আজ সেই মহিমান্বিত দিন। সারা জাহানের মুসলমানদের জন্য অতি আনন্দ আর রহমতের দিন। দোজাহানের শান্তি ও কল্যাণের দূত নবীকুল শিরোমণি , আখেরি জমানার শেষ নবী, হাবিব এ খোদা, মহানবী হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পৃথিবীর বুকে আগমণ ও ইন্তেকালের অবিস্মরণীয় দিন ১২ রবিউল আউয়াল। মুসলমানদের কাছে বিশেষ মর্যাদা আর গুরুত্ববহ, সব ঈদের সেরা ঈদ ‘ঈদ এ মিলাদুন নবী’ বা নবী দিবসের আনন্দের দিন।
দিনটি শুধু মুসলমানদের কাছে নয়, সমস্ত পৃথিবীর মানবজাতির কল্যাণ ও পরকালের মুক্তির দূত হিসেবে মহান রাব্বুল আলামিনের রহমত স্বরূপ তিনি ধরা পৃষ্টে অবতীর্ণ হন। মহান আল্লাহ সব নবীদের উদ্দেশ্য যাকে আল্লাহর রহমত বা রহমাতুল্লিল আলামীন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তার শান আর কুদরতকে সবার সমগ্র মানবজাতির পথ প্রদর্শক ও পরকালীন মুক্তির জন্য শাফায়াতকারী হিসেবে খোদার পক্ষ থেকে স্বীকৃত হয়েছেন। সুবহানাল্লাহ।
আজ সেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব, দোজাহানের শান্তি ও মুক্তির কান্ডারি হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম তিথিতে সমস্ত প্রকৃতি ও মানব সমাজ যেন সমস্বরে গাইছে:
ইয়ানবী সালামু আলাইকা
ইয়া রাসুল সালামু আলাইকা
ইয়া হাবীব সালামু আলাইকা
সালাওয়া তুল্লা আলাইকা।
অনেকগুলো কারণেই নবীজির জন্মদিনটি তামাম পৃথিবীতে, সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি মহিমান্বিত দিন।
হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মা আমেনার কোল আলোকিত করে যখন আরবের ধূসর মরুভূমিতে শান্তির বারি হয়ে ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট, সোমবার, চন্দ্রমাসের ১২ রবিউল আউয়ালে জন্ম গ্রহণ করেন তখন সমগ্র আরব দেশ ও আরব জাতি ছিল জঘন্য বর্বরতা আর পাপাচারে নির্মগ্ন। পৃথিবীর ইতিহাসের ওই সময়টাকে বলা হতো- আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগ। গোত্র বিদ্বেষ, বর্ণবিরোধ, হানাহানি, খুনখারাপি, কন্যা শিশু হত্যা, ব্যাভিচার, পরস্পরের প্রতি সম্মান, সহানুভূতি, মানবতা প্রদর্শন না করা ছিল নৈমিত্তিক কাণ্ড। বিশেষত পোত্তলিকতা আর নারীবিদ্বেষ ছিল চরম পর্যায়ের। তারা পূর্ববর্তী নবীদের দেখানো পথ থেকে দূরে সরে গিয়ে একেশ্বরবাদীতার স্থলে বহু ঈশ্বর বাদীতায় লিপ্ত হয়ে পরকাল ভুলে গিয়ে ছিল। খোদার শাস্তির কথা মনে না রাখায় কঠিন কঠিন পাপের বোঝায় তারা লিপ্ত হয়ে যায়। আরব ও বিশ্ববাসীর এমন এক পঙ্কিল সময়ে বিশ্বমানবতা আর পরকালের মুক্তির দূত হিসেবে মহান রাব্বুল আলামিন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন মা আমেনার কোলে সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহর রহমত ও হেদায়েত হিসেবে। আলহামদুলিল্লাহ। একটা অন্ধকার যুগে আলোর প্রদীপ হয়ে জন্ম নেয়া এই মহা মানবের আবির্ভাবের দিনটি তাই সমগ মুসলিম জাহানে সব চেয়ে আনন্দের দিন। ঈদ এ মিলাদুন নবী।
যার আগমন ঘিরে এমন একটি শুভ ও আনন্দময় দিন আমরা পেলাম আজ সেই মহা মানবের জীবনী নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) আমার প্রিয় নেতা। কেননা তিনি আইয়ামে জাহেলিয়ার সেই অন্ধকার যুগে এসেও আরবের বুকে সত্যের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে সকল অন্ধকার দূর করেছেন। যখন মানবসমাজ এক চরম অধঃপতনে পৌঁছেছিল, তখন তিনি মুক্তির দ্যূত হয়ে এ ধরাধামে আগমন করেছিলেন। মানব কল্যাণে তার অবদান অতুলনীয়।
জন্ম ও বংশ পরিচয়:
৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট সোমবার সুবহে সাদেকের সময় পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। আরবের সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশের কুল শ্রেষ্ঠ হাশেমী গোত্রে তার জন্ম।
আদর্শ সমাজ সংস্কারক নেতা মহানবী (সা.):
মানব সভ্যতার ইতিহাসে মহানবী (সা.) বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নেতা ও আদর্শ সমাজ সংস্কারক তা সর্বজনস্বীকৃত। একটি অধঃপতিত আরব জাতিকে সুসভ্য জাতিতে পরিণত করার বিরল কৃতিত্ব কেবল তারই।
জাহেলিয়াতের ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত আরব সমাজকে তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানামুখী সংস্কারের মাধ্যমে একটি আদর্শ সমাজে পরিণত করতে সক্ষম হন। একটি আদর্শ সমাজ নির্মাণে মহানবী (সা.) যেসব গুণ অর্জন ও সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন তা নিচে উপস্থাপন করা হলো:
আল আমীন উপাধি লাভ:
একজন আদর্শ নেতার প্রধান গুণ সততা। আর ছোটকাল থেকেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) এ গুণের অধিকারী ছিলেন। সততা, মহত্ত্ব, ন্যায়পরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার কারণে আরববাসী তাকে ‘আল আমীন’ বলে ডাকত।
মদিনায় হিজরত:
কুরাইশদের অত্যাচারের মাত্রা যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন মহানবী (সা.) আল্লাহর নির্দেশে স্বদেশ ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেন। ফলে ইসলাম প্রচারে যোগ হয় নতুন মাত্রা। শুরু হয় মহানবী (সা.)-এর মাদানী জীবন।
রাজনীতিবিদ:
মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বকালের সেরা রাজনীতিবিদ। বিশৃঙ্খলাপূর্ণ আরব সমাজে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কার সাধন করেন। মদিনায় রাষ্ট্র গঠন, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, মদিনা সনদ, হোদায়বিয়ার সন্ধি প্রভৃতি তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক।
কয়েকটি যুদ্ধ:
মদিনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে মক্কার কুরাইশরা শঙ্কিত ও ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র গঠন ও মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তার প্রতিরোধকল্পে বিধর্মীরা ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কয়েকটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর জীবন অনেক বৈচিত্রময়। যেমন পূর্ণময় আর পবিত্র তেমনি অমানবিক কষ্ট আর লাঞ্ছনার। নবুয়ত্ব লাভের পর থেকে ইসলাম প্রতিষ্ঠা, প্রচার ও প্রসারের জন্য নবীজির প্রাণান্তর প্রচেষ্টা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। তিনি নবুয়ত প্রাপ্তির আগ থেকেই যেমন ছিলেন নিষ্পাপ, বিশ্বাসী আর ঈমানদার। নবুয়ত প্রাপ্তির পর সেটা আরও বেড়ে যায়। মহান আল্লাহর প্রতি মানুষের বিশ্বাস আর পরকালের আজাবের প্রতি ভিতি তৈরির কাজটা ওই কাফের আর জাহেলিয়াত যুগে খুব সহজ ছিল না। নিজের এবং সাহাবীদের জীবন বাজী রেখে তাকে ইসলাম প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হয়েছে। সে জন্য শারীরিক ও মানসিক আঘাতের কোনো কমতি ছিল না। সব সহ্য করে নবীজি ইসলামকে আরব মরুভূমিতে সভ্যতার , মানবতা আর পরকালের মুক্তির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তার এই ত্যাগ আর আলোকিত জীবনকে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখতে পৃথিবীতে এই দিনটিকে মুসলমানরা বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উদযাপন করে। এই উপলক্ষে দোয়া-দরুদ, মিলাদ মাহফিল, নফল রোজা রাখার পাশাপাশি আনন্দ মিছিল বা জসনে জুলুসে বের হয়। এই ধরনের উদযাপন নিয়ে মুসলমানদের মাঝে তাই মত-বিরোধও ইদানীং লক্ষণীয়। কারণ, নবী সাহাবা বা খেলাফত যুগে দিবসটি এভাবে পালিত হতো না। তখন সোমবার দিন বা ১২ রবিউল আউয়ালে নবীজির মতো রোজা রাখা হতো। আর ছিল দোয়া-দরুদ। সালাম। কিন্তু ১২০০ শতাব্দীর পর থেকে মিসর ও তুরস্ক ও কিছু আরব ভূমিতে দিনটিকে ঈদের মর্যাদা দিয়ে উদযাপন শুরু হয়। কাল ক্রমে এটি অন্যান্য মুসলিম দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আনন্দ মিছিল বা জসনে জুলুস বের করার প্রবণতা এখন বাংলাদেশসহ পাকিস্তান, ভারত, আফগান, ইরান, ইরাকসহ অনেক মুসলিম দেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যার সঙ্গে দ্বিমত করছেন বহু আলেম ও স্কলারস। তাদের বক্তব্য হচ্ছে নবীজি যা করেননি বা করতে বলেননি তা ইসলামে জায়েজ নয়। ইসলামে বহু নবী-রাসুলের আগমন ঘটেছে কিন্তু কারোরই জন্মদিন পালনের নজীর নেই।
অন্যপক্ষ মনে করেন ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার নবীজির তিরোধান দিবসও বটে। পৃথিবীকে পূর্ণতার আলোয় ভরিয়ে দিতে যে নবীজি এলেন সেই নবী সমগ্র মানবজাতিকে এতিম করে, কাঁদিয়ে যেদিন চির বিদায় নিলেন সেই দিনটি আনন্দের হয় কী করে?
সে যাক আমরা কোনো তর্কে না গিয়ে বলতে পারি যে প্রক্রিয়ায় নবীজিকে উপযুক্ত মর্যাদা আর শান্তির প্রতীক হিসেবে সবার শীর্ষে আসীন রাখা যায় আমাদের সেই পথটাই অনুসরণ করতে হবে। এমন কিছুতেই উৎসাহিত করা ঠিক না যা নবীর মেহনত ও ইসলামের মর্যাদাকে খাটো করতে পারে।
আমাদের বিশ্বাস করতেই হবে যে, বড় সমাজ সংস্কারক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, মানবাধিকারের প্রবক্তা বিশ্বে আর দ্বিতীয় কেউ নেই। এ জন্য বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিরাও একথা স্বীকার করেছেন, রাসূল (সা.) ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মানুষ। বর্তমানেও তার এ নীতি অনুসরণের মাধ্যমেই কেবল পৃথিবীর যেকোনো সমাজকে আদর্শ সমাজে পরিণত করা সম্ভব।
আমরা সব সময় বলি:
‘তুমি না এলে দুনিয়ায়, আঁধারে ডুবত সবি।’ মহান আল্লাহ আমাদের সেই প্রিয় নবীর সঠিক মর্যাদা আর ইসলামকে সমুন্বত রাখার তৈফিক দিন। আমিন।
পরিশেষে দরুদ সেই পবিত্র স্বত্বার নবী মোহাম্মদের প্রতি:
বালাগাল উলা বি কামালিহি
কাসা ফাদ্দুজা বি জামালিহি
হাসানাত জামিয়্যু খেছালিহি
সাল্লা আলাইহি ওয়া আলিহি।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট।
সূরা সাজদাহ, পর্ব ২
অনুবাদ
(৪) আল্লাহ হলেন সেই সত্তা, যিনি আসমান ও জমীন এবং উভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তা ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমাসীন হন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবকও নেই এবং সুপারিশকারীও নেই। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? (৫) তিনি আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত সবকিছু পরিচালনা করেন। অতঃপর সবকিছু (বিচারের জন্য) তারই নিকট উপস্থাপিত হবে এমন এক দিনে যার দৈর্ঘ্য হবে তোমাদের হিসাবমতে এক হাজার বছর। (৬) তিনিই অদৃশ্য ও দৃশ্যমানের জ্ঞানী। তিনি মহাপরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। (৭) যে জিনিসই তিনি সৃষ্টি করেছেন উত্তমরূপে সৃষ্টি করেছেন এবং মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদা মাটি দিয়ে। (৮) অতঃপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস থেকে। (৯) তারপর তিনি তাকে সুঠাম-সুডৌল করেছেন এবং নিজের নিকট থেকে তাতে জীবন সঞ্চার করেন। তিনি তোমাদের দিয়েছেন কান, চোখ ও হৃদয়। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
মর্ম ও শিক্ষা
ইতোপূর্বে আল্লাহর কিতাব কুরআন নাজিলের বর্ণনা ছিল, যার মাধ্যমে রাসূল (স) মানুষকে সত্যের দাওয়াত দেন এবং আল্লাহর নাফরমানী সম্পর্কে সতর্ক করেন। তারপর এখানে আলোচ্য আয়াতসমূহে সে দাওয়াতী কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এতে রয়েছে আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদ, আল্লাহর সৃষ্টি, প্রতিপালন ও ব্যবস্থাপনা, কিয়ামত, আখিরাত ও আখিরাতের জবাবদিহিতার আলোচনা।
আল্লাহ গোটা সৃষ্টির স্রষ্টা
আল্লাহ হলেন সেই সত্তা যিনি আসমান, জমীন ও তার মধ্যে যা কিছু আছে অর্থাৎ গোটা সৃষ্টিতে যা কিছু আছে সবই সৃষ্টি করেছেন। গোটা সৃষ্টি জগত ও তার বাইরে এমন কেউ নেই যারা একটি জিনিসও সৃষ্টি করতে পারে। একটা তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র জিনিস সৃষ্টি করার ক্ষমতা কারো নেই। যিনি পৃথিবী, সৌরজগত ও মহা সৃষ্টির স্রষ্টা, তিনি আল্লাহ।
ছয় দিনে সৃষ্টির দ্বারা উদ্দেশ্য
আয়াতে ছয় দিনে সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ ছয় দিনে কেনো সৃষ্টি করেছেন, অনেকে এর ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন। কারণ আল্লাহ হও বললেই হয়ে যায়। নিমিষেই সব কিছু হয়ে যায়, তাহলে ছয়দিনের কিসে প্রয়োজন। আসলে এ বিষয়টি অন্য জগতের বিষয়। আমাদের পৃথিবীর জ্ঞান অনুযায়ী তা প্রকৃত কারণ জানা কঠিন। তাই কোনো ব্যাখ্যায় না গিয়ে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে আল্লাহ ছয়দিনে বা সময়ের ছয়টি এককে সৃষ্টি করেছেন। এর প্রকৃত অর্থ কি তা আল্লাহই ভালো জানেন।
আরশে আরোহণের মর্ম
গোটা জগতের সৃষ্টির পর আল্লাহ আরশে সমাসীন হন। সাধারণত দুনিয়ার দৃষ্টিতে আরশ হলো রাজা বাদশাদের সিংহাসন। কিন্তু এ সিংহাসন আর সেই সিংহাসন এক না। আরশের প্রকৃত অবস্থা পার্থিব জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ বলেন এটি একটি নূরানী সত্ত্বা। কিন্তু এর মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ ইসলামী জীবন-বিধান অনুসরণ করা আরশের অবস্থা জানার উপর নির্ভর করে না। এরপরে কথা হলো আরশে সমাসীন হওয়া প্রসঙ্গে। কোরআনে সাত জায়গায় আরশে সমাসীন হওয়ার কথা এসেছে। কিন্তু তার মর্ম নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক আছে। তা কি দৈহিক নাকি রূপক, এ নিয়ে অনেক কথা আছে। কেউ কেউ বলেন, আল্লাহর আরশে সমাসীন হওয়া দৈহিক, তিনি সদেহে আরশে আরোহন করেছেন। আর কেউ বলেন, আল্লাহর আরশে সমাসীন হওয়া দৈহিক নয়, কারণ আল্লাহ আরশের গন্ডি ও আওতার মধ্যে সীমিত নন। এছাড়া আরশ হলো আল্লাহর সৃষ্ট, অথচ তিনি আরশের পূর্ব থেকেই আছেন। যাই হোক এ ব্যাপারে বিতর্কের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এটা আমাদের পার্থিব জ্ঞানের বাইরে। আমাদের শুধু বিশ্বাস করতে হবে, আল্লাহ আছেন, তিনি এক ও একক, তিনি যেভাবে যেখানে আছেন, তাতেই আমরা বিশ্বাস করি।
কিয়ামত দিবস কতটুকু দীর্ঘ হবে
আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, কিয়ামত দিবস বা হিসেবের দিন হবে দুনিয়ার হিসেবে এক হাজার বছরের সমান। কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, তা হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। এ দুটির সংখ্যা দুই রকম হলেও ব্যাপারটি আসলে সাংঘর্ষিক নয়। বিভিন্ন মুফাসসির বিভিন্নভাবে এর ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথম, কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ এই যে কিয়ামতের দিনের দৈর্ঘ্য হবে এক হাজার বছরের সমান, তবে কিয়ামতের দিবসটি এতো কঠিন হবে যে তা মানুষের নিকট পঞ্চাশ হাজার বছরের সমানই মনে হবে। দ্বিতীয়, কিয়ামত দিবসের দৈর্ঘ্য বিভিন্ন মানুষের উপর নির্ভর করবে। যারা সৎ কর্মশীল তাদের জন্য সময় কম লাগবে। আর যারা পাপিষ্ঠ ও নাফরমান, তাদের সময় হবে অনেক বেশি।
আল্লাহ একই সঙ্গে মহাপরাক্রশালী এবং দয়ালু
আল্লাহ হলেন মহাপরাক্রশালী এবং পরম দয়ালু। যারা আল্লাহর অবাধ্য হয়, যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো শরিক স্থাপন করে, যারা আল্লাহর দ্বীনের বিরোধিতা করে এবং যারা সত্যপন্থিদের উপর নির্যাতন চালায়, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ অত্যন্ত কঠিন। তাদের জন্য আল্লাহর শাস্তি হবে অত্যন্ত কঠিন। অপরদিকে যারা মন-প্রাণ দিয়ে আল্লাহর পথে চলতে চায়, আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখতে চায়, কিন্তু তবুও মানবীয় দুর্বলতার কারণে তাদের বিচ্যুতি হয়ে যায়, আল্লাহ তাদের প্রতি হবেন করুণাময়। তাদেরকে করুণা করে ক্ষমা করে দিবেন। আর আল্লাহর এ দুটি গুণ দুনিয়ার বেলায়ও প্রযোজ্য। কোনো জাতি যখন সীমালঙ্ঘন করে যায়, আল্লাহ তাদেরকে ধরেন এবং পাকড়াও করেন। অনেক জাতি এভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। যেমন, লূত (আ)-এর জাতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে এবং তার ধ্বংসাবশেষ এখনও জর্ডানের মৃত সাগরে বিদ্যমান আছে। অপরদিকে যারা দুনিয়াতেও আল্লাহর পথে থাকে, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে, আল্লাহ তাদের বিপদে সাহায্য করেন, করুণা করেন, বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।
আল্লাহর গোটা সৃষ্টিই নান্দনিক
আল্লাহ প্রতিটি সৃষ্টিকে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যে গড়ে তুলেছেন। মানবদেহের অঙ্গ থেকে শুরু করে প্রকৃতির প্রাণী-পক্ষী ও সমুদ্রের জীবজন্তু-সবকিছুতেই তার নিখুঁত কুদরতের নিদর্শন ফুটে ওঠে। বাহ্যিক রূপের মতোই অভ্যন্তরীণ গঠনও বিস্ময়করভাবে সাজানো। আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য ভালোবাসেন এবং মানুষের কাছ থেকে সুন্দর আচরণ ও সুন্দর ইবাদত কামনা করেন।
মানব সৃষ্টির সূচনা
আল্লাহ মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন মাটি দিয়ে। আল্লাহ আদম (আ)-কে মাটি দিয়ে তৈরী করেন। এরপর আদম সন্তানকে সৃষ্টি করেন শুক্র কণা থেকে, যা তৈরি হয় মানুষের খাবার ও রক্ত থেকে। বলাবাহুল্য, এ খাবারও মাটিতেই উৎপন্ন হয়। কাজেই প্রথম মানবের সৃষ্টি এবং পরের মানবের সৃষ্টির উৎসমূলে রয়েছে মাটি।
মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়
আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ মানুষকে সঠিক অবয়ব দান করেছেন এবং জীবন দিয়েছেন, পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়েছেন। আল্লাহ মানুষকে তৈরি করেছেন সুন্দরতম অবয়বে। মানুষকে মেধা দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। এ মেধা দিয়ে ছোট্ট একটা মানুষ অনেক বড় প্রাণীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। মানুষ নতুন নতুন উদ্ভাবন করতে পরে। যদিও মানুষের মেধার মধ্যে এ উদ্ভাবণী শক্তি আছে, কিন্তু তাও মানুষ স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারে না। যখন যতটুকু উদ্ভাবণী শক্তি প্রয়োজন হয়, তখন আল্লাহ সে উদ্ভাবণী শক্তিকে ব্যবহারের যোগ্যতা দান করেন এবং মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে। আল্লাহ বলেছেন, সকল প্রাণীর জীবিকা আল্লাহর দায়িত্বে। এখন থেকে শতাব্দী পূর্বেও কোনো কোনো দেশ বলেছে, মানুষের প্রবৃদ্ধি যেভাবে হচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে তাদের খাবার থাকবে না এবং মানুষ উপোষ করে মারা যাবে। কিন্তু আল্লাহ মানুষের উদ্ভাবণী শক্তিকে কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তার ফলে যেখানে মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে, তিনগুণ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদন হচ্ছে তার চেয়েও বেশি। এ সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪ বছরের ইতিহাস কেবল শিক্ষার ইতিহাস নয়, বরং এ দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। এই ইতিহাসের কেন্দ্রে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, ডাকসু। ১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে শুরু হওয়া ডাকসুর পথচলা দীর্ঘ শতাব্দী ধরে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার, নেতৃত্ব বিকাশ ও জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখার এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও শত বছরের মধ্যে হয়েছে মাত্র ৩৭ বার। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে নির্বাচনের সংখ্যা মাত্র সাতবার। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে কতটা অবহেলা, দলীয় প্রভাব ও দখলদারিত্বের কারণে একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রথমদিকে ডাকসু মূলত সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণকেন্দ্রিক একটি মঞ্চ ছিল। কিন্তু পঞ্চাশের দশক থেকে এটি পরিণত হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্মভূমিতে। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান কিংবা মুক্তিযুদ্ধ—সবখানেই ডাকসুর ভূমিকাই ছিল কেন্দ্রীয়। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, পরবর্তীকালে ছাত্রদল—সব সংগঠনের নেতারা ডাকসুর মঞ্চ থেকে উঠে এসেছেন। সে কারণে ডাকসু কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সংসদ নয়, বরং জাতীয় রাজনীতিরও প্রতিফলন। ডাকসুর রাজনৈতিক উত্থানের সূচনা হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই আন্দোলনের মূল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ডাকসুর তৎকালীন নেতারা সামনের সারিতে ছিলেন। এরপর ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, যার সূত্রপাতও হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হাত ধরে, ডাকসুর নেতৃত্বেই তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই আন্দোলনের তীব্রতা এতটাই ছিল যে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ডাকসুর ভূমিকা ছিল আরও সুদূরপ্রসারী। তৎকালীন ডাকসুর মঞ্চে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়েছিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিতে। এই সময়ের ডাকসু নেতারা কেবল ছাত্রনেতা ছিলেন না, তারা ছিলেন জাতির মুক্তির দিশারী।
স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক দলগুলোর দখলদারিত্ব ডাকসুকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেয়। ১৯৭২-৭৩ শিক্ষাবর্ষের নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মাহবুব জামান ভিপি-জিএস নির্বাচিত হলেও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়নি। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের দ্বন্দ্ব নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ভেঙে দেয়। এর পর থেকে অনিয়ম, সহিংসতা ও স্থগিতকরণই হয়ে ওঠে ডাকসুর নিয়তি। সত্তর ও আশির দশকে ডাকসুতে নেতৃত্ব দিয়েছেন আমান উল্লাহ আমান, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মনসুর আহমদ প্রমুখ, যারা পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্র ফিরে এলেও ডাকসু নিয়মিত নির্বাচনের মুখ দেখেনি। কারণ সহজ—ক্ষমতাসীন দলগুলো ভয় পেত, নির্বাচনে তাদের ছাত্রসংগঠন হারলে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ হারাবে। গত তিন দশকের অভিজ্ঞতাই সেই আশঙ্কা সত্য করেছে। ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুরু করে। গেস্টরুম ও গণরুম সংস্কৃতি চালু হয়, যেখানে নতুন শিক্ষার্থীরা জোরপূর্বক রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে বাধ্য হয়। শিক্ষার্থীদের ওপর দলীয় চাপ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এক নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা তাদের কণ্ঠস্বর প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হারিয়ে ফেলে, এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় দলীয় প্রভাব বিস্তারের একটি কেন্দ্রে।
দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হলেও তা আস্থাহীনতার জন্ম দেয়। সহিংসতা, কারচুপি এবং প্রশাসনিক পক্ষপাতের অভিযোগে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপার ভর্তি ব্যাগ পাওয়ার ঘটনা, এবং নির্বাচনের দিন বিভিন্ন কেন্দ্রে ছাত্রলীগের বহিরাগতদের উপস্থিতি ও বলপূর্বক ভোট দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। নুরুল হক নুর ভিপি নির্বাচিত হলেও ছাত্রলীগ অধিকাংশ পদে জয়ী হয়। নির্বাচনের পর ডাকসু প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের মৌলিক সমস্যা সমাধানে খুব একটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেননি, যার ফলে শিক্ষার্থীরা মনে করে ডাকসু আর তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে না, বরং এটি দলীয় স্বার্থের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই ব্যর্থতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্ররাজনীতি ও ডাকসু সম্পর্কে এক গভীর হতাশা তৈরি করে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গণঅভ্যুত্থান ক্ষমতার সমীকরণ পাল্টে দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দীর্ঘ দখলদারিত্ব ভেঙে পড়ে। শিক্ষার্থীরা গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতি, জোরপূর্বক মিছিলে অংশগ্রহণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। এ পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের নতুন করে প্রত্যাশা তৈরি করেছে। এবারকার নির্বাচনের মূল ইস্যু হলো দখলদারিত্বের অবসান, গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতির সমাপ্তি, সুলভ মূল্যে ক্যানটিনে খাবার, এবং একটি শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাস। নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আহমেদ সজীবের ভাষায়, ‘সবাই যাতে প্রথম বর্ষে এসেই হলে সিট পান, গণরুম-গেস্টরুম যাতে আর ফিরে না আসে, ক্যানটিনে সুলভ মূল্যে ভালো খাবার পাওয়া যায়—এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন, এমন প্রতিনিধিই আমরা চাই।’ এই বক্তব্যটি কেবল একজন শিক্ষার্থীর নয়, এটি হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মনের কথা।
এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ৩৯,৭৭৫ জন। ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৭১ জন প্রার্থী, এর মধ্যে ৬২ জন নারী। সদস্য পদে প্রার্থী সংখ্যা সর্বাধিক—২১৭ জন। পাশাপাশি ১৮টি হল সংসদে মোট ১,০৩৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রতিটি পদে একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যা গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার বার্তা বহন করে। এই নির্বাচনের মূল বিষয়গুলো কেবল রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা সরাসরি শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের একক আধিপত্যে ক্যাম্পাসে যে গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতি, রাজনৈতিক চাপ ও সহিংসতা ছিল, তার অবসানই এবারের নির্বাচনের প্রধান এজেন্ডা। বিভিন্ন প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের প্রচারে এই বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন।
ভিপি পদের জন্য এবার ৪৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আবিদুল ইসলাম খান (ছাত্রদল), উমামা ফাতেমা (স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য), সাদিক কায়েম ও ইয়াসিন আরাফাত। জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৯ জন, যার মধ্যে রয়েছেন আবু বাকের মজুমদার (বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ), তানভীর বারী হামিম, এস এম ফরহাদ এবং অন্যরা। এই বিশালসংখ্যক প্রার্থীর মধ্যে কে বিজয়ী হবেন, তা বলা কঠিন, তবে শিক্ষার্থীদের মূল মনোযোগ হলো এমন প্রার্থীদের দিকে, যারা দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে পারবেন। স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা তার বক্তব্যে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ এবং ডাকসুর হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচিত হলে সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীতের স্বাক্ষর রাখার চেষ্টা করব। তবে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানকেন্দ্রিক বিষয়গুলোকে আমরা অগ্রাধিকার দেব।’ উমামার এই বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে তারা কেবল বড় রাজনৈতিক ইস্যুতেই নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদা যেমন—হলগুলোতে সিট নিশ্চিত করা, ক্যানটিনে মানসম্পন্ন ও সুলভ মূল্যে খাবার সরবরাহ, এবং একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস পরিবেশ তৈরির দিকেও গুরুত্ব দেবেন। অন্যদিকে, ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান সরাসরি গণরুম ও গেস্টরুম সংস্কৃতির নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হলে প্রথম কাজ হবে ক্যাম্পাসে এবং হলগুলোতে আর কখনো গণরুম ও গেস্টরুমের সংস্কৃতি ফিরে আসতে দেব না।’ আবিদুলের এই বক্তব্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে, কারণ এই সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের এক প্রধান উৎস ছিল। আরেকজন ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম তার প্রার্থিত্বকে শিক্ষার্থীদের মূল সমস্যা সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করার প্রতিশ্রুতি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে ক্যাম্পাসের সকল শিক্ষার্থী যেন সমান সুযোগ পান, বিশেষ করে হল সিট বরাদ্দ ও ক্যানটিনের সুলভ খাবার সংক্রান্ত ক্ষেত্রে। এছাড়া তিনি শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার এবং গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতি নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইয়াসিন আরাফাত নামের আরেকজন ভিপি প্রার্থী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়ন, সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার বিকাশ এবং হল সংসদ কার্যক্রমকে আরো কার্যকর করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের সমস্যা ও দাবি সমাধানের জন্য প্রতিনিয়ত কার্যক্রম গ্রহণ এবং সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্যানেল, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের জিএস প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার ডাকসুকে তার পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ডাকসুকে সেই পুরোনো গৌরবের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে চাই।’ এই প্যানেল মূলত জুলাই মাসের গণআন্দোলনের চেতনাকে সামনে রেখে গঠিত হয়েছে এবং তাদের মূল লক্ষ্য হলো ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা।
ডাকসুর গঠনতন্ত্র শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক, ক্রীড়া, সামাজিক কার্যক্রম ও প্রকাশনা কাজে জোর দেয়। ২০২৫ সালের জুনে সিন্ডিকেট নতুন তিনটি সম্পাদকীয় পদ সংযোজন করেছে—মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক এবং ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক। বয়সসীমাও তুলে নেওয়া হয়েছে। এসব পরিবর্তন ডাকসুকে আরও সময়োপযোগী করে তুলতে পারে। প্রশ্ন একটাই—এ নির্বাচন কি সত্যিই সুষ্ঠু হবে? দলীয় প্রভাব কি আবারও গ্রাস করবে? স্বাধীনতার পর থেকে অন্তত ৭৫টি খুন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যার বড় অংশ দলীয় দখলদারিত্বের ফল। সাড়ে ১৫ বছর ছাত্রলীগের দখলে নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তাই এবারের নির্বাচন শিক্ষার্থীদের মুক্তির পথ হতে পারে। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তবে ডাকসু আবারও শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠতে পারে। অন্যথায় এটি আরেকটি দলীয় যন্ত্রে পরিণত হবে।
ডাকসু নির্বাচন কেবল শিক্ষার্থীদের ভোটের লড়াই নয়, বরং হারানো গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণের সন্ধিক্ষণ। এটি শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণের লড়াই, দখলদারিত্বমুক্ত ক্যাম্পাসের লড়াই এবং আগামী দিনের নেতৃত্ব গড়ে তোলার লড়াই। যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, তবে ডাকসু আবারও হয়ে উঠবে সেই কেন্দ্র যেখানে গড়ে উঠবে আগামী দিনের জাতীয় নেতৃত্ব, বিকশিত হবে সংস্কৃতি ও ক্রীড়া, এবং গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক। আর যদি ব্যর্থ হয়, তবে শিক্ষার্থীদের আস্থাহীনতা আরও গভীর হবে, যা দেশের ভবিষ্যতের জন্যও অশনিসংকেত।
রাজু আলীম
কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
মানব জীবনের টিকে থাকার মূল ভিত্তি হলো খাদ্য, পানি, বায়ু এবং প্রকৃতি। এ চারটি উপাদান ছাড়া জীবন কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতি, অতিরিক্ত শিল্পায়ন, জনসংখ্যার চাপ, নগরায়ণ এবং পরিবেশ দূষণের কারণে আজ এ মৌলিক উপাদানগুলো বিপর্যয়ের মুখে। টেকসই ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য, পানি, বায়ু ও প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করা এখনই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
খাদ্য সুরক্ষা: খাদ্য হলো মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ অপুষ্টি ও রোগব্যাধিতে ভুগছে। কৃষিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত উপাদান জমছে, যা মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অপরদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খাদ্য উৎপাদন হুমকির মুখে। বাংলাদেশসহ বহু দেশে খরা, বন্যা, লবণাক্ততা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। খাদ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন জৈব কৃষি সম্প্রসারণ, নিরাপদ খাদ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা, কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ এবং খাদ্য অপচয় রোধ। পাশাপাশি খাদ্যপণ্যে ভেজাল ও রাসায়নিক ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
পানি সুরক্ষা: পরিষ্কার ও নিরাপদ পানি মানুষের সুস্থ জীবনের অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন, শিল্প বর্জ্য, কীটনাশক, এবং প্লাস্টিক দূষণের কারণে পানির গুণমান দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ ইতোমধ্যেই লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির স্বল্পতা ও লবণাক্ততা বেড়ে চলেছে। পানি সুরক্ষার জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, নদী ও খাল পুনরুদ্ধার, পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগ এবং পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কার্যকর বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন বাধ্যতামূলক করা জরুরি।
বায়ু সুরক্ষা: বায়ুদূষণ বর্তমানে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম বড় কারণ। যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্প কারখানার নির্গমন, নির্মাণকাজ এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বায়ুকে বিষাক্ত করে তুলছে। ঢাকাসহ বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে বায়ুর মান বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে গেছে, যার ফলে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ফুসফুস ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বায়ু সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার, গাছ লাগানো, গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, যানবাহনে মানসম্মত জ্বালানি ব্যবহার এবং শিল্প বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ। একই সঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে।
