শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫
১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

সাংবাদিকতা; হলুদ সাংবাদিকতার সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি

সোমা ঘোষ মণিকা
সম্পাদকীয়
প্রকাশিত
সম্পাদকীয়
প্রকাশিত : ২৭ নভেম্বর, ২০২৫ ২৩:১৮

সাংবাদিকতা একটি সভ্য সমাজের আলোকবর্তিকা। যে সমাজে তথ্য গোপন থাকে, যেখানে সত্যকে আড়াল করা হয়, সেখানে সভ্যতার অগ্রগতি থেমে যায়। সংবাদমাধ্যম তাই শুধু সংবাদ পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠান নয়, এটি রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয়ের মধ্যে এক সেতুবন্ধন। একজন সাংবাদিক যখন মাঠে যান, তখন তিনি শুধু খবর সংগ্রহ করেন না বরং সমাজের অদেখা সত্যগুলো খুঁজে বের করেন। এই সত্য প্রতিষ্ঠার দায় থেকেই সাংবাদিকতা আজও গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে সাংবাদিকতার পথচলা দীর্ঘ। ছাপাখানার আবিষ্কার ছিল তথ্য বিপ্লবের প্রথম ধাপ। ইউরোপের নবজাগরণ পর্বে সংবাদপত্র মানুষের চিন্তা ভাবনা পরিবর্তন করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে দৈনিক সংবাদপত্রের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা একটি পূর্ণাঙ্গ পেশায় রূপ নেয়। এরপর কালের পরিক্রমায় সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিক শাসন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম—সবকিছুর সঙ্গেই সাংবাদিকতা এক মিশনে যুক্ত ছিল।

সুস্থ সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি হলো সত্য, নিরপেক্ষতা এবং অনুসন্ধান। সাংবাদিকতা কখনো শুধু ঘটনার বিবরণ নয়, বরং ঘটনার পেছনের কারণ, প্রেক্ষাপট এবং তার সামাজিক প্রভাব তুলে ধরার কলা। বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে সাংবাদিকতার নৈতিকতা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। তথ্য যাচাই, বিভিন্ন সূত্রের মতামত গ্রহণ, পর্যালোচনা, প্রমাণভিত্তিক বিশ্লেষণ—এসব নিয়ম অনুসরণ করেই গড়ে ওঠে বিশ্বাসযোগ্য সাংবাদিকতা।

বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতার সূচক প্রতি বছর দেখায় কোন রাষ্ট্রে সাংবাদিকরা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন। যেখানে সাংবাদিকতা স্বাধীন সেখানে সমাজে বা স্বচ্ছতা বজায় থাকে ,রাষ্ট্রক্ষমতা জবাবদিহিতার আওতায় থাকে এবং জনগণের মতো প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়। কিন্তু যে দেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা সংকুচিত হয় সেখানকার গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে।

একসময় সংবাদপত্র ছিল মানুষের তথ্য জ্ঞানের প্রধান উৎস। পরবর্তীতে রেডিও টেলিভিশন এবং বর্তমানে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যুক্ত হওয়ায় সাংবাদিকতার বিস্তার বেড়েছে বহুগুণ। এখন সংবাদ ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না মুহূর্তের বেশি। এই গতির সঙ্গে এসেছে প্রতিযোগিতা আর সেই প্রতিযোগিতাই কখনো কখনো সংবাদমাধ্যমকে টেনে নিয়ে গেছে অপসংস্কৃতির দিকে।

এই অপসংস্কৃতির সবচেয়ে পরিচিত নাম হলো হলুদ সাংবাদিকতা। হলুদ সাংবাদিকতার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে দুই সংবাদপত্র মালিকের তীব্র প্রতিযোগিতা থেকে। তারা পাঠক বাড়ানোর জন্য এমন সব শিরোনাম তৈরি করতে শুরু করেন যা ভয় উদ্বেগ বা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এতে তথ্যের সত্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা উপেক্ষিত হতে থাকে। শিরোনাম বড় হতে থাকে সংবাদ ছোট হতে থাকে অথচ পাঠকের অনুভূতিকে উত্তেজিত করার কৌশল হয়ে ওঠে প্রধান লক্ষ্য।

হলুদ সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য সহজেই চেনা যায়। প্রথমত এতে অতিরঞ্জিত শিরোনাম ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয়ত তথ্য যাচাই খুব কম দেখা যায়। তৃতীয়ত অজানা বা গোপন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তেজক সংবাদ তৈরি করা হয়। চতুর্থত অপরাধ যৌনতা রক্তক্ষয় স্ক্যান্ডাল ইত্যাদি বিষয় অধিক গুরুত্ব পায়। পঞ্চমত সংবাদকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয় যাতে পাঠকের মনে আকস্মিক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। ইতিহাসে দেখা গেছে অতিরঞ্জিত সংবাদ কখনো কখনো যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরির ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছে। রাজনৈতিক বিভাজন বাড়ানোর ক্ষেত্রে হলুদ সাংবাদিকতা অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেক সময় রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে জনমত প্রভাবিত করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হওয়া সাম্প্রতিক সময়ের বড় উদাহরণ।

সারসংক্ষেপে বলা যায় সাংবাদিকতা সমাজের বিবেক আর হলুদ সাংবাদিকতা সেই বিবেকের ওপর আঘাত। সুস্থ সংবাদমাধ্যম একটি জাতিকে আলোকিত করতে পারে আর অসুস্থ সংবাদমাধ্যম জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে। তাই দায়িত্বশীল সাংবাদিকতাই আমাদের পথ দেখাবে উন্নত মানবিক সমাজের দিকে।


এভাবে কি ফেরা যায়?

ডা. এ কে এম মাজহারুল ইসলাম খান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ এমন এক সময় এসেছে যখন একটি প্রশ্ন চারদিকে ভাসছে—৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ যে আচরণ ও কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে, এই উপায়ে কি তারা আবার ফিরে আসতে পারবে? একসময় স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী, ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠা এই দলটি আজ যেভাবে হুমকি, উসকানিমূলক বক্তব্য, প্রতিশোধের রাজনীতি এবং আগুন সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়েছে, তাতে জনগণের মনে প্রশ্ন—এই দল কি সত্যিই আবার রাজনীতির মূলধারায় জায়গা করে নিতে পারবে, নাকি নিজেদের ভুল স্বীকার করে আত্মসমালোচনার পথে না হাঁটলে তাদের রাজনৈতিক পুনর্জন্ম আর সম্ভব নয়?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস কখনোই সহিংসতামুক্ত ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকে ক্ষমতার পালাবদলের প্রতিটি অধ্যায়ে দমননীতি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, গ্রেপ্তার, মামলা ও হামলা ছিল এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় যে ভয়াবহ সহিংসতার জন্ম হয় এবং তার পরপরই যে প্রতিশোধপরায়ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে নতুন এক দাগ এঁকে দেয়। শেখ হাসিনার পতনের পর যখন মানুষ ভেবেছিল একটি শান্তিপূর্ণ নতুন অধ্যায় শুরু হবে, তখন দেশের নানা জায়গায় আওয়ামী লীগের অংশবিশেষ অনুসারীরা উসকানিমূলক ভাষণ, হুমকি এবং আগুন সন্ত্রাসের মতো কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়। এটি কেবল ক্ষমতা হারানোর প্রতিক্রিয়া নয়; এটি ছিল এক মানসিক প্রতিক্রিয়া, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় ‘authoritarian relapse’ বা স্বৈরাচারী মানসিকতার পুনরুত্থান। ক্ষমতা হারানোর পর সহিংসতায় ফিরে যাওয়ার এই প্রবণতা শুধু বাংলাদেশের নয়, অনেক দেশের ইতিহাসেই দেখা গেছে। লাতিন আমেরিকার চিলি, আফ্রিকার রোয়ান্ডা কিংবা মিশর—সব জায়গায় ক্ষমতা হারানো দলগুলো নিজেদের হারানো নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য প্রথমে হুমকি ও ভয়কে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এই পথ কোনো দলকেই টিকিয়ে রাখতে পারেনি। চিলির সামরিক শাসক অগাস্টো পিনোচের পতনের পর তার অনুসারীরা যখন পুনরায় রাজনীতিতে ফিরতে চাইল, তখন জনগণ তাদের মনে রেখেছিল রক্তপাতের স্মৃতি। সেই দল পরে ক্ষমতার কাছে নয়, বরং অনুশোচনার কাছে ফিরে গিয়েই টিকে থাকতে পেরেছিল।

দক্ষিণ আফ্রিকার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)–এর উদাহরণও এখানে প্রাসঙ্গিক। নেলসন ম্যান্ডেলার পর দলটি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে জড়িয়ে পড়ে। জনগণের আস্থা হারিয়ে যখন দলটি সংকটে পড়ে, তখন সিরিল রামাফোসা প্রকাশ্যে আত্মসমালোচনার পথ নেন, দলের ভেতরে ‘আত্মশুদ্ধি কমিশন’ গঠন করেন। এই অনুশোচনাই এএনসিকে টিকিয়ে রেখেছিল। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের জন্যও সেই আত্মশুদ্ধির মুহূর্ত এখন অপরিহার্য।রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘legitimacy crisis’ বা বৈধতার সংকট বলে একটি ধারণা আছে—যখন কোনো দল রাজনৈতিক বৈধতা হারায়, তখন তাদের পুনরাগমন সম্ভব হয় দুটি শর্তে: প্রথমত, তারা হিংসা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে সরে এসে বিশ্বাসের রাজনীতিতে ফিরে আসে; দ্বিতীয়ত, তারা জনগণের সামনে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং নতুন সামাজিক চুক্তি প্রতিষ্ঠা করে। আজ আওয়ামী লীগের পুনরাবর্তন এই দুই শর্তের ওপরই নির্ভর রাজনীতি আসলে স্মৃতির প্রতিযোগিতা। জনগণ কখনও ভুলে যায় না কে তাদের ভয় দেখিয়েছিল, কে তাদের বঞ্চিত করেছিল। তাই যারা জনগণের মনে ভয় তৈরি করে, তারা পরবর্তীতে ক্ষমা চাইলেও সহজে গ্রহণযোগ্য হয় না। জনগণের কাছে আবার হতে হলে ভয় নয়, সহানুভূতির স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে হয়। বিএনপি ২০০৭ সালে সেনাশাসনের পর যখন জনগণের আস্থা হারিয়েছিল, তখন আত্মসমালোচনার জায়গায় তারা অভিযোগের পথে গিয়েছিল—ফলাফল ছিল দীর্ঘ রাজনৈতিক নির্বাসন। রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানে বলা হয়, মানুষ ভুল করে কিন্তু অনুশোচনা করলে ক্ষমা করতে পারে। জার্মানির নাৎসি-পরবর্তী রাষ্ট্রগঠনে এই তত্ত্বের সফল প্রয়োগ দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির সমাজে যেসব ব্যক্তি নাৎসি দলের সদস্য ছিল, তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করে নেয় নিজেদের ভুল, অংশ নেয় পুনর্গঠনে, শেখে গণতন্ত্র। ফলাফল—জার্মানি আজ ইউরোপের স্থিতিশীল গণতন্ত্রগুলোর একটি। ক্ষমা ও আত্মসমালোচনার শক্তিই সেখানে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের মূলভিত্তি হয়েছিল।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগও যদি নিজের অতীতের দায়—দমননীতি, গণগ্রেফতার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, এবং আগুন-সন্ত্রাসের ঘটনাগুলোর জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করে, তবে তার মধ্য দিয়েই নতুনভাবে রাজনীতির সূচনা সম্ভব। কিন্তু যদি তারা অস্বীকারের রাজনীতি চালিয়ে যায়, যদি অহংকার ও প্রতিশোধকে রাজনীতির ভাষা করে তোলে, তবে ইতিহাসের চাকা আর তাদের পক্ষে ঘুরবে না।মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড বা আর্জেন্টিনার পেরোনিস্টদের অভিজ্ঞতাও তাই বলে। ক্ষমতা হারিয়ে তারা প্রথমে সহিংস প্রতিরোধে নেমেছিল, কিন্তু পরে উপলব্ধি করেছিল, জনগণের সঙ্গে সংঘর্ষ করে নয়, বরং জনগণের পাশে দাঁড়িয়েই টিকে থাকা যায়। আওয়ামী লীগ যদি শেখে, রাজনীতিতে ভয় নয়, বিশ্বাসই টিকে থাকার একমাত্র পথ—তবে এখনো তাদের জন্য দরজা বন্ধ হয়নি। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বাংলাদেশ এখন এক ‘রাজনৈতিক আঘাতপ্রাপ্ত সমাজ’—যেখানে মানুষ রাজনীতির নাম শুনলে আতঙ্কিত হয়। দীর্ঘ দেড় দশক ধরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, প্রশাসনিক নিপীড়ন ও দলীয় কর্তৃত্ব মানুষকে রাজনীতি থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন করেছে। জনগণ এখন রাজনীতিতে ফিরে চায় আশ্বাস—আমি কি নিরাপদ? আমার ভোট কি গণ্য হবে? আমার মতো প্রকাশের স্বাধীনতা কি থাকবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারলেই কোনো দল নতুন করে জনগণের মন জয় করতে পারে।

এখানে ফেরা মানে আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া নয়; ফেরা মানে নতুন হয়ে ফেরা। আওয়ামী লীগ যদি তাদের পুরনো গৌরব—স্বাধীনতার দল, সংবিধান প্রনয়ণের সাথে সম্পৃক্ত দল, জনগণের প্রতিনিধি—এই মূল্যবোধগুলো পুনরুদ্ধার করতে চায়, তবে তাদের আগে ভয় ও দমননীতির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মানুষ এখন আর অন্ধভাবে অনুসারী নয়; তারা বিচার করে, তারা স্মরণ রাখে, তারা পরিবর্তনের দাবিদার। তবু আশার জায়গা আছে। বাংলাদেশের রাজনীতি বহুবার ভেঙে পড়েছে, তবু প্রতিবারই উঠে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতির নতুন নৈতিক রূপান্তরও অসম্ভব নয়। কিন্তু সেই পরিবর্তন আসবে কেবল তখনই, যখন ক্ষমতা নয়, নৈতিকতা হবে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু।

রাজনীতি শেষ পর্যন্ত মানুষের বিশ্বাসের শিল্প। ক্ষমতা ধরে রাখা যায় ভয় দিয়ে, কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে টিকে থাকা যায়। আওয়ামী লীগের জন্য এখন মূল প্রশ্ন—তারা কোনো পথ বেছে নেবে? তারা কি নিজেদের ভুলের দায় স্বীকার করে, জনগণের সামনে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাইবে, নাকি প্রতিহিংসার পথে থেকেই ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়ে হারিয়ে যাবে? উত্তরটি এখনো সময় দেয়নি, কিন্তু ইতিহাসের সূত্র খুব স্পষ্ট—যে দল আত্মউপলব্ধি করে, সে ফিরে আসে; যে দল অহংকারে অন্ধ হয়, সে মুছে যায়। তাই প্রশ্নটি আজও অমীমাংসিত থেকে যায়—এভাবে কি ফেরা যায়?

