সোমবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫
২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

বেহাল দশা নওগাঁ জেলা পরিষদ পার্কের

দৈনিক বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত
দৈনিক বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত : ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ ২২:৩২

দেশের অনেক জেলা পরিষদ পার্কের আজ বেহাল দশা। একসময়ের কোলাহলপূর্ণ, শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত এসব পার্ক এখন যেন এক পরিত্যক্ত প্রান্তর, যা কেবল স্থানীয় বাসিন্দা, বিশেষত শিশু ও তরুণ প্রজন্মের কাছে এক গভীর হতাশার নাম।পার্কের ভেতরে তাকালে চোখে পড়ে ভাঙাচোরা দোলনা, স্লিপার, স্যাঁতসেঁতে ও অপরিষ্কার পথঘাট, আগাছা জন্মানো খেলার জায়গা এবং আবর্জনার স্তূপ। পর্যাপ্ত আলো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে সন্ধ্যার পর এই পার্ক মাদকাসক্ত ও অসামাজিক কার্যকলাপের আখড়ায় পরিণত হয়েছে, যা শিশুদের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এমন একটি পার্কের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে গত ৭ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলা প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘অযত্ন-অবহেলায় বেহাল দশা নওগাঁ জেলা পরিষদ পার্কের’। এ থেকে জানা যায়, নওগাঁ জেলা পরিষদ পার্কটি প্রায় দুই বছর ধরে অযত্ন-অবহেলায় বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। শিশুদের বিনোদনের রাইডগুলো ভাঙাচোরা, নেই পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। সন্ধ্যা নামলেই অন্ধকারে সাপ-পোকামাকড়ের আতঙ্কে থাকেন দর্শনার্থীরা।

শহরের প্রাণকেন্দ্র মুক্তির মোড়ে শতবর্ষ আগে ২ দশমিক ৪৬ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ পার্কটি দীর্ঘদিন ধরে জেলার একমাত্র জনবিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় প্রবীণ ও মধ্যবয়সিরা হাঁটাহাঁটি করতে আসেন এখানে। বিকেলে উন্মুক্ত থাকে সবার জন্য। ছুটির দিনে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সি মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে পার্কটি।

বর্তমানে পার্কের শিশুদের রাইডগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। তিনটি ঢেঁকির সবগুলোই ভাঙা, অধিকাংশ দোলনা অচল, দুটি স্লিপার থাকলেও তাতে মরিচা ধরেছে এবং যেকোনো সময় ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দোলনার নিচে গর্ত হয়ে বৃষ্টির পানি জমে থাকে, ফলে শিশুরা পড়ে কাদা-ময়লায় নোংরা হয়ে যায়। এসব কারণে শিশুদের বিনোদন ব্যাহত হচ্ছে। তা ছাড়া মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হতে হচ্ছে দর্শনার্থীদের। গত দুই বছর ধরে পার্কের বাতিগুলো নষ্ট থাকায় সন্ধ্যার পর পুরো এলাকা অন্ধকারে ঢেকে যায়। এতে হাঁটতে গিয়ে প্রবীণদের প্রায়ই বিপদে পড়তে হয়। অনেকেই সাপ-পোকামাকড়ের ভয়ে সন্ধ্যার পর পার্কে প্রবেশ করেন না। স্থানীয়দের অভিযোগ পার্কটি যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। এছাড়া পার্কের প্রধান ফটকের সামনে মোটরসাইকেল রাখা এবং ফুটপাতে ফাস্টফুডের দোকান বসানোর কারণে পথচারীদের চলাচলে চরম ভোগান্তি তৈরি হয়েছে। উকিলপাড়ার এক গৃহবধূ বলেন, ‘ছুটির দিনে বাচ্চারা পার্কে আসার জন্য জেদ করে। কিন্তু দোলনায় বৃষ্টির পানি জমে থাকে, মইগুলো ভাঙা, স্লিপারেও জং। বছরের পর বছর এমন অবস্থায় রয়েছে। কেউ যেন দেখার নেই। অথচ পার্কটি জেলার একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র হলেও কোনো উন্নয়ন নেই। রাইডগুলো নষ্ট, পুকুরের পাড় ভাঙছে, পানি অপরিষ্কার, ফুলের গাছ নেই। যে পরিবেশে মানুষ বিনোদন পাবে তার কিছুই নেই।

নওগাঁ জেলা পরিষদ পার্কটি বছরের পর বছর ধরে সামান্য রক্ষণাবেক্ষণও করা হয়নি,এটা খুর দুঃখজনক। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনোদন কেন্দ্র যখন এমন দুর্দশায় পড়ে, তখন তা কেবল একটি পার্কের সমস্যা থাকে না, বরং এটি পুরো জনজীবনে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশুরা বাধ্য হয়ে মোবাইল গেমসের প্রতি আসক্ত হচ্ছে, আর বড়রাও পাচ্ছে না একটু নির্মল বিনোদনের সুযোগ। তাই জেলা পরিষদ পার্ককে তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে দিতে হবে। এটি শুধু ইট-পাথরের কাঠামো নয়, এটি আমাদের সুস্থ বিনোদনের জায়গা, আমাদের শিশুদের হাসি-খুশির ঠিকানা। তাই,কর্তৃপক্ষ দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করে পার্কটিকে আবার প্রাণবন্ত করে তোলবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।


স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এক একটি গোলাপের কুঁড়ি 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
দৈনিক বাংলা ডেস্ক

আজকের ছাত্র-ছাত্রীরা হলো গোলাপ, রজনীগন্ধা, রক্তকরবী, কামিনী, কদম, হাসনাহেনা, ডালিয়ার কুঁড়ি। সামান্য ভালোবাসার জল সিঞ্চনে যা হয়ে উঠবে প্রস্ফুটিত ফুল। আজকের অঙ্কুর অচিরেই হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের বনস্পতি। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে লালিত-পালিত হয়ে ওরাই হতে পারে ভবিষ্যতের ‘নেতাজী সুভাসচন্দ্র’, ‘মহাত্মা গান্ধী’, ‘ইন্দিরা’, ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’, ‘সুরেন্দ্রনাথ’, ‘মতিলাল নেহরু’, ‘শেরেবাংলা’, ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘জীবনানন্দ’, ‘নজরুল’। যাদের পদস্পর্শে ধন্য হবে জগৎ, কৃতার্থ হবে বঙ্গ জননী, কৃতার্থ হবে ধরনী।

একখণ্ড ধূসর স্মৃতি মোজাম্মেল স্যর- ১৯৬৪ সাল। তখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি পিরোজপুরের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সম্ভবত সেই বছর থেকে মোজাম্মেল স্যরকে চিনি। তিনি কোন বিষয়ের ওপর ক্লাস নিতেন, তা দীর্ঘ ৬১ বছর পরে আজ আর মনে পড়ছে না। মোজাম্মেল স্যরকে নিয়ে একটি মধুর ঘটনা খুব করে মনে পড়ে। স্কুলে সেদিন আমি পড়া পারিনি। কে যেন এক সহপাঠী, সম্ভবত প্রদীপ মোজাম্মেল স্যরকে বলল, ‘লিয়াকত তো স্কুলে এসে চিত্রনায়ক-নায়িকাদের নিয়ে আলোচনা করে, লেখাপড়া তলানিতে নেমে গেছে ওর।’ প্রদীপের (ক্ষেত্র মোহন মাজি উকিলের ছেলে) এ কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হল, সেও পড়া পারবে না। বেতের পিটুনি থেকে বাঁচার জন্য সে এ ফন্দি করেছিল। ও আরও বললো, ‘স্যর ওর বইয়ের মধ্যে গানের একটি খাতা আছে।’ তৎক্ষণাৎ মোজাম্মেল স্যর আমার বইখাতা তল্লাশি করে তার মধ্যে একটি গানের খাতা পেলেন। গানের খাতাটি হাতে তুলে নিয়ে প্রথম গানটি এক ঝলক দেখে তা উল্লেখ না করে দ্বিতীয় গানটি পড়তে শুরু করলেন, ‘মনে যে লাগে এতো রং ও রঙিলা’- স্যর আমাকে বললেন, ‘ও তুমি ‘রঙিলা’ সেজেছ।’ তিনি গানের খাতাটি নিয়ে গেলেন। সেই খাতাটি তিনি কয়েকদিন পরে আমার আব্বার হাতে দিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার আব্বা আমাকে কিছুই বললেন না। কেননা, আমার সিনেমা দেখা শুরু হয়েছিল আমার আব্বার হাত ধরে। আমি অল্প বয়সে প্রথম সিনেমা দেখি, ‘শেষ উত্তর’। ওই ছবির শুরুতে নায়িকা কানন দেবী গেয়েছিলেন, ‘তুফান মেল যায় তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে’। গানের খাতায় প্রথম গানটি ছিল এটিই। মোজাম্মেল স্যর এ গানটি দেখে ওভারলুক করার কারণ ছিল, সম্ভবত তারও প্রিয় নায়িকা ছিলেন কানন দেবী। অবশ্য সে কথা পরবর্তীতে অন্য একজন স্যরের মুখে শুনেছিলাম। দ্বিতীয় গানটি অর্থাৎ ‘ও রঙিলা মনে যে লাগে এত রং’ গানটি ছিল ‘জোয়ার এলো’ ছবিতে, গেয়েছিলেন ফেরদৌসী রহমান। সেই ১৯৬৪ সালে সবার মুখে মুখে তখন ছিল, ‘ও রঙিলা’। আর এই কারণে মোজাম্মেল স্যর আমাকে বারবার বলেছিলেন, ‘রঙিলা সেজেছ, রঙিলা সেজেছ।’ মোজাম্মেল স্যর একসময় আদর্শ পাড়াতে জায়গা কিনে বাড়ি করলেন। তখন তো তিনি আমাদের প্রতিবেশী হলেন। আমার বড় বোন বকুল আপা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী, সেই ১৯৬৪-৬৫ সালে। মোজাম্মেল স্যর সে কথা আমার কাছেই শুনে একবার আমাদের বাসায় এলেন আমার বড় বোনের সঙ্গে আলাপ করার জন্য। কেননা, মোজাম্মেল স্যর ছিলেন বাংলা সাবজেক্টের ওপর ভীষণ দুর্বল। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, নজরুল, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখের কাব্যগ্রন্থ নিয়ে তিনি আলোচনা করতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি স্কুলে আমাদেরকে শাসন করার পাশাপাশি বাবার মতো স্নেহ দিতেও কার্পণ্য করতেন না। আমাদের যুগে যে কোনও স্যরকে দেখে ভয় পেতাম, দেখামাত্র অন্য পথ দিয়ে চলে যেতাম। মোজাম্মেল স্যরের কথা কোনদিন ভোলা সম্ভব নয়। অমন শিক্ষক কালেভদ্রে জন্মায়।

১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কোনোরকম কেউ অশোভন আচরণ তো দূরের কথা, পা ছুঁয়ে পর্যন্ত সালাম দিতাম। সেই মমিন স্যার, মহসিন স্যার, অদুদ স্যার, জাহানারা ম্যাডাম সহ অন্যান্য স্যারদেরকে সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন, সন্মান জানাতেন। তাদেরকে দেখামাত্র আমরা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিতাম। কি করে ভুলি সেই শিক্ষকদেরকে! তারা এক একজন ছিলেন আমাদের কাছে বাবার মতো, আর আমরা ছিলাম তাদের কাছে সন্তানতুল্য। সেই দিন আর ফিরে আসবে না। যায় দিন ভালো যায়।

লেখক: চিঠিপত্র বিশারদ।


চট্টগ্রাম বন্দর: নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
দৈনিক বাংলা ডেস্ক

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, যা দেশের বেশিরভাগ আমদানি-রপ্তানি (৭০% এর বেশি) পরিচালনা করে এবং ভারত, নেপাল ও ভুটান ট্রানজিট ব্যবহার করে থাকে; বর্তমানে বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার জন্য বিদেশি কোম্পানি নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে, যা নিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছিল এবং সম্প্রতি একটি বিভক্ত রায় এসেছে, যেখানে একটি টার্মিনাল (লালদিয়া) ডেনমার্কের এপি মোলারকে ৩০ বছরের জন্য দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর আমাদের প্রধান বন্দর। বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত, যা দেশের সিংহভাগ বাণিজ্য পরিচালনা করে। আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করতে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর রিজিওনাল ইকনোমিক হাব হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারত, নেপাল এবং ভুটানের জন্য ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা প্রদান করে। এই গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনালটি বিদেশি কোম্পানিকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে সম্প্রতি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন হয়েছিল।এই রিটের বিষয়ে হাইকোর্ট একটি বিভক্ত রায় দিয়েছে, যেখানে একজন বিচারপতি চুক্তি প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলেছেন এবং অন্যজন দ্বিমত পোষণ করেছেন। ডেনমার্কের এপি মোলার কোম্পানিকে ৩০ বছরের জন্য লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে এর ব্যবহার শুরু, যা নবম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে 'শেটগাং' নামে পরিচিত ছিল এবং ষোড়শ শতাব্দীতে 'পোর্টে গ্র্যান্ড' নামে পরিচিতি পায়। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন নেই; বরং প্রয়োজন আলোচনাকে বাস্তব সমাধানের দিকে নেওয়া।


আজকের বাস্তবতায় বাংলাদেশ যদি ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে যেতে চায়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ ও চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়নের বিলম্ব করার সুযোগ নেই; যদিও কিছু ব্যাপারে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে।এখন এ কথা শুনতে যতটা সহজ, বাস্তবে ততটা নয়। কারণ, বন্দর শুধু একটা অবকাঠামো নয়, বরং এটা দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য, লজিস্টিকস, মুদ্রানীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও প্রশাসনিক সংস্কারের কেন্দ্রবিন্দু। চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের অর্থনীতির প্রধান প্রবেশদ্বার। দেশের ৯২ শতাংশ সমুদ্র–বাণিজ্য ও ৯৮ শতাংশ কনটেইনার কার্গো এখান দিয়ে ওঠানো নামানো হয়। ২০২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন টিইইউ হ্যান্ডল করা হয়েছে। কিন্তু এই বৃদ্ধির মধ্যেও বন্দরের কার্যকারিতা এক জায়গায় আটকে আছে। সিঙ্গাপুর বন্দর বছরে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন টিইইউ হ্যান্ডল করে, কলম্বো ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন টিইইউ। তার তুলনায় চট্টগ্রামের ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন টিইইউ এখনো আঞ্চলিক মানের অনেক নিচে। বিশ্বব্যাংকের কনটেইনার পোর্ট পারফরম্যান্স অনুযায়ী চট্টগ্রামের অবস্থান ৩৩৭তম/৪০৫। টার্মিনালের ক্রেন উৎপাদনশীলতা মাত্র ১৮-২১ মুভ/ঘণ্টায়, যেখানে আন্তর্জাতিক মান ৩৫-৪৫।বিশ্বব্যাংক তার অক্টোবরের প্রতিবেদনেও এ কথা তুলে ধরেছে। এনসিটিতে কিছু নতুন ইকুয়েপমেন্ট ব্যবহার করলেও অনেক ইকুয়েপমেন্ট আছে ২০-৩০ বছরের পুরাতন।
প্রায়ই ব্রেকডাউন হয়, স্পেয়ার পার্টসের অভাবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ অচল থাকে। একটি আধুনিক টার্মিনালে যেখানে ৯৫ শতাংশের বেশি আপটাইম থাকে, সেখানে এনসিটির আপটাইম ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। এর মানে হলো, বিদ্যমান অবকাঠামোই আমাদের অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। ২০২৫ সালের আগস্টে এনসিটি একাই রেকর্ড ১ লাখ ২২ হাজার ৫১৭ টিইইউ হ্যান্ডল করেছে আগের একই সময়ে বছরের তুলনায়। জুলাই-সেপ্টেম্বরে এনসিটির ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গেছে। কিন্তু সিডিডিএলের মধ্যস্থতা সত্ত্বেও অপেক্ষার সময় এখনো ৭ দিনের ওপর। যদিও নভেম্বরে জাহাজের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এনসিটির ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গেছে। যদিও নভেম্বরে জাহাজের চাপ কম থাকাতে এবং ম্যানেজমেন্ট ভালো করলে এই ওয়েটং টাইম প্রায় শূন্যতে নিয়ে আসা গেছে। কিন্তু চাপ বাড়লে তখন কতটা ধরে রাখা যাবে, তা সামনে বলা যাবে।ফলাফল একটাই—কোনো জাহাজকে যদি বহির্নোঙরে ৭ থেকে ১০ দিন অপেক্ষা করতে হয়, প্রতিদিন অতিরিক্ত খরচ ১২ থেকে ২০ হাজার ডলার। প্রতি বছর এ বিলম্বে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ১ দশমিক ৫ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ বহন করেন।

