গত ২১ ডিসেম্বর দিনটি ছিল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। ৭৪ বছরের মাঝে এই প্রথম মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করল। সঙ্গে মিয়ানমারের অবহেলিত, নিপীড়িত জনমানুষের জন্যও দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মিয়ানমারের বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব ২৬৬৯ গৃহীত হয় এই দিন। নিরাপত্তা পরিষদ এই ঘোষণায় ‘সামরিক বাহিনী কর্তৃক আরোপিত চলমান জরুরি অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে এবং বেশ কয়েকটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোরও প্রদান করে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার জন্য এই ঘটনা একটি বিশেষ সাফল্য বহন করে। কেননা মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গৃহীত হওয়া এটিই প্রথম প্রস্তাব। এই প্রস্তাব মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সমস্যার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যই বটে।
আন্তর্জাতিক শান্তি, সংহতি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে এই ঘটনার মাধ্যমে এক নতুন আলোর সঞ্চার দেখা যায়। নিরাপত্তা পরিষদের তিন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য চীন, ভারত ও রাশিয়া ভোট প্রদানে বিরত থাকে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে চীন ও রাশিয়া তাদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ না করার মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রতি তাদের মনোভাবের পরিবর্তনের আভাস দিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা সামান্য হলেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
এই প্রস্তাবকে চারটি ভিন্ন দিক থেকে দেখা যায়। প্রথমত, এটি মিয়ানমার জান্তার ওপর চাপ তৈরি করার একটি পশ্চিমা কৌশল। এর ফলে পশ্চিমের কাছ থেকে কূটনৈতিকভাবে বেশ জোরালো চাপের মুখে পড়েছে মিয়ানমার জান্তা সরকার। যুক্তরাজ্য এই প্রস্তাব উত্থাপন করলেও দেশটি ছিল এই বিশেষ ঘটনায় পশ্চিমাদের মুখপাত্রস্বরূপ। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে মিয়ানমার জান্তা পড়েছে গভীর সংকটে, যার চিত্রায়ণ দেখা যাবে কূটনৈতিক মহলে।
দ্বিতীয়ত, এই প্রস্তাবে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিশেষ করে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ কঠিন পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। কাউন্সিল রাখাইন রাজ্যের সংকটের মূল কারণগুলো সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেয়। তারা রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি তৈরি করার কথা বলে। এটি রোহিঙ্গাদের মুখোমুখি হওয়া সমস্যাগুলোর সমাধানে সহায়তা করার জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করবে।
তৃতীয়ত, এই প্রস্তাবের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দৃশ্যমান ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এনএলডিকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করে আসছে জান্তা সরকার। অং সান সু চিসহ শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। চলছে গৃহযুদ্ধ। দেশের ভেতরে তৈরি হয়েছে এক ছায়া সরকার। তবে এই ছায়া সরকারের সঙ্গে শুরুতে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখলেও বর্তমানে পশ্চিমের রয়েছে নিবিড় কৌশলগত যোগাযোগ। সঙ্গে যোগ হয়েছে চীন ও রাশিয়ার পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসার মতো ঘটনা। এই ইস্যুতে ভেটো ক্ষমতার ব্যবহার না করার মাধ্যমে সরাসরি বিরোধিতা থেকে সরে এসেছে দেশ দুটি। তাই এই দ্রুত পদক্ষেপগুলো হয়তো দেখতে পাবে এক নতুন গতিশীলতা।
চতুর্থত, এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পেছনে আসিয়ানের দেশগুলোর বিশেষ অবদান রয়েছে। ভোটাভুটির পূর্বাপর ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল এই প্রস্তাব গ্রহণের পেছনে। একদিকে পশ্চিমাদের আগ্রহ, অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কায় অনেকটা বাস্তববাদী আচরণ করে এই দেশগুলো। যার ফলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট ও রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সমাধানের ক্ষেত্রে আসিয়ানের ভূমিকা ফুটে উঠেছে। এটি ভবিষ্যতে আসিয়ানের ভূমিকাকে আরও জোরালো করতে সাহায্য করবে।
উল্লেখ্য, কাউন্সিল তার শর্তাবলির মাধ্যমে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াগুলো সমুন্নত রাখার এবং মিয়ানমারের জনগণের ইচ্ছা ও স্বার্থ অনুসারে গঠনমূলক আলোচনা ও পুনর্মিলনের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে। সব পক্ষকে অবশ্যই মানবাধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনকে সম্মান করতে হবে। সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করতে এবং এই বিষয়ে আসিয়ান নেতৃত্বাধীন প্রক্রিয়া ও প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উৎসাহিত করতে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর (আসিয়ান) কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। সঙ্গে আসিয়ানের পাঁচ দফা ঐকমত্যকে কার্যকরভাবে ও পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়।
তবে প্রস্তাবের ভাষা নিয়ে ছিল প্রশ্ন। জাতিসংঘ সনদের অধ্যায় সাত (শান্তির প্রতি হুমকি, শান্তি ভঙ্গ এবং আগ্রাসনের ক্রিয়াকলাপের বিষয়ে পদক্ষেপ) এখানে সংযুক্ত নয়। নেই কোনো কঠোর বার্তাও। তাই কূটনৈতিক মহলে চলছে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা। এর তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করছেন সমালোচকরা। বিশ্ব পরিস্থিতি আমলে নিলে এবং এই অঞ্চলের ভূরাজনীতি একটু খতিয়ে দেখলে অবশ্য এই প্রস্তাবকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বরং অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি চাপে রয়েছে জান্তা সরকার- এটুকু জোর দিয়েই বলা যায়। আর এতে আছে জাতিসংঘে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের বিশেষ কৃতিত্ব।
জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধিরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করার লক্ষ্যে। এই প্রস্তাব তাই যেন বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য। আমাদের কূটনীতিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেয়ার বার্তাই যেন এই প্রস্তাব। যেসব দেশ মিয়ানমারের পাশে থেকে সাহায্য করে যাচ্ছে, তাদের জন্য এই প্রস্তাব এক বার্তাস্বরূপ। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে তারা কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না। বরং সময় এসেছে মিয়ানমারকে প্রশ্ন করার। কেননা আন্তর্জাতিকভাবে দরকার আরও জোরালো পদক্ষেপের।
তবে সামগ্রিক পরিস্থিতির বিচারে আন্তর্জাতিক তৎপরতা যথেষ্ট নয়। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সমগ্র বিশ্বের মনোযোগ সরে গিয়েছে রোহিঙ্গা সংকট থেকে। মানবতার চরম বিপর্যয় তাই এড়িয়ে গেছে বিশ্ববাসীর চোখ। জাতিসংঘের এই পরিবর্তিত রূপের ফলে আশা করা যায়, বিশ্বের দৃষ্টি আবারও এসে পড়বে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিপীড়নের ওপর। এর আগে সাধারণ পরিষদে বহুবার ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হলেও, এবারই প্রথম কার্যকরী কোনো সংস্থা থেকে এ রকম প্রস্তাব গৃহীত হলো।
পুরো বিষয়টিকে বাংলাদেশের কূটনীতির জন্য এক নতুন দিগন্তের সূচনা হিসেবে দেখা যায়। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের প্রতি চাপ প্রয়োগে এই প্রস্তাব এক কাঠামোগত রূপরেখা হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়াও সনদের অধ্যায় সাত সংযুক্ত করার ব্যাপারেও আরও সোচ্চার ভূমিকা পালন করা যাবে। এতে অবশ্যই চীন, রাশিয়াসহ অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তির সহায়তা লাগবে। তবে আশা জাগানোর মতো বিষয় হচ্ছে, চীন, ভারত ও রাশিয়া জাতিসংঘের এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটির ভোটাভুটিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া ইচ্ছা করলে তাদের ভেটো প্রয়োগ কিংবা অতীতের মতো হুমকি প্রদান করতে পারত। সঙ্গে পশ্চিমের প্রত্যক্ষ আগ্রহও উল্লেখ করার মতো। তবে সংকট সমাধান করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যেতে হবে বহুদূর।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিগত সরকারের দেওয়া তথ্য, বক্তব্য ও পরিসংখ্যানে বক্তব্যে দেশের অর্থনীতির সঠিক চিত্র দেখা যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিগত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছে। এর মাধ্যমে বর্তমান সরকার উপলব্ধি করবে, কী ধরনের উত্তরাধিকারের অর্থনীতিতে তাদের কাজ করতে হবে। সেই ভিত্তিভূমি নিরূপণ করাই কমিটির কাজ। নব্বই দিনের মধ্যে এটি সরকারকে জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। শ্বেতপত্রে দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র থাকার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ, জাতিসংঘের টেকসই অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন ও বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে করণীয় বিষয়ের প্রতিফলন থাকবে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করবে।
শ্বেতপত্রের ধারণাটি এসেছে যুক্তরাজ্যের সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে। সরকারের দ্বারা প্রকাশিত কোনো নীতিগত নথি যেখানে সংসদীয় প্রস্তাবনা থাকে, সেগুলোই শ্বেতপত্র, যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে এভাবেই শ্বেতপত্রের বর্ণনা দেওয়া আছে। এর ফলে, অধিকতর আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়। উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটেনে পার্লামেন্ট রিপোর্টের প্রচ্ছদ থাকত নীল রঙের। যদি রিপোর্টের বিষয়বস্তু সরকারের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ হতো নীল প্রচ্ছদ বাদ দিয়ে সাদা প্রচ্ছদেই সেগুলো প্রকাশ করা হতো। সেই রিপোর্টগুলোকে বলা হতো হোয়াইট পেপারস। এ প্রথা কোনো প্রস্তাবিত নীতি বা জনস্বার্থ সম্পর্কিত সমস্যার সঙ্গে যুক্ত নয়। বরং কোনো রাজনৈতিক দলের সরকার পরিচালনার পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক শাসক দলের কুকীর্তির দলিল হিসাবে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দায় নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার ঋণ রেখে গেছে ১৮ লাখ কোটি টাকা। বিগত বছরগুলোতে মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অবস্থাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতি সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে কেমন অর্থনৈতিক অবস্থা পেল সেটি বুঝতে অর্থনীতির একটা ‘হেলথ চেক আপ’। শ্বেতপত্র প্রণয়ন বর্তমানে অর্থনীতি কোন অবস্থায় আছে, উত্তরাধিকারসূত্রে কী পাওয়া গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলছে সেগুলোকে চিত্রায়িত করার কাজটাই করবে। এটা স্বাস্থ্য পরীক্ষার মতো। এ ছাড়া ‘মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাও করা হবে। পলিসি বা নীতিগত দিকটা কীভাবে চলছে, সেই পর্যালোচনাও থাকবে শ্বেতপত্রে। তারা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করবেন না। তারল্যসংকট, নামে-বেনামের ঋণ, সঞ্চিতি ঘাটতি এসব বিষয়ে পর্যালোচনা করা হবে। আর যেন টাকা পাচার না হয়, টাকা পাচার করলে শাস্তি পেতে হবে, এমন কথা বলা থাকবে শ্বেতপত্রে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে আকৃতি ও প্রভাব বিবেচনায় বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্পও রয়েছে। কোনো কোনো মেগাপ্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, কোনোটির কাজ চলমান। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অর্জন হিসেবে এসব মেগা প্রকল্পের কথা বেশ জোরেসোরেই প্রচার করে আসছিল। তবে পদ্মা সেতুসহ মেগাপ্রকল্পগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি অভিযোগ করে আসছে সরকার বিরোধীরা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার স্বার্থে প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। সময় স্বল্পতার কারণে সব প্রকল্প বিশ্লেষণ করবে না। তবে তারা মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করবে। মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যদি কোনো একটি বিশেষ প্রজেক্টের ওপর মনোযোগ দিতে হয় তারা সেটা করবেন।
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে আকৃতি ও প্রভাব বিবেচনায় বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্পও রয়েছে। কোনো কোনো মেগাপ্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, কোনোটির কাজ চলমান। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অর্জন হিসেবে এসব মেগাপ্রকল্পের কথা বেশ জোরেসোরেই প্রচার করে আসছিল। তবে, পদ্মা সেতুসহ মেগাপ্রকল্পগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি অভিযোগ করে আসছে সরকার বিরোধীরা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার স্বার্থে প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। সময় স্বল্পতার কারণে সব প্রকল্প বিশ্লেষণ করবে না। তবে তারা মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করবে। মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যদি কোনো একটি বিশেষ প্রজেক্টের ওপর মনোযোগ দিতে হয় তারা সেটা করবেন। কয়েক মাস আগে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রথম দশ মাসের রপ্তানি আয়ের হিসেবে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য ধরা পড়ে। রপ্তানির বাৎসরিক হিসেবে প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি দেখানোর ঘটনা বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। সরকারি সংস্থাগুলো পরিসংখ্যান নিয়ে অর্থনীতিবিদদের বিভিন্ন সময় সংশয় প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। ফলে তাদের দেওয়া তথ্য-উপাত্তের ওপর ভর করে পাওয়া চিত্র কতটা সঠিক হবে তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। যা তথ্য পাওয়া গেছে অর্থাৎ, বিবিএস (পরিসংখ্যান ব্যুরো), ইপিবি এবং অন্য সংস্থাগুলোর কাছে যা আছে তার ভিত্তিতে অর্থনীতির একটা বস্তুনিষ্ঠ চিত্রায়ণ এখানে আশা করা যেতে পারে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিতে অর্থনীতিবিদ ছাড়াও জ্বালানি, অভিবাসন, উন্নয়ন ও সুশাসনের মতো বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। নীতি বিশ্লেষক বা বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে কমিটির সদস্যরা তাদের মতামত দেবেন। আগামী দুই মাসের মধ্যেই কার্যক্রম গুছিয়ে আনা হবে। খাতওয়ারি যেমন- জ্বালানি, প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যাংক, রাজস্ব খাত, অর্থ পাচার, বৈষম্য ও দারিদ্র্য বিমোচনসহ বিভিন্ন বিষয় সদস্যদের মধ্যে ভাগ করা হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি জ্বালানি খাতসহ বিগত বছরগুলোতে হওয়া বৈদেশিক ঋণ চুক্তিগুলো খতিয়ে দেখা হবে। বিগত বছরগুলোতে বিদেশি ঋণসংক্রান্ত চুক্তিগুলো যদি পাওয়া যায় তাহলে তা খতিয়ে দেখে অবশ্যই তারা মূল্যায়ন করবেন। কোন সদস্য কী বিষয়ে দায়িত্ব পালন করবেন, ঠিক করা হয়েছে। ইস্যুগুলো নিয়ে তারা ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে ও বিদেশেও যারা বিশেষজ্ঞ আছেন তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। দেশের উন্নয়নে ১০ খাতে শ্বেতপত্র কমিটি কাজ করবে। শ্বেতপত্র কমিটি কোন কোন বিষয়ে মনোযোগ দেবে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো- সাধারণ অর্থনীতি, সামষ্টিক অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাত, মেগাপ্রকল্প, কর আহরণ, পাচার হওয়া অর্থ, বৈষম্য, দারিদ্র্য বিমোচনসহ শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কাজ করবে শ্বেতপত্র কমিটি। তথ্যগুলো আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তুলনা করে যাচাই করা হবে। ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র কমিটি যাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে, তাদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ বিগত সরকারের রেখে যাওয়া সামগ্রিক অর্থনীতির শ্বেতপত্র তৈরির কাজকর্ম শুরু করেছে। কমিটির কাজের পরিধি হবে নির্দেশনামূলক; বাধ্যতামূলক নয়। সময়ে সময়ে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তথ্যের সঠিকতা যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এবং সবার মতামত ও পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে গঠিত কমিটি কাজ করবে। দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ, জাতিসংঘের টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন ও স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে করণীয় বিষয়ের প্রতিফলন তুলে ধরা হবে এই শ্বেতপত্রে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটা শ্বেতপত্র তৈরি করা দরকার। শ্বেতপত্র তৈরি করলে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে। এই মুহূর্তে অর্থনীতিতে যে জটিল পরিস্থিতি রয়েছে, তা জানার জন্য এবং পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যা হবে একটি নির্দেশিকা। শ্বেতপত্রের অনেক সুবিধা আছে। নতুন সরকার কোন অবস্থায় অর্থনীতিকে পেল, তার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন তাদের যেমন দরকার, ইতিহাসের জন্যও দরকার। শ্বেতপত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি মূল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আলোচনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সৃষ্টি হবে। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যা এক ধরনের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দেবে। কোনো কারণে সরকার যদি না করে তাহলে পেশাজীবী নাগরিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসতে হবে। তাই শ্বেতপত্র তৈরি করা জরুরি।