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।


মাদক আমাদের শেষ করে দিচ্ছে

সৈয়দ শাকিল আহাদ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

মরণব‍্যাধী নেশা ড্রাগ বা মাদক এর করাল গ্রাস থেকে মুক্তির জন‍্য আমাদের সন্তানদের সহ সমাজের বিভিন্ন স্বরের শ্রেণিপেশার জনগণের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ সচেতনতা সৃষ্টি ও ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে পারলে এই ভয়াল অধঃপতন থেকে নিজ পরিবারকে, সমাজকে ও দেশকে দ্রুত উন্নত করে তোলা সম্ভব হতে পারে। একই সঙ্গে প্রয়োজন পরিবেশসংশ্লিষ্ট উদ্যোগ, প্রশাসনের সক্রিয়তায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও মাদক ব‍্যবহার ও ব‍্যবসায়ীদের ধরে দৃষ্টান্ত মুলক শাস্তি ও জরিমানা আদায়। মানবজাতি আজ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে প্রবেশ করছি আমরা। ঠিক এই সময়ে মহাবিশ্বে আমাদের একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহটিকে টিকিয়ে রাখার দুশ্চিন্তায় আতঙ্কগ্রস্ত।
সর্বনাশা মাদকের মরণ ছোবলে আক্রান্ত বর্তমান বাংলাদেশের তরুণ ও যুব সমাজ আজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। সারা দেশে মাদকের ব‍্যবসা ও প্রয়োগ দেশের অভ‍্যন্তরে আনাচে কানাচে জন্ম দিচ্ছে একের পর এক ভয়াবহ অপরাধ। এই প্রকার ঘৃনিত অপরাধ সমূহের অন‍্যতম কারণ মাদক বলে মনে করেন সুশীল সমাজের সংখ‍্যাগরিষ্ট লোকেরা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহ, সকলেই জানি মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটে উল্লেখযোগ্যভাবে নেতিবাচক পরিবর্তন এবং ঐ দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে।

মাদকের মধ‍্যে উল্লেখযোগ‍্য ইয়াবা, গাঁজা, মদ, হেরোইন, আফিম, চরস, বাংলা মদ, গুল, মরফিন, কোকেন, হিরোইন, পেথিডিন, মরফিন, মারিজুয়ানা, এল এস ডি, ইলেক্সার, ফেনসিডিল ইত্যাদি বিগত শতাব্দীর বহুল পরিচিত মাদক বা নেশাদ্রব্য ইতাাদি বেশ পরিচিত, এগুলোকে মাদকদ্রব্য বলার চেয়ে বরং মরণ বিষ বলাই অধিকতর শ্রেয়। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে মাদক জগতে এক নতুন সদস্যের প্রবেশ ঘটে, নাম তার ইয়াবা,
যা বর্তমানে বাংলাদেশে এক আলোচিত মাদক। তার নীল ছোবল থেকে সমাজের শিশু-বৃদ্ধ, পুরুষ-নারী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সচেতন-অসচেতন,
ধনী-গরিব, যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী কেউই রেহাই পায়নি এবং পাচ্ছেও না। দেশে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখের ওপর, যার ১৫ থেকে ২০ শতাংশই মহিলা।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ-বাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ছে এই ইয়াবা, সবাইকে এক ভয়াবহ ধ্বংস ও বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করছে। এখন নতুন আরও একটি মাদক ব্যবহৃত হচ্ছে, তার নাম আইস। ইয়াবার তুলনায় অন্তত চার-পাঁচ গুণ বেশি মেথএ্যামফিটামিন থাকায় আইস অনেক বেশি বিষাক্ত।
দেশের অনেক তরুণ-যুবক এটি সহজলভ্য হওয়াতে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছে এবং এর ফলে নেশার ঝুঁকি আরও বেশি বেশি হচ্ছে।
কোন ব‍্যক্তির ক্রমাগত নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, ব্যর্থতা, দুঃখ-বেদনা, বিষণ্ণতা, মানসিক চাপ ইত্যাদির ফলে জীবনকে করে তোলে হতাশা ও অবসাদগ্রস্ত। এসব থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে এরা জড়িয়ে পড়ে মাদকের ভয়াল থাবায়। এছাড়াও পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক অস্থিরতা, বন্ধু-বান্ধবের অসত্য প্রলোভন ও প্ররোচনা, অর্থনৈতিক সংকট, এমনকি বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে মনোমালিন্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব মাদকাসক্তির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ইয়াবার রয়েছে প্রচণ্ড উত্তেজক ক্ষমতা কেউ কেউ যৌন উত্তেজক হিসেবেও এই মাদক কে অনেকে ব্যবহার করে। যাদের ওজন বেশি তাদের কেউ কেউ স্লিম হওয়ার ওষুধ হিসেবে শুরু করে ইয়াবা সেবন। ঘুম কমিয়ে দেয় বলে সারা রাতের পার্টির আগে ক্লান্তিহীন উপভোগ নিশ্চিত করতে অনেকের পছন্দ ইয়াবা। আবার কিছু শিল্পীও ইয়াবা সেবন করেন তাদের শিল্পকর্মের দক্ষতা বাড়বে মনে করে।
যে কোনো মাদকের ন‍্যায় ইয়াবা, আইসসহ সব মাদকদ্রব্যই ভয়াবহ। শুরুতে মাদকের ব্যবহার সত্যিই আনন্দদায়ক, উদ্দীপক, উত্তেজক, যা সাময়িকভাবে উচ্ছ্বসিত ও রোমাঞ্চিত করে। কিন্তু শেষ পরিণতি হয় বেদনাদায়ক, মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ও ধ্বংসাত্মক। দেখা যায় কিছুদিন ইয়াবা সেবনের পর শুরু হয় এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কৌতূহল বশত কয়েক দিন সেবনের পরই আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, এটি ছেড়ে দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মাদক ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না। তখন ঐ মাদক পেতে যে কোনো হীন অপকর্ম করতেও হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। প্রথমে কম মাত্রায় এ ট্যাবলেট কাজ করলেও ধীরে ধীরে মাত্রা বাড়াতে হয়। বাড়াতে হয় ট্যাবলেটের পরিমাণ। ক্ষণস্থায়ী আনন্দের পর বাড়তে থাকে ক্ষতিকর নানা উপসর্গও। রাত কাটে নির্ঘুম, শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, গলা-মুখ শুকিয়ে আসে, অনবরত প্রচণ্ড ঘাম আর গরমের অসহ্য অনুভূতি বাড়ে। এর সঙ্গে বাড়ে নাড়ির গতি, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা আর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি। দেহে আসে মানসিক অবসাদ, চিন্তা আর আচরণে বৈকল্য। মেজাজ খিটখিটে হয়, অহেতুক রাগারাগি, ভাঙচুরের প্রবণতা বাড়ে। মানুষ আর মানুষ থাকে না, হয়ে ওঠে হিংস্র, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। ন্যায়-অন্যায় বোধ লোপ পায়, হয়ে ওঠে অপরাধ প্রবণ। বিঘ্নিত হয় সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তা, ব্যাহত হয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্রোতধারা। এতে একদিকে যেমন আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে, তেমনি মাদকাসক্ত অনেক তরুণ-তরুণী সন্ত্রাস, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, এমনকি খুনও করে নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য। মা-বাবার গলায় ছুরি ধরে টাকার জন্য, বুকে বসে ছুরি চালাতেও তার হাত কাঁপে না। নেশার টাকা না পেয়ে নেশাখোর বাবা মাদক সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে ক্রোধে খুন করে নিজ সন্তানকে, এমনকি স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা, মাকে জবাই করা, আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার মতো অমানবিক ঘটনাও ঘটছে হরহামেশা। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এসব ঘটনার দায় পড়ে মাদকসেবীর ঘাড়ে। কিন্তু একটু গভীর দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায়, কোনো কোমল হৃদয় বা মানুষের বিবেক এই খুন বা অপকর্ম করে না, করে এক ভয়ানক সর্বনাশা মাদক, যা জীবন থেকে জীবন আর হূদয়ের আবেগ-অনুভূতি কেড়ে নেয়। আলোর পথ ছেড়ে নিয়ে যায় অন্ধকার পথে। স্বাধীন হূদয় পরিণত হয় নেশার দাসে।

মানসিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি একসময়ে শরীরেও প্রভাব পড়তে শুরু করে। হৃদ্যন্ত্র, ফুসফুস, লিভার, কিডনি থেকে শুরু করে শরীরে সব অঙ্গই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইয়াবা খেলে উচ্চ রক্তচাপ হয়, মস্তিষ্কের ভেতরকার ছোট রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে। মাদকাসক্ত তরুণদের নিউরো জটিলতায় ভোগার প্রবণতা বেশি থাকে। আইস, কোকেন, ইয়াবা, ফেনসিডাইল সেবন করলে স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ে। যৌন-উদ্দীপক হিসেবে গ্রহণ করা হলেও আসলে যৌনক্ষমতা হারিয়ে যায়, এমনকি শুক্রাণু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সন্তান উত্পাদনক্ষমতাও কমে যায়। মেয়েদের ঋতুস্রাবেও সমস্যা হয়। বেশি পরিমাণে ইয়াবা সেবনের ফলে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম নষ্ট করে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।
মাদকাসক্তি প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করাই অতি উত্তম। তাই মাদকের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে সামগ্রিক প্রতিরোধ খুবই জরুরি; যেমন—
১. আসক্ত ব্যক্তি, যিনি পুনরায় স্বাভাবিক সুস্থ জীবন ফিরে পেতে চান, তার নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। এ কথা মোটেই সত্য নয় যে, তারা আর কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে না। শুধু প্রয়োজন ধৈর্যসহকারে দীর্ঘমেয়াদি চিকিত্সা। একবার কেউ আসক্ত হয়ে গেলে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করে বারবার কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ভালোভাবে বোঝাতে হবে। কোনোক্রমেই বকাবকি, মারধর, বেঁধে বা তালাবন্ধ করে রাখা অনুচিত।

২. শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসার জন্য মনোরোগ চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
৩. ওষুধ, সাইকোথেরাপি ও অন্যান্য উপায়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক এবং সুস্থ জীবনযাপন-পদ্ধতিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এতে মনোরোগ চিকিত্সক ও মনোবিজ্ঞানীর যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পরিবার, আত্মীয়স্বজন আর প্রকৃত বন্ধুরও। একজন নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি সবার সম্মিলিত সহযোগিতায়ই আবার ফিরে পেতে পারে মাদকমুক্ত সুস্থ জীবন। ৪. মাদকের বিরুদ্ধে প্রথমে পরিবারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বাবা-মাকে সন্তানের মধ্যে এমন বীজ বপন করতে হবে, যাতে সে আত্মপ্রত্যয়ী হয়, অশুভকে চিনতে পারে। বাবা-মায়ের কোনো কলহ-বিবাদ যেন সন্তানকে প্রভাবিত করতে না পারে। তাই পারিবারিক শিক্ষা, যথাযথ অনুশাসন এবং সচেতনতা খুবই জরুরি। ৫. তরুণ প্রজন্মকে মাদক থেকে দূরে রাখতে হলে তাদের জন্য দরকার খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা এবং এগুলো চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করা।

৬. ধর্মীয় অনুশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মচর্চা অনুশীলন করলে অনেক ক্ষেত্রে সর্বগ্রাসী মাদক বর্জন এবং প্রতিকার সম্ভব। ৭. মাদক ব্যবহারের কুফল, এর পাচার প্রতিরোধে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে দেশের শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এবং সংবাদপত্রসহ মিডিয়ার কর্মীদেরও দায়িত্ব অপরিসীম।
৮. মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন এবং চিকিৎসা কার্যক্রমের জন্য সহায়তা করতে রাষ্ট্র, এনজিও এবং কমিউনিটিকে এগিয়ে আসতে হবে।