এ খরচ শেষ পর্যন্ত পণ্যের দামে, রপ্তানির সময়সীমায় এবং দেশের লজিস্টিক খরচে উঠে আসে। সোজা কথায়, বন্দর জ্যাম মানেই জাতীয় অর্থনীতির জ্যাম। যারা বন্দর পরিচালনা, মেশিনারি রক্ষণাবেক্ষণ, অটোমেশন কিংবা ডিজিটাল টিওএস বোঝেন, তারা জানেন, একটা টার্মিনালের দক্ষতা বাড়ানো মানে শুধু নতুন ক্রেন বসানো নয়। এটা হলো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনা, প্রশিক্ষিত জনবল, ডিজিটালাইজেশন, গ্লোবাল শিপিং নেটওয়ার্কে প্রবেশ এবং দৃঢ় ম্যানেজমেন্ট শৃঙ্খলা। সে জন্যই সরকার এনসিটি ও এলসিটিতে জিটুজি ও পিপিপি মডেলে বিদেশি অপারেটর আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
ডিপি ওয়ার্ল্ডের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলছে, তারা সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে, জাহাজের অপেক্ষার সময় ৪০ শতাংশ কমাতে পারে, ডুয়েল টাইম কমিয়ে আনে এবং পুরো টার্মিনালকে তথ্যভিত্তিক করে তোলে। কর্ণফুলীর ডান তীরে পতেঙ্গায় লালদিয়ার চরের চিত্র। এখানে কনটেইনার টার্মিনাল তৈরির জন্য ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে চুক্তি করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সীমানা প্রাচীরে ঢাকা এই চর ঘাসে ভরা। বর্তমানে ভিয়েতনাম, ভারত, এমনকি শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলোও দ্রুতগতিতে আধুনিক হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর যদি এখনই র‍্যাডিকেল সংস্কার না করে, তাহলে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সরবরাহশৃঙ্খলে আমরা মার্জিনালাইজড হয়ে পড়ব। শিপিং লাইনগুলো সরাসরি কলম্বো বা ক্ল্যাংয়ে যাবে, সেখান থেকে ফিডার করে ছোট জাহাজে পণ্য বাংলাদেশে আসবে, যা রপ্তানিকারকদের জন্য সময় ও খরচ—দুটিই বাড়িয়ে দেবে।বন্দরের দক্ষতা বাড়লে শুধু জাহাজ দ্রুত লোড-আনলোড হবে না; এর তরঙ্গের প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়ে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রতি বছর ৫ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার বাড়তে পারে। তৈরি পোশাক, কৃষি, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং—সব খাতেই অপেক্ষার সময় কমে যাবে। লজিস্টিক খরচ জিডিপির শূন্য দশমিক ৮ থেকে ১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। আজ বাংলাদেশে রপ্তানিকারকদের লজিস্টিক খরচ ভিয়েতনাম ও ভারতের চেয়ে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি। এই অদক্ষতা যত দিন থাকবে, এফডিআই আসবে না।


চট্টগ্রাম বন্দরের দীর্ঘদিনের একটি সমস্যার নাম অপারেশনাল ধীরগতি। জাহাজের টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনগুলো প্রায়ই বাড়তি খরচ বহন করে, আর এর চাপ পড়ে আমদানিকারক–রপ্তানিকারকদের ওপর। কিন্তু আধুনিক অপারেটরের দক্ষ ব্যবস্থাপনা, অটোমেশন এবং প্রযুক্তিনির্ভর মনিটরিং যুক্ত হলে বন্দরের প্রতিদিনকার কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়বে। দ্রুত লোড–আনলোড, উন্নত লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা ও পণ্য চলাচলের স্বচ্ছতা পুরো অর্থনীতির গতি বদলে দিতে পারে। এতে ব্যবসায়ী ব্যয় কমবে, আমদানি–রপ্তানি প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হবে, এবং বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা বাড়বে। একটি দেশের বন্দরের সক্ষমতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে অন্যতম প্রধান সূচক। এনসিটি ও সিসিটির আধুনিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপারেশনাল পদ্ধতি চালু হলে বাংলাদেশ নতুনভাবে বিনিয়োগের মানচিত্রে জায়গা করে নিতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে এমন স্থানে অবস্থিত যে, চট্টগ্রাম বন্দর সহজেই আঞ্চলিক লজিস্টিক হাবে পরিণত হতে পারে। ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার এই অঞ্চলের বড় বাজার, আর তাদের ট্রানশিপমেন্ট চাহিদা যদি বাংলাদেশ আকর্ষণ করতে পারে, তবে এর আর্থিক লাভ সরাসরি দেশের রাজস্ব, বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং কর্মসংস্থানে প্রতিফলিত হবে। এছাড়া উন্নত বন্দর সুবিধা থাকলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শিল্পকারখানা স্থাপনে আগ্রহী হয়, ফলে ইকোনমিক জোন, গুদাম, লজিস্টিক পার্ক এবং শিল্পাঞ্চল—সব ক্ষেত্রেই নতুন বিনিয়োগ বাড়বে। চুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্ক শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। অনেকের ধারণা এমন চুক্তি হলে শ্রমিক বেকার হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র দেখায়। আধুনিক টার্মিনাল পরিচালনায় নতুন ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন হয়, যা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। শ্রমিকরা তখন আগের তুলনায় উচ্চ দক্ষতা ও বেশি বেতনভিত্তিক কাজে যুক্ত হতে পারেন। পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং, আইটি, লজিস্টিক, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, নেভিগেশনসহ বিভিন্ন পেশায় নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। টার্মিনাল যত সম্প্রসারিত হবে, বন্দরের বাইরের খাত যেমন পরিবহন, গুদাম, সরবরাহ শৃঙ্খল, কাস্টমস ক্লিয়ারিং—সবখানেই বাড়তি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বৃদ্ধির দিকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত আন্তর্জাতিক অপারেটরদের সঙ্গে চুক্তিতে কনসেশন ফি, মুনাফার ভাগ, বন্দর ব্যবহারের ফি এবং কার্গো হ্যান্ডলিং বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে।

যখন একটি বন্দর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক হয়, তখন তার ব্যবহারও বহুগুণ বাড়ে। এতে শুধু রাজস্ব নয়, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও বাড়ে। এ অর্থ দেশের মেগাপ্রকল্প, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সামাজিক বিনিয়োগেও সহায়তা করতে পারে।অন্যদিকে প্রযুক্তি ও দক্ষতা স্থানান্তর দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য বড় সম্পদ হবে। বিদেশি অপারেটররা সাধারণত বিশ্বমানের যন্ত্রপাতি, ট্র্যাকিং সিস্টেম, সফটওয়্যার এবং নিরাপত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তাদের সঙ্গে কাজ করলে স্থানীয় জনশক্তি এসব প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারে। এটি শুধু বর্তমান বন্দরের জন্য নয়, ভবিষ্যতে দেশীয় বন্দর বা টার্মিনাল পরিচালনার সক্ষমতা তৈরিতেও সহায়ক হবে। আধুনিক টার্মিনাল মানেই দ্রুত পণ্য পরিবহন, নির্ভরযোগ্য সাপ্লাই চেইন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আস্থা বৃদ্ধি। আগামী দিনের অর্থনীতি হলো ‘স্পিড ইকোনমি’। যে দেশ যত দ্রুত পণ্য সরবরাহ করতে পারে, সে দেশ তত বেশি রপ্তানি অর্ডার পায়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, ওষুধ, জাহাজ, ইলেকট্রনিক্স—সব রপ্তানি খাতই গতি-নির্ভর। চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন তাই সরাসরি এসব খাতের সক্ষমতা বাড়াবে। সবশেষে বলা যায়, এনসিটি ও সিসিটি পরিচালনার অংশীদারিত্ব চুক্তি বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে পারে। এটি কেবল বন্দর ব্যবস্থাপনার বিষয় নয়; দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক মর্যাদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যদি যথাযথ পরিকল্পনা, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা, রাষ্ট্রীয় তদারকি এবং চুক্তির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়, তবে এই উদ্যোগ দেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরে এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী উন্নীত করতে এর কোনো বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী উন্নীত করা এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি এবং এনসিটি–সিসিটি চুক্তি সেই লক্ষ্য পূরণের বাস্তব সম্ভাবনা প্রদান করতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে চট্টগ্রাম বন্দর কতিপয় শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের খেয়ালখুশির শিকার হয়ে বিপর্যয়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিল। তাদের অযৌক্তিক দাবি দাওয়া, চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য, দখলদারিত্বের কারণে জিম্মি হয়ে থাকতে হয়েছে আমদানিকারক রপ্তানিকারকদের। এখন সেই তুঘলকি রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে নতুন গতিতে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হবে আমাদের প্রধান সমুদ্র বন্দর। বিশ্ব রেংকিংএ বন্দরের মান উন্নত হবে এতে বহি বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাবে এবং অনেক বিদেশি জাহাজ বাংলাদেশে আসার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এর মাধ্যমে উপমহাদেশের সবচেয়ে আধুনিক এবং প্রযুক্তি নির্ভর বন্দর হয়ে উঠতে পারে চট্টগ্রাম।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট।


ভূমিকম্প: অর্থনৈতিক চাপ ও মানসিকতায় নতুন সংকট

আপডেটেড ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ ২২:১৭
দৈনিক বাংলা ডেস্ক

দেশে ২১ নভেম্বর ২০২৫ সালের ভূমিকম্প শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা ছিল না; এটি সমগ্র সমাজকে নাড়া দেওয়া এক আবেগতাত্ত্বিক অভিঘাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সমাজতত্ত্বের আধুনিক ধারণা-বিশেষত ‘ইমোশন ইকোনমি’-অনুসারে, ভয়, চাপ, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা এখন আর কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়; বরং এগুলো সামাজিক কাঠামোর উৎপন্ন শক্তি, যা সরাসরি অর্থনীতি, রাজনীতি, নগরজীবন এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ধরনকে প্রভাবিত করে।

বিশ্লেষনে দেখা যায় যে বাংলাদেশে ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়টায় এক আবেগতাত্ত্বিক শক্তির প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যখন দেশটিতে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জলবায়ু-ঝুঁকির মতো বহুমাত্রিক চাপের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। একটি সমাজে যেখানে অনিশ্চয়তা জীবনের নিত্যসঙ্গী, সেখানে জনগণের মানসিক অবস্থা সমস্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট আতঙ্ক এবং বিদ্যমান অর্থনৈতিক চাপ মিলে একটি নতুন ‘মানসিকতার অর্থনীতি’ তৈরি করেছে, যা আমাদের সামাজিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিকে দুর্বল করছে।

ইমোশন ইকোনমি তত্ত্ব অনুসারে, যে সমাজে কাঠামোগত অনিশ্চয়তা বেশি, সেই সমাজে জনগণের আবেগও হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের চালিকাশক্তি। আজকের বাংলাদেশে ভূমিকম্প-উদ্ভূত আতঙ্ক শুধু মুহূর্তিক প্রতিক্রিয়া নয়; এটি বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপের সঙ্গে মিশে এক বৃহত্তর আবেগতাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করছে। এই আবেগতাত্ত্বিক কাঠামো তিনভাবে কাজ করে, ১. এটি মানুষের ঝুঁকি-উপলব্ধিকে প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিয়ে সমাজে স্থায়ী উদ্বেগের পরিবেশ তৈরি করে; ২. এটি অনলাইন স্পেসকে তথ্য-ভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার উর্বর জায়গায় রূপান্তরিত করে; ৩. এই আবেগগুলো অর্থনীতি ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। মানুষ ভোগ কমায়, জরুরি জিনিস মজুত করতে শুরু করে, অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়, পরিবারগুলো তরল সঞ্চয়কে অগ্রাধিকার দেয়।

ভূমিকম্পের ভয় সমাজের প্রতিটি সংবেদনশীল গোষ্ঠীকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় আঘাত করে, এবং এর প্রভাব অর্থনীতিতে অনুভূত হয়। স্কুলগামী শিশুরা এই আকস্মিক কাঁপুনিকে ‘জীবনহানির আশঙ্কা’ হিসেবে উপলব্ধি করে, যা দীর্ঘমেয়াদি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস-এ রূপ নিতে পারে। অভিভাবকেরা তখন স্কুল ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সন্তানদের স্কুলে পাঠানো কমিয়ে দিতে পারেন, যা শিক্ষা-অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলে।

অন্যদিকে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জন্য ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা ভিন্ন এক সামাজিক ভয়। তাদের নড়াচড়ার স্বাধীনতা নেই, আর চিকিৎসা সরঞ্জাম, অক্সিজেন লাইন বা লাইফ-সাপোর্ট ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা বাস্তব আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এটি স্বাস্থ্যসেবার প্রতি কাঠামোগত আস্থাহীনতাকে আরও প্রকট করে তোলে এবং জরুরি স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত বিনিয়োগের চাপ তৈরি করে। শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মনে রানা প্লাজার স্মৃতি এখনও তাজা; তাই সামান্য দোলনাও সেখানে গণউৎকণ্ঠার ঢেউ তোলে, যা দ্রুত গুজব ও হুড়োহুড়িতে পরিণত হয়ে উৎপাদন ব্যাহত করে। এই আতঙ্ক কেবল শ্রমিকের নয়, বরং সমগ্র শিল্প খাতের জন্য এক নতুন অনিশ্চয়তার পুঁজি তৈরি করে, যা বিদেশি ক্রেতাদের আস্থাকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও গবেষণা বলছে, বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে দেশে ৩৪৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে। সারাদেশে ঝুঁকির মুখে থাকা ভবন প্রতিস্থাপনে ব্যয় হতে পারে ৩৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক শতকে দেশে অন্তত ২০০টিরও বেশি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ধরনের ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। বছরে গড়ে ২৫ থেকে ৩০টি ক্ষুদ্র ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে, যার বড় অংশ সিলেট, চট্টগ্রাম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। আন্তর্জাতিক সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি-জাইকার এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় ম্যাগনিচিউড ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে ৭০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, দুই লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে এবং সামগ্রিক ক্ষতি হতে পারে ৩০ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার। ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে ওঠা নগরগুলোর একটি হওয়ায় ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণ বাড়তে পারে। একটি বড় ধরনের ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে বহুমাত্রিকÑ অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন টাকা (৩০ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার) ছাড়াতে পারে।