প্রকৃতি সুরক্ষা: প্রকৃতি আমাদের জীবনের মূল সহায়ক। বন, নদী, পাহাড়, প্রাণীজগত এবং জীববৈচিত্র্য আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। কিন্তু বন উজাড়, পাহাড় কাটা, নদী দখল, প্লাস্টিক দূষণ এবং প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বাড়ছে। প্রকৃতি সুরক্ষার জন্য বন সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ, নদী ও জলাশয় রক্ষা, বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইন কার্যকর করা এবং টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অপরিহার্য। একই সঙ্গে মানুষের ভোগবাদী মনোভাব পরিবর্তন করে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
খাদ্য, পানি, বায়ু এবং প্রকৃতি, এ চারটি উপাদানই মানবজীবন ও পৃথিবীর টেকসই অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এগুলোর সুরক্ষা ছাড়া স্বাস্থ্য, অর্থনীতি কিংবা উন্নয়নের কোনোটিই সম্ভব নয়। তাই সরকার, নাগরিক সমাজ, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিটি মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব নীতি ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। এখনই যদি আমরা সচেতন হই এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করি, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী নিশ্চিত করা সম্ভব।
নীতি নয়, বাস্তবায়ন জরুরি:
পরিবেশ সুরক্ষায় নীতি নয়, এখন কার্যকর বাস্তবায়ন জরুরি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই পরিবেশ সুরক্ষার জন্য নানা ধরনের নীতি, আইন ও কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। কাগজে-কলমে এই নীতিগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, তবে বাস্তবতায় এগুলোর প্রভাব খুব সীমিত। বন উজাড়, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, কৃষিজমি কমে যাওয়া, প্লাস্টিক বর্জ্যের বিস্তার, নদী দখল ও ভরাট, এসব সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে কার্যকর বাস্তবায়নের ঘাটতি। শুধু নীতি প্রণয়ন করলেই পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয়, এর জন্য শক্তিশালী প্রশাসনিক পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতার সমন্বিত প্রয়োগ জরুরি। নীতিগত কাঠামোতে পরিবেশের সুরক্ষা প্রাধান্য পেলেও বাস্তবে দেখা যায় শিল্প-কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই নদীতে ফেলা হচ্ছে, নগরীতে নিয়ম ভঙ্গ করে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে এবং বনভূমি ক্রমাগত ধ্বংস হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে আইন থাকা সত্ত্বেও কার্যকর তদারকি ও কঠোর শাস্তির অভাব সমস্যাকে গভীরতর করেছে। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য এখন সবচেয়ে প্রয়োজন নিয়মিত মনিটরিং, জবাবদিহি ও শাস্তির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। এছাড়া, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া টেকসই পরিবেশ সুরক্ষা সম্ভব নয়। শিক্ষা, গণমাধ্যম এবং প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। একই সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, বর্জ্য পুনর্ব্যবহার এবং সবুজ শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কাঠামো দাঁড় করাতে হবে। অতএব, পরিবেশ সুরক্ষার জন্য নতুন নতুন নীতি নয়, বরং বিদ্যমান আইন-কানুন ও নীতির কঠোর ও কার্যকর বাস্তবায়নই এখন সময়ের দাবি। কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে আমাদের পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, সবাই নিরাপদ থাকবে।
টেকসই উন্নয়নে চাই জীবনধারায় বিবর্তন:
টেকসই উন্নয়নের জন্য জীবনধারায় বিবর্তন আনতে হবে। বর্তমান বিশ্ব দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তবে এই অগ্রযাত্রা অনেক ক্ষেত্রেই পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের হ্রাস, পানির অভাব, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং দূষণের মতো সংকটগুলো আমাদের উন্নয়নের ধারা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ পরিস্থিতিতে টেকসই উন্নয়ন আর কেবল একটি বিকল্প নয়, এটি এখন বেঁচে থাকার শর্ত। আর টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যক্তি ও সমাজ উভয় পর্যায়েই জীবনধারায় পরিবর্তন বা বিবর্তন অপরিহার্য।
প্রথমত, ভোগবাদী মানসিকতা থেকে সরে আসতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোগ না করে ‘স্মার্ট কনজাম্পশন’ বা সচেতন ভোগ নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য, পানি ও শক্তির অপচয় রোধ করা প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব। যেমন, খাবারের অবশিষ্টাংশ ফেলে না দিয়ে সঠিকভাবে ব্যবহার, পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অপচয় বন্ধ করা ইত্যাদি অভ্যাস দৈনন্দিন জীবনে গড়ে তুলতে হবে।
দ্বিতীয়ত, পরিবেশবান্ধব জীবনধারা গ্রহণ করতে হবে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ব্যবহার, গণপরিবহন বা সাইকেল চালানো, গাছ লাগানো এবং কার্বন নিঃসরণ কমানো এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
তৃতীয়ত, সমাজে টেকসই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে শিক্ষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সবার মাঝে পরিবেশ সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা তৈরি করতে হবে। শিক্ষা ও গণমাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে।
সবশেষে বলা যায়, টেকসই উন্নয়ন কেবল নীতি-নির্ধারকদের কাজ নয়; বরং প্রতিটি নাগরিকের সচেতনতার ফলাফল। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিটি পর্যায়ে যদি পরিবেশবান্ধব জীবনধারার বিবর্তন ঘটানো যায়, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী পাবে।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রতিটি নির্বাচন একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কখনো তা আশার, কখনো আশঙ্কার। এবারও ব্যতিক্রম নয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে জনমনে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে তো? না হলে কবে হবে নির্বাচন? কারা করবেন? কারা অংশ নেবেন না? নির্বাচন কি অবাধ হবে? আলোচনায় এসেছে জাতীয় সরকারের ধারণাও। কেউ আবার প্রস্তাব করছেন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (চজ) পদ্ধতির নির্বাচন। এসব কিছুর ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে বড় এক সংশয়। গণতন্ত্র কি তার নির্ধারিত পথে থাকবে, না কি আবার কোনো ‘ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’র দিকে যাবে রাষ্ট্র? প্রতিটি নির্বাচন হওয়া উচিত একটি গণতান্ত্রিক উৎসব। কিন্তু যখন নির্বাচনই হয়ে যায় জনগণের উদ্বেগ, তখন বোঝা যায় গণতন্ত্র গভীর কোনো ব্যাধিতে আক্রান্ত। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় সরকার, পিআর পদ্ধতি ও আশঙ্কাজনক রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে নিচের দীর্ঘ পর্যালোচনাটি জরুরি।
আলোচনায় আসা পিআর পদ্ধতি জনগণের ন্যায্যতা না নির্বাচনী জটিলতা? আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি বা চজ বিশ্বের বহু দেশে ব্যবহৃত হয়। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইসরায়েল, নিউজিল্যান্ডসহ বহু দেশে এটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয়েছে। এতে ভোটের হার অনুযায়ী আসন বণ্টন হয়। ফলে ছোট দলগুলোও পার্লামেন্টে প্রবেশ করতে পারে এবং রাজনৈতিক বৈচিত্র্য ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। এই পদ্ধতির বড় সুবিধা হচ্ছে-এটি অধিকতর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করে এবং একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মতামত উপেক্ষিত হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটি প্রয়োগ করা কতটা বাস্তবসম্মত? এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের ভোটার মনস্তত্ত্ব, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সংগঠনভিত্তিক দলীয় রাজনীতির কারণে চজ পদ্ধতি এক প্রকার দূরহ হয়ে পড়ে। একে বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক সংশোধন প্রয়োজন, যার জন্য সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার, যা বর্তমান কাঠামোতে কঠিন। সেইসঙ্গে ভোটারদের এই পদ্ধতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণাও নেই। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এ বিষয়ে ঐকমত্য নেই। বড় দলগুলো এতে আগ্রহী নয়, কারণ এতে তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অতএব, চজ পদ্ধতি বর্তমানে একাডেমিক আলোচনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ এবং রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা প্রয়োগে এখনো অনেক দূর যেতে হবে। তবে বাংলাদেশে এ পদ্ধতিতে নির্বাচন করা গেলে একক দলের ক্ষমতা কমবে। তাতে দুর্নীতি, বলপ্রয়োগ, অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে।
জাতীয় সরকারের প্রস্তাব সমঝোতার ডাক, না রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ? জাতীয় সরকার গঠনের দাবি নতুন কিছু নয়। অতীতেও এমন প্রস্তাব এসেছে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের বিকল্প হিসেবে। যারা এটি চাইছেন, তারা বলছেন, জাতীয় সরকারই একমাত্র গ্রহণযোগ্য রূপরেখা যা নির্বাচনের আগে একটি নিরপেক্ষ পরিবেশ তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে যেখানে রাজনৈতিক বিভাজন তীব্র এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস ব্যাপক, সেখানে জাতীয় সরকারের মতো একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা জরুরি বলে মনে করেন অনেকে। তবে প্রশ্ন জাগে-এই সরকার কাদের নিয়ে গঠিত হবে? কী হবে ক্ষমতার কাঠামো? কতদিন চলবে? এর সাংবিধানিক ভিত্তি কী? জাতীয় সরকারের আইনি কাঠামো কোথায়, তার ম্যান্ডেট কী, নির্বাচন কমিশনের উপর এর কর্তৃত্ব কতটা থাকবে—এসব প্রশ্নের কোনো স্বচ্ছ জবাব নেই। সমালোচকদের মতে, জাতীয় সরকারের ধারণাটি অনেকটাই অস্পষ্ট। একপক্ষের কাছে এটি ‘নিরপেক্ষতার নামান্তর’, আরেকপক্ষের কাছে ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের পাঁয়তারা’। আর যেহেতু সংবিধানে জাতীয় সরকারের কোনো ধারা নেই, তাই এই ধারণার বাস্তবায়ন সাংবিধানিক টানাপোড়েন তৈরি করতে পারে। অতএব, এটি সমঝোতার মাধ্যমে প্রস্তাবিত হলে আলোচনাযোগ্য, অন্যথায় এটি রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।
একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন হলো সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে কমিশনের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক ছড়ায়। বিশেষ করে ২০১৮ ও ২০২৪ সালের রাতে ভোট দেওয়ার অভিযোগ কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিলেও রাজনৈতিক পক্ষগুলোর আস্থা আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। ঊঠগ ব্যবহারের প্রসঙ্গে একপক্ষের আপত্তি, পর্যবেক্ষকদের সীমিত অনুমতি এবং রাজনৈতিক সংঘর্ষে কমিশনের নীরবতা জনমনে আরও অনাস্থা জন্ম দিয়েছে। আস্থা অর্জনের একমাত্র পথ হলো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং সব পক্ষকে সমানভাবে সুযোগ দেওয়া। তা না হলে কমিশন যতই প্রচার চালাক, ততই তা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে।
অনেকেই মনে করেন, দেশে যদি নির্বাচন সুষ্ঠু না হয়, তাহলে সেনাবাহিনী একটি নিরপেক্ষ রক্ষক হিসেবে কাজ করতে পারে। যদিও এ কথা বললে গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হলো জনগণের বিশ্বাস অর্জন করার জন্য সেনা হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা কিছুটা প্রবল। অন্যদিকে, সেনা শাসন চিরকালীন নয়, এ ধরনের পরিস্থিতি গণতন্ত্রের পক্ষে একটি প্রতিকূল সংকেত। সেনা হস্তক্ষেপ সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা কমিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বর্তমানে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে। বড় দলগুলো অথবা একাধিক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম একাধিকবার একে অপরকে খারাপ হিসেবে অভিহিত করেছে। ফলে একটি কার্যকরী রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বিভাজনের প্রভাব এতটাই গাঢ় যে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই বিভিন্ন পক্ষ তাদের মতামত জোরালভাবে তুলে ধরছে। এ ধরনের আস্থা সংকট রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে এবং এতে নির্বাচনী প্রস্তুতি বিলম্বিত হতে পারে। শুধু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, নাগরিক সমাজও এর অংশ হতে পারে। প্রত্যাশিত নির্বাচন নিয়ে গুজবের বাজার কিছুটা তোলপাড় হয়ে উঠেছে। কেউ বলছেন, নির্বাচন এক বছরের জন্য স্থগিত হতে পারে, আবার কেউ বলছেন, জাতীয় সরকার গঠন হওয়ার পর নির্বাচন এগিয়ে আসবে। এসব গুজব পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে, যা ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ না করার কারণে এইসব গুজবের প্রতি জনগণের বিশ্বাস স্থাপন করা বাড়িয়ে দিয়েছে।
গণতন্ত্রে ভোট একটি মৌলিক অধিকার, জনগণের মতামত জানানোর একমাত্র কার্যকর প্রক্রিয়া। কিন্তু যখন নির্বাচন গোপন এজেন্ডা, পূর্বনির্ধারিত ফলাফল কিংবা ক্ষমতাকেন্দ্রিক তদবিরের যন্ত্রে পরিণত হয়, তখন তা জনগণের অধিকারকে ছিনিয়ে নেয়। যা কিনা বিগত হাসিনা সরকারের সময় হয়েছে। আমাদের দেশে বহুবার দেখা গেছে ভোট হয়েছে, কিন্তু ভোটাররা বলতে পারছে না তাদের ভোট আসলে গণনা হয়েছে কি না। অনেক ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পারার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। আবার প্রশাসনিক প্রভাব, রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অস্পষ্টতা পুরো নির্বাচনকে সন্দেহজনক করে তোলে। এভাবে যখন নির্বাচনকে স্বচ্ছ রাখা হয় না, তখন জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ে। মানুষ প্রশ্ন তোলে আমরা কি সত্যিই ভোট দিচ্ছি, নাকি একটি নাটকের অংশগ্রহণ করছি? গণতন্ত্র তখন কাগজে-কলমে থেকে যায়, কিন্তু বাস্তবে তা জনজীবনে প্রতিফলিত হয় না। নির্বাচনের মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় ‘আমার ভোট কি গণনা হয়েছে?’। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে গণতন্ত্রের অধিকার কেবলই একটি প্রতিশ্রুতি হয়ে থাকে, বাস্তবে তার কোনো কার্যকারিতা থাকে না। ফলত গোপন বা পূর্বনির্ধারিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে গণতন্ত্র গড়ে ওঠে, তা আসলে ফাঁপা এক কাঠামো যা জনগণের অধিকারকে নিঃশেষ করে দেয়। তবে অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার দাবি রাখে আমজনতা।
বাংলাদেশ আজ নিঃসন্দেহে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অস্থিরতা, মারামারি রক্তপাত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অসহযোগিতা সব কিছু ওলটপালট করে দিচ্ছে। সব কিছুতে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য জাতীয় সরকার, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব কিংবা সংবিধান সংশোধনের মতো বিভিন্ন প্রস্তাব আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এগুলোর কোনোটি কার্যকর হবে না যদি জনগণের আস্থা অর্জন না করা যায়। গণতন্ত্র কেবল একটি কাঠামোগত ব্যবস্থা নয়; এর প্রাণশক্তি হলো জনগণের সম্মতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা। আজকের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো সেই সম্মতি ও আন্তরিকতাকে দৃঢ় করা।
এ কথা বলতেই হয়, বাংলাদেশে আজ সংকটজনক ভোটের দ্বারপ্রান্তে। জাতীয় সরকার হোক বা পিআর পদ্ধতি, সবই তখনই অর্থবহ, যদি তার পেছনে থাকে জনগণের ইচ্ছা ও সর্বদলীয় সম্মতি। নচেৎ এগুলো কেবল স্লোগান বা ছলচাতুরি হয়ে থাকবে। ভোট কেবল ভোট না এটা হলো দেশের ভবিষ্যতের দিশা নির্ধারণ। তাই গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে সংযমী, সংলাপমুখী এবং সর্বোপরি জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে। নইলে সামনে যে অন্ধকার, তা শুধু রাজনীতির জন্য নয় গোটা জাতির জন্যই হুমকিস্বরূপ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সকল রাজনৈতিক শক্তিকে বুঝতে হবে, একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সমঝোতা, সহমর্মিতা এবং ক্ষমতা ভাগাভাগির সংস্কৃতি ছাড়া এ পথ সম্ভব নয়। অন্যথায় ভবিষ্যৎ ইতিহাস হয়তো কঠিন ভাষায় লিখবে-এই জাতি জুলাই আন্দোলনের সুবাদে সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু তারা তা ধরে রাখতে পারেনি। ভোট তখন আর গণতন্ত্র রক্ষার হাতিয়ার হবে না, বরং ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার অস্ত্র হয়ে দাঁড়াবে। আর সেই ব্যর্থতা থেকে যে অরাজকতা ও অনিশ্চয়তা জন্ম নেবে, তার দায় পুরো জাতিকেই বহন করতে হবে। এর দায় আন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও নিতে হবে বৈকি!
লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।
পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। বর্তমানে দেশে পাট চাষির সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার সংস্থান হচ্ছে পাট চাষে। পাট শিল্পে ও পাটপণ্য রপ্তানির কাজে জড়িত আছেন প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক। জিডিপিতে পাটের অবদান প্রায় শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। কৃষি জিডিপিতে পাটের শরিকানা প্রায় ১ শতাংশ। মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ২ শতাংশ উপার্জন হয় পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি থেকে। তৈরি পোশাক শিল্পের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। পাট থেকে আহরিত মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে। এক সময় পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত। পাট থেকে আহরিত মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে। এক সময় পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে মোট বৈদেশিক আয়ে পাটের অংশ ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ১ দশমিক ৮৮ শতাংশে। ১৯৫৮ সালে এ দেশে সাদা পাটের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল শতকরা ৭৫ দশমিক ৪৮ ভাগ এবং তোষা ২৪ দশমিক ৫২ ভাগ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তোষা পাট শতকরা প্রায় ৮৯ ভাগ, সাদা পাট প্রায় ৪ ভাগ এবং মেস্তা ও কেনাফ প্রায় ৭ ভাগ জমিতে চাষ করা হয়। তোষা পাটের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ১৩ দশমিক ৬৪ বেল, সাদা পাটের উৎপাদন ৯ দশমিক ৭৩ বেল এবং মেস্তা ও কেনাফের গড় উৎপাদন ১০ দশমিক শূন্য ৬ বেল। সারাদেশে হেক্টরপ্রতি পাটের গড় উৎপাদন ১৩ দশমিক ২৪ বেল। নব্বইয়ের দশকে এ দেশে পাটের চাষ হতো প্রায় ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। ক্রমেই তা নেমে আসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ হেক্টরে।
মাঠ গবেষণায় দেখা যায় একসময় রংপুর অঞ্চলের অর্থনীতির মূল প্রাণ ছিল পাট। কিন্তু এখন সেই ঐতিহ্য হারাচ্ছে। গত ২০ বছরে পাট চাষ কমেছে প্রায় ৭০%, ফলে হাজার হাজার কৃষক বেকার হয়েছেন। এর প্রধান কারণ বন্যা, ভালো বীজের অভাব এবং বাজারের অনিশ্চয়তা। তবে এবার নতুন পাট বাজারে ওঠায় এবং ভালো দাম পাওয়ায় কৃষক খুশি। রংপুর কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর (খরিফ-১ মৌসুমে) রংপুর বিভাগের আট জেলার (রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী) মোট ৫৪ হাজার ৬৬৯ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। প্রত্যাশা ৭ লাখ ৯ হাজার ৭৯৯ বেল পাট উৎপাদন হবে। উল্লেখ্য, গত তিন বছরে এই অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে দুইশ থেকে চারশ হেক্টর জমিতে পাট চাষ কমেছে। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলায় মোট ৫১ হাজার ৬২৭ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছিল। এ উৎপাদনে প্রায় ৭০ হাজার কৃষক যুক্ত ছিলেন। ২০২২ সালে, ৫৬ হাজার ৪১২ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়। ওই প্রায় ৭৫ হাজার কৃষক এতে জড়িত ছিলেন। গত ১০ বছরে এই অঞ্চলে পাট চাষের পরিমাণ প্রায় ৪০% কমেছে। আর গত ২০ বছরের হিসাবে এই হ্রাসের পরিমাণ ৭০%।
পাট চাষ কৃষি শ্রমিকদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করে। কৃষকরা পাট কাটার পর আমন ধানের চারা রোপণ করেন। এরপর প্রায় এক থেকে দেড় মাস তাদের হাতে কোনো কাজ থাকে না। এই সময়ে পাট জাগ দেওয়া ও আঁশ ছাড়ানোর কাজ করে কৃষি শ্রমিকরা কর্মসংস্থান পান।তবে পাট চাষ কমে যাওয়ায় কাজের সুযোগও কমে গেছে। কৃষি শ্রমিকের বাজারও ছোট হয়ে আসছে। তবে আশার কথা, এই বছর নতুন পাট বাজারে উঠতে শুরু করেছে। প্রতি মণ পাট মানভেদে ৩,০০০ থেকে ৩,২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে কৃষকরা কিছুটা লাভবান হচ্ছেন। এছাড়াও, প্রতি মণ পাটকাঠি ৭০০ থেকে ১,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাটকাঠি এখন আর শুধু জ্বালানি নয়, এটি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। পাটকাঠি দিয়ে হার্ডবোর্ড তৈরি হয়। এছাড়াও, বিশেষ প্রক্রিয়ায় পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করা হয়, যা গুঁড়ো করে কার্বন ও ডিজিটাল প্রিন্টারের কালি বানানো হয়। পাট চাষ এখন কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক ফসল।
লালমনিরহাটের কৃষক মো. আশরাফ দুই একর জমিতে ৪৫ মণ পাট উৎপাদন করে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা আয় করেছেন। ৭০ মণ পাটকাঠি বিক্রি করে আরও ৪৯ হাজার টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি। চাষের সব খরচ বাদ দিয়ে তার ৫০ হাজার টাকা লাভ হবে। কৃষক আব্দুস সাত্তার (৫০) জানান, একসময় উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল পাট। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই ফসলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। কিন্তু আধুনিকতার প্রভাব, চাষের খরচ বৃদ্ধি এবং ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় পাট চাষ এখন বিলুপ্তির পথে। তবে এই সংকট মোকাবিলায় সরকার পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় বাজারে কিছুটা গতি ফিরেছে। ভবিষ্যতে পাট চাষ বাড়াতে হলে কৃষকদের উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে এবং পাটের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
রংপুর পাট গবেষণা ও উন্নয়ন বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বন্যা, বীজের অভাব, পর্যাপ্ত পানির সংকট এবং বাজারের অনিশ্চয়তার কারণেই রংপুর বিভাগে পাট চাষের জমি ও উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে। তবে আশার কথা হলো, চলতি খরিফ মৌসুমে উঁচু জমিতে পাট চাষের পর্যাপ্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনাবৃষ্টির কারণে পাট জাগ দেওয়া (পচানো) নিয়ে একসময় কৃষকের মনে ভয় ছিল। কিন্তু আষাঢ় মাসের শেষের দিকে বৃষ্টি হওয়ায় খাল-বিলে পানি জমে যায় এবং শেষ পর্যন্ত পাট পচন নিয়ে বড় ধরনের কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক, কৃষিবিদ ড. মো. আবু সাইখুল আরিফিন জানান, পাট এখন কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক ফসল। কৃষক এই অঞ্চলে দুটি প্রধান ফসলের মাঝে পাট চাষ করতে পারেন। কারণ পাট কাটার পর আমন ধানের চারা রোপণ করা যায় । তিনি জানান, এই অঞ্চলের কৃষকরা এখনও সনাতন পদ্ধতিতে পাট আঁটি করে জাগ দেন। এতে পাটের মান ও রং খারাপ হয়ে যায়, শ্রমিক বেশি লাগে এবং উৎপাদন খরচও বাড়ে। তিনি কৃষকদের সনাতন পদ্ধতির বদলে ‘ফিতা রেটিং’ পদ্ধতিতে পাট জাগ দিতে উৎসাহিত করেন। এই পদ্ধতিতে কম পানি লাগে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজে আঁশ ছাড়ানো যায় ও উৎপাদন খরচও কমে।
এখন নীতিনির্ধারণী ও গবেষণা পর্যায়ে অনেক কিছু করার রয়েছে। পাট গবেষণার ক্ষেত্রে এ নাগাদ সাদা পাটের ১২টি উচ্চ ফলনশীল জাত পাওয়া গেছে। তোষা পাটের আটটি, কেনাফের চারটি ও মেস্তার তিনটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর সম্প্রসারণ চলছে মাঠ পর্যায়ে। বর্তমানে পাটের গড় ফলন পৃথিবীর পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বেশি। এর পেছনে কৃষি বিজ্ঞানীদের এবং বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবদান অনস্বীকার্য। সম্প্রতি পাটের বংশ গতি বিন্যাস (জেনোম সিকুয়েন্স) উদ্ভাবন হয়েছে। তাতে রোগ ও পোকা প্রতিরোধক আরো উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। হচ্ছে। এখন আমাদের এমন পাটের জাত উদ্ভাবন করতে হবে যা খরা, লবণাক্ততা ও শীতসহিষ্ণু। সারা বছর উৎপাদন উপযোগী পাটজাত উদ্ভাবন এখন সময়ের দাবি। এরই মধ্যে বছরে দুবার অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে পাট বোনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাতে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তবে গবেষণার মাঠে নতুন উদ্ভাবিত পাট জাতের ফলন যত বেশি, কৃষকের মাঠে তত বেশি নয়। গবেষণা ও কৃষকের মাঠে প্রাপ্ত উৎপাদনে প্রায় ৪০ শতাংশ ফারাক বিদ্যমান। এটি কমাতে হবে। এর জন্য গবেষণা ও সম্প্রসারণের মধ্যে জোরাল সমন্বয় প্রয়োজন। পাট গবেষণা ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন ৷ তার সঙ্গে বাজার স্থিতিশীল রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। পাট সংশ্লিষ্ট শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে।
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
বাংলাদেশ আজ এক অস্থির অথচ প্রত্যাশার সময় অতিক্রম করছে। গণঅভ্যুত্থান, দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সরকার পতনের নাটকীয় মোড় এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশ আবারও নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা, গণতন্ত্রের পুনর্গঠন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকনির্দেশক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালের আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ যে অশান্ত ও রূপান্তরমুখী রাজনীতির মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তার প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে দৃশ্যমান। এ প্রেক্ষাপটে নির্বাচনকে ঘিরে যে উত্তেজনা, আশঙ্কা এবং প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, তা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গেই তুলনীয়। আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ও সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ প্রচেটায় শেখ হাসিনার দীর্ঘমেয়াদি শাসনের অবসান হয়। সে সময় একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় আসা ছিল মূলত জনগণের দাবির ফলাফল। এ পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধানের বক্তব্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তিনি যে ভাষায় জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন এবং নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা দেশে রাজনৈতিক আস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। সেনাপ্রধান স্পষ্ট করে বলেছেন, দেশের স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করবে। এটি সাধারণ নাগরিকদের জন্য এক ধরনের স্বস্তি তৈরি করলেও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এটি আবারও ক্ষমতায় ফেরার সুযোগ এনে দিয়েছে। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগ এক ধরনের আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে সময় কাটাচ্ছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে দলটির ভেতরে যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, অগণতান্ত্রিক চর্চা এবং প্রশাসনকেন্দ্রিক নির্ভরতা তৈরি হয়েছিল, তা তাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। এখন দলটি সংগঠন পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে, তবে তাদের বড় চ্যালেঞ্জ হলো- জনগণের আস্থা ফিরে পাওয়া। আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব কতটা বিশ্বাসযোগ্য বার্তা দিতে পারবে, তা আগামী নির্বাচনে তাদের অবস্থান নির্ধারণ করবে। অন্যদিকে বিএনপি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও নেতৃত্ব সংকট কাটিয়ে আবারও সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তবে দলটি এখনো সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নেতৃত্বের অনিশ্চয়তায় ভুগছে। খালেদা জিয়ার উপস্থিতি, তারেক রহমানের অবস্থান এবং সময় যে গণজোয়ার তারা পেয়েছিল, তা নির্বাচনে রূপান্তর করতে পারলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আস্থা তৈরি এবং জনগণের সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগ রক্ষা করা। একই সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, বাম গণতান্ত্রিক জোট কিংবা আঞ্চলিক দলগুলোও নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে চাইবে। জামায়াত সাম্প্রতিক সময়ে সাংগঠনিকভাবে কিছুটা সক্রিয় হলেও তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। জাতীয় পার্টি আবারও ক্ষমতার সঙ্গে আপস করার কৌশল খুঁজছে। বাম দলগুলো নানা আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও জাতীয় নির্বাচনে তাদের প্রভাব সীমিত থাকবে। তবে একাধিক ছোট দল জোট গঠন বা সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে গণঅভ্যুত্থানে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন শক্তি তৈরি হচ্ছে। এই প্রজন্ম অতীতের দলীয় বিভাজনের বাইরে গিয়ে পরিবর্তনের দাবি তোলছে। তারা চায় একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি। নির্বাচনে তরুণদের ভোট এবং অংশগ্রহণ যেকোনো দলের জন্য গেম-চেঞ্জার হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারও তাই তরুণ প্রজন্মকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলও নিবিড় দৃষ্টি রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ও চীনসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে একটি শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। ভারত তার কৌশলগত কারণে স্থিতিশীল বাংলাদেশ চায়, আর চীন অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার দিকটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই আগ্রহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে, কারণ নির্বাচন যদি বিতর্কিত হয় তবে তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হারানোর ঝুঁকি তৈরি করবে। নির্বাচনের পথ যত এগিয়ে আসছে, ততই চ্যালেঞ্জও প্রকট হয়ে উঠছে। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, প্রশাসনের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ভূমিকা নিশ্চিত করা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এখন প্রধান কাজ। নির্বাচনকালীন সময়ে সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন বা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে আবারও হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এ কারণে সেনাপ্রধান ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা বিশাল। তারা বিশ্বাস করতে চাইছে, এবার আর কোনোভাবে প্রহসনের নির্বাচন হবে না। অন্যদিকে অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতাও নির্বাচনের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকিং সেক্টরের অস্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগে মন্দাভাব দেশের অর্থনীতিকে সংকটময় অবস্থায় নিয়ে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করানো সম্ভব নয়। বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষ সবাই আশা করছে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বৈধ ও গ্রহণযোগ্য সরকার গঠিত হলে অর্থনীতিতে আস্থা ফিরবে এবং উন্নয়নের গতি পুনরুদ্ধার হবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে- কে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের প্রতি একটি বড় অংশের বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। আবার বিএনপি সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে। তবে জনগণ আর শুধু দলীয় প্রতিশ্রুতি শুনতে চায় না, তারা কার্যকর নীতি, বাস্তবসম্মত সমাধান এবং জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা দেখতে চায়। এ কারণে আসন্ন নির্বাচন শুধু দলীয় ক্ষমতার পালাবদলের প্রশ্ন নয়, বরং গণতন্ত্রকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার একটি সুযোগও বটে। এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনী এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নির্ধারক। সরকার যদি প্রমাণ করতে পারে যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের দূরে রেখে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণ স্বাধীনতায় কাজ করার সুযোগ দিয়েছে, তবে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। যদি ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয় বা কোনো একটি পক্ষকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে, তবে তা আবারও রাজনৈতিক অচলাবস্থার জন্ম দিতে পারে। জনগণের আশা ও আস্থার ভারসাম্য তাই এখন মূলত তাদের হাতেই।
সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশ এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। অতীতের অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিতর্ক জনগণের মনে এখনো তাজা। তারা আর প্রহসনমূলক নির্বাচন দেখতে চায় না। তাই এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে নতুন ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর যে সুযোগ এসেছে, সেটি কাজে লাগানো না গেলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আবারও অনিশ্চয়তায় ডুবে যাবে। তবে যদি নির্বাচন সত্যিকার অর্থে অবাধ, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক হয়, তবে তা কেবল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও নতুন এক আস্থার সূচনা করবে।
বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্রের জন্য বহুবার লড়াই করেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের গণআন্দোলন কিংবা ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান- সবকিছুই প্রমাণ করে যে জনগণ কখনোই তাদের অধিকার থেকে সরে যায় না। এবারও সেই জনগণ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা চায় একটি এমন নির্বাচন, যা তাদের কণ্ঠকে প্রতিফলিত করবে, যা হবে নতুন যাত্রার সূচনা। বাংলাদেশের রাজনীতির এই মুহূর্তে সেটিই সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা, আর সেটিই নির্ধারণ করবে আগামী দিনের পথচলা।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তি
সুরা সাজদাহ, পর্ব ১
অনুবাদ
(১) আলিফ-লাম-মীম। (২) এ কিতাব বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ ; এতে কোনো সন্দেহ নেই। (৩) তবে কী তারা বলে, এই ব্যক্তি নিজে এটা রচনা করেছে? বরং তা তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে আগত মহাসত্য, যাতে তুমি এমন এক জাতিকে সতর্ক করতে পারও, যাদের নিকট তোমার পূর্বে কোনো সতর্ককারী আসেনি। হয়তো তারা হিদায়াত পেয়ে যাবে।
মর্ম ও শিক্ষা
পূর্বের সূরা লোকমানও আল্লাহর কিতাব কোরআন দিয়ে শুরু হয়েছে। এরপর এখানে সূরা সিজদাহ আল্লাহর কিতাব কোরআনের দিকে মানুষকে তাগিদ করে শুরু হয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ এ দুটি সূরাতেই ইমানের মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, যার মধ্যে আল্লাহর কিতাবের প্রতি ইমান অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ কোরআনে ইসলামী জীবন-দর্শনের দলীল রয়েছে। কোরআন মেনে নিলে সবই মানা হয়। এতে ইমান আনলে অন্য সবকিছুর ওপর ইমান আনা হয়ে যায়।
কোরআন হলো নাযিলকৃত ঐশী কিতাব
আয়াতে বলা হয়েছে, কোরআন হলো- রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। আরবি মূল শব্দ হলো- তানযিলুল কিতাব। অর্থাৎ নাযিলকৃত কিতাব। অর্থাৎ এ কিতাব আল্লাহর নিকট থেকে জিবরাইল (আ)-এর মাধ্যমে ওহী স্বরূপ সরাসরি নাযিলকৃত। নাযিলকৃত মানে হলো- ওপর থেকে অবতরণকৃত। এ কথাগুলো সরাসরি আল্লাহর কথা, যা জিবরাইল নিয়ে এসে শেষনবীর নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। কখনো জিবরাইল (আ.) মানুষের বেশে এসে রাসূলের নিকট কথাগুলো বলেছেন। কখনো আকৃতিহীনভাবে বলেছেন। কখনো রাসূলের মনে এ কোরআনের বাণীগুলো নাযিল করা হয়েছে। এ কোরআনের বাণীগুলো প্রেক্ষাপট সৃষ্টির মাধ্যমে রাসূল (স.)-এর ২৩ বছরের জীবনে ধীরে ধীরে নাযিল হয়েছে। এ গোটা কিতাবটিকে মুদ্রিত আকারে এক সঙ্গে উপস্থাপন করা হয়নি। বরং প্রত্যেকটা কথার পৃষ্ঠে কোনো ঘটনা বা প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তার আলোকে ওহী এসেছে। যেন ওহীর অর্থ বোঝতে সুবিধা হয়। বলাবাহুল্য, নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে আয়াত নাযিল হলেও তা শুধু সেই প্রেক্ষাপটের সঙ্গে নির্ধারিত বা নির্দিষ্ট নয়, বরং এর দিকনির্দেশনা সাধারণ, সর্বক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য।
কোরআন রাসূল (স.)-এর রচিত গ্রন্থ নয়
কোরআন যে সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে নাযিলকৃত কিতাব, এ বিষয়টিতে আরও তাগিদ ও জোর দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় আয়াতে আরও বলা হয়েছে, তারা কী বলে যে মুহাম্মদ (স.) নিজে তা রচনা করেছেন? অর্থাৎ বাতিলপন্থিরা কোরআনকে গ্রহণ না করার অজুহাত হিসেবে বলে বেড়াত যে, এ কোরআন হলো- মুহাম্মদের নিজের রচিত। যেহেতু তিনি নিরক্ষর ছিলেন, সেহেতু তার পক্ষে হয়তো তা রচনা করা সম্ভব হয়নি। সেহেতু কোনো ইহুদি পণ্ডীতের সাহায্য গ্রহণ করে তিনি পুরোনো কল্পকাহিনী শুনেছেন এবং সেগুলো কোরআন বলে চালিয়েছেন। কেউ কেউ বলত, তিনি ছিলেন একজন কবি। আর সেই সুবাদে কোরআনের কথাগুলো রচনা করে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিয়েছেন। এভাবে কোরআন প্রত্যাখ্যান করার জন্য অনেক ধরনের অজুহাত সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে তার জবাব দেওয়া হয়েছে যে, কোরআন রাসূলের রচিত কিতাব নয় বরং আল্লাহর নিকট থেকে নাযিলকৃত। এটা এ পৃথিবীর জিনিস না। কারও রচিত নয়। এতে কোনো জাদু নেই, কবিতা নেই। এখানে গণকের কোনো কথা নেই। তা কোনো কবি সাহিত্যিকের বানানো নয়। কোনো মতবাদ বা জীবনাদর্শ যদি কোনো মানুষ দ্বারা রচিত হয়, তবে তা সে ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, মতাদর্শ ও সীমাবদ্ধতায় সীমিত থাকে। তা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সার্বজনীনতার গুণে গুণান্বিত হতে পারে না। ফলে তা আজ চললেও- কাল চলে না। এ সমাজে প্রযোজ্য হলেও- সে সমাজে তা পরিত্যাক্ত হয়। কাজেই কোনো ব্যক্তি রচিত সে মানব রচিত মতাদর্শ স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সকলের জন্য কল্যাণময় হওয়া সম্ভব নয়।
এ কথাটিকে আরও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাতিলপন্থিদের একাধিকবার চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়েছে যে, এটা যদি মানুষের রচিত হয়, তাহলে তোমাদের সকল শিক্ষিত ব্যক্তি, পণ্ডিত, কবি, সাহিত্যিক এবং সবাই একত্র হয়ে কোরআনের মতো অল্প কিছু রচনা করে দেখাও তো! কিন্তু তারা পারেনি। সেটা ছিল সাহিত্যের উৎকর্ষতার যুগ। কিন্তু তাদের সম্মিলিত চেষ্টা সত্ত্বেও তারা তা করতে পারেনি। কাজেই তা প্রমাণ করে যে, কোরআন মানব রচিত নয়। কোরআন হলো- আল্লাহর নিকট থেকে নাযিলকৃত ও অবতরণকৃত কিতাব।
কোরআন হলো আল্লাহর দেওয়া জীবনাদর্শ ও জীবন-বিধান
কোরআন প্রতিপালক আল্লাহর নিকট থেকে আগত মহাসত্য, হক ও হিদায়াত (আয়াত-৩)। আল্লাহই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। মানুষকেও তিনিই সৃষ্টি করেছেন। স্বভাবতই যে কারিগর কোনো যন্ত্র তৈরি করে, সে জানে সে যন্ত্র কীভাবে চালাতে হবে, কীভাবে চালালে সে যন্ত্র নষ্ট হবে, আর কীভাবে চালালে সে যন্ত্র সুস্থ থাকবে, সঠিক থাকবে। তেমনিভাবে মানুষের জন্য কোনো জীবন-ব্যবস্থা কল্যাণকর আর কোনটা অকল্যাণকর তা আল্লাহই ভালো জানেন। কোনো মানুষ নিজে অপরিপক্ব জ্ঞানে তা নির্ধারণ করতে অপরাগ। হয়তো কোনো ব্যক্তি তার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোনো মত ও পথকে কল্যাণকর মনে করতে পারে, কিন্তু সময়ের আবর্তে কিছুদিন পরে তা অকল্যাণকর ও মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু যেহেতু আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এককভাবে জানেন ও বোঝেন। একমাত্র তিনিই এমন জীবন- বিধান দিতে পারেন, যা সর্বযুগের জন্য মানব জীবনের কল্যাণ নিয়ে আসবে এবং আখিরাতেও শান্তি পাবে। আর সে আদর্শ ও ব্যবস্থাই কোরআনে দেওয়া হয়েছে। কোরআন হলো- আল্লাহর দেওয়া জীবনাদর্শ ও জীবন-বিধানের লিখিত দলিল।
কোরআন হলো জান্নাতে ফিরে যাওয়ার রোডম্যাপ
আলোচ্য আয়াতের শেষ দিকে বলা হয়েছে, কোরআন নাযিলের উদ্দেশ্য হলো- মানুষকে সতর্ক করা, যাতে মানুষ হিদায়াত পেতে পারে। আল্লাহ যখন আদম (আ.)-কে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠান, তখন বলেছিলেন, তোমরা অল্প সময়ের জন্য পৃথিবীতে যাচ্ছ, সেখানে আমার হিদায়াত আসবে, যারা এ হিদায়াত গ্রহণ করবে তাদের কোনো চিন্তা বা ভয় নেই, তারা আবার জান্নাতে ফিরে আসতে পারবে। দুনিয়া থেকে জান্নাতে ফিরে যাওয়ার রোডম্যাপ হলো- আল্লাহর কিতাব। সে রোডম্যাপকেই হিদায়াত বলা হয়েছে। বর্তমান উম্মতের জন্য সে কিতাব হলো- কোরআন। সূরা বাকারার প্রথমেই বলা হয়েছে, কোরআন হলো হিদায়াত, তবে একটা শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে, কোরআন হিদায়াত তাদের জন্য যাদের মধ্যে তাকওয়া আছে। অন্যত্র বলা হয়েছে, কোরআন হলো সকল মানুষের জন্য হিদায়াত। অর্থাৎ কোরআনের উদ্দেশ্য হলো- সকল মানুষের হিদায়াত, কিন্তু এখান থেকে উপকৃত তারাই হবে যাদের ইতিবাচক মানসিকতা আছে, যারা সত্য অনুসন্ধান করে, যাদের মধ্যে আল্লাহভীতি ও তাকওয়া আছে।
কোরআন সন্দেহমুক্ত
আয়াতে বলা হয়েছে, ‘লা-রাইবা ফীহ’ অর্থাৎ এ কোরআনে কোনো সন্দেহ নেই। কোরআনের সূচনা সূরা বাকারার প্রথম দিকেও এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ এতে কোনো প্রকার সন্দেহ নেই। এর কয়েকটি দিক আছে। প্রথম, কোরআন আল্লাহর নিকট থেকে নাযিল হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়, কোরআন যে মানুষের জন্য কল্যাণকর জীবন-ব্যবস্থা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তৃতীয়, এ কোরআন মানুষের জন্য কল্যাণময় হিসেবে কালোত্তীর্ণ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এতে দেওয়া জীবনাদর্শ সাময়িক কিছু কালের জন্য মানব জীবনের কল্যাণ নিয়ে আসে না, বরং যখন কোরআন নাযিল হয়েছে তখন থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগ, শতাব্দী ও সহস্রাধেই এ কল্যাণময়তা ও মঙ্গল অপরিবর্তিত থাকবে। চতুর্থ, এ কোরআনের বাণী ও দিকনির্দেশনা স্পষ্ট, পরিষ্কার ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীন। কোরআনের দিকনির্দেশনায় কোনো অস্বচ্ছতা বা অস্পষ্টতা নেই। যদি কোনো নির্দেশ, আদেশ বা কথা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ হয়, অর্থাৎ তার একাধিক ব্যাখ্যা থাকে, তাহলে সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে, দিকনির্দেশনা ও নির্দেশ আসলে কোনটি। কিন্তু এখানে এমনটি নয়। কোরআনে নির্দেশ, আদেশ ও দিকনির্দেশনা অত্যন্ত পরিষ্কার। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
কোরআনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
আয়াতে বলা হয়েছে, কোরআন নাযিল করা হয়েছে, যেন রাসূল মানুষকে সতর্ক করতে পারেন, যাতে তারা হিদায়াত পায়। এখানে দুটি বিষয় আছে। প্রথম, কোরআন হলো- হিদায়াত তথা আল্লাহর মনোনীত জীবন-ব্যবস্থা। দ্বিতীয়- তা গ্রহণ ও অনুসরণের উদ্বুদ্ধ করা এবং তা প্রত্যাখ্যানের কঠিন পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা। আল্লাহর দেওয়া দীনকে প্রত্যাখ্যান করলে এবং তার সঙ্গে সংঘর্ষিক অন্য কোনো পথে চললে দুনিয়াতেও মানুষের জন্য রয়েছে অকল্যাণ, আর আখিরাতেও রয়ছে কঠিন শাস্তি। সারকথা, কোরআনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো- মানুষকে সুপথের দিকনির্দেশনা দিয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের হিদায়াত দান করা।
নবুয়তের দায়িত্ব
বলা হয়েছে, শেষনবীকে- কোরআন দিয়ে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছে যেন তিনি মানুষকে সতর্ক করতে পারেন। অর্থাৎ নবীদের দায়িত্ব হলো- মানুষকে সতর্ক করা। সতর্ক করার দুটি দিক। প্রথম- মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক করা যে, আল্লাহর দেওয়া জীবনাদর্শ ও জীবন-ব্যবস্থা বা আল্লাহর দীন অনুসরণ করা অপরিহার্য ও অবশ্যকর্তব্য। তা করলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন এবং মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ পাবে। দ্বিতীয়- আসল সতর্কতা হলো- এই যে, মানুষ যদি কোরআনে প্রদত্ত আল্লাহর দেওয়া জীবন-ব্যবস্থা অনুসরণ না করে তাহলে দুনিয়াতেও তাদের জন্য রয়েছে অকল্যাণ ও আখিরাতেও রয়েছে কঠিন শাস্তি। অন্যভাবে বলতে গেলে নবুয়তের দায়িত্ব হলো- মানুষকে সত্যের দাওয়াত দেওয়া, ভালো কাজের উপদেশ দেওয়া এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখা। বলাবাহুল্য, শেষ নবীর পর আর কোনো নবী আসবেন না। সে দায়িত্ব বর্তায় শেষ নবীর অনুসারী সত্যপন্থিদের ওপর। সে জন্যই এ উম্মত শ্রেষ্ঠ উম্মত।
যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় পূর্ণ হচ্ছে না বেসরকারি শিক্ষকদের সকল শূন্য পদ। তাই ছাড় দেওয়া হচ্ছে বয়সে, যোগ্যতায়, পরীক্ষায়। অথচ শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। এই মানুষ গড়ার কারিগর যত বেশি যোগ্য হবেন, সুদক্ষ হবেন ততবেশি, যোগ্য নাগরিক পাব আমরা। তাই তো জীবনের সব পরীক্ষায় অতিউত্তম ফলাফল অর্জনের পাশাপাশি একজন শিক্ষককে চলায়, বলায়, সাজে, পোশাকে, চিন্তায়, চেতনায়, জ্ঞানে, দক্ষতায়, মেধায়, নীতিতে, আদর্শে, দেশপ্রেমে, জাতীয়তাবোধে, আধুনিকতায় হতে হয় উত্তম। এসব বিবেচনায় যার উত্তম হওয়ার ইচ্ছা আছে, যোগ্যতা আছে, শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নেওয়ার মানসিকতা আছে তাকে বাছাই করার কাজটি আসলেই কঠিন। আমাদের দেশে শিক্ষক বাছাইয়ের প্রচলিত-প্রক্রিয়া কতটা মানসম্মত তা ভেবে দেখা উচিত। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বাছাই ক্ষমতা এনটিআরসিএর হাতে নেওয়ার ফলে আগের তুলনায় কিছুটা অধিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছেন সারা দেশে। তথাপি সেই মান প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছেনি।
এখনো কিছু কিছু বিষয়ে এমন শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া যাচ্ছে, যাদের সাধারণ জ্ঞান ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের গভীরতা ও প্রায়োগিক ক্ষমতা অত্যন্ত কম এবং তারা জানেন না ও পারেন না অনেক শব্দের সঠিক বানান ও উচ্চারণ! শ্রেণিকক্ষেও পরিহার করতে পারেন না আঞ্চলিক ভাষা! প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য অবশ্যই আরও উন্নত করতে হবে শিক্ষক বাছাই-প্রক্রিয়া। সর্বস্তরেই বৃদ্ধি করতে হবে শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম শিক্ষাগত এবং বাছাইয়ে মূল্যায়ন করতে হবে আরও অনেক বিষয়। তদুপরি শিক্ষক বাছাইকালে অবশ্যই প্রার্থীদের অংশগ্রহণ করাতে হবে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ও প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে। যেন মূল্যায়ন করা যায় তাদের কথা বলার ও পাঠদানের তথা কোনো কিছু উপস্থাপনের দক্ষতা এবং চিহ্নিত করা যায় অযোগ্যতা বা দুর্বলতা।
একজন ভালো শিক্ষক আজীবন লালন করবেন জানার এবং জানানোর ঐকান্তিক ইচ্ছা। শিক্ষককে জ্ঞানার্জনে হতে হবে নিরলস। অত্যন্ত সমৃদ্ধ হতে হবে নির্ধারিত বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে। শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি অত্যন্ত ভালোভাবে জানা থাকতে হবে শিক্ষার সংজ্ঞা, শিক্ষার উদ্দেশ্য ও শিক্ষাদানের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি।
আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষককে থাকতে হয় সমৃদ্ধ। জানতে হয় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার, সুফল-কুফল এবং সে আলোকে শিক্ষার্থীকে দিতে হয় সঠিক দিকনির্দেশনা। শিক্ষালাভে শিক্ষককে সদা সর্বদা থাকতে হয় সক্রিয়। হতে হয় বই ও প্রকৃতির একনিষ্ঠ পাঠক এবং সেভাবেই গড়ে তুলতে হয় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষক নিজে হতে হয় সবচেয়ে বড় শিক্ষার্থী। যিনি নিজে শিক্ষার্থী নন, তিনি অন্যের শিক্ষক হবেন কী করে? শিক্ষাদান শিক্ষকের একান্ত কর্তব্য। আর শিক্ষাগ্রহণ শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব। শিক্ষাদানের পূর্বশর্তই শিক্ষাগ্রহণ।
প্রতিনিয়ত শিক্ষাদান কার্যের পূর্বপ্রস্তুতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত শিক্ষাগ্রহণ। অবশ্যই থাকতে হবে বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ। যে শিক্ষক ভাববেন, আমি কেবল পড়াব, পড়ব না; সে শিক্ষক কখনো ভালো শিক্ষক হবেন না। শিক্ষক নিজের মধ্যে শিক্ষার সঠিক চর্চা করেই সঠিক পরিচর্যা করবেন শিক্ষার্থীর। ভালো শিক্ষক নিজের মধ্যে জ্ঞানের চর্চা করবেন প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, আজীবন। নিরলসভাবে অর্জন ও বিতরণ করবেন নতুন নতুন জ্ঞান। শিক্ষার্থী ও সমাজের সব মানুষকে করবেন জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ। আলোকিত করবেন দেশ ও জাতি।
একজন ভালো শিক্ষক হবেন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তার থাকবে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মতো মন-মানসিকতা। ভোগের চেয়ে ত্যাগের ইচ্ছাই থাকবে বেশি। তিনি কী পেলেন, তার চেয়ে বেশি ভাববেন কী দিলেন এবং কী দিতে পারলেন না। ভোগের চেয়ে ত্যাগেই বেশি আনন্দিত হবেন তিনি। বস্তু প্রাপ্তির নয়, জ্ঞানপ্রাপ্তি ও প্রদানের সংগ্রামে অবতীর্ণ থাকবেন শিক্ষক।