সামগ্রিক দৃষ্টিতে মাদক সেবনের ক্ষতি অসীম ও অপূরণীয়। এতে পুরো সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা ও অপরাধী হিসেবে বড় করে না দেখে কোথা থেকে, কীভাবে, কারা মাদক সরবরাহকারী, চোরাকারবারি বা কারা এসবের মূল হোতা তাদের বিচার ও শাস্তির আওতায় আনা। প্রয়োজনে যথাযথ আইন প্রণয়ন করা এবং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। তবেই মাদকের ভয়ংকর ছোবল থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ-প্রজন্ম ও কোমল মতি সন্তানদের রক্ষা করা সম্ভব হবে। তাই এখনোই উচিত সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে মাদক বিরোধী স্লোগানে সোচ্চার হয়ে মাদক মুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। মনে রাখতে হবে অপরাধী নয়, অপরাধই ঘৃণার বিষয়। স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে তাদের প্রতি ঘৃণা নয়, বরং সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের চারিপাশে সচেতনতা বৃদ্ধি ও এই ভয়াবহ মাদকের করুন পরিনতি নিয়ে পারিবারিক গন্ডি, স্হানীয়ভাবে সমাজের বিভিন্ন স্হানে ও সরকারী উদ্দোগে, নিয়মিতভাবে দৈনিক সংবাদপত্র সহ বিভিন্ন প্রকার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে এর ব‍্যপক ক্ষতির বা ঝুঁকির বর্ননা উল্লেক করে জনসচেতনতা মূলক অনুষ্টানাদি ঘন ঘন প্রচার চালিয়ে যেতে হবে ।
লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক।


ফুলের নদী: কেউকেনহফ

শাকেরা বেগম শিমু
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

নদী বলতে বুঝায় বহমান স্বচ্ছ পানির ধারা যা গিয়ে শেষ হয়েছে কোন সাগর বা মহাসাগরে। যদিও নদীর মধ্যে কখনো রং বেরঙের পানিও প্রবাহিত হয় যেমন কলোম্বিয়ার ‘রেইনবো রিভার’। যেখানে একসাথে রংধনুর সাতটি রং এর পানি প্রবাহিত হয়। তাই অনেকে একে রংধনু নদী নামেও অভিহিত করে থাকে। কিন্তু এখন যে নদীটির কথা বলতে যাচ্ছি সেটা রঙিন বা স্বচ্ছ কোনরকম পানির নদীই নয়। সেটা হচ্ছে ‘ফুলের নদী’! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। বিচিত্র এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে যা দেখলে স্রষ্টার সৃষ্টি নিয়ে মন ভাবনায় পড়তে বাধ্য। তবে এ সবই একমাত্র মহান রবের কুদরতের নিশানা। আজ পরিচয় করিয়ে দেব এরকমই এক নদীর সাথে যেখানে কোন পানি নেই। আছে শুধু ফুল আল ফুল। এতে আছে চেরি, নীল অপরাজিতা, টিউলিপ ও নদীর মতো বেয়ে আসা ছোট ছোট নীল ফুলের সারি। চমৎকার এই নীলাভ ফুলটি এক ধরনের ঘাসফুল যা হাঁটার সময় পায়ের তলায় চুরচুর করে ভেঙে পড়তে চায়। এই পুষ্পদ্বয়ের দোলায়িত দীর্ঘ ও প্রশস্ত বাগান দেখলে যে কেউ ই ভাববে এটা কোন ফুলের নদীই হবে, যা বয়ে চলেছে কোন পুষ্পসাগরে মিলিত হবার জন্য।

অবস্থান: অপূর্ব, অসাধারণ, অপরূপা সুন্দর এই ফুলের বাগানটি অবস্থিত ইউরোপ মহাদেশের নেদারল্যান্ডস এর ‘কেউকেনহফ’ শহরে। এ জায়গাটি পুষ্পসম্ভারে এতোই মনোরম ও মনোমুগ্ধকর যে, তা যে কারো স্বপ্নকেও হার মানায়। এখানে আছে নানা প্রজাতির রঙ-বেরঙের হাজার নয় লক্ষ লক্ষ টিউলিপ ফুলের বাগান।এ ফুলগুলো সাদা, লাল, গোলাপী, নীল, হলুদ, দুধে-আলতা প্রভৃতি হরেক রং এর হয়ে থাকে। এই এলাকা থেকে প্রতি বছর এসব টিউলিপ ফুল আমেরিকা ও জাপানে রপ্তানি করা হয়। এছাড়াও আরো অনেক ফুলপ্রেমি দেশ ও রাজ্য নেদারল্যান্ডস এর এই ‘কেউকেনহফ’ থেকে টিউলিপ আমদানি করে নিয়ে যায়। একে ফুলপ্রেমিদের জন্য একটি ফুলের স্বর্গই বলা যায়। যেদিকে চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। অনেকে এই ফুলের সমাহারের সৌন্দর্য্য পুরোপুরি উপভোগ করার জন্য এই কেউকেনহফ শহরে এসে অনেকদিন থেকেও যায়।

বসন্তে এর রূপ: একে তো এই অঞ্চলটি ফুলের জন্য বিখ্যাত, তারউপর বসন্ত এলে এখানে যেন ফুলপরীরা অসংখ্য ডানামেলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বসন্তে এর রূপ অনন্যা হয়ে চোখে ধরা দেয়। সাথে মন-মাতানো সৌরভে চারদিকের বাতাস ভরভর করে। আর তাই এসময় এখানে পর্যটকের সংখ্যাও স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেকটা বেড়ে যায়। যেদিকে চোখ যায় শুধু রঙ-বেরঙের আর নানা প্রজাতির ফুল যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তখন দূর থেকে ‘কেউকেনহফ’ এর ঘরবাড়িগুলো কে দেখলে মনে হবে ফুলের এক মহাসাগরের মাঝখানে ছোট ছোট কয়েকটি মাত্র দ্বীপ গড়ে উঠেছে। বাকি পুরোটাই ভর্তি শুধু চোখ ধাঁধানো রঙ-বেরঙের ফুল আর ফুলের সমাহারে।

নদীতে ভ্রমণ: ‘কেউকেনহফ’ এ এলে শুধু ফুল দেখেই যে চোখ জুড়াবে তা নয়, এখানে ফুলের স্বর্গীয় নদীর পাশাপাশি আছে ছোট ছোট সত্যিকারের নদী যেগুলোর দুই তীর শুধু বাহারী রঙের ফুলে ফুলে সজ্জিত। এ নদীতে নৌকায় করে ভ্রমণ করলে আশেপাশের প্রকৃতি দেখে মনে হবে এটা হয়তো পৃথিবীর বাইরের অন্য কোন জগতে চলে এসেছি।

ফুলের চাষ: প্রতি বছর এ অঞ্চলে প্রায় সত্তর লক্ষের মতো ফুলের বীজ ও চারাগাছ রোপণ করা হয়। স্বভাবতো সেজন্যই এটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাগান হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এখানে ফুলের আকর্ষণে আগত পর্যটকদের জন্য উপযুক্ত সময়টা হলো মার্চ মাস থেকে শুরু করে মধ্য মে পর্যন্ত। মার্চের শেষের দিক থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্ত সময়টা।লো টিউলিপ ফুটার উপযুক্ত সময়। এসময় ‘কেউকেনহফে’র প্রধান বাগান যেটা প্রায় আড়াইশ বিঘা জমির উপরিভাগ জুড়ে রয়েছে, তার উপরিভাগ পুরোটাই জুড়ে থাকে শুধু এই হরেক রঙের টিউলিপ ফুলের সমাহার। এর সাথে নদীর তীরে, পার্কে, বা মাঠে রয়েছে অজস্র অপরাজিতা, চেরি বা নীলাভ রঙের ঘাসফুলের বাহার। সবকিছু মিলিয়ে এ ‘কেউকেনহফ’ কে শুধু ‘ফুলের নদী’ নয় পুরো একটি ফুলের সাগরও বলা যায়।


সহিষ্ণুতা ও সমঅধিকারের সমাজ

আপডেটেড ২৬ নভেম্বর, ২০২৫ ২৩:১১
সম্পাদকীয়

সুবর্ণ ভূমির কোমল পলির মতো বাঙালির মনোভূমি। আমাদের অর্থনীতি চিরকাল কৃষিভিত্তিক। জীবন ও জীবিকা একসময় ছিলো নদীকেন্দ্রিক। গভীর রাতে কিংবা অলস দুপুরে উদাও কন্ঠে বাউল ভাটিয়ালি গানের সুর আমাদের জনজীবনকে মুখরিত করে তুলত। যাত্রাপালার দর্শক হয়ে নিপীড়িতের উপর নির্যাতন দেখে বাঙালি অঝোর ধারায় কাঁদত একসময়। যাত্রার বিবেক বাঙালির বিবেক হয়ে নৈতিক কথা বলতো। শ্যাক্সপিয়রের কিংবা এলিয্যবেথান যুগের নাটকে ‘কোরাস’ যে ভূমিকা পালন করত আমাদের যাত্রাগানের বিবেকও সে ভূমিকা পালন করে গেছে। আমাদের অকৃত্রিম সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য শাখা ছিল যাত্রা পালা।

এক সময় ‘পঞ্চায়েত’ গ্রামের সুখ দুঃখের সকল অনুষ্ঠান, বিচার ব্যবস্থা, সমাজের কল্যাণ মূলক কাজের দায়িত্ব স্বতঃপ্রণোদিত গ্রহণ করত। আধুনিক উন্নয়ন বিজ্ঞান যাকে বলে জননেতৃত্বে সামাজিক কর্মকাণ্ড।

বাঙালির ধৈর্য, স্থৈর্য সীমাহীন। পরার্থে জীবন দানের অগণন নজির আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে। আবার এই ভীতু, কোমল বাঙালি বুক পেতে দাঁড়িয়ে যায় মাতৃভূমির মুক্তির যুদ্ধে। আমেরিকা থেকে সপ্তম নৌবহর আসার খবর বিচলিত করেনা লাঠি হাতে প্রতিরোধ করা বাঙালিকে।

কী হলো কোমল স্বভাবের বাঙালির। হঠাৎ করে এত অস্থিরতা, চিত্তে এত চাঞ্চল্য। বাঙালির অনুভুতিও কী কিছুটা ভোঁতা হয়ে গেল। মিরপুরের গার্মেন্টস ও ক্যামিকেল কারখানার অগ্নিকান্ডে তরতাজা ষোলটা মানুষ প্রাণ হারালো এ নিয়ে মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক বেদনাবোধ লক্ষ্য করা গেল না। সামজিক মাধ্যমে এ নিয়ে উল্লেখ করার মতো আবেগ প্রকাশিত হতেও দেখা গেলো না।

সামাজিক অস্থিরতা, মানবিকতাহীনতা ও অসহিষ্ণুতা যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। পারিবারিক

সংঘাত, সংঘর্ষ, গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ, স্থানীয় আধিপত্য, রাস্তাঘাটে মারামারি ইত্যাদি নানা ঘটনা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। মানুষ এমনিতেই নানা কারণে বিষাদগ্রস্ত। এসব ঘটনা মানুষকে আরও বিষাদগ্রস্ত করে তুলছে। সামাজিক এসব অনাচার ও বিশৃঙ্খলার ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। এ কারণেই বোধ হয় সুযোগ পেলেই মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশও ঘটাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণাবাচক মন্তব্য, রাজনৈতিক মতভেদে শত্রুতা, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ে বৈষম্য–এসবই প্রশ্ন তোলে, আমরা কি জাতিগতভাবে অমানবিক ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি?

সহিষ্ণুতা আসলে কী। সহিষ্ণুতা কী শুধু নৈতিক গুণ। সভ্য, সমঅধিকারের সমাজে সহিষ্ণুতা হলো টিকে থাকার সবচেয়ে বড় শর্ত। সমতা, সমদৃষ্টির, বহুত্ববাদী সমাজ গড়ার সব চেয়ে বড় হাতিয়ার হলো সহিষ্ণুতা। সহিষ্ণুতার কী কোন সূচক আছে জাতিসংঘে, আমার জানা নেই। সূচক থেকে থাকলে আমাদের চিন্তার কোন কারণ নেই। সাম্প্রতিককালে আমাদের যে সহিষ্ণুতার মান, সেই মান নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামলে নিচের সারিতে আমাদের অবস্থান ঠেকায় কে। ব্যক্তি, পরিবার কিংবা সমাজকে বিবেচনা করলে আমাদের অবস্থা তপ্ত কড়াইয়ের মতো। পানি কিংবা তৈল যা কিছু ঢালা হোক না কেনো আমরা ধুম্র সহ জ্বলে উঠব। সেই জ্বলা এতই তীব্র কখনো কখনো বড় অট্টালিকাও জ্বালিয়ে দিতে পারি আমরা নির্ভয়ে। জাতি হিসেবেও আমরা অগ্নিশর্মা। সহিষ্ণুতার অভাবে যে অগ্নি সংযোগ ঘটে, সেটিই হলো প্রকৃত মবদন্ড বা মব জাস্টিস।

জাতিগতভাবে আমরা যে অসহিষ্ণু ছিলাম না তা ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপকে বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যাবে। আমাদের স্বদেশপ্রেম, স্বাধিকারের দাবির জন্য আক্রমন আসলে আমরা প্রতিহত করেছি। এসব ক্ষেত্রে আমরা সতত আপসহীন ছিলাম। আমাদের মানসজগত মূলত লালন, হাসন, রাধারমণ, আরকুম শাহ সহ সকল মরমী কবিদের চেতনায় সমৃদ্ধ। বৈচিত্র্য, বহুত্ববাদের দর্শন আমরা প্রকৃতিগত ভাবে ধারণ করি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের আগমনের পূর্বে বাঙালি মানসে সামান্য পরিমাণও সাম্প্রদায়কতার প্রকাশ দেখা যায়নি। সমাজকে বিভাজিত করার যে কূটকৌশল গ্রহণ করেছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক এর প্রভাবে পাকিস্তানের স্বাধীনয়াত্র অব্যবহিত পূর্বে এবং পাকিস্তানত্তোর সময়ে কিছুটা সাম্প্রদায়িক মনোমালিন্য, দাঙ্গার নজির সৃষ্টি হয়েছিলো। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন উদার, বহুত্বভাদ, প্রগতিবাদী এক সমাজের ধারণা সফল ভাবে বাঙালি হৃদয়ে প্রোথিত করতে সমর্থ হয়। বায়ান্নের আন্দোলনের মালিকানা ছিল বাংলাদেশের জনগণের। তাই এই মহান আন্দলনের স্বরূপ আন্বেষন করলে বাঙালি মননের প্রকৃত রূপ দর্শন করা যায়।