ব্রিজ, কালভার্ট, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল ভায়াডাক্ট, পুরান শহরের নড়বড়ে ভবন, অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস লাইনে আগুন লাগার আশঙ্কা-সব মিলিয়ে নগরবাসীর মনে একটি মৌলিক প্রশ্ন জাগে: ‘এই শহর কি আদৌ নিরাপদ? এই অবকাঠামোতে আমার জীবন কতটা সুরক্ষিত?’ এই প্রশ্নটি কেবল দুর্যোগসংক্রান্ত নয়; বরং এটি নগর-অবকাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি অবহেলা, দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীনতা ও লাগামহীন জনঘনত্বের চাপের ফসল। যখন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও নাগরিকেরা একটি নিরাপদ শহর পান না, তখন এই ভৌত দুর্বলতা তাদের মানসিক নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত করে। এই হতাশা এবং অবিশ্বাসই আবেগের অর্থনীতিকে চালিত করার মূল শক্তি, যা সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল সংস্কারের দিকে ঠেলে দেয়।

সর্বশেষে বলা যায় ভূমিকম্প প্রতিরোধ নয়, ক্ষয়ক্ষতি কমানোই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। এখানে শুধু সরকার নয়, সবারই দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণ বাধ্যতামূলক করা এবং রাজউক, সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সুষম মনিটরিং নিশ্চিত করা জরুরি। পুরনো স্কুল, হাসপাতাল ও আবাসিক ভবনগুলো পুনর্মূল্যায়ন করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা ও রেট্রোফিটিং করা।

দেশে আরও সিসমিক স্টেশন, ভূ-প্রযুক্তি গবেষণাগার ও আঞ্চলিক মনিটরিং সিস্টেম প্রয়োজন। ভূমিকম্প-উদ্ভূত আতঙ্ক বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সামাজিক বার্তা বহন করে। উন্নয়ন শুধু সেতু-ফ্লাইওভার তৈরির বিষয় নয়, বরং একটি নিরাপদ, পরিকল্পিত, মানবিক নগর ও সমাজ গড়ে তোলার ব্যাপার। মানুষের মানসিক নিরাপত্তা রক্ষাই আগামী দিনে রাষ্ট্রের অন্যতম বড় নীতি-চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু ফিজিক্যাল অবকাঠামো মজবুত করলেই চলবে না; প্রয়োজন একটি সমন্বিত উদ্যোগ: তথ্য-ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, দুর্যোগ-পরবর্তী ট্রমা মোকাবিলা এবং মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনিয়োগ করা।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা


কোচিং সেন্টারগুলো কি সময়ের সৃষ্টি নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত?

মাছুম বিল্লাহ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

আমাদের দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানীর বড় বড় স্পট ছাড়াও অলিতে গলিত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য কোচিং সেন্টার। একাডেমিক কোচিং, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং, মেডিকেল কোচিং, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিং, ক্যাডেট কলেজ ভর্তি কোচিং, বিসিএস কোচিং, আমিং-নেভি-বিমান বাহিনীতে চাকরি পাওয়ার কোচিংসহ বহু ধরনের কোচিং সেন্টার। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য রাজধানীতেই মোট ৩৩টি কোচিং সেন্টার আছে বলে একটি জাতীয় দৈনিক খবর প্রকাশ করেছে। প্রশ্ন হচেছ এতসব কোচিং কেন?

আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেছে বহু আগে। ফলে দেশে সৃষ্টি হয়েছে কোচিং বিপ্লব!! বোর্ড থেকে সার্টিফিকেট পাওয়ার মাধ্যম যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না হতো তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যে কি অবস্থা হতো সেটি চিন্তা করতে কষ্ট হয়। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উদীয়মান শিক্ষার্থীরা সামাজিকতা শেখে, সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ ও শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য উপস্থিত বক্তৃতা, নির্ধারিত বক্তৃতা, কবিতা আবৃত্তি, নাটক মঞ্চস্থ করা, বিভিন্ন ধরনের ইনডোর ও আউটডোর গেমস ইত্যাদি নিয়মিতভাবে প্রাকটিস করা কথা। একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠানে একাডেমিক বিষয়ের পাশাপাশি এসব বিষয় সমানভাবে গুরুত্ব পায় কারণ ভবিষ্যৎ জীবনে এগিয়ে যেতে হলে একাডেমিক বিষয়ের সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের জীবনে এগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক’জন চিনে, আর তাদের মধ্যে ক’জন ই বা জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকরী ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন বা রাখতে পেরেছেন? অথচ একজন শিল্পী, একজন খেলোয়াড়, একজন গায়ক, একজন ভালো লেখক দেশ, সমাজ ও বৈশ্বিক মন্ডলে অবদান কার্যকরী ভূমিকা রাখেন, দেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করান। এগুলো দৃশ্যমান বাস্তবতা। কিন্তু আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এসব বিষয়ে খুবই কম গুরুত্ব দেয়! কারণ কি শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? অবশ্যই না। সব ধরনের অভিভাবক চান তার ছেলে বা তার মেয়ে ক’টি বিষয়ে এ প্লাস পেয়েছে, পুরো ফল কি গোল্ডেন জিপিএ না খালি জিপিএ। কোন অভিভাবক চিন্তা করেন না, গুরুত্ব দেননা যে, আমার ছেলেটি বা মেয়েটি বাংলায় ভালভাবে কথা বলতে শিখেছে কিনা, নিজে দুচার কথা বানিয়ে লিখতে পারে কিনা, বিজ্ঞান ও গণিতে বিষয়ে মূল ধারণা নিতে পেরেছে কিনা, ইংরেজিতে কিছু বলতে পারে কিনা। কোন শিক্ষক কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান যদি এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চায়, অভিভাবকগন তখন তাতে উষ্মা প্রকাশ করেন। তারা বলেন, ‘পড়ালেখা বাদ দিয়ে আপনার এসব নিয়ে বেশি ভাবছেন।’ অর্থাৎ তারা সবাই চান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়া দেওয়া হবে, মুখস্থ করানো হবে এবং সেগুলো লিখে শিক্ষার্থীরা ভালো জিপিএ পাবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সেটি কেউই বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করতে চাননা। তারা চান সব শিক্ষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘এক একটি কোচিং সেন্টার হবে!’ তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও সেই চাওয়ার একটা পরিবেশ বিরাজ করছে এবং তার সাথে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কোচিং সেন্টার। সমাজ যা চায় তাইতো হবে!

উচচ মাধ্যমিক পাস করার পর শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রিকালচারাল বিশ্ববিদ্যালয়, সামরিক বাহিনীর পদগুলোতে পরীক্ষা ফেস করতে হয়। এগুলোর মধ্যে কোনগুলোর পরীক্ষা দ্রুত হয়, বাকীগুলোর বেশ কয়েকমাস লাগে। এই সময়টিতে শিক্ষার্থীরা নিজেরা অনেকেই পড়াশোনা করে না। নিজে পড়তে গেলেও নিয়ম শৃংখলার মধ্যে থাকে না। আজ হয়তো আটঘন্টা পড়াশোনা করলো, কাল সিনেমা দেখতে গেল। কিন্তু কোচিং বা এই জাতীয় কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলে একটা নিয়ম শৃংখলার মধ্যে থাকে, পড়াশোনার চাপের মধ্যে থাকে। দ্বিতীয়ত, এগুলোতে নিয়মিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, পরীক্ষার ফল তাদের অগ্রগতির কথা বলে দেয়। তারা মোটামুটি একটা প্রস্তুতির মধ্যে থাকে। তৃতীয়ত, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির জন্য কিছু কমন আর কিছু বিশেষায়িত প্রশ্ন ও সেগুলোর উত্তর দেয়ার স্টাইল থাকে যেগুলোর সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা ঐসব সেন্টারে ভর্তি হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে মাত্র ১২০ দিন ক্লাস হয়, তারমধ্যেও থাকে বহু ধরনের প্রোগ্রাম, পরীক্ষার বন্ধ, বোর্ড পরীক্ষার সেন্টার যেসব প্রতিষ্ঠানে পড়ে সেই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ইত্যাদি কারনে শিক্ষার্থীদের প্রতিটি বিষয়ে যে পরিমাণ পড়াশোনা ও অনুশীলন দরকার তা কোথাও হয়না। আর যেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি সেগুলোর তো কথাই নেই। কিন্তু কোচিং সেন্টারগুলো বড় বড় বন্ধেও তাদের কার্যক্রম খোলা রাখে, কোনগুলো বরং বন্ধের সময় বেশি গুরুত্ব দিয়ে ক্লাস করিয়ে থাকে। ফলে, অভিভাবকগণ সেসব সেন্টারে তাদের সন্তানদের পাঠিয়ে থাকেন। এগুলো সমাজের বাস্তবতা। কাজেই এ নিয়ে আমরা যতই নেগেটিভ কথা বলি, নেগেটিভলি উপস্থাপন করি তাতে কোনো লাভ নেই।

এখানে আর একটি সামাজিক ব্যধি লক্ষণীয়। সেটি হচেছ কোন শিক্ষার্থীই এবং বলা যায় কোন অভিভাবকই কিন্তু তাদের সন্তানদের মূল পড়ালেখা শেখানোর জন্য বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে থাকেন না। তারা পাঠান পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেতে, ভালো গ্রেড পেতে। সেটি যে শিক্ষক, বা যে কোচিং সেন্টার করাতে পারে সেখানে সব শিক্ষার্থী, সব অভিভাবক ভীড় করেন। তারা শুধুমাত্র প্রশ্নপত্র নিয়ে আলোচনা করা, পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়ার টেকনিক নিয়ে আলোচনা করা শিক্ষক ও কোচিংএ ছোটাছুটি করেন।। বিদ্যালয় বা কলেজেও একই অবস্থা। আপনি যদি শিক্ষার্থীদের গণিতের, বিজ্ঞানের বা ইংরেজির বেসিক শেখাতে চান, প্রকৃত পড়াশোনা শেখাতে চান দেখবেন কোন অভিভাবক ঐ শিক্ষক বা ঐসব কোচিং সেন্টারে যাবেনা, বাচ্চাদের পাঠাবেন না। বিদ্যালয়ে যে শিক্ষক কমার্শিয়ালি পড়াতে পারবেন অর্থাৎ প্রশ্ন পত্র কিভাবে আসবে, কিভাবে একটি প্যারাগ্রাফ পরে বাংলা ও ইংরেজিত বেশি নম্বর পাওয়া যায়, গণিতে কিভাবে ৫টি অংক করলে কমন পড়বে, সেইসব শিক্ষকদের কাছে সব অভিভাবক ভীড় করেন, সেই শিক্ষক বা সেই সেন্টারে ঢোকার জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেন। কিন্তু আপনি যদি প্রকৃত শিক্ষক হোন, প্রকৃতঅর্থেই শিক্ষার্থীদের শেখাতে চান, তাদের জীবনের জন্য প্রস্তত করতে চান, দেখবেন আপনার কাছে কেউ যাবেনা। আপনাকে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিাভাবক এমনকি সমাজ কেউ আপনাকে পছন্দ করবে না, চাবেনা।

সমাজের এই ব্যধি দূর করার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে শুধু কোচিং সেন্টারের দোষ দিয়ে আর সরকারকে দায়ী করে লাভ কি?কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য রাজধানীতেই মোট ৩৩টি কোচিং সেন্টার রয়েছে। মেডিক্যাল ও ডেন্টালে ভর্তির জন্য রয়েছে ১৩টি কোচিং সেন্টার। একাডেমিক কোচিং সেন্টার রয়েছে ১৯টি এবং চাকরির কোচিং রয়েছে ১৩টি। বছরে বিশ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কোচিং সেন্টার যা শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এডুকেশন কমিউনিকেশনের জরিপ অনুযায়ী কোচিং সেন্টারগুলোত বছরে ৩০ থেকে ৩৫হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। আর এডুকেশন রিসার্চ কাউন্সিল (ই আরসি) বলছে দেশে আড়াই হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হয়ে থাকে। সন্তানদের জন্য এই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচেছ অভিভাবকদের। পাঁচ বছরে কোচিং ফি বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তিতে বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য আর এগুলোর ভর্তি সহায়ক বাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্ধেক বই বিক্রি করে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার। দেশে নিবন্ধিত কোচিং সেন্টারের সংখ্যা ৬হাজার ৫৮৭টি তবে নিবন্ধনহীন কোচিং সেন্টার দুই লক্ষাধিক। এ বছর উদ্ভাস কোচিং সেন্টারে প্রায় বিশ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে, প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১৫-২০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে, মানে বিশাল বিজনেস! দেশের জাতীয় দৈনিকগুলো কোচিং বাণিজ্যের এই চিত্রগুলো প্রায়ই প্রকাশ করে থাকে কিন্তু এগুলো কেন হচেছ সেটি নিয়ে কথা বলার লোক কম দেখা যাচেছ। কেউ কেউ বলছেন রাষ্ট্রীয় নজারদারির অভাবে এগুলো হচ্ছে। তারা চাচ্ছেন নিয়ম কানুন এখানে চাপিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। রাষ্ট্রীয় নিয়ম বা বিধিনিষেধ দেওয়া মানে হচেছ আইন শৃংখলা বাহিনী, ইনকাম ট্যাক্সসহ অন্যান্য বিভাগগুলোকে বৈধতা দেওয়া যাতে তারা এখান থেকেও নিয়মিত উৎকোছ গ্রহণ করতে পারে। আমাদের দেশের কোন বিষয় সরকারি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা মানে হচেছ কালো টাকার খেলা, দেশ ও জাতির কোন কল্যাণ করার আরও বারোটা বাজানো!

এর মধ্যেও সরকার যে কিছু করেনি বিষয়টি তা নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ২০১২ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। হাইকোর্টের আদেশে ২০১৯ সালে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। যেখানে বলা হয়েছে কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারেন। ঐ নীতিমালা কাগজে কলমেই আছে, অন্ধকার ফাইলের মধ্যে লুকিয়ে আছে, বাস্তবে কোথাও নেই। সরকার তো নিয়ম কাগজে লিখেই খালাস! কে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে? শিক্ষার্থী, অভিভাবক আর সমাজ যেখানে চায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সব কোচিং সেন্টার হোক আর প্রতিষ্ঠানগুলোর আশে পাশে গড়ে উঠুক আরও হাজারো কোচিং, সেখানে রাষ্ট্র কি করবে?

