই সুসংহত হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচন আয়োজনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত ও প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে যেন কোনো ধরনের সহিংসতা বা অনিয়মের ঘটনা না ঘটে। সেনাবাহিনীর প্রস্তুতিও দেশের জনগণের মাঝে একটি আস্থার এবং ভরসার পরিবেশ তৈরি করেছে। অতীতে দেখা গেছে, সশস্ত্র বাহিনী মাঠে থাকলে ভোটাররা নিরাপদ বোধ করেন এবং নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। এবার সশস্ত্র বাহিনী অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মত ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে।
অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করেছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, প্রার্থীদের মনোনয়ন যাচাইসহ নানা প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমকে আরো কার্যকর ও স্বচ্ছভাবে পরিচালনা হবে এই আশা সবার।
তবে নির্বাচনকে সফল করার জন্য কেবল সরকারি প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়। এতে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, গণমাধ্যমের স্বাধীন ভূমিকা এবং জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ প্রয়োজন। নির্বাচন যেন প্রতিযোগিতামূলক হয়, সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্বশীল আচরণ কাম্য। নির্বাচন কমিশনকেও হতে হবে দৃঢ়, নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে যাচ্ছে। সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যদি একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে তা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে আরো মজবুত করবে এবং জনগণের আস্থাও ফিরে আসবে।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনী তোড়জোড় শুরু করেছে। রাজধানী থেকে তৃণমূলে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মাঠ গোছানো শুরু হয়েছে। ইসি সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ করেছে। সরকারের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যেকোনো মূল্যে নির্বাচন আয়োজনে বদ্ধপরিকর। ইসি নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ চলমান রেখেছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর সরকারের পটপরিবর্তন হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সদা তৎপর। ম্যাজিস্ট্র্যাসি ক্ষমতা নিয়ে নির্বাচনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে সেনাবাহিনী। দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সেনাবাহিনী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আলোচনার কেন্দ্রে নির্বাচন। ভোটের মাঠে প্রতিপক্ষকে টেক্কা দেওয়ার কৌশল ঠিক করার কাজ শুরু করেছে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। তবে জুলাই সনদ, বিচার এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সংশয় এখনো কাটেনি বলেও দাবি করছেন অনেকে। আগামী রোজার আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি শেষ করতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠিও দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। সে অনুযায়ী কাজও শুরু করেছে ইসি। এ ছাড়া সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে।
অন্যতম প্রধান দল বিএনপির নেতারা বলেছেন, ইতোমধ্যে দেশের মানুষ এবং তাদের নেতাকর্মীরা নির্বাচনমুখী হয়েছেন। নির্বাচনের আগে সংস্কার ও ছাত্র জনতার হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সরকার কতটা করে, সেদিকেও নজর রাখার কথা বলছে তারা। এছাড়া নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, সেদিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে এই দলগুলো।
নির্বাচনের ঘোষণা ইতিবাচক হলেও মাঠের রাজনীতিতে নির্বাচন ঘিরে সংশয় এখনো কাটেনি বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। কিন্তু এ সংশয় নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার পর কাটচে। তফসিল ঘোষণা হলে দেশ নির্বাচনী উৎসবে মাতবে। এতে করে সব ধরনের অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা কেটে যাবে। আশার কথা, অভিযোগ আর সংশয় ছাপিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি সারছে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা বলছে, দাবি আদায়ের চেষ্টা আর ভোটের মাঠের প্রস্তুতি চলবে পাশাপাশি।
জুলাই ঘোষণাপত্র কিংবা নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা নিয়ে আপত্তি নেই বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদী দল বিএনপির। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণাকে ‘ঐতিহাসিক’ বলেও অভিহিত করেছে দলটি। তাদের দাবি, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা কেটে যাবে। এরই মধ্যে নির্বাচনের জন্য সাংগঠনিক প্রস্তুতিও শুরু করেছে দলটি। ভোটের মাঠের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে বৈঠক করেছে বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব। ভোটের মাস-তারিখ নিয়ে দ্বিমত না থাকলেও জুলাই ঘোষণাপত্র এবং সংস্কার নিয়ে কিছু আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। সংস্কার প্রক্রিয়ার আইনগত ভিত্তি নিয়ে সংশয়ে জামায়াতে ইসলামী। আর নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেও বিভিন্ন দাবিতে সরকারের সঙ্গে আলোচনাও চালাতে চায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ কয়েকটি দল। তারা বলছে, দ্রুত আইনগত বিষয়টি নিশ্চিত করে, এই সংস্কারের ভিত্তিতেই আগামী নির্বাচন হওয়া উচিত। এছাড়া সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের আরো বেশি কিছু করার রয়েছে বলেও মনে করে দলটি। সংস্কার ও বিচার নিয়ে দাবিদাওয়া থাকলেও নির্বাচনের প্রস্তুতি আগেভাগেই শুরু করেছে জামায়াতে ইসলামী। তিনশ আসনে প্রার্থী ঠিক করার বিষয়টিও অতীতে জানানো হয়েছিল দলটির পক্ষ থেকে।
এদিকে, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের কার্যকারিতার ভিত্তিতে সামনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে বলে আবারো দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। জুনের মধ্যে যেকোনো সময় নির্বাচন আয়োজন করা হলে তাদের কোনো আপত্তি নেই বলেও জানিয়েছেন দলটির সদস্য সচিব নির্বাচন আয়োজন করা হলে তাদের কোনো আপত্তি নেই বলেও জানিয়েছেন দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি বলছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদেরও নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে, কিন্তু নির্বাচন আয়োজনের আগে সংস্কার ও বিচারকাজ বাস্তবায়নসহ অবশ্য পালনীয় কাজগুলো সরকার কতটা দৃশ্যমান করে সেদিকে নজর রাখবেন তারা।
দেশের সব নাগরিক জানে, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চলেছে। বর্তমান সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার নয়। সময়ের প্রয়োজনে কিছু বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য এ সরকার গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এছাড়া বিগত স্বৈরাচারী শাসনামলে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে উদার গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শেষ দুটি দায়িত্ব পালনের জন্য বেশকিছুটা সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। চাইলেই তাৎক্ষণিকভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকার্য সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। এতে বিচারে ত্রুটি থেকে যেতে পারে। বিচারকার্য যাতে গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানের হয়, তা নিশ্চিত করা সরকারের একটি বড় দায়িত্ব। অন্যথায় এ বিচারকার্য নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত থাকতে পারে। আর বড় ধরনের কোনো সংস্কার কার্যক্রম নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়াটাই যৌক্তিক। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের প্রাথমিক কার্যক্রম সূচনা করে যেতে পারে। ভবিষ্যতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার এসে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করবে।
মহলবিশেষ নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা নির্বাচনের ব্যাপারে জনগণকে সন্দিহান করে তোলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কেউ কেউ এমনো বলার চেষ্টা করছেন যে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। তারা নানা ধরনের কল্পকাহিনী প্রচার করছেন। সরকারের বিভিন্ন অর্গানের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমনকি সেনাবাহিনী নিয়েও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কিন্তু এসব কাজে দেবে না।
প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকার সংশ্লিষ্টরা বারবার বলেছেন, এ নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তাদের মতে, যারা অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিতে চায় না, তারা নানাভাবে বাধা দেবে। বাংলাদেশের এক সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা বাধা দেবে। তারা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চালাবে, যাতে নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হতে না পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করার জন্য এ মহলটি চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যেই এ ধরনের কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, তারা আরো বেশি তৎপর হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ পরিহার করে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয় তবে এ বাধা দূর হবে। তাই এ মুহূর্তে সব রাজনৈতিক দল এবং সংশ্লিষ্ট মহলকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ইস্পাত কঠিন দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
যেকোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ইসি সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায় রয়েছে। আশার কথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি সকল বাহিনী একটি ভালো নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে সহযোগিতা করতে বদ্ধপরিকর। সবচেয়ে বড় কথা দেশের মানুষ একটি ভোট উৎসবের জন্য মুখিয়ে আছে।
আবারো বলছি, সরকারকে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে কৃত অঙ্গীকারে দৃঢ় ও অবিচল থাকতে হবে। আর রাজনৈতিক দলসহ চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ও সমর্থকদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও ভেদাভেদ ভুলে জাতির এই ক্রান্তিকালে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে; যেমন ঐক্য গড়ে উঠেছিল গত বছর আন্দোলনকালে।