ফিরে আসি সহিষ্ণুতার আলোচনায়। সহিষ্ণুতার প্রতিফলন দেখা যায় সব চেয়ে বেশি শাসক এবং রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম, আচার আচারণে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, চর্চার ভেতরে মুক্তোর মতো ঝিনুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকে সহিষ্ণুতা। কিছুটা কাব্যিক শুনাতে পারে, তবে সহিষ্ণুতার ভেতরেই সমতা, সমদৃষ্টি, সমঅধিকারের বীজ লুক্কায়িত থাকে। উদার, সহিষ্ণু একটি রাজনৈতিক দল সব সময় সমাজের প্রান্তিক, বিপন্ন, অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য লড়াই করে যায় সেটি নির্ভর করে দলটির দর্শনে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আমরা যেমন সমাজের প্রতিটি সদস্যের দিকে ‘সমদৃষ্টি’ দিতে সক্ষম হইনি একইভাবে রাজনৈতিক দলের ভেতরে নিবেদিত, নেতৃত্বগুণে সমৃদ্ধ সকল শ্রেণিপেশার মানুষের প্রতি দৃষ্টির নীতিকেও অনুসরণ করতে পারিনি। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে যেমন পদ পদবী ক্ষমতার চর্চা হয়েছে, একইভাবে শাসক দলগুলোর ভেতরে ক্ষমতার লড়াই বহমান ছিলো। ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতা শাসকদলের ভেতরে এমনভাবে রোপণ করা হয়েছে যে বীজ থেকে ক্রমান্বয়য়ে ক্ষমতার লড়াই আকারে বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতা অর্জনের লড়াই যখন প্রবল হয়ে যায় তখন সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে নির্বাসিত হতে থাকে।

আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই, দেখতে পাব-সহিষ্ণুতা রাতারাতি জন্মায়নি, বরং এটি দীর্ঘ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার ফল। সমাজের আচরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের আচরণকে প্রভাবিত করে। ক্ষমতা যখন রাজনৈতিক দলের একমাত্র আরাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন সমাজেও এর প্রবল চর্চা হতে থাকে। সমাজের আচরণ এবং রাজনৈতিক দলের আচরণকে বিভক্ত করা কঠিন। সমাজের আচরণ রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সমাজের চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। মূলত রাজনৈতিক দলের আচরণের সংস্কৃতি গণমুখী, কল্যাণকামী, সমদৃষ্টি সম্পন্ন না হলে সমাজের সকল স্তরে অস্থিরতা এবং বিভাজন চলতে থাকে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মানসিক পরিশুদ্ধতা, উন্নত রুচি ও সংস্কৃতি বারবার প্রত্যাশা করেছে মানুষ। প্রত্যাশা করেছে, দেশ ও জাতি গঠনে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে এদের মাধ্যমে বড় ধরনের জাগরণ ঘটবে। দেশের উন্নয়নসহ হতদরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা শুধুই হতাশায় রূপ নিচ্ছে। দেশটা কিছুতেই সামনের দিকে এগোতে পারছে না। জনগণ শুধু অসহায়ের মতো লক্ষ্য করছে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ একে অন্যের প্রতি আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ লিপ্ত হয়ে রয়েছে। আক্রোশ আক্রোশ আক্রমণের মধ্যে দলীয় ব্যর্থতার চেয়ে ব্যক্তি বিদ্বেষ, ব্যক্তি কুৎসা অতিমাত্রায় দৃশ্যমান বলে মনে হয়। পারস্পরিক এই যে দ্বন্ধ এ দ্বন্দ্বের পেছনে প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া মানুষকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার যে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা তা’ কাজ না করে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার প্রবল কামনাই প্রধান হয়ে ওঠে।

সমাজ, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের সহিষ্ণুতা একই সূত্রে গাঁথা। সামজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয় সহিষ্ণুতাকে প্রভাবিত করে। আবার রাষ্ট্রীয় সহিষ্ণুতা সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার চাহিদাকে অনুসরন করে। স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থা আবার কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করেনা। একমাত্র নিরবিচ্ছিন্ন গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমেই যেমন সকল মানুষের প্রতি সমদৃষ্টি প্রদানের সংস্কৃতি জাগ্রত করা যায় একই সাথে মানুষের সহিষ্ণুতার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে সহিষ্ণুতা মূলত একটি নৈতিক গুণ যা সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে কোন ভাবেই আরোপ করা যায়না। ক্ষমতার রাজনীতি থেকে যদি সকল মানুষের প্রতি মমতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায় তাহলে ধীরে ধীরে আমরা সহিষ্ণুতার মতো নৈতিক গুণ অর্জন করতে সক্ষম হব। সহিষ্ণু সমাজ গণতন্ত্রকে খুব দ্রুত সংস্কৃতির অংশ হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। আর প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় জন অংশগ্রহণ স্থিতিশীল সমাজ, স্থিতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম বলে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন। আমরা কি সে পথে এগোতে পারবো। এই পারা না পারার উপর জাতি হিসেবে টিকে থাকার উপাদান গুলো নিহিত আছে বলে মনে করি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক


জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কীভাবে হবে 

মিজানুর রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে মতানৈক্য ছিল। এ নিয়ে মিটিং মিছিল বেশ হয়েছে। মাঠ ও উত্তপ্ত হয়েছে। বিএনপি দাবি ছিল সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হতে হবে। আর জামায়াতের বক্তব্য হলো নভেম্বরে গণভোট হতে হবে অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে গণভোট চাই। জুলাই অভ্যুত্থানে প্রথম সারির সৈনিক এনসিপি বলছে জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে জুলাই সনদের জন্য অধ্যাদেশ জারি করতে হবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো মতৈক্য পৌঁছাতে না পারায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। ১৩ নভেম্বরে উপদেষ্টা পরিষদে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন অধ্যাদেশ, ২০২৫ অনুমোদন করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করেন। সকল জল্পনা ও কল্পনার অবসান ঘটিয়ে উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তগুলো ঘোষণা করেন।
সরকার জুলাই সনদ যেভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য পরিকল্পনা নিয়েছেন যেমন:-সনদ বাস্তবায়নে জুলাই জাতীয় সনদ(সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারি। আদেশে গণভোট ও গণভোটের প্রশ্ন এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন সংক্রান্ত বিধান আছে। গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য আইন (অধ্যাদেশ) করা হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করা হবে।গনভোটে হ্যাঁ জয়ী হলে আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। সংবিধান সংস্কার হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চ কক্ষ গঠন করবে। নিম্ন কক্ষ বা সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চ কক্ষে আসন বণ্টন। উচ্চ কক্ষের মেয়াদ নিম্ন কক্ষের মেয়াদের সাথে শেষ হবে।
কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে গণভোটের প্রশ্নমালার ও রূপরেখা দিয়েছেন যেমন
প্রথম প্রশ্ন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্নিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন আাগামী সংসদ হবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চ-কক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চ কক্ষের সংখ্যা গরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
তৃতীয় প্রশ্ন সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন প্রধান মন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরন রাষ্টপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
চতুর্থ প্রশ্ন জুলাই সনদে বর্নিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
বাংলাদেশের ২২% লোক নিরক্ষর। তাদের কাছে এই ৪টি প্রশ্ন সহজবোধ্য হবে কি? যারা কম লেখাপড়া জানে তাদের কাছে বিষয়টি এতটা সহজতর নয়।যাদের সক্ষমতা আছে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে ৪টি বিষয় পড়ে ভোট কার্যসম্পাদন করতে কমপক্ষে ৫/৬ মিনিট সময় ব্যয় হবে। তাহলে ভোটদান প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। জাতীয় পর্যায়ে ভোট কাস্টিং কম হবে। সুতারাং প্রশ্নগুলো সহজ করতে না পারলে ভোটাররা অন্ধকারে

থেকে যাবে। যেহেতু জুলাই সনদে ইতোপূর্বেই রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছে সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি অঙ্গীকারনামা রয়েছে। জুলাই সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে জাতির কাছে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হলো। আমরা অবগত ৯০ এ এরশাদ বিরোধী আন্দোলন এর সময় তিন জোট একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে ছিলেন। অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার পতনের পর তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী গনভোট হয়েছিল। তখনকার আন্দোলনকারী ও বিশ্লেষকদের মতে এটি ছিল ‘ক্ষমতা হস্তান্তর ও রাজনীতি রাষ্ট্র পরিচালনার দলিল যা পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি।’
রাজনৈতি বিশ্লষকদের মতে ওই রূপরেখার সাফল্য হলো এরশাদের পতন ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হওয়া কিন্তু পরে দুই প্রধান দল নিজেদের রূপরেখা থেকে শুধুই উপেক্ষা করেননি বরং অনেক ক্ষেত্রে উল্টো কাজ করেছে। বিশ্লেষকরা আরও বলেন,তিন জোটের রূপরেখা অঙ্গীকার ১৯৯১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত দলগুলো মেনে চললেও পরে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন ছাড়া আর কিছুই হয়নি বরং উল্টোপথে গেছে দলগুলো, যার পরিনতি হলো ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে।
শংকা থেকেই যাচ্ছে এবার ও যদি অমনটি হয়?এমনটি হওয়ার কি সুযোগ আছে?কিন্ত ২৫টি রাজনৈতিক দল ১৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অঙ্গীকার নামায় যে স্বাক্ষর কার্য সম্পাদন করেছেন যে কর্মটি দেশের জনগণ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে তা থেকে সরে আসাটা কঠিন। তাই অঙ্গীকারনামা বাস্তবায়ন না করে উপায় নেই। সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ

বলেছেন ‘অঙ্গীকার নামায় যা আছে তা বাস্তবায়ন করতে বিএনপি বদ্ধপরিকর’ তাহলে জাতীর সামনে কি অঙ্গীকার করা হয়েছিল? যদি ফিরে তাকাই :-- (:ক) জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই - আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ- তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জন- আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রণীত ও ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব।
(খ) যেহেতু জনগণ এই রাষ্ট্রের মালিক তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সেহেতু রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আলাপ-আলোচনা ভিত্তিতে জনগনের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ গ্রহন করেছি বিধায় এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করব।
(গ)জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করবো না উপরোক্ত উক্ত সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করব। (ঘ) গণতন্ত্র মানবাধিকার ও আইনের শাষণ প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করব।
(ঙ)গণঅভ্যুত্থান পূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই আগষ্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংগঠিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনবার্সনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।
(চ) জুলাই সনদ ২০২৫ এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা তথা সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান এবং বিদ্যমান আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমামার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করব।
(ছ) জুলাই জাতীয় সনদ২০২৫ এর ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যে সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো কোন প্রকার কালক্ষেপন না করেই দ্রুততম সময়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।

দলগুলো যদি একসাথে বসে অঙ্গীকারনামা করে থাকে ক্ষমতায় এসে ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন করা না হলে জাতির সাথে প্রতারণা হবে। তাহলেত আমরা আবার পুরানো ধারায় চলে গেলাম। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত গনভোট বা জুলাই সনদ নিয়ে দলাদলি না করে তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সবাই সোচ্চার থেকে আগামী সংসদ সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে গণতন্ত্রের ধারায় দেশ ফিরে আসুক ধীরে ধীরে জুলাই জাতীয় সনদ ও বাস্তবায়ন হউক সেটাই জাতির প্রত্যাশা।

লেখক: কলামিস্ট ও ব্যাংকার।


পরাবাস্তবতার বাস্তবতা

সাকিব রায়হান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অস্বস্তিকর সত্যের চেয়ে স্বস্তিকর মিথ্যাকেই বেছে নেই। এই কথাটা অনেক ব্যাপক এবং আমরা মেনে নিতে চাই না। অথচ বাস্তবতা এটাই। নিজের বাসা, কর্মস্থল, আড্ডার জায়গা সবখানেই একই চিত্র। চারিদিকে মিথ্যার জয়জয়কার এবং সত্য কোণঠাসা। এটা কিন্তু ঘটনাক্রমে হচ্ছে না, বরং আমি, আপনি, আমরা সবাই মিলে এই পরিস্থিতি তৈরি করে রাখছি। এটা একটা সম্মিলিত স্বার্থ যাকে আমরা উপরে উপরে অস্বীকার করলেও মনে মনে প্রমোট করে চলেছি। এটুকু পড়েই অনেকে বিরক্ত হয়ে গেছেন হয়তো। এটা আসলে বিরক্তি না বরং অস্বস্তি। সত্যকে মোকাবিলা করতে হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা অস্বস্তিতে পড়ে যাই। আজকে আমি চেষ্টা করব সেই অস্বস্তিকর বিষয়েই আলোচনা করতে যাকে আমরা সম্মিলিতভাবে ভয় পাই এবং প্রতিহত করি। এর ফলে, মিথ্যা এবং অন্যায়ের জয় হলেও আমরা আনন্দ চিত্তে মেনে নেই। কারণ আমরা সত্য খুঁজি না, আমরা আমাদের কম্ফোর্টকে নিশ্চিত করার জন্যে ভুল বা মিথ্যাকে ভ্যালিডেটেড করতে চাই।

আমার অবসর সময়ের অনেকটাই কাটে পড়া লেখা করে, টেলিভিশনে খেলা এবং নাটক সিনেমা দেখে। সময় পেলে হলে গিয়ে সিনেমাও দেখি। নাটক-সিনেমা বা এজাতীয় কিছু যখন অন্য কারো সাথে দেখি বা পরবর্তীতে এসব নিয়ে অন্য কারো সাথে আলোচনা করি তখন একটা বিষয়ে প্রায় সবাই একমত থাকে। সেটা হচ্ছে, ‘নাটক- সিনেমা দেখি বিনোদনের জন্যে, এখানে ভারী বা গভীর কিছু ভালো লাগে না’। এটা নিয়ে আমিও ভেবেছি; এবং একমতও হয়েছি। সেটা হচ্ছে আমাদের বিনোদন দরকার। তবে যে বিষয়ে একমত হতে পারিনি সেটা হচ্ছে আমাদেরকে হালকা বা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় বিনোদন দিতে সক্ষম হবে কেন?