লেখক: সাবেক অধ্যাপক ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, সিলেট, কুমিল্লা ও মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ- ব্র্যাক শিক্ষা, কান্ট্রি ডিরেক্টর-ভাব বাংলাদেশ।


বন্দর লিজ…বিনিয়োগের গতি বাড়াতে সহায়ক হবে

মিজানুর রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস নভেম্বর ১৭ তারিখে জাতির উদ্দেশে ভাষণে উল্লেখ করেন চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কমটেইনার টার্মিনালটি ৩০ বছরের জন্য পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ডেনমার্ক ভিত্তিক শিপিং ও লজিস্টিক প্রতিষ্ঠান এপি মোলার মাসের্স্ক (এপিএ)। তাছাড়া একইদিনে বুড়িগঙ্গার পাড়ে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেনার টার্মিনালকে ২২ বছরের জন্য সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেডেলগের দায়িত্ব দিতে চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন সরকার।

নিউমুড়িং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল। এখানকার ৪৪ শতাংশ কন্টেইনার সামলায় এনসিটি। এই টার্মিনালে এক সঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ও একটি অভ্যন্তরীণ নৌপথের ছোট জাহাজ ভিড়ানো যায়। এনসিটি জাহাজ থেকে বার্ষিক ১০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানো নামানোর স্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে। গত এই টার্মিনাল ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডেল করেছে।
দেশীয় প্রতিষ্ঠান দরপত্রের মাধ্যমে গত ১৭ বছর ধরে এনসিটি টার্মিনালটি পরিচালনা করছে। বর্তমানে এটি পরিচালনা করছে নৌবাহিনী নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেড। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ(সিপিএ) এনসিটি থেকে মোট রাজস্ব আয় করেছে ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। আর ব্যয় বাদে লাভ হয়েছে ৫৭৪ কোটি টাকা। এটিকেও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

তবে এনসিটি পরিচালনা করতে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিদেশি কোম্পানির চুক্তি সম্পর্কিত প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে শুনানী চলছে। নিষ্পত্তি হলে সরকার টার্মিনালটি সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে পরিচালনা করতে দিয়ে দেবে। তার আগ পর্যন্ত বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পর্কিত প্রক্রিয়া চালানো যাবে না বলে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর আগে গত বছরের জুনে চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা টার্মিনালটি পরিচালনার কার্যক্রম শুরু করে সৌদি আরবের রেড সি গ্রেডওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল ( আরএসজিটিআই)। তবে এখনো প্রতিষ্ঠানটি কন্টেইনার পরিচালনায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহের পর্যায়ে আছে।

চট্রগ্রাম বন্দরের বাকি দুটি টার্মিনাল দেশীয় বেসরকারি বার্থ অপারেটর পরিচালনা করছে… চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি)ও জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি)এর মধ্যে সিসিটি মোট কনটেইনারের ১৯ শতাংশ এবং জিসিবি ৩৭ শতাংশ হ্যান্ডেল করে।

বন্দরে কন্টেইনার কম বা বেশি পরিবহন হয় মূলত বৈদেশিক বাণিজ্য কম বেশির ওপর। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর যা দেশের আমদানি রপ্তানি ৯০ শতাংশের বেশি হ্যান্ডেল করে। বন্দরের প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক ২০২৩ সালে এই বন্দরে ৩০ লাখ ৫০ হাজার ৭৯৩ একক কনটেইনার পরিবহন হয়েছে। ২০২৪ সালে তার তুলনায় সোয়া দুই লাখ বেড়ে এর পরিমাণ হয়েছে ৩২ লাখ ৭৫ হাজার একক কনটেইনার। এ হিসাবে কনটেইনার পরিবহন বেড়েছে ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

সরকার দেশের বিনিয়োগ এর পরিবেশ আরও গতিশীল করতে বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়ানোর অংশ হিসাবে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে ।

বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তির বিপক্ষে দেশের স্বার্থ রক্ষাসহ কৌশলগত অর্থনৈতিক এবং প্রক্রিয়াগত নানা উদ্বেগ দেখিয়ে জোড় সমালোচনা চলছে নানা পক্ষ থেকে। গত ১৭ নভেম্বর সম্পাদিত চুক্তিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাষ্টমস কী পরিমাণ ট্যারিফ মাসুল, চার্জ,শুল্ক কর ইত্যাদি পাবে,সেই বিষয়গুলো গোপন রাখা হয়েছে।

এ নিয়ে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বলেছে লালদিয়া এবং পানগাঁও ও বন্দর পরিচালনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হওয়া চুক্তিটি নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (গোপনচুক্তি)। তাই এ নিয়ে তথ্য প্রকাশ করা যাচ্ছে না।

ননডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট(নন ডিএ) তখনই জরুরি হয় যখন দুই- ততোধিক পক্ষের মধ্যে গোপন তথ্য বিনিময় হয়। যেই তথ্য ফাঁস হলে ব্যবসায়িক আর্থিক আইনি বা ব্যক্তিগত ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

এই বিষয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে বিডা নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, কোন দেশের সরকারই পিপিপি চুক্তির দলিল জনসম্মুখে প্রকাশ করবে না আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে। সরকারি ক্রয় নীতি ও পিপিপি গাইড লাইন অনুযায়ী পূর্ণ প্রকাশ নিরাপদ নয় সেই সঙ্গে বেসরকারি অংশীদারদের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি তিনি জানান।

বন্দর বিদেশি অপারেটর বাছাইয়ের আগে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা উচিত বলে মনে করেন অনেকে। এই প্রক্রিয়া মানা হয়নি বলে আসা অভিযোগের ও জবাব দিয়েছেন আশিক চৌধুরী। তিনি ওই পোষ্টে আরও লেখেন পিপিপি নীতিমালার জিটুজি পদ্ধতির আলোকে টেন্ডার আহব্বান প্রাক- যোগ্যতা যাচাই টেকনিক্যাল ও ফিনান্সিয়াল মূল্যায়ন এবং ডিউ ডিলিজেন্সের মাধ্যমে অপারেটর চূড়ান্ত করা হয়েছে।

কিন্ত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কনটেইনার টার্মিনালগুলো পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে চলছে জোড় আলোচনা। কিন্তু বিষয়টি কেউ তলিয়ে না দেখে সমালোচনা করছেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তে যেমন একদিকে বন্দরের কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি অন্যদিকে স্বচ্ছতার অভাব জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

অন্যদিকে সরকারের অভিমত পজেটিভ।সরকার যুক্তি দিচ্ছে… সীমিত বন্দর সক্ষমতা সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং দক্ষতা বাড়াতেই বিশ্বমানের অপারেটর আনা হচ্ছে। দুর্নীতি ও অদক্ষতাকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সচরাচর পণ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে এতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। বন্দরের সূত্র মতে যেমনটি জানা যায়,
চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজ বার্থিংয়ের জন্য গড়ে তিন চারদিন অপেক্ষা করে যেখানে সিঙ্গাপুরে সময় লাগে মাত্র ১৪ থেকে ২৪ ঘন্টা। কনটেইনার খালাসে ও ৮ থেকে ১২ দিন সময় লাগে, যা আন্তর্জাতিক মানের( ২--৩ দিন) চেয়ে অনেক বেশি। বিদেশি অপারেটররা তাদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্দরের এই টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম কমিয়ে দক্ষতা বাড়াতে পারবে বলে আশা করছে সরকার।
লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ডেনমার্কের কোম্পানিটি প্রায় ৬ হাজার ৭০০কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এর চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই ২৫০ কোটি টাকা সাইনিং মানি হিসাবে পেয়েছে দেশ।পানগাঁও টার্মিনালে সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৪৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। সুইজারল্যান্ড সাইনিং মানি হিসাবে দিয়েছে ১৮ কোটি টাকা। এতে করে দেশের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার না করে বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে অবকাঠামো তৈরি হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে কোন অর্থ ব্যয় করতে হবে না। যা সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। চুক্তি সই অনুষ্ঠানে জানানো হয়, লালদিয়া টার্মিনালে বছরে নয় থেকে দশ লাখ কনটেইনার ওঠা নামার সক্ষমতা থাকবে। বাড়ার ক্ষেত্রে আট লাখ পর্যন্ত প্রতি একক কনটেইনারে ২১ডলার করে পাবে বাংলাদেশ। আর আট লাখের বেশি কনটেইনার ওঠানো নামানো হলে প্রতি একক কনটেইনারের জন্য পাবে ২১ থেকে ২৩ ডলার করে।অন্যদিকে পানগাঁও নৌ টার্মিনালে ১ লাখ ৬০ হাজার একক কনটেইনার হ্যান্ডেলিং হবে বলে জানিয়েছে মেডলগ। প্রতি একক কনটেইনার থেকে ২৫০ টাকা করে পাবে সরকার।

মালামাল লোডিং আনলোডিং সময় কম লাগবে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে দেশ উন্নত হবে। করের অবকাঠামো উন্নয়ন হবে বহুলোকের কর্মসংস্থান হবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে। বন্দরের বিশ্ব মানদণ্ডের কাঠামো উন্নয়ন হবে। গুনগত মান বৃদ্ধির ফলে বিদেশি জাহাজের আগমন বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে এই উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বন্দর হবে চট্টগ্রাম। বন্দরের দুর্নীতি বন্ধে এই প্রক্রিয়া বিশেষ অবদান রাখবে বলে আমার ও ধারণা।

লেখক: কলামিস্ট ও ব্যাংকার।


মৎস্য ও পোল্ট্রি খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণ জটিলতা নিরসন জরুরি

মো. রহমত উল্লাহ্
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

আমাদের বিপুলসংখ্যক মানুষের দৈনন্দিন আমিষের ঘাটতি তথা মাছ-মাংসের চাহিদা পূরণের জন্য অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে অনেক মৎস্য ও পোল্ট্রি খামার। বিশেষ করে মুরগি ও হাঁস উৎপাদনের এ খামারগুলোর অধিকাংশের উদ্যোক্তাও প্রত্যন্ত এলাকার স্বল্পশিক্ষিত উদ্যোগী মানুষ। তারা নিজেরাই তৈরি করেছে তাদের কর্মসংস্থান। আমরা সবাই জানি, আমাদের নতুন প্রজন্মের খাদ্য চাহিদার শীর্ষে বর্তমানে অবস্থিত মুরগির মাংস। আমিষের ঘাটতি পূরণের জন্য এটি অত্যাবশ্যক। পছন্দের খাবার মুরগির মাংসকে আরো পছন্দনীয় করে তোলার জন্য গড়ে উঠেছে অনেক ফাস্টফুডের দোকান। সেখানেও তৈরি হয়েছে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান।

মৎস্য ও পোল্ট্রি উৎপাদন বৃদ্ধিতে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা প্রশংসনীয়। ব্যক্তি উদ্যোক্তা তৈরিতে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তাগণ প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন মৎস্য ও পোল্ট্রি উৎপাদন বৃদ্ধিতে। এর পাশাপাশি ভূমিকা রেখেছে বিভিন্ন এনজিও। মাছের ও হাঁস-মুরগির চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি বৃদ্ধি পেয়েছে উৎপাদন, বৃদ্ধি পেয়েছে মাছের ও হাঁস-মুরগির খাবার ও ঔষধের চাহিদা। গড়ে উঠেছে তাদের খাদ্য ও ঔষধ উৎপাদনের জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান; যার অধিকাংশই ক্ষুদ্রশিল্প। বর্তমানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধিত পোল্ট্রি ও ফিস ফিড উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩০০টি। সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগের নির্ধারিত ফি দিয়ে সার্টিফিকেট/ অনুমোদন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে এ সকল প্রতিষ্ঠান। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভেটেরিনারি ও অ্যাকুয়াতে ডিগ্রি অর্জনকারী অনেক কর্মকর্তা এ সকল কোম্পানিতে নিয়োজিত। এদের কারখানায় পরীক্ষাগার ও পরীক্ষক রয়েছেন এবং উৎপাদিত খাদ্য বিএসটিআই’র মানের কাছাকাছি রয়েছে বলে তাদের দাবি। এ দাবির শতভাগ সঠিকতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে মৎস্য ও পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদন সম্ভব বিধায় দেশের আনাচে-কানাচে অনুমোদনহীন শতাধিক উৎপাদনকারী থাকার অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। বাস্তবে যদি তেমন প্রতিষ্ঠান থেকে থাকে তো সেগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা আবশ্যক। মোটকথা মৎস্য ও পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদনকারী কোনো প্রতিষ্ঠান খাবার উৎপাদনে ট্রেনারি বর্জ্য ও বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর উপাদান ব্যবহার করে না, করবে না এবং তাদের উৎপাদিত খাদ্যের মান সম্পূর্ণ সঠিক আছে ও থাকবে তা শতভাগ নিশ্চিত করা সরকারের একান্ত দায়িত্ব।

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য সে খাদ্য নিরাপদ হওয়াও প্রয়োজন। খামারে উৎপাদিত মাছ ও হাঁস-মুরগির সুস্থতার উপর আমাদের সুস্থতা অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তাই আমাদের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্যই সবার প্রিয় খাদ্য মাছ ও হাঁস-মুরগির সুস্থতা নিশ্চিত করা আবশ্যক। আবার মাছ ও হাঁস-মুরগির সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য তাদের খাবার ও ঔষধের মান নিয়ন্ত্রণ করা অত্যাবশ্যক। নির্ধারিত মান নিশ্চিত করে মাছ ও পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদন করলে রোগ বালাই ও দূষণ রোধ হবে। মাছ, মাংস ও ডিম নিরাপদ হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এসবের মান নিয়ন্ত্রণ করবে কারা? প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর নাকি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন তথা বিএসটিআই? এক্ষেত্রে কাদের সক্ষমতা বেশি তাও বিবেচ্য। শুরু থেকে দীর্ঘদিন ধরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বিষয়টি দেখভাল করে আসলেও গত ২০১৮ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিএসটিআই বিষয়টি দেখভাল করার উদ্যোগ নেয়। পোল্ট্রি ও মাছের খাদ্যসহ ২৮টি পণ্যের বিক্রি, বিতরণ ও বাণিজ্যিক প্রচারণার আগে মান নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। তারা মৎস্য ও পোল্ট্রি খাদ্যমান নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন কারখানায় অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এর পাশাপাশি মোটা অংকের ফি প্রদান করে তাদের নিকট থেকে সার্টিফিকেশন মার্কস তথা সিএম সার্টিফিকেট নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। দ্বৈত অধীনতায় পড়ে যায় মৎস্য ও পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিএসটিআই তাদের সিএম সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য পোল্ট্রি ও ফিস ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। কিন্তু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অধীনে যেতে এবং মোটা অংকের টাকা দিয়ে সিএম সার্টিফিকেট নিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। অতিরিক্ত চাপে পড়ে সিএম সনদ নিতে বাধ্য হয় হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি। দ্বৈত অধীনতার কারণে এবং অতিরিক্ত ফি দাবি করার কারণে অসন্তোষ তৈরি হয় কোম্পানির মালিকদের মধ্যে। দেখা দেয় হয়রানি ও ফিডের মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা। ফিডের মূল্য বৃদ্ধি পেলে অবশ্যই এর বিরূপ প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের মূল্য তালিকায়।