শ্বেতপত্রের অনেক সুবিধা আছে। নতুন সরকার কোন অবস্থায় অর্থনীতিকে পেল, তার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন তাদের যেমন দরকার, ইতিহাসের জন্যও দরকার। শ্বেতপত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি মূল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আলোচনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সৃষ্টি হবে। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যা এক ধরনের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দেবে। কোনো কারণে সরকার যদি না করে তাহলে পেশাজীবী নাগরিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসতে হবে। তাই শ্বেতপত্র তৈরি করা জরুরি। শ্বেতপত্র তৈরি করতে হলে অবশ্যই সরকারকে একটি কাঠামো দিতে হবে। কাঠামোর সঙ্গে সরকারের আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান অবস্থানপত্র তৈরি করবে। যেমন- ইতোমধ্যে দায়দেনা পরিস্থিতি নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্র রয়েছে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার অবস্থানপত্র লাগবে। পাশাপাশি অংশীজনের মতামত নিতে হবে। এখানে বেসরকারি খাত, বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং উন্নয়ন সহযোগীদের আনতে হবে। ব্যক্তি খাতের বড় ও মাঝারিদের পাশাপাশি ছোট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মতামত নিতে হবে। শ্বেতপত্র তৈরিতে এক মাসের বেশি সময় নেওয়া উচিত হবে না। অনেক কিছুই নির্ভর করবে সরকারের মেয়াদকালের ওপর। মেয়াদকাল যাই হোক না কেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি ডেটা কমিশন করতে পারে। তথ্য-উপাত্তের ক্ষেত্রে যেসব ব্যত্যয় হয়েছে এবং ঘাটতি আছে বা যে ক্ষেত্রে নতুন প্রয়োজন দেখা দিয়েছেÑ সেই জায়গাটা পরিষ্কার করবে। তথ্যের উৎপাদক, ব্যবহারকারী এবং মূল্যায়নকারী এই তিন পক্ষকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সরকারি তথ্য-উপাত্ত সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। পাশাপাশি সাংবিধানিক সুরক্ষা দিতে হবে। ব্যাংকিং এবং জ্বালানি- এ দুটি খাত অর্থনীতির ফুসফুসের মতো কাজ করে। ব্যাংকিং কমিশন তৈরি করা দরকার। কিন্তু এর পরিধি কী হবে- তা সরকারের সময়কাল ও সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করবে। যে সময় পর্যন্ত সরকার থাকবে, তার মধ্যে ব্যাংকিং খাতের রোগ নির্ণয় করার সময় পাবে নাকি পথ্য দেওয়া ও চিকিৎসা করার সময় পাবে এবং ফলাফল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারবে- তা আমরা জানি না; কিন্তু একটি কমিশন হওয়া উচিত। ব্যাংকিং খাতে তথ্য-উপাত্তের সঠিকতা যাচাই করা হবে এর প্রথম কাজ। খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে বড় কাজ। প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন পর্যাপ্ততার মতো বিষয়গুলোকে স্বচ্ছতার সঙ্গে যাচাই করতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে মালিকদের প্রতিনিধিত্ব এবং সময়কাল পর্যালোচনা করে বর্তমানের শিথিল অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আমানতকারীদের স্বার্থ বিঘ্নিত না করে একটি বাস্তবসম্মত ‘এক্সিট পলিসি’ করতে হবে। ঋণ অবলোপনের নিয়ম পর্যালোচনা করতে হবে। ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ হতে হবে স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে। যেসব শক্তিশালী শিল্পগোষ্ঠী বা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী ব্যাংকের মালিকানায় রয়েছে, তাদের মালিকানার প্রশ্নটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সুরাহা করতে হবে। এটি খুবই জটিল রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়। করপোরেট সুশাসনে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে, যার সঙ্গে মালিকানা ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত। সরকারি ব্যাংক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে দিতে হবে। অভিজ্ঞ, বিজ্ঞ ও পেশাদারদের সমন্বয়ে একটা ‘ব্লুরিবন’ কমিটি করা যেতে পারে, যারা ব্যাংকে পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী নিয়োগের সুপারিশ অনুমোদন দেবে। ব্যাংকের পাশাপাশি এ ধরনের কমিটি দুদক, নির্বাচন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে হতে পারে। এতে রাজনৈতিক অনুগ্রহে নিয়োগের চর্চা বন্ধ হবে। জ্বালানি খাতের জন্য একটা টাস্কফোর্স করতে হবে। ২৩ থেকে ২৪ হাজার মেগাওয়াটের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট কেন উৎপাদন করতে হচ্ছে এবং একই সঙ্গে আমদানি করতে হচ্ছে টাস্কফোর্স তার ওপর প্রাথমিক একটা প্রতিবেদন দিতে পারে। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও দায়মুক্তির বিষয়গুলোও সেখানে আসবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট
ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধ অছিমদ্দীন ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল আর হালের বাংলাদেশ আমলে ৫৩ বছর পার করেছেন। পরকালের পথে পা দিয়ে রেখেছেন তিনি। অছিমদ্দীন দেখেছেন কীভাবে তার সামনে ব্রিটিশরা তল্পিতল্পাসহ চলে গেছে এ দেশ ছেড়ে, দেখেছেন কীভাবে সংসার ভেঙেছে পাকিস্তানিদের। নিজে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশ স্বাধীন করতে মহান মুক্তিযুদ্ধে। অতীত তার কাছে এখন ধূসর, স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে আনন্দ-বেদনার সুখ সর্বনাশের মুহূর্তগুলো গুটিয়ে গেছে। অফুরন্ত অবসরের আয়নায় অছিমদ্দীন দেখেন তার ছেটোবেলা, কৈশোরকাল, ক্যাম্পাস জীবন, যুদ্ধের রণাঙ্গন, মনুষ্য কারসাজিতে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির বেসাতি, নীতি-নৈতিকতার নানান বেশভূষা। নব্বই বছরে কত কিছিমের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে তার। জমিদার বরকন্দাজের পর একবিংশ শতাব্দীর সূচনাপ্রহরে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ এই সময়ও সমাজে বয়স, বর্ণ, পর্যায় ও প্রকারভেদে নানান কিছিমের মানুষ এখনো রীতি পদ্ধতি, নীতি ও নিয়মে ঔপনিবেশিত। শ্রমজীবী কর্মক্লান্ত মানুষের পাশাপাশি অতিচালাক ফিটফাট ট্রেড ইউনিয়ন নেতা-কর্মী, শিক্ষাবিহীন শিক্ষিতের সমারোহের পাশে প্রযুক্তিপ্রখর মেধাবী মুখ, মুক্তবুদ্ধি শান্ত সমাহিত চিন্তা-চেতনার সারিতে সহসা মৌলবাদী চেহারার মানুষ, উন্নয়নকর্মীর পাশাপাশি নিজের আখের গোছাতে তৎপর এনজিও কর্ণধার, সন্ত্রাসীর ভয়ে আতঙ্কিত মানুষ, চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী আত্মোৎসর্গীকৃত সেই পুলিশ সার্জেন্ট, ষড়যন্ত্রের শিকার গৃহহীন মানুষ, আশ্রয়ণ প্রকল্পে হাসিমুখের মানুষ, বানভাসি মানুষ, নিঃস্বার্থ ত্রাণকর্মীর পাশে সুযোগ-সন্ধানী অসৎ উদ্দেশ্য অভিলাষী চোখের মানুষ, কোণঠাসা সৎ ও নিষ্ঠাবান চাকুরে, ধান্দাবাজ আর আত্মস্বার্থের শর্করাসমৃদ্ধ জনস্বার্থসেবী আমলা, অবিবেচক বাসের হেলপার, ট্রাকের মাতাল ড্রাইভার, নীল সাদা অধ্যাপক, একচোখা আঁতেল, রাজনৈতিক শিল্পী, ঋণখেলাপি, ব্রিফকেসবাহী নতুন শিল্পপতি, নকল সরবরাহকারী, উদ্ধত ছাত্রনেতার সামনে অসহায় অধ্যক্ষ, জামিনপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী, কুকুরের মাংস বিক্রেতা আর এসিডে দগ্ধ তরুণীর দেশে সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটার। সময় সমাজ ও সংসারে এত পরিবর্তন দেখার জন্য প্রভু নিরঞ্জন তাকে যে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছেন এটাই আশ্চর্য লাগে। বড় কৃতজ্ঞতা তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি।
চোখে মোটা চশমা পরেন তিনি। ইতোমধ্যে তিনবার চোখের ছানি কাটাতে হয়েছে, দুবার বড় অপারেশন, ৪৩-এর মন্বন্তরে, ৭১-এর রণাঙ্গনে, অতিমারী করোনাকালে মরণপথ থেকে ফিরে এসেছেন। চৌকষ ক্রিকেটারের মতো সাফল্যের ছক্কা মেরেছেন কয়েকবার, আবার বোল্ড আউট হয়েও সাজঘরে ফিরেছেন কখনো-সখনো। শ্রান্তি ও ক্লান্তির কোলে মাথা রেখে তন্দ্রায় গিয়েছেন আবার নতুন উদ্যমে জেগে উঠেছেন। অছিমদ্দীন তালপাতায় হাত মকশ করেছে, শ্লেটে পেনসিল ভেঙেছেন, কাগজে মুখে কালির আলপনা এঁকেছেন। এখন তিনি দেখেন তার নাতি-পুতিরা কম্পিউটারে লেখাপড়া করে। ক্যালকুলেটরে অঙ্ক কষে, নামতা মুখস্ত তারা করে না, বানান শেখা লাগে না তাদের, ব্রেনে অঙ্ক কষার কাজটা নিয়েছে কত রং-বেরঙের জীবন জলন্ত জীবন তরঙ্গ।
ব্রিটিশ আমলে অছিমদ্দীন দেখেছেন গোরা পুলিশ, খাকি হাফপ্যান্ট বেল্টপরা চৌকিদার-দফাদার, নায়েব কানুনগো, মোটা পেট পঞ্চায়েত, শৌখিন ধুতিপরা জমিদার বাবু, রুমি টুপিপরা মৌলবী, পৈতা লাগানো ব্রাহ্মণ আর বাংলার বার বধূ। কলের গানে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ কিংবা ‘নিমাই দাঁড়াবে’ জাতীয় গান শুনতে শুনতে রাতে ঘুমুতে যেত বালক অছিমদ্দীন। কলের গান থেকে টেপ, টেপ থেকে চিপসে এখন গান শোনা যায়, ইউটিউবে পুরো সিনেমা দেখা যায়। স্কুলে যাওয়ার তাড়া ছিল না, তবে কুটে পণ্ডিতের হাতের বেতের ভয় তো ছিলই। বিনা মূল্যে পাওয়া পাঠ্যবই, দামি গাইড বইয়ের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে লেখাপড়ার মান। অকাতরে বিদ্যাদানে ধণ্য গুরুমশাইরা এখন কোচিংয়ের কসাই।
সেই অছিমদ্দীন কি দেখছে তার ৫২ বছর বয়সি বাংলাদেশে? জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নীতি-নৈতিকতাবিহীন দলীয় কর্মীর প্রবেশের প্রথা কেন চালু হলো এই সৌহার্দ-সম্প্রীতির পারিবারিক, সামাজিক সংসারে? এখন সামান্য একটা চারিত্রিক সনদ আনতে গেলে ইউপি সদস্য পর্যন্ত পক্ষ বিপক্ষভেদে আচরণ করে। গ্রামের ভেতর দিয়ে এলজিইডি রাস্তা বানাবে সেখানে ভাগ বসাবে ক্ষমতাসীন দলীয় কর্মী, সেই রাস্তা ওজন সর্বস্ব ভারী যানবাহন চলাচল করে রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত করবে ইউপি চেয়ারম্যান, স্থানীয় ঠিকাদার এমনকি উপজেলা প্রশাসনের নাকের ডগায়, চোরে চোরে মাসতুতো ভাইয়ের মতো আচার-আচরণে স্থানীয় শান্তি নিয়ম-শৃঙ্খলার মাঠ হচ্ছে বেদখল। বড় রাস্তার শরীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য বড় বড় উপদেশমূলক (গতিসীমা, ওভারলোডেড গাড়ি, একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না) বিলবোর্ডের খরচটাও অকার্যকর অপচয় মনে হয় প্রতিদিন গড়ে ৭০-৮০ জনের পথে দুর্ঘটনায় মৃত্যুও সংবাদে। বড় শহরে ট্রাফিক সিগনাল ও জলে আবার হাততোলা ট্রাফিকের বিচার বিবেচনাহীন ব্যবসাও চলে। অছিমদ্দীনের গ্রামের বসতবাড়ির গা ঘেঁষে চলে গেছে পাকা রাস্তা। সে রাস্তায় নসিমন মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতিতে চলাচলে সেই রাস্তায় হাঁটতে ভয় পায় সবাই। অকাল মৃত্যুর ফাঁদ পেতে মানুষকে গৃহবন্দি করে তুলছে। ফিটনেসবিহীন, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চলছেই কেউ দেখার নেই। গরিবের দিন এনে দিন খাওয়ার উপার্জন আনে যে ভ্যানগাড়ি তা চুরি হলে থানায় কিংবা পরিষদে নালিশ বা উদ্ধার প্রার্থনাতেও পয়সা লাগে, পাছে প্রশাসন ও বাহিনী তার চৌদ্দগোষ্ঠী যাচাইয়ে নেমে বিব্রত করতে শুরু করবে। অছিমদ্দীন ভাবে পদে পদে এসব ঠেকা-বেঠোকায় পড়ার জন্য কি তারা স্বাধীন হয়েছে। দিন দিন ভালো মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে, পালিয়ে বেড়াচ্ছে। রাতের চাইতে ভোরবেলায় ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য বেড়ে যাচ্ছে। কে কাকে দেখবে? বিপুল উন্নয়ন দৈনন্দিন সুশাসন কেড়ে নিচ্ছে কি না, শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন নতুন সংস্কার এর নামে পঙ্গু করে দিচ্ছে না তো জাতিকে, দেশের অদক্ষ শ্রমিক যাচ্ছে বিদেশে আর প্রতিবেশী দেশের শিক্ষিত ও দক্ষরা এসে এদেশ থেকে রেমিট্যান্স নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে স্মার্ট বাংলাদেশে। সাগর-রুনির চার্জশিট দিতে বিলম্বের কারণ খোঁজা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে সহযোদ্ধা সহকর্মীরা। সবখানে সংশয়, সন্দেহ, অধৈর্য, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং কেনাবেচা চলছে তো চলছে।
জাপানের এক মন্দিরে ৩ বানরের মূর্তি আছে- একটি বানর মুখে আঙ্গুল দিয়ে, এক বানর কানে আঙ্গুল দিয়ে এবং অপর বানর চোখে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। বানর তিনটির একান্ত প্রতিজ্ঞা যে, তারা খারাপ কিছু শুনবে না, খারাপ কিছু বলবে না এবং খারাপ কিছু দেখবে না। অছিমুদ্দীন কোরআন শরিফের সুরা বাকারার ৭ম আয়াতে পড়েছে (যারা গাফিল তারা ফিরবে না) আল্লাহ তাদের অন্তকরণ এবং তাদের কানগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন আর তাদের চোখগুলো পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন। আবার গাফিল বা কাফিরদের বলা হয়েছে ‘তারা বধির, ম্ক ও অন্ধ সুতরাং তারা ফিরে আসবে না’। (বাকারা, আয়াত-১৮)। অছিমুদ্দীন ভাবে সত্যিই তো মুখের কথা কানে শোনা এবং চোখের দেখায় তারতম্য ঘটলে বিপদ নিজের জন্য, পরিবারের জন্য ও দেশের জন্য। অছিমুদ্দীন প্রায়ই দেখেন নানান বিষয় আশ্রয়ে আচার-আচরণে চলনে বলনে সবাই কেমন যেন খাপছাড়া ও সমন্বয়হীনতার উদাহরণ সৃষ্টি করেই চলেছেন। অছিমুদ্দীন শুনেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নাকি বলা আছে কোনো বন্ধুদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিনষ্ট হতে পারে এমন কোনো মন্তব্য বা বক্তব্য দেওয়া যাবে না। অছিমুদ্দীন ভাবেন নিজেদের দূর্বলতা অন্যেরা জানুক এটা অন্যায়কারীরা কথা বলুক তা মোকাবিলা করতে পরস্পরের দোষারোপে ও দুর্বৃত্তপনাতে ও কম যান না অনেকে। কারও মাজা ভেঙে দিয়ে তারপর বলা তার মাজা ভেঙে গিয়েছে। অছিমুদ্দীনের ছেলেবেলায় পড়া, মনে হয় বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় বা বনফুলের একটা গল্প -পড়েছিলেন দুই গ্রামের পণ্ডিত কে কেমন বুদ্ধিমান তার পরীক্ষা প্রতিযোগিতা হচ্ছে দুই গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে। দিনক্ষণ ঠিক করে সবাই দুই গ্রামের মাঝখানে বটতলায় দুই পণ্ডিতের পাণ্ডিত্বের পরীক্ষা/বির্তক সভার আয়োজন করেছে। এক পণ্ডিত প্রশ্ন করলে অন্য পণ্ডিত জবাব দিতে পারলে সবাই ঢাকঢোল পিটিয়ে আনন্দ হৈ চৈ করে। বিষয়টি অনেকটা টাই ব্রেকারে গোল দেওয়া বা ঠেকানোর কসরতের মতো। তো একপর্যায়ে এক পণ্ডি -এর বাংলা কি হবে জানতে চাইল অন্য পণ্ডিত সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল ‘আমি জানি না’। আর যায় কোথায় মূর্খ গ্রামবাসী হৈ চৈ করে উঠল পণ্ডিত মহাশয় এটা জানে না, তিনি নিজেই স্বীকার করলেন। কি আর বলা, সঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য পণ্ডিত মহাশয়ের পরাজয় ঘোষিত হলো। কেউ আসল কথার ধারেকাছে গেল না, গলাবাজির সরগরমে সবার যুক্তি ও বুদ্ধি লোপ পেল। আপন আচরি ধর্মে আস্থাবান অছিমুদ্দীন ইদানীং দেখেন তার চারপাশে এভাবে এখনো বোকা বানানোর চেষ্টা চলছে।
লেখক: সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআর-এর সাবেক চেয়ারম্যান
সততা মানব চরিত্রের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ। মানব জীবনে সততার প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা সীমাহীন। মানবসমাজের নিরাপত্তা, সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির ভিত্তি হলো সততা। যারা এ গুণ অর্জন করতে সক্ষম হন, মহান স্রষ্টা দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। সত্যিকার মুমিন সততাকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকেও ঊর্ধ্বে মনে করেন। কেননা তারা জানেন, সততা ইমান ও ইসলামকে পরিপূর্ণতা দান করে। সততা ও বিশ্বস্ততার প্রতি আহ্বান জানিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক’ (সূরা আত তওবা-১১৯)।