লেখক: সাংস্কৃতিক, ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে ইতিহাস আবারও নতুন মোড় নিল। ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের অপ্রত্যাশিত জয় যেন শুধু ছাত্ররাজনীতির নয়, গোটা জাতীয় রাজনীতিরও সঙ্কেত। ঠিক এ সময়েই ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে, যেখানে ক্ষমতাসীনদের দাপট আর বিরোধীদের প্রত্যাশা মিলেমিশে তৈরি করছে অনিশ্চয়তার দিগন্ত। এর মধ্যেই উঠেছে পিয়ার পদ্ধতির দাবি যা বলছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার খেলায় নয়, বরং ভোটের আসল অংশীদারিত্বে গণতন্ত্রের মানদণ্ড গড়তে হবে। তিনটি বিষয় আলাদা মনে হলেও, আসলে এগুলো একসুত্রে বাঁধা বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোন পথে হাঁটবে, সেই প্রশ্নের উত্তরে এখন খোঁজার পালা। ইতিহাস বলে, বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি বহুবার জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেছে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে নব্বইয়ের সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল ছাত্রসমাজ। তাই আজ ডাকসুর এই পরিবর্তন শুধু একটি শিক্ষাঙ্গনের ঘটনা নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির দিকদর্শনও বটে।
ছাত্ররাজনীতির নতুন অঙ্ক:
ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের উত্থান বাংলাদেশে এক নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মতো প্রভাবশালী সংগঠনগুলো এত বছর ধরে নিজেদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে ডাকসুকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু এবার ফলাফল দেখিয়ে দিল, তরুণ প্রজন্ম আর কেবল পুরোনো মুখ ও স্লোগান দিয়ে তুষ্ট হতে চাইছে না। অনেক শিক্ষার্থী ভোট দিল শিবিরকে কেবল মতাদর্শের কারণে নয়, বরং বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিকল্প খুঁজে পাওয়ার ব্যর্থতার কারণে। এটি এক ধরনের ‘প্রতিবাদী ভোট’, যা বাংলাদেশের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে।
প্রভাবশালী ছাত্রসংগঠনের ধাক্কা: ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সবসময় ডাকসুর মতো সংগঠনকে ব্যবহার করেছে ক্ষমতার প্রদর্শনী হিসেবে। ১৯৭৩ সালের প্রথম ডাকসু নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সব ক্ষেত্রেই এই দুই সংগঠন একচ্ছত্র আধিপত্য করেছে। কিন্তু এখন শিবিরের উত্থান তাদের জন্য বড় ধাক্কা। প্রশ্ন উঠছে, কেন এত বছর ক্ষমতা ভোগ করার পরও তারা তরুণ সমাজকে ধরে রাখতে পারল না? এটি মূলত ব্যর্থতার ফল যেখানে ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ব্যস্ত থেকেছে, অথচ শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যাকে উপেক্ষা করেছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে পিয়ার পদ্ধতির প্রশ্ন:
প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা ‘পিয়ার পদ্ধতি’ বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় বহুদিন ধরেই আলোচনায় আছে। ভারত, নেপাল, জার্মানি অন্য অনেক দেশে এ পদ্ধতি চালু আছে, যেখানে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন করা হয়। বাংলাদেশে বারবার অভিযোগ উঠেছে বড় দুই দলের বাইরে ছোট দলগুলোর কোনো অস্তিত্ব টিকে থাকে না। ডাকসুর ফলাফল সেই দাবিকে নতুন করে সামনে এনেছে। তরুণরা মনে করছে, ভোটের অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হলে অন্তত সত্যিকারের গণতন্ত্রের পথ খুলবে।
ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে সংশয়: বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস বিতর্কে ভরা। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’ অভিযোগ সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ মানুষ এখন ভোটের প্রতি আস্থাহীন। তাই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মনে তীব্র সংশয়। মানুষ ভাবছে, এবার কি সত্যিই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে, নাকি আবারও ক্ষমতার দাপটে একতরফা ফল বেরিয়ে আসবে? ভোটকেন্দ্রে মানুষের উপস্থিতি, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা সবকিছু মিলিয়েই এখন জাতির সামনে এক বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
ছাত্রশিবিরের বার্তা: শিক্ষার্থীরা শিবিরকে ভোট দিয়ে আসলে একটি বড় বার্তা দিয়েছে তারা পুরোনো শক্তিগুলির প্রতি আস্থা হারিয়েছে। অনেকে বলছে, এটি মতাদর্শের ভোট নয়, বরং পরিবর্তনের ডাক। এই প্রবণতা যদি জাতীয় নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়, তবে দুই বড় দলের প্রভাব ক্রমশ ভেঙে পড়বে। তরুণ প্রজন্ম যেভাবে বিকল্প খুঁজছে, তা ভবিষ্যতে নতুন রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিতে পারে।
বড় রাজনৈতিক দল আর ক্ষমতাসীনদের চিন্তা:
শিবিরের উত্থান ক্ষমতাসীনদের জন্য সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। কারণ তারা জানে, শিক্ষাঙ্গনের বাতাসই একদিন জাতীয় রাজনীতির ঝড়ে রূপ নেয়। ১৯৮০-এর দশকে এরশাদের পতনের সময় যেমন ছাত্রদের আন্দোলন বড় ভূমিকা নিয়েছিল। এখন যদি তরুণ প্রজন্মের অসন্তোষ বাড়তে থাকে, তবে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন থেকে শুরু করে আগামী বছরগুলোতেও সরকারকে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
বিরোধীদের উল্লাস:
বিরোধীরা শিবিরের সাফল্যকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার শুরু করেছে। তারা দাবি করছে এটি জনতার পরিবর্তনের ইচ্ছার প্রতিফলন। ডাকসুর নির্বাচনে শিবিরকে ভোট দেওয়া অনেকটা ‘প্রতীকী বিদ্রোহ’, যা জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত। বিরোধীদের ভাষ্য যদি শিক্ষার্থীরা এভাবে আস্থা হারিয়ে বিকল্পকে বেছে নিতে পারে, তবে সাধারণ মানুষও ফেব্রুয়ারিতে একই পথে হাঁটতে পারে হয়তে।
প্রশাসনের ভূমিকা:
বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ডাকসুর ভোটেও সেই অভিযোগ থেকে রেহাই মেলেনি। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন যদি প্রশাসন সঠিকভাবে পরিচালনা না করে, তবে তার বৈধতা আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। প্রশাসনের উপর জনগণের আস্থা ফেরানো এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ প্রশাসন যদি কোনো দলের পক্ষ নেয়, তবে নির্বাচন যতই অংশগ্রহণমূলক হোক না কেন, তা গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
তরুণ প্রজন্মের হতাশা:
বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ তরুণ, এবং এরা মূলত চাকরি, শিক্ষার মানোন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার চায়। কিন্তু বারবার নির্বাচনে বিতর্কের কারণে তারা হতাশ হয়েছে। ডাকসুর ফলাফল অনেকটা তাদের ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম। তরুণরা বিকল্প শক্তিকে ভোট দিয়ে জানিয়ে দিল তারা পুরোনো রাজনীতির ব্যর্থতায় ক্লান্ত। এই হতাশা যদি ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বড় আকার ধারণ করে, তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন শক্তি জন্ম নিতেও পারে।
পিয়ার পদ্ধতি না এলে সংকট:
বাংলাদেশে বর্তমানে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট পদ্ধতি চালু আছে। এতে যে দল এক ভোট বেশি পায়, সেই দল পুরো আসন জিতে যায়। এর ফলে অনেক সময় ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন হয় না। যেমন ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধীরা লাখ লাখ ভোট পেলেও আসন পেল হাতে গোনা। তরুণরা মনে করছে এই অন্যায় পরিস্থিতি পাল্টাতে হলে পিয়ার পদ্ধতি জরুরি। নইলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ফলও বিতর্কিত হবে এবং সংকট আরও গভীর হবে।
আন্তর্জাতিক নজরদারি:
বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে সবসময় নজর রাখে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক পাঠানোর পরিকল্পনা করছে, জাতিসংঘও বারবার স্বচ্ছ নির্বাচনের ওপর জোর দিচ্ছে। ডাকসুর নির্বাচনের ফল আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচনার খোরাক। প্রশ্ন উঠছে যদি শিক্ষার্থীরা বিকল্পকে বেছে নিতে পারে, তবে ফেব্রুয়ারিতে ভোটাররা কী করবে? আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে যদি নির্বাচন নিয়ে আবারও বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
অর্থনীতি ও অস্থিরতা: বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতিমধ্যেই চাপে। মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, রিজার্ভের পতন সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে। এর মধ্যে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা যোগ হয়, তবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যাবে। ২০১৩-১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছিল কয়েক বিলিয়ন ডলার। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে যদি সহিংসতা ছড়ায়, তবে সেই দৃশ্য পুনরাবৃত্তি হওয়ার ঝুঁকি প্রবল।
রাস্তায় উত্তাপ: বাংলাদেশের রাজনীতি মানেই রাস্তায় উত্তাপ। নির্বাচন এলেই সমাবেশ, মিছিল, অবরোধ, হরতাল শুরু হয়। এতে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডাকসুর ফলাফল বিরোধী শিবিরকে নতুন আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। তারা রাস্তায় শক্তি প্রদর্শনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোও ক
পাল্টা কর্মসূচি দেবে। ফলে ফেব্রুয়ারির আগে দেশজুড়ে উত্তেজনা বেড়ে সহিংসতার আশঙ্কা বহুগুণ বাড়বে।
পথ কোনদিকে? শেষ প্রশ্ন একটাই- বাংলাদেশ সামনে কোন পথে হাঁটবে? ডাকসুর নির্বাচনে তরুণ প্রজন্ম স্পষ্ট করে বলেছেতারা পরিবর্তন চায়। এখন জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলো কি সেই বার্তা শুনবে? নাকি আবারও পুরোনো দখলদার রাজনীতির পুনরাবৃত্তি হবে? ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে। যদি এই নির্বাচনও স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য না হয়, তবে বাংলাদেশ আবারও অনিশ্চয়তা, বৈধতার সংকট এবং আন্তর্জাতিক চাপে ডুবে যাবে।
শেষ কথা: ডাকসুর ফল কেবল ক্যাম্পাসের ভোট নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির আগাম ইঙ্গিত। তরুণরা যে পরিবর্তনের ডাক দিচ্ছে, তা উপেক্ষা করলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। ইতিহাস সাক্ষী, ছাত্ররাজনীতি বহুবার জাতীয় আন্দোলনের সূচনা করেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
এই তিনটি ইস্যু আলাদা হলেও, মূল প্রশ্ন আসলে একটাই বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটছে?
মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এমন এক নাম, যিনি দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গণতন্ত্র, আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতীক হয়ে আছেন। তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল এক শোকস্তব্ধ মুহূর্তে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিএনপি একটি অস্থিরতা ও নেতৃত্ব সংকটের মুখে পড়ে। সে সময় একজন সাধারণ গৃহিণী থেকে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশ শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব গ্রহণ নয়, বরং দেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তার হাতে গড়া আন্দোলন ও নেতৃত্বে বিএনপি ধীরে ধীরে পরিণত হয় একটি গণআন্দোলনের শক্তিতে, যার লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের পর থেকে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়। মাত্র দুই বছরের মধ্যে, ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি পূর্ণাঙ্গ চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। সেই সময় সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দেশের রাজনীতিতে বিরোধী শক্তিকে একত্রিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। খালেদা জিয়া নেতৃত্ব দেন সাত-দলীয় ঐক্যজোট গঠনে, যা পরবর্তী সময়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে তার আপসহীন অবস্থান এবং দৃঢ় নেতৃত্ব তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে রাজনৈতিক অভিধানে অমর করে রাখে। আন্দোলনের সময় তিনি বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন—১৯৮৩, ১৯৮৪ এবং ১৯৮৭ সালে—কিন্তু প্রতিবারই তিনি দৃঢ়ভাবে রাজনীতির মঞ্চে ফিরে এসেছেন। সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল তার নেতৃত্বের পরীক্ষার আসল ক্ষেত্র। ছাত্র-জনতা, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে অবশেষে ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন ঘটে। এরপরের ইতিহাস হলো বিএনপির অভ্যুদয়ের ইতিহাস। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তার নেতৃত্বেই রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাস হয়। এই পদক্ষেপ শুধু রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন করেনি, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে একটি নতুন গতিপথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় আসে ২০০১ সালে, তখন দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে। তার নেতৃত্বে এ সময় দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীলতা পায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পায় এবং বৈদেশিক বিনিয়োগও নতুন উচ্চতায় পৌঁছে। কিন্তু তাঁর এই রাজনৈতিক যাত্রা কখনোই মসৃণ ছিল না। ২০০৬ সালের পর রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং ২০০৭ সালের ১/১১ এর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা, গ্রেপ্তার এবং রাজনৈতিকভাবে হেয় করার চেষ্টা তার ও তার দলের জন্য নতুন সংকট তৈরি করে। এই সময় খালেদা জিয়াকে দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকতে হয়, যা তার রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও দৃঢ় করে তোলে।
২০০৮ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের একটানা ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপির ওপর শুরু হয় তীব্র দমননীতি। হাজার হাজার মামলা, গ্রেপ্তার, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে এক অমানবিক সময়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনগুলোতেও উঠে আসে এই নিপীড়নের চিত্র। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও চালানো হয় প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা পরে হাইকোর্ট দশ বছরে উন্নীত করে। একই বছরের অক্টোবরে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাত বছরের সাজা ঘোষণা হয়। এর ফলে তিনি বন্দি অবস্থায় দীর্ঘদিন কারাগারে কাটান। পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি পরিত্যক্ত ভবনে তাকে রাখা হয়েছিল, যা ছিল মানসিক ও শারীরিক কষ্টকর অভিজ্ঞতা।
তার এই বন্দিত্ব শুধু একজন রাজনীতিকের নয়, বরং গণতন্ত্রের উপর আঘাত হিসেবে ধরা হয়। বিএনপি ও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো মনে করত, এটি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ। দীর্ঘ কারাজীবনের পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান। তবে এই মুক্তি পূর্ণ স্বাধীনতা নয়; তিনি কার্যত গৃহবন্দি অবস্থায় গুলশানের ফিরোজায় থাকেন। শারীরিক অসুস্থতা এবং বয়সজনিত কারণে সক্রিয় রাজনীতিতে সরাসরি অংশ নিতে না পারলেও, তার উপস্থিতি এবং রাজনৈতিক অবস্থান বিএনপিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
এই দীর্ঘ সময় তার রাজনৈতিক জীবন ছিল সংগ্রাম, কারাবাস এবং গৃহবন্দিত্বে ভরা। কিন্তু খালেদা জিয়ার যে রাজনৈতিক পরিচয়, তা হলো আপসহীন গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব। তিনি কখনোই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আপস করে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করেননি। বরং তার কারামুক্তি দিবস প্রতি বছর বিএনপি ও গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে হয়ে ওঠে এক প্রতীকী দিন, যা মনে করিয়ে দেয় রাজনীতিতে তার অবদান ও ত্যাগের কথা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা থেকে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এই মুক্তি কেবল তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ফেরানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক প্রতীকী ঘটনা। গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণে তার ভূমিকা নতুন করে আলোচনায় আসে। তিনি হয়ে ওঠেন প্রতীক, যিনি নিপীড়ন, কারাবাস ও প্রতিহিংসার রাজনীতির মুখোমুখি হয়েও তার আদর্শ থেকে সরে আসেননি।
আজ যখন আমরা খালেদা জিয়ার কারামুক্তি দিবস স্মরণ করি, তখন কেবল একজন নেত্রীর মুক্তি উদযাপন করি না, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংগ্রামী পথকেও স্মরণ করি। তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পাল্টাতে হলে দৃঢ় নেতৃত্ব ও আপসহীন অবস্থানের প্রয়োজন। তার কারাবাস ও মুক্তির ইতিহাস আসলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসেরই অংশ।
বিএনপির জন্ম, জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া রাজনৈতিক দর্শন এবং খালেদা জিয়ার হাতে সেই দর্শনের বিকাশ আজও প্রাসঙ্গিক। তার নেতৃত্ব প্রমাণ করেছে যে, গণতন্ত্রের পথ কখনো সহজ নয়, বরং সংগ্রাম, ত্যাগ এবং আপসহীনতার মাধ্যমেই তাকে এগিয়ে নিতে হয়। খালেদা জিয়ার কারামুক্তি দিবস তাই কেবল একটি তারিখ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনিবার্য অধ্যায়, যা নতুন প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই কখনো থেমে থাকে না।
রাজু আলীম, কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
অনুবাদ:
(১০) তারা বলে, আমরা যখন মাটিতে মিশে যাব, তখন কি আমাদেরকে আবার নতুনভাবে সৃষ্টি করা হবে? আসলে তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতকেই অস্বীকার করে। (১১) ( হে নবী,) বলে দাও: তোমাদের জীবন হরণ করবে মৃত্যুর ফেরেশতা, যাকে তোমাদের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। অতঃপর তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরিয়ে নেওয়া হবে। (১২) তুমি যদি তাদের দেখতে, যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে নতশিরে দণ্ডায়মান হবে! (তারা বলবে,) হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম ও শোনলাম। এখন আমাদেরকে (একবার দুনিয়াতে) পাঠিয়ে (সুযোগ) দিন, আমরা সৎকাজ করবো। আমরা (এখন) দৃঢ় বিশ্বাসী। (১৩) আমি চাইলেই প্রত্যেক ব্যক্তিকে হিদায়াত দিয়ে দিতাম। কিন্তু আমার কথাই সত্যে পরিণত হবে যে, ‘নিশ্চয়ই আমি জিন ও মানবজাতি উভয়ের দ্বারা জাহান্নাম ভরে দেব।’ (১৪) সুতরাং তোমরা যে এ দিবসের সাক্ষাত ভুলে গিয়েছিলে, তার স্বাদ গ্রহণ কর। আমিও তোমাদের ভুলে গেলাম এবং তোমাদের কর্মের দরুন অনন্তকালের শাস্তি ভোগ করতে থাক।