একটি বিষয় পরিষ্কার প্রতিমান হচ্ছে যে, পোল্ট্রি ও ফিস ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে উভয় মন্ত্রণালয়ই দেখভাল বা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এখানে অতি আগ্রহে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ না হোক। আশা করি, উভয়ের উদ্দেশ্যই মহৎ। কিন্তু দুটি প্রতিষ্ঠানকে একইসঙ্গে এ দায়িত্ব দেওয়া হলে জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যদি পোল্ট্রি ও মৎস্য সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদানের দায়িত্ব প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে রেখে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিএসটিআইকে এদের খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয় তো চরম ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে। কেননা, পোল্ট্রি ও মৎস্য রোগাক্রান্ত হলে, বৃদ্ধি ব্যাহত হলে, খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অথবা অন্য কোনো সমস্যা হলে পরস্পরকে দোষারোপ করা হবে। এক দপ্তর বলবে খাদ্যের মান সঠিক ছিল না, অন্য দপ্তর বলবে চিকিৎসা ও পরিচর্যা সঠিক ছিল না। তাছাড়া দুই পক্ষকে মেন্টেন বা সন্তুষ্ট করতে গিয়ে হিমশিম খেতে পারে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে দ্রুত বর্ধমান অত্যন্ত সম্ভাবনাময় গুরুত্বপূর্ণ পোল্ট্রি ও মৎস্য শিল্প।

বাস্তবে পোল্ট্রি ও মৎস্য ফিড শিল্প কারখানা সরাসরি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করে না। তারা মাছ ও হাঁস-মুরগির খাবার উৎপাদন করে। তাদের উৎপাদিত খাদ্যমানের উপর মাছ ও হাঁস-মুরগির সুস্থতা অনেকাংশের নির্ভরশীল। অর্থাৎ নিরাপদ মাছ-মাংস ও ডিম পাওয়ার জন্য পোল্ট্রিফিড ও ফিশফিড নিরাপদ থাকা আবশ্যক। প্রশ্ন হচ্ছে, নিরাপদ পোল্ট্রিফিড ও ফিসফিড এবং ঔষধ ও সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করে মানুষের জন্য নিরাপদ মাছ-মাংস ও ডিম সরবরাহের তদারকি কোন প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা উচিত? বিএসটিআই অনুমোদিত হাজার হাজার পণ্যের সবটির মান বিতর্কের ঊর্ধ্বে কিনা? কোন মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এককভাবে এ সংক্রান্ত সবকিছু দেখভাল করা সম্ভব? এই পুরু প্রক্রিয়াটি তদারক করার প্রয়োজনীয় যোগ্য/বিশেষজ্ঞ লোকবল এবং বিস্তৃতি কোন প্রতিষ্ঠানে অধিক?

মৎস্য ও হাঁস-মুরগির খাবারের মান নিয়ন্ত্রণ করাই যথেষ্ট নয়; তাদের সঠিক চিকিৎসা ও পরিবেশ নিশ্চিত করে সুস্থভাবে বেড়ে উঠা নিশ্চিত করা জরুরি। সে কাজের জন্য প্রয়োজন প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, খামার ভিজিট ও সঠিক পরিচর্যা। সেই সাথে প্রয়োজন খামারিকে গুরুত্বপূর্ণ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদান। মৎস্য ও হাঁস-মুরগির উপর কোনো রসায়নিকের বা এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। যার জন্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনকারীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতার কোন বিকল্প নেই। সারাদেশের প্রতিটি থানা/উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে তাদের লাইভ স্টক অফিসার রয়েছে। তারা মূলত সুস্থ-সবল গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিয়োজিত। পোল্ট্রিফিডে ও ফিসফিডে কোন ভেজাল থাকলে সেটিও চিহ্নিত করার এবং প্রয়োজনীয় (সহনীয় মাত্রায়) সরকারি ফি আদায় করার বর্ধিত সক্ষমতা অর্জনের যোগ্যতা তাদের রয়েছে। প্রয়োজনে তাদের লোকবল বৃদ্ধি, আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং পরীক্ষাগারের সংখ্যা ও মান বৃদ্ধি করতে হবে। সেইসাথে বৃদ্ধি করতে হবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিধারী যোগ্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ। এককভাবে একটি মন্ত্রণালয়কেই দিতে হবে সকল দায় ও দায়িত্ব। ক্রমবর্ধমান এ শিল্পের সঠিক সমৃদ্ধির জন্য যা খুবই জরুরি। মোটকথা সুস্থ-সবল গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করে মানুষের জন্য নিরাপদ মাছ-মাংস নিশ্চিত করার দায়িত্ব মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কেই দেওয়া উচিত এবং এটি করা উচিত অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে।

লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট।


তাফসীরে হিদায়াতুল কোরআন

ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

সূরা ফাতির পর্ব ২

অনুবাদ

(৫) হে মানুষ, নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদের প্রতারিত না করে। আর বড় ধোঁকাবাজ (শয়তান) যেন তোমাদের আল্লাহর ব্যাপরে প্রতারণায় ফেলতে না পারে। (৬) নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের শত্র ‘। কাজেই তাকে শত্রু’ হিসেবেই গণ্য করো। সে তার দলকে এজন্যই (তার পথে) ডাকে, যাতে তারা জ্বলন্ত আগুনের (দোযখের) অধিবাসী হয়ে যায়। (৭) যারা কুফরী করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। আর যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে, তাদের জন্য রয়েছে মাগফিরাত ও মহা প্রতিদান। (৮) কাউকে যদি তার বদ আমলকে সুশোভিত করে দেখানো হয়, অতঃপর সে এটাকে ভালো মনে করে (সে কি তার সমান, যে ভালোকে ভালো ও মন্দকে মন্দ দেখে)? আসলে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা গোমরাহ করেন, আর যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন। সুতরাং (হে নবী,) তাদের জন্য আফসোস করে নিজ জীবন নষ্ট করো না। এরা যা করে, আল্লাহ তা ভালভাবেই জানেন।…

মর্ম ও শিক্ষা

ইতোপূর্বে ঈমানের দুটি মৌলিক ভিত্তির কথা বরা হয়েছে। যা হলো, তাওহীদ ও রিসালাত। এরপর এখানে আলোচ্য আয়াতে ঈমানের তৃতীয় মৌলিক ভিত্তির আলোচনা এসেছে। আর তা হলো পুনরুত্থান, কিয়ামত, আখিরাত, আখিরাতের বিচার, পুরস্কার ও শাস্তি ইত্যাদি। এরপর শয়তানের প্ররোচনা থেকে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে, যা মানুষকে এই তৃতীয় ভিত্তির উপর ঈমান আনার ক্ষেত্রে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দেয়। এছাড়া মানুষকে দুটি দলে ভাগ করা হয়েছে। একটি হলো শয়তানের দল যার জন্য আখিরাতে কঠিন শাস্তি রয়েছে। আরেকটি হলো আল্লাহর দল যাদের জন্য আখিরাতে মহাপুরস্কার রয়েছে।

ঈমানের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি: কিয়ামত ও আখিরাত

আয়াতে বলা হয়েছে নিঃসন্দেহে আল্লাহর ওয়াদা সত্য। কিয়ামত, হাশর, কিয়ামতের বিচার, আখিরাত, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি সম্পতেক আল্লাহ যে ওয়াদা দিচ্ছেন তা অকাট্য সত্য ও নির্ভুল। কিয়ামত ও আখিরাতে বিশ্বাস হলো ইসলিামী জীবনাদর্শে ঈমানের মৌলিক ভিত্তিসমূহের অন্যতম। আর এই বিশ্বাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জবাবদিহিতা না থাকলে সত্য পথে চলার এবং অশ্লীলতা থেকে বেচে থাকার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকে না। তাহলে মানুষ যা খুশি তাই করতে পারে। ভোগ বিলাসী জীবনে মত্ত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তা নয় মানুষকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। আর তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে কিয়ামতের বিচারের দিবস। এটি হলো আল্লাহর ওয়াদা যা একান্তভাবে সত্য ও অকাট্য।

দুনিয়ার চাকচিক্য ও শয়তানের ধোকা থেকে সাবধানতা অবলম্বন

যেহেতু মানুষের প্রতিটি চিন্তা, কল্পনা ও কর্মের জবাবদিহিতা আছে, সেহেতু দুনিয়ার চাকচিক্যে আত্মহারা হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। দীর্ঘ জীবন, প্রশস্ত রিয্ক্ ও ধন-সম্পদ এবং শারিরীক সুস্থতা দেখে জবাবদিহিতার চেতনা ভুলে থাকা ঠিক নয়। জীবন যতই দীর্ঘ হোক মৃত্যু আছে। ধন-সম্পদ যতই সুপ্রশস্ত হোক তা একদিন শেষ হবে। আর না হয় এগুলো ছেড়ে মৃত্যু বরণ করতে হবে। যতই আরাম-আয়েশ থাকুক এগুলো শেষ হবে। দেহ রোগক্রান্ত হয়ে পড়বে এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে। কাজেই এগুলোতে বিভোর হয়ে ভবিষ্যতকে ভুলে যাওয়া ঠিক নয়।

শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে সাবধান থাকা

একদিকে দুনিয়ার চাকচিক্য যেমন মানুষকে জবাবদিহির চেতনা ভুলিয়ে দিতে পারে, অন্যদিকে শয়তানের ধোকা ও প্রতারণা মানুষকে আত্মভোলা করে ফেলতে পারে। শয়তান মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয়, যা নগদ তা হাত পেতে নাও। আখিরাতের কল্পনায় যে আনন্দের জীবন সামনে আছে তা থেকে বঞ্চিত থাকা উচিত নয়। শয়তান মানুষের প্রবৃত্তিকে উজ্জীবিত করে এবং বিবেককে করে পরাভূত। একদিকে মানুষকে দুনিয়ার চাকচিক্য আকর্ষণ করে, আরেকদিকে শয়তান সে চাকচিক্যে নিজকে বিলীন করে দেয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং আলোচ্য আয়াতে শয়তানের ধোকা, প্রতারণা ও কু প্ররোচনা থেকে সাবধান থাকতে বলা হয়েছে।

দুনিয়া ও আখিরাতের আপেক্ষিক অগ্রাধিকার

দুনিয়া হলো আখিরাতের কর্মক্ষেত্র। মানুষের জন্য দুনিয়া ততটুকু দরকার যতটুকু তার জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজন। আর এই জীবনের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো আখিরাতের সাফল্য। দুনিয়া হলো উপকরণ, আর আখিরাতের হলো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এখন দুনিয়ার চাকচিক্য ও শয়তানের প্রতারণায় মানুষ যদি দুনিয়াকেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বানিয়ে নেয় এবং আখিরাতকে গৌণ হিসাবে চিন্তা করে, তাহলে লাগে যতো বিপত্তি। যেখানে দুনিয়ার ও আখিরাত সাংঘর্ষিক সেখানে দুনিয়াকেই গ্রহণ করে এবং আখিরাতকে ত্যাগ করে। অথচ দুনিয়ার জীবন ক্ষণিকের ও তুচ্ছ। আর আখেরাতের জীবন হলো অনন্তকালের। এই ক্ষণিকের জীবনের জন্য অনন্তকালের জীবনকে বিসর্জন দেয়া নিতান্তই বোকামী। যেকোন বিকেকসম্পন্ন ও যুক্তিক মানুষের কর্তব্য হলো দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে আখিরাতকে অগ্রাধিকার দেয়া। দুনিয়ার চাকচিক্যে ভুলে না যাওয়া শয়তানের প্ররোচনায় প্রতারিত না হওয়া। এটাই হলো আলোচ্য আয়াতের মূল কথা।

শয়তান নিজ দল ভারী করতে চায়

বিতাড়িত শয়তান ফায়াসালা পেয়ে গেছে যে, সে নিশ্চিতভাবে দোযখে যাবে। কাজেই সে দোযখে তার দলকে ভারী করতে চায় (আয়াত ৬)। সে প্রাণপণ চেষ্টা করে যতো বেশি মানুষ পাওয়া যায়, তত বেশি যেন দোযখে তার সঙ্গী হয়। এজন্য সে টার্গেট নিয়ে মানুষের পিছনে লেগে যায়। বিশেষ করে যারা দুনিয়াদার। দুনিয়ার মোহ ও চাকচিক্যে যারা দুর্বল, তাদের শয়তান টার্গেট করে। কেননা তাদের প্রতারিত করা সহজ। তাদের মন এমনিতেই দুর্বল। দুনিয়ার চাকচিক্য দেখে তারা অনন্তকালের আখিরাতকে ভুলে যায়। কাজেই এই দুর্বল মানুষকে প্রতারিত করা সহজ। কাজেই দুনিয়াদারী আর শয়তানের চক্রান্তে প্রতারিত হওয়ার মধ্যে একটা ইতিবাচক ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

শয়তানের দল বা হিজবুস শয়তান

শয়তান মানুষকে নানাভাবে কুপ্ররোচনা দিয়ে নিজ দলে ভিড়ায়। তার দল বড় হয়। যারাই তার দলে যোগদান করে, তাদেরকেই শয়তান সকল প্রকার মন্দ ও অশ্লীল ও অনৈতিক কাজকে সুশোভিত করে দেখায়। যা মন্দ তাকে ভালো করে প্রকাশ করে। আর যা ভালো তা থেকে মানুষকে দুরে সরিয়ে রাখে। শয়তানের এই কু চক্রান্তে পড়ে যারা শয়তানের দলে যোগ দেয়, তাদেরকে নিয়ে হয় শয়তানের দল। কোরআনের অন্যত্রও এই শয়তানের দলের কথা বলা হয়েছে। যারা আখিরাতের অনন্ত কালের শাস্তি ভোগ করবে।

জ্বীন শয়তান ও মানুষ শয়তান

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ মানুষকে শয়তান সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলেছেন। সুতরাং শয়তান সম্পর্কে আরেকটু ধারণা থাকা প্রয়োজন। কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী শয়তান দুই প্রকার। জ্বীন শয়তান ও মানুষ শয়তান। জ্বীন শয়তান হলো ইবলিস ও তার বংশধর। তা অদৃশ্যভাবে মানুষকে কু-প্ররোচনা দিতে পারে। মানুষের ভেতরে ঢুকে মনকে বিভ্রান্ত করতে পারে। জ্বীন শয়তান ছাড়াও রয়েছে মানুষ শয়তান। মানুষ শয়তান হলো তারা যারা মানুষ হয়েও শয়তানের দলে যোগ দেয়। শয়তান যেমন মানুষকে বাতিলের দিকে নিয়ে যেতে চায়। সে সব মানুষও নিজে বাতিলের পথে চলে। আর অন্য মানুষকে সত্য পথে বাধা দেয় এবং বাতিলের পথেচলতে অনুপ্রাণিত করে। এমনকি কোনো কোনো সময় তারা ইসলামী জীবনাদর্শের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক দল ও গোষ্ঠী সৃষ্টি করে। এদেরকে বলা হয় মানুষ শয়তান। এ ধরনের জ্বীন শয়তান ও মানুষ শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। সুতরাং প্রতিটি মানুষের উচিত জ্বীন শয়তান ও মানুষ শয়তান থেকে সতর্ক থাকা তাদের প্রতারণা ও ধোকায় পতিত না হওয়া। এবং তাদেরকে সঙ্গ বা বন্ধু হিসাবে গ্রহণ না করা।