মহান স্রষ্টা মানবসমাজকে যে সীমারেখায় চলার নির্দেশ দিয়েছেন, এগুলোর মধ্যে সততা অন্যতম। সততা শুধু মুসলমান নয়, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই প্রয়োজন; সে ইসলামের অনুসারী হোক কিংবা অন্য ধর্মের, চাকরিজীবী কিংবা ব্যবসায়ী, পদস্থ কর্মকর্মা কিংবা সহকর্মী, শিক্ষক বা ছাত্র, ধনী হোক বা গরিব, পিতা-মাতা হোক বা সন্তান। মানবসন্তানের চলার পথে প্রতিটা বিভাগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হল সততা। এই গুণ মানুষকে উন্নত, আদর্শ ও নৈতিকতায় ভূষিত করে এবং এর মাধ্যমেই মানবজীবনের সম্পূর্ণতা অর্জিত হয়।
সততা ব্যক্তি চরিত্রে আরোপিত একটি বিশেষ গুণ। গুণটি যখন কোনো ব্যক্তির চরিত্রে ওপর আরোপিত হয় তখন তাকে বলা হয় সৎ। সততার অস্তিত্ব চিন্তায় ও মননে; ধ্যানে, জ্ঞানে ও কর্মে। সততার ব্যবহারিক অভিব্যক্তি চরিত্রের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। একজন ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র ভালো হলে তিনি সচ্চরিত্রের অধিকারী হন; সবাই তাকে গ্রহণ করেন। অন্যদিকে নৈতিক চরিত্র খারাপ হলে তিনি দুশ্চরিত্রের অধিকারী হন; সবাই তাকে বর্জন করেন। আর এ জন্যই বলা হয়, ‘দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য’।
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন কোরআনুল কারিমের বহু স্থানে সততা ও স্বচ্ছতা অবলম্বনকারী নারী-পুরুষের ফজিলত, আখিরাতে তাদের পুরস্কার, তাদের মর্যাদার ব্যাপারে বলেছেন। সততা কেবল সত্য কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সত্য কথা বলার সঙ্গে কাজ-কর্ম, আকিদা-বিশ্বাস সবগুলোতেই সততা অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর কেউ আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করলে সে নবী, সিদ্দীক (সত্যনিষ্ঠ), শহীদ ও সৎকর্মপরায়ন-যাদের প্রতি আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন-তাদের সঙ্গী হবে এবং তারা কত উত্তম সঙ্গী’। (সূরা নিসা আয়াত-৬৯)।
কিয়ামতের দিন শেষ বিচারে সততার কারণে জান্নাত মিলবে সত্যবাদীদের। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ বলবেন, এ সেদিন যেদিন সত্যবাদীগণ তাদের সত্যের জন্য উপকৃত হবে, তাদের জন্য আছে জান্নাত যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে; আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তার প্রতি সন্তুষ্ট; এটা মহাসফলতা’। (সূরা মায়িদা আয়াত-১১৯) আল্লাহ সত্যবাদীদের পুরস্কৃত করেন তাদের সত্যবাদিতার জন্য এবং তার ইচ্ছা হলে মুনাফিকদের শাস্তি দেন অথবা তাদের ক্ষমা করেন। সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গ লাভ করার প্রতি আহ্বান জানিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর সঙ্গে তাদের করা অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন, তাদের কেউ কেউ (অঙ্গীকার পূর্ণ করে) মারা গেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা তাদের অঙ্গীকারে কোন পরিবর্তন করেনি; যাতে আল্লাহ পুরস্কৃত করেন সত্যবাদীদের তাদের সত্যবাদিতার জন্য এবং শাস্তি দেন মুনাফিকদের যদি তিনি চান অথবা তাদের ক্ষমা করেন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’। (সূরা আহজাব আয়াত-২৩-২৪)
অনেক সৎ গুণের সমষ্টি হলো সততা। অসংখ্য হাদিসেও সততার গভীরতার বিষয়টি ফুটে উঠেছে। এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়তের বিশুদ্ধতা ও সততার সঙ্গে আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের প্রার্থনা করেন, আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদায় পৌঁছাবে, যদিও সে বিছানায় মৃত্যুবরণ করে’। (সহিহ মুসলিম)। অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি সততা আন্তরিকতার সঙ্গে শাহাদত লাভ করতে চায়, শহীদ না হলেও শহীদের মর্যাদা ও সওয়াব দেওয়া হবে’। (সহিহ মুসলিম)।
রাসূল্লাহ (সাঃ) আরও বলেন ‘তোমাদের উচিত সততা ও সত্যতা অবলম্বন করা। কেননা সততা ও সত্যতা মানুষকে পুণ্যের পথে পরিচালিত করে আর পুণ্য জান্নাতের দিকে পরিচালিত করে। কোনো ব্যক্তি যখন সত্য কথা বলে এবং সততা ও সত্যতার গুণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, তখন আল্লাহর কাছে সত্যবাদী সিদ্দিক হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে বিরত থাক। নিঃসন্দেহে মিথ্যা পাপের দিকে চালিত করে। পাপ জাহান্নামে নিয়ে যায়। ব্যক্তি যখন মিথ্যা বলে এবং মিথ্যায় মনোনিবেশ করে তখন তার নাম আল্লাহর কাছে মিথ্যাবদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়’। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যাবতীয় লেনদেনে সততার পরিচয় দিলে তাতে বরকত হয়। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যদি ক্রেতা-বিক্রেতা সত্য বলে এবং ভালো-মন্দ প্রকাশ করে দেয় তাহলে তাদের লেনদেন বরকতময় হবে। আর যদি উভয়ে মিথ্যা বলে এবং দোষত্রুটি গোপন করে তাহলে এ লেনদেন থেকে বরকত উঠিয়ে নেওয়া হবে, (মুসলিম, হাদিস: ১৫৩২)।
সততা অবলম্বনকারীদের জন্য মহানবী (সা.) সুপারিশ করবেন। সততার প্রশংসা করে মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমার সুপারিশ তার জন্য যে সাক্ষ্য দেবে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। এমন নিষ্ঠার সঙ্গে যে তার অন্তর তার মুখকে সত্যায়ন করবে এবং মুখ অন্তরকে সত্যায়ন করবে, (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৮০৭০)।
মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সৎ ও সত্যবাদী হবে এবং কখনোই মিথ্যাবাদী হবে না, এমনটা নয়। সততা চর্চার বিষয়। সততার বিপরীত মিথ্যাÑযা পাপ, অন্যায় ও অপরাধের মূল উৎস। মিথ্যার চর্চা ও প্রচলনের ফলে মুসলিম সমাজে নেফাক, খেয়ানত ও প্রতারণার মতো নৈতিক অধঃপতন ও বিকৃতি দেখা দেয়। পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দার মধ্যে সিদ্দিকীন বা সাদেকীনদের কথা নবীদের পর পর উল্লেখ করা হয়েছে। সাদেকিন (সত্যবাদী) পক্ষে উন্নতি হওয়ার লক্ষ্যে প্রত্যেক মুমিনেরই চেষ্টা-সাধনায় ব্রতি হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন সর্বোত্তম আদর্শ ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নবুয়ত লাভের অনেক আগেই তার সততা ও বিশ্বস্ততার সুনাম সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সব মানুষ তাকে আল-আমিন বা মুহাম্মাদুল আমিন অর্থাৎ পরম বিশ্বস্ত সত্যবাদী উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তিনি প্রতিটি কাজে সততা, সত্যতা ও বিশ্বস্ততা রক্ষা করতেন।
একটি দেশের সব শ্রেশি-পেশা নির্বিশেষে-রাজনীতিবিদ, বিচারক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকতা, ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী, পেশাজীবী, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী সবার জন্য সৎ হওয়া অপরিহার্য। নীতির সঙ্গে নৈতিকতা সম্পর্কিত। নীতির কাজ মূল্যবোধ নির্ধারণ করা, আদর্শের মানদণ্ড নির্ণয় করা। আর নৈতিকতা হলো নীতির বাহ্যিক রূপ। নৈতিকতা নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করে। নীতির স্থান কেবল ব্যক্তির চিন্তা-চেতনায়, বিবেক, মগজে। আর নৈতিকতা শোভা পায় ব্যক্তির আচার-আচরণে, কাজকর্মে। মূলত আমরা যা বলি, যে কাজ করি কিংবা যে ভাবাদর্শ মানি, তা আমাদের ভেতরকার লালনকৃত নীতি-নৈতিকতারই প্রতিচ্ছবি।
তাই প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য জীবনে সততা ও বিশ্বস্ততার ফসল আহরণে যত্নবান হওয়ার। কেননা সততা ও সত্যবাদিতা আখলাকে হাসানের অন্যরকম বৈশিষ্ট্য। যার মধ্যে এ গুণের সমাহার থাকবে সমাজের সব ধরনের লোক তাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করবে। সর্বোপরি আখিরাতে আল্লাহর কাছে এর বিনিময় লাভ করবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে।
লেখক: পুলিশ সুপার, নৌ-পুলিশ
ছাত্র-জনতার বিপ্লবে দীর্ঘদিনের ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর যেসব অভাবনীয়, আনন্দের ঘটনা ঘটেছে এবং মুক্তির স্বাদ মিলেছে তন্মধ্যে অন্যতম ঘটনা হলো ৫ আগস্ট গণভবন জনতার দখলে যাওয়া। মানুষের কষ্ট আর ক্ষোভ এত বেশি ছিল, সেনাবাহিনী প্রথম দিকে গণভবনে ঢুকতে বাঁধা দিলেও পরবর্তীতে তারা সরে যায়। লাখো জনতা হুমড়ি খেয়ে পড়ে সাবেক স্বৈরাচার প্রধানের বাসভনের আনাচ-কানাচ দখলে। ভবনে প্রথম দিকে প্রবেশকারী অনেকে বলেছেন, নিয়মমাফিক দুপুরের রান্নাও হয়েছিল, ভাত ও তরকারি থেকে গরম ভাঁপ বের হচ্ছিল কিন্তু অপরাধীদের খেয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। রাষ্ট্রের ও জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বিলাসী জীবনের প্রতিচ্ছবি জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। জনগণের ক্ষোভের এ পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু লুটপাটের বিষয়টি প্রত্যাশিত ছিল না। শ্রীলঙ্কাতেও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনবিপ্লবের পর জনগণ রাষ্ট্রপতির বাড়ি দখল করে সুইমিং-এ গোছল করেছে, রাষ্ট্রপতির ব্যবহারের খাটে, চেয়ারে বসেছে; কিন্তু এগুলো নিজের মনে করে বাসায় নিয়ে যায়নি। ৫ আগস্টের বিপ্লবের বিজয়ের এ ঐতিহাসিক ঘটনা সারা বিশ্বের মানুষ লাইভ প্রত্যক্ষ করেছে। আমার অনেক বন্ধু যারা এ বিপ্লবে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে, তারা বিদেশ থেকে বলেছে, সবই ঠিক ছিল তবে লুঠতরাজের বিষয়টি বিশ্বদরবারে আমাদের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করেছে। তবে এ লুটতরাজের ফুটেজ ভালোভাবে দেখলে তা যে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা করেনি তা সহজেই বোঝা যাবে। শুনেছি পাশের জেনেভা ক্যাম্পের অনেক টোকাই বা ছেচকা চোরেরা এসব করেছে। কেউ কাউকে সেখানে বাঁধা দেওয়ার ছিল না। অধিকাংশ ছাত্র-জনতা এসব জিনিসে হাতই দেয়নি। তারপরও ভুলে যারা এ কাজ করেছে তারা ভুল বুঝতে পেরে গণভবনের ফটকে অনেক লুটের জিনিস ফেরত দিয়ে এসেছে। এগুলো এখনো সেভাবেই পড়ে আছে। আরেকটি ব্যাখ্যাও আমলে আনার মতো, মূল লুটপাট করেছে গণভবনের ভেতরে থাকা সাধারণ কর্মচারী ও শ্রমিকরা। তারা আসলে জানত কোথায় কি আছে। প্যাসিবাদের দুস্কৃতকারীরাও এরমধ্যে ছিল ইতোমধ্যে এর অনেক প্রমাণ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে।
যাই হোক বিপ্লবের পরবর্তী এক মাস এ ভবনে কোনো সংস্কার হয়নি। যেভাবে নিরাপত্তা দেয়ালসহ ভিতরে ভাঙচুর হয়েছে সেভাবেই রেখে দেওয়া হয়েছে। এক মাসপর উপদেষ্টা পরিষদ এখানে বিপ্লবোত্তর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে তথ্য ও আইসিটি উপদেষ্টা জানিয়েছেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্রুততম সময়ে গণভবনকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর করা হবে। সেখানে তুলে ধরা হবে বিগত ১৬ বছরের গুম, খুন, নির্যাতনের সামগ্রিক চিত্র। তার ভাষায়, অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা পাঁচ আগস্ট নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। জনগণের বিজয়কে ধারণ করে রাখার উদ্দেশ্যেই গণভবনের বর্তমান ভগ্নাবশেষ অক্ষত রেখেই জাদুঘরে রূপান্তর করা হবে যা জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। উপদেষ্টা বলেন, যেকোনো ফ্যাসিস্ট, স্বৈরচারী ও খুনি রাষ্ট্রনায়কদের কী পরিণতি হয়, তা পৃথিবীর বুকে একটা নির্দশন হিসেবে রাখার জন্য এই ভবনকে জাদুঘর করা হচ্ছে। আর জনগণই যে রাষ্ট্র ক্ষমতার আসল মালিক সেই বিষয়টিকে গুরুত দিয়ে গণভবনকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি জাদুঘরে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য একটি কমিটি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এ কাজ সম্পন্ন করা হবে। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও যারা জাদুঘর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি জাদুঘর করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের পরামর্শ নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়া বলেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি এবং বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের জনগণের ওপর অত্যাচার, গুম, খুনের স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখার জন্য গণভবনকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হবে। পরে জনসাধারণের জন্য তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। শিল্পী এবং জাদুঘর বিশেষজ্ঞ আর্কিটেক্টদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। পরিদর্শনকালে শিল্প উপদেষ্টা আজিজুর রহমান খান উপস্থিত ছিলেন।
উপদেষ্টার লক্ষ্য উদ্দেশ্য অবশ্যই মহৎ। তাছাড়া তিনি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কদের অন্যতম ছিলেন। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে তারা আন্দোলন চালিয়ে সব মত ও পথের মানুষকে একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। বিপ্লবের একমাস পর জাদুঘর করে এ স্মৃতি রক্ষার চিন্তা অবশ্যই ধন্যবাদ পাবে, তবে গণভবনইে স্মৃতিজাদুঘর করতে হবে বিষয়টি এমন নয়। বিপ্লবের নেতাদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে, বিপ্লবের স্মৃতি জাদুঘর কারও কাছে ইতিহাস রোমন্থন অন্যদিকে কারও কাছে ঘৃণা আর জিঘাংসা উদ্রেকের স্থান হিসেবে পরিগণিত হবে। আমার আশঙ্কা এভাবে জাদুঘর করলে যেমনটি উপদেষ্টা বলেছেন সাময়িকভাবে সবাইকে আন্দোলিত করলেও সময়ের বিচারে পরিস্থিতি উল্টে যেতে পারে। বরং এমনভাবে এর পরিকল্পনা করতে হবে যেন ফ্যাসিবাদের সমর্থকরা তা দেখে লজ্জিত হয় এবং তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে। মিসরের তাহরির স্কয়ারের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। যে তাহরির স্কয়ারের বিপ্লব মিসরে গণতন্ত্র এনেছিল এবং মুরসি সরকারকে ক্ষমতায় এনেছিল মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ঠিক তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবেই মুরসির পতন হয়েছিল এবং বিপ্লবের অনেক স্মৃতি ও গ্রাফিতি মুছে দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য আমার মনে হয় গণভবনে কারও বিজয়ের উচ্ছ্বাস আবার বিপরীতে ফ্যাসিবাদের সমর্থকদের কষ্টের কারণ হবে এবং সময়ের অপেক্ষায় থাকবে এটাকে নষ্ট করার। এ জন্য আমি মনে করি গণভবনে পাবলিক সংশ্লিস্ট কোনো স্থাপনা করে জনগণের প্রত্যহিক সেবার ব্যবস্থা করলে ভবিষ্যতে কোনো পরিবর্তন হলেও জনসেবার স্থানটি আর পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। এমন উদাহরণ আমাদের দেশে অনেক আছে। এ জন্য অনেকের সঙ্গে কথা বলে আমার যে ধারণা জন্মেছে তা হলো দ্রুত আবেগী সিদ্ধান্ত না নিয়ে উপদেষ্টার কথা অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করুণ এবং তারা দেশে-বিদেশের অভিজ্ঞতা দিয়ে একটি সুপারিশ করুক। এ সুপারিশ জাতির কাছে উন্মুক্ত করে তবেই আপনারা এ স্মৃতি জাদুঘর প্রকল্পে হাত দিন। প্রয়োজনে অনলাইনে সবার মতামত চাওয়া যেতে পারে। আমার মনে হয়, প্রস্তাবিত বিশেষজ্ঞ কমিটি শ্রীলঙ্কার ইন্ডিপেনডেন্ট স্কয়ার, ওয়াশিংটনের ‘সেকেন্ড ওয়াল্ডওয়ার ভ্যাটার্নস মেমোরিয়াল এবং ভিয়েতনাম ভেটার্নস মেমোরিয়ালকে তাদের কাজের স্যাম্পল হিসেবে নিতে পারে। এসব উদাহরণের মধ্যে আমার কাছে ভিয়েতনাম ভেটার্নসদের মেমোরিয়ালকে খুব যৌক্তিক ও আবেগ সৃষ্টিকারী মনে হয়েছে। সত্যিকারভাবে ফ্যাসিবাদের কালো অধ্যায় এবং বিপ্লবের স্বর্ণালী ইতিহাস ও শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে হলে প্রত্যেক শহীদের ইতিহাস ঐতিহ্য, তাদের জীবন বৃত্তান্ত, বিপ্লবে সংযুক্তির ইতিহাস সংযুক্ত করতে হবে যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত এখান থেকে ফ্যাসিবাদের শেষ করুণ পরিণতির শিক্ষা পায়। আরও যেসব বিষয় এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার চিন্তায় সংযুক্ত করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি: (১) ত্যাগ ও সংগ্রামের স্মরণ: মেমোরিয়াল বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাত্রদের সাহস, নিষ্ঠা এবং ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। এটি শহীদ ছাত্র-জনতাকে সম্মান জানাবে যারা এ ঐতিহাসিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের অবদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় থাকবে। (২) সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার প্রতীক: বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিজয় সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিজয়কে প্রতিনিধিত্ব করে। মেমোরিয়ালটি এ মূল্যবোধগুলোর প্রতীক হিসেবে থাকবে এবং বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রামের গুরুত্বের একটি স্থায়ী স্মারক হিসেবে কাজ করবে। (৩) ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা: মেমোরিয়ালটি একটি শক্তিশালী শিক্ষামূলক উপকরণ হিসেবে কাজ করবে, যা ইতিহাসের সঙ্গে একটি বাস্তব সংযোগ তৈরি করবে। এটি এমন একটি স্থান হবে কেবল বাংলাদেশের নয় বরং সারা পৃথিবীর শিক্ষার্থী, গবেষক এবং সাধারণ মানুষ আন্দোলন, এর কারণ এবং সমতাপুর্ণ সমাজ গঠনে এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারবে। (৪) সামাজিক অংশগ্রণের অনুপ্রেরণা: ছাত্রজোটের সফলতা তুলে ধরে মেমোরিয়ালটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সামাজিক কার্যক্রম, সামাজিক আন্দোলন এবং মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারে। (৫) সমষ্টিগত স্মৃতি সংরক্ষণ: একটি জাতির সমষ্টিগত স্মৃতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মেমোরিয়াল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে অতীতের সংগ্রাম ও বিজয়কে প্রতিফলিত করে এমন একটি পাবলিক স্পেস রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে অর্জিত শিক্ষা প্রাসঙ্গিক থাকে। (৬) জাতীয় গৌরব ও ঐক্য বৃদ্ধি: বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রদর্শন করে একটি মেমোরিয়াল জাতীয় গৌরব ও ঐক্যের অনুভূতি তৈরি করতে পারে। এটি নাগরিকদের মনে করিয়ে দেবে যে সংকল্প ও ঐক্যের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। (৭) গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করা: বৈষম্যমূলক প্রথার বিরুদ্ধে বিজয়কে স্মরণ করে মেমোরিয়াল গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ইনক্লোসিভ সোসাইটি এবং প্রতিবাদের অধিকারের মতো মূল্যবোধগুলোকে পুনঃমূলানের সুযোগ করে দেয় যা একটি সুস্থ, প্রাণবন্ত সমাজের ভিত্তি। একটি নিরপেক্ষ স্থানে একটি সার্বজনীন স্মৃতি জাদুঘর বা স্মৃতি মেমোরিয়াল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতিকে সর্বদা সজাগ রাখার এ মহতী উদ্যোগে উল্লিখিত পরামর্শগুলোকে আমলে নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক: সমাজচিন্তক, ইন্টারফেইথ বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