আমাদের দেশের বাংলা সিনেমা মূলত এখন ঈদ নির্ভর। ঈদ আসলে কিছু সিনেমা রিলিজ পায় আর বছরের বাকী সময় ধরে নামমাত্র কয়েকটা সিনেমা রিলিজ পায় যার অনেকগুলোই একদমই মান সম্মত না। যাই হোক, গত ঈদে আমি বেশ কয়েকটি সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছি। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে হাতে গোণা দারুণ হিট মুভিগুলো একটা বাদে বাকিগুলো অপ্রাসঙ্গিক, আজগুবি এবং আমাদের জীবনের কথা বলে না। ঠিক একইভাবে টেলিভিশনে কয়েকটি মিলিয়ন্স ভিউপ্রাপ্ত নাটক দেখেছি যেগুলো এতটাই মানহীন যে পাঁচ মিনিটের বেশী দেখতে ইচ্ছা হয় নি। আবার এমন কিছু দারুণ সিনেমা দেখেছি যেটা হিট হয়নি বা কিছু ভালো নাটক দেখেছি যেগুলো তেমন ভিউ পায়নি।এই অদ্ভুত অবস্থার জন্যে আসলে কারা দায়ী? অনেকেই অনেক মতবাদ দিবেন। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে কিছু শিক্ষিত মানুষের মুখে বলতে শুনেছি, ‘নাটক, সিনেমা দেখি এন্টারটেইন্ড হতে। দেশ সমাজ নিয়ে ভাবার জন্যে না’। আমাদের এই চিন্তাই আমাদেরকে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই চিন্তাই ভালো কিছুকে খারাপ কিছুর কাছে হারিয়ে দিচ্ছে। আগেকার দিনে কমেডির মাধ্যমে সমাজের নিদারুণ বাস্তবতাকে তুলে ধরা হতো আর এখন কমেডি নাটকের নামে সমাজকে তামাশায় ফেলে দিচ্ছে। আগে থ্রিলার মুভি-নাটকে সাসপেন্সের মাধ্যমে টুইস্ট থাকতো আর এখন টুইস্টের নামে অযৌক্তিক ঘটনার অবতারণা করা হচ্ছে। আর এসব অযৌক্তিক জিনিষে আমরা এন্টারটেইন্ড হয়ে ভালো কিছুকে উঠে আসতে দিচ্ছি না।

এটা শুধু নাটক সিনেমাতেই আবর্তিত না। সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখেন। এন্টারটেইনার, গুরু, ইনফ্লুয়েন্সার, মোটিভেটর, সবজান্তায় চারিদিক আচ্ছন্ন। এদের ক’জনা আমাদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করছে? কারা আমাদেরকে মিথ্যা থেকে দূরে রেখে সত্যের দিকে ধাবিত করছে? এটা নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই আবার সেই একই সমস্যা। সমাজের অনেকেই বলবেন, ‘আরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটু মজা নিতে আসি। এখানে এত গভীর কথাবাত্রা শুনে কি লাভ হবে?’ সোশ্যাল মিডিয়ায় যাদের অনেক ফলোয়ার তাদের দিকে একটু গভিরভাবে খেয়াল করেন। তাদের আলোচনার টপিক এবং দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই করার চেষ্টা করেন। একটা জায়গায় দারুণ মিল পাবেন। সবাই প্রতিটা বিষয়ে একটা নির্দিষ্ট মতবাদ দিচ্ছে। সেই মতবাদ একটা টাইপের। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট গ্রুপ অফ পিপলের জন্যে। সেই নির্দিষ্ট গ্রুপ অফ পিপল তাদের মতাদর্শের ভ্যালিডেশন খুঁজছে সেসব ফেমাস ইনফ্লুয়েন্সারদের কাছ থেকে। গুরু বা ইনফ্লুয়েন্সাররা সত্যকে প্রমোট করছে না বরং একটা নির্দিষ্ট মতবাদকে প্রমোট করে একটা নির্দিষ্ট গ্রুপ অফ পিপলকে ফলোয়ার বানিয়ে দেদারসে কামাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, সেসব ইনফ্লুয়েন্সাররা প্রকৃতপক্ষে নিজের জ্ঞান দিয়ে কাউকে ইনফ্লুয়েন্স করতে পারে না বরং একটা নির্দিষ্ট আদর্শের মানুষ তাদের মতাদর্শের ভ্যালিডেশনের জন্যে তাদের কাছে আসে। এ কারণেই ডিপ থট বা গভীর চিন্তার উদ্রেগ যারা ঘটাতে পারে তাদের চেয়ে নির্দিষ্ট মতাদর্শকে সুন্দরভাবে ভ্যালিডেটেড করতে পারে তাদের ফলোয়ার বেশি। আরেকটু ভিন্নভাবে বললে, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ফলোয়ার পেতে হলে বেশি

রভাগ ক্ষেত্রেই যে গুনটার প্রয়োজন হয় সেটা হচ্ছে গুছিয়ে অন্যের মনের কথা বা আবেগকে বলতে পারা, নিজের মতাদর্শ বা জ্ঞানকে প্রচার করার ক্ষমতা না।

শুধু সোশ্যাল মিডিয়াতেই বা কেন। এবার কর্মক্ষেত্রে খেয়াল করে দেখেন বিশেষ করে আপনি যদি করপোরেট জব করে থাকেন। আপনার কতটা মেধা আছে বা আপনি কত ক্লিয়ারলি চিন্তা করতে পারেন সেটার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনি কতটা গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। আর ইংরেজিতে দক্ষ হলে তো কথাই নেই। কি বলছেন সেটা নিয়ে কেউ ভাববে না, কিভাবে গুছিয়ে কথা বলছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। তেলবাজ এবং চাপাবাজদের কর্মক্ষেত্রে জয়জয়কার। কর্মক্ষেত্রের চাপাবাজেরা খুব কম জ্ঞানের অধিকারী হয়। তাদের সবচেয়ে যে ক্ষমতা থাকে সেটা হচ্ছে বসের মন বুঝে কথা বলার ক্ষমতা এবং অন্যের কাছ থেকে আইডিয়া নিয়ে হালকা জ্ঞানকে দারুণভাবে উপস্থাপন করা যেটাতে মনে হবে সে দারুণ কিছু বলছে। মেধা দিয়ে না, তারা বসকে ইমপ্রেস করে গুছিয়ে কথা বলে।

আমি মনে করি, সমাজে দুই শ্রেণির মানুষ বসবাস করে। এক শ্রেণির মানুষ হচ্ছে আম-জনতা এবং আরেক শ্রেণির মানুষ হচ্ছে আম জনতাকে বেঁচে বড়লোক হওয়া। এই আম জনতাকে বেঁচে দেওয়া কিন্তু বিভিন্ন ফরমেটে হয়। তার মধ্যে একটা হচ্ছে সরাসরি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। ছোটবেলায় দেখতাম বিজ্ঞাপন গুলো খুব ডাইরেক্ট হতো। যেমন অমুক দেশের অমুক প্রোডাক্ট সেরা, কিনে ফেলেন। এরপর দেখলাম বিজ্ঞাপনে ভিন্নতা আসছে। আমাদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করতে দিচ্ছে না। কারণ, আপনি যখন কোন প্রোডাক্ট নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবেন তখন সেই প্রোডাক্ট দারুণ একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে। তাই তারা হালকাভাবে বিজ্ঞাপন করা শুরু করলো। যার কোনো যুক্তি নেই, বাস্তবতা নেই। আছে শুধু চটুলতা আর মজা। এতেই আমরা আম-জনতা প্রোডাক্টের প্রেমে পড়ে হুমড়ি খেয়ে দোকানে হাজির। এরপর বিজ্ঞাপন আরেক মাত্রায় গেলো। বর্তমান সময়ে আমরা ড্যাটা এবং পরিসংখ্যানের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল। তার ওরা বলা শুরু করলো ৮০%, ৯৯.৯৯% , সাধারণের চেয়ে দশ গুণ বেশি ইত্যাদি। এসব তথ্য উপাত্ত নিয়ে আমরা কিন্তু কেউ কিছু ভাবছি না। বিজ্ঞাপনের মোহাচ্ছন্নতায় প্রোডাক্ট কেনা শুরু করে দেই। একটা প্রোডাক্ট গুনগতভাবে কতটা ভালো তারচেয়েও আমরা বেশি গুরুত্ব দেই সেই প্রোডাক্টটার বিজ্ঞাপন কত সুন্দর হয়েছে এবং সেই বিজ্ঞাপনে আমাদের কোন গুরু বা ইনফ্লুয়েন্সার অংশ নিয়েছে।

আমার ছেলের বয়স যখন তের চৌদ্দ বছর তখন একদিন আমার ফেইস বুকের কয়েকটা স্ট্যাটাস পড়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘বাবা, এসব লিখে ফেমাস হতে পারবা না। তোমার এত জটিল কথা পড়ার মানুষের সময় নেই। মজার কিছু হালকা করে লিখ, অনেক ফলোয়ার পাবা’। পরে অনেকক্ষণ ভেবেছিলাম ছেলের কথাটা। উপলব্ধি করেছিলাম যে এটাই বাস্তবতা। এই বাবলের মধ্যে থাকা সমাজের এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা যে একটা কিশোর ছেলেকেও বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে তথাকথিত সাফল্যের জন্যে বেশি গভীর কিছু ভাবা যাবে না। এটাকে আমরা হালকাভাবে নিলে বড় রকমের ভুল করে ফেলবো। আমাদের এই সমাজের নাটের গুরুরা কিন্তু এটাই চায়। তারা চায় আমি, আপনি সবকিছুকে হালকাভাবে ভাবতে শুরু করি। তাহলেই তারা আমাদেরকে অনেক কিছু গিলিয়ে ইনকাম করতে পারবে। আমাদের চিন্তা শক্তি যত প্রখর হবে, আমরা যত রিজনিং খুঁজব তত অন্যায়কে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের উচিৎ হবে পরবর্তী প্রজন্মকে গভীর চিন্তা করার ক্ষমতা অর্জন করতে সহায়তা করা। আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে তরুনরা যেন ইনফ্লুয়েন্সারের দুষ্টু ইনফ্লুয়েন্সে না পড়ে তারা যা বলছে সেটা ঠিক বলছে কি না সেটা যাচাই করার ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করা। তা না হলে পরবর্তী প্রজন্ম এক ইলিউশনে পড়ে যাবে যেখান থেকে আর মুক্তি মিলবে না।

লেখক: কথাশিল্পী ও নাট্যকার।


এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান 

লিয়াকত হোসেন খোকন 
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সারা বিশ্বে প্রায় ৪৬ কোটি শিশু সঙ্ঘাতপূর্ণ এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রে বাস করে। যা কিনা সেই সকল শিশুর নিরাপত্তাহীনতার এবং ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও সারা বিশ্বে অপুষ্টি, অকাল জন্ম এবং সংক্রামক রোগ শিশুদের বড় হয়ে ওঠার পথে বাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মনে হয়, একটু দৃষ্টি নিয়ে এদিকে সেদিকে তাকালে এরকম দৃশ্য চোখে পড়বেই।

শিশুদের বলা হয়, ফিউচার অফ দ্য নেশন। শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে যেকোনও দেশের ক্রীড়া, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতির অঙ্গনে তাঁদের প্রাধান্য বিস্তার করে আজকের শিশুরা। সুতরাং সকল দেশ এবং জাতির কর্তব্য, আজকে যারা শিশু, তাদের মানসিক এবং শারীরিক উন্নতির জন্য চিন্তা - ভাবনা করা, তাদের আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত করে তোলা। কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করে যাচ্ছি যে, গোটা বিশ্বেই বর্তমান সময়ে শৈশব বিধ্বস্ত। বিশেষ করে, যুদ্ধে যে সকল দেশ জড়িয়ে পড়েছে, সেই সকল দেশের শৈশব আজ প্রচণ্ড ভাবে বিপর্যস্ত। ইজরায়েল, প্যালেষ্টাইন, রাশিয়া, ইউক্রেন, সুদান, সিরিয়া, ইরান, ইরাক ইত্যাদি দেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি যুদ্ধাস্ত্রের আঘাতে প্রচুর শিশু নিহত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। আহতের সংখ্যা নিহতের থেকেও বেশি। মা - বাবাকে জনমের তরে হারিয়ে বহু শিশু হয়ে পড়েছে অনাথ, অসহায়। তাদের পড়াশোনা, মানসিক বিকাশ সম্পূর্ণ ভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া অনেক দেশে অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক শিশু তাদের স্কুল জীবন অসমাপ্ত রেখেই নিয়োজিত হচ্ছে বিভিন্ন কাজে। তারা কাজ করছে বিভিন্ন যানবাহনের গ্যারেজে, হোটেলে, দোকানে, রেস্তোরাঁয় বা চায়ের দোকানে। তাদের অর্থাৎ শিশুদেরকে নানা রকম কাজে নিয়োজিত করা হয় সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। কখনও কখনও তাদের ওপর শারীরিক অত্যাচার পর্যন্ত করা হয়। এই ধরনের কর্মকাণ্ড কখনওই শৈশবের ভবিষ্যৎ চিত্র খুব একটা উজ্জ্বল করে না।