মর্ম ও শিক্ষা-
ইতোপূর্বে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, তার কিতাব কোরআন এবং রিসালাতের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়েছে। তারপর এখানে আলোচ্য আয়াতগুলোতে ঈমানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। তা হলো কিয়ামত ও আখিরাত। দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়, বরং এরপর সবাইকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে। সবারই পুনরুত্থান হবে। কিয়ামত হবে, আখিরাত আছে। তখন প্রতিটি মানুষকে দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি কর্মের হিসাব দিতে হবে।
বাতিলপন্থিদের আখিরাতে অবিশ্বাস ও অস্বীকৃতি-
অবিশ্বাসী ও বাতিলপন্থিরা মনে করে, মৃত্যুর পর তারা যখন মাটিতে মিশে যাবে, তখন তাদেরকে আর পুনরুত্থিত করা হবে না তারা মনে করে, দুনিয়ার জীবনই শেষ। দুনিয়ার মৃত্যুই শেষ। এরপর আর পুনর্জীবন নেই। সুতরাং দুনিয়াতে তারা যে কর্মই করুক, সে ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। তাদেরকে আল্লাহর সম্মুখীন হতে হবে না। কোনো কিছুর হিসাব দিতে হবে না। এ জবাবদিহির চেতনা ও অনুভূতি না থাকার কারণে, তারা যা ইচ্ছা তা করতে পারে।
ফেরেশতাদের মাধ্যমে মানুষের জীবন হরণ-
সকল প্রাণীরই মৃত্যু আছে। নির্দিষ্ট সময়ে সবকিছুই মারা যাবে, কিন্তু মানুষের মরণ এবং অন্যান্য প্রাণীর মরণের মধ্যে পার্থক্য আছে। মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা। সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান ও সম্মানিত সকল প্রাণীকে আল্লাহই প্রাণ দেন, কিন্তু শুধু মানুষের বেলায় বলা হয়েছে, আল্লাহ নিজের নিকট থেকে মানুষের জীবন সঞ্চার করেন। আর এখানে আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, যখন মৃত্যুর সময় হবে তখন অন্য প্রাণীর মতো মানুষের প্রাণ বায়ু এমনিতে উড়ে যাবে না বরং ফেরেশতা এসে তার জান কবজ করবেন। আল্লাহর নিকট থেকে মানুষের প্রাণ সঞ্চার করার কথা বলে যেমন সম্মান দেয়া হয়েছে, তেমনি মৃত্যুর সময়ও মানুষের বিশেষ সম্মান দেয়া হয়েছে। মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইলের হাতেই মানুষের জান কবজ হবে।
কিয়ামতে পুনরুত্থান-
কিন্তু মৃত্যুই শেষ নয়। আয়াতে বলা হয়েছে, অতঃপর তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরিয়ে নেয়া হবে। অর্থাৎ মৃত্যু এলো, কবর দেয়া হলো, দিনে দিনে মানুষের লাশ পচে গলে মাটির সাথে মিশে গেলো, এটাই শেষ নয়। বরং এক নির্দিষ্ট সময়ে কিয়ামত আসবে। আল্লাহর নির্ধারিত ফেরেশতা সিঙ্গায় ফুৎকার দিবেন। সেই আওয়াজে কবর থেকে সকল মানুষ পুনরুজ্জীবিত হয়ে কিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে। সৃষ্টির প্রথম মানুষ থেকে শেষ মানুষ সবাই হাশরের মাঠে একত্রিত হবে। তা হবে অগণিত মানুষের বিরাট সমাবেশ।
কিয়ামতের দিনের হিসাব ও বিচার-
কিয়ামতের দিনের সেই বিরাট সমাবেশের এক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। সেদিন সকল মানুষ আল্লাহর সম্মুখীন হবে, সবাই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে। প্রতিটি মানুষের প্রতিটি কাজের হিসাব হবে। আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে)। উল্লেখ্য, মানুষকে শুধু আল্লাহর ইবাদতের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্য পালনে সে কতটুকু স্বার্থক হলো, আর কতটুকু ব্যর্থ হলো, তার হিসাব দিতে হবে। যারা মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করে কিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে, সেদিন আল্লাহর বিচারের রায় তাদের পক্ষে যাবে। তারা মুক্তি পাবে এবং অনন্তকালের জান্নাতের শান্তির স্থান পাবে। যারা মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে, তারা সেদিন কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হবে। আল্লাহর বিচারের রায় তাদের বিপক্ষে যাবে। তারা অনন্তকালীণ শাস্তির দোযখে পতিত হবে।
সময় থাকতে শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া উচিত-
কিয়ামতের দিন অবিশ্বাসী ও বাতিলন্থীদের কি পরিণাম হবে, এখানে আল্লাহ আগেই বলে দিয়েছেন। একথাও বলা হয়েছে, সময় ফুরিয়ে গেলে পরে আফসোসে কোন কাজ হবে না। শত আকুতি মিনতি করলেও লাভ হবে না। এখান থেকে আল্লাহ একথাটি বুঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, সময় থাকতে শুভ বুদ্ধির উদয় হওয়া উচিত। সময় শেষ হয়ে গেলে কান্না কাটি করেও লাভ নেই। কাজেই দুনিয়ার জীবনে সত্যপথ গ্রহণ করা উচিত এবং আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করা উচিত।
আখিরাতে বিশ্বাস, জবাবদিহিতা এবং তদনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা-
এখানে শুধু অবিশ্বাসী ও বাতিলপন্থিদের জন্যই শিক্ষা নয়, বরং সত্যপন্থি ও ঈমানদারদের জন্যও শিক্ষা রয়েছে। তা হলো এই যে, তারা যখন কিয়ামত ও আখিরাতের জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করে, তখন তাদের উচিত আল্লাহর দেয়া জীবনাদর্শ ও জীবন-বিধানকে শক্তভাবে আকড়ে ধরা এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করা। অলসতায় গা ভাসিয়ে দেয়া ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, শুধু বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়, বরং বিশ্বাস অনুযায়ী আমল ও কর্ম হতে হবে। ঈমানের দাবি অনুযায়ী জীবন চালালেই আখিরাতে মুক্তি পাওয়া যাবে। তা না হলে মুক্তি পাওয়া কঠিন হবে। উল্লেখ্য, কারো যদি ঈমান থাকে এবং তার কর্ম ঈমানের দাবি অনুযায়ী না হয়, বরং বিচ্যুতি ও অপরাধই বেশি হয়, তাহলে তার শাস্তি হতে পারে। ঈমানের কারণে আল্লাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন, কিন্তু অবহেলাজনিত অপরাধ থাকলে যদি ক্ষমা পাওয়া না যায় তাহলে শাস্তি ভোগ করতে হবে। তবে দোযখে শাস্তি ভোগ করার পর ঈমানের কারণে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া যাবে। কাজেই এ শাস্তি থেকেও আত্মরক্ষার জন্য ঈমানের দাবী অনুযায়ী জীবন যাপন করা উচিত।
সত্যগ্রহণে মানুষের স্বাধীনতা-
আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে প্রত্যেককে হিদায়াত দিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। আর তা করেননি যৌক্তিক কারণে। আল্লাহ যদি বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে হিদায়াত দিয়ে দিতেন, তাহলে সৎপথে চলার পুরস্কার এবং বাতিলের পথে চলার শাস্তির কোন অর্থ থাকে না। কারণ তখন কেউ বাতিলের পথে চলবে না। কাজেই শাস্তির প্রশ্নই উঠে না। আর যেহেতু বাধ্যতামূলকভাবে সবাই সৎ পথে চলে, সেহেতু পুরস্কারেরও কোন অর্থ থাকে না। এজন্যই ফেরেশতাদের জন্য পুরস্কার বা শাস্তি নেই। কারণ তারা বাধ্যতামূলকভাবেই আল্লাহর অনুগত। শুধু মানুষ ও জিন জাতিকেই মত ও পথ গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কোন্ পথে চললে আল্লাহ খুশি হন তা কুরআনে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। আর কোন্ পথে চললে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, তারও বর্ণনা রয়েছে তাতে। এছাড়া সত্য পথে চললে কি পুরস্কার রযেছে, আর বাতিলের উপর চললে কি শাস্তি রয়েছে, তাও বলে দেয়া হয়েছে। এসব বলে দেয়ার পর মানুষ ও জিন জাতিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। তারা বুঝে-শুনে নিজ পথ বেছে নিতে পারে। এ ব্যাপারে তাদের পূর্ণ স্বাধীনাত দেয়া হয়েছে।
কিয়ামতে অপরাধীদের প্রতি তিরস্কার-
কিয়ামতের দিন অবিশ্বাসী, বাতিলপন্থী ও মুশরিকরা শুধু শাস্তিই পাবে না, বরং তাদেরকে তিরস্কার করা হবে। তারা দুনিয়াতে যেভাবে সত্যপন্থিদের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রূপ করত, কিয়ামতের দিন তাদের প্রতি বিদ্রূপ করা হবে। যেমন তাদের বলা হবে, তোমরা তো আখিরাতকে ভুলে গিয়েছিলে, এখন মজা ভোগ করো। বলাবাহুল্য, শাস্তির মজা বা স্বাদ ভোগ করার কথা বলা বিদ্রূপাত্মক। শাস্তি কখনো মজা হতে পারে না।
আখিরাত অস্বীকার করাই বিপথে চলা ও শাস্তির মূল কারণ-