হিজবুল্লাহ বা আল্লাহর দল

যারা শয়তানের ধোঁকা, প্রতারণা ও কুপ্ররোচণা থেকে আত্মরক্ষা করে এবং ধৈর্যের সাথে সকল প্রকার আকর্ষণীয় অশ্লীলতা ও অনৈতিক আচরণ থেকে বিরত থাকে, মযবুত ঈমান রাখে এবং ঈমানের দাবি অনুযায়ী আমল করে, তারা হলো আল্লাহর দল বা হিজবুল্লাহ। তারা আখিরাতের অনন্তকালের জীবনে মহা পুরস্কার পাবে এবং মহাশান্তিতে বাস করবে।

আখেরাতের সাফল্যের জন্য প্রতিদানের সাথে মাগফিরাত প্রয়োজন

আয়াতে বলা হয়েছে, যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে তাদের জন্য রয়েছে মাগফিরাত ও মহাপ্রতিদান। এখানে লক্ষ্যণীয় আখিরাতের মুক্তি ও সাফল্যের জন্য দুটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। একটি হলো প্রতিদান ও মাগফিরাত। প্রতিদান হলো মানুষের কর্মের ফল। মানুষ যতই কর্ম করুক। আল্লাহর অগণিত নিয়ামতের যথাযথ শুকরিয়া আদঅয় করা সম্ভব নয়। সুতরাং প্রতিদানের সাথে প্রয়োজন মাগফিরাত। এছাড়া কোনো মানুষই বিচ্যুতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। সে যতই মযবুত ঈমানের অধিকারী হোক। যতই নেক আমল করুক। তার অজান্তেই অনেক ভুল করে থাকতে পারে। সুতরাং ঈমান ও আমলের সাথে বেশি বেশি মাগফিরাত কামনা করা উচিত।

মানুষের কর্মের জন্য সে নিজেই দায়ী

আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা গোমরা করেন আর যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন। এই আয়াতের সঠিক অর্থ বুঝতে হবে। এর অর্থ এই নয় যে আল্লাহ হিদায়াতের মালিক। আল্লাহ হিদায়াত দিলেই মানুষ হিদায়াত প্রাপ্ত হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি হিদায়াতের পথে চলে, তার কোনো কৃতিত্ব নেই। আর যে ব্যক্তি গোমরাহীর পথে চলে, এইজন্য যে আল্লাহ তাকে গোমরাহী করেছে। আয়াতটি অর্থ এমন নয়। বরং আয়াতটি অর্থ হলো, যে বক্তি ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে সত্য পথ অনুসন্ধান করে আর যখন সত্যকে পায় তখনই সে পথে চলার জন্য প্রচেষ্টা চালায়। তাকে আল্লাহ হিদায়াতের পথে চলতে সাহায্য করেন। এমন নয় যে মানুষ সত্য পথে চলতে চায় না তাকে আল্লাহ জোর করে হিদায়াত দেয়। অপর দিকে যারা হঠকারিতা ও গোয়ার্তুমির কারণে সত্য পথে না চলার প্রত্যয় ব্যক্ত করে, সত্যপন্থিদের সাথে বিদ্রƒপের আচরণ করে, ইসলামী জীবনাদর্শের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়। এক কথায় যারা জেনে শুনে সত্যের বিরোধিতা করে এবং বাকা পথে চলতে চায়, আল্লাহ তাদেকে বাধা পথে চলতে দেয়। আল্লাহ তাদের জোর করে নিয়ে আসেন না। সত্য পথের হিদায়াত দেন না। এই অর্থেই কোরআনে বলা হয়েছে তারা যখন বাকা পথ অবলম্বন করল তখন আল্লাহ তাদরে হৃদয়কে বাকা করে দেন। সারকথা, মানুষ নিজেই তার কর্মের জন্য দায়ী। একের বোঝা অন্যে নিবে না। এবং কারো বিপথে চলার জন্য আল্লাহ দায়ী নয়।

নবী ও সত্যপন্থিদের দাওয়াতী দায়িত্বের মাত্রা

নবী ও সত্যপন্থিদের দাওয়াতের মাত্রা হলো এতটুকু যে, তারা সুস্পষ্টভাবে সত্যের দাওয়াতকে মানুষর নিকট পৌঁছে দেবেন। এরপর সেই দাওয়াতে সাড়া দেয়া বা না দেয়া তাদের নিজের দায়িত্ব। তারা যদি সাড়া দেয় তাহলে তারা কল্যাণের পথ পেয়ে যাবে এবং আখিরাতে অনন্তকালের শান্তি পাবে। আর যাদের দাওয়াতে তারা সত্য পথ পেয়েছে, তারাও তাদের আমলে ভাগী হবে। কিন্তু তারা যদি সত্য পথের দাওয়াতে সাড়া না দেয়, তাহলে এজন্য তারাই দায়ী যারা সত্য পথের দাওয়াতে কর্ণপাত করে না। এজন্য সত্যপন্থিরা মোটেই দায়ী নয়। তাদের দায়িত্ব হলো শুধু দাওয়াতকে পৌঁছে দেয়া।

বাতিলপন্থিদের আল্লাহ তায়ালার কঠিন শাস্তি হুমকি

বাতিলপন্থিদের ব্যাপারে আফসোস না করার পরামর্শ দেয়ার পর ঘোষণা দেয়া হয়েছে, এসব বাতিলপন্থিরা যা করে আল্লাহ তা ভালোভাবেই জানেন। আসলে এটা হলো আল্লাহর তরফ থেকে কঠোর শাস্তির হুমকি। অর্থাৎ যারা সত্যের দাওয়াতে কর্ণপাত করে না, যারা বাতিলের পথে চলে, যারা সত্যের পথে বাধা হয়ে দাড়ায় তাদের প্রতিটি কর্ম ও কাণ্ড কারখানার ব্যাপারে আল্লাহ পুরোপুরি খবর রাখেন। আল্লাহ তার যথাযোগ্য শাস্তি দেবেন।


কৃতিতে শীতের আমেজ 

সোমা মুৎসুদ্দী
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

প্রকৃতিতে এসেছে শীত। পৌষ ও মাঘ মাসই হলো শীতের বিরাজ এই সবুজ প্রকৃতির বুকে। শীত কালে কখনো, কখনো আকাশ মেঘলা থাকে। মাঝে, মাঝে মেঘের ফাঁকে সূর্য উঁকি দিয়ে জানান দেয় শীতের আগমন। ভোরের কচি ঘাসের আগায় কুয়াশার টুপটাপ ফোঁটা যেনো আরও মোহনীয় হয়ে ওঠে।এই সময় তুলে রাখা কাঁথা, কম্বল, চাদর ও সোয়েটার বের করা হয় শীতকে নিবারণ করতে। শীতকালে টাটকা শাক সবজি ও প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। তাছাড়া নতুন খেজুর গুড়ের সাথে জমে ওঠে মায়ের হাতে তৈরি নতুন চালের নানান পিঠা ও পায়েস। ভাপা, চিতই,নকশি,পুলি আর নানা পিঠা। এই সময় খেজুরের রস ছাড়াও শুকনো পাটালি গুড় পাওয়া যায়। উঠোনের এক কোনায়, দাদি নানি আগুন জ্বালিয়ে পোহায় শীত থেকে বাঁচতে। শীতের সকালে বাংলাদেশের কৃষক ভাই সকাল হতেই মাঠের পানে ছোটে, নানা রকম বাহারি শাক সবজি তুলে নানা হাট, বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে। শীতের সবজির মধ্যে আছে, শীম মটরশুঁটি, ফুলকপি, পাতাকপি, মুলা ওল, নতুন আলু, টমেটো, কাঁচামরিচ, ধনে পাতা নানান রকম শাক। শুঁটকির সাথে সিম আর মুলার তরকারি যেন জমে ওঠে এবং সেই সাথে দুপুরের রোদ পোহাতে, পোহাতে উঠোনে বসে গরম ভাতের সাথে খেতে সেই তরকারির স্বাদ অপূর্ব লাগে। গ্রামে, গঞ্জে ও শহরে পিঠা বিক্রেতারা ভাপা পিঠা চিতই পিঠা, পাটিসাপটা ও ছিটকা পিঠার পসরা নিয়ে আসে। এই সময় হাঁসের মাংসের সাথে চালের গুড়োর ছিটকা পিঠা বেশ জমে ওঠে অনেক অঞ্চলে এই পিঠাকে জালি পিঠাও বলে। শীতকে সামনে রেখে অনেকে পিঠার স্টল নিয়ে বসে। সবাইকে হারিয়ে যাওয়া দেশীয় সংস্কৃতির অনেক পিঠার সাথে পরিচয় করাতে। ছেলে, বুড়ো থেকে শুরু করে অনেক ভোজন রসিক এই পিঠা উৎসবে অংশ নেয়। তাছাড়া নবান্ন উৎসব, শীত উৎসব পালিত হয় গান ও কবিতার আসরে। কোথাও, কোথাও, বাউল গান, পালা গানের আসর বসে। শীতের বিকেলে, ফসলের সবুজ মাঠ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। গ্রাামের চায়ের টং দোকানগুলো চা ও পিঠার সাথে জমে ওঠে নানা রাজনৈতিক আলোচনায়। শীতের আমেজে বিকেল বেলা নৌকা ভ্রমণ করতেও বেশ ভালো লাগে।এই সময় প্রচুর বনভোজনের আয়োজন করা হয়। কেউবা ঘুরে বেড়ানোর জন্য পাহাড়কে বেছে নেয়। চলে যায় রাঙামাটি, বান্দরবান অথবা খাগড়াছড়ির সাজেক। কেউবা চলে যায় উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়ে ভারতের এভারেস্টের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সাথে বাংলাদেশ সীমানার চা -বাগান নয়তো মহানন্দাার সৌন্দর্য দেখতে।নানা ভাবে শীত চলে আসে কবিদের লেখায়, কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, কখনো ছড়ায়। প্রকৃতির নিয়মে ছয়টি ঋতুর মাঝে শীতও একটি ঋতু। আসুন সবাই উপভোগ করি শীতের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ার সাথে নতুন পিঠাপুলির স্বাাদ। বাঁচিয়ে রাখি ঋতুভিত্তিক সংস্কৃতিকে, কখনো চাদরে কখনোবা গরম কম্বলের উষ্ণতায়।
লেখক: আবৃত্তিকার ও উপস্থাপিকা।


প্রম্পট দিলেই লেখা—ডিজিটাল যুগের আলাদিনের চেরাগ চ্যাটজিপিটি

প্রফেসর ড. ইকবাল আহমেদ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

ডিজিটাল যুগে আমরা এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে লেখালেখি করা মানেই--আর মাথায় ব্যাথা ধরা, চোখে সর্ষে ফুল দেখা, ডেস্কে তিন কাপ চা জমে ক্ষীর হয়ে থাকা বা শেষ রাতে ‘এই লাইনটা আরেকবার লিখি?’—এই ধরনের আত্মসংকট আর নেই। লেখক-সাহিত্যিকদের পরীক্ষিত কষ্টগুলো এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। আর এই দায়িত্ব পালনে অগ্রণী ভূমিকায় থাকা চ্যাটজিপিটি কিংবা ডিপসিক যেন সেই বন্ধুটাই—যে বন্ধুর কাছে আপনি জাস্ট বলবেন, ‘একটু লিখে দে তো,’ সে হাসিমুখে বলবে ‘কিসের ওপর লিখতে চাও?’ এবং মুহূর্তের মধ্যে ঢেলেঢুলে সাজিয়ে-গুছিয়ে সব লিখে দেয়। ফলে চ্যাটজিপিটি, ডিপসিক কিংবা অন্যান্য এআই টুলস আজকের লেখকদের কাছে একরকম ডিজিটাল আলাদিনের চেরাগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো—চ্যাটজিপিটি ঠিক যেন সেই ছাত্র, যে খুবই মেধাবী, তবে কখনো কখনো গুগল-ঘেঁষা আত্মবিশ্বাসে ভুল তথ্যও দিয়ে বসে। আর তখন তাকে একটু বিশেষ কায়দায় সামলাতে হয়। তার মানে চ্যাটজিপিটিকে ব্যবহার করা মানে শুধু লেখা দিয়ে দেওয়া নয়; তাকে সঠিকভাবে, সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশনা দেওয়া—যাকে আধুনিক ভাষায় বলা হয় ‘প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং’ (Prompt Engineering)—এটাই হলো শিল্প, বিজ্ঞান এবং মাঝে-মাঝে খানিকটা পটানো-পাটানোর কৌশল।

এখন, আপনি যদি চ্যাটজিপিটি বা ডীপসিক ব্যবহার করতে চান যেকোনো কিছু লেখার জন্য—নিবন্ধ থেকে শুরু করে রিপোর্ট, প্রেমপত্র থেকে গবেষণাপত্র—সবই সম্ভব। তবে সঠিক প্রম্পট ছাড়া চ্যাটজিপিটি কিংবা ডিপসিক ঠিক সেই ওয়েটারের মতো, যে আপনার ‘চা দাও’ কথাকে কখনো ব্ল্যাক টি, কখনো মিল্ক টি আবার কখনো লেমন টি বানিয়ে এনে বলতে পারে—‘ভাই, নেন চা খান, এগুলোও তো চা!’ তাই প্রথম জরুরি কাজ হচ্ছে—স্পষ্ট নির্দেশ দিন। আপনি যদি লেখাটিকে ৩০০ শব্দে চান, সেটা বলুন। যদি পজেটিভ, নেগেটিভ ভঙ্গিতে চান, সেটাও উল্লেখ করুন। যদি উদাহরণসহ চান, সে কথাও লিখুন। আপনি যত স্পষ্ট বলবেন, চ্যাটজিপিটিও তত স্পষ্ট লিখবে। তাই প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং শুরুই হয় ‘স্পষ্টতা’ দিয়ে।

তারপর আসে বিস্তারিতভাবে লিখা নিয়ে। মানুষ যে কাজটা করতে গিয়ে ‘না বললেই নয়’ ধরনের ভঙ্গিতে লেখার সময় দুবার ভাবেন, চ্যাটজিপিটি সেখানে কোনো সংকোচ বোধ করে না। আপনি যদি বলেন ‘একটা ৫০০ শব্দের আর্টিকেল লিখো, তবে যেন লিখার স্টাইল পজেটিভ হয়, আবার যেন সেটা তথ্যভিত্তিক হয়’—চ্যাটজিপিটি সেটাই করবে। তাকে যত বেশি প্রসঙ্গ দেবেন, নির্দেশ দেবেন, তত বেশি আপনার মতো মনে হবে লেখা। অনেকেই রসিকতা করে বলেন—চ্যাটজিপিটি আসলে একে ‘দীর্ঘবাক্যপ্রেমী তথ্যভাণ্ডার’। সে কিছুতেই কম লিখতে চায় না, আর আপনি যত বলেন ‘কম লিখো,’ সে তত মনে করে ‘কম মানে কত?’। তাই তাকে নির্দিষ্টভাবে বলে দিতে হয়—ঠিক কত শব্দ, কোন ভঙ্গি, কোন শ্রোতা বা পাঠকের জন্য লিখতে হবে।