শৈশবে দেখেছি,পাঠশালায় ‘বাংলা এবং ইংরেজি’ অক্ষর চেনা, জানা ও হাতে ধরে লেখার জন্য পণ্ডিতদের কাছে পাঠাতেন। তারা হাতে হাত রেখে বা ধরে ইংরেজি এবং বাংলা অক্ষর লেখা শিখাতেন। পাঠশালাতে প্রায় ১ বছর ধরে অক্ষর সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান হওয়ার পর প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হত। শিশু বয়সে পণ্ডিতদের কাছ থেকে অক্ষর চেনা, জানা ও লিখতে পারার জ্ঞান অর্জন করা শুধু নয়, পাশাপাশি তারা প্রতিটি শিশুকে আদর্শিক হিসাবে গড়ে ওঠার শিক্ষা দিতেন। বাংলাদেশে আদিকাল থেকে গুরুভিত্তিক পাঠশালার অস্তিত্ব ছিল, যা আমরাও শিশু বয়সে পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে সরকার নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তনের ফলে পাঠশালা শিক্ষা ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, আমাদের পিরোজপুর শহরে আদর্শ হিন্দু স্কুলের একটি শাখা ছিল, সেটি আদর্শ কালিবাড়ী পাঠশালা হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই পাঠশালাটি ১৯৭১ সালে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

তাছাড়া আদর্শ হিন্দু স্কুলের অস্তিত্বও আর নেই। সত্যি বলতে কি, এ যুগে পাঠশালা না থাকার কারণে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করার ব্যবস্থা চিরতরে বন্ধ হওয়া মানেই বর্তমান প্রজন্ম যে আদর্শিক হতে গড়ে উঠবে, সে সুযোগ আজ কোথায়! যেজন্য পাঠশালার পণ্ডিতদের অস্তিত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পণ্ডিতও নেই তাই বোধহয় মানুষ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না এ প্রজন্মের একাংশ। আজকাল প্রায়শই পত্রিকার পাতায় দেখা যায়, ছাত্র কর্তৃক শিক্ষক

লাঞ্ছিত - অপমানিত। কারণ, ঐ যে শিশু বয়সে তারা পণ্ডিত মশাই পাননি। কেননা, পণ্ডিতরাই সত্যিকার অর্থে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতেন সেই সময়ের শিশুদেরকে। যে জন্য শিশুরা বড় হয়ে শিক্ষকসহ সর্বস্তরের গুরুজনদেরকে সন্মান করতেন, শ্রদ্ধা জানাতেন।

লেখক: চিঠিপত্র বিশারদ


নতুন অসন্তোষ কোনোভাবেই কাম্য নয়

ড. সুলতান মাহমুদ রানা
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দিয়েছে সরকার।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে একটা চিঠি পাঠানো হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, গণভোটের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। আর এই গণভোট এবং জাতীয় সংসদের নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। আর এই ইস্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক বিশেষ মুহূর্ত অতিক্রম করছে। রাজনীতির এটই সময়টি এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্ত শুধু রাজনৈতিক নয়- রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো, গণতন্ত্রের রূপ নির্ধারণ এবং জনগণের ক্ষমতার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে। গত কয়েক সপ্তাহে নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনের সম্ভাবনা উত্থাপিত হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, তা স্বাভাবিক উত্তেজনার অনেক বাইরে। এটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সীমা অতিক্রম করে এখন হয়ে উঠেছে এক বৃহদাকার রাজনৈতিক বিতর্ক। আর এই বিতর্কে রাজনৈতিক দল, সাধারণ জনগণ, গণমাধ্যম, রাজনীতি বিশ্লেষক এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও গভীর নজর রাখছে।

এছাড়াও বিভিন্ন সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, নির্বাচন কমিশনও এক অভূতপূর্ব চাপের মুখে রয়েছে। তারা এটিকে ‘দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট, গণভোটের ব্যালট, আলাদা গণনা, পর্যবেক্ষণ, নিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণÑ সব মিলিয়ে এমন দ্বৈত আয়োজন বাংলাদেশের মতো দেশে এই প্রথম। কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি, কর্মী প্রশিক্ষণ, ব্যালটপেপার মুদ্রণ, নিরাপত্তা সমন্বয়- সবকিছুই এখন এক প্রকার যুদ্ধ।

সরকার ও নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কাঠামো গঠনের অন্যতম রোডম্যাপ। নতুন রাষ্ট্র কাঠামো, বিশেষ করে Upper House-এর মতো একটি প্রস্তাব বাস্তবায়নের আগে জনগণের মতামত নেওয়া জরুরি। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক শূন্যতা দীর্ঘায়িত হলে রাষ্ট্র আরও অস্থিতিশীল হবে- তাই দ্রুত প্রক্রিয়া শুরু করা ছাড়া উপায় নেই। বিএনপি বলছে, গণভোটকে অজুহাত করে নির্বাচনের প্রস্তুতির সময় সংকুচিত করা হচ্ছে, যাতে তারা সংগঠিত কৌশল নিতে না পারে। অন্যদিকে যারা গণভোটের পক্ষে, তারা বলছে, নতুন রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাপারটি এতদিন ধরে ঝুলে ছিল। দেশের অবস্থা ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিবেচনায় এখনই জনগণের সামনে প্রশ্নটি উপস্থাপন করার সময়। এই দুই বিপরীত অবস্থান মাঠে এক ধরনের দ্বৈত উত্তাপ তৈরি করেছে। একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়তে পারে অথবা কমতেও পারে। তবে প্রশাসনিকভাবে ভুলের ঝুঁকি বহু গুণ বাড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, দেশের আমলাতন্ত্র, নিরাপত্তা বাহিনী, নির্বাচন পরিচালনা কাঠামো- সবকিছুই সীমিত সম্পদে পরিচালিত হয়। একটি বিশাল জাতীয় নির্বাচনই যেখানে বিশৃঙ্খলা বা জটিলতার আশঙ্কা তৈরি করে, সেখানে একই দিনে দ্বৈত ভোট আয়োজন করলে ভুল হওয়ার সুযোগও দ্বিগুণ হবে। সেই ভুল যদি ফলাফল, ব্যালট গণনা বা কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় ঘটে- তাহলে তা রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দেবে, যার প্রভাব বহুদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। তবে যদি নির্বাচন ও গণভোট আলাদা দিনে করা হয়, তাহলেও রাজনৈতিক উত্তেজনা দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ঢা যায় না। বাংলাদেশে নির্বাচনী আবহ যখনই সৃষ্টি হয়, তখনই অনিশ্চয়তা, গুজব, দলীয় ইস্যু এবং সহিংসতা বেড়ে যায়। সে প্রেক্ষাপটে আলাদা দিনে ভোট দুটি আয়োজন করলে দেশের ওপর চাপও দ্বিগুণ হবে। সুতরাং একটি দিনের সিদ্ধান্তই অনেকের কাছে ‘রাজনৈতিকভাবে ন্যূনতম ঝুঁকির পথ’ মনে হচ্ছে।

নতুন রাষ্ট্র কাঠামো তৈরির যে আলোচনাটি চলছেÑতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে Upper House বা উচ্চ কক্ষ গঠনের প্রস্তাব। গণমাধ্যমের এক একটি প্রতিবেদন সূত্রে জানতে পারলাম যে, উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্ব কীভাবে নির্ধারণ হবে- এটি এখন রাজনৈতিক বিরোধের সবচেয়ে বড় ইস্যু। কেউ চান এটি সরাসরি নির্বাচিত হোক, কেউ চান পেশাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব, আবার কেউ চান অংশভিত্তিক মনোনয়ন ব্যবস্থা। রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ মনে করছে যে, এটি ক্ষমতা ভাগাভাগির নামে ক্ষমতার পুনঃবিন্যাসের নতুন কৌশল। আবার অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, উচ্চকক্ষ গঠিত হলে টেকসই আইন প্রণয়ন, সংবিধান সংশোধন এবং রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি নীতি নির্ধারণ আরও শক্তিশালী হবে।

গত এক দশকে নানান রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন-সংঘর্ষ, আদালতের নানা সিদ্ধান্ত, নির্বাচন নিয়ে বিতর্কÑসব মিলিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক অবসাদও জমেছে। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দেওয়া হলেও তা এই নির্বাচনে প্রযোজ্য নয়। এমন একটি সিদ্ধান্তও নাগরিকদের মনে নতুন বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। অনেকে বলছেন, আদালতের এই রায় ভবিষ্যতে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামো গঠনের পথ তৈরি করবে। আবার কেউ বলছেন, এটি রাজনৈতিক সংকট আরও জটিল করবে। বিএনপি দাবি করছেÑগণভোটের ফলে নির্বাচনের আসল ইস্যুগুলো আড়ালে পড়ে যাবে এবং সরকার প্রক্রিয়াটি নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করবে। তাদের বক্তব্যÑ‘এক দিনে নির্বাচন ও গণভোট মানে দুইটি বিশাল রাজনৈতিক চাপকে একসঙ্গে বেঁধে দেওয়া।’এতে ভোটারের মনোযোগ বিভক্ত হবে। অন্যদিকে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন যে, যারা গণভোটকে বিলম্বের কৌশল বলছেন, তারা নিজেরাই রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে ব্যর্থ। তারা মনে করেন, গণভোটের প্রশ্ন জনগণের ওপর আস্থা রাখার একটি সুযোগ।

গণভোটের বাস্তব চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণ কি গণভোটের জন্য প্রস্তুত? একটি দেশের গণভোট তখনই সার্থক হয় যখন জনগণ বিষয়টি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ও তথ্যসমৃদ্ধ থাকে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন রাষ্ট্রগঠনের যে প্রস্তাব নিয়ে এত আলোচনা- তা আদৌ কয়জন গভীরভাবে বুঝেছে? এই কাঠামো কীভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দেবে? এতে প্রশাসনের ওপর কী প্রভাব পড়বে? জনগণের ক্ষমতায়ন কি বাড়বে, নাকি এটি ক্ষমতাবৃত্তির আরেকটি স্তর তৈরি করবে?

গণমাধ্যমের ভূমিকাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রচলিত মিডিয়ার পাশাপাশি অনলাইন মিডিয়া, ইউটিউব চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন রাজনৈতিক বয়ান তৈরির মূল ক্ষেত্র। কিন্তু এখানেও এক ধরনের ‘বিভক্ত গণমাধ্যম বাস্তবতা’ দেখা যাচ্ছে। কেউ শক্তভাবে নির্বাচন-গণভোট একইদিনে করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছে, আবার কেউ এটিকে রাজনৈতিক কৌশল বলে আখ্যা দিচ্ছে। এই ভিন্নমুখী কাঠামো জনগণের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বেও প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে উপেক্ষা করা যায় না। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের নির্বাচন এখন আন্তর্জাতিক নজরদারির অন্যতম বিষয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ ও ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ প্রসঙ্গে। একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের ধরনও বদলে যাবে। অনেক প্রতিষ্ঠান হয়তো দুটি ইভেন্টেই পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারবে না। ফলে পর্যবেক্ষণের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।

সব মিলিয়ে এখন স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক পর্যায়ে ঢুকেছে, যেখানে নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজন করা হবে কিনা- এ প্রশ্নটাই রাজনৈতিক রূপরেখা নির্ধারণ করবে। এই আয়োজন সফল হলে এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রে কাঠামোগত পরিবর্তনের ঐতিহাসিক সূচনা হতে পারে। বিশেষ করে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতা বিভাজন, আইনি সংস্কার- সবই এক নতুন রাজনৈতিক দিগন্তের সূচনা করবে। কিন্তু যদি আয়োজন ব্যর্থ হয়, গণনা ভুল হয়, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় বা রাজনৈতিক দলগুলো ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে- তাহলে তা দেশে নতুন অস্থিতিশীলতা, নতুন অসন্তোষ এবং নতুন ধরনের সংকটের জন্ম দিতে পারে। যা নিয়ন্ত্রণ করা নতুন সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে এখন লড়াই শুধু দলগত নয়Ñএটি আদর্শিক লড়াইয়েও রূপ রিয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোন পথে যাবে- এটি এখনো অনিশ্চিত। কিন্তু একটি বিষয়ে দেশ ইতোমধ্যে নিশ্চিত যে, বাংলাদেশের রাজনীতি আর আগের জায়গায় থাকবে না। নির্বাচন ও গণভোটের এই সিদ্ধান্তই হয়তো আগামী রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করবে অথবা নতুন অস্থিরতার দরজা খুলে দেবে।

লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে আমরা ঋণী

অ্যাড. আব্দুর রাজ্জাক খান রানা
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

প্রতিটি শিশু কিছু অধিকার ও দ্বায়িত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। জন্মের পর থেকেই সে অধিকারগুলো ভোগ করতে শুরু করলেও দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়। দায়িত্ব ও কর্তব্য শুরু হয় আরও কিছু দিন পর থেকে। যেমন জন্মের শুরু থেকেই শিশু আহার, নিদ্রা, চিকিৎসা, মায়ামমতা ও নিরাপত্তার অধিকার ভোগ করতে থাকে। কিন্তু দায়িত্ব ও কর্তব্য দেখা যায় আরও কিছু দিন পর থেকে। যেমন- একটি শিশুকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য বাবা মা তাকে স্কুলে পাঠাবেন এটা ঐ শিশুর অধিকার। কিন্তু ভালোভাবে লেখাপড়া করা ঐ শিশুর কর্তব্য। এমনি করে অধিকার ভোগের পাশাপাশি শিশুর কর্তব্য ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। যেমন নিয়মিত স্কুলে যাওয়া। পড়ার টেবিল গুছিয়ে রাখা। সময় মত পড়তে বসা। লেখাপড়ার সময় লেখা পড়া করা, খেলাধুলার সময় খেলাধুলা করা। বাবা মায়ের কথামত চলা। বড়দের সম্মান করা ইত্যাদি। আর একটু বড় হলেই তার উপর দায়িত্ব ভর করতে শুরু করে। যেমন-ছোট ভাই বোনদের প্রতি খেয়াল রাখা ও তাদের প্রতি যত্নবান হওয়া। ছোটদেরকে স্নেহ করা। বড়দের সম্মান করতে শেখানো, সংসারের কাজে বাবা মাকে সাহায্য করা ইত্যাদি।