অবিশ্বাসী বাতিলপন্থিরা নবী, রাসূল, আল্লাহর কিতাব কোরআন, রাসূলের আদর্শ ও ইসলামী জীবনাদর্শের সবকিছুকেই অস্বীকার করে অথবা প্রত্যাখ্যান করে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো আল্লাহর কাছে আখিরাতের জবাবদিহিতাকে অস্বীকার করা। এ বিষয়টিকেই এখানে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। কারণ আখিরাত অস্বীকার করলে জবাবদিহিতার কোন ভয় থাকে না, শাস্তি বা পুরস্কারের প্রশ্ন উঠে না। সুতরাং যারা আখিরাতকে অস্বীকার করে, তাদের নিকট অন্যায় ও মন্দ পথ ছেড়ে ভালো পথে চলার কোন অনুপ্রেরণাই থাকে না। মন্দ পথে চললে যদি দুনিয়ার স্বাচ্ছন্দ ও শন্তি পাওয়া যায়, তাহলে তাদের জন্য এটাই তো ভালো, কারণ আখিরাত তো নেই। কাজেই যারা আখিরাত অবিশ্বাস করে তারা তাদের পক্ষে মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক। অপরদিকে যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে, এ বিশ্বাস তাদের সকল কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করে। কারণ যখন তারা কোন কাজ করতে চায়, তখনই তার বিবেক প্রশ্ন করে, এটা ভালো কি মন্দ। মন্দ হলে আখিরাতে জবাব দিতে হবে। এভাবে কিয়ামত ও আখিরাতে বিশ্বাস মানুষের আচার ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডের উপর বিরাট প্রভাব ফেলে।
ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক, সূরা সাজদাহ, পর্ব ৩
সংকটাপন্ন পাঁচ ইসলামি ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক একীভূত করে দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। একীভূত ব্যাংকের সম্ভাব্য নামও নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’। ফলে এই ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের মাঝে ইতোমধেই স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে এবং অন্তবর্তী সরকারের এই উদ্যোগকে দেশের আর্থিকখাত স্থিতিশীল করার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, নতুন প্রণীত ব্যাংক রেজোল্যুশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫ এর অধীনে প্রণীত এই একীভূত প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে আনুমানিক ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা মূলধন প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা দেবে সরকার এবং বাকী ১৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে প্রাতিষ্ঠানিক তহবিল ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে রূপান্তরের মাধ্যমে। একীভূত কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ইতোমধ্যেই আট সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির কাজ হলো ব্যাংকগুলোর একীভূত কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা এবং নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য লাইসেন্স, আরজেএসসি থেকে নিবন্ধনসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমের সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহন করা।
কমিটির আহ্বায়ক হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহাম্মদ। অন্য সদস্যরা হলেন- অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ রাশেদুল আমিন ও উপসচিব ফরিদ আহমেদ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দুই যুগ্ম সচিব শেখ ফরিদ ও মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক রেজল্যুশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জহির হোসেন এবং একই বিভাগের দুই অতিরিক্ত পরিচালক কাজী আরিফ উজ জামান ও মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন। কমিটির পক্ষ থেকে দাবী বলা হচ্ছে যে, একীভূত করণের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং অক্টোবরের মধ্যেই অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন হবে।
সরকারের সিদ্ধান্ত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা তৎপরতা দেখে স্পষ্টতই ধারণা করা যায় ব্যাংকগুলোর একীভূত প্রক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পুনর্গঠন উদ্যোগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো আমানতকারীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সমস্যাগ্রস্থ ব্যাংকগুলোর লিকুইডেশন বা অবসায়ন প্রক্রিয়া এড়িয়ে চলা, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ব্যাংকগুলোর কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
একীভূত হওয়ার জন্য নির্ধারিত চারটি ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ও সোশ্যাল ইসলামী—এর আগে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অভিযোগ রয়েছে, তারা বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে শেল কোম্পানির মাধ্যমে তহবিল অন্যত্র সরিয়ে নেয়। অন্যদিকে, এক্সিম ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ করেছেন নাসা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক লুটপাটের কারণে উক্ত পাঁচটি ইসলামি ব্যাংক মাত্রাতিরিক্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০২৪ সালের আগস্টে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকের পুরোনো বোর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন বোর্ড নিয়োগ করে। বৈশ্বিক অডিট ফার্ম দিয়ে করানো ফরেনসিক অডিটে তাদের নাজুক আর্থিক অবস্থার চিত্র উঠে আসে। অডিটে উঠে আসা খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায়—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামীতে ৯৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকে ৯৭ দশমিক ৮ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামীতে ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামীতে ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকে ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকারের সম্মতি পাওয়ায় এবার ব্যাংকগুলোর পর্ষদ বাতিল করে আলাদা একটি পর্ষদ গঠন করা হবে। নতুন ব্যাংকটির সরকারের পক্ষে পরিচালনগত দিক দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভিন্ন পর্যায় থেকে তহবিল নিয়ে ব্যাংকটি তিন থেকে পাঁচ বছর সরকারি মালিকানায় চলবে। এরপর ব্যাংকটি লাভজনক পর্যায়ে আসার পর এটিকে বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক বহুজাতিক কোনো সংস্থা নতুন ব্যাংকের মালিকানায় যুক্ত হতে পারে। ব্যাংকটি বিক্রির পর মুনাফাসহ সরকারের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংকটির জন্য ইসলামী ব্যাংকিং, আর্থিক খাত, তথ্যপ্রযুক্তি এবং আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে স্বতন্ত্র একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নিয়ে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞ একজনকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেবে। পাঁচটি ব্যাংকের অনেক ক্ষেত্রে একই এলাকায় একাধিক শাখা রয়েছে। এই শাখাগুলো বন্ধ করা হলে এতে করে কর্মী ছাঁটাইয়ের একটি প্রশ্ন আসবে। কর্মীদের গণহারে যাতে ছাঁটাই করতে না হয়, সে লক্ষ্যে এই ব্যাংকগুলোর শহর এলাকার বাড়তি শাখাগুলো গ্রামীণ এলাকায় স্থানান্তর করা হবে।
জানা যায়, দেশের মোট উপজেলার প্রায় ৩০০টি উপজেলায় এই পাঁচটি ব্যাংকের কোন শাখা নেই। সুতরাং সেসব উপজেলাগুলোতে নতুন ব্যাংকের শাখা খোলার যথেষ্ট সুযোগ থাকবে নতুন এই ব্যাংকটির। এতে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ সহজেই ইসলামি ব্যাংকিং সেবা পাবেন এবং দেশের আর্থিক অন্তর্ভূক্তি প্রক্রিয়া ত্বান্বিত হবে। একটি পরিসংখ্যানে জানা যায়, সারাদেশে এই পাঁচটি ব্যাংকের ৭৬০টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং ৯৭৫টি এটিএম বুথ রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী একটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এটি। একীভূত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে আরেকটি শক্তিশালী ইসলামি ব্যাংক গঠন করা হলে এর প্রতি আমানতকারী, অন্যান্য গ্রাহক এবং সাধারণ মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি শরিয়াহ ব্যাংকিংয়ের একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হবে।