এবার আসা যাক ভুল তথ্য বা হ্যালুসিনেশন সমস্যা নিয়ে। চ্যাটজিপিটি অনেক সময় এমনভাবে ভুল তথ্য দেয়, যেন ছাত্র পরীক্ষায় আন্দাজ করে লিখেছে, কিন্তু লেখার ঢংটা এতই স্মার্ট যে শিক্ষকও ৫০% নম্বর দিতে বাধ্য। আপনি যদি কোনো তথ্য জানতে চান—যেমন কোনো তারিখ, বৈজ্ঞানিক তথ্য, পরিসংখ্যান—তখন চ্যাটজিপিটিকে দুটো জিনিস করতে বলুন, তথ্যের উৎস দিতে বলুন, এবং উৎস যাচাই করে দিতে বলুন। তারপরও যদি সে ভুল তথ্য দেয়, আপনি সহজভাবে বলুন—‘এ তথ্যটা সঠিক নয়, আবার চেক করে দাও।’ চ্যাটজিপিটি তখন মাথা চুলকানোর অভিনয় করে বলে, ‘ওহ, ভুল হয়েছিল, ঠিক করে দিচ্ছি।’ আসলে সে পিছনে দ্রুত নতুন তথ্য প্রসেস করে আপনাকে আপডেট দেয়।

তার মানে হলো—চ্যাটজিপিটিকে ভুল ধরিয়ে দেওয়াও এক ধরনের কথোপকথন (Dialog Engineering)। তাকে বলুন কোথায় ভুল, কীভাবে সংশোধন দরকার—সে তখন অনেক বেশি নির্ভুল হবে। কেউ কেউ বলেন—চ্যাটজিপিটি ভুল করলে তাকে বকা দিলে নাকি আরও ভালো কাজ করে! যদিও এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়, তবে তাকে ভদ্রভাবে বুঝিয়ে বললে সে সত্যি আরো সাহায্যকারী হয়ে ওঠে—এটা নিশ্চিত।

কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—চ্যাটজিপিটি আসলে কোনো যাদুকর নয়, সে আপনার মাথার চিন্তা পড়তে পারে না। তাই আপনি যদি অস্পষ্টভাবে বলেন, ‘একটা ভালো কিছু লেখো’—সে নিজের মতো করে ‘ভালো’ ঠিক করবে। ফলে তার সৃষ্ট ফলাফল অনেক সময় আপনার প্রত্যাশার সাথে মিলবে না। তাই লেখার ধরন, বিষয়, লক্ষ্য—সবকিছু আপনাকেই আগে থেকে ঠিক করতে হবে। আর ভুলে গেলে চলবে না—চ্যাটজিপিটি আপনার সহকারী, আপনার চিন্তার প্রসারক, কিন্তু আপনার জায়গা নেওয়ার জন্য নয়। আপনি তাকে বলবেন ‘কী লিখবে’, আর সে আপনাকে বলবে ‘কীভাবে লিখতে পারে’—এভাবেই সম্পর্কটা সিম্বায়োটিক।

এখন ধরুন, আপনি আরও উচ্চ পর্যায়ের প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং করতে চান। সেখানে কৌশল আরো সূক্ষ্ম। যেমন—‘তোমাকে আমি তিনটি ভূমিকায় দেখতে চাই: লেখক, সম্পাদক এবং তথ্যবিশ্লেষক। প্রতিটি ভূমিকায় আলাদা আউটপুট দাও।’ ‘একই বিষয় তিনটি স্টাইলে দাও—আনুষ্ঠানিক, রসাত্মক, সাংবাদিকতা-ধর্মী।’ অথবা ‘এটা আবার লিখ, তবে যেন গবেষকের লেখার মতো লাগে, বাক্যগঠন একটু তথ্য-ভিত্তিক হয়।’ এগুলোকে বলে মাল্টি-স্টেপ প্রম্পটিং বা রোল-বেসড প্রম্পটিং—যা চ্যাটজিপিটিকে আরও বেশি মানবসদৃশ আউটপুট দিতে সাহায্য করে। আরও আছে ‘কনস্ট্রেইন্ট-বেসড প্রম্পটিং’—যেটা খুব কাজে লাগে। যেমন, ‘৩০০ শব্দ, ৪ প্যারাগ্রাফ, প্রতিটি প্যারাগ্রাফে ৫টি বাক্য।’ কিংবা ‘কোনো টেকনিক্যাল টার্ম ব্যবহার করবে না।’ ‘শুরুতেই সুকান্তের একটি কবিতার লাইন থাকবে।’ এই ধরনের সীমাবদ্ধতা দিলে চ্যাটজিপিটি আরও বেশি নির্ধারিত পথে চলে।

তবে চ্যাটজিপিটি শুধু লেখা নয়—লেখা সম্পাদনা (editing) করতেও অসাধারণ। আপনি বাজে, এলোমেলো বা অসম্পূর্ণ লেখা দিলেও সে সেগুলোকে সাজিয়ে, গুছিয়ে এমনভাবে ফিরিয়ে দেয় যেন পুরো লেখাটাই জন্ম থেকেই খুব পরিপাটি ছিল। আবার চাইলে তাকে দিয়ে পুরো লেখার সারাংশ বের করা, ভাষা শোধরানো, ব্যাকরণ ঠিক করা, বানান ঠিক করা বা নির্দিষ্ট পাঠকের উপযোগী করে পুনর্লিখন—সবই করা যায়।

সব মিলিয়ে চ্যাটজিপিটি লেখকদের জন্য এক অনবদ্য সহায়ক টুল। এটি এমন এক ডিজিটাল সহকারী, যে ক্লান্ত হয় না, বিরক্ত হয় না, খাওয়া-দাওয়ার সময় চায় না—বরং যে কোনো সময়, যে কোনো বিষয়ে আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। তবে তার সবচেয়ে ভালো দিক হলো—সে আপনাকে লেখার কাজ সহজ করে দেয়, কিন্তু চিন্তার কাজ আপনার হাতেই রাখে! ফলে আপনার সৃজনশীলতাই আসল, চ্যাটজিপিটি কেবল এর গতি বাড়িয়ে দেয়।

তাই বলা যায়—আজকের দুনিয়ায় লেখালেখিকে আর একাকী যুদ্ধ মনে করার প্রয়োজন নেই। চ্যাটজিপিটিকে পাশে রাখুন, তাকে স্পষ্ট করে বলুন কী চান, ভুল ধরিয়ে দিন, প্রয়োজন হলে একটু শাসনও করুন—দেখবেন, সে আপনার লেখার সহকারী নয়, আসলে ‘সহকর্মী’ হয়ে উঠবে। আর তখন লেখালেখি হবে সহজ, দ্রুত, সময়সাশ্রয়ী এবং—সবচেয়ে বড় কথা—মজার! আর এখন শেষ কাজটি আপনাদের—খুঁজে বের করুন কয়টি বানান অশুদ্ধ হয়েছে আমার—তাকেই বলেছিলাম সব বানানগুলো চেক করে দেয়ার জন্য—চ্যাটজিপিটির ভুল ধরার দায়িত্ব যে আপনাদেরই!

লেখক: প্রফেসর ড. ইকবাল আহমেদ, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


নারায়ণগঞ্জ–কমলাপুর আধুনিক রেল লিংক: সময়ের কঠিন বাস্তবতায় এখনই প্রয়োজন দ্রুত উদ্যোগ

অধ্যাপক ড. মোখলেছুর রহমান
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

ঢাকার নিত্যদিনের যানজট এখন আর কেবল একটি ভোগান্তি নয়, এটি অগ্রগতির পথে স্থায়ী বাধা। বিশেষ করে ঢাকা–নারায়ণগঞ্জ করিডর দেশের অন্যতম ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ রুট, যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষ কর্মস্থল, ব্যবসা, চিকিৎসা কিংবা শিক্ষার উদ্দেশে যাতায়াত করেন। শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জের উৎপাদনশীলতা, আশপাশের অঞ্চলের বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবং রাজধানীতে সংযোগ, সব মিলিয়ে এই রুট দেশের অর্থনীতির জন্য বিরাট গুরুত্ব বহন করে। অথচ এ রুটের পরিবহন অবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই সীমাবদ্ধ, অনির্ভরযোগ্য এবং সময়ের সঙ্গে বেমানান।

এ কারণে নারায়ণগঞ্জ–কমলাপুর আধুনিক রেল লিংক প্রকল্পকে এখন আর বিলম্ব করা যায় না। এটি শুধু একটি পরিবহন উন্নয়ন নয়- বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, নাগরিক স্বস্তি এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য সিদ্ধান্ত।

প্রস্তাবিত আধুনিক রেল ব্যবস্থায় থাকবে মেট্রোরেলের মতো উন্নতমানের কোচ, ডিজিটাল টিকিটিং, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরামদায়ক যাত্রা, শব্দহীন চলাচল, উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- প্রতি ৩০ মিনিটে সময়নিষ্ঠ ট্রেন। দীর্ঘদিন ধরে যাত্রীরা যে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতেন, আধুনিক রেল লিংক তা পুরোপুরি দূর করবে। এটি হবে এক স্বস্তিদায়ক, দ্রুত এবং নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থা।

ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও ঢাকা–নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে বর্তমান যানবাহনের চাপ বহন করার মতো সক্ষমতা নেই। প্রতিদিন পণ্যবাহী ট্রাক, যাত্রীবাহী বাস, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের ভিড়ে সড়ক যেন কোনোভাবে টিকে আছে। শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা প্রায়ই দেরিতে কর্মস্থলে পৌঁছান, ব্যবসায়িক কাজ বাধাগ্রস্ত হয়, এবং পণ্য পরিবহনে বিলম্বের কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অবস্থায় নতুন রেল লিংকই হতে পারে সবচেয়ে দ্রুতগামী ও কার্যকর সমাধান।

এই রেল লিংক বাস্তবায়িত হলে নারায়ণগঞ্জ, গজারিয়া, মতলব, মুন্সীগঞ্জসহ বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষ নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবেন। দিনে হাজার হাজার মানুষ দ্রুত, নিরাপদ এবং আরামদায়কভাবে ঢাকায় পৌঁছাতে পারবেন। সময় সাশ্রয় মানে অর্থনৈতিক লাভ। শিল্পকারখানার উৎপাদনশীলতা বাড়বে, ব্যবসায়িক যোগাযোগ উন্নত হবে, এবং কর্মজীবী জনগোষ্ঠীর জীবনমান নাটকীয়ভাবে উন্নত হবে।

সরকারের জন্যও এটি হবে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত বিনিয়োগ। রাজস্ব আয় বাড়াতে আধুনিক রেল লিংক হবে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। টিকিট বিক্রি, স্টেশনভিত্তিক দোকান, বিজ্ঞাপন, পার্সেল সেবা এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম থেকে সরকারের আয় বাড়বে বহুগুণে। তাছাড়া কম গাড়ি রাস্তায় চলার ফলে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও কমে আসবে। দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, কারণ রেলভিত্তিক পরিবহন জ্বালানি খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়।

পরিবেশগত দিক থেকেও এই প্রকল্প হবে যুগান্তকারী। ঢাকার বায়ুদূষণ ইতোমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ শহরগুলোর একটি হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন অসংখ্য গাড়ির ধোঁয়া, শব্দদূষণ এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রা নগরের বাসিন্দাদের জীবনমানকে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আধুনিক রেল সেবার মাধ্যমে হাজার হাজার গাড়ি সড়ক থেকে কমে গেলে, বায়ুর গুণমান উন্নত হবে এবং নগরের পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা দেবে।

শুধু পরিবহন নয়, এ রেল লিংক অঞ্চলজুড়ে নতুন অর্থনৈতিক করিডর তৈরি করবে। নারায়ণগঞ্জ–ঢাকা–মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলের মধ্যে ত্রিমুখী সংযোগ ব্যবসা-বাণিজ্যকে আরও গতিশীল করবে। নতুন বিনিয়োগ, নতুন শিল্পাঞ্চল, ছোট-বড় ব্যবসা—সবকিছুরই প্রসার ঘটবে। দেশের প্রতিটি উন্নত অঞ্চলের পিছনে থাকে শক্তিশালী পরিবহন ব্যবস্থা; এই রেল লিংক সেই ভিত্তি স্থাপন করবে।

এখন প্রশ্ন হলো- আর কতদিন আমরা সড়কভিত্তিক যানজটের দড়িতে আটকে থাকব? উন্নয়নের গতিকে কতদিন ধরে রাখবে পুরোনো পরিবহন কাঠামো? দেশের পরবর্তী প্রজন্ম কি আধুনিকতা, দক্ষতা এবং প্রযুক্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকবে? উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখি—তাদের উন্নয়ন রেলের ওপর দাঁড়িয়ে। দ্রুত, নিরাপদ, প্রযুক্তিনির্ভর রেল ব্যবস্থা ছাড়া কোনো দেশই দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে সফল হয়নি। বাংলাদেশও সেই পথে হাঁটছে। মেট্রোরেল তার প্রমাণ। কিন্তু উন্নয়ন এখানেই থেমে থাকতে পারে না। নারায়ণগঞ্জ–কমলাপুর আধুনিক রেল লিংক সেই ধারাবাহিকতার অংশ, যা একদিকে ঢাকার ওপর চাপ কমাবে, অন্যদিকে জাতীয় অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।

এ প্রকল্প যত দ্রুত বাস্তবায়িত হবে, দেশ তত দ্রুত উপকৃত হবে - মানুষের সময় বাঁচবে, দেশের অর্থনীতি বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচবে। এখন আর অপেক্ষা নয় - সময়ের দাবি পূরণে আধুনিক রেল লিংক বাস্তবায়নে এগিয়ে আসা ছাড়া বিকল্প নেই। যারা প্রতিদিনের যানজটে ক্লান্ত, যারা উন্নয়ন চায়, যারা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন - তাদের সবার দাবি একটাই: উন্নত, আধুনিক, সময়নিষ্ঠ রেল যোগাযোগ- এখনই চাই।