জীবনের প্রতিটি ধাপে মানুষের দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। আগেই বলা হয়েছে শিক্ষা মানুষের অধিকার। কিন্তু যথাযথভাবে শিক্ষা লাভ করে সেই শিক্ষাকে নিজের ও দেশের কল্যাণে কাজে লাগানো তার দায়িত্ব। একজন মানুষ কর্মজীবনে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত দেশের সর্বশ্রেণিপেশার মানুষের কাছে ঋণী হতে থাকে। একজন নাগরিককে সুশিক্ষিত করে তুলতে সরকারকে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করতে হয়। আমাদের সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধার জন্য সরকার যে অর্থ ব্যয় করে সেই অর্থ দেশের প্রতিটি মানুষের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। কাজেই সহজেই অনুমান করা যায় যে, আমরা মানুষের কাছে কতভাবে ঋণী। কর্মজীবনে প্রবেশের পরও মানুষের কাছে ঋণী হওয়া বন্ধ হয় না। মানুষ চাকরি যে বেতন পায় তাতেও থাকে সর্ব শ্রেণিপেশার মানুষে ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের টাকা। অর্থাৎ মানুষ যত বড়লোকই হোক, যত বড় চাকুরেই হোক, যত বড় ব্যবসাই হোক, যে পেশারই হোক না কেন সর্বশ্রেণিপেশার অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক, কুলী, মজুর, রিকসাওয়ালা, ঝাড়ুদার, এমন কি একজন ভিক্ষুকের কাছেও সে ঋণী। এটাই আমাদের দায়। এই দায় থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি ভাবে এই ঋণী পরিশোধ করে নিজেকে দায়মুক্ত করব? প্রশ্নের যখন উদয় হয়েছে, উত্তরও অবশ্যই মিলবে। উত্তর হলো এই ঋণ পুরোপুরি পরিশাধ যোগ্য নয়। তবে প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে এই ঋণের ভার বেশ খানিকটা হালকা করতে পারি। যেমন-প্রতিটি পেশাজীবি মানুষের স্তর অনুযায়ী সমাজে অবস্থান থাকে।

প্রতিটি মানুষ যদি তার অবস্থান থেকে সঠিক ভাবে তার দায়িত্ব পালন করে তবেই সে দায় থেকে মুক্তি পেতে পারে। নিজেকে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ‘নৈতিক শিক্ষা’। কিন্তু নৈতিক শিক্ষা কিভাবে লাভ করা যায়? পরিবার হচ্ছে নৈতিক শিক্ষার আতুর ঘর। অর্থাৎ শৈশবে পরিবার থেকেই শুরু হয় মানুষের নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষা হচ্ছে সেই শিক্ষা যা মানুষকে উচিৎ-অনুচিৎ, ন্যায় অন্যায় বুঝতে শেখায়। মানুষকে শিষ্টাচারী, মানবতাবাদী হিসেবে গড়ে তোলে। মানুষের মধ্যে আত্মতৃপ্তি এবং আত্ম বিশ্বাস তৈরি করে। নৈতিক শিক্ষা মানুষকে ভালো কাজে উৎসাহ যোগায় এবং মন্দ কাজে নিরুৎসাহিত করে। তাই সমাজের সর্বস্তরে নৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে।

অ্যাড. আব্দুর রাজ্জাক খান রানা: সমাজ সেবক, আয়কর আইনজীবী।


ভূমিকম্পের ঘণ্টা বাজছে: আতঙ্ক নয়, প্রস্তুতি জরুরি

আ.ন.ম খলিলুর রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের মাটিতে হঠাৎ কম্পনের অনুভূতি জনসাধারণের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। প্রথমে ছোটখাটো দমকা বা কম্পন মনে হলেও, পরপর কম্পনের ঘটনা মানুষকে নিশ্চিন্ত হতে দিচ্ছে না। ছোট-বড় সকল শ্রেণির মানুষ দোকানদার, অফিসকর্মী, শিক্ষার্থী, দিনমজুর একই প্রশ্ন নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন: ‘পরবর্তী ধাক্কা কি আরও বড়ো হতে পারে?’ এই অনিশ্চয়তা এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গেছে।

সাধারণ মানুষের আতঙ্কের পেছনে শুধু প্রকৃত ভূমিকম্পই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে প্রতিনিয়ত অ্যানিমেশন, ভিডিও, চিত্র এবং তথ্যচিত্র ছড়ানো হচ্ছে। অনেক সময় এগুলো আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে নাটকীয় রূপ পায়, যা জনমনে অতিরিক্ত ভয় সৃষ্টি করে। ভিডিওতে অগ্নিকাণ্ডের চিত্র, ভেঙে পড়া ভবন, মানুষের দৌঁড়াদৌঁড়ি সবই অতিমাত্রায় আতঙ্ক সৃষ্টিকারী। ফলে, সাধারণ মানুষ বাস্তব ও কল্পনার পার্থক্য করতে পারছেন না।

এটি শুধু মানসিক উদ্বেগই নয়, সামাজিক জীবনেও প্রভাব ফেলছে। দৈনন্দিন জীবনের রুটিন দোকান খোলা রাখা, স্কুল-কলেজে পড়াশোনা, অফিসে যাতায়াত সবকিছুই স্থবির হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানপাট খোলার বিষয়ে দ্বিধায় পড়েছেন, পরিবারগুলো রাতে ঘুমাতে পারছেন না, শিশুরা আতঙ্কিত। বিশেষ করে যেসব এলাকা পুরনো ভবন এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ, সেসব স্থানে আতঙ্ক আরও তীব্র। অনেকেই ইতোমধ্যেই নিজের বাড়ি বা অফিসে নিরাপদ স্থানের খোঁজ শুরু করেছেন।

বিগত কয়েক বছরের নগরায়ন অভ্যাসও এই আতঙ্কের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। নগরায়ন পরিকল্পিত না হওয়ায় আমাদের শহরে রাস্তা সংকীর্ণ, বহুতল ভবন অনিয়মিতভাবে নির্মিত এবং অনেক পুরাতন ভবন এখনো ব্যবহার হচ্ছে। একদিকে শহরের জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, অন্যদিকে নিরাপদ নির্মাণের মান কমছে। এই পরিবেশে ভূমিকম্পের প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই বেশি। শহরের আকাশচুম্বী ভবন, জনবহুল মার্কেট, রাস্তার সংকীর্ণতা এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করছে, যা সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ককে প্রজ্বলিত করছে।

সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও পরিস্থিতিকে জটিল করছে। দেশের রাজনৈতিক মাঠে উত্তাপ, ভোটের প্রস্তুতি এবং শীতের আগমন সবকিছু একসঙ্গে মানুষের মনকে উদ্বিগ্ন করছে। এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিরিক্ত আতঙ্ক ছড়ানো হলে সাধারণ মানুষের মানসিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয়। একে অযথা আতঙ্ক বলা যায় না, কারণ এটি বাস্তব জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, কিন্তু অতিরিক্ত তথ্য এবং নাটকীয় চিত্র জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।

সরকারের করণীয় এখানে স্পষ্ট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিক ও দ্রুত তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছানো। বিভ্রান্তিকর বা অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণে আতঙ্ক আরও বাড়তে পারে। প্রতিটি জেলায় স্থানীয় প্রশাসনকে সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে হবে। নিরাপদ স্থানের তথ্য, ভূমিকম্প মোকাবিলার নিয়মাবলি, জরুরি সেবা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থানীয় ক্লাব ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় শুধু আতঙ্কই তৈরি করে না, বরং আমাদের প্রস্তুতির সক্ষমতাকেও পরীক্ষার মুখে ফেলে। এই প্রস্তুতিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ঘটনা ঘটার মুহূর্তে তারা তৎপরভাবে উদ্ধার, চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হলে সাধারণ মানুষ দ্রুত নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র পেশাদার সংস্থার উপর নির্ভর করলেই চলবে না।

এক্ষেত্রে স্কাউট, যুবসংগঠন এবং স্থানীয় কমিউনিটি দলের মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর প্রশিক্ষণ ও অংশগ্রহণও অত্যন্ত জরুরি। তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বয়স্ক মানুষ ও শিশুদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর দিকনির্দেশনা দিতে পারে। তাছাড়া, সাধারণ বাসিন্দাদেরও প্রাথমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক ভূমিকম্পের সময় কিভাবে আশ্রয় নেবেন, জরুরি সাপ্লাই সংরক্ষণ কোথায় থাকবে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে যোগাযোগের সঠিক পথ কী।

এই প্রস্তুতির কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে। প্রত্যেক জেলা ও উপজেলায় ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি নীতি প্রণয়ন, নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র চিহ্নিতকরণ, জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং স্থানীয় জনগণকে প্রশিক্ষিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি।

শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত জনসচেতনত সামজিক যোগাযো মধ্যম ভিডিও ও লিখিত তথ্যের মাধ্যমে শিক্ষামূলক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। এভাবে নাগরিকরা শুধু আতঙ্কিত হবে না, বরং বিপদের মুহূর্তে স্বশক্তিতে নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জন করবে।

ফলশ্রুতিতে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পেশাদার প্রস্তুতি, স্কাউট ও যুব সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী সহায়তা এবং সাধারণ বাসিন্দাদের সচেতনতা একসাথে মিলিত হলে, ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক বিপদকে যথাযথভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে এই সব ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

নাগরিকদেরও তাদের ভূমিকা বোঝা জরুরি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর বা আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কন্টেন্ট ছড়ানো বা সেয়ার থেকে বিরত থাকতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে সরকারি সূত্র এবং নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যম থেকে তথ্য গ্রহণ করা উচিত। পরিবার, প্রতিবেশী ও স্থানীয় কমিউনিটির সঙ্গে সক্রিয় সংযোগ রক্ষা করলে মানুষ মানসিকভাবে আরও প্রস্তুত হতে পারে।

এছাড়াও, বাস্তব জীবনের উদাহরণও আমাদের শেখায় যে সচেতনতা এবং প্রস্তুতি ভয়কে মোকাবিলার শক্তি বৃদ্ধি করে। জাপান, চিলি, তুরস্কের মতো দেশগুলোতে, যেখানে ভূমিকম্প স্বাভাবিক ঘটনা, জনগণ এবং প্রশাসন আগে থেকেই প্রস্তুত থাকে। সেখানে শিক্ষামূলক সিমুলেশন, জরুরি ব্যবস্থা এবং জনসচেতনতা কার্যক্রমের ফলে আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমাদের দেশেও একই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা সম্ভব। প্রতিটি শহর, উপজেলা ও গ্রামে এই ধরনের প্রস্তুতি নিলে মানুষের জীবন এবং মানসিক শান্তি দুইই রক্ষা করা সম্ভব।

বিভিন্ন গবেষণাও প্রমাণ করে, আতঙ্কিত মানুষ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, যা বিপদের সময় আরও ক্ষতি সৃষ্টি করে। তাই মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি। স্কুল-কলেজে ভূমিকম্প সচেতনতামূলক ক্লাস নেওয়া, অফিস ও কারখানায় জরুরি পরিকল্পনা তৈরি করা, পরিবারকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার শিক্ষাদান এগুলো সবই জনগণকে আতঙ্কমুক্ত রাখতে সহায়ক।

বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রভাবও এই আতঙ্কের সঙ্গে যুক্ত। ব্যবসায়ীরা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে দ্বিধায় পড়ছেন, শেয়ার বাজার বা অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। এমন অবস্থায় সরকারি পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতা জরুরি। শুধু আতঙ্ক দূর করা নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বোপরি, ভূমিকম্প যেমন একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, তেমনি আমাদের সচেতনতা ও প্রস্তুতি সেটিকে মোকাবেলার সক্ষমতা নির্ধারণ করে। আতঙ্ককে দূরে সরিয়ে সঠিক তথ্য, শিক্ষিত নাগরিক এবং কার্যকর প্রশাসন একত্রিত হলে আমরা নিরাপত্তা এবং মানসিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারি। সমাজ এবং সরকার একযোগে কাজ করলে আতঙ্ক কমানো সম্ভব, এবং জনগণ নিরাপদভাবে দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।

আজকের এই মুহূর্ত আমাদের জন্য একটি হুঁশিয়ারি: আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনভাবে এবং সুপরিকল্পিত প্রস্তুতির মাধ্যমে আমরা ভূমিকম্পের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এটি শুধু সরকারের কাজ নয় সাধারণ জনগণও সচেতনতা, দায়িত্বশীল আচরণ এবং সহমর্মিতার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে হবে। একমাত্র সঠিক তথ্য, প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি মিলিত হলে আতঙ্ককে আমরা সামলাতে পারব, জীবন রক্ষা করতে পারব এবং মানসিক শান্তি বজায় রাখতে পারব।

ভূমিকম্প একটি প্রকৃতির পরীক্ষা, এবং আমাদের প্রতিক্রিয়া এই পরীক্ষার প্রকৃত মান নির্ধারণ করে। আতঙ্ক নয়, প্রস্তুতি এটাই আমাদের একমাত্র নিরাপত্তা। আজকের জনগণ সচেতন হলে আগামী দিনের বাংলাদেশ আরও নিরাপদ, আরও স্থিতিশীল এবং আরও সুসংগঠিত হবে।