এ বছর গোমতীতে প্রচুর পানি বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন অযত্নে থাকার কারণে বাঁধের অবস্থা খুবই দুর্বল ছিল। পানি বৃদ্ধি পেতে পেতে বাঁধে যখন পানি উপচে পড়ার উপক্রম, তখন নদী দুপাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে চরম উৎকণ্ঠা বেড়ে যাচ্ছিল। স্থানীয়রা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে বাঁধ মেরামতে শরিক হতে দেখা যায়। এ কাজটি যখন এরা করছিল প্রতিনিয়ত নদী ভাঙন নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছিল। অবশেষে ২২ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টায় কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া গ্রামে হঠাৎ করে নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। বাঁধের পরিধি বিস্তৃত হতে হতে প্রচণ্ড বেগে লোকালয়ে পানি ঢুকে গ্রামকে গ্রাম ভাসিয়ে দেয়। মানুষের স্বপ্ন নিমিষে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। গোমতীর সঙ্গে সঙ্গে ঘুংঘুর নদী ও সালদা নদীর বাঁধও ভেঙে বিস্তৃর্ণ এলাকা প্লাবিত করে।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয়েছে কুমিল্লার ১৪টি উপজেলা। পানিবন্দি অবস্থায় ১৩দিন এলাকাটি থাকার পর ধীরে ধীরে পানি কমতে শুরু করে। দৃশ্যমান হতে দেখা যাচ্ছে রাস্তার ক্ষত। এরই মধ্যে রাস্তাঘাট বাড়ির উঠান থেকে পানি সরে যাওয়ার পর অনেকেই ফিরতে শুরু করেছেন নিজ বসতবাড়িতে। ঘরের উনুনটা তলিয়ে গেছে। রান্না ঘরটার অবস্থা যাচ্ছে তাই। প্রতিটা বসতবাড়ি দুরগন্ধময় পরিবেশ। পচা আবর্জনা কর্দমাক্ত হয়ে একাকার। এর প্রভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। থাকার ঘরের ধ্বংসের পাশাপাশি গ্রামবাসীর কৃষি খাত ও মাছের ঘের প্রাণিসম্পদ, রাস্তাঘাট ও ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মিলিয়ে কুমিল্লা জেলাজুড়ে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে সবার ধারণা। জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, এবারের বন্যায় জেলার মোট ২৩ হাজার ৪২টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মৎস্য জমির আয়তনে এর পরিমাণ ৫ হাজার ৮৩৫ দশমিক ৬১ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত এসব খামারে ২৫ হাজার ৫৩৮ দশমিক ৫০টন ফিন ফিশ ১০দশমিক ২৮ টন চিংড়ি মাছ, ১০কোটি ১৭ লাখ সংখ্যক পোনা মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে আরও করুণ অবস্থা। বুড়বুড়িয়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী মিথিলাপুর গ্রামের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির এমএসসি পাশ। ঢাকার একটি নামীদামি কোম্পানিতে চাকরি করা অবস্থায় স্টোকে প্যারালইসড হয়ে ডান সাইডটা তার একদম অবশ হয়ে যায়। ধার-কর্য করে বাড়িতে হাঁস-মুরগি খামার, গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প ছাড়া ও তিনটি পুকুরে মৎস্য চাষ করে। এগুলো আয়ের নির্ভরতাই ছিল তার সংসার । বন্যায় তার তিনটি পুকুরই তলিয়ে যায়। প্রায় ৫ লাখ টাকার মাছ বন্যার পানিতে ভেসে যায়। এ ক্ষতিতে লোকটি এখন পাগলপ্রায়। ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা তার জন্য খুবই কষ্টকর। এ রকম শত শত হুমায়ুন কবিরের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ এবারের বন্যায় ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এদের পাশে সরকার না দাঁড়ালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। মোট জাতীয় উৎপাদনেও ঘাটতি দেখা দেবে।
পুরো জেলায় ৫০০ কোটি টাকার মৎস্যসম্পদ বাবদ ক্ষতি হয়েছে। খামারিরা নিঃস্ব হয়ে গেল। কুমিল্লাতে মৎস্য উৎপাদনের জন্য পানি ও আবহাওয়ার দিক দিয়ে অত্যন্ত উপযোগী । তাই তো কৃষকরা ধান চাষে লাভবান হতে না পেরে মৎস্য চাষে বেশি উৎসাহিত হচ্ছেন। দিন দিন মৎস্য খামারির সংখ্যা বেড়েই চলছে। তাছাড়া মিঠা পানিতে মাছ উৎপাদনে সারাদেশে কুমিল্লার অবস্থান দ্বিতীয়। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে শুধু দাউদকান্দি উপজেলায় প্লাবন পানিতে উৎপাদিত মৎস্য দেশের এক দিনের মৎস্যের যোগানে সক্ষম । এই খাতে লাভবান হওয়ার কারণে সেখানে ধান চাষের চেয়ে মৎস্য চাষে অধিক পরিমাণে উৎসাহিত হচ্ছে ।কুমিল্লা জেলায় ২০২১- ২২ অর্থবছরে মাছের চাহিদা ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৫৭ মেট্রিক টন।উৎপাদন হয় দুই লাখ ৮৪ হাজার ৪১ মেট্রিক টন। উদ্ধৃত্ত ছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ১৯৪ মেট্রিক টন। ঢাকার বাজারে কুমিল্লার মাছেই বেশি সরবরাহ হয়। মৎস্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ও কুমিল্লা ভালো ভূমিকা রাখছে।আশে পাশের জেলার চাহিদা মিটিয়ে গত অর্থ বছরে কুমিল্লা থেকে ৫০ মেট্রিক টন মাছ রপ্তানি হয় যার মূল্য ১ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। মৎস্য চাষে অনেক পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন ও হয়েছে। রোপা আমনের বীজতলা, রোপা আমন ধান, আখের চাষ, শাকসবজি চাষাবাদে ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছে। কুমিল্লা জেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ১লাখ ৩৫ হাজার ২৩৮ হেক্টর। যার মধ্যে ৬৩ হাজার ৯৭৪ হেক্টর জমি ক্ষতি হয়। যা টাকায় মূল্য হলো ৮০০ কোটি টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বলেন এবারের বন্যায় জেলায় কৃষক প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।।আমরা এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষি প্রণোদনা, বিনামূল্যে সার ও বীজ বিতরণ ক্ষুদ্র ঋণ নেয়ার সহায়তা বিনামূল্যে কৃষি সেবা ও সার্বিক সহযোগিতা করবে। এবারের বন্যায় জেলায় গবাদি পশুর চার হাজার খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২ লাখ ৯ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির গবাদি পশুর ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত গরুর সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার ১৬ টি মহিষ,৩০ হাজার ছাগল, ৭০০ ভেড়া। ক্ষতিগ্রস্ত পশু থেকে গরু মারা গেছে ৩৫টি,০৩টি মহিষ, ১৭১টি ছাগল,৭টি ভেড়া। এ ছাড়া পোল্ট্রি ও হাঁস মুরগির খামার আছে ১৩ লাখ ৬৬ হাজার, সবগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মারা গেছে ১০ লাখ ২২ হাজার মুরগি ২ হাজার হাঁস। বন্যার সময় প্রচুর ত্রাণ বিতরণ হয়েছে। কোন কোন আশ্রয় কেন্দ্রে তিন বেলাই খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বুড়িচং উপজেলার সোনার বাংলা কলেজে আশ্রয় কেন্দ্রে বানভাসি ৬০০ জন আশ্রয় নিয়েছিল, এদের সঙ্গে ১৮০টি গরু ছাগল অবস্থান নিয়েছিল। সবাইকে তিন বেলা আহার ২৩ শে আগষ্ট থেকে ০১/০৯/২৪ তারিখ পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করা হয়েছে। বিষয়টি ওই কলেজের প্রিন্সিপাল সেলিম রেজা সৌরভ তার দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে করতে সক্ষম হয়েছে। এই আশ্রয় কেন্দ্রে সেনাবাহিনীর প্রধান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পরিদর্শনে এসে ত্রান বিতরণে সন্তোষ প্রকাশ করেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যেভাবে ত্রান কাজের পূর্ণতা পেয়েছে তেমনিভাবে পূর্ণবাসন ক্ষেত্রে ও হওয়া দরকার। ইতোমধ্যে সে নমুনা ও আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং আশাবাদী ।
পুনর্বাসনে নিজ উদ্যোগে যারা এগিয়ে এসেছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সর্ব প্রথম নিতে হয়। ছাত্ররা আমনের চারা উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। এরি মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ একর নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ একর, চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ৪ একর লক্ষীপুরে ২ একরসহ মোট ১২ একর জমিতে চারা উৎপাদন করা হচ্ছে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করার জন্য। তাদের দেখাদেখি দিনাজপুরের হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ লাখ সবজির চারার পাশাপাশি ৫ একর জমিতে ধানের চারা রোপন করছে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করার জন্য। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এর মৎস্য বিজ্ঞান ও একুয়াকালচার ও মেরিন সায়েন্সের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে মাছের পোনা উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে নিজেরা। ইতোমধ্যে তারা কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করেছেন।এদের মাঝে তেলাপিয়া ও কার্প মাছের পোনা বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। শুধু ছাত্ররা উদ্যোগ নিলে হবে না স্কুল কলেজ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিষ্ঠানে বীজতলা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে তৈরি করে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ বিতরণ করার সুযোগত এখনই। সরজমিনে দেখা কিছু কিছু এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে যেমন কুমিল্লা সদর উপজেলার বানাসূয়া গ্রামের বন্যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তাগুলো প্রবাসীদের আর্থিক সাহায্য নিয়ে মেরামতের কাজে হাত দিয়েছে। সেটা অন্যান্য গ্রামের ক্ষেত্রেও হতে পারে। সরকারের জন্য অপেক্ষা না থেকে মেরামতের কাজটা ও এভাবে করা হয় তাহলে সরকারের ওপর চাপ কমবে।
সরকারের পক্ষ থেকে মৎস্যজীবীদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।অনেকের গৃহ নেই তা মেরামতের জন্য সহায়তা করতে হবে।আবার যেন শস্য উৎপাদন করতে পারে প্রয়োজনীয় সার্বিক সহযোগিতা করা না হলে কৃষকরা দাঁড়াতে পারবে না। বন্যা শেষ হলে ও জমির পানি অত্যন্ত ধীরগতিতে নামছে। কারণ খালগুলো ভরাট ও দখল হয়ে গেছে সেজন্য পানি নামছে না। পানি না নামলে আমন রোপন করা সমস্যা হবে বলে কৃষকরা জানান। অতি দ্রুত বেদখলকৃত খাল উদ্ধার করে সরকারকে খাল খননের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রবল বর্ষণে পানি ধারণ ক্ষমতার জন্য খালগুলো গভীর হলে জমির পানি অনায়াসে খালে নেমে আসবে। নতুবা পানি নিয়ে আবার কৃষকদের সমস্যায় পড়তে হবে। বন্যার্তের মধ্যে ত্রাণ নিয়ে দেশের সবাই মিলে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও এমনটি হলে কৃষকরা আবার প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পাবেন।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট
দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নগ্ন দলীয়করণ, অনিয়ম ও সীমাহীন দুর্নীতির কারণে শিক্ষাকার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। এই সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে এদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। তাই একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের মাধ্যমে এদেরকে চিহ্নিত করে আইনের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আরেকটি কথা না বললেই নয়, আমরা জানি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয় খোলা-বন্ধের কোনো এখতিয়ার নেই। গত ১৬ জুলাই আবু সাঈদকে হত্যার পর শেখ হাসিনার নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ জন্য ইউজিসি প্রজ্ঞাপন দেয়। গত ৫২ বছরে ইউজিসি এ কাজ করে নাই। এ ঘটনার বিচার হওয়া প্রয়োজন। আমার ধারণা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নির্দেশ ফ্যাসিবাদীদের দোসরদের নির্দেশে হয়েছে। যে করেছে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। এটা যদি ফ্যাসিবাদের নির্দেশে হয়ে থাকে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এটা স্বৈরশাসকের নির্দেশে করে থাকলে সেটা জাতিকে জানাতে হবে এবং যিনি বা যারা নিয়মবহির্ভূতভাবে এ কাজটি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শাস্তি লঘু বা গুরু হোক দিতে হবে। ইউজিসিতে যেসব অনিয়ম হয়েছে এগুলোর তদন্ত করতে হবে এবং দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব অনিয়ম হয়েছে সেগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তদন্ত বা সরকার উচ্চপদস্থ তদন্ত করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে পারে।
ইউজিসির বড় কাজ বাজেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বরাদ্দ দেওয়া। কিন্তু তাদের প্রধান কাজ কারিকুলাম দেখা। এটা যুগোপযোগী, কার্যকরী, গণমুখী কি না। যে জ্ঞান কাজে আসে না সে জ্ঞান দিয়ে আমি কী করব? গবেষণার জন্য টাকা দেওয়া আরেকটা কাজ। এই প্রতিষ্ঠানের দেখতে হবে এ গবেষণার মূল্যায়ন কী? এটা সমাজের কী কাজে লাগল? ইউজিসিকে আরও সক্রিয় হতে হবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন যেন আর না দেয়। ডিগ্রি বেচাকেনা করা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বন্ধ করতে হবে।
এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। এই ১৬ বছরে নোংরা দলীয়করণ করে লেখাপড়া একরকম শেষ করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ জ্ঞানচর্চা। এটা আর হয় না। এখন হয় দলচর্চা। বিগত ১৬ বছরে যারা হাসিনার শাসক দলে ছিল তাদের উন্নতি হয়েছে। তারা লেখাপড়া না করে ডিগ্রি পেয়েছে। শিক্ষকদের নিয়োগ-পদোন্নতি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ হয় নেই। এখন কঠোরভাবে যোগ্যতাকে মাপকাঠি হিসেবে ধরতে হবে। আর ছাত্ররা যেন হলে সহাবস্থান করতে পারে। যারা অপরাধী তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, জেলে পুরতে হবে। এই পরিবেশ ফেরাতে হলে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা জরুরি। ছাত্রদের প্রতি অনুরোধ তোমরা এখন ক্লাসে ফিরে যাও। তোমরা একটা মহৎ অর্জন করেছো। তোমরা দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন করেছো। তোমাদের জ্ঞানচর্চা করতে হবে। তোমাদের এই অর্জন যেন বৃথা না হয়। আবার যদি প্রয়োজন হয় আবারও আন্দোলন করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও ক্লাস কিন্তু বন্ধ হয় নাই। যেখানে বোমা পড়েছে সেখান থেকে স্কুল-কলেজ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। একটা-দুইটা করলে তো হবে না। হয়তো অনেকে বলবে শিক্ষা কমিশন করে শিক্ষানীতি করতে হবে। এটা একটা দুরূহ কাজ। এটা না করে সরকার যেটা করতে পারে যে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টগুলো আছে এগুলো পর্যালোচনা করে কয়েকটা সুপারিশ করতে পারে। যেগুলোর কয়েকটি এক্ষুণি ইমপ্লিমেন্ট করতে পারে। একটা সুপারিশ আছে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা। এটি বাস্তবায়ন করতে পারে। কারিগরি ও গণমুখী যে সুপারিশ আছে এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে। এগুলো করতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনতো (পিএসসি) দুর্নীতির কারখানা। প্রত্যেকটা পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে। এটা বিলুপ্ত করে নতুন করে গঠন করা উচিত। এটা পুরোটা দুর্নীতিগ্রস্ত। এটার সংস্কার শুধু নয়, এটার মূলোৎপাটন করা উচিত। শুধু তাই নয়, টিক মার্ক দিয়ে মেধার যাচাই করা যায় না। ভাষা জ্ঞানের ওপর জোর দেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