কেবল বস্তুগত প্রাপ্তির আশায় যিনি শিক্ষক হবেন ও শিক্ষকতা করবেন তিনি কখনো প্রকৃত শিক্ষক হয়ে উঠবেন না। কেননা, প্রকৃত শিক্ষাদানের অন্তর্নিহিত অনাবিল আনন্দ ও শিক্ষাদানের পুণ্য থেকে তিনি বঞ্চিতই থেকে যাবেন। শিক্ষকতার প্রকৃত পরিতৃপ্তি লাভের অতল সাগরে কোনো দিন যাওয়া হবে না তার। শিক্ষার্থীর জন্য যিনি নিবেদিতপ্রাণ তিনিই পরম শ্রদ্ধেয়। তাকেই শ্রদ্ধাভরে আজীবন মনে রাখে শিক্ষার্থী।
অত্যন্ত দূর-দৃষ্টিসম্পন্ন হবেন শিক্ষক। তিনি হবেন সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল ও বাস্তববাদী। তার আয়ত্তে থাকবে শিক্ষাদানের মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান ও আধুনিক কলাকৌশল। একজন ভালো শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর মন-মানসিকতা, যোগ্যতা-অযোগ্যতা, আগ্রহ-অনাগ্রহ বোঝার অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। নিজের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সব দিক থেকে প্রতিনিয়ত মূল্যায়ন করবেন শিক্ষক। সেই মূল্যায়নের আলোকেই দেখাবেন শিক্ষার্থীর সামনে এগিয়ে যাওয়ার সঠিক পথ।
দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধে পরিপূর্ণ হবেন শিক্ষক। ভালোভাবে জানবেন দেশ-জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। নিজের মধ্যে গভীরভাবে লালন ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সচেতনভাবে সঞ্চালন করবেন দেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনা। দেশপ্রেমে ও জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করবেন শিক্ষার্থীদের।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষকের থাকতে হবে প্রাকৃতিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির একনিষ্ঠ ছাত্র হবেন শিক্ষক। থাকতে হবে প্রতিনিয়ত প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের ঐকান্তিক ইচ্ছা। নিজে শিখবেন এবং নিজের শিক্ষার্থীদের শিখাবেন প্রকৃতির পাঠ। সেই সঙ্গে শিখিয়ে দেবেন প্রকৃতির পাঠ রপ্ত করার কৌশল। শিক্ষার্থী যেন প্রকৃতিকে বানাতে পারে তার জীবনের নিত্য শিক্ষক।
যতই আধুনিক শিক্ষা উপকরণ যুক্ত করা হোক, উন্নত সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বহুতল ভবন নির্মাণ করা হোক; শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা খুবই কঠিন কাজ বিশেষ করে আমাদের দেশে যেখানে সর্বোচ্চ মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসেননি, আসছেন না যুগ যুগ ধরে। টাকা হলে রাতারাতি শিক্ষা উপকরণ বদল করা যায়, পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা যায়; কিন্তু শিক্ষকদের বদল বা মান বৃদ্ধি করা যায় না। শিক্ষকের মান বৃদ্ধি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। শিক্ষকের বেতন সর্বোচ্চ নির্ধারণ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সব শিক্ষকের মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে যাবে এমনটি অবাস্তব। কেননা, এই আমি যতদিন আছি ততদিন দিয়েই যাব ফাঁকি, রেখেই যাব কম দক্ষতার স্বাক্ষর। তথাপি বৃদ্ধি করতে হবে আমার তথা শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা। প্রশিক্ষিতদের দিতে হবে আরও বর্ধিত বেতন। শিক্ষকতায় আনতে হবে সর্বোচ্চ মেধাবী ও যোগ্যদের।
কোনো রকম কোটা সংরক্ষণ করে, যোগ্যতা কম নির্ধারণ করে, বয়স বেশি নির্ধারণ করে, বাছাই প্রক্রিয়া শিথিল করে, তুলনামূলক কম যোগ্যদের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ দেওয়া মোটেও উচিত নয়। কেননা, শিক্ষক অযোগ্য হলে জাতি অযোগ্য হয়। আমাদের সর্বাধিক মেধাবী ও যোগ্য সন্তানরা যেদিন সাগ্রহে এসে দখল করবে আমাদের স্থান সেদিনই উন্নীত হবে আমাদের শিক্ষকদের কাঙ্ক্ষিত মান। সেটি যতই সময়সাপেক্ষ হোক এখন হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না কোনো অজুহাতেই। ব্যাপক প্রশিক্ষণ দিয়ে যথাসম্ভব বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে আমার মতো বিদ্যমান শিক্ষকদের মান। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে শিক্ষক হওয়ার জন্য টিচিং ডিগ্রি/ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক। তিনি যে পর্যায়ের, যে বিষয়ের শিক্ষকই হতে চান না কেন তার নিজস্ব বিষয়ে ডিগ্রির পাশাপাশি টিচিংয়ের ওপর আলাদা ডিগ্রি থাকতেই হবে। অর্থাৎ পাঠদানের বৈজ্ঞানিক কৌশল না জেনে কেউ শিক্ষক হতে পারেন না। অথচ আমাদের দেশে যে কেউ যেকোনো সময় শিক্ষক বা হুজুর হয়ে যাচ্ছেন! শিক্ষক হওয়ার জন্য শিক্ষকতা শিক্ষা করার অর্থাৎ শিক্ষা মনোবিজ্ঞান ও পাঠদানের আধুনিক কলাকৌশল আয়ত্ত করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই আমাদের বিদ্যমান শিক্ষক বা ওস্তাদদের যতটুকু সম্ভব প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদানে। এর কোনো বিকল্প নেই বর্তমান বাস্তবতায়।
দীর্ঘদিনের এই দুরবস্থা থেকে শিক্ষার উত্তরণ ঘটাতে চাইলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও বাড়াতে হবে শিক্ষকদের প্রকৃত আর্থিক সুবিধা এবং সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে তাদের বাস্তবিক কর্মঘণ্টা। আর সেটি আন্তরিকভাবে মেনে নিতে হবে শিক্ষকদের। উন্নত বিশ্বের শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত ক্লাসেই দিয়ে থাকেন পরিপূর্ণ শিক্ষা। স্কুলের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় না ক্লাসের পড়া।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমত নিশ্চিত করতে হবে মানসম্মত শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয়ত শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা প্রদানের মাধ্যমে আরও বেশি সময় প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। যেন শিক্ষকদের না থাকে বেতন-ভাতার অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের ধান্দা এবং শিক্ষার্থীদের না থাকে ক্লাসরুমের বাইরে ক্লাসের বিষয় পড়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট
বিগত সময়ে আমরা যাদের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে পেয়েছি (রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী) তাদের মধ্যে রাষ্ট্রনায়কসুলভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্র্যের অধিকারী ব্যক্তিত্বের সংখ্যা ছিল খুবই কম। ফলে তাদের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের ফলে দেশ সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারেনি। এতে দেশের উন্নয়নের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি কীভাবে উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাট করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক পরিচয়ে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করা হয়েছে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব রোর্ডের গোয়েন্দা শাখা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তারা বিভিন্ন দেশে বিগত সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে। এখানেই শেষ নয়, বিগত সরকারের আমলে সরকারি সমর্থনে যারা অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন তারা সব অর্থ বিদেশে পাচার করতে পারেননি। লুণ্ঠিত অর্থের বেশির ভাগই দেশে রয়ে গেছে। অর্থের প্রতি অন্ধলোভ কিছু মানুষকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তোলে। তাদের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য হচ্ছে টাকা কামানো, যা বৈধভাবে হোক বা অবৈধভাবে হোক। বিগত সরকার নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র পক্ষ শক্তি এবং দেশপ্রেমিক বলে প্রচার করতেন। কিন্তু একজন দেশপ্রেমিক মানুষ কখনই অর্থলোভী হতে পারেন না। জাতির ক্ষতি হবে এমন কোনো কাজ করতে পারেন না। কিন্তু সরকারের এমন একজন মন্ত্রীও পাওয়া যাবে না যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের অভিযোগ নেই।
একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক নাগরিক রাষ্ট্রের চেয়ে ঊর্ধ্বে কোনো কিছুকে স্থান দিতে পারেন না। কিন্তু আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষের মধ্যে এই চেতনাবোধ নেই বললেই চলে। তারা সব সময় রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তবে আশার কথা যে, এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে অধিকাংশ সময় এরাই দেশ শাসন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তারা সংকীর্ণ ব্যক্তি অথবা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের এই অন্যায় কর্ম কখনই প্রতিবাদহীনভাবে মেনে নেয়নি। বাংলাদেশের মানুষ বীরের জাতি। তারা জাতির যে কোনো সংকটে নিজের জীবন দিয়ে হলেও সংকট মোচনের চেষ্টা করেছে। এই জাতি যেমন যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তেমনি আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থেকেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও গণমানুষ তাদের অধিকার ফিরে পায়নি। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের ক্ষমতালিপ্সা জাতিকে বারবার বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। স্বাধীনতার পর দেশের মানুষ আশার আলোর স্বপ্ন দেখেছিল। তারা মানুষের মতো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ধুলোয় লোটাতে খুব একটা সময় লাগেনি। তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাড়ে তিন বছরের স্বেচ্ছাচারী শাসনের কবলে পড়ে মানুষের প্রত্যাশা ভেস্তে যায়। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দেশকে নরকে পরিণত করা হয়। একপর্যায়ে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রক্ষমতা চিরস্থায়ী করার মানসে একদলীয় বাকশাল গঠনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়। একই বছর ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। তার পর দেশে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়। কিন্তু সেই রাস্তা মোটেও কুসুমাকীর্ণ ছিল না। আমাদের দেশের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিকভাবে সরকার গঠনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের মাঝে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এই দুটি প্রত্যাশা অধরাই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মানুষ বারবার তাদের অধিকার আদায়ের জন্য চরম মূল্য দিয়েছে। স্বাধীনতার পর জাতির ঘাড়ে চেপে বসে দেশীয় স্বৈরাচার। ১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরাচার এইচএম এরশাদের বিরুদ্ধে তিনদলীয় জোট দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। তিনদলীয় জোটের রূপরেখা মোতাবেক দেশ পরিচালিত হবে। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। বাংলাদেশের যে ৪টি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় সেগুলোই ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে অবিতর্কিত এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেসব জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার কোনোটিতেই একটি রাজনৈতিক দল পরপর দুবার সরকার গঠন করতে পারেনি। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কোনো পর্যায়েই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
তত্ত্বাবধায় সরকার পদ্ধতি যদি বাতিল করা না হতো তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে পারত। কিন্তু ব্যক্তির খায়েশ পূরণ করতে গিয়ে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে। যদিও এক সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তাদের আন্দোলনের কারণে অনেক জীবনহানি হয়েছিল। ক্ষমতার প্রতি অতিলোভের কারণেই সাবেক স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা গর্ব করে বলতেন, আগামী একশ বছরেও আওয়ামী লীগকে কেউ ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে না। তাদের সেই দর্পচূর্ণ হতে এক বছরও লাগেনি। বাংলাদেশের মানুষ দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হলে অসাধ্য সাধন করতে পারে তার প্রমাণ দেখিয়েছে ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো নিয়মিত সরকার নয়। অনির্বাচিত সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। দেশকে গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত করা এবং মানবকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বেশ কিছু সংস্কার কার্যক্রম শুরু করা। যারা বিগত সরকার আমলে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন বা দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করেছেন তাদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংস্কার কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। আর মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তির বিধান করার জন্য বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। এই মুহূর্তে দেশের মানুষের প্রত্যাশা হচ্ছে, একটি নতুন গণতান্ত্রিক, মানবকল্যাণমূলক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য এই মুহূর্তে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত সময়সূচি মোতাবেক, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে অর্থাৎ পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। তার পরও নির্বাচন নিয়ে যেটুকু অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ।
প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের আলাদা কর্মসূচি থাকে। যেসব রাজনৈতিক দল ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে শামিল ছিল বা সমর্থন করেছে তারা সবাই চায় দেশে কার্যকর, উদার এবং কল্যাণমূলক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হোক। এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক যেখানে আর কোনো স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি বাংলাদেশকে সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায় তাহলে কোন্ পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে তা নিয়ে মতান্তর থাকা উচিত নয়। কেউ বলছে, নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হোক। এটাই দেশের জন্য কল্যাণকর হবে। আবার অন্য পক্ষ বলছে, নির্বাচন সনাতন পদ্ধতিতেই অনুষ্ঠিত হোক। আমাদের মনে রাখতে হবে, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কার হঠাৎ করেই সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া বিচার প্রক্রিয়া চাইলেই তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এজন্য সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। তাই সংস্কার অসমাপ্ত রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত নয় এমন যুক্তি ধোপে টেকে না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে নির্বাচিত সরকার এসে তা বাস্তবায়ন করবে। সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং অপরাধীদের বিচারের অজুহাতে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করা কোনোভাবেই সঙ্গত হবে না। রাজনৈতিক দলগুলো যদি মনে করে, দেশ সবার ওপরে তা হলে এসব বিষয় নিয়ে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়। রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে এসব সমস্যা খুব সহজেই সমাধান করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি। দেশের স্বার্থকে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।
কাজেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রচলিত পদ্ধতিতেই হতে পারে। নির্বাচনে যাতে ভোটাররা প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যেতে পারে। নির্বাচনে যাতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচব। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে। কাজেই ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ ত্যাগ করে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোনো কারণে সৃষ্ট ঐক্যে ফাটল ধরলে পরাজিত ফ্যাসিবাদ আবারও ফিরে আসতে পারে। সেই দুঃসহ কালো অধ্যায় জাতির জীবনে আবারও ফিরে আসুক নিশ্চয়ই আমরা তা চাইতে পারি না। কাজেই এই মুহূর্তে সব রাজনৈতিক দলকে সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে এবং দেশের স্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দিতে হবে।
অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
বর্ষার সময় শহর কিংবা গ্রামের খাল-বিল, নদ-নালা, ডোবা ও অন্যান্য জলাশয়ের তীর দিয়ে হাঁটলে চোখে পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য—নদীর জলে ভেসে চলা অসংখ্য রিং বা চায়না দুয়ারি জাল। এই জালগুলো নানা আকৃতিতে তৈরি, যার মধ্যে মাছের পোনা, ছোট মাছ, এমনকি অন্য জলজ প্রাণীও আটকে পড়ে। অথচ সরকারিভাবে এই জাল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তবুও বিক্রেতা এবং জেলেরা এই জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করছে—যা দেশের জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিভিন্ন খাল, বিল, ডোবা এবং নদীতে মোট ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ দেখা যায়। এর মধ্যে ছোট মাছের সংখ্যা ১৪৩ প্রজাতি। উল্লেখযোগ্য প্রজাতির মধ্যে আছে—মলা, ঢেলা, চেলা, পুঁটি, শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা, কাজলি, বাতাশি, টেংরা, বাচা, টাকি, চেং, কাকিলা, বোটা, ভাংনা, টাটকিনি, বৌ-মাছ, চাপিলা, বাইম, খলিশা, কৈ, বেলে, চান্দা, চিংড়ি। তবে এদের মধ্যে ১২ প্রজাতি চরম বিপন্ন, ২৮ প্রজাতি বিপন্ন এবং ১৪ প্রজাতি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে।অতীতে নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয়ে দেশীয় মাছের প্রাচুর্য ছিল অপরিসীম। গ্রামের মানুষজন তাদের দৈনন্দিন জীবিকা, খাদ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য এসব মাছের ওপর নির্ভর করতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জলাশয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস, রাসায়নিক ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার, খাল-বিল ভরাট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশীয় মাছের সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এই সংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারি জালের অবাধ ব্যবহার।রিং বা চায়না জাল এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, একবার মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণী জালে আটকে গেলে তারা মুক্ত হতে পারে না। মাছ শিকারিরা প্রয়োজনীয় মাছ রেখে বাকি মাছ এবং জলজ প্রাণী ধ্বংস করে ফেলে। বিশেষ করে বোয়াল, পাবদা, গুচি, চেংড়ি, ময়া, টেংরা, টাকি মাছের পোনা ও ছোট মাছ বিলুপ্তির পথে। এভাবে অবৈধ মাছ শিকার শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে না, বরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও প্রভাব ফেলছে।এ ধরনের অবৈধ শিকারের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কার্যক্রম সময়ে সময়ে সীমিত। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ‘মানুষ দেখানো’ অভিযান হলেও, বাস্তবে শাস্তি কার্যকর হয় না। ফলে জেলেরা আরও বেপরোয়া হয়ে এই নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করছে। নদী ও খাল থেকে মাছের পোনা এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী ধ্বংসের এই প্রক্রিয়ার কারণে ভবিষ্যতে মুক্ত জলাশয়ে মাছের অভাব এবং প্রজাতির বিলুপ্তি নিশ্চিত।রিং জাল ব্যবহার শুধু মাছের পোনা ও ছোট মাছ ধ্বংস করছে না, বরং জলজ জীববৈচিত্র্যকে পুরোপুরি বিপন্ন করে দিচ্ছে। এই জাল দিয়ে মাছ শিকারের সময় একবার জালে আটকে গেলে মাছ সহ জলজ প্রাণী দীর্ঘ সময় বন্দি থাকে। পরিশেষে শিকারীরা প্রয়োজনীয় মাছ রেখে বাকি মাছ ও অন্যান্য প্রাণী মেরে ফেলে। ফলে এক ধরনের ‘মরণ ফাঁদ’ তৈরি হচ্ছে, যা পরিবেশ এবং মাছ সংরক্ষণের জন্য একেবারে ধ্বংসাত্মক।পেশাদার ও সৌখিন মৎস্য শিকারিরা এই জাল ব্যবহার করে বড় আয়ের লক্ষ্য রাখলেও দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভবিষ্যতের প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করছে। এ কারণে সরকারের দায়িত্ব আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আইনগত ব্যবস্থা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা, অবৈধ জাল নিয়ন্ত্রণ এবং প্রচলিত মাছ শিকারের নিয়মাবলি মেনে চলা নিশ্চিত করা জরুরি।একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। নদী, খাল, বিল ও জলাশয়ে মৎস্য শিকারের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা না হলে, আমাদের ভবিষ্যতের প্রজন্মের খাদ্য ও জীবিকাশ্রয় হুমকির মুখে পড়বে। সরকারি উদ্যোগে প্রয়োজনীয় জাল উচ্ছেদ, মাছের প্রজনন রক্ষা, এবং স্থানীয় জেলেদের প্রায়শঃ নিরাপদ ও বৈধ পদ্ধতিতে মাছ শিকার করার জন্য সহযোগিতা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।একসময় দেশীয় জালের পরিবর্তে কারেন্ট জাল ও সুতি জাল ছিল মৎস্যজীবীর মূল সম্বল। তবে কালের বিবর্তনে আধুনিক ও নতুন ধরনের মাছ শিকারের যন্ত্রপাতি চলে এসেছে। কিন্তু এসব আধুনিক ফাঁদে মাছ শিকার করতে গিয়ে ছোট-বড় সব ধরনের মাছের পোনা ও অন্য জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে। পেশাদার ও সৌখিন শিকারিরা নিজেদের সুবিধার্থে মাছ শিকার চালাচ্ছে, যা দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।যে কোনো প্রকল্পের সাফল্য নির্ভর করে প্রশাসনিক তৎপরতা, আইন প্রয়োগ ও জনগণের সচেতনতার ওপর। রিং বা চায়না জাল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও এটি কার্যকরভাবে ধ্বংস না করলে ভবিষ্যতে দেশের জলজ প্রাণীর বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। এজন্য সরকারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় মৎস্য অধিদপ্তর এবং সাধারণ জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে।নদী, খাল, বিল এবং জলাশয় শুধু মাছের উৎস নয়, বরং আমাদের জীবিকাশ্রয় এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য অপরিহার্য। এগুলো রক্ষা না করলে আমরা কেবল খাদ্য নিরাপত্তা হারাব না, বরং দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট হবে। রিং বা চায়না জাল ধ্বংস করে দেশের জলজ প্রাণী ও প্রাকৃতিক সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের অন্যতম জরুরি দাবি।যদি অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের নদী-বিল থেকে দেশীয় মাছের প্রজননশীল পোনা বিলুপ্ত হতে পারে। এটি শুধুমাত্র মৎস্যশিল্পের জন্য নয়, দেশের পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও এক বিরাট সংকট। তাই সচেতনতা, আইনের কঠোর প্রয়োগ, এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে রিং বা চায়না জালের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে—এটাই একমাত্র সমাধান।
সেলিম রানা, কলামিস্ট
বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস যেন এক দীর্ঘ অনিশ্চয়তার কাহিনী। ‘সুষ্ঠু এবং ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন-এই দুই শব্দই বহু বছর ধরে জনমানসে আস্থার সংকট সৃষ্টি করেছে। কারও কাছে নির্বাচন মানে একদিনের উৎসব, আবার কারও কাছে তা একেবারেই অচল গণতন্ত্রের প্রতীক। গত দেড় দশকে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলো এই সন্দেহকেই প্রবল করেছে। বিরোধী দলের অনুপস্থিতি, ভোটকেন্দ্র ফাঁকা পড়ে থাকা, ‘রাতের ভোট’-এর অভিযোগ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দলীয়করণ-সব মিলিয়ে জনমনে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২৬ সালের সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনীতির আঙিনায় আবারও ঝড় উঠেছে। প্রশ্ন একটাই-এবার কি সত্যিই একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ভোট হবে? নাকি আগের মতোই নিয়ন্ত্রিত প্রহসনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে? সাধারণ ভোটার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক-সবার কণ্ঠেই তাই একই দ্বিধা ও উৎকণ্ঠা। একদিকে জনগণের প্রত্যাশা প্রবল; অন্যদিকে শঙ্কার ছায়াও ঘন। রাজনীতির ময়দান যেমন দুই ভাগে বিভক্ত, তেমনি আন্তর্জাতিক মহলও কড়া দৃষ্টি রেখেছে ঢাকার দিকে। অনেকে বলছেন, শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা থাকলেই হবে না। অতীত অভিজ্ঞতা বলে দিয়েছে, ক্ষমতার লড়াইয়ে দলগুলো নিজেদের স্বার্থকেই আগে দেখবে। তাই জনগণ এখন তাকিয়ে আছে আন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দিকে। আরেকটি দিকে-যে শক্তি অতীতে কখনও আস্থার প্রতীক হয়েছে, আবার কখনও সমালোচিতও হয়েছে। সেই শক্তি হলো সেনাবাহিনী। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ২০২৬ সালের নির্বাচন নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য হবে কিনা, তার বড় নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়াবে সেনাবাহিনীর ভূমিকা। এই বাস্তবতায়, সেনাবাহিনীকে ঘিরে জনআশা ও আশঙ্কার ভারসাম্য কীভাবে দাঁড়াচ্ছে-তা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি।
হাসিনা আমলের নির্বাচনী সংশয়-অভিজ্ঞতার স্মৃতিতে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ তিনটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ভোটার আচরণে ‘শেখা অসহায়ত্ত’তৈরি করেছে: অনেকে বিশ্বাস করেন, ফল আগে-থেকেই নির্ধারিত; ভোটে যাওয়া সময়ের অপচয় ও ঝুঁকি। এই মানসিকতা ভাঙতে কেবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়; দরকার ‘প্রসেসিভ জাস্টিস’-প্রক্রিয়াগত ন্যায়বিচারের দৃশ্যমান প্রমাণ। যেমন: আগাম রাতে ব্যালট সুরক্ষা, ব্যালট-বক্স/ভোটকক্ষ লাইভ-লগিং, ইন্টারনেট সচল রাখা, অভিযোগ-ডেস্কে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ কর্মকর্তা, এবং ‘টাইম-বাউন্ড রেড্রেসাল’। প্রতিটি ধাপে যদি মানুষ দেখে-একটি অভিযোগ উঠলেই তাৎক্ষণিক নথিভুক্ত হয়, ভিডিও-ফিড রিভিউ হয় এবং অপকৃতির শাস্তি/পুনঃভোটের সিদ্ধান্ত হয়-তবে ২০২৫-এর ‘রিপিট রিস্ক’কমে। সেনাবাহিনীর ভূমিকা এখানে ‘ফেসিলিটেটর অব প্রসেস’-কার্যকর, দৃশ্যমান ও জিরো-টলারেন্স।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসে সেনাবাহিনীকে দুইটি পরস্পর-সম্পর্কিত কারণে আস্থার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়: (ক) সার্বভৌমত্ব রক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং (খ) রাজনৈতিক দলীয় দ্বন্দ্বের বাইরে তুলনামূলকভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নিয়মানুবর্তী প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়। সাম্প্রতিক দশকে আমলাতান্ত্রিক ও পুলিশি কাঠামোতে দলীয়করণের অভিযোগ প্রবল হওয়ায় সাধারণ নাগরিকের ‘ন্যূনতম নিরপেক্ষতার’ প্রত্যাশা প্রায় এককভাবে সেনাবাহিনীর প্রতি কেন্দ্রীভূত হয়েছে। গণমাধ্যম জরিপে এই আস্থার ধারাবাহিকতা ফুটে উঠলেও বাস্তব প্রয়োগে প্রশ্ন হলো-কোন শর্তে এই আস্থা কার্যকরভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়? অভিজ্ঞতা বলছে, শুধুমাত্র উপস্থিতি নয়; স্পষ্ট ম্যান্ডেট, অপারেশনাল স্বাধীনতা, দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও জবাবদিহিমূলক কমান্ড-চেইন নিশ্চিত হলেই ভোটকক্ষভিত্তিক নিরাপত্তা তৈরি হয়। মনস্তাত্ত্বিকভাবে ‘ডিটারেন্স’ বা ভীতি-নিবারক প্রভাব তখনই জন্ম নেয়, যখন সম্ভাব্য গণ্ডগোলকারীরা বুঝতে পারে-কারচুপি বা সহিংসতার চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক, দৃশ্যমান ও সমানভাবে আইনপ্রয়োগ হবে। ফলে আস্থার প্রতীক হওয়া কেবল ভাবাবেগ নয়, এটি প্রক্রিয়াগত নকশা, স্বচ্ছতা ও বাস্তব প্রয়োগের ফাংশন; যার অনুপস্থিতিতে সেনাবাহিনীর মর্যাদা প্রতীকী হয়ে পড়ে, কার্যকারিতা কমে যায়।
ভোটকেন্দ্রে সেনা মোতায়েনের কার্যকারিতা: ১৯৯১/১৯৯৬/২০০১-এর অভিজ্ঞতা দেখায়-শৃঙ্খলাবদ্ধ, ক্ষমতাসম্পন্ন ও দ্রুত-প্রতিক্রিয়াশীল সেনা-উপস্থিতি ভোটদানে আস্থা বাড়ায়। ২০১৮-তে সীমিত ম্যান্ডেটের ফলে উপস্থিতি ‘সিম্বলিক’ হয়ে পড়ে। শিক্ষা: (ক) কেন্দ্র-পর্যায়ে স্পষ্ট ‘রুলস অব এনগেজমেন্ট’-কখন সতর্কতা, কখন আটক, কখন পুনঃভোটের সুপারিশ; (খ) ‘এসক্যালেশন-ম্যাট্রিক্স’-ঘটনা-স্তর নির্ভর প্রতিক্রিয়া (ভাঙচুর/দখল/হামলা/ব্যালট কারচুপি); (গ) একীভূত কমান্ড-সেন্টার-ইসির সঙ্গে রিয়েল-টাইম লিঙ্ক, ভিডিও-ফিড ও জিপিএস-ট্র্যাকিং। তবেই ভোটকক্ষের ‘ফ্লোর কন্ট্রোল’ সম্ভব হয় এবং কারচুপির উইন্ডো সঙ্কুচিত হয়।
প্রশাসন ও পুলিশের দলীয়করণ যেন না থাকে। নির্বাচনের আগে ও চলাকালে প্রশাসন/পুলিশের পক্ষপাত অথবা ভয়-ভীতি সৃষ্টির অভিযোগ একটি ‘স্ট্রাকচারাল ডিফেক্ট’-যেখানে বদলির রাজনীতি, মামলা-ব্যবস্থার রাজনৈতিক ব্যবহার, এবং ক্যারিয়ার-ইনসেনটিভের বিকৃতি মিলেমিশে প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতাকে ক্ষয় করে। এই ক্ষয় যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন কেবল নির্বাচন কমিশনের আহ্বান বা প্রশাসনিক সার্কুলার দিয়ে নিরপেক্ষতা ফেরানো যায় না; দরকার ‘থার্ড-পার্টি এনফোর্সমেন্ট। এখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি মধ্যস্থ শক্তি হিসেবে কাজ করে: (ক) পুলিশি একচ্ছত্রতা কমে, (খ) নির্বাচনী এলাকায় ‘চেকস-অ্যান্ড-ব্যালান্সেস’ তৈরি হয়, (গ) প্রিসাইডিং অফিসার থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ওপরে চাপ কমে। তবে শর্ত হল—সেনাবাহিনীর দায়িত্বসংজ্ঞা স্পষ্ট, নাগরিক অধিকার রক্ষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ-নির্দেশনা দৃশ্যমান এবং যেকোনো অভিযোগের দ্রুত স্বাধীন তদন্তের ব্যবস্থা রাখতে হবে; নইলে ‘মিলিটারাইজড পোলিং’ নিয়ে পাল্টা অবিশ্বাস জন্মাতে পারে।
বৈশ্বিক গণতন্ত্রের মানদণ্ড এখন কেবল ভোটগ্রহণে সীমাবদ্ধ নয়; ‘ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল’-এই তিন স্তরের গ্রহণযোগ্যতা একসঙ্গে নিশ্চিত করতে হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কমনওয়েলথ বা জাতিসংঘ-সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকেরা যখন সেনাবাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতির কথা বলেন, এর পেছনে তিনটি যুক্তি কাজ করে: (ক) প্রশাসন-নিরপেক্ষতার ঘাটতি পূরণের ‘ট্রাস্ট-সাপ্লিমেন্ট’, (খ) সহিংসতা-প্রবণ নির্বাচনী ভূগোল-গ্রামীণ/শহুরে ‘হটস্পট’-এ দৃশ্যমান শক্তি প্রক্ষেপণ, এবং (গ) ফল-গ্রহণযোগ্যতার ন্যূনতম শর্ত পূরণ। দেশীয় সক্ষমতার প্রশ্নে তাই প্রয়োজন ‘হাইব্রিড মডেল’: নির্বাচন কমিশনের নীতিনির্ধারণ; মাঠে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ-র্যাব-আনসার-আর নিরপেক্ষ ‘ওভারওয়াচ’ ও ‘র্যাপিড কারেকটিভ’ হিসেবে সেনাবাহিনী। এই বিন্যাস আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে সহায়ক, কারণ দায়িত্ব বণ্টন স্পষ্ট, জবাবদিহি নির্ধারিত এবং মানবাধিকার-সম্মত আচরণবিধি প্রয়োগযোগ্য হয়।
এদিকে ইন্টারনেট বন্ধ করা আধুনিক কালে নির্বাচনী স্বচ্ছতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আঘাত; এতে ভোটকেন্দ্রের ‘আই-উইটনেস’ হারিয়ে যায়। করণীয়: (ক) নির্বাচনী সময়ে ইন্টারনেট-শাটডাউন নিষিদ্ধ করার আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক প্রোটোকল; (খ) সেনাবাহিনীর সাইবার/সিগন্যাল কর্পসকে ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার মনিটর’ হিসেবে নিয়োগ-কোনো এলাকার ব্যান্ডউইথ অস্বাভাবিকভাবে কমলে তৎক্ষণাৎ রিপোর্ট; (গ) কেন্দ্রভিত্তিক সিসিটিভি-ফিডের নির্ভরযোগ্য ব্যাকআপ (লোকাল + ক্লাউড), যাতে ‘ব্ল্যাকআউট’ হলেও প্রমাণ থাকে। এতে ডিজিটাল কারচুপির ঝুঁকি কমে এবং তথ্যপ্রবাহে জনগণের আস্থা বজায় থাকে। তরুণ ভোটারের আস্থা-পলিটিক্যাল ইফিকেসি, প্রমাণভিত্তিক সংকেত ও অংশগ্রহণের নতুন ব্যাকরণ তৈরি করবে। ৪ কোটিরও বেশি তরুণ ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে আনতে হলে ‘বিশ্বাসযোগ্য সংকেত’ দিতে হবে-কথায় নয়, প্রমাণে। যেমন: প্রথম দুই ঘণ্টায় প্রতিটি কেন্দ্রে সেনা-টহল দৃশ্যমান; সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ ‘ইনসিডেন্ট ড্যাশবোর্ড’; অভিযোগ করলে ৩০ মিনিটে টিম পৌঁছাবে-এমন এসএলএ প্রকাশ। পাশাপাশি তরুণদের জন্য ভোটকেন্দ্রে কিউ-ম্যানেজমেন্ট, বিশেষ সহায়তা ডেস্ক, প্রতিবন্ধীবান্ধব ব্যবস্থা ও নিরাপদ যাতায়াত কোরিডর ঘোষণা করা যেতে পারে। যখন তরুণ দেখে ‘সিস্টেম আমার জন্য প্রস্তুত’, তখনই তাদের রাজনৈতিক সক্ষমতার বোধ জাগে। সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ পাহারা এই বার্তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।