দেশের মানুষের নিকট শরিয়াহসম্মত ব্যাংকিং সেবার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন ব্যাংকটি প্রকৃত অর্থে একটি শরিয়াহ পরিপালনকারী ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হলে মানুষের কাঙ্খিত ব্যাংকিং চাহিদা পূরণ হবে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সুনিশ্চিত হবে। তবে এ জন্য শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবিড় তত্তাবধান ও কঠোর নজরদারির মাধ্যমে এই ব্যাংকটিতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে। শরিয়াহর নীতিমালা পরিপালনে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে।
দেশব্যাপি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ও বৈচিত্রপূর্ণ ইসলামি ব্যাংকিং প্রোডাক্ট ও সার্ভিস এবং সার্বিক কল্যাণের বার্তা নিয়ে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে ব্যাংকিং সেবা দিতে পারবে এই নতুন ব্যাংক। ইসলামি শরিয়াহর উদ্দেশ্যের আলোকে বিনিয়োগ বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় আমানত স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (এসএমই) অগ্রাধিকার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নতুন উদ্যোক্তা উন্নয়নে অবদান রাখবে ব্যাংকটি। এতে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং খাত আরো সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হবে। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা আরো বৃদ্ধি পাবে।
লেখক: সার্টিফায়েড শরিয়াহ অ্যাডভাইজর অ্যান্ড অডিটর এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের হেড অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন্স।
সাংহাই ফাইভ গ্রুপ - ১৯৯৬ সালে রাশিয়া, চীন কাজাকিস্থান, কিরগিজস্থান তুর্কেমেনিস্থানের সমন্বয়ে গঠিত একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ফোরাম। যে ফোরামের মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ইউরেশিয়ান অঞ্চলের সীমান্ত নিরাপত্তা সুরক্ষা। এতদ উদ্দেশে ১০৯৭ সালে মস্কোতে ওই দেশের শীর্ষ নেতারা মিলিত হয়ে সংশ্লিষ্ট সীমান্তগুলো থেকে সামরিক শক্তি কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ৯০ পরবর্তী সমিকরণে সাংহাই ফাইভ গ্রুপের উদ্যোগটি রাশিয়া চীনের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপ অভিমুখী সম্প্রসারণ নীতির ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে ইউরেশিয়ান অঞ্চলকে নিরাপদ রাখতে সহায়তা করে। এ পর্যায়ে রাশিয়া ও চীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি বহুমেরুভিত্তিক নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন। মস্কো ও বেইজিংয়ের এই অঙ্গীকারের সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক নিরাপত্তার ধারনায় আসে গুণগত পরিবর্তন। ফলে ইউরেশিয়ান অঞ্চল, ককেশাস, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুত্রপাত হয়। এ ধরনের নানা রাজনৈতিক রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে ২০০১ সালে সাংহাই ফাইভ গ্রুপে যোগ দেয় উজনেকিস্থান। ফলে এটি সাংহাই সিক্স গ্রুপ হিসেবে পরিচিতি পায়। এ পর্যায়ে সাংহাই সিক্স গ্রুপের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আরও বিস্তৃত পরিসরে নেয়ার উদ্যোগ নেয় সদস্য দেশগুলো। উপরোক্ত ধারণাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে ২০০১ সালের ১৫ জুন চীনের সাংহাইয়ে সাংহাই সিক্স গ্রুপের শীর্ষ নেতারা মিলিত হয়ে এসসিও ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করলে জন্ম নেয় একটি নতুন আন্তর্জাতিক সংগঠন। যার নাম সাংহাই কো অপারেশন অর্গানাইজেশন সংক্ষেপে এসসিও। পরবর্তীতে ভারত ও পাকিস্তান এবং ইরান ও বেলারুশ এই সংস্থায় যোগ দিলে এর সদস্য সংখ্যা দশে উন্নিত হয়। রাশিয়া ও চীনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় গঠনমূলক ভূমিকার উপযোগিতায় বিস্তৃত করা হয় এই ফোরামের পরিধি। এক্ষেত্রে প্রথম থেকেই সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সামরিক কর্মকাণ্ডের সমন্বয় দেখা গেছে। ওই আলোকেই ধারণা করা হচ্ছিল যে এসসিওকে একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক জোট হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে সদস্য দেশগুলো। যেখানে রাশিয়া ও চীন নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ। একপক্ষীয় বিশ্ব ব্যবস্থার বিপরীতে রুশ চীন প্রস্তাবিত বহুমেরুভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থা বাস্তবায়নে এসসিও এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সর্বশেষ চীনে অনুষ্ঠেয় এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের ফোকাস এ সংক্রান্ত স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে। দুইদিন ব্যাপী এবারের এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের যুগপৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আশিতম বার্ষিকী উপলক্ষে চীনের সুবিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ ছিল পশ্চিমা বিশ্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানো। এই দুই ইভেন্টে অংশ নিতে গত সপ্তাহে বেইজিংয়ে বিশ্ব নেতাদের ঢল নেমেছিল। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম লিডার কিম জং উন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়াও বেইজিংয়ে জড়ো হয়েছিলেন পশ্চিমা একাধিপত্যবাদের কড়া সমালোচক অনেক দেশের নেতারা। একইসঙ্গে ন্যাটো সদস্য তুরস্ক, ইইউ এর সদস্য স্লোভাকিয়া এবং ইউরোপের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ সার্বিয়ার নেতাদের অংশগ্রহণ এই সম্মেলনের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। যা চীন ও রাশিয়ার প্রস্থাবিত বহুমেরুভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থার কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সাধারণভাবে এই আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য শুধুমাত্র এসসিও"র পূর্ণাঙ্গ সদস্য দেশগুলোর চিন্তা ভাবনার ওপর নির্দিষ্ট। তথাপি এসসিও সম্মেলন সমাপ্তীর মাত্র একদিন পরেই চীনের ভিক্টরি ডে প্যারেড অনুষ্টিত হওয়া, সেইসঙ্গে এসসিওর পর্যবেক্ষক সদস্য দেশ, সংলাপ অংশিদার সহ বহু দেশের রাষ্ট ও সরকার প্রধানের ব্যপক উপস্থিতির কারণে এবারের এসসিও শীর্ষ সম্মেলন আরও বিস্তৃত পরিসরে আলোচনার দাবি রাখে। বৈশ্বিক অস্থিরতার নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে অনুষ্ঠেয় এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের শুরুতেই গত জুনে ইরানে ইসরায়েল মার্কিন যৌথ হামলার তীব্র নিন্দা জানায় সদস্য দেশগুলো। অন্যদিকে সম্মেলনের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে তিয়ানজিং ঘোষনাপত্রে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন পূর্বক প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। এছাড়া কোনো দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। শক্তি প্রয়োগের প্রবণতা রোধ, একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরোধিতা করা হয় তিয়ানজিন ঘোষনায়। একপক্ষীয় বিশ্ব ব্যবস্থায় বিদ্যমান উপরোক্ত প্রবণতাগুলো প্রতিরোধে একটি সমন্মিত নীতি গ্রহণের ব্যপারে সম্মত হয়েছে এসসিও। যা সদস্য দেশগুলোর আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডের পথকে করবে সহজ। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় একটি সহজতর প্রক্রিয়া অনুসরণের পদ্ধতি প্রস্তুত করেছে এসসিও। যা শেষ পর্যন্ত গ্লোবাল সাউথের সমস্যা উত্তরণেও গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও গ্লোবাল সাউথের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিশেষ কিছু নীতি গ্রহণের ব্যাপারে এসসিও নেতারা আগে থেকেই একমত ছিলেন। গ্লোবাল সাউথকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর পর্যায়ে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ মুলক নীতি বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে রাশিয়া ও চীনের পূর্বতন চিন্তা ভাবনাগুলো এসসিওর মাধ্যমে সম্পন্ন করার পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবার। ফলে অর্থনৈতিক সাহায্যের আড়ালে গ্লোবাল সাউথের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার পশ্চিমা প্রচেষ্টাগুলোকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। এমনটি হলে পশ্চিমাদের প্রভাব মুক্ত পরিবেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনায় স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে উন্নয়নশীল বিশ্ব। বলা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডকে নানাভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেই ফেলেছে এসসিও। আগামী দশ বছর ধরে এসসিওকে আরও উপযোগী করার অঙ্গিকার করেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা অর্জনের মাধ্যমে মানবিক, রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে ২০৩৫ সালের মধ্যে এসসিওকে পূর্ণাঙ্গ বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রস্তুত করার কথা বলেছেন তিনি। এক্ষেত্রে চীনের প্রস্থাবিত আরেকটি ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ সফল হলে সেটি খুবই কার্যকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। চীনে এই সংস্থার শীর্ষ সম্মেলন সত্যিকার অর্থেই উম্মুক্ত করেছে বৈশ্বিক পরিবর্তনের বহু পথ। যদিও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সামরিক লক্ষ্য কি সেটি স্পষ্ট করা হয়নি। তথাপি এসসিওর সামরিক লক্ষকেই আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। কেননা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের আলোচনায় এসসিওকে মনে করা হয় ন্যাটোর প্রতিদ্বন্দ্বী জোট হিসেবে। এ কথা সত্য হিসেবে ধরে নেয়ার অনেক কারণ আছে। বিশেষত গত দশকে এসসিও সদস্য দেশসমূহ নিয়মিতভাবে বেশ কয়েকটি যৌথ সামরিক মহড়া সম্পন্ন করেছিল। যেগুলো তখনকার প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত সংবেদনশীল ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এসসিও এ ধরনের কর্মকাণ্ডের শিথিলতা লক্ষ্য করা গেলেও এই সংস্থার একটি বিস্তৃত সামরিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। যা তারা হয়তো আপাতত ফোকাস করতে চাইছেন না। এই অবস্থায় এসসিও এর কর্মকাণ্ড ঘিরে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে পশ্চিমা বিশ্বে । গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা, ইরান- ইসরায়েল যুদ্ধের আশঙ্কা, রুশ- ইউক্রেনীয় যুদ্ধের ভয়াবহতা সেইসঙ্গে এশিয়া প্রশান্ত মহসাগরীয় অঞ্চলে বিদ্যমান সামরিক উত্তেজনার আলোকে এসসিওর সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে রীতিমতো উদ্বেকে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার যুক্তরাষ্ট্র ও তার নেতৃত্বে পরিচালিত পশ্চিমি শক্তিগুলো অনেকটাই অপ্রস্তুত। যে কারণে সম্ভাব্য যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাদের নয়া কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে ন্যাটো রাশিয়া যুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে সংস্লিষ্ট ইস্যুতে এসসিও হঠাৎ কোনো যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভেস্তে দিতে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসের সমস্ত পরিকল্পনা। একইকথা প্রযোজ্য ইরান ইসরায়েল যুদ্ধ, তাইওয়ান ও কোরিয় উপদ্বীপের ক্ষেত্রেও। এ ধরনের বাস্তবতার কারণে সাংহাই কো অপারেশন অর্গানাইজেশনই এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক অঙ্গণের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। চীনের সর্বশেষ সম্মেলন সাংহাই সহযোগীতা সংস্থার লক্ষ ও উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ওই আলোকে এটি খুবই পরিস্কার যে স্নায়ুযুদ্ধ উত্তর দূনিয়ায় পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো কিংবা অন্যান্য কাঠামোর বিরুদ্ধে প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি করার শক্তি অর্জন করেছে এসসিও। সময়ের পরিক্রমায় এসসিওর ভূমিকা সম্প্রসারিত হবে এটিই বিশেষজ্ঞদের ধারনা। সদস্য দেশগুলোর সমন্বিত নীতির আলোকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করবে সাংহাই সহযোগীতা সংস্থা।
এসসিও সম্মেলন ও তিয়ানজিন ঘোষণা, হাসান জাবির, বিশ্লেষক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা
বিএনপি ৪৭ বছরে পা দিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম করা দলটি এখন এক নতুন যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ১৫ বছরের কঠিন সংগ্রামের পর শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক এবং মাফিয়াবাদী শাসনতন্ত্র উৎখাতের মধ্যে দলটি এবং দলের নেতা-কর্মীরা অনেকদিন পর একটু স্বস্তির জায়গায় পৌঁছেছে। আসন্ন নির্বাচনে জিতলে আবারও দলটির নতুনভাবে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (যার সুযোগ নিতে আমরা এতদিন চরমভাবে ব্যর্থ), আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নতুন যুগ, দেশের পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য যেই ক্ষমতায় আসুক, তাকে দায়িত্ব নিতেই হবে। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দলটি আমাদের দিয়েছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। আমরা এখন জোর গলায় বলতে পারি, আমরা বাংলাদেশপন্থি মানুষ। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমাদের দেশে শুধু বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দলগুলোই আছে, যার শুরুটা বিএনপির হাত দিয়েই। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরত যাওয়ার মতো পুরো ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়েছিল বিএনপির হাত দিয়েই। আসলে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন বা সংস্কারগুলো এখন পর্যন্ত বিএনপির হাত দিয়েই হয়েছে। বাকশালের পর বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফেরত এনেছিল বিএনপিই। এরপর এনেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। অনেক নতুন জিনিস এসেছিল বিএনপির হাত দিয়েই। যেমন ভ্যাট ব্যবস্থা প্রবর্তন। বাংলাদেশের আয় এক ধাক্কায় বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এই আইন।
বাংলাদেশ তার রাজনীতিতে এখনো- একজন জিয়াউর রহমানকে খুঁজে বেড়ায়। স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে নিজের মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষণা করা, যুদ্ধে আহত হওয়া- বাংলাদেশের একমাত্র সেনা অফিসার, যিনি দুদেশের জীবিতদের মধ্যে একমাত্র সর্বোচ্চ খেতাবধারী ছিলেন। খাল খনন এবং আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের আমদানি তিন ভাগের দুই ভাগ কমিয়ে এনেছিলেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথাও তার মাথা থেকে আসে, যা এখন চরমভাবে ব্যর্থ। গার্মেন্ট দিয়ে দেশের পুরো অর্থনীতির মোড় ঘোরানোর শুরু তার হাতে। আবার ছিলেন সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম জিয়ার চরিত্রহননের বহু গল্প বানালেও তার সততাকে কখনোই প্রশ্ন করতে পারেনি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর একজন গৃহিণী বেগম খালেদা জিয়া দায়িত্ব নেন। সেই খালেদা জিয়াই এখন বাংলাদেশের ঐক্যের প্রতীক। তার আপসহীন এবং হার না মানা চিন্তা-ভাবনা থেকে দেশের মানুষের অনেক কিছু শেখার আছে। তার শাসনামলের প্রধান লক্ষ্যই ছিল- দেশকে শিক্ষা এবং অর্থনীতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। অসুস্থ খালেদা জিয়ার পর দলের হাল এখন তারেক রহমানের হাতে। তার সবচেয়ে বড় সাফল্য দলকে এত অত্যাচারের মধ্যেও এক রাখতে পারা এবং দলকে একটা উদারপন্থি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে টিকিয়ে রাখা। ৩১ দফা ঘোষণার মাধ্যমে দেশের সংস্কার যে প্রয়োজন তা আসলে বিএনপিরই ঘোষণা।