গত ১৬ বা ১৮ বছরে একটা দেশের সব প্রতিষ্ঠান একে একে ধ্বংস করা হয়েছে। মানুষের বাক-স্বাধীনতা হরণ ও নির্বাচন চুরি করা হয়। যার ফলে গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়। আরবের ‘আইয়্যামে জাহেলিয়াত’ যুগের মতো অবস্থা ছিল। হত্যা, গুম, খুন, ডাকাতি, চুরি, ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার লুট এগুলো করে দেশকে সর্বস্বান্ত করে ফেলা হয়। এরা ছিল লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণি। পরিকল্পিতভাবে দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে নিয়ে যায়। সম্পদ বিদেশে পাচার করায় দেশের মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হয়। ভারতের কথা যদি বলি আদানি, টাটা, ডাল মিয়া এরাও লাভ করে, এরাও শ্রমিকদের বঞ্চিত করে কিন্তু তারা তাদের পুঁজি দেশে বিনিয়োগ করে। হাসিনার লোকদের এদের কোনো জাতীয় চরিত্র নেই। এর ফলে মানুষ বাজারে গিয়ে হাঁসফাঁস করে। এই কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবেই কমাতে পারে নাই। এ জন্য মানুষ মুক্তির প্রতীক্ষা করেছে। এ কারণেই মানুষ ছাত্রদের আন্দোলনে যুক্ত হয়, মুক্তি চায়। ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই বলেছিল, আমিই রাষ্ট্র, আমি যা বলি তাই আইন। হাসিনার শাসনও আইন ছিল। হিটলার পতনের তিন বছরের আগে বলেছিল, আমরা (জার্মানরা) বিশ্বকে এক হাজার বছর শাসন করব। হাসিনা যখন বলে, হাসিনা পালায় না। এই কথা বলার তিন সপ্তাহ পরে পালিয়ে গেল।
সমাজে বিশৃঙ্খলা দূর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এই কাজ শুরু করেছে; কিন্তু পুলিশ প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। দ্বিতীয় পরামর্শ, যে গণহত্যা হয়েছে যত ছাত্র আত্মাহুতি দিয়েছে স্বৈরাচার থেকে মুক্তির জন্য তাদের হত্যার বিচার করতে হবে। এটাকে প্রায়রিটি দিতে হবে। হাসিনাসহ সব হত্যাকারী ও লুটেরাদের বিচার করতে হবে। তৃতীয়ত, পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কারণ ড. ইউনূস বিশ্বনন্দিত মানুষ। তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আছে। আমি আশাবাদী কারণ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান। সব সম্ভব নয় কিন্তু একটা অংশ তো ফিরে আসবে।
সরকার তো আহত-নিহতদের সাহায্য করছে। আমরা যারা শিক্ষক তারা মিলে একটা ফান্ড সৃষ্টি করতে পারি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা যদি আসে তাহলে আমরা এই ফান্ড গঠন করতে চাই। এই ফান্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, সচিব বা ইউজিসি চেয়ারম্যান তাদের কাছে থাকবে। ছাত্ররা যদি চায় আমি দায়িত্ব নিয়ে একটা ফান্ড করতে চাই।
লেখক: সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক রাষ্ট্রদূত
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো আর্থিক খাতে শুরু হয়েছে বড় ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া। পুরো আর্থিক খাতের শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। এখন অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে কোন সংস্কার এখনই শুরু করা দরকার। আর্থিক খাত সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে যেটা করা দরকার, তা এখনই শুরু করতে হবে। না হলে বড় বিপদ আসবে পুরো আর্থিক খাতে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার ও বিদেশ থেকে অবৈধ পথে দেশে টাকা পাঠানোর বিষয়টি। আর এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে হুন্ডির নাম। বলা হচ্ছে, দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে রেমিট্যান্স ঢুকছে মূলত হুন্ডির মাধ্যমে। এর ফলে সরকার একদিকে বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে। পাশাপাশি প্রবাসীরা তাদের আয় দেশে পাঠালেও হুন্ডির কারণে তা যোগ হচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে। সরকারের কোনো পদক্ষেপেই থামছে না হুন্ডির দৌরাত্ম্য। বরং প্রযুক্তির সহায়তা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ফাঁকফোকরে দিন দিন আরও ফুলে ফেঁপে উঠছে হুন্ডির কারবার। হুন্ডিচক্রে বন্দি হয়ে পড়েছে বৈধপথের রেমিট্যান্স। এর ফলে অর্থ পাচারও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে প্রতি ডলারে বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে, যা হুন্ডি প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। হুন্ডিচক্র বিদেশে ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা রেখে দেয় এবং তাদের এজেন্টরা দেশে সুবিধাভোগীদের হাতে টাকা পৌঁছে দেয়। ফলে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। এর ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতি বয়ে আনছে। সাধারণত বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। মূলত শুল্ক ফাঁকি ও অর্থ পাচারের জন্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় কম মূল্য বা বেশি মূল্য দেখানো হয়। অর্থ পাচারের জন্য দেশের বাইরে যে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়ে, তা হুন্ডিচক্র মেটায়। ব্যাংকিং চ্যানেলে কেউ পাঠালেও প্রবাসীর সুবিধাভোগী দেশে টাকা পান। বিদেশি হুন্ডি এজেন্ট প্রবাসীর বৈদেশিক মুদ্রা কিনে এখানে টাকা পরিশোধ করে। ব্যবসার পাশাপাশি যারা বিদেশে বাড়ি বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেন, তারা নানাভাবে হুন্ডি চক্রের দ্বারস্থ হন।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের দুটি প্রধান উপায় হলো পণ্য রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমাদের আমদানি খরচ বেশি। ফলে এই উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার বাড়ানোর সুযোগ কম। সে ক্ষেত্রে প্রবাসী আয়ের ওপরই নির্ভর করতে হয়। প্রবাসী আয়ের একটা বড় অংশ আসে অবৈধ চ্যানেল বা হুন্ডির মাধ্যমে। এতে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হয় । দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশ মালদ্বীপে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিক আছেন দুই লাখের মতো। বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক এক কোটি। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ থেকে কী পরিমাণ প্রবাসী আয় হুন্ডির মাধ্যমে আসে, অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। এই হুন্ডি ব্যবসার পেছনে সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক মুদ্রানীতি ও অর্থ পাচারই মূলত দায়ী। নানা কারণে প্রবাসী শ্রমিকেরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতে বেশি উৎসাহী হন। সরকার প্রণোদনা দিয়েও তাদের ব্যাংকমুখী করতে পারেনি। হুন্ডি ব্যবসা প্রসারের আরেকটি কারণ দেশ থেকে ব্যাপক হারে অর্থ পাচার হওয়া। পাচারকারীরাই মূলত হুন্ডি ব্যবসায়ীদের অর্থের জোগানদাতা। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে পাচারকারীদের ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। সরকার যতই প্রণোদনা দিক না কেন, বাইরের বাজারে তার চেয়ে বেশি দাম পেলে প্রবাসীরা সেখানেই ঝুঁকবেন। বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে হলে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধের বিকল্প নেই। ডলারের বিনিময় হার বাজারের হাতে ছেড়ে না দেওয়ায় দেশ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেওয়া এখন সময়ের দাবি বলে মনে করি।
উপমহাদেশে হুন্ডির উদ্ভব মুঘল আমলে। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রদেশগুলোর দূরত্ব ছিল অনেক বেশি। তাছাড়া পথঘাটও ছিল অনেক দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল। প্রদেশগুলো থেকে আদায় করা রাজস্ব দিল্লিতে প্রেরণের জন্য স্থানীয় মহাজনদের সাহায্য গ্রহণ করতেন বিভিন্ন প্রদেশের মুঘল প্রশাসকরা। এই স্থানীয় মহাজনদের ছিল ভারতজুড়ে নিজস্ব নেটওয়ার্ক। তারা নিজেদের মধ্যে অর্থ বিনিময় করতেন এক ধরনের স্বীকৃতিপত্র বা দলিলের মাধ্যমে, যাকে তুলনা করা যায় আধুনিক ব্যাংকিংয়ের চেকের সাথে। এই দলিলকেই বলা হতো হুন্ডি।ভারতের বিভিন্ন শহরে গড়ে ওঠা মহাজনদের এই নেটওয়ার্ক আবার বজায় থাকতো তাদের পরিচিতি, দীর্ঘদিনের লেনদেন এবং পারস্পরিক বিশ্বস্ততার মধ্য দিয়ে। মুঘল প্রশাসকরা দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানোর জন্য এই মহাজনদের ওপর নির্ভর করতেন। এই মহাজনরাই তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ পৌঁছে দিতেন কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। ১৭৫৭ সালের পলাশী ট্রাজেডির অন্যতম কুশীলব জগৎ শেঠও ছিলেন একজন হুন্ডির মহাজন। পুরো ভারত জুড়ে ছিল তার হুন্ডির কারবার। মুঘল আমলের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ আমলেও জনপ্রিয়তা পায় হুন্ডি। এর কার্যকারিতার জন্য ব্রিটিশরাও একে অর্থ লেনদেনের দেশীয় ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেয়। এমনকি একে বৈধতা দেবার জন্য রানীর সিলসহ স্ট্যাম্প ব্যবহারের প্রচলন করে।
হুন্ডি একটি বৈশ্বিক চক্র। ফলে সারাবিশ্ব থেকে প্রবাসীদের পাঠানোর অর্থ দেশে পরিজনদের পৌঁছে দেন। হুন্ডি কারবারিরা প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন অনেক সময় তারা ব্যাংকে যেতে পারেননা। আবার প্রবাসের সব শ্রমিকের বৈধ কাগজ নেই। যে কারণে চাইলেও অনেকে ব্যাংকে অর্থ পাঠাতে পারেননা। হুন্ডি হলো প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির বাইরের অর্থ লেনদেনের একটি উপায়। একে বাণিজ্যিক আদান প্রদান ও লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক দলিলও বলা যেতে পারে। যার মাধ্যমে দুই পক্ষ বা ব্যক্তির মধ্যে টাকা লেনদেন হয়। বিশ্বের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির অনুসরণ হয়না বলে হুন্ডির লেনদেনে দেশের সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। মধ্যযুগে ভারতে সম্পদ লেনদেনের জন্য প্রথম এই পদ্ধতির সূচনা হয়। বর্তমানে বৈধ পদ্ধতি এড়িয়ে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে দেশে টাকা আনার কাজে হুন্ডি পদ্ধতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে।বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে টাকা পাঠানো ও দেশ থেকে অর্থ পাচার এই দুটো বিষয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় হুন্ডির মাধ্যমে। প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশ থেকে ডলার আনলে বা ডলার এনে ঘোষণা দিলে সেটা বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে যোগ হয়। কিন্তু অনুমোদিত চ্যানেলের বাইরে দেশে অর্থ আসলে সেটা রিজার্ভে জমা হয় না। আবার অবৈধ আয়, চাঁদাবাজি-তদবিরে আয় করা অর্থ, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সাধারণত দেশ থেকে পাচার হয়েছে। এ ছাড়া রপ্তানি মূল্য কম দেখিয়ে এবং আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছে । পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয়েছে হুন্ডির মাধ্যমে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের জন্য দেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক, দেশের মানি এক্সচেঞ্জ, বিদেশি ব্যাংক ও হুন্ডির রেট ভিন্ন ভিন্ন। ব্যাংকের বিনিময় হারের তুলনায় হুন্ডিতে ভালো বিনিময়মূল্য পান বলেই প্রবাসীরা হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর দিকে আগ্রহী হন। এমনকি সরকার ঘোষিত প্রণোদনার পরও হুন্ডিতে অনেক বেশি বিনিময় মূল্য পান প্রবাসীরা। এজন্যই ব্যাংকের বদলে হুন্ডির দিকে ঝুঁকেছেন তারা। বিদেশগামী ছাত্র, ব্যবসায়ী, রোগী কিংবা পর্যটক সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে ডলার কিনতে গেলে নানা হয়রানির শিকার হন। বিদেশ থেকে আনা মুদ্রা বিক্রি করতে গেলে ব্যাংকে অনেক সময়ই বিনিময় মূল্য কম পাওয়া যায়। তাছাড়া ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হয়। এতে ডলার কিনতে আগ্রহী গ্রাহকদের সময় ও কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। বিপরীতে হুন্ডি এজেন্টদের গ্রাহকরা ফোন দিলে তারা গ্রাহকের বাসায় টাকা ও বিদেশি মুদ্রা নিয়ে আসে, পাশাপাশি তাদের দেয়া রেটও ব্যাংকের থেকে ভালো। গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকের থেকে হুন্ডির সেবা তাই সহজ, দ্রুত এবং নিরাপদ।
সামগ্রিকভাবে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রতি উৎসাহী। আরব আমিরাতের দুবাই, শারজা ও আবুধাবিতে কর্মরত আছেন হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিক। তারা দেশে টাকা পাঠাতে আলাদা কোনো ছুটি পাননা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাপস ব্যবহার করে নিজের একাউন্ট প্রবাসে বসেই পরিচালনা করতে পারেন। প্রবাসী শ্রমিকেরা অ্যাপস ব্যবহারে এখনো অনেক পিছিয়ে আছেন। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে ভয়ও কাজ করে। এজন্য তারা এক্সচেঞ্জ হাউসে গিয়ে দেশে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে পারেননা। বাসার পাশেই হুন্ডি করার সুযোগ আছে, এটাই সহজ পথ। আবার এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে পাঠালে যেখানে প্রতি দিরহামে পাওয়া যায় ২৯ টাকা ২০ পয়সা, সেখানে হুন্ডিতে মেলে ৩১ টাকার বেশি। দুই টাকা বেশি পেতে তারা হুন্ডিতে টাকা পাঠান। দুবাইয়ের ডেইরা, লেবার ক্যাম্প-সংলগ্ন মার্কেট ও সবজি বাজার, আবুধাবির আল আইন; শারজার রোলা; আজমানের সবজি বাজার ও লেবার ক্যাম্প প্রভৃতি এলাকায় বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক থাকেন। প্রতিটি জায়গাতেই রয়েছে হুন্ডি করার ব্যবস্থা। ব্যাংকে হয়রানির পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত রেট পাননা তারা। পাশাপাশি বিদেশ থেকে টাকা আনার ক্ষেত্রে ব্যাংকের কাছে অনেক বেশি জবাবদিহি করতে হয় তাদের। অবৈধ হয়ে পড়া প্রবাসীরা হুন্ডি ছাড়া দেশে টাকা পাঠাতে পারেননা। বিদেশে বাংলাদেশের অনেক প্রবাসী শ্রমিকেরই বৈধ কাগজ নেই। ফলে তারা নিজেদের ডকুমেনট দিয়ে ব্যাংকে লেনদেন করতে পারেননা। সেক্ষেত্রে দেশে টাকা পাঠাতে তাদের সহজ সমাধান হুন্ডি। বিমানবন্দরগুলোতে প্রবাসীদের সঙ্গে মার্জিত ব্যবহার করা হয়নি এতদিন । হয়রানির কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের প্রতি প্রবাসীদের মধ্যে এক ধরনের ঘৃণা ও আতঙ্ক বিরাজ করেছে। অনেক প্রবাসীই হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছেন, এর নীরব প্রতিবাদ জানান। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে বিস্তার লাভ করছে হুন্ডি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডি তদন্ত করে জানিয়েছে, বিভিন্ন মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত পাঁচ হাজার এজেন্ট অবৈধ উপায়ে বিদেশ থেকে অর্থ আনা ও বিদেশে অর্থ পাঠানোয় জড়িত। হুন্ডির মাধ্যমে (প্রবাসীদের ভাষায় মোবাইল ফোনে) আসা অর্থ দেশে তাদের পরিবারের কাছে মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) হিসাবে পাঠিয়ে দেয় হুন্ডি চক্রের এদেশীয় অংশীদাররা। ২০২০ সালে করোনায় বন্ধের মধ্যে প্রবাসীদের আয় কমেছিল। অথচ রেমিট্যান্স ব্যাপকভাবে বেড়েছিল। ওই বৃদ্ধি ছিল ক্ষণস্থায়ী। মূলত হুন্ডি চাহিদা কম থাকায় তখন প্রবাসী আয়ের প্রায় পুরোটা বৈধ চ্যানেলে এসেছিল। এ ছাড়া ভ্রমণ চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্যও বিদেশে যাওয়া বন্ধ ছিল। ফলে ডলারের চাহিদা ছিল কম। এখন চাহিদা বেড়েছে। এতে হুন্ডিও বেশি হচ্ছে। এ যাবৎকালের মধ্যে প্রথমবারের মতো রেমিট্যান্স দুই হাজার কোটি ডলারের ঘর অতিক্রম করেছিল করোনায় বিশ্বব্যাপী লকডাউনের মধ্যে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। আগের অর্থবছরের চেয়ে যা ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। অথচ ওই সময় বিশ্বের অনেক দেশে আয় কমেছিল। হুন্ডি প্রবণতা কমানোর উদ্যোগ নিতে বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি লিখেছিল সরকার। পাশাপাশি রেমিট্যান্স কমার কারণ অনুসন্ধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে দুটি টিম পাঠিয়েছিল। ওই প্রতিনিধি দল শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে রেমিট্যান্স কমার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে তুলে ধরে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে বাইরে বেশি অর্থ পাওয়া। তখন রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানো ও অর্থ পাচার ঠেকাতে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। তবে সরকার রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ না কমিয়ে প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে হুন্ডির চাহিদা বন্ধ না করা গেলে অবৈধপথে অর্থ আনা ঠেকানো যাবে না। পাশাপাশি শুধু প্রণোদনা না দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচও কমাতে হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের একের পর এক ভুল নীতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্থিক খাতের নানা অস্থিরতা। ফলে আর্থিক খাতের পরিস্থিতি কেবল নাজুকই হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে আর্থিক খাতকে বের করে আনতে হলে সবার আগে বিদেশে অর্থ পাচার ও হুন্ডি তৎপরতা ঠেকাতে হবে কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে এবং এ কাজ করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক
সব জাতি, দেশের কিছু ঘটনা, কাজ থাকে যা পরবর্তী প্রজন্মকে উৎসাহ দিয়ে থাকে। এমন একটি কাজ ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ আমাদের উপহার দিয়েছে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন, ১৯৯০ সালে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পাওয়ার সংগ্রামের পর যুক্ত হয়েছে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান আমাদের ইতিহাসে। ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে ঠিকই কিন্তু রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী একটি দেশের স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টার হিসাবের খাতায় বছরের সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের জনগণকে বারবার রক্ত দিতে হচ্ছে। ২০২৪ সালে যে সংখ্যায় বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে তা মনে হলে আমি মুক্তিযোদ্ধা হয়েও নিজকে অপরাধী ভাবতে হয়। যারা আহত, পঙ্গু হয়েছে তাদের কথা চিন্তা করতেও কষ্ট হয় তবে ভরসা এই আমাদের যুবসমাজ গণ-অভ্যুত্থানের পরে ঘরে ফিরে যায় নাই যেভাবে ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরে গিয়েছিল।
সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাপনার জগতে দেখা দিচ্ছে নানাবিধ বৈচিত্র্য। ব্যবসা, সংসার, সমাজ, দেশের ব্যবস্থাপনায় দিন দিন দেখা দিচ্ছে বৈচিত্র্যের সঙ্গে সমস্যাও। ছোট পরিসরে একক ব্যবস্থাপনায় যেমন সুবিধা আছে তেমনি সমস্যাও। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও প্রয়োজন হয় অন্যের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনার। আর তখন বড় পরিসরে ব্যবস্থাপনার জন্য নির্ভর করতে হয় নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের ওপর। এখানেই সমস্যা আমাদের দেশে বর্তমানে। বাংলাদেশের মতো শিক্ষা জগতে অনগ্রসর অবস্থায় দক্ষ জনবল পাওয়ার সমস্যায় ভুগছে পাবলিক, প্রাইভেট সেক্টর। শুধু তাই নয়- বিদেশেও যাচ্ছে অদক্ষ জনবল। ফলে শ্রমিকের চাকরি নিয়ে আমাদের যুবসমাজ এক মানবেতর জীবনযাপন করছে। দক্ষ জনবল পাওয়ার সময় যদি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের লোক নিয়োগ দিয়ে যায় তাহলে যা হওয়ার তাই হবে। যেমন হয়েছে সম্প্রতি বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশ গুলিই করে থেমে থাকেনি, লাশে আগুন দিয়েছে, সে এক অমানুষিক কাজ। আমি বলব জ্ঞানের স্বল্পতার সঙ্গে যোগ হয়েছিল রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। এখানে অবশ্যই মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসবেই। যদি কোনো দেশে সুস্থ রাজনীতি না থাকে তাহলে সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে এমন আচরণ অসম্ভব হয় না। এমন সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনেই দেখা দেয় সমাজে অনিয়ম, দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি। একটি দেশ যখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অধীনে চলে তখন যদি এমন অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি হয় তখন সমাজের গরিব, দুর্বল লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমাজে এমন অবস্থা বিরাজ দীর্ঘদিন করলে গণ-অভ্যুত্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যা আমরা দেখেছি ৫ আগস্ট ২০২৪-এ। এই গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণের যেমন অংশগ্রহণ ছিল তেমনি তার বিজয়ে সবাই আশাবাদী সামনের দিনে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে এই আশায়। এই প্রসঙ্গে চার মুক্তিযোদ্ধার বড় বোনের মন্তব্য উল্লেখ করার মতো। আমার বড়বোনের কথা বলছিলাম ভালোমন্দ নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, তোমরা দেশ স্বাধীন করেছিলে, এবার আদরের ছেলেরা যা অর্জন করেছে তাও তার চেয়ে কম নয়। আমিও একমত এই বিষয়ে।
ভালো কিছু পেতে হলে ক্ষতি বা কিছু ছাড় দিতে হয়। আমাদের ছাত্র-জনতা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এই আগস্টে তার একটি চিত্র সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে আমাদের সামনে এসেছে। সংবাদে শিরোনাম ‘মেরুদণ্ডে বুলেট, চোখের ভেতরে গুলি আর পা হারানো তামিমের গল্প’। এই ছিল সংবাদের ভিতরের অংশে প্রকাশ ‘শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মিরপুরে যে আনন্দ মিছিল হয়, সেটায় অংশ নিয়েছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তামিম হোসেন। একপর্যায়ে মিছিলে পুলিশ গুলি ছুড়লে একটি গুলি এসে পায়ে লাগে তামিমের।’ তার মানে আনন্দ মিছিলে অংশ নিয়ে তামিম একাধিক গুলির সম্মুখীন আমাদের সরকারি কর্মচারী ‘পুলিশের’ হাতে। এমন তামিমের সংখ্যা নিশ্চয়ই এক না। আমরা শুনে আসছি প্রায় প্রতিদিন কেউ না কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীদ হচ্ছেন। দেশের জন্য যারা মারা যান বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বেঁচে থাকবেন তাদের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা তারা বর্তমানে সরকার থেকে মাসিক আর্থিক সহায়তা পাচ্ছি। সরকারকে ধন্যবাদ তবে ১৯৭২ সালে যদি তা শুরু করা যেত তাহলে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো না। এক সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ‘নো ওয়ার্ক, নো পেমেন্ট’-এর আওতায় কাজ হারিয়েছিল, আর তখন সেই সন্তানের পিতা সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুর পর যেন রাষ্ট্রীয় সম্মানে দাফন করা না হয় তা বলেছিলেন (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫/১০/২০১৯)। তবে আশার কথা আমাদের যুবসমাজের প্রতিনিধিরা যাদের সম্পৃক্ততায় আজকের উপদেষ্টা পরিষদ, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেমন- ‘আমরা কখনোই শহিদদের স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না-প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের দায়িত্ব সরকারের-নাহিদ ইসলাম’। সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। উপদেষ্টা পরিষদ সামনের দিনে আরও সুন্দর এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত সময়ে নেবেন সে আস্থা আমার আছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যা দক্ষ জনবলে। দক্ষ জনবল সৃষ্টি করার প্রথম স্তর শিক্ষা জগতের প্রাথমিক শিক্ষা। আমাদের শিক্ষার উন্নতির যাত্রাপথেই বাধাগ্রস্ত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। আজকের অবস্থাও যেন এমন না হয়। আমাদের সন্তানদের যোগ্য এবং উপযুক্ত নাগরিক হয়ে সামনের দিনে প্রতিযোগিতায় সম্মুখীন হতে হবে। এই ক্ষেত্রে এক দিনও নষ্ট করা ঠিক হবে না। সংবাদে প্রকাশ ‘জবঃঁৎহ ঃড় পষধংংৎড়ড়স, পধসঢ়ঁংবং ঈযরবভ অফারংবৎ ঁৎমবং ংঃঁফবহঃং” (ঞযব ঋরহধহপরধষ ঊীঢ়ৎবংং, ৬ ঝবঢ়ঃবসনবৎ ২০২৪)।
বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ সেই বাংলাদেশের আদিকাল থেকে। সেই অনিয়মের বিরুদ্ধে সরকারের দুর্নীতি দমন দপ্তরের এক সেমিনারের কার্যপত্র উপস্থাপন করেছিলেন আজকের প্রধান উপদেষ্টা। আমি যদি ভুল না করে থাকি তাহলে তার কার্যপত্রের টাইটেল ছিল ‘আমি যদি দুদকের চেয়ারম্যান হতাম’। সেখানে উল্লেখ ছিল, ২০% কাজ করতে হবে অতীত নিয়ে, ২০% কাজ করতে হবে আজকের জন্য আর ৬০% সময় দিতে হবে আগামীর কজে। সেই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি আজ বাংলাদেশ পরিচালনের দায়িত্বে এক বিশেষ সমস্যা সংকুল সময়ে। প্রধান উপদেষ্টার ওপর আস্থা রেখে বলতে চাই বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে। সমাজের অনেক অনিয়মের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম দূর বা নিয়ন্ত্রণ করে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে হবে। দক্ষ জনবল যদি সৃষ্টি করা যায় এবং প্রশাসনে যদি যোগ্য লোক নিয়োগ করা যায় তাহলে সমাজের আসল এবং কার্যকর উন্নতি পরিলক্ষিত হবে। সরকারের কাজ হতে হবে দল নিরপেক্ষ ভাবে, দেশের মানুষের স্বার্থে। বর্তমানে দেশের মানুষ যা আশা করছে। বর্তমান সরকারের সামনে অনেক এজেন্ডা বা দাবি। অনেক সংস্কার করতে হবে। দেশ পরিচালনে যেহেতু রাজনৈতিক দল জড়িত তাই রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই দেশ পরিচালিত হতে হবে দীর্ঘমেয়াদে। বারবার আমাদের যে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে তা একমাত্র রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের জন্য। এ অবস্থার সম্মুখীন আমরা আর হতে চাই না। যা যা করণীয় বা দরকার তা যথসম্ভব দ্রুত করতে হবে। অনেকের মতো আমিও আশাবাদী। আজকে অনেকের সঙ্গে আমিও বলতে চাই ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়ে আমরা আমাদের ভাষার সম্মান দিতে পারি নাই, ১৯৭১ সালে রক্তের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করেও স্বাধীনতার স্বাদ পাই নাই, ১৯৯০ সালে গণতন্ত্রের জন্য রক্ত দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার পাই নাই। সম্প্রতি এক সংবাদে প্রকাশ ‘পটুয়াখালী, বাউফলে আর্থিক অনটনে উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে না গুলিবিদ্ধ সুমনের (প্রথমআলো, ৬/৯/২০৪)। আজ আমাদের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফসল যেন আমরা পাই। আমার জানা মতে আমাদের মতো বয়সের মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কম ছিল, আমি ছিলাম এসএসসি পরীক্ষার্থী। আমিই এখন ৭০ বছরের কাছাকাছি। আর বেশিদিন আমরা বাংলাদেশের আলো-বাতাস নিতে পারব সেই ভরসা নেই। আমাদের তরুণ সমাজ যারা আজকের গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক তাদের কাছে আমার মতো মুক্তিযোদ্ধার দাবি আমরা যা পারি নাই তা তোমরা করবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরের মাথায় আমরা যে অবস্থায় আছি তা ছিল না স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্দেশ্যে এবং লক্ষ্যে। সব শহীদদের রক্তের মূল্য দিতে হবে। শহীদরা জীবন দিয়েছে তাদের জন্য নয়। তারা দেখতে চায় বাংলাদেশের মানুষের শান্তি, উন্নতি।
লেখক: চেয়ারম্যান, এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (ইডিএ)
আওয়ামী সরকারের আমলে নির্বাচনগুলো কি সুষ্ঠুভাবে হয়েছিল? উপজেলা, জেলা বা জাতীয় সব নির্বাচন হয়েছে প্রহসনের। আওয়ামী লীগ সরকার যে জনগণের রায় মানেনি, অর্থাৎ যেনতেন ক্ষমতায় আসা চাই এটাই তাদের লক্ষ্য। এরা মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়াক না কেন, গণতন্ত্র এদের চক্ষুশূল। বারবার একক নির্বাচন দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতিকে হিমাঘরে পাঠিয়েছিল। তখন প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন সবই ছিল তাদের কবজায়। কোথাও কোনো নির্বাচন এলেই তাদের দলীয় নেতা-কর্মী ও ছাত্রলীগের গুণ্ডা বাহিনী ব্যবহার করেছে। ভোটারদের বাড়ি বাড়ি শুধু নয়, নির্বাচনে নিরোধী দলের প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি ঢুকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে প্রার্থীপদ প্রত্যাহারে বাধ্য করা হতো। ভোটের দিন যাচ্ছেতাইভাবে নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়। আওয়ামী সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে চাটুকার দল জাতীয় পার্টি ছাড়া বিরোধী দলের তেমন কোনো দলকে আসতে দেওয়া হতো না। সংসদ নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা সর্বত্র নিজের বা সরকারের সমালোচনার প্রতি সর্বত্র বিরক্তি মনোভাব প্রকাশ করতেন। কর্মক্ষেত্রে তিনি সরকারি বিধি বা নীতিমালা মানতেন না। পরিবার ও দলীয় লোকদের দুর্নীতির কথা উঠলেও তিনি কখনই পাত্তা দিতেন না। অর্থ পাচার ও ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে তার সরকারের নমনীয়তায় দেশের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দুদককে অকার্যকর করে রাখা হয়েছিল। গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল ছাড়া এককভাবে ৯০ শতাংশ আসনে জয়লাভ করে। বিরোধী যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারাও আওয়ামী লীগের লোকজন। প্রতি নির্বাচনে সরকারকে জাতীয় পার্টি সমর্থন দিয়েছিল। তৎকালীন সরকারের প্রতিটি অবৈধ নির্বাচনের জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিরোধী দলের আসন দখল করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। আওয়ামী লীগ নিজেও ভালো করে জানে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে তাদের অস্বিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগ শাসনামলে সব নির্বাচনই হয়েছিল একতরফা; এভাবে কি দেশ চলতে পারে? কিন্তু আর কতদিন? ছাত্র-জনতা যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে গত ৫ আগস্ট গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশছাড়া করে; এতেই প্রমাণিত হয় যে, দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে সকল প্রকার অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে তখন কিন্তু কেউ রেহাই পায় না। বলে রাখা ভালো কোনো সরকারই চিরস্থায়ী নয়।
গত ৫ আগস্ট দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী যিনি ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে তার দল ও দলের নেতা-কর্মীদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে রেখে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে গেলেন, যা একটি অগণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই সম্ভব। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী এভাবে দেশত্যাগ করে নাই, যা শেখ হাসিনা করে দেখালেন। সবার মুখ বন্ধ, ভোট চুরি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দমন-পীড়ন, গুম, শিশুহত্যা, আয়নাঘর তৈরি ইত্যাদি বহু অভিযোগে শেখ হাসিনা অভিযুক্ত। তবে পালানোর সময় তিনি তার দল আওয়ামী লীগের মতো সংগঠনটিকে ধ্বংস করে গেছেন। তার সরকারের আমলে দেশের যা উন্নতি হয়েছিল, তা তার নিজের একগুঁয়েমি, জেদ, হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার-অহমিকা, দম্ভের কারণে তিনি এর সব অর্জন ধ্বংস করে গেছেন। পাশাপশি তার বাবার সম্মানটুকু মাটিতে লুটিয়ে দিয়েছেন। গত ১৫টি বছর শেখ হাসিনার মধ্যে সম্মানিত লোকদের সম্মান বা শ্রদ্ধা করার প্রবণতা হারিয়ে ফেলতে দেখা গিয়েছে। তার মধ্যে এক ধরনের দম্ভও কাজ করতে দেখা গেছে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্বকে তিনি কথায় কথায় কত না অপমান-অপদস্ত করেছেন, যা গণমাধ্যমে দেশের জনগণ দেখেছেন। ছাত্র আন্দোলনের কাছে টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত গণ-অভ্যুত্থানে তার ক্ষমতা আর টিকে রাখা সম্ভব হয়নি। তার বিভিন্ন প্রেস কনফারেন্সে দেখা যেত দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিকদের প্রতি তার ক্ষোভের দৃশ্য। তিনি কথায় কথায় জনগণই তার ক্ষমতার উৎস বললেও আসলে পুলিশ ও প্রশাসন নির্ভরতার ওপর তার অঢেল ভরসা ছিল। আর এতেই তার সরকারের আমলে সীমাহীন দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে; যা ছিল ধরাছোঁয়ার বাহিরে। পারিবারিক দুর্নীতিকে শেখ হাসিনা এতই প্রশ্রয় দিয়েছেন, যা আগে কখনো কোনো সরকারের আমলে দেখা যায়নি। তিনি দিন দিন নিত্যনতুন ডিজিটাল নিরাপওা আইন তৈরি করে সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের গলা চেপে ধরতেন। বহু সাংবাদিক তার আমলে জেল-জুলুম খেটেছেন। তিনি সর্বত্র দেশের গুণীজন, সিভিল সোসাইটি ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর ক্ষেপে থাকতেন। তাদের কখনো মূল্যায়ন করতেন না। মুখের কথার জন্য শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছে। শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবিটি কালক্ষেপণ না করে সঠিক সময়ে মেনে নিতেন তাহলে আজ তাকে দেশছাড়া হতে হতো না। দেশ না ছাড়লে সেদিন শেখ হাসিনাকে লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফী বা ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের মতো পরিণতি হতে পারত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শেখ হাসিনা কখনো ভাবতে পারেনি যে তার কপালে করুণ পরিণতি রয়েছে। সব সময় ভাবতেন তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে রয়েছে। এক্ষেত্রে তার গোয়েন্দা ও দলের তথ্য ছিল ভুল। আর এ ভুলের জন্য শেখ হাসিনার পতন কেউ ঠেকাতে পারেনি। ইহা ছিল জনগণের ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের পঞ্জীভূত ক্ষোভের বহির্প্রকাশ। শেখ হাসিনা পালালেও তার এত মন্ত্রী, এমপিরা কেন গ্রেপ্তার হচ্ছে না এটাই এখন জনমনে প্রশ্ন?
