বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

তৃতীয় ধারার জনগণই বেশি শক্তিশালী

এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশিত
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশিত : ৭ ডিসেম্বর, ২০২২ ০৯:০০

অনেক বছর আগের কথা। যখন রাজনীতির নানা পঙ্‌ক্তিমালা সম্পর্কে আমার ধারণা তেমন স্বচ্ছ ছিল না। তখন বিস্মিত হতাম স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সময়। প্রার্থীদের পোস্টার দেখে বিস্ময়টি বড় হতো। অমুক ভাইকে চেয়ারম্যান বা মেম্বার পদে ভোট দিন। পোস্টারের নিচে লেখা হতো, ‘প্রচারে নির্বাচনী এলাকার জনগণ’। প্রশ্ন জাগত, নির্বাচনী এলাকার সব ভোটার যদি এই প্রার্থীকেই চায় তাহলে আর প্রচারের প্রয়োজন কি! তিনি তো জিতেই আছেন। পরে দেখি তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রচারেও রয়েছে সব জনগণ। পরে বুঝলাম এভাবে প্রার্থীরা জনগণের নাম ভাঙিয়ে প্রচারণা চালান। বিষয়টি আমার কাছে একধরনের প্রতারণা মনে হতো। এ ধারার এখনো কোনো পরিবর্তন হয়নি।

পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকের শুরুর দিকের কথা। প্রথম পর্বটি আব্বার মুখে শোনা। শেষ অধ্যায়ের ছবি কিছুটা নিজের স্মরণে থাকা। আইয়ুব খানের বুনিয়াদি গণতন্ত্রে (বেসিক ডেমোক্রেসি) চলছিল দেশ। এই অদ্ভুত গণতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে বেশ সমালোচিত। তারপরও এই বুনিয়াদি গণতন্ত্রী তৃণমূলের নেতারা জনগণের জন্য নিবেদিত ছিলেন। আব্বার মামাকে আমরা প্রেসিডেন্ট দাদা নামেই চিনতাম। তার জীবন সায়াহ্নটা আমার দেখা। তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট (চেয়ারম্যান) ছিলেন। বিক্রমপুরের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার কোনো একটি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। আজীবন অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বিস্তর জমিজমা ছিল তার। সরকারি বরাদ্দের বাইরেও নিজের জমিজমা বিক্রি করে জনগণের দুঃখ ঘোচানোর চেষ্টা করতেন। পরিণতি হিসেবে তিনি তার ছেলেদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি। আমার চাচারা কায়ক্লেশে স্বজনদের সহযোগিতায় বড় হয়েছেন।

এসব শুনে ও দেখে মনে হতো রাজনৈতিক নেতারা ঈশ্বরের বরপুত্র। নানা ত্যাগ স্বীকার করে তারা জনকল্যাণ করতে চান। আবার নির্বাচনের সময় যখন একটি পদের জন্য একাধিক প্রার্থী দাঁড়ান তা দেখে আবেগে চোখের পাতা ভিজে যেত। আহা সমাজের কত মানুষ আছেন যারা জনগণের সেবা করার জন্য স্বেচ্ছায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

ধীরে ধীরে ধারণা পাল্টে যেতে থাকল। জনবিচ্ছিন্ন, সাধারণ মানুষের খুব আপনজন নন, এমন প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি সামনের সারিতে আসেন নির্বাচনে। ভালোবেসে জনগণ সমর্থন দেবে এই আত্মবিশ্বাস থাকে না বলে জেতার জন্য অর্থ ছড়ান আর পেশিশক্তি ব্যবহার করেন নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে। ক্ষমতা থাকলে প্রশাসনকেও ব্যবহার করেন। এভাবে নির্বাচিত হন তারা। এখনকার প্রার্থীদের বড় অংশ আগে থেকেই জনবিচ্ছিন্ন, নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হওয়ার পরও জনগণের কাছে অধরা হয়ে যান। এসব কারণে এখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে এমপিদের উল্লেখযোগ্য অংশ নির্বাচনী এলাকা ছেড়ে শহরে বিলাসী জীবনযাপন করতে বেশি পছন্দ করেন। জনপ্রতিনিধির তকমা গলায় ধারণ করে ব্যক্তিগত লাভালাভ নিয়ে অনেকে ব্যস্ত থাকেন। আমার প্রেসিডেন্ট দাদার মতো জননেতারা জনকল্যাণ করে নিঃস্ব হতে পছন্দ করতেন, আর এখনকার জনপ্রতিনিধিদের বড় অংশ ফুলে-ফেঁপে ঢোল হন আর উত্তরাধিকারীদের জন্য বিপুল বিষয়-বৈভব রেখে যান। এখন তো প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর নেতারা ক্ষমতা পেতে আর ধরে রাখতে নিজেদের অবস্থান গৌরব আর ব্যক্তিত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাজনৈতিক ঝগড়াকে কৌতুকে পরিণত করছেন।

সম্প্রতি নির্বাচন সামনে বলে রাজনৈতিক ঝগড়া তুঙ্গে। নেতাদের শব্দচয়ন আর কণ্ঠভঙ্গিকে পরিশীলিত বলা যাবে না। হতাশ হয়ে ভাবি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিস্ময়কর ত্যাগ স্বীকার করে দেশ স্বাধীন করেছে যে জাতি; দূরদর্শিতা আর অক্লান্ত পরিশ্রম করে অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিশ্ব দরবারে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন সেখানে একশ্রেণির নেতা তাদের অপরিশীলিত নিম্নমানের শব্দ প্রয়োগে ঝগড়া করে এবং তা আবার গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে নোংরা করছেন দেশের গৌরবময় ক্যানভাস। জনগণের কষ্টে পাশে না দাঁড়ানো মানুষগুলো নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য জনগণের নাম ভাঙানোর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। তাদের প্রতিদিনের বক্তৃতা শুনলে মনে হয়, দেশে এখন তিন ধারার জনগণ রয়েছে। একটি আওয়ামীপন্থি জনগণ, একটি বিএনপিপন্থি জনগণ আর তৃতীয় ধারার আরেকটি জনগণ। ‘জনগণ’ শব্দটি এতকাল অবিভাজ্য থাকলেও নেতারা রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিভাজিত করে ফেলছেন প্রতিদিন। এতে সাধারণ মানুষ আগে বিস্মিত হতো,Ñএখন বিরক্ত হয়। ভাষা-ভাষণে এখন নির্বাচনী মাঠ মারদাঙ্গা হয়ে উঠছে যেন। বিএনপি নেতারা যখন বলেন তারা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন গড়ে তুলবেন। অথবা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ‘আওয়ামী সন্ত্রাসীদের’ প্রতিরোধ করবেন। তখন মনে হবে দেশের সব জনগণ বিএনপি দলের পেছনে। এসব দেখে এবং শুনে একজন রাজনৈতিক সমালোচক চমকে যেতে পারেন। ভাববেন এ কী করে সম্ভব! যে দল এখনো প্রকাশ্যে তারেক রহমানকে নিজেদের দলনেতা হিসেবে পরিচয় দেয়। যিনি দুর্নীতিগ্রস্ত ও অর্থ পাচারকারী হিসেবে পরিচিত, জঙ্গি ও জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতা করে ক্ষমতার একচ্ছত্র নায়ক হতে চেয়েছেন। যিনি দেশের আদালতে সাজাপ্রাপ্ত আসামি, রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে দেশ ত্যাগ করে নিজেকে বাঁচিয়েছেন; তেমন নেতৃত্বের গণ্ডিতে কিসের মোহে আর ভালোবাসায় জনগণ পাশে দাঁড়াবে! তাহলে বোধ হয় এ ধারার জনগণ বিএনপি নেতাদের কল্পিত জনগণের অংশ, দলীয় বৃত্তে বন্দি জনগণ। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতিতে বিধ্বস্ত মানুষ, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত তারা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের কঠিন সময় পার করছে এ দেশবাসী, অঙ্কের হিসাবে দেশের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে, কিন্তু এর বড় অংশ চলে যাচ্ছে ক্ষমতাবানদের ঝুড়িতে। এমন বাস্তবতায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের উদাহরণ বাজারে-বিধ্বস্ত মানুষের কঠিন বস্তুগত জীবনে তেমন প্রভাব ফেলছে না। তাই প্রতিদিনের বক্তৃতা ও দেহ-ভাষায় সরকারি দলের নেতাদের তেমন সপ্রতিভ মনে হচ্ছে না। বিএনপির বিভাগীয় জনসভা দুর্বল করতে অপ্রয়োজনে বারবার পরিবহন মালিকদের দিয়ে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে কেন যে আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের দুর্বলতার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। এখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ নেতারাও জনগণের নাম ভাঙাচ্ছেন। বিএনপি নেতারা যেমন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন করবেন, তাদের ভাষায় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করবেন, তেমনি আওয়ামী লীগ নেতাদের জবানীও অনেকটা এক। তারাও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির সন্ত্রাস ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।

এসব দেখে ১৩ শতকের বাংলার ইতিহাসের একটি বাস্তব চিত্র মনে পড়ল। সেই সময় সবে মুসলমান আক্রমণকারীরা দিল্লি অধিকার করেছে। পত্তন ঘটেছে স্বাধীন সুলতানি শাসনের। দিল্লির সুলতানরা সেনাপতি পাঠিয়েছেন বাংলা জয় করতে। অনেক গভর্নরই বাংলার ক্ষমতায় বসে নিজ সুলতানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন। সে যুগের নিজেদের শাসন বৈধ বোঝাতে সুলতানরা বাগদাদের খলিফার কাছ থেকে সনদ আনতেন। আর নিজ মুদ্রায় খলিফার নাম ব্যবহার করে জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য প্রচার করতেন। কিন্তু মুশকিল হলো দিল্লির সুলতান ইলতুতমিশ তার নামাঙ্কিত মুদ্রায় খলিফার নাম ব্যবহার করলেও একই সময় বাংলায় তার বিদ্রোহী সেনাপতি গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ খলজি স্বাধীন সুলতান হিসেবে নিজ নামে মুদ্রা প্রচারের সঙ্গে খলিফার নাম ব্যবহার করেন। বাগদাদের খলিফার একই সঙ্গে দিল্লির সুলতান ও তার বিদ্রোহীকে সনদ দেয়ার কথা নয়। তাই গবেষকরা মনে করেন জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইওয়াজ খলজি জাল সনদ ব্যবহার করছেন।

এখন আমাদের অবস্থা আরও জটিল। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষই দাবি করছে জনগণ তাদের পক্ষে আছে। জনগণের পক্ষ কোনটি তা জানার একমাত্র উপায় সহি হ্যাঁ-না ভোট। তেমন কোনো আয়োজন তো এ দেশে হয়নি। তাহলে জনগণের নাম ভাঙাচ্ছেন কোন তথ্যের ভিত্তিতে। জনসভায় লোকসমাগম দেখে কোনো পক্ষেরই আহ্লাদিত হওয়ার কিছু দেখছি না। প্রকৃত জনগণ জানেন, সব পক্ষের জনসভায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কমন জনগণ থাকে। দলগুলোর নেতারা জানেন এসব জনসমাগম ঘটাতে কী পরিমাণ অর্থ ছড়াতে হয়। তার পরও নেতারা জনগণ জপ করেন। আমি বিশ্বাস করি অতি সাধারণ জনগণও এসব বোঝে। তবুও সব পক্ষের নেতা গ্রাম্যতায় ভরা সাতপুরোনো রাজনৈতিক আচরণ থেকে বেরুতে পারছেন না।

আমরা মনে করি তথাকথিত বিএনপির জনগণ ও আওয়ামী লীগের জনগণকে বাদ দিয়ে এ দেশের প্রকৃত জনগণ যারা আছেন তারা বায়বীয় নন বলে তারাই প্রকৃত শক্তিশালী। তারা দলীয় আজ্ঞাবহ নন। নিজেদের বিবেক ও বিবেচনাবোধকে তারা নির্বাসনে পাঠাননি। দেশপ্রেমিকতা তাদের সঠিক পথ দেখায়। কিন্তু কণ্ঠশীলন করা নেতারা এসব জনগণের কাছে যান না, তাদের পাশে দাঁড়ান না। দাম্ভিকতা ও অসততার শক্তি দিয়ে রাজনীতির ঘূর্ণাবর্ত অতিক্রম করতে চান, যা অনেকটাই দুরূহ।

আমাদের মনে হয়, নির্বাচনের ওয়ার্মআপের মাঠে প্রতিদিন খেলাখেলির রাজনীতি জনগণের সামনে এনে নিজেদের খেলো না করে মেধাবী ও গণতান্ত্রিক শব্দ প্রয়োগে একটি আধুনিক ও স্মার্ট দেশের মানুষ হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করুন। আর মাথায় রাখুন একে অন্যকে যতই পেশিশক্তির হুমকি দেন, বেলা শেষে প্রমাণ পাবেন তৃতীয় ধারার এই দেশপ্রেমিক জনগণই প্রকৃত শক্তিশালী।

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


মাটির ঘর

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আলমগীর খোরশেদ

শান্তিময় আবাহ, সুজলা, সুফলা, সবুজে ছেয়ে থাকা, গ্রাম-বাংলার একটি প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন হলো মাটির ঘর। লাল মাটির এলাকাগুলোতে মাটির ঘর বেশি পাওয়া যায়। এমন একদিন ছিল, সারা গ্রাম হেঁটে এলেও কোনো টিনের ঘর পাওয়া যেত না। একটু অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থবাড়িতে দোচালা টিনের অথবা অঞ্চলভিত্তিক মাটির ঘর চোখে পড়ত। দৃষ্টিনন্দন এসব মাটির ঘর শহরের চার দেয়ালে থেকে দেখা যাবে না, দেখতে হলে চলে যেতে হবে দূরের গ্রামে। যেখানে যান্ত্রিকতা এখনো শেষ করে দেয়নি মানুষের মন ও মানবতাকে। গ্রামে এখনো মানুষের ঘুম ভাঙে পাখ-পাখালির কলরবে। সকালে গোয়াল ঘরে বেঁধে রাখা গাভীর বাছুরটির চিৎকারে।

আগে গ্রামাঞ্চলে খুব ডাকাতি হতো। বিত্তবান গৃহস্থরা তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করে মাটির তৈরি দোতলা ঘর তৈরি করাতেন এবং নিজে দোতলায় থাকতেন। তৎকালীন সময়ে বিত্তবানদের শৌখিন ও আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে তৈরি হতো মাটির ঘর। ভূমিকম্পে মাটির ঘরের খুব একটা ক্ষতি হয় না। যত্ন নিলে মাটির ঘর এক থেকে ১৫০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। মাটি দ্বারা তৈরি এসব ঘরগুলোকে বলা হয় ‘শান্তির নীড়’ বা (বালাখানা)। অনেক সময় নিয়েও ব্যয় সাপেক্ষ মাটির ঘর যারা বানান, তাদের বলা হয়, ‘দেল বারুই’। বসবাসের জন্য আরামদায়ক মাটির ঘর, এঁটেল বা আঁঠাল মাটিকে কাদায় পরিণত করে তিন থেকে চার ফুট চওড়া দেওয়াল তৈরি করা হয়।