বাংলাদেশের নির্বাচন আঞ্চলিক পরিসরে ‘সিকিউরিটি এক্সটারনালিটি’ তৈরি করে-শরণার্থী প্রবাহ, সীমান্ত-টানাপোড়েন, লজিস্টিকস করিডর, ব্লু-ইকোনমি। সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ইমেজ দুইভাবে গুরুত্বপূর্ণ: (ক) প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক শক্তির কাছে স্থিতিশীলতার বার্তা-নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা নিয়ন্ত্রণযোগ্য; (খ) কূটনৈতিক দরকষাকষিতে নৈতিক উচ্চভূমি-‘আমরা প্রক্রিয়া-নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে সশস্ত্র বাহিনীকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়োজিত করেছি’। এতে নিষেধাজ্ঞা/ভিসা-নীতির ঝুঁকি কমে, উন্নয়ন সহযোগিতার ধারাবাহিকতা বাড়ে। অর্থনীতি অনিশ্চয়তাকে অপছন্দ করে। একতরফা নির্বাচনের আশঙ্কা ‘পলিটিক্যাল রিস্ক প্রিমিয়াম’ বাড়ায়-ঋণ ব্যয়, বিমা, ইনভেন্টরি কস্ট সব ওঠে। সমাধান: নির্বাচনী ক্যালেন্ডার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ‘সিকিউরিটি অ্যান্ড স্টেবিলিটি প্লেবুক’ প্রকাশ-কোন জেলায় কত প্লাটুন, শিল্পাঞ্চলে ২৪/৭ কুইক-রেসপন্স,পোর্ট/কাস্টমস/হাইওয়েতে সুরক্ষা কোরিডর। চেম্বার/বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে জয়েন্ট কমান্ড সেল খোলা যায় যাতে সরবরাহ-শৃঙ্খল ব্যাহত না হয়। সেনা-নেতৃত্বাধীন এই স্থিতিশীলতা সংকেত বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়ায়, বাজারে ভোলাটিলিটি কমায়।
গ্রামে ‘লোকাল নেটওয়ার্ক’-ইউনিয়ন-ভিত্তিক তদারকি, চৌকিদার-দারোয়ান, দলীয় প্রভাবশালী-ভোটকেন্দ্র দখলকে সহজ করে। প্রতিকার: (ক) মাইক্রো-জিওগ্রাফিক রিস্ক স্কোরিং-গত নির্বাচনের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ভূগোলগত দূরত্ব মিলিয়ে কেন্দ্রে-ভিত্তিক ঝুঁকিমাত্রা; (খ) ঝুঁকি-উচ্চ কেন্দ্রে আগাম ‘স্ট্যাটিক’ সেনা-পোস্ট; (গ) নারী-ভোটারের জন্য আলাদা নিরাপদ প্রবেশপথ ও টহল; (ঘ) রাত-সার্ভেইলেন্স-গ্রামীণ রাস্তায় মোবাইল প্যাট্রোল ও ড্রোন নজরদারি। এতে ‘ব্যালট বাক্স ভরার’ ঐতিহ্যগত অবকাশ কমে, এবং গ্রামীণ ভোটার সাহস পায়।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ যেন এক সুস্পষ্ট বার্তা-সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তবে এখানে ‘নিরাপত্তা’ শব্দের অর্থ কেবল বাহ্যিক হুমকি থেকে রক্ষা নয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখা, স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ নিশ্চিত করা। সংবিধান ভোটাধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা মানেই দেশের সার্বভৌমত্বের ক্ষতি, এবং নিরাপত্তার ঘাটতি তৈরি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যদি কেন্দ্রগুলো দখল হয়ে যায়, ভোটাররা ভয়ে ঘরে থাকে, বা ব্যালট আগেই ভর্তি হয়ে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের সেই মৌলিক অধিকার কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এটি শুধু ভোটের প্রসঙ্গ নয়, পুরো দেশের গণতান্ত্রিক অস্তিত্বের প্রশ্ন। এ ধরনের পরিস্থিতি রোধ করাই সেনাবাহিনীর সাংবিধানিক দায়িত্ব। কারণ নিরাপত্তা মানে কেবল জীবন বাঁচানো নয়; মানুষের রাজনৈতিক অস্তিত্ব, নাগরিক অধিকার এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেও রক্ষা করা। সংবিধান জনগণের সার্বভৌমত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, আর জনগণের ভোট ছাড়া সেই সার্বভৌমত্বের কোনো অর্থ থাকে না।
সেনাবাহিনী যদি ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসে, তা কেবল রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নয়-বরং সংবিধান রক্ষার সরাসরি প্রয়াস। এটি হবে গণতন্ত্রকে মর্যাদা দেওয়া, জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন করা এবং দেশের ভবিষ্যৎকে সংহত করার এক বড় দায়িত্ব। এই দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে, নির্বাচন আর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। ফলে সেনাবাহিনীকে এই মুহূর্তে নিরপেক্ষভাবে এবং দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিতে হবে—যা হবে সাংবিধানিক কর্তব্য, নৈতিক দায়িত্ব এবং দেশের প্রতি দীর্ঘমেয়াদি দায়বদ্ধতার স্বীকৃতি।
উপসংহার: বাংলাদেশের মানুষ এখন অনন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপর গণতন্ত্রে বিশ্বাস রাখে। তবে হাসিনা আমলের বারবার প্রহসনমূলক নির্বাচন সেই বিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যখন ভোটকেন্দ্রগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে, অথচ ফলাফল আগেই লেখা হয়ে যায়, তখন সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করে-আমাদের মতামতের কি কোনো মূল্য আছে? দীর্ঘ মেয়াদি এ ধরনের পরিস্থিতি গণতন্ত্রকে মৃতপ্রায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়। জনগণ রাজনীতির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়, বিমুখ হয় এবং ধীরে ধীরে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এই মুহূর্তে জাতির প্রত্যাশা একটাই-বর্তমান সরকার এবং সেনাবাহিনী দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবে, ভোটকেন্দ্রকে নিরপেক্ষ করবে এবং নাগরিকদের নিরাপদ পরিবেশে ভোট দেওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করবে। সরকার এবং সেনাবাহিনী যদি সত্যিকারের নির্বাচন আয়োজন করতে পারে, তারা কেবল একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, বরং পুরো জাতির ভবিষ্যৎকে বাঁচাবে। এটি হবে দেশের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক, যা ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক মান, জনগণের আস্থা এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদা সবকিছুকে পুনঃসংহত করবে। অন্যথায়, বাংলাদেশ আবারও অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক সংকট এবং গণতান্ত্রিক ব্যর্থতার অন্ধকারে ঠেলে যাবে। প্রতারণামূলক নির্বাচনের কারণে রাষ্ট্রব্যবস্থা দুর্বল হবে, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এবং জনগণ রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই আজকের এই মুহূর্তে সরকার ও সেনাবাহিনীর দায়িত্ব শুধু নির্বাচন নয়, বরং জাতিকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা। এই পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ হলে আগামী প্রজন্ম কৃতজ্ঞ থাকবে; ব্যর্থ হলে ইতিহাসের কঠিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
সরকার এবং সেনাবাহিনী যদি নিরপেক্ষ ও দৃঢ় অবস্থান দেখায়, তবে তারা কেবল ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করবে না, বরং দেশের গণতন্ত্রকে নতুন প্রাণ দেবে, জনগণের আস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে এবং জাতীয় ভবিষ্যতের রূপটাই স্থির করবে। এটি হবে এক যুগান্তকারী অধ্যায়, যা ইতিহাসে উজ্জ্বলভাবে লেখা থাকবে।
লেখক : মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবষেক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।s
কচ্ছপ চলাফিরায় একটি ধীরস্থির প্রাণী। আর এটিকে ঘিরে অতি প্রাচীনকালে অর্থাৎ কয়েক হাজার বছর আগেই প্রখ্যাত লেখক ঈশপ কচ্ছপ ও খরগোশের গল্পে তা তুলে ধরেছেন। যাহোক, প্রাণী জগতের মধ্যে দৈহিক কাঠামোগত দিক দিয়ে কচ্ছপ অদ্ভুত বিধায় সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। কাছিম টেস্টুডিনেস বর্গে আওতাভুক্ত। সাধারণত বাংলাদেশে ২৭ প্রজাতির কাছিম পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। দুঃখের বিষয় হলো যে, আগে গ্রাম্য জনপদে কচ্ছপ দেখা গেলেও, এখন আর তেমন দেখা যায় না। বস্তুত কচ্ছপ হলো সরীসৃপের একটি ক্রম, যা টেস্টুডিন নামে পরিচিত। এদেরকে প্রধানত পাঁজর থেকে বিকশিত একটি শেল দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সাধারণত কচ্ছপ দুটি প্রধান দলে বিভক্ত: পার্শ্ব-ঘাড়ের কচ্ছপ এবং লুকানো ঘাড়ের কচ্ছপ। মূলত এই দল দুটি মাথা ভেতরে প্রত্যাহার করার পদ্ধতিতে ভিন্ন। এদিকে বিহঙ্গ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ অন্যান্য সরীসৃপদের মতো কচ্ছপেরা বাতাসে শ্বাস নেয় এবং পানির উপরে ডিম দেয়। তবে এর অনেক প্রজাতি পানিতে বা তার চারপাশে বাস করে। আর জেনেটিক প্রমাণ অনুযায়ী সাধারণত তাদের কুমির এবং পাখির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আর কচ্ছপের খোলস বেশিরভাগই হাড় দিয়ে তৈরি। উপরের অংশটি গম্বুজযুক্ত ক্যারাপেস এবং নীচের অংশটি ফ্ল্যাটার প্লাস্ট্রন বা বেলি-প্লেট। মজার ব্যাপার হলো যে, এদের বাইরের পৃষ্ঠ কেরাটিন, চুল, শিং এবং নখর উপাদান দিয়ে তৈরি আঁশ দিয়ে আবৃত এবং ক্যারাপেস হাড়গুলি পাঁজর থেকে বিকশিত হয়, যা পাশের দিকে বৃদ্ধি পায় এবং চওড়া সমতল প্লেটে বিকশিত হয়। এই চওড়া সমতল প্লেট শরীরকে ঢেকে দেয়। কচ্ছপ হলো ইক্টোথার্ম বা ‘ঠাণ্ডা রক্তযুক্ত’, যার অর্থ তাদের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা সরাসরি পরিবেশের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এরা সাধারণত সর্বভুক।
সাগর কিংবা নদীর তীর, এমনকি অনেকসময় পুকুর, জলাশয় ইত্যাদিতে মাথা তুলে রাখা অবস্থায় দেখা মেলে। আবার মাঝে মধ্যে ডাঙাতেও দেখা যায়। সাধারণ মানুষের ভাষায় এরা সবই কচ্ছপ বা কাছিম বলে পরিচিত হলেও, বই-পুস্তকের ভাষাতে যারা পানিতে বাস করে তাদেরকে কাছিম, স্থলে বাস করলে কচ্ছপ এবং যারা ঈষৎ লবণাক্ত পানিতে বাস করে তাদের টেরাপিন বলে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, কাছিম ও কচ্ছপের বেশ পার্থক্য বিদ্যমান। কচ্ছপ ও কাছিম দুটি ভিন্ন প্রাণী, যা চোখে দেখেই সহজে আলাদা করা যায়। পূর্বেই কিছুটা উল্লেখ করেছি যে, কচ্ছপ স্থলজ প্রানী, জীবনের বেশির ভাগ সময় স্থলে কাটায়। তৃষ্ণা পেলে কেবল পানির সংস্পর্শে আসে। অন্যদিকে কাছিম জলজ প্রাণী। আর কচ্ছপ স্থলে থাকার কারণে এর পিঠে শক্ত গোলাকার খোলস থাকে। নিজেদের আত্মরক্ষার্থে এটি তাদের প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু কাছিমের পিঠে খুব একটা শক্ত খোলস থাকে না বিধায় পাতলা খোলসের কারণে তারা অনায়াসে পানিতে সাঁতার কাটতে পারে। এদিকে বেশির ভাগ কচ্ছপই তৃণভোজী হয়ে থাকে। অন্যদিকে কাছিম সর্বভুক; মাছ, মাংস, ফলমূল, সবজি, কোনো কিছুতেই এদের ‘না’ নেই। কিছু ব্যতিক্রমধর্মী প্রজাতি ছাড়া কচ্ছপ সাধারণত কয়েক সেন্টিমিটার থেকে দুই মিটার পর্যন্ত বড় হয়। দিবাচর প্রাণী হিসেবে কচ্ছপ পরিচিত। তবে দলবদ্ধ হয়ে জীবনযাপনে খুব একটা অভ্যস্ত না। জীবনকালের দিক থেকে কচ্ছপ কাছিমের চেয়ে অনেক বেশি বছর বেঁচে থাকে। কচ্ছপ সাধারণত ৬০ থেকে ৮০ বছর বাঁচে, কিছু ক্ষেত্রে শত বছরও পার হয়ে যায়। সে তুলনায় কাছিমের জীবনকাল অনেক কম, মাত্র ২০ থেকে ৪০ বছর। আর কাছিমের পায়ের আঙ্গুলগুলোর মাঝে বুনট চামড়ার জাল থাকে। কিন্তু কচ্ছপের এ রকম থাকে না, যার কারণে কচ্ছপ মাটিতে হাঁটতে পারলেও কাছিম পারেনা। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২৩ মে ‘বিশ্ব কাছিম দিবস’ হিসাবে পরিচিত। মূলত জীববৈচিত্র বজায় রাখার গুরুত্ব ও এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণেই ২০০০ সালে ‘অ্যামেরিকান কচ্ছপ উদ্ধার’ নামক প্রতিষ্ঠান এই দিবসের সূচনা করেন। তখন থেকেই সারা পৃথিবীজুড়ে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর প্রায় সকল সমুদ্রেই এদের বিচরণ রয়েছে এবং এরা বাসা বানানোর জন্য সাধারণত তুলনামূলক উষ্ম অঞ্চল পছন্দ করে। খাবার গ্রহণ, বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে মিলন থেকে শুরু করে সকল আনুষঙ্গিক কাজই সাগরে করলেও ডিম পাড়ার সময়ে স্ত্রী কাছিমকে দ্বীপে আসতেই হয়। এরা ডিম পাড়ার সময়ে খুব নির্জন স্থান বেছে নেয় এবং যদি সেখানে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতি দেখে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ডিম পাড়া বন্ধ করে মা কাছিম আবার সাগরে ফেরত চলে যায়। কচ্ছপদের অনেক প্রজাতির নারী ও পুরুষ আলাদা। কিছু প্রজাতির পুরুষদের ঘাড় মেয়েদের থেকে লম্বা থাকে। আবার কিছু প্রজাতির মেয়েদের নখ পুরুষদের থেকে বড় হয়ে থাকে। অধিকাংশ কচ্ছপ প্রজাতিতে পুরুষদের থেকে মেয়েরা আকারে বড় হয়ে থাকে। পুরুষের খোলসের উপরের অংশ প্রজননে সুবিধার জন্য ভেতরের দিকে বাঁকানো থাকে। কচ্ছপদের লিঙ্গ নিরূপণের সব থেকে সহজ উপায় হলো তাদের লেজ প্রত্যক্ষ করা। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, সাধারণত মেয়েদের নিচের দিকে বাঁকানো ছোট লেজ থাকে। অন্যদিকে পুরুষদের উপর দিকে বাঁকানো তুলনামূলকভাবে বড় লেজ থাকে। আর বড় কচ্ছপরা শুকনো জমিতে খুব ধীরে চলে, প্রায় ০.২৭ কিমি./ঘণ্টা। পূর্বেই কিছুটা উল্লেখ করেছি যে, অধিকাংশ ডাঙ্গায় বসবাসকারী কচ্ছপ তৃণভোজী। এরা সাধারণত ঘাস, আগাছা, পাতা, ফুল এবং ফল খেয়ে বেঁচে থাকে। অবশ্য কিছু সর্বভূক কচ্ছপও আছে। কিছু প্রজাতি তাদের বাসস্থানে প্রাপ্ত কীটপতঙ্গ এবং মৃতদেহও খেয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, তৃণভোজী কচ্ছপদের অতিরিক্ত আমিষ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কেননা খোলস বিকৃতিসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যগত জটিলতা সৃষ্টি করে থাকে। সেহেতু প্রত্যেক প্রজাতির কচ্ছপের পুষ্টির চাহিদা ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। সনাতনী ধর্মে কচ্ছপ নিয়ে মজার কাহিনী আছে। এ ব্যাপারে উল্লেখ্য যে, কূর্ম অবতার ভগবান বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার। মৎস্য অবতারের মত কূর্ম অবতারও সত্য যুগের। ভগবান বিষ্ণু শরীরের উপরের অংশ মানুষের এবং নিচের অংশ কচ্ছপের রূপ ধারণ করেন। তাকে প্রথাগতভাবেই চতুর্ভুজ রূপে দেখা যায়। তিনি মহাপ্রলয়ের পর সাগরের নিচে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকেন। সমুদ্র মন্থনের সময় তার পিঠে মন্দার পর্বত স্থাপন করে মন্থনের কাজ সম্পন্ন হয়। এদিকে প্রাচীন চীনে কচ্ছপের খোলস ভবিষ্যদ্বাণী করতে ব্যবহার করা হতো। আর প্রাচীন গ্রিক দেবতা হার্মিস এর প্রতীকও কচ্ছপ। কচ্ছপের খোলসের উপরের অংশে যে সমকেন্দ্র বিশিষ্ট বিং থাকে, তা তাদের বয়সের একটি ধারণা দিয়ে থাকে; যেমনটি গাছের ক্ষেত্রে বর্ষবলয়ে দেখা যায়। কিছু কিছু কচ্ছপের ১৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচার কথা শোনা যায়। বস্তুত দীর্ঘ আয়ুর বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, স্তন্যপায়ী প্রাণীতে ক্যান্সারের হার গড়ে ১০ শতাংশ। পাখীদের হার প্রায় ৩ শতাংশ। অথচ এদের ক্যান্সারের হার ধারাবাহিকভাবে ১ শতাংশেরও নিচে। তাছাড়া কচ্ছপের বিপাক ক্রিয়া ধীর এবং রোগসৃষ্টির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান।
পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা ভরাট, ঝোপ-ঝাড় বিনষ্ট, পানি দূষণ, খাদ্যাভাব ও মানুষের আক্রমণে পরিবেশের বন্ধু কচ্ছপ হারিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর ২৭০ প্রজাতির কচ্ছপের মধ্যে প্রায় ১শ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। অবৈধ শিকার, বাণিজ্য ও খাদ্য হিসেবে গ্রহণের কারণে বাংলাদেশের কাছিম ও কচ্ছপের সব প্রজাতিই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, সাতক্ষীরা, খুলনা, মাদারিপুর ও গোপালগঞ্জেও কাছিম ও কচ্ছপ বেচা কেনা ও খাওয়ার আধিক্য দেখা হয়। সাধারণত অমুসলিমরা এর মাংস খেয়ে থাকে। অবশ্য বর্তমানে প্রকৃতির বন্ধু এই প্রাণী রক্ষায় উদ্যোগ পরিলক্ষিত হতে দেখা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে ‘পরিবেশ বন্ধু কাছিম, প্রকৃতিতে বাঁচতে দিন’ স্লোগানের আওতায় শুরু হয়েছে ক্যাম্পেইন। এটি সত্য যে, নদী-পুকুরের পানি পরিস্কারের ব্যাপারো কচ্ছপ বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি এই মর্মে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে, বিপন্ন এই কচ্ছপ যাতে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে না যায়, সে ব্যাপারে সবাইকে যার যার মতো করে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এ বিশ্বে কোনো জীবই এমনি আসেনি। এর পেছনে তাদের প্রয়োজনীয়তা আছে। কেননা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে এদের ভূমিকা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। জলাশয়ে বা নদীতে কাছিম থাকলে এর পানি পরিস্কার থাকে এবং জলজ বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য বজায় থাকে। আর সেই নদী বা জলাসয়ের সার্বিক অবস্থা ভালো থাকে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে কাছিম নদীর তলদেশের পঁচা আবর্জনা খায়, যা পানিকে দূষিত হওয়া থেকে বাঁচায়। এতদ্ব্যতীত কাছিম নদীর তলদেশে অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর খাদ্য সরবরাহ সহায়তা করে থাকে। আর সনাতনী ধর্ম মতে কচ্ছপ সৌভাগ্য, সমৃদ্ধ, সম্পদ এবং শান্তি আকর্ষণ করতে সহায়তা করে বলে বিশ্বাস করা হয়।
লেখক : গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।