এখানে ছাত্র-জনতার বিজয় হয়েছে। মূলত গণ-আন্দোলনের মুখে বিশ্বের কোনো শাসকই টিকে থাকতে পারে নাই। শেখ হাসিনাকেও সেই অনিবার্য নিয়তি মেনে নিতে হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর ৫০ বছর পর সেই শোকের আগস্ট মাসেই শেখ হাসিনাকে জীবন নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে হলো; এর চেয়ে অপমানের আর কী বা হতে পারে। এটা আওয়ামী সরকার-মন্ত্রীদের দুষ্কর্মের ফল। খালি মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশের সম্মানহানি ও বঙ্গবন্ধুর মানসম্মান ঢুবিয়েছেন তারা। শেখ হাসিনা কখনো খালেদা জিয়া, বিএনপি-জামায়াতকে দেখতে পারত না। তথাকথিত ১৪ দলের কথা শুনে বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে বাহিরে রেখে তিনি সব সময় এককভাবে জাতীয় নির্বাচন করতেন আর লোক দেখাতেন জিতেছি। এটাও এক ধরনের অপরাধ ও প্রতারণা। তিনি ছাত্রদের দাবিকে অগ্রাহ্য করে ছাত্রলীগকে দিয়ে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করাটাই ছিল তার সরকারের চরম ভুল। শেখ হাসিনার পলায়নের পর দেশ এখন অনেকটা শান্তি ও স্বস্তিতে ফিরে আসতে শুরু করছে। আর কোনো হামলা-মামলা বা প্রতিশোধ নয়, দেশকে সুশৃঙ্খল করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারের দায়িত্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নেওয়ার দাবি জানাই।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট
বন্যাপরবর্তী কৃষি পুনর্বাসনের সহায়তার জন্য শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠে ধানের চারা উৎপাদন করার জন্য বীজতলা তৈরির কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। বন্যাপরবর্তী সময়ে কৃষকদের সহযোগিতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে এভাবেই লেখেন কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. জামিলুর রহমান। গবেষণা মাঠে ধানের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলা তৈরির এলাকার ছবি জুড়ে দিয়ে তিনি আরও লেখেন, বীজতলায় আমন ধানের বিভিন্ন জাতের চারা যেমন- ব্রি ধান-৭৫, ব্রি ধান-২৩, বিনা ধান-১৭ বপন করা হবে। এ ছাড়া সবজি ফসলের চারা উৎপাদনের কাজও এগিয়ে চলছে। বাণিজ্য মেলায় মাঠে ব্যাপক আকারে বিভিন্ন সবজির চারা উৎপাদন করা হবে। এই পোস্টে নিচে মন্তব্য পড়েছে ৩৩টি এবং ৬৬ জন শেয়ার করেছেন।
লেখা শুরুতেই এ ধরনের উদাহরণ তুলে ধরার কারণ হচ্ছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়া এবং ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের ১১টি জেলা বন্যায় প্লাবিত হয়। ৩১ আগস্ট শনিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আকস্মিক বন্যায় এখন পর্যন্ত ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশের কিছু জেলায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে উল্লেখ করে মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, এখনো দেশের ১১টি জেলায় ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। চলমান বন্যায় দেশের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জমির শাক-সবজি, ধানসহ অন্যান্য ফসল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সবচেয়ে অসুবিধা গবাদিপশুর বাসস্থান নিয়ে। গোয়ালঘরসহ বসতভিটাই পানি উঠাতে গোখাদ্যের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। পশুর অসুখ-বিসুখ বেড়ে গেছে। যাদের পুকুরে মাছ ছিল, সেগুলোও ভেসে গেছে।
সম্প্রতি বন্যাকবলিত আমার নিজ এলাকায় কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা গিয়েছিলাম ত্রাণ দিতে। এ সময় দেখেছি মানুষ কত অসহায়। অনেক বাড়িঘর পানির নিচে চলে যাওয়ায় মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। অনেক আশ্রয়কেন্দ্রের মাঠে গবাদিপশু বেঁধে রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও উঁচু সড়কের ওপর বেঁধে রাখা হয়েছে। দানাদার খাবার খাওয়াতে না পেরে অনেকে কচুরিপানা খাওয়াচ্ছেন। পশুর পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে না পেরে অনেকে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কৃষিবিভাগকে এখনই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের প্রথম কাজ হবে ক্ষতির পরিসংখ্যান ও প্রকৃতি নির্ণয় করা। ২৪ আগস্ট সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বন্যাদুর্গত এলাকায় কৃষি খাতে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ দ্রুত নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা।
চলমান বন্যায় প্রাণিসম্পদ- পোলট্রি, পশুখাদ্য, মাছ এবং অবকাঠামোর দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে মৎস্য খামারিরা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর, জলাধার ও খামারের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯ এবং ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন। এ ছাড়া প্রায় ৩৭৫ কোটি মাছের পোনা ও পোস্ট লার্ভা চিংড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গবাদিপশু খাতে এখন পর্যন্ত ৪৫০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। আকস্মিক বন্যার পানিতে অনেক গবাদিপশু ভেসে গেছে। নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনেক খামারি। বন্যার এই ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব পড়বে আমাদের জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদায়। প্রাণিসম্পদ খাতে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা খামারিদের জন্য সত্যি খুব কঠিন। তাই তাদের ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান একান্তই দরকার।
বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও বন্যা পরবর্তী করণীয় বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় ১২টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সিদ্ধান্তর মধ্যে রয়েছে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় আপদকালীন বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। আরও রয়েছে নাবী জাতের ধানের বীজ দেশের বন্যামুক্ত এলাকা থেকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করা পরামর্শ। আমি মনে করি, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা মাঠে বন্যা পরবর্তী সময়ে কৃষকদের সহযোগিতার জন্য যেভাবে বীজতলা তৈরি করে চারা উৎপাদন করছে। এভাবে কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিংবা দেশের বিত্তশালীরা উঁচু এলাকায় বীজতলা তৈরি করে পরবর্তীতে বন্যাকবলিত এলাকায় দিতে পারবেন।
ইতোমধ্যে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। সেপ্টেম্বর মাসের পর বড় বন্যার প্রকোপ দেখা না গেলে এ ক্ষেত্রে আমন ধান নষ্ট হলেও ধান চারার সংস্থান করা গেলে পুনরায় স্বল্পমেয়াদি আমন ধান যেমন- বিআর-৫, বিআর-২২, বিআর-২৩, ব্রি ধান-৩৪, ব্রি ধান-৪৬, ব্রি ধান-৭৫, বিনা ধান-১৭ জাতগুলো বীজতলায় চারা উৎপাদন করে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোপণ করা যাবে। তবে কোনোভাবেই যেসব জমি থেকে বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও সরে না যায়, সেসব জমিতে আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না। কারণ এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যাবে এবং ওই জমিতে রবিশস্য সঠিক সময়ে চাষ করা যাবে না; কিন্তু যেসব জমির বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের আগেই নেমে যাবে, সেসব জমিতে দ্বিতীয়বার চারা রোপণ উঁচু জমির ধানের কুশি উঠিয়ে প্রতি গোছায় ২-৩টি কুশি রোপণ করা যেতে পারে। যদি কুশির বয়স ১০-১২ দিনের মধ্যে হয় তা হলে মূল গোছার তেমন ক্ষতি হবে না। লক্ষ্য রাখতে হবে যে মূল জমির ধানের যে গোছায় কমপক্ষে ৬-৭টি কুশি আছে সেখান থেকে ২টি কুশি তোলা যেতে পারে। এসব কুশি লাগানো গেলে তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে নতুন কুশির জন্ম দেবে এবং কৃষক কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। এ ছাড়া মাসকালাই জাতীয় ফসল নরম মাটিতে বিনা চাষেই করা যেতে পারে। অন্যদিকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গবাদিপশুর রোগবালাই বেড়ে যায়। রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর মরিচ ও ডালজাতীয় ফসলের বীজ বোনা যেতে পারে। বন্যার পানি নেমে গেলে বিনা চাষে গিমাকলমি, লালশাক, ডাঁটা, পালং, পুঁইশাক, ধনে, সরিষা, খেসারি, মাষকালাই আবাদ করা যেতে পারে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলি জমির রস কমানোর জন্য মাটি আলগা করে ছাই মিশিয়ে এবং সামান্য ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
মৎস্য চাষিদের প্রথমে পুকুর বা জলাশয়ের পাড় ভেঙে গেছে সেগুলো দ্রুত মেরামত বা সংস্কার করতে হবে। বন্যার পানির সঙ্গে বিভিন্ন অচাষযোগ্য মাছ যদি প্রবেশ করে, তখন ঘন ঘন জাল টেনে মাছগুলো তুলে ফেলতে হবে। বন্যার পানি নেমে গেলে স্থানীয় মৎস্য অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী পুকুরে পরিমাণমতো চুন এবং লবণ প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া বন্যা পরবর্তী সময়ে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির নানা ধরনের রোগবালাই যেমন- গরুর খুরা রোগ, গলাফোলা রোগ, তড়কা, বাদলা, হাঁস-মুরগির রাণীক্ষেত, ছাগল ও ভেড়ার পিপিআর ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
নানা ধরনের পরজীবী বা কৃমির আক্রমণ বাড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগিকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের সহযোগিতা ও পরামর্শে প্রতিষেধক টিকা প্রদান এবং কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
আগামী রবি ফসলের বাম্পার ফলন না হলে কৃষকের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। কাজেই এখনই কৃষককে রবি ফসল বিশেষ করে গম, ভুট্টা, আলু ও ডালের উন্নত চাষাবাদের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষককে বীজসহ কৃষি উপকরণ আগাম সরবরাহ করতে হবে। চর এলাকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে কৃষি উপকরণের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষির ওপর ভর্তুকি হলো সরকারের প্রকৃত কৃষি বিনিয়োগ। অনেক সময়ই সরকারের কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা দুর্গমে কাজ করতে আগ্রহী হয় না। ফলে নতুন প্রযুক্তি থেকে প্রান্তিক কৃষক বঞ্চিত হয় বা বিলম্বে তা জানতে পারে। মনে রাখতে হবে, প্রান্তিক কৃষক কৃষিকাজ করতে নিরুৎসাহিত হলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তা হবে এক মারাত্মক হুমকি।
কৃষকরা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। রাষ্ট্রের কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতার কারণে কৃষিজমি ও কৃষকরা অবহেলা আর ভোগান্তির মধ্যে আছে। কৃষকরা কী পরিমাণ কষ্ট এবং দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে সেটা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝা যাবে না। কৃষকরা উৎপাদন বন্ধ করে দিলে দেশের উন্নয়ন ভেস্তে যাবে। ব্যবসায়ী, মহাজন সবাই কৃষকদের শোষণ করছে। অবিলম্বে কৃষকদের স্বাস্থ্য বিমার পাশাপাশি কৃষি বিমা চালু করতে হবে। শস্যবিমা করা থাকলে কোনো কারণে ক্ষতি হলে বিমাকারী প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তা দেয়। শুধু শস্যই নয়, কৃষির অন্যান্য উপখাত-গবাদিপশু ও মৎস্য খাতকেও কৃষিবিমার আওতায় আনা প্রয়োজন। যেহেতু নিচু এলাকায় প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয় এবং ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে সেহেতু নিচু এলাকার কৃষি ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত।
সমাজের সবাইকে তার জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। আর এ সবকিছু করতে হবে সবাইকে নিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে। কৃষকদের পুনর্বাসনের জন্য কাউন্সেলিং করাতে হবে। পাশে দাঁড়িয়ে সাহস দিতে হবে। এ পর্যায়ে কৃষকের সবচেয়ে বেশি দরকার হয় আর্থিক ও মানসিক সাহায্য। তাদের টিকে থাকার জন্য গবাদিপশু পালন ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত রাখতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান কৃষকদের সাহায্য করবে, তাদেরও আয়কর কমানোসহ প্রণোদনা দিতে পারে সরকার। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিতে হবে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সরকারকে এখনই বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সর্বস্বান্ত হওয়া কৃষকের জন্য শুধু ত্রাণ যথেষ্ট নয়; বন্যার পরে কৃষককে তার কৃষিকাজের সঙ্গেই যতটা সম্ভব সম্পৃক্ত রাখাটাই আসল। পাশাপাশি আয়ের বিকল্প উৎস তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে হবে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে যেমন উদ্যোগী হতে হবে, তেমনি সার্বিকভাবে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। নদী ও খাল-বিল খননের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ সচল রাখা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
পূর্ববতী সরকারের তথাকথিত নতুন শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের বিভাগ বিভাজন অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য তুলে দেওয়া হয়েছিল। এর পেছনে শক্ত কোনো যুক্তি ছিল না। যে শিক্ষার্থী গণিত বোঝেনা তাকেও গণিত ও বিজ্ঞান পড়তে হবে, যে শিক্ষার্থীর গণিত, বিজ্ঞানে আগ্রহ বেশি তাকেও সাধারণ বিজ্ঞান অর্থাৎ বিজ্ঞানে যাদের আগ্রহ নেই তাদের জন্য দায়সারা গোছের যে বিজ্ঞান সিলেবাস সেই বিজ্ঞান পড়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। একইভাবে বাণিজ্যে পড়ার যাদের কোনোই আগ্রহ নেই সবাইকে সেই বিষয় পড়তে হবে অর্থাৎ জোর করে সবাইকে সবকিছু পড়তে হবে। এটি কোনো সুচিন্তিত মতামত নয়। আমি তৎকালীন মেম্বার কারিকুলামকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বিজ্ঞান শিক্ষার্থীরা যদি বিজ্ঞানের বিষয় আরও বিষদভাবে জানতে চান তাদের সেটি করতে দেওয়া উচিত কিন্তু উনি উত্তরে বললেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়ে আমাদের দেশকে সার্ভ করেনা, তারা আমেরিকাকে সার্ভ করে। অতএব, মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান পড়ার কোনো দরকার নেই। আমি একথার উত্তরে বলেছিলাম বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা আমেরিকা চলে যায় বলে তারা বিজ্ঞান পড়বে না? তার কোনো সদুত্তর পাইনি অর্থাৎ আমাদের কথার কোনো গুরুত্ব তাদের কাছে ছিল না। তারা দুই-চারজন যা ভাবতেন তাই করতেন। যাদের জন্য বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য বিভাগ বা যাদের ছেলেমেয়ে এসব বিভাগে পড়বে তাদের সঙ্গে কথা না বলে এনসিটিবির কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সবাইকে সব বিষয় পড়তেই হবে। যার সাহিত্য ও ইতিহাস ভালো লাগে কিন্তু বিজ্ঞানে আগ্রহ কম কিংবা বোঝে না তাদেরও বিজ্ঞান পড়তে হবে। বিষয়টি নিয়ে বারবার বলেছি, লিখেছি কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। তারা সবাইকে সব বিষয় পড়িয়ে পূর্ণজ্ঞানদান করার কথা বলেছিলেন। আমি বলেছিলাম, যে বিজ্ঞানে পড়েও অনেকে নিজ আগ্রহে সাহিত্য পড়েন কিন্তু জোর করে পড়ানো যায়না। এটি আমি প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি অনেক মেডিকেলের শিক্ষার্থী, বুয়েটের শিক্ষার্থী নিজ আগ্রহে সাহিত্যের বহু বই পড়ে ফেলেছেন। এটি সবাই করবে না। কিন্তু যাদের আগ্রহ আছে তারা করবেনই। তাই বলে জোর করে সবাইকে সবকিছু পড়তে বলার মানে হলো কুইনিন খাওয়ানো। দ্বিতীয়ত, উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে হঠাৎ করে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিকে বিশাল সিলেবাস অনুসরণ করতে পারা অনেক শিক্ষার্থীদের জন্য মানানসই হয় না কারণ উচ্চ মাধ্যমিকে সময় কম, বিষয় ও বিষয়ের কন্টেন্ট অনেক বেশি। ফলে, অনেকেই তা ডাইজেস্ট করতে পারে না। তাই ফল খারাপ করে। এসব কোনো চিন্তাই তাদের টাচ করেনি।
কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মাধ্যমিকে বিভাজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের অনেক বিষয় ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ অনুসারে প্রণীত বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষাভিত্তিক পাঠ্যপুস্তকগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হবে যাতে শিক্ষার্থীরা এক শিক্ষাবর্ষের মধ্যেই পাঠ্যসূচিটি সম্পন্ন করতে পারেন। অর্থাৎ এখন যারা নবম শ্রেণিতে পড়েন তারা বিভাগ বিভাজনের সুযোগ পাননি, তারা দশম শ্রেণিতে উঠে বিভাগ বিভাজনের সুযোগ পাবে যেটি সংক্ষিপ্ত হবে। এটি একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত যা শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষাসংক্রান্ত ব্যক্তিদের দুশ্চিন্তাকে অনেকটাই লাঘব করবে। আরও বলা হয়েছে শিক্ষাবিদ, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট প্রশাসক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও অভিভাবক প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ২০২৫ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম চূড়ান্ত করা হবে, যা ২০২৬ সাল থেকে পরিপূর্ণরূপে কার্যকর করা হবে। এটিও চমৎকার প্রস্তাব কারণ পূর্ববর্তী কারিকুলাম পরিবর্তন বা পরিমার্জনের সময় মুখচেনা কিছু শিক্ষাবিদ যাদের মাঠের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, বর্তমান শ্রেণিকক্ষ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তাদের নিয়ে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। আর বেশি সময়ই শিক্ষা প্রশাসকদের নিয়ে মিটিং করা হতো যাদের বই সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না কারণ এখানে অর্থের ব্যাপার আছে। আমরা আর একটি কথা ভুলে যাই, শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশি হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষা গবেষকরা কারণ তারা দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টির সঙ্গে লেগে থাকেন বলা যায় ৩০-৪০ বছর কিংবা সারাজীবন। শিক্ষা প্রশাসকদের কয়েক বছরের বিশেষ করে মন্ত্রণালয়ে যারা থাকেন। অথচ তাদের সিদ্ধান্তকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তারা এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে ঘুরতেই থাকেন, অতএব শিক্ষার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কিন্তু কম। অথচ পূর্ববর্তী কারিকুলামের কাজের সময় তারাই মিটিং, ওয়ার্কশপে থাকতেন। আবার মাউশি ও এনসিটিবিতে যেসব শিক্ষক ডেপুটেশনে বা বদলি হয়ে আসেন তারাও কিন্তু বই, কারিকুলাম, শ্রেণিকক্ষ এগুলোর কথা ভুলে যান। তারা শিক্ষকের চেয়ে কর্মকর্তা পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বই পড়া, শ্রেণিকক্ষের অবস্থার কথা কিন্তু তারা ভুলে যান। এই শ্রেণিকেও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এগুলো সবই কিন্তু ভুল ও আংশিক সিদ্ধান্ত। তাই, বর্তমান সরকার যা বলেছে তা যুক্তিযুক্ত।
জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২ ও নতুন পুস্তক মুদ্রণ এবং চলমান মূল্যায়ন পদ্ধতি সংক্রান্ত জরুরি নির্দেশনা বিষয়ক এ পরিপত্রে বলা হয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২-এর বিষয়ে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা তথা অংশীজনদের অভিমত, গবেষণা ও জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের অপ্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ঘাটতি, পাঠ্য বিষয়বস্তু ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে অস্পষ্টতা ও নেতিবাচক ধারণা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার প্রকট অভাব ইত্যাদি নানাবিধ বাস্তব সমস্যা বিদ্যমান থাকায় ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় মর্মে প্রতীয়মান। এ বিষয়টিও আমরা বারবার বলেছিলাম, মাঠের চিত্র ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে কিন্তু তারা কেউই কর্ণপাত করেননি। নির্দেশনায় বলা হয় ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চলমান পাঠ্যপুস্তকগুলো ২০২৪ সালব্যাপী বহাল থাকবে। ২০২৫ সালে যথাসম্ভব সংশোধিত ও পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হবে। ২০২৪ সালের অবশিষ্ট সময়েও বার্ষিক পরীক্ষায় ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সংশোধিত ও পরিমার্জিত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হবে এবং তার একটি রূপরেখা শিগগিরই বিদ্যালয়ে পাঠানো হবে। ছয়মাস পর পর একটি করে লিখিত পরীক্ষা হবে এবং প্রশ্ন হবে সৃজনশীল। রূপরেখাটি বিদ্যালয়ে পাঠানোর সঙ্গে সব মিডিয়ায় বেশি বেশি প্রচার করতে হবে যাতে সবাই বিষয়টি ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে পারে। শ্রেণি কার্যক্রমগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির প্রতিটির ৬টি করে বিষয়ভিত্তিক যে মূল্যায়ন কার্যক্রম অসম্পন্ন রয়েছে সেগুলো আর অনুষ্ঠিত হবে না। এই সিদ্ধান্তটি দিতে মন্ত্রণালয়ের একটু বিলম্বই হয়েছে কারণ বিদ্যালয় খোলার পর বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন এবং আমরা বিষয়টির সিদ্ধান্ত দ্রুত জানানোর জন্য অনুরোধ করেছিলাম। যেসব শিক্ষার্থী ২০২৫ সালে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবে, তাদের জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২-এর আলোকে প্রণীত শাখা ও গুচ্ছভিত্তিক সংশোধিত ও পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তকগুলো (বর্তমানে অর্থাৎ ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ব্যবহার করছেন) প্রদান করা হবে। এই শিক্ষার্থীরা নবম ও দশম শ্রেণি মিলিয়ে দুই শিক্ষাবর্ষে সম্পূর্ণ পাঠ্যসূচি শেষে ২০২৭ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। নতুন কারিকুলামে ছিল, শুধু দশম শ্রেণির সিলেবাসে শিক্ষার্থীদের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, সেটিও পরিবর্তন হলো।
নির্দেশনায় প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়- প্রাথমিক স্তরে প্রাক-প্রাথমিক, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে ধারাবাহিকতা রেখে ইতোমধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইগুলোর পাণ্ডুলিপি প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন করে মুদ্রণ করা হবে। নতুন কারিকুলাম যে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে এবং এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়, সেটি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয় যে জন্য আমরা মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাই। শিক্ষার এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এত সহজে অনুধাবন করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
চিন্তা বলতে আমরা আমাদের মনের ভেতরের কথা বা পরিকল্পনাকে বুঝিয়ে থাকি। আমাদের প্রতিটি চিন্তাই কাজে প্রতিফলন ঘটায় না। কিছু চিন্তা-চেতনা মানুষের কাজে পরিণত হয়। একেক জনের চিন্তা-ভাবনা একেক রকম। কারণ আমরা ভিন্ন ভিন্ন মানুষ। আমাদের বড় হওয়ার পরিবেশও ভিন্ন। শিক্ষা-দীক্ষার পরিবেশ ভিন্ন। সে কারণেই আমাদের একই বিষয়ে কারও চিন্তা ইতিবাচক আবার কারও নেতিবাচক। চিন্তাবিদদের মতে, এক গ্লাস পানির যদি অর্ধেকটা পূর্ণ থাকে তাহলে কেউ বলবে গ্লাসটির অর্ধেকটা খালি আবার কেউ বলবে গ্লাসটির অর্ধেকটা পূর্ণ। যদিও দুটি মতই সঠিক। কিন্তু এখানেও রয়েছে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপার। কারও আবার মাঝামাঝি। ইতিবাচক চিন্তা হচ্ছে এমন এক মানসিক মনোভাব ধারণ করা যার জন্য আমরা প্রতিটি কাজের ভালো ও সন্তোষজনক ফলাফল আশা করি। শৈশবকাল থেকেই আমরা ভাবতে শিখি এবং বলতে শিখি। অন্যভাবে বলতে গেলে ইতিবাচক চিন্তা হচ্ছে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আশাহত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পরিবেশকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার চেষ্টা করে যাওয়া। জীবনকে সুস্থ ও সুন্দর করার জন্য ইতিবাচক চিন্তার কোনো বিকল্প নেই।
চেতনা হলো কর্ম বিকাশের মাধ্যম। আমাদের প্রধান শক্তি হলো চিন্তা বা কল্পনা। আমরা যে বাংলাদেশ চিন্তা করি সেটিই কিন্তু প্রকাশ করি। যা চিন্তা করি না সেটি প্রকাশও করি না। এই যে চিন্তা, আমাদের পাপেরও শুরু এই চিন্তা থেকেই। প্রথমে আমরা চিন্তা করি, তারপর সে অনুযায়ী যদি কুকর্মে প্রবৃত্ত হই তবে সেটি পাপ। কিন্তু এর শুরু হয় চিন্তা থেকেই। একই কথা ভালো কাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাদের নানা অনিয়ম যে শুরু সেখানে যদি পরিবর্তন আনতে পারি, দেশটিকে যদি নিজের ঘর ভাবতে পারি তাহলে পরিবর্তন ইতিবাচক হবেই। আর যদি দেশ ও পরিবার ভিন্ন মনে করি, তাহলে চিৎকার করাই বৃথা, কোনো কাজের কাজ হবে না। সে কারণেই বলছি, আগে চিন্তার সংস্কার করতে শিখুন, পরে সমাজ এবং সবশেষে দেশ। নিজের মস্তিষ্ককেই যদি কুসংস্কার, কার্পণ্য এবং হিংসামুক্ত করতে না পারেন, দেশটিকে কীভাবে এসব থেকে মুক্ত করবেন। প্রথমেই নিজের চেন্তা-চেতনাকে এসব থেকে মুক্ত করতে হবে। তারপর তা ছড়িয়ে দিতে হবে। আপনার চিন্তা যদি সমাজ সংস্কারের কাজে লাগে, তাহলে সেটিই হবে বড় সংস্কার। এর জন্য আহামরি বক্তৃতার প্রয়োজন নেই। ভাবুন এবং তা যাচাই করুন। চিন্তাকে যদি লোভের কাছে বিক্রি না করেন, দেখবেন কাজও বিক্রি করতে হবে না। অতএব সবার আগে চাই চিন্তার সংস্কার।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
আমাদের বাংলাদেশের অবস্থান গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকায় হওয়ায় এবং বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত বিভিন্ন উপনদীর কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছরই বর্ষাকালে ছোট থেকে মাঝারি আকারের বন্যা হয়ে থাকে।
আমাদের জানা দরকার বন্যা কী?
বন্যা হলো জলের উপচে পড়া বা খুব কমই অন্যান্য তরল যা সাধারণত শুষ্ক জমিকে নিমজ্জিত করে। ‘প্রবাহিত জল’ অর্থে, শব্দটি জোয়ারের প্রবাহের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সাম্প্রতিক বন্যা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের ১২টি জেলার ব্যাপক ক্ষতি করে, বিশেষ করে কৃষি জমিতে ফসল, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, খাল-বিল, পুকুরসহ আবাদি জমি ও গৃহপালিত পশু এবং বাড়িঘর, দেকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল, ব্যাংক-বিমা এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়ও মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব দাবি করছেন, তারা উপদ্রুত এলাকা থেকে মানুষকে আগেভাগে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন, তবে মানুষ আসতে চায়নি।
আবহাওয়া অধিদপ্তর দাবি করেছে, তাদের কাছে থাকা বন্যার আগাম তথ্য তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানিয়েছে, কাজেই দায় তাদের না। তবে একজন পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আবহাওয়া অধিদপ্তর যে ভাষায় বার্তা দেয়, তা মানুষ বোঝে না। তার মতে, বার্তার ভাষাও পাল্টাতে হবে।
বন্যা-পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ও সহায়তা প্রদান করা দরকার।
বর্তমানে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিটি বিভাগসহ সারা দেশের সর্বস্তরের জনগণের এমনকি বিদেশে অবস্থানরত সহৃদয়বান দেশি-বিদেশি জনগণের সবার উচিত বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে সাধ্যমতো সহায়তা করা।
বন্যা-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য সমস্যা এবং সংকট গুরুতর আকার ধারণ করে। বন্যার কারণে পানি দূষিত হয়, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। এই পরিস্থিতিগুলো দ্রুত নিরসন করা না হলে বন্যা প্লাবিত এলাকায় মহামারি আকার ধারণ করতে পারে রোগব্যাধি।
দূষিত পানি পান ও খাদ্যগ্রহণের ফলে ডায়রিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এটি শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এবং সময়মতো চিকিৎসা না পেলে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বন্যা-পরবর্তী সময়ে কলেরা সবচেয়ে বিপজ্জনক, পানিবাহিত রোগগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। দূষিত পানি ও খাবার থেকে এই রোগ ছড়ায় এবং দ্রুত অনেক মানুষের মধ্যে তা সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এ ছাড়া দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে ছড়ানো টাইফয়েড বন্যার পরে খুবই সাধারণ একটি রোগ। রোগ বাড়তে না দিয়ে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে চিকিৎসা না করা হলে তাতে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বন্যার ফলে স্থির পানি জমে থাকা এলাকাগুলো মশার প্রজননের আদর্শ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ কারণে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার জন্য বন্যা-পরবর্তী অবস্থা উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। এটি দ্রুত রোগ ছড়াতে সক্ষম এবং ক্রমান্বয়ে পানিবাহিত এই রোগ মারাত্মক হতে পারে। চিকুনগুনিয়া আরেকটি মশাবাহিত রোগ- যা ডেঙ্গু এবং ম্যালেরিয়ার মতোই বন্যার পরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে পানির সংস্পর্শে থাকার কারণে ত্বকে ফাঙ্গাল ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে ‘এথলেটস ফুট’ এবং অন্যান্য চর্মরোগ উল্লেখযোগ্য। ভেজা মাটি এবং পানিতে হাঁটাহাঁটি করার কারণে পায়ের ত্বকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ হতে পারে, বিশেষ করে যারা জুতা ছাড়া হাঁটেন তাদের মধ্যে। বন্যার পরে আর্দ্র ও ঠাণ্ডা পরিবেশে ঠাণ্ডা, কাশি এবং জ্বরের মতো সমস্যাগুলো বেড়ে যায়। দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এই রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব বাড়িয়ে তোলে। ঘরের ভেতর আর্দ্রতা বাড়ার কারণে অ্যাজমা এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা বাড়তে পারে, বিশেষ করে যারা ধুলা ও আর্দ্রতার প্রতি সংবেদনশীল।
বন্যা উত্তর পরিস্থিতি অল্পদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। বন্যায় বিপৎসীমার ওপরে ওঠা পানি যখন আস্তে আস্তে নেমে আসে, ঠিক তখনই আসল যুদ্ধ শুরু হয়। সাধারণত বন্যার চেয়েও কঠিন হয়ে থাকে বন্যা-পরবর্তী সময় মোকাবিলা করা। সে সময় বর্তমান সময়ের মতো এত মানুষও পাশে থাকে না। তখন সামাল দিতে হয় নিজেদের। মোকাবিলা করতে হয় বন্যা-পরবর্তী সময়ের কঠিন পরিস্থিতিকে।
বন্যা-পরবর্তী সময়ে উপদ্রুত এলাকায় জনগণের স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও নোয়াখালী জেলায় বন্যা-পরবর্তীতে ডায়রিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। জেনারেল হাসপাতালসমূহে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধারণক্ষমতার চেয়ে ১১ গুণ বেশি রোগী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গুরুত্ব সহকারে প্রতিটি বাড়ির টিউবওয়েল, টয়লেট, ড্রেনেজ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায় ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিক অবস্থা, সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় জনগণকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে বিষয়ে সচেতন করতে হবে। এতে বন্যা-পরবর্তী রোগ প্রতিরোধে জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। বেশি বেশি করে রেডিও, টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সচেতনতা বার্তা বারবার প্রচার করা যেতে পারে।
বেসরকারি উদ্যোগেও বন্যা-পরবর্তী সতর্কতামূলক পদক্ষেপসমূহের ব্যাপক প্রচারণা সংকট মোকাবেলায় সহায়ক হবে।
চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব এলাকার মানুষ। লক্ষ করা গেছে, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও মানুষের ঠাঁই হচ্ছে না। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ছোট-বড় সড়ক ও মহাসড়ক এবং রেললাইনও। এমনকি বেশ কিছু স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ আছে। অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন এই ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর বেশির ভাগ লোকজন।
এদিকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ সারা দেশের সঙ্গে সেনাবাহিনী বন্যাকবলিতদের উদ্ধারে এবং সহযোগিতায়, ছাত্র-জনতা ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
বন্যা-পরবর্তী সময়ে বন্যার পানিতে হাঁটা উচিত নয়, সাঁতার কাটাও নিরাপদ নয়; তাছাড়া সাপের উপদ্রব তো আছে। ইদানীং সারা দেশে রাসেল ভাইপার আতঙ্কের কারণেও বন্যা উপদ্রুত এলাকায় ব্যাপক সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তায় স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালানোও ঝুঁকির কারণ। কেননা ৬ ইঞ্চি পানির স্তরেও যেকোনো গাড়িচালক যেকোনো সময় নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন।
ভেজা বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি থেকে দূরে থাকা উচিত, এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি আছে।
বাড়িতে ঢোকার আগে প্রত্যেকের দেখে নেওয়া প্রয়োজন যে, কোনো কাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে কি না।
বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র পরিদর্শন করার আগে কখনোই পাওয়ার চালু করা উচিত না, কারণ যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা।
সাপ ও বিভিন্ন প্রাণী বাড়িতে থাকতে পারে, তাই সবারই সতর্ক থাকা উচিত। সম্ভব হলে গ্লাভস ও বুট পরার অভ্যাস করতে হবে। বন্যা-দূষিত প্রতিটি বাড়ির বিভিন্ন ঘর পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত ও শুকিয়ে রাখতে হবে।
যদি কোনো বিমা থাকে, তাহলে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে, বিমা দাবির নথি হিসাবে ছবি বা ভিডিও আছে কি না।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের করণীয় সম্পর্কে বন্যার পানিতে ভেসে আসা কচুরিপানা, পলি, বালি এবং আবর্জনা যত দ্রুত সম্ভব পরিষ্কার করতে হবে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর ৫-৭ দিন কাদাযুক্ত ধানগাছ পরিষ্কার পানি দিয়ে, প্রয়োজনে স্প্রে মেশিন দিয়ে ধৌত করে দিতে হবে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই সার প্রয়োগ করা ঠিক নয়। এতে ধান গাছ পচে যেতে পারে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার ১০ দিন পর ধানের চারায় নতুন পাতা গজানো শুরু হলে বিঘাপ্রতি ৮ কেজি ইউরিয়া ও ৮ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ব্রি উদ্ভাবিত আলোক সংবেদনশীল উফশী জাত যেমন- বিআর৫, বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৪৬, ব্রি ধান৫৪ এবং নাইজারশাইলসহ স্থানীয় জাতসমূহ রোপণ করতে হবে। এ ছাড়া, ব্রি উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকালসম্পন্ন জাত ব্রি ধান৫৭ ও ব্রি ধান৬২ রোপণ করা যেতে পারে।
বন্যা উপদ্রুত জেলাসমূহের কৃষি সম্প্রসারণ অফিসারদের সমন্বয়ে টিম গঠন করে দুর্যোগ মোকাবেলায় সম্ভাব্য করণীয় নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে; চলমান কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি জোরদার করতে হবে; বন্যার ক্ষতি মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত জাতের আমন ধানের বীজের পর্যাপ্ত সংস্থান ও সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে; অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় আপৎকালীন বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করতে হবে; নাবী জাতের রোপা আমন ধান চাষে কৃষকদের পরামর্শ দিতে হবে; নাবী জাতের ধানের বীজ দেশের বন্যামুক্ত এলাকা হতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; বন্যা কবলিত ঝুঁকিপূর্ণ গুদামে রক্ষিত সার নিরাপদ জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে; আগাম জাতের শীতকালীন সবজি উৎপাদনের বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে; বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতার লক্ষ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ-পূর্বক মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করতে হবে; বন্যা দুর্গত এলাকার কৃষি অফিসসমূহে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা দরকার।
বন্যা দুর্গত এলাকার সার্বক্ষণিক তথ্য সরবরাহের লক্ষ্যে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় উপজেলা, জেলা, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপনপূর্বক হালনাগাদ তথ্য সরবরাহ করতে হবে। বন্যাকবলিত এলাকায় সরকারি অফিসসমূহের মালামাল নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করতে হবে।
সব মিলিয়ে বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি পূর্বাঞ্চলের ওই জেলাসমূহে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
যে যা-ই বলুক বা মনে করুক আমাদের ব্যবস্থা ও প্রতিকার আমাদেরই নিতে হবে। সুদুরপ্রসারী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দ্বারা যথাস্থানে বাঁধ নির্মাণ, ফসলি জমিকে উৎপাদনমুখী, রাস্তাঘাট পুনর্নির্মাণ, পুকুর জলাশয়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে মাছচাষে দ্রুত মনোযোগ ও গরিব অসহায় জনগোষ্ঠীর গৃহ পুনর্নির্মাণে সহায়তা করতে হবে।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক