আসল নাম ইসমাইল খান। কিন্তু সিন্ডিকেটের সবাই তাকে ডাকে ‘কালো মাকড়সা’ বলে। কারণ মুহূর্তেই সে বেয়ে উঠতে পারে কয়েক তলা ভবন। না, সিঁড়ি বেয়ে নয়, যেকোনো ভবনের সানসেট বা পাইপ ধরে মাকড়সার মতো তরতর করে বেয়ে ওঠে ওপরে। সময় নেয় দুই-এক মিনিট। তারপর বিশেষ কায়দায় কেটে ফেলে গ্রিল। বাসায় ঢুকে বেছে বেছে চুরি করে নিয়ে যায় মূল্যবান সামগ্রী। আসল স্বর্ণলংকার পরীক্ষার জন্য নিয়ে যায় ডিটেক্টরও।
রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় গ্রিল কেটে চোর চক্রের অন্যতম এই হোতা ইসমাইল খানকে গত বুধবার রাতে কেরানীগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে হাতিরঝিল থানার পুলিশ। সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার দুই সহযোগীকেও। তারা হলো ফাহাদ হোসেন কমল ও আরিফ হোসেন। গতকাল বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে সোপর্দ করে এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজ আল ফারুক দৈনিক বাংলাকে জানান, গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইসমাইল পাঁচ শতাধিক চুরির কথা স্বীকার করেছে। যেকোনো ভবন বেয়ে ওঠায় তার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। শুধু রাজধানীতে নয়, বিভিন্ন জেলায় গিয়ে ইসমাইল ও তার সহযোগীরা চুরি করে আসে। তাদের অপর সহযোগীদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে।
পুলিশ জানায়, চলতি বছরের ৬ মে তৌহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া নামে এক ব্যক্তি হাতিরঝিল থানায় একটি চুরির মামলা করেন। মামলার এজাহারে তিনি জানান, তার বাসা ইস্কাটনের দিলু রোডে। ৩০ এপ্রিল তিনি পরিবার নিয়ে নরসিংদীতে গ্রামের বাড়িতে যান। ৫ মে ইস্কাটনের বাসায় ফিরে এসে দেখেনে বাসার সবকিছু এলোমেলো, জানালার গ্রিল কাটা। চোরেরা বাসা থেকে স্বর্ণালংকারসহ প্রায় ১৮ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে গেছে।
চুরির এই মামলাটি তদন্ত করছিলেন হাতিরঝিল থানার এসআই সুজন দে। তিনি জানান, চোর চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করতে তিনি সিআইডির ক্রাইম সিন দলকে খবর দেন। ক্রাইম সিনের সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন।
সুজন দে জানান, মামলার তদন্তভার পাওয়ার পরপরই তিনি তথ্যপ্রযুক্তি ও ম্যানুয়াল সোর্সের মাধ্যমে চোর চক্রের সদস্যদের শনাক্তের চেষ্টা করছিলেন। ঘটনাস্থলের পাশের একটি সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা যায়, অজ্ঞাত এক যুবক মাস্ক পরিহিত অবস্থায় হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে সিএনজিতে উঠছে। ওই সিসিটিভি ফুটেজ ধরে চোরকে শনাক্ত করার চেষ্টা করতে করতেই সিআইডির ক্রাইম সিন বিভাগ থেকে একজনের আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়। সেই আঙুলের ছাপ পুলিশের কাছে সংরক্ষিত ক্রিমিনাল ডাটাবেজ সেন্টারের সঙ্গে মিলিয়ে পাওয়া যায় ইসমাইল খানকে।
ইসমাইলের ব্যক্তিগত তথ্যভাণ্ডারে তার গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদর বলে উল্লেখ ছিল। কিন্তু ঢাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকত সে। সেখানে না পেয়ে প্রযুক্তির সহায়তায় কেরানীগঞ্জের ফুলপুরের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডায়মন্ড ডিটেক্টর নিয়ে যেত ইসমাইল
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইসমাইল ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে চুরি করা বেশ কিছু স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা জিনিসের মধ্যে ডায়মন্ট ডিটেক্টরও রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে ইসমাইল জানিয়েছে, সে চুরি করার সময় ডায়মন্ড ডিটেক্টর সঙ্গে নিয়ে যেত। চুরির সময় ইমিটেশনের গয়না ও প্রকৃত স্বর্ণ বা হীরার গহনা ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষার পর ব্যাগে ঢোকাত। প্রথম দিকে চুরি করতে গিয়ে স্বর্ণালংকার মনে করে ইমিটেশনের গয়না নেয়ায় এই বুদ্ধি বের করেছে সে।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ইসমাইল ও তার সহযোগীরা অনেক চতুর। তারা মোটরসাইকেল নিয়ে চুরি করতে যায়। চক্রের একজন আগে টার্গেটকৃত বাসাবাড়ি সম্পর্কে খোঁজ করে। ইসমাইল গিয়ে চুরি করে। আর আরেকজন মোটরসাইকেল নিয়ে আশপাশের কোথাও অপেক্ষা করে। চুরি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেল বা সিএনজি নিয়ে পালিয়ে যায় তারা।
ইসমাইলকে জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশ কর্মকর্তা সুজন দে জানান, এই চক্রটি ঢাকার বাইরে সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় চুরি করেছে বলে নিজেরাই স্বীকার করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে এসব চুরির ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশকেও জানানো হবে।
ঢাকায় বেড়েছে চুরি
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকায় আশঙ্কাজনক হারে গ্রিল কাটা চুরির সংখ্যা বেড়েছে। আগে প্রতি মাসে রাজধানীর ৫০ থানায় সর্বোচ্চ ১০-১৫টি চুরির মামলা নথিভুক্ত হলেও চলতি বছরে এর সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। চলতি বছরের শুরু থেকেই প্রতি মাসেই রাজধানীতে শতাধিক চুরির মামলা হচ্ছে। অস্বাভাবিকভাবে চুরির মামলা বৃদ্ধি হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে গত মাসে ও চলতি মাসে থানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘চুরির মামলা বৃদ্ধি নিয়ে আমরা বৈঠক করেছি। প্রতিটি ঘটনায় আসামিদের ধরতে থানার পুলিশকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’