বিএনপির সবচেয়ে বড় দুই সমস্যার একটি লাগামছাড়া তৃণমূল। প্রতিটি আসনে দুয়ের অধিক প্রার্থী। নিজেদের দলাদলিতে ভুক্তভোগী হচ্ছে মানুষ। তারা তিন হাজারের বেশি বহিষ্কার করেছে, তাও পারছে না। মানুষ ভাবছে এটা একমাত্র সম্ভব তারেক রহমান দেশে এসে দলের দায়িত্ব নিলে। বিএনপির উচ্চ আত্মবিশ্বাস আরেকটা ক্ষতি হতে পারে। ফলে অনেকেই ধরাকে সরা জ্ঞান করে, অনেকে ভোটারদের বিরক্তের কারণ হচ্ছে। এই সমস্যাগুলো কিন্তু বিএনপি দল হিসেবেই কিছুটা সমাধান করতে পারত। তাদের যদি একটা রেজিস্টার্ড মেম্বার লিস্ট থাকত এবং যা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা থাকত, বাইরের থেকে কেউ এসে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করে যেতে পারত না। এদিকে দলে অনেকদিন কাউন্সিল না হওয়ায় নেতাদের মধ্যে মানুষের কাছে জবাবদিহির কালচারটাও হারিয়ে গেছে। জিয়াউর রহমানের সময়ে দলের ভেতরের গণতন্ত্র অনেক বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। দলে তরুণ নেতৃত্ব আনতে হবে, করতে হবে পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে মূল্যায়ন। ডাকসুতে যেমন চমৎকার একটা প্যানেল হয়েছে, এ রকম প্রার্থী হতে হবে দেশজুড়েই। বিএনপিকে জনমানুষের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। রাজনৈতিক দল মানেই গণমানুষের, তাই সবাই যাতে যোগাযোগ করতে পারে, একটা হেল্প সেন্টার, সঙ্গে ই-মেইল অ্যাকসেস থাকতে হবে। সেই অনুযায়ী নিতে হবে ব্যবস্থা। বাংলাদেশের ভালো থাকা আসলে কীভাবে জানি বিএনপির সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে। তাই আমাদের ভালোর জন্যই বিএনপির ভালো করতে হবে, ভালো থাকতে হবে এখন। খেয়াল করে দেখবেন, বিএনপির সফলতার লিস্টে কোনো উন্নয়নকাজ নেই, বরং সব কাজই সংস্কারমূলক। এবারও বিএনপি প্রায় সব বড় সংস্কারসহ ৯৪ শতাংশ প্রস্তাব পুরোপুরি বা আংশিক মেনে নিয়েছে। একটাই বড় সংস্কারে দ্বিমত আছে- আনুপাতিক উচ্চকক্ষ, কে জানে এখন পর্যন্ত একমাত্র প্রমাণিত সংস্কারক দল বিএনপির হাত ধরেই হয়তো আনুপাতিক উচ্চকক্ষ আসবে, কিন্তু কারও প্রেশারে নয়। দলের গঠনতন্ত্র সংস্কারসহ গণতন্ত্রে ফিরে আসাসহ আমরা হয়তো আগামী ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আগেই অনেক নতুন কিছু দেখতে পাব।
অতীতের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। দেশে যেন একক ব্যক্তির স্বৈরাচারী শাসন ফিরে আসতে না পারে, সে জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন হবে। অতীতে যা ঘটেছিল, সেগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। অপশাসন, বিচারহীনতা, দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচার যেন না ঘটে। যারা এসব অন্যায় করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারের জন্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করতে হবে। বিকৃত, নিম্নমানের, প্রতিহিংসামূলক ও ল্যাং মারার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বদল আনতে হবে। এটি পরিবর্তন দুরূহ ও কষ্টসাধ্য। কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন, এ বিষয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকারের বরখেলাপ করে। ২০০৮ সালের আগেও দলগুলো রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলের কথা বলেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারে সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্ব আসেনি । ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধি নেই। প্রশাসন যারা ভালো বোঝেন, এমন কেউ নেই। গণমাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এটাকে আরও সম্প্রসারিত করা সম্ভব। পরিবর্তিত পটভূমিতে মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ ও অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। তাই রাষ্ট্র সংস্কারের প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য যৌক্তিকভাবে যতটুকু সময় প্রয়োজন হবে, তা রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নিতে হবে। তারপর ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতেই হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির নতুন করে সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশের তরুণেরা ২০২৪ সালের আগের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশকে ফিরে যেতে দেবে না। আগামীর বাংলাদেশে তরুণেরাই রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ও গুণগত পরিবর্তন আনবে। বাংলাদেশে শিক্ষাগত বৈষম্য সবচেয়ে গুরুতর। এখানে অল্প একটা গোষ্ঠী উন্নত শিক্ষা পেয়ে থাকে। এর থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো শুরু করা না গেলে এই সংকট আগামী দশকেও এই অঞ্চলের মানুষকে ভোগাবে । তাই রোহিঙ্গাদের নিয়ে আগামী সাত-আট বছর সামনে রেখে একটি পরিকল্পনার ওপর জোর দিতে হবে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক দক্ষিণের জন্য আশার আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের শ্রমিকনির্ভর অর্থনীতির ওপর নির্ভর না করে জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে । সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশের বিপুল যে সম্ভাবনা রয়েছে তা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু ঝুঁকির প্রশ্নে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা আসিয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ইতিবাচক সম্ভাবনা রয়েছে । রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশ আসিয়ানকে পাশে পাবে।
আমলাতন্ত্রকে আরও বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করতে হবে। একজন সচিব কী সুবিধা পান, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, পদায়ন- প্রশাসনে এসব ছোট বিষয়। আমলাতন্ত্রকে আরও বৃহৎ পরিসরে দেখা উচিত। বিশ্ববাণিজ্য সংস্কার (ডব্লিউটিও) সম্মেলনে সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ভূমিকা রাখতে পারছেন কি না, অন্যান্য বড় চুক্তি ও সম্মেলনে সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ভূমিকা রাখতে পারছেন কি না, তা দেখা উচিত। রাজনৈতিক সংস্কার বাদ দিয়ে প্রশাসনকে সংস্কার করা যাবে না। রাজনৈতিক দলেই জবাবদিহি নেই। তাহলে প্রশাসন কার কাছে জবাবদিহি করবে। সিটি করপোরেশন থাকতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রয়োজন কেন?
প্রশাসনে সংস্কার আনতে হলে আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সদিচ্ছা থাকতে হবে। দেশে এত বিসিএস ক্যাডারের প্রয়োজন নেই। প্রশাসনে রাজনীতিকরণের কারণে গত দেড় দশকে কী হয়েছে তা , বিগত সময়ে সংস্কার কমিশন থেকে সুন্দর সুন্দর প্রস্তাব এসেছে; কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। প্রশাসন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারা নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। বিগত সময়ের সংস্কার কমিশনের সুপারিশ কেন বাস্তবায়িত হয়নি, তা খতিয়ে দেখা। নতুন করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের কোনো দৃশ্যমান বৈঠক দেখা যায়নি। এসব সুপারিশ নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করবে। তাই রাজনৈতিক দলকে নিয়ে কমিশনকে বসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধসহ দেশে অনেক যুদ্ধ ও সংগ্রাম হয়েছে; কিন্তু আমরা সেসব সংগ্রামের ফসল তুলতে পারিনি। দেশ স্বাধীনের পর ২৬ বার জনপ্রশাসন সংস্কারে কমিশন হয়েছে; কিন্তু সেসব কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। এসব সুপারিশকে বাস্তবায়ন করবে? রাজনৈতিক দল করবে। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠিত হয়নি। দেখা গেল, সংস্কার কমিশন হয়তো বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরল। কিন্তু সেটা যদি বাস্তবায়ন না করে বসে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যদি কানে তুলা দিয়ে বসে থাকে। হয়তো তারা কান থেকে তুলা খুলে বলবে, কিছু শুনিনি। তাই সবার আগে রাজনৈতিক সংস্কার জরুরি। রাজনৈতিক দলের সংস্কার ছাড়া জনপ্রশাসনের সংস্কার হবে না। জনপ্রশাসনে সংস্কার আনতে হলে রাজনৈতিক দলে সংস্কার আনতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।