আ.ন.ম খলিলুর রহমান (ভিপি ইব্রাহীম): লেখক ও টকশো বিশ্লেষক।

সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দল


জাতীয় ঐক্য সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্ব শর্ত

রেজাউল করিম খোকন
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্রের নানা সমীকরণ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে-এমন ঘোষণার পর অপশক্তিগুলো নির্বাচন বানচাল করতে চতুর্মুখী অপতৎপরতা শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী এবং পতিত আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা নাশকতা সৃষ্টিসহ পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মতো ক্ষেত্র তৈরির অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে ছদ্মবেশে থাকা পতিত আওয়ামী লীগের দোসররা সক্রিয় রয়েছে। এ অবস্থায় এসব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হলে সবার আগে দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এটি হলো অন্যতম পূর্বশর্ত। আর দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে এ মুহূর্তে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য নির্বাচন পর্যন্ত আগামী কয়েকটি মাস ভালোভাবে পার করতে সরকারের পাশে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের সব শক্তিকে শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে। সরকার নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়া জানতে আন্তরিক সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এই মুহূর্তে সৃষ্ট সংকট নিরসনে সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। নির্বাচন বানচাল করতে ইতোমধ্যেই একটি মহল এখন প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ শুরু করেছে। এটি হলো তাদের বড় শক্তি। এটা তাদের একধরনের ষড়যন্ত্রমূলক মিশন। এজন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তারা প্রতিনিয়ত গুজব ছড়াতে ব্যস্ত রয়েছে। ফলে সৃষ্ট সংকট ও বহুমুখী ষড়যন্ত্র কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে হলে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য গণঅভ্যুত্থানের সব শক্তিকে সত্যিকারার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ক্ষমতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে নিজেরা বিভেদে জড়িয়ে পড়লে বিপদ অনিবার্য।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান ঘিরে শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে দেড় বছর না পেরোতেই সেই ঐক্যে ফাটল ধরেছে। যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। অপরদিকে নির্বাচনের সময় নিয়ে কারও অপত্তি না থাকলেও কয়েকটি দল বিতর্কিত কিছু দাবি তুলছে। এমনকি কোনো কোনো নেতা তাদের দাবি পূরণ না হলে নির্বাচন হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন। এতে করে নির্বাচন নিয়ে জনমনে নানা সন্দেহ ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হচ্ছে। জটিল হয়ে উঠছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিষয়টি নিয়ে দুই ধরনের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। একটি হচ্ছে-এটি তাদের ‘রাজনৈতিক কৌশল’ হতে পারে। কারণ, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আসন ভাগাভাগি নিয়ে পর্দার আড়ালে হয়তো কিছু দেনদরবার করতে চাইছে ওই সব দল। দ্বিতীয়ত, হতে পারে যারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বেশি সুবিধা করতে পারবে না, তারা নির্বাচন ছাড়া ভিন্ন পথে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। এর ফলে প্রকারান্তরে লাভবান হচ্ছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। তাদের ষড়যন্ত্রের পথকে এভাবে মসৃণ করে দেওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনার দুঃশাসনের সময় তিনটি নির্বাচন হয়েছিল। সেসব নির্বাচনে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কাজেই নির্বাচনহীন অবস্থা থেকে মুক্তির সমাধান হচ্ছে-একটি সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও নির্ভরযোগ্য নির্বাচন। তাই ৫ আগস্টের পর দেশে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, আবারও সেই ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য সব দলের উচিত হবে নির্বাচনমুখী হওয়া এবং ঐক্যবদ্ধভাবে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেওয়া।

দেশ যাতে গণতান্ত্রিক অবস্থায় ফিরে আসতে না পারে, সেজন্য বিভিন্ন জায়গায় ষড়যন্ত্র চলছে। ষড়যন্ত্র চলছে আগামী জাতীয় নির্বাচন যাতে না হয়, সেজন্যও। সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা যাতে বাস্তবায়ন না হয়, ভন্ডুল হয়ে যায়-সেজন্য ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা। সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থেকে এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনও ভোটের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের বড় দল বিএনপি তাদের মিত্র দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে। আসন নিয়ে দর কষাকষি চলছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচন বর্জন করা আরও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। এই প্রক্রিয়াকে সাধুবাদ জানাতে হয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকা যায়-সে বিষয়ে এখন সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার কৃত অপরাধের বিচার শেষে কয়েকটি অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে তার ফাঁসির রায় হয়েছে। সেই রায়কে কেন্দ্র করে পতিত আওয়ামী লীগ এখন দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত করছে। এ ব্যাপারে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন থাকতে হবে।

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ করতে হলে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। ঐক্যের মধ্যে কোনো বিভাজন সৃষ্টি হলে তা দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। চব্বিশের ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানের পর জাতীয় ঐক্যমতের সরকার গঠনের যে সম্ভাবনা রয়েছে, সেটিকে কাজে লাগিয়ে জনগণের অধিকার ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথকে সুদৃঢ় করতে হবে। দেশের জনগণ এখন পরিবর্তন চায়। নতুন ধারার রাজনীতির চর্চা দেখতে চায়। নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ চায়। আজকের নতুন প্রজন্ম গণতন্ত্র ও সুশাসনের বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমাদের সবাইকে সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, যেন কেউ বিভেদ সৃষ্টি করে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পথে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। গত ১৬ বছরেরও বেশি সময় পছন্দের মানুষকে ভোট দিতে না পারার কারণে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর যারা ভোটার হয়েছেন তারা আজ পর্যন্ত ভোট দিতে পারেননি। নিজের পছন্দের ভিত্তিতে সরকার পরিবর্তনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই তাদের। এমন অবস্থায় আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশা ও আগ্রহ তৈরি করেছে, সেটি সাধারণ জরিপে আসবে না। কারণ, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অনেক সময় জরিপের বিশ্বাসযোগ্যতা নিম্নমানের। এটা মূলত একটি সামাজিক প্রত্যাশা তৈরি করেছে এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ ও জবাবদিহিমূলক শাসন তৈরির প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে নিরাপত্তা জোরদার, কালো টাকার প্রভাব রোধকল্পে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য বদ্ধপরিকর। তবে এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং আন্তরিক সহযোগিতা অপরিহার্য। নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন ও পরে এই তিনটি পর্যায়েই রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা লাগবে। সবার লক্ষ্য একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। এজন্য কালো টাকার প্রভাব, পেশিশক্তির ব্যবহার, ধর্মের অপব্যবহার এবং প্রশাসনিক কারসাজি বন্ধ করা জরুরি। ভোটগ্রহণ যাতে আরও নিরপেক্ষ হয়, সেজন্য একই উপজেলার শিক্ষকদের নিজ উপজেলায় দায়িত্ব না দিয়ে অন্য উপজেলায় দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এতে নির্বাচন আরও সুষ্ঠু ও ন্যায্য হবে বলে আমরা মনে করি। এই নির্বাচন কমিশনের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না করে নতুন ইতিহাস তৈরি করতে হবে তাদের। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, নির্বাচন কমিশনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা। একে পুনরুদ্ধার করার জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। আমরা চাই,রাজনৈতিক অনৈক্য এবং বিভেদ দূর হোক। সাধারণ মানুষের চাওয়া হচ্ছে সর্বজনগ্রাহ্য, শান্তিপূর্ণ, সুসংগঠিত নির্বাচন। আমরা বিশ্বাস করি, আসন্ন নির্বাচন হবে ঐতিহাসিক এবং দৃষ্টান্তমূলক- যেখানে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের নয়, সাধারণ জনগণের স্বপ্ন পূরণ হবে। জাতীয় নিরাপত্তা কেবল সামরিক সক্ষমতার বিষয় নয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজনীতির বিকাশ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ। জনগণের ক্ষমতায়ন ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে পারলে জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এর মানে এই নয় যে সবার মধ্যে ঐক্য নেই। জাতীয় স্বার্থে সবাই আমরা ঐক্যবদ্ধ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে দ্রুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া জরুরি। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে পারলেই জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। ১৫-২০ বছর ধরে যে যুদ্ধ চলছে, তা বাংলাদেশের মানুষের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। এ মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার পথ একটাই—জনগণের হাতে ব্যালট পেপার তুলে দেওয়া, যাতে তারা স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন। ঐক্যের একমাত্র পথ হচ্ছে গণতন্ত্র। এটি নিশ্চিত হলে ঐক্য নিশ্চিত হবে। এ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি ‘ন্যাশনাল আর্মি’ গঠন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এর উদাহারণ চীনে আছে, সুইজারল্যান্ডে আছে, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তারা দায়িত্বে থাকেন এবং তারা সেনাবাহিনীর ট্রেনিং করে। সবার মধ্যে দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার করে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে। ইতোমধ্যেই আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠা হয়েছে। তবে তা কার্যকর হবে চতুর্দশ জাতীয় নির্বাচনের সময়। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন যেনতেন একটি নির্বাচন যেন হয়ে না ওঠে সেদিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু জাতীয় সংহতি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে সবাইকে।

রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।


গুলশান সাউথ ক্লাব " কেন  বাংলাদেশের একটি সেরা ক্লাব হবে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হলেও, ঢাকার রাজধানী গুলশান, সেটা সবাই স্বীকার করে।

কারণ গুলশানে এখন বড় বড় সব জায়ান্ট কর্পোরেট হাউজগুলোর হেড অফিস। যেমন, বহুজাতিক টেলিকম কোম্পানি রবি, এয়ারটেল, বাংলালিংক, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো সহ

সবগুলো ব্যাংকের স্থায়ী প্রধান কার্যালয় এখানে অবস্থিত। তাছাড়া রয়েছে অনেকগুলো বিলাস বহুল পাঁচ তারকা হোটেল ও ৫০ টির বেশি গেস্ট হাউস।

গুলশান - বারিধারা আবাসিক এলাকায় পৃথিবীর প্রায় ৬০ টির ও বেশি দেশের দূতাবাস রয়েছে।

গুলশানে বাংলাদেশের সবচেয়ে এলিট শ্রেণীর লোক বাস করে।

গুলশানে এখন ক্লাব ও বারের ব্যবসা খুবই জমজমাট। রাত হলেই জমে ওঠে ক্লাবগুলো।

যেখানে বিলাস বহুল গাড়িগুলো ক্লাবের আঙ্গিনা পেরিয়ে বাইরের রাস্তাগুলিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

এখন আসি "গুলশান সাউথ ক্লাব " কেন একটি সেরা ক্লাব হবে।

গুলশান সাউথ এরিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্পোরেট হাউস এবং ব্যাংক গুলোর স্থায়ী প্রধান কার্যালয় অবস্থিত।

বর্তমানে সিটি ব্যাংক, শাহজাহান ইসলামী ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক , এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক , যমুনা ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক,উরি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এন,এ, ইউসিবি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এইচ এস বি সি, ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক,পদ্মা ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক সহ প্রায় ২০টির ও বেশি ব্যাংকের স্থায়ী হেড অফিস গুলশান সাউথে অবস্থিত।

এছাড়া রবি ও বাংলালিংক এর প্রধান কার্যালয় গুলশান সাউথেই অবস্থিত। কর্পোরেট হাউজ গুলির মধ্যে ডিবিএল গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, রানার গ্রুপ, ইফাদ গ্রুপ, সুপারস্টার গ্রুপ, এনার্জিপ্যাক গ্রুপ,

ইস্ট কোস্ট গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এসিআই গ্রুপ, আকিজগ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ সহ কমপক্ষে পঞ্চাশটির বেশি কর্পোরেট হাউস গুলশান সাউথে অবস্থিত। তাছাড়াও ফ্যাশন হাউস গুলোর মধ্য রয়েছে, ভাসাবি

জারা, প্রেমস কালেকশন,

জুয়েলারি হাউজ গুলোর মধ্য ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, আপন জুয়েলার্স, নিউ জড়ুয়া গুলশান সাউথে অবস্থিত । গুলশান সাউথই রয়েছে সুইচ টেল ও হায়াত রিজেন্সি নামে বিলাস বহুল ২টি পাঁচ তারকা হোটেল। শপিং মল গুলির মধ্য রয়েছে, গুলশান সার্কেল - ১, এ নির্মিত হচ্ছে ৩৫ তলা ডি,এন,সি,সি শপিং মল, রয়েছে নাভানা সেন্টার শপিং মল ও পুলিশ প্লাজা কনকর্ড।

সাউথে রয়েছে, দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল ও ডাঃ ফজলে রাব্বি সাউথ পার্ক।

বাংলাদেশের সাংহাই ও নিউইয়র্ক হিসেবে খ্যাত গুলশান - তেজগাঁও লিং রোডে বর্তমানে ৪১ তলা

কমার্শিয়াল স্পেস নির্মাণ করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে ১০০ তলা পর্যন্ত সু উচ্চ ভবন নির্মাণ করা হবে।

গুলশান সাউথতেই রয়েছে, চোখ ধাঁধানো লাক্সারি সব গাড়ির শোরুম যেখানে সাজানো রয়েছে

BMW, RANS ROVER এবং AUDI মতো নিত্য নতুন সব মডেলের গাড়িগুলো, যা প্রমাণ করে দেয় যে, গুলশান সাউথ এরিয়া বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে

দামি এরিয়া হতে চলেছে।

সুতরাং "গুলশান সাউথ ক্লাব " নিঃসন্দেহে হতে চলছে বাংলাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ ক্লাব।

এবং আমরা বিশ্বাস করি ২০৩০ সালের দিকে "গুলশান সাউথ ক্লাবের মেম্বারগন একসময় গর্ব করে বলবেন, ভাগ্যিস সাউথ ক্লাবের মেম্বারশিপ নিয়েছিলাম,

না হলে তো এখন এক কোটি টাকা

লাগতো।

লেখক: মোহাম্মদ খুরশিদ আলম; ফাউন্ডার ও সাধারণ সম্পাদক; গুলশান সাউথ ক্লাব লিমিটেড


banner close