এক তলা মাটির বাড়ির জন্য বারো থেকে চৌদ্দ ফুট উঁচু দেয়ালে বাঁশ কাঠ বা লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে সিলিং তৈরি করে তার ওপর টিনের ছাউনি দেওয়া হয়। আর দোতলা বাড়ির জন্য তেরো থেকে পঁচিশ ফুট উঁচু দেওয়াল তৈরি করে তেরো ফুটের মাঝে তালগাছের ফালি দিয়ে পাটাতন তৈরি করে দুই থেকে তিন ইঞ্চি মোটা কাঠের ছাউনি দেওয়া হয়। তারপর পঁচিশ ফুটের মাথায় একতলা বাড়ির মতো টিনের ছাউনি দেওয়া হয়। ময়মনসিংহের ভালুকা, ত্রিশাল, গাজীপুর ও সিলেট এলাকায় মাটির ঘর এখনো দেখা যায়।

ইদানীং মাটির ঘর তৈরির পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে মানুষ। কাদামাটির পরিবর্তে শুকনো ঝরঝরে মাটি, খড় ও ৫% সিমেন্ট মিশিয়ে ব্লক তৈরি করে দুরমুজ দিয়ে পিঠিয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই মাটির ঘর তৈরি করা হচ্ছে।

গোবরের সঙ্গে কালো ছাই ও জল মিশিয়ে মাটির ঘরের যত্ন করেন কৃষাণিরা। ফুল, পাখি, বিভিন্ন আলপনা ও জীবজন্তুর ছবি মাটির ঘরের দেওয়ালে আঁকার কাজটি ছিল পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সম্মানের ব্যাপার।

গরমের সময় হালকা ঠাণ্ডা আমেজ ও শীতের সময় হালকা গরম আমেজ পাওয়া যেত মাটির ঘরগুলোতে। ফলে মাটির ঘরকে বলা হতো ‘গরিবের বালাখানা’ বা ‘গরিবের এয়ারকন্ডিশন’। মাটির বাড়িগুলো গ্রামের সহজ-সরল মানুষের জীবনযাত্রা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে আমরা আরও হারাচ্ছি গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। মাটির ঘরের দেওয়ালে আলপনা বিভিন্ন জীব-জন্তুর ছবি এঁকে শোভাবর্ধন করা হতো। সময়ের দাবি মানতে গেলে পরিবর্তন আসতেই পারে, তাই বলে নিজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাবে, সেটাও মানে না মন।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক


মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তিক ইতিহাস: প্রেক্ষাপট পাগলা থানা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সোহেল মাজহার 

’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সব থেকে গৌরবময় অধ্যায়। ৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্বপ্ন এখনো অধরা রয়ে গেছে। জাতি হিসাবে বাংলাদেশকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের পথে হাঁটছে।

এই সময়ের ভিতর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এসব গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের অজানা ঘটনা ও অনালোকিত অধ্যায় পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছে। তারপরেও অনেক ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধের বহু গৌরবদীপ্ত স্মৃতি ও বীরগাঁথা আজও স্বীকৃতি পায়নি। অনেক অর্জন ও স্বীকৃতি বেহাত অথবা বেহাত হয়ে যাওয়ার পথে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ময়মনসিংহের পাগলা থানার গৌরব। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাগলা থানা স্বতন্ত্র কোনো পরিচয় ছিল না। পাগলা ছিল গফরগাঁও থানা অন্তর্গত দত্তের বাজার ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম্য বাজার। তদুপরি অঞ্চলটি গফরগাঁও উপজেলার দক্ষিণের ৮টি ইউনিয়নের প্রায় মধ্যবিন্দু হওয়ার সব সময় এর একটি রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল। ২০১২ সালে পাগলা একটি নতুন থানা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

শুধু ময়মনসিংহের মধ্যে নয়- বাংলাদেশের ভিতর পাগলা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গৌরবজনক ঘটনা ঘটে; কিন্তু প্রশাসনিক পরিচয়ের কারণে পাগলা অঞ্চলে সংগঠিত সকল যুদ্ধ ও যুদ্ধ সম্পর্কিত সকল ঘটনা- গৌরবময় বীরগাঁথা গফরগাঁও-এর নামে প্রচারিত হয়েছে। এই অঞ্চলের সিংহভাগ মুক্তিযুদ্ধ পাগলা থানার ৮টি ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলে সংগঠিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার ঐতিহাসিক ভাষণে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মূলত এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করেন। তিনি আরও ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ এই ঘোষণার পর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হয়ে যায়। একইভাবে তৎকালীন ঢাকা জেলা বর্তমান গাজীপুর জেলার কাওরাইদ কে এন উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং শুরু হয়। অঞ্চলটি গাজীপুর জেলার আওতাভুক্ত হলেও ময়মনসিংহ পাগলা থানার সীমান্তবর্তী অঞ্চল। এই ট্রেনিং সেন্টারের মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনজন নেতা। তন্মধ্যে সাইদুর রহমান সিরাজ তৎকালীন গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মো. মফিজুল হক চেয়ারম্যান তৎকালীন গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগের ও ময়মনসিংহ সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাদের দুজনের বাড়ি বর্তমান পাগলা থানার পাইথল ও নিগুয়ারী ইউনিয়নে। অপরজন কাওরাইদ ইউনিয়নের মনির উদ্দিন ফকির ছিলেন শ্রীপুর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। একইভাবে মশাখালী রেলস্টেশন সংলগ্ন চাইড়বাড়িয়া মাদ্রাসা মাঠে আরফান আলী চেয়ারম্যান, সাইদুর রহমান কামাল ও শাহাদাত হোসেন মাস্টার।

২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধু মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ২৫ মার্চের রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পাগলা থানার বিভিন্ন অঞ্চল যেমন- গয়েশপুর মাদ্রাসা মাঠে, মশাখালী চাইড়বাড়িয়া মাদ্রাসা, মাইজবাড়ি স্কুল মাঠ, দক্ষিণ হাড়িনা পার্বতীর মাঠ, দাওয়াদাইর প্রাইমারি স্কুল মাঠ, ছাপিলা মান্দারগড় প্রাইমারি স্কুল মাঠ, কুরচাই, তললী প্রাইমারি স্কুল মাঠ, অললী প্রাইমারি স্কুল মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং সেন্টার স্থাপিত হয়। এসব ট্রেনিং সেন্টারের নেতৃত্ব ও সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি সাইদুর রহমান সিরাজ, গফরগাঁও থানা ও ময়মনসিংহ সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মফিজুল হক চেয়ারম্যান, অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ, আরফান আলী চেয়ারম্যান, সাইদুর রহমান কামাল, শাহাদাত হোসেন মাস্টার, ইকবাল ই আলম কামাল এ কে এম নিজাম উদ্দিন মাস্টার প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মে-জুন মাসের দিকে সাইদুর রহমান সিরাজ, মফিজুল হক চেয়ারম্যান, অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ প্রমুখ কসবা সি অ্যান্ড বি ব্রিজ পার হয়ে আগরতলা হাঁপানিয়া যুব শিবিরে যান। সেখানে সাইদুর রহমান সিরাজ যমুনা যুব শিবিরে উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আবার সোনার বাংলা যুব শিবিরের চিফ ও ডেপুটি চিফ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে- অধ্যাপক শামসুল হুদা এম এন এ ও অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ। মফিজুল হক ও গিয়াস উদ্দিন মাস্টার পলিটিকাল মটিভেটর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ট্রেনিং কার্যক্রম শেষ হলে ৩নং সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান মফিজুল হককে গফরগাঁও থানা মুক্তিবাহিনীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেন। তার ওপর ফজলুল হক কোম্পানি, হাবিবুল হক মন্টু কোম্পানি ও এম এ কাদির কোম্পানির দায়িত্ব ন্যস্ত করে গফরগাঁও ও ভালুকা অঞ্চলে পাঠিয়ে দেন। শুধু মফিজুল হক নয় তার সহোদর দুই ভাই বজলুল হক ও জহিরুল হক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে জহিরুল হক নভেম্বর মাসের ২০ তারিখ ভালুকা অঞ্চলের ৯নং বাঁধ এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে শহীদ হন। গফরগাঁও অঞ্চলের তিনজন কোম্পানি কমান্ডারের মতো চতুর্থ কোম্পানি কমান্ডার ইকবাল ই আলম কামালের বাড়িও পাগলা থানায়।

গফরগাঁও উপজেলার তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগ মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান পাগলা থানার ৮ ইউনিয়নের বাসিন্দা। গফরগাঁও-এর অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে বর্তমান পাগলা থানার বিভিন্ন অঞ্চলে।

পাগলা থানা এলাকায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। ১ সেপ্টেম্বর ইকবাল ই আলম কামালের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী রাজাকার ক্যাম্প দখল করে। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, বিস্ফোরক ও রসদ দখল করে। যুদ্ধে মাইজউদ্দীন ফকির নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সেপ্টেম্বর মাসের ১১-১২ তারিখ ইকবাল ই আলম কামালের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী বাগেরগাঁও- বাকশীতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এই যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তান বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। এই যুদ্ধে আবদুল মজিদ, আবদুর রশিদ, আবদুস সাহিদ, মহর চাঁদ, মনিন্দ্র মোদক, আবদুল হাই, আফাজ, মফিজসহ ১১ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হন। ১৭ সেপ্টেম্বর ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানি দক্ষিণ পাড়ায় একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে মোবারক ও আলাউদ্দীন নামে দুজন শহীদ হন। ২৪-২৫ সেপ্টেম্বর সীমাখালীর দ্বিতীয় যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর মাহতাব ও মান্নান শহীদ হোন। উস্থি- নয়াবাড়ির যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তান বাহিনীর কয়েকজন সদস্য নিহত হন। পরবর্তীতে ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানি পাকিস্তান বাহিনীর বারইগাঁও ক্যাম্পে আকাশ করে সাফল্য পায়। ৯ ডিসেম্বর মুক্ত গফরগাঁওয়ে ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানির নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা উত্তোলন করেন।

অন্যদিকে গফরগাঁও থানা মুক্তিবাহিনীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা মফিজুল হক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ফজলুল হক কোম্পানি ও হাবিবুল হক মন্টু কোম্পানি অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ভারত থেকে ট্রেনিং গ্রহণ করে মফিজুল হক, ফজলুল হক ও মো. সেলিমের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি নিয়ে গফরগাঁও-পাগলা ও ভালুকায় পদার্পণ করেন। তন্মধ্যে দুটি সেকশন ভালুকার মেজর আফসার উদ্দিনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মফিজুল হক চেয়ারম্যান, ফজলুল হক ও এম এ সেলিম মূল বাহিনী নিয়ে প্রসাদপুর ওমর মেম্বারের বাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করেন। এই ঘাঁটি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ফরচুঙ্গি - শিলার রেলব্রিজে ও মশাখালী স্টেশনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক সাফল্য পায়। মশাখালী রেলস্টেশনের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কাছে ৬৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করেন। কিছুদিন পর অতর্কিতে পাকিস্তান বাহিনী ওমর মেম্বারের বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুললেও আক্রমণের তীব্রতায় একপর্যায়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে হেলাল নামে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

ইব্রাহিম খান একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তান বাহিনী কাওরাইদ থেকে রওনা হয়ে নিগুয়ারী গৈয়ারপাড়ের রয়ান বিল পর্যন্ত অগ্রসর হলে শিলানদীর তীরে গৈয়ারপাড়ে অবস্থান নিয়ে স্টেনগান দিয়ে গুলি করে পাকিস্তান বাহিনী অগ্রগতিকে রোধ করেন। ১৯ নভেম্বর পাকিস্তান বাহিনী কাওরাইদ থেকে রওনা হয়ে নান্দিয়াসাঙ্গন- নিগুয়ারী খান বাড়ি হয়ে ত্রিমোহনীতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী তললী চৌকিদার বাড়ির ঘাট হয়ে সুতারচাপরে আশ্রয় নেয়। সেখানেও পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এই যুদ্ধে আ. রাজ্জাক, সালাহউদ্দিন, সুলতান ও মান্নানসহ অন্তত ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষ শহীদ এবং নিহত হন। একই দিন পাকিস্তান বাহিনী নিগুয়ারীতে অপারেশন শেষ করে কাওরাইদ ফিরে যাওয়ার পথে হাবিবুল হক মন্টু কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধারা কেল্লারপাড়ে পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থানের ওপর একটি সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত ও আহত হয়।

নভেম্বর মাসে মোশাররফ হোসেন রতনের নেতৃত্বে শিলার বাজার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। একপর্যায়ে পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় মুক্তিবাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। মোশারফ হোসেন রতন একটি পুরাতন কবরে আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচায়। যুদ্ধে আবদুল আওয়াল ঝানু, সিদ্দিকুর রহমান চানুসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২০ নভেম্বর ফটুয়ার টেকে পাকিস্তান বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে ফজলুল হক কোম্পানি, হাবিবুল হক মন্টু ও ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানির যৌথ নেতৃত্বে গয়েশপুর বাজারে পাকিস্তান বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় হলেও মহর আলী, আবদুস সাত্তার, আ. কাদের ও নিজাম উদ্দিনসহ মোট ১১ জন শহীদ হন।

স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের চারণভূমি পাগলা থানায় কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি- উন্নয়ন সাধিত হয়নি। পাগলা থানার সমন্বিত উন্নয়নে নিম্নোক্ত সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করছি-

(১) সর্বাগ্রে পাগলা থানাকে উপজেলায় উন্নীত করতে হবে। (২) কিশোরগঞ্জ হতে হোসেনপুর, পাকুন্দিয়া, পাগলা ও কাওরাইদ হয়ে টাঙ্গাইল পর্যন্ত নতুন রেললাইন স্থাপন করতে হবে। (৩) পাগলা বাজারে একটি সরকারি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (৪) দত্তের বাজার ও পাকুন্দিয়ার মধ্যে সংযোগ সৃষ্টির জন্য পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর সড়ক সেতু নির্মাণ করতে হবে। (৫) পাগলা এলাকায় গ্যাস সংযোগসহ একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (৬) পাগলা থানায় আইটি পার্ক নির্মাণ করতে হবে। (৭) পাগলা থানার অভ্যন্তরীণ নদী-খাল ও সড়কপথ সংস্কার করতে হবে।

উপরোক্ত দাবিসমূহ বাস্তবায়নের মধ্যে পাগলা থানার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নিহিত। অন্যথায় এ অঞ্চলের গণমানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল পৌঁছাবে না। সব অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে নিহত গণমানুষ, নিপীড়িত মা-বোন প্রত্যেকের অতৃপ্ত আত্মা গুমরে গুমরে কেঁদে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন তাদের কাছে অর্থবহ না হয়ে ব্যর্থ বলে পরিগণিত হবে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্বপ্নের মধ্যে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নিশ্চিত করা, উন্নয়ন বৈষম্য নিরসন করা ও সবার জন্য সমান সুযোগ অধিকার নিশ্চিত করা। পাগলায় এসব সূচকের কোনোটি পূরণ হয়নি। বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট সব মহলকে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, পাগলা উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক


মহান স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন ও দ্রব্যমূল্যের চ্যালেঞ্জ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
শেখর দত্ত

২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপিত হয়ে গেল। একাত্তরের এই তারিখের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় দেশকে স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার ঘোষণা যেমন হঠাৎ করে ঘোষিত হয়নি, তেমনি মুক্তিযুদ্ধও আকস্মিকভাবে শুরু হয়নি। এ যুদ্ধ গণযুদ্ধ, ‘সেনাযুদ্ধ’ নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুদীর্ঘ ২৪ বছর শাসন-শোষণ, নির্যাতন-নিপীড়নের ফলে দেশবাসীর গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের রক্তক্ষয়ী লড়াই-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতার জন্য জনগণ মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। এই লড়াই-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সকল সুকীর্তি। ইতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণে নেতা-জনতার অভূতপূর্ব ঐক্য ও সশস্ত্র লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

দেখতে দেখতে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার করছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। একটা জাতির জীবনে তা খুব কম সময় নয়। এটা তো কারোরই অজানা নয়, পরিবর্তনই জীবনের ধর্ম। তবে সুদূর অতীতে বাস্তবজীবনে যেমন তেমনি চিন্তা-চেতনারও গতি ছিল শ্লথ। বর্তমান সময়ের পরিবর্তনের গতি অতীতে কল্পনাও করা যেত না। তাই একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিশ্বব্যবস্থা কিংবা আমরা যে অবস্থায় ছিলাম, আমাদের চিন্তা-চেতনার গতি-প্রকৃতি যা ছিল; তা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে এবং এর গতি ক্রমেই বাড়ছে।

একটু খেয়াল করলেই অনুধাবন করা যাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমেরিকার নেতৃত্বে ধনতান্ত্রিক ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের যে ঠাণ্ডাযুদ্ধের যুগ শুরু হয়, তাতে উপনিবেশ যুগের সমাপ্তির ভেতর দিয়ে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করতে থাকে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে শরিক হয়; কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা আবার পড়ি সাম্রাজ্যবাদের ছোট শরিক পাকিস্তানের পরাধীনতার অক্টোপাসের জালে। ওই অক্টোপাস ছিন্ন করে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে আমরা যে স্বাধীন দেশ অর্জন করি, তা হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের স্বাধীন দেশগুলোর তালিকার সর্বশেষ সারির।

স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠার পর আমরা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে ‘গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার পথ গ্রহণ করি। পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকারের জন্য সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জন্য এই পথ নির্ধারণ করে দেয়। আমরা জাতীয় চারনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করি। বিশ্ব বাস্তবতা ও জনগণের চেতনা ও পছন্দ স্থিরকৃত থাকায় এ ছাড়া তখনকার বাস্তবতায় বিকল্প কোনো পথ ছিল না; কিন্তু হত্যা-ক্যু, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসন ওই পথে আমাদের থাকতে দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণীর পথ আমরা ধরে রাখতে পারিনি। পথভ্রষ্ট হই আমরা।

ইতোমধ্যে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সংঘটিত হয় চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এই যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার পতন ঘটে। ধনতন্ত্র-সমাজতন্ত্র ঠাণ্ডাযুদ্ধ যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। আমেরিকার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং তা স্থায়ীরূপ নেবে বলেই মনে হতে থাকে। সেই ব্যবস্থাও স্থায়ী হতে পারে না। বর্তমানে বিশ্ব বহুকেন্দ্রিক এবং ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক দিক থেকে মহাশক্তিধর দেশগুলো এখন কোনো রাখ-ঢাক না রেখেই বিশ্বব্যাপী প্রভাব বলয় বিস্তারে তৎপর। মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই দেশ রাশিয়া-আমেরিকা ছিল মুখোমুখি আর এখন অনেক দেশ অনেক রকমভাবে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে।

সম্পূর্ণ এক নতুন যুগে রয়েছে বর্তমান বিশ্ব। ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক স্বার্থ ও অধিপত্যের কাছে নিয়ম-নীতি-নৈতিকতা এখন কোণঠাসা, পদদলিত। রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় ও ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতার সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক প্রভাব বলয় বিস্তারের চিন্তা ও তৎপরতা বিশ্বকে টালমাটাল ও রক্তাক্ত করে তুলছে। লোভ-লালসা , হিংসা- দ্বেষ সমগ্র বিশ্বে, দেশে দেশে পরিব্যাপ্ত। রাজনীতি দেশ ও মানবসেবা, ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়ম-নৈতিকতা সুরক্ষা, সমাজে আইন মেনে চলা প্রভৃতি এখন যেন পরিত্যক্ত হতে যাচ্ছে। মন্দ দ্রুতই ভালোকে অধীন ও বন্দি করছে।

পঞ্চাশ বছর আগে মানুষের মুক্তি, নীতি-নৈতিকতা প্রভৃতি যা ছিল মানবজাতি, বাঙালি জাতির জন্য গর্ব ও অহংকার, তা আজ যুগের তীব্র ঝঞ্ঝার কবলে পড়ে গোড়া থেকে যেন উপড়ে ফেলতে চাইছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ বর্তমানে ক্ষমতায়। এই অবস্থায় স্বাধীনতার মর্মবাণী তথা লাখ লাখ শহীদের স্বপ্নসাধ ধারণ করে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে যারা ধৈর্য ধরে মুক্তিযুদ্ধ নির্ধারিত লক্ষ্যাভিমুখী পথে অগ্রসর হতে চান, তারাও আজ নিরাশ হচ্ছেন। আর যারা আমূল পরিবর্তন মেনে নিয়ে খাপ খেতে পারছেন না, তাদের মধ্যে অতি ডান-বাম প্রবণতা লক্ষণীয় হয়ে উঠছে।

এটা তো কারোরই অস্বীকার করার উপায় নেই, নিরাশা-হতাশা হচ্ছে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের আঁতুড়ঘর। এই অবস্থায় দেশি-বিদেশি যড়যন্ত্র-চক্রান্ত যে প্রবল হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিগত নির্বাচনের আগে আমরা এই বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছি। এটা ঠিক, আমরা সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ভোট সম্পন্ন করতে পেরেছি। সংবিধান অনুযায়ী নতুন সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; কিন্তু এটা তো জনগণের অজানাই থেকে যাচ্ছে, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত এখন কোন পর্যায়ে, কীভাবে, কোন ধরনের গভীরতা ও বিস্তৃতি নিয়ে চলছে। বাংলাদেশের জনগণ ঠাণ্ডাযুদ্ধ যুগের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করেছে; কিন্তু বর্তমান যুগে কতটা কি রূপ নিতে পারে তা আমাদের অজানা। অজানার ভয়ই বড় ভয়। প্রবাদ বলে, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। স্বাধীনতা দিবস পালনের দিনগুলোতে জনগণ তো এমন ভয় পাবেই।

এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না, বিদ্যমান বাস্তবতায় সাংবিধানিকভাবে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আগামী ৫ বছর এই সরকারের অধীনেই দেশ চলবে। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা ও আইনের শাসন সুরক্ষায় সরকার নির্বাচনী অঙ্গীকার কতটুকু বাস্তবায়িত করবে, সেদিকে জনগণ লক্ষ্য রাখবে, সজাগ থাকবে। নির্বাচনী অঙ্গীকারে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বলেছে: রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সুশাসন গণতান্ত্রিক মূল্য বোধের চর্চা সুপ্রতিষ্ঠিত করা; আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষা করা এবং শিক্ষিত, চৌকষ ও দুর্নীতিমুক্ত মানুষকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী করে তোলা হবে। এই ওয়াদা কতটুকু বাস্তবায়িত করে সরকার ও সরকারি দল, তা জনগণ আগামী দিনগুলোতে গভীরভাবে বিবেচনায় নেবে।

তবে জনগণের কষ্ট লাঘবে সরকারি দল আশু সম্পন্ন করার যেসব অঙ্গীকার করেছে, তা নিয়ে কিন্তু বিন্দুমাত্র বসে থাকার সময় নেই। সরকারের প্রথম ও প্রধান অঙ্গীকার হচ্ছে, ‘দ্রব্যমূল্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।’ নতুন সরকার মানেই ‘হানিমুন পিরিয়ড’। এই মধুর শব্দটি এবার উঠতে উঠতেও ওঠেনি। জনগণ যখন দ্রব্যমূল্যের চাপে কষ্টে রয়েছে, তখন তা হয়ে উঠেছে কষ্ট লাঘবে ‘প্রচেষ্টার সময়কাল’। মানুষ অন্ধ নয়, সরকারের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করছে না; কিন্তু জনগণের প্রধান মাথাব্যথা মজুতদারি ও সিন্ডেকেট। সর্বোপরি বাজার ব্যবস্থাপনা। এমনটাও জানা যাচ্ছে, ‘অ্যাপসে ওঠে সড়কের চাঁদা’।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘আমদানি-রপ্তানিতে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েজ, শুল্ক ফাঁকি, বিদেশে অর্থ পাচার, হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন, মজুতদারি ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং অতি মুনাফা প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে।’ মূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনার কথাও রয়েছে। সম্প্রতি আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদের বলেছেন, ‘সিন্ডিকেটের সঙ্গে বিএনপির যোগাসাজশ খতিয়ে’ দেখা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে সিন্ডিকেট কাদের নিয়ে গঠিত, তা খতিয়ে দেখার ও ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার ও দায়িত্ব সরকারের রয়েছে। সার্বিক বিচারে সিন্ডিকেট দেশে রয়েছে এটাই বাস্তবতা। আর এটাও সঠিক, মজুত ও সিন্ডিকেটের কোনো দল নেই।

স্বাধীনতার মাসে রোজার মধ্যে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারমূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তা তেমন কার্যকর হয়নি। সরকারের নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। জানা যায়, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা মূল্যবৃদ্ধির জন্য দুষছেন মিলারদের আর মিলাররা ব্যবসায়ীদের। এই বাস্তবতায় প্রচেষ্টা তৎপরতা থেকে জনগণের কাছে আদৌ সুস্পষ্ট নয়, সরকার সিন্ডিকেটের আসল জায়গায় হাত দিচ্ছে কি না? বঙ্গবন্ধুর আমলে অসাধু ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনৈতিক গণশত্রু নেক্সাস গড়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু তাদের বলতেন ‘চাটার দল’।

অতীতের ওই বিয়োগান্তক ও মর্মান্তিক ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে সরকার জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনাই বর্তমানে সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে সরকারের সাফল্যের বিকল্প নেই। কারণ এটাই সর্বজনবিদিত, অর্থনৈতিক সংকটই রাজনৈতিক সংকটকে ত্বরান্বিত করে। দুই জমজ সংকট ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকে কার্যকর করে, চরম ক্ষতিকর ও ভয়াবহ রূপ নিয়ে তা প্রকাশিত হয়। তাই স্বাধীনতার মাসে রোজার মধ্যে ঈদ সামনে রেখে জনগণ চায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকুক এবং স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন সুরক্ষায় অসাধু ব্যবসায়ী মজুতদারি ও সিন্ডিকেট চিহ্নিত হোক। গণশত্রুরা আইনের আওতায় আসুক।

লেখক: রাজনীতিক ও কলামিস্ট


খাদ্য যখন পথ্য হয়, রোগ তখন দূরে রয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
শফিকুল ইসলাম

খাদ্য যখন পথ্য হয় রোগ তখন দূরে রয়। কথাটি ৮৪ বছর বয়স্ক খাদ্য পথ্য বিশেষজ্ঞ শহীদ আহমেদের। তিনি খাদ্য পথ্য দিয়ে মানুষকে সুস্থ রাখতে নিরলসভাবে এই বয়সেও কাজ করে যাচ্ছেন। সুস্থতা আল্লাহর নিয়ামত। কাজেই সুস্থ থাকার কোনো বিকল্প নেই।

মানুষ যা খায় তা সবই খাদ্য আর যে খাদ্যদ্বারা রোগ নিরাময় হয় তাকে পথ্য বলে। আমরা যদি পুরাতন দিনে ফিরে যাই, দেখতে পাবেন ডাক্তাররা ওষুধের পাশাপাশি উপযুক্ত পথ্য গ্রহণের উপদেশ দিতেন। এর অন্তর্নিহিত অর্থ প্রমাণ করে, উপযুক্ত পথ্যের অভাবই এই অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহজেই বোঝা যায়, উপযুক্ত পথ্য গ্রহণ দ্বারাই সব রোগ নিরাময় সম্ভব।
যদি পথ্য উপযুক্ত না হয় তা হলে কোনো ওষুধ দ্বারাই রোগ নিরাময় সম্ভব হবে না। এমন হতে পারে যে ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় বিপরীত দিকে যাবে এবং আরও ক্ষতিকর রোগ আপনার জন্য অপেক্ষা করবে।

তাই ইফতারিতেও জীবন্ত এবং মৃত খাবারের সমারোহ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দরকার। যেসব খাবারে ঔষধি গুণ আছে তাই পথ্য। ঔষধি গুণসম্পন্ন অরান্না খাবারগুলোই হচ্ছে পথ্য। যা খেলে পেটও যেমন ভরে তেমনি ওষুধের কাজও করে। তাতে সুস্থতাও নিশ্চিত হয়।

খাদ্যকে পথ্য হিসেবে প্রয়োগ করে নিরাপদ খাদ্য, বিষমুক্ত খাদ্য, রাসায়নিক সারমুক্ত খাদ্য, পরিমিত আহার এবং খাদ্যশৃঙ্খলা দিয়ে মানুষকে সুস্থ রাখতে আমাদের দেশে অনেকেই কাজ করে যাচ্ছেন। শহীদ আহমেদ ছাড়াও যারা নিরলসভাবে কাজ করছেন তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করতেই হয়। কাজী মামুনুর রশীদ- যিনি পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক হলেও সুদীর্ঘ চার দশক ধরে প্রাকৃতিক চিকিৎসায় যুক্ত। যার হাতের ছোঁয়ায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত অগণিত মৃত্যু পথযাত্রী। এ ছাড়া যিনি একেবারে সিরিয়াস হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি হলেন ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবির। একটি নির্দেশিত জীবনশৈলী রূপান্তর করে তিনি দিচ্ছেন ডা. জাহাঙ্গীর কবির। তার মতে খাবার খেয়ে যেন কেউ অসুস্থ না হয়। খাদ্যকে পথ্য হিসেবে গ্রহণ করতে তিনি মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছেন। সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এবং প্রচলিত চিকিৎসার সঙ্গে এক রকম যুদ্ধ করে যাচ্ছেন।

এসব নিরাপদ পথ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আরও কিছু নিবেদিত প্রাণ। তাদের মধ্যে ডা. মুজিবর রহমান, ডক্টরেট অব মেডিসিন, কারডিওলজিস্ট অ্যান্ড ন্যাচরোপ্যাথ। ডা. রহমান চিকিৎসাবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে থাইল্যান্ডের পাতায়াতে ভানটেজ ন্যাচারাল হেলথ ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে আন্তর্জাতিকভাবে চিকিৎসা প্রদান করেন।

এমন জীবনশৈলীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, বৃক্ষপ্রেমী নওশের আহমেদ। শতভাগ ইকোলজিক্যাল অরগানিক কৃষি খামার তৈরি করেছেন তিনি। কয়েক দশক ধরে তিনি পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য নিবিড়ভাবে শখের কৃষির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রায় এক দশক ধরে নিষ্পাপ কৃষির ওপর কাজ করে চলেছেন। মাত্র ১২ জন কৃষি সহযোগী ও একজন স্বশিক্ষিত প্রাকৃতিক কৃষিবিদ মিজানুর রহমানকে সহযোগী করে এক অসাধ্য সাধন করেছেন। যা শিক্ষিত তরুণদের কৃষি কাজে আসতে উৎসাহ জোগাবে।

আরও আছেন জাহিদ হোসেন ও এমদাদ। দুজনই উচ্চশিক্ষিত এবং সচ্ছল। আধুনিক জীবন ত্যাগ করে তারা প্রকৃতির মধ্যে শুধু বসবাসই করেন না তারা নীরবে প্রাকৃতিকভাবে চাষাবাদ করে সিনথেটিক কেমিক্যালমুক্ত নানা রকম ফসল উৎপাদন করে মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যের জোগান দিয়ে চলেছেন।

জাহিদ হোসেন পদ্মার চরে নিজস্ব জমিতে পুকুর কেটে ওই মাটি দিয়ে ঢিবি বানিয়ে তার ওপর ঘর তুলে জনা দশেক কৃষি সহকর্মী নিয়ে চরের জমিতে জৈব কৃষি করেন। ওই চর বছরে দুমাস বন্যার পানির নিচে থাকে। অর্থাৎ পলি পড়ে প্রতি বছর মাটির উর্বরতা বাড়ে। আমি ভাগ্যবান ওনার প্রাকৃতিক খামারে তিন দিন অবস্থান করে প্রাকৃতিক আহার এবং পরিবেশ উপভোগ করতে পেরেছি। জাহিদের প্রধান ফসল আখ এবং নান রকম ডাল, গম, যব এবং ওটস।

এমদাদ খামারে মাটিতে মা কেচোর বসবাস। পুরা জমিটা কেচোর মলে ভরা। মাটি বিষমুক্ত হলেই কেবল কেচোর দেখা মিলবে এবং এসব খামারের ফসল খেলে শুধু পেটই ভরবে না এটা ওষুধেরও কাজ করবে। আমার জানা মতে আরও একজন জৈব কৃষির সঙ্গে জড়িত যিনি মিজান ভাই নামে পরিচিত। তিনি যেসব জায়গায় কাজ করেন সেসব জমিতেও কেচো নিবিড়ভাবে বসবাস করেন।

লেখক: সাংবাদিক ও সমাজকর্মী


ব্যাংক খাতের সংস্কার ও আর্থিক সুশাসন

ছবি: সংগৃহীত
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রজত রায়

কোনো এক সকালে যদি সব আমানতকারী গচ্ছিত ধনরাশি ফেরত চান, পৃথিবীর সেরা ব্যাংকেরও লালবাতি জ্বলবে। কারণ গ্রাহকদের জমা রাখা আমানত থেকেই তো ব্যাংক ঋণ দিয়েছে। দীর্ঘমেয়াদের সেসব ঋণ তো চাওয়ামাত্রই ফেরত পাওয়া যাবে না, তাহলে উপায়?

ডায়মন্ড-ডিবভিগের উল্লিখিত পেপারে এবং ডায়মন্ড এককভাবে ২০০৭ সালে ইকোনমিক কোয়ার্টারলিতে প্রকাশিত ‘‘ব্যাংকস অ্যান্ড লিকুইডিটি ক্রিয়েশন অ্যা সিম্পল এক্সপোজিশন অব দ্যা ডায়মন্ড ডিবভিগ মডেল’ শিরোনামের প্রবন্ধে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, সরকারের আমানত বিমা প্রকল্প ব্যাংককে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারে। গ্রাহকরা যদি জানেন, কোনো ব্যাংক কখনো ফেল করতে পারে না, তাহলে সেই ব্যাংক সত্যিই কখনো দেউলিয়া হবে না। প্রশ্ন হলো- সেই বিশ্বাস আসবে কী করে? এর সহজ রাস্তা আমানত বিমার ভরসা। অথবা সরকার নিজেই যদি সেই ভরসা দেয়। আর ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্তকরণের পিছনে অন্যতম উদ্দেশ্য কিন্তু সেই ভরসার জায়গা তৈরি করা।

আর্থিক সম্পদ ধারণ করা সব ব্যাংকিংয়ের মূল বিষয় এবং যেখানে এটি প্রাচীনকালে শুরু হয়েছিল- যদিও এটি ধনী পৃষ্ঠপোষকদের জন্য স্বর্ণমুদ্রা সংরক্ষণের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত হয়েছে। সবচেয়ে মৌলিক স্তরে, একটি ব্যাংক ব্যক্তি বা ব্যবসার কাছ থেকে আমানত নেয়, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে আমানতকারী যখন এটি চায় তখন টাকা প্রত্যাহার করা যেতে পারে, যদিও কখনো কখনো তাড়াতাড়ি তোলার জন্য জরিমানাসহ অ্যাকাউন্টের প্রকারের ওপর নির্ভর করে। ব্যাংক আমানতকারীর অর্থের ওপর সুদও দিতে পারে। ব্যাংকগুলো তাদের অর্থ ব্যবহারের জন্য আমানতকারীদের যে সুদের হার দেয় এবং তারা ঋণগ্রহীতাদের যে উচ্চ সুদের হার নেয় তার মধ্যে পার্থক্যের ভিত্তিতে মুনাফা করে। বেশির ভাগ দেশে ব্যাংকগুলোর র‌্যাঙ্কিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে এবং সরকারি ব্যাকস্টপ সুবিধাগুলোর জন্য যোগ্য হওয়ার জন্য একটি সনদের প্রয়োজন হয়। যেমন- কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জরুরি ঋণ এবং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত ব্যাংক আমানত বিমা করার সুস্পষ্ট গ্যারান্টি। ব্যাংকগুলো তাদের দেশের আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সাধারণত নিয়মিত তত্ত্বাবধানে থাকে। যদি ব্যাংকগুলো বিদেশে সক্রিয় থাকে, তবে সেগুলো আয়োজক দেশ দ্বারা ও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। বিঘ্ন কমাতে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোতে হস্তক্ষেপ করার জন্য নিয়ন্ত্রকদের ব্যাপক ক্ষমতা রয়েছে।

একটি বড়সংখ্যক লোক একটি ব্যাংক থেকে টাকা তোলা শুরু করলে তখন তারা ভয় পায় যে প্রতিষ্ঠানের অর্থ ফুরিয়ে যাবে। একটি ব্যাংক রান সাধারণত প্রকৃত দেউলিয়া হওয়ার পরিবর্তে আতঙ্কের ফলাফল। যাই হোক, ভয়ের দ্বারা চালিত একটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। একটি ব্যাংক রান হলো যখন কোনো ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকরা ব্যাংকের সচ্ছলতা সম্পর্কে ভয়ে একই সময়ে তাদের আমানত প্রত্যাহার করে। যত বেশি লোক তাদের তহবিল প্রত্যাহার করে, ডিফল্ট হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে, আরও বেশি লোক তাদের আমানত প্রত্যাহার করতে পারে। চরম ক্ষেত্রে, ব্যাংকের রিজার্ভ উত্তোলন কভার করার জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে।

তারল্য ঝুঁকি বৃহত্তর অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। তারল্য ঝুঁকি বৃহত্তর অর্থনীতিজুড়ে প্রবল প্রভাব ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি আর্থিক সংকটের সময়, প্রধান আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্য সমস্যা ক্রেডিট সংকটের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যেখানে ঋণ দেওয়া সীমিত হয়ে যায়, যার ফলে ব্যবসা, ভোক্তা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধি প্রভাবিত হয়। একইভাবে, বড় করপোরেশনগুলোতে তারল্য সমস্যা চাকরি হারাতে পারে, ভোক্তাদেরও ব্যয় হ্রাস করতে পারে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস পেতে পারে।

অর্থব্যবস্থায়, বিশেষ করে আর্থিক সংকটের সময়ে, ব্যাংকের ভূমিকা কী? এক বিষয়টি আরও বুঝতে যে বিষয়টি মূল আলোচ্য তা হলো আসলে ব্যাংকের সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যেই তার মরণ বীজ লুকিয়ে থাকে। আধুনিক ব্যাংক গ্রাহকদের নানা ধরনের পরিষেবা দিয়ে থাকে। তবে ব্যাংকের মূল ব্যবসা ঋণ দেওয়া-নেওয়ার। ব্যাংকের কাছে আমরা সঞ্চয় গচ্ছিত রাখি। তার বিনিময়ে ব্যাংক আমাদের একটি পূর্ব-ঘোষিত কিন্তু সময়ে-সময়ে পরিবর্তনযোগ্য হারে সুদ দেয়। গ্রাহকরা চাইলে তাদের সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে যেকোনো সময় আমানত তুলতে পারেন। আমানতকারীদের সুদ মেটাতে গেলে ব্যাংকের আয় চাই। সেই আয় আসে ব্যাংক ঋণ থেকে। লগ্নিকারীদের মূলধনের প্রধান উৎস হচ্ছে ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট সুদের বিনিময়ে ঋণ। আমরা বাড়ি-গাড়ি ক্রয় করতে বা অন্য কোনো কারণে ঋণ নেই। ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত আমানত হচ্ছে ব্যাংকের লায়াবিলিটি বা দায় পুরোটাই ‘লিকুইড’ মানে যেকোনো সময়ে নগদে সম্পূর্ণ পরিবর্তনযোগ্য। ব্যবসার ধরনটাই এমন হওয়ার ফলে ব্যাংকের সামনে বরাবর দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।

এক বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বাড়ছে তাহলে কি করপোরেট সুশাসনের অভাব? ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের পরিমাণও অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি করে ব্যাংকে সুশাসন ফেরানোর তাগিদ দিচ্ছে। সঞ্চিত সংরক্ষণের হার বাড়ানোর পাশাপাশি খেলাপি ঋণ গণনার মেয়াদও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে যাচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা বাড়ছে না।

বিশ্লেষকদের মতে, খেলাপি ঋণ পরিশোধে সহনশীলতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিল করার শিথিলনীতি নন- পারফর্মিং ঋণের (এনপিএল) বাড়তে থাকা ধারার ওপর রাশ টেনে ধরতে পারেনি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি ঋণ পুনঃতফসিল করার নীতি আরও শিথিল করেছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানোর জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ‘সিস্টেম্যাটিক রিস্ক ড্যাশবোর্ড’ শীর্ষক প্রকাশনায় সর্বশেষ সংখ্যার তথ্যানুযায়ী, গত বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতের আয় ব্যয়ের অনুপাত ছিল ৭১ শতাংশ। যা ২০২২ সালের জুন মাসে ছিল এ অনুপাত ৫৭ শতাংশ। একটি ব্যাংকের প্রতি ১০০ টাকা আয়ের জন্য কত ব্যয় করতে হয় সেটিকেই আয়-ব্যয়ের অনুপাতের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোর প্রতি ১০০ টাকা আয়ের বিপরীতে ৭১ টাকা ব্যয় হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিচালনা মুনাফা হিসাবে থাকছে মাত্র ২৯ টাকা। এ মুনাফার বিপরীতে আবার ৩৭ দশমিক ৫০ থেকে ৪০ শতাংশ পরিশোধ করতে হয় সরকারের কর হিসাবে। এ ছাড়া রয়েছে খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের চাপ। ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো ব্যাংকগুলো বড় অঙ্কের পরিচালন আয় করেও নিট মুনাফা গড়ে তুলতে না পারা। তাহলে? আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের আয়-ব্যয় অনুপাত ৪০ শতাংশের নিচে হলে সেটিকে সন্তোষজনক হিসেবে ধরা হয়।

আমাদের নন-পারফর্মিং ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা (আইএমএফ) জানিয়েছে, নন-পারফর্মিং ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকলে তা প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি তার নিজস্ব বোধ ও বুদ্ধিমতো মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে পারে, তাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তাদের সম্পদ ও দায়ের মধ্যে একটি সুষম ভারসাম্যের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এমন আদর্শ পরিস্থিতিতে আর্থিক সংকট বা মন্দার মতো ভয়াবহতা অনেকটা কাটিয়ে ওঠা যায়। তাই ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার মধ্যে অবশ্যই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। যা একটি দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপেও পরিবর্তিত হবে না।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

বিষয়:

শব্দদূষণ রোধের নতুন প্রযুক্তি কোয়েটপ্রো 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
প্রদীপ সাহা  

পরিবেশ দূষণের ব্যাপারে আমরা সবাই এখন অবগত। ক্রমাগত বিভিন্নভাবে আমরা এর শিকার হচ্ছি-Ñ এ কথা বলার অপেক্ষায় রাখে না। তবে পরিবেশ দূষণ হিসেবে শুধু বায়ুদূষণ, পানিদূষণ কিংবা মাটিদূষণের কথা বেশি ভাবলেও আমরা শব্দদূষণের কথা কম ভাবছি। শব্দদূষণ প্রতিরোধে আমরা কার্যকর ব্যবস্থাও কম নিচ্ছি; কিন্তু এর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবের কথা অবশ্যই আমাদের গভীরভাবে ভাবা উচিত। নরওয়ে শব্দদূষণের হাত থেকে বাঁচাতে এক চমৎকার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। ইউরোপের সবচেয়ে তেলসমৃদ্ধ দেশ নরওয়ের উত্তর সাগরের বুকে রয়েছে অসংখ্য তেল উত্তোলন ক্ষেত্র। আর এই তেল উত্তোলন ক্ষেত্রগুলোতে বিকট শব্দের মাঝে কাজ করতে গিয়ে অধিকাংশ শ্রমিক তাদের শ্রবণশক্তি হারাচ্ছেন। জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর কমপক্ষে ৬ শ শ্রমিকের ক্ষেত্রেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। নরওয়ের মূল ভূখণ্ড থেকে তেলক্ষেত্রগুলোতে যাওয়া-আসার জন্য একমাত্র বাহন হচ্ছে হেলিকপ্টার। আর এর ফলে তেল উত্তোলন ক্ষেত্রের অন্যান্য জোরালো শব্দের সঙ্গে হেলিকপ্টারের বিকট শব্দ সেখানকার কর্মীদের নিত্যসঙ্গী। উত্তর সাগরের এই উচ্চ শব্দের মধ্যেই কাজ করছেন স্টেলে আস। তিনি বলেন, প্রতিটি তেলক্ষেত্রেই রয়েছে ঘূর্ণায়মাণ যন্ত্রপাতি, পানির তোড়ে ঘোরতে থাকা মোটরের চাকা, কপাটক এবং উত্তোলক যন্ত্রসহ আরও অনেক ধরনের যন্ত্রপাতির তীব্র শব্দ। এই উচ্চমাত্রার শব্দদূষণের মধ্যে তার কাজ করার বিরাট অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর তাই নিজের শ্রবণক্ষমতার সমূহ ঝুঁকির ব্যাপারে তিনি বেশ সচেতন।

নরওয়ের বৃহত্তম তেল কোম্পানি হচ্ছে ‘স্টাটওয়েল’। তারা বিকট শব্দ থেকে কর্মীদের বাঁচাতে ‘কোয়েটপ্রো’ নামের এক বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এটি কানে ব্যবহার করার মতো একটি ডিজিটাল প্লাগ। এটি ১২০ ডেসিবেল মাত্রার বিকট আওয়াজকে মাত্র ৩০ ডেসিবেলে নামিয়ে এনে শ্রবণ উপযোগী করে কানে পৌঁছায়। শুধু শব্দের মাত্রা সহনীয় করে তোলা নয়, পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও এটি দ্বিগুণ কাজ করে। প্রযুক্তির কার্যকরিতা নিয়ে কাজ করছেন মি. মেলভ্যার। তিনি বলেন, এই প্রযুক্তির প্লাগটি বাহিরের শব্দের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম। এ প্লাগ যেমন হেলিকপ্টার উড্ডয়নের সময় সৃষ্ট বিকট আওয়াজকে কানে পৌঁছতে দেয় না, তেমনি এটিকে সাধারণ শ্রবণযন্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। শুধু তাই নয়, ব্যবহারকারী স্পষ্টভাবে শুনতে পাবে তার কাছে পাঠানো রেডিও বার্তা এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত মাইক্রোফোনের মাধ্যমে অন্য প্রান্তে বার্তা ফেরতও পাঠানো যাবে।

বিমান কিংবা একটু গোলমালের মধ্যে ভালো ঘুমের জন্য যেসব ইয়ার প্লাগ ব্যবহার করা হয়, এটিও সেরকমই একটি প্লাগ। শুধু এর সঙ্গে তার দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে একটি ছোট পকেট কম্পিউটার, যা সেকেন্ডের মধ্যেই বাইরের শব্দের মাত্রা বিশ্লেষণ করে তাকে কানের উপযোগী করে আবার মাইক্রোফোনের মাধ্যমে পাঠানো বার্তা অপর প্রান্তে সরবরাহ করে। তেলক্ষেত্রগুলোতে কর্মরত মানুষদের জন্য এটি এখন জীবন রক্ষাকারী যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। মেলভ্যারের মতে, মানুষের শ্রবণশক্তি সুরক্ষায় বিশ্বে এটিই প্রথম যন্ত্র, যা ব্যবহারকারীদের কানের পর্দায় পৌঁছানো শব্দের সঠিক মাত্রা নির্ণয় করতে পারে। শুধু তাই নয়, এটির সাহায্যে নির্ধারিত সময়ে শব্দ শ্রবণের মাত্রা মেপে পরবর্তীতে কারো শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাসের ঘটনাও নির্ণয় করা সম্ভব। এর ফলে একজন মানুষের জন্য কতটুকু মাত্রার শব্দ সহনীয় এবং কতটুকু মাত্রা অসহনীয় সেটিও নিঁখুতভাবে নির্ণয় করা যায়। নরওয়ের মতো আমরাও কি পারি না শব্দদূষণের হাত থেকে এভাবে নিজেকে বাঁচাতে?

লেখক: বিজ্ঞান ও পরিবেশবিষয়ক কলামিস্ট


একাত্তরের গণহত্যা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আলমগীর খোরশেদ 

সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা এই বাংলায় মানুষের সুখ ছিল, শান্তি ছিল, সারা দিন কাজের শেষে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যেত। সম্পদে পূর্ণ এই জনপদে বারবার আঘাত এসেছে। ঔপনিবেশিক শাসন এসে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে জনপদের সুখের ঠিকানাকে। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়, সেনাপতি মীর জাফরের বেইমানি স্বাধীনতার সূর্যটা অস্তমিত হয়ে যায়। ঔপনিবেশিক শাসন এল, ইংরেজ বেনিয়ার কূটকৌশলে মিলিত হলো দেশীয় কুলাংগাররা। না পারলো নিজেরা টিকে থাকতে, না পারলো দেশটাকে রক্ষা করতে। ইংরেজদের প্রায় দুইশত বছর শাসনামলে স্বাধীনতা লাভের জন্য স্বদেশী আন্দোলন, রাজা বাদশাহ, সন্যাস, ফকির আন্দোলন করেছে। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছাড়ে। তারপর পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান নামে দুটো দেশ হয়ে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের তথা বাঙালিদের ওপর নিপীড়ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য দাবিয়ে রাখার কৌশল বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা লাভে একত্রিত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

কম সময়ে অধিক মানুষকে হত্যা, যা জাতি, বর্ণ, ধর্ম, গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত মানুষদের সম্পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংস বা নিশ্চিহ্ন করার ইচ্ছা, তা বাস্তবে ঘটানো, সেটাই গণহত্যা। গণ মানে গোষ্ঠী, আর হত্যা হলো সংহার। গণহত্যার ইংরেজি হলো জেনোসাইড। গ্রিক জেনোস অর্থাৎ মানুষ আর সাইড মানে মারা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে শুরু হয় গণহত্যা। যা শতাব্দীর সবচেয়ে নৃশংসতম গণহত্যাগুলোর মধ্যে একটি। একাত্তরের বাঙালি নিধণে মাস্টার মাইন্ড ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া খান, আর তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করেন জেনারেল টিক্কা খান ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। গণহত্যার প্রেক্ষাপট আরো পিছন থেকে। সংখ্যা গরিষ্ঠ লোক ছিল বাঙালি। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভাবতো পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের ঘৃণা করতো এবং নিচু আবাস্থল ভাবা হতো। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান। দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, বৈষম্য, নিপীড়ন, নির্যাতন করে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার মানুষদের দাবিয়ে রাখে। কোণঠাসা করে রাখে। পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার জনগণকে জব্দ করতে প্রথম আঘাতটা আসে ভাষার ওপর। রাষ্টভাষা উর্দু করার পাঁয়তারা শুরু করে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা বুঝিয়ে দেয়, কাজটা কিন্তু হবার নয়। অধীনতা নিপীড়ন, দাবিয়ে রাখা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধিকার, স্বাধীনতার স্বপ্নে জনগণকে সংগঠিত করেন বঙ্গবন্ধু। চুয়ান্নের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন জাতির মত প্রকাশ স্বাধীনতাবোধেরই প্রকাশ। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান জানান দেয় বাঙালি জাতি দমে যাবার নয়। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে ম্যান্ডেট পান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জুলিওকুরী উপাধিপ্রাপ্ত বিশ্বনেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামীলীগ। সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়েও ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা শুরু করে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব বড় বড় শহর দখল ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে শুরু হয় গণহত্যা। বাঙালিদের স্বাধিকারের দাবি নির্মূল করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করে দেন। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তান সরকার এই প্রদেশে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়। এদিকে পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীও বসে নেই। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এক বৈঠকের ভিত্তিতে মার্চের শুরুতে ১৪তম জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী অপারেশনের মূল পরিকল্পনা তৈরি করেন। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক বিভাগের জিওসি জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস এম আহসান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর সামরিক হামলাকে সাপোর্ট করেনি বিধায় অপারেশনের আগেই তাদেরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তারপর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও জিওসি করে পাঠানো হয়।

পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সিওএস জেনারেল হামিদ টেলিফোন করে জেনারেল রাজাকে অপারেশনের পরিকল্পনা করার দায়িত্ব দেন। ১৮ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি কার্যালয়ে বসে মেজর জেনারেল রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরী করেন। পরিকল্পনাটি জেনারেল রাও ফরমান নিজ হাতে হালকা নীল রঙের একটি অফিস প্যাডের পাঁচ পাতা জুড়ে লিড পেন্সিলে লিখেন। সাথে বিভিন্ন সামরিক কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত, সীমা, নির্ধারণ করেন। জেনারেল খাদিম সেনাদের অবস্থানের স্থান বিতরণ, বিভিন্ন ব্রিগেড, ইউনিট তদারকির দায়িত্ব দেন। ২০ মার্চ জেনারেল হামিদ এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান বাঙালিদের নিরস্ত্র করন বিষয়ে আলোচনা করেন। ইপিআর আর্মড পুলিশদের নিরস্ত্র করার অনুমতি দেন। অপারেশন শুরু হয় ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতের শেষ প্রহরে। ঢাকার সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। পাকস্তানি শাসকদের মুখের বুলি ছিলো, ‘তুম ভি মুসলিম, মে ভি মুসলিম হো।’ কিন্তু বাস্তবে কার্যক্ষেত্রে অমুলিমের সব কাজ করতো। অপারেশনের অন্যান্য স্থানসমূহ ছিল খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর ও সিলেট। সামরিক দায়িত্ব বণ্টন ছিল নিম্নরপ:

৫৭তম পদাতিক বাহিনী স্থান:- ঢাকা

ব্রিগেডিয়ার জাহানবাজ আবরারের নেতৃত্বে

৫৩তম পদাতিক বাহিনী –স্থান:--কুমিল্লা

ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির নেতৃত্বে

২৩ হম ব্রিগেড—স্থান:-- রংপুর

ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ খান মালিকের নেতৃত্বে

১০৭তম ব্রিগেড—স্থান:--যশোর

ব্রিগেডিয়ার এ আর দূররীনের নেতৃত্বে

স্থান:- চট্টগ্রাম, ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার

বাঙালি ব্রিগেডিয়ার

২৪, ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বিভাগের জেনারেলদের একটি দল হেলিকপ্টারে প্রধান প্রধান গ্যারিসন প্রদক্ষিণ করে সিনিয়র কর্মকর্তাদের দিক নির্দেশনা দেন। এই দলে ছিলেন জেনারেল হামিদ, জেনারেল মিটটা, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার কর্নেল সাদ উল্লাহ।

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে--- যশোর পাঠানো হয়।

জেনারেল খাদিমকে--- কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম

ব্রিগেডিয়ার এল ইদ্রিস ও কর্নেল সাদউল্লাহ- রংপুর

সফরে যান।

১৩তম সীমান্তবর্তী সৈন্যদল, সেনানিবাস সংরক্ষণ

৪৩তম হালকা বিমানধ্বংসী বাহিনী তেজগাঁও বিমানবন্দর

৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট -- রাজারবাগ পুলিশ লাইন নিষ্ক্রিয় করা

১৮তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট-- পুরান ঢাকা, নবাবপুর

৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্ট-- মোহাম্মদ পুর, মিরপুর

৩ এসএসজি একটি প্লাটুন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করবে, দায়িত্বে:- মেজর বেলাল ও লেফ: কর্নেল জেড এ খান

২২তম বালুচ ও ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

২২তম বালুচ পিলখানা

১৮ ও ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট-- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা

পাকিস্তানি সেনারা শহীদ মিনার, দৈনিক ইত্তেফাক কার্যালয়, ডেইলি পিপল কার্যালয়, রমনার কালি মন্দির ধ্বংস করে।

মেজর রাও ফরমান আলীর ডায়রীতে লেখা ,‘পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি লাল করে দেয়া হবে।’ কসাই জেনারেল টিক্কা খান সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আমি মাটি চাই, মানুষ নয়। কিল দি পিপল থ্রি মিলিয়ন।’ ২৫ মার্চ বিকেলে জেনারেল ইয়াহিয়া খান অত্যন্ত গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। চলে যান কলম্বো হয়ে পাকিস্তান।

জেনারেল টিক্কাখানও ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ছাড়েন। থেকে যান জেনারেল নিয়াজি। রক্তখেলায় মেতে উঠে দেশীয় রাজাকারদের সহযোগিতায়। লুটতরাজ, নারী ধর্ষণ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, করে চালিয়ে যায় গণহত্যা। পরবর্তীতে টিক্কা খান পাকিস্তানে ফিরলে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নারীদের ধর্ষণের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তরে তিনি বলেন, ‘মাত্র তিন হাজার বাঙালি ধর্ষিত হয়েছিল। তাদের গর্ভে পাকিস্তানিদের সন্তান সাচ্চা মুসলমান হয়ে জন্ম নিবে।’ সাংবাদিক ডা. ডেভিসের মতে যুদ্ধের সময় প্রায় চার লাখ চার হাজার নারী ধর্ষিত হয়। কম করে হলেও এক লাখ সত্তর হাজার মহিলা ঐ সময়ে গর্ভপাত করেন। যুবতী মেয়েরা রেহাই পেতো না, রাজাকাররাই ব্যাক্তিগত আক্রোশ থেকে মেয়েদের ধরে নিয়ে আর্মি ক্যাম্পে দিয়ে দিত। গণহত্যার হিসাব অনেক চোখের জলে মিশানো এক ভয়ংকরতম অধ্যায়। যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক


বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান স্বাধীনতা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ‌্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন

আজ ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আজকের দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং একইসঙ্গে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবেও ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশি বাঙালি ও আদিবাসীদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিন আজ, যা কোনোভাবেই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। বিশেষ করে, স্বাধীন দেশে জন্ম নেওয়া কোনো মানুষের পক্ষে পরাধীনতা কী-তা কখনোই এবং কোনোভাবেই বোঝা সম্ভব না এমনকি স্বাধীনতা কী তাও বোঝা সম্ভব না। কারণ, তারা পরাধীনতার কষ্ট কখনো বুঝতে পারেনি। যারা স্বাধীনতার জন্য স্বজন হারিয়েছেন, তারা কিছুটা হয়তো অনুধাবন করতে পারেন আজকের দিনটিকে। তাও কি বুঝতে পারেন? যতটুকু পারেন সেটা স্বজন হারানোর কষ্ট। কিন্তু পরাধীনতা কী তাদের পক্ষে আদতে বোঝা সম্ভব? সম্ভবত সম্ভব না। এজন্য বর্তমান যারা নতুন প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি তারা হয়তো আজকের এই দিনটির মাহাত্ম ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারবেন না। কিন্তু আপনার পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে গেলেই আপনারা এই দিনটির তাৎপর্য গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। কবি মহাদেব সাহা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং এ দেশের একজন হতে পেরে বলেছিলেন, “তোমার বুকের মধ্যে আমাকে লুকিয়ে রাখো, আমি এই মাটি ছেড়ে, মাটির সান্নিধ্য ছেড়ে, আকাশের আত্মীয়তা ছেড়ে, চাই না কোথাও যেতে, কোথাও যেতে”। হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, “আমি আমার নিজের দেশ নিয়ে অসম্ভব রকম আশাবাদী। আমাকে যদি একশোবার জন্মাবার সুযোগ দেয়া হয় আমি একশোবার এই দেশেই জন্মাতে চাইব। এই দেশের বৃষ্টিতে ভিজতে চাইব। এই দেশের বাঁশবাগানে জোছনা দেখতে চাইব।”

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।”

১৯৪৭ সালে যখন পাক-ভারত স্বাধীন হয় তখন আর সবার মতো পূর্ববঙ্গের মানুষ তাদের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি প্রত্যাশা করেছিল। বিশেষ করে, ১৯০ বছরের ইংরেজ শাসন ও দেশীয় জমিদারের জুলুম থেকে যখন পরাধীন দেশ স্বাধীন হলো তখন এই চাওয়াটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুসহ অপরাপর নেতাও পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুসলিম লীগের সভাপতি ও পাকিস্তানের গর্ভনর মোহাম্মদ আলী জিন্না ও তাদের অপরাপর নেতার ভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে দেওয়া ভাষণে স্পষ্ট হয়ে যায় ‘পাকিস্তান’ নামক দেশের আমরা কেউ নই। ভাষার বিষয়টিকে যারা শুধু রাজনৈতিক ভাবেন তারা ভুল ভাবেন। এই বিষয়টির সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক গভীরভাবে যুক্ত। ফলে আমরা বুঝে গেলাম আমাদের করণীয়। ভাষা প্রশ্নে মূলত আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক হলাম। ভাষার জন্য জীবন দিলাম। এরপর আমাদের প্রকৃত এক হবার বিষয়টি বোঝা গেল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের মাধ্যমে। এরপর শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনের শুরু। পাকিস্তান স্বাধীন হবার ৯ বছর পরও একটি সংবিধান রচনা করা যায়নি। এটা একটি জাতির নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতা। সেই সংবিধান আমরা পেলাম ১৯৫৬ সালে। তার মেয়াদও থাকল মাত্র ২ বছর। জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণ করে সংবিধান রহিত করলেন। পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনের ইতিহাসে মাত্র ২ বছর একটি বিকলাঙ্গ সংবিধান দ্বারা দেশ পরিচালিত হয়েছে। বাকি ২২ বছর সেই সংবিধানও ছিল না। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর আমরা দেখিয়েছি, একটি দেশের জন্য ১ বছরেরও কম সময়ে একটি কার্যকর ও জনমতের প্রতিফলন ঘটে এমন একটি সংবিধান দেওয়া যায় বা রচনা করা যায়। এরপর ১৯৬২ সলের শিক্ষা আন্দোলনের পর যখন ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করেন তখন বাঙালি জাতি পেয়ে যায় তাদের মুক্তির সনদ। মূলত ৬ দফার ওপর দাঁড়িয়েই আমাদের বাংলাদেশ। ৬ দফা ঘোষণার কয়েক মাস পরই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাবন্দি করা হয়। শুরু হয় বাঙালি জাতির এক নতুন সংগ্রাম। শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় নেতাদের জেলখানা থেকে মুক্ত করা এবং একই সঙ্গে আইয়ুব খানের শাসনের অবসান ঘটানো। বাঙালি জাতি ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেই ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হয়। তারা শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজবন্দিদের মুক্ত করে এবং একইসঙ্গে আইয়ুব খানের এক দশকের শাসনের অবসান ঘটায়। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন, ১ বছরের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন দেবেন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ইয়াহিয়া খান নির্বাচন দেন। আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক (পূর্ব পাকিস্তান/ পূর্ব বাংলা) ও জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানের দ্বিতীয় জনপ্রিয় দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য গো ধরে বসলেন। ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের পূর্ব নির্ধারিত অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন।

শুরু হয় বাঙালির অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই রাস্তায় বের হয়ে আসে। পূর্ব পাকিস্তানে ২ তারিখ থেকে হরতাল পালিত হয়। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির জন্য পরবর্তীতে কী করণীয় তা বলে দেন। শুরু হয় জুলফিকার-ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে তারা সময়ক্ষেপণ শুরু করে। মূলত সেই সময়ক্ষেপণের মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের বাঙালিকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তারা ইতিহাসের জঘণ্যতম হত্যাকাণ্ড শুরু করে। নাম দেয় অপারেশন সার্চলাইট। এটি মূলত ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত পরিকল্পিত গণহত্যা, যার মাধ্যমে তারা ১৯৭১-এর মার্চ ও এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। এই গণহত্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আদেশে পরিচালিত, যা ১৯৭০-এর নভেম্বরে সংঘটিত অপারেশন ব্লিটজ্‌-এর পরবর্তী অনুষঙ্গ। অপারেশনটির আসল উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চ এর মধ্যে সব বড় বড় শহর দখল করে নেওয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার গভীর রাতে পূর্ব পাকিন্তানের নিরীহ জনগণের ওপর হামলা চালায়। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গোলাবর্ষণ করা হয়, অনেক স্থানে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয় এবং অনেক স্থানে পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানায়, ঢাকার রাস্তায়। এমতাবস্থায় বাঙালিদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং অনেক স্থানেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা না করেই অনেকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। পরবর্তিতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাবার পর আপামর বাঙালি জনতা পশ্চিম পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ভারতের অবিস্মরণীয় সমর্থনের ফলস্বরূপ দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে (২৬ মার্চ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হবার একটু আগে ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর (২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে) তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন যা চট্টগ্রামে অবস্থিত তৎকালীন ই.পি.আর-এর ট্রান্সমিটারে করে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৪ বছর। বাংলাদেশের আজ ৫৪তম স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন এখনো পুরন হয়নি। বিশেষকরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে যে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার মিশন শুরু হয়, তা প্রায় দেড় দশক ধরে চলে। বিশেষ করে জেনারেল জিয়ার অপশাসন; জিয়া তার এক আদেশে বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার বন্ধ করে খুনিদের পুনর্বাসন শুরু করলেন। বিভিন্ন দূতাবাসে তাদের বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত করলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রথম ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬ সালে। অর্থ্যাৎ যে দল স্বাধীনতা এনেছিল সেই দল বা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতার ৪ বছর পর থেকে টানা ২১ বছর ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে জেনারেল জিয়ায় আইনটি বাতিল করেন। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার। ২০০৯ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়। পরবর্তীতে আরও ১ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। ১ জন জিম্বাবুয়েতে মৃত্যুবরণ করে। এখনো ৫ জন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও বিভিন্ন দেশে পলাতক আছে। আমদের প্রত্যাশা ইন্টারপোল এবং ঐ দেশগুলো খুনিদের ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে এবং তাদেরও ফাঁসি কার্যকর হবে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থেকে আমাদের লক্ষ্য এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা এখন ধীরে ধীরে পূরণ হচ্ছে। বাংলাদেশের যে কারণে স্বাধীনতা প্রয়োজন ছিল সেই প্রয়োজন এখন পূরণ হচ্ছে। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের চর্চা সুদৃঢ় হচ্ছে। আমাদের দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম সেই ধারা অব্যাহত রাখবে বলেই আশা করি। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “এই স্বাধীনতা তখনি আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে।” বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত বাংলাদেশের প্রত্যাশায় আমরা সবাই।

লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)


লোকদেখানো মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
হীরেন পণ্ডিত

বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরব ও অহঙ্কারের বিষয় হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। কোনো জাতির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে শরিক থাকা, সামান্যতম অবদান রাখতে পারা যে কোনো ব্যক্তির জন্য গর্বের ব্যাপার। আমাদের গৌরবের জায়গা হলো এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। শোষণ-বঞ্চনামুক্ত একটি উদার, গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়েই এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটি জাতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সব ধরনের ব্যবস্থাই নিয়েছিল পাকিস্তাানিরা। এ কারণেই তারা দেশের শ্রমজীবী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের হত্যা করেছিল। যারা বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছিলো বাঙালি জাতি কীভাবে তাদের পরাজিত করেছিল তার সঠিক ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা সবারই দায়িত্ব ও কর্তব্য।গণতান্ত্রিক যে চেতনা নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিলো স্বাধীনতার ৫২ বছর পর মানুষ আজ সেই সুফল ভোগ করছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ এমন উদ্যোগ লোকদেখানো ও ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয় মনে করেন এদশের সচেতন মহল। মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগকেই তাদের আদর্শিক দল মনে করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের যথযথ মল্যায়নের সময় এসেছে বলেও তারা মনে করেন।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞা ও নির্দেশিকার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আয়োজনে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার অপরিণামদর্শি কার্যকলাপের দায় আমাদের সকলকে বহন করতে হবে। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে প্রায় ত্রিশটি জাতীয়করণকৃত লাভজনক বিশাল বিশাল শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ন্যস্ত করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য ঢাকার চিড়িয়াখানা পাশে কয়েক একর জমি বরাদ্দ রেখেছিলেন।

সামরিক বাহিনী, বিডিআর, জাতীয় রক্ষীবাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনীসহ সিভিল প্রশাসনে বেশকিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে পুনর্বাসন করেছেন। তিনি প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০% কোটাও প্রবর্তন করেন। অপরদিকে এক বিরাট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান। অবশিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধারাও বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রীয় আর্থিক অসহায়ত্ততা অনুধাবন করে কোনো কিছু দাবি না করে, জাতির পিতার উপদেশ অনুযায়ী যে যার অবস্থানে ফিরে যান। তবে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় গণ্য করে তাদেরকে আদর করে 'আমার সোনার ছেলে' ও 'আমার লালঘোড়া' অভিধায় আখ্যায়িত করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ভবিষ্যতে তাঁর আরো অনেক পরিকল্পনা ছিলো যার সব কিছুই আমরা জানি।

১৯৭৫ সালের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পালাবদলে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অবস্থান নিয়ে জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও খালেদা-নিজামী সরকার প্রায় আড়াই যুগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের কোনোই মূল্যায়ন করেননি। আদর্শ ও চেতনাগত দিক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারাও সেসব সরকারের নিকট থেকে কিছু আশাও করেননি। ২৩ জুন ১৯৯৬ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে একটু অন্ন তুলে দিয়েছেন সম্মানী দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারাও স্বস্তি পেয়ে আজ নিজেদের সম্মানের সাথে প্রকাশ করতে পারছেন। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের নামের পূর্বে 'বীর' অভিধা প্রদান করায় বঙ্গবন্ধু-কন্যার প্রতি কৃতজ্ঞ।

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ পালন করেছে বিএনপি। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বাঙালি জাতির ৫৩ বছরের অর্জন-মর্যাদা নিয়ে তামাশা করা সাধারণ কোনো ভুল নয়। এটি শুধু একটি অনৈতিক কাজই নয় বরং একটি ফৌজদারি অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ৩০ লাখ শহীদদের আত্মত্যাগ, দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা তরুণ প্রজন্মের কাছে দেশ প্রেম ও দেশাত্মবোধ সৃষ্টির একটি অনন্য দিন।

মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আমরা যে মুক্তির পথে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেই যাত্রা পথকে রুদ্ধ করে দিয়ে আবারও পাকিস্তানী ভাবধারায় ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার প্রমাণ আমরা পাই যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর নাম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, জয়বাংলা নিষিদ্ধ হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা নিধন করা হয়েছিল।
সশস্ত্র বাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করা হয়েছিল, সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হয়েছিল।

আলবদর, রাজাকার, আল শামসের প্রধানদের ক্ষমতায় বসিয়েছিল, যারা এই দেশটাকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করতে লিপ্ত ছিল, যারা যুদ্ধাপরাধ করেছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তাদের নিয়ে তারা ক্ষমতায় বসেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা নিধন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পরিপূর্ণভাবে বিকৃত করে ফেলা হয়েছে, বাকশালকে একদলীয় শাসনের অপবাদ দিয়ে বহুদলীয় শাসনের নামে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করা হয়েছিল। একজন অবৈধ ক্ষমতা দখলদারের পকেট থেকে ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেয়ার অপচেষ্টায় ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট গিলিয়ে বিভিন্ন দল থেকে ছুটে আসা লোকজন, মানুষের অধিকারকে নিয়ে খেলায় মেতে উঠে।

আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি তার ভাষার অধিকার পেয়েছে, স্বাধীনতা পেয়েছে, বাঙালি গণতন্ত্র পেয়েছে, আজ বাঙালি উন্নত সমৃদ্ধ জীবন পেয়েছে, বাঙালি তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। আর দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি-সমৃদ্ধি এসেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বিজয়ের মাসে ও স্বাধীনতার মাসে এখনো মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে কটাক্ষ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ ছিলো বাঙালি জাতির শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো আমাদের বাঙালি জাতির আজন্মলালিত স্বপ্ন, একটি জাতির চেতনার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন দোলা দিয়েছে আমাদের মনে, আমাদের স্বপ্নকে অনুপ্রাণিত করেছে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। সহায়তা করেছে স্বপ্ন বাস্তবায়নে এবং এই স্বপ্নকে বেগবান করেছে এবং এক নতুন আশা ত্বরান্বিত করেছে। যে চেতনা বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করেছিল একটি গণতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায়। এই চেতনা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আমাদের আরো কাজ করতে হবে। নতুন প্রজন্মের চেতনাকে আরো শাণিত করতে হবে।

যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, কিন্তু শুনেছে গল্পের আকারে তাদের পরিবারের কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির কাছে, শিক্ষকের কাছে, কোনো নেতার কাছে, কোনো মুক্তিযোদ্ধার কাছে বা বইতে পড়েছে। সেই শোনা বা পড়া কতটুকু সঠিক বা তার বিস্তৃতি কতটুকু, তা আমরা জানি না। একটি উদ্যোগ নিতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য আমরা কতটুকু সফল? ইতিহাস বিকৃতি জাতিকে ধ্বংস আর বিভ্রান্তি ছাড়া কিছুই দিতে পারে না।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে সে বিষয়টি নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা। যা নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসই হবে নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস, এই চেতনাকে শাণিত করতে আমাদের এখনই কাজ শুরু করা উচিত।

শেখ হাসিনার স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, দেশের মানুষকে উন্নয়নের স্বাদ পাইয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা, বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্থান দিয়ে যথাযথ মর্যাদার আসনে বসানোই ছিল মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অঙ্গীকার ছিলো দেশবাসীর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার পূরণ করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশি-বিদেশি নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উন্নয়ন, অগ্রগতি আর সমৃদ্ধির পথে হাঁটছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আমরা সবসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার অঙ্গীকার করি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা বলি, কিন্তু নতুন প্রজন্মকে বোঝাতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়া কী? বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল একটা দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়া। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা এসব কোমলমতিদের হৃদয়ে গেঁথে দিতে হবে। এদের হাত ধরেই এ দেশ এক দিন দুর্নীতিমুক্ত, হিংসামুক্ত, বৈষম্যহীন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে উঠবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৩০ লাখ শহিদ, শহিদ বুদ্ধিজীবী, অজস্র, অগুনতি মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধা ও লাখ লাখ বীরাঙ্গনা এবং স্বাধীনতা প্রত্যাশী কোটি কোটি বাঙালির নাম জড়িত। মাত্র ৯ মাসে দেশ স্বাধীন হওয়ার নেপথ্যে যা অন্যতম বিষয় হিসেবে কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপনে বড় বাধা, ব্যর্থতা ছিল দেশে চলমান রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিন্নতা। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও সার্বিক ইতিহাস উপস্থাপনে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে স্বাধীনতাবিরোধী জনগোষ্ঠী। এক কথায়, তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। ১৯৭৫ সাল কিংবা তার পরবর্তীকালে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তার পারিবারিক রাজনৈতিক চেতনা ও সমাজে বিদ্যমান চিন্তাধারা থেকে জেনেছে এবং শিখেছে। এই শেখা ছিল নিজেদের মতো করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সার্বিকভাবে উপস্থাপনে বাধা দিয়েছে তৎকালীন শাসকশ্রেণি, যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ছিল না বলে প্রতীয়মান হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নাম বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি মেনে নিতে পারেনি, পারে না ২৫ মার্চসহ অন্যসব পাশবিক হত্যাকাণ্ড। মূলত এই মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী দলগুলোই বাঙালি জাতির ভেতর বিভক্তি টেনে দিয়েছিল এবং আজও দিয়ে চলছে। দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার পাঁয়তারা চালিয়ে আসছে। দেশকে পরাধীনতার দিকে ঠেলে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করছে। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সাধারণ জনগণই পারে এই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে রুখতে। এর জন্য প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের প্রতি স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ধারণা এবং সার্বিক জ্ঞান। প্রয়োজন জনসচেতনতা।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট


স্বাধীনতা দিবস: জাতি, জাতির পিতা ও স্মৃতিজাগানিয়া মার্চ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মো: শাহিনুর রহমান

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন, যে-কারণে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পরিগণিত । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনে, এবং সেইহেতু বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনেও মার্চ মাসটির গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯২০ সালে মার্চ মাসের ১৭ তারিখ মুজিব প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। ৫১ বছর বয়সে, ১৯৭১-এর ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ বাঙালির উপস্থিতিতে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি ‘মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এর ডাক দেন ।

এমনিতে তো বছরের বারো মাসের প্রতিটিরই গুরুত্ব এবং তাৎপর্য রয়েছে। কিন্তু ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মার্চ মাসটি আমাদের জাতীয় জীবনের বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্যবহ এবং ঐতিহাসিক একটি মাস। সত্যি বলতে কি, এই মার্চ মাসটি আমাদের জাতীয় জীবনে সবসময়েই যেন সংগ্রাম ও মুক্তির বারতা নিয়েই আবির্ভূত হয়েছে।

১৯৪৭-এ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ভারত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র গঠিত হলে বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান নামে তার অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে শুরু হয় আমাদের সংগ্রাম। এরই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধীনতার আন্দোলন, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১-এ প্রত্যক্ষ যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জনতা তাদের মাতৃভূমিকে পাকিস্তানী নবউপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত স্বাধীন করে, এবং এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রায় পুরোটা জুড়েই জাতিকে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।

বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অব্দি মার্চ মাসটির নানান তারিখ নানান প্রাসঙ্গিকতায় উৎকীর্ণ আছে। সালের শেষ প্রান্তে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। ১১ মার্চ ‘বাংলাভাষা দাবি দিবস’ হিসেবে কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে বিশেষ ভূমিকা রাখে ছাত্র সমাজ। তৎকালীন ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। প্রতিবাদে ১২ মার্চ ও ১৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন চাপের মুখে বাধ্য হয়ে ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৮ দফা দাবি পুরণে স্বাক্ষর করেন।

১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসভায় জিন্নাহ্ ঘোষণা দেন, “উর্দু, এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” তার ঘোষণায় উপস্থিত জনতা ‘না না’ ধ্বনিতে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবেশেও একই ঘোষণা দেন, এবং সেখানে ছাত্ররাও ‘না না’ বলে জিন্নাহর কথার প্রতিবাদ জানায় । তারপর বহু প্রতিবাদ মিছিল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান আর একঝাঁক ছাত্র ও সাধারণ মানুষের শাহাদতের বিনিময়ে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো বাঙালির মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা, প্রাণের ভাষা বাংলা ।

১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টে পূর্ব বাংলার জনগণ নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ২১ দফা সনদ তৈরি করে। কিন্তু বাঙালিদের দাবিয়ে রাখতে পাকিস্তান সরকার ষড়যন্ত্রের পথ বেঁচে নেয় । ফলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। এভাবে পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য থেকে রক্ষা পেতে, নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে প্রাণান্তকর সংগ্রাম চালিয়ে যায়।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ভুট্টো এক অধিবেশনের ঘোষণা দেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভুট্টো-ইয়াহিয়া ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালিত হয় ।

স্বাধিকারের চেতনায় উদ্ভাসিত ছাত্রনেতারা ২ মার্চ প্রথম বারের মতো বাংলার মাটিতে লাল-সবুজের (তখন আমাদের জাতীয় পতাকায় সূর্যের উপর লাল বৃত্তের মাঝখানে হলুদ রঙের কাপড়ে তৈরি বাংলাদেশের মানচিত্র ছিল) পতাকা উত্তোলন করতে সক্ষম হয়েছিল ।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর প্রতারণার কথা তুলে ধরেন। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তিনি বলেন, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যার কাছে যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ । জয় বাংলা।”

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলার জনগণ দৃঢ় চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যক্রম অচল প্রায় হয়ে যায়। রেডিওতে, ঘরে ঘরে, মানুষের মুখে মুখে বাজতে থাকে “জয় বাংলা বাংলার জয় / হবে হবে হবে জয়, হবে নিশ্চয়। / কোটি প্রাণ একসাথে / জেগেছে অন্ধরাতে / নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়।”

অবস্থা ভয়াবহ দেখে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসে। এর পর আসে পশ্চিম পাকিস্তানের তৎকালীন বৃহত্তম দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো । ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ভুট্টো-ইয়াহিয়া আলোচনার নামে নানা অজুহাতে সময় অতিবাহিত করতে থাকে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর হত্যা পরিকল্পনায় অপারেশন সার্চ লাইট নামক নীল নকশা তৈরি করে। হত্যাযজ্ঞের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ২৫ মার্চ রাতের ভুট্টো আর ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে।

২৫ মার্চ রাতের মধ্যেই ঘুমন্ত বাঙালির উপর শুরু হয় বর্বরোচিত গণহত্যা। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ২৫ মার্চ কালরাত্রি নামে পরিচিত। কালরাত্রি অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে রাত পোহানোর আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন হানাদার বাহিনীর করতলগত হয়ে যাওয়ায় পরদিন চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্থাপিত অস্থায়ী বেতারকেন্দ্র থেকে জাতির জনকের এ ঘোষণা সম্প্রচার করা হতে থাকে ।

সমগ্র জাতি, অর্থাৎ বাংলাদেশের সে-সময়কার সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রায় সবাই পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ত্রিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ আর দু লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে মাতৃভূমি শেষপর্যন্ত হানাদারমুক্ত হয় প্রায় নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর । বীর বাঙালি জাতি তাদের মহান নেতার দিকনির্দেশনায় এই জনযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে স্বাধীন দেশের নাগরিকে পরিণত হয়।

তাই ২৬ মার্চ জাতির স্বাধীনতা দিবস; আবার ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মদিবস। বাঙালি জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০-এ এই গৌরবের মাস মার্চেই জন্মগ্রহণ করেন তৎকালীন ফরিদপুর (বর্তমান গোপালগঞ্জ) জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। বাংলাদেশে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং আন্তর্জাতিক শিশু দিবস একসঙ্গে উদযাপন করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর ১৭ মার্চ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় আর ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যে দিয়ে পালন করা হয়।

২০১৮’র ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনেই জাতিসংঘ বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশকেও একটি উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে, যা আমাদের জন্য পরম গর্ব ও গৌরবের বিষয় বটে। একই বছরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিও ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করে। দু’টোই জাতীয় জীবনে আমাদের অনেক বড় অর্জন।

বিভিন্ন অনিবার্য ঘটনার পরম্পরায় মার্চ মাসটি আমাদের জাতির ও জাতির পিতার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। হয়তো শীতের জড়িমার পর বসন্ত ঋতুর এ মাসটি স্বাধীনচেতা বাঙালির মধ্যে নবপ্রাণের ও প্রণোদনার সঞ্চার করে। মার্চের বসন্তের জাতক বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই প্রাণ ও প্রণোদনার পেছনকার প্রধান পুরুষ । তিনি যেন আমাদের মুক্তির, স্বাধীনতার মার্চের প্রতীকস্বরূপ । যতদিন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি এ পৃথিবীতে টিকে থাকবে, মার্চের গুরুত্ব বহমান থাকবে এবং বঙ্গবন্ধুর নাম বার বার স্মৃত, বৃত ও উল্লিখিত হতেই থাকবে ।

লেখক: কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ফোকলোরিস্ট।


পলাশফুলের ক্যাম্পাস বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ফারহানা ইয়াসমিন

কনকনে শীতের কুয়াশায় ঢাকা মেঘাচ্ছন্ন আকাশকে বিদায় জানিয়ে বাংলার বুকে পালাক্রমে ফিরে আসে বসন্তের ছোঁয়া। এমন মুহূর্তে প্রতিটি হৃদয়, প্রতিটি মানুষ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে নানানভাবে বসন্তকে বরণ করার তরে। এমনকি প্রকৃতিও নুয়ে পড়ে বসন্তকে আপন করে নিতে। চারপাশটা যেন নবউদ্যমে সেজে ওঠে বসন্তের পলাশ পরশে।

এ বছরের বসন্তে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসসংলগ্ন মুক্তমঞ্চের চারদিকে রাজত্বের আসনে বসেছে পলাশের হাট। এই হাটের ক্রেতা নেই, বিক্রেতাও নেই। তবে আছে শুধুই দর্শনার্থী। যারা হাটে আসে শুধু পলাশের পরশ নিতে, পলাশকে উপভোগ করতে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে পলাশের বিস্তার হাট আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর হৃদয়ে। শিক্ষার্থীরা যেমন দল বেঁধে নিজের স্থিরচিত্র ধারণ করছে পলাশের সঙ্গে তেমন শিক্ষকরাও দলবেঁধে পলাশের সঙ্গে অভিবাদন জানাচ্ছে তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে। অনেক সময় দেখা যায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ে একত্রিত হয়ে পলাশ প্রাঙ্গণে এসে ভাব-বিনিময় করে। মোদ্দাকথা, যৌবনের উন্মাদনার মতো ক্ষণস্থায়ী পলাশফুল। তবে এই ক্ষণয়স্থায়ী সুখ চলে গেলেও স্মৃতিতে থেকে যাবে পুরো বছর। সেই স্মৃতিচারণের জন্য ক্যাম্পাসের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রুচিশীল পোশাক পরিধান করে ক্যামেরায় বন্দি করে নিচ্ছে পলাশের সঙ্গে তাদের খুনসুটির মুহূর্তগুলো। বাইরের দর্শনার্থীরাও এসে ভিড় জমাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পলাশ প্রাঙ্গণে। সম্প্রতি শুরু হয়েছে বিভিন্ন বিভাগের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান উপভোগ করার পাশাপাশি সবাই সাদরে গ্রহণ করছে রক্তঝরা পলাশের ঘ্রাণ। এ কারণে বলতেই হচ্ছে মুক্তমঞ্চসংলগ্ন পলাশ প্রাঙ্গণ হয়েছে এখন ববির হটস্পট।

উল্লেখ্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পলাশফুলের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে বসন্ত এসে গেছে। সময়ের শাসন মেনে পলাশফুল আবার বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তেই ডুব দেবে অতল গহ্বরে। তবে পলাশের বিদায় যেন সুন্দরভাবে হয় সে জন্য মহৎ এক উদ্যোগ হাতে নিয়েছে বাংলা বিভাগের একদল শিক্ষার্থী। তারা নিজ উদ্যোগে সচেতনামূলক বাক্য কাগজে লিখে অতঃপর কাগজটি বেঁধে দিয়েছে পলাশ গাছে। ‘পলাশফুলকে সুন্দরভাবে উপভোগ করুন। অযথা ছিঁড়ে, ফুল নষ্ট করা থেকে বিরত থাকুন’। এমন লিখিত বাক্যগুলো থেকে বোঝা যায় সময়মতো বিদায় নিয়ে যাক পালাশফুল, অত্যাচার কিংবা আঘাত করে ফুলগুলোকে অকালে বিদায় নিতে বাধ্য করা থেকে আমরা যেন বিরত থাকি। এমন মহৎ উদ্যোগের জন্য আসলেই তারা প্রশংসার দাবিদার। সবশেষে বলতে চাই আগুনঝরা পলাশ জানান দিচ্ছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। বিলুপ্ত প্রায় এই পলাশকে বাঁচিয়ে রাখা এবং টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের উচিত বেশি বেশি করে পলাশগাছ লাগানো।


কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর নতুন ব্রিজ নির্মাণ খুবই জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আবুল কাসেম ভূঁইয়া

বর্তমান সরকার দক্ষিণ চট্টগ্রামে অবস্থিত দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু করেছে। কক্সবাজারের সঙ্গে রেল যোগাযোগ চালু হওয়ায় দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হলো। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বার্মার সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ চালু করার লক্ষ্যে ১৯৩০ সালের দিকে এখানে রেল ব্যবস্থা চালু করে। চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে; কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলের পরে পাকিস্তান আমলে এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো সরকার ওই রেললাইন আর সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়নি। বর্তমানে শেখ হাসিনা সরকার সেই অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন। দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারে সারা বছর ধরে পর্যটকদের আনাগোনা রয়েছে। বর্তমানে পর্যটকরা সড়ক পথে যাতায়াত করে থাকে। সড়ক পথে যাতায়াত করতে গিয়ে পর্যটকদের নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা সরাসরি বাসে করে কক্সবাজার আসছেন। বাসে যাতায়াত করতে পর্যটকদের অনেক সময় ব্যয় হয় এবং সড়ক পথে যানজটসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি বিমান সার্ভিস রয়েছে। যারা বিত্তবান তারা বিমানে স্বল্প সময়ে বেশ আরামে কক্সবাজার পৌঁছে যাচ্ছেন। কক্সবাজার রেল সার্ভিস চালু হওয়ায় শুধু চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়া যাবে না, রাজধানী ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের কলকাতা থেকে সরাসরি রেল সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। কক্সবাজার পর্যন্ত রেল সার্ভিসের ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা হচ্ছে। এই রুটে সর্বাধুনিক মানসম্পন্ন দ্রুতগামী রেল সার্ভিস চালু করা হবে। পর্যটকদের দেওয়া হবে নানা সুযোগ-সুবিধা। আরামদায়ক, নিরাপদ এবং দ্রুতগামী রেল সার্ভিস হওয়ার কারণে পর্যটকরা রেল সার্ভিসকে প্রাধান্য দিচ্ছে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেল সার্ভিস চালু হওয়ায় কক্সবাজারের গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে গেছে। কক্সবাজার হবে এশিয়ার অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। শুধু তাই নয়- কক্সবাজারের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে গেছে। বর্তমানে পর্যটন খাত থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আয় আসছে। তাছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের মৎস্যশিল্প, লবণশিল্প, বনজশিল্পের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের এবং শিল্পোদ্যোক্তাদের দুর্ভোগের অবসান হবে। আন্তঃএশিয়া রেল সার্ভিস চালুর যে পরিকল্পনা রয়েছে তাও বাস্তবায়ন হবে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেল সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের হলেও বর্তমান সরকার এর বাস্তবরূপ দিয়েছেন। অতীতে কোনো সরকার এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিতে সক্ষম হয়নি। সম্প্রতি পর্যটননগরী কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু হওয়ায় কক্সবাজারে পর্যটকদেরও আনাগোনা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু হওয়ায় দেশের মানুষ অনেক সন্তোষ প্রকাশ করেছে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ উন্নত হলেও একটি জায়গায় ত্রুটি রয়ে গেছে। বর্তমানে এই রুটে দ্রুতগামী রেল চলাচল করছে; কিন্তু কর্ণফুলী নদীর ওপর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কালুরঘাট সেতু দিয়ে বেশ ঝুঁকি নিয়ে রেলগুলো পারাপার হচ্ছে। ২৩৯ মিটার দীর্ঘ লোহার নির্মিত এ ব্রিজটি অনেক আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তারপরও জোড়াতালি দিয়ে এ কালুরঘাট ব্রিজকে পুনর্নির্মাণ করে রেল সার্ভিস চালু করা হয়েছে। জোড়াতালি দিয়ে নির্মিত এ ব্রিজ দিয়ে কতদিন পর্যন্ত রেলব্যবস্থা চালু রাখা যাবে তা আল্লাহ জানেন। কালুরঘাট ব্রিজ নির্মাণের পর ১৯৬০ সালের দিকে রেলের পাশাপাশি যানবাহন চলাচল চালু করা হয়। কালুঘাট ব্রিজ দিয়ে সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থা রক্ষা হতো। ১৯৮৯ সালের দিকে কর্ণফুলী নদীর ওপর যানবাহন চলাচলের জন্য শাহ আমানত সেতু নির্মাণ করা হয়। এই সেতু দিয়ে সড়ক পথে দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়। এদিকে কালুরঘাট ব্রিজ পুরাতন এবং জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় রেল যোগাযোগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ কারণে এ ব্রিজ দিয়ে রেল যোগাযোগ মাঝে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে কালুরঘাট ব্রিজ মেরামত করে রেল যোগাযোগ চালু করা হয়। সম্প্রতি কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু হওয়ায় কালুরঘাট ব্রিজকে বাংলাদেশ রেলওয়ে বুয়েটের কারিগরি সহায়তায় সংস্কার করে। বর্তমান সময়ে কালুরঘাট সেতু যে অবস্থায় আছে তা দিয়ে দ্রুতগামী রেল সার্ভিস চালু রাখা সম্ভব নয়। কালুরঘাট এলাকায় কর্ণফুলী নদীর ওপর নতুন ব্রিজ নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের; কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় অতি সম্প্রতি সরকার কালুরঘাট এলাকায় নতুন ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার আর্থিক সহায়তায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ডুয়েল গেজ এবং ডাবল লাইন ব্রি নির্মাণের ব্যাপারে চেষ্টা চলছে। তবে কবে নাগাদ এ ব্রিজের কাজ ধরা হবে তা এখনো জানা যায়নি। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা যায় ২০২৮ সালের মধ্যে এ ব্রিজের কাজ শেষ হওয়ার কথা। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে এখন পর্যটননগরী কক্সবাজারের রেল যোগাযোগ চালু হওয়ায় পর্যটকরা বেশ আরাম করে নিরাপদে কক্সবাজার যাতায়াত করতে পারছে। সরকারও কক্সবাজারকে আরও উন্নত এবং আকর্ষণীয় করার বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। কক্সবাজারের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে রেল যোগাযোগ চালুর স্বার্থে কালুরঘাটে নতুন ব্রিজ নির্মাণ একান্ত জরুরি। চট্টগ্রামবাসীর প্রাণের দাবি এই নতুন ব্রিজ নির্মাণ। চট্টগ্রামবাসী মনে করেন বর্তমান সরকার যেখানে পদ্মা সেতুর মতো সেতু নির্মাণ করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সেখানে কালুরঘাটে নতুন ব্রিজ নির্মাণ করা বর্তমান সরকারের জন্য কঠিন কিছু নয়। আশা করি কালুরঘাট এলাকায় নতুন ব্রিজ নির্মাণের ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক।


২৫ মার্চের স্মৃতি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
তোফায়েল আহমেদ

’৭১-এর ২৫ মার্চ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। মনে পড়ে, ২২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে বৈঠকে কর্নেল এম এ জি ওসমানী সাহেব (মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি) বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডু ইউ থিংক দ্যাট টুমরো উইল বি এ ক্রুসিয়াল ডে?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, ‘নো, আই থিংক, ইট উইল বি টুয়েন্টি ফিফথ্।’ তখন ওসমানী সাহেব পুনরায় তীক্ষ্ণ স্বরে তার কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘কাল তো ২৩ মার্চ। পাকিস্তান দিবস। সে উপলক্ষে ওরা কী কিছু করতে চাইবে না?’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ওরা যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছু করতে পারে। তার জন্য কোনো দিবসের প্রয়োজন হয় না।’ কী নিখুঁত হিসাব বঙ্গবন্ধুর। হিসাব করেই তিনি বলেছিলেন ২৫ মার্চেই পাকিস্তানিরা ক্র্যাকডাউন করবে।

মধ্য মার্চে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যখন বঙ্গবন্ধুর সংলাপ চলে, তখন আমাদের চারজনকে-যারা আমরা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে মুজিব বাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছি-মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমাকে প্রতিরাতেই ব্রিফ করতেন যে কি হয়েছে, কি ঘটছে এবং কি হতে চলেছে। তিনি কখনোই মনে করেননি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তিনি বলেছিলেন, ‘ইয়াহিয়া খানের সময় দরকার, আমারও সময় দরকার। তোমরা প্রস্তুতি নাও। আমি আক্রান্ত হব; কিন্তু আক্রমণকারী হব না। যখনই ওরা আক্রমণ করবে এবং আমরা আক্রান্ত হব, তখনই পৃথিবীর মানুষ বুঝবে স্বাধীনতা ঘোষণা করা ছাড়া আমার আর কোনো বিকল্প ছিল না।’

২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। সেদিন পাকিস্তানের পতাকা কোথাও ওড়েনি। শুধু ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া। আসগর খান তার বইয়ে লিখেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান সফরে গিয়ে আমি অবাক হয়েছি। কারণ পাকিস্তানের চিহ্ন আমি পূর্ব পাকিস্তানের কোথাও দেখিনি। শুধু ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া।’ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শুরুর আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে আসগর খান জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এরপর কি হতে পারে?’ বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ইয়াহিয়া খান আসবে। তার সঙ্গে অর্থনীতিবিদ আসবে। প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এম এম আহমেদ আসবে। তার সঙ্গে বিচারপতি কর্নেলিয়াস আসবে। আরও কিছু লোক আসবে এবং এসে আমার সঙ্গে আলোচনা করবে; কিন্তু এ আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না। এক দিন সে বাঙালি জাতির ওপর আক্রমণ করবে এবং সেদিনই পাকিস্তানের সমাধি রচিত হবে।’ ২৩ মার্চ আমরা বাংলার ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি।

আমার স্মৃতির পাতায় ’৭১-এর ভয়াল ২৫ মার্চের গণহত্যার কথা মনে পড়ে। ২৫ মার্চ বহু লোক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসেছেন। অনেকেই অনুরোধ করে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু, ৩২ নম্বরের বাসভবন ত্যাগ করেন।’ বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘ওরা যদি আমাকে না পায়, ঢাকা শহরকে ওরা তছনছ করবে। লাখ লাখ লোককে ওরা হত্যা করবে। আমি তো সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আমি এভাবে অন্য জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে পারি না। আমি আমার বাড়িতেই থাকব। কারণ আমি আমার জীবন বাংলার মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছি। জীবন এবং মৃত্যু একসঙ্গে। আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য মৃত্যুকে বারবার আলিঙ্গন জানিয়েছি। এবারও আমি এখানেই থাকব। আমার দেশ যে স্বাধীন হবে এতে কোনো সন্দেহ নাই।’ বঙ্গবন্ধু সবার শুভ কামনা করে বিদায় জানিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা যাও, আমার যা করার আমি করেছি।’ আমার মনে আছে ২৫ তারিখ তিনি বলেছিলেন, ‘সত্যিই আমার জীবন সার্থক। আমি যা চেয়েছিলাম আজ তাই হতে চলেছে। এই তো প্রথম বাঙালিরা বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পেরেছে। আজ আমার কথামতো, আমার নির্দেশিত পথে বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে। আজ আমি যা বলি মানুষ তা পালন করে। আমার অসহযোগ আন্দোলন সার্থক ও সফল হয়েছে।’ আমরা যখন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম, ওরা তো আপনাকে গ্রেপ্তার করবে। আপনাকে হত্যাও করতে পারে। উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমাকে গ্রেপ্তার করে, হত্যা করে ওদের লাভ হবে না। ওরা আগেও আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল। ওদের লাভ হয় নাই। এবারও আমাকে গ্রেপ্তার করুক, হত্যা করুক ওদের লাভ হবে না। আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। আমার মৃত্যুর পরে কেউ যদি আমার মৃতদেহ দেখে, দেখবে আমার মুখে হাসি। আমার জীবন সার্থক। কারণ, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হতে চলেছে।’ আমি এবং মণি ভাই সবশেষে রাত ১১টায় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। তিনি আমাদের দুজনের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। কোথায় গেলে অর্থ ও সাহায্য পাব সেসব কথা বলে আমাদের কপালে চুমু দিয়ে সে রাতে বিদায় দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন যাচ্ছি, তখন রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড। সেগুনবাগিচার একটি প্রেসে মণি ভাই লিফলেট ছাপতে দিয়েছিলেন। সেগুনবাগিচা গেলাম। আমরা হেঁটে মণি ভাইয়ের বাসায় গেলাম। এরপর রাত ১২টায় জিরো আওয়ারে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নীলনকশা অনুযায়ী শুরু হয় ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা নগরীর নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর পাকবাহিনী ট্যাঙ্ক ও ভারী অস্ত্রসহ ঝাঁপিয়ে পড়ে। কামানের গোলা, মর্টারের শেল আর মেশিনগানের ভয়াল গর্জনে রাত ১২টার পর পুরো নগরীই জাহান্নামে পরিণত হয়। চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী শুরু করে ইতিহাসের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড। শুরু হয় বাঙালি নিধনে গণহত্যা। চারদিকে শুধু বিকট আওয়াজ। লক্ষাধিক লোককে এক রাতেই হত্যা করেছে পাকবাহিনী। রাতে ওখানেই ছিলাম আমরা।

২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইয়াহিয়া খান বলেন, শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ‘মুজিব ইজ এ ট্রেইটর। দিস টাইম হি উইল নট গো আনপানিসড।’ বক্তৃতায় তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে আরও আগেই আমার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত ছিল। এদের নেতাদের আগেই আমার গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল।’

পরদিন ২৭ মার্চে ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ প্রত্যাহার হলে আমরা ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা বোরহানউদ্দিন গগনের- যিনি পরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন-বাড়িতে আশ্রয় নিই। কেরানীগঞ্জে ২ রাত থাকার পর ২৯ মার্চ আমি, মণি ভাই, জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান সাহেব এবং আমাদের বন্ধু ’৭০-এ নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. আবু হেনাসহ যিনি অসহযোগ আন্দোলনের সময় যে পথে কলকাতা গিয়েছিলেন এবং এসেছিলেন, সেই পথে-আমরা প্রথমে দোহার-নবাবগঞ্জ, পরে মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, বগুড়া হয়ে বালুরঘাট দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে ৪ এপ্রিল, ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করি।

মার্চের ২৫ থেকে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত কালপর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি নিধনে ৯ মাসব্যাপী বর্বর গণহত্যা পরিচালনা করে। ‘অপরাশেন সার্চলাইট’-এর নীলনকশায় ঢাকার ৪টি স্থান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং তৎকালীন পিলখানা ইপিআর (বর্তমান বিজিবি)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরাসহ ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্রলীগ নেতা চিশতী হেলালুর রহমান ও জাফর আহমদকে হত্যা করে। এ ছাড়া জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্রকে হত্যা করা হয়। ঢাকার ৪টি স্থান ছাড়াও রাজশাহী, যশোর, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রাম ছিল ‘অপরাশেন সার্চলাইট’-এর আওতাভুক্ত এলাকা। ’৭১-এর গণহত্যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ যে শহীদ হয়েছে তার অকাট্য প্রমাণ বহন করছে তৎকালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলো। অস্ট্রেলিয়ার পত্রিকা হেরাল্ড ট্রিবিউনের রিপোর্ট অনুসারে ২৫ মার্চ রাতে শুধু ঢাকা শহরেই ১ লাখ লোককে হত্যা করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন ’৭১ সালে। তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যা চালানোর অভিযোগ করেন। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ঙ্কর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের ড্যান কগিন, যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক, একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ÔWe can kill anyone for anything. We are accountable to no one.Õ বিশ্বখ্যাত এই পত্রিকাটির একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল, ÔIt is the most incredible, calculated thing since the days of the Nazis in Poland.Õ আন্তর্জাতিক মহলের মতে ’৭১-এ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘তিন মিলিয়ন’ বা ত্রিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে। এই সংখ্যার সমর্থন রয়েছে Encyclopedia Americana Ges National Geographic Magazine-G । এসব রিপোর্টে লেখা আছে, বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডে নাজী বাহিনীর বর্বরতার চাইতেও ভয়াবহ। এই গণহত্যা সম্পর্কে পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ডায়রিতে লিখেছেন, Ôpaint the green of East Pakistan redÕ অর্থাৎ তিনি বাংলার সবুজ মাঠকে লাল করে দেবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত হেরাল্ড ট্রিবিউন ’৭১-এর ১ জুন লিখেছে, ‘পাকিস্তানের গণহত্যা থেকে রেহাই পেতে লাখ লাখ উদ্বাস্তু মুসলমান এবং অন্যরা স্রোতের মতো ভারতে চলে আসছে।’ মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভের ১ মাস পর ২৬ এপ্রিল নিউজউইক লিখছে, ‘ইসলামাবাদ হাইকমান্ডের নির্দেশে সেনারা পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক এবং নেতৃত্ব প্রদানে সম্ভাবনাময় এমন সব লোককে পাইকারি হারে হত্যা করছে।’ রবার্ট পেইন তার ÔMassacreÕ গ্রন্থে ইয়াহিয়া খানকে উদ্ধৃত করে লেখেন, ÔKill three million of them and the rest will eat out of our hands.Õ ’৮১তে জাতিসংঘের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ÔAmong the genocides of human history, the highest number of people killed in lower span of time is in Bangladesh in 1971. An average of 6000 (six thousand) to 12000 (twelve thousand) people were killed every single day. …This is the highest daily average in the history of genocides.Õ এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশে গণহত্যা তদন্তে পাকিস্তানে যে ‘হামুদুর রহমান কমিশন’ গঠিত হয়েছিল, সেই কমিশন তাদের রিপোর্ট বাংলাদেশে গণহত্যার কথা স্বীকার করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের কথা বলেছে।

পৃথিবীতে অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু এভাবে রক্ত দিয়ে একজন নেতার নেতৃত্বে সব বাঙালি জাতি এক কাতারে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত হয়ে রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ২ লক্ষাধিক মা-বোনের সুমহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে ৯ মাসে মহান বিজয় অর্জন মানবজাতির ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনাই বটে!

লেখক: সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।


banner close