লেখক: পরমাণবিক ও প্রকৌশল বিভাগ, এমআইএসটি, ঢাকা।


বাম্পার ফলন সত্ত্বেও চালের দামে আগুন

ওসমান গনি
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী, যখন কোনো পণ্যের উৎপাদন বা সরবরাহ বাড়ে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার দাম কমে আসার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের চালের বাজার যেন সেই চিরাচরিত সূত্রকে বরাবরই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছে। প্রতি বছরই, বিশেষ করে আমন ও বোরো মৌসুমে, যখন কৃষকের মাঠে বাম্পার ফলন হয় এবং নতুন ধানের গন্ধে গোলা ভরে ওঠে, তখনও চালের দাম কেবল স্থির থাকে না, বরং অনেক সময় উল্টো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। এটি শুধু অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় নয়, এটি দেশের কোটি কোটি সাধারণ ভোক্তা, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য এক চরম ভোগান্তির কারণ। প্রশ্ন হলো, বাম্পার ফলন এবং সরকারের গুদামে রেকর্ড পরিমাণ মজুত থাকা সত্ত্বেও চালের দামে এই অস্বাভাবিক অস্থিরতা ও ক্রমাগত বৃদ্ধি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বাজারের সরবরাহ শৃঙ্খলের গভীরে লুকিয়ে থাকা 'অদৃশ্য সিন্ডিকেট'-এর কারসাজির বিষয়টি সামনে চলে আসে।

সাম্প্রতিক সময়ে চাল ব্যবসায় কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর প্রবেশ এই সিন্ডিকেটকে আরও শক্তিশালী করেছে। তারা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে বা তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ধান কিনে মজুত করে। এরপর সেই চাল প্যাকেজিং করে ‘ভিআইপি চাল’ বা ব্র্যান্ডেড চাল হিসেবে চড়া দামে বাজারে ছাড়ে। এই প্রক্রিয়ায় একদিকে যেমন খোলা বাজারের চালের সরবরাহ কমে যায়, তেমনি প্যাকেজিং করা চালের উচ্চমূল্য সাধারণ চালের দামকেও প্রভাবিত করে ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে।

বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদদের মতে, এই সংকটের মূলে রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা। প্রথমত, কৃষি উৎপাদিত ফসলের সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যে অনেক সময় গরমিল দেখা যায়, যার ফলে বাজার সম্পর্কে সঠিক চিত্র পাওয়া যায় না। মজুতদাররা এই অনির্ভরযোগ্য তথ্যের সুযোগ নিয়ে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় কারসাজি করে। দ্বিতীয়ত, সরকারের মনিটরিং ও বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। চালের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার বিভিন্ন সময় শুল্ক প্রত্যাহার বা আমদানি শুরুর মতো পদক্ষেপ নিলেও মজুতদারদের লাগাম টেনে ধরার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইনের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগ দেখা যায় না। বাজারে কে কতটুকু ধান বা চাল মজুত করতে পারবে, সে বিষয়ে আইনি কাঠামো থাকলেও তার বাস্তবায়ন অনেকটাই শিথিল। মজুতদারদের সিন্ডিকেট ভাঙতে অভিযান অব্যাহত রাখার কথা বলা হলেও, বাজারে তার স্থায়ী প্রভাব খুব কমই দেখা যায়।

চাল উৎপাদনের বিশ্ব তালিকায় বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে থাকা সত্ত্বেও যদি ভরা মৌসুমেও দামের এই লাগামহীন বৃদ্ধি চলতে থাকে, তবে তা সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কঠোর পদক্ষেপ অপরিহার্য। কেবল ফলন বাড়লেই হবে না, সেই ফলনের সুফল যেন মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে না গিয়ে সরাসরি ভোক্তা ও কৃষকের কাছে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

আমন ধানের বাম্পার ফলন সত্ত্বেও চালের দামে লাগাম টানতে না পারাটা স্পষ্টত দেশের খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল ও বাজার ব্যবস্থাপনার গভীর দুর্বলতাকেই নির্দেশ করে। এটি কেবল অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় নয়, বরং দেশের কোটি কোটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের ওপর নেমে আসা এক অসহনীয় দুর্ভোগ। একদিকে কৃষকরা পাচ্ছেন না তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য, অন্যদিকে ভোক্তারা সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চড়া দামে চাল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। মিলার, মজুতদার এবং করপোরেট কোম্পানিগুলোর সমন্বয়ে গঠিত এই ‘অদৃশ্য সিন্ডিকেট’ বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে।

এই চক্র ভাঙতে হলে সরকারকে দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, মজুতদারি নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং নিয়মিত বাজার তদারকি অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, কৃষি উৎপাদন ও মজুত সংক্রান্ত তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কারসাজির সুযোগ কমে আসে। এবং তৃতীয়ত, সরকারের খাদ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করে কৃষকের ন্যায্য দাম এবং দরিদ্র মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। বাম্পার ফলনের সুফল জনগণের ঘরে পৌঁছে দিতে না পারলে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


পার্বত্য শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা

রেজাউল করিম খোকন
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সম্পাদকীয়

১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠে। এই দাবিতে ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং ১৯৭৩ সালে সংগঠনেটির সশস্ত্র শাখা কথিত শান্তিবাহিনী গঠন হয়। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এক পর্যায়ে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (কথিত শান্তি চুক্তি)। এটি পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। চুক্তির আওতায় গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ১টি শক্তিশালি (ভারতের অঙ্গরাজ্যের আদলে) আঞ্চলিক পরিষদ, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু বিষয়ক টাস্কফোর্স এবং ৩ জেলায় ৩ টি সায়ত্ত্বশাসিত পার্বত্য জেলা পরিষদ। ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) মোট জনসংখ্যা ছিল ১৮,৪২,৮১৫ জন। তবে ধারণা করা হচ্ছে এ জনসংখ্যা এখন ২০ লাখের মত। যা দেশের ১১.১৯ শতাংশ আয়তনের মধ্যে ১.১৬ শতাংশ মানুষের বসবাস। জনশুমারির হিসাব মতে এর মধ্যে: উপজাতি মোট: ৯,২০,২১৭ জন (৪৯.৯৪%) এবং বাঙালি ৫০.০৬ শতাংশ তথা ৯,২২,৫৯৮ জন। শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে৷ এর মূল কথা কথা ছিল, পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং সেজন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হবে৷ উপজাতীয় আইন এবং সামাজিক বিচারকাজ এই পরিষদের অধীনে থাকবে; পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা; উপজাতীয়দের ভূমি মালিকানা অধিকার ফিরিয়ে দেয়া; পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা ইত্যাদি৷ শান্তি চুক্তির ধারাবাহিকতায় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সে অঞ্চলে গঠন করা হয়েছে৷ পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারহীনতা কোনো বিচ্ছিন্ন বাস্তবতা নয়। এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক অনীহার সমন্বিত ফল। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সত্ত্বেও পাহাড়ে যে সহিংসতা, ভূমি দখলের সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে, তা এ বিচারহীনতাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে পাকিস্তান আমলে। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে স্বাধীনতার পরও। এ বিচারহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা দূর করতে পার্বত্য চুক্তির ধারাগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন, ভূমি কমিশনের পুনঃসক্রিয়করণ ও একটি স্বাধীন মানবাধিকার তদন্ত কমিশন গঠন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়৷ কিন্তু আমরা বরাবরই রাজনৈতিক নেতাদের অনাগ্রহ দেখেছি৷ আসলে শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি৷ তাহলেও কিছুটা শান্তি সেখানে মিলতে পারে৷ শান্তি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় গত ২৬ বছরে ছয়টি আঞ্চলিক দলের সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ে ৷ এসব দল নিজেরাও অভ্যন্তরীণ বিরোধেও জড়াচ্ছে ৷

পাহাড়ের অন্যতম সমস্যা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০১ সালে গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন৷ এ পর্যন্ত ছয়বার কমিশনের চেয়ারম্যান পরিবর্তন হলেও ভূমি বিরোধ সমস্যা সমাধানে কোনো সফলতা আসেনি৷ শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নয়৷ এখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যুক্ত৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিষয়টির সমন্বয় করে থাকে৷ ফলে কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে সেটা বলা মুশকিল৷ সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থাকা সন্ত্রাসীদের হাতে স্বাধীনতার পর থেকে চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে নিহত, আহত ও অপহরণ কিংবা নিখোঁজের শিকার হয়েছেন অন্তত ৮ হাজার ১৪০ জন৷ নিহতদের মধ্যে ১ হাজার ১৩৮ জন পাহাড়ি৷ বাঙালি আছেন ১ হাজার ৪৪৬ জন৷ এই সময়ে বিভিন্ন বাহিনীর ৩৮০ জন সদস্য নিহত হয়েছেন ৷ আর শান্তি চুক্তি হওয়ার পরও ৮৯৯ জন পাহাড়ি, ৩৯০ বাঙালি এবং সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর ২৬ জনসহ ১ হাজার ৩১৫ জন নিহত হয়েছেন৷ আহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৮২৩ জন৷ চুক্তি পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ১৯৮ জন৷ কিন্তু কোনো ঘটনারই দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়নি৷ সংঘাত এড়াতে পার্বত্য জেলাগুলোর পাড়া-মহল্লায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের নিয়ে বৈঠক করছে জেলা প্রশাসন৷ গঠন করা হয়েছে একাধিক সম্প্রীতি কমিটিও৷

পাহাড়ে যেটা হচ্ছে, সেটা শোভন নয়৷ আমরা সেখানে আর কোনো রক্তপাত দেখতে চাই না৷ আমরা এটাও চাই না যে, নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে কেউ মৃত্যুবরণ করুক৷ অন্তর্বর্তী এই সরকারে পাহাড়ের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা৷ আমরা আশা করি, এখন যিনি সরকারপ্রধান তিনি শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন৷ ফলে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবেন৷ তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন৷ প্রশাসনিক কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় জনগোষ্ঠির নেতৃবুন্দের হাতেই প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। অন্যদিকে বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব তুলনামূলকভাবে দুর্বল, বিশেষ করে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিষদগুলোতে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনটি মূল স্তম্ভের উপর। যথা- এক. প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বা বিনা নির্বাচনে পরিচালিত পরিষদগুলোর গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন। দুই. নিরাপত্তার ভারসাম্য বা সেনা উপস্থিতি যেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, শাসন নয়। তিন. সামাজিক সংহতি বা উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা ও অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
বিশেষ অঞ্চল হিসেবে নিরাপত্তার বাস্তবতায়, সেনাবাহিনী দৃশ্যমান হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত আইন ও কাঠামো অনুযায়ী, উপজাতীয় নেতৃত্বই এখানে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আরও সহজভাবে বললে- পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন করছে উপজাতিরাই। তবে সংখ্যায় অর্ধেক জনসংখ্যা হলেও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে, বাঙালিরা প্রান্তিক। এই বাস্তবতা থেকেই উঠে আসে দ্বন্দ্ব, অভিযোগ, এবং ‘সেনা শাসন বনাম উপজাতীয় আধিপত্য’ বিতর্ক। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে গণতন্ত্র, সংলাপ ও সমতার ভিত্তিতে একটি নতুন কাঠামো নির্মাণের উপর। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাস ও হত্যার ইতিহাস দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক: খাগড়াছড়িতে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনা তারই অংশ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’ হিসেবে পরিচালিত হওয়ার ফলে এই অঞ্চল সরাসরি ব্রিটিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। তখন স্থানীয় পাহাড়ি রাজা ও সম্প্রদায়কে আঞ্চলিক শাসনের অধিকার দেওয়া হয়। জমির মালিকানা ও প্রশাসনিক ক্ষমতা মূলত উপজাতীয় সমাজের হাতে রাখা হয়। ফলে তাদের সামাজিক কাঠামো ও স্বায়ত্তশাসন মজবুত ছিল। ব্রিটিশ শাসন শেষে পাকিস্তান আমলেও পার্বত্য অঞ্চলে প্রশাসনিক অবহেলা, বৈষম্য ও শোষণ চলতে থাকে; সেই সময় কেন্দ্রীয় শাসন স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে ‘বিভক্ত করো ও শাসন করো’ নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এর ফলে জমি দখল, প্রশাসনিক নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেড়ে সামাজিক অস্থিরতার ভিত্তি গড়ে ওঠে এবং পর্যায়ক্রমে সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে; কখনো তারা নিজস্ব জাতিগত স্বার্থ রক্ষা করতে, আবার কখনো বাইরের রাজনৈতিক প্রভাবে হত্যা, অপহরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে। ১৯৬০-এর দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে হাজার হাজার চাকমা ও অন্যান্য পাহাড়ি জনগণ বাস্তুচ্যুত হয়; অনেকেই ভারতে ও মিয়ানমারে আশ্রয় নেয়। এই বাস্তুচ্যুতি পার্বত্য অঞ্চলে সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে এবং বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে গভীর অসন্তোষের বীজ বোনা হয়। স্বাধীনতার পরেও পরিস্থিতি পালটায়নি। পার্বত্য শান্তি নামক দেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী কালো চুক্তি বাতিল করা অথবা পার্বত্য সমস্যার পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করে চুক্তি বা নীতি-নবায়ন করা, যেখানে প্রয়োজন হলে ১৯৯৭ সালের চুক্তির দুর্বলতা শনাক্ত করে জনগণের অংশগ্রহণমূলক, বাস্তবভিত্তিক ও ন্যায্য কাঠামোর আওতায় নতুন সমঝোতা গঠন করা হবে। জনগণের আস্থাভিত্তিক নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রকে শক্ত মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু সেই শক্তি প্রয়োগ মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবায়ন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ; এখানে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও বাঙালি-সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং সবার অধিকার সমান। যে কোনো বিভাজনমূলক শব্দ বা ধারণা জাতীয় ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি; তাই রাষ্ট্র ও সমাজকে মিলেই কাজ করতে হবে, যাতে পাহাড়ে নিরাপত্তা, ন্যায্যতা ও উন্নয়ন একসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করেছে যে, সীমান্তের উভয় পাশে সংঘর্ষ-প্রবণতা ও স্বাধীনতাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রয়েছে। তাই সীমান্ত তত্ত্বাবধান আরো জোরদার, গোপনীয় গোয়েন্দা তথ্য কার্যকরভাবে ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার উৎস নির্ণয় ও সমাধান করা দরকার। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলনকে দেশের সবার অধিকার আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে হবে। আদিবাসীরাও এ দেশের মূলধারার মানুষ। তারাও এ দেশের নাগরিক। পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে হলে সেনাবাহিনীর সদিচ্ছা জরুরি বলে মনে করি। এই দেশে কোনো সরকারের কোনো এখতিয়ার ছিল না আদিবাসী অধিকার রক্ষা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। ছিল না, এখনো নাই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যদি শান্তি ফেরাতে পারে, তাহলে পার্বত্য অঞ্চলে কেন তারা সে উদাহরণ তৈরি করতে পারবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একমাত্র শক্তি, তাদের যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি সম্ভব। ১৯৯৭ সালে চুক্তির পর আমরা ভেবেছিলাম একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। চুক্তির কোন অংশ কখন বাস্তবায়ন করা হবে এ রকম সময় নির্ধারণ করা ছিল না। রাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর যে জীবনধারা, তাদের যে মানবাধিকার, ভূমি অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার, নাগরিক অধিকারকে আমরা স্বীকার করতে চাই না। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তির খোঁজে প্রায় ২৭ বছর আগে শান্তি চুক্তি হয়েছিল৷ কিন্তু শান্তি ফেরেনি৷ এখনও পড়ছে লাশ, ঝড়ছে রক্ত ৷ শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচারই পারে পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে৷ এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ৷

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলামিস্ট